- বইয়ের নামঃ ফাইভ লিটল পিগস্
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ বুক স্ট্রিট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
ফাইভ লিটল পিগস্
১.১ আসামী পক্ষের উকিল
ফাইভ লিটল পিগস্ (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
ভূমিকা :- কার্লা লেমারচেন্ট
আগ্রহ আর প্রশংসার দৃষ্টিতে এরকুল পোয়ারো লক্ষ্য করছিলো মেয়েটিকে। মেয়েটি ঘরের মধ্যে এলো চাকরের পেছন পেছন।
তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য ওর লেখা চিঠিতে ছিলো না। সাদামাঠা একটা অনুরোধ মাত্র দেখা করার জন্যে, চিঠিটিতে কেন দেখা করতে চায় তার আভাস বিন্দুমাত্র দেওয়া হয়নি। ব্যবসাদারী ঢংয়ে ছোট্ট করে লেখা চিঠি, হাতের লেখার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে শুধু বোঝা যায় যে একজন কমবয়সী মহিলা কার্লা লেমারচেন্ট।
এখন সশরীরে সেই মেয়েটিই হাজির। ছিপছিপে গড়ন, লম্বা, বয়স কুড়ি-বাইশ হবে। মানুষ দুবার বাধ্য তাকাতে এই ধরনের যুবতীদের দিকে। পোষাক দামী ও সুন্দরও বটে, বেশ সামঞ্জস্য আছে কাঁধ আর মাথার মধ্যে। বেশ পুরু প্রাটি, চমৎকার নাকের গড়নটিও, সুস্পষ্ট চিবুকে দৃঢ়তার ছাপ। বেশ সতেজ প্রাণবন্ত চেহারা। এই সজীব ভাবটা রূপের চেয়েও বেশি সুস্পষ্ট।
এরকুল পোয়ারোর নিজেকে বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছিলো ঘরে মেয়েটি আসার আগে, এখন কেটে গেছে সেই ঝিমুনিটা, বেশ সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে নিজেকেও।
ওকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে পোয়ারো এগিয়ে এলো এবং বুঝতে পারলো তখনই পোয়ারোকে তীক্ষ্ণ ভাবে মেয়েটি তার গাঢ় ধূসর রঙের চোখ দিয়ে জরীপ করছে।
মেয়েটি পোয়ারোর বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেট বসার পর ধরালো। পোয়ারোকে লক্ষ্য করেই চললো দু-একটা টান দিয়ে।
পোয়ারো খুব শান্ত গলায় বললো, হ্যাঁ, আগেই স্থির করে নিতে হবে মনটা, তাই নয় কি?
মেয়েটি চমকে উঠল, মাফ করবেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথা। খুব আকর্ষণীয় মেয়েটির কণ্ঠস্বর, খসখসে ভাব আছে একটু, তবে ভীষণ ভাল লাগে সেটা।
মনস্থির করতে তো পারছেন না আপনি, ভাবছেন এসে পড়েছেন একটা হাতুড়ের কাছে, না আমার মতো সত্যিসত্যিই লোকই দরকার আপনার।
হেসে ফেললো মেয়েটি, আঁ…হা…ব্যাপার এই ধরনের আর কি। মঁসিয়ে পোয়ারো সত্যি বলতে কি, যা কল্পনা আমি করেছিলাম আপনার কিন্তু তার সঙ্গে মিল নেই।
এবং বৃদ্ধ আমি, তাই না? যা ভেবে আপনি এসেছিলেন তার চেয়েও বৃদ্ধ?
হ্যাঁ..তাও বটে অনেকটা…, মেয়েটি একটু দ্বিধাভাবে বললো, একটু স্পষ্টাস্পষ্টি কথাটা আমি বলতে চাই, দেখুন…আমার প্রয়োজন…প্রয়োজন নয় শুধু…আমার প্রয়োজন সবার সেরা সাহায্য।
থাকতে পারেন নিশ্চিত, সবার সেরা আমিই।
দেখছি আদৌ আপনি বিনয়ী নন, বললো কালা, ঠিক আছে আপনার কথা আমি মেনে নেবো মনে করছি।
পোয়ারো ধীর গলায় বলল, সকলকে যে পেশীর সাহায্য নিয়েই কাজ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দেখুন হাঁটা হামাগুড়ির সাহায্যে, পায়ের ছাপের মাপ নেওয়া, সিগারেটের টুকরো কুড়নো বা চাপে নুয়ে পড়া ঘাস ইত্যাদি নিয়ে আমি কাজ কারবার করি না। আমার কেবল চেয়ারে বসে চিন্তা করতে পারলেই চলে। শুধু এইটা কাজ করে…পোয়ারো নিজের ডিমের মতো মাথাটা দেখালো।
জানি। আর আপনার কাছে সেই জন্যেই এসেছি। দেখুন এক অসাধ্য-সাধন করতে হবে আপনাকে।
একটু নড়েচড়ে বসলো এরকুল পোয়ারো, ব্যাপারটা বেশ মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং হবে।
কার্লা লেমারচেন্ট জোরে নিঃশ্বাস নিলো, তারপর মাথা নিচু করে বললো, কার্লা নয়, আমার নাম ক্যারোলিন, আমার মায়ের নাম মিলিয়ে আমার নাম রাখা হয়েছিলো, আবার একটু থেমে নিয়ে বললো, আমাকে লেমারচেন্ট বলে সবাই জানলেও আমার আসল পদবী ক্রেল।
সামান্য চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো পোয়ারোর কপালে, ক্রেল মনে হচ্ছে যেন শোনা শোনা।
শিল্পী ছিলেন আমার বাবা, বেশ সুখ্যাতি ছিলো ছবি আঁকার ব্যাপারে–বাবা খুব নাম করা চিত্রশিল্পী ছিলেন অনেকে বলেন। তাই মনে হয় আমার…।
প্রশ্ন করলো পোয়ারো, অ্যামিয়াস ক্রেল?
হ্যাঁ। …মেয়েটি একটু থেমে তারপর বললো, আমার মা ক্যারোলিন ক্রেলের বিচার হয়েছিলো বাবাকে খুন করার জন্যে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ,…মনে পড়ছে বটে এখন…তবে খুব আবছা ভাবে। তখন আমি বিদেশে ছিলাম। কিন্তু অনেকদিন আগেকার ঘটনা সেটা।
ষোলো বছর, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো মেয়েটি। ভীষণ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখটা। এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা শুধু চোখগুলোতে।
বুঝতে পারছেন আমার কথা? …মার শাস্তি হয়েছিলো বিচারে। অবশ্য ফাঁসি দেওয়া হয়নি, কারণ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্যে ওঁদের মতে অনেকটা কমে গিয়েছিলো অপরাধের গুরুত্ব। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় মাকে। তবে মা জেলেই এক বছরের মাথায় মারা যান। বুঝতে পারছেন? …সব কিছু হলো…ঘটলো…এবং হয়ে গেলো শেষও…।
অতঃপর, খুব ঠান্ডা গলায় পোয়ারো প্রশ্ন করলো।
হাতের মুঠি দুটো কার্লা লেমারচেন্ট নামের মেয়েটির শক্ত হয়ে উঠলো, ওর বলার মধ্যে থেমে থেমে বললেও অদ্ভুত ধরনের এক প্রত্যয় ছিলো। ও বলতে লাগলো,
ব্যাপারটা আপনাকে ঠিক মতো বুঝতে হবে–মানে যা বলতে চাইছি আমি। যখন ঘটেছিলো ব্যাপারটা তখন বয়স আমার প্রায় পাঁচ। তখন ব্যাপারটা বোঝার মতো বয়স আমার নিশ্চয়ই ছিলো না। মাকে…বাবাকে ঠিকই মনে আছে, আর আমাকে হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় তাও আমার মনে আছে। মনে আছে মোটাসোটা চাষী বৌ আর শুয়োরগুলোর কথাও…আমাকে স্নেহ করতো সবাই…আমার দিকে সবাই কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাতো আমি সে কথাও ভুলিনি। এটা বুঝতে পারতাম কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, যেমন বুঝতে পারে সব বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, কিন্তু সেটা যে কী তা জানতাম না।
আমাকে জাহাজে করে তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো, আমার কাছে সে যে দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার ছিলো। শেষ পর্যন্ত কানাডায় পৌঁছলাম আমি, দেখা হলো সাইমন মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। তারপর মনট্রিয়ালে মাসী লুইসি আর মেসো সাইমনের সঙ্গে আমি থাকতে লাগলাম। মাসীরা মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলতেন তারা শীগগীরই আসবেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে গেলে ওদের কথা ভুলেই গেলাম। কেমন যেন একটা আবছা ধারণা আমার জন্মে গেল তারা যেন আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। যদিও সেকথা খোলাখুলিভাবে আমাকে কেউ বলেননি। এবং যা হয় এরপর আমি আর ভাবতাম না মা বাবার কথা। আমার মাসীর বাড়িতে বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন মাসী আর মেসো। আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। অনেক বন্ধু বান্ধব হলো। আমার যে একটা অন্য নাম আছে তাও আমার মনে রইলো না। আমার যে লেমারচেন্ট পদবী নয় তাও গেলাম ভুলে। কানাডাতে ঐ নামই চলবে তা মাসী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এবং আমারও মনে হয়েছিলো হয়তো নিয়মটা তাই। কিন্তু ঐ যে পরে বলেছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে অন্য একটা নাম আমার আগে ছিলো।
কার্লা তারপর হঠাৎ তার একটু অহংকারীর মত মুখটা উঁচু করে বললো, দেখুন আমাকে, মনে হয় না যে দেখলে এমন একটা মেয়ে এ যে কোনো কিছুতেই সে ঘাবড়াবার পাত্রী নয়, বা কোনো দুঃশ্চিন্তা এর থাকতে পারে। অবস্থা আমার সচ্ছল, স্বাস্থ্যও সুন্দর। খারাপ নই দেখতেও, উপভোগ করতে জানি জীবনকে। যখন কুড়ি বছর বয়স ছিলো আমার তখন নিজেকে ছোট মনে করতাম না পৃথিবীতে কারুর চেয়ে।
কিন্তু আমার জীবনে তারপর থেকেই এল এক সমস্যা। নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে শুরু করলো। প্রসঙ্গঃ আমার বাবা মা। কে ছিলেন তারা? কি করতেন? হয়তো আমি উঠে পড়ে লাগতামও সবকিছু জানবার জন্যে।
মাসীরা কিন্তু তার আগেই আমাকে জানিয়েছিলেন সত্যি কথাটা। তখন পা দিয়েছি আমি একুশে। আমাকে ওঁরা অবশ্য বাধ্যই হয়েছিলেন বলতে কারণ আমার হাতে আমার টাকাকড়ি এখন তুলে দেওয়া হলো, আর জানেন আমার হাতে ঠিক তখনই এলো চিঠিটা। আমাকে উদ্দেশ্য করে যে চিঠিটা লিখে রেখে গিয়েছিলেন আমা মা মারা যাবার আগে।
মেয়েটির মুখের ভাব মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই কেমন যেন মলিন হয়ে উঠলো। সেই উজ্জ্বলতা আর নেই তার চোখের দৃষ্টিতে। তার বদলে সেখানে ফুটে উঠলো ছায়াঘেরা ছোট্ট দীঘির মতো শান্ত গভীরতা। আবার মেয়েটি বলতে শুরু করলো, আর আমি ঠিক তখনই সত্যি কথাটা জানতে পারলাম যে খুনের অপরাধে আমার মা দণ্ড পেয়েছিলেন। মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না কয়েক সেকেন্ড, আবার মুখ খুললো ধীরে ধীরে, আর একটা ব্যাপার আছে আপনাকে যেটা বলতেই হবে। আমার বিয়ের কথা এক জায়গায় ঠিক আছে। মাসীরা বলেছিলেন আমার বয়েস একুশ না হওয়া পর্যন্ত যেন আমি অপেক্ষা করি। ওরা কেন ও কথা বলেছিলেন তা এখন বুঝতে পারি।
একটু নড়েচড়ে উঠলো পোয়ারো, তারপর মুখ খুললো প্রথম, কি প্রতিক্রিয়া হলো আপনার বাগদত্তের ঐ কথা শুনে?
জনের? এসব পরোয়া করে না জন। আমাকে ও বললো ও এসব ঘটনা নিয়ে রাজী নয় মাথা ঘামাতে। ও আর আমি বলতে জন আর কার্লাকে শুধু বোঝে, ও চিন্তা করে না অতীত সম্বন্ধে। মেয়েটি আবার একটু ঝুঁকে বসে বললো, এখনও কিন্তু আমরা বাগদত্ত। কিন্তু এটা উড়িয়ে দেবার ব্যাপার নয় তা তো আপনি বোঝেন, আমার কাছে এমন কি জনের কাছেও নয়…মাথা ঘামাচ্ছি না অতীতটা নিয়ে, কিন্তু ভবিষ্যৎ?–হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠলো মেয়েটির, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো আমরা তো নিশ্চয়ই বিয়ের পর বাচ্চা চাইবো এবং আমাদের সন্তান এরকম একটা অস্বস্তিকর আশংকার মধ্যে মানুষ তোক এটা আমি চাই না।
পোয়ারো বললো, কিন্তু আপনি কি এটা বুঝতে পারেন না যে এই ধরনের হিংসাত্মক বা পাপের ঘটনা প্রত্যেক পরিবারের অতীত ইতিহাসে বিরল নয়?
ঠিক বুঝতে পারছেন না আপনি। আপনার কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু সাধারণতঃ তা কেউ জানে না বা মনে রাখে না। আমি যে জেনে ফেলেছি, তাছাড়া এই ধরনের ঘটনাটা যে আমার নিকটতম আত্মীয়ের জীবনে ঘটে গেছে। আমি দেখেছি মাঝে মাঝে জন যেন কেমন ভাবে তাকায় আমার দিকে। ধরুন ওকে যদি বিয়ের পর আমি আমার দিকে ঐভাবে তাকাতে দেখি?
কিভাবে মারা যান আপনার বাবা?
কার্লা অকপটভাবে পরিষ্কার করে বললো, বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো।
বুঝেছি, কথা বলে পোয়ারো চুপ করে গেলো।
কার্লা একটু পরে নির্লিপ্ত অথচ শান্তভাবে বললো, ধন্যবাদ আপনার সহৃদয়তার জন্যে। আমার কথাটা আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এতে কৃতজ্ঞ আমি। আপনি যে আমাকে স্তোক দেবার চেষ্টা করেননি মামুলী সান্ত্বনার কথা বলে এতেই মনে হয় কাজ হবে আমার।
আমি ভালই বুঝেছি আপনার ব্যাপারটা। একটা কথা বুঝতে পারছি না…আপনি আমার কাছ থেকে কি চান?
কার্লা খুব সরলভাবে জানালো, জনকে বিয়ে করতে চাই আমি। সত্যিই চাই। আমি মা হতে চাই দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের। এবং বাস্তবে যেন সেটা সম্ভব হয় আপনাকে তার জন্যে সাহায্য করতে হবে।
তার মানে–মানে আমি আপনার জনের সাথে কথা বলি আপনি কি তাই চান? না, না, বড্ড বেশি করে বোকামির কাজ হয়ে যাবে। যা বলতে চাইছিলেন আপনি তার সঙ্গে যেন এর কোথায় একটা দারুণ অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। খুলে বলুন না কি চান আপনি?
মঁসিয়ে পোয়ারো শুনুন, আমার কথাটা পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করুন–আমি আপনাকে একটি খুনের কেসের তদন্ত করার জন্যে নিয়োগ করতে চাইছি।
কি বলতে চাইছেন আপনি?
হ্যাঁ, চাইছি। খুনের কেস খুনেরই কেস, তা সে গতকালই হয়ে থাক, খুনটা বা ষোলো বছর আগেই হয়ে থাক তাতে যায় আসে না এমন কিছু।
কিন্তু…।
মঁসিয়ে পোয়ারো দাঁড়ান, আপনি এখনও শোনেননি সবটা, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আছে।
বলুন। আবার গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে পোয়ারো।
নির্দোষ ছিলেন আমার মা। কার্লা লেমারচেন্ট বললো।
পোয়ারো নিজের নাকটা ঘসতে ঘসতে বিড়বিড় করে বললো, ও হ্যাঁ, স্বাভাবিক খুবই..তাই অনুমান করেছিলাম আমিও…।
ভাবালুতার ব্যাপার নয় কিন্তু এটা। একটা চিঠি আছে মার লেখা। আমার জন্যে এটা রেখে গিয়েছিলেন মারা যাবার আগে। চিঠিটা আমাকে একুশে পা দিলে দেওয়া হয়। মা ওটা আমাকে একটি মাত্র কারণেই লিখেছিলেন–যেন কোনো সন্দেহ না থাকে আমার মনে। এটুকুই চিঠির মূল বক্তব্য। মা করেননি ও কাজটা আর আমি যেন বিনা দ্বিধায় সে কথাটা বিশ্বাস করি।
এরকুল পোয়ারোর দিকে যৌবন দীপ্ত একটি মুখ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দেখে ধীরে ধীরে সে বললো, তা তো বটেই…।
মৃদু হেসে কার্লা বললো, না, ঐ রকম ছিলেন না আমার মা। মনে করছেন আপনি হয়তো মিথ্যে কথাটা–মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে একটা আবেগের ঘোরে!…না মঁসিয়ে পোয়ারো, শুনুন কতগুলো এমন জিনিস থাকে যা খুব ভাল বোঝে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, মনে রাখে, আমার মনে আছে আমার মার কথা–যদিও টুকরো টুকরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, তবে কি ধরনের মানুষ তিনি ছিলেন তা মনে আছে। কখনো মিথ্যে কথা মা বলতেন না এমন কি স্নেহ মমতা দেখাতে গিয়েও না। মনে দুঃখ পাবে জানলেও সব সময়ে তিনি সত্যি কথাটা বলতেন। তার স্বাভাবিক এক অনীহা ছিল মিথ্যে সম্বন্ধে। উনি যে খুব ভালবাসতেন আমাকে তা মনে হয় না, তবে মাকে খুব বিশ্বাস করতাম আমি। এখনও করি। যদি মা বলে থাকেন বাবাকে খুন করেননি তিনি, তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই পারে না থাকতে যে খুন করেছেন মা। বিশেষ করে মৃত্যু আসন্ন এটা যখন উনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন তখন এই ধরনের একটা কথা যা কিনা মিথ্যে তা তিনি লিখে যেতে পারেন বলে বিশ্বাস হয় না আমার।
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো মন খুব একটা সায় না দিলেও! যেন মেনে নিচ্ছে কথাটা। বলে চললো কার্লা, এবং জনকে বিয়ে করার ব্যাপরে সেই কারণেই আমার কোনো দ্বিধা নেই। কারণ মার দিক থেকে ও ধরনের কিছু ঘটেনি তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু জনের ব্যাপারটা আলাদা। সাধারণ সব মেয়েরই মত ও মনে করে নিজের মাকে আমিও নির্দোষ ভাবছি। ফলে পরিষ্কার হওয়া উচিত ব্যাপারটা। এবং মঁসিয়ে পোয়ারো ও কাজটা করতে হবে আপনাকেই।
আপনার কথাটা ঠিক তা ধরে নিচ্ছি…কিন্তু ইতিমধ্যে তা কেটে গেছে ষোলটা বছরও।
কাজটা খুবই কঠিন তা মানছি। কিন্তু এ কাজটা আপনি ছাড়া আর কেউই করতে পারবে না।
দুটো চোখ এরকুল পোয়ারোর ঝিকমিক করে উঠলো, এ হে হে, একেবারে আমাকে তুলে দিচ্ছেন গাছে।
আপনার কথা আমি শুনেছি, সব কেস যে করেছেন তাও জানি, জোগাড় করেছি কি ভাবে করেছেন সে খবরও। বেশিটা আপনি নির্ভর করেন মনঃস্তত্ত্বের ওপর, তাই না? আর কখনও তো ওটা বদলায় না। সিগারেটের টুকরো, পায়ের ছাপ, নুয়ে পড়া ঘাস–ওগুলো তো নশ্বর জিনিস, আপনার নিশ্চয়ই ওসবে দরকার হবে না। তবে খুঁটিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন ঘটনার পুরো বিবরণটা, তখনকার মানুষজনের সঙ্গেও দরকার পড়লে কথা বলতে পারেন। এখনও বেঁচে আছেন তাদের প্রায় সকলেই…এবং তারপর..তারপর…চেয়ারে হেলান দিয়ে আপনার কথাতেই বলছি শুধু চিন্তা করে তুলে ধরতে পারেন প্রকৃত ঘটনার স্বরূপ…।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরকুল পোয়ারো,-গোঁফে এক হাত দিয়ে তা দিতে দিতে বললো, মাদমোয়াজেল, দারুণ সম্মানিত বোধ করছি আমি। আমি আপনার এই অগাধ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো। আমি দায়িত্ব নিলাম খুনের রহস্য ভেদ করার। ষোল বছর আগেকার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে তুলে ধরবোই প্রকৃত সত্যকে আমি।
উঠে দাঁড়িয়েছে কালাও, উজ্জ্বল আভা তার চোখেও, কিন্তু শুধু মুখে বললো, বেশ।
পোয়ারো বললো আঙুল তুলে, এক মিনিট আর, সত্যের স্বরূপ আমি প্রকাশ করবো তা আমি বলেছি। পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন আমার মধ্যে ওঠে না। আপনার মা নির্দোষ আপনি বলেছেন, এখন সেটা আমি মেনে নিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত যদি তিনিই প্রমাণিত হন দোষী? কি হবে তখন?
অহংকারীর মতো কার্লা ঘাড় বেঁকালো, তার মেয়ে আমি। সত্যি কথাটা আমি জানতে চাই।
ঠিক আছে, দেখা হবে আবার তাহলে।
.
প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
আসামী পক্ষের উকিল :
আমার মনে আছে কি না ক্রেল মামলা? স্যার মন্টেগু ডিপ্লিচ প্রশ্ন করলেন, নিশ্চয়ই আছে, মনে আছে খুব ভালোভাবেই বেশ আকর্ষণ ছিলো মহিলার, তবে কিছু একটা গণ্ডগোলও ছিল মাথায়। বড্ড বেশি আত্মসংযমের অভাব।
পোয়ারোর দিকে স্যার মন্টেগু আড়চোখে তাকালেন, কিন্তু কেন আমাকে ওকথা জিজ্ঞেস করছেন?
দরকার আছে আমার। এটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, স্যার মন্টেগু তার কুখ্যাত নেকড়ে হাসি হাসলেন, যে হাসি ধরিয়ে দিতো অতীতে সাক্ষীদের হৃৎকম্প বলে খ্যাতি আছে। আমি হেরে গিয়েছিলাম এই মামলাটায়। পারিনি মহিলাকে বাঁচাতে।
জানি, সংক্ষেপে সারলো পোয়ারো।
কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার মন্টেগু, অবশ্য আমার ততো অভিজ্ঞতাও তখন ছিলো না, তবে যতোটা করা সম্ভব মনের মানুষের পক্ষে ততটাই আমি করেছিলাম। খুব একটা এগোনো যায় না সহযোগিতা না পেলে। দরখাস্তও করেছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সব মা-বৌয়েরা, মহিলাটির ওপর সবার সহানুভূতি ছিলো।
স্যার মন্টেগু পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে হঠাৎ বেশ বিজ্ঞজনোচিত ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বললেন, যদি গুলি করতেন মহিলা, বা খুন করতেন ছুরি দিয়ে তবে আমি সাজাতে পারতাম মানুষ খুনের মামলা। কিন্তু বিষ…খেলা করা চলে না এটা নিয়ে। ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে ওঠে…খুবই জটিল।
কি ছিলো আসামী পক্ষের বক্তব্য, প্রশ্ন করলো পোয়ারো, যদিও ইতিমধ্যে সে পড়ে ফেলেছে পুরোনো খবরের কাগজ। জেনেও নিয়েছে পুরো ঘটনাটা, কিন্তু তার ভালই লাগছিলো না জানার ভান করতে। স্যার মন্টেগুর সামনে বিশেষ করে।
আরে ঐ আত্মহত্যার ব্যাপার। ও ছাড়া একমাত্র আর তো বলা যায় না কিছু। কিন্তু সেটিও তুলে ধরা যায়নি ঠিক মতো। আত্মহত্যা করার লোকই ছিলো না ক্রেল। আপনার কখনো ওর সাথে দেখা হয়নি, তাই না, না। ও একটা দারুণ প্রাণ চঞ্চল, খোশ মেজাজী মানুষ ছিলো। কলির কেষ্ট বিয়ার–পাগল..এই জাতীয় যা কিছু বাকি ওর সব গুণই ছিলো। প্রবল ছিল দেহ লালসা, এবং মনে হয় তার বেশ ভালই লাগতো। নিজের থেকে চুপচাপ বিষ খেয়ে এই ধরনের নোক খতম করবে নিজেকে এটা বোঝানো কষ্টকর জুরীদের। আদৌ তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ওটা হারা মামলা। আর ঠিক মতো তাল সামলে চলতে পারলেন না মহিলাও। আর উনি কাঠগড়ায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো। লড়াই করার কোনো চেষ্টাই ওর তরফ থেকে ছিলো না। আর আপনার মক্কেলকে যদি আপনি কাঠগড়ায় তুলতে না পারেন বুঝতেই পারছেন জুরীরা যা বোঝার বুঝে নেবেন।
পোয়ারো বললো, সহযোগিতা না পেলে কিছুই যে করা যায় না, একটু আগে বললেন–তাই কি এর মানে?
নিশ্চয়ই, জাদুকর তো আর আমরা নই, কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারছে আসামী জুরীদের ওপর, অর্ধেক লড়াই নির্ভর করে তারই ওপর। বহুবার দেখেছি আমি জুরীরা একমত হন না জজের বক্তব্য বোঝানোর সঙ্গে। করেছে ঠিকই বা ও করতেই পারে না একাজ–তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এই ধরনের মনোভাব। সংগ্রামী মনোভাব দেখাবার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি ক্যারোলিন ক্রেল।
কিন্তু কেন?
স্যার মন্টেগু কাঁধ ঝাঁকালেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে। জিজ্ঞেস করবেন না ও কথা। ক্যারোলিন ভালই বাসতো স্বামীকে, একেবারে ভেঙে পড়েছিলো নিজের অপরাধের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে। আমার বিশ্বাস আঘাতটা সামলাতে পারেননি বলেই।
মহিলাটি তাহলে আপনার মতে অপরাধ করেছিলেন?
একথা শুনে স্যার মন্টেগু যেন চমকে উঠলেন, আহ…মানে…মনে হয়েছিলো তো আমার আমরা ও কথাটা মেনে নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
কখনো কি আপনার কাছে ক্যারোলিন ক্রেল অপরাধ স্বীকার করেছিলেন?
বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন স্যার মন্টেগু, না, না…নিশ্চয়ই না। কয়েকটা নীতিনিয়ম আছে আমাদের, আপনি নিশ্চয়ই জানেন। মক্কেল নির্দোষ তা ধরেই নেওয়া হয়। যদি এতো কৌতূহল থাকে আপনার তাহলে তো মুশকিল হলো দেখছি, কারণ আপনি তো আর মেহিউকে পাবেন না। এই মামলার ব্রিফ পেয়েছিলাম মেহিউর কাছ থেকেই আমি। এ ব্যাপারে বুড়ো মেহিউ অনেক ভাল বলতে পারতেন আমার থেকে। কিন্তু এখনতো আর উনি এ জগতে নেই। অবশ্য জর্জ মেহিউ নামে ওনার ছেলে আছে, কিন্তু সেও তো ষোলো বছর আগে বাচ্চা ছিলো। ব্যাপারটা অনেকদিন আগেকার, তাই না।
হ্যাঁ, জানি তা, আপনার অনেক কিছুই মনে আছে তা আমার ভাগ্য। স্মৃতি শক্তির প্রশংসা আপনার করতে হয়।
বেশ খুশি হলেন স্যার মন্টেগু, আস্তে আস্তে বললেন, মানে সকলেরই মনে থাকে হেডলাইনগুলো। বিশেষ, করে তো কথাই নেই যদি অভিযোগটা খুনের হয়। তাছাড়া কাগজে খুব হৈচৈ করেছিলো ক্রেল মামলাটা নিয়ে। ব্যাপারটা মেয়ে ঘটিত ব্যাপার তো, এর মধ্যে জড়িত ছিলো যে মেয়েটি, সে আবার দেখতে দারুণ, তবু শক্ত ধাতুতে গড়া।
যদি বারবার একটা কথা আমি জিজ্ঞেস করে ফেলি, আমায় ক্ষমা করবেন দয়া করে। একবার প্রশ্ন করছি আমি, দোষী ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল, আপনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে ছিলেন তো?
আবার কাঁধ ঝাঁকালেন স্যার মন্টেগু, নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি সত্যি কথা বলতে কি, ও ব্যাপারে সন্দেহ করার কিছু ছিলো না তা আমার মনে হয়। হা…ওটা ক্যারোলিনই করেছিলো।
কি কি সাক্ষ্য প্রমাণ ছিলো ওঁর বিরুদ্ধে?–জানতে চাইলো পোয়ারো, খুবই খারাপ। উদ্দেশ্য ছিলো প্রথমেই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কয়েকবছর ধরে ছিলো অনেকটা কুকুর-বেড়ালের মতো, ঝগড়া হতো প্রায়ই। প্রায়ই কোনো না কোনো মেয়ের সঙ্গে স্বামীটি জড়িয়ে পড়তো। নিজেকে সংযত কিছুতেই রাখতে পারতো না। ঐ ধরনের স্বভাব ছিলো। মোটামুটি সহ্য করে নিতো স্ত্রীটি। কিছুটা লাগাম ছেড়ে রেখেছিলো মেজাজের কথা ভেবে, তাছাড়া একেবারে পয়লা-সারির চিত্রশিল্পী ছিলো স্বামীটি। অনেক দামে বিক্রি হতো ওর আঁকা ছবি। আমার অবশ্য ঐ ধরনের ছবি পছন্দ হয় না, তবুও অসাধারণ ওর ছবিগুলো একথা পারবো না অস্বীকার করতে।
ঐ যে বলছিলাম মাঝে মাঝে ঝঞ্ঝাট বাঁধতো মেয়েদের নিয়ে। মুখ বুঝে সব সহ্য করার মতো ভীরু মিসেস ক্রেল ছিলো না। চেঁচামেচিও হতো, এবং শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছেড়ে আবার স্বামীটি ফিরে আসতে স্ত্রীর আশ্রয়ে আবার ভুলেও যেতো ঐ সব ঘটনা। কিন্তু অন্য ধরনের ছিল শেষ ঘটনাটি। ভীষণ কম বয়েসী ছিলো এবারের মেয়েটি, মাত্র কুড়ি।
এলসা গ্ৰীয়ার ছিলো ওর নাম। ইয়র্ক শায়ারের এক ব্যবসাদারের একমাত্র মেয়ে। টাকা ও গোঁ দুটোই ছিলো মেয়েটির। আর সে ভাল বুঝতো নিজের প্রয়োজনটাও। অ্যামিয়াস ক্রেলের ওপর ওর নজর পড়লো। নিজের ছবি আঁকাবে ক্রেলকে দিয়ে। এই ধরনের সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ও অবশ্য প্রতিকৃতি আঁকতো না, তবে আঁকতো মানুষের ছবি। তাছাড়া মনে হয় না কোনো মহিলা তার নিজের ছবি ওকে দিয়ে আঁকাতো, কারণ কাউকে ছেড়ে ক্রেল কথা বলতো না। কিন্তু ও এঁকে ছিল এই মেয়েটির ছবি, আর শেষের দিকে জড়িয়েও পড়েছিলো পুরো মাত্রায়। ওর তখন চল্লিশ বছর বয়স হতে চলেছে। বুঝতেই পারছেন, বেশ কয়েক বছর হলো বিয়েও হয়ে গেছে। ওর একরত্তি মেয়ের জন্যে ভেড়া হয়ে ওঠার বয়েস হয়ে উঠেছিলো, আর এলসা গ্ৰীয়ার হলো সেই একরত্তি মেয়েটা। ক্রেল ওর জন্য পাগল হয়ে গিয়ে স্ত্রীকে তালাক দেবার চিন্তা করতে শুরু করেছিলো এলসাকে বিয়ে করার কথাও।
এটা মেনে নিতে রাজী ছিল না ক্যারোলিন ক্রেল, শাসিয়ে ছিলো স্বামীকে, ওদের কথাবার্তা দুজন মানুষ শুনে ফেলেছিলো, বিশেষ করে যখন তার স্বামী অ্যামিয়াসকে ক্যারোলিন বলেছিলো, যদি না ছাড়ে ওই মেয়েটাকে তবে ক্যারোলিন ওকে খুন করবে। এবং ওর শুধু ওটা মুখের কথা ছিল না। আগের দিন ঘটে ঘটনাটা, ওরা চা খেতে গিয়েছিলো এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। লতাপাতা নিয়ে শখের গবেষণা করতেন সেই প্রতিবেশীটি। নানা রকমের ওষুধ-বিষুধ বাড়িতেই তৈরি করতেন। কোনাইন ছিল ওঁর তৈরি করা ওষুধের মধ্যে একটা–এই বিষটা যে চিতি-বিষলতা চায়ের আসরে কত মারাত্মক এবং কাজ করে কিভাবে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিলো সামান্য।
ভদ্রলোক পরদিন সকালে আবিষ্কার করলেন অর্ধেক খালি কোনাইনের বোতলটা। সন্দেহ ঘোরালো হয়ে উঠলো ওঁর মনে। মিসেস ক্রেলের ঘরে একটা আলমারীর তলার তাকে ওরা মানে পুলিশরা খুঁজে পেয়েছিলো প্রায় খালি একটা বোতল।
এরকুল পোয়ারো সামান্য অস্বস্তিতে একটু নড়ে উঠলো, ওটা ওখানে অন্য কেউ রেখে দিয়ে আসতে পারে।
না, আদালতে স্বীকার করে মিসেস ক্রেল সেই রেখেছিলো বোতলটা ওখানে। ও কথাটা খুবই বোকার মত স্বীকার করে ফেলেছিলো, ওকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এমন কোনো ওর সলিসিটারও ছিলো না। তাই ও তরফ থেকে বোতলটা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতেই ও স্বীকার করে নেয়।
কিন্তু কেন?–আবার প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
বিষটা চুরি করে আত্মহত্যা করার জন্যেই একথা বলেছিলো ক্যারোলিন। কিন্তু কি করে বোতলটা খালি হয়ে গেলো তার কারণ কিছুই সে দেখতে পারেনি বা কেন শুধু তার এবারই আঙুলের ছাপ বোতলে পাওয়া গিয়েছিলো ওর পক্ষে সাক্ষ্যের এই অংশটা খুবই মারাত্মক। স্ত্রীর বক্তব্য ও আত্মহত্যা করেছে স্বামী অ্যামিয়াস ক্রেল। কিন্তু স্ত্রীর ঘরের আলমারীতে লুকোনো কোনাইনের বোতল থেকে কেউ যদি আত্মহত্যা করার জন্যে বিষ চুরি করে তবে তার আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে তো থাকা দরকার।
বিয়ারের সঙ্গে তো বিষটা দেওয়া হয়েছিলো, তাই না?
হ্যাঁ। মহিলাটি নিজেই বাগানে নিয়ে যায় বোতলটা বের করে ফ্রিজ থেকে, যেখানে ছবি আঁকছিলো তার স্বামী। নিজের হাতে মহিলা বীয়ার ঢেলে দিয়েছিলো তার স্বামীকে, তারপর স্বামীকে বিয়ারটা খেতে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। তারপর লাঞ্চ খেতে চলে যায় সবাই, স্বামী বাদে। প্রায়ই করতো এটা স্বামীটি। খেতে যেতো না খাবার টেবিলে, পরে স্ত্রী আর গভর্নেস দুজনে দেখতে পায় মরে পড়ে আছে অ্যামিয়াস ক্রেল। যে বীয়ার ও দিয়েছিলো ক্যারোলিনের বক্তব্য তাতে কোনো দোষ ছিলো না। বলতে চেয়েছিলাম আমরা অ্যামিয়াসের মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয় কোনো দুশ্চিন্তার যার ফলে নিজেই বীয়ারে বিষ মিশিয়ে খেয়ে নেয়। গল্পটা ধোপে টেকেনি। কারণ আত্মহত্যা করার মতো লোকই ছিলো না আমিয়াস। তাছাড়া সব ভেস্তে দিলো বোতলে আঙুলের ছাপটা।
ক্যারোলিনের আঙুলের ছাপ কি বোতলে পেয়েছিলো পুলিশ?
না, পায়নি। শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় বোতলে। তবে যখন গভর্নেস ডাক্তারকে টেলিফোন করতে দোতলায় যায় তখন ক্যারোলিনই একমাত্র মৃতদেহের কাছে ছিলো। এবং কোনো সন্দেহই এ বিষয়ে নেই যে নিজের আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে সেটা মুছে দিয়ে ছাপ লাগিয়ে নিয়েছিলো স্বামীর হাতের। দেখাতে চেয়েছিলো ক্যারোলিন যে ও যেন কখনই বীয়ারের বোতলটা ছোঁয়নি। কিন্তু কাজ হয়নি ওতে কোনো। বুড়ো রুডলফ সরকার পক্ষের কৌসুলী ছিলেন, কোর্টে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে খুব রগড় করেছিলো। কোর্টে হাতে কলমে সে দেখিয়ে দেয় যে ঐভাবে বোতল ধরা যায় না–আমরাও প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম যে বোতল ঐভাবে ধরা যায়। মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করার সময় বিশেষ করে। কিন্তু খুবই জোলো ছিলো যে আমাদের যুক্তিগুলো তা বলাই বাহুল্য।
এরকুল পোয়ারো বললো, বাগানে বীয়ারের বোতলটা নিয়ে যাবার আগে ওতে কোনাইন নিশ্চয়ই মেশানো হয়ে গিয়েছিলো?
কোনাইন ছিলোই না বোতলে, ছিলো গ্লাসে।
একটু থামলেন স্যার মণ্টেণ্ড–তাঁর ভারিক্কী সুন্দর মুখের ভাবটা পাল্টে গেলো হঠাৎ। মাথা খুব জোরে নেড়ে বললেন–আরে তাইতো, কী বলতে চাইছেন পোয়ারো আপনি?
পোয়ারো বললো, যদি নির্দোষ হবে ক্যারোলিন ক্রেল তাহলে কোনাইন বীয়ারে এলো কোত্থেকে? অ্যামিয়াস ক্রেল নিজেই রেখেছিলো আসামী পক্ষ থেকে তা বলা হয়েছিলো। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব আপনি বলছেন–এবং যদি আমাকে বলেন, তবে আমিও বলবো একমত আপনার সঙ্গে। অ্যামিয়াস ক্রেল ঐ ধরনের লোক ছিলো না। অতএব যদি কাজটা ক্যারোলিন না করে থাকে তবে অন্য কেউ নিশ্চয়ই ওটা করেছে।
স্যার মন্টেগুর প্রায় রাগে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো, উনি বললেন, মশাই আজেবাজে কথা ছাড়ুন তো। চাবকে কখনো মরা ঘোড়াকে ছোটানো যায় না। ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে অনেক বছর আগেই। ক্যারোলিনই করেছিলো খুন। যদি আপনি সেই সময় ওকে দেখতেন তাহলে কোনো সন্দেহই মনে থাকতো না। সব কিছু ক্যারোলিনের মুখে চোখে ফুটে উঠেছিলো। ভয় পায়নি একটুও এমনকি নার্ভাসও হয়নি। বিচারটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক ও যেন তাই চাইছিলো। তা বলতে হবে সাহস ছিলো মহিলার, সত্যিই ছিলো সাহস…।
এবং তৎসত্ত্বে, উনি একটা চিঠি লিখে রেখে যান মারা যাবার সময় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে, তাতে তিনি নিজেকে নিরপরাধ বলে গেছেন ঈশ্বরের নামে শপথ করে।
জোর দিয়েই কিন্তু আমি বলবো খুন করেছিলেন মহিলা, আমি-আপনিও ওর জায়গায় থাকলে তাই করতাম, বললেন স্যার মন্টেগু ।
উনি ঐ ধরনের মহিলা ছিলেন না তা বলছেন ওর মেয়ে।ওর মেয়ে বলছেন ফুঃ, সে এসব ব্যাপারের কী জানে? যখন বিচার চলছিলো তখন তো একেবারে বাচ্চা ছিলো মেয়েটা। বয়স ছিলো কত…চার…পাঁচ। ইংল্যান্ডের বাইরে কোনো আত্মীয় স্বজনের কাছে ওকে ওর নাম বদলে দিয়ে ওরা পাঠিয়ে দেয়। কতটুকুই বা মেয়েটা জানতে পারে, আর কতটুকুই বা মনে রাখতে পারে?
কখনও কখনও শিশুরা খুব ভাল মানুষ চিনতে পারে।
হয়তো তা পারে, কিন্তু তা নয় এক্ষেত্রে। তবে খুব স্বাভাবিক এটাও যে বিশ্বাস করতে চায় না মেয়ে যে ঐ কাজটা তার মা করেছে। সে ঐ বিশ্বাস নিয়েই থাকুক না। তাতে তো কোনো ক্ষতি হবে না কারুর।
মাথা নাড়লো পোয়ারো, এই দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে প্রমাণ চাইছে এখন মেয়েটি।
স্যার মন্টেগু হাঁ হয়ে গেলেন তার স্বামীকে ক্যারোলিন ক্রেল খুন করেনি প্রমাণ চাই তার?
হা। মাথা নাড়লো পোয়ারো। তাই নাকি, কিন্তু পাবে না।
তাই কি মনে করেন আপনি, বিখ্যাত কিংস-কাউন্সেল পোয়ারোর কথা শুনে গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, আপনি খুব সৎ প্রকৃতির লোক আমার কিন্তু তা ধারণা ছিলো। কিন্তু পোয়ারো এসব কি করছেন? সরল মাতৃভক্তির সুযোগ নিয়ে একটি মেয়ের কিছু টাকা কমাতে চাইছেন?
আপনি জানেন না মেয়েটিকে। ও খুব সাধারণ মেয়ে নয়। একটা অস্বাভাবিক তেজ আছে মেয়েটার চরিত্রে।
তা হবে। আমার ভাবা উচিত ছিলো অ্যামিয়াস আর কারোলিন ক্রেলের মেয়ে যে ঐ ধরনেরই হবে। মেয়েটি কি চায়?
প্রকৃত সত্য জানতে।
হুম! আমার মনে হয় না প্রকৃত সত্যটা খুব উপাদেয় ঠেকবে ওর কাছে। পোয়ারো সত্যি কথা বলতে কি, ও ব্যাপারে আমার তো মনে হয় কোনো কারনেই থাকতে পারে না সন্দেহের। ক্যারোলিনই করেছিলো খুনটা।
স্যার মাফ করবেন, আমি নিজে নিঃসন্দেহ হতে চাই এ বাপারে। নিজের মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় পোয়ারো জানিয়ে দিলো।
নতুন করে আপনি আর কি করতে পারেন তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তখনকার খবরের কাগজে বিচারের খুঁটিনাটিগুলো পাবেন। হামফ্রে রুডলফ সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন। মারা গেছেন তো উনি, ভেবে দেখি দাঁড়ান, কে ছিলো জুনিয়ার? হা পড়েছে মনে, ছোকরা ছিলো একটা, যাক, হা হামফ্রের সহকারী ছিলো ফগই। কথা বলে দেখতে পারেন ওর সঙ্গে। তাছাড়া আরও কয়েকজন আছেন ঐ সময়কার। তবে পুরো ব্যাপারটা নতুন করে খুঁচিয়ে তোলার ব্যাপারে মনে হয় না নাক গলানোটাকে খুব একটা পছন্দ করবেন। তবে সাহস করে এটা বলতে পারি যে ওঁদের কাছ থেকে আপনি যা চাইবেন জানতে তা পাবেন। আপনার মত শয়তানের সঙ্গে বাঁচাতুরিতে এঁটে ওঠা মুশকিল।
ঐ যে কাদের কথা বলছিলেন যেন ঐ সময়কার, আমার খুব দরকার। ওঁদের কথা খুব আশাকরি মনে আছে আপনার।
একটু চিন্তা করলেন স্যার মন্টেগু, ভেবে দেখি দাঁড়ান। ব্যাপারটা তো অনেকদিন আগের। বলতে গেলে মাত্র পাঁচজন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এর মধ্যে চাকর-বাকরদের কথা ধরছি না কিন্তু…সবাই ওরা ভালো মানুষ, সন্দেহই করা যায় না ওদের।
ছিলেন পাঁচজন, আপনি তাই তো বললেন। আমাকে কিছু বলুন তাদের সম্বন্ধে।
আচ্ছা ফিলিপ ব্লেবোর কথা প্রথমেই বলি। সবচেয়ে বড় বন্ধু ক্রেলের, ওদের বন্ধুত্ব ছিলো ছোটবেলা থেকে। ওই বাড়িতেই ঐ সময়ে ফিলিপ ছিলো। বেঁচে আছে এখনও। মাঝে মাঝে দেখা হয় এখনও গলফের মাঠে। সেন্ট জর্জেস হিলে হলো ওর বাড়ি, দালালি করে শেয়ারের বাজারে। ও ভালো বোঝে ব্যবসাটা, পয়সা করেছে প্রচুর। একটু মোটা হয়ে যাচ্ছি ইদানীং।
বুঝলাম, কে তার পরে?
ফিলিপের বড় ভাই। এক ছোট খাটো জমিদার। লোকটা একটু ঘরকুনো ধরনের, থাকতো। বাড়িতেই।
একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠলো মনের মধ্যে। ওটাকে অতি কষ্টে পোয়ারো চাপা দিলো। সব সময়ে ছেলে ভুলানো ছড়া চিন্তা করা ওর উচিত নয় আদৌ। অথচ এই এক রোগ হয়েছে ইদানীং তার। ছড়ার সুরগুলো ওর মনের মধ্যে যখন তখন ঝংকার দিয়ে ওঠে, বাজারে এই শুয়োর ছানাটা গিয়েছিলো, বাড়িতেই রয়ে গেল ঐ শূয়োর ছানাটা…।
আপন মনে বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, রয়ে গেলো বাড়িতেই হা, কি যেন বলছিলেন?
বলছিলাম এর কথাই তো…সে এক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছিলো ওষুধপত্র গাছপালা মিলিয়ে। রসায়ন চর্চা করতো। ওর ছিলো ওটাই নেশা। দাঁড়ান মনে করে দেখি নামটা। মিল ছিলো সাহিত্যিকের নামের সঙ্গে। হ্যাঁ পড়ছে মনে…মেরিডিথ..মেরিডিথ ব্লেক। এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না।
কে তারপর?
তারপরে? সব গণ্ডগোলের দলে ছিলো তারপরের জনই। এই মামলা যে মেয়েটাকে নিয়ে এলসা গ্ৰীয়ার।
মাংসের কোর্মা খেয়েছিলো এই শূয়োর ছানাটা। আপন মনে পোয়ারো বিড়বিড় করে বললো।
পোয়ারোর দিকে বড় বড় চোখ করে স্যার মন্টেগু তাকালেন। এ কথা মানতে হবে ওর মা-বাবা মেয়েটাকে ভালোমতই খাইয়েছিলো মাংস। দারুণ নাছোড়বান্দা মেয়ে। তার তিনবার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তখনই। ওর কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের আদালতে যাওয়া আসা করাটা ছিলো জলভাতের মতো সহজ। তবে স্বামী পাল্টেছে প্রত্যেকবারই ভালো মক্কেল ধরে আগের বারের চেয়ে। উনি সম্প্রতি লেডি ডিটিশাম। ওর নাম পাবেন গুজব রটানো পত্রিকার যে কোনো একটার পাতা খুলুন।
আর বাকি দুজন?
বাড়ির গভর্নেস তো একজন। মনে নেই নামটা কাজের মহিলা বেশ। টমসন…জোনস্..এই ধরনের নাম ছিলো। বাচ্চা মেয়ে আর একটা, সৎ বোন ক্যারোলিন ক্রেলের। তখন বড়জোর পনের বছর বয়েস ছিলো। মেয়েটার খুব নাম হয়ে গিয়েছিলো। সাক্ষ্য দিয়েছিলো গুছিয়ে অতীতের অনেক কথা স্মরণ করে করে। ওয়ারেন–অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন। একবারে সাড়া জাগানো মহিলা হয়ে উঠেছে এখন। কদিন আগেই দেখা হয়েছিলো।
উঁউঁ করে কাদা শূয়োর ছানার মতো এই মেয়েটি তাহলে ছিলো না…।
পোয়ারোর দিকে অবাক হয়ে স্যার মন্টেগু তাকিয়ে রইলেন। নীরস গলায় তারপর বললেন, তাকে অবশ্য সারা জীবনই কাঁদতে হয়েছে, মুখটাকে একেবারে বিকৃত করে দিয়েছে মুখের এক পাশে একটা বিশ্রী দাগ।…আপনি সব ব্যাপারটা বুঝতে পারছি জানতে চান, পোয়ারো তাই না? আপনি পাবেন সব খবরই, চিন্তা করবেন না।
উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, ধন্যবাদ। আমাকে অনেক উপকার করলেন। যদি তার স্বামীকে মিসেস ক্রেল হত্যা না করে থাকেন। স্যার মন্টেগু মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, আঃ উনিই করেছেন বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা। তার এই মাঝপথের ব্যাঘাত পোয়ারো গ্রাহ্য না করে শেষ করলো নিজের আগেকার কথাটা–তবে যুক্তিগ্রাহ্য এটাই বলে মনে হয় যে কেউ না কেউ এই পাঁচজনের মধ্যে তা করেছে।
একজন এদের মধ্যে কাজটা করে থাকতে পারতো, কিন্তু করবে কেন খুঁজে পাচ্ছি না তার কোনো কারণ, কোনো কারণ নেই। আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত খুন এরা কেউই করেনি। মশাই পোকাটাকে মাথা থেকে তাড়ান তো।’
পোয়ারো মাথা নেড়ে স্যার মন্টেগুর কথার উত্তর না দিয়ে একটু হাসলো।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
সরকার পক্ষের কৌসুলী
মিঃ ফগ এককথায় উত্তর দিলেন-নরকের কীটের মতো পাপী।
ভাবুকের মতো পোয়ারো তাকিয়ে রইলো ব্যারিষ্টার মিঃ ফগের চাচাছোলা কথায় তার মুখের দিকে।
স্যার মন্টেগুর, কিংস কাউন্সেল কোয়ান্টিন ফগের সঙ্গে মিল নেই একটুও। কর্মশক্তি, সম্মোহিনী শক্তি, স্বেচ্ছাচারিতার মূর্ত প্রতীক যেন স্যার মন্টেগু । একটু খোঁচা দিয়ে লোককে কথা বলার অভ্যেস আছে। দ্রুত নাটকীয় পরিবর্তন আচরণে ঘটিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পটু অপরের ওপর। শহুরে সুন্দর দেখতে, খুব মিষ্টি ব্যবহার এই মুহূর্তে, ম্যাজিকের মতো পর মুহূর্তেই রূপান্তর ঘটিয়ে ধূর্তের হাসি চাপা ঠোঁটে ফুটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন যেন তোমার ওপর।
রোগামতোন কোয়ান্টিন ফগ, চেহারা ফ্যাকাসে, মনে হয় না ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু আছে বলে। শান্ত ভাবে প্রশ্ন করেন, ভীষণ অভাব উত্তাপের–তবে ধীর স্থির এবং অবিচল আসল ব্যাপারে। যদি ছুঁচালো মুখ তলোয়ারের সঙ্গে স্যার মন্টেগুকে তুলনা করা যায় তবে তুরপুনের সঙ্গে করা যায় ফগকে। ফুটো করে চলেন ধীর ভাবে। ইনি অর্জন করেননি বটে সেরকম সাড়া জাগানো খ্যাতি, তবে নাম যশ আছে পয়লা সারির আইনজ্ঞ বলে। মামলায় সাধারণতঃ হারেন না।
পোয়ারো তাকে খুব চিন্তান্বিত ভাবে লক্ষ্য করে চলেছিলো। সে বললো, তাহলে তাই মনে হয়েছিলো আপনার?
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ফগ, আপনার আসামীর কাঠগড়ায় মহিলাকে দেখা উচিত ছিলো, বুড়ো হাম্পি রুডলফ আমার সিনিয়র, জেরায় জেরায় একেবারে কিমা করে ছেড়েছিলেন মহিলাকে।
ফগ একটু থেমে আবার বললেন, তবে যেন পুরো ব্যাপারটা ভালো ছিলো বড় বেশি মাত্রায়।
মিঃ ফগ কিছু মনে করবেন না, ঠিক ধরতে পারলাম না আপনার শেষ কথার মানেটা।
ফগ সুন্দর ভ্রূ-জোড়া কুঁচকে নরম আঙুল ঠোঁটে বোলাতে বোলাতে বললেন, কথাটা বলি কিভাবে? একটা চলতি কথা আছে ইংরেজদের মধ্যে, সেটা একমাত্র ভালো বোঝে ইংরেজরাই বসে থাকা পাখিকে গুলি করা–আমার বক্তব্য এই কথাটা বললে ঠিক বোঝানো যায়। কিছু কি বুঝতে পারছেন?
ইংরেজদের ঘরোয়া হলেও কথাটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি আমি তা আমার মনে হয়। প্রধান ফৌজদারী আদালতে, সব সময়ে ইংরেজরা তাদের প্রতিপক্ষকে হারাতে চায় একটু খেলোয়াড় সুলভ সুযোগ দিয়ে।
ধরেছেন ঠিক। ঐ অভিযুক্ত মহিলা কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো সুযোগই পাননি। মহিলাকে হাম্পি রুডলফ লাগিয়ে ছিলেন নিজের ইচ্ছে মতো, স্যার মন্টেগুকে দিয়ে শুরু হয়েছিলো, মহিলা দাঁড়িয়ে কাঠগড়ার মধ্যে। যেন একটা বাচ্চা মেয়ে বিরাট একটা পার্টিতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। প্রশ্ন করেছিলেন স্যার মন্টেগু আর শেখানো পড়ানো কাকাতুয়ার মতো মহিলা উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিরীহ অত্যন্ত, কথা মেপে মেপে বললেও আদৌ সেগুলো হতে পারছিলো না বিশ্বাসযোগ্য, জুরীর কাছে বিশেষ করে কোনো দোষ ছিলো না বুড়োর, চেষ্টা করেছিলেন যথাসাধ্য। কিন্তু কোনো সহযোগিতাই পাননি মহিলার পক্ষ থেকে। তারপর হাম্পি রুডলফ উঠেছিলেন জেরা করতে।
জেরায় জেরায় মহিলাকে উনি বানিয়ে ছেড়ে ছিলেন কিমা তা তো আগেই বলেছি। প্রত্যেকবার স্বীকার করিয়ে ছাড়ছিলেন তাঁর কথায় অসঙ্গতি মহিলার মুখ দিয়েই। তারপর শেষ বাণগুলো ছুঁড়তে শুরু করেছিলেন জেরা শেষ করার মুখে, আমার মতে আপনি, এই যে কথাগুলো মিসেস ক্রেল বলেছেন, যেমন কোনাইন চুরি করেছিলেন আত্মহত্যা করার জন্যে আপনি, সম্পূর্ণ মিথ্যে একথা। আমার মতে স্বামীকে খাওয়াবার জন্যে আপনি চুরি করেছিলেন। বিষটা, যিনি তখন অন্য এক মহিলার দিকে আপনাকে ছেড়ে বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এবং জেনে শুনেই আপনি বিষ দিয়েছিলেন স্বামীকে। …আহা, ঐ সুন্দর, শান্ত নরমশরম মহিলাটি তখন প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলেছিলেন… না না,…করিনি আমি।…আচ্ছা বলুন তো কোনো কাজ হয় এই ধরনের উত্তরে, বিশ্বাস করে কেউ, আমি দেখেছিলাম স্যার মন্টেগুর ঐ উত্তর শোনার পর চেয়ারের মধ্যে কেঁপে উঠেছিলো শরীরটা, পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন উনি–শেষ খেলা, কিছু করার আর নেই।
ফগ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর আবার শুরু করলেন বলতে, এখনও পর্যন্ত..ঠিক বুঝতে পারিনি একটা ব্যাপার। হয়তো মহিলা দারুণ ধূর্তের মতো চাল চেলেছিলেন। যে দয়া মায়া মানুষের মধ্যে বিশেষ করে অসহায় মহিলাদের প্রতি যে সুনাম আছে সহানুভূতির জন্যে, তিনি আবেদনটা তারই কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন ঠিক মতো। জুরী কেন শুধু, যারা যারা সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলো, যেন সবাই বুঝতে পেরেছিলো কতো অসহায় মহিলা, উনি কিছুমাত্র সুযোগ পাননি আত্মপক্ষ সমর্থন করার। মহিলা বিনা প্রতিবাদে হাম্পি রুডলফের নিষ্ঠুর আক্রমণের বিরুদ্ধে অসহায় প্রাণীর মতো আত্মসমর্পণ করেছিলেন। …তবে ওঁর কিছু বলারও ছিলো না ও ছাড়া। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছিলেন জুরীরাও–তাঁদের রায় ঘোষণা করা হলো, অপরাধী তবে সুপারিশ করা হচ্ছে সেই সঙ্গে দয়া দেখাবার।
ব্যাপারটা কি জানেন আসলে, আর একজন যে মহিলা ছিলো মামলাতে, তবে ঐ মেয়েটা যার বয়স কম, এঁর পার্থক্যটা ছিলো তার সঙ্গে একেবারে বিপরীত ধরনের। ঐ মেয়েটাকে প্রথম থেকেই তেমন পছন্দ করেননি জুরীরা। ওর ব্যাপারে কেউ সহানুভূতিশীলও ছিলো না। দারুণ সুন্দরী, পোড়খাওয়া, আধুনিকা মেয়েটা। যে সব মহিলা আদালতে ছিলেন তাদের চোখে ঘর ভাঙানি মেয়ে ছিলো ও। আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখলে ওই ধরনের মেয়েদের সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে নিজের নিজের ঘর সংসার সামলাতে, যেন মেয়ে তো নয়, যেন এক বাণ্ডিল সেক্স। তাদের যেন নেশা মা-বৌদের অধিকারগুলোকে ভাঙচুর করাই। তবে মেয়েটিকে স্যার বলতো একটা ব্যাপারে নিজেকেও বাদ দেয়নি ও। অ্যামিয়াস ক্রেলকে সে ভালোবেসেছিলো তা স্পষ্ট স্বীকার করেছিলো, এবং তাকে ভালোবাসতো ক্রেলও। ফলে অ্যামিয়াসকে তার নিজের সংসার থেকে জোর করে মেয়েটি চেয়েছিলো উপড়ে তুলে নিয়ে যেতে।
আমি ওকে এক দিক দিয়ে প্রশংসাও করি, বলতে হবে সাহস ছিলো। স্যার মন্টেগু কিন্তু জেরার সময় কিছু নোংরা প্রশ্ন করেছিলেন, ঘাবড়ায়নি মেয়েটা। উত্তর দিয়েছিলো চোখা চোখা। অবশ্য মেয়েটাকে পছন্দ করেননি জজও, আদালতও না। জজ কিন্তু জুরীদের অভিযোগের বয়ান পড়ে শোনানোর সময় মোটামুটি আসামীর সম্বন্ধে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। অস্বীকার না করলেও ঘটনাকে, আসামী যে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলো যথেষ্ট মাত্রায় প্ররোচিত হয়ে এ ধরনের আভাস দিয়েছিলেন।
হঠাৎ প্রশ্ন করলো এরকুল পোয়ারো, আত্মহত্যার ইঙ্গিতটা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা মেনে নেননি, জজ, না?
মাথা নাড়লেন ফগ, কোনো ভিত্তিই ওটার ছিলো না। মনে রাখবেন একবারের জন্যেও কিন্তু একথা আমি বলছি না যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছিলেন স্যার মন্টেগু তার তরফ থেকে। বরং বলা যায় আসামীকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ খেটেছিলেন। উনি দারুণ মামলা লড়েছিলেন। এক উদারমনা মুখ সন্ধানী, একটু অভিমানী অস্থির প্রকৃতির পুরুষ হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছে গভীরভাবে একটা কম বয়েসী মেয়ের সঙ্গে, তারপর জর্জরিত বিবেকে কশাঘাতে, অথচ আসতে পারছে না বেরিয়েও এমন এক মানুষের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মর্মস্পর্শী ভাষায় আদালতের সামনে। তারপর কীভাবে সেই পুরুষটি ধাক্কা খাচ্ছে, ঘৃণা করছে নিজেকে, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধাচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্যে, মনের মধ্যে টানা পোড়েন সন্তানের জন্যে, শেষ পর্যন্ত বদ্ধপরিকর সব কিছুর অবসান ঘটাবার জন্যে…এবং ঐ অকালে মৃত্যু তারই পরিণতি। এ জগৎ থেকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া। স্যার মন্টেগু অসাধারণ আর্গুমেন্ট করেছিলেন। অনেকের চোখে জল এসে গিয়েছিলো ওঁর কথায়। হতভাগ্য মানুষটাকে গভীর আসক্তি আর কর্তব্যবোধের টানাপোড়েনে যেন চোখের সামনে সবাই দেখতে পাচ্ছিলো। ভীষণ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিলো। তারপর ওঁর কথা যখন একসময় শেষ হলো, তখন ধীরে ধীরে কেটে গেলো যাদুর প্রভাবটাও। অ্যামিয়াস ক্রেল রূপকথার নায়ক হিসেবে বর্ণিত তার সঙ্গে সত্যিকারের অ্যামিয়াস ক্রেলের মিলটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো তখন কারণ সকলেরই জানা ছিলো ওর স্বভাব চরিত্রের কথা। ও আদৌ অতটা ভালো মানুষ ছিলো না। এমন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণও স্যার মন্টেগু পেশ করতে পারেননি যা দিয়ে জোরালো করে তুলতে পারতেন তার বক্তব্যকে। বরং বলতে আমি বাধ্য হবো বিবেক বুদ্ধি আসে সামান্যতম এমন মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায় না ক্রেলের। দারুণ ভালো নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, ভালো মেজাজে থাকলে, ও আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী মানুষ ছিলো, ওর ন্যায় নীতি বলতে যা ছিলো তা শুধু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে। হলফ করে এ কথা আমি বলতে পারি ও তা কখনো সে প্ররোচনা যতোই আসুক না কেন ছবি আঁকতো না আজে বাজে। এবং ও জীবনের অন্যক্ষেত্রেও ছিলো এক পুরো রক্ত মাংসের মানুষ, শতরূপে ভালোবাসতো জীবনকে, চাইতো বাঁচতে। আত্মহত্যা? ও তেমন মানুষই ছিলো না।
আসামী পক্ষ থেকে মনে হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের পথটা বাছা হয়নি ঠিকমতো, বললো পোয়ারো।
ফগ রোগা রোগা কাঁধ দুটো নাচিয়ে বললেন, কীই বা আর ছিলো করার, বসে থাকা চুপচাপ আর মামলা প্রমাণ করতে সরকার পক্ষকে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় ছিলো না। গাদাগাদা প্রমাণও ছিলো বিরুদ্ধে। মহিলা নিজের হাতেই বিষটা এনেছিলেন, স্বীকারও করেছিলেন চুরি করার কথাটা। উপায়, উদ্দেশ্য, সুযোগ, ছিলো সব কিছুই।
কৃত্রিমভাবে এগুলো যে সাজানো হয়েছিলো পরপর এটা প্রমাণ করার চেষ্টাও তো কেউ করে থাকতে পারে।
কাঠখোট্টার মত ফগ বললেন পোয়ারোর কথার উত্তরে, মহিলা স্বীকার করেছিলেন বেশিরভাগই অভিযোগ। তাছাড়া খুবই কষ্ট কল্পিত আপনার বক্তব্যটি। আমার মনে হয় আপনি সবটাই অনুমান করে নিচ্ছেন। অন্য কেউ খুন করে আপনার মনে হয় সবকিছু এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ভদ্রমহিলাই খুন করেছেন মনে হয়।
আপনি কি অযৌক্তিক মনে করছেন আমার বক্তব্যটাকে? পোয়ারো প্রশ্ন করলো পাল্টা।
ধীরে ধীরে ফগ বললেন, মনে হচ্ছে করছি। আপনার মতে কাজটা করেছিলো কোনো এক রহস্যময় অজ্ঞাত ব্যক্তি। কিন্তু আমরা তাকে পাবো কোথায়?
খুব নিকট আত্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যে অবশ্যই। পাঁচজনের কথা তো বলছিলেন, তাই না? কে এদের মধ্যে থাকতে পারে জড়িত?
পাঁচজন? দাঁড়ান, দেখি ভেবে, একজন তো হলো গাছপালার শেকড়-বাকর নিয়ে কী সব করতো ঐ বুড়ো অকর্মার ধাড়ীটা। নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক শখটা। তবে অমায়িক লোকটা। মানুষটা একটু ধোয়াটে গোছের। তা ওকে মনে হয় না ওই রহস্যময় অজ্ঞাত পুরুষ বলে। তারপর ঐ মেয়েটা, পারলে ও খুন করতো ক্যারোলিনকে। আদৌ অ্যামিয়াসকে না। তারপর ঐ দালালটা আসে শেয়ার বাজারে। আবার সে প্রাণের বন্ধু ক্রেলের। ওসব চলে গোয়েন্দা কাহিনীতে। এছাড়া তো আর কেউ নেই–ও হা… ওই সৎ বোনটা…না না সন্দেহ করা যায় না ওকে। মোটে তো চারজন হলো।
গভর্নেসের কথাটা কিন্তু আপনি বাদ দিয়ে গেলেন। মনে করিয়ে দিলো পোয়ারো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তো। গভর্নেস আজে বাজে লোক–আমাদের এতো মনে থাকে না সাধারণ মানুষের কথা। মনেও পড়ছে আবছা মহিলা মাঝ বয়েসী, মানুষ হিসেবে সিধেসাধা তবে কাজেরও ছিলো। হয়তো বলতে পারেন মনঃস্তত্ত্ববিদরা তার কোনো রকম গুপ্ত কামনা ছিলো ক্রেলের সম্বন্ধে, যার জন্যে খুন করেছে। যেমন হয় অবিবাহিতা মেয়েরা যাদের বয়স পেরিয়ে গেছে বিয়ের, এও সেরকম ছিলো। তবে ঠিক হবে না অভিযোগ আনাটা ওর বিরুদ্ধে। যতদূর মনে পড়ে আমার তার কোনো রকম মানসিক বিকারও ছিলো না।
বহুদিন আগের ঘটনা ব্যাপারটা তো?
তা তো পনেরো-ষোলো বছর হবেই। এবং সবটাই যে আমার মনে থাকবে এতদিন আগের ঘটনা এ আশাও করা উচিত নয় আপনার।
কিন্তু কি আশ্চর্য আপনি অবিশ্বাস্যভাবে সবকিছুই মনে রেখেছেন। দেখতে পান আপনি তাই না? যখন কথা বলেন আপনি মনে হয় তখন আপনার চোখের সামনে পুরো ছবিটা ভেসে ওঠে।
মাথা নাড়লেন ফগ ধীরে ধীরে, হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, দেখতে পাই আমি…চোখের সামনে একেবারে।
পোয়ারো বললো, আমার কিন্তু ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে জানতে, এটা কেন আপনার হয়?
কেন? একবার প্রশ্নটাকেই ফগ প্রশ্নের মতো করে উচ্চারণ করলেন, তারপর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো তার মুখটা, বেড়ে উঠেছে যেন আগ্রহও–ও হা কেন প্রশ্ন করছেন ভেসে ওঠে?
আপনার চোখের সামনে কি এতো সহজেই ভেসে ওঠে? সাক্ষীরা? কৌসুলীরা? জজ? না, দাঁড়িয়ে থাকা কাঠগড়ার আসামী?
শান্তভাবে ফগ বললেন, বোধ হয় এটাই আসল কারণ, ঠিক জায়গাটায় আপনি ঘা মারতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। ঐ মহিলাকেই আমি সব সম সময়ে দেখি। ব্যাপারটা ভারী মজার, ভাবালুতা। তবে সে গুণ নিশ্চয়ই মহিলার ছিলো। তিনি সত্যি সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন কিনা তা ঠিক বলতে পারছি না–কম নয় বয়সও, ক্লান্তির ছায়া চেহারায়, চোখের কোলে কালি। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই যেন সব কিছু আবর্তিত হচ্ছিলো। তাকেই নিয়ে যেন নাটক। অথচ উনি ওখানে বেশির ভাগ সময় থাকতেন না, শুধু দেহটা ওঁর থাকতো ওখানে, ওঁর মন, যেন চলে যেতো ওঁর আত্মা অনেক, অন্য কোথাও অনেক দূরে অন্য কিছুর সন্ধানে। শান্ত, বিনীত মৃদু হাসি সমাহিত মুখে, আলো ছায়ার খেলা চেহারায়। অনেক বেশি প্রাণবন্ত সব মিলিয়ে, বিশেষ করে সুন্দরী, সুতনুকা ঐ কমবয়েসী মেয়েটার চেয়ে তো বটেই। আমি প্রশংসা করি এলসা গ্ৰীয়ারকে, দারুণ তেজী মেয়ে। জানে লড়তে, ও একটুও ভেঙে পড়েনি জেরার মুখে। আবার আমি শ্রদ্ধা করি ক্যারোলিন ক্রেলকে, উনি চাননি লড়তে। কারণ যেন তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন আলো আঁধারের জগতে। উনি কখনও হারেনওনি, লড়ার চেষ্টা করেননি বলে।
ফগ একটু থেমে আবার বললেন, তবে আমার একটা ব্যাপারে ভুল হয়নি। উনি খুন করেছিলেন যাকে, তাকে ভালোও বাসতেন গভীরভাবে। ভালোবাসতেন এত বেশি যে সেই সঙ্গে মরে গিয়েছিলেন নিজেও। তখন অনেক কম আমার বয়স। ভীষণ ছটফট করছি নাম করার জন্য। অথচ আমাকে ভীষণভাবে এই ঘটনাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিলো। ক্যারোলিন ক্রেল ছিলেন এক অসাধারণ মহিলা এ কথা বলতে বাধ্য, তাকে আমি ভুলতে পারবো না কখনই…পারবো না।
.
তৃতীয় অধ্যায়
সলিসিটার কমবয়সী
প্রথম থেকেই খুব সাবধান হয়ে জর্জ মেহিউ কথাবার্তা বলছিলো, স্পষ্টভাবে হ্যাঁ না বলছিলো না কোনো কথার উত্তরেই।
মনে পড়েছে বটে মামলাটা, তবে স্পষ্টভাবে নয়। মামলার ভার ছিলো ওর বাবার হাতেই–আর তার বয়স তখন তো মাত্র উনিশ।
হ্যাঁ, খুব হৈহৈ পড়ে গিয়েছিলো মামলাটা নিয়ে, কারণ খুব বিখ্যাত লোক ছিলেন ক্রেল। দারুণ সুন্দর ওঁর আঁকা ছবিগুলো, ওঁর দুটো ছবি বিখ্যাত স্টেট গ্যালারিতে জায়গা পেয়েছে, তার মানে খুব একটা আজেবাজে শিল্পী উনি ছিলেন না।
এতোদিন পরে মঁসিয়ে পোয়ারো কেন যে মাথা ঘামাচ্ছেন ঐ মামলা নিয়ে সেটা ঢুকছে না তার মাথায়। ওঃ মেয়েটার কথা বলছেন? সত্যিই কি তাই? ঠিক তো? কানাডায়, মেয়েটা থাকতো নিউজিল্যান্ডে ও তো সব সময়েই তা শুনে এসেছে।
আস্তে আস্তে জর্জ মেহিউ একটু নরম হলো, ঘাড় কিন্তু পোয়ারো শক্ত করেই থাকলো।
নিঃসন্দেহে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা মেয়েদের জীবনে। সহানুভূতি আছে গভীর, যেন বেশি ভাল হতো সত্যি কথাটা মেয়েটা না জানলেই। অবশ্য ওসব কথা বলে এখন আর লাভ নেই।
এখন জানতে চায় মেয়ে? কিন্তু আছেই বা কি জানবার? তখনকার কাগজে অবশ্য বিচারের খবরগুলো ছাপা হতো। এখন কিছুই ওর মনে নেই।
না। জজের মনে মিসেস ক্রেলের অপরাধ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাকে অবশ্য ক্ষমাও করা যায় কিছুটা পরিমানে। ঘর করা এই শিল্পীগুলোর সঙ্গে খুব সহজ কাজ নয়। ঐ ক্রেলের জীবনে যতদূর জানে সব সময় থাকতো একটা না একটা মেয়ে।
আর বোধ হয় খুব তীব্র ছিলো ঐ মহিলার অধিকার বোধটা। মেনে নিতে পারেননি বাস্তবকে। নিশ্চিন্ত হয়ে যেতেন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে এখনকার দিন হলে। তারপর জর্জ মেহিউ খুব সাবধান হয়ে বললেন, একটু ভেবে দেখি দাঁড়ান–এখন ঐ মেয়েটি মামলার লেডি ডিটিশাম।
তারও সেইরকম ধারণা, পোয়ারো জানালো।
মাঝেমধ্যে ওর কথা থাকে খবরের কাগজে। বহুবার ওকে আদালতে যেতে হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। শুনেছি প্রচুর টাকা পয়সাও আছে মেয়েটার। ডিটিশামকে বিয়ে করার আগে ও বিয়ে করেছিলো সেই বিখ্যাত অভিযাত্রীকে। সেই জাতীয় মেয়ে এলসা যারা বেঁচে থাকতে চায় সব সময় খবর হয়ে আর সুখ্যাতির চেয়ে কুড়োতে চায় বেশি কুখ্যাতি।
আচ্ছা। মিসেস ক্রেলের হয়ে কি আপনার ফার্ম অনেক দিন কাজ করেছিলো? হঠাৎ আলোচনার মোড় ফেরালো পোয়ারো।
মাথা নাড়লো জর্জ মেহিউ, জোনাথান অ্যান্ড জোনাথন সলিসিটার ফার্ম প্রথম দিকে মহিলার হয়ে মামলা দেখাশোনা করতো। পরে আর কাজ করতে চাইলেন না মিঃ জোনাথন। আমাদের, অর্থাৎ কথাবার্তা বলে আমার বাবার সঙ্গে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলেছিলেন মামলাটা। মিঃ জোনাথনের সঙ্গে যদি আপনি যোগাযোগ করেন তবে অনেক সুবিধে হতে পারে আপনার। অবশ্য ব্যবসা থেকে উনি এখন অবসর নিয়েছেন, সত্তরের ওপর বয়সও হয়ে গেছে। তবে উনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন ক্রেল পরিবারের সঙ্গে। এসব কথা উনি অনেক ভালো বলতে পারবেন আমার চেয়ে।
জর্জ মেহিউ পোয়ারোর সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, কথা বলে দেখতে পারেন আমাদের ম্যানেজিং ক্লার্ক এডমণ্ডসের সঙ্গে, এই মামলাটা নিয়ে উনি খুব মাথা ঘামিয়ে ছিলেন।
কম কথার মানুষ এডমণ্ডস। পোয়ারোকে তিনি আইন জানা লোকের মতো ভালোভাবে সাবধানী চোখে বিচার করতে লাগলেন। তারপর বললেন, মনে পড়েছে ক্রেলদের কেসের কথা।…বিশ্রী কেলেংকারীর ব্যাপার। পোয়ারোকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করার পর বললেন, আবার ও সব নিয়ে এতোকাল পরে কেন খোঁচাখুঁচি?
সব সময়ে আদালতের রায়টাই শেষ কথা হতে পারে না, এডমণ্ডস মাথা নাড়াতে নাড়াতে এই কথাটা বললেন, আমি আপনার কথাটাই যে ঠিক একথা বলতে পারছি না।
নিজের মনেই কিন্তু বলে চললো পোয়ারো, একটি মেয়ে ছিলো মিসেস ক্রেলের।
হা মনে পড়ছে। ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো বিদেশে আত্মীয়দের কাছে, তাই না?
ওর মা নিরপরাধ মেয়েটির দৃঢ় বিশ্বাস।
কাঁকড়া ভ্রূ মিঃ এডমণ্ডসের কুঁচকে উঠলো, ও এই ব্যাপার তা হলে?
আপনি আমায় তেমন কিছু খবর কি দিতে পারেন মেয়েটির বিশ্বাসের সমর্থনে?
যেন চমকে উঠলেন এডমণ্ডস, তারপর মাথা ধীরে ধীরে নাড়িয়ে বললেন, তেমন কিছু খবর তো নেই আমার বিচার বিবেচনায়। আমি প্রশংসা করি মিসেস ক্রেলকে। উনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ভদ্রমহিলা আর যাই হোন না কেন। পাঁচজনের মত আর নয়। বেহায়াপনা ছিলো না একটুও। ঋজু ইস্পাতের মত, শুধু জড়িয়ে পড়েছিলেন একটা বাজে ঘটনার মধ্যে, তবে ভুল করেননি নিজের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতেও। দারুণ মহিলা।
কিন্তু খুনী তো বটেই? খোঁচা মারলো যেন পোয়ারো।
ভ্রূ কুঁচকে উঠলো এডমণ্ডসের, এবং অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শুরু করে দিলেন আগের চেয়ে। দিনের পর দিন ঠিক এই প্রশ্নটাই নিজেকে করেছি আমি। শান্তভাবে কাঠগড়ার মধ্যে বসে থাকতেন। তখন নিজের মনে আমি বলতাম, কিছুতেই বিশ্বাস করবো না আমি। তবে মিঃ পোয়ারো যদি আমার কথা মানেন তাহলে আমি বলবো একটুও অবকাশ ছিলো না অন্য কিছু বিশ্বাস করার। মিঃ ক্রেলের বীয়ারের গ্লাসে বিয লতার ঐ বিষ নিজের থেকে চলে আসতে পারে না। মেশানো হয়েছিলো ওটা আর যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আর কে করতে পারে মিসেস ক্রেল ছাড়া? পোয়ারোকে আবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখলেন এডমণ্ডস,-ও, ওই প্রশ্নটাই কি ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার মাথায়?
কি ধারণা আপনার? পোয়ারো প্রশ্ন করলো পাল্টা।
এডমণ্ডস বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বললেন, নাহ, উপায় ছিলো না অন্য কিছু ধারণা করার, উপায় ছিলো না কোনো।
আপনি মামলা চলার সময় আদালতে যেতেন?
প্রত্যেক দিন।
সাক্ষীদের কথা শুনতেন?
শুনেছিলাম।
কোনো অস্বাভাবিকতা, কপটতা কি কারুর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন?
মানে মিথ্যে কথা কেউ বলেছিলো কি না তাই চাইছেন তো জানতে? মিঃ ক্রেলের কি মৃত্যু কামনা করতো ওদের মধ্যে কেউ? মিঃ পোয়ারো মাফ করবেন, আপনি বড় বেশি মাত্রায় চিন্তা করছেন যা কিনা নাটুকে।
অনুনয় করলো পোয়ারো, ভেবে দেখুন একটু।
পোয়ারো তাকিয়ে রইলো এডমণ্ডসের ধারালো চোখের দিকে। খুব দুঃখিত এমন ভাব দেখিয়ে আস্তে আস্তে যেন বলতে শুরু করলেন এডমণ্ডস, বড্ড কটকটে আর প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলো ঐ মিস গ্রীয়ার মেয়েটা। যতোটা বলা উচিত ভদ্রভাবে বহুবার ছাড়িয়ে গিয়েছিলো তার মাত্রাও। তবে ও কখনো মিঃ ক্রেলের মৃত্যু চায়নি। ওরই তো ক্ষতি তাতে। ও অবশ্যই চাইতো মিসেস ক্রেলের ফাঁসি হোক–কিন্তু একটাই তার কারণ। হঠাৎ তার মনের মানুষটিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলেই। হয়ে উঠেছিলো বাধা পাওয়া বাঘিনীর মতো। ঐ যে তবে আগেই বলেছি যে অ্যামিয়াস মারা যাক তা এলসা চাইতো না। অবশ্য ফিলিপ ব্লেকও ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, প্রথম থেকেই ওঁর মনটা বিষিয়ে ছিলো, তাই কোপ মারতে ছাড়েন না সুযোগ পেলেই। তবে ভদ্রলোক যে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি মতো কোনো অন্যায় কাজ যে করেননি আমি একশোবার একথা বলবো। ক্রেলের বিশেষ বন্ধু ছিলেন ফিলিপ। মেরিডিথ ব্লেক ওঁর ভাই–অত্যন্ত বাজে সাক্ষী হিসাবে, অস্পষ্ট, দ্বিধাগ্রস্তভাবে সব সময়ে উত্তর দিয়েছিলেন। এই ধরনের সাক্ষীদের কথা শুনলে মনে হয় যেন মিথ্যে কথা বলছে। না বললে নয় যেটুকু, এঁরা কিছুই বলতে চায় না তার বাইরে। চায়নি মেরিডিথ ব্লেকও, তবে ওঁর পেটের কথা টেনে বের করেছিলো কেঁৗসুলী। আর ঐ গভর্নেস, ঠিকঠাক জবাব দিয়েছিলো কাটাকাটা কথায়। আজেবাজে কথা একটাও বলেনি। তবে বলেছিলো যা তার থেকে সে যে জানতো অনেক বেশি আমার এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আমারও নেই, বললো পোয়ারো। মিঃ অ্যালফ্রেড তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এডমণ্ডসকে লক্ষ্য করলো, নিশ্চয় উনি আভাস দিতে চাইছেন কোনো কিছুর।
.
চতুর্থ অধ্যায়
বৃদ্ধ সলিসিটার
এসেক্সে মিঃ ক্যালের জোনাথন থাকতেন। পোয়ারো সৌজন্য বজায় রেখে কয়েকটা চিঠি লেখালিখির পর পেয়ে গেলো একেবারে রাজকীয় আমন্ত্রণ, ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকতে হবে গিয়ে। সত্যিই এক অসাধারণ চরিত্রের মানুষ বৃদ্ধ। মিঃ জোনাথন যেন কম বয়েসী বেরসিক জর্জ মেহিউয়ের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ, অবশ্য সুপ্রাচীন জিনিসের প্রতি আকর্ষণের মতো মানুষের।
নিজের দৃষ্টিকোণ দিয়ে সবকিছুকে উনি পছন্দ করেন দেখতে এবং গভীর রাতে সুগন্ধী ব্র্যাণ্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সেটা করতে ভালোবাসেন। তাড়াহুড়ো করে যে এরকুল পোয়ারো তার কাছে হঠাৎ না এসে সময় করে চিঠি লিখে দেখা করতে আসছে এটা খুব ভালো লেগেছে তাঁর। ফলে এখন বিস্তারিত আলোচনা করতে ক্রেল পরিবার সম্বন্ধে তাঁর খারাপ লাগবে না।
আমাদের ফার্মের সঙ্গে ক্রেল পরিবারের বহু পুরুষ থেকে পরিচয় ছিলো। আমি অ্যামিয়াস ক্রেল, তার বাবা রিচার্ড ক্রেলকেও জানতাম। এমন কি এনোক ক্রেল ওর ঠাকুর্দা তার সঙ্গে আলাপ ছিলো আমার। ওঁরা গ্রামের জমিদার ছিলেন, তাঁদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল মানুষের চেয়ে ঘোড়ার সঙ্গে। জীবন কাটাতেন ঘূর্তিতে, একটুও ভাবনা চিন্তার দাস ছিলেন না। কিন্তু তার ব্যতিক্রম ছিলেন রিচার্ড ক্রেলের স্ত্রী। চিন্তা খেলতো ওঁর মাথায়। অনেক বেশি প্রবল ছিলো প্রবৃত্তির চেয়ে চিন্তাশক্তি। বুঝতেন গান বাজনা, ভালোবাসতেন কবিতা, বাজাতে পারতেন তারের যন্ত্র, ভালো ছিলো না স্বাস্থ্য, পটের বিবির মতো বসে থাকতেন সোফার ওপর। খুব ভক্ত ছিলেন লেখক কিংসলের, তাই অ্যামিয়াস নাম রেখেছিলেন ছেলের। এই নিয়ে স্বামী ঠাট্টা করলেও, মেনে নিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
অ্যামিয়াস কাজে লাগিয়েছিলো মা বাবার চরিত্রের এই ভিন্নমুখিতার পূর্ণ সুযোগ। ক্ষীণস্বাস্থ্যের মার কাছ থেকে শিল্পী ভাবটা পেয়েছিলো আর উদ্দাম, বেপরোয়া, নিষ্ঠুর ভাবটা পেয়েছিলো বাবার কাছ থেকে। আত্মকেন্দ্রিক ছিলো ক্রেল পরিবারের সব পুরুষরাই।
বৃদ্ধ, পোয়ারোকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সরু সরু আঙুলগুলো চেয়ারের হাতলে ঠুকতে ঠুকতে, মঁসিয়ে পোয়ারো শুধরে দেবেন ভুল হলে, তবে মনে হয় আমার আপনি আগ্রহী মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে, তাই না?
ওটাই হল আমার সব মামলার আগ্রহের বিষয়। আমার কাছে বিশেষ করে।
বুঝতে পারছি। আপনি কি জানতে চান অপরাধীদের মনে অগোচরে কি আছে তা। ব্যাপারটা দারুণ, ভালো লাগে খুব। অবশ্য ফৌজদারী মামলা হাতে নেয়নি আমাদের ফার্ম। ফলে আমরা একটা বড় ফার্মের হাতে মিসেস ক্রেলের মামলাটা তুলে দিই, ব্রিফ দেওয়া হয়েছিলো স্যার মন্টেগুকে। একটা দারুণ বুদ্ধিমান ছিলেন খুব তা নয়, তবে নাটক জমাতে পারতেন কোর্টে খুব চমৎকার আর খুব বেশি ছিলো ফী-টাও। ওঁর সঙ্গে নাটক করার ব্যাপারে মিসেস ক্রেল যে তাল দিতে পারবেন না, উনি যে এটা কেন ভাবেননি তা জানি না। আর যাই হোন মহিলা নাটুকে ছিলেন না।
তাহলে কি ছিলেন? আর আমি ঠিক ঐ জিনিসটাই জানতে চাই ভালোভাবে। জানতে চাইলো পোয়ারো।
বুঝেছি বুঝেছি, কিভাবে উনি ঐ কাজটা করলেন? সত্যিই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কিন্তু মহিলাটিকে বিয়ের আগে থাকতেই চিনতাম। ওঁর নাম তখন ছিলো ক্যারোলিন স্পলডিং। অশান্ত খুব, ওঁর জীবন ছিলো দুঃখের। যখন খুব ছোট ক্যারোলিন তখন ওঁর বাবা মারা যান। ক্যারোলিন বিধবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। অবশ্য পরে ওর মা আবার বিয়ে করেন। একটা বাচ্চাও হয়। সত্যিই তার পরের ব্যাপারটা খুব দুঃখের। মাঝে মাঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যে অদ্ভুত এক ঈর্ষা দেখা দেয়।
কাউকে কি ক্যারোলিন ঈর্ষা করতেন?
নিশ্চয়ই। ঘটে যায় একটা বিশ্রী ঘটনাও একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরেছিলেন নিজের সৎ বোনকে। একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় বোনটার, আর বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মুখটাও। অবশ্য পরে সব সময় ঐ ব্যাপারটা নিয়ে ক্যারোলিন দুঃখ প্রকাশ করতেন।..আর যত সামান্যই হোক না কেন বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা, এটাকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে ধরা হয়েছিলো বিচার চলার সময় জুরির সামনে।
বৃদ্ধ একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, সরকার পক্ষ ঐ ঘটনাটা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে ভীষণ রাগী চরিত্রের ক্যারোলিন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণা। অবশ্য ঠিক নয় কথাটা। না, ঠিক নয়।
বৃদ্ধ সলিসিটার আর এক দফা থেমে আবার শুরু করলেন স্মৃতি রোমন্থন করা। ক্যারোলিন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে এসে স্পলডিং থাকতেন। খুব ভালো ঘোড়ায় চড়তেন, বুদ্ধিমতীও বটে। ওঁকে রিচার্ড ক্রেল খুব পছন্দ করতেন। তাকে খুব ভালোবাসতেন মিসেস ক্ৰেলও। নিজের বাড়িতে সুখ-শান্তি ক্যারোলিন পেতেন না। বেশ হাসিখুশি থাকতেন অ্যাল্ডারবেরিতে এলে। ক্যারোলিনের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো অ্যামিয়াসের বোন ডায়না ক্রেলের সঙ্গে। তখন প্রায়ই অ্যাল্ডারবেরিতে আসতে পাশের গ্রামের ফিলিপ আর মেরিডিথ ক্লিক। বরাবরই লোভী নোংরা স্বভাবের ছিলো ফিলিপ, টাকা পয়সা কি করে কামাতে হয় এ ছাড়া অন্য চিন্তা থাকতো না তার মাথায়। দোষ নেই স্বীকার করতে আমি পছন্দ করতাম না ছেলেটাকে। তবে খুব ভালো গল্প বলতো তা শুনেছি আর দারুণ সৎ ছিলো বন্ধুত্বের ব্যাপারে। তখন সকলেই মেরিডিথকে বলতো ন্যাকা-বোকা অভিমানী ছেলে। সব সময়ে গাছপালা, লতাপাতা, প্রজাপতি, পাখি, পোকামাকড় নিয়ে পড়ে থাকতো, যাকে আজকাল বলে প্রকৃতি পাঠ। ওদের বাবার মনে ঐ ছোকরা দুটোর জন্যে কম দুঃখ ছিলো না। একটা ছেলেও তার মনের মতো হলো না, যারা মাথা ঘামায় শিকার করা মাছ ধরা নিয়ে। মেরিডিথ পশু পাখি শিকার করার বদলে ভালোবাসতো ওদের পর্যবেক্ষণ করতে। আর গ্রাম ছেড়ে তো ফিলিপ চলো গেলো শহরে, অর্থ উপার্জন করতে হবে তার নেশা। সৈন্যবাহিনীর এক অস্থায়ী অফিসারের সঙ্গে ডায়নার বিয়ে হলো। আদৌ ভদ্রলোক লোকটা ছিলো না। এদিকে অ্যামিয়াস প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা অপরূপ সুন্দর দেখতে এতো জিনিস থাকতে পৃথিবীতে কেন যে নেশায় পড়লো ছবি আঁকার, কে পারে বলতে। এইসব কারণেই বোধহয় দুঃখে মারা যান রিচার্ড ক্রেল।
তারপর ক্যারোলিন স্পলডিংকে এক সময়ে বিয়ে করলো অ্যামিয়াস। সব সময়েই ওদের ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো মন কষাকষি, তবে ঠিক ছিলো ভালোবাসার বাঁধনটা। দুজনের জন্য দুজনেই পাগল হয়ে থাকতো। এবং এইভাবেই চলতো ওরা। কিন্তু অ্যামিয়াসও ছিলো ক্রেল পরিবারের পুরুষদের মতো বেশি মাত্রায় অহংকারী। ভালোবাসতো ঠিকই ক্যারোলিনকে তবে ক্যারোলিনকে কোনোদিনই বুঝবার চেষ্টা করেনি। চলতো নিজের খেয়াল খুশি মতো। অ্যামিয়াস আর পাঁচটা মেয়েকে আমার মতে ভালোবাসতে পারতো, কিন্তু ছবি আঁকার চেয়ে কাউকেই বড় করে নয়। অ্যামিয়াসের প্রথম প্রেম ছিলো ছবি। এবং কখনোই বেশি প্রাধান্য কোনো মেয়েকে শিল্পের চেয়ে দেয়নি। ওর জন্যে যে সব মেয়েরা প্রেরণা জোগাতো অ্যামিয়াস তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তো কিন্তু ওটা ফুরোলেই তার তাদের ভুলে যেতে সময় লাগতো না বিন্দুমাত্র। ভাবপ্রবণ বা রোমান্টিকও খুব বেশি ছিলো না। আবার ভোগী যে শুধু ছিলো তাও নয়। তবে তারই মধ্যে কিছুটা টান ছিল স্ত্রীর প্রতি। ক্যারোলিন খানিকটা স্বামীর চরিত্রের দুর্বলতার দিকটা মেনেই নিয়েছিলো বলতে হবে। এটাও জানতো যে তার স্বামী এক অসাধারণ শিল্পী। তাই শ্রদ্ধাও করতো। মাঝে মাঝে হৃদয়গত ব্যাপারে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করতো তারপর ফিরে আসতো একসময় নেশা ছুটে গেলে এবং প্রায়ই সেই মেয়েটার ছবি নিয়ে ফিরে আসতো।
কারুর কিছু বলার থাকতো না এলসা গ্ৰীয়ারের ব্যাপারেও। কিন্তু এলসা গ্ৰীয়ার…মিঃ জোনাথন মাথা নাড়লেন হতাশ ভাবে।
মিঃ জোনাথন হঠাৎ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলেন, বেচারী আহা বেচারী…।
ওঃ তাহলে আপনার করুণা হয় মেয়েটির সম্বন্ধে?
হয়তো বুড়ো হয়ে গেছি বলেই হয়। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো আমি দেখেছি আমার চোখ জলে ভরে ওঠে যৌবনের এই অসহায়ত্ব দেখে। আঘাত পায় কত অল্পেতে, আবার এই যৌবন কী ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। যতটা এর উদারতা, ততটা স্বার্থপরতাও। মিঃ জোনাথন কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। উল্টো দিকে কাঁচের আলমারী থেকে বই একটা পেড়ে এনে পড়তে শুরু করলেন একটা পাতা,
তোমার ভালোবাসার অভিলাষ যদি এতই মহৎ হয়, বিবাহ চাও পরিণতিতে, তবে খবরটুকু পাঠিয়ে দিও আগামীকাল, যাতে চলে যেতে আমি পারি তোমার কাছে, তুমি আয়োজন করবে যখন এবং যেখানে উৎসবের। অঞ্জলি দেব আমার সমস্ত সম্পদ তোমার চরণে হে নাথ যেখানে নিয়ে যাবে, তোমার সাথে সেখানেই যাবো।
যৌবনের কথা হলো এই, জুলিয়েটের মুখে ভালোবাসার কথা। সংযম নেই কোনো, নেই কোনো পিছিয়ে আসা, তথাকথিত আনত নয়না কুমারীর সলাজ ভঙ্গী নেই। এখানে যৌবন মদমত্ত নারী সাহসিকা, অকুতোভয় হয়ে উঠেছে। শেক্সপীয়ার ভালোই জানতেন দেখছি যৌবন কি জিনিস। রোমিওকে নির্বিচারে আলাদা করে বেছে নিচ্ছে জুলিয়েট। ওথেলোকে চেয়ে বসেছে ডেসডিমোনা। কোনো দ্বিধা নেই তাদের জন্যে, দ্বন্দ্ব নেই তার দাবীতে অচল অহংকারী যৌবন–অটল হয়ে আছে।
চিন্তান্বিতভাবে পোয়ারো বললো, আপনি তাহলে বলছেন জুলিয়েটের ভাষাতেই এলসা গ্ৰীয়ার কথা বলেছিলো?
হ্যাঁ, বড়লোকের লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে ও ছিলো–যুবতী, সুন্দরী, ধনী। পুরুষ সঙ্গীকে মনের মতো খুঁজে পেয়েই দাবী করে বসলো তাকে। তবে অবিবাহিত যুবক রোমিওকে নয়। মাঝ বয়সী এক বিবাহিত চিত্রশিল্পীকে। এলসার কোনো বিধিনিয়ম জানা ছিলো না নিজের কামনাকে সংযত করার মতো। নিয়ে নাও যা চাও, একটাই আমাদের জীবন,–ওর জপমালা ছিলো আধুনিকতার এই মূলমন্ত্রটিই।
মিঃ জোনাথন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারের পিঠে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, তবে এক হিংস্র জুলিয়েট। যুবতী, নিষ্ঠুর অথচ দুর্বল ভীষণভাবে। পাশার চাল দেয় মরিয়া হয়ে হারবে হয়, নয় জিতবে। এবং ও জিতেছিলো তা তো মনে হয়… কিন্তু তারপর শেষ মুহূর্তে গিয়ে–শোনা গেল মৃত্যুর পদধ্বনি–সেইসঙ্গে এলসা গ্ৰীয়ার যে কিনা প্রাণবন্ত, আনন্দের উত্তাপে ভরা সে মরে গেলো। শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণা, নিষ্ঠুর, কঠোর হৃদয় এক মেয়ে রয়ে গেলো, সেই মহিলাটিকে যে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলো যে সব সুখকে এলসার জীবনের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
মিঃ জোনাথন হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বললেন–আরে দেখুন তো ভাই, কি বলতে কি বলেছি, আমাকে এইটুকু অতি নাটকীয়তার জন্য ক্ষমা করবেন। স্কুল জীবনবোধসম্পন্ন যুবতী ছিলো এলসা। ওর চরিত্রে আকর্ষণীয় কোনো দিকই নেই আমার মতো গোলাপ সাদা যৌবন, ভরপুর হৃদয়ের আবেগে, বিবর্ণ’ ইত্যাদি। আর কি থাকে এইটুকু বাদ দিলে মেয়েটির জন্যে, একজন খ্যাতিমান পুরুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মামুলী একটা যুবতী হৃদয়ের সিংহাসনে বসাবার জন্যে ।
যদি বিখ্যাত শিল্পী না হতেন অ্যামিয়াস ক্রেল…বলতে শুরু করতেই পোয়ারো মিঃ জোনাথন সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন ঘাড় নেড়ে, ঠিক, ঠিক, ব্যাপারটা দারুণ ধরেছেন। বীরপূজা করে আজকালকার এলসারা। কিছু একটা করতে হবে পুরুষটিকে, কেউকেটা হতে হবে একজন।…অবশ্য ব্যাঙ্কের কেরাণী বা বীমার দালালের মধ্যেই ক্যারোলিন ক্রেল তার মনের মানুষ খুঁজে নিতে পারতো। মানুষ হিসেবে ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে ভালোবেসেছিলো, শিল্পী হিসেবে নয়। ক্যারোলিন অমার্জিত ছিলো না এলসা গ্ৰীয়ারের মতো… অথচ এলসা যুবতী, সুন্দরী, কিন্তু ও ভারী অসহায় আমার মনে হতো।
পোয়ারো শুতে গেলো নানা রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে। ওর চিন্তা ব্যক্তিত্বের সমস্যা নিয়ে। একটা বেহায়া মেয়ে ছাড়া এলসা আর কিছু নয় এডমণ্ডের চোখে। অথচ সে হলো শাশ্বত জুলিয়েট আর ক্যারোলিন ক্রেল বৃদ্ধ জোনাথনের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিন সম্বন্ধে প্রত্যেকে ভিন্নতর কথা বলেছে। ক্যারোলিনের পরাজিতের মনোভাবের জন্যে স্যার মন্টেগু ক্যারোলিনের নিন্দে করেছেন। যেন রোমান্সের প্রতিমূর্তি ক্যারোলিন কমবয়েসী ফগের মতে। ক্যারোলিন নিছক এক মহিলা এডমণ্ডসের দৃষ্টিতে। ক্যারোলিনকে মিঃ জোনাথন বলেছেন এক অবাধ্য ঝোড়ো হাওয়া।
দেখলে কি দৃষ্টিতে দেখতে এরকুল পোয়ারো, আর এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের ওপরই পোয়ারোর অভীষ্ট সিদ্ধির ব্যাপারটি নির্ভর করছে।
পোয়ারো এখন পর্যন্ত আলাপ করেছে যত লোকের সঙ্গে তাদের মধ্যে সন্দেহ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি একজনও যে আর যাই হোক ক্যারোলিন ক্রেল, খুনীও বটে সেই সঙ্গে।
.
পঞ্চম অধ্যায়
পুলিস সুপারিনটেণ্ডেন্ট
চিন্তামগ্ন হয়ে অবসরপ্রাপ্ত পুলিস সুপার হেল পাইপে টান দিয়ে বললেন, আপনার এই চিন্তাটা মঁসিয়ে পোয়ারো বেশ উদ্ভট কিন্তু।
হয়তো বলতে পারেন সামান্য অসম্ভব, খুব সাবধানে ওর কথায় পোয়ারো সায় দিলো।
দেখুন বহুদিন আগেকার ব্যাপারটা, কথাটা হেল শুরু করতেই মনে মনে এরকুল পোয়ারো সামান্য বিরক্ত হয়ে উঠলো, যেমন বিরক্ত লাগে একই কথা বারবার শুনতে।
হা একটু বেড়ে যায় বৈ কি অসুবিধেটা, বিনীতভাবে বললো পোয়ারো।
খুঁচিয়ে তোলা অতীতকে, পুলিশ সুপার হেল প্রায় আপন মনে বলতে লাগলেন, তাও যদি একটা এর কোনো উদ্দেশ্য থাকতো…।
একটা উদ্দেশ্য আছে।
কি সেটা?
অনেকে তো আনন্দ পায় সত্যকে খুঁজে বের করার জন্যে, তাদেরই একজন আমি। তাছাড়া আপনি নিশ্চয়ই ঐ কমবয়সী মেয়েটিকে ভুলে যাবেন না।
হা, হা দেখা তো উচিত মেয়েটির দিকটাও। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো মাফ করবেন, উদ্ভাবনী শক্তির তো সীমা নেই আপনার। মেয়েটিকে একটা কিছু বানিয়ে দিন না বলে।
ঠিক মতো আপনি চেনেন না মেয়েটিকে।
আর ওসব কথা ছাড়ুন তো অভিজ্ঞ লোক আপনার মতো…মাঝে মাঝে বাধা দিয়ে পুলিশ সুপারের কথায় বলে উঠলো পোয়ারো, দেখুন ভাই আমি একজন উঁচুদরের মিথ্যেবাদী হতে পারি, হয়তো তাই মনে করেন আপনি আমাকে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের আমার নৈতিক সততা, নিজের নীতি নিয়েই আমি চলি।
মঁসিয়ে পোয়ারো দুঃখিত, ও কথা আপনাকে আঘাত দেবার জন্যে বলিনি। কিন্তু ধরতে গেলে এটা কি একটা মহৎ কাজ হবে না।
তাই কি সত্যি? ধীরে ধীরে হেল বললেন, সত্যি কি দুর্ভাগ্য মেয়েটির। একটা নিষ্পাপ সুখী মেয়ে ঠিক যখন যাচ্ছে বিয়ে করতে তখন কিনা পারলো জানতে তার মা খুনী। যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম তাহলে বুঝিয়ে দিতাম মেয়েটিকে ওটা আর কিছুই নয় আত্মহত্যা ছাড়া, বলতাম মামলাটা ঠিক মতো দাঁড় করাতে পারেননি স্যার মন্টেগু। ক্রেল নিজেই বিষ খেয়েছিলো মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলতাম এবং আপনার মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
কিন্তু সন্দেহ যে আছে আমার মনে। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না এক মুহূর্তের জন্য। যে আত্মহত্যা করেছিলেন ক্রেল বিষ খেয়ে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় এটা সম্ভব বলে?
হেল আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে বললেন, জানেন?–না আমি মেনে নেবো সত্যি কথাটাই, আমি মানবো না আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য মিথ্যেকে। হেলের মুখ চোখ লাল হয়ে উঠলো কথাটা বলতে বলতে, সত্য সম্বন্ধে আপনি তো কথা বলছিলেন, তাই না। আপনাকে আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছি যে আমরা জানতে পেরেছিলাম ক্রেল মামলাতে সত্যের স্বরূপ।
একথা আপনার মুখ থেকে শোনার তাৎপর্য আলাদা। আপনাকে ভালোমতো জানি আমি, আপনি একজন সৎ এবং দক্ষ অফিসার। এবার আমায় একটা কথা বলুন, কখনোই কি আপনার মনে ক্রেলের অপরাধ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি?
পুলিশ সুপার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, না বিন্দুমাত্র না। মিসেস ক্রেলকেই কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা দোষী প্রমাণ করে, আমরা যে সকল তথ্য খুঁজে পেতে সংগ্রহ করেছিলাম তা জোরদার করে তোলে ঐ ধারণাটিকে।
যে সব সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছিলো মহিলার বিরুদ্ধে তার মোটামুটি একটা আভাস দিতে পারবেন কি?
পারবো। মামলার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিলাম আপনার চিঠিটা পাবার পর। হেল একটা ছোট্ট নোটবই বের করলেন, এতে মূল ঘটনাগুলো লিখে রেখেছি।
বন্ধু অশেষ ধন্যবাদ। আমার শুনতে ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে।
হেল একটু কেশে শুরু করলেন বলতে, তার কণ্ঠস্বরে সরকারী অফিসারের মেজাজের স্পর্শ পাওয়া গেলো। ইন্সপেক্টর কনওয়ে ১৮ই সেপ্টেম্বরের দুপুর ২টা বেজে ৪৫ মিনিটে একটা টেলিফোন পেয়েছিলেন ডাঃ অ্যান্ড ফসেটের কাছ থেকে। অ্যাল্ডারবেরির মিঃ অ্যামিয়াস ক্রেল মারা গেছেন হঠাৎ ডাঃ ফসেট তা জানিয়ে ছিলেন এবং মৃত্যু হয়েছে যে পরিস্থিতিতে এবং ঐ বাড়ির জনৈক অতিথি মিঃ ব্লেকের বক্তব্য থেকেও এটা পুলিশের কেস তার ধারণা।
ইন্সপেক্টর ফসেট সার্জেন্ট আর পুলিশের ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে সোজা অ্যাল্ডারবেরিতে চলে যান। ওখানে অপেক্ষা করছিলেন ডাঃ ফসেট, যেখানে মৃতদেহ পড়েছিলো তিনি পুলিশদের নিয়ে যান, ছোঁয়াছুঁয়ি করেনি কেউ অবশ্যই।
মিঃ ক্রেল ছবি আঁকছিলেন একটা ছোট্ট ঘেরা বাগানে বসে। সমুদ্র এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আর ক্ষুদে ক্ষুদে কামান বসানো আছে দেওয়ালের খাঁজকাটা জায়গাগুলোতে আর সেই কারণেই কামানের বাগান বলা হয় বাগানটাকে। বাগানটা বাড়ি থেকে প্রায় চার মিনিটের রাস্তা। সূর্যের আলো সেদিন পাথরের ওপর পড়ে সৃষ্টি করেছিল যে পরিবেশ, ছবি আঁকার পক্ষে সেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলো বলে উনি আর বাড়িতে ফেরেননি লাঞ্চ খাবার জন্যে। ঐ আলোটা পরে নাও থাকতে পারে। ফলে ক্রেল একাই আপন মনে কামান বাগানে ব্যস্ত ছিলেন ছবি আঁকতে। অবশ্য এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়, যে হতে হবে আশ্চর্য। মিঃ ক্রেল ভীষণ উদাসীন ছিলেন খাবার ব্যাপারে। একটুকরো স্যাণ্ডউইচ কখনো কখনো পাঠিয়ে দিলেই চলতো। তবে তিনি চাইতেন কেউ যাতে তাকে বিরক্ত না করে। জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছিলো ক্রেলকে মিস এলসা গ্ৰীয়ার (তিনি তখন ঐ বাড়িতেই থাকছিলেন) এবং মিঃ মেরিডিথ ব্লেক (নিকট একজন প্রতিবেশী)। অন্যান্যদের সঙ্গে লাঞ্চ খাবার জন্য এই দুজন বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলেন। সামনের খোলা চত্বরে বসে খাবার পর সবাই কফি খাচ্ছিলো। কফি শেষ করে মিসেস ক্রেল বললেন, নিচে যাচ্ছি, দেখি কত দূর এগোলো অ্যামিয়াসের কাজ। ওঁর সঙ্গে গভর্নেস মিস সিসিলিয়া উইলিয়ামস গেলো। একটা সোয়েটারের খোঁজ করছিলো গভর্নেস তার ছাত্রীর জন্যে, মিসেস ক্রেলের বোন মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন হলো ওর ছাত্রী। অ্যাঞ্জেলা খুব সম্ভব সমুদ্রের তীরে ফেলে এসেছিলো সোয়েটারটা তাই ওটার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
এক সঙ্গেই এঁরা দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একটু ঢালু মতন বাগানে যাবার পথটা, একটা সামান্য জঙ্গল পার হয়ে যেতে হয়। কামান বাগানের দরজাটা কিছুদূর গেলেই চোখে পড়ে। কামান বাগানেও যাওয়া যায় ঐ পথটা দিয়ে আবার চাইলে সমুদ্রের তীরে সোজা চলে যাওয়া যায়।
সোয়েটারের খোঁজে গভর্নেস সিসিল চলে গেলো সমুদ্রের দিকে আর কামান বাগানে গেলেন মিসেস। মিসেস ক্রেল বাগানের ভেতর পা দিয়েই আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিসিলও ফিরে আসে। মিঃ ক্রেল বাগানের ভেতরে একটা আসনের ওপর পড়ে আছেন এলিয়ে, প্রাণ নেই দেহে।
সিসিল সঙ্গে সঙ্গে মিসেস ক্রেলের কথায় বাড়ি ফিরে যায় টেলিফোন করার জন্যে ডাক্তারকে। মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে যাওয়াতে তার ওপর টেলিফোন করার কাজটা চাপিয়ে ফিরে আসে কামান বাগানে সিসিল। ডাঃ ফসেট মিনিট পনেরোর মধ্যে আসেন। মিঃ ক্রেল কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন তিনি দেখেই বুঝতে পারেন। একটা থেকে দুটোর মধ্যে ডাক্তারের মতে মারা যাবার সময়। অবশ্য বোঝা যাচ্ছিলো না মৃত্যুর কারণটা, কোনো চিহ্ন নেই আঘাতের, আর খুবই স্বাভাবিক ক্রেলের মুখের ভাবও। এঁদের পারিবারিক ডাক্তার ডঃ ফসেট, ক্রেলের শরীর স্বাস্থ্য ভালো তা উনি জানতেন, তার কোনো অসুখ বা এধরনের কোনো দুর্বলতা ছিলো না। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে এই মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারলেন না। এই সময় ডাঃ ফসেটের সঙ্গে ফিলিপ ব্লেকের কিছু কথাবার্তা হয়।
হেল এতদূর বলে একটু থামলেন, আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করলেন বলতে, কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় যেন এবার শুরু হচ্ছে,
ঐ কথাগুলোই পরে মিঃ ব্লেক জানান ইন্সপেক্টর কনওয়েকে। এই ধরনের ছিলো কথাটা, ব্লেক সেদিন সকালে তার দাদা মেরিডিথের কাছ থেকে টেলিফোন পান একটা (দেড় মাইল দূরে হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে মেরিডিথ থাকতেন)। একজন সখের রসায়নবিদ ছিলেন মেরিডিথ ব্লেক, বোধহয় ভেষজ-বিজ্ঞানী বললেই ভালো হয়। মেরিডিথ নিজের গবেষণাগারে সকালে ঢুকে চমকে ওঠেন, বিষলতার বিষের শিশিটা যেটা তাকের উপর রাখা সেটা প্রায় খালি হয়ে গেছে। যদিও ওটা ভর্তি ছিলো আগের দিন। উনি ভাইকে খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে ফোন করে কি করা উচিত এক্ষেত্রে জানতে চান। দাদাকে সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপ অ্যাল্ডারবেরিতে চলে আসতে বলে সামনাসামনি যাতে আলোচনা করা যায় ব্যাপারটা নিয়ে। নিজেই খানিকটা পথ ফিলিপ এগিয়ে যান, তারপর একসঙ্গে দুই ভাই বাড়িতে ফেরেন। কি করা উচিত এক্ষেত্রে এ নিয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পেরে, ঠিক করলেন দুজনেই এনিয়ে আর এক দফা লাঞ্চের পর আলোচনা করা যাবে।
ইন্সপেক্টর কনওয়ে আরও খোঁজখবর নেবার পর যেসব নতুন তথ্য জোগাড় করেছিলো সেগুলো হলো এই অ্যাল্ডারবেরি থেকে আগের দিন বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচজন হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে যান। ওখানে চায়ের নেমন্তন্ন ছিলো। এই পাঁচজন হলেন মিঃ আর মিসেস ক্রেল, মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, মিস এলসা গ্ৰীয়ার, আর মিঃ ফিলিপ ব্লেক। ওখানে নেশা সম্বন্ধে মিঃ মেরিডিথ ব্লেক জোর আলোচনা জানান, তারপর সবাইকে নিজের গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে সব কিছু দেখান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সেই সময় কয়েকটা বিশেষ বিশেষ ওষুধের নাম বলেন মেরিডিথ, একটা হলো তার মধ্যে বিষলতার থেকে পাওয়া কোনাইন চিতল এক বিশেষ ধরনের বিষ। তারপর মেরিডিথ নানা গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেন বিষটার, বলেন দুঃখ করে যে এই ওষুধটার নামই ফার্মাকোপিয়া থেকে এখন উবে গেছে, অথচ কোনাইন খুব অল্প মাত্রায় খাইয়ে হুপিং কাশি, হাঁপানি সারানো যেতে পারে। অবশ্য পরে মারাত্মক দিক্ষাগুলো নিয়েও আলোচনা করেন বিষটার। কিভাবে এই বিষটার ক্রিয়া হয় তা বলার জন্যে একজন গ্রীক লেখকের বই থেকে মেরিডিথ খানিকটা অংশ পড়েও শুনিয়েছিলেন।
আবার একটু থামলেন পুলিশ সুপার হেল, তামাক ভরলেন পাইপে এবং শুরু করলেন কাহিনীর তৃতীয় অধ্যায় :
মামলাটা চীফ কনস্টেবল কর্নেল ফ্রিরে আমার হাতে দেয়। খুনটা সম্বন্ধে ময়না তদন্তের ফলাফল থেকে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। যতদূর জানি কোনাইন বিষ ময়না তদন্তে দেওয়া হয়েছিলো কিনা এই বিষয়ে সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে বিষটা এটা ভালোমতই জানতেন ডাক্তাররা। তাই মৃত্যুর দু-তিন ঘণ্টা আগে যে বিষটা দেওয়া হয়েছিলো তার প্রমাণ যথেষ্টভাবে পাওয়া গেলো। মিঃ ক্রেলের সামনে পাওয়া গিয়েছিলো একটা টেবিলের উপর খালি একটা গ্লাস আর বিয়ারের একটা খালি বোতল। পরীক্ষা করে দেখা গেলো দুটোরই তলানি, বোতলে কোনাইন ছিলো না, কিন্তু ছিলো গ্লাসে। জানতে পারলাম খোঁজ খবর নিয়ে যে একটা ছোট ঘরে কামান বাগানের এক একস বিয়ার আর বোতল হতে রাখা, ছবি আঁকতে আঁকতে ক্রেল যাতে সহজেই তেষ্টা পেলে পেতে পারেন। কিন্তু ঐ দিন সকালে বিশেষ করে মিসেস ক্রেল বাড়ি থেকে স্বামীকে এক বোতল সদ্য ঠান্ডা করা বিয়ার এনে দিয়েছিলো। যখন উনি বিয়ারটা আনেন তখন ছবি আঁকতে ব্যস্ত ছিলেন মিঃ ক্রেল। আর পোজ দিয়ে একটা কামানের উপর বসেছিলেন মিস এলসা গ্ৰীয়ার।
বোতল থেকে বিয়ার গ্লাসে ঢেলে মিসেস ক্রেল গ্লাসটা স্বামীর হাতে বাড়িয়ে দেন। এক ঢেকে সবটাই খেলেন ক্রেল ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে। মিঃ ক্রেলের নাকি ঐভাবেই বিয়ার খাওয়ার অভ্যেস ছিল। মুখটা খাওয়ার পর বিকৃত করে ক্রেল নাকি বলেছিলেন, সবিকছুরই স্বাদ যেন আজ খারাপ লাগছে। এলসা গ্ৰীয়ার হাসতে হাসতে ওর কথা শুনে বলেছিলো, লিভার।
মিঃ ক্রেল বলেছিলেন, তবে বেশ ঠান্ডা আছে আর যাই হোক না কেন কিন্তু।
একটু থামতেই হেল প্রশ্ন করলো পোয়ারো, কখন হয়েছিলো এটা?
আন্দাজ সওয়া এগারোটা। মিঃ ক্রেল তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন ছবি আঁকতে। জানা গিয়েছিলো এলসা গ্ৰীয়ারের বক্তব্যনুসারে যে মিঃ ক্রেল কিছুক্ষণ পরে বলেছিলেন যে বোধহয় ওঁর বাত হচ্ছে, কারণ সব আড়ষ্ট লাগছে হাত পা সব। এমন এক ধরনের মানুষ ছিলেন মিঃ ক্রেল, যাঁরা কিছুতেই মানতে রাজী হন না নিজের অসুস্থতার কথা এবং অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন যে শরীর খারাপ লাগছে। বিরক্ত হয়ে একটু পরে লাঞ্চ খেতে চলে যেতে বলেন সবাইকে, কারণ একলা থাকতে চান একটু। এমন একটুতেই যে উনি বিরক্ত হয়ে যান, সবাই এ কথা জানতেন।
ঘাড় নেড়ে পোয়ারো সায় দিলো, বলে চললেন হেল, ফলে কামান বাগানে ক্রেলকে একলা রেখে চলে গিয়েছিলো সকলে। কোনো সন্দেহই নেই এ বিষয়ে। উনি তারপরে বসে পড়েন। বোধহয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো পেশীতে পক্ষাঘাতের ক্রিয়া। উনি কোনোরকম সাহায্য পাননি হাতের কাছে এবং মিঃ ক্রেলকে গ্রাস করলো মৃত্যু এসে।
আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো।
কিন্তু তারপর শুরু করে দিলাম রুটিন মাফিক তদন্ত। তেমন অসুবিধা হয় না তথ্য সংগ্রহ করতে। মিসেস ক্রেল আর এলসা গ্ৰীয়ারের মধ্যে আগেরদিন বেশ খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। বেশ রাগত ভাবেই এলসা আপত্তি জানিয়েছিলো ফার্নিচার সাজানোর ব্যাপারে, বিশেষ করে, যখন আমি এখানে থাকছি।
মিসেস ক্রেল সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠেন, তোমার কথার মানে? আবার তুমি থাকতে যাচ্ছ কেন এখানে?
উত্তর দেয় এলসা গ্ৰীয়ার, ক্যারোলিন। যা আমি বলতে চাইছি সেটা ভান কোরো না না জানার। যেন তুমি মুখ গোঁজা উট পাখি বালির মধ্যে। অ্যামিয়াস আর আমি পরস্পরকে চাই তা তুমি ভালোই করেই জানো এবং শিগগির আমরা বিয়েও করতে যাচ্ছি। মিসেস ক্রেল বলেন, ও সব জানি না আমি কিছু।
এলসা গ্ৰীয়ার বলে, বেশ এখন থেকে তাহলে জেনে নাও।
অ্যামিয়াস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে বাগান থেকে ঘরে ঢোকেন, মিসেস ক্রেল স্বামীকে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন এটা কি সত্যি অ্যামিয়াস, তুমি যে বিয়ে করতে যাচ্ছ এলসাকে?
পোয়ারো খুব উৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করলো, মিঃ ক্রেল তার উত্তরে কি বলেছিলেন?
এলসা গ্ৰীয়ারের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গে অ্যামিয়াস যতদূর শোনা যায়, তোমার কি ওকথাটা না বললেই চলতো না। তোমার কি মুখ বন্ধ করে রাখার মতো লোপ পেয়ে গেছে বুদ্ধিসুদ্ধিও?
এলসা গ্ৰীয়ার বলেছিলো, ক্যারোলিনের সত্যি কথাটা জানা উচিত আমার তো মনে হয়।
স্বামীকে প্রশ্ন করেছিলেন মিসেস ক্রেল, সত্যি কি কথাটা?
অ্যামিয়াস স্ত্রীর দিকে মুখ সরিয়ে নিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলেছিলেন।
আবার মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, মুখ ফুটে বলো, বলো তুমি। জানতেই হবে আমাকে।
অ্যামিয়াস তখন বলেন, সত্যি কথাটা। তবে ওসব নিয়ে এই মুহূর্তে আমি রাজী নই আলোচনা করতে।
অ্যামিয়াস রাগে গরগর করতে করতে হুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, এলসা গ্ৰীয়ার বললো, শুনলে তো। তারপর অনেক কথা কাটাকাটি হয় ওদের মধ্যে, মিসেস ক্রেলকে নাকি এলসা বলেছিলো কেন অকারণে সে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওদের জীবনে, ঘটবার যা তা তো যাচ্ছেই ঘটতে। বুদ্ধি খরচ করে সবারই উচিত পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া। তবে হ্যাঁ, বন্ধুত্ব বজায় থাকতে পারে ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াসের মধ্যে। এলসার তাতে কোনো আপত্তি নেই।
মিসেস ক্রেল তখন কি বলেছিলেন? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
জানা যায় সাক্ষীদের কথা থেকে যে এলসার ঐ কথা শুনে হেসে মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, এলসা, আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না। মিসেস ক্রেল কথাটা বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঘর থেকে তখন, তোমার কথার মানে? পিছন ফিরে তাকিয়ে মিসেস ক্রেল বলেছিলেন, আমি অ্যামিয়াসকে খুন করে ফেলবো তোমার হাতে তুলে দেবার আগে।
একটু থামলেন হেল।
বিশ্রী ব্যাপার খুব, তাই না?
মাথা নেড়ে পোয়ারো বললো, হ্যাঁ, তবে কে শুনেছিলো ঐ কথাগুলো?
গভর্নেস সিসিল আর ফিলিপ ব্লেক। ঘরের মধ্যেই ছিলেন দুজন। নিশ্চয়ই ওরা খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন।
দুজনের বর্ণনায় ঘটনাটা সম্বন্ধে মিল ছিলো তো?
যথেষ্ট পরিমাণে–তবে মঁসিয়ে পোয়ারো জানেন তো দুজনে সাক্ষী কিন্তু হুবহু একভাবে একই দৃশ্য মনে রাখতে পারে না। আপনিও তো জানেন সেকথা। তাই না?
ঘাড় নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। তারপর যেন বললো চিন্তা করতে করতে, হ্যাঁ তবে দেখতে হবে… শেষ না করেই কথাটা পোয়ারো থেমে গেলো।
আবার শুরু করলেন হেল, বাড়িটায় তল্লাশী চালাই আমি। মিসেস ক্রেলের শোবার ঘরের একটা আলামারীর তলার তাকে একটা শিশি পাই গরম মোজার তলায়, তাতে লেবেল আঁটা ছিলো জুই ফুলের আতরের। অবশ্য খালিই ছিলো শিশিটা। ওর গায়ের আঙুলের ছাপ নিয়ে দেখলাম মিসেস ক্রেলের আঙুলের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে একমাত্র। পরীক্ষা ভালোভাবে করে দেখা গেলো জুইয়ের আতরের গন্ধ আছে সামান্য শিশিটাতে আর আছে কোনাইন হাইড্রো ব্রোমাইড অ্যাসিড।
শিশিটা মিসেস ক্রেলকে দেখাতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন যে মানসিক অবস্থা তার খুব ভালো যাচ্ছিলো না, তাই কোনাইনের বর্ণনা শুনে মেরিডিথ ব্লেকের মুখে একবার টুক করে গবেষণাগারে একলা ঢুকে পড়েছিলেন, ব্যাগ থেকে তারপর জুইয়ের আতরের শিশিটা নিয়ে জানলা গলিয়ে সবটা আতর ফেলে দিয়ে খালি করে নেন শিশিটা। আর বেশ খানিকটা কোনাইনের বোতল থেকে তাতে ঢেলে নেন। কেন করলেন একাজ জানতে চাইলে বলেছিলেন মিসেস ক্রেল, কয়েকটা কথা এমন আছে যার সবটা কিছুতেই আমি বলতে পারছি না। তবে ভীষণ আঘাত পেয়েছি আমি মনে। আমাকে ছেড়ে আমার স্বামী অন্য একজনকে বিয়ে করার চিন্তা করছিলেন। সেটা ঘটলে কোনো প্রয়োজন থাকে না বেঁচে থাকার, অন্ততঃ আমি বিষটা নিয়েছিলাম সেই কথা ভেবেই।
পোয়ারো বলে উঠলো হেল একটু থামতেই, সেটাও তো সম্ভব হতে পারে?
–মঁসিয়ে পোয়ারো হতে পারে। কিন্তু ওর মুখে যে কথা ঘটনার আগের দিন শোনা গিয়েছিলো তার সঙ্গে তো খাপ খায় না এটা। তাছাড়া একটা ঘটনা ঘটেছিলো তার পরের দিনও। কথাবার্তার কিছুটা ফিলিপ ব্লেক শুনেছিলেন আর অন্য খানিকটা অংশ এলসা গ্ৰীয়ারও শুনেছিলেন। সেদিন লাইব্রেরী ঘরে ঝগড়া হচ্ছিলো মিঃ আর মিসেস ক্রেলের মধ্যে। পাশের হল ঘরে ছিলেন ফিলিপ, শোনেন সেখান থেকে। বাইরের বারান্দায় খোলা জানালার পাশে এলসা ছিলেন। তাই শুনছিলো একটু বেশি।
ওরা কি শুনেছিলো? জানতে চাইলো পোয়ারো।
শুনেছিলেন ফিলিপ ব্লেক মিসেস ক্রেল বলেছেন–তুমি আর তোমার ঐ মেয়ে মানুষরা আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে খুন করতে। তুমি একদিন আমার হাতে খুন হবে।
আত্মহত্যার কথা কিছু বলেননি? ঠিক তাই। একটাও না। যদি তুমি করো এটা তাহলে আত্মঘাতী হবো আমি।উনি ও ধরনের কোনো কথা বলেননি। তেমন কোনো কথা মিস এলসা গ্রীয়ারের সাক্ষ্যেও শোনা যায়নি। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এলসা বলেছিলেন, সব জিনিসটাকে বুদ্ধি দিয়ে ক্যারোলিন বিচার করার চেষ্টা করো। আমার খুব প্রিয় তুমি এবং সব সময়ে তোমার আর তোমার বাচ্চার আমি মঙ্গল কামনা করি। তাই বিয়ে করতে যাচ্ছি এলসাকে সব সময়েই আমরা তো রাজী আছি পরস্পরকে মুক্তি দেবার ব্যাপারে। মিসেস ক্রেল তার উত্তরে বলেছিলেন, ঠিক আছে তবে যেন বলতে না শুনি কোনোদিন যে তোমাকে আমি সাবধান করে দিইনি। অ্যামিয়াস আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, তুমি কি বলতে চাইছো, ক্যারোলিন তখন বলেছিলো, আমি বলতে চাইছি যে তোমাকে আমি ভালবাসি এবং আমি তোমাকে হারাতে রাজী নই। বরং তোমাকে আমি মেরে ফেলবো তবুও কাছে যেতে দেবো না ওর।
একটু নড়েচড়ে বসলো পোয়ারো, মিস গ্ৰীয়ার যথেষ্ট নির্বুদ্ধিতার কাজই করেছিলেন এই প্রসঙ্গটা তোলার ব্যাপারে। বিবাহ বিচ্ছেদে মিসেস ক্রেল সম্মতি না দিয়েই তো সহজ করে তুলতে পারতেন কাজটা।
আমরা ঐ ব্যাপারে কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছিলাম, হেল বললেন, বিশ্বাস করে মিসেস ক্রেল তাদের বহুদিনের বিশ্বস্ত পারিবারিক বন্ধু মেরিডিথ ব্লেককে বলেছিলেন মনের কিছু কথা। মেরিডিথ খুব বিচলিত হয়ে এ নিয়ে আলোচনা করেন অ্যামিয়াসের সঙ্গে। মনে হয় যতদূর আগের দিন বিকেল বেলায় এই কথাবার্তাটা হয়েছিলো। সামান্য বকাবকিও করেছিলেন মেরিডিথ তার বন্ধুকে। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হবে ওদের বিবাদ বিচ্ছেদ হওয়াটা। তাছাড়া অত্যন্ত কম বয়সী মেয়ে এলসা গ্ৰীয়ার ওকে টেনে নিয়ে কোর্টে যাওয়াটা ভালো কাজ হবে না। মিঃ ক্রেল তার উত্তরে মুখটিপে হেসে বলেছিলেন, ওসব কিছুই চায় না এলসা। ও যাবে না কোর্টে। নিজেরাই এটা মিটিয়ে নেবো আমরা।
তাহলে তো মিস এলসা গ্রীয়ারের পক্ষে ঐভাবে সব কথা ফাঁস করে দেওয়াটা আরও বোকামির কাজ হয়েছে? বললো পেয়ারো।
আঃ আপনি মেয়ে মানুষদের চেনেন তো? এ ওর টুটি টিপে ধরতে পারলে কিছু আর চায় না, বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছিলো পরিস্থিতি। কেন যে অ্যামিয়াস ক্রেল ও ভাবে চলতে দিচ্ছিলেন তা আজও আমি পারি না বুঝতে। যা বলেছিলেন মেরিডিথ ব্লেককে তা থেকে জানা যায় তিনি ছবি আঁকাটা আগে চাইছিলেন শেষ করতে। আচ্ছা এর কোনো মানে হয়?
হা, হয় তা আমার মতে। আমার মতে হয় না। অকারণে মানুষটা বাট বাড়াতে চাইছিলো।
এলসা গ্ৰীয়ার কথাটা যে ভাবে ফাঁস করে দিয়েছিলো, বোধ হয় তাতে খুব রেগে গিয়েছিলেন মিঃ ক্রেল।
হা, হয়েছিলেন তা, তাই বলেছিলেন মেরিডিথ ব্লেক, যদি ছবিটা শেষ করারই প্রশ্ন হতো, তাহলে কয়েকটা ফটো মেয়েটির তুলে নিয়ে কোনো অসুবিধে ছিলো কি কাজ করার? জল রঙ দিয়ে ছবি আঁকে এমন একজন কে আমি জানি। ওইভাবে ফটো তুলে ও কাজ করে।
মাথা নাড়লো পোয়ারো, না অনেকটা বুঝতে পারছি আমি শিল্পী ক্রেলকে। আপনাকে এ কথা মনে রাখতে হবে যে ঠিক ঐ সময়ে আর কিছুই ঐ ছবিটা ছাড়া ক্রেলের কাছে বড় হয়ে উঠতে পারেনি। যতো গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রশ্নটা বোধহয় ছবিটাই বড় হয়ে উঠেছিলো সবচেয়ে এই মুহূর্তে। তাই ওখানে মেয়েটির আসা বা থাকার ব্যাপারে তখন প্রাধান্য দিতে চাননি অন্য কোন প্রসঙ্গকে অবশ্য কারণটা মেয়েটি বুঝতে পারেনি। প্রেমটাই সব থেকে প্রধান হয়ে ওঠে মেয়েদের কাছে।
আমি কি তা আর জানি না? গাঢ় সুরে পুলিশ সুপার হেল বললেন।
পুরুষরা, বিশেষ করে একটু অন্য ধরনের হয়ে থাকে শিল্পীরা, আবার মন্তব্য করলো পোয়ারো।
শিল্পকলা সুপারিনটেন্টে বললেন ব্যাঙ্গের সুরে, যতসব বাজে কচকচি শিল্পকলা নিয়ে। ওটা আমি কখনই বুঝিনি এবং বুঝবোও না। যে ছবিটা ক্রেল আঁকছিলেন ওটা দেখা উচিত আপনার কোনো সামঞ্জস্য নেই কোথাও। এমনভাবে মেয়েটিকে এঁকেছে যেন মনে হচ্ছে কনকন করছে ওঁর দাঁত। ছবিটা পুরো বাজে। ছবিটা সম্বন্ধে বহুদিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে একটা বাজে চিন্তা ঘুরপাক খেত। মুছে ফেলতে পারতাম না কিছুতেই, বিশেষ করে মেয়েটিকে।
হেসে ফেললো পোয়ারো, দেখুন, আপনি কেমনভাবে না জেনে অসাধারণ যে অ্যামিয়াসের শিল্প তা স্বীকার করে নিচ্ছেন।
ছাড়ুন তো বাজে কথা। সুন্দর যা কিছু আনন্দ দেয় মনকে এমন জিনিস আঁকে না কেন শিল্পীরা? যতো সব কুৎসিত জিনিসগুলোকে খুঁজে পেতে নিয়ে পড়ে কেন?
অনেকেই যে আমাদের জন্য সৌন্দর্যকে বিচিত্র জায়গায় খুঁজে বেড়ান। বিজ্ঞের মতো বললো পোয়ারো।
মেয়েটা ভালো ছিল দেখতে ঠিকই, মেখেছিলো দারুন সাজগোজ আর রঙচঙ। আর পোষাক ছিলো না বললেই চলে। ওভাবে মেয়েদের পক্ষে পোষাক পরাটা শোভন নয়। মনে রাখবেন ষোল বছর আগেকার ঘটনাটা। অবশ্য এখন তো ঐ ধরনের পোষাক পরছে সব মেয়েরাই। কিন্তু আমার তখন খুব খারাপ লেগেছিলো। ফুলপ্যান্ট আর তার সঙ্গে সূতীর জামা, বুক খোলা। আর কিছু না।
খুব ভালো ভাবে মনে আছে অনেক কিছুই আপনার-বিড় বিড় করে পোয়ারো বলতো ধূর্তের মতো তাকিয়ে।
লজ্জা পেয়ে হেল বললেন, মানে, আমার যা মনে হয়েছিলো তখন আপনাকে তাই বলছি।
তা তো বটেই তা তো বটেই, হেলকে ভোলাবার জন্যে মিষ্টি করে বললো পোয়ারো। তারপর বললো, মিসেস ক্রেলের বিরুদ্ধে তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রধান সাক্ষী ছিল ফিলিপ ব্লেক ও এলসা গ্ৰীয়ার?
হ্যাঁ, খুব ক্ষেপে ছিলো দুজনেই। জোর সাক্ষ্য দিয়েছিলো। তবে গভর্নেস সিসিলকেও ডাকা হয় সরকার পক্ষ থেকে। ওর বক্তব্য আবার বেশি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছিলো ঐ দুজনের চেয়েও; প্রথম থেকেই মিসেস ক্রেলের সঙ্গে সিসিল পক্ষ নিতে শুরু করেছিলো। তবে সৎ বলে মহিলাটি কোনোকিছু লুকোছাপা না করে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলো সত্যি কথাই।
আর মেরিডিথ ব্লেক?
বেচারা! পুরো ব্যাপারটাতে এতো বেশি ভদ্রলোক ভেঙে পড়েছিলেন যে বলার নয়। তিনি যেন নিজেই দোষী। তখন নিজেকেই অপরাধী মনে করেছিলেন বিষয়টা তৈরি করার জন্যে। তাকে দোষ দেয় করোনার কোর্টও, বিষ সংক্রান্ত আইনের ১নং সিডিউল কোনাইন আর এই সল্টকে ফেলা হয়েছে। খুব ধমক-ধামক দিয়েছিলো আদালত ভদ্রলোককে। তাছাড়া উভয় পক্ষেরই বন্ধু ছিলেন তো উনি–মনে ওঁর খুব লেগেছিলো। বিশেষ করে এই ধরনের গ্রামাঞ্চলের ভদ্রলোকেরা ভীষণ অখ্যাতিকে ভয় পায়।
সাক্ষ্য দেয়নি মিসেস ক্রেলের ছোট বোনটি?
না। দরকার পড়েনি। যখন তার স্বামীকে ধমকাচ্ছিলেন মিসেস ক্রেল তখন ও ছিলো না ওখানে। এমন কিছু মেয়েটা জানতও না যা আমাদের মামলার ব্যাপারে কাজে লাগতে পারতো। শুধু ও দেখেছিলো ফ্রিজ থেকে মিসেস ক্রেল নিয়ে যাচ্ছেন ঠান্ডা বিয়ারের বোতল। মেয়েটাকে আসামী পক্ষ থেকে সমন জারি করে নিশ্চয়ই সাক্ষী হিসেবে আনা যেতো, তবে কোনো দরকার ছিলো না তার, কারণ কোনাইন তো পাওয়া যায়নি বোতলের মধ্যে।
মিসেস ক্রেল দুজনের চোখের সামনে কিভাবে বিষ মেশালেন গ্লাসে? জানতে চাইলো পোয়ারো।
দেখুন, প্রথমতঃ সেভাবে নিশ্চয়ই অ্যামিয়াস বা এলসা গ্ৰীয়ার নজর রাখেনি। তার মানে ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন অ্যামিয়াস ক্রেল আর সেখানে বসে এলসা গ্ৰীয়ার পোজ দিচ্ছিলেন সেদিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ক্যারোলিন ক্রেল বিয়ার ঢেলেছিলেন।
ঘাড় নাড়লো পোয়ারো। আবার হেল বলতে শুরু করলেন, ঐ বলছিলাম যা, মিসেস ক্রেলের দিকে দুজনেই তাকায়নি। নিশ্চয়ই মিসেস ক্রেলের কাছে ফাউন্টেনপেনে কালি ভরার ড্রপার জাতীয় কোনো ছোট্ট কাঁচের নল ছিলো, বিষটা যার মধ্যে ভরে রেখে ছিলেন। কারণ ঐ জাতীয় কাঁচের সরু নল বাড়ি থেকে বাগানে যাবার রাস্তার একধারে একেবারে গুঁড়োনো অবস্থায় আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম।
প্রায় আপন মনে বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, আপনাদের কাছে দেখছি একটা না একটা জবাব আছে সব কিছুরই।
মঁসিয়ে পোয়ারো দেখুন। যা আগে বলেছি কোনো রকম পরিবর্তন সে সম্বন্ধে না ঘটিয়েই এখন বলছি, স্বামীকে খুন করবে বলে ক্যারোলিন ভয় দেখিয়ে ছিলেন। মেরিডিথের গবেষণাগার থেকে মহিলা জিনিসটা সরিয়ে ছিলেন। মহিলাটিরই ঘরে খালি শিশিটা পাওয়া গেছে, এবং সেটা তিনি ছাড়া আর কেউই নাড়াচাড়া করেনি। মহিলা ঠান্ডা করা বীয়ার নিজের থেকেই পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বামীকে, অথচ মজার ব্যাপার এই যে কথাবার্তা ওঁদের মধ্যে বন্ধ ছিলো।
আশ্চর্যের ব্যাপার খুবই। আমি আগেই তো এ ব্যাপারে বলেছি, বললো পোয়ারো।
হ্যাঁ ধরা যায় এই ছোট্ট ব্যাপারটা থেকেই, মহিলা হঠাৎ কেন এতো সহৃদয় হয়ে উঠলেন? স্বামী বিয়ারের স্বাদ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন–খুব বিশ্রি কোনাইনের স্বাদও, কামান বাগানে এমনভাবে আসছেন যাতে আবিষ্কার করা যায় দেহটাকে, অন্য মহিলাকে কায়দা করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন টেলিফোন করতে কিন্তু কেন? যাতে বোতোল আর গ্লাশ থেকে ঐ সময়ের মধ্যে আঙুলের দাগটা মুছে ফেলে লাগিয়ে নিতে পারেন স্বামীর আঙুলের ছাপ। যাতে করে স্বামী মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছেন বলতে পারেন। গল্পটা চলে যেতে পারত চালালেও।
তবে মহিলা গল্পটা খুব ভালমতো ফঁদতে পারেননি, বললো পোয়ারো।
তা পারেননি। উনি অতো চিন্তা করার সময় পাননি। ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো ঈর্ষা। তখন একটাই চিন্তা মহিলার মাথায় কি করে সরিয়ে ফেলা যায় স্বামীকে। এবং তারপর যখন ব্যাপারটা শেষ হলো, যখন স্বামীকে উনি মৃত অবস্থায় দেখলেন ওখানে, তখন, আমার যতোদূর মনে হয়, মহিলা তখনই হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন, বুঝতে পারেন তিনি খুন করে ফেলেছেন এবং ফাসী হয় খুন করলে। এবং তখনই উনি মরিয়া হয়ে নিজেকে বাঁচবার একটি মাত্রই পথের কথা চিন্তা করেন, এবং আত্মহত্যা হলো সেটা…।
যুক্তি আছে আপনার কথায়। ওভাবে চিন্তা করে থাকতে পারেন মহিলা, বললো পোয়ারো, খুনটাকে প্রমাণ করতে পারলে আত্মহত্যা বেঁচে যেতেন উনি।
পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে এই অপরাধটা করা হয়েছে একদিক দিয়ে বিচার করলে, আবার তা নয় অন্য দিক দিয়ে বিচার করলেন। মহিলা সত্যি সত্যিই ভেবেছিলেন খুন করার কথা আমার তো বিশ্বাস হয় না। কাজটা রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে করে ফেলেন।
ভাবছি আমি…, আপন মনে বিড়বিড় করলো পোয়ারো।
হেল একটু আশ্চর্য হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, আমি কি ব্যাপারটা ঠিক মতো বোঝাতে পেরেছি আপনাকে মঁসিয়ে পোয়ারো যে সাধারণ মামলা এটা একটা?
প্রায়। তবে পুরোটা না। অদ্ভুত ব্যাপার আছে দু-একটা…।
আপনার ধারণা অন্য আর কি হতে পারে, বোঝাতে পারেন যুক্তি দিয়ে? বললেন হেল।
অন্যান্য মানুষগুলোর গতিবিধি সেদিন সকালে কেমন ছিলো? প্রশ্ন করলো পোয়ারো হেলকে।
আমি ওঁদের কাছে গিয়েছিলাম। খুঁটিয়ে খুঁজে খবর নিয়েও ছিলাম প্রত্যেকের সম্বন্ধে অন্য জায়গায় থাকার অজুহাত দেখিয়ে। খুনির সঙ্গে জড়িত না হবার যুক্তি মানুষ দেখাতে চায় এক্ষেত্রে তেমন ছিলো না কারুর-যাকেও না বিষ দিয়ে খুন করার ব্যাপারে। কেননা যদি কেউ কাউকে খুন করতে চায় বিষ খাইয়ে তবে হজমের ওষুধ বলে একটা ক্যাপসুল বিষ ভরা দিয়ে বলবে খাবার পর কালকে এটা খাবেন। এবং দেশের অন্য প্রান্তে সেই অবসরে চলে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতে পারে।
এক্ষেত্রে কিন্তু আপনার তাই হয়েছে বলে মনে হয় না নিশ্চয়ই, পোয়ারো বললো।
হজমের গণ্ডগোল ছিলো না অ্যামিয়াস ক্রেলের। তাছাড়া আমি এরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনাও দেখিনি। মেরিডিথ ব্লেক সে নানারকম জিনিস মিশিয়ে ওষুধ বিষুধ তৈরি করার সম্বন্ধ যে মনগড়া অনেক কথা যা কিনা উল্টোপাল্টা তা বলেছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো, তাই বলে নিজের ওপর যে অ্যামিয়াস প্রয়োগ করবে তা বিশ্বাস করি না আমি। এবং কেনই বা মেরিডিথ ক্রেলকে খুন করতে চাইবেন? বিচার করে সব কিছু দেখা যায় খুব গাঢ় ছিলো অ্যামিয়াস আর মেরিডিথের বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব ছিলো ওঁদের সবারই মধ্যে। অ্যামিয়াসের প্রাণের বন্ধু ছিলেন ফিলিপ ব্লেক। ভালোবাসা হয়েছিলো এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে। যদিও এর জন্য গভর্নেস সিসিলিয়া অ্যামিয়াসকে পছন্দ করতেন না খুব একটা তবে কারুর চরিত্রের নৈতিক দিকের জন্যে কেউ বিষ খাওয়াবে না। বাচ্চা মেয়েটা, অ্যামিয়াসের খটাখটি যে লাগতো না অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের সঙ্গে তা নয়, তবে ঐ রকম একটু হয়েই থাকে ঐ বয়সের মেয়েরা। তারা দুজনেই খুব ভালোবাসতো দুজনকে। অ্যাঞ্জেলাকে বাড়ির সবাই বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতো। আগেই তো শুনেছেন কারণটা। ক্যারোলিন ক্রেল রাগের চোটে পাগল হয়ে গিয়ে মারাত্মক ভাবে জখম করে ফেলেছিলেন তার সৎ বোন অ্যাঞ্জেলাকে। ক্যারোলিনের চরিত্রের মধ্যে এ থেকেই তা বোঝা যায় একটা বেপরোয়া ভাব ছিলো। তাই না?
বোঝা যায় বৈকি, চিন্তান্বিতের মতো পোয়ারো বলতে থাকলো, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের পক্ষে অসম্ভব নয় ক্যারোলিন, ক্রেলের ওপর বিদ্বেষ থাকা।
হয়তো তাই বলে, কিন্তু অ্যামিয়াস ক্রেলের বিরুদ্ধে নয়। আর তাঁর ছোট্ট বোনকেও ক্যারোলিন খুব ভালোবাসতেন। বোনকে তো উনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন মা বাবা মারা যাবার পর, আর ভীষণ ভালোবাসতেন আগেই বলেছি। আদর দিয়ে নাকি বোনের মাথা খাওয়া হয়েছে সবাই বলতো। দিদিকে অ্যাঞ্জেলাও খুব ভালোবাসতো, বোনকে যাতে ধারে কাছে না আসতে দেওয়া হয় মামলা চলার সময় এ ব্যাপারে ক্যারোলিন ভীষণ জেদ ধরেছিলেন। তবে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো মেয়েটা, দিদির সাথে জেলে গিয়ে দেখা করতে চাইতো, রাজী হননি উনি, ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন উল্টে লেখাপড়া করবার জন্যে।
খুব নাম করা মহিলা হয়ে উঠলেন মিস অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ঘুরে বেড়ান ইতিহাসের ভগ্ন স্থূপে। বক্তৃতা দেন রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে এই আর কি।
এবং কারুরই মনে নেই মামলার কথা? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
হ্যাঁ তাই বলা যায়, ঘুরিয়ে বললে। কুমারী নামের পদবীও তো ভিন্ন ছিল ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলার। মা একজনই কিন্তু দুজন তো বাবা। স্পলডিং ছিলো ক্যারোলিনের আগেকার পদবী,
ঐ সিসিলিয়া উইলিয়ামস, কার গভর্নেস ছিলেন উনি, অ্যাঞ্জেলার না অ্যামিয়াসের মেয়ের?
অ্যাঞ্জেলার। আলাদা নার্স ছিলো মেয়েটার জন্যে, তবে সিসিলিয়ার কাছে যতোদূর শুনেছি। মাঝে মাঝে পড়াশোনা করতো সামান্য।
বাচ্চা মেয়েটা ঘটনাটা ঘটার সময় কোথায় ছিলো?
দিদিমার কাছে, লেডি ট্রেসি লিয়ানের কাছে ওকে নার্স নিয়ে গিয়েছিলো, ঐ বাচ্চাটিকে উনি খুব ভালোবাসতেন।
তাই নাকি, মাথা নাড়লো পোয়ারো।
আবার বলতে শুরু করলেন হেল, অন্যান্যরা কে কোথায় ছিলেন খুনের দিন, আমি বলতে পারি যদি জানতে চান।…জলখাবার সকালের খাবার পর এলসা গ্ৰীয়ার লাইব্রেরী জানালার কাছে খোলা বারান্দায় বসেছিলেন। উনি ওখানে বসেই শুনেছিলেন ঝগড়াঝাটি। তারপর কামান বাগানে চলে যায় এলসা ক্রেলের সঙ্গে এবং ছবি আঁকানোর জন্য লাঞ্চ পর্যন্ত সিটিং দেন।
সকালে ফিলিপ ব্লেকও বাড়িতে ছিলেন, উনিও ঝগড়ার কিছুটা শুনেছিলেন। কাগজ পড়ছিলেন অ্যামিয়াস আর এলসা চলে যাবার পর, তারপর সমুদ্রের দিকে যান দাদার ফোন পেয়ে দাদার সঙ্গে দেখা করতে। দুজন তারপর কথা বলতে বলতে কামান বাগানের পাশ দিয়ে আসেন, এলসা গ্ৰীয়ার ঠিক সেই সময় বাড়িতে গিয়েছিলো একটা সোয়েটার আনবার জন্যে, তার একটু শীত শীত করছিলো। ক্যারোলিন স্বামীর সঙ্গে অ্যাঞ্জেলার স্কুলে যাবার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
দুজনের এই সাক্ষাৎকার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো কিনা জানতে চাইলো পোয়ারো।
আদৌ নয়। স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কেঁঝে কথা বলছিলো অ্যামিয়াস। খুঁটিনাটি ঘর সংসারের ব্যাপারে আলোচনায় মনে হয় খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। ছাড়াছাড়িই যদি হয় তাহলে আগে থাকতে ব্যবস্থা করে নিতে হবে ধরে নিয়ে ক্যারোলিন কথা বলছিলেন।
মাথা নাড়লো পোয়ারো। আবার বলতে শুরু করলেন হেল, অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে মেরিডিথ আর ফিলিপ দুই ভাই দু একটা কথা বলেছিলেন। ইতিমধ্যে নিজের জায়গায় এলসা গ্ৰীয়ার ফিরে এসে বসে পড়েছেন। বোধ হয় অ্যামিয়াসও দুই-ভাইকে এড়াবার জন্যে তুলি নিয়েছিলো তুলে। মনের ভাবটা অ্যামিয়াসের বুকে নিয়ে ব্লেকরা বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিন্তু ওঁরা কামান বাগানে যখন ছিলেন ঠিক তখনই বাগানের ঘরে রাখা বিয়ারগুলো যে গরম, যাচ্ছে না খাওয়া, বলেছিলেন। এই ধরনের কথা বলেছিলেন অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিনও উনি পাঠিয়ে দেবেন বাড়ি থেকে ঠান্ডা বিয়ার।
আহা।
তাহাই বটে। যেন মধু ঝরছিলো ক্যারোলিনের মুখে তারপর ব্লেকরা দুইভাই বাড়িতে গিয়ে কথা বলছিলেন বাইরের চত্বরে বসে। ওদের বিয়ার দেওয়া হলো ওখানে।
তারপর অ্যাঞ্জেলা সমুদ্রে স্নান করতে গেলো, ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে বাগানের সামনে একটা ভোলা জায়গায় বসে মেরিডিথ ব্লেক আবার চুরি যাওয়া কোনাইন সম্বন্ধে শুরু করেছিলেন চিন্তা করতে। এলসা গ্ৰীয়ারকে ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিলো। তারপর মেরিডিথ কামান বাগানে গেলেন খাবারের ঘণ্টা বাজলে ওদের ডেকে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু তার সঙ্গে শুধু এলসাই গিয়েছিলেন। মেরিডিথ যাবার সময় লক্ষ্য করেছিলেন খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছিলো অ্যামিয়াসকে। তবে মনে হয়নি তেমন কিছু। কখনো শক্ত অসুখ করেনি অ্যামিয়াসের, খুবই ভালো ছিল স্বাস্থ্য, তাই মাথায় আসেনি অসুস্থ হয়েছে চিন্তাটা বরং মনোমত আঁকার ব্যাপারটা না হলে বেশ ক্ষুব্ধ হতেন অ্যামিয়াস, রাগারাগি করতেন। কেউ তখন ওঁকে ঘাঁটায় না, থাকতে দেয় একলা। এবং মেরিডিথ আর এলসাও সেদিন তাই করেছিলো।
অন্য চাকরবাকরেরা বাড়ির কাজে ব্যস্ত ছিলো, খাতা দেখছিলো সিসিলিয়া স্কুল ঘরে। পরে কিছু সেলাই-টেলাই করে চত্বরে বসে। বাগানে সকালে ঘুরে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ফলটল খেয়ে বেড়াচ্ছিলো গাছে চড়ে সাধারণতঃ যা করে বছর পনেরোর মেয়েরা আর কি। ফিরে এসে সমুদ্রে স্নান করতে চলে যায় ফিলিপের সঙ্গে।
পুলিশ সুপার হেল একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, কোনো রহস্যের সন্ধান এর মধ্যে পাচ্ছেন কি?
পোয়ারো বললো, আদৌ না, তাহলে এই একটি কথাই হেলের অনেক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করলো। একই ব্যাপার, ভাবছি আমি আমি…
ভাবছেন কি করবেন?
আমি এই পাঁচজনের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা শুনবো।
হেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মশাই খারাপ হয়ে গেছে আপনার মাথা। কারুর কথাই ওদের কারুর সঙ্গে মিলবে না। বুঝতে পারছেন না এই সামান্য ব্যাপারটা, দুজন কখনোই একটা ঘটনা একরকম ভাবে বলতে পারে না। তাছাড়া এতো বছর পরে আর কি হবে, পাঁচ রকম ভাবে বলবে পাঁচজনে খুনের কাহিনীটা।
আর আমি তো সেই জিনিসটাই চাই। তা থেকে শেখা যাবে অনেক কিছু। বললো পোয়ারো।
১.২ ছোট্ট শূয়োর ছানাটা
ষষ্ঠ অধ্যায়
বাজারে গিয়েছিল এই ছোট্ট শূয়োর ছানাটা…
ফিলিপ ব্লেকের চেহারা হুবহু মিলে গেলো স্যার মন্টেগুর দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে। বেশ ধনী, ধূর্ত, হাসিখুশি মানুষ শুরু করেছেন একটু মোটা হতে।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় শনিবার দেখা করার সময় এরকুল পোয়ারো ঠিক করেছিলো। গলফ খেলছিলেন ফিলিপ বাজী রেখে বন্ধুর সঙ্গে। বল ফেলা হয়ে গেছে ১৮নং গর্তে, বলা যায়। পাঁচ পাউণ্ড জিতে ফেলেছেন, ফলে বেশ প্রসন্ন মন মেজাজ।
নিজের পরিচয় দিয়ে পোয়োরো উদ্দেশ্যটা জানালো দেখা করার। অবশ্য তার কৌতূহল আজ তত তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না।
হায় ভগবান, আবার এতদিন পরে এসব কেন?
এখানে খুব বেশি পাত্তা পাবে না তা পোয়ারো জানে। তাই হাল্কা করে বললো, মানুষের এটাই তো স্বভাব। এই আমি বা আপনি, যারা আমরা জগৎটাকে চিনি মানুষ সম্বন্ধে কোন মোহ নেই আমাদের মধ্যে, ভ্রান্ত ধারণা নেই। সবাই তো আর খারাপ লোক নয়, সবাইকে তো সেই সঙ্গে আবার আদর্শরূপ বলে দেখানো যায় না।
ফিলিপ বেশ খুশি মনে বললেন, আমি বহুদিন আগেই মোহ বিসর্জন দিয়েছি।
আর শুনেছি খুব সুন্দর নাকি আপনি গল্প বলেন।
আনন্দে চক চক করে উঠলো ফিলিপ ব্লেকের চোখ, তাও শুনেছেন?
পোয়ারো উত্তরে মাপা হাসি হাসলেন, বেশ আরাম করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ফিলিপ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে।
হঠাৎ মনে হলো পোয়ারোর এক আত্মপরিতৃপ্ত শূয়োর ছানার মতো দেখাচ্ছে ফিলিপকে বাজারে গিয়েছিলো এই ছোট শূয়োর ছানাটি…।
এই ফিলিপ ব্লেক কেমন মানুষ? একটা এমন মানুষ যার ভাবনা চিন্তা নেই কোনো, অবস্থাপন্ন, সুখী, কিছুই নেই দুঃশ্চিন্তা বলতে। বিবেকের তাড়না নেই অতীতের কোনো ব্যাপারে, এ যেন পেট পুরে খাওয়া একটা শূয়োর ছানা যে বাজারে গেছে–এবং দামটা পুরো উসুল করেছে…।
ফিলিপ ব্লেকের তো এককালে আরো অনেক কিছু থেকে থাকতে পারতো। নিশ্চয়ই আরও দেখতে সুন্দর ছিলো বয়সকালে। হয়তো একটু ছোট চোখটা, কিন্তু ওটা মানিয়ে যেতে পারে ভালো স্বাস্থ্যের যুবকের ক্ষেত্রে। এখন পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে ফিলিপের বয়স। তার মানে তখন বয়স ছিলো চল্লিশ-এর কোঠায়। যৌবনের তখন অনেক দাবী, সব সময় সবগুলো যে মিটতো তাও নয়…
যে সব চালু কথা দিয়ে কথা শুরু করতে হয় সেই ভাবে বললো পোয়ারো, আপনি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন…।
না, বুঝতে পারছি না সত্যি বলছি। এত লোক থাকতে আপনি কেন? আপনি লেখক?
না তা ঠিক নয়…মানে একজন গোয়েন্দা আমি। এর আগে এমন বিনীত ভাবে কখনো কথা বলেছে কিনা সন্দেহ পোয়ারো।
আমরা সবাই সে কথা জানি, বিখ্যাত এরকুল পোয়ারো।
প্রশংসার ফাঁকে ফিলিপ ব্লেকের কথায় কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গের হুল লুকানো ছিল। একটু বিরক্ত হলো পোয়ারো, জীবনে সাফল্য অর্জন করেছে বলে এই মানুষটা এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না তেমন। এতো অপমান চূড়ান্ত।
পোয়ারো কৃত্রিম কৃতজ্ঞতার মুখোশ এঁটে বললো, খুব খুশি হলাম আমি এই জেনে যে আমাকে চেনেন আপনি। আমার সাফল্যের মূলে আছে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি এক অদ্ভুত মনঃস্তত্ত্ব–সেই অনন্ত প্রশ্ন মানুষের আচরণ সম্পর্কে কেন? মিঃ ব্লেক জানেন এখন প্রধান হয়ে উঠেছে বর্তমান জগতে অপরাধের মূলে এই প্রশ্নটিই। আগে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার ছিলো এটা। বিখ্যাত অপরাধের কাহিনীগুলোর পুনরাবৃত্তি করা হতো আগেকার যুগে একটি মাত্র দৃষ্টিকোণের বিচারে স্নেহের ব্যাপারটা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এখন পাল্টে গেছে কিন্তু। এখন দেখা যায় ভীষণ অহংকারী স্ত্রী, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে স্বামীকে, তাই হীনম্মন্যতার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে স্বামী-স্ত্রীকে খুন করে। খুন করেছে একটি মেয়ে তার বাবাকে, কারণ মেয়েটি তিন বছর বয়সে দারুণ বকুনী খেয়েছিলো তার বাবার কাছে। আর আমি সেই জন্যই বলছিলাম কি খুব বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে এ যুগে অপরাধের মূল কারণটাই।
ফিলিপ ব্লেক ছোট্ট একটু হাই তুলে বললেন, অপরাধের বেশির ভাগ কারণটা তো বোঝা যায় স্পষ্ট, আমার মতে আসল কারণ হলো টাকা পয়সা।
চেঁচিয়ে উঠলো পোয়ারো, আঃ। বলেন যে কি মশাই, কারণটা স্পষ্ট বোঝা যায় না কখনই আর আসল ব্যাপার হলো সেটাই।
আর আপনার বিশেষত্ব সেখানেই?
মিঃ ব্লেক ঠিক ধরেছেন, আমার বিশেষত্ব ওইখানেই। অতীতের অপরাধ কাহিনীগুলোকে মনঃস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ দিয়ে নতুন করে লেখা উচিত। মনঃস্তত্ত্বই হলো অপরাধে আমার বিশেষত্ব। আর আমি স্বীকার করে নিয়েছি সেই দায়িত্বটা।
আশাকরি এতে আমদানী ভালোই হয়। ফিলিপ ব্লেক হাসির ভাব দেখালেন দাঁত চেপে।
হয় মনে হয়…নিশ্চয়ই হয়…রইলো অভিনন্দন। আচ্ছা এবার এর মধ্যে আসি কি করে আমি বলুন তো?
বলবো নিশ্চয়ই। ক্রেল মামলার ব্যাপারটায়।
ফিলিপ ব্লেক কথাটা শুনে একটুও চমকে উঠলেন না, বরং বললেন, চিন্তার সুরে, ও হ্যাঁ। …ক্রেল মামলা…।
পোয়ারো উদ্বেগের সঙ্গে বললো, মিঃ ব্লেক খুব অসন্তুষ্ট হচ্ছেন না তো আপনি?
ওই…ওই ব্যাপারে, ফিলিপ ব্লেক কাধ ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন, না, মানুষের যে ব্যাপারে কোনো হাত নেই, সে সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হওয়ার। প্রকাশ্য ব্যাপার তা ক্যারোলিন ক্রেলের মামলা, ওটা যে কেউ নিয়ে লিখতে পারে। তাতে কোনো আপত্তি করবার কারণ আমার থাকতে পারে না। ব্যাপারটা আমি খুবই অপছন্দ করি তা আপনাকে বলতে আমার আপত্তি নেই, আমার বিশেষ বন্ধু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল। আমার খারাপ লাগবে পুরো ব্যাপারটা নতুন করে খুঁচিয়ে তুলতে কিন্তু আর কি করা যায়? অহরহ তো ঘটছেই এসব।
মিঃ ব্লেক আপনি দেখছি কথা বলছেন দার্শনিকের মতো?
না। না। খোঁচা খেলেই যে পাল্টা আঘাত দিতে হয় আমি এটা মানি না। তবে অন্যদের মতো আপনি ততো খারাপ কিছু করবেন না তা আমার বিশ্বাস।
রেখে ঢেকে যতোখানি সম্ভব ভদ্রভাবে লেখা যায় নিশ্চয়ই ততোটা করবো, আশা রাখি।
হো হো করে ফিলিপ ব্লেক হেসে উঠলেন, আর সত্যিকারের প্রাণের ছোঁয়া তাতে ছিলো না, হাসি আর চাপতে পারছি না আপনার কথা শুনে।
কিন্তু মিঃ ব্লেক ব্যাপারটা সম্বন্ধে সত্যি বলছি আমি আগ্রহী, টাকাকড়ির ব্যাপার নয় এটা শুধু। আমি নতুন করে গড়তে চাই অতীতের ঘটনাকে, যা ঘটেছিলো আঁকতে চাই তার আসল রূপটা। অন্তরালে যা কিছু ছিলো সবার সামনে সেগুলো তুলে ধরতে চাই…।
বললেন ফিলিপ ব্লেক, কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার এর মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয় না। খুবই স্থল, পারিবারিক ঈর্ষা ব্যাপারটা। আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলো ব্যাপারটা সম্বন্ধে সেটা জানতে পারলে মিঃ ব্লেক আমি ভীষণ খুশি হবো।
ফিলিপ হঠাৎ রেগে উঠলেন, লাল হয়ে গেলো মুখ চোখ, প্রতিক্রিয়া! প্রতিক্রিয়া! দয়া করে অতসব গাল ভরা কথা বলবেন না। তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে আমি দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিক্রিয়া নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে দিতে পারি না, সে সময় বা মনোভাব তখন ছিলো না আমার। মশাই আপনি বুঝতে পারছেন না, খুন হচ্ছে আমার বন্ধু–তাকে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে, যদি একটু তৎপর আমি থাকতাম তাহলে বোধ হয় বাঁচাতে পারতাম তাকে।
মিঃ ব্লেক কেন একথা বলছেন আপনি।
এই জন্যে বলছি যে ধরে নিচ্ছি আমি আপনি ইতিমধ্যে এই মামলার খবরাখবর পড়ে নিয়েছেন।..যদি তা হয় শুনুন আমার দাদা মেরিডিথ ঐ দিন সকালে ফোন করে আমাকে জানান যে, যে সব গাছ-গাছড়া নিয়ে উনি গবেষণা করেন তার মধ্যে খুবই মারাত্মক একটা রস এবং তার ল্যাবরেটারি থেকে সেই রকম চুরি গেছে একটা বিষ। দাদাকে আমি আসতে বললাম, আলোচনা সামনে বসে করে যা করলে ভালো হয় সবচেয়ে তাই করা যাবে। মিঃ পোয়ারো কী রকম নির্বোধের মতো কাজ করেছিলাম বুঝতে পারছেন তো, সঙ্গে সঙ্গে আমার তো অ্যামিয়াসকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিলো। দাদার ল্যাবরেটরি থেকে ক্যারোলিন মারাত্মক বিষ চুরি করেছে, অতএব তুমি আর এলসা সাবধান হও নিজেদের ব্যাপারে।
ফিলিপ ব্লেক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন, পায়চারি করতে করতে বললেন, কী ভাবছেন মশাই এ ব্যাপারটা নিয়ে? আপনার কি ধারণা আমি চিন্তা করিনি? আমি জানতাম, আমার ওকে বাঁচাবার সুযোগ ছিলো। তা না করে অকারণে দাদার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইলাম। চুরি করেছে বিটা ক্যারোলিন, এবং ওটাকে কাজে লাগাবেই সে দেরী না করে। আর ঠিক হলোও তাই। ক্যারোলিন প্রথম সুযোগেই কাজ সেরে ফেললো। জানতাম আমি জানতাম যে বেশ বিপদ ঘনিয়ে আসছে অ্যামিয়াসের, অথচ আমি কিছুই করিনি…।
মিঃ ব্লেক অযথা দোষ দিচ্ছেন নিজেকে, আপনার হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো না…।
ফিলিপ মাঝপথে বাঁধা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো। বলতে পারতাম অ্যামিয়াসের কাছে গিয়ে, অবশ্য ও হয়তো বিশ্বাস করতো না। হেসে উড়িয়ে দিতো নিজের বিপদের কথা উঠলে। কত বড় যে শয়তান ছিলো ক্যারোলিন একথা কোনোদিনও বুঝতে পারেনি অ্যামিয়াস। বোঝার চেষ্টাও করেনি। অবশ্য আমি ক্যারোলিনের কাছে গিয়েও বলতে পারতাম কোনাইন চুরি গেছে দাদার ল্যাবরেটরি থেকে, যদি অ্যামিয়াস বা এলসা কেউ মরে তবে কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না ফঁসীর দড়ি থেকে, কাজ হতে পারতো এতে। তাছাড়া জানিয়ে দেওয়া যেত পুলিশকেও যে চুরি গেছে বিষ। করা যেতো অনেক কিছুই। শুধু করা যায়নি দাদার জন্যে। বাড়ির বড় ছেলে দাদা। পেয়ে গিয়েছিলো বেশ খানিকটা সম্পত্তিও, কুঁড়েমি আর নড়বড়ে ভাব সব কাজে। এই ঘটনাটা ঘটে গেলো দাদা দেরী করলো বলেই।
আপনার মনে তাহলে একটুও সন্দেহ নেই যে কে চুরি করেছিলো বিষটা? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
নিশ্চয়ই না এটা ক্যারোলিনের কাজ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি যে খুব ভালোভাবে ক্যারোলিনকে চিনি।
ব্যাপারটা ভারী ইন্টারেস্টিং তো। কি ধরনের মহিলা ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল একটু বলবেন কি মিঃ ব্লেক?
লোকে মনে করেছিলো মামলা চলার সময় ও একটা নিষ্পাপ মহিলা অকারণে আঘাত পাওয়া। কিন্তু ওরকম আদৌ ক্যারোলিন ছিলো না।
তাহলে উনি কেমন ছিলেন?
ফিলিপ তীক্ষ্ণভাবে বললেন, আপনি কি সত্যি সত্যিই জানতে চান তা?
অবশ্যই।
সম্পূর্ণ বিকৃত চরিত্রের এক মেয়ে মানুষ ছিলো ক্যারোলিন। ওর ব্যবহার সুন্দর ছিলো মনে রাখবেন। এমন একটা মিষ্টিভাব ছিলো ব্যবহারে সবাই যাতে প্রতারিত হয়। এমন একটা হতাশার ভাব চোখের দৃষ্টিতে ফুটে থাকতো যে সাহায্য করতে সহানুভূতি জানাতে ওকে সবাই ছুটে আসতো আগবাড়িয়ে। ইতিহাস তো এককালে পড়েছিলাম, মেরী, কুইন অফ স্কট মনে হয় ঐ ধরনের মহিলা ছিলেন। সব সময়ে স্বভাবে মধুর বাইরে থেকে। আকর্ষণ চুম্বকের মতো অথচ যেন জড়িয়ে আছে দুর্ভাগ্য এবং ঠান্ডা মাথায় ভেতরে ভেতরে ফন্দী এঁটে চলেছে। কাকে কিভাবে সরিয়ে ফেলা যায়। তাই করেছিলো ক্যারোলিনও প্রচণ্ড বদ স্বভাবের দিক দিয়ে।
ওরা আপনাকে বলেছে কিনা জানি না আমি, তবে প্রশ্নটা মামলা চলার সময় ভীষণ গুরুত্ব পেয়েছিলো–আগে যা বলেছিলো বোনের সঙ্গে ক্যারোলিন তার কথা বলছি। প্রচণ্ড ঈর্ষা আবার বিয়ে করেন ক্যারোলিনের মা, ওর মায়ের অসাধারণ টান দেখে ছোট্ট অ্যাঞ্জেলার ওপর সহ্য করতে পারেনি, ভেঙে দিতে চেয়েছিলো মাথাটা একটা শাবল দিয়ে খুব জোরে লাগেনি ভাগ্য ভালো। বলুন তো কি ভয়ংকর ব্যাপার?
তা তো বটেই, মাথা নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। বুঝলেন, আসল ক্যারোলিন হলো এই। ওকে প্রথম হতে হবে সব ব্যাপারেই। ও কিছুতেই পিছিয়ে থাকতে রাজী নয়। একটা আত্মকেন্দ্রিক অহংকারী শয়তান ওর মধ্যে বাসা বেধেছিলো, ওই পরিণতি তারই।
আবেগপ্রবণ একটু দেখালেও, ও ছিলো ভেতরে ভেতরে দারুণ হিসেবী। ও যখন কম বয়সে অ্যাল্ডারবেরিতে থাকতো তখন সবাইকে আমাদের একবার করে বাজিয়ে নেবার পর ঠিক করেছিলো নিজের প্ল্যান, তখন কোনো টাকা পয়সা ওর ছিলো না। ওর পেছনে অবশ্য আমি কখনই ছুটিনি। বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে তখন আমি তৈরি করতে ব্যস্ত নিজের পথ। (মজার ব্যাপার এই যে আমি এখন মেরিডিথ এবং বেঁচে থাকলে অ্যামিয়াসকেও সামর্থ্য রাখি কিনে নেবার।) মেরিডিথকে প্রথমে বাছলেও ক্যারোলিন বিয়ে করলো শেষ পর্যন্ত অ্যামিয়াসকে। এমনি টাকা পয়সা অ্যাল্ডারবেরি ছাড়া বেশি না থাকলেও অ্যামিয়াস শিল্পী হিসেবে যে নাম করবে এতে ক্যারোলিনের সন্দেহ ছিলো না, জুয়া খেলতে বসে ভাগ্য নিয়ে? ক্যারোলিন অবশ্যই জিতেছিলো, কারণ অ্যামিয়াস পরে অর্থ উপার্জন করে প্রচুর।
অ্যামিয়াস অর্থ এবং প্রতিভার স্বীকৃতি দুটোই পায়। ছবি ওর বিক্রি হতো। আচ্ছা আপনি কি ওর কোনো ছবি দেখেছেন? …আসুন, একটা আছে ওখানে।
ফিলিপ একটা ছবি দেখালেন খাবার ঘরে গিয়ে বাঁদিকের দেওয়ালে যা ঝোলানো ছিলো। আঁকাটা গতানুগতিক। একটা পালিশ করা মেহগিনি কাঠের টেবিলের ওপর রাখা পাত্রে গোলাপফুল। অদ্ভুত রঙ আর কি ব্যবহার তুলির। যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা গোলাপের গুচ্ছ। তার ছায়া পড়েছে কাঠের পালিশের ওপর। যেন প্রাণের আবেগের স্পর্শে পুরো জিনিসিটাই থরথর করে কাঁপছে।
অনেকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে পোয়ারো ফিরে এলো বসবার ঘরে।
আমি আদৌ ছবিটবি বুঝি না তবে এই ছবিটাকে কি জানি আমি ভীষণ দেখি, দারুণ, অসাধারণ ভাললা…। যেন আপন মনে ফিলিপ ব্লেক বললেন।
স্বীকার করলো পোয়ারো, সত্যিই অসাধারণ। তারপর সিগারেট ধরালেন দুজনে।
এবং এই সেই অসাধারণ শিল্পী…এই গোলাপের ছবি যে এঁকেছিলো, কয়েকটা আরও বিখ্যাত ছবি সৃষ্টি করেছিলো–এমন অকাল মৃত্যু কিনা তার? শেষ পর্যন্ত ওর মতো প্রাণবন্ত শিল্পী কিনা ঈর্ষা আর হিংসার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে গেলো…।
আমি খুব কড়াকড়ি কথা বলছি আপনি বলবেন–বলবেন আমি অকারণে অকরুণ হচ্ছি ক্যারোলিনের প্রতি। ওর ছিলো মোহিনী শক্তি সেটা আমি নিজেই অনুভব করেছি। তবে সূক্ষ্ম আবরণের আড়ালে তার যে আসল একটা কুটিল নিষ্ঠুর মন লুকিয়ে আছে আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম…।
হঠাৎ পোয়ারো বলে উঠলো, অথচ বলা হয়েছে আমাকে যে ক্যারোলিনের বিবাহিত জীবনে ক্রেলকে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলা?
ঠিক তাই, আর ঠিক এটাও যে সবাইকে সে কথা জানাতেও ক্যারোলিন কসুর করেনি। সে যেন সব সময়েই শহীদের ভূমিকা নিয়ে থাকতো। বেচারি অ্যামিয়াস, নরকের মতো ছিলো ওর বিবাহিত জীবন, অসাধারণ শিল্প প্রতিভা ছবি আঁকার মতো না থাকলে হয়তো ও পাগল হয়ে যেতো। অ্যামিয়াস তার মুক্তি শিল্প সৃষ্টির মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলো। যখন ও ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে যেতো তখন ওকে স্পর্শ করতে পারতো না সাংসারিক কোনো কিছুই। চেঁচামেচি ঝগড়া-ঝাটি ক্যারোলিনের সব কিছুকেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে সপে দিতো ছবির মধ্যে। আর ঝগড়া? সাতদিন তো সপ্তাহে হতোই। ক্যারোলিন ওতে আনন্দ পেতো। ক্যারোলিন প্রতিবার ঝগড়ার পর পুঁদ হয়ে থাকতো এক অনাস্বাদিত তৃপ্তির মধ্যে। আর যেন অ্যামিয়াস নিজের মধ্যে থাকতে পারতো না, বিশৃঙ্খলায় ভরে যেতো সব কিছু। শান্তি চাইতো ও, তার বদলে পেতো শুধু অশান্তিতে ভরা জীবন যা কিনা অকারণে তৈরি করা। উচিতই ছিলো না ওর মতো মানুষের বিয়ে করা। বিয়ের বাঁধনে ধরা দেওয়া এই ধরনের শিল্পীদের উচিত নয়।
আপনি কি এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানতেন?
মিঃ পোয়ারো দেখুন ও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। আর অভিযোগ করার, এসব ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে না, সবই দেখা যায় চোখ থাকলে। তাছাড়া অ্যামিয়াসের লাগানো স্বভাব ছিলো না। তবে মাঝে মাঝে বলতো, যতো নষ্টের গোড়া এই মেয়ে মানুষগুলোই কিংবা; বিয়ে কোরো না ভুলেও, নরক এর থেকে অনেক ভালো।
আপনি কি এলসা গ্ৰীয়ারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানতেন?
হ্যাঁ, এটা বুঝতে পারতাম যে ক্রমশঃ ওরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এক অসাধারণ সুন্দর মেয়ের সঙ্গে ও বলেছিলো ওর আলাপ হয়েছে। এর আগে এই ধরনের মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি ওর। ওর কথায় আমি যে গুরুত্ব দিতাম তা নয়, কারণ মাঝে মাঝে ও এই ধরনের কথা বলতো। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে এই ধরনের অসাধারণ মহিলার পরিচয় ঘটতো।
আবার মাসখানেক পরে হাঁ করে চেয়ে থাকতো অ্যামিয়াস সেই মেয়েটির কথা তুললে কারণ সে ভুলে বসে আছে ইতিমধ্যে। তবে সত্যিই অন্য ধরনের মেয়ে ছিল এলসা গ্ৰীয়ার, যখন আমি কিছুদিন অ্যাল্ডারবেরিতে কাটাতে এসেছিলাম, তখন দেখা হয় ওর সঙ্গে এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম অসাধারণ মেয়ে। অ্যামিয়াসকে মেয়েটা ভালোমতোই ফেলেছিলো গেঁথে।
তাহলে এলসা গ্ৰীয়ারকেও দেখছি পছন্দ হয়নি আপনার, বললো পোয়ারো।
পছন্দ হয়নি। পুরোদস্তুর শিকারী মেয়ে ও, একেবারে গ্রাস করে নিতে চেয়েছিলো অ্যামিয়াসকে। তবে আমার মতে এলসা মেয়েটা অনেক ভালো হতো অ্যামিয়াসের জীবনে ক্যারোলিনের তুলনায়। আর ঠিক এটাও নিজেকে না জড়ানোই ভালো হতো মেয়েদের ব্যাপারে আমার বন্ধুর পক্ষে। অথচ ঐ ভুলই করে এসেছিলো ও বার বার। অবশ্য অন্য কোনো মহিলা এলসা আর ক্যারোলিন ছাড়া তেমনভাবে জীবনে ছাপ ফেলতে পারেনি অ্যামিয়াসের জীবনে।
জানতে চাইলো পোয়ারো তার মেয়েকে অ্যামিয়াস ভালোবাসতেন কিনা।
অ্যাঞ্জেলাকে? আহ। অ্যাঞ্জেলাকে সবাই আমরা ভালোবাসতাম। দারুণ ফুটফুটে মেয়ে। রোজ ওর গভর্নেসের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতো। হ্যাঁ, অ্যাঞ্জেলাকে ভালোবাসতো অ্যামিয়াসও তবে রেগে যেতো খুব বাড়াবাড়ি করলে। আর কি আশ্চর্য ক্যারোলিন এসে তখন অ্যাঞ্জেলাকে আড়াল করে দাঁড়াতো। ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াসের মধ্যে তাই নিয়ে মাঝে মাঝে মন কষাকষি হতো। আবার খবরদারী খুব বেশি করতো বলে অ্যাঞ্জেলাও আমিয়াসের ওপর চটে থাকতো। ঐ বছরের শরৎকালে অ্যামিয়াস নিজে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, ফলে আরও ক্ষেপে ওঠে মেয়েটা। মেয়েটা স্কুলে যেতে ভালোবাসত না তা নয়, কিন্তু অ্যামিয়াস যেভাবে জোর করে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাচ্ছিলো, তার ফলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মেয়েটা। অ্যাঞ্জেলা বদলা নেবার জন্য নানারকম বদমাইসিও করছিলো। মেয়েটাকে সামলানো যাচ্ছে না গভর্নেস সিসিলিয়াও বলেছিলেন।
পোয়ারো বললো ফিলিপ একটু থামতেই, জানতে চেয়েছিলাম আমি তার মেয়েকে অ্যামিয়াস ভালোবাসতেন কিনা, মেয়ে বলতে তার নিজের মেয়ের কথা আমি বলছিলাম।
ও। আপনি কার্লার কথা বলছিলেন, ওকে ভীষণ ভালোবাসতো। ভালো মেজাজ থাকলে মেয়ের সঙ্গে খুব খেলতো। তবে যদি আপনি ভেবে থাকেন তেমন ভালোবাসলে মেয়েকে এলসাকে আটকাতো বিয়ে করাটা? না, অ্যামিয়াস মেয়েকে তেমনভাবে ভালোবাসতো না।
আচ্ছা ক্যারোলিন ক্রেল কি ভালোবাসতো তার মেয়েকে?
ঠোঁট বেঁকালেন ফিলিপ ব্লেক, মা হিসেবে ক্যারোলিন ভালো ছিলো না একথা বলছি না। না, বলতে পারি না সেকথা। তবে একটা ব্যাপার…।
মিঃ ব্লেক, বলুন?
ফিলিপ ব্লেক যেন বেশ কষ্ট করে বললেন, আমার আজও দুঃখ হয় একটা ব্যাপারের জন্যে, সেই বাচ্চা মেয়েটাও রকম একটা দুর্ঘটনার মুখে অতো অল্প বয়সে তাকে পড়তে হয়েছিলো। ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো অ্যামিয়াসের মাসতুতো বোনের কাছে। আশাকরি আসল ঘটনাটা নিশ্চয়ই ওর কাছে লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন মাসী আর মেসোমশাইরা।
মাথা নাড়লো পোয়ারো, একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে সত্যের, সে কখনও লুকিয়ে রাখতে পারে না নিজেকে। বহু বছর পরেও না।
ধীরে ধীরে ফিলিপ বললেন, আশ্চর্যের ব্যাপার।
নিজের কথার সূত্র ধরে পোয়ারো বলতে লাগলো, সত্যের খাতিরে মিঃ ব্লেক আমি একটা কাজ করতে বলছি আপনাকে।
কি কাজ?
বিনীত প্রার্থনা আমার তখন যা যা ঘটছিলো অ্যাল্ডারবেরিতে তার একটা সঠিক বিবরণ আমায় লিখে দিন আপনি। অর্থাৎ খুন আর খুনের আনুষঙ্গিক বর্ণনা লিখতে বলছি আপনাকে।
আরে মশাই এতোদিন পরে ভীষণ ভুল থেকে যেতে পারে লিখতে গেলে।
কেন তা হবে। বরং সুবিধেই হয় বহুদিন পরে লিখতে গেলে, আর যা কিছু ফালতু সব বাদ পড়ে যায়।
কিন্তু বিবেক? অতোদিন আগেকার ঘটনা মিঃ পোয়ারো, যদি কথাবার্তা মনে করতে না পারি ঠিকমতো?
মিঃ ব্লেক, নির্ভুল ভাবে যতোটা সম্ভব লেখার চেষ্টা করবেন, আমার তাতেই কাজ হবে।
খুব অবাক হয়ে তাকালেন ফিলিপ ব্লেক পোয়ারোর দিকে, কিন্তু কেন? সব ঘটনা তো পুলিশের ফাইলে ভালোভাবে লেখা আছে?
আমি ঘটনাকে মিঃ ব্লেক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করতে চাইছি। আমার শুধু ঘটনা জেনে লাভ নেই। আপনি ঘটনা এবং তথ্যগুলোকে বাছবেন কিভাবে আমি সেটাই জানতে চাই। আর সেই বাছাইয়ের ব্যাপারে আমি চাই সময় আর আপনার স্মৃতিই সহায়ক হোক। ঘটেছিলো যে সব ঘটনা। বলা হয়েছিলো যে সব কথা,আমি পুলিশ ফাইলেই সেগুলো বা সেগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে আপনি বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন আমি বিশেষভাবে সেগুলোই জানতে চাই।
বেশ কড়াভাবে প্রশ্ন করলেন ফিলিপ, আপনি কি আমার বক্তব্য ছাপবেন?
নিশ্চয়ই না, ওগুলো একমাত্র আমিই পড়বো একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে আসার জন্যে।
এবং একটা লাইনও আমার সম্মতি ছাড়া ব্যবহার করবেন না?
নিশ্চয়ই না।
হুম। মিঃ পোয়ারো আমি খুব ব্যস্ত লোক তা তো আপনি জানেন।
নিশ্চয়ই জানি। আপনার ওটা লিখতে গেলে সময় নষ্ট আর কষ্ট দুই হবে। এর জন্যে তাই বলছিলাম আপনি নিশ্চয়ই এর জন্যে কী নেবেন।
ফিলিপ ব্লেক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, না। যদি লিখি, লিখবো পয়সা না নিয়েই।
এবং লিখছেন আপনি? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
তবে মনে রাখবেন, স্মৃতিশক্তি নির্ভুল নাও হতে পারে আমার।
মনে রাখবো।
তা হলে লিখব–লেখাও উচিত আমার। অন্তত একদিক দিয়ে, আমি আমার বন্ধু অ্যামিয়াস ক্রেলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ এইভাবে শোধ করবো।
.
সপ্তম অধ্যায়
বাড়িতে এই ছোট্ট শূয়োর ছানাটি রয়ে গেলো…
এরকুল পোয়ারো দারুণ সাবধানী। ছোটোখাটো ব্যাপারেও ফিলিক ব্লেকের মতো মেরিডিথ ব্লেক যে হবেন না এটা ধরে নিয়েই খুব সাবধানে এরকুল পোয়ারো এগোতে চাইলো। এখানে লাভ নেই তাড়াহুড়ো করে, বরং এগোতে হবে ধীরে সুস্থে।
দুর্ভেদ্য দুর্গ মেরিডিথের মতো আক্রমণ করতে হলে এখোননা উচিত ভালোভাবে তৈরি হয়ে এবং তার জন্যে দরকার উপযুক্ত পরিচয়পত্র। এবং আনতে হবে সেই পরিচয়পত্র সমাজের উঁচু ধাপে যারা আছেন পেশায় আর সামাজিকতায় সমাজের উঁচু ধাপে তাদের কারুর কাছ থেকে। কর্মসূত্রে সৌভাগ্যবশতঃ পোয়ারোর পরিচয় হয়েছিল নানা কাউন্টি পরিবারের সঙ্গে, মেরিডিথের পরিচয় আছে ডিভনশায়ার কাউন্টির দুজন নামকরা লোকের সঙ্গে এটা জানতে পেরে প্রথমে পোয়ারো লেডী মেরী লিটন গোরে, জমিদার বিধবা পত্নী আর পরে হাজির হলো মেরিডিথের কাছে ঐ কাউন্টির অবসর প্রাপ্ত এক অ্যাডমিরালের চিঠি নিয়ে।
মেরিডিথ ব্লেক কিছুটা অবাক হয়ে পোয়ারোকে স্বাগত জানালেন।
ইদানীং তার মনে হতে শুরু করেছে পৃথিবীটা আগের মতো আর নেই। তার মধ্যে যে কী জিনিস বেসরকারী গোয়েন্দাগুলো তা অবশ্য বলার নয়। অথচ লেডী মেরী লিটন গোরে লিখেছেন, আমার একজন পুরানো এবং শ্রদ্ধেয় বন্ধু এরকুল পোয়ারো। আপনি তাকে দয়া করে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন, করবেন তো? এবং সমাজের যে স্তরের মহিলা মেরী লিটন গোরে তাতে নিশ্চয়ই তিনি বন্ধুত্ব রাখবেন না মামুলী বেসরকারী গোয়েন্দার সঙ্গে এবং লিখেছেন অ্যাডমিরাল ক্রনশ, ছোকরা খুব ভালো দারুণ বুদ্ধিমান। কৃতজ্ঞ থাকবো এর উপকার করলে। খুব মজার মানুষ,আপনাকে নানা ধরনের গল্প শোনাতে পারে।
এবং এখন সশরীরে সেই মানুষটি সামনে এসে হাজির। সত্যি লোকটি অনুপযুক্ত পোষাক উল্টোপাল্টা জুতো বোম লাগানো। …কিস্তৃত গোঁফ অবিশ্বাস্য রকমের। উপযুক্ত মানুষ নয় মেরিডিথ ব্লেকের, কখনও শিকার টিকার করেছে দেখলে মনে হয় না। উপরন্তু বিদেশী।
পোয়ারো মনে মনে একটু হেসে নিলো মেরিডিথের মনের কথা বুঝতে পেরে।
পোয়ারো বুঝতে পেরেছিলো পশ্চিম দেশে আসার সময় তার আগ্রহ ট্রেনে বসে ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। এবার নিজের চোখে সে দেখতে পাবে ষোলো বছর আগে সেই জায়গা যেখানে ঘটেছিলো ঐ ঘটনাটা।
দুটি কমবয়েসী ভাই এখানে এই হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে থাকতেন, অ্যাল্ডারবেরিতে প্রায়ই যেতেন, ঠাট্টা তামাশা, গল্প করতেন, টেনিস খেলতেন, অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় করে তোলবার চেষ্টা করতেন, এমনকি ক্যারোলিনের সঙ্গেও। এই জমিদারী প্রাসাদ থেকেই সেই অভিশপ্ত সকালে অল্ডারবেরিতে গিয়েছিলেন মেরিডিথ, প্রায় সোল বছর আগে। যে মানুষটা খানিকটা অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তাকে ভদ্রভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন তাকে পোয়ারো খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো।
অনুমান করেছিলো যা ঠিক তাই–মেরিডিথ ব্লেক ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের জমিদারদের মতোই খোলামেলা আচরণের মানুষ এবং আকর্ষণ খুব বেশি বাইরের জগতের প্রতি।
একটা পুরানো টুইড কোট গায়ে মাটি আবার ঝুলঝুলে, রোদে জলে মানুষ হওয়া হাসি খুশি একটা মানুষ, হারিয়ে গেছে গোঁফের আড়ালে মেরিডিথ ব্লেক সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তার ছোট ভাই ফিলিপ ব্লেকের থেকে একটু দ্বিধার ভাব স্বভাবে, মনে হয় ইনি বয়সের ভাবের শ্লথ হয়ে এসেছেন যেমন, আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন ছোট ভাই।
তাড়াহুড়ো করলে এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যাবে না। পোয়ারো বেশ চিন্তা করে ঢিলে-ঢালা ভাবে শুরু করলো এগোতে। মাত্র কয়েক বছরের বড় হলেও মেরিডিথকে অনেক বেশি বুড়ো দেখায়।
রক্ত আছে জমিদারী আভিজাত্য। এমন ভদ্রলোককে বশ করতে পেরেছে বেশ কায়দা করে, পোয়ারো দেখে মনে মনে খুশি। লেডী মেরী আর অ্যাডমিরাল ক্রনশ ছাড়াও প্রসঙ্গ এলো এমন কিছু নামকরা লোকের যাঁদের চেনেন দুজনেই। পোয়ারোর পরিচিতি দেখে মেরিডিথ খুশি মোটামুটি।
বেশ সভ্যভব্য ভাবে পোয়ারো ব্যক্ত করলো আগমনের উদ্দেশ্যটা। মিস ক্রেল–মিস লেমার চেণ্টের সনির্বন্ধ অনুরোধে লিখতে হবে বইটি। কোনো ভুলভ্রান্তি, অতিশয়োক্তি যাতে না হয় তার জন্যে সাবধান হয়…।
মেরিডিথ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন পোয়ারোর কথা শেষ হবার আগেই, এতো নরকঘাঁটা মশাই একেবারে, যো…লো…বছর আগে কি ঘটেছে, তা নিয়ে এতোদিন পরে খোঁচাখুঁচি করার কোনো মানে দেখি না আমি।
পোয়ারো অসহায়ের ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, আমি একমত আপনার সঙ্গে, তবে চাহিদা ঐ ধরনের জিনিসের আছে বলেই তো নতুন ভাবে অতীতের ঘটনাকে পরিবেশন করতে হচ্ছে।
এটা খুবই অপমানজনক মনে হচ্ছে আমার কাছে।
বিড়বিড় করে পোয়ারো বললো, আমি সত্যিই দুঃখিত। একটা দারুণ নিষ্ঠুর জগতে বাস করতে হচ্ছে আমাদের। মিঃ ব্লেক আশ্চর্য হবেন শুনলে এরকম কতো আসল রূপ অপ্রীতিকর ঘটনার আবিষ্কার করে জীবনকে আমি সহজতর করে তুলেছি অনেকটা। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার হাত থেকে এ ব্যাপারে মিস ক্রেলকে মুক্তি দিতে আমি উৎসুক ভীষণ ভাবে।
আপন মনে বললেন মেরিডিথ, সেই বাচ্চাটা ছোট্ট কার্লা। বেশ বড়সড়ো তো হয়ে উঠেছে এখন নিশ্চয়ই। বিশ্বাসই করা যায় না…।
জানি হু হু করে তো সময় কেটে যায়, তাই না?
বড় বেশি হু হু করে..দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেরিডিথ বললেন।
চিঠিটাতো মিস কার্লার আপনি পড়লেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনি ঐ অতীতের ঘটনাটা সম্বন্ধে বিস্তারিত সব কিছু জানবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন উনি।
মেরিডিথ বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন? নতুন করে খোঁচানো কেন আবার? কি প্রয়োজন অতীতকে নতুন করে জানবার?
ভালো করে অতীতটাকে জানেন বলেই আপনি একথা বলতে পারছেন মিঃ ব্লেক। কিন্তু মিস কার্লা একবার ভেবে দেখুন কিন্তু জানে না কিছুই। কতটুকু আর থাকে সরকারী নথিপত্রে।
সত্যি আমি একেবারে বেচারি মেয়েটার কথা গিয়েছিলাম ভুলে। সত্যিই খুব খারাপ ওর অবস্থাটা। নিশ্চয়ই মনে খুব দুঃখ পেয়েছে সত্যি কথাটা জানার পর।
আইনের কচকচানিতে শুধু কিন্তু সত্যের প্রতি সুবিচার করা যায় না। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসগুলো দরকার সেগুলোকেই দেওয়া হয় বাদ–মনের আবেগ, অনুভূতি, নাটকের পাত্রপাত্রী, কমাতে পারে অপরাধের গুরুত্ব এমন অবস্থা…।
পোয়ারো চুপ করলো এতোটা বলে, সহ অভিনেতার মতো সঙ্গে সঙ্গে কথার খেই ধরে শুরু করলেন বলতে মেরিডিথ, এমন অবস্থা কমাতে পারে অপরাধের গুরুত্ব। ঠিক তাই। যদি সত্যি ঐ ধরনের অবস্থা থাকে, তবে নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে তা ছিলো। আমার পুরানো বন্ধু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল, আমাদের পরিবারের পরিচয় ওদের পরিবারের সঙ্গে বহু যুগের, তবে খোলাখুলি একথা স্বীকার করতেই হবে যে ভালো ছিলো না ওর স্বভাব, শিল্পী ছিলো, সে বিষয়ে সন্দেহই নেই কোনো, এবং বোধহয় সেইজন্যই তার ঐ ধরনের চরিত্র ছিলো। ঐ ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি মাঝে মাঝে ও সৃষ্টি করে ফেলতো। সাধারণ ভদ্রলোক সে পরিস্থিতি কখনই কল্পনা করতে পারে না।
আমার আগ্রহ বাড়ছে আপনার মুখে একথা শুনে। মাঝে মাঝে আমি তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলাম, মানে ঐ পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে, তবে মানুষ ভাল বংশের। জাগতিক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই ওঁর মতো করবেন না।
মেরিডিথের রোগা মুখটার মধ্যে এতক্ষণ দ্বিধার ভাব ছিলো, এবার কেটে গিয়ে সেটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললেন, তবে আসল ব্যাপারটা হলো সাধারণ মানুষ ছিলো না অ্যামিয়াস। শিল্পী মানুষ, শিল্পকে জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো। আমি এইসব শিল্পী-টিল্পীদের ঠিক বুঝতে পারিও না, পারিনি। তবে ক্রেলকে আজীবন বন্ধুত্ব সূত্রে বুঝতে পারতাম একটু-আধটু। ওকে জন্ম থেকে চিনি তো, আমাদের খুব মিল আছে ওদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে। ও ষোলআনা খাঁটি মানুষ শিল্পী অ্যামিয়াসকে বাদ দিলে, আমাদেরই মতো পুরোপুরি। তাছাড়া সৌখীন শিল্পী ও আবার ছিলো না, অ্যামিয়াস একটা প্রতিভা সবাই বলতো। হয়তো ঠিক, এবং সেই কারণেই বোধহয় ও ছিলো অস্থিরচিত্ত একটু বেশি। ও অন্য জগতের মানুষ হয়ে যেতো ছবি আঁকার সময়, ঘুরে বেড়াতো স্বপ্নের রাজ্যে। অ্যামিয়াস আবার বাস্তব জগতে ফিরে আসতে ছবি শেষ হলে।
ওঁর কথা পোয়ারো বুঝতে পারছে কিনা ঐভাবে তাকাতেই ঘাড় নাড়লো সে, অর্থাৎ বুঝেছে।
বুঝতে পেরেছেন দেখছি আপনি। এবার মনে হয় বুঝতে পারছেন আপনি ঐ রকম, কেন হয়েছিলো পরিস্থিতিটা, ঐ মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলো অ্যামিয়াস, পাগল হয়ে উঠেছিলো বিয়ে করার জন্যে। মেয়েটার জন্য এমনকি বৌ-মেয়েকেও রাজী ছাড়তে। কিন্তু ছবি আঁকতে যেহেতু শুরু করেছে তাই শেষ না করা পর্যন্ত ওটা অন্য কোনো চিন্তায় ঠাই পাচ্ছিলো না ওর মাথায়। আর ওর ঐ ব্যবহারের সঙ্গে যে জড়িত দুটি মহিলা অ্যামিয়াস সেটাও খেয়াল করতে চেষ্টা করেনি।
মিঃ ক্রেলের মনের কথা মহিলা দুজনও কি বুঝতে পারেননি? জানতে চাইলো পোয়ারো।
হ্যাঁ, একদিক দিয়েই তো বটেই। বোধহয় এলসা মেয়েটি বুঝতে পেরেছিলো। ও পাগলের মতো ভালোবাসতো অ্যামিয়াসের ছবি আঁকার ব্যাপারটাকেও এবং স্বভাবতই বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিলো ওর অবস্থা। আর ক্যারোলিন…।
…ক্যারোলিন, দেখুন…আমি সব সময়ই ক্যারোলিনকে পছন্দ করতাম। সময় ছিলো একটা…আমি যখন…ওঁকে আমি চেয়েছিলাম বিয়েও করতে। কিন্তু অঙ্কুরেই সে ব্যাপারটা বিনাশ হয়ে গিয়েছিলো। তবুও…তবুও…ওর কাজে লাগতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
মাথা নাড়িয়ে পোয়ারো সায় দিলেও চিন্তা করতে লাগলো মনে মনে মেরিডিথের শেষ কথাটা নিয়ে। প্রাচীনপন্থী একটু অভিব্যক্তি হলেও প্রেমের ব্যাপারে উনি যে দারুণ রোমান্টিক আর আত্মনিবেদিত একথা তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেমে প্রতিদান পাবার আশা না করেই, নিজেকে সমর্পণ করতে পারার মতো মানুষ এই মেরিডিথ। পোয়ারো বললো খুব সাবধানে, এই যে মহিলাটির প্রতি…অবিচার যে করা হচ্ছিলো…আপনি তার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করেছিলেন?
হা করেছিলাম। আমি বলতে গেলে অ্যামিয়াসকে এ ব্যাপারে বেশ বকাবকিও করেছিলাম।
কবে?
ঐ ঘটনাটা যেদিন ঘটালো ঠিক তার আগের দিন। আমার এখানে ওরা এসেছিলো চায়ের নেমন্তন্ন রাখতে। অ্যামিয়াসকে আমি আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম খোলাখুলি। এমন কি বলেছিলাম এও যে, ও ভালো করছে না কাজটা।
এই কথাই তাহলে আপনি বলেছিলেন?
হা, কথাটা ওর কানে ঢুকেছিলো আমার মনে হয় না।
ঢোকেনি সম্ভবতঃ, বললো পোয়ারো।
ব্যাপারটা ক্যারোলিনের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমি বলেছিলাম। যদি বিয়ে করতেই চাও ঐ মেয়েটাকে, কেন এক বাড়িতে রেখেছে, নির্লজ্জের মতো ক্যারোলিনের চোখের সামনে এমনভাবে নিজেকে কেন জাহির করছো? কেউ সহ্য করতে পারে না এ অপমান।
কৌতূহল বাড়ছে পোয়ারোর।
অ্যামিয়াস তার উত্তরে কী বলেছিলেন?
মেরিডিথ নাক কুঁচকে বললেন, অ্যামিয়াস বলেছিলো–এটা মেনে নিতে হবে ক্যারোলিনকে।
ভ্রূ বেঁকে উঠলো পোয়ারোর, উত্তর কী নিষ্ঠুরের মতো।
ঘেন্না ধরে গিয়েছিলো তো আমার। ঠিক রাখতে না পেরে মেজাজে বলেছিলাম যেমন সে বুঝতে পারে না নিজের স্ত্রীকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, ঠিক তেমন চিন্তা করছে না কেন ঐ এলসা মেয়েটার কথাও। অবস্থাটা যে ওর পক্ষে বেশ ঘোরালোলা? আমিয়াস তার উত্তরে বলেছিলো, এটা মেনে নিতে হবে এলসাকেও …তারপর বলেছিলো অ্যামিয়াস, মেরিডিথ তুমি জানো, এখন যে ছবিটা আমি আঁকছি, আমার এটাই হবে সবার সেরা ছবি। এটা অসাধারণ ছবি হচ্ছে, কাজ বন্ধ করতে পারি না দুজন ঈর্ষাকাতর মহিলার জন্যে, না বন্ধ করবো না।
তর্ক করেও কোনো লাভ ছিলো না ওর সঙ্গে। সামান্য ভদ্রতা বোধটুকু পর্যন্ত ভুলে গেছো তুমি, আমি বলেছিলাম। জীবনের সব নয় ছবি আঁকাটাই। আমার কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে ও বলেছিলো, কিন্তু নিশ্চয়ই আমার কাছে।
আমার রাগ তখনও পড়েনি। বলেছিলাম ওঁকে ওর ব্যবহারটা ক্যারোলিনের সঙ্গে আদৌ ভদ্র নয়। অ্যামিয়াস দুর্বিষহ করে তুলেছে ক্যারোলিনের জীবনটাই। ও বলেছিলো তার উত্তরে, আমি দুঃখিত ওর জন্যে, সত্যিই দুঃখিত। মেরিডিথ আমি জানি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করছে না। কিন্তু সত্যি কথাটা। আমি নরক করে তুলেছি ক্যারোলিনের জীবন। তবে দেবীর মত সর্বংসহা ও যেন। ওকে আমি আমার সব কথাই বলেছি উচ্ছঙ্খল জীবনের।
তারপর কড়াভাবে আমি অ্যামিয়াসকে বলেছিলাম, আর যাই করুক যেন নষ্ট না করে বিবাহিত জীবনটা। মেয়েটার কথাতো সবার ওপরে চিন্তা করতে হবে। আরও বলেছিলাম আমি, এলসার মতো মেয়েরা বুঝতে পারছি মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে পুরুষের। তবুও বিয়ের মতো ব্যাপারটাকে তার জন্যে নষ্ট করা উচিত নয়। খুবই কম এলসার বয়স। হয়তো এখন ওর পছন্দ হচ্ছে এই টাক মাথাকেই। নিশ্চয়ই এর জন্যে পরে পস্তাবে। এই সম্পর্কটা তুমি ভেঙে দিয়ে ফিরে যাও স্ত্রীর কাছে।
অ্যামিয়াস তার উত্তরে কি বললেন? ও যেন বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে মনে হচ্ছিলো। আমার কাঁধ চাপড়ে বললো, মেরিডিথ তুমি খুব ভালো মানুষ, তবে আবেগে ভরা বড় বেশি। অপেক্ষা করো ছবিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত। স্বীকার করবে তখন আমি ভুল করিনি।
গোল্লায় যাক তোমার ছবি। আমি বলেছিলাম। অ্যামিয়াস চাপা হাসি হেসে বলেছিলো যে সব মানসিক বিকারগ্রস্ত ইংল্যান্ডের মেয়ে মানুষরা তা করতে পারে না। আমি তখন বললাম –অন্ততঃ ক্যারোলিনকে ছবিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত এর থেকে দূরে রাখতে পারতে। আমার কোনো দোষ নেই এতে। বলেছিলো অ্যামিয়াস। নিজেই গোপন ব্যাপারটা এলসা ফাস করে দিয়ে লজ্জায় ফেলতে চেয়েছিলো ক্যারোলিনকে। কেন, অ্যামিয়াস প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলো সব কিছু খোলামেলাভাবে এলসা করতে চাইতো। একথা ঠিকই যত খারাপই হোক না কেন ওর আচরণে এলসা নিজের সততা বজায় রাখতে চেয়েছিলো।
পোয়ারো মন্তব্য করলো, এতো বেশি দুঃখ কষ্টের বোঝা সতোর জন্যে।
এই মন্তব্যটার মানে মেরিডিথ ঠিক মতো বুঝতে না পেরে একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, সেই সময়টা আমাদের কাছে ছিলো খুবই খারাপ।
একমাত্র অ্যামিয়াস ক্রেলকে ঐ পরিস্থতিটা প্রভাবিত করেনি, বললো পোয়ারো।
এবং কেন, এই জন্যে যে ও ভীষণভাবে অহংকারী ছিলো। এখন মনে পড়ছে ওর একটা কথা, ও আমায় হাসতে হাসতে বলেছিলো মেরিডিথ চিন্তা কোরো না, মিটে যাবে সব সমস্যাই।
পোয়ারো আপন মনে বললো, আশাবাদী অবিশ্বাস্য রকমের।
সেই ধরনের পুরুষ ছিলো অ্যামিয়াস যারা কখনই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে মেয়েদের গ্রহণ করে না। ওকে জানিয়ে দেওয়া আমার উচিত ছিলো যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্যারোলিন।
আপনাকে কি ক্যারোলিন তেমন কোনো কথা বলেছিলেন?
না ঐ ভাষায় ঠিক নয়। তবে বিকেলবেলায় সেদিন যেমন থমথমে ওর মুখ দেখেছিলাম ওই রকম প্রতিদিন দেখতাম। বেশি বড় হাসছিলো আর কথা বলছিলো। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার ছাপ চোখের তারায় ফুটে উঠেছিলো। আহা বেচারি!
মিনিট দুই কোনো কথা বললো না এরকুল পোয়ারো। পরের দিন যে মহিলাটি তার স্বামীকে খুন করতে চলেছেন তার ছবিটি ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন মেরিডিথ।
মেরিডিথ এতক্ষণে অনেক স্বচ্ছন্দ হয়ে এসেছেন, কথা বলে চলেছেন অনর্গল আর পোয়ারো শুনে চলেছে নিবিষ্ট মনে। যেন নিজের মনে মেরিডিথ কথা বলছেন। বলতে লাগলেন এভাবে, উচিত ছিলো আমার সন্দেহ করা। প্রথমে ক্যারোলিনই ঐ নেশা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা শুরু করেছিলো। দোষ নেই স্বীকার করতে, তাতে আমি খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। আলাদা একটা নেশা আছে গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করার। এককালে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো এমন অনেক লতাপাতা আছে। কিন্তু এখন ঔষধ বিজ্ঞানের পাতা থেকে বাতিল হয়ে গেছে। কোনো কোনো গাছপালার কাঁথ দিয়ে করা যায় অসাধ্য সাধন, আশ্চর্য লাগে ভাবলেও। এসব জানা থাকলে অর্ধেকের বেশি রোগে ডাক্তারই ডাকতে হয় না।
এই তো কাগজে সেদিন পড়েছিলাম কতো ভেষজ বাতিল ঔষুধ ব্যবহার করছেন ডাক্তাররা। আর পাচ্ছেন সুফলও। কিন্তু আমি সাধনা করে যাচ্ছিলাম নিজের জন্যে, সমাজের যেটুকু উপকারেই আসি না কেন। তাছাড়া শেকড়-বাকড় সংগ্রহ করা, জাল দেওয়া সেগুলো থেকে নির্যাস বের করা, কম আনন্দ পাওয়া যায় না এই ধরনের বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকর্মে। মনে আছে আমার আমি সেদিন চিতি বিষলতার কথা বলেছিলাম। দুবার ফুল ফোটে বছরে, পেকে ফলগুলো হলদে সবার আগই তুলে নিতে হবে। আজকাল উঠে গেলেও কোনাইনের ব্যবহার, অব্যর্থ ফল দেয় হুপিংকাশি, হাঁপানিতে।
পোয়ারো প্রশ্ন করলো, এতো কথা নিয়ে আপনার ল্যাবরোটারিতে আপনি আলোচনা করেছিলেন।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হ্যাঁ সব দেখিয়েছিলাম, কি কি কাজ নানা ওষুধের তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। বিষের কথা উঠলো কথা প্রসঙ্গে। নাম করলাম বেলেডোনা অ্যাট্রোপিনের। খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিলো ওরা।
ওরা? কাদের কথা বলছেন ওরা বলতে, যেন একটু আশ্চর্য হলেন মেরিডিথ ব্লেক, ধারণা ছিলো তার সেদিনের কথা পোয়ারো সবটাই জানে।
ওহ, পুরো দলটা। বলছি, দাঁড়ান, ফিলিপ, অ্যামিয়াস, ক্যারোলিন, অ্যাঞ্জেলাও ছিলো। আর এলসা গ্ৰীয়ার ছিলো।
ব্যাস, মাত্র এই ক’জন?
হা, মনে পড়ছে তাইতো, নাহ, ভুল হচ্ছে না তো। কেন কেউ কি আর থাকতে পারে?
মনে হয়েছিলো আমার খুব সম্ভব গভর্নেস…।
ওহ বুঝেছি, নাঃ গভর্নেস সেদিন বিকেলে ছিলো না। দেখছি নামটাও ভুলে গেছি। চমৎকার মহিলা, ভীষণ সজাগ নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে। ওকে খুব জ্বালাতো অ্যাঞ্জেলা মনে হয়।
কিন্তু কেন?
দেখুন, বেশ ভালোই ছিলো মেয়েটা। তবে ওর মাথায় মাঝে মাঝে চাপতো ভূত। একটা না একটা সব সময় পিছনে লেগে থাকতো। অ্যামিয়াস খুব পরিশ্রম করে একদিন একটা ছবি আঁকছিলো, টেবিলের ওপর অ্যাঞ্জেলা রেখে এসেছিলো একটা ছোট শামুক। অ্যামিয়াস সেদিন দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলো, তারপরেই তো মেয়েটাকে স্কুলে পাঠাতে হবে ঠিক করে।
স্কুলে পাঠালো অ্যাঞ্জেলাকে? হ্যাঁ, অবশ্য তার মানে আমি এ বলতে চাইছি না যে ওকে ভালোবাসতো না অ্যামিয়াস। বাসতো ঠিকই, তবে দুষ্টুমি করতো যে বড্ড। আর মনে হতো আমার…
আপনার কি মনে হতো?
অ্যাঞ্জেলাকে যেন অন্ধের মতো ভালোবাসতো ক্যারোলিন, সেটা সহ্য করতে পারতো না অ্যামিয়াস। অবশ্য একটা কারণ তারও আছে, আমি সেটা বলতে চাই না এখন, কিন্তু…।
বাধা দিলো পোয়ারো, কারণটা এই যে একাকার রেগে গিয়ে ক্যারোলিন একটা এমন কাণ্ড করেছিলেন যার ফলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটার মুখ।
ওঃ তাহলে আপনি কারণটা জানেন দেখছি। ওটা আমি আর নিজের মুখে বলতে চাইছিলাম না। অতীতের জন্যে অতীতের কথা থাকাই ভালো। হ্যাঁ, ক্যারোলিন ঐ কারণে অ্যাঞ্জেলা সম্বন্ধে ও, যা করেছে তা যেন কিছুতেই পর্যাপ্ত নয় মনে করতো।
পোয়ারো ঘাড় নাড়লো চিন্তা করতে করতে, আর অ্যাঞ্জোলা? তার কি কোনো রাগ ছিলো সৎ বোনের বিরুদ্ধে?
না, না, চিন্তা করবেন না ওসব। দিদিকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতে অ্যাঞ্জেলা। ও আদৌ পুরোনো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতো না। বরং ক্যারোলিনই বলা যায় যেন ঘটনাটা ভুলতে পারতো না।
অ্যাঞ্জেলা বোর্ডিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারটা কি ভালো মনে নিয়েছিলো?
মেরিডিথ স্পষ্টভাবে, জানালেন পোয়ারোর এই প্রশ্নের উত্তরে, না, নেয়নি। ভীষণ রেগে গিয়েছিলো অ্যামিয়াসের ওপর। এবং বোনের পক্ষ নেওয়া সত্ত্বেও ক্যারোলিন, গোঁ ধরে বসে রইলো অ্যামিয়াস, বোর্ডিংয়ে পাঠাবেই অ্যাঞ্জেলাকে। এমনিতে বেশ সাদাসিধে মানুষ ছিলো অ্যামিয়াস, কিন্তু ক্ষেপে গেলে একবার আর তাকে শান্ত করা যেতো না, হার মানতে হয়েছিলো ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলা দুজনকেই।
বোর্ডিংয়ে পাঠাবার কথা ছিলো অ্যাঞ্জেলাকে, তাই না, কবে?
যে সেসন শুরু হয় শরৎকালে, তাতে। ওরা গোছগাছ করছিলো ওর জিনিসপত্র। আর কয়েকদিন পরেই হয়তো যেতো ও দুর্ঘটনাটা না ঘটলে। ঐদিন সকালে কিছু জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করার কথা ছিলো।
হঠাৎ এখানে প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আর ঐ গভর্নেস?
আপনি কি বলতে চাইছেন…গভর্নেস?
গভর্নেস কি চোখে নিয়েছিলো অ্যাঞ্জেলাকে বোর্ডিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারটা। তার তত চলে যাবার কথা চাকরি? তাই না?
ও হ্যাঁ, তাই তো দাঁড়ায় একদিক দিয়ে। তখন কার্লার বয়স পাঁচ কি ছয়, গভর্নেসের কাছে পড়াশুনা করতো একটু আধটু। একজন নার্স ওর জন্য ছিলো বটে। তবে মিস উইলিয়ামসকে ওর জন্যে ওরা রাখতো কিনা সন্দেহ। ওই নামটা এই তো মনে পড়ে গেছে। সিসিলিয়া উইলিয়ামস। কেমন মজার ব্যাপার দেখছেন, নামটা মনে পড়ে গেলো কথা বলতে বলতে।
তা ঠিক, এখন আপনি অতীত জগতে চলে গেছেন। তাই না? আপনার চোখের সামনে নতুন করে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে, তখন যেভাবে কথা বলছিলো লোকেরা হাত-পা নেড়ে ছিলো কিভাবে, সবই নিশ্চয়ই মনে পড়ছে?
ধীরে ধীরে মেবিডিথ ব্লেক বললেন, বলতে পারেন তা। তবে বাদ পড়ে যেতে পারে মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়তে পারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোই। ধরুন ক্যারোলিনকে ছেড়ে দিতে চাইছে অ্যামিয়াস একথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম ভীষণ, অথচ মনে পড়ছে না আমার ঐ ছাড়াছাড়ির কথাটা আমি শুনেছিলাম কার কাছ থেকে অ্যামিয়াস, না এলসা? অবশ্য মনে আছে এটাও যে এলসাকে আমি চেষ্টা করেছিলাম বোঝাবার ও কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো আমার কথা সেকেলে পন্থী নাকি আমি। ঠিক কথাটা, সেকেলে পন্থা আমি, তবে ভুল ছিলো না আমার বক্তব্যটাও, স্ত্রী মেয়েকে ছেড়ে বিয়ে অন্য কাউকে করতে চাওয়াটা ঠিক হয়নি অ্যামিয়াসের পক্ষে।
হ্যাঁ, ঘটনাটা তবে মনে রাখবেন ষোলো বছর আগেকার, এখনকার মতো সহজে তখনকার দিনে বিবাহ বিচ্ছেদ হতো না। অথচ আধুনিক হতে চেয়েছিলো এলসা, ওর মতে স্বামী-স্ত্রী যদি একসঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারে তাহলে বিচ্ছেদ হওয়াই ভালো। যেহেতু একদিনও ঝগড়া না করে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন কাটাতে পারছিলো না, তাই ছাড়াছাড়ি হওয়াটাই মঙ্গলজনক সন্তানের মুখ চেয়েই।
এবং আপনার মনোমত হয়নি এলসার যুক্তিটা? প্রশ্ন করলে পোয়ারো।
ধীরে ধীরে মেরিডিথ ব্লেক বললেন, সব সময়ে আমার কেমন যেন মনে হয়েছিলো নিজেই জানে না এলসা সে কি বলছে। কিছু বইপড়া, কিছু শোনা কথা বন্ধু-বান্ধবের মুখে তোতাপাখির মতো আওড়ে যেতো। কথায় একটা গভীর দুঃখের ব্যাপার ছিলো ওর ব্যাপারে। অথচ কম বয়সী খুব আত্মবিশ্বাসী খুবই। একটা নিজস্ব ধর্ম আছে যৌবনের, মিঃ পোয়ারো তাই না–সব কিছুকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়।
অথচ কাজটা ভালো করছে না অ্যামিয়াস, বয়সের তফাৎ দুজনের মধ্যে প্রায় কুড়ি বছর…ওদের ব্যাপারে এইসব মনে করে নাক গলাতে গিয়েছিলাম। হয়নি ফল, কখন হতও না। আমি কাউকে ঠিক মত কিছু বোঝাতে পারি না।
নিজের যে দুর্বলতার সমালোচনা মেরিডিথ করছেন বুঝতে পেরে পোয়ারো পাল্টাতে চাইলো প্রসঙ্গটা–এখনও আপনার ঐ ওষুধ বিষুধের ল্যাবরেটরিটা আছে?
কড়া জবাব এলো সঙ্গে সঙ্গে, না। নষ্ট করে ফেলেছি সব, ওসব ঐ ঘটনার পর আর কেউ রাখে। বলতে পারেন আপনিও তো আমি ওই ব্যাপারটার মুলে ছিলাম।
না, না মিঃ ব্লেক। দেখছি আপনি বড় বেশি স্পর্শকাতর। কিন্তু বুঝতেই বা-আপনি পারছেন না কেন যদি আমি ঐ নোংরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রাখতাম তাহলে তো ঘটতো না দুর্ঘটনাটা। আমি উল্টে অহংকার করে জাহির করার জন্যে নিজের বিদ্যে লেকচার দিয়েছিলাম কোনাইন সম্বন্ধে। কাজ করেছিলাম কী বোকার মতোই না। এমনকি লাইব্রেরি ঘরে ফিরে গিয়ে একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছিলাম ওদের বই থেকে, যেখানে ফিডো সক্রেটিসের মৃত্যু বর্ণনা করছে। রচনাটা অসাধারণ। কিন্তু ঐ দৃশ্যটা তারপর থেকে আমায় হানা দিয়ে আসছে বারবার।
কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো কোনাইনের বোতলে।
ক্যারোলিন ক্রেলের।
আপনারটা নয় কেন?
সেদিন আমি বোতলটা ধরিনি, তাছাড়া এর ৫-৬ দিন আগেই ঝাড়ামোছা করেছিলাম সব। আমার সব কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা স্বভাব।
তালা বন্ধ রাখতেন ঐ ঘরের দরজা?
অবশ্যই।
আপনার ল্যাবরেটারি থেকে কখন ক্যারোলিন ক্রেল কোনাইন চুরি করেছিলেন?
মেরিডিথ ব্লেক খুব অনিচ্ছা নিয়ে উত্তর দিলেন, সবার শেষে ঘর থেকে বেরিয়েছিলো। ক্যারোলিনই। ওকে ডেকেছিলাম আমি। খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে এলো ও, চোখে মুখে উত্তেজনা।
আচ্ছা, আপনার সঙ্গে সেদিন ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছিলো?
মেরিডিথ গলা নামিয়ে উত্তর দিলেন, সোজাসুজি হয়নি। ও যে মনের দিক দিয়ে খুব বিপর্যস্ত ছিলো আগেই একথা তো বলেছি। এক সময়ে আমরা দুজনে যখন শুধু একটু একলা ছিলাম, ক্যারোলিনকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছু কি ঘটেছে নাকি, ও বলেছিলো তার উত্তরে, ঘটে গেছে তো সবকিছুই……বুঝতে পারতেন ওর কথাটা শুনলে কেমন হতাশ হয়ে গিয়েছিলো ও।
ও বলেছিলো, শেষ হয়ে গেছে সব কিছুই। মেরিডিথ শেষ হয়ে গেছি আমিও। হঠাৎ তারপর হাসতে হাসছে চলে গেলো দলের কাছে। এর আগে ওকে কখনও আমি এরকম অস্বাভাবিক ও উদ্দামভাবে খুশি হতে দেখিনি।
পোয়ারো চীনেম্যানদের মতো ভাবলেশহীন মুখ করে বললো, ও বুঝেছি…ঐ হয়েছিলো…তাই না…।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে টেবিলে ঘুসি মেরে প্রায় মেরিডিথ চেঁচিয়ে উঠলেন, তবে আপনাকে একটা কথা বলছি মিঃ পোয়ারো–মামলা চলার সময় যখন ক্যারোলিন বললো ও নিয়েছিলো বিষটা নিজের খাবার জন্যেও তখন সত্যি কথাই বলেছিলো, আমি হলফ করে বলতে পারি। ওর খুন করার ইচ্ছে ছিলো না। না, ছিলো না। ওর মাথায় ও চিন্তাটা পরে এসেছিলো।
এরকুল পোয়ারো বললো, আপনি এ বিষয়ে ভুল করছেন না তো যে ওঁর মাথায় এসেছিলো ঐ চিন্তাটা পরে?
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কি বলছেন। বোকার মতো কেমন যেন তাকিয়ে কথাটা মেরিডিথ বললেন।
খুন করার চিন্তাটা আগে ক্যারোলিনের মাথায় আসেনি এ বিষয়ে নিশ্চিত তো আপনি, আর খুন যে ক্যারোলিনই করেছেন এ কথাটা বিশ্বাস করেন আপনি?
এলোমেলো হয়ে গেলো মেরিডিথের নিঃশ্বাস
কিন্তু যদি তা…যদি তা না হয়..আপনি তাহলে কি বলতে চাইছেন…একটা দুর্ঘটনা এটা…?
যে ঠিক তাই, তা নয়।
মিঃ পোয়ারো আপনি খুব আশ্চর্য কথা শোনাচ্ছেন?
তাই কি? ক্যারোলিন ক্ৰেল, আপনিই তো বলেছেন ধীরস্থির প্রকৃতির মহিলা ছিলেন। খুন করে কি শান্ত প্রকৃতির মেয়েরা।
ঠিকই শান্তশিষ্ট ছিলো, তবে ভীষণ ঝগড়া করতো মাঝে মাঝে।
তাহলে শান্তশিষ্ট যতোটা বলছেন ততোটা নয়।
কিন্তু ক্যারোলিন তো…ওহ, বুঝিয়ে এসব জিনিস বলা যে কী কষ্টকর…।
বলুন, চেষ্টা করছি আমি বোঝবার।
একটু আলগা ছিলো ক্যারোলিনের জিভটা–কথা বলতো বড় ঝেঝে। বলতে পারতো মুখের ওপর, ঘেন্না করি আপনাকে, মরণ হয় না কেন আপনার। কিন্তু তাই বলে ঘটুক ওগুলো তা নিশ্চয়ই চাইতো না।
আপনার মতে তাহলে খুন করার মতো ব্যাপারটা একেবারেই খাপ খায় না মিসেস ক্রেলের চরিত্রের সঙ্গে।
মিঃ পোয়ারো আপনি কিন্তু দারুণ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। শুধু আমি বলেছি–হ্যাঁ খাপ খায় না ওর চরিত্রের সঙ্গে। ভীষণভাবে ওঁকে খোঁচানো হয়েছিলো বলেই হয়তো কাজটা করে ফেলেছিলো উত্তেজিত হয়ে। স্বামীকে এমনিতে ও ভীষণ ভালোবাসতো। শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু যে কোনো মহিলা ও রকম পরিস্থিতিতে পড়লে…মানে…খুন করে ফেলতে পারে। ঘাড় দুলিয়ে পোয়ারো বললো, আপনার সঙ্গে একমত আমি।
আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম কথাটা শুনে। সত্যি তা ভাবতেই পারিনি। এবং সত্যিও না কথাটা। কারণ আসলে ক্যারোলিন পারে না ওটা করতে।
মিঃ ব্লেক কিন্তু একথা তো স্বীকার করবেন অবশ্যই আপনি যে ক্যারোলিন খুনী আইনের চোখে।
হাঁ করে তাকালেন আবার মেরিডিথ ব্লেক পোয়ারোর মুখের দিকে, আরে মশাই–যদি ও করে না থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বিকল্প একটা কিছু হতে হবে? দুর্ঘটনা? তা নয় নিশ্চয়ই। আবার বলা যাচ্ছে না আত্মহত্যাও। বিশ্বাস করবে না কেউ, ওসব করতেই পারে না অ্যামিয়াসের মতো লোক।
তা ঠিক। স্বীকার করলো পোয়ারো।
তাহলে কি আর হতে পারে? জানতে চাইলেন মেরিডিথ।
পোয়ারো খুব ঠান্ডা গলায় বললো, আমিয়াস ক্রেলকে অন্য কেউ খুন করেছিলো এটাও তো হতে পারে?
অসম্ভব।
সত্যিই তাই মনে করেন আপনি?
হা কে আর খুন করতে চাইবে ওকে? কেই বা ওকে খুন করতে পারে?
আপনারই বেশি ভালো জানা উচিত আমার চেয়ে।
সত্যি সত্যিই আপনি কিন্তু বিশ্বাস করেন না…।
হয়তো না। আমার ভালো লাগে পরীক্ষা করে সম্ভাবনাগুলোকে দেখতে। …আচ্ছা একটু গভীরভাবে আপনি চিন্তা করে বলুন তো আমায়…।
মেরিডিথ পোয়ারোর দিকে মিনিট দুই চুপ করে চেয়ে থাকলেন, মাথা নেড়ে তারপর বললেন, আমি কিছুতেই অন্য কোনো বিকল্প কল্পনা করতে পারছি না, পারছি না চেষ্টা করেও। নির্দোষ ক্যারোলিন আমি আগ বাড়িয়ে একথা বিশ্বাস করতে চাই, অবশ্য অন্য কাউকে যদি সন্দেহ করার কোনো সঙ্গত কারণ থাকে। খুন করেছে ক্যারোলিন ও চিন্তা করতেও আমি চাই না। কিন্তু কে কে ছিলো আর। ফিলিপ, অ্যামিয়াসের প্রাণের বন্ধু। এলসা? অবিশ্বাস্য। আমি, আমাকে কি দেখতে লাগে খুনীর মতো, সম্ভ্রান্ত একজন গভর্নেস? কয়েকটা বিশ্বাসী চাকর, এরপর হয়তো আপনি বলবেন খুন করেছিলো অ্যাঞ্জেলা? না, মিঃ পোয়ারো বিকল্প নেই কোনো। ওকে খুন করতে পারে না অ্যামিয়াসের স্ত্রী ছাড়া আর কেউ। তবে ওকে এটা করতে বাধ্য করেছিলো অ্যামিয়াসই, সেই অর্থে বলতে পারেন আত্মহত্যা।
অর্থাৎ মারা যান, আমিয়াস নিজের কৃতকর্মের ফলেই নিজের হাতে না মরলেও? কথাটা বলে পোয়ারো তাকালো মেরিডিথের দিকে।
কল্পনা বড় বেশি করা হয়ে যাচ্ছে, তাই না? ঐ কথাটাই ঠিক তবুও বলি, বিশেষ করে বোঝা যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের দিকটা দেখলেই।
আচ্ছা, মিঃ ব্লেক আপনি কি একথা এখনও ভেবে দেখেছেন নিহত মানুষটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে চিন্তা গবেষণা করলে খুনের উদ্দেশ্যটা জানা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে?
কোনোদিনও ওরকম ভাবিনি বটে, তবে মনে হয় কথাটা ভুল নয় আপনার।
এবং নিহত মানুষটি সেই জন্যেই কেমন ছিলেন, খুন হয়েছিলেন কি পরিস্থিতিতে এগুলো জানতে উৎসুক আমি। আপনি এবং আপনার ভাই আমাকে সাহায্য করছেন এ বিষয়ে…।
মেরিডিথ আদৌ কান দিলেন না পোয়ারোর কথায়, তার সমস্ত মনোযোগ অতোগুলো কথার মধ্যে একটি শব্দ দাবী করছিলো, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ফিলিপ।
হা।
ওর সঙ্গেও আপনি কথা বলেছেন?
নিশ্চয়ই।
হঠাৎ মেরিডিথ কড়া সুরে বলে উঠলেন, আপনার সবার আগে আসা উচিত ছিলো আমার কাছে।
পোয়ারো নম্র-ভদ্র-ভঙ্গী করে বললো, আমার জ্যেষ্ঠত্বের অগ্রাধিকার সূত্রানুসারে উচিত ছিলো আগে আপনার কাছেই আসা। জানতাম আমি মিঃ ফিলিপ ব্লেকের চেয়ে আপনি বড়ো। তবে পারছেন তো বুঝতে, লন্ডনের কাছে থাকে আপনার ভাই, তাই সহজ হয়েছিলো আগে দেখা করাটা।
তখনো কমেনি মেরিডিথের রাগটা, বিরক্তির ভাব ঠোঁটে ফুটিয়ে বললেন, আপনার তবুও উচিত ছিলো আগে আমার কাছে আসা।
পোয়ারো কোনো উত্তর দিল না এবার, ফলে আবার বলতে শুরু করলেন মেরিডিথ, পক্ষপাতিত্ব আছে ফিলিপের।
তাই নাকি?
আসলে এই ধরনের পক্ষপাতিত্বের দোষ ওর মনের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, চট করে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে পোয়ারোকে আবার বললেন, আপনার কাছে ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে বলেনি?
এতোদিন পরে, বিশেষ কোনো দরকার আছে কি তার?
মেরিডিথ চট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানি। এতোদিন আগের ঘটনা, চুকে বুকে গেছে সবকিছুই। সব লাভ লোকসানের ঊর্ধে ক্যারোলিনও। তবুও একটা ভুল ধারণা আপনি নিয়ে থাকবেন আমি এ চাই না।
এবং মনে হয় আপনার ছোট ভাই একটা ভুল ধারণা আমার মনে জন্মে দিতে পারেন?
সত্যি কথা বলতে কি, হয় কথাটা কিভাবে বলি…ওদের মধ্যে…মানে এক অদ্ভুত ধরনের শত্রুতা ছিলো ফিলিপ আর ক্যারোলিনের মধ্যে।
কেন? মেরিডিথকে বেশ বিরক্ত আর চঞ্চল করে তুললো পোয়ারোর প্রশ্নটা।
কেন কি করে জানবো আমি কেন? এভাবেই ঘটে এগুলো। ফিলিপ সুযোগ পেলেই খোঁচা মারতো ক্যারোলিনকে। ওকে অ্যামিয়াস বিয়ে করার পর বেশ রেগেই গিয়েছিলো ফিলিপ। ওদের ছায়া এক বছরেরও বেশি মাড়াতো না। অথচ সব সময়েই অ্যামিয়াস ছিলো ওর প্রাণের বন্ধু। ক্যারোলিন ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বের, ফিলিপ এই ধরনের আশংকা করতো।
ফাটল ধরেছিলো কি?
না, নিশ্চয়ই না। ভীষণ ভালোবাসতো ফিলিপকে, অ্যামিয়াস। ঠাট্টা নিজেদের মধ্যে করলেও শেষ দিন পর্যন্ত চিড় খায় না বন্ধুত্বে।
আপনার ভাই এলসা গ্ৰীয়ারের ব্যাপারটা কি চোখে নিয়েছিলেন?
কঠিন বলা। তবে বেশ বিরক্ত হয়েছিলো অ্যামিয়াসের পাগলামির জন্যে। শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না প্রায়ই বলতো। অ্যামিয়াসকে মাঝখান থেকে কষ্ট পোয়াতে হবে। তবে ক্যারোলিনকে আমার ধারণা ঐভাবে অপদস্থ হতে দেখে বোধহয় ফিলিপ ক্ষীণ একটা আনন্দ উপভোগ করতো মনে মনে।
চমকে উঠলো পোষারো, সত্যি কি ওরকম কিছু ভাবতেন উনি? না না, আমায় ভুল বুঝবেন না। বড়জোড় বলতে পারি আমি ওই ধরনের একটা চিন্তা অগোচরে ওর মনের মধ্যে থাকতে পারতো। নিজেও ও বুঝতে পারতো কিনা সন্দেহ। ফিলিপের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, তবে একই রক্ত দুজনের শরীরে বইছে তো। মোটামুটি বুঝতে পারে এক ভাই অন্য ভাইয়ের চিন্তাভাবনা।
আর ঐ দুর্ঘটনা ঘটার পরে? মেরিডিথ ব্লেক জোরে মাথা নাড়লেন, ব্যথার ঢেউ মুখের ওপর বয়ে গেলো। বললেন, বেচারি ফিলিপ কষ্ট পেয়েছিলো ভীষণ মানসিক। খুবই ভালবাসতো অ্যামিয়াসকে। বছর দুয়েকের ছোট্টো ছিল ফিলিপ, ফলে একটু বেশিই পেয়েছিলো আঘাতটা। এবং দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলো ক্যারোলিনের ওপর।
তাহলে ফিলিপের মনে তখন অন্ততঃ কোনো সন্দেহ এ ব্যাপারে ছিলো না।
কারুরই ছিলো না আমাদের। ..এতদিন পরে আজ আপনি এসে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছেন পুরানো ব্যাপারটা।
আমি না, ক্যারোলিন ক্রেল? মেরিডিথ ব্লেক বোবার মতো তাকিয়ে থেকে বললেন, ক্যারোলিন? মানে বুঝতে পারছি না আপনার কথা।
পোয়ারো, মেরিডিথের চোখে চোখ রেখে বললো, দ্বিতীয় ক্যারোলিন ক্রেল।
আস্তে আস্তে মেরিডিথের মুখে উত্তেজনার ভাবটা মিলিয়ে গেলো, ও হ্যাঁ, বাচ্চা মেয়েটা, কার্লা–আপনাকে ভীষণ ভুল বুঝছিলাম একটুর জন্য আমি।
আসলে আমি ক্যারোলিনের কথা বলছি আপনি ভেবেছিলেন? ভেবেছিলেন আপনি কিছুতেই ক্যারোলিন-কি ভাবে বলি?–শান্তি পাচ্ছেন না কবরের মধ্যে।
কেঁপে উঠলেন মেরিডিথ, না মশাই, না, চুপ করুন।
ঐ মহিলা একটা চিঠি লিখেছিলেন মেয়েকে আপনি জানেন, শেষ চিঠি, আর উনি নির্দোষ তাতে লিখেছিলেন।
অবিশ্বাসের সুর গলায়, মেরিডিথ বলে উঠলেন, ক্যারোলিন ঐ কথা লিখেছিলো?
হা বললো পোয়ারো, কেন আশ্চর্য লাগছে খুব?
আদালতে ওকে দেখলে একথা শুনে আপনিও আশ্চর্য হতেন। অসহায়, বেচারী, ওকে সবাই তাড়া করে চলেছে ব্যাধের মতো। এবং সামান্যতম চেষ্টা পর্যন্ত বাঁচবার জন্যে ও করছে না।
তবে কি হার মেনে নিয়েছিলেন উনি?
্না, না, ওর এই ধরনের পরাজিতের মনোভাব ছিলো না। আমার মনে হয়েছিলো সে যে মানুষটিকে ভালবাসতো সে তাকেই খুন করে ফেলেছে জানতে পেরে এটা হয়ে গিয়েছিলো ওই রকম। জেনেশুনেই নয়তো করেছে।
আপনি কি এখনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন।
ও, এই ধরনের চিঠি লেখার কথা বলছেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আপনি?
মিথ্যা ভাষণ তো হতে পারে সৎ উদ্দেশ্যে, আভাস দিলো পোয়ারো।
হতে পারে, মনের দ্বিধাভাব কাটিয়ে কথাটা বলেই মেরিডিথ বলে উঠলেন, না, হতে পারে না তা, ও ধরনের কাজ ক্যারোলিনের চরিত্রে সম্ভব নয়…।
মাথা নেড়ে সায় দিলো পোয়ারো। সে কথা কার্লা লেমারচেন্টও বলেছিলো। তবে শৈশবের স্মৃতির ওপর নিজের করে ওর বক্তব্য বলা। মেরিডিথ ব্লেক সেদিক দিয়ে অনেক ভাল ভাবে ক্যারোলিনকে চিনতেন। পোয়ারো এই প্রথম সমর্থন পেলে কার্লার বিশ্বাসের।
যেন নিজের মনে মেরিডিথ বলতে লাগলেন, যদি…যদি ক্যারোলিন নির্দোষ হয়…তবে তো একটা বিরাট পাগলামি পুরো ব্যাপারটাই।…না, না, অন্য কিছু আমি ভাবতে পারছি না। পোয়ারোর দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন, আপনি? কী মনে করেন আপনি?
পোয়ারো সামান্য নিস্তব্ধতার পর বললো, আমি এখনও পর্যন্ত কিছু ভাবিনি। আমি এখন শুধু অতীত সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে সংগ্রহ করে চলেছি। কেমন ছিলেন ক্যারোলিন। কেমন ছিলেন অ্যামিয়াস ক্রেল। অন্য যারা ঐ সময়ে ছিলেন, কেমন মানুষ ছিলেন তাঁরা। ঠিক কি কি ঘটেছিলো ঐ দুদিন। আমার দরকার এগুলো। তারপর বিশ্লেষণ করতে বসবো ঘটনাগুলোকে নিয়ে। আপনার ভাই ও ব্যাপারে সাহায্য করছেন। ওঁর মনে আছে ঘটনা সম্বন্ধে যেটুকু আমাকে তার একটা বিবরণ লিখে দিচ্ছেন।
মেরিডিথ কড়া গলায় বললেন, আপনার ও থেকে লাভ হবে না তেমন কিছু। খুব ব্যস্ত মানুষ ফিলিপ। ওর মনে থাকে না অতীতের সব কথা। হয়তো তথ্য ভুল দিয়ে বসবে।
বাদ পড়ে যেতে পারে ফাঁক থেকে, যেতে পারে, বুঝি সেটা। হঠাৎ কথার মধ্যে কথা বলে উঠলেন মেরিডিথ। বলছিলাম কি আমি…একটু লাল হয়ে গেলেন লজ্জায়, আপনি যদি চান–পারি আমিও মানে ওর লেখাটা আমার লেখার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে আপনি পারবেন। ভালো হবে না?
পোয়ারো খুব খুশি হয়ে বললো, হবে, আমার কাছে আপনার লেখাটাও ভীষণ মূল্যবান হবে। একেবারে পরিকল্পনা পয়লা সারির।
ঠিক তাই। লিখবো আমি। কিছু পুরানো ডাইরি আছে আমার। আমার ভাষা-টাষা তেমন ভালো নয়, ভুল লিখি বানানও। অতএব আমার কাছে খুব ভালো একটা আশা করবেন না।
আহা, আপনার কাছ থেকে আমি তো কোনো সাহিত্য চাইছি না, স্রেফ সরল বর্ণনা ঘটনার। কি বলেছিলো কারা, কেমন কে দেখতে, ঠিক ঘটেছিলো কি এই সব চাই জানতে। এমন কি জানাবেন অপ্রাসঙ্গিক মনে করলেও। পরিবেশটাকে সব কিছু মিলিয়ে জানা সম্ভব হবে।
মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছি, যে সব জায়গা বা মানুষদের দেখেননি আপনি একটা কল্পনা তাদের সম্বন্ধে হবে আপনার পক্ষে।
ঘাড় নেড়ে স্বীকার করলো পোয়ারো, আপনার কাছে আর একটা অনুরোধ আছে। এরই লাগোয়া অ্যাল্ডারবেরির জমিদারীটা, ওখানে সম্ভব হবে কি একবার চাওয়া। মানে দুর্ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিলো সেটা আমি নিজের চোখে একবার দেখতে চাই।
তা যেতে পারি নিয়ে, কিন্তু বদলে গেছে অনেক।
কিছু তৈরি করা হয়নি তো নতুন করে? উদগ্রীব হলো পোয়ারো।
না, অতো খারাপ হয়ে যায়নি ঘর বাড়ির অবস্থা। এখন ওটা একটা হোস্টেল হয়ে গেছে। ছেলে-ছোকরা থাকে অনেক। ঘরগুলো ছোট করা হয়েছে পাটিশন করে। কিছু কিছু বদলেছে। উঠোনগুলোও।
কেমন ছিলো আগে নিশ্চয়ই আমাকে আপনি বুঝিয়ে দিতে পারবেন?
চেষ্টা করবো যতোটা সম্ভব। মেরিডিথ পোয়ারোকে একটা ঢালু লনের পথ দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।
কে বিক্রি করলো অ্যাল্ডারবেরির বাড়িটা?
যে একজিকিউটার ছিলে কার্লার পক্ষে তারা। অ্যামিয়াস মারা যায় উইল না করেই, ফলে মেয়েরই প্রাপ্য এখন সব সম্পত্তি। কারণ মেয়েকে ক্যারোলিনও তার অংশ দিয়ে যায়।
কিছু দেননি সৎ বোনকে?
মোটামুটি ভালোই টাকাকড়ি রেখে গেছেন অ্যাঞ্জেলার বাবা।
ঘাড় নাড়লো পোয়ারো, বুঝেছি।..কিন্তু আপনি আমায় এ কোথায় নিয়ে চলেছেন? সমুদ্রের তীর তো সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
আপনাকে এখানকার ভূগোলটা একটু বুঝিয়ে দিতে হবে দেখছি। সব দেখতে পাবেন একটু এগোলেই।…একটা খাঁড়ি ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন…ওটাকে লোকে উটের খাঁড়ি বলে কারণ উটের গলার মতো দেখতে বলে। ছোটখাট একটা নদীর মুখের মতো। অ্যাল্ডারবেরিতে ড্যাঙ্গা দিয়ে যেতে গেলে যেতে হয় অনেকটা ঘুর পথে। যাতায়াত এই খাড়ি নৌকো করে করলে সময় ও পথ দুটোই কম লাগে। অ্যাল্ডারবেরি হল খাঁড়ির উল্টো পাড়ে। এই তো দেখা যাচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে।
ওরা একটা সরু তীরের কাছে এসে পড়েছে কথা বলতে বলতে, ছোট্ট একটু জঙ্গল সামনে, তার পাশ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাল্ডারবেরির চুড়ো।
দুটো নৌকো তীরের ওপর তোলা। একটা নৌকো ঠেলাঠেলি করে জলে ভাসিয়ে দুজনে এগোতে লাগলেন উল্টো পাড়ের দিকে দাঁড় বেয়ে।
আগে আমরা খুব একটা ঝড় বৃষ্টি না হলে এইভাবেই যেতাম। গাড়ীতে গেলে প্রায় তিন মাইল লাগে ঘুরপথে।
দুজনে ওপাড়ে পৌঁছে আবার একটা সরু পথ দিয়ে শুরু করলেন হাঁটতে। গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে পথটা বেরিয়ে এগিয়ে গেছে পাথর বসানো দেওয়ালের গা ঘেঁষে। মেরিডিথ বললেন সেটা দেখিয়ে, ওরা ঐটাকে কামান বাগান বলতো। একটা বাঁক নেবার পর একটা দরজা দেখা গেলো দেওয়ালের গায়ে। দুজনে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় আসছিলেন এতোক্ষণ বেশ, ফাঁকা জায়গায় এখানে ঢুকে হঠাৎ পোয়ারোর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। খোলামেলা সুন্দর উঁচু জমি কামান বসানো দেওয়ালের ফোকরে ফেঁকরে। দূরে সমুদ্র গাঢ় নীল রঙের।
জায়গাটা চমৎকার। বললেন মেরিডিথ। সিমেন্ট কংক্রিটের একটা নতুন বাড়ি বাগানের পেছন দিকটায়। আগে কিন্তু এটা ছিলো না, ওখানেই অ্যামিয়াস ছবি আঁকতো। তখন বেঞ্চ, টেবিল পাতা থাকতো। দেখছি খুব একটা বদলায়নি।
তাহলে এখানেই ঘটনাটা ঘটেছিলো? আগ্রহের সুর পোয়ারোর গলায়।
হ্যাঁ, ওখানে বেঞ্চটা ছিল, ঐ শেডটার পাশে। অ্যামিয়াসকে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো ওটার ওপরেই। এমনিতে ছবি আঁকার সময় মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে বেঞ্চটার ওপর একমনে ইজেলের ওপর দেখতো ছবিটাকে। তারপর এক সময় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ক্যানভাসের ওপর তুলি বোলাতে শুরু করতো পাগলের মতো।
মেরিডিথ আবার শুরু করলেন একটু থেমে, ব্যাপারটা সেই জন্যেই খুব স্বাভাবিক লেগেছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন অ্যামিয়াস বিশ্রাম করছে চোখ বুজে। কিন্তু ভোলা চোখ আর শক্ত হয়ে ওঠা দেহটাকে দেখেই বাড়ে সন্দেহ। ঐ ভাবে…ঐ ভাবেই তো ঘটে।…ব্যথা নেই কোনো…
যে প্রশ্নটা পোয়ারো করলো যেন সেটা আশা করেছিলেন মেরিডিথ, প্রথম কে দেখেছিলো?
ও দেখেছিলো। ক্যারোলিন, লাঞ্চ খাবার পর। দেখেছিলাম সব শেষে আমি আর এলসা, মানে জীবিত অ্যামিয়াসকে। মনে হয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো বিষের ক্রিয়া। যাই হোক সবটা তো আমি লিখেই দিচ্ছি। আমার পক্ষে সহজ হবে সেটাই।
তারপর হুড়মুড় করে কোনো কথা না বলে মেরিডিথ হাঁটতে লাগলো ওর পেছনে পেছনে।
দুজনে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আর একটা উঁচু মতন জায়গায় পৌঁছলেন। মেরিডিথ গাছগাছালির মধ্যে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে ছিলো একটা বেঞ্চ তার টেবিল। আমি এখানে সেদিন সকালে বসেছিলাম। তখন অবশ্য এখানে এতো গাছপালা ছিলো না পরিষ্কার দেখা যেতে কামান বসানোর দেওয়ালটা। ঘাড় বেঁকিয়ে ঐখানে বসে এলসা পোজ দিয়েছিলো। মেরিডিথ নিজের ঘাড়টা বেঁকিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
ওখান থেকে বাড়ির দিকে এগোলেন। জর্জিয়ান প্যাটার্নের। আগেকার দিনের বাড়ি। প্রায় পঞ্চাশটা খুপরি করা হয়েছে কাঠের সবুজ লনের ওপর। এগুলো নতুন। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা এখানে থাকে। হৈ চৈ লেগে থাকে বোর্ডিং বাড়ির। সকলেই নতুন এখানকার বাসিন্দারা, অতএব কিছু দেখার নেই। ফেরা যাক চলুন। আবার হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে ফিরে এলেন মেরিডিথ আর পোয়ারো।
মেরিডিথ হঠাৎ বলে উঠলেন, জানেন, আমি ঐ ছবিটা কিনে নিয়েছিলাম। অ্যামিয়াস যে ছবিটা আঁকছিলো। যদি ছবিটা নোংরা মনের লোকর হাতে পড়তো তাহলে কেচ্ছা কাহিনী ফলাও করে প্রচার হতোই নানারকম, যাতে সেটা না হয় তার জন্যে ওটা আমি নিজেই কিনে নিই। চমৎকার ছবি। এটাই ওর সেরা শিল্পকর্ম তা বলতো অ্যামিয়াস। শেষ হয়ে এসেছিলো প্রায়। মাত্র দু-একদিনের কাজ বাকি ছিলো। দেখতে চান…দেখবেন নাকি একবার ছবিটা।
দেখবো নিশ্চয়ই।
মেরিডিথ হলঘর পার হয়ে একটা ছোট্ট ঘরের দরজা খুললেন। ঘরটা বোধহয় তেমন ব্যবহার করা হয় না। ধুলোময়লার ভ্যাপসা বন্ধ। বেশ কষ্ট করে মেরিডিথ একটা জানলা খুললেন। এঁটে গিয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটাকে এক ঝলক মিষ্টি গন্ধ এসে ভরিয়ে দিলো। বলার দরকার পড়লো না ঘরটা যে কি তা। বেশ তাক কয়েকটা, সেখানে এখনও শিশি-বোতল রাখার ছাপগুলো আছে। একটা বেসিন গাঁথা দেওয়ালে। কিছু অকেজো রাসায়নিক গবেষণার যন্ত্রপাতি।
নিঃশ্বাস বুক ভরে নিয়ে মেরিডিথ বাইরের দিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, সব কথা কত সহজে মনে পড়ে যায়। জুইফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম এইখানে দাঁড়িয়ে–আর নির্বোধের মতো কথার জাল বুনে চলেছিলাম। গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেছিলাম আমার ওষুধ পত্রের।
পোয়ারো জানলা দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়িয়ে জুই ফুলের একটা ছোট্ট ডাল ছিঁড়ে নিলো। মেরিডিথ বড় বড় পা ফেলে হেঁটে গেলেন একটা দেওয়ালের দিকে। ছবি ঝুলছে একটা, যাতে ময়লা না পড়ে তার জন্য এটা একটা বড় কাগজ দিয়ে ঢাকা।
মেরিডিথ কাগজটা একটানে সরিয়ে দিলেন। পোয়ারোর নিঃশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো। অ্যামিয়াস ক্রেলের এর আগে পোয়ারো মোট চারটে ছবি দেখেছে। দুটো স্টেট গ্যালারীতে, লণ্ডনের একটা ছবির দোকানে অন্য একটা আর একটা গোলাপ গুচ্ছের। আর চোখের সামনে এখন ভেসে উঠেছে এমন একটা ছবি, যেটাকে শিল্পী নিজে সবার সেরা বলেছেন। এবং বুঝতে পারলো পেয়ারোও সত্যিই অ্যামিয়াস এক অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্পী।
ছবিটাকে একটা ভাসা-ভাসা জিনিস বলে মনে হচ্ছিলো প্রথম নজরে, যেন ভালো একটা পোস্টার। সুস্পষ্ট উল্টোপাল্টা রঙের স্কুল ব্যবহারের চিহ্ন। কটকটে হলদে রঙের জামা একটা মেয়ের পরনে প্যান্ট গাঢ় নীল রঙের। উত্তাপ নীল রঙের সমুদ্রের পটভূমিতে ধূসর রঙের দেওয়ালের ওপর বসে।
বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে কিন্তু প্রথম দর্শনে। সূক্ষ্ম বিকৃতি সামান্য সামান্য নানা জায়গায় ঘটানো হয়েছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগায় অসাধারণ উজ্জ্বল আর স্বচ্ছ আলোর খেলায় ছবিটা। আর মেয়েটি…।
..এবং প্রাণবন্ত অদ্ভুত। যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্যে যেন জ্বলজ্বল করছে ছবিটার সব কিছুই। যেন কথা বলছে মুখটি আর চোখ…।
প্রাণের স্পন্দন অতিমাত্রায় স্পষ্ট সেখানেও। মোহময়ী যৌবনের প্রতীক। তাহলে অ্যামিয়াস ক্রেল এটাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন এলসা গ্ৰীয়ারের মধ্যে যার ফলে শান্তির প্রতিমূর্তি ক্যারোলিনকেও উপেক্ষা করার জন্যে উনি অন্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এক অফুরন্ত প্রাণশক্তি এলসা, যেন এলসাই যৌবন।
অপূর্বসুন্দর দেহলতা, উদ্ধত, অহংকারী, হেলানো মাথাটা, জয়ের আনন্দের জিগীষা চোখের দৃষ্টিতে, যেন তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, লক্ষ্য করছে…করছে অপেক্ষা…।
বলে উঠলো পোয়ারো, অসাধারণ–দারুণ অসাধারণ ছবি।
একটু যেন মেরিডিথের গলাটা কাপলো, এতো বাচ্চা মেয়েটা
ঘাড় নেড়ে পোয়ারো ঠিক করে নিলো মনে মনে তারপর ভাবলো, সাধারণ এই কথাটা বলার সময়, কি ভাবে পুরুষেরা, এ তো বাচ্চা। নিষ্পাপ কতো, কতো অসহায়। কিন্তু তা তো নয়, যৌবন। বড় স্থূল যৌবন, উদ্ধত বড়, নিষ্ঠুর বড়। এবং আর একটা জিনিস–কত অল্পেই ভেঙে পড়ে যৌবন।
পোয়ারো বেরিয়ে এলো মেরিডিথের সঙ্গে। নাহ এবার দেখা করতে হবে এলসা গ্ৰীয়ারের সাথে। কালের স্পর্শে এই যৌবনবতী, মোহময়ী, বিজয়িনী স্কুল প্রকৃতির মেয়েটি পাল্টেছে কতোটা দেখা দরকার তা। আগ্রহ বাড়ছে পোয়ারোর।
তাকে অনুসরণ করে চলেছে যেন মেয়েটির দৃষ্টি। পোয়ারোকে কিছু বলতে চাইছে।
যদি পোয়ারো এটা বুঝতে পারতো কী বলতে চাইছে, তাকে রক্ত মাংসের মহিলাটিই বা কি বলতে পারে, কিংবা এমন কথা বলতে চাইছে ঐ চোখ দুটো যা বলতে পারবে না সত্যিকারের মহিলাটি?
বিজয়িনীর অস্মিতা চোখের ভাষায় জগতকে তুচ্ছ করা। অথচ তার হাত থেকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে করায়ত্ত শিকারটিকে।
হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ফলে কামনার ধন, চোখের আলোয় কি পাওয়া যাবে এখনও বঞ্চিতের, হতাশার শেষ ম্লান আভাটুকু।
শেষবারের মতো পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে আর একবার ছবিটা দেখে নিলো।
একবারে যেন জীবন্ত।
হঠাৎ পোয়ারোকে এক অজানা আশংকা এসে গ্রাস করলো…।
.
অষ্টম অধ্যায়
রোস্ট করা মাংস পেয়েছিলো এই ছোট্ট শূকরছানাটি..
ডারউইন টিউলিপ ফুলের বাহার ব্রুকস্ট্রীটের বাড়িটার জানলা বাক্সে। দরজা দিয়ে সাদা লাইলাব ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছে হল ঘরে রাখা পবরাট ফুলের পাত্রের থেকে।
পোয়ারোর হাত থেকে একজন মাঝবয়সী খানসামা টুপি আর ছড়িটা নিলো। ওটা নিয়ে গিয়ে আর একজন চাকর যথাস্থানে রাখলো। আস্তে আস্তে খানসামা পার্থক্য বজায় রেখে বললো, স্যার এই পথ দিয়ে আসুন।
হলঘর পার হয়ে একটা ঘরের দরজা একটু খুলে নিখুঁত ভাবে এরকুল পোয়ারোর নামটা উচ্চারণ করে তার আগমন বার্তা খানসামা ঘোষণা করলো।
একজন রোগা লম্বা মতন ভদ্রলোক উঠে এসে পোয়ারোকে স্বাগত জানালেন।
এখনও চল্লিশ পার হননি লর্ড ডিটিশাম। শুধু তিনি লর্ড খেতাবধারী জমিদারই নন, কবিও বটে একজন। প্রচুর অর্থব্যয়ে তার লেখা ছুটি কাব্যনাটিকা মঞ্চস্থ করা হয়েছিলো এবং দুটিই মঞ্চসফল। বেশ উঁচু কপালটা, ধারালো ভাব চিবুকে, অপ্রত্যাশিতভাবে চোখ আর মুখটা সুন্দর। লর্ড ডিটিশাম বললেন, মিঃ পোয়ারো বসুন।
পোয়ারো বাড়ানো সিগারেটটা নিলো, সযত্নে দেশলাই জ্বেলে লর্ড ডিটিশাম ওটা ধরিয়ে দিলেন, তারপর বললেন চিন্তা করতে করতে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনি যে দেখা করতে এসেছেন আমি তা জানি।
পোয়ারো বললো, লেডি ডিটিশাম আমাকে দয়া করে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দিয়েছেন। ওহ হ্যাঁ।
বেশ কিছুক্ষণ লর্ডকে অস্বস্তিকর ভাবে চুপ করে থাকতে দেখে পোয়ারো বললো, আপনার আশা করি তাতে আপত্তি নেই, লর্ড ডিটিশাম।
হঠাৎ স্বপ্নালু মুখে হাসি ফুটে উঠলো চকিতে, মিঃ পোয়ারো আজকাল স্বামীদের আপত্তিতে ততো আর গুরুত্ব কেউ আরোপ করে না।
আপনার তাহলে আপত্তি আছে?
না, আমি তা বলতে পারি না। তবে আমি অস্বীকার করতে পারছি না যে একটু আতঙ্কের প্রতিক্রিয়া যে আমার স্ত্রীর মনের ওপর হবে তা নয়, বলছি খোলাখুলি ভাবেই। অনেক বছর আগে তখন আমার স্ত্রীর বয়েস অনেক কম, তখন তাকে যেতে হয়েছিলো এক দারুণ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে। আমার ধারণা যে সেই আঘাতটা কাটিয়ে উঠেছে বলেই। সে সেটা ভুলেও গেছে আমার বিশ্বাস। আপনি এতোদিন পরে এলেন এবং পুরোনো স্মৃতি যে জাগিয়ে তুলবে আপনার প্রশ্নাবলী একথা অস্বীকার করা যায় না।
সত্যিই আমি খুব দুঃখিত এর জন্যে। বিনীতভাবে পোয়ারো বললো।
বুঝতে পারছি না ঠিক, এর ফল কি হবে।
লর্ড ডিটিশাম আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, যত সংক্ষেপে কাজটা সারা যায় সারবো। এবং যতোটা সম্ভব কম দুঃখ দেবার চেষ্টা করবো লেডি ডিটিশামকে। উনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কোমল এবং কাতর হয়ে ওঠেন অল্পে।
হঠাৎ পোয়ারোকে চমকে দিয়ে লর্ড ডিটিশাম জোরে হেসে উঠলেন, এলসা? এলসা ঘোড়ার মতো শক্তি রাখে।
তাহলে…? পোয়ারো খুব বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
লর্ড ডিটিশাম বললেন, যে কোনো মানসিক আঘাত সহ্য করবার ক্ষমতা রাখে আমার স্ত্রী। কেন সে আপনার সাথে দেখা করতে রাজী হয়েছে আপনি কি তা জানেন?
ধীর ভাবে পোয়ারো বললো, কৌতূহল?
শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠলো লর্ডের চোখে, তাহলে ধরতে পেরেছেন?
এটাই তো স্বাভাবিক। সব সময়েই মহিলারা বেসরকারী গোয়েন্দাদের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের নরকে যাবার পরামর্শ দেন পুরুষেরা।
নরকে যাবার পরামর্শ কিছু মহিলাও দিতে পারেন।
হ্যাঁ, তবে দেখা করার পর, আগে নয়।
ঠিক হয়তো, একটু থামলেন লর্ড ডিটিশাম, তা আসল উদ্দেশ্যটা কি এই বইটি লেখার পেছনে?
কাঁধ ঝাঁকালো পোয়ারো, পুরানো দিনের সুর লোকে খুঁজে বেড়ায় সন্ধান করে পুরানো দিনের নাটকের, পোক চায় পুরানো দিনের, আবার অনেকে পুরানো দিনের কথা জানতে চায় নতুন করে।
ফুঃ! বললেন লর্ড ডিটিশাম, যদি তা বলেন তবে আমিও বলবো ফুঃ। কিন্তু তাই বলে আর পাল্টে দিতে পারেন না মানুষের স্বভাব। এক ধরনের নাটক খুন করা। মানবজাতির আগ্রহ নাটক সম্বন্ধে সেই অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে।
বিড়বিড় করে লর্ড ডিটিশাম বললেন, তা জানি, তা জানি…।
বুঝতে পারছেন তাহলে…লেখা হবে বইটা। কর্তব্য হলো আমার দেখা যাতে কোনো ভুল তথ্য ঢুকে না যায়, বিকৃত যেন না হয়ে যায় কোনো ঘটনা।
ধারণা ছিলো আমার তো সত্য ঘটনা জনসাধারণের সম্পত্তি, লর্ড ডিটিশাম বললেন।
তা ঠিক, কিন্তু নিশ্চয়ই তার ব্যাখ্যাগুলো নয়।
রাগতভাবে হঠাৎ ডিটিশাম বললেন, মিঃ পোয়ারো জানতে পারি কি এ কথার মানে?
লর্ড ডিটিশাম দেখুন, নানা পন্থা আছে, ঐতিহাসিক কোনো সত্য ঘটনাকে দেখার। যেমন ধরুন মেরী কুইন অফ স্কাটস–ওঁকে কেউ শহীদ বলেছে, বা কেউ নীতিজ্ঞানহীন স্বার্থপর মহিলা হিসেবে ওঁকে এঁকেছেন, কেউ বলেছেন একজন সরলমনা দেবী ছিলেন মেরী, ওঁকে কেউ খুনী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দেখেছেন। উনি ছিলেন অনেকের মতে ভাগ্য আর পরিস্থিতির শিকার। মনে করতে পারে যার যা খুশি।
কিন্তু এক্ষেত্রে, তার স্ত্রী খুন করে অ্যামিয়াস ক্রেলকে। অবশ্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিচার চলাকালীন এবং অবাঞ্ছিভাবে বেশ কিছুটা ঝঞ্ঝাটে আমার স্ত্রী জড়িয়ে পড়েন। খুব বিরূপ হয়ে উঠেছিলো সাধারণ মানুষ তার প্রতি।
একটু প্রখর ইংরেজদের নীতিজ্ঞানটা। পোয়ারো বললো।
আপনার?
আমার, সুস্থ নৈতিক জীবনযাপন আমি করি। তবে নীতিজ্ঞানের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই তার সঙ্গে।
লর্ড ডিটিশাম বললেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কেমন ছিলেন ঐ মিসেস ক্রেল মহিলাটি। শুধু কি স্ত্রীর অপমানিত ব্যাপার, না অন্য কিছু ছিলো এর পেছনে?
সেটা জানতে পারেন আপনার স্ত্রী, জানালো পোয়ারো।
ঐ মামলাটা সম্বন্ধে আমার স্ত্রী একটা কথাও আজ পর্যন্ত বলেনি।
যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো পোয়ারোর আগ্রহ, যেন দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে…।
আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো লর্ডের গলার স্বর।
কবির সৃজনধর্মী মানস কল্পনা…। উঠে গিয়ে লর্ড ডিটিশাম ঘণ্টা বাজালেন, আপনার জন্যে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছে…।
পোয়ারো খানসামার সঙ্গে পা ডুবে যাওয়া নরম কার্পেটের ওপর হাঁটতে লাগলো। পোয়ারো দু থাক সিঁড়ি ভেঙে একটা ঘরের মধ্যে এলো। শুধু অর্থের প্রাচুর্য চারপাশে। চারদিকে মায়াজাল সৃষ্টি করেছে স্তিমিত আলোয়, ফুলের বাহার সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে। দামী জিনিস লর্ড ডিটিশামের ঘরটায় থাকলেও তাতে রুচির পরিচয় ছিলো। এখানে কিন্তু বড় বেশি স্থূলভাবে প্রকট হয়ে আছে অর্থের প্রাচুর্য। এখানে অহংকারটাই প্রধান রুচির বদলে। মনে মনে পোয়ারো বললো, মাংস রোস্ট করা,…হ্যাঁ, রোস্ট করা মাংস।
এটা বসবার ঘর লেডি ডিটিশামের উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা ম্যান্টলপীসের পাশে।
পোয়ারোর মাথার মধ্যে একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠলো, তা সরাতে পারলো না শত চেষ্টাতেও যৌবনেই মৃতা…।
পোয়ারোর–এ কথাটাই মনে হলো এলসা ডিটিশামের দিকে তাকিয়ে।
তার পক্ষে এলসাকে চেনা সম্ভব হতো না মেরিডিথ ব্লেকের বাড়িতে দেখা ছবিটা দিয়ে। ঐ ছবিটা ছিলো, যৌবনের প্রাণশক্তির মূর্ত প্রতীক। পোয়ারো যাঁকে এখন দেখছে, তার মধ্যে চিহ্নমাত্র নেই যৌবনের, যৌবন কোনো কালে ছিলো বলে মনে হয় না। তবে অস্বীকার করা যায় না একথা যে এলসা সুন্দর এবং সুন্দরী আছেন এখনও, পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে এগিয়ে এলেন এলসা। খুব বেশি নয় বয়সও, বড়জোর ছত্রিশ। সযতনে কুচকুচে কালো চুল বাঁধা। অপূর্ব সুন্দর দেহের বাঁধুনী।
মনের মধ্যে পোয়ারোর একটা অব্যক্ত ব্যথার সুরে গুমরে উঠলো। বৃদ্ধ বলেছিলেন জোনাথন জুলিয়েটের কথা। কিন্তু এলসার মধ্যে সেই জুলিয়েটের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। জুলিয়েট, রোমিওকে হারিয়ে মরে গিয়েছিলো যৌবনেই।
অথচ মরেনি এলসা গ্ৰীয়ার…। মিঃ পোয়ারো আমার খুবই আগ্রহ আছে। বসুন, আমাকে কি করতে হবে বলুন, কোনো উত্থান পতন নেই এলসা ডিটিশামের জানায়, কথাগুলো বলে গেলেন এক সুরে।
মনে হলো পোয়ারোর, ওঁর কিন্তু কোনো আগ্রহই নেই। এঁকে কোনো কিছুই আর আকর্ষণ করে না।
বড় বড় ধূসর রঙের চোখ–নিষ্প্রাণ হ্রদের মতো। পোয়ারো এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ করে থাকে যা তাই করলো, গেয়ে উঠলো সম্পূর্ণ উল্টো সুরে, ম্যাডাম সব গুলিয়ে ফেলছি আমি, গুলিয়ে যাচ্ছে সব।
না, না, কেন তা হবে? লেডি ডিটিশাম বললেন।
কারণ মনে হচ্ছে আমার নতুন করে অতীতের নাটকটাকে গড়ে তোলার চেষ্টাটা ভীষণ বেদনার হবে আপনার পক্ষে।
কথাটা শুনে এলসা বেশ খুশি হলেন। হ্যাঁ, বেশ আনন্দ, মুখে সত্যিকারের আনন্দের আভা ফুটে উঠলো।
মনে হচ্ছে আপনার মাথার মধ্যে কথাটা আমার স্বামী ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আগেই তো দেখা হয়ে গেছে। তবে কিছুই বুঝতে পারেন না উনি। কখনও পারেনওনি। আমাকে যতোটা স্বামী স্পর্শকাতর মনে করেন আমি অতোটা নই।
তখনো এলসার খুশির আমেজটা কাটেনি, বললেন, জানেন কারখানার মজুর ছিলেন আমার বাবা। অনেক টাকা পয়সা করেন প্রচুর খেটে। মোটা চামড়া না হলেও কাজটা করা যায় না। আমারও তাই।
মনে হলো পোয়ারোর ও কথাটা সত্যি। মোটা চামড়া না হলেও কেউ ও ভাবে এসে উঠতো না ক্যারোলিন ক্রেলের বাড়িতে।
লেডি ডিটিশাম বললেন, কি করতে হবে বলুন আমাকে?
ম্যাডাম আর একবার বলছি, আপনার কষ্ট হবে না তো পুরানো দিনের স্মৃতিচারণ করতে?
লেডি ডিটিশাম একটু চিন্তা করতেই শুরু করলেন। হঠাৎ পোয়াবোর তাই দেখে মনে হলো অত্যন্ত খোলামেলা মনের মহিলা এলসা। মিথ্যে কথা প্রয়োজনে বলতে পারেন, আদৌ ইচ্ছাকৃতভাবে নয়।
ধীরে ধীরে এলসা বললেন, না, কষ্ট হবে না। তবে বোধহয় হলে ভালো হতো…।
কেন?
ধৈর্য্যের বাঁধ যেন এলসা ডিটিশামের ভেঙে পড়লো, বললেন, কত বেদনার অনুভূতি না থাকাটা…।
এবং মনে হলো এরকুল পোয়রোর হ্যাঁ, মরে গেছে এলসা গ্ৰীয়ার।
অবশ্য মুখে বললো, লেডি ডিটিশাম যাই হোক, এতে কিন্তু বেশ সহজ হয়ে উঠবে আমার কাজটা।
এলসা খুশি মনে প্রশ্ন করলেন, আপনি কী জানতে চান?
ম্যাডাম আপনার স্মৃতিশক্তি তো ভালোই?
ভালো বলেই তো মনে হয় মোটামুটি।
এবং আপনি পুরানো দিনের কথা তুললে কষ্ট পাবেন না এটাও ঠিক তো?
না হবে না। মানুষ তো ব্যথা পায় ঘটনাগুলো ঘটার সময়েই। পরে নয়।
…কিছু কিছু লোকের জানি তাই হয় বলে।
কিছুতেই এডওয়ার্ড এ কথাটার মানে বুঝতে চায় না আমার স্বামী। ওর ধারণা মামলা, বিচার আর ঐসব ব্যাপারগুলো দারুণ ক্ষতির ছিলো আমার পক্ষে।
ছিলো নাকি?
উত্তরে এলসা ডিটিশাম বললেন, না বরং ওগুলো বেশ উপভোগ আমি করেছিলাম।…ওহ ভগবান, স্যার মন্টেগু ঐ বুড়ো জেরায় জেরায় আমাকে খতম করতে চেয়েছিলো। ভালোই লেগেছিলো ওঁর সঙ্গে আমার লড়তে। চেপে ধরতেও পারেননি আমাকে।
আত্মতৃপ্তির সুরটা কথাগুলো বলার সময় পোয়ারোর কান এড়ালো না। বলেই চললেন এলসা, মোহভঙ্গ করছি না তো আপনার। একটা কুড়ি বছরের মেয়ে, একেবারে ধরাশায়ী হয়ে পড়া উচিত ছিলো তার তো, মানে লজ্জায় অপমানে। আমি অথচ হইনি। ওঁরা যা বলেছিলেন আমাকে আমি গায়ে মাখিনি সেসব কথা। শুধু আমি একটা জিনিসই চাইছিলাম।
সেটা কি?
ফাঁসিতে ঝোলাতে ক্যারোলিনকে, সঙ্গে সঙ্গে এলসা ডিটিশাম বললেন।
লেডি ডিটিশামের হাত ভারী সুন্দর লম্বাটে ধরণের গড়ন হাতের তা লক্ষ্য করলো পোয়ারো। নখ বাঁকানো, শিকারী প্রাণীর থাবা।
প্রতিহিংসাপরায়ণ মনে করছেন আমাকে আপনি? ক্ষতি করলে আমার, কেউ আঘাত করলে আমাকে প্রতিশোধ নিতে আমি দ্বিধা করি না। সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মহিলা ছিলো আমার চোখে ঐ মহিলাটি। অ্যামিয়াস আমাকে চাইছে ও জানতো। ওকে ছেড়ে অ্যামিয়াসের আমাকে বিয়ে করতেও ইচ্ছে আছে। আর ঠিক সেই কারণে যাতে ওকে আমি না পাই তাই খুন করে ফেললো স্বামীকে নিজের হাতে।
সুদূর প্রসারিত করে পোয়ারোর পাশ দিয়ে দৃষ্টিকে এলসা ডিটিশাম আবার বললেন, আপনি কি কাজটাকে নীচতা বলে মনে করেন না।
আপনি কি ঈর্ষার ব্যাপারটা বোঝেন না, বা বোঝার চেষ্টা করেন না সহানুভূতি দিয়ে লেডি ডিটিশাম?
না, করি না। যদি হেরে যান আপনি, হেরে গেছেন। যদি না পারেন স্বামীকে বেঁধে রাখতে, তাকে যেতে দিন ভদ্রভাবে। এই মুঠোর মধ্যে জিনিসটা পুরো রাখা একেবারেই পছন্দ করি না আমি।
হয়তো আপনি অ্যামিয়াস ক্রেলকে বিয়ে করলে তা বুঝতে পারতেন।
আমার তো মনে হয় না তা, আমরা…এলসা হঠাৎ একটু হাসলেন। মনে হলো পোয়ারোর ঠিক হাসি নয় হাসিটা, তাতে ভয়ের ছাপ আছে। যেন বাস্তব অনুভূতির সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই তার। কথাটা ঠিক মতো আপনাকে বলে রাখা ভালো। কখনই একথা মনে করবেন না যে এক সরল মেয়েকে অ্যামিয়াস ক্রেল ভুলিয়ে তার সর্বনাশ করেছিলো। ব্যাপারটার জন্যে আমাদের মধ্যে আমার দায়িত্বই বেশি ছিলো। আমি ওকে পাবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলাম একটা পার্টিতে দেখা হবার পর থেকেই।
এক হাস্যকর অনুকরণ–এ এক অসম্ভব ভাবে হাস্যকর প্রচেষ্টা অনুকরণ করার অথচ
আমার সর্বস্ব আমি নিবেদিত তোমার চরণে
হে আমার প্রভু, সঙ্গে যাব যেথা লয়ে যাবে…
জানতেন যদিও বিবাহিত অ্যামিয়াস,
অনুপ্রবেশকারীরা অবৈধভাবে দণ্ডিত হবে, ছাপানো নোটিশ ছাড়া বাস্তব জগতে কিন্তু আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। যদিও তার স্ত্রীকে নিয়ে সুখী না হতে পারে, আর সুখী হয়। আমাকে পেলে, তবে বাধা থাকবে কেন তা হবার পথে? একটাই তো মাত্র জীবন।
কিন্তু অ্যামিয়াস তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সুখীই ছিলেন একথা তো শুনেছি।
না। ঝগড়া করতে কুকুর-বেড়ালের মতো। স্বামীর খুঁত ধরে বেড়াতো সব সময়। ওঁর স্ত্রী কি জঘন্য মেয়েমানুষ ছিলো।
একটা সিগারেট ধরালেন এলসা উঠে গিয়ে, তারপর বললেন মৃদু হেসে, হয়তো ক্যারোলিনের প্রতি অবিচার করেছি আমি। কিন্তু সত্যিই বলছি সে বড়ো কদর্য মনের মেয়েমানুষ ছিলো।
ভীষণ দুঃখের কিন্তু ঘটনাটা, ধীরে ধীরে বললো পোয়ারো।
হ্যাঁ, সত্যিই ভীষণ দুঃখের ঘটনাটা, কথাটা বললেন এলসা আগেকার সেই ক্লান্ত সুর, তারপর যেন হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে বলে উঠলেন, আমাকেও কিন্তু দুর্ঘটনাটা শেষ করে দিয়েছিলো। মরণ হয়েছিলো আমারও। আমার জীবনে তারপর থেকে আর কিছু নেই অসীম শূন্যতা ছাড়া। আমি যেন…যেন আমি কাঁচের পাত্রে রাখা একটা খড়পোড়া মাছ, বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন এলসা শেষের কথাটা বলতে বলতে।
আপনার জীবনে কি তাহলে অ্যামিয়াস ক্রেল অতোটা জুড়ে ছিলেন?
এলসা কথাটা ঘাড় নেড়ে স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু একটু বিষাদের যেন ছায়া আছে সেই…স্বীকৃতির মধ্যে।
মনে হয় এক পেশে মন নিয়ে সব সময় আমি চলতাম,..মনে হয় উচিত সবারই জুলিয়েটের মতো অবসান ঘটিয়ে দেওয়া নিজের জীবনের। কিন্তু…কিন্তু লোকে ধরে নেবে সেটা করলে পরে আপনি হেরে গেছেন, পরাজিত হয়েছেন জীবনের যুদ্ধে।
আর তা না করলে, একটু খোঁচা মারলো পোয়ারো।
থেকে যায় সব কিছুই তো…আগের মতোই ঠিক..যদি জোর করে একবার বেরিয়ে আসা যায় সব বাধা ছিঁড়ে। পেরেছিলাম আমি। তাই আমার কাছে ওটা ততো আর বড় হয়ে ওঠেনি। চিন্তা করে দেখেছিলাম আমি এগিয়ে যেতে হবে আমাকে পরের ধাপে পা ফেলে।
হ্যাঁ, পরের ধাপ। বুঝতে পারলো পরিষ্কার পোয়ারো এই মহিলা পরের ধাপে পা ফেলেছেন প্রচণ্ড মানসিকতা দৃঢ়তা নিয়ে। মহিলা এখনও সুন্দরী, পুরুষের মনোহারিণী, তীক্ষ্ণ নখ নিয়ে শিকারী পাখির মতো আঁকড়ে ধরে জীবনের যে অংশটা শূন্য হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ তা ভরিয়ে তুলতে চাইছেন। বীর পূজা–বিয়ে হয়েছিলো নাম করা বৈমানিকের সঙ্গে। বিখ্যাত একজন অভিযাত্রী। অ্যামিয়াস ক্রেলের মতো নিশ্চয়ই ছিলেন আরনল্ড স্টিভেনসন। অন্ততঃ শরীর স্বাস্থ্যে-সৃজনধর্মী শিল্পী এলেন তারপরেই ডিটিশাম।
এলসা ডিটিশাম বললেন, কখনও ভণ্ডামি দেখা যায়নি আমার মধ্যে। আমি ভীষণ পছন্দ করি স্পেন দেশের প্রবাদ বাক্যটা–বলেছেন ঈশ্বর, চাও যা গ্রহণ করো, এবং মূল্য দাও তার যথোচিত, তা সারা জীবনে আমিও করে এসেছি। যা পেয়েছি চেয়েছি, আর সব সময়ে তার মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত।
এরকুল পোয়ারো বললো, সেটা আপনার জানা নেই, তা হলো এই যে অনেক এমন জিনিস আছে যা কেনা যায় না টাকা দিয়ে।
পোয়ারোর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন, শুধু টাকা পয়সার কথা আমি কিন্তু বলিনি।
না, না, আমি বুঝেছি সেটা। তবে এমন অনেক জিনিস পৃথিবীতে আছে সেগুলো বিক্রি করার জন্যে নয়।
বাজে কথা।
পোয়ারোর ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো, হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠলে কারখানার শ্রমিকের যে ঔদ্ধত্য ফুটে ওঠে, এলসার গলায় ফুটে ওঠে সেই সুরটাই।
পোয়ারোর মনের আকাশে নেমে এলো বিষাদের ছায়া–এক রূপসী নারী সামনেই বসে, তাকে কলুষিত করতে পারেনি কালের হস্তাবলেপ, অথচ অসীম ক্লান্তির ছাপ চোখের দৃষ্টিতে সে আর যেন জীবনের ভার বইতে পারছে না। অ্যামিয়াস ক্রেল এই মেয়েটিরই ছবি এঁকেছিলেন।
এলসা ডিটিশাম বললেন, আপনার বইয়ের কথা শুনি, বলুন। লিখছেন কেন, কি উদ্দেশ্যটা।
কি বলি বলুন তো…সাড়া জাগানো অতীতের ঘটনাকে বর্তমানের মাদক রসে জারিত করে পরিবেশন করা ছাড়া আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
কিন্তু লেখক তো আপনি নন? না অপরাধতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ।
তার মানে লেখকরা অপরাধ সংক্রান্ত বই লিখতে গেলে পরামর্শ নেন আপনার?
সব সময়ে না। দায়িত্ব এক্ষেত্রে কাঁধে চেপেছে।
কে চাপিয়েছে?
মানে, একজনের ইচ্ছাপূরণ করার জন্যেই বলা যেতে পারে যে বইটা প্রকাশ করার চেষ্টা চলছে।
সেই একজন কে?
মিস কার্ল লেমারচেন্ট।
মেয়েটি কে?
অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন ক্রেলের মেয়ে।
এলসা একমুহূর্ত চেয়ে রইলেন হাঁ করে, ও হা, মেয়ে একটা ছিলো বটে। মনে পড়ছে। তা এখন সে তো বড় হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, একুশ বছর।
দেখতে কেমন হয়েছে?
বেশ লম্বা, গাঢ় রং মার মত সুন্দরী এবং সাহস আর ব্যক্তিত্ব তার দুইই আছে।
একটু চিন্তা করে এলসা বললেন, দেখা করতে ইচ্ছে করছে ওর সঙ্গে।
আপনার সঙ্গে মেয়েটি দেখা না করতে চাইতে পারে।
চমকে উঠলেন এলসা। কেন? ও বুঝেছি। বাজে ব্যাপার যতোসব। ওর মনে তো ওসব কথা না থাকাই উচিত। ওর বয়স তখন তো দু বছরেরও বেশি ছিলো না।
জানে মেয়েটি তার মায়ের বিচার হয়েছিলো তার বাবার হত্যাকারী হিসেবে।
আর ধারণা ওর আমারই দোষটা?
সেটাই তো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
কাঁধ নাচালেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে, কখনো এরকম বেওকুফির কথা শুনিনি। যদি সামান্য বুদ্ধি দিয়ে ক্যারোলিন কাজ করতো…।
তাহলে আপনার কোনো দায়িত্ব নেই আপনি বলছেন।
কেনই বা থাকবে? আমি লজ্জা পাবার মতো কিছুই করিনি। আমি ভালোবাসতাম অ্যামিয়াসকে, ওকে চেয়েছিলাম সুখী করতে।
এলসা দূর মনস্কের মতো তাকালেন পাল্টে গেলো মুখের ভাব। ছবির এলসা গ্ৰীয়ারের চেহারাটা পোয়ারোর সামনে ভেসে উঠলো। বলে উঠলেন হঠাৎ, আপনাকে যদি দেখতে পারতাম; ব্যাপারটা যদি আপনি আমার তরফ থেকে দেখেন, তাহলে দেখতেন…।
ঝুঁকে বসলো পোয়ারো আর আমি ঠিক সেইটাই করতে চাই। এই দেখুন না, মিঃ ফিলিপ ব্লেক, তখন তো উনি বর্তমান ছিলেন, উনি তখনকার একটা খুঁটিনাটি বিবরণ কষ্ট করে লিখে দিচ্ছেন আমাকে। মিঃ মেরিডিথ ব্লেকও দেবেন বলেছেন। আপনি এখন যদি…।
এলসা ডিটিশাম জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন, ওই দুজন! এক নম্বরের হাঁদা ছিলেন ফিলিপ আর সব সময়ে ক্যারোলিনের পাশে ঘুর ঘুর করতেন মেরিডিথ। তবে ভালো মানুষটি। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে ওঁদের লেখা থেকে কিছুই আপনি জানতে পারবেন না।
লক্ষ্য করতে লাগলো পোয়ারো। এলসার মধ্যে কীভাবে আবার সঞ্চার হচ্ছে প্রাণের, জ্বলজ্বল হয়ে উঠছে চোখ দুটো। হঠাৎ বললেন ভয় পাইয়ে দেবার মতো করে, আপনি সত্যি কথাটা জানতে চান? না, না, বই লেখার জন্য নয়, শুধু নিজের জন্যে আপনার…।
কিছুই প্রকাশ করা হবে না আপনার বিনা অনুমতিতে।
আমার নিজেই সত্যি কথাটা লিখতে ইচ্ছে করছে; উত্তেজিত হয়ে উঠলেন বলতে বলতে এলসা ডিটিশাম, যদি পুরোনো দিনের কথা লিখতে হয়…লিখবো…দেখাবো আপনাকে যে খুন করেছিলো ক্যারোলিনই। বাঁচতে চাইতো অ্যামিয়াস। উপভোগ করতে চাইতো জীবনটা। ঘৃণা কখনই ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠা উচিত নয়। অথচ এটা হয়েছিলো ক্যারোলিনের ক্ষেত্রে এবং আমিও ঘৃণা করি ওকে এর জন্যে…ঘৃণা করি…ঘৃণা করি…।
পোয়ারোর কাছে উঠে এলেন এলসা, চেপে ধরে কোটের হাতটা, বললেন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন আপনি…আপনাকে করতেই হবে। আমি অ্যামিয়াস–আমরা ভীষণ ভালোবাসতাম দুজন দুজনকে…একটা জিনিস আপনাকে দেখাচ্ছি দাঁড়ান।
একটা ঘরের কোণের টেবিলের দেরাজ টেনে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা চিঠি গুপ্ত খোপ থেকে নিয়ে এলেন এলসা। বিবর্ণ হয়ে গেছে কালিটা। উদ্ধত, প্রতিহিংসাপরায়ণা একটি মেয়ের মতো মুখ ভার করে পোয়ারোর হাতে গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এলসা ডিটিশাম।
পোয়ারো খুললো চিঠিটা। এলসা-স্বপ্নের খুকু সোনা আমার। পৃথিবীতে বোধহয় তোমার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। কিন্তু আমি তবুও ভয় পাচ্ছি–অনেক বয়স হয়ে গেছে আমার-মাঝ বয়সী আমি একটা রাগী মানুষ স্থিরতা বলতে আমার মধ্যে কিছুই নেই। ভরসা রেখো না আমার ওপর, বিশ্বাস করো না আমাকে–আমি ভালো নই একটুও–শুধু ছবি আঁকা ছাড়া। ওটাই একমাত্র ভালো দিক আমার। অতএব তুমি কোনোদিনও বলতে পারবে না আমাকে যে তোমাকে সাবধান করে দিইনি।
রূপসী আমার যাই হোক না কেন, আমার চাই-ই তোমাকে, প্রয়োজনে যে আমি শয়তানের দ্বারস্থ হতেও রাজী তা জানো নিশ্চয়ই তুমি। এমন একটা ছবি আঁকবো তোমার যাতে মাথা ঘুরে যাবে মাথামোটা মানুষগুলোর,আমি পাগল তোমার জন্যে–ঘুমোতে পারছি না, ভালো লাগছে না খেতে।
এলসা…এলসা..এলসা…চিরকালের জন্যে আমি তোমারই…আমি মৃত্যুতেও তোমার। অ্যামিয়াস।
ষোল বছর আগেকার লেখা, বিবর্ণ হয়ে গেছে কালি, ছিঁড়ে পড়ার জোগাড় পাতাটা, অথচ জীবন্ত ভাষাটা, যেন থরথর করে কাঁপছে প্রাণশক্তিতে…
পোয়ারো তাকালো এলসার দিকে, কিন্তু না, কোনো নারীকে চোখের সামনে দেখতে পেল না। দাঁড়িয়ে আছে তার বদলে প্রেমে পড়া একটি বালিকা। আবার পোয়ারোর মনে পড়ে গেলো জুলিয়েটের কথা।
.
নবম অধ্যায়
কিছুই জোটেনি এই ছোট্ট শূয়োর ছানার–
কিন্তু কেন, মিঃ পোয়ারো তা কি জানতে পারি আমি?
কি উত্তর হওয়া উচিত প্রশ্নটার পোয়ারো চিন্তা করতে লাগলো, একজোড়া ধূসর রঙের তীক্ষ্ণ চোখ যে লক্ষ্য করে চলেছে তাকে এটা বুঝতে পারছিলো।
পোয়ারো বিরাট একটা ফ্ল্যাট বাড়ির ওপর তলায় এসেছে। এখানে ছোট্ট ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাট। ঐ এক চিলতে ঘরের মধ্যে রান্না করা, খাওয়া-বসা, শোয়া, সবই করা হয়। এতো সুন্দর করে তারই মধ্যে সাজিয়ে রেখেছেন, যে মনে মনে মিস সিসিলিয়া উইলিয়ামসকে তারিফ না করে পোয়ারো থাকতে পারলো না। সুন্দর রঙ লাগানো। দেওয়ালে কিছু নাম করা ছবির কপি ঝুলছে। পারিবারিক ফটোও আছে, তবে ঝাপসা হয়ে এসেছে সেগুলো।
কার্পেট, ফার্নিচার সবেরই দৈন্যদশা, সিসিলিয়া উইলিয়ামস খুব অভাবের মধ্যে আছেন বুঝতে অসুবিধে হলো না।
আবার তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো মিস উইলিয়ামসের, আমার যা মনে আছে ক্রেল মামলা সম্বন্ধে সেটা জানতে চান আপনি? কিন্তু কেন?
এরকুল পোয়ারো সম্বন্ধে তার বন্ধু-বান্ধবদের ধারণা যে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে তার ডাহা মিথ্যে কথা বলতে বাধে না। অথচ সে অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিলো এক্ষেত্রে। মিস উইলিয়ামস হলেন সেই ধরনের জবরদস্ত ইংরেজ গভর্নেস যারা অসাধারণ এক কর্তৃত্বের অধিকারী। এবং অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়া তাদের যায় না।
ফলে বই লেখার মিথ্যে কথাটা পোয়ারো না বলে আসল উদ্দেশ্যটা সরাসরি সংক্ষেপে বললেন।
মিস উইলিয়ামস মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন, খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার কথা শুনতে, কেমন হয়েছে ও, কতো বড়টি হয়েছে জানতে ইচ্ছে করছে।
দেখতে হয়েছে ভারী সুন্দর, সাহস আর মানসিক দৃঢ়তাও সমান আছে।
ভালো, মিস উইলিয়ামস সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
জেদীও আছে একটু, একবার ধরে যেটা তার শেষ না দেখে ছাড়ে না।
গভর্নেস চিন্তা করতে করতে প্রশ্ন করলেন, শিল্পীভাব ওর মধ্যে আছে কি?
মনে হয় না।
মিস উইলয়ামস নীরস ভাবে বললেন, একটা ব্যাপারে অন্ততঃ থাকা গেলো নিশ্চিন্ত।
যে মহিলার শিল্পীদের সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব আছে সেটা বোঝা গেল এই কথা থেকে।
আবার একটু থেমে বললেন, মনে হচ্ছে আপনার বর্ণনা থেকে তার মায়ের মতোই দেখতে হয়েছে।
খুব সম্ভব। আপনি হয়তো ওকে দেখলে বলতে পারবেন। দেখতে চান নাকি?
দেখতে তো নিশ্চয়ই চাই। চেনাজানা মেয়ে এককালের এখন কতো বড়ো হয়ে উঠেছে দেখতে মন চায় বৈকি। যখন শেষ দেখি ওকে তখন ওর বয়েস মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। দেখতে ছিলো ভারী মিষ্টি, শান্ত, বড় বেশি খেলনা নিয়ে খেলতো নিজের মনে। নিষ্পাপ, সরল শিশু ছিলো।
বলতে হবে ভাগ্য ভালো, তার ভীষণ কম ছিলো বয়েসটা, তা না হলে সহ্য করতে পারতো না ঐ মানসিক আঘাতটা। কিন্তু একটা ঘটেছে ও এটা বুঝতে পেরেছিলো। তবে নিশ্চয়ই সঠিকভাবে কিছুই জানতে পারেনি। বাচ্চাদের পক্ষে ওগুলো তো সুখের নয়।
মিস উইলিয়ামস বললেন, যতোটা ভাবছেন আপনি ততোটাতো নাও হতে পারতো।
কার্লা লেমারচেন্ট…আলোচনা ছোট্ট কার্লা ক্রেলের বিষয়টা নিয়ে শেষ করার আগে একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করবো যদি কেউ বলতে পারে তা আমার ধারণা তবে সে আপনিই।
বলুন? জানবার ইচ্ছেটা প্রবল কথার মধ্যে।
পোয়ারো নিজের বক্তটাকে বোঝাবার জন্যে হাত নেড়ে বলতে শুরু করলো, একটা খুব মুগ্ধ তারতম্য আছে, তবে আমি তা ঠিক মতো বুঝতে পারি না।
বুঝতে পারি কালার কথা বলার সময় সব কথা বলে উঠতে পারছি না ঠিকমতো। অপর পক্ষের কাছ থেকে মেয়েটার প্রসঙ্গ উঠলে তেমন সাড়াও পাই না, না মনে করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত ঠিক মতো যেন না চিনতেও পারে। অথচ ঠিক নয় এটা তো। মেয়েটা এসব ক্ষেত্রে নিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তেমন না হলেও পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে সবকিছুর মূলে। পরিত্যাগ করা স্ত্রীকে বা পরিত্যাগ করতে না চাওয়ার পেছনে নিজস্ব কারণ থাকতে পারে অ্যামিয়াস ক্রেলের কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের সাধারণ ক্ষেত্রে খুব বড় হয়ে ওঠে বাচ্চা ছেলেমেয়ের প্রশ্নটা। অথচ মেয়েটাকে এক্ষেত্রে কেউ পাত্তাই দেয়নি, আমার কাছে এটা খুব আশ্চর্য মনে হয়েছে।
চট করে মিস উইলিয়ামস বলে উঠলেন, আপনি ঠিক মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটাই ধরতে পেরেছেন। মিঃ পোয়ারো আপনি ঠিক বলেছেন। আর একটু আগে সেইজন্যেই আমি বলছিলাম যে ভিন্নতর পরিবেশে কার্লাকে পাঠিয়ে দেওয়াটা ভালই হয়েছিলো একদিক দিয়ে। সাংসারিক জীবনে বড় হবার পর একটা কিসের অভাব থেকে যেতো তা না হলে।
বেশ সতর্ক হয়ে একটু ঝুঁকে বসে আবার শুরু করলেন বলতে মিস উইলিয়ামস, কর্মসূত্রে স্বাভাবিক ভাবেই মা-বাবা আর ছেলেমেয়েদের দেখতে হয়েছে নানা সমস্যার দিক আমাকে। বহু ছেলেমেয়ে বরং বলা উচিত ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ মা-বাবার কাছ থেকে আদর শাসন পেয়ে থাকে মাত্রাতিরিক্ত। ওদের ওপর বড় বেশি নজরদারি করা হয়, আদরের অত্যাচার হয় বড় বেশি। তাই তারা এই স্নেহ বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্তি চায়। অলক্ষ্যে থাকতে চায় সবার। আর তো কথাই নেই এক সন্তান হলে, তাদের বড় বেশি ক্ষতি করে ফেলে মায়েরা। স্বামীর সঙ্গে তারা ঠিক পরবর্তীকালে মানিয়ে চলতে পারে না, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বোধ হয় একটু অবহেলার মধ্যে মানুষ হলেই ভালোভাবে গড়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের মনের স্বাস্থ্য। বড় পরিবারের মধ্যে এটা দেখা যায়, আর ততো ভালো নয় যাদের অবস্থা, সব সময়ে মা-বাবারা ব্যস্ত থাকেন কাজে, ভালোবাসারও ঘাটতি হয় না সন্তানদের প্রতি।
আবার আছে অন্যদিকও। দেখা যায় অনেক সময় নিজেদের নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে। স্বামী-স্ত্রীরা যে সময়ই পায় না সন্তানের দিকে নজর দেবার। ছেলেমেয়েরা সে সব ক্ষেত্রে মনে করে যে তাদের পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মিঃ পোয়ারো একটা কথা কিন্তু মনে রাখবেন অবহেলার কথা আমি বলছি না, ধরা যাক মিসেস ক্রেলের কথা, সহজে দেখা যায় না ওরকম মা, ভীষণ ভালোবাসতেন কার্লাকে, তার যত্ন করতেন, দেখতেন খাওয়া-দাওয়া, খেলতেন, গল্প করতেন ওর সঙ্গে। অথচ অজ্ঞান ছিলেন স্বামী বলতে, সবচেয়ে বড় অংশটা স্বামীই তাঁর জীবন থেকে গ্রাস করে নিয়েছিলেন। যেন শুধু তার স্বামীর জন্য উনি বেঁচে থাকতেন আর নিজেকে স্বামীর মধ্যেই খুঁজে পেতেন। আবার একটু থেমে বললেন, মনে হয় আর যা পরে উনি করেছিলেন সেটা প্রমাণ করে আমার কথাই।
পোয়ারো বললো, ওদের মধ্যে তার মানে স্বামী-স্ত্রীর বদলে প্রেমিক-প্রেমিকার ভাবটাই থাকতো বড় হয়ে।
মিস উইলিয়ামস যেন এই ধরনের কথায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন, হ্যাঁ চাইলে বলতে পারেন সে কথা। ভীষণ ভালোবাসতেন স্বামী-স্ত্রী দুজন-দুজনকে। তবে হাজার হোক স্বামীরা পুরুষ মানুষ তো।
যেমন করে ধনীরা বলশেভিক বলে, যেভাবে পুঁজিপতি বলে খাঁটি কমুনিস্টরা, ঠিক সেই রকম পুরুষ মানুষ কথাটা উচ্চারণ করলেন ঘৃণার সুরে সিসিলিয়া। আজীবন কুমারী থেকে গভর্নেস হিসেবে জীবন কাটিয়ে যাওয়ার ফলে তার যে অনীহা আছে পুরুষ জাত সম্বন্ধে এটা বোঝা যায় ঐ কথাটা শুনে।
পুরুষদের আপনি পছন্দ করেন না, না।
মিস উইলিয়ামস বিরস ভাবে বললেন, যা কিছু ভালো পৃথিবীর সব পুরুষদের ভোগে লাগে।
তবে চিরকাল তো আর এরকম চলতে পারে না।
পোয়ারো বললো মিস উইলিয়ামসের চরিত্রের গভীরতর দিকটা ভালোভাবে বোঝাবার জন্যে, আপনি আমিয়াস ক্রেলকে পছন্দ করতেন না?
করতামই না পছন্দ তো, বরদাস্ত করতাম না মিঃ ক্রেলের আচরণও। বহুকাল আগেই ওঁর স্ত্রী হলে আমি ছেড়ে ওঁকে চলে আসতাম। ব্যাপার আছে কতগুলো যা মেনে নিতে পারে না মেয়েমানুষেরা।
কিন্তু মেনে নিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল তো?
হা।
তবে উনি কি ভুল করেছিলেন? হা করেছিলেন। মেয়েমানুষের কিছুটা আত্মসম্মান থাকা উচিত, সহ্য করা যায় না অপমান।
মিসেস ক্রেলকে কি আপনি এই ধরনের কোনো কথা বলেছিলেন?
না। আমার সেরকম কোনো অধিকার ছিলো না। আমায় চাকরী দেওয়া হয়েছিলো অ্যাঞ্জেলাকে পড়াবার জন্যে মিসেস ক্রেলকে উপদেশ দেবার জন্যে নিশ্চয়ই নয়।
আপনার পছন্দ হতো মিসেস ক্রেলকে?
ভালোবাসতাম ভীষণ, গলার সুর কেতাদুরস্ত দক্ষ গভর্নেসের নরম হয়ে এলো, ফুটে উঠলো স্নেহ ভালোবাসার আদ্রা। ওঁকে ভীষণ ভালোবাসতাম, ভীষণ দুঃখও হয়।
আপনার ছাত্রীকে–অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন?
যতো ছাত্রী ছিলো আমার তাদের মধ্যে ও সবার সেরা ছিল। বুদ্ধিমতী খুব, একটু রগচটা, বেপরোয়া, ওকে অনেক ব্যাপারে মনের মতো চালোনা করে যেতো না। তবে অমন অসাধারণ মেয়ে চরিত্রের দিক দিয়ে দেখা যায় না।
আবার বললেন একটু থেমে, সব সময়ে আমার আশা ছিল বিরাট একটা কিছু করবে। এবং করেওছে। ওর সাহারা সম্বন্ধে লেখা বইটা কি আপনি পড়েছেন? অ্যাঞ্জেলা ফাইয়ুমে খোঁড়াখুঁড়ি করে আবিষ্কার করেছে কিছু প্রাচীন সমাধি মন্দিরও। আমার গর্ব হয় এর জন্যে। অ্যাল্ডারবেরিতে আমি ছিলাম মাত্র আড়াই বছর। ঐটুকু সময়ের মধ্যে মনে হয় পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধে আমি ওর আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলাম।
আচ্ছা, যখন স্কুলে পাঠানোর কথা হয়েছিলো ওকে নিশ্চয়ই আপনি বাধা দিয়েছিলেন? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
মিঃ পোয়ারো আদৌ না। বরং প্রস্তাবটাকে আমি পুরোপুরি সমর্থন করেছিলাম। …ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বলি আপনাকে। অত্যন্ত ভালো ছিলো অ্যাঞ্জেলা মেয়েটি। মন ওর খুব ভালো ছিলো, তবে সে চলতো একটু ঝোঁকের মাথায়। আর অবাধ্য ছিলো বড় বেশি, তবে কোনো কিছু মেনে চলতে চায় না ওই বয়সটাই তো। মেয়েরা কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে খুব অস্থির থাকে নিজের সম্বন্ধে। তাই ছিলো অ্যাঞ্জেলাও, সে কখনো গম্ভীর আর পর মুহূর্তেই দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে বাচ্চার মতো। স্কুলে যাওয়াটা খুব ভালো এই বয়সে। নিজের মতো আরো অনেকের সংস্পর্শে এসে বেশ ভদ্র হয়ে ওঠে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। বাড়ির পরিবেশ নিশ্চয়ই অ্যাঞ্জেলার ভালো ছিলো না। মিসেস ক্রেল অতি আদর দিয়ে বিগড়ে দিয়েছিলেন মাথা। ফলে সব সময় অ্যাঞ্জেলাও তার দিদিকে ধরে থাকতো আঁকড়ে। আর মিঃ ক্রেল সহ্য করতে পারতেন না এই ব্যাপারটাই। মিঃ ক্রেল চাইতেন স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সোল আনা ভালোবাসা নিজের একান্ত করে পেতে। মিঃ ক্রেলও খুব স্নেহ করতেন অ্যাঞ্জেলাকে এটাও ঠিক। সম্পর্ক এমনিতেই ভালোই ছিলো, মিসেস ক্যারোলিন ক্রেলকে নিয়ে ঝাট হতো। অভিযোগ করতেন অ্যাঞ্জেলা আর মিঃ ক্রেল দুজনেই অন্যজনের ওপর মিসেস ক্রেল পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন। মিঃ ক্রেলও সব পুরুষদের মতো ছিলেন অত্যন্ত জেদী আর খেয়ালী, সবাই ওঁকে নিয়ে হৈহৈ করুক ওঁর ইচ্ছে। অ্যাঞ্জেলার সাথে মাঝে মাঝে ওর ঝগড়া লাগলে, মিসেস ক্রেল আগলাতেন তার বোনকেই। ফলে মিঃ ক্রেল আরও চটতেন। আবার অ্যাঞ্জেলা কেঁদেকেটে একাকার করে দিতে স্বামীকে সমর্থন করলে। কখনো কখনো মিঃ ক্রেলের বিয়ারে দুষ্টুমী করে মিশিয়ে রাখতো নুন, বিছানায় ছেড়ে দিত এক গাদা গুগলি শামুক। মিঃ ক্রেল শেষ ঘটনাটা ঘটার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন স্কুল বোর্ডিংয়ে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাতেই হবে। অ্যাঞ্জেলা আগে নিজের থেকেই বলেছিলো স্কুলে যাবার কথা, কিন্তু কান্নাকাটি শুরু করে দেয় এবারে খুব ভয় পেয়ে। স্কুলে পাঠাতে রাজী ছিলেন না মিসেস ক্রেল, আমি খুব করে বোঝতে দিলেন মত। অ্যাঞ্জেলারই যে ওতে মঙ্গল হবে একথা শোনার পর দক্ষিণ উপকূলের বিখ্যাত হলস্টন স্কুলে পাঠাতে মিসেস ক্রেল রাজী হয়েছিলেন। তবে প্রসন্ন ছিলেন
মনে মনে, আর তো পাগল হয়ে উঠেছিলো অ্যাঞ্জেলা। একটা চাপা রাগের স্রোত বইছিলো ওই তিনজনের মধ্যে, মানে ঐ ঘটনাকে নিয়ে।
তার মানে এলসা গ্ৰীয়ার? জানতে চাইলো পোয়ারো।
সঙ্গে সঙ্গে মিস উইলিয়ামস বললেন ঝাঝালো ভাবে ঠিক তাই। এবং ঠোঁট বন্ধ করলেন কথাটা বলেই।
আপনার কি ধারণা এলসা গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে?
আদৌ আমার কিছু বলার নেই। সম্পূর্ণ নীতি-জ্ঞানহীন যুবতী মাত্র।
ছিলেন তো খুবই কম বয়সী? নিশ্চয়ই বোঝবার মতো বয়স ছিলো। কোনো অজুহাত ওঁর তরফ থেকে ছিলো না। থাকার কথাও নয়। মিঃ ক্রেলকে তো ভালোবাসতো মেয়েটি। মনে হয় আমার…
দুম করে কথার মাঝখানে বলে উঠলেন মিস উইলিয়ামস, তা প্রেমে পড়েছিলেন বটে। আমাদের হৃদয়বৃত্তি মিঃ পোয়ারো যাই হোক না কেন, ভীষণ জরুরী নিজের কর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা। নীতিটিতির বালাই ছিলো না মেয়েটির। উনি একেবারেই ভেবে দেখেননি যে মিঃ ক্রেল বিবাহিত, নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্যে নির্লজ্জের মতো ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে চলেছিলেন। ঠিক মতো শিক্ষাদীক্ষা ওঁকে ছোটবেলায় দেওয়া হয়নি এছাড়া আর কোনো যুক্তিই তো খাড়া করা যায় না।
উনি নিশ্চয়ই মিঃ ক্রেলের মৃত্যুতে খুব আঘাত পেয়েছিলেন।
পেয়েছিলেন তা। তবে ওই মেয়েটিকেই দায়ী করা যায় সব কিছুর জন্য। খুন যে উনিই করেছেন তা বলছি না। তবে তাই দাঁড়ায় ব্যাপারটা। ইচ্ছাকৃতভাবেই কোণঠাসা করা হয়েছিলো ক্যারোলিন ক্রেলকে। আপনাকে ভোলাখুলি ভাবেই বলছি মিঃ পোয়ারো, আমার ইচ্ছে হতো মাঝে মাঝে খুন করে ফেলি দুজনকেই। অন্য মেয়ের স্ত্রীর সামনে প্রশ্রয় দেওয়া ঐ মেয়েটা বড় বেশি নির্লজ্জও ছিলো। অ্যামিয়াস ক্রেলের শাস্তিটা সত্যি কথা বলতে কি ঠিকই হয়েছিলো। যারা ঐ ধরনের ব্যবহার করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঐ রকমই পরিণতি হয়।
দৃঢ়ভাবে কী আপনি বিশ্বাস করেন… মিস উইলিয়ামস ঝাঝালো গলায় বলে উঠলেন পোয়ারোর কথার মাঝখানে, দৃঢ়ভাবেই আমি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাকে বিশেষ মর্যাদা দিই। দেশের সমাজের অধঃপতন হয় এটা না করলে। সত্যি সত্যিই মিসেস ক্রেল ভীষণ ভালোবাসতেন স্বামীকে এবং কখনো অবিশ্বাসের কাজ করেননি। অথচ স্বামী তারই সামনে নিজের প্রেমিকাকে বাড়িতে এনে তুলছেন। যেন বড় বেশি চাপ দেওয়া হয়েছিলো স্ত্রীর ধৈর্য্যের ওপর, এবং স্বামীকে তার ফল ভোগ করতেও হলো।
আপনি ঠিক বলেছেন, কাজটা মিঃ ক্রেল ভালো করেননি, কিন্তু উনি যে একজন নামকরা শিল্পী তা মনে রাখতে হবে।
উইলিয়ামস গরগর করে উঠলেন রাগে, হা, হা জানি তা, সবাই আজকাল দেখাতে চায় এই অজুহাতটা। মদ খাওয়া, চেঁচামেচি করা, অসৎ হওয়া দাম্পত্য জীবনে এইসব বেহিসেবী বেলেল্লাপনার জন্যে সুন্দর পথ আর কি সাফাই গাইবার। যাই বলুন না কেন বিচার করলে সবকিছু জানা যায় উনি কী ধরনের শিল্পী ছিলেন। ওঁর ছবি নিয়ে দু-চার বছর হৈ হৈ করা যায়। আর নয় তারপর। আরে উনি ছবি আঁকতেই জানতেন না। ফ্লোরেন্সে আমি একসময় ছবি আঁকা শিখেছিলাম কয়েকবছর। আমি পরিচিত বড় বড় শিল্পীদের হাতের কাজের সঙ্গে। না…আর যাই বলুন মিঃ পোয়ারো আমায় মিঃ ক্রেলের ছবির প্রশংসা করতে বলবেন না।
স্টেট গ্যালারীতে কিন্তু দুটো ছবি আছে, মনে করিয়ে দিলো পোয়ারো।
নাক সিটকালেন মিস উইলিয়ামস, থাকতে পারে। শিল্পী এপস্টেইনের তৈরি একটা মূর্তি তো ওখানে আছে। তাতে কি হয়েছে?
বুঝে নিলো পোয়ারো আর আলোচনা করে লাভ নেই শিল্প নিয়ে, তার চুড়ান্ত মতটা মিস উইলিয়ামস জানিয়ে দিয়েছেন। পাল্টালো সে প্রসঙ্গ।
যখন মিসেস ক্যারোলিন ক্রেল তার স্বামীর দেহটাকে দেখেছিলেন আপনি তখন তো ওঁর সঙ্গে ছিলেন।
হ্যাঁ,আমি আর মিসেস ক্রেল দুজনে দুপুরের খাওয়ার পর একসঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। স্নান সারার পর ওর সোয়েটারটা অ্যাঞ্জেলা হয় সমুদ্রের তীরে বা নৌকোর ওপর এসেছিলো ফেলে। মেয়েটি বড় অসাবধানী ছিলো নিজের জিনিসপত্র সম্বন্ধে। একসঙ্গে কামান বাগানের দরজার কাছে পর্যন্ত এসে সমুদ্রের দিকে দু-চার পা এগিয়েছি আমি, আমাকে মিসেস ক্রেল ডাকলেন। ইজেলের কাছে বেঞ্চের ওপর গিয়ে দেখি মিঃ ক্রেল এলিয়ে পড়ে আছেন, প্রাণ বেরিয়ে গেছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে।
উনি কি ওটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন?
মিঃ পোয়ারো আপনার প্রশ্নের মানেটা ধরতে পারছি না ঠিক মতো? তবে হ্যাঁ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল। বললেন আমাকে ডাক্তার ডাকতে টেলিফোন করে। সত্যিই যে উনি মারা গেছেন এটা স্পষ্টভাবে তখনো পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারিনি।
আর টেলিফোন করতে গেলেন আপনি?
আমার মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে দেখা হয় কিছুটা দূর যাবার পর। তাকে টেলিফোন করার ভারটা দিয়ে মিসেস ক্রেলের কাছে আমি আবার ফিরে এলাম। আশংকা হচ্ছিলো আমার উনি অজ্ঞান-টজ্ঞান না হয়ে যান।
মিস উইলিয়ামস শুকনো গলায় বললেন, নিজেকে উনি বেশ শান্ত সংযত করেই রেখেছিলেন, কান্নাকাটি করে এলসা গ্রীয়ারের মতো পাগলামি করেননি।
পাগলামি কি ধরনের? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।
মিসেস ক্রেলকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন মিস এলসা গ্ৰীয়ার।
উনি তার মানে বুঝতে পেরেছিলেন যে অ্যামিয়াস ক্রেলের মৃত্যুর জন্যে মিসেস ক্ৰেলই দায়ী?
মিস উইলিয়ামস কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, না মনে হয় না তা। তখন পর্যন্ত এ সন্দেহটা জাগেনি। চেঁচিয়ে মিস গ্ৰীয়ার বলে উঠেছিলেন, ক্যারোলিন এসব কর্ম তোমার। ওকে তুমি মেরেছো। তোমারই দোষটা। কিন্তু স্পষ্টভাবে একথা বলেননি যে ওকে বিষ। দিয়েছো তুমি। তবে মনে হয় আমার এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিলো না মিস গ্রীয়ারের মনে।
আর মিসেস ক্রেল? একটু যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন মিস উইলিয়ামস, মিঃ পোয়ারো আমার পক্ষে কি অতোটা বাড়াবাড়ি করা ভালো হবে? মিসেস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে কি ভাবছিলেন তা আমার পক্ষে জানা কি সম্ভব?
উনি কি দারুণ ভয় পেয়েছিলেন নিজের কৃতকর্মের ফলে…? ও রকম কিছু মনে হয়েছিলো কি?
না-না…ঠিক ভাবে বলতে পারবো না তা হয়েছিলো কিনা, তবে হতভম্ব হয়ে গেলেন বলা চলে ভয় পেয়েছিলেন। হ্যাঁ, ভয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক তো সেটাই।
পোয়ারোর যেন কথাটা পছন্দ হলো না, বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয় স্বাভাবিক সেটাই…প্রকাশ্যে কী ধরনের মনোভাব দেখিয়েছিলেন স্বামীর মৃত্যু সম্বন্ধে মিসেস ক্রেল?
আত্মহত্যা, এটা আত্মহত্যার ঘটনা উনি বলে আসছিলেন প্রথম থেকেই।
একান্তে আপনার সঙ্গে কথা বলার সময়েও কি ঐ কথা বলেছিলেন তিনি, না প্রকাশ করেছিলেন অন্য কিছু অভিমত?
না, আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন উনি আমাকে বোঝাতে যে আত্মহত্যা ছাড়া ওটা আর কিছুই নয়। একটু বিব্রত দেখে মিস উইলিয়ামসকে দুম করে প্রশ্ন করে বসলো পোয়ারো, আচ্ছা আপনি কি বলেছিলেন এ ব্যাপারে?
মিঃ পোয়ারো সত্যিই কি কোনো দাম আছে আমার মতামতের?
আমি তো মনে করি আছে…। এমন কিছু একটা ছিলো পোয়ারোর কথার মধ্যে যার ফলে ইতস্তত করতে করতে মিস উইলিয়ামস বললেন, আমি বলেছিলাম মনে হয়, মিসেস ক্রেল নিশ্চয়ই, এটা আত্মহত্যারই ঘটনা।
আপনি কি নিজের বক্তব্যটা বিশ্বাস করেছিলেন?
মিস উইলিয়ামস হঠাৎ শক্ত করে উঁচু করলেন মাথাটা, বললেন, না, করিনি। কিন্তু মিঃ পোয়ারো একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন, সব সময়েই আমি ছিলাম মিসেস ক্রেলের দিকে। সহানুভূতি দেখাবার প্রশ্ন উঠলে সেটা পুলিশের দিকে না গিয়ে, যেভো মিসেস ক্রেলের দিকেই।
ছাড়া পান উনি, আপনি নিশ্চয়ই এটা চাইতেন?
হ্যাঁ, চাইতাম।
তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর মেয়ের মনের ইচ্ছে সম্বন্ধেও সহানুভূতি থাকবে আপনার।
আমি সব করতে পারি কার্লার জন্যে।
একটা বিশদ বর্ণনা দিতে কি ঐ দুর্ঘটনার আপত্তি আছে আপনার?
মানে ওটা কার্লা পড়বে? তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না আপত্তির। ওকি বদ্ধপরিকর পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে দেখবার জন্যে?
হাঁ, তবে অভয় দেন যদি তো বলি ওর কাছে সত্যটা গোপন রাখলেই ভালো হতো…।
মিস উইলিয়ামস বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, না, অনেক বেশি ভালো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোটা। দুঃখ এড়াবার জন্যে বিকৃত করার কোনো অর্থ হয় না সত্যকে। কার্লা নিশ্চয়ই প্রকৃত সত্যটা জেনে মর্মান্তিক ব্যথা পেয়েছে, বোধ হয় এখন জানতে চায় ঘটনার খুঁটিনাটি, সে সত্যিকারের বলিষ্ঠ মনের পরিচয়ই দিচ্ছে। ঠিকঠাক একবার জেনে নিলে ও এ নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারবে ভবিষ্যৎ জীবন।
পোয়ারো বললো, বোধ হয় আপনার কথাই ঠিক।
বোধ হয় না আমার কথাটাই ঠিক, মিস উইলিয়ামস বেশ জোর দিয়ে বললেন কথাটা।
কিন্তু একটা কথা, আরো একটু গুরুতর ব্যাপারটা। জানা শুধু নয়, ও চায় প্রমাণও যে ওর মা নির্দোষ।
বেচারী, করুণভাবে মিস উইলিয়ামস কথাটা বললেন।
আপনি তো ঠিক ঐ কথাটাই বললেন, তাই না মিস উইলিয়ামস?
ও তাই আপনি একটু আগে বলেছিলেন ভালো হতো ওর কাছে সত্যটা গোপন রাখলেই। তবে আমার মতে যা হয়েছে সবচেয়ে ভালো সেটাই। খুবই স্বাভাবিক মাকে নির্দোষ জানতে চাওয়াটা, আর সুস্পষ্টভাবে সত্যের স্বরূপ জানাটা যে বেশ কঠিন ব্যাপার তাও অজানা নয় আমার। তবে কার্লা নিশ্চয়ই আপনার কথানুযায়ী মনের জোর নিয়ে স্বীকার করে নেবে সত্যকে।
তাহলে সত্য এটাই যে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আপনার?
ঠিক মতো আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না যে?
এমন কোনো ফাঁক-ফোকর কি আপনি দেখতে পান না যা দিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করা যায় মিসেস ক্রেলকে।
সে রকম কোনো সম্ভাবনাকে আদৌ খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা তো করা হয়নি।
মহিলা তৎসত্ত্বেও ঐ আত্মহত্যা কথাটার ওপর জোর দিয়ে গেছেন বরাবর।
মিস উইলিয়ামস শুকনো গলায় বললেন, ওঁর তরফ থেকে এছাড়া আর বলার কিছু তো ছিলো না।
জানেন কি আপনি মিসেস ক্রেল মারা যাবার আগে যে চিঠিটা তার মেয়ের উদ্দেশ্যে লিখে রেখে গিয়েছেন, উনি তাতে নির্দোষ বলেছেন নিজেকে।
মিস উইলিয়ামস প্রায় কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠলেন, উনি খুব অন্যায় কাজ করে গেছেন।
তাই কি মনে হয় আপনার?
হা, হয়। আপনিও দেখছি বেশিরভাগ পুরুষের মতোই বড় বেশি আবেগপ্রবণ।
অসন্তুষ্ট হলো পোয়ারো, আবেগপ্রবণ নই আদৌ আমি।
অনেকেরই তো মিথ্যা ভাবপ্রবণতা থাকে। একটা ঐ রকম পবিত্র মুহূর্তে কি মিথ্যে কথা ওরকম লিখতে পারে? না লেখা উচিত, দুঃখ লাঘব করা মনের মেয়ের, হা, তা হয়তো অনেক মহিলা করতে পারেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না মিসেস ক্রেল তা করতে পারেন বলে। সাহস ছিলো ওঁর, সত্যবাদী তো বটেই। মেয়েকে যদি বিচার না করার উপদেশ দিয়ে যেতেন তাহলে মনে হয় সেটাই ঠিক হতো আমার মতো।
পোয়ারো একটু রাগতভাবে বললো, যা লিখে গেছেন ক্যারোলিন ক্রেল তা সত্যি কি না একথাটা বিচার করে দেখতেও কি চান না আপনি?
নিশ্চয়ই চাই না।
অথচ স্বীকার করেছেন আপনি যে ওঁকে ভালোবাসতেন আপনি?
বাসতাম। আমার ওঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর স্নেহ ছিলো।
তাহলে…।
মিস উইলিয়ামস অদ্ভুতভাবে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছেন না আপনি, আমি কি বলি না বলি আজ এতোকাল পরে সেটার কি কোনো মূল্য আছে? ধরুন যেমন, ক্যারোলিন ক্রেল যে অপরাধী আমি তা জানি।
কি বললেন? পোয়ারো চমকে উঠলো।
সত্যি কথাটা। সত্যি কথাটা তখন চেপে গিয়ে ভালো করেছিলাম কি মন্দ করেছিলাম সে কথা অবান্তর, তবে এটা সত্যি চেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কাছ থেকে এ কথাটা স্পষ্ট জেনে যান যে ক্যারোলিন ক্রেল অপরাধী আমি জানি…।
.
দশম অধ্যায়
উ…উ..উ কেঁদে উঠলো এই ছোট্ট শুয়োরছানাটি–
পরিষ্কার দেখা যায় অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের ফ্ল্যাট থেকে রিজেন্টস পার্ক। হু হু করে হাওয়া আসছে খোলা জানলা দিয়ে, ভয়ংকর গাড়ী ঘোড়ার শব্দ না থাকলে মনে হতো বসে আছি কোনো গ্রামাঞ্চলে।
পোয়ারো দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মুখ ফেরালো জানলা থেকে, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন ঘরে ঢুকছেন।
পোয়ারো এর আগেও অ্যাঞ্জেলাকে দেখেছে। অ্যাঞ্জেলার বক্তৃতা শুনেছে রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে। নীরস কিছু বিষয়টা হলেও পাণ্ডিত্য আর সুন্দর অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বক্তৃতা অসাধারণ করে তুলেছিলো সেদিনের পরিবেশকে। নেই দ্বিধা, পুনরাবৃত্তি নেই, জটিলতা নেই বক্তব্যে, উল্টে সামান্য বিষয়কেই অসামান্য করে তোলার ক্ষমতা মানবিকতার ছোঁয়ায় মহিলার আছে। শিক্ষিত মনের এই ধরনের মানুষ খুব পছন্দ পোয়ারোর।
খুব কাছ থেকে আজকে দেখার পর মনে হলো পোয়ারোর ঐ কাটা দাগটা মুখে না থাকলে অ্যাঞ্জেলাকে অসাধারণ সুন্দরী বলা যেতে পারে। নিখুঁত সৌষ্ঠবের সঙ্গে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোতে একটু শানিত ভাব আছে। চওড়া কাঁধটা আর কিছুটা পুরুষালি হাঁটার ভঙ্গীটা।
এমন কিছু নিশ্চয়ই নেই অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের মধ্যে যা দেখে মনে হতে পারে উউ করে কাঁদতে পারে এই ছোট্ট শুয়োর ছানাটি। কিন্তু ক্ষতচিহ্ন ডান গালের, কুঁচকানো দাগ পাশের চামড়াতে, খানিকটা বিকৃতি ডান চোখটার, বেশ খানিকটা সব মিলিয়ে সৃষ্টি করে রেখেছে বীভৎসতা। কেমন যেন মনে হলে পোয়ারোর, দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ফলে মহিলা সম্পূর্ণ উদাসীন নিজের বিকৃতি সম্বন্ধে। তদন্ত করতে গিয়ে এই ব্যাপারে যে পাঁচজন সম্বন্ধে কেন্দ্রীভূত হয়েছে তার আগ্রহ, প্রথম জীবনে তারা বেশ ভালোভাবে শুরু করলেও তেমন কোনো কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেননি পরবর্তী জীবনে। শুধু ব্যতিক্রম অ্যাঞ্জেলা। ধরা যাক প্রথমেই এলসা গ্ৰীয়ার, রূপ যৌবন, সম্পদ তার কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না। অথচ কীটদৃষ্ট কুঁড়ির মতোই অকালে ব্যর্থ হয়ে গেছে তার জীবন যৌবন। এরপর সিসিলিয়া উইলিয়ামস আসে, তার কোনো অহংকার নেই পার্থিব ধনসম্পদের। অথচ ভিক্টোরিয়ার আমলের শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ। এ বিষয়ে কোনো আক্ষেপও নেই সিসিলিয়ার মনে। সব সময় তিনি কর্তব্যে অটল, মনে ঈর্ষা, অসন্তোষ বা দুঃখ নেই কিছুই। উল্টে এমন মানসিকতা নিয়ে অনীহা দূরের কথা জীবন সম্বন্ধে যেন একটু কমেনি সব কিছুকে ভালোবাসার আগ্রহ।
আর এখন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের সামনে বসে আছে পোয়ারো। শারীরিক বিকৃতি নিয়ে জন্মের কিছুকাল পর থেকেই হেয় হয়ে থাকতে হতো যাকে সবার সামনে। কিন্তু আজ সে আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। সেই অবাধ্য ছোট্টবেলার দুষ্টু মেয়েটি এখন অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্না, পরিণত হয়েছেন বিদূষী মহিলায়। মনে হলো পোয়ারোর খুব সুখী আর সফল মহিলা।
পোয়ারো খুব একটা পছন্দ করে না এই ধরনের মহিলাদের। নারীসুলভ সূক্ষ্ম কোমলতার মিশেল ঘটেছে তীক্ষ্ণবুদ্ধির সঙ্গে। পোয়ারো বেশ উদ্দাম, চঞ্চলা, ময়ূরীর মতো বর্ণাঢ্য মহিলাদের বেশ ভালোবাসে।
পোয়ারো কার্লা লেমারচেণ্টের সঙ্গে সংক্ষেপে সাক্ষাৎকারের বিবরণ বললো।
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সেই ছোট্ট কালা, এখানেও এসেছে না কি? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে ওকে।
আপনি ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি, না?
উচিত ছিলো রাখা, রাখিনি, স্কুলে যাই আমি যখন, তখন ও চলে গিয়েছিলো কানাডাতে। মাঝে মাঝে দু-একবার বড় দিনের উপহার দেওয়া-নেওয়াই ছিলো একমাত্র যোগসূত্র আমাদের। ও নিশ্চয়ই এতদিনে খাপ খাইয়ে নিয়েছে কানাডার পরিবেশের সঙ্গে।
স্বাভাবিক এ রকম ধারণা করাটাই। নাম বদলানো, জায়গা পাল্টানো। নতুন জীবন, কিন্তু সব সময় তা হয় না বাস্তবে।
কার্লার সঙ্গে ধীরে ধীরে তার যোগাযোগ, মার চিঠি, ইংল্যান্ডে আসার উদ্দেশ্য পোয়ারো সব বললো।
একহাতে বিক্ষত গালটা চেপে একমনে ঘাড় কাৎ করে সব কথা শুনলেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, শান্তভাবে পোয়ারোর কথা শেষ হলে বললেন, ভালো কাজই করেছে কার্লা।
চমকে উঠলো পোয়ারো, এ ধরনের কথা সে এই প্রথম শুনলো। আপনি তাহলে কার্লাকে সমর্থন করছেন মিস ওয়ারেন?
নিশ্চয়ই। কামনা করছি ওর সাফল্যও। যা সাহায্য দরকার এর জন্যে আমি করবো। এ ব্যাপারে আমি নিজের থেকে কিছু করতে না পারার জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করি।
আপনি কি তাহলে মনে করেন একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কার্লার ধারণাকে? ঠিক ওর ধারণাটা?
নিশ্চয়ই। ও কাজটা ক্যারোলিন করেনি। জানতাম আমি, সে কথা এখনও জানি।
আপনার কথা শুনে আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। কথা বলেছি যার সঙ্গে, প্রত্যেকে তারা…।
অ্যাঞ্জেলা বাধা দিয়ে দুম করে বললেন, কান দেবেন না ওসব কথায়। ভীষণ জোরদার যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সাক্ষ্য প্রমাণগুলো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু আমার বিশ্বাসের মূলে আছে দিদি সম্বন্ধে আমার ধারণা। তাকে যতোদূর আমি জেনেছি, ওকাজ করতেই পারে না দিদি।
অতো জোর দিয়ে কি মানুষ সম্বন্ধে একথা বলা যায়?
হয়তো অনেক ক্ষেত্রে যায় না। অনেক রকমের চমক থাকে যে মানুষরূপী প্রাণীদের মধ্যে এ বিষয়ে আমি একমত আপনার সঙ্গে। কিন্তু বিশেষ কারণ আছে ক্যারোলিনের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি আমি।
অ্যাঞ্জেলা গালের দাগটা দেখিয়ে বললেন, দেখছেন এটা? মনে হয় এর কথাও শুনেছেন?
মাথা নাড়লো পোয়ারো, হা, ক্যারোলিনের কাজ এটা। আর আমি নিশ্চিতভাবে এই জন্যেই জানি, জানি যে খুন করতে ও পারে না।
অন্যদের কাছে কিন্তু আপনার যুক্তিটা ধোপে টিকবে না।
ঠিক বলেছেন, লোকে উল্টো ভাববে বরং। এবং সেই ভাবেই ঐ ঘটনাকে কাজে লাগানো হয়েছিলো। বদ মেজাজী যে ক্যারোলিন তারই প্রমাণ হিসেবে বার বার বলা হয়েছিলো ঐ ঘটনার কথা। যেহেতু ঐভাবে আমার মত বাচ্চা মেয়েকে আঘাত করতে পেরেছিলো, তাই খুন করাটা অবিশ্বাসী স্বামীকে তারপক্ষে সমানভাবে সম্ভব।
সূক্ষ্ম পার্থক্যটা যে আছে আপনার বক্তব্যে সেটা আর কেউ না বুঝুক বুঝতে পারছি আমি। প্রচণ্ড রগচটা যারা প্রথমে তাদের পক্ষে বিষ চুরি করা, পরে ঠান্ডা মাথায় কাউকে পরের দিন বিষ খাওয়ানোর ব্যাপারটা সু-যুক্তির কথা নয় খুব একটা।
অধৈর্য হয়ে উঠলেন অ্যাঞ্জেলা পোয়ারের কথায়, বললেন, আমি আদৌ ও কথা বলতে চাইনি। খুব সহজ করে দাঁড়ান বুঝিয়ে বলি আপনাকে আমার বক্তব্য। আপনি মনে করুন একজন সাধারণ স্নেহশীল, দয়ালু মানুষ। আবার তীব্র ঈর্ষাও থাকতে পারে আপনার মধ্যে। মনে করুন এমন একটা সময় এলো আপনার জীবনে যখন সংযত করে রাখা নিজেকে কঠিন, এমন তখন হতে পারে যে আপনি রাগের বশে এমন কিছু করে ফেলতে পারেন যা পড়ে খুনের পর্যায়ে। আপনার মনে তখন যে দুঃখ, শোক, অনুশোচনা আসবে একবার তার কথা ভাবুন। সহজে ক্যারোলিনের মতো কাতর মহিলার পক্ষে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন সেই দুঃখ আর অনুশোচনার হাত থেকে। এবং সে কখনো নিষ্কৃতিও পায়নি। আমি যে তখন একথা বুঝেছিলাম তা নয়, অতীতের কথা পরবর্তীকালে চিন্তা করে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। সব সময়ে আমাকে আঘাত করার ব্যাপারটা ওকে দগ্ধ করতে অনুশোচনায়। ও যেন অনুশোচনার হাত থেকে কখনো রেহাই পায়নি। চিরকালের মতো মনের শান্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। প্রতিটি ঘটনার মধ্যে আমার সঙ্গে তার ব্যবহারের সেই ভাবটা জড়িয়ে থাকতো সব সময়ে। ও অ্যামিয়াসের সঙ্গে আমার জন্যে ঝগড়া করতো। কখনো ও আমার দোষ ধরেনি। বরং ঈর্ষা বোধ করতাম আমিই। অ্যামিয়াসকে নানাভাবে উত্যক্ত করতাম। অ্যামিয়াসের বিছানায় একবার তো কাটাচুয়া রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যারোলিন প্রত্যেকবারই ঝগড়া করেছে। আমার হয়ে।
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, এ ধরনের কাজ আমার পক্ষে খুবই খারাপ ছিলো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। অবাধ্য হয়ে উঠেছিলাম ভীষণ আমি। কিন্তু এখন সে কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। তার কি প্রভাব পড়েছিলো ক্যারোলিনের ওপর তাই নিয়েই তো আলোচনা করছিলাম। আমরা মনের মধ্যে একবার সেই যে হিংসের ভাব জেগেছিলো ক্যারোলিনকে তার স্মৃতি সচেতন করে রাখতো সব সময়ে যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় ঐ ধরনের ঘটনার। এবং সতর্ক প্রহরায় নিজেকে রাখবার নিজস্ব পদ্ধতিও সে বের করে নিয়েছিলো। একটা হলো সেই পদ্ধতির মধ্যে ভাষার অসংযম। ও মনে করতো আমার ধারণা যে মনের রাগটা যদি প্রকাশ করে নেয় ভাষার মধ্য দিয়ে তাহলে কাজের মধ্য দিয়ে তা করার আর দরকার পড়বে না। এবং পদ্ধতিটা যে কার্যকর সেটা তার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে বুঝে নিয়েছিলো। ক্যারোলিনকে সেইজন্য মাঝে মাঝে বলতে শুনতাম এই ধরনের কথা, টুকরো টুকরো করে অমুককে কেটে আস্তে আস্তে ভাজবে ফুটন্ত তেলে। কখনো আমাকে বা অ্যামিয়াসকে বলতো, খুন করে ফেলবো তোমাকে, আমাকে চটালে। সহজেই এইভাবে সে ভীষণ রাগারাগি করে ঝগড়া করতো। ও নিজের চরিত্রের এই দুর্বলতার দিকটা জানতে এবং রাগটাকে ঝগড়াঝাটি করে ভিন্ন পথে চালিয়ে দিতো। প্রায়ই অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়ে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন প্রচণ্ড ঝগড়া করতো।
হ্যাঁ, শুনেছি সে কথা। কুকুর-বেড়ালের মতো নাকি ওঁরা ঝগড়া করতেন, বললো পোয়ারো।
বললেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন, ঠিকই করতো তবে বড় বাজেভাবে ব্যাপারটাকে আদালতে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। ঝগড়া করতো ওরা, অকথ্য ভাষায় নিষ্ঠুরের মতো রাগ মেটাতে নিজেদের মনের আর যে ঝগড়াটাকে ওরা উপভোগ করতে একথা বোঝবার ক্ষমতা ছিলো না অন্যদের। অথচ আনন্দ পেতে ওরা, পেতেন অ্যামিয়াসও। ঐ ধরনের স্বামী স্ত্রী ছিলো ওরা। অভিনয় আর আবেগপূর্ণ দৃশ্য দুজনেই ভালবাসতো। সাধারণতঃ পুরুষেরা তা পছন্দ করে না, শান্তি চায় তারা। কিন্তু শিল্পী ছিলেন অ্যামিয়াস, উনি চিৎকার, চেঁচামিচি, ভয় দেখানো এমনকি আঘাত দিতে ভালোবাসতেন প্রচণ্ড। কিছু সামান্য হারালে বাড়ি তোলপাড় করে ফেলতেন। আর মনের মধ্যে এই সব করে রাগ বেরিয়ে যাবার একটা পথ খুঁজে পেতো। অবিশ্বাস্য মনে হলেও শুনতে এইভাবে অবিরাম ঝগড়া আর ভাব করার মধ্য দিয়ে ভীষণভাবে উপভোগ করতে জীবনটাকে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন।
একটা অধৈর্যের ভাব ফুটে উঠলো অ্যাঞ্জেলার মধ্যে, যদি ওরা ওখান থেকে আমাকে তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে না দিতো, ডাকতো সাক্ষ্য দিতে, আমি বলতাম এসব কথা।…তবে মনে হয় না আমার কথা বিশ্বাস করতে বলে। কিন্তু ঠিক এটাও সেদিন যে বলতে পারতাম এই কথাগুলোই, কোনো স্থিরতা তার ছিলো না। একটা চিন্তা মাথায় ছিলো এই ধরনের, ভাবিনি স্বপ্নেও কাউকে কোনো দিন বলতে পারবো।
দূরমনস্কভাবে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে আবার অ্যাঞ্জেলা বললেন, যা বলতে চাইছি আমি নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন আপনি?
পোয়ারো জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো, বুঝতে পারছি স্পষ্ট আর আপনার কথাগুলো যে ঠিক অনুভব করতে পারছি সেটাও। এমনকিছু লোক আছে মতের মিল হওয়াটা যাদের কাছে খুব একঘেয়ে লাগে। নাটকীয়তার চমক তাদের জীবনযাত্রায় আনার জন্যে প্রয়োজন দেখা দেয় মতবিরোধ সৃষ্টি করার।
ঠিক তাই।
একটা কথা কি মিস ওয়ারেন জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনার মনের ভাব তখন কি ছিলো?
অ্যাঞ্জেলা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন, হতাশা আর বিভ্রান্তি। সে এক দুঃস্বপ্নের সময় গেছে। গ্রেপ্তার হলো ক্যারোলিন প্রায় তিনদিন পরে। আমার ঘৃণা, চাপা রাগ আর সবার ওপরে আমার ছেলেমানুষী ভাবটার কথা এখনও মনে আছে আমার। ভুল করে গ্রেপ্তার করেছে আমি ভেবেছিলাম। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। আমার জন্যে ভীষণ ক্যারোলিন ভাবিত ছিলো, ও চাইত আমাকে এর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে মিস উইলিয়ামসকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলো এক আত্মীয়ের বাড়ি। পুলিশ তাতে আপত্তি করেনি। তারপর ঠিক হলো যখন যে সাক্ষ্য দিতে হবে না আমাকে, সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের স্কুলে তখন পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
আমি অবশ্য একটুও যেতে চাইনি। বোঝানো হলো আমাকে যে মানসিক প্রচণ্ড ক্ষতি হবে ক্যারোলিনের যদি আমি থাকি সামনে। ফলে আমি বাধ্য হই চলে যেতে।
আবার একটু থেমে শুরু করলেন বলতে, মিউনিখে আমি চলে গেলাম। যেদিন বের হয় আদালতের রায়, তখন আমি সেখানে। ক্যারোলিনের সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম, যেতে দেয়নি ওরা। ক্যারোলিন এ ব্যাপারটায় বুঝতে ভুল করেছিলো।
ঠিক যে আপনি বুঝেছিলেন মিস ওয়ারেন একথা মনে করবেন না। ভালোবাসতেন খুব এমন একজন কাউকে দেখতে গেলে জেলখানায় কমবয়সী স্পর্শকাতর মেয়ের মনে ভয়ানক চাপ পড়তে পারতো।
হয়তো তাই।
হঠাৎ অ্যাঞ্জেলা উঠে দাঁড়ালেন, রায় বের হবার পর, আমাকে একটা চিঠি দিদি লিখেছিলো। আমি ওটা কাউকে দেখাইনি, তবে মনে করছি এখন আপনাকে দেখানো উচিত বলে। কী ধরনের মহিলা ছিলো ক্যারোলিন সেটা বুঝতে চিঠিটা সাহায্য করতে পারে। আপনি কার্লাকেও ওটা চাইলে দেখাতে পারেন। অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়ালেন, আমার সঙ্গে আসুন, ক্যারোলিনের আমার ঘরে একটা ছবি আছে।
অবাক বিস্ময়ে দ্বিতীয়বার ছবিটার সামনে স্তব্ধ হয়ে পোয়ারো দাঁড়িয়ে রইলো।
এটা ছবি হিসেবে খুব একটা উঁচুদরের নয়–আর শিল্পমূল্য নিয়েও মাথা ঘামালো না পোয়ারো।
…ডিমের মতো মুখটা নিটোল চোয়াল আর গালটা, মুখে ভীরু মিষ্টভাব। এই মুখের মালিক যেন একটা অনিশ্চয়তায় ভুগতেন নিজের সম্বন্ধে। আবেগপ্রবণ, চাপা সৌন্দর্য। জোরালো তীব্রভাব মেয়ের মুখের আর এর মধ্যে পরিস্ফুট প্রাণশক্তির অভাব।–উৎসাহ, উদ্দীপনা আর যে আনন্দ জীবনটা ভোগ করার কার্লা লেমারচেণ্টের সত্তায় ফুটে আছে, সেটা যে পিতৃ-সূত্রে পাওয়া কোনো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে।
অ্যাঞ্জেলা চিঠিটা নিয়ে ফিরে এসেছেন। বললেন শান্তভাবে, দেখলেন তো দিদিকে, এবার পড়ুন চিঠিটা।
পোয়ারো চিঠিটা সাবধানে খুললো, প্রায় ষোল বছর আগে চিঠিটা লিখেছিলেন ক্যারোলিন ক্রেলঃ
অ্যাঞ্জেলা আমার ছোট, তুমি দুঃসংবাদ শুনবে এবং দুঃখও পাবে, কিন্তু তোমাকে যা আমি বলতে চাইছি তা হলো এই যে এটাই ঠিক…ঠিক হয়েছে। কখনও তোমাকে আমি মিথ্যে কথা বলিনি, সত্যিই যে আমি সুখী একথাটাও বলছি না মিথ্যে–আমি যেন সত্যিই বাস করছি এক সততা আর শান্তির জগতে। ঠিক হলো এটাই সোনা, ঠিক হলো এটাই। আমার জন্যে অতীতের দিকে তাকিয়ে দুঃখ, শোক কোরো না, এগিয়ে যাও নিজের জীবনযাত্রায় সফল হও। তুমি পারবে তা আমি জানি। সোনা ঠিক হয়েছে এটাই, আমি চলে যাচ্ছি আমার অ্যামিয়াসের কাছে। একসঙ্গে যে আমরা মিলিত হবোই আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে। আমি বাঁচতে পারি না ওকে ছেড়ে। …একটা কাজ কোরো আমার মুখ চেয়ে কিন্তু…সুখে থেকো। আমি বলছি…সুখে আছি আমি। শোধ তো করতেই হবে নিজের ঋণটুকু। শান্তিকে মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়াটাই আনন্দের স্বরূপ।
তোমার প্রিয় দিদি
ক্যারোলিন
চিঠিটা আরেকবার এরকুল পোয়ারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লো।
সুন্দরি ভারী চিঠি…অসাধারণ…অত্যন্ত সাধারণ চিঠি।
খুব অসাধারণ মানুষ ছিলো ক্যারোলিনও।
হ্যাঁ, অদ্ভুত একটা মন ছিলো তার..আচ্ছা আপনার এই চিঠিটা পড়ে মনে হয় নিশ্চয়ই নির্দোষ ছিলেন আপনার দিদি?
নিশ্চয়ই মনে করি। আদৌ স্পষ্টভাবে কিন্তু কথা বলা হয়নি।
কারণ জানতো দিদি যে আমি তাকে কোনোদিন স্বপ্নেও অপরাধী ভাবতে পারি না।
হয়তো তাই…তাই হয়তো…কিন্তু অন্যভাবে ব্যাপারটাকে তো দেখা যেতে পারে। হতে পারে এটাও যে উনি পাপটা করেছিলেন এবং প্রায়শ্চিত্ত করে শান্তি পাচ্ছেন মনে।
ক্যারোলিনকে যে রূপে আদালতে দেখা গিয়েছিলো তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে এই ব্যাখ্যাটা বলে পোয়ারোর মনে হলো। এবং যে বিশ্বাসটা এতদিন পর্যন্ত ভীষণ জোরদার হয়েছিলো পোয়ারোর মধ্যে, যেন চিড় ধরতে শুরু করেছে সেটাতে। তত্ত্ব আর তথ্য জোগাড় হয়েছে যে সব সবগুলোই বিপক্ষে ক্যারোলিনের, আজ তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে এই চিঠিটাও।
অটল প্রত্যয় নিয়ে অন্যদিকে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন। ও যে দিদিকে ভালোভাবে চিনতো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে। কিন্তু ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই চেনাটার সঙ্গে দিদির প্রতি অন্ধ তার ভালোবাসা, ফলে তার বিশ্বাস, কতোটা গ্রহণযোগ্য তার মতামত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
বুঝতে পেরেই পোয়ারোর মনের ভাবটা যেন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন বললেন, না, মিঃ পোয়ারো, জানি আমি দিদি আমার অপরাধী নন। সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো বললো, ঈশ্বর জানেন, আপনার বিশ্বাসের মূলে আমি চাইছি না আঘাত করতে। কিন্তু বাস্তবসম্মত ভাবে আমাদের উচিত চিন্তা করা। আপনি বলছেন অপরাধী নন আপনার দিদি। ঠিক আছে, আসলে কী ঘটেছিলো তাহলে বলুন।
অ্যাঞ্জেলা চিন্তা করতে করতে মাথা নাড়লেন, আমি একমত আপনার সঙ্গে, বলা ওটা কঠিন। আমার ধারণা এবং দিদিও বলেছিলো তাই, আত্মহত্যা করেন আমিয়াস।
যতদূর আপনি ভদ্রলোকটিকে চিনেছিলেন, তাতে কি ওটা করা সম্ভব তাঁর পক্ষে?
সম্ভব নয় খুব একটা।
অথচ দিদির বেলায় যেটা অসম্ভব বলেছেন স্পষ্টভাবে, এক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে তেমন অসম্ভব বলতে পারছেন না, তাই না।
না, কারণ অনেক অসম্ভব কাজ অনেক লোক অনেক সময় করে ফেলতে পারে, যেটা তার পবিত্র ধর্মবিরোধী আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা আপনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে যদি তাদের জানেন, তবে চরিত্র বিরোধী আদৌ মনে হবে না।
ভালোভাবে আপনি আপনার জামাইবাবুকে চিনতেন?
হ্যাঁ, তবে যতটা চিনতাম দিদিকে ততোটা নয়। আত্মহত্যা করেছেন অ্যামিয়াস আমার কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার মনে হয় করেও থাকতে পারেন। আসলে তাই করেছিলেন উনি।
আপনি অন্য কোনো কারণ ভাবতে পারেন না?
অ্যাঞ্জেলা আমার অভিমতটাকে শান্ত মনে মেনে নিলেন বটে কিন্তু কোনোরকম প্রচেষ্টা করার চিহ্নমাত্র প্রকাশ করেন না। বুঝতে পারছি আপনার কথা…আমি কখনো চিন্তা করিনি সেরকম কোনো সম্ভাবনার কথা…বলতে চাইছেন আপনি অন্য কেউ খুন করে থাকতে পারে? ঠান্ডা মাথায় কেউ ঐ খুনটা করেছিলো?
হতেও তো পারে, পারে না?
হা হতে পারে…কিন্তু মনে হচ্ছে কি খুব একটা সম্ভব বলে?
অসম্ভব মনে হচ্ছে কি আত্মহত্যার চেয়েও?
বলা কঠিন সেটা…আর কাউকে তো এমনি সন্দেহ করা যায় না। চিন্তা করলেও অতীতের কথা সেটা এখন পারছি না মেনে নিতে।
ঠিক আছে, চিন্তা করা যাক সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে। পরিচিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে কে…মানে বলছি কি…ওটা কার পক্ষে করা সম্ভব?
দাঁড়ান ভাবতে দিন। আচ্ছা, খুন করিনি আমি। আর ঐ এলসা বেচারীও করেনি। মেয়েটা রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিল অ্যামিয়াস মারা গেলে। আর কে ছিলো ওখানে? মেরিডিথ ব্লেক? উনি খুব ভক্ত ছিলেন দিদির। অবশ্য সেটা হতে পারে একটা উদ্দেশ্য। হয়তো অ্যামিয়াসকে সরিয়ে দিয়ে উনি বিয়ে করার কথা চিন্তা করে থাকতে পারেন দিদিকে। অবশ্য তাহলে অ্যামিয়াসকে উনি সোজাসুজি বলতে পারতেন, এলসাকে নিয়ে তুমি কেটে পড়ো। ক্যারোলিনকে আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে…। না, কিছুতেই আমি খুনি মনে করতে পারি না মেরিডিথকে। বড্ড ভীরু আর সাবধানী বড় বেশি। কে ছিলো আর?
স্মরণ করিয়ে দিলো পোয়ারো, মিস উইলিয়ামস? ফিলিপ ব্লেক?
অ্যাঞ্জেলার মুখ কয়েক মুহূর্তের জন্যে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো, মিস উইলিয়ামস? খুন করতে পারে বলে কল্পনাও করা যায় না, বাড়ির গভর্নেস। সব সময়ে মিস উইলিয়ামস আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর সৎ চরিত্রের মহিলা ছিলেন।
আবার একটু থেমে বলতে লাগলেন, অবশ্য ক্যারোলিনকেও উনি খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন, উনি সব কিছু করতে পারতেন দিদির জন্যে। মিস উইলিয়ামস তাছাড়া ঘেন্না করতেন অ্যামিয়াসকে। উনি উগ্র সমর্থক ছিলেন নারী স্বাধীনতার। আর ভীষণ অপছন্দ করতেন পুরুষদের। এটাই কি খুন করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি? নিশ্চয়ই নয়।
পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আমার আগ্রহ ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে আপনার কথায়। প্রশ্ন করি একটা, আপনি কেন একথা বললেন?
কিছুই বলছি না নির্দিষ্ট করে। যেটুকু আমার মনে আছে ফিলিপ ব্লেক সম্বন্ধে তার ভিত্তিতে বলতে পারি বেশ স্থল আর স্বার্থপর ধরনের মানুষ ছিলেন উনি।
এবং স্থূল আর স্বার্থপর মানুষরা খুনটুন করতে পারে এরকম ধারণা একটা আপনার আছে?
অসুবিধা নিজের দূর করার জন্যে যে কোনো নিষ্ঠুর পথ এই শ্রেণীর লোক অবলম্বন করতে পারে। তাই না?
হা মনে হয় ঠিকই বলেছেন আপনি। একটা এরকম ব্যাপার আছে। কিন্তু মনে হয় আমার আরও ঘটনা কিছু আছে। কি হতে পারে ফিলিপ ব্লেকের অভিসন্ধিটা?
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন কোনো উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিলেন না। মেঝের দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে রইলেন।
পোয়ারো বললো, অ্যামিয়াস ক্রেলের ভীষণ প্রিয় বন্ধু ছিলেন তো উনি, তাই না?
ঘাড় নেড়ে অ্যাঞ্জেলা সায় দিলেন।
কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার মিস ওয়ারেন, এমন ঘটনা কিছু আছে যেটা আমাকে বলছেন না আপনি। দুজনের মধ্যে কি ঐ এলসা মেয়েটাকে নিয়ে রেষারেষি ছিলো?
সজোরে ঘাড় নেড়ে অ্যাঞ্জেলা বললো, না, না, ফিলিপ না।
তাহলে কি ব্যাপারটা? অ্যাঞ্জেলা খুব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, বেশ কয়েক বছর কোনো কোনো ঘটনা হঠাৎ মনের মধ্যে কি করে ভেসে ওঠে তা কি আপনি জানেন? কথার মানেটা আমার বুঝিয়ে বলছি। বয়েস যখন আমরা এগারো, একজন তখন আমাকে একটা গল্প বলেছিলাম। আমি গল্পটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। আর মাথাও ঘামাইনি সে নিয়ে, ভুলেই গিয়েছিলাম গল্পটা। একটা নাটক বছর দুয়েক আগে দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো গল্পটা। আর এতো আমি চমকে উঠেছিলাম যে আমার মুখ দিয়ে বেশ জোরে কথা বেরিয়ে এলো, আরে চালের পুডিং নিয়ে সেই বাজে ঘটনার গল্পটার মানে যে বেশ বুঝতে পারছি এখন। অথচ কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগের আভাস নেই ঐ দুটি ঘটনার মধ্যে।
পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি।
তাহলে যা বলতে যাচ্ছি এখন আপনি সেটাও বুঝতে পারবেন। একটা হোটেলে একবার ছিলাম। হাঁটছি লম্বা বারান্দা দিয়ে হঠাৎ এক পরিচিত মহিলা একটা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ওঁর ওটা কিন্তু শোবার ঘর ছিলো আর অন্যের শোবার ঘর থেকে তিনি যে বেরিয়ে এলেন সে কথা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিলো মুখের ভাবে।
আর অ্যাল্ডারবেরিতে সঙ্গে সঙ্গে একদিন রাতে ফিলিপ ব্লেকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা ক্যারোলিনের মুখের ভাবটার অর্থ বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো পোয়ারো, অ্যাঞ্জেলা তাকে বাধা দিয়ে বলতে থাকলেন, আমি কিছুই সে রাতে বুঝতে পারিনি। যতটুকু জানে ওই বয়সের মেয়েরা, বোঝে, তাই জানতাম আমিও বুঝতাম, কিন্তু ঐ ঘটনার সঙ্গে মেলাতে পারিনি তা। আমার কাছে ক্যারোলিনের বেরিয়ে আসাটা ফিলিপ ব্লেকের শোবার ঘর থেকে খুবই সাধারণ ঘটনা বলে মনে হয়েছিলো। মিস উইলিয়ামস বা আমার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মতোই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এমন একটা অদ্ভুত ভাব ক্যারোলিনের চোখে মুখে দেখেছিলাম যার অর্থ প্যারিসের হোটেলে মুখের ভাব ওই মহিলার দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক মতো।
আস্তে আস্তে পোয়ারো বললো, মিস ওয়ারেন আপনি যা বলছেন তা আমাকে চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আমি কথা বলছি ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে, মনে হয়েছিলো আমার আপনার দিদিকে উনি ভীষণ ঘেন্না করেন এবং আগেও করতেন।
অ্যাঞ্জেলা বললেন, জানি। বুঝিয়ে বলতে পারবো না আমার কথাটা, তবে ঘটেছিলো ঘটনাটা।
আস্তে আস্তে পোয়ারো মাথা নাড়লো। ফিলিপ ব্লেকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর ওর যেন কেমন মনে হয়েছিলো কোথায় যেন বলা হচ্ছে অসত্য। মাত্রাতিরিক্ত বিদ্বেষটা যে ক্যারোলিনের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সেটা মনে হয়েছিলো পোয়ারোর।
কথাবার্তার অংশ বিশেষ মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে তার মনে পড়তে লাগলো। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো অ্যামিয়াসকে বিয়ে করাতে…ওদের বাড়ির দিকে একবছরেরও বেশি মাড়ায়নি।
তাহলে কি ভালোবাসা ছিল ফিলিপের সঙ্গে ক্যারোলিনের। আর সেই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো অ্যামিয়াসকে বিয়ে করার ফলে?
হ্যাঁ, ভীষণ রাগী আর ভীষণভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ছিলো ফিলিপ। ওর সম্বন্ধে মনে মনে ভাববার চেষ্টা করলো পোয়ারো। হাসিখুশি সৌভাগ্যশালী মানুষ। আত্মতৃপ্ত গফের মাঠ আর সুন্দর বাড়ি নিয়ে। ফিলিপ ব্লেকের মনোভাব কেমন ছিলো ষোলো বছর আগে? অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন তখনও বলে চলেছেন, এটা আমি বুঝতে পারি না। দেখুন আমি ঠিক বুঝতে পারি না ভালোবাসাবাসি ব্যাপারটা, ওটা কখনো আমার জীবনে আসেনি। আপনাকে ঘটনাটা এই জন্যে বললাম যদি এই ব্যাপারে সাহায্য হয় কোনো হয়তো এর কোনো সম্পর্কও ঘটনার সঙ্গে থাকতে পারে।
২.১ ফিলিপ ব্লেকের আখ্যান
দ্বিতীয় খণ্ড
ফিলিপ ব্লেকের আখ্যান
(পাণ্ডুলিপির সঙ্গে পাঠানো চিঠি)
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
পালন করছি প্রতিশ্রুতি। এর সঙ্গে অ্যামিয়াস ক্রেলের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাবলীর বিবরণ লেখা কাগজ পাঠালাম। এতোদিন পরের ঘটনা, তাই বাধ্য জানিয়ে রাখতে যে আমার স্মৃতিশক্তি নির্ভুলভাবে সব সময়ে কাজ নাও করে থাকতে পারে, তবে মনে করতে পেরেছি যতটা ততটা লিখেছি।
আপনার বিশ্বস্ত
ফিলিপ ব্লেক
যে সব ঘটনার ফলে ১৯… সালের সেপ্টেম্বর মাসে
নিহত হন অ্যামিয়াস ক্রেল তার অগ্রগতি সম্পর্কিত বিবরণ।
আমার বন্ধুত্ব দীর্ঘকালের নিহত মানুষটির সঙ্গে। আমাদের দুজনেরই বাড়ি ছিলো গ্রামে পাশাপাশি। বন্ধুত্বও ছিলো পারিবারিক। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় অ্যামিয়াস ক্রেল। আমরা একসঙ্গে ছুটির দিনে খেলাধুলো করতাম এক স্কুলে না পড়লেও।
দীর্ঘদিনের পরিচয় সূত্রে মানুষটির সঙ্গে আমি মনে করি তার চরিত্র ও জীবন সম্বন্ধে, আমার বিশেষ অধিকার আছে তার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী সম্বন্ধে কিছু বলার। যারা ভালোভাবে অ্যামিয়াস ক্রেলকে জানে একথা তাদের কাছে আমি বলতে পারি খোলাখুলিভাবে যে ওর আত্মহত্যা ব্যাপারটা অবাস্তব সম্পূর্ণ। কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না অ্যামিয়াস। বরং ও বড় বেশি ভালোবাসতো বাঁচতে। ঘনিষ্ঠভাবে যারা ক্রেলকে চেনে তারা জানে যে আদালতে আসামীপক্ষের বক্তব্য–সে বিষ খায় অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে একেবারেই মিথ্যা একথা। আমি বরং বলবো বিবেক বলতে কিছুই অ্যামিয়াসের ছিলো না। যেটুকু ছিলো তার মধ্যে কোনো স্থান ছিলো না বিষাদের। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওদের এমনই সম্পর্ক খারাপ ছিলো যে তা ভেঙে দেবার ব্যাপারে একটুও বিবেকের দংশন স্বামীর মনে হতো না। স্ত্রী ও মেয়ের ভরণপোষণের আর্থিক দিকটা দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিলো অ্যামিয়াস আর সে ব্যাপারে আমার ধারণা সে বেশ উদারতাই দেখাতো। অ্যামিয়াস খুব সদাশয় আর উদার মানুষ ছিলো। তার জুড়িমেলা ভার স্নেহ পরায়ণ ও আন্তরিকতায়। শুধু যে শিল্পী হিসেবে বড় ছিলো তা নয়, ওকে খুব ভালোবাসতো ওর বন্ধু-বান্ধবরা। ওর কোনো শত্রু ছিলো না যতদূর জানি।
আমি বহুদিন ধরে ক্যারোলিন ক্রেলকেও জানি বিয়ের আগে থাকতেই, ও যখন মাঝে মাঝে এসে থাকতে অ্যাল্ডারবেরিতে। তখন কিছুটা খ্যাপাটে মেয়ে ছিলো ক্যারোলিন, হঠাৎ মাঝে মাঝে খুব রেগে উঠতো। আকর্ষণ যে রূপের মধ্যে ছিলো না তা নয়, তবে এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ ঘর করা।
ও অ্যামিয়াসের ব্যাপারে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের অনুরাগ প্রকাশ করে ফেললো। সত্যি সত্যিই গভীরভাবে অ্যামিয়াস ক্যারোলিনকে ভালোবেসে ফেলেছিল আমার তা মনে হয় না। অথচ প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেতো দুইজনকে, আর আগেই বলেছি আকর্ষণ ছিলো ক্যারোলিনের ফলে বিয়ে করা দুজনে পাকাপাকি করে ফেললো। অ্যামিয়াস ক্রেলের বন্ধুদের মধ্যে এই বিয়ের ব্যাপারে বেশ খানিকটা আশংকা যে ছিলো না তা নয়, কারণ ক্যারোলিন যোগ্য নয় অ্যামিয়াসের তা সবাই বুঝতো।
প্রথম কয়েক বছর এর ফলে অ্যামিয়াস ক্রেলের স্ত্রী আর অ্যামিয়াসের বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষের একটা চাপা প্রবাহ বয়ে চলেছিলো। কিন্তু ভীষণভাবে বন্ধুবৎসল ছিলো অ্যামিয়াস, তাই বন্ধুদের সে স্ত্রীর কথায় ছাড়েনি। আমি আর অ্যামিয়াস কয়েক বছর পরে আবার আগের মতোই বন্ধু হয়ে উঠলাম, অ্যান্ডারবেরিতে প্রায়ই যেতে শুরু করলাম। একথাও বলে রাখি প্রসঙ্গক্রমে ওদের মেয়ে কার্লার ধর্মপিতাও আমি হয়েছিলাম। আমার ধারণা এটাই বড় মস্ত প্রমাণ যে আমাকে অ্যামিয়াস তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মনে করতো এবং তার ফলেই অধিকার জন্মেছে আমার সেই মানুষটি সম্বন্ধে কিছু বলার, যে নিজে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে বলা কওয়ার।
যে বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছে আমাকে তার আসল ঘটনায় এবার আসা যাক। আমি এসেছিলাম অ্যাল্ডারবেরিতে পাঁচদিন আগে অপরাধটা ঘটবার (পুরানো ডাইরী থেকে তাই আমি দেখতে পাচ্ছি) অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে। যে একটা উত্তেজনা চলছে ওদের বাড়ির পরিবেশের মধ্যে এটা ওখানে আমি পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে পেরে গিয়েছিলাম বুঝতে। ঐ বাড়িতে সে সময় মিস এলসা গ্ৰীয়ারও ছিলেন। তার ছবি আঁকছিলো অ্যামিয়াস।
আগে থেকেই মিস গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম, কিন্তু সশরীরে সেই প্রথম দেখলাম তাকে। অ্যামিয়াসের মুখে প্রায় মাসখানেক আগে ওঁর ভূয়সী প্রশংসা শুনেছিলাম। ও বলেছিলো, ওর আলাপ হয়েছে এক অসাধারণ চমৎকার মহিলার সঙ্গে। অ্যামিয়াস এত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলো মিস গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে যে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, বুড়ো খোকা সাবধানে থেকো, নইলে তোমার মাথা আবার বিগড়োবে। ও উত্তরে বলেছিলো যেন আমি গাধামি না করি। শুধু মেয়েটার ছবি আঁকছে অ্যামিয়াস, এছাড়া তার পর আর কোনো ব্যক্তিগত আগ্রহ নেই। আমি বলেছিলাম, গাঁজাখোরদের তুমি ওসব কথা বুঝিয়ো বন্ধু, আমি অনেকবার এর আগে শুনেছি। ও বলেছিলো, আলাদা এবারের ব্যাপারটা, নিষ্ঠুরের মতো ব্যঙ্গ করে আমি বলেছিলাম, সে তো সব বারেই হলো। তখন বেশ চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো অ্যামিয়াস, বলেছিলো, বুঝতে পারছো না তুমি, একটা বাচ্চা মেয়ে ও নিতান্তই। এটাও বলেছিলো সেইসঙ্গে মেয়েটার দৃষ্টিভঙ্গী খুব আধুনিক আর একেবারে মুক্ত সেকেলের কুসংস্কার থেকে। মেয়েটা অত্যন্ত সৎ, স্বাভাবিক অ্যামিয়াস বলেছিলো, সে জানেই না ভয়ডর কাকে বলে।
মুখে না বললেও আমি মনে মনে বুঝেছিলাম এবার খুব খারাপভাবেই অ্যামিয়াস জড়িয়ে পড়েছে। অন্যদের মন্তব্য কয়েক সপ্তাহ পরে কানে আসতে লাগলো। কেউ বললো, একেবারে মজে গেছে এলসা মেয়েটা। অন্য একজনের মন্তব্য–একেবারেই গেছে অ্যামিয়াসের মাথাটা নইলে মেয়েটার বয়সের কথা চিন্তা করছে না একবারও। আবার নাকসিটকে অনেকে বললো নিজের পথটা এলসা গ্ৰীয়ার ভালোভাবে জানে। মেয়েটা বসে আছে টাকার গদিতে। অন্য একজনের বক্তব্য, যা চায়, তাই পায়। অনেক অশালীন কথা আরও বলাবলি করতো ওর সম্বন্ধে লোকেরা। কী ভাবতো এ ব্যাপারে অ্যামিয়াসের স্ত্রী এটা একটা বড় প্রশ্ন ছিলো এবং ক্যারোলিন ঐ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যে ধরনের উত্তর দিতে বাধ্য হতো কেউ কেউ গম্ভীর হয়ে সে সম্বন্ধে বলতো যে মহিলা জ্বলে-পুড়ে মরতে ঈর্ষায় আর একেবারে নরক করে তুলেছিলো স্বামীর জীবন।
আমি প্রয়োজন মনে করছি এসব কথা উল্লেখ করা এই কারণে যে ওখানে আমি পৌঁছাবার আগে কী ধরনের ব্যাপার চলছিলো তা জানা দরকার সঠিকভাবে।
আমার দেখার আগ্রহও ছিলো মেয়েটাকে–সুন্দরী অসাধারণ আর দারুণ মোহময়ী স্বীকার করতে বাধ্য যে রুক্ষ ব্যবহার ক্যারোলিনের দেখে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম আমি। এই খুশির মূলে এক ধরনের বিদ্বেষ ছিলো।
হালকা মেজাজে যতোটা থাকা উচিত অ্যামিয়াস জেল ততোটা ছিলো না। ওকে যারা ভালোভাবে চেনে না তারা কিন্তু স্বাভাবিকই মনে করতো ওর আচরণটাকে। কিন্তু এতো ঘনিষ্ঠভাবে ওকে চিনি বলেই বুঝতে পারছিলাম প্রচণ্ড চাপ পড়েছে ওর মনের ওপর, হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে, খুব খেয়ালী হয়ে পড়ছিলো মাঝে মাঝে, আর সব মিলিয়ে ভীষণ খিটখিটে।
অ্যামিয়াস ছবি আঁকার সময় প্রায়ই ভীষণ খেয়ালী হয়ে উঠতো, কিন্তু আঁকছিলো যে ছবিটা তার জন্যে মানসিক অতোটা চাপ হবার তেমন কোনো সঙ্গত কারণ দেখতে পাইনি আমি। ও খুব খুশি হয়েছিলো আমাকে দেখে যেই দুজন একা হয়েছি আমরা ও বললো আমাকে, ভালো হয়েছে খুব তুমি এসেছো ফিল। একটা বাড়িতে চারজন মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকতে হলে পাগল হয়ে যাবে যে কোনো মানুষ। ওরা মনে হচ্ছে পাগলাগারদে আমাকে না পাঠিয়ে ছাড়বে না।
খুব অস্বস্তিকর ছিলো সত্যিই পরিবেশটা। ক্যারোলিন ভীষণ রুক্ষ হয়ে উঠেছিলো তা আগেই বলেছি। আপত্তিকর কথা একটাও উচ্চারণ না করে অবিশ্বাস্যভাবে ক্যারোলিন শান্ত সংযত আর ভদ্র উপায়ে সবচেয়ে বেশি রুঢ় হয়ে উঠেছিলো এলসার ব্যাপারে। খোলাখুলি এবং অভব্য ক্যারোলিনের সঙ্গে এলসাও অভদ্র ব্যবহার করেছিলো। বিজয়িনী সেই যে, সেটা বুঝতো এলসা, এবং ভদ্র বংশের শিক্ষা-দীক্ষার রুচিও খোলাখুলিভাবে অভদ্র আচরণ করা থেকে তাকে পারেনি বিব্রত করতে। ফলে ছবি আঁকার সময়টুকু বাদ দিয়ে অ্যামিয়াস অন্য সময়ে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে খুনসুটি করতো। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক এমনিতে ছিলো খুবই মধুর। অবশ্য ঠাট্টা ফোকুড়ি করা পরস্পরকে, ঝগড়াঝাটি যে মাঝে মাঝে না হতো তা নয়। কিন্তু অ্যামিয়াস যেন বড় বেশি মাত্রায় সেবারে ক্ষেপে গিয়েছিলো এবং তার প্রতিটি আচরণে তা প্রকাশ পাচ্ছিলো। বড় বেশি রেগে উঠেছিলো অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলা দুজনেই দুজনের ওপর। গভর্নেস ছিলেন চতুর্থ ব্যক্তি। ওকে অ্যামিয়াস বলতো, খিটখিটে ডাইনী বুড়ী। ভীষণ ঘেন্না করতে আমাকে। চুপচাপ ঠোঁট চেপে বসে বসে লক্ষ্য করে আমায় আর সব সময়ে আমাকে অপছন্দ করে।
অ্যামিয়াস ঐ সময়েই আমাকে বলেছিলো, নরকের দরজা মেয়েমানুষ জাতটাই, যদি কেউ জীবনে সুখ শান্তি চায় তবে শত হস্তেন দূরে থাকতে হবে মেয়েমানুষ থেকে।
বলেছিলাম আমি, অ্যামিয়াস বিয়ে করাই উচিত হয়নি তোমার। ঠিক হয়নি ঘর সংসারের বন্ধনে জড়ানো।
ও বলেছিলো ওসব আলোচনা এতোদিন পরে না করাই ভালো। এটাও বলেছিলো অ্যামিয়াস যে ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে ভালোই হবে ক্যারোলিনের। আমি তখনই আভাস পেয়েছিলাম যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অস্বাভাবিক।
আমি বলেছিলাম, কি হচ্ছে কি এসব! ব্যাপারটা কি তাহলে সুন্দরী এলসার সঙ্গে সত্যিই চলে গেছে গুরুতর পর্যায়ে।
খুব সুন্দরী ও, তাই না, মনে হয় মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে দেখা না হলেই যেন ভালো হতো। যন্ত্রণার আভাস অ্যামিয়াসের গলায় ফুটে উঠলো।
আমি বলেছিলাম, শোন হে বুড়ো খোকা, এবার একটু নিজের রাশটা সামলাও। জড়িয়ে পোড়ো না যেন আর কোনো মেয়েমানুষের সঙ্গে।
অ্যামিয়াস আমার কথা শুনে হেসে বললো, কথাটা তোমার পক্ষে বলা সহজ। আমি মুক্তি পেতে পারি না মেয়েদের বাঁধন থেকে, কিছুতেই পারি না, চেষ্টা করি যদিবা আমাকে একা থাকতে দেয় না ওরা।
অ্যামিয়াস তারপর নিজের চওড়া কাঁধটা ঝাঁকিয়ে হাসলো বিষণ্ণভাবে, শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে সবই বন্ধু, থাকবে না কিছুই। তবে ভালো যে আঁকছি ছবিটা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করবে?
যে ছবিটা এলসার ও আঁকছিলো তার কথাই অ্যামিয়াস বলছিলো। ছবির পরিভাষাটা আমি বুঝি না তেমন, তবে দারুণ যে হচ্ছে ছবিটা সেটা অসুবিধা হয় না বুঝতে।
অ্যামিয়াস ভিন্ন মানুষ ছবি আঁকার সময়। তর্জন-গর্জন, আর্তনাদ, বেপরোয়া গালাগালি করতো, তুলি-টুলি ছুঁড়ে কখনো কখনো ফেলে দিতো, কিন্তু সে যে সুখের জগতে ডুবে আছে মনে মনে এটা বোঝা যেতো।
যখন ও খাবার সময় একমাত্র বাড়ির ভেতরে আসতো তখন ঐ মহিলাদের বিষাক্ত আচরণে সে কাহিল হয়ে পড়তো, চরমে উঠেছিলো মহিলাদের শত্রুতা ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে। আমরা সবাই দুপুরে খাবার সময় বেশ বিব্রত বোধ করছিলাম। এলসা ছিলো ভীষণ…এককথায় উদ্ধত বললেই বোধ হয় বোঝানো যায়। সে ক্যারোলিনকে খোলাখুলিভাবে উপেক্ষা করতো এমনকি ঘরে ক্যারোলিন থাকলেও অ্যামিয়াসের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতো যেন কেউ আর ঘরে নেই। অবশ্য ক্যারোলিন হেসেটেসে হালকাভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলতো, কিন্তু কায়দা করে এমনভাবে বলতো যে খোঁচা মারার যেখানে ঠিক বিধবো সেখানে। ক্যারোলিনের মধ্যে এলসা গ্ৰীয়ারের অসহ্য সতোর ছিটেফোঁটা ছিলো না। সবকিছুই ক্যারোলিনের একটু তির্যক, আভাস ইঙ্গিতে বলাটাই তার স্বভাব সোজাসুজি না বলে।
আমরা যখন ড্রইংরুমে বসে কফি খাচ্ছিলাম দুপুরের খাবার পর তখন চরমে উঠলো ব্যাপারটা। ঘরে খুব পালিশ করা একটা কাঠ খোদাইয়ের মূর্তি ছিলো, দেখতে ভারী অদ্ভুত। ওটার প্রশংসা আমি করতেই বলেছিলো ক্যারোলিন, ওটা নরওয়ের একজন ভাস্করের তৈরি। ওঁর শিল্পকর্ম অ্যামিয়াস আর আমি দুজনেই পছন্দ করি দারুণ। দুজনেই যাবো ভাবছি আগামী গ্রীষ্মে। নিশ্চিন্ত এই ধরনের অধিকারবোধ অসহ্য হয়ে উঠলো এলসার কাছে। সে এড়িয়ে যেতে দেয় না কোনো রকমের চ্যালেঞ্জকে। এলসা দু-এক মিনিট অপেক্ষা করার পর বেশ স্পষ্টভাবে বিশেষ জোর গলার ওপর দিয়ে বলেছিলো, এই ঘরটাই ঠিক মতো সাজালে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। আসবাবপত্র বড্ড বেশি হয়ে গেছে। যখন এখানে থাকবো আমি তখন বাজে এইসব জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে মাত্র বাছা বাছা দু-একটা রেখে দেবো। তামাটে রঙের পর্দা লাগাবো যাতে অস্তগামী সূর্যের আলো পশ্চিমের জানলা দিয়ে এসে পড়ে তার ওপর। তারপর আমার দিকে ফিরে বললো, খুব সুন্দর হবে না? কি মনে হয় আপনার?
উত্তর দেবার সময়টুকু আমি পেলাম না। বলে উঠলো ক্যারোলিন, নরম আর মসৃণ তার কণ্ঠস্বর, বিপজ্জনক ছাড়া আর কিছু আমার কাছে মনে হয়নি। ক্যারোলিন বলেছিলো, বাড়িটাকে কেনার কথা তুমি চিন্তা করছো নাকি এলসা?
এলসার উত্তর, দরকার পড়বে না কেনার।
তুমি কি বলতে চাও? ক্যারোলিনের গলার স্বরে নরম ভাব সে আর নেই। কঠোর আর রুক্ষ হয়ে উঠেছে। হেসে উঠলো এলসা, আমাদের কি কোনো প্রয়োজন আছে বোঝার ভান করার, কেন আমার কথা কি ক্যারোলিন তুমি বুঝতে পারছো না? আমি কি বলতে চাইছি তা তুমি জানো।
না, আমি কিছুই জানি না। এলসা তখন বলে উঠেছিলো, চেষ্টা কোরো না উট পাখি হবার। আমি আর অ্যামিয়াস, দুজনেই পছন্দ করি দুজনকে। এই বাড়িটাও তোমার নয়, অ্যামিয়াসের ওর সঙ্গে বিয়ের পর এখানেই থাকবো আমি।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি তোমার? বলেছিলো ক্যারোলিন। এলসা বলেছিলো, না, খারাপ হয়নি একটুও এবং তুমিও সেটা ভালো করে জানো। দুজনে যদি দুজনের কাছে আমরা খোলাখুলি সব কথা স্বীকার করি তাহলে বেশ সহজ হয়ে ওঠে জিনিসটা, তাই না? আমি আর অ্যামিয়াস পরস্পরকে ভালোবাসি–স্পষ্ট বুঝতেও পারছো এ ব্যাপারটা। সবচেয়ে শোভন কাজ হবে তোমার পক্ষ থেকে মুক্তি দেওয়া অ্যামিয়াসকে।
একটা কথাও তোমার বিশ্বাস করছি না। সেই দৃঢ়তা কিন্তু ক্যারোলিনের গলায় ছিলো না, ওর গোপন জায়গাতে এলসা আঘাত দিতে পেরেছে।
অ্যামিয়াস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে এসেছিলো ঘরের মধ্যে, ক্যারোলিনকে বললো হেসে এলসা, বিশ্বাস না হলে আমার কথা জিজ্ঞেস করে দেখো অ্যামিয়াসকে।
ক্যারোলিন বললো, করছি, অ্যামিয়াসের দিকে এই বলে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো, অ্যামিয়াস, তুমি ওকে বিয়ে করতে চাও এলসা বলছে। সত্যি কি কথাটা?
আমার দুঃখ হয়েছিলো বেচারা অ্যামিয়াসের জন্যে। ঘাড়ে এই ধরনের পরিস্থিতি চাপিয়ে দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ বোকা হয়ে যায়। অ্যামিয়াস রাগে ফেটে পড়েছিলো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে। প্রশ্ন করেছিলো এলসার দিকে তাকিয়ে কেন মনের কথা সে চেপে রাখতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিলো ক্যারোলিন, সত্যি তাহলে কথাটা?
কোনো উত্তর না দিয়ে অ্যামিয়াস জামার কলারের তলাটা ঘষতে লাগলো, কোণঠাসা যে কোনো ভাবে হলে ওই রকম হাত বোলাতে কলারে ছোটবেলা থেকেই। অ্যামিয়াস সম্মান বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বেচারা পারেনি। ও বলেছিলো, আলোচনা করতে চাই না ও নিয়ে।
ক্যারোলিন বলেছিলো, আলোচনা কিন্তু আমরা করতে চাইছি।
এলসা টুক করে টিপ্পনী কাটলো, সত্যি কথাটা ক্যারোলিনকে বলে দেওয়াই ভালো।
আবার শান্ত ভাবে ক্যারোলিন প্রশ্ন করলো? অ্যামিয়াস, সত্যি কি কথাটা?
অ্যামিয়াস লজ্জা পেয়েছে মনে হচ্ছিলো, সাধারণত স্বামী-স্ত্রীরা বেকায়দায় পড়লে লজ্জা পেয়ে থাকে যেভাবে।
আবার বললো ক্যারোলিন, দয়া করে উত্তর দাও। জানতেই হবে আমাকে।
কোণঠাসা ষাঁড়ের মতো হঠাৎ ঘাড় উঁচু করে অ্যামিয়াস দাঁড়ালো, হ্যাঁ, সত্যি, তবে এ নিয়ে এখন আলোচনা করবো না।
অ্যামিয়াস কথাটা বলেই ঘর থেকে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছাড়লাম আমিও, ঐভাবে থাকতে মেয়েদের সঙ্গে একটুও ভালো লাগছিলো না। ওকে ধরলাম আমার বাইরের বারান্দায় গিয়ে। শাপ-শাপান্ত করছিলো অ্যামিয়াস, আমি কখনো এভাবে রাগ করতে দেখিনি। গর্জে উঠলো তারপর, কেন থাকতে পারে না মুখ বন্ধ করে? কেন পারে না? আগুনে এবার তো ঘি পড়েছে। ঠ্যালা বোঝ। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে ছবিটা।…ফিলিপ শুনছো আমার কথা? এটাই সবার সেরা আমার কাজ মতো ছবি জীবনে এঁকেছি তার মধ্যে কারুর সঙ্গে এটার তুলনা করা যায় না। আর মাথামোটা দুটো মেয়েমানুষ ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে ভণ্ডুল করতে চায় এটাকে।
একটু শান্ত হয়ে আস্তে আস্তে সে বললো, কোনো মাত্রাজ্ঞান থাকে না মেয়ে জাতটারই। আমি না হেসে থাকতে পারলাম না, বললাম, ছাড়তো এখন এসব কথা, এতো নিজের কৃতকর্মের ফল তোমার।
আমি কি তা আর জানি না।…কিন্তু নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে একটা কথা ফিলিপ, যদি কোনো পুরুষের এলসাকে দেখে মাথা ঘুরে যায় তবে দোষ দেওয়া যায় না তাকে। অন্ততঃ তা বোঝা উচিত ছিলো ক্যারোলিনের।
জিজ্ঞেস করলাম আমি, ক্যারোলিন যদি খুব কড়া হয়ে গিয়ে রাজী না হয় বিবাহ বিচ্ছেদে। তাহলে কি হবে।
অ্যামিয়াস ততক্ষণে চলে গেছে এক কল্পনার জগতে, দ্বিতীয়বার বললুম আমার কথাটা, ওর কানে সেটাও ঢুকলো না, কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে বললো, কখনই কিন্তু ক্যারোলিন অতোটা প্রতিহিংসা পরায়ন হতে পারে না। বুঝতে পারছো না তুমি ভাই।
একটা বাচ্চা আছে তাছাড়া, আমি বললাম কালার কথা।
অ্যামিয়াস আমার হাত ধরে বলেছিলো, ভালো কথাই তুমি বলেছো ফিলিপ, কিন্তু ঘ্যানঘ্যান করে এইভাবে অমঙ্গলের কথা বলে লাভ কি। আমি সামলাতে পারবো আমার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। না হলে তুমি দেখো।
আসলে অ্যামিয়াস হলো এই, উগ্রভাবে সব সময়ে আশাবাদী, যুক্তিতর্কের ধার পর্যন্ত ধারে না। তারপর হাসিখুশি মুখে সে বললো, ওদের ঝাড়ে বংশো নরকে পাঠানো উচিত।
আমাদের কোনো কথা তারপর হয়েছিলো কিনা মনে নেই, ক্যারোলিন ঘর থেকে কয়েক মিনিট পরে বেরিয়ে বারান্দায় এলো। একটা গাঢ় বাদামী রঙের অদ্ভুত ধরনের টুপি মাথায়।
কিছুই যেন ঘটেনি এমন স্বাভাবিক ভাবে বললো, ঐ রঙ লাগা কোটটা অ্যামিয়াস পাল্টে নাও। চায়ের নেমন্তন্ন আছে মেরিডিথের বাড়িতে, বসে আছে নাকি ভুলে?
তাকিয়ে রইলো বোকার মতো কিছুক্ষণ তারপর প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলো অ্যামিয়াস, ওহ,…হা ভুলেই গেছিলাম।..হ্যাঁ, হা…যাচ্ছি…নি…নিশ্চয়ই।
তাহলে যাও চেহারাটা একটু ভদ্র করে নাও পোযাক পাল্টে। গলার স্বর স্বাভাবিক হলেও ক্যারোলিনের, ও কিন্তু তাকাচ্ছিলো না অ্যামিয়াসের দিকে। কিছু ডালিয়া ফুল ফুটেছিলো সামনেই, ঝুঁকে পড়ে ক্যারোলিন তুলতে লাগলো খুব ফোঁটা ফুলগুলো।
ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর অ্যামিয়াস চলে গেলো। আমার সঙ্গে ক্যারোলিন বকবক করতে শুরু করেছিলো আবহাওয়া সম্বন্ধে। মাছ ধরা যাবে কিনা এই সময়, যদি যায় তবে ও মাছ ধরতে যাবে অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। সত্যিই এই ক্যারোলিন অসাধারণ মহিলা। ওকে দিতেই হবে এ মর্যাদাটা।
তবে মনে হয় আমার ওর আসল রূপটাকে এই ঘটনাটাই ফুটিয়ে তোলে। ক্যারোলিনের মনের জোর ছিলো দারুণ আর আত্মবিশ্বাস ছিলো অদ্ভুত। ও তখনই স্বামীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কিনা জানি না, তবে নিলেও কিছু নেই আশ্চর্য হবার। তৈরি করা নিজের পরিকল্পনা এবং তা কার্যকর করার ক্ষমতাও ঠান্ডা মাথায় তার ছিলো।
দারুণ বিপজ্জনক মহিলা ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল। তখনই আমার বোঝা উচিত ছিলো যে মুখ বুজে ব্যাপারটা ও সহ্য করবে না। অথচ বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও নীরবে মেনে নেবার জন্যে ভাগ্যকে তৈরি হচ্ছে, কিংবা ভেবেছিলো হয়তো অ্যামিয়াসের মন স্বাভাবিক ব্যবহার করলে পাল্টাতেও পারে।
সকলেই তৈরি হয়ে একটু পরে বেরিয়ে পড়লো। একটু উদ্ধত এলসা, কিন্তু বিজয়িনীর ভাব মুখে। ওর দিকে তাকালোই না ক্যারোলিন। অ্যাঞ্জেলা সামাল দিলো পরিস্থিতির। তর্ক করতে লাগলো মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে কিছুতেই ও পাল্টাবে না নিজের পোষাক। এসব দিকে মেরিডিথ নজর দেন না।
হাঁটছিলাম আমরা। ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলা এক সঙ্গে। আমি আর আমিয়াস। একা একা এলসা, মৃদু হাসি মুখে।
কখনো আমাকে এলসা মুগ্ধ করতে পারেনি–উগ্র প্রকৃতির মেয়ে বড় বেশি মাত্রায়। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে একথা যে তাকে সেদিন বিকেলে অপূর্ব সুন্দরী লাগছিলো। মেয়েদের মনের বাসনা পূর্ণ হলে যেমন দেখতে লাগে অসাধারণ।
বিকেলবেলার ঘটনাগুলো সেদিন আমার খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে না। ঝাপসা হয়ে আছে সব ব্যাপারটা। তবে মনে আছে এটা যে বাড়ি থেকে মেরিডিথ বেরিয়ে এসেছিলেন আমাদের স্বাগত জানাবার জন্যে। প্রথমে মনে হয় আমরা বাগান ঘুরে হেঁটেছিলাম। অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে টেরিয়ার কুকুরদের ট্রেনিং দিতে হয় কিভাবে এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। অ্যাঞ্জেলা আপেল খাচ্ছিলো পেটুকের মতো, আর জোর করছিলো আমাকেও খাবার জন্যে।
দেখলাম বাড়িতে ঢোকার পর বিরাট সিডার গাছের তলায় আয়োজন করা হয়েছে চায়ের। খুব বিব্রত লাগছিলো মেরিডিথকে। মনে হয় আমার, ক্যারোলিন বা অ্যামিয়াস কিছু বলেছিলো দাদাকে। সন্দেহের চোখে কেমন যেন একবার ক্যারোলিনের দিকে আর একবার তাকাচ্ছিলেন এলসার দিকে দাদা। মনে হয় খুব চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন।
কয়েকটা কথা দাদা চট করে চায়ের পর আমার সঙ্গে বলে নিয়েছিলেন, ফিলিপ দ্যাখ, এটা করতে পারে না অ্যামিয়াস।
আমি বলেছিলাম, আর কোরো না ও ভুলটা; ও করবেই।
ওই মেয়েটার সঙ্গে যাবার জন্যে নিশ্চয়ই ফেলে দিতে পারে না অ্যামিয়াস নিজের বৌ-মেয়েকে, তাছাড়া বড় জোর আঠার হবে ঐ মেয়েটার বয়স, ওর থেকে অনেক বড় অ্যামিয়াস।
দাদাকে আমি জানিয়েছিলাম পুরো কুড়ি বছরের মহিলা মিস এলসা গ্ৰীয়ার।
যাই হোক না কেন, কম বয়সটা, ওর বোঝার ক্ষমতা নেই কী করছে।
বেচারা মেরিডিথ বুড়ো, সব সময়ে অতি উৎসাহী পাক্কা সাহেব। আমি বলেছিলাম, চিন্তা কোরো না একটুও বুড়ো খোকা। ও কি করছে এলসা গ্ৰীয়ার জানে এবং ওর ভালোই লাগছে করতে।
আমরা পেয়েছিলাম ঐটুকুই বলার সুযোগ। মনে হয়েছিলো আমার স্বামী পরিত্যক্তা হতে চলেছে ক্যারোলিন এই কথাটা চিন্তা করে খুব সম্ভব মেরিডিথ বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। ক্যারোলিন অবশ্যই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে আশা করবে যে আছে তার প্রতীক্ষায় এতোদিন ধরে তাকে সে নিশ্চয়ই বিয়ে করবে, এই দুর্বলতাটা মেরিডিথের আমি জানতাম এবং মজাও লাগতো আমার বেশ কথাটা ভেবে।
ঐ দুর্গন্ধে ভরা ঘরে গিয়ে মেরিডিথের কি করেছিলাম তা মনে নেই বললেই চলে। নিজের শখের নেশা মানুষ দেখাতে ভালোবাসে পাঁচজনকে। অথচ আমার খুব বিরক্তিকর মনে হয় ব্যক্তিগতভাবে জিনিসটা। মনে পড়ে যতদূর যখন দাদা ল্যাবরেটারিতে বিশদ ব্যাখ্যা করছিলেন কোনাইন বিষের তখন অন্যদের সঙ্গে সেখানে আমিও ছিলাম, তবে স্মরণ নেই ঠিক। এবং ক্যারোলিনকে ঐ জিনিসটা চুরি করতেও দেখিনি। যা বলেছিলাম, বড্ড বেশি চালাক আর চটপটে মেয়ে ক্যারোলিন। প্লেটো দিয়েছিলেন সক্রেটিসের মৃত্যুর যে বর্ণনা সেই অংশটা পড়ে শুনিয়েছিলেন মেরিডিথ। আমার ভালো লাগে না ওসব প্রাচীন সাহিত্য।
এর বেশি আমার আর সেদিনের ঘটনা মনে নেই। বেশ জমিয়ে অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলা একপ্রস্থ ঝগড়া করে নিলো, আমরা বেশ রসিয়ে উপভোগও সেটা করেছিলাম। এর ফলে সম্ভব হয়েছিলো অন্য অসুবিধেগুলো এড়ানো। শেষ পর্যন্ত গালাগালি দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলো, অ্যামিয়াসকে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে অভিশাপ দিয়েছিলো-১। সে এর বদলা নেবে, ২। অ্যাঞ্জেলা মরণ কামনা করছে অ্যামিয়াসের, ৩। অ্যামিয়াস কুষ্ঠ ব্যাধি হয়ে মরুক, তাহলেই শাস্তি হবে উপযুক্ত, ৪। অ্যামিয়াসের নাকে রূপকথার কাহিনীর মতো যেন সসেজ আটকে যায়, না খোলে কিছুতেই। ওর ছেলেমানুষী কথা শুনে খুব হেসেছিলাম আমরা।
বিছানায় তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলো ক্যারোলিন, মিস উইলিয়ামস চলে গেলেন তার ছাত্রীর সন্ধানে –এলসা আর অ্যামিয়াস বাগানে বেড়াতে গেলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে আমাকে কেউ চাইছিলো না, তাই একা একা আমি বেড়াতে লাগলাম, ভারী সুন্দর ছিলো রাতটা।
নিচে নেমে এসে পরদিন সকালে বসলাম খাবার ঘরে, মাঝে মাঝে বেশ মজার জিনিস মানুষ মনে রাখে। তাই আমারও সেদিনের খাবারের কথাগুলো মনে আছে স্পষ্ট।
পরে ঘুরে ঘুরে আমি সবার খোঁজখবর শুরু করেছিলাম নিতে। গেলাম বাইরে, কোথাও নেই কেউ, সিগারেট একটা খেয়ে ফিরছি, দেখি মিস উইলিয়ামস খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ফাঁকিবাজ ছাত্রীকে। শুনতে পেলাম হলঘরে ফিরে এসে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন লাইব্রেরী ঘরে কথা কাটাকাটি করছে। ওরা বেশ জোরেই কথা বলছিলো, ক্যারোলিন বলছে আমি শুনলাম, তুমি আর তোমার ঐ মেয়ে মানুষটা। ইচ্ছা করছে তোমাকে খুন করতে, আমি তোমাকে এক দিন না একদিন খুন করবই। অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো, ক্যারোলিন বোকামি কোরো না। উত্তরে ক্যারোলিন বলেছিলো, করি কিনা দেখো।
আমার আড়াল থেকে আর ওদের ঝগড়া ইচ্ছে হয়নি শুনতে, বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। এলসার সঙ্গে চত্বরে দেখা হাঁটতে হাঁটতে।
এলসা একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছিলো, পাতা ছিলো বেঞ্চটা লাইব্রেরী ঘরের জানলার ঠিক নিচে। এলসা সব কথাই জানালাটা খোলা ছিল বলে শুনতে পেয়েছিলো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অত্যন্ত শান্তভাবে এলসা এগিয়ে এলো আমাকে দেখে, হাসি মুখে, হাত ধরে আমাকে বললো, কি সুন্দর সকালটা, তাই না?
সকালটা সুন্দরই ছিলো বটে তার মতো নিষ্ঠুর মেয়ের পক্ষে। না, বলা ঠিক নয় অতোটা। মোটামুটি সৎ আর বড় বেশি গদ্যময় মেয়েটি। ও শুধু নিজের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কিছু দেখে না।
ওর সঙ্গে প্রায় মিনিট পাঁচেক গল্প করলাম চত্বরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দড়াম করে লাইব্রেরীর দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠে দেখলাম বেরিয়ে আসছে অ্যামিয়াস। মুখ চোখ লাল। তারপর ভদ্রতার ধার কোনোরকম না ধরেই এলসার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলো সময় হয়েছে সিটিং হয়েছে, শেষ করতে হবে ছবিটা।
বললো এলসা, ঠিক আছে। শুধু একবারটি আমি গিয়ে আনবো সোয়েটারটা, শীত শীত করছে একটু।
বাড়ির ভেতরে গেলো এলসা। ভাবছিলাম আমি দেখি আমার সঙ্গে কথা বলে কি না অ্যামিয়াস। ঠিকই বললো, তবে কয়েকটা মাত্র শব্দ, এই সব মেয়েমানুষগুলো।
বুড়ো খোকা ওসব কথা বাদ দাও হাসতে হাসতে আমি বললাম।
ফিরে না আসা পর্যন্ত এলসা আর আমাদের কোনো কথা হয়নি।
কামান বাগানে ওরা দুজনেও চলে গেলে বাড়ির মধ্যে আমিও ফিরলাম। ক্যারোলিন দাঁড়িয়েছিলো হলঘরে, লক্ষ্য করলো কি না আমাকে জানি না। মাঝে মাঝে ও ওইরকম করতো। নিজেকে হঠাৎ ভীষণভাবে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতো। আপন মনে বিড়বিড় করে ক্যারোলিন কি যেন বলছিলো। আমার কানে কয়েকটা কথা এসেছিলো, বড্ড বেশি নিষ্ঠুর…
ও ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলো। তারপর হেঁটে আমার পাশ দিয়ে ওপরে চলে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। আমাকে তখন লক্ষ্য করেনি কিন্তু, ও যেন মনে হচ্ছিলো একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নিজের ধারণা আমার (অবশ্য আমার কোনো অধিকার নেই একথা বলার, বলে রাখছি একথা আপনাকে) ও গিয়েছিলো ওপরে বিষটাকে নেবার জন্য এবং ও ঠিক করে নিয়েছিলো তখনই কি করবে।
সেই মুহূর্তে ঠিক বেজে উঠলো টেলিফোনটা, চাকররা এসে অন্য বাড়ি হলে ফোন ধরে, কিন্তু এতোবার আমি এসেছি অ্যাল্ডারবেরিতে যে ফোনটা নিজেই তুলে নিলাম।
ফোন করছিলেন আমার দাদা মেরিডিথ। ঘাবড়ে গেছেন বেশ। জানালেন যে আমাকে ল্যাবরেটরিতে সকালে গিয়ে দেখেছেন অর্ধেক খালি হয়ে আছে কোনাইনের শিশি।
দু’বার করে আর একই কথা বলার দরকার নেই। মনে হয় এখন আমার, তখন তাই করা উচিত ছিলো। আমায় দারুণ চমকে দেয় ব্যাপারটা, গিয়েছিলাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, সেই অবস্থা দাদারও। এমন সময় কার পায়ের শব্দ সিঁড়িতে শুনে বলেছিলাম–কথা হবে ঘরে। যেন এখুনি চলে আসেন দাদা।
আমি তারপর নিজেই দাদার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম দেখা করার জন্যে। আপনার তো জানা নেই এ দিকটা, তাই লিখছি,একটা জমিদারী থেকে অন্য জমিদারীতে যাবার সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হলো নৌকো করে যাওয়া। অতএব আমি এগিয়ে গেলাম জেটির দিকে, পথটা চলে গেছে কামান বাগানের পাশ দিয়ে। অ্যামিয়াস আর এলসা কথা বলছে যেতে যেতে শুনলাম, ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে। বেশ বেপরোয়া আর হাসিখুশি লাগছিলো ওদের। দারুণ গরম পড়েছে, অ্যামিয়াস বলছিলো (গরম পড়েছিলো সেপ্টেম্বরের পক্ষে বৈকি) আর সিটিং দিচ্ছিলো এলসা পাঁচিলের কাছে বসে। ওখানে শীত শীত ভাব সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায়। হঠাৎ বলে উঠলো এলসা, আর ভালো লাগছে না পোজ দিয়ে বসে থাকতে। লক্ষ্মীটি একটু বিশ্রাম করে নেবো? গর্জে উঠেছিলো সঙ্গে সঙ্গে অ্যামিয়াস, না, এখন ওসব বিশ্রাম-টিশ্রাম চলবে না, বসে থাকো চুপ করে। বড়ো ঝামেলার মেয়ে তুমি। এগোচ্ছে ছবিটা, অতএব কথা নয় কোনো। এলসা হাসতে হাসতে আমার কানে এলো বলছে, জংলী জানোয়ার কোথাকার।
একাই নৌকো চালিয়ে এলেন মেরিডিথ। নৌকো বেঁধে ছোট্ট জেটিতে রাখার পর আমার কাছ ফ্যাকাশে মুখ করে দাঁড়ালেন।
ফিলিপ আমার চেয়ে তোমার বুদ্ধি অনেক বেশি। কি করা যায় এক্ষেত্রে বলল, ভীষণ বিপজ্জনক জিনিসটা। বলেছিলাম আমি, আপনার এ ব্যাপারে একটুও ভুল হচ্ছে না তো? বলে রাখি এখানে বরাবরই আমার দাদাটি একটু ভুলো টাইপের মানুষ, তাই ততো গুরুত্ব ওঁর কথায় দিইনি; অথচ উচিত ছিলো দেওয়া। কিন্তু ওঁর কোনো ভুল হয়নি দাদা বললেন, শিশিটা ভর্তি ছিলো গতকাল বিকেল পর্যন্ত।
আর চুরি কে করেছে সঠিক করে এ বিষয়েও কিছু বলতে পারছেন না আপনি?
বলতে পারলেন না উনি, উল্টে কী মনে হয় আমার জানতে চাইলেন সে কথা। কেউ করে থাকতে পারে কি চাকরদের মধ্যে? হতে পারে আমি বলেছিলাম, তবে তারা কেউ করেনি খুব সম্ভব আমার ধারণা। রোজই তো বন্ধ করে রাখা হতো দরজা, তাই না? তা রাখা হতো দাদা বলেছিলেন। তারপর এক দীর্ঘ বক্তৃতা অসংলগ্ন ভাব কেঁদেছিলেন, কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন উনি একটা জানলার পাল্লার তলার দিকে ফাঁক দেখা গিয়েছিলো বেশ কয়েক ইঞ্চি। কেউ ঢুকে থাকতে পারে ঐ পথে–এই সব।
হতে পারে কি সিদেল চোরের কাণ্ড? আমি প্রশ্ন করেছিলাম সন্দিগ্ধভাবে। এর পেছনে আমার তো মনে হচ্ছে অনেক কিছু নোংরা থাকতে পারে।
ঠিক কি কথা আমি চিন্তা করছি তা জানতে চেয়েছিলেন দাদা। তখন বলেছিলাম আমি বিষটা চুরি যাবার ব্যাপারটা ঠিক হয় যদি তার ধারণা হয় আমার চুরি করেছে ক্যারোলিন, এলসাকে খাওয়াবার জন্যে, চুরি করেছে এলসা। তার প্রেমের পথ থেকে ক্যারোলিনকে সরিয়ে দেবার জন্যে।
একটু উত্তেজিত হয়ে মেরিডিথ বলেছিলেন, অসম্ভব এটা, অতি-নাটকে চিন্তা এবং সত্যি হতে পারে না কখনই। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা চুরি তো বিষটা হয়ে গেছে ঠিকই, এখন আপনি কি ব্যাখ্যা এ ব্যাপারে দিতে পারেন, বলুন? কোনো সঠিক ব্যাখ্যা উনি দিতে পারেননি। উনিও আসলে ঠিক আমার কথাটাই চিন্তা করছিলেন, কিন্তু মুখ ফুটে সাহস করে বলতে পারছিলেন না।
তখন প্রশ্ন করলেন মেরিডিথ, এক্ষেত্রে কি করা উচিত আমাদের?
এবং বোকার মতো আমিও বলেছিলাম, এ ব্যাপারে খুব ভালোভাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে। হয় বিষটা সবার সামনে চুরি যাবার কথা ঘোষণা করুন, কিংবা এ ব্যাপারে চাপ দিন ক্যারোলিনকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাতে যদি মনে হয় আপনার ক্যারোলিন চুরি করেনি বিষ, তখন এলসার ওপর ওই ভাবে চাপ দেবেন। তখন মেরিডিথ বলেছিলেন ও কাজ এলসার মতো মেয়ে করতে পারে।
ঐ পথটা ধরে বাড়ির দিকে আমরা এগিয়ে আসছিলাম। শেষ মন্তব্যটির পরে আমরা আর কোনো কথা বলিনি। ক্যারোলিনের গলার স্বর শুনতে পেলাম কামান বাগানের কাছে এসে।
মনে হয়েছিলো আমার ঝগড়া হচ্ছে তিনজনের মধ্যে, অথচ ওরা আসলে আলোচনা করছিলো অ্যাঞ্জেলার ব্যাপার নিয়ে। প্রতিবাদ জানিয়ে ক্যারোলিন বললো, বড় বেশি নিষ্ঠুর ব্যবহার হয়ে যাবে মেয়েটার ওপর। বেশ অধৈর্য হয়ে আমিয়াসও সায় দিয়েছিলো তার কথায়। তারপর আমাদের ঢুকতে দেখে বাগানের দরজা খুলে বেশ অবাক হয়ে যায় অ্যামিয়াস। বেরিয়ে আসছিলো ক্যারোলিন, আমাদের দেখে বললো, হ্যালো মেরিডিথ আমরা অ্যাঞ্জেলাকে স্কুলে পাঠাবার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ঠিক বুঝতে পারছি না আমি ওর পক্ষে এটা মঙ্গল হবে কিনা।
অ্যামিয়াস বলে উঠেছিলো, বেশি বাড়াবাড়ি করবে না মেয়েটাকে নিয়ে। ভালোই থাকবে মেয়েটা স্কুলে। নিষ্কৃতি পাবো আমরাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে লাল টকটকে একটা সোয়টার হাতে এলসা বাড়ির দিক থেকে এলো। অ্যামিয়াস ওকে দেখে বলে, চলো চলো, পোজ দেবে চলো, আর সময় নষ্ট করতে চাই না। ইজলের সামনে গিয়ে মিয়াস দাঁড়ালো। ওর পা-টা একটু কঁপছিলো, তবে কি মদ খুব বেশি খেয়েছে। যে রকম চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি চলছে তাতে ও এটা করবে আর আশ্চর্যের কি আছে!
বিরক্তির সুর গলায় ফুটিয়ে বললো, যেন আগুনের মতো গরম বিয়ারটা। কেন যে এখানে বরফ রাখা হয় না কে জানে?
তখন ক্যারোলিন বলেছিলো, আমি এখুনি ফ্রিজের ঠান্ডা বিয়ার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ধন্যবাদ, কোনো রকমে অসন্তোষ চাপা দিয়ে কথাটা অ্যামিয়াস বলেছিলো।
তারপর ক্যারোলিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে কামান বাগানের দরজা ভেজিয়ে বাড়িতে এলো। চত্বরে বসে পড়লাম আমরা বাড়ির মধ্যে ক্যারোলিন ঢুকে গেলো। অ্যাঞ্জেলা মিনিট পাঁচেক পরে কয়েক বোতল বীয়ার আর গ্লাস নিয়ে এলো। বেশ গরম ছিল দিনটা, আমরা তার সদগতি করতে লাগলাম সানন্দে। এমন সময় দেখি ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে এক বোতল বীয়ার নিয়ে দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে চেয়েছিলেন যেতে মেরিডিথ, কিন্তু বাঁধা দিয়ে ক্যারোলিন জোর করেই চলে গেলো একলা। আমি ভেবেছিলাম ক্যারোলিন ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছে। একলা থাকতে দিতে চাইছে না অ্যামিয়াস আর এলসাকে, অথচ মনে হয় আজ বোকার মতোই না আমি তখন ও কথা ভেবেছিলাম।
ওকে চলে যেতে দেখেছিলাম আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে আমি আর দাদা। কি করবো আমরা তখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। অ্যাঞ্জেলা এমন সময় ডাকলো আমাকে সমুদ্রে স্নান করতে যাবার জন্যে। একলা পাওয়া মেরিডিথকে মুস্কিল হচ্ছে দেখে শুধু বলে গেলাম যাবার সময় দুপুরে খাওয়ার পর। মাথা নেড়ে সায় দিলেন দাদা।
অনেকক্ষণ অ্যাঞ্জেলার সাথে সাঁতার কেটে রৌদ্র স্নান করছিলাম একটা পাথরের ওপর শুয়ে। আর বকবক করছিলো না অ্যাঞ্জেলা, ফলে আমি ভাববার সময় পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম আমি ক্যারোলিনকে দুপুরে খাওয়ার পর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুরির ব্যাপারে প্রশ্ন করবো সরাসরি। চলবে না দাদাকে দিয়ে করলে, উনি বড্ড দুর্বল চিত্ত মানুষ। ক্যারোলিন বাধ্য হবে চাপ পড়লে ফিরিয়ে দিতে বিষটা, না দেয় যদি, ওটা কাজে আর লাগাতে পারবে না। আর বেশ পোড় খাওয়া মেয়ে এলসা, কম বয়স, নিশ্চয়ই গণ্ডগোল বাধাবে না বিষ নিয়ে। অত্যন্ত চালাক চতুর মেয়ে, নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলবেই। ক্যারোলিন আবার এ ব্যাপারে ভীষণ বিপজ্জনক মানুষ, ভারসাম্য নেই মনের। অনেক কিছু করে ফেলতে পারে আবেগের ঘোরে। ওর নার্ভগুলোও ভালো নয়। তবে একটা কথা আমি তখন পারছিলাম না মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে–কোনো ভুল করছেন না তো দাদা? আবার চুরি তো চাকর বাকরও করতে পারে? নিশ্চয়ই জানেন, অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ব্যাপার বিষের ব্যাপারটা ভরসা করা যায় না এর ওপর।
এবং কিছু না ঘটে যতক্ষণ, কিছু বলাও যায় না।
অনেক সময় কেটে গেছে এইসব চিন্তা করতে করতে। ছুটলাম আমি আর অ্যাঞ্জেলা, সময় হয়ে গেছে লাঞ্চ খাওয়ার। সবাই টেবিলে বসে পড়েছে অ্যামিয়াস বাদে। অ্যামিয়াস কামান বাগানেই থেকে গেছে। ও প্রায়ই এ রকম করে, তবে আমার সেদিন মনে হয়েছিলো অ্যামিয়াস এলো না ঝঞ্জাট এড়াবার জন্যে।
কফি খেলাম চত্বরে বসে। কেমন দেখাচ্ছিল ক্যারোলিনকে, কী করছিলো ক্যারোলিন এটা মনে করতে পারছি না কিছুতেই, ভালো হতে পারলে। তবে একটুও ওকে মনে হয়নি উত্তেজিত। ও একটা আস্ত শয়তানি।
কারণ ঠান্ডা মাথায় বিষ খাইয়ে কাউকে মারাটা শয়তানি ছাড়া আর কি। ও যদি এর চেয়ে স্বামীকে রিভলবার চালিয়ে খুন করতো, তাহলেও ওর সম্বন্ধে যা হোক অন্য কিছু ধারণা করতাম। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় এইভাবে বিষ খাওয়ানো প্রতিশোধ নেবার জন্যে…এ যে ভাবাই যায় না।
ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো–অ্যামিয়াসকে কফি দিয়ে আসতে হবে। ও জানতো অথচ..যা হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে, আর বেঁচে নেই অ্যামিয়াস। ওর সঙ্গে মিস উইলিয়ামস গেলো। তবে ডেকে ছিলো কিনা ক্যারোলিন তা মনে নেই।
চলে গেলো দুজনে। এমনি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মেরিডিথ। আমি দাদার কাছে একটা অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি ছুটতে ছুটতে আসছেন এমন সময় দেখি, সাদা হয়ে গেছে মুখটা, হাঁফাতে হাঁফাতে কোনো রকমে বললেন, ডাকতে হবে ডাক্তার…শিগগীর…অ্যামিয়াস…
চমকে উঠলাম আমি, ও কি অসুস্থ…মনে হচ্ছে মরে যাবে?
মেরিডিথ বললেন, মনে হয় তো আমার মরে গেছে।
মুহূর্তের জন্যে আমরা এলসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর তীব্র চিৎকার হঠাৎ কানে এলো। যেন বিলাপ করছেন বাস্তুলক্ষ্মী।
কেঁদে উঠলো, এলসা, মরে গেছে? মরে গেছে…। এলসা ছুটে চলে গেলো আহত হরিণীর মতো। ও যেন প্রতিশোধ নেবার হিংসাতে পাগল হয়ে উঠেছে।
কোনো রকমে মেরিডিথ বললেন, যাও ওর সঙ্গে। টেলিফোন করতে যাচ্ছি আমি। ওকে ধরো, বলা যায় না কি করে ফেলে।
আমি এলসার পেছনে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি ছুটলাম। আর একটু হলে ও ক্যারোলিনকে খুব সহজেই মেরে ফেলতে পারতো। জীবনে কখনো দেখিনি শোক আর ঘৃণার এমন অভিব্যক্তি। খুব পলেস্তারা বসে গেছে শিক্ষা-দীক্ষার। এলসার মিল মজদুর বাবা আর তার মায়ের রূপটা তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে।
তার ভেতরের আদিম নারী সত্ত্বা প্রেমিকাকে হারিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পাঁচিলের ওপর থেকে আঁচড়ে-কামড়ে ফেলে দিতে চাইছিলো ক্যারোলিনকে, কেমন যেন ধারণা হয়েছিলো এলসার অ্যামিয়াসকে ছুরি মেরেছে ক্যারোলিন। ও অবশ্য বুঝেছিলো, কোনো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে।
ওকে ধরে ফেললাম আমি, তারপর ব্যাপারটা নিজের হাতে উইলিয়ামস তুলে নিলেন। সত্যি ভালো গভর্নেসটি, এ মানতেই হবে আমাকে। চেঁচামেচি যে এই পরিস্থিতিতে করতে নেই, শান্ত থাকতে হয় এই সব কথা বলে এলসাকে ঠান্ডা করে দিলো মিনিট খানেকের মধ্যে। সত্যিই বুদ্ধিমতী মহিলাটি, এবং যা ধরে তা আর ছাড়ে না। ফলে একপাশে দাঁড়িয়ে এলসা কাঁপতে লাগলো।
আর ক্যারোলিন..মনে পড়ে যতদূর, খুলে পড়েছিলো মুখোেশ। এক পাশে ভীষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো বলতে পারেন আপনি হতভম্ব হবার মতো হয়েছিলো। কিন্তু আসলে একটুও হয়নি। ওকে ধরিয়ে দিচ্ছিল ওর চোখ দুটোই। ক্যারোলিন ভীষণ সাবধানীর মতো লক্ষ্য করে চলেছিলো সব কিছু। মনে হয় আমার ভয় ওকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছিলো…।
খুব আস্তে কথা বললাম আমি ওর কাছে গিয়ে, এতো আস্তে যা শুনতে পেলো না বাকি মহিলা। আমি বলেছিলাম, খুনী কোথাকার, শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুকে তুমি খুন করলে।
নিজেকে অদ্ভুত ভাবে গুটিয়ে নিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠলো ক্যারোলিন, না, …না, করেছে ও নিজেই…।
ক্যারোলিনের চোখে আমি চোখ রাখলাম, তুমি পুলিশকে ও সব গল্প বোলো। বলেও ছিলো ক্যারোলিন, কিন্তু বিশ্বাস করেনি পুলিশ।
ফিলিপ ব্রেকের বিবৃতির সমাপ্তি–
বিবৃতি মেরিডিথ ব্লেকের
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
কথা দিয়েছিলাম আমি তাই ষোলো বছর আগে ঘটে গিয়েছিলো যে দুঃখজনক ঘটনা, তার মনে পড়ে যতোটা সেই বিবরণ আপনাকে জানাচ্ছি লিখিত ভাবে। বলে রাখি প্রথমেই সম্প্রতি আপনার সঙ্গে দেখা হবার সময়ে আপনি যা যা বলেছিলেন খুব গভীরভাবে সে সম্বন্ধে আমি চিন্তা করেছি। আমি ভেবে দেখলাম আগে যা বিশ্বাস করতাম এখন সেই কথাই বিশ্বাস করছি আরও বেশি পরিমাণে যে ক্যারোলিন ক্রেল বিষ দেয়নি তার স্বামীকে। সব সময়েই কথাটা বেখাপ্পা লাগতো আমার কাছে। কিন্তু কোনো অন্য কারণ না থাকায় এবং নিজের তার আচরণের জন্যে আমিও অন্যদের ভেড়ার মতো মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম অভিমতটাকে, তাছাড়া ও না খুন করলে আর কে করতে পারে খুন।
আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে অনেক ভেবেছি বিষয়টা নিয়ে আমি। বিকল্প যে যুক্তি সে সময়ে দেখানো হয়েছিল এবং আসামীপক্ষ বিচারের সময় থেকে যা বলা হয়েছিলো বিশ্লেষণ করেছি সবকিছু। যুক্তিটা হলো সেই এই যে আত্মহত্যা করেছে অ্যামিয়াস ক্রেল। যতটুকু জানি আমি অ্যামিয়াসকে তার ভিত্তিতে সে সময়ে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো যুক্তিটাকে আমার। মনে করি বর্তমানে আমার বদলানো উচিত অভিমত। প্রথমেই বলি এবং গুরুত্ব আছে কথাটার যথেষ্ট যে ঐ কথাটা ক্যারোলিনও বিশ্বাস করতো। আমরা যদি এখন মেনে নিই একথা যে অন্যায় ভাবে ঐ সুন্দরী নম্র স্বভাবের মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো তবে মর্যাদা দিতে হয় তার বহুঁকালিক বিশ্বাসটিকে। ও অ্যামিয়াসকে আমাদের সকলের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চিনতো। যদি ওটাকে ক্যারোলিন আত্মহত্যা মনে করে থাকে তবে অবিশ্বাসী অ্যামিয়াসের বন্ধুরা যাই বলে থাকুক না কেন ওটা আত্মহত্যাই।
একটা তত্ত্ব আমি খাড়া করছি–বিবেক বলে একটা বস্তু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যে, চাপা অনুতাপও ছিলো মনের মধ্যে এর, ওই কাজটা ও করে থাকতে পারে। চরম হতাশার আবর্তে পড়ে এবং এই ধরনের ওর মানসিক যন্ত্রণার কথা বেশি ভালো করে স্ত্রী ছাড়া আর কে পারে জানতে বলুন। যদিও ঐ ধরনের কোনো কিছু কখনো শুনিনি বলতে আমি। তবে ঠিক এ কথাও অনেক গুজবের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে এই ধরনের যা আদৌ সন্দেহ করা যায় না এবং তার প্রকাশ হঠাৎ হলে বেশ আশ্চর্য হয়ে যাই আমরা। সম্মানিত ও সংযমী মানুষের মধ্যে জীবনের অনেক স্থূল দিক লুকিয়ে থাকতে পারে। অনেক সময় অর্থলোভী মানুষের মধ্যে দেখা দেয় অসাধারণ শিল্পবোধ। কোমলতা, স্নেহ থেকে আপাত নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ে। নিষ্ঠুর প্রবৃত্তির চাপ থাকে হাসিখুশি মানুষের মধ্যে।
ফলে হতে পারে এটা যে অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যেও ছিলো একটা আত্মধিক্কারের বোধ। সে যতই চেঁচামেচি বাইরে করুক না কেন, তাকে সহ্য করতে হতো বিবেকের দংশন সংগোপনে। এটা অযৌক্তিক হলেও আপাত দৃষ্টিতে, আমার মনে হচ্ছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য করার নয় কথাটা বারবার ক্যারোলিনও বলেছিলো। আর আমি বলছি আজ, উড়িয়ে দেবার নয় কথাটা।
এবারে আসা যাক প্রকৃত ঘটনায়, অর্থাৎ এই নতুন বিশ্বাসের আলোতে আমাদের প্রকৃত ঘটনার মূল্যায়ন করি।
মনে হয় আমার এক্ষেত্রে অ্যাল্ডারবেরিতে এলসার প্রথম আসার সময় অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহ আগে ঐ দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটার ক্যারোলিনের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিলো আমার তার বর্ণনা দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আগেই তো আমি বলেছি আপনাকে যে আমার ক্যারোলিনের প্রতি প্রগাঢ় স্নেহ আর বন্ধুত্বের মনোভাবটা অজানা ছিলো না তার। ফলে সহজেই আমার কাছে সে তার মনের গোপন কথা বলতে দ্বিধা করতো না। মনে মনে ও যে অশান্তিতে ভুগছে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তবুও একদিন যখন প্রশ্ন করে বললো যে সত্যি সত্যিই কী অ্যামিয়াস জড়িয়ে পড়েছে এলসার ব্যাপারে, তখন পারিনি আশ্চর্য না হয়ে।
আমি বলেছিলাম শুধু ছবি আঁকার ব্যাপারে অ্যামিয়াস আগ্রহী। অ্যামিয়াসকে তুমি তো ভালোভাবেই চেনেনা।
ক্যারোলিন মাথা নেড়ে বলেছিলো, না, মেয়েটাকে ও ভালোবাসে।
তা একটু আধটু হতে পারে। ভীষণভাবে ভালোবাসে আমার ধারণা।
আমি বলেছিলাম, মেয়েটা দারুণ সুন্দরী স্বীকার করছি। আর এ ব্যাপারে আমরা জানি অ্যামিয়াসের দুর্বলতার কথা তবে এটাও ঠিক যে যদি মনে প্রাণে অ্যামিয়াস কাউকে চায়, সে তুমিই। ওর মোহ এ ব্যাপারে বরাবরই আছে। কিন্তু বেশিদিন তা টেকে না। আর খারাপ ব্যবহার তোমার সঙ্গে করলেও তুমিই সব ওর কাছে।
বলেছিলো ক্যারোলিন, সব সময়ে তাই মনে করতাম আমিও আগে।
ক্যারোলিন বিশ্বাস করো, তাই আছে এখনও।
না মেরিডিথ এবার কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে আমার। ঐ মেয়েটা..মনেপ্রাণে ভীষণভাবে চাইছে। প্রচণ্ড কম বয়সও…তীব্রতাও বেশি। কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার বেশ জটিল এবারে ব্যাপারটা।
আমি বলেছিলাম, বয়েস যে ওর কম, আর প্রচণ্ড আন্তরিকতাও তাই তেমন কোনো ভাবনার কারণ দেখা দেবে না। অ্যামিয়াসের মেয়ে শিকারের ব্যাপারে কোনো বাছ-বিচার না থাকলেও ব্যাপারটা অন্যরকমের দাঁড়াবে এই ধরনের মেয়ের ক্ষেত্রে।
হ্যাঁ, আমি সে ভয়টাই খাচ্ছি, ব্যাপারটা দাঁড়াবে অন্যরকমের, ক্যারোলিন বললো, এখন আমার চৌত্রিশ চলছে। দশবছর হলো বিয়ে হয়েছে। আমার তুলনা করা চলে না ঐ এলসা মেয়েটার সঙ্গে আর আমি সেটা ভালোভাবেই জানি।
কিন্তু ক্যারোলিন তুমি তো জানো, যে সত্যি সত্যিই অ্যামিয়াস ভালোবাসে তোমাকে।
ক্যারোলিন তার উত্তরে বলেছিলো, সব সময় কী পুরুষদের চেনা যায়? একটু বিষাদের সুরে তারপর বললো, মেরিডিথ একটা আদিম নারীসত্ত্বা আছে আমার মধ্যে, ইচ্ছে করে আমার, একটা কাটারি হাতে মেয়েটির কাছে চলে যাই।
বুঝিয়েছিলাম আমি ক্যারোলিনকে যে হয়তো মেয়েটা বুঝতেই পারছে না যে ও কী করছে। দেবতার মতো ভক্তি করে অ্যামিয়াসকে এবং চিন্তাও করতে পারে না ওকে ভালোবেসে বসে আছে অ্যামিয়াস।
আমার কথাটা ক্যারোলিন হেসে উড়িয়ে দিলো এব বাগান সম্বন্ধে প্রসঙ্গ পাল্টে গল্প করতে লাগলো। ও বোধ হয় ভুলে গেছে আমি ভেবেছিলাম।
আমি বলেছিলাম, মেয়েটার ভীষণ আকর্ষণ আছে স্বীকার করছি। আর দুজনেই আমরা জানি যে অ্যামিয়াস একটু বেশি দুর্বল এ ব্যাপারে তবে একথাও সেইসঙ্গে তোমার জানা উচিত যে যদি কাউকে অ্যামিয়াস ভালবাসে তবে সে তুমিই। এইসব মোহ তার থাকলেও, কেটে যায় কদিন পরে। তুমিই একমাত্র মহিলা ওর কাছে, যতো ঝগড়াই হোক না কেন, ও নিশ্চিন্ত। তোমার ব্যাপারে।
তাইতো মনে করতাম এতোদিন।
ক্যারোলিন বিশ্বাস করো আমার কথা, তাই আছে এখনও।
এবার কিন্তু মেরিডিথ বেশ ভয় করছে আমার। ভীষণভাবে মেয়েটা…অ্যামিয়াসকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে চাইছে যে ভয় লাগছে আমার। বয়স কম…তীব্রতাও আছে আকাঙ্ক্ষায়।
আমি বলছিলাম ওর কথা শুনে, কম বয়স মেয়েটার, তার ওপর ভীষণভাবে আবার একনিষ্ঠ বলছে, তাহলে তো কমেই গেলো ভয়ের ব্যাপার। নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারে এ ধরনের মেয়েরা। এটা তো ঠিক অ্যামিয়াস মেয়েদের নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসে। ও অন্য পথ নেবে এই ধরনের মেয়ের পাল্লায় পড়লে।
হ্যাঁ, সেই ভয়ই তো হচ্ছে আমার, ও ধরতে পারে অন্য পথ, বললো ক্যারোলিন, এখন চৌত্রিশ চলছে আমার। বিয়ে হয়েছে দশ বছর হলো, পাল্লা দিতে এলসার সঙ্গে যে পারবো না সে কথা জানি ভালভাবেই আমি।
আমি তখন বলেছিলাম, কিন্তু ক্যারোলিন সেইসঙ্গে তুমি একথাও জানো তুমি জানো যে তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে অ্যামিয়াস।
ক্যারোলিন উত্তরে বললো, পুরুষদের ব্যাপারে কখনো কি সঠিকভাবে কিছু বলা যায়, তারপর বিষাদের হাসি একটু হেসে বললো, আমার মধ্যে কিন্তু একটা আদিম মেয়েমানুষ আছে। বলা যায় না ওর কাছে দা নিয়ে পৌঁছেও যেতে পারি।
আমি ক্যারোলিনকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, বলেছিলাম এলসা মেয়েটা বাচ্চা, বোঝে না কি করবে কিছুই। ও অ্যামিয়াসের মুগ্ধ ভক্ত, কিন্তু নিশ্চয়ই একথা বুঝতে পারছে না যে ক্রমশঃ ওকে আমিয়াস ভালবেসে ফেলছে।
তার উত্তরে শুধু ক্যারোলিন বলেছিলো, তুমি সত্যিই সরল মানুষ মেরিডিথ, তারপর একরকম ইচ্ছে করেই বাগান করা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিলো। যেন সে পাল্টাতে চায় প্রসঙ্গটা।
এলসা এর কিছুদিন পরেই লন্ডনে চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ বাইরে ছিলো অ্যামিয়াসও। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের ব্যাপারটা। আবার জানলাম ফিরে এসেছে এলসা অ্যাল্ডারবেরিতে যাতে ছবিটা অ্যামিয়াস তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারে।
আমাকে একটু বিচলিত করেছিলো খবরটা। কিন্তু যখন দেখা হলো ক্যারোলিনের সঙ্গে তেমন কিছুই আমাকে বললো না। ও সাধারণতঃ যেমন কোনো দিকে না কান দিয়ে যেতে থাকে নিজের কাজে তাই দেখলাম এবারও। ধরে নিয়েছিলাম আমিও, তাহলে ঠিক আছে সবকিছু।
কিন্তু ব্যাপারটা পরে অততদূর গড়িয়েছে শুনে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম আমি মনে।
যা কথাবার্তা হয়েছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল আর এলসার সঙ্গে তা আপনাকে আমি জানিয়েছি। আলোচনা করার সুযোগ হয়নি ক্যারোলিনের সঙ্গে। মাত্র দু-একটা কথা হয়েছিলো, আপনাকে যার কথা আগেই জানিয়েছি।
এখনো আমি দেখতে পাই তার মুখখানা, বড় বড় কালো চোখের তারা, সমাহিত শান্ত দৃষ্টি। কানে ভাসে এখনও তার কথাটা, সব শেষ হয়ে গেছে…
যে হতাশা এই কটা কথার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিলো তা আমি বর্ণনা করতে পারবো না ভাষায়। যেন বাণীরূপ দেওয়া হয়েছে পরম সত্যকে। এই বিচ্যুতির ফলে অ্যামিয়াসের সব যে হারিয়ে ফেলেছিলো ক্যারোলিন। ঐ তো একমাত্র পথ পালাবার। বোকার মতো বিষটা সম্বন্ধে যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তাতেই তো ক্যারোলিন পথের সন্ধান পেয়ে যায়। এবং যে অংশটা ফিডো থেকে পড়ে শোনাই তাতে এক মহান মৃত্যুর সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো।
এখনো বিশ্বাস আমার ক্যারোলিন বিষ এনেছিলো আত্মহত্যা করার জন্যেই, পরিত্যাগ করেছে ওকে আমিয়াস এই হতাশা আর হয়তো দুঃখবোধ থেকেই ক্যারোলিন ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটাও আমার ধারণা যে ওকে বিষ চুরি করতে দেখেও থাকতে পারে অ্যামিয়াস, কিংবা কথাটা পরে জানতে পেরেছিলো।
জানতে পারায় ওটা নিশ্চয়ই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তার মনের ওপর। তার ব্যবহারে ভয় পেয়েছিলো, আজ কত নীচে নামতে হচ্ছে ক্যারোলিনকে এই ভেবে। কিন্তু এলসাকে শত দুঃখ অনুশোচনা সত্ত্বেও ছাড়ার কথাও ভাবতে পারেনি। অবশ্য বোঝা যায় সেটা, এলসার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন।
অ্যামিয়াস যেন চিন্তাই করতে পারে না এলসাকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা, আবার এটাও জানে যে ক্যারোলিন বাঁচতে পারে না ওকে বাদ দিয়ে। ফলে ও ঠিক করেছিলো জটিল এই জাল থেকে বেরিয়ে আসার একটিমাত্র পথ খোলা আছে এবং সেটা হচ্ছে কাজে লাগানো নিজের কোনাইনটাকে।
আর ও কোনাইন যেভাবে খেলো সেটা বেশ খাপ খেয়ে যায় ওর চরিত্রের সঙ্গে। ও বোধ হয় ছবি আঁকাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো পৃথিবীতে। এবং আক্ষরিক অর্থে মনকে বরণ করার মতো হাতে তুলি নিয়ে সে পথটাই বেছে নিয়েছিলো। ভীষণ ভালোবেসেছিল যে মেয়েটাকে ও তাঁকে দেখতে দেখতে বোধ হয় মরাটাকেই জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বেছে নেয়। অ্যামিয়াস হয়তো ভেবেছিলো মেয়েটার মঙ্গল হবে ওর মৃত্যুতেই…।
এই তত্ত্বটাকে স্বীকার করছি যুক্তি দিয়ে খাড়া করতে চাইলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় কিছু অদ্ভুত তথ্যের ব্যাখ্যা। যেমন ক্যারোলিনের শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে খালি কোনাইনের বোতলে কেন? আমার বক্তব্য তার উত্তরে ওটা অ্যামিয়াস ধরার পরে যেভাবে রাখা হয়েছিলো কাপড় জামার মধ্যে তাতে আঙুলের ছাপ ঘষা লেগে উঠে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। এবং ওর মৃত্যুর পর ক্যারোলিন নিশ্চয়ই ঘেঁটেছিলো বোতলটা। হয়তো কেউ ওটা ছুঁয়েছে কি না দেখতে চেয়েছিলো। এটা নিশ্চয়ই সম্ভব, আর আঙুলের ছাপ বিয়ারের বোতল সম্বন্ধে সাক্ষীরাই তো বলেছিলো যে বিষ খাবার পর কাঁপা কাঁপা হাতের ছাপ মানুষের অমন বিকৃত হওয়া সম্ভব।
বুঝিয়ে বলতে হবে আর একটা জিনিস। ক্যারোলিনের মনোভাব বিচারের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার এখন মনে হয় আমি জেনে গেছি তার কারণ। আমার ল্যাবরেটারি থেকে ক্যারোলিনই বিষটা চুরি করেছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো স্বামীর পথ থেকে আত্মহত্যা করে সরে যাওয়া। ঐ রকম একটা মনের হয়তো বিষাদময় পরিস্থিতিতে নিজেকেই ক্যারোলিন স্বামীর মৃত্যুর কারণ বলে শুরু করেছিলো ভাবতে–নিজেকে হয়ত বুঝিয়ে ছিলো যে তার স্বামীকে সেই খুন করার অপরাধে অপরাধী–যদিও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো যে অপরাধের, সত্যি সত্যিই তেমন কোনো অপরাধ সে করেনি আক্ষরিক অর্থে অনুমান এমন করা অসঙ্গত নয় আমার পক্ষে।
মনে হয় আমার এটা হতে পারে। এবং যদি তাই হয় তবে কার্লাকে প্রকৃত ঘটনাটা বোঝানো আপনার পক্ষে বোধ হয় সহজ হবে। সে ঐ যুবককে স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে পারে। এবং সন্তুষ্ট থাকতে পারে এটা জেনে যে ওর মা আসলে অবসান ঘটাতে চেয়েছিলো নিজেরই জীবনের।
দুঃখের বিষয় এই যে আপনি এসব কথা জানতে চাননি আমার কাছ থেকে অথচ আসল ঘটনা হলো এটাই আমার মনে পড়ে যতদূর। বাদ পড়ে গিয়েছিলো যে সব কথা এবার আমি সে সব পূরণ করে দিতে চাই। অ্যামিয়াসের মারা যাবার আগের দিন ঘটেছিলো যা যা তাতো আপনাকে আগেই বলেছি। ঐ দিনটায় কথায় এবারে আসছি।
ঘুম ভালো হয়নি রাতে বন্ধুদের ব্যাপারে আমার যে বিপজ্জনকভাবে ঘটনাবলী মোড় নিয়েছিলো তার জন্যে আমার ভীষণ উদ্বেগ ছিলো। অনেক রাত পর্যন্ত আমি জেগে জেগে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম চরম বিপর্যয়টাকে কীভাবে এড়ানো যায়। আমি ভোর ছ’টার সময় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম গাঢ় ঘুমে। আমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি ভোরের চা-ও, যখন শেষে উঠলাম তখন প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে, ভীষণভাবে মাথা ভার হয়ে আছে। মনে হলো তার একটু পরে ঠিক তলার ঘরটাতে কে যেন চলাফেরা করছে, আমি যে ঘরটাকে ল্যাবরেটারি হিসেবে ব্যবহার করি।
একটা কথা এখানে বলে রাখি, শব্দ যেটা আসছিলো সেটা হতে পারে বেড়াল ঢুকে পড়ার জন্যেও। একটু ভোলা জানলার শার্সিটা, যেন অসাবধানে গতরাতে ওটা কেউ তুলে রেখে গেছিলো ওইভাবে। তবে বড়জোর একটা বেড়াল ঐ ফঁক দিয়ে ঢুকতে পারে। আমি শুধু শব্দের কথা উল্লেখ করলাম এইটুকু ব্যাখ্যা করার জন্যে যে আমি কেন ল্যাবরেটারিতে এসেছিলাম।
যেটুকু সময় লাগে পোষাক পরতে, আমি ল্যাবরেটারিতে ঢুকলাম তারপরেই, দেখলাম অন্য বোতলের সারি থেকে কোনাইনের বোতলটা একটু বেরিয়ে এসেছে। নজর ঐভাবে পড়ার পর চমকে উঠলাম আমি, খানিকটা বেশ খালি দেখাচ্ছে বোতলটা। বোতলটা প্রায় ভর্তি ছিলো আগেরদিন, আজ প্রায় খালি হয়ে আছে।
টেনে বন্ধ করলাম জানালাটা, তারপর বেরিয়ে এলাম দরজায় তালা দিয়ে। হতভম্ব তো বটেই খানিকটা বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি। চমকে উঠলে হঠাৎ আমার বুদ্ধি আর কাজ করতে চায় না ঠিকমতো।
উত্তেজিত হয়ে উঠলাম প্রথমে, তারপর ঘিরে ধরলো আশংকা এসে, শেষে ভয় পেলাম ভীষণ, জিজ্ঞেস করলাম বাড়ির লোকজনদের–না, কেউ তারা ঢোকেনি ল্যাবরেটারিতে। খানিকক্ষণ আরও চিন্তা করার পর ভাইকে আমি ফোন করে ঠিক করলাম তার মতামত নেওয়া।
আমার চেয়ে ফিলিপ বুদ্ধিমান, চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। ঐ চুরি যাওয়ার ব্যাপারটার গুরুত্ব সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে যেতে বললো আমাকে আলোচনা করার জন্যে ওর কাছে।
দেখা হলো বাইরে গিয়ে গভর্নেস মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে। উনি এসেছিলেন ওপার থেকে ফাঁকিবাজ ছাত্রীর সন্ধানে। ও ব্যাপারে ওঁকে আমি কিছুই বললাম না। অ্যাঞ্জেলার ভীষণ প্রিয় ছিলো আমার বাগানের আপেল গাছটা, তাই বাগানে গিয়ে খোঁজ করতে বললাম মিস উইলিয়ামাসকে। তাড়াতাড়ি নৌকো বেয়ে তীরে গিয়ে অ্যাল্ডারবেরির দিকে চলে গেলাম। আমার ভাই ওখানে আগে থাকতেই অপেক্ষা করছিলো।
সেদিন যে পথ দিয়ে আমি আর আপনি গিয়েছিলাম বাড়ির দিকে, সেই পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা। সেদিন তো ঐ জায়গাটা আপনি নিজে দেখেছেন, অতএব বুঝতে পারছেন কামান বাগানের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সেদিন যেতে যেতে যা কথা হচ্ছিল বাগানের ভেতরে সবই আমরা শুনেছি। উপায় ছিলো না, না শুনে।
কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন চটাচটি করছিলো। এটুকু জানা ছাড়া অবশ্য আমি মন দিয়ে আদৌ শুনিনি বলা হচ্ছিলো কি কি কথা।
তবে ভয় দেখানোর মতো ক্যারোলিনকে কোনো কথা বলতে শুনিনি। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। যাতে স্কুলে ওকে না পাঠানো হয় এই নিয়ে ক্যারোলিন কাকুতি-মিনতি করছিলো, অথচ নাছোড়বান্দা অ্যামিয়াসও, গরগর করছিলো ও রাগে, না ঠিক যখন হয়ে গেছে সব ওকে যেতেই হবে তখন। যাতে গুছিয়ে নেয় জিনিসপত্র অ্যাঞ্জেলা সেটা ক্যারোলিনের দেখার ভার।
পৌঁছেছি কামান বাগানের দরজার কাছে হঠাৎ ক্যারোলিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিলো ওকে। একটু হাসলো নিজের অজান্তেই আমাকে দেখে, বললো ওরা আলোচনা করছিলো অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে এলসা ঐ পথ দিয়ে এলো, তাড়াতাড়ি ছবিটা শষ করতে চাইছিলো অ্যামিসও।
আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি সঙ্গে সঙ্গে বলে পরে ফিলিপ দোষ দিয়েছিলো নিজেকে। কিন্তু ওভাবে আমি তখন ভাবিনি। কল্পনাও করতে পারিনি আমরা যে খুন করার মতো একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে কেউ। (আমার তাছাড়া এখনও বিশ্বাস কেউ চিন্তাও করেনি খুনের কথা)। একথা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমরা যে আমাদের কিছু একটা করা উচিত, তবে এখনও আমি বলবো প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে সাবধানে চিন্তা করার কথা আলোচনা করে ভুল করিনি আমরা। কি ঠিক করা উচিত এটা প্রয়োজন ছিলো স্থির করা–আমি দু-একবার ভেবেছিলাম একথাও যে ভুল করছি না তো আমি। আগেরদিন কি বোতলটা সত্যি সত্যিই ভরা ছিলো? একেবারে সবকিছু সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে আমি পারি না (আমার ভাই ফিলিপ যেমন হয়)। স্মৃতিশক্তি মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। যতো চিন্তা করতে লাগলাম আমি ঠিক কোথায় রেখেছিলাম বোতলটা ততোই সব গুলিয়ে ফেলতে লাগলাম। ফলে বেশ রেগে গিয়েছিলো ফিলিপ আমার ওপর।
আলোচনা স্থগিত রইলো তখনকার মতো, কথা ছিলো লাঞ্চ হবার পর হবে। (বলে রাখি একটা কথা অ্যান্ড’রবেরিতে ইচ্ছে করলেই স্বাধীনতা ছিলো আমার খুশিমতো লাঞ্চ খাবার)।
পরে বিয়ার এনে দিলো আমাদের অ্যাঞ্জেলা আর ক্যারোলিন। জিজ্ঞেস করলাম অ্যাঞ্জেলাকে কেন পড়াশোনায় ও কঁকি দিচ্ছে, মিস উইলিয়ামস ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এও বললাম, ওর কপালে বকুনী আছে। স্নান করতে গিয়েছিলো সমুদ্রে, জানালো অ্যাঞ্জেলা, কিন্তু যখন সব জামাকাপড়ই ওর স্কুলে যাবার জন্যে নতুন হচ্ছে তখন ওকে দিয়ে কেন মিছিমিছি মিস উইলিয়ামস পুরনো জামাটা সেলাই করতে চাইছেন ওর সেটা মাথায় ঢুকছে না।
নিভৃতে ফিলিপের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না দেখে ব্যাপারটা নিয়ে একা একা ভাববার জন্যে হাঁটতে শুরু করলাম আমি কামান বাগানের দিকে। ওদিকে একটা বেঞ্চ পাতা ছিলো গাছপালার ফাঁকে, আমি আপনাকে জায়গাটা দেখিয়েছিলাম। সিগারেট ধরালাম ওখানে বসে, তারপর চিন্তা করতে করতে দেখছিলাম চারপাশটা। এলসা পোজ দিয়ে বসে আছে চোখ পড়লো।
সেই দিনকার ওর রূপটা আমি ভুলবো না কোনোদিনও। সে কাঠ হয়ে বসেছিলো, একটা হলদে জামা গায়ে, প্যান্ট গাঢ় নীল রঙের আর গলায় জড়ানো লাল রঙের সোয়েটার।
যৌবন আর স্বাস্থ্যের উজ্জ্বল আভা ওর মুখে। ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা মিষ্টি গলায় বলে চলেছিলো। মনে হতে পারে এটা শুনে যে আড়ি পাতছিলাম আমি, কিন্তু তা নয়। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো আমাকে এলসাও। অ্যামিয়াস আর এলসা দুজনেই জানতো যে ওখানে বসে আছি আমি। মেয়েটা আমাকে হাত নেড়ে ডেকে বলেওছিলো অ্যামিয়াস একেবারে অভদ্রের মতো ব্যবহার করছে সেদিন সকাল থেকে। একটুও বিশ্রাম নিতে দিচ্ছে না ওকে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে সারা শরীর। ব্যথাও করছে।
হুঙ্কার দিয়ে উঠলো অ্যামিয়াস। এলসার নিশ্চয়ই ওর মতো মাথা ব্যথা নেই, সারা শরীরে ওর বাত হয়েছে। এলসা ব্যঙ্গ করে বললো, আহা! বুড়ো মানুষ বেচারা, অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো এই অকর্মণ্য নড়বড়ে লোকটাকেই তো ও ঘাড়ে নিচ্ছে যেচে।
আমার খুব খারাপ লেগেছিলো কথাটা শুনে, তারা হালকাভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎকে মেনে নিচ্ছিলো বটে কিন্তু বেশ কষ্ট যে পাচ্ছে সেটাতে দুজন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ মেয়েটার ওপর বিরূপ হতে পারলাম না আমি। এতো অল্পবয়সী, আত্মবিশ্বাস এতো আর গভীরভাবে প্রেমে এলসা জড়িয়ে পড়েছে। আর কিযে সে করছে ঠিক তাও বুঝতে পারছে না। কাকে কষ্ট বলে তাও ঠিক জানা নেই। বসে আছে সরল বিশ্বাস নিয়ে এই ভেবে যে ক্যারোলিনের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে আর শিগগীরই কাটিয়ে উঠতে পারবে সে সব বাধা। নিজেকে আর অ্যামিয়াসকে ছাড়া মেয়েটা অন্য কারুর কথা খেয়ালই করেনি। সুখে থাকবে দুজনে মিলে। আমাকে আগেই এলসা বলেছিলো আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা সেকেলে। মনে ওর ছিলো না কোনো সন্দেহ, না ছিলো বিবেকের দংশন-কারুর জন্যে করুণাও ছিলো না। কেউ কি দৃপ্ত যৌবনের কাছ থেকে আশা করতে পারে? বয়োবৃদ্ধদের ধর্ম ওটা। অবশ্য ওরা বেশি কথা বলেনি। কোনো শিল্পীই বকবক করতে চায় না কাজ করার সময়। এলসা দশ মিনিট অন্তর অন্তর একটা না একটা মন্তব্য করেছিলো আর ফুঁসতে ফুঁসতে অ্যামিয়াসও তার উত্তর দিচ্ছিলো। এলসা একবার বললো, যা বললে তুমি স্পেনের ব্যাপারটা সেটাই ঠিক ভেবে দেখলাম। আমরা প্রথমে ওখানেই যাবো। আমাকে তুমি ষাঁড়ের লড়াই দেখাতে নিয়ে যাবে। দারুণ হবে, তাই না। তবে ইচ্ছে আমার মানুষটাকে মারুক ষাঁড়টাই। যখন রোমের মহিলারা মরতে দেখতেন মানুষকে তখন তাদের যে মনোভাব হতো আমি সেটা অনুভব করতে পারি। জানোয়াররা অনেক বেশি সুন্দর মানুষের তুলনায়।
মনে হয় আমার মেয়েটি নিজেই ছিলো পশুর মতো যুবতী এবং আদিম মনোভাবাপন্না। মানুষের দুঃখের অভিজ্ঞতা বা দ্বিধা জড়িত জ্ঞান তার মধ্যে কোনোটিই ছিলো না। এলসা চিন্তা করতে পারে আমার মনে হয় না, শুধু অনুভূতি ছিলো ওর। বড় বেশি প্রাণবন্ত ছিলো তবে, অত প্রাণপ্রাচুর্য আমি আর দেখিনি কারুর মধ্যে।
আমার শেষ দেখা সেই ওকে, প্রাণোচ্ছল এবং আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর–যেন সে বিচরণ করছিলো স্বর্গে।
লাঞ্চ খাবার ঘণ্টা পড়তেই উঠে আমি পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমার সঙ্গে যোগ দিলো কামান বাগানের দরজার কাছে এলসা। গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখ ধাঁধাচ্ছিলো আমার ওখানকার আলোকে। দেখতে পারছিলাম না ভালো। অ্যামিয়াস শুয়ে ছিলো হাত পা ছড়িয়ে। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো ছাদটার দিকে। ওইভাবে আমি অনেকবার ওকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। আমি কি করে জানবো যে তখন সেদিন শুরু হয়ে গেছে বিষের ক্রিয়া, হাত-পা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে।
আমিয়াস ঘেন্না করতে অসুস্থতাকে। দুর্বলতা দেখাতো না কখনও এবং নিজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কখনও অভিযোগও করত না।
এলসা বললো, ও আসবে না লাঞ্চ খেতে। আমি মনে মনে অ্যামিয়াসের বুদ্ধির তারিফ করলাম, মুখে বললাম, আসছি তাহলে।
ছবির দিক থেকে চোখ সরিয়েও তাকালো আমার দিকে। সে এক বিচিত্র–বোঝাবো কি ভাবে ফুটে উঠেছিলো পরশ্রীকাতরতার চিহ্ন তার মুখে।
আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। মনের মতো ছবি অনেক সময় না হলে তার মুখের ভাব ঐরকম হিংস্র হয়ে উঠতো। সেরকমই মনে হয়েছিলো এবারও।
তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করিনি আমি বা এলসা–মনে হয়েছিলো শিল্পীর মেজাজ।
অ্যামিয়াসকে ফলে ওখানে একলা ফেলে রেখে হাসতে হাসতে আমি আর এলসা চলে গেলাম বাড়ির দিকে। তখন যদি বেচারী জানতে ও জীবনে আর কোনো দিনও দেখতে পাবে না অ্যামিয়াসকে…ভালোই হয়েছিলো অবশ্য যে জানতো না, আরও কিছুক্ষণ তো ও পেয়েছিলো সুখে থাকতে।
ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ছিলো খাবার টেবিলে নিজেকে নিয়ে একটু যেন ব্যস্ত ছিলো, আর কিছু না। আর প্রমাণ কি এটাই নয় যে ও ব্যাপারে কোনো হাত ছিলো না ওর? সে তো অতো বড় অভিনেত্রী নয়।
আরও পরে গভর্নেস নীচে নেমে গিয়ে ঐভাবে আবিষ্কার করেছিলো অ্যামিয়াসকে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো মিস উইলিয়ামসের, ডাক্তারকে ফোন করতে উনিই বলেছিলেন।
আর ঐ বেচারী…ঐ এলসার কথা বলছি…বাচ্চার মতো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলো সে শোকে। বিশ্বাসই করতে পারে না ওদের মতো মেয়েরা যে এই ধরনের ঘটনা জীবনে ঘটতে পারে। খুব শান্ত ছিলো ক্যারোলিন। হ্যাঁ বলতে হবে বেশ শান্তই ছিলো। অন্ততঃ ও নিজেকে এলসার তুলনায় বেশ সংযত রাখতে পেরেছিলো। কোনো অনুশোচনা ছিলো না ওর মধ্যে। শুধু বলেছিলো এটা অ্যামিয়াস নিজেই করেছে। অবশ্য তা আমরা বিশ্বাস করিনি। রাগে এলসা ফেটে পড়ে ক্যারোলিনের মুখের ওপরেই বলেছিলো যে তার দোষটা।
তবে ক্যারোলিনও বুঝতে পারছিলো ততক্ষণে যে তাকে সবাই সন্দেহ করবে।
নিঃসন্দেহ ছিলো তো ফিলিপ কাজটা করেছে ক্যারোলিনই।
তখন বেশ মিস উইলিয়ামস তৎপর হয়ে উঠে সাহায্য করেছিলেন নানাভাবে। জোর করে এলসাকে ঘুমোবার ওষুধ খাওয়ালেন শুইয়ে দিয়ে। অ্যাঞ্জেলাকে সরিয়ে দিলেন পুলিশ আসার আগেই। আর নিজে আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব নিয়ে মোকাবিলা করলেন পুরো ব্যাপারটার।
যেন পুরো ব্যাপারটাই এক দুঃস্বপ্ন। খানা তল্লাসী করছে পুলিশ, প্রশ্ন করছে সবাইকে, তারপর কাগজের রিপোর্টাররা পৌঁছে গেলো, ফ্ল্যাশ বা ঘন ঘন জ্বলে উঠতে লাগলো।
সে এক ঘোরতর দুঃস্বপ্নের জগৎ-এতগুলো বছর তারপর থেকে পার হবার পরও দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনাকে মনে হয়। হে ঈশ্বর, প্রকৃত ঘটনাটা ছোট্ট কালার মন থেকে তুমি তো মুছেই দিয়েছিলে, চিরকালের জন্য আমরাও ভুলে যেতে চাই।
শোনাক না কেন যত অসম্ভব–আত্মহত্যাই করেছিলো অ্যামিয়াস।
বক্তব্য শেষ মেরিডিথ ব্লেকের।
.
লেডী ডিটিশামের বিবৃতি
আমার অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় থেকে শোচনীয় তার মৃত্যু পর্যন্ত আমি এখানে লিখছি সমগ্র কাহিনী।
একটা স্টুডিয়ো পার্টিতে আমি ওকে প্রথম দেখি। ও দাঁড়িয়েছিলো। একটা জানলার ধারে যতদূর মনে পড়ে, ওকে আমি দেখেছিলাম দরজার কাছে আসার পর। ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যেন ও বললো যে ও ক্রেল, শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে আমি বলেছিলাম পরিচিত হতে চাই ওর সঙ্গে।
আমরা সেবারে বোধ হয় কথা বলেছিলাম মিনিট দশেক। কিভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছিলো ও তা বর্ণনা করা কঠিন। তবে বলতে পারি এটুকু ওর পাশে আর সবাইকে মনে হয়েছিলো ভীষণ ম্লান।
ঐ দেখা হবার পরে যতগুলো আমি পারলাম দেখলাম ওর আঁকা ছবি। সেই সময় একটা প্রদর্শনী চলছিলো বণ্ড স্ট্রীটে। অ্যামিয়াসের ছবি ছিলো ম্যানচেষ্টার লীডস আর লন্ডনের দুটো ছবির গ্যালারীতে। সবগুলো দেখার পর দেখা করে ওকে বললাম,আপনার সবকটা ছবি আমি দেখেছি. সত্যিই অসাধারণ।
শুনে যে খুব খুশি হয়েছে ও তা বোঝা গেলো, ও বললো, কে বললো যে একজন ছবির সমঝদার আপনি? আমার তো মনে হয় না আপনি এ সম্বন্ধে কিছু জানেন।
আমি বলেছিলাম, কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু অসাধারণ ছবিগুলো, চমৎকার।
ও দাঁত বের করে হেসে বলেছিলো, কথা বলবেন না অতি উৎসাহী বাচ্চার মতো।
আমি বললাম, বলছি না। আমি চাই আমার একটা ছবি আঁকুন আপনি।
অ্যামিয়াস বলেছিলো, যদি একটুও বুদ্ধি থাকতো আপনার মাথায় তবে দেখতেন যে সুন্দরী মহিলাদের প্রতিকৃতি আমি আঁকি না।
আঁকতে হবে যে প্রতিকৃতিই একথা আমি বলিনি, তাছাড়া সুন্দরীও নই আমি।
আমার দিকে ও তাকালো, যেন নতুন করে আমায় দেখতে শুরু করেছে, বললো, তা ঠিক, ঠিক তুমি সুন্দরী নও।
তাহলে কি আমার ছবি আঁকবেন?
অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় কাৎ করে আমাকে দেখলো, একটা অদ্ভুত মেয়ে তুমি, তাই না? আমি বলেছিলাম, ভালোই টাকা পয়সা আছে আমার। ছবিটার জন্যে ভালো টাকাই দিতে পারবো।
ও বলেছিলো, আমাকে দিয়েই তুমি বা ছবি আঁকতে চাইছো কেন?
ইচ্ছে হয়েছে আমার।
ওটাই কি কারণ?
হা, যখন যা চাই আমি তাই পাই।
ও তখন বললো, আহারে একেবারে বাচ্চা তুমি।
আমি বললাম, তাহলে আমার ছবি আঁকছেন আপনি?
আমার কাধ ধরে ও মুখটা ভালোভাবে দেখলো আলোর দিকে ফিরিয়ে। তারপর সরে দাঁড়ালো একটু দূরে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম নিশ্চল হয়ে। ও বলেছিলো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমার অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকাও পাখি অবিশ্বাস্য রঙে রাঙানো সেন্টপলস গির্জার ওপর নামছে একরকম ছবি আঁকা একটা। যদি কোনো একটু প্রাচীন আমলের প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে আঁকতে পারি তোমায় তাহলে আমার হয়তো ইচ্ছেপূরণ হলেও হতে পারে।
আমি বললাম, আপনি তাহলে আমাকে আঁকছেন? বলেছিলো ও, যত মেয়ে আমি দেখেছি তুমি হলে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সবচেয়ে স্থূল, এক অসাধারণ অগ্নিশিখা বিচিত্র বর্ণের সংমিশ্রণে। তোমার ছবি আমি আঁকবো।
তাহলে পাকা কথা? ও তখন বলেছিলো, তোমায় কিন্তু আমি সাবধান করে দিচ্ছি, এলসা গ্ৰীয়ার, তোমার ছবি যদি আঁকি তাহলে হয়তো প্রেমও করতে পারি তোমার সঙ্গে।
আমি বলেছিলাম, তুমি আশাকরি করবে…। খুব শান্ত অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে আমি কথাটা বলেছিলাম, দম বন্ধ যে হয়ে গেছে আমার কথা শুনে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, পাল্টে গিয়েছিলো ওর চোখের দৃষ্টিও।
মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছেন, একেবারে হঠাৎই ঘটে গিয়েছিলো ব্যাপারটা।
আবার আমাদের দু-একদিন পরে দেখা হলো। আমাকে অ্যামিয়াস জানালো যে ধরনের পশ্চাদপট ও চাইছে আমাকে তার জন্যে যেতে হবে ডিভনশায়রে। আর আমি বিবাহিত জেনে রাখো। আমি খুব পছন্দও করি স্ত্রীকে।
নিশ্চয়ই সে খুব সুন্দর তা না হলে তাকে তুমি কেন পছন্দ করবে। বলেছিলাম আমি।
ও বলেছিলো স্ত্রীকে আমি সত্যি কথা বলতে কি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। অতএব এলসা যদি তোমার অন্য কোনো মতলব থাকে, তবে পথ দেখো!
আমি বুঝেছি। ও আমার ছবি এক সপ্তাহ পরে আঁকতে শুরু করলো। বেশ ভালোভাবেই ক্যারোলিন ক্রেল আমাকে গ্রহণ করেছিলো। তবে পছন্দ করতো না খুব একটা, আর কেনই বা করবে? আমিয়াসের নজর থাকতো চারদিকে, ও চালাক ভীষণ। কথা যে ওর স্ত্রীর কানে যেতে পারে আমাকে সে সম্বন্ধে কিছুই বলেনি এবং ওর সঙ্গে আমিও খুব নম্র আর ভদ্র ব্যবহার করতাম। অবশ্য আমরা তলে তলে জানতাম দুজনেই।
ও আমাকে দশদিন পরে ফিরে যেতে বললো লন্ডনে। আমি বললাম, কিন্তু শেষ তো হয়নি ছবি।
উত্তর দিলো ও, এই তো মাত্র শুরু হয়েছে। এলসা আসল কথা কি, তোমার ছবি আমি আঁকতে পারছি না।
কেন?
কেন তার কারণটা এলসা তুমি ভালো করেই জানো। আর সেইজন্যেই কেটে পড়তে হবে তোমাকে এখান থেকে। আমি চিন্তাই করতে পারছি না ছবির কথা…আমার অন্য কিছু মাথাতেই আসছে না তুমি ছাড়া।
কামান বাগানে তখন ছিলাম আমরা। বেশ গরম ছিলো দিনটা, চারদিক সূর্যের আলোয় ভরা, গুন গুন করে বেড়াচ্ছিলো পাখি আর মৌমাছি। সুখের আর শান্তির হওয়ার উচিত ছিলো পরিবেশটা। কিন্তু তার উল্টো বাস্তব ক্ষেত্রে দুঃখে ভরা বড়। বেশি…যেন…যেন…প্রতিফলন ভবিষ্যতের ছবিটার সেদিনই গিয়েছিলো দেখা।
জানতাম আমি লন্ডনে ফিরে কোনো লাভ আমার হবে না। তবুও বললাম, ঠিক আছে, আমি ফিরে যাবো তুমি বলছো বলেই।
গিয়েছিলাম ফিরেও, কিন্তু চিঠি দিইনি ওকে। ও নিজেই দশদিন পরে চলে এলো, এ্যাতো রোগা ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত ওকে লাগছিলো যে কষ্ট হলো আমার।
ও বললো, এলসা তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তুমি ওকথা বলতে পারবে না যে, সাবধান করে দিইনি।
আমি বলেছিলাম, আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি। তুমি আসবেই জানতাম।
এক ধরনের চাপা গোঙানির শব্দ ওর মুখ দিয়ে ভেসে এলো, কয়েকটা এমন জিনিস আছে যা শক্তিশালী মানুষের চেয়েও খেতে পারছি না আমি, পারছি না ঘুমোতে, তোমার অভাবে পারছি না কিছু করতে।
জানিয়েছিলাম আমি এরকম যে হবে আমি সেটা জানতাম। একই দশা আমারও। এবং আমি ডুবেছি প্রথম দিন থেকেই। নিয়তি ওটাই, কোনো মানে হয় না এর বিরুদ্ধে লড়াই করার।
অ্যামিয়াস বলেছিলো, তেমন কোনো লড়াই তোমাকে করতে হয়নি, এলসা তাই না।
ওসব করার কিছু চেষ্টা আমি করিনি।
ও বলেছিলো আমার বয়স কেন এতো কম, আমি বলেছিলাম তাতে আসে যায় না কিছু। বলতে পারি আমরা খুব সুখে ছিলাম তার পরের কয়েকটা সপ্তাহ। তবে সব বলা যাচ্ছে না সুখ কথাটায়, আরও গভীর তার চেয়েও, আর ভয়ানক কিছু।
পরস্পরের জন্যেই যেন আমরা জন্মেছিলাম, এবং এতোদিন পরে খুঁজে পেয়েছি দুজনে দুজনকে, আর চিরকাল দুজনকে, জানতাম একসঙ্গেই থাকতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে ঘটলো অন্য ঘটনা। মন থেকে দূর করতে পারছিলো না অসমাপ্ত ছবিটার কথা অ্যামিয়াস। ও একদিন আমাকে বললো, মজার ব্যাপার কি কখনই তোমার ছবি আগে হলে আঁকতাম না, জোর করে তুমিই জড়িয়েছিলে এ ব্যাপারে আমাকে। এখন কিন্তু এলসা তোমার ছবি আঁকতে চাই। এমনভাবে আমি তোমাকে আঁকবো যাতে আমার শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি হবে ওটাই। ভেতরটা আমার ভীষণ ছটফট করছে, এখুনি সেই কামান বাগানে ইচ্ছে করছে চলে যাই। তুমি বুড়ো চেস্টনাস্ট গাছের তলায় কামানের ওপর বসবে, সেই চির পরিচিত সুনীল সমুদ্র থাকবে পেছনে আর বিচিত্র রঙের দেশী গাছ…আর তুমি…সুতীব্র আনন্দের একটা বেসুরো উচ্ছ্বাসের মতো বসে থাকবে।
ও বলেছিলো, তোমার ছবি ঐ ভাবেই আঁকবো। তবে আমাকে নিয়ে গণ্ডগোল বা বিরক্তি করা চলবে না আঁকার সময়। ছবিটা শেষ হলে সব কথা ক্যারোলিনকে আমিই বলবো, তখন চুকে যাবে সব ঝাট। আমি বলেছিলাম, ক্যারোলিন তোমাকে ডিভোর্স করার ব্যাপারে গণ্ডগোল করবে না তো? মনে তো হয় না। তবে মুস্কিল মেয়ে মানুষদের চেনা, বলেছিলো অ্যামিয়াস।
আমি বলেছিলাম এই ভাবে ক্যারোলিনের মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত আমি, কিন্তু ঘটে তো এই রকমই।
ও বলেছিলো, তুমি কতো সুন্দর আর সমঝদার এলসা। কিন্তু একটুও বুঝতে চায় না ক্যারোলিন, কখনও চেষ্টাও করবে না বোঝবার। আমাকে ও ভালোবাসে।
আমি বলেছিলাম বুঝেছি, তবে অ্যামিয়াসকে ও যদি ভালোবাসে তাহলে স্বামীকে সবদিক দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করা ওর উচিত, অন্ততঃ মুক্তি চাইলে স্বামী ওর উচিৎ হবে না তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা।
ও বলেছিলো, অসাধারণ সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়ে ও বলেছিলো আধুনিক সাহিত্যের তো জীবনের সমস্যার সত্যিই সমাধান করা যায় না। প্রতিহিংসা পরায়ণা বড়ই প্রকৃতি, এটা মনে রেখো।
আমি বলেছিলাম, আমরা তো এখন সবাই সভ্য মানুষ। আমিয়াস হেসে উঠেছিলো উত্তরে, সভ্য মানুষ? হায় রে। মনে হয় ক্যারোলিন তো ছুটবে কাটারি নিয়ে তোমাকে মারতে। তুমি কি এটা বোঝো না যে এলসা এতে ও কষ্ট পাবে…কষ্ট পাবে। এলসা তুমি জানো না কাকে কষ্ট পাওয়া বলে?
তখন আমি বলেছিলাম, ওকে তাহলে বোলো না।
ও বলেছিলো, না, ছিন্ন তো করতেই হবে সম্পর্ক, এলসা তোমাকে চাই সম্পূর্ণভাবে। জগতের সকলের সামনে, একান্ত আপন করে।
ধরো যদি বিবাহ বিচ্ছেদে ও রাজী না হয়?
সে ভয় আমি করি না।
তখন আমি বললাম, তাহলে ভয় কি তোমার?
অ্যামিয়াস অস্ফুট স্বরে বলেছিলো, জানি না আমি…অতএব বুঝতে পারছেন মিঃ পোয়ারো, ঠিক চিনেছিলো ও ক্যারোলিনকে, পারিনি আমি।
মজার ব্যাপার হলো সবচেয়ে এই যে একেবারেই কোনো কিছুকে অ্যামিয়াস পরোয়া করছিলো না। ও পছন্দ করতো ক্যারোলিনকে, তাই সততা বা অসৎ হওয়ার প্রশ্নটা নিয়ে ঘামালেন না মাথা। পাগলের মতো সব ভুলে গিয়ে ছবি আঁকতে লাগলো। ওঁর এই তন্ময়তা দেখে পারলাম বুঝতে ও কত বড় শিল্পী। ও চিন্তাই করতো না ছোটখাটো ভালো মন্দর কথা। অথচ অবস্থা আমার সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। ওর মতো তো আর আমি নই। আমার ওপর ক্যারোলিন অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলো।
ওকে সব কথা বলা উচিত ছিলো, কিন্তু ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যামিয়াস ও নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না।
আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে আমি সৎ থাকতে চাই। ক্ষেপে গিয়ে অ্যামিয়াস বলেছিলো, তোমার সততা গোল্লায় যাক। শেষ করতে দাও আমাকে ছবি। ওর কথা আমি বুঝতে পারলাম, কিন্তু ও বোঝার চেষ্টাই করতো না আমার কথাটা।
আমিই শেষ কালে ভেঙে পড়লাম। ক্যারোলিনরা পরের শরৎকালে বেড়াতে যাবে কোথায় দুজনে আমাকে এসব কথা শোনাচ্ছিলো কায়দা করে, রাগ আমি আর সামলাতে পারিনি। মুখের ওপর আসল কথাটা বলে দিয়েছিলাম। না ভুল করিনি, মনে হয় আজও ঠিক করেছিলাম। তবে নিশ্চয়ই বলতাম না ভবিষ্যতের কথা জানলে।
সংঘর্ষ বাঁধলো এর ফলে, আমার ওপর অ্যামিয়াস চটে লাল হলেও আমার কথাটা স্বীকার করলো ঠিক।
ক্যারোলিনকে ঠিক আমি বুঝতে পারিনি। সবাই মিলে আমরা মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি গিয়েছিলাম, হেসে, কথা বলে ক্যারোলিন দারুণ অভিনয় চালিয়ে গেলো। আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম ব্যাপারটাকে বোধ হয় মেনে নিচ্ছে ও ভালো মনে। ছাড়তেও পারছিলাম না বাড়িটা, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে অ্যামিয়াসের ভেবেছিলাম নিজের থেকেই চলে যাবে ক্যারোলিন।
আমি ওকে কোনাইন নিতে দেখিনি। সত্যি কথাটা আমি স্বীকার করতে চাই, ওর কথাটাই ঠিক আমার ধারণা, বিষ চুরি করে থাকতে পারে ও আত্মহত্যা করার জন্যেই। তবে ও বড় ঈর্ষা পরায়ণ মেয়ে মানুষ, গ্রাস করে নিতে চায় সব কিছু। ওর নিজস্ব সম্পত্তি ছিলো আমিয়াস। মনে হয় আমার অন্য কোনো মেয়ের হাতে স্বামীকে ছেড়ে দেবার বদলে ও মেরে ফেলতে তৈরি ছিলো তাকে। আর যখন খোলাখুলি ভাবে কোনাইনের কথা মেরিডিথ বলছিলেন ও তখনই মনে মনে প্ল্যান এঁটে নেয় খুন করার। ভীষণ নিষ্ঠুর ক্যারোলিন, প্রতিহিংসাপরায়ণ মেয়ে মানুষ। ওকে ঠিকই চিনেছিলো অ্যামিয়াস। আমি পারিনি চিনতে।
পরদিন ক্যারোলিনের সঙ্গে লেগে গেলো অ্যামিয়াসের। বাইরে চত্বরে বসে আমি শুনেছিলাম ওদের কথা। মেজাজ দারুণ ঠান্ডা রেখে অ্যামিয়াস বোঝাচ্ছিলো, যা করার করবে বৌ আর মেয়ের কথা খেয়াল রেখেই। ক্ষেপে গিয়ে শেষের দিকে বলেছিলো–জেনে রাখো তবে আমি বিয়ে করবোই এলসাকে। পরস্পরকে ছেড়ে স্বাধীনতা তো বরাবরই আমাদের দুজনের ছিলো। মানুষের জীবনে এরকম তো ঘটেই থাকে।
খুব শান্তভাবে ক্যারোলিন বলেছিলো, যা খুশি করো তোমার, তবে তোমায় সাবধান করে দিলাম আমি।
ক্যারোলিন এর মানে কি? প্রশ্ন করেছিলো অ্যামিয়াস।…
উত্তর হয়েছিলো, আমার তুমি এবং তোমাকে খুন করবো আমি…।
ঠিক সেই সময়ে চত্বরে ফিলিপ ব্লেক আসতে আমি ওঁর কাছে উঠে চলে গেলাম, ওদের ঝগড়া ব্লেক শুনুক তা চাইছিলাম না।
অ্যামিয়াস একটু পরে বেরিয়ে এল। শেষ করতে চায় ছবিটা, তাই কামান বাগানে গেলো আমাকে নিয়ে। পথে বললো ভীষণ বাড়াবাড়ি করছে ক্যারোলিন, তবে যেন কোনো কথাবার্তা না হয় এ নিয়ে। আর একটা দিন লাগবে ছবিটি শেষ করতে।
ও বলেছিলো, আমার সবার সেরা কাজ হবে এটাই। এর জন্যে যদিও প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে।
আমি একটু পরে বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলাম সোয়েটার আনতে, ঠান্ডা লাগছিলো একটু। ফিরে দেখি ক্যারোলিন, হয়তো জানাতে এসেছিলো শেষ কাকুতি-মিনতি। ওখানে ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও ছিলেন।
অ্যামিয়াস ঠিক তখনই খুব ঠান্ডা বিয়ার চেয়েছিলো। খুব স্বাভাবিক সুরে ক্যারোলিন বলে ছিলো পাঠিয়ে দিচ্ছে বরফ দেওয়া বিয়ার। কী অসাধারণ ও অভিনেত্রী ছিলো। কারণ ও নিশ্চয়ই ততক্ষণে কী করবে ঠিক করে ফেলেছিলো।
ক্যারোলিন দশ মিনিট পরে অ্যামিয়াসের সামনে বিয়ার এনে গ্লাসে ঢেলে রাখলো। দুজনেই আমরা তখন কাজে ব্যস্ত নিজের। নজর দিইনি ওর দিকে।
বিয়ার গলায় ঢাললো এক ঢোকে, অ্যামিয়াস বিয়ার খেতো ঐ ভাবেই। মুখ বিকৃত করে বললো, বিশ্রী লাগলো ভীষণ, তবে খুব ঠান্ডা।
আমার সন্দেহ তখনও হয়নি, শুধু হেসে আমি বলেছিলাম, লিভার।
ক্যারোলিন, অ্যামিয়াসকে বিয়ার খেতে দেখে চলে গেলো।
অ্যামিয়াস ব্যথা আর শরীর শক্ত হয়ে ওঠার কথা প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে বললো। বোধহয় ওর বাত হয়েছে পেশীতে, ওর মনে হয়েছিলো এটাই। একেবারে সহ্য করতে পারতো না অসুখ বিসুখ। তারপর বললো হালকা সুরে, বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। এলসা শেষ পর্যন্ত একটা প্যানপেনে বুড়োকে পছন্দ করলে। ওর সুরে আমি সুর মেলালাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম পা-টা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে, মুখও বিকৃত করলো দু-একবার। তবে ভাবিনি স্বপ্নেও অন্য কিছু বাত ছাড়া হতে পারে। ও বেঞ্চটা টেনে শুয়ে পড়লো হাত-পা ছড়িয়ে, ও প্রায়ই এরকম করতো ছবি আঁকতে আঁকতে। তাই ওটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগেনি।
দুজনেই লাঞ্চের ঘণ্টার শব্দ শুনেছিলাম, কিছু খাবে না ও বললো। আশ্চর্য হইনি তাতেও, বোধ হয় ও চাইছিলো না ক্যারোলিনের মুখোমুখি হতে।
কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে যেন কেমন করে বের হচ্ছিলো, ও রকম ভাবে ও কথা বলতে মেজাজ বিগড়ে থাকলে।
আমরা খেতে চলে গেলাম ওকে একলা ওখানে রেখে। আমার তেমন অসুখ বিসুখের সঙ্গে পরিচয় নেই। অ্যামিয়াস ভেবেছিলাম শিল্পীর খেয়ালে আছে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম, অসুস্থ ও…বুঝতে পারতাম যদি…তাহলে ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম ডাক্তার এনে…হায় ভগবান…কেন যে করিনি…এখন অবশ্য চিন্তা করাও বৃথা। বোকা হাঁদা একেবারে আমি অন্ধ।
আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।
খাওয়ার পরে ক্যারোলিন আর গভর্নেসটা নীচে নেমে গিয়েছিলো। মেরিডিথ যান তারপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন উনি দৌড়ে। জানালেন যে মারা গেছে অ্যামিয়াস।
বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। বুঝতে পেরেছিলাম মানে ক্যারোলিনেরই যে কাজ ওটা তা বুঝে ফেলেছিলাম। অবশ্য বিষের কথা তখনও মনে হয়নি আমার। ভেবেছিলাম আমি ক্যারোলিন হয় নীচে গিয়ে গুলি করেছে অথবা খুন করেছে ছুরি মেরে অ্যামিয়াসকে।
ওকে খুন করবার জন্যে ছুটলাম আমি…ও করলো কি করে একাজ? প্রাণ প্রাচুর্যে, জীবনী শক্তিতে ভরা এভাবে অ্যামিয়াসকে মারলো কেন? যাতে আমি ওকে না পাই এই জন্যেই কি।
কী ভয়ংকর মেয়ে মানুষ, ওকে আমি ঘৃণা করি।
ওকে ফাসী পর্যন্ত দিলো না ওরা। ওকে ফাঁসীতে ঝোলানো উচিত ছিলো।
বোধহয় ফাঁসী দিলেও ওর শাস্তি তেমন হতো না…
সমাপ্তি লেডী ডিটিশামের বিবৃতি :
সিসিলিয়া উইলিয়ামসের বিবৃতি
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
১৯… সালের সেপ্টেম্বর, আপনাকে একটি বিবরণ পাঠাচ্ছি সেইসব ঘটনার। খুবই খোলাখুলি ভাবে আমি বলছি আপনাকে এবং লুকোইনি কোনো কথাই। কার্লা ক্রেলকে এটা আপনি দেখাতেও পারেন, সব সময়েই আমি সত্যের পূজারী, ক্ষতি করে মিষ্টি কথা, আমাদের বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস থাকা উচিত। বাস্তব সত্যকে যারা আড়ালে রাখতে চায় আমাদের তারাই বেশি ক্ষতি করে সবচেয়ে।
বিশ্বাস করুন
ভবদীয়
সিসিলয়া ইউলিয়ামস
আমার নাম সিসিলিয়া উইলিয়ামস। ১৯… সালে আমাকে মিসেস ক্রেল তার সৎ বোন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের গর্ভনেস নিযুক্ত করেন। …আমার বয়স তখন ৪৮ বছর।
অ্যাল্ডারবেরিতে আমি কাজে যোগ দিলাম, দক্ষিণ ডিভনে একটা সুন্দর জমিদারীতে, মিঃ ক্রেলের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি ছিলো এটা। জানতাম যে একজন নামকরা শিল্পী ছিলেন মিঃ ক্রেল। কিন্তু তাকে আমি দেখিনি অ্যাল্ডারবেরিতে ওঠার আগে পর্যন্ত।
মিঃ আর মিসেস ক্রেল ঐ বাড়িতেই থাকতেন, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন (তার বয়স ছিলো তখন মাত্র ১৩ বছর) আর থাকতো তিনটে চাকর। এরা সবাই ওখানে চাকরী করছিলো দীর্ঘদিন ধরে।
আমরা ছাত্রীটিকে দেখলাম বেশ ভালো আর সম্ভাবনাময়। তার অনেক গুণ ছিলো, আনন্দ পেতাম ওকে পড়িয়ে। তবে স্বভাব ছিলো একটু বন্য আর উচ্ছল, সব মিলিয়ে আমার ভালোই লাগতো ওকে। তাদের মনের মতো করে প্রাণশক্তি থাকলে মানুষ করা যায়।
অ্যাঞ্জেলাকে মোটামুটিভাবে নিয়ম শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলা যেভাবে বুঝতে পারলাম সেটা। ও একটু দুষ্টু হয়ে উঠছিলো মিসেস ক্রেলের প্রশ্রয়ে। তবে আমার মতে মিঃ ক্রেলের প্রভাবটাও ঠিক ছিলো না। তিনি খুব প্রশ্রয় দিতেন মাঝে মাঝে, আবার রুক্ষ ব্যবহার কখনও করতেন, শিল্পী মানুষ তো, মেজাজ তো থাকবেই।
তবে আত্মসংযমের ক্ষমতাকে শিল্পী হলেই যে বিসর্জন দিতে হবে এর কোনো যুক্তি জানি না আমি। আমার ভালো লাগতো না মিঃ ক্রেলের ছবিও। ভালো নয় আঁকা, বড্ড চড়া রঙের ব্যবহারও।
আমার ঘনিষ্ঠতা খুব গাঢ় হয়ে উঠেছিলো মিসেস ক্রেলের সাথে খুবই তাড়াতাড়ি। তার শান্ত আচরণ বিপদ বা ঝাটের মুখে আমার খুব ভালো লাগতো। মিঃ ক্রেল স্বামী হিসেবে খুব বিশ্বস্ত ছিলো না, এবং মনে হয় তার জন্যে খুব কষ্ট পেতেন মিসেস ক্রেল। আরো একটু শক্ত মনের মহিলা হলে স্বামীকে ছেড়ে কবে চলে যেতেন। সে ধরনের কিছু মিসেস ক্রেল চিন্তা করতেন না। স্বামীকে মেনে নিয়েছিলো দোষ ত্রুটি সমেত। তবে ভীরুর মতো নয়–বেশ বকাঝকা, চেঁচামেচি মাঝে মাঝে করতেন। এবং মেজাজের সঙ্গেই।
স্বামী-স্ত্রী কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া করতেন বিচারের সময় তা বলা হয়েছিলো। আমি বলবো না অতোটা। কখনও মিসেস ক্রেলের মর্যাদা বোধ অতো নীচে তাঁকে নামতে দেয়নি, ঝগড়া হতো। এবং সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয় ঐ পরিস্থিতিতে আমার।
মিসেস ক্রেলদের দু বছর কাটার পর আবির্ভাব হলো ওখানে এলসা গ্ৰীয়ারের। ১৯… সালের গ্রীষ্মকালে উনি অ্যাল্ডারবেরিতে এসেছিলেন। তার আগে কখনো মিসেস ক্রেল দেখেননি এলসা গ্ৰীয়ারকে। এলসা মিঃ ক্রেলের বান্ধবী ছিলেন, নিজের ছবি আঁকাতে এসেছিলেন।
আর সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ক্রেল মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছেন তা আমাদের চোখে পড়লেন আর তাকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা মেয়েটিও করছেন না। বরং ব্যবহার করতেন বড় বেশি নির্লজ্জের মতো এবং অভদ্র আচরণ করতেন মিসেস ক্রেলের প্রতি আর ঢলাঢলি করতেন খোলাখুলিভাবে মিঃ অমিয়াস ক্রেলের সঙ্গে।
আমাকে মুখ ফুটে মিসেস ক্রেল কিছু না বললেও আমি সব বুঝতে পারতাম। এলসা গ্ৰীয়ারকে নিয়ে ওদিকে ছবি আঁকতে বসলেও ছবির কাজ এগোতে দেখতাম না খুব একটা। বোধ হয় বেশির ভাগ সময়ই ওঁরা কাটাতেন গল্প করেই।
অবশ্য মিসেস ক্রেল স্বামী আর এলসা মেয়েটির সম্বৰ্কটাকে মনে করতেন বন্ধুত্বই। তবে ওকে অপছন্দ করতেন এলসার নির্বুদ্ধিতা। এবং মনে হয় আমার ঠিক ওঁর অনুমানটাই, বোধ হয় খুব ভালো ছিলো না এলসা গ্ৰীয়ারের শিক্ষা-দীক্ষা কখনো বই পড়তে বা আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে দেখিনি। সহ্য করতে পারতেন না কোনো উঁচুদরের আলোচনাও।
সব সময়ে মেয়েটি নিজের রূপ, পোষাক আর পুরুষদের নিয়ে ভালোবাসতেন ব্যস্ত থাকতে।
বোধ হয় অ্যাঞ্জেলাও বুঝতে পারেনি যে খুব অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন ওর দিদি। অবশ্য সে সব বোঝার ক্ষমতাও তার ছিলো না। গেছো মেয়ে ছিলো একটু, গাছে চড়া, সাইকেল চালানো বেশি পছন্দ করতো। তবে খুব বই পড়তে এবং রুচিটাও সে ব্যাপারে খুব সুন্দর।
বোনের সামনে মিসেস ক্রেলও কখনো দুঃখে বা অশান্তির কথা প্রকাশ করতেন না।
লন্ডনে ফিরে গেলে মিস এলসা গ্ৰীয়ার সত্যি কথা বলতে কি সবাই খুশি হয়েছিলাম আমরা। অন্যদের অসুবিধেয় ফেলে এই ধরনের মেয়েরা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
মিঃ ক্রেলও অল্পদিন পরে গেলেন এবং উনি মেয়েটির সন্ধানেই গেছেন আমি জানতাম। আমার যত দুঃখ মিসেস ক্রেলের জন্যে হয়েছিলো, ঠিক ততোটাই ওঁর স্বামীর ওপর রাগ হয়েছিলো। সুন্দর, ভদ্র, বুদ্ধিমতী স্ত্রী থাকতে মিঃ ক্রেলের ঐ রকম খারাপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার ছিলো না।
আশা করছিলাম আমি আর মিসেস ক্রেল দুজনেই তাড়াতাড়ি শেষ হোক ব্যাপারটা। আলোচনা আমাদের মধ্যে না হলেও দুজনের মনের কথা দুজনে বুঝতাম।
কয়েক সপ্তাহ পরে দুর্ভাগ্যবশতঃ ফিরে এলে দুজনেই এবং আবার শুরু হলে ছবি আঁকার কাজ।
মিঃ ক্রেল এবারে ছবিটা শেষ করার জন্যে পাগলের মতো উঠে পড়ে লাগলেন। তার আকর্ষণ যেন মেয়েটার তুলনায় ছবির প্রতিই বেশি দেখা যাচ্ছিল, তবে স্বাভাবিক ঘটনা যে এটা নয় তা বুঝতে পারছিলাম। ওঁকে মুঠোয় পুরে ফেলেছে মেয়েটা এবং উনি ছাড়বার পাত্রী নন। যেন মিঃ ক্রেল ওঁর হাতের ময়লা শুধু।
ঘটনা চরমে উঠলো উনি মারা যাবার আগে অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর।
মিস এলসার উদ্ধত ব্যবহার শেষের কদিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিজের ব্যাপারে এসে যাওয়াতে নিজেকে সব ব্যাপারেই বেশ জাহির করতে উনি শুরু করেছিলেন। খাঁটি আভিজাত্যের মতো ব্যবহার ছিলো মিসেস ক্রেলের। শান্ত নম্র বরফের মতো, তবে নিজের মনের ভাবটা এলসা সম্বন্ধে যেমন করে তোক বুঝিয়ে দিতে ছাড়তেন না স্পষ্ট ভাবে।
ঐ ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে, আমরা সবাই লাঞ্চের পর ড্রইংরুমে বসে আছি, তখন মিস গ্ৰীয়ার হঠাৎ বলে উঠলেন অ্যাল্ডারবেরিতে যখন উনি পাকাপাকি ভাবে শুরু করবেন থাকতে তখন কী ভাবে সাজাবেন ঘরটাকে।
এবং এ কথা স্বাভাবিক ভাবেই সহ্য করে নেবার মতো মহিলা নন মিসেস ক্রেল। চ্যালেঞ্জ করতেই উনি নির্লজ্জের মতো মিস এলসা আমাদের সকলের সামনে বললেন যে উনি শিগগীরই মিঃ ক্রেলকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। স্ত্রীর মুখের ওপর বলা হচ্ছে অন্য একজন তার স্বামীকে বিয়ে করবে। আমি খুব চটে ছিলাম মিঃ ক্রেলের ওপর। আর একজন মহিলাকে দিয়ে নিজেই ড্রইংরুমে বসে নিজের স্ত্রীকে অপমান কেন উনি করাচ্ছেন? পালিয়ে গিয়ে চুপচাপ বিয়ে করলেই পারতেন।
যাই ভেবে থাকুন না কেন মনে মুখে মিসেস ক্রেল ভদ্রতা বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে ঠিক ওখানে ওঁর স্বামী এলেন এবং মিসেস ক্রেল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে বসলেন এলসার কথা ঠিক কিনা।
মিঃ ক্রেল স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্যে চটে গেলেন। এবং পুরুষেরা বড় অহংকারী হয়ে ওঠে অসুবিধের মধ্যে পড়লে।
সিংহের মতো মানুষটিকে তখন অসহায় লাগছিল ভেড়ার মতো। উনি বিড়বিড় করে জেরার মুখে স্বীকার করলেন কথাটি এলসার ঠিক। তবে কথাটি তাকে এখুনি জানানোর দরকার ছিলো না।
মিসেস ক্রেল নিদারুণ অবজ্ঞা দেখিয়ে ঘর থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন। একে সুন্দরী মহিলা, তায় অহংকার, ওকে সব মিলিয়ে সম্রাজ্ঞীর মতো লাগছিলো।
এভাবে এই মহৎ প্রাণ মহিলাকে অসম্মানিত করার জন্যে অ্যামিয়াস ক্রেলের শাস্তি হোক আমি মনে প্রাণে এটা চাইছিলাম।
সেই প্রথম মিসেস ক্রেলকে আমার মনের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, স্বাভাবিক ভাবেই যথাসম্ভব আমাদের থাকা কর্তব্য। মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি আমরা সকলে যাচ্ছি চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে।
আমি বলেছিলাম তখন, আমার কাছে মিসেস ক্রেল, আপনি এক অসাধারণ মহিলা।
উনি বলেছিলেন, জানো না তুমি…।
চলে যেতে যেতে আমাকে ফিরে এসে চুমু খেয়ে বললেন, আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা তুমি।
তারপর নিজের ঘরে গিয়ে উনি কেঁদেছিলেন বোধ হয়। ওঁকে একেবারে দেখলাম চায়ের নিমন্ত্রণ রাখার জন্যে, সবাই যখন বেরোচ্ছি তখন। উনি বিরাট ফাঁদওলা একটা টুপি পরেছিলেন, তাই ছায়া পড়েছিলো চোখেমুখে। ওই টুপিটা তিনি সচরাচর পরতেন না।
নিজের অস্বাচ্ছন্দ্য ভাবটা মিঃ ক্রেল কাটবার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন সব জিনিস হালকা করার। মনে হচ্ছিল মিস এলসা গ্ৰীয়ারকে বিড়াল যেন নাগালের মধ্যে পেয়ে গেছে দুধের বাটি।
সন্ধ্যা ছ’টার সময় ফিরে এলো। রাতে খাবার টেবিলে মিসেস ক্রেলকে দেখলাম। খুব শান্ত, গম্ভীর। খেয়ে তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলেন।
অ্যামিয়াস ক্রে আর অ্যাঞ্জেলা ঝগড়া করে কাটিয়ে দিলেন সন্ধ্যে বেলাটা। জটিলতা দেখা গেলো সেই স্কুলে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে। হয়ে গেছে সব কেনাকাটা, এখন বেঁকে বসেছে অ্যাঞ্জেলা, যাবে না। মনে হয় ও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো দিদির ব্যাপারটা নিয়ে। শেষে মিঃ ক্রেলকে লক্ষ্য করে একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে বেরিয়ে গেলো রাগে কাঁপতে কাঁপতে অ্যাঞ্জেলা।
ওকে গিয়ে ধমকাই আমি বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার করার জন্যে, অথচ বাগ মানানো যাচ্ছে না ওকে দেখে আমি কিছু না বলে ফিরে এলাম।
ঘরে যাবার ইচ্ছেটা মিসেস ক্রেলের দমন করলাম। মাঝে মাঝে মনের কথা বলার জন্যেও মানুষের তে দরকার হয়। মিঃ ক্রেলের সঙ্গে দেখা নিজের ঘরে যাবার সময়। উনি জানালেন শুভরাত্রি, আমি উত্তর দিলাম না।
ভারী সুন্দর ছিল পরদিন সকালটা, সবারই মন এমনদিনে প্রসন্নতায় ভরা থাকে। অ্যাঞ্জেলার ঘরে সকালবেলাতেই গেলাম, দেখি মেঝেতে পড়ে আছে ছেঁড়া স্কার্টটা, ও নেই। ঠিক করে রাখলাম ওকে দিয়ে সেলাই করাতে হবে।
নীচে নেমে শুনলাম ও রুটি আর জেলী রান্নাঘর থেকেই খেয়ে চলে গেছে। খুঁজতে বেরোলাম ওকে আমি। এসব কথা লেখার কারণ এই যে কেন সকালে সেদিন থাকতে পারিনি মিসেস ক্রেলের সঙ্গে।
স্নানের পোষাক নেই অ্যাঞ্জেলার তা দেখে সমুদ্রের তীরে আমি গেলাম। জলে বা ডাঙ্গায় পাথরের ওপর ওর চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলাম না, ভাবলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেকের কাছে তাহলে গেছে। বেশ বন্ধুত্ব ছিলো ওঁদের দুজনে। ওকে পেলাম না ওখানে, ফিরে এসে দেখি মিসেস ক্রেল বসে আছেন চত্বরে, ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও।
হাওয়া চত্বরটা ছিলো না বলে গরম লাগছিলো ভীষণ, বরফ দেওয়া বিয়ার খাওয়ার কথা মিসেস ক্রেল বললেন।
ভিক্টোরিয়ার আমলে তৈরি ঐ বাড়িতে একটা কাঁচঘরের বাগান ছিলো। ওটাকে মিসেস ক্রেল মদের বার করে তুলেছিলেন। ফ্রিজে বিয়ার আর জিঞ্জার বিয়ার থাকতো, তাকে থাকতো নানারকমের মদ।
ঐ ঘরে গেলাম মিসেস ক্রেলের সাথে। একটা বিয়ারের বোতল অ্যাঞ্জেলা ফ্রিজ থেকে বের করছিলো। মিসেস ক্রেল ছিলেন আমার আগে, বললেন, অ্যামিয়াসকে এক বোতল বিয়ার দিতে হবে।
আমার মনে তখন সন্দেহ হয়েছিলো কিনা বলা কঠিন। স্বাভাবিক ভাবেই ওঁর গলার স্বর শান্ত ছিলো। আমি পড়লাম অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ও অপরাধী-অপরাধী মন নিয়ে ফ্রিজের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
আমি যথারীতি বকতে শুরু করলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য ও রইলো শান্ত হয়ে। ও যে স্নান করতে যায়নি সেকথা বলতে ও শুধু হাসলো। বোধহয় সমুদ্রতীরে সোয়েটারটা ফেলে এসেছে।
আমি এই কারণে এতো কথা বলছি যে আমি কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম বলেই কামান বাগানে মিসেস ক্রেলকে যেতে হয়েছিলো।
তারপর কি কি হয়েছিলো সেদিন সকালে আমার মনে নেই একটুও। অ্যাঞ্জেলা কথা না বাড়িয়ে সেলাই করে নিলো নিজের স্কার্টটা।
মিসেস ক্রেল লাঞ্চ খাওয়ার পর বললেন কামান বাগানে যাচ্ছেন উনি। তলায় নামলাম আমিও, অ্যাঞ্জেলার সোয়েটারটা সমুদ্রের পাড় থেকে আনতে হবে। কামান বাগানে ঢুকলেন উনি, পাশের পথ দিয়ে আমি এগোচ্ছি তীরের দিকে এমন সময় ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের চিৎকারে, তাড়াতাড়ি টেলিফোন করতে বললেন ডাক্তার ডাকার জন্যে। মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে মাঝপথেই দেখা হলো, টেলিফোন করতে বলে ওঁকে আবার আমি ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের কাছে।
এই কথাই আমি বলেছিলাম করোনারের বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে যাচ্ছি তা কাউকে কখনও বলিনি। কিন্তু ঠিক এটাও বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে হয়েছিলো তার একটাও মিথ্যে উত্তর আমি দিইনি। তবে সত্যি কথা কিছু বলা হয়নি। এবং কোনো অনুশোচনাও নেই তার জন্যে আমার। এটাও জানি আমি লোকে আমার নিন্দে করতে পারে এই কথাগুলো বলার জন্যে, কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে এতোকাল পরে খুব যে কেউ মাথা ঘামাবে তা মনে হয় না আমার-বিশেষ করে এই কারণে যে আমার সাক্ষ্য ছাড়াই ক্যারোলিন ক্রেল সাজা পেয়েছিলেন।
ঘটনাটা এবার বলি–তাড়াতাড়ি কামান বাগানে ফিরে এলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেককে বলে। কোনো শব্দ হয়নি কারণ বালিতে হাঁটার জুতো পায়ে ছিলো বলে। আমি দেখলাম মিসেস ক্রেল নিজের রুমাল দিয়ে বিয়ারের বোতলের গাটা মুছলেন তাড়াতাড়ি, তারপর বোতলের গায়ে স্বামীর হাতটা নিয়ে আঙুলের ছাপ লাগিয়ে দিলেন। উনি সতর্ক ভাবে এটা করার সময় কান খাড়া রেখেছিলেন আর তাকাচ্ছিলেন চারপাশে, ভয়ের ভাবটা ফুটে উঠেছিলো মুখে।
তখনই বুঝে ফেলেছিলাম আমি তার স্বামীকে মিসেস ক্রেল বিষ দিয়েছেন। তাকে আমি এর জন্য দোষ দেবো না। কেননা মিঃ ক্রেল-সহ্য শক্তির চরম সীমায় মিসেস ক্রেলকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
ক্যারোলিন ক্রেলের মেয়ের উচিত নয় নিজের জীবন মিথ্যের ওপর গড়ে তোলা। তার যত কষ্টই হোক না কেন সত্যটা জেনে, এটা উচিত জানা।
মেয়েটিকে আমার তরফ থেকে বলবেন, ও যেন মার বিচার না করতে বসে। সহ্য শক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়েছিলো একজন স্নেহশীলা মহিলার। মেয়ে যেন সে কথা বুঝে ক্ষমা করে মাকে।
সমাপ্তি সিসিলিয়া উইলিয়ামসের বিবৃতি :
.
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বিবৃতি
প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
সেই দুঃসহ যন্ত্রণার ষোল বছর আগেকার দিনগুলোর যতোটুকু মনে পড়ছে তাই পাঠাচ্ছি। লিখে আপনাকে, পালন করেছি প্রতিশ্রুতি। আমি লেখাটা শুরু করার পর বুঝতে পারলাম কতো সামান্য অংশ মনে আছে আমার।
আমার স্মৃতিতে সেই গ্রীষ্মকালের স্মৃতি খুবই অস্পষ্ট হয়ে আছে–সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোও, বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন জামাইবাবুর মৃত্যু। তখন কি ঘটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
এবং ভাবছিলাম মনে রাখতে না পারাটা যুক্তিসঙ্গত কি না। আমারই মতো অন্ধ আর কার্লা হয় কি বছর পনেরোর কিশোরীরা, হয়তো হয়, চঞ্চলা মেয়ের মত ঐ বয়েসে আমি শুধু লক্ষ্য করতাম অন্যের মেজাজগুলোই, কিন্তু বোঝবার চেষ্টা করতাম না তার পেছনের কারণগুলো।
তাছাড়া সেই সময় ঠিক শব্দের মাদকতা আমি আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। যা পড়তাম, কবিতা শেক্সপীয়ার…সবকিছু ঘুরপাক খেতো মাথার মধ্যে। কতদিন বাগানে মনে আছে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবৃত্তি করেছি আপন মনে ঘন সবুজের দোলায় দোলায়…।
আর একটা নেশা এর সঙ্গে ধরেছিলো, সাঁতার কাটা, ফল খাওয়া গাছে উঠে। ঘোড়াদের ধাওয়ানো আর পেছনে লাগা আস্তাবলের বাচ্চা চাকরদের।
আমার জীবনের সবকিছু ছিলো দিদি আর জামাইবাবু। অথচ আমি একেবারেই ওদের কথা চিন্তা করতাম না, গুরুত্ব দিইনি এলসা গ্ৰীয়ারের আবির্ভাবটাকেও। এবং ও বোকা মনে হতো, আর তেমন কিছু আহামরি নয় দেখতেও। এক ধনী মেয়ের ছবি আঁকছে জামাইবাবু, ব্যাস আমি ক্ষান্ত ছিলাম এইটুকুই জেনে।
লাঞ্চ খাবার পর একদিন বসে আছি চত্বরে, এমনি সময় ওদের ঝঞ্ঝাটের ব্যাপারটা প্রথম কানে এলো আমার, শুনতে পেলাম এলসা বলছে সে বিয়ে করবে অ্যামিয়াসকে। আমার খুব হাস্যকর মনে হয়েছিলো ব্যাপারটা। হ্যান্ডসে মনে আছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে জামাইবাবুকে এ নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
কেন বলছে এলসা তোমাকে ও বিয়ে করবে? ও তো পারে না তা করতে। দুটো বউ তো লোকের থাকতে পারে না। তোমাকে জেলে দিয়ে দেবে।
ক্ষেপে লাল জামাইবাবু, কি করে এ সব কথা তোমার কানে যায়? লাইব্রেরীর জানলা দিয়ে বলেছিলাম আরো সেই শুনে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠাবার কথা সে বললো। কাজ নেই কোনো কেবল আড়িপাতা পরের কথায়। জামাইবাবু বলেছিলো।
আমি খুব অপমানবোধ করেছিলাম জামাইবাবুর কথায় তবুও আমি রাগের চোটে বলেছিলাম, এলসা ওই ধরনের অসভ্য কথা, বলবে কেন?
জামাইবাবু বলেছিলো–ওটা ঠাট্টা, আমি মেনে নিয়েছিলাম জামাইবাবুর কথাটা, তবে বিশ্বাস করিনি পুরোপুরি।
এলসাকে ফেরার পথে ধরলাম, জামাইবাবুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাকে এলসা বিয়ে করবে বলছে, তার মানে কি, ও তাতে বললো ওটা ঠাট্টা করে বলেছো তুমি তাই কি?
এলসা এতেই জব্দ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এলসা শুধু হাসলো উত্তর না দিয়ে, ভালো লাগেনি আমার হাসিটা, খাবার আগে দিদির ঘরে সেই রাতে, প্রশ্ন করেছিলাম সোজাসুজি জামাইবাবুর পক্ষে কি বিয়ে করা সম্ভব এলসাকে।
আজো আমার দিদির উত্তরটা কানে বাজে, না মরা পর্যন্ত আমি, তোর জামাইবাবু বিয়ে করতে পারবে না এলসাকে।
আমি একেবারে দিদির কথাতে নিশ্চিত হয়ে যাই। কারণ বহু দেরি মৃত্যু আসতে। তবে রাগ আমার যায়নি জামাইবাবুর ওপর–ওই স্কুলে পাঠাবার কথাটার জন্যে। খাবার সময়েও সেদিন রাতে এক পশলা জামাইবাবুর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেলো। সারারাত সেদিন কেঁদেছিলাম।
সেদিন সন্ধ্যেবেলার মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি কথা তেমন ভালোভাবে আমার মনে নেই। তবে মেরিডিথ যখন সক্রেটিশের মৃত্যু বর্ণনা পড়েছিলেন, ভীষণ ভালো লেগেছিলো আমার।
আমার তার পরের দিনের কথা আরও মনে নেই, যদিও অনেক ভেবেছি ঐ নিয়ে, এইটুকু শুধু মনে পড়ে স্নানটান করার পর আমাকে কি একটা সেলাই দেওয়া হয়েছিলো করতে।
মেরিডিথ চত্বর থেকে ফ্যাকাশে মুখে ওপরে দৌড়ে আসার আগে পর্যন্ত অস্পষ্ট আর ধোয়াটে ছিলো সব কিছুই। মনে আছে টেবিল থেকে একটা কফিপেয়ালা পড়ে ভেঙে যায়, এলসা ফেলেছিলো মনে আছে এটাও। ভয়ংকর মুখ করে নীচে ছুটে নেমে যায় সে।
মনে মনে আমি বলেছিলাম, মরে গেছে জামাইবাবু! সত্যি কথাটা বলে আমার মনে হয়নি। কেউ জামাইবাবুর কাছে আমাকে যেতেও দেয়নি। পুলিশও এসেছিলো।
পরে আমাকে দিদির ঘরে নিয়ে যান মিস উইলিয়ামস। খুব অসুস্থ লাগছিলো দিদিকে। আদর করে আমাকে ওই বাড়ি ছেড়ে লোড্রী ট্রেসিলিনার বাড়ি চলে যেতে বললো, ওখানে কাল ও থাকবে।
আমি দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম আমি যাবো না ওকে ছেড়ে। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে শেষ পর্যন্ত ওরা রাজী করালো আমাকে চলে যেতে।
আমাকে নিয়ে তারপর পুলিশের কাছে যাওয়া হয়েছিলো। একজন জামাইবাবু সম্বন্ধে খুব মিষ্টি করে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন? তখন ভেবেছিলাম কোনো মানে হয় না এগুলোর। কিন্তু এখন বুঝি। ওঁরা আমাকে এসব শোনার পর ছেড়ে দিলেন লেডী ট্রেসিলিনার ওখানে যাবার জন্যে।
আমাদের খুব ভালো ভাবেই লেডী ট্রেসিলিনা নিলেন। পরে দিদিকে গ্রেপ্তার করেছে শুনলাম পুলিশ। আমি অসুস্থ হয়ে যাই কথাটা শুনে।
যে সব কিছু লিখতে আমি পারিনি তাতো দেখতেই পাচ্ছেন আপনি, ভালোভাবে অনেক ভেবেছি কিছুই মনে পড়ছে না। কোনো কিছুই তো নয়ই অপরাধ সংক্রান্ত, এলসার পাগলামী, দুঃশ্চিন্তায় মেরিডিথের মুখ ফ্যাকাশে, শোকার্ত ফিলিপ এবং ক্রুদ্ধ–এসব কিছুকেই তখন স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। তবে অভিনয় যে কেউ করে যাচ্ছে এটা মনে হচ্ছিল আমার। একটা কথাই আমি জানতামও আজ দিদি করেনি।
আমি এ ব্যাপারে ভুল করিনি, করছি না এখনও। অবশ্য আমি যতো দিদির চরিত্রকে ভালোভাবে চিনি তারই ওপর এটা বলছি নির্ভর করে, কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ এর পেছনে দিতে পারবো না।
সমাপ্ত অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বিবৃতির :–
৩. উপসংহার
তৃতীয় খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
উপসংহার
মুখ তুলে তাকালো কার্লা লেমারচেন্ট, চোখে ক্লান্তি আর বেদনার ছাপ। কাগজের বাণ্ডিলটা ছুঁয়ে বললো, এতো গোলমেলে ঠেকছে সব ব্যাপারটা, ভিন্ন-ভিন্ন দিক দিয়ে প্রত্যেকেই মাকে দেখেছেন। অথচ একটাই বক্তব্য, কেউ দ্বিমত নন দেখছি আসল ব্যাপারে।
এগুলো পড়ে খুব হতাশ হয়েছেন?
হ্যাঁ, আপনি হননি? না, অনেক মূল্যবান তথ্য আছে এই কাগজগুলোতে।
ভালো করতাম এগুলো না পড়লেই–পোয়ারো বললো কালার এই কথাটা শুনে, তাহলে আপনিও ঐ কথাটা চিন্তা করেছেন?
কার্লা ঝাঁকানো সুরে বললো, অ্যাঞ্জেলা মাসী ছাড়া মা ওটা করেছিলেন সবাই মনে করে। আর কেউ মানবে না মাসীর কথা। কারণ পেছনে যুক্তি নেই। শুধু কি কাজ হয় বিশ্বাসে?
ঐ ভাবেই তাহলে ব্যাপারটাকে আপনি নিয়েছেন?
বলুন না অন্য কিভাবে নেওয়া যায়? যদি আমার মা করে থাকেন ওটা, তবে এই পাঁচ জনের মধ্যে করেছেন কেউ না কেউ। এবং আমি তার কারণও চিন্তা করে দেখেছি।
আহ! ব্যাপারটা ভারী আশ্চর্যের তো। বলুন শুনি।
না, না, শুধুই তত্ত্ব ওগুলো। যেমন ধরুন ফিলিপ ব্লেক–উনি ব্যবসা করেন শেয়ারের। প্রাণের বন্ধু বাবার হয়তো ওঁকে বিশ্বাসও করতেন আমার বাবা। শিল্পী বেশ অসাবধানী হয় টাকা পয়সার ব্যাপারে। ঝাটে পড়ে হয়তো ফিলিপ টাকা নিয়েও থাকতে পারেন বাবার কাছ থেকে। কিছু সইও করিয়ে নিয়ে থাকতে পারেন বাবাকে দিয়ে, তাহলে হয়তো সত্যি কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং তাকে বাঁচাতে পারতো বাবার মৃত্যুই। মনে হচ্ছে এই ধরনের কথা।
দেখছি খুব অযৌক্তিক চিন্তা করেননি। আর কি?
ঐ এলসার ব্যাপারটা। এখানে বলেছেন ফিলিপ ব্লেক যে বিষ নিয়ে কারসাজি বাবার ব্যাপারে নাকি বড় বেশি মাথা ঘামিয়ে ছিলেন এলসা, কথাটা তো সত্যি বলে আমার মনে হয় না। ধরুন এলসাকে আমার মা বললেন বাবাকে ডিভোর্স দেবেন না কিছুতেই। তাহলে যাই বলুন না কেন যে বড়লোকী ভাব এলসার মধ্যে আছে তার জন্যে সে বিবাহ চাইবে সম্মানজনক ভাবে। এবং খানিকটা ঐ বিষের জোগাড় করে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতো মাকে। হয়তো ক্যারোলিনের ক্ষতি না করে ভাগ্যদোষে বাবার ক্ষতি করে দিলো।
না, খুব ভুল চিন্তা করেননি এবারও আপনি। আর কি?
মানে, ধারণা হয়েছিলো আমার…মেরিডিথও এটা করে থাকতে পারেন।
তাই নাকি, মেরিডিথ ব্লেক?
হা। দেখুন খুনী খুনী মনে হয় ওঁর কথাবার্তা শুনলে। হয়তো মনে হবে না বাইরে থেকে কারণ খুব চাপা লোক উনি। যাকে উনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাকে বাবা বিয়ে করে নিয়েছিলেন। বিষ তৈরি করতেন মেরিডিথ। হয়তো কাউকে মারার জন্যেই ওগুলো উনি তৈরি করতেন। কি হয় বিষ খেলে এই সব ব্যাখ্যা করে নিজেকে উনি চেয়েছিলেন সন্দেহের অতীত করে রাখতে। হয়তো উনি ফঁসী কাঠে আমার মাকে ঝোলাতে চেয়েছিলেন, কারণ মা ওঁকে অনেককাল আগে প্রত্যাখ্যান করেন। অনেক সময় মানুষ উল্টোপাল্টা কথা বলে যার সঙ্গে কোনো সঙ্গতি থাকে না তার চরিত্রের। এ-ও তো হতে পারে তিনি নিজেকেই ওটা লেখার সময় বোঝাতে চেয়েছেন।
পোয়ারো বললো, অন্ততঃ এ ব্যাপারে ভুল করেননি আপনি সব সময় লেখাগুলোকে সত্যি বলে নেওয়া চলে না। ইচ্ছে করেই ভুল পথে চালাবার জন্যে মিথ্যে কথা বলা হয়ে থাকতে পারে।
হা, জানি এবং আমার মাথায় এটাও আছে।
আর ভেবেছেন কিছু।
ধীরে ধীরে বললো কালা, আমি মিস উইলিয়ামসের কথা এগুলো পড়ার আগে চিন্তা করেছিলাম। স্কুলে অ্যাঞ্জেলা চলে যাবার ফলে চাকরী চলে যায় মহিলার। এবং যদি হঠাৎ অ্যামিয়াস মারা যান তবে স্কুলে যেতে নাও হতে পারে অ্যাঞ্জেলাকে। আমি কিন্তু বলতে চাইছি স্বাভাবিক মৃত্যুর কথাই। এবং যদি বিষ চুরির ব্যাপারটা মেরিডিথ না জানতে পারতেন তবে মৃত্যুকে ওই ভাবেই চালানো হতো, সর্দিগর্মি বা ঐ জাতীয় কোনো কারণে মারা গেছে। চাকরি হারাবার ভয়ে মানছি কাউকে খুন করার যুক্তিটা টিকবে না ধোপে। তবে সামান্য কারণে এর তো খুন হয়েছে এর আগে।
আমার এটা পড়ার আগে মনে হয়েছিলো তাই। কিন্তু তেমন তো মনে হয় না মিস উইলিয়ামসকে। তিনি একটুও অযোগ্য নন…।
তা তো ননই। এখনও বেশ চটপটে আর বুদ্ধিমতী ভদ্র মহিলা।
জানি। দেখাও যায় সেটা। ওকে মনে হয় খুব বিশ্বাসীও। আর আমাকে সেটাই ভাবিয়ে তুলেছে। আপনি তো সবই জানেন…পারেন তোতা বুঝতেও। সব সময়ে আপনি তো বলছেন প্রকাশ করতে চান প্রকৃত সত্যটাকে। মনে হয় আমার এবার আমরা সত্যটা পেয়েছি। বিশ্বাস করতে চান বলেই কখনো মিথ্যের ওপর জীবনের ভীত গড়া উচিত নয়। ঠিক আছে মেনে নিচ্ছি আমি নির্দোষ ছিলেন না আমার মা। মনের দুর্বলতার আর বাঁচাবার জন্যেই আমাকে মিথ্যে চিঠি লিখেছিলেন। বিচার করছি না তার আমি। মানুষের জেলে কি হয় তা জানা নেই আমার। মরীয়া হয়ে বাবার জন্যে ওটা করেও থাকতে পারেন মা, তাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। আবার ঐ ধরনের প্রাণশক্তিতে ভরপুর বাবাকেও দেবো না দোষ। বোধ হয় ওঁর উপায় ছিলো না…একজন অতো বড় শিল্পী, বাবার অনেক কিছুই ক্ষমা করা যায়।
পোয়ারো বললো, তাহলে…সন্তুষ্ট তো আপনি?
সন্তুষ্ট। কার্ল লেমারচেন্ট বললো। চেঁচিয়ে উঠলো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে।
ঝুঁকে পড়ে পোয়ারো হাত বুলিয়ে কালার পিঠে সান্ত্বনা দিলো। শুনুন, যখন লড়াই করা ঠিক দরকার আপনি তখনই লড়াই চাইছেন শেষ করতে বিশেষ করে যখন আমি এরকুল পোয়ারো ভালোভাবে ঘটনাটাতে বুঝতে শুরু করেছি।
হাঁ করে তাকালো কার্লা পোয়ারোর দিকে, মাকে ভালোবাসতেন মিস উইলিয়ামস, নিজের চোখে উনি দেখেছেন আত্মহত্যা বলে চালাবার জন্যে যা করেছিলেন মা। যদি আপনি বিশ্বাস করে থাকেন ওঁর…।
উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, সেটা এই জন্যে দেখেছিলেন যে আপনার মা স্বামীর আঙুলের ছাপটা বিয়ারের বোতলে লাগাচ্ছিলেন বিয়ারের বোতলে মনে রাখবেন–ঐ একটা ঘটনাই আমাকে স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে নিজের স্বামীকে আপনার মা খুন করেননি।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
পাঁচটা প্রশ্ন পোয়ায়োর
০১.
মিঃ পোয়ারো বললেন গলায় বিরক্তির সুর ফিলিপ ব্লেকের ট্র্যাজেডী সম্বন্ধে ক্রেল পরিবারের যা লিখে দিয়েছেন ধন্যবাদ তার জন্যে।
প্রচ্ছন্ন গর্ব জেগে উঠলো ফিলিপ ব্লেকের–অশেষ ধন্যবাদ। দেখলাম লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথাই, কি আশ্চর্য, তাই না?
বর্ণনা দিয়েছেন অপূর্ব সুন্দর, তবে বাদ পড়ে গেছে কিছু, তাই না?
বাদ পড়ে গেছে? ভ্রু কুঁচকালের ফিলিপ ব্লেক।
সব সময়ে আপনার বর্ণনা আপনি খোলা মন নিয়ে পুরোপুরি লেখেননি, গলাটা পোয়ারোর ক্রমশঃ কঠিন হয়ে আসছে, খবর পেয়েছি আমি যে কোনো এক গ্রীষ্মকালের রাতে খুবই উদ্ভট সময়ে আপনার ঘর থেকে মিসেস ক্রেলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছিলো।
অনেকক্ষণ পরে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ফিলিপ বললেন, কে বলেছে আপনাকে?
সেটা বড় কথা নয় কে বলেছে। আমি যে জানি এটাই বড় কথা।
নিস্তব্ধতা নেমে এলো আবার, মনঃস্থির করে ফিলিপ ব্লেক বললেন, কেমন করে আপনি জানি না হঠাৎ ব্যক্তিগত ব্যাপারটা আমার জেনে ফেলেছেন, হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি, আমার বিবৃতির সঙ্গে অসঙ্গতি আছে এর। যদিও অসঙ্গতি নেই আমার মতে। ফলে বাধ্য হচ্ছি আমি সত্যি কথাটা বলতে।
আমার মনে কিছুটা বিদ্বেষ ভাব ছিলো ক্যারোলিন ক্রেলের প্রতি। তবে আকর্ষণ বোধ করতাম সেই সঙ্গে ওর প্রতি। হয়তো প্রথমটার জন্ম দিয়েছিলো শেষোক্তটিই। ওর প্রভাবটাকে আমার ওপর ঘৃণা করতাম এবং সেই জন্যেই ওর খারাপ দিকগুলো নিয়ে খালি আঘাত করবার চেষ্টা করতাম। পছন্দ করিনি ওকে, অথচ যেকোনো মুহূর্তে ওর সঙ্গে প্রেম করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিলো আমার পক্ষে। আমি ওকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতাম। অথচ আমাকে ও পাত্তা দেয়নি। ফলে কোনো দিনও ওকে আমি ক্ষমা করিনি।
যখন ঐ এলসা মেয়েটার প্রেমে মজলো অ্যামিয়াস তখন সুযোগ আমার এসে গেলো। বিনা কারণেই সম্পূর্ণ আমি আমার ভালোবাসার কথা ক্যারোলিনকে বলে ফেললাম। ও শান্ত ভাবে বলেছিলো, হ্যাঁ, তা তো আমি বরাবরই জানি। মহিলার কী ঔদ্ধত্য।
অবশ্য জানতাম আমিও যে ও ভালোবাসে না আমাকে। তবে ঐ অ্যামিয়াসের মতিগতি দেখে বেশ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলো ক্যারোলিন। মেয়েদের জয় করা সহজ এই রকম মানসিকতার। ও আমার কাছে সেই রাতে আসতে রাজী হয়েছিলো। এবং এসেওছিলো।
এবার চুপ করলো ফিলিপ। বোধ হয় পরের কথাগুলো বলতে বেশ ওর কষ্ট হচ্ছে।
ও এসেছিলো আমার ঘরে। তারপর খুব ঠান্ডা গলায় আমার আলিঙ্গনের মধ্যেই বলেছিলো ভালো নয় এটা। সে এক পুরুষে আসক্তা ও অ্যামিয়াস ক্রেলের, তা সে হোক ভালো অথবা মন্দ, ও যে ভালো ব্যবহার আমার প্রতি করেনি সেটা স্বীকার করলো এবং এটাও বললো যে ওর ছিলো না কোনো উপায় চাইলো ক্ষমা।
তারপর চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। আশ্চর্য হবেন শুনলে মিঃ পোয়ারো ওর প্রতি একশোগুণ ঘৃণা বেড়ে গেলো। শুনলে কি আপনি আশ্চর্য হবেন যে আমি কখনই ক্যারোলিনকে ক্ষমা করতে পারিনি? আমাকে যে ভাবে ও অপমান করেছিলো–এবং পৃথিবীতে আমার বিশেষ করে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে যে ভাবে ও খুন করেছিলো তার জন্যে ।
কাঁপতে কাঁপতে রাগে ফিলিপ ব্লেক বলে উঠলেন, কিছু বলতে চাই না এ ব্যাপারে শুনছেন? আমি কোনো উত্তর দেবো না। এবার আসুন। আর কোনোদিনও এই ধরনের প্রশ্ন করবেন না আমাকে।
.
০২.
আপনার অতিথিরা সেদিন কে কি ভাবে এবং কার পর কে বেরিয়েছিলেন ল্যাবোরেটরি থেকে সে সম্বন্ধে আমি জানতে চাই কিছু।
মিঃ মেরিডিথ ব্লেক প্রতিবাদ করে উঠলেন–কিন্তু মিঃ পোয়ারো ষোলো বছর পর…কি করে তা সম্ভব মনে থাকা? সবার শেষে ক্যারোলিন বেরিয়েছিলো আপনাকে তো বলেছি।
আপনার ও বিষয়ে ভুল হচ্ছে না তো…?
না…অন্ততঃ…তাই তো মনে করি…
চলুন ওখানে যাওয়া যাক। পুরো মাত্রায় আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, বুঝছেন তো।
মেরিডিথ আপত্তি জানাতে জানাতেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। দরজার তালা খুলে, খুলে দিলেন জানলার পাল্লাগুলোও। পোয়ারো বেশ মেজাজের মাথায় বলতে শুরু করলো–বন্ধু এবার মনে করুন গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি করার ব্যাপারটা আপনার অতিথিদের বলা হয়ে গেছে। একটু ভাবুন চোখ বন্ধ করে…।
মেরিডিথ বাধ্য ছেলের মতো তাই করলেন। একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে ধীরে ধীরে পোয়ারো ওটা নাড়াতে লাগলেন ব্লেকের নাকের সামনে, একটু কুঁচকে উঠলো নাকটা, বিড়বিড় করে মেরিডিথ শুরু করলেন বলতে-হা…হা…কী আশ্চর্য মনে পড়ে যাচ্ছে সব কথা…একটা হালকা কফি রঙের পোষাক ক্যারোলিন পরেছিলো। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো ফিলিপকে…সব সময়েই ও মনে করতো কোনো মানে হয় না আমার এই নেশাটার।
পোয়ারো বললো, চিন্তা করুন এবার, ঘর থেকে আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। আপনি যাচ্ছেন এখান থেকে লাইব্রেরীতে…সবার আগে ঘর থেকে কে বের হলো–আপনি কি?
এলসা আর আমি। আগে দরজা দিয়ে ও বেরিয়ে গেলো। ওর খুব কাছেই ছিলাম আমি কথা বলতে বলতে ওর সঙ্গে বাকীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবার বন্ধ করতে হবে তো দরজাটা। তারপরে ফিলিপ এলো। অ্যাঞ্জেলা ফিলিপের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো। অ্যামিয়াস এবং সব শেষে ক্যারোলিন ওদের পেছনেই ছিলো।
এ বিষয়ে তাহলে কোনো দ্বিধা নেই আপনার তো–সবার পরে ক্যারোলিন বেরোয়? কি করেছিলেন উনি তা কি দেখেছিলেন?
মাথা নাড়লেন মেরিডিথ, না, ঘরের দিকে আমি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বোঝাচ্ছিলাম এলসাকে কোন্ লতা তুলতে হয় পূর্ণিমার দিন…যত সব কুসংস্কারের গল্প। বেরিয়ে এলো ক্যারোলিন যেন ব্যস্ত একটু…তালা দিলাম দরজায়। মেরিডিথ কথা শেষ করে চোখ খুললেন, রুমালটা পকেটে ভরছিলো পোয়ারো। বেশ বিরক্ত হয়ে নাক টেনে মেরিডিথ বললেন মনে মনে, এ লোকটা কেন আবার সুগন্ধী ব্যবহার করে। মুখে বললেন, ওরা এইভাবেই বেরিয়েছিলো –এলসা, আমি, ফিলিপ, অ্যাঞ্জেলা আর ক্যারোলিন, আপনার কি এতে কিছু লাভ হবে?
ঠিক আছে সব। শুনুন এখানে আমি একটা জমায়েতের ব্যাপার করতে চাই। আশাকরি অসুবিধে হবে না…।
.
০৩.
এলসা ডিটিশাম বাচ্চা মেয়ের মতো কৌতূহল দেখিয়ে বললেন বলুন।
ম্যাডাম একটা প্রশ্ন করতে চাই। করুন।
পোয়ারো বললো, সবকিছু, মানে শেষ হবার পর বিচার, মেরিডিথ ব্লেক আপনার কাছে কি বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন?
হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন এলসা, যেন বিবক্ত হয়েছেন খুব।
হা-করেছিলেন। কেন?
তাতে কি আপনি আশ্চর্য হয়েছিলেন?
হয়েছিলাম কি? পড়ছে না মনে।
কি বলেছিলেন আপনি?
এলসা হেসে উত্তর দিলেন? কি মনে হয় আপনার কী বলেছিলাম? অ্যামিয়াসের পরে– মেরিডিথ? আর কি হতে পারে এর চেয়ে হাস্যকর। বোকার মতো উনি ব্যবহার করেছিলেন।
মুচকি হেসে এলসা হঠাৎ বললেন, আমাকে বাঁচাতে উনি চেয়েছিলেন আমার দেখাশোনা করতেও–কথাটা এইভাবেই বলেছিলেন। মেরিডিথেরও অন্যদের মতো কেমন যেন ধারণা হয়েছিলো আমি বেশ কষ্ট পাচ্ছি ঐ ধরনের কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে!..বেচারা মেরিডিথ বুড়ো..গাধা কোথাকার। আবার এলসা জোরে হেসে উঠলেন।
.
০৪.
পোয়ারো আর একবার মর্মভেদী দৃষ্টির সম্মুখীন হলো মিস উইলিয়ামসের। একটা প্রশ্ন আছে আস্তে আস্তে জানালো। সম্মতি ঘাড় নেড়ে জানাতেই খুব সাবধানে পোয়ারো প্রশ্নটা করলো, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন খুব ছোট অবস্থাতে জখম হয়েছিলো। আমি দেখেছি দুজনের বিবৃতিতে উল্লেখ আছে তার। একটাতে বলা হয়েছে পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মিসেস ক্রেল ওকে মেরেছিলেন। উনি অ্যাঞ্জেলাকে মেরেছিলেন শাবল দিয়ে অন্যটায় আছে। কার কথাটা এর মধ্যে ঠিক?
মিস উইলিয়ামস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন–আমি কখনো শাবলের কথা শুনিনি। পেপার ওয়েট ব্যাপারটাই ঠিক।
এটা কার কাছ থেকে শুনেছিলেন?
অনেক দিন আগে অ্যাঞ্জেলা নিজেই আমাকে কথাটা বলেছিলো।
অ্যাঞ্জেলা ঠিক কথা বলেছিলো?
ও নিজের গালটা ছুঁয়ে বলেছিলো যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন দিদি পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরেছিলো বলে এই রকম হয়ে গেছে। তবে কখনো একথা যেন বলবেন না ওকে, ও কষ্ট পায় খুব।
ও কথা মিসেস ক্রেল কখনও আপনাকে বলেছিলেন?
আভাসে। ব্যাপারটা আমি জানি উনি ধরে নিয়েছিলেন। ওঁকে আমি বলতে শুনেছিলাম, আমি জানি মনে করেন আপনি অ্যাঞ্জেলাকে আদর করে আমি নষ্ট করেছি। আমার সব সময়ে মনে হয় যে ক্ষতি করেছি আমি তার ক্ষতি পূরণ করার সাধ্য আমার নেই। আর একবার বলেছিলেন, স্থায়ী কারুর ক্ষতি করেছি এই চিন্তাটা চিরকাল মানুষের জীবনে গুরুভারের মতো চেপে বসে থাকে তা মনের ওপর।
ধন্যবাদ, মিস উইলিয়ামস। আমার জানার ছিলো এইটুকুই।
তীক্ষ গলায় উনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ঠিক আপনাকে বুঝতে পারছি না মিঃ পোয়ারো। ঐ যে দুঃখের ঘটনার বর্ণনা আমি লিখে দিয়েছি, অ্যাঞ্জেলাকে কি সেটা দেখিয়েছেন?
মাথা নাড়লো পোয়ারো, আর এখনও আপনি, কথাটা মিস উইলিয়ামস শেষ করলেন না।
পোয়ারো বললো, চিন্তা করুন এক মিনিট। একজন জেলে যদি দেখেন বসে আছে বারোটা মাছ নিয়ে, তখন মনে হতে পারে আপনার সত্যিকারের মাছটা বারোটা। কিন্তু নকল তো একটাও হতে পারে।
দৃপ্তকণ্ঠে বেশ জবাব দিলেন মিস উইলিয়ামস, অবাস্তব কথা খুবই, অথচ…। ।
..ও, অবাস্তব…কিন্তু অসম্ভব তো নয়…কারণ আমার একবার এক বন্ধু নিয়ে গিয়েছিলো একটা নকল মাছ (বুঝতেই পারছেন ওর নকল মাছ তৈরি করার ব্যবসা ছিলো) আসলের সঙ্গে তুলনা করার জন্যে। এবং যদি আপনি কারোর বৈঠকখানায় ইন্নিয়াস মাছগুলোকে মাছের অ্যাকোরিয়ামে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে করেন জ্যান্ত নয় ওগুলো, তবে ভুল করবেন, সোজা বাগদাদ থেকে ওগুলো প্লেনে করে আনা আনা হয়েছে।
আজেবাজে কী সব বকছেন? কেঁঝে উঠনে মিস উইলিয়ামস।
বকছি এই জন্যে যে আপনাকে আমি দেখাতে চাই চোখ দিয়ে মানুষ যা দেখে তা মন দিয়েও অনেক সময় দেখতে হয়…।
.
০৫.
রিজেন্ট পার্কের ফ্ল্যাটে বাড়িটার কাছে এসে পোয়ারো চলার গতিটা কমিয়ে দিলো।
তেমন কিছু অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনকে জিজ্ঞেস করার না থাকলেও এখানে আসা সামঞ্জস্যটা রাখার জন্যেই। পাঁচটা প্রশ্ন পাঁচজনকে করতেই হবে।
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন সাদর অভ্যর্থনা জানালো।
পেলেন কিছু?
এগোতে পারছি শেষ পর্যন্ত।
ফিলিপ ব্লেক? মন্তব্য খানিকটা, অ্যাঞ্জেলা খানিকটা মন্তব্য, খানিকটা প্রশ্নের মাঝামাঝি সুরে অ্যাঞ্জেলা জানতে চাইল।
আমাকে এখনও কোনো প্রশ্ন করবেন না। এখনও সময় আসেনি। তবে অনুরোধ একটা করতে এসেছি, রাজী সবাই, এখন দয়া করে যদি আপনি একবার হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরে মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি আসেন।
আপনার কি উদ্দেশ্য ঘটাতে চান নাকি ষোলো বছর আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি?
দেখতে চাই আরও একটু সুস্পষ্ট ভাবে। তা আসছেন তো?
যাবো। এক সঙ্গে সবাইকে মনও চাইছে দেখতে, আপনার ভাষায় সকলকে আরও একটু সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবো।
সঙ্গে আনবেন সেই চিঠিটাও, যেটা দেখিয়েছিলেন আমাকে।
না, আপনাকে দেখিয়েছি বলেই দেখাতে হবে তার কোনো মানে নেই।
এ ব্যাপারে কিন্তু আপনার উচিত আমার কথামতো চলা।
নিশ্চয়ই না। হয়তো চিঠিটা নিয়ে যাবো, তবে দেখাবো কিনা সেটা নির্ভর করবে আমার ইচ্ছের ওপর।
ঠিক আছে।…প্রশ্ন করছি একটা…ঐ দুর্ঘটনাটা ঘটার কাছাকাছি সময় আপনি দি মুন অ্যাণ্ড দি মিক্স পেন্স উপন্যাসটা সমারসেট মমের লেখা তা পড়েছিলেন?
কি আশ্চর্য? হা, কিন্তু কি করে জানলেন আপনি?
আপনাকে শুধু দেখাতে চাই, তুচ্ছ ব্যাপারেও খুব আমি কেমন জাদু দেখাতে পারি। অনেক কিছু না বললেও আমি জানতে পারি।
.
তৃতীয় অধ্যায়
পুনর্গঠন
হ্যাণ্ডক্রশ ম্যানরের ল্যাবরেটারিতে বিকেলের রোদের আলোয় সবাই আবার এসে সমবেত হচ্ছেন। কাটতে চাইছে না বাড়িটার পরিত্যক্ত রূপটা।
মেরিডিথ ব্লেক একটু অস্বস্তির মধ্যে এলোমেলো ভাবে কালার সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন এক সময়ে, জানো বাছা, তুমি কয়েকটা দিক দিয়ে একেবারে তোমার মায়ের মতো, আবার একেবারেই নও কয়েকটা ব্যাপারে।
প্রশ্ন করলো কালা–মিল কোথায় আর অমিল কোথায়-শুনি বলুন না।
রঙ, হাঁটা চলা মায়ের মতো, তবে…বলি কিভাবে…অনেক বেশি স্পষ্ট।
ফিলিপ ব্লেক জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বাইরে, বিরক্তির রেখা ফুটে উঠছে কপালে, এর কি মানে হয়? এমন সুন্দর সন্ধ্যে বেলায় শনিবারের… ।
সবাইকে শান্ত করলেন এরকুল পোয়ারো এক কথায়, আমি ক্ষমা চাইছি…এভাবে গলফ খেলার সময় নষ্ট করার জন্যে…তবে আপনার প্রিয় বন্ধুর মেয়ের জন্যে…খেয়াল করে ওর কথা…।
ঘোষণা করলো খাস-খানসামা এসে–এসেছেন মিস ওয়ারেন। ওকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মেরিডিথ নিয়ে এলেন। অ্যাঞ্জেলা সময় নষ্ট করেও এসেছো, খুশী হলাম ভারী।
ছুটে গেলো কার্লা, এই যে অ্যাঞ্জেলা মাসী। তোমার প্রবন্ধ পড়লাম আজকের টাইমস পত্রিকায়। কী ভালোই না লাগে নামী আত্মীয় থাকলে, লম্বা মতো একজন, চৌকো চোয়ালওলা যুবককে দেখিয়ে বললো, এই হলো জন ব্যাটারি। আমি আর ও…ইচ্ছে আছে বিয়ে করবার…
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন বললেন, আঃ…জানতাম না তাতো…।
এগিয়ে গেলেন মেরিডিথ আর একজন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে–এই যে মিস উইলিয়ামস দেখা কত বছর পরে…।
রোগা, দুর্বল অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে এলেন গভর্নেস, একবার পোয়ায়োকে দেখে নিয়ে দামী সুট-প্যান্ট পরা লম্বা মতো একজনের দিকে তাকালেন।
এগিয়ে এসে অ্যাঞ্জেলা হাসি মুখে বললেন, নিজেকে আবার স্কুলের মেয়ে মনে হচ্ছে।
মিস উইলিয়ামস বললেন, আমার গর্ব হয় তোমার জন্যে বাছা, আমার মুখ রেখেছো তুমি। এই তো কালা, তাই না। নিশ্চয়ই ওর মনে নেই আমাকে…তখন বড্ড ছোট ছিলো…।
ফিলিপ অস্থির হয়ে উঠেছেন–এসব কী হচ্ছে? আমাকে তো কেউ বলেনি।
এটার নাম দিয়েছি আমি…অতীত ভ্রমণ। আসুন, বসি সবাই মিলে। কাজ শুরু হবে শেষ অতিথি এসে গেলেই। উনি এলেই…নামানো হবে আত্মাকে, পোয়ারো বললো।
বিরক্ত হয়ে ফিলিপ বললো, কি ছেলেমানুষী হচ্ছে এসব? নিশ্চয়ই আপনি কোনো চক্র ডাকতে যাচ্ছেন না প্ল্যানচেটের।
না, না, নিশ্চয়ই না। আলোচনা করবো শুধু অতীতের ঘটনা নিয়ে। আবির্ভাব হবে না ভূত-টুতের ঠিকই। তবে বলতে পারে কে এই মুহূর্তে এঘরে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিনের আত্মা নেই?
যা তা কি সব বকছেন, চেঁচিয়ে উঠতেই ফিলিপ খাস-খানসামা এসে লেডী ডিটিশাম এসেছেন জানালো।
লেডী ডিটিশাম এলেন, মুখের রেখায় ঔদ্ধত্য আর বিরিক্তির ক্ষীণ আভাস পরিস্ফুট। একটু হাসলেন মেরিডিথের দিকে তাকিয়ে শীতল দৃষ্টিতে। অ্যাঞ্জেলা আর ফিলিপের দিকে তাকিয়ে বসলেন একটা আলাদা চেয়ারে গিয়ে। দামী হারের বাঁধনটা গলা থেকে আলগা করে দিতেই লুটিয়ে পড়লো পেছন দিকে হা করে কার্লা দেখছিলো এলসাকে। তার জীবনে এই মহিলাটির জন্যেই ঐ সর্বনাশ নেমে এসেছিলো। তবে ঘৃণার বদলে তার দৃষ্টিতে ছিলো কৌতূহল।
এলসা বললো, দুঃখিত মিঃ পোয়ারো একটু দেরী হয়ে গেলো।
আপনি এসেছেন এটাই ম্যাডাম বড় কথা।
জোরে নাক টানতেই সিসিলিয়া উইলিয়ামস এলসা তাকালেন ওর দিকে, অবজ্ঞার ভাব। বললেন, অ্যাঞ্জেলা চিনতে পারতাম না তোমাকে। বলো তো কতোদিনের কথা, ষোলো বছর।
পোয়ারো কাজে লাগালো এই সুযোগটাকে, হ্যাঁ আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি যোবলা বছর আগেকার ঘটনা নিয়েই, বলে নিই তার আগে আমরা কেন জড়ো হয়েছি এখানে। কালার অনুরোধ সংক্ষেপে এবং তার দায়িত্ব নেওয়ার কথাটা বলে ফিলিপ আর মেরিডিথের তরফ থেকে ঝড় উঠতে যাচ্ছে প্রতিবাদের দেখে পোয়ারো তাড়াতাড়ি বললো, আমি কাজের ভারটা নিয়েছি–কাজও শুরু করেছি সত্যটা আবিষ্কার করার জন্যে।
পোয়ারোর কথা শুনতে শুনতে কার্লা অলক্ষে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো আগন্তুক পাঁচজনের মুখের ওপর এদেরই মধ্যে একজন। কেউ খুন করেছিলো ওর বাবাকে।
কল্পনা করতে লাগলো কালা–কাউকে না কাউকে এরা খুন করেছেন–রাগে পাগল হয়ে গিয়ে ফিলিপ ব্লেক একজন মহিলার গলা টিপে ধরেছেন, একটা সিদেল চোরকে মেরিডিথ রিভলভার দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন, হঠাৎ চলে গেলো গুলি, ভেবে চিন্তে অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন গুলি করছেন কাউকে…সিলেক মোড়া সোফায় বসে প্রাচীন দুর্গে হুকুম দিচ্ছেন এলসা হতভাগাটাকে দুর্গের পাঁচিল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দাও তলায়। …নানা বিচিত্র এই ধরনের কল্পনার জগতে কালার মন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর একবার ভাবলো যেন ও প্রশ্ন করছে-মিস উইলিয়ামস কাউকে কখনো খুন করেছেন আপনি, উত্তর দিচ্ছেন উনি, মন দিয়ে অংক কষে, আজে বাজে চিন্তা না করে।
নাঃ পাগল হয়ে যাবো এসব চিন্তা করলে, পোয়ারোর কথাই তার চেয়ে শোনাই ভালো, সবই তো জানেন উনি।
বলে চলেছেন পোয়ারো, আমার কাজ এটাই…অতীত কাগজে উল্টো গিয়ারে চালিয়ে চলে গিয়ে যা ঘটেছিলো আসলে তা আবিষ্কার করা।
ফিলিপ ব্লেক বললেন, আমরা সবাই জানি ঘটনাটা, আপনি বলছেন। আপনি কিছু না ভেবেই কথাটা বললেন। কোনো ঘটনার সম্বন্ধে স্বীকৃত বয়ানটাই সত্যি হবে যে সব সময়ে এমন কোনো কথা নেই। যেমন মিঃ ব্লেকের কথা ধরা যাক–অপছন্দ করতেন উনি ক্যারোলিন ক্রেলকে। ওটা স্বীকৃত বয়ান আপনার মনোভাব সম্বন্ধে। কিন্তু যার সামান্যতম জ্ঞান আছে মনঃস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তারা কিন্তু ধরে নেবে উল্টা কথাটাই, ভীষণভাবে আপনি চাইতেন ক্যারোলিনকে, শুধু সমালোচনা করতেন না পাওয়ার দুঃখে। আবার মেরিডিথ ব্লেকের কথা দেখুন উনি মনে মনে বহু বছর ধরে ক্যারোলিনের প্রতি আসক্ত ছিলেন। উনি ক্যারোলিনের প্রতি নিজের বিবৃতিতে অ্যামিয়াসের ব্যবহারের প্রতিবাদ জানাতেন সে কথা বলেছেন। ভালো করে বিবৃতিগুলো পড়ে দেখলে জানা যাবে সুন্দরী তরুণী এলসার মতো আবির্ভাবের পরেই সব যেন শুরু করলো গোলমাল হতে। শ্রদ্ধা ভালোবাসা এতোদিনের অন্য পাত্রীতে সমর্পিত হলো।
প্রতিবাদ করার মতো মেরিডিথ শব্দ করলেন, মিষ্টি করে লেডী ডিটিশাম হাসলেন।
বলে চললো পোয়ারো, শুধু দৃষ্টান্ত দেবার জন্যে এগুলো আমি বললাম। খুনের কোনো সম্পর্ক নেই এর সঙ্গে। ঠিক আছে অতীত জগতে এবার ফেরা যাক। …বলে নিই কিভাবে করেছি এটা..আমি ক্যারোলিন ক্রেলের উকীলদের সঙ্গে আর সরকার পক্ষের সহকারী উকীলের সঙ্গে ক্রেল পরিবারের সঙ্গে পরিচিত বৃদ্ধ সলিসিটার আর উকীলের মুহুরীর সঙ্গে, আর তদন্তকারী মামলায় পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি। এবং কথা বলেছি প্রত্যক্ষদর্শী পাঁচজনের সঙ্গে, ঘটনার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন। আমি এবার মহিলাটির একটি পূর্ণাবয়স্ক ছবি আঁকার চেষ্টা করছি ঐসব তত্ত্বের ভিত্তিতে, যা জেনেছি তা হলো…ক্যারোলিন ক্রেল একবারের জন্যেও তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রতিবাদ করেননি (ঐ চিঠিটা মেয়েকে লেখা ছাড়া)।
কোনো রকম ভয়ের চিহ্ন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ করেননি তিনি, আগ্রহ দেখাননি কোনোরকম। পরাজিতের মনোভাব আগাগোড়া নিয়ে, আত্মসমর্পণ করেছিলেন ভাগ্যের কাছে। উনি হাজতে থাকাকালীনও খুব শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন এই বিপর্যয়কে। বোনের কাছে একমাত্র লেখা চিঠিটাতে নিয়তির এই নিষ্ঠুর পরিহাসের কথা তিনি বলেছিলেন। অথচ আমি কথা বলেছি যাদের সঙ্গে, প্রত্যেকেই তারা (মাত্র একজন বাদে) বলেছেন অপরাধী ক্যারোলিন ক্রেল।
মাথা নাড়লেন ফিলিপ, ও দোষী নিশ্চয়ই।
পোয়ারো বললো, রায় অন্যদের মেনে নেওয়াটা কাজ নয় আমার। আমি নিজে সাক্ষ্য প্রমাণগুলো পরীক্ষা করেছি। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে মানসিকতা ছিলো তথ্যটা তার সঙ্গে মেলে কতটা শুধু তাই পরীক্ষা করে আমি দেখেছি। এরজন্য পড়েছি পুলিশের ফাইল, প্রত্যক্ষদর্শীর পাঁচজনের বিবৃতি নিয়েছি, যেগুলোকে অবান্তর মনে করেছিলো পুলিশ সেগুলোকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি, এবং জোগাড় করেছি নতুন অনেক তথ্যও, যেমন–(ক) যেগুলোকে পুলিশ অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিলো এমন কিছু আলোচনা এবং ঘটনা, (খ) কি মনে করেছিলেন বা ভেবেছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল সে সম্বন্ধে অভিমত বিভিন্ন লোকের (আইনতঃ যদি গ্রাহ্য নয় ওগুলো) এবং (গ) কিছু তথ্য যা পুলিশের কাছে ইচ্ছাকৃত ভাবে চেপে যাওয়া হয়েছিলো।
আমি নিজেই এখন মামলাটার বিচার করতে পারি। মনে হয় এমনিতে খুন করার পক্ষে ক্যারোলিনের যথেষ্ট কারণ ছিলো, স্বামীকে উনি ভালোবাসতেন, প্রকাশ্যে স্বামী অন্য স্ত্রীলোক আসক্তির কথা বলেছেন এবং নিজেই স্বীকার করেছেন স্ত্রী তিনি খুব ঈর্ষাপরায়ণ।
কার্য সাধনোপায়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। উদ্দেশ্য থেকে একটা খালি সেন্টের শিশি যাতে কোনাইন ছিলো ক্যারোলিনের আলমারীতে তা পাওয়া গেছে। তাঁরই আঙুলের ছাপ আবার শিশির গায়ে। ক্যারোলিন স্বীকারও করেছিলেন পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে ওটা এই ঘর থেকে নিয়েছিলেন। সেদিন সবার শেষে এই ল্যারেটারি থেকে বেরিয়ে ছিলেন এবং একমাত্র হাতের যে ছাপ কোনাইনের বোতলে পাওয়া গেছে তাও ক্যারোলিনেরই। দেখা যাচ্ছে সব মিলিয়ে উনি চুরি করেছিলেন কোনাইন। আর একটা পরোক্ষ প্রমাণ আছে সেদিন আমায় মেরিডিথ ব্লেক বলেছিলেন, মনে পড়ছে দাঁড়িয়েছিলাম এইখানে, জুই ফুলের গন্ধ খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিলো। কিন্তু সেপ্টেম্বর ছিলো সেই মাসটা জুন-জুলাই হলো জুই ফুলের সময়।
অতএব বোঝা যাচ্ছে ক্যারোলিন বিষ চুরি করার মতলবটা আঁটার পর ব্যাগের মধ্যে থেকে জুইফুলের সেন্টের শিশিটা বের করে জানলা গলিয়ে সেন্টটা ফেলে দেন, তারপর বিষ ভরে নেন খালি শিশিটাতে।
মিঃ মেরিডিথ ব্লেককে কদিন আগে বলেছিলাম আমি কে কি ভাবে সেই দুর্ঘটনার দিন ঘর থেকে বেরিয়েছিলো সেই দৃশ্যটার পুনরাবৃত্তির অভিনয় করতে। ওকে জুই ফুলের সেন্ট মাখানো রুমাল নেড়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় শোকাতেই ওঁর মনে পড়ে যায় পূর্বস্মৃতি। মাঝে মাঝে বুদ্ধির চেয়ে প্রাণশক্তি অনেক বেশি কাজ করে।
আসা যাক এবার সেই সর্বনাশা দিনটার সকালবেলায়। মিস এলসা গ্ৰীয়ার প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন আমিয়াসকে বিয়ে করার কথা। চরম বিপদের মুখে ক্যারোলিনকে ঠেলে দিয়ে সে কথা আমিয়াস স্বীকারও করলেন, এ ব্যাপারে অনেকই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
স্বামী স্ত্রী তুমুল ঝগড়া হলো পরদিন লাইব্রেরীর ঘরে। হল ঘর থেকে ফিলিপ ব্লেক শুনতে পেলেন ক্যারোলিন বলছেন, তোমাকে একদিন খুন করবো আমি। বাইরের চত্বর থেকে মিস এলসাও কথাটা শুনলেন। অ্যামিয়াস ক্রেল তারপর আরও খানিকটা রাগারাগির পর ছবি আঁকতে চলে গেলেন এলসাকে নিয়ে।
মনস্তাত্ত্বিকতার বিচারে এতোক্ষণ পর্যন্ত কোনো অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নানারকম গরমিল আসছে তার পরেই।
বিষ চুরি যাওয়ার কথা জেনে মেরিডিথ ব্লেক ভাইকে জানাচ্ছেন। অ্যাল্ডারবেরিতে চলে আসছেন আলোচনা জন্যে। শুনতে পেলেন কামান বাগানের কাছে এসে স্কুলে অ্যাঞ্জেলাকে পাঠাবার ব্যাপার নিয়ে তর্ক চলছে স্বামী স্ত্রীতে। খটকা লাগছে ঐখানেই। মিনিট কুড়ি আগে সামান্য, স্বামী স্ত্রীতে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। খুন করাকরির কথাও উঠেছে। তারপরে কি করে তুচ্ছ ঘরোয়া কথা বলতে স্ত্রী যান।
মেরিডিথের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললোবলি আপনার ভাষাতেই আপনি বলতে শুনেছিলেন অ্যামিয়াসকে, ঠিক হয়ে গেছে সব…আমি দেখবো ওর গোছ-গাছের ব্যাপারটা। তাই না?
হা, ঐ ধরনের কথা বটে, মেরিডিথ বললেন।
পোয়ারো বলল ফিলিপের দিকে তাকিয়ে-তাই কি শুনেছিলেন আপনিও।
ফিলিপ ভ্রূ-কুঁচকে বললেন, আপনি না বলা পর্যন্ত মনে পড়েনি। কী একটা কথা হয়েছিল গোছ-গাছের।
মিঃ ক্রেল বলেছিলেন–মিসেস ক্রেল কিন্তু নয়?
অ্যামিয়াস বলেছিলো। তবে নিষ্ঠুরতা হবে মেয়েটার ওপর এ ধরনের কথা ক্যারোলিন বলেছিলো। কিন্তু ও নিয়ে এখন কেন আলোচনা হচ্ছে?
পোয়ারো বললো, আপনারা কেন আমার আপত্তির কারণটা দেখতে পাচ্ছেন না? অ্যামিয়াস ক্রেল কেন মেয়েটির গোছ-গাছের ব্যাপার দেখবেন? ঐ কাজটা তো মেয়েদের কাজ, বাড়িতে আছেন মিসেস ক্রেল, গভর্নেস আছেন, অতএব বুঝতে পারছেন তো…?
ফিলিপ অধৈর্য হয়ে বললেন, কি হয়েছে তাতে, খুনের কোনো সম্পর্ক নেই এর সঙ্গে।
মনে করেন না আপনি?
আর একটা দেখুন ঘটনা…স্বামীকে একটু আগে খুন করে দেবার ভয় দেখান যিনি তিনিই বা কি করে ভার নেন ঠান্ডা বিয়ার পরিবেশন করার?
হঠাৎ মেরিডিথ বলে উঠলেন, মাথায় খুন করার পরিকল্পনা থাকলে ওটাই তো স্বাভাবিক, তাই তো মানুষ করে–গোপন করে মনের ভাব।
আপনি তাই মনে করেন তো? বিষ দেবার ব্যাপারে স্বামীকে মনস্থির করে নিয়েছিলেন মিসেস ক্রেল। কামান বাগানেই স্বামী বিয়ার রাখে। ঔ বোতলে চাইলে বিষ দিয়ে রাখতে পারতেন নিশ্চয়ই।
আপত্তি জানালেন মেরিডিথ, না করতেন না তা, যদি খেয়ে ফেলে অন্য কেউ?
হ্যাঁ, পারতেন এলসা। আচ্ছা স্বামীকে খুন করার সিদ্ধান্ত আপনার মতে নিয়ে নেবার পর ও কি খুন না করার ব্যাপারে এলসাকে বিবেকের দিক দিয়ে ক্যারোলিন খুব একটা চিন্তা করতেন।
আচ্ছা আলোচনা থাক, এ নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকা যাক প্রকৃত তত্ত্বের মধ্যেই। স্বামীকে ঠান্ডা বিয়ার ক্যারোলিন পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে নিজেই ফিরে গিয়ে নিয়ে এলেন, তাই নয় শুধু স্বামীকে ঢেলে দিলেন নিজের হাতে-ওটা খেয়ে অ্যামিয়াস বলেছিলেন সব কিছুই খেতে আজ খারাপ লাগছে।
তারপর বাড়ির ভেতরে মিসেস ক্রেল চলে যান। লাঞ্চ খান, স্বাভাবিক ছিলেন বেশ। বলা হয়েছে একটু চিন্তান্বিত দেখা গিয়েছিলো তাকে। কোনো লাভ হয় না তাতে আমাদের, কারণ কোনো স্থির মানদণ্ড নেই খুনীর আচরণ সম্বন্ধে শান্তও থাকতে পারে খুনী, আবার হতে পারে উত্তেজিতও।
আবার কামান বাগানে যান খাবার পর, দেখেন গিয়ে স্বামী মৃত…এবং যা ভেবে রেখেছিলেন বলা যেতে পারে তাই হয়েছে দেখে প্রকাশ করেন উত্তেজনা, কথা বলেন ডাক্তার দেখাবার। সবাই তো জানেন এটা? এ ছাড়াও এখন কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে.যদি আপত্তি না থাকে আপনার, পোয়ারো শেষের প্রশ্নটি করলো গভর্নেস মিস উইলিয়ামসকে।
মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মিস উইলিয়ামের, বললেন, কথাটা গোপন রাখার ব্যাপারে কোন চুক্তি তো আমার হয়নি আপনার সঙ্গে। ফলে…।
গভর্নেস আস্তে আস্তে যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি পোয়ারো করলো।
নড়ে উঠলেন এলসা ডিটিশাম। তাকিয়ে থেকে হাঁ করে অবিশ্বাসের সুরে বললেন, ওটা আপনি নিজে দেখেছিলেন?
লাফিয়ে উঠলেন ফিলিপ, তাহলে তো চুকেই গেলো সব।
তার দিকে নিরীহ ভাবে তাকিয়ে বললো পোয়ারো–তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তীক্ষ্ণ গলায় অ্যাঞ্জেলা আপত্তি জানালো, একথাটা আমি বিশ্বাস করি না। তারপর গভর্নেসের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকালো।
উত্তেজিত মেরিডিথ, একমাত্র নির্বিকার মিস উইলিয়ামস বসে আছেন ঘাড় শক্ত করে। না, আমি ওটা নিজের চোখে দেখেছিলাম।
কিন্তু আপনার তো ওটা শুধু মুখের কথা, ধীরে ধীরে বললো পোয়ারো।
হ্যাঁ মুখেরই কথা, আমার কথায় মিঃ পোয়ারো কেউ সন্দেহ করুক আমি এটা পছন্দ করি না।
পোয়ারো মাথা নীচু করে বললো, সন্দেহ করছি না। যা বলেছেন আপনি সেটাই ঘটেছিলো। আর বুঝতে পেরেছি আপনার কথা থেকেই ক্যারোলিন ক্রেল খুনী নয়।
জন ব্যাটারি এই প্রথম মুখ খুললেন–আপনি কেন এ কথা বলছেন মিঃ পোয়ারো জানতে আমি আগ্রহী।
জানাবো নিশ্চয়ই। কি দেখেছিলেন মিস উইলিয়ামসনা, বিয়ারের বোতল থেকে ক্যারোলিন হাতের ছাপ মুছে সাবধানে স্বামীর হাতের ছাপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ারের বোতলে লক্ষ্য করুন। অথচ গ্লাসে কোনাইন ছিলো–বোতলে নয়। বিষ বোতলে ছিলোই না। এবং ক্যারোলিন সে কথা জানতেন না।
স্বামীকে খুন করার অভিযোগ যে মহিলা সম্বন্ধে আনা হচ্ছে, তিনি জানেন না বিষ দেওয়া হয়েছে কীভাবে। বিষ বোতলে ছিল ওঁর ধারণা।
প্রতিবাদ করলেন মেরিডিথ কিন্তু কেন…ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে পোয়ারো বললো, হা…কেন? আত্মহত্যা বলে ব্যাপারটা চালাবার জন্যে কেন মরীয়া হয়ে ঐ চেষ্টা করেছিলেন ক্যারোলিন? খুব সোজা তার উত্তরটা। কারণ জানতেন উনি ওঁর স্বামীকে কে বিষ দিয়েছে এবং তাকে পাছে সবাই সন্দেহ করে তাই বাঁচাবার জন্যে তাকে উনি বাধ্য হয়েছিলেন সব রকম ঝুঁকি নিতে।
এবার চিন্তা করা যাক আরও একটু এগিয়ে গিয়ে। কে হতে পারে সেই ব্যক্তিটি, তিনি কি বাঁচাতে চেয়েছিলেন ফিলিপ বা মেরিডিথকে? না, এলসা গ্ৰীয়ারকে? না সিসিলিয়া উইলিয়ামসকে? না, ক্যারোলিন যে কোনো মূল্যে শুধু একজনকে বাঁচাতে চেয়ে থাকতে পারেন।
অ্যাঞ্জেলা ওয়ারনকে একটু থেমে পোয়ারো বললো, যদি দিদির চিঠিটা এনে থাকেন তবে দিন, সবাইকে আমি পড়ে শোনাই।
না স্পষ্ট জবাব অ্যাঞ্জেলার, মিঃ পোয়ারো আমি বুঝতে পারছি যে আমিই জামাইবাবুকে আপনার মনে খুন করেছি আর সে কথা দিদি জানতো। আমি এই অভিযোগ অস্বীকার করছি সম্পূর্ণ।
হাত বাড়ালো পোয়ারো, চিঠিটা…?
ওটা আমার চিঠি, আমারই ব্যক্তিগত ভাবে।
পরস্পরের দিকে দু’জন কম বয়সী মেয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন, শেষপর্যন্ত কার্লা লেমারচেন্ট বললেন, অ্যাঞ্জেলা মাসী, মিঃ পোয়ারোর অনুরোধ রাখলে ভালো হয়।
অ্যাঞ্জেলা ঝেঁঝে উঠলেন, কার্লা সত্যি, মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি তোমার। তোমার মা ছিলেন না উনি…তুমি… কি না…।
কেটে কেটে কার্লা পরিষ্কার করে বললো, হ্যাঁ, আমার মা ছিলেন উনি, চিঠিটা পড়া হোক সেই অধিকারেই বলছি।
পোয়ারোকে চিঠিটা দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা বেশ রাগত ভাবেই বললেন, না দেখানোই ভালো ছিলো এটা।
পোয়ারো শেষ চিঠিটা পড়লো ক্যারোলিনের। ধীরে ধীরে ঘরের কোণে অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে আসতে শুরু করেছে। কার্লার হঠাৎ মনে হলো কে যেন ঘরের মধ্যে এসেছে, রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে, শুনছে, নিঃশ্বাস পড়ছে তার, যেন সে অপেক্ষা করছে, মনে হলো ওর উনি এসেছেন এখানে…এখানে এসেছেন আমার মা…এখন ক্যারোলিন এই ঘরের মধ্যে।
হঠাৎ পোয়ারোর কণ্ঠস্বর সেই অদ্ভুত নৈশব্দ ভঙ্গ করে ভেসে এলো, নিশ্চয় আপনারা সবাই একমত হবেন আমার সঙ্গে যে চিঠিটা অদ্ভুত ভারী। সন্দেহ নেই সুন্দর, তবে অদ্ভুতও বটে। এতে বাদ পড়ে গেছে একটা উল্লেখযোগ্য জিনিস–কোনো প্রতিবাদ নেই নিজের অপরাধ সম্বন্ধে।
অ্যাঞ্জেলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন ওখান থেকেই, কোনো দরকার ছিলো না তার। নির্দোষ যে ক্যারোলিন, সে কথা জানাবার কোনো প্রায়োজন তিনি অনুভব করেননি বোনকে, কারণ জানতেন তিনি কেন জানেন প্রকৃত ঘটনাটা। বোনকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিলেন ক্যারোলিন, এবং যাতে ভয় পেয়ে অ্যাঞ্জেলা দোষ স্বীকার করে না ফেলে তাকে তার জন্যে ব্যস্ত রাখতে অন্য চিন্তায়। বারবার উনি একটা কথা লিখেছেন চিঠিতে–ঠিক আছে সব, লক্ষ্মী সোনা ঠিক আছে সব কিছু। অ্যাঞ্জেলা বললেন, কেন বুঝতে পারছেন না? আমি সুখী হই দিদি চাইছিলো।
হ্যাঁ তাই ঠিক। নিজের মেয়ের চেয়েও উনি অনেক বেশি আপনার কথা চিন্তা করেছিলেন। উনি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, মানুষকে তো ঋণ শোধ করতেই হবে।
সব বোঝা যায় এই একটা কথা থেকেই। ক্যারোলিন যে অপরাধ বোধ দীর্ঘকাল ধরে পুষে আসছিলেন মনের মধ্যে, ছোটো বোনের যে ক্ষতি করেছিলেন রাগের চোটে তার ঋণ শোধ করছেন। এবং সেটা করতে পেরে ভীষণ শান্তি পেয়েছিলেন মনে মনে ক্যারোলিন। যেহেতু মনে করেছিলেন তিনি অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তাই অতো বড় অভিযোগকে আদালতে শান্তভাবে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। নিন্দা, ঘৃণা কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি তাকে।
দেখুন এইবার, ক্যারোলিনের সব কাজকর্মের কতটা মিল পাই আমার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে। প্রথমতঃ এমন একটা ঘটনা ঘটে তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় যা মনে পড়িয়ে দিয়েছিলো ক্যারোলিনের কৈশোরের কথা-পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মারা অ্যাঞ্জেলার অ্যামিয়াসকে। ক্যারোলিনও ঐ ধরনের একটা কাজ করেছিলেন, তারপর চিৎকার করে অ্যাঞ্জেলা বলেছিলেন–আমি চাই মরুক অ্যামিয়াস। বিয়ারের বোতল নিয়ে পরদিন সকালে ঘাঁটতে দেখেন অ্যাঞ্জেলাকে। স্মরণ করুন মিস উইলিয়ামসের কথা, ওখানে ছিলো অ্যাঞ্জেলা। মনে হচ্ছিল ওকে অপরাধী…! বলতে চেয়েছিলেন গভর্নো পড়া ফাঁকি দেবার অপরাধে অপরাধী, আর তার অর্থ ছিলো ক্যারোলিনের কাছে অন্য। মনে রাখবেন এটাও অন্ততঃ তার আগে অ্যাঞ্জেলা একবার অ্যামিয়াসের মদের গ্লাসে একটা কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাই ভেবেছিলেন ক্যারোলিন।
ক্যারোলিন, অ্যাঞ্জেলার দেওয়া বোতলটা নিয়ে কামান বাগানে চলে যান। আপনারা তার পরের ঘটনা জানেন।
ক্যারোলিনের মনে তখনও সন্দেহ জাগেনি। লাঞ্চ খাবার পর তলায় গিয়ে ঐ অবস্থায় স্বামীকে দেখে সন্দেহ হয় প্রথমেই কে করতে পারে? …তবে কি অ্যাঞ্জেলা, বোনের সেই অপরাধী মুখটা নিজের কাছে ভেসে উঠলো ক্যারোলিনের মনে। প্রতিশোধ? না, জামাইবাবুর নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ। দিদির সম্বন্ধে ভীষণ খেয়ালী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এই বয়সের মেয়েরা। অতএব বাঁচাতে হবে বোনকে। অ্যাঞ্জেলার আঙুলের ছাপ বোতলের গায়ে মুছে ফেলার জন্যে তাই তিনি অতি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
ক্যারোলিন তারপরেই অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে ভীত হয়ে উঠেছিলেন, দাদার প্রতি যদি অতি ভালোবাসর ফলে স্বীকার করে নেয় সে দোষ। তাই অ্যাঞ্জেলাকে কোনো গতিকে ইংল্যান্ডের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ক্যারোলিন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
.
চতুর্থ অধ্যায়
সত্য
জানলার দিক থেকে ধীরে ধীরে বাকীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ঘৃণা। উনি বললেন। অন্ধ, নির্বোধ সবাই আপনারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না, আমি খুন করলে স্বীকার করতামই। দিদিকে আমার জন্যে কষ্ট পেতে দিতাম না।
পোয়ারো বললো, কিন্তু একটা অবৈধ কিছু বিয়ার নিয়ে আপনি করেছিলেন।
আমি? কিছু মেশানোর কথা বলছেন বিয়ারে?
পোয়ারো বললো মেরিডিথের দিকে ফিরে, শুনুন মিঃ ব্লেক, পরদিন সকালে আপনি ল্যাবরেটারিতে বলেছিলেন না বেড়াল ঢোকার কথা?
হা, সেটাতো মাত্র একটা বেড়াল।
জানলেন কি করে সেটা, দেখে ছিলেন কি নিজের চোখে? না, তবে ফাঁক ছিলো যেটুকু জানলা তাতে বেড়াল ঢুকতে বড়ো জোর পারে। পারে না মানুষ।
কিন্তু মিঃ ব্লেক শার্সিটা তো নামাল ওঠানো যায়। তাহলে শুনুন-ধরুন খুনের ঘটনার দিন কেউ আপনার ল্যাবরেটারিতে সকালবেলায় ঢুকছিলো, কেউ যদি অ্যাল্ডারবেরি থেকে এসে থাকেন তবে ফিলিপ, এলসা ক্যারোলিন বা অ্যামিয়াস হবেন না, কারণ ওঁরা তখন কে কি করেছিলেন প্রমাণ আছে তার। দুজনে বাকী থেকে যায়–মিস উইলিয়ামস আর অ্যাঞ্জেলাও যাবেন। বাড়ি থেকে আপনি বেরোতেই দেখা হয়েছিলো মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলাকে উনি নাকি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। অ্যাঞ্জেলা বলছেন সমুদ্রে ঐ সময় স্নান করছিলেন। অথচ ওঁকে মিস উইলিয়ামস জলে দেখতে পাননি। অতএব হতে পারে সাঁতার কেটে অ্যাঞ্জেলা এখানে এসে কিছু নিয়ে যান ল্যাবরেটারি থেকে।
দৃঢ় স্বরে অ্যাঞ্জেলা বললেন, আমি ও ধরনের কিছু করিনি…অন্তত…না…।
বিজয়ীর হাসি হেসে পোয়ারো বলে উঠলো, আজ, তাহলে আপনার মনে পড়েছে দেখছি কথাটা আমায় তো আপনি বলেও ছিলেন একটা বিশ্রী রসিকতা জামাইবাবুর সঙ্গে করার জন্যে আপনি ঐ যাকে বলে বিড়ালের খাদ্য খানিকটা তাই সরিয়ে রাখবেন–মানে…।
ঝট করে মেরিডিথ বলে উঠলেন, ভ্যালেরিয়ান নিশ্চয়ই ভ্যালেরিয়ান।
হা, ঠিক তাই। এবং আপনি সেই জন্যেই বেড়ালের কান্ড মনে করেছিলেন ওটাকে। শব্দ শুনে ল্যাবরেটারিতে নেমে এসে সম্পূর্ণ ভ্যালেরিয়ানের গন্ধ অজান্তেই পেয়ে বিড়ালের কথা স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে পড়েছিলো। ভ্যালেরিয়ান খেতে বেড়াল ভালোবাসলেও, এমনিতে খুব খারাপ ওটার স্বাদ। তারই খানিকটা অ্যাঞ্জেলা জামাইবাবুর বিয়ারের সঙ্গে চেয়েছিলেন মেশাতে…।
আশ্চর্য হয়ে অ্যাঞ্জেলা বলে উঠলেন, ওটা কি ঠিক ঘটেছিলো এই দিনই, এখন মনে পড়ছে ওটা চুরি করার কথা, বিয়ারের বোতলে মেশানোর পর মুহূর্তে দেখেছিলো দিদি আমাকে, সেটাও মনে পড়ছে কিন্তু ঘটনাকে তার সঙ্গে জড়ানোর কথা কখনও চিন্তা করিনি। করবেনই বা কেন…ঐ দুটো ঘটনার মধ্যে আপনার মনে তো কোনো ক্ষোভ ছিলো না। সম্পূর্ণ আলাদা দুটো ঘটনা। একটা ছেলেমানুষী দুষ্টুমি, অন্যটা গভীর ট্রাজেডী। আপনিই অথচ বলেছিলেন, চুরি করেছিলাম আমি ইত্যাদি ইত্যাদি, জামাইবাবুর ড্রিঙ্কের সঙ্গে মেশাবার জন্যে। বললেন যে আপনি তো মিশিয়ে ছিলেন।
বলিনি, তার কারণ আমি ওটা করিনি। যখন খুলছিলাম বোতলের মুখটা এসে যায় দিদি। আহ, আর ভেবে নিলো দিদিও আমি করেছি।
অ্যাঞ্জেলা একটু থেমে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন আবার, সবাই তো আপনারা তাই মনে করেছেন? বিশ্বাস করুন জামাইবাবুকে আমি খুন করিনি। করলে বন্ধ করে থাকতাম না মুখ।
করোনি নিশ্চয়ই বোকারা ছাড়া একমাত্র একথা ভাবতে পারে না কেউ। পোয়ারোর দিকে রেগে তাকালেন মিস উইলিয়ামস।
পোয়ারো খুবই নিরীহ ভাবে বললো, বোকা নই আমি এবং সে কথা আমিও ভাবিনি। কে খুন করেছে অ্যামিয়াস ক্রেলকে আমি তা জানি ভাললাভাবেই।
একটু থামলেন। প্রমাণ করা হয়েছে যে ভাবে ঘটনা বাস্তবে তা না হলে মেনে নেওয়া যায় না কোনো প্রমাণকেই। নেওয়া যাক না কেন অ্যাল্ডারবেরির ঘটনাটাই। সেই চিরাচরিত কাহিনী দুটি মহিলা আর একজনের পুরুষের এটা প্রায় আমরা মেনেই নিয়েছি যে অ্যামিয়াস ক্রেল নিজের স্ত্রীকে অন্য একটি মহিলার জন্যে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। আমি কিন্তু বলছি–তার ওই রকম কোনো ইচ্ছেই ছিলো না।
দুর্বলতা আর মোহ মহিলাদের প্রতি তার বরাবরই ছিলো। কিন্তু চিরস্থায়ী হতো না কোনোটাই। যে সব মহিলার সঙ্গে আগে জড়িয়ে ছিলেন উনি তাদের অভিজ্ঞতা ছিলো কিছুটা, তাই বেশী কিছু অ্যামিয়াসের কাছ থেকে দাবি করতেন না। বয়স কম এবারকার মেয়েটির আশা-আকাঙ্ক্ষাও তার ভিন্নতর। বলি ক্যারোলিনের ভাষাতেই, ভীষণ ভাবে মেয়েটি ছিলো একনিষ্ঠ। কাটাকাটা কথাবার্তা হলে কি হবে, ভয়ংকর একমুখী একটা মন ছিলো ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই অল্পবয়সী মেয়েটির। যেভাবে স্বামীকে ক্যারোলিন ভালোবাসতেন, সেই গভীরতা এই মেয়েটির মধ্যেও দেখে তিনি আশংকিত হয়ে উঠেছিলেন, হয়তো তাকে স্বামী ছেড়ে এই মেয়েটিকে বিয়ে করতেও পারেন।
প্রশ্ন করতে পারেন এবার আপনারা, কেন অ্যামিয়াস ছলনা করবেন না তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। উত্তর আমার-ঐ ছবিটি। উনি চাইছিলেন শেষ করতে ছবিটা।
এই যুক্তিটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে–কিন্তু শিল্পীদের যাঁরা চেনেন, জানেন তারা। এবং প্রমাণ পাওয়া যায় এই কথার অ্যামিয়াস আর মেরিডিথের কথাবার্তা থেকে– অ্যামিয়াস কিছুটা বিব্রত হয়ে মেরিডিথের কাঁধে চাপড়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন–পরে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। একটা ছবি উনি আঁকছেন, দুটি মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলার আবর্তে পড়ে ব্যাঘাত ঘটাতে দিতে রাজী ছিলেন না অ্যামিয়াস শিল্প সৃষ্টিতে। তার কাছে ছবিটাই বড় ছিলো।
সত্যি কথাটা এলসাকে বললে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতো ছবি আঁকা। সেই জন্যে তার কথায় কোনো প্রতিবাদ করতে চাননি। ছবিটা দু-একদিনে হয়ে গেলে সত্যি কথাটা বলা যাবে। কথা দেবার ব্যাপারে মেয়েদের কাছে সহজ যেমন ছিলেন অ্যামিয়াস, তেমনি ভাঙতেও।
প্রথমে এলসাকে ভাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অ্যামিয়াস। তাকে সাবধানও করে দিয়েছিলেন। মেয়েটি কিন্তু পুতুল হয়ে গেলো নিয়তির হাতের। আর অ্যামিয়াস মেয়েদের ব্যাপারে বেশ উদার ছিলেন। এবং এও জানতেন এলসাও ফিরে যাবে মোহ কেটে গেলে।
আসলে স্ত্রী ছাড়া আর কারুর কথা অ্যামিয়াস কখনো গভীরভাবে ভাবেননি। তাকে কখনও মাথা ঘামাতে হয়নি স্ত্রীকে নিয়ে। এলসাকে ভাগাবেন ছবি আঁকাটা হয়ে গেলেই এবং যেমন আছেন নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তেমনি থাকবেন অ্যামিয়াস এই ধরনের ভাব নিয়ে যা খুশি তাই করে যাচ্ছিলেন। ঐ ধরনের মেয়ে ঘটিত ব্যাপারের পর অতীতেও ক্যারোলিন তো ওঁকে ক্ষমা করেছেন।’
কিন্তু মনে হয় আমার অ্যামিয়াস আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় সত্যিই চিন্তায় পড়েছিলেন। হয়তো কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন রাতে ক্যারোলিনকে। যাই হোক সারারাত ছটফট করে কাটাবার পর স্ত্রীকে সত্যি কথাটা বলেন সকালে প্রাতঃরাশের পর। তার মোহ কেটে গেছে এলসার প্রতি। ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না ছবিটা শেষ হলেই।
আর ক্যারোলিন ক্ষেপে গিয়েছিলেন ওই কথা শুনেই, তুমি আর তোমার মেয়ে মানুষগুলো এই কথাটায় এলসাকে আর পাঁচ জন মহিলাদের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো। ক্যারোলিন শেষে এ কথাও বলেছিলেন, একদিন তোমায় আমি খুন করবো।
স্বামীর প্রতি এলসার এই আচরণে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ক্যারোলিন। যখন হলঘরে ফিলিপ ক্যারোলিনকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলেন এ নিষ্ঠুরতা ভারী, তখন কিন্তু এলসার কথা তিনি চিন্তা করছিলেন।
লাইব্রেরী থেকে অ্যামিয়াস বেরিয়ে এসে ডাকলেন এলসাকে শেষ করতে হবে ছবি। জানতেন না উনি লাইব্রেরীর বাইরের দিকের জানলার তলায় বসে স্বামী স্ত্রীর সব কথাগুলো শোনেন এলসা গ্ৰীয়ার। এলসা আলোচনা সম্বন্ধে যা বলেছেন সবটা তার সত্যি নয়।
এবার কল্পনা করুন নিজের সম্বন্ধে স্বকর্ণে নিষ্ঠুর সত্যটা শুনলে কী অবস্থা হয়।
মেরিডিথের ল্যাবরেটরির সামনে আগের দিন বিকেলবেলায় সকলে বেরিয়ে আসছিলে, মেরিডিথ তখন দরজার দিকে পেছন ফিরে মুখোমুখি বসে গল্প করছিলেন এলসার সঙ্গে। তার মানে ক্যারোলিন ঘরের ঘরের ভিতর গল্প করছিলেন এলসা গ্ৰীয়ার পুরোটা দেখেছিলেন।
বিষ চুরি করতে ক্যারোলিনকে দেখেও এলসা কিছু বলেননি। লাইব্রেরীর ঘরের জানলার তলায় বসে স্বামী স্ত্রীর কথা শোনার সময় তার মনে পড়ে যায় ঐ বিষ চুরির কথা।
কামান বাগানে যাবার জন্যে এলসাকে ডাকলেন অ্যামিয়াস। এলসা ঘরে এলেন সোয়েটার আনবার অজুহাত দেখিয়ে। মেয়েদের পক্ষে জানা সহজ মেয়েদের গোপন রাখার জায়গাগুলো, তাই সাবধানে ফাউন্টেন পেনে কালি ভরার ডুপার দিয়ে হাতের দাগ না লাগিয়ে বিষটা বের করে নিয়েছিলেন এলসা।
তারপর কামান বাগানে যথারীতি আসা। এবং বিয়ারের সঙ্গে প্রথম সুযোগেই মিশিয়ে খাইয়ে দিলেন অ্যামিয়াসকে ওটা।
মনে মনে ওদিকে ভীষণ অস্থির ক্যারোলিন, ফিরতে দেখে এলসাকে (এবার সত্যিই গরমজামা সে নিতে এসেছিলেন) কামান বাগানে তাড়াতাড়ি গেলেন। স্বামী যা করতে চাইছেন এলসাকে নিয়ে, তা সম্পূর্ণ অমানবিক আচরণ, উনি সহ্য করতে পারছেন না ক্যারোলিন বললেন। অ্যামিয়াস বাধা পেয়ে ক্ষেপে লাল। জানিয়ে দিলেন পরিষ্কার এলসাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবেন ছবি শেষ হলেই।…ঠিক হয়ে গেছে সব…গোছগাছের ব্যাপারটা ওর, আমি কথা দিচ্ছি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবো ওকে।
এবং ফিলিপ মেরিডিথের পায়ের শব্দ ঠিক সেই মুহূর্তে পেয়ে বেরিয়ে আসেন ক্যারোলিন, মুখ বাঁচাবার জন্যে অ্যাঞ্জেলার কথা বলেন বিড়বিড় করে, যাতে মনে করে সবাই অ্যাঞ্জেলাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিলো। এবং, ওকে আমি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবো। কথাটা হয়ে দাঁড়ালো, আমি দেখবো ওর গোছগাছের ব্যাপারটা।
এই সময় এলসা হাসি হাসি মুখে ফিরছিলেন। শুরু হয়ে গেলো ছবি আঁকাও। ক্যারোলিনের ঘরে কোনাইনের শিশি পাওয়া যাবে ফলে তাকেই যে সবাই সন্দেহ করবে এ বিষয়ে এলসা নিশ্চিন্ত ছিলেন। আরও একটা সুযোগ করে দিলেন ক্যারোলিন নিজেকে জড়াবার।-বাড়ি থেকে ঠান্ডা বিয়ার আনলেন, স্বামীকে ঢেলেও দিলেন।
এক চুমুকে অ্যামিয়াস সবটা খেয়ে বলেছিলেন–সব কিছু আজ বিস্বাদ লাগছে। তার অর্থ ক্যারোলিনের দেওয়া বিয়ারের আগেও কিছু একটা তিনি খেয়েছিলেন এবং তখনও তার খারাপ স্বাদটা মুখে ছিলো। ফিলিপ ব্লেক আর একটা কথা অ্যামিয়াসের পা টলার কথা বলেছেন। তার মানে আস্তে আস্তে আগে খাওয়া কোনাইনের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
অসুস্থতাকে ঘৃণা করতেন অ্যামিয়াস, তাই শরীর খারাপ ভেতরে ভেতরে শুরু করা সত্ত্বেও কিছুই বললেন না মুখে।
ঘণ্টা পড়লো খাবার, যেটুকু বিষ কাছে ছিলো তাড়াতাড়ি করে তা অ্যামিয়াসের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে চলে গেলেন এলসা।
(নিশ্চয়ই কোথাও ড্রপারটাকে পথে ফেলে দেন।)
ছায়ার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসায় মেরিডিথ শুধু চোখধাঁধানো আলো দেখতে পাচ্ছিলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে বন্ধু হাত-ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এবং এক অসাধারণ তীব্রতা চোখের দৃষ্টিতে।
কিছু কি বুঝতে পেরেছিলেন অ্যামিয়াস! কি ছিলো মনে জানি না, তবে মিথ্যে বলেনি চোখ আর ঝুলে পড়া হাত।
পোয়ালরা দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো ছবিটা দেখিয়ে বললো, এই ছবিটা সম্পর্কে বোঝা উচিত ছিলো আমার, কারণ অসাধারণ ছবিটা–নিহত মানুষটি এঁকেছেন তাঁর নিজের খুনীর ছবি। এটা একটা ছবি যাতে তার প্রেমিককে মেয়েটি মরতে দেখছে।
.
পঞ্চম অধ্যায়
পরিণাম
এক ভয়াবহ হিমশীতল নিস্তব্ধতা নেমে এলো এর পরেই। ঘরের মানুষের মাথাগুলো শুধু বোঝা যাচ্ছিলো অস্তগামী সূর্যের শেষ ক্ষীণ আলোয়।
একটু নড়েচড়ে বসে এলসা ডিটিশাম বললেন, মেরিডিথ বাইরে নিয়ে যান ওদের। আমি একটু একা থাকতে চাই মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে।
এলসা সবাই চলে যাবার পর বললেন, খুব চালাক আপনি, মিঃ পোয়ারো তাই না?
উত্তর দিলো পোয়ারা, না। আবার এলসা বললেন, আপনি কি চান? স্বীকারোক্তি?
হা–পোয়ারো মাথা নেড়ে জানালো।
আমি সেরকম কিছুই করবো না। দুজনে এখানে বসে যা বলবো একান্তভাবে এটা আমাদের মুখের কথা হবে।
ঠিক তাই।
আপনি কি করতে চান আমি তা জানতে চাই।
পোয়ারো বললো, আমি আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করবো কর্তৃপক্ষকে ক্যারোলিন ক্রেলকে মরণোত্তর রায়দানে ঘোষণা করা হোক নিরপরাধ।
এলসা বললেন-কি আশ্চর্য নিরপরাধ ঘোষণা করতে হবে অপরাধ না করা সত্ত্বেও? …যাই হোক কি ভাবছেন আমার ব্যাপারে?
আমার সিদ্ধান্ত জানাবো উপযুক্ত লোকেদের সামনে তারপর যা করবেন তারা। তবে আপনার বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রমাণ নেই আমার হাতে, শুধু তো অনুমানে কিছু করা যায় না। তাছাড়া বর্তমান মর্যাদার কথা আপনার চিন্তা করে কিছু করতে সাহস পাবে কিনা পুলিশ বলা যায় না।
পরোয়াও করি না আমি। জীবনের জন্যে লড়তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভালোই লাগবে আমার।
হয়তো আপনার স্বামীর ভালো লাগবে না।
স্বামীর জন্যে চিন্তা করবো আপনি কি মনে করেন?
না মনে করি না তা। কারণ আপনি শুধু নিজেকে ছাড়া সারা জীবনে আর কারুর কথাই তো চিন্তা করলেন না গভীর ভাবে। হয়তো খুশি হতেন করলে।
আমার জন্যে আপনি এতো কেন চিন্তা করছেন?
এই জন্যে বাছা, অনেক কিছু শেখা তোমার বাকী আছে।
আবার কী বাকী আছে শেখার?
দয়া, মমতা, সহানুভূতি…শিখতে হবে এগুলো। শুধু দুটো জিনিস তুমি জানো প্রেম, ঘৃণা।
বিষ চুরি করতে ক্যারোলিনকে দেখে ভেবেছিলাম ও চায় আত্মহত্যা করতে। কিন্তু পরদিন আমি পেলাম স্বামী-স্ত্রীর কথা শোনার পর। আমাকে তাড়িয়ে দেবে অ্যামিয়াস ছবি আঁকা হয়ে গেলেই। এবং আমার জন্যে ক্যারোলিন দুঃখ প্রকাশ করলো। সহানুভূতির ওর কাছ থেকে পেতে ঘৃণা করি। ফলে অ্যামিয়াসকে বিষ খাওয়ালাম। ওকে তিল তিল করে চোখের সামনে মরতে দেখে কি উল্লাস আমার হয়েছিলো তা বোঝাতে পারবো না…আমিয়াস মরছে দেখলাম।
হঠাৎ হতাশায় হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে এলসা বললেন, তখন আমি বুঝিনি যে নিজেকে আমি খুন করছি…ওকে নয়। …তারপর ফাঁদে পড়লো ক্যারোলিন…ভাল হলো না সেটাও। ওকে আঘাত দিতে পারলাম না ঠিক মতো…ও বোধ হয় আমার নাগাল ফসকে গেলো। এমন জগতে ক্যারোলিন আর অ্যামিয়াস দুজনে চলে গেলো যেখানে ওদের ধরতে পারি না আমি। কিন্তু মরলো না ওরা, আমি মরলাম।
উঠে দাঁড়ালেন এলসা ডিটিশাম। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার আমি মরলাম।
সদ্য ফুটে উঠতে শুরু করছে হলঘরে এমন দুজন যুবক-যুবতীর পাশ দিয়ে চলে গেলেন উনি।
গাড়ির দরজা শোফার খুলে দিলো। গাড়িতে বসলেন লেডী ডিটিশাম। ফারের কম্বল দিয়ে শোফার পা ঢেকে দিলো।