তিনি এখানে আসার আগে তেমনটি তো ছিল না? পাল্টা প্রশ্ন করে তাকালো মিস জনসন।
আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না। পোয়ারো তাকে মনে করিয়ে দেয়, মিসেস লিডনারের স্বভাব-চরিত্র কিম্বা তার মেজাজ সম্বন্ধে আপনার কি মতামত তা তো জানালেন না?
মিস জনসন পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার নিরীক্ষণ করে নিল পোয়ারোকে, সেই ফাঁকে হয়তো ভেবে নিল তার বক্তব্য। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল সে, হ্যাঁ, দারুণ মেজাজী ছিলেন তিনি। এই রোদ, এই বৃষ্টি যেন। আজ যার সঙ্গে খুব মেজাজে কথা বলছেন, কালই দেখাচ্ছেন তাকে রুক্ষ মেজাজ। তবু বলব, মানুষ হিসাবে ভাল ছিলেন তিনি, আমার অন্তত তাই মনে হয়। তবে অন্যদের কাছে তিনি ছিলেন বহু বিতর্কিত মহিলা। এক এক সময় আমার মনে হয়েছে, তিনি তার সারাজীবনটা নষ্ট করে ফেলেছেন। তবে একটা ব্যাপারে আমি তাকে কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। তার স্বামী ডঃ লিডনার অমন বিখ্যাত একজন মানুষ, অথচ তার প্রশংসা করা দূরে থাক, কচ্চিৎ ভুলেও কখনো তার নাম উল্লেখ করতে শুনিনি ভদ্রমহিলার মুখে। এই ব্যাপারটা আমাকে মাঝে মাঝে আজও ভীষণ পীড়া দেয়। অবশ্য তাকে আমি লক্ষ্য করেছি, সব সময় তিনি কেমন চিন্তিত, বুঝি বা ভীতগ্রস্থ। স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন তিনি ইদানীং। তার দেখাশোনার জন্য নার্স লিথেরানকে আনার জন্য ধন্যবাদ ডঃ লিডনারকে।
ভালো কথা, পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তার পাওয়া সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?
বারান্দা থেকে মিস জনসনের মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে তার মুখের প্রোফাইল কেমন বদলে যেতে দেখলাম। পোয়ারোর পিঙ্গল চোখের দৃষ্টি পলকের জন্য মিস জনসনের মুখের উপরে নিবদ্ধ হল। সে মুখে এখন একটা ধূসর পান্ডুর ছায়া। দু’চোখের গভীরে পুঞ্জীভূত ভয় ও হতাশা।
আমার মনে হয় আমেরিকায় তার উপরে কোন লোকের আক্রোশ আছে, এবং সেই লোকই সেখান থেকে তাকে চিঠিতে ভয় দেখাচ্ছে, কিম্বা তাকে বিরক্ত করছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা। শুনেছেন তো ভদ্রমহিলা খুব সুন্দরী ছিলেন। সুন্দরী মেয়েদের অনেক শত্রু থাকাটা স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, সেই চিঠিগুলো কোন মহিলা লিখে থাকবে। মিসেস লিডনার ছিলেন একটু ভীতু সম্প্রদায়ের–তাই সেই চিঠিগুলো পেয়ে তিনি দারুণ ভয় পেয়ে যান, নার্ভাস হয়ে পড়েন।
সব মানলাম, থেমে থেমে পোয়ারো তাঁর কথাটার শেষ প্রশ্ন করলেন–কিন্তু মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল শেষ চিঠিটা ডাকে আসেনি, প্রেরক নিজের হাতে কিম্বা তার দূত মারফত তার ঘরে ফেলে গিয়ে থাকবে সেটা।
মেয়েরা তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য সবরকম বিপদের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না।
হ্যাঁ, তারা সব পারে, কথাটা আমিও ভেবেছি বৈকি।
হয়তো আপনার কথাই ঠিক মাদমোয়াজেল। আপনার কথা মতো সুন্দরী মিসেস লিডনারের শত্রু থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বললেন, ভাল কথা, মিস রেলিকে আপনি চেনেন? ডঃ রেলির কন্যা?
শীলা রেলির কথা বলছেন! হ্যাঁ, চিনি বৈকি!
পোয়ারো চালাকি করে একটা বেশ রসালো গল্পের অবতারণা করল।
আমি একটা গুজব শুনেছি (স্বাভাবিক কারণেই ডঃ রেলিকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি), ডঃ লিডনারের একজন কর্মচারীর সঙ্গে মিস রেলির নাকি অন্তরঙ্গতা আছে। কথাটা কী সত্যি? আপনার কী মনে হয় মিস জনসন?
ওহো, এই কথা? মিস জনসন হাসতে হাসতে বলেন–তা কোলম্যান এবং ডেভিড এমোট দু’জনেই শীলার নাচের সঙ্গী। আমার মনে হয়, তাদের দু’জনের মধ্যে কে শীলার জীবনসঙ্গী হবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে মন কষাকষি হতে পারে, তবে এ ব্যাপারে শীলার কোন ভূমিকা নেই, কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আর একটা কথা বলে রাখি, বিমান বাহিনীর কর্মচারীদের নাচের আসরে অনেক যুবক কর্মচারীর নাচের সঙ্গিনী হয়ে থাকে শীলা।
অতএব আপনি বলতে চাইছেন, সেরকম কিছু ঘটেনি শীলার জীবনে। গুজবটা সত্যি সত্যি গুজবই বটে!
না, আমি ঠিক সে কথা বলতে চাইছি না। মিস জনসনকে এবার একটু যেন চিন্তিত বলে মনে হল। এ কথা ঠিক যে, মেয়েটি প্রায়ই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনার একদিন কথার ছলে ডেভিড এমাটকে ঠাট্টা করে বলছিলেন, তোমার পিছনে পিছনে মেয়েরা কেন ছুটে বেড়ায় বল তো! আমার মনে হয় না, কথাটা ডেভিডের পছন্দ হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে এ ধরনের পরনিন্দা-পরচর্চা কারই বা ভাল লাগে বলুন? হ্যাঁ, শীলাও তাতে কান দেয়নি। দুর্ঘটনার দিন অপরাহ্নে আমি তাকে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে দেখেছি। মিস জনসন খোলা জানালা পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলতে থাকে তবে ডেভিড, এমাট কিম্বা কোলম্যান, কেউই সেদিন তাদের কাজে যায়নি। রিচার্ড ক্যারি ছিল ইনচার্জ। হ্যাঁ, সম্ভবতঃ এদেরই মধ্যে একজন তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকবে। তবে তাদের মধ্যে কে, কে তাকে পছন্দ করত, সেটা আমি বলতে পারব না। বিল ছেলেটি চমৎকার, যে যতই বোকা হওয়ার ভান করুক না কেন, আসলে তার মত চালাক ছেলে খুব কম আছে। শান্ত প্রকৃতির ডেভিড এমাটের মধ্যে গভীরতা আছে।
তারপর সে কৌতূহলী চোখ নিয়ে পোয়ারোর দিকে তাকাল, কিন্তু এটা কী কোন অপরাধের তালিকায় পড়ে মঁসিয়ে পোয়ারো?