শুকনো কাপড় গায়ে দিয়ে তীরে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসল ওরা।
ব্যাপার কী? প্রশ্ন করল রবিন। কী মনে হয়, কিশোর? আশ্চর্য না? বাতিল মাল? নইলে পানিতে ফেলছে কেন এসব?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। তা হলে এত যত্নের সঙ্গে ওয়াটারপ্রুফ প্ল্যাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে প্যাক করত না, ফেলার সময় প্যারাশুট ব্যবহার করত না। বাতিল অস্ত্র ডাম্প করছে না ওরা, ভালো অস্ত্র লুকিয়ে রাখছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
লুকিয়ে রাখছে! কপালে উঠল জিনার চোখ। কী করবে ওরা এগুলো। দিয়ে?
এরা খুব সম্ভব অস্ত্র চোরাচালানী। কোনও জায়গা থেকে হাজার হাজার অস্ত্র এনে জমা করছে এখানে। পরে চাহিদা মত সাপ্লাই দেবে। সরকার উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করতে চায় এমন সব বিদ্রোহী গ্রুপের কাছে এসবের খুব চাহিদাসম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা মধ্য বা দূর প্রাচ্যের কোনও দেশে যাবে এসব অস্ত্র। বাংলাদেশেও যেতে পারে।
ঠিক তাই, এই রকমই কিছু হবে, কথাটা সমর্থন করল মুসা। গোলমাল তো লেগেই আছে দুনিয়াময়। ওদের অস্ত্র দরকার, আর এদের টাকা।
কিন্তু এখান থেকে এগুলো তুলবে কী করে? প্রশ্ন তুলল কিশোর। বোট যদি লেগুনে ঢোকানো না যায়, কীসে করে নেবে ওরা অস্ত্রগুলো? একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চই আছে,..কী সেটা?
এর জবাব নেই ওদের কারও কাছে।
আমার মনে হয়, বলল রবিন, প্লেন থেকে কিছু ফেলা হচ্ছে দেখেই আঙ্কেল ডিকের সন্দেহ হয়েছিল। তাই একা একা সীগালে করে সারাদিন সূত্র খুঁজেছিলেন দ্বীপগুলোয়। টের পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে ওরা।
যাদের কারণে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল তাকে, এরাই তারা কি না কে জানে! বলল জিনা।
পাথরে হেলান দিয়ে গল্প করছিল ওরা, এমনি সময়ে উপরের একটা পাথরে বসা কিকো চ্যা করে সতর্ক করল ওদের। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়েই মাথাটা নামিয়ে নিল মুসা।
একটা বোট আসছে, কিশোর! জরুরি কণ্ঠে বলল সে। সোজা আসছে। এই দিকেই। ব্যারিয়ারের কাছে চলে এসেছে প্রায়। এখুনি নোঙর ফেলবে। এখন লুকাই কোথায়?
এদিক-ওদিক চেয়ে কাছেই পানিতে ভেসে আসা একগাদা সামুদ্রিক শৈবালের দিকে আঙুল তাক করল কিশোর। ওর নীচে। খালি নাকটা জাগিয়ে রাখব আমরা।
ঝপাঝপ পানিতে পড়ল ওরা। মাথার উপর শৈবাল টেনে ঝুপ করে ফেলল। চোখের কাছে শুধু ফাঁক রাখল সামান্য। কিকোকে কাঁধে নিয়ে তার উপর এক বোঝা শৈবাল চাপিয়ে সাবধান করে দিল মুসা, চু-উ-উ-প!
ওকেও পাল্টা সাবধান করল কিকো। তারপর চুপ হয়ে গেল।
ওদের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল সখা-সখি। এ আবার কী রকম খেলা! যাই হোক, কোন স্তূপের নীচে কিশোর আছে আন্দাজ করে নিয়ে একজন উঠে বসল ওর মাথার উপর, অপরজন সাঁতার কাটছে মাথার চারপাশে। মনে মনে হাসল কিশোর। পাফিন দুটোকে দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে চার-চারটে ছেলেমেয়ে লুকিয়ে আছে এইখানে।
খোলা সমুদ্র থেকে লেগুনে ঢুকবার কোনও রাস্তা নেই, তাই প্রাচীরের পাশে বোট ভিড়িয়ে নোঙর ফেলল ওরা। শব্দ শুনে বোঝা গেল নিচু পাথরের ওপাশে খুব কাছেই পারে নামল কয়েকজন। আসছে এইদিকে। তামাকের গন্ধ নাকে আসায় বোঝা গেল সিগারেট ধরিয়েছে ওরা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কান খাড়া হয়ে গেল জিনা ও তিন গোয়েন্দার।
শেষ চালান তো পৌঁছে গেল, ভারী গলায় বলল একজন। মনে হয়। মালে ছেয়ে গেছে গোটা লেগুনের তল।
হ্যাঁ। এখন তোলা শুরু করতে হবে, বলল আরেকজন। কথা শুনলে মনে হয় ধমক মারছে। তবে তার আগে আমাদের পরিষ্কার ভাবে জানতে হবে ঠিক কী তথ্য পাঠিয়েছে ওই লোকটা তার হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু ব্যাটা তো একটা কথাও বলছে না!
তৃতীয় একজনের গলা ভেসে এল, এত চেষ্টা করেও যখন একে দিয়ে, কথা বলানো গেল না, তখন আমাদের চীফকে জরুরি মেসেজ পাঠানো দরকার। আমার তো মনে হয়, ওয়াশিংটন থেকে আরও টিকটিকি পৌঁছে যাবার আগেই যতটা পারা যায় তুলে ফেলা ভালো।
দ্বিতীয় লোকটার কী অবস্থা? এ-ও কি কথা বলবে না?
এটা তো আগেরটার চেয়েও কড়া মাল! বলল প্রথম জন। মনে হয় হলিউড থেকে এসেছে নামজাদা কোনও অভিনেতা! কোনও কথা স্বীকার করানো যায় না, মেজাজ দেখায়, নালিশ করবার ভয় দেখায়; খালি অরনিথো অরনিথো করছে, আর হাবাগোবার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। কী আহ্লাদ! একই দ্বীপে ধরা পড়ল, অথচ ওরা দুজন কেউ নাকি কাউকে চেনে না!
পানির নীচে দাঁত দিয়ে জিভ কাটল মুসা। কার কথা বলছে এরা, ওয়েনস্টেইন নয় তো? কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওরা যেমন তার একটা কথাও বিশ্বাস করতে পারেনি, শত্রুপক্ষের লোক মনে করে শায়েস্তা করেছে; এরাও ঠিক সেই একই ব্যবহার করছে তার সঙ্গে-বিশ্বাস করছে না তার একটা কথাও
এদেরকে অনির্দিষ্ট কাল বন্দি করে রাখা কিন্তু খুবই রিস্কি, বলল তৃতীয় লোকটা।
দ্বিতীয়জন বলল, ঠিক বলেছ। অর্ডারও এসে গেছে। আজই সন্ধের সময় ওদেরকে বোটে তুলে ফেলতে হবে। মাঝরাতে এমন এক জায়গায় পাঠিয়ে দেব, যেখান থেকে কেউ কখনও ফেরে না। দুনিয়ার কেউ কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না ওদের। গত একটা বছর আমাদের জ্বালিয়ে মেরেছে এই কার্টার বদমাশটা! অযথা জেরা করে এখন আর সময় নষ্ট করা যায় না। ওটাকে যত শীঘ্রি খতম করে দেয়া যায়, ততই মঙ্গল।
শৈবাল স্তূপের নীচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা চারজন। বুকের ভিতরটা কাঁপছে, কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে নড়ল না একটুও। লোকগুলো কথা বলতে বলতে সরে গেল দূরে। বোঝা গেল ওরা দেখতে এসেছে এক-আধটা বোঁচকা ডাঙায় পড়ল কি না। মিনিট বিশেক পর মোটর-বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট নিল, আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে যেতে মাথার উপর থেকে শৈবাল সরিয়ে উঠে পড়ল ওরা ডাঙায়।