- বইয়ের নামঃ পাগল সংঘ
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
পাগল সংঘ
১
আহ, বন্ধ করো, অনুনয় করলো কিশোর, বন্ধ করো ওটা।
সুইভেল চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে সে। খসখসে হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধুর সামনে অত্যাচার করা হচ্ছে তাকে, অথচ সেটা থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না ওরা। বরং তার কষ্ট দেখে হাসছে মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড।
ওদের গোপন হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিনজনেই। তাকিয়ে রয়েছে একটা টেলিভিশন সেটের দিকে। পর্দায়, রান্নাঘরের একটা বড় টেবিলের ওপর আসন মুড়ে বসে রয়েছে গোলগাল খুব মোটা একটা বাচ্চা। তার হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে গেছে আট-নয় বছরের একটা ছেলে। এগারো বছরের আরেকটা ছেলে চিনামাটির বাটিতে কি যেন গুলছে। এই ছেলেটা লম্বা, পাতলা, মাথার চুল কামানো, ডিমের মতো চকচক করছে সাদা মাথার চামড়া, স্পষ্ট দেখা যায়। ওর হাবভাব দেখে ওই ডিমের মতো খুলির ভেতরে ডিমের কুসুম ছাড়া মগজ বলে আর কোনো পদার্থ আছে বলে মনে হয় না।
না না, প্লীত (প্লীজ), অস্বাভাবিক ভারি গলায় অনুনয় করলো বাচ্চা ছেলেটা, প্লীত, আমার বতন্ত (বসন্ত) দরকার নাই।
বন্ধ করো! আবার অনুরোধ করলো কিশোর। দোহাই তোমাদের, বন্ধ করো ওটা!
কিন্তু আমি তো দেখতে তাই (চাই), বাচ্চাটার অনুকরণে বললো মুসা হেসে, দেখতে তাই পেত পর্দন্ত কি কলে।
এসো মোটুরাম, জলহস্তীর বাচ্চা, হেসে বললো পর্দার একটা ছেলে, কাছে এসো। এই ছেলেটা নিগ্রো, গাট্টাগোট্টা শরীর, শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শক্ত চুল। বয়েস বারো। হাসিটা এতোই নিস্পাপ, দুনিয়ার কোনো খারাপ কাজ সে করতে পারে বলে মনে হয় না। তোমার আম্মু আর আবু যখন দেখবে তোমার শুটিবসন্ত হয়েছে, ভয়ে চোখ উল্টে দেবে। তোমার সাথে ছিলাম বলে সবাই ভাববে ছোঁয়াছে রোগটা আমাদের রক্তেও ঢুকেছে। তখন আর আমাদের ইস্কুলে যেতে হবে না।
হ্যাঁ, তার সুরে সুর মেলালো যেন বিশাল পা-ওয়ালা আরেকটা হেলে, সবাই তাই ভাববে।
পর্দায় মাথাকামানো ছেলেটার নাম মড়ার খুলি, তরল জিনিসটা গোলা শেষ করেছে সে। এগিয়ে গেল বাচ্চাটার দিকে।
দুহাতে চোখ ঢাকলো কিশোর পাশা। এরপর কি ঘটবে জানা আছে। পরিষ্কার মনে আছে তার, কান নাচাতে পারে ডিমের মতো মাথাওয়ালা ছেলেটা। এতো ঘন ঘন নাচায়, বড় বড় লতিদুটোকে তখন মনে হয় জেলি, কানের নিচে লেগে থেকে ঝুলছে।
অভিনেতা হিসে, এটা তার একমাত্র গুণ।
মুসা আর রবিনের হাসি কিশোরের গায়ে জ্বালা ধরালো।
কান নাচাতে নাচাতে গিয়ে একটা রঙ লাগানোর তুলি তুলে আনলো মড়ার খুলি। তারপর বাটি থেকে লাল রঙ তুলে তুলে লাগিয়ে দিতে লাগলো বাচ্চাটার গোলগাল মুখে। শরীর মুচড়ে সরে যাবার চেষ্টা করলো মোটুরাম, কিন্তু কাদলো না। আগের মতোই হাসি হাসি চেহারা।
কিন্তু কিশোরের মুখে হাসির চিহ্নই নেই। আঙুল ফাঁক করে তার ভেতর দিয়ে আবার তাকিয়েছে টিভির দিকে। বিশ্বাসই করতে পারছে না ওই বাচ্চাটাই ছিলো সে নিজে। বাদামী রঙের ফারমার ওভারঅল পরা গোলআলুর মতো মুখওয়ালা ওই বাচ্চাটা সে ছিলো একথা ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। নাকে, গালে, সমানে রঙের ফোঁটা দিয়ে চলেছে মড়ার খুলি যে বাচ্চাটার, সে-ই কি আজকের তুখোড় গোয়েন্দা কিশোর পাশা, যার বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে দুর্ধর্ষ পুলিশবাহিনীরও তাক লেগে যায়?
বিশ্বাস করতে না চাইলেও উপায় নেই, জানে কিশোর। একসময় মোটুরাম ছিলো তার উপাধি, ইংরেজি শব্দটার বাংলা করলে অবশ্য এই নামই দাঁড়ায়। আধ ঘন্টার একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করতো সে। হবিটার বাংলা নাম করলে দাঁড়ায় পাগল সংঘ।
জীবনের ওই সময়টাকে ভুলে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিশোর। তিন বছর বয়েসে নিজের ইচ্ছেয় সে ওই ছবিতে অভিনয় করতে যায়নি। তবে বাবা-মাকেও দোষ দেয় না সে। তারা চেয়েছিলেন একদিন বড় অভিনেতা হবে তাঁদের ছেলে।
একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ছিলেন কিশোরের বাবার বন্ধু। প্রায়ই আসতেন তাদের বাড়িতে। এক রোববার বিকেলে খেলতে খেলতে বাচ্চা কিশোর এসে হাজির হলো তার সামনে।
বড় হয়ে খুব ভালো নাচতে পারবে তুমি, খোকা, হেসে বললেন পরিচালক।
না, ওই বয়েসেই অবিশ্বাস্য রকম ভারি গলায় দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো কিশোর, আমি নাচবো না। আমি পুলিশ হবে। চোর-ডাকাত ধরবো। চোরেরা আমার ভয়ে কাঁপবে।
কিশোরের কথা শুনে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলেন পরিচালক। তারপর তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বয়েস কতো? ছেলেটার পাকা পাকা কথা গুনে তাজ্জব হয়ে গেছেন।
দুই বছর এগারো মাস, জবাব দিয়েছেন বাবা।
এরপর যাওয়ার আগে আর কিশোরের সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না পরিচালক। তবে গাড়িতে ওঠার পর আরেকবার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করলেন, অসাধারণ প্রতিভা! কাজে লাগাতে পারলে…
কয়েকদিন পরেই এক আজব জায়গায় কিশোরকে নিয়ে গেলেন তার বাবা। স্ক্রীন টেস্ট নেয়া হলো তার। কয়েক মাসের মধ্যেই পাগল সংঘ-এর মোটুরাম হয়ে গেল কিশোর।