- বইয়ের নামঃ দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন
১. সাদা চুলের লোকটি
দি মিস্ট্রি অফ্ ব্লু ট্রেন (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
০১.
সাদা চুলের লোকটি
প্রায় সারারাত। জানুয়ারির কনকনে শীতে সারা প্যারী শহরটা যখন ঝিমিয়ে পড়েছে তখন প্রেস দ্য লা কনকর্ড দিয়ে একটি লোক হনহন করে চলছে। নাম বোরিস আইভনোভিচ। খর্বাকৃতি সাধারণ চেহারা সেভিয়েট দূতাবাসের একজন পদস্থ কর্মচারী। তার দেহের শীর্ণতা গায়ের পুরু ফার কোটেও ঢাকা পড়েনি।
সে হাঁটতে হাঁটতে সীন নদীর ওপরে যে ব্রীজটা আছে সেটা পার হয়ে অখ্যাত পল্লীর ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেশ কিছুদূর যাবার পর সে একটা আধভাঙা বড় ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারিদিকটা দেখে সে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে একেবারে সিঁড়ি বেয়ে সোজা পাঁচ তলায় উঠে একটা ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে দেখা দিল এক তরুণী– ওলগা ডেমির। সেও সেভিয়েত দূতাবাসের কর্মচারী।
কোনোরকম অভ্যর্থনা বা কোনো কথা বলল না ওলগা। বোরিসও কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওম্মা দরজা বন্ধ করে দিল।
–এদিকে সব ঠিক আছে তো? চাপাকণ্ঠে জিজ্ঞেসা করল বোরিস।
– মনে হয় আমার আসার পথে কেউ পিছু নেয়নি। কথাগুলো আপনমনে বলেই জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই কয়েক পা পিছিয়ে এল।
– কি ব্যাপার?– ওলগা জিজ্ঞেস করল।
–সামনে ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে দুটো লোক এই ঘরটার দিকে তাকিয়ে আছে– বোরিসের বিস্মৃত কণ্ঠস্বর।
– ওরা তোমার আসার আগে থেকেই আছে। ওলগা আশ্বাস দিল।
–কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ওরা আমাদের দিকে নজর রাখছে।
– হতে পারে, কারণ সন্ধ্যার ঠিক আগেই ওই লোক দুটোকে একটা সাদা চুলওয়ালা লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখছি। লোকটার চাল চলন যেন কেমন, আমার মনে হচ্ছিল ওদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল।
-তাহলে তো মনে হয় তোক দুটো তার ভাড়া করা গুণ্ডা।
— ঐ রকম একটা কিছু মনে হয়।
— তাহলে তো রীতিমত ভয়ের কথা।
–তোমার আবার ভয় কিসের? তুমি তো আর বামাল সমেত যাচ্ছ না।
–বামাল সমেত না হলেও টাকা নিয়ে তো যেতে হবে। যাকগে, এখন সেই আমেরিকান সময়মত এলে হয়। ভালো কথা, প্যাকেটটা ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, ওটা যথাস্থানেই আছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেলটা বেজে উঠল।
– এলেন বোধ হয়– মন্তব্য করল বোরিস।
ওলগা দরজা খুলতে গেল। ভদ্রলোক দেখছি খুবই পাংচুয়াল।
এক দশাসই প্রৌঢ়কে নিয়ে একটু পরেই ফিরে এলো।
তিনি বোরিসের দিকে তাকিয়ে : মঁসিয়ে, ক্রাসনিন?
–হ্যাঁ, আমিই সেই সেই লোক। কাজটা খুবই গোপনীয় বলে আপনাকে কষ্ট দিয়ে এতদূর আনার জন্য ক্ষমা চাইছি।
– আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কেউ আমাদের লেনদেনের ব্যাপারে জানবে না। নিন্ মালটা বের করুন এবার।
টাকা এনেছেন তো?
— নিশ্চয়ই।
বোরিস্ ওলগাকে ইশারা করল। ও চুল্লীর কাছে গিয়ে ভেতরে হাত দিয়ে ছাই আর পোড়া কয়লার মধ্যে থেকে একটা কাগজ মোড়া প্যাকেট বার করে আনল।
প্যাকেটটা নিয়ে বোরিস কাগজের মোড়কটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ভেলভেটের বাক্স।
গভীর আগ্রহে বোরিসের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ভদ্রলোক ঢাকনিটা খুলে ফেলল। ভেতরে পায়রার ডিমের মতো একটা নিটোল রুবী এবং সঙ্গে আরও কয়েকটা ছোট রুবী।
জিনিসগুলো দেখে আপন মনে বুঝে সে নিশ্চিন্ত হল। বাক্সটা বন্ধ করে বেলটের পাশের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে ভেতরের পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে বোরিসের হাতে দিয়ে দিল।
নোটগুলো সবই ছিল হাজার পাউণ্ডের। গুণতে বেশি সময় লাগল না। এবার সে বলল, ঠিক আছে স্যার।
এবার তাহলে চলি। গুড নাইট। ওলগা দরজা খুলে দিল। ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে এসে বলল, এবার আমার পাওনা মিটিয়ে দাও তো।
দুখানা নোট তার হাতে দিল বোরিস। খুশী তো? আশাতীত পেয়ে খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল সে। নোট দুটোকে ভাজ করে সে তার মোজার ভেতরে রাখল।
জানলার কাছে গিয়ে ওরা দেখল ভদ্রলোক দ্রুতপায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তারপরেই দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
–যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হলো দেখছি। চাপাকণ্ঠে বলল বোরিস।
একটু বাদেই দেখা গেল আরেকটি লোক তাদের অনুসরণ করছে। ওগাঁ লোকটিকে চিনতে পারল।
ওই দেখ সেই লোকটা। বোরিস সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দিকে তাকাল। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে একটি লোক–তার মাথার চুলগুলো বেশ ঘন আর ধবধবে সাদা।
.
০২.
মঁসিয়ে নে মার্কুইস
সাদা চুল লোকটা গদাইলস্করি চালে হাঁটছে। যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তারপর একটা মোড়ের কাছে সে হাজির হলো। দুটো রাস্তা দুদিকে গেছে। সে ডানে না গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরল। কিছুদূর গিয়েই আরেকটি মোড় এবার ডানদিকে গেল।
কয়েক মিনিট বাদেই দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল। থমকে দাঁড়িয়ে লোকটা বুঝতে চেষ্টা করল আওয়াজটা কোনোদিক থেকে এসেছে। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল কুর হাসির রেখা।
আবার সে চলতে শুরু করল ঠিক আগের মত করে। একি! সামনে ওটা কিসের ভিড় জমেছে। সে ভিড়ের কাছে গেল।
কালো ওভারকোট পরা একটি লোক কি যেন লিখছে নোট বইতে। তাকে ঘিরেই ভিড় জমেছে।
–কি হয়েছে এখানে? সাদা চুলওলা লোকটি একজনকে প্রশ্ন করল।
–খুনের চেষ্টা। খুব বেঁচে গেছেন ভদ্রলোক।
— কি রকম?
–দুজন গুণ্ডা একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল।
–তারপর?
–তারপর আর কি? পালাতে পথ পায় না বাছাধনরা; ভদ্রলোকের বাহাদুরি আছে বলতে হবে। গুণ্ডা দুটো গুলি করার আগেই ভদ্রলোকটি গুলি করে! আর ওরা লেজ গুটিয়ে চম্পট।
লোকটা কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে সীন নদীর ব্রীজের দিকে এবং পায়ে পায়ে কখন পৌঁছেও যায়।
ব্রীজ পার হয়ে আবার হাঁটতে লাগল সামনের দিকে এবার দ্রুত গতিতে।
রাত বারোটা বেজে গেছে। লোকটা একটা বন্ধ জুয়েলারী দোকানের সামনে দাঁড়ায়। তারপর দোকানের পাশে সরু গলিতে ঢুকে দোকানের ওপর তলায় ওঠবার সিঁড়ির দরজায় পরপর তিনবার কলিং বেল টিপল। একটু পরেই দারোয়ান দরজা খুলে বিরক্তিতে বলল; কি চান?
–আমি মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
–এত রাত্রে তার সঙ্গে দেখা হবে না। আপনি বরং কাল দিনের বেলায় আসুন।
–না, দিনের বেলা আসা সম্ভব নয়। তুমি মনিবকে বলো মার্কুইস এসেছে। দারোয়ান সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে দরজাটা বন্ধ করে দিল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল।
–আপনি ভেতরে আসুন মঁসিয়ে। মালিক আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।
মার্কুইস ঘরে ঢুকতেই মালিক অভ্যর্থনা জানালেন। এই যে মঁসিয়ে নে মাকুইস! দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।
মার্কুইস ধন্যবাদ বলতেই পপোপুলাস তাকালেন; কি খবর বন্ধু! মাল এনেছেন?
– না, আমার প্রথম প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে তবে হাল ছেড়ে দিইনি। এবার অন্য পথে যেমন করে থোক ও জিনিস আমার চাই-ই।
-আপনার হাতযশের নাম আছে সুতরাং আপনি সফল হবেন।
– সফল হতেই হবে। ও জিনিস চাই-ই। আপনার সঙ্গে যে ব্যবস্থা হয়েছে তা যেন ঠিক থাকে।
–আমার কথার নড়চড় হয় না। মাকুইস, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
–গুড নাইট মঁসিয়ে।
–গুড নাইট মার্কুইস, আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।
মার্কুইস বেরিয়ে যেতেই ভেতরের দরজায় খট করে একটা শব্দ হলো। উঠে গিয়ে পপোপুলাস দরজা খুলতেই একটি মেয়ে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি উঠে লজ্জিত দৃষ্টিতে পপোপুলাসের দিকে তাকাল।
–কি ব্যাপার জিয়া। এখানে কি করছিলে?
–আমি চাবির গর্ত দিয়ে লোকটাকে দেখছিলাম।
–দেখতে পেয়েছ তাকে?
– না, ভালো করে দেখতে পাইনি। তবে একটা জিনিস দেখেছি মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। পপোপুলাস হেসে বললেন : ওটা পরচুল।
.
০৩.
হার্ট অফ ফায়ার
স্যাভয় হোটেল।
আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধন কুবের মিঃ রিউফাস ভ্যান আলডিন একটা স্যুট নিয়ে এই হোটেলে বাস করছেন। রীতিমত অফিস চালাচ্ছেন তিনি। কেরানি, টাইপিস্ট, বয়, বেয়ারা তো আছেনই, একজন সেক্রেটারীও নিযুক্ত করেছেন।
দুদিন মিঃ আলডিন ছিলেন না এবং কেউ জানত না যে তিনি কোথায় আছেন। সেক্রেটারী মিঃ কিংটন তো রীতিমত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন।
বেলা প্রায় নটায় মিঃ আলডিন এলেন।
কিংটন হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল; গুড মর্নিং স্যার। আপনার জন্যে আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম।
-হ্যাঁ এত দেরি হবে ভাবিনি, জরুরী কিছু খবর আছে কি?
–আছে স্যার, মিসেস ক্যাথারিন দুবার ফোন করেছিলেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছেন।
খবরটা শুনে আলডিন ভাবলো, নিশ্চয়ই রুথ কোনোরকম ঝামেলায় পড়েছে। হয়তো ড্রেক ক্যাথারিন আবার তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।
অস্থির ভাবে পায়চারি করতে শুরু করলেন আলডিন। ঘরে ঢুকে ওভারকোটটা আবার পরে ফেললেন তিনি।
–আপনি কি আবার বাইরে যাচ্ছেন স্যার?
–হ্যাঁ, আমি রুথ-এর কাছে যাচ্ছি।
–কলিটন থেকে কেউ ফোন করলে কি বলবো?
–বলবে, জাহান্নামে যাও।
–বেশ, তাই বলব স্যার। কিন্তু সে হয়তো সেই উৎকৃষ্ট জায়গায় যেতে রাজী হবে না।
মিঃ আলডিন এবার হেসে ফেললেন, তোমার এই গুণের জন্যেই তোমাকে আমি পছন্দ করি। ওদের লোক এলে বলবে আমি পরে দেখা করবো। এখন আমি খুবই ব্যস্ত।
ঘর থেকে বেরিয়ে দু-পা এগিয়েই হঠাৎ থামলেন।
কিংটন এগিয়ে গেল তার কাছে, আমাকে কিছু বলবেন? স্যার
হ্যাঁ, তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।
পকেটে হাত দিয়ে একটা ভেলভেটের বাক্স বের করে ঢাকনিটা খুলে –এই দেখো।
কিংটন- এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হল।
–এত সুন্দর এবং এত বড় রুবী আগে দেখিনি স্যার? খুব দামী নিশ্চয়ই?
–দামী বলে দামী। এ জিনিস অমূল্য। মাঝখানে যে বড় রুবীটা–ওটি রাশিয়ান জারিনার কণ্ঠে শোভা পেত। ওর নাম হার্ট অফ ফায়ার। ইতিহাসে প্রসিদ্ধ মণি এটা।
–এই মহামূল্য রত্ন নিয়ে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্যার! দুষ্ট লোকে জানতে পারলে হয়তো….
–ছিনতাই করবে–তাই তো? সে চেষ্টা করেছিল বৈকি।
–বলেন কি স্যার।
-হ্যাঁ, দুটো গুণ্ডা লোক আমাকে আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার রিভলবারটা গর্জে উঠলে ওরা পালায়।
–জিনিসটা বোধ হয় মিসেস ক্যাথারিনকে উপহার দিতে চাইছেন, তাই নয় কি?
–ঠিকই ধরেছ। রুথের জন্যেই আমি এটা কিনেছি!
–এতক্ষণে বুঝলাম মিসেস ক্যাথারিন-এর উৎকণ্ঠার কারণ।
-তোমার এবারের অনুমান ঠিক হলো না। রুথ কিছুই জানে না! এটা উপহার দিয়ে আমি ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে চাই। ওর মুখের হাসির দাম আমার কাছে হার্ট অফ ফায়ার-এর চেয়ে অনেক বেশি।
বাক্সটা বন্ধ করে পকেটে রাখলেন আলডিন।
–ঘন্টা খানেক বাদেই আমি ফিরে আসছি।
.
০৪.
রুথ ক্যাথারিন
কার্জন স্ট্রীটে বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করে রুথ। মিঃ ভ্যান আলডিন-এর একমাত্র সন্তান। লর্ড লুকোবারীর একমাত্র পুত্র ড্রেক ক্যাথারিন-এর সঙ্গে রুথ-এর বিয়ে দিয়েছেন।
ড্রেক-এর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন অনেক রঙীন আশা নিয়ে। বৃদ্ধ লর্ড-এর মৃত্যুর পরে তার জামাই হবে লর্ড লুকোনবারী এবং রুথ হবে লেডি লুকোনবারী। কিন্তু ড্রেক আজ স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে লম্পটের জীবন যাপন করছে।
মেয়েকে সুখী করতে গিয়ে আলডিন তাকে চরম অসুখী করে ফেলেছেন। এই কারণেই তিনি মেয়েকে ঐতিহাসিক হার্ট অফ ফায়ার দিয়েও খুশী রাখতে চাইছেন।
রুথ-এর বাড়িতে প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ হাজির হলেন। বাড়িতে ঢুকেই নুতন মেইড মিস ম্যাসনকে দেখে বলেন, রুথ কোথায়?
মিস ম্যাসন আলডিনকে দেখেই অভিবাদন করে বলল, তিনি এখন দোতলায় ড্রয়িং রুম-এ আছেন স্যার।
মিঃ আলডিন ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই রুথ এসে তার গলা জড়িয়ে ধরল। দুদিন তুমি হোটেলে ছিলে না। আমি দুবার ফোন করেছি। কোথায় গিয়েছিলে, বাপি?
–হ্যাঁ, বিশেষ একটা কাজের জন্য বাইরে ছিলাম দুদিন এবং বাইরে ছিলাম তোমার জন্যেই।
–আমার জন্যেই!
–হ্যাঁ, তোমারই জন্যেই। কিন্তু সে কথা পরে হবে। এবার বলো, আমার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চাইছিলে কেন? ড্রেক কি আবার দুর্ব্যবহার করেছে।
নতুন করে ও আর কি দুর্ব্যবহার করবে। গত তিন সপ্তাহ ওর সঙ্গে দেখাই হয়নি। আগে যদিও বা মাঝে মাধ্যে বাড়িতে আসতো। ও এখন মেতে উঠেছে এক নাচনেওয়ালীকে নিয়ে।
–নাচনেওয়ালী! কে সে?
–তার নাম মিরেলী। পেশাদার নাচিয়ে।
–এ খবরটা আমার কানেও গেছে। আমি তাই গত সপ্তাহে লুকোবারীর কাছে এ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছি।
–তিনি কি বললেন?
–আমার সঙ্গে তিনি ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ড্রেক সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বেচারার জন্য আমার কষ্ট হয়।
-বেচারা মানে? কার সম্বন্ধে বলছ কথাটা?
–বলছি লর্ড লুকোবারীর সম্বন্ধে। আমার মনে হল ড্রেক এখন ওকে পাত্তাই দেয় না। জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ পিতাকে সে পথের কাঁটা মনে করে।
এ ব্যাপারে তুমি কিছু করতে পার না, বাপি?
–হয়তো পারি। কিন্তু ওর সঙ্গে আমি সম্পর্কই রাখতে চাই না। তুমিও ওর সম্পর্কটা শেষ করে দাও।
–তার মানে?
–ডিভোর্স। হ্যাঁ, ডিভোর্স। যত তাড়াতাড়ি পার ততই ভাল।
–কিন্তু…..
-না রুথ, এর মধ্যে আর কিন্তু নয়। তোমার মনে এখনো ওর জন্যে কিছুটা দুর্বলতা আছে। কিন্তু সে দুর্বলতা তোমাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
কথা বলতে বলতে আলডিন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ও তোমাকে টাকার জন্যে বিয়ে করেছিল। ওর মত স্কাউনড্রেল-ব্রুট এর উপরে আর কোনো টান রাখার দরকার নেই! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ছাঁটাই কর।
–ও যদি রাজী না হয়?
-রাজী ওকে হতেই হবে। রাজী হওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তুমি এতে রাজী আছ কি? তোমার মত বলল।
–ও যদি কেসটা কনটেস্ট করে?
–না, ও তা করবে না। করতে পারবে না।
–কিন্তু খবরের কাগজে ব্যাপারটা নিয়ে হৈ চৈ পড়বে। কাগজওলাদের আমি ভয় করি।
–ওদের মুখ বন্ধ করার মহৌষধ আমার জানা আছে। সেই মহৌষধটি কয়েকটা ডোজ খাওয়ালেই মুখ বন্ধ।
-বেশ, তুমি যখন বলছ….
–আমি বলছি মানে? তোমার কি সম্মতি নেই না কি?
–না, তা বলছি না। আমার সম্মতি আছে বৈকি।
–এই তো আমার মেয়ের মতো কথা! এতে তোমার ভালোই হবে। এবার দেখ তোমার জন্যে কি জিনিস এনেছি আমি।
পকেট থেকে সেই ভেলভেটের বাক্সটা বার করে রুথকে দিলেন। বাক্সটা খুলেই রুথ বিস্ময়ে আর আনন্দে আত্মহারা হলো। কি সুন্দর! অপূর্ব! এরকম সুন্দর আর এত বড় রুবী আগে কোনোদিন দেখিনি।
–ঠিক বলেছ। এ রত্ন অদ্বিতীয়, অমূল্য। এবার বল, তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
–খু-উ-ব! কিন্তু এটা তুমি কিভাবে যোগাড় করলে বাপি?
–সে অনেক কাহিনী। এটা যোগাড় করতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। তাছাড়া এর জন্যে ব্যয় হয়েছে কয়েক লাখ ডলার।
–কয়েক লাখ ডলার! বলো কি!
–ঠিকই বলছি। রুবীটার সত্যিকারের দাম অনেক বেশি। পৃথিবীতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে কটি মণিমাণিক্য আছে, এটি তারই একটি। এর নাম হার্ট অফ ফায়ার।
হার্ট অফ ফায়ার! রাশিয়ার জারিনা যে রুবীটা গলায় পরতেন?
–হ্যাঁ, এটা সেই রুবীই।
রুথ বাক্স থেকে সেই রুবীটা বের করে বুকের ওপর চেপে ধরল আর খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল ওর মুখ।
–আমাকে এত ভালোবাস, বাপি!
–তোমাকে ভালোবাসব না তো কাকে ভালোবাসব? তুমি আমার চোখের মণি একমাত্র সন্তান। তোমাকে খুশী করতে কোহিনুর পেলে তা কিনতেও রাজী আছি। তোমার মুখে যদি হাসি ফোঁটাতে না পারি তাহলে আমার ধনদৌলতের দাম কি?
এতক্ষণে রুথের মনে হলো যে, তার বাপির বোধহয় খাওয়া হয়নি। এবেলা এখানেই খেয়ে নাও, বাপি।
-না। আমাকে এখুনি যেতে হবে। অনেক জরুরী কাজ পড়ে আছে।
উঠে দাঁড়ালেন আলডিন, আমি এখন যাচ্ছি রুথ। কাল তোমাকে নিয়ে একবার সলিসিটার অফিসে যাব। তুমি তৈরি হয়ে থেকো। সাড়ে বারটায় আসব না হলে ফোন করে দেব।
–বেশ, তাই হবে। কিন্তু
–কিন্তু কি রুথ?
–আমি যে রিভিয়ারায় যাব বলে সব কিছু ঠিক করে ফেলেছি। যাওয়াটা বন্ধ হবে না। তো?
–বন্ধ হবে কেন? কালই তো আর মামলা দায়ের করা হচ্ছে না। কালকে শুধু আলোচনা হবে সলিসিটারের সঙ্গে। তুমি ফিরে এলেই হবে। হ্যাঁ, কবে রওনা হচ্ছ?
–আগামী ১৪ই, ব্লু ট্রেনে।
–ঠিক আছে। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে যাবার আগে রুবীটাকে ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্ট-এ রেখে যেও।
–কেন বাপী? এটা সঙ্গে থাকলে অসুবিধা কি?
–অসুবিধে বিশেষ কিছু নেই, তবে….
–তবে কি বাপি?
–এ ধরনের দুর্লভ-রত্নের জন্য বিপদ ঘটা বিচিত্র নয়। রত্নচোরেরা খবর পেয়ে আমাকে আক্রমণ করেছিল।
-তাই নাকি?
–হ্যাঁ, রুবীটা কিনে যখন ফিরছিলাম দুজন আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিলো তার আগেই আমার রিভলবারটা গর্জে উঠে, ওরা দ্রুত পালায়।
–অসাধারণ তোমার সাহস বাপি।
আলডিন বললেন, এই জন্যে রুবীটা ব্যাঙ্কে রাখতে বললাম!
–বেশ, আমি দু-একদিনের মধ্যেই রুবীটা ব্যাঙ্কে রাখব।
মিঃ আলডিন তখন মেয়ের কপালে স্নেহচুম্বন দিয়ে বিদায় নিলেন। হোটেলে ফিরে তিনি সেক্রেটারীকে বললেন, এখুনি মিঃ গোবির কাছে যাও তো। তাকে বলবে সে যেন আমার সঙ্গে আগামীকাল সকাল নটায় দেখা করেন।
.
০৫.
গোপন সংবাদের সন্ধানে
গোবি পরদিন সকালেই হাজির হলো ঠিক নটায়। তার সময়ানুবর্তিতার জন্যে খুশী হলেন আলডিন।
–বসুন মিঃ গোবি, আপনার সঙ্গে কিছু কাজের কথা আছে।
-বলুন।
–একটা লোকের সম্বন্ধে কিছু গোপন খবর দিতে হবে?
–গোপন সংবাদ বিক্রি করাই তো আমার পেশা।
–আপনি নিশ্চয়ই জানেন, লর্ড লুকোনবারীর ছেলে ড্রেক ক্যাথারিন আমার জামাই।
–তা জানি।
-আমার মেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করবে। মামলা দায়ের করাটা সলিসিটার-এর কাজ কিন্তু যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেই জন্যেই আমি ড্রেক সম্বন্ধে সব কিছু গোপন খবর জানতে চাই।
-অর্থাৎ, আপনি তার ব্যক্তিগত চরিত্র এবং আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান, এই
-হ্যাঁ, খবরগুলো কখন পেতে পারি?
–আপনার কি খুব তাড়া আছে।
–হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানতে চাই।
-ঠিক আছে, আজ দুটোর সময় আমি আসছি। আশা করি সব খবর জানতে পারবেন। এবার তাহলে আমি আসি, গুড মর্নিং।
–আসুন মিঃ গোবি, গুড মর্নিং। মিঃ গোবি চলে যেতেই আলডিন সেক্রেটারীকে ডেকে বললেন, এবার আমি অফিসের কাজ করব। আজকের করনীয় কাজ সব ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, স্যার, সবই ঠিক করে রেখেছি। আপনি আসুন।
সাড়ে নটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করলেন আলডিন। তারপর স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম করলেন।
একটু পরেই হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক টেলিফোন করে জানালেন মাননীয় ড্রেক ক্যাথারিন তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাকে কি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব স্যার?
–হ্যাঁ, দিন। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ক্যাথারিন এসে হাজির হল।
–আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
–হ্যাঁ, বসো।
–গতকাল আমি রুথের কাছে গিয়েছিলাম। আমার উপদেশমত সে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করছে।
–আর কিছু বলবার আছে কি?
-না, আর বিশেষ কিছু বলবার নেই। রুথ-এর সঙ্গে তুমি যে ব্যবহার করেছ–তারপরে এখন নাকি এক নাচনেওয়ালীর পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
–ব্যক্তিগত কথা যখন তুললেন তাহলে আমার কথাটাও শুনে নিন। আমি ঘরছাড়া হয়েছি আপানার মেয়ের জন্যেই। নিজের স্ত্রী, কোনো পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করবে সেটা কোনো পুরুষই সহ্য করবে না।
-তুমি জানো তুমি কি বলছ?
–ঠিকই বলছি। একটু খোঁজ নিলেই সত্যাসত্য জানতে পারবেন। আপনার মেয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল বংশ মর্যাদার জন্যে আর ভবিষ্যতে লেডী লুকোনবারী হবে সেই আশায়।
আলডিন বেশ একটু ঝঝের সুরেই বললেন, উপাধির এখন কোনো মূল্য নেই, এখন কোনো সম্মান যে কোনো উপাধিকারী অপেক্ষা কম নয়। আমার সংকল্প সফল হবেই। আমি তাই আশা করি যে, মামলা আদালতে উঠলে তুমি কনটেস্ট করবে না।
–আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
–তা যদি মনে হয় তবে তাই।
–আমি যদি কনটেস্ট করি তাহলে আপনি কি করবেন?
কনটেস্ট করবে! বেশ, তাহলে সেই চেষ্টাই করো?
-আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার। ও ব্যাপারে আমি কোনো উপদেশ শুনতে চাই না।
উপদেশ দেওয়া আমার স্বভাব নয়।
–কিন্তু আপনি তো সেটাই করছেন। আপনার মেয়েকে উপদেশ দিয়েছেন মামলা করতে, আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন মামলায় কনটেস্ট না করতে।
–হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার একমাত্র সন্তানের ভালোমন্দ জড়িত বলেই আমি রুথকে উপদেশ দিতে বাধ্য হয়েছি।
-বেশ, আপনি ভালোমন্দ দেখতে থাকুন, আমি বিদায় হচ্ছি। তবে এটুকু বলে যাচ্ছি যে পরের ছিদ্র দেখার আগে নিজেদের ছিদ্র সম্বন্ধেও কিছু খোঁজ খবর নেবেন।
–কে সে লোক?
–আপনি তাকে চেনেন। তিনি হলেন মহামাননীয় কাউন্ট দ্য লা রোচি। আচ্ছা চললাম।
ক্যাথরিন চলে যেতেই মেয়ের কাছে টেলিফোন করেন। কিন্তু ম্যাসন জানায় যে মিসেস ক্যাথারিন কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আলডিন-এর মনে হলো যে তিনি বেলা সাড়ে বারটায় সলিসিটারের কাছে যাবেন বলেছিলেন রুথকে। তাই বোধ হয়…. তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।
সলিসিটার-এর অফিস থেকে দুটো বেজে পাঁচ মিনিটে ফিরে এলেন আলডিন। এসে দেখেন মি গোবি বসে আছেন।
তাকে দেখে বললেন, কি! যোগাড় হয়েছে?
–এ শর্মা যে কাজের ভার নেয় তা অসম্পূর্ণ থাকে না স্যার। এই নিন।
পকেট থেকে একটা নোট বের করে দিলেন, সব খবর এতে লেখা আছে স্যার।
নোটবই পড়া শেষ হলে আলডিন খুব খুশী হয়ে বললেন, ধন্যবাদ মিঃ গোবি। আমি যা জানতে চেয়েছিলাম সবই আছে এতে।
নোটবইটা সযত্নে ড্রয়ারে রেখে দিলেন। তারপর আলডিন একতাড়া ব্যাঙ্ক নোট মিঃ গোবির হাতে দিলেন, এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। নোটগুলো পকেটে রেখে গোবি উঠে দাঁড়ালেন, এবার তাহলে আসি স্যার। দরকার হলে আবার ডাকবেন।
নিশ্চয়ই ডাকব। আপনার কাজে আমি খুব খুশী।
গোবি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আলডিন নোট বইখানা সঙ্গে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুথের বাড়িতে পৌঁছলেন। রুথ বিস্মিত হলেন, কি হয়েছে বাপি?
–তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম। সলিসিটারের সামনে সে কথা বলা ঠিক হতো না।
–কি কথা, বাপি?
-ক্যাথারিন আমাকে বলেছে, তুমি এখনও সেই হতভাগাটার সঙ্গে মেলামেশা করো। একথা কি সত্যি?
–কার কথা বলছ, বাপি?
-বলছি সেই লম্পট কাউন্ট দ্য লা রোচির কথা। আমি জানতে চাই, তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে কিনা?
-ও তোমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। কাউন্টের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই, বাপি। ও নিজের দোষ ঢাকবার জন্যেই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে।
মেয়ের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি গোবির দেওয়া নোটবইখানা মেয়েকে দিলেন। ড্রেক-এর যাবতীয় গোপন খবর পড়ে দেখো।
রুথ নোটবইখানা শেষ করে বাপিকে ফেরৎ দিয়ে বলল, ও যে এত নিচে নেমে গেছে তা আমি জানতাম না বাপি।
-এবার তাহলে বুঝতে পারছ, যে এই অস্ত্রেই আমি ওকে ঘায়েল করতে পারব। ও যাতে মামলাটা কনটেস্ট করতে না পারে তার জন্যেই এটা আমি সংগ্রহ করেছি। এবার তুমি নিশ্চিন্তে মামলা রুজু করতে পার।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর মিঃ আলডিন মেয়ের কাছে বিদায় নিলেন।
২. মিরেলি
০৬. মিরেলি
শ্বশুরের ঘর থেকে ফিরে এসে ড্রেক ক্যাথারিন-এর মনে ভেতরে ঝড় বইছে। মিঃ আলডিন-এর কথাগুলো তার মনটাকে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রাগে অপমানে তার মনটা একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। উনি কোটি কোটি পাউণ্ডের মালিক, আমার তাতে কি! আমি কি ওকে তোয়াক্কা করি নাকি! বাবাকেই পাত্তা দিলাম না আর উনি তো শ্বশুর।
ভাবতে ভাবতে মাতালের মত চলতে চলতে একটা মেয়ের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ে। মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি কি অন্ধ নাকি?
খুব লজ্জিত হলো ক্যাথারিন, ক্ষমা করবেন। অন্যমনস্ক ছিলাম তাই আপনাকে দেখতে পাইনি। ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।
ক্যাথারিন-এর বিনীত ব্যবহারে মেয়েটি নরম হলো। না না, আমি কিছু মনে করিনি, আচ্ছা চলি।
মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপন মনেই বলল–কে গো তুমি সুন্দরী। ক্যাথারিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিফট-এর দিকে এগিয়ে গেল।
রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা মিরেলির হোটেলের দরজায় গেল। মিরেলির ঘরে গিয়ে দেখে সে চোখ বুজে গা এলিয়ে বিশ্রাম করছে।
ক্যাথারিন তার পাশে বসে আলতো ভাবে একটা চুমু খেল, কিগো আরামে ঘুমিয়ে পড়লে?
ক্যাথারিন-এর প্রশ্নে সে চোখ খুলল, না ঘুমোইনি। এতক্ষণ চোখ বুজে একটা নতুন নাচের মহলা দিচ্ছিলাম। অ্যাসব্রোচ এসেছিল। তার পরবর্তী অপেরার যে নাচটি হবে আমাকে বোঝাচ্ছিল। নাচটা দেখে দর্শকদের মাথা ঘুরে যাবে।
-তোমার নাচের কথা রেখে এবার আমার কথাটা শোনো।
–তোমার কথা মানে? কি হয়েছে তোমার?
–আমার মাননীয় শ্বশুর মহাশয় তার মেয়েকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
–কি গেরো! কিন্তু তোমার শ্বশুর বা তার মেয়ের এত রাগ কেন তোমার ওপরে? কি তোমার অপরাধ?
–অপরাধ অনেক। প্রথম অপরাধ তোমার সঙ্গে মেলামেশা।
–তুমি তাহলে কি করবে ঠিক করেছ?
–কি আর করবো? আমি ভাবছি অন্য কথা।
–কি?
–ভাবছি, মামলাটা দায়ের হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই পাওনাদারের দল আমাকে ঘিরে ধরবে। আর তুমি তখন আমাকে বিদায় করবে।
একথা তুমি ভাবলে কি করে? তোমার সঙ্গে কি আমার টাকার সম্পর্ক? টাকাই আমার কাম্য হলে টাকা দেবার লোকের অভাব হতো না আমার। তোমার কাছে টাকার প্রত্যাশা আগেও করিনি আর করব না। তোমার বিপদে-আপদে সব সময়েই আমি তোমার পাশে থাকবো।
-তোমার কথা শুনে আমার মনের বল বাড়লো।
আজ আমি নতুন করে বুঝলাম যে সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু এবার কি করা যায় বলতো?
আমি বলি কি, তুমি তোমার বউ-এর সঙ্গে একটা মিটমাট করে নাও সে যাতে মামলার পথে না যায় তার জন্যে তাকে খুশী রাখতে চেষ্টা করো।
-না, তা হবার নয়। আমার শ্বশুরের জেদ তুমি জান না। আর তাছাড়া বর্তমান সভ্য জগতে টাকার জোরে অনেক কিছু করা যায়।
তা হয়তো যায়, কিন্তু ডিভোর্সের মামলাটা আর তিনি রুজু করলে চলবে না। এটা করতে হবে তোমার বউকে দিয়ে। সে নারাজ থাকলে শ্বশুর কিছুই করতে পারবে না। তাই তোমার বউয়ের সঙ্গে মিটমাট কর।
-না, তা আমি পারব না। সে চায় আমাকে তার ভেড়ুয়া করে রাখতে সে আমি পারব না। তাছাড়া আমার স্ত্রী বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় তাকে শুনতেই হবে। ওর বাবার মতো ধনকুবের খুব কমই আছে। এই তো তিনি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ হার্ট অফ ফায়ার কিনে ফেলেছেন।
-বলো কি?
–হ্যাঁ তাই-ই। লক্ষাধিক পাউণ্ড ব্যয় করে ওই অমূল্য-রত্নটি কিনেছেন। আমার ধারণা এটা উনি ওর মেয়ের জন্যেই কিনেছেন।
–তোমার বউ কি তার একমাত্র সন্তান?
–হ্যাঁ।
–তাহলে বাবার মৃত্যুর পর সেই-ই হবে তার সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী?
–হ্যাঁ তাই হবে।
–তোমার বউ-এর নিজস্ব টাকাকড়ি এখন কি আছে?
–তা ধর ত্রিশ লক্ষ পাউণ্ড। ব্যাঙ্কেই তো আছে কুড়ি লক্ষ পাউণ্ডেরও বেশি।
–এত টাকার মালিক তোমার বউ!
–হ্যাঁ, তাই।
–আচ্ছা হঠাৎ যদি কোনো কারণে তার মৃত্যু হয় তাহলে তার ওয়ারিশ কে হবে?
-তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু ওর মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ ও রীতিমত স্বাস্থ্যবতী।
-স্বাস্থ্যবতী মেয়েরা কি মরে না? কোনোরকম আকস্মিক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণেও তো মৃত্যু হতে পারে।
মিরেলির দিকে বিস্মৃত দৃষ্টিতে তাকাল ড্রেক। মিরেলি বলল, তাই বলে ভেবো না আমি তোমার বউ-এর মৃত্যু কামনা করছি। যাক গে, তুমি বরং তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করে নাও যাতে ও মামলায় সাক্ষী না হয়, সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।
–সে যদি আমার কথা না শোনে?
–আমার মনে হয় সে শুনবে। খবরের কাগজে তার চরিত্র নিয়ে আলোচনা সে নিশ্চয়ই চাইবে না।
তার মানে?
–তোমার বউ সম্পর্কে অনেক কথাই জানি সে সব তোমার না শোনাই ভালো।
–কি জানো তুমি ওর সম্বন্ধে?
–বললাম তো, অনেক কিছুই জানি।
–তোমাকে বলতে হবে সে কথা।
–নিতান্তই শুনবে? তোমার বউ কাউন্ট দ্য লা রোচীর উপপত্নী; বিয়ের আগে থেকেই তার সঙ্গে নয় ছয় ছিল। এখন তোমার বউ প্যারীতে গিয়ে ওর সঙ্গে রাত কাটায়।
–একথা আমি বিশ্বাস করি না।
–বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। আমার কথার সত্যতা তুমি যাচাই করে দেখতে পারো। তোমাকে আর একটা খবর দিতে পারি।
–কি খবর?
–সামনের চোদ্দ তারিখে তোমার বউ রিভিয়ারয়ে কাউন্টের সঙ্গে কটা দিন স্ফুর্তি করার জন্যে যাচ্ছে।
–এসব কথা তুমি কেমন করে জানলে?
-আমি প্যারীর মেয়ে সে কথা ভুলে গেলে। প্যারীতে আমার এমন অনেক বন্ধু আছে যারা কাউন্টের বিশেষ বন্ধু।
যাকগে ওসব কথা নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। মনে রেখো অপরিমিত অর্থ বলে বলীয়ান লোকের সঙ্গে তোমার মোকাবিলা করতে হবে। অতএব, তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে তার মেয়েকে কজা করতে হবে।
–থাম। আর কিছু শুনতে চাই না। আমার মাথার ভেতরে তুমি আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছ?
একবার মিরেলির দিকে তাকিয়ে দ্রুত পদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ক্যাথারিন।
ক্যাথারিন চলে যেতেই মিরেলির ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
.
০৭.
মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ড–এর চিঠি
মিসেস ক্যাথারিন গ্রে বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়েছে। সম্পত্তিটা এম্মা হারফিল্ডের। দীর্ঘ বার বছর ধরে এই নিঃসন্তান ধনবতাঁকে সেবা করেছে ক্যাথারিন। তাই মৃত্যুর পূর্বে উইল করে তিনি তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং সেন্ট মেরী মিড়-এর বিশাল বাড়িটি ক্যাথারিনকে দিয়ে গেছেন।
সেন্ট মেরী মিড পল্লীর সবাই এতে খুশী হয়েছে। দীর্ঘ বার বছর তারা ক্যাথারিনের ব্যবহারে এবং সুসংযত চালচলনে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই মুগ্ধ।
কিন্তু স্থানীয় নরনারী খুশী হলেও মিসেস হারফিল্ডের দেওর মিঃ স্যামুয়েল হারফিল্ড এতে খুশী নন। তার ধারণা ছিল যে এম্মা হারফিল্ড-এর মৃত্যুর পর সেই হবে তার বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাই মনে হয় সে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাথারিন-এর ওপর।
এ ব্যাপারে তার স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বেশি রেগে যায়। ভদ্রমহিলা রীতিমত কুটবুদ্ধি সম্পন্না। তার এই কুটবুদ্ধির জন্য তার স্বামীও তাকে রীতিমত সমীহ করে চলে এবং সব ব্যাপারেই তার পরামর্শ নেয়।
কয়েকদিন ধরে দুজনে পরামর্শ করে ঠিক হল স্যামুয়েল-এর বউ একখানা চিঠি দেবে ক্যাথারিনকে এবং চিঠিতে তাকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে আইন অনুসারে এম্মা হারফিল্ড-এর উইলের কোনো মূল্যই নেই। আদালতে ওই উইল সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য হবে।
অনেকবার কাটাকাটির পর চিঠির বয়ানটা স্বামী স্ত্রীর মন মতো তৈরি হলো। তারা মনে করলো যে, চিঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথারিন ছুটে আসবে। চিঠিটা লেখা শেষ করে আবার পড়ে দেখল দুজনে।
কল্যাণীয়া ক্যাথারিন,
আমার স্বামীর ভ্রাতৃবধূকে তুমি এতদিন যেভাবে সেবা-যত্ন করেছ তার জন্য আমি এবং আমার স্বামী তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমরা আমাদের কর্তব্য শেষ করবো না। তোমার ভবিষ্যৎ জীবন যাতে সুখে কাটে সে ব্যবস্থাও আমরা নিশ্চয়ই করব।
এম্মার মৃত্যুতে আমরা শোকে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়েছি। আমরা জানি যে মৃত্যুর পূর্বে তার মাথাটা একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। অতএব বিকৃত মস্তিষ্কে তিনি যে উইল করেছেন তা আইন সম্মত হয়নি। আদালতে গেলে সে উইল অগ্রাহ্য হবে।
তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। হারফিল্ড-এর উইলের ব্যাপারে যাতে আমাদের আদালতে যেতে হয় সে ব্যবস্থা তুমি নিশ্চয়ই করবে। আমাদের মনে হয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এটা সবচেয়ে ভালো হবে।
তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও আমরা চিন্তা করেছি। তোমাকে একটা ভালো চাকরি যোগাড় করে দেব তাছাড়া এম্মা হারফিল্ডকে যেভাবে যত্ন করেছ তার পুরস্কার হিসাবে তোমাকে মোটা টাকা দেব স্থির করেছি। আশা করি আমাদের স্নেহের দান তুমি গ্রহণ করবে।
শুভাকাক্ষিণী অ্যা
নি হারফিল্ড।
পরদিন সকালের ডাকেই চিঠিখানা ক্যাথারিন-এর হস্তগত হলো। চিঠিখানা পড়ে নিজের মনেই একটু হাসল-এখন দেখছি দরদ উথলে পড়েছে। এম্মা বেঁচে থাকতে তো একদিনও বাড়ির খোঁজ নাওনি!
কিন্তু ওরা যে লিখছে তা কি ঠিক। না, আমাকে কালই লণ্ডনে সলিসিটার-এর সঙ্গে দেখা করে সব কিছু জানতেই হবে।
তখুনি ডক্টর হ্যারিসন এসে হাজির। ক্যাথারিনকে খুবই স্নেহ করেন তিনি। সময় পেলে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যান।
–তোমাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে যেন!
–হ্যাঁ–মিসেস স্যামুয়েল হারফিল্ড আমাকে একটা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠির কথাই ভাবছিলাম।
-কি লিখেছেন তিনি? কথাটা বলেই উনি লজ্জিত সুরে আবার বললেন। মানে, তোমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে দরকার নেই।
-না আপত্তি থাকবে কেন? আপনি পড়ুন। তিনি চিঠিটা পড়ে ক্যাথারিনকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, রাবিশ!
ওরা হয়তো ভেবেছে যে এই চিঠি পেলেই তুমি ওদের কাছে ছুটে যাবে।
–কিন্তু ওরা যা লিখেছে তা কি ঠিক?
-কখনও নয়। ওরা বলতে চায় মিসেস হারফিল্ড অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় উইলটি করেছেন। একথা যে কত বড় মিথ্যে তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি জানি তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সুস্থ শরীর এবং স্বেচ্ছায় ওই উইলটি করেছেন তাছাড়া আমি আর মিসেস হারফিল্ডের সলিসিটার ছাড়া আর কেউ জানত না।
–আপনি তো উইলের সাক্ষী ছিলেন। সম্পত্তির মূল্য সম্বন্ধে আপনার একটা ধারণা নিশ্চয়ই আছে, তাই না?
–তা আছে বৈকি, আমার ধারণা ওর সম্পত্তির মূল্য এক লক্ষ পাউণ্ডের কাছাকাছি।
–না, আপনার ধারণা ঠিক নয়। ওঁর সম্পত্তির মূল্য আরও অনেক অনেক বেশি।
এই বলে ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে একখানা বড় আকারের খাম বের করে ডক্টর হ্যারিসন-এর হাতে দিয়ে বলল, এর ভেতরে একটা স্টেটমেন্ট আছে। ওটা একবার পড়ে দেখুন আপনি।
স্টেটমেন্ট পড়ে একেবারে অবাক ডক্টর হ্যারিসন। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, এ যে দেখছি উপন্যাসের মত ঘটনা। মিসেস হারফিল্ড যে এত বড় প্রতিষ্ঠানের পার্টনার ছিলেন তা আমরা কোনো দিনই জানি না।
–স্টেটমেন্টের তলায় টাকাকড়ির হিসেবটা দেখেছেন কি!
-হ্যাঁ। প্রতি বছর আট হাজার থেকে দশ হাজার পাউণ্ড-এর হিসেবে জমা হয়েছে এবং দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ এই লভ্যাংশ জমা হতে হতে ওটা এখন ত্রিশ লাখ পাউণ্ডের কাছাকাছি এসে গেছে।
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু এছাড়াও ব্যাঙ্কে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং ফিক্সড় ডিপোজিটে ওর নামে যে টাকা জমা আছে তার পরিমাণও এক লাখ পাউণ্ডেরও বেশি। এছাড়া স্থাবর সম্পত্তি এবং জুয়েলারী যা আছে তার মূল্যও প্রায় দশ লাখ পাউণ্ড।
-অর্থাৎ, ওর মোট সম্পত্তির মূল্য প্রায় চল্লিশ লাখ পাউণ্ড। অথচ উনি এমন সাধারণভাবে থাকতেন যে, আমরা কোনোদিন ভাবতেই পারিনি উনি অত টাকার মালিক।
–ঠিকই বলছেন ডক্টর। আমি নিজের চোখেই দেখেছি যে, ওনার বার্ষিক আয় দশহাজার পাউণ্ড থাকা সত্ত্বেও উনি চার হাজার পাউণ্ডের বেশি খরচ করতেন না।
তার মানে, এদিক থেকেও তবে বেশ কিছু জমেছে।
–হ্যাঁ, তাই-ই। এই বাড়তি টাকা দিয়ে উনি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতেন। আমার মনে হয়, ওঁর নামে যে শেয়ারগুলো আছে তার মূল্য কয়েক লাখ পাউণ্ড।
-মনে হয় বলছ কেন?
-বলছি, তার কারণ হলো ওগুলো এখনও ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্ট-এ আছে। ভল্ট-এর চাবিটাও আমার কাছেই আছে। তাই আমি লণ্ডনে গিয়ে শিগগিরই ব্যাঙ্কের হিসেবগুলো দেখে নেব।
ক্যাথারিন-এর কথা শুনে ডক্টর হ্যারিসন মৃদু হাসলেন। আজ বুঝতে পারছি, মিসেস হারফিল্ড তোমাকে তেমনি ভালোবাসতেন।
–তিনি আগাগোড়াই আমাকে ভালোবাসতেন। তবে, তিনি তার যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি আমাকে দেবেন সেটা কিন্তু ভাবিনি। বার বছর আগে ওর কাছে আমি এসেছিলাম সামান্য একজন সেবিকা হয়ে আর আমি তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু একি। আপনি এখুনি চলে যাবেন না কি।
–হ্যাঁ ক্যাথারিন। এখুনি একটা কলে-এ যেতে হবে। যাবার আগে আবার বলছি মিসেস স্যামুয়েল-এর চিঠি সম্বন্ধে চিন্তার কিছু নেই। এ চিঠির কোনো মূল্য নেই।
–সত্যিই কি কোনো মূল্য নেই? আমার মনে হয় ওরা ও ব্যাপারে হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। তাছাড়া…..
তাছাড়া কি?
–বলছিলাম আমি যদি উড়ে এসে জুড়ে না বসতাম তাহলে ওরাই তো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতেন। আমি তাই ভাবছি সম্পত্তির একটা অংশ ওদের দিয়ে দেব। ওদের দীর্ঘনিশ্বাস পড়বে সেটা চাই না, ডক্টর।
–তার মানে, তুমি মনে করছ যে সম্পত্তিটা তুমি বৈধ ভাবে পাওনি, মিসেস হারফিল্ডকে যে লোক ভুলেও একবার দেখতে আসেনি, আগেই পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ করে নিয়ে আলাদা বাস করছে, সেই-ই হবে বৈধ দাবিদার আর তুমি মেয়ের মত হারফিল্ডকে সেবা যত্ন করেছ আর তুমিই যদি ওনার মেয়ে হতে তাহলে কি তোমার একথা মনে হতো?
-না তা হোত না কিন্তু……
-না ক্যাথারিন, এর মধ্যে কোনো কিন্তু নয়। তুমি ওর মেয়ের চেয়েও বেশি ছিলে। আজ তুমি যদি সম্পত্তির অংশ অন্য লোককে দান করো তবে ওর মৃত আত্মাকে অসম্মান করা হবে।
ডক্টর হ্যারিসন খুশী মনে বিদায় নিলেন।
সেইদিন বিকেলে মিসেস হ্যারিসন এলেন। ক্যাথারিনের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন– কয়েকদিন থেকেই আসব ভাবছি কিন্তু আর হচ্ছে না। আজ তাই তাড়াতাড়ি কাজকর্ম ছেড়ে চলে এসেছি।
-আপনি আসায় আমি খুশী হয়েছি। এবার জনির খবর বলুন। কি করছে সে?
জনি এখন নেভীতে চাকরি করছে। ভালোই আছে সে। শুনলাম আপনি নাকি বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসি।
–কোথায় যাবেন তা ঠিক করেছেন কি?
–না; তা এখনও ঠিক করিনি। তবে যেখানেই যাইনা কেন বেশিদিন থাকবো না, জোর মাস দুয়েক। আজ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের বাইরে যাবার সুযোগ হয়নি আমার। এখন যখন সুযোগ এসেছে দু-চারটে দেশ দেখে আসব মনে করেছি।
-তা ভালো। দেশভ্রমণে একদিকে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় অন্যদিকে মনের প্রসারতাও বাড়ে। আমারও বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে হয় কিন্তু সংসারের চাপে এমন জড়িয়ে গেছি যে সম্ভব হয় না।
–একদিক দিয়ে সংসারটা যেমন ঝামেলা ঠিক, কিন্তু তবুও তো সবাই সংসার করছে।
— হ্যাঁ, তা করছে। এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু একটা কথা দিল্লী কা লাড়ু যো খায়া উয়ো ভি পস্তায়া। ঔর যো নেহি খায়া উয়ো ভি পস্তায়া। সংসার জিনিসটা প্রায় সেই দিল্লীর লাড়ুর মতো।
–আপনি বুঝি খুব বই পড়েন?
-হ্যাঁ, তা পড়ি। ওটা আমার একটা নেশা। নানা আলাপ আলোচনার পর বেলা চারটের সময় মিসেস্ হ্যারিসন বিদায় নিলেন।
পরদিন ক্যাথারিন সেন্ট মেরী সিড-এর বর্ষীয়ান মহিলা ডিনার সঙ্গে দেখা করতে গেল।
ক্যাথারিনকে দেখে খুশী হয়ে ডিনার বললেন, শুনলাম তুমি নাকি বিদেশ যাচ্ছ?
-হ্যাঁ, কিছুদিনের জন্য এখান থেকে চলে যাচ্ছি, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
–বেশ করেছ। তা, কোথায় কোথায়, যাচ্ছ?
–তা এখনো ঠিক করিনি। তবে বেশিদিন থাকব না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরব।
–বাড়ি ঘরের কি ব্যবস্থা করে যাচ্ছ?
–সেই জন্যেই তো আপনার কাছে এলাম। আমার অনুপস্থিতিতে আপনাকেই সব কিছু দেখাশুনা করতে অনুরোধ করছি।
–সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। তবে, একা বাইরে যাচ্ছ, একটু সাবধানে থেকো।
.
সেদিন সকালে লেডী টাম্পলিন তার বাড়ির প্রশস্ত দোতলার বারান্দার ওপর একখানা গদি মোড়া চেয়ারে বসে চা পান করতে করতে সেদিনের খবরের কাগজখানা দেখছিলেন।
তার পাশেই ছিল তার মেয়ে মাদামোয়জেল লেন। সে তখন উত্তাল তরঙ্গ-সঙ্কুল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ মায়ের কথায় চমক ভাঙল। খবরের কাগজ বাঁ হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল এই খবরটা পড়ে দেখ লিনা।
-কি খবর, মা?
–পড়েই দেখ না।
–কোনো খবরটার কথা বলছ, মা?
মিসেস হারফিল্ডের মৃত্যুর সংবাদটার কথা বলছি। সংবাদটা পড়ে লেন বলল, এ-রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কে এক প্রৌঢ়া বিধবা অনেক টাকার সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। এতে আর নতুনত্ব কি আছে?
নতুনত্ব আছে বৈকি! দেখছ না, মৃত্যুর পূর্বে সে তার সেবিকা ক্যাথারিন গ্রেকে উইল করে দিয়ে গেছেন।
–তাতে আমাদের কি আসে যায়?
–কিছুটা আসে যায় বৈকি! যে মেয়েটি ঐ বিশাল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছে সে আমার নিকট আত্মীয়া।
-তাই নাকি! কে হয় সে তোমার?
ও আমার মামাতো বোন। একসময় ওর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি ওর চেয়ে বয়সে বড় হলেও আমরা একসঙ্গে বন্ধুর মতো খেলাধূলা করতাম। আমি ভাবছি, আজই ওকে একটা চিঠি লিখব। ওকে এখানে আসার জন্যে অনুরোধ করবো।
–তাতে তোমার কিছু লাভ হবে কি?
–আমি কি সবকাজ লাভের জন্য করি নাকি।
তাছাড়া আবার কি?
–দেখো লিনা, দিন দিন তুমি বড় ভেঁপো হচ্ছ। দিদি হয়ে ছোট বোনকে আসতে লিখব। তাতে তুমি ছিদ্র বের করার চেষ্টা করছ। তোমার স্বভাবটা বদলাতে চেষ্টা কর।
এবার বুঝতে পেরে সে লজ্জিত হলো। সে তখন মাকে খুশী করার জন্যে বলল, বেশ, তাহলে আজই চিঠি লিখে দাও, মা। কিন্তু আমাদের সমাজে সে খাপ খাবে তো?
-আমিও তাই ভাবছি। এতদিন সে মিসেস হারফিল্ডের সেবিকা হয়ে কাজ করেছে। অভিজাত সমাজে মেলামেশা করার সুযোগ পায়নি। তার চালচলন যদি ছোটলোকের মত হয় তাহলে…..
–অত যখন চিন্তা, তাহলে দরকার নেই তাকে লিখে।
-না, মিসেস হারফিল্ডকে আমি চিনতাম। তার বাড়িতেও অনেক বিখ্যাত লোক আসতেন। অতএব ক্যাথারিনকে সমাজে মেশবার পক্ষে অযোগ্য হবে মনে হয় না। বহুদিন দেখিনি আজ কাগজে নামটা দেখেই তাকে দেখতে ইচ্ছে করল।
–বেশ তাহলে আসতেই লিখে দাও।
–হ্যাঁ, তাই ভালো। আমি চিঠিখানা এখুনি লিখছি। তোমার কাজ থাকলে সেরে নাও।
.
মিস ডিনা-এর সঙ্গে দেখা করার পরদিনই ক্যাথারিন লণ্ডনে রওনা হল। এর আগে লণ্ডনে গিয়ে সে স্যাভয় হোটেলে উঠেছে। তাই এবারও সে স্যাভয় হোটেলেই উঠল।
হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সে গেল সলিসিটারের অফিসে। সলিসিটার তাকে দেখেই খুশী হয়ে বললেন, তোমার চিঠি আমি আজই পেলাম। এবার বলো তুমি কি বিষয়ে জানতে চাও?
ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে মিসেস হারফিল্ডের চিঠিখানা দিলেন। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।
চিঠিখানা মনোযোগ সহকারে পড়ে তিনি বললেন, আইনের চোখে এই চিঠির কোনো মূল্য নেই। মিসেস এম্মা হারফিল্ড সুস্থ শরীরে, স্বেচ্ছায় এই উইল সম্পাদন করেছেন। তাছাড়া উইলের প্রোবেটও নেওয়া হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমিই মিসেস হারফিল্ডের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী।
–আমি তাহলে খুশিমত ব্যয় করতে পারি?
–নিশ্চয়ই পার। তবে হ্যাঁ ব্যাঙ্কে একবার তোমাকে যেতে হবে। আমি অবশ্যই আগেই জানিয়েছি। তুমি ব্যাঙ্কে গিয়ে তোমার স্পেসিমেন সিগনেচার রেকর্ড করিয়ে নিলেই কাজ হবে।
–আমি একা গেলেই কাজ হবে কি?
–না, একজন সনাক্তকারীকে দরকার হবে। ও কাজটা দেখছি আমাকেই করতে হবে। চলো এখুনি ব্যাঙ্কে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিচ্ছি।
ব্যাঙ্ক থেকে কাজ সেরে ক্যাথারিন একটা নাম করা পোশাকের অর্ডার দিল। দোকানের মালিক একজন ফরাসী মহিলা। ক্যাথারিন তার সঙ্গে দেখা করে বলল, সবচেয়ে দামী আর মানানসই পোশাক তৈরি করাতে চাই। তাছাড়া কাটছাটও যেন আধুনিক রুচিসম্মত হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ফরাসী মহিলা হেসে বললেন, বেশ তাই হবে। আজ থেকে সাতদিন পরে পোশাকগুলো
ডেলিভারী পাবেন। হা, ভালো কথা, কাপড় পছন্দ করে দেবেন কি?
-না, ও ব্যাপারটা আপনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।
–বেশ, তাই হবে। আপনি আগামী সোমবার বেলা এগারোটায় ডেলিভারী পাবেন।
একজন সহকারিণীকে ডেকে ক্যাথারিনের মাপ নিতে বলল। মাপ নেওয়া হলে ক্যাথারিন খুশী মনে দোকান থেকে চলে গেল।
পরদিন সকালের ডাকে লেডী টাম্পলিন-এর চিঠিখানা ক্যাথারিন-এর হস্তগত হলো। চিঠিখানা সেন্ট মেরী মিড থেকে রি-ডাইরেক্ট হয়ে এসেছে।
চিঠিখানা পড়ে ক্যাথারিন-এর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এতদিন পরে মামাতো বোনের কথা মনে পড়েছে।
লেডী টাম্পলিন ক্যাথারিনকে বারবার অনুরোধ করেছে তার বাড়িতে যাবার জন্যে। ক্যাথারিনও বাইরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিল কিন্তু যাবার জায়গা ঠিক করতে পারছিল না। চিঠিখানা পেয়ে মনে মনে স্থির করল সে যাবে।
টমাস কুক-এর অফিসে ফোন করে ক্যাথারিন জানতে পারলো নিস-এ যাবার সবচেয়ে ভালো যানবাহন হলো ব্লু ট্রেন, ওটা ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে ছাড়ে। কুক কোম্পানীর কর্মচারীরা তাকে জানালো যে ঐ ব্লু ট্রেনে কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করতে হলে অন্ততঃ তিন দিন আগে করতে হবে।
টেলিফোন ছেড়ে ক্যাথারিন মনে মনে হিসাব করে দেখল যে সে তার পোষাকগুলি ডেলিভারী পাচ্ছে বারো তারিখে। তাই তাকে তেরো কিংবা চোদ্দ তারিখে রওনা হতে হবে। কিন্তু তেরো তারিখটা তার কাছে আনলাকি নাম্বার তাই সে চোদ্দ তারিখেই রওনা হবে।
১০ই জানুয়ারি বেলা এগারোটায় টমাস কুক-এর অফিসে গেল ক্যাথারিন। ওখানে। যেতেই সে দেখল কিছুদিন আগে স্যাভয় হোটেলের করিডরে যে লোকটি তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সে দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টারের সামনে। সেও লক্ষ্য করল ক্যাথারিনকে।
ক্যাথারিনের কেন যেন মনে হলো যে সে শীগগিরই কোনো বিপদের জালে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে বুঝতে পারল না।
এদিকে ক্যাথারিন যখন টিকিট কিনে কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করার জন্যে কাউন্টার ক্লার্কের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, ততক্ষণে সে কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেছে।
.
০৮.
শ্বশুর জামাই সংবাদ
পৃথিবীতে এমন কিছু লোক আছে যারা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও মেজাজ ঠান্ডা রাখতে পারে।
মিঃ ক্যাথারিনও এই রকমের লোক তাই দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং আসন্ন ডাইভোর্সের সম্মুখীন হয়েও সে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেননি।
মিরেলির কথা শুনে সেদিন যদিও সে সাময়িক উত্তেজিত হয়েছিল তবুও কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঠান্ডা করতে সে সক্ষম হলো।
কয়েকদিন বাদে সেন্ট জেমস স্ট্রীট ধরে হেঁটে যেতে যেতে পিকাডেলি সার্কাস পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ তার নজরে পড়লো টমাক কুক অ্যাণ্ড কোং-এর সাইন বোর্ডের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, সামনের চোদ্দ তারিখে তার স্ত্রী রিভিয়ারায় তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছে। ক্যাথারিন স্থির করল, সেও ওই তারিখে রিভিয়ারা রওনা হবে এবং তার স্ত্রীর মত সেও ব্লু ট্রেনের যাত্রী হবে। ট্রেনে আত্মগোপন করে থেকে সে তার স্ত্রীর ওপরে নজর রাখবে।
সেদিন ছিল দশ তারিখ। সেদিন টিকিট না কাটলে ব্লু ট্রেনে জায়গা পাওয়া যাবে না। তাই কুক কোম্পানীর অফিসে গেল ক্যাথারিন। একজন কেরাণীকে জিজ্ঞেস করল : ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে নিস পর্যন্ত একটা বার্থ রিজার্ভ টিকিট আমার চাই। চোদ্দ তারিখে ব্লু ট্রেনে রওনা হবো।
–বেশ, নাম ঠিকানা বলুন।
–লিখুন, প্যাভেট হচিনস্। ২৮ নং জারমিন স্ট্রিট।
–ঠিক আছে। একটু দাঁড়ান, আমি এখুনি সব ব্যবস্থা করছি।
–না, এখুনি দরকার নেই। আপনি সব ঠিক করে রেখে দিন। ঘণ্টাখানেক বাদে আমার চাকরের হাতে টাকা পাঠিয়ে দেব। এখন আমার সঙ্গে টাকা নেই, তাই তাকেই টিকিটখানা দিয়ে দেবেন।
–বেশ, তাই হবে। তার হাতে একখানা লেটার অব অথরিটি পাঠাবেন।
-ঠিক আছে। আমি তাহলে এখন যাচ্ছি। চলে যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াতেই ক্যাথারিন দেখতে পেল স্যাভয় হোটেলের করিডরে যে মেয়েটির গায়ের ওপরে গিয়ে পড়েছিল, সেই মেয়েটি ওখানে। মনে হলো মেয়েটি তাকে লক্ষ্য করেনি তাই সেও কথা বলল না। চলে গেল সেখান থেকে। বাড়িতে ফিরে এসেই প্যাভেটকে ডাকল ক্যাথারিন। প্যাভেট এসে দাঁড়াতেই বলল, শোন প্যাভেট–তুমি এখুনি একবার টমাস কুক-এর অফিসে যাও। সেখানে তোমার নামে নিস-এর একখানা টিকিট বুক করে এসেছি। একটা বার্থ রিজার্ভ করতে বলেছি। তুমি সেই টিকিটখানা আর বার্থ রিজার্ভেশন-এর স্লিপটা নিয়ে এসো।
একখানা একশো পাউণ্ডের নোট বের করে সে প্যাভেট-এর হাতে দিল। এই চিঠিখানা আর নোটখানা কাউন্টার ক্লার্ককে দিলেই টিকিট তার স্লিপখানা পেয়ে যাবে, ফেরত টাকা হিসেব করে গুণে দেখে নিও।
চিঠি আর নোট নিয়ে প্যাভেট তক্ষুণি বেরিয়ে গেল। ক্যাথারিন তার আসন্ন বিপর্যয়ের কথা ভাবছে যখন তখনই দরজায় নক করার শব্দ। কে?
–ভেতরে আসতে পারি কি স্যার?
–আসুন।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরে মিঃ কিংটন। তাকে দেখে ক্যাথারিন বিস্মিত স্বরে বলল, মিঃ কিংটন যে! কি খবর?
–খবর আছে, স্যার। আমি আপনার শ্বশুর মশাইয়ের বার্তাবহ হয়ে এসেছি আজ।
–তা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। এবার বলুন কি বার্তা বহন করে এনেছেন।
মিঃ আলডিন একটি প্রস্তাব করেছেন আপনার কাছে।
–কি প্রস্তাব?
–প্রস্তাবটা বলতে একটু সংকোচবোধ করল কিংটন। আমার যদি কোনো অপরাধ হয় ক্ষমা করবেন। জানেন তো, বেতনভুক কর্মচারীকে মনিবের কথামতো চলতে হয়।
–আপনার সংকুচিত হবার কোন কারণ নেই। শ্বশুরমশাই যা বলেছেন আপনি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।
এবার অনেকটা সহজ হয়ে কিংটান বলল, মিঃ আলডিন বলেছেন, আপনি যদি ডিভোর্সের মামলাটা কনটেস্ট না করেন তাহলে উনি আপনাকে এক লাখ পাউণ্ড দিতে রাজী আছেন।
টাকার অঙ্কটা ভালোই। এতে আমার সমস্ত দেনা শোধ হয়ে আরও কিছু হাতে থাকবে। একটু চিন্তা করেই ক্যাথারিন স্থির করে ফেলল, মাননীয় শ্বশুরমশাইকে বলবেন যে ড্রেক ক্যাথারিন তার এই ঘুষ দেবার প্রস্তাবটাকে প্রত্যাখান করেছে।
-ধন্যবাদ, মিঃ ক্যামারিন। আপনার বক্তব্য শুনে আমার মনিব হয়তো খুশী হবেন না কিন্তু আমি এতে সত্যি খুব খুশী হয়েছি। আচ্ছা, এবার তাহলে আসি, স্যার। গুড় ইভনিং।
.
০৯.
ব্লু ট্রেন
স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসেছিল। ট্রেন ছাড়তে তখনও কিছু দেরি ছিল। হঠাৎ মিঃ আলডিনকে দেখে রুথ খুশী হয়ে বলল, বাবা তুমি যে স্টেশনে আসবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। তুমি বলেছিলে যে আজ সকালে একটা কনফারেন্স আছে।
–ঠিকই বলেছিলাম। কনফারেন্স সেরেই এলাম। তোমার সঙ্গে দেখা না করে কি আমি থাকতে পারি?
তুমি এত পরশ্রিম কর কেন বাবা? কি দরকার তোমার এত পরিশ্রম করার? তোমার কি আরও টাকার দরকার?
মিঃ আলডিন বললেন, টাকা রোজগারটা কেমন যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছে আমায়। আমি জানি, আমার মতো ধনী পৃথিবীতে কমই আছে তবুও কেন যেন চুপ করে বসে থাকতে পারি না।
রুথ বুঝল যে, অজ্ঞাতে সে বাবার দুর্বল স্থানে আঘাত করেছে। তাই সে কথাটা ঘুরিয়ে বলল, তুমি আসাতে আমার এত ভালো লাগছে যে তোমাকে তা বোঝাতে পারবো না। আরও ভালো লাগতো যদি তুমি আমার সাথে যেতে। কথাটা বলেই ভাবলো যে, বাবা সঙ্গে গেলে তো মুস্কিল তাই বাবার মনের কথা জানার জন্যে, তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও, বাবা?
–গেলে মন্দ হতো না। কয়েকটা দিন বিশ্রাম হতো।
–রুথ তার মনের ভাব চেপে রেখে এমন ভাব দেখাল যে, সে যেন খুব খুশিই হয়েছে; তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কিন্তু……
-”কিন্তু কি রুথ?
–তোমার ব্যাগ স্যুটকেশ তো দেখছি না!
আলডিন হেসে বললেন, না রুথ, আমার পক্ষে এখন লণ্ডন ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। আর সেগুলো অন্যকে দিয়ে হবে না। চলো ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গেলো, এবার ট্রেনে উঠে বসা যাক।
–হ্যাঁ তাই ভালো চলো।
প্ল্যাটফর্মে এসে আলডিন বললেন, তোমার কামরাটা দেখে নিয়েছ তো?
–না, এখনও দেখিনি, তবে সেজন্য অসুবিধা হবে না। মিস ম্যাসনকে বলেছি সে যেন আমার কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেনের করিডোরে ঢুকেই কামরাটা দেখতে পেল রুথ। সে বাবাকে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়লো।
মিস ম্যাসন বললো, আপনার ড্রেসিং কেসটা সীটের নিচে রেখেছি। র্যাগের দরকার হবে কি?
-না, না এখন র্যাগের দরকার হবে না। তুমি গিয়ে বরং তোমার কামরাটা ঠিক করে নাও।
মিঃ আলডিন তার এ্যাটাচি কেস থেকে একখানা মাসিক পত্রিকা বার করে রুথ-এর সামনে রেখে বললেন, সময় কাটাবার জন্যে নিশয়ই কিছু আনোনি?
-তোমার দেখছি সব দিকেই নজর আছে, বাবা। সত্যিই আজ আমি কিছুই আনিনি।
–তুমি ফিরছ কবে?
–ফেরবার তারিখ ঠিক করিনি। তবে আশা করি মাস খানেকের মধ্যেই ফিরে আসবো।
–হ্যাঁ, তাই এসো। তুমি এলেই মামালাটা রুজু করা হবে। ও, আর একটা কথা, রুবীটা সেফ ডিপজিট ভল্ট-এ রেখে এসেছ তো?
-হ্যাঁ।
–ভালো করেছ। ও জিনিস নিয়ে ট্রাভেল করা উচিৎ নয়।
রুথ কিন্তু মিথ্যে বলল বাবাকে। আসলে সে রুবীটাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে এমন একটা কারণে, যা সে বাবাকে কিছুতেই বলতে পারবে না।
হঠাৎ এই সময় রুথ-এর বয়সী একটা মেয়েকে কামরার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে আলডিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে স্যাভয় হোটেলে দেখেছি মনে হচ্ছে?
-হ্যাঁ, লণ্ডনে এলে আমি ওখানেই উঠি।
–তুমিও কি রিভিয়ারার যাত্রী?
–হ্যাঁ।
–তাহলে দয়া করে একবার ভেতরে এস আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।
মিঃ আলডিন-এর কথায় মেয়েটি দ্বিরুক্তি না করে কামরায় ঢুকে পড়ল। রুথ উঠে মেয়েটির হাত ধরে তার পাশে বসাল।
-এই আমার মেয়ে রুথ, মানে রুথ ক্যাথারিন।
–আর… আমার না ক্যাথারিন গ্রে।
আপনি কি রিভিয়ারায় বেড়াতে যাচ্ছেন?
–হ্যাঁ, একরকম তাই-ই। আমার এক পিসতুত দিদি আছেন ওখানে। তার বাড়িতেই যাচ্ছি আমি।
–এই প্রথম যাচ্ছেন, না আগেও গেছেন?
–এই প্রথম যাচ্ছি। দিদি আমাকে তার বাড়িতে যাবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছেন। আপনিও কি প্রথম যাচ্ছেন নাকি?
–না, ওখানে আমি আরও কয়েকবার গেছি।
–তাহলে হয়তো আমার দিদিকে চিনতেও পারেন। তার নাম লেডী টাম্পলিন।
–লেডী টাম্পলিন আপনার পিসতুত দিদি? তার সঙ্গে তো আমার ভালো পরিচয় আছে।
এই সময় মিঃ আলডিন বললেন, লেডী টাম্পলিন-এর নাম আমিও শুনেছি, তবে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় করবার সুযোগ হয়নি আমার।
তার কথা শেষ হতে না হতেই ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা পড়লো। তিনি রুথ আর ক্যাথারিনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নেমে এলেন।
ট্রেন ছেড়ে দিল। রুথ জানালা দিয়ে মুখ বার করে রুমাল নাড়লো আর মিঃ আলডিনও রুমাল নেড়ে বিদায় অভিনন্দন জানালেন মেয়েকে। একসময় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে মিলিয়ে গেল ট্রেন।
–আমি এবার উঠি মিসেস ক্যাথারিন। আবার দেখা হবে।
নিশ্চয়ই, আজ আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খাব, কেমন?
–বেশ, তাই হবে। গুড বাই।
–গুড বাই।
ক্যানে স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়তেই লাঞ্চের ঘণ্টা বেজে উঠল। যাত্রীরা সবাই ডাইনিং কোচ-এর দিকে গেল। রুথ আর ক্যাথারিন একটা টেবিলে মুখোমুখি বসল। খেতে খেতে দুজনের কথাবার্তা চললো।
রুথ বলল–আচ্ছা, আমাকে দেখে কি রকম মনে হয় আপনার?
-তার মানে?
-মানে, প্রথম দর্শনেই কাউকে ভালো আবার কাউকে খারাপ লোক বলে মনে হয়। তাই আমাকে দেখে কি রকম মেয়ে বলে মনে হয়?
-আমাকে কি থট রীডার মনে করলেন নাকি?
–না থট রীডার মনে করিনি। তবু কথাটা জানতে ইচ্ছে করছে আমার।
–বেশ, আপনি যখন এতই ইচ্ছুক তবে শুনুন। আপনার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে যে, আপনি কোনো দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
-আপনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। আমার মনের কথাগুলো যদি আপনাকে বলতে পারতাম তাহলে হালকা হতো আমার মনটা।
-বেশ, আপনার মন যদি হালকা হয় বলতে পারেন।
-না, এখানে নয়। লাঞ্চের পরে আপনাকে আমার কামরায় নিয়ে গিয়ে সব কথা বলব। লাঞ্চ শেষ হলে দুজনে রুথের কামরায় গিয়ে বসলেন–পাশাপাশি।
-এবার শুনুন আমার কথাগুলি।
–বলুন, আমি শুনছি।
অনেক আগে থেকেই। কিন্তু আমাকে জোর করে সরিয়ে আনা হয়। আমার বাবার মতো ধনীলোক পৃথিবীতে খুব কমই আছেন। বাবা জানতে পেরে জোর করে লর্ড-এর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন। কিন্তু আমি এ বিয়েতে খুশী হইনি।
-তারপর?
–এখনও, মানে আমি রিভিয়ারায় যাচ্ছি তার সঙ্গে মেলবার জন্যে। কিন্তু এদিকে বাবা চাইছেন আমার স্বামীর চালচলনে অসন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ডিভোর্সের মামলা করাতে। বাবার ইচ্ছে রিভিয়ারা থেকে ফিরেই আমি যেন মামলাটা দায়ের করি। কিন্তু……
-কিন্তু কি?
–আমি যে একজন পর পুরুষের সঙ্গে মিলতে যাচ্ছি তা বাবা জানেন না। আমি-মানে-আমি ঠিক বুঝতে….
কথাটা শেষ না করেই রুথ থেমে গেল। ক্যাথারিন দেখল যে, সে থরথর করে কাঁপছে। তার অবস্থা দেখে মায়া হলো।
-আমি বুঝতে পারছি যে, এ ব্যাপারটা আপনার মনে ঝড় তুলেছে।
–ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এখন আমার আর পিছবার উপায় নেই।
–কেন?
–আমি যদি এখন পিছিয়ে যাই আমার বন্ধুর মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
-মানুষের মন অতটা ভঙ্গুর নয় যে, কারো সঙ্গে দেখা না হলে মনটা ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে। আপনি কি শুধু সাহস দেখাবার জন্যে এ কাজ করেছেন? কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না নিজেই একবার ভেবে দেখুন না।
–আমি–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে শীগগিরই আমার একটা বিপদ হবে। আপনি হয়তো ভাববেন আমি পাগলামি করছি। কিন্তু কেন যেন বারবার ঐ কথাই মনে হচ্ছে শুধু।-কেন বলুন তো?
–আপনার মনে হয়, আপনি যদি প্যারীতে নেমে আপনার বাবাকে টেলিগ্রাম করে নিয়ে আসেন তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তিনি এসে পড়লে আপনার কোনো বিপদ হবে না।
–ঠিক বলছেন। আপনার কথা মতোই কাজ করব আমি।
ক্যাথারিন-এর মনে হলো এই মহিলার এখন একা থাকা দরকার।–আমি তাহলে এখন আসি। ডিনার খেতে ডাইনিং কোচে যাবেন তো?
-ইচ্ছে তো আছে। আবার হয়তো ডিনার বাস্কেটও নিতে পারি।
রুথ-এর কামরা থেকে করিডরে পা দিতেই ক্যাথারিন লক্ষ্য করল যে পাশের কামরার দরজাটা খুলে রুথ-এর মেইড কামরা থেকে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ক্যাথারিনকে দেখেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, মনে হলো কোনো কিছু দেখে সে চমকে উঠেছে। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সে পেছনের দিকে তাকালো কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না। এদিকে রুথ-এর মেইড দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
ক্যাথারিন এবার তার কামরার দিকে যেতেই দেখল, একটা কামরার দরজা খুলে একটি মেয়ে ক্যাথারিনের দিকে লক্ষ্য করছে। সে তাকাতেই তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু মুখটা দেখে মনে হল চেনা কিন্তু মনে করতে পারল না কোথায় দেখেছে।
নিজের কামরায় ঢোকবার পরেও ওই সিল্ক কোট পরা মেয়েটির কথা মনে হচ্ছিল। সীটের ওপরে বসে একটা কুশন টেনে নিয়ে তাতে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সে।
ট্রেনটা গেয়ার দ্য লায়ন স্টেশনে থামল। সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল ক্যাথারিন। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগলো তার।
হঠাৎ সে দেখল যে তার পূর্ব পরিচিত বান্ধবী জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডিনার বাস্কেট নিচ্ছে।
ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে তাড়াতাড়ি নিজের কামরায় চলে এল। মিনিট কয়েক বাদেই ডিনারের ঘণ্টা বাজল। ক্যাথারিন একখানা ডিটেকটিভ উপন্যাস হাতে নিয়ে ডিনার কোচে গিয়ে দেখল, একটি টেবিলে একটি চেয়ারই শুধু খালি আছে। আর টেবিলের দ্বিতীয় চেয়ারে বসেছেন লম্বা গোঁফওয়ালা একজন ছোটখাটো লোক। বাধ্য হয়েই সেই খালি চেয়ারে বসলো ক্যাথারিন। ভদ্রলোকটি হেসে বললেন, আপনি বুঝি খুব ডিটেকটিভ বই পড়েন?
-হ্যাঁ, এগুলো আমার ভালো লাগে।
-এই ধরনের বই-এর চাহিদা খুব বেশি শুনেছি। কিন্তু কেন এগুলির অত চাহিদা বলতে পারেন কি?
রহস্যজনক এবং রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ে মনে একটা উত্তেজনা জাগে। আমার মনে হয় এই কারণেই লোকে বেশি পড়ে।
-হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছেন। এতে যেসব রোমাঞ্চকর ঘটনা থাকে সেগুলি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।
–কিন্তু আমার ধারণা বাস্তব জগতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।
–না মাদমোয়াজেল আপনার ধারণা ভুল। এরকম অনেক ঘটনা বাস্তবেও ঘটে।
–বলেন কি?
–ঠিকই বলছি। এমনও হতে পারে, আপনিও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
-না, আমার তা মনে হয় না। আমার জীবনে এরকম কোনো ঘটনা কোনোদিনই ঘটেনি।
–অতীতে না ঘটলেও ভবিষ্যতে যে ঘটবে না তা কে বলতে পারে।
–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে।
–তা আছে। এবং এ ধরণের ঘটনায় নিজেকে জড়িত করাটা অপছন্দ করি না আমি। জীবনে যে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছি তা হলো, লোকে যা চায় তা অনেক ক্ষেত্রেই পেয়ে যায়। আপনিও হয়তো যা চাইছেন তা পেয়ে যাবেন।
–আপনি কি ভবিষ্যৎ বক্তা না কি?
–না, আমি যা বলি তা আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি।
এই ধরণের কথাবার্তার ভিতর দিয়ে ডিনার শেষ করে ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ক্যাথারিন ডাইনিং কোচ থেকে রুথ-এর কামরার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখল রুথ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর ট্রেনের কণ্ডাক্টার সীটের ওপরে বিছানা পেতে দিচ্ছে। সে আরও লক্ষ্য করল, পাশের ছোট কামরায় কতগুলো কম্বল এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে কিন্তু রুথ-এর সহকারিণী মেয়েটি সেখানে নেই।
নিজের কামরায় ঢুকে ক্যাথারিন দেখল যে, তার বিছানা পেতে দেওয়া হয়েছে। রাত সাড়ে নটা, সে তখন তার কামরায় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ক্যাথারিন। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়ি দেখতে গিয়ে দেখল তার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। কি মনে করে বিছানা ছেড়ে কামরা থেকে বেরিয়ে ট্রেনের কণ্ডাক্টরের কাছে সময় জেনে ঘড়িটা মিলিয়ে নেবার জন্যে কণ্ডাক্টরের সীটের দিকে গেল।
ক্যাথারিন করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুটা যেতেই দেখল কণ্ডাক্টরের সীটটা খালি। সে তখন উল্টো দিকে গেল। রুথ ক্যাথারিন-এর কামরার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল ক্যাথারিন। দেখল একটি নোক সেই কামরার দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটি করিডোরের দিকে পেছন ফিরে ছিল বলে ক্যাথারিন তার মুখটা দেখতে পেল না কিন্তু বুঝতে পারলো যে লোকটির বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের বেশি নয়।
হঠাৎ লোকটি ঘুরে দাঁড়াতেই ক্যাথারিন তাকে চিনতে পারল। এতো সেই লোকটি যে স্যাভয় হোটেলের করিডোরে তার গায়ের উপর পড়েছিল–তাছাড়া টমাক কুক-এর অফিসেও তাকে দেখেছিল।
তবে কি এই লোকটির কথাই রুথ বলেছিল। এর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই কি রিভিয়ারায় যাওয়া।
পরক্ষণেই মনে হলো সে হয়তো কামরাটা ভুল করেছে। ওটা হয়তো ওই ভদ্রলোকের কামরা হবে।
এই কথা মনে হতেই সে নিজের কামরায় চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদেই ট্রেনের গতিবেগ কমে গেল। তার পরেই ট্রেন এসে থামল লায়ন স্টেশনে।
.
১০.
হত্যাকাণ্ড
খুব ভোরেই ক্যাথারিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সে দেখল, চারিদিক বেশ ফর্সা হয়েছে।
তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে সে ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং কোচে গেল। কিন্তু সেখানে তার পূর্ব পরিচিত কাউকে দেখল না।
ব্রেকফাস্ট সেরে নিজের কামরায় এসে দেখে কণ্ডাক্টর তার বিছানা গুটিয়ে দিচ্ছে।
ক্যাথারিনকে দেখে তাকে সুপ্রভাত জানাল, আপনার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কারণ আকাশে আজ সূর্য দেখা দিচ্ছে। অন্যান্য দিন এ সময় বাইরে কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে।
কণ্ডাক্টরের কথার উত্তর দিল না, ক্যাথারিন বলল, ট্রেন লেট হয়নি তো?
–হ্যাঁ। কিছুটা লেট হয়েছে বৈকি। এতক্ষণ নিস-এ পৌঁছে যাবার কথা।
–নিস-এ পৌঁছতে আর কত দেরি?
–আর বেশি দেরি নেই। এসে গেলাম বলে। এরপর কেন, তারপরেই নিস। আপনি বিশ্রাম করুন, নিস-এর কাছাকাছি এলেই আমি এসে খবর দেব। কণ্ডাক্টর চলে গেল।
ক্যাথারিন বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগল। দূরে পামগাছের সারি। সেই গাছের সারির ভেতর দিয়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি দেখা যাচ্ছে। আকাশটাও বেশ পরিষ্কার। দৃশ্যটা খুবই ভালো লাগল ক্যাথারিনের।
কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটা কেন স্টেশনে এলো। ক্যাথারিন পুরু ওভারকোট গায়ে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ তার নতুন বন্ধুটির কথা মনে পড়ল। ঘণ্টাখানেক কথা হয়েছে তার সঙ্গে। কিন্তু এই অল্প সময়েই তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে ক্যাথারিন।
রুথ ক্যাথারিন-এর কথা মনে হতেই কামরার দিকে তাকিয়ে দেখল সব জানালাগুলি বন্ধ। তবে কি ওর ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও! কিন্তু তার সঙ্গে মেইড রয়েছে, তারও কি ঘুম ভাঙ্গেনি! কে জানে? হবেও বা!
ট্রেন ছাড়বার ঘন্টা পড়লেই সে তার কামরায় উঠে পড়ল। ট্রেন ছাড়বার মিনিট কয়েক পরে কণ্ডাক্টর এসে জানিয়ে গেল যে, আর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ট্রেন নিস-এ পৌঁছে যাবে।
ক্যাথারিন তার হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে এক পাউণ্ডের একখানা নোট বার করে কণ্ডাক্টরের হাতে দিল, এটা তোমায় বকসিস দিলাম।
নোটখানা পকেটে ভরে সে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল সে যেন কিছু বলতে চায়। ক্যাথারিন বিরক্ত হলো। আশ্চর্য! লোকটা এক পাউণ্ড বকসিস পেয়েও খুশী হয়নি।
বিরক্তির সুরে বলল, কি ব্যাপার! তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-হ্যাঁ, মানে… গত কাল আপনি যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আপনার কত দিনের পরিচয়?
–একথা আমাকে জিজ্ঞেস করার অর্থ কি?–বেশ একটু ঝাঁঝিয়ে কথাটা বলল ক্যাথারিন।
তাকে রেগে যেতে দেখে আমতা আমতা করে বলল, না, মানে সেই মহিলাটি….
কথাটা শেষ না করেই কণ্ডাক্টর তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেল ক্যাথারিনের কামরা থেকে।
মিনিট পাঁচেক পরেই ট্রেন পৌঁছে গেল নিস স্টেশনে। ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে রিসিভ করতে এসেছে কিনা।
একটু পরে একজন সুশ্রী যুবক তার সামনে এসে দাঁড়াল, ক্ষমা করবেন। আপনি কি মিস গ্রে?
-হা কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
–আমার নাম চ্যাব্বি। আপনার পিসতুত দিদি মানে লেডী টাম্পলিন আমার স্ত্রী। আপনার জিনিসপত্রগুলো দেখিয়ে দিন। কাস্টমস-এর ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে হবে।
দুটি স্যুটকেশ আর বিছানা ছাড়া ক্যাথারিন-এর সঙ্গে কিছুই ছিল না। চ্যাব্বিকে সেগুলো দেখিয়ে দিতেই তিনি হাঁকডাক করে একজন কুলি ডেকে সেগুলো মাথায় চাপিয়ে দিলেন।
আসুন মিস গ্রে। এবার কাস্টমস্ অফিসে যেতে হবে। কাস্টমস্-এর ঝামেলা মেটবার পর ক্যাথারিন আর চ্যাব্বি দরজার দিকে পা বাড়াতেই একজন পুলিশ-অফিসার ক্যাথারিনের সামনে এগিয়ে বলল, আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, মাদমোয়াজেল!
-কেন বলুন তো?
–কোনো বিশেষ একটা ঘটনা সম্বন্ধে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।
–কোনো ঘটনা? তাছাড়া আপনিই বা কে?
–আমি নিস-এর কমিশনার অব পুলিশ।
–আপনি কি আমার পাশপোর্ট দেখতে চান?
–না, আমি আপনার কাছে কয়েকটা খবর জানতে চাই।
–খবর কি বিষয়ে?
–একজন মহিলার সম্বন্ধে। আমি জানতে পেরেছি আপনি গতকাল তার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছেন এবং লাঞ্চের পরেও অনেকক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করেছিলেন।
-কারো সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া বা গল্প করা অপরাধ নাকি?
-না। তা নয়, তবে ওই মহিলাটির সম্বন্ধে আমরা যাবতীয় খবর জানতে চাই বলেই আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার।
–দেখুন মঁসিয়ে কমিশনার, কোথাকার কোনো মহিলার খবর জানাবার জন্যে আমার মোটেই মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া এভাবে কোনো মেয়েকে বিরক্ত করাটাও বোধহয় আইনসম্মত নয়।
–ফরাসী পুলিশ অকারণে কোনো কিছু করে না। মাদমোয়াজেল কারণ একটা অবশ্যই আছে।
–কারণটা দয়া করে বলবেন কি?
নিশ্চয়ই বলব। যে মহিলাটির সম্বন্ধে আমরা খবরাখবর জানতে চাইছি, তিনি গত রাত্রে মারা গেছেন।
মারা গেছেন! বলেন কি?
–মারা গেছেন বললে ঠিক হয় না। তিনি নিহত হয়েছেন অর্থাৎ কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে।
–কি সর্বনাশ; মিসেস ক্যাথারিন খুন হয়েছেন।
এবার তাহলে বুঝতে পারছেন কেন আমরা আপনাকে যেতে দিচ্ছি না। চলুন আমরা ট্রেনের কামরায় যাই।
–তা না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আমার কাছ থেকে বিশেষ কোনো খবর আপনি পাবেন না। কারণ তার সম্বন্ধে আমি একেবারে কিছুই জানি না বললেই হয়। আমার মনে হয়, তার মেইডের কাছ থেকে সব খবর জানতে পারবেন।
-মেইড পালিয়েছে।
–বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। সেইজন্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কারণ ট্রেনের যাত্রীদের ভেতরে শুধু মাত্র আপনার সঙ্গেই তার কথাবার্তা হয়েছিল।
-বেশ, তাহলে চলুন কোথায় যেতে চান।
এই সময় চ্যাব্বি বলল, আমি কি ওর সঙ্গে যেতে পারি?
–আপনি কে? প্রশ্ন করে কমিশনার।
–আমি হলাম ওর দিদির, মানে লেডী টাম্পলিনের স্বামী। আমি ওকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে এসেছি।
-আপনাকে একটু বাইরে অপেক্ষা করতে হবে মঁসিয়ে। মনে হয়, আধ ঘণ্টার মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শেষ করতে পারব। এই সময়টা আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
চ্যাব্বিকে বলার পর কমিশনার ক্যাথারিনকে সঙ্গে করে একটা কামরায় গিয়ে ঢুকলেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন ঢুকে পড়ল সেখানে।
তাকে দেখে কমিশনার খুশী হয়ে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো যে! আপনাকে পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
উনি মৃদু হেসে বললেন, ভাগাড়ে মড়া পড়লেই শকুন এসে হাজির হয়, তাই না?
–এটা কি বলছেন মঁসিয়ে, বিশ্ববিখ্যাত ডিটেকটিভ মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে এখানে পেয়ে আমি যে কত নিশ্চিন্ত হয়েছি সে কথা মুখে বলে বোঝাতে পারব না। আপনি দয়া করে বসুন মঁসিয়ে, মাদমোয়াজেল গ্রে-কে আপনার সামনেই জিজ্ঞাসা করছি। ওঁর সঙ্গে নিহত মহিলাটির পরিচয় হয়েছিল, কিছু কথাবার্তাও হয়েছিল ওঁদের ভেতরে।
মঁসিয়ে পোয়ারো তখন ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কেমন মাদমোয়াজেল, বলেছিলাম না, আপনি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারেন, কাথাটা খেটে গেল তো?
–হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।
এইসময় কমিশনার বললেন, আপনাকে আর বেশিক্ষণ আটকে রাখব না। এবারে আপনি বলুন, মৃত মহিলাটির সঙ্গে আপনার কি কি কথা হয়েছিল।
কমিশনারের প্রশ্নের উত্তরে ক্যাথারিন সব কথা খুলে বলল তাকে। রুথ ক্যাথারিন-এর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে তাদের ভেতরে যা যা কথা হয়েছিল সেগুলো প্রায় হুবহু বলে গেল সে। এমন কি, রুথ যে তার বাবাকে গোপন করে লাভারের কাছে যাচ্ছিল সে কথাও বলল কমিশনারকে।
সব কথা শোনবার পর মঁসিয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে কমিশনার বললেন, ওনার মনে হয় ওই লোকটাই হয়তো…..
তার কথায় বাধা দিয়ে ক্যাথারিন বলল, ব্যাপারটা তো আত্মহত্যাও হতে পারে।
-না, আত্মহত্যার ঘটনা এটা নয়। কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে নিজের গলায় ফাঁস লাগান না।
–কি বললেন। গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করা হয়েছে।
–শুধু তাই নয়, কোনো ভোতা জিনিস দিয়ে আঘাত করে তার মুখটা বিকৃত করা হয়েছে।
-কী ভয়ানক!
সত্যিই ভয়ানক। হত্যাকারী যেই হোক, সে যে মহাপাষণ্ড এতে কোনোই ভুল নেই। যাই হোক, আপনাকে আর একটু কষ্ট দেব আমি। আমাদের সঙ্গে সেই মহিলাটির কামরায় একবার যেতে হবে।
কেন বলুন তো?
-মৃতদেহটা একবার দেখবেন। এখনও সনাক্ত হয়নি মৃতদেহটা। আমার মনে হয় আপনি হয়তো সনাক্ত করতে পারবেন।
-বেশ তাহলে চলুন।
এইসময় পোয়ারো বললেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি কি?
–একথা জিজ্ঞেস না করলেও চলতো মঁসিয়ে। আপনি নিশ্চয়ই যাবেন।
রুথ ক্যাথারিনকে সীটের ওপরে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তার বিকৃত মুখখানা দেখে ক্যাথারিন শিউরে উঠেছিল। গতকালের সেই হাসিখুশী মুখের সঙ্গে আজকের এই মুখের কত তফাৎ। রুথের অত সুন্দর মুখখানার বীভৎস পরিণতি দেখে ক্যাথারিন-এর চোখে জল এল।
কমিশনার বললেন, আপনি একে চিনতে পারছেন তো?
–হ্যাঁ, পারছি। মুখ দেখে চেনার উপায় না থাকলেও ওর গায়ের ওই সিল্ক কোট আর ডান হাতের কব্জির ওপর তিল চিহ্ন দেখে আমি ওকে চিনতে পেরেছি।
পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল-এর সাক্ষ্যটা খুবই মূল্যবান হবে মঁসিয়ে কক্স। কিন্তু এখনও খুনীর উদ্দেশ্যটা জানা যায়নি।
–আমার মনে হয় ওকে রব করবার জন্য হত্যা করেছে।
–তাই যদি হয়, তাহলে হত্যাকারী ওর মুখখানাকে ওভাবে বিকৃত করবে কেন?
–তাও তো বটে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয়?
–কিছুই মনে হয় না। তদন্ত না করে এবং ঘটনাবলী বিশ্লেষণ না করে এ ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না। তবে এটা ঠিক যে এটা রবারী কেস নয়।
এই সময় ক্যাথারিন বলল, আমাকে আর কতক্ষণ আটকিয়ে রাখবেন মঁসিয়ে?
-না, আর বেশিক্ষণ নয়। এবার পাশের কামরাটা একটু দেখেই আপনাকে ছেড়ে দেব। ক্যাথারিন ও পোয়ারোকে নিয়ে কমিশনার পাশের কামরায় ঢুকেই দেখে যে, কামরার ভেতরে তিন-চার খানা কম্বল এলোমেলো ভাবে জড়ো হয়ে পড়ে আছে।
কম্বলগুলো তুলে একটা একটা করে পরীক্ষা করতে লাগলেন পোয়ারো। কমিশনার কয়েকটা পরীক্ষা করলেন।
সীটের পাশে একটা টুপি রাখার বাক্স এবং দুটো স্যুটকেশ দেখতে পাওয়া গেল।
জিনিসগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কমিশনার ক্যাথারিন-এর দিকে তাকালেন। এখান থেকে কোনো কিছু খোয়া গেছে কিনা দেখুন তো, মাদমোয়াজেল।
কমিশনারের কথা শুনে ক্যাথারিন ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখে বলল, একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি না।
–কি জিনিস?
–বেগুনি রং-এর একটা ভেলভেটের বাক্স। ওটাকে আমি মেইডের হাতে দেখেছিলাম।
–বাক্সটার ভেতরে কি ছিল জানেন কি?
-না, তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম, বাক্সটার ওপরে আর. কে. (R. K.) এই অক্ষর দুটি এমব্রস করা ছিল। আমার মনে হয় মেইড এটা নিয়ে সরে পড়েছে।
ক্যাথারিন-এর কথার উত্তরে কমিশনার বললেন, না। আপনার অনুমান ঠিক নয়। মেইডটি প্যারী স্টেশনে নেমেছেন।
কমিশনার যখন কথা বলছিলেন পোয়ারো কিন্তু তখনও কম্বলগুলো পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ একটা কম্বলের ভাঁজের ভেতরে দুগোছা সোনালী রঙের পরচুল দেখতে পেলেন তিনি।
চুলের গোছা দুটো হাতে তুলে কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জিনিসটা একবার দেখুন মঁসিয়ে কক্স।
–এতো দুগোছা চুল। এর কি কোনো গুরুত্ব আছে।
-কিসের গুরুত্ব আছে আর কিসের নেই সেটা আগে থেকে বলা যায় না। আমাদের প্রতিটি বিষয়ের দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। আপাতত কোনো কিছু অকেজো মনে হলেও সেটাও নোট করতে হবে। এই বলে চুলের গোছা দুটো একটা কাগজে মুড়ে পকেটে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, কণ্ডাক্টরকে একবার ডেকে পাঠান মঁসিয়ে কক্স। তার বক্তব্যটা বিশেষভাবে শোনা দরকার।
কমিশনার ডেকে পাঠানোর দুমিনিটের মধ্যেই কণ্ডাক্টর এসে হাজির হলো। কমিশনার বললেন, আপনার নাম?
–পিয়ের মিচেল।
–আপনি আমাকে যে সব কথা বলেছিলেন সেগুলো আরেকবার এই ভদ্রলোককে বলুন। পিয়ের মিচেল বলতে শুরু করল, আমাদের ট্রেনটা গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশন থেকে ছাড়বার পর আমি বিছানা ঠিক করে দেবার জন্য মাদামের কামরায় আসি। কামরায় ঢোকবার আগে আমি ভাবছিলাম যে মাদাম হয়তো ডিনার খেতে ডাইনিং কোচে গেছেন। কিন্তু কামরায় ঢুকে দেখি যে তিনি ডিনার বাস্কেট নিয়েছেন। আমি তার মেইডের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলেন যে তিনি তাকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়েছেন। আমাকে তিনি একটি মাত্র বিছানা পাততে বলেন। বিছানা পাতা হয়ে গেলে তিনি আমাকে বলেন যে তাকে যেন সকালে ঘুম ভাঙ্গানো না হয়। আমি তাকে বলি তার কথা মতই কাজ হবে। তারপর তিনি আমাকে গুড-নাইট জানান, আমিও তাকে গুড-নাইট জানিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাই।
–আপনি মেইডের কামরায় ঢুকেছিলেন কি?–প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।
–না মঁসিয়ে।
–মেইডকে আপনি দেখেছিলেন?
–ট্রেন প্যারীতে আসবার আগে একবার দেখেছিলাম।
তার কাছে কোনো ভেলভেটের বাক্স দেখেছিলেন কি?
–না।
–আচ্ছা মেইডের কামরায় কোনো পরপুরুষ আছে বলে আপনার সন্দেহ হয়েছিল কি?
–সন্দেহ নয়, সত্যিই ঐ কামরায় একটা লোক ছিল। দরজাটা পুরোপুরি খোলা না থাকায় আমি তার মুখটা দেখতে পাইনি। তবে সে যে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল এতে কোনো ভুল নেই।
–আপনি আর কিছু লক্ষ্য করেছিলেন কি?
-না মঁসিয়ে। আর বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিনি।
–ভোর হবার পর আপনি ওদের এদিকে এসেছিলেন কি?
–হ্যাঁ, এসেছিলাম কিন্তু উনি ঘুম ভাঙাতে নিষেধ করেছেন বলে মাদামের কামরায় ঢুকিনি।
-তারপর? কি করলেন?
–কেন্স স্টেশন আসবার আগে আর একবার এই কামরার সামনে অত বেলায় তখনও দরজা বন্ধ দেখে আমি দরজায় করাঘাত করি কিন্তু ভেতরে কোনো সাড়া পাই না। আমি তখন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করি। মাদামকে দেখে মনে হলো তখনও ঘুমিয়ে আছেন। তাই আমি তাকে জাগিয়ে দেবার জন্য তার মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিই। তারপরেই…
-তারপরই আপনি দেখতে পান যে মহিলাটিকে হত্যা করা হয়েছে তাই না?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। ব্লু ট্রেনে যে এই রকম একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে আমার ধারণার বাইরে। এটা সত্যই ভয়ানক। কিন্তু আমি জ্ঞানত আমার কর্তব্য কর্মে অবহেলা করিনি।
কমিশনার বললেন, না, আপনার কর্তব্য কর্মে ত্রুটি হয়নি। এ ব্যাপারে আপনার কোনো চিন্তা নেই।
কমিশনারের কথায় আশ্বস্ত হয়ে কণ্ডাক্টর বলল, মঁসিয়ে যদি দয়া করে কর্তৃপক্ষকে আমার সম্বন্ধে একটু বলেন তাহলে বড় ভাল হয়।
–ঠিক আছে। রেল কর্তৃপক্ষকে আপনার কথা বলব। কণ্ডাক্টর সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে চলে গেল।
কমিশনার বললেন, ডাক্তারের কথা মেনে নিলে ধরতে হয় মহিলাটিকে হত্যা করা হয়েছিল। গেয়ার দ্য নয়েন এবং নয়েন স্টেশনের মধ্যে। কিন্তু কে এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। মাদমোয়াজেল-এর কথায় বোঝা যায় যে মহিলাটি তার লাভারের সঙ্গে দেখা করতে রিভিয়ারায় যাচ্ছিলেন। তবে কি লোকটা প্যারীতে এর সঙ্গে দেখা করেছিল? আমার মনে হয় দেখা করেছিল এবং এই মহিলাটি তাকে পাশের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। এরপর মহিলাটি হয়তো তাকে জানায় যে তিনি আর তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। এবং এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে কলহের দরুণ ওকে হত্যা করে সে নয়েন স্টেশনে নেমে যায়।
পোয়ারো বললেন, অথবা সে নিস স্টেশনেও আসতে পারে।
-তা পারে, কিন্তু সেটা তার পক্ষে চরম দুঃসাহসের কাজ হবে।
–এটা তো ডাকাতদের কাজও হতে পারে।
–হ্যাঁ, তাও হতে পারে। কিন্তু সেই মেইডটির খোঁজ না পাওয়া অবধি সঠিক কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভেলভেটের বাক্সটি যদি তার কাছে পাওয়া যায় তাহলে এটা রেল-ডাকাতদের কাজ নয়। শুধু তাই নয়। বাক্সটার সন্ধান পওয়া গেলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে এটা প্রেমঘটিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা ট্রেন-ডাকাতদেরই কাজ। আজকাল ওরা ভয়ানক দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে।
এই সময় ক্যাথারিন বলল, আমাকে আর কতক্ষণ আটকে রাখতে চান আপনারা?
কমিশনার বললেন, না, আর আপনাকে আটকে রাখব না। এবার আপনি যেতে পারেন আর যাবার আগে আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যান।
–লিখে নিন। ক্যাথারিন গ্রে, কেয়ার অব লেডী টাম্পলিন, মার্গারেট ভিলা, নিস। ঠিকানাটা দিয়েই সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।
৩. মার্গারেট ভিলা
১১. মার্গারেট ভিলা
মার্গারেট ভিলায় ডাইনিং রুমে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিল লেডী টাম্পলিন, তার স্বামী মিঃ চার্লস ইভান্স ওরফে চ্যাব্বি। লেডীর ভূতপূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে লেনক্স এবং ক্যাথারিন। ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে লেডী টাম্পলিন বলল, তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমিও জড়িয়ে পড়লে। আমি কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না, তোমাকে এ ব্যাপারে পুলিশ কেন টানছে।
লেডী টাম্পলিনের কথাটা ক্যাথারিনের কাছে বিরক্ত বোধ হল তাছাড়া লাঞ্চ টেবিলে এসব আলোচনা মোটেই ভালো লাগল না তাই সে চুপ করে রইল।
চ্যাব্বি বলল, পুলিশ যখন ওকে নিতে চাইল তখন আমিও সঙ্গে যেতে চাইলাম কিন্তু আমাকে তারা অপেক্ষা করতে বলল।
লেডী টাম্পলিন আবার বলল, আমার মনে হয় নিহত মেয়েটির সঙ্গে তোমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে তা থেকে ওরা একটা সূত্র বের করতে চেষ্টা করছে।
ওদের কথাগুলো যে ক্যাথারিনের ভালো লাগছিল না সে কথা লেনক্স বুঝতে পেরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্তির সুরেই বলল, দয়া করে থামবে এবার!
মেয়ের বিরক্তি লক্ষ্য করে লেডী টাম্পলিনও বিব্রত স্বরে বলল, তুমি জানো না লেনা। খবরের কাগজে-বিষয়টাকে এমনভাবে লিখবে যে শেষ পর্যন্ত হয়ত আমাকেও টেনে আনবে এর মধ্যে। যাতে এটা না হয় সে ব্যবস্থা আমি করছি। মঁসিয়ে দ্য হেভীল্যাণ্ড আমার বিশেষ বন্ধু। খবরের কাগজের রিপোর্টারদের ওপর তার অসীম প্রভাব। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করব আমি। কি বলো ক্যাথারিন? মতলবটা কেমন মনে হয় তোমার?
এতক্ষণে কথা বলল ক্যাথারিন, না এসব কিছুই করতে হবে না আপনাকে।
ক্যাথারিন-এর কথা শুনে লেডী টাম্পলিন বেশ একটু দমে গেল। কিন্তু কেউ তাকে থামাবে এটা সে সহ্য করতে পারে না। তাই সে শুরু করল, মাদাম ক্যাথারিনকে আমি চিনতাম। ভারি সুন্দর চেহারা ছিল তার। তাছাড়া খরচের হাতটা এত বেশি যে জলের মতো টাকা খরচ করত সে।
লাঞ্চ শেষ হয়ে গেলে লেনক্স ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে বলল, চলো মাসী, তোমার ঘরটা একবার দেখে আসি।
ক্যাথারিন খুশী মনেই লেনক্স-এর কথায় সম্মতি জানাল, হ্যাঁ তাই চলো। ক্যাথারিন তিন তলায় ছোট একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা অবশ্য ছোট হলেও চমৎকার সাজানো রয়েছে।
ঘরে ঢুকে একটা সোফার ওপর দুজনে বসল কিন্তু তখনও ক্যাথারিনের বিরক্ত ভাবটা কাটেনি। তাই লেনক্স বলল, মায়ের কথায় তুমি কিছু মনে করো না মাসী। মায়ের স্বভাবই ওই রকম। কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না আর চ্যাক্মিমশাইও একই রকম, সেই জন্যেই আমি তোমাকে ওদের কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলাম। এবার তুমি বিশ্রাম নাও, আমি চলি।
এখুনি যাবে?
–হ্যাঁ, ওরা কি বলছে তা শুনতে চাই আমি। সে আবার মায়ের কাছে ফিরে এলো। তার মা আর মিঃ ইভান্স তখন দোতলার বারান্দায় কথাবার্তা বলছিল। লেডী টাম্পলিন বলল, মেয়েটাকে যত বোকা ভাবছিলাম তত নয়। তবে, বড় গম্ভীর। কথা একরকম বলতেই চায় না!
চ্যাব্বি বলল, তা ঠিক। তবে ভদ্রমহিলার চেহারাটা কিন্তু খুবই সুন্দর। পোষাক পরিচ্ছদও বেশ রুচি সম্মত। সব দিক থেকে সমাজে মেশবার উপযুক্ত।
উপযুক্ত না ছাই। অমন গোমড়ামুখো মেয়ে কি সমাজে মেলামেশা করতে পারে?
এবার লেনক্স বলল, মোটেই গোমড়ামুখো নয়। তোমরা দুজনে যা শুরু করেছিলে তাতে মরা মানুষেরও রাগ হয়। সারা সকাল পুলিশের হয়রানি সহ্য করেছে আবার তোমরা তাকে রেহাই দিচ্ছিলে না।
-তুমি যাই বল না কেন লেনা, পরের সম্পত্তি হাতে পেয়ে খুব অহঙ্কারী হয়েছে। আর মনটাও বেশ ছোট।
-ওর কাছ থেকে কিছু খসানো যাবে না তাই না?
–কি বলতে চাও তুমি?
–ঠিকই বলছি। ওর কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেবার মতলবেই তো তুমি ওকে চিঠি লিখে এখানে এনেছ।
-তুমি ভুলে যাচ্ছ যে ও আমার মামাতো বোন।
এই কথা শুনে চ্যাব্বি হঠাৎ উৎসাহিত হল, তাই নাকি? তাহলে তো আমি ওর নাম ধরেই ডাকতে পারি তাই না?
–তা পার বৈকি?
–বেশ। তা এখন থেকে আমি ওকে নাম ধরেই ডাকবো, টেনিস খেলতে পারে নিশ্চয়ই।
–ও খেলবে টেনিস। তাহলেই হয়েছে। সারাটা জীবন গেল বুড়ীর সেবা করতে। টেনিস খেলা জানবে কোত্থেকে
লেনক্স এবার রেগে গেল, তোমরা তাহলে পরনিন্দা করতে থাকো আমি চললাম। উঠে দাঁড়াল লেনক্স।
–কোথায় চললে?–জিজ্ঞাসা করলো তার মা।
–কোথায় আবার! তোমরা যার নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়েছ তার কাছেই যাচ্ছি আমি।
ক্যাথারিন সমুদ্রের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল। লেনক্স এসে বলল–কি গো মাসী! অমন তন্ময় হয়ে কি দেখছ?
-না কিছু না। কখন এলে তুমি?
–এই আসছি। একটা কথা তোমাকে বলতে এলাম।
–কি?
-তুমি এখানে না এলেই ভালো করতে। কেন এলে এখানে?
–না এলে যে তোমার সঙ্গে পরিচয় হোত না।
–না, ঠাট্টা নয়। তোমার দিদির স্বামীটি একটি চীজ। সব সময় স্ত্রীর আঁচল ধরেই আছে। কোনো স্বামী যে স্ত্রীর ওইভাবে মোসাহেবী করতে পারে তা আমার জানা ছিল না।
–মিঃ চ্যাব্বি বুঝি দিদির মোসাহেবী করে?
–হরদম। আর মোসাহেবী না করলে চলবেই বা কি করে টাকা চাই তো।
–সেকি উনি কোনো কাজকর্ম করেন না?
করেন বৈকি। বেকার সমিতির প্রেসিডেন্ট।
লেনক্স-এর কথা শুনে হেসে ক্যাথারিন বলল, তুমি তো খুব হাসাতে পার দেখছি। এবার আমার কথাটা শোন। তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমি এতদিন এক বৃদ্ধ মহিলার সেবা শুশ্রূষা করতাম। ভদ্রমহিলা মারা যাবার আগে তার সমস্ত সম্পত্তির-উইল করেছেন আমার নামে।
-হা শুনেছি। পদ্ধতিটা বোধহয় ভালোই, তাই না?
–হ্যাঁ, তা ভালোই বলা চলে। তবে সম্পত্তির মূল্য পঞ্চাশ লক্ষ পাউণ্ডেরও ওপর।
–বলো কি মাসী। তুমি তাহলে একজন জাঁদরেল মহিলা।
–তাই বুঝি। তা হবে, তারপর শোনো, এতদিন আমি হাই সোসাইটিতে মেলামেশা করার কোনো সুযোগ পাইনি। এবার আমি হাই সোসাইটিতে মিশতে চাই। আর সেই জন্যেই তোমার মায়ের চিঠি পেয়েই চলে এসেছি। তবে আমি আসাতে দিদি যদি……
ক্যাথারিনের কথা শেষ হবার আগেই লেডী টাম্পলিন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল; একটা সুখবর আছে লেনা।
কি?
–এইমাত্র ড্রেক আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আজ রাত্রে সে আমাদের এখানে ডিনার খাবে।
–এটা সত্যিই সুখবর মা, আজকের ডিনারটা খুবই আকর্ষণীয় হবে দেখছি।
–হ্যাঁ ড্রেক আসাতে ডিনার পার্টিটা সত্যই জমজমাট হবে।
–তুমি কি ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করেছ নাকি?
–নিশ্চয়ই। ক্যাথারিনের সঙ্গে পরস্পরের পরিচয় করে দিতে হবে তো। কয়েকজন বিশিষ্ট লোককে নিমন্ত্রণ করতে বেরোচ্ছি। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও?
–না, মা। আমি আজ মাসীর সঙ্গে গল্প করছি আর কোথাও বেরোব না।
লেডী টাম্পলিন চলে গেলে ক্যাথারিন বলল, ড্রেক কে লেনা?
–লর্ড লুকোনবারীর ছেলে। যেমন বংশমর্যাদা তার তেমন চেহারা। তাছাড়া চালচলন কথাবার্তা সবেতেই চৌকস। মেয়েরা তো তাকে দেখলেই পতঙ্গের মত ছুটে যায় তার দিকে।
-কেন?
-কেন তা বলতে পারি না। তবে মনে হয় তার বেপরোয়া চাল চলনে তার জুয়াড়ী স্বভাবের জন্যেই তার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
জুয়াড়ী স্বভাব মানে?
–মানে, জুয়ায় তার সর্বস্ব পণ রাখতে ওর বাধে না। এটা নাকি ওর বংশানুক্রমিক স্বভাব। আমি শুনেছি, ওর পূর্বপুরুষেরা তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজি ধরে জুয়া খেলতেন। তাছাড়া কেউ কেউ নাকি তাদের সুন্দরী বউদেরও বাজি ধরতেন। বংশের সেই ধারাটাই ড্রেক পেয়েছে।
আরও কিছুক্ষণ গল্প করে লেনক্স বিদায় নিল। যাবার আগে ক্যাথারিনকে বলে গেল, সে যেন তার সবচেয়ে দামী আর সুন্দর পোশাকটা পরে ডিনার পার্টিতে যায়।
রাত প্রায় সাড়ে সাতটায় ক্যাথারিন ড্রয়িংরুমে এলো। ড্রয়িংরুমটা ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট আর বৈশিষ্টদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ পরীর মত সুন্দর বেশে ক্যাথারিনকে ঢুকতে দেখে সবাই খুশী হলো।
লেডী ট্যাম্পলিন খুশী হলো তার মামাতো বোনকে দেখে। সে মনে মনে স্বীকার করল যে সত্যই মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞান আছে। উঠে দাঁড়িয়ে গেস্টদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কাজিন, মিস ক্যাথারিন গ্রে। মস্ত বড় সম্পত্তির মালিক। অনেক কাজ ওর কিন্তু আমার অনুরোধে কাজকর্ম ফেলে রেখেই চলে এসেছে।
গেস্টরা খুশী হলো। একে একে এসে ক্যাথারিন-এর সঙ্গে করমর্দন করতে লাগলো। লেডী টাম্পলিন প্রত্যেকের পরিচয় জানিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে।
এদিকে খানসামা এসে জানিয়ে গেছে যে, ডিনারের আয়োজন প্রস্তুত হয়ে গেছে। কিন্তু ড্রেক কে না দেখে লেডী টাম্পলিন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
একটু পরেই ড্রেক এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই নাটকীয় কায়দায় বো করল অতিথিদের উদ্দেশ্যে। দেরির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। তারপর সোজা এগিয়ে গেল লেডী টাম্পলিনের সামনে।
লেডী টাম্পলিন করমর্দন করে ড্রেককে পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসো ড্রেক। আমরা এতক্ষণ তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার এত দেরি করা উচিত হয়নি।
ড্রেক আরেকবার ক্ষমা প্রার্থনা করল তার ত্রুটির জন্যে। তারপর শুরু হলো কুশল প্রশ্ন। লেডী টাম্পলিন আলাপে জমে উঠল। ক্যাথারিন একটু দূরে বসে ড্রেককে লক্ষ্য করছিল। তাহলে ইনিই ড্রেক। এই নিয়ে চারবার এর সঙ্গে দেখ হল। স্যাভয় হোটেলের করিডেরে, টমাস কুক-এর অফিসে, ব্লু ট্রেনে। এবং চতুর্থবার এখানে।
তার মনে হল ড্রেক তাকে চিনতে পেরেছে। সে মাঝে মঝেই তাকাচ্ছিল তার দিকে। ড্রেক ক্যাথারিনকে লক্ষ্য করছে দেখে টাম্পলিন বলল, আমার মামাতো বোন ক্যাথারিন। আমার এখানে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। মস্ত বড় সম্পত্তির মালিক হয়েছে ও।
–বিবাহিত নন নিশ্চয়ই? মৃদু স্বরে ড্রেক বলল।
-না এখনও বিয়ে হয়নি ওর। ভাবছি, এবার পাত্রস্থ করব। এই রকম দু-চারটে কথা বলার পর খানসামা বলল, ডিনার তৈরি আপনারা সবাই আসুন।
ডিনারের জন্যে সবাই রওনা হল ডাইনিং হলের দিকে। ডিনার টেবিলে বসেই ক্যাথারিন দেখল তার পাশের আসনে ড্রেক বসেছে। সে তখন ড্রেক-এর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যে আপনার সঙ্গে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।
–আমিও তাই, এইবার নিয়ে তিনবার দেখা হলো আপনার সঙ্গে। স্যাভয় হোটেলে, কুক কোম্পানির অফিসে এবং তৃতীয়বার এখানে।
–আপনি হয়তো ভুল করলেন মঁসিয়ে। এবার নিয়ে চারবার ব্লু ট্রেনেও দেখা হয়েছিল আপনার সঙ্গে।
-কি বললেন ব্লু ট্রেনে? হ্যাঁ তা হয়তো….
হঠাৎ যেন মুখের চেহারাটা বদলে গেল ড্রেকের। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল, হ্যাঁ, ট্রেনে একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে শুনলাম। কে একজন মারা গেছেন নাকি ট্রেনে।
-হ্যাঁ। একজন মহিলা।
–বড়ই দুঃখের ব্যাপার। ট্রেনে মৃত্যুটা খুবই মর্মান্তিক তাই না?
টেবিলের অপরদিক থেকে একজন আমেরিকান মহিলা বলল, মিঃ ক্যাথারিন কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
–সেকি! আপনাকে চিনতে পারবো না মানে। কেমন আছেন বলুন?
–তা একরকম ভালই আছি। আপনি কবে এলেন?
–আজই সকালে।
ব্লু ট্রেনে নিশ্চয়ই?
–হ্যাঁ।
এদিকে ক্যাথারিন ভাবছে এর সঙ্গে কি সেই নিহত ভদ্রমহিলার কোনো সম্পর্ক আছে। তার পদবীটাও তো ক্যাথারিন। তবে কি সে তার স্ত্রী। কিন্তু তাই যদি হয় তবে ইনি এমন হেসে কথা বলছেন কেমন করে।
ক্যাথারিন যখন এইসব ভাবছে সেই সময় একজন চাকর এসে ড্রেককে একখানা চিরকুট দিয়ে কানে কানে কি যেন বলল।
চিরকুট খানা একবার পড়েই ড্রেক দাঁড়িয়ে পড়ল। লেডী টাম্পলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার বাইরে যেতে হচ্ছে মাদাম। পুলিশের প্রিফেক্ট আমার সঙ্গে এক্ষুনি একবার দেখা করতে চান। আমি বুঝতে পারছি না কেন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এই কথা বলেই ড্রেক ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল, সে চলে গেল।
লেডী টাম্পলিন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলল, কি ব্যাপার! পুলিশ ওর খোঁজ করছে কেন!
প্রত্যেকের মনে তখন একই প্রশ্ন–পুলিশ ওর খোঁজ করছে কেন?
.
১২.
মৃত্যু সংবাদ
মিঃ আলডিন তার সেক্রেটারীর জন্যে অপেক্ষা করছেন। একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে প্যারীতে পাঠিয়েছেন। কথা আছে রাত আটটার মধ্যেই ফিরে আসবে সে এবং রিপোর্ট নিয়ে এলেই তিনি তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করবেন।
ঠিক সময়েই ফিরে এলো কিংটন। তাকে দেখে মিঃ আলডিন বললেন, খবর ভালো তো? ওদিক সব ঠিক আছে?
-হা স্যার। সবই ঠিক আছে। আপনি গেলেই কাজটা হয়ে যাবে।
–আর কোনো খবর?
–বিজনেসের খবর আর কিছু নেই। তবে মিস ম্যাসন-এর সঙ্গে আমার প্যারীতে দেখা হয়েছিল।
–তার মানে! সেকি রুথের সঙ্গে যায়নি নাকি?
-না। সে বললে যে, মিসেস ক্যাথারিন তাকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়েছেন। তিনি নাকি বলেছেন তার পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে যেন রীহ্ হোটেলে অপেক্ষা করে।
-তোমার সঙ্গে কোথায় তার দেখা হয়েছিল?
গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।
খবরটা শুনে বিরক্ত হলেন আলডিন। তার মনে হলো মিস ম্যাসনকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়ে রুথ একা গেছে সেই হতভাগা কাউন্টের সঙ্গে মিশতে। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, মিঃ ম্যাসন আর কিছু বলেছিল কি?
-হ্যাঁ বলেছিল। সে বললে, মিসেস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে হঠাৎ তার এক বন্ধুর দেখা হয়ে যায় ট্রেনে। তারপরই তিনি তাকে প্যারী স্টেশনে নেমে যেতে বলেন। মিঃ আলডিনকে গম্ভীর ভাবে চুপ করে থাকতে দেখে কিংটন বলল, এবার আমি কি যেতে পারি স্যার?
–হ্যাঁ, তুমি এখন যাও। আজ রাতটা বিশ্রাম নাও গিয়ে।
কিংটন পা বাড়াতেই হোটেলের একটি বয় একখানা টেলিগ্রাম মিঃ আলডিন-এর হাতে দিয়ে বলল, আপনার টেলিগ্রাম স্যার।
–ঠিক আছে, তুমি এবার যেতে পার।
টেলিগ্রামটা পড়ে আলডিনের মুখের ভাব বদলে গেল। মুখখানা ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অক্লান্তভাবে চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন তিনি।
মিঃ আলডিন-এর এই ভাবান্তর দেখে কিংটন বিনীতভাবে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে স্যার?
কোনো কথা না বলে আলডিন টেলিগ্রামটা কিংটনের হাতে দিলেন। টেলিগ্রামটা পড়ে কিংটন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। কি সর্বনাশ!
হা কিংটন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি এখুনি নিস-এ রওনা হব। চাকরকে বলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার ব্যাগ স্যুটকেশ গুছিয়ে দিতে আর তুমিও তৈরি হয়ে নাও।–আমার সঙ্গে যেতে হবে।
এবার কেরানী এসে হাজির হলো সেখানে। মিঃ আলডিন রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন–কি ভাই?
–মিঃ গোবি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, স্যার।
–চুলোয় যাক। আমি এখন কারুর সঙ্গে দেখা করবো না। মিঃ আলডিনের কথা শুনে কেরানী ঘাবড়ে গিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
-শোনো।
থমকে দাঁড়াল কেরানী। কি বলছেন, স্যার?
–মিঃ গোবিকে এখানে পাঠিয়ে দাও। এক মিনিটের মধ্যেই মিঃ গোবি এসে পড়ল।
–আপনার বক্তব্য তাড়াতাড়ি শেষ করুন মিঃ গোবি। আমি এক্ষুনি একটা বিশেষ কাজে বের হচ্ছি।
আপনি আমার কাছে মিঃ ক্যাথারিন-এর গতিবিধির খবর জানতে চেয়েছিলেন। তিনি গত চোদ্দ তারিখে রিভিয়ারায় গেছেন। আবার বলল মিঃ গোবি, তাছাড়া মিরেলি নামে যে নাচিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দহরম মহরম সেও রিভিয়ারায় গেছে।
–কোনো ট্রেনে গেছে?
–ব্লু ট্রেনে।
-ধন্যবাদ মিঃ গোবি। দুটো খবরই আমার কাছে মূল্যবান। আচ্ছা আপনি আসুন, গুড নাইট।
.
১৩.
ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে
তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট ক্যারেজ-এর আদালত। আজ এখানে বিচার হচ্ছে না। সুতরাং ভিড় নেই।
আদালত কক্ষে আজ মাদাম রুথ ক্যাথারিন-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রাথমিক এবং গোপন শুনানির দিন স্থির হয়েছে। কয়েকজন সাক্ষীকে আনা হয়েছে, তারা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে।
আদালত কক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার আরদালী ও দুজন দেহরক্ষী ছাড়া আর যাঁরা উপস্থিত আছেন তারা হলেন নিস শহরের কমিশনার অব পুলিশ মঁসিয়ে কক্স। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাইভেট ডিটেকটিভ মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো এবং নিহত মাদাম ক্যাথারিন-এর পিতা মিঃ কিউফাশ ভ্যান আলডিন।
মঁসিয়ে পোয়ারোই প্রথমে কথা বললেন, মঁসিয়ে আলডিন দ্রুত অ্যাকশন আশা করেন, তাই না মঁসিয়ে কক্স?
পোয়ারোর কথা শুনে এবং বিশেষ করে তার সিভিল ড্রেস দেখে মিঃ আলডিন তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন বলতে চাইলেন–ইনি আবার কে?
তার মনে কথাটা আঁচ করে মঁসিয়ে কক্স বললেন, একে বোধহয় আপনি চেনেন না। আলডিন, এর নাম এরকুল পোয়ারো। পোয়ারোর নাম এবং খ্যাতির কথা আগেই শুনেছেন তাই পরিচয় পেয়ে খুশী হলেন।
পরিচয় পর্ব শেষ হতেই মিঃ আলডিন বললেন, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি মিঃ পোয়ারো, আমার ইচ্ছে আপনি আমার পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করুন পুলিশের কাজ পুলিশ তো করবেই। তাদের বাধা দেবার কিছু নেই, আমি শুধু জানতে চাই হত্যাকারী কে? আশা করি আমার অনুরোধটা আপনি রাখবেন।
–আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত, মিঃ আলডিন।
-ধন্যবাদ, আপনি যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে যে কোনো অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তাতে কোনোই অসুবিধা হবে না।
–ঠিক আছে মঁসিয়ে। আমি আজ থেকে কাজে লেগে যাচ্ছি।
এবার ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, এবার তাহলে কাজ আরম্ভ করতে পারি। কি বলেন মঁসিয়ে কক্স?
–নিশ্চয়ই স্যার। আর দেরি করা ঠিক নয়।
ম্যাজিস্ট্রেট কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিয়ে এসো এখানে। দুমিনিটের মধ্যেই স্ত্রীলোকটিকে আনা হলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
-আপনার নাম?
–আমার নাম অ্যাডা বিয়েত্রিস্। ডাক নাম অ্যাড়া ম্যাসন।
–মাদাম ক্যাথারিনকে চেনেন কি?
–বিশেষভাবে। আমি তার মেইড।
–তিনি নিহত হয়েছেন সে খবর জানেন কি?
–জানি।
—আপনরা কি একই সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন?
–হ্যাঁ।
–আপনি যখন লণ্ডন থেকে রওনা হন তখন কি আপনি জানতেন যে আপানকে প্যারীতে নেমে যেতে হবে?
-না, স্যার।
–আপনি কি এর আগেও মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে বিদেশে গেছেন?
–না, স্যার, সে সুযোগ হয়নি, কারণ মাত্র দুমাস হলো আমি তার মেইড নিযুক্ত হই।
–ট্রেনে ওঠবার সময় বা ওঠবার পরে মাদাম ক্যাথারিন-এর কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন কি?
–হ্যাঁ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তিনি বেশ কিছুটা চিন্তিত।
–আপনাকে যে প্যারীতে নেমে যেতে হবে সে কথা উনি কখন আপনাকে বলেন?
–গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে, ওখানে ট্রেনটা থামতেই মিসেস ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নামার জন্যে করিডরে আসেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নামা আর হয়নি তার। আমি দেখতে পাই, একজন ভদ্রলোককে সঙ্গে করে আবার তিনি ফিরে আসেন।
–ভদ্রলোকটিকে আপনি চেনেন কি?
-না স্যার। আমি তাকে আমার কামরা থেকে অল্পক্ষণের জন্য দেখতে পাই। তাছাড়া মুখটাও ভালো করে দেখতে পাইনি।
-তারপর কি হলো?
–তারপর মিসেস ক্যাথারিন তার কামরার ভেতরে যে দরজাটা ছিল তা বন্ধ করে দেন। কিছু পরে দরজাটা একটু ফাঁক করে আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে তিনি বলেন যে তার কাছে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমি যেন রীজ হোটেলে অপেক্ষা করি।
-তারপর?
তাঁর নির্দেশমত আমি প্যারী স্টেশনে নেমে যাই এবং রীজ হোটেলে একটা রুম নিয়ে তাঁর নির্দেশের অপেক্ষা করি।
–আপনি যখন নেমে যান তখন সেই লোকটিকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?
-হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। তিনি তখন মিসেস ক্যাথারিন-এর কামরার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
-এবার তার মুখটা দেখতে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই?
-না স্যার। ভদ্রলোক আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন তাই আমি তার মুখটা দেখতে পাইনি।
-তাঁকে কি ওই ট্রেনের যাত্রী বলে মনে হয়েছিল আপনার?
–না।
–কেন বলুন তো?
-তার গায়ে পুরু ওভারকোট আর মাথায় ফেল্ট-এর হ্যাট ছিল। এয়ার কণ্ডিশন করা ট্রেনে কোনো যাত্রী এরকম পোশাক পরে থাকে না। আমার মনে হয় মিসেস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হতেই তাকে নিজের কামরায় নিয়ে আসেন। তবে এটা আমার অনুমান মাত্র।
-মাদাম ক্যাথারিন কি কণ্ডাক্টরকে তার ঘুম ভাঙাতে নিষেধ করেছিলেন?
–হ্যাঁ, স্যার।
–এটা কি অস্বাভাবিক মনে হয়নি আপনার?
–না, কারণ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো তার অভ্যাস।
–তার জিনিসপত্রের ভেতরে একটা ভেলভেটের বাক্স ছিল?
–হ্যাঁ, ছিল।
–তার ভেতরে কি ছিল বলতে পারেন কি?
–সঠিক বলতে পারি না। তবে আমার ধারণা, ওর ভেতরে হীরে বা ওই জাতীয় কোনো দামী রত্ন ছিল।
–নেমে যাবার সময় সেই বাক্সটা কি আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন?
–সে কি! আমি সেটা নিয়ে যাব কেন?
তার সঙ্গে কি আরও হীরে, জহরত ছিল?
–ছিল বলেই মনে হয়। কারণ তিনি হীরে জহরত খুবই পছন্দ করতেন।
–হার্ট অফ ফায়ার নামে কোনো রুবী তার কাছে ছিল কি?
–থাকতে পারে, কারণ ওই নামটা যেন একবার তার মুখে শুনেছিলাম বলে মনে হচ্ছে।
রুবীটা সম্বন্ধে কি বলেছিলেন তিনি?
–বলেছিলেন যে তার কাছে এমন একটা রুবী আছে যার দাম কয়েক লক্ষ পাউণ্ড। রুবীটার নাম হার্ট অফ ফায়ার বলেই মনে হয় কথাটা বলেছিলেন।
মিস ম্যাসন-এর থেকে হার্ট অফ ফায়ার-এর কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে আলডিন জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কি সে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল?
হা স্যার। সেই রকম কথাই যেন শুনেছিলাম তার কাছে।
–হ্যায় ভগবান! তাহলে ঐ রুবীটাই ওর মৃত্যুর কারণ। আমি তাকে পইপই করে বলেছিলাম ওটা ব্যাঙ্কে রেখে আসতে। আমার কথা সে গ্রাহ্যই করেনি। এবং এই জন্যেই প্রাণ দিতে হয়েছে। এই সময় ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনারা আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চান কি এঁকে?
কমিশনার বললেন, না স্যার, আমার কিছু জিজ্ঞাসা নেই। মিঃ পোয়ারো কিছু জিজ্ঞেস করবেন কি?
-না! আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিস ম্যাসন-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে মাদমোয়াজেল, আপনার কথাগুলো সব টাইপ করতে দেওয়া হয়েছে। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টাইপ কাগজ আপনার কাছে পাঠানো হবে। আপনি সেটা পড়ে সই করে দিলেই আপনার ছুটি।
মিস ম্যাসন সেখান থেকে চলে যাবার পর ম্যাজিস্ট্রেট তার ড্রয়ারের ভেতর থেকে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বললেন, এই চিঠিখানা মাদাম ক্যাথারিন-এর হ্যাণ্ডব্যাগের ভেতরে পাওয়া গেছে। আমার মনে হয় এই চিঠিখানা গুরুত্বপূর্ণ।
-আমি একবার দেখতে পারি কি চিঠিখানা?–বললেন মিঃ আলডিন।
–নিশ্চয়ই পারেন। দেখুন।
মিঃ আলডিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা ছিল :
প্রিয়তমে,
আমি এখন তোমার কথামতই চলব। তুমি ঠিকই বলেছ রিভিয়ারায় থাকাটা ঠিক হবে না। তাই আমি ওর দ্বীপে সব ব্যবস্থা করেছি। জায়গাটা সব দিক থেকেই নিরাপদ। তোমার কোনোই চিন্তা নেই। আমার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হবে না।
আর একটা কথা, হার্ট অফ ফায়ার সম্বন্ধে আমি একটা প্রবন্ধ লিখছি। আসবার সময় ওটা সঙ্গে নিয়ে এসো। আমি একবার ওর চেহারাটা দেখতে চাই।
আজ এই পর্যন্তই। দেখা হলে সব হবে। তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। ইতি
তোমার
আরমাগু
চিঠিখানা পড়ে মিঃ আলডিন-এর চোখমুখ রাগে একেবারে লাল হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে তিনি চিঠিখানা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফিরিয়ে দিলেন।
চিঠিখানা ড্রয়ারে রাখতে যাবেন এই সময় পোয়ারো বললেন, ওটা আমার দেখলে কি আপত্তি আছে?
-না, আপত্তি আর কি। এই নিন।
চিঠিখানা পড়ে পোয়ারো বললেন, এ থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা পাচ্ছি। একটি হলো মাদাম ক্যাথারিন এই রুবীটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং অপরটি হলো রুবীটা দেখবার জন্যে পত্ৰলেখকের আগ্রহ। আশা করি, মিঃ আলডিন ওই লোকটাকে চেনেন?
-হ্যাঁ চিনি। যে লোকটা চিঠিখানা লিখেছে সে নিজেকে কাউন্ট দ্য রোচি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
–আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে ঔ লোকটার সম্বন্ধে দু-একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে। আমি জানি এখন জিজ্ঞেস করা মানে আপনাকে দুঃখ দেওয়া। কিন্তু আপনার মেয়ের হত্যাকারীকে বের করতে হলে তো আমার সবকিছু জানতেই হবে। আপনি দয়া করে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন।
নিশ্চয়ই দেবো। কি জানতে চান বলুন?
–লোকটার সম্বন্ধে আপনি যা যা জানেন, দয়া করে সব খুলে বলুন।
-বেশ, তাহলে শুনুন। আজ থেকে বার বছর আগে রুথ-এর সঙ্গে প্যারীতে ওর পরিচয় হয়। রুথ-এর বয়স তখন সবে মাত্র আঠারো বছর। ওই বয়সে মেয়েরা সাধারণতঃ রোমান্টিক হয়। রুথ-এরও তাই হলো। আমার অজ্ঞাতে ওদের মেলামেশা চলতে থাকে। বেশ কিছুদিন পর আমি ব্যাপারটা জানতে পারি।
–তারপর?
-আমি তখন ওই কাউন্ট-এর সম্বন্ধে গোপনে খোঁজখবর নিতে থাকি। কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারি যে ওর পরিচয়টা একেবারে ভুয়ো। ওর বাপ, দাদা চোদ্দ পুরুষ কেউই কাউন্ট ছিল না। আমি আরও জানতে পারি যে লোকটা একটা পয়লা নম্বরের স্কাউনড্রেল। বড় ঘরের মেয়েদের পটিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেল করাই ওর কাজ।
এই সময় কমিশনার বলে উঠলেন : আপনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই ওর কাজ হলো মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও আমরা ওকে আইনের ফাঁদে ফেলতে পারিনি। যে সব মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করে তারা কেলেঙ্কারির ভয়ে পুলিশের কাছে মুখ খোলে না। এবং কোর্টেও আসতে চায় না। আর এই সুযোগে কাউণ্ট মশাই তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওর ওপরে আমাদের নজর আছে। এবার আপনার বক্তব্য বলুন।
কাউন্টের আসল পরিচয় পাবার পর আমি রুথকে ওর খপ্পর থেকে উদ্ধার করে লর্ড লুকোনবারীর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিই। ভেবেছিলাম ওদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে কিন্তু তা হলো না। চরিত্রহীন লর্ড নন্দন রুথ-এর সঙ্গে এমন দুব্যবহার করতে লাগলো যে শেষ পর্যন্ত আমি রুথকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করতে বলি।
–মামলাটা কি রুজু হয়েছে? –বললেন পোয়ারো।
–না। কথা ছিল যে রুথ রিভিয়ারা থেকে ফিরে এলে মামলাটা রুজু করা হবে।
–এবার হার্ট অফ ফায়ার সম্বন্ধে বলুন।
মাস দুয়েক আগে থেকে রুবীটা সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে করতে দশদিন আগে সেটা আমার হাতে আসে।
-তারপর কি করলেন?
রুবীটা আমার হাতে আসার পরদিনই আমি সেটা রুথকে উপহার দিই। তবে আমি ওকে বিশেষভাবে বলেছিলাম যে রুবীটা রিভিয়ারায় যাবার সময়ে যেন সঙ্গে না নেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ও আমার কথা অমান্য করার ফলে ওকে প্রাণ দিতে হলো।
মিঃ আলডিন-এর কাছে সব কথাগুলি জেনে মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন, এবার তাহলে ঘটনাগুলিকে পর্যায়ক্রমে সজানো যায়। পরপর সাজালে যা দাঁড়াচ্ছে, ত হলো :
(১) হার্ট অফ ফায়ার যে মাদাম ক্যাথারিন-এর কাছে আছে এ খবর কাউন্ট দ্য রোচি জানতে পেরেছিল।
(২) মাদাম ক্যাথারিন যাতে রুবীটা সঙ্গে নিয়ে যান, তার জন্য চিঠিতে ওই রুবী সম্বন্ধে প্রবন্ধ রচনার আকারে গল্প জুড়ে দিয়েছিল কাউন্ট।
(৩) গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে একটি লোক ট্রেনে উঠে মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিল। মাদাম নিজেই তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
(৪) মাদামের মেইড মিস ম্যাসন সেই লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তার মুখ দেখতে না পাওয়ায় তাকে চিনতে পারেনি।
(৫) লোকটি মাদামের কামরায় আসবার পরে মাদাম তার মেইডকে প্যারী স্টেশনে নেমে যেতে বলেন।
(৬) মেইড প্যারী স্টেশনে নেমে যায়। তবে যাওয়ার আগেও সে লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল।
(৭) মিস ম্যাসন-এর কাছ থেকে জানা যায় যে, ভেলভেটের বাক্সটা মাদামের কাছেই ছিল।
(৮) মাদাম কন্ডাক্টরকে বলেছিলেন, সে যেন সকালে তার ঘুম না ভাঙায়।
(৯) এর পরেই মাদাম নিহত হল এবং হার্ট অফ ফায়ার অপহৃত হয়।
(১০) সেই লোকটির আর পাত্তা পাওয়া যায় না।
মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘটনা সাজাবার কায়দা দেখে সবাই খুশী হলেন। কমিশনার বললেন, এবার হত্যাকারীর মোটিভটা বুঝতে পারা যাচ্ছে।
তাছাড়া হত্যাকারী কে? সে সম্বন্ধে একটা ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে–বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
পোয়ারো বললেন, এবার ওপরের দশদফা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা যাক।
মিস ম্যাসন-এর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে গাড়ি থামলে মাদাম ক্যাথারিন ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামবার জন্যে করিডরে আসেন। প্ল্যাটফর্মে কোনো একটি লোককে তিনি দেখতে পান। লোকটিকে তিনি সঙ্গে করে নিজের কামরায় নিয়ে আসেন।
এরপর মাদামের কাজকর্ম ও কথাবার্তা শুনে স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ আসে যে ওই লোকটি কাউন্ট দ্য রোচি ছাড়া আর কেউ নয়। এবং আরো সন্দেহ হয় যে, কাউন্টই মাদামকে হত্যা করে রুবীটা অপহরণ করে সরে পড়েছিল।
আপনি ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে। আমারও ঠিক এই রকম মনে হচ্ছে যে, ওই শয়তান রুথকে হত্যা করেছে।
–না মিঃ আলডিন। আগে থেকেই এটা ধরে নেওয়া চলে না। ঘটনা পরম্পরায় কাউন্ট দ্য রোচির ওপরে সন্দেহ এলেও সেই-ই যে ট্রেনে উঠেছিল তার কোনো প্রমাণ নেই।
–কিন্তু তাহলে আর কে হতে পারে! না মঁসিয়ে, আপনি যাই বলুন না কেন, আমার বিশ্বাস লোকটি কাউন্ট ছাড়া আর কেউ নয়।
আমার এই রকমই সন্দেহ, মিঃ আলডিন। কিন্তু সন্দেহ হলেই আইনতঃ আমরা তাকে। গ্রেফতার করতে পারি না।
ম্যাজিস্ট্রেট কথাটা স্বীকার করলেন। বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, সত্যিই তার বিরুদ্ধে আমরা এমন কোনো প্রমাণই পাচ্ছি না যে, যার জোরে তাকে এই মামলার আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করা যায়।
–সত্যিই যদি তিনি অপরাধী হন। বললেন পোয়ারো।
–আপনি এখনও যদি বলছেন।
-হা মঁসিয়ে কমিশনার, এখনও আমি যদি বলছি।–কথাটা বেশ জোর দিয়েই বললেন পোয়ারো।
কথাটা প্রথমে কমিশনারের খারাপ লাগল কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ভাবলেন যে, সত্যিই অনুমানের ওপর নির্ভর করে কাউকে আগে থেকেই অপরাধী বলে ধরে নেওয়া যায় না বা উচিৎ নয়।
-আপনার কথাই ঠিক মঁসিয়ে। এরপর আপনি কি বলতে চান। তার জন্যে আমার খুবই আগ্রহ হচ্ছে।
–এরপর যা বলতে চাইছি সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়। সত্যিই যদি কাউন্ট অপরাধী হয়; সে তাহলে একটা আত্মরক্ষার পথও বেছে রেখেছে। কাউন্ট-এর মতো চতুর লোক আগে থেকে সাবধান না হয়ে কোনো কিছু করেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বে কোনো একটি বিশেষ কারণের জন্য তার ওপরে পুরোপুরি সন্দেহ আসছে না।
–কি সে কারণ?
মনস্তত্ত্ব।
–মনস্তত্ত্ব, বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। কাউন্ট একটা লম্পট। স্বীকার করি এ কথা। কাউন্ট জোচ্চোর, তাতেও ভুল নেই। কাউন্ট নারী লোভী তাও জানি। সে হার্ট অফ ফায়ার চুরি করার মতলব করেছিল সেও ঠিক। কিন্তু সে যে হত্যাকারী, একথা স্বীকার করতে পারছি না। এই ধরণের লোকেরা স্বভাবতই ভীরু হয়। কোনো রকম বিপদের ঝুঁকি নিতে চায় না তারা। ছলচাতুরী আর জাল জোছুরী যাদের পেশা তারা হত্যা করে না। ধরা পড়ে ফাঁসীকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হবে–তাই তারা একাজ থেকে সব সময় দূরে থাকে।
ম্যাজিস্ট্রেট কিন্তু মেনে নিতে পারেন না তার কথা। তিনি বললেন, আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্যরকম। আমার বিচারক জীবনে এমন কেসও আমি দেখেছি যে অভিজাত বংশের লোকেরাও সময় সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অতএব আপনার সঙ্গে আমি একমত নই।
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নে মতভেদ নিশ্চয়ই থাকতে পারে। আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত মতমতই ব্যক্ত করেছি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি এও বলতে চাই যে, কাউন্টকে আমি জালে ফেলতে পারলে খুবই খুশী হব। আমি চাই ঐ রকম ভদ্রবেশী শয়তানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ তার মুখোশ খুলে দিক। আশা করি আপনিও তাই চান।
নিশ্চয়ই।
–আপনার মতামত কি মিঃ আলডিন?
-আমিও চাই শয়তানটাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হোক।
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, কিন্তু বর্তমানে আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যার বলে ওকে গ্রেপ্তার করা যায়। তবে ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্যে আমি চেষ্টা করবো। আজই বিভিন্ন স্থানে টেলিগ্রাম করব ওর খবরা-খবর সংগ্রহ করতে।
–আপনি যদি চান আমিও এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে রাজী আছি। বললেন পোয়ারো।
–আপনার সাহায্য পেলে আমরা খুবই খুশী হব। আপনি তাহলে কবে থেকে কাজে নামতে চান?
-আজ থেকেই।
.
১৪.
পোয়ারোর কাজ শুরু হলো
মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো তার কাজ শুরু করলেন। তার কাজের ধরন একেবারেই আলাদা। এটি হলো ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ। এবং এই পদ্ধতিতেই তিনি কাজ শুরু করলেন।
-আপনার হয়তো মনে হচ্ছে যে কাউন্ট দ্য রোচিই মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী, তাই না?–পোয়ারো বললেন।
-হ্যাঁ, আমার দৃঢ় ধারণা ওই শয়তানই রুথকে হত্যা করেছে।
–কিন্তু আরও একটি ঘটনা আপনি একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছেন যে।
–কোনো ঘটনা?
ঘটনাটা হলো –মিঃ ক্যাথারিনও ওই ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন।
–আপনি ড্রেককে কি সন্দেহ করেন?
–না। এখনও সেরকম কিছু মনে করছি না। তবে ইতিমধ্যেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশের প্রিফেক্ট নিজে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
–তার কাছে কি বলেছে সে?
–তিনি বলেছেন তার স্ত্রী যে ওই ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন সে খবর তিনি জানতেন না।
-আমারও তাই মনে হয়। কারণ সে যদি জানত যে রুথ এই ট্রেনে ভ্রমণ করছে, তাহলে সে তার ফিয়াসেকে নিয়ে একই ট্রেনে ভ্রমণ করত না।
–ফিয়াসে! –বিস্ময়ের সঙ্গে বেরিয়ে এলো কমিশনারের মুখ থেকে; কে সে?
–তার নাম মিরেলি।–আলডিন বললেন, শুনেছি সে নাকি একজন নাম করা নাচিয়ে।
–ঠিকই শুনেছেন। নাচিয়ে হিসেবে সত্যিই তার নাম আছে।–বললেন কমিশনার।
–আর একটা কথা আমি যোগ করতে চাই।–পোয়ারো বললেন, কথাটা হলো, মিরেলিকে পেতে হলে জলের মতো টাকা ব্যয় করতে হয়। আর একটা কথা জানতে চাইছি।
–কি জানতে চান?
–স্ত্রীর মৃত্যুতে আর্থিক দিক দিয়ে কোনো লাভ হয়েছে কি?
-তা হয়েছে বৈকি! ব্যাঙ্কে রুথ-এর নামে ত্রিশ লক্ষ পাউণ্ড জমা আছে। ও টাকা এখন তারই প্রাপ্য। অথচ রুথ যদি কোনো উইল করে যেত তাহলে ও টাকার উত্তরাধিকারী হত উইলের বেনিফিসিয়ারী। তবে আমি যতদূর জানি রুথ কোনো উইল করেনি।
–অর্থাৎ তার মৃত্যুতে মিঃ ক্যাথারিন ত্রিশ লক্ষ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। তাই না?
–হ্যাঁ। সেই রকমই।
–মিঃ ক্যাথারিন-এর আর্থিক অবস্থা কি রকম?
–খুবই খারাপ। দেউলেও বলা চলে। আমি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি যে, দেনায় একেবারে ডুবে আছে সে।
–মাদাম ক্যাথারিন যে ডাইভোর্সের মামলা রুজু করতে যাচ্ছিলেন, এ খবর তিনি জানতেন কি?
-হ্যাঁ, জানত। আমি নিজেই সে কথা তাকে বলেছিলাম।
ডিভোর্সের মামলা ডিক্রি হলেও টাকা নিশ্চয়ই তিনি পেতেন না। তাই না?
–কি বলতে চাইছেন আপনি?
–কিছুই বলতে চাইছি না। আমি শুধু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছি।
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার আমি চলি, আশা করি শীগগিরই কিছু নতুন খবর জানাতে পারব আপনাকে।
-না মঁসিয়ে। এই মুহূর্তে আপনার কাছে জানার আর কিছু নেই।
–আপনার না থাকলেও আমার আছে। চলুন, বাইরে গিয়ে সে কথা বলছি।
কোর্ট থেকে বেরিয়ে দুজনে হাঁটতে লাগলেন। মিঃ আলডিন বললেন, আপনি হয়তো জানেন যে আমার কিছু টাকা কড়ি আছে।
-হ্যাঁ, কয়েক শো কোটি ডলার।
–এবং রুথ আমার একমাত্র সন্তান।
–তাও জানি।
–তাহলে আমার মনের কথাটা শুনুন। পুলিশ তদন্তের ওপরে আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমি রুথ-এর হত্যাকরীকে খুঁজে পেতে চাই। আমার জীবনটা যে পাষণ্ড হতাশায় ভরে দিয়েছে তাকে আমি উপযুক্ত শাস্তি দিতে চাই।
–আপনি কি আইনকে নিজের হাতে নিতে চান?
দরকার হলে তাও আমি নেব। হত্যাকরীকে যদি আপনি খুঁজে বের করতে পারেন। অথচ আইনের চোখে সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তখন আর আমি আইনের তোয়াক্কা করি কেন। আপনি কি হত্যাকারীকে বের করতে পারবেন?
–এরকুল পোয়ারো আজ পর্যন্ত যতগুলো কেস হাতে নিয়েছে, তার কোনোটাতেই সে বিফল হয়নি, মিঃ আলডিন।
-বেশ, তাহলে আজ থেকেই কাজে লেগে যান। টাকাকড়ির দরকার হবে কি কিছু?
-এখুনি দরকার হবে না। আপনার মতো আমার কোটি কোটি ডলার না থাকলেও টাকাকড়ির অভাব আমার নেই। আমাকে যা দেবার তা পরে দিলেও চলবে।
–আমার কাছ থেকে আর কিছু জানতে চান কি?
–হ্যাঁ, আর একটা কথা জানতে চাই।
–কি বলুন।
–আপনার মেয়ে যে ডিভোর্সের মামলা রুজু করতে যাচ্ছে একথাটা আপনার জামাইকে কবে এবং কোথায় বলেছিলেন?
–আটদিন আগে তাকে আমার ড্রয়িংরুমে ডেকে এনে বলেছিলাম।
–কথাটা শুনে তিনি কি বলেছিলেন?
–সে আমার মেয়ের চরিত্র সম্বন্ধে কথা তুলেছিল।
–আপনি কি তাকে মামলাটা কনটেস্ট করতে নিষেধ করেছিলেন?
–হ্যাঁ, মানে, একরকম তাই বটে।
–আপনি কি তার পরেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?
–না।
না শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কেস আমি হাতে নেব না। আচ্ছা। চলি মঁসিয়ে আলডিন।
-সে কি! হঠাৎ এভাবে বেঁকে বসলেন কেন বলুন তো?
–আপনি আমার কাছে ঘটনা গোপন করছেন, মিঃ আলডিন। আমি জানি যে, এর পরেও আপনি মিঃ ক্যাথারিন-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আমার কাছে যারা ঘটনা গোপন করেন, তাদের কেস আমি হাতে নিই না।
খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত মঁসিয়ে। সত্যিই আমি ঘটনাটা গোপন করেছিলাম। আমি টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
টাকার অঙ্কটা বলবেন কি?
–এক লাখ পাউণ্ড।
–ঠিক আছে। আশা করি পনের দিনের মধ্যেই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারব। মিঃ আলডিন পোয়ারোর কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আপনার কথা আমার কাছে যথেষ্ট মূল্যবান।
.
১৫.
অভিজাত সংস্কৃতি
পরদিন সকালে পোয়ারোর সঙ্গে ভৃত্য জর্জ-এর কথা হচ্ছিলো। পোয়ারো বলেছিলেন, এর আগে তুমি রিভিয়ারায় এসেছিলে কি, জর্জ?
-হ্যাঁ, এসেছিলাম। আমি তখন লর্ড এডওয়ার্ড ফ্রমোটান-এর কাছে চাকরি করতাম।
-মনে কর তুমি লর্ড ফ্রমোটান। এবং কোনো কারণে তোমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে, অথচ তোমার স্ত্রীর হাতে রয়েছে প্রচুর টাকা। এই অবস্থায় তোমার স্ত্রী যদি তোমার বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা করতে চায়, তাহলে তুমি কি করবে?
-আমি আমার স্ত্রীর মত পরিবর্তন করতে চেষ্টা করবো।
–শান্তিপূর্ণ উপায়ে, না ভয় দেখিয়ে?
–কোনো লর্ড কখনও তার স্ত্রীর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেন না।
–কোনো লর্ডের ছেলের সম্বন্ধে কি এ কথা খাটে?
–নিশ্চয়ই। কোনো লর্ড-এর ছেলে যত অভাবেই পড়ুক না কেন সে কখনও তার স্ত্রীর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করবে না। সে চরিত্রহীন হতে পারে, জুয়াড়ী হতে পারে, কিন্তু কোনোরকম হীন কাজ সে কিছুতেই করবে না।
জর্জ-এর কথা শেষ হতে না হতেই হোটেলের একজন চাকর চিরকূট এনে পোয়ারোর হাতে দিয়ে বলল, একজন পুলিশ অফিসার আপনার উত্তরের জন্যে রিসেপশন রুমে অপেক্ষা করছেন।
স্যার। চিরকূট খানা পাঠিয়েছেন কমিশনার অফ পুলিশ। তিনি লিখেছেন : কাউন্ট দ্য লা রোচিকে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার সময় আপনি উপস্থিত থাকলে ভালো হয়। ম্যাজিস্ট্রেটেরও এরকমই ইচ্ছা।-কক্স।
তিনি চাকরটিকে বললেন, পুলিশ অফিসারকে একটু অপেক্ষা করতে বল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
মিনিট পনেরর মধ্যেই কোর্টে হাজির হলে পোয়ারো। তিনি আসতেই ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
-কাউন্ট মশাই কি এসে গেছেন?
–হ্যাঁ, তাঁকে পাশের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে।-বললেন কমিশনার।
–বেশ, এবার তাহলে নিয়ে আসুন তাঁকে। শোনা যাক, মহামান্য কাউন্ট কি বলতে চান!
ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তক্ষুনি আনা হলো কাউন্টকে। সবাই লক্ষ্য করলেন পোশাক পরিচ্ছদ আর চেহারার দিক থেকে লোকটাকে খুব উঁচুদরের লোক বলে মনে হয়। তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, দয়া করে আসন গ্রহণ করুন মঁসিয়ে লা কাউন্ট।
কাউন্ট বললেন, আমাকে কি জন্য তলব করা হয়েছে। দয়া করে বলবেন কি?
নিশ্চয়ই বলব। আপনাকে ডেকে এনেছি মাদাম ক্যাথারিন-এর সম্বন্ধে দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে। আমি জানতে পেরেছি যে আপনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল।
–নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয় থাকাটা অপরাধ নাকি?
–আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন মিঃ কাউন্ট। আপনি হয়তো জানেন না যে, মাদাম ক্যাথারিন মারা গেছেন।
-মারা গেছেন! বলেন কি!
–শুধু মারা গেছেন বললে ভুল হবে। তিনি নিহত হয়েছেন।
–কী সর্বনাশ! মাদাম ক্যাথারিন নিহত হয়েছেন। এ কি দুঃসংবাদ। কবে, কখন, কোথায় নিহত হলেন তিনি? কে তাকে হত্যা করল?
–গত চোদ্দই জানুয়ারি শেষরাত্রে ব্লু ট্রেনের একটা কামরার ভেতরে নিহত হয়েছেন তিনি। কোনো অজ্ঞাত আততায়ী তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে তাঁকে।
খবরটা শুনে কাউন্ট দ্য রোচি একেবারে মুষড়ে গেলেন। তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ এমনভাবে ছিলেন যে, দেখেই মনে হলো তিনি যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন।
মিনিট দুই এইভাবে থাকবার পর তিনি বললেন, ট্রেনে ভ্রমণ করা দেখছি রীতিমত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। আজকাল ট্রেন ডাকাতরা নির্বিবাদে যা খুশী তাই করে চলেছে। আর
আমাদের পুলিশ বিভাগ নিরপরাধ লোকদের ধরে টানা-হাচড়া ও হয়রানি করছে।
–পুলিশ বিভাগ অকারণে কাউকে হয়রান করে না মিঃ কাউন্ট। বললেন কমিশনার।
-শুনে ব্যথিত হলাম। তা আমাকে ট্রেন ডাকাত বলে মনে হয়েছে নাকি আপনাদের?
কাউন্টকে থামিয়ে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীর স্বরে বললেন, দয়া করে থামুন মঁসিয়ে। পুলিশ এত বোকা নয় যে আপনাকে ট্রেন ডাকাত বলে মনে করবে। যাক, এবার শুনুন, কেন আপনাকে ডেকে আনা হলো। নিহত মাদাম ক্যাথারিন-এর হ্যাণ্ডব্যাগে আপনার লেখা একখানা চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠির বিষয়বস্তু আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় কাউন্ট বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তার চোখে মুখে একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো।
ম্যাজিস্ট্রেট আবার বললেন, চিঠিখানা পড়ে আমরা জানতে পেরেছি যে মাদাম ক্যাথারিন আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসছেন। শুধু তাই নয়, আপনি তাকে ইতিহাসে বিখ্যাত হার্ট অব ফায়ার রুবীটাও সঙ্গে আনতে লিখেছিলেন। অতএব বুঝতে পারছেন, বিনা কারণে আপনাকে এখানে আনা হয়নি। ওই চিঠি সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য আমরা শুনতে চাই।
ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের জবাবে কাউন্ট দ্য লা রোচি ধীর অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, চিঠিখানা যখন আপনারা পড়েই ফেলেছেন তখন আর কিছু গোপন করে লাভ নেই। আমি অকপটেই স্বীকার করছি মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে আমার প্রণয় ছিল। আমরা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। এবং অনেকের মতো আমারও একটা প্রাইভেট লাইফ আছে। মাদাম ক্যাথারিন সত্যিই আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসছিলেন।
–আপনি গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে মাদামের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তারপর ট্রেনে উঠে তাঁর কামরাতেই ছিলেন। তাই নয় কি?
-না, এ কথা সত্যি নয়।
-আপনি কি চোদ্দ তারিখে সন্ধ্যার সময় তাঁর সঙ্গে গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে দেখা করেননি?
–নিশ্চয়ই না। ঐ তারিখে ভোর বেলায় আমি নিস-এ পৌঁছই। অতএব আপনার অনুমান একেবারে ভিত্তিহীন।
-ভিত্তিহীন হলেই আমি খুশী হব মিঃ কাউন্ট। কিন্তু আপনার বক্তব্যের সমর্থনে আমরা কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ চাই। চোদ্দ তারিখের বিকেল বেলা থেকে পনেরো তারিখের ভোর রাত্রি পর্যন্ত আপনি কোথায় কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন তার একটা তথ্য নির্ভর প্রমাণ আপনার কাছে আছে তাই না মঁসিয়ে?
ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে কাউন্ট বললেন, সেদিন সন্ধ্যার পরে মন্টিকার্লোর কাফে দ্য প্যারীতে ডিনার খেতে যাই। ডিনার শেষ হলে আমি যাই লে স্পোর্টিং-এ, সেখানে জুয়া খেলে কয়েক হাজার ফ্র লাভ করেছিলাম।
-তারপর কি করলেন?
–তারপর সোজা আমি বাড়িতে চলে আসি।
–আপনি কি ট্রেনে এসেছিলেন?
–না। আমি আমার টু সীটার গাড়ীতে এসেছিলাম।
–আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল নাকি?
–না।
–আপনার এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন কি?
–নিশ্চয়ই পারব, কাফে দ্য প্যারী এবং লে স্পোর্টিং-এ অনেকেই আমাকে দেখেছিলেন। ওই দু জায়গায় খবর নিলেই আমার কথার সত্যতা জানতে পারবেন।
–আপনি বাড়িতে এসেছিলেন কখন?
শেষ রাত্রে।
দরজা খুলে দিয়েছিল কে? আপনার চাকর নিশ্চয়ই।
–না, আমি নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলাম। সদর দরজার একটা বাড়তি চাবি আমার কাছে থাকে।
সেই চাবির সাহয্যেই আমি ভেতরে ঢুকেছিলাম।
–তার মানে, লে স্পোর্টিং থেকে বাড়িতে ফেরা অবধি আপনার বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই। তাই না?
-হ্যাঁ, অবস্থাটা প্রায় সেই রকমই দাঁড়াচ্ছে।
হাকিম কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, মহিলাদের ঘরে যে স্ত্রীলোকটি বসে আছে, তাকে নিয়ে এস।
এক মিনিটের মধ্যে মিস ম্যাসন হাজির হলেন আদালত কক্ষে। তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনাকে একটা বিশেষ দরকারে ডেকে আনা হয়েছে এখানে।
-কি জানতে চান বলুন।
–আপনি বসুন, তারপর বলছি।
ম্যাসনের কানে কানে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, দেখুন তো এই ভদ্রলোকটিকে আপনি চেনেন কি না।
কাউন্ট দ্য লা রোচিকে দেখিয়ে দিলেন তিনি।
মিস ম্যাসন কাউন্টকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল, না, এঁকে আমি দেখেছি বলে মনে হয় না।
তার কথায় ম্যাজিস্ট্রেট হতাশ হলেও সেটা প্রকাশ না করে বললেন, আচ্ছা, কার্জন স্ট্রীটের বাড়িতে এঁকে কোনোদিন দেখেছিলেন কি?
-না, তাও ঠিক নয়। মাদামের কামরায় সেদিন যাকে দেখেছিলাম, তার চেহারাটা প্রায় ওঁর মতোই। তবুও আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না, ইনিই সেই ভদ্রলোক কি না।
পোয়ারো এতক্ষণ প্রশ্নোত্তর শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি এবার বললেন, আপনার টিকিটখানা কি করেছিলেন মাদমোয়াজেল ম্যাসন?
-টিকিট।
–টিকিট। লণ্ডন থেকে নিস পর্যন্ত ট্রেনের টিকিটের কথা বলছি আমি।
পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে মিস ম্যাসন বেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, টিকিটখানা কণ্ডাক্টরকে দিয়েছিলাম।
কথাটা শুনে পোয়ারো এবং কমিশনার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। চোখে-চোখে কি যেন কথা হলো উভয়ের মধ্যে। ম্যাজিস্ট্রেটও লক্ষ্য করেছিলেন এটা। কিন্তু ও নিয়ে আর কিছু না বলে মিস ম্যাসন-এর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন মিস ম্যাসন।
মিস ম্যাসন চলে যেতেই পোয়ারো তার নোট বইয়ের পৃষ্ঠায় কি যেন লিখলেন। তারপর পৃষ্ঠাখানা ছিঁড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে দিলেন।
কাগজখানা পড়ে কমিশনারের হাতে দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কমিশনার সেটা পড়ে পোয়ারোর দিকে একবার তাকিয়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে কাউন্ট একটু বিরক্ত স্বরে হাকিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে আর কতক্ষণ থাকতে হবে স্যার?
-না, আর আপনাকে আটকে রাখব না। আপনি এবার যেতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে কাউন্ট উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কাউন্ট যাবার মিনিট দুই পরেই কমিশনার ফিরে এসে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার উপদেশমত ওর পেছনে দুজন গুপ্তচর নিযুক্ত করে এলাম।
পোয়ারো বললেন, শুধু গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলেই চলবে না, মঁসিয়ে কমিশনার আমাদের নিজেদেরও কাজে নামতে হবে। আমাদের যাচাই করতে হবে ওঁর কথাগুলো কত পারসেন্ট সত্যি। তাছাড়া, উনি যাতে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারেন যে আমরা ওর গতিবিধি লক্ষ্য করছি।
পোয়ারোর কথা শেষ না হতেই মিঃ ক্যাথারিন এসে হাজির হলো আদালত কক্ষে। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে আদালতে তলব করে আনা হলো কেন, স্যার?
মিঃ ক্যাথারিন-এর কথাগুলি অনেকটা কৈফিয়ত চাওয়ার মতো শোনায়।
–আপনি হয়তো ভুলে গেছেন এটা আদালত কক্ষ এবং যার সঙ্গে আপনি কথা বলছেন তিনি ম্যাজিস্ট্রেট।
ম্যাজিস্ট্রেটের ধমক খেয়ে ক্যাথারিন বুঝতে পারল ওভাবে কথা বলা তার উচিত হয়নি।
-আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। নানা করণে আমার মনটা এতই চঞ্চল হয়েছে যে স্থান কাল পাত্র ভুলেই গিয়েছিলাম।
–ঠিক আছে, আপনি বসুন। আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আশাকরি উত্তরগুলো ঠিকমত পাবো।
–কি জানতে চান, বলুন।
-আপনি বলেছিলেন যে, ট্রেনে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। কথাটা কি ঠিক?
–নিশ্চয়ই। কিন্তু এই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যেই যদি আমাকে ডেকে আনা হয়ে থাকে তাহলে আমি বলব যে ফরাসী পুলিশের কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা কম।
–পুলিশের কাণ্ডজ্ঞান ঠিকই আছে মিঃ ক্যাথারিন। এবার যা যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সেগুলোর উত্তর দিন।–বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
–বেশ প্রশ্ন করুন।
প্রশ্ন করতে শুরু করলেন পোয়ারো।
–আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই কোনো উইল করে যাননি?
–সেই রকমই মনে হয়।
–তিনি যদি কোনো উইল না করে থাকেন তাহলে তার সম্পত্তির আইনসম্মত উত্তরাধিকারী কে হচ্ছেন, মঁসিয়ে?
–কি বলতে চাইছেন আপনি?
-আমি বলতে চাইছি যে মাদাম ক্যাথারিন-এর মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তার স্বামী, অর্থাৎ আপনি কেমন, ঠিক তো?
–হয়তো তাই। কিন্তু আপনি কে? তাছাড়া আপনাকে প্রশ্ন করার অধিকার কে দিল?
-আমার নাম এরকুল পোয়ারো। নামটা হয়তো আপনার অপরিচিত নয়। আর প্রশ্ন করার অধিকার-ম্যাজিস্ট্রেট নিজে আমাকে এই অধিকার দিয়েছেন।
-আপনি কি তাহলে মনে করেন যে, আমিই আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছি? যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমি তার রুবীটা চুরি করতাম না?
–ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে। আমিও তাই মনে করি।
–আমার মনে হয়, অভিশপ্ত হার্ট অ ফায়ারই তার মৃত্যুর কারণ। ইতিহাস প্রসিদ্ধ রত্নের জন্য আগেও কয়েকটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে, কিন্তু নারীহত্যা বোধহয় এই প্রথম।
-আমারও তাই মনে হয় মঁসিয়ে। এবার আরেকটা কথা জানতে চাইছি আপনার কাছে।
–বলুন।
–আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ আপনার দেখা হয়েছিল কতদিন আগে?
একটু চিন্তা করে ক্যাথারিন বলল, ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে।
–তারিখটা মনে আছে কি?
–না। তবে তারিখটা তিন সপ্তাহ আগে তো বটেই, এমন কি কিছু বেশি হতেও পারে। ক্যাথারিন তখন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুমতি চাইল, এবার তাহলে আমি যেতে পারি কি?
-হ্যাঁ, আপনি এবার যেতে পারেন।
মিঃ ক্যাথারিন আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই পোয়ারো তাকালেন কমিশনারের দিকে।
–আমাকে কিছু বলতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করলেন কমিশনার।
–হ্যাঁ, হার্ট অব ফায়ার চুরি যাবার কথা আপনি কবে বলেছেন মিঃ ক্যাথারিনকে?
–আমি এ ব্যাপারে কোনো কথাই ওকে বলিনি।
-তাহলে ওটা চুরি যাবার কথা উনি কেমন করে জানলেন? মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে। সে সময় মাদাম নিজেও জানতেন না যে হার্ট অব ফায়ার তার হাতে আসবে। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে না কি?
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন।
–আপনি কি চলে যাচ্ছেন?
–হ্যাঁ, আমাকে এখুনি যেতে হচ্ছে।
পোয়ারো কোট থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৪. আবার মিরেলি
১৬. আবার মিরেলি
কোর্ট থেকে বেরিয়ে ক্যাথারিন সোজা গিয়ে হাজির হলো নেগ্রেসকোতে। এটা হলো রিভিয়ারার সবেচেয়ে দামি রেস্তোরাঁ। নেগ্রেসকোর সুস্বাদু খাদ্য আর উৎকৃষ্ট খাদ্য আর উৎকৃষ্ট ককটেলের জন্যে সব সময়ই লোকের ভিড় থাকে এখানে। লাঞ্চ পর্বটা সেরে নেবার জন্য এসেছিল।
সে একটা টেবিলে বসে এক পাত্র ককটেলের অর্ডার দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে গেল। ক্যাথারিন তা পান করতে করতে সমুদ্রের দিকে এবং পান-ভোজন রত নর-নারীর দিকে চোখ বুলোতে লাগল।
এই সময় মিরেলিকে সেখানে ঢুকতে দেখল সে। মিরেলিও তাকে লক্ষ্য করছিল। হাসিমুখে মিরেলি ক্যাথারিন-এর সামনে এলো। কি আশ্চর্য ড্রেক, তোমাকে যে এখানে পাব ভাবতেই পারিনি।
মিরেলি ক্যাথারিন-এর সামনের চেয়ারটায় বসল। তার দিকে তাকিয়ে ক্যাথারিন বলল, কবে এসেছ?
–দুদিন আগে।–এসে অবধি তোমার খোঁজ করছি।
–আমার খোঁজ কেন?
করব না! যে আমার জন্যে এতটা করেছে তার খোঁজ করব না।
–মানে?
–মানে কি তুমি বোঝো না? সত্যিই তুমি অসাধ্য সাধন করেছ, ড্রেক। তোমার এই সৎসাহসের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তোমাকে বলেছিলাম যে দুর্ঘটনা যখন তখন ঘটতে পারে। কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি নাটকীয়ভাবে ঘটবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আচ্ছা, পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করেনি তো?
দয়া করে থামবে কি?
–নিশ্চয়ই। এসব কথা এখানে আলোচনা করা ঠিক নয়। এখন আর দেনার দায়ে তোমাকে বিব্রত হতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত হয়েছে। এখন আঃ….. আমাদের দুজনের সুখের দিন এসেছে। তুমি এখন ত্রিশ লাখ পাউণ্ডের মালিক, তাই না?
–এখনও হইনি। তবে শীগগির হব বলে মনে হচ্ছে।
–টাকার অঙ্কটা মোটেই খারাপ নয়, কি বল?
-কে বলেছে খারাপ। সমস্ত দেনা মেটানোর পরেও আমার হাতে বিশ লাখ পাউণ্ড থাকবে।
-ব্যস। ওতেই চলবে। হ্যাঁ, খুব ভালোভাবে চলবে আমাদের। আর তার পরেই তো তুমি লর্ড লুকোনবারী হয়ে যাবে। তখন আর পায় কে আমাদের।
-তুমি একটু চুপ করবে কি? দেখছ না অনেকেই আমাদের লক্ষ্য করছে। –
-ঠিক বলেছ। এবার তুমি লাঞ্চের অর্ডার দাও। দুজনে একসঙ্গেই লাঞ্চ খাব।
–আমি দুঃখিত। তোমার সঙ্গে আজ লাঞ্চ খেতে পারব না।
–কেন বলতো?
–আমি আজ আর একজনের সঙ্গে এনগেজড়। তাছাড়া….
–কি বলছিলে বল না? বলতে গিয়ে থেমে গেলে কেন?
-না, থেমে যাব কেন। বলছিলাম যে, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না।
তার মানে? –
-মানে আর কিছু নেই। এরপর থেকে তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
–তোমার কি হয়েছে বলতো? ঠাট্টা রাখ, এবার লাঞ্চের অর্ডার দাও, প্লিজ।
–বললাম তো, আমি আজ আর একজনের….
এমন সময় গ্রে ক্যাথারিন রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই ড্রেক ক্যাথারিন তার দিকে এগিয়ে গেল।
ক্যাথারিন এভাবে চলে যাওয়ায় মিরেলি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো। তাছাড়া নিজেকে অপমানিতা বোধ করে অস্ফুট স্বরে বলল, আচ্ছা দেখা যাবে। মিরেলি অপমান হজম করার মেয়ে নয়। তোমার দুঃসাহসিকতার ফল তোমাকেই পেতে হবে।
ক্যাথারিন-এর কাছে গিয়ে ক্যাথারিন যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, গুড মর্নিং, মিস গ্রে।
আজ আপনি আমার সঙ্গে লাঞ্চ খেলে ভালো লাগত আমার। ক্যাথারিন-এর প্রস্তাবে ক্যাথারিন একটু বিস্মিত হয়ে পরক্ষণেই একটু ভেবে বলল, আমারও খারাপ লাগত না আপনার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।
-তাহলে আসুন নিরিবিলি দেখে একটা টেবিলে বসি।
–বেশ, চলুন।
দুজনে কোণের দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক সেই সময় রেস্তোরাঁয় আর এককোণে একজোড়া জ্বলন্ত দৃষ্টি ওদের দুজনকে লক্ষ্য করছে।
.
১৭.
কাউন্ট–এর বাড়িতে
কাউন্ট সেদিন আর লাঞ্চ খেতে বাইরে যাননি। বাড়িতেই লাঞ্চ খাওয়ার পর চাকর হিপোলাইট কফি এনে দিল।
কফির পেয়ালায় এক চুমুক দিয়েই বললেন, শোন হিপো, এখন থেকে প্রায় রোজই কোনো না কোনো অচেনা লোক আমার খোঁজ নিতে আসবে। তাদের তুমি কোনো মতেই বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।
ইতিমধ্যেই দু-চারজন এসেছিল। কেমন, তাই না?
–না, হুজুর। আজ পর্যন্ত তেমন কোনো লোক আসেনি।
–ঠিক বলছ তো?
–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি?
–তুমি তো সব সময় বাড়িতে থাকো না, তাই তারা হয়তো তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে।
–আমার তা মনে হয় না, হুজুর। মেরী তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে সে কথা বলত।
হিপোলাইট-এর কথা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও তার মনে হলো ইতিমধ্যে না এলেও অদূর ভবিষ্যতে তারা নিশ্চয়ই আসবে। তিনি তখন বললেন, শোন, তোমাকে শিখিয়ে রাখছি, যদি কোনো অচেনা লোক বা পুলিশ অফিসার তোমার কাছে জানতে চায় যে, গত চোদ্দ তারিখে আমি কোথায় ছিলাম, তুমি বলবে যে ওই তারিখে আমি বাড়িতে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে।
-বেশ, সেই কথাই বলব।
–শুধু তাই নয়, তুমি বলবে যে, তার আগের দিন আমি বাড়িতে ছিলাম না। শেষ রাত্রে বাড়িতে এসে আমার অতিরিক্ত চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলাম। মনে থাকবে তো?
নিশ্চয়ই। আমি এই কথাই বলব।
–শুধু তুমি বললেই চলবে না। মেরীও যেন বলে।
–তাই বলবে। আমি তাকে শিখিয়ে দেব।
–দেব নয়, এক্ষুনি বলে দাও তাকে।
হিপোলাইট যাবার জন্যে পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার বলল, কি বলতে হবে, মনে আছে তো?
–আছে, হুজুর। চোদ্দ তারিখে সকালে উঠেই দেখি আপনি বাড়িতেই ফিরে এসেছেন।
–কখন ফিরলাম?
–বোধ হয় শেষ রাত্রে।
বোধ হয় বলবে কেন?
–বলব। তার কারণ হলো, আপনি ঠিক কখন ফিরে এসেছেন তা আমরা দেখিনি।
–বাড়িতে ঢুকলাম কেমন করে?
–আপনার কাছে সদর দরজার অতিরিক্ত একটা চাবি থাকে। তার সাহায্যে দরজা খুলে আপনি হয়তো ঢুকেছেন।
-হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। এই কথাগুলি তোমরা বলবে। মিনিট দুয়েক বাদেই হিপোলাইট কফির পেয়ালা আর পিরিচ রেখে ফিরে এলো।
-কি ব্যাপার? আবার ফিরে এলে যে? কাউন্ট বললেন।
–এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, হুজুর।
–আশ্চর্য! বয়স কত ভদ্রমহিলার? দেখতে কেমন?
–পঁচিশ-ছাব্বিশ বলে মনে হয়। দেখতে খুবই সুন্দর।
-বেশ, তাকে এখানেই নিয়ে এস।
হিপোলাইট মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একজন অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতাঁকে সঙ্গে নিয়ে এলো।
কাউন্ট দাঁড়িয়ে উঠে বিস্মিত স্বরে বললেন, কি আশ্চর্য! মাদমোয়াজেল মিরেলিকে যে আমার এই ক্ষুদ্র কুটিরে দেখতে পাব একথা আমি কোনোদিন ভাবিনি।
-আপনি আমাকে চেনেন দেখছি।
-নৃত্যশিল্পী মিরেলিকে চেনে না এমন হতভাগ্য কেউ আছে নাকি। আসন গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন। কাউন্টের অনুরোধে মিরেলি আসন গ্রহণ করল।
–আর বলুন, আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি?
–আমার জন্যে নয়, আমি আপনার জন্যেই এসেছি।
–আমার জন্যে এসেছেন। দয়া করে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করলে বাধিত হব।
–হ্যাঁ, পরিষ্কার করেই বলছি। কোনো কোনো মহলে আলোচনা চলছে যে, আপনি নাকি মাদাম ক্যাথারিনকে হত্যা করেছেন।
-আমি! হত্যা করেছি মাদাম ক্যাথারিনকে! একি ভয়াবহ যন্ত্রণা?
–হ্যাঁ, এই কথাই লোকে বলাবলি করছে।
–লোকে যা বলুক। আমি তো আমাকে জানি। এরকম ঘৃণ্য কাজ আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়।
–কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে লাভ নেই মঁসিয়ে। আমি জানি যে, পুলিশও তাই সন্দেহ করছে।
-বলেন কি মাদমোয়াজেল! আপনি এ খবর কোথায় পেলেন?
পেলাম পুলিশের কাছে। আমার কয়েকজন পুলিশ বন্ধু আছে। তাদের কাছেই শুনেছি যে পুলিশের প্রধানও সেই সন্দেহ করছেন।
–আপনি আমাকে ভাবিয়ে তুললেন মাদমোয়াজেল।
–ভাববার কিছু নেই, মঁসিয়ে। আমি আপনাকে রক্ষা করবার জন্যেই এসেছি। কারণ আমি জানি মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী আপনি নয়, অন্য কোনো ব্যক্তি।
–আপনি কি তাকে চেনেন না কি?
–হ্যাঁ, বিলক্ষণ চিনি।
–কে?
–তার নাম ড্রেক ক্যাথারিন—
–অর্থাৎ, মাদাম ক্যাথারিন-এর স্বামী!
–হ্যাঁ।
–কিন্তু…
–না, এর মধ্যে কিন্তু নয়। আমি জানি যে ড্রেক ক্যাথারিন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে।
–কিছু মনে করবেন না মাদমোয়াজেল, আপনি একথা কেমন করে জানলেন।
-কেমন করে জানলাম?–উত্তেজিতভাবে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল মিরেলি, সে নিজের মুখে একথা আমাকে বলেছে। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই দৃশ্যটা। ড্রেক ক্যাথারিন নিঃশব্দে ঢুকল কামরার ভেতর। বেচারা রুথ তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ও পকেট থেকে একগাছা কালো সিল্কের কর্ড বের করল, তারপর সেই কর্ডটা জড়িয়ে–উঃ! কী ভয়ংঙ্কর।
–এবং এসব কথা মিঃ ক্যাথারিন আপনাকে বললেন। আশ্চর্য ব্যাপার তো।
–না, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। হত্যা করবার আগেই সে আমাকে এসব বলেছে।
–আরও আশ্চর্য! হত্যাকাণ্ডের আগেই হত্যা করার পরিকল্পনা আপনাকে জানালেন ভদ্রলোক!
–আপনি কি আমার কথাগুলো পাগলের প্রলাপ বলে মনে করছেন নাকি?
-না, তা করছি না। তবে কি না, লাজিকের দিক থেকে….
–চুলোয় যাক আপনার লজিক। ড্রেক নিজে আমাকে বলেছিল যে, তার স্ত্রী যদি কোনো কারণে মারা যায় তাহলে সে অনেক টাকা পেতে পারে। এবং সেই টাকায় সে দেনা মুক্ত হতে পারে।
–তাতেই কি প্রমাণিত হয় যে, তিনিই হত্যাকারী?
-না, তা হয় না। সে আমাকে আরও বলেছিল যে, ট্রেনে রিভিয়ারা যাবার পথে হয়তো এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যাতে সে মারা যেতে পারে।
–বেশ, মেনে নিলাম কথাটা। কিন্তু তাতেও তো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
–কি প্রশ্ন?
–তিনি মাদামের রুবীটা চুরি করলেন কেন?
–কারণ, এই হত্যাকাণ্ডকে ট্রেন রবারদের কাজ বলে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছিল সে।
এতক্ষণে কাউন্ট মিরেলির কথাগুলো হেঁয়ালি বলে মনে করলেন না। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, এ ব্যাপারে আমার কি করণীয় থাকতে পারে, মাদমোয়াজেল?
–আপনি পুলিশের কাছে গিয়ে সব কথা জানিয়ে দিন, যে মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী তার স্বামী–আপনি নন।
–পুলিশ যদি আমার কাছে প্রমাণ চায়?
–তাহলে তাদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি তাদের কাছে প্রমাণ দেব। আর কিছু না বলে মিরেলি চলে গেল।
কাউন্ট এবার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। মেয়েটা দেখছি ভীষণ উত্তেজিত। কিন্তু সত্যি ঘটনাটি কি? সন্দেহ তো প্রমাণ নয়। ও তাহলে পুলিশের কাছে কি প্রমাণ দেবে। মিঃ ক্যাথারিন-এর উপর ভীষণ রাগ, নিশ্চয়ই ওকে অপমান করেছে। কিংবা ওকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে জুটেছে। সেই কারণেই ওকে পিছে ফেলতে চায়। কিন্তু আমাকে খুব সাবধান হতে হবে। ওই সর্বনেশে চিঠিটা যদি রুথ-এর হ্যাণ্ডব্যাগে না পওয়া যেত তাহলে কেউই আমাকে সন্দেহ করতে পারত না। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ছুটে গেলেন শোবার ঘরে।
খাটের পাশে রাখা একটা ছোট টেবিল ও চেয়ার। তার গোপনীয় সব ঐ টেবিলের টানায় থাকত। তিনি টানাটা খুলে একটা চাবি নিয়ে একটা স্টীলের আলমারীর কাছে এগিয়ে গেলেন। আলমারী খুলে তার ভেতর থেকে একটা ভেলভেটের বাক্স বের করে আলমারিটা বন্ধ করে দিলেন।
ভেলভেটের বাক্সটা একবার খুলে দেখল কাউন্ট। তারপর সেটাকে বন্ধ করে কাগজ দিয়ে মুড়ে সুতো দিয়ে প্যাকেটের মতো করে বেঁধে ফেললেন।
প্যাকেটের ওপরে কি সব যেন লিখলেন। তারপর প্যাকেটটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিচে এলেন। নিচে নামতেই হিপোলাইটের সঙ্গে দেখা হলো। কাউন্ট বললেন, আমি নেগ্রেসকোতে যাচ্ছি ফিরতে দেরি হবে। কোনো অচেনা লোক খুঁজতে এলে কথাগুলো সেইভাবে বলবে। কথাগুলো মনে আছে তো?
–আছে, হুজুর।
কাউন্ট তাঁর দু-সীটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
মন্টিকালোতে গিয়ে তিনি কয়েক পেগ হুইস্কি পান করে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিলেন। তিনি চললেন মেণ্টনের পথে। মেন্টনে যেতে একটা পাহাড় পার হয়ে যেতে হয়। পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই সে দেখল একখানা ধূসর রঙের গাড়ি তার গাড়িটাকে অনুসরণ করছে। কাউন্ট তখন যথাসম্ভব তার গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
এদিকে পেছনের বড় গাড়িটা অসমতল পাহাড়ী রাস্তায় ছোট গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না। কিছুক্ষণ বাদে আর পিছনের গাড়িটা দেখা গেল না।
অবশেষে পাহাড় পার হয়ে সমতল রাস্তায় এসে কাউন্ট তাঁর গাড়ির গতিবেগ আরও বাড়িয়ে দিল। মাইল দুয়েক যাবার পরেই একটা পোস্ট অফিস। সেখানে গাড়ি থামিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পোস্টঅফিসের বারান্দায় উঠে পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে লেটার বাক্সে ফেলে দিয়ে আবার ফিরে এলেন গাড়িতে।
গাড়ি ঘুরিয়ে আবার তিনি ফিরে চললেন মন্টিকালোর দিকে। একটু এগোতেই সেই ধূসর রঙের গাড়িটা তার গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।
কাফে দ্য প্যারীতে ডিনার খেয়ে রাত প্রায় সাড়ে দশটায় কাউন্ট বাড়ি ফিরলেন। হিপোলাইট সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সামনে এলো, তার মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।
-কি হয়েছে হিপো, জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট।
-আপনি বাইরে যাবার ঘন্টাখানেক বাদে কে একজন টেলিফোনে আমাকে বলল যে, আপনি আমাকে নেগ্রেসকোতে দেখা করতে বলেছেন।
–অদ্ভুত কাণ্ড তো! তুমি কি সেখানে গিয়েছিলে না কি?
–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আপনি যেতে বলেছেন শুনে কি না গিয়ে পারি?
–তারপর?
–সেখানে গিয়ে শুনলাম যে, আপনি সেখানে যাননি। কে টেলিফোন করেছে সে কথাও তারা বলতে পারল না।
-তুমি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তখন মেরী কোথায় ছিল?
–সে তখন বাজার করতে গিয়েছিল হুজুর। আমি ফিরে আসবার পরে সে বাড়িতে আসে।
-এটা বোধহয় কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ। যাই হোক, এর জন্যে দুঃশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। তুমি তোমার কাজে যেতে পার।
কাউন্ট সোজা দোতলায় উঠে গিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখলেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে কে বা কারা তার ঘরটা তল্লাসী করেছে।
কাউন্ট নিজের মনেই বললেন-পুলিশ এসেছিল দেখছি। মিরেলি তাহলে ঠিক কথাই বলেছে।
.
১৮.
প্রেম–অভিসার
মার্গারেট ভিলার বাগানে বসে লেনক্স গল্প করছিল। লেনক্স বলছিল, তোমার বোধহয় এখানে ভালো লাগছে না। তাই না মাসী?
-খারাপও লাগছে না। তবে আমি কোনোদিনই হৈ-হল্লা পছন্দ করি না, তাই নিজেকে এখানে খাপ খাওয়াতে পারছি না।
-কিন্তু, এই হলো সোসাইটি। এখানে সবই গিল্টি করা অর্থাৎ বাইরের দিকটা চকচকে। এবং আমাদের এই গিল্টি করা সোসাইটিতে বাস করতে হয়। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, মাসী?
-কি?
–মঁসিয়ে ক্যাথারিনকে তোমার কেমন লাগে?-
-কেমন লাগে মানে?
–মানে, তুমি কি ওকে পছন্দ করো?
–পছন্দ অপছন্দের কোনো কথাই ওঠে না। কারণ ওর সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।
–যাই বল মাসী, ওঁর চেহারাটা কিন্তু ভারী সুন্দর।
–তা হবে হয়তো।
–তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওঁকে তুমি মোটেই পছন্দ কর না।
-আমার পছন্দ-অপছন্দের জন্যে তোমার দুশ্চিন্তা কেন?
-না, তা নয়। মানে…. আমার মনে হয়েছে যে, মিঃ ক্যাথারিন তোমাকে বিশেষ নজরে দেখেন। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
লেনক্স-এর কথা শেষ হতে না হতেই একজন পরিচারিকা এসে ক্যাথারিনকে বলল, আপনার টেলিফোন এসেছে।
-কে ফোন করেছে জানো?
–হ্যাঁ। মঁসিয়ে পোয়ারো।
ক্যাথারিন কোনো কথা না বলে টেলিফোন ধরতে চলে গেল। রিসিভারটা কানে তুলে ক্যাথারিন সাড়া দিতেই ওধার থেকে মিঃ পোয়ারোর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, সুপ্রভাত মাদমোয়াজেল। মঁসিয়ে ভ্যান আলডিন আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চান। আপনি যদি দয়া করে নেগ্রেসকোতে তার স্যুইটে আসেন অথবা মার্গারেট ভিলাতেও যেতে পারেন উনি।
পোয়ারোকে একটু লজ্জা দেবার উদ্দেশ্যে ক্যাথারিন বলল, আপনি কি এখন মিঃ আলডিন-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী।
খোঁচাটা হজম করে পোয়ারো হেসে বললেন, অনেকটা তাই। কারণ ওঁর মেয়ের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার যখন নিয়েছি। শুধু প্রাইভেট সেক্রেটারী কেন ভৃত্যের ভূমিকায় বা অন্য কোনো চেহারাতেও দেখতে পাবেন। যাক আপনি আসবেন, না আমাদেরই যেতে হবে?
-না। আপনাদের আসার দরকার নেই, আমিই যাব। কখন গেলে সুবিধে হয় আপনাদের?
–আমাদের কথা বাদ দিন। আপনি কখন আসবেন বলুন।
–এক ঘন্টা পরে যদি যাই?
-বেশ, সেই কথাই রইল। আপনাকে নিয়ে আসবার জন্যে যথা সময়ে গাড়ি নিয়ে মার্গারেট ভিলায় যাচ্ছি। আপনি দয়া করে তৈরি হয়ে থাকবেন।
তিন কোয়ার্টারের ভেতরেই মিঃ পোয়ারো এলেন মার্গারেট ভিলায়। ক্যাথারিন দেরি না করে তার গাড়িতে গিয়ে বসলেন। পোয়ারো গাড়ি চালিয়ে দিলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করলে ক্যাথারিন বলল, তদন্তের কাজ কতটা এগিয়েছে মঁসিয়ে।
–পুলিশের বিশ্বাস, তারা প্রায় ফয়সালা করে এনেছে। এখন হত্যাকারীকে বিচারালয়ে তোলা বাকি।
–তার মানে! পুলিশ কি হত্যাকারীকে বের করেছে না কি?
–পুলিশ তো সেই কথাই বলছে। তাদের বিশ্বাস, কাউন্টই এই নাটকের নায়ক, অর্থাৎ সেই-ই হত্যাকারী।
বার বার পুলিশের কথা বলছেন কেন? আপনি কি ওকে হত্যাকারী মনে করেন না?
–আমি কিছুই মনে করি না; কারণ আমি কাউন্ট সম্বন্ধে এখনো বিশেষ কিছুই জানি না।
–হ্যাঁ, ভাল কথা, মিঃ ক্যাথারিন-এর খবর কি?
–আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম আপনাকে। আপনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল?
-হ্যাঁ, হয়েছিল। একবার মার্গারেট ভিলায় আর একবার নেগ্রেসকোতে।
–ব্লু-ট্রেনে তাকে দেখেছিলেন কি?
–দেখেছিলাম।
–ডাইনিং কোচে?
–না। মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ওকে ঢুকতে দেখেছি। –ঠিক বলছেন?
–নিশ্চয়ই।
–আশ্চর্য ব্যাপার! আচ্ছা, কাউন্ট দ্য রোচিকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?
–না। নয়েন স্টেশনে একজন যুবককে ট্রেন থেকে নামতে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে নামছে।
–যুবকটির চেহারা কিরকম?
–তার মুখটা আমি দেখতে পাইনি। গায়ে একটা ওভারকোট এবং মাথায় টুপি ছিল। ঐ যুবকটি ছাড়া আরও একজন লোককে দেখেছিলাম। বেশ মোটা, তাকে দেখে আমার ফরাসী বলে মনে হয়েছিল। সে তখন এক কাপ কফি পান করছিল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ওরা দুজন ছাড়া আর সবাই ছিল রেল কর্মচারি।
–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাউন্ট ট্রেনে ওঠেইনি। সে নিজেও এই কথাই বলেছিল। আমরা পৌঁছে গেছি।
ক্যাথারিন বাইরে দেখল নেগ্রেসকোর সামনে গাড়িটাকে পার্কিং-এর জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে নিলেন পোয়ারো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যাথারিনকে নিয়ে মিঃ আলডিনের স্যুইটে হাজির হলেন পোয়ারো। মিঃ আলডিন ক্যাথারিনকে দেখেই বললেন, তুমি আসাতে আমি খুবই খুশী হয়েছি। প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সেদিন আমার পাশে রুথ ছিল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন আলডিন। কিন্তু আজ সে কোথায়?
কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য দুজনের মনকেই ভারাক্রান্ত করে তুলল।
মিঃ আলডিন তাঁর একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। তার মানসিক অবস্থাটা ক্যাথারিন বুঝতে পারলো। রুথের কথা মনে পড়ায় তার অন্তরটাও কেঁদে উঠল।
ক্যাথারিনকে চুপ করে থাকতে দেখে আলডিন বললেন, ওসব কথা ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই। আমি তোমার কাছে কয়েকটা কথা জানবার জন্যে দেখা করতে চেয়েছি।
-কি জানতে চান, বলুন।
–ট্রেনে রুথ তোমাকে কিছু বলেছিল কি?
–হ্যাঁ, বলেছিলেন।
–সব কথা বলতে কোনো আপত্তি আছে?
–না। এখন আর আপত্তি নেই।
–মানে?
–কারণ, তিনি আমাকে এমন কয়েকটি কথা বলেছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকলে আমি কাউকেই বলতাম না। কিন্তু আজ উনি বেঁচে নেই তাই আমার কোনো আপত্তি নেই।
এই সময় মিঃ আলডিন বললেন, যদি কিছু মনে না করেন মিঃ পোয়ারো, দয়া করে একটু পাশের ঘরে গেলে ভালো হয়। মিস গ্রে-র সঙ্গে আমি গোপন কিছু আলোচনা করতে চাই। তুমিও যাও কিংটন।
পোয়ারো বললেন, এতে মনে করার কি আছে? আসুন কিংটন।
ওরা যাবার পর মিঃ আলডিন বললেন, এবার সব খুলে বল। কোনো কিছু গোপন করার, দরকার নেই।
রুথ-এর সঙ্গে তার যা কথা হয়েছিল সবই খুলে বলল ক্যাথারিন। রুথ-এর সঙ্গে কাউন্টের গোপন প্রেম করার কথা, ওর সঙ্গে মিলতে যাচ্ছিল সে কথা, এমনকি সে রুথকে যে উপদেশ দিয়েছিল এবং তার উপদেশ শুনে রুথ কি বলেছিল সব কথাই বলল ক্যাথারিন।
সব কথা শুনে মিঃ আলডিন বললেন, তুমি রুথকে সত্যিই সদুপদেশ দিয়েছিলে কিন্তু সে প্রথমে তোমার কথায় রাজী হয়েও পরে আবার মত পরিবর্তন করল কেন?
আমার মনে হয় গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার পরই তিনি কোনো বিশেষ কারণে তার মত পরিবর্তন করেছিলেন। কেন করেছেন সেটা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।
কাউন্ট-এর সঙ্গে কোথায় দেখা করবে বলে সে স্থির করেছিল? প্যারীতে, না রিভিয়ারায়।
–সেকথা তিনি কিছুই বলেননি আমাকে।
–কিন্তু একথাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি সময় মত সবই জানা যাবে।
মিঃ আলডিন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন। তারপর পাশের ঘরের দরজাটা খুলে পোয়ারোকে আসতে অনুরোধ করলেন। পোয়ারো এলে মিঃ আলডিন বললেন, আজ আমার এখানে আপনারা লাঞ্চ খেলে আমি খুবই খুশী হব।
ক্যাথারিন বিনীতভাবে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল, আপনার কথাটা রাখতে পারছি না। বলে আমি খুবই দুঃখিত। দিদি আর লেনক্সের সঙ্গে লাঞ্চ খাব বলেই কথা আছে। ওঁরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমাকে এখুনি যেতে হবে।
ক্যাথারিন চলে যেতে চায় শুনে কিংটন বলল, তাহলে আপনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।
-চলুন।
ক্যাথারিন আর কিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ক্যাথারিনকে তুলে দিয়ে এসে দেখল মিঃ আলডিন পোয়ারোর সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। মিঃ আলডিন বলছিলেন, রুথ-এর উদ্দেশ্যটা যদি জানা যেত ব্যাপারটা বোঝা যেত। মিস গ্রে-র কথাতে বোঝা গেল, হয়তো তার প্যারীতেই নামার কথা ছিল কিন্তু পরে মত বদল করেছে। আবার এও হতে পারে মিস গ্রে-কে সে তার সব কথা খুলে বলেনি। কিন্তু মিস ম্যাসন-এর কথায় মনে হচ্ছে শয়তান কাউন্ট রুথ-এর সঙ্গে ট্রেনে দেখা করেছিল। এখানেই জট পাকাচ্ছে। কি বল কিংটন?
–কি বলছেন স্যার? আমি ঠিকমত শুনতে পাইনি।
–তুমি কি জেগে স্বপ্ন দেখছ? তোমার এরকম অন্যমনস্কতা তো আগে দেখিনি। ও, তুমি এতক্ষণ ঐ মেয়েটির কথা চিন্তা করছিলে!
লজ্জায় মাথা নত করল কিংটন। তা দেখেই বোঝা গেল যে, ক্যাথারিনকে দেখে সে মজেছে।
.
১৯.
টেনিস কোর্টে
কয়েকদিন পরের কথা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্যাথারিন প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরতেই লেনক্স বলল, তোমার নতুন বন্ধুটি ফোন করেছিল মাসী।
নতুন বন্ধু আবার কে?
–মিঃ আলডিন-এর সেক্রেটারী মিঃ কিংটনের কথা বলছি। বারো বছর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে রাইফেলের বুলেটে একবার ঠ্যাং ভেঙেছিল, এবার দেখছি হৃদয় ভেঙেছে অন্য একটি বুলেটে।
-ঠ্যাং ভেঙেছিল মানে?
–উনি তখন সেনাবাহিনীতে চাকরী করতেন, সম্ভবতঃ মেজর ছিলেন। সেই সময় একবার গুরুতর আহত অবস্থায় মায়ের হাসপাতালে ছিলেন বেশ কিছুদিন।
-তোমার মা বুঝি হাসপাতাল খুলেছিলেন?
-হ্যাঁ। আহত সৈনিকদের জন্য একটা একজিলিয়ারী হাসপাতাল খুলেছিলেন মা। আমার তখন আট-নয় বছর হবে।
লেডী টাম্পলিন সেই সময় সেখানে এলেন, তাকে দেখে ক্যাথারিন বলল, মিঃ কিংটন ফোন করেছিলেন শুনলাম। কি বলছিলেন?
-বলছিলেন আজ বিকেলে তুমি টেনিস খেলতে রাজী আছ কি না। রাজী থাকলে তিনি তোমাকে নিয়ে যাবেন।
একথাও বললেন যে, মিঃ আলডিনের নির্দেশেই তিনি ফোন করেছেন।
মায়ের কথার জের টেনে লেনক্স বলল, তোমার তরফ থেকে আমরা কিন্তু আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। তাকে যথাসময়ে আসতে বলে দিয়েছি।
–সে কি! আমি যাব কিনা, তা না জেনেই বলে দিলে?
–হ্যাঁ, দিলাম। এটা যদি মিঃ কিংটন-এর ব্যক্তিগত নিমন্ত্রণ হতো তাহলে স্বতন্ত্র। নিমন্ত্রণটা মিঃ আলডিন-এর বলে না বলতে পারলাম না। বুড়োর সঙ্গে পরিচয় থাকাটা বিশেষ দরকার।
–আমার, না তোমার?
–উভয়েরই বলতে পার। তার সঙ্গে পরিচিত হতে আমি নিশ্চয়ই চাই।
এই প্রসঙ্গে লেডী টাম্পলিন বললেন, আমিও তো পরিচিত হতে চাই তার সঙ্গে। শুনেছি তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনকুবের। এ রকম লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকলে সম্মান বাড়ে।
–এমনিতেই কি তোমার সম্মান কম দিদি?
বলেই সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে একটা মন্তব্য কানে গেল–”কিংটন-এর সঙ্গে ওকে সুন্দর মানাবে কিন্তু।
লাঞ্চের একটু পরেই কিংটন এসে গেল। গাড়ি থেকে নামতেই লেডী টাম্পলিন তাকে মৃদু হেসে অভ্যর্থনা করল। আসুন মিঃ কিংটন। ক্যাথারিন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
-কোথায়?
–নিচের ড্রয়িংরুমে। আপনি আসুন।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে কিংটন দেখল ক্যাথারিন ও লেনক্স গল্প করছে।
লেনক্স বলল, আসুন মঁসিয়ে, এই নিন আপনাদের শিকার।
তার মানে?–কিংটন-এর চোখে বিস্ময়।
–না না। আমি আপনাকে মিন করছি না। আপনাদের কথাটা কিন্তু বহুবচন। কথাটা আমি মিঃ আলডিনকে মিন করেছি।
–আপনি কিন্তু মিঃ আলডিনের ওপর অবিচার করেছেন। তিনি এখন ষাটের কাছাকাছি।
–তাতে কি হয়েছে? টাকার জোর থাকলে বুড়োও যুবক হয়ে যাবে।
-তা যা বলেছেন। মিঃ আলডিনকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না যে, তার অত বয়স হয়েছে। দেখলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের বেশি মনে হয় না।
–তাহলে তো বিপদের কথা।
–কি রকম?
–ধেড়ে রোগের লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে। বুড়ো বয়সে ধেড়ে রোগ হয় জানেন তো?
-লেনা কি যা তা বলছ। এরকম একজন মানী লোকের সম্বন্ধে সমীহ করে কথা বলতে হয়।–বললেন টাম্পলিন।
-সমীহ করেই তো বলছি। তবে মাসীর ওপরে তার যে রকম টান দেখছি তাতে মনে হচ্ছে …..
-মিঃ আলডিন আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন তাই তো? হ্যাঁ, তিনি আমাকে ভালোবাসেন তার মেয়ের মতো। তাই না মিঃ কিংটন?
-ঠিক বলেছেন। এবার কিন্তু আমাদের বেরিয়ে পড়া দরকার। আর দেরি না করাই উচিত।
ক্যাথারিন বলল, আমি তৈরি হয়েই আছি, চলুন। গাড়িতে দুজনে পাশাপাশি বসল। কিংটন গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, মিঃ পোয়ারোও আসছেন টেনিস লনে।
-তাই নাকি! তাহলে তো মনে হচ্ছে ওখানে টেনিস খেলা ছাড়া অন্য খেলাও চলবে।
-আমারও সেইরকম ধারণা। কারণ মিঃ পোয়ারো কখনও বাজে সময় নষ্ট করে না।
–উনি কি হত্যাকারীকে ধরতে পারবেন বলে মনে হয় আপনার?
–নিশ্চয়ই পারবেন। ওর কর্মদক্ষতার ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে। আমার তো মনে হয় উনি কাউন্টের জন্যেই টেনিস লনে আসছেন। কাউন্ট বুদ্ধিমান স্বীকার করলেন না। কিন্তু এবারে ওনার হাত থেকে পিছলে বার হওয়া কঠিন ব্যাপার।
–আপনার তাহলে ধারণা কাউন্টই মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী?
ধারণা নয় মিস গ্রে–আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কাউন্টই মাদাম ক্যাথারিনকে হত্যা করেছেন। এবারে ওর হাতে কয়েকদিনের মধ্যেই হাতকড়া পড়বে।
তারা টেনিস লনে এসে পৌঁছল। গাড়ি থেকে নামতেই মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে দেখা। তার বেশবাসের ঘটা দেখে ক্যাথারিন বলল, আপনাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে এই পোশাকে।
-তাই নাকি! কিন্তু সুন্দর দেখাবার বয়স তো অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।-হেসে বললেন পোয়ারো।
–মিঃ আলডিন কোথায় মঁসিয়ে?–কিংটন বলল।
–তিনি তার সীটেই আছেন। লনে ঢুকলেই দেখবে। এই সময় ড্রেক ক্যাথারিনকে আসতে দেখা গেল।
পোয়ারো বললেন, কি আশ্চর্য! মিঃ ক্যাথারিনও এসেছেন।
কিংটন এগিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানাল তাকে। প্রতি সম্ভাষণ জানাল ক্যাথারিনও। মিঃ ক্যাথারিন বলল, মিস গ্রেও এসেছেন দেখছি। আপনার দিদিও এসেছেন নাকি?
-না।
–চলুন, মাঠে ঢোকা যাক।
মাঠে ঢুকে সবাই আসন গ্রহণ করল। মিঃ ক্যাথারিন আর মিস গ্রে পাশাপাশি বসল। তার পাশেই পোয়ারো এবং পোয়ারোর পাশে কিংটন বসল।
আসন গ্রহণ করবার পর মাঠের অপরদিকে মিঃ আলডিনকে দেখে কিংটন দেখা করতে চলে গেল।
মিঃ ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে মিঃ পোয়ারো বললেন, লোকটা বেশ চৌকস, তাই না মঁসিয়ে?
–হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়।
— পোয়ারো পকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বার করে ক্যাথারিন-এর সামনে ধরলেন, দেখুন তো মাদমোয়াজেল, এটা আপনার সিগারেট কেস কিনা?
ক্যাথারিন দেখল কৌটোর ঢাকনির ওপরে Kঅক্ষরটি এমব্রস করা আছে।-না মঁসিয়ে, ওটা আমার জিনিস নয়।
–আমার কিন্তু মনে হয়েছিল আপনার নামের আদ্যক্ষর K বলেই এটা আপনার আর আপনি এটা ভুলে মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ফেলে এসেছিলেন।
পোয়ারো এবার মিঃ ক্যাথারিনকে বললেন, দেখুন তো মঁসিয়ে এটাকে আপনি চিনতে পারেন কিনা? হয়তো এটা মাদাম ক্যাথারিন-এর সিগারেট কেস।
মিঃ ক্যাথারিন ভালো করে দেখে বললেন, না মঁসিয়ে, এরকম কোনো সিগারেট কেস আমার স্ত্রীর ছিল না। তবে হয়তো তিনি সম্প্রতি কিনেছেন এটা।
–আপনার নয় তো?
–আমার নিশ্চয়ই না।
মিঃ ক্যাথারিন-এর কথার স্বরে বোঝা গেল সত্যিই। তবু আবার সন্দেহটা নিরসন করবার জন্য বললেন, ক্ষমা করবেন মঁসিয়ে। আমি ভেবেছিলাম এটা তাহলে আপনার হতেও পারে। কারণ সে রাত্রে আপনি তো মাদামের কামরায় গিয়েছিলেন।
–আমি গিয়েছিলাম, কে আপনাকে বলেছে? না, আমি কখনও সেখানে যাইনি।
–ক্ষমা করবেন মঁসিয়ে, আমি কথাটা মিস গ্রের কাছে শুনেছি।
কথাটা শুনে ক্যাথারিন বেশ বিব্রত বোধ করল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে, ভুল করেছেন মিস গ্রে। হয়তো আমি রুথের পোষাকে কামরায় থাকায় আপনি ভুল দেখেছেন।
ইতিমধ্যেই মিঃ আলডিনকে আসতে দেখে মিঃ ক্যাথারিন বললেন, আমি এবার আপনাদের কাছে বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমার শ্বশুরমশায়টিকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
মিঃ আলডিন এসে ক্যাথারিনকে দেখে বললেন, তুমি এসেছ দেখে আমি খুব খুশী হয়েছি। আরে মিঃ পোয়ারো যে, আপনি টেনিস খেলা দেখতে আসবেন আমি ভাবতেও পারিনি।
মিঃ আলডিনের খোঁচাটা বুঝতে পেরে পোয়ারো বললেন, ভাবতে না পারাটাই স্বাভাবিক, কারণ আমি ডিটেকটিভদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছি। খেলাধূলা-আমোদ-প্রমোেদ সব কিছু ছেড়ে দিনরাত কেবল মক্কেলদের কাজ করাই ডিটেকটিভদের ধর্ম। তাই না? উল্টো খোঁচা খেয়ে মিঃ আলডিন চুপ করলেন।
পোয়ারো কিন্তু তখনও বলে চলেছেন, আপনার কোনো চিন্তার কারণ নেই মিঃ আলডিন। আমি নিতান্ত অকারণে খেলা দেখতে আসিনি। আমাদের বিপরীত দিকে যে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি বসে আছেন, তার সঙ্গে দেখা করতেই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।
লোকটিকে একবার চকিতে দেখে নিয়ে মিঃ আলডিন বললেন, লোকটি কে?
–উনি হলে বিখ্যাত রত্ন ব্যবসায়ী মিঃ পপোপুলাস। ভদ্রলোক হঠাৎ প্যারী থেকে এখানে ছুটে এসেছেন দেখে মনে হচ্ছে উনি অকারণে আসেননি।
পোয়ারের কথায় মিঃ আলডিন খুব খুশী হলেন। তিনি এবার বেশ কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন মিঃ পোয়ারো। আপনার সম্বন্ধে আমি যে মন্তব্য করেছিলাম তার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত।
দুঃখিত হবার কিছু নেই, কিন্তু এবার আরও কিছু নতুন সংবাদ শুনুন। ইতিমধ্যে কাউন্টের বাড়িটা সার্চ করেছে পুলিশ।
-সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে কি?
–না।
–কিছুই পাওয়া যায়নি?
–না। এ ছাড়াও কিছু আছে। কাউন্টের অনুসন্ধান করে একটা জিনিস পাওয়া গেছে।
পোয়ারো একবার চারিদিক দেখে নিলেন কেউ কিছু লক্ষ্য করছে কিনা। তারপরে তিনি পকেট থেকে একটা ভেলভেটের বাক্স বের করে আলডিন-এর হাতে দিলেন।
বললেন, এই জিনিসটা পাওয়া গেছে কাউন্টকে ফলো করে। দেখুন মঁসিয়ে।
বাক্সটার ভেতরের জিনিস সব ঠিক আছে দেখে অবাক হয়ে আলডিন বললেন, আশ্চর্য! এ যে হার্ট অফ ফায়ার, কিভাবে উদ্ধার করলেন।
-একটা লেটার বক্সের ভেতর থেকে। কাউন্ট মহোদয় এই প্যাকেটের উপরে যথারীতি প্রাপকের ঠিকানা লিখে পোস্টঅফিসের বক্সে ফেলে দিলেন।
কিন্তু প্রাপকের হাতে পৌঁছানোর আগেই আমার হাতে এলো। কাল দুপুরের পরে কাউন্টকে দুজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে আমি অনুসরণ করি। বলাবাহুল্য আমরা সবাই ছদ্মবেশে ছিলাম। আমাদের গাড়িটাকে পেছনে দেখে কাউন্ট তার টু-সীটারের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। আমরাও ইচ্ছে করে স্পীড কমিয়ে বিশেষ শক্তিশালী লেন্স-এর দূরবীনের সাহায্যে আমি বহুদূর থেকে তাকে লক্ষ্য করি। আমি স্পষ্ট দেখলাম একটা প্যাকেট পোস্টঅফিসের লেটার বক্সে ফেললেন। এরপর গাড়িতে উঠে মেন্টন-এর দিকে চলে গেলেন।
-তারপর?
-তারপর আমরা সদলবলে পোস্টঅফিসে গিয়ে পোস্টমাস্টারকে বলে লেটার বক্স খুলে এই প্যাকেটটা উদ্ধার করি।
প্যাকেটের ওপর প্রাপক হিসাবে যার নাম ঠিকানা ছিল তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কি?
-না, কারণ প্রাক ছিল এমন একটা প্রতিষ্ঠান যাদের কাজ হলো চিঠিপত্র এবং পার্শেল নিজেদের কাছে রেখে পরবর্তী কালে কিছু কমিশন আদায় করে প্রেরকের কাছে চিঠি নিয়ে কোনো লোক এলে তাকে নির্দিষ্ট বস্তুটি দেওয়া। চিঠি বা পার্শেলের ভেতরে কি থাকে তা তারা জানতে চেষ্টা করে না। এই কারণেই সেখানে খোঁজখবর করিনি। এবার আমার কাজে যাচ্ছি মঁসিয়ে।
-আবার কবে দেখা হবে আপনার সঙ্গে?
-কাল এগারোটার সময়ে। আশা করি তখন আরও কিছু নতুন সংবাদ আপনাকে দিতে পারব। ওসব নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করবেন না। চলি।
পোয়ারো যেতেই আলডিন, ক্যাথারিন এবং কিংটনকে দেখলেন তারা গল্পে মশগুল।
.
২০.
মঁসিয়ে পপোপুলাস
পূর্বোক্ত ঘটনার পরের দিনের কথা।
ব্রেকফাষ্ট করছিলেন পপোপুলাস, সামনের চেয়ারে মুখোমুখি বসেছিল তার মেয়ে জিয়া।
হোটেলের বয় এসে পপোপুলাসের হাতে একটা কার্ড দিল। কার্ডখানা দেখে পপোপুলাস বললেন, ভদ্রলোককে আসতে বলো।
বয় চলে গেলে তিনি জিয়াকে বললেন, টিকটিকি পোয়ারো আসছে রে, কি ব্যাপার! ও হঠাৎ আমার পেছনে লাগল কেন?
জিয়া বলল, গতকাল ওকে টেনিস লনে দেখেছিলাম। মনে হয় উনি কোনো খোঁজখবর পেয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে উনি নাক গলাচ্ছেন কেন?
পপোপুলাস বললেন, আমার মনে হয় মিঃ আলডিন তাকে নিযুক্ত করবেন। রুথ এবং হার্ট অব ফায়ার দুটো হারিয়ে ভদ্রলোক একেবারে ক্ষেপে গেছেন।
পোয়ারো এসে হাজির হলেন সেখানে, সুপ্রভাত মিঃ পপোপুলাস। ভালো আছেন নিশ্চয়ই?
জিয়ার দিকে তাকিয়ে, আমাকে ভুলে যাননি তো মাদমোয়াজেল?
আপনাকে কেউ ভুলতে পারে? দয়া করে বসুন মঁসিয়ে। পোয়ারোর বসবার পর পপোপুলাস বললেন, কফি চলবে কি?
–না, এই মাত্র কফি খেয়ে আসছি।
–তা, এখানে কি মনে করে?
-কেন? পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে কি আসতে নেই? পপোপুলাস হেসে বললেন, পুরনো বন্ধুর জন্যে এমন টান যে প্যারী থেকে রিভিয়ারায় ছুটে এসেছেন, আমি তাহলে একজন কেউকেটা বলুন!
পোয়ারো হেসে বললেন, মাঁসয়ে পপোপুলাস কি নিজেকে এত অখ্যাত মনে করেন? আপনি যে একজন বিখ্যাত লোক, একথা কে না জানে।
–অন্য কেউ না জানলেও যে সব গোয়েন্দা আমার ওপর গোপনে নজর রাখেন তাদের চোখে আমি একদিক দিয়ে বিখ্যাত বৈকি। যা এবারে দয়া করে আসল কথাটা ব্যক্ত করুন পোয়ারো।
–আমি কোনো একটা ব্যাপারে আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি মিঃ পপোপুলাস।
-আশ্চর্য! আমি সাহায্য করব বিশ্ববিখ্যাত ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারোকে! এরকম অদ্ভুত কথা এর আগে কোনোদিন শুনেছি বলে মনে হয় না।
–না, ঠাট্টা নয় বন্ধু। সত্যিই আমি আপনার সাহয্যপ্রার্থী।
–বেশ, কি সাহায্য করতে হবে বলুন। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব গুরুতর তাই না?
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা গুরুতরই বটে। মাদাম ক্যাথারিন-এর মৃত্যুর ব্যাপারে আমি তদন্ত করছি।
–কাগজে পড়েছি খবরটা। কে বা কারা তাকে ব্লু ট্রেনের কামরার ভেতরে হত্যা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?
পকেট থেকে ভেলভেটের বাক্সটা বের করে পপোপুলাস-এর হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন ত, রুবীগুলোর দাম কত হবে?
বাক্সটা খুলে রুবীগুলোর দিকে তাকিয়ে পপোপুলাস বললেন, আপনি কি সত্যিই এগুলোর দাম জানতে চান, না আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?
–ঠিকই ধরেছেন। আমি জানি, এগুলোর দাম পাঁচ হাজার পাউণ্ডও হবে না।
-হা নকল হলেও এগুলো দেখতে আগের মতই। সাধারণ লোকে নকল বলে বুঝতেই পারবে না। কিন্তু এগুলো আপনার হাতে এলো কি করে? কার কাছে ছিল?
–ছিল কাউন্ট দ্য লা রোচির কাছে।
–আশ্চর্য ব্যাপার তো!
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা একটু আশ্চর্য বটে। এবার শুনুন এগুলো বোঝা যাচ্ছে নকল। কিন্তু আসল রুবীগুলো মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরা থেকে অপহৃত হয়েছে।
–কি বলছেন!
–শুনুন বন্ধু! চোরাই মাল উদ্ধার করার কাজ পুলিশের।
আমি শুধু হত্যাকারীকে বের করতে চাই। মিঃ আলডিন আমাকে এই কাজের জন্যেই নিযুক্ত করেছেন। তবে হত্যাকারীর সন্ধান করতে গেলেই রুবীগুলোর ব্যাপারও এসে যায়। কারণ মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যা আর রুবী অপহরণ দুটো ঘটনাই পরস্পর সংযুক্ত।
পপোপুলাস হেসে বললেন, তারপর?
–আমার ধারণা, রুবীগুলো শীঘ্রই হস্তান্তরিত হবে বা হয়ে গেছে এই শহরেই। এই কারণেই মনে হচ্ছে আমার–আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।
–কিভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি বলুন।
–আপনার মতো বুদ্ধিমান লোককে কি খুলে বলতে হবে? রাশিয়ার কোনো ভূতপূর্ব গ্র্যাণ্ড ডিউক, অষ্ট্রেলিয়ার কোনো কোনো আর্কডাচস, কিংবা ভারতের কোনো মহারাজা যদি কোনো দামী রত্ন বিক্রি করতে চান তাহলে সেগুলো কোথায় এবং কার কাছে যায় সে খবর আপনার জানা আছে।
-হ্যাঁ, এ ধরনের গোপন লেনদেনের ব্যাপারে আমার কিছুটা সুনাম আছে বটে। কারণ আপনার মতো আমিও গোপনীয়তা রক্ষা করে থাকি।
–তাহলে বুঝতে পারছেন কেন আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইছি। এর সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
পপোপুলাস বললেন, ধরুন এ ব্যাপারটা যদি আমার জানা থাকে, তবু সে কথা আপনাকে বলব কেন? পেশাগত গোপনীয়তা আমি জানাতে রাজী নই মিঃ পোয়ারো।
–কথাটা ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আশা করি আমাকে অন্ততঃ বলবেন সেটা। কারণ সতের বছর আগে কোনো একজন নাম করা লোক তার দামী জিনিস আপনার কাছে জামিন হিসাবে গচ্ছিত রেখে ছিল এবং জিনিসটি আপনার হেফাজত থেকে চুরি হয়েছিল। সে সময় আমিও আপনাকে কোনো বিশেষ ব্যাপারে গোপন ভাবেই সাহায্য করেছিলাম।
পোয়ারো একবার জিয়ার দিকে দেখলেন সে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে কথাগুলো শুনছে। পোয়ারো বলে চললেন, আমি তখন প্যারীতে। আপনি আমাকে সেখান থেকে এনে সেই চোরাই মাল উদ্ধারের কাজ আমার ওপরে ছেড়ে দিলেন। এবং আমি সেই জিনিস উদ্ধার করে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
–সে কথা আমি ভুলিনি মিঃ পোয়ারো। আমি এত অকৃতজ্ঞ নই।
–হ্যাঁ আপনাদের এই গুণটা আছে বটে।
–গ্রীক জাতির কথা বলছেন তো?
-না মঁসিয়ে, আমি ইহুদী জাতির কথা বলছি। পোয়ারোর কথায় বিস্মিত হলেন পপোপুলাস। তার ধারণা ছিল তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানে না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি ইহুদী।
-তাহলে আপনি আমাকে সাহায্য করছেন তো?
–আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি খুবই খুশী হতাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তবে আপনি যদি চান তাহলে রেসের একটা টিপস দিতে পারি আপনাকে। রেসের মাঠে যান তো!
–তা যাই বৈকি!
-তাহলে শুনুন। আগামী রেসের দিন মাকুইন নামের ইংলিশ ঘোড়াটা বাজি মারবে বলে খবর পেয়েছি।
পপোপুলাসের কাছে রেসের টিপসটা পেয়ে খুশী খুশী মনে পোয়ারো পপোপুলাস এবং জিয়ার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
সেই দিন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ইনসপেক্টর মিঃ জ্যাক-এর কাছে একখানা জরুরী চিঠি লিখলেন পোয়ারো। চিঠিতে তিনি মার্কুইস নামে পরিচিত একজন ক্রিমিন্যালের সম্বন্ধে সব কথা জানতে চাইলেন।
৫. একটি নূতন সূত্র
২১. একটি নূতন সূত্র
মিঃ আলডিন তার নিজের স্যুইটের ড্রয়িংরুমে বসে পোয়ারোর জন্যে অপেক্ষা করছেন। পোয়ারো ফোনে জানিয়েছেন এগারোটায় আসছেন তিনি।
এগারটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মঁসিয়ে পোয়ারো ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন।
মিঃ আলডিন খুশী হয়ে বললেন, আপনি তো খুব পাংচুয়াল দেখছি।
–হ্যাঁ, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করি পাংচুয়ালিটি বজায় রাখতে। আচ্ছা, এবার কাজের কথা শুরু করা যাক।–সোফায় বসলেন পোয়ারো।
-বলুন।
–প্রথমেই আমি মিস ম্যাসন-এর সঙ্গে আর একবার কথা বলতে চাই। সে এখানেই আছে তো?
–হ্যাঁ, আপনার কথামত তাকে এখানেই রেখেছি। এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি।
কলিং বেল টিপে বয়কে বললেন মিস ম্যাসনকে আসতে।
একটু পরেই মিস ম্যাসন ঘরে প্রবেশ করলেন। পোয়ারো বললেন, বসুন মিস ম্যাসন। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
–সেদিন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আপনি যা যা বলেছেন তার সব কথা মনে আছে তো?
–নিশ্চয়ই।
–আপনি বলেছিলেন, মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় যে লোকটিকে দেখেছিলেন তাকে আপনি চেনেন না–তাই না?
–হ্যাঁ, এবং এখনও সেই কথাই বলছি।
–আচ্ছা, মঁসিয়ে ক্যাথারিনকে আপনি চেনেন নিশ্চয়ই?
–চিনি, তাকে আমি দুবার মাত্র দেখেছি।
কাছ থেকে কি কখনও দেখেছেন?
-না, খুব কাছে দেখিনি। একবার কার্জন স্ট্রীটের বাড়িতে আর একবার পার্কে। বাড়িতে যখন এসেছিলেন তখন আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর মিঃ ক্যাথারিন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র দেখেছিলাম।
–পার্কে তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলেন কি?
-হ্যাঁ, সেদিন আমি তাকে ভালোভাবে দেখেছিলাম, সেদিন তার সঙ্গে একজন বিদেশিনী মহিলা ছিলেন।
–বিদেশিনী?
–হ্যাঁ, মহিলাটি ইংরেজ নন।
–আচ্ছা, এবার একটু ভেবে বলুন তো, সেদিন মাদামের কামরায় যাকে দেখেছিলেন তার চেহারাটা মিঃ ক্যাথারিন-এর মতো কিনা?
এবার মিস ম্যাসন বিস্মিত স্বরে বললেন, একথা আমি চিন্তাও করিনি স্যার। তিনি মানে
–আপনি হয়তো শুনে থাকবেন মিঃ ক্যাথারিন ওই ট্রেনেই ছিলেন। মাদাম ক্যাথারিন যে ঐ ট্রেনেই যাচ্ছিলেন সে কথাও তিনি জানতেন। অতএব সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
–কিন্তু স্যার, মাদামের কামরায় যে ভদ্রলোককে দেখেছি তিনি ট্রেনের যাত্রী নন।
–একথা কেন বলছেন?
-কারণ, ওঁর গায়ে ওভারকোট আর মাথায় টুপি ছিল। ট্রেনের কোনো যাত্রী হলে নিশ্চয়ই তিনি ওভারকোট আর টুপি পরে কামরায় যেতেন না।
একদিক দিয়ে ঠিকই বলছেন কথাটা। কিন্তু এমন তো হতে পারে, মঁসিয়ে ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নামবার জন্য ওভারকোট ও টুপি পরে করিডরে বেরিয়ে হঠাৎ তার মত পরিবর্তন করে মাদামের কামরায় গিয়েছিলেন। হয়তো করিডরে মাদামের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার পর তিনি আর প্ল্যাটফর্মে না নেমে মাদামের কামরায় মাদামের সঙ্গে ঢুকেছিলেন।
মিস ম্যাসন বললেন, একথাটা আগে আমার মনে হয়নি। কিন্তু আপনার কথায় এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক। তবে এ ব্যাপারে আমি হলফ করে কিছু বলতে পারবো না।
পোয়ারো পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বার করে মিস ম্যাসনের হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন তো এটা মাদাম ক্যাথারিন-এর সিগারেট কেস কি না?
মিস ম্যাসন ভালো করে দেখলেন এক পিঠে K অক্ষরটা সোনালী রঙে এমব্রস করা রয়েছে। এটা কার বলতে পারেন কি?
সঠিক বলতে পারি না, কিন্তু এটা মাদামের নয়। সিগারেট কেসটা পোয়ারোকে ফিরিয়ে দিল।
–এটা তাহলে মিঃ ক্যাথারিন-এর হতে পারে। কারণ, তাঁর নামের আদ্যক্ষরও K।
–হ্যাঁ, স্যার, আপনার কথাই ঠিক মনে হচ্ছে। মাদাম তার স্বামীকে উপহার দেবার জন্যে একটা সিগারেট কেস কিনেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই সেটা হবে।
মিস ম্যাসন আলডিন এবং পোয়ারোকে অভিবাদন জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিঃ আলডিন বললেন, আপনি তাহলে বলতে চান ড্রেকই একাজ করেছে? অথচ গতকাল আপনিই বলেছেন পুলিশ কাউন্টকে সন্দেহ করছে।
-ঠিকই বলেছিলাম মঁসিয়ে।
–তাহলে?
–কি তাহলে?
–এখন তো দেখছি আপনি ড্রেককে সন্দেহ করছেন।
-সন্দেহ করাটাই তো আমার পেশা। কিন্তু আমি যে ড্রেককে সন্দেহ করছি, একথা আপনার মনে হলো কেন?
–মিস ম্যাসনকে জেরার ধরন দেখে।
-তাতেই কি ধরে নিতে হবে আমি মিঃ ক্যাথারিনকে সন্দেহ করছি? না আমি কাউকেই করছি না। আমি শুধু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অপরাধীকে বের করতে চেষ্টা করছি।
-কিন্তু আপনি সেদিন বলেছিলেন কাউন্টকে অনুসরণ করে হার্ট অফ ফায়ার উদ্ধার করেছেন। এবং জিনিসটা আমাকে দেখিয়েছেন।
–সেকথা তো অস্বীকার করছি না মিঃ আলডিন।
-আপনার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাহলে রুবীটা বাদ দিয়ে এবার আপনি বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করছেন।
–না মঁসিয়ে, বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করা পোয়ারোর কাজ নয়।
–তাহলে সেই রুবীটা!
-ওটা নকল।
পোয়ারোর কথায় মিঃ আলডিন বিস্ময়ে বিহ্বল হলেন। তাঁর বিস্মিত মুখের ভাব দেখে পোয়ারো বললেন, এবার তাহলে বুঝতে পারছেন তো ঘটনার গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে এগোচ্ছে। কাউন্টের পেছনে ঘোরা বৃথা পণ্ডশ্রম।
–কাউন্টকে আপনি আগাগোড়াই হত্যাকারী ভাবেননি।
–তা ভাবিনি, এবং সেকথা আপনার কাছে গোপন রাখিনি।
–তা সত্ত্বেও কি ওই রুবীর ব্যাপারে তাঁকে আপনি সন্দেহ করেননি।
করেছিলাম। কারণ কাউন্ট ওই রুবীটা হস্তগত করার জন্যে মাদাম ক্যাথারিনকে চিঠিতে রুবীটা আনার অনুরোধ জানাল। কাউন্ট জানতেন মাদাম রুবীটা আনবে তাই তিনি আগেই নকল হার্ট অফ ফায়ার যোগাড় করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ সুযোগ মত আসলটি হাতিয়ে তার জায়গায় নকলটি রেখে দেবেন। তিনি আরও বুঝেছিলেন মাদাম কখনও আসল নকলের প্রভেদ বুঝতে পারবেন না। আর কেলেঙ্কারীর ভয়ে কোনোদিন বুঝতে পারলেও কথাটা চেপে যাবেন।
–আপনি তাহলে কি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলেন কাউন্ট নকল রুবী সংগ্রহ করে রেখেছেন।
-না তা করিনি। এবং সেই জন্যেই সন্দেহ মুক্ত ছিল না। এখন আর তাকে সন্দেহ করি না।
-এখানে কি আর একটা প্রশ্ন আসে না?
–কি প্রশ্ন মঁসিয়ে?
–কাউন্ট নকল রুবীটা পাচার করার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন?
–কারণ কাউন্ট বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশ তার বাড়ি সার্চ করবে আর তখন নকল রুবীটা পেলে তাকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেপ্তার করবে। তাই নকল রুবীটা সরাবার ব্যস্ততা।
–এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু ও যদি হত্যাকারী না-হয়, তবে কে এই পাষণ্ড?
-যে গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, কে সেই লোক?
তবে কি ড্রেকই আমার সর্বনাশ করেছে?
–সঠিক কিছু বলতে পারছি না। এখন আমার একমাত্র কাজ হবে সেই লোকটাকে খুঁজে বের করা।
আশা করি শীগগিরই তাকে পাবো। আজ উঠি।
নেগ্রেসকো থেকে বেরিয়ে আসতেই মিঃ পোয়ারো দেখতে পেলেন মিঃ ক্যাথারিন একটা মোটর গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির আরোহীর সঙ্গে কথা বলছেন। গাড়ির আরোহীকে দেখে চিনতে পারলেন–মিস গ্রে।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদেরকে লক্ষ্য করলেন, কিন্তু ওরা দেখতে পেল না।
মিনিট দুয়েক পরেই গাড়িটা চলে গেল। মিঃ ক্যাথারিন তখনও দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন চলমান গাড়িটাকে।
মেয়েটি চমৎকার, তাই না মঁসিয়ে?
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালেন মিঃ ক্যাথারিন। পোয়ারো তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
ক্যাথারিন বললেন, আপনি এখানে?
-মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন কি কিছু বলেছেন আপনাকে? আপনাকে দেখে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে।
–সব কথাই যে আপনাকে বলতে হবে তার কোনো কারণ আছে কি?
-না না, তা থাকবে কেন! মিষ্টি হেসে পোয়ারো আবার বললেন, আপনি হয়তো দেখতেই পাননি…. আপনি যখন কথা বলছিলেন আরেকটা গাড়ি থেকে অপর একজন মহিলা আপনাকে লক্ষ্য করছিলেন। বাঁ দিকে তাকালে তাকে দেখতে পাবেন।
বাঁ দিকে তাকিয়েই দেখল মিরেলি তাকে লক্ষ্য করছে আরেকটা গাড়িতে বসে।
–ও দেখছি এখনও পেছন ছাড়েনি।
–ও নিশ্চয়ই জানে যে আপনি এখন অনেক টাকার মালিক।
–ঠিক বলেছেন। ওর কাজই হলো মক্কেল বধ করা। অনেক মেয়ের সংসর্গে আমি এসেছি কিন্তু ওর মতো মেয়ে আজও দেখেনি। ওর ওই সুন্দর চেহারার আড়ালে আছে কুৎসিত মন।
–মাদমোয়াজেল, ক্যাথারিনও তো খুব সুন্দরী, তাই না।
মিস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে ওর তুলনা করবেন না মঁসিয়ে। ক্যাথারিন হলেন স্বর্গের দেবী আর ও হলো নরকের কীট। আপনি হয়তো ভাবছেন মিস গ্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মিরেলিকে ছেড়ে তার পেছনে ঘুরছি আমি, তাই নয় কি?
–না মঁসিয়ে, এটা ঠিক নয়। মিরেলির সঙ্গে কি সত্যিই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন আপনি?
-হ্যাঁ।
-তাহলে এগিয়ে যান মাসিয়ে। মিস গ্রে-কে স্ত্রীরূপে পাওয়া যে কোনো পুরুষের পক্ষেই ভাগ্যের কথা।
–কিন্তু তার আগে মিরেলির সঙ্গে একবার বোঝাঁপড়া করতে হবে। কেন ও এখনও আমার পেছনে লেগে আছে তার অবসান ঘটাতে চাই।
দ্রুতপদে মিরেলির গাড়ির দিকে সে চলল। আর পোয়ারো তাঁর বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
হোটেলে ফিরে পোশাক ছেড়ে পোয়ারো সবে বিশ্রাম করতে বসেছেন, হঠাৎ তার টেলিফোনটা বেজে উঠল।
রিসিভার তুলে নিলেন পোয়ারো, হ্যাল্লো–এরকুল পোয়ারো বলছি।
অপর প্রান্ত থেকে মিঃ আলডিন–এর প্রাইভেট সেক্রেটারী। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। দয়া করে লাইনটা ধরুন।
একটু পরেই আলডিন কথা বললেন, মিঃ পোয়ারো বলছেন কি? আমি আলডিন।
–হ্যাঁ, বলুন। আমি কথা বলছি।
-শুনুন মঁসিয়ে, এইমাত্র মিস ম্যাসন ফোন করে বললেন, আপনার কথা শোনার পর এতক্ষণ ধরে তিনি চিন্তা করেছিলেন। এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন রুথ-এর কামরায় যাকে দেখেছিলেন সে ড্রেক ছাড়া আর কেউ নয়।
-ধন্যবাদ মঁসিয়ে। এটা সত্যিই একটি দামী খবর।
.
২২.
নাগিনীর বিষ নিঃশ্বাস
মিঃ ক্যাথারিন তার হোটেলে ফিরে আসতেই রিসেপশন ক্লার্ক বললেন, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
-কে? কি নাম?
–নাম বললেন না। শুধু বললেন, আপনার সঙ্গে তার দরকারী কথা আছে। আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলেছি।
-কোথায়?
–সেলুনে।
–ঠিক আছে। আমি এখুনি যাচ্ছি।
সেলুনে ঢুকেই দেখলেন বসে আছেন কাউন্ট দ্য লা রোচি। তিক্ত কণ্ঠে বললেন, আমার মনে হয় এখানে আসাটা নিতান্তই পণ্ডশ্রম হয়েছে আপনার।
–আমার তা মনে হয় না। আমার কথাগুলো শুনলে আপনি বুঝবেন কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
–বেশ বলুন, কি বলতে চাইছেন।
–প্রথমে আমি আপনার গভীর শোকের বেদনা জানাই।
–আপনি যদি একথা বলার জন্যে এসে থাকেন তাহলে আপনি আসুন। এসব শোনার সময় আমার নেই।
–ইংরেজদের ভদ্রতাবোধ যে কত কম তা আর একবার প্রমাণিত হল। এবার আমার বক্তব্যটা শুনুন। আপনি এখন বেশ মোটা টাকার মালিক, তাই না?
–তাতে আপনার কি এসে যায়?
–আমাকে পুলিশ আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছে।
–তাই নাকি?
–আমি এ ব্যাপারে একেবারেই নিরপরাধ। আমি আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করে বলছি….
–আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে লাভ নেই, ওটা আপনি মঁসিয়ে ক্যারেজ-এর কাছে করলে লাভবান হবেন। তিনি মামলার অ্যাজ দ্য ইনস্ট্রাকশন।
–আমার আরও কিছু বক্তব্য আছে মঁসিয়ে।
–সংক্ষেপে সারুন।
–বর্তমানে আমি খুবই আর্থিক অনটনে পড়েছি। আমার কিছু টাকার দরকার। কাউন্টের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেক আসন ছেড়ে উঠল।
এই কথাটাই আমি শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু জেনে রাখ নরপশু, ব্ল্যাকমেলিং করে আমার কাছ থেকে একটি ফ্রাও আদায় করতে পারবে না।
কাউন্ট দেখলেন যে ক্যাথারিন চলে যাচ্ছেন তাই বললেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মিঃ ক্যাথারিন। আমি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি। আমি বলতে এসেছি, আপনি যে আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন এর নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে আমার কাছে। আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে কিছু টাকার বিনিময়ে ব্যাপারটা চাপা দিতে চাই। আশা করি বিষয়টার গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার মতামত এখুনি আমায় জানিয়ে দেবেন।
–আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন?
-না, কাউকে ভয় দেখানো আমার পেশা নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, আপনি ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে চাপা দিতে পারেন। যে মহিলা আপনার অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, তার মুখ বন্ধ করতে হলে অবশ্যই কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে আপনাকে। তাছাড়া আমারও কিছু চাই…
–কার কথা বলছেন আপনি? মিরেলি?
–হ্যাঁ তিনিই। এক লক্ষ ফ্রা হলেই মুখ বন্ধ করা যাবে।
–এবার তাহলে আমার উত্তরটা শুনবেন কি?
–নিশ্চয় শুনবো মঁসিয়ে।
–আপনি এখান থেকে সোজা বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথারিন সেলুন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ড্রেক ক্যাথারিন সেলুন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন মিরেলির হোটেলে। রিশেপশন অফিসে খবর জানতে পারলেন মিরেলি ঘরেই আছেন। তিনি তার নাম ছাপানো কার্ডখানা রিশেপশন ক্লার্কের হাতে দিলেন। আমি তার সঙ্গে এখুনি দেখা করতে চাই।
বয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে মিঃ ক্যাথারিনকে বললেন, আপনি আসুন মঁসিয়ে।
তিনতলায় একটা ঘরের সামনে গিয়ে বলল, এই ঘরেই মাদমোয়াজেল থাকেন। আপনি ভেতরে যান।
ড্রেক ঘরে ঢুকতেই মিরেলি চোখ সরাল। তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমি এলে? আমি জানতাম তুমি আসবে। এলেই যখন, বসতে আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই।
ড্রেক না বসেই বললেন, কাউন্টকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে কেন?
–সেকি! আমি তাকে পাঠাব কেন?–সারা শরীরে বিস্ময় দেখান মিরেলি।
–ব্ল্যাকমেলিং করে কিছু হাতিয়ে নেবার জন্যে।
ড্রেক-এর কথা শুনে মিরেলি বললেন, কাউন্ট যে তোমাকে ব্ল্যাকমেলিং করতে যাবে তা অনুমান করতে পারিনি। আমি তার কাছে গিয়েছিলাম ঠিকই, এবং তোমার ওপরে অভিমান করে কয়েকটা কথা বলেছিলাম কিন্তু আসলে কিছুই না। ওকথা কেবল তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না। ড্রেক ডারলিং, মিছিমিছি আমাকে ভুল বুঝো না।
কাছে এগিয়ে এসে ড্রেকের মুখের সামনে নিজের মুখটি তুলে ধরে আবেশে চোখ বুজলো। ড্রেক তাকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তুমি যদি ভেবে থাক আমার স্ত্রীকে আমিই হত্যা করেছি তাহলে মহা ভুল করবে তুমি। আমি এতটা নিচে নামিনি যে টাকার জন্যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করব।
এবার মিরেলি বিষধর গোখরো সাপের মতো রাগে মাথা তুলে বলল, তুমি এ ব্যাপারে আমাকে ধাপ্পা দিতে পারবে না ড্রেক। এখনও বলছি তুমি আগুন নিয়ে খেলা করো না। সেদিন তুমি বলেছিলে তোমার স্ত্রীর মতো স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীলোক কেবল অ্যাকসিডেন্টেই মরতে পারেন আর কোনো কারণে তোমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে তুমি তোমার পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ড্রেক তুমি যদি এখনও আমার কাছে ফিরে আস তাহলে তোমার কথা কোনো তৃতীয় ব্যক্তির কানে যাবে না।
তুমি আমাকে ভয় দেখিয়ে বশ করতে চাও! কিন্তু তোমার যা খুশি তাই করতে পার, আমি আর তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না।
-বেশ, তাহলে তাই হবে। তোমার অপকর্মের সঙ্গী আমি নিজে। আমি নিজের চোখে দেখছি নয়েনশ স্টেশনে ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে তুমি তোমার স্ত্রীর কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছিলে আর তখন তোমার স্ত্রী আর বেঁচে ছিল না।
মিরেলির কথাগুলো শোনার পর নিঃশব্দে ড্রেক কি চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
২৩.
সাবধান বাণী
লেডী টাম্পলিন ক্যাথারিনকে নিয়ে মণ্টিকালোতে এসেছিল। বাগানে দুজনে বসে যখন কথা বলছে তখন কিংটন আর পোয়ারো এসে হাজির হলেন। কিংটনকে দেখে প্রায় ছুটে গেল লেডী টাম্পলিন। কি অশ্চর্য! আপনাকে যে এখানে দেখব সে কথা ভাবতেও পারিনি।
–আমিও ভাবতে পারিনি। ভারী খুশী হলাম আপনাকে দেখে।
–তাহলে আসুন, বেড়াতে বেড়াতে দু-চারটে কথা বলি। সেই হাসপাতালের দিনগুলোর কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে?
কথা বলতে বলতে কিংটনকে অন্য দিকে নিয়ে চলল লেডী টাম্পলিন। পোয়ারো ক্যাথারিন-এর কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভালোই হলো আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার খুব দরকার ছিল। মাদমোয়াজেল, জীবনে এমন কিছু ঘটনা আছে যা ঘটবার আগেই তার আভাস পাওয়া যায়। যেমন সূর্য ওঠবার আগেই আকাশে তার আভাস পাওয়া যায়।
–হেঁয়ালিই করবেন, নাকি–আসল কথাটা বলবেন?
–ঐ আমার দোষ। মাঝে মাঝে হেঁয়ালি করতে আমার ভালো লাগে। ঠিক আছে, তাহলে সোজাসুজিই বলি। মিষ্টি করে হেসে বললেন, মিঃ কিংটনকে কেমন লাগে আপনার? যদিও প্রশ্নটা একান্তই আপনার মনের ব্যাপার।
-কথাবার্তায় আলাপে ব্যবহারে তো ভালো লোক বলেই মনে হয় ওকে। কিন্তু হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করার কারণ কি?
–কারণ আর কিছু নয় আমি আপনাকে জীবনে সুখী দেখতে চাই মাদমোয়াজেল। মাঝে মাঝে এমন কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ হয় যাদের সুখী দেখলে আমি নিজেও সুখী হই। আপনি তাদেরই একজন।
ক্যাথারিনের মনে হল এ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। পোয়ারোর এমন গলার স্বর আর কখনও শোনেনি সে। পোয়ারোর কথার আন্তরিকতা, তার ব্যক্তিত্ব ক্যাথারিনকে মন্ত্রমুগ্ধ করল।
পোয়ারো আবার বললেন, আচ্ছা, এবার বলুন মিঃ ক্যাথারিনকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
–তাঁর সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানি না।
–এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
–আমার কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ঠিকই হয়েছে।
–ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমি দুনিয়ার অনেক লোক দেখেছি অনেক কিছু দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে খারাপ স্ত্রীলোকের সংসর্গে এলে ভালো লোকও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়, আবার একটি ভালো মেয়েকে ভালোবেসে কোনো খারাপ লোক তার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তা তার ভালোবাসা যতই খাঁটি হোক না কেন।
–সর্বনাশ বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন?
–আমি কারো নাম বলতে চাই না। শুধু একথা জেনে রাখুন যে, এমন কিছু লোকের চেহারা আকর্ষণীয়। আর সেই আকর্ষণে ধরা দেবার উন্মাদনা আমি আপনার মধ্যে দেখেছি। আমি এরকুল পোয়ারো, আবারও বলছি, আপনার এই উন্মাদনা যেন কোনো আকর্ষণেই ধরা না পড়ে লক্ষ্য রাখবেন মাদমোয়াজেল। মন দিতে গিয়ে যে কোনো হত্যাকারীকে বরণ করে ফেলবেন না। আশা করি আমার কথা মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল।
হঠাৎই পোয়ারো চলে গেলেন কোনো কথা না বলে। পোয়ারোর যাওয়া দেখতে দেখতে ক্যাথারিন তার কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। তিনি কেনইবা বললেন এই কথাগুলো। তবে কি….
–কি অত তন্ময় হয়ে ভাবছেন বলুন তো?
ক্যাথারিন চমকে তাকাতেই দেখল মিঃ ক্যাথারিন পাশে দাঁড়িয়ে। সম্বিৎ ফিরে এলো তার, কই কিছু না তো! আপনি হঠাৎ কোথা থেকে?
-আর বলবেন না, আমি এতক্ষণ জুয়া খেলছিলাম। খেলতে খেলতে সব টাকা খুইয়ে তবেই ক্যাসিনো থেকে বের হলাম।
–আপনি একজন জুয়াড়ী? –প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল ক্যাথারিনের স্বর।
-আপনি ভীষণ অবাক হচ্ছেন। দেখুন, মানুষের জীবনটাই তো একটা ক্যাসিনো। জন্মালেই মানুষকে ভাগ্যের কাছে জীবনটাকে বাজী রাখতে হয়। তারপর আমৃত্যু চলে সেই বাজী হারা জেতার খেলা। আর আমি খেলি টাকা পয়সা রেখে ক্যাসিনোতে গিয়ে। জুয়া খেলি এই তো?–ঠোঁট বেঁকিয়ে স্পর্ধার হাসি হাসলো ড্রেক; আর পরের ওপর এই যে অনিশ্চয়তার একটা উত্তেজনা। ভালো শিকারী যেমন শিকার দেখলে নিজের প্রাণ বিপন্ন হলেও শিকারের পেছনে ধাওয়া করে, ভালো জুয়াড়ীও তেমনি জুয়ায় সব কিছু হারাতে পারে জেনেও জুয়ার দালাল ধরতে ছুটে যায়।
ক্যাথারিন ড্রেকের এমন বেপরোয়া স্পর্ধিত চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
ড্রেক বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কে জানে পরে হয়তো কথার সময় হবে না। অনেকের ধারণা আমি নাকি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। স্রেফ বাজে কথা বুঝলেন, পুলিশের কাছে অবশ্য আমাকে কিছু অল্পস্বল্প বলতে হয়েছে কিন্তু আপনার কাছে কিছু গোপন করব না। আপনাকে পাওয়া মানেই রাজত্বর সঙ্গে রাজকন্যা। সুতরাং আপনাকে নির্ভেজাল সত্যি কথাই আমাকে বলতে হবে। রুথকে বিয়ে করেছিলাম টাকার জন্যে। অবশ্য রুথও আমাকে বিয়ে করেছিল লুকোনবারী হবার জন্যে। কিন্তু ওর টাকা আছে বলে আমি নেপো হয়ে থাকবো আর তিনি কাউন্টের সঙ্গে বৌ বৌ খেলা করবেন। না না, আপনি ভাববেন না আমি অভিযোগ করছি। সে কাহিনী আমার শ্বশুরমশায়ের কাছে ভালোভাবে শুনবেন। অবশ্য একথা সত্যি রুথ-এর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে আমার পকেট গড়ের মাঠ ছিল। দেনায় অন্ধকার দেখছিলাম চারদিক আর ঠিক সেই সময় রুথ নিজে মরে আমাকে বাঁচিয়ে গেল।–যেন বড় রকমের একটা জুয়ার বাজী জিতল এমনভাবে হেসে উঠলো ড্রেক।
ক্যাথারিন বুঝি বিরক্ত হলো। কি বিশ্রী? স্ত্রীর মৃত্যুতে কেউ উন্মাদের মতো হো হো করে হেসে স্ফুর্তি দেখায়। অদ্ভুত!
তা লক্ষ্য করেই ড্রেক বলল, বুঝতে পারছি আমার হাসাটা উচিত হয়নি। এবার বলি আমার মনের কথা। সেই যে স্যাভয় হোটেলের বারান্দায় তোমার সঙ্গে ধাক্কা লাগল আমার; সেই ধাক্কার দোলায় এখনও পর্যন্ত হৃদয় দুলছে। বিশ্বাস কর আমার মনে হলো, তোমার মতো মেয়েকেই আমি খুঁজছি। লোকে দুর্নাম দেবে আমার নামে, হা, সত্যি অনেক কথাই তোমাকে হয়তো কোনোদিনই বলা সম্ভব হবে না এমন কুকাজও আমি করেছি। তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আবার ভাল হবার চেষ্টা করব। নতুন করে মানুষের মত মানুষ হতে চেষ্টা করব। সে সুযোগ কি আমায় দেবে না ক্যাথারিন? বলতে বলতে ক্যাথারিনের কাঁধে একটা হাত দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করল ড্রেক।
ক্যাথারিন খুব ঘাবড়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তবুও অদ্ভুত ব্যাপার ড্রেক-এর আকর্ষণ সে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারল না।
–আমার কথার উত্তর পেলাম না কিন্তু।
–আমি আমি জানি না।
ঠিক এমন সময় দূর থেকে কিংটন আর লেডি টাম্পলিনকে দেখে ক্যাথারিন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
-উনি এতক্ষণ লেডি টাম্পলিনের সঙ্গে প্রেম করছিলেন। কথাটা বলেই ড্রেক সোজা বেরিয়ে গেল।
-মাঝপথ থেকে লেডি টাম্পলিনকে ছেড়ে দিয়ে কিংটন এলো ক্যাথারিনের কাছে। দুজনেই আবার বসল।
কিছুদিন ধরেই আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে সুযোগ খুঁজছিলাম মিস গ্রে। ভালোই হল আপনাকে পেয়ে।
কিংটনও শুরু করল প্রেম নিবেদন, তবে খুব ভদ্র ও বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে অবশ্য একটা কথা বলি।
-বলুন।
–কি বলতে চাইছি আশাকরি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখি আমি মানে–ইতস্ততঃ করতে লাগল কিংটন। আবার অবশ্য এত তাড়াতাড়ি একথা আপনাকে বলা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কি জানেন, মিঃ আলডিন হয়তো যে কোনোদিন ফিরে যেতে পারেন। তাই বলছি। আমার এই চাকরী ছাড়া ব্যক্তিগত কিছু সম্মতি আছে বটে, অবশ্য খুব বেশি নয়। এই মুহূর্তে আপনার উত্তর না দিলেও হবে। হঠাৎ যদি আমাকে চলে যেতে হয় তাই আপনার মতামতের একটু আভাস পেলে ভালো হয়। আমার কথায় আপনার সম্মানহানি হলে আমায় ক্ষমা করবেন।
কিংটন-এর নম্র ও ভদ্র কথাবার্তা ক্যাথারিনকে আকৃষ্ট করল। তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলেন ক্যাথারিন। লজ্জা নম্র দৃষ্টি একবার কিংটনের মুখের ওপর বুলিয়েই মুখ নিচু করল সে।
কিংটন আলতো করে ক্যাথারিনের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল।
–আর একটা কথা। কোনোদিন কোনো প্রয়োজন হলে বলবেন। যদি কিছু করতে পারি।
সামান্য একটু চাপ দিয়ে একটা ঘামে ভেজা হাতের উত্তাপ নেবার চেষ্টা করল। পর মুহূর্তে হাতটাকে ক্যাথারিন-এর কোলের ওপর নামিয়ে দিয়ে পাশ থেকে উঠে চলে গেল। একবারও পেছনে তাকাল না।
ক্যাথারিন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ভাবতে লাগল ড্রেক আর কিংটন-এর মধ্যে কত তফাত। ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছল ক্যাথারিন। কিসের একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে সজাগ করে দিল। ক্যাথারিন-এর মনে হলো, সে যেন একা বসে নেই। হঠাৎ তার মনে হলো পাশেই যেন রুথ এসে দাঁড়িয়েছে। রুথ ক্যাথারিন কি যেন বলতে চাইছে তাকে। রুথ-এর এক ঢাল সোনালী চুলের ভেতর দিয়ে তার করুণ চোখ যেন কিসের এক আকুতিতে ভরে উঠেছে। এক নির্বাক ভাষা যেন ফুটে বেরোতে চাইল রুথ-এর ঠোঁটে।
ক্যাথারিন-এর এতে স্পষ্ট মনে হলো রুথ-এর উপস্থিতি যে সে স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল রুথ শূন্যে। ঘামে ভিজে উঠছে ক্যাথারিন। কিসের আকুতি রুথ-এর চোখে ঠোঁটে ক্যাথারিন দেখল? রুথ কি বলতে চাইছিল তাকে! কি!
.
২৪.
নারীর প্রতিহিংসা ক্যাথারিন-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিংটন পোয়ারোর খোঁজ করতে লাগল। নানান জায়গায় ঘুরে অবশেষে তাকে পাওয়া গেল জুয়ার ঘরে। পোয়ারো তখন মেতে উঠেছে জুয়া খেলায়। একটা জোড় সংখ্যার ওপর অল্প টাকার বাজি ধরে কাটা ঘোরালেন পোয়ারো। কাটা থামল বিজোড় সংখ্যায় এসে।
-ইস! নেহাতই বরাত খারাপ। পাশ থেকে কিংটন আপশোষ জানাল, আবার খেলবেন নাকি?
-না, এখন আর নয়।
–আপনার জুয়া খেলতে ভালো লাগে মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো চোখ তুললেন।
–টেবিলে জুয়া খেলায় ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ও আমার ভালো লাগে না। আমি জুয়া খেলি বুদ্ধিকে বাজি ধরে।
–আপনি কি এখন ব্যস্ত? আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
–স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। বলেন তো আমরা বাগানে গিয়ে বসি।
–তাই চলুন।
পোয়ারোকে নিয়ে কিংটন বাইরে বেরিয়ে এলো।
-জানেন রিভিয়ারা আমার খুব ভালো লাগে। যেতে যেতে কিংটন বলল, বার বছর আগে একবার এসেছিলাম, অবশ্য আহত সৈনিক হয়ে, আর ভর্তি ছিলাম লেডি টাম্পলিনের সৈনিক হাসপাতালে। সদ্য যুদ্ধক্ষেত্রের পরই রিভিয়ারাকে স্বর্গ বলে মনে হয়েছিল সেদিন।
-মনে হওয়াই স্বাভাবিক।–পোয়ারো সায় দিলেন।
–সে যেন কতদিন আগেকার কথা।–কিংটন যেন স্মৃতিচারণ করতে করতে হাঁটতে লাগলেন।
–আপনার বেশ কিছু কথা বলার আছে আমাকে বুঝতে পারছি।
–ঠিক বলেছেন তো! কেমন করে বুঝলেন?
–আপনার মুখই বলে দিচ্ছে সেকথা।
–আমার মুখ দেখে যে আমার মনের কথা বোঝা যায় এ ধারণা আমার ছিল না। আমি তাহলে জলের মতই স্বচ্ছ বলুন?
-ভুলে যাবেন না, মুখের ভাষা পড়াই আমার প্রধান কাজ।
–আচ্ছা। মিরেলি নামে কোনো পেশাদার নাচিয়েকে চেনেন নাকি মঁসিয়ে।
–মঁসিয়ে ক্যাথারিন-এর প্রেমিকার কথা বলছেন তো? হ্যাঁ চিনি।
–আপনি হয়তো এও জানেন আমার বস মিঃ আলডিন দুচক্ষে দেখতে পারেন না ওকে। মিরেলি আগে একবার চিঠি লিখে মিঃ আলডিনের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আজ একদম আমাদের হোটেলে এসে উপস্থিত। দেখা করবেই, নাছোড়বান্দা।
–বেশ তারপর?
–আর বলবেন না। এদিকে মিঃ আলডিন তো রেগে আগুন। আমাকে ভাগিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। আমার কেবলই মনে হলো মিরেলির যেন খুব প্রয়োজনীয় কিছু বলার আছে। কারণ মিরেলিও সেদিন ব্ল ট্রেনে ছিল, হয়তো কিছু দেখেও থাকতে পারে। আপনি কি বলেন মঁসিয়ে?
-মিরেলিকে প্রত্যাখ্যান করে মিঃ আলডিন বোকামি করেছিলেন।
–বলুন তো, বোকামি করেননি বস্?-উৎসাহিত হলো কিংটন। তারপর শুনুন। আমি মিঃ আলডিনের নিষেধ অমান্য করে ওয়েটিংরুমে মিরেলির সঙ্গে দেখা করে বললাম, উনি তো খুব ব্যস্ত; প্রয়োজনীয় কথা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। মিরেলি তাতে রাজী হলো না। আমার বিশ্বাস ওর কাছে কিছু খবর পাওয়া যাবেই।
-মিরেলির ঠিকানা জানেন?
–জানি।
–তাহলে চলুন। এখুনি আমরা তার সঙ্গে দেখা করব।
–কিন্তু মিঃ আলডিন? তাকে কি বলব?
–সে আমি বুঝব। বরং মিরেলিকে গিয়ে বলতে হবে মিঃ আলডিনই আমাদের পাঠিয়েছেন।
কিংটন তখনও ইতস্তত করতে লাগল। তবুও যেতেই হলো পোয়ারোর সঙ্গে কিংটনকে।
–মঁসিয়ে আলডিন-এর নির্দেশে আমরা আপনার কাছে এসেছি মাদমোয়াজেল।
–তিনি নিজে না এসে আপনাদের পাঠালেন কেন?
–তিনি নিজেই আসতেন কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় আমাদের পাঠালেন। উনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী। আর আমি তোর মেয়ের হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো।
-আপনিই মঁসিয়ে পোয়ারো। বেশ, তাহলে আর কোনো আপত্তি নেই। আপনারা বসুন, আমি সব কথাই বলব, আমাকে অপমান করা, ও ভেবেছে যে কেউ ওকে দেখতে পায়নি…
–কার কথা বলছেন মাদমোয়াজেল? বললেন পোয়ারো।
–কার কথা আবার। যে লম্পট নিজের বউকে খুন করেছে। হা ড্রেক ক্যাথারিন-এর কথাই বলছি। জানেন সে কি করেছে?
–না তো।
–তা জানবেন কেন? খুনীকে ছেড়ে বুনো হাঁসের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমি তাকে রেহাই দেব না।
–আপনি একটু স্থির হয়ে বসে সব কথা খুলে বলুন মাদমোয়াজেল। আমি বুঝতে পারছি মিঃ ক্যাথারিন আপনাকে অপমান করায় আপনি এত রেগে গেছেন যে, সব কথা গুছিয়ে বলতে পারছেন না। তাই আপনাকে একটু স্থির হয়ে বসতে বলছি।
পোয়ারোর কথায় তার অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ সে টেবিলের ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারল দেয়ালের গায়ে। ঝনঝন শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল পোর্সেলিনের সুন্দর ফুলদানিটা; এইভাবে আমিও ড্রেককে খান খান করব ভেঙে….
মিরেলির কথাবার্তা আর চালচলন মোটেই ভালো লাগছিল না কিংটন-এর। পোয়ারো কিন্তু খুশী। তার মনে হচ্ছিল যে, মিরেলির এই উত্তেজনাটা বেশিক্ষণ থাকাই ভাল, সবকথা বেরিয়ে আসবে। আর হলোও তাই।
একখানা চেয়ার টেনে পোয়ারোর মুখোমুখি বসে বলল, স্ত্রীকে খুন করার মতলব আগেই জানিয়েছিল আমাকে।
-বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। তাছাড়া আমি নিজে তাকে ক্যাথারিন-এর কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি।
–কখন?
–ট্রেনটা নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে।
–আপনি কি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একথা বলতে রাজী আছেন? মনে রাখবেন, আপনার একথার গুরুত্ব কতখানি। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ক্যাথারিনকে গ্রেপ্তার কুরআমি এদরি নয়। চা যেন এখানে খাবে না।
-হ্যাঁ, আমি এসব কথা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলতে রাজী আছি মিঃ পোয়ারো।
–তাহলে আর দেরি নয়। আপনি এখুনি আমার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চলুন।
–এখুনি।–মিরেলির কণ্ঠস্বরটা যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত।
-হ্যাঁ, এখুনি যেতে হবে। মিঃ ক্যাথারিন এখানে থাকতে থাকতেই তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তিনি ইংলণ্ডে চলে গেলে সহজে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
–বেশ, তাহলে চলুন আমি প্রস্তুত।
আধঘণ্টার মধ্যেই মিরেলি আর কিংটনকে নিয়ে পোয়ারো ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে গেলেন। কমিশনার অব পুলিশও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। ম্যাজিস্ট্রেট কিছুটা আশ্চর্য হলেন ওদের দেখে।
–কি ব্যাপার, মঁসিয়ে পোয়ারো? ইনি কে?
–ইনি হলেন সুবিখ্যাত নৃত্য শিল্পী মাদমোয়াজেল মিরেলি। ইনি আপনার কাছে এসেছেন মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যে।
ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিরেলিকে বললেন, আপনি বসুন মাদমোয়াজেল, আমি এখুনি আপনার বক্তব্য লিখে নেবার ব্যবস্থা করছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। এবার আপনার বক্তব্য বলুন, মাদমোয়াজেল।
মিরেলি, সুস্পষ্ট কণ্ঠে তার বক্তব্য শুরু করল। মিরেলির কথা শেষ হলে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনার কথাগুলো সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটা ব্যাপার, আপনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন এ ব্যাপারে।
সে কি। আমি কিভাবে জড়িত হচ্ছি?–আপনি বলেছেন, ড্রেক ক্যাথারিন যে তার স্ত্রীকে হত্যা করবে সেকথা আগেই আপনাকে বলেছিল। এই রকম একটা গুরুতর কথা শুনেও আপনি পুলিশকে জানাননি কেন?
-আমার মনে হয়েছিল যে কথাটা তামাশাছলে বলছে।
–তাই যদি হয় আপনিও তার সঙ্গে একই ট্রেনের যাত্রী হলেন কেন?
এই প্রশ্নে মিরেলি যেন বিচলিত হলো কিছুটা; সে বলল, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও আমি বলছি, আমি ড্রেককে ভালোবাসতাম। মানে খুবই। আমি তাই ওর সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম।
এই সময় পোয়ারো চোখ তুললেন, আপনি মিঃ ক্যাথারিন-এর ইচ্ছে অনুসারেই তার সঙ্গিনী হয়েছিলেন?
একটু ইতস্তত করে বলল, এধরণের কাজে আমি আমার ইচ্ছামতই চলি।
যদিও মিরেলির উত্তরটা সন্তোষজনক নয় তবুও পোয়ারো অন্য প্রশ্ন করলেন। মিঃ ক্যাথারিন যে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন, এটা আপনি কখন বুঝতে পারেন?
–নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার একটু আগে। ও যখন রুথ ক্যাথারিন-এর কামরা থেকে বেরিয়ে আসছিল, সেইসময় ওর মুখটা কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। ওর চোখের চাউনিও ছিল অস্বাভাবিক। ওর সেই সময়কার চেহারা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
-তারপর?
–তারপর ট্রেনটা ছেড়ে যেতেই আমি বুঝতে পারি যে, মাদাম ক্যাথারিন মারা গেছে। মানে, হত্যা করা হয়েছে।
কমিশনার বললেন, একথা জেনেও আপনি পুলিশকে বলেননি কেন?
–যাকে আমি এত ভালোবাসি তাকে কিনা বিপদে ফেলব? না না, এ আপনি কি বলছেন?
–কিন্তু এখন তো তাই চাইছেন?
–এখনকার কথা আলাদা।–মিরেলির দুচোখ রাগে জ্বলে উঠলো। ড্রেক আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাকে অপমান করেছে। এখন আর তার ওপরে আমার কোনো মায়াদয়া নেই।
পোয়ারো বললেন, আর একটা কথা মাদমোয়াজেল। মাদাম ক্যাথারিন যে নিহত হয়েছেন একথা আপনি জানলেন কি করে?
এবার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কথাটা যাত্রীদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। অনেকেই তখন ঐ কথা নিয়ে আলোচনা করছিল। তবে, কার কাছে শুনেছিলাম ঠিক স্মরণ করতে পারছি না।
পোয়ালরা বুঝতে পারলেন মিরেলি মিথ্যে কথা বলছে কিন্তু তিনি বললেন, তা না পারাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা, হার্ট অব ফায়ার সম্বন্ধে কিছু জানেন কি?
–হার্ট অব ফায়ার?
–হ্যাঁ, ইতিহাস প্রসিদ্ধ রুবী হার্ট অব ফায়ার। ওটা তখন মাদাম ক্যাথারিন-এর কাছেই ছিল।
না। ও সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। যাক এবার আমি চলি কি বলেন?–ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট পোয়ারোকে বললেন, আপনার কিছু জিজ্ঞাসা আছে কি?
-না। আমারও কিছু জিজ্ঞাসা নেই।
এরপর কমিশনারকে বললেন ম্যাজিস্ট্রেট, আপনার? মঁসিয়ে কক্স?
-না। আমারও কিছু জিজ্ঞাসা নেই।
–হ্যাঁ, এবার আপনি যেতে পারেন।
–ম্যাজিস্ট্রেট মিরেলিকে যাবার অনুমতি দিলেন। পোয়ারো বলেলেন, আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে কি?
না তার দরকার হবে না।
অফিস থেকে মিরেলি বেরিয়ে গেল।
-আমার সন্দেহ ও আদৌ সত্যি কথা বলল কিনা।–সন্দেহে ভুরু কোচকালেন কমিশনার।
–পুরোপুরি না হলেও বেশির ভাগই সত্যি।
পোয়ারো বললেন, ওর বক্তব্যের সমর্থনে অন্য প্রমাণও আছে। মাদমোয়াজেল ক্যাথারিনও আমকে বলেছেন। মিঃ ক্যাথারিনকে তিনি তার স্ত্রীর কামরায় দেখেছেন।
-কখন।
–নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার একটু আগে।
–তাহলে তো দেখছি ঘটনার গতি অন্যদিকে মোড় নিল।-কমিশনার বললেন, আমি ভেবেছিলাম কাউন্টকে এবার হাতে পেয়েছি। কিন্তু পিছলে গেল সে।
ম্যাজিস্ট্রেট বেশ চিন্তিত হলেন। আমাদের এবার খুব সাবধানে এগোতে হবে। মঁসিয়ে ক্যাথারিন অভিজাত বংশের ছেলে। স্ত্রী হত্যার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করলে লণ্ডনের খবরের কাগজে হৈ চৈ পড়ে যাবে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার আগে আমাদের খুব ভালো করে বিচার বিবেচনা করে চিন্তা করতে হবে। কারণ আমাদের ভুল হলে খুবই অপদস্থ হতে হবে সকলের কাছে।
–তা ঠিক। কমিশনার কক্স বললেন, কারণ আমরা এখনও রুবীগুলো সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারিনি। ও ব্যাপারে মিরেলি একেবারে মুখ খোলেনি।
–আর মিঃ ক্যাথারিন যদি রুবীগুলো নিয়েই থাকেন তো নিশ্চয়ই সেগুলোকে বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।চশমাটা খুলে ম্যাজিস্ট্রেট টেবিলের ওপর রাখলেন। কিন্তু ওরকম ইতিহাসখ্যাত রুবী খুব সহজে বিক্রি করাও সম্ভব নয়।
–এ সম্বন্ধে আমার একটা নিজস্ব অনুমান আছে। হাসলেন পোয়ারো, তার আগে বলতে পারেন মার্কুইস বলে কোনো লোককে চেনেন কিনা?
–মার্কুইস?–উত্তেজিত হলেন কমিশনার; মার্কুইস-এর কথা জিজ্ঞেস কছেন কেন? আপনার কি মনে হয় সে এর সঙ্গে জড়িত আছে?
-আমি শুধু জানতে চাই আপনি মার্কুইস সম্বন্ধে জানেন কি?
–বিশেষ কিছু জানি না। যতটুকু জানি সে নিজে একজন রীতিমত অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। নিজে হাতে বড় একটা কাজ করে না। তার আজ্ঞাবহদের দিয়েই কাজ সারে সে। এবং যথার্থই সৎ বংশজাত এইটুকুই জানি।
-সে কি একজন ফরাসী?
-হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না? কারণ মার্কুইস ফরাসী ইংরেজী এবং আরও কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, আর কখনও একজায়গায় থাকে না সে। এই তো গত বছরই সুইজারল্যাণ্ডে একটা মস্তবড় ডাকাতি মার্কুইস-এর কাজ বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু আপনি এসব জানতে চাইছেন কেন?
–এখন নয়।–গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। হয়তো কোনো খবর ইতিমধ্যেই আমার হোটেলে এসে থাকতে পারে।
–কিন্তু মার্কুইস যদি এ ব্যাপারে জড়িত থাকে….ম্যাজিস্ট্রেট বেশ নিরাশই হলেন।
–সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।-কমিশনার মাথা চুলকোতে লাগলেন।
–আমার কিন্তু বেশ সহজ বলেই মনে হচ্ছে।–পোয়ারো দৃষ্টি উজ্জ্বল করলেন। যদি কোনো দরকারী খবর পাই সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের জানিয়ে দেব। চলি।
পোয়ারো খুব চিন্তিত মুখে হোটেলে ফিরলেন। ভৃত্য জর্জ এসে তার হাতে একটা টেলিগ্রাম দিল। টেলিগ্রামখানা দুবার পড়ে সেটাকে পকেটে রেখে আরামকেদারায় বসতে বসতে বললেন, জর্জ, এক কাপ চকোলেট খাওয়াতে পার? বড় ক্লান্ত লাগছে।
যথা সময়ে জর্জ এক কাপ গরম চকোলেট নিয়ে এসে পোয়ারোর সামনে ধরল।
–আচ্ছা জর্জ, আমার এখানে কাজ করার আগে তুমি তো অনেক অভিজাত বংশে কাজ করেছ।-কাপটা হাতে নিতে নিতে বললেন পোয়ারো, মনে হয় ইংরেজদের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে তোমার বেশ ভাল ধারণাই আছে। তাই না?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।
–আচ্ছা, অপরাধী কি শুধু ছোটোজাত থেকেই আসে বলে তোমার ধারণা?
–আজ্ঞে না। অনেক বড় ঘরেও অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়। একটা ঘটনা বলি। এখন যিনি ডেভিজের ডিউক, তোর ছোট ছেলে নানা ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করেছিল। পুলিশকে পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছিল। শেষে ডিউক তাকে অষ্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেন আর সেখানেও আরেক নামে অপরাধ করে ধরা পড়ে সে। অথচ এমনিতে ছেলেটি কিন্তু অত্যন্ত চালাক এবং মিষ্টভাষী।
–হুঁম্।–বিড় বিড় করলে পোয়ারো। অপরাধের উত্তেজনাটিকে ভালোবাসে বোধ হয়। আবার ভাবতে অবাক লাগছে।
–কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তার। পকেট থেকে টেলিগ্রামখানা বের করে আবার পড়তে লাগলেন।
–আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, অপরাধ করার মধ্যে সবসময়ই একটা উত্তেজনা থাকে। সহজ সরল জীবনের চেয়ে অন্ধকারের জটিলতাই ওদের বেশি পছন্দ। এতেই ওদের উত্তেজনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে কি ভেবে পোয়ারো বললেন, জর্জ মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর মেয়ে জিয়াকে ফোন করেছিলে।
-আজ্ঞে হ্যাঁ। আজ রাতে ওদের সঙ্গে আপনার নৈশভোজের নেমন্তন্ন।
-আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তোমার কথা ভাবি।–স্নেহের চোখে তাকালেন পোয়ারো, ইচ্ছে করলেই তুমি কোনো লর্ড বা ডিউকের কাছে ভালো মাইনের কাজ করতে পারতে। কিন্তু সামান্য ডিটেকটিভের কাছে পড়ে আছ কেন?
–আপনাকে আমি সামান্য লোক মনে করি না স্যার। সারা ইউরোপে আপনার নাম কে জানে। আমি একথাও শুনেছি ইংলণ্ডের রাজাও আপনার প্রশংসা করে থাকেন। আপনি আশ্চর্য তদন্ত ধারায় জটিল কেসগুলো ফয়সালা করেন। জানতে ইচ্ছে হতো আপনার কর্মধারা তাই আপনার কাছে চাকরী করার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও আমি আপনাকে কোনো-রকম সাহায্য করতে পারছি না।
–এজন্য তোমার সংকোচ বোধ করবার কারণ নেই। তুমি শুধু আমার কাজকর্ম লক্ষ্য করে যেও তাহলেই ধীরে ধীরে তদন্তের কাজ শিখে একজন পাকা ডিটেকটিভ হয়ে উঠবে। কাঠবিড়াল যেমন একটা একটা করে বাদাম সংগ্রহ করে ভবিষ্যতে কাজে লাগায়। আমিও তেমনি টুকরো টুকরো খবর সংগ্রহ করে জমা করি এবং পরে সেগুলোকে একত্রে কাজে লাগাই। এ ব্যাপারে পশুজগতের কাজকর্ম আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সময় সময় আমি বিড়ালের মত ইঁদুরের গর্তের দিকে লক্ষ্য রাখি। আবার কখনও বা কুকুরের মতো গন্ধ খুঁকে এগিয়ে যাই শিকারের সন্ধানে। তবে আমি এই কেসে কাঠবিড়ালের পদ্ধতিই অনুসরণ করছি। এবং আমার আশা শীগগিরই আমি কৃতকার্য হব।
.
২৫.
কাঠবিড়ালের স্বভাব
সন্ধ্যার পরে বের হলেন পোয়ারো। মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর সঙ্গে তার ডিনার খাওয়ার কথা রাত আটটার সময়, মণ্টিকালোতে। তিনি একখানা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে গেলেন মার্গারেট ভিলায়, ক্যাথারিন-এর সঙ্গে একবার দেখা করতে চান তিনি। মার্গারেট ভিলায় হাজির হতেই লেনক্স-এর সঙ্গে দেখা হলো তার।
-মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন বাড়িতে আছেন কি?–জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।
–হ্যাঁ আছে। আপনি বসুন, উনি এখন নিচে নামবেন।
–না, এখন আর বসব না। আমি এসেছিলাম তাকে একটা খবর জানাবার জন্যে।
–খবরটা আমাকে বলতে আপত্তি আছে কি?
–না, আপত্তি থাকবে কেন। মিঃ ক্যাথারিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
–বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী সন্দেহে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আচ্ছা, আমি চলি। খবরটা মিস গ্রেকে জানিয়ে দেবেন।
ওদের কথা হচ্ছিল বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে। পোয়ারো ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই লেনক্স বলল, কিছু যদি মনে না করেন, আমি আপনার সঙ্গে দু চারটে কথা বলতে চাই।
তাহলে আসুন ঐ বেঞ্চটাতে বসা যাক।
–সেই ভালো। ওখানেই বসা যাক।
–কি বলতে চাইছি, আপনি কি ড্রেককে হত্যাকারী বলে মনে করেন?
–এ কথা জিজ্ঞেস করবার কোনো কারণ আছে কি?
–কারণ আছে বৈকি, মঁসিয়ে পোয়ারো। মাদাম ক্যাথারিন আর মঁসিয়ে ক্যাথারিন একই ট্রেনে সেদিন এসেছিলেন। ক্যাথারিন তাকে মাদামের কামরায় দেখতে পেয়েছিল। দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন মিঃ ক্যাথারিন এবং মাদামের মৃত্যুতে তিনি আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছেন–এই সব মিলিয়ে যে কোনো লোকেরই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনিই হত্যাকারী কিন্তু….
–কিন্তু কি মাদমোয়াজেল?
-কিন্তু তিনি যদি মাদাম ক্যাথারিন কে হত্যা করে তাহলে হার্ট অব ফায়ার রুবীটাও তিনি অপহরণ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন কি?
লেনক্স-এর এই রকম বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে পোয়ারো খুশী হলেন, কথাগুলো ঠিক বলেছেন মাদমোয়াজেল, কিন্তু মিঃ ক্যাথারিন-এর নির্দোষিতা প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই করণীয় নেই। ঘটনা পরম্পরা তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
-হা স্থূলভাবে বিচার করলে সেই রকমই মনে হয় বটে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, তিনি মাদামের কামরা থেকে বেরিয়ে এলে অন্য কেউ মাদামের কামরায় ঢুকে তাকে হত্যা করেছে এবং রুবীটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
-আপনি তাহলে বলতে চাইছেন ট্রেনের অন্য যাত্রী মাদামকে খুন করেছে?
-না। আমি বলতে চাইছি ট্রেনটা যখন নয়েন স্টেশনে এসে থেমেছিল, সেই সময় বাইরে থেকে কোনো লোক ট্রেনে উঠে মাদামের কামরায় ঢুকে তাকে হত্যা করেছে এবং রুবীটা নিয়ে সরে পড়েছে। আমার বিশ্বাস কয়েক মিনিটের মধ্যেই অর্থাৎ ট্রেনটা যখন নয়েন স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়েই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
আশ্চর্য আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা মাদমোয়াজেল। ঠিকই অন্ধকারে আমি হাতড়াচ্ছিলাম, আপনি আলো দেখালেন।–মাথা নাড়তে লাগলেন পোয়ারো, ইস, এই ব্যাপারটি আমি একদম লক্ষ্য করিনি আগে। আচ্ছা, চলি এখন।
লেনক্স-এর কাছে বিদায় নিয়ে পোয়ারো চলে গেলেন।
মন্টিকালোতে পৌঁছতে পোয়ারোর সামান্য দেরি হয়ে গেল। মঁসিয়ে পপোপুলাস ও তার মেয়ে জিয়া আগেই এসে গেছেন। পোয়ারো আসতেই তারা হাসি ঠাট্টা শুরু করলেন। পোয়ারোও তাদের রসিকতায় যোগ দিলেন।
ডিনার খেতে খেতে পপোপুলাস বললেন, আমি যে টিপষ্টা দিয়েছিলাম সেটা কাজে লাগিয়েছেন কি?
–না। এখনও ঠিকমত কাজে লাগাতে পারিনি। এ ব্যাপারে বুকির কাছে আরও কিছু খবর আশা করছি।
–ঘোড়াটা ভালো বলেই শুনেছি। বেশ নাম আছে ওর।
–দুর্নামও বলতে পারেন। অনেকে ওকে ব্ল্যাক হর্স বলে থাকেন।
ডিনার শেষ হলে তিনজনেই গেলেন জুয়ার ঘরে। সেখানে পোয়ারো জুয়া খেলায় মেতে উঠেছেন এই সুযোগে পপোপুলাস সরে পড়লেন। পোয়ারো যে লক্ষ্য করেছেন এটা তিনি বুঝতেই দিলেন না।
কিন্তু খেলার দিকে তার মন ছিল না। তার কেবলই মনে হতে লাগলো নিশ্চয়ই পপোপুলাস কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
এদিকে কয়েকটা দান খেলেই জিয়া দুহাজার ঐ জিতে ফেলল। সে বলল, আমি আর খেলব না।
–চমৎকার! পোয়ারো হেসে বললেন, একেই বলে বাপ কি বেটি। কখন শুরু করতে হয় আর কখন শেষ করতে হয় ভালোই জানেন দেখছি। কিন্তু মিঃ পপোপুলাস কোথায় গেলেন, তাকে দেখছি না তো।
হয়তো বাগানে গেছেন।
–তাহলে চলুন। আমরা বরং সেখানেই যাই, কেমন?
—তা মন্দ না। তাই চলুন।
–আচ্ছা, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি ক্লোকরুম থেকে ওভার কোট আর টুপিটা নিয়ে আসি।
–চলুন, আমাকেও সেখানে যেতে হবে ওভারকোট নিতে।
–আপনি বরং বাগানেতেই যান। আমি যাবার সময় আপনার ওভারকোটটা নিয়ে যাব। পোয়ারো এগিয়ে গেলেন।
পোয়ারো কিন্তু এগিয়ে গেলেন হলঘরে যেখানে অনেক নরনারীর ভীড়। সেই ভীড়ের মধ্যে মিশে পপোপুলাসকে খুঁজতেই দেখতে পেলেন যে কোণের দিকে একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে মিরেলির সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।
পোয়ারো একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনলেন। মিরেলি বলছিল, আমাকে আরও কিছুদিন সময় দিতে হবে। কয়েকটা দিন সময় পেলেই আমি টাকা যোগাড় করতে পারব। পপোপুলাস বললেন, না, আর আমি অপেক্ষা করব না।
–আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতেই হবে আপনাকে, আমি কথা দিচ্ছি, দশদিনের মধ্যেই কাজ শেষ করব।
পপোপুলাস কি যেন বলতে যাচ্ছিল তখনই পোয়ারো এসে হাজির হলেন সেখানে। তার সরল মুখ দেখে কেউ বুঝতেই পারল না যে উনি এতক্ষণ তাদের লক্ষ্য করেছেন।
–এই যে মিঃ পপোপুলাস। আপনাকেই খুঁজছিলাম। আমরা মানে আমি আর মিস জিয়া বাগানে গিয়ে বসি। ওখানেই আমাদের পাবেন।
তারপর পাশে মিরেলির দিকে নজর ফেরালেন, কি আশ্চর্য! আপনি এখানে? এতক্ষণ আপনাকে লক্ষ্যই করিনি। মনে কিছু করবেন না আমার এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য। চলি।
ওঁদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে পোয়ারো ক্লোক রুম থেকে দুটো ওভারকোট নিয়ে জিয়ার কাছে চলে এলেন।
–এই জন্যেই পুরুষগুলো মরে! হেসে চোখ তুলল জিয়া; মিছিমিছি কত খাটাতে গেলেন বলুন তো?
-লোকে তো তাই বলে। দেখুন মাদমোয়াজেল, ভালো খাওয়া ভালো থাকা আর মনের মতো সঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের কথা। যারা পয়সা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে এসব আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত রাখে, হয় তারা নেহাতই হতভাগ্য, আর নয়ত হৃদয়ের দহন সহ্য করবার মতো ক্ষমতা তাদের নেই।
পোয়ারোর রসিকতায় হেসে উঠল জিয়া।
-না না, কারো রোমান্স আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন না মাদমোয়াজেল।–একটু ঝুঁকে এলেন; আপনি যে রীতিমতো সুন্দরী।
সুন্দরী না ছাই! তেত্রিশ বছর চলছে জানেন? নেহাতই ছেলেমানুষ সেজে থাকি তাই বোঝা যায় না। বরং সেই সতেরো বছর আগে যখন দেখেছিলেন তখন আপনার কথা খাটতো।
-কিন্তু সত্যি আপনাকে দেখলে আরও কম মনে হয়। আমার তো মনে হয় আপনি একই রকম আছেন, শুধু একটু শুকনো। সামান্য নিষ্প্রভ আর গম্ভীর হয়েছেন।
-সতেরো বছর আগে, মানে ষোল বছর বয়সে কেমন বোকা আর সরল ছিলাম না?
–সত্যি আপনি খুব সরল ও বোকা ছিলেন। যে যা বলত, তাই বিশ্বাস করতেন। যার জন্যে অতবড় ব্যাপারটাই ঘটে গেল সেবার। অবশ্য আপনার বাবা আসল ভেতরের খবর কিছুই জানেন না।
-সে কি! বাবা জনেন না আপনি ঠিক জানেন?
–আমাকে আপনার বাবা যখন ব্যাপারটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, হারানো জিনিস ফেরত পেয়েছেন আর কিছু জানতে চাইবেন না–আপনার পক্ষে অপ্রীতিকর হবে। জানেন কেন বলেছিলাম এ কথা?
-না, কেন?–আড়ষ্ট হল জিয়া।
-সতেরো বছর আগের সেই কিশোরীটির মুখ চেয়ে আমার নিজের মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল।
–আপনি কি সব বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
–বুঝতে পারছেন না? অ্যান্টনিও পিরেজিও-আপনার বাবার দোকানের সেই যুবক কর্মচারীটিকে কি আপনার মনে পড়ছে না? যে আগে থেকেই চুরির মতলব নিয়ে ঢুকেছিল আর যার জন্য তাকে আপনার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হয়েছিল? যাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে সেই কিশোরীটি তার বাবার মহামূল্যবান রত্ন রাখার গুপ্তস্থান পর্যন্ত বলে দিয়েছিল? তাকে ভুলে গেলেন মাদমোয়াজেল? ওঃ সেদিনের সেই কিশোরীটির চেহারা আজও আমার চোখের ওপর ভাসছে। বেচারা সব বুঝতে পারছে অথচ কিছু বলতে পারছে না। কি বলবে! আর কে বিশ্বাস করবে। যাক, এরকুল পোয়ারোর তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিকে অনেক ধন্যবাদ যে কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই চোরাই মাল উদ্ধার করে আসল মালিককে দিতে পেরেছিলেন।
–কে আপনাকে অ্যান্টনিওর কথা বলেছিল?–রেগে লাল হলো জিয়া।
-কেউ না। আমার নির্ভুল অনুমান আর আপনার মুখের নির্বাক ভাষা। দেখুন মাদমোয়াজেল, যদি আপনাদের মুখের না বলা ভাষা আমি না পড়তে পারলাম তাহলে কিসের এরকুল পোয়ারো?
-তা এতদিন পরে একথা বলছেন কেন? বাবাকে বলবেন নাকি?
ছি ছি, এ কি বলা যায়?
তার বদলে আমার কাছে কিছু আশা করেন নিশ্চয়ই।
–আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী মাদমোয়াজেল।
–আপনাকে সাহায্য করব একথা ভাবলেন কি করে?
–ভাবিনি। শুধু আশা করেছিলাম মাত্র।
–যদি না করি তাহলে বাবাকে বলে দেবেন তো?
–মাদমোয়াজেল, আমি অনুরোধ করছি আপনার ঐ ধারণাটা বদলান। আমি ব্ল্যাকমেলার নই।–একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন পোয়ারো। যদি না চান তো না-ই করলেন। আমার করার কিছুই নেই।
–কিন্তু বাবা তো আপনাকে একটা আভাস দিয়েছেন।
–তার জন্যে পোয়ারো তার কাছে কৃতজ্ঞ।
-কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে…. আচ্ছা-না, আপনাকে বলব, নিশ্চয়ই বলব। সেদিন আপনি ঠিকই ধরেছেন কেন আমরা নিস-এ এসেছি। রুবীগুলো এখানেই হস্তান্তর করা হয়েছে। ওগুলো এখন বাবার কাছেই আছে। আর কে এই মক্কেল সে তো বাবা ঘোড়ার নামে টিপস্ দিয়ে আভাস দিয়েছে।
-মার্কুইস।
–হ্যাঁ, মার্কুইস।
–আচ্ছা মাদমোয়াজেল, মাকুইসকে আপনি কি কখনও দেখেছেন?
–একবার মাত্র। তাও চাবি লাগবার গর্ত দিয়ে। মুখে প্ল্যাস্টিক-এর হুবহু মানুষের অনুকরণে একটা মুখোশ ছিল। মাথার চুল ধবধবে সাদা।
–যুবক না বয়োজ্যেষ্ঠ?
–গলার স্বর এবং চলা দেখে বয়স্ক বলে মনে হয় না।
–আবার তার গলার স্বর শুনলে চিনতে পারবেন?
–হয়তো পারব। কিন্তু এর চেয়েও প্রয়োজনীয় কথা আপনাকে বলছি।
–বলুন। সজাগ হলেন পোয়ারো।
–আমি আপনাকে আগেই বলেছি রুবীগুলো এই নিস শহরেই হাত বদল হয়েছে। এবং যে এটা করেছে সে….
-সে একজন….
–সে একজন নারী।
৬. আবার ব্লু ট্রেনে
৩১. আবার ব্লু ট্রেনে
ভয়াবহ গতিতে ছুটে চলেছে ব্লু ট্রেন। যার আর একম নাম– কোটিপতি ট্রেন। শুধু কোটিপতিরাই এই ট্রেনে ভ্রমণ করার খরচ পোষাতে পারেন। অনেকক্ষণ ধরে অনেক বড় একটা বাঁক শেষ করে আবার ভূমধ্যসাগরের কোণ ঘেঁসে হাওয়ার বেগে ছুটে চলল। কোটিপতিদের ট্রেন-ব্লু ট্রেন। ভ্যান আলডিন, কিংটন আর পোয়ারো কোনো কথা না বলে যে যার জানালা দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিলেন।
ভ্যান আলডিন ও কিংটন-এর কামরা দুটোর মাঝখানে পরস্পর সংযোগকারী দরজা আছে। ঠিক যেমন আসল ঘটনার দিন রুথের কামরা আর তার পরিচারিকার কামরা দুটোর মাঝখানে ছিল। পোয়ারোর নিজের কামরাটা ছিল একটু পেছন দিকে।
এবারের ব্লু ট্রেনে ভ্রমণ ভ্যান আলডিন-এর মনে এক অতি বেদনাদায়ক স্মৃতি বয়ে যাচ্ছিল। তাঁর বারবার মনে পড়ছিল যে তার প্রাণাধিক রুথ-এর এই ট্রেনের কামরায় শেষ দেখা করুণ মুখখানা। পোয়ারো আর কিংটন কখনও নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছিলেন। দুজনেই মিঃ আলডিন-এর মনোভাব বুঝে তাকে বিরক্ত করেননি।
তারপর ট্রেন যথাসময়ে গেয়ার দ্য নয়েন-এ পৌঁছানো মাত্রই বিদ্যুৎবেগে কাজে লেগে গেলেন পোয়ারো। ভ্যান আলডিন বুঝলেন পোয়ারোর ট্রেনে করে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্যই হলো সেদিনের সেই ঘটনার ছবিটা তুলে ধরা। অবশ্য পোয়ারো নিজেই প্রত্যেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে লাগলেন। প্রথমেই রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকার ভূমিকায়। ঠিক যেন রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকা নিজের কামরায় তাড়াতাড়ি ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর রুথ ক্যাথারিন-এর ভূমিকায়। স্বামীকে অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রেনে নিজের কামরায় দেখে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠল। তারপর স্বামী ড্রেক ক্যাথারিন–এর ভূমিকায় ড্রেক ক্যাথারিন যেন হঠাৎই আবিষ্কার করলেন যে তার স্ত্রী রুথও ঐ ট্রেনে যাচ্ছে। তারপর পোয়ারো দ্বিতীয় কামরাটায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখার যতরকমের সম্ভাব্য জায়গা থাকতে পারে সেগুলোও যাচিয়ে দেখলেন।
ট্রেন প্যারীতে আসতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শক্ত করে ভ্যান আলডিনের হাতটা চেপে ধরলেন। একটা জিনিস ভেবে দেখিনি আগে, আমাদের প্যারীতে নেমে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি নামুন। নামুন! কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে স্যুটকেসগুলো নিয়ে ট্রেন থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। হতভম্ব আলডিন ও কিংটন নেমে পড়লেন। পোয়ারোর এই অদ্ভুত কাজকর্ম তার ক্ষমতা সম্বন্ধে আলডিনকে আরও বেশি। নিরাশ করতে লাগল। রেলিঙের ধারে এসে ওদের থামতে হলো টিকিট কালেক্টরের কাছে। টিকিট খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, ট্রেনের কণ্ডাক্টরের কাছেই রয়ে গেছে ওদের তিনজনের টিকিট। নামার সময় কেউই খেয়াল করেননি। পোয়ারো অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু রাশভারী টিকিট কালেক্টরের মন তাতে বিগলিত হলো না। পোয়ারো কিন্তু নিরাশ না হয়ে তখনও বুঝিয়ে চললেন….
কথা না বাড়িয়ে চলুন এখান থেকে চলে যাই। আলডিন খুবই বিরক্ত হলেন। বুঝতে পারছি আপনারও তাড়া আছে। ক্যালে থেকে হিসেব করে যা ভাড়া হয় চুকিয়ে দিন, তারপর চলুন আপনার যা করণীয় আছে করবেন।
পোয়ারো খুব সরল ভাবে বললেন, সত্যি আমি বোকা। আমার দেখছি দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চলুন, আমরা ট্রেনেই ফিরে যাই। আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। মনে হয় ভাগ্য ভালো, ট্রেনটা পেয়ে যাব আমরা। চলুন, চলুন।
আলডিন ও পোয়ারো ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিল। সবশেষে কিংটন কোনোমতে চলন্ত ট্রেনে লাফ মেরে উঠলো।
কণ্ডাক্টর খুব যত্ন করে আবার লাগেজগুলো বয়ে নিয়ে ওদের কামরায় রেখে দিল। আলডিন মুখে কিছু না বললে বিরক্তস্বরে কিংটনকে বললেন, লোকটা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। ঘটনার জটিলতায় লোকটা নিজের আস্থা তো হারিয়েছেই। সেই সঙ্গে নিজের ধৈৰ্য্যও হারিয়ে ফেলেছে। লোকটার বুদ্ধি ছিল। চিন্তাশক্তি ছিল কিন্তু হলে হবে কি? যে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এই মুহূর্তে বলছে এক পরমুহূর্তে করছে আরেক। এমন লোকের দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে আসা কি করে সম্ভব?
কয়েক মুহূর্তের পরে হতাশ মনে পোয়ারো এসে আলডিন ও কিংটনের কাছে খুবই দুর্দশাগ্রস্তের মত অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা চাইলেন। মিঃ আলডিন মনের রাগ আর মুখে প্রকাশ করলেন না। ট্রেনেই তারা ডিনার খেলেন। ডিনার খাওয়ার পর পোয়ারো বললেন, এবার আমরা তিনজনেই মিঃ আলডিন-এর কামরায় গিয়ে বসব, পোয়রোর কথায় দুজনেই অবাক হলেন।
–আপনি আমাদের কাছে কিছু গোপন করছেন মঁসিয়ে।
–চোখ কুঁচকে মিঃ আলডিন বললেন।
–আমি? কি লাভ বলুন।
আলডিন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। কণ্ডাক্টর রাতে তার শোবার বিছানা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দিলেন। নিঃশব্দে তিনজনে বসে ব্লু ট্রেনের দোলানি খেতে লাগলেন।
হঠাৎ পোয়ারো কেমন যেন অস্থির আর চঞ্চল হলেন।
-মেজর কিংটন, আপনার কামরার দরজাটা বন্ধ আছে তো? মানে আমি বলছি কামরা থেকে করিডরে যাবার দরজাটা।
–হ্যাঁ, আমি এখনি বন্ধ করে এসেছি।
–ঠিক বন্ধ করেছেন তো?
–যদি বলেন তো আবার একবার নিশ্চিত হয়ে আসি।
–না না, আপনাকে যেতে হবে না। আমি দেখে আসছি।….
–পোয়ারো গিয়ে আবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, বন্ধই আছে দরজাটা।–বয়স হয়েছে তো। তাই অকারণে ব্যস্ত হই। এবার দু-কামরার মাঝের দরজাটা বন্ধ করে পোয়ারো ডান দিকের কোণে গিয়ে বসলেন।
সময় কেটে যাচ্ছে। তিনজনেই ক্ৰমে ঢুলতে শুরু করলেন। মিঃ আলডিন ও কিংটন ভেবে বেশি বিরক্ত হচ্ছিলেন যে প্রত্যেকের আলাদা কামরা রিজার্ভ থাকলেও পোয়ারো কি করছেন। পোয়ারো থেকে থেকে ঘড়ি দেখতে লাগলেন। মাঝে একবার গিয়ে সংযোগকারী দরজাটা খুলে পাসের ঘরটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। আবার এসে নিজের জায়গায় বসলেন।
–কি ব্যাপার বলুন তো? ফিসফিস করল কিংটন। আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কিছু ঘটবে আসা করছেন নাকি?
-হ্যাঁ, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি আমি… যেন টালির ছাদে ওত পেতে শিকারের আসায় বসে থাকা ধূর্ত বেড়াল। সামান্যতম শব্দও আমাকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
-ওঃ জীবনে এতবার ট্রেনে চাপলাম কিন্তু এবারের মতো জঘন্য ট্রেন যাত্রা-হাই তুলে বিড়বিড় করতে লাগলেন কিংটন। আমার মনে হয় মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি জানেন কি হবে।
তারপর কিংটন একটু আরাম করে বসে ঘুমোতে লাগল। আলডিনও এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন। ঝুঁকে পড়ে আলডিন-এর কাধ ধরে মৃদু আঁকানি দিয়ে বললেন, আপনি তো দেখছি ঘুমে বিভোর কিন্তু এদিকে যে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই
ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন আলডিন। নয়েনস্? হে ভগবান।তার চোখ মুখ কেমন যেন উদভ্রান্ত আর ফ্যাকাশে মনে হলো। তাহলে তো সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, যখন আমার রুথকে মেরে ফেলা হয়। তার করুণ উদভ্রান্ত দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। ঠোঁট দুটো সামান্য ফঁক, মন খুঁজে বেড়াতে লাগলো এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া হৃদয়ের ধনকে। যে তার জীবনের সবটুকু আনন্দ নিয়ে চলে গেছে।
মাঝে মাঝে ব্রেকের একটানা লম্বা আওয়াজ করে ট্রেনের গতি কমতে লাগল। তারপর ট্রেন নয়েন স্টেশনে ঢুকল। আলডিন জানলাগুলো খুলে ঝুঁকে বাইরের দিকটা দেখলেন।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নতুন সূত্র যদি নির্ভুল হয় অর্থাৎ ড্রেককে যদি বাদ দিই, তাহলে বলতে হয় এইখানেই সেই লোকটি ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছিল।
-না। কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। গম্ভীর মুখে তাকালেন পোয়ারো।
–সেকি। আপনার নুতন সূত্র অনুযায়ী তো-।
-না মঁসিয়ে আলডিন, আমি আবার বলছি, কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। ট্রেন থেকে যে নেমেছিল সে লোক নয়। সে একজন স্ত্রীলোক।
চমকে তাকালেন কিংটন।
–একজন স্ত্রীলোক! চেঁচিয়ে উঠলেন আলডিন।
-হ্যাঁ, একজন স্ত্রীলোক। আপনার হয়তো মনে থাকতে নাও পারে মঁসিয়ে, কিন্তু মিস গ্রে তাঁর বক্তব্যে টুপি ও ওভার কোট পরা একটি যুবককে প্ল্যাটফর্মে পায়চারী করতে দেখার কথা বলেছিলেন।
সাধারণতঃ অনেকক্ষণ একভাবে ট্রেনে বসে থাকার পর কোনো স্টেশন এলে আমরা যেমন প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করে হাত পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিই। সেই রকমই ভান করেছিল সে, যেটা মিস গ্রে ধরতে না পেরে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেই যুবকটি একজন স্ত্রীলোক।
-কিন্তু কে সেই স্ত্রীলোক? আলডিন বলল।
–তার নাম?–পোয়ারো গলার স্বরে অদ্ভুত একটা আস্থা নিয়ে বললেন, বহু বছর যাবৎ সবাই তাকে যে নামে চিনত তা হলো– কি টি কিড়। কিন্তু মিঃ আলডিন, আপনি তাকে চিনতেন অন্য নামে–অ্যাজ ম্যাসন।
–ম্প্রিঙের মতো লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল কিংটন। কি বললেন?
সবেগে কিংটন-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন পোয়ারো। কি বললেন? ওঃ হোঃ! ভুলেই গিয়েছিলাম। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে এগিয়ে ধরলেন কিংটন-এর দিকে; মঁসিয়ে, দয়া করে আপনারই সিগারেট কেস থেকে আপনাকেই একটি সিগারেট অফার করার অনুমতি দিন আমাকে। প্যারীর যে বাঁকটাতে আপনি ট্রেনে উঠেছিলেন সেইখানে অসাবধানবশতঃ এটা আপনার পকেট থেকে পড়ে যায়।
কিংটন বোকার মতো তাকিয়েই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠলেন পোয়ারো।
-না, যাবার চেষ্টা করবেন না। পাশের কামরার দরজা খোেলাই আছে। এবং আপনাকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার সময় করিডরে যাবার দরজাটা আমি নিজে খুলে দিয়ে এসেছি? এখন সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের পুলিশ বন্ধুরা। হাঁ, ফরাসী পুলিশের আপনাকে বিশেষ জরুরী প্রয়োজন আছে। মঁসিয়ে কিংটন–কিংটন? নাঃ তার চেয়ে বরং বলি মঁসিয়ে লে মার্কুইস।
.
৩২.
পোয়ারোর বিশ্লেষণ নেগ্রেসকোতে মিঃ আলডিন-এর নিজস্ব স্যুইটে সেদিন এরকুল পোয়ারোর লাঞ্চের নেমন্তন্ন ছিল। মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে খাচ্ছিলেন আলডিন ও পোয়ারো। খাওয়া শেষ করে পোয়ারো তার নিজের ছোট একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের কড়িকাঠের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে কি ভাবলেন তারপর তাকালেন আলডিনের দিকে।
ঘটনার বিশ্লেষণ শুনতে চান? হ্যাঁ, বলব।–একটা টান দিলেন সিগারেটে। একটা জিনিসই আমাকে ধাঁধায় ফেলেছিল। জানেন কি সেটা? সেটা হলো মৃতের মুখ। বিকৃত করা মুখ। খুনের ব্যাপারে মৃতের পরিচিতের জন্যে এই রকম করে খুনীরা। বিকৃত করা মুখটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল–সত্যিই কি উনি মিসেস ক্যাথারিন। কিন্তু একমাত্র গ্রে-র নির্ভুল সনাক্তকরণের জন্যে আমার আর চিন্তা ছিল না।
–পরিচারিকাকে কখন থেকে আপনার সন্দেহ হলো?
–প্রথম থেকে নয়। ট্রেনের কামরায় পাওয়া সিগারেট কেসটা ও বলে, ওটা নাকি মিসেস ক্যাথারিন তার স্বামীকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রথম থেকেই গরমিল। আর সেই গরমিল যখন উভয়কেই বৈষম্যের চরমে উপস্থিত করেছিল, ঠিক সেই সময় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে উপহার দেওয়াটা যথার্থই অবিশ্বাস্য। এটাই আমাকে আজ ম্যাসন-এর সততা সম্বন্ধে সন্ধিগ্ধ করে তোলে। অ্যাজ ম্যাসন মাত্র দুমাস কাজে লেগেছে, আর এই দুমাসের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ বই ভালো হয়নি। মিঃ ড্রেক প্রায়ই মিরেলির কাছে থাকতেন। আর মিসেস ক্যাথারিনও রিভিয়ারায় কাউন্ট-এর সঙ্গে মিলতে যেতেন। এমন পরিস্থিতিতে পরিচারিকার উপহার দেওয়ার কথাটা মেনে নিই কেমন করে? তবুও এত কাণ্ডের পরেও ঠিক জুত করে অ্যাজ ম্যাসন-এর সম্বন্ধে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ সে প্যারীতে নেমে গিয়েছিল, আর তার চেয়েও বড় কথা সে প্যারীতে নামার পরেও অনেকেই মিসেস ক্যাথারিনকে জীবিত দেখেছেন, কিন্তু–পোয়ারো একটু ঝুঁকে এসে মিঃ আলডিন-এর সামনে একটা আঙুল নাড়লেন নিজেকে দেখিয়ে; মঁসিয়ে আলডিন, আমার অসীম বিশ্বাস আর আস্থা আছে এই ছোটোখাটো লোকটার ওপরে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে অ্যাজ ম্যাসন আদৌ যে প্যারীতে নেমেছিল সেটা কেমন করে জেনেছি? অবশ্য আপনার সেক্রেটারী বলেছে। সে মিস ম্যাসনকে প্যারীতে দেখেছে। কিংটন তখন সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি। তার সঙ্গে এ কেসের কোনো সম্পর্কই ছিল না। এবং কণ্ডাক্টরের কথায় আমার মনে অসম্ভব আর প্রায় আজগুবি একটা চিন্তা উঁকি দিল। মনে মনে ভাবলাম। আমার অসম্ভব চিন্তায় বলছে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে দেখতে যাওয়ার কথাটা একটু ধোঁয়াটে মতন।
পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করলেন পোয়ারো। কিংটন-এর অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীর রীজ হোটেলে দেখতে পাওয়া নিয়েই কাজ শুরু করি। যদিও ওটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু খুব সতর্কভাবে ঘটনাকে খুঁটিয়ে দেখার পর দুটো জিনিস আমার নজরে আসে। প্রথমত:-একটা আশ্চর্য রকম যোগাযোগ বেরিয়ে পড়ল–কিংটন নিজেও ঠিক দুমাস হলো আপনার কাজ করছে। দ্বিতীয়ত :- কিংটন-এরও প্রথম অক্ষর K মুখটা রুমাল দিয়ে মুছলেন। যদি ধরা যায়, মানে নেহাতই কল্পনা করি যে সিগারেট কেসটা তার এবং তারা দুজনে মিলে যদি এ কাজ করে। তাহলে অ্যাজ ম্যাসনকে সিগারেট কেসটা দেখানো মাত্রই সে এটা কিংটন-এর বলে চিনতে পেরেছিল। সেক্ষেত্রে মিস ম্যাসন-এর ঐ ধরনের মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। মিস ম্যাসন এমনই একটা উত্তর দেয়, যেটা মিঃ ক্যাথারিনকে আরও বেশি অপরাধের জালে জড়িয়ে ফেলে। অবশ্য আসল উদ্দেশ্য এটা ছিল না, কাউন্টকে ফসানোর জন্যেই সে বলে। কিন্তু কাউন্ট যদি খুনের সময় অন্য কোথাও ছিল বলে প্রমাণ করেন, সেইজন্যই মিস ম্যাসন নিশ্চিন্ত হজয়ে কাউন্ট-এর সম্বন্ধে কিছু বলেনি। এবার আমি একটা ঘটনা বলি যা কিছুদিন আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করবেন। আমি ম্যাসনকে যতবার বলি, যে লোকটাকে সে ট্রেনের কামরায় দেখেছিল সে কাউন্ট নয়, সে ড্রেক ক্যাথারিন, সে সময় তাকে বেশ বিচলিত হতে দেখি। কিন্তু আমি আপনার ওখান থেকে হোটেলে ফিরে আসার একটু পরেই আপনি, আমায় ফোন করে জানান যে অ্যাজ ম্যাসন জানিয়েছে যে সে ভেবে দেখল, ঐ লোকটা ড্রেক ক্যাথারিনই, কাউন্ট নয়। আমি এটাই আশা করেছিলাম। তার মানে আপনার ওখান থেকে ফিরে অ্যাজ ম্যাসন কারো সঙ্গে পরামর্শ করে তারপর তার মতামত আপনাকে জানায়। এখন প্রশ্ন হল কে সেই পরামর্শদাতা? মেজর রিচার্ড কিংটন আর একটা তুচ্ছ ঘটনা–কথায় কথায় কিংটন একবার বলেছিল, ইয়র্কশায়ারে যে বাড়িতে সে থাকত, সে বাড়িতে নাকি একবার রত্ন চুরির ঘটনা ঘটে। দুটো চুরির ঘটনার এই মিল হয়তো আকস্মিক–আবার হয়তো উভয় ঘটনাই গ্রন্থিবদ্ধ–একটা ক্ষীণতর যোগসূত্র হয়তো বা আছে। অন্ততঃ আমার তা-ই মনে হচ্ছিল। জানেন তো ডিটেকটিভকে প্রথমে করতে হয় অনুমান। পরে সেই অনুমানকে কাজে লাগাতে হয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তির সাহায্যে।
–কিন্তু একটা ব্যাপার যে আমি বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো? প্যারীতে ট্রেনের ভেতরে ঐ লোকটা তাহলে কে ছিল? ড্রেক ক্যাথারিন না কাউন্ট?
–আঃ হা। সমস্ত ব্যাপারটা ওইখানেই একটা বিরাট ধোঁকা দেওয়া হয়েছে আসলে কোনো লোকই ছিল না। বুঝতে পারছেন না চালাকিটা কোথায়? আচ্ছা, ট্রেনের সেই লোকটার কথা আমরা কার বক্তব্য থেকে জানতে পারছি? শুধুমাত্র অ্যাজ ম্যাসনই একথা বলেছে। সেটা আমরা বিশ্বাস করছি কেন? কিংটন বলেছে তার সঙ্গে অ্যাজ ম্যাসন-এর প্যারীতে দেখা হয়েছে। তাহলে দেখুন আমরা কিংটন-এর কথায় বিশ্বাস করেছি যে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তো?
–কেন? পরিচারিকাকে নামিয়ে দেবার কথা রুথ নিজেই কণ্ডাক্টরকে বলেছে।
–ব্যস্ত হবেন না। আসছি। ও ব্যাপারেই আসছি। হ্যাঁ, মিসেস ক্যাথারিন-এর নিজের উক্তি বলেই আমরা ধরে নিয়েছি, কিন্তু এটা মিসেস ক্যাথারিন-এর উক্তি নয়।
তার মানে?
তার মানে মঁসিয়ে, মৃত কখনও কথা বলে না। কণ্ডাক্টরকে যখন একথা বলা হয়, তার আগেই মিসেস ক্যাথারিন-এর মৃত্যু হয়েছে। এটা মিসেস ক্যাথারিন বলেনি, বলেছে পরিচারিকা। এবং দুটো বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে।
–আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আঁসিয়ে। তাহলে কি কণ্ডাক্টর মিথ্যে বলেছে?
-না না, কখনও না। মিথ্যে সে কখনও বলেনি। যা সত্যি তাই সে বলেছে। কিন্তু যে রুথ তার পরিচারিকা নামিয়ে দেবার কথা বলেছে, সে আপনার মেয়ে রুথ নয়। সে সেজেছিল মাত্র।
হতভম্ব আলডিন-এর মুখে কোনো কথা নেই।
–মঁসিয়ে আলডিন, মনে রাখবেন গেয়ার দ্য নয়েনস পৌঁছবার আগেই আপনার মেয়েকে হত্যা করা হয়। এটা হলো অ্যাজ ম্যাসন-এর কাজ, সে তার কী নিহত হবার পর তার গা থেকে ফারের কোট এবং মাথার টুপিটা খোলে। নিজে সেগুলো পরে নিয়ে তারই ছদ্মবেশে কামরা থেকে হাত বাড়িয়ে ডিনারের বাক্স কেনে এবং সেই কণ্ডাক্টরকে একথা বলে।
–অসম্ভব। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন রুথ-এর ছদ্মবেশে অ্যাজ ম্যাসনই একাজগুলো করেছে? আর কণ্ডাক্টর তাকে চিনতে পারল না।
-না মঁসিয়ে আলডিন, না। কিছুই অসম্ভব নয়। ক্ষণিকের দেখায় একজন আরেকজনের মুখ যত না মনে রাখে, তার চেয়েও বেশি মনে রাখে তার সাজপোশাককে। আপনার মেয়ে এবং অ্যাজ ম্যাসন দুজনেই মাথায় মাথায়। তার ওপর সেই একই ফারের কোট তার গায়ে, মাথায় সেই একই টুপি এবং সর্বোপরি রুথ ক্যাথারিন-এর মাথা থেকে কেটে নেওয়া কয়েক গোছা সোনালী চুল। নিজের মাথার দু-পাশের চুলের সঙ্গে বিনুনি করে কান পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে মাথার টুপিটাকে চোখ পর্যন্ত টেনে দেয়। ও সহজেই কণ্ডাক্টরের চোখকে ফাঁকি দেয়। কণ্ডাক্টরের কাজ যাত্রীরা যখন ট্রেনে ওঠে তখন টিকিটগুলো সংগ্রহ করে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে যাত্রীদের স্ব স্ব কামরা বলে দেওয়া। কাজেই কণ্ডাক্টরের পক্ষে সম্ভব নয় প্রতিটি যাত্রীর মুখ চিনে রাখা। শুধু মাত্র রাত্রে যাত্রীদের কামরায় গিয়ে তাদের বিছানাগুলো ঠিক করে বিছিয়ে দেওয়া। এখানেও সে তাই করেছে। একথা ঠিক অ্যাজ ম্যাসনই টিকিটগুলো তার হাতে জমা দেয়। কিন্তু টিকিট সংগ্রহ করার সময় সে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে কামরা বলে দিতে ব্যস্ত ছিল। একটি স্ত্রী লোকের হাত থেকে টিকিট নিচ্ছে এটাই লক্ষ্য করেছে শুধু। কত্রী বা পরিচারিকাকে চিনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। আর এও মনে রাখবেন, অ্যাজ ম্যাসন বা কিটি কিন্তু একজন নামকরা তুখোড় অভিনেত্রী। মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেহারা বা কণ্ঠস্বর বদলে দিতে সে অদ্বিতীয়। তার পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একটা বিপদের আশঙ্কা ছিল, যেটা হলো পরদিন সকালে রুথ ক্যাথারিনকে ঘুম ভাঙাতে এসে কণ্ডাক্টর হয়তো চিনে ফেলবে যে গতরাতে বিছানা পাতবার সময় সে যার সঙ্গে কথা বলেছে সে এই নিহত মহিলাটি নয়। এই কারণেই রুথ-এর মুখ বিকৃত করেছিল। অত্যন্ত মূল্যবান একটা সূত্র কণ্ডাক্টরের চোখের সামনেই ছিল। কিন্তু শুধু অসাধারণ দূরদর্শিতার জন্যে অ্যাজ ম্যাসন তার চোখে ধুলো দিয়েছে। এছাড়া আরও একটা বিপদের আশঙ্কা করেছিল মিস ম্যাসন, সেটা প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার পর হয়তো ক্যাথারিন গ্রে এই কামরায় মিস ক্যাথারিন কাছে আসতে পারে। তাই সে মিস গ্রে কে দেখিয়ে ডিনার বাক্সটা কেনে এবং নিজের কামরা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ মিস গ্রেকে হাবভাবে বোঝাল সে যেন তার কামরায় না আসেন।
–কিন্তু রুথকে কে হত্যা করল আর কখন?
–প্রথমেই মনে রাখতে হবে এই অপরাধ দুজনে মিলে করেছে কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন। কিংটন সেদিন আপনারই কাজে প্যারী যায় এবং প্যারীর কাছে যে লুপ অর্থাৎ বড় বাঁকটা আছে, যেখানে ট্রেনের গতি মন্থর হয় সেখানে কোনো একটা জায়গায় কিংটন ট্রেনে ওঠে। মিসেস ক্যাথারিন তাকে দেখে খুবই অবাক হয়। তারপর কিংটন হয়তো বেশ কিছু দেখিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরে মিসেস ক্যাথারিন-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় এবং যেই সে সেদিকে দৃষ্টি ফেরায়, অমনি মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে সরু মজবুত সিল্ক কর্ডটা তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়। বাকি কাজটা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। কামরার দরজা বন্ধই ছিল। এরপর কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন কাজে লেগে যায়। প্রথমে মিস ক্যাথারিন-এর ওপরের জামাগুলো খুলে নেয়। তারপর মৃত দেহটাকে একটা কম্বলের মধ্যে জড়িয়ে পাশের সংযোগকারী কামরায় সুটকেস ও ব্যাগের সঙ্গে সিটের ওপর রেখে দেয়। এবার কিংটন জুয়েলস কেসটা নিয়ে নেমে যায়। বলা বাহুল্য ট্রেনটা তখনও বাঁকের মধ্যে থাকায় গতি আস্তেই ছিল। কিংটন দেখল বারো ঘন্টার আগে খুনের ব্যাপার জানাজানি হবার কোনো ভয় নেই, তারপর আজ ম্যাসন-এর মিসেস ক্যাথারিন সেজে কণ্ডাক্টরকে এক গল্প ফাদার ব্যাপার তো আছেই। সুতরাং অপরাধের সময় নিজের উপস্থিতিকে অন্য কোথাও প্রমাণ করতে বেগ পেতে হবে না। রুথ এর ড্রেস পরে নিয়ে গেয়ার দ্য নয়েন–এ এবার ডিনার বাক্সে কেনে অ্যাজ ম্যাসন। তারপর কণ্ডাক্টরকে তাঁদের ফাঁদের গল্প করল। কণ্ডাক্টরকে বলার সময় সে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। যাতে করিডর দিয়ে যাবার সময় কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। সেখান দিয়ে তখন অনেকেই যাতায়াত করছিলেন। এমন কি মিস গ্রে ও সেই সময় সেখান দিয়ে যায় এবং যার ফলেই অনেকের মতো সে, সে সময় মিসেস ক্যাথারিন-এর জীবিত থাকার কথা বলেছিল।
-বলুন, বলুন,–আলডিন তাড়া দেয়।
ট্রেন নয়েনস্-এ আসার আগেই অ্যাজ ম্যাসন মৃতদেহটাকে আবার আগের কামরায় নিয়ে আসে। নিজে মিসেস ক্যাথারিন-এর ছদ্মবেশ বদলে ফেলে পুরুষ মানুষের ছদ্মবেশ ধরে ও ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হয়। ড্রেক যখন তার স্ত্রীর কামরায় ঢোকে তখন সে দেখে তার স্ত্রী ঘুমোচ্ছে। মিঃ ক্যাথারিন আসার আগেই সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো হয়ে গিয়েছিল। এবং অ্যাজ ম্যাসন তখন তার নিজের কামরাতেই লুকিয়েছিল। তারপর নয়েনস্-এ ট্রেন থামলে কণ্ডাক্টর যেই ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামে সেই সুযোগে পুরুষবেশী অ্যাজ ম্যাসনও প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারী করতে থাকে। তারপর একসময় সকলের অলক্ষ্যে ঘুরতে ঘুরতে পরের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে প্রথম ট্রেনটা ধরে প্যারীতে গিয়ে পৌঁছয় এবং সেখান থেকে রীজ হোটেলে গিয়ে ওঠে। সেখানে কিংটন-এর অপরাধী জীবনের একমহিলা সহকারিণী আগের রাত থেকেই হোটেলের একটা ঘর বুক করে রাখে। সে শুধু চুপচাপ সেখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। রুবীগুলো এখন তার কাছে নেই এবং কখন ছিলও না। এদিকে আপনার সেক্রেটারীর ওপর কারোর নজরই পড়েনি তাই সে নির্ভাবনায় রুবীগুলো নিয়ে নিস্-এ চলে আসে। সেখানে মঁসিয়ে পপপুলাস-এর কাছে ওগুলো বিক্রির ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে। শুধু ব্যবস্থা অনুযায়ী রুবীগুলো পপোপুলাস-এর কাছে পৌঁছে দেয় অ্যাজ ম্যাসন। মার্কুইস-এর মতো দুর্ধর্ষ ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন অপরাধীরও এক যোগ্য প্ল্যান বটে। তার স্বভাবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো তার সুন্দর ব্যবহার মানুষকে আকৃষ্ট করে। এবং আপনিও তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অতি অল্প সময়ের আলাপেই তাঁকে সেক্রেটারী নিযুক্ত করেন।
–কিন্তু কিংটন আমার সেক্রেটারী হবার জন্যে কোনো ব্যগ্রতা দেখায়নি। একথা আমি হলফ করতে বলতে পারি।
-সেক্রেটারী হবার জন্য সে ব্যগ্রতা দেখায়নি ঠিকই কিন্তু, সে আপানকে ব্যর্থ করে তুলেছিল। হা হা, এটাই তো তার অপরকে আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা। আপনার সেক্রেটারী হবার জন্য কোনো ছলচাতুরী না করে শুধু মন ভোলানো ব্যবহারেই আপনাকে তার শিকার করে ফেলল। রিচার্ড কিংটনের কোনোরকম অসামাজিক বা অপরাধমূলক কাজের নজির নেই। বরং বড় ঘরের ছেলে, শিক্ষিত, সমাজের নামী লোকদের সঙ্গে কারবার এবং গত বিশ্বযুদ্ধে পদাতিক বাহিনীতে মেজর ছিলেন। আমি যখন একটু একটু করে মাকুইস-এর খোঁজ খবর নিতে থাকি তখন অনেক জায়গায় দুজনের মিল খুঁজে পাই। কিংটন অনর্গল ফরাসী ভাষায় কথা বলতে পারে। মাকুইসও পারে। কিংটন যে সময় ইংল্যাণ্ডে, আমেরিকা ও ফ্রান্সে ছিল মাকুইস-এর অপরাধগুলোও ঠিক একই সময় সংঘটিত হয়। মার্কুইস-এর শেষ অপরাধ সুইজারল্যাণ্ডে এবং সেই সময় সেইখানেই আপনার সঙ্গে কিংটনের পরিচয় হয়। সুইজারল্যাণ্ডে আপনার আগমন যে হার্ট অব ফায়ার সংগ্রহ করতে সে কথাও আপনি কথায় কথায় কিংটনকে বলেন।
কিন্তু সে খুন করতে গেল কেন?–করুণ একটা ভাব ফুটে উঠল আলডিন-এর মুখে এতই ধূর্ত যখন সে। শুধু রুবীগুলো চুরি করলেই তো পারত।
-না মঁসিয়ে আলডিন।–মাথা নাড়লেন পোয়ারো। মার্কুইস-এর এটাই প্রথম খুন নয়। অপরাধের সঙ্গে হত্যা করাটাও ওর একটা প্রধান চারিত্রিক বিশেষত্ব। আর অপরাধের কোনো প্রমাণই রাখে না মাকুইস সামান্য হলেও তাকে নিঃশেষে মুছে দেয়। সুতরাং খুন তাকে করতেই হয়। সিগারেটে একটা টান দিয়ে কাত হয়ে বললেন পোয়ারো, রত্ন চুরি করাই মার্কুইস-এর একটা বিশেষত্ব। বিশেষ করে যে সব রত্ন দুষ্প্রাপ্য। আপনার হার্ট অব ফায়ার সংগ্রহের কথা জেনে নেওয়ার পরই সে তার মতলব ঠিক করে ফেলে। প্যারীতে যেদিন আপনি রুবীটা কেনেন সেদিন দুজন গুণ্ডাকে আপনার পেছনে লাগিয়েছিল সেটা নেহাতই একটা মামুলী চেষ্টা। অবশ্য মার্কুইস পরের মতলবটা এতই মারাত্মক ভাবে করেছিল যে সেবার অকৃতকার্যতা তাকে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ায়নি।
কিন্তু মার্কুইস রক্তমাংসের মানুষ। আরও সকলের মতো মার্কুইস-এর দুর্বলতা এসেছিল। হ্যাঁ, সে ভালোবেসে ফেলেছিল মিস ক্যাথারিন গ্রেকে। এখানে তার কোনো ছলচাতুরী ছিল না। মনে প্রাণে সে মিস গ্রেকে ভালোবেসেছিল! কিন্তু মার্কুইস-এর ধারণা ছিল মিস গ্রে মিঃ ক্যাথারিনকে ভালোবাসে। তাই ঘটনাক্রমে মিঃ ক্যাথারিন যখন এই খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে গেল, মাকুইস-এর সামনে তখন সুবর্ণ সুযোগ মিঃ ক্যাথারিনকে ফাঁসিয়ে দেবার। বেচারা ড্রেক ক্যাথারিনকে হাজতে যেতে হলো। পায়ের উপর পা দিয়ে বসলেন পোয়ারো, এদিকে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। মন্টিকার্লোর বাগানে বসে মিস গ্রেকে প্রেম নিবেদন করল কিংটন। কিংটন চলে যাবার ঠিক পরেই মিস গ্রে হঠাৎ অদ্ভুত ভাবে আপনার মৃত কন্যার উপস্থিতি অনুভব করল। এবং এই উপস্থিতি সম্পর্কে মিস গ্রে দৃঢ় নিশ্চিত। আর আমি ভালোভাবে জানি মিস গ্রে কোনো রকম কল্পনা প্রবণতাকে মনে স্থান দেন না। উনি শুধু আপনার মেয়ের উপস্থিতিই অনুভব করেননি উপরন্তু আপনার মেয়ে যে তাকে একান্তভাবে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলেন সে সম্বন্ধেও তিনি স্থির নিশ্চিত।
প্রথমে মিস গ্রে আপনার মেয়ের ইঙ্গিতটা বুঝতে পারেনি কিন্তু অনেক চিন্তার পর তার মনে হয় আপনার মৃত কন্যা কিংটনকেই খুনী বলে দেখিয়ে দিতে এসেছিলেন। এইভাবে একটা আজব ঘটনার মধ্যে দিয়ে উনি কিন্তু ইঙ্গিতটাকে বিশ্বাস করেছিলেন সেই বিশ্বাসে তিনি তার কাজ করে যেতে লাগলেন। তিনি কিংটনকে প্রত্যাখ্যান না করে বরং এমন ভাব দেখালেন যেন তিনিও বিশ্বাস করেন যে ড্রেক ক্যাথারিনই দোষী।
–আশ্চর্য তো আলডিন ফিসফিস করে বললেন।
–হ্যাঁ, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। এ কাউকে বলায় নয় মিস গ্রেও তাই কাউকে কিছু বলেননি। আরও একটা জায়গায় আমি ধাঁধাঁয় পড়েছিলাম। আপনার সেক্রেটারী একটু খুঁড়িয়ে চলত। কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে যুদ্ধে তাঁর পায়ে বুলেট লাগে তাই। অথচ মার্কুইস খুঁড়িয়ে চলে না। এই দুটো অমিল আমাকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু লেনক্স একবার আমাকে বলেন, তার মায়ের সৈনিকদের হাসপাতালে যে ডাক্তার কিংটনকে চিকিৎসা করেছেন তিনি দীর্ঘদিন পরেও কিংটনকে খুঁড়িয়ে চলতে দেখে অবাক হন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। এই খুঁড়িয়ে চলাটাই তার ছদ্মবেশ। কিংটন ও মার্কুইস-এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যেই এই ছলনা। আমি লণ্ডনে গিয়ে সেই ডাক্তারের সঙ্গে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে এটা ওর ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। পরশুদিন কিংটন-এর শুনানীর সময় আমি সেই ডাক্তারের নাম বলেছি। যার নাম কিংটন কখনও কাউকে বলেনি। কারণ কিংটন জানত যে তার খুঁড়িয়ে চলার কোনো যুক্তিই ডাক্তারের কাছে ছিল না। আর এখানেই আমি আমার শেষ মোক্ষম সিদ্ধান্তে পৌঁছই। মিস গ্রেও আমাকে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দেখান যা থেকে আমি জানতে পারি, কিংটন যখন লেডি টাম্পলিন-এর সৈনিক হাসপাতালে ছিল, সেই সময় সেখানে একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্যারী থেকে আমার চিঠি পেয়েই মিস গ্রে বুঝতে পারে যে ওঁর আর আমার সন্দেহ একই লক্ষ্যে। প্যারীতে আমার জানবার ছিল যে অ্যাজ ম্যাসন রীজ হোটেলে কখন এসে পৌঁছয়? হ্যাঁ, আমার ধারণা ঠিক। আগের রাতেই রীজ হোটেলে একটা ঘর অ্যাজ ম্যাসন-এর নামে রিজার্ভ হলেও অ্যাজ ম্যাসন সেখানে পরের দিন ভোরে পৌঁছায়।
পোয়ারো চুপ করলেন। কিছুক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে আলডিন একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার প্রশংসা করার মতো কোনো ভাষা নেই। আপনি সত্যিই অনন্য। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে একটা চেক দিতে চাই, যদিও এর দ্বারা আমি আমার কৃতজ্ঞতার পরিমাণ আপানকে বোঝাতে পারব না।
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। মৃদু হাসি ও বিনম্র স্বরে বললেন, আমি তো সামান্য এরকুল পোয়ারো। আমাকে দিয়ে আপনার কার্যোদ্ধার হয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ও বড় পুরস্কার।
আলডিন-এর কাছে বিদায় নিয়ে হোটেলের লাউঞ্জে দেখা হলো মঁসিয়ে পপোপুলাস ও তাঁর মেয়ে জিয়ার সঙ্গে।
–আরে। মঁসিয়ে পোয়ারো যে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি নিস থেকে চলেই গেছেন। পোয়ারোর একটা হাত নিজের হাতে নিলেন পপোপুলাস।
–আমার কাজই আমাকে আবার টেনে নিয়ে এলো।
–কাজ?
–সত্যিই তাই। আপনি আছেন কেমন?
–ভালোই আছি। কালই আমরা প্যারীতে ফিরে যাচ্ছি।
-খুব সুখবর। শুনলাম আপনি না কি প্রাক্তন গ্রীক মন্ত্রীকে বেশ ভালোভাবেই বধ করেছেন?
-আমি?
-হ্যাঁ। আপনি ওঁর কাছে একটা অপূর্ব সুন্দর রুবী বিক্রি করেছেন না? যেটা নৃত্যশিল্পী মিরেলি পরেন। অবশ্য ব্যাপারটা একান্তভাবে আপনার আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলেই বললাম।
-ও হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
-আচ্ছা, রুবাটা সেই বিখ্যাত হার্ট অব ফায়ারর মত নয় তো?
–অনেকটা তার সঙ্গে মিল আছে বটে।
–সত্যিই মিঃ পপোপুলাস, রত্নের ব্যাপারে আপনার হাতযশ অসামান্য। কিন্তু মাদমোয়াজেল জিয়া যে আমাকে নিঃসঙ্গ করে এত তাড়াতাড়ি প্যারী ফিরে যাচ্ছেন, কোথায় ভাবলাম কাজকর্ম শেষ হলো, এবার মিস জিয়ার সঙ্গে প্রাণ খুলে আলাপ করা যাবে। না; তা আর হলো না দেখছি।
-আচ্ছা, জিজ্ঞেস করতে পারি কি মঁসিয়ে কাজটা কি ছিল এখানে?–বললেন পপোপুলাস।
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এতদিন যে শুধু বুদ্ধির জোরেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অবাধে অপরাধ লীলা চালিয়ে এসেছে, সেই মাকুইসকে ধরার ব্যাপারেই একটা সাহায্য করলাম মাত্র। মাকুইস-এর এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এরকুল পোয়ারো।
-মাকুইস।–বিড়বিড় করলেন পপোপুলাস। কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে নামটা?; মনে করতে পারছি না।
–ও আপনি মনে করতে পারবেন না। ও কথা বাদ দিন। আমি একজন বিখ্যাত অপরাধীর কথা বলেছিলাম। রত্ন চুরি করাই তার অন্যতম প্রধান নেশা। সম্প্রতি সে মাদাম ক্যাথারিন নামে এক ইংরেজ মহিলাকে খুন করার জন্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।
-তাই নাকি। শুনতে হবে তো একদিন ঘটনাটা। আজ আমার আবার একটু কাজ….
-হা মঁসিয়ে পপোপুলাস, আমারও একটু তাড়া আছে। মাদমোয়াজেল জিয়া, আবার কোনো এক সুন্দর দিনে আপনার সুন্দর মুখ দেখার আশায় রইলাম, তখন ভালো করে আলাপ করা যাবে। চলি।
পোয়ারোর সুন্দর রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বাবা ও মেয়ে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর পপোপুলাস বললেন, লোকটা একটা ধূর্তের শিরোমণি।
–কিন্তু যাই বলো বাবা, আমার কিন্তু ওকে ভালোলাগে। আমি ওঁকে পছন্দ করি। ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার।
-কিন্তু আমাদের কাছে ও একটা সাক্ষাৎ শয়তান, সাক্ষাৎ….
.
৩৩.
সমুদ্রের স্বাদ
আরও দুদিন কেটে গেছে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি মানুষের মন থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে গেছে। শুধু একটা প্রায় মিলিয়ে যাওয়া স্মৃতির করুণ সুর কয়েকটি বিশেষ মনকে থেকে থেকে আক্ষেপে ভরিয়ে তুলেছে। মার্গারেট ভিলার বারান্দায় মুখোমুখি বসে এরকুল পোয়ারো ও লেনক্স। সামনের সমুদ্রকে আজ যেন বড় বেশি নীল দেখাচ্ছে। পোয়ারো এই মাত্র লেনক্সকে সমস্ত ঘটনাটা শোনালেন। চুপ করে একটু ভেবে তারপর আস্তে আস্তে বলল লেনক্স, ড্রেকের কি হলো?
–তাকে গতকাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
–কোথায় গেছে সে?–করুণ দেখাল লেনক্সকে
–গত রাত্রেই তিনি নিস্ ছেড়ে চলে গেছেন।
–কোথায়? সেন্ট মেরি মিড়-এ?
–হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর লেনক্স প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল, আমারই চিনতে ভুল হয়েছে মাসীকে। আমি ভেবেছিলাম ও বোধহয় ড্রেককে গ্রাহ্যই করে না।
মিস গ্রে অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মহিলা। উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে কখনও অধীর হন না। নিজের মনের কথা আজ অবধি কাউকেই বলেননি।
–অবশ্য আমাকে বললে নিশ্চয়ই ওর কোনো ক্ষতি হতো না।– অভিমান ফুটে উঠল। লেনক্স-এর স্বরে।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আপনাকে বিশ্বাস করলে তার নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন সেই জাতের মেয়ে, যারা নিজের কথা বলার চেয়েও অন্যের কথা শুনতে ভালোবাসে। এদের জীবনের সুখ-দুঃখের কোনো ব্যাপারেই এঁরা অন্যকে ভাগীদার করেন না। নিজেরাই সব সইয়ে নেন।
-সত্যি আমি কি বোকা! জানেন, আমি ভাবতাম, মাসী বোধ হয় কিংটনকে ভালোবাসে। আমার আরও একটু বোঝা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আমি অহেতুক নিজেকে ড্রেক-এর প্রতি….।
-গলার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতাগুলোও ভিজে আসছিল লেনক্স-এর। পোয়ারো তাড়াতাড়ি তার একটা হাত তুলে নিজের হাতে নিয়ে একটু চাপ দিলেন। মাদমোয়াজেল দুঃখ করবেন না। আমি জানি আপনি ক্যাথারিনকে ভালোবাসেন। তিনি কিন্তু। আপনাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেন।
–ঠিকই বলেছেন আপনি।–বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে গালের ওপর গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা চোখের জল মুছে নিল লেনক্স। তাছাড়া ড্রেকের কাছে এখনও আমি ছোটটিই হয়ে গেছি। ও এখন পরিণত স্পর্শের আস্বাদ চায়। অনেকক্ষণ চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। কিন্তু যাই বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমিও কিছু সাহায্য করেছি। যে ভাবেই হোক আমার সাহায্যও কাজে লেগেছে।
নিশ্চয়ই আপনি সাহায্য করেছেন মাদমোয়াজেল। আপনি যে মুহূর্তে বলেন খুনীর পক্ষে ট্রেনের যাত্রী না হয়েও বাইরে থেকে খুন করা সম্ভব, সেই মুহূর্ত থেকেই আমি সত্যের আলো দেখতে পাই। আমার কাছে খুনের ব্যাপারটা তখন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। তার আগে খুন হওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়েছিল। সে কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আপনার। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল লেনক্স :- ওই আমার সান্ত্বনা–তাতেই আমি খুশী।
অনেকদূর থেকে ইঞ্জিনের তীব্র বাঁশির আওয়াজ ভেসে এলো। লেনক্স বলল, এই সেই ব্ল ট্রেন যাচ্ছে। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো ট্রেন জিনিসটা অদ্ভুত সৃষ্টি না। এ কোনোদিন থামবে না। এর চলার কোনো বিরাম নেই। বিশ্রাম নেই। মানুষ খুন হচ্ছে। কত নানা রকমের ঘটনা ঘটছে। এই ট্রেনের বুকে অথচ বিরামহীন তার চলা। যাকগে, কি সব যা তা বকে চলেছি আমি।
-হা হা, ঠিকই বলেছেন মাদমোয়াজেল। মানুষের জীবনটা তত ট্রেনেরই মতন! ট্রেনেরই মত তার অবিশ্রাম গতিবেগ। তবে দুয়ের মিল মঙ্গলসূচক।
-কেন?
–কারণ যাত্রাপথ যত দীর্ঘই হোক না কেন ট্রেনকে অবশেষে একটা জায়গায় থামতেই হয়। যাত্রাপথেরও একসময় শেষ হয়। আর সেই যে একটা প্রবাদ আছে-যাত্রাপথের শেষ হলেই মানুষ তার ভালোবাসার জনকে পায়।
হেসে উঠল লেনক্স। আমার বেলায় ও কথা প্রযোজ্য নয়। একেবারেই মিলল না।
-এখনও আপনার যাত্রাপথ শেষ হয়নি মাদমোয়াজেল। শেষ হোক–তখন নিশ্চয়ই মিলবে। আপনি এখনও ছেলেমানুষ।
নিজেকে যতটা ছেলেমানুষ ভাবেন তার চেয়েও অনেক বেশি ছেলেমানুষ আপনি। মানুষের ট্রেনরূপী জীবনে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল, কারণ এই ট্রেনের চালক স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।
আবার ইঞ্জিনের বাঁশি শোনা গেল।
-ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল। অন্তরঙ্গ চোখে তাকালেন পোয়ারো, আর বিশ্বাস রাখবেন এই এরকুল পোয়ারোর দিকে। আপনাদের পোয়ারো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যে মূল্য লাভ করেছে, তা স্বর্গীয় তা অমৃত সমান।
৬. গৃহের আকর্ষণে
২৬. গৃহের আকর্ষণে
কল্যাণীয়া ক্যাথারিন,
এত আমোদ-প্রমোদের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই এই বুড়ীর বা এখানকার নিরানন্দ জীবনের কথা তোমার এখন মনে পড়ে না। কত বন্ধু হয়েছে তোমার। অবশ্য স্থল আনন্দে ডুবে থাকার মেয়ে যে তুমি নও, সে কথা আমি জানি। এখানকার খবর গতানুগতিক। এখানকার বেয়াড়া মেয়েদের নিয়ে বড়ই ঝামেলায় পড়তে হয় মাঝে মাঝে। অবাধ্য সব, বললেও গ্রাহ্য করে না। তোমার সঙ্গে যে এদের কত তফাৎ এখানে তাই ভাবি। এত করে বলি মেয়েদের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট আর বড় মোজা পরতে তা কেউ শোনে না আমার কথা। আমার বাতের ব্যথা খুব বেড়েছিল। ডক্টর হ্যারিসন আমাকে লণ্ডনে নিয়ে গিয়ে বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন রোগটা ক্যান্সার। সাবধানে থেকো। অল্পবয়স আর প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী তুমি। অসৎ পুরুষ মানুষের বন্ধুত্ব করো না। কিন্তু মন্দ পুরুষ মানুষের ছলনায় কত মেয়ের জীবন যে নষ্ট হয়েছে তার একাধিক উদাহরণ আমি জানি। যদিও তুমি ভিন্ন প্রকৃতির মেয়ে তবুও তোমার মঙ্গলকামী বলেই একথা লিখলাম। সবসময় মনে রাখবে তোমার জন্যে এখানকার দরজা চিরদিনই ভোলা থাকবে। আশীর্বাদ জেনো।
—আমেনিয়া ডিনার।
পুনঃ খবরের কাগজে তোমার দিদিভাই টাম্পলিনের সঙ্গে তোমার নাম দেখলাম। প্রার্থনা করি অহেতুক দম্ভ বা অসার আত্মশ্লাঘা তোমার চারিত্রিক মাধুর্যকে যেন বিনষ্ট করে।
ক্যাথারিন বার কয়েক চিঠিটা পড়ল। সেন্ট মেরী মিড়-এর স্মৃতি তার চোখে ভেসে আসতে লাগল। তার কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল। হঠাৎ লেনক্স এসে ঘরে ঢুকল।
–কি হয়েছে মাসী?
–কই, কিছু না তো।–চিঠিটা ব্যাগে রাখতে রাখতে ক্যাথারিন বলল।
–কিছু না? তবে মুখ ভার কেন?
–ডিনার-এর চিঠি পেলাম, ওর ক্যান্সার হয়েছে। তাই মনটা খারাপ লাগছে। বল, কি বলবে?
-রাগ করবে না তো। জান, আমি না, তোমার সেই ডিটেকটিভ বন্ধু পোয়ারোকে তোমার নাম করে ফোন করে নিস্-এ আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছি। আমি ভাবলাম, তোমার নাম করে না বললে হয়তো উনি রাজী হবেন না। রাগ করলে মাসী?
-রাগ করতে যাব কেন? তুমি তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও?
–সে আর বলতে! আমি বোধহয় ওর প্রেমেই পড়ে গেছি।
–বুঝতে পেরেছি। তাই কয়েকদিন ধরেই দেখছি শুধু ড্রেক ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তার। আর ব্লু ট্রেনের কথা বলছ বিশেষ করে ড্রেক-এর গ্রেপ্তারের পর থেকে।
–আমি গাড়ি বের করতে বলছি ড্রাইভারকে। মাকে বলিনি কারণ মা তাহলে আমাদের সঙ্গে যাবে আর মা গেলে আমি কোনো চান্সই পেতাম না কথা বলার। শুধু শ্রোতা হয়েই থাকতে হতো।
–ঠিক আছে, তুমি নিচে নাম, আমি আসছি। লেনক্স ও ক্যাথারিন নেগ্রেসকোতে পৌঁছে দেখল পোয়ারো ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। পোয়ারোর অভিনন্দন জানানোর সুন্দর ভঙ্গি ওদের দুজনকেই মুগ্ধ করল। আহারের সময় পোয়ারোর কথার মাধুৰ্য্য আহার্যকে আরও উপভোগ্য করে তুলল। ক্যাথারিন চুপ করেছিল। আহার শেষে কফি খেতে খেতে লেনক্স বলল, কতদূর হলো মিঃ পোয়ারো? কি বললাম বুঝতে পেরেছেন?
হাতের আঙ্গুল মটকালেন পোয়ারো। তাদের সুবিধেমত তারা কাজ করছে।
–আর আপনি বসে বসে দেখছেন।
-মাদমোয়াজেল। আপনি তরুণী, আপনার গতিবেগ চঞ্চল। কিন্তু তিনটে জিনিসের গতি ধীর হয়। যা কখনও তাড়াতাড়ি হয় না। ভালোবাসা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ফুল ধীরে ধীরে ফোটে আর ধীরে ধীরে কাজ করে বুড়োরা।
–ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আহা, আপনি মোটেই বুড়ো নন।
–সত্যি? শুনলেও ভালো লাগে।
–কিংটন আসছেন। সঙ্গে মিঃ আলডিনও আসছেন দেখছি।
-আমি চট করে একটা কথা মিঃ কিংটনকে জিজ্ঞেস করেই এখুনি আসছি।–লেনক্স উঠে গেল।
-আপনাকে আনমনা লাগছে কেন? কত দুরের চিন্তা করছেন? পোয়ারো বললেন।
-খুব বেশি দূরের নয়।–ব্যাগ থেকে ডিনারের চিঠিটা বের করে পোয়ারোর হাতে দিলেন।
চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বললেন, আপনি তাহলে ফিরে যাচ্ছেন ইংলণ্ডে?
–না। আপাতত যাচ্ছি না। কেনই বা যাব।
–ও। আমারই ভুল হয়েছিল। এক মিনিট একটু আসছি। পোয়ারো উঠে দেখেন মিঃ কিংটন, মিঃ আলডিন ও লেডী টাম্পলিন যেখানে ছিল সেখানে গেলেন। মিঃ আলডিনের চেহারা খুব খারাপ লাগছে এবং পোয়ারোকে দেখে তিনি বেশি একটা খুশী হলেন না।
পোয়ারো কিংটনকে পাশে ডেকে বললেন, মিঃ আলডিন কি অসুস্থ?
–আর অসুস্থ হবেন না? মেয়ে খুন হল, আর খুনী কিনা জামাই। এখন আপনার হাতে তদন্ত দিয়েছেন বলে ওর আফসোস হচ্ছে।
–ওঁর ইংলণ্ডে ফিরে যাওয়া উচিত মিঃ কিংটন। ওকে সেখানে নিয়ে যান।
–আমরা তো পরশুদিনই ইংলণ্ডে যাচ্ছি।
–তাই নাকি। খুব ভালো কথা। মিস গ্রেকে বলবেন।
–কি বলব?
–এই আপনার, মানে মিঃ আলডিনকে নিয়ে ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা।
কিছুক্ষণ পরে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে নানারকম আলোচনা করতে লাগলেন। ক্রমে বিদায় নেবার পালা এলো। প্রথমেই মিঃ আলডিন ও তার সেক্রেটারী বিদায় নিলেন।
-খুব ভালো লাগল আপনাদের এমন মধুর সঙ্গ। অন্যদিনের চেয়েও আজকের খাবার যেন বেশি সুস্বাদু মনে হলো। আপনাদের সঙ্গদানের ফলে। পোয়ারো বললেন, এখন প্রাণশক্তিতে ভরপুর আমি। হাসবেন না মিস গ্রে। আপনি দেখেছেন এক নির্জীব নিরীহ এরকুল পোয়ারোকে, কিন্তু তার আরও একটা বিপরীত রূপ আছে। সে চেহারা জানে অন্য এক জগতের লোকেরা। তাদের কাছে এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতি মৃত্যুর উপস্থিতির সমতুল্য, ক্যাথারিন-এর মনে হলো। যে পোয়ারো কথা বলছিলেন এখন যেন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। ক্যাথারিন যেন পোয়ারোর দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করল।
-এবারও বুদ্ধির লড়াইতে এরকুল পোয়ারোর জিত হবে। হা, জিত নিশ্চয়ই হবে। চললাম মাদমোয়াজেল। কয়েক পা এগোতেই পেছনে ক্যাথারিন বললেন,
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কথাই ঠিক। আমি ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাচ্ছি।
–তাই নাকি!
–বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?
-না, তা নয়। ভাবছি পোয়ারো কি করে আগেই জানলো। পোয়ারো গাড়িতে উঠে বললেন, কাউন্ট দ্য লা রোচির বাড়ি চল।
কাউন্টের বাড়িতে এসে দরজায় বেল টিপলেন পোয়ারো। দরজা খুলে গেল।
–আজ্ঞে, কাউন্ট তো বাড়ি নেই।
–আমি জানি তা। তুমি হিপোলাইট ফ্লাভেল না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
–মেরী ফ্ল্যাভেল তোমার বউ না?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু…
–তোমাদের দুজনকেই আমার দরকার আছে।
বলতে বলতে হিপোলাইটকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন পোয়ারো। তোমার বউ নিশ্চয়ই রান্নাঘরে? হিপোলাইট কিছু বুঝে ওঠার আগেই পোয়ারো হলঘরের উল্টোদিকের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে অদৃশ্য হলেন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।
-আরে একি, কোথায় যাচ্ছেন? কি আপদ!–হিপোলাইটও ছুটল ভেতরে।
–আমি এরকুল পোয়ারো।-রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব মেরীকে বললেন।
ততক্ষণে হাঁপতে হাঁপাতে হিপোলাইটও এসে গেছে সেখানে, কি ব্যাপার দেখছ মেরী! কোথাকার,
–এরকুল পোয়ারোর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ তোমরা?
–জীবনে কোনোদিন শুনিনি।–সবেগে মাথা নাড়ল হিপোলাইট।
–না, তোমাদের নিয়ে পারা গেল না।–অশান্ত ছোট ছেলের ভঙ্গি করলেন পোয়ারো, কোনো পাঠশালায় পড়েছিলে। এমন একজন নামকরা লোক। সাধারণ জ্ঞানের বই ছিল না তোমাদের ক্লাস-রুটিনে?
দুজনেই বিস্ময়ে ঢোক গিলে বলল, আজ্ঞে মশায়ের আসার কারণটা যদি
-হ্যাঁ বলছি। পুলিশের কাছে সাতটা মিথ্যে কথা কেন বলেছো সেটাই আমার জানা দরকার।
–মিথ্যে কথা। কখনও নয়।রেগে গেল হিপোলাইট।
–কিন্তু ও নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।–পাশেই রাখা একটা টুলে বসে পোয়ারো বললেন, আমি জানতে চাই, কাউন্ট দ্য লা রোচি চোদ্দই জানুয়ারি সকালে এখানে এসেছেন বলে পুলিশের কাছে তুমি জবানবন্দি দিয়েছ কিনা?
কিন্তু সেটা মিথ্যে নয় মঁসিয়ে। উনি চোদ্দই মানে মঙ্গলবার সকালে ফিরে আসেন। কি, তাই না মেরী?
–হ্যাঁ, আমার পরিষ্কার মনে আছে।
–আচ্ছা, সেদিন কি ডিনার দিয়েছিলে মনিবকে।
–ডিনার।….ঠিক মনে করতে পারছি না।
–একই দিনের ঘটনা পরিষ্কার মনে আছে আরেকটা পারছে না। সেদিন তোমার মনিব বাইরে ডিনার খেয়েছেন।-বাঁ হাতের চেটোয় সজোরে ডান হাতে আঘাত করলেন।
-হা হা।
–ওহো মিথ্যে বলছো, ভাবছো কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু দুজনকে ফাঁকি দিতে পারোনি। এক ওঁকে….একটা হাত ওপরে অনন্ত আকাশের দিকে তুলে ধরলেন, আর একজন এই এরকুল পোয়ারো।
-কিন্তু আপনি ভুল করছেন মঁসিয়ে। কাউন্ট সোমবার রাতে প্যারিস ছেড়েছেন।
-হ্যাঁ, তা জানি। কিন্তু তারপর তিনি বেঙ্গনায় আর একদিন কাটিয়েছেন সেটা তুমি, আমি কেউ জানি না। শুধু জানি বুধবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন।
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো; ঠিক আছে বিপদ যখন তোমরা চাইছ; বিপদে পড়।
তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি? –মেরী বলল।
-মাদাম ক্যাথারিন-এর খুনের ব্যাপারে জড়িত আছে সন্দেহে পুলিশ তোমাদের গ্রেপ্তার করবে।
-খুন! কি বলছেন মঁসিয়ে! আমরা খুনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।–ঠক ঠক করে দুজনের পা কাঁপতে লাগল।
–হ্যাঁ, প্রস্তুত থেকো তোমরা।–পোয়ারো যাবার জন্যে পা বাড়ালেন।
শুনুন, শুনুন সিয়ে, ব্যাপারটা যে এতদূর গুরুতর সে সম্বন্ধে….
–থামো–এক ধমক দিলেন পোয়ারো, নিজের ভালমন্দ বোঝে না এমন দুটো বোকার সঙ্গে বাজে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। শেষবারের মতো বলছি, কবে আর কখন কাউন্ট এই ভিলাতে ফিরে আসেন, মঙ্গলবার না বুধবার?
বুধবার–হিপোলাইট বলল।
–তবু ভালো, সুবুদ্ধি হলো শেষ পর্যন্ত। ভয়ানক বিপদে ফেলতে যাচ্ছিলে নিজেদের তোমরা।
কাউন্ট-এর মারিনা ভিলা থেকে বেরিয়ে পোয়ারো মিরেলির হোটেলের দিকে গেলেন।
কাঁটায় কাঁটায় ছটা। পোয়ারো হোটেলে মিরেলির কাজের ঘরে ঢুকলেন। পোয়ারোকে দেখে মিরেলি জ্বলে উঠল।
কি ভেবেছেন আপনারা? অনেক যন্ত্রণা তো দিয়েছেন এখনও সাধ মেটেনি! আমাকে দিয়ে যা নয় তাই বলিয়ে বেচারা ড্রেককে জেলে দিয়েছেন। আরও চান?
–শুধু ছোট একটা প্রশ্নের জবাব চাই মাদমোয়াজেল। পোয়ারো মিরেলির চোখে চোখ রাখলেন। সেদিন নয়েন স্টেশন ছাড়ার পর কখন আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিলেন?
-মানে?
–আমি বলছি কখন আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিলেন?
–কখনোই যাইনি।
-মিথ্যে কথা। গর্জে উঠলেন পোয়ারো। কি হয়েছিল সেদিন, আমি বলছি। আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকে তাঁকে মৃত দেখেছিলেন। কারণ আমিও কাছাকাছি ওখানেই কোথাও ছিলাম সেদিন। এখনও বলছি আপনাকে, এরকুল পোয়ারোকে মিথ্যে কথা বলার পরিণাম বড় সাংঘাতিক।
–আমি আমি কিছু করিনি…।হঠাৎ থেমে গেল মিরেলি।
–একটা কথাই ভাবি শুধু মাদমোয়াজেল। যার জন্যে আপনি গিয়েছিলেন তা কি পেয়েছিলেন, না আপনার আগেই কেউ সেখানে ঢুকেছিল?
-আর কিছুই বলতে পারব না। দোহাই আপনার। মিরেলি পাশের ঘরে চলে গেল। পোয়ারো বেরিয়ে এলেন হোটেল থেকে, মুখে তার তৃপ্তির হাসি।
.
২৭.
ডিনার–এর রায়
মিস ডিনার-এর শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ক্যাথারিন বাইরে তাকিয়েছিল। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। জানালা দিয়ে সামনের বাগানটা দেখা যায়। বাগানের একপাশ দিয়ে লাল ছোট ছোট নুড়ি পাথরের রাস্তা গেট পর্যন্ত চলে গেছে।
মিস ডিনার একটা পুরানো আমলের খাটে আধ শোয়া অবস্থায় আছেন। পাশেই একটা ট্রেতে প্রাতঃরাশের সামান্য ভুক্তাবশেষ কিছু পড়ে আছে। বৃদ্ধা একমনে সেদিনের চিঠিপত্র পড়ে চলেছেন আর তীক্ষ্ণ ভাষায় নিজের মতামত দিয়ে চলেছেন।
একটা খোলা চিঠি হাতে ক্যাথারিন বসেছিল। ইতিমধ্যে চিঠিখানা ক্যাথারিন দুবার পড়েছে। চিঠির ওপরে লেখা–রীজ হোটেল প্যারিস।
প্রিয় মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন,
নিশ্চয়ই ভাল আছেন। শীতের ইংল্যাণ্ড আশা করি আপনার খারাপ লাগছে না। আমার কাজ আমি যথাসাধ্য আন্তরিকভাবে করে চলেছি। ভাববেন না যেন ছুটি কাটাতে এখানে রয়েছি। খুব শীগগিরই আমাকে ইংল্যাণ্ডে যেতে হবে। তখন আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে। লণ্ডনে পৌঁছেই আপনার কাছে চিঠি লিখব। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
প্রীতিমুগ্ধ
এরকুল পোয়ারো।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে ক্যাথারিন কখন একসময় ভাবের রাজ্যে চলে গেছে, চমক ভাঙল বৃদ্ধা ডিনার-এর তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে।
–আমি তখনই বলেছি ওদের, এ তোমরা নও, বুঝলে? ক্যাথারিন, লেডী টাম্পলিন-এর বোন। কি ভাবো তোমরা?
–তুমি কি আমার হয়ে সকলের সঙ্গে ঝগড়া করবে নাকি?
তোমার সম্বন্ধে বাজে কথা বললে আমি কি চুপ করে থাকতে পারি বল? আধুনিক সমাজের ঠুনকো আদবকায়দা শেখার জন্যে তুমি নাকি বড়লোকদের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছ
–এ কথা তো সত্যিও হতে পারে মিস ডিনার। আমি যে সে চেষ্টা করছি না, তা কেমন করে জানলে?–কই, আধুনিক সমাজের বেলেল্লাপনা তো দেখছি না। কই, তোমার স্কার্ট তো হাঁটুর ওপরে ওঠেনি আর অসভ্যের মতো জুতোও তো পরোনি।
–একটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমায়। ক্যাথারিন বলল, আমার এক রিভিয়ারার বন্ধু এখানে একদিন আসতে চায়।
বন্ধু মানে পুরুষ মানুষ?
-হ্যাঁ।
–কে সে?
–এক কোটিপতি মার্কিন ভদ্রলোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী।
–কি নাম?
–কিংটন। মেজর রিচার্ড কিংটন।
-হুম! কোটিপতির সেক্রেটারী এখানে আসতে চায়। ক্যাথারিন, তোমার ভালোর জন্যে একটা কথা বলি। যদিও তুমি বিচক্ষণ মেয়ে তবুও জেনে রাখ, প্রতি মেয়েই জীবনে একবার না একবার ঠকে। তোমায় যেন একবারও ঠকতে না হয়।
-তাহলে বন্ধুকে আসতে বারণ করে দেব?
-না না, বারণ করবে কেন? তাকে নিশ্চয়ই আসতে বলবে। তোমার বন্ধুকে একদিন লাঞ্চ খেতে বল এখানে। অবশ্য এলেন-এর যা রান্না।
তারপর একদিন যথাসময়ে কিংটন নেমন্তন্ন রাখতে সেন্ট মেরী মিড-এ এলো। বৃদ্ধা ডিনার খুশি হলেন কিংটন-এর সঙ্গে আলাপ করে। অনেক গল্প করে তারপর বিকেলে চা খেয়ে কিংটন বিদায় নিল সেন্ট মেরী মিড থেকে।
ক্যাথারিনকে ডাকলেন ডিনার। না, তোমার লোক চিনতে ভুল হয়নি। পুরুষ মানুষ যতই মেজর কর্নেল হোক না কেন, গভীর ভালোবাসার জালে জড়িয়ে না পড়লে এমন অসহায়ের মতো চেহারা কখনও হয় না।
–তুমি বড় ভালো।–বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ক্যাথারিন।
.
২৮.
ইম্পেসারি ও মিঃ অ্যারন
মদের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিলেন মিঃ জোসেফ অ্যারন্।
আঃ, খুব উৎকৃষ্ট জিনিসই অর্ডার দিয়েছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।-মুখে লেগে থাকা ফেনাটুকু বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিতে নিতে জড়ানো চোখে চাইলেন পোয়ারোর দিকে। হ্যাঁ, এমন জিনিস খেয়েও আরাম, খাইয়েও আরাম। দিন-দিন, ঢালুন–বেশি করেই ঢালুন।
–চিকেন মেয়নিজ?
-হা হা, নিশ্চয়ই দেবেন। কিডনি পুডিং অবশ্যই আমার অত্যন্ত প্রিয় খাবার। অবশ্য অ্যাপ টার্ট দিয়েই আমি খাওয়া শেষ করি।
কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে একের পর এক অর্ডার দিয়ে চললেন পোয়ারো। কিছুক্ষণের জন্যে খাবারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন মিঃ অ্যার। তারপর একসময় খাওয়া শেষ হলে নেশাগ্রস্ত চোখ তুললেন। কি যেন একটা দরকারী কথা আছে বলছিলেন মিঃ পোয়ারো? যদি আপনার কোনো সাহায্যে আসতে পারি তো বলবেন, আমার যথাসাধ্য করব।
অনেক ধন্যবাদ। মঞ্চ জগৎ সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে একমাত্র আপনি ছাড়া তো দ্বিতীয় কেউ নেই, তাই আপনার কথাই মনে হয়েছে সর্বপ্রথম।
নেহাত ভুল বলেননি। বেশ আত্মতৃপ্তির মুখভঙ্গি করলেন অ্যারন্। –মঞ্চ জগতের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে এই ইম্পেসারি ও জোসেফ অ্যার-এর কাছে আসতে হবে।
–আচ্ছা মিঃ অ্যারন্, কি নামে কোনো যুবতাঁকে এ লাইনে চিনতেন কি?
–কি? কি টি কিড।
–সম্ভবতঃ কি টি কিড।
-খুব চালাক চতুর ছিল মেয়েটা। আর ছেলের ভূমিকায় ভালো করত। গান আর নাচ জানত ভাল। ছেলে সাজলে কেউ ধরতেই পারত না। এর কথাই বলছেন কি?
-হ্যাঁ এরই কথা জানতে চাইছিলাম।
-ওঃ। খুব ভালো রোজগার করত মেয়েটা। ওর বেশির ভাগ কনট্রাক্টই ছিল পরুষ ভূমিকায়। একটা দিন কামাই করত না। কিন্তু স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করার সময় ও নিজেকে ছুঁতে দিত না কাউকে।
-আমিও তাই শুনেছি। কিন্তু তাকে অনেকদিন ধরে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে না। জানেন কি?
হ্যাঁ। এক প্রচুর বড়লোক মক্কেল পাকড়ে মঞ্চকে চিরবিদায় জানিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে।
-কতদিন আগে সেটা?
–দাঁড়ান, ভেবে দেখি। তা বছর তিনেক আগে তো নিশ্চয়ই।
–যার সঙ্গে কিটি গিয়েছিল সেই লোকটি সম্বন্ধে কিছু জানেন কি?
–তিনি তখন পুরোদমে টাকার সমুদ্রে ভাসছেন। কি যেন নাম। কাউন্ট অথবা মাকুইস। এ ধরনের কিছু একটা হবে। সম্ভবতঃ মার্কুইসই।
–আর কিছু জানেন?
-না, আর কিছুই জানি না। এমনি যে কিটির সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখাও হয়নি। আপনাকে আরও কিছু খবর দিতে পারলে খুশী হতাম। কোনো একসময় আপনিও যে আমার যথেষ্ট উপকার করেছিলেন সে কথা জোসেফ অ্যারন্ কোনোদিনই ভুলে যাবে না।
–সে ঋণ তো শোধ হয়ে গেল আপনার।
-উপকারীর উপকারের চেষ্টা সবসময়ই করা উচিত।
–তারপর আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে?
-ভালো-মন্দয় চলে যাচ্ছে। দর্শকদের ভোয়ালে কখন কোনোটা ভালো লাগে কখন লাগে না- সবসময় দুচোখ খুলে কাজ করতে হয়।
-আচ্ছা এখন নাচের কদর বেড়েছে বোধহয়, তাই না?
–হ্যাঁ, দর্শকরা নাচটা পছন্দ করে দেখছি।
–মিরেলি নামে এক নাচিয়ের সঙ্গে আলাপ হল রিভিয়ারায়।
–মিরেলি? ওর এখন বাজার গরম। ও না চাইলেও অর্থ যেচে আসে ওর কাছে। তবে আমার এখনও প্রয়োজন হয়নি ওর কাছে যাবার। শুনেছি ভীষণ মেজাজী আর দেমাকী। ব্যবহারও খুব ভালো নয়।
-হ্যাঁ। আমিও একমত। আচ্ছা, মিরেলি কতদিন হলো মঞ্চে এসেছে বলুন তো? খুব বেশিদিন বোধহয় না?
-তা বছর আড়াই হবে। কে একজন ফরাসী ডিউক ওকে এ লাইনে নামিয়েছেন। তারপর মাঝে মিরেলির সঙ্গে গ্রীসের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দহরম-মহরম হয়।
–এ খবরটা অবশ্য জানতাম না আমি।
-এখন আবার শুনছি, মিরেলির জন্যেই নাকি ড্রেক ক্যাথারিন তার বউকে খুন করেছে। মিঃ ক্যাথারিন তো হাজতে। অবশ্য মিরেলি হোটেলেই আছে শুনেছি। মিরেলি নাকি কোথাকার একটা খুব দামী এবং ঐতিহাসিক পাথর সংগ্রহ করেছে। নীলা না রুবী কি যেন বলে। এবার বোধহয়…হেসে উঠলেন অ্যারন নাচ ছেড়ে পাথর সংগ্রহের দিকে ঝুঁকবে। ওই রুবী নীলা পরে অনেক জায়গায় মাঝে মাঝে যায় সে।
-রুবী!–পোয়ারোর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বেশ, বেশ।
–আমাকে আমার এক বন্ধু ইম্পোসারিও কথাটা বলেছে মিরেলিকে নিয়ে তাকে মাঝে মাঝে কাজ করতে হয়। কিন্তু আমি জানি ওসব নামী দামী বাজে কথা। স্রেফ রঙীন কাঁচের। এ ধরনের মেয়ে মানুষেরা ঝুরি ঝুরি মিথ্যে কথা বলে। আর কি প্রমাণ? দুনিয়া সুদ্ধ লোক তো আর পাথর বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে নেই। হেসে উঠলেন তিনি আবার। ওর আবার একটা কি যেন একটা হার্ট অব ফায়ার বলে নাম দিয়েছে সে।
–আমার যতদূর মনে পড়ে–পোয়ারো যেন কিছু মনে করতে চাইলেন, ওই হার্ট অব ফায়ার নামে রুবীটা কেনে একটা গলার হারের মধ্যমণি রূপে আছে।
–আপনি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করছেন ওটা আসল বলে। আরে মশাই, লাইনের লোক আমি। নানারকমের স্ত্রী চরিত্র দেখছি। নিজেদের গয়না নিয়ে অফুরন্ত মিথ্যে বলতে এদের জুড়ি নেই পৃথিবীতে। হ্যাঁ, একটা সরু প্ল্যাটিনামের চেনে ওটাকে কখনও কখনও গলায় পরে বলে শুনেছি।
-না, গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। ওটা একট মামুলী রঙীন কাঁচ বলে আমি মনে করি না।
.
২৯.
পোয়ারো ক্যাথারিন সংবাদ
স্যাভয় হোটেলের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে পোয়ারো আর ক্যাথারিন গল্প করছিলেন।
-আপনি অনেক বদলে গেছেন মাদমোয়াজেল।
–যথা? চোখ তুলল ক্যাথারিন।
–এই ধরনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো ঠিক বলে বোঝানো যায় না।
–বয়স বেড়েছে তো, ম্লান হাসলো ক্যাথারিন।
–হ্যাঁ, তা বেড়েছে, কিন্তু বয়স বাড়ার পরিবর্তনের কথা আমি বলছি না। প্রথম যখন আপনাকে দেখি জীবন সম্বন্ধে আপনার আগ্রহ তখন অসীম।
কোটিপতির জীবন থেকে শুরু করে কাঠঠোকরার কাঠ খুঁটে খুঁটে বাসা তৈরি করাও লক্ষ্য করতে ভুলতেন না।
-আর এখন?
-এখন আর সেই কৌতূহল আপনার মাঝে দেখতে পাই না। হয়তো আমার অনুমান ঠিক নয়। তবু কেমন যেন মনে হয় আপনার ক্লান্তি এসেছে।
আমার বৃদ্ধা বন্ধুটির সঙ্গে থাকলে আপনিও ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। একদিন সেন্ট মেরি মিড-এ এসে ওর সঙ্গে আলাপ করে যান। আপনার ভালো লাগবে বৃদ্ধাকে।
ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। পোয়ারো প্লেট থেকে একটা চিকেন ক্যাসরোলে উঠিয়ে, আচ্ছা আমার বন্ধু হেস্টিংস-এর কথা আপনাকে বলেছি, না? যে আমাকে শামুক আখ্যা দিয়েছে। ওর মতে পোয়ারো নাকি সব সময় একটা আড়ালের ভেতর থেকে তার কাজ করে যায়। এ কথাটাকে আপনি বোধহয় আমাকে ছাড়িয়ে যাবেন।
–কি যে বলেন?
–এরকুল পোয়ারো কখনও বাজে কথা বলে না। এখানে আসার পর আপনার রিভিয়ারার কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে কি?
–মেজর কিংটনের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
–আচ্ছা। তাই নাকি। তাহলে মিঃ আলডিন লণ্ডনেই আছেন?
–হ্যাঁ।
–কাল অথবা পরশু ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
–কোনো খবর দেবার আছে ওর কাছে?
–একথা মনে হলো কেন আপনার মাদমোয়াজেল?
–এমনিই মনে হলো।
–মাদমোয়াজেল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি আমাকে কিছু বলবেন। কিন্তু বলছেন না কেন? আমাকে কি বন্ধু ভাবতে পারছেন না? এই ব্ল ট্রেনের ব্যাপারে যেদিন থেকে আমরা দুজনে জড়িয়ে গেছি, সেদিন থেকেই কি আমরা পরস্পর সাহায্যকারী বন্ধু নই?
–হ্যাঁ, কিছু কথা বলার আছে আপনাকে। আচ্ছা প্যারীতে কি করছিলেন আপনি?
–রাশিয়ান এমব্যাসীতে একটু কাজ ছিল।
ও।
-নিরাশ হলেন তো? কিন্তু না, নিরাশ করব না আর। এবার সময় হয়েছে শামুক থেকে বেরিয়ে আসার। হাতের তাস এবার টেবিলে রাখব আমি। মিঃ ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তারের পর কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই।
আমি কিন্তু ভেবেছিলাম মিঃ ক্যাথারিনকে গ্রেপ্তার করালেন আর আপনার কর্তব্যও শেষ হলো।
–একথা মানছি আমি। আমারই একটা পরীক্ষামূলক কাজের ফল মিঃ ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তার হওয়া। কিন্তু এটা না হলে ম্যাজিস্ট্রেট ক্যারেডা এখনও কাউন্টকে অপরাধী করার বৃথা চেষ্ট করে যেতেন। সত্যকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। যদিও পুলিশ বলে এই ঘটনার এখানেই শেষ কিন্তু এরকুল পোয়ারো সন্তুষ্ট নন। পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল লেনক্স-এর খবর জানেন?
-হ্যাঁ, একটা ছোট চিঠি পেয়েছি। আমার চলে আসার জন্যে লেনক্স খুব রেগে আছে।
-মাদমোয়াজেল! আমি একটা খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। কেউ একজন আছে যে মিঃ ক্যাথারিনকে ভালোবাসে–যদি আমার ধারণা ভুল বলে মনে হয়, দয়া করে আমাকে বলবেন। আর তার মুখ চেয়েই বলছি। আমি ঠিকই করেছি। বরং পুলিশই ভুল করেছে। জানেন, কে সে?
-হ্যাঁ, জানি।
সামনে ক্যাথারিন-এর দিকে ঝুঁকে বললেন পোয়ারো, না মাদমোয়াজেল, না! আমি জানি সত্যকে খুঁজতে গেলেই পথ বারংবার মিঃ ক্যাথারিন-এর কাছেই নিয়ে যাবে, তবু একটা হিসেবে আমার গরমিল থেকে যাচ্ছে কেন?
–কি সেটা?
–সেটা হল নিহত রুথ ক্যাথারিন–এর বিকৃত করা মুখ। শতশত বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি স্ত্রীকে খুন করার পরও মৃত স্ত্রীর মুখ নির্মমভাবে থেতলে দেবেন, সত্যিই কি ড্রেক ক্যাথারিন সেই চরিত্রের নোক? মুখটাকে বিকৃত করায় কি স্বার্থ সিদ্ধি হতে পারে? মনের আক্রোশ মেটানো সাধারণতঃ মনস্তত্ব বলে, কাউকে আক্রোশের বসে খুন করতে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রোশ মিটে যায়। মৃতের পরিচয় গোপন করার জন্যেই মাথা কেটে ফেলে। মুখ থেতলে দেয়। সেদিক থেকেও মন সায় দেয় না। একটা মাত্র জিনিসই এই সমস্যায় আমাকে সাহায্য করেছে।
পকেট থেকে নিজের নোট বইটা থেকে কয়েকটা লম্বা চুল বের করে দেখালেন, মনে পড়ে মাদমোয়াজেল?
ব্লু ট্রেনের সেই কামরায় কম্বলের সঙ্গে এগুলো জড়িয়ে ছিল? সামনে ঝুঁকে ক্যাথারিন সেই চুলগুলো দেখতে লাগল।
–কিছুই ধরতে পারছেন না? কিন্তু অনেক কিছু এর মধ্যে জানতে পারবেন মাদমোয়াজেল।
–একটা জিনিস আঁচ করছি। একটা অদ্ভুত কথা। আর সেইজন্যেই আপনাকে বলছিলাম প্যারীতে কেন গিয়েছিলেন?
–আপনাকে যখন চিঠি লিখি—
–রীজ হোটেল থেকে লেখা চিঠির কথা বলছেন তো?
–হ্যাঁ, রীজ হোটেলের কথাই বলছি। জানেন মাঝে মাঝে আমি খুব বড়লোক হয়ে যাই যখন কোনো কোটিপতি আমার হোটেলে থাকার খরচা দেন।
–কিন্তু সোভিয়েট এমব্যাসী এ ব্যাপারে জড়িত নয়।
-আমি কিছু খবর জানতে গিয়েছিলাম সেখানে। কোনো এক বিশেষ লোকের কাছেই গিয়েছিলাম এবং তাকে ভয় দেখিয়ে এসেছি।
-পুলিশের ভয়?
-না, খবরের কাগজে সেই লোকটির কীর্তির কথা ছাপিয়ে দেবার ভয় দেখিয়েছি। এসব ব্যাপারে ওরা প্রেসকে বেশি ভয় করে।
-তারপর?
-তারপর জানতে পেরেছি কোথায়, কখন, কবে এবং কাকে সেই রুবীটা বিক্রি করা হয়। লোকটাকে চাপ দিতেই সব বলেছে আমায়, এমনকি সেইদিন রুবীটা বিক্রি হবার পর রাস্তায় দেখা সেই লোকটি যে একমাথা সাদা চুল নিয়েও যুবকের মতো চলছিল। তার কথাও বলেছে। যাকে আমি নাম দিয়েছি –মঁসিয়ে লে মাকুইস।
আপনি লণ্ডনে এসেছিলেন কি মিঃ আলডিনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
–শুধু সেই জন্যেই নয় আরও কাজ ছিল। একজন মঞ্চজগতের ভদ্রলোক ও হার্লে স্ট্রীটের এক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছি এবং দুজনের কাছেই কিছু খবর পেয়েছি। এইসব একবার দেখুন আমি যা পাচ্ছি আপনি তা পাচ্ছেন না।
–আমি?
–হ্যাঁ, আপনি। একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছিল। খুন এবং রুবী চুরি করা একই লোকর কাজ কিনা। অনেকদিন পর্যন্ত আমি কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারিনি।
-এখন?
–এখন আমি জানি।
–আমি কিন্তু আপনার মতো বুদ্ধিমান নই মঁসিয়ে। আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখছিলাম।
একই কথা। একই আয়নার সামনে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে আয়না দেখলে কি হবে? কাউকে সামনে, কাউকে পাশ থেকে দেখা যাবে। মোট কথা দেখা যাবেই। আয়নায় প্রতিফলন হবেই।
–আমি যা ভেবেছি তা হয়তো আপনার অসম্ভব মনে হতে পারে কিন্তু
–হা হা, বলুন।
-দেখুন তো এটা আপনার কোনো সাহায্যে আসে কিনা? একটা খবরের কাগজের কাটিং দিলেন। মিস ডিনার-এর পুরনো সংগ্রহ থেকে পেয়েছি।
কাটিংটা পড়ে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন পোয়ারো–যে কথা আপনাকে বলছিলাম মাদমোয়াজেল। একই আয়নায় একই জিনিস নানাভাবে রেখে দেখলেও প্রতিচ্ছবি একই দেখাবে।
–আমায় এবার ফিরতে হবে। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ালেন ক্যাথারিন। মঁসিয়ে পোয়ারো–
-বলুন মাদমোয়জেল।
–এটা–এটা আর বেশিদূর বুঝতে পেরেছেন–আমি–আমি আর পারছি না। এভাবে।
গলাটা ধরে এলো ক্যাথারিন–এর।
ক্যাথারিন-এর হাত ধরে পোয়ারো আশ্বাস দিলেন, সাহস সঞ্চয় করুন মাদমোয়াজেল। এখন ভেঙে পড়লে কিছুতেই চলবে না। শেষ প্রায় হয়ে এসেছে।
.
৩০.
পোয়ারোর নতুন কথা
-স্যার। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন।
-চুলোয় যাক। যত সব। রাগে ফেটে পড়লেন আলডিন। আলডিনের অবস্থা দেখে মায়া হলো কিংটন-এর।
–আজ সকালের পত্রিকাটা দেখেছ একবার?–অশান্তভাবে পায়চারি করতে লাগলেন আলডিন।
–একবার চোখ বুলিয়েছি স্যার।
–এখনও পর্যন্ত কাগজগুলো এটা নিয়ে কি নোংরামিই না করে চলেছে।–নিষ্ফল আক্রোশে দুহাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে বসে পড়লেন আলডিন। ছিঃ ছিঃ, বাইরে মুখ দেখানা যাচ্ছে না কাউকে। এখন আফশোস হচ্ছে, এই অপদার্থ বেলজিয়ানটার ওপর রুথ-এর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করার ভার দিয়েছি বলে।
–কিন্তু স্যার। আপনার সামনেই বেকসুর নিরপরাধ হয়ে থাকবে এও আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন না?
–তার বোঝাপড়া আমিই করতাম।
–স্যার, তাতে আপনার কিছু সুবিধে হতো বলে মনে হয় না।
–এখনই বা কি সুবিধেটা হচ্ছে আমার?–দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন আলডিন। তা, ওকি সত্যিই দেখা করতে চায়?
–হ্যাঁ স্যার, বিশেষ দরকার আছে বলেছেন।
–তাহলে আজ বেলার দিকে আসতে বলো তাকে।
সকাল দশটায় পোয়ারো আলডিন-এর সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখলেন তাকে যেমন সুন্দর আর তেমনি প্রাণবন্ত লাগছে। তিনি প্রাণ খুলে খোশ গল্প করতে শুরু করলেন। বললেন এক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে লণ্ডনে এসেছিলেন। ডাক্তারের নামও বললেন।
-আমার পুরনো স্মৃতি জড়ানো আছে এই ডাক্তারটির সঙ্গে। তখন পুলিশে কাজ করি। কয়েকটা বদমায়েসকে ধরতে গিয়ে বুলেট লাগে এই কাঁধটায়। তারপর হঠাৎ কিংটন-এর দিকে তাকিয়ে, আচ্ছা আপনার সঙ্গে মিস গ্রে-র দেখা হয়েছে, তাই না?
–আমার সঙ্গে-হ্যাঁ, দু একবার দেখা হয়েছে।
–তাই নাকি! কই আমাকে তো বলেননি কিছু?
–আজ এটা মামুলী কথা বলেই আপনাকে বলিনি।
-না না। মেয়েটিকে আমার ভারী ভালো লাগে। ওই মেয়ে কোথাকার সেন্টমেরি মিড়-এ পড়ে আছে। ভাবলে খুব খারাপ লাগে।
-সত্যিই ভালো মেয়ে। নয়তো অমন একজন খিটখিটে মেজাজের অনাত্মীয়া বৃদ্ধাকে দেখাশোনা করার জন্যে কে অত মাথা ঘামাতো? কিংটন বললেন।
-তা যাই বলুন, ক্যাথারিন-এর মতো মেয়ের এ এক অপমৃত্যুই বলা যায়। বললেন পোয়ারো। আচ্ছা, এবার কিছু কাজের কথা বলব আপনাদের। ধরুন ড্রেক ক্যাথারিন তার স্ত্রীকে খুন করেননি।
-মানে?
দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে।
–ধরুণ আমি বলছি, মিঃ ড্রেক ক্যাথারিন তার স্ত্রীকে খুন করেননি।
–আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি মঁসিয়ে?
-না মঁসিয়ে আলডিন, পাগল আমি নই। তবে লোকে বলে আমি না কি অদ্ভুত স্বভাবের লোক, খামখেয়ালী। যাকগে, যা বললাম তা যদি সত্যি হয়, আপনি তাহলে আনন্দিত না দুঃখিত হবেন?
–নিশ্চয়ই আনন্দিত হব। কিন্তু একি আপনার নেহাতই কল্পনা না এর পেছনে কোনো বাস্তবতা আছে?
-একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখব ঠিক করেছি। কারণ আমার মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত কাউন্টই হবেন বোধহয়। অন্তত ওর পক্ষে যে অসম্ভব ছিল না সেটাই খুঁজে বের করেছি।
পোয়ারো কড়িকাঠের দিকে দেখতে লাগলেন।
-কি করে বের করলেন?
–আমার কতগুলো নিজস্ব পদ্ধতি আছে। আর আছে কৌশল ও বুদ্ধি। তাই দিয়েই বের করতে হয়েছে।
–কিন্তু রুবীর ব্যাপারটা; কাউন্ট-এর কাছ থেকে যে রুবী পাওয়া গেছে সেগুলো তো নকল?
–একমাত্র রুবীগুলোর জন্যেই কাউন্টের পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু একটা জিনিষ আপনারা লক্ষ্য করছেন না; সেটা হলো, শুধু যদি রুবীর ব্যাপারটা ধরেন তাহলে এও সম্ভব যে কাউন্ট-এর আগে আর কেউ হয়তো সেখানে গিয়েছিল, যার পক্ষে রুবীগুলো নিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। আর যার ফলে কাউন্ট হত্যা করার পরও রুবীগুলো পায়নি।
এতো সম্পূর্ণ নতুন কথা বলছেন মঁসিয়ে উত্তেজিত হলো কিংটন। এভাবে কেউই তো চিন্তা করিনি।
আপনি কি এই অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা বিশ্বাস করেন মঁসিয়ে পোয়ারো?–আলডিন জানতে চাইলেন।
-দেখুন মিঃ আলডিন, এটা আমার অনুমান মাত্র, এখনও কিছু প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আমার এই অনুমানের প্রতিটি সূত্রই খুব মূল্যবান। সেইজন্যেই আপনাকে আমার সঙ্গে ফ্রান্সের দক্ষিণে একবার যেতে হবে এবং ঘটনাস্থানে থেকে আমাদের কাজ করে দেখতে হবে।
-আপনি কি বাস্তবিকই আমার যাওয়া প্রয়োজন মনে করেন মঁসিয়ে।
–সেই প্রয়োজনটা আপনি নিজে ভেবে দেখুন মিঃ আলডিন।
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তা কবে যাবেন ঠিক করেছেন? আপনার কিন্তু এখন পরপর অনেকগুলো বোর্ড মিটিং আছে স্যার। –কিংটন মনে করিয়ে দিলেন।
-কিন্তু এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আমার কাছে। ঠিক আছে মঁসিয়ে পোয়ারো, কালই যাবো। বলুন কোনো ট্রেনে যাবেন?
–আমি ঠিক করেছি, ব্লু ট্রেনেই যাবো আমরা। হাসলেন পোয়ারো।