রিচার্ড! স্বামীর ধমকানি খেয়ে লুসিয়া তেড়ে উঠে দাঁড়াল–কি বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলল।
বাবা শেষ কথাগুলি কি বলেছিলেন, খেয়াল আছে তোমার? রিচার্ড প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল–আজ কফিটা বড্ড তেতো লাগছে–ঘুরে ফিরে কয়েকবার এই কথা বলছিলেন।
লুসিয়া তখনও হাঁ–আজ কফিটা বড্ড তেতো লাগছে? বলছিলেন নাকি? স্বামীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। হঠাৎ তার বুঝি ঘুম ভাঙল, অজানা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল।
-এতক্ষণে তাহলে মগজে ঢুকেছে, কি তাই তো? আবার রিচার্ডের গলা থেকে চাপা ধমকানি শোনা গেল–শোনো, বাবা এই পরিবারের কোন একজন বিষ খাইয়েছে, বুঝতে পারছ, ওই টাক মাথার লোকটাকে এখানে রেখে দিলে সব খুঁচিয়ে বের করবে, অ্যামরি পরিবারের কেলেঙ্কারির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তুমি কি জেনে-বুঝে তা হতে দিতে চাও?
-হা কপাল, লুসিয়া সামনের দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল–দয়াময়, আমাদের রক্ষা করুন।
রিচার্ড এবার পোয়ারোকে ডাকল। পোয়ারো শান্তগলায় সাড়া দিলেন।
-মশিয়ে পোয়ারো, রিচার্ড থামল, নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে উগরে দিল আমার স্ত্রী লুসিয়া আপনাকে কেন এখানে রাখতে চাইছে, তা এখনও আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
তাই বুঝি? পোয়ারো একটু হেসে রসিয়ে রসিয়ে বললেন, মনে করুন, একটা দলিল চুরির তদন্তের কারণেই। তাছাড়া বারবারাকে ঈঙ্গিত করে আরও বললেন, উনি, ওই মহিলাও আমাকে একই কথা জানিয়েছেন।
-কিন্তু যে দলিল খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার ওপর ন্যস্ত করা হচ্ছে, তা তো পাওয়া গেছে, মশিয়ে পোয়ারো। রিচার্ড কথাগুলো বারবারাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল।
-সত্যিই কি পাওয়া গেছে? পোয়ারো পাল্টা প্রশ্ন করলেন। তার কথা শুনে রিচার্ড ধন্দে পড়ল।
আচমকাই একটা লম্বা খাম পোয়ারোর নজরে পড়ল, স্যার ক্লডের আর্মচেয়ারের পাশের ছোট টেবিলের ওপর সেটা পড়ে আছে। মৃত্যুর ঘটনায় ভীত ও উত্তেজিত নারী পুরুষের তা নজরে পড়েনি।
তার মানে? রিচার্ডের কঠিন কণ্ঠস্বর।
পোয়ারো আবার নিজের গোঁফে হাত বুলাতে লাগলেন, তারপর ধুলো সাফ করার অছিলাতে জ্যাকেটে দু-আঙুল টোক্কা দিলেন। স্মিত হাস্যে জবাব দিলেন, মি. অ্যামরি, এখানে কি ঘটেছে, এখনও সে ব্যাপারে আমি অজ্ঞ। তবু একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে, অনেক আগে শুনেছিলাম–খালি বোতল, যার মধ্যে কিছুই ছিল না।
-আপনার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারছি না, মশিয়ে পোয়ারো।
–আপনাকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। আপনি সব বুঝতে পারছেন, অথচ মুখে তা স্বীকার করছেন না। কথা বলতে বলতে পোয়ারো টেবিলের ওপর থেকে খামটা তুলে নিলেন, ফাঁক করে উঁকি দিলেন কিছুই নেই। সেটা রিচার্ডের হাতে দিয়ে দিলেন।
রিচার্ড দেখল, খামটা খালি। সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সেটা আগের জায়গায় রেখে দিল। লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলল–কোথায় গেল সেই ফর্মুলা, খামটা তো খালি।
স্বামীর কথার বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগল। রিচার্ড আপন মনেই বিড়বিড়িয়ে উঠল–খানা তল্লাশি ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ রইল না।
রিচার্ড ঘর ভর্তি নারী, পুরুষের দিকে তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি যেন বোঝার চেষ্টা করল। ক্যারোলিন ও বারবারার সন্দেহ ভরা দৃষ্টি তাকে ভাবিয়ে তুলল।
এডওয়ার্ড রেনরের চোখে জমেছে যত রাজ্যের ঘৃণা, যা রিচার্ডের কাছে অপমানজনক মনে হল। কেবল ডঃ কারোলিকে ব্যতিক্রমী দেখা গেল। তিন ভদ্র ও অমায়িক। এবার নিজের স্ত্রীর দৃষ্টি দেখে তার মনের কথা পড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হল, কারণ লুসিয়া ঘনঘন তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটাচ্ছিল।
–মশিয়ে অ্যামরি, পোয়ারো তীক্ষ্ণ চোখে রিচার্ডের দিকে তাকালেন, বললেন আমাকে আপনি মোটেও সহ্য করতে পারছে না, বুঝতে পারছি। কিন্তু ঢিল হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। অতএব, যতক্ষণ না ডাক্তার এসে আপনার বাবাকে পরীক্ষা করছেন, ততক্ষণ আপনাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। লাইব্রেরির লাগোয়া দরজাটা আঙুল তুলে দেখিয়ে পোয়ারো জানতে চাইলেন–মশিয়ে অ্যামরি, ওই দরজাটা কোন কাজে লাগে?
–পাশেই বাবার স্টাডি। ওই দরজাই একমাত্র পথ।
রিচার্ডের কথা শুনে ধীর পায়ে এরকুল পোয়ারো সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে স্টাডির ভেতরে দৃষ্টি দিলেন। বনবন করে ঘুরে বেড়াল তার অনুসন্ধানী চোখ। কয়েক মিনিট কেটে গেল। সন্তোষজনক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন। ঘুরে দাঁড়ালেন রিচার্ডের দিকে।
চোখ ঘুরে গেল ঘরের অন্যান্য সদস্যদের দিকে। আটকে গেল তা ডঃ কারোলির ওপর। সামান্য হেসে বললেন–আপনাদের আর কলে পড়া ইঁদুরের মতো এখানে আটকে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবে হ্যাঁ, বাড়ির বাইরে কারো যাবার হুকুম নেই।
একথা শুনে সকলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বারবারা বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াল। এডওয়ার্ড রেনর এগিয়ে এসে তার হাত ধরল, তারা পাশাপাশি হেঁটে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–কথাটা খেয়াল রাখবেন, মশিয়ে অ্যামরি, পোয়ারো রিচার্ডকে লক্ষ্য করে বললেন, এ বাড়ি ছেড়ে আপনারা কোথাও যেতে পারবেন না, আবারও বলছি।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে, হবে না, বোঝা গেল রিচার্ড প্রচণ্ড রেগে গেছে–আপনার হুকুম সকলের কানে গেছে।