যাই হোক না কেন, কম বয়সটা, ওর বোঝার ক্ষমতা নেই কী করছে।
বেচারা মেরিডিথ বুড়ো, সব সময়ে অতি উৎসাহী পাক্কা সাহেব। আমি বলেছিলাম, চিন্তা কোরো না একটুও বুড়ো খোকা। ও কি করছে এলসা গ্ৰীয়ার জানে এবং ওর ভালোই লাগছে করতে।
আমরা পেয়েছিলাম ঐটুকুই বলার সুযোগ। মনে হয়েছিলো আমার স্বামী পরিত্যক্তা হতে চলেছে ক্যারোলিন এই কথাটা চিন্তা করে খুব সম্ভব মেরিডিথ বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। ক্যারোলিন অবশ্যই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে আশা করবে যে আছে তার প্রতীক্ষায় এতোদিন ধরে তাকে সে নিশ্চয়ই বিয়ে করবে, এই দুর্বলতাটা মেরিডিথের আমি জানতাম এবং মজাও লাগতো আমার বেশ কথাটা ভেবে।
ঐ দুর্গন্ধে ভরা ঘরে গিয়ে মেরিডিথের কি করেছিলাম তা মনে নেই বললেই চলে। নিজের শখের নেশা মানুষ দেখাতে ভালোবাসে পাঁচজনকে। অথচ আমার খুব বিরক্তিকর মনে হয় ব্যক্তিগতভাবে জিনিসটা। মনে পড়ে যতদূর যখন দাদা ল্যাবরেটারিতে বিশদ ব্যাখ্যা করছিলেন কোনাইন বিষের তখন অন্যদের সঙ্গে সেখানে আমিও ছিলাম, তবে স্মরণ নেই ঠিক। এবং ক্যারোলিনকে ঐ জিনিসটা চুরি করতেও দেখিনি। যা বলেছিলাম, বড্ড বেশি চালাক আর চটপটে মেয়ে ক্যারোলিন। প্লেটো দিয়েছিলেন সক্রেটিসের মৃত্যুর যে বর্ণনা সেই অংশটা পড়ে শুনিয়েছিলেন মেরিডিথ। আমার ভালো লাগে না ওসব প্রাচীন সাহিত্য।
এর বেশি আমার আর সেদিনের ঘটনা মনে নেই। বেশ জমিয়ে অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলা একপ্রস্থ ঝগড়া করে নিলো, আমরা বেশ রসিয়ে উপভোগও সেটা করেছিলাম। এর ফলে সম্ভব হয়েছিলো অন্য অসুবিধেগুলো এড়ানো। শেষ পর্যন্ত গালাগালি দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলো, অ্যামিয়াসকে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে অভিশাপ দিয়েছিলো-১। সে এর বদলা নেবে, ২। অ্যাঞ্জেলা মরণ কামনা করছে অ্যামিয়াসের, ৩। অ্যামিয়াস কুষ্ঠ ব্যাধি হয়ে মরুক, তাহলেই শাস্তি হবে উপযুক্ত, ৪। অ্যামিয়াসের নাকে রূপকথার কাহিনীর মতো যেন সসেজ আটকে যায়, না খোলে কিছুতেই। ওর ছেলেমানুষী কথা শুনে খুব হেসেছিলাম আমরা।
বিছানায় তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলো ক্যারোলিন, মিস উইলিয়ামস চলে গেলেন তার ছাত্রীর সন্ধানে –এলসা আর অ্যামিয়াস বাগানে বেড়াতে গেলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে আমাকে কেউ চাইছিলো না, তাই একা একা আমি বেড়াতে লাগলাম, ভারী সুন্দর ছিলো রাতটা।
নিচে নেমে এসে পরদিন সকালে বসলাম খাবার ঘরে, মাঝে মাঝে বেশ মজার জিনিস মানুষ মনে রাখে। তাই আমারও সেদিনের খাবারের কথাগুলো মনে আছে স্পষ্ট।
পরে ঘুরে ঘুরে আমি সবার খোঁজখবর শুরু করেছিলাম নিতে। গেলাম বাইরে, কোথাও নেই কেউ, সিগারেট একটা খেয়ে ফিরছি, দেখি মিস উইলিয়ামস খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ফাঁকিবাজ ছাত্রীকে। শুনতে পেলাম হলঘরে ফিরে এসে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন লাইব্রেরী ঘরে কথা কাটাকাটি করছে। ওরা বেশ জোরেই কথা বলছিলো, ক্যারোলিন বলছে আমি শুনলাম, তুমি আর তোমার ঐ মেয়ে মানুষটা। ইচ্ছা করছে তোমাকে খুন করতে, আমি তোমাকে এক দিন না একদিন খুন করবই। অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো, ক্যারোলিন বোকামি কোরো না। উত্তরে ক্যারোলিন বলেছিলো, করি কিনা দেখো।
আমার আড়াল থেকে আর ওদের ঝগড়া ইচ্ছে হয়নি শুনতে, বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। এলসার সঙ্গে চত্বরে দেখা হাঁটতে হাঁটতে।
এলসা একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছিলো, পাতা ছিলো বেঞ্চটা লাইব্রেরী ঘরের জানলার ঠিক নিচে। এলসা সব কথাই জানালাটা খোলা ছিল বলে শুনতে পেয়েছিলো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অত্যন্ত শান্তভাবে এলসা এগিয়ে এলো আমাকে দেখে, হাসি মুখে, হাত ধরে আমাকে বললো, কি সুন্দর সকালটা, তাই না?
সকালটা সুন্দরই ছিলো বটে তার মতো নিষ্ঠুর মেয়ের পক্ষে। না, বলা ঠিক নয় অতোটা। মোটামুটি সৎ আর বড় বেশি গদ্যময় মেয়েটি। ও শুধু নিজের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কিছু দেখে না।
ওর সঙ্গে প্রায় মিনিট পাঁচেক গল্প করলাম চত্বরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দড়াম করে লাইব্রেরীর দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠে দেখলাম বেরিয়ে আসছে অ্যামিয়াস। মুখ চোখ লাল। তারপর ভদ্রতার ধার কোনোরকম না ধরেই এলসার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলো সময় হয়েছে সিটিং হয়েছে, শেষ করতে হবে ছবিটা।
বললো এলসা, ঠিক আছে। শুধু একবারটি আমি গিয়ে আনবো সোয়েটারটা, শীত শীত করছে একটু।
বাড়ির ভেতরে গেলো এলসা। ভাবছিলাম আমি দেখি আমার সঙ্গে কথা বলে কি না অ্যামিয়াস। ঠিকই বললো, তবে কয়েকটা মাত্র শব্দ, এই সব মেয়েমানুষগুলো।
বুড়ো খোকা ওসব কথা বাদ দাও হাসতে হাসতে আমি বললাম।
ফিরে না আসা পর্যন্ত এলসা আর আমাদের কোনো কথা হয়নি।
কামান বাগানে ওরা দুজনেও চলে গেলে বাড়ির মধ্যে আমিও ফিরলাম। ক্যারোলিন দাঁড়িয়েছিলো হলঘরে, লক্ষ্য করলো কি না আমাকে জানি না। মাঝে মাঝে ও ওইরকম করতো। নিজেকে হঠাৎ ভীষণভাবে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতো। আপন মনে বিড়বিড় করে ক্যারোলিন কি যেন বলছিলো। আমার কানে কয়েকটা কথা এসেছিলো, বড্ড বেশি নিষ্ঠুর…
ও ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলো। তারপর হেঁটে আমার পাশ দিয়ে ওপরে চলে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। আমাকে তখন লক্ষ্য করেনি কিন্তু, ও যেন মনে হচ্ছিলো একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নিজের ধারণা আমার (অবশ্য আমার কোনো অধিকার নেই একথা বলার, বলে রাখছি একথা আপনাকে) ও গিয়েছিলো ওপরে বিষটাকে নেবার জন্য এবং ও ঠিক করে নিয়েছিলো তখনই কি করবে।