- বইয়ের নামঃ ঈশ্বরের অশ্রু
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
ঈশ্বরের অশ্রু
০১.
সাবধান! তিন গোয়েন্দাকে হুঁশিয়ার করল হেনরি বেসিন, একটু এদিক ওদিক হলেই কিন্তু খেপে যাবে বুড়োটা।
এমনিতে হাসিখুশি লোক বেসিন। রসিক। কিন্তু এখন ভুরু কুঁচকে রেখেছে। ওই শকুনটা, বললো সে। এমন কিপটের কিপটে, পয়সাই ছাড়তে চায় না। তাই তোমাদের ইউনিফর্ম ঠিকমত করে দিতে পারলাম না। কিশোর, জ্যাকেটটা ঢলঢলে হয়েছে।
হাতের ট্রেটা নামাল কিশোর। চীজ পাফ আর রুমাকিগুলো সরিয়ে রাখল। তারপর তাকাল গায়ের শাদা ওয়েইটারের পোশাকটার দিকে। তার চেয়ে অনেক মোটা লোকের পোশাক এটা। সব জায়গাতেই ঢোলা। বিশেষ করে দুই কাঁধ থেকে হাতা অনেকখানি ঝুলে পড়েছে।
এর বেশি আর কিছু দিতে পারছি না, বেসিন বলল। ছোট আরেকটা আছে অবশ্য, তবে সেটা গায়েই লাগবে না তোমার। নাহ্, এভাবে আর পারা যায় না।
কিশোরের পেছনে রয়েছে মুসা। তার হাতেও ট্রে। তাতে ক্যারট স্টিক আর ডিপ। তার জ্যাকেটটা এত খাটো হয়েছে, প্রায় কোমরের কাছে উঠে এসেছে। কনুইয়ের সামান্য নিচে হাতা, কবজি থেকে অনেক দূরে। অনেকটা কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত লাগছে তাকে।
আর রবিনেরটা তো সব চেয়ে ঢোলা। এমনকি কিশোরেরটার চেয়েও। হাতা গুটিয়ে রাখতে হয়েছে। নইলে আঙুল সহ ঢেকে যায়। হাতে ট্রে। বেঢপ লাগছে। শরীরটা পোশাকের কারণে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল বেসিন। আর কিছু করার নেই আমার। যাও, মেহমানদের খাবার দাও। লিসটারের সামনে না পড়লেই হবে। কিছু ভাঙলে নিজের দায়িত্বে ভাঙবে। আমি কিছু করতে পারব না। এক ফোঁটা চা ফেলে দিলেও মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে বুড়োটা।
রান্নাঘরের দরজা খুলে দিল বেসিন। ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিভিং রুমের গেস্টদেরকে খাবার বিতরণ করতে লাগল। পুরনো আমলের ঘর। মানুষগুলোও পুরনো। পুরনো আসবাব আর তাক বোঝাই জিনিসপত্র কেমন অস্বস্তি জাগায়। বাগানের দিকের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোগুলো খোলা। ফুরফুর করে ঢুকছে জুনের উষ্ণ হাওয়া। গরম লাগছে তিন গোয়েন্দার। অস্বস্তিতে শক্ত হয়ে গেছে শরীর, নড়তে চাইছে না যেন হাত পা। শক্ত করে ধরে রেখেছে ট্রে, একটু খাবারও যাতে না পড়ে সেদিকে কড়া নজর। ভীষণ বদমেজাজী ডেভিড লিসটারের গালাগাল শুনতে চায় না।
মিস্টার লিসটারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি ওদের। দেখাই হয়নি। তবে তার সম্পর্কে এত কথা শুনেছে, দেখা করার প্রচণ্ড ইচ্ছে। ওয়েস্ট কোস্টের একজন কোটিপতি তিনি। রকি বীচে তার প্রতিবেশী এবং তার সঙ্গে যাদের ব্যবসার সম্পর্ক আছে, তাদের কেউই ভাল বলে না। আর এমন কিপটের কিপটে, নব্বইটা সেন্ট পেলে না খেয়ে জমিয়ে রেখে দেয় এখনও, আরও দশটা সেন্ট জোগাড় করে পুরো একটা ডলার করার জন্যে।
পার্টিতে সাহায্য করার জন্যে তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করেছে হেনরি বেসিন। কিছুটা বেপরোয়া হয়েই। কারণ ওই খরচের টাকাটাও লিসটারের কাছ থেকে আদায় করতে ঘাম ছুটবে তার। শহরের নতুন এবং সবচেয়ে অল্প বয়েসী ক্যাটারার সে। এতদিন ছোটখাট কাজ করেছে। এই প্রথম লিসটারের বাড়িতে পার্টির মত বড় একটা কাজ পেয়েছে। কাজেই নাম করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে সে। তার সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় আছে তিন গোয়েন্দার। স্যালভিজ ইয়ার্ডে পুরনো জিনিস কিনতে যায়। লিসটারের নাম তিন গোয়েন্দাও শুনেছে। কেমন লোক দেখার ইচ্ছে কিশোরের অনেক দিনের। কথায় কথায় বেসিনের কাছে যখন শুনল, পার্টিতে সাহায্য করার জন্যে লোক খুঁজছে, ওয়েইটারের কাজটা দেয়ার জন্যে চেপে ধরল তাকে। লিসটারের বাড়িতে ঢোকার এইই সুযোগ। কম পয়সায়, কাজের লোক পেয়ে বেসিনও রাজি হয়ে গেল। ওরকম কিপটে লোকের বাড়িতে যেতে মুসা প্রথমে রাজি হতে চায়নি। অনেক বলেকয়ে তাকে রাজি করিয়েছে কিশোর। রবিনের ব্যাপারটা অন্যরকম। গানের কাজ একঘেয়ে লাগতে আরম্ভ করায় কিছুদিন ছুটি নিয়েছে সে। তাছাড়া বেশ কিছুদিন থেকে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছে না। দক্ষিণ সাগরে যেতে পারেনি। এখন আবার মনপ্রাণ দিয়ে লেগে গেছে পুরনো কাজে।
হেনরি বেসিনকে কন্ট্রাক্ট করেছে লিসটার খরচ বাঁচানোর জন্যে। বড় এবং নামী ক্যাটারার ভাড়া করতে চাইলে অনেক খরচ। কড়া হুকুম দিয়ে দিয়েছে যত, কম খরচে সম্ভব পার্টি শেষ করতে হবে। ওয়েইটার নিয়ে শুরু হয়েছে খেঁচাখেঁচি। কজন লাগবে সেটা নিয়ে। অনেক চাপাচাপি করে তারপর লিসটারকে রাজি করাতে পেরেছে বেসিন। তবে এক শর্তে, সব চেয়ে কমদামী ওয়েইটার নিয়োগ করতে হবে।
তা-ই করেছে বেসিন। আর এ কারণেই বাগানে যে মেয়েগুলো টেবিল সাজাতে ব্যস্ত, ওরা সব রকি বীচ হাই স্কুলের ছাত্রী। বারটেনডারের দায়িত্বে রয়েছে যে ছেলেটা, সে লস অ্যাঞ্জেলেসের কাপ অভ চিয়ার বারটেনডিং স্কুলের একজন শিক্ষানবিস। আর পিকো নামের যে ভবঘুরে লোকটা বাসন ধোয়ামোছার কাজ করছে, তাকে রাস্তা থেকে ধরে এনেছে বেসিন। একটা মিশনারির কাছে ঘুরঘুর করছিল খাবারের লোভে।
ওয়েইটার রাখা হয়েছে তিন গোয়েন্দাকে। টাকার জন্যে আসেনি। এত কম দামে কেউ ওয়েইটারের কাজ করতে রাজি হত না। ওরা হয়েছে শুধু কৌতূহল মেটানোর জন্যে।
ডেভিড লিসটার রহস্যময় মানুষ। রকি বীচে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। নিঃসঙ্গ মানুষ। একা থাকতে পছন্দ করেন। মকিংবার্ড লেনে তার বাড়িটা যেন একটা পোড়োবাড়ি। বাগানটাকে বলা যায় লতাপাতার জঙ্গল। আর কিছুদিন ওভাবে পড়ে থাকলে দক্ষিণ আমেরিকার ইতুরি জঙ্গল হয়ে যাবে। লোকে বলে, ঢুকলে গা ছমছম করে। ভূতের বাসা। মুসা যে রাজি হতে চায়নি আসতে এটা একটা কারণ।
লিসটারের মেয়ে এলিনার সম্মানে দেয়া হচ্ছে এই পার্টি। বৃদ্ধের একমাত্র মেয়ে সে। বোর্ডিঙে থেকে স্কুলে পড়ত। ফলে রকি বীচের ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি, বন্ধুত্ব করতে পারেনি। এখন পুবের একটা কলেজে পড়ে। গোপনে তিন গোয়েন্দাকে বলেছে বেসিন, মেয়েটা এই পার্টিতে তার এনগেজমেন্টের খবরও ঘোষণা করতে পারে। বেসিন নিশ্চিত, ভাবি জামাইকে দুচোখে দেখতে পারবেন না লিসটার। এই পার্টি দেয়ারও ইচ্ছে ছিল না তার, মেয়ের চাপে বাধ্য হয়েছেন।
সারাক্ষণ গজগজ করছে বুড়ো, বেসিন বলেছে। এসব নাকি টাকা পানিতে ফেলার ফন্দি। চাপে পড়ে রাজি হয়েছে বটে, তবে যতটা সম্ভব কম টাকা খরচ করে কোনমতে কাজটা সারতে চায়। কিছু সাধারণ খাবার আর কয়েকজন তৃতীয়। শ্রেণীর মিউজিশিয়ানকে ভাড়া করেছে, যেনতেন ভাবে মেয়েকে খুশি করতে পারলেই বাঁচে। তার ইচ্ছে, মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, মেয়ের ফিয়াশেকে ভয় দেখিয়ে, দুজনকে আলাদা করবে। তারপর ওয়াল স্ট্রীটের কোন বড় ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে। মেয়েকে ব্যবসায় ঢোকাবে। এগুলো সবই অবশ্য আমার অনুমান।
সমস্ত কথা মনে পড়ছে কিশোরের। কলরব করছে মেহমানরা। কেন যে এত কথা বলে লোকে বুঝতে পারে না সে। অহেতুক বকবক করে। চীজ পাফ সরবরাহ করতে লাগল ওদেরকে। অবাক হয়ে ভাবছে কোন মানুষটা ডেভিড লিসটার। বেশির ভাগই মাঝবয়েসী। সে শুনেছে, লিসটারের বয়েস সত্তর। মেহমানদের পরনে দামী পোশাক। দামী দরজির দোকান ঘুরে এসেছে। অনেক খরচ পড়েছে তার জন্যে। এরকম দামী পোশাক লিসটারের পরনেও থাকবে, আশা করতে পারল না সে।
হাসাহাসি করছে মেয়েরা। উচ্চকণ্ঠে কথা বলছে। চেঁচাচ্ছে। গান গাইছে। যা ইচ্ছে করছে। ওদেরই কেউ একজন হবে এলেনা লিটার। হয়ত চুলের রঙ হবে লাল, পরনে শাদা পোশাক। কিংবা হতে পারে সোনালি চুল, তাতে গোলাপী আভা। ওই যে সোনালি চুল, নীল পোশাক পরা মেয়েটা কথা বলছে ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে সে-ও হতে পারে এলেনা। কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। মহিলাকে। যখন পাশের মসৃণ চেহারার তরুণের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ঘুরল মেয়েটা, ছাতের দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে রইলেন মহিলা। অমনোযোগী। হঠাৎ হাত উঠে গেল গলার কাছে। ঈশ্বরের অশ্রু
ওপরে তাকাল কিশোর। এক কোণে মাকড়সার জাল ঝুলে রয়েছে। কে। জানি একটা শুয়াপোকা মেরেছিল, দেয়ালে লেপ্টে রয়েছে এখনও।
বিরক্তিতে কুঁচকে গেল মহিলার মুখ, দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন। হাসি চাপতে কষ্ট হল কিশোরের। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ওয়েইটারের কাজ, এখন তাই মনে হল। তবে আনন্দ পাচ্ছে।
হঠাৎ, মিউজিশিয়ানরা সবে একটা বাজনা শেষ করেছে, এই সময় একটা গেলাস ভাঙল একটা মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল কিশোর, ডেভিড লিসটার কার নাম। লম্বা, তালপাতার সেপাই, ধূসর চুল, কালো মলিন স্যুট পুরনো হতে হতে চকচকে ভাবটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এক কোণ থেকে ছুটে এলেন তিনি। রাগে চিৎকার করে ছুটলেন বাগানের দিকে। কিশোরের মনে হল, মেয়েটাকে ধরে মারবেনই বুঝি লিসটার। শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন। বকা দিলেন, গায়ে জোর নেই? খাও না? বিড়বিড় করে আরও কি বললেন, বোঝা গেল না। কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে।
আব্বা, রাগটা একটু কমাও, বলে লিসটারের দিকে এগিয়ে গেল নীল পোশাক পরা মেয়েটা।
এলেনা? মেয়েটাকে আটকানোর জন্যেই বোধহয় হাতটা বাড়িয়ে ছিলেন ধূসর চুল মহিলা, সরিয়ে নিলেন। মসৃণ চেহারার যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিক, দেখলি! একটা লোক বটে!
এগিয়ে গেল যুবক। এলেনা, দাঁড়াও। মিস্টার লিসটার, শান্ত হোন। মেয়েটা তো আর ইচ্ছে করে ফেলেনি। আপনি…
ফিরেও তাকালেন না লিসটার। গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুললেন ধাক্কা দিয়ে। দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন।
তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। সাংঘাতিক ব্যস্ত বেসিন। চুলার কাছ থেকে দৌড়ে যাচ্ছে টেবিলের কাছে, আবার টেবিল থেকে চুলার কাছে। অনেকগুলো প্লেটে খাবার সাজাতে হচ্ছে। একগাদা বাসন সিংকে ফেলে ধুচ্ছে ভবঘুরে লোকটা।
হেনরি, চিৎকার করে উঠলেন লিসটার। কোত্থেকে কি ধরে এনেছ! ওই গর্দভ মেয়েটাকে বের কর আমার বাড়ি থেকে! ওই গেলাসের দাম রেখে দেবে ওর কাছ থেকে! নইলে তোমার টাকা থেকে কাটব।
আব্বা, শান্ত হও না, আহ! পেছনে গিয়ে দাঁড়াল মেয়ে। এমন কাণ্ড শুরু করলে! আমার পার্টিই তো শেষ করবে। এসো। এই, আব্বা। প্লীজ! লিসটারের হাত ধরে টান দিল এলেনা। এ কিন্তু চিৎকার বন্ধ করার ইচ্ছে নেই লিসটারের। ফিরে তাকাল পিকো। হাতে একগাদা বাসন। তাকিয়ে রয়েছে ভদ্রলোকের চোখের দিকে। এতগুলো বাসন। একসঙ্গে নেয়াই বোধহয় ঠিক হয়নি, কিংবা অন্য কোন কারণে গেল একটা। পিছলে। ব্যস, বাকিগুলোও মেঝেতে পড়ে ভাঙল ওটার সঙ্গে সঙ্গে।
লিসটারের চিৎকারে সব আলাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। নীরবতার মাঝে প্রচণ্ড শব্দ হল বাসন ভাঙার। ঝনঝন করে।
হাঁ হয়ে গেলেন লিসটার।
আব্বা, তোমার জন্যেই এমন হল? চেঁচিয়ে উঠল এলেনা। তুমি…তুমি… আব্বা!
বুক চেপে ধরেছেন লিসটার। ভঁজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু।
আমি আগেই বলেছি। এজন্যেই রাগতে মানা করেছি। আব্বা? আব্বা? কডি, জলদি এস! বেহুশ হয়ে যাচ্ছে!
বাবার কোমর জড়িয়ে ধরল এলেনা।
.
০২.
লিভিং রুম থেকে দৌড়ে এল কালোচুল এক তরুণ। সে আর বেসিন মিলে মেঝে থেকে তুলল লিসটারকে। ডাইনিং রুম থেকে একটা চেয়ার এনে পেতে দিল। এলেনা, তাতে বসান হল তার বাবাকে।
আব্ব, কতবার মানা করলাম তোমাকে! রাগে, দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলল। এলেনা। আমি জানতাম এরকম একটা কিছু করবে।
ডাক্তার কই? চেঁচিয়ে উঠল মোটা এক মহিলা। সব কিছু ঠিক করার দায়িত্ব যেন এখন তারই। এগিয়ে এসে লিসটারের নাড়ি দেখল। টেলিফোন কোথায়? ডাক্তারকে ফোন করছি।
না! চিৎকার করে বলল লিসটার। হুশ ফিরেছে। ডাক্তার লাগবে না! লাগবে
ঝুঁকে দাঁড়াল কালোচুল তরুণ। মিস্টার লিসটার, আমরা আপনাকে সাহায্য করতেই চাইছি…
আমি বলেছি ডাক্তার লাগবে না আমার! খেঁকিয়ে উঠলেন লিসটার। ইডিয়ট!
কিছুই মনে করল না তরুণ। যেন শুনতেই পায়নি। দেখেশুনে কিশোরের মনে হচ্ছে লিসটারের স্বভাবই হল মানুষকে অপমান করা। কিন্তু একজন মেহমান এই অপমান সইবে কেন?
এই সময় নিচু গলায় একজনকে বলতে শুনল, ছেলেটার নাম কডি হোয়েরটা। লিটারের পারসনাল সেক্রেটারি।
আজকাল চাকরি পাওয়াটা বোধহয় কঠিনই হয়ে উঠেছে, শুকনো মন্তব্য করল আরেকজন।
ওপরে! লিসটার বললেন, ওপরে নিয়ে চল আমাকে! কয়েক মিনিট শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাব।
মেহমানদের দিকে তাকাল কডি। মুসার ওপর চোখ পড়ল। অস্বাভাবিক খাটো ওয়েইটারের পোশাক পরে বুফে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এই, তাকে ডাকল সেক্রেটারি। এস তো। ধর।
টেবিলে ট্রে রেখে লিসটারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। সে আর কডি মিলে লিসটারকে ধরে তুলল। ধীরে ধীরে নিয়ে চলল সামনের হলের দিকে, সেখানে রয়েছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। আগে আগে চলল এলেনা। মেহমানরা সরে পথ করে দিতে লাগল ওদেরকে।
একেবারে হালকা শরীর লিসটারের। যেন কোন ওজনই নেই। সিঁড়ি বেয়ে তুলতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না। মুসা একাই পারত। বেডরুমে নিয়ে আসা হল তাকে। ঘরটা বাড়ির সামনের অংশে। জানালা দিয়ে পর্বত দেখা যায়।
আরাম করে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল লিসটারকে। লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে ঢুকল এলেনা, বাবাকে এক গেলাস পানি এনে দেয়ার জন্যে। পানি এনে দিলে ঠেলে সরিয়ে দিলেন লিসটার। বিছানায় ছলকে পড়ল পানি। চেঁচিয়ে উঠলেন, নিট্রো! আমার নিট্রো কোথায়?
এই যে, আছে, একটা ড্রয়ার খুলল এলেনা। একটা ওষুধের শিশি বের করল।
খোল! জলদি কর! চাবুকের মত শপাং করে উঠল যেন লিসটারের কণ্ঠ। হাঁ। করে দাঁড়িয়ে আছ কেন, বলদের মত!
আব্বা, নিট্রো নয়, একদিন বিষ খাওয়াবো তোমাকে আমি। স্ট্রিকনিন। বিশ্বাস কর। শিশি ঝাঁকি দিয়ে উপুড় করল এলেনা। বাবার মেলে দেয়া হাতে। ফেলে দিল কয়েকটা ট্যাবলেট।
তা আর করতে দিচ্ছি না, লিসটার বললেন। উইলে কি লিখেছি ভাল করেই জান। আমার অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে একটা কানাকডিও আর পাবে না তুমি।
জিভের নিচে ট্যাবলেট রেখে দিয়ে চিত হয়ে শুলেন তিনি।
বাবা-মেয়ের এই ধরনের আলোচনায় অস্বস্তি লাগছে মুসার। বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরতেই তার হাত চেপে ধরল এলেনা। তুমি থাক এখানে, আব্বার কাছে। আমি যাই। মেহমানদের দেখাশোনা করিগে। কডি, এস। আমি একা পারব না।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। এত বদমেজাজী অসুস্থ একজন বুড়ো মানুষের কাছে থাকার কোন ইচ্ছেই তার নেই। মিস লিটার, বলতে গেল সে। ওখানে আমার কাজ…
এটাও কাজ, বাবার মতই খেঁকিয়ে উঠল এলেনা। এখানে থাকতে বলা হয়েছে, থাক।
কিন্তু…কিন্তু যদি ওঁর…মানে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়…।
হবে না। এটা হার্ট অ্যাটাক নয়, অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল এলেনা। একে বলে অ্যানজিনা। রক্তবাহী শিরা বিদ্রোহ করেছিল বলা যায়। তাতে হৃৎপিণ্ডে ঠিকমত অক্সিজেন পৌঁছতে পারেনি। বুক ব্যথা করছে সে কারণেই। ট্যাবলেট নিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।
তোমার হলে বুঝতে! কটকট করে বললেন লিসটার, যার হয় সে-ই বোঝে। ভয়ের কিছু নেই তুমি জানলে কি করে?
জানার ব্যাপার, তাই জানলাম। গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এলেনা।
মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল হোয়েরটা, যেন তার জন্যে আফসোস হচ্ছে, তারপর বেরিয়ে গেল এলেনার পিছু পিছু।
নিথর হয়ে পড়ে আছেন লিস্টার। চোখ বোজা। বিছানার কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসল মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বৃদ্ধ মানুষটার দিকে। মুখের চামড়া ধূসর রঙের, তার মাঝে শিরাগুলো জেগে রয়েছে বেগুনী জালের মত। উঁচু, পাতলা নাক। বসা গাল। হাতের দিকে দৃষ্টি সরে গেল তার। একেবারে যেন কঙ্কাল, এক ছটাক মাংস আছে কিনা সন্দেহ। আড়াআড়ি ফেলে রেখেছে বুকের ওপর। যেন। কবর দেয়ার জন্যে শোয়ানো হয়েছে মানুষটাকে।
ভয় ধরে গেল মুসার। দ্রুত সরিয়ে নিল চোখ। দেখতে লাগল ঘরে কি আছে। গত শীতের পর বোধহয় আর পরিস্কার করা হয়নি ফায়ারপ্লেসটা। পিতলের কালো হয়ে যাওয়া বেড়ার ওধারে উঁচু হয়ে আছে ছাই। কাছে একটা পিতলের ঝুড়িতে রাখা কিছু লাকডি। আর একগাদা হলদেটে খবরের কাগজ। ওগুলো দিয়ে আগুন ধরাতে সুবিধে। ফায়ারপ্লেসের ওপরের ম্যানটেলপিসে সাজানো একটা জাহাজের মডেল, আর চীনামাটির মোমদানিতে দুটো মোম। সব কিছুতে ধুলো জমে রয়েছে। পুরু হয়ে।
লম্বা দম নিল মুসা। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। দেয়াল, ময়লা পর্দা আর রঙচটা কার্পেট থেকেই হালকা কুয়াশার মত উড়ছে ওই ধুলো-তার ধারণা।
বড় একটা ড্রেসারের ওপরে ঝুলছে একটা আয়না, দাগ পড়া, হলদেটে। পেছনে জায়গায় জায়গায় পারা উঠে গেছে। ড্রেসারের পাশে দুটো ছোট আর্মচেয়ার রাখা। গদির রঙ উঠে গেছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোরও একই রকম করুণ দশা। জাহাজ আর সাগরের ছবি–উত্তাল সাগরে চলেছে জাহাজ, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে পাথুরে উপকূলে।
আর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে যেন বুককে। দেয়াল ঘেঁয়ে, ড্রেসারের ধারে, চেয়ারের পাশে। বই উপচে পড়ছে ওসব কেসে। পেপারব্যাক, হার্ডকভার, ছোট বই, বড় বই, ভলিউম; খাড়া করে, কাত করে, শুইয়ে, যতোভাবে ঢোকানো সম্ভব, রাখা হয়েছে। আর আছে কাগজপত্র। রোল পাকিয়ে, চ্যাপ্টা করে, ভাজ করে, গুঁজে দেয়া হয়েছে বইয়ের ফাঁকে সামান্যতম জায়গা যেখানে পাওয়া গেছে। সেখানেই। আরও আছে বাদামী রঙের ম্যানিলা খাম আর ফোল্ডার, ছোট, বড়, বইয়ের মাথার ওপরের ফাঁকে, কিংবা পাশের অন্যান্য ফাঁকে। মা বিছানার দিকে তাকাল আবার মুসা। লিসটার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেমন খসখসে কাঁপা নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে নিয়মিত। হাড্ডিসর্বস্ব আঙুলগুলো এখন আর মুঠো হয়ে নেই, খুলে রয়েছে বুকের ওপর।
উঠে একটা বুককেসের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। বইয়ের পেছনের নাম পড়ল। একটার নাম ব্লাডি মার্ডার। আরেকটার নাম শার্ক হান্টার। এডগার অ্যালান পো-র গল্প সংকলন রয়েছে কিছু। আরেকটা বইয়ের নাম দেখা গেল পোলারিস। ওটা টেনে বের করে খুলল সে। নাবিকদের গাইডবুক ওটা। সমুদ্রে নক্ষত্র দেখে কি করে জাহাজ চালাতে হয় তার ওপর লেখা।
গুঙিয়ে উঠলেন লিসটার। এমন চমকে উঠল মুসা যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বইটা আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। তাকিয়ে রয়েছে বুড়ো মানুষটার দিকে। কানে আসছে নিচতলায় মেহমানদের কণ্ঠস্বর। কতক্ষণ চলবে পার্টি? কতক্ষণ তাকে আটকে থাকতে হবে এখানে, এমন একটা বিরক্তিকর কাজে?
হাতের দিকে তাকাল সে। ধুলো-ময়লা লেগে গেছে। বুককেসটা কতদিন পরিষ্কার করা হয় না কে জানে। কয়েক মাস হতে পারে, কয়েক বছর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল মুসা। ওখানেও বই আছে। পুরনো আমলের বাথটাব আর ওয়াশবেসিনের পাশে একটা টেবিলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। নানা রকম গল্প আর প্রবন্ধের বইয়ের মাঝে রয়েছে কার্টুনের বই। অ্যাটমিক এনার্জির ওপর লেখা বইও আছে একটা। তার মানে যা পান তা-ই। পড়েন লিসটার, সব ধরনের বই। কিশোরকে বলার মত একটা খবর বটে।
কলের মুখ খুলে হাত ধুতে শুরু করল মুসা।
হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেল তালা লাগানোর শব্দ।
এইই! টান দিয়ে তোয়ালে নিয়ে দরজার দিকে ছুটল সে। নব ধরে মোচড় দিল। নড়লও না। তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বাথরুমে।
নরম গলায় ডাকল সে, মিস্টার লিস্টার! মিস্টার লিসটার, দরজাটা খুলুন, প্লীজ!
কেউ জবাব দিল না।
আরও জোরে ডাক দিল, মিস্টার লিস্টার!
দরজার কাছ থেকে সরে গেল পদশব্দ। কাঠের পালায় কান রাখল মুসা। নিচতলা থেকে মেহমানদের কথা আর হাসি কানে আসছে। বাজনা বন্ধ। কাছেই
একটা দরজা খোলা হল। জোরাল হল নিচের কোলাহল।
মিস্টার লিস্টার!
কেউ সাড়া দিল না। দরজা খুলতে এল না কেউ।
অস্বস্তি লাগছে মুসার। ভয় লাগছে। বাথরুম ব্যবহার করায় কি রেগে গেলেন লিসটার? হয়ত ভেবেছেন মুসা চোরটোর কিছু। পুলিশকে খবর দিতে গেছেন?
বাথটাবের কিনারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল সে। পুলিশ এলে বরং ভালোই। আবার শোনা গেল পদশব্দ। একই রকম পায়ের আওয়াজ, আগের বার যেমন শুনেছিল। বাথরুমের দরজার কাছে এসে থামল। কিন্তু দরজা খুলল না।
বিচিত্র একটা শব্দ হল। মাটিতে পড়ে গেলেন বোধহয় লিসটার, কারও সঙ্গে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। গুঙিয়ে উঠল কেউ, তারপর চুপ।
লাফ দিয়ে উঠে দরজার কাছে চলে এল মুসা। থাবা দিতে দিতে চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার লিসটার!
কে এই সময় নিচে লিভিং রুমে আবার শুরু হল গানবাজনা। কোরাস গেয়ে উঠল রক দল, বেইবে, হোয়াই এইনটু ইউ মাই বেইবে নো মোর? জোরাল কণ্ঠ। সেই সাথে দ্রিম দ্রিম করে বাজছে ড্রাম।
মিস্টার লিসটার! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল মুসা, আপনি ঠিক আছেন?
বেজেই চলেছে বাজনা, গাইছে গায়কদের দল।
ঘামছে মুসা। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। লাথি মারতে শুরু করল দরজায়।
জবাব দিচ্ছেন না কেন লিসটার? হার্ট অ্যাটাক হয়েছে? হয়ত মারা যাচ্ছেন এ মুহর্তে, এ দরজাটার ঠিক ওপাশেই।
এই কে আছ, শুনছো? চিৎকার করতে লাগল মুসা। বের কর! বের কর আমাকে।
কেউ শুনল না তার ডাক। কেউ এল না।
বেইবে, হোয়াই এইনট ইউ মাই বেইবে না মোর? প্রশ্নটা করে উপসংহার। টানল গায়কেরা, কিন্তু বাজনা বন্ধ হল না। আরেক সুরে চলে গেল। ড্রামের বিরতি নেই। গেয়ে উঠল ওরা, রকিং রকিং রকিং অল দা নাইট।
হতাশ ভঙ্গিতে দুম দুম করে দরজায় কিল মারতে লাগল মুসা। এখন কি করব? ভাবছে সে। একজন মানুষ ওদিকে মরতে বসেছে। সে জানতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। করবটা কি এখন? কিশোরটা কোথায়?
শান্ত হয়ে বস, স্মৃতিতে বেজে উঠল যেন কিশোরের কণ্ঠ। মাথা ঠাণ্ডা রেখে। ভাব।
ঠিক! ভাবল মুসা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ছোট ঘরটায় চোখ বোলাল। জানালায় দৃষ্টি আটকে গেল।
জানালা! হ্যাঁ, জানালা! পুরনো আমলের বাথরুমটায় একটা জানালা আছে। ওটার বাইরে দেয়ালের কাছেই রয়েছে একটা গাছ। বেশ বড় একটা অ্যালডার। গাছ, বেয়ে নামা যাবে সহজেই।
জানালাটা খুলল মুসা। বইগুলো নামিয়ে রেখে টেবিলটা নিয়ে এল জানালার। কাছে। ওটাতে উঠে মাথা বের করে দিল জানালার বাইরে, তারপর বের করল। কাধ।
নিচে তাকাল। চোখে পড়ল বাড়ির একপাশ। ঠিক নিচেই রয়েছে সিমেন্টে বাঁধন পথ। পড়লে হাত-পা ভাঙার ভয় আছে।
তবে সে ভয় তেমন করল না। গাছটাছ ভালই বাইতে পারে। পড়বে না। আর পড়া চলবেও না, অন্তত এখন। মারা যাচ্ছেন লিসটার। মুসা গিয়ে দ্রুত। সাহায্য আনতে না পারলে মারাই যাবেন।
.
০৩.
যতো দ্রুত সম্ভব নামছে মুসা। কোথায় ধরছে, কোথায় পা রাখছে সেদিকেও খেয়াল নেই। বাড়ির এই পাশটা নির্জন, কাউকে চোখে পড়ছে না। কিন্তু সে মাটিতে নামতে না নামতেই একটা লাল চুল ওয়ালা মেয়ে এসে হাজির হল। বাহ, নামার বেশ ভাল উপায় বের করেছ তো! আমি তো জানতাম লোকে সিঁড়ি দিয়েই নামতে চায়।
আমিও চাই। ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করল না মুসা। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে দৌড় দিল বাড়ির অন্য পাশে যেখানে লম্বা জানালাগুলো রয়েছে সেদিকে। একটা জানালা গলে যখন ঢুকছে তখনও বাজনা বাজছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে মেহমানদের ট্রে হাতে ঘুরছে রবিন আর কিশোর, ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে সোজা এলেনার দিকে ছুটল মুসা। সেই ধূসর সিল্ক পরা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে মেয়েটা। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে তার হাত চুল সে। ফিরে তাকিয়ে মুসাকে দেখেই ভুরু কুচকে ফেলল এলেনা। তুমি এখানে কেন? ড্রামের ভারি গমগম শব্দকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে। এ বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। এখানে কথা বলা অসম্ভব মনে হচ্ছে তার কাছে। ইশারায় এলেনাকে সরে আসতে বলল রান্নাঘরের দিকে।
ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে, যাওয়ার সময় কডি হোয়েরটাকে দেখতে পেল ওরা। ঘরের একধারে হেনরি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেটে খাবার। সাজাচ্ছে ক্যাটারার। আঙুল বাকা করে ইশারায় হোয়েরটাকে ডাকল এলেনা। খালি রান্নাঘরের দিকে এগোল। তার পেছনে নির্জন রান্নাঘরে চলে এল লোকটা। মুসা ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল যাতে বাজনার শব্দ কম শোনা যায়।
আপনার বাবা আমাকে বাথরুমে তালা আটকে রেখেছিলেন, মুসা বলল। হাত ধুতে গিয়েছিলাম আমি। দুই এক মিনিট পরেই একটা শব্দ শুনলাম। মনে হল তিনি পড়ে গেছেন। চিৎকার করে অনেক ডাকাডাকি করলাম। শুনলেনই না। জবাব দিলেন না। শেষে জানালা গলে বেরিয়ে গাছ বেয়ে নেমে এসেছি…
শোনার জন্যে আর অপেক্ষা করল না এলেনা। পেছনের সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। তার পেছনে ছুটল হোয়েরটা।
ডাইনিং রুমে ঢোকার দরজাটা ফাঁক হল। মুখ বের করল কিশোর। তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাচ্ছে রবিন।
কি হয়েছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
বারোটা বেজেছে লিসটারের! কি হয়েছে বলল মুসা। এলেনা দেখতে গেছে বাবাকে।
ছাতের দিকে তাকাল কিশোর। তারপর পেছনের সিঁড়ির দিকে। রওনা হয়ে গেল।
কোথায় যাচ্ছ? বাধা দেয়ার চেষ্টা করল রবিন, এলেনা আমাদের কুত্তার মত দূর দূর করে তাড়াবে। বাপ আর মেয়ের তো একই স্বভাব।
মিস্টার লিসটার সত্যিই অসুস্থ হয়ে থাকলে, কিশোর বলল, আমাদের সাহায্য দরকার হবে তার।
যাও, ভুরু নাচাল মুসা। মাথায় ডাণ্ডা খেতে চাইলে। কিন্তু পরক্ষণেই কিশোরের পেছনে রওনা হল সে-ও। কিছুটা কৌতূহলী হয়েই। কিশোরকে কি বলে এলেনা দেখার জন্যেই। তাছাড়া লিসটারের আসলে কি হয়েছে সেটাও দেখার ইচ্ছে।
দ্বিধা করল রবিন। তারপর সে-ও চলল দুজনের পেছনে।
ওপরের হলঘরে. যেন পালকের তুষারপাত হচ্ছে। একটা বালিশ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। খোলটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে, ভেতরের পালকগুলো উড়ছে। তার মাঝ দিয়ে ছুটে গেল এলেনা। শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল একবার, নব মোচড় দিয়ে ঠেলে খুলে ভেতরে তাকাল। চেঁচিয়ে উঠল। হোয়েরটা চেঁচাল না। তাকিয়ে রয়েছে ভেতরে।
ওখানেই কোথাও আছে! চিৎকার করে বলল এলেনা। যাবে কোথায়? যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
ঠেলা দিয়ে পাল্লা পুরোটা খুলে দিল হোয়েরটা। ভেতরটা এখন কিশোরও দেখতে পাচ্ছে। বিছানার চাঁদরে কুঁচকে রয়েছে। খানিক আগে যে ওখানে একজন মানুষ শুয়েছিল বোঝা যায়। ফায়ারপ্লেসে নাচানাচি করছে ছোট ছোট আগুনের শিখা। কাগজ পোড়া কালো ছাই, গরম বাতাসের সঙ্গে উড়ে চিমনিতে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভুরু কুঁচকাল কিশোর। গরম আবহাওয়া। এই সময়ে ফায়ারপ্লেস, জ্বালানোর দরকার পড়ল কেন?
দৌড়ে গেল সে। ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা চিমটাটা তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল আগুনের ভেতর। কিন্তু কাগজ, যা ফেলা হয়েছিল পুড়ে গেছে। চিমটার খোঁচা। লেগে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল পোড়া কাগজ।
কি করছ? কিশোরের হাত থেকে চিমটাটা টান মেরে নিয়ে নিল এলেনা। রাগত কণ্ঠে বলল, এখানে ঢুকেছ কেন? যাও, নিচে যাও!
মিস লিসটার, বেশ গঙার ভারিক্কি গলায় বলল কিশোর, আমরা থাকলে আপনার সুবিধে হতে পারে। রহস্যময়, অস্বাভাবিক ঘটনা, এসব তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল এলেনা। হাসিটা চেপে রাখল মুসা। নাটকীয় ভাবভঙ্গি করে আবার বাজিমাত করে দিয়েছে কিশোর পাশা।
শান্ত দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বোলাল কিশোর। এখনও বন্ধ রয়েছে বাথরুমের দরজা। তালায় দোকান রয়েছে পুরনো ধাচের স্কেলিটন কী। এগিয়ে গিয়ে তালা খুলে দরজাটা খুলল কিশোর। মুসা যেভাবে ফেলে গেছে সেভাবেই রয়েছে বাথরুম। জানালার নিচে টেবিলটা রয়েছে।
চাবিটা দিয়ে হলঘর আর শোবার ঘরের মাঝের দরজার তালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। লেগে গেল। এ বাড়ির যে কোন তালা এ চাবি দিয়ে খোলা যাবে মনে হচ্ছে। মিস লিসটার, পালানোর আগে মুসাকে বাথরুমে আটকেছিলেন আপনার বাবা। মেহমানদের সঙ্গে এরকম ব্যবহারই করেন নাকি উনি?
তোমার বন্ধু মেহমান নয়, কাটা জবাব দিল এলেনা। এখানে কাজ করতে এসেছে।
বেশ, তাহলে কর্মচারী। তো আপনার বাবা কি কর্মচারীদের এরকম করে বাথরুমে আটকে রাখেন?
জবাবের অপেক্ষায় না থেকে মুসার দিকে তাকাল কিশোর। তোমাকে আটকে ফেলার পর ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছ বললে। কিছু একটা পড়েছিল। মানুষ পড়ার শব্দ? মিস্টার লিসটার?
হতে পারে। আর কেউ তো ছিল না।
মিস্টার লিসটারের কাছে যখন বসে ছিলে তখন ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছিল?
না, মাথা নাড়ল মুসা। একেবারেই আগুন ছিল না।
গরম আবহাওয়া, আনমনে বলল কিশোর। কেন আগুন জ্বালতে যাবে। ফায়ারপ্লেসে?
বিছানার দিকে তাকাল সে। হলঘরে দেখে এলাম একটা বালিশ ছিঁড়েছে। বিছানায় এখন বালিশ নেই। যেটা ছিঁড়েছে সেটা আগে থেকেই কি ফাটা ছিল? আর আরেকটা বালিশ কোথায়? বিছানায় তো সাধারণত দুটো বালিশ থাকে। কারণ এটা ডাবল বেড।
ভ্রূকুটি করল মুসা। দুটোই থাকার কথা। তবে খেয়াল করিনি আমি।
অবশ্যই দুটো ছিল, এলেনা বলল। দেখ, এসব শার্লক হোমসগিরি করে ভোলাতে পারবে না আমাকে। যাও, নিচে যাও। মেহমানদের খাবার লাগবে…
তার কথা যেন কানেই ঢুকল না কিশোরের। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, আজ এখানে কি ঘটেছে বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি। স্পষ্ট। মুসা বাথরুমে। ঢুকেছিল। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছেন আপনার বাবা, যাতে সে বেরোতে না পারে। তারপর কিছু পুড়িয়েছেন ফায়ারপ্লেসে।
ঘরে ঢুকল এতক্ষণে হোয়েরটা। এমন কিছু, কিশোরের সুরে সুর মিলিয়ে বলল সে, যেটা অন্য কাউকে দেখতে দিতে চাননি। গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তিনি…
দেখ, কডি, কড়া গলায় ধমক দিল এলেনা। ছেলেগুলোকে আর উসকানি দিয়ো না। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, কি করেছে আমি বলি। মূল্যবান কিছু পোড়ায়নি বাবা। ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর জন্যে কাগজ ব্যবহার করেছে। একটা বালিশ ছিঁড়েছে, আরেকটা লুকিয়েছে। নিজেও গায়েব। এসব করেছে। আমাকে রাগানোর জন্যে। কোন কিছু পছন্দ না হলেই এরকম করে। এর চেয়ে খারাপ কাজ করেছে আগেও। বিশ্বাস কর। আজকের এই পার্টি একটুও পছন্দ ছিল। না তার।
তার মানে আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন? কিশোরের প্রশ্ন। তা-ই যদি করে থাকেন এখন তিনি কোথায়?
নাক দিয়ে খোঁৎখোঁৎ শব্দ করল এলেনা। খুঁজতে শুরু করল। তার সঙ্গে যোগ দিল হোয়েরটা। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে তিন গোয়েন্দাও যোগ দিতে গেল। বাধা দিতে গিয়েও দিল না এলেনা, বরং বলল, ঠিক আছে, খেজ। বেশি লোকে খুঁজলে তাড়াতাড়ি বের করা যাবে।
বিরাট বর্গাকার শোবার ঘরগুলোয় পুরু হয়ে ধুলো জমে রয়েছে। নোংরা। সাফ। করা হয় না। কয়েকটাতে বিছানা আর ড্রেসার রয়েছে। বাকিগুলোতে ছাত সমান উঁচু শেলফে রয়েছে গাদাগাদা বই আর কাগজপত্র।
বই সংগ্রহের বাতিক ছিল, মন্তব্য করল কিশোর।
এটা একটা রোগ, এলেনা বলল। বিশ্বাস কর। আব্বার জন্যে এটা রোগ।
শুধু বইই সংগ্রহ করেননি ডেভিড লিসটার। অনেক ধরনের ট্রফিও রয়েছে। দূরদূরান্তে জাহাজে করে ঘুরে বেড়ানোর প্রমাণ ওগুলো। তুর্কি টুপি, হুকের নল, একজোড়া চামড়ার চটি দেখিয়ে এলেনা বলল, ওগুলো মিশরের বাজার থেকে আনা হয়েছে। আফ্রিকা থেকে এসেছে হাতির দাঁতে খোদাই করা জিনিস। মারাকে থেকে একটা পিতলের ল্যাম্প। পেনসিলের বাক্স আর পুরনো ম্যাগাজিনের পাশে তাকে অগোছাল হয়ে রয়েছে জাহাজ চালনার যন্ত্রপাতি।
কোন জিনিস ফেলে না আব্বা। পরিষ্কার করতেও দেয় না। তার ভয়, কাউকে ঢুকতে দিলেই জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে পালাবে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। তার জন্যে খারাপই লাগল তিন গোয়েন্দার। বাবা আর মেয়ের স্বভাবে অনেক অমিল। আর তার জন্যে নিশ্চয় মনোকষ্টে ভুগতে হয় মেয়েকে। মেয়ে চায় সাফসুতরো থাকতে, আর বাবাটা একদম নোংরা। এলেনার নিজের ঘরটা ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার।
দোতলায় আরও একটা ঘর পরিষ্কার আছে, সেটা কমপিউটার রুম। ধুলো ময়লা সহ্য করতে পারে না ওই যন্ত্র, তাই বাধ্য হয়েই সাফ রাখতে হয়। ঘরটা লিসটারের শোবার ঘরের পাশেই। এয়ারকুলার লাগানো। শাদা দেয়াল। লাল রঙ করা ইস্পাতের ফ্রেমের চেয়ার। আর দুটো কমপিউটার কনসোল রয়েছে ঘরে।
একটা সেট রাখা হয়েছে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে, হোয়েরটা জানাল। বাইরে বেরোতেই চান না মিস্টার লিসটার। যোগাযোগ রাখার জন্যে তাই কমপিউটার ব্যবহার করেন। কর্মচারীদের হুকুম দেন এই যন্ত্রের সাহায্যে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে চান না। কমপিউটারে আরেকটা মস্ত সুবিধে রয়েছে। কেউ আদেশ পালন না করলে কিংবা কাজে ভুল করে ফেললে রেকর্ড থেকে যায়, কোন ভাবেই ফাঁকি আর দিতে পারে না।
গোলমালটা কোনখানে হয়, সেটা আগে খুঁজে বের করতে চায় আব্বা, এলেনা বলল। যাতে খুব তাড়াতাড়ি সেটা মিটিয়ে ফেলা যায়। ঠোঁট কামড়াল। কই, এখানেও তো নেই!
চিলেকোঠা আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
আছে। তাতেও বই, বাক্স আর স্যুভনির। অতীতের সাক্ষি। তবে ডেভিড লিসটার নেই।
ওপরতলায় খোঁজা শেষ। কিশোরের দিকে তাকাল এলেনা। বেশ, বল এবার, কোথায় আব্বা? খুব তো চালাকি জাহির করেছিলে। এখন বল, সে কোথায়?
অনেক সম্ভাবনাই আছে। তবে আপাতত সেসব বলছি না, কিশোর বললো। একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। তিনি হেঁটে বেরিয়ে গেছেন সামনের দরজা দিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে। মেহমানরা আলাপে ব্যস্ত, তাকে দেখতে পায়নি…
বাধা দিল এলেনা। আমার তা মনে হয় না। আমি সিঁড়ির দিকে মুখ করে ছিলাম। নামলে দেখতে পেতামই।
তাহলে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে? অনুমান করল হোয়েরটা। ওখান দিয়ে নেমে সেলারে চলে যেতে পারেন। পেছনের আঙিনায় বেরোতে পারেন। কেউ দেখতে পাবে না।
বালিশ নিয়ে? কিশোরের প্রশ্ন।
বালিশের কথা বার বার কেন বলছো? জিজ্ঞেস করল এলেনা।
কারণ, আমার মনে হচ্ছে ওটা একটা বড় সূত্র।
পেছনের সিঁড়ির কাছে চলে এল ওরা। যে ভবঘুরে লোকটাকে ধোয়ামোছায় সাহায্য করার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছিল সে সিংকে ব্যস্ত।
এই, আমার আব্বাকে এখান দিয়ে যেতে দেখেছ?
এলেনার দিকে ঘুরে তাকাল, লোকটা। বয়েস পঞ্চাশ, এমনকি ষাটও হতে পারে। বয়েসের তুলনায় স্বাস্থ্য বেশ ভাল, শক্তসমর্থ, পেশিবহুল। ডান বাহুতে একটা ড্রাগন আঁকা উল্কি দিয়ে। কিশোরের মনে হল মুখটা বেশি গোমড়া করে রেখেছে লোকটা। শুধু মাথা নেড়ে এলেনার কথার জবাব দিয়ে আবার তার কাজে মন দিল।
ডাইনিং রুম থেকে এল হেনরি বেসিন। কিছু হয়েছে?
আব্বাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
সেলারে খুজল তিন গোয়েন্দা। আছে ভাপসা গন্ধ, পুরনো ট্রাঙ্ক আর মাকড়সার জাল। বেরিয়ে এসে বাড়ির বাইরেটা ঘুরে দেখতে লাগল। বড় বড় ঘাস। ঝোপঝাড়। অযত্ন আর অবহেলার ছাপ সর্বত্র। বাগানে টেবিল পেতে দেয়া। হয়েছে। তাতে বসে খাচ্ছে মেহমানরা। কিন্তু লিসটারকে দেখা গেল না ওদের। মাঝে।
অবশেষে সব জায়গায় খোঁজা হয়ে গেল, আর কোন জায়গা বাকি রইল না।
হু, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল এলেনা। বেরিয়েই চলে গেছে। আমাকে ফেলে, রেখে। আমার বিয়েতে মত ছিল না, তাই ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েছে। যাতে আমি কিছু করতে না পারি। ভেবেছে, এরকম করলে বেকায়দায় পড়ে যাব আমি। এনগেজমেন্ট আর করতে পারব না আজ…
তা না-ও হতে পারে, কিশোর বলল। বালিশের কথা ভুলে যাবেন না। চলে। যাওয়ার ইচ্ছে হলে একজন বয়স্ক লোক বালিশ সঙ্গে নিয়ে যাবেন কেন? সেই গল্পটার কথা মনে হচ্ছে, লিনুস আর কম্বলের কথা। আরেকটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। ধুপ করে একজন মানুষকে পড়ে যেতে শুনেছে মুসা। আর ফায়ারপ্লেসে। আগুন জ্বলারই বা অর্থ কী?
কি অর্থ? ভাবতে লাগল, এলেনা। আর ওই শব্দ…ওটা হতে পারে, তার পরিকল্পনারই একটা অংশ। এরকম সে করতেই পারে। তার কাছে ওটা খেলা। আমাকে রাগানোর চেষ্টা। যাতে মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসি, আর সে সুযোগ পায়।
মাথা নাড়ল কিশোর। তার চেয়ে আরও সহজ যুক্তিতে আসুন না। কারও হাত থেকে বাঁচানর জন্যে কোন একটা জিনিস ফায়ারপ্লেসে পুড়িয়েছেন আপনার আব্ব। আর সেই লোকটাই তাকে ধরে নিয়ে গেছে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে, যাতে চিৎকার করতে না পারেন।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল এলেনা। রক্ত সরে যাচ্ছে মুখ থেকে। তুমি বলছ কিডন্যাপ করা হয়েছে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
পুরো এক মিনিট চুপ করে রইল এলেনা। ভাবল। তারপর বলল, পুলিশকে খবর দেয়া দরকার!
.
০৪.
আপনার বাবা হারিয়ে গেছেন? সত্যি? বড় বড় হয়ে গেল লালচুল মেয়েটার চোখ। মুসাকে গাছ বেয়ে নামতে দেখে মজা পেয়েছিল। এখন এলেনার কথা শুনে অবাক হল।
নিচের হলঘরে ঢুকেছে এলেনা। টেলিফোন রিসিভারে হাত। রকি বীচ পুলিশকে ফোন করেছে।
এটা একটা খেলা, তাই না? লালচুল মেয়েটা বলল আবার। অনেক পার্টিতেই, এরকম খেলা হয়। কেউ একজন খুন হয়ে যাওয়ার ভান করে। অন্যদেরকে তখন বলতে হয় কে খুন করেছে।
আহ, চুপ কর তো, নিনা, বিরক্ত হয়ে বলল এলেনা। এটা খেলা নয়।, কিন্তু মেয়েটা শুনল না। আমাদের বলতে হবে আপনার বাবা কোথায় লুকিয়েছেন, তাই না? কিংবা কে তাকে লুকাতে সাহায্য করেছে। তাই তো? বলতে হবে মোটিভটা কি।
নিনা, তোমার মাথায় গোবর আছে!
মসৃণ চেহারার যে যুবক যাকে কিছুক্ষণ আগে এলেনার সঙ্গে দেখা গিয়েছিল সে বেরিয়ে এল লিভিং রুম থেকে। অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। কিশোর জেনেছে ওই যুবকই এলেনার হবু বর। যাকে মেয়েটা বিয়ে করতে চায়। নাম নিকিনজা ভিশন। একই কলেজে পড়ে দুজনে। ধূসর সিল্ক পরা মহিলা তার মা। বোস্টন থেকে ছেলের সঙ্গে এসেছেন পার্টিতে যোগ দিয়ে এনগেজমেন্টের ঘোষণা শোনার জন্যে।
বিকেলে কিশোর দেখছে, জানালার চৌকাঠে আঙুল ছুঁইয়ে ধুলো পরীক্ষা করছেন মহিলা। ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে খুশি হয়েছেন কিনা কে জানে। লিসটারের মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তার ছেলে, এতেও কতটা খুশি হয়েছেন বোঝার উপায় নেই। কিশোর অন্তত বোঝেনি এখনও।
কোথায় ছিলে? এলেনাকে জিজ্ঞেস করল নিক। সবাই তোমাকে খুঁজছে।
আব্বাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।
ও। কেন? এখনও রাগ পড়েনি? ভুলে যাও ওসব।
কাছেই দাঁড়িয়ে রইল কিশোর, কথা শোনার জন্যে।
কড়া চোখে নিকের দিকে তাকাল এলেনা। দেখ, তুমি পছন্দ কর আর না-ই কর, সে আমার বাবা। লিভিংরুমে এসে ঢুকল সে। চেঁচিয়ে বাদকদেরকে বলল বাজনা থামাতে।
একবার বললে শুনল না। ক্রমেই গলা চড়িয়ে মোট তিনবার বলতে হল। এলেনাকে। পুরোদমে গলা আর বাদ্যযন্ত্রের ওপর গায়ের ঝাল মেটাচ্ছিল যেন। বাদকের দল। অবশেষে শুনতে পেয়ে. থামল।
মেহমানদের দিকে ফিরল এলেনা। আমার আব্বা-আমার আব্বার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন…এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। কেউ দেখেছেন? সিঁড়ি দিয়ে নামতে?
গুঞ্জন উঠল। একে অন্যের দিকে তাকাতে শুরু করল মেহমানেরা। কয়েকজন শ্রাগ করল। কয়েকজনকে মুচকি হাসতে দেখল কিশোর, দৃষ্টিতে ব্যঙ্গ। তবে কথা। বলল না কেউই। ডেভিড লিসটারকে দেখেনি কেউ।
ড্রাইভওয়েতে ইঞ্জিনের শব্দ হল। সামনের দরজায় দেখা দিল দুজন পুলিশ। অফিসার। সরে তাদেরকে ঢোকার জায়গা করে দিল মুসা। এগিয়ে নিয়ে এল। এলেনা আর নিক।
আবার উত্তেজিত গুঞ্জন উঠল মেহমানদের মাঝে। মোটা বয়স্ক একজন লালমুখো মানুষ বেশ জোরেই বলল, বাহ, চমৎকার!
এই পিটার, চুপ, তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে বলল তার পাশে দাঁড়ানো। মহিলা। কি বলবে বুঝতে পেরেছি।
কি বলব? পকেট থেকে চুরুট বের করল পিটার। বুড়ো জলদস্যুটা অবশেষে ধরা পড়তে যাচ্ছে একথা বলতে মানা করছ?
চুপ! সিগারেট খেতে হলে বাইরে গিয়ে খাও। যাও! হাতে হাতব্যাগ, তাই শুধু হাতটা নাড়তে পারল না, ব্যাগসহই নাড়ল। আরেকটু হলেই লোকটার মুখে বাড়ি লাগত।
ধূসর রঙের চুলওয়ালা একজন লোক মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসল। ডেভিড লিসটার জলদস্যু ছিলেন, সত্যি?
এইই, ডোপ, বলল আরেকজন। রিমলেস চশমার পেছনে চকচক করছে তার চোখ, তুমি না তার উকিল? তোমার মুখে এসব মানায় না কিন্তু। বেশ মজাই পাচ্ছে যেন লোকটা।
তুমিও তো তার ম্যানেজার, খোঁচা দিয়ে বলল উকিল, ব্যাপারটা কি। এনথনি? হঠাৎ এত ভদ্র হয়ে গেলে কিভাবে? নাকি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছ?
উকিলের কণ্ঠটা কেমন যেন ভোঁতা লাগল কিশোরের কাছে। অবাক হয়ে ভাবল, অনেক বেশি গিলে ফেলল না তো? মাতাল?
কি বলতে চাও? রেগে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যেন এনথনি।
বলতে চাই, লিসটারের কিছু হয়ে গেলে তোমার তো আর কিছু হবে না। বরং তোমার তখন পোয়া বারো…
ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগল অন্যেরা। কয়েকজন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কান তবু চলেই গেল ওদের কথায়। রুমাল দিয়ে বার বার কপাল মুছতে লাগলেন নিকের মা মিসেস ভিশন। বললেন, নিক, ভীষণ গরমরে এখানে। আমি বাইরে যাচ্ছি।
নিক যেন তার কথা শুনতেই পেল না। বেসিন হাসল। হাসিটা কেমন যেন বাকা। ইতিমধ্যেই মেহমানরা তার বুফের বেশির ভাগটাই সাবার করেছে। কাজেই দরজায় এসে দেখার সুযোগ পেল তরুণ ক্যাটারার, কি নিয়ে এত উত্তেজনা।
সাউথ’স স্পেশালিটি স্টোরের ম্যানেজার ছিলে যখন, ডোপ বলছে। কন্ট্রাকটরদের সঙ্গে তোমার গোপন চুক্তি হত। ভাবছ ভুলে গেছি। পোমোনার ওই নতুন ব্রাঞ্চটা খোলার সময় তো রীতিমত তাদেরই একজন হয়ে গিয়েছিলে তুমি। অবশ্য বেশি টাকার প্রয়োজন হলে আর ওরকম সুযোগ পেলে কে না কাজে লাগায়। বল। কন্ট্রাকটররা তো মানুষকে টাকা দেয়ার জন্যে মুখিয়েই থাকে।
মিথ্যে কথা! প্রায় চিৎকার করে উঠল এথনি। নিজে যেমন অন্যকেও তেমনই ভাবে সবাই। এসব কাণ্ড নিশ্চয় তুমিই করতে, তাই না, ডোপ?
চুপ করে আছে ডোপ। কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসল এন্থনি। স্টক মার্কেটে দ্রুত বেশ কিছু কামিয়ে নিলে, সেটা নিশ্চয় সৎ উপায়ে নয়। ঠিক বলছি না? লিটারের সন্দেহ ছিল, মক্কেলের গচ্ছিত টাকা তাদেরকে না জানিয়ে বিনা অনুমতিতে নিজের ব্যবসায় খাঁটিয়েছ।
থাম! চেঁচিয়ে উঠল ডোপ। চুপ কর!
লিসটারের টাকাও নষ্ট করেছিলে নাকি? ধরা পড়ে গেছ? তার ওপর সে কারণেই রেগেছ… আচমকা থেমে গেল এনথনি। চারপাশে তাকিয়ে যেন এই প্রথম খেয়াল করল ঘরে আরও লোক রয়েছে, তাদের উত্তপ্ত বিতণ্ডা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে।
সিগার ধরিয়েছে যে লোকটা সে ঘড়ির দিকে তাকাল। আরে, এত্তো দেরি হয়ে। গেছে। জোরেই বলল কথাটা। স্পষ্টই বুঝিয়ে দিল, যথেষ্ট হয়েছে, এই বিচ্ছিরি পরিবেশে আর থাকতে চায় না। যাওয়া দরকার। পুলিশ কি বেশি দেরি করবে?
এটা সূচনা। বিরক্ত প্রায় সবাই হয়েছে। হাত মেলাতে শুরু করল বয়স্ক মেহমানেরা। গুডবাই জানিয়ে বিদায় নিতে লাগল। একসাথে লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে। দিন ঠিক করছে দুজন লোক, শুনে ফেলল কিশোর। এলেনার অল্পবয়সী বন্ধুরাও লম্বা জানালা দিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেল, সেখান থেকে হেঁটে বাড়ির বাইরে।
পার্টি শেষ। অধিকাংশ মেহমানই চলে গেছে। বেসিন আর তার সহকারীরা মিলে টেবিলগুলো পরিষ্কার করতে লাগল। টেবিল থেকে গোলাপী রঙের টেবিলক্লথগুলো নিয়ে বাগানে চলে গেল ধোয়ামোছার জন্যে যে লোকটাকে রাখা হয়েছে সে। সেখান থেকে ছোট একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে গেল পেছনের হলঘরে। বারের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকটা খালি বোতল ভরতে লাগল বাক্সে।
ফোল্ডিং চেয়ার আর টেবিলগুলো ভাজ করে বয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে তুলতে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। গিয়ে দেখল, টেবিলক্লথ ঝেড়ে পরিষ্কার করে ভাজ করে বয়ে নিয়ে এসেছে ধোয়ামোছার লোকটা, ট্রাকে তুলছে কাপড়গুলো।
পুলিশের সঙ্গে যখন বেরিয়ে এল এলেনা, তখনও ট্রাকে মাল তোলায় ব্যস্ত তিন গোয়েন্দা। সিঁড়ির দিকে দেখাল মেয়েটা। হোয়েরটাকে সাথে করে উঠে গেল দুই অফিসার। হলের ভেতর দিয়ে লিভিং রুমে চলে এল এলেনা।
উসখুস করছে নিক। যেন এখানে থাকার কথা নয় তার। এলেনা, তুমি ঠিক আছ তো? বলল কোনমতে।
আছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলেনা। বু-বুঝতে পারছি না কি করব। ভয় পাব না। কি করব। আব্বা ইচ্ছে করে একাজ করে থাকতে পারে। পার্টি দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। আমার চাপাচাপিতেই করেছে। মেহমানরা চলে গেলেই এসে ঢুকবে হয়ত, চওড়া হাসি দেবে আমার দিকে তাকিয়ে। তাহলেও ভাল হত। কিন্তু যদি সত্যিই বিপদে পড়ে থাকে?
পুলিশ কি বলে?
কি আর বলবে। তদন্ত করবে। ওরা এখনও ভাবছে না আব্বার খারাপ কিছু হয়েছে। গেছে যে বেশিক্ষণ হয়নি। তাছাড়া খামখেয়ালি মানুষ, শুনেছেই তো। জিজ্ঞেস করেছে আব্বর শত্রু আছে কিনা। তাদের নাম জানি কিনা। কি আর বলব বল। আমার আব্বার শত্রুদের নাম? লস অ্যাঞ্জেলেসের পুরো টেলিফোন ডিরেকটরিটাই দিয়ে দিতে হয় তাহলে!
অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
এগিয়ে আসতে দেখা গেল মিসেস ভিশনকে। মুখে হাসি। যেন সব কিছু ঠিক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর কোন অসুবিধে হবে না, হাসিতেই বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। কাছে এসে বললেন, এলেনা, মা, কিছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে দরকার হলে একটুও দ্বিধা না করে মোটেলে ফোন করো।
থ্যাঙ্ক ইউ, বলল এলেনা।
দস্তানা পরতে শুরু করল্লেন নিকের মা। চমৎকার একটা পার্টি দিলে, সত্যি। বলেই বুঝলেন ভুল করে ফেলেছেন, রুটিন মাফিক সৌজন্য দেখানো অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে চলবে না, শুধরে দেয়ার জন্যে বললেন, মানে হতো আরকি। যদি তোমাদের যাকগে। কিচ্ছু ভাববে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। নিক, আয়। মেয়েটা একা থাকুক কিছুক্ষণ। রেস্ট নিক।
আমি ফোন করব, এলেনাকে কথা দিল নিক।
হ্যাঁ, বিড়বিড় করে বললেন মিসেস ভিশন। অবশ্যই করবে। করতে তো হবেই।
ঘুরে তাকাতেই কিশোরের ওপর চোখ পড়ল এলেনার। কী? কিছু লাগবে?
ইয়ে…মিস লিসটার…আমি দুঃখিত, বলল, কিশোর।
হ্যাঁ, সবাইই দুঃখিত। কিন্তু তাতে আমার কি উপকার হবে?
এই মুহূর্তটার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল কিশোর। পকেট থেকে বের করল তিন গোয়েন্দার কার্ড। বাড়িয়ে দিল এলেনার দিকে। দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল রবিন আর মুসা।
হেসে উঠল এলেনা। তিন গোয়েন্দা! প্রাইভেট ডিটেকটিভ! হাহ হাহ!
তিনজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে। অনেক ধন্যবাদ। গোয়েন্দার দরকার হলে প্রফেশনাল লোককেই ভাড়া করতে পারব আমি, নবিসকে নয়।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিছুটা হতাশই হয়েছে এলেনার আচরণে। যদিও মানুষের এই আচরণ নতুন নয় তার কাছে। তবে একেবারে নিরাশ করেনি তাকে– মেয়েটা। কার্ডটা ফিরিয়ে দেয়নি কিংবা ফেলে দেয়নি। ল্যাম্প রাখা আছে যে টেবিলটায় তার ড্রয়ারে গুঁজে রেখে দিল।
বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। হেনরি বেসিনের গাড়িতে করে চলল। তার দোকানে গিয়ে তার নিজস্ব জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করবে। তারপর ট্রাকটা। নিয়ে চলে যাবে পিকো। ডেকোরেটরের টেবিল চেয়ার আর টেবিলক্লথ ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। বেসিনের দোকান থেকে, তাদের সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরবে ছেলেরা।
ডিনারের পর মুসাদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে, সেটাতে যোগ দিতে হবে। তাকে। তার দাদার জন্মদিনের পার্টি। কিন্তু রবিনের তেমন কোন কাজ নেই। কিশোরের সঙ্গে ইয়ার্ডে যেতে অসুবিধে নেই তার।
বেসিনের ওখানে কাজ সেরে বাড়ি রওনা হল তিন গোয়েন্দা। কিছুদূর এসে মোড় নিয়ে একদিকে চলে গেল মুসা, কিশোর আর রবিন আগের পথেই রইল। চলে এল স্যালভিজ ইয়ার্ডে। ওয়ার্কশপে সাইকেল রেখে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ট্রেলারে ঢুকল, তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার। বিকেলের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনার জন্যে।
তো, কি ভাবছ? কথা শুরু করল রবিন। মিস্টার লিসটার কি সত্যিই পাগল?
খামখেয়ালি তো বটেই। এবং নিষ্ঠুর। একটা বিশেষ ভঙ্গিতে বলল কিশোর। যখন কোন রহস্যের সমাধান খোঁজে কিংবা প্রশ্নের জবাব বের করতে চায় তখন এভাবে কথা বলে সে। নইলে পার্টি থেকে ওরকম করে চলে গিয়ে মেয়েকে অপদস্ত করার কি মানে? পাগল না হলে করে কোন ভদ্রলোক?
একটা প্যাডে আনমনে আঁকতে শুরু করল গোয়েন্দাপ্রধান। পার্টির মেহমানরাও অদ্ভুত। কেমন যেন। শুধু একটা ব্যাপারেই ওদের মিল দেখতে পেলাম, লিসটারকে কেউ পছন্দ করে না। তাদের অনেকেই নিশ্চয় তার কর্মচারী। ওই যে উকিল আর অন্য লোকটার মাঝে বিশ্রী আলোচনা হল..
জঘন্য! মুখ বিকৃত করল রবিন। কোন ভদ্রলোক যে ওভাবে কথা বলতে পারে…তবে এলেনার কলেজের বন্ধুরা কিন্তু ভাল, অন্তত স্বাভাবিক বলা চলে। অবাক ব্যাপারই। ওরকম বদমেজাজী একটা মেয়ের সঙ্গে যে কারও বন্ধুত্ব হয়। বিশ্বাস করা কঠিন।
টেলিফোন বাজল।
তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর। বলুন।
রবিন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে।
ও, কিশোর বলল, তাই!
আরও কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনল। তারপর বলল, বেশ।
রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। এলেনা লিসটার। এখুনি যেতে বলেছে আমাদের। তার বাবাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
.
০৫.
পনের মিনিটের মাথায় লিসটারের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা। কলিং বেল বাজাল কিশোর।
দরজা খুলে দিল এলেনা। পুরনে এখনও সেই নীল পোশাক, পার্টিতে যেটা পরেছিল। তবে এখন আর তেমন ধোপদুরস্ত নেই, কুঁচকে গেছে। হাই-হলিও নেই পায়ে।
টাকার জন্যে নোট পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নীরবে একটুকরো কাগজ কিশোরের হাতে তুলে দিল এলেনা। জোরে জোরে পড়ল গোয়েন্দাপ্রধান, বিশপের বই বদল করলেই শুধু ফেরত আসবে বাবা। পুলিশ ডাকা চলবে না। যা করার জলদি করতে হবে। দেরি করলে ভীষণ বিপদ হবে।
পেন্সিল দিয়ে বড় করে লেখা রয়েছে বিশপ শব্দটা। বাকি শব্দগুলো খবরের কাগজের পাতা থেকে কেটে সাটা হয়েছে।
বিশপ শব্দটা খবরের কাগজে হরহামেশা ছাপা হয় না, এলেনা বলল। সেজন্যেই পায়নি। হাতে লিখতে হয়েছে। খামে করে পাঠায়নি। শুধু কাগজটা। .. পেছনের দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিয়েছে কেউ। তারপর ঘণ্টা বাজিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে।
কিডন্যাপিংই, আপনি শিওর? কিশোরের প্রশ্ন। আজ বিকেলে কিন্তু আপনার সন্দেহ হয়েছিল, আপনার আব্বা পুরো ব্যাপারটা প্ল্যান করেই করেছেন।
নাহ্, আব্বা অতোটা খারাপ নয়। দরজার ঘন্টা বাজিয়ে দৌড়ে পালাতেও পারবে না। ক্ষমতা নেই। জোরে হাঁটতেই কষ্ট হয় ইদানীং। এটা কিডন্যাপিংই। এখন আমাকে বিশপের বই খুঁজে বের করতে হবে। কোন বই ওটা এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার। তোমাদেরকে সেজন্যেই ডেকেছি। বইটা খুঁজতে আমাকে সাহায্য করতে হবে।
নোটটা তুলে ধরল কিশোর। এটার কথা পুলিশকে জানানো উচিত। জানিয়েছেন?
না। তোমরাও বলবে না। কারণ লোকটা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। এ ঝুঁকি আমি নিতে পারব না। এমনকি আমার আব্বার মত বদমেজাজি লোকের জন্যেও না। বিপদে পড়বে। আরও একটা কথা আছে, তার খারাপ কিছু হলে আমারও সাংঘাতিক ক্ষতি। সম্পত্তির একটা কানাকডিও পাব না। উইলে সে রকমই লেখা আছে। যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার, কিংবা গায়েব হয়ে যায়। রহস্যজনকভাবে, তাহলে আমাকে ফকিরের মত ঘাড় ধরে এ বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া আছে। বোঝ এবার, কেমন বাপ আমার। আমার কোন দোষ না থাকলেও বঞ্চিত করা হবে তখন আমাকে।
হু! মাথা দোলাল কিশোর।
চমকে গেলে নাকি? আব্বা সব সময় খারাপ দিকটাই ভাবে, আর আমাকে সন্দেহ করে। আমার তা-ই মনে হয়। ভেবে দেখ, নিজের মেয়েকে অবিশ্বাস করে। নইলে ওরকম উইল লিখতে পারতো? থাক ওসব কথা। এসো, কাজ শুরু করিগে।
ঘুরে সিঁড়ির দিকে রওনা হল এলেনা। তাকে অনুসরণ করল ছেলেরা। মেয়ের মুখে লিসটারের অদ্ভুত চরিত্রের কথা শুনে অবাক হয়েছে।
ওপরের হলঘরে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার লাগান হয়েছে। ছেঁড়া বালিশের পালক যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলেছে এলেনা। তবে পুরোপুরি পারেনি। বিভিন্ন জায়গায় কিছু কিছু রয়ে গেছে এখনও। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। গোয়েন্দাদের। যে কাজ করতে ডাকা হয়েছে ওদের সে কাজে মনোযোগ দিল। ডেভিড লিসটারের শোবার ঘর থেকে শুরু করল বইটা খোঁজা। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বই রয়েছে এখানে। দর্শনশাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্রের মত কঠিন বিষয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পাখি নিয়ে গবেষণার বই। তার পাশাপাশিই রয়েছে হালকা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। অভিধান আছে, আছে মূল্যবান পাথরের ওপর লেখা বই। ঠিক তার কাছেই রয়েছে ডিকেনসের লেখা সুদৃশ্য চামড়ায় বাঁধানো একসেট বই।
এই যে একটা পেলাম, ধুলো পড়া নোংরা মলাটের একটা পেপারব্যাক বই। তুলে ধরল কিশোর। নাম দা বিশপ মারডার কেস। এস. এস. ভ্যান ডাইন-এর লেখা একটা রহস্যকাহিনী।
বইটা নিয়ে হলদেটে পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল এলেনা। দূর! এটার জন্যে কিডন্যাপিঙের মত একটা অপরাধ করবে না কেউ। থাক এটা। খুঁজতে থাক।
নাকে ধুলো ঢুকেছে রবিনের। জোরে হাঁচি দিল। তাক থেকে বই নামিয়ে মলাট দেখছে, নাম পড়ছে, আবার তুলে রেখে দিচ্ছে আগের জায়গায়। বলল, অনেক পড়াশোনা করেন আপনার আব্বা, তাই না?
না, বই দেখে যতটা মনে হয় ততটা না। বই কেনেই শুধু। নেশা। বলে, সময় করে নিয়ে ভালমত পড়তে শুরু করবে একদিন। সব পড়ে শেষ করে। ফেলবে। কিন্তু সেই সময় আর করতে পারে না। কিনেই চলেছে, কিনেই চলেছে, তাকে তুলে রাখছে। নামানো আর হয় না। বইয়ের মালিক হতে পেরেই যেন খুশি। আব্বা। কোন বই কখনও হাতছাড়া করে না, ফেলে দেয়া তো দূরের কথা। শুধু বইই না, কোন জিনিসই ফেলে না।
বড় দেরাজটার দিকে ঘুরল এলেনা। দেখি, এর ভেতরে কি আছে। বিড়বিড় করতে করতে গিয়ে টান দিয়ে ড্রয়ার খুলল সে। কয়েক জোড়া মোজা, একটা মাফলার আর কাগজের বাণ্ডিল। কাগজগুলো বের করে তার ভেতরে বই খুঁজল। খবরের কাগজের কাটিং, ছেলেদেরকে জানাল। একটা প্রেসক্রিপশন। কিছু। ভ্রমণের ব্রশিয়ার।
কাগজগুলো আবার ড্রয়ারে ছুঁড়ে ফেলল সে। কি খুঁজছি জানা থাকলে অনেক সহজ হত। একটা রহস্যোপন্যাস চেয়ে পাঠিয়েছে একথা একদম বিশ্বাস করতে পারছি না। তাও আবার পুরনো।
এটার ব্যাপারে কি মনে হয়? একটা বই তুলে ধরল রবিন। নাম দা ডে লিংকন ওয়াজ শট। লেখকের নাম জিম বিশপ।
মনে হয় না, কিশোর বলল। যাক। তাকে তুলো না। বাইরেই রাখ।
হতে পারে কোন বইয়ের দুর্লভ প্রথম সংস্করণ, আন্দাজ করল এলেনা। কিংবা প্রকাশই হয়নি এমন কোন পাণ্ডুলিপি চায়। নোট কিংবা বৈজ্ঞানিক গবেষণার নথিপত্রও হতে পারে। অথবা কোন লগবুক-অতীতের কোন গোপন ঘটনার কথা লেখা রয়েছে যাতে। সাংঘাতিক মূল্যবান কোন দলিল। কোন। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ইতিহাস। হতে পারে না? কী
সবই খুঁজে দেখব, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
বুককেসগুলো দেখা শেষ করে পুরনো আলমারির তাকে রাখা বাক্স আর ফোল্ডারগুলোর দিকে দৃষ্টি দিল গোয়েন্দারা। ক্যানূসেল করে দেয়া ব্যাংক চেকের বাণ্ডিল দেখতে পেল। পুরনো টেলিফোনের বিল, পোস্টকার্ড কোন কোনটা সুদূর জিব্রালটার আর কায়রো থেকেও এসেছে। সব শাদা। লেখা নেই। বোঝা গেল। চিঠি লেখার জন্যে নয়, স্যুভনির হিসেবে আনা হয়েছে ওগুলো।
তরুণ বয়েসেই সাগর পাড়ি দিয়েছিল আব্বা, এলেনা জানাল। ইনডাস্ট্রির ব্যবসায় ঢোকার অনেক আগের কথা সেটা। ওয়াল স্ট্রীটে তো তার ডাকনামই দিয়ে ফেলা হয়েছে জলদস্যু। হয়ত পাইরেটই ছিল, কে জানে! নইলে একেবারে জিভারো থেকে শুরু করে এতটা ওঠে কিভাবে? শুরু যখন করে একটা ফুটো পয়সা ছিল না পকেটে। লোকে জানে, একথা। কিন্তু দেখতে দেখতে একটা শিপিং লাইনের মালিক হয়ে গেল। কয়েকটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়ে ফেলল। তারপর কিনল একটা পেপার মিল, গোটা তিনেক ব্যাংক। অথচ অতটা চালাক লোক নয় সে, সাংঘাতিক বুদ্ধিমান যে তা-ও নয়।
ততটা খারাপও ভাবতে পারছি না, কিশোর বলল।
এই সময় টেলিফোন বাজল। চমকে উঠল এলেনা। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিছুই বলল না। তারপর চিৎকার করে উঠল, চেষ্টা তো করছি! শোন, কিছু কিছু পেয়েছিও। লাগলে নিয়ে যেতে পার। একটার নাম দা বিশপ মারডার কেস। আরেকটা বইয়ের লেখকের নাম জিম বিশপ…
থেমে গেল সে। ভ্রূকুটি করল। আবার বলল, তোমাকে ঠকানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। শোন, কি খুঁজতে বলছ সেটাই জানি না। জানলে আরে শোন শোন… রিসিভারটা নামিয়ে এনে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে।
কিডন্যাপার? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ। তার ধারণা আমি তার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছি। পুরনো খুনের গল্পের বই চায় না সে। সে চায় বিশপের বই। আর কোন তথ্য না জানিয়েই লাইন কেটে দিল।
গলা শুনে কি মনে হল? রবিনের প্রশ্ন, চিনলেন?
মাথা নাড়ল এলেনা। খসখসে। হয় ঠাণ্ডা লেগেছে, নয়ত মুখে রুমাল দিয়ে নিয়েছিল। যাতে চেনা না যায়। কথায় এক ধরনের টান রয়েছে। তবে বুঝতে পারলাম না কোন দেশের।
আবার গিয়ে দেরাজে খোঁজায় মন দিল এলেনা। শেষ ড্রয়ারটা যখন খোঁজা শেষ করল সে, রবিন আর কিশোর তখন সবগুলো তাক দেখে শেষ করে ফেলেছে। অধৈর্য হয়ে উঠছে তিনজনই। এলেনার খিদে পেয়েছে। নার
ডিনার খাইনি, বলল সে। ফ্রিজেও কিছু নেই। পার্টির জন্যে খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছিল। খুব হিসেব করে। এখন পিজা কিনে এনে খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
চলবে, হাসল রবিন।
রবিন, তুমিও যাও। একটু পনিরটনিরও নিয়ে এসো, কিশোর বলল। আর কোক।
রবিন গেল এলেনার সঙ্গে খাবার কিনতে। কিশোর রয়ে গেল। খোঁজা বন্ধ করল না। পরের বেডরুমটায় রওনা হল সে। চিলেকোঠায় যাওয়ার দরজাটার ওপর চোখ পড়ল।
কি মনে করে টান দিয়ে দরজাটা খুলল সে। সুইচ টিপে সিঁড়ির আলোটা জ্বালল। তারপর উঠতে শুরু করল ওপরে।
এককোণে ঠেলে সরিয়ে রাখা হয়েছে ট্রাঙ্কগুলো। বাক্স আর বুককেস আছে, তবে উপচে পড়ছে না অন্যান্য জায়গার মত। দরজার কাছের তাকগুলো থেকে খোঁজা শুরু করল কিশোর। পাতলা একটা বই টেনে বের করল। নাম দা সিক্রেট অভ টাইপরাইটিং স্পীড। ১৯১৭ সালে লেখা।
বইটা আবার তাকে রেখে দিল। কানে এল নিচে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। রবিন! ডাক দিল সে। তুমি?
জবাব এল না। তাকের দিক থেকে ঘুরে কান পাতল কিশোর। হঠাৎ বুঝতে পারল রবিন কিংবা এলেনা নয়। পিজা নিয়ে এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়। ওদের।
কিন্তু কেউ একজন ঢুকেছে।
আর ডাকল না কিশোর। নড়লও না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদশব্দ শোনা গেল। উঠে আসছে কেউ।
কাপড়ের খসখস শোনা গেল। সিঁড়ির মাথার কাছেই পৌঁছে গেছে বোধহয় লোকটা। ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে।
কিট করে উঠল লাইট সুইচ। চিলেকোঠার আলো নিভে গেল।
হঠাৎ অনেক বেশি অন্ধকার লাগল কিশোরের কাছে। মনে হল যেন চারদিক থেকে চেপে এসে ধরতে চাইছে। বুককেসের কাছ থেকে সরে গেল সে। লুকোতে গেল আরেকটা বুককেসের আড়ালে। কিন্তু তার আগেই গায়ে এসে পড়ল উজ্জ্বল। আলো। টর্চ।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এল আলোক রশ্মি। গায়ের ওপর থেকে সরছে না। ঘরে ঢুকল লোকটা। উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ায় আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। লুকানোর উপায় নেই। বেরোনোর পথ নেই। দরজা আগলে দাঁড়িয়েছে লোকটা।
পিস্তল আছে কি লোকটার হাতে? চোখের ওপর হাত তুলে এনে দেখার চেষ্টা। করল কিশোর। দেখতে পেল না। যা থাকে কপালে ভেবে লাফ দিয়ে এগোল। দা চালানোর মত কোপ মারল লোকটার টর্চ ধরা হাতের কব্জিতে। উফ করে উঠল। লোকটা। টর্চ খসে পড়ল। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙল। গড়িয়ে সরে যাচ্ছে টর্চটা। কয়েকবার মিটমিট করে নিভে গেল আলো। আবার অন্ধকারে ডুবে গেল চিলেকোঠা।
আলো নেই। এবার দুজনেই সমান। অন্ধকারে চলল একে অপরকে পরাজিত করার চেষ্টা। কিশোরের গলা টিপে ধরতে চাইল লোকটা। সরে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। পিছাতে গিয়ে কিসে যেন পা বেধে গেল। উল্টে পড়ত আরেকটু হলেই। সামলাতে কষ্ট হল।
হাত পড়ল তার কাঁধে। ঝাড়া দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল কিশোর। ছাড়ল না তাকে আঙুলগুলো। খামচে ধরেছে। হাতটা খুজছে বোধহয় মুচড়ে ধরার জন্যেই।
আন্দাজে লোকটার চোয়াল সই করে ঘুসি চালাল কিশোর। লাগল না। পেট সই করে হাত চালাল। এবারেও লাগাতে পারল না। জোরে ঠেলা লাগল কাঁধে ] জোর আছে লোকটার গায়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। সামলে নিতে পারত, একটা বাক্সে পা বেধে যাওয়াতেই পড়ে গেল।
নিচে দরজা খোলার শব্দ হল।
কিশোর! ডাক দিয়ে বলল রবিন। এনেছি। এসো।
বিড়বিড় করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। কিছু বুঝতে পারল না কিশোর। অন্ধকারে দরজা দিয়ে প্রায় ছুটে বেরোল রহস্যময় হামলাকারী। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ দুপদাপ করে নেমে চলে গেল।
হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল কিশোর। দৌড় দিল সে-ও। লোকটাকে ধরার জন্যে। দোতলায় পৌঁছে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল পেছনের সিঁড়িতে।
আবার ডাকল রবিন, এই কিশোর! কি হয়েছে?
জবাব না দিয়ে দৌড়ে নামল কিশোর। রান্নাঘরে ঢুকল। দড়াম করে লেগে গেল ঘরের পেছন দিকের দরজাটা। লোকটা বেরিয়ে গেল। ছুটে গিয়ে সে দরজা। খুলে তাকাতে তাকাতে, আঙিনা পার হয়ে গেল হামলাকারী।
.
০৬.
পুলিশকে খবর দিল এলেনা। এসে রিপোর্ট লিখে নিল ওরা। বাড়ির চারপাশে ঝোপগুলোতে খুঁজে দেখল। গ্যারেজে দেখল। তারপর এলেনাকে পরামর্শ দিল, আবার যদি কেউ হামলা করতে আসে নাইন ওয়ান ওয়ানে যেন ফোন করে।
লিসটারের আর কোন খবর আছে কিনা জিজ্ঞেস করল পুলিশ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভয় নেই, অনেকেই ওরকম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, আবার ফিরেও, আসে। র্যানসম নোটটার ব্যাপারে কিছুই বলল না এলেনা। দরজায় দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়িটা চলে যেতে দেখল। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কে ওই লোক? সাধারণ চোর? নাকি কিডন্যাপার? চিন্তায়ই ফেলে দিল।
আমার ধারণা কিডন্যাপার, রবিন বলল। হয়ত বিশপের বইয়ের জন্যে তর সইছে না আর। অস্থির হয়ে নিজেই দেখতে চলে এসেছে।
হয়ত, কিশোর বলল। তবে তার চেয়ে আমাদেরই খুঁজে দেখার সুযোগ বেশি। আমাদের ওপর দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকাই তার জন্যে সুবিধে। একটা ব্যাপার অবশ্য জেনে গেলাম, এ বাড়ির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
ভয় ফুটল এলেনার চোখে। আজ রাতে মায়ের কাছে চলে যাব কিনা ভাবছি। এ বাড়িতে আমি একা থাকতে পারব না।
আপনার আম্মা কি কাছেই থাকেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
সান্তা মনিকায়। আব্বার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। হ্যাঁ, চলেই যাব। কিন্তু…থাকতে পারলেই ভাল হত। আবার ফোন করতে পারে কিডন্যাপার। আমি না থাকলে কথা বলবে কে? কডিকে ফোন করে অবশ্য থাকতে বলতে পারি। আব্বার সেক্রেটারি যখন, এটা তার ডিউটির মধ্যেই পড়ে। কিছু ওভারটাইম দিলেই হবে।
আপনার হবু বর আর তার মা এসে থাকতে পারেন না?
পারত। তবে বোস্টন থেকে নাকি খবর এসেছে, বাড়িতে জরুরী কাজ। আজ রাতেই চলে যেতে হবে ওদেরকে। গুঙিয়ে উঠল এলেনা। নিক অবশ্য থাকতে চেয়েছিল, আমি মানা করে দিয়েছি।
কিশোর বলল, আপনি চাইলে আমি আর রবিন থাকতে পারি।
চোখ মিটমিট করল এলেনা। এমন ভান করতে লাগল এলেনা যেন প্রস্তাবটায় খুশি হয়নি, কিন্তু চেপে রাখতে পারল না। অবশেষে বলল, বেশ। আমি তোমাদের মক্কেল। কাজেই আমার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব এখন তোমাদের। হাসল। তোমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি আসবে না তো?
না। আমাদের এসব অত্যাচার বাড়িতে গা সওয়া হয়ে গেছে। রাতে না ফিরলে এখন আর কিছু মনে করে না। তবে একটা ফোন করে বলে দিতে হবে, বলল কিশোর।
বাসায় বলে দিল কিশোর আর রবিন। এলেনাকে পাহারা দেয়ার জন্যে লিসটারের বাড়িতে রাত কাটাতে অনুমতি মিলল দুজনেরই। ফোন করার পর মনে। পড়ল রবিনের পিজা খাওয়ার কথা। খাওয়া শেষ করে আবার বিশপের বই খোঁজায় মন দিল। দোতলার ঘরে অনেক বই, কাগজপত্র আর স্যুভনির মিলল, ম যেগুলো প্রমাণ করে তরুণ বয়েসে নাবিক ছিলেন লিসটার, সাগরে সাগরে; ঘুরেছেন।
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লেখক ছিলেন আপনার আব্বা, হাতির দাঁতের তৈরি একটা হাতির প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। ভারত থেকে আনা হয়েছে জিনিসটা। দেশে দেশে ঘুরতে নিশ্চয় খুব ভাল লাগত তার।
অ্যাডভেঞ্চারটা তখন করতে হয়েছে পেটের দায়ে, বিষণ্ন কণ্ঠে বলল এলেনা। যেখানে কাজ পেত সেখানেই চলে যেত। তারপর কোন ভাবে কিছু টাকা। জমিয়ে কিনল লিসটার স্টীমশিপ লাইন। পুরনো মরচে পড়া দুটো মালবাহী। জাহাজ, হিউসটন থেকে ক্যারিবিয়ান বন্দরগুলোতে যাতায়াত করত। ওই দুটো লক্কড় মার্কা জাহাজের আয় থেকেই আরেকটু ভাল আরেকটা জাহাজ কিনল। আরও টাকা জমল। ভিজালিয়ায় ছোট একটা ব্যাংক কিনল। ঢুকে পড়ল স্টক মার্কেটে।
আম্মা বলে ওই সময়টাতেই টাকার জন্যে রীতিমত খেপে ওঠে আব্বা। ভাল একটা মানুষ চোখের সামনে পাকা জুয়াড়ি হয়ে গেল যেন, আম্মার কাছে তা-ই। মনে হয়েছে। আসলে আমার মনে হয় আম্মা আব্বাকে বুঝতে পারেনি।
আপনি পারেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।
শ্রাগ করল এলেনা। মনে হয়। অন্তত আর সবার চেয়ে বেশি। মজুতদারী ব্যবসা আরেকটু কম করলেই আমি খুশি হতাম। ওকাজটা আমার ভাল লাগে না। মাল কিনে জমিয়ে রেখে সুযোগ বুঝে ছেড়ে দেয়া। অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাকে আব্বা, তার মধ্যে ওটা একটা। এর জন্যে অবশ্য অনেক সচেতন থাকতে হয়। ভুল করলেই ডুবতে হবে।
আমার পাঁচ বছর বয়েসে আম্মার সঙ্গে আব্বার ডিভোর্স হয়ে যায়। কলেজে যাওয়ার আগে আম্মার কাছেই বেশি থাকতাম। অন্যখানে থাকলেও পরের দিকে প্রায়ই দেখা করতাম আব্বার সঙ্গে। তাকে মনে করিয়ে দিতে চাইতাম যে তার একটা মেয়ে আছে।
দোতলায় খোঁজা শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। গুড নাইট জানিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল এলেনা। ওপর তলার হলঘরে পালা করে পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর আর রবিন। এলেনার কাছাকাছি থাকতে পারবে এতে। সামনে আর পেছনের দিকটায়ও একই সঙ্গে নজর রাখতে পারবে। পা টিপে টিপে এসে হঠাৎ ওদের ওপর হামলা চালাতে পারবে না কেউ।
প্রথম পালা রবিনের। বেডরুম থেকে একটা আর্মচেয়ার এনে একটা কোকের বোতল হাতে নিয়ে আরাম করে বসল।
আলমারি থেকে কম্বল বের করে অব্যবহৃত শোবার ঘরের একটাতে শুয়ে. পড়ল কিশোর। শুরুতে মনে হল ঘুমই আসবে না। সারাদিন অনেক উত্তেজনা। গেছে। সেগুলো ঘুরছে মাথার মধ্যে।
রবিনের ঝাঁকানিতে ঘুম ভাঙল তার। তিনটে বাজে। আমি আর পারছি না। ওঠো। এবার তুমি যাও।
কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সেই জায়গায় ঢুকল রবিন। হুমম! গরম কম্বলের জন্যে ধন্যবাদ।
দুঃখিত। তোমার ধন্যবাদটা নিতে পারলাম না, গোঁ গোঁ করে বলল কিশোর। হলঘরে চলে এল পাহারা দিতে। ঠাণ্ডা লাগছে। বসে পড়ল চেয়ারে। তার মনে হল, রাত তিনটে হল দিনের সব চেয়ে বিষণ্ণতম সময়।
ভোর হতে কতক্ষণ লাগবে জানা আছে, কিন্তু সেই সময়টা কাটবে কি করে। বুঝতে পারছে না।
মাথার ওপরে কি যেন নড়ছে। ওপর দিকে তাকাল। দম বন্ধ করে ফেলেছে। কান খাড়া।
কিছুই না! একেবারে নীরব। পুরনো অদ্ভুত এই বাড়িটা, স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলতে আরম্ভ করেছে। অলীক কল্পনা শুরু হয়ে গেছে তার।
কিন্তু না, কল্পনা নয়। আবার শোনা গেল। খুব হালকা নড়াচড়া। খালি পায়ে চিলেকোঠার মেঝেতে হাটছে যেন। ছোট্ট, হালকা পাতলা শরীরের কোন মানুষ।
কিন্তু ওখানে তো কারও থাকার কথা নয়!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। চিলেকোঠার দরজার সামনে এসে থামল। হাত বাড়িয়ে নব চেপে ধরে মোচড় দিল। আস্তে ঠেলা দিয়ে ফাঁক করল পাল্লা।
অন্ধকার ঘর। আলোর চিহ্নমাত্র নেই। পরিত্যক্ত জায়গার এক ধরনের পুরনো ধুলোটে গন্ধ এসে নাকে লাগছে।
কেউ আছে। সিঁড়ির মাথায়। দেখতে পাচ্ছে না, তবে কাপড়ের মোলায়েম খসখস কানে আসছে। বুঝতে পারছে তাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে মানুষটা, ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে।
তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। মস্ত ভুল করেছে আসার আগে সিঁড়ির আলোটা না জ্বেলে। লোকটার হাতে পিস্তল থাকলে চমৎকার একটা নিশানা হয়ে আছে এখন সে।
যে লোকটা তখন আক্রমণ করেছিল এ কি সেই লোক? যদি হয়, ফিরে এল কেন? ভেতরেই বা ঢুকল কিভাবে? চিলেকোঠায় কি করছে?
পিছিয়ে এসে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর।
কি হয়েছে? কিশোরের পেছনে ফিসফিস করে কথা শোনা গেল।
এমন চমকে উঠল কিশোর যেন গুলি খেয়েছে।
আরে আমি।
এলোমেলো হয়ে আছে রবিনের পোশাক। পায়ে জুতো নেই। বিছানা থেকে সোজা উঠে চলে এসেছে। ছাতের দিকে দেখিয়ে বলল, ওপরে কেউ হাঁটছিল। ফিসফিস করছে এখনও।
তুমিও শুনেছো?
মচ করে উঠল একটা তক্তা। সিঁড়ি থেকে সরে গেছে লোকটা। বাড়ির সামনের দিকে চলেছে।
তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, কিশোর বলল। ওই লোকটা তোমার সামনে দিয়েই গিয়েছিল। আর কোন পথ ছিল না। ঘুমিয়ে ছিলে বলেই দেখতে পাওনি।
একটুও না? জোর দিয়ে বলল রবিন। এক সেকেণ্ডের জন্যেও না। ঘুম তাড়ানোর জন্যে দুবার উঠে পায়চারিও করেছি।
ভুরু কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। যাই হোক, সে ঢুকেছে। জানে সে একা নয়। আমরা রয়েছি। জানে ওখানে কি আছে। আর সেজন্যেই…
এক টান দিয়ে চিলেকোঠার দরজা খুলে ফেলল সে। চেঁচিয়ে বলল, এই, কে কে ওখানে?
জবাব নেই। তবে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।
আবার ডাকল কিশোর।
সাড়া নেই এবারেও।
চিলেকোঠার আলো জ্বালল কিশোর।
না না যেও না! বাধা দিল রবিন। লোকটার কাছে পিস্তল থাকতে পারে!
গুলি করার ইচ্ছে থাকলে এতক্ষণে করে ফেলত। তবে আত্মবিশ্বাসের জোর ততটা নেই।
এক দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। কেউ নেই। শূন্য ঘর। বুককেস, ট্রাঙ্ক আর বাক্সগুলো রয়েছে আগের মতই। কিন্তু কোন মানুষ নেই। চিলেকোঠা থেকে লোকটা সিঁড়িঘরে বেরোনোর আগেই সে উঠে যেতে চায়।
নিরাপদেই পৌঁছল। কিন্তু মানুষ দেখতে পেল না। শূন্য চিলে কোঠা। বুককেস, ট্রাঙ্ক, বাক্স সব আগের মতই রয়েছে। মানুষ নেই।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল সে।
কোন শব্দ নেই।
বেরিয়ে এল আবার সিঁড়িতে। নিচে তাকাল। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
কিছুই নেই, কিশোর জানাল। আমরা…আমরা নিশ্চয় কোন ধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ছিলাম!
আমি বিশ্বাস করি না!
কেউ নেই এখানে। চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। তবে এই সিঁড়ি বাদে আসাযাওয়ার আর কোন পথ যদি থাকে, আলাদা কথা। হ্যাঁ, তা-ই হয়েছে। পুরনো বাড়ি একটা। গোপন পথ থাকতেই পারে। আগের দিনে লোকে গুপ্তপথ তৈরি করে রাখত। এই পথের খবর যে ওখানে উঠেছে সে ছাড়া আর কেউ জানে না।
রবিনের পেছনে হলঘরে এসে ঢুকল এলেনা। পরনের শোবার পোশাকটা দুমড়ে কুঁচকে গেছে। ভারি হয়ে আছে চেহারা। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? কিশোর, ওখানে কি করছো?
এলেনা, মেয়েটার অনুরোধেই তাকে মিস লিসটার বলা বাদ দিয়েছেনকিশোর। এ বাড়িতে কি কোন গোপন পথ আছে? চিলেকোঠায় ওঠা যায়?
জানি না তো?
কোন গুজব শুনেছেন পথটা সম্পর্কে।
মাথা নাড়ল এলেনা। না।
খুঁজতে লাগল কিশোর। বাক্স আর ট্রাঙ্কের পিছনে দেখল। চিমনির কাছের জিনিসপত্র সরাল, যদি কোন গুপ্তদরজা থেকে থাকে ওখানে সে আশায়। রান্নাঘর থেকে একটা টর্চ নিয়ে এল। কাঠের মেঝের শেষ প্রান্তে যেখানে চালু হয়ে। কডিকাঠের ওপর নেমে এসেছে ছাত; সেখানে খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে দেখতে দেখতে সেখানটায় চলে এল। শোবার ঘরের ছাতের কিছুটা জায়গার পাসটার চোখে পড়ে এখান থেকে। তবে বেরোনোর মত কোন পথ নেই। বহু বছরে অনেক ময়লা জমেছে ওখানে। আর এমন টুকিটাকি জিনিস, যেসব ফেলে দিয়ে তারপর ভুলে যায় লোকে। যেমন, একটা পুরনো, গলফ বল, একটা কোকা কোলার বোতল, আর দলা পাকিয়ে ফেলে দেয়া কিছু কাগজ।
চিলেকোঠার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখে তারপর বেরোল কিশোর। নেমে এল নিচের হলঘরে। রবিন আর এলেনা বসে রয়েছে ওখানে।
আশ্চর্য! পথ নেই শুনে বলল রবিন।
সব তোমাদের কল্পনা, বলল এলেনা।
নিজের ঘরে গিয়ে আবার দরজা দিল সে।
শোবার ঘর থেকে গিয়ে কম্বলটা নিয়ে এল রবিন। শরীর মুড়ে বসে পড়ল। কিশোরের আমচেয়ারের পাশে।
শোবে না আর? কিশোর বলল, এখন আমার ডিউটি। চলে যাও।
একা যেতে আর ভাল্লাগছে না। এখানেই থাকি।
বাকি রাতটা ওখানে বসেই কাটাল দুজনে। তাকিয়ে রইল সিঁড়িতে যাওয়ার। পথের দিকে। একটু পর পরই মুখ ভোলে ছাতের দিকে। কান সজাগ এমনি করেই ভোর হল।
আরেক বার পায়ের আওয়াজ শুনল বলে মনে হল রবিনের। তবে এত হালকা, নিশ্চিত হতে পারল না সত্যিই শুনেছে কিনা।
অবশেষে পাতলা ধূসর আলো দেখা দিল জানালায়। সূর্য উঠতে দেরি নেই। শেষ হল দীর্ঘ বিরক্তিকর পাহারার পালা।
হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল কিশোর। তালায় চাবি ঢোকানোর আওয়াজ শুনেছে। নিচতলায়। রান্নাঘরের দরজা খুলল। ওখানে কেউ রয়েছে। যার কাছে চাবি আছে।
একলাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল কিশোর। অস্ত্র। একটা অস্ত্র দরকার। খালি হাতে আর যাবে না।
কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রবিন।
ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে শব্দ করতে মানা করল কিশোর। চুপ থাকতে ইশারা করল। চিলেকোঠার সিঁড়ির দেয়ালে ঝোলানো একটা পিতলের বাসন দেখতে পেয়ে সেটাই খুলে নিল। ভাল কোন অস্ত্র নয়, তবে হাতে একেবারে কিছু না থাকার চেয়ে ভাল।
পেছনের সিঁড়ি ধরে ছুটে নামতে শুরু করল। পেছনে রবিন।
সিঁড়ির গোড়ায় নেমে রান্নাঘরের ভেতরে তাকানোর চেষ্টা করল। রান্নাঘরের। দরজার ওপরের অর্ধেকটা কাঁচের। কিন্তু অন্য পাশে কাপড়ের পর্দা লাগানো থাকায় এপাশ থেকে ভেতরটা দেখা যায় না। দরজা না খুলে ভেতরে কে আছে দেখার উপায় নেই।
সামনে এগোল কিশোর। বাসনটা শক্ত করে ধরল।
মৃদু একটা খটখট শব্দ হচ্ছিল। থেমে গেল সেটা। হাঁ হয়ে খুলে গেল দরজা।
বাড়ি মারার জন্যে বাসন তুলল কিশোর।
.
০৭.
ও বাবা গো!
চিৎকার করে পিছিয়ে গেল ধূসর চুল এক মহিলা। বাসনের বাড়ি থেকে বাঁচানোর জন্যে দুহাত তুলে নিয়ে এল মাথার ওপর।
পাথর হয়ে গেছে যেন কিশোর। একটা সেকেণ্ড জমেই রইল সে, বাসনটা তোেলা। মহিলার হাতের বাজারের থলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল এই মানুষের কাছ থেকে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সরি, বলে বাসনটা নামিয়ে নিল সে।
পুলিশ! আবার চিৎকার করে উঠল মহিলা। বাঁচাও! বলেই ঘুরে দিল দৌড়। গেটের দিকে।
আরে শুনুন শুনুন! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। প্লীজ! এক মিনিট।
শোবার পোশাক পরে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এল এলেনা। মহিলাকে দেখতে পেয়ে সে-ও চেঁচিয়ে ডাকল, মিসেস বেকার, শুনুন শুনুন!
কিশোরের পাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। মহিলা অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই তাকে ধরে ফেলল। শুনুন। ওরা ভাল ছেলে। কিছু করবে না।
ধীরে ধীরে ফিরে এল আবার মহিলা।
রবিন, কিশোর, পরিচয় করিয়ে দিল এলেনা। ও মিসেস বেকার। আমাদের হাউসকীপার। মিসেস বেকার; ওরা আমার বডিগার্ড।
কড়া চোখে গোয়েন্দাদের দিকে তাকাতে লাগল মিসেস বেকার, বিশেষ করে কিশোরের দিকে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। কিশোরের মনে হল বহু বছর পর এত জোরে দৌড়েছে মহিলা।
বডিগার্ড? মহিলার চোখে সন্দেহ। গুপ্তধন পেয়েছ নাকি? বডিগার্ড লাগে কেন? তোমার আব্বই বা কোথায়? তোমার জন্যে তিনিই তো যথেষ্ট। যে কোন মানুষের জন্যেই! শয়তানও কাছে ঘেঁষবে না।
আব্বা নেই। নিরুদ্দেশ। কাল থেকে। কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে।
কিডন্যাপ? বল কি!
ঠিকই বলছি, এলেনা বলল। বাবার রহস্যময় নিরুদ্দেশের কথা খুলে বলল। র্যানসমের নোটটাও দেখাল মিসেস বেকারকে। এরা আমাকে সাহায্য করছে, গোয়েন্দাদের দেখিয়ে বলল সে। বিশপের বই খুঁজছি আমরা। ঈশ্বরই জানেন ওটা কি! ওই নামটা আব্বার মুখে কখনও শুনেছেন?
না, সোজাসাপ্টা জবাব দিল মিসেস বেকার। পাদ্রী-(বিশপ)র সঙ্গে তোমার আব্বার বনিবনা হবে না। কোনদিন হয়েছে বলেও মনে হয় না। তুমি বলতে চাইছ কেউ বাড়িতে ঢুকে, তোমার আব্বাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই নোট পাঠিয়েছে? ফ্যাকাসে ওই ছোকরাটাকে জামাই করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার, তুমি জান। আমারও পছন্দ নয় ছেলেটাকে। পছন্দ করার মত কিছু থাকলে তো করব। তোমার কাছে হেরে গিয়ে ওই পার্টি দেয়াটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে তোমার আব্বার। কিন্তু রাজি তুমি করিয়ে ছেড়েছ। আর দিয়েছ রোববারে, এমন একটা দিনে যেদিন আমার ডিউটি নেই। তোমার বাবা কিডন্যাপ হয়েছেন বলছ? আমার বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয় চলে গেছেন লুকিয়ে, নোট পাঠিয়েছেন তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে। আসলে কায়দা করে তোমার বিয়েটা ঠেকাতে চাইছেন।
না, জোর দিয়ে বলল এলেনা। আমার তা মনে হয় না। নিজে নিজেই চলে গেছে একথা ভেবে চুপ করে থাকতে পারব না আমি। ঝুঁকিটা নেয়া কি ঠিক আপনিই বলুন? কিডন্যাপাররা যদি কোন ক্ষতি করে তার?
মাথা নাড়তে লাগল মিসেস বেকার। বিচ্ছিরি অবস্থা। বাজারের থলেতে হাত ঢুকিয়ে একটা অ্যাপ্রন বের করে আনল। সেটা পরে নিয়ে নাস্তা বানাতে বসল। কথা বলে চলেছে একনাগাড়ে। বাড়ি হল এটা একটা? অভিশাপ আছে এর। ওপর। সব সময়ই খারাপ ঘটনা ঘটছে। বাড়িটা বানিয়েছিল ডিক ব্রাউন নামে এক লোক। আমার পড়শী শেলি টেনারের কাছে শুনেছি এসব। ব্রাউন খুব ধনী লোক ছিল। কিন্তু যেদিন বাড়িটা তৈরি শেষ হল সেদিনই সব কিছু খোয়াল। স্টক মার্কেট ধসে পড়ল, সেটা কবে যেন? হ্যাঁ, উনিশ শো উনত্রিশ সালে। ব্রাউন এখানে। থাকতে আসেনি। বহু বছর খালিই পড়ে রইল বাড়িটা। তারপর, আমি যেই নিউ : ইয়র্কে চলে গেলাম কার্পলি নামের এক পরিবার বাড়িটা কিনল। ওদের কথা মনে আছে আমার। দ্রলোক বেশ বড়সড় শরীরের মানুষ ছিলেন, একদিন পড়ে গেলেন সিঁড়ি থেকে। কোমর ভাঙলেন। জীবনে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। হাটাচলা বাদ।
কার্পলিদের পরে এল মিস হ্যাঁমারসন। বৃদ্ধা। অনেক টাকার মালিক। একা মানুষ। সেজন্যেই বোধ করি তার এক ভাস্তিকে নিয়ে এল। মেয়েটাকে আমি দেখেছি। সুন্দর ছিল খুব। কিন্তু বিষণ্ণ। সারাক্ষণই মন খারাপ করে রাখত। এর জন্যে অবশ্যই মিস হ্যাঁমারসন দায়ী। বেশি কড়াকডি করত মেয়েটার সঙ্গে। ইস্কুল থেকে এসেই রাতের খাবার বানাতে সাহায্য করতে হত ফুফুকে। মিস হ্যাঁমারসন। বলত, কাজ করা ভাল, তাতে আখেরে উন্নতি হয়। চরিত্র ঠিক হয়। আমার বিশ্বাস, চাকরের পয়সা বাঁচাতেই মেয়েটাকে এনেছিল বুড়ি। সাংঘাতিক কিপটে ছিল তো। আহারে, বেচারি মেয়েটার জন্যে খুব কষ্ট হত আমার। ওর বয়েসী ছেলেমেয়েরা যখন খেলত, কিংবা গল্প করত, সে তখন খেটে মরত রান্নাঘরে।
মেয়েটার চোদ্দ বছর বয়েস তখন। একদিন একটা চুলের কাটা হারিয়ে গেল। মিস হ্যাঁমারসনের। দোষ দিয়ে বসল মেয়েটাকে। বলল সে-ই চুরি করেছে। রাগ করে তখন মেয়েটাকে তার বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দিল। শুনেছি, কয়েক বছর পর একটা শয়তান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে মেয়েটা। তার পর যা হয় তা-ই হল। কিছু দিন পর মেয়েটাকে ফেলে রেখে পালাল ছোকরা। শেষ খবর যা জানি, স্যানফ্রানসিসকোয় আছে মেয়েটা। একটা মার্কেটে চাকরি করে।
ডিম, টোস্ট আর ভাজা মাংস এনে টেবিলে সাজিয়ে দিল মিসেস বেকার। এক কাপ কফি খাবার জন্যে নিজেও বসল সবার সঙ্গে।
এ বাড়িতে ভূতের উপদ্রব আছে, শুনেছেন কখনও? কিশোর জিজ্ঞেস করল। এখানে যেসব কাণ্ড হয়েছে তাতে নিশ্চয় অনেক কানাঘুষা করেছে লোকে। গুজব রটেছে।
লোকে তো বলেই, মিসেস বেকার বলল। আর পুরনো বাড়ির ব্যাপারে খামোকাই অনেক কথা বলে, কিছু না থাকলেও। তবে এ বাড়ি সম্পর্কে আমি। তেমন কিছু শুনিনি। কিছু দেখিওনি। বাড়িটা আনলাকি, একথাই শুধু বলতে পারি। আর মাঝে মাঝে, মেঘলা দিনে এমন মনে হয়…মনে হয় কি যেন তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে! লুকিয়ে আমাকে দেখছে। কেন যে এমন লাগে বলতে পারব না। রাতের বেলা আর কিছুতেই থাকতে রাজি নই আমি এখানে।
যত্তোসব ছেঁদো কথা! বিড় বিড় করল এলেনা।
চিলেকোঠায় ঘুরে বেড়ানো কোন কিছুর কথা আপনি শুনেছেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
চিলেকোঠায়? মাথা নাড়ল মিসেস বেকার। নাহ! ওরকম কিছুই শুনিনি, আমি। চিলেকোঠায় কিংবা কোনখানেই কিছু আছে বলে জানি না। শুধু শুধু আমার মনে হয়, আছে.। কোথাও কোন একটা ব্যাপার রয়েছে, ঠিক বুঝতে পারি না।
কফির কাপে ঘন ঘন কয়েকবার চুমুক দিল মিসেস বেকার। গম্ভীর হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গটা বদল করল দুই গোয়েন্দা। মিসেস বেকার তেমন কোন তথ্য দিতে পারল না ওদেরকে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল ওরা, গত রাতের ঘটনাটা এ বাড়িতে নতুন।
নাস্তা শেষ করে, এলেনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল মেরিচাচীর সঙ্গে। কিশোর ভেবেছিল, তাকে দেখলেই নানা কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করবেন তিনি। কিন্তু করলেন না। ফুরসৎ নেই। কাজে ব্যস্ত। প্যাসাডেনায় একটা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে ভোলা হবে। ওটার যত পুরনো জিনিসপত্র আছে সব কিনে নিয়ে এসেছেন রাশেদ পাশা। শুধু তাই নয়, পুরনো ইটও নিয়ে এসেছেন। সুড়কি লেগে রয়েছে। কিশোর আর রবিনকে দেখেই কাজে লাগিয়ে দিলেন মেরিচাচী। ইট পরিষ্কারের কাজ।
মেজাজ খিঁচড়ে গেল কিশোরের। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। মেরিচাচীর মুখের ওপর না বলার সাহস নেই তার। কাজ শেষ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে এল দুজনে। খেতে দিলেন চাচী। স্যাণ্ডউইচ। ডাইনিং রুমে বসে না খেয়ে সেগুলো নিয়ে ওয়ার্কশপে চলে এল ওরা।
বেঞ্চে বসে খাবার চিবুচ্ছে, এই সময় মাথার ওপরের লাল আলোটা জ্বলে নিভে জানান দিল হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ট্রেলারে ঢুকল দুজনে। রিসিভার তুলে নিল কিশোর। ফোন করেছে ডেভিভ লিটারের সেক্রেটারি কডি হোয়েরটা।
এলেনা বলল তোমাকে ফোন করতে। সারা সকাল ধরে সেই রহস্যময় বইটা খুঁজেছি। পাইনি। তখন এলেনা বলল, তার আব্বার কমপিউটারে খোঁজ নিতে। ফাইল দেখলে হয়ত কিছু জানা যাবে। কিন্তু ফাইল বের করার সংকেত জানি না। এলেনা তোমাকে আসতে বলেছে। তার ধারণা, তুমি কিছু করতে পারবে।
রবিনের দিকে ঘুরল কিশোর। রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে হোয়েরটা কি। বলেছে বলল। জিজ্ঞেস করল, যাবে নাকি?
যাব।
হাত সরিয়ে নিয়ে হোয়েরটাকে বলল কিশোর, আমরা আসছি।
বাইরে বেরিয়েই মুসাকে দেখতে পেল ওরা। সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তুলছে সহকারী গোয়েন্দা। লিসটারের বাড়িতে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করল তাকে কিশোর। বলল, এলেনা আমাদের সহ্য করে নিয়েছে।
আমি তাকে পারব কিনা জানি না, মুসা বলল। বাপের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
কিন্তু রবিন আর কিশোর যখন রওনা হল ঠিকই ওদের সঙ্গে চলল সে।
কয়েক মিনিট পরেই লিসটারের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। বেল। বাজাল। মিসেস বেকার খুলে দিল দরজা। এক হাতে একটা স্প্রে, উইনডো। ক্লীনার, আরেক হাতে একমুঠো পেপার টাওয়েল, জানালা পরিষ্কার করছিল বোধহয়। খুশি খুশি গলায় বলল, এদ্দিন পরে সুযোগ পেলাম। সব ময়লা এবার ঝেটিয়ে বিদেয় করব। বুড়োটার জ্বালায় পারতাম না। ছুতেই দিত না কোন কিছু। তোমরা যাও। এলেনা আর কডি কমপিউটার রুমে অপেক্ষা করছে।
ঘুরে সিঁড়ির দিকে রওনা হল মিসেস বেকার। তার পেছনে চলল তিন গোয়েন্দা। সিঁড়ির মাথায় উঠে ইশারায় কমপিউটার রুমের দিকে যেতে বলে নিজে গিয়ে ঢুকল একটা শোবার ঘরে।
দুটো কমপিউটারের মধ্যে যেটা ছোট, সেটার সামনে বসে রয়েছে হোয়েরটা। চাবি টিপছে। প্রতিটি চাপের পর পরই টিইট টিইট শব্দ করছে কমপিউটার।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এলেনা।
এটা আব্বার ব্যক্তিগত কমপিউটার, ছেলেদেরকে জানাল, সে। আব্বার অফিসে যে কমপিউটার সিসটেম রয়েছে তারই একটা অংশ এই বড়টা। তবে ছোটটা একেবারে আলাদা। এটার সঙ্গে কোনটার যোগাযোগ নেই। মডেম নেই, কাজেই বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না এটাতে। সংকেতটা বের করতে পারলেই তার ফাইলগুলো দেখতে পারব। এমনও হতে পারে, বিশপের বই আসলে বইই। নয়, অন্য কোন কিছুর সংকেত। কোড নেম।
মাথা নাড়ল হোয়েরটা। বুই না ছাই। আসলে মিস্টার লিসটারের ওপর ভীষণ রাগ আছে কারও। শোধ তুলছে। তিনি নিখোঁজ হলে অনেকেরই সুবিধে হয়, অনেকেই খুশি হবে। কি জানি কি করেছেন। মাথায় ছিট আছে তো। হয়ত নিজেই বেরিয়ে চলে গেছেন।
উনি তোমার বস! কঠিন কণ্ঠে বলল এলেনা। ভদ্রভাবে কথা বল!
সরি, কীবোর্ডের দিকে ফিরল হোয়েরটা। কর্মচারীদের ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করেন তিনি, তিন গোয়েন্দাকে বলল সে। তাদের অতীত জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, সব। যেহেতু আমি তার সেক্রেটারি, তাই জানি। এসব জানতে হলে গোয়েন্দা লাগাতে হয়। প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর। তাদের বিলগুলো আমাকেই করতে হয়। তবে রিপোর্ট আমাকে দেখতে দেয়া হয় না। সেটা শুধু মিস্টার লিসটারই দেখেন। আমার বিশ্বাস কিছু কিছু কর্মচারীর অতীত এত বেশি গোলমেলে, অফিসের ফাইলে সেগুলো রাখা যায় না। তাই ব্যক্তিগত কমপিউটারে ঢুকিয়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু বিশপের বই? কোন বিশপের সঙ্গে তাঁর আলাপ নেই।
কোড নেম, আবার বলল এলেনা। কোড নেম হতে পারে।
পাসওয়ার্ড নয়, এটা জেনে গেছি, হোয়েরটা বলল। দেখলামই তো টেস্ট করে।
মিনিট খানেক চুপ করে থেকে ভাবল সে। তারপর টাইপ করে লিখল হাসলার
পি এইচ ইউ এস টি এল ই আর, পড়ল মুসা। মানে কি?
হাসলার কি জান না?
আভিধানিক অর্থ জানি। তিনটে মানে হয়। কর্মতৎপর ব্যক্তি, যে লোক তাড়াহুড়ো করে কাজ করে এবং প্রতারক। কোনটা বোঝাতে চাইছেন?
=ভেঙে বলি। ধর ফুটবল খেলতে নামল কোন লোক। তাকে ভালমত চেনে না। অন্য খেলোয়াড়েরা। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। শুরুতে ভাল খেলতে না। পারার অভিনয় করে গেল সে। তারপর সুযোগ বুঝে কায়দা করে গোল দিয়ে। দিল। এমন সময় গোল, যখন প্রতিপক্ষের আর কিছুই করার থাকল না। ওই চালাকি অবশ্য মিস্টার লিসটারও পছন্দ করেন, তাই লিখলাম। চালাক লোক দরকার তার। আর এমন লোক যাদের অতীত রহস্যময়, কোন গোলমাল আছে। ওই ধরনের লোককে খাটানোর সুবিধে, তার দুর্বলতা জানা থাকলে।
আব্বা খুব চালাক, তাই না?
এলেনার কথার জবাব দিল না হোয়েরটা।
টিট টিট করছে কমপিউটার। মনিটরে লেখা উঠলঃ অশুদ্ধ সংকেত। আবার চেষ্টা করুন। এবার স্লাই ফক্স টাইপ করল হোয়েরটা।
আবার টিট টিট করল যন্ত্র। আবার মেসেজ দিল, অশুদ্ধ। আমার বাবা ধূর্ত শেয়াল? তুমি…তুমি একটা শয়তান! চেঁচিয়ে উঠল আচমকা এলেনা। সে জন্যেই এসব লিখছ!
তাহলে বন্ধ করে দেব? শীতল কণ্ঠে বলল হোয়েরটা। কমপিউটারে খোঁজার আইডিয়াটা কিন্তু তোমারই ছিল।
না, থামব না! জানতেই হবে আমাদের। কিন্তু আব্বার অপমান হয় এমন কিছু করতে পারবে না তুমি। ভাল করেই জান ব্যবসাটা তার কাছে একটা মজার খেলা। উঁচু মানের ফুটবল কোচ বলা যায় তাকে। ভীষণ চালাক। তাতে দোষটা কোথায়? চালাক না হলে কি ব্যবসা করা যায়? আর আব্বা চায় সব সময়। জিততে। জেতার জন্যে যা যা দরকার সবই করে।
নীরবে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ঢুলু ঢুলু চোখ, যেন তন্দ্রালু। হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল, খেলা? আপনার আব্বা ব্যবসাটাকে খেলা হিসেবে দেখেন? পাসওয়ার্ডের সূত্র এর মধ্যে নেই তো?
দ্রুত গেম শব্দটা টাইপ করে ফেলল হোয়েরটা। টিইট টিইট করে একঘেয়ে শব্দ করল যন্ত্র।
নানা রকম খেলা চালিয়ে যান, রবিন পরামর্শ দিল। ফুটবল দিয়ে শুরু করুন।
ফুটবল দিয়ে লাভ হল না। বেজবল, বাস্কেট বল, হকি, কোনটা দিয়েই নয়।
খেলাধুলায় বিশেষ আগ্রহ ছিল না আব্বার, এলেনা বলল। অন্য কিছু দিয়ে। চেষ্টা করা যাক।
একচেটিয়া ব্যবসা করার খুব আগ্রহ, হোয়েরটা বলল। মনোপলি লিখে দেখা যাক।
তাতেও সুবিধে হল না।
পোকার লিখে দেখুন তো, মুসা বলল।
একে একে পোকার, জিন রামি, পিনোকল, ব্ল্যাকজ্যাক, সব কিছু দিয়েই দেখা হল। নিরাশ করল কমপিউটার।
তাসের নাম দেয়া শুরু করি, বলে এস লিখল হোয়েরটা। তারপর কিং। সেই একই অবস্থা। কোন মেসেজ দিতে পারল না যন্ত্র। কিন্তু যেই জোকার লেখা হল, অন্য মেসেজ দেখা দিল স্ক্রীনে। আসুন, আমরা খেলা করি! আমন্ত্রণ জানাল, কমপিউটার।
খাইছে! বলে উঠল মুসা।
কমপিউটারকে একটা নির্দেশ দিল হোয়েরটা।
নামের একটা লম্বা তালিকা ফুটে উঠল মনিটরে। ডোপের ওপর একটা ফাইল খুলেছেন লিসটার। এনথনির নামেও আছে একটা। ভিজালিয়া ব্যাংকের ম্যানেজার। আর বড় বড় অফিসারদের নাম চিনতে পারল হোয়েরটা। আরও অনেক নাম, এমনকি হাউসকীপার মিসেস বেকারের নামও রয়েছে ফাইলে।
আরেকটা ফাইল দেখা গেল কডি হোয়েরটার নামে।
আপনাকেও বাদ দেননি, মুচকি হাসল রবিন।
আড়চোখে সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে কিশোর দেখতে পেল হোয়েরটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এলেনারও নজর এড়াল না সেটা। আপনার ফাইলে কি আছে?
সাধারণত যা থাকে, কোনমতে বলল হোয়েরটা। বয়েস, শিক্ষা, এসব।
দেখি তো, খসখসে হয়ে গেছে এলেনার কণ্ঠ।
এলেনা, আমার ফাইল দেখে….
আমি দেখব!
শ্রাগ করল হোয়েরটা। একটা চাবি টিপল। লিস্টে তার নামের কাছে চলে এল কারসরটা। আরেকটা চাবি টিপল সে। মিলিয়ে গেল নামের তালিকা। পর্দায় ফুটল কডি হোয়েরটা। তার পরে দেখা দিলঃ আসল নাম আরনি ভিনসেনজো। বাবার নাম কার্লো ভিনসেনজো। আমাকে কিছু করার তালে আছে মনে হয়। আরও কিছুদিন কাছাকাছি রাখব। কর্মঠ লোক। আমার ভয়ে যখন কাপে, দরদর করে ঘামে, দেখতে খুব ভাল লাগে আমার।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হোয়েরটা। কমপিউটারের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাচ্ছি! আর কখনও ফিরব না!
.
০৮.
সর্বনাশ! গলার কাছে হাত নিয়ে গেল এলেনা। কার্লো ভিনসেনজোর ছেলে কডি! সে-ই! কিডন্যাপ সে-ই করেছে।
একটা ভুরু উঁচু করল কিশোর। সহায়তা করে থাকতে পারে। তবে সে নিজে কিডন্যাপটা করেনি। সারাক্ষণ পার্টিতে ছিল, মনে আছে? আর সহায়তাইবা করবে কেন? কার্লো ভিনসেনজোই বা কে?
একজন লোক…ওয়েস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন টায়ার ব্যবসায়ী। যে জায়গাটায় তার দোকান সে জায়গাটা আব্বার খুব পছন্দ। অফিসের জন্যে একটা। বহুতল বাড়ি বানাতে চায় ওখানে। অনেক টাকার অফার দিয়েছে আব্বা, বিক্রি করতে রাজি হয়নি ভিনসেনজো। তখন তার দোকানের পাশে আরেকটা টায়ারের দোকান দিয়েছে আব্বা। শস্তায় ভাল জিনিস বিক্রি করছে। তাতে তার লস হলেও কেয়ার করছে না। আসলে ভিনসেনজোর ব্যবসা খারাপ করে দিয়ে তাকে ওখান থেকে তোলার জন্যেই একাজ করেছে আব্বা। টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। ভিনসেনজো। কম দামে টায়ার দেয়ার চেষ্টা করেছে। আব্বার সঙ্গে পারেনি, লস দেয়ার মত এত টাকা তার নেই। ছয় মাসের মধ্যেই কাবু হয়ে গেছে বেচারা।
কাজেই তার ছেলে ছদ্ম নামে চাকরি নিয়েছে এখানে, এলেনার কথার খেই ধরল রবিন। আপনার আব্বার ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু তার আগেই আপনার আব্বা জেনে গেছেন হোয়েরটার আসল পরিচয়। হোয়েরটা কি করে ভাবতে পারল। যে লোক অন্যের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্যে গোয়েন্দা লাগান, তার বিরুদ্ধে সে। কিছু করতে পারবে?
হয়ত ভেবেছে তার কভার স্টোরি এত ভাল যে গোয়েন্দাকে বোকা বানিয়ে দিতে পারবে, কিশোর বলল। কীবোর্ডের সামনে বসে পড়ল। কডি হোয়েরটার ফাইলের ফুল প্রিন্ট দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে। জীবন্ত হয়ে উঠল প্রিন্টার। কটকট কটকট করে আধ মিনিটের মধ্যেই বের করে দিল হোয়েরটার ফাইল। বের করে নিয়ে জোরে জোরে পড়ল কিশোর, সবাইকে শোনানোর জন্যে।
চাকরির দরখাস্তে যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর ব্যবহার করেছে হোয়েরটা, সেটা তার হাই স্কুলের এক বন্ধুর। রুটিন চেক করে কিছু পাওয়া যায়নি। তারপর গোয়েন্দা লাগিয়েছেন লিসটার। জেনেছেন, কাজের শেষে ওশন পার্কে ভিনসেনজোর বাড়িতে রোজ যায় হোয়েরটা। প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নিয়েছে গোয়েন্দা। বীমার দালাল পরিচয় দিয়ে। সত্যি কথাগুলো জেনে এসেছে।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন। কিডন্যাপের একটা মোটিভ দেখা যাচ্ছে। লোকটাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না এতবড় একটা অপরাধ করতে পারে।
তা অবশ্য হয় না, একমত হল এলেনা। আর এই বিশপের বই…এটার মাখামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কডি হোয়েরটা:নাহ, আমার ভাল লাগছে না!
বড় কমপিউটারের সামনে বসে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করে কপাল টিপে ধরল। কডি একাজ করেছে একথা বিশ্বাসই করতে পারছি না। করেওনি। তাহলে। এই কমপিউটারটা নষ্ট করে দিতই, যাতে তার নাম না জানতে পারি। নাহ, সে করেনি। অন্য কারও কাজ।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ও-কে। আরও কিছু ফাইল দেখা যাক। মিরহাম এনথনির ফাইলটার জন্যে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে।
শুরুতে এনথনির ওপরও রুটিন চেক করা হয়েছে। বিয়ে করেছিল, স্ত্রী মারা গেছে। ছেলেমেয়ে নেই। সার্চন্ট এলাকার একটা বাড়িতে বাস করে। ডি. এল. ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ম্যানেজারের পদটা নেয়ার আগে অন্য মালিকের আরেকটা স্টোরের ডিরেক্টর অভ অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছে। লিসটারের স্টোরটা সান্তা মনিকায়।
খানিক পরেই এনথনির ডোসিয়ার আর সাধারণ রুটিন চেকের আওতায় থাকল না। আরও গভীরে ঢুকতে লাগল। একবার গ্রেফতার হয়েছে। একটা বীমা কোম্পানিতে জালিয়াতির অভিযোগে। একটা বাড়ির মালিক ছিল সে। আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার পর বীমা কোম্পানি সন্দেহ করে বসল এতে এনথনির হাত রয়েছে। অ্যারেস্ট করা হলেও পরে তাকে সসম্মানে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ, কারণ কোম্পানি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তারপর। প্রথম স্টোরটায় চাকরি নিল এনথনি। সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। আছে। সরাসরি কেউ কিছু বলেনি। তবে কানাঘুষা হয়েছে, কন্ট্রাকটর আর। সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে ঘুষ নিত সে।
ফাইলের শেষে দুটো শব্দে, খুব বাজে একটা মন্তব্য পেশ করা হয়েছেঃ উইমেন-চেজার। অর্থাৎ মহিলাদের পেছনে লাগার বদস্বভাব আছে।
লিটারের উকিল ডোপের ডোসিয়ারও কম মজার নয়। ডোপ ছিল একজন। জুয়াড়ি। রেসের খেলা আর পোকারে আসক্ত। স্টক মার্কেটেও বেশ বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছে। লিসটারের সন্দেহ জরুরী কাজে খরচের জন্যে যে ফাণ্ড রাখা আছে তার কাছে সেটা থেকে সে নিজের প্রয়োজনে খরচ করে। বার অ্যাসোসিয়েশনে। যোগাযোগ করে তার অ্যাকাউন্ট চেক করানোরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। এক হুমকিতেই কাজ হয়ে গেছে বলে লিটারের ধারণা।
ভিজালিয়া ব্যাংকের ম্যানেজারের ফাইল বলছে, ডোপ নেভিতে ছিল আগে। সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তাকে, কি একটা অপরাধ করেছিল বলে। লিসটার যে একথা জেনেছেন, সেটা আবার জানিয়ে দিয়েছেন ম্যানেজারকে।
ফাইলের পর ফাইল দেখে চলল কিশোর। একের পর এক মজার তথ্য উঠে আসছে মনিটরের পর্দায়। মিসেস বেকারেরও একটা বড় রকমের দোষ রয়েছে। প্রতি হপ্তায়ই একটা বিশেষ জায়গায় জুয়া খেলতে যায়। নেশা হয়ে গেছে সেটা।
এসব দেখে কোন লাভ হবে না আমাদের, এলেনা বলল অবশেষে। এখানে। এমন একদল লোকের ডোসিয়ার যারা আব্বাকে দুচোখে দেখতে পারে না। ঘৃণা করে। তার কোন বন্ধু নেই। ভাবতেই খারাপ লাগছে আমার। লোকের ব্যক্তিগত জীবন ঘাটাঘাটি করেছে, এটাও ভাল্লাগছে না আমার।
কেঁদে ফেলবে যেন সে। এই একটি বার বাবার পক্ষে সাফাই গাইছে না।
কিশোরকেও স্বীকার করতে হল, এই সব গোপন ফাইল আসল কাজের কোন সাহায্য করছে না। প্রত্যেকেরই মোটিভ রয়েছে লিসটারের ক্ষতি করার। কিন্তু কোন একজন বিশেষ মানুষ বেরিয়ে আসছে না যাকে সন্দেহ করা যায়। সবাইকেই করা যায়, আবার কাউকেই করা যায় না।
আর একটা ফাইল আছে, বলল সে। এটাও দেখার দরকার। ফাইলটার। নাম মুজের/ভিয়েজা। স্প্যানিশ এই শব্দের মানে বৃদ্ধা মহিলা।
বাহ, ভাল কথা, মুসা বলল। হয়ত মিসেস বেকারের সম্পর্কে আরও কিছু লেখা রয়েছে। তার দুর্বলতা যাতে প্রকাশ না হয় সে জন্যে মিস্টার লিসটারকে গায়েব করে দিয়েছে।
কিন্তু আবার ফেরত দেবেও বলেছে, মনে করিয়ে দিল রবিন। বিশপের বইটা দিলে। প্রতিশোধ বলতে পার। দুর্বলতা ঢাকা দেয়ার জন্যে কিডন্যাপটা করেনি।
ওদের কথা শুনছে না কিশোর। আনমনেই বলল, মিসেস বেকারের ফাইল স্প্যানিশে লেখা থাকবে কেন? চাবি টিপে ফাইলটা কল করল সে।
অন্য ফাইলের চেয়ে এটা আলাদা। একটা চিঠি। এলেনাকে লেখাঃ
সোগামোসোকে দিয়ে শুরু কর। বৃদ্ধা মহিলার কাছে যাও। মধ্যগ্রীষ্মের দিনে সূর্যাস্তের সময় তার ছায়া স্পর্শ করে ঈশ্বরের অশ্রুকে। সব তোমার জন্যে। তবে সিয়েটার ব্যাপারে সাবধান থেক। সে কি লিগাল? চেক ইনস।
চমৎকার, এতক্ষণে খুশি হল কিশোর। চিঠিটার একটা প্রিন্ট আউট বের করে দিতে নির্দেশ দিল কমপিউটারকে। কাগজের ওপর ছোটাছুটি শুরু করল প্রিন্ট হেড। এই সুযোগে এলেনার দিকে তাকাল সে। চোখে জিজ্ঞাসা।
মাথা নাড়ল এলেনা।
কিছুই বুঝতে পারছেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
একটা বর্ণও না।
সিয়েটার ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। বলেই সরাসরি এলেনার চোখের দিকে তাকাল কিশোর। তাকে চেনেন?
শ্রাগ করল এলেনা। আব্বার আরেক ফেরেশতা হবে হয়ত। কর্মচারী। ব্যবসার সহযোগীও হতে পারে। পার্টিতে কোন সিয়েটাকে আসতে দেখিনি। মারাত্মক কিছু শত্রুকে মনে হচ্ছে দাওয়াত থেকে বাদই দিয়েছিল আব্বা।
কাঁদতে শুরু করল এলেনা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। মোছার চেষ্টা করল না সে।
ঠিক আছে, কিশোর বলল। আর কোথাও কোন সূত্র আছে কিনা দেখা দরকার।
টেবিলের ড্রয়ার ঘাটতে শুরু করল সে। রবিনও তাকে সাহায্য করল। একটা ছোট নোটবুক পেয়ে তুলে, দেখাল। অ্যাড্রেস বুক। অনেক ঠিকানা আছে। হাতে লেখা।
প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রতিটা ঠিকানা খুঁটিয়ে দেখা হল, কিন্তু কোন সিয়েটাকে পাওয়া গেল না।
আম্মা হয়ত জানতে পারে, এলেনা বলল। সামলে নিয়েছে। ইদানীং আর আব্বার সঙ্গে দেখা হয় না তার, কথাও হয় না। তবে অনেক পুরনো কেউ হতে পারে, একসাথে যখন ছিল দুজনে তখনকার কোন সিয়েটা থাকতেও পারে।
ফোন করে জিজ্ঞেস করবেন? মুসা জানতে চাইল।
ইয়ে…তাতেও সমস্যা আছে। আম্মা রেগে আছে আমার ওপর। এখানে। আসাটা একদম পছন্দ নয় তার। আমার হবু বরকেও দেখতে পারে না।…যাই হোক, চেষ্টা করে দেখি।
রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করল এলেনা। ওপাশের কথা শুনে কানের কাছ থেকে সরিয়ে এনে বলল, ঘরে নেই। জবাব দিচ্ছে অ্যানসারিং মেশিন। রিসিভারে কিচকিচ শুনে তাড়াতাড়ি আবার কানে ঠেকাল সে। কে? আম্মা? কোথায় গিয়েছিলে? আমি। আম্মা, শান, আব্বাকে মনে হয় কিডন্যাপ করা হয়েছে। তিনটে ছেলে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ওরা তিন গোয়েন্দা, কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কথা বলবে?…আচ্ছা।…কিছু জানা থাকলে ওদেরকে বলে দিও। আমি চলে আসতাম তোমার কাছে, কিন্তু আব্বা বাড়িতে নেই। খালি ফেলে যেতেও পারছি না। আব্বার ব্যাপারটা ফয়সালা হলেই চলে আসব।
মাকে গুড বাই জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল এলেনা। যেতে পার। আমার আম্মা খুব ভাল। সবাইকেই সাধ্যমত সাহায্য করে।
যতগুলো প্রিন্ট আউট বের করেছে, সব একখানে করল কিশোর। মায়ের ঠিকানা লিখে দিল এলেনা। সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ঠিক হল, মুসা থাকবে এ বাড়িতে। বাকি দিনটা। রাতটাও। মিসেস বেকার রাতে থাকে না, বাড়ি চলে যায়। তার স্বামী আছে। রবিন বাড়িতে যাবে, কিছু জরুরী কাজ আছে। সেখান থেকে মিউজিকের অফিসে গিয়ে টু মেরে দেখে আসবে একবার কি পরিস্থিতি। রকি বীচ লাইব্রেরিতে যাবে। অনেক দিন যায় না ওখানে। অথচ কত বছর কাজ করেছে। সময় পেয়েছে যখন লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দেখা করে আসবে। আরও মা একটা কারণ আছে লাইব্রেরিতে যাওয়ার। রেফারেন্স বইতে সোগামোসো খুজবে।
সিয়েটার রেফারেন্স খোঁজার বোধহয় কোন প্রয়োজন নেই, কিশোরকে বলল সে। লস অ্যাঞ্জেলেসের ফোন বুকে ওই নামের অভাব নেই। তবে সোগামোসোটা সাধারণ নাম নয়। এই রহস্য ভেদের শুরু এটা দিয়েও হতে পারে।
কোন লোকের নাম না-ও হতে পারে এটা, কিশোর বলল। কোন জায়গা। কিংবা কোম্পানির নাম হলে অবাক হব না।
কিশোর যাবে এলেনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এলেনা আর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হল সে। সাইকেল নিয়ে চলল সান্তা মনিকায়। এই আরেকবার আফসোস হতে লাগল একটা গাড়ি নেই বলে। ভাল জিনিস ছাড়া তার মন ভরে না। আর ভাল কিনতে হলে নতুন দরকার। এত টাকা নেই। পুরনো ভাল জিনিস কে খুঁজে দেবে? মুসা তো কথা কানেই তোলে না। নিকভাইটারও দেখা নেই…
নির্জন একটা রাস্তার ধারে ভদ্রমহিলার বাড়ি। একতলা। লিসটারের বাড়ির ঠিক উল্টো। নতুন রং করা। ঝকঝকে তকতকে। সুন্দর বাগান। সবুজ লন। পায়ে চলা যে পথটা চলে গেছে বাড়ির দরজায়, সেটাতে একটা কুটোও, পড়ে নেই। দিনে অনেকবার করে ঝাট দেয়া হয়, বোঝা যায়।
ঘন্টা বাজাতেই খুলে দিলেন, এলেনার মা। সুন্দর চেহারা। কফি রঙের চুল। একই রঙের চোখ। মোটাই বলতে হবে তাকে। তবে চামড়া বেশ মসৃণ, কোথাও একটা ভাজ নেই। ডেভিড লিসটারের চেয়ে বয়স অনেক কম।
তুমি নিশ্চয় তিন গোয়েন্দার একজন, বললেন তিনি। বেরোতে হবে। বেশি। সময় দিতে পারব না, তোমাকে। এসো।
হলঘরের ভেতর দিয়ে কিশোরকে লিভিং রুমে নিয়ে এলেন মহিলা। নরম সবুজ কার্পেট। সোফা আর অন্যান্য আসবাবপত্রের কভার শাদা মখমলের তৈরি।
ফায়ারপ্লেসের কাছে বড় একটা চেয়ারে বসলেন ভদ্রমহিলা। কিশোর বসল। সোফায়। এলেনা ভাল আছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। সত্যি বল তো, ও আসছে না কেন?
ফোন করে খবর জানতে চাইতে পারে কিডন্যাপার, জবাব দিল কিশোর। সে জন্যে রয়ে গেছে।
আমারও ওখানে যাওয়া উচিত, কিন্তু ভাল লাগে না। ওই বাড়িটাকে দেখলেই রাগ হয় আমার, ঘৃণা করি। ওখানে ঢোকার পর থেকে অশান্তি শুরু হল। আমাদের। তার আগে ভালই ছিলাম।…এলেনা কি একা রয়েছে?
না। আমার বন্ধু মুসা রয়েছে তার সঙ্গে।
তোমার বন্ধু? নিশ্চয় তোমারই বয়েসী। পুলিশ কোথায়? এরকম। পরিস্থিতিতে ওদেরকে দরকার। একটা ছেলে আর কতটা সাহায্য করতে পারবে। এলেনাকে।
বয়েস অল্প, কিন্তু কোন বয়স্ক লোকের চেয়ে কম নয় মুসা। কারাত জানে। গুলি চালাতে পারে। দুচারজনকে খালি হাতেই পিটিয়ে তক্তা করে দিতে পারে। পুলিশকে খবর দিতে মানা করেছে কিডন্যাপার। হুঁশিয়ার করে দিয়েছে তাহলে মিস্টার লিসটারের ক্ষতি করবে। বিশপের বইটা দিলেই তাকে ছেড়ে দেবে। বলেছে।
বিশপের বই? সামনে ঝুঁকলেন ভদ্রমহিলা। কিশোরের মনে হল অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন তিনি। যেন কোন শব্দ শুনে কান খাড়া করেছেন। অপেক্ষা করছেন আবার শোনার আশায়।
কিশোরও কান পাতল। কিছুই শুনল না। বাড়িটা বেশি নীরব।
বিশপের বই সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?
মাথা নাড়লেন ভদ্র মহিলা। না। কিছুই জানি না। আজকাল ডেভিড কি করছে না করছে কোন খোঁজই রাখি না আমি। এ জন্যেই কি দেখা করতে এসেছ? বইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে? হাজার হাজার বই আছে ডেভিডের। ওগুলো দেখেছ?
দেখেছি। কিডন্যাপার যেটা খুঁজছে সেটা পাইনি। আপনি সিয়েটা নামে কাউকে চেনেন? আর সোগামোসো?
সোগা-কি?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
আমি খুব একটা সাহায্য করতে পারছি না, তাই না? বললেন ভদ্রমহিলা। সরি। জানলে অবশ্যই বলতাম। আবার বল তো নামটা। সিয়েটা বাদে আরেকটার কথা যেটা বললে?
সোগামোসো।
মাথা নাড়লেন তিনি। সরি।
মিস্টার লিসটারকে কি কখনও বৃদ্ধা মহিলার কথা বলতে শুনেছেন? স্প্যানিশে ওটার মানে মুজের ভিয়েজা।
বলতে পারলেন না তিনি। ঈশ্বরের অশ্রুর কথাও তিনি কিছু জানেন না। দ্রুত জবাব সারছেন। কিশোর চলে গেলেই খুশি হন।
ঈশ্বরের অশ্রু বেশ কাব্য করে বলা হয়েছে, বললেন তিনি। কিন্তু ডেভিড। কবিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সরি, আমি কিছুই বলতে পারব না। আইলিন লিসটারে খোঁজ নিয়েছ? অনেক সময় ওখানে জিনিস রাখে ডেভিড।
আইলিন লিসটার?
ওর ইয়টের নাম। আমার আর ডেভিডের নামে জাহাজটার নাম রেখেছে ও। ওটা কেনার সময় সম্পর্ক ভালোই ছিল আমাদের।
উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। যেতে হবে এবার, সে কথা আর মুখ ফুটে বলতে হল না কিশোরকে। সে-ও উঠল। মহিলার পিছু পিছু চলে এল দরজার কাছে। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, যদি কিছু মনে পড়ে আপনার, আমাদের তদন্তে সাহায্য হবে ভাবেন, তাহলে দয়া করে এই নাম্বারে ফোন করবেন।
করবেন, বললেন তিনি। বেরিয়ে এল কিশোর।
মোড়ের কাছে এসে থামতে হল তাকে। একটা বাসকে সরে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যে। পেছন ফিরে তাকাল একবার, এলেনার মায়ের বাড়ির দিকে।
গাঁট্টাগোট্টা একজন লোক বেরিয়ে আসছে পায়েচলা পথ ধরে বড় রাস্তার দিকে। লোকটাকে আগে দেখেছে কিশোর। লিসটারের বাড়িতে। এলেনার পার্টির একজন মেহমান ছিল ওই লোক।
এনথনি! বিড়বিড় করল বিস্মিত কিশোর।
লিসটারকে সরিয়ে দেয়ার যথেষ্ট মোটিভ রয়েছে লোকটার। ও বাড়িতে কি করছে সে? কিশোর যখন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল তখন নিশ্চয় সে বাড়িতে ছিল ও। দুজনের কথা নিশ্চয় শুনেছে। কল্পনায় দেখতে পেল কিশোর, রান্নাঘরে ঝুঁকে রয়েছে লোকটা, দরজায় কান পেতে।
এ কারণেই উত্তেজিত হয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা। বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়া করে বের করে দিতে চেয়েছিলেন কিশোরকে। বাইরে যাওয়ার কথা নয় তার। ঘরে লোক রেখে বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ব্যাপারটা কি? এলেনার মা আর এনথনি মিলে ষড়যন্ত্র করেছে? মহিলার চেহারা দেখে মনেই হয় না এরকম একটা অপরাধ করতে পারেন। তবে বলা যায় না কিছুই। অপরাধ জগৎ এমনই একটা জগৎ, যেখানে যা খুশি ঘটতে পারে। চেহারা কোন ব্যাপার নয়। যেটা অসম্ভব বলে মনে হয়, সেটাই ঘটে যেতে পারে।
রাস্তা পেরোল এনথনি। কিছুদূরে পার্ক করে রাখা একটা গাড়িতে গিয়ে উঠল। জ্বলে উঠল ব্রেক লাইট। একজস্ট পাইপ থেকে এক ঝলক ধোয়া বেরোল। চলতে শুরু করল গাড়িটা।
সাইকেল ঘোরাল কিশোর। পিছু নিল গাড়িটার। দুশো গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করে চলল। পায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডাল করছে, যতোটা জোরে সম্ভব ঘোরাতে চাইছে চাকা।
.
০৯.
যে সময় আসবে আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক পরে লাইব্রেরিতে আসতে পারল রবিন। কোনখান থেকে খোঁজা শুরু করবে?–ঢুকেই ভাবল। টেলিফোন ডিরেক্টরির কথা প্রথমেই বাদ দিয়ে দিল। লাভ হবে না। তবু একবার চোখ বোলাতে অসুবিধে কি?
লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করে এল প্রথমে। তারপর ডিরেক্টরিটা দেখতে বসল। লস অ্যাঞ্জেলেস টেলিফোন বুকে সিয়েটার অভাব নেই। তবে একটা সোগামোসোও চোখে পড়ল না।
লিসটারের কমপিউটারে করা মেসেজের প্রিন্ট আউটটা বের করে টেবিলে বিছাল সে। শব্দগুলো যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। সোগামোসোকে দিয়ে শুরু কর…
কি করব? ভাবছে রবিন। মেসেজটায় সাঙ্কেতিক কথা রয়েছে। মানে বের করতে হলে আগে সিয়েটা আর সোগামোসাকে খুঁজে বের করতে হবে। শেষ শব্দ ইনস, আই এন এস। ইনিশিয়ালের সংক্ষেপও হতে পারে ওটা, কিংবা ইমিগ্রেশন অ্যাণ্ড নেচারালাইজেশন সার্ভিসের আদ্যাক্ষর। সিয়েটা হয়ত একজন ইলিগাল লোক এদেশে, অবৈধ ভাবে প্রবেশ করেছে। জানতে পারলে খুব সুবিধে হবে কি? সিয়েটার খোঁজ পেলে তাকে আই এন এস-এর হাতে ধরিয়ে দেয়ার কথা বলেননি তো এলেনাকে লিসটার? দূর! কিছু বোঝা না গেলে রাগই লাগে।
আর এরকম একটা নোটই বা কেন কমপিউটারের মেমোরিতে রেখে গেলেন। লিসটার? কমপিউটারে আগ্রহ নেই এলেনার। মেসেজটা যে দেখবেই এরকম কোন নিশ্চয়তা ছিল না।
হতে পারে, এর চেয়ে ভাল আর কোন উপায় বের করতে পারেননি লিসটার, তাড়াহুড়ায়। হয়ত হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছেন বিপদে পড়তে চলেছেন তিনি। যে লোকটা তাঁর হুমকির কারণ, কমপিউটার সম্পর্কে তার জ্ঞান না থাকলে নিরাপদে থাকবে মেসেজটা। কিন্তু এলেনাও যদি কিছু বুঝতে না পারে, ওই মেসেজ কোন উপকার করবে না তার।
রেফারেন্সের বই রাখা হয় যেসব তাকে সেখানে এসে দাঁড়াল রবিন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর অনেক ডিরেক্টরি রয়েছে এখানে। ডেভিড লিসটার ব্যবসায়ী। তার ব্যবসার সঙ্গে যোগামোসোর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। বড় একটা বইতে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর তালিকা রয়েছে। নাম রাখা হয়েছে, স্ট্যাণ্ডার্ড অ্যাণ্ড পুয়োরস। সেটাতে সোগামোসো খুঁজল সে। পেল না। তারপর খুঁজল দা ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল এবং ফোর্বস ম্যাগাজিনে। সোগামোসোর চিহ্নও নেই। হজ হু-এর। যতগুলো সংস্করণ পেল, সবগুলোতে দেখল, কোনটাতেই পাওয়া গেল না ওই নাম।
বিখ্যাত লোক নয় সোগামোসো, বোঝা গেল। ব্যবসায় জড়িত নয়। পুরোপুরি অন্য কিছু। স্প্যানিশ কোন শব্দ নয় তো? স্প্যানিশ শব্দ ব্যবহার করেছেন লিসটার। স্প্যানিশ টু ইংলিশ ডিকশনারিটা নামিয়ে আনল সে। পেল না। ওটাতেও। বোকা হয়ে গেল। রেফারেন্স সেকশনের সব চেয়ে নিচের তাকটায় রয়েছে ম্যাপ। বড় একটা বই এনে ফেলল টেবিলে। অবশেষে দেখা মিলল সোগামোসোর।
কলাম্বিয়ার একটা শহর সোগামোসো।
দশ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে লাইব্রেরি! ঘোষণা করল পাবলিক অ্যাড্রেস সিসটেমের যান্ত্রিক কণ্ঠ।
ইনডেক্স দেখে দ্রুত পাতা ওল্টাল রবিন। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম কোণের একটা ম্যাপ বেরিয়ে পড়ল। কলাম্বিয়া রয়েছে ওখানে। বেগুনী রঙে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। শাদাটে রঙে আঁকা রয়েছে অ্যানিডজ পর্বতমালা।
তেরছা দৃষ্টিতে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সোগামোসো! ইনডেক্সে বলা হয়েছে, শহরটার লোকসংখ্যা উনচল্লিশ হাজার। তার মানে বড় শহর নয়।
বোগোটার উত্তর-পুবে শাদা পর্বতের গায়ে ছোট্ট একটা ফোঁটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে সোগামোসো। এত দূরের একটা অঞ্চলে বৃদ্ধা মহিলাকে খুঁজতে কেন যেতে বলেছেন লিসটার? আসলেই কি তেমন কোন মহিলা আছে? বিশেষ কোন মহিলা? না যে কোন মহিলা হলেই চলবে?
ম্যাপের পাশে সোগামোসোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।
কলাম্বিয়ায় বসতি তেমন জমে ওঠেনি, পড়ছে রবিন। মানুষজন বাস করে শুধু উপকূলের কাছে, আর অ্যানডিজ পর্বতমালার পশ্চিম দিকের পাদদেশে। উপকূলের কাছের ভেজা অঞ্চলে ইক্ষু আর ক্যাকাও-এর চাষ হয়। আর অনেক উঁচুতে, তিন থেকে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সব চেয়ে বড় কফি খেত রয়েছে। উপত্যকায় জুনে বার্লি আর গম। পাহাড়ী চারণভূমিতে ভেড়া চরার ব্যবস্থা আছে, তাই বিপুল পরিমাণে ভেড়া পোষা হয় সেখানে। অ্যানটিওকুইয়া ভ্যালিতে রয়েছে টেক্সটাইল মিল। সোগামোসোর কাছে কয়লা আর লোহার খনি রয়েছে, তাই সেখানে গড়ে উঠেছে ইস্পাতের কারখানা। সোনা আর পান্নার খনিও রয়েছে পর্বতের গায়ে। বেশির ভাগ কলাম্বিয়ানই কফির আয় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।
মিটমিট করতে লাগল মাথার ওপরের আলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে। যাবে লাইব্রেরি, ঘোষণা করল লাউড স্পীকার।
ম্যাপটা ঠেলে সরিয়ে তাড়াহুড়া করে এনসাইক্লোপেডিয়ার তাকগুলোর কাছে, চলে এল রবিন। আমেরিকানায় বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা রয়েছে কলাম্বিয়া সম্পর্কে। ব্রিটানিকাতেও বেশ প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সব পড়ার সময় নেই। রেফারেন্স বই লাইব্রেরির বাইরে নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি নেই।
আবার জ্বলতে লাগল আলো। তাকের কাছে দৌড়ে গেল রবিন। দক্ষিণ আমেরিকার ওপর লেখা দুটো বই বের করল। একটার নাম কলাম্বিয়া, ল্যাও অ্যাণ্ড কনট্রাস্টস। আরেকটা কলাম্বিয়া, ফ্রম নিউ এ্যানাডা টু বলিভার।
মেসেজটা টেবিল থেকে প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে চেকআউট ডেস্কে চলে এল সে। একটু পরেই বেরিয়ে এল বাইরে, লাইব্রেরির গেটের পাশের সাইকেল র্যাক থেকে সাইকেল বের করল। কলাম্বিয়ার ওপরে লেখা বইগুলো পড়তে পারলে খুশি হত। যতগুলো রয়েছে লাইব্রেরিতে। সময় পায়নি। যেদুটো নিয়েছে সেগুলো পড়ার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে সে। কোন সূত্র মিলতেও পারে, যা দিয়ে লিসটার রহস্যের সমাধান হবে।
.
প্রায় দশটা বাজে। পায়ের শব্দ শুনতে পেল মুসা। লিভিং রুমে রয়েছে সে আর এলেনা। রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রাইড চিকেন এনে খেয়েছে। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে দিয়ে আরাম করে বসেছে। বেশি গরম হয়ে গেছে ঘর। তবে বেশ আলো হয়েছে। অন্ধকার ছায়াগুলোকে একেবারে ঘরের কোণে ঠেলে নিয়ে গেছে যেন আগুনের লালচে আভা।
তাস খেলছিল দুজনে। এলেনা জিতছিল। এই সময় থেমে যেতে হল পায়ের শব্দে। শুনেই বুঝল মুসা চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে কেউ। নীরব বাড়িটাতে সেই শব্দ বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, যেন সমস্ত বাড়িতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
দমে গেল মুসা। ওপরতলায় যেতে চায় না সে। লিসটারের বাড়িটা ভাল, লাগেনি। কেমন যেন! ভূত থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানকার সব কিছুই তার অপছন্দ। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা। অনেক ধোয়ামোছা দরকার। দরজা জানালা সব খুলে দিয়ে বোদ বাতাস লাগানো দরকার। আর এমন একটা চিলেকোঠা রয়েছে যেটা কারও প্রয়োজনই নেই, কেউ ব্যবহার করে না। গত রাতেও নাকি পায়ের শব্দ পাওয়া গেছে, অথচ রবিন আর কিশোর গিয়ে কিছুই দেখেনি।
গত রাতে হয়েছিল, আজ আবার শুরু হয়েছে।
মুখ তুলল এলেনা। শুনছ? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল সে।
না বলতে চাইল মুসা। কিছুই বলতে পারল না। আরেকদিকে মুখ ফেরাল।
পেছনের দরজায় তালা লাগিয়েছিলে? এলেনার প্রশ্ন।
আমি তো মনে করেছি আপনি লাগিয়েছেন।
উঠে দাঁড়াল এলেনা। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ ঢুকেছে।
ওপথে ঢুকলে শুনতে পেতাম। দরজা খুললেই টের পেয়ে যেতাম আমরা।
রান্নাঘরের দিকে এগোল মুসা। দরজাটা পরীক্ষা করল। তালা দেয়া। ছিটকানি লাগানো ওপথে। কেউ আসেনি।
নাকি কেউ ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দিয়েছে?
রান্নাঘরে এসে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল এলেনা। ভ্রুকুটি করল। তারপর পিছিয়ে: বেরিয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে হলে চলে এল মুসা। সিঁড়ির দিকে চেয়ে রয়েছে এলেনা।
শুনছো! এলেনা বলল।
জোরালো হয়েছে পদশব্দ। চিলেকোঠার কাঠের মেঝেতে ফাপা আওয়াজ তুলছে।
মরুক! টেলিফোনের দিকে এগিয়ে এল এলেনা। রিসিভার তুলে ৯১১ ডায়াল করল। শয়তানটার কথা পুলিশকে না বলে আর পারছি না।
শয়তান, অর্থাৎ মানুষের কথা বলছে এলেনা। কিন্তু আসলে কি মানুষ? কিশোর বলেছে গতরাতে সিঁড়ি দিয়ে কাউকে উঠতে দেখেনি। কাউকে নামতেও দেখেনি। কিন্তু চিলেকোঠায় গিয়েছিল কেউ। হেঁটেছিল।
আমার ভাল্লাগছে না! বলেই ফেলল মুসা।
শুনলই না যেন এলেনা। লাইনের অন্য পাশে ডিসপ্যাচারকে ঠিকানা বলছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল মুসা। কাঁপছে সে। গলা এত শুকিয়ে গেছে ঢোকই গিলতে পারছে না। তবু উঠছে…এক ধাপ..আরেক ধাপ…আরও এক ধাপ…
চিলেকোঠায় পায়চারি চলছেই। ভূত? নাকি ভূতের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু?
রিসিভার রেখে মুসাকে অনুসরণ করল এলেনা। সে-ও ভয় পেয়েছে। মুসার কাছাকাছি থাকতে চাইছে।
যখন ছোট ছিলাম, বলল সে। আমাদের বাড়িতে একজন বাবুর্চি ছিল। মানুষকে ভয় দেখানোর ওস্তাদ। বিশেষ করে ছোটদেরকে। ছাতি থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল ও। ও বলেছিল এ বাড়িতে ভূত আছে।
তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বাধা দিল মুসা। আর বলবেন না, প্লীজ!
ওপরের হলে উঠে দাঁড়াল দুজনে। পায়চারি বন্ধ হয়ে গেছে। কান পেতে রইল আবার শব্দ শোনার অপেক্ষায়।
ওপরেও কি কেউ কান পেতে রয়েছে? চিলেকোঠার সিঁড়িতে অপেক্ষা করছে, রেলিঙে হেলান দিয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে? শিকার দেখলেই ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়ার জন্যে ওত পেতে রয়েছে?
এখানেই থাকি, যেতে চায় না মুসা। একটা চেয়ার নিয়ে এল কমপিউটার। রুম থেকে। বসার ইঙ্গিত করল এলেনাকে।
পুলিশ এসে যদি দেখে, এলেনা বলল। কিছুই নেই, সব সময়ই যেমন থাকে না, তাহলে কি ভাববে বলতো?
পাগল।
ঠিক। আর এরকম করে বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে যদি করতে থাকি, এক সময় আসাই বন্ধ করে দেবে ওরা। আমি ফোন করলেই হাসবে। বলবে কিপটে লিসটারের পাগলা মেয়ে ডাকছে।
কিন্তু আমার মনে হয় যতবারই ফোন করুন না কেন পুলিশকে আসতেই হবে। বলা যায় না, কখন সত্যিকারের বিপদে পড়ে যাবেন আপনি। ওই ঝুঁকি ওরা নিতে চাইবে না। এসে কিছু না দেখলে বকাঝকা করবে হয়ত, কিন্তু আসতে ওদেরকে হবেই।
পুরো এক মিনিট চুপ করে থেকে ভাবল মুসা। কিশোর এখন এখানে থাকলে কি করত? প্রমাণ খুজত, যেটা দেখিয়ে পুলিশকে বিশ্বাস করানো যায়। ভাঙা তালা…পায়ের ছাপ! হ্যাঁ, পায়ের ছাপ!
লিসটারের বাথরুমে একটা জিনিস দৈখেছিল মনে পড়ল মুসার। গতকাল ওখানে আটকে ছিল, তখন দেখেছে। বেসিনের ওপরের তাকে রাখা ট্যালকম পাউডারের একটা টিন।
দৌড়ে এসে লিসটারের ঘরে চলে এল সে। বাথরুমে ঢুকল। সুইচ টিপে আলো জেলে, দেখল টিনটা আগের জায়গাতেই রয়েছে। থাবা দিয়ে ওটা নামিয়ে নিয়ে আবার দৌড়ে ফিরে এল হলে। চিলেকোঠার দরজার কাছে মেঝেতে পাউডার ছিটিয়ে দিল।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে তাকাল এলেনা।
মানুষ হলে এপথে ছাড়া বোরোতে পারবে না। বুঝিয়ে বলল মুসা, আর এদিকে এলে তাকে দেখতে পাবই। এই পাউডার মাড়িয়ে যেতে হবে। পায়ের। ছাপ রেখে যাবে। পুলিশকে দেখাতে পারব তখন। প্রমাণ।
ঠিক! ঠিক বলেছ! হাততালি দিতে গিয়েও থেমে গেল এলেনা, কিন্তু যদি পায়ের ছাপ পড়ে?
জবাব দিল না মুসা। ড্রাইভওয়েতে ইঞ্জিনের শব্দ হল। দড়াম করে বন্ধ হল গাড়ির দরজা। বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখতে লাগল কেউ। শব্দ হচ্ছে। দেখছে। বোধহয় ঝোপঝাড়ে, কেউ লুকিয়ে আছে কিনা।
সিঁড়িতে অর্ধেক নেমে গেছে এলেনা, এই সময় বাজল কলিং বেল। দরজা খুলে দিল সে। রকি বীচ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দুজন অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। এলেনাকে বলতে শুনল মুসা, ওপরে চিলেকোঠায় আসুন।
চলুন, বলল একজন অফিসার। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
আরেকটা শব্দও কানে আসছে মুসার। চিলেকোঠার সিঁড়িতে, নামছে বোধহয় রহস্যময় অনুপ্রবেশকারী।
ঝট করে দরজার দিকে ফিরল সে। এখান থেকেই সিঁড়ির গোড়াটা দেখা যায়।
হঠাৎ করেই থেমে গেল চিলেকোঠার সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ হল না আর। মেইন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে লাগল একজন অফিসার।
সাহস পেয়ে চিলেকোঠার দরজার কাছে উঠে এল মুসা। যেমন পাউডার তেমনি রয়েছে। কোন ছাপ পড়েনি। মানুষের চিহ্নও চোখে পড়ছে না।
ভূত! কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল মুসার কণ্ঠ থেকে। ভূতের বাড়ি এটা!
সব শুনে এলেনা বলল, তোমরা থাকলে থাক! আমি আর এক মুহূর্তও না! মার কাছে চলে যাচ্ছি।
.
১০.
তিন ব্লক পেছনে রয়েছে কিশোর, এই সময় সান্তা মনিকা বুলভার ধরে পুবে মোড়। নিল এনথনির গাড়ি। চার ব্লক পেছনে পড়ে গেল যখন মেফিল্ডে ঢুকল গাড়িটা। গতি কমাল। একটা মার্কেটের পার্কিং লটে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল। ডি. এল; ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দেখা গেল কমপ্লেক্সের পশ্চিম প্রান্তে। এই ব্রাঞ্চেই লিসটারের ম্যানেজারি করে সে। র্যাকে সাইকেল তালা দিয়ে রেখে দোকানের দিকে এগোল কিশোর।
এখন কেনাকাটার সময় লোকের। দোকানদারী ফেলে এই সময়ে ওবাড়িতে কেন গিয়েছিল এনথনি? অবাকই লাগছে তার। দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করছে মিস্টার লিসটারের বিরুদ্ধে? এতে কি লাভ ওদের?
ঠোঁট কামড়াল কিলোর। এনথনির সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে– বলবে, সে আর তার বন্ধুরা মিলে এলেনা লিসটারকে সাহায্য করছে। বিশপের– বইয়ের ব্যাপারে কিছু জানে কিনা জিজ্ঞেস করবে। সিয়েটা আর সোগামোসোর। কথাও জানতে চাইবে। এসব প্রশ্ন অবশ্য নতুন নয় এনথনির জন্যে। এলেনার মায়ের রান্নাঘরে লুকিয়ে থেকে তো সবই শুনেছে। তবু তার প্রতিক্রিয়া দেখার কৌতূহল সামলাতে পারছে না কিশোর। এমনও হতে পারে মুখ ফসকে কোন তথ্য দিয়ে ফেলতে পারে এনথনি, যেটা তদন্তের সুবিধে করে দেবে।
স্টোরের অফিসগুলো রয়েছে তিনতলায়। চিলড্রেনস ডিপার্টমেন্টের পেছনে। ডেস্কের ওপাশে বসা এক মহিলা কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল। কি সাহায্য করতে পারে জিজ্ঞেস করল। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড দিয়ে নিজের নাম বলে জিজ্ঞেস করল কিশোর মিস্টার এনথনির সঙ্গে দেখা করা যাবে কিনা।
কার্ডটার দিকে তাকাল মহিলা। গোয়েন্দা? কিছুটা অবাক হয়েই আবার কিশোরের দিকে মুখ তুলল।
মিস্টার লিসটারের নিখোঁজের ব্যাপারে কথা বলব, কিশোর বলল। গতকাল এলেনা লিসটারের এনগেজমেন্ট পার্টিতে ছিলাম। মিস্টার এনথনির সঙ্গে ওখানেই। দেখা হয়েছে।
মিস্টার লিসটার? হাসি চলে গেছে মহিলার মুখ থেকে। তিনি নিখোঁজ হয়েছেন?
মিস্টার এনথনি সব জানেন।
কিশোর আর কিছু বলতে চায় না এটা বুঝে ফোন তুলল মহিলা। এক্সটেনশনে ডায়াল করে বলল কিশোর পাশা এসেছে, মিস্টার এনথনির সঙ্গে দেখা। করতে চায়। তারপর বলল মিস্টার লিসটারের সম্পর্কে কথা বলবে।
ওপাশের কথা শুনল। রিসিভার নামিয়ে রেখে কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, মিস্টার এনথনি খুব ব্যস্ত। আজ কথা বলতে পারবেন না।
তাই? অতীতে বহুবারই বহুজুন কিশোরের সঙ্গে দেখা করতে অসম্মতি জানিয়েছে, এটা নতুন নয় তার কাছে একটুও নিরাশ হল না। তবে একটা উপায় বের করতেই হবে দেখা করার। এবং আজই। লিটারের কমপিউটারের ফাইলের কথা হয়ত জানে না এনথনি। ওটার কথা শুনলে নরম হতেও পারে।
আমি জানি মিস্টার এনথনি ব্যস্ত মানুষ, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কিন্তু তারপরেও আমার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চাইবেন। তার জন্যে খবর আছে। মিস্টার লিটারের ব্যাক্তিগত ফাইলে লেখা রয়েছে তার নাম।
মোলায়েম হাসি হাসল গহিলা। বেশ, তোমার কার্ড আর মেসেজ রেখে যাও। তাকে দেব। দরকার মনে করলে ফোন করবেন।
বসকে পাহারা দেয়ার গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন যেন মহিলা। কিছুতেই দেখা করতে দেবে না। কিশোরকে সরাতে সর পরিকর। ঘড়ি দেখল কিশোর। পাঁচটার। বেশি। আরেকটু পরেই শেষ হয়ে যাবে, অফিসের সময়। ঠিক আছে, বসি, বলল সে। তিনি বেরোলেই নাহয় কথা বলব।
অনেকক্ষণ বলতে হবে তাহলে। দোকান বন্ধ হতে নটা।
অফিস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। এসকেলেটর, অর্থাৎ চলমান সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে নিচে। তাতে উঠল। হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাবে? নাকি অপেক্ষা করবে এনথনির জন্যে? কাপড় আর পারফিউমের দোকানের পাশ দিয়ে নামতে নামতে এসব কথা ভাবছে সে। দোতলা থেকে একতলায়, নামল, আসবাব আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ওখানে।
এনথনির জন্যে অপেক্ষাই করবে ঠিক করল কিশোর। অফিস বন্ধ করার। আগে নিশ্চয় তার মেসেজ পেয়ে যাবে ম্যানেজার। ঘাবড়ে গিয়ে কথা বলতে চাইবে। আর তা যদি না করে, লোকটার ওপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আইলিন লিসটার আর এনথনির মাঝে কোন একটা সম্পর্ক নিশ্চয় আছে। কি, সেটা বের করতে হবে। হয়ত লিটারের কিডন্যাপিঙের সঙ্গেও এর যোগাযোগ রয়েছে।
নিচে আঙিনায় নেমে এল কিশোর। এখন সময় কাটাতে হবে, কয়েক ঘন্টা। কয়েকটা ইলেকট্রনিকের দোকানের সামনে ঘুরল। বিভিন্ন মডেলের স্টেরিও সেট আর রেকর্ড দেখল,। একটা স্ন্যাকস শপে ঢুকে চিকেন বারগার আর কোক খেল। একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে ব্যায়ামের জন্যে কিছু পোশাক পছন্দ করল। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে বই বের করে পড়তে শুরু করে দিল। দোকানদার বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকানো শুরু করতে করতে শেষ করে ফেলল অর্ধেকটা কাহিনী।
বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর। আরও এক ঘন্টার বেশি রয়েছে। একটা আসবাবের দোকানে ঢুকে চামড়ায় মোড়া একটা বড় সোফায় বসল হেলান দিয়ে। চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
দোকানের এই কোণটা নীরব, বড় বেশি নীরব। খরিদ্দার বেশি নেই। নিঃসঙ্গ। একজন সেলসম্যান পায়চারি করছে আসবাবের সারির মাঝের লম্বা একটা ফাঁকে। তার পায়ের শব্দ ঢেকে দিচ্ছে মেঝেতে বিছানো কার্পেট। বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে গেল কিশোরের। ঢুলতে শুরু করল। আগের রাতে লিটারের বাড়িতে ভাল ঘুম হয়নি। এখন সেটার খেসারত দিতে হচ্ছে।
চিলেকোঠায় অনুপ্রবেশকারীর কথা মাথায় ঢুকতেই তন্দ্রা টুটে গেল তার। যদিও মাথাটা ঝুলেই রইল বুকের ওপর। এই আরেকটা রহস্য। কি ঘটেছে। চিলেকোঠায়? ভূতে হাঁটাহাঁটি করেছে?
কিন্তু ভূত বিশ্বাস করে না কিশোর। র্যাপারটা অদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু ভূত। নয়। কবর থেকে উঠে আসতে পারে না প্রেতাত্মা। গলা কেটে বললেও কিশোরকে অন্তত একথা বিশ্বাস করাতে পারবে না কেউ। ওই শব্দের অন্য ব্যাখ্যা আছে। হতে পারে সাগরের দিক থেকে জোরাল হাওয়া এসেছিল ওই সময়, কোনভাবে শব্দের সৃষ্টি করেছে। তবে এটা একটা সম্ভাবনা, অন্য কিছুও হতে পারে। এই যেমন, বড় ইঁদুর।
আবার ঢুলতে লাগল সে। হঠাৎ চমকে জেগে গেল। চোখ মেলল।
অন্ধকার। চারপাশে তাকিয়ে নানারকম আকৃতি দেখতে পেল সে। কালো কালো অদ্ভুত সব ছায়ামূর্তি যেন। চিনতে অবশ্য দেরি হল না। দোকানের আলমারি, চেয়ার, টেবিল, ওয়ারড্রোব এসব।
সতর্ক হয়ে গেল সে। দেরি করে ফেলেছে! দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। টেরই পায়নি সে কখন বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে সেলসম্যান।
উঠে দাঁড়াল কিলোর। কান পাতল। নিশ্চয় ঝাড়ুদার আছে বাইরে। কিন্তু বাড়ুর শব্দ কানে এল না। পাহারাদার থাকবেই। ওরা এসে তাকে জাগিয়ে দিল না কেন? সেলসম্যানই বা এভাবে দোকান বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল কেন? তাকে জাগিয়ে বের করে দিতে পারত।
একটাই কারণ হতে পারে। এমন এক কোণে ঢুকে বসে আছে সে, যেখানে ভাল করে না তাকালে কারও চোখ পড়বে না। তার তিন ফুট দূর দিয়ে হেঁটে গেলেও না।
চোখ ডলল কিশোর। আলমারি আর কিছু উইং চেয়ারের ওপাশে একটা আলো জ্বলছে, ঘোলাটে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে শুধু। তার নিচে লেখা রয়েছে একজিট, তার মানে বেরোনোর পথ।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সেদিকে এগোল কিশোর। একব্জিটের কাছে পৌঁছে আরেকটা নির্দেশ দেখতে পেলঃ ইমারজেন্সি একব্জিট ওনলি। অ্যালার্ম উইল রিং ইফ দিস ডোর ইজ ওপেনড। জরুরী অবস্থায় বেরোনোর পথ। দরজা খুললেই সতর্কীকরণ ঘন্টা বেজে উঠবে।
কল্পনায় দেখতে পেল কিশোর, ইমারজেন্সি তোর ঠেলে বাইরে বেরিয়েছে। প্রচণ্ড শব্দে বাজতে আরম্ভ করেছে অ্যালার্ম বেল। জ্বলে-নিভে সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে বিশেষ আলো। কোন সন্দেহ নেই টিভি মনিটরের সামনে পাহারাদারও বসে রয়েছে, চোখ রাখছে সর্বত্র। পর্দায় কিশোরকে দেখামাত্র ছুটে আসছে ওরা। পিস্তল বের করে ফেলেছে। মার্কেটের সীমানা পেরোনার আগেই ধরে ফেলা হয়েছে তাকে। তার পরের ঘটনা আর মনে করতে চায় না সে।
কেঁপে উঠল কিশোর। কয়েক মাস আগে একটা ছেলেকে পাওয়া গিয়েছিল। আঙিনার ভেতরে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে। ধরে তাকে প্রথমে ভালমত ধোলাই দিয়েছে পাহারাদাররা, যদিও সেটা আইন বিরুদ্ধ। তারপর পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেলখাটা কিছুতেই এড়াতে পারেনি ছেলেটা। কিশোরের ক্ষেত্রে জেলটা না থাকলেও ধোলাইটা খেতেই হবে। ধরলে কিছু উত্তম মধ্যম না দিয়ে ছাড়বে না প্রহরীরা। তার ওপর রয়েছে লোকাল নিউজপেপারগুলো। ছবিসহ বড় করে ছাপবে সামনের পাতায়, হেডিং লিখবে সুপার মার্কেটে চোর। রাতের বেলা কি কারণে আসবাবের দোকানে ঢুকে লুকিয়ে বসেছিল কিশোর, কিছুতেই বোঝাতে পারবে না রিপোর্টারদেরকে।
ইমারজেন্সি একব্জিটের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল সে। প্রধান প্রবেশ পথের দিকে চলল। ইস্পাতের মস্ত শাটার লাগানো রয়েছে সেখানে।
সাবধানে এগোল সে। সামান্যতম শব্দ না করে এসে খুঁজে বের করল কর্মচারীদের প্রবেশ পথটা। এই দরজাতেই সাবধান বাণী লেখা রয়েছে। জোর করে বেরোতে গেলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে।
দরজার পাশের একটা ঘড়িতে দেখা গেল রাত এগারোটা বাজে। বাড়িতে খবর দিতে পারেনি কিশোর। রেগে কাই হয়ে যাবেন মেরিচাচী।
খুঁজতে খুঁজতে একটা পে ফোন বের করল সে। স্লটে পয়সা ফেলে বাড়ির নম্বরে ডায়াল করল। মেরিচাচী ধরলেন। কণ্ঠ শুনেই কিশোর বুঝে ফেলল উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। সে নাম বললেই ফেটে পড়বেন এখন। তা-ই করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথায়?
আমাদেরকে এলেনা লিসটারের প্রয়োজন, ঘুরিয়ে জবাব দিল, কিশোর। সত্যি কথাই বলল।
কি মাঝে মাঝে আমারও তোকে প্রয়োজন হয়! সেকথা কখনও ভেবেছিস? লিসটারের বাড়ি থেকে বলছিস নাকি? ওর বাপের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?
না। চাচী, শোন, আজ রাতেও থাকতে চাই। তোমার কোন অসুবিধে হবে না। তো?
রাতে আর কি অসুবিধে? ইয়ার্ডের কাজ তো দিনের বেলা। থাকতে চাইলে থাক। তবে সাবধানে থাকবি। বিপদ-আপদ ঘটাবি না।
লাইন কেটে দিলেন তিনি।
ফোন ছেড়ে দিয়ে আবার আসবাবের দোকানে ফিরে এল, ঘরের কোণে তার। সেই সোফায়। সোফাটাকেই এখন তার বাড়ি ভাবতে আরম্ভ করেছে। বসে পড়ল। সকাল হতে অনেক দেরি। কি করে যে রাতটা কাটবে কে জানে।
মোচড় দিয়ে উঠল পেট। খিদে জানান দিচ্ছে। একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। একটা ছেলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে রাতের বেলা আটকা পড়েছিল। রেস্টুরেন্টের রেফ্রিজারেটর থেকে খাবার বের করে খেয়েছিল সে। কিন্তু বিকেলে ভেতরে কোন রেস্টুরেন্ট দেখতে পায়নি কিশোর। আছে বলেও মনে হয় না। রাখার কোন প্রয়োজন মনে করেননি লিসটার। কারণ স্টোরের বাইরেই চত্বরে অনেক খাবারের দোকান রয়েছে।
তবু, খাবার কি খুঁজবে? সুইট কাউন্টার কিংবা ছোটখাট স্ন্যাকস থাকতে পারে কোথাও।
বাতিল করে দিল ভাবনাটা। অতিরিক্ত ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে।
চোখ মুদল সে। আবার তন্দ্রা এসে গেল। ঢুলতে শুরু করল। স্বপ্ন দেখল। লিসটারের বাড়িতে রয়েছে আর কে যেন টোকা দিচ্ছে দরজায়। স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারল কে লোকটা, ডেভিড লিসটার। ভেতরে ঢুকতে চাইছেন। আসছি! চিৎকার করে সাড়া দিল কিশোর। যাবেন না! এখুনি আসছি!,
জোর করে যেন টেনে তুলল শরীরটাকে। আলোকিত হয়ে গেছে। লোকজন। দেখতে পেল সামনে। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাসাহাসি করতে লাগল ওরা। সকালের খরিদ্দার। বিজনেস স্যুট পরনে, হাতে খবরের কাগজ। ওদেরই একজন টোকা দিচ্ছিল জানালায়।
জানালা! কাল সন্ধ্যায় যখন বসেছিল তখন তো ওটা ছিল না। এখন এল কোথা থেকে?
বুঝতে পারল অন্ধকারে অন্য জায়গায় এসে বসেছে। আগের দিন সন্ধ্যায়, শুরুতে যে সোফায় বসেছিল এটা সেটা নয়। ডিসপ্লে উইনডোতে জমায়েত হয়েছে লোকে দোকানের ভেতর তাকে ঘুমোতে দেখে। যেন এটা তাদের কাছে এক। সাংঘাতিক মজার ব্যাপার।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। যে কোন মুহূর্তে হাজির হয়ে যেতে পারে প্রহরীরা, চেপে ধরতে পারে তাকে। পুলিশ ডাকবে। তারা খবর দেবে মেরিচাচী আর রাশেদ চাচাকে।
প্রহরীদের গলা শোনা গেল। কর্মচারীদের ঢোকার দরজা খুলছে ওরা।
দৌড়ে গিয়ে বড় একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ল কিশোর।
আসবাবের সারির মাঝের পথ দিয়ে এগিয়ে এল ওরা। এখানেই আছে, বলল একজন। আশোঁপাশে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে।
কিশোর যে টেবিলের নিচে লুকিয়েছে তার কাছে এসে দাঁড়াল আরেকজন। মোটা গলায় বলল, কাল রাতে দেখলে না কেন? কারও চোখে পড়ল না?
সব কটা চেয়ার টেবিলের তলায় তো আর উঁকি দেয়া সম্ভব না, প্রথম লোকটা জবাব দিল। টহল দিই। তখন চোখে পড়লে তো ধরতামই।
লোকগুলো চলে গেলে বেরিয়ে এসে মাথা তুলে উঁকি দিল কিশোর। ডিসপ্লে উইনডোর কাছে দেখতে পেল ওদেরকে। সোফাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন ওটাই ওদেরকে বলে দেবে কিশোর কোথায় আছে।
পেছনে শব্দ হল। ফিরে তাকাল কিশোর। হাড়সর্বস্ব একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে দোকানের প্রধান প্রবেশ পথের কাছে। পরনে জলপাই রঙের জাম্প স্যুট। তালা খুলল লোকটা। তারপর টান দিয়ে তুলতে শুরু করল ইস্পাতের শাটার।
পথ পরিষ্কার হয়ে আসছে।
লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। একছুটে লোকটার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করল না লোকটা। অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে শুধু তার দিকে।
চত্বরে বেরোল কিশোর। এই সময় শুনতে পেল চিৎকার। দেখার জন্যে থামল।, ফিরেও তাকাল না। ছুটে চতুর পার হয়ে অটোমেটিক দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে এল পার্কিং এরিয়ায়।
র্যাকে আগের জায়গাতেই বাঁধা রয়েছে সাইকেলটা। খুলতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় হাত থেকে চাবিই ফেলে দিয়েছিল প্রায়। কাঁপা হাতে খুলল তালাটা। একটানে সাইকেলটা বের করে নিয়েই চেপে বসল। প্যাডাল ঘোরাতে শুরু করল। পেছনে ছুটে আসছে লোকজন।
এবারও ফিরে তাকাল না কিশোর। এখন একটাই করণীয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া, লোকগুলোর হাতে পড়ার আগেই।
.
১১.
ভূত বিশ্বাস করি না আমি, ঘোষণা করল কিশোর। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। মুসার দিকে।
তা তো বুঝলাম, মুসা বলল। কিন্তু ভূত না হলে কী?
বাতাসের কারসাজি হতে পারে। ইঁদুর হতে পারে, রবিন বলল।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। কিশোর বসেছে তার নির্দিষ্ট ডেস্কের ওপাশে। চোখ লাল। ঘুম ঘুম দৃষ্টি। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে রাতের ধকলের স্বাক্ষর। মুসার চোখেও ক্লান্তি। শুধু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে রবিনকে। তিনজনের মধ্যে রাতে একমাত্র তারই ভাল ঘুম হয়েছে।
লাইব্রেরি থেকে যে বই দুটো পড়তে এনেছিল রবিন সেদুটো নিয়ে এসেছে। এখানে। পাতা ওল্টাতে শুরু করল।
ভূত হলেই বা কি? বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল সে। লিসটারের বাড়িতে নিশ্চয় অনেক দিন ধরে বাস করছে সে। হঠাৎ করে লিসটারকে নিয়ে পরপারে চলে যাওয়ার ইচ্ছে নিশ্চয় তার হয়নি। আমাদেরকে এখন বিশপেরই বই খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা করতে পারলেই লিসটারকেও বের করে আনতে পারব। কাজেই ভূতের ওপর জোর না দিয়ে এখন বিশপের বইয়ের ওপরই জোর দেয়া উচিত। আর সেজন্যে কমপিউটারের মেসেজের মানে বের করতে হবে আমাদের। যাই হোক, তোমাদেরকে থ করে দেয়ার মত খবর আছে আমার কাছে। মুখ তুলল। রবিন। হাসল। হাততালি দেয়ার দরকার নেই। বাহবা দেয়ার দরকার নেই। শোন, আমি সোগামোসো খুঁজে পেয়েছি।
ঘুম থেকে যেন জেগে গেল কিশোর। একেবারে সজাগ। পেয়েছ! কে?
কে নয়, কি। দক্ষিণ আমেরিকার কলাম্বিয়ার একটা ছোট শহর। মাত্র, উনচল্লিশ হাজার লোকের বাস। এখন এলেনা গিয়ে যদি বৃদ্ধা মহিলাকে জিজ্ঞেস করে সে কি চায় তাহলে হয়ত জেনে আসতে পারবে। ওই মহিলা নিশ্চয় সোগামোসোরই বাসিন্দা।
আর সেটা করতে গেলে সিয়েটার ব্যাপারে হুশিয়ার থাকতে হবে তাকে,, মুসা মনে করিয়ে দিল। কমপিউটারের মেসেজে সেকথা বলা আছে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। মহিলাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। হুশিয়ার থাকতে হবে যাতে সিয়েটার কানে এসব কথা চলে না যায়।
না, মাথা নাড়ল কিশোর। সিয়েটা কলাম্বিয়ায় নেই। লিসটার কমপিউটারে মেসেজ লেখার সময় অন্তত ছিল না। লিসটার জানতেন না সিয়েটা বৈধ কিনা। আই এন এস-এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। আই এন এস মানে ইমিগ্রেশন অ্যাণ্ড নেচারালাইজেশন সার্ভিস। সুতরাং ধরে নিতে পারি বেআইনী ভাবে আমেরিকায় প্রবেশ করেছে সিয়েটা, তার কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই।
বেশ, রবিন বলল। তাহলে এখানেও হুশিয়ার থাকতে হবে এলেনাকে। যতক্ষণ সোগামোসোয় রওনা না হচ্ছে ততক্ষণ সাবধান থাকতে হবে যাতে সিয়েটার সামনে না পড়ে যায়। কিংবা সামনে পড়লেও কোন কথা ফাঁস না করে দেয়। কিশোর, তোমাকে চিলেকোঠায় যে আক্রমণ করেছিল সে-ই সিয়েটা হতে পারে। তোমার ওপর হামলা চালিয়েছিল একজন মানুষ, ভূত-প্রেত নয়।
ভূত তো হতেই পারে না, কিশোর বলল। মানুষ। জীবন্ত মানুষ।
টেলিফোন বাজল।
এলেনা হয়ত ভাবছে আমরা কি করছি, মুসা আন্দাজ করল। কাল রাতে মায়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বাবার ওখানে থাকতে সাহস পায়নি।
তাকে দোষ দেয়া যায় না। রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর। এলেনার ফোন নয়। আরনি ভিনসেনজো ওরফে হোয়েরটার।
টেলিফোন লাইনের সঙ্গে লাগানো লাউডস্পীকারের সুইচ অন করে দিল কিশোর, সকলের শোনার জন্যে। আপনি ফোন করলেন, অবাকই লাগছে মিস্টার ভিনসেনজো। কাল তো বেরিয়ে চলে গেলেন…
আমাকে কডিই বলবে। ওটা ছদ্মনাম নয়। মিডল নোম। আরনি কডি ভিনসেনজো। বন্ধুরা আমাকে ওই নামেই ডাকে। আর কাল চলে না গিয়ে কি করতে পারতাম। এত বড় অপমান…থাক ওসব কথা। আজ থানায় গিয়েছিলাম। লিসটারের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয় পুলিশ। তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। তবে কিডন্যাপের কথা জানলে হয়ত ঘামাত। আর তখন আমিও তাদের সন্দেহের তালিকায় পড়ে যেতাম।
কারণ লিসটারকে কিডন্যাপের মোটিভ রয়েছে আপনার, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, স্বীকার করল আরনি। ওই বুড়ো ভামটাকে একটা শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে ছিল আমার। আমার বাবার সর্বনাশ করার জন্যে।
সহজ সরল স্বীকারোক্তি। বন্ধুদের দিকে তাকাল কিশোর।
সত্যিই বলছে মনে হয়, বিড়বিড় করল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বেশ, বিশ্বাস করলাম আপনার কথা। কিন্তু আমাকে ফোন করেছেন কেন?
তোমাদের ওপর এলেনার বিশ্বাস আছে, তাই আমারও হয়েছে। মিস্টার লিসটারকে খুঁজে বের করতে আমার কোন সাহায্য দরকার হলে, করব। এটা তার জন্যে দয়া নয়, আমার নিজেরই স্বার্থে। যতদিন লিসটার নিখোঁজ হয়ে থাকবে, আমার ওপর সন্দেহ থাকবে তোমাদের। এটা বয়ে বেড়াতে পারব না আমি। কাজেই, আমাকে দরকার হলেই ফোন করবে।
এখনই একটা কথা ভাবছি, কিশোর বলল। মোগামোসো সম্পর্কে কিছু জানেন?
সোগা…সোগা কে?
নামটা আবার বলল কিশোর। কিছু বুঝতেই পারল না আরনি, বলা তো দুরের কথা। সিয়েটার কথা শুনে বলল, ওই নামে কয়েকজনকে চিনি। খুব প্রচলিত এই নাম, অনেকেই রাখে। তাঁদের কেউই লিসটারকে চেনে না এটাও বলতে পারি।
কখনও ঈশ্বরের অশ্রুর কথা বলতে শুনেছেন মিস্টার লিসটারকে? ঈশ্বরের অশ? তা কি করে হয়? কি করে হয় জানি না। তবে ওটা মিস্টার লিসটারের কাছে খুবই জরুরী। সরি। শুনিনি। শুনলে ওরকম একটা কথা মনে না থাকার কথা নয়।
তা ঠিক। আরেকটা প্রশ্ন। সোগামোসোর কথা আমরা জানি। ওটা কলাম্বিয়ার। একটা ছোট শহর। কোকেনের প্রধান ঘাঁটিগুলোর একটা। মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সঙ্গে মিস্টার লিসটারের কোন যোগ নেই তো?
মোটেই না, জোর দিয়ে বলল আরনি। মাদককে ঘৃণা করে লিসটার। নেশা করে শুনলেই যত ভাল কর্মচারীই হোক চাকরি থেকে বের করে দেয় সে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এলেনাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।
তাকে ধন্যবাদ দিল কিশোর।
যোগাযোগের জন্যে টেলিফোন নম্বর দিয়ে লাইন কেটে দিল আরনি।
অসংখ্য ছেঁড়া সুতো রয়েছে এই কেসে, কিশোর বলল। সব জোড়া দিতে। পারলে রহস্যের কিনারা করা যাবে না। অথচ কোনটার সঙ্গে কোনটার। যোগাযোগ দেখতে পাচ্ছি না এখনও{ দুদিন আগে যে অন্ধকারে ছিলাম এখনও তা-ই রয়েছি।
সোগামোসোও কোন সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না, মুসা বলল। ওখানে গিয়ে বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে এলেনা যোগাযোগ করার আগেই হয়ত এদিকে তার বাপ মরে ভূত হবে।
স্বাভাবিক মৃত্য যদি হয়, বলল রবিন। বয়েসের কারণে। ও-কে, এর পর কি করব?
এলেনার মা পরামর্শ দিয়েছেন আইলিন লিসটারে খোঁজ নিতে, কিশোর বলল। লিসটারের বাড়িতে তো আর খোঁজা বাদ রাখিনি। এখন জাহাজটায় গিয়ে খুঁজলে মন্দ হয় না। কোথায় আছে ওটা এলেনা নিশ্চয় জানে।
জানতে পারে, মাথা দোলাল রবিন। আর ওখানে বিশপের বইটা খুঁজে বের করতে পারলে তার বাবা মুক্তি পাবে। লিসটারই তখন বলে দিতে পারবে বৃদ্ধা। মহিলাকে কোথায় পাওয়া যাবে, কোথায় মিলবে ঈশ্বরের অশ্রু।
সান্তা মনিকায় এলেনার মায়ের বাড়িতে ফোন করল কিশোর। ফোন ধরল। এলেনা। সে ওদেরকে বলল সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিন করপোরেশনের ড্রাই ডকে রয়েছে ইয়টটা। ওটা একটা শিপইয়ার্ড, এলেনা বলল। বোটি ড্রাইভে। ফোন। করে আমি ওদেরকে বলে দিচ্ছি তোমরা যাচ্ছ। তোমাদের যাতে ইয়টে উঠতে দেয়া হয়।
মিনিট কয়েক পরেই কোস্ট হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। বিশ মিনিট একটানা প্যাড়াল করে এসে পৌঁছল বোটি ড্রাইভে।
তীর থেকে মাইলখানেকেরও বেশি সাগরের ভেতরে ঢুকে গেছে মানুষের তৈরি এক টুকরো জুমি। মাটি ফেলে ফেলে তৈরি করা। বিশাল এক দানবের আঙুল। যেন। আঙুলের মাথায় জেটি। একটা ইয়ট ক্লাব আর এক সারি দোকানপাট। জেটির দক্ষিণ পাশে। উত্তর পাশে কয়েকটা শিপইয়ার্ড। বড় রাস্তা থেকে প্রায়। কোয়ার্টার মাইল ভেতরে সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিন করপোরেশন। ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে বেশ শক্ত বেড়া চারপাশ ঘিরে। গেটে পাহারা দিচ্ছে ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান। গেটের পাশে ছোট গার্ডহাউসে বসে আছে সে।
গেটের কাছে এসে থামতে হল তিন গোয়েন্দাকে। পরিচয় দিল কিশোর।
হ্যাঁ, মিস লিটার ফোন করেছিলেন, দারোয়ান বলল। তবে বয়স্ক মানুষ আশা করেছিলাম আমি। যাকগে, মিস যখন বলেছেন, আমার কি এখানে সই করতে হবে। ঈশ্বরের অশ্রু
একটা নোটবুক বের করে দিল লোকটা। এক এক করে সই করল তিন গোয়েন্দা। তিনজনের নামের পাশে নোট লিখল দারোয়ান। তারপর তার পেছনের পেগবোর্ড থেকে একগোছা চাবি নিয়ে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে ধরল, আইলিন লিসটারের কেবিন আর হুইলহাউসগুলোতে তালা দেয়া। এটা দরকার হবে।
ডানে দেখাল সে। ওদিক দিয়ে পথ। ওই যে স্কুনারটা, ওটার পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। ওই যে, নিচের রঙ চেছে তুলে ফেলা হয়েছে যে। হ্যাঁ, তার পরেই রয়েছে আইলিন লিসটার। ড্রাই ডকে। বড় জাহাজ। কালো খেল। গলুইয়ের কাছে সোনালি রঙে নাম লেখা রয়েছে।
লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। সাগর থেকে, আসছে তাজা বাতাস। মাথার ওপরে চক্কর দিচ্ছে গাল, কর্কশ চিৎকার করছে। বাতাসে শুকনো শ্যাওলা, ঝিনুক, মাছ আর জাহাজের রঙের মিশ্র গন্ধ। পানি থেকে মেরামতের জন্যে শুকনোয় তোলার পর খোলে লেগে থাকা শ্যাওলা। শুকিয়ে এক ধরনের শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
অনেক জাহাজের পাশ কাটাল ছেলেরা। বেশির ভাগই সেইলবোট। কাঠ আর ফাঁইবারগ্লাসে তৈরি বোটগুলো লম্বায় চল্লিশ থেকে ষাট ফুট। আইলিন লিসটার জাহাজটাকে অনেকটা আলাদা লাগল ওগুলোর তুলনায়, অন্য রকম। ছোট একটা ওশন লাইনার। কালো খোল। শরীরটা শাদা। বিলাসতরীর রূপ দিয়েছে। ইয়টটাকে।
খাইছে! বলে উঠল, মুসা। বুড়োটার রুচি আছে! বাড়িঘরগুলো অমন করে রাখে কেন? এখানে তো কিপটেমি নেই!
থাকবে কি করে, রবিন মন্তব্য করল। এটা কাজের জিনিস যে। কমপিউটার রুমটা দেখনি। কেমন ঝকঝকে তকতকে, দামী মেশিন।
সেইলবোটগুলোকে যেভাবে পানি থেকে টেনে তোলা হয়েছে সেরকম করে তোলা হয়নি এটাকে। কংক্রিটের মস্ত ট্রেঞ্চের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়েছে, এটাকেই বলে ড্রাই ডক। ট্রেঞ্চের সাগরের দিকের বিশাল ওয়াটারপ্রুফ গেটগুলো বন্ধ, তালা দেয়া। জাহাজটাকে এখানে আনার পর দমকলের সাহায্যে সমস্ত পানি বের করে দেয়া হয়েছে। খটখটে শুকনো এখন খোলের নিচে। ড্রাই ডকের ভেতরে বিরাট বিরাট ইস্পাতের কাঠামোর ওপরে ডিমে তা দিতে বসা হাঁসের মত করে। যেন বসে রয়েছে আইলিন লিসটার।
সিঁড়ি উঠে গেছে জাহাজের ওপর। প্রথম ডেকে উঠল কিশোর। তারপর রবিন। আর মুসা।
সামনের দিকে এগোল তিনজনে। ব্রিজে ওঠার মই বেয়ে উঠে এল। চাবি বের করল কিশোর। এক এক করে তালায় ঢোকাতে শুরু করল। লেগে গেল একটা। হুইলহাউসের দরজা খুলল সে। ভেতরে ঢুকল ওরা। চারপাশে বড় বড় কাঁচের জানালা। বালি আর লবণ লেগে নোংরা হয়ে আছে। জানালার নিচে কেবিনেট, অনেক ড্রয়ার ওগুলোতে। অল্প আসবাবে সুন্দর করে সাজানো ঘরটা, জাহাজের হুইলহাউস যে রকম হয়।
আমি আশা করেছিলাম অগোছাল হবে, রবিন বলল। মিস্টার লিসটারের যা স্বভাব। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা সব।
জাহাজের ব্যাপারে হয়ত তার অন্য মনোভাব, কিশোর বলল। পুরনো জিনিস ছড়িয়ে রাখার জায়গা নয় জাহাজ।
কিংবা এমন কাউকে ক্যাপ্টেন বানিয়েছেন, মুসা বলল। যে নোংরামি একদম সইতে পারে না। তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না লিটার।
টান দিয়ে একটা ড্রয়ার খুলল কিশোর। সুন্দর করে একটার পর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে ম্যাপ। দ্রুত ওগুলো উল্টে দেখতে শুরু করল সে। সবই নটিক্যাল চাট, কোথায় প্রবাল প্রাচীর, কোথায় গভীরতা কম, এসব দেখানো রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের কাছের চার্ট ওগুলো।
সোগামোসোতে বন্দর নেই, রবিন বলল। ওখানে যেতে চাইলে স্থলপথে। যেতে হবে লিসটারকে। কিংবা ভেনিজুয়েলার কোন বন্দরে নেমে গাড়িতে করে।
আমরা এখানে সোগামোসো খুজুতে আসিনি, মনে করিয়ে দিল মুসা। এসেছি বিশপের বই খুজতে। সেটাই খোঁজা দরকার। কোথায় ওটা?
ভাল প্রশ্ন। একটা ড্রয়ার খুলল রবিন। আরেকটা। তারপর আরেকটা। ড্রয়ারের পর ড্রয়ার ঘেঁটে চলল, যা পেল, বেশির ভাগই চার্ট। আলমারিগুলোতে খুঁজছে মুসা। কিশোর খুঁজছে কয়েকটা খোলা তাকে। জাহাজ চালানোর ওপর কিছু বই পাওয়া গেল, আর কিছু যন্ত্রপাতি, কিন্তু বিশপের বইটা মিলল না। বিশপের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এরকম কিছুও না।
হুইলহাউসের প্রতিটি ইঞ্চি খোঁজার পর বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল কিশোর। দুই সহকারীকে নিয়ে মই বেয়ে আবার নেমে এল ডেকে। দুই ধারেই সারি সারি কেবিন রয়েছে। ওগুলোতে ঢুকে দেখতে লাগল ওরা।
বেশির ভাগই মনে হল অব্যবহৃত। বাংক আর রেডগুলোতে চাদর বালিশ কিছুই নেই। উল্টে ফেলে রাখা হয়েছে ম্যাট্রেস। নাবিকদের কোয়ার্টারটা দেখে। মনে হল, অল্প কিছু দিন আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংকের নিচে একটা টি শার্ট দলা পাকিয়ে ফেলে রেখে গেছে একজন নাবিক। ময়লা ফেলার ঝুড়িতে পড়ে রয়েছে পোভা সিগারেটের গোড়া, দলা পাকানো কাগজ।
অবশেষে সবচেয়ে বড় একটা কেবিনে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা। জানালায় পর্দা টানা। অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। দরজার পাশের সুইচ টিপল কিশোর। আলো জ্বলল না।
পাওয়ার নেই, বিড়বিড় করে বলল সে। আইলিন লিসটার এখন মরা। জাহাজ।
দরজার পল্লা পুরোটা খুলে দিল কিশোর। চওড়া একটা বিছানা প্লাস্টিকের চাঁদরে ঢাকা। চেয়ার আর টেবিলগুলোও ঢেকে রাখা হয়েছে একই রকম চাদর দিয়ে। কেবিনের একধারে রয়েছে অসংখ্য তাক। তাকের সামনের ধারগুলোতে নিচু রেলিঙ দেয়া, যাতে কোন জিনিস গড়িয়ে পড়তে না পারে।
একটা তাকে টর্চ দেখতে পেল কিশোর। নামিয়ে এনে জ্বালল। সারা ঘরে আলো বোলাল।
হ্যাঁ, এটাই লিসটারের ঘর, মুসা বলল।
তাকের ওপর যা থাকার কথা তা-ই রয়েছে। বই আর বই। যেখানেই ফাঁক। পাওয়া গেছে ঠেসে ভরে দেয়া হয়েছে কাগজপত্র। বইয়ের ফাঁকে টোল পড়ে যাওয়া দুটো টেনিস বলও ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। চামড়ার একটা দস্তানা ফেলে। রাখা হয়েছে একটা বাউলিং ট্রফির পাশে, আরনেস্ট জে. ক্র্যাবস নামে একজনকে ওটা পুরস্কার দিয়েছে ওয়েস্টসাইড কোলারস ক্লাব।
আরেকজনের পুরস্কার লিসটার রেখেছেন কেন? রবিনের প্রশ্ন।
এগিয়ে গেল কিশোর। ট্রফিটার দিকে চোখ। মেঝেতে স্তূপ করে রাখা জিনিসে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ত আরেকটু হলেই। পেছনের দেয়াল থেকে টেনে সরিয়ে আনা হয়েছে একটা তাক। কাত হয়ে রয়েছে ওটা। বইপত্র মেঝেতে ছড়ানো। নিচু হয়ে স্কুপের সব চেয়ে ওপরের বইটা তুলে নিল কিশোর। অনেক পুরনো একটা বই। চামড়ায় বাধানো। শক্ত হয়ে গেছে পুট, ফলে খুলে ছেড়ে দিলেই ঝট করে বন্ধ হয়ে যায়, যেন স্প্রিং লাগানো রয়েছে।
আলো ফেলে ভাল করে দেখল কিশোর। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কাভারের ডিজাইনটার দিকে। চোখা, উঁচু চূড়াওয়ালা একটা টুপির মত দেখতে। টুপিটার সামনের দিকে একটা ক্রস।
দুই সহকারীকে দেখাল ওটা সে। বিশপের টুপির মতই তো লাগছে। বিশপের বইটা বোধহয় খুঁজেই পেলাম অবশেষে।
দরজার দিকে ঘুরল সে। ডেকে ফিরে যাওয়ার জন্যে। বাধা পেল। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন মানুষ। চওড়া কাধ। নীল রঙের ওয়র্ক শার্ট পরা।
ভালুকের থাবার মত বড় একটা হাত বাড়াল লোকটা। ওটা নিয়ে যেতে পারবে না এখান থেকে। দেখি, দাও!
.
১২.
বারো বিশালদেহী লোকটার পেছনে এসে হাজির হল আরও দুজন। চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই তিন গোয়েন্দার।
বইটা দিতে চাইল না কিশোর। তার হাত থেকে কেড়ে নিল বিশালদেহী লোকটা।
পেছনের একজনের হাতে একটা পাইপ। এক হাতে আলতো করে ধরে ওটার মাথা বাড়ি মারতে লাগল আরেক হাতের তালুতে। এমন ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে। তাকাল, যেন তার মাথায় বাড়িটা মারতে পারলে খুশি হত।
বিরক্ত করে ফেলেছে, লোকটা বলল। কি করে যে বেড়া ডিঙিয়ে চলে আসে! আর এলেই কেবল চুরির তাল! এবার আর ছাড়ছি না। চুরির মজা এবার টের পাবে।
আমরা চোর নই, জবাব দিল কিশোর। মিস এলেনা লিসটারের অনুরোধে এসেছি। গেটে সই করেছি। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
সন্দেহ ফুটল লোকগুলোর চোখে। একজনও স্বীকার করতে রাজি নয়, ভুল করেছে।
আমাদের কিছু হলে মিস লিসটারের কাছে জবাব দিতে হবে আপনাদেরকে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল আবার কিশোর।
এবং শুধু দিয়েই পার পাবেন না, আরেকটু ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে বলল মুসা, আরও ভোগান্তি আছে।
সেটা বুঝতে পেরে রবিন বলল, পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার আমাদের বন্ধু। যান। বিশ্বাস না করলে থানায় ফোন করে দেখতে পারেন। কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ডকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করুন।
কি বল, ডিক? পাইপওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। একজন।
আমাদের বোকা বানাচ্ছে, বলল বিশালদেহী ভালুক। কিন্তু গলায় জোর নেই। তাকিয়ে রয়েছে গেটের দিকে, যেখান দিয়ে ঢুকেছে ছেলেরা।
শিওর হওয়া দরকার, বলল তৃতীয়জন। আগেই কিছু করা উচিত হবে না। গেটে যাওয়ার জন্যে রওনা হল সে।
অপেক্ষা করতে লাগল অন্য দুজন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল। লোকটা। সঙ্গে এসেছে দারোয়ান। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, এরাই। আধ ঘন্টা আগে ঢুকতে দিয়েছি।
তাই, সাংঘাতিক নিরাশ হল যেন বিশালদেহী লোকটা। কিছু কিলচড় দেয়ার জন্যে হাত নিশপিশ করছিল বোধহয়। সেটা আর পারল না। বেশ। কর, যা করছিলে।
বইটা দিন, হাত বাড়াল কিশোর।
সরি! বইটা ফেরত দিল লোকটা। ভুল হয়ে গেছে। অনেক চোরছ্যাচড়। আসে তো, বড় জ্বালাতন করে।
চলে গেল লোকগুলো। লোহালক্কড়ের জঙ্গলে ওরা হারিয়ে না যাওয়া তক অপেক্ষা করল ছেলেরা। তারপর লম্বা দম নিয়ে হাতের রইটার দিকে তাকাল। কিশোর।
তুমি কাঁপছ, মুসা বলল।
দূর! মনে মনে ধমক দিয়ে হাতটাকে কাঁপতে নিষেধ করল কিশোর। ধাপ্পা দিচ্ছিল লোকগুলো। কিছুই করত না।
বইটার মলাট ওলটাল সে। ভয় হল পাতা খুলে ছড়িয়ে যাবে, কিন্তু গেল না। শুকিয়ে খসখসে হয়ে আছে। বেশি জোরে চাপ লাগলে মুড়মুড় করে ভেঙেও যেতে পারে, এমনই মনে হল তার কাছে। বইয়ের মাঝের কয়েকটা পাতা নেই। কেটে নেয়া হয়েছে।
এটা একটা ডায়রি, ঘোষণা করল যেন গোয়েন্দাপ্রধান। কিংবা ডায়রির মতই কিছু। হাতে লেখা। তারিখ রয়েছে। শুরু হয়েছে এনিরো দিয়ে। স্প্যানিশে জানুয়ারিকে এনিরো বলে। জানুয়ারির পয়লা তারিখে বিশপ সান্তাফে বোগোটা নামে একটা জায়গায় গিয়েছিল…
বোগোটা! প্রায় চিৎকার করে বলল রবিন। ওটা তো কলাম্বিয়ায়! তাহলে সোগামোসোর সঙ্গে একটা যোগাযোগ পাওয়া গেল। সোগামোসোও কলাম্বিয়ায়।
ঠিক! শান্ত থাকার চেষ্টা করছে কিশোর, কিন্তু পারছে না, চকচক করছে চোখ। এখন আর স্বীকার করতে বাধা নেই ডেভিড লিসটারের গায়েব হওয়ার সঙ্গে ওই কমপিউটারের মেসেজেরও সম্পর্ক রয়েছে। হয়ত ওটাই আসল কারণ।
কিন্তু বইটার ব্যাপারে কি হবে? মুসার প্রশ্ন। কিশোর, কি আছে, বলত?
ভ্রূকুটি করল কিশোর। অনেক শব্দই অপরিচিত। লেখাও আবছা। আর এত ঘন, মাঝে মাঝে দুটো লাইন প্রায় এক হয়ে গেছে। আমার পড়ার সাধ্য হবে না, বলল সে। ইংরেজি হলেও পারতাম না, যা অবস্থা।
কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। হ্যাঁ। পুরনো দলিলের মত। যেগুলোতে এস লিখলে এফ-এর মত লাগে।
তাহলে আর এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? মুসা বলল, জলদি চল, প্রফেসর সাইনাসের কাছে চলে যাই। ডক্টর ওয়ালটার সাইনাস, রুক্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রফেসর, স্প্যানিশ আর মেকসিকান ইতিহাস বিশেষজ্ঞ। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের বন্ধু। আগেও অনেক সাহায্য করেছেন তিন গোয়েন্দাকে।
তার কাছে গেলেই ভাল হয়, কিশোর বলল। তবে বইটা নিতে হলে। এলেনার অনুমতি দরকার। আমাদেরকে বইটা খুঁজে দিতে অনুরোধ করেছে সে, যাতে ওটা দিয়ে তার বাবাকে উদ্ধার করে আনতে পারে কিডন্যাপারদের হাত থেকে। হয়ত বইটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তার। বাবাকে উদ্ধার করতে পারলেই খুশি।
তা বটে, একমত হল মুসা। কেসটা এমনই, মাঝে মাঝেই আমি, কিডন্যাপিঙের কথা ভুলে যাই। অথচ ওটাই আসল ব্যাপার।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। লিটারের কেবিনের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। গেটে এসে চাবির গোছা বুঝিয়ে দিল দারোয়ানকে। তারপর চলল একটা পে ফোন খুঁজে বের করতে। এলেনার মায়ের বাড়িতে ফোন করে এবার আর তাকে পেল না। জবাব দিল আনসারিং মেশিন। একটা মেসেজ রেখে দিয়ে, রকি বীচে লিসটারের বাড়িতে ফোন করল কিশোর।
ফোন ধরল মিসেস বেকার। বলল, ধর। আমি ডেকে আনছি ওকে।
এলেনা লাইনে এলে তাকে সব কথা খুলে বলল কিশোর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত যেন স্তব্ধ হয়ে রইল সে, যেন খবরটা হজম করতে সময় লাগছে, তারপর বলল, থ্যাঙ্ক গুডনেস!
বইটা কেন এত জরুরী, কিশোর বলল, বের করতে চান? নাকি শুধু পেলেই খুশি, কিডন্যাপারদের দিয়ে দেবেন?
দ্বিধা করল এলেনা। সময় কম। আবার ফোন করেছিল লোকটা। তাকে বলেছি বইটা খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। আর মাত্র একদিন সময় দিয়েছে।
তার মানে আগামী কাল পর্যন্ত সময় পাচ্ছি, খুশি হয়ে উঠল কিশোর। ডক্টর সাইনাসের কথা বলল। তিনি হয়ত পড়ে দেবেন। আর তার সময় না থাকলে অন্য কারও কাছে পাঠাবেন। তো বইটা কি নিয়ে যাব?
নিতে পার। আরেক মুহূর্ত দ্বিধা করল এলেনা। সেটাই বোধহয় ভাল হবে। কি জিনিসের জন্যে আব্বাকে আটক করেছে ওরা জানার আগ্রহটা চেপে রাখতে। পারছি না। লেগে যাও কাজে। এছাড়া আর কিছু করারও নেই এখন আমাদের। বইটা যে পেয়েছি লোকটাকে জানানোর উপায় নেই। সে ইচ্ছে করে যখন ফোন। করবে তখন বলতে পারব। তার আগে সম্ভব না।
একটা সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল এলেনা, আর বাড়িতে এখন বইটা রাখতেই সাহস পাচ্ছি না আমি। যেটার জন্যে আব্বা কিডন্যাপড় হয়েছে সেটার জন্যে আমারও ক্ষতি করতে পারে অন্য কেউ, বলা যায় না। কাল রাতে কেউ ঢুকেছিল এ বাড়িতে। আমার ঘর, আলমারি, ড্রয়ার সব খুঁজেছে। মনে হচ্ছে চাবি আছে লোকটার কাছে। আব্বাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হয়ত তার কাছ থেকে আদায় করেছে। ইচ্ছে মত আসাযাওয়া করতে পারছে এখন লোকটা।
একজন চাবিওয়ালাকে ডাকন, পরামর্শ দিল কিশোর। তালাগুলো বদলে দিয়ে যাক। এভাবে চলতে পারে না। ঠিক আছে, আমরা প্রফেসর সাইনাসের। ওখানে যাচ্ছি। কিছু জানতে পারলে আপনাকে জানাব।
রুক্সটনে প্রফেসর সাইনাসকে ফোন করল কিশোর। ভাগ্য ভাল। গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে, তবু অফিসেই পাওয়া গেল প্রফেসরকে। নিয়মিত অফিসে আসেন। তিনি ছুটিতেও। ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি হলেন।
তাড়াতাড়ি ইয়ার্ডে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। রাশেদ চাচাকে অনুরোধ করল। পিকআপটা দেয়ার জন্যে। তিনি তখন বেরোচ্ছিলেন, তিন গোয়েন্দাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে যেতে রাজি হলেন। সেখান থেকে কাজে চলে যাবেন। ফেরার পথে সুযোগ পেলে আবার তুলে নেবেন ওদেরকে। আপাতত এই ব্যবস্থাই মেনে নিতে হল কিশোরকে।
একজন বন্ধুর সঙ্গে অফিসে বসে রয়েছেন প্রফেসর সাইনাস। তার বন্ধুটি ভীষণ রোগা। চকচকে টাক। ইনি ডক্টর ক্রুগার মনটাগো, পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্ট অভ রোমান্স ল্যাঙ্গুয়েজের হেড। তোমাদের জন্যেই বসিয়ে রেখেছি। পুরনো স্প্যানিশ পাণ্ডুলিপির প্রতি তাঁর সাংঘাতিক আগ্রহ।
হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল কিশোরের। এরকম একজনকেই আশা করছিল মনে মনে। প্রফেসর সাইনাসের চেয়ে ডক্টর মনটাগোকে দিয়ে বেশি সাহায্য হবে, বুঝতে পারছে সে। বিশপের বইটা বের করে বাড়িয়ে দিল ভক্টরের দিকে।
বই খুলে প্রথম পৃষ্ঠাটার দিকে চেয়েই বলে উঠলেন তিনি, বাহ! পাতার পর। পাতা ওল্টাতে থাকলেন তিনি। হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখ। সাংঘাতিক জিনিস!
কি স্যার? জানতে চাইল কিশোর।
পয়লা জানুয়ারি, সান্তা ফে বোগোটায়, আবার প্রথম পৃষ্ঠায় ফিরে এলেন, মনটাগো। লেখক নিউ গ্রানাডার মানুষের জন্যে ঈশ্বরের কাছে দোয়া করছেন। বলছেন যেন তাদের চেষ্টা সফল হয়। তারপর রয়েছে একটা চিঠির কথা। প্রাসাদে অপেক্ষা করছিল হিজ মোস্ট গ্রেশাস ম্যাজেসটি কিং কার্লোসের চিঠিটা।
বই থেকে মুখ তুললেন ডক্টর। এ তো একটা গুপ্তধন পেয়ে গেছ। এই জার্নালের লেখক সম্ভবত বিশপ ছিলেন। একটা প্রাসাদের কথা লিখেছেন তিনি। আসলে বলতে চেয়েছেন প্যালেস। বিশপের বসত বাড়িকে প্যালেসই বলে। তার কাছে চিঠি লিখতেন রাজা। ওই বিশপ সাধারণ পাদ্রী হলে এভাবে তাঁর কাছে লেখার কথা নয় রাজার। সেটা অবশ্য জানা যাবে একটু পরেই। এসব পুরনো লেখা থেকে তথ্য খুঁজে বের করার কায়দা আছে। কাগজ, কালি এসব পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে ডায়রিটা এনরিক জিমিনির, রক্তাক্ত বিশপ বলা হত যাকে!
রক্তাক্ত বিশপ? প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর।
ঢোক গিলল মুসা। কিছু হয়েছিল নাকি তার?
আসলে, আমাদের সবারই কিছু না কিছু ঘটে, ডক্টর মনটাগো বললেন। জীবন হল একটা সাময়িক ব্যাপার। তাই মৃত্যু থেকে মুক্তি নেই কারও। রক্তাক্ত বিশপের ঠাণ্ডা লেগেছিল। তখনকার দিনে ঠাণ্ডা ছিল মারাত্মক অসুখ। সহজেই নিউমোনিয়ায় রূপ নিয়ে শেষ করে দিত মানুষকে। শোনা যায়, অসুস্থতার সময় তাকে এড়িয়ে চলেছিল তার একজন চাকর। ইচ্ছে করেই। যাতে তার মৃত্যটা তাড়াতাড়ি হয়। তবে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না একথা। সন্দেহটা গাঢ় হয় একটা ব্যাপার থেকে, বিশপের মৃত্যুর পর পরই পালিয়েছিল সেই চাকর। প্রতিদিন জার্নাল লিখতেন বিশপ জিমিনিজ, কিন্তু তাঁর সেই জার্নাল পাওয়া যায়নি।
প্রফেসর সাইনাস দরাজ হাসি হাসলেন তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে। যাও, পেয়ে গেলে আরেকটা রহস্য। পুরনো রহস্য খুঁচিয়ে বের করতে তো ওস্তাদ তোমরা। বেশি না, মাত্র চারশো বছরের পুরনো এই ঘটনা। সূত্রটুত্র এখনও নিশ্চয় কিছু পাবে।
স্বর্ণ জড়িত থাকতে পারে এতে, মনটাগো বললেন। ছেলেদের দিকে তাকালেন। দক্ষিণ আমেরিকায় এসে ঢুকল স্প্যানিশ সৈন্যরা। মার্চ করে এগিয়ে। চলল। চলার পথে যত জমি পড়ল, সব দখল করে নিল রাজা আর রানীর নামে। সোনাও পাওয়া যেত মাঝে মাঝে। জাহাজ বোঝাই করে সেসব সোনাচালান যেত স্পেনে। মূল্যবান, যা কিছু পেয়েছে নিয়ে গেছে স্প্যানিশরা। জোর করে ধরে এনে ইনডিয়ানদেরকে খনির কাজ করতে বাধ্য করেছে। শোনা যায় সোনার খনিতে যে। সব ইনডিয়ানরা কাজ করত তাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার করেছেন বিশপ জিমিনিজ। সে জন্যেই তার নাম হয়ে গিয়েছিল রক্তাক্ত বিশপ…
ও, কথাটা শোনামাত্রই বিশপের ওপর থেকে শ্রদ্ধা চলে গেল রবিনের। এই ব্যাপার। তাহলে তো তার নাম রাখা উচিত ছিল রক্তখেকো বিশপ।
তবে সত্যিই তিনি অত্যাচারী ছিলেন কিনা জানা যায়নি, মনটাগো বললেন। হতে পারে রাজার লোকেরাই গিয়ে মিথ্যে কথা ছড়িয়েছে। খনির ওভারশিয়ার নিজেই হয়ত ওসব অত্যাচার করেছে, দোষ দিয়েছে বিশপের। শত শত বছর পরে এখন আর কে ঠিক করে করে বলবে?
যাই হোক, বিশপ নাকি পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়েছেন। বৃদ্ধ বয়েসে ইনডিয়ানদের সঙ্গে ভাব করে অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন। লোকে মানুষের ভালটার চেয়ে খারাপটাই বেশি দেখে। ভাল বেশি। হলেও দেখে না, খারাপ কম হলেও সেটা মনে রেখে দেয়। রক্তাক্ত বিশপের বেলায়ও এই ব্যাপারই ঘটেছে। তার কুকর্মগুলোর কথাই বেশি মনে রেখেছে লোকে।
নীরব হয়ে রইল ছেলেরা। ভাবছে সেই চারশো বছর আগের ঘটনার সঙ্গে বর্তমান লিসটার কিডন্যাপিঙের কি যোগাযোগ?
অবশেষে জিজ্ঞেস করল কিশোর, বিশপ জিমিনিজের জার্নালটা কি খুবই দামী কিছু? যেটা খোয়া গেছে?
দ্বিধায় পড়ে গেলেন ডক্টর মনটাগো। দামী? তা সবার জন্যে না-ও হতে পারে। স্কলার আর ঐতিহাসিকদের কাছে হয়ত অমূল্যই হবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে নয়। এই যেমন ম্যাগনা কার্টা-র লেখার খসড়া, কিংবা কলম্বাসকে লেখা রানী ইসাবেলার চিঠির মত অনেক দামে বিক্রি হবে না এটা।
বইটা বগলদাবা করলেন মনটাগো। কিন্তু একজন স্কলারের কাছে? অসাধারণ! আমি আর থাকতে পারছি না। এখনই গিয়ে অনুবাদে বসতে চাই…
না না! রবিন বলল।
সময় পাবেন না! বলল মুসা।
মানে? হাসি মুছে গেছে মনটাগোর।
এর বর্তমান মালিক কিডন্যাপড হয়েছেন, বুঝিয়ে বলল কিশোর। তাঁকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে এই বইটা দাবি করেছে কিডন্যাপার। কালকের মধ্যে না দেয়া গেলে কি করে বসে ঠিক নেই।
ও, চিন্তায় পড়ে গেলেন যেন ডক্টর। পরক্ষণেই উজ্জ্বল হল মুখ। তাহলে…ফটোকপি করার সময়…নাহ, হবে না। এরকম বই সাধারণ জেরোক্স মেশিনে করা যাবে না। ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থায় ফটোকপি করে নেবে ওরা।
বগলের নিচ থেকে বইটা বের করে ওটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন ডক্টর। যেন ওটা একটা মহামূল্যবান বস্তু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িয়ে দিলেন বলে কিশোরের দিকে।
আশা করি, বললেন তিনি। আর এটা নিখোঁজ হবে না। কোনভাবে বাঁচাতে যদি পার…।
চেষ্টা তো নিশ্চয় করব, স্যার, আশ্বাস দিল কিশোর। আর রাখতে পারলে অনুবাদের জন্যে আপনাকেই প্রথম দেব।
দরজার দিকে চলল তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ ফিরে তাকাল কিশোর, আচ্ছা, ঈশ্বরের অশ্রুর কথা আপনি কিছু জানেন, স্যার?
ঈশ্বরের অশ্রু? ভুরু কোচকালেন মনটাগো। পান্নার ওই নাম রেখেছে ইনডিয়ানরা। কেন? তার সঙ্গে এই বইয়ের কোন সম্পর্ক আছে?
থাকতে পারে!
.
১৩.
পান্না! চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসল রবিন। তাকিয়ে রয়েছে হেডকোয়ার্টারের ছাতের দিকে। স্প্যানিশ সৈন্য! চোরাই ডায়রি! নিরুদ্দেশ চাকর! সব মিলিয়ে। চমৎকার এক রহস্য! মিস্টার ক্রিস্টোফার শুনলে খুব খুশি হবেন। এরকম কাহিনীই তো তিনি চান ছবি বানানোর জন্যে।
কিশোরও হাসল। বানাতে চাইলে অপেক্ষা করতে হবে তাকে। সমস্ত রহস্যের জট খুলে পুরো একটা কাহিনী তৈরি করতে হবে, তার পর না ছবি।
মেসেজের কমপিউটার প্রিন্ট আউটটা ডেস্কে রেখে দেখছে গোয়েন্দাপ্রধান। ঈশ্বরের অশ্রু এলেনার জন্যে সূত্র। কিন্তু অশ্রুগুলো কোথায়? আর রক্তাক্ত বিশপের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক ছিল?
কলাম্বিয়ায় প্রচুর পান্না পাওয়া গেছে, রবিন বলল। পান্নার খনি আছে। ওখানে। দুনিয়ার সব চেয়ে বড় পান্নার খনি, রেফারেন্স বইতে পড়েছি। মনে হচ্ছে, ওগুলো খুঁজে আনার জন্যে এলেনাকে সোগামোসোতে যেতেই হবে। পান্নার খনির সঙ্গে বিশপের কোন যোগাযোগ ছিল না তো? নাকি শুধুই সোনা?
ঘড়ি দেখল কিশোর। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিকেল তো শেয। ফোন করে এলেনাকে জানানো দরকার সব কথা। রিসিভার তুলল সে। লিটারের নম্বরে ডায়াল করল। দ্বিতীয়বার রিং হতেই জবাব দিল এলেনা। আমি, কিশোর বলল। কি ব্যাপার? উত্তেজিত লাগছে। ফোন করেছিল নাকি আবার?
না। তুমি করলে তো, ভাবলাম কিডন্যাপারই করেছে। রুক্সটনে গিয়েছিলে?
গিয়েছি। বইটা একজন লিশপের ডায়রি। কয়েক শো বছর আগে কলাম্বিয়ায় বাস করতেন। সোনার খানকে সাংসাতি অত্যাচার করতেন ইনডিয়ানদের ওপর, সে জন্যে নাম হয়ে গেছে রক্তাক্ত বিশপ। অসুখ হয়ে বিশপ মারা গেলে ডায়রিটা নিখোঁজ হয়ে যায়। সব কিছু পরিষ্কার বলা যাচ্ছে না, কারণ বইটার পুরো অনুবাদ করা হয়নি। উক্টর মনটাগোর কাছে রেখে আসতে পারলে, সময় দিতে পারলে, হত। আমরা তো সেটা করতে পারি না।
না, পার না।
আরেকটা কথা, ঈশ্বরের অশ্রু জিনিসটা কি জানতে পেরেছি। অ্যাডিজ পর্বতের ইনডিয়ানরা পান্নার ওই নাম দিয়েছে।
পান্ন? এক সেকেও চুপ করে থাকল এলেনা। তারপর আবার বলল, পান্না? আমাকে এতগুলো দামী জিনিস দান করে দিল আব্বা? মধ্য গ্রীস্মের দিন আর বৃদ্ধা টি মহিলা বলতেই বা কি বোঝাতে চেয়েছে? আরও যেসব সংকেত?
আপনার আব্বাকে উদ্ধার করে আনতে পারলে সমস্তই জানা যাবে। এখন যেটা জরুরী, বইটা কিডন্যাপারকে দিয়ে তাকে মুক্ত করে আনা। আজ রাতে কোথায় থাকবেন? ওখানেই? কাউকে আপনার সঙ্গে থাকতে হবে?
না, এলেনা বলল। দরকার নেই। আজ রাতে আম্মা এসে থাকবে বলেছে। কিছু জানতে পারলে তোমাদেরকে জানাব।
লাইন কেটে দিল এলেনা।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেজে উঠল ফোন। হেনরি বেসিন ফোন করছে। এলেনা লিসটার আমার সমস্ত পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে। দোকানে আসতে পারবে? তোমাদের টাকাটা দিয়ে দিতাম।
নিশ্চয়ই, জবাব দিল কিশোর।
রিসিভার নামিয়ে রেখে বইটা আলমারিতে ভরে তালা দিল কিশোর। তারপর দুই সহকারীকে নিয়ে বেরিয়ে এল ট্রেলার থেকে। সাইকেল নিয়ে রওনা হল।
রকি বীচের একটা গলিতে বেসিনের দোকান। ছেলেরা পৌঁছে সামনের অংশে। কাউকে দেখতে পেল না। রান্নাঘরে চলে এল ওরা। ওখানে পাওয়া গেল বেসিনকে। টেবিলে খাতা বিছিয়ে গভীর মনোযোগে হিসেব করছে। কিশোররা ঢুকতে একটা মেয়ে বেরিয়ে গেল। সে-ও পার্টিতে কাজ করতে গিয়েছিল। পাওনা বুঝে নিয়ে গেল বোধহয়।
হাসল বেসিন। টাকা রেডিই রেখেছি। একটা করে খাম তুলে দিল তিনজনের হাতে। সবাইকেই দিয়েছি। বাকি রইল একমাত্র পিকো।
পিকো? কিশোর বলল। ওহহো, মনে পড়েছে। ধোয়ামোছার জন্যে যাকে নেয়া হয়েছিল।
হ্যাঁ। গত দুহপ্তা ধরে আমার এখানে কাজ করছে। অনেক সাহায্য হচ্ছে আমার।
নিজের খামটা খুলল রবিন। নোটগুলো গুণে বলল, বেশি দিয়ে ফেলেছেন।–
কিছুটা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বেসিন বলল। এত কম হাতে উঠছিল না। অনেক খেটেছ, দেখেছি তো। চকলেট কেক খাবে? কাল বিকেলে একটা বাচ্চার জন্মদিনে গিয়েছিলাম। অনেক কেক বেঁচেছিল, নিয়ে এসেছি। আমি মুখেও দিতে সাহস করিনি। এমনিতেই মোটা হয়ে যাচ্ছি। আমার গার্লফ্রেণ্ডও জানলে মাথায় বাড়ি দেবে।
কেকটা ভালই হয়েছে, না? জানতে চাইল কিশোর।
হাসল বেসিন। প্যানট্রিতে রয়েছে। ওই দরজাটার ওপাশে, তাকে।
প্যানট্রিতে এসে ঢুকল কিশোর। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত রয়েছে অসংখ্য তাক। জিনিসপত্র বোঝাই। চকলেট, ময়দা, চিনি, তেল, খাবার বানাতে লাগে। এরকম নানা জিনিস।
চকলেট কেকটা নামাতে দরজাটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। পাল্লাটা অর্ধেক ভেজিয়ে দিল কিশোর। কেকের পাত্রের পাশে যে ছুরিটা রেখে দিয়েছে বেসিন সেটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়িয়েছে সে, এই সময় পায়ে লাগল কি যেন। নিচে চেয়ে দেখল দরজার পেছনে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ ঠেলে রাখা হয়েছে। লাল ব্যাগ। উজ্জ্বল বেগুনী রঙে লেখা রয়েছে কোম্পানির নাম। ডি এল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে এসেছে জিনিসটা।
একটা মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তাহলে লিসটারের দোকানে গিয়েছিল বেসিন। তা যেতেই পারে। জিনিস কিনতে যে কেউ যেতে পারে ওই দোকানে। ক্যাটারার গেলেও কোন দোষ নেই। কি কিনতে গিয়েছিল? শার্ট? জুতো? এন্থনির সঙ্গে নিশ্চয় ব্যবসার সম্পর্ক নেই বেসিনের।
এলেনার মায়ের বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসছে এনথনি, দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল কিশোরের। ঠিক কোন জায়গাটায় ছিল সে, যখন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল কিশোর?
লুকিয়ে ছিল। আর কোন ব্যাখ্যাই হতে পারে না। যদি কোন কুমতলব না থাকত, আর শুধুই দেখা করতে যেত তাহলে লিভিং রুমেই বসে থাকত, স্বাভাবিক ভাবে। কিশোরের সামনে থাকতে দ্বিধা করত না। কিন্তু সে লুকিয়েছিল। কেন?
তার সঙ্গে হেনরি বেসিনেরও কোন সম্পর্ক রয়েছে? লিসটারের কিডন্যাপের ব্যাপারে তারও হাত রয়েছে? নাহ, লোকটাকে দেখে সেরকম মনে হয় না। তবে মুখ দেখে সব সময় অপরাধীকে সনাক্ত করা যায় না। তাহলে মোটিভটা কি? লিসটারের কমপিউটারে বেসিনের নাম নেই। থাকার কথাও নয়। লিসটারের কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে না বেসিন। কিন্তু তাই বলে শত্রুতা থাকতে পারে না এমন কোন কথা নেই। কে যে কখন কিভাবে কার শত্রু হয়ে উঠবে বলা মুশকিল। এমনও হতে পারে রক্তাক্ত বিশপের ডায়রির কথাটা জানে বেসিন। কিংবা এনথনি জানিয়েছে। বেসিনের টাকার দরকার। কাজেই সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। ঘুস নিয়েছে।
প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের ওপর দিকটায় নীল রঙের কি যেন রয়েছে। ঝুঁকে ছুঁয়ে দেখল, কিশোর। একটা উইণ্ডব্রেকার। নাড়া লেগে কাত হয়ে পড়ে গেল ব্যাগটা, ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল উইণ্ডব্রেকারটা। ওটার নিচে রয়েছে ভঁজ করা একটা খবরের কাগজ। চুলো না কিশোর। শুধু তাকিয়ে রইল।
দেখতে পাচ্ছে কাগজটার বিভিন্ন জায়গা কাটা। শব্দ! প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন থেকে শব্দ কেটে নেয়া হয়েছে। ওগুলো কেটেই লাগিয়েছিল এলেনার কাছে। পাঠানো নোটে…
কিশোর? রান্নাঘর থেকে ডাকল বেসিন। কি করছ? পাওনি?
ভীষণ চমকে গেল কিশোর। তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভেতরে উইণ্ডব্রেকারটা ঢুকিয়ে আগের মত করে রেখে দিল। দ্রুত হাতে তিন টুকরো কেক কেটে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যান্ট্রি থেকে।
আপনার জন্যে আনলাম না, বেসিনকে বলল সে।
না, খাব না। ঠিকই করেছ।
খেতে শুরু করল রবিন আর মুসা। একটা টুল টেনে নিয়ে নিজের টুকরোটায় কামড় বসাল কিশোর।
তারপর? যেন নিছকই আলোচনার জন্যে বলল বেসিন। এলেনার সঙ্গে কেমন কাটছে তোমাদের? কিছু পেলে? বাবাকে মুক্ত করতে পারবে মেয়েটা?
চেষ্টা তো নিশ্চয় করবে। কিন্তু খুব কঠিন কাজ। কিডন্যাপার এমন একটা জিনিস চাইছে যেটার মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যায় না। টাকাটুকা কিছু না, লোকটা। চাইছে বিশপের বই।
খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে রবিন আর মুসা। কিশোরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। মুসা বলেই ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমরা তো জানি!
কি ভেবে বলল না সেকথা। বলার জন্যে মুখ খুলে ফেলেছে, কিছু একটা বলতেই হয়, লিসটারের বাড়ির হাজার হাজার বই ঘেঁটে ফেলেছি আমরা। আরও কত জিনিস যে ঘেঁটেছি। কোন কিছুই ফেলে দেয় না লোকটা। এক অদ্ভুত চরিত্র।
হাসল বেসিন। হ্যাঁ। বেশির ভাগেরই কানাকড়ি দামও নেই।
ভাবছি, কিশোর বলল, সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিনেও যাব। বোম্প্রিট ড্রাইভের শিপইয়ার্ডটার কথা শুনেছেন? সেখানে ড্রাই ডুকে লিসটারের একটা ইয়ট তুলে রাখা হয়েছে। আইলিন লিসটার। দেখা যাক, বিশপের বই মেলে কিনা ওখানে। ওখানেও নিশ্চয় বাড়ির মতই জঞ্জাল বোঝাই করে রেখেছেন লিটার।
রাখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে তাকাল বেসিন। এসেছ। এস। টাকা রেড়ি। যা বলেছিলাম তার চেয়ে বেশিই পাবে।
ফিরে তাকিয়ে কিশোরও দেখতে পেল পিকোকে। ছেলেদের দিকে একবার মাথা নুইয়ে এগিয়ে গেল বেসিনের কাছে।
তোমাদের হল? রবিন আর মুসাকে বলে শেষ টুকরোটা মুখে পুরল কিশোর।
বেসিনকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। দাঁড়িয়ে রয়েছে বেসিনের ভ্যান। সেটার পাশ কাটাল ওরা। গলি পার হয়ে এসে পড়ল বড় রাস্তায়। ফিরে তাকাল কিশোর।
ব্যাপারটা কি বল তো? জিজ্ঞেস করল রবিন। ওরকম না জানার ভান করলে কেন?
নিশ্চয় কিছু বের করেছ, মুসা বলল।
প্যানট্রিতে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ আছে, কিশোর বলল। লিসটারের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের জিনিস। তার মধ্যে একটা খবরের কাগজ আছে। কিছু কিছু শব্দ কেটে নেয়া হয়েছে।
বল কি! হাঁ হয়ে গেল রবিন।
ঠিকই বলছি।
বেসিন? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। ও কিডন্যাপার? যত যাই বল আমার বিশ্বাস হয় না! তোমার দাদা ড্রাকুলা ছিলেন একথা বললে যেমন বিশ্বাস হবে না
বিশ্বাস না হলেও ব্যাপারটা সত্যি হতেই পারে, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। বেসিনের ব্যাপারটাও অসম্ভব কিছু নয়। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না।
তার মানে তার জন্যে একটা ফাঁদ তৈরি করে এলে, রবিন বলল।
করে এলাম। সে ভাববে শিপ ইয়ার্ডে ইয়টের মধ্যে থাকতে পারে বিশপের, বই। জানল তো। দেখা যাক এখন কি করে।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মুসা। তার পিছু নিতে হলে একটা গাড়ি এখন জরুরী। আমাদেরগুলো তো জাহান্নামে গেছে। কোথায় যে পাই…
আরনি ভিনসেনজোর কাছে, সমাধান করে দিল কিশোর। আমাদেরকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছে সে।
.
১৪.
পনেরো মিনিটেই পৌঁছে গেল আরনি। ধূসর রঙের একটা সিডান নিয়ে এসেছে। বাম্পারে মরচে পড়া। রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায়। পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি, জানাল সে। ইচ্ছে করেই আনলাম। এত পুরনো গাড়ির ওপর নজর দেয় না কেউ। তা কার পিছু নিতে হবে?
হেনরি বেসিন, কিশোর বলল। ওদিকটায় তার দোকান। বেরোবে। এখনই।
বেসিন? অবাক হল আরনি। সে এতে জড়িত? এত ভাল একটা লোক?
বিশ্বাস করা শক্ত, স্বীকার করল কিশোর। কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়েছি-ওই যে, বেরোল।
ক্যাটারিং শপের পেছন দিকে তাকাল সবাই। ছিটকানি লাগাচ্ছে বেসিন।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল আরনি।
ভ্যানে উঠল বেসিন। চলতে শুরু করল গাড়িটা।
মাথা নিচু করে ফেলল ছেলেরা।
মোড়ের কাছে গিয়ে ব্রেক করল বেসিন। ডানে বায়ে তাকাল। তারপর মোড় নিয়ে কোস্ট হাইওয়ের দিকে রওনা হল।
একটা ব্লক তাকে এগোতে দিল আরনি। তারপর অনুসরণ করে চলল।
চৌরাস্তায় এসে থামতে হল বেসিনকে। লাল আলো জ্বলেছে। দূরে থাকতেই গতি কমিয়ে দিল আরনি। আরেকটা ভ্যান পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল মাঝের ফাঁকে। গাড়িটাতে কয়েকজন লোক, সার্ফ করতে চলেছে সাগরে।
বেশ সাবধানী লোক আপনি, প্রশংসা করল মুসা।
হাসল আরনি। ডিটেকটিভ ছবি দেখেছি অনেক। কি করে অনুসরণ করতে হয় শিখে নিয়েছি।
সবুজ আলো জ্বলল। হাইওয়েতে উঠল গাড়িগুলো। উত্তরে চলল, বোম্প্রিটের। দিকে। শেষ মোড়টার কাছে গিয়ে উত্তেজনায় টান টান হয়ে গেল কিশোরের স্নায়ু। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে থামল না ক্যাটারারের ভ্যান, সোজা এগিয়ে চলল।
কিশোর, রবিন বলল। থামল না তো! তার মানে এসবে নেই?
জবাব দিল না কিশোর।
চ্যাপার্যাল ক্যানিয়নে পৌঁছে ব্রেক করল বেসিন। ডানে মোড় নিল। হাইওয়ে থেকে তিন ব্লক দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। ওটার সামনে গাড়ি রেখে গিয়ে সামনের দরজায় উঠল সে। বেল বাজাল।
ভ্যানের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল আরনি। পরের ব্লকের কাছে গিয়ে থামল। পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেরা। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখল বেসিনকে। কয়েক মিনিট পরে একটা মেয়েকে সহ বেরিয়ে এল। সুন্দর চেহারা মেয়েটার, কালো চুল। দুজনে এসে উঠল ভ্যানে। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে চলল আবার গাড়িটা।
কিন্তু এবারেও গতি কমাল না শিপইয়ার্ডের কাছে।
নাহ, যাচ্ছে না তো, নিরাশ হয়ে বলল রবিন। আজ রাতে আর যাবে না।
সত্যিই গেল না বেসিন। সোজা দক্ষিণে মেরিনা ডেল রে-এর কাছে একটা রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে গিয়ে ঢুকল।
বুঝলাম, আরনি বলল। গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে গেছে ডিনারে। এতে কোন দোয নেই। ক্রাইম করেনি। ও শিপইয়ার্ডে ঢুকলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত আমার।
আরনি কথা বলছে, বেসিন তখন রেস্টুরেন্টের সামনের দরজায় গিয়ে দড়িয়েছে। দরজা ঠেলে খুলে ধরে রাখল যাতে মেয়েটা ঢুকতে পারে। তারপর ফিরে তাকাল। যেন আরনির গাড়িটার দিকেই তার নজর। একই মুহূর্তের জন্যে। ডেভিড লিটারের দাঁড়ানোর ভঙ্গি মনে পড়ে গেল কিশোরের। গেলাস ভাঙার পর রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লিসটার, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বেসিন আর পিকোর দিকে। কল্পনায় দেখতে পেল পিকোর চেহারা, তাকিয়ে রয়েছে লিসটারের দিকে। আরনির বলা হার্ট অ্যাটাক শব্দটা যেন প্রতিধ্বনি তুলল। কিশোরের মনে।
আমি একটা গাধা! কপালে চাপড় মারল কিশোর। বেসিন কি করে হয়? ও হতেই পারে না। এখন আমার মনে পড়ছে। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে। দাঁড়িয়েছিলেন লিসটার, বেসিনকে শাসানোর জন্যে, তার ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া। একটা মেয়ে গেলাস ভেঙে ফেলেছে বলে। তখন থেকেই সমস্ত ঘটনা শুরু।
নীরব হয়ে গেল সে। তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। চোখ মুদে ফেলল ধীরে ধীরে। ওখানে হেনরি বেসিনও ছিল। ট্রেতে খাবার রাখছিল। পিকো কাজ করছিল। সিংকে। সাবান দিয়ে বাসন ডলছিল। হাত ভেজা। ওই মুহূর্তের আগে। কিডন্যাপিঙের প্লটই তৈরি হয়নি। বাজি ধরে বলতে পারি। নিরাপদেই ছিলেন লিসটার, হঠাৎ করেই পরিস্তিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠল তার জন্যে। মারাত্মক বিপদ। সেটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। আমি দেখেছি সেটা। অথচ তখন বুঝতে পারিনি।
সামনে ঝুঁকল রবিন। কেন পারলে না? কি ঘটেছিল?
কি রকম রেগে গিয়েছিলেন লিসটার মনে আছে? চিৎকার করছিলেন। তাকে থামানোর চেষ্টা করছিল এলেনা। তারপর পিকো তাকিয়েছিল তার দিকে। হাত থেকে বাসন ফেলে দিয়েছিল। আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিল লিসটারের।
তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, আরনি বলল। কোন জিনিস ভাঙলে ভীষণ খেপে যায় বুড়োটা। চোখের সামনে একগাদা বাসন ভাঙতে দেখলে শান্ত থাকার কথা নয় তার।
আসল কারণ সেটা নয়, কিশোর বলল। বাসনগুলো ভাঙার পর প্রথম ভালমত পিকোর ওপর নজর দিয়েছিলেন লিসটার। তাঁর দিকে তাকিয়েছিল পিকো। লিসটারের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি, কিন্তু পিকোর পাচ্ছিলাম। অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটেছিল তার চোখে। আমি তখন ভেবেছিলাম বুঝি ভয় পেয়েছে। এখন বুঝতে পারছি ভয় নয়, ঘৃণা। কেঁচোর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় মানুষ, সেই দৃষ্টি। লিসটারকে চিনতে পেরেছিল পিকো। আগে থেকেই পরিচয় ছিল। লিসটারও চিনতে পেরিছিলেন তাঁকে। এ কারণেই অ্যানজিনার অ্যাটাক হয়।
হাঁ করে শুনছে রবিন। পিকো…পিকোই সিয়েটা!
হতে পারে, কিশোর বলল। ওর ব্যাপারেই এলেনাকে হুঁশিয়ার করেছেন হয়ত লিটার। আমার ভুল না হয়ে থাকলে এ মুহূর্তে আইলিন লিসটারে বিশপের বই খুঁজতে চলে গেছে পিকো। আমি বেসিনের সঙ্গে যখন ইয়টটার সম্পর্কে কথা বলছিলাম, ওই সময়ই সে ঢুকেছিল। নিশ্চয় শুনে ফেলেছে। প্যাস্ট্রিতে যে ব্যাগটা পেয়েছি ওটা বেসিন রাখেনি ওখানে, পিকো রেখেছে।
চল তাহলে! তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘোরাল আরনি। তীব্র গতিতে ছুটল বোটি ড্রাইভের দিকে।
সেন্ট্রাল কোস্ট মেরিনে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। মুসার ভয় হতে লাগল, দারোয়ান ওদেরকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না।
গেট দিয়ে যাওয়ার দরকারও নেই, কিশোর বলল। ওই দেখ।
দেখল সবাই। আরনির গাড়ির হেডলাইটে ধরা পড়েছে পিকো। শিপইয়ার্ডের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। বেড়ার এক জায়গায় বেশ বড় একটা ফোকর কাটা হয়েছে।
থামবেন না! প্রায় চিৎকার করে বলল রবিন। আমরা যে দেখেছি বুঝতেই যেন না পারে। আগে হাতেনাতে ধরি, তারপর জিজ্ঞেস করা যাবে লিসটারকে কি করেছে।
চলে যান, কিশোর বলল। পরে নেমে তার পিছু নেব।
এগিয়ে গেল আরনি। পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল গোয়েন্দারা। দেখল, বেড়ার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে পিকো। দৌড় দিল হাইওয়ের দিকে।
পুরো আধপাক ঘুরে গাড়ির মুখ আবার ঘুরিয়ে ফেলল আরনি। হেডলাইট নিভিয়ে দিয়ে এগোল। আরেক বার পাশ কাটাল পিকোর। লোকটা তখন হেঁটে চলেছে। আরনির গাড়ির পার্কিং লাইট শুধু জ্বলছে। অন্য গাড়ি মনে করল পিকো। হাত তুলল থামানোর জন্যে। লিফট চায়।
তুলে নেব? আরনির প্রশ্ন।
মাথা খারাপ? কিশোর বলল। চিনে ফেলবে না?
থামল না আরনি। দক্ষিণে এগিয়ে গেল ব্লক দুয়েক। তারপর একটা রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে ঢুকে থামল। এবারও পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে গোয়েন্দারা। রাস্তায় একটা ভ্যানকে দেখল থেমে পিকোকে তুলে নিতে।
ডার্ক শেভি ভ্যান, বলল কিশোর।
বুঝেছি, আরনি বলল।
আবার অনুসরণের পালা। দুটো গাড়ির পেছনে রইল আরনি সর্বক্ষণ। চলে এল সান্তা মনিকায়। লিংকন বুলভারে পৌঁছে থেমে গেল ভ্যান। পিকে নেমে গেলে চলতে শুরু করল গাড়িটা।
আরেকবার পিকোর পাশ কাটাল আরনি। কোণের কাছে পৌঁছে- থামল। পেছনের জানালা দিয়ে চেয়ে রয়েছে ছেলেরা।
মাথা নিচু, কাঁধ বাঁকা করে হাঁটছে পিকো। ফিরে এল আরনি। পাশ কাটাল। দাঁড়াল। আবার ঘুরল। পাশ কাটাল। দাঁড়াল। এভাবেই অনুসরণ করে চলেছে। খেয়ালই করছে না যেন পিকো।
কয়েক ব্লক পরে একটা নির্জন জায়গায় চলে এল ওরা। জায়গাটা পতিত। যেন দানবীয় কোন রেজর ব্লেড দিয়ে চেঁছে তুলে নেয়া হয়েছে ওপরের মাটি।
পুরনো বাড়িঘর সব ভেঙে ফেলা হয়েছে এখানে, আরনি বলল। পার্ক বানাবে বোধহয়। রাস্তার এত কাছে, যা শব্দ, পার্ক কেমন হবে কে জানে। জায়গা সিলেকশন ভাল হয়নি ওদের। পার্ক হওয়া দরকার নীরব জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তাকিয়ে রয়েছে পিকোর দিকে।
লোকটা এখন শুধু একটা ছায়া। কয়েকটা অন্ধকার আকৃতির দিকে হেঁটে চলেছে। আলো নেই এখানটায়। খোলা জায়গাটার ওপাশের আকৃতিগুলো। বাড়িঘরের। নির্জন, শূন্য, ধ্বংস হয়ে আসা সব বাড়ি। দুটো বাড়ির মাঝের গলিতে হারিয়ে গেল পিকো।
গাড়ি নিয়ে না গিয়ে, কিশোর বলল, হেঁটেই যাই। সুবিধে। দরজা খুলল সে।
বেরিয়ে এল চারজনেই। নীরবে পিছু নিল পিকোর। যেদিকে অদৃশ্য হয়েছে সে সেদিকে চলল দ্রুতপায়ে।
এখানে কোথায় এল? অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মুসা।
শশশ! হুঁশিয়ার করল কিশোর। দেখ!
সামনে ম্লান আলো। আলোর আভা বললেই ঠিক বলা হয়, পরিত্যক্ত একটা বাড়ির ভেতর থেকে আসছে। পা টিপে টিপে এগোল গোয়েন্দারা। আরও কাছে এলে দেখল জানালার ভেতর দিয়ে আসছে আলোটা। শাটার লাগানো। কিন্তু কয়েক জায়গায় ভাঙা, আলো বেরোচ্ছে ওই পথে।
অন্য পাশ দিয়ে বাড়ির একেবারে গা ঘেষেই চলে গেছে গাড়ি চলাচলের পথ। এত জোরে হর্ন বাজাল একটা লরি, চমকে উঠল ওরা।
গর্জন করতে করতে চলে গেল গাড়িটা। শাটারের একটা ভাঙা অংশে চোখ রাখল কিশোর। একটা ঘর। একটা বিছানা। পাশে একটা পুরনো আলমারি। তার ওপর হারিকেন জ্বলছে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পিকো। লোকটাকে মনে হচ্ছে বেহুশ। কাত হয়ে আছে। মুখটা জানালার দিকে ফেরানো। চোখ বন্ধ। এক গোড়ালিতে একটা আংটা, সেটার সঙ্গে শেকল লাগানো। শেকলের আরেক মাথা মেঝের বড় একটা পাথরের ফুলকে গাথা। আরেকটা আংটার সঙ্গে লাগানো। বেঁধে রাখা হয়েছে লোকটাকে।
পিছিয়ে এল কিশোর। সঙ্গীদেরকে ইশারা করল সরে যাওয়ার জন্যে।
বেশ কিছুটা সরে এসে ফিসফিস করে ওদেরকে জানাল কিশোর, ডেভিড লিসটারকে পেয়েছি। বের করে আনতে হবে এখন।
.
১৫.
আরেকটা পরিত্যক্ত বাড়িতে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা। পরিকল্পনা করার জন্যে।
সোজা ঢুকে পড়তে পারি আমরা, আরনি বলল। পিকোর কাছ থেকে জোর করে চাবি আদায় করে খুলে নিয়ে আসতে পারি। তবে পিস্তল থাকতে পারে পিকোর কাছে। তাহলে মুশকিল হবে। রাগের মাথায় লিসটারকেই গুলি করে। বসতে পারে।
আমাদেরকেও করতে পারে, মুসা বলল। এত ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে পুলিশকে ফোন করতে পারি আমরা।
তা পারি। বেশ, আমি ফোন করতে যাচ্ছি। ওরা এসে হাতে নাতে ধরবে পিকোকে। আমি সন্দেহ থেকে বাদ যাব। বেঁচে যাই তাহলে। একটু থেমে আরনি বলল, তোমরা এখানেই বসে থাক।
ছেলেদেরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল আরনি।
আমাদের কারও যাওয়া উচিত ছিল ওর সঙ্গে আরনির পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে আফসোস করল মুসা।
কেন? রবিনের প্রশ্ন। সে কি পুলিশকে ফোন করতে পারবে না?
তা পারবে। কিন্তু করবে কিনা সেটাই প্রশ্ন। লিসটারকে ঘৃণা করার তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মত বদলাতে পারে। চলে যেতে পারে। তাহলে আমরা এখানে বসেই থাকব বসেই থাকব, গাধা হয়ে।
থাকতে যাচ্ছে কে? মুখ খুলল কিশোর। আরনিও ভাল করেই জানে বেশিক্ষণ তার জন্যে এখানে বসে থাকব না আমরা। আর চলে গেলে তো সন্দেহমুক্ত হতে পারল না, বরং তার ওপর আমাদের সন্দেহ আরও বাড়বে। নাহ, সে যাবে না। পুলিশকে ফোন করবে। লিসটারকে এখন আর হাতছাড়া করতে চাইবে না। এক সেকেণ্ড চুপ করে ভাবল গোয়েন্দাপ্রধান। শোন, পিকোর হাবভাব একটুও ভাল লাগেনি আমার। মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। খারাপ কিছু করে বসতে পারে।
অযথা বসে না থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। চলে এল স্লান আলোকিত জানালাটার কাছে। ফোকরে চোখ রাখল কিশোর। এখনও আগের জায়গাতেই। রয়েছে পিকো। ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে লিসটারের দিকে। হারিকেনের আবছা আলোয় মনে হচ্ছে তার গালে মাংস নেই, গর্ত। আর সারাটা জীবনই যেন ক্ষুধার্ত রয়ে গেছে লোকটা।
বুড়ো ভাম, বিড়বিড় করে বল পিকো। আমাকে তুমি বোকা বানাতে পারবে। এইই, এইই! বলে, জোরে চিৎকার করে ডাকল সে। জানালায় কাঁচ নেই। তাই রাস্তার গাড়িঘোড়ার শব্দকে ছাপিয়ে সেই চিকরি কানে এল গোয়েন্দাদের।
এইই, শুনছো! আরও ঝুঁকে লিসটারের পা চেপে ধরল পিকো। জোরে ঝাঁকি। দিল। ঠিকই শুনতে পাচ্ছ। ভান করছ না শোনার। যেন বেহুশ হয়ে গেছে, এহ! আমার সঙ্গে ওসব চালাকি খাটবে না।
ঘাবড়ে গেল তিন গোয়েন্দা। লিসটারকে কিছু করবে না, তো পিকো? পুলিশ নিয়ে আরনি ফেরার আগেই ওরা কিছু করার চেষ্টা করবে?
বইটা চাই আমি! লিসটারের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল পিকো। ওটা আমার জিনিস, আমি অনেক কষ্ট করেছি, আদায় করে নিয়েছি বলা যায়। সারাটা জীবনই নষ্ট করেছি ওটার জন্যে। জেল খেটেছি। তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে আপত্তি ছিল না আমার। কিন্তু তুমি এমনই লোভী, পুরোটা একাই মেরে। দেয়ার তালে ছিলে। তুমি আমাকে জেলে পাঠিয়েছ, পাঠাওনি? বইটা হাতে পেতেই চলে গিয়েছ পুলিশের কাছে। গিয়ে বলেছ ওটা কার কাছে আছে জান। আমার নাম বলে দিয়েছ। আমাকে অ্যারেস্ট করল ওরা। আমার মত একজন মানুষকে! পিকো সিয়েটাকে! ছ্যাচড়া চোরের মত কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়ে আমাকে জেলে ভরল পুলিশ!
আমার ঘরে বইটা পায়নি ওরা, তা-ও জান তুমি। জানবেই তো, তোমার কাছেই তো ছিল। ওরা আমাকে কি করেছে জান? পিটিয়েছে। বার বার জিজ্ঞেস করেছে, বইটা কি করেছি। বলতে পারলাম না। ওরা ধরে নিল আমি ওটা বিক্রি করে দিয়েছি। কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। জেলে ভরলই ওরা আমাকে।
তারপর তুমি কোথায় গিয়েছ লিসটার, আমি জানি। সোজা সেই জায়গাটায় চলে গিয়েছিলে। পকেট ভর্তি করার জন্যে। ধনী হওয়ার জন্যে!
বিছানার কাছ থেকে সরে এল পিকো। ঘুরে দাঁড়াল। পায়চারি শুরু করল। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে।
আরনি যেদিকে গেছে অধৈর্য হয়ে সেদিকে তাকাল মুসা। এখনও আসছে না। কেন? এত দেরি কেন?
পায়চারি থামাল পিকো। বিছানার কাছে গিয়ে আবার কথা বলতে লাগল। অন্য রকম হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। মানসিক চাপের লক্ষণ। তার জন্যে এখন তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তুমি ভেবেছ, তোমার মেয়েটা গিয়ে পুলিশকে বলবে। ওরা খুজতেই থাকবে,খুজতেই থাকবে, তারপর নাটকীয় ভাবে চলে আসবে, এখানে, তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে। না, তা হবে না। সে রকম কিছু যাতে না ঘটতে পারে সেজন্যে সতর্ক রয়েছি আমি। মেয়েটা আস্ত ভীতু। রাতে একা বাড়িতে থাকতে পারে না বলে কয়েকটা ছেলেকে ডেকে এনেছে সঙ্গ দেয়ার। জন্যে। আরও বেশি যখন ভয় পেলে, পালিয়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ও রকম একটা মেয়ের ওপর ভরসা করে আছ তুমি। পুলিশ নিয়ে আসবে। হুহ! এখানেই। থাকতে হবে তোমাকে, বুঝলে?
কোথায় আনা হয়েছে ভাল করেই জান তুমি, লিসটার। এখানে কেউ আসে। কেউ চলাচল করে না এদিক দিয়ে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কারও কানে যাবে না। সময়ের অভাব নেই আমার। তাড়াহুড়া করব না। যতক্ষণ না বলছ, ছাড়ছি না। বুঝলে?
গটমট করে শাটারের কাছে এসে দাঁড়াল পিকো।
ঝট করে একপাশে সরে গেল মুসা।
আরেক পাশে সরল রবিন।
কিশোর পিছিয়ে গেল। লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সময় মত পারল না, দেরি করে ফেলল। শাটার খুলে দিল পিকো। আরেকটু হলেই বাড়ি লাগত কিশোরের মুখে।
চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। পুরো একটা সেকেণ্ড নড়তে পারল না। কিশোর, পা যেন অসাড় হয়ে গেছে। তারপর পাশ থেকে হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিল মুসা। ততক্ষণে গোলমাল যা হওয়ার হয়ে গেছে।
দৌড় দিল তিনজনে।
চেঁচিয়ে উঠল পিকো। দড়াম করে আবার বন্ধ হয়ে গেল শাটার। আরও জোরে শব্দ হল দরজার।
ওদের পেছনে ছুটে আসছে পিকো।
পেছনে তাকাল কিশোর। লোকটার হাতে অস্ত্র দেখতে পেল। পিস্তল নয়। লাঠি জাতীয় কিছু। অন্ধকারে ভাল দেখতে পেল না সে, আন্দাজ করল পুরনো বেজবল ব্যাট হবে। পিকোর মত লোকের হাতে ওই জিনিসই আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। ওই ব্যাটের কাছে কিশোর আর মুসার জুডো ক্যারাট খাটবে না। লোকটার গায়ে ষাড়ের শক্তি। বন বন করে ঘোরাতে ঘোরাতে যদি এগিয়ে আসে, কাছেও ঘেষতে পারবে না তিনজনের কেউ। পালানো ছাড়া গতি নেই।
ছুটছে তিন গোয়েন্দা। তেড়ে আসছে পিকো, চিৎকার করে গালাগাল করছে। স্প্যানিশ আর ইংরেজিতে। সব বুঝতে পারল না ওরা। এটুকু বোঝা গেল, ধরতে পারলে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। গালাগাল থামিয়ে দিল আরও জোরে দৌড়ানোর জন্যে।
তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মত গুঙিয়ে উঠল মুসা। দুটো বাড়ির মাঝের অন্ধকারে ঢুকে পড়ল। তার পেছনে গেল রবিন। সব শেষে কিশোর। নিজেকে যেন ছুঁড়ে দিল অন্ধকার ছায়ায় মিশে যেতে চাইছে।
পিকো থামছে না। আসছেই। ছুটে আসছে ব্যাট উঁচ করে।
আর দৌড়ানোর কোন মানে হয় না। বুঝতে পারছে তিনজনেই। রুখে দাঁড়ানোই দরকার।
ঝুঁকিটা অনেক বেশি হয়ে যাবে, ভাবল মুসা। মাথায় এক বাড়ি পড়লে, দুফাঁক হয়ে যাবে খুলি। বাড়ি লাগার আগেই ব্যাট ধরে হ্যাঁচকা টানে যদি নিয়ে চলে আসা যায় তাহলে…তবে তার জন্যে সুযোগ দরকার।
অযথা ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। পিকো একা, ওরা তিনজন, সুযোগ আসবেই। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল মুসা। কিশোর এগোল ওদের। পেছনে। আবার ফিরে তাকাল পেছনে, পিকো কতখানি এসেছে দেখার জন্যে।
অনেক কাছে চলে এসেছে।
মুসা এসে দাঁড়াল কিশোরের পাশে। রবিনকে সরিয়ে দিয়ে এসেছে। হাত তুলে দেখাল। অন্ধকারে আবছামত চোখে পড়ল কিশোরেরও, একটা দরজা। শূন্য বাড়িটাতে ঢুকে লুকিয়ে পড়া যায়।
ঢুকে পড়ল কিশোর আর মুসা। আগেই ঢুকে বসে আছে রবিন। হাত ধরাধরি করে এগোল তিনজনে, যাতে আলাদা হয়ে না যায়। অত অন্ধকার, চোখ খোলা। রাখা আর বন্ধ রাখা সমান কথা।
কয়েক পা এগিয়েই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। বাইরের আলো আসছে, ফলে ওখানটায় অন্ধকার কিছুটা কম। ফ্যাকাশে। দরজার বাইরে থামতে শোনা গেল পিকোকে। খসখসে হয়ে উঠেছে নিঃশ্বাস। শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয় দরজার কাছে ঘাপটি মেরে রয়েছে, ভাবল কিশোর, ওদের বেরোনোর অপেক্ষায়। শব্দ শোনার চেষ্টা করছে, যাতে বুঝতে পারে ওরা কোথায় আছে।
অবশেষে নড়ল পিকো। একটা পা বাড়াল, নীরবতার মাঝে এত মদু শব্দও কিশোরের কান এড়াল না। পিছিয়ে যেতে লাগল সে। দরজার কাছ থেকে যতটা সম্ভব সরে যাওয়া উচিত।
এক পা এক পা করে পিছাতে পিছাতে দেয়ালে এসে ঠেকল, পিঠ। মুসা এসে থামল তার পাশে। নাকি রবিন? যে-ই হোক, তাতে কিছু এসে যায় না। তিনজনের একসঙ্গে থাকার দরকার,ব্যস।
পাশে সরতে শুরু করল তিনজনে। এক সময় পিঠের কাছটায় শুন্য মনে হল কিশোরের। দেয়াল নেই। ফাঁকা। তার মানে দরজা। যেটাতে রয়েছে ওরা তার পেছনে আরেকটা ঘর। দরজা দিয়ে পিছাতে লাগল কিশোর। সঙ্গে এল অন্য দুজন। আপাতত নিরাপদ। তবে কয়েকটা সেকেণ্ড কিংবা মিনিটের জন্যে। ওঘরেই রয়েছে পিকো। চুপ করে আছে। কান পেতে শুনছে নিশ্চয়। শব্দ শুনলেই ছুটে আসবে।
চারপাশে তাকাল কিশোর। আর কোন দরজা কিংবা জানালা আছে কিনা। বোঝার চেষ্টা করল। বেরিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। নেই। শুধু নিচ্ছিদ অন্ধকার। ঈশ্বরের অশ্রু
আরনি! এতক্ষণে মনে পড়ল তার কথা। আরনি কোথায়? পুলিশ নিয়ে আসছে না কেন?
মুসার সন্দেহই সত্যি হল, তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। মত বদল করেছে আরনি। ওদেরকে ফেলে চলে গেছে। যা করার এখন নিজেদেরকেই করতে হবে। কারও সাহায্য পাবে না। পিকোকে আক্রমণ করে তার হাত থেকে ব্যাটটা কেড়ে নিতে হবে। তার পরেও কথা থাকে। পিকোর পকেটে পিস্তল থাকতে পারে। ব্যাট হাতছাড়া হয়ে গেলে বের করবে ওটা। তাহলে মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে ওরা।
আচমকা কেঁপে উঠল মেঝেটা। ওদের পায়ের তলায় মাটির গভীরে যেন প্রচণ্ড তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারি কোন লরি রাস্তা দিয়ে গেলে যেমন কেঁপে ওঠে মাটি অনেকটা তেমনি।
তারপর গর্জে উঠল ধরণী। গর্জন বাড়ছেই, আরও, আরও। এমন ভাবে ভরে দিল দিগ্বিদিক, যেন ওই শব্দটাই একমাত্র আছে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। টলতে শুরু করল বাড়িটা। ঝিলিক দিয়ে উঠছে আলো। বিদ্যুৎ চমকের মত উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো। বাইরের টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো চোখে পড়ল, মাটিতে দেবে যাচ্ছে, যেন মুহূর্তে নরম কাদা হয়ে গেছে কঠিন মাটি।
অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে যেন বাড়িটার। তীব্র আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। তীক্ষ্ণ রোম খাড়া করা শব্দ করে তা থেকে খুলে আসছে খুঁটিতেমারা পেরেক।
ভূমিকম্প! আর বুঝতে অসুবিধে হল না ছেলেদের। যে কোন মুহূর্তে এখন ধসে পড়তে পারে পুরনো বাড়িটা। দেয়াল থেকে সরে যাবে ছাত, ধুড়ুম করে ভেঙে পড়বে ওদের মাথায়। বাঁচতে চাইলে এখনি বেরিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু বেরোতে পারছে না কিশোর। এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে। মেঝে দুলছে অশান্ত সাগরের মত। তক্তা আঁকড়ে ধরে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা চালাল।
আটকা পড়ল ও।
.
১৬.
কেঁপেই চলেছে ধরণী। থামবে না নাকি? বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে কিশোর। সিনেমায় দেখেছে, ভূমিকম্পের সময় কি রকম করে মাটি ফাঁক হয়ে যায়। তার ভেতরে তলিয়ে যায় ডাইনোসরের মত বিশাল প্রাণীও। কল্পনায় সেসব দেখতে দেখতে শিউরে উঠল সে। তার নিচেও ওরকম ফাঁক হয়ে যাবে না তো? তলিয়ে যাবে না তো মাটির গভীরে? তার পর হাজার বছর পরে ভবিষ্যতের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক খুড়ে বের করবে তার ফসিল হয়ে যাওয়া কঙ্কাল…
চারপাশে গুঙিয়ে চলেছে খুঁটি আর তজ্ঞা। দেয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে টানাটানি করছে ছাত। কাছেই বিকট একটা শব্দ হল। ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের বুক। এই বুঝি গেল বাড়িটা। না, পুরোটা নয়, একটা দেয়াল ধসে পড়েছে। আরও বিকট আরেকটা শব্দ হল। আস্ত একটা বাড়ি ধসেছে। এটাও পড়বে। হঁটকাঠের তলায় জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে তিন গোয়েন্দার।
অবশেষে দীর্ঘ এক যুগ পরে যেন থামল ধরণীর কম্পন। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। ঘরের কালো অন্ধকারের মাঝে চারকোণা একটা ফ্যাকাশে ফোকর চোখে পড়ল। জানালা। তারমানে দেয়ালটা দাঁড়িয়েই আছে। সাংঘাতিক শক্ত বাড়ি তো! ধসে পড়ার আর ভয় নেই।
অন্ধকারে বলে উঠল মুসা, বাপরে বাপ! কাণ্ডটা কি হল। এভাবে ভূমিকম্পের মধ্যে আর পড়িনি কখনও।
নাগরদোলায় চড়লাম! রসিকতার চেষ্টা করল রবিন, জমল না, কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল তার গলা দিয়ে।
পিকোর কথা মনে পড়ল কিশোরের। ভুমিকম্প শুরুর আগে পাশের ঘরটায় ছিল সে। এখনও কি আছে?
কাঁপা পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। ঘরটা এখন আর আগের মত অন্ধকার নয়। দেয়াল ধসেছে। রাস্তার গাড়ির আলো এসে পড়েছে ভেতরে। বাতাসে ধুলো উড়ছে। ভারি, কেমন যেন শ্যাওলা শ্যাওলা গন্ধ। পিকোকে দেখা গেল না।
অসংখ্য আলো আছে রাস্তায়। গাড়ির। তবে সব অচল হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে গেছে সব। লোকের চিৎকার, গাড়ির তীক্ষ্ণ হন, আগের নীরবতার কিছুই অবশিষ্ট নেই আর এখন। নড়ছে না একটা গাড়িও, কিংবা হয়ত নড়তে পারছে না।
রাস্তার পাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে গেল কিশোর। কয়েক মিনিট। আগেও যেটা আস্ত ছিল, সেটার অনেকখানিই ধসে পড়েছে এখন। বাড়ি বলেই চেনা যায় না আর। তিন দিকের দেয়াল নেই। বাকি একটা দেয়ালের ওপর কাত হয়ে ঠেস দিয়ে রয়েছে কোনমতে ছাতটা।
ওটাই সেই বাড়ি! যেটাতে লিসটারকে বন্দি করে রেখেছিল পিকো!
সর্বনাশ! গুঙিয়ে উঠল রবিন। ভু-ভর্তা হয়ে গেছে…
থেমে গেল একটা গাড়ির আলো দেখে। উঁচুনিচু জমিতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে, এগিয়ে আসছে ওটা। অন্ধকারের চাদর ফুড়ে দিয়েছে যেন ওটার হেডলাইট। বিদ্ধ করেছে পিকোকে।
ধসে যাওয়া বাড়ির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সে। এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে তাকাল। অন্ধ করে দিয়েছে যেন তাকে হেডলাইট। পেছনে যে আরেকটা গাড়ি আসছে দেখতেই পেল না। হাতের ওপর জ্বলছে লাল-নীল আলো। পুলিশের গাড়ি।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। এসে গেছে পুলিশ।
ফিরে তাকাল পিকো। ছেলেরা যে বাড়িটায় রয়েছে সেদিকে। হাতে এখনও রয়েছে বেজবল ব্যাটটা। বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সতর্ক রয়েছে। পিকো ব্যাট উঁচিয়ে তেড়ে এলেই সরে যাবে তিন দিকে। কিন্ত এল না লোকটা। বরং ব্যাটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে হারিয়ে গেল ধসে পড়া বাড়ির দেয়ালের আড়ালে।
জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল পুলিশের গাড়ি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নামল দুজন অফিসার। ধসে পড়া বাড়িটার দিকে দৌড় দিল। আরনিও নামল। লিসটারের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে ছুটল, বলল, আর কোন ভয় নেই।
জবাবে ভেসে এল আরেকটা কণ্ঠ, রেডিওর স্পীকারের মত কড়কড় করে উঠল যেন, জলদি এস! গাধা কোথাকার! আস্ত একটা বাড়ি ধসে পড়েছে আমার ওপর, আর বলছে কোন ভয় নেই! রামছাগল!
ডেভিড লিসটার। বেঁচে আছেন এখনও। ধসে পড়া বাড়ির নিচে চাপা পড়েছেন। এত বড় বিপদে থেকেও মেজাজের সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি তার।
পিকোর পিছু নিয়েছে পুলিশ। রাস্তায় পৌঁছার আগেই ধরে ফেলল তাকে। হাতকড়া পরিয়ে দিল। নিয়ে আসতে লাগল গাড়ির দিকে।
ও-ই কিডন্যাপার, অফিসারদের দিকে এগিয়ে গেল রবিন।
পুলিশের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পিকো। লাফ দিয়ে এসে লাথি মারার চেষ্টা করল রবিনকে। ঝট করে সরে গেল রবিন।
আবার তাকে চেপে ধরল পুলিশ। শক্ত করে, যাতে আর ছুটতে না পারে। টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে এনে তুলল।
দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আরনি। চিৎকার করে বলল, ভয় নেই, মিস্টার লিসটার, আমরা আপনাকে বের করে আনব।
তাহলে করছ না কেন? সারারাত লাগাবে নাকি? খেঁকিয়ে উঠলেন লিসটার।
এই সময় মনে পড়ল আরনির, সে কে, কেন এখানে এসেছে। বাবার কথা ভাবল। যাকে ধংস করে দিয়েছে দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে থাকা ওই বুড়োটা।
মিস্টার লিসটার, চুপ করে থাকুন! বলল সে। ফিরে গেল তার গাড়িতে। ভেতরে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। আর কোন সাহায্য করতে রাজি নয়। বেরোলই না আর। মাঠের ওপর দিয়ে যখন নাচতে নাচতে ছুটে এল এলেনার গাড়িটা, তখনও না।
আসার সময় ফোন করে এসেছে নিশ্চয় এলেনাকে, অনুমান করল মুসা। আসতে এত দেরি হয়েছে সে জন্যেই। সব দিক গোছগাছ করেই এসেছে।
এলেনার সঙ্গে এসেছেন ওর মা। বাবা কোথায় আছে জানতে পেরে যেন পাগল হয়ে গেল মেয়েটা। দেয়ালের জানালা দিয়েই গিয়ে ঢুকতে চাইল। তাকে ধরে রাখলেন মা, যেতে দিলেন না।
আপনারা কিচ্ছু ভাববেন না, একজন অফিসার বলল। যা করার আমরা। করছি।
যা করার একটু জলদি করলে ভাল হয় না? চেঁচিয়ে বললেন লিসটার। ধুলোয় দম আটকে যাচ্ছে তো! লাশ হয়ে গেলে আর বের করে লাভ কি?
মড়মড় করে উঠল কাত হয়ে থাকা ছাত। গোঙাল। বাকি দেয়ালটাকেও ধসিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে।
জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ল দুই অফিসার। বাইরে যারা রইল, তারা দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। আপাতত পড়বে না আর দেয়ালটা, যতই হুমকি। দিক। ছাতটাও এমনভাবে আটকে গেছে পড়ার ভয় নেই। যদি আবার কাঁপুনি শুরু না হয়। বড় ভূমিকম্পের পরে মাঝে মাঝেই আবার শুরু হয় কাপুনি, বিরতি দিয়ে দিয়ে। সে রকম একটা কম্পন এলেই সর্বনাশ। এখন সামান্য একটা কাপুনিই। ছাতটাকে ধসিয়ে দিতে যথেষ্ট।
তবে আর কোন কম্পন শুরু হল না। খানিক পরে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল। একজন অফিসার। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুচকাল। মেঝের সঙ্গে শেকলে বাধা। একথাটা জানানো হয়নি আমাদের। অনেকটা অভিযোগের সুরেই বলে গাড়িতে ফিরে গেল সে। সাহায্যের জন্যে ফোন করতে।
দমকলের গাড়ি এল ফোন পেয়ে। আধ ঘণ্টা পর। তবে এসে আর দেরি করল না একটা মুহূর্ত। আটকা পড়া মানুষকে উদ্ধার করার ট্রেনিং আছে ওদের। দুজন ঢুকে গেল জানালা দিয়ে। ভেতরের অবস্থাটা দেখে এল। একটা লোহাকাটার করাত চাইল সহকর্মীদের কাছে। করাত দিয়ে কাজ সারার পর চাইল একটা শাবল। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তাদের কাজ করার বিচিত্র শব্দ হতে লাগল। একটা স্ট্রেচার ঢোকান হল জানালা দিয়ে। এর খানিকক্ষণ পরে ওই পথেই বের করে আনা হল লিসটারকে।
ততক্ষণে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে।
খবরদার, মাথামোটার দল! অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় চিৎকার করে বললেন লিসটার, ছেড়ে দিও না!
বাবার পাশে পাশে এসেছে এলেনা। ওফ, আব্বা, একটি বারের জন্যেও কি চুপ থাকতে পার না! বাবার সঙ্গে সে-ও অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। হাসপাতালে যাবে।
ঠিক ওই সময় আবার কেঁপে উঠল মাটি। মা-ভূমিকম্প ঘুরে যাওয়ার পরে হাজির হয়ে গেছে ছানা-ভূমিকম্প। ছোট ছোট কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল। যেন হ্যাঁচকা টানে কাত করে ফেলল অবশিষ্ট দেয়ালটাকে, পুরোপুরি ধসিয়ে দিল ছাত, একটু আগেও যেটার নিচে আটকা পরে ছিলেন ডেভিড লিসটার। ধুলো উড়তে লাগল চারদিকে।
.
১৭.
তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা। স্যালভিজ ইয়ার্ডে আসবেন ডক্টর ত্রুগার মনটাগো। লিসটারকে উদ্ধার করে আনার পর পুরো একটা হপ্তা পেরিয়ে গেছে। তিনি এলে তাকে নিয়েই মিস্টার ভিকটর সাইমনের ওখানে যাবে ওরা। চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার নেই হলিউডে। জরুরী একটা কাজে ইউরোপ চলে গেছেন। তবে যাবার আগে দেখা হয়েছে গোয়েন্দাদের সঙ্গে। কেসের রিপোর্ট পড়েছেন। গল্পটা ভারি পছন্দ হয়েছে তাঁর। ছবি বানাবেন। চিত্রনাট্য লিখে দিতে অনুরোধ করেছেন মিস্টার সাইমনকে।
তাকে পুরো গল্পটা শোনাতেই তিন গোয়েন্দার যাওয়ার কথা আজ। রওনা হবে হবে করছে, এই সময় ফোন এসেছে রুক্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ডক্টর মনটাগোর। দেখা করতে আসতে চাইলেন তিনি। বিশপের বইটাতে কি লেখা আছে বলার জন্যে।
গাড়ি নিয়ে এলেন তিনি। কোথায় কি জন্যে যেতে হবে তিন গোয়েন্দাকে, খুলে বলল তাকে কিশোর।
আপনিও যেতে পারেন, মুসা বলল। অসুবিধে নেই। মিস্টার সাইমন খুব ভাল মানুষ। তাকে আপনারও ভাল লাগবে। অনেক বড় গোয়েন্দা। তেমনি বড় লেখক। কোনটাতে যে বেশি সুনাম কামিয়েছেন, বলা মুশকিল। বিরাট এক বাড়ির মালিক। এককালে ওটা সরাইখানা ছিল।
তাই নাকি? মনটাগো বললেন। শুনে তো যাওয়ার জন্যে লোভই হচ্ছে।
লোভটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়ার জন্যেই রবিন বলল, শুধু কি বাড়ি। ভিয়েতনামী একজন কাজের লোকও আছে। নাম নিসান, জাং কিম। সে-ও খুব ভাল। তবে একটা দোষ আছে, অদ্ভুত সব খাবার রান্না করার ঝোঁক। আর সুযোগ পেলেই মানুষকে খাইয়ে সেসব রান্না কেমন হয়েছে পরীক্ষা করার প্রবণতা। কিছু। কিছু রান্না তো দারুণ! আর কিছু কিছু…মুখেই দেয়া যায় না!
আর লোভ সামলাতে পারলেন না ডক্টর মনটাগো। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। বিশপের বই নিয়ে আলোচনা ওখানেও করা যাবে।
ডক্টরের গাড়িতেই চলল তিন গোয়েন্দা। সামনে বসল কিশোর, ড্রাইভারের পাশের সীটে। রবিন আর মুসা বসল পিছনে। পথ দেখিয়ে দিতে লাগল কিশোর। কোস্ট হাইওয়ে থেকে মোড় নিয়ে সরু একটা পাহাড়ী পথে উঠল গাড়ি। কিছু দূর এগোনোর পর বিরাট একটা শাদা রঙ করা বাড়ি চোখে পড়ল।
এই কিশোর, দেখ, পেছন থেকে বলল মুসা। বাড়ির দরজা খোলা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা মেয়ে। একটা চামড়ার ফিতে দিয়ে কপাল আর চুল বাঁধা। তাতে পাখির লাল পালক গোঁজা।
ইনডিয়ান মেয়ে! মনটাগো বললেন। ওর কথা তো কিছু বলনি।
নতুন এসেছে মনে হয়, জবাব দিল কিশোর। ইনডিয়ানদের মত লাগছে, তবে ইনডিয়ান নয়।
ভাল করে দেখে ডক্টরও একমত হলেন কিশোরের সঙ্গে। মেয়েটা এশিয়ান। লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে হাত নাড়ল। নিসান জাং কিম বেরিয়ে এল বারান্দায়। মেয়েটার হাত ধরল।
চুমাশ রাজকুমারীর পোশাক পরেছে। সুন্দর না? মেয়েটার কথা বলল কিম, ক্যালিফোর্নিয়ার আদিম মানুষের আচার আচরণ শিখছে।
মনটাগোকে নিয়ে বারান্দার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। আরও কয়েকটা বাচ্চা বেরিয়ে এল। সবাই এশিয়ান। পরনে ইনডিয়ান পোশাক।
পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বন্ধুত্বের চেষ্টা করছে এরা, বুঝিয়ে বলল কিম। আমেরিকানদের রীতিনীতি শেখাচ্ছে আমাদের দেশের বাচ্চাদের। যাতে সহজেই যে কোন আমেরিকান ইস্কুলে ভর্তি হতে পারে। সহপাঠীদের সাথে মিশতে পারে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পড়তে গেলে আর সে দেশের কিছুই জানা না থাকলে অসুবিধে হয়ে যায়।
প্রজেক্টটা তাহলে নতুন শুরু করলেন, হেসে বলল রবিন।
হ্যাঁ, করলাম।
ইনডিয়ানদের দিয়েই শুরু? আরও তো লোক রয়েছে আমেরিকায়।
তা আছে। তবে আসল অধিবাসী তো ইনডিয়ানরাই। এখানে তাদের রীতিনীতিই হল খাঁটি। বাকি সব ভেজাল। নানা দেশের লোক এসে ভিড় জমিয়েছে আমেরিকায়, সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সে জন্যে ইনডিয়ানদেরই বেছে নিয়েছি। আজকে ওদেরকে রান্না শেখাচ্ছি। চুমাশ ইনডিয়ানদের রান্না। পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে শিখে এসেছি। অ্যাক্রন কেক। ক্রীমড ড্যানডেলিয়ন। আর হজমের সুবিধের জন্যে রোজহিপ চায়েরও ব্যবস্থা করব।
মারছে! বিড়বিড় করল মুসা, অবশ্যই নিচু স্বরে, যাতে কিম শুনে না ফেলে।
বেরিয়ে এলেন ভিকটর সাইমন। বাচ্চাদেরকে ভেতরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল কিম। ডক্টর মনটাগোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর। আসার উদ্দেশ্যও জানাল। বিশপের বই নিয়ে আলোচনা করতে চান ডক্টর। হাত মেলালেন সাইমন। খুব খুশি হলেন। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে ওয়েলকাম জানালেন ওদেরকেও।
প্রথমেই প্রশ্ন করল মুসা, আচ্ছা, স্যার, এই ক্রীমড ড্যানডেলিয়নের ব্যাপারটা কি বলুন তো?
মুচকি হাসলেন সাহিত্যিক গোয়েন্দা। ভয় নেই। কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি আমি। আমরা চুমাশ নই, ভিয়েতনামী শিশুও নই যে আমেরিকানদের রীতি শিখতে হবে। কাজেই পাহাড় থেকে শিখে আসা কোন ইনডিয়ান খাবার চলবে না। সকালে আমি নিজে বাজারে গিয়ে পছন্দ মত খাবার কিনে এনেছি। আলাপ আলোচনা শেষ হোক, তারপর খেতে বসব।
হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন তিন গোয়েন্দা। যাক, অন্তত এই একটা দিন সাইমনের বাড়িতে এসে তার ভিয়েতনামী বাবুর্চি কিমের অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। অ্যাক্রন কিংবা ড্যানডেলিয়ন চেখে দেখার কোন ইচ্ছেই ওদের নেই।
পথ দেখিয়ে মেহমানদেরকে মস্ত ঘরটায় নিয়ে এলেন সাইমন, যেটা থেকে সাগরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। সরাইখানা চালু থাকার সময় এ ঘরটা ছিল প্রধান ডাইনিং রুম। এখন হয়েছে একাধারে লিভিং রুম, লাইব্রেরি আর অফিস। কফি টেবিল ঘিরে বসল সবাই। কেসের রিপোর্ট ফাইলটা ঠেলে দিল রবিন। এতে সব নেই, বলল সে। সেগুলো ডক্টর মনটাগো মুখেই বলবেন।
মাথা ঝাঁকালেন ডক্টর। আগে ফাইলটা পড়া শেষ করুন। আমার কাহিনী অনেক পুরনো একটা রহস্য নিয়ে। চারশো বছর আগের। তাড়াহুড়া নেই। সব বলা যাবে।
পড়তে আরম্ভ করলেন সাইমন। রান্নাঘরে শোনা যাচ্ছে বাচ্চাদের কলরব। কিন্তু পড়তে পড়তে এতই মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি, সে সব শব্দ কানেই ঢুকল না। শেষ পৃষ্ঠাটাও শেষ করে মুখ তুললেন। হাসলেন। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি খেয়েও তাহলে লিটারের মেজাজ ঠিক হয়নি! হাহ্ হাহ্।
কিশোরও হাসল। চিতাবাঘ কি আর চামড়ার ফোঁটা মুছে ফেলতে পারে। সিয়েটাও কিন্তু কম বদমেজাজী নয়। দুজনে মিলেছিল ভাল।
দুটো দক্ষিণ আমেরিকান দেশে সিয়েটাকে খুঁজছে পুলিশ, রবিন জানাল। বড় রকমের অপরাধী। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছে জেলখানায়। বিশপের ডায়রি চুরির ব্যাপারে তার হাত কতটা ছিল, ডক্টর মনটাগো সেটা ভাল বলতে পারবেন। এসব নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। আগেও অনেক অপরাধ। করেছে সিয়েটা। তবে বিশপের বই হাতে গিয়েই প্রথমবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। জেলে গেল। তার পরে কুকাজ করতে গিয়ে আরও কয়েকবার জেলে গেছে।
অ্যাটাচি কেস খুলে চামড়ায় বাধানো পুরনো বইটা বের করলেন মনটাগো। আইলিন লিসটারে ওটা খুঁজে পেয়েছিল কিশোর। আমি এখন শিওর, ডক্টর বলতে লাগলেন, এটাই বিশপ এনরিক জিমিনিজের হারানো ডায়রি। অনেক বছর আগে বোগোটাতে বাস করতেন তিনি। সোনার খনিতে ইনডিয়ান শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করার কারণে লোকে তার নাম দিয়েছিল রক্তাক্ত বিশপ। স্প্যানিশ বিজেতাদের দখল করা পান্নার খনিও দেখাশোনা করেছেন তিনি। স্প্যানিশ কলোনির একজন উঁচুদরের লোক ছিলেন। গভীর আঁতাত ছিল। সরকারের সঙ্গে।
লোকে বলে তিনিও অত্যাচারী ছিলেন। অথচ বিশপ তার ডায়রিতে লিখে গেছেন, খনির শ্রমিকদের ওপর স্প্যানিশদের অত্যাচারে তিনি মর্মাহত। সেসব অত্যাচার ঠেকানোর জন্যেই নাকি খনি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন তিনি। একটা পান্নার খনিতেও গিয়েছিলেন। এক চিলতে জমিতে পাওয়া গিয়েছিল খনিটা। বেশি গভীরে খুঁড়তে পারেনি ইনডিয়ানরা, কেবল ওপরটা কিছুদূর খুঁড়েছিল। আরও ভেতরে কেন নামতে পারছে না ওর। সেজন্যে সাংঘাতিক অত্যাচার চলছিল। ওদের ওপর। দেখেশুনে আর স্থির থাকতে পারেননি বিশপ। ছুটে এসেছিলেন। বোগোটায়। স্প্যানিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে। যাতে ইণ্ডিয়ানদেরকে খনির কাজ থেকে রেহাই দেয়া হয়। সরকার কিছু করার আগেই পর্বতে ভূমিধস ঘটল। যে খনিটা দেখে এসেছিলেন বিশপ, সেটা চাপা পড়ে গেল। অনেক মাটির তলায়।
এ পর্যন্ত বলে থামলেন মনটাগো। দম নিলেন। তারপর ডায়রি খুলে পড়ে অনুবাদ করে বলতে লাগলেন, কয়েক মাস ধরে খুঁড়ল অনেক লোক মিলে। মাটি সরানোর চেষ্টা করল। কাজটা মারাত্মক বিপজ্জনক। আরও ভূমিধস নামতে পারে। আলগা মাটি খসে পড়ে মানুষকে চাপা দিতে পারে। কিন্তু এত বিপদের মধ্যেও লোকগুলোকে কাজ করতে বাধ্য করল সৈন্যরা। বিদ্রোহী হয়ে উঠল ইনডিয়ানরা। আর খুড়তে অস্বীকার করল। এই সময় আদেশ এল সরকারের কাছ থেকে, খনিটা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ওটাতে আর কাজ করানোর দরকার নেই। বাঁচল ইনডিয়ানরা। তবে ঈশ্বরের অশ্রু খুঁজতে গিয়ে অনেক অশ্রু ঝরে গেছে ততদিনে।
হুমম! মাথা দোলালেন সাইমন। এতদিন তাহলে ভুল কথা জেনে এসেছি। বিশপ অন্যায় করেননি। অত্যাচারী ছিলেন না।
অযথা বদনামের ভাগী হয়েছেন, মুসা বলল। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস…
বইয়ের মাঝখানে নাকি কিছু পৃষ্ঠা নেই। সাইমন জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলোতে কি লেখা ছিল? কিছু বুঝতে পেরেছেন?
ওগুলোই ছিল আসল, মনটাগো জানালেন। খনিটার অবস্থান। বোগোটা থেকে রওনা দিয়ে খনিতে পৌঁছতে যে কদিন লেগেছিল সে কদিনের কথা নিশ্চয়। লেখা ছিল ওই পৃষ্ঠাগুলোতে। ওই লেখার নির্দেশ পড়ে গিয়ে পৌঁছানো যাবে, সোগামোসোর সেই পান্নার খনিতে। যে জায়গায় বৃদ্ধা মহিলা তার ছায়া ফেলবে সেখানেই পাওয়া যাবে খনিটা। বৃদ্ধা মহিলা, অর্থাৎ ওল্ড উয়োমেন হল অ্যানডিজ পর্বতমালার একটা চুড়ার নাম। স্থানীয় ইনডিয়ানরা ওই নাম রেখেছে।
বহু বছর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল বিশপের ডায়রি। মালিক জানতই না এটাতে কি লেখা রয়েছে। তার হাত থেকে চলে গেল এক বই ব্যবসায়ীর হাতে, দুর্লভ বই কিনে বিক্রি করত ওই ব্যবসায়ী। তার মনে হয়েছিল মূল্যবান আবিষ্কার। করা যাবে ও বইয়ের লেখার মানে বের করতে পারলে। কিন্তু বের করার আগেই চুরি হয়ে গেল বইটা। পুলিশ সন্দেহ করল ব্যবসায়ীর অ্যাসিসটেন্টকে। লোকটার বাসায় গিয়ে হানা দিল একদিন। বেশ কিছু দুর্লভ দলিল বের করল ওখান থেকে। সব চোরাই মাল। দোকান থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে যেটার জন্যে যাওয়া সেই ডায়রিটাই পেল না।
তাই? ডিটেকটিভ বললেন। ওই অ্যাসিসটেন্ট নিশ্চয় আমাদের সিয়েটা।
হ্যাঁ, জবাবটা দিল মুসা। শুরুতে সব অস্বীকার করে সিয়েটা। বলে সে কিছু জানেই না। শেষে চাপে পড়ে বলে একজন আমেরিকান দোকানে ঢুকে ডায়রিটা নিয়ে চলে গেছে। জ্যাকেটের নিচে লুকিয়ে। একথাও বিশ্বাস করেনি পুলিশ। জেলে পাঠিয়ে দিল তাকে।
আসলে কি ঘটেছিল আন্দাজ করতে পারি আমরা, রবিন বলল। কিমের রান্নাঘরে হঠাৎ যেন এক ঝলক হাসির ঝড় উঠল। সেটা মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। অপেক্ষা করতে হল তাকে। এখনও কেউ মুখ খুলছে না, সিয়েটাও না, লিসটারও না। এলেনার কাছে তার বাবার সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে একটা ধারণা করতে। পারি আমরা। এক সময় নাবিক ছিলেন লিসটার, দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। বন্দরে জাহাজ থামলে বসে থাকতেন না। যতটা পারতেন ঘুরে বেড়াতেন দেশের ভেতরে। প্রচণ্ড উচ্চাকাভক্ষা ছিল তার। সব সময় সুযোগ খুজতেন। বোগোটায়। কোন ভাবে পরিচয় হয়েছিল সিয়েটার সঙ্গে। ডায়রিটা, পড়েই হোক কিংবা যে ভাবেই হোক সোগামোলোর পান্নার খনির কথা জেনে ফেলেছিল সিয়েটা। সেটা বলেছিল লিসটারকে। তারপর দুজনে মিলে চুরি করে ডায়রিটা। সিয়েটার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন লিসটার। ফলে সিয়েটা গেল জেলে আর তিনি দেশে ফিরে এলেন বিপুল টাকার মালিক হয়ে।
তার মানে পান্নার খনিটা তিনি পেয়েছিলেন, সাইমন বললেন।
তাই তো মনে হয়, কিশোর বলল। বিশপের ডায়রিতে যে পথের কথা লেখা আছে সে ভাবে চলে আমরাও পৌঁছতে পারব খনির কাছে। পড়া খুব কঠিন।
স্প্যানিশ না জানলে হবে না।
মাথা ঝাঁকালেন মনটাগো। কিছু কিছু জানা থাকলে অবশ্য পারতেও পার। ডিকশনারি আর রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিয়ে। আমার বিশ্বাস লিসটারও তাই করেছিলেন। গত চারশো বছরে স্প্যানিশ ভাষার ততটা পরিবর্তন হয়নি।
আইলিন লিসটারে গেল কি করে ডায়রিটা? জানতে চাইলেন সাইমন।
মনে হয়, রবিন বলল। পান্নার দরকার হলেই জাহাজ নিয়ে কলাম্বিয়ায় চলে যেতেন লিসটার। ওই ডায়রিটাই হল খনিতে যাওয়ার পথ নির্দেশক। তাই ওটা সঙ্গে রাখতেন। যদি ভুল হয়ে যায় দেখে মিলিয়ে নেয়ার জন্যে। শেষবার যাওয়ার পর আর অনেকদিন যাবেন না বুঝতে পেরেই হয়ত আসল পাতাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে এসেছিলেন। লুকিয়ে রেখেছিলেন বাড়িতে। ডায়রিটা ফেলে রেখেছিলেন সাধারণ বইয়ের সঙ্গে। কারণ ওটার আর তখন দাম নেই। তবু কোন জিনিস ফেলে দেয়ার স্বভাব নয় তো, রেখে দিয়েছিলেন।
হুঁ। তাহলে বড় লোক হওয়ার পুঁজিটা তিনি পান্নার খনি থেকেই জোগাড় করেছেন। জানালা দিয়ে সাগরের দিকে তাকালেন সাইমন। আবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, তারপর তার অপরাধের সঙ্গী এসে সেদিন মেয়ের পার্টিতে হাজির হল। দেখে ভীষণ চমকে যাওয়ারই কথা।
হয়েছেন মানে। একেবারে অ্যানজিনার অ্যাটাক হয়ে গিয়েছিল। অনেক বছর পরে দেখা। তবু তাকে চিনতে ভুল করেনি সিয়েটা।
মুসা বলল, আমি যখন লিসটারের কাছে বসে ছিলাম, ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলেন তিনি। আসলে তার মনে তখন দুশ্চিন্তার ঝড়। বুঝে ফেলেছিলেন সিয়েটা প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবেই। ডায়রিটা চাইবে। কিন্তু তখনও ওটা দেয়ার ইচ্ছে ছিল না লিসটারের। অন্তত আসল পাতাগুলো। তাই পয়লা সুযোগটা পেয়েই আমাকে বাথরুমে আটকে পাতাগুলো বের করে ফায়ারপ্লেসে ফেলে পুড়িয়েছেন। তারপর কমপিউটার রুমে গিয়ে একটা মেসেজ লিখলেন এলেনার জন্যে। খনিটার কথা মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি, যদি তার কিছু ঘটে যায় তাহলে এলেনা যাতে গিয়ে খুঁজে বের করতে পারে ওই সম্পদ।
শ্রদ্ধা চলে যাচ্ছে আমার লোকটার ওপর থেকে, বিরক্ত কণ্ঠে বললেন সাইমন। লিসটার ভীষণ লোভী। যা আনার তো এনেছিল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত, আর কেন? ডায়রিটা সিয়েটাকে দিয়ে দিলেই হত। ..
ঠিকই বলেছেন, মাথা ঝাঁকাল মুসা। আমি বাথরুমে আটকা পড়ে আছি। নিশ্চয় ওই সময়টাতেই পা টিপে টিপে দোতলায় উঠে এসেছিল সিয়েটা। আমাকে বাথরুম থেকে বের করতে এসেছিলেন তখন লিসটার, সিয়েটার জন্যে পারেননি। একটা বালিশ এনে তার মুখ চেপে ধরেছিল সিয়েটা, যাতে চেঁচাতে না পারেন। ভয় দেখানোর জন্যেও হতে পারে। টানাটানিতে গেল ওটা ছিঁড়ে। তখন দ্বিতীয়। বালিশটা নিয়ে এল সিয়েটা। বেহুশ করে ফেলল লিসটারকে। বোধহয় খুন করে ফেলেছে বলে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সিয়েটা। সে চেয়েছিল ভয় দেখিয়ে ডায়রিটার কথা বের করে নেবে। খুনের ইচ্ছে ছিল না। ঘাবড়ে গিয়ে লাশ সরিয়ে ফেলার। জন্যেই লিসটারকে সরিয়ে নিয়ে যায়, এমন ভাবে, যাতে সবাই ভাবে নিজে নিজেই। চলে গেছেন লিসটার।
বাড়ি থেকে বের করল কিভাবে? জানতে চাইলেন সাইমন।
ঠেলাগাড়িতে করে। ময়লা টেবিলক্লথ দিয়ে ঢেকে।
শেষ পর্যন্ত ময়লার গাড়ি? হাহ।
আগের কথার খেই ধরল কিশোর, পার্টি শেষে ডেকোরেটরের জিনিসপত্র। ফেরত দিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল সিয়েটার ওপর। ভেবেছিল তখনই সুযোগ করে। লিসটারের লাশটা নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলবে কোথাও। কিন্তু লাশ বের করতে গিয়ে দেখে মরেননি লিসটার, বেহুশ হয়ে আছেন। অ্যানজিনার অ্যাটাক, এমনিতেই দুর্বল শরীর, তার ওপর ওই ধকলে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন।
এতে মস্ত সুযোগ পেয়ে গেল সিয়েটা, কিশোরের মুখের কথা টেনে নিয়ে বলল রবিন। লিসটারকে বন্দি করল নিয়ে গিয়ে ওই নির্জন বাড়িটায়। যত চেঁচামেচিই করুন, ওখানে কারও কানে যাবে না। আর পোড়ো বাড়িতেও মানুষ। থাকতে পারে, এতে সন্দেহের কিছু নেই। ভবঘুরেরা যেখানে সেখানে রাত কাটায়। কাজেই বাড়িটা থেকে সিয়েটাকে বেরোতে যদি কেউ দেখেও থাকে, কেয়ারই করেনি। খুঁজেপেতে ভাল বাড়িই বের করেছিল সিয়েটা। যে ঘরে লিসটারকে আটক করেছিল সে, সেটা নিশ্চয় মেশিরুম ছিল। কোন বড় ধরনের মেশিন ছিল ওখানে, যার জন্যে ওই আঙটার প্রয়োজন হত। সিয়েটা সেই আঙটায় শেকল লাগিয়ে বাঁধল লিসটারকে।
তাকে মারতে চায়নি সিয়েটা। তাই নিয়মিত খাবার আর পানি নিয়ে যেত। ডায়রিটার কথা জিজ্ঞেস করাও উদ্দেশ্য ছিল তার। কিন্তু লিসটার এমনই ধড়িবাজ, সিয়েটাকে দেখলেই বেহুশ হয়ে যাওয়ার ভান করতেন। নড়া নেই চড়া নই কোন প্রশ্নের জবাব দেয়া নেই। ভান যে করছেন সেটা সিয়েটাও বুঝতে পারত। কিন্তু বেশি চাপাচাপি করার সাহস পেত না সে, পাছে মরে যান। খুনের দায় তো চাপবেই ঘাড়ে, খনির ঠিকানাটাও চিরতরে মুছে যাবে।
এখন কেমন আছেন লিসটার? জিজ্ঞেস করলেন সাইমন।
সুস্থ হচ্ছেন, মুসা জানাল। একটা অলৌকিক ব্যাপারই বলা যায়। হাতটা ধসে পড়ল, অথচ একটা আঁচড়ও লাগেনি তার গায়ে।
হুঁ। ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়, হাসলেন ডিটেকটিভ। তবে ভূমিকম্পটা তত বড় ছিল না, তাহলে আর বাঁচতে হত না তোমাদের কারোই। গত হপ্তায় নিউ ইয়র্কে ছিলাম আমি। এখানে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটাকে গুরুত্বই দেয়নি কোন কাগজ।
ওরা যা-ই বলুক, রবিন বলল। আমাদের বারোটা বাজতে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই। ভাগ্যিস আমাদের বাড়িটা ধসেনি।
সেজন্যেই তো বলছি, বড় ছিল না। তাহলে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলত। কেউ বাঁচতে না তোমরা…
নাক কুঁচকালো মুসা। অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে। হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল চুমাশ ইনডিয়ানদের কোলাহল। ভাগ্যিস ইনডিয়ান হয়ে জনুগ্রহণ করেনি সে। ওরকম বিদঘুঁটে গন্ধ-ওয়ালা খাবার খেয়ে বাঁচার কোন ইচ্ছেই তার নেই। কদিন ধরেই হাসপাতালে আছেন লিসটার, বলল সে। বেড়ালের জান। মরবেন না। ভাল হয়ে উঠছেন দ্রুত। তবে হওয়ার পর আরেকটা ধাকা খাবেন, এলেনা বলেছে আমাদেরকে। বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে চিরদিনের জন্যে মায়ের কাছে চলে যাবে সে, আর থাকতে আসবে না। বাবার কাছে। সে বুঝে গেছে, কোন দিনই তার বাবার মেজাজ ঠিক হবে না। ওরকম একটা খেপা লোকের কাছে থাকলে যে কোন সুস্থ মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। এলেনার কথাঃ টাকাই জীবনে সব নয়। টাকার নেশা মানুষের সর্বনাশ করে ছাড়ে।
আর পান্নার খনির ব্যাপারে যা ভেবেছিলাম, রবিন বলল কিছুটা হতাশ কণ্ঠেই। আসলে তা নয়, গোপন নেই আর ওটা। বহু বছর আগেই আবিস্কার হয়ে গেছে। লিসটারই করেছেন। ওটা কোন রহস্য নয়। অযথাই এর পেছনে সময় নষ্ট করলাম।
আরও একটা খবর, মিটিমিটি হাসছেন মনটাগো। লিসটারও জানেন না। অনেক দিন আগে শেষ গিয়েছিলেন তো খনিটাতে, তাই। আমি খোঁজ নিয়ে। জেনেছি কয়েক বছর আগে আরেকটা লোক ওটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। কলাম্বিয়ার সরকার দখল করে নিয়েছে এখন ওটা। লিসটার যদি সন্ধান বলতেনও আর সিয়েটা যদি যেতও, কিছুই পেত না। খনির কাছে ঘেঁষতেই দেয়া হত না। তাকে।
আহহা, এটা তাকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল, জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল। মুসা। অযথাই কষ্ট করল বেচারা। খামোকা আবার জেলে গেল।
অপরাধীদের ওরকম সাজাই হয়, সাইমন বললেন।
লিসটারেরও একটা শাস্তি হওয়া উচিত।
আর কি হবে? হয়েছেই ভোস্ত্রী তালাক দিয়ে চলে গেছে। মেয়ে থাকে না। নিজে আধ পাগল। কোটি কোটি টাকা থাকলেই কি না থাকলেই কি। এটা একটা জীবন হল। কেউ তাকে দেখতে পারে না। সম্মান করে না।
আমরাও করি না, ফস করে বলে ফেলল মুসা। বলেই বুঝল কথাটা বলা ঠিক হয়নি। গাল চুলকাতে শুরু করল সে।
মুসার অস্বস্তি বুঝতে পারলেন সাইমন। আসলে সম্মান জিনিসটা জোর করে কাউকে করা যায় না। ভেতর থেকে আসে। তোমাদের আসে না, তো কি করবে।
হাসপাতালে গিয়ে কিশোর যা সব কথা বলে এসেছে না, রবিন বলল। ইজ্জত রাখেনি।
কি বলেছে?
কিশোর আর আমাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন লিসটার, আমরা তাকে উদ্ধার করেছি বলে। মুখের ওপর বলে দিল কিশোর, তিনি ওরকম জানলে কখনোই কাজটা করত না। বলেছে, আমরা টাকা নিই না কাজের জন্যে। লোকের উপকার করাই আমাদের ব্রত। কিন্তু যারা অন্যায় করে তাদেরকে সাহায্য করার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই।
লিসটার কি বললেন?
চুপ হয়ে গেলেন।
হু! বলবেন আর কি? বলার তো কিছু নেই। এক মুহূর্ত চুপ থেকে জানতে চাইলেন ডিটেকটিভ, আরনি ভিনসেনজোর খবর কি?
একটা ব্যাঙ্কে নতুন চাকরি নিয়েছে, রবিন জানাল। ডি এল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই বহাল রয়েছে এনথনি, ভাবছে তার, শয়তানীর কথাটা ভুলে যাবেন লিসটার। এলেনার মায়ের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বহুদিন থেকেই, সেটা লিসটারকে জানাতে চায়নি বলেই কিশোরকে দেখে লুকিয়ে পড়েছিল। ভদ্রমহিলাও সে কারণেই ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন। কিশোরকে বের করে। দেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মহিলা অবশ্য বলেছেন, তার সঙ্গে…
থাক, হাত তুললেন সাইমন। ওসব কথা শুনতে চাই না। লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এইবার আসল কথাটা বল তো। ফাইলে লেখনি। চিলেকোঠার সেই ভুতের ব্যাপারটা। কি ব্যাখ্যা দেবে? কিশোরকে প্রশ্নটা করলেন তিনি।
আমি বুঝতে পারছি না, স্যার, মাথা নাড়ল কিশোর। এটা সত্যিই একটা বড় রহস্য। বের করব একদিন। মিসেস বেকার একটা গল্প বলেছে। মুসা বিশ্বাস করে, আমি করি না। মহিলা বুলে, সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে তার ধনী ফুফুর কাছে, বড় হয়েছিল, তাকে একবার সাংঘাতিক মেরেছিল ফুফু। সোনার একটা পিন হারিয়েছিল বলে।
তারপর অনেক ভুগতে হয়েছে মেয়েটাকে। তার পরিবারের সবাই ভাবতে আরম্ভ করে, সে চোরই। আমরা চলে আসার পর চিলেকোঠায় গিয়েছিল মিসেস বেকার, খোঁজাখুজি করতে। যে কোন ব্যাপারে, বিশেষ করে ভূতের, তার খুব কৌতূহল। পুরনো একটা ট্রাঙ্কের ভেতরে লেপের মধ্যে আটকে থাকা এই জিনিসটা বের করে এনেছে, পকেট থেকে একটা সোনার ব্রোচ বের করে টেবিলে রাখল গোয়েন্দাপ্রধান। মিসেস বেকারের ধারণা, এই জিনিসটা চুরির অপবাদ দিয়েই মারধর করা হয়েছিল মেয়েটাকে। কিন্তু আসলে সে চুরি করেনি। ট্রাঙ্কে লেপ ভরার সময় নিশ্চয় টান লেগে বা অন্য কোনভাবে জিনিসটা লেপের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। সেখানে আর খোঁজেওনি ফুফু, পায়ওনি। মহিলা ওই বাড়িতে থাকতেই মারা গেছে। তার অনেক পুরনো জিনিস এখনও রয়ে গেছে বাড়ির চিলেকোঠায় আর স্টোররুমে। ওই ট্রাঙ্কটাও তারই। বাড়িটা কেনার পর এখন মিস্টার লিসটারের সম্পত্তি হয়ে গেছে।
আমার বিশ্বাস, চিলেকোঠার প্রথম অনুপ্রবেশকারী হল সিয়েটা। এলেনার ওপর ভরসা রাখতে পারেনি সে, তাই নিজেই খুজতে এসেছিল বিশপের বই। দুবার আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একবার বিরোধ বাধে। আরেকবার এসে এলেনার জিসিনপত্র ঘাটাঘাটি করে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়জন যে এসেছে সে কে? সেটার জবাব দিয়েছে মিসেস বেকার। খোঁজ নিয়েছিল সে, ব্রোচটা পাওয়ার পর। মোটর দুর্ঘটনায় নাকি মারা গেছে মেয়েটা। এলেনার পার্টি যেদিন হয় সেদিন। মিসেস বেকার জোর গলায় বলছে, নিশ্চয়, সেই মেয়েটার অশান্ত আত্মাই এসে ঢুকেছে চিলেকোঠায়, ব্রোচটা খুঁজে বের করে মানুষকে দেখানোর জন্যে যে সে সত্যিই ওটা চুরি করেনি, চোর ছিল না।
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে, অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ডিটেকটিভ।
মাথা, ঝাঁকাল কিশোর। সে চোর ছিল না এটা বিশ্বাস করছি। কিন্তু ভূত সেজে চিলেকোঠায় এসেছে একথা আমি বিশ্বাস করব না কিছুতেই। ভূত, প্রেতাত্মা এসব থাকতেই পারে না। ওই শব্দের অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে।
আমারও তাই ধারণা। বাতাসের কারসাজি হতে পারে। অনেক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় বাতাস, বিশ্বাস করা যায় না। ইঁদুরও হতে পারে। ঠিক আছে, আমিও নাহয় একদিন যাব তোমাদের সঙ্গে। রহস্যটার সমাধান করতে। অবশ্যই যদি লিসটার অনুমতি দেন।
হঠাৎ প্রতিবাদের ঝড় উঠল রান্নাঘরে। থেমে গেল আবার। একটু পরে দরজায় উঁকি দিল কিম। ঘোষণা করল, খাবার তৈরি। উদ্ভট একটা গন্ধ এসে ঢুকছে রান্নাঘর থেকে, সবার নাকেই লাগছে সেটা। সেদ্ধ করা কাঠের গুডোর গন্ধ মনে হল মুসার কাছে।
অ্যাক্রন কেক খেতে চাইছে না বাচ্চারা, বিষণ্ণ কণ্ঠে জানাল কিম। ওসব খেয়ে চুমাশ ইনডিয়ান সাজার কোন ইচ্ছেই ওদের নেই। কাপড় পরেছে যে এই বেশি।
তাই! ঘাবড়ে গেলেন মিস্টার সাইমন। ওঁদেরকেই না আবার চেখে দেখতে বাধ্য করে কিম। চোখ ফেরালেন আরেক দিকে।
রবিও ঘাবড়ে গেল।
ভয়ে ভয়ে আবার চোখ ফেরালেন সাইমন। তাহলে এগুলোর কি গতি হবে? আর বাচ্চাদেরকেই বা কি খাওয়াবে? ওদেরকে তো অভুক্ত রাখা যায় না।
ওদের নিয়ে ভাবনা নেই, হাসল কিম। হাইওয়েতে একটা পিজার দোকানে নিয়ে যাব। আমেরিকান অ্যাক্রন না খেতে চাইলে কি হবে, আমেরিকান পিজা খুবই পছন্দ ওদের।
ভাল। তাই নিয়ে যাও। আর অ্যাক্রনগুলো ফেলে দাও, কিংবা কোন চুমাশ ইনডিয়ানের সঙ্গে পরিচয় থাকলে তাকে দিয়ে দাও।
চোখে অনেক আশা নিয়ে মুসার দিকে তাকাল কিম।
এদিক ওদিক তাকাল মুসা। আবার তাকাল কিমের দিকে। না, তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে বাবুর্চি, কোন সন্দেহ নেই। খাইছে! বিড়বিড় করল সে। কিমকে জিজ্ঞেস করল, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি চুমাশ নাকি?
না, চুমাশ নও। তবে চুমাশের বাপ। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কিম। আচমকা মুসার দুহাত চেপে ধরল। মুসা, প্লীজ, লক্ষ্মী ভাই আমার, একটি বার! শুধু একটা চামচ! তার বেশি বলব না…
মানে?
অ্যাক্রন এই নতুন রান্না করলাম। কেউ না চাখলে তো বুঝতে পারব না কেমন হয়েছে। শুধু এক চামচ…
মাথা চুলকাল মুসা। রাজি হয়ে গেল, বেশ। তবে এক শর্তে।
কি শর্ত? যে কোন শর্তে রাজি কিম।
প্রচুর পরিমাণে স্যাণ্ডউইচ, মাংসের বড়া, ডিম ভাজি, পনির, কেক, সালাদ, আইসক্রীম…
আছে, সব আছে। থালা ভর্তি করে দেব। যত চাও দেব…
ঠিক আছে। নিয়ে এস তোমার অ্যাক্রন, এমন একটা ভঙ্গি করল মুসা, যেন অ্যাক্রনেরই একদিন কি তারই একদিন। দেখে নেবে আজ।
হাসি ফুটল অন্যদের মুখে। নিস্তার পেয়েছে।
নাচতে নাচতে রান্নাঘরের দিকে চলল নিসান জাং কিম।
.
আরও পনের দিন পর। ট্র্যাকে মোটা একটা খাম এসে হাজির হল কিশোরের নামে। ইয়ার্ডের কাজ করছিল সে। এই সময় পিয়ন দিয়ে গেল চিঠিটা। কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে গোয়েন্দাপ্রধান। বিশ্রাম নেয়ার কথা ভাবছিল অনেকক্ষণ থেকেই। পেয়ে গেল ছুতো এবং সুযোগ দুটোই। অফিসের সামনের বারান্দায় এসে বসল। ধীরেসুস্থে খুলল খামটা।
ভেতরে বেশ বড় একটা চিঠি। টাইপ করা। আর একটা কার্ড, দাওয়াতের। অবাক হল সে। কে দাওয়াত করল? আগে তাই কার্ডটাই দেখল। পড়ে আরও অবাক। লিসটার দাওয়াত করেছেন। আরেকটা পার্টি দিচ্ছেন তিনি। মেয়ের বিয়ের কথা ঘোষণা করবেন, এনগেজমেন্ট করা হবে, হ্যাঁ, নিক ভিশনের সঙ্গেই। আশ্চর্য!
তিন গোয়েন্দাকেও দাওয়াত করা হয়েছে।
চিঠির নিচের সইটা দেখল কিশোর। লিটারের। ব্যাপার কি? পড়তে আরম্ভ করল সে। তাকেই লেখা হয়েছেঃ
কিশোর,
সেদিন তুমি হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর অনেক ভেবেছি। আসলেই, খারাপ লোক আমি। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। জীবনে। অনেক অন্যায় করেছি। সেসব কথা ভেবে ভীষণ, অনুশোচনা হচ্ছে এখন। অনেকগুলো বছর পেছনে ফেলে এসেছি, আর অনেক অন্যায়, সবগুলোর প্রায়শ্চিত্ত তো আর করতে পারব না, তবু যতটা পারি করার চেষ্টা করছি। ঠিকই বলেছ তুমি, শুধু টাকা থাকলেই হয় না, জীবনে ইজ্জত-সম্মানের অনেক দাম। এবং সৎ থাকার।
তোমাকে কয়েকটা কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। আমার মত একটা মানুষকে সাহায্য করেছ বলে রাগ হচ্ছে তোমার, দেখ এসব জানার পর রাগ কিছুটা কমে কিনা। সিয়েটার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করিনি আমি পুলিশের কাছে। বলেছি, আমাকে কিডন্যাপ করেনি সে, নিজের ইচ্ছেতেই আমি তার সঙ্গে গিয়েছিলাম। পুলিশ তখন জিজ্ঞেস করল, আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হল কেন? বললাম, সেটা আমাদের দুই বন্ধুর ব্যাপার। পুলিশ অসন্তুষ্ট হলেও যেহেতু আমি কোন অভিযোগ করিনি, সিয়েটাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে নিয়ে এসেছি আমার কাছে। পুরনো বন্ধুত্বটা আবার ঝালাই করার চেষ্টা করছি।
তোমরা নিশ্চয় একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছ, পান্নার খনি থেকে পানা তুলে এনে বিক্রি করেই আমি আমার ব্যবসার পুঁজি জোগাড় করেছি। ভুল। আসলে, জীবনে যা করেছি আমি, যেখানে এসে উঠেছি, সব আমার নিজের চেষ্টায়। অনেক পরিশ্রম করে টাকা কামিয়ে দুটো ঝরঝরে স্টীমার কিনেছিলাম। সেই দিয়েই শুরু। বিশ্বাস না করলে এসে দেখে যেতে পার, খনি থেকে তুলে আনা পান্নাগুলো আজও আমার কাছেই আছে। একটাও নষ্ট করিনি কিংবা বিক্রি করিনি। সব সিয়েটাকে দিয়ে। দেব ঠিক করেছি।
ডায়রির পাতাগুলো আমিই পুড়িয়েছি। ঠিকই আন্দাজ করেছ। আর কেউ যাতে যেতে না পারে, সেজুন্যেই পুড়িয়েছিলাম পথের নির্দেশ। এখন ভাবি, ভালই করেছি। কেউ আর সে নির্দেশক পাবে না। পেলেই লোভ হত, আর লোভ থেকেই পাপ। আমি যে অন্যায় করেছি তা আর কেউ করতে পারবে না এখন।
ভাবছি, সিয়েটাকে ব্যবসার অংশীদার করে নেব। সে রাজি হবে। কিনা জানি না। যতদূর জানি, আমার চেয়ে তার আত্মসম্মানজ্ঞান বেশিই।
ও হ্যাঁ, আরনি ভিনসেনজোর সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। তার পুরনো চাকরিটা ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। রাজি হয়নি। নতুন একটা চাকরি। জুটিয়ে নিয়েছে। শেষে তার বাবার সঙ্গে দেখা করে যে ক্ষতি আমি করেছি তার জন্যে মাপ চাইলাম। ওখানে আমার টায়ারের দোকান বন্ধ। করে দিয়েছি। ভিনসেনজোর দোকানপাট আবার সাজিয়েগুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি আমি। যা লোকসান হয়েছে সব পুষিয়ে দেয়ার কথাও বলেছি।
তোমাদের কাছে আরও একটা জিনিস নিশ্চয় খুব খারাপ লেগেছে। আমার কমপিউটারে সমস্ত কর্মচারীদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপন ফাইল রেখে দেয়ার ব্যাপারটা। সব মুছে ফেলেছি আমি। ওরকম ব্ল্যাকমেল করে। মানুষকে দিয়ে কাজ হয়ত করান যায়, কিন্তু তাদের শ্রদ্ধা মেলে না। স্পষ্ট করে সব কর্মচারীকে জানিয়ে দিয়েছি, ঠিকমত দায়িত্ব নিয়ে আমার এখানে কাজ করলে, কারোরই কোন অসুবিধে হবে না। কাউকে অন্যায় ভাবে চাপ দিয়ে আর কাজ করাব না আমি। তবে যে ফাঁকি দেবে তারও জায়গা হবে না আমার এখানে।
সব শেষে আসি মেয়ের কথায়। তার বিয়েতে আমার কোন অমত নেই আর। জীবনটা তার, কাকে নিয়ে কাটাবে সেটাও তার পছন্দ, আমার নাক গলান ঠিক হয়নি। নিককে নিয়ে যদি সুখী হতে পারে, আমার আপত্তি কি?
কিশোর, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। স্বীকার করতে লজ্জা কিংবা দ্বিধা নেই, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আরও আগেই যদি তোমার মত ওভাবে কেউ আমার চোখ খুলে দিতে পারত, অনেক ভাল হত। জীবনটা অনেক সুন্দর হয়ে যেত আমার কাছে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শেষ কথা, মেয়ের বিয়ের এনগেজমেন্ট হবে, কার্ড পাঠালাম। আসবে, অবশ্যই। তিন গোয়েন্দার দাওয়াত রইল। খুব খুশি হব। না এসে বুড়ো মানুষটাকে আর দুঃখ দিও না, প্লীজ।
ইতি–
ডেভিভ লিসটার।