পোয়ারো ভালো করে লক্ষ্য করলেন ডঃ কাবোলির ভেকধারী টোনিওকে–তাঁর এক হাত জ্যাপের বজ্রমুঠির মধ্যে, অন্য হাত সবলে ধরে আছে। রহস্যানুসন্ধানী এরকুল পোয়ারো। স্যুটকেসের ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন পোয়ারো, তারপর ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলেন।
–আপনি নিজেকে কী মনে করেন? আমার সঙ্গে চালাকি করতে আসবেন না। ডঃ কারোলির চাপা হুঙ্কার শোনা গেল। আমি ছাড়াও ও জিনিস চুরি করার জন্য এ বাড়িতে আরও অনেক লোক আছে, সেটা ভেবে দেখেছেন?
–আপনার মুখ বুজে থাকাই মঙ্গল, পোয়ারো হুঁশিয়ারি ছিলেন।
পোয়ারোকে সমর্থন করে জ্যাপ বললেন, উনিও তোকে চুপ থাকতে বলছেন, আমিও বলছি, মুখ খুলে নিজের খারাপ ডেকে আনিস না। জনি, আমি এই শয়তানটাকে দেখছি, তুমি ওপরে যাও, সকলকে বলল, আমি এখুনি ডাকছি, ওরা যেন নীচের এঘরে চলে আসেন।
–বেশ, যাচ্ছি, ডঃ কারোলির হাতটা ছেড়ে দিয়ে কনস্টেবল ঘরের বাইরে চলে গেল। এই সুযোগে এক ঝটকায় জ্যাপের হাত ছাড়িয়ে ডঃ কারোলি খোলা জানলার দিকে ছুটে গেলেন, অবশ্য তাড়াহুড়োতে তার স্যুটকেসটা নিতে ভোলেননি। কিন্তু এবারেও তাকে ব্যর্থ হতে হল। পোয়ারোর জুজুৎসুর প্যাঁচের পাল্লায় যে পড়েছে, সে জানে কত ধানে কত চাল। কারোলির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। একেবারে সটান মুখ থুবড়ে তিনি পড়লেন মেঝের ওপর। হাতে ধরা স্যুটকেসটা ছিটকে পড়ল খানিক দূরে।
জ্যাপ কঠিন চোখে তাকালেন কারোলির দিকে, স্যুটকেসটা তুলে নিলেন। বাজখাঁই গলায় বললেন–তোর কি এখানে বসেই মারধোর খাওয়ার সখ হয়েছে? আমার এই ছোকরা কনস্টেবলকে তো চিনিস না, তোকে কয়েকটা মোক্ষম দাওয়াই দেওয়ার জন্য ওর হাতটা নিশপিস করছে, বুঝতে পারছি, কেবল আমার হুকুমের অপেক্ষায়। তাই বলছি, শুধু-শুধু মারধোর না খেয়ে ভদ্রছেলের মতো এখানে বোস, আরাম কর।
কারোলির কাঁধ দুটো ধরে জ্যাপ জোর করে তাকে সোফার ওপর বসিয়ে দিলেন। সত্যি ডঃ কারোলি ইন্সপেক্টার জ্যাপের কথা রেখেছেন, আর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেননি, বরং গদিতে ঠেস দিয়ে আয়েস করে বসেছেন।
তবে ভেতরে-ভেতরে সাপের মতো ফুঁসছেন, তা বোঝা গেল। মাঝে মধ্যে কঠিন দৃষ্টিতে জ্যাপ ও পোয়ারোকে দেখছেন।
কারোলি এই মুহূর্তে ম্যাপের নাগালের মধ্যেই আছেন বুঝে পোয়ারো সেখান থেকে সরে এলেন, ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন খোলা জানলার দিকে। দাঁড়ালেন।
এসময় ক্যাপ্টেন আর বারবারা বাগানে বেড়াচ্ছিলেন। এবার ওঁদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। দু’জনে হাতে হাত রেখে হাসতে হাসতে হেঁটে আসছেন। ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে অনিমিখ নয়নে পোয়ালরা এই দৃশ্য উপভোগ করলেন। ওঁরা ভেতরে এসে ঢুকলেন, পোয়ারোকে কেউ দেখতে পাননি।
পোয়ারো এসে দাঁড়ালেন বন্ধু ও সহকারী হেস্টিংস-এর গা ঘেঁষে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন–এসব কী হচ্ছে, হেস্টিংস? আমার অবর্তমানে ঘর থেকে পালিয়ে গেলে ওই ছুকড়ির সাথে প্রেমালাপ করতে? বলিহারি বাপু! দিনে দিনে ছোট হচ্ছো দেখছি। তোমার বউয়ের কানে খবরটা না তুললেই নয় দেখছি, মজা বুঝবে তখন।
নিরুপায় হয়েই, হেস্টিংস লজ্জিত হলেন, একটুকরো হাসি দেখা গেল ঠোঁটে, তোমার কথা মতো এখানেই ছিলাম। কোত্থেকে বারবারা এল। বাগানে যাবার জন্য টানাটানি করতে লাগল, কোনও জোর আপত্তি শুনল না। বিশ্বাস করো, একটু মিথ্যে বলছি না। বুঝলে পোয়ারো, মেয়েটার মস্তিষ্ক বিকৃতি আছে, সামান্য হলেও আছে। না হলে একটানা কেউ অত বকতে পারে। এই কারণেই বোধহয় ডঃ গ্রাহাম ওকে বিয়ে করতে তালবাহানা করছেন।
ইতিমধ্যে অ্যামরি পরিবারের লোকেরা ভেতরের দরজা দিয়ে স্টাডিতে ঢুকতে শুরু করছেন। বারবারা জ্যাপের দিকে তাকাল, একটু হাসল, তারপর সোফাতে বসে পড়ল, অবশ্য ডঃ কারোলির থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই।
হবে হয়তো। হেস্টিংসএর কথায় পোয়ারো কোনোরকমে জবাব দিলেন। তারপর বললেন–যাক, এবার কাজের কথায় আসি। এবাড়ির লোকেরা কে কোথায় কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন, তা নিখুঁত ভাবে দেখে নেওয়া তোমার দায়িত্ব। স্মৃতির মধ্যে ধরে থাকবে, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
-কী কাজে লাগবে, শুনি?
–ফের তর্ক! আস্তে অথচ ধমকের সুরে পোয়ারো বললেন। চোখে হাসির ঝিলিক খেলিয়ে বললেন–আমার কথার অবাধ্য হয়েছে তো, মনে রেখো, আজ রাতেই তোমার বউয়ের কাছে খবর পৌঁছে যাবে।
***
পোয়ারোর নির্দেশ মতো হেস্টিংস তাঁর কাজ শুরু করে দিলেন। অবশ্য পোয়ারোও সবকিছু লক্ষ্য করছেন। দেখা গেল পিসিমা ক্যারোলিনকে, তার এক হাত রিচার্ড ধরেছে, অন্য হাতটি লুসিয়া। তারা ঘরের মধ্যে চলে এলেন। একটা ছোট টুলে ক্যারোলিনকে বসিয়ে দিয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী এসে বসল টেবিলের ডান পাশের দুটি কাছাকাছি চেয়ারে। লুসিয়ার ওপর নজরদারি চালাতে সুবিধা হবে বলে রিচার্ড তার বউয়ের গা ঘেঁষে বসেছে, তা বুঝতে দেরি হল না স্বনামধন্য গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো ও তার সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর।
তখনও একজন আসতে বাকি। অবশেষে তিনি এসে ঢুকলেন। আরামকেদারায় বসলেন, যেখানে বসে স্যার ক্লড অ্যামরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। ইনি হলেন স্যার ক্লডের সচিব এডওয়ার্ড রেনর।
রিচার্ড প্রথমে ক্যারোলিন ও বারবারাকে উদ্দেশ্য করে জ্যাপকে দেখিয়ে বলল–উনি হলেন স্কটল্যন্ড ইয়ার্ডের এক নামী ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার জ্যাপ।