….ন…. ..ন… আ….. না। এ কখনো হতে পারে না। লুসিয়া ভয়ে কেঁদে ফেলল।
–পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আপনার বারণে কিছু যায় আসে না। এবার ভেবে দেখুন, আপনি কী করবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। তবে এখনও পর্যন্ত আপনাকে সহায়তা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, অবশ্য আপনি চাইলে। পরে হয়তো পুলিশ আর আইনকে সহায়তা করতে বাধ্য হব।
বেশ, আমি রাজী। লুসিয়া সরাসরি পোয়ারোর দিকে তাকাল, বলুন, কী জানতে চান?
–আমি জানতে চাইছি, আপনি কেন সত্যি কথাটা গোপন রেখেছেন? পোয়ারো সহজভাবে জানতে চাইলেন।
কী যা-তা বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। কোন সত্যি কথা আমি চেপে রেখেছি। আপনাকে বোঝা দুষ্কর। বলুন, কী বলবেন? কথা দিচ্ছি, সব বলব!
পোয়ারো তার ঝুলি থেকে সেই চিঠিটা বের করলেন, যেটা খানিক আগে এডওয়ার্ড রেনরের কাছ থেকে পেয়েছেন কয়েকদিন আগে এই চিঠিটা স্যার ক্লডের কাছে এসেছিল। চিঠিটা লুসিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন পোয়ারো, নজরদার’ শব্দটা লক্ষ্য করুন। আমি নিঃসন্দেহ, প্রেরক নিজের নাম গোপন রাখতে চায়, তাই ওই শব্দের ব্যবহার।
লুসিয়া খুব মন দিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে চিঠিটা পড়ল। তারপর মাথা তুলে অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল–এসবের মানে কী?
লুসিয়া যে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, পোয়ারোর তা বুঝতে দেরি হল না, কিন্তু তার মুখে-চোখে প্রকাশ ঘটেছে।
পোয়ারো সহজভাবে জানতে চাইলেন–সেলমা গেতজ-এর নাম লেখা আছে, দেখেছেন নিশ্চয়ই। এই নামের সঙ্গে আপনার পরিচিতি আছে কি?
-সেলমা গেতজ। এমন নাম জীবনে শুনিনি। কে ইনি?
গেল বছর নভেম্বরে জেনোয়ার এক জেলে তার মৃত্যু হয়েছে।
–তাই?
–হয়তো সেখনেই আপনার সাথে ওঁর দেখা হয়েছিল, চিঠিটা জ্যাকেটের পকেটে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ মাত্রায় নিশ্চিত।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, লুসিয়া ভীষণ চটে গেছে, কর্কশ কণ্ঠে বলল–জেনোয়ায় কোনোদিন আমি যাই-ই নি, ওর সঙ্গে দেখা হওয়াতো দূরান্ত।
–মিথ্যে বলছেন, যদি বলেন, জেনোয়াতে আপনাকে সেলমা গেতজের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে, তাহলে কী বলবেন?
-বলব, তার দেখার মধ্যে ত্রুটি রয়ে গেছে।
কিন্তু মাদাম, আমাকে আপনি ঠকাতে পারবেন না, পোয়ারো জোর দিয়ে বললেন, জেনোয়াতেই আপনার স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল। এই ধরনের খবর আমি পেয়েছি।
–কে দিয়েছে আপনাকে এ খবর? রিচার্ড নিশ্চয়ই? নাঃ, রিচার্ডের স্মরণশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। ও কি করে ভুলে গেল আমাদের প্রথম দেখার সেই জায়গাটা। মঁসিয়ে পোয়ারো, ওটা জেনোয়া নয়, মিলান।
-তাহলে জেনোয়াতে যে মহিলার সঙ্গে আপনি ছিলেন……
–এক কথা বারবার কেন বলছেন? জেনোয়াতে আমি এবয়সে এখনও যাইনি, বুঝেছেন?
বোঝা গেল লুসিয়া খুব চটে গেছে।
হতে পারে, দুঃখিত মাদাম, আসলে ব্যপারটা এতই গোলমেলে যে—
গোলমেলে! কোন ঘটনার কথা বলছেন?
–জানতে যখন চাইছেন তখন আর আড়াল করব না।
এরকুল পোয়ারো বেশ আয়েস করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। আমার এক বন্ধু আছেন, লন্ডনেই থাকে। প্রেস ফটোগ্রাফার। ওর বাছাই করা ভোলা ছবি বেশ নামকরা কাগজগুলোতে ছাপা হয়। ম্যাগাজিনগুলোও বাদ যায় না। ফটো ভোলার দৌলতে বেচারাকে চরকির মতো ঘুরতে হয়। নামজাদা ফ্যাশান মডেল, সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদুষী ও সুন্দরী যুবতীদের ফটো তুলে লন্ডনের প্রেসে পাঠিয়ে দেয়। সেগুলো ছেপে বের হয় কাগজে। সমুদ্রের ধারে বালির ওপর শুয়ে কোনো রূপসী কন্যা রোদন করছে–এমন কত ছবি।
….গতবছরের কথা বলছি। নভেম্বর মাস। বন্ধু তখন জেনোয়াতে গিয়েছিলেন নিজের পেশার সুবাদে। সেখানে এক রূপসী মহিলার সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল। মহিলার নাম ব্যারোনেস দ্যা গিয়ার্স। কোন নামজাদা ফরাসী কূটনীতিকের রক্ষিতা। এ ব্যাপারে মহিলার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাছাড়া ওই কূটনীতিক তার গোপন প্রেমলীলা বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি সত্যকে আড়াল করার পক্ষপাতী ছিলেন না, মাদাম, এবার বুঝতে পারছেন, সত্য একদিন যেভাবেই হোক প্রকাশিত হবে, চাপা রাখা যায় না। আপনার শুনতে কি ভালো লাগছে না?
-আপনি যে ছাই কী বলতে চাইছেন, তাই বুঝতে পারছি না।
–বেশ, একটু সময় দিন। বুঝিয়ে দিচ্ছি। কথা বলতে বলতে পকেট থেকে পোয়ারো নোটবইটা টেনে বের করলেন। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। বললেন–কাজের কথায় আসি। ওই মহিলা অর্থাৎ ব্যারোনেস দ্য গিয়ার্স নামে যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ফটো আমি দেখেছি, অর্থাৎ আমায় বন্ধুটি দেখিয়েছিলেন। মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একজন প্রাক যুবতী। আমি অবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অপরূপ সুন্দরী, কেবল আমি নয়, যে দেখবে, সে আর জীবনে ওই মুখচ্ছবি ভুলতে পারবে না।
পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন, নোটবইটা চালান করে দিলেন পকেটে। বললেন–সেই মুখ আবার আমি দেখতে পেলাম। কোথায় জানেন? এই বাড়িতে যেদিন সন্ধ্যায় এসে পা রাখলাম। ফটোয় দেখা মেয়েটির সাথে হুবহু একরকম। তাকে চিনতে আমার দেরি হল না।
–হুঁ, লুসিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। কী যেন চিন্তা করল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল কৃত্রিম হাসির ঝিলিক–আপনি আমার থেকে কী জানতে চাইছেন বুঝতে পেরেছি। ফটোর ওই মহিলা, মানে ব্যারোনেস দ্য গিয়ার্সকে আমি খুব ভালো ভাবেই চিনি। ওঁর সৌন্দর্য আমাকে পাগল করে দিত। ওর সঙ্গ ভালো লাগত। তাই প্রায়ই সময় ওর বেড়ানোর সঙ্গী হতাম। আর ওর মেয়েটার কথা বলছেন? ও তো একটা ক্যাবলা, বুদ্ধিসুদ্ধি বলে কিছু নেই। মনে হয়, যখন আমি ওই মহিলার সঙ্গে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আপনার দেখা ফটোটা তোলা হয়েছিল। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।