–মাদাম, ব্যস্ত হবেন না, কলিংবেলে হাত রাখতে গিয়েও নামিয়ে নিলেন ক্যারোলিন, ও কাজটা আমিই সেরে রেখেছি।
-কী আর করি, বলুন, ক্যারোলিন স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে লাগলেন, বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দেখছেন তো। বুদ্ধি বলে কিছু আছে। আপনি ডাক্তার মানুষ তায় আবার এ পরিবারের মাননীয় অতিথি, কোথায় আপনার স্যুটকেসটা গাড়িতে তুলে দেবে, তা নয়। ওদেরই বা দোষ দিই কী করে? মনিব মারা গেছেন, তাঁর মৃত্যু রহস্যের কুলকিনারা করতে বাড়িতে হোমরা-চোমরা মানুষদের ভিড়। গোয়েন্দা, পুলিশ কে নেই বলুন। এসব দেখে বেচারারা মাথা ঠিক রাখতে পারে বলুন? আমার বয়স হয়েছে, তার ওপর মনমেজাজ ভালো নেই। কিন্তু আরও দুটো মেয়ে তো আছে, একজন ফিটের ব্যামো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, আর অন্যজন ডঃ গ্রাহামের সঙ্গে যখন-তখন দেখা করার জন্য ছুটছে কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় মরে যাই আর কী!
–আমার একটা ফোন করা দরকার, আপনি যদি, আঙুল তুলে ডঃ কারোলি টেলিফোনটা দেখালেন।
-ফোন? ক্যারোলিন বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, তারপর ঘাড় কাত করে বললেন–করুন, দরকার যখন, নিশ্চয়ই করবেন। আপনি সোয়া বারোটার ট্রেনেই যাচ্ছেন বুঝি। কিন্তু ও গাড়ি লন্ডনে পৌঁছতে যথেষ্ট সময় নেয়।
-জানি, সংক্ষেপে জবাব দিয়ে ডঃ কারোলি টেলিফোনের দিকে এগিয়ে এলেন। ডিরেক্টরির পাতা ওল্টাতে লাগলেন, ক্যারোলিনের নজর অন্যদিকে ফেরানোর প্রচেষ্টা আর কী। বললেন–বাগানের দিক থেকে চেনা-চেনা গলা পেলাম। মনে হয় আপনার ভাইঝি, মাদাম।
আমার ভাইঝি! তার মানে বারবারার কথা বলছেন, না? খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ক্যারোলিন, চাপা গলায় বলতে শুরু করলেন, মেয়েটা ওপরেই অমন ছলবলে, অথচ বুকের ভেতর দুঃখের পাহাড়, নিঃসঙ্গ, ভাই আছে বটে একটা, নামে মাত্র। জ্যেঠু ছিল, তাও মরে গেল। ছন্নছাড়া জীবন আর কী! আর ওর মতো বয়সে আমরা মা-মাসীর আদর-যত্ন পেয়েছি। সেই সময় বীসওয়াক্স’ নামে একটা ওষুধের খুব চাহিদা ছিল। ওর মধ্যে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি–চারটে গুণই ছিল। রোজ নিয়ম করে খেতে হত।
ক্যারোলিনের শেষ কথাগুলো শুনে ডঃ কারোলি সচকিত হলেন–বীসওয়াক্স! আপনি এই কথাটাই বললেন তো?
হ্যাঁ, ওইরকমই বিশ্রী রকমের কিছু হবে। ক্যারোলিন বলে চললেন–বেরিবেরির জন্য ওই চার ভিটামিনওয়ালা ওষুধ ছিল। এদেশে ও রোগ খুব কম হয়। শুনেছি নেটিভ দেশগুলোতে বেরিবেরি বেশি হয়। যারা ধান থেকে চাল বাছাই করে, মানে চাষা ভূযো আর কী, ওদের মধ্যে নাকি এই অসুখের প্রকোপ বেশি। অন্যদের কি হয় না? মি. রেনরের কথাই বলি। উনি তো আর চাষের কাজ করেন না, অথচ মুখখানা হলদে-সাদাটে হয়ে গিয়েছিল। ব্রেকফাস্টের পরে রোজ সকালে আমার কথামতো একটা করে বড়ি খেত। লুসিয়াকেও বলেছিলাম জানেন, আমার কথা কানে নিলে তো, মেয়েটার ভাব-গতিক বুঝি না, কেমন মনমরা গোছের। যাক গিয়ে, আমি হাঁফিয়ে মরি কেন, এখানকার ছেলেমেয়েরা কি এই বুড়ির উপদেশ মানতে চায়? জানেন ডঃ কারোলি, আমার বাবার আশি বছর বয়সেও চোখের জ্যোতি ছিল স্বাভাবিক। চশমার প্রয়োজন হয়নি তার। দিব্যি বাইবেল পড়েছেন। গোয়েন্দা গল্প, খবরের কাগজ পড়তে একটুও অসুবিধা হয়নি। বাবা কখনো রাতে জানলা খুলে শুতেন না, রাতের হাওয়া নাকি শরীরে লাগানো ভালো নয়, কিন্তু গেঁটে বাতের ব্যথা যখন বেড়ে গেল, তখন তার দেখাশোনার জন্য একজন মহিলা ছিল। ওই নার্স রাতে সব জানলা খুলে দিত। ব্যাস, ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল, বাবাকে কাবু করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু।
–হ্যালো এক্সচেঞ্জ? তখনও ক্যারোলিন বিড়বিড় করে চলেছেন। ডঃ কারোলির মন তখন টেলিফোনের দিকে–হ্যালো, হ্যালো, এক্সচেঞ্জ। মাকে ক্লিভ থ্রি। থ্রি-ওয়ান থেকে বলছি। লন্ডনে একটা কানেকশন চাই। ……হ্যাঁ, নম্বর বলছি…….. সোহো ডবল এইট ফাইভ থ্রি……. হ্যাঁ, ফাইভ থ্রি…….. আপনারাই ডাকবেন? …….বেশ, অপেক্ষা করছি।
ডঃ কারোলি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ক্রমশ তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে, উত্তেজনার তাড়নায় দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলেন, কেমন অস্থির ভাব।
খানিকক্ষণ কেটে গেল। এসে ঢুকলেন এডওয়ার্ড রেনর। ঘরের ভেতর পা দিয়ে সজাগ দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন। এবার ধীর পায়ে ফায়ার প্লেসের পাশে এসে দাঁড়ালেন, এখানেই রয়েছে ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখা মাঝারি মাপের ফুলদানিটা, যার মধ্যে আগুন ধরানোর জন্য কুচানো কাগজ আর মোমের ছোট ছোট খণ্ড রাখা আছে।
ফুলদানিতে হাত দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়াতে হল রেনরকে। দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে এল, সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরালেন। হা, স্টাডির দরজা ঠেলে ডঃ কারোলি ভেতরে ঢুকছেন। তাকে দেখে রেনর যথেষ্ট ঘাবড়ে গেলেন।
অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আপনি? এখানে? কী মনে করে?
–আমার একটা ফোন কল আসার কথা, তাই…..
ডঃ কারোলির কৈফিয়ত রেনরের পছন্দ হল না, তিনি চুপসে গেলেন।
–শুনলাম পুলিশ এসেছে, কতক্ষণ?
ডঃ কারোলির প্রশ্নের উত্তরে রেনর জানালেন বেশীক্ষণ নয়, কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হবে। ওই সবজান্তা গোয়েন্দাটার সঙ্গে পুলিশ অফিসারের খুব ভাব। আরে কী যেন নাম লোকটার জ্যাপ, বেঁটে গোয়েন্দার সঙ্গে বেশ খাতির করে কথা বলছে। চেনেন নাকি ওই পুলিশ অফিসারকে?