- বইয়ের নামঃ মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ ভূমিপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া
০১. শহর বাগদাদ
মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া (এরকুল পোয়ারো)
০১.
শহর বাগদাদ। প্রিন্সটন হোটেলের হলে হাসপাতালের একজন নার্স তখন একটা চিঠি, লেখায় দারুণ ব্যস্ত, কাগজের উপর তার ঝর্ণা কলম দ্রুত চলছিল।
……প্রিয়, সত্যি এ সবই যেন আমার খবর। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গা দেখে রাখা ভালো, যদিও আমার কাছে ইংলন্ড সব সময়েই দর্শনীয়। বাগদাদের অবস্থা যে এত নোংরা ও অগোছালো চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না। আরব্য রজনীর সেই মিষ্টি পরিবেশ, রোম্যান্টিক ভাবের সঙ্গে শহর বাগদাদের মিল খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হয় যেন। অবশ্য প্রকৃতি এখানে কৃপণ নয়, কল কল শব্দে নদী তার ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে বাগদাদ শহরটাকে নিজের কোলে টেনে রেখে। কিন্তু শহরটা যেন গিলতে চাইছে, কি ভয়ঙ্কর বীভৎস তার চেহারা! ভালো দোকানের বড় অভাব। মেজর কেলসি সঙ্গে করে আমাকে বাজারে নিয়ে যান।
ডঃ রেলির সেই কাজটার প্রসঙ্গে পরে আমি তোমাকে সবিস্তারে লিখে জানাব। তিনি জানিয়েছেন, সেই আমেরিকান ভদ্রলোক এখন এই বাগদাদ শহরেই আছেন এবং সম্ভবত আজ অপরাহ্নে তিনি আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে পারেন। প্রসঙ্গ তাঁর স্ত্রী, ভদ্রমহিলা দারুণ সৌখিন, কল্পনাবিলাসীনী। তার সম্বন্ধে ঠিক এরকমই একটা আভাস দিয়েছিলেন ডঃ রেলি। এর বেশি আর কিছু তিনি বলেন নি। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিশক্তি অবশ্যই আছে, আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই। এই ডঃ লিডনার, ইনি একজন প্রত্মতত্ত্ববিদ এবং বিশাল এই মরুভূমির কোন এক প্রান্তরে আমেরিকান মিউজিয়াম তৈরি করার জন্য মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত এখন তিনি।
এবার চিঠির ইতি টানতে যাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম, স্টাকিন্স সম্বন্ধে তুমি যা বলেছিলে সেটা নিছক ধ্বংসের ব্যাপার। আচ্ছা মেট্রন কী বলছিল?
বলার আর কিছু নেই।
তোমার চিরদিনের অ্যামি লিথেরান।
খামের উপর ঠিকানা লিখল সে, সিস্টার কারশ, স্টোফার হসপিটাল, লণ্ডন।
লেখা সে সবে মাত্র শেষ করেছে, এমন সময় স্থানীয় এক যুবক তার সামনে এসে দাঁড়াল।
ডঃ লিডনার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
নার্স লিথেরান ফিরে তাকাতেই দেখল তার সামনে মাঝারি উচ্চতার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, কাঁধটা ঈষৎ ঝুঁকে আছে, বাদামী রং-এর দাড়ি, ক্লান্ত চোখ।
ওদিকে ডঃ লিডনারের সেই ক্লান্ত চোখের সামনে তখন ভাসছিল বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবতী, ঋজু দেহ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তার ধারণা বদলাতে হল, তিনি ভেবেছিলেন লিথেরানকে তিনি দেখবেন মৃত্যুপথযাত্রী কোন রুগীকে দেখে ঘাবড়ে যাওয়া হসপিটাল নার্সের মতো; কিন্তু তার মুখের অবয়ব যেন অন্য কথা বলছিল, স্পষ্ট নীল দুটি চোখে কৌতুকের ছোঁয়া, মসৃণ চকচকে বাদামি চুলে তার মুখ ঢেকে গেলেও উৎফুল্ল ভাবটা ঢাকা পড়েনি। নার্স লিথেরান, তিনি ভাবলেন, তার কাজে লাগতে পারে।
.
০২.
অ্যানি লিথেরানের পরিচয়
আমি লেখিকা নই, লেখার সম্বন্ধে আমার কোন ধ্যান-ধারণাও নেই। কিন্তু ডঃ রেলির অনুরোধ কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারে না বলেই আমি এ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি।
কিন্তু ডাক্তার, বললাম, আমি আদৌ কোন সাহিত্যিক নই।
অবান্তর কথা? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, মনেই করো না এটা একটা কেস নোট লিখছো তুমি।
তা বটে, ঘটনাটাকে এভাবে নেওয়া যেতে পারে।
ডঃ রেলি আরো বললেন, তেল ইয়ারিমাহর ব্যবসা সংক্রান্ত একটি সহজ সরল ঔজ্জ্বল্যহীন বিবরণ পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
স্বার্থসম্পন্ন কেউ যদি সেটা লেখে তাতে কোন প্রত্যয় থাকে না।
বেশ তো, তাহলে আপনি নিজে কেন লিখছেন না ডক্টর? –প্রশ্নটা হঠাৎ আমার মুখে এসে গেল।
ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না, কিন্তু তুমি ছিলে, তাছাড়া, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বললেন, আমার মেয়ে আমাকে অনুমতি দেবে না।
এভাবে মেয়ের কাছে তাঁর পরাজয় স্বীকার করাটা কত যে ঘৃণ্য, কথাটা আমি তাকে বলতে গিয়েও চেপে গেলাম, তাঁর চোখে একটা অসহায় ভাব দেখে। বিচিত্র তার সেই চাহনি, বোঝা মুশকিল, তিনি কৌতুক করছেন কি করছেন না।
ঠিক আছে, দ্বিধাগ্রস্থভাবে আমি তাকে শুধোলাম, মনে হয় আমি পারব।
অবশ্যই তোমাকে করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে সেটা শুরু করব বুঝতে পারছি না।
এর অতীতের কিছু ভাল নজির আছে। শুরু থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে হবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে এর কোথায় এবং কীভাবে শুরু সেটাই তো আমার ভাল করে জানা নেই।
বিশ্বাস কর, নার্স, শুরু করার অসুবিধেটা যত না বেশি তার চেয়েও বেশি অসুবিধে হল কীভাবে তুমি শেষ করবে।
আপনি কী আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন ডক্টর?
না, না মোটেই তা নয়। আমার কথায় পরিহাসের কোন স্থান নেই। এ কাহিনী রক্তে মাংসে গড়া মানুষের, মানুষে গড়া তাদের নকল প্রতিমূর্তির নয়। তোমার নিজের মতো করে তাদের বিষয়ে লেখবার চেষ্টা করো। তুমি বুদ্ধিমতী, এ ব্যাপারে তোমার সাধারণ জ্ঞান যথেষ্ট আছে বলেই আমার বিশ্বাস।
অতএব এই হল আমার কাজের ভূমিকা। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আমার সাধ্য মতো আমি চেষ্টা করে দেখব।
কিন্তু শুরুতেই আমি হোঁচট খেলাম। ডাক্তারকে আমি ঠিকই বলেছিলাম, কীভাবে শুরু করব এটা জানার খুবই অসুবিধা আছে এ ব্যাপারে।
আমার ধারণা আমার নিজের সম্বন্ধে দু-চার কথা অবশ্যই বলা দরকার। আমার বয়স বত্রিশ, নাম অ্যানি লিথেরান। সেন্ট কৃস্টোফারে ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর দু’বছর প্রসুতি-বিদ্যার শিক্ষা নেওয়ার পর ডিভোন-শায়ার প্লেসে মিসেস বেন্ডিক্সের নার্সিংহোমে বছর চারেক কাজ করি। ইরাকে আমি মিসেস কেলসির সঙ্গে এসেছি, তিনি বাগদাদে আসছিলেন তার স্বামীর সঙ্গে। মিসেস কেলসির স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না তখন। বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল একা বহন করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই মেজর কেলসি তাদের সঙ্গে আমায় বাগদাদে আসার ব্যবস্থা করেন। আমার কাজ বরাদ্দ হল তাঁদের ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার ভার নেওয়া। আমার খরচের ভার নিলেন তারা। অন্য আর একজন নার্স পেলেই তারা আমাকে রেহাই দেবেন এরকম কথা হয়েছিল তাদের সঙ্গে।
ভালো কথা, কেলসিদের সম্বন্ধে বেশি বিবরণ দেবার আর দরকার নেই বলে আমি মনে করি। ভারি সুন্দর তাদের ছোট্ট বাচ্চাটি। মিসেস কেলসি একটু খিটখিটে স্বভাবের হলেও ভারি চমৎকার মানুষ ছিলেন। ওরকম দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা আমার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি।
লম্বাটে মুখ ডাঃ রেলির, কালো চুল। কখনো কখনো নিষ্ঠুর এবং বিমর্ষ গলায় খুব মজার মজার কথা বলতেন তিনি। হাসানিয়ে বলে একটি জায়গায় সিভিল সার্জেন ছিলেন তিনি, বাগদাদ থেকে দেড় দিনের যাত্রাপথ।
বাগদাদে সপ্তাহ খানেক থাকার সময় ডঃ রেলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি জানতে চান, আমি কবে নাগাদ কেলসিদের ছেড়ে আসছি। আমি তাঁকে বলি, তার এরকম অদ্ভুত কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে থাকতে পারছি না, কারণ সত্যি কথা বলতে কি রাইটস্ পরিবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেশে ফিরে যাচ্ছেন এবং তাঁদের নার্স ছাড়া পাওয়া মাত্র সোজা চলে আসছে।
প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, রাইটসদের কথা তিনি শুনেছেন এবং সেই জন্যেই নাকি তিনি আমাকে প্রশ্নটা করেছিলেন।
আসল কথা কি জানো, ডঃ রেলি একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যে একটা সম্ভাব্য কাজের সন্ধান আমি পেয়েছি।
কেন?
তার মুখটা একটু কুঁচকে উঠল, তাঁকে একটু চিন্তিত বলে মনে হল।
হ্যাঁ, এটাকে তুমি একটা কেস বলেও ধরে নিতে পারো। প্রসঙ্গ একটি ভদ্রমহিলার, বলা যেতে পারে তার একটা নেশা আছে।
ওঃ! অস্ফুটে একটা ছোট্ট শব্দ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। (এর অর্থ যে কেউ ধরে নিতে পারে–মদ কিংবা মাদকদ্রব্য জাতীয় কিছু!)।
ডঃ রেলি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, বেশি কিছু বলতে চাইলেন না।
হ্যাঁ’, প্রসঙ্গান্তরে ফিরে এলেন তিনি, মিসেস লিডনার। তাঁর স্বামী একজন আমেরিকান, আমেরিকান–সুইডিশ বললেই বোধহয় ঠিক হবে। বিরাট জ্ঞানী মানুষ আমেরিকান খননকার্যের প্রধান তিনি। ডঃ রেলি ব্যাখ্যা করে বললেন, আমিরিয়ানের মতো বিরাট প্রাচীন শহরের নিচে খননকার্যের অভিযান কি করে চালানো হচ্ছে। জায়গাটা হাসানিয়ের থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না, তবে খুব নির্জন। এখন ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
সারাদিন কি তাকে স্থানীয় লোকেদের মধ্যে ছেড়ে রাখা হয়? জিজ্ঞেস করলাম।
না, না, তার কাছে যথেষ্ট ভিড় থাকে, সাতটা আটটা পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় না, তিনি বাড়িতে কখনও একা থাকেন। তবে সন্দেহ নেই, এক অস্বস্তিকর জায়গার মধ্যে তাঁকে কাজ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও স্বীকার করতে হয়, শত কাজের মধ্যেও লিডনার তার স্ত্রীর ভাল-মন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। প্রখর দৃষ্টি থাকে তার স্ত্রীর উপর। এ অবস্থায় কোন অভিজ্ঞ নার্স যদি তার স্ত্রীর উপর নজর রাখার দায়িত্ব নেয়, তিনি তাহলে খুব খুশি হবেন।
তো এ ব্যাপারে মিসেস লিডনার নিজে কী ভাবেন বলুন তো?
ডঃ রেলি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন?
মিসেস লিডনার? চমৎকার মহিলা। দু দিন আগেও এ ব্যাপারে একমত ছিলেন না তিনি। তবে সামগ্রিক বিচারে এই পরিকল্পনাটা তার মনঃপুত বলা যেতে পারে। তিনি আরও বললেন, বড় অদ্ভুত এই মহিলা, মিথ্যা কথায় তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু লিডনারের ধারণা, অন্য কোন কারণে তার স্ত্রী প্রাণের আশঙ্কা করছেন।
বেশ তো সব মানলাম, তা মিসেস লিডনার নিজে আপনাকে কিছু বলেন নি?
ওহো, তিনি আমার সঙ্গে কোন পরামর্শই করেননি। অনেক কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করেন না। আসলে লিডনারই আমার কাছে আসেন এবং এই পরিকল্পনার কথা বলেন। তা তোমার এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে কি অভিমত বল? বাড়ি ফেরার আগে এ দেশটার ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য তুমি সংগ্রহ করতে পারবে। আরো দুমাস খনন কার্যে লিপ্ত থাকছেন তারা, আর এ কাজটা খুবই আকর্ষণীয়।
ডঃ রেলির প্রস্তাবটা আমার মনে ঝড় তুলেছিল তখন। দ্বিধা, জড়তা মুহূর্তে কাটিয়ে উঠে বললাম, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অপূর্ব, ডঃ রেলি উঠতে গিয়ে বললেন, লিডনার এখন বাগদাদে। আমি তাকে বলব, তোমার সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা পাকা করে নেবার জন্য।
সেদিনই অপরাহ্নে ডঃ লিডনার এলেন হোটেলে। ভদ্রলোক মাঝ-বয়সী, দ্বিধাগ্রস্থ মনোভাব, বুঝি বা একটু ভীত সম্প্রদায়েরও। দেখলে মনে হয়, স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত অনুগত তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, স্ত্রীর ঠিক অসুবিধাটা যে কি সেটা তাঁর কাছে এখনও অজ্ঞাত।
দেখ, অভ্যাস মতো তিনি তার দাড়িতে টান দিয়ে বললেন, আমার স্ত্রী অত্যন্ত দুর্বল, স্নায়ুর চাপে ভুগছেন। তার সম্বন্ধে আমি খুবই উদ্বিগ্ন।
আচ্ছা ওঁর স্বাস্থ্য ভাল তো?
ও হ্যাঁ, স্বাস্থ্য ওর খুব ভাল। সেদিক থেকে কোন চিন্তা আমার নেই। তবে
তবে কী?
বলতে গিয়ে কি যেন চেপে গেলেন তিনি। দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে বললেন, কোন কাজই তাকে করতে হয় না এক রকম। ওর এই ভয়ের কোন কারণ তো আমি খুঁজে পাই না।
ভয়! কিসের ভয় ডঃ লিডনার?
ও কিছু নয়। ডঃ লিডনারের কথায় একটা অস্পষ্টতার ছাপ, স্নায়বিক দুর্বলতায় আজকাল সব কিছুতেই আতঙ্কের ছায়া দেখতে পায় বুঝলেন।
দশটা থেকে একটা, ভাবলাম, এ আর এমন কিছু নয়, অতিরিক্ত মাদক দ্রব্য সেবনের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ডঃ লিডনার সে কথা বিশ্বাস করতে চান না, বিশ্বাস করতে চান না তাদের স্ত্রী এমন অস্বাভাবিক অভ্যাসের বশবর্তী হতে পারেন।
জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার ব্যাপারটা আপনার স্ত্রী নিজের থেকে অনুমোদন করেছেন তো? ডঃ লিডনারের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমি তো রীতিমতো অবাক। শুনে ও কি বলল জানো? ও এখন অনেকটা নিরাপদ বলে মনে করছে।
নিরাপদ! কথাটা হঠাৎ আমার কানে বাজল। সেই থেকে আমি ভাবতে শুরু করলাম, মিসেস লিডনারকে হয়তো মানসিক রুগিনীর পর্যায় ফেলা যেতে পারে।
তারপর তিনি ছেলেমানুষের মতো আগ্রহের আতিশয্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন।
আমি নিশ্চিত ওর সঙ্গ তোমার ভাল লাগবেই। আমার নিজের স্ত্রী বলে বলছি না, মানুষকে আকর্ষণ করার মতো সত্যি ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। হাসলেন তিনি ওকি মনে করে জান? তোমাকে কাছে পেলে ওর মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। আমিও তাই মনে করি। কেন জানি না, তোমাকে দেখা মাত্র আমার স্ত্রীর কথাটাই সর্বপ্রথম মনে হয়েছিল। আমি হলফ করে বলতে পারি, একমাত্র তুমিই হলে লুসির উপযুক্ত সঙ্গিনী।
ঠিক আছে মিঃ লিডনার, আমি আবার বলছি, সাধ্যমত চেষ্টা করব। খুশি হয়ে বললাম, মনে হয় আমি বোধহয় আপনার স্ত্রীর সাহায্যে আসতে পারি। আমার ধারণা, ওঁর এই স্নায়বিক দুর্বলতার মূলে এখানকার স্থানীয় কালো চমড়ার লোকগুলো।
ওহো না, তা নয়। মাথা নাড়লেন তিনি সকৌতুকে। আমার স্ত্রী আরবদের খুবই ভালবাসে, তাদের সরলতা ওর খুব পছন্দ। এখানে আমরা মাত্র এক বছর এসেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েকেরও কম হবে, কিন্তু এর মধ্যেই ও কেমন সুন্দর আরবী ভাষায় কথা বলতে শিখে গেছে।
একটু চুপ করে থেকে আমি আর একবার চেষ্টা করে দেখলাম। আচ্ছা ডঃ লিডনার, সত্যি করে বলুন তো আপনার স্ত্রীর ভয়ের প্রকৃত কারণটা কী?
প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করে তারপর ধীরে ধীরে তিনি বললেন, আমার বিশ্বাস সে কথা ও নিজের থেকেই তোমাকে বলবে।
ব্যস, এর বেশি কিছু জানা গেল না তার কাছ থেকে।
.
০৩.
খোশগল্প
ঠিক হল আগামী সপ্তাহে আমি তেল ইয়ারিমাহর যাব।
মিসেস কেলসি তার আলইউয়ার বাড়িতে বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করছিলেন, এবং আমি তার কাজের বোঝা কিছু হাল্কা করবার ব্যবস্থা করছিলাম, সেই সময় লিডনারের অভিযান সংক্রান্ত ব্যাপারে দু একটা মন্তব্য আমার কানে ভেসে এল। মিসেস কেলসির বন্ধু অল্পবয়সী স্কোয়ার্ডন লিডার হঠাৎ বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে, চমৎকার লুসি। ইনিই তাহলে ওঁর শেষতম সঙ্গিনী? বলে আমার দিকে ফিরল সে। আশ্চর্য হবেন নার্স, আমাদের দেওয়া ওঁর ডাকনাম এটা। চমৎকার লুসি নামেই পরিচিতা উনি আমাদের কাছে।
তিনি কী সত্যিই খুব সুন্দরী? আমি জানতে চাইলাম।
উনি তো নিজেকে তাই মনে করে থাকেন।
এটা তোমার ব্যক্তিগত আক্রোশের কথা হয়ে গেল জন, মিসেস কেলসি টিপ্পনী কাটলেন, তুমি বেশ ভাল করেই জানেন যে, ও কথা উনি কেবল একাই মনে করেন না, অনেকেই ওঁর রূপের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছেন।
তোমার কথাই হয়তো ঠিক। তবে যাই বল এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ওঁর একটা বাড়তি আকর্ষণ করবার ক্ষমতা আছে।
মিসেস কেলসি হেসে ওঠেন শব্দ করে। তুমি যে দেখছি সম্পূর্ণ ভাবে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছ।
স্কোয়ার্ডন লীডারের মুখ লজ্জায় আরক্তিম। যাইহোক, ওঁর একটা নিজস্ব জগৎ আছে। ডঃ লিডনারের ক্ষেত্রে বলা যায়, ওঁর মতো পত্নীবৎসল স্বামী খুব কম চোখে পড়ে। ওঁর স্ত্রী যে পথ দিয়ে যান, সেই পথ উনি পুজো করে থাকেন। তাদের সম্পর্কে এখন এই মুহূর্তে হয়তো আলাপ করা যেতে পারে।
এক সঙ্গে কজন তারা থাকেন বলতে পারেন?
অনেক দেশের অনেক মানুষ, আনন্দের সঙ্গে স্কোয়ার্ডন লীডার জানালেন, একজন ইংরেজ স্থপতি, একজন ফরাসী ফাদার। আরও আছেন, বুঝলেন? মিস জনসন, ইংরেজ মহিলা। মোটাসোটা ফটোগ্রাফার, উনি একজন আমেরিকান নাগরিক এবং মারকাডোরা–ঈশ্বর জানেন কোন জাতি তারা? আর একটি অল্প বয়সের মেয়ে, সাপের মত চেহারা। সুন্দরী লুসিকে কী ঈর্ষার চোখে দেখে না সে? তাদের মধ্যে কয়েকজন খাপছাড়া হলেও মোটের উপর সবাই বেশ চমৎকার, পেনিম্যান এ ব্যাপারে আপনি আমার সঙ্গে একমত নন?
পেনিম্যান একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি তখন নিজের নাকে স্প্রিংয়ের চশমা আটকাবার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ অনুরোধের বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠে ফিরে তাকালেন স্কোয়ার্ডন লীডারের দিকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অত্যন্ত চমৎকার বৈকি! তবে আলাদাভাবে বলতে গেলে, তার মানে, মারকাডোকে আমার এক বিচিত্র মানুষ বলেই মনে হয়।
তার ওই অদ্ভুত দাড়ি দেখলেই মনে হয়। মিসেস কেলসি মন্তব্য করলেন, লোকটা কেমন যেন সন্দেহজনক।
কথার মধ্যে বাধা পাওয়া সত্ত্বেও মেজর পেনিম্যান কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই বলতে থাকলেন আমেরিকানরা একটু চুপচাপ থাকতে ভালবাসে, আর ওদিকে ইংরাজ ছেলেরা যেন একটু বেশি মাত্রায় কথা বলে থাকে। লিডনার নিজেই অত্যন্ত আমোদপ্রিয়, ভদ্র এবং বিচক্ষণ। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত ভাবে তারা সবাই অত্যন্ত আমোদপ্রিয় মানুষ। যে কারণেই হোক আমি একটু কল্পনাবিলাসী, বাস্তবের ধার আমি ধারি না। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের দেখবার জন্য আমি যাই এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমি বুঝতে পারি মানে আমার এই ধারণা হয় যে, একটা কোন গণ্ডগোল এর মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। তবে গণ্ডগোলটা যে ঠিক কোথায় তা আমি জানি না। সত্যি কথা বলতে কি কাউকেই স্বাভাবিক বলে আমার মনে হয় না। চারিদিকে একটা সন্দেহের আবহাওয়া। এর একটা ব্যাখ্যাও আমি অবশ্য করেছি, বাইরে থেকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে সবাই সবাইকার পিঠ চাপড়াতে চায়, এই আর কি। ভেতরে ভেতরে তারা যে কতখানি এ ওর উপর হিংসাপরায়ণ উপর থেকে সেটা বোঝা মুশকিল।
এ ঘটনা আমার কাছে যেন সম্পূর্ণ নতুন, এই মনোভাব ব্যক্ত করতে মুখে কৃত্রিম আরক্তভাব ফোঁটাতে হল, কারণ আমি আমার মতামত খুব বেশি প্রকাশ করতে চাই না এই মুহূর্তে। তাই নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে বললাম, লোকেদের যদি এক জায়গায় অনেকদিন ধরে আটকে রাখা হয়, দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের স্নায়ুর উপর দারুণ চাপ পড়ছে। এ কথা আমি হসপিটালে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
সে কথা ঠিক, মেজর কেলসি বললেন, তবে এখন কথা হচ্ছে, এ ঘটনা তো হালফিলের। আর কতদিনই বা তাদের আটক করে রাখা হয়েছে? এই অল্প সময়ে অমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠার কোন কারণ যে থাকতে পারে আমার তা জানা নেই।
এখানে এই অভিযানটা আমরা আমাদের নিজেদের জীবনের মত মনে করে থাকি। মেজর পেনিম্যান এবার মুখ খুললেন অনেকক্ষণ পরে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, ঘোঁট পাকাবার দল এর মধ্যে থেকেই গড়ে উঠছে বলে আমার অনুমান।
যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। মেজর কেলসি সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন, এ বছর বহু ভাল ভাল নবাগতরাও এসেছে।
দেখা যাক কে কে এসেছে। স্কোয়ার্ডন লীডার তার আঙুলে গুনতে গিয়ে বলে, রেইটারের মতো কোলম্যান নবাগত। মারকাডোদের মতো ইমাট গতবছর এখানে আসে। তবে ফাদার ল্যাভিগনিও নবাগত, ডঃ বার্ডের পরিবর্তে তিনি এখানে আসেন। অবশ্য ক্যারি এখানকার সব থেকে পুরনো লোক, শুরু থেকে আছে সে এখানে, তা প্রায় পাঁচ বছর হবে। ক্যারির মতোই মিস জনসন এখানে পাঁচ বছরের পুরনো।
সব সময় আমার মনে হয় তেল ইয়ারিমাহে, মেজর কেলসি মন্তব্য করলেন, এরা যেন একটি সুখ দুঃখে সমান অংশীদার। এ রকম একটা সুস্থ পরিবেশ, এক সঙ্গে এতগুলো লোকেদের মধ্যে নির্বিবাদে থাকা যেটা কল্পনা করা যায় না। নার্স লিথেরান যে আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবে, সেটা আমি নিশ্চিত জেনে গেছি।
আপনি ঠিক বলছেন কিনা, সেটা আমি কী করে জানব বলুন?
হ্যাঁ, প্রত্যেকে আরো গভীরে যেতে চাইবে বৈকি’, মেজর পেনিম্যান বোধহয় আমার মনের খবরটা হদিশ করতে পেরেছিলেন। আমারও তাই মনে হয়, এ ব্যাপারে বোধহয় আরও কিছু জানবার থাকতে পারে। অত্যন্ত ভদ্র ডঃ লিডনার। তাছাড়া তার সব থেকে বড় গুণ হল, পরের মেজাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তাঁর। সব সময় সকলের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে তিনি তার অভিযান সুখময় রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। তবু এ সব সত্ত্বেও একদিন একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করেছিলেন।
হাসলেন মিসেস কেলসি।
আর তার কারণ আপনি জানতে পারলেন না?
আপনি কী বলতে চাইছেন?
অবশ্যই মিসেস লিডনার।
ওঃ মেরি, তার স্বামী একটু যেন বিস্মিত, উনি চমৎকার মহিলা, আমার তো মনে হয় না, তিনি ঝগড়াটে স্বভাবের।
না, না আমি বলছি না তিনি ঝগড়াটে। তবে কখনো কখনো ঝগড়ার কারণ হয়ে ওঠেন তিনি।
কীভাবে? আর কেনই বা তিনি তা হতে যাবেন?
কেন? কারণ তাঁর জীবন একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর হবেনই বা কেন? তার কাজ কোথায়! তিনি তো আর প্রত্নতত্ত্ববিদ নন, এখানে প্রত্মতত্ত্ববিদের স্ত্রী মাত্র। তাই নিজের একঘেয়েমি জীবনে বৈচিত্র্য আনতে মাঝে মাঝে ঝগড়াটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, হয়তো তাতে তিনি নতুনত্ত্বের স্বাদ পান, আনন্দ পান।
মেরি, এ সবই তোমার অনুমান মাত্র। আসলে তুমি এর কিছুই জানো না।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এ আমার অনুমান বটে। তবে একদিন দেখবে, আমার অনুমানই ঠিক। সুন্দরী লুসি কোন মতেই মোনালিসা নয়। হয়তো সে কারোর ক্ষতি করবে না, তবু তিনি দেখতে চান, তাঁকে ঘিরে কি ঘটতে পারে।
তিনি কিন্তু স্বামীর প্রতি অনুগত। ওঃ ওঁদের দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস আমার নেই। সে প্রসঙ্গে আমি যেতেও চাই না। আমি কেবল বলতে চাইছি, ওই ভদ্রমহিলাকে আমরা কেউই চিনতে পারিনি।
মেয়েরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত সহৃদয় শুনেছি, কথাটা বলে হাসলেন মেজর কেলসি। আমি জানি, বিড়াল, বিড়ালের মতো ব্যবহার করে থাকে তারা, এই কথাটা আপনি বলতে চাইছেন তো! তবে এ কথাও জেনে রাখুন, আমরা মেয়েরা আমাদের নিজেদের ব্যাপার অত্যন্ত সচেতন।
ওই একই ব্যাপার, মেজর পেনিম্যান কি যেন চিন্তা করে বললেন, মিসেস কেলসির সব বক্তব্য সত্য বলে ধরে নিলেও, আমি মনে করি না, তার সেই কৌতূহলের কোন রেশ থাকতে পারে। বরং আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, একটা বিরাট ঝড় উঠতে যাচ্ছে এবং সে ঝড় যে কোন মুহূর্তে উঠতে পারে।
তাই বলে এই নতুন নার্সটিকে শুরুতেই ভয় পাইয়ে দেবেন না, মিসেস কেলসি সতর্ক করে দেন, দিন তিনেকের মধ্যে ও সেখানে যাচ্ছে। এ সময় এমন কিছু বলবেন না, যাতে ও ঘাবড়ে যায়।
ওহো, আপনারা আমাকে কিছুতেই ভয় পাওয়াতে পারবেন না। কথাটা বলে আমি হাসলাম।
যাইহোক, ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু কানে তখন বাজছিল। বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সেই অদ্ভুত মন্তব্য তার স্ত্রীর সম্বন্ধে। আমার সঙ্গ পেলে ওঁর স্ত্রী নাকি নিরাপদ বলে মনে করবে নিজেকে। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রকৃত ভয়ের কারণটা সবার কাছে তখন অজ্ঞাত? আর সেই জন্যই কী তাদের এত মাথা ব্যথা? নাকি তার ভয়ের কারণটা তারা জেনে গেছেন বলেই তাঁদের এত ভয়, কখন কি হয়, কে জানে?
মিসেস কেলসির শেষ মন্তব্যের অর্থটা এখন আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না।
ঠিক আছে, আমি নিজের মনে ভাবলাম, আমি অপেক্ষা করে দেখব।
.
০৪.
হাসানিয়েয় পৌঁছে
তিনদিন পরে আমি বাগদাদ ছেড়ে এলাম।
মিসেস কেলসি এবং বেবীকে ছেড়ে আসতে গিয়ে আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল। মেজর কেলসি নিজে আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনে এলেন। আগামীকাল সকালে কিরকুকে আমার পৌঁছানোর কথা, যেখানে হয়তো কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
বিশ্রীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ট্রেনে কখনো আমার ভাল ঘুম হয় না। যাইহোক, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার বাইরে নজর পড়তেই চোখ সার্থক হল, দিনটা চমৎকার বলে মনে হল, চলমান দৃশ্যগুলো আরো বেশি চমৎকার যেন। আমার খুব কৌতূহল হল লোকগুলোর সম্বন্ধে, যাদের আমি দেখতে যাচ্ছি।
আমার দৃষ্টি প্রসারিত প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে, বুঝি বা একটু ইতস্ততঃ। চেয়ে থাকতে গিয়ে আমার মনে হল একটি যুবক আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফ্যাকাশে লাল গোল মুখ। সত্যি কথা বলতে কি জীবনে এ রকম আর কাউকে দেখিনি যার সঙ্গে মিঃ পি. জে. উডহাউসের বইয়ের সেই যুবকটির সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই মুখ, সেই চোখ।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো,তার চোখে এক অজানা কৌতূহল, আপনি নার্স লিথেরান না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি নার্স লিথেরান নিশ্চয়ই। হ্যাঁ হ্যাঁ! অধমের নাম কোলম্যান। ডঃ লিডনার আমাকে পাঠিয়েছেন। কেমন বুঝছেন? জঘন্য ট্রেন যাত্রা, এই তত? এই দেখুন, আমি খুব বেশি কথা বলছি, না? চলুন, এবার যাওয়া যাক, বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বাস নয়, স্টেশন-ওয়াগান বলা যেতে পারে, আবার ছোট লরী কিংবা বড় গাড়িও বলা যেতে পারে। মিঃ কোলম্যান আমাকে চালকের পাশের আসনে বসার পরামর্শ দিল, ঝাঁকুনি কম হবে।
ঝাঁকুনি! এখানে এসে পথ চলতে গিয়ে আমার দেহের সব হাড়গুলো যে এখনো আস্ত আছে সেটাই এখন বড় বিস্ময়। এখানকার জীর্ণ ক্ষত-বিক্ষত রাস্তাগুলো দেখে আমাদের ইংলণ্ডের দৃষ্টি নন্দনকারী রাস্তাগুলোর কথা মনে পড়লে দেশে ফেরার জন্য মনটা কেমন উতলা হয়ে ওঠে।
কোলম্যান বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েছিল, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে সে বলে, ট্রাকটার অবস্থা মোটামুটি ভালই! ভয়ের কোন কারণ নেই। তাছাড়া আপনার পক্ষে খুব ভাল, লিভারটাকে ঝাঁকুনি দেয়। বললো সে, আপনার সেটা জানা দরকার নার্স।
যদি আমার মাথা ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে লিভার ভাল রেখে কী লাভ?
বৃষ্টির পর আপনার আসা উচিত ছিল। নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারতেন।
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
চারঘন্টা লাগল হাসানিয়েতে আসতে। জায়গাটা বেশ বড়। নদী পেরিয়ে শহর। চোখ ধাঁধান মনোরম দৃশ্য। দূর থেকে শ্বেত পাথরের সাদা ধবধবে মিনারগুলো পরীদের মতো মনে হয়।
মিঃ কোলম্যান আমাকে ডঃ রেলির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ডঃ রেলি লাঞ্চের অপেক্ষায় বসেছিলেন। চির হাস্যময় শান্ত সুন্দর মেজাজের ডঃ রেলির মতোই তাঁর বাড়িটাও বেশ ঝকঝকে উজ্জ্বল, ঘর বাথরুম সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। স্নান সেরে গায়ে ইউনিফরম চাপাবার পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে খোশ মেজাজের বলে মনে হল।
লাঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ডঃ রেলি তার মেয়ের দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলেন। লাঞ্চের মাঝে তার মেয়ে এসে হাজির হল। ডঃ রেলি পরিচয় করিয়ে দিলেন, নার্স, এ আমার মেয়ে শীলা।
টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে করমর্দন করল সে এবং আশা করল, আমার ট্রেন যাত্রা সুখকর হয়েছে নিশ্চয়ই। তারপর কোলম্যানের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নেড়ে বসল শীলা।
আচ্ছা, বিল, জিজ্ঞাসা করল সে, সব কেমন চলছে?
তারা ক্লাব আর পার্টি নিয়ে আলোচনা করছিল। ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু আমার ঠিক পছন্দের নয়। মনে হয় মেয়েটি একটু হাল্কা ধরনের, যদিও সে দেখতে ভাল, নীল চোখ, কালো চুল, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে ক্লান্তির ছাপ, দেখলে মায়া হয়। কিন্তু ওদের বিদ্রুপে ভরা কথাবার্তা আমাকে দারুণ আঘাত করল। কোলম্যানের কথাবার্তাও এখন কেমন বিসদৃশ্য। শীলার সংস্পর্শে এসে সে তার সেই আগেকার স্বাভাবিক কথাবার্তা ভুলতে বসেছে। কেমন নিরেট নির্বোধের মতো কথা বলার ভঙ্গি তার। সে আমাকে এমন একটা কুকুর সম্বন্ধে সতর্ক করে দিল, যাকে আমি আদৌ চোখে দেখিনি এখনো।
লাঞ্চের পর ডঃ রেলি হাসপাতালে চলে গেলেন। তার দেখাদেখি মিঃ কোলম্যান শহরের পথে চলল কিছু কেনাকেটা করার জন্য। মিস রেলি জানতে চাইল, শহর ঘুরে দেখতে আমি যাব কিনা, নাকি বাড়িতে বিশ্রাম নেব। সে আরো বলল, মিঃ কোলম্যান তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসবেন।
দেখবার কিছু আছে এখানে?
কতকগুলো ছবির প্রদর্শনী আছে, মিস রেলি সঙ্গে সঙ্গে বলল, তবে আমার মনে হয় না সেগুলো তোমার পছন্দ হবে। কারণ অত্যন্ত নোংরা সেগুলো।
ওর কথাটা কাটার মতো বিধল আমার কানে। ওর এ কথা বলার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না। এ ব্যাপারে ও আমার পছন্দ অপছন্দের কথা জানল কী করে। অন্তত আমি তো ওকে বলিনি।
একেবারে শেষে ও আমাকে ক্লাবে নিয়ে গেল। সামনেই নদী, জলের ক ক শব্দ ভেসে আসছিল হাওয়ায়। ইংরাজি পত্র পত্রিকা চোখে পড়ল সেখানে।
বাড়ি ফিরে এসে মিঃ কোলম্যানকে দেখতে পেলাম না। তাই কি করি! ফিরে দুজনে আবার গল্প করতে বসলাম। তবে কথাবার্তা খুব একটা সহজভাবে এগুলো না। শীলা জানতে চাইল, এখনো পর্যন্ত মিসেস লিডনারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কি না।
‘না’, প্রত্যুত্তরে বললাম, তার স্বামীর সঙ্গে কেবল দেখা হয়েছে।
ও, তাই বুঝি, শীলা বলে, জানি না মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে কী তুমি ভাবছ?
ওর এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমি দিলাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবার নিজের থেকেই বলতে লাগল, ডঃ লিডনারকে আমি খুব পছন্দ করি। সবাই তাকে পছন্দ করে থাকে।
তার মানে তার স্ত্রীকে তুমি পছন্দ করো না। উত্তরে এই কথাটা আমার বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু এর পরেও আমি আগের মতোই নীরব রইলাম। এবার ও আকস্মিক ভাবে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস লিডনারের কী ব্যাপার বলো তো? ডঃ লিডনার কিছু বলেছেন তোমাকে?
আমি আমার রুগিনীকে এখন পর্যন্ত চোখে দেখিনি, না দেখার আগেই তার সম্বন্ধে খোশগল্পে মেতে উঠতে আমি রাজী নই। তাই কৌশলে তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, শুনেছি ভগ্ন-স্বাস্থ্য ওঁর। দেখাশোনা করার জন্য ওঁর লোক দরকার। হাসল শীলা, ওর সেই হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল।
ভাল, ভাল, তেমনি বিশ্রী হাসি হাসতে হাসতে ও বলল, নজন লোক তার দেখাশোনা করছে এখন, সেটাই কী যথেষ্ট নয়?
আমার মনে হয় তারা যে যার কাজে ব্যস্ত।
যে যার কাজে ব্যস্ত? অবশ্যই তাদের কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা হয় বৈকি। কিন্তু লুসি কী তাতে সন্তুষ্ট হয়?
জানি না, আমি নিজের মনেই বললাম, তুমি নিশ্চয়ই ওঁকে পছন্দ কর না। করলে এ কথা কখনো বলতে না।
এটা একটা কথা হল, মিস রেলি বলতে থাকে, আমি ভেবে পাই না, একজন পেশাদার নার্সের এমন কী প্রয়োজন হল তার? আমার তো মনে হয় অপেশাদার কাউকে রাখলে তার পক্ষে সেটা যথেষ্ট বলেই মনে হতো। মুখে থার্মোমিটার খুঁজে দেওয়া কিংবা পালস্ দেখার মতো রুগীনী তো আর নন তিনি।
আমার কি রকম কৌতূহল হল যেন। তাই ভাবলাম, শীলার যুক্তিটা মেনে নেওয়া বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তাহলে তুমি কি মনে কর অসুখ বলতে তার তেমন কিছু হয়নি? প্রশ্নটা শীলার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
হ্যাঁ, ঠিক তাই! ষাঁড়ের মতোই শক্ত সমর্থ হল মেয়েটা। প্রিয় লুসির চোখে ঘুম নেই। তার চোখের নিচে কালো বৃত্তের দাগ। হ্যাঁ সেখানে নীল পেন্সিলের দাগ টেনে দাও। এই অবস্থায় একটা কিছু আকর্ষণ করতে হলে সবাই তার সামনে দলবদ্ধ হতে হবে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলবার জন্য। তবে যদি ঘুম আসে।
এর থেকে বোঝা যায়, একটা কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে ওঁর মধ্যে। আমি জানি (যা অন্য কোন নার্সের জানা নেই) এমনি এক স্নায়বিক রোগগ্রস্থ রুগীদের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম, তাদের একটা খেয়াল ছিল। বড় অদ্ভুত সেই খেয়াল, পরিবারের সকলকে নাচিয়ে ছাড়তে সে।
মনে হয়, মিসেস লিডনার হয়তো এ ধরনের কোন এক রুগীনী হবেন। স্বভাবতই এক্ষেত্রে স্বামীরাই সর্ব প্রথম শিকার হয়ে থাকেন, প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমি দেখেছি এ ধরনের অসুখ সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বামীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহজ সরল বিশ্বাসী হয়ে থাকে। তবু এ সব সত্ত্বেও এতদিন আমি যা শুনে এসেছি, যা দেখে এসেছি, এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। সেই সব যুক্তি তর্ক যেন একেবারেই বেমানান মিসেস লিডনারের বেলায়। নিরাপদ ডঃ লিডনারের সেই কথাটা ভাবতে গিয়ে আমি যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
মজার ব্যাপার হল সেই কথাটা এখনো আমার মনের মধ্যে কেমন গেঁথে আছে। সেই প্রসঙ্গে ফিরে এসে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা মিসেস লিডনার স্নায়ুর চাপে ভুগছেন না তো? মানে একটু ঘাবড়ে যাওয়া
কিন্তু সেরকম হবার কারণই বা কী থাকতে পারে? সব সময় দশজন অনুচর তাঁর কাছে থাকে। তারা সব অনেক দিনের পুরনো প্রহরী, ভয় পাবার কি আছে! না, না তার ঘাবড়াবার কোন কারণ থাকতে পারে না।
কি ভেবে শীলা মিনিট দুই চুপ করে থাকল। তারপর আবার মুখ খুলল ও।
কী অদ্ভুত সব কথা বলছ তুমি?
কেন?
একদিন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জার্ভিস এবং আমি ঘোড়ায় চড়ে আসছি। সময় সকাল। প্রায় সবাই তখন খননকার্যে লিপ্ত। মিসেস লিডনার তখন চিঠি লিখতে ব্যস্ত। মনে হয় আমাদের দেখতে কিংবা পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। যে ছেলেটি তোমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসে, সেও তখন ছিল না সেখানে। আর আমরা সোজা বারান্দায় চলে এলাম। আপাত দৃষ্টিতে দেওয়ালে ফ্লাইট-লেফটেনান্ট জার্ভিসের ছাঁয়া পড়তেই সেদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন তিনি। পরে অবশ্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নিতে গিয়ে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন অচেনা আগন্তুক কেউ। কিন্তু তাই যদি বা হয়, আগন্তুক কাউকে দেখে ও ভাবে কেন তিনি আঁতকে উঠবেন। আগন্তুক তো আর বাঘ-ভাল্লুক কিছু নয় যে, ভয় পেতে হবে?
সে কথা আমিও ভাবছিলাম বৈকি। তাই নীরবে মাথা নাড়লাম।
মিস রেলি মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে হঠাৎ ফেটে পড়লেন : জানি না এ বছর ওদের মধ্যে কি হয়েছে। একটা ব্যাপারে সবাই একমত। প্রত্যেকের মধ্যে একটা ঢাক ঢাক ভাব, চাপা গুঞ্জন। জনসন এমনি বিষণ্ণ যে, তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বার হয় না। ডেভিড ভুলেও কথা বলে না, পাছে অজান্তে তার পেট থেকে অজানা কোন তথ্য বুঝি বা বেরিয়ে যায়। অবশ্য বিল ঠিক উল্টো, কিন্তু তার অনর্গল বকবকানিতে সবাই বিরক্তবোধ না করে পারে না। ক্যারি এমন অদ্ভুত চোখে তাকায়, দেখলে মনে হয় অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝি সে কারোর মনের গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে। আর তারা পরস্পরের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে যেন, যেন–ওঃ আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বুঝি না; তবে এটুকু বলতে পারি, সন্দেহের অবকাশ থেকে কেউ বোধহয় মুক্ত নয়।
বিচিত্র, বড় বিচিত্র সব ঘটনা। তার চেয়েও বিচিত্র বোধহয় মানুষের মন। ভাবলাম, দুজন দুই প্রান্তের মানুষ যাদের মধ্যে কোন মিল নেই, অথচ সেই দুজন মানুষ মিস রেলি এবং মেজর পেনিম্যান কিন্তু একটা ব্যাপারে একই মতামত পোষণ করছে, অন্তত তাদের আলোচনা আমার মনের মধ্যে যথেষ্ট দাগ ফেলতে পেরেছে। আমাকে এক অজানা ভাবনায় ফেলে দিতে পেরেছে।
ঠিক সেই সময় মিঃ কোলম্যান হৈ-চৈ করতে করতে ফিরে এল। হৈ-চৈ বললাম বটে, বা এও হতে পারে, তার কথাবার্তার ভাবভঙ্গীই হয়তো এইরকম।
হ্যালো, বলল সে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাজার সরকার বলতে নিশ্চয়ই আমি। শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন ওঁকে?
শহর দেখার উৎসাহ খুব একটা নেই ওর, মিস রেলি শুকনো গলায় জবাবটা দিল। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ছবির প্রদর্শনী কিংবা প্রাচীন নিদর্শন দেখবার ঝোঁক তোমারও তো নেই বিল, আছে নাকি তোমার? আমি ভাবতেই পারি না, কি করে তুমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হলে?
তার জন্য আমাকে দোষ দিও না, দোষ যদি দিতে হয় তাহলে আমার অভিভাবককে দিও। শিক্ষিত তিনি, কলেজের ফেলো তিনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাষা ভাষা চোখ বুলিয়ে নেয় বইয়ের উপর, এমনি লোক তিনি।
তুমি মূর্খ, তাই তোমার পেশাগত কাজে তেমন মন নেই, শীলা তাকে স্পষ্ট কথা শুনিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না।
কিন্তু এ আমার মুর্খামী নয় শীলা, আসলে কি জানো, এই চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার কোন বিশেষ পেশার প্রতি লক্ষ্য আছে কিনা। আমি না বলে দিই, তাই তিনি নিজের খেয়াল-খুশি মতো এখানে পাঠিয়ে দেন আমাকে। যাইহোক, টাকা রোজগারের ধান্দায় আমি এখানে এসেছি। আমার ইচ্ছে মোটর-দৌড় কপ্রতিযোগিতায় যোগদান করা। ব্যস, এই পর্যন্ত।
অবাস্তব তোমার ধ্যানধারণা, মিস রেলিকে ক্রুদ্ধ বলে মনে হল।
তুমি ভুল করছ। হে আল্লা বলে যে কোন লোকের সঙ্গে এখানে মিশে গিয়ে আমি চিৎকার করতে পারি তাদের গলার স্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে। স্কুল জীবন থেকে অপরের হাতের লেখা নকল করার দিকে আমার দারুণ ঝোঁক ছিল। এখন আমি একজন ফার্স্টক্লাস জালিয়াত। যদি কোনদিন বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমাকে তোমার সামনে দিয়ে রোলস্ রয়েস হাঁকিয়ে চলে যেতে দেখো, তাহলে ধরে নিও আমি একজন ক্রিমিনাল।
ভুলে যেও না, অনেক আগেই এখান থেকে তোমার রওনা হয়ে যাবার কথা ছিল। সে জায়গায় তুমি এখনো এখানে সেই থেকে বকবক করে যাচ্ছো।
আমার অতিথি সেবাপরায়ণ, তাই না নার্স?
আমি নির্লিপ্ত ভাবে বলি, মনে হয়, এবার আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ মিঃ কোলম্যান।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ নার্স।
মিস রেলির সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এবং একটু পরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট রূপ আছে শীলার, মিঃ কোলম্যান বললেন, তবে সব সময় ও আমার কাজ কিংবা কথার খুঁত ধরে, হয়তো ও আমাকে সরিয়ে দেবার মতলব আঁটছে।
শহরের বাইরে ছোটে আমাদের ছুটন্ত গাড়িটা। পথের দুধারে সবুজ শস্যখেত। প্রায় আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একটা বিরাট বাঁধের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিঃ কোলম্যান বলেন, আরো একটু এগুলেই আমাদের তেল ইয়ারিমাহ।
দূরে কালো কালো চেহারার মানুষগুলোকে এখান থেকে ছোট ছোট পিঁপড়ের দল বলে মনে হচ্ছিল। আমার চোখে চোখ পড়তে তারা ছুটতে শুরু করল।
অভিযান পরিচালনা করার বাড়িটা ছিল নদী থেকে খানিকটা দূরে। মাঝখানে একটা কোটইয়ার্ড। সেই কোর্টইয়ার্ডের চারপাশে সারি সারি ঘর। প্রথমদিকে দক্ষিণ দিকের ঘরগুলো নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের অভিযানের তৎপরতা, পরে পূব দিকের কয়েকটা অপ্রয়োজনীয় ঘরগুলোর দখল নেওয়া হয়।
প্রত্যেক ঘরের দরজাগুলো কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে। আর জানালাগুলো বেশির ভাগ বহির্মুখখা। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা সিঁড়ি উপর দিকে উঠে গেছে। বিল্ডিং-এর আর তিনটে দিকের থেকে এ দিকটা একটু বেশি বড়।
পূর্বদিকে একটা খোলা বারান্দা। বারান্দা পার হলেই দরজা। মিঃ কোলম্যান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন এবং আমাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন। আমরা যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম সেখানে বহু লোক একটা চায়ের টেবিল ঘিরে আড্ডা দিচ্ছিল জমিয়ে।
টেবিলটার মাঝখানে বসে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল। এক পলকে সেই আমার প্রথম দেখা লুসি লিডনারকে।
১০. শনিবারের অপরাহ্ন
১০. শনিবারের অপরাহ্ন
মিসেস লিডনার এক শুক্রবার তার জীবনের কাহিনী আমাকে শোনালেন। পরদিন শনিবার সকালে বাতাসে যে সুর ভেসে আসে, বুঝি তার কাহিনীর সঙ্গে কোথায় যেন একটা অমিল থেকে যায়। বিশেষ করে আমি লক্ষ্য করেছি, আমার উপর প্রভুত্ব করার একটা ঝোঁক আছে। আমি ওঁর সেবিকা হিসাবে এখানে কাজে এসেছি, সে কথা আমি অস্বীকার করছি। না, কিন্তু তাই বলে আমাকে ভুল বোঝানো হবে, বিশেষ, করে তার মানসিক রোগ উপশমের ভারটা যখন আমার উপরে ন্যস্ত, সেই দাবীতে আমি অন্তত ওঁর কাছ থেকে প্রকৃত সত্য ঘটনাটা আশা করতে পারি, পারি কি না? ঠিক আছে, তার জন্য আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র বিস্মিত নই। এ রকম ঘটনা বার বার আমার জীবনে ঘটছে এবং ঘটবে, এর মধ্যে অবাক হবার কী আছে? মেয়েরা সাধারণতঃ আবেগের মাথায় নিজেদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে থাকে। পরে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সত্য ঘটনাটা তখন বেমালুম চেপে যায়। এই হল মানুষের স্বভাব। আমরা সবাই স্বভাবের দাস, এ কথা অস্বীকার করা যায় না, তা না হলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়।
তারপর থেকে আমি খুব সতর্ক হলাম, মিসেস লিডনার যে কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলেন, সে নিয়ে তার কাছে ফিরে আর আমি উচ্চবাচ্য করলাম না ভুলেও। ওদিকে সকালেই মিঃ কোলম্যান হাসানিয়ের পথে যাত্রা করেছে। সঙ্গে চিঠিগুলো নিতে সে ভোলেনি। শ্রমিকদের বেতন দিবস আজ, ব্যাঙ্ক থেকে খুচরো মুদ্রা আনতে হবে তাকে। বিকেলের আগে ফিরতে পারছে না সে। আমার অনুমান শীলা রেলির সঙ্গে অপরাহ্নের ভোজ সারবে সে। সাড়ে তিনটার পর খোঁড়া খুঁড়ির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, কারণ একটু পরেই বেতন দেওয়া শুরু করা হবে।
ছোকরা আবদুল্লার কাজ হল মাটির পাত্রগুলো বোয়া মোছা করা। কোটইয়ার্ডের ঠিক মাঝখানে বসে সে তার কাজ করছিল এবং মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল চারিদিকে। মিঃ কোলম্যান ফিরে না আসা পর্যন্ত ডঃ লিডনার এবং মিঃ এমাট তাদের নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত রইলেন। আর মিঃ ক্যারি খনন কার্যের তদারকি করতে থাকলেন।
ওদিকে মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর আরামের যথাযথ ব্যবস্থা করে আমি আমার ঘরে ফিরে আসি। ঘুম আসছিল না, বই খুলে পড়তে বসলাম। তখন পৌনে একটা হবে, হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। নার্সিংহোমে মৃত্যু–রীতিমতো রোমাঞ্চকর কাহিনী। যদিও লেখকের লেখার ধরণ দেখে আমি মনে করি নার্সিংহোম পরিচালনার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা কম, এ ব্যাপারে তিনি আর একটু যত্ন নিলে বোধহয় ভালো হত। যাইহোক, এ ব্যাপারে লেখককে দু-একটা কথা লেখার কথা আমি ভাবছিলাম। অবশেষে বই বন্ধ করে (কাহিনীর বিবরণ মত ভোজ টেবিলের পরিচারিকাকে অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু একবারও তাকে আমার সন্দেহ হয়নি) ঘড়ির দিকে তাকালাম, তিনটে বেজে কুড়ি! সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম এবং গায়ে ইউনিফর্ম চাপিয়ে কোর্ট ইয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আবদুল্লা তখন তার কাজে ব্যস্ত এবং তার সেই বিষণ্ণ গানের সুরটা ঠোঁটে লেগেছিল। ডেভিড এমাট তার পাশে দাঁড়িয়ে ব্রুশ দিয়ে ধোয়া মাটির পাত্র গুলো আলাদা করে রাখছিলেন। আমার দৃষ্টিটা সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিতে হল কারণ ডঃ লিডনারকে ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখলাম তখন।
অপরাহ্নটা খুব একটা খারাপ নয়, ডঃ লিডনার উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ছাদটা পরিষ্কার করে এলাম। কদিন থেকে লুসিও অভিযোগ করছিল, ছাদে বেড়াবার জন্য এতটুকু জায়গা নেই। লুসি এবার খুশি হবে। এই খবরটা আমি এক্ষুনি তাকে দিতে যাচ্ছি।
মনে হয় মিনিট দেড়েকও হয় নি ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, সেটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি আবার ফিরে এলেন। তার দিকে এই মুহূর্তে তাকালে মনে হয় আমি যেন রাতের বিভীষিকা দেখছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘরে ঢোকার সময় তাকে বেশ হাসি-খুশি দেখেছিলাম। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন। ঠিক মাতাল অবস্থায়, পা টলছে, মুখে আতঙ্কের ছাপ।
নার্স–ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, বিচিত্র চাহনি, নার্স সঙ্গে সঙ্গে আমার কেন জানি না মনে হল, একটা কোন অঘটন ঘটেছে নিশ্চয়ই। ডঃ লিডনারের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর অন্তত যে কথাই বলে দিচ্ছে যেন। তাই আমি তাড়াতাড়ি তার কাছে ছুটে এলাম। আমার দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি, ভয়ঙ্কর বীভৎস সেই চাহনি। টান-টান ধূসর রঙের মুখ। তার অবস্থা দেখে মনে হল, যে কোন মুহূর্তে তার দেহটা অবশ হয়ে পড়ে যেতে পারে।
আমার স্ত্রী… কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার, আমার স্ত্রী ……… ওঃ হায় ঈশ্বর……
তার অসমাপ্ত কথাটা শোনবার জন্য আমার বুঝি আর তর সইছিল না। ডঃ লিডনারের পাশ কাটিয়ে তার স্ত্রীর শয়নকক্ষে ছুটে গেলাম। ঘরে ঢোকা মাত্র আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হল যেন।
বিছানার উপরে মিসেস লিডনারের দেহটা দলাপাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
আমি তার উপরে ঝুঁকে পড়লাম। তার দেহে প্রাণের কোন সাড়া নেই। স্পন্দনহীন দেহটা দেখে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না, তিনি মৃত। মৃত্যু ঘটেছে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে। মৃত্যুর কারণটা অনুমান করা খুবই সহজ ডানদিক ঘেঁষে মাথার উপর প্রচণ্ড আঘাত করার ফলেই তার মৃত্যুটা ঘটে থাকবে। মনে হয়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি একবার বিছানার উপর উঠে বসবার চেষ্টা করে থাকবেন, তারপর যেভাবে যে অবস্থায় ছিলেন ঠিক সেখানেই পড়ে থাকেন। বিশেষ কারণেই আমি তার মৃতদেহ স্পর্শ করলাম না।
ক্লু খোঁজার জন্য চকিতে ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম, কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু চোখে পড়ল না। জানালাগুলো সব বন্ধ এবং ছিটকিনি লাগানো। খুনের চিহ্ন লুকিয়ে রাখার মতো জায়গাও তেমন চোখে পড়ল না। মনে হয় খুনী অনেক আগে নির্বিবাদে তার কাজ হাসিল করে কেটে পড়েছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ডঃ লিডনার তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। ডেভিড এমোট তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। তার চোখে অনেক প্রশ্ন।
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম এক এক করে। গলা থেকে কিছুতেই স্বর বেরুতে চাইছিল না, তবু কোন রকমে নিচু গলায় বললাম সমস্ত ঘটনা, সংক্ষেপে।
ডেভিডের উপর আমার বরাবর আস্থা ছিল। শান্ত প্রকৃতির মানুষ। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, তিনি আমার খবরটা উপলব্ধি করে নীল চোখে বড় বড় করে তাকালেন। কম কথার মানুষ তিনি, তার ওই চোখের চাহনিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, ঘটনাটা সাধারণ নয়, তার জটিলতা ভয়ানক রূপ নিতে বাধ্য।
একটু সময় চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশে একবার আমাদের খবর দেওয়া উচিত। যেকোন মুহূর্তে বিল ফিরে আসতে পারে। এখন লিডনারকে নিয়ে কি করব, সেটাই এখন বিরাট সমস্যা আমাদের কাছে যেন।
ওঁকে ওঁর ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসুন আমায় একটু সাহায্য করুন।
মাথা নাড়ল সে।
মনে হয় দরজায় সর্বপ্রথম একটা তালা লাগান দরকার। ডেভিড বলে। তারপর তিনি দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা আমার হাতে দিয়ে বলেন, চাবিটা তোমার কাছে থাকাই ভাল। যখন-তখন
দুজনে ধরাধরি করে তার ঘরে তাকে বহন করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমরা। তারপর ব্রান্ডির খোঁজে বেরিয়ে গেলেন মিঃ এমোট। একটু পরে মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। মিস জনসনকে কেমন চিন্তিত এবং তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিল, তবে তাকে বেশ শান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। তার উপর ডঃ লিডনারকে ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম কোর্টইয়ার্ডে দ্রুত পায়ে।
ঠিক সেই সময় ধনুকাকৃতি খিলান পথ দিয়ে স্টেশন ওয়াগনটা কোর্ট ইয়ার্ডে এসে প্রবেশ করল। বিলকে হাসি মুখে নামতে দেখে আমরা সবাই বিচলিত এ সময়।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, খুশিতে উপচে পড়ে সে আবার বলে ওঠে, হাইওয়ের কোন ডাকাতির নামগন্ধ নেই আর–
কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ সে চুপ করে গেল। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে, কি ব্যাপার? আপনারা সব চুপ কেন, কথা বলছেন না কেন? আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, আপনাদের প্রিয় পোষা পাখিটাকে দুষ্টু বেড়ালটা মেরে ফেলেছে।
মিসেস লিডনার মৃত, মিঃ এমাট সংক্ষেপে বললেন, তাকে খুন করা হয়েছে।
কি বললে? বিলের ফর্সা মুখটা হঠাৎ অবিশ্বাস্য ভাবে বদলে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে, মিসেস লিডনার মৃত!
মৃত? কান্না-জড়ানো কণ্ঠস্বর। পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখি মিসেস মারকাডো দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি কি বলতে চাও মিসেস লিডনার নিহত?
হ্যাঁ, আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, খুন হয়েছেন তিনি।
না! আর্ত চিৎকার। ওঃ না! এ আমি বিশ্বাস করি না। সম্ভবতঃ তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যা? নিজের মাথায় কেউ অমন মারাত্মক ভাবে আঘাত করে আত্মহত্যা করতে পারে? আমি শুকনো গলায় বলি, তিনি খুন হয়েছেন মিসেস মারকাডো।
হঠাৎ শব্দ করে একটা কাঠের প্যাকিংবাক্সের উপর তিনি বসে পড়লেন। উঃ, এ যে ভয়ঙ্কর, বীভৎস–
ভয়ঙ্কর, বীভৎস এ ঘটনা, একথা এখন আর অজানা নয় আমাদের কাছে। এ সব কথা ওঁর মুখ থেকে শুনতে আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না। আমার আশঙ্কা ভদ্রমহিলা বোধহয় লিডনারের প্রতি হিংসার মনোভাব প্রদর্শনের জন্য এখন অনুতপ্ত, বিবেকের দংশনে ক্ষত-বিক্ষত।
মিনিট পনেরো পরে একরকম এক নিঃশ্বাসে তিনি জিজ্ঞেস করে ফেললেন, তা এখন তোমরা কী করতে যাচ্ছো!
ওঁর কথার উত্তর আমরা কেউ দিলাম না। চুপ করে যে যার কাজে লেগে পড়লাম তারপর।
মিঃ এমোট শান্তভাবে তার কাজ বুঝে নিলেন।
শোন বিল, তুমি বরং আবার হাসানিয়েয় ফিরে যাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানকার নিয়ম কানুন আমি ঠিক জানি না। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এখানকার পুলিশের বড় কর্তা, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মনে হয় ঠিক হবে। তবে তার আগে ডঃ রেলিকে খবর দিতে হবে। তিনি জানেন, এরপর আমাদের কি করতে হবে। কি করা উচিত।
মিঃ কোলম্যান মাথা নাড়লেন। তার মাথায় তখন একরাশ প্রশ্ন গিজগিজ করছিল। তার মুখ দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে গেছে। নিঃশব্দে সে অপেক্ষামান স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসে। একটু পরেই গাড়ি চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় সে।
তারপর মিঃ এমোট কতকটা অনিশ্চিত ভাবে বলে, আমার মনে হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদটা এখন সেরে নিলে ভাল হয়। বলেই সে গলা চড়িয়ে হাঁক দেন, ইব্রাহিম!
হুজুর।
পরিচারক ইব্রাহিম ডাক শুনে ছুটে আসে। মিঃ এমাট তার সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলতে থাকেন! মিঃ এমাটের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় তার প্রশ্নগুলো খুব কঠিন এবং চোখা চোখা হচ্ছিল। ছেলেটার মুখ নাড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, সব কথাতেই সে না বলছিল, অস্বীকার করছিল।
অবশেষে মিঃ এমাট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলে, ইব্রাহিমের বক্তব্য হল, আজ অপরাহ্নে কোন আগন্তুক কিংবা অপরিচিত কোন লোক এখানে আসেনি, এবং যেই আসুক না কেন নিঃশব্দে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে তার কাজ হাসিল করে পালিয়েছে।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সে তাই করেছে। মিসেস মারকাডোই প্রথম মুখ খুললেন, পরিচারকরা যখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, তখনই আততায়ী মিসেস লিডনারকে খুন করে পালায়।
হ্যাঁ, মিঃ এমাটের কথায় অনিশ্চয়তার সুর আমার কানে বাজে, বোধহয় তাই।
তারপর সে বাচ্চা পট-বয় আবদুল্লার দিকে ফিরে আরবি ভাষায় কতকগুলো প্রশ্ন করে তাকে। প্রত্যুত্তরে ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে আরবি ভাষায় কি যেন বলল তাকে।
মিঃ এমাট হতভম্বের মত ভ্রু কুঁচকায়, এ আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, নিজের মনে বিড়বিড় করে সে বলতে থাকে, এ আমি আদৌ বুঝতে পারি না।
কিন্তু সে আমাকে বলল না, কি সে বুঝতে পারছে না।
.
১১.
বিচিত্র ঘটনা
এখানে আমার ব্যক্তিগত ভূমিকার কথা যতটা সম্ভব সবিস্তারে বর্ণনা দেবার চেষ্টা করব। পরবর্তী দু’ঘণ্টা আমাকে নীরবে কাটাতে হল ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, পুলিশ এবং ডঃ রেলির আগমনের অপেক্ষায়। তখন অপরাহ্নের শেষ আলো এসে পড়েছিল কোর্টইয়ার্ডের পশ্চিম প্রান্তে, সময় পাঁচটা। ডঃ রেলি তার অফিস ঘরে যেতে বললেন আমাকে। ডঃ লিডনারের চেয়ারে বসে তিনি আমাকে তার বিপরীত আসনে বসতে বললেন।
আচ্ছা নার্স, এবার শুরু থেকে আরম্ভ করা যাক, কি বলো? নোটবুক তার হাতের কাছেই ছিল। এ আমার নিজের সন্তুষ্টির জন্য, বুঝলে? এখন বল তো ঠিক কখন ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর মৃতদেহ দেখতে পান?
তা তখন তিনটে বাজতে পনেরো হবে।
ঠিক আছে, ডঃ রেলি নোটবুক থেকে মুখ তুলে তার পরবর্তী প্রশ্নের জন্য তৈরি হলেন, আচ্ছা, মিসেস লিডনারের ঠিক কখন মৃত্যু হয়, এ ব্যাপারে তোমার কী অনুমান?
ওঃ ডক্টর আমি অত্যন্ত দুঃখিত, গলার স্বরটা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে বললাম, আমার বলা উচিত নয়।
অমন পেশাদারী কথা বলো না। আমি দেখতে চাই আমার সঙ্গে তোমার অনুমান মিলে যায় কি না!
ঠিক আছে, তাহলে বলি, আমার অনুমান এক ঘন্টা আগে ওঁর মৃত্যু ঘটে থাকবে।
তা হতে পারে। সাড়ে চারটের সময় আমি মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখেছি, এবং নোটবুকে মৃত্যুর সময় উল্লেখ করেছি একটা পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ। মৃত্যুর সময় মোটামুটি দেড়টা হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, কি বল?।
আমি চুপ করে ওঁর কথাগুলো শুনে গেলাম। কোন মন্তব্য নয়।
এই খুন-খারাবি ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত, ডঃ রেলি নিজের থেকেই আবার বলেন, আচ্ছা, আপনি বলেছেন, তখন আপনি নাকি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভাল কথা, কোন শব্দ শুনতে পাননি।
দেড়টার সময় ?না ডক্টর। দেড়টা কেন, তার আগে কিম্বা পরে কোন সময়েই আওয়াজ বলতে কিছু আমার কানে আসেনি। পৌনে একটা থেকে তিনটে কুড়ি পর্যন্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই কোন শব্দ আমি শুনতে পাইনি, কেবল ওই আরবী ছেলেটির গুন গুন আওয়াজ ছাড়া এবং ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে ছাদ থেকে ডঃ লিডনারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মিঃ এমাটের চিৎকারধ্বনি আমার কানে আসা ছাড়া অন্য আর কোন শব্দ আমি শুনতে পাইনি।
হ্যাঁ, সেই আরবী ছেলেটি
ডঃ রেলির চোখে ভ্রুকুটি।
ঠিক সেই সময় ঘরের দরজাটা খুলে যায়, ডঃ লিডনার এবং ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রবেশ করলেন। ব্যস্তবাগীশ মানুষ এই কাপ্টেন মেটল্যান্ড, ধূসর চোখে ক্রুর চাহনি।
ডঃ রেলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডঃ লিডনারকে আসন ছেড়ে দিলেন। বসুন আপনি। আপনি যে আসতে পেরেছেন, তাতেই আমি খুব খুশি। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন হবে। বড় বিচিত্র এই কেস।
ডঃ লিডনার মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
আমি জানি। ডঃ লিডনার এবার আমার দিকে তাকালেন। নার্স লিথেরানের কাছে আমার স্ত্রী সব সত্য কথা প্রকাশ করে গেছেন। এই সময় কোন কিছু গোপন করা উচিত হবে না আমাদের। নার্স, তাই বলছি, গতকাল আমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার যে সব কথাবার্তা হয়, সব তুমি খুলে বল ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এবং ডঃ রেলিকে, কোন কিছু গোপন করো না।
আমাদের কথাবার্তা যতটা সম্ভব অক্ষরে অক্ষরে আমি বলে গেলাম।
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড আকস্মিক ভাবে কখন কখন কথা বলছিলেন। আমার বলা শেষ হতেই তিনি ফিরে তাকালেন ডঃ লিডনারের দিকে।
আর এ সব কথা সবই সত্য, তাই না লিডনার।
নার্স লিথেরানের প্রতিটি কথা সত্য।
কি বিচিত্র কাহিনী! ডঃ রেলির সরস মন্তব্য এবং জিজ্ঞাসা সেই চিঠিগুলো আপনি দেখাতে পারেন?
তিনি তার এ্যাটাচি কেস থেকে বার করে চিঠিগুলো আমাকে দেখান। তারপর সেগুলো তিনি টেবিলের উপরে রেখে দেন।
তাহলে সেগুলো সেখানে পড়ে আছে নিশ্চয়ই।
এ কাহিনীর ব্যপারে চুপ করে বসে থাকা ঠিক হবে না ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, ডঃ রেলি এবার ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে বলেন, এখন এই পত্রলেখককে খুঁজে বার করে শাস্তি দিতে হবে।
আচ্ছা এ কাজ কী মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামীর বলে আপনারা বিশ্বাস করেন? আমি আমার কৌতূহল আর চাপতে পারলাম না।
কেন, তুমি কী তা মনে করো না? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, একটু দ্বিধার সঙ্গে আমাকে বলতে হল, এর মধ্যে একটু সন্দেহ থেকে যায় বৈকি।
সে যাই হোক, এবার ডঃ লিডনার বলেন, লোকটা অবশ্যই খুনি এবং আমি এ কথাও বলব, মারাত্মক বিপদজ্জনক উন্মাদ লোক সে। তাকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, আর সে কাজটা খুব কঠিন বলে মনে হয় না আমার।
আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা তার থেকেও অনেক কঠিন, কাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে ডঃ রেলি বলেন, তাই না মেটল্যান্ড?
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড উত্তর না দিয়ে গোঁফে তা দিতে থাকেন।
হঠাৎ সেই সময় আমার মুখ থেকে কথাটা ফসকে গেল, আমাকে মাফ করবেন, এ ব্যাপারে একটা কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না।
তারপর আমি সেই ইরাকি লোকটার কথা বললাম। দুদিন আগে নোকটা ফাদার ল্যাভিগনির ঘরের কাছে ঘোরাফেরা করছিল, সে কথাও বললাম ওঁদের।
ভাল কথা, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড সব শুনে বলেন, খবরটা আমরা নোট করে রাখলাম। খবরটা পুলিশের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে হয়। এ কেসের ব্যাপারে লোকটা জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।
মনে হয়, লোকটা গুপ্তচরের কাজ করছিল, আমি ওঁদের বললাম, পথ পরিষ্কার হয়ে গেলে লোকটার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে হবে।
ডঃ রেলি ভ্রু কুঁচকে বলেন, মনে কর পথ আদৌ পরিষ্কার হল না, তখন, তখন কী করবে?
হতভম্বের মত তার দিকে আমি তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।
খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন ডঃ লিডনার, এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য আমরা পেয়েছি, এ হল তার সারমর্ম। মধ্যাহ্নভোজের পর, তখন পৌনে একটা হবে, নার্স লিথেরানকে সঙ্গে নিয়ে আপনার স্ত্রী তার শয়নকক্ষে চলে যান। আর আপনি নিজে তখন ছাদে চলে যান, সেখানে ঘণ্টা দুই কাটান, ঠিক?
হুঁ।
এই সময়ের মধ্যে আপনি কী একবারও নিচে নেমে আসেন নি?
কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছাদে উঠে আসেনি?
হ্যাঁ, এমোট ঘন ঘন এসেছিল। তার কাজই হল আমার সঙ্গে আলোচনা করার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে নিচে নেমে গিয়ে মাটির পাত্র বোয়ার কাজে নিযুক্ত ছোকরাটার কাজ তদারক করা।
আচ্ছা ডঃ লিডনার এবার খুব ভাল করে মনে করে দেখুন, সব চেয়ে দীর্ঘ সময় কখন তিনি আপনার কাছে ছিলেন, আর সবচেয়ে কত বেশি সময় তিনি কোর্ট ইয়ার্ডে অনুপস্থিত ছিলেন? কোর্ট লিডনার মনে করার চেষ্টা করেন।
বলা মুশকিল, সম্ভবত দশ মিনিট। ব্যক্তিগতভাবে আমি বলব দুই কি তিন মিনিট, কারণ আমি যখন কোন কাজে ব্যস্ত থাকি তখন সময়ের জ্ঞান বলতে আমার কিছু থাকে না।
চকিতে একবার ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড। তারপর নোটবুকের পাতা উল্টাতে গিয়ে তিনি বলেন, এবার শুরু থেকে পড়ে শোনানো যাক। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, দেখুন মিঃ লিডনার দুপুর একটা থেকে দুটোর মধ্যে আপনার এক্সপিডিসনের সদস্যরা কে কি করছিল, তার একটা সঠিক বিবরণ দেবার চেষ্টা আমি করছি।
একটু অপেক্ষা করুন। আমার বক্তব্যটা পুরোপুরি শুনলে বুঝতে পারবেন, আমি কি বলতে চাইছি। প্রথমে মিঃ ব্যান্ড মিসেস মারকাডো তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তিনি তখন তার শয়নকক্ষে শ্যাম্পু করা অবিন্যস্ত চুল বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন। মিস জনসন বলেছেন, তিনি নাকি তখন বসবার ঘরে বসে সিলেন্ডার সীলের ছাপ নিচ্ছিলেন। মিঃ রেইটারের জবানবন্দীতে দেখা যাচ্ছে, তিনি তখন ডার্করুমে ফটো ডেভেলপিং’র কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ওদিকে ফাদার ল্যাভিগনি বলেছেন, দুর্ঘটনার সময় তিনি তার শয়নকক্ষে কাজ করছিলেন। অপর দুজন সদস্য ক্যারি এবং কোলম্যানের প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ক্যারি তখন খনন কাজে ব্যস্ত ছিল, আর কোলম্যান তখন হাসানিয়ায়। এরপর এখন পরিচারকদের প্রসঙ্গে আসা যাক– বলে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এখানে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন?
আপনাদের ভারতীয় পাঁচকটি তখন প্রবেশ পথে প্রহরীর সামনে বসে একটা একটা করে পাখি শিকার করছিল। দুপুর একটা পনেরো নাগাদ হাউসবয় ইব্রাহিম এবং মনসুর তার সঙ্গে মিলিত হয়। আড়াইটে পর্যন্ত তারা সেখানে হাসি-ঠাট্টা এবং গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দেয়। আর সেই সময়ের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে।
ডঃ লিডনার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, আপনি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিলেন যেন। বলুন, আপনি কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন?
তার আগে বলুন, কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে দরজা ছাড়া আপনার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করার অন্য আর কোন পথ আছে কি না!
না, থাকার মধ্যে দুটি জানালা, কিন্তু সেগুলো শক্ত রেলিং দিয়ে ঘেরা, তাছাড়া, আমার ধারণা, জানালা দুটি বন্ধ ছিল।
সপ্রশ্ন চোখে আমার দিকে তাকালেন ডঃ লিডনার, আমার সম্মতি পাওয়ার জন্য।
হ্যাঁ, জানালা দুটি ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া ছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
সে যাই হোক, জানালা দুটি ভোলা থাকলেও ঘন লোহার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে কেউ তার ঘরে ঢুকতে পারে না, কিম্বা সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতেও পারে না। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বলতে থাকেন, সে কথা আমি এবং আমার অনুগামীরাও ভেবে দেখেছি, কোন মতেই জানালা পথ দিয়ে আততায়ীরা আসতে পারে না। তাই আমার যতদূর মনে হয়, আপনার স্ত্রীর শয়নকক্ষে প্রবেশের জন্য আততায়ী নিশ্চয়ই খিলান পথের দরজা দিয়ে কোর্টইয়ার্ডে ঢুকে থাকবে। তবে সেই সঙ্গে প্রহরী, এবং সেই দুজন হাইসবয়দের কথা ধরে নিলে বলতে হয়, সে পথ দিয়ে তৃতীয় কোন ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে না।
সঙ্গে সঙ্গে ডঃ লিডনার লাফিয়ে উঠলেন।
তার মানে কী, কী বলতে চান আপনি?
শান্ত হয়ে আপনি বসুন ডঃ লিডনার, আমাদের কথা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, ডঃ রেলি শান্তভাবে বললেন, আমি আপনার মনের অবস্থা জানি, স্ত্রী বিয়োগে আপনি এখন শোকাভূত, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাস্তবের মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আপনার স্ত্রীর খুনী বাইরে থেকে আসেনি, অতএব সে নিশ্চয়ই ভেতরের কেউ। মনে হয়, আপনাদের এক্সপিডিসনের কোন সদস্য মিসেস লিডনারের খুনের জন্য দায়ী।
.
১২.
আমি বিশ্বাস করি না….
না, না!
ডঃ লিডনার লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকেন পাগলের মতন।
এ একেবারে অসম্ভব, আপনি কি যেন বললেন ডঃ রেলি? অসম্ভব। আমাদের মধ্যে কেউ একজন? এ আপনি কী বলছেন? লুসিকে এখানকার প্রতিটি সদস্য ভালবাসত, ওর প্রতি সবাই অনুগত ছিল।
ডঃ রেলি স্তম্ভিত। এ অবস্থায় কিই বা তিনি বলতে পারেন? নীরব থাকা মানেই যে সম্মতির লক্ষণ, তার ক্ষেত্রে অন্তত এ কথাটা খাটে না।
অসম্ভব! ডঃ রেলিকে চুপ করে থাকতে দেখে ডঃ লিডনার নিজের থেকেই আবার বলতে থাকেন, তারা সবাই লুসির প্রতি অনুগত। সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। লুসিকে-
মাফ করবেন ডঃ লিডনার, ডঃ রেলি তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বলে, এ আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। ধরুন, আপনার এক্সপিডিসনের কেউ যদি একান্তই আপনার স্ত্রীকে অপছন্দ করে থাকে, এত বোকা সে নয় যে, তার মনের কথাটা সে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আপনাকে শোনাতে যাবে!
ডঃ লিডনারকে কেমন অসহায় দেখায়।
সত্যি, খুবই সত্যি কথা। কিন্তু রেলি, তবু আমি বলব, এ আপনার ভুল ধারণা। এখানকার সবাই যে লুসির অনুগত, এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ডঃ লিডনার এক সময় ফেটে পড়লেন।
আপনার ধারণা আজগুবি, অবিশ্বাস্য।
কিন্তু সত্যকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না ডঃ লিডনার, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বলেন, পারেন অস্বীকার করতে অকাট্য কোন প্রমাণকে?
অকাট্য প্রমাণ? ভারতীয় পাঁচক, আরব হাউস-বয়, এরা কী সবাই মিথ্যে বলছে? এদেরকে আমি আপনি সবাই বেশ ভাল করে জানি। আপনারা যা জানতে চেয়েছেন, ওরা তো তাই বলেছেন।
এক্ষেত্রে, ডঃ রেলির গলা শুকিয়ে আসছিল। সেই অবস্থায় তিনি বললেন, ওরা এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করে, যা আমরা শুনতে চাই না। তাছাড়া, আপনার এক্সপিডিসনের সদস্যদের স্বভাব আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। গেটের বাইরে ওদের একটা সমিতি ধরনের আড্ডাস্থল আছে। দুপুরে যখনই এখানে এসেছি, আমি লক্ষ্য করেছি, আপনার বেশির ভাগ কর্মচারী সেখানে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। জায়গাটা তাদের পক্ষে আদর্শ তাই না ডঃ লিডনার?
আসলে কথাটা কি জানেন, আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি ভীষণ ভাবপ্রবণ ব্যক্তি। ডঃ লিডনার তাকে মনে করিয়ে দেয়, আচ্ছা এমন তো হতে পারে, আততায়ী অনেক আগে মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে কোথাও লুকিয়েছিল?
একেবারে অসম্ভব নয়, এ কথা আমি মানতে পারছি না, ডঃ লিডনার ঠাণ্ডা মাথায় বলতে থাকেন, ধরে নেওয়া যাক, আগন্তুক নিঃশব্দে কারোর চোখে না পড়ে মিসেস লিডনারের শয়ন কক্ষে গিয়ে ঢুকেছিল, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে সেখানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল আবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথাও ভাবতে হবে, মিসেস লিডনারের ঘরে লুকোবার মত তেমন কোন সুযোগ ছিল না আদৌ। অতএব এ ক্ষেত্রে সেই আরবী ছোকরার দৃষ্টি এড়িয়ে তাকে একটা বিরাট ঝুঁকি নিতে হয় সেখানে প্রবেশ এবং প্রস্থান করতে গিয়ে।
সেই ছেলেটি, হ্যাঁ সেই ছেলেটির কথা আমি বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম, ডঃ লিডনার একটু ব্যস্ত ভাবে বললেন, ছেলেটি খুব চতুর। তবে, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, আমার বিশ্বাস সে নিশ্চয়ই খুনীকে আমার স্ত্রীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে দেখে থাকবে।
হ্যাঁ, তার ব্যাখ্যাও আমরা করেছি। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড সেই ছোকরার প্রসঙ্গে এসে যা বলল তা এই রকম : ছোকরাটা নাকি প্রায় সর্বক্ষণ মাটির বাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল, মিনিট দশেক কোর্টইয়ার্ডে তার অনুপস্থিত থাকতে দেখা যায়, তখন প্রায় দেড়টা হবে।
হ্যাঁ ডঃ লিডনার বলেন, সঠিক সময়টা আমি বলতে পারছি না, তবে ওই রকমই হবে।
খুব ভাল কথা, তাহলে মনে হয়, এই দশ মিনিট ছোকরাটা নিশ্চয়ই গেটের বাইরে আড্ডায় জমে গিয়েছিল। এমাট ফিরে এসে দেখেন ছোকরা সেখানে নেই, এবং একটু রেগে গিয়ে ছোকরাটিকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, না বলে কয়ে হঠাৎ তার এই কাজ ছেড়ে যাওয়ার মানে কি থাকতে পারে? আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হয় যে, এই দশ মিনিট সময়ের মধ্যেই আপনার স্ত্রী খুন হয়ে থাকবে।
আঁতকে উঠে ডঃ লিডনার বসে পড়লেন মাথা গুঁজে।
ডঃ রেলির কাহিনী সমাপ্তির পথে। শান্ত সংযত কণ্ঠস্বর।
যে সব তথ্য আমার হাতে এসেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমি বলতে পারি, তিনি বলেন, আমি তাকে পরীক্ষা করে দেখবার ঘন্টা তিনেক আগে তাঁর মৃত্যু ঘটে থাকবে হয়তো। এখন কেবল একটাই প্রশ্ন–কে, কে এই নিষ্ঠুর কাজটা করল?
সেই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এল। তাপর এক সময় বুকফাটা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে উঠলেন ডঃ লিডনার, হাতটা তার যথারীতি কপালে।
আপনার সব যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি ডঃ রেলি,, শান্ত স্থির ভাবে ডঃ লিডনার বলতে থাকেন, আমি স্বীকার করছি এ কাজ আমাদের ভেতরের লোকেরই। কিন্তু তবু আমার কেন জানি না মনে হয়, কোথায় যেন একটা ভুল থেকে যায়। আপাত দৃষ্টিতে এটা ন্যায় সঙ্গত হলেও, কোথাও না কোথাও একটা ত্রুটি থেকে যায়।
আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কথা শুনতে হবে, আশা করিনি। ডঃ লিডনার বলতে থাকেন, আমার স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে চিঠি লেখা হচ্ছিল। কোন এক ব্যক্তিকে আমার স্ত্রীর হত্যাকারী সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। তারপর আজ তিনি খুন হলেন। আর আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন সেই লোকটার দ্বারা তিনি খুন হননি, খুন হয়েছেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রকৃতির লোকের দ্বারা। তাই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, অদ্ভুত অনুমান।
হ্যাঁ, ডঃ রেলি গম্ভীর ভাবে চিন্তা করে বলেন, তাই মনে হয় বৈকি।
তারপর তিনি ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে তাকালেন, আঃ অদ্ভুত অনুমান? মেটল্যান্ড, আপনি কী বলেন? আপনি কী ওঁর সঙ্গে একমত? নাকি লিডনারের উপরে কেসটা ছেড়ে দেব?’
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড মাথা নাড়লেন এবং সংক্ষেপে বললেন, এগিয়ে যান।
ডঃ লিডনার, আপনি এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন।
বিহ্বল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন ডঃ লিডনার। তারপর বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে তিনি বলেন, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে নামটা যেন শুনেছি। তার কথায় দ্বিধাগ্রস্থ ভাব। মনে পড়ছে, একদিন মিঃ ভান আলাদিনকে ওঁর সম্বন্ধে খুব উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনেছিলাম। উনি একজন প্রাইভেট ডিকেটটিভ, তাই না?
হ্যাঁ, তিনি সেই লোক।
কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই লন্ডনে থাকেন, তাহলে কীভাবে তিনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন?
তিনি যে লন্ডনে বাস করেন, সে কথা ঠিক, ডঃ রেলি বলেন, তবে ঘটনাচক্রে তিনি এখন লন্ডনে নেই, এখন তিনি সিরিয়ায়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, বাগদাদ যাবার পথে আগামীকাল তিনি হাসানিয়ে হয়ে যাবেন।
এ খবর কে আপনাকে দিল?
জীন বেরাট, ফ্রেঞ্চ কনসাল। কাল আমাদের সঙ্গে নৈশভোজের সময় ওঁর কথা বলছিলেন তিনি। মনে হয় সিরিয়ায় মিলিটারি স্ক্যান্ডালের ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছেন তিনি। বাগদাদ যাবার পথে তিনি এখানে এসেছেন। তারপর লণ্ডনে ফেরার পথে আবার সিরিয়া হয়ে যাবেন। কি অদ্ভুত যোগাযোগ বলুন!
ডঃ লিডনার একটু ইতস্ততঃ করে কাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালেন, এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রত্যুত্তরে বলেন, আমার ছেলেরা আরবদের বহুদিনের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ডঃ লিডনার, আপনার স্ত্রীর কেসটা একেবারে ভিন্ন ধরনের, আমার বুদ্ধির বাইরে। সমস্ত ব্যাপারটা যেন সন্দেহজনক। এই সব কথা ভেবেই এরকুল পোয়ারোর হাতে আপনার স্ত্রীর কেসটা আমি তুলে দিতে চাই। আর সেইজন্য আপনাকে–
তার মানে আপনি বলতে চান যে, পোয়ারোকে আমি যেন অনুরোধ করি কেসটা হাতে নেবার জন্য। ডঃ লিডনার একটু থেমে প্রশ্ন চোখে তাকালেন, আর ধরুন, উনি যদি আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন?
কোন মতেই তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। ডঃ রেলি দৃঢ়স্বরে বললেন।
আপনি কী করে জানলেন?
কারণ, আমিও একজন পেশাদার লোক, ডঃ রেলি নিজের সমর্থনে বলতে থাকেন, সাধারণ কিন্তু জটিল কোন কেস হলে আমাদের না বলার কোন অধিকার নেই, আমরা কেসটা ফিরিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু এ কেসটা সাধারণ অপরাধের পর্যায় পড়ে না লিডনার।
না, ডঃ লিডনার অস্ফুটে বললেন দাঁতে দাঁত ঘষে। ফলে দংশন যন্ত্রণায় তার মুখটা ঈষৎ কম্পিত হল। তাহলে ডঃ রেলি, আমার হয়ে আপনারা এরকুল পোয়ারোকে অনুরোধ করছেন তো?
চেষ্টা করে দেখব।
ডঃ লিডনার তাকে ধন্যবাদ জানালেন।
বিশ্বাস করুন, ধীরে ধীরে বললেন তিনি, এখানো আমি ভাবতেই পারছি না, সত্যি লুসি মৃত!
আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলাম না।
ওঃ উঃ লিডনার, এবার ফেটে পড়লাম, আমার যে কি খারাপ লাগছে। আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি আমার কর্তব্যে অবহেলার জন্য সত্যি খুব মর্মাহত। মিসেস লিডনারের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, সে দেখার ভার ছিল আমার উপরে। সেই আমি-
ডঃ লিডনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠেন, না নার্স, তোমাকে অত অনুশোচনা করতে হবে না। ভাঙা গলায় তিনি বলেন, দোষ যদি দিতে হয় তো আমাকে দাও। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, এমন কি আমি কখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সত্যিকার কোন বিপদ ঘটতে পারে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ হয়ে গেছে এই কয়েক মিনিটে।
আমি, হ্যাঁ আমি বোধ হয় ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি… হ্যাঁ, ঠিক তাই, কিন্তু কথাটা কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে, তাই না?
তিনি আর ঘরে থাকতে পারলেন না। ডঃ রেলি অপসৃয়মান ডঃ লিডনারের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমিও নিজেকে ঠিক, ত্রুটিমুক্ত ভাবতে পারি না, আক্ষেপ করে বললেন তিনি।
কোন ক্ষেত্রেই ব্যাপারটাকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। অকপটে আমি আমার দোষ ত্রুটির কথা স্বীকার করলাম।
আমরা তিনজনেই, বোধহয় একই ভুল করছি, ডঃ রেলি গম্ভীর ভাবে কথাটা বললেন।
অতএব, এবার কাপ্টেন মেটল্যান্ড মন্তব্য করলেন, আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়
.
১৩.
এরকুল পোয়ারোর আবির্ভাব
মনে হয় এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারব না। অবশ্য পরবর্তী কালে ওঁর সঙ্গে আমার বহুবার সাক্ষাত হয়েছে, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, প্রথম সাক্ষাতের রোমান্সই বলুন, আর ট্রাজেডিই বলুন, আর মূল্যায়ন অন্য এক নিরীখে হওয়া উচিত। যাইহোক, যে কথাটা আমি বলতে গিয়েও মনের দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে, সব শেষে শালীনতার দিক থেকে বাধা পাচ্ছিলাম, সেটা এবার বলেই ফেলি, পোয়ারোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে আমি তো রীতিমত শক্ পাই। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেকের মনে এই একই ধারণা হয়ে থাকে।
ঠিক জানি না, পোয়ারোর সম্বন্ধে আমার কিরকম উচ্চাশা ছিল, শার্লক হোমস এর মতন? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লম্বাটে মুখ। অবশ্য আমি জানি, তিনি একজন বিদেশী। তবে তাকে ঠিক যতটা বিদেশী বলে মনে করা উচিত উনি ঠিক ততটা নন, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি।
ওঁকে প্রথমে দেখা মাত্রই আপনাদের হাসির উদ্রেক হবে। মনে হবে রঙ্গমঞ্চে কিম্বা ছায়াচিত্রের সঙ্গে তিনি যেন জড়িত আছেন। প্রথম থেকে শুরু করা যাক, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির বেশি লম্বা তিনি নন। একটু বেঁটেই বলতে হয় বুঝি বা একটু বয়স হয়েছে, প্রকাণ্ড দেহ, ডিম্বাকৃতি মুখ। কতকটা কৌতুক নাটকে নরসুন্দরের মত দেখতে তাকে।
হ্যাঁ, এই লোকই মিসেস লিডনারের খুনীর সন্ধান করতে যাচ্ছেন।
মনে হয় আমার মুখের উপর বিরক্তির ছায়া পড়ে থাকবে এবং সেটা পোয়ারোর চোখে ধরা পড়ে গেছে। তা না হলে সরাসরি কি করে তিনি বললেন, আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি ম্যাডাম? মনে রেখো, পুডিং খেতে কেমন কেবল মুখে দিলেই বোঝা যায়।
উপমাটা মন্দ নয়। কিন্তু নিজের মধ্যে তেমন আস্থা অনুভব করতে পারলাম না।
রবিবার, মধ্যাহ্নভোজের পর ডঃ রেলি তাঁর গাড়িতে চড়িয়ে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে এলেন। পোয়ারোর পরবর্তী কাজ হল আমাদের এক সঙ্গে জড়ো করে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার সুবিধার জন্য আমরা সবাই ডাইনিংরুমে সমবেত হলাম। ডাইনিং টেবিলের সামনে এরকুল পোয়ারো বসেছিলেন, তার একপাশে ডঃ লিডনার, অন্য দিকে ডঃ রেলি তার সঙ্গে নিচু গলায় কি যেন আলোচনা করছিলেন তখন, হয়তো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছিলেন, কি ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পালাটা শুরু করা যায়।
আমাদের সবাইকে সমবেত হতে দেখে ডঃ লিডনার গলা পরিষ্কার করেও দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন। আজ তিনি হাসানিয়ে হয়ে বাগদাদে ফিরে যাচ্ছিলেন। দয়া করে তিনি তার যাত্রাপথে বিরতি ঘটিয়ে আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন। ইরাকের পুলিশ এবং ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিন্তু এ এক বিচিত্র কেস, ডঃ রেলির দিকে ফিরে তিনি আবার বলতে থাকেন, মনে হয় তাদের পক্ষে এই জটিল কেসের সঠিক সমাধানে পৌঁছুতে অসুবিধা হবে।
সব দিক থেকে তারা তেমন দক্ষ নন, তাই কী? টেবিলের মধ্যমণি সেই ছোট বেঁটে খাটো লোকটি মন্তব্য করে তাকান চারদিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী, ভাল করে ভাষাটা রপ্ত করতে পারেন নি কেন, কে জানে?
ওহো, যে ভাবেই হোক তাকে ধরতেই হবে। মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন, সে যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সেটা আমাদের কাছে অসহ্য হবে।
দেখলাম মিসেস মারকাডোর কথাটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করছেন পোয়ারো। তার চোখের চাহনিতে অন্তত সেই কথা মনে হল আমার।
কে, কে সে ম্যাডাম?
কেন, সেই খুনী ছাড়া আর কার কথা বলতে পারি?
খুনী? ও, হ্যাঁ
কথাটা এমন হাল্কা ভাবে বললেন এরকুল পোয়ারো যে খুনীর ব্যাপারটা যেন কিছুই নয়।
আমাদের সবার অবাক চোখ তার দিকে। এবং তার সন্ধানী চোখ এক এক করে আমাদের মুখের উপর পরিক্রমারত।
আপনাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, পোয়ারো বলেন, আপনারা কেউই এর আগে কোন খুনের মুখোমুখি হননি।
একটা সমবেত আক্ষেপধ্বনি বেরিয়ে এল। এরকুল পোয়ারো হাসলেন।
তাহলে এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনাদের কারোরই খুনের অ, আ, ক, খ সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। অপ্রীতিকর, হা এখানে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপার রয়েছে। যেমন প্রথমেই ধরা যাক, এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।
সন্দেহ?
মিস জনসন এই প্রথম মুখ খুলল। মিঃ পোয়ারো চিন্তিত ভাবে তাকালেন তার দিকে। আমার ধারণা, মিস জনসনের কথায় তার সায় আছে। সেই মনোভাব তার কথায় প্রকাশ পেল। দেখছি এখানে একজন সমঝদার বুদ্ধিমতী মহিলা আছেন। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, হ্যাঁ, ম্যাডাম, সন্দেহজনকই বটে! এ বাড়িতে এখন আপনারা সবাই সন্দেহজনক ব্যক্তি। পাঁচক, হাউস-বয়, পরিচারক, পট বয়, হা, সবাই, এমন কি আপনাদের এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যই পুলিশের চোখে এখন সন্দেহজনক ব্যক্তি।
মিসেস মারকাডো সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠলেন, আপনার সাহস তো কম নয়? এ কথা বলার স্পর্ধা হল কী করে আপনার? এ উক্তি জঘন্য এবং অসহনীয়। ডঃ লিডনার আপনি চুপ করে বসে থাকবেন না। এই লোকটাকে –হ্যাঁ এখুনি এই লোকটাকে আপনি
ডঃ লিডনার ফলাত ভাবে বলেন, একটু শান্ত হবার চেষ্টা কর মেরী।
মিঃ মারকাডোও উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাত, রক্তবর্ণ চোখ। এ অন্যায় অপমান, আমাদের সম্মানের পক্ষে হানিকর।
না, না, মিঃ পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনাদের অপমান করতে চাই না। আমি আপনাদের সবাইকে এক অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে বলেছি মাত্র। যে বাড়িতে কেউ খুন হয়, সেই বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দাই সন্দেহের ভাগীদার হয়ে থাকে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। তারপর আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, খুনি যে বাইরে থেকে এসেছিল তার প্রমাণই বা কোথায়?
মিসেস মারকাডো গর্জে উঠলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই সে বাইরে থেকে এসেছে।
একথা ভাববার যথেষ্ট কারণ আছে! কেন জানেন? একটু থেমে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে এনে তিনি বললেন, এ ছাড়া অন্য সব কিছুই অবিশ্বাস্য।
ম্যাডাম, এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহ, অস্বীকার করছি না, পোয়ারো মাথা নিচু করে বলেন, আমি তো আপনাদের আগেই বলেছি, এই পরিস্থিতিতে প্রথমে আমি আপনাদের সবাইকে নিরপরাধ ভেবে প্রকৃত অপরাধীর খোঁজ করব। আর সেই সময়টুকু, শুধু সেই সময়টুকুর জন্য আমরা এখন আপনার হাতের মুঠোয়, ফাদার ল্যাভিগনি বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলেন, আমরা যে নির্দোষ, এ ব্যাপারে নিজেকে সন্তুষ্ট করবার ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করুন, যাতে করে আমরা এই অস্বস্তিকর অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।
প্রয়োজনীয় সময়ের অতিরিক্ত খরচ করব না। আসলে ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার করার দরকার বলে মনে করেছিলাম। কারণ আচমকা প্রশ্ন করলে আপনারা যাতে ঘাবড়ে না যান।
বেশ তো প্রশ্ন করুন না আমি প্রস্তুত, ফাদার ল্যাভিগনি সাহসের সঙ্গে কথাটা বলেন।
এটাই কী আপনার প্রথম বছর এখানে?
হুঁ।
আর এখানে কবে এসেছেন?
প্রায় সপ্তাহ তিনেক আগে। সাতাশে ফেব্রুয়ারি।
ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আর একটা কথা, এখানে আসার আগে মিসেস লিডনারের সঙ্গে আপনার কি কোন পরিচয় ছিল?
না, এখানে এসেই ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ-আমার।
এবার বলুন মিসেস লিডনার খুন হওয়ার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
আমার ঘরে বসে পারস্য দেশের শিলালিপিতে আবিষ্কার করা বর্ণমালাগুলো পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছিলাম।
পোয়ারোর কুনুইয়ের নিচে বিল্ডিংয়ের একটা খসড়া প্ল্যান পড়ে থাকতে দেখলাম।
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় এই ঘরটা আপনার, আর আপনার ঘরের ঠিক বিপরীত দিকে মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষ, ঠিক বলেছি না?
হুঁ।
তা কখন আপনি আপনার ঘরে যান ফাদার ল্যাভিগনি?
মধ্যাহ্নভোজের ঠিক পরেই, তা তখন একটা চল্লিশ হবে।
আর সেখানে আপনি ঠিক কতক্ষণ ছিলেন বলতে পারেন?
ঠিক তিনটের আগে পর্যন্ত। স্টেশন ওয়াগান ফিরে আসার শব্দ পেলাম। তারপর সেটা আবার ফিরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে আমি একটু অবাক হলাম এবং ব্যাপারটা জানবার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলাম।
ঘরে থাকার সময় কোন অস্বাভাবিক শব্দ কিংবা এমন কিছু আপনার চোখে পড়েনি যার সঙ্গে এই বিয়োগান্ত নাটকের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
না।
কোর্টইয়ার্ডের দিকে আপনার ঘরের কোন জানালা নেই?
না, দুটো জানালাই রাস্তার দিকে।
কোর্ট ইয়ার্ড থেকে সাড়া শব্দ পাননি?
খুব বেশি নয়, তবে আমার ঘরের পাস দিয়ে মিঃ এমাটের বার বার ছাদে যাতায়াত করার শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।
কোন্ সময়, মনে আছে আপনার?
না, বলতে পারব না। কারণ তখন আমি আমার কাজে ডুবেছিলাম।
কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা স্তব্ধতা নেমে আসে। মনে হয় পোয়ারো তখন চিন্তা করার সুযোগ নিচ্ছিলেন। তিনিই সেই নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, এ কেসের ব্যাপারে আপনার কিছু বলার নেই? মানে খুন হওয়ার আগে অস্বাভাবিক কিছু আপনার চোখে পড়েনি?
ফাদার ল্যাভিগনিকে একটু অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া হল যেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে ডঃ লিডনারের পানে তাকালেন তিনি।
এটা একটা খুব কঠিন প্রশ্ন মঁসিয়ে, ফাদার ল্যাভিগনি উত্তরে বলেন,তাহলে খোলাখুলি ভাবেই বলি, আমার মতে মিসেস লিডনার বলতে গেলে এক রকম সব সময় মৃত্যু ভয়ে দিন গুণছিলেন। আগন্তুক খুনীর আসন্ন আবির্ভাবের কথা ভেবে দারুণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আমি তার নার্ভাস হওয়ার মানে বুঝি, কিন্তু কারণটা জানি না। আর মিসেস লিডনার বিশ্বাস করে কখনো তার গোপন কথা আমার কাছে খুলেও বলেন নি।
পোয়ারোর হাতে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা নোট। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন সেই নোটটা। তারপর সেদিন থেকে চোখ তুলে তাকালেন ফাদার ল্যাভিগনির দিকে।
আমার কাছে খবর আছে, দু-তিন দিন আগে এখানে চুরির ভয় দেখান হয়েছিল।
ফাদার ল্যাভিগনি দৃঢ়স্বরে যা বললেন তা ঠিক এই রকম : অ্যান্টিকরুম থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো নাকি তিনি দেখতে পান। কিন্তু সেই আলো আলেয়ার মতই রহস্যই রয়ে গেছে এখন। ব্যর্থ অনুসন্ধান বলা যেতে পারে।
আপনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না জানি না, তবে শুনে রাখুন, একজন অচেনা অজানা লোক সেই সময় প্রবেশ করেছিল এখানে।
আমি জানি না, এর পরেও কি ভাববার থাকতে পারে, ফাদার ল্যাভিগনি খোলাখুলি ভাবে বলেন, কারোর কিছু চুরি গেল না, কিংবা কাউকে উত্তক্তও করা হল না। তাই মনে হয় হাউস বয়দের কেউ একজনকে–
নাকি এক্সপিডিসনের কেউ?
এক্সপিডিসনের কেউ যদি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কারোর স্বীকার না করার কোন অর্থ তো দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু বাইরের কোন আগন্তুক হলে?
আমি তাই মনে করি।
আচ্ছা ধরা যাক, বাইরের কোন লোক যদি আগের দিন গোপনে প্রবেশ করে থাকে এখানে, এখন কথা হচ্ছে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পরদিন, মানে দুর্ঘটনার দিন অপরাহ্ন পর্যন্ত তার পক্ষে আত্মগোপন করে থাকাটা সম্ভবপর কিনা?
প্রশ্নটা ফাদার ল্যাভিগনি এবং ডঃ লিডনারকে উদ্দেশ্য করে বললেন পোয়ারো। তারা দুজনেই প্রশ্নটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখলেন।
আমার মনে হয় না সেটা সম্ভব,অবশেষে ডঃ লিডনার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, কোথায় যে সে লুকোতে পারে, আমি তো দেখতেই পাচ্ছি না। ফাদার ল্যাভিগনি, আপনার কি মনে হয়, কেউ এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে?
না, না, আমি তা আদৌ মনে করতে পারি না।
এবার পোয়ারো মিস জনসনের দিকে ফিরলেন।
আর মাদাম আপনি? আমার ধারণাটা আপনার কী সম্ভবপর বলে মনে হয় না?
না, প্রত্যুত্তরে মিস জনসন বলে, আমি মনে করি না, এখানে কোথায় কে লুকোতে পারে? শয়নকক্ষ সব সময়ই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্য ঘরগুলো, যেমন ডার্ক-রুম, ড্রইং-অফিস, ল্যাবরেটরি, সেগুলো সব হয় সেদিন, নয় পরদিন ব্যবহার করা হয়েছে, কেউ সেখানে লুকিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই কারোর না কারোর ঠিক নজরে পড়তোই। তবে চাকর-বাকররা যদি কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে
হ্যাঁ, সেটা হতে পারে, পোয়ারো তাকে সমর্থন করে বললেন, আবার অসম্ভবও বলা যেতে পারে।
ফাদার লাভিগনির দিকে আবার ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
আর একটা কথা, নার্স লিথেরান বলছিলেন, (আপনি নাকি একদিন বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন) সেই লোকটাকেই তিনি জানালায় উঁকি মারতে দেখেছিলেন। এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা ঘোরা-ফেরা করছিল।
হ্যাঁ সে কথা আমি অস্বীকার করছি না, ফাদার ল্যাভিগনি অনেক চিন্তা করে কথাটা বললেন যেন।
লোকটার সঙ্গে আপনি প্রথম কথা বললেন, নাকি সে আপনার সঙ্গে প্রথম কথা বলেছিল?
ফাদার ল্যভিগনি কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন।
হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে, সে-ই প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলে।
তা কী বলেছিল সে?
ফাদার ল্যাভিগনি আবার মনে করার চেষ্টা করলেন।
আমার যতদূর মনে পড়ছে, এই আমেরিকান এক্সপিডিসন হাউসের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছিল সে। তারপর এই এক্সপিডিসনে কতজন আমেরিকান কাজ করছে ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি লোকটাকে আমি ভাল করে বুঝতেই পারিনি। তবে আরবী ভাষাটা রপ্ত করার জন্য আমি তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাই।
আপনি কী বিশেষ কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন?
আমার যতদূর মনে পড়ে, কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম, হাসানিয়ে একটা বড় শহর। তারপরে আমরা দুজনেই স্বীকার করলাম, বাগদাদ শহরটা সব থেকে বড়। এরপর বোধহয় সে জানতে চেয়েছিল, আমি আমেরিকান, নাকি সিরীয় ক্যাথেলিক।
তার চেহারার বিবরণ দিতে পারেন?
আর এক দারুণ ভাবনায় পড়লেন ফাদার ল্যাভিগনি।
ছোট-খাট বেঁটে লোক, অবশেষে তিনি বললেন, তবে চেহারা বেশ গাঁট্টাগোট্টা এবং টেরা। গায়ের রং ফর্সা।
মিঃ পোয়ারো এবার আমার দিকে তাকালেন।
ফাদার ল্যাভিগনির দেওয়া লোকটার বর্ণনার সাথে আপনি কী একমত?
না, ঠিক তা নয়, একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, বেঁটে নয় বরং তাকে বেশ লম্বাই বলা যায় এবং গায়ের রং অত্যন্ত কালো। রোগাটে চেহারা, আর তাকে টেরা বলে আমার মোটেই মনে হয়নি।
মিঃ পোয়ারোর মুখে চোখে হতাশার ছায়া।
এ কী করে সম্ভব? একই লোকের বর্ণনা দুজন লোকের কাছে দুরকম কী করে হতে পারে? পোয়ারো ফাদার ল্যাভিগনির দিকে ফিরে বলেন, আপনি যদি পুলিশ হতেন, কী চোখে দেখতেন ব্যাপারটা?
লোকটা যে টেরা ছিল, এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ফাদার ল্যাভিগনির কথায় দৃঢ়তার সুর, নার্স লিথেরান হয়তো অন্য বিষয়গুলি ঠিক ঠিক বলে থাকবে। যেমন ধরা যাক, আমি বলেছি লোকটার গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা। তার মানে আমি বলতে চেয়েছিলাম, ইরাকীদের মধ্যে তাকে বেশ ফর্সা বলা যেতে পারে। আমার ধারণা, নার্স তাকে কালো বলেই বর্ণনা দেবে।
শুধু কালো নয়, অত্যন্ত কালো, আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কালচে হলুদ রঙের চেহারা।
আমার কি মনে হল, ডঃ রেলির দিকে তাকাতেই দেখলাম, ঠোঁট টিপে তিনি হাসছেন।
হঠাৎ পোয়ারো হাত নেড়ে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলেন, সেই লোকটা, হা সেই আগন্তুক হয়তো সে এ কেসের ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য নোক হয়ে উঠতে পারে, আবার নাও হতে পারে। সে যাই হোক, যে ভাবেই হোক, তাকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে। সেই সঙ্গে আসুন তদন্ত চালিয়ে যাওয়া যাক।
পোয়ারোর দ্বিধাজড়িত চোখের দৃষ্টি এখন অশান্ত, ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দ্রুত স্থির নিবদ্ধ হয় মিঃ রেইটারের মুখের উপরে।
আমার শুভাকাঙ্খী, আসুন। গতকাল অপরাহ্নের ঘটনা সম্পর্কে আপনি যা যা জানেন বলুন।
মিঃ রেইটারের লাল গোলগাল মুখটা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
আ–আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনাকেই। শুরু করার আগে আপনার নাম এবং বয়স দয়া করে বলুন।
কার্ল রেইটার, আঠাশ।
আমেরিকান নিশ্চয়ই?
হু, শিকাগো থেকে আসছি।
এটাই কী আপনার প্রথম বছর এখানে?
হু, ফটোগ্রাফির ব্যাপারে আমি ভারপ্রাপ্ত।
বেশ, বেশ। পোয়ারো এবার কাজের কথায় ফিরে আসে, এবার বলুন গতকাল অপরাহ্নে আপনি কী করছিলেন মিঃ রেইটার।
তা বেশিরভাগ সময় ডার্ক রুমে ছিলাম।
বেশির ভাগ সময়?
হ্যাঁ, বললাম তো, কতকগুলো প্লেট ডেভেলপের কাজে ব্যস্ত ছিলাম তখন। মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফির-রুমেও আসতে হয়েছিল।
বাইরে?
না, না বাইরে যেতে হবে কেন? ডার্করুম এবং ফটোগ্রাফি রুম পাশাপাশি।
তার মানে ফটোগ্রাফি রুম থেকে আপনি কোন সময়ই বাইরে আসেননি, বলছেন?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
সেই সময় কোর্টইয়ার্ডে অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে দেখেননি?
মিঃ রেইটার মাথা ঘাড় নাড়লেন।
না, আমি এখন কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তবে গাড়ির শব্দ হতেই বেরিয়ে আসি, আমার কোন চিঠি পত্র এসেছে কিনা দেখবার জন্য। কিন্তু বাইরে এসেই দেখি–।
তা কখন আপনি আপনার কাজ শুরু করেন মিঃ রেইটার?
তখন একটা বাজতে দশ হবে।
এই এক্সপিডিসনে যোগ দেবার আগে মিসেস লিডনারের সঙ্গে আপনার কী কখন পরিচয় হয়েছিল?
না স্যার। এখানে আসার আগে আমি তাকে কখনো দেখিনি।
আপনার কী অনুমান? এটা কী কোন একটা দুর্ঘটনা।
কার্ল রেইটার মাথা নাড়লেন। হতাশ ভাবে বললেন, না, স্যার আমি দুঃখিত এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
মিঃ এমাট?
আমেরিকানদের মতো পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ডেভিড এমাটের এবং একটু সতর্কতার সঙ্গেই তিনি বললেন, পৌনে একটা থেকে পৌনে তিনটে পর্যন্ত আমি পটারির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আবদুল্লার কাজের উপর নজর রাখাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। মাঝে মাঝে ডঃ লিডনারকে সাহায্য করার জন্য ছাদে উঠতে হয়েছিল।
তা কতবার এরকম যেতে হয়েছিল?
চারবার মনে হয়।
কতক্ষণ?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের জন্য। তবে একবার দশ মিনিটেরও বেশি সময় আমাকে থাকতে হয়। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, কোন্ কোন্ মাটির পাত্রগুলো রেখে দেব, আবার কোনগুলো ফেলে দেব।
আমি শুনেছি, তখন ফিরে এসে আপনি দেখেন, ছেলেটি সেখান থেকে কেটে পড়েছে?
হ্যাঁ, আমার চেঁচামেচিতে সে ফিরে আসে। গেটের বাইরে অন্যদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে ছেলেটি স্থান ত্যাগ করে।
না ঠিক তা নয়, বারকয়েক আমি তাকে ছাদে পাঠিয়েছিলাম পটারির কাজে।
আচ্ছা মিঃ এমাট, ভাল করে ভেবে দেখুন তো, সেই সময়ে মিসেস লিডনারের ঘরে কাউকে ঢুকতে কিংবা বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন কি না?
না, সেরকম কাউকে আমার চোখে পড়েনি, মিঃ এমাট সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, এমন কি সেই দু’ঘণ্টা সময় আমি কাউকেই কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেখিনি।
আর আপনার স্মরণশক্তি মত আপনি বলেছেন, ঠিক দেড়টার পর কিছু সময় আপনি এবং সেই ছেলেটি কোর্টইয়ার্ডে অনুপস্থিত ছিলেন, এই তো?
ঠিক দেড়টা কিনা বলতে পারি না, মিঃ এমাট বললেন, তবে কাছাকাছি ওই সময়টা ধরে নেওয়া যেতে পারে।
ডঃ রেলির দিকে ফিরলেন পোয়ারো।
ডক্টর, আপনার অনুমানই ঠিক। মৃত্যুর সময় বেলা দেড়টার কিছু পরে।
হ্যাঁ, তা না হয়ে যেতেই পারে না।
মিঃ পোয়ারো তার লম্বা গোঁফে তা দিতে থাকেন। তার কণ্ঠে গভীরতার ছোঁয়া। আমার মনে হয়, মিসেস লিডনারের মৃত্যু ঘটে সেই দশ মিনিট সময়ের মধ্যে। সেটাই আমরা মৃত্যুর সময় বলে ধরে নিতে পারি। না ডক্টর?
.
১৪.
আমাদের মধ্যে একজন?
খানিক স্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। আর সেই স্তব্ধতা একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা ছড়িয়ে দিল যেন সারা ঘরময়। ওঁরা কথা বলছিলেন, তবু ভাল ছিল বোধ হয়। কিন্তু নীরবতা যেন অসহ্য।
ডঃ রেলির অনুমান আক্ষরিক ভাবে যে সত্য, সেই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম, সেই প্রথম আমি বিশ্বাস করলাম।
আমি তখন বেশ বুঝতে পারছিলাম, মিসেস লিডনারের খুনী ঘরের ভিতরেই আছে, আমাদের মধ্যে বসে থেকে সব কথাই শুনছে সে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যেই কেউ একজন…..
সম্ভবতঃ মিসেস মারকাভোও কথাটা অনুভব করে থাকবেন আমার মতন। তা না হলে সহসা তিনি অমন করে কাতরে উঠবেন কেন?
এ আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না,কান্না জড়ানো কণ্ঠস্বর তার, উঃ! কি ভয়ঙ্কর। আমি, আমি–
অমন করে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না মেরী, সাহস সঞ্চয় করো। মিসেস মারকাভোর স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিলেন।
তারপর তিনি আমাদের দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালেন।
আমার স্ত্রী বড় ভাবপ্রবণ। আপনারা যেন কিছু মনে করবেন না। একটুতেই বড্ড বেশি চিন্তা করে ও।
আমি, আমি লুসির কি যে ভক্ত ছিলাম- কান্নায় কথা জড়িয়ে আসে মিসেস মারকাডোর।
আমি জানি না, আমার মুখের হাবভাবে কি ছিল, তবে হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম মিঃ পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।
আমি আমার শান্ত চোখ দুটি তুলে তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।
বলুন ম্যাডাম পোয়ারো মুখ খুললেন, গতকাল অপরাহ্ন বেলাটা আপনি কী ভাবে খরচ করলেন?
চুলে শ্যাম্পু দিচ্ছিলাম, মিসেস মারকাডো আগের মতোই কান্না চোখে তাকালেন, আমি তখন আমার চুলের পরিচর্যা করতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, অন্য কিছু আমার কাছে তখন অতি নগন্য বলে মনে হয়েছে।
আপনি কী তখন ঘরের ভিতরেই ছিলেন?
হুঁ। গাড়ির শব্দ না শোনা পর্যন্ত আমি ঘরের ভিতরে ছিলাম। তারপর গাড়ির শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে ঘটনার কথা আমি জানতে পারি। ডঃ কি ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা।
ঘটনাটা কী আপনাকে বিস্মিত করেছিল?
মিসেস মারকাডো কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালেন।
আপনি কী বলতে চান মিঃ পোয়ারো? আপনি কী পরামর্শ দিচ্ছেন?
আমি আর কী বলতে চাইব ম্যাডাম? একটু আগে আপনিই তো বললেন মিসেস লিডনারের খুব ভক্ত ছিলেন আপনি। সম্ভবতঃ আপনার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল। তিনি আপনাকে সময় সময় তার গোপন কথা প্রকাশ করে থাকবেন নিশ্চয়ই। বলুন ঠিক বলেছি কিনা?
ওহো, না, না প্রিয় লুসি আমাকে তার কোন গোপন কথাই বলেননি। তবে তাকে সব সময় ভীষণ চিন্তিত দেখাত, নার্ভাস বলে মনে হতো। তারপর সেই অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটে, জানালায় ধাক্কা মারা, ইত্যাদি।
আমার মনে আছে, আপনি বলেছিলেন, আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে যে একটু উত্তেজিত করতে পেরেছি, তাতেই আমার আনন্দ। মিঃ পোয়ারো আর একবার আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম।
ম্যাডাম, আপনার কথা মত তাহলে ধরে নেওয়া যায়, আপনি তখন আপনার চুলের পরিচর্যার ব্যস্ত ছিলেন, আপনি কিছুই শোনেননি, কিছুই দেখেননি। এছাড়া আপনার কি অন্য আর কিছুই মনে হয় না, যা এই কেসের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে?
চিন্তা করবার প্রয়োজন মনে করলেন না মিসেস মারকাডো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন না, সে রকম তো কিছুই মনে পড়ছে না। আর সেটাই সব থেকে বেশি বিস্ময়কর। তবে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, খুনী বাইরে থেকেই এসেছিল। এর পিছনে যথেষ্ট কারও আছে।
পোয়ারো এবার তাঁর স্বামীর দিকে ফিরলেন।
আর মঁসিয়ে আপনি, আপনার কিছু বলার নেই?
মিঃ মারকাডো ভয়ে ভয়ে তাকান।
হ্যাঁ, তাই হবে, তাই হবে। তার কণ্ঠস্বরে ভয়ের ছোঁয়া। কিন্তু তার এমন ক্ষতি কে করতে পারে? তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র দয়ালু তারপর তিনি আপন মনে মাথা নেড়ে বলতে থাকেন, তাকে যেই খুন করে থাকুক না কেন, শয়তান ছাড়া আর কিছু নয় সে।
মঁসিয়ে আপনি নিজে গতকাল অপরাহ্ন কী ভাবে কাটালেন বলুন?
আমি? তার চোখে অনিশ্চিত ভাব।
জোসেফ, তুমি খেয়াল করতে পারছো না? তাঁর হয়ে মিসেস মারকাডো উত্তরটা বলে দেন, কেন, তুমি তো তখন লাবোরেটরিতে ছিলে, মনে পড়ছে না?
ও হ্যাঁ, তাই তো ল্যাবোরেটরিতে তো ছিলাম। এ আমার নিত্য কাজ।
কখন গিয়েছিলেন?
তিনি আবার অসহায় ভাবে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, উদ্দেশ্যে, কি হবে তুমি বলে দাও।
একটা বাজতে দশ তখন, জোসেফ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ তখন দশ মিনিট বাকি ছিল একটা বাজতে।
দুর্ঘটনার কথাটা আপনি কখন জানতে পারলেন?
আমার স্ত্রী এসেই খবর দেয়। ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ সেটা। বিশ্বাস করা যায় না। এমন কি এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সত্যি কী তিনি খুন হয়েছেন?
হঠাৎ তিনি কঁপতে শুরু করে দিলেন।
উঃ কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর
মিসেস মারকাডো দ্রুত তার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ জোসেফ, আমরাও সেটা অনুভব করি। কিন্তু এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। বেচারা, উঃ লিডনারের কথাও ভাবতে হবে আমাদের।
ডঃ লিডনারের মুখে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ আমি দেখতে পেলাম। আমার মনে হয় স্ত্রী বিয়োগের প্রসঙ্গটা তিনি খুব সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং এ প্রসঙ্গে বাড়তি আলোচনাও যেন তার কাছে অসহ্য বলে মনে হচ্ছিল। পোয়ারোর দিকে তাকালেন তিনি, চোখে করুণ আবেদন। পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে তার আবেদনে সাড়া দিলেন।
মিস জনসন?
আমার আশঙ্কা, আমি বোধহয় খুব বেশি খবর আপনাকে দিতে পারব না। মিস জনসন একবার মিসেস মারকাডোর দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, বসার ঘরে আমি তখন কাজ করছিলাম।
অস্বাভাবিক কিছু আপনি দেখেননি? কিংবা আপনার চোখে পড়েনি?
না।
আপনি কী একেবারে নিশ্চিত এ ব্যাপারে? কোন অস্পষ্ট শব্দ—
না, আমি ঠিকই বলছি।
যদি বলি আপনার চোখ বলছে, কিছু একটা আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই।
না, না আমি ঠিক বলছি কিছুই দেখেনি।
তাহলে কোন শব্দ শুনে থাকবেন — পোয়ারো একটু জোর দিয়েই বলেন, যা আপনি খেয়াল করতে পারছেন না।
মিস জনসন অবজ্ঞার হাসি হাসলেন।
আপনি আমাকে যে ভাবে চাপ দিচ্ছেন মিঃ পোয়ারো, তাতে মনে হয়, আমি যা কল্পনা করছি তা আমাকে বলতে হবে।
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, আপনি কিছু একটা অনুমান বা কল্পনা করছেন।
মিস জনসন কি যেন ভাবলেন, তারপর থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন, আমার যতদূর মনে পড়ছে, গতকাল দুপুরের সময় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আমার কানে আসে। আওয়াজটা মানুষের কান্নার মতো মনে হয়।
তারপর?
সব থেকে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, যথা সময়ে কান্নার আওয়াজ আমি ঠিকই শুনতে পাই। আমার বসবার ঘরের সব জানালাগুলো ভোলাই ছিল। আর কান্নার আওয়াজটা যে মিসেস লিডনারের, সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। সেটাই আমার দুঃখের কারণ। তা সত্ত্বেও আমি যদি তখন তার ঘরে ছুটে যেতাম, কে জানে, হয়তো আমি আততায়ীকে—
ডঃ রেলি তার কথার মাঝে বাধা দিলেন।
ওই চিন্তাটা তখন আর মাথায় আনতে হবে না। ডঃ রেলি তার কথার জের টেনে বলেন, আমার কোন সন্দেহ নেই, মিসেস লিডনার (আমাকে ক্ষমা করবেন লিডনার) বলতে গেলে একরকম আততায়ী তার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র আঘাত পান, মাত্র একটি ঘুষির আঘাতই যথেষ্ট ছিল। দ্বিতীয়বার আততায়ীকে ঘুষি ব্যবহার করতে হয় নি। কারণ তা হলে, তার দেহে প্রাণ থাকলে তিনি নিশ্চয়ই সাহায্যের জন্য আবার চিৎকার করতেন নিশ্চয়ই।
তবু মনে হয় আততায়ীকে আমি বোধহয় ধরতে পারতাম একটু তৎপর হলে। মিস জনসন আক্ষেপ করে বললেন।
তা তখন সময়টা কত ছিল মাদাম মঁসিয়ে? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন, দেড়টার কাছাকাছি?
হ্যাঁ, সময়টা ওই রকমই হবে।
ভাল কথা। পোয়ারোর কথায় চিন্তার ছোঁয়া, এ ছাড়া আর কোন শব্দ আপনি কী শুনতে পাননি? এই ধরুন দরজা জানালা খোলা কিংবা বন্ধ করার শব্দ?
মিস জনসন মাথা নাড়েন, না, সেরকম কিছু তো মনে পড়ছে না।
আমার ধারণা আপনি সেই সময় টেবিলে বসেছিলেন। তা কোন্ দিকে মুখ করে বসেছিলেন বলুন তো? কোর্টইয়ার্ডের দিকে? অ্যান্টিকরুমের দিকে? বারান্দার দিকে? কিম্বা শহরের উন্মুক্ত পথের দিকে?
কোর্টইয়ার্ডের দিকে।
সেখান থেকে আপনি বয় আবদুল্লাকে দেখতে পাচ্ছিলেন?
ও হ্যাঁ, চোখ তুলতে দেখতে পেতাম বৈকি! কিন্তু তখন আমি নিজের কাজে দারুণ ব্যস্ত ছিলাম, মুখ তুলে তাকাবার মত অবসর আমার ছিল না।
চোখ না তুলেও অনুভবে তো বোঝা যায়, পোয়ারোর সুচিন্তিত প্রশ্ন, কোর্টইয়ার্ডের দিকে জানালার পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেছে বলে আপনার মনে হয়নি?
না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু কেউ যদি কোর্টইয়ার্ডের মাঝখানে দিয়ে চলে গিয়ে থাকে, সেটা কী আপনার নজরে পড়েছে?
সম্ভব নয়। তার কারণ তো আমি আগেই বলেছি, চোখ তুলে তাকাবার মত ফুরসত আমার ছিল না তখন।
বয় আবদুল্লাকে কাজ ছেড়ে বাইরে সহকর্মী অন্য পরিচারকদের সঙ্গে আড্ডা মারার জন্য চলে যেতে দেখেননি আপনি?
না।
দশ মিনিট, ধ্যান মগ্ন সন্ন্যাসীর মত আপন মনে চোখ বন্ধ করে ভাবলেন পোয়ারো, সেই সর্বনাশা দশ মিনিট।
সেই সময় একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে তাদের আলোচনার মাঝে।
হঠাৎ, হা হঠাই মিস জনসন মাথা তুলে বললেন, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার । মনে হয় অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমি আপনাকে ভুল বুঝিয়েছি। ভাল করে ভেবে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমার বিশ্বাস হয় না, আমার ঘরের অবস্থান যা, যেখান থেকে মিসেস লিডনারের চিৎকার আমি শুনতে পেয়েছিলাম। মাঝখানে এ্যান্টিক রুম। তাছাড়া আমি শুনেছি, ওঁর ঘরের জানালাগুলো বন্ধ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল সেই সময়।
সে যাই হোক, নিজের উপর অমন করে আস্থা হারাবেন না মাদাম। বিনয়ের সঙ্গে বললেন পোয়ারো। এটা খুব একটা জরুরী ব্যাপার নয়।
না, অবশ্যই নয়, সে কথা আমি জানি। কিন্তু দেখুন, আমার কাছে সেটা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আমি মনে করি, একটু সজাগ থাকলে হয়তো কিছু একটা আমি করতে পারতাম।
প্রিয় অ্যানি, ওভাবে নিজের উপর আস্থা হারিও না। ডঃ লিডনারের কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়, সমস্ত ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করো। এমনও হতে পারে, যে শব্দটা তুমি শুনেছিলে সেটা কোর্টইয়ার্ডের বাইরে কোথাও দূর থেকে এসে থাকবে।
ডঃ লিডনারের সান্ত্বনায় মিস জনসনের মুখ থেকে আংশিক মেঘ সরলেও আমি লক্ষ্য করলাম, দীর্ঘ সময় ধরে চোখের জল কষ্ট করে ধরে রাখার সেই ধৈর্য্যের বাঁধটা হঠাৎ ভেঙ্গে রেণু রেণু হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে নিল ও, হয়তো চোখের জল ঢাকবার জন্য এবং কথা হল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, প্রসঙ্গ বিক্ষিপ্ত।
মিস জনসনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিয়োগান্ত নাটকের শেষ অঙ্কে মাঝে মাঝে কল্পনার প্রভাব পড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক।
পোয়ারো আর একবার তার নোটবুকের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর মিঃ রিচার্ড ক্যারির দিকে ফিরলেন তিনি।
মিঃ ক্যারি, আমার ধারণা, এর পরেও আপনাকে বেশি কিছু বলতে হবে।
দম দেওয়া পুতুলের মত ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন রিচার্ড ক্যারি।
আমার আশঙ্কা, এ ব্যাপারে আমি আপনাদের খুব বেশি সাহায্য করতে পারব না। দুর্ঘটনার সময় আমি খনন কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, খবরটা আমাকে সেখানেই দেওয়া হয়।
খুন হওয়ার আগে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ে না যা এ কেসের ব্যাপারে সাহায্যে আসতে পারে?
না, তেমন কিছুই তো মনে পড়ছে না।
মিঃ কোলম্যান?
সমস্ত ব্যাপারটাই আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেছে?মিঃ কোলম্যানের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়, সে যেন বলতে চাইছে, আমাকে এ ব্যাপারে আর জড়ানো কেন।এখানে সবাই জানে শ্রমিকদের বেতনের টাকা অনার জন্য গতকাল সকালেই আমি চলে যাই হাসানিয়েয়। ফিরে এসে মিঃ এমাটের কাছ থেকে দুর্ঘটনার কথা শুনতে পাই। পরমুহূর্তে আমি গাড়ি ঘোরাই, গন্তব্যস্থল পুলিশ স্টেশন এবং ডঃ রেলিকে দুঃসংবাদটা পরিবেশন করার কথাটাও আমার মনে পড়ে যায় তখন।
আর তার আগে?
বলছি স্যার, মিঃ কোলম্যানের চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া কাপে, আপনি নিশ্চয়ই এখানকার অ্যান্টিক-রুমের কথা শুনেছেন। বুঝলেন, সেই ঘরের জানালার সামনে অপরিচিত মুখ দুর্ঘটনার দিন কয়েক আগে দেখা সেই অদ্ভুত দৃশ্য। সেই দৃশ্যপটের আড়ালে যে-ই কলকাঠি নাড়ুক না কেন, আজও সে পলাতক। আপনার মনে আছে? ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন তার সমর্থন পাবার জন্য, তিনি মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানালেন।
আমার ধারণা, মিঃ কোলম্যান বললেন, হয়তো তদন্ত করতে গিয়ে আপনি জনি নামে এক ভিখারীকে আবিষ্কার করবেন, যে লোকটা সেদিন কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করে থাকবে।
দু-এক মিনিট নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন পোয়ারো, তাকে বোঝবার জন্য।
মিঃ কোলম্যান, আপনি কী ইংলিশম্যান? অবশেষে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন পোয়ারো তার দিকে।
হ্যাঁ, আপনার অনুমানই ঠিক স্যার, খাঁটি ব্রিটিশ।
এ বছরই কী আপনার প্রথম এখানে আসা?
হুঁ।
আপনি কী আন্তরিকভাবে প্রত্মতত্ত্বে আগ্রহী?
এই একটা প্রশ্নে মিঃ কোলম্যানকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হল। অপরাধী ছাত্রের মত তাকাল সে ডঃ লিডনারের দিকে। তারপর কি ভেবে সে বলে, নিশ্চয়ই, আমার আগ্রহ আছে বৈকি। আমতা আমতা করে সে, না-মানে আমি খুব একটা মেধাবী ছাত্র নই।
অসমাপ্ত তার বক্তব্য। তবু পোয়ারো তার কাছ থেকে বাকী কথা আদায় করার তেমন কোন আগ্রহ দেখালেন না। তাকে এখন ঠিক ধ্যানমগ্ন যোগীর মত দেখাচ্ছিল। টেবিলের উপর পেন্সিলের দাগ কাটা, সেকি অন্যমনস্কতার দরুন, নাকি তিনি সময় নিচ্ছিলেন নিজেকে তৈরি করতে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসাবে।
তাহলে এর থেকে মনে হচ্ছে, পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন, যে কোন মুহূর্তে আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে পারি। আপনাদের মধ্যে যদি কারোর মনে হয় যে, আপনারা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানেন, যা আপনারা মনে করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারছেন না ঠিক এই মুহূর্তে, আমি তাদের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, সেই কথাটা আপনাদের স্মরণ-বীণায় যে মুহূর্তে ঝঙ্কার তুলবে আমার কাছে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। এখন আপনারা যে যার কাজে ফিরে যেতে পারেন। আমি এখন ডঃ লিডনার এবং ডঃ রেলির সঙ্গে কয়েকটা জরুরি আলোচনা করতে চাই।
সভা ভাঙ্গার সংকেত জানিয়ে দিলেন পোয়ারো। আমরা সবাই যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করলাম। ওদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমি প্রায় দরজার ওপারে পা রাখতে যাব, মঁসিয়ে পোয়ারোর ডাকে ফিরে আসতে হল।
সম্ভবত মঁসিয়ে পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নার্স লিথেরান দয়া করে থেকে যাবেন। আমার অনুমান, আপনার সহযোগিতা আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে।
তাই আমাকে ফিরে আসতে হল। আমি আমার আগের আসন দখল নিলাম আবার।
১৫. পোয়ারোর পরামর্শ
১৫. পোয়ারোর পরামর্শ
ডঃ রেলি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই চলে যাবার পর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি। তারপর পোয়ারোর দিকে চকিতে একবার তাকালেন, ইশারায় তাদের মধ্যে কি কথা হল কে জানে, তবে পরমুহূর্তে ডঃ রেলিকে কোর্টইয়ার্ডের দিকের জানালাটা বন্ধ করতে দেখা গেল। তারপর তিনি তার আসনে আবার ফিরে এলেন।
চমৎকার! পোয়ারোর কথায় খুশির আমেজ, আমরা এখন এক গোপন আড্ডা গড়ে তুলেছি। কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না এখানে। আমরা এখন স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারি। এক্সপিডিসনের সদস্যরা কে কি বলেছে, তা আমরা ইতিমধ্যে শুনেছি। কিন্তু ও হ্যাঁ, সে যাইহোক, মাদাম বলুন, এ কেসের ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? আপনার কী চিন্তা ভাবনা দয়া করে আমাদের বলুন!
পোয়ারোর কথায় আমার সারা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। এখন আর অস্বীকার করবার উপায় নেই, পোয়ারো ছোট-খাটো বেঁটে লোক হলে হবে কি তার চোখ দুটো বড় তীক্ষ্ণ, বড় কৌতূহলোদ্দীপক! মনে হয়, আমি তার চোখে ধরা পড়ে গেছি, আমার ভাবনার কথা তিনি জেনে গেছেন।
ও কিছু নয়, উত্তরে আমি বললাম।
এবার তুমি নির্ভয়ে মুখ খুলতে পার নার্স, ডঃ রেলি তাড়া দেন, বিশেষজ্ঞদের অযথা দাঁড় করিয়ে রেখো না।
সত্যি বলছি, ও কিছু নয়, আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এমনি কথাটা আমার মনে হঠাৎ উদয় হল, তাই বলছিলাম। ধরা যাক, কেউ হয়তো জানেন কিংবা সন্দেহ করেন কাউকে মিসেস লিডনারের খুনী হিসাবে, কিন্তু প্রকাশ্যে বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সামনে তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। আশ্চর্য, আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো আমার সমর্থনে মাথা নাড়লেন।
কথাটা একেবারে খাঁটি সত্যি। ওঁদের সঙ্গে আলোচনার মাঝেও আপনি এ কথাটাই বলেছিলেন। ভাবছেন হয়তো, তবু কেন আলাদা করে আপনাকে আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনার মধ্যে রেখে দিলাম? তবে কী একটু আগের আলোচ্য সভার কোন অর্থ নেই? না, ঠিক তা নয়। একটু আগে যে ছোট খাট জমায়েত এখানে হয়ে গেল, তারও প্রয়োজন ছিল বৈকি, সেটা বর্তমান কেসের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী যে হতে পারে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। কেন নেই, তার ব্যাখ্যা আমি করছি। আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, ইংলন্ডের রেসের মাঠে ঘোড়দৌড় শুরু হবার আগে প্রতিযোগী ঘোড়াদের একটা প্যারেড হয়ে থাকে। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা, যাতে করে সবার পক্ষে তাদের দেখবার এবং বিচার করবার সুযোগ পাওয়া যায়। এই ছোট খাট জমায়েতের এটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। খেলোয়াড়ী দৃষ্টি নিয়ে আমি সম্ভাব্য স্টার্টারদের নিরীক্ষণ করেছি।
ডঃ লিডনার প্রবলভাবে আপত্তি জানালেন, আমার এই এক্সপিডিসনের কোন সদস্য বা সদস্যা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে বলে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না।
তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে আমার সমর্থন লাভের আশায় বললেন, নার্স, তুমি যদি মঁসিয়ে পোয়ারোকে বুঝিয়ে বল আমার স্ত্রীর সঙ্গে গত দুদিন থাকার সময় কি কি তোমার নজরে পড়েছিল, কিংবা তোমাদের দুজনের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল আমি তাহলে বাধিত হব এই কারণে যে, বুঝতে পারব প্রকৃত তথ্য আমরা তুলে ধরতে পেরেছি ওঁর কাছে।
ডঃ লিডনারের অনুরোধ আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। তবে আমি যেটুকু জেনেছি তার থেকে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলবার প্রয়োজন মনে করলাম না। এমন কি মিসেস লিডনার যে সব কথাগুলো ব্যবহার করেছিলেন, ঠিক সেই কথাগুলোই আমার বক্তব্যে স্থান দিলাম। আমার মনে হল, এই মুহূর্তে মিসেস লিডনার যেন আমার উপরে ভর করেছেন।
আমার বলা শেষ হতেই মঁসিয়ে পোয়ারো বলে উঠলেন, খুব ভাল, খুব ভাল। দেখছি আপনার সব ঠিক মনে আছে। আমার ধারণা, এখানে আপনি আমার অনেক কাজে লাগতে পারেন।
তারপর তিনি ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে বললেন, চিঠিগুলো আপনার কাছে আছে?
হ্যাঁ। চিঠিগুলো আমি সঙ্গে নিয়েই এসেছি। আমার অনুমানই ঠিক ভেবেছিলাম প্রথমেই আপনি চিঠিগুলো দেখতে চাইবেন।
তাঁর হাত থেকে নিয়ে পোয়ারো পড়তে শুরু করে দিলেন এবং তার অভ্যাস মত খুব সতর্কতার সঙ্গে চিঠিগুলো পড়লেন। কিন্তু তার একটা কাজের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমি লক্ষ্য করলাম, চিঠিগুলোর উপরে গুঁড়ো পাউডার ব্যবহার করলেন না তিনি, এমন কি মাইক্রোস্কোপ কিংবা ওই রকম জাতীয় কিছু ব্যবহার করলেন না তিনি চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে। সাধারণ যেমন চিঠি পড়ে থাকেন, ঠিক সেই ভাবেই চিঠিগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলেন তিনি এবং চিঠিগুলো টেবিলের উপরে রেখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন।
এখন আসুন ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। দেখা যাচ্ছে, প্রথম চিঠিটা আপনার স্ত্রী পান আমেরিকায় আপনার সঙ্গে তার বিবাহের কিছু পরেই। তারপরে আরো কিছু চিঠি তিনি পান, তবে সেগুলো তিনি নষ্ট করে ফেলেন। এখানে দ্বিতীয় চিঠির তারিখ দেখে মনে হচ্ছে, এই চিঠিটা পাওয়ার কিছু দিন পরেই আপনারা দুজনেই বিষাক্ত কয়লার গ্যাসে মৃত্যু হওয়া থেকে কোন রকমে রেহাই পেয়ে যান। তারপর আপনারা এখানে এই বিদেশে চলে এলেন, এবং এই দু’বছরে কোন চিঠি আসেনি আপনাদের কাছে। এই বছরের মরশুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার আপনার স্ত্রী চিঠি পেতে থাকেন গত তিন সপ্তাহের মধ্যে। ঠিক কিনা?
হুঁ।
আপনার স্ত্রী হাবভাবে বুঝিয়ে দেন তার মনের আকাশে একটা দারুণ আতঙ্কের মেঘ জমে উঠেছে। স্ত্রীর অমন অবস্থায় ডঃ রেলির পরামর্শ মত নার্স লিথেরানকে নিয়োগ করেন আপনার স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার জন্য, যাতে করে তার ভয়টা কেটে যায়। তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
ইতিমধ্যে কয়েকটা অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়, যেমন মিসেস লিডনারের ঘরের জানালায় নক্ করার শব্দ, ভুতুড়ে মুখের আবির্ভাব, অ্যান্টিকরুম থেকে ভুতুড়ে শব্দ ভেসে আসা। এ সব কী আপনার চোখে পড়েনি?
না।
তাহলে এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে মিসেস লিডনার ছাড়া অন্য আর কেউ বিন্দুবিসর্গ জানেন না।
ঠিক তা নয়, ডঃ লিডনার স্মরণ করিয়ে দেন, ফাদার ল্যাভিগনি অ্যান্টিকরুমে আলো দেখতে পেয়েছিলেন, সে কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
হ্যাঁ, আমি তা ভুলিনি।
পোয়ারো মিনিট দুই কি যেন চিন্তা করলেন, তারপর কি ভেবে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্ত্রী কি কোন উইল করে গেছেন?
না, আমার তা মনে হয় না।
কেন! তিনি ধনবতী ছিলেন না?
হ্যাঁ, ছিলেন বৈকি, জীবিত অবস্থায় কেবল। ওর বাবা ওর জন্য একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ গচ্ছিত রেখে যান। তবে আসল টাকায় হাত দিতে পারত না ও। ওর মৃত্যুর পর ওর কোন ছেলে-মেয়ে থাকলে সেই ট্রাস্ট্রের টাকা তার প্রাপ্ত হত, আর অপুত্রক হলে পুরো টাকাটাই পিটস্টাউন মিউজিয়ামের অধিকারে চলে যাওয়ার কথা।
টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে পোয়ারো নিজেকে চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন।
তাহলে এক্ষেত্রে আমরা একটা মোটিভ সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। সেই মোটিভটা যে কি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। মানে মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পর কে লাভবান হচ্ছে? এক্ষেত্রে একটি মিউজিয়াম। অন্য দিকে মিসেস লিডনার যদি প্রচুর অর্থ এবং সম্পত্তি রেখে যেতেন, সেক্ষেত্রে একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে আমাকে। আমাকে প্রমাণ করতে হতো সেই অর্থের অধিকারী কে হতেন? আপনি না মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামী? তবে তার প্রাক্তন স্বামীর পক্ষে দাবী প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার, কারণ সেক্ষেত্রে প্রথমেই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে, তিনি একজন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলে। তবে এ অনুমান এক্ষেত্রে খাটে না দুটি কারণে; প্রথম কারণ হল মিসেস লিডনার সে রকম কোন অর্থ কিংবা সম্পত্তি রেখে যাননি। অতএব বর্তমান পরিবেশে স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বামীকে সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এক্ষেত্রে প্রথমেই আপনি প্রমাণ রেখেছেন, গতকাল সেই দুর্ঘটনার সময় আপনি আপনার স্ত্রীর ঘরের সামনে যাননি কখনো, দ্বিতীয়ত স্ত্রীর মৃত্যুতে লাভের চেয়ে লোকসানই হয়েছে আপনার বেশি, এবং তৃতীয়ত
এখানে একটু সময়ের জন্য থামলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলুন তারপর? ডঃ লিডনার তাড়া দিলেন।
আপনার স্বপক্ষে তিন নম্বর যুক্তি হল, পোয়রা তার কথার জের টেনে বলতে থাকেন, কথা-বার্তা শুনে আমার মনে হয়েছে, স্ত্রীকে আপনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, এমন স্ত্রীবৎসল স্বামী তার স্ত্রীকে কখনোই খুন করতে পারে না, এ আমার একান্ত বিশ্বাস ডঃ লিডনার এবং এর জন্য আমি আপনার প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। বলুন, আমার অনুমান ঠিক কিনা?
হ্যাঁ, ডঃ লিডনারের ঠোঁটে বিনয়ের হাসি।
অতএব, পোয়ারো একটু চিন্তা করে বললেন, এই কেসের ব্যাপারে আরো একটু এগুনো যাক।
কেন, এখানে আমরা যা জেনেছি, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? ডঃ রেলি বেশ একটু অধৈর্য হয়েই কথাটা বলে ফেললেন যেন।
পোয়ারো চকিতে তার দিকে ফিরে তাকালেন, ধৈর্য ধরুন ডঃ রেলি, এত ব্যস্ত হবেন না। অসম্পূর্ণ তদন্তে আমি বিশ্বাসী নই। শুধু এই কেসের ব্যাপারেই নয়, যে কোন কেসের ব্যাপারে তুরুপের তাস সহ সম্ভাব্য সমস্ত তাসগুলো আমি আমার টেবিলে হাজির দেখতে চাই, সে যত প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয়ই হোক না কেন। আমি চাই না একটা তাসও আমার দৃষ্টির আড়াল করে রাখা হোক।
পোয়ারোর শেষ কথায় ডঃ লিডনারকে একটু বিস্মিত বলে মনে হল।
বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, কোন কিছুই আমি গোপন করে রাখিনি। যতটুকু জানি, সব আপনাকে বলেছি। আমার বলার আরও কিছুই অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু আমি যদি বলি সব কথা আপনি আমাকে বলেননি?
হ্যাঁ, অবশ্যই বলেছি। আমার মনে হয় না, কোন কথা বাদ পড়ে গেছে।
এই মুহূর্তে ডঃ লিডনারকে কেমন অসহায় বলে মনে হয়।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে বললেন, না, না সব কথা আপনি আমাকে খুলে বলেননি। যেমন ধরুন নার্স লিথেরানকে কেন আপনি নিয়োগ করলেন, বলেছেন সে কথা?
ডঃ লিডনারকে এখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত বলে মনে হল। কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গীতে কোন রকমে তিনি বলেন, তবে তার ব্যাখ্যা আমি করেছি। এটা একান্ত প্রয়োজন ছিল–আমার স্ত্রী স্নায়ুর চাপে ভুগছিল, তাছাড়া ওর ভয় কাটানোর জন্য।
টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়েছিল ডঃ লিডনারের মুখের উপরে। মনে হয় সেই ফাঁকে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন কি ভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবেন। এ যেন প্রাক্ যুদ্ধের প্রস্তুতি।
না, না। এর পরেও এমন একটা ব্যাপার আছে, যেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আপনার স্ত্রী বিপদের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছিলেন, হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে নয়। আর এও সত্যি যে, তাঁকে প্রাণ নাশের ভয় দেখানো হয়েছিল। আর এ সব সত্ত্বেও পুলিশকে আপনি খবর দেন নি, এমন কি আপনি কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের পরামর্শ নেবারও প্রয়োজনবোধ করেননি। কিন্তু নার্সের ব্যবস্থা আপনি কেন যে করতে গেলেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়!
আ–আ–আমি, ডঃ লিডনারের কথা জড়িয়ে যায়। তার মুখের রঙ বদলায়। আমি ভেবেছিলাম- এবার তিনি একেবারে থেমে যান।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এখন সেই কথাতেই আসছি, পোয়ারো তাকে উৎসাহিত করেন, কী, কী ভেবেছিলেন আপনি– ডঃ লিডনার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, আমি জানি না। আমি জানি না।
ইঁদুর ধরবার জন্য ইঁদুরের গর্তের সামনে বিড়াল যেমন, তেমনি ভাবে স্থির চোখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকিয়ে থাকেন পোয়ারো।
তাহলে আপনি আর কী ভাবতে পারেন তখন!
আমি জানি না, বললাম তো, আমি জানি না।
কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন, এবং বেশ ভাল করেই জানেন। হয়তো এ ক্ষেত্রেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। ডঃ লিডনার, সত্যি করে বলুন তো, চিঠিগুলো যে আপনার স্ত্রীই নিজের হাতে লিখতেন, একথা আপনার মনে কখনো সন্দেহ হয়নি?
এরপর ডঃ লিডনারের উত্তর দেবার আর কোন প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। পোয়ারোর অনুমানের মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়েছিল বোধহয়। ডঃ লিডনার তার হাত দুটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে যে ভাবে তুলেছিলেন, তাঁর সেই ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তার নিজের গল্প বলা বোধহয় এখানেই শেষ।
এবার আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম, এই প্রথম। তাহলে আমার অনুমানই ঠিক, ভাবলাম। এই প্রসঙ্গে ডঃ লিডনারের একটি প্রশ্ন আমার মনে পড়ে গেল, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার স্ত্রীর প্রসঙ্গে আমার কী ধারণা? আপন খেয়ালে আমি আমার মাথাটা আস্তে আস্তে দোলাতে গিয়ে দেখি, পোয়ারোর শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার উপরে।
নার্স, আপনিও তো তাই মনে করেন, কেন করেন না?
হ্যাঁ, সত্য কথা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা হয় না, কথাটা আমারও মনে হয়েছিল?
কারণ?
মিঃ কোলম্যান মিসেস লিডনারের হাতে লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখান, সেই চিঠি এবং মিসেস লিডনারকে হুমকি দিয়ে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্যের কথা আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বলি।
ডঃ লিডনারের দিকে ফিরলেন পোয়ারো।
সেই সাদৃশ্য আপনি কী লক্ষ্য করেছিলেন ডঃ লিডনার?
ডঃ লিডনার মাথা নিচু করে বললেন, হ্যাঁ, শুধু একটা নয়, অনেক, অনেক সাদৃশ্য আমি লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে এস, ই অক্ষরগুলো দেখলে মনে হয় সেই চিঠিগুলোর হাতের লেখার সঙ্গে আমার স্ত্রীর হাতের লেখার মধ্যে কোন তফাত নেই; হুবহু এক। তবে আমি হস্তরেখা বিশারদ নই যে জোর করে আমার নিজস্ব ধারণা অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেব। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে পারি যে, সব চিঠিগুলো একই লোকের লেখা। এই
অনিশ্চিত সম্ভাবনার কথা আমাদের মনে অবশ্যই ঠাই দিতে হবে।
তারপর পোয়ারো তার চেয়ারে হেলান দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথায় চিন্তার ছোঁওয়া স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে আমার তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যায়। প্রথমত, হাতের লেখার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। দ্বিতীয়ত, এই হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার পিছনে মিসেস লিডনারের মধ্যে এক দুর্বোধ্য মানসিকতার কারণ আমরা দেখতে পাই। তৃতীয় সম্ভাবনা হল, চিঠিগুলো কেউ হয়তো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে মিসেস লিডনারের হাতের লেখা নকল করে লিখে থাকবে। কিন্তু কেন? এর মধ্যে কোন যুক্তি অবশ্য পাওয়া যায় না। যাইহোক, এই তিনটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি অবশ্যই ঠিক এবং নির্ভুল।
পোয়ারো কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডঃ লিডনার, প্রথম যখন আপনার মনে হল, সেই চিঠিগুলোর লেখিকা মিসেস লিডনার নিজেই, তখন আপনার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া হল বলুন?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই অনুমানটা আমি আমার মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই। কারণ আমার মনে হয়েছিল, আমি যা ভাবছি সেটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
এর কারণ কি আপনি কখনও খুঁজে দেখেছেন?
হ্যাঁ, দেখেছি বৈকি! ডঃ লিডনার একটু ইতস্ততঃ করে বলেন, ইদানিং আমার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হয়েছিল, অত্যাধিক মানসিক চাপে এবং অহেতুক চিন্তা-ভাবনার জন্য হয়তো ও ওর মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে থাকবে সাময়িকভাবে এবং আমার ধারণা সেই সময় –হ্যাঁ, সেই সময়ের মধ্যেই তিনি লিখে থাকবেন। তখন তিনি আর তার মধ্যে ছিলেন না। সম্পূর্ণ অবচেতন মনে লেখা সেই চিঠিগুলো। এটাই সম্ভব তাই না? ডঃ রেলির দিকে ফিরলেন তিনি তার সমর্থন আদায় করার জন্য।
মানুষের মন হেন কাজ নেই যে করতে পারে না। ডঃ রেলি স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাইলেন না।
চিঠিগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্ব আছে। তবে সামগ্রিক ভাবে কেসটার উপরে আমাদের আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে তিনটি সমাধানের পথ আছে। পোয়ারো তার সুচিন্তিত মতামত জানালেন।
তিনটি?
হ্যাঁ, প্রথম সমাধান খুবই সহজ। আপনার স্ত্রীর প্রথম স্বামী এখনো জীবিত। প্রথমে তিনি আপনার স্ত্রীকে হুমকি এবং পরে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলেন একের পর এক। এই সহজ সরল সমাধানের পথটা বেছে নিলে আমাদের সমস্যা হবে খুঁজে দেখা, কি করে তিনি এখানে প্রবেশ করলেন, আর কি ভাবেই বা বেরিয়ে গেলেন কাউকে দেখা না দিয়ে?
দ্বিতীয় সমাধান হল : মিসেস লিডনার নিজেই, কী কারণে কে জানে (এ ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের চেয়ে চিকিৎসাবিদ্ৰা বোধহয় সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবেন) সেই হুমকি দেওয়া চিঠিগুলো লিখতেন। গ্যাস প্রয়োগের প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে তিনি একাই সেই গ্যাসের ঘ্রাণ পেয়েছিলেন তাঁর কথায় আপনি সায় দিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু মিসেস লিডনার যদি নিজেই চিঠিগুলো লিখে থাকেন, সেক্ষেত্রে তার বিপদের সম্ভাবনা কি করে থাকতে পারে? অতএব খুনীর সন্ধানে আমাদের অন্য পথে উঁকি মারতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এক্ষেত্রে আপনার স্টাফদের মধ্যে অনুসন্ধান চালাতে হবে। হ্যাঁ, ডঃ লিডনারের চাপা প্রতিবাদকে অস্বীকার করে পোয়ারো বলতে থাকেন, যুক্তি-তর্কের দিক থেকে–সেটাই একমাত্র সমাধানের পথ বলে মনে হয়। যে তাদের মধ্যে কেউ একজন ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য মিসেস লিডনারকে খুন করে থাকবে। আর সেই ব্যক্তি মনে হয়, চিঠিগুলো সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল এবং সেই চিঠিগুলোর ব্যাপারে মিসেস লিডনারের যে ভয় ছিল, কিম্বা ভয়ের ভান করতেন, সেটা তার জানা ছিল। খুনীর মতে সেই তথ্যটা তার পক্ষে নিরাপদে থাকাটা একটা বিশেষ সহায়ক। সে ভেবেছিল, খুনের দায়টা সে বাইরের পত্র লেখকের ঘাড়ে সহজেই চাপিয়ে দেওয়া যাবে এই ভাবে।
এই সব বিভিন্ন সমাধানের সূত্রগুলো একত্রিত করলে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে খুনী নিজের ওই চিঠিগুলো লিখেছিল মিসেস লিডনারের অতীত ইতিহাস জেনে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভাববার আছে, অপরাধী কেন মিসেস লিডনারের হাতের লেখা নকল করতে গেল? এই ব্যাপারটা এখনো খুব পরিষ্কার নয়। বাইরের কারোর হাতের লেখা হলে এতো চিন্তার প্রয়োজন থাকতো না এবং সেক্ষেত্রে খুনীর বাড়তি সুবিধাও হত। আমাদের সন্দেহ গিয়ে পড়তো বাইরের লোকের উপরে।
তৃতীয় সমাধানের সূত্র আমার মতে সব চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আমার ধারণা চিঠিগুলো নির্ভেজাল এবং সেই চিঠিগুলো লেখা হয় তো মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামী (কিম্বা তার ছোট ভাইয়ের), যিনি প্রকৃতপক্ষে এই এক্সপিডিসনের একজন সদস্য।
.
১৬.
রহস্যময়
ডঃ লিডনার কথাটা শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলেন।
অসম্ভব! এ একেবারে অবাস্তব ধারণা!
মিঃ পোয়ারো শান্ত চোখে তাকালেন তার দিকে, কিন্তু কিছুই বললেন না।
তার মানে আপনি বিশ্বাস করতে বলছেন, আমার স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামী আমাদের এই এক্সপিডিসনের একজন কর্মী এবং আমার স্ত্রী তাকে চিনতে পারেনি?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। অতীতের দিকে একবার ফিরে তাকান। বছর পনের আগে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার স্ত্রী কয়েক মাস বসবাস করেছিলেন। আপনি কী মনে করেন দীর্ঘ পনের বছর পরে আপনার স্ত্রী তাকে চিনতে পারবেন? আমার তো তা মনে হয় না। ভদ্রলোকের মুখের আদল বদলে যেতে পারে, চেহারার বদল হতে পারে। আর মনে রাখবেন, মিসেস লিডনার তার প্রাক্তন স্বামীকে খুঁজব মনে করে কখনো চেষ্টা চালান নি। মিসেস লিডনার তাকে আগন্তুক হিসাবেই গ্রহণ করে থাকবেন হয়তো। না, আমার তো মনে হয় না, তিনি তার প্রাক্তন স্বামীকে চিনতে পেরেছিলেন। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, তার প্রাক্তন স্বামীর ছোট ভাই, ছেলেবেলায় যে তার ভায়ের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিল। এখন তার বয়স বেড়েছে, এখন সে রীতিমত সাবালক। সেদিনকার দশ বার বছরের বালক আজ তিরিশোর্ধ যুবক, আপনার স্ত্রী কী তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন, না পারা সম্ভব? যুবক উইলিয়াম বসনারকে বিশ্বাসঘাতক বলা যায় না বরং তাকে দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে। সে তার দেশ জার্মানির জন্য প্রাণ দিতে পারে। তার চোখে মিসেস লিডনার ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক, সে জানত তার দাদার মৃত্যুর জন্য মিসেস লিডনারই দায়ী। শিশুদের মনে কারোর সম্বন্ধে একবার বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তা আর থামতে চায় না। তারা তখন মরীয়া হয়ে ওঠে প্রতিহিংসা নেবার জন্য। আহত বাঘের মতো শিকারের খোঁজে তারা তখন সাংঘাতিক বেপরোয়া।
খাঁটি কথা, ডঃ রেলি তার মতামত জানাতে গিয়ে বলেন, সাধারণ মানুষের মতামত হল, শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি সব কথা ভুলে যায়, এটা ঠিক নয়। আসলে তাদের সব কিছু ঠিক ঠিক মনে থাকে। প্রতিবাদ করার জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
তার মনে আপনি বলছেন, এখানে দুটি সম্ভাবনা বর্তমান। ফ্রেডরিক বসনার, এখন যার বয়স পঞ্চাশ, এবং ইউলিয়াম বসনার, তিরিশোর্ধ বয়স যার। সম্ভাব্য এই দুই ব্যক্তির কথা খেয়াল রেখে এবার আপনার কর্মচারীদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
বিচিত্র! ডঃ লিডনার বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, আপনার কর্মচারী! আমার নিজের এক্সপিডিসনের সদস্যদের সন্দেহ করব?
–নিশ্চয়ই! প্রত্যুত্তরে পোয়ারো বলেন, কে বলতে পারে, তাদের মধ্যে ফ্রেডরিক কিম্বা উইলিয়াম লুকিয়ে নেই?।
তাহলে মহিলারা বাদ?
হ্যাঁ, আপাততঃ ওদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়। মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডোকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আর কে হতে পারে?
ক্যারি? আমি এবং সে দীর্ঘদিন ধরে এক সঙ্গে কাজ করেছি, এমন কি লুসির সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক আগে থেকে তার সঙ্গে আমার–
তাছাড়া তার বয়সেরও অমিল। আমার মনে হয়, তার বয়স আটত্রিশ কি ঊনত্রিশ, ফ্রেডরিকের থেকে অনেক ছোট, আর উইলিয়ামের থেকে অনেক বেশি বয়স তার। এখন যারা বাকি, তাদের দেখতে হবে। ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিঃ মারকাডো। এঁদের দুজনের মধ্যে যে কেউ একজন নিশ্চয়ই ফেডরিক বসনার।
কিন্তু মঁসিয়ে, ডঃ লিডনার উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, ফাদার ল্যাভিগনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত এপিগ্রাফিস্ট এবং নিউ ইয়র্কের একটি বিখ্যাত মিউজিয়ামে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন মিঃ মারকাডো। আপনার অনুমান মতো তাদের মধ্যে যে কোন একজনকে আমার স্ত্রীর হত্যাকারী ভাবাটা অসম্ভব।
অসম্ভব! অসম্ভব! এ কথা আমি আমার মনের কোথাও স্থান দিতে চাই না। অসম্ভব ব্যাপারের উপরেই আমার ঝোঁক বেশি। সেই অসম্ভব ব্যাপারটা নিয়ে আমার যা কিছু গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অসম্ভবকেই আমি সম্ভবপর করে তুলি। তবে এক্ষেত্রে আমি অবশ্য ওঁদের দুজনের মধ্যেই থেমে থাকতে চাই না। আপনার সদস্যদের মধ্যে আর কে কে আছেন? কার্ল রেইটার বয়সে যুবক, জার্মান নাম, ডেভিড এমাট–
মনে রাখবেন, সে আমার সঙ্গে দুটি সিজন কাজ করছে।
যুবকটির ধৈর্য আছে। যদি সে অপরাধ করে থাকে, ঝটিতি করেনি। ঠাণ্ডা মাথায় অনেক ভেবে চিন্তে খুন করে থাকবে সে।
ডঃ লিডনারের চোখে-মুখে হতাশার ভাব।
আর আমাদের শেষ সন্দেহভাজন ব্যক্তি হলেন উইলিয়াম কোলম্যান। পোয়োররা তার কথার জের টেনে বলেন।
সে একজন ইংলিশম্যান।
জানি। সেই সঙ্গে মিসেস লিডনারের কথাও মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ছেলেটি আমেরিকা থেকে পালিয়ে যায় এবং তার কোন হদিশ পাওয়া যায় না। অতএব তাকে অনায়াসে ইংলন্ডে আনা যায়। আর সেই ভাবেই সে-
উত্তর যেন আপনার মুখে লেগেই আছে! ডঃ লিডনার পরিহাস করে বলেন।
হ্যাঁ, শুরু থেকেই আমি মিঃ কোলম্যানের কথা ভাবছিলাম। তার আচরণ কখনই স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। তার আচরণে কেমন একটা অভিনয়ের ছোঁয়া আমি দেখতে পেয়েছি। সত্যি কি উনি অভিনেতা? নাটক করেন?
ডঃ লিডনার চুপ করে থাকেন।
পোয়ারো সেই ছোট্ট নোটবুকে কলম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আসুন এবার সম্ভাব্য খুনীর নাম নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক। পোয়ারো বলেন, প্রথম পর্যায়ে আমরা দুটি নাম পেয়েছি, ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিঃ মারকাডো। দ্বিতীয় পর্যায় কোলম্যান, এমাট এবং রেইটার। এর ঠিক বিপরীত চিন্তাও আমাদের করতে হবে, দেখতে হবে এ ধরণের অপরাধ করার সুযোগ কার বেশি? একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে থাকেন, দুর্ঘটনার সময় ক্যারি ছিলেন খনন কার্যে ব্যস্ত, কোলম্যান যান হাসানিয়ায়, আপনি নিজে ছিলেন ছাদে, এখন অবশিষ্ট থাকেন ফাদার ল্যাভিগনি, মিঃ মারকাডো, মিসেস মারকাডো, ডেভিড এমাট, কার্ল রেইটার, মিস জনসন এবং সব শেষে নার্স লিথেরান।
ওঃ! আমি আঁতকে উঠলাম,
মিঃ পোয়ারো আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন।
হ্যাঁ, আমার আশঙ্কা, আপনার নামটাও যোগ করা উচিত। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আমার অবাস্তব ভাবনা। না ঠিক তা নয়। আমার ধারণা, কোর্ট ইয়ার্ডে খনন জনশূন্য, চারিদিকে নির্জনতা বিরাজ করছিল, তখন আপনি অনায়াসে মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ করে তাকে খুন করে আসতে পারেন। আপনি ছিলেন তার নার্স, সন্দেহ করার কিছু নেই। আপনার স্বাস্থ্য ভাল, একটা ঘুষির আঘাতে (বস্তুত যা হয়েছিল মিসেস লিডনারের খুন হওয়ার ক্ষেত্রে) অনায়াসে, তাঁকে খতম করে দিতে পারেন।
মিঃ পোয়ারোর কথায় আমি এমন হতাশ হয়ে পড়ি যে, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।
বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো। ডঃ রেলি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, একজন নার্স একের পর এক রুগীকে খুন করে যাচ্ছে।
আমার চোখ দুটো হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে উঠল, সেই জ্বলন্ত চোখে আমি তাকালাম ডঃ রেলির দিকে।
ওদিকে ডঃ লিডনারের মনে তখন অন্য চিন্তা, অন্য ভাবনা।
মঁসিয়ে পোয়ারো, এমাট নয়, ডঃ লিডনার বাধা দিয়ে বললেন, আপনার সন্দেহের তালিকা থেকে তার নামটা বাদ দিয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন, সেই অভিশপ্ত দশ মিনিট সময় সে আমার সঙ্গে ছাদে ছিল।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত ডঃ লিডনার, কোন মতেই আমি তাঁর নাম আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি না। অনায়াসে তিনি নিচে নেমে এসে মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ করতে পারেন এবং নিঃশব্দে তাঁকে খুন করে চলে যেতে পারেন। তারপর বয়কে ডাকতে পারেন। কিংবা এমন হতে পারে যে, বয়কে কাজের অছিলায় আমার কাছে ছাদে পাঠিয়ে, সেই ফাঁকে মিসেস লিডনারকে খুন করে আবার তিনি তার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছিলেন।
ডঃ লিডনার সজোরে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, আমি কী তবে দুঃস্বপ্ন দেখছি? বিচিত্র অনুমান আপনার।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো বললেন, বিচিত্র নয় ডঃ লিডনার, হ্যাঁ, এটা খুবই সত্য। এ এক বিচিত্র খুনই বটে। সাধারণতঃ খুন জিনিসটা অতি জঘন্য, অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। কিন্তু এ যেন এক বিচিত্র খুন। ডঃ লিডনার, আমার সন্দেহ হয়, আপনার স্ত্রী ছিলেন এক অস্বাভাবিক মহিলা।
কথাটা কি ঠিক নার্স? ডঃ লিডনার শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ওঁকে বলে দাও লুসি মানুষ হিসাবে কি রকম ছিল। তোমার কাছ থেকেই আমি নিরপেক্ষ বিচার আশা করি।
খোলাখুলি ভাবেই আমি বললাম, চমৎকার মহিলা ছিলেন উনি। তোষামোদ করে ওঁর মন জয় করা যেত না। ওঁর মতন সুন্দর মহিলা এর আগে আমি কখনো দেখিনি।
ধন্যবাদ, ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বাইরের লোকের কাছ থেকে পাওয়া এ এক মূল্যবান পরিচয় পত্র। মার্জিত সুরে বললেন পোয়ারো, যাইহোক, ধরে নেওয়া যাক, আমার তৃতীয় অনুমানটাই ঠিক। তার মানে খুনী হয় ফ্রেডরিক, না হয় উইলিয়াম বসনার। আর এই ফ্রেডরিক কিম্বা উইলিয়াম আপনার এক্সপিডিসনেরই একজন সদস্য। আমার সন্দেহের তালিকা সংকুচিত করে চারজনের তালিকা তৈরি করতে পারি। এই চারজন হলেন, ফাদার ল্যাভিগনি, মিঃ মারকাডো, কার্ল রেইটার এবং ডেভিড এমাট।
ফাদার ল্যাভিগনি প্রশ্নাতীত, ডঃ লিডনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি এমন জঘন্য কাজ কিছুতেই করতে পারেন না। এবং তাঁর দাড়ি খাঁটি, নকল নয়! তার সমর্থনে আমি বললাম।
প্রথম শ্রেণির খুনীরা কখনো নকল দাড়ি ব্যবহার করে না। পোয়ারো উত্তরটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
আপনি কী করে বুঝলেন? সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, খুনী প্রথম শ্রেণির?
তা না হলে সমস্ত ব্যাপারটাই জোলো হয়ে যেত। কেসটা এত জটিল হয়ে উঠত না।
এ যেন পুরোপুরি বুদ্ধির খেলা, মনে মনে আমি ভাবলাম।
যাইহোক, দাড়ির প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে আমি বললাম, দাড়ি গজাতে বেশ কিছু সময় নিশ্চয়ই লেগেছিল?।
এটা একটা বাস্তব পর্যবেক্ষণ, পোয়ারো মন্তব্য করেন।
ওদিকে ডঃ লিডনারের কথায় উত্তেজনা প্রকাশ পায়, কিন্তু এ অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। তিনি এবং মারকাডো দুজনেই অতি পরিচিত ব্যক্তি, আর সে পরিচয় দীর্ঘদিনের।
চকিতে ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
আপনাকে ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে আপনি আমল দিতে চাইছেন না। ফ্রেডরিক বসনার যদি মৃতই না হয়, তাহলে এতদিন সে কী করছিলেন? নিশ্চয়ই সে নাম ভঁড়িয়েছে?
আমার মতামত যদি জানতে চান, ডঃ রেলি তাদের আলোচনায় বাধা দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে কার্ল রেইটারের নামটাই যথার্থ এবং আইনত ন্যায়সঙ্গতও বলা যেতে পারে। বয়সে তরুণ, উইলিয়াম বসনারের বয়সের সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে তার। তাছাড়া জার্মান নাম তার। এ বছরই সে প্রথম এসেছে এবং মিসেস লিডনারের ঘরের কাছেই তার ঘর, সুযোগটা বেশি তারই ছিল। কোর্টইয়ার্ডে উল্টোদিকে তার ঘর। ফটোগ্রাফার সে। যদি কেউ বলে যে তার ঘরে তাকে দেখা যায় নি দুর্ঘটনার সময়, জবাব তার মুখেই লেগে থাকার কথা,–অনায়াসে সে বলতে পারবে, সে তখন ডার্করুমে ছিল। জানি না এই যুবকটি আপনার সন্দেহের আওতায় আসে কি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে, তাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকায় তার নাম প্রথমেই লিখতে পারেন।
পোয়ারো তেমন আগ্রহ দেখাল না এ ব্যাপারে। মাথা নেড়ে সায় দিল বটে সে, তবে কেমন দায়সারা গোছের যেন।
হ্যাঁ, তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে তাকে সন্দেহ করাটা ন্যায় সঙ্গত হলেও প্রমাণ করাটা কিন্তু খুব সহজ ব্যাপার নয়। তারপর তিনি একটু থেমে বলেন, এখন আর কোন কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি এখন নিহত মিসেস লিডনারের ঘরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
নিশ্চয়ই! ডঃ লিডনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডঃ রেলির দিকে ফিরে তাকালেন, ঘরের চাবি তো ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের কাছে।
মেটল্যান্ড চাবিটা আমাকে দিয়ে গেছেন। ডঃ রেলি বললেন সেই কুরডিশের ব্যাপারে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। অতঃপর চাবিটা এগিয়ে দেন ডঃ রেলি।
পোয়ারোর হাতে চাবিটা তুলে দিতে গেলে ডঃ লিড়নারকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হয় যেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার সঙ্গে আমি যেতে পারছি না, সম্ভবত নার্স
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনাকে আমি অযথা বিরক্ত করব না। তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যদি আমাকে একট সঙ্গ দেন-
নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
.
১৭.
ওয়্যাশস্ট্যান্ডে রক্তের দাগ
পোস্টমর্টেমের জন্য মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ইতিমধ্যে হাসানিয়েয় চালান করা হয়েছিল। তবে তার ঘরের হেরফের কিছুই হয়নি, যেমনটি আগে ছিল, এখনো ঠিক তেমনি আছে। ঘরটা এতই ছোট যে, ঘুরে দেখার জন্য খুব বেশি সময় লাগেনি পুলিশের।
দরজার ডানদিকে বিছানা। দরজার ঠিক বিপরীত দিকে শহরমুখী গরাদ-বিহীন দুটি জানালা। মাঝ বরাবর ওক কাঠের টেবিল, ড্রেসিংটেবল হিসাবে ব্যবহার করতেন মিসেস লিডনার, সংলগ্ন দুটি ড্রয়ারে তার প্রসাধন সামগ্রী থাকত। পূবদিকের দেওয়ালের বুকে ঝুলছিল সারি সারি পোশাক। দরজার ঠিক বাঁদিকে কাপড় রাখার স্ট্যান্ড। ঘরের ঠিক মাঝখানে ওক কাঠের একটা টেবিল শোভা পাচ্ছিল। টেবিলের উপরে লেখার সরঞ্জাম ও একটি এ্যাটাচি কেস। মিসেস লিডনার সেই অভিশপ্ত চিঠিগুলো ওই এ্যাটাচি কেসের ভিতরে চালান করে দেন। পর্দাগুলো মামুলি ধরনের। পাথরের মেঝের উপরে ছাগলের কার্পেট বিছানো।
ঘরের মধ্যে কাপবোর্ড কিংবা আড়াল করার মত কোন জিনিস বড় একটা চোখে পড়ে না। বিছানায় সস্তা দামের সুতির তোশক। দামী শয্যা সামগ্রী বলতে তেমন কিছুই ছিল না, কেবল দামী তিনটি বালিশ ছাড়া।
মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ঠিক কোথায় পাওয়া যায় বোঝাতে গিয়ে অল্প কথায় ডঃ রেলি যেন অনেক কিছুই বলে গেলেন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আমাকে ইশারায় এগিয়ে আসতে বললেন।
দুর্ঘটনার পর আমি যা, দেখেছি তার অনুরূপ বর্ণনা আমি সংক্ষেপে বললাম। ডঃ রেলি আমাকে তার সাধ্য মত সাহায্য করলেন।
ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর অমন অবস্থা দেখে মাথাটা তুলে ধরেন, ডঃ রেলি বলেন, তবু আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিসেস লিডনারের মৃতদেহ যেখানে যে অবস্থায় তিনি প্রথম দেখতে পান সেখানেই আছে, নাকি সরিয়েছেন? ওঁর কথার হাবভাব এবং পরিবেশ দেখে আমার মনে হয়েছিল, মৃতদেহ উনি সরাননি।
মনে হয় মিসেস লিডনার তখন বিছানায় শুয়েছিলেন, পোয়ারো তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন, হয়তো তিনি তখন ঘুমুচ্ছিলেন, কিংবা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেই সময় কেউ দরজা খুলে থাকবে, তাকে দেখে তিনি হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে যান এবং তখনই আততায়ী নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হেনে থাকবেন, পোয়ারো কথাটা শেষ করলেন, সেই একটা ঘুষির আঘাতেই মিসেস লিডনার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে থাকবেন এবং একটু পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দেখুন-
অতঃপর মিসেস লিডনারের আঘাতের বিশদ বিবরণ দিলেন ডঃ রেলি।
তাহলে খুব একটা বেশি রক্ত পড়েনি? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও মনে হয় ব্রেনের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে থাকবে।
তাহলে এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুটা সরাসরিই ঘটে থাকবে, তবে একটা ব্যাপারে কেমন খটকা লাগছে। আততায়ী যদি আগন্তুক, মানে মিসেস লিডনারের অপরিচিতই হয়ে থাকবে, তাহলে তিনি কেন সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেন না। চিৎকার করলে নার্স লিথেরান, এমাট এবং পটবয় নিশ্চয়ই শুনতে পেতো।
তা এর উত্তর তো খুবই সহজ, ডঃ রেলি শুকনো গলায় বলেন, কারণ সে আগন্তুক ছিল না।
হু, গভীর ভাবে চিন্তা করে পোয়ারো বলেন, তিনি হয়তো লোকটিকে দেখে একটু অবাক হয়ে থাকবেন, কিন্তু ভয় পাননি। তারপর সে তার মাথায় অতর্কিতে আঘাত করলে তিনি হয়তো অস্ফুটে চিৎকার করে থাকবেন, কিন্তু তখন অনেক, অনেক দেরি হয়ে যায়।
তবু সেই অস্ফুট চিৎকার মিস জনসন শুনতে পায়।
এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। কারণ এমন মোটা দেওয়াল বিশেষ করে বন্ধ জানালা পেরিয়ে মিস জনসন কি করে তার অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন জানি না?
মিসেস লিডনারের বিছানার দিকে এগিয়ে যান পোয়ারো।
আপনি কী তাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে যান? পোয়ারো এবার আমার উদ্দেশ্যে তার প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন।
জীবিত অবস্থায় মিসেস লিডনারকে আমি ঠিক কি অবস্থায় দেখে যাই, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি তাকে দিলাম। তাকে আমি দু খানি বই দিয়ে যাই। মনে হয় বই পড়তে পড়তে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। হা, তখন তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে আমার নজর এড়াতে না নিশ্চয়ই।
আমার কথাগুলো পোয়ারো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর তিনি তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করলেন ঘরের চারিদিকে।
আর খুনের পর ঘরে ঢুকে আপনি কী আগের মতোই সব ঠিক ঠিক দেখেছিলেন এখানে?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলি, আমার মনে হয় না, ঘরের মধ্যে কোন তফাৎ আমার চোখে পড়েনি।
এই ধরুন, যেমন কোন অস্ত্র, যা দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছিল?
না।
ডঃ রেলির দিকে তাকালেন পোয়ারো। এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত ডঃ রেলি?
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন।
খুব শক্তিশালী কোন একটা বস্তু হতে পারে। তবে খুব একটা ধারালো নয়। এই যেমন, স্ট্যাচুর মতো কিছু একটা বস্তু। মনে রাখবেন, আমার এই অনুমানটা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি না, কিন্তু এ ধরনের অস্ত্রের কথাই আমি বলতে চাইছি। মনে হয়, সেই বস্তু দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়ে থাকবে।
একজন বলিষ্ঠ মানুষের ঘুষির আঘাত? একজন মানুষের কালো হাত?
হ্যাঁ, তা না হলে—
তা না হলে কী?
ডঃ রেলি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, মনে হয় মিসেস লিডনার নতজানু হয়ে বসেছিলেন, উপর থেকে ঘুষির আঘাতে তেমন প্রচণ্ডতা না থাকলেও এক আঘাতেই তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
নতজানু হয়ে বসেছিলেন, পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন, হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়
হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক, ডঃ রেলি নিজেকে সমর্থন করে বলেন, এ ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবা যায় না।
হয়তো সম্ভব।
হুঁ, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করে দেখলে মনে হবে, এটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন, এবং নতজানু হতে বাধ্য হন। তখনো তিনি জানতেন না যে, তিনি খুন হতে যাচ্ছেন। কিন্তু সম্বিৎ যখন ফিরে পেলেন তখন আর ফেরবার পথ ছিল না।
হ্যাঁ, পোয়ারোকে রীতিমত চিন্তান্বিত বলে মনে হল। এটা অনুমেয় বটে।
কিন্তু সেই ধারণাটা বড়ই দুর্বল বলে আমার মনে হল। আমি ভাবতেই পারি না, মিসেস লিডনার কারোর কথায় কিম্বা ভয়ে নতজানু হয়ে বসে থাকতে পারেন।
পোয়ারো জানালা দুটির সামনে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সেই পথে মাথা গলানো যেখানে মুশকিল সেখান দিয়ে আততায়ীর পক্ষে পালানো একরকম অসম্ভব ব্যাপারই বটে। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটার সময় জানালাগুলো বন্ধ ছিল বলেই তাকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ এবং প্রস্থানের একটি মাত্রই পথ হল দরজা। আর সেই দরজার সামনে আসা একটি মাত্র পথ হল কোর্টইয়ার্ড এবং সেই কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করতে হলে খিলান পথ দিয়ে আসতে হবে। সেই খিলান পথের বাহিরে তখন পাঁচজন কর্মচারী আড্ডা দিচ্ছিলেন এবং তারা সবাই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছে। পোয়ারো মনে করেন, তারা মিথ্যা বলেনি বা তারা কখনোই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। কিম্বা ঘুষ দিয়ে তাদের মুখও বন্ধ করা হয়নি। অতএব খুনী এখানে এঁদের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
আমি কোন কথা বললাম না। গোল টেবিলের বৈঠকে আমরা যখন আটক হয়ে পড়ি কথাটা তখনি আমার মনে উদয় হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি।
পোয়ারো নিঃশব্দে কখন যে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একজন বয়স্ক লোকের ফটো বার করে নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন আমরা কেউ খেয়াল করিনি। বয়স্ক লোকটির মুখে ছাগলের মতো সাদা দাড়ি। আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন পোয়ারো।
ফটোটা মিসেস লিডনারের বাবার, প্রত্যুত্তরে আমি বলি, উনি আমাকে সেরকমই বলেছিলেন।
ফটোটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর ছড়ানো প্রসাধন সামগ্রীগুলো এক নজরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সাধারণ প্রসাধন, তবে গুণগত বিচারে বেশ ভাল। তারপর বুকসেলে রাখা বইগুলোর নাম জোরে জোরে পড়তে থাকলেন।
হুঁ, ওয়ার দ্যা গ্রীজ? ইনট্রোডকশনস টু রিলেটিভিটি। লাইফ অফ লেডি হেস্টার স্ট্যানহোপ। ফ্রিউ টেন। ব্যাক টু মেথুমেলা। লিন্ডা কনডন। হ্যাঁ, এই বইগুলো যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনাদের মিসেস লিডনার বোকা ছিলেন না।
ও হ্যাঁ। অত্যন্ত, বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন তিনি, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, সাধারণ মহিলা ছিলেন না তিনি।
তার দৃষ্টি আমার দিকে, ঠোঁটে হাসি।
না, সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম।
কথা বলতে বলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়্যাশস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে থামলেন পোয়ারো। সেখানে সারি সারি বোতল সাজানো, সেই সঙ্গে টয়েলেট ক্রীম। তারপর হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে কম্বলটা পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন তিনি।
ডঃ রেলি এবং আমি দ্রুত তার কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তখন সেই কম্বলের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের দাগটা লক্ষ্য করছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেই দাগটার প্রতি ডঃ রেলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের কী মনে হয়, ওটা রক্তের দাগ?
ডঃ রেলির নতজানু হয়ে বসলেন, হতে পারে, তবে আপনি চাইলে আমি পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
আপনি যদি দয়া করে ।
তারপর পোয়ারো জাগ এবং বেসিনটা ভাল করে পরীক্ষা করতে থাকলেন। ওয়্যাশস্ট্যান্ডের পাশে পড়ে ছিল জাগটা। ফাঁকা বেসিন। তবে ওয়্যাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা নোংরা জল ভর্তি কেরোসিন টিন পড়ে থাকতে দেখা গেল।
আমার দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
নার্স, আপনার মনে আছে। আপনি যখন মিসেস লিডনারের ঘর ছেড়ে যান তখন এই জাগটা বেসিনের বাইরে না উপরে রাখা ছিল?
ঠিক খেয়াল করতে পারছি না, মিনিট দুই পরে কি ভেবে বললাম, তবে মনে হয়, ওটা বেসিনের উপরেই ছিল। লাঞ্চের পর পরিচারকরা বেসিনের উপরেই ওটা রেখে গিয়ে থাকবে হয়তো। না থাকলে আমার দৃষ্টি এড়াতো না। তবে এ সবই আমার অনুমান মাত্র। বুঝলেন?
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। এ সবই আপনার হাসপাতাল থেকে পাওয়া ট্রেনিং-এর ফসল। রুগীদের প্রতিটি ব্যবহৃত জিনিসের উপরে আপনার সজাগ দৃষ্টি থাকে, এদিক ওদিক হবার উপায় নেই। যাইহোক, এবার বলুন খুনের পর কী দেখেছিলেন? এখন যেমনটি দেখছেন ঠিক তেমনি?
সঙ্গে সঙ্গে আমি মাথা দোলাই।
তখন আমি লক্ষ্য করিনি, উত্তরে আমি বলি, তখন আমার লক্ষ্য ছিল আততায়ী পালালো কোথায়? ঘরের মধ্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের লুকানোর মত জায়গা কোথায় থাকতে পারে? আমার আর একটা দেখার ছিল, খুনী তার ব্যবহৃত কোন জিনিস ভুলে ফেলে গেছে কিনা।
হ্যাঁ, এটা রক্তেরই দাগ বটে। ডঃ রেলি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
পোয়ারোর পিঙ্গল চোখে ভ্রুকুটি, মেজাজটা হঠাৎ যেন একটু খিটখিটে হয়ে যায়।
আমি বলতে পারি না। কি করেই তা বলব আমি? হয়তো, আদৌ এর কোন সম্পর্ক নেই মিসেস লিডনারের খুনের সঙ্গে। তবে আমি বলতে পারি যে, এ সবই আমার অনুমান। সেই অনুমানের উপরে ভিত করেই বলতে পারি, খুনী হয়তো তাকে স্পর্শ করে থাকতে পারে এবং তার হাতে হয়তো সেই কারণে একটু আধটু রক্ত লেগে থাকবে, তবু রক্ত রক্তই এবং সেই রক্ত মুছে ফেলবার জন্যই এই ওয়্যাশস্ট্যান্ডে তার আসা, হ্যাঁ এ রকমই একটা কিছু ঘটে থাকবে। তবে তাই বলে এই নয় যে, এ ব্যাপারে তাড়াতাড়ি আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। এমনও তো হতে পারে, ওই রক্তের দাগের সঙ্গে এই কেসের কোনও সম্পর্কই নেই।
খুব সামান্য রক্ত, ডঃ রেলি মন্তব্য করেন, মনে হয় নিহত মিসেস লিডনারের ক্ষত স্থানের রক্ত সেটা অবশ্য আততায়ী যদি সেই ক্ষত স্থানে হাত দিয়ে থাকে, তবেই রক্তের দাগ এখানে লাগতে পারে।
হঠাৎ আমার শরীরটা কেঁপে উঠল ভয়ে, বিস্ময়ে। একটা বিশ্রী কুৎসিত চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটি মুখের ছবি, মনে হয় সেই ফটোগ্রাফারের মুখ, প্রথমে মিসেস লিডনারকে খুন করে সে, তারপর তার ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে দেখতে যায় ক্ষতের গভীরতা এবং সম্ভবতঃ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে তার মুখের রঙ বদলে যায়, পাগলের মত ছুটে যায় ওয়্যাশস্ট্যান্ডের দিকে।
ডঃ রেলির চোখে আমার কাপনের ছায়া পড়েছিল বোধহয়।
কী ব্যাপার নার্স জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
কিছু নয়, হঠাৎ গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল, এই আর কি!
ডঃ পোয়ারো আমার দিকে তাকায়। তার চোখে কৌতূহল।
আমি জানি আপনার কি প্রয়োজন। পোয়ারো বলতে থাকেন, আমাদের এখানকার কাজ আপাততঃ শেষ। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাসানিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ভাবছি আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। তার আগে ডাক্তার, নার্স লিথেরানকে আপনি
আনন্দ মানে একটু সুখ!
না, না ডাক্তার, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম। ও সব কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না।
বন্ধুর মতো আমার পিঠের উপরে আলতো করে একটা টোকা মারলেন পোয়ারো। একেবারে ব্রিটিশ কায়দায়, বিদেশীদের মতো নয়।
ম্যাডাম, আপনি যা বলবেন তাই হবে। পোয়ারো এবার তার কাজের প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। আপনাকে সঙ্গে পেলে আমার খুব উপকার হয়। এমন কতকগুলো কথা আছে, সব জায়গায়, সবার সামনে বলা যায় না। ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে বলতে গেলে একরকম দেবদেবীর চোখে দেখতেন, তাঁকে সময় সময় পুজোও করতেন এবং তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন, তাঁর মতো অন্য সবাই তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। মানুষের মন না মতিভ্রম, ভুল-ভ্রান্তি, এই নিয়েই তো মানুষের জীবন। তাই আমি এ ব্যাপারে বিশেষ করে মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে একান্তে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। আপনার মতে ভদ্রমহিলা কেমন ছিলেন, সেটা আমার আগে জানতে হবে। হাসানিয়েয় গিয়ে এ নিয়ে আপনার সঙ্গে বিশদ ভাবে আলোচনা করতে চাই।
আমার মনে হয়, একটু ইতস্ততঃ করে আমি বলি, এই অবস্থায় এখান থেকে চলে গেলে এখানকার সবাই সেটা খুব একটা ভাল চোখে দেখবেন না।
তাতে কি হয়েছে, দু-একদিনে কিছু এসে যায় না, পোয়ারোর হয়ে ডঃ রেলি বলেন, মিসেস লিডনারকে কবর দেবার আগে তো আর আপনি যেতে পারছেন না।
তা অবশ্য ঠিক, আমার পরবর্তী প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত ধরনের হল, ধরুন, আমিও যদি খুন হই?
কথাটা আমি বললাম ঠাট্টার ছলে, এবং ডঃ রেলিও হাল্কা ভাবে গ্রহণ করলেন সেটা। কিন্তু পোয়ারো আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত মুখ নেড়ে বললেন নাটকীয় ভঙ্গিতে।
আঃ, তাই যদি হয়, অস্ফুট কণ্ঠস্বর, বিপদ, হা, মহা বিপদ, তাই যদি হয় তাতে কার কী করার থাকতে পারে? কতক্ষণ বা একজনকে চোখে চোখে রাখা যায়?
কেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি বললাম, আমি তো ঠাট্টা করেই কথাটা বলেছিলাম, আপনার কথা সত্যি ধরে নিলে স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে, কে, কে আমাকে খুন করতে পারে?
শুধু আপনি কেন, অন্য কেউও খুন হতে পারেন, পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে গভীর প্রত্যয়ের ছাপ। জানি না, তাঁর এ কথা বলার কি অর্থ থাকতে পারে।
কিন্তু কেন? কেন আমরা যে কেউ খুন হতে পারি? আমার মধ্যে কেমন একটা জিদ চেপে গেল, পোয়ারোর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ আমাকে জানতেই হবে।
আমার দিকে সরাসরি তাকালেন পোয়ারো।
আমি ঠাট্টা করছিলাম, পোয়ারো বললেন, কিন্তু এমন এক একটা ব্যাপার আছে, যা নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলে না। আমি আমার পেশাদার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, খুন করা মানুষের একটা স্বভাব……..
.
১৮.
ডঃ রেলির বাড়িতে চায়ের আসর
ফিরে যাবার আগে এক্সপিডিসন হাউস এবং তার চারপাশ একবার ঘুরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায় পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুললেন না তিনি। তবে পোয়ারোর প্রশ্নগুলো ইংরিজি থেকে আরবী ভাষায় এবং পরিচারকদের উত্তরগুলো আরবী থেকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে দিলেন ডঃ রেলি। প্রশ্নগুলো সেই আগন্তুককে ঘিরে, যাকে মিসেস লিডনার, আমি এবং ফাদার ল্যাভিগনি দেখেছিলাম জানালা পথে।
আপনার কি ধারণা সেই আগন্তুকের কোন প্রয়োজন হতে পারে এই কেসের ব্যাপারে? হাসানিয়ের যাবার পথে ডঃ রেলি জানতে চাইলেন পোয়ারোর কাছ থেকে।
পোয়ারোর উত্তর, সবরকম খবর সংগ্রহ করে রাখাই হল আমার কাজ।
পোয়ারোর এই কাজের পদ্ধতিটা আমার খুব ভাল লাগল। দেখলাম, সত্য ঘটনা থেকে শুরু করে খোশগল্প কথা, কোন কিছুই বাদ দিলেন না, খুব মন দিয়ে তিনি তাঁর নোটবুকে লিপিবদ্ধ করলেন প্রশ্নোত্তরগুলো।
স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ডঃ রেলির বাড়িতে চা খুব ভাল লাগল, অনেকক্ষণ থেকে এর অভাব বোধ করছিলাম। লক্ষ্য করলাম পোয়ারো যেন একটু বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন, এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি।
চায়ের চামচটা রাখতে গিয়ে পোয়ারো বললেন, এখন আমরা খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করতে পারি, কেন পারিনা? আমরা এখন মনস্থির করতে পারি, এই অপরাধ কে বা কারা করতে পারে?
ল্যাভিগনি, মারকাডো, এমাট কিংবা রেইটার? ডঃ রেলি জিজ্ঞাসা করলেন।
না, না, ওটা তো সেই তিন নম্বর থিয়োরি। আমি এখন দু নম্বর থিয়োরির উপরে মনোনিবেশ করতে চাই। মিসেস লিডনারের সেই রহস্যময় স্বামী কিংবা তার দেওরের প্রসঙ্গ এখানে ভোলা থাক। এখন আসুন এই এক্সপিডিসন হাউসে দেখা যাক মিসেস লিডনারকে খুন করার সুযোগ কার সব থেকে বেশি ছিল এবং সম্ভাব্য খুনী কে হতে পারে? আমার মনে হয়, পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, এই এক্সপিডিসনের সদস্যদের মধ্যে কে তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়ে ডঃ লিডনারের সামনে আলোচনা করলে কেমন হয়? মনে হয় তাতে খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আর একটা কথা বলে রাখি এ প্রসঙ্গে, তার স্ত্রী সবার শ্রদ্ধেয় ছিলেন এবং এখানকার সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো, বিতর্কিত প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি রাখতে চাই।
হ্যাঁ, আমরা এখানে ভাবানুবেগের কোনও প্রশ্রয় দেব না। ডঃ রেলি বলেন, আমাদের বিচার হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, অন্য কারোর মতামতকে আমরা কোন পাত্তা দেব না। এ ব্যাপারে আশাকরি নার্স লিথেরান আমাদের সাহায্য করবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উনি একজন ভাল পর্যবেক্ষক।
না, না ও ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম।
আসুন মাদাম, ডঃ রেলির হয়ে পোয়ারো বলেন, আপনাকে কিছু জানতে হবে না, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, এখন বলুন, মিসেস লিডনারের প্রতি এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যদের কার কী রকম মনোভাব ছিল?
কিন্তু মিঃ পোয়ারো, আমি তো মাত্র এক সপ্তাহ হল এখানে এসেছি
আপনি বুদ্ধিমতী, তার ওপর নার্স, রুগীর নাড়ি টিপলেই বুঝতে পারেন, মাত্র এক সপ্তাহ তো সেদিক থেকে অনেক দীর্ঘ সময়। পোয়ারো মৃদু হেসে বলেন, আসুন, এবার প্রথম থেকে শুরু করা যাক। সবার আগে ফাদার ল্যাভিগনির নাম নেওয়া যাক।
ঠিক আছে, তবে সত্যি কথা বলতে কি ওঁর ব্যাপারে আমি তেমন কিছুই জানি না। তাছাড়া ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিসেস লিডনার বেশির ভাগ সময়ে ফরাসী ভাষায় কথা বলতেন। আর ফরাসী ভাষা খুব একটা ভাল আমার জানা নেই, ছেলেবেলায় স্কুলে কিছুদিন ক্লাস করেছিলাম। তাতে বুঝতে পারি, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বইপত্তর।
তাহলে বলতে পারেন, জুটি হিসাবে ওঁরা মন্দ ছিলেন না।
হ্যাঁ, আপনি তা মনে করতে পারেন, আমি তাকে বললাম, কিন্তু আমার যতদূর ধারণা, ফাদার ল্যাভিগনি মিসেস লিডনারের ব্যাপারে শেষ দিকে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, বলা যেতে পারে, ওঁকে নিয়ে তিনি মহা সমস্যায় পড়েছিলেন। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
তারপর আমি তাকে ফাদার ল্যাভিগনির সঙ্গে আমার কি কথাবার্তা হয়েছিল সব বললাম সবিস্তারে। আর এও বললাম, ফাদার ল্যাভিগনির মতে মিসেস লিডনার নাকি একজন বিপজ্জনক মহিলা।
বিপজ্জনক মহিলা? পোয়ারো চমকে উঠলেন, ফাদার ল্যাভিগনি বলেছেন এই কথা? দারুণ মজার ব্যাপার তো। পোয়ারো নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন, তার মুখের ভাব দেখে মনে হল, তিনি যেন কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। আর মিসেস লিডনার তার সম্বন্ধে কিছু কি বলেছিলেন?
সেটা বলা খুবই শক্ত। মিসেস লিডনারের মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারিনি আমি। তবে–
তবে কী?
একদিন তার স্বামীকে বলতে শুনেছিলাম, ফাদার ল্যাভিগনির মতো যাজক তিনি নাকি এর আগে কখনো দেখেননি।
দেখছি ফাদার ল্যাভিগনির জন্য একটা বড় মাপের শনের দড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, ডঃ রেলি ঠাট্টা করে বললেন।
প্রিয় বন্ধু, পোয়ারো কপট দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আপনার কী ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে? আমি জানি, আপনি একজন চিকিৎসক, তাই খুব বেশি সময় আমি নেব না। তবে একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আমার কতকগুলো জরুরী কথা আছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় আর একবার চায়ের ব্যবস্থা হলে খুব ভাল হয়।
এক প্লেট স্যান্ডউইচ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পোয়ারো তার স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বললেন, এগুলো খেয়ে নিন। খেতে খেতে আলোচনা করব।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, পোয়ারো কথার জের টেনে বলতে থাকেন, আপনার কী মনে হয়, মানে কারা কারা মিসেস লিডনারকে পছন্দ করত বলে আপনার মনে হয় নার্স?
বলছি, তবে আগেই বলে রাখছি, এ আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাস্তবের সঙ্গে এর মিল নাও থাকতে পারে। তবু বলছি এই কারণে যে খবরটা আপনার তদন্তের কাজে হয়তো সুবিধা হতে পারে। জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার যতদূর ধারণা, মিসেস মারকাডো ভীষণ ঘৃণা করতেন মিসেস লিডনারকে।
আর মিঃ মারকাডো?
তার মনোভাব একটু নরম ছিল, আমি তাকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিলাম, তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন মহিলা তার প্রতি বড় একটা নজর দেয় না। আর মিসেস লিডনার-এর ওই এক স্বভাব ছিল, যে কোন লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতেন, তার কাছে সবাই সমান আলাদা করে কাউকে বিশেষ ভাবে ভাবতেন না।
আর মিসেস মারকাডো হলেন তার ঠিক বিপরীত চরিত্র, কী বলেন?
তিনি ঠিক কি রকম ছিলেন জানি না, তবে আর পাঁচটা মেয়ের মতো তাঁর স্বামীর বান্ধবী কিংবা স্নেহভাজন মহিলার প্রতি তার হিংসা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, মিসেস মারকাডোর সঙ্গে কথা বলার সময় ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর প্রসঙ্গটা যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তা না হলে–
আপনি যা বলতে চাইছেন, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। অতএব ধরে নিতে পারি, মিসেস লিডনারের প্রতি মিসেস মারকাভোর হিংসা ছিল এবং তাকে তিনি ঘৃণা করতেন।
কিন্তু তাই বলে তিনি যে খুন করতে পারেন, ওই কথা স্বপ্নেও আমি কখনো ভাবিনি। ওঃ ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। মিঃ পোয়ারো, ও কথা আমি ভাবিনি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়!
না, না আমি বুঝতে পারি সব। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল। পোয়ারো তার বক্তব্য শুধরে নিয়ে বললেন, মিসেস মারকাভোর তখন শত্রুতাচরণের ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়, মিসেস লিডনার চিন্তিত ছিলেন?
না, আমার তো মনেই হয় না, আদৌ তিনি চিন্তিত ছিলেন। এমন কি মিসেস মারকাডো যে তার সঙ্গে শত্রুর মতো ব্যবহার করতেন, সে খবরও বোধহয় তার জানা ছিল না। এক এক সময় আমি ভেবেছি, তাকে সব খুলে বলি, সাবধান করে দিই। পরে আবার ভেবেছি, দু দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই চুপ করেছিলাম।
এ আপনার বুদ্ধিরই পরিচয় মাদাম। কি যেন চিন্তা করে পোয়ারো বললেন, তাহলে উনিই মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন? আচ্ছা, খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আপনার দিকে কী চোখে তাকিয়েছিলেন বলুন তো? মানে, ওঁর বলার আগে আপনি অন্য কারোর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনেছিলেন কিনা, সেটা যাচাই করতে
আপনি কী মনে করেন, সত্যিই সেই ব্যাপারটার সত্যতা সম্বন্ধে উনি নিঃসন্দেহে ছিলেন?
অসম্ভব কিছু নয়। হয়তো চিঠিগুলো তিনি নিজের হাতেই লিখে থাকবেন।
আমারও তাই ধারণা। মনে হয় প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য অমন অপ্রিয় কাজটা তিনি করেছিলেন।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। পোয়ারো আমার কথায় সায় দিয়ে বলে ওঠেন, তবে সে কাজ বড় নিষ্ঠুর, বড় অমানুষিক। এক কথায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন। বড় নিষ্ঠুর হত্যা, অবশ্যই।
একটু থেমে পোয়ারো তার কথার জের টেনে আবার বলতে থাকেন, তার একটা কথা বড় অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আমি জানি তুমি কেন এখানে এসেছ। আপনাকে ওঁর এ কথা বলার কী অর্থ হতে পারে ভেবে দেখেছেন?
না, সহজভাবেই বললাম আমি, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি মাদাম। আপনার এখানে আসার কারণটা সবাই যা জানে, মিসেস মারকাড়ো সেটা বিশ্বাস করতেন না। তার ধারণা ছিল, আপনার এখানে আসার পিছনে অন্য কোন বিশেষ কারণ ছিল। কী সেই কারণ? যার জন্য আপনার এখানে আসার মুহূর্ত থেকে তিনি আপনার উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে গেছেন!
কে জানে, আমি একটু বিরক্ত হয়েই একটা রূঢ় কথা বলে ফেললাম, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার যতদূর মনে হয়, তাকে ঠিক লেডির পর্যায় ফেলা যায় না।
কিন্তু মাদাম, ওটা ঠিক উত্তর হল না।
পোয়ারোর কথার রহস্যটা আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। কিছু বোঝবার আগেই তিনি আবার বলতে শুরু করে দিলেন। প্রসঙ্গ এবার অন্য। অন্য মন, অন্য লোক।
আর অন্য সদস্যদের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা নার্স?
মিস জনসনের কথাই ধরা যাক না কেন, আমার তো মনে হয়, মিসেস লিডনারকে তিনি খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন না। তবে ডঃ লিডনার-এর প্রতি তিনি খুব অনুরক্ত ছিলেন। খুবই স্বাভাবিক, বহু বছর এক সঙ্গে ওঁরা দুজন কাজ করেছেন, অনুরাগ থাকারই কথা। তবে লিডনারদের বিয়েটাই পরিবর্তন এনে দেয় তাদের মধ্যে, হয়তো সেইজন্যই মিস জনসন মিসেস লিডনারের প্রতি অমন বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন।
হ্যাঁ, পোয়ারো আমার কথায় সায় দিয়ে বলেন, হয়তো মিস জনসনের কাছে ওঁদের বিয়েটা গ্রহণীয় নয়। ওঁর সঙ্গে ডঃ লিডনারের বিয়েটা বোধহয় ঠিক হতো।
হ্যাঁ, যা বলেছেন, আমি স্বীকার করলাম, কিন্তু একশোর মধ্যে বোধহয় একজোড়া বিবাহিত দম্পতি সুখী হয় না। তবে সত্যি কথা বলতে কি এর জন্য ডঃ লিডনারকে কেউ দোষ দিতে পারে না। মিস জনসন, বেচারি দেখতে তেমন আহামরি বলে কিছু নয়। তার তুলনায় মিসেস লিডনার, বয়স হলেও যে কোন যুবতী নারীর চেয়ে বেশি সুন্দরী, রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দিতেন পুরুষদের। সত্যি ওই বয়সেও পুরুষদের আকর্ষণ করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখতেন। মনে পড়ে মিঃ কোলম্যান বলতেন, মিসেস লিডনারের রূপের আগুনে প্রলোভিত পুরুষরা নিজেদের মরণ জেনেও ঝাঁপ দিতে কসুর করতো না। তার রূপ সম্বন্ধে আমার এই উপস্থাপনায় হয়তো আপনি হাসবেন, কিন্তু আমি আবার বলছি, তার মধ্যে একটা অপার্থিব এমন কিছু ছিল, যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যেত না।
হুঁ! পোয়ারো ছোট্ট করে মাথা নাড়লেন।
তবে আমার মনে হয় না, মিঃ ক্যারির সঙ্গে তার সম্পরটা খুব একটা মধুর ছিল। আমার ধারণা, মিঃ জনসনের মতো মিঃ ক্যারিও ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। সব সময় মিসেস লিডনারের প্রতি তার মনোভাব ছিল অনমনীয় আর মিসেস লিডনারও তাকে সেই চোখেই দেখতেন। তিনি তাঁর স্বামীর পুরনো বন্ধু ছিলেন অবশ্যই, তবে ওই যে প্রবাদ আছে, কিছু কিছু মহিলা আছেন যাঁরা তাঁদের স্বামীর পুরনো বন্ধুদের কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না।
বুঝতে পারছি, আর সেই তিনজন যুবক? কোলম্যান, আপনার কথা থেকে ধরে নেওয়া যায়, ছেলেটির কাছে মিসেস লিডনার যেন একটি কবিতা ছিলেন। ঠিক তাই না?
আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।
এ এক হাস্যকর ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো, হাসতে হাসতে বললাম, নিতান্ত যুবক সে।
আর অন্য দুজন?
মিঃ এমাটের ব্যাপারে সত্যি আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। শান্তশিষ্ট মানুষ কথা বলেন কম। তাঁর কাছে মিসেস লিডনারও ছিলেন অতি চমৎকার মহিলা। আর মিসেস লিডনারও ছিলেন তাঁর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, আদর করে তাকে ডেভিড বলে ডাকতেন, মিস রেলির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন। ওঁদের দুজনের সম্পর্কটা ছিল ঠিক এই রকম।
আর মিঃ রেইটার?
তাঁর সঙ্গে মিসেস লিডনারের সম্পর্কটা খুব একটা ভাল ছিল না। ধীরে ধীরে বললাম, প্রায়ই মিসেস লিডনার তার সঙ্গে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে কথা বলতেন।
তাতে সে কিছু মনে করত না?
বেচারা! মুখ লাল করে ফিরে যেত।
রেইটারের প্রতি আমার দুঃখবোধ থেকে হঠাৎ কেন জানি না একটা নিষ্ঠুর সত্য কথা আমার মনে উদয় হল। ঠাণ্ডা মাথায় সে খুন করেনি তো? সেই সম্ভাবনার কথাটা মনে হতেই আমি চমকে উঠলাম, তবে আমার মনের কথাটা প্রকাশ করলাম না পোয়ারোর কাছে।
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি মৃদু চিৎকার করে উঠি, সত্যি কী ঘটেছে বলে আপনার মনে হয়?
চিন্তিত মুখ পোয়ারোর। ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন।
তার আগে বলুন, আজ রাতে সেখানে ফিরে যেতে আপনার ভয় হচ্ছে না?
ওহো, না না, আমি বললাম, অবশ্য আপনার কথা আমার মনে আছে। কে, কে আমাকে খুন করতে পারে মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমার মনে হয় না কেউ আপনাকে খুন করতে পারে, ধীরে ধীরে বললেন পোয়ারো, আপনাদের কাছ থেকে এমনি আশঙ্কার কথা আমি আশা করছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কেউ যদি বাগদাদে আমাকে বলত– কথা বলতে গিয়ে মাঝ পথে থামলাম।
মিস রেলি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন, হাতে র্যাকেট, টেনিস খেলে ফিরছে ও।
হাসানিয়েয় পৌঁছেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পোয়ায়োর।
আমার কুশল সংবাদ নিয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরল ও, মঁসিয়ে পোয়ারো, হত্যা রহস্যের ব্যাপারে কতদূর এগুলেন বলুন!
খুব বেশি এগুতে পারিনি।
যাইহোক, বিপদের হাত থেকে নার্সকে রক্ষা করতে পেরেছেন দেখতে পাচ্ছি।
নার্স লিথেরানের কাছ থেকে আমি এক্সপিডিসনের সদস্যদের সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে নিহত মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক অজানা খবর এখন আমার হাতের মুঠোয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিই সেই খুনের কেসে একটা উল্লেখযোগ্য ক্লু হয়ে উঠেছে।
এ আপনার বুদ্ধিরই পরিচয় মঁসিয়ে পোয়ারো, মিস রেলির কথায় আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া, মিসেস লিডনার খুন হওয়ার মতই মহিলা ছিলেন।
মিস রেলি? রাগে, উত্তেজনায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, এ আপনি কী বলছেন?
থামল সে, তার হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল আমার।
নার্স লিথেরান, আপনি হয়তো সত্য ঘটনা জানেন না বলেই এমন আশ্চর্য হচ্ছেন। আর পাঁচজনের মত আমার এই স্পষ্ট কথাগুলো আপনার কানে ঔদ্ধত্যের মত শোনাচ্ছে। পেটে খিদে, মুখে লাজের মত স্বভাব আমার নয়, আমি স্পষ্ট বক্তা। তারপর সে পোয়ারোর দিকে ফিরে বলে, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই প্রথম বোধহয় আপনাকে অসাফল্যের মালা ঝোলাতে হবে গলায়। আমি চাই না মিসেস লিডনারের খুনী ধরা পড়ুক।
মেয়েটি ক্রমশঃ আমার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। জানি না, পোয়ারো তার কথাগুলো কিভাবে নিচ্ছিলেন।
তাহলে, পোয়ারো এই প্রথম মুখ খুললেন, মনে হচ্ছে, গতকাল অপরাহ্নের ঘটনার ব্যাপারে আপনার এ্যালিবি আছে, আছে না?
মুহূর্তের নীরবতা, হাতের র্যাকেট খসে পড়ে যায় তার মেঝের উপরে। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ঢিলে-ঢালা স্ন্যাক্স আঁটো করার খেয়াল নেই এখন তার। তারপর সে এক নিঃশ্বাসে কথা বলে গেল, ও হা, আমি তখন ক্লাবে টেনিস খেয়াল বস্ত ছিলাম। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনারকে আপনি ঠিক চেনেন না। চিনলে আপনার ধারণা বদলে যেত নিশ্চয়ই।
আবার সেই অদ্ভুত চোখে তাকালেন পোয়ারো, আপনি আমাকে সব খুলে বলতে পারেন?
একটু ইতস্ততঃ করে সে আবার মুখ খোলে। কিন্তু তার কথার মধ্যে কেমন বোকা বোকা ভাব, সৌন্দর্যের অভাব, সেটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিল।
মৃত লোক, সে যতই খারাপ হোক না কেন, তার সমালোচনা করা মানবিক দিক থেকে বাঞ্ছনীয় নয়। আমি মনে করি, এ অন্যায়, এ পাপ। সত্য সব সময়ই সত্য। সত্য কখনো গোপন থাকে না। তবে তাই বলে জীবিত লোকের ব্যাপারে মুখ না খোলাই ভাল। তাতে তার ক্ষতি হতে পারে, মৃত্যু এখন অতীত। শেক্সপীয়রের সেই বিখ্যাত উক্তিটা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে হয়। তেল ইয়ারিমাহর সেই ভয়ঙ্কর আবহাওয়ার কথা কী নার্স আপনাকে বলেছে? এখানে এখন সবাই সবাইকে ঘৃণার চোখে দেখে, শত্রু বলে মনে করে। এর জন্য দায়ী লুসি লিডনার। তিন বছর আগে আমার অল্প বয়সেই অনুভব করতে পারতাম, তখন তারা সবাই বেশ সুখে শান্তিতে ছিল, এমন কি গত বছরেও সেই সুখী পরিবারে ব্যাঘাত ঘটতে দেখেনি। কিন্তু এই বছর তাদের মধ্যে হঠাৎ কেমন রেষারেষি মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। আমার ধারণা, এর জন্য মিসেস লিডনারই দায়ী ছিল। কাউকে সুখে থাকতে দিতে চাইতেন না, তার মনোভাব ছিল এমনই। আর তার একটা বাজে অভ্যাস ছিল, পুরুষদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলতে ভালবাসতেন ভীষণ। উঃ! কি সাংঘাতিক মহিলা তিনি–
মিস রেলি? আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমার মনে হয়, এসব সত্য নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এ সব সত্যি নয় বলেই আমি এমন জোর দিয়ে বলতে পারছি।
কিন্তু শীলা রেলি আমার কথায় কান দিল না। নিজের কথায় নিজেই ব্যস্ত সে তখন। শুনেছি ডঃ লিডনার নাকি তাঁর স্ত্রীকে দেবীর মত পুজো করতেন। তাতেও খুশি ছিলেন না মিসেস লিডনার। মার্কোডার মত ইডিয়ট, যার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই, তাকে তিনি বশ করেছিলেন, বোকা বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতেন। তারপর তিনি বিলকেও তার মোহজালে জড়িয়ে ফেলেন ধীরে ধীরে। আর কার্ল রেইটার? মিসেস লিডনার নাকি তাকে কোনদিন সুনজরে দেখেননি। তাকে অত্যাচার করে একটা বিজয়ীর আনন্দ অনুভব করতেন। একধরনের মহিলা আছেন, যারা পুরুষদের উপরে প্রভুত্ব করে সুখ পায়, মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। কিন্তু ডেভিড ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান। মিসেস লিডনারের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করলেও নিজের সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিল সে। তাছাড়া তাকে খুব একটা পাত্তাও দিত না সে। তিনি যে কি ধরনের মহিলা তার জানা হয়ে গিয়েছিল।
শীলার কথাগুলো আমার গায়ে তীরের মতো বিঁধছিল। মিসেস লিডনারের অমন জঘন্য ব্যবহারের জন্যই শীলা নাকি তাকে ঘৃণা করত। অবুঝ মহিলা। কারোর বন্ধুত্ব তার কাম্য ছিল না, একজনের বিরুদ্ধে অন্য আর একজনকে লড়িয়ে দিয়েই তৃপ্তি পেতেন তিনি। জীবনে কারোর সঙ্গে তিনি ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হননি, কিন্তু তিনি যেখানেই গেছেন ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। তার নাটকের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেই নাটকে তিনি নিজেকে জড়াতে চাইতেন না। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো।
বুঝলেন মঁসিয়ে পেয়ারো, এর থেকেই বুঝতে পারবেন, কি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা ছিলেন এই মিসেস লিডনার।
না, আপনি দেখছি আমার থেকে অনেক বেশি ভাল বুঝেছেন পেয়ারের কথায় রাগ ও ঘৃণার সুর ঝঙ্কার তুলছিল তখন।
শীলা রেলি বোধহয় পোয়ারোর মনোভাব আন্দাজ করতে পেরেছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল, আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই মনে করুন। কিন্তু তার সম্বন্ধে আমার ধারণা অভ্রান্ত, তাতে কোন ভুলচুক নেই।
আর তার স্বামী? পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তার সঙ্গে মিসেস লিডনারের সম্পর্কটা কিরকম ছিল মিস রেলি?
স্বামীকে ঠিক আঘাত দিতে চাননি তিনি, ধীরে ধীরে মিস রেলি বলে, অন্তত সেরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি। বরং স্বামীর প্রতি তিনি সদয় ছিলেন। আমার ধারণা, ডঃ লিডনার তার খুব প্রিয় ছিল। আগেই বলেছি, ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে দেবীর মতো পুজো করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। মনে হয় তাতে কোন মহিলা ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবে। কিন্তু মিসেস লিডনারের তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যে কোন জ্ঞানী লোকের চোখে ডঃ লিডনার মুখের স্বর্গে বাস করছেন বলে মনে হবে। কিন্তু তবু ডঃ লিডনারের কাছে মূখের স্বর্গ বলে মনে হয় না, কারণ মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল অন্য। যদিও অন্য কারোর পক্ষে সেটা অনুমান করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার মনে ঠিক কি ছিল–
এখানে এসে শীলা থামল।
থামলেন কেন বলুন তারপর– পোয়ারো তাড়া দিলেন।
শীলা হঠাৎ আমার দিকে ফিরল।
একটু আগে রিচার্ড ক্যারির ব্যাপারে কী যেন মন্তব্য করলে তুমি?
মিঃ ক্যারি সম্বন্ধে? আমি অবাক হলাম।
মিসেস লিডনার এবং ক্যারিকে কেন্দ্র করে।
ঠিক আছে, প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, আমি আবার বলছি, মনের দিক থেকে তারা খুব বেশিদূর এগোননি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল শীলা।
খুব বেশিদূর এগোননি তিনি? আপনি বোকা, তাই কিছু বোঝেন না। ক্যারি তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তাঁর মন বলে কোন পদার্থ ছিল না কারণ ডঃ লিডনারের মত তিনিও তাকে অন্ধ হয়ে পুজো করতেন। ক্যারি তাদের দীর্ঘ দিনের পরিবারের বন্ধু। অবশ্য তাতে তার বাড়তি সুবিধা হয়েছিল। তাদের দুই বন্ধুর মাঝে ধূমকেতুর মত উদয় হন তিনি। তাই আমার মনে হয়েছিল।
কী?
শীলার চোখে ভ্রুকুটি। কি যেন ভাববার চেষ্টা করছিল সে।
আমার মনে হয়েছিল, এ ব্যাপারে তিনি অনেক দূর এগিয়েছিলেন। পুরুষ হিসাবে ক্যারি অত্যন্ত আকর্ষনীয়। মিসেস লিডনার ঠাণ্ডা মাথায় শয়তানি করতেন। কিন্তু আমার মনে হয়, ক্যারির সংস্পর্শে এসে তার সেই স্বভাবের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে থাকবে।
ছিঃ ছিঃ, মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে–এসব উক্তি মানহানিকর। রাগে তখন আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছিল, এ সব কথার কোন মানে হয় না, এঁদের মধ্যে খুব কমই কথাবার্তা হত।
তাই নাকি? শীলা সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে ফিরে তাকায়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবে না নার্স, আপনি জানেন, সব জানেন। মিঃ ক্যারি এবং মিসেস লিডনার বাড়ির বাইরে গিয়ে মিলিত হতেন, বলুন, এ খবর আপনি জানেন কিনা? বলুন, ফুলের বাগানে কিংবা নদীর ধারে তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখা যায়নি কি না?
একটু থেমে পোয়ারোর দিকে তাকাল শীলা।
মঁসিয়ে পোয়ারো, পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি বললাম, আমি ওঁর একটা কথাও বিশ্বাস করি না। আপনি করেন?
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন পোয়ারো। (তার চাহনিটা কেমন সন্দেহজনক বলে আমার মনে হল),–এই কেসের উপরে মিস রেলি যে নতুন করে আলোকপাত করলেন, আপনি তা অস্বীকার করতে পারেন না নার্স।
.
১৯.
নতুন করে অবিশ্বাস
সেই মুহূর্তে ডঃ রেলি ঘরে প্রবেশ করার জন্য আমরা আর বেশি আলোচনা করতে পারলাম না। তিনি এবং পোয়ারো মনস্তত্ব এবং মিসেস লিডনারকে লেখা সেই বেনামা চিঠিগুলো নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন হলেন। ডঃ রেলি কতকগুলো জটিল রোগের প্রসঙ্গ তুললেন এবং পোয়ারো তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কতকগুলো চমকপ্রদ কাহিনীর প্রসঙ্গ তুললেন।
ব্যাপারটা যতটা সহজ বলে মনে হয়, ঠিক তা নয়, প্রসঙ্গের জের টানতে গিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ক্ষমতার লড়াই এবং অত্যন্ত হীনমন্যতার প্রকাশ আমি দেখেছি।
ডঃ রেলি মাথা নাড়লেন।
আর তাই বুঝি আপনার শেষ সন্দেহভাজন ব্যক্তিই হল সেই চিঠিগুলোর বেনামা লেখক?
চিন্তার ফসল ফলালেন পোয়ারো তাঁর কথায়, আপনি কী তাহলে বলতে চান, মিসেস লিডনারের মধ্যে হীনতাভাবের ঝোঁক ছিল?
উঃ রেলি মুখ থেকে পাইপটা সরালেন।
পৃথিবীর শেষতম মহিলা হিসাবে আমি এই ভাবেই বর্ণনা করব। তার সম্বন্ধে সংযত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। জীবন, আরও সুখের জীবন, এই ছিল তার কাম্য এবং পেয়েছিলেন তিনি।
মনস্তত্বের দিক থেকে বলতে গেলে, আপনারা কী মনে করেন, সেই চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি বৈকি। কিন্তু এর কারণ কী? কেন এই নাটকের অবতারণা? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? আমি খবর নিয়ে জেনেছি, মিসেস লিডনারের জীবনে বহু চিত্রাভিনেতা এসেছে। তিনি চেয়েছিলেন তাদের মধ্যমণি হবেন নিজেকে লাইমলাইটে নিয়ে এসে। ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিবাহ অসম, তার স্বামী তখন অবসরের বুড়ি প্রায় দুই ছুঁই, তবে স্বামী হিসাবে আদর্শ বলা যেতে পারে। স্ত্রীর আদর-যত্নের ত্রুটি রাখতেন না। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হলে যা হয় তাই আর কি। কিন্তু মিসেস লিডনারের তাতে মন ভরত না। তার চাহিদা ছিল পর্বত প্রমাণ। ছায়াচিত্রের নায়িকা হবার বাসনা তাকে পেয়ে বসেছিল তখন।
সত্যি কথা বলতে, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন মিসেস লিডনার সেই সব চিঠিগুলো নিজে লিখেছিলেন, কিন্তু পরে সে কথা তার মনে ছিল না, ডঃ লিডনারের এই মতবাদ আপনি সমর্থন করেন না?
না, আমি তা মনে করি না। ডঃ লিডনার যা মনে করেন, তা, সত্যি নয়। কারণ কোন স্বামী তার স্ত্রীর অমন নির্লজ্জ অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে না। সত্যি কথা বলতে কি কোন স্বামীকে তার স্ত্রীর সম্বন্ধে সত্য কথা না বলাই ভাল, কারণ স্ত্রীর খারাপ দিকটা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বেশির ভাগ স্ত্রী তার স্বামীকে মাতাল, অবিশ্বাসী জেনেও কেমন আনায়াসে তাকে গ্রহণ করে নেয়। বাস্তবিক নারী জাতির মতো বাস্তববাদী মানুষ বোধহয় কেউ হতে পারে না।
সত্যি করে বলুন তো ডঃ রেলি, মিসেস লিডনারকে আপনার কী রকম মনে হয়?
ডঃ রেলি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ধীরে ধীরে পাইপ টানতে টানতে কী যেন ভাবছিলেন, বোধহয় মনে মনে উত্তরটা তৈরি করে নিচ্ছিলেন তিনি। একটু পরে মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
সত্যি কথা বলতে কি ওঁর সম্বন্ধে কোন মতামত প্রকাশ করা খুব মুশকিল। তাছাড়া ওঁর সম্বন্ধে আমি কতটুকুই বা জানি। তবে ওঁর সম্বন্ধে যেটুকু জানি বলতে পারি, উনি ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সহানুভূতিশীলা তবে কেন জানি না সব সময় আমার একটা কথা মনে হত (কিন্তু তার প্রমাণ আমার হাতে ছিল না।), তিনি ছিলেন একজন মার্জিত রুচিসম্পন্না মিথ্যাবাদী। কিন্তু যে কথাটা আমি জানতাম না (জানতে খুব ইচ্ছা হয়) তা হল, তার সেই সব মিথ্যাভাষণ কী নিজের কাছে কেবল, না অন্য লোকদের উদ্দেশ্যেও? মেয়েরা জন্ম-অভিনেত্রী, মিথ্যাভাষণে পটু, অস্বীকার করি না। তবে আমি মনে করি না, পুরুষ-শিকারী ছিলেন তিনি। পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন খেলোয়াড়ী মনোভাব নিয়ে, তার বেশি কিছু নয়। যাইহোক, এ ব্যাপারে আপনি যদি আমার মেয়ের সঙ্গে–
আপনার মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ আগেই আমরা পেয়েছি, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন।
তাই নাকি? ডঃ রেলি বলেন, আশাকরি, আপনাদের সময় খুব বেশি নষ্ট করেনি ও। তবে ওর কথাবার্তা একটু চাঁচাছোলা গোছের। আজকের যুবক-যুবতীরা মৃত্যুর ব্যাপারে ভাবপ্রবণতার কোন ধার ধারে না, রুচিবাগীশ হয় সাধারণতঃ। তারা পুরনো সংস্কার সব বাতিল করে দিয়ে নিজেদের নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। মিসেস লিডনার-এর কার্যকলাপে ওর হয়তো সমর্থন থাকত। কিন্তু মিসেস লিডনারের নাটুকেপনাটা ও সহ্য করতে পারত না। বিড়াল ইঁদুর দেখলেই তাড়া করবে, এ যে সহজাত প্রবৃত্তি। মিসেস লিডনারের ব্যপারটাও যেন কতকটা তাই। পুরুষরা বাচ্ছা ছেলে নয় যে, তাদের সব সময় চোখে চোখে রাখা যায়। মেয়েদের সঙ্গে তারা মিশবেই, তার উপর মেয়েদের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেলে তো আর কথাই নেই। জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, পিকনিক করার স্থান নয়। লিডনারকে ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ দিল শীলার। মাঝবয়সী ওই ভদ্রমহিলা, বিশেষ করে যাঁর জীবনে দু-দুটির স্বামীর আগমন ঘটেছিল, তার অমন আগুন নিয়ে খেলাটা পছন্দ করত না শীলা। চমৎকার মেয়ে এই শীলা, রীতিমতো সুন্দরী এবং পুরুষদের আকর্ষণ করার মত রূপ আছে ওর। কিন্তু মিসেস লিডনারের ভাবগতিক ছিল অন্য রকম। তাৎক্ষণিক চাতুরির খেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি–ডঃ রেলির এ কথায় মধ্যে কী কোন অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে?
আপনার মেয়ে, কথাটা অসমীচীন হবে না, সম্ভবতঃ এখানকার কোন একটি যুবককে নিজের আপনজন বলে নির্বাচন করে ফেলেছে। এ কথা কী সত্য?
না না না আমি তা মনে করি না। এমাট এবং কোলম্যান ওর নাচের সঙ্গী। আমার তো মনে হয় না, তাদের কাউকে ও পছন্দ করে। তারা ছাড়া বিমান বাহিনীর কয়েকজন সুপুরুষ যুবকও আছে এখানে। আমার ধারণা, তারা সবাই শীলার জালে ধরা পড়তে পারে মাছের মতো। কিন্তু না, তাদের ধরে রাখার কলাকৌশল বোধহয় তার জানা ছিল না। আমার মনে হয় সেই বয়সে যৌবনের অমন বিপর্যয়টা শীলার বিরক্তির কারণ। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে আমার থেকে বেশি ভাল বোধহয় শীলা জানতো না। শীলা সুন্দরী মেয়ে হতে পারে, কিন্তু লুসি লিডনার ছিলেন রূপসী, অপরূপা! উজ্জ্বল চোখ দুটি তার কি অপূর্বই না ছিল। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন সত্যি-রূপসী, অপরূপা!
হ্যাঁ, ডঃ রেলি ঠিকই বলেছেন, সে কথা আমিও ভেবেছি অনেকবার। লুসি লিডনারের চোখ ধাঁধানো অমন রূপ দেখে সত্যি হিংসা করতে হয়। তাকে প্রথম দিন দেখেই এ কথা আমার মনে হয়েছিল। সেই রাত্রেই আমার মনে বার বার উঁকি দিতে থাকে, কেমন অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। এক সময় শীলার কথাগুলো আমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করিনি, আমার তখন মনে হয়েছিল, আর পাঁচটা হিংসুটে মেয়েদের মতো ও বোধহয় মিসেস লিডনারের নামে মিথ্যা কুৎসা রটাচ্ছে।
কিন্তু এখন হঠাৎ আমার একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। শেষ অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছিল কোর্টইয়ার্ডে। মিসেস লিডনারকে কেমন চঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল। একটু পরেই জানতে পারলাম, তিনি একা একা ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে চান। আমি তাকে বার বার অনুরোধ করলাম, এ সময় আপনার একা একা বাইরে কোথাও যাওয়া উচিৎ নয়, তাই আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। কিন্তু আমার কথায় তিনি কান দিলেন না, একাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন তিনি গোপনে মিঃ ক্যারির সঙ্গে মিলিত হতে যাননি তো? হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে তারা দুজনে কি রকম অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলতেন যেন। অন্যদের তিনি ক্রিশ্চিয়ান নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু মিঃ ক্যারির বেলায় তা করতেন না, কেন এই পার্থক্য?
মিঃ ক্যারিকে কখনো তার দিকে সরাসরি তাকাতে দেখিনি, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারকে ঘৃণা করতেন, কিম্বা এর ঠিক বিপরীতও হতে পারে।
আজ আমি বুঝতে পারছি, শীলার রাগের কারণ। ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ না হলে কেউ হঠাৎ অমন করে ফেটে পড়ে না।
অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, মিসেস লিডনার ওকে সুনজরে দেখতেন না। মিঃ এসোটের সম্মানার্থে সেদিন মধ্যাহ্নভোজের দিন শীলার প্রতি ওঁর অমন দুর্ব্যবহারটা মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। আজ বুঝতে পারছি, শীলার কোন অপরাধ ছিল না। হতে পারে এসোট ওর দিকে যে ভাবে তাকিয়ে ছিল, সেটা অনুরাগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। সম্ভবত সে কিছু ভাবছিল। মিঃ এসোটের ভাবনার কথা কেউ হদিশ করতে পারে না। এমনি চাপা স্বভাবের মানুষ সে। তাবে মানুষ হিসাবে চমৎকার সে। সত্যি কথা বলতে কি তার উপরে নির্ভর করা যায়।
কিন্তু মিঃ কোলম্যানের মত অমন বোকা লোক আমি কখনো দেখিনি। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন রাত নটা বেজে গেছে। দরজায় তালা লাগানো ছিল। ইব্রাহিম তার চাবির গোছা নিয়ে ছুটে এল আমাকে ভিতরে আহ্বান করার জন্য।
একটু তাড়াতাড়ি আমরা যে যার বিছানায় চলে গেলাম। বসবার ঘর অন্ধকার। ড্রইং-অফিস এবং ডঃ লিডনারের অফিস ঘর থেকে আলো চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছিল, তবে অন্য সব জানালাগুলো অন্ধকারে ডুবে ছিল।
আমরা ঘরে যাবার জন্য ড্রইং-অফিসের পাশ দিয়ে দেখলাম, মিঃ ক্যারি তখনো একটা বিরাট প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। আমার মনে হল, তাকে খুব ক্লান্ত বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। তাঁর অমন রূপ আমি তার আগে কখনো দেখিনি। তাঁর দিন যেন সীমিত, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
মুখ ঘোরাতেই তিনি দেখতে পেলেন আমাকে। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাসানিয়ের থেকে ফিরে এলেন?
হ্যাঁ, মিঃ ক্যারি, কিন্তু আপনি এত রাত পর্যন্ত কাজ করছেন? এখন সবাই প্রায় ঘুমে অচৈতন্য।
আগামীকাল থেকে খনন কার্য আবার শুরু হচ্ছে। তাই করণীয় কাজগুলো দেখে নিচ্ছি।
এত তাড়াতাড়ি? আমি চমকে উঠলাম।
অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি।
এ অবস্থায় ঘরে বসে এ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী লাভ? ব্যাপারটা ডঃ লিডনারের উপর ছেড়ে দিয়েছি। আগামীকাল বেশিরভাগ সময় তিনি হাসানিয়েয় থাকছেন। বাকী আমরা সবাই এখানে থাকছি।
ভুল বলেন নি তিনি। আমি তার বক্তব্য সমর্থনে বললাম, এক হিসাবে আপনি ঠিকই বলেছেন, বাড়িতে চুপচাপ বসে থেকে কোন লাভ নেই। কাজের মধ্যে দিয়ে ভুলে থাকা যাবে।
আমি জানতাম পরের দিনের পরদিন মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা হতে যাচ্ছে।
মিঃ ক্যারি আবার তার প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়লেন। কেন, আমি তা জানি না। তবে তার জন্য কেন জানি না আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। আমার মনে হল, আজ রাতে তিনি আর ঘুমাতে যাচ্ছেন না।
মিঃ ক্যারি, আপনার ঘুমের ট্যাবলেট দরকার?
মাথা নাড়লেন তিনি, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়াটা বদ অভ্যাস। রাতটা আমি কাটিয়ে দিতে পারব।
তাহলে শুভরাত্রি মিঃ ক্যারি, চলে আসবার সময় বললাম, যদি কোন প্রয়োজন হয় তো বলবেন আমাকে
ধন্যবাদ নাস, অমন চিন্তা মনে আনবেন না। শুভ-রাত্রি।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিঃ ক্যারি, বিশেষ করে আপনার জন্য আমি ভীষণ চিন্তিত।
আমার জন্য? কিন্তু কেন?
কারণ আপনি ওঁদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন বলে।
ডঃ লিডনারের আমি পুরানো বন্ধু হতে পারি, কিন্তু মিসেস লিডনারের নয়।
মিঃ ক্যারি কথাটা এমন ভাবে বললেন, যেন প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনারকে তিনি দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন, তার বন্ধুত্ব তিনি স্বীকার করতে চান না। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, মিস রেলি যেন তার কথাটা শুনে থাকে।
শুভ রাত্রি, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দ্রুত পায়ে আমি আমার ঘরে চলে এলাম।
পোশাক বদলে বিছানায় দেহটা এলিয়ে দেবার তোড়জোড় করেছিলাম, ডঃ লিডনারের অফিস ঘরে আলো তখনো জ্বলতে দেখে ভাবলাম, একবার ওকে শুভ-রাত্রি জানিয়ে এলে কেমন হয়! একটু ইতস্ততঃ করলাম, তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন, এ সময় তার কাজের মধ্যে তাকে বিরক্ত করলে? কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি মনস্থির করে ফেললাম, শুভ রাত্রি জানালে কোন ক্ষতি নেই। স্রেফ একবার শুভ-রাত্রি জানিয়ে তাকে জিজ্ঞসা করে আসব, তার কোনো প্রয়োজনে তিনি যেন আমাকে ডাকেন।
কিন্তু ডঃ লিডনার তাঁর অফিসঘরে ছিলেন না। ঘরের আলো জ্বললেও মিস জনসন ছাড়া সেখানে কেউ ছিলেন না। টেবিলের উপরে মাথা রেখে কাঁদছিল সে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মিস জনসনকে এ ভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে কেমন অবাক হলাম। তাহলে?
কি হয়েছে মিস জনসন? তার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলোতে গিয়ে শুধালাম, এখন এভাবে ভেঙ্গে পড়লে, চলবে না। ওঠো, কেঁদো না।
মিস জনসন আমার কথার উত্তর দিল না। বরং সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শোনো এ ভাবে কেঁদো না, শান্ত হও, আমি তোমার জন্য চা তৈরি করে নিয়ে আসছি।
এবার সে মাথা তুলে তাকাল। না, না, আমি ঠিক আছি নার্স। বোকার মত আমি-
তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না সে, পরে এক সময় সে বলে, সে বড় ভয়ঙ্কর, বড়-
এখন, এসব কথা চিন্তা করো না, আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, যা হবার হয়ে গেছে, ভুল তত আর সংশোধন করা যাবে না।
মিস জনসন এবার সোজা হয়ে বসল। চুলে বিলি কাটতে কাটতে সে বলে, আমি কী বোকা? অফিসঘর পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম। তারপর হঠাৎ ধূমকেতুর মতো–
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি বৈকি। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, এক কাপ কড়া চা আর গরম জলের বোতল তোমার বিছানার পাশে দেখতে চাও, এই তো?
ধন্যবাদ নার্স, আমি বিছানায় তার পাশে বসলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে বলে, তোমার মতো কর্তব্য পরায়ণ মহিলা আমি এর আগে দেখিনি। চমৎকার মেয়ে তুমি। তারপর একটু থেমে সে অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করে, একটু আগে কী যেন বলছিলে তুমি? কথাটা কী সত্যি? যা ঘটে গেছে তা আর সংশোধন করা যায় না–
মিনিট দুই নীরব থেকে সে একটা অদ্ভুত কথা শোনাল, জানো নার্স, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।
আমি তার কথার কোন প্রতিবাদ করলাম না। আমার আশঙ্কা, তবে কি মিস জনসন তার মৃত্যুতে মনে মনে খুশি হয়েছিল? তারপর এখন সেই কথা ভেবে সে লজ্জাবোধ করছে!
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আমি তৎপর হলাম। চেয়ারের উপর থেকে তার পরণের কোর্ট, স্কার্ট হ্যাংগারে রাখতে গিয়ে মেঝের উপরে একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলাম। মনে হয়, তার কোটের পকেট থেকে সেটা পড়ে গিয়ে থাকবে।
কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে জানালা গলিয়ে ফেলতে যাব, মিস জনসন চিৎকার করে উঠল, ওটা আমায় দাও!
আমি তার কথা মতো কাগজের টুকরোটা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সে একরকম ছিনিয়ে নিল আমার হাত থেকে সেটা এবং সেটা সে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় মেলে ধরল যতক্ষণ না সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু তার আগে দূর থেকে সেই কাগজের হাতের লেখাটা দেখে আমি স্তব্ধ, হতবাক।
বিছানায় শুয়েও প্রসঙ্গটা আমার মনে দারুণ আলোড়িত হতে থাকে। এখন বুঝতে পারছি, ওঁরা কেন আমাকে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আমি একজন মহিলা বলেই মিস জনসনের বেডরুমে প্রবেশ করতে পেরেছি। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, সেই একই হাতের লেখা, বেনামা চিঠিগুলোতে সেই একই রকম হাতের লেখা আমি দেখেছিলাম।
তবে কী এই কারণেই সে তখন অনুতাপ করছিল? সেই বেনামা চিঠিগুলো কী তাহলে মিস জনসন এতদিন লিখে আসছিল?
২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার
২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার
আমি ভাবতেই পারিনি, সেই বেনামা চিঠিগুলোর সঙ্গে মিস জনসন জড়িয়ে পড়বে। সম্ভাব্য নাম মিসেস মারকাডো। কিন্তু মিস জনসনের মতো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, সমঝদার এবং খাঁটি মহিলা নয়। এ যেন অবিশ্বাস্য একটি নাম।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে আজ সন্ধ্যায় পোয়ারো এবং ডঃ রেলির সন্দেহের কথা মনে পড়ে যেতেই নিজেকে আমি প্রশ্ন করি, কেন, কেন সে এ কাজ করতে গেল? মিস জনসন এই খুনের ব্যাপারে জড়িত, এক মুহূর্তের জন্যও সে কথা অস্বীকার করা যায় না, মিসেস লিডনারকে সে অপছন্দ করত, কেন? এমনও তো হতে পারে, মিসেস জনসনের প্রতি তার সেই বিরূপ মনোভাব তাকে এ কাজে প্রলোভিত করে থাকবে।
তবে মিসেস লিডনারের খুন হওয়ার পর তার মনে অনুশোচনা জেগে থাকবে, হ্যাঁ, ঠিক অনুশোচনা নয়, ভয় বলা যেতে পারে। সেই ভীতির কারণ দুটি প্রথমতঃ তার সেই নিষ্ঠুর চতুর খেলার জন্য দ্বিতীয়ত খুনের পর সে বুঝতে পারে, সেই চিঠিগুলো প্রকৃত খুনীর স্বপক্ষে একটা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সে ওভাবে ভেঙ্গে পড়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু এখনো আমি বিশ্বাস করি, তার মত কোমল নারী সচরাচর খুব কম দেখা যায়। এর প্রমাণ আমি তার কথায় প্রতিফলিত হতে দেখেছি। তা না হলে আমি যখন তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম, যা ঘটার ঘটে গেছে, সে ভুলের সংশোধন আর হতে পারে না, কেন মিস জনসন সে কথায় আগ্রহ দেখাতে গেল?
এবং তারপরে নিজের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য তার সেই রহস্যময় উক্তি, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।
প্রশ্ন হল, আমার এখন কী করা উচিত? অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি ঠিক করলাম, প্রথম সুযোগেই খবরটা দিতে হবে মিঃ পোয়ারোকে।
পরদিন তিনি আবার এলেন, কিন্তু বলার সুযোগ বলতে যা বোঝায়, মানে সেই গোপন পরিবেশটা আমি পেলাম না। সুযোগ এসেছিল মাত্র এক মিনিট, সেই এক মিনিট সময়ে যখন আমি ভাবছি, কি করে প্রসঙ্গটা শুরু করব ঠিক সেই সময় তিনি আমার কাছে এসে কানে কানে মন্ত্র দেওয়ার মতো করে বললেন।
মিস জনসন এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমি আলোচনা করব বসবার ঘরে সম্ভবত। আপনার কাছে মিসেস লিডনারের ঘরের চাবি আছে না?
হ্যাঁ, আছে বৈকি!
তাহলে মিস লিডনারের ঘরে ঢুকে অতি সন্তর্পনে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করবেন। তারপর কান্নার মতো করে চেঁচাবেন, তবে ঠিক আর্তচিৎকার নয়, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। স্রেফ বাইরের লোকদের সতর্ক করে দেওয়া আর কি!
এরপর ওঁর সঙ্গে কথা আর এগোয়নি, কারণ মিস জনসনের হঠাৎ কোর্টইয়ার্ডে সেই সময় আবির্ভাব হবার জন্য।
আমি জানি, মিঃ পোয়ারোর উদ্দেশ্যটা কি। মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বসবার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র আমি মিসেস লিডনারের ঘরের তালা খুলে চকিতে ঢুকে পড়লাম। পিছন ফিরে একবার তাকালাম, না, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে না।
বন্ধ ঘরের ভিতরে আমি একা। পোয়ারোর নির্দেশ মতো আমি মৃদু চিৎকার করে উঠলাম ওঃ! খুব জোরেও নয়, আবার খুব আস্তেও নয়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম পা টিপেটিপে।
তবে অতো সাবধান হবার কোন দরকার ছিল না। পোয়ারো এবং মিস জনসন গভীর মনোযোগ দিয়ে দুজনে আলোচনা করছিল এবং কোন ব্যাঘাত ঘটল না তাদের সেই আলোচনায়। ঘরের ভিতরে গিয়ে তাদের আলোচনায় আমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। বারান্দায় একটা খালি চেয়ারে বসলাম। সেখান থেকে তাদের কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
কেসটা অত্যন্ত জটিল, বুঝতে পারছেন, পোয়ারো তখন তাকে বোঝাচ্ছিলেন, ডঃ লিডনার নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রীকে আদরযত্ন করতেন–
তিনি তাকে পুজোও করতেন, জনসন তাকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ডঃ লিডনার বলেছেন, তার কর্মচারীরাও খুব শ্রদ্ধাশীল ছিল তার স্ত্রীর প্রতি। খুবই স্বাভাবিক, প্রভুপত্নীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাটাই ভদ্রতা। তাদের সেই ব্যবহারে হয়তো আন্তরিকতা থাকতে পারে, সততা থাকতে পারে। আবার নাও থাকতে পারে। মাদমোয়াজেল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই প্রহেলিকার চাবিকাঠি মিসেস লিডনারের চরিত্রে নিহিত আছে। তাই বলছি, আমি যদি এখানকার প্রতিটি সদস্যদের কাছ থেকে সৎ পরামর্শ পেতাম, তাহলে ওই ব্যাপারে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি এই কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। আর আমি এও জানি, ডঃ লিডনার এখন হাসানিয়েয় থাকবেন। ওঁর অনুপস্থিতিতে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার কাজটা একটু সহজ হবে বলেই মনে হয়। আমি আপনাদের সাহায্য প্রার্থী।
ঠিক আছে, মিস জনসন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।
পোয়ারোর দৃষ্টি পড়েছিল তার উপরে। কি ভেবে তিনি বললেন–তবে আনুগত্যের খাতিরে সময় সময় অনেক অপ্রিয় কথা চেপে যেতে হয়। অপরাধ জগতে এই আনুগত্যের ভাবটা একটা মস্তবড় অপরাধ। সেটা বার বার সত্যকে গোপন করে।
এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহে থাকতে পারেন,মিস জনসনের ঠোঁটে শুকনো হাসি, মিসেস লিডনারের প্রতি আমার কোন বিশেষ আনুগত্য নেই। মিসেস লিডনারের প্রসঙ্গে তার কথার মধ্যে কিসের একটা জ্বালা অনুভূত হয় যেন। ডঃ লিডনারের ব্যাপার আলাদা। যাইহোক, তিনি ছিলেন তার স্ত্রী।
তা অবশ্য ঠিক, তা অবশ্য ঠিক। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি আপনার চীফের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে চান না। কিন্তু এটা কোন সাক্ষ্য প্রমাণের প্রশ্ন নয়। এ প্রশ্ন হঠাৎ এবং রহস্যজনক একটি মৃত্যুকে ঘিরে। মিসেস লিডনার ছিলেন দেবদূত, নিহত হয়ে আজ তিনি শহীদ হয়েছেন, আমার এই বিশ্বাস তবু কাজটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
আমি অবশ্যই তাকে দেবদূত আখ্যায় ভূষিত করব না। মিস জনসনের কথায় আগের থেকে বেশি উত্মা প্রকাশ হতে দেখা যায়।
একজন নারী হিসাবে লিডনারের সম্বন্ধে আপনার মতামত কী পরিষ্কার করে বলুন তো?
হুঁ বলছি। তবে শুরুতেই আপনাকে বলে রাখি আঁসিয়ে পোয়ারো, আমি পক্ষপাত দুষ্ট। আমি, শুধু আমি কেন বলছি, আমরা সবাই ডঃ লিডনারের এখানে আসায় শুরুতে আমরা ঈর্ষান্বিত ছিলাম তার প্রতি। আমরা চাইতাম না বাড়তি সময় খরচ করুন, আদর যত্ন করুক। মিসেস লিডনারের এখানে আসাতে আমরা বিরক্তবোধ করেছিলাম। তবে এ কথা ঠিক যে, মিস জনসন তার কথার জের টেনে বলে–আমার মনের ভাবটা আমি কখনো বাইরে প্রকাশ করতাম না। অন্য সবার থেকে আমাদের তফাত হল এইখানে, বুঝলেন?
আমাদের? আমাদের কেন বলছেন আপনি?
মিঃ ক্যারি এবং আমি। কারণ কি জানেন, দুজনই কেবল বহুদিনের পুরনো কর্মচারী এখানকার। তাই আমরা কোন পরিবর্তন বরদাস্ত করতে পারতাম না। সেটাই তো স্বাভাবিক, কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
কেন, পরিবর্তনটা কিসের বলুন তো?
ওঃ! পরিবর্তন তো সবেতেই। আগে আমরা এখানে কতই না সুখে ছিলাম। ডঃ লিডনার খুব আমুদে লোক ছিলেন, তাঁকে নিয়ে আমরা কতই না ঠাট্টা তামাশা করতাম। আমাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে তিনি একেবারে বাচ্চা ছেলে হয়ে যেতেন।
আর মিসেস লিডনার আসার পর তিনি বদলে যান, এই তো?
সে যাইহোক আমি কিন্তু মনে করি না, এর জন্য মিসেস লিডনার দায়ী। বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, গত বছরটা আমাদের খুব একটা খারাপ যায়নি, আর আমাদের বিরক্তিকর কোন কাজ তিনি করেননি। আমার কাছে তিনি সব সময় চমৎকার মহিলা বলেই মনে হত। তাঁর মতো অমন ভাল মহিলা কেউ আর হতে পারে না।
সে যাইহোক– পোয়ারো স্মরণ করিয়ে দেন, পরিবর্তনটা কিন্তু এ বছরই লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াটা কেমন বদলে যায় এখানকার তাই না?
হ্যাঁ, সত্যি সম্পূর্ণ আবহাওয়াটাই কেমন বদলে যায়। মিস জনসন ভাবতে থাকে, কেন, কেন এই পরিবর্তন? সবেতেই কেমন ভুল-ভ্রান্তি, অবশ্য তাদের কাজকর্মে নয়। ভুল-ভ্রান্তি তাদের মেজাজে, তাদের স্বভাবে।
আর তার জন্য সব দোষ আপনারা চাপাতে চান মিসেস লিডনারের ঘাড়ে?
তিনি এখানে আসার আগে তেমনটি তো ছিল না? পাল্টা প্রশ্ন করে তাকালো মিস জনসন।
আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না। পোয়ারো তাকে মনে করিয়ে দেয়, মিসেস লিডনারের স্বভাব-চরিত্র কিম্বা তার মেজাজ সম্বন্ধে আপনার কি মতামত তা তো জানালেন না?
মিস জনসন পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার নিরীক্ষণ করে নিল পোয়ারোকে, সেই ফাঁকে হয়তো ভেবে নিল তার বক্তব্য। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল সে, হ্যাঁ, দারুণ মেজাজী ছিলেন তিনি। এই রোদ, এই বৃষ্টি যেন। আজ যার সঙ্গে খুব মেজাজে কথা বলছেন, কালই দেখাচ্ছেন তাকে রুক্ষ মেজাজ। তবু বলব, মানুষ হিসাবে ভাল ছিলেন তিনি, আমার অন্তত তাই মনে হয়। তবে অন্যদের কাছে তিনি ছিলেন বহু বিতর্কিত মহিলা। এক এক সময় আমার মনে হয়েছে, তিনি তার সারাজীবনটা নষ্ট করে ফেলেছেন। তবে একটা ব্যাপারে আমি তাকে কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। তার স্বামী ডঃ লিডনার অমন বিখ্যাত একজন মানুষ, অথচ তার প্রশংসা করা দূরে থাক, কচ্চিৎ ভুলেও কখনো তার নাম উল্লেখ করতে শুনিনি ভদ্রমহিলার মুখে। এই ব্যাপারটা আমাকে মাঝে মাঝে আজও ভীষণ পীড়া দেয়। অবশ্য তাকে আমি লক্ষ্য করেছি, সব সময় তিনি কেমন চিন্তিত, বুঝি বা ভীতগ্রস্থ। স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন তিনি ইদানীং। তার দেখাশোনার জন্য নার্স লিথেরানকে আনার জন্য ধন্যবাদ ডঃ লিডনারকে।
ভালো কথা, পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তার পাওয়া সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?
বারান্দা থেকে মিস জনসনের মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে তার মুখের প্রোফাইল কেমন বদলে যেতে দেখলাম। পোয়ারোর পিঙ্গল চোখের দৃষ্টি পলকের জন্য মিস জনসনের মুখের উপরে নিবদ্ধ হল। সে মুখে এখন একটা ধূসর পান্ডুর ছায়া। দু’চোখের গভীরে পুঞ্জীভূত ভয় ও হতাশা।
আমার মনে হয় আমেরিকায় তার উপরে কোন লোকের আক্রোশ আছে, এবং সেই লোকই সেখান থেকে তাকে চিঠিতে ভয় দেখাচ্ছে, কিম্বা তাকে বিরক্ত করছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা। শুনেছেন তো ভদ্রমহিলা খুব সুন্দরী ছিলেন। সুন্দরী মেয়েদের অনেক শত্রু থাকাটা স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, সেই চিঠিগুলো কোন মহিলা লিখে থাকবে। মিসেস লিডনার ছিলেন একটু ভীতু সম্প্রদায়ের–তাই সেই চিঠিগুলো পেয়ে তিনি দারুণ ভয় পেয়ে যান, নার্ভাস হয়ে পড়েন।
সব মানলাম, থেমে থেমে পোয়ারো তাঁর কথাটার শেষ প্রশ্ন করলেন–কিন্তু মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল শেষ চিঠিটা ডাকে আসেনি, প্রেরক নিজের হাতে কিম্বা তার দূত মারফত তার ঘরে ফেলে গিয়ে থাকবে সেটা।
মেয়েরা তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য সবরকম বিপদের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না।
হ্যাঁ, তারা সব পারে, কথাটা আমিও ভেবেছি বৈকি।
হয়তো আপনার কথাই ঠিক মাদমোয়াজেল। আপনার কথা মতো সুন্দরী মিসেস লিডনারের শত্রু থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বললেন, ভাল কথা, মিস রেলিকে আপনি চেনেন? ডঃ রেলির কন্যা?
শীলা রেলির কথা বলছেন! হ্যাঁ, চিনি বৈকি!
পোয়ারো চালাকি করে একটা বেশ রসালো গল্পের অবতারণা করল।
আমি একটা গুজব শুনেছি (স্বাভাবিক কারণেই ডঃ রেলিকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি), ডঃ লিডনারের একজন কর্মচারীর সঙ্গে মিস রেলির নাকি অন্তরঙ্গতা আছে। কথাটা কী সত্যি? আপনার কী মনে হয় মিস জনসন?
ওহো, এই কথা? মিস জনসন হাসতে হাসতে বলেন–তা কোলম্যান এবং ডেভিড এমোট দু’জনেই শীলার নাচের সঙ্গী। আমার মনে হয়, তাদের দু’জনের মধ্যে কে শীলার জীবনসঙ্গী হবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে মন কষাকষি হতে পারে, তবে এ ব্যাপারে শীলার কোন ভূমিকা নেই, কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আর একটা কথা বলে রাখি, বিমান বাহিনীর কর্মচারীদের নাচের আসরে অনেক যুবক কর্মচারীর নাচের সঙ্গিনী হয়ে থাকে শীলা।
অতএব আপনি বলতে চাইছেন, সেরকম কিছু ঘটেনি শীলার জীবনে। গুজবটা সত্যি সত্যি গুজবই বটে!
না, আমি ঠিক সে কথা বলতে চাইছি না। মিস জনসনকে এবার একটু যেন চিন্তিত বলে মনে হল। এ কথা ঠিক যে, মেয়েটি প্রায়ই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনার একদিন কথার ছলে ডেভিড এমাটকে ঠাট্টা করে বলছিলেন, তোমার পিছনে পিছনে মেয়েরা কেন ছুটে বেড়ায় বল তো! আমার মনে হয় না, কথাটা ডেভিডের পছন্দ হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে এ ধরনের পরনিন্দা-পরচর্চা কারই বা ভাল লাগে বলুন? হ্যাঁ, শীলাও তাতে কান দেয়নি। দুর্ঘটনার দিন অপরাহ্নে আমি তাকে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে দেখেছি। মিস জনসন খোলা জানালা পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলতে থাকে তবে ডেভিড, এমাট কিম্বা কোলম্যান, কেউই সেদিন তাদের কাজে যায়নি। রিচার্ড ক্যারি ছিল ইনচার্জ। হ্যাঁ, সম্ভবতঃ এদেরই মধ্যে একজন তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকবে। তবে তাদের মধ্যে কে, কে তাকে পছন্দ করত, সেটা আমি বলতে পারব না। বিল ছেলেটি চমৎকার, যে যতই বোকা হওয়ার ভান করুক না কেন, আসলে তার মত চালাক ছেলে খুব কম আছে। শান্ত প্রকৃতির ডেভিড এমাটের মধ্যে গভীরতা আছে।
তারপর সে কৌতূহলী চোখ নিয়ে পোয়ারোর দিকে তাকাল, কিন্তু এটা কী কোন অপরাধের তালিকায় পড়ে মঁসিয়ে পোয়ারো?
আপনি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলেন মাদমোয়াজেল, ফরাসী কায়দায় হাত নেড়ে পোয়ারো বলেন যুবক-যুবতীদের প্রেমের ক্ষেত্রে আমি অত্যন্ত আগ্রহী। আমার পূর্ণ সমর্থন আছে তাদের উপরে।
বড় বিচিত্র চরিত্রের মেয়ে এই শীলা রেলি,মিস জনসন আরো বলে–কাঁচা বয়স, তবে বেসামাল নয় অবশ্যই।
পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আপনাদের স্টাফদের মধ্যে আর কোন সদস্য বাকি আছে?
মেরী মারকাডোকে দেখতে পাচ্ছি না। বোধহয় খনন কার্য দেখতে গেছেন। সবাই তখন এখানেই আছে। মিস জনসন কথা বলতে বলতে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে আসে, আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সে বলে নার্স লিথেরান আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে আপত্তি করবেন না বলেই আমার মনে হয়।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মিস জনসন, আমি তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে বললাম, মিসেস মারকাডো এখন ছাদে আছেন। আপনি কী প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করতে চান?
হ্যাঁ, সেই ভাল–চলুন উপরে যাওয়া যাক।
সিঁড়ি পথে উঠতে গিয়ে পোয়ারোকে আমি বললাম, আপনার কথা মতো, আমি তো কাজ করলাম। তা আপনি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন?
না–কোন শব্দই কানে আসেনি।
মিস জনসনকে তাহলে নতুন করে তার জবানবন্দীর কথা আবার ভেবে দেখতে হবে।
পোয়ারো আমার কথাগুলো খুব মনযোগ সহকারে শুনলেন কিন্তু হা-না কিছুই বললেন না।
প্যারাপেটের উপরে বসেছিলেন মিসেস মারকাডো। নিচের দিকে মুখ, গভীর চিন্তায় এমনি মগ্ন যে পোয়ারো তার সামনে গিয়ে সুপ্রভাত না জানানো পর্যন্ত তার হুঁশ ছিল না। তাকে খুব অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল। চোখের কোলে গভীর কালো আস্তরণ, বিমর্ষ মুখ।
আমি একটা বিশেষ কাজ নিয়ে এখানে এসেছি, বলে পোয়ারো অতঃপর কাজের প্রসঙ্গে চলে গেলেন কোন ভূমিকা না করে। সেই একই প্রশ্ন যা তিনি একটু আগে মিস জনসনের সামনে রেখেছিলেন। অর্থাৎ মিসেস লিডনার সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য তিনি জানতে ভীষণ আগ্রহী।
আমি বেশ ভাল করেই জানতাম যে, মিস জনসনের মতো সত্য কথা কিছুতেই বলতে পারে না মিসেস মারকাডো! মুখে একরকম আর কাজে আর একরকম। মুখে তিনি অবশ্য মিসেস লিডনার সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করলেন পোয়ারোর কাছে, কিন্তু আমি হাল্কা করে বলতে পারি যে, মনে মনে তিনি অকথ্য ভাষায় তার নিন্দা করতে কসুর করেন না।
ওঃ আমাদের প্রিয় লুসি। যারা তাঁকে চাক্ষুস করেনি, কিম্বা তার সংস্পর্শে আসেনি, আমি মনে করি তাদের কাছে তার গুণাবলির ব্যাপারে যত কিছুই বলি না কেন, তবু যেন আক্ষেপ থেকে যায়, হায় কিছুই বুঝি বলা হল না আমার। তার মতো অমন দরদী, পরোপকারী মিষ্টি মহিলা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে তার কোন জ্ঞান না থাকলেও, অবাক লাগে সে ব্যাপারে তার সেই অদম্য কৌতূহলের কথা ভাবতে। হ্যাঁ, শুধু এই জন্যই বোধহয় আমরা তার ব্যবহারে সবাই প্রীত ও মুগ্ধ।
ম্যাডাম, তাহলে আমি যা শুনেছি সত্যি নয়? এখানে কিছুদিন আগে যে একটা খারাপ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সত্যি নয়?
মিসেস মারকাডো বড় বড় চোখ করে তাকালেন, কে, কে এ কথা বলেছে? নার্স? না কি ডঃ লিডনার? বেচারা ডক্টর! আমার মনে হয় না, আজকাল তিনি ঠিক দেখার মতো করে দেখেন না।
মিসেস মারকাডোর কথায় অবজ্ঞার ভাব। জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পর এখন এখানকার সবাই ভান করতে চাইছে, তারা বুঝি অনেক কিছু জানে, কিন্তু আসলে তারা কিছুই জানে না। তারা অনেক ঘটনার কথা বলে, যা আদৌ ঘটেনি। জানেন, অস্বাভাবিক আবহাওয়া, উত্তেজনা, এ সব কী ঘটছে আসলে? না, আমার তা মনে হয় না। এসব হল লোকের গল্প কথা।
তারা অনেক ঘটনার কথা বলে, এর মানে আপনি কী বলতে চান ম্যাডাম? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
ওসব বাজে কথা ছেড়ে দিন। ওদের কথার মধ্যে বাস্তবতার বড় অভাব। এখানে আমরা সুখী পরিবার ছিলাম।
মিসেস লিডনারের উপর আমার দারুণ ঘৃণা হচ্ছিল। এক্সপিডিসন হাউস থেকে বেরিয়ে এসে পথে পোয়ারোকে বললাম, ওই মহিলার মত ডাহা মিথ্যুক আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আমার দৃঢ় ধারণা, সত্যি সত্যি মিসেস লিডনারকে তিনি ঘৃণা করতেন। যাইহোক, ওঁর কথা ছেড়ে দিন। সত্যি কথা ওঁর কাছ থেকে আশা করা বৃথা। মিথ্যে সময় নষ্ট।
তা ঠিক। তা ঠিক। তবে বারবার তিনি মুখে মিথ্যে কথা বললেও একদিন না একদিন তাঁর চোখের তারায় সত্যের ছবি প্রতিবিম্বিত হবে। আচ্ছা তার অতো ভয় কিসের জন্য? ছোট-ম্যাডাম–মারকাডোর জন্য? পোয়ারো তার ধারণার কথা বললেন–আমি তার চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেয়েছি। হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই কোন কিছুর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ। দারুণ কৌতূহলের ব্যাপার এটা।
আমার না বলা কথাগুলি আমাকে বারবার তাগিদ দিচ্ছিল, সব না বলতে পারলেও কিছু অন্তত বলব। শেষপর্যন্ত বলেই ফেললাম,–মঁসিয়ে পোয়ারো?
কিছু বলবেন আমাকে?
হ্যাঁ, আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল।
তারপর আমি আগের দিনের ঘটনার কথা সব খুলে বললাম। আর এও বললাম যে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই সব বেনামা চিঠিগুলোর লেখিকা হলেন মিস জনসন।
মিস জনসন মিথ্যুক। আমি তাকে বললাম, আজ সকালে ঠাণ্ডা মাথায় তিনি আপনাকে যেমন গুছিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বলে গেলেন, একটার পর একটা।
হ্যাঁ, যথেষ্ট কৌতূহল আছে তার কথার মধ্যে, পোয়ারো আমার কথা সমর্থন করে বলেন, তবে এমনও হতে পারে, গতকাল ডঃ লিডনার তাকে চিঠিগুলোর কথা বলাটা স্বাভাবিক, কারণ তারা পরস্পর দুজনের অনেকদিনের বন্ধু। আর তা যদি না হয়, তাহলে ভাববার কথা। মিস জনসন জানলেন কী করে চিঠিগুলোর কথা?
পোয়ারো কৌশলে যে ভাবে চিঠিগুলোর কথা উত্থাপন করলেন, তাতে তার উপরে আমার আরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিল সবাই তখন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমেই দেখা হল মিঃ রেইটারের সঙ্গে, দেওয়ালের ছবি তুলছিলেন তিনি তখন। ছবি নেওয়ার পর রেইটার তার ক্যামেরা এবং প্লেট সহ বয়ের হাতে তুলে দেন। ছবি তোলার ব্যাপারে তাকে কতকগুলো প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। উত্তরগুলো যে তৈরি ছিল, চটপট জবাব দিলেন তিনি। তার কাজের সম্বন্ধে প্রশ্ন করাতে তাকে যেন একটু খুশি বলে মনে হল।
মিঃ রেইটার দুঃখ প্রকাশ করলেন আমাদের তিনি বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারছেন না বলে। তারই মাঝে পোয়ারো থেমে থেকে টুকরো টুকরো কয়েকটা কথা বললেন বিক্ষিপ্তভাবে। এ ধরনের কথা বলা পোয়ারোর একটা কৌশল। সরাসরি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে অন্য কথার মাধ্যমে লোকটাকে বাজিয়ে নেন একবার। যাইহোক, শেষপর্যন্ত কাজের কথাটা তিনি বলেই ফেললেন।
বুঝেছি, বুঝেছি আপনি কি বলতে চাইছেন, মিঃ রেইটার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রয়োজনীয় উত্তরটা ঠিক ঠিক দেবার চেষ্টা করে বললেন,–কিন্তু আমার তো মনে হয় না, আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি। সত্যি কথা বলতে কি, কেবল এ বছরই আমি এখানে এসেছি। তাছাড়া মিসেস লিডনারের সঙ্গে বড় একটা কথাবার্তা আমার তখনও হত না। তাই আমি অত্যন্ত দুঃখিত মঁসিয়ে পোয়ারো, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না।
বেশ তো, পোয়ারো শান্তস্বরে বলেন–আপনি তাকে পছন্দ করতেন কি করতেন না, এর জবাব তো আপনি দিতে পারেন, কেন পারেন না?
মিঃ রেইটারের মুখটা হঠাৎ কেমন লাল হয়ে গেল, কথায় জড়তা প্রকাশ পেল। ও হ্যাঁ, লোককে আকর্ষণ করার মতো বিশেষ গুণ তার অবশ্যই ছিল, এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন।
আপনি তাকে পছন্দ করতেন? আর তিনি আপনাকে পছন্দ করতেন?
তখনও লাল দেখাচ্ছিল রেইটারের মুখ।
আ-আমি সেটা লক্ষ্য করিনি। দু’একবার আমি তার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার আড়ষ্টতা আমাকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আমার এই জড়তাই বলুন কিম্বা আড়ষ্টতাই বলুন, এর জন্য আমি তার বিরক্তির কারণ নিশ্চয়ই হয়েছিলাম। কিন্তু আজ অকপটে স্বীকার করছি, সেটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না।
পোয়ারো তার কথায় করুণাবোধ করলেন।
ঠিক তা ঠিক। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আচ্ছা, এখানকার আবহাওয়ার কী তেমন সুখপ্রদ ছিল?
অনুগ্রহ করে–
আর একটা প্রশ্ন করব, অতঃপর পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা সবাই এখানে সুখে-শান্তিতে ছিলেন তো? মানে আপনারা সবাই প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন তো?
না, না, ঠিক তা নয়। একটু অসুবিধা ছিল– রেইটার এখানে একটু থেমে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাঁপড়ার চেষ্টা করলেন বোধহয়। তারপর আবার মুখ খুললেন, দেখুন আমি খুব একটা মিশুকে নই। কেমন একটা সংকোচবোধ সব সময় আমাকে ঘিরে রাখে। ডঃ লিডনার আমার প্রতি সদাশয় সব সময়। অথচ আমি কি বোকা দেখুন, আমার এই জড়তা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না। সব সময় কেমন ভুল হয়ে যায়। এ আমার দুর্ভাগ্য।
সত্যি সত্যি তাকে কেমন অসহায় শিশুর মতোন দেখাচ্ছিল।
আমরা সবাই ছেলেবেলায় এরকম করে থাকি, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন পরে নিজেকে বিচার করে থাকি। তারপর বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে পোয়ারো স্থান ত্যাগ করলেন ধীরে ধীরে।
হয় নোকটা অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ, পোয়ারো মন্তব্য করলেন ফিরে আসার পথে, নয় তত তিনি একজন অভিজ্ঞ অভিনেতা। তাই না?
আমি কোন উত্তর দিলাম না। তার কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ ধরনের মানুষ দারুণ বিপজ্জনক হয়ে থাকে, এরা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পিছপা হয় না। তবে যে কারণেই হোক, এমন সুন্দর সূর্যস্নাত প্রভাতে সেটা অসম্ভব বলেই মনে হল আমার কাছে।
.
২১.
মিঃ মারকাডো এবং রিচার্ড ক্যারি
দেখছি ওঁরা দুজন আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করেন। এক জায়গায় একটু থেমে, কথাটা বললেন পোয়ারো।
ঝুড়ি মাথায় শ্রমিকরা মাটির নিচ থেকে উঠে আসছিল সারিবদ্ধ ভাবে, কণ্ঠে তাদের কোরাস গান, ভাষা আরবি। তেমনি দল বেঁধে কিছু শ্রমিক ঝুড়ি মাথায় ফিরে যাচ্ছিল মাটির নিচে। টুকরো টুকরো মৃত্তিকার বাসনপত্র হলেও ডঃ লিডনার বেশ আগ্রহ নিয়েই সেগুলো মাটি খুঁড়ে তুলে আনার ব্যবস্থা করছিলেন।
চলুন, ওখানে যাওয়া যাক, পোয়ারোর আগ্রহও কম নয়।
সূর্যের তাপ বাড়ছিল, আমাদের চলার গতি তাই শ্লথ হল।
দূর থেকে মিঃ মারকাড়োকে একজন ফোরম্যানের সঙ্গে আলাপরত দেখা গেল। ফোরম্যানের পরনে টুইড কোট, ডোরাকাটা মূর্তির গাউন, কচ্ছপের মতো কতকটা।
সরু পিচ্ছিল মেটো পথ। তবু শ্রমিকরা কেমন অনায়াসে বুড়ি মাথায় ওঠা-নামা করছিল। দূর থেকে তাদের ঝুলন্ত বাদুড়ের মতো দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের পক্ষে সেই পথে নামাটা বেশ কষ্টসাধ্য বলে মনে হল।
পোয়ারোকে অনুসরণ করছিলাম হঠাৎ তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন, আচ্ছা মিঃ মারকাডো ন্যাটা নাকি আর পাঁচজনের মতো ডান হাতেই সব কাজ করেন?
এ যেন এক অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন। বাজে কথা বলার লোক নন পোয়ারো। তাই অনেক ভাবনা-চিন্তার পর নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, ডান হাতই ব্যবহার করে থাকেন উনি।
মিঃ পোয়ারো প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখালেন, কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি, বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার এ ব্যাপারে। তবে মিঃ মারকাডো সঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে থাকলেন।
তারপর নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে মাটির একটা পাত্র থেকে চকমকি পাথরের ছুড়িটা তুলে নিতে গেলে মিঃ মারকাডো হঠাৎ শূন্যে লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমার দিকে করুণ চোখে তাকালেন তিনি। আর পোয়ারো অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। বাঁ হাত দিয়ে তিনি তার হাতটা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।
আগুনে পোড়া লাল ছুঁচের মত কি যেন বিধলো আমার হাতে।
সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হলেন পোয়ারো।
আসুন নার্স লিথেরান, পোয়ারো ব্যস্ত হয়ে বললেন, দেখা যাক ওঁর কি হল?
আমি এগিয়ে গেলাম।
পোয়ারো তার জামার হাতাটা গুটিয়ে কাঁধের উপরে তুলে ধরলেন ক্ষত স্থানটা নিরীক্ষণ করার জন্য।
ওই যে ওখানে–মিঃ মারকাডো অপর হাত দিয়ে নিজের ক্ষতস্থান দেখান।
কাঁধ থেকে প্রায় ইঞ্চি তিনেক নিচে এক জায়গায় রক্তের দাগ লক্ষ্য করা গেল।
আশ্চর্য! তাঁর হাতের সেই রক্তের দাগটার উপরে স্থির দৃষ্টি রেখে অস্ফুটে বললেন–কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, তবে মনে হয় পিঁপড়ে কেটে থাকবে।
একটু আইডিন লাগিয়ে দিলে ভাল হয়, আমি বললাম।
আইডিন পেন্সিল আমার সঙ্গেই ছিল। মিঃ মারকাভোর ক্ষতস্থানে আইডিন লাগাতে গিয়ে আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বুঝিবা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তার কুনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত হাতের উপরে ছোট ছোট ফুটোর দাগ। আমি বেশ ভালো করেই জানি, ওইগুলো কিসের দাগ হতে পারে। অধস্থকে প্রদেয় ইনজেকসনের ছুঁচের দাগ!
মিঃ মারকাডো জামার হাতটা নিচে নামিয়ে দিতে গিয়ে একটু আগের ঘটনাটা পুনরায় ব্যাখ্যা করলেন। মিঃ পোয়ারো তার কথাগুলো শুনলেন বটে, কিন্তু এর মধ্যে লিডনারদের প্রসঙ্গ টানতে কোন চেষ্টাই করলেন না তিনি। সত্যি কথা বলতে কি, কোন প্রশ্নই তিনি করলেন না মিঃ মারকাডোকে।
আপাততঃ মিঃ মারকাডোকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমরা আবার উপরে উঠে এলাম।
কাজটা খুব নির্ঝঞ্ঝাটে সারা গেল, তাই না?
কলারের ভাজ থেকে একটা জিনিস টেনে বার করে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করছিলেন পোয়ারো। তার হাতে রিপু করার সুঁচ জাতীয় জিনিস, মোমের আড়ালে ঢাকা, একটা পিনের মতো দেখাচ্ছিল।
মিঃ পোয়ারো? আমি চিৎকার করে উঠলাম, ওটা আপনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ, তাই তো বললাম, কাজটা বেশ নিঝঞ্ঝাটে সারা গেল। কেন আপনি লক্ষ্য করেননি?
হ্যা, আমি অকপটে স্বীকার করলাম, আমার নজর এড়িয়ে গেছে এক্ষেত্রে। শুধু আমারই বা কেন বলছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি মিঃ মারকাভোর। মনে হয়, কাজটা খুব তড়িৎগতিতে
কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি আমাকে, আপনি কোন কিছু লক্ষ্য করেছেন মিস্টার?
মাথাটা আমি নাড়লাম ধীরে ধীরে।
অধঃস্থকে প্রদেয় ইনজেকসন-এর সঁচের দাগ?
হ্যাঁ, ঠিক তাই, পোয়ারো আমাকে সমর্থন করে বললেন, তাহলে এর থেকে বোঝ যাচ্ছে, মিঃ মারকাভোর সম্পর্কে কিছু আমরা জানতে পেরেছি অন্তত। আমার সন্দেহটা যে ঠিক তা অনুমান করতে পারছি না। তবে জানাটা দরকার।
হঠাৎ পোয়ারো পকেটে হাত ঢোকালেন।
এই যা! রুমালটা আমি ফেলে এসেছি সেখানে। সেই রুমাল দিয়ে আপনি ঢেকে নিন পিনটা।
ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এই কেসের ব্যাপারে মিঃ পোয়ারো এবং আমি যথাক্রমে ডাক্তার এবং নার্স হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি। অন্তত এক্ষেত্রে মানে, এই অপারেশনের ক্ষেত্রে মিঃ পোয়ারো একজন বিরাট শল্য চিকিৎসকের ভূমিকা নিলেন যেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমি বেশ কৌতুকের সঙ্গে উপভোগ করছিলাম। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম রুমালটা আমি খুঁজে নিয়ে আসছি।
নার্সের ট্রেনিং লাভের পর আমি আমার কর্ম জীবনের রুগীদের অপারেশনের সময় সার্জেনদের সাহায্য করেছি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে দরকারী জিনিসগুলোর যোগান দিয়ে কখনও ফরসেপ, কখনও বা ছুরি-কাঁচি। আর এই মুহূর্তে ঠিক সেই রকম একটা পরিবেশের কথা আমার মনে পড়ে গেল। সেই রকম একজন সার্জেনের কথা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন পোয়ারো যেন। ঠিক সেই রকম ছোট বেঁটে-খাটো নোক, দেখতে কুৎসিত, বাঁদরের মতো মুখের অবয়ব, কিন্তু সার্জেন হিসাবে অপূর্ব। কখন কি ভাবে কাজে এগুতে হয়, সেটা তিনি বেশ ভাল করেই জানেন। বহু সার্জেনের সান্নিধ্যে আমি এসেছি, এবং তাদের মধ্যে প্রভেদটা যে কোথায়, সেটা আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। কে শ্রেষ্ঠ সার্জেন আমি তাদের কাজ দেখলেই বুঝতে পারি। সেই রকম পোয়ারোর মধ্যে তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় পেয়েই বোধহয় তার উপরে আস্থা আমার আরও বেড়ে গেল।
রুমাল হাতে ফিরে এসে প্রথমে আমি তাকে দেখতে পাই না। তবে শেষপর্যন্ত তাকে দেখতে পেলাম, তখন তিনি কথা বলছিলেন মিঃ ক্যারির সঙ্গে। আর মিঃ ক্যারির লোক তার কাছে দাঁড়িয়েছিল, তাঁর হাতে সেই বিরাট রড, যার উপরে মিটারের দাগ দেওয়া। তবে সেই সময় তিনি সেই লোকটাকে কি যেন বললেন–পর মুহূর্তেই চলে গেল সে। মনে হয়, আপাততঃ সেই রডটার কাজ তাঁর শেষ হয়ে গেছে।
পোয়ারোকে এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে তিনি তার রুমাল খুঁজে আনতে পাঠালেন কেন? তবে কি তিনি আমাকে রুমাল খুঁজে আনার অছিলায় দূরে সরিয়ে রাখলেন? আর আমার অনুপস্থিতিতে তিনি তার প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে নিলেন?
এও যেন সেই অপারেশনের ব্যাপার। বড় বড় সার্জেনরা তাদের কাজের সুবিধার জন্য চরম মুহূর্তে নবাগত নার্সদের মামুলি কাজের অছিলায় অপারেশন থিয়েটার থেকে সরিয়ে দেয়, পাছে তারা ভুল করে বসে, কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, এখনও পর্যন্ত আমার কাজে কোন ভুল হয়নি। অবশ্য আমি মনে করি না, মিঃ ক্যারির সঙ্গে তার কথা আমাকে শুনতে দিতে তিনি নারাজ। মনে হয় আমার অনুপস্থিতিতে মিঃ ক্যারির সঙ্গে বেশ খোলাখুলিভাবে তার আলোচনা করতে সুবিধা হবে বলেই তিনি আমাকে বুদ্ধি করে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামানো আমার স্বভাব নয়। তবে এ কথাও ঠিক যে, মিঃ পোয়ারো একান্তই যদি তার ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে মিঃ ক্যারির সঙ্গে আলাপ করে থাকতেন তাহলে আমি অমন আগ্রহ নিয়ে তাদের কথায় কান রাখতাম না। একটা সুবিধাজনক স্থানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। যাইহোক, অনুভূতিশূন্য রুগীর (অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগে) কাজ থেকে অনেক কিছু শুনতে পাবেন। তবে রুগী চাইবে না, আপনি শুনুন সব কথা শুনলেও সে কিছু টের পাবে না। এক্ষেত্রে মিঃ ক্যারিকে আমি রুগী হিসাবে ধরে নিয়েছি।
বিরাট আবর্জনা স্তূপের পিছনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম বলে ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। লুকিয়ে এভাবে আড়ি পেতে অপরের কথা শোনা যদি নিয়ম-বহির্ভূত হয়, সে কথা মানতে আমি রাজী নই। কোন কেসের ভারপ্রাপ্ত নার্সের কাছে কিছুই গোপন করা উচিত নয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ডাক্তারের কর্তব্য হল কি করা উচিত, সে কথা বলে দেওয়া।
পোয়ারোর মনে কি আছে, তখনও আমি জানি না। তবে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার প্রথমে নজর পড়ল তার চোখের উপরে। তার সন্ধানী চোখ দুটি যেন কি খুঁজছিল তখন।
ডঃ লিডনার যে তার স্ত্রীর প্রতি অনুগত ছিলেন, সেটা এখানকার কেউই পছন্দ করতেন না, তিনি তখন বলছিলেন–তাই এর থেকে অনুমান করা যায়, একজনের সম্বন্ধে জানতে গেলে তার বন্ধুদের চেয়ে শত্রুর কাছ থেকে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, তাদের সতোর থেকেই দোষ-ত্রুটির বেশি গুরুত্বপূর্ণ? প্রশ্ন করলেন মিঃ ক্যারি। তাঁর কথায় বিদ্রুপের ছোঁয়া ছিল।
নিঃসন্দেহে তাই বিশেষ করে খুন সংক্রান্ত কেস হলে তো কোন কথাই নেই।
আমার আশঙ্কা, এ ব্যাপারে আমি বোধহয় আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারব না, মিঃ ক্যারি বলেন। সত্যি কথা বলতে কি মিসেস লিডনারের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকা দূরে থাক কোন ব্যাপারে তার সাথে আমার কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি। যদিও আমরা কেউ কারোর শত্রু ছিলাম না, তবে ঠিক বন্ধু যে ছিলাম একথাও আবার বলা যায় না। মিসেস লিডনারের স্বামীর পুরানো বন্ধু আমি, সম্ভবত এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে তার বোধহয় ঘোরতর আপত্তি ছিল। আমরা স্বীকার করছি, সবাইকে আকর্ষণ করার মতো রূপ, মাধুর্য সবই ছিল, তবু বলব–ডঃ লিডনারের উপরে তাঁর জোর খাটানো, তাকে তার প্রতি একান্ত অনুগত করে তোলার বিরুদ্ধে আমাদের বিরক্তি, ক্ষোভ যথেষ্ট। যার ফলে তার সঙ্গে মিশতে গিয়ে আমরা সবাই নম্রতা, ভদ্রতার একটা মুখোস পরে থাকতাম, কোনদিন তার একান্ত কাছে যাইনি, তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠিনি আমরা।
তাহলে আপনার কথামত ধরে নেওয়া যায় যে, মিসেস লিডনারকে আপনি সত্যি-সত্যি পছন্দ করতেন না।
মিঃ ক্যারি নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠলেন। পোয়ারোর সজাগ দৃষ্টি তার উপরে নিবদ্ধ।
মিস জনসনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। ডঃ লিডনারের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করতে তিনি নারাজ। তবে তার কথাবার্তা শুনে মনে হয় মিসেস লিডনারকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। মিসেস মারকাডোর অভিমতও ঠিক তাই। তাঁর মতে মিসেস লিডনারের মতো অমন চমৎকার মহিলা আর কেউ হতে পারে না। তাই না?
হ্যাঁ, না কোন উত্তর দিলেন না মিঃ ক্যারি। পোয়ারো মিনিট দুই তার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন এবার–কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না বলেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আপনার কথা শুনেও আমার মন ভরল না। অর্থাৎ আপনার কথাও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ ক্যারি।
ক্যারির চোয়াল দুটো কেমন কঠিন হয়ে উঠল। বেশ বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে তিনি রেগে যাচ্ছেন, তাঁর কথায় সেই রাগটা প্রকাশ পেল।
মিঃ পোয়ারো, একটা কথা আপনাকে বলে রাখি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন কি না, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। যা সত্যি তাই বললাম, এখন সেটা গ্রহণ করা না করা আপনার ব্যাপার। এর বেশি কিছু আমি বলতে চাই না।
পোয়ারোর মুখ দেখে মনে হল, ক্যারির কথায় একটু ক্ষুণ্ণ হলেন বটে, কিন্তু রাগের কোন লক্ষণ প্রকাশ করলেন না তিনি। কেমন শান্ত এবং সংযত স্বরে তিনি বললেন–এ আমার অপরাধ, হয়তো বিশ্বাস করতে পারি না বলে। কিন্তু আমিও মানুষ। মনে রাখবেন মিঃ ক্যারি–বুঝতে পারবেন, এখন এখানে নানান গুজবের গল্প আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার কিছু কাহিনী আছে যা শুনে সত্যি সত্যি উপলব্ধি করতে হয়। উপলব্ধি করার মতো সেই সব কাহিনীর কথা আমি এখানে বলতে চাইছি, বুঝলেন?
আমি স্পষ্ট দেখলাম, পোয়ারোর কথায় হয়তো সামান্য একটু বিচলিত হলেন মিঃ ক্যারি, তবে তাতে তার মুখটা আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই কারণেই মেয়েরা বোধহয় তার প্রেমে পড়ে যায়।
তা সেসব কাহিনী কিসের শুনতে পারি?
মিঃ ক্যারির দিকে আড়চোখে তাকালেন পোয়ারো–আপনি হয়তো অনুমান করতে পারেন, সেই চিরন্তন কাহিনী মিসেস লিডনার এবং আপনাকে কেন্দ্র করে সেই সব কাহিনী।
ছিঃ ছিঃ মানুষের মন কত হীন! বিরক্তির ছোঁয়া মিঃ ক্যারির কথায় প্রকাশ পায়। আর আপনি সেই সব কাহিনী বিশ্বাস করেন?
আমি সত্যের প্রকাশ দেখতে চাই মিঃ ক্যারি! আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কথাটা বললেন পোয়ারো।
আমার সন্দেহ হয়, প্রকৃত সত্য ঘটনা আপনি শুনেছেন কি না?
বেশ তো, আপনি শোনান না সেই সত্য ঘটনার কথা। পাল্টা প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।
তাহলে সত্যি কথাটা শুনবেন? মিঃ ক্যারির কথায় ঘৃণা, বিরক্তি ঝরে পড়ে, লুসি লিডনারকে আমি ঘৃণা করতাম। আমি তাকে ঘৃণার চোখে দেখতাম, এখনও দেখি–বুঝলেন?
.
২২.
এমোট ল্যাভিগনি এবং নতুন আবিষ্কার
দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ক্যারিকে চলে যেতে দেখা যায়। রাগে গজরাচ্ছিল সে তখন। তার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো ফিসফিসিয়ে বললেন–হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি।
তারপর মাথা না ঘুরিয়ে তাকে এবার একটু জোরে বলতে শোনা গেল, এখানে মিনিট খানিকের জন্য এসো না নার্স। আমার রুমালটা আপনি পেয়েছেন? অজস্র ধন্যবাদ।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে আমি এতক্ষণ তাঁদের আলোচনার কথা শুনছিলাম, সে ব্যাপারে কোন উল্লেখই তিনি করলেন না। যাক একটা জবাবদিহির হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল।
মিঃ পোয়ারো, মিসেস লিডনারকে উনি ঘৃণা করতেন, এ কথাটা সত্যি কী আপনার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়? থাকতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম শেষপর্যন্ত।
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন পোয়ারো, কৌতূহলী চোখ। হ্যা। ঠোঁটটা তার নড়ে উঠল, আমার মনে হয়, সত্যি-সত্যি তিনি তাকে ঘৃণা করতেন।
তারপর তিনি দ্রুত পায়ে উপরে উঠে এসে হাঁটতে শুরু করে দিলেন কাছেই মাটির ঢিবিটার দিকে। দু’একজন আরব দেশীয় লোক ছাড়া অন্য কারোর মুখ আমাদের চোখে পড়ল না। অবশেষে ঢিবির সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই চোখে পড়ল ডেভিড এমোটকে। মুখ তার নিচের দিকে। চোখের সামনে একটা কঙ্কাল ঝাড়পোঁছ করেছিলেন, সবেমাত্র সেই কঙ্কালটা মাটির নিচ থেকে তুলে আনা হয়েছিল।
আমাদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই একটা মিষ্টি হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠতে দেখা গেল।
কি ব্যাপার, জায়গাটা ঘুরে দেখতে চান? জানতে চাইলেন এমোট, এক মিনিট, হাতের কাজটা সেরে নিয়েই আপনাদের সঙ্গে কথা বলব, কেমন?
এমোট আবার তার কাজে মন দিলেন। ছুরি দিয়ে সেই কঙ্কালটার উপর থেকে মাটি চেঁছে পরিষ্কার করলেন খুব যত্ন নিয়ে, মাঝে মাঝে কঙ্কালটার উপরে মুখ নামিয়ে ঠু দিচ্ছিলেন ধুলো ঝাড়বার জন্য।
এটা ভাল নয় মিঃ এমোট। ওই কঙ্কালটার মধ্যে কত বিষাক্ত বীজাণু থাকতে পারে। আপনার মুখে বীজাণু যদি–।
ওই সব বিষাক্ত বীজাণু আমার নিত্য খাদ্য নার্স, আমাকে বাধা দিয়ে তিনি আরও বলেন–কোন বীজাণুই প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে ক্ষতিকারক হতে পারে না বুঝলেন!
কঙ্কালটার আকৃতি দেখে মনে হয় কোন মহিলার। ছুরি দিয়ে দাগ কাটছিলেন কঙ্কালটার উপরে। মিঃ রেইটার সেই সব চিহ্নিত অংশের ফটো তুলবে মধ্যাহ্ন ভোজের পরে।
কে, কে এই মহিলা?? পোয়ারোই প্রথম সেই কঙ্কালের প্রসঙ্গে গেলেন।
প্রথম হাজার বছরের কোন এক সময়ের মহিলা হবেন হয়তো। করোটিটা একটু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। মারকাডোকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে বলব। দেখে মনে হয় মহিলার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না।
তবে কি ধরে নিতে পারি, হাজার হাজার বছর আগে আর এক মিসেস লিডনারের মতো?
সম্ভবত, সংক্ষিপ্ত উত্তর মিঃ এমোটের।
বিল কোলম্যান একটা পাথরের টুকরো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। এমোট তাকে ডেকে সংক্ষেপে কি যেন বলবেন, ঠিক বোঝা গেল না। তারপর এক সময় কব্জি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এমোট ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে।
এবার কী বাড়ি ফিরে যাবেন?
গেলে মন্দ হয় না! পোয়ারো এমনভাবে বললেন–যেন এমনটিই চাইছিলেন তিনি।
আস্তে আস্তে হাটছিলাম আমরা। পোয়ারোই প্রথম মুখ খুললেন–আমার বিশ্বাস, পুনরায় কাজে ফিরে এসে আপনারা সবাই বেশ খুশি, তাই না?
হ্যাঁ, ভালই তো, এমোট গর্বভরে জবাব দেন, বাড়িতে বসে খোশ-গল্প করার থেকে এ অনেক ভাল।
আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন খুনীর এ কথা জেনেও পোয়ারো প্রশ্নটা করে স্থির চোখে তাকালেন এমোটের দিকে।
এমোট কোন উত্তর দিলেন না, কিম্বা ভিন্নমতও পোষণ করলেন না। এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে–হাউসবয়দের ডেকে মিঃ পোয়ারো জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই এমোট জেনে গেছেন, তাঁরা সবাই এখন তার চোখে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন লোককে তিনি খুনী বলে ঘোষণা করতে পারেন–বলতে পারেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল, ইত্যাদি—
মিঃ পোয়ারো? শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ এমোট–আপনি কোন সূত্রের সন্ধান পাচ্ছেন বলে মনে হয়?
যে-কোন মুহূর্তে পাবার আশা রাখি বৈকি! পোয়ারো বেশ গর্বের সঙ্গেই কথাটা বললেন–তবে সেটা নির্ভর করছে, আপনারা কতটুকু সাহায্য আমাকে করবেন তার উপরে।
বেশ তো, আমি আপনার কী সাহায্যে লাগতে পারি বলুন?
আগের মতই এমোটের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে পোয়ারো বলেন–এই কেসের কেন্দ্র-ব্যক্তি হলেন মিসেস লিডনার। আমি তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই মিঃ এমোট।
তা আপনি তার সম্বন্ধে কী জানতে চান বলুন তো?
কোথা থেকে তিনি এসেছেন? কুমারী বেলায় কি তার পদবী ছিল, কি রকম দেখতে ছিলেন, তার চোখের রং কি ছিল, এসব আমি জানতে চাই না। মানে আমি কেবল তার সম্বন্ধে জানতে চাই। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই!
আপনি কী মনে করেন এই কেসের ব্যাপারে সেটা খুব প্রয়োজনীয়?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। পোয়ারো বলেন, আর এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আপনি বলতে পারেন, ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন তিনি।
আমি কী পারব?
কেন, এর আগে আপনি কী কখনও ভেবে দেখেননি?
মিঃ এমোট কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হয় কিভাবে শুরু করা যায়, সেই কথাটা তিনি ভাবছিলেন। ভাববার পর তিনি বললেন, তার সম্বন্ধে নার্স কি ভাবেন সেটা আমাদের আগে জানা দরকার। একজন মহিলা অন্য আর এক মহিলাকে খুব তাড়াতাড়ি চিনে নিতে পারে। আর নার্স হিসাবে ওঁর অভিজ্ঞতা প্রচুর।
আমার বলার ইচ্ছা থাকলেও পোয়ারো আমাকে বলার সুযোগ একেবারে দিলেন না। আমার হয়ে তিনি দ্রুত বললেন–তার সম্বন্ধে একজন পুরুষের কি চিন্তাধারা সেটা জানাই আমার উদ্দেশ্য। এমোটের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা।
আমার মনে হয় চিন্তাধারা একই হবে, একটু থেমে তিনি আবার বলেন, বয়স তার যথেষ্ট হয়েছিল, তবে আমি হলপ করে বলতে পারি যে, এই বয়সেও তার মত অমন রূপসী মহিলার সংস্পর্শে আমি এর আগে কখনও এসেছি বলে মনে হয় না।
এ তমামুলি উত্তর মিঃ এমোট, এমোটের কথায় পোয়ারোর মনপুতঃ হল না, আমি আপনার কাছ থেকে আরও কিছু আশা করি।
মিনিট দুই চুপ করে থেকে এমোট আবার বলতে শুরু করলেন–ছেলেবেলায় আমি এক রূপকথার কাহিনী শুনেছিলাম। তুষার রানী এবং খুদে কে। আমার ধারণা, মিসেস লিডনারকে সেই তুষার রানীর সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে না।
ও, হ্যাঁ, হানস্ এন্ডারসনের গল্প তাই না? আর হ্যাঁ, সেই কাহিনীতে একটি ছোট্ট মেয়ের ভূমিকা ছিল। কি যেন মেয়েটির নাম? জেরদা না?
হতে পারে। তবে আমার খুব বেশি মনে নেই।
ওঁর সম্বন্ধে আর একটু আলোকপাত করতে পারেন না, মিঃ এমোট?
ডেভিড এমোট মাথা নাড়লেন।
আপনি তো জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, বড় দুরূহ নারী চরিত্র। দেবতারা যেখানে তাদের চরিত্র ঠিক ভাবে নিরুপণ করতে পারেন না, আমি মানুষ। তাদের থেকে বেশি কি আর জানতে পারি বলুন? সত্যি বড় বিচিত্র ছিল মিসেস লিডনারের চরিত্র। তার চেয়েও বিচিত্র ছিল তার মন। এই রোদ, এই বৃষ্টির মতন। তার মনের হদিশ পাওয়া বড় মুশকিল ছিল। আজ হয়তো তাকে খুব রূঢ় বলে মনে হল, আবার কাল সকালে তার ব্যবহার হয়তো অতি মনোরম বলে মনে হবে। তবে ওঁর সম্বন্ধে মুখে আমরা যাই বলি না কেন আপনি ঠিকই বলেছেন এ কেসের কেন্দ্রবিন্দু হলেন তিনি। আর তিনিও তো নিজেকে ঠিক এই রকমই চাইতেন সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে। সবাই তাকে মান্য করুক, খাতির করুক আর তিনি তাদের উপরে খবরদারি করুন। এই ছিল তাঁর কাম্য।
আর কেউ যদি তাকে সেই ভাবে সন্তুষ্ট করতে অপারগ হয়ে থাকেন? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–তার সম্ভাব্য পরিণাম কী ঘটতে পারত অনুমান করেছেন?
সেক্ষেত্রে তার রূপ হত অতি কদাকার।
এই কথার পর আমি লক্ষ্য করলাম মিঃ এমোটের চোয়াল দুটো কেমন শক্ত হয়ে উঠল, দাঁতে দাঁতে ঘষছিলেন কথা বলতে গিয়ে। এই পরিবর্তনটাই কী আশা করছিলেন মিঃ পোয়ারো?
আমার অনুমান মিঃ এমোট, বেসরকারিভাবে আপনি আপনার মতামত, জানাতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না, পোয়ারো আর কোন ভূমিকা না করেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, মিসেস লিডনারের সম্ভাব্য খুনী কে হতে পারে মিঃ এমোট?
জানি না। মিঃ এমোট সরাসরি অস্বীকার করে বসলেন–সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এক এক সময় আমি ভাবি, আমি যদি কার্ল রেইটার হতাম, তাহলে আমি হয়তো তার সম্ভাব্য খুনী হতে পারতাম। কার্লের কাছে তিনি ছিলেন শয়তান। তবে তার সেই ভূমিকায় কার্লের সমর্থন ছিল বোধহয়। সে নিশ্চয়ই চাইতো, তাঁর কাছে তিনি শয়তানের রূপ নিয়ে দেখা দিন, তাকে তিনি লাথি মেরে বিদেয় করুন।
তা মিসেস লিডনার কি তাকে সত্যি সত্যি লাথি মেরেছিলেন?
না। ঠিক তা নয়। তবে এমব্রয়ড্রারির সুঁচ দিয়ে খোঁচা মারার মতোন আর কি। কাউকে পিছন থেকে লাথি মারার পদ্ধতিই ছিল তার ঠিক এই রকম।
আড়চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালাম তার ঠোঁট জোড়া ভয়ে কেঁপে উঠতে দেখলাম।
কিন্তু, পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু কার্ল রেইটার যে তাকে খুন করতে পারেন, এ ধারণা আপনার নেই নিশ্চয়ই!
না নেই। আমার মনে হয় না, কোন নারী আপনাকে বার বার বোকা বানালেও আপনি এমন কোন অস্বাভাবিক আচরণ করবেন না, যাতে করে সেটা খুনের পর্যায়ে নেমে আসে।
পোয়ারো মাথা নাড়তে নাড়তে কি যেন ভাবছিলেন।
মিসেস লিডনারকে অমানুষের পর্যায় ফেলতে চান ডেভিড এমোট। সেই সঙ্গে আবার বিপরীত দিকটার কথা চিন্তা করতে গেলে অন্য কিছুও ভাবতে হবে বৈকি। ওদিকে মিঃ রেইটারের আচরণ অত্যন্ত রিক্তিকর এবং অসহ্য।
আমি একবার ভাবলাম–মিঃ পোয়ারোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। কিন্তু আসন্ন মধ্যাহ্ন ভোজের প্রস্তুতির জন্য সুযোগ পাওয়া গেল না তখন।
ডাইনিং রুম। মিঃ এমোটের আসতে একটু দেরি হল। আমি এবং তিনি প্রায় এক সঙ্গে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলাম। মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডো আগেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে এবং তারপর মিনিট কয়েক পরে মিঃ মারকাডো, মিঃ রেইটার এবং বিল কোলম্যান আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
ওদিকে ফাদার ল্যাভিগনির ডাকে পোয়ারো তার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন।
আমরা সবাই যে যার আসনে বসে। আবার বয়কে দিয়ে মারকাডো খবর পাঠিয়েছেন। ফাদার ল্যাভিগনির কাছে, মধ্যাহ্নভোজ প্রস্তুত, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শুনে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। আমাদের মধ্যে মিস জনসনকে একটু বেশি ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম। তার মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর তার, কী ব্যাপার? আবার কী ঘটল?
সেই মুহূর্তে পোয়ারো এবং ফাদার ল্যাভিগনি এসে উপস্থিত হলেন সেখানে।
আমরা ভাবলাম, কেউ বোধহয় আহত হল, বললেন মিস জনসন।
আমি হাজার বার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মাদমোয়াজেল, পোয়ারো দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দোষটা আমার। ফাদার ল্যাভিগনির ঘর থেকে চিৎকারটা আমি করেছিলাম। আপনারা হয়তো সেই চিৎকার শুনেই পোয়ারো কিন্তু তার সেই চিৎকারের কারণটা খুলে বললেন না।
আমরা ভাবলাম, মিসেস মারকাডো হাসতে হাসতে বললেন–আর একজন খুন হলেন বুঝি। তাঁর কথা শুনে দমফাটা হাসির ফোয়ারায় ফেটে পড়ল সবাই।
মেরী? মারকাডোর কথায় ধমকের সুর। ছোট্ট কথায় যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। স্ত্রীকে সতর্ক করে দিলেন তিনি–অবুঝের মত হেসো না, এখন হাসবার সময় না।
ওদিকে মিস জনসন তখন কান খাড়া করে শুনছিলেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু। সীমাবদ্ধ ছিল বেশির ভাগ প্রত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে।
পোয়ারোকে সঙ্গে নিয়ে ফাদার ল্যাভিগনি প্রবেশ করলেন সেই এ্যান্টিক রুমে। আমিও অনুসরণ করলাম তাদের। সব কিছু খুঁটিয়ে জানার প্রবণতাটা আমার মনের মধ্যে দারুণভাবে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তখন। ফাদার ল্যাভিগনি তখন একটা সোনার কাপ দেখাচ্ছিলেন পোয়ারোকে, পোয়ারোর মুখ থেকে সেই জিনিসটার ভূয়সী প্রশংসা শুনলাম।
আঃ! কি চমৎকার! কি অদ্ভুত কারুকার্য!
মধ্যরাত্রে অতিথিদের কাছে এটা একটা বিরাট আকর্ষণ। আমার উপস্থিতির কথা খেয়াল না করেই তারা ফরাসী ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকেন।
ওদিকে মিসেস মারকাডো তার স্বামীর জন্য মোজা বুনতে ব্যস্ত, মিস জনসনের চোখ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। মিস জনসন সাধারণতঃ নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই তাকে এ সময় বই পড়তে দেখে অবাক লাগল।
পোয়ারো সবার অজান্তে তার পর্যবেক্ষণের কাজটা ঠিক চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলাম, মিস জনসনই তার বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরগুলো দিচ্ছিলেন।
কার্ডবোর্ডের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন পোয়ারো। সেফের ভিতরে ঘরে ঘরে সাজানো রয়েছে প্ল্যাস্টিসিন, ডিউরেফিক্স, ফটোগ্রাফিক পেস্ট এবং অন্য আর কিছু টুকিটাকি জিনিস। ভাল করে নিরীক্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ল পোয়ারোর। কার্ডবোর্ডের ভিতরের লুকনো রয়েছে কোঁচকানো একটা জিনিস।
ওটা, ওটা কী মাদমোয়াজেল? কথা বলতে বলতেই একটা হাত ঢুকিয়ে দেন পোয়ারো সেই কার্ডবোর্ডের পিছনে। এবং একটু পরেই তাঁকে দেখা যায়, একটি ধুলো মলিন কোঁচকানো জিনিস হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। একটা বোবা বিস্ময় ছড়িয়ে ছিল তার সারা চোখেমুখে।
এক সময়, পোয়ারো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তার হাতের সেই জিনিসটা স্পষ্ট হল আমাদের কাছে। যার নাম মুখোশ। ভারতীয় কালি দিয়ে আঁকা মুখ চোখ। রঙটা যেন একটু কাঁচা। সমস্ত জিনিসটার উপরে প্লাস্টিসিন (প্লাস্টিক জাতীয় তরল পদার্থ) প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয়।
সত্যি কি অস্বাভাবিক জিনিস এটা। মিস জনসন বিস্মিত। কিন্তু ওটা তো আমি এর আগে কখনও দেখিনি ওখানে, ওটা এল কী করে? আর ওটা কিই বা?
লুকিয়ে রাখার জায়গা হিসাবে কাপবোর্ডটা হয়তো আদর্শ। আমার অনুমান এই সিজন কাপবোর্ডটা কখনও ঘোরানো হয়নি। ওটা কি, এবং ওটার প্রয়োজনই বা কি, মনে হয় উত্তরটা পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, মৃত্যুর আগে মিসেস লিডনার তার ঘরের জানালার সামনে হঠাৎ একটি ভুতুড়ে মুখের আবির্ভাব। ঘটতে দেখেছিলেন, দেহবিহীন মুখ।
হঠাৎ মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন।
মিস জনসনের মুখটা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিড়বিড় করে তিনি বলতে থাকেন, তাহলে এখন মিসেস লিডনারের মৃত্যুটাকে আর স্বাভাবিক ভাবা যায় না কিছুতেই। মৃত্যু নিয়ে মারাত্মক খেলা। কিন্তু কে তার মৃত্যু নিয়ে এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলতে পারে?
হ্যাঁ, আমারও সেই প্রশ্ন, মিসেস মারকাডোও চিৎকার করে উঠলেন–কে, কে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে বলে মনে হয়?
উত্তর দেবার কোন চেষ্টা করলেন না পোয়ারো। তাঁর মুখটা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছিল। একটা কার্ডবোর্ড বক্সের ভিতরে সেই কোঁচকানো মুখোশটা রাখলেন।
এটা পুলিশকে অবশ্যই দেখানো দরকার। তাহলে আপনি কী মনে করেন, সব কিছু এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? মিসেস মারকাডো তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, মানে সম্ভাব্য অস্ত্র বলতে, গদা, মুগুর জাতীয় রক্ত মাখা কোন অস্ত্র যা দিয়ে মিসেস লিডনারকে হত্যা করা হয়–ওঃ! আমার ভীষণ ভয় করছে।
আর একটু হলে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, মিস জনসন ঠিক সময়ে ধরে ফেললেন তাকে।
শান্ত হন। ধমকের সুরে মিস জনসন তাকে বলেন–ডঃ লিডনার রয়েছেন, আমরা ভেঙ্গে পড়লে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে; তাই এভাবে আমাদের ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়।
বস্তুতপক্ষে সেই মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন ডঃ লিডনার। বিবর্ণ মুখ। চোখের কোলে কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। এই তিন দিনে তার বয়স যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
শান্ত গলায় ধীরে ধীরে তিনি খবরটা দিলেন–কাল সকাল এগারোটায় অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। মেজর ডীন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া পরিচালনা করবেন।
মিসেস মারকাডো আমতা আমতা করে কি যেন বলতে গেলেন, কিন্তু কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে।
অ্যানি, তুমি আসছো তো? মিস জনসনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন ডঃ লিডনার।
হ্যাঁ প্রিয়, নিশ্চয়ই আসব। কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে গলা কেঁপে উঠল মিস জনসনের।
প্রিয় অ্যানি, ডঃ লিডনারের কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া। তুমি আমার পুরানো বান্ধবী, আমার দুঃসময়ের সঙ্গিনী। তোমার কাছে এলে আমার সব দুঃখ জ্বালা যেন নিমেষে জুড়িয়ে যায়।
ডঃ লিডনার কাছে গিয়ে মিস জনসনের হাতে হাত রাখেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম–মিস জনসনের দেহটা ঈষৎ কেঁপে উঠল, মুখের রঙ লাল হল। সেই মুহূর্তে কেন জানি না আমার মনে হল, মিস জনসনের মতো সুখী মহিলা আর কেউ সেখানে ছিল বলে মনে হয় না।
আর একটা সম্ভাবনার কথা হঠাৎ আমার মনে উদয় হল। সম্ভবত পরে কোন এক সময় পুরানো বন্ধুত্বের সুবাদে ওঁরা পরস্পরের কাছে আসার চেষ্টা করবেন এবং এক নতুন সুখী জীবন হয়তো গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার আগে এসব কথা আমার চিন্তা করা উচিত নয়, তবু মনে হয় ওঁদের বন্ধুত্বের পরিণতি এভাবেই হওয়া উচিত। বিশেষ করে মিস জনসন যখন মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি অনুরক্ত বাকি জীবনটা মিলন সুখে গা ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। আর আমি তো জানি, মেয়েরা যে জিনিসটা চাইব মনে করে, না পাওয়া পর্যন্ত থেমে থাকতে পারে না।
তারপর ডঃ লিডনার ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে, জানতে চাইলেন কেসের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি হল কিনা।
ডঃ লিডনারের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস জনসন। তার দৃষ্টি পড়েছিল পোয়ারোর হাতের কার্ডবোর্ডের বক্সের উপরে। চোখে করুণ মিনতি পোয়ারোর প্রতি। তিনি যেন ওই বাক্সবন্দি মুখোশের কথাটা এই মুহূর্তে ডঃ লিডনারকে না বলেন। অন্তত আর একটা দিন তিনি যেন চুপ করে থাকেন এ ব্যাপারে।
পোয়ারো তার অনুরোধ রাখলেন। ধীরে ধীরে ডঃ লিডনারের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললেন–এসব কেসের কাজে অগ্রগতি হয় অতি ধীরে ধীরে মঁসিয়ে।
তারপর দু’একটা দরকারি কথাবার্তা সেরে ডঃ লিডনার স্থান ত্যাগ করে চলে যান।
মিঃ পোয়ারোকে একা পেয়ে আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিল ডজন খানেক প্রশ্ন করি তাঁকে। কিন্তু কিছুই বলা হল না। সার্জেনের সামনে সহকারী নার্স যেমন অসহায় বোধ করে, আমার অবস্থাও ঠিক তাই। ডাক্তারের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া নিজস্ব বক্তব্য বলতে কিছু থাকতে যে পারে না, এই মুহূর্তে সেই সত্যটা বার বার আমি উপলব্ধি করলাম।
কিন্তু মিঃ পোয়ারো আমার সব ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিয়ে বললেন, খুকুমণি, এখন থেকে আপনি আপনার নিজের যত্ন নেবেন। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বলেন, আমার আশঙ্কা এ জায়গাটা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। যত তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে চলে যান।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে ডঃ লিডনারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই, আমি তাকে বললাম। কিন্তু অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কাজ সমাধা না হওয়া পর্যন্ত তো আমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারছি না আঁসিয়ে!
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, সেই সময়টুকু অযথা কোন বাড়তি উৎসাহ দেখাবার চেষ্টা করবেন না। আপনার কাজ হল আমাকে ছুরি কঁচি এগিয়ে দেওয়া আর আমার কাজ হল রুগীর অপারেশন করা বুঝলেন?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। আমি তখন বেশ বুঝে গেছি, এরপর আমার কৌতূহল দমন করতে হলে কি করা উচিত।
পোয়ারো নিজে থেকেই আবার বললেন–ফাদার ল্যাভিগনি বড় অদ্ভুত মানুষ।
একজন সন্ন্যাসীর প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়াটা আমার কাছে কেমন যেন বেমানান বলে মনে হয়। কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না আমি।
আমি প্রোটেস্ট্যান্ট, আমি কিন্তু একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমার বেশ ভাল ধারণা আছে। তারপর তিনি চোখে ভ্রুকুটি টেনে বলেন মনে রাখবেন, ফাদার ল্যাভিগনি আপনার থেকে অনেক বেশি চতুর। যে-কোন মুহূর্তে তিনি আপনার সর্বনাশ করতে পারেন।
আমার তখন মনে হল–গল্পকথা শুনে তিনি যদি আমাকে সতর্ক করে থাকেন, সে সতর্কতায় কোন গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। আমার অন্তত তাই মনে হল।
.
২৩.
মনোবিশ্লেষণের পালা
মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় তার শত্ৰুমিত্র নির্বিশেষে সবাই যোগ দিলেন। এমনকি শীলা রেলি পর্যন্ত। তার পরনে ছিল কালো রঙের কোট এবং স্কার্ট। তাকে খুব শান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে এসে ডঃ লিডনারকে অনুসরণ করলাম এবং আমার প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গটা তুললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। প্রশংসা করে বললেন, আমি নাকি আমার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছি। আমাকে তিনি বাড়তি এক সপ্তাহের বেতন দিতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম–আমার তো একদিনেরও বেতন পাওয়া উচিৎ নয় ডঃ লিডনার। আপনি বরং আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার খরচটা দিন, তাতেই যথেষ্ট বলে মনে করব আমি।
তুমি অহেতুক কিন্তু উতলা হচ্ছ। ওসব কথা মাথায় এনো না। আমি তো আর তোমাকে মহিলা গোয়েন্দা হিসাবে নিযুক্ত করিনি। তাছাড়া আমার স্ত্রীর এমন আসন্ন বিপদের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, স্নায়ুর চাপে ভুগছে, সাময়িক, কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শেষ দু’তিন দিন ওকে আমি বেশ খুশিই বলে মনে করেছিলাম। তোমাকে বিশ্বাস করে নিয়েছিল ও। অতএব তোমার অনুতাপ করার কিছু নেই এই ব্যাপারে।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর তাঁর। আমি জানি কি ভাবছেন তিনি। মিসেস লিডনারের ভয়কে তেমন কোন গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য একমাত্র তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। ডঃ লিডনার, আমার কেমন কৌতূহল হল, জিজ্ঞাসা করলাম–সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনি কী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন?
কোনটা যে বিশ্বাস করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা, মিঃ পোয়ারো কি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন?
আমি জানি গতকাল পর্যন্ত কোন খবর নেই। তবে একবার ভাবলাম মিস জনসনের নামটা উল্লেখ করে দেখি তার মনে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়। চিঠিগুলোর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গত পরশু ডঃ লিডনার এবং মিস জনসনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গভাব আমি দেখেছি, তাতে আমার আগ্রহটা নতুন করে আবার জেগে উঠল। তবে মিস জনসন যদি একান্তই চিঠিগুলো লিখে থাকেন তাহলে এ কথা ঠিক যে, মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পরে তার সময়টা সত্যি ভাল যাচ্ছে বলে মনে হয় না।
সেই বেনামা চিঠিগুলো কোন এক মহিলার লেখা বলেই সন্দেহ হয়।
হয়তো বা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন–কিন্তু নার্স, তুমি ভুলে যাচ্ছ, চিঠিগুলো প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিক বনসারেরই লেখা। ওর মতো পাগল ছাড়া অন্য আর কে এ কাজ করতে পারে? দুর্ঘটনার দিন যেভাবেই হোক (হয়তো চাকরদের ঘুষ দিয়ে থাকবে সে) আমার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করে থাকবে সে। আমিও তাই বিশ্বাস করি।
ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকালেন, আমি তার কথা মন দিয়ে শুনছি কি না দেখার জন্য বোধহয়, কিন্তু মিঃ পোয়ারো সে কথা বিশ্বাস করেন না। তার ধারণা চিঠিগুলো—
হয়তো আপনার অনুমানই ঠিক,আমার কথায় সন্দেহের অবকাশ রেখেই আমি তার কথায় সায় দিলাম।
ডঃ লিডনার তখন উত্তেজিত অবস্থায় বলতে থাকেন, মিঃ পোয়ারো আমার এক্সপিডিসনের লোকেদের সন্দেহ করছেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা কেউই এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন না। আমি তাদের সবাইকে খুব ভাল করে চিনি।
কিন্তু পত্র লেখকের হাতের লেখায় যে মেয়েলী টান আছে ডঃ লিডনার!
আমার অনুমান, মিসেস মারকাডোকে তুমি সন্দেহ করছে। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? না, না এ কাজ তিনি করতে পারেন না।
তাহলে, তাকে বাদ দিলে বাকি থাকেন কেবল মিস জনসন, কথাটা বলে আমি তার ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম।
সে চিন্তা তো আরও অবিশ্বাস্য!
তার স্বল্প হাসির মধ্যে একটা কিছু গোপন করার ভাব যেন লুকিয়ে ছিল। আমার দৃষ্টি এড়ালো না। মিস জনসন যে চিঠিগুলো লিখতে পারেন, এ কথাটা তিনি কিছুতেই মাথায় আনতে চান না। কিন্তু আমি কোন কথা বললাম না। আমি তো জানি, আমি নিজের চোখে মিস জনসনকে অনুতাপ করতে দেখেছি। ডঃ লিডনার তাকে যত আড়ালই করুন না কেন, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না।
যাইহোক, ঠিক হল পরদিন আমি ইংলন্ডে ফিরে যাব। ডঃ রেলির মাধ্যমে ব্যবস্থা করলাম, হসপিটালে মেট্রনের সঙ্গে দু-একদিন আমি থাকব। তারপর ইংলন্ডে ফিরে যাব –গাড়ি এবং ট্রেন পথে বাগদাদ কিম্বা সরাসরি লিসবন হয়ে।
ডঃ লিডনার অনুগ্রহ দেখালেন আমাকে, তার একান্ত ইচ্ছা মিসেস লিডনারের স্মৃতি হিসাবে আমি যেন তার স্ত্রীর ব্যবহৃত দামী কচ্ছপের খোলে তৈরি টয়লেট সেটটা সঙ্গে নিয়ে যাই।
না, না ডঃ লিডনার এ অনুরোধ আমাকে করবেন না, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম, অত দামী সেট আমি নিতে পারব না।
জানো, আমার স্ত্রীর কোন বোন নেই, আর এ জিনিস অন্য কাউকে দেওয়াও যায় না।
তার কথা শুনে মনে হল, ওই দামী টয়লেট সেটটা তিনি লোভী মিসেস মারকাভোকে দিতে চান না। আর আমার মনে হয় না, সেটা তিনি মিস জনসনকে উপহার হিসাবে দিতে চাইবেন।
একটু ভেবে দ্যাখো, ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর আলমারির চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন–আলমারির মধ্যে লুসির অলঙ্কার আছে, তোমার পছন্দ মত একটা বেছে নিও। আর একটা কথা, ওর সব পোষাকগুলো সঙ্গে নিয়ে যেও। ডঃ রেলি হাসানিয়ের গরীব খ্রিশ্চিয়ান পরিবারদের মধ্যে ওর সেই পোষাকগুলো বিতরণ করার ব্যবস্থা করবেন।
ওঁর অমন সৎ প্রস্তাব শুনে আমি খুব খুশি হলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ওঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
মিসেস লিডনারের ঘর। আমার কাজ সেরে তার আলমারিতে চাবি দিয়ে ফিরে আসার আগে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিতে ভুললাম না। ওই সেই খাট, ওই খাটের পাশে দুর্ঘটনার দিন আমি একটা চেয়ারে বসে তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। তিনি বই পড়তে পড়তে আমার কথার জবাব দিচ্ছিলেন। তারপর ওঁর ঘর থেকে চলে আসার পর কি যে হল
আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই। তবু কেন জানি না আমার মনে হল, মিসেস লিডনারের আত্মা বোধহয় এই ঘরের ভিতরে বিচরণ করছে নিশ্চয়ই। হাসপাতালে মেয়েদের সেই প্ল্যানচেট করার কথা আমার মনে পড়ে গেল। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সেই প্ল্যানচেটে লেখা হয়েছিল। কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই যেন নিজেকে সম্মোহিত করে ফেললাম। আমি আর তখন আমি নই। আমি তখন মিসেস লিডনারে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। সময় সেদিনকার সেই দুপুরবেলা। আমি মিসেস লিডনার! নিজের মনেই আমি নিজেকে মিসেস লিডনার হিসাবে জাহির করতে থাকলাম। তার বিছানায় চোখ বন্ধ করে আধো ঘুমে ঘুমিয়ে আছি আমি।
ঠিক বেলা দেড়টার সময় ভেজানো দরজার পাল্লাটা একটু করে খুলে যেতে থাকে।
এবার আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রসারিত হল দরজার উপরে। সেই সময় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা আমি দেখতে চাই, দরজা ঠেলে কে ঘরে ঢোকে?
ধীরে ধীরে দরজার ফাঁক বড় হতে থাকল। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে যেতেই দেখলাম দরজার ওপরে বিল কোলম্যান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে তার এক গুচ্ছ লাল টকটকে ফুল।
আমি দুঃখিত নার্স অপরাধীর মতো তিনি কৈফিয়ত দিতে চাইলেন, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে, আগে থেকে আপনাকে খবর না দিয়ে ঘরে ঢোকাটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
কি সরল যুবক। মায়া হল তার জন্য। হাসতে হাসতে বললাম–আপনি মিঃ কোলম্যান, দেখুন তো কি ভয় না আমাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কোলম্যান আর একদফা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তার এখানে আসার উদ্দেশ্যর কথা জানালেন। মিসেস লিডনারের ছবির সামনে ওই লাল ফুলগুলো তিনি নাকি রোজ রেখে যান তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।
সত্যি তাকে শ্রদ্ধা জানানোর এ এক মহৎ প্রচেষ্টা মিঃ কোলম্যান। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম স্বাভাবিক, আপনি ছিলেন তাঁর সত্যিকারের একজন গুণগ্রাহী। আপনার আচরণে খাঁটি ইংরেজ বনেদিয়ানা পুরোপুরি বর্তমান।
আমি যাচ্ছি শুনে ফাদার ল্যাভিগনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–মিঃ পোয়ারোকে আজ দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় তিনি?
আমি তাকে বললাম আজ সারাদিন তিনি টেলিগ্রাম পাঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকবেন।
ফাদার ল্যাভিগনি ভ্রু কোঁচকালেন।
টেলিগ্রাম? আমেরিকায়?
হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।
তারপর তিনি জানতে চাইলেন মিসেস লিডনার এবং আমি কখন কোথায় কিভাবে জানালার সামনে সেই আগন্তুককে মিসেস লিডনারের ঘরে উঁকি মারতে দেখেছি, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি দিতে পারি কি না। শেষে তিনি তার মতামত জানিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ হয়, নোকটা ইউরোপীয় কি না, কারণ এখানে ইরাকি ছাড়া ওভাবে কেউ উঁকি দিতে পারে না।
ফাদার ল্যাভিগনির ধারণাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো তার কথাই ঠিক, এ কাজ স্থানীয় লোকেরাই করে থাকবে।
তাছাড়া, খুনী নিশ্চয়ই একটা না একটা জিনিস ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়ে থাকবে। ফাদার ল্যাভিগনি বাড়ির বাইরেটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন–গোয়েন্দা গল্পে অপরাধীরা সব সময় এরকম ভুল করে থাকে।
কিন্তু বাস্তব জীবনে অপরাধীরা দারুণ চালাক। আমি তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিলাম।
ফাদার ল্যাভিগনি চলে যাবার পর আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলাম। মিস জনসনকে ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তার দৃষ্টি সামনের দিকে। স্থির চোখে কি যেন লক্ষ্য করছিলেন তিনি। কাছে গিয়ে তার পিঠে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম–অমন নিবিষ্ট মনে কী দেখছেন মিস জনসন?
তাঁর চোখে আতঙ্কের ছায়া থিরথির করে কাঁপতে থাকে–কেমন করে বাইরে থেকে কোন লোক নিঃশব্দে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে, আমি সেটা খুঁটিয়ে দেখছি।
মিস জনসনকে অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সামনের দিকে। দেখলাম, মিঃ রেইটার ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পার হচ্ছিলেন।
সত্যি? কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। একটু খুলে বলবেন মিস জনসন?
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন মিস জনসন, এখন নয়, এখন নয়, পরে। আরও ভাল করে আমাদের দেখতে হবে। আমাকে প্রথমে ভাবতে হবে, তারপর–
কথাটা অসমাপ্ত রেখে নিচে নেমে যান মিস জনসন। আমাকে আহ্বান না জানিয়েই। বেশ বুঝতে পারি, এই মুহূর্তে উনি আমার সঙ্গ চান না। অতঃপর আমি আবার দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম। প্রধান প্রবেশ পথের সামনে ওয়াটার বয় এবং ভারতীয় রাঁধুনি আলাপরত। আমার ধারণা, ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।
.
২৪.
খুন একটা অভ্যাস
সেদিন রাত্রে আমরা একটু সকাল সকাল ঘুমোতে গেলাম। নৈশভোজের সময় মিস জনসনের আচরণ আগের থেকে একটু স্বাভাবিক বলেই মনে হল। তবে সব সময় চুপচাপ ছিল সে। স্তব্ধ, হতবাক। মনে হয়, মনের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই চালাচ্ছিল সে ভিতরে ভিতরে। মাঝরাতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজে আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। কান পেতে শুনি আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে। দরজার বাইরে এসে টের পেলাম শব্দটা আসছে মিস জনসনের ঘর থেকে। তাড়াতাড়ি তার ঘরে ছুটে যাই। আমার ঘরের পাশেই তার ঘর।
বিছানায় মিস জনসনের দেহটা থরথর করে কাঁপছিল। আমার হাতের মোমবাতিটা তার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই কথা বলার জন্য চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু তার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ফিস্ ফিস্ শব্দের মত শোনাল। বোঝা গেল না একবর্ণও। ভাল করে তাকাতে গিয়ে আমি দেখলাম মিস জনসনের ঠোঁট দুটি এবং চিবুকের একটা অংশ পুড়ে গেছে।
মিস জনসন তার দৃষ্টি আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা একটি গ্লাসের উপরে ফেললেন, যেটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি সেটা হাতে তুলে নিয়ে তার ভিতরে একটা আঙুল রাখতে গিয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে উঠলাম। আমার আঙুলটা তখন জ্বলে যাচ্ছিল যেন। পরক্ষণে আমি মিস জনসনের মুখের দিকে তাকালাম।
ঘটনাটা যে কি, বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হল না। যেভাবেই হোক, ইচ্ছাকৃত কিম্বা জোর করেই হোক, কিছু পরিমাণ, অক্সালিক কিম্বা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তাকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। আমার তাই সন্দেহ।
আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ডঃ লিডনারকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম এবং পরে তিনি সবার ঘুম ভাঙ্গালেন হৈ-চৈ করে। ডেভিড এয়োটকে পাঠানো হল হাসানিয়ের ডঃ রেলিকে ডেকে আনার জন্য।
মিস জনসনকে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করলাম। ঝুঁকে পড়ে আমি তাকে মরফিয়া ইনজেকসন দিতে গেলে অস্ফুটে কি যেন বলতে গেলেন তিনি। কোন কথাই স্পষ্ট নয়, শ্বাসরোধ করা কণ্ঠস্বর।
এই জানালা…… কোন রকমে তিনি বলেন, নার্স, ওই জানালা…..
সেই শেষ কথা তাঁর, সেই শেষ তার চোখ মেলে তাকানো। তারপরেই তার দেহের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মিস জনসন। সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় রাত্রির কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। তারপর একে একে এলেন ডঃ রেলি, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, এবং সব শেষে এলেন এরকুল পোয়ারো।
পোয়ারোকে দেখে আমি চোখে জল রাখতে পারলাম না। উঃ কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো। সান্ত্বনার সুরে বললেন–হ্যাঁ, অত উতলা হবেন না। আমি জানি, আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা আপনি করেছেন। আমার মনে হয়, সম্ভবতঃ মিস জনসন ঘুম থেকে সম্পূর্ণ জেগে ওঠার আগে ওই অ্যাসিডের কিছু অংশ গলাধঃকরণ করে থাকবেন। তা আপনার কী ধারণা নার্স?
না, আমার তা বিশ্বাস হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম আমার বিশ্বাস, গতকাল অপরাহ্নে অস্বাভাবিক কিছু একটা তিনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন।
আপনি কী বলতে চাইছেন? তবে কি তিনি কিছু দেখেছেন?
তারপর পোয়ারোকে আমি আমাদের গতকালের সেই কথাবার্তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করে শোনালাম। সব শোনার পর একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। সেই শব্দ আক্ষেপের, দীর্ঘশ্বাসের।
তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ছাদে উঠে এলাম জায়গাটা দেখানোর জন্য। যেখান। থেকে গতকাল অপরাহ্নে মিস জনসন হয়তো কাউকে দেখে থাকবেন, যে তার ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে।
ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে মিঃ রেইটারকে তখন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার কথা এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পেরিয়ে যাওয়ার কথা, সব আমি খুলে বললাম, কোন কথাই গোপন করলাম না কিন্তু আমরা তো তখন অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পাইনি। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–কী তিনি দেখেছিলেন?
ঠিক সেই সময় ভোর হয়ে আসছিল। সারা পূর্ব আকাশে রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে।
আঃ কি চমৎকার সূর্যোদয়! শান্তভাবে বললেন পোয়ারো। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হল পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।
তারপর আমি তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম।
সত্যি আমি কি বোকা, বিড়বিড় করে আপন মনে তিনি বলে চলেন, সত্যি যেখানে এত স্পষ্ট, এত স্পষ্ট–
২৫. আত্মহত্যা নাকি খুন
২৫. আত্মহত্যা নাকি খুন
পোয়ারো কি বলতে চান, তাকে জিজ্ঞাসা করার অবসরটুকুও আমি পেলাম না ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের জন্য। তিনি তখন নিচ থেকে হাত নেড়ে ডাকছিলেন, নিচে নেমে আসুন, জরুরী আলোচনা আছে। তাই আমরা দ্রুত নিচে নেমে আসি।
আর এক বিপর্যয়ের কাহিনী শুনুন মঁসিয়ে পোয়ারো তিনি বললেন, –সেই সন্ন্যাসী ফাদার ল্যাভিগনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেকি? চমকে উঠলেন পোয়ারো তার কথা শুনে।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো, তাকে তার ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে আমাদের কারোরই খেয়াল হয়নি তার সম্বন্ধে। ভোর হতেই আমাদের মনে হল–কই ফাদার ল্যাভিগনিকে তো দেখা যাচ্ছে না। তিনি কোথায়? তারপর তার ঘরে গিয়ে দেখি।
বাড়ির চাকরদের ডাক পড়ল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল, তারা নাকি ফাদার ল্যাভিগনিকে গতকাল রাত আটটার পর তার রোজকার অভ্যাস মত বাড়ির বাইরে বেড়াতে যান, কিন্তু কেউ তাকে ফিরে আসতে দেখেনি। রাত ন’টার পর প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে যায়। আজ সকালে সেই ফটক ঘোলা থাকতে দেখে দু’জন চাকর মনে করে তাদের মধ্যে কেউ একজন নিশ্চয়ই খুলে থাকবে। কিন্তু আসলে তারা কেউই ফটক সেদিন খোলেনি।
তাঁদের আলোচনার মাঝে ডঃ রেলি এসে হাজির হলেন, তার পিছন পিছন এলেন মিঃ মারকাডো।
হ্যালো রেলি, কিছু পেলেন?
হ্যাঁ, ল্যাবরেটরি থেকে অ্যাসিডটা নেওয়া হয়। প্রতিটি অ্যাসিডের বোতল আমি পরীক্ষা করে দেখেছি মিঃ মারকাভোর সঙ্গে। এইচ. সি. এল-র বোতলে এই অ্যাসিডের পরিমাণ একটু কম ছিল। অতএব।
কেন, ল্যাবরেটরিতে চাবি দেওয়া থাকে না?
মারকাডো মাথা নাড়েন। ভয়ে তার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমতা আমতা করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, থাকবে না কেন। তবে কি জানেন, চাবিটা থাকে বসবার ঘরে।
বাঃ, তাহলে তো খুবই মজার ব্যাপার, মেটল্যান্ড মুখ বিকৃতি করে বলে ওঠেন, যে-কেউ যে-কোন ঘরের চাবি নিয়ে যা খুশি করতে পারে। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, এখন দেখতে হবে মিস জনসন নিজের হাতে ল্যাবোরেটরি থেকে সেই অ্যাসিড সংগ্রহ করেছিলেন কি না?
না, তিনি নিজে সংগ্রহ করেননি, হঠাৎ আমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার হাতে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। ফিরে তাকাতেই দেখি পোয়ারো আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে গভীর প্রত্যয়।
প্রসঙ্গটা অবশ্য ধামাচাপা পড়ে গেল হঠাৎ সেখানে একটা গাড়ির আবির্ভাব হতে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন ছোট বেঁটে ধরনের লোক। নাম তার ভেরিয়ার। ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ। আরবী ভাষা জানেন না। ইটালি যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে যান। ডঃ লিডনার তাকে দুর্ঘটনার কথা বলতে ভদ্রলোক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন আপনাদের মাঝে আমি এমন সময় এলাম যখন আপনারা একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
আমাদের অবস্থা দেখে তিনি পত্রপাঠ ফিরে গেলেন।
আমার ধারণা, করোসিভ অ্যাসিডেই মৃত্যু হয়ে থাকবে মিস জনসনের। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড নতুন করে আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, কখন কি অবস্থায় মিস জনসনকে আমি দেখতে পাই। সংক্ষেপে আমি তাকে উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বললাম।
সব শুনে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন–তাহলে আপনার অভিমত হল, মিস জনসন নিজেই সেই অ্যাসিড খেয়েছিলেন?
না, না, সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম–ওরকম চিন্তা আমি কখনোই করতে পারি না। না, কখখনও নয়।
জানি না এত বিশ্বাস পেলাম কোথা থেকে? তবে এটুকু বলতে পারি যে, খুন একটা অভ্যাস, পোয়ারোর ওই মন্তব্যটা আমাকে কেমন বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল, মিস জনসন কখখনো আত্মহত্যা করতে পারেন না।
আমি ধরেই নিলাম আপনার অনুমানই ঠিক, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড একটু চিন্তা করে আবার বললেন–কিন্তু কেউ যদি দুশ্চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং হাতের কাছে আত্মহত্যা করার রসদ পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনার কী ধারণা হতে পারে নার্স?
কেন, মিস জনসন কি মানসিক ভারসাম্য সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেলেছিলেন? আমার কেমন সন্দেহ হল।
মিসেস মারকাডো তো সেই কথাই বলেছেন। তিনি বলছিলেন, গতকাল নৈশভোজের সময় মিস জনসনকে নাকি অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল, কথা তিনি বলছিলেনই না একরকম। মিস জনসন যে মানসিক রোগে ভুগছিলেন এবং তার হাত থেকে রেহাই পেতে তিনি যে আত্মহত্যা করার পথ বেছে নেন, এব্যাপারে মিসেস মারকাডো নিশ্চিত।
ঠিক আছে আমি সরাসরি অস্বীকার করে বললাম–আমি মোটেও সে কথা বিশ্বাস করি না।
তাহলে আপনি কী মনে করেন?
খুন হয়েছেন তিনি? দ্বিধাহীন আমার উত্তর।
আপনার এই ব্যক্তিগত ধারণার পিছনে কোন যুক্তি আছে?
হ্যাঁ, আছে বৈকি! তারপর আমি তাকে গতকাল অপরাহ্নে মিস জনসনের সঙ্গে আলোচনার কথা সবিস্তারে বললাম।
তিনি কি দেখেছিলেন, সে কথা বলেননি?
না, আরও ভেবে দেখার জন্য সময় নেন তিনি।
তাঁর মনের কথাটা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন না নার্স?
না।
তা আপনি কী ভাবছেন মঁসিয়ে পোয়ারো? এবার পোয়ারোর দিকে ফিরে প্রশ্নটা রাখলেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।
আমার মনে হয়, মোটিভ আপনার হাতের কাছেই রয়েছে।
খুনের?
হ্যাঁ, খুনের! অতঃপর পোয়ারো তার সন্দেহের কারণটা ব্যাখ্যা করে বলতে থাকেন, মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মিস জনসন ইশারায় তার ঘরের জানালার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। মনে হয় ওই জানালা পথে আততায়ী–
তা মিস জনসনের ঘরে কতগুলো জানালা আছে বলে মনে হয়?
একটিমাত্র, পোয়ারোর হয়ে উত্তরটা আমিই দিলাম।
ঠিক আছে বলে যান নার্স। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এবার আমার দিকে ফিরলেন, তারপর?
ওঁর ঘরের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক জিনিস আমার নজরে পড়ে। আমি আমার সন্দেহের কথাটা এই প্রথম প্রকাশ করলাম, মাঝরাত্রে জল খাবার অভ্যাস ছিল মিস জনসনের। তাই তিনি তার বিছানা ঘেঁসে টেবিলের উপরে জলের গ্লাস রাখতেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি সেই জল ভর্তি গ্লাসটা মেঝের উপরে পড়ে আছে।
এমনও তো হতে পারে, গ্লাসটা মিস জনসনের হাত থেকে পড়ে গিয়ে থাকবে।
তাহলে সেটা ভাঙ্গা অবস্থায় দেখতাম। কোন ভূমিকা না করে আমি এবার আসল কথাটা বললাম–মনে হয় আততায়ী সেই গ্লাসটা সরিয়ে টেবিলের উপরে অ্যাসিডের কাপটা রেখে থাকবে এবং মিস জনসন জল মনে করে আধো ঘুমে অ্যাসিডের পাত্রে চুমুক দিয়ে থাকবেন।
হ্যাঁ, ঘুমন্ত অবস্থায় এরকম ভুল সব মানুষই করে থাকে। ডঃ রেলি আমাকে সমর্থন করে বলেন, আমারও তাই ধারণা। মিস জনসন খুন হয়েছেন।
তাহলে এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় যে, হয় তিনি আত্মহত্যা –না হয় খুন হয়েছেন কী বলেন ডঃ লিডনার? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রশ্ন করলেন ডঃ লিডনারের দিকে তাকিয়ে।
আত্মহত্যা করার মত মেয়ে সে ছিল না– ডঃ লিডনার মন্তব্য করেন, অতএব ধরে নেওয়া যায় মিস জনসন খুন হয়েছেন।
হ্যাঁ, ঠিক তাই, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড তার হাতের প্যাকেটটা খুলতে গিয়ে বললেন, আপনারা কেউই জানেন না নিশ্চয়ই এটা আমি মিস জনসনের বিছানার নিচ থেকে সংগ্রহ করেছি।
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের হাতে কাগজের ওই মোড়কটা আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম। মোড়কটা খুলে একটা হস্তচালিত যাঁতা কিম্বা গ্রাইন্ডার জাতীয় পাথরের চাকা টেবিলের উপরে রাখলেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।
একটা লোককে খুন করার পক্ষে এ জাতীয় ভারী পাথর যথেষ্ট, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড ধীরে ধীরে বলেন–আমার বিশ্বাস, এর মধ্যে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
.
২৬.
এরপর আমার পালা
এ এক ভয়ঙ্কর ভয়াবহ ব্যাপার। যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন ডঃ লিডনার। আমি নিজেও অসুস্থবোধ করছিলাম।
পেশাদারি কায়দায় ডঃ রেলি সেটা পরীক্ষা করে দেখলেন।
আমার ধারণা, হাতের কোন ছাপ নেই। তদন্তের মাঝে কথাটা বলে এক জোড়া ফরসেড বার করলেন তিনি তার মেডিক্যাল বক্স থেকে অনুসন্ধান কাজটা নিখুঁত করার জন্য।
হু–এক টুকরো চুল, স্বর্ণকেশী। অবশ্য এটা বেসরকারি অনুমান। এরপর আমাকে খুব কঠোর পরীক্ষা চালাতে হবে, পরীক্ষা করে দেখতে হবে ব্লাডগ্রুপ এবং আরও কত কি সব পরীক্ষা চালাতে হবে। এরই মধ্যে একটা আন্দাজ আমি করেছি। মনে হয় মিসেস লিডনারকে প্রথমে খুন করেছে মিস জনসন। তারপর তার মনে অনুশোচনা হয় এবং সেই অনুশোচনাবোধ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন ডঃ লিডনার, না আত্মহত্যা সে করতে পারে না।
কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, মেটল্যান্ড বলেন, এই ভারী জিনিসটা কোথায় সে লুকিয়ে রাখল?
হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা আমার মনে হল, কেন সেই কাপবোর্ডের মধ্যে? কিন্তু আমি কিছুই বললাম না।
যেখানেই সেটা থাকুক না কেন, মনে হয় আত্মহত্যা করার আগে মিস জনসন সেটা নিজের ঘরে এনে থাকবে।
এ আমি বিশ্বাস করি না, চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি। আমি ভাবতেই পারি না, অমন নিষ্ঠুরভাবে মিসেস লিডনারের মাথায় মিস জনসন কি করে আঘাত করল? এ যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর এই কারণেই বোধহয় বিশ্বাস করা যায় না, অনুশোচনার জন্য তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন!
কি যে বিশ্বাস করতে হবে, আমি নিজেই সে কথা জানি না।ক্যাপ্টেন মেটলান্ড ধীরে ধীরে বলতে থাকেন। এরই মাঝে ফাদার ল্যাভিগনির হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটাও বড় রহস্যজনক, সেই রহস্যটাও আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওঁদের মত তিনিও যদি আমাদের প্রজেক্টের কোথাও মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে থাকেন, সেটা দেখার জন্য আমরা লোক পাঠিয়েছি।
ওহো, এবার আমার মনে পড়েছে আমি বলতে শুরু করি। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি আমার দিকে তখন।
ঘটনাটা গতকাল অপরাহ্নের আমি বলি–ফাদার ল্যাভিগনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, রহস্যময় ট্যারাচোখা যে লোকটা মিসেস লিডনারের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল, কোন্ পথ দিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়? তার ধারণা ছিল, অপরাধ বিজ্ঞানের মতে ঘটনাস্থলে একটা না একটা কোন চিহ্ন ঠিক ফেলে রেখে যায় অপরাধী। সেই ক্লু আবিষ্কার করার জন্য তিনি বাইরে একটু ঘুরে আসতে চান।
ওসব অপরাধ-বিজ্ঞানের সূত্র-টুত্র রেখে দাও। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বিরক্ত হয়েই বলেন, ফাদার ল্যাভিগনির আসল উদ্দেশ্যটা কি তা আগে জানতে হবে। এক্ষেত্রে আমার অনুমান, মিস জনসন এবং তিনি প্রায় একই সময় একটা ক্লু আবিষ্কার করে থাকবেন। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলতে থাকেন, ট্যারাচোখো লোক! ট্যারাচোখো লোক! আমি বুঝতে পারছি না, আমার নোক কেন যে তাকে ধরতে পারছে না!
সম্ভবতঃ সে আদৌ ট্যারাচোখো নয় বলে! শান্তস্বরে পোয়ারো বললেন।
তবে কী আপনি মনে করেন ট্যারাচোখে তাকানোটা তার নকল? আসলে সে আদৌ ট্যারা নয়?
কথা প্রসঙ্গে পোয়ারো বলেন–তাহলে ট্যারাচোখের লোকটা এক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
লোকটা ট্যারা কি ট্যারা নয়, সেটা মূল প্রশ্ন নয়–এখন সে কোথায়, সেটাই একমাত্র জানার বিষয়!
আমার অনুমান, পোয়ারো বলেন–এতক্ষণ সে বোধহয় সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে।
সমস্ত সীমান্ত প্রহরীদের টেলিগ্রাম করে আমি সতর্ক করে দিয়েছি, প্রতিটি গাড়ি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য। পাসপোর্টে গন্ডগোল থাকলে গাড়ি যেন আটক করা হয়। গাড়ির আরোহী দু’জন। তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নাড়েন, হ্যাঁ, দু’জনই বটে!
মঁসিয়ে পোয়ারো, প্রথমেই আমার কেমন খটকা লেগেছিল, অনেক কথা আপনি আপনার পেটের মধ্যে রেখে দেন দেখছি।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। না, ঠিক তা নয়। আসলে আজই সকালে সত্য উদঘাটন হতে দেখলাম। আমি তখন সূর্যোদয় দেখছিলাম।
আমার মনে হয় না আপনারা কেউ মিসেস মারকাডোকে চুপিসারে ঘরে চলে যেতে দেখেছেন। অত বড় একটা রক্তপাত ঘটে গেল–আমরা তখন ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অথচ তিনি তখন তার ঘরে একলা। আর তখন উনি এমন চিৎকার করছেন, যেন শূকর ছানার গলায় ছুরি বসানো হয়েছে।
হায় ঈশ্বর! মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন–এবার বুঝতে পারছি। এবার আমি বুঝতে পারছি, এসব কাজ ফাদার ল্যাভিগনির। পাগল তিনি ধর্মান্ধ তিনি। তার ধারণা, মেয়েরা পাপী! তিনি তাদের সবাইকে খুন করে ফেলবেন। প্রথমে মিসেস লিডনারকে, তারপর মিস জনসনকে। এবার আমার পালা।
আঁতকে উঠে ছুটে যান তিনি ডঃ রেলির দিকে। আমি আপনাকে বলে রাখছি, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। সাংঘাতিক লোক তিনি, নিশ্চয়ই এখানে কোথাও ওঁৎ পেতে বসে আছেন আমার অপেক্ষায়।
ডঃ রেলিকে সাহায্য করার জন্য মিসেস মারকাডোকে শান্ত করিয়ে একটা চেয়ারে বসালাম, কেউ আপনাকে খুন করতে যাচ্ছে না। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, আপনি শান্ত হন, আপনার কোন ভয় নেই।
তারপর আর এক বাধা, দরজা ঠেলে শীলা রেলি ঘরে এসে ঢুকলেন। তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিল। সোজা সে চলে এল পোয়ারোর কাছে। একটু আগে আমি পোষ্ট অফিসে যাই মঁসিয়ে পোয়ারো, যেখান থেকে আপনার একটা টেলিগ্রাম নিয়ে এসেছি।
ধন্যবাদ মাদমোয়াজেল।
ওটা কী আমেরিকা থেকে আসছে? মিসেস মারকাড়ো তার দিকে দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞাসা করলেন।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। না ম্যাডাম, এটা আসছে টিউনিস থেকে।
একটু সময় পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ফাদার ল্যাভিগনি, আমার অনুমান তাহলে ঠিক! সাংঘাতিক লোক তিনি। না, এক মুহূর্তও আমি আর এখানে থাকব না। একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, এ জায়গা আমাকে ছেড়ে যেতেই হবে। এখন আমি আর জোসেফ রেস্ট হাউসে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে চাই।
ধৈর্য ধরুন ম্যাডাম, পোয়ারো ধীরে ধীরে মুখ খুললেন–আমি আপনাদের কাছে সব ব্যাখ্যা করে বলছি।
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকিয়েছিলেন পোয়ারোর দিকে। ডঃ রেলির দিকে ফিরে পোয়ারো অনুরোধ করলেন, ডঃ রেলি, দয়া করে আপনি যদি সবাইকে খবর দেন এখানে চলে আসার জন্য, তাহলে আমার একটু উপকার হয়।
ডঃ রেলি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
.
২৭.
যাত্রা শুরু
বিসমিল্লাহি আর রহমান আর রহিম’–আরবি ভাষায় এই প্রবাদটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পোয়ারো বলেন, করুণাময়, দয়াময় আল্লার নামে এই প্রবাদটা যে-কোন যাত্রার শুরুতে ব্যবহার করা হয়। আমাদেরও যাত্রা শুরু হল। এ যাত্রা সুদূর অতীতে। এ যাত্রা সেই সব বিচিত্র জায়গায়, যেখানে মানুষের আত্মা ঘোরাফেরা করে থাকে আজও।
সত্যি কথা বলতে কি পোয়ারোর কথায় হঠাৎ আমার প্রাচ্যের সেই মোহিনী মায়ার’ কথা মনে পড়ে গেল। ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে সেই সব বিচিত্র দৃশ্য। মনে পড়ল সমরখন্দ এবং ইমপাহানের নাম, সওদাগর, হাঁটুমুড়ে বসে থাকা উটের দল, পিঠে কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে নুইয়ে পড়া শ্রমিকদের চলমান স্রোত, মেয়েদের মেহেন্দি রঙে কলপ দেওয়া মাথার চুল, টাট্টু ঘোড়ার চি-চি শব্দ।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘরের চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম এবং আমার মনে। একটা অদ্ভুত চিন্তার উদয় হল, মিঃ পোয়ারো যা যা বললেন সব কি সত্যি আমরা সবাই সেই নিরুদ্দেশ যাত্রার পথিক, সমবেত হয়েছি এখানে। কিন্তু আমাদের সবার চিন্তা এখন প্রবাহিত ভিন্ন ভিন্ন ধারায়।
এখানে প্রথম আসেন রেইটার এবং এমোট। তারপর বিল কোলম্যান, রিচার্ড ক্যারি এবং সব শেষে মিঃ মারকাভো। প্রথমে আমি তাদের যে চোখে দেখেছিলাম আজও ঠিক সেই চোখে দেখছি; সেই রঙ, সেই ঢঙ, বদলায়নি কিছুই।
কিন্তু তারা যেন কেউ স্বাভাবিক নন। কেমন ভয়ে ভয়ে মিঃ মারকাডো তার হাতের আঙুলগুলো মোচড়াচ্ছিলেন। স্বামীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন মিসেস মারকাডো। একটা অদ্ভুত কায়দায় ডঃ লিডনারকে কেমন সঙ্কুচিত বলে মনে হল। ওদিকে মিঃ কোলম্যান সরাসরি তাকিয়েছিলেন পোয়ারোর দিকে। তার মুখটা ঈষৎ খোলা, দৃষ্টি প্রসারিত। এই মুহূর্তে তাকে ঠিক সূর্যের মতো দেখাচ্ছিল। মিস রেলি জানালার দিকে তাকিয়ে কি যে ভাবছিলেন জানি না। তবে যে কারণেই হোক মিঃ ক্যারির মুখের ভাব দেখে আমার কেমন একটু করুণা হল। জানি না, পোয়ারো আমাদের সম্বন্ধে এখন কি ভাবছেন।
এ যেন এক বিচিত্র অনুভূতি।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর শান্ত সংযত, ভঙ্গিমা বুদ্ধিদীপ্ত, গভীর নদীর শান্ত ঢেউয়ের মত।
একেবারে গোড়া থেকে আমার মনে হয়েছে, এই কেসের গভীরে পৌঁছতে হলে বাইরে থেকে কোন ক্ল সন্ধানের প্রয়োজন নেই, সত্যিকারের ক্লু হল ভিতর থেকে অনুসন্ধান কাজ চালানো। এ কেসের ব্যাপারে আমি বলতে পারি–কারোর ব্যক্তিগত এবং গোপন হৃদয়ের সংঘাতই হল অমন নিষ্ঠুর পরিণতি। আমার ধারণা, এ কেসের সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করার মত রসদ যদিও আমার হাতে ছিল না গোড়ার পর্বে, তবু আমি বলতে পারি যে সম্ভাব্য সমাধানের পথ এখানেই নিহীত আছে।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
এখানে এসে এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সময় থেকে আমার অনুসন্ধানের যাত্রা শুরু। আমার ধারণা প্রতিটি ঘটনার একটা নির্দিষ্ট আকৃতি এবং রূপ আছে। এই ঘটনার ধরন দেখে মনে হয় মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমাধানের সূত্রটা লুকিয়ে আছে। তাই যতক্ষণ না জানতে পারছি, মিসেস লিডনার ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়–কেন তিনি খুন হলেন, আর কেই বা তাকে খুন করল? অতএব আমার অনুসন্ধানের প্রথম কাজ হল–মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হওয়া।
মনস্তত্বের দিক থেকে আর একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল–এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যদের মনের মধ্যে সব সময় একটা উদ্বেগ, উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে, মিসেস লিডনারের উপরে তাদের দুর্বলতার জন্যই বোধহয় এমনি আশঙ্কা। যাইহোক, পরে এক সময় আমি এর সঠিক মূল্যায়ন করব আপনাদের কাছে।
শুরুতেই বলে রাখি, মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের উপরে আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছি।
আমার ধারণা, মিসেস লিডনার একটু উগ্র প্রকৃতির হলেও তাঁর মধ্যে একটা শিশুসুলভ রুচিবোধ আছে। তার শয়নকক্ষে বইগুলো দেখে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে তার বুদ্ধি ছিল এবং তিনি ছিলেন অহঙ্কারী।
হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে যে পুরুষদের আকর্ষণ করার প্রবণতা ছিল তার প্রবল। তবে তাই বলে এই নয় যে, তার সেই প্রবণতার দরুণই এমনি এক দুর্ঘটনায় পতিত হন তিনি।
তাঁর সংগৃহীত বইগুলোর মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব ছিল। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় তার এই রুচিবোধ। উপন্যাসের মধ্যে, লিনডা কনডন এবং ক্রিউ ট্রেন বই দুটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নারী স্বাধীনতায় মিসেস লিডনারের সহানুভূতি এবং সমর্থন ছিল। এর থেকে বোঝা যায় লেডী হেস্টার স্ট্যানহোপের ব্যক্তিত্ব তাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। লিনডা কনডন-এ দেখা যায়, ভদ্রমহিলা তার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে বড্ড বেশি সচেতন। এসব পর্যালোচনা করে আমি বেশ বুঝতে পারছি–এই মৃত ভদ্রমহিলা ঠিক কি ধরনের ছিলেন।
ডঃ রেলি এবং অন্যদের সঙ্গে আমি গোপনে আলোচনা করে জেনেছি–মিসেস লিডনার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দারুণ সচেতন এবং অহঙ্কারী ছিলেন। এই সব মহিলারা ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে–সময় সময় নিজের ক্ষেত্রে এবং কখনও বা অপরের ক্ষেত্রে। মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। নারী-পুরুষ ভক্তবৃন্দের মধ্যে মক্ষিরানী হয়ে বসে থাকতে ভালবাসতেন তিনি। নার্স লিথেরান, যিনি একজন উদার মনোভাবাপন্ন মহিলা–যাঁর একটা কাব্যিক চেতনাবোধ আছে, তিনিও মিসেস লিডনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মানুষের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে আর একটা উপায় জানা ছিল মিসেস লিডনারের, মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের প্রভাবিত করা।
এখন সব থেকে জরুরী এবং প্রধান সমস্যা হল, সেই রহস্যময় বেনামা চিঠিগুলোর সমাধান করা। কে, কে এই সব চিঠিগুলো লিখল আর কেনই বা? নিজেকে প্রশ্ন করি, তবে কি মিসেস লিডনার নিজেই সেই চিঠিগুলো লিখেছিলেন।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একেবারে গোড়ায় মানে মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহোত্তর দিনগুলোয় ফিরে যেতে হয়।
যৌবনে মিসেস লিডনার ছিলেন রীতিমতো সুন্দরী এবং স্বাধীনচেতা নারী। তাই বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাননি বেশি দিন। অথচ তার প্রথম স্বামী ছিলেন দৃঢ়চেতা পুরুষ এবং তার মধ্যে এমন কোন শক্তি ছিল যার জন্য সহজে তাঁর হাত থেকে রেহাই পেতে পারছিলেন না মিসেস লিডনার। তাই তিনি নকল দেশপ্রেমিকের ভূমিকা নিয়ে তার পিতার সাহায্যে ফ্রেডরিক বনসারকে সরিয়ে দিলেন তার জীবন থেকে চিরতরে।
এখন আমরা সেই চিঠিগুলোর প্রসঙ্গে আসি–ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি তিনি পুরুষের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়া ছিলেন। যখনই তিনি একজন পুরুষের প্রেমে পড়েছেন, তখনি তিনি হুমকি দেওয়া একটা চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই সব চিঠিগুলো কে লিখল? ফ্রেডরিক বনসার, নাকি তার ভাই উইলিয়াম কিম্বা মিসেস লিডনার নিজেই?
কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল–ডঃ লিডনার তার জীবনে আসার পর থেকেই হুমকি দেওয়া সেই সব চিঠিগুলো আসা বন্ধ হয়ে যায়। মিসেস লিডনার হওয়া পর্যন্ত কোন বাধার সম্মুখীন তাকে হতে হয়নি।
কিন্তু কেন, কেন? একসঙ্গে আমরা সবাই প্রশ্ন করে তাকালাম পোয়ারোর দিকে।
ধরে নিলাম চিঠিগুলো মিসেস লিডনারই লিখেছিলেন। আর এও সত্য যে–ডঃ লিডনারকে তিনি খুব ভালবাসতেন এবং তাই তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে বিয়ের পরেও তিনি কেন আবার চিঠি লিখতে গেলেন? নাটকের পুনরাবৃত্তি কার জন্য?
এবার অন্য আর এক সূত্রে আসা যাক। মনে করা যাক সেই চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের প্রথম স্বামীর কাছ থেকেই এসেছিল। তাই যদি হয় কেন সে তাদের বিয়েতে বাধা দিল না? যেমন আগের বিবাহের প্রস্তাবে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিল সে? যাইহোক, বিয়ের পর সে আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করে? আমার উত্তর সন্তোষজনক নয়। হয়তো সে তখন কোন জেলে বন্দী ছিল কিম্বা চলে যায় বিদেশে কোথাও।
এক্ষেত্রে তিনটে নির্দিষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে : (১) চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের নিজেরই লেখা; (২) চিঠিগুলো ফ্রেডরিক বনসার (কিম্বা যুবক উইলিয়াম বনসার) লিখতে পারে; (৩) চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের কিম্বা তার প্রথম স্বামী লিখে থাকলেও সেগুলো হয়তো পরবর্তীকালে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সেই তৃতীয় ব্যক্তিই তাদের বিয়ের পর চিঠিগুলো আবার লিখতে শুরু করে। কে জানে সেই তৃতীয় ব্যক্তিই এই সব হত্যাকাণ্ডের নায়ক কি না? অতএব আমাকে এখন মিসেস লিডনারের অনুগামী লোকজনদের খুঁটিয়ে বিচার করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে আমি তিনজনকে আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাইরে রাখতে পারি। ডঃ লিডনার, কারণ দুর্ঘটনার সময় তিনি ছাদের উপরে ছিলেন। তারপর মিঃ ক্যারি, কারণ তিনি তখন নদীর ধারে বাঁধ বাঁধার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সব শেষে মিঃ কোলম্যান, তিনি তখন হাসানিয়েয় ছিলেন।
কিন্তু একথাও আবার ঠিক যে, ডঃ লিডনার বাদে (কারণ দুর্ঘটনার সময় তিনি যে ছাদের উপর ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই) মিঃ ক্যারি যে বাঁধ বাঁধার কাজে নিযুক্ত ছিলেন কিম্বা মিঃ কোলম্যান প্রকৃতপক্ষে যে হাসানিয়েয় গিয়েছিলেন তার কী প্রমাণ আছে?
বিল কোলম্যানের মুখটা লাল হয়ে উঠল। চোখ-মুখে অস্বস্তির ছোঁয়া। মুখ খুলতে পারলেন না তিনি। ওদিকে মিঃ ক্যারির মুখে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না।
তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন?
আর একজনকে আমার সন্দেহ হয়। মিস রেলির সাহস আছে, বুদ্ধি আছে এবং একটু নির্মমও বটে। নিহত মিসেস লিডনারের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি ক্ষেপে যান। আমি ওঁকে সন্দেহ করি, কথাটা বলতেই উনি সরাসরি জানিয়ে দেন–দুর্ঘটনার সময় তিনি নাকি ক্লাবে টেনিস খেলছিলেন। কিন্তু পরদিন মিস জনসনের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জানান, মিস রেলি নাকি আদৌ সে সময় টেনিস খেলতে যাননি, বাড়ির কাছাকাছি ছিলেন তিনি দুর্ঘটনার সময়। অতএব, মিস রেলি প্রকৃতপক্ষে অপরাধী না হলে মনে হয় উনি আমাকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে পারেন। এখানে একটু থেমে শান্তভাবে তিনি বললেন, মিস রেলি, সেদিন অপরাহ্নে আপনি কি দেখেছিলেন বলবেন দয়া করে?
অনেকক্ষণ পরে জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মিস রেলি বলেন, মধ্যাহ্ন ভোজের পর ঘোড়ায় চড়ে বাঁধের দিকে বেড়াতে যাই। মাপা কণ্ঠস্বর তাঁর।
মিঃ ব্যারিকে দেখেছিলেন সেখানে?
না।
না!
আশ্চর্য! মিঃ ক্যারির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো, আপনার কিছু বলার আছে মিঃ ক্যারি?
আমি তখন বেড়াতে গিয়েছিলাম নদীর ধারে।
বাড়ির দিকে ফেরেননি?
না।
আমার অনুমান মিস রেলি এবার মিঃ ক্যারির দিকে তাকিয়ে বলেন, ক্যারির জন্য আপনি তখন অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু সে আসেনি। ক্যারি তার দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু জবাব দিলেন না।
তাকে কোন চাপ দিলেন না পোয়ারো। আর একটা প্রশ্ন আপনাকে করব। আর কিছু আপনার চোখে পড়েছিল মাদমোয়াজেল?
হ্যাঁ। সেই সময় হঠাৎ মিঃ কোলম্যানকে এক্সপিডিসন হাউসের দিকে হেঁটে যেতে দেখি। মাথা নিচু করে কি যেন খুঁজছিলেন তিনি।
দেখুন, এখানে আমার বলার আছে। মিঃ কোলম্যান নিরুত্তাপ গলায় কৈফিয়ত দেন, আমার পকেট থেকে একটা সিলিন্ডার সীল পড়ে যায় বাড়ি ফেরার পথে। সেটা খুঁজতেই আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসি হাসানিয়ে থেকে। কিন্তু সেটা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসি বাসে চড়ে। তাই স্বভাবতই ধরে নেয় সবাই আমি ফিরে এসেছি। তবে কোর্টইয়ার্ড দিয়ে আমি আসিনি। তাহলে বাড়ির পরিচারকরা নিশ্চয়ই দেখতে পেত। আর তারা তো স্বীকারই করেছে, কোন আগন্তুককে কোর্টইয়ার্ডে ঢুকতে দেখেনি।
আপনার বক্তব্য ঠিক মেনে নিতে পারছি না, পোয়ারো বলেন–আগন্তুকের কথাই জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের, কিন্তু এক্সপিডিসনের সদস্যদের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অতএব এই বলে তিনি এবার রিচার্ড ক্যারির দিকে ফিরলেন।
ক্যারি এতক্ষণ তাকে লক্ষ্য করছিলেন, তার নীল গভীর চোখ উজ্জ্বল হল।
আপনি কী আমাকেও দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমি আমার সন্দেহের কথা বলেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কাউকে আমি চিহ্নিত করতে পারছি না। তবে এ কথা ঠিক যে, এখানকার এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যই এখন আমার চোখে সন্দেহজনক ব্যক্তি। এমন কি নার্স লিথেরানও খুনী হতে পারেন।
ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলাম–আমি এখানে সবে এসেছি। তাছাড়া আমি তো এখানে আগন্তুক মাত্র, এখানকার সদস্য নই।
ভুলে যাবেন না, মিসেস লিডনারের ভয় ছিল কোন আগন্তুক তাকে খুন করতে পারে।
কিন্তু ডঃ রেলি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমার সম্বন্ধে ভালই জানেন–
আপনার সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানেন তিনি? আপনি নিজের সম্বন্ধে যতটুকু বলেছেন তার বেশি কিছু নয়
বেশ তো সেন্ট ক্রিস্টোফারকে চিঠি লিখে খবর নিতে পারেন আপনি।
আপনি একটু চুপ করবেন? এভাবে তর্ক করলে আমার পক্ষে কাজ চালানো অসম্ভব। পোয়ারো বিরক্ত প্রকাশ করেন–তাছাড়া, আমি তো এখনও পর্যন্ত আপনাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিনি। শুধু বলেছি এ, আমার অনুমান। যেমন আমি প্রথমে মনে করি–মিসেস মারকাডোই খুনী। কেন, আপনিই তো বলেছিলেন, মিসেস লিডনারের প্রতি তার একটা প্রচ্ছন্ন আক্রোশ ছিল। কেন বলেননি আপনি মিসেস মারকাডো নেশা করতেন। নেশার ঘোরে যে-কোন লোক তার শত্রুকে খুন করতে পারেন অনায়াসে। তাছাড়া জনশূন্য কোর্টইয়ার্ডে মিঃ এবং মিসেস মারকাভোর পক্ষে মিসেস লিডনারকে দশ মিনিটে খুন করার পক্ষে সেটা যথেষ্ট সময় বৈকি!
সহসা চিৎকার করে উঠলেন মিসেস মারকাডো, না, না এ কথা সত্যি নয়।
আমার পরবর্তী সন্দেহভাজন ব্যক্তি হলেন মিসেস জনসন। খুন করার পক্ষে সত্যি কি তিনি উপযোগী? নিজেকে আমি প্রশ্ন করি বার বার। হ্যাঁ, সম্ভব। স্পষ্টবাদী মেয়ে ছিলেন মিস জনসন। তিনি হয়তো মনে করে থাকবেন মিসেস লিডনার তার স্বামীর প্রতি অবিচার করছেন, অতএব (অবশ্য যদি ডঃ লিডনারের প্রতি তার কোন দুর্বলতা থেকে থাকে) অন্যায়ের প্রতিকার এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয়তো মিসেস লিডনারকে তিনি খুন করে থাকলেও থাকতে পারেন।
তারপর আমি তিনজন যুবককে সন্দেহ করতে পারি। তারা তিনজন হলেন–কার্ল রেইটার, উইলিয়াম কোলম্যান এবং মিঃ এমোট। এখন দেখতে হবে এই তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে উইলিয়াম বনসারের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে? এদের মধ্যে মিঃ কারি এবং মিঃ উইলিয়াম বনসারের বেশি সাদৃশ্য থাকার কথা। অতএব তিনিও একজন সম্ভাব্য খুনী হতে পারেন। আর মিস রেলির কথা সত্য বলে ধরে নিলে তো উইলিয়াম কোলম্যানকেও একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। নার্স লিথেরানের ভাষায় তার সঙ্গে মিসেস লিডনারের এতটুকু বনিবনা ছিল না। মিসেস লিডনারকে তিনি একটুও সহ্য করতে পারতেন না। অতএব মিসেস লিডনারকে তিনিও খুন করতে পারেন।
এখনও একজন লোক আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়ে আছেন। তিনি হলেন ফাদার ল্যাভিগনি। প্রথম থেকেই তার উপরে আমার সন্দেহ ঘনীভূত হয়। মিসেস লিডনারের ঘরের জানালার সামনে যে লোকটা উঁকি দেয়–ফাদার ল্যাভিগনি নাকি তাকে দেখেছিলেন, সেই আগন্তুক নাকি ট্যারা ছিল। কিন্তু নার্স লিথেরানের আগন্তুকের সম্বন্ধে বিবরণের সঙ্গে ফাদার ল্যাভিগনির কোন মিল নেই। তবে কি ফাদার ল্যাভগনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের ভুল পথে চালিত করার জন্য অমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন?
আমার কাছে প্রমাণ আছে ফাদার ল্যাভিগনির পরিচয় আসল নয়। তবে কি তিনি ফ্রেডরিক বসনার? তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার এই ধারণা হয়েছে যে একজন ক্যাথলিক প্রিস্টের যে যে গুণ এবং জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তার অভাব ছিল তার মধ্যে। এই সব কারণে আমার মনে সন্দেহ জাগতেই আমি টেলিগ্রাম পাঠাতে শুরু করে দিই নানান জায়গায়।
তারপর নার্স লিথেরান আমাকে একটি অতি মূল্যবান ক্লর সন্ধান দেন। অ্যান্টিক রুমে মূল্যবান অলঙ্কার পরীক্ষা করছিলাম তখন। হঠাৎ তিনি আমাকে দেখালেন–একটি সোনার কাপের উপরে মোমের দাগ লেগে রয়েছে। মোমের দাগ? হঠাৎ, হা হঠাৎই একটা সম্ভাবনার কথা আমার মনে পড়ে গেল। তবে, তবে কি ফাদার ল্যাভগনি–
আমার শেষ টেলিগ্রামের জবাবে উত্তরটা আমি পেয়ে গেলাম আজই, একটু আগে। টিউনিস থেকে আমার খবরদাতা জানিয়েছেন ফরাসী পুলিশের সূত্রে ব্যাপারটা এখন খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে, ফাদার ল্যাভিগনি একজন অতি চতুর দাগী চোর–যার কাজ হল মিউজিয়াম থেকে দামী দামী অলঙ্কার আত্মসাৎ করা। তার আসল পরিচয় হল রাউল সেনিয়ার এবং তার দোসর হল প্রথম শ্রেণির স্বর্ণকার আলি ইউসুফ। রাউলের কাজ হল মিউজিয়ামের আসল অলঙ্কারগুলোর ছাঁচ সংগ্রহ করা এবং সেই ছাঁচের আদলে নকল অলঙ্কার তৈরি করা হল আলির কাজ। এইভাবেই ফাদার ল্যাভিগনি যেসব মিউজিয়ামে যান, নকল পরিচয় দিয়ে আসল অলঙ্কার চুরি করার ফঁদ পাতেন।
আজ সকাল পর্যন্ত এই নিয়ে আটটি সম্ভাবনার কথা আমার মনে উদয় হয়েছে, কিন্তু ঠিক জানি না, আসল খুনী কে হতে পারে?
তবে খুন একটা বদ অভ্যাস, খুনী সে নারী কিম্বা পুরুষই হোক না কেন একবার খুন করলে বার বার সে খুন করবেই এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার খুন করে খুনী আমার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেছে বলে আমার মনে হয়। আমার অনুমান সত্য হলে খুনীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠতে বাধ্য।
আমার আশঙ্কা ছিল প্রধানতঃ নার্স লিথেরানের জন্য। তার অত্যাধিক কৌতূহলের জন্য প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার আশঙ্কা ফললো মিস জনসনের মৃত্যু দিয়ে। তবে মিস জনসন যে আত্মহত্যা করতে পারেন না–এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
প্রথমতঃ দেখা যাক, রবিবার সন্ধ্যায় মিস জনসনকে কাঁদতে দেখেন নার্স লিথেরান। সেই সন্ধ্যাতেই নার্স লিথেরান তাকে তার ঘরে একটি চিঠি পোড়াতে দেখেন, সেই চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে বেনামা চিঠিগুলোর হাতের লেখার অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলেন নার্স লিথেরান।
দ্বিতীয় তথ্য হল, মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় ছাদের উপরে মিস জনসনকে খুব চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পান নার্স। জানতে চাইলে মিস জনসন বলেন তিনি নাকি এমন একটা জিনিস দেখেছেন যা প্রকাশ হয়ে পড়লে নতুন তথ্য-আবিষ্কার হাতে পারে। আমি যা দেখেছি, অন্য কেউ দেখেনি তবে একোরে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে পারব না।
এবং তৃতীয় তথ্য, মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে তার শেষ কথা হল–ওই জানাল, ওই জানালা।
এইগুলো হল আমাদের সূত্র এবং আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তা হল- ..
সেই সব চিঠিগুলোর প্রকৃত অর্থ কী? ছাদের উপর থেকে সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন কি দেখেছিলেন? ওই জানালা, ওই জানালা বলতে তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
প্রথমেই দেখা যাক আমাদের দ্বিতীয় সমস্যার কথা। ছাদের উপর থেকে তিনি কি দেখেছিলেন, কাকে দেখেছিলেন। ফাদার ল্যাভিগনিকে কোর্টইয়ার্ড অতিক্রম করে আসতে তিনি দেখেন। তবে কি তিনি তাঁকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন? তবে কি তিনি তার ছদ্মবেশের আড়ালে আসল রূপটা চিনে ফেলেছিলেন? মিসেস লিডনার হয়তো তাকে চিনে ফেলেছিলেন বলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় তার মুখ বন্ধ করার জন্য।-এবং মিস জনসন সেই গোপন সত্যটা জেনে ফেলেছিলেন বলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এ কেসের একটা সঠিক সমাধান পেতে হলে সব কিছু আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে যা এখনও পর্যন্ত অনুল্লেখিত থেকে গেছে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন ছাদের উপর থেকে কি দেখে অমন চিন্তিত হয়ে ওঠেন? তাঁর কাছ থেকে যে তথ্যটা নার্স লিথেরান সংগ্রহ করতে পারেননি, আজ সকালে ছাদে গিয়ে আমি সেই অজানা তথ্যটা সংগ্রহ করেছি অনেক কষ্টে, নিজের মনকে বিশ্লেষণ করে। ছাদে দাঁড়িয়ে সেই তিনটি বিষয় আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল–সেই চিঠিগুলো, সেই ছাদ এবং সেই জানালা। আর ঠিক তখনই আমি দেখতে পাই-মিস-জনসন যা দেখেছিলেন, যা এখন আমি আপনাদের ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছি ।
.
২৮.
যবনিকা
ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন পোয়ারো। আমাদের প্রত্যেকের চোখ এখন নিবদ্ধ তার উপরে। আমরা সবাই তখন এক অদ্ভুত মানবিকতার শিকার হতে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবার মনে তখন কেবল একটাই চিন্তা, একটা সত্য উদ্যাটন হতে যাচ্ছে, সব না হলেও কিছু কিছু অন্তত–
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আগেই বলেছি অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সময় তিনজন লোকের এ্যালিরি ছিল। তার মধ্যে দুজনের এ্যালিবি অযোগ্য বলে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন দেখছি আমি ভুল করেছি। তৃতীয় জনের এ্যালিবিও গ্রহণযোগ্য নয়। আচ্ছা ডঃ লিডনার কি কখনও খুন করতে পারেন? কিন্তু এখন আমি বিস্মিত যে, সেদিন তিনি তার স্ত্রীকে খুন করেন।
তাহলে ডঃ লিড়নারই কী খুনী? একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল সেখানে তখন। ডঃ লিডনারের মুখে কোন কথা নেই। যাইহোক, ডেভিড এয়োটকে একটু অস্থির দেখাচ্ছিল এবং সেই প্রথম মুখ খুলল–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে আগেই বলেছি বেলা পৌনে তিনটের আগে ছাদ ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও নিচে নেমে আসেননি তিনি। আমি মিথ্যে বলছি না। অতএব তার পক্ষে ছাদ থেকে তার স্ত্রীকে হত্যা করা কি করে সম্ভব?
পোয়ারো মাথা নাড়লেন ধীরে ধীরে।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি বৈকি! আমিও বলছি–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে নেমে আসেননি সেদিন সেই সময়। কিন্তু আমি যা দেখেছি যা মিস জনসন দেখেছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়, তার থেকে ধারণা করে নেওয়া যায় যে–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে না নেমেই তার স্ত্রীকে খুন করতে পারেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকালাম।
সেই জানালা, পোয়ারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন–সেই জানালা! মিস জনসনের মতো আমিও এই কথাটা উপলব্ধি করি। মিসেস লিডনারের ঘরের জানালাটা ছিল কোটইয়ার্ডের ঠিক বিপরীত দিকে। ডঃ লিডনারের বড় এ্যালিবি হল–তিনি তখন ছাদের উপর নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এবং সেই ভারী হস্তচালিত পাথরের যাঁতাটা তার হাতের কাছেই সংগ্রহ করা ছিল। সত্যি কত সহজেই না ছাদের উপর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে একটা হত্যাকাণ্ড সবার অলক্ষে ঘটানো যায়! ওঃ কি অপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য!
পোয়ারো বলতে থাকেন।
ডঃ লিডনার ছাদে ব্যস্ত তার পটারির কাজে। মিঃ এমোট, মনে আছে তিনি আপনাকে মিনিট দশেক ছাদে আটক করে রাখেন কথার ছলে। ইতিমধ্যে আপনার সহকারী সেই বাচ্চা বয়টি কোটইয়ার্ডের বাইরে চলে যায়। নিচে ফিরে এসে আপনি তার খোঁজে চিৎকার শুরু করে দেন। সেই সুযোগে ডঃ লিডনার তৎপর হয়ে ওঠেন তার পরিকল্পিত কাজের চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্য। পকেট থেকে আঠালো মুখোসটা বার করেন, যে মুখোস দিয়ে এর আগে তিনি তার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ভয় দেখিয়েছিলেন। ছাদের প্যারাপেট থেকে ডঃ লিডনার তার দেহটা ঝুলিয়ে দেন, তার হাতের মুখোসটা মিসেস লিডনারের ঘরের জানালায় আঘাত করতে থাকেন ক্রমাগত। মনে রাখবেন–সেই জানালাটা ছিল কান্ট্রিসাইডের ঠিক বিপরীত দিকে।
ওদিকে তখন মিসেস লিডনার আধোঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। তখন ভরা দুপুর। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি চিন্তা করেন। প্রকাশ্য দিবালোকে তার জানালায় টোকা মারার মতো দুঃসাহস কে দেখায়? বিছানা থেকে নেমে তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ান। কৌতুহল মেটাতে জানালা খোলেন তিনি অন্য মেয়েদের মত। তারপর খলা জানালা পথে মুখ বাড়িয়ে উপর দিকে তাকাতে যান। ওদিকে প্যারাপেটের উপর অপেক্ষা করছিলেন ডঃ লিডনার তার হাতের সেই ভারী পাথরের যাতাটা নিয়ে। মুহূর্তে আর বিলম্ব না করে সেই মুহূর্তে তিনি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তার স্ত্রীর মাথা লক্ষ্য করে
একটা ক্ষীণ আর্তচিৎকার (মিস জনসন যে শব্দটা শুনতে পান) করার পর মিসেস লিডনারের রক্তাক্ত দেহটা জানালার নিচে লুটিয়ে পড়ে।
তিনি যদি তার স্ত্রীকে অত ভালবেসেই থাকবেন, কেন তবে তাকে হত্যা করতে যাকেন? অধৈর্য হয়ে ডঃ রেলি প্রশ্ন করেন-এ খুনের মোটিভ কী? লিডনার আপনি বলতে পারেন? বলে দিন মঁসিয়ে পোয়ারোকে পাগলের প্রলাপ বকছেন তিনি।
ডঃ লিডনার না পারলেন কথা বলতে, না পারলেন একটু নড়ে চড়ে বসতে।
তার হয়ে পোয়ারোই জবাব দিলেন–আমি আপনাদের বলেছি অপরাধটা একটা অভ্যাস। মিসেস লিডনারের প্রথম স্বামীও তো খুব ভালবাসতেন, তবে কেন তিনি তাঁকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতেন? কারণ তিনি তাকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। ফ্রেডরিক বনসারের প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বিতীয়বার আমি আবার মিসেস লিডনারের আগের জীবনে ফিরে যাচ্ছি। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন–ডঃ লিডনারের তাঁর বিয়ে হওয়ার আগের মুহূর্তে কিম্বা ঠিক পরমুহূর্তে সেই ধরনের কোন বেনামা চিঠি আসেনি তাঁর কাছে। কেন? এই প্রশ্নের মধ্যেই আমি ডঃ লিডনারের পরিচয় উপলব্ধি করতে পেরেছি সত্যি কি সহজ উপলব্ধি আমার–ডঃ লিডনারের আসল পরিচয় হল ফ্রেডরিক বনসার। যৌবনে এই ফ্রেডরিক লুসিকে পাগলের মত ভালোবাসতেন। সেই স্ত্রী তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পিতার সাহায্যে তাঁর প্রাণদন্ডের ব্যবস্থা করেন। পরে তিনি জেল-হাজত থেকে পালিয়ে যেতে গিয়ে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হন। সৌভাগ্য যে, প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তার সহযাত্রী সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক লিডনার তার চোখের সামনে সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন। ফ্রেডরিকের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় তখন। এরিক লিডনারের পরিচয় নেন তিনি এবং নিহত এরিক লিডনারকে তার পোষাক এবং পরিচয় ভূষিত করে সরে পড়েন ঘটনাস্থল থেকে। পরবর্তীকালে এরিক লিডনারের মৃতদেহ ফ্রেডরিক বনসারের বলে সমাধিত করা হয়।
তারপরের ঘটনা তো অতি সহজ এবং সরল। নতুন করে এরিক লিডনারের পরিচয় দিয়ে লুসির মন জয় করেন তিনি। ছদ্মবেশের আড়ালে লুসি তাকে চিনতে পারলেন না। বেচারি! ডঃ লিডনার সুযোগ খোঁজেন কিভাবে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। মাঝে কতকগুলো বেনামা চিঠি পাঠিয়ে তিনি তার এ্যালিবি তৈরি করে রাখেন, ফ্রেডরিক বনসার তখনও জীবিত। শেষ দিকে মিসেস লিডনার বোধহয় তার পরিচয়টা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। যার ফলে তিনি শেষ দিকে রিচার্ড ক্যারির দিকে ঝোঁকেন। এই সুযোগটাই চাইছিলেন ডঃ লিডনার। এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করেন সেদিন অপরাহ্ন বেলায় সবার অলক্ষ্যে হলেও মিস জনসনের চোখে তিনি ধরা পড়ে যান। তাই তাঁকেও চলে যেতে হল। আমি আবার বলছি–খুন একটা বড় অভ্যাস ডঃ লিডনারের, তাই তিনি রেহাই দিলেন না মিস জনসনকেও! কি–আমি ঠিক বলিনি ডঃ লিডনার?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন ডঃ লিডনার। অবশেষে তিনি ভেঙ্গে পড়লেন–হ্যাঁ আমি তাকেও খুন করেছি। বেচারি জনসন। আমি দুঃখিত–এ আমার অজ্ঞতার পরিচয়, এ আমার নিষ্ঠুরতার পরিচয়। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনিও একজন দক্ষ প্রত্নতত্ত্ববিদ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের অতীতকে আবিষ্কার করলেন এক নতুন রঙে, এক নতুন ঢঙে। আমার ঘুমন্তু সত্ত্বাকে আপনি জাগিয়ে তুললেন, লুসির ব্যবহারে পৃথিবীর সমস্ত নারীর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাই খুন আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। মিস জনসন সেই বদ অভ্যাসের শেষতম শিকার!
আর লুসিকে আমি ভালবেসেছিলাম এবং তাকে আমি খুনও করেছি। আপনি যদি লুসিকে বুঝে থাকেন, অহলে আমাকেও উপলব্ধি করতে পারবেন….না, আমার ধারণা আমার সম্বন্ধে আপনার চিন্তাধারা অন্য…..।
৫. তেল ইয়ারিমাহ
০৫. তেল ইয়ারিমাহ
স্বীকার করতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই যে, মিসেস লিডনারকে প্রথম দেখে আমার মনে যে ধারণা হয়েছে সেটা পুরোদস্তুর বিস্ময়কর যেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনার অতৃপ্ত কামনা-বাসনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন এখন। আমি ভেবেছিলাম, একটা বিশ্রী অবস্থায় ওঁকে দেখতে হবে। কিন্তু আমার সব ধারণা পাল্টাতে হল, আমি যা ভেবেছিলাম উনি তা নন। শুরুতেই বলে রাখি, সুন্দরী, রীতিমত সুন্দরী উনি। তবে ওঁর স্বামীর মতো জাতে উনি সুইডিস নন। স্বর্ণকেশী, স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশের মেয়েদের মতো রূপ ওঁর, সচরাচর এরকম দেখা যায় না। ওঁকে ঠিক যুবতী বলা যায় না। মাঝবয়সী, তিরিশ থেকে চল্লিশ বয়স হবে। ওঁর মুখটা ঈষৎ কৃশ, তবে চোখ দুটো অপূর্ব, ওরকম সুন্দর বেগুনি রঙের চোখ আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। বড় বড় চোখের নীচে সামান্য একটু কালো ছায়ার আস্তরণ। রোগাটে চেহারা। ওঁর চাহনির মধ্যে কি একটা যেন গোপন করবার অদম্য কৌতূহল লুকিয়েছিল।
আমার দিকে তিনি তার হাতটা প্রসারিত করে হাসলেন। মুক্তোর মতো সারিবদ্ধ দাঁতের হাসিটা বড় মিষ্টি বলে মনে হল। নিচু গলায় শান্ত ভাবে তিনি শুধোলেন, চা খাবে? নাকি একেবারে তোমার ঘরেতে গিয়ে উঠবে? তাঁর কথায় আমেরিকান সুর।
চা খাবার ইচ্ছাটা প্রকাশ করলাম আমি। টেবিলটাকে ঘিরে বসে থাকা অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বললেন,–ওঁরা হলেন মিস জনসন এবং মিঃ রেইটার, মিসেস মারকাডো, মিঃ টমোট, ফাদার ল্যাভিগনি। আমার স্বামী একটু পরেই এখানে এসে হাজির হচ্ছেন। তারপর ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিস জনসনের মাঝখানের আসনটা দেখিয়ে তিনি বললেন, তুমি ওই জায়গাটায় বস।
মিস জনসন বেশ আলাপী। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে নিলেন। আমারও বেশ ভাল লাগল তাঁকে। পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার কথার মধ্যে যথেষ্ট গভীরতা ছিল এবং মিষ্টি করে কথা বলার সময় একটা ব্যস্ততা লক্ষণীয়। টুইড কোর্ট এবং স্কার্টে তাকে কতকটা পুরুষের মতোই দেখাচ্ছিল। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে তিনি বললেন, ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা তিনি।
ওঁদের মধ্যে ফাদার ল্যাভিগনিকে একটু সতর্ক বলে মনে হল। রীতিমতো লম্বা তিনি, কালো দাড়ি, নাকে স্প্রিং লাগান চশমা। মিসেস কেলসি বলেছিলেন, এখানে একজন ফরাসী সন্ন্যাসী আছেন। এখন ফাদার ল্যাভিগনির পরনে সাদা উলের আলখাল্লা দেখে মনে হল, ইনিই তাহলে সেই ফরাসী সন্ন্যাসী। ওঁকে এখানে এই লোকালয়ে দেখে অবাক হয়ে যাই, কারণ ছেলেবেলা থেকে আমি জেনে এসেছি, সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণত লোকালয় ছেড়ে নির্জন মঠ বা আশ্রমে বাস করে থাকেন, মঠের বাইরে থাকেন না কখনও তারা।
মিসেস লিডনার বেশির ভাগ সময় ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনি বেশ স্পষ্ট ইংরেজি ভাষায় কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। লক্ষ্য করলাম, ওঁর মুখের ভাব-ভঙ্গী এবং চাহনির মধ্যে একটা চতুরতার ছাপ আছে। ওঁর মেপে মেপে কথার বলার মধ্যে একটা পরিশ্রমের ছাপও পাওয়া যায়।
আমার ঠিক বিপরীত দিকে অপর তিনজন বসেছিল। মিঃ রেইটার বেশ শক্ত সমর্থ যুবক, চোখে চশমা। তার কোঁকড়ানো চুল কাঁধের অনেক নিচে নেমে গেছে। এবং নীল গোলাকৃতি চোখ। প্রখর দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, সে যেন একটা নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু তাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আমার মনে হল, শূকরছানার মুখ ধারণ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষের অবয়ব। অপর দুটি যুবকের চুল ছোট করে ছাঁটা। একজনের মুখের দিকে তাকালে আমার কেন জানি না মনে পড়ে যায় একজন ভাড়ের কথা, তার দাঁতগুলো ভারী চমৎকার। হাসলে তাকে ভারী সুন্দর দেখায়। কম কথা বলে সে। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। রেইটারের মত সেও জাতে আমেরিকান। শেষ ব্যক্তি হল মিসেস মারকাভো। তার দিকে আমি ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না, কারণ যখনই আমি তাকে আড়চোখে দেখতে যাই, বুঝতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার ক্ষুধার্ত চোখ দিয়ে। যেভাবে সে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে মনে হবে যে, হাসপাতালের নার্স মাত্রই যেন এক একটি জানোয়ার; সভ্যতা ভদ্রতা বলে কিছু জানে না তারা।
মিসেস মারকাভোর বয়স খুব বেশি নয়, পঁচিশের কাছাকাছি হবে হয়তো। গায়ের রঙ কালো এবং চেহারা দেখে মনে হয়, বোধহয় এই মাত্র সে গর্ভপাত করিয়ে এসেছে। তবে এককালে সে যে সুন্দরী ছিল তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। গায়ের পুলওভারের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নখে নখ পালিশ লাগান। পাখির ঠোঁটের মত সরু ঠোঁটে চাপা উত্তেজনা। বড় বড় চোখ দুটো সজাগ সদা সর্বদা। মুখে সব সময় যেন একটা সন্দেহের ছাঁয়া লেগে আছে।
চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারি, ভাল স্বাদ আছে। একেবারে সস্তা দামের কিছু নয়। সঙ্গে জ্যাম-জেলি মাখন টোস্ট। মিঃ এমাট আমার খাবারের তদারকি করছিলেন।
মিসেস লিডনার বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং একবার তার দিকে ফিরে তাকালেন, কিন্তু তাতে কোন ফল হল না।
আমাদের আলাপের একেবারে শেষ পর্বে মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো এসে উপস্থিত হলেন সেখানে।
মিঃ লিডনার তার স্বভাব সুলভ সুন্দর ভঙ্গিমায় আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। চিন্তিত মুখে তিনি দ্রুত তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, পরক্ষণেই লক্ষ্য করলাম, তার মুখের উপর থেকে সেই ভাবনার ছায়াটা উধাও হয়ে গিয়ে, একটা তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল সেখানে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসলেন মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো মিসেস লিডনারের শূন্য আসনটা দখল করলেন।
দীর্ঘদেহী মিঃ মারকাভোর মুখটা অজানা আতঙ্ক এবং বিষণ্ণতায় ভরা, স্ত্রীর থেকে তার বয়স অনেক বেশি, অবিন্যস্ত দাড়ি। মনে হয় কোন কারণে নিজের শরীরের উপর তেমন যত্ন তার নেই। তার আগমনে আমি একটু খুশি হলাম, কারণ তিনি সেখানে প্রবেশ করা মাত্র তার স্ত্রী আমার দিকে তাকান বন্ধ করে দিল, এবং তার স্বামীর দিকে নজর দিল। তাকে ভীষণ অধৈর্য এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তার এই ভাবগতিক কেমন খাপছাড়া লাগল আমার কাছে। মিঃ মারকাভোর মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম, যেন স্বপ্নের ঘোরে চা খাওয়া শেষ করলেন নিঃশব্দে, কোন কথা নেই। অন্য কিছু খাওয়ার দিকে তেমন ইচ্ছা নেই। প্লেটের কেক প্লেটেই থেকে গেল।
এখনো একটা আসন ফাঁকা ছিল সেখানে। আর সেই সময় দরজা ঠেলে একটা লোক প্রবেশ করল।
আগন্তুক রিচার্ড ক্যারি। তার মত সুপুরুষ অনেকদিন চোখে পড়েনি। একই সঙ্গে কাউকে যদি একবার সুপুরুষ বলা যায়, এবং পরমুহূর্তে যদি বলা হয় যে, অন্য কোন মৃত সুপুরুষ ব্যক্তির মাথাটা কেটে তার দেহের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, স্বভাবতই কথার মধ্যে একটা বিসদৃশ্য ভাব থেকে যায়, তবু কথাটা সত্যি। এতটুকু বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলা নয়। তার বাদামি মুখে জ্বলজ্বলে নীল চোখ দুটো বড় অদ্ভুত, বড় বেমানান, এরকম বিসদৃশ এর আগে আমি কখনো দেখিনি বোধহয়। লম্বায় ছ’ফুট, বয়স মনে হয় চল্লিশের নিচেই হবে।
নার্স, ইনি হলেন আমাদের প্রত্মতত্ত্ববিদ মিঃ ক্যারি, ডঃ লিডনার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আনন্দের অতিশয্যে অস্পষ্ট গলায় ইংরাজিতে কি যেন বললো ফিসফিসিয়ে, বোঝা গেল না। তারপর তিনি গিয়ে বসলেন মিসেস মারকাভোর পাশে।
তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, তাঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে আগন্তুক, তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখলে মনেই হয় না যে তারা পরস্পরের পূর্ব পরিচিত, কেউ কেউ আবার একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচিত বেশ কয়েক বছরের।
.
০৬.
প্রথম সন্ধ্যা
চায়ের আসরের পর আমাকে ঘর দেখাবার জন্য নিয়ে গেলেন। মনে হয় এখানে ঘরগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া দরকার। বোঝবার কোন অসুবিধা নেই, অতি সহজ সরল প্ল্যান।
বিরাট উন্মুক্ত বারান্দা, বারান্দার দু’দিকেই দরজা, মূল দুটি ঘরের প্রবেশ পথ। ডানদিকে ডাইনিংরুম যেখানে একটু আগে আমরা চা খেয়ে এলাম। অপর দিকে ঠিক সেই রকমই আর একটি ঘর, (এটা আমি শয়ন কক্ষ বলে মনে করি) বসবার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেটা। যেখানে কিছু ড্রইং-এর কাজ হয়ে থাকে।
বসবার ঘরের মধ্যে লাগোয়া আর একটা ঘর আমার চোখে পড়ল। খননকার্য চালাবার সময় মাটির নিচে থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য জিনিসগুলোর প্রদর্শনী ক্ষেত্র বলা যেতে পারে এই ঘরটা। দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া সেলফ, পায়রার খোপের মত ছোট ছোট খোপগুলোয় জিনিসগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই চোরাকুঠুরি থেকে সরাসরি বেরুবার কোন দরজা নেই।
সেই চোরাকুঠুরির পাশের ঘরটা মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষ। কোর্টইয়ার্ডে যাবার দরজা আছে সেই ঘরের। মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষটা ছিল এক কোণায়। তার পাশের ঘরটা ডঃ লিডনারের, তবে দুটি ঘরের যোগাযোগের সেতু বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ কোন দরজার বালাই ছিল না। বাড়ির পূর্বদিকের এই ঘরটাই ছিল প্রথম। তারপরের ঘরটা আমার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আমার ঠিক পরবর্তী ঘরটা মিস জনসনের। তার পরের দুটি ঘর যথাক্রমে মিঃ অ্যান্ড মিসেস মারকাভোর। তারপর দুটি বাথরুম।
প্রতিটি শয়নকক্ষ প্রায় একই রকম, একটি জানালা এবং কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র দরজা। দক্ষিণে ড্রইং অফিস, ল্যাবরেটারি এবং ফটো তোলার ঘর।
অপরদিকের ঘরগুলোর ব্যবস্থাও ঠিক একই রকমের, কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র রাস্তা। ড্রইংরুম সংলগ্ন অফিসঘর। মিসেস লিডনারের অনুরূপ ঘরটা ফাদার ল্যাভিগনির, তাকে সব থেকে বড় ঘরটা দেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ছাদে যাবার সিঁড়ি। পশ্চিমদিকে শুরুতে রান্নাঘর কোয়ার্টার এবং পর পর চারটি ছোট আকারের শয়নকক্ষের বাসিন্দারা হল চারজন যুবক, ক্যারি, ইমোট, রেইটার এবং কোলম্যানের।
উত্তর-পশ্চিম কর্নারে ডার্করুম, মধ্যে ফটো তোলার ঘর। তার পাশেই ল্যাবরেটরি। তারপরেই একমাত্র প্রবেশ পথ, বিরাট খিলানের নিচে দরজা। সেই দরজাপথ দিয়ে আমরা প্রবেশ করেছিলাম। বাইরে স্থানীয় ভৃত্যদের থাকবার কোয়ার্টার, সৈনিকদের জন্য প্রতীক্ষালয়, ঘোড়াদের আস্তাবল।
বিল্ডিংয়ের একটা পূর্ণ বিবরণ আমি এখানে দিলাম, এই কারণে যে, পরে তার পুনরাবৃত্তি করতে যেন না হয়।
একটু আগে যা বললাম, মিসেস লিডনার নিজে আমাকে সঙ্গে করে সারা বিল্ডিংটা ঘুরিয়ে দেখালেন, অবশেষে আমার থাকবার ঘরে নিয়ে এলেন, উদ্দেশ্য এরপর যাতে করে আমি পূর্ণ বিশ্রামের অবকাশ পাই। ঘরটা দারুণ পরিপাটি করে সাজানো।
মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজের আগে এবং সকালে অবশ্যই ছেলেরা গরম জল দিয়ে যাবে। বাড়তি জলের প্রয়োজন হলে বাইরে বেরিয়ে এসে হাতের ইশারায় ছেলেদের ডাকতে হবে। তারা কাছে এলে বলবে, জিব মাই হার কথাটা মনে থাকবে তো?
মাথা নাড়লাম। নিচু গলায় দু-চারবার কথাটা আওড়ালাম।
ঠিক আছে। আরবরা সাধারণ ইংরাজি ভাষার এক বর্ণও বোঝে না।
ভাষাটা দেখছি এখানে একটা দারুণ সমস্যা।
তা যা বলেছ, মিসেস লিডনার বলেন, এখানে প্যালেস্টাইনে একটা চার্চ আছে, সেখানে উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা প্রার্থনা সংগীত বিভিন্ন ভাষায় লেখা আছে।
ঠিক আছে, আমি বললাম সেই লেখাগুলো আমি অবশ্যই লিখে রাখব, পরে আমার কাকীমাকে বলব, তিনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন।
আমি আশাকরি, এখানে তুমি সুখেই থাকবে, তারপর হঠাৎ মিসেস লিডনার তার বেগুনি রঙের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –সত্যি করে বল তো নার্স, আমার স্বামী ঠিক তোমাকে আমার সম্বন্ধে কি বলেছেন? আমার কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করো না।
আমি শুনেছি, আপনার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে মিসেস লিডনার, সহজ ভাবে কথাটা একরকম ছুঁড়ে দিলাম, আর সেই কারণে আপনার দেখাশোনা করবার জন্য এবং আপনার সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখবার জন্য আপনি আমাকে এখানে এনেছেন।
চিন্তিত ভাবে ধীরে ধীরে মাথাটা একটু কাত করে মিসেস লিডনার বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি আমার উপকারে আসবে বৈকি!
তাঁর কথাটা হেঁয়ালির মত শোনাল। কিন্তু এ নিয়ে আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না। বরং আরো একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, আশা করব, আপনি আমাকে আপনার বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করার সুযোগ দেবেন, আমাকে বেকার হয়ে বসে থাকতে দেবেন না।
হাসলেন তিনি। ধন্যবাদ নার্স।
তারপর তিনি আমার বিছানায় বসে হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলছি এই কারণে যে, তাঁর চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে গিয়ে সেই প্রথম আমার মনে হল মিসেস লিডনার একজন মহিলা। আর আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোন মহিলা অন্য কোন মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামিয়ে থাকে। কিন্তু তিনি যেন তাদের ব্যতিক্রম। আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানবার আগ্রহ তার খুব। কোথায় আমি ট্রেনিং নিয়েছি। এখানে আসার কী কারণ থাকতে পারে। আমাকে ডঃ রেলি সুপারিশ করলেন কী জন্য। এমন কি তিনি জানতে চাইলেন, আমেরিকায় আমি কখনো গেছি কি না এবং সেখানে আমার কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধু-বান্ধব আছে কিনা। তারপর তিনি এমন কয়েকটা প্রশ্ন করলেন যা ঠিক সেই সময় আমার কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু পরে দেখলাম যথেষ্ট অর্থবাহক বটে।
তারপর হঠাৎ তিনি কেমন বদলে গেলেন। হাসলেন, সূর্যস্নাত উচ্চ হাসি। তার মিষ্টি কণ্ঠস্বর আমার কানে যেন মধু বর্ষণ করল, আমাকে পেয়ে তিনি নাকি খুশি এবং তিনি নিশ্চিত আমি তার অনেক উপকারে আসতে পারি। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন, ছাদে গিয়ে আমি সূর্যাস্ত দেখতে চাই কিনা। আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং তখুনি আমরা দুজনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাগদাদ থেকে আসবার সময় নির্দিষ্ট কোন লোক তোমার নজরে পড়েছে?
উত্তরে আমি বললাম, তেমন কোন নির্দিষ্ট লোককে আমার মনে পড়ে নি, তবে রেস্টুরেন্ট-কারে দু’জন ফরাসীকে দেখেছিলাম। আর তিনজন লোককে পাইপ লাইনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুনেছিলাম।
তিনি মাথা নাড়লেন। তার মুখ-চোখের অবস্থা দেখে মনে হল, তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
মিসেস মারকাডো বসেছিলেন প্যারালোটের উপর এবং ডঃ লিডনার কতকগুলো টুকরো টুকরো পাথর এবং মাটির বাসনের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছিলেন নির্দিষ্ট মনে। মনে হয় সেই জিনিসগুলো অতি দুষ্প্রাপ্য। সত্যি কথা বলতে কি অমন অদ্ভুত ধরনের পাথর আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।
এই যে এখানে এসো’, মিসেস মারকাভোর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম তার দিকে, দৃশ্যটা সুন্দর না?
পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, অপূর্ব সেই দৃশ্য, অনস্বীকার্য। অদূরে টাইগ্রিস নদীর কলকল শব্দ। এই মুহূর্তে দূর থেকে হাসানিয়েকে যেন এক স্বপ্নময় দেশের সুন্দরী পরীর মত দেখাচ্ছিল। এই মুহূর্তে আমরাও যেন স্বপ্নের আবর্তে পড়ে একাকার হয়ে গেলাম।
চমৎকার, তাই না এরিক? মিসেস লিডনারের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি।
আবিস্ট চোখে তাকালেন ডঃ লিডনার, ফিসফিসিয়ে বললেন, চমৎকার, চমৎকার। কথা বলতে বলতেই তিনি সেই মাটির বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছিলেন।
মিসেস লিডনার হাসলেন, প্রত্মতত্ত্ববিদরা বড় বেরসিক, তারা তাদের পায়ের নিচের জিনিস ছাড়া অন্য কিছু দেখতে চায় না। তাদের মাথার উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটা সুন্দর আকাশ যে আছে, সেটা বোধহয় তাদের জানা নেই।
মিসেস মারকাডো মুচকি হাসলেন।
ওঃ, ওঁরা যে সন্দেহবাতিক লোক, একটু পরেই তুমি তা টের পাবে নার্স। একটু থেমে ঠোঁটের প্রান্ত রেখায় হাসির একটা সূক্ষ্ম রেখা টেনে তিনি আবার বললেন, তুমি এসেছ, তাতে আমরা সবাই খুব খুশি। আমাদের প্রিয় মিসেস লিডনারকে নিয়ে আমাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল, তাই না লুসি?
তোমার কী খুব দুশ্চিন্তা ছিল? মিসেস লিডনারের কথা শুনে মনে হল, মিসেস মারকাভোর কথায় তিনি খুব একটা স্বস্তিবোধ করলেন না। যাইহোক, আমার ব্যাপারে তোমাকে আর ভাবতে হবে না মেরি। এখন থেকে নার্স আমার যত্ন নেবে।
নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই! আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম।
মিসেস লিডনারের কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হল, খুব সহজে তিনি তার শত্রু সৃষ্টি করতে পারেন। তার কথাবার্তায় একটা রুক্ষ্ম, মেজাজের সুর ধ্বনিত হয়–(তবে এর জন্য আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না)।
ওদিকে মিসেস লিডনার ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে তার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। ভঃ লিডনার টের পাননি তার আগমনের কথা, তার পিঠে কোমল হাতের স্পর্শ পড়তেই তিনি ফিরে তাকালেন চকিতে। ডঃ লিডনার শান্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর পানে, সে চোখে অনেক জিজ্ঞাসা এবং অনেক অজানা কৌতূহল।
মিসেস লিডনার শান্তভাবে মাথা নাড়লেন, তার একটা হাত লিডনারের কাঁধে জড়ানো ছিল।
ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর প্রতি খুবই অনুরক্ত, তাই না? মিসেস মারকাডো প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন।
হ্যাঁ, প্রত্যুত্তরে বললাম, দেখতে বড় ভাল লাগে।
কথাটা বোধহয় মিসেস মারকাডোর মনঃপুত হল না। সন্দেহ এবং বিরক্তির ছায়া পড়েছিল তার মুখে চোখে।
ওঁর সম্বন্ধে তোমার সত্যিকারের কী ধারণা বলোত? গলার স্বরটা খাদে নামিয়ে এনে তিনি শুধোলেন।
ওহো, তেমন মারাত্মক কিছু নয়, ব্যাপারটাকে হাল্কা করার উদ্দেশ্যে বললাম, আমার ধারণা, সাময়িক ভাবে ওঁর স্বাস্থ্যটা বোধহয় একটু ভেঙে পড়ে থাকবে।
তখনও তার সন্দেহ বোধহয় ঘাচেনি। হঠাৎ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কী মানসিক রোগগ্রস্থ রুগীদের নার্স?
ওহো, না, না সে সব কিছু নয়, সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললাম, কিন্তু এ কথা আপনার কেন মনে হল বলুন তো?
এক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন, তুমি জান না কি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা উনি। কেন, ডঃ লিডনার তোমাকে কিছু বলেননি?
আমার কাজের ব্যাপারে খোশগল্প করতে আমার ইচ্ছা ছিল না। তাছাড়া আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ সব কেসে রুগীর আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে সত্য খবরটা আশা করা বৃথা। নিজের চোখে দেখা না পর্যন্ত কোন গুজবে কান দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলে অন্য কথা। কিন্তু সেরকম কাউকে এখানে দেখা যাচ্ছে না। ডঃ রেলি একজন চিকিৎসক হলেও পেশাদার চিকিৎসক হিসাবে তাকে এখানে ডাকা হয় না। তাছাড়া ডঃ লিডনারও আমাকে খোলাখুলি ভাবে কিছু বলেন নি এখনও পর্যন্ত। ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। যাইহোক, সব কিছু ভাল করে জানার পর আমি আমার কর্তব্য ঠিক করব। মনে হয় মিসেস মারকাডো কিছু বলতে চান। কিন্তু তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, মিসেস লিডনারের উপর অহেতুক আক্রোশ বা হিংসে আছে। যাইহোক আমার যা পেশা, তাছাড়া মানবতার খাতিরে তার কথা আমাকে শুনতেই হবে।
আমার যতদূর ধারণা, তাকে বললাম, সম্ভ্রান্ত মিসেস লিডনার এক এক সময় ঠিক স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছেন না। খুব শিগগীর তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।
স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন? আমি বলছি, তা আর সম্ভব নয়। ওঁর ভয়ে সব সময় আমরা তটস্থ, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। ওঁর ভয়ার্ত চিৎকারে আমরা ব্যতিব্যস্ত। একদিন রাত্রে ওঁর ঘরের জানলায় আঙুলের টোকা পড়তে শুনেছেন উনি। তারপর আর একদিন তিনি নাকি দেখেছেন তার জানালার সামনে একটা কাটা হাত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেই হাতটা ছাড়া দেহের আর কোন অংশ তিনি দেখতে পাননি। একটা হলুদ মুখ জানালায় প্রতিবিম্বিত হতেই দ্রুত ছুটে যান তিনি সেদিকে, কিন্তু জানালার ধারে গিয়ে দেখেন কেউ কোথাও নেই।
এ যেন একটা তাজ্জব ব্যাপার। তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এ ব্যাপারে আমাদের নাক না গলানোই উচিৎ নয় কি? তবু মাথা ঘামাতে হচ্ছে।
মনে হয় কেউ বোধহয় ওঁকে এভাবে ভয় দেখাতে চাইছে, প্রতারণা করতে চাইছে, আমি আমার ধারণার কথা বললাম।
ওহো না, এ সব ওঁর স্থল কল্পনা। এই তো মাত্র তিন দিন আগে নৈশভোজের সময়, এখান থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে একটা গ্রামে গুলির শব্দ হতেই মিসেস লিডনার লাফিয়ে ওঠেন এবং আঁতকে ওঠেন। আর ডঃ লিডনার? তিনি তখন এক হাস্যকর কান্ড ঘটালেন, দ্রুত স্ত্রীর কাছে ছুটে এসে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকেন, ও কিছু নয় প্রিয়তমা। আদৌ ও সব কিছু নয়। আমার মনে হয়, নার্স তুমি নিশ্চয়ই জানো, সব পুরুষরা এমন সব হিস্ট্রিয়াগ্রস্ত নারীদের এমনভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু এ অন্যায়, এটা একটা খারাপ নজির। প্রতারণাকে কখনই উৎসাহিত করা উচিৎ নয়।
আর সেগুলো যদি প্রতারণা না হয়?
এছাড়া আর কিই বা হতে পারে?
আমি উত্তর দিলাম না, কারণ আমি জানি না কি বলতে হবে। এ এক বড় অদ্ভুত ব্যাপার। গুলির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠা ও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই ভুতুড়ে মুখের গল্প এবং কাটা হাতের গল্প যেন অন্যরকম। ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন মেজাজের, যার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। এ ব্যাপারে আমার দুটো ধারণা হয়েছে। হয় এটা মিসেস লিডনারের বানানো গল্প (ছোট ছেলেরা যেভাবে বানিয়ে গল্প বলে, যা বাস্তবে ঘটেনি, সেই রকম তিনিও হয়তো সবার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করানোর জন্য গল্পটা নিজে বানিয়ে বলে থাকবেন), কিংবা এমন হতে পারে, আমার যা ধারণা, একটু আগে যে কথা আমি বলেছি, তাকে কেন্দ্র করে এটা একটা কারোর ইচ্ছাকৃত ঠাট্টা-তামাশাও হতে পারে। আমার শেষোক্ত ধারণাটা যদি সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে মিঃ কোলম্যানকে আমার কেমন সন্দেহ হয়। ছেলেটি অদ্ভুত ধরণের। এ ব্যাপারে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। তাই আমি ঠিক করলাম, তার উপর কড়া নজর আমি রাখব। নার্ভাস রুগীরা সামান্য একটু ঠাট্টা কিংবা তামাশার ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
মিসেস মারকাডো চকিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন :
আচ্ছা নার্স, তোমার কি মনে হয় না, ওঁর চেহারাটা রীতিমত রোমান্টিক ধাঁচের। এমন মেয়ের জীবনে অনেক কিছু ঘটতে পারে।
কেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওঁর জীবনে তেমন কোন ঘটনা ঘটেছে নাকি?
ওঁর প্রথম স্বামী যুদ্ধে যখন নিহত হন এখন ওঁর বয়স মাত্র কুড়ি। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক, এবং বড় রোমান্টিক, তাই না?
হ্যাঁ, এক হিসাবে রাজহংসী এবং রাজহংসও বলা যেতে পারে।
কি উদ্ভুত উপমা? মিসেস মারকাডো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু তখন ছাদের উপর থেকে বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার জেঁকে বসতে যাচ্ছে। আমি বললাম, এবার আমাদের নিচে নেমে যাওয়া উচিৎ। মিসেস মারকাডো আমার কথায় সায় দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি ল্যাবরেটরি দেখতে চাই কিনা! আমার স্বামী এখন সেখানে আছেন আলাপ হয়ে যাবে।
ল্যাবোরেটরিতে আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু বড় ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। মিসেস মারকাডো ল্যাবোরেটরি ঘুরিয়ে দেখালেন আমাকে, কিছু দামী যন্ত্রপাতি, আমার গহনাপত্র, মোম লাগানো হাড়ের কয়েকটা টুকরো।
কিন্তু জোসেফ কোথায় যেতে পারে? মিসেস মারকাডো স্বগোতক্তি করলেন।
ড্রয়িং অফিসেও নেই। সেখানে ক্যারি তার কাজে ব্যস্ত ছিল। আমরা সেখানে ঢুকতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সে আমাদের দিকে। তার সেই অদ্ভুত ধরনের চাহনি আমাকে বিস্ময়ের আবর্তে ফেলে দিল যেন। এই লোকটি তার নিজস্ব ক্ষমতার একেবারে শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। খুব শিগগীর একটা কিছু ঘটবে নিশ্চয়ই। আমার মনে হয় অন্য
কেউ নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমনি একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করে থাকবে।
চলে আসার সময় আমি আর একবার ফিরে তাকালাম তার দিকে। তখন সে তার কাগজের উপর ঝুঁকে কি যেন নিরীক্ষণ করছিল, শক্ত করে চেপে ধরে রাখা ঠোঁট, না বলা কথার মধ্যে যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে। হয়ত এ রকমই তার অভিব্যক্তি। কিন্তু সে যাই হোক, আমার ধারণা এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে, সে যেন কোন এক বয়স্ক নাইট, যুদ্ধে যাচ্ছে এবং সে জেনে গেছে তার মৃত্যু অনিবার্য।
তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে আমার আর একবার মনে হল, সত্যি মানুষকে আকর্ষণ করার কি অদ্ভুত ক্ষমতাই না আছে তার মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত বসবার ঘরে মিঃ মারকাড়োকে পাওয়া গেল। তিনি তখন নতুন কোন গবেষণার কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলেন মিসেস লিডনারের সঙ্গে। মিসেস লিডনার একটা সাধারণ কাঠের চেয়ারের উপর বসেছিলেন। আর একবার আমি অবাক হলাম তার সেই পোশাক ও অদ্ভুত হাল্কা শরীরটা দেখে। দূর থেকে তাকে তখন ঠিক পরীর মতো দেখাচ্ছিল, রূপকথার দেশের রাজকন্যা আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে, রক্তে-মাংসে গড়া দেহের থেকেও বেশি সুন্দরী তিনি।
মিসেস মারকাডো হৈ-হৈ করে ছুটে গেলেন, ওহো জোসেফ তুমি এখানে। আমরা ভেবেছিলাম, তোমাকে ল্যাবোরেটরিতে দেখতে পাব।
লাফিয়ে ওঠেন জোসেফ, স্ত্রীর দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে তোতলাতে তোতলাতে বলতে থাকেন, আমাকে এখন যেতেই হবে। আমি এখন মাঝখানে– কথাটা তিনি সমাপ্ত করলেন না, তবে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
মিসেস লিডনার তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অলসভাবে বললেন, অন্য কোন এক সময় তুমি তোমার কথা শেষ করো, শুনতে আমি খুব আগ্রহী। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন। ওঁর হাসিটা কেমন কৃত্রিম বলে মনে হল।
মিনিট দু’এক পরে মিসেস লিডনার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ওই বুকশেকে কয়েকটা নির্বাচিত বই রেখেছি, ওগুলোর মধ্যে একটা বই পছন্দ করে নিয়ে এসে বসে পড়।
বুকশেলফের দিকে আমাকে যেতে দেখে মিসেস মারকাডো একবার আমার দিকে। তাকিয়েই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চকিতে তিনি আমার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন, সেই মুহূর্তটুকু সময়ের মধ্যে মিসেস মারকাডোর মুখটা দেখতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। রাগে থম থম্ করছে মুখ, চোখে হিংস্র চাহনি। মিসেস কেলসির কথা মনে পড়ল, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে তিনি আমাকে মোটামুটি এ ধরণের একটা আভাস অবশ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন আমি তার কথায় আমল দিইনি। এখন যে দিই তা নয়। মিসেস লিডনারকে আমি পছন্দ করে থাকি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও মনে হল, তাদের বক্তব্য কি একেবারে উড়িয়ে দেবার, এতটুকু সত্যের অবকাশ কি নেই তার পিছনে?
তবে মিসেস লিডনারের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু কুরূপা মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডোকে সে কথা বোঝানো যায় না, সব সময় তাঁরা যেন অগ্নিশর্মা, মিসেস লিডনারের কথা কিছু বললেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
বেচারা মারকাডো। আমার মনে হয় না, মিসেস লিডনার এ নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন মনে করেন, কিন্তু মিসেস মারকাডো সত্যি সত্যি মনে করেন, মিসেস লিডনারের তার স্বামীকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়, হাজার হোক তিনি পরস্ত্রী মারকাডোর কাছে।
আমার মনে হল, মিসেস লিডনারকে একটু সাবধান করে দিলে কেমন হয়। ওঁর দিকে তাকালাম, উনি তখন ওঁর হাতের সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। আমার আরো মনে হল, ওঁকে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ, মানুষ হিংসার বশে যে কোন জঘন্য নিষ্ঠুর কাজ করে বসতে পারে। অতএব ওঁর এখন এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয়, যাতে করে ওঁর শত্রুরা তার সুযোগ নিতে পারে।
তারপর আমি নিজেকে বললাম, আমি লিথেরান, তুমি বোকা, মিসেস লিডনার বাচ্চা মেয়ে নয়, ইতিমধ্যে তিনি চল্লিশ পেরিয়ে এসেছেন। আর জীবন সম্বন্ধে ওঁর অভিজ্ঞতা কম নয়।
কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হল, বোধহয় সে অভিজ্ঞতা ওঁর নেই। এক এক সময় তার চোখে আতঙ্ক ভাব দেখে অন্তত তাই মনে হয় আমার।
সত্যি, কি তার জীবন! মাত্র দু বছর আগে ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এবং মিসেস মারকাডোর কথা মতো প্রায় পনেরো বছর আগে তার প্রথম স্বামীর মৃত্যু হয়।
ড. লিডনার আমার ঘরে এলেন, এই রকমই আমি চাইছিলাম। করমর্দন করে বললেন, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে। প্রথম সাক্ষাতেই ও তোমাকে আপন করে নিয়েছে, তাতে আমি খুব খুশি। আমার মনে হয়, এখন থেকে সব ঠিক ঠিক চলবে।
বাচ্চা ছেলের মতো আগ্রহ দেখালেন মিঃ লিডনার।
আমারও তাই মনে হয়, মিসেস লিডনার আমাকে তার আপনজন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু ডঃ লিডনারের মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আমি হতে পারছি না। আমার কি রকম একটা ধারণা হল, মিসেস লিডনারের ব্যাপারে উনি আরো অনেক কিছু জানেন, যা উনি প্রকাশ করতে চাইছেন না।
হয়তো কিছু, হয়তো এমন কিছু, যার হদিশ আমি পাচ্ছি না, কিন্তু বাতাসে তার আভাস আমি অনুভব করছি। পশমের মত নরম সুন্দর বিছানা, তবু সেই নিবিড় ঘুম যাকে বলে, ঠিক সেই ভাবে চোখের পাতা দুটো এক করতে পারলাম না। এরই মাঝে বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে কয়েকবার।
মনে পড়ে ছেলেবেলায় কীটসের কবিতার দুর্বোধ্য কথাগুলোর অর্থ জানবার জন্যে যে ব্যাকুলতা আমার হয়েছিল, ঠিক সেই রকম কৌতূহল এখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থ খুঁজতে গিয়ে বারবার আমি ব্যর্থ হই, মনটা খারাপ হয়ে যায়। এটা একটা এমনি কবিতা, যা আমি সব সময় ঘৃণা করে থাকি। আমি মনে করি এবং আমি বিশ্বাস করি, সেটা আমি চাই কি চাই না আগে আমায় জানতে হবে। যাইহোক, অন্ধকারে ঘুম থেকে জেগে উঠতেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা একটা অপূর্ব দৃশ্য যা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।
ওঃ কি যাতনা নাইট তোমার, নিঃসঙ্গ একাকী এবং (কি সেটা?) বিষণ্ণ মুখ খুঁজে বেড়াও………? সেই প্রথম আমার মনের আয়নায় সেই নাইটের মুখখানি প্রতিফলিত হতে দেখি, আর সেই মুখ মিঃ ক্যারির টান-টান, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, ঠিক এরকম মুখ আমি ছেলেবেলায় যুদ্ধের সময় বেচারা যুবকদের মধ্যে দেখে ছিলাম, যুদ্ধাতঙ্ক। তার জন্য আমার দুঃখ হল, একটু পরেই আমার চোখে ঘুম নেমে এল। স্বপ্নে আমি আবার দেখলাম, বেলি ডেন সান্ড মারসি যেন মিসেস লিডনার, অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করে একদিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন, হাতে এমব্রয়ডারি করা একগুচ্ছ ফুল এবং তারপর ঘোড়াটা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু ভয়ে আমার দেহের কাঁপুনি তখনও থামেনি।
.
০৭.
জানলায় মানুষের মুখ
আমার মনে হয় শুরুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার, এ কাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় কোন ঘটনা জড়িত নয়। স্বীকার করতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই, প্রত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান নেই, আর জানবার ইচ্ছাও তেমন নেই। মিঃ ক্যারি আমাকে বলতে শুরু করেছেন, আমার মধ্যে প্রত্মতাত্ত্বিকের মেজাজ নাকি দেখতে পায় না সে, সত্যি কথা বলতে কি তার ধারণা একেবারে মিথ্যা নয়।
আমার পৌঁছানোর পর দিনই ক্যারি জানতে চাইলেন, তার পরিকল্পিত পা্যলেস আমার দেখার ইচ্ছা আছে কিনা। কয়েক যুগ আগের ঘটনাকে আজ সে কি করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে সে কথা আমার অজানা, স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমার। স্বভাবতই সেই কাল্পনিক দৃশ্যটা দেখার কৌতূহল হওয়া আমার স্বাভাবিক। তাই আমি তাঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম, সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমি নিজেই খুব উৎসাহিত বোধ করছিলাম। প্রায় তিন হাজার বছর আগের পুরনো প্যালেস, তখনকার দিনের প্যালেস কি রকম হতে পারে, সেটা দেখাই আমার একমাত্র কৌতূহল। তুতানখামেনের ছবিতে সে দৃশ্য আমি দেখেছিলাম, সেটা চাক্ষুস দেখার সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। কিন্তু আমাকে দারুণভাবে হতাশ হতে হল। বিশ্বাস করা যায়, সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু না? দু’ফুট উঁচু মাটির দেওয়াল, প্যালেসের ধ্বংসাবশেষ বলতে এই পর্যন্ত। তবু বেশ উৎসাহ নিয়ে মিঃ ক্যারি আমাকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বোঝাতে থাকে, ওটা একটা বিরাট আদালত, ওখানে কতকগুলো চেম্বার, দোতলা ঘর, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমার তখন কেবল একটাই চিন্তা, ও কি করে জানল এত সব? খুব মার্জিত ভাবেই প্রশ্নটা রাখলাম তার কাছে। ওরা যে যাই বলুক, আমি কিন্তু খুব নিরাশ হয়েছি ওদের কাজকর্ম দেখে। সমস্ত খননকার্য আমার কাছে মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু বলে মনে হয়নি। কোথায় সেই মার্বেল পাথরের সৌধ, সোনার কারুকার্য কিংবা, সুদৃশ্য কিছু দর্শনীয় বস্তু? ক্রীলউডে আমার কাকীমার বাড়িতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখানে কোথায় সেই অ্যাসিরিও বাসীদের জীবন-ধারার প্রামাণ্যচিত্র, যাদেরকে রাজা বলে আখ্যা দেওয়া হতো?
অবশিষ্ট মাটির ঢিবিগুলো আমাকে দেখানোর ভার সে তুলে দিল ফাদার ল্যাভিগনির হাতে। ফাদার লাভিগনি একজন বিদেশী, তার ওপর তিনি একজন সন্ন্যাসী এবং গম্ভীর প্রকৃতির লোক বলে তাঁর সম্বন্ধে আমার একটু জড়তা ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে মিশতে গিয়ে আমার মনে হল, তিনি অতিশয় সদাশয় ব্যক্তি, যদিও তিনি আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট।
কথায় কথায় তিনি আমাকে জানালেন, আমার এখানে আসাটা নাকি বিস্ময়কর ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত তিনি তো বলেই ফেললেন, আচ্ছা মিসেস লিডনার সত্যি কি তাহলে অসুস্থ?
না, ঠিক অসুস্থ নন। বেশ সতর্কতার সঙ্গে কথাটা বলতে হল।
অদ্ভুত মহিলা উনি। তিনি বললেন, তাছাড়া আমার মনে হয়, উনি বিপজ্জনকও বটে।
এ কথার অর্থ কী? পাল্টা প্রশ্ন করলাম, বিপজ্জনক? কি রকম বিপজ্জনক?
চিন্তিত ভাবে তিনি মাথা নাড়লেন।
বড় বেশি নির্দয় তিনি। একটু থেমে তিনি তার নিজের কথার সমর্থনে আবার বললেন, হ্যাঁ, অত্যন্ত নিষ্ঠুর তিনি।
আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার মুখে চোখে অবরুদ্ধ বিরক্তির ঝঝ ফুটিয়ে বললাম, এ আপনার অন্যায় অভিযোগ। ওঁর সম্বন্ধে এ আপনার অবান্তর কথাবার্তা।
মাথা নাড়লেন তিনি।
মেয়েদের আমি যতটা জানি তার থেকে বেশি তুমি জানো না।
মজার ব্যাপার, আমি ভাবলাম, একজন সন্ন্যাসীর মুখ থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনব, আমি ভাবতেও পারিনি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও ভাবলাম, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক তথ্য জেনে থাকবেন। কিন্তু একজন সন্ন্যাসী হয়ে তিনি যে এইসব ঘরোয়া কথায় কান দেবেন, সেটাও কেমন অবিশ্বাস্য লাগে আমার কাছে।
হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা, ফাদার ল্যাভিগনি গভীরভাবে চিন্তা করে বললেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে আমি এ কথাও বলতে পারি, তার মনটা পাথরের মতো কঠিন হলেও একটা ব্যাপার তিনি কিন্তু দারুণ ভীত। এখন জানতে হবে, তার সেই ভয়ের কারণটা কী?
হ্যাঁ, আমরা সবাই উদগ্রীব সেই কারণটা জানবার জন্য। আমার ধারণা, তাঁর স্বামী ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তির সেই কারণটার কথা জানার কথা নয়।
ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে। আমার ধারণা– হঠাৎ তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন, বোধহয় ডঃ লিডনার নিজেও সে কথা জানেন না। কোন একটা ব্যাপারে তিনিও বেশ চিন্তিত।
তার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে?
হয়তো সেজন্য হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। কি সেই কেমন করে আমি বোঝাব এ যে ভীষণ অস্বস্তিবোধ—
হ্যাঁ, সে কথা অবশ্য ঠিক। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ, একটা অস্বস্তিবোধের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছি আমরা সবাই।
তারপর আর কোন কথা বলা গেল না, কারণ মিঃ লিডনারকে সেই দিকেই আসতে দেখলাম। তখন সবে মাত্র একটা শিশুর কবর আবিষ্কার হয়েছিল, তিনি আমাকে দেখালেন শিশুর সেই কবরটা। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। ছোট ছোট হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো।
কিছুক্ষণ পরে ডঃ লিডনার জানালেন, তিনি বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন চা-পিপাসা নিবারণের জন্য।
মিসেস লিডনারকে আজ একটু ভালো দেখাচ্ছিল, সেই ক্লান্ত, রোগাটে ভাবটা আর নেই। বলতে গেলে চা একরকম তৈরিই ছিল। চায়ের আসরে ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে আজকের আবিষ্কারের বিবরণ দিলেন সংক্ষেপে, তারপর তিনি তার কাজে ফিরে গেলেন।
তারপর মিসেস লিডনার আমাকে সেই চোরাকুঠুরীতে নিয়ে গেলেন সংগৃহীত জিনিসগুলো দেখানোর জন্য। অধিকাংশই জিনিসই ভগ্নঅবস্থায় পড়েছিল এখানে।
আচ্ছা, এই ভাঙ্গা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রেখে লাভ কি বলুন? এর কি মূল্যই বা আছে?
হাসলেন মিসেস লিডনার। এরিককে তুমি তো চেনো না। এই সব ভাঙ্গা মাটির বাসনপত্র ওঁর কাছে অনেক মূল্যবান। প্রায় সাত হাজার বছর আগেকার পুরানো সব। যা কিছু পুরাতন, ওঁর কাছে বরণীয় সব। একটু থেমে তিনি বলেন, এসো, এবার তোমাকে একটা বিস্ময়কর জিনিস দেখাই। দেখে তুমি চমকে উঠবে নিশ্চয়ই।
শেল্ফের উপর থেকে একটি বাক্স নামালেন তিনি। তারপর সেই বাক্সের ডালাটা খুলতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি।
সোনার ছোরা, নীল পাথর ঘটি ও হাতল।
এ যে দেখছি সোনার ছোরা?
হাসলেন তিনি, হ্যাঁ, সবাই সোনা পছন্দ করে, কেবল আমার স্বামী ছাড়া।
কিন্তু ডঃ লিডনারের পছন্দ না করার কারণটাই বা কি থাকতে পারে মিসেস লিডনার?
প্রথমত সোনা জিনিসটা খুবই মূল্যবান। তাছাড়া শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তার বিনিময়ে কিছু মূল্য দিতে হয়।
কি আশ্চর্য, এর জন্য তাদের টাকা দিতে হবে কেন?
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। এর ফলে চুরির অভ্যাসটা ওরা ত্যাগ করতে পারে। ধরো, ওরা যদি ওই সোনার ছোরাটা চুরি করতো, তাহলে প্রত্মতাত্ত্বিক মূল্য বলতে কিছু থাকত না ওদের, সেক্ষেত্রে তারা এটাকে গলিয়ে ফেলতে পারত অনায়াসে। তাই আমি ওদের কিছু সৎ হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।
এর পর তিনি আর একটি ট্রে শেল্ফ থেকে নামিয়ে আনলেন। এবং সত্যি সত্যি অত্যন্ত সুন্দর একটি সোনার কাপ তিনি আমাকে দেখালেন। আমি আবার বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
হ্যাঁ, এটা সত্যি খুব চমৎকার জিনিস। তাই না? এ সবই পাওয়া গেছে রাজকুমারের কবরখানা থেকে। রাজপরিবারের অন্য আরো কবর আমরা আবিষ্কার করেছি বটে, তবে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ লুণ্ঠিত।
মিসেস লিডনারের চোখে ভ্রুকুটি। চোখের কাছে তুলে ধরা সেই সোনার কাপটা। নখ দিয়ে আঁচড় কাটেন উনি কাপটার উপরে।
কি আশ্চর্য! এই কাপটার উপরে মোমের ফোঁটা পড়ল কী করে? তাহলে মোমবাতি হাতে নিশ্চয়ই কেউ এখানে এসেছিল? মিসেস লিডনারের চোখে কালোছায়া।
বেলা বারোটায় মধ্যাহ্নভোজে আবার আমরা সবাই এক সঙ্গে মিলিত হলাম। তারপর ডঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো কিছু মাটির পাত্র পরিষ্কার করতে বসলেন। পরিষ্কার করার মাধ্যম হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। পরিষ্কারের পর সুন্দর কিশমি রঙের একটা পাত্র পাওয়া গেল, অপর একটি পাত্রের গা থেকে মাটি পরিষ্কারের পর ফুটে উঠল একটি ষাঁড়ের এক জোড়া শিং। সত্যি এ যেন যাদুমন্ত্রের বলে মাটির পাত্রগুলোর উপরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিত্র ফুটে উঠছে এক এক করে।
মিঃ ক্যারি এবং মিঃ কোলম্যান মাটি খোঁড়ার কাজে চলে যায়। আর মিঃ রেইটার তার ফটো স্টুডিওয় গিয়ে ঢোকে।
তা তুমি এখন কী করবে লুসি? ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নিলে ভাল হয়।
আমি শুনেছি, দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে থাকো।
ঘণ্টাখানেকের জন্য নেবো। তারপর কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বাইরে ঘুরতে যাব।
ভালোই তো। নার্সও তোমার সঙ্গে যাবে। যাবে না তুমি?
নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
না, না, মিসেস লিডনার বাধা দিয়ে বললেন, একা যেতে ভাল লাগে আমার। তাছাড়া নার্স না ভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা সে আমার ডিউটিতে আছে।
না, তাতে কি হয়েছে। আমি নিজেই তো যেতে চাইছি ম্যাডাম।
না, আমি চাই, তুমি যেন যেতে না চাও। কোন যুক্তি তর্ক মানতে চাননা তিনি।
অবশ্য আমিও খুব বেশি জোর করলাম না। কিন্তু ঘুমোবার আগে আমার কেমন সন্দেহ হল, মিসেস লিডনার দারুণ নার্ভাস, একটুতেই ভয় পেয়ে যান, সঙ্গী না নিয়ে কি করে তিনি একা একা ঘুরে বেড়ানোর সাহস পান?
যাই হোক, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর চায়ের টেবিলে আবার তার মুখোমুখি হলাম। এখন তাকে অনেকটা নরম বলে মনে হল। নিজের থেকেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নদীর ধারে আমার বেড়ানোর ইচ্ছা আছে কি না! এই মিসেস লিডনার আজ দুপুরে আমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেছিলেন, ওঁর সঙ্গে আমি যেতে না চাইলে তিনি খুব খুশি হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি
তারপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে, অনেক ঘোলা জল পরিষ্কার হয়েছে। মিসেস লিডনারের মনেও হয়তো বা! তিনি বুঝতে পেরেছেন, আমি তার কথায় আঘাত পেলেও পেতে পারি। তাই তিনি জানতে চাইলেন, আমি তার কথায় রাগ করে বসে আছি কিনা।
কিন্তু আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, নার্সদের অমন ঠুককো সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না এবং আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।
অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু উধাও হয়ে গেল নদীর উপর থেকে। একটু পরেই একটা সুন্দর সন্ধ্যা নেমে এল সেখানে।
প্রথমে পথের দু ধারে বার্লির খেত তারপর কিছু ফল আর ফুলের বাগান পেরিয়ে অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম টাইগ্রিস নদীর ধারে। আমাদের ঠিক পাশেই তেল শ্রমিকরা তাদের অদ্ভুত করুণ সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছে।
এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অপূর্ব, তাই না? মিসেস লিডনার আমার দিকে তাকালেন।
আর জায়গাটা ভারি শান্তিপ্রিয়, প্রত্যুত্তরে বললাম, মনে হয় যে কোন জায়গা থেকে এ অনেক, অনেক দূরে।
হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সেই সঙ্গে নিজের একটা মন্তব্য জুড়ে দিলেন, এখানে অন্তত যে কেউ নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করতে পারে।
চকিতে তার দিকে আমি ফিরে তাকালাম। কিন্তু আমার মনে হল তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার থেকে নিজের সঙ্গে নিজের কথাই বেশি বলছেন যেন। তিনি বুঝতেও পারছেন না যে, তাঁর মনের কথাটা ফাস হয়ে পড়ছে।
এবার ঘরে ফেরার পালা। আমাদের পথ চলা আবার শুরু হল।
হঠাৎ মিসেস লিডনার এমন সজোরে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম।
কে ওখানে নার্স? কি করছে ওখানে?
অদুরে পথটা এক্সপিডিসন হাউসের গা ছুঁয়ে যেখান দিয়ে গেছে, ঠিক সেখানে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল, পরনে তার ইউরোপীয় পোশাক, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বুঝি পায়ের আঙুলের ডগার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং একটি জানলা পথে উঁকি মারার চেষ্টা করছিল।
আমাদের চোখে তার চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করল। ওদিকে আমি অনুভব করলাম, মিসেস লিডনার আমাকে ক্রমশ শক্ত করে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন।
নার্স, আমার কানে তার ফিসফিস্ শব্দ রিমঝিম বৃষ্টি পড়ার মত শোনায়, নার্স শুনছ?
সব ঠিক আছে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে, আমি তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম, আপনি ঘাবড়াবেন না।
লোকটা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ইরাক দেশের লোক সে। কাছ থেকে লোকটাকে দেখে মিসেস লিডনার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
যাইহোক, ইরাকের লোক বই তো আর কিছু নয় সে। মিসেস লিডনারের মুখের ওপর থেকে ভাবনার মেঘটা কেটে গেছে তখন।
এক্সপিডিসন হাউসের কাছ দিয়ে যেতে গিয়ে জানালাগুলো দেখলাম ভাল করে। লোহার গরাদ দেওয়াই শুধু নয়, জানালাগুলো খুবই উঁচুতে রাস্তা থেকে। জানালার ওপারে কিছু দেখতে যাওয়া বোকামো।
আমার মনে হয়, এটা একটা মামুলি কৌতূহল ছাড়া আর কিছু নয়, আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। মিসেস লিডনার মাথা নাড়লেন।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু এক লহমায় আমি ভেবেছিলাম– কি যেন বলতে গিয়ে চেপে গেলেন তিনি।
আমার কেমন সন্দেহ হল। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা আপনি তখন কী ভেবেছিলেন বলুন তো? আমার জানতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কী ভেবেছিলেন বলুন তো?
মুখে তিনি কিছু না বললেও আমি তখন একটা কথা বেশ স্পষ্ট ভাবে জেনে গেছি মিসেস লিডনার নিশ্চয়ই একজন কাউকে দারুণভাবে ভয় করে থাকেন।
.
০৮.
নৈশ বিপদ সংকেত
আমার এখানে আসার পর এক সপ্তাহে ঠিক কী কী ঘটেছে সেগুলো মনে করা একটু কষ্টসাধ্য। পিছনের দিকে ফিরে তাকালে অনেক ছোট-খাটো ভাল ভাল লক্ষণ আমি দেখতে পাই, তবে প্রথমদিকে আমি অন্ধ ছিলাম। যাইহোক, এ কাহিনীর সঠিক বিবরণ দিতে হলে মনে হয় সর্বাগ্রে আমার কৌতূহলগুলো মেটানো উচিত। বিশেষ করে যেসব কৌতূহল আমাকে ধাঁধায় ফেলেছে, অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে এবং আমায় বুঝতে শিখিয়েছে, এ কাহিনীর আড়ালে একটা কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।
বিল কোলম্যান, ডেভিড এমোট; এদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তাদের কথার মধ্যেও সেই অজানা রহস্যের একটি প্রচ্ছন্ন আভাস, আমি অনুভব করেছি। কিন্তু তাদের কথায় রহস্যের কোন সূত্র আমি খুঁজে পাইনি এখনও পর্যন্ত।
বরং মিস জনসনের আলোচনার উপর আলোকপাত করলে বোধহয় ভাল হয়। তাকে আমার খুব পছন্দ। ও একজন দক্ষ, বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমতী মহিলা। ডঃ লিডনারকে গুরুর মত শ্রদ্ধা করে।
এই উপলক্ষে ডঃ লিডনারের জীবনের কাহিনী আমাকে শোনায় মিস জনসন, একেবারে তার ছেলেবেলা থেকে। মিস জনসন জানে কোথায় কোথায় তিনি খনন কার্য চালিয়েছিলেন এবং সেই সব খনন কার্যের ফলাফলও ওর বেশ ভাল জানা আছে। মিস জনসন তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা শুনেছে। ও আমাকে বলেছে, ডঃ লিডনারের মতো অমন জ্ঞানী-গুণি প্রত্নতত্ত্ববিদ খুব কমই চোখে পড়ে থাকে।
সত্যি উনি এতই সরল প্রকৃতির মানুষ যে, আমি ওঁর মধ্যে কখনো অহঙ্কার দেখতে পাইনি, আত্মগর্বে উৎফুল্ল হতে দেখেনি ওঁকে। কেবল মহান ব্যক্তিরাই এমন সহজ সরল হতে পারে।
সে কথা ঠিক, আমি বললাম, মহান ব্যক্তিরা নিজেদের ঢাক নিজে পেটায় না। কিংবা এ ওর পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া কথা কখনও বলে না।
শুধু কি তাই? ওঁর মতো অমন মিশুকে তোক বোধহয় হয় না। হাল্কা মন নিয়ে তিনি কথা বলতেন আমার এবং রিচার্ড ক্যারির সঙ্গে। ওঁর সংস্পর্শে এসে আমরা সবাই খুব সুখী। রিচার্ড ক্যারি ওঁর সঙ্গে প্যালেস্টাইন থেকে কাজ করছে, তা প্রায় দশ বছরের বন্ধুত্ব ওঁর সঙ্গে। আর ওঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সাত বছরের।
সুপুরুষ চেহারা মিঃ ক্যারির, আমি বললাম, কিন্তু বড় সে শান্ত, স্বল্পভাষী, তোমার তা মনে হয় না?
ওরকম হবার কথা নয় তার, আগেও এরকম ছিল না সে, মিস জনসন তাড়াতাড়ি বলে, এই কেবল সেদিন কথাটা অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ ও চুপ করে গেল।
কেবল সেদিন মানে? আমি ওর কথার পুনরাবৃত্তি করে জিজ্ঞাসা করলাম।
ও হ্যাঁ– মিস জনসন তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, আজকাল কত ভাল ভাল জিনিস কেমন সহজে বদলে যাচ্ছে এই আর কি।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। মিস জনসন নিজের থেকেই তার কথার জের যে টানবে, আমি তা জানতাম এবং হলও তাই।
আমি একজন রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের লোক। এক এক সময় আমি ভাবি, প্রত্মতত্ত্ববিদের স্ত্রীরা সত্যি যদি আগ্রহান্বিত না হয়, তাদের উচিত নয় স্বামীদের সঙ্গে এ ধরনের অভিযানে আসা। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর মনোমালিণ্যের কারণ ঘটতে পারে।
মিসেস মারকাডো– আমি জানতে চাইলাম।
ওঃ উনি! মিস জনসন অতি সাবধানে মিসেস মারকাডোর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি এখন আমার মিসেস লিডনারের কথা ছাড়া অন্য কারোর, কথা মনে পড়ে না। আকর্ষণীয় মহিলা। ওঁকে যে কেউ একটিবার দেখলেই বুঝতে পারবে, ডঃ লিডনার কেন ওঁর প্রেমে পড়েছিলেন?
তবে শেষ পর্যন্ত মিসেস লিডনারই এই অবিশ্বাস্যপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য যে দায়ী মিসেস কেলসির সঙ্গে মিস জনসন একমত হল এ ব্যাপারে।
তারপর একটু ভয়ে ভয়ে মিস জনসন বলে, আমি নিশ্চয়ই তার প্রশংসা করব। চমৎকার মহিলা উনি।
সেই পুরনো খেলা, কেন জানি না আমার মনে হল, মেয়েরাই বোধহয় মেয়েদের পরম শত্রু। কোন মেয়ের বাড়বাড়ন্ত হলে অন্য মেয়েদের হিংসা হয়, কারণে অকারণে তারা তখন তার খুঁত খোঁজে কি করে তাকে অপদস্থ করা যায়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিস জনসন খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ও ওর প্রধানের স্ত্রীকে পছন্দ করে না (এবং সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক), এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তাহলে ধরে নিতে পারি, মিসেস লিডনারকে দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন মিসেস মারকাডো।
আর একজন যিনি মিসেস লিডনারকে পছন্দ করেন না, তিনি হলেন শীলা রেলি। একবার কি দুবার আমি তাকে দেখেছি। তাতেই আমার মনে হয়েছে সেই শান্ত নীরব আমেরিকান যুবক এমাটের উপর শীলার দুর্বলতা আছে। এমাট অন্য কারোর সঙ্গে খুব বেশি কথা না বললেও শীলার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যায়। মনে হয় এমাটও বোধ হয় শীলার প্রতি অনুরক্ত।
একদিন মধ্যাহ্বতভাজের সময় মিসেস লিডনার ওদের রাগ-অনুরাগ পর্বের উপর মন্তব্য করেন।
রেলির মেয়েটি এখনও ডেভিডের মন জয় করতে ব্যস্ত। একটু হেসে তিনি আবার বলতে থাকেন, বেচারা ডেভিড।
মিঃ এমাট উত্তর দিলেন না। কিন্তু তার মুখটা কেমন টান-টান হয়ে গেল। থরথর করে তার লাল মুখটা কাঁপতে থাকে। চোখ তুলে তাকালেন মিসেস লিডনারের দিকে। মিঃ এমাটের মুখে চোখে এক অস্বাভাবিক কৌতূহল। মিসেস লিডনারের চোখে সোজা-সুজি দৃষ্টি রেখে তিনি যেন তার কাছে চালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
মিসেস লিডনারের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি।
আমার মনে হল, ফাদার ল্যাভিগনি ফিসফিস্ করে কি যেন বলতে যান, কিন্তু আমি যখন বললাম, ক্ষমা করবেন, তিনি নিজের থেকেই কি ভেবে মাথা নাড়লেন এবং মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেন।
সেদিনই অপরাহ্নে মিঃ কোলম্যান আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, সত্যি করে বলতে কি মিসেস লিডনারকে গোড়ার দিকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে এখন আমি তাকে ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছি। তার মত দয়ালু মহিলার সঙ্গে এর আগে কখনো মিলিত হয়েছি বলে আমার মনে হয় না। শীলা রেলির সম্বন্ধে তিনি হয়তো তার ভালর জন্যই একটু কড়া সমালোচনা করে থাকবেন, কিন্তু শীলা তার ভদ্রতার সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়ে যেভাবে তার সঙ্গে দুতিনবার রূঢ় ব্যবহার করে, তার সঙ্গে কোন তুলনা হয় না। তখন মনে হয়েছিল ভদ্রতা বলে ও বোধহয় কিছু জানে না।
হ্যাঁ, আমি তা বিশ্বাস করি। আসলে ডঃ রেলিই ওকে নষ্ট করেছেন, শীলার কোন দোষ নেই।
আমার তাতে কোন দ্বিধা নেই। কারণ দুদিন আমি হাতে হাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।
প্রথমতঃ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে ল্যাবোরেটরি থেকে কিছু রাসায়নিক তরল পদার্থ আনতে যাই। মিঃ মারকাডো তখন আরাম কেদারায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েছিলেন, চোখ-মুখ দেখে মনে হয়েছিল, তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমি তাকে বিব্রত করতে চাইনি। তাই নিঃশব্দে আমি আমার কাজ হাসিল করে চলে আসি।
সেইদিনই সন্ধ্যায় আমাকে অবাক করে দিয়ে মিসেস মারকাডো কৈফিয়ত চাইলেন আমার কাছ থেকে।
তুমি কি ল্যাবোরেটরি থেকে অ্যাসিডের বোতলটা নিয়ে এসেছো?
হ্যাঁ, আমি বললাম, নিয়েছি বৈকি।
কেন, তুমি তো বেশ ভাল করেই জানবে, ওই অ্যাসিডের একটা ছোট্ট বোতল সব সময় মজুত থাকে অ্যান্টিকরুমে। বেশ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বললেন তিনি।
তাই নাকি? আমি তো জানতাম না।
জানতে না বললেই হবে। তুমি ঠিকই জানতে। মুখ ঝামটা দিয়ে মিসেস মারকাডো অভিযোগ করেন, আসলে তুমি গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসেছিলে। আমি জানি হসপিটাল নার্সদের স্বভাবই এই রকম।
অবাক চোখে আমি তার দিকে তাকালাম।
মিসেস মারকাডো, আপনি কি যে বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বললাম, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, কারোর উপর গোপনে নজর রাখার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, এখনও নেই।
হ্যাঁ ছিল এবং এখনও আছে। তুমি কি মনে করো, আমি কিছুই জানি না? এখানে তোমার আসার উদ্দেশ্যটা যে কি, ভেবেছো তা আমি কিছুই জানি না!
বলেন কি ভদ্রমহিলা! আমি স্তব্ধ; হতবাক! সত্যি, মিনিট দুই-তিন নীরবে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, ভদ্রমহিলা ড্রিঙ্ক করেননি তো? কোন কথা আর না বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিন্তু আমি ভাবলাম, এভাবে চুপচাপ চলে আসাটা কেমন বেমানান।
কোনদিকে না তাকিয়ে আমি তখন দ্রুত পা চালিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে নজরে পড়ল, ফাদার ল্যাভিগনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং সঙ্গে আর একজন। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমি উপলব্ধি করলাম, আমার সেই দ্বিতীয় আবিষ্কার হল মিসেস লিডনার, আমার মনে পড়ল ইনিই বোধহয় সেদিন জানালায় উঁকি মারছিলেন।
আপনাদের আমি ঠিক দেখতে পাইনি, ক্ষমা চাইতে গেলে ফাদার ল্যাভিগনি হাসলেন। তারপর মিসেস লিডনার-কে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলেন।
শোন, আমি খুবই লজ্জিত। তিনি বললেন, আমি একজন ওরিয়েন্টাল ভাষার ছাত্র, কিন্তু এইসব ভাষায় শিক্ষারত ছাত্ররা কেউই আমাকে বুঝতে চায় না। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, আরবি ভাষা শিখছিলাম, কিন্তু খুব বেশি সফল হইনি। তবে লিডনার বলে আমার আরবি ভাষা নাকি খুবই খাঁটি।
সেই রাতটা আমাদের দারুণ আতঙ্কের রাত।
তখন প্রায় রাত দুটো হবে। আমার ঘুম খুব পাতলা, সব নার্সদের যা হয়ে থাকে। ঘুম থেকে জেগে উঠে সবে বিছানায় উঠে বসেছি, সেই সময় আমার ঘরের দরজা খুলে গেল।
নার্স! নার্স!
মিসেস লিডনারের আর্ত চিৎকার বাতাসে ভেসে আসে। দেশলাই জ্বেলে মোমবাতি জ্বালালাম।
দরজার ওপারে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস লিডনার। ভয়ার্ত চোখ, কাঁপা ঠোঁট। পরনে নীল ড্রেসিং গাউনটা থরথর করে কাঁপছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন নীল আকাশে হঠাৎ বিদ্যুতের চমক।
আমার পাশের ঘরে হয়তো কেউ ঢুকেছে–তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে আমি শুনেছি।
কথাটা শোনা মাত্র আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তার কাছে ছুটে গেলাম। এই তো আমি আপনার কাছে এসে গেছি ম্যাডাম, আপনার আর ভয় কিসের? আমি তাকে আস্বস্ত করতে বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরিককে ডাকো, ফিসফিসিয়ে বললেন তিনি।
মাথা নেড়ে আমি তাড়াতাড়ি ছুটে যাই ডঃ লিডনারের দরজায় টোকা মারার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি এসে হাজির হলেন আমাদের মধ্যে। মিসেস লিডনার তখন আমার বিছানায় বসেছিলেন। তার বুকের ওঠা নামা ক্রমশঃ দ্রুত হচ্ছিল।
আমি তাকে– মিসেস লিডনার বলতে থাকেন, আমি তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে শুনেছি।
মনে হয় অ্যান্টিক-রুমে কেউ ঢুকেছে, ডঃ লিডনার চিৎকার করে উঠলেন। বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ, হা হঠাই আমার মনে খটকা লাগল, মিসেস লিডনারের ভয়টা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, কিন্তু ডঃ লিডনারের চিন্তা-ভাবনা তখন তার সংগ্রহশালার জন্য।
অ্যান্টিক-রুম! মিসেস লিডনার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাইতো! সত্যি আমি কি বোকা বলো তো?
মিসেস লিডনার এবার বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন।
তারপর আমরা অ্যান্টিকরুমে গেলাম ডঃ লিডনার এবং ফাদার ল্যাভিগনির সন্ধানে। ফাদার ল্যাভিগনিও নাকি শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, সেই সঙ্গে অ্যান্টিকরুম থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু পায়ে চটি, গলাতে গিয়ে এবং টর্চ খুঁজতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে এসে তেমন কোন বিসদৃশ্য তার চোখে পড়েনি, কোন অচেনা লোককে দেখতে পাননি সেখানে। তাছাড়া ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল, যেমন সাধারণত থেকে থাকে।
একটু পরে ডঃ লিডনার এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনিও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যখন কোন কিছু চুরি যায়নি কিংবা ক্ষতি কিছু হয়নি,অতএব সেখানে বাইরের কারোর প্রবেশ ঘটতে পারে না।
রাতের প্রহরীর বক্তব্যও তাই। তার জবানবন্দীতে দেখা যায়, বাইরের কোন লোক তার দৃষ্টি এড়িয়ে অ্যান্টিক-রুমে ঢোকেনি। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবাই যখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল সেই সময়, তাহলে কি করে তারা এতো জোর দিয়ে বলতে পারে যে, বাইরের কোন লোকের প্রবেশ সেখানে ঘটেনি।
আবার এমনও হতে পারে, ফাদার ল্যাভিগনির পায়ের শব্দে মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙে যায় এবং তাতে তিনি অমন ভয় পান।
আবার কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনির কথাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ প্রথমত তিনি নিজের কানে তার ঘরের জানালার সামনে তৃতীয় ব্যক্তির পায়ের শব্দ শুনতে পান এবং দ্বিতীয়তঃ অ্যান্টিকরুম থেকে আলোর রেখা, সম্ভবতঃ টর্চের আলো দেখতে পান তিনি।
ওরা ছাড়া অন্য আর কেউ কিছু দেখেনি কিংবা শুনতে পায়নি।
যাইহোক, পরদিন মিসেস লিডনারের কাছ থেকে যে কাহিনী আমি শুনি তাতে এই ঘটনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেড়ে যায়।
.
০৯.
মিসেস লিডনারের কাহিনী
মধ্যাহ্নভোজ তখন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। রোজকার অভ্যাস মতো মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করলেন বিশ্রাম নেবার জন্য। যথেষ্ট সংখ্যক বালিশ এবং তার প্রিয় কতকগুলো বই বিছানায় রেখে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাব, মিসেস লিডনারের ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম।
যেও না নার্স, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।
আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম।
দরজাটা বন্ধ করে দাও।
বাধ্য মেয়ের মত আমি তার কথা রাখলাম।
দরজা বন্ধ। আড়চোখে একবার সেদিকে দেখে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আপন খেয়ালে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকলেন তিনি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমাকে কিছু বলবার আগে তিনি যেন নিজের মনটাকে সেই ভাবে তৈরি করে নিচ্ছেন। তাই আমি তাঁকে বাধা দিলাম না।
অবশেষে সেই ইতস্ততঃ ভাবটা কাটিয়ে উঠে আমার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি এবং হঠাৎ বললেন, বসো।
শান্ত ভাবে বসলাম। কথা বলার শুরুতেই তাকে একটু নার্ভাস বলে মনে হল আমার। এই সব দেখে শুনে তুমি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছ তাই না?
কথা না বলে কেবল মাথা নাড়লাম।
শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি মনস্থির করলাম, তোমাকে আমি খুলে বলব–সব কিছু। কাউকে না কাউকে আমার বলা একান্ত দরকার, তা না হলে আমি তো পাগল হয়ে যাব।
এই মুহূর্তে তার হাঁটা চলার মধ্যে একটা নিদারুন অস্থিরতার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তার সেই অস্থির পা দুটো হঠাৎ স্তব্ধ হল, তিনি তখন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
তুমি কি জান আমার কিসের ভয়?
কোন একটি লোককে।
হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো বললাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি নিজেই আবার বলেন, আমার আশঙ্কা আমি বোধ হয় খুন হয়ে যাচ্ছি।
সে সম্ভাবনা এখন আর নেই। তবু এ ব্যাপারে তাকে সান্ত্বনা দেবার কোন প্রয়োজন নেই।
ও, তাহলে এই ব্যাপার?
আমার কথার মধ্যে কি ছিল কে জানে, তারপর হঠাৎ তিনি হাসতে শুরু করলেন। হাসি, হাসি আর হাসি। এবং তারপর কান্না। অশ্রুর বাদল নামল তার দু চোখের কোল বেয়ে।
যে ভাবে তুমি বললে! হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি অনুযোগ করলেন, যেভাবে তুমি কথাটা বললে-
এখন, এখন আর ও নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, ঠাণ্ডা জল এনে তার কপালে ঢালোম তাকে শান্ত করার জন্য।
এখন আর অবুঝ হবেন না,, একরকম ধমক দিয়ে আমি তাকে বললাম, শান্ত ভাবে সব গুছিয়ে আমাকে বলুন আপনার জীবনে কি ঘটেছিল।
তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু, নার্স, তুমি আমাকে এমন বোঝাচ্ছ যেন আমি দু বছরের বাচ্চা মেয়ে। যাইহোক, আমি তোমাকে বলব, সব খুলে বলব।
এই তো ভাল মেয়ের মতো কথা হল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম।
তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, এবার শান্ত এবং সংযত তার কণ্ঠস্বর। কোন তাড়াহুড়া নেই, কোন আবেগ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। মিসেস লিডনার এখন অন্য মানুষ, অন্য মন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন।
কুড়ি বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় একজন প্রতিষ্ঠিত যুবকের সঙ্গে। তখন ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ হবে।
জানি, আমি বললাম, মিসেস মারকাডো আমাকে বলেছেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান।
কিন্তু, মিসেস লিডনার মাথা নেড়ে আপত্তি জানালেন।
কিন্তু বলে থেমে গেলেন কেন? আমার কেমন কৌতূহল হল।
উনি যা ভেবে থাকেন। শুধু উনি কেন বলছি, সবাই ওই একই কথা ভেবে থাকে আমার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। জানো নার্স, সেই বয়সে আমি তখন ভীষণ দেশপ্রেমিক উৎসাহী মেয়ে ছিলাম। আমি আমার আদর্শের একচুল বাইরে যেতাম না। বিয়ের কয়েক মাস পরে এক আকস্মিক ঘটনায় আমি জানতে পারি, আমার স্বামী জার্মানদের একজন বেতনভুক গুপ্তচর ছাড়া আর কিছু নয়। তখন আমার কাছে একটা খবর ছিল, আমার স্বামী একটা গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান জাহাজ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সফল হলে বেশ কয়েকশো লোকের সলিল সমাধি হওয়ায় সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমি জানি না সেই অবস্থায় পড়লে অন্য কোন স্ত্রী দেশপ্রেমিক হিসাবে কি করতে তখন। তবে আমি কি করেছিলাম সেদিন তাই তোমাকে বলছি। সরাসরি আমি বাবার কাছে গেলাম, তিনি তখন যুদ্ধ বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁকে আমি সব খুলে বললাম, কিছুই গোপন করলাম না। এমন কি স্বামী হিসাবেও কোন দুর্বলতা প্রকাশ করা নয়, তখন আমার মানসিকতা ঠিক এরকমই ছিল এই ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছিলাম। ফ্রেডরিক যুদ্ধে নিহত হয় পরবর্তীকালে, –কিন্তু আমার কাছে আরো একটা খবর ছিল, আমেরিকায় গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
উঃ কি ভয়ঙ্কর। আমি চমকে উঠলাম।
হ্যাঁ, তোমার মতো আমিও তখন দারুণ চমকে উঠেছিলাম। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর সত্যই বটে। সে ছিল অত্যন্ত দয়ালু, ভদ্র এবং সব সময় কিন্তু আমার মনে কোন সংশয় ছিল না, ফ্রেডরিকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমি একটুও ইতস্ততঃ করিনি। সম্ভবতঃ আমি ভুল করেছিলাম।
বলা মুশকিল, প্রত্যুত্তরে বললাম, জানি না আপনার মতো অবস্থায় পড়লে অন্যরা কি করতো।
তোমাকে যা বলছি বাইরের কেউ জানে না। লোকে জানে, আমার স্বামী ফ্রন্টে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। সৈনিকের বিধবা পত্নী হিসাবে অনেকে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন তখন।
কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর কি রকম ভারী হয়ে আসে, উপলব্ধির ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম।
বহু পুরুষ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার মনটা তখন দারুণ বিষিয়ে উঠেছিল। আমি তখন ভাবতেই পারি না, নতুন করে আবার আমি বিশ্বাস করতে পারব।
হ্যাঁ, আপনার তখনকার মনের অবস্থা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারি।
তারপর হঠাৎ আমি একটি যুবকের প্রেমে পড়ে যাই। আমার মনটা ভীষণ বিচলিত হয়ে ওঠে তার সান্নিধ্যে এসে। সেই সময় একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়। ছদ্মনামে লেখা একটা চিঠি পাই ডাকে–চিঠিটা ফ্রেডরিকের। হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি, আমি যদি আবার অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করি, তাহলে ও আমাকে খুন করবে।
ফ্রেডরিকের কাছ থেকে? তার মানে আপনার মৃত স্বামীর কাছ থেকে?
হ্যাঁ, আমার স্বামীর কাছ থেকে বৈকি! প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আমি পাগল হয়ে গেছি কিংবা স্বপ্ন হয়ে গেছি। অবশেষে আমি আমার বাবার কাছে যাই। তিনি তখন আমাকে সত্য ঘটনাটা খুলে বলেন। আমার স্বামী নাকি প্রকৃতপক্ষে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাননি। কয়েক সপ্তাহ পরে একটি ট্রেন ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন তিনি এবং তাতেই অন্যদের সঙ্গে তার মৃতদেহ ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পাওয়া যায়। যাইহোক, লোকটা যখন আর জীবিত নেই, তাই তিনি আমাকে তার মৃত্যুর খবরটা দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। একটু থেমে মিসেস লিডনার আবার বলতে থাকেন, কিন্তু সেই চিঠিটা একটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তবে কি আমার স্বামী বেঁচে আছেন?
মিসেস লিডনারের বাবা ব্যাপারটা খুব সাবধানে এড়িয়ে যান। তিনি খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দেন, ফ্রেডরিকের মৃতদেহ বলে যাকে কবর দেওয়া হয় সেটি প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিকেরই। তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন, ফ্রেডরিক মৃত এবং সেই চিঠিটা একটা বিদ্বেষপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
এ ঘটনা শুধু একবারই নয়, বারবার ঘটে। কারোর সঙ্গে আমার যদি খুব ঘনিষ্ঠতা থাকত, তাহলে সেই সব হুমকি দেওয়া চিঠিগুলোর অর্থ বুঝতে পারতাম।
আপনার স্বামীর হস্তাক্ষর আপনি চিনতে পারেন?
সেটা বলা মুশকিল, ধীরে ধীরে তিনি বললেন, তার কোন চিঠি আমার কাছে নেই। স্মৃতি শক্তি ছাড়া আমার তহবিলে আর কিছু নেই।
তবে কি এটা কোন অলৌকিক ঘটনা কিংবা সেরকম কিছু।
না, তা নয়। মিসেস লিডনার যা বললেন তা এই রকম, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত কতকগুলো সাংকেতিক ভাষায় মনের ভাব বিনিময় হতো, যেমন নিকনেম। কেউ যদি সেই সব ভাষাগুলো তাদের চিঠিতে ব্যবহার করতো তাহলে না হয় বিশ্বাস করা যেত।
হ্যাঁ, অনেক ভেবে-চিন্তে আমি বললাম, এক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত বলেই মনে হয়, চিঠিগুলো আপনার স্বামীর লেখা নয়। তবে কি সে অন্য কেউ হতে পারে?
হ্যাঁ, সেই সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফ্রেডরিকের এক ভাই ছিল, আমাদের বিয়ের সময় তার বয়স ছিল দশ কি বারো। ফ্রেডরিককে সে শ্রদ্ধা করতো এবং ফ্রেডরিক তাকে স্নেহ করতেন। উইলিয়াম তার নাম। তার পর সেই ছেলেটির যে কি হল, জানি না। ছেলেটি তার দাদাকে ভালবাসতো, তাই ফ্রেডরিকের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য মনে হয় সরাসরি সে আমাকে দায়ী বলে মনে করে। এমনিতেই আমার প্রতি তার হিংসা ছিল এবং ফ্রেডরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সে হয়তো আমাকে শাস্তি দেবার জন্য এই পরিকল্পনা করে থাকবে।
হ্যাঁ, এটা সম্ভব, আমি বললাম, শকের ব্যাপারে শিশুদের মনে দারুণ রেখাপাত করে থাকে।
জানি, আমিও জানি। হয়তো এই ছেলেটি প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায় তার জীবন উৎসর্গ করতে চায়।
তারপর? আমি ওঁকে তাড়া দিলাম, থামলেন কেন, বলে যান ম্যাডাম।
এরপর বেশি কিছু বলার নেই। তিন বছর আগে আমি এরিকের সঙ্গে মিলিত হই। তবে তাকে বিয়ে করার কথা আমার কখনোই মনে হয়নি তখন। এরিক একটু একটু করে তার ভালবাসা, মমতা দিয়ে আমার মনের মধ্যে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দেয়। আমাদের বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছিলাম সেই ধরনের হুমকি দেওয়া আর একটা চিঠির জন্য। কিন্তু কোন চিঠিই এলো না। তাই আমার তখন মনে হয়েছিল, পত্রলেখক যেই হোক না কেন, হয় সে মৃত এখন তা না হলে সে তার নিষ্ঠুর খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের বিয়ের দুদিন পরেই এই চিঠিটা আবার পেলাম।
ছোট এ্যাটাচি-কেসের ডালা খুলে একটা চিঠি বার করে আমার হাতে তুলে দিলেন তিনি। চিঠিটা ঈষৎ বিবর্ণ এবং মেয়েলী হাতের লেখা। চিঠির ভাষাটা এই রকম, তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ। তাই এখন তুমি আর রেহাই পেতে পারো না। একমাত্র ফ্রেডরিক কানারের স্ত্রী তুমি। অতএব মরতে তোমাকে হবেই!
আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। তবে যত বেশি ভয় পাবার কথা ঠিক ততটা আমাকে পেতে দেয়নি এরিক। ও আমাকে তার একান্ত নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে দেয় তখন। দ্বিতীয় চিঠির ভাষা আগেরই অনুরূপ,আমি ভুলে যাইনি। পরিকল্পনা করছি। মরতে তোমাকে হবেই। কেন তুমি আমার কথার অবাধ্য হলে?
আপনার স্বামী এসব কথা জানেন?
মিসেস লিডনার একটু সময় চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, আমাকে যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এ কথা তিনি জানেন। দ্বিতীয় চিঠিটা আসতে আমি তাঁকে দুটো চিঠিই দেখাই। সমস্ত ব্যাপারটা তিনি একটি জালিয়াতি বলে মনে করলেন। আমার প্রথম স্বামী জীবিত, এই খবরটা প্রচার করে কেউ হয়তো আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায় বলে তার ধারণা হল।
দ্বিতীয় চিঠিটা পাবার কিছুদিন পরে একটুর জন্য বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যুর হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান তারা। ঘটনাটা এই রকম; ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ তাদের এ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে গ্যাসের সুইচটা খুলে দিয়ে থাকবে। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক সময় মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং গ্যাসের গন্ধ তাঁর নাকে লাগে। তখন তিনি নার্ভাস হয়ে পড়েন। তিনি তার স্বামীকে সব খুলে বলেন। এও বলেন, কিভাবে তিন বছর ধরে তিনি অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি তাঁর স্বামীকে বলেন, পত্ৰলেখক পাগল হোক, আর যাই হোক, সত্যি সত্যি সে এবার তাকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। কেন জানি না সেই প্রথম তার মনে হল, পত্রলেখক ফ্রেডরিক ছাড়া অন্য আর কেউ হতে পারে না। এর আগেও তিনি তার মধ্যে এমনি একটা নিষ্ঠুর ভাব লক্ষ্য করেছিলেন।
মনে হয়, মিসেস লিডনার আবার মুখ খুললেন, এরিক আমার থেকে একটু কম সতর্ক বলে মনে হল। পুলিশকে খবর দিয়ে সে তার কর্তব্য পালন করতে চাইল। স্বভাবতই আমি তার কথায় তেমন আমল দিলাম না। অবশেষে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এলাম আমরা, আমি তার সঙ্গে এখানে এসে বসবাস করব। আর গ্রীষ্মবকাশে আমেরিকায় ফিরে না গিয়ে লণ্ডন কিম্বা পারিসে গিয়ে থাকাটাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
পরিকল্পনা মতো তাদের সব কাজ ঠিক ঠিক চলতে থাকে এবং তারপর সপ্তাহ তিনেক আগে আর একটা চিঠি পান মিসেস লিডনার। খামের উপর ইরাকের স্ট্যাম্প মারা ছিল। সেই তৃতীয় চিঠিটাও তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন
তুমি ভেবেছ, তুমি রেহাই পেয়ে যাবে। কিন্তু তোমার ভুল ধারণা। অন্যের হয়ে আমার কাছে তুমি বেঁচে থাকতে পারো না কিছুতেই। এ কথা আমি তোমাকে সব সময় বলে আসছি। তোমার মৃত্যু আসন্ন।
আর সপ্তাহ খানেক আগে এই চিঠিটা। এখানে এই টেবিলের উপর পড়েছিল। এমন কি ওটা ডাক ঘরেও যায়নি।
ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠিটা আসেনি? কেমন কৌতূহল হল। তার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিলাম। তিন অক্ষরের লেখা চিঠি নয়, যেন একটা চিরকুট, কিন্তু ভয়ঙ্কর তার অর্থ, একটা অশুভ ইঙ্গিত।
আমি এসে গেছি।
মিসেস লিডনার অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
বুঝলে, যে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে! সে লোক ফ্রেডরিক হতে পারে, আবার ইউলিয়ামও হতে পারে। তবে সে যেই হোক না কেন, সে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে।
কথা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর কঁপছিল। আমি তার কব্জিটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
এখন আমরা আপনার অনেক কাছে এসে গেছি। ভয় কি? এখন থেকে আমরা আপনার উপর নজর রাখব। আপনার কাছে স্যাম্ভল্যাটলি (মূৰ্ছাপ্রবণতায় ব্যবহৃত অ্যামনিয়াম কার্বনেট প্রস্তুত ঔষধ) আছে?
মিসেস লিডনার চোখের ইশারায় দেওয়াল-আলমারির দিকে তাকালেন। আমি তাকে ভাল রকম একটা ডোজ দিলাম।
একটু পরে তিনি সহজভাবে বললেন, হ্যাঁ, এখন আমি একটু সুস্থ বোধ করছি। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার বর্তমান অবস্থার কথা। আমি যখন জানালার সামনে লোকটাকে দেখি, আমি ভাবলাম, সে আসছে–এমন কি তুমি যখন এখানে এলে তখনও আমার সন্দেহ ছিল, তুমি বোধহয়–
একজন সাধারণ হসপিটাল নার্স, এই তো?
না, না ও কথা আমি ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, বুঝি সেই লোকটার সঙ্গে তোমার আঁতাত আছে।
আপনার চিন্তাধারা বিজ্ঞচিত নয়।
হ্যাঁ, হয়তো, বা তাই। কিন্তু আমার জ্ঞানের পরিধি যেন সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু যদি মনে করেন তো জিজ্ঞাসা করি, আপনার প্রথম স্বামীকে, আপনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।
জোর দিয়ে বলতে পারি না, ধীরে ধীরে তিনি বলেন, পনের বছর আগের কথা, হয়তো তার মুখ আমি চিনতেই পারব না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি কেঁপে উঠলেন।
কেবল একদিন রাত্রে দেখে ছিলাম, তবে সেটা মৃত লোকের মুখ। জানলায় টোকা মারার শব্দ হতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখি, সেই মৃত লোকের মুখ। ভয়ে আমি আঁতকে উঠি। আমার চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে আসে। কিন্তু তারা বলে, কেউ কোথাও নেই।
মিসেস মারকাডোর গল্প মনে পড়ে গেল।
আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম, আপনি তখন স্বপ্ন দেখছিলেন?
না, স্বপ্ন নয়, সত্যি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারি না। কারণ এ ধরনের ঘটনা রাতের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। যাইহোক, কোন রুগীর বিরোধিতা আমি করি না। মিসেস লিডনারকে যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করতে গিয়ে আমি বললাম, এ পাড়ায় যে কোন আগন্তুকই আসুক না কেন, আমি নিশ্চিত, সে এখানকার সবার পরিচিত না হয়ে থাকতে পারে না।
এখন তাকে একটু স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। তাই তাকে ছেড়ে আমি চলে এলাম ডঃ লিডনারের কাছে এবং তাকে আমাদের আলোচনার কথা সব খুলে বললাম।
ও যে তোমাকে সব কথা বলেছে, শুনে আমি খুশি হলাম, ডঃ লিডনার বললেন, ওই ঘটনাটা আমাকে দারুণ একটা আতঙ্কের মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমার ধারণা ওর বর্ণনা মতে, জানালার উপর টোকা মারা, লোকের মুখের আবির্ভাব ঘটা, এ সবই ওর পক্ষে একটা অনুমান মাত্র। এর প্রতিকারের পথটা আমার জানা নেই। তা সামগ্রিক ভাবে ব্যাপারটা তোমার কি মনে হয়?
তিনি কি বলতে চান ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। ওই সব চিঠিগুলি একটা নিষ্ঠুর আক্রোশের নিটফল ছাড়া আর কিছু নয়।
হ্যাঁ, তা অবশ্য হতে পারে কিন্তু আমাদের তরফ থেকে করণীয় কী থাকতে পারে? চিঠিগুলো ওকে পাগল করে তুলেছে। আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি নিজেই বোধহয় পাগল হয়ে যাব। আমার কিন্তু অতো চিন্তা নেই। আমার মনে তখন একটা কথাই বার বার গুঞ্জন তুলছিল, এ ব্যাপারে কোন মহিলার হাত থাকাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চিঠিগুলির হস্তাক্ষর দেখে মনে হয় তা কোন মহিলার লেখা। এ প্রসঙ্গে মিসেস মারকাভোর মুখটা বার বার উঁকি দিতে থাকে আমার মনে। আচ্ছা যদি ধরে নেওয়া যায় যে, মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহের সমস্ত ঘটনার পূর্ণ বিবরণ তার জানা। সাধারণতঃ মেয়েরাই মেয়েদের পরম শত্ৰু, এই প্রবাদটা সত্যি ধরে নিলে স্বভাবতই মনে হয়, মিসেস লিডনারের উপর আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য তিনি এমন জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে আমার এই অনুমানের কথা ডঃ লিডনারকে আমি বলতে চাই না। কারণ সেটা তিনি কি ভাবে নেবেন সেটা বোঝা শক্ত।
ও হ্যাঁ, উৎফুল্ল হয়ে আমি বললাম, আমরা ভাল জিনিসই আশা করব। আমার মনে হয় কথাগুলো খোলাখুলি বলে তিনি এখন যথেষ্ট হাল্কা বলে মনে করছেন নিজেকে।
ও যে তোমাকে সব কথা খুলে বলেছে, এটা খুবই ভাল লক্ষণ। ডঃ লিডনার বলেন। এর থেকে বোঝা যায়, ও তোমাকে বিশ্বাস করে। কি করলে ওর ভাল হয়, ভাবতে ভাবতে আমি একেবারে চরম হতাশার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি স্থানীয় থানায় ব্যাপারটা জানাবেন, কিন্তু পর মুহূর্তেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম কথাটা চেপে গিয়ে।
পরদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শ্রমিকদের মাহিনার টাকা আনবার জন্য কোলম্যান হাসানিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত। রোজকার অভ্যাস মতো আমাদের ডাকের চিঠিগুলো তার সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার কথা। ডাইনিংরুমের একটা কাঠের বাক্সে আমরা যে যার চিঠি ফেলে রাখি, যেখান থেকে চিঠিগুলো সংগ্রহ করে থাকে মিঃ কোলম্যান। সেই চিঠিগুলো গুছিয়ে নিতে গিয়ে হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে।
কি ব্যাপার? আমি তার কাছে গিয়ে শুধোই।
এই দেখো, আমাদের প্রিয় লুসির কাণ্ড দেখো। উনি কাকে যেন চিঠি লিখছেন, ৪২তম স্ট্রীট, প্যারিস, ফ্রান্স। কিন্তু আমার মনে হয় না, ঠিকানাটা ঠিক। তিনি মনে হয় এখন বিছানায়, দয়া করে তুমি ওঁর কাছে গিয়ে সঠিক ঠিকানাটা লিখিয়ে আনবে?
চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে আমি দ্রুত মিসেস লিডনারের ঘরে ছুটে যাই। এবং ঠিকানাটা তিনি সংশোধন করে দেন সঙ্গে সঙ্গে।
এই প্রথম আমি মিসেস লিডনারের হাতের লেখা দেখি। এবং ভাল করে দেখতে গিয়ে হঠাৎ, হা হঠাৎই কেন জানি না আমার মনে হল, এরকম হাতের লেখাটা আমার কাছে খুব যেন পরিচিত।
মাঝরাতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, হাতের লেখাটা যে কার, সেটা আমি ধরে ফেলেছি। কেবল সেই লেখাগুলো একটু বড় আকারের এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে ছাড়ানো। মিসেস লিডনারের হাতের লেখার সঙ্গে সেই ছদ্ম নামের লেখা চিঠিগুলোর একটা অদ্ভুত মিল আছে।
একটা নতুন সম্ভাবনার কথা হঠাৎ অমার মাথায় এল। তবে, তবে কি মিসেস লিডনার কল্পনা করে নিয়ে নিজেই সেই চিঠিগুলো লিখেছিলেন?
এবং সেই সম্ভাবনার কথাটা কি ডঃ লিডনার জেনে গেছেন।