- বইয়ের নামঃ গোরস্থানে সাবধান!
- লেখকের নামঃ শামসুদ্দীন নওয়াব
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার
গোরস্থানে সাবধান!
এক
এটা দেখুন, মা বলল এক মহিলাকে। মার গ্রীনহাউসে বসে কফি পান করছে তারা। গ্রীনহিলস শহরের একটি প্রাচীন গোরস্থানের এক সমাধিস্তম্ভের ছবি দেখাচ্ছে মা। গরমের দিন। আকাশ মেঘলা।
কবরের মাথায় স্থাপন করা কোন কোন পাথরখণ্ড, অর্থাৎ হেডস্টোন, তিনশো বছরের পুরানো! মা ইদানীং প্রাচীন হেডস্টোনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অ্যাঙ্গেল আর কৌতূহল জাগানো লিপি খুব টানছে মাকে।
আমি যাই, বলে উঠে পড়লেন মার বান্ধবী। জিনিসপত্র গোছগাছ। করে নিলেন। মনে হচ্ছে ঝড় আসবে।
টোয়াং! মা আর তার বান্ধবী আঁতকে উঠলেন। কিশোর ওর ইলেকট্রিক গিটারে উদ্ভট এক কর্ড বাজিয়েছে। শব্দটা এমনই, কানে লাগারই কথা।
উপস, সরি, লাল হয়ে গেছে ওর মুখের চেহারা। কেউ শুনে ফেলেনি তো!
রবিন করতাল বাজিয়ে ব্যে ড্রামে বাড়ি দিল।
মনে হয় না শুনতে পেয়েছে, বলল ও। লিভিং রূম থেকে গ্রীনহাউসের দিকে চাইলাম আমরা।
সবার বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা আছে তো? মা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল। ঝড় আসবে কিন্তু।
ডুগি হেঁটে যাবে, পাল্টা চেঁচালাম। রাশেদ চাচা পাঁচটার সময় কিশোরকে তুলে নেবেন আর রবিনকে নেয়ার জন্যে শীঘি আন্টি আসবেন।
মুসা, আমার উদ্দেশে বলল কিশোর, মনে হচ্ছে বড় ধরনের ঝড় আসছে। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রয়েছে। পিছনের উঠনে গাছগুলোকে পাগলা হাওয়ায় দুলতে দেখছে।
তাই তো মনে হচ্ছে, বললাম।
.
সেরাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবছিলাম। বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।
আমাদের শহরে বড় বড় প্রাচীন গাছ আছে। আমাদের বাড়ির আশপাশের গাছগুলো দুলছে না, নুয়ে পড়েছে। ভয় হচ্ছে, বাড়ির উপর না এক-আধটা ভেঙে পড়ে।
প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কখন গাছ ভাঙার প্রথম শব্দটা কানে আসবে সে অপেক্ষাই করছি। তীব্র শোঁ-শোঁ শব্দে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বাবার অ্যান্টিকের দোকান, কিউরিও শপ-এর সাইনবোর্ডটা কীভাবে কাঁচ কাঁচ শব্দে সামনে-পিছনে দুলছে অনুমান করতে পারছি। পুরানো বাড়িটার শাটারগুলো বাজের শব্দ তুলে বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালের গায়ে।
এবার অন্য এক শব্দ কানে এল। বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। নিথর শুয়ে রইলাম। কীসের শব্দ ওটা? কম্বল আঁকড়ে ধরেছি।
আধ সেকেন্দ্রে জন্য মনে হলো শাটারের শব্দ। থপ! খাইছে, পরমুহূর্তে মনে হলো এ বাড়িতে তো কোন শাটার নেই!
দুই
কয়টা পড়েছে? ফোনে কাকে যেন জিজ্ঞেস করল মা। চারধারে নজর বুলোম। উজ্জ্বল রোদ চুঁইয়ে ঢুকছে জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে।
স্থানীয় হিস্টোরিকাল সোসাইটির কেউ একজন মাকে ফোন করেছেন পরামর্শের জন্য। রাতের ঝড়ে অনেক গাছ-পালা, বেড়া আর প্রাচীন গোরস্থানের বেশ কিছু হেডস্টোন উপড়ে পড়েছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নায় চোখ রাখলাম। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে হলো যেন ভূত দেখেছি।
মুসা, মা ডাকল, আমাকে ক্রসরোডের পাশের গোরস্থানটায় যেতে হচ্ছে। কালরাতে বেশ কিছু হেডস্টোন পড়ে গেছে। যাবি?
এখুনি আসছি, চেঁচালাম। মার সঙ্গে পুরানো বাড়ি কিংবা কবরস্থানে যেতে ভাল লাগে আমার। মা ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি জানে। পুরানো আমলের মানুষ…এবং ভূতেদের কথাও তার নখদর্পণে।
মা ভুতুড়ে বাড়ির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। এ বিষয়ে নানা ধরনের বই আছে তার।
মাঝে মাঝে ভূতেরা টের পায় না যে তারা মারা গেছে, মা বলেছে আমাকে। মনে করে এখনও বেঁচে আছে। প্রিয় জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়ায় তারা। প্রিয়জনদের দেখার জন্য রাতের পর রাত ঘোরে। ব্যাপারটা দুঃখজনক। তবে আমরা ওদের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারি।
খাইছে, তারমানে? জিজ্ঞেস করেছি আমি। তুমি ভূতকে কীভাবে সাহায্য করবে?
ওদেরকে এই বলে শুরু করতে হবে যে তোমরা…মারা গেছ।
ভুতুড়ে ব্যাপার, বলেছি আমি।
তা না। ওরা কারও ক্ষতি করে না। ওরা স্রেফ নিজেদের রাস্তা খুঁজে পেতে চায়।
ওদের রাস্তা কোথায়? আমার প্রশ্ন।
পরের স্তরে। আত্মার স্তর বলে যেটাকে।
কিন্তু মানুষ ভূতের সাথে কথা বলে কীভাবে?
যেভাবে আমরা মানুষের সাথে কথা বলি, এমন দায়সারা ভাবে বলল মা, ব্যাপারটা যেন টেলিফোনে কথা বলার মতই স্বাভাবিক।
.
আমরা এখন ছোট্ট এক গির্জার সিঁড়ি ভেঙে উঠছি।
কালো সুট পরা একবৃদ্ধ এগিয়ে এলেন আমাদের উদ্দেশে। পরনে মান্ধাতা আমলের পোশাক। ভদ্রলোক মিনিস্টার কিনা কে জানে।
মিসেস আমান! আপনি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। বললেন ভদ্রলোক। আমার নাম রয় ম্যাকয়।
গ্ল্যাড টু মীট ইউ, মিস্টার ম্যাকয়, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল মা। এ আমার ছেলে মুসা।
আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন মি. ম্যাকয়। ঠোঁটে মৃদু হাসি। ভদ্রলোকের ছোঁয়া এতটাই হালকা, টেরই পেলাম না আমি।
হেডস্টোনগুলো কোথায় পড়েছে আসুন দেখিয়ে দিই, বললেন। মি. ম্যাকয়। ছোট এক পথ ধরে প্রাচীন গোরস্থানের উদ্দেশে এগোলাম আমরা। কাল রাতে কেউ মনে হয় এখানে এসেছিল। হেডস্টোনগুলোকে ইচ্ছেমত সরিয়েছে, বললেন ভদ্রলোক।
অমন আবহাওয়ার মধ্যে কারা এল, মাথা নেড়ে বলল মা।
অনেকেই বোঝে না জিনিসগুলো কত দামী, এগুলোর যে ঐতিহাসিক মূল্য আছে, বললেন মি. ম্যাকয়। এলাকার অনেকেরই পূর্বপুরুষদের কবর আছে এখানে। এখন মুশকিল হচ্ছে, যেভাবে নাড়াচাড়া করা হয়েছে, আবার ঠিক জায়গামত সেট করা যাবে কিনা সন্দেহ। এত বছর পর কোন্টা কার কবর বুঝব কী করে?
মা ইতোমধ্যে কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাথরগুলো দেখছে আর প্যাডে কী সব টুকছে।
কিছু ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে, মাটির দিকে চেয়ে হিজিবিজি করে নোট নিচ্ছে। দুএকটা পাথর ভেঙে দুআধখানা করা হয়েছে।
মি. ম্যাকয় বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন।
আমি জানি, বললেন।
কিছু কিছু পাথর মেরামত করা যাবে, মা বলল। গ্রীনহিলস ইউনিভার্সিটির ল্যাবে নিয়ে যাওয়া দরকার।
তা হলে তো খুবই ভাল হয়, বললেন মি. ম্যাকয়। আশ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
আমরা কোথায়? ভাবলাম। আশপাশে তো ওঁকে ছাড়া আর কাউকে দেখছি না।
আমি একটা ভ্যানের ব্যবস্থা করব, মা বলল।
বিমর্ষ দেখাল মি. ম্যাকয়ের চোখজোড়া।
কিন্তু কবরগুলোর কী হবে? প্রশ্ন করলেন। পাথরগুলোকে ঠিকঠাকমত বসাব কীভাবে?
আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, মা বলল। এগুলোর রেকর্ড আছে। কোন কোন ডকুমেন্ট তিনশো বছরের পুরানো। প্রাচীন ভিলেজ রেকর্ড ঘাঁটলে অনেক কিছু জানা যাবে। সবগুলো পাথর রিপ্লেস করতে না পারলেও বংশের নাম এবং এ ধরনের ব্যাপারগুলো জানতে পারব।
মি. ম্যাকয় আমাদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলেন। লিকলিকে লোকটা সামান্য ঝুঁকে পড়েছেন। এক মাথা তুষারশুভ্র চুল। ওঁকে ভাল লেগেছে আমার।
আমি বিকেলে লোকজন নিয়ে ফিরব, মা বলল। গাড়ি চলতে শুরু করলে মি. ম্যাকয় হাত তুলে আমাদের উদ্দেশে নাড়লেন। মুহূর্তের জন্য অন্যদিকে চেয়েছিলাম, এবার গোরস্থানের উদ্দেশে তাকাতেই দেখি মি. ম্যাকয় নেই। খাইছে, অথচ অত্যন্ত ধীরে হাঁটেন ভদ্রলোক।
.
মার সঙ্গে আবারও গোরস্থানে এসেছি আমি। ভ্যানে হেডস্টোনগুলো বোঝাই দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হচ্ছে মেরামতের জন্য। এক প্রফেসরকেও মা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। শক্তসমর্থ কিছু ছাত্রও হাজির হয়েছে।
ভ্যান নিয়ে লোকজন চলে গেলে, আমি আর মা আরেকবার ঘুরে দেখলাম গোরস্থানটা।
মিস্টার ম্যাকয় কোথায় গেলেন? চারধারে নজর বুলিয়ে বলল মা। অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ভেবেছিলাম বিকেলে উনি থাকবেন। ঝুঁকে পড়ে কাছ থেকে কিছু একটা দেখছে। মুসা, দেখ, হাতছানি দিয়ে ডাকল আমাকে।
কাছিয়ে গেলাম। ছোট এক হেডস্টোন, ঘাসের উপর পড়ে। ওতে খোদাই করা: মিশেল রবার্টস। জন্ম আগস্ট ১২, ১৯৮৭। মৃত্যু ডিসেম্বর ৬, ১৯৯৬।
মাত্র নবছর বয়স ছিল ওর, মা বলল। ব্যথিত দেখাচ্ছে তাকে। ভ্যানে তোলার সময় এটা মনে হয় চোখ এড়িয়ে গেছে। পাথরে একটা আঙুল ছোঁয়াল মা। আমরা মিশেলকে এখানে ফেলে রাখতে পারি না।
এ-ই হচ্ছে আমার মা, মনে মনে বললাম। একটা হেডস্টোনকে মিশেল বলে ডাকছে।
এটা গাড়িতে তুলতে তোর হেল্প দরকার, বলল মা।
আমার সোয়েটশার্টে মুড়ে গাড়ির পিছনের সিটের মেঝেতে হেডস্টোনটা নামিয়ে রাখলাম আমরা।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর ওখানে যাওয়া যাবে না। তোর বাবাকে বলেছি রাতে স্প্যাঘেটি আর মিটবল করব। এখন পর্যন্ত বাজারই করা হয়নি! মা গাড়ি চালানোর সময় চিন্তামগ্ন হলো। আগে বাসায় যাব। নইলে আমরা যখন মার্কেটে থাকব মিশেলকে কেউ গাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।
হেডস্টোনটাকে আমরা গ্রীনহাউসে বয়ে নিয়ে গেলাম।
তুই আমার সাথে শপিঙে যাবি? মা প্রশ্ন করল।
যাব, মা। এখুনি আসছি। মিনিট খানেক গ্রীনহাউসে থাকলাম আমি। হেডস্টোনটা টানছে আমাকে। কাছ থেকে পাথরটা দেখছি, ভাবছি খোদাই করা লেখাগুলো কতই না পুরানো, এসময় গ্রীনহাউসের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস-এক সেকেণ্ডের জন্য। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে চাইলাম। একখণ্ড মেঘ ভেসে যেতেই মুহূর্তের জন্য কালো হয়ে গেল আকাশ। ঠাণ্ডায় শিউরে উঠলাম।
তিন
কাল রাতের ঝড়টা কেমন হলো, বাবা? সন্ধেয় ডিনারে বসে প্রশ্ন করলাম।
ঝড়? কীসের ঝড়? আমাকে জ্বালানোর জন্য বলল বাবা। মিটবলগুলো দারুণ হয়েছে। আরেকটু স্প্যাঘেটি নিবি, মুসা?
মাথা নাড়লাম।
কাল রাতের ঝড়ের সময় একটা শব্দ শুনেছ?
কই না তো। শুধু বাতাসের শব্দ শুনেছি, বলল বাবা। কীগো, তুমি শুনেছ? মার উদ্দেশে জানতে চাইল। পরক্ষণে আবার আমার দিকে চোখ ফেরাল।
বাতাসের শব্দে ঘুম আসছিল না। তারপর তোমরা শুতে যাওয়ার পর দড়াম দড়াম করে শাটার বাড়ি খাওয়ার মত শব্দ হচ্ছিল, বললাম।
এখানে তো শাটার নেই। হয়তো পাশের বাড়িতে শব্দ হয়েছে, বলল বাবা।
পরদিন পাশের বাসায় গিয়ে জানালাগুলো পরখ করলাম। শাটার নেই। এবার আমার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। তবে কি গাছের ডালের শব্দ ছিল ওটা? সি আমাদের পিছনের উঠনে চলে এলাম, আমার বেডরুমের জানালাগুলো যেখানে। ছাদের দিকে চাইলাম। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। বাড়ি, জানালার ধারি সব খুঁটিয়ে লক্ষ করলাম। কোনও ডাল-পালা চোখে পড়ল না, কিংবা বাড়ির এমন কোন জায়গা যেখানে বাড়ি খেতে পারে গাছের ডাল। তা হলে?
শুনেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কীসের শব্দ ছিল ওটা?
.
পরের কদিন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সাঁতার নিয়ে। ঝড়ের কথা মনেই থাকল না।
সেদিন সন্ধেয় পিত্যা খাওয়ার পর রাশেদ চাচা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন সিডি ভাড়া করতে। আমরা ভূতের এক সিনেমা বাছলাম। ঠিক করলাম ঘর অন্ধকার করে তারপর দেখব। মজার ব্যাপার হলো, সিনেমাতেও ঝড় আর ভারী বৃষ্টির সিন রয়েছে। সেসঙ্গে বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন। ঠিক আমাদের শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টার মতন।
এবার ছবিতে কী যেন বাড়ি খেতে লাগল।
অ্যাই, তোমরা জোরাল কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কাল রাতের ঝড়ের মতন? বলে উঠলাম আমি।
কই না তো, বলল কিশোর।
বন্ধুদেরকে সে রাতের শব্দটার কথা জানালাম। আরও বললাম, আমি ছাড়া আর কেউ শব্দটা শোনেনি।
আমিও শুনিনি, রবিন বলল।
এবার হঠাৎই জমে গেলাম আমরা। ছবির দড়াম-দড়াম শব্দটা জোরাল হয়েছে। এক মহিলা শুয়ে রয়েছে প্রাচীন এক পোডড়া বাড়িতে। ব্ল্যাঙ্কেট ক্রমেই টেনে তুলেছে চিবুক পর্যন্ত। ঘরের বিশাল কাঠের দরজাটা দেখা গেল। কাছ থেকে দেখাচ্ছে। খুব শক্তিশালী কেউ একজন বাড়ি দিচ্ছে দরজায়। ফলে, কাঠ ভেঙে ছিটকে পড়ছে। এবার ডোরনবটা মোচড় খেল!
খাইছে!
দরজা খুলতেই দেখা গেল বাইরে কেউ নেই। তা হলে বাড়ি দিচ্ছিল কে?
ছবি শেষ হলে বাড়ি চলে এলাম।
.
রাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছি। তবে নিশ্চিত নই। হঠাই ঘুম ভেঙে গেল। কটা বাজে কে জানে। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেলাম। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে না, তা হলে পাওয়ার অফ কেন? বিরক্তি বোধ করলাম।
ফ্ল্যাশলাইটটা তুলে নিয়ে হল ধরে দ্রুত পায়ে এগোলাম। কী ঘটছে দেখতে চাই। বাবা-মা ঘুমোচ্ছে। গোটা বাড়ি শান্ত। স্ট্রীটলাইটের নীল আলোয় লিভিং রুমে কেমন এক ভুতুড়ে আভা। অদ্ভুত তো, ভাবলাম। কারেন্ট না থাকলে রাস্তার আলো জ্বলছে কীভাবে?
বাবার প্রকাণ্ড গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়িটা ক্রমাগত টিকটিক করে চলেছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে বড্ড কানে লাগছে শব্দটা। পেটের ভিতরে শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে।
ঢং! আঁতকে উঠলাম। ঘড়িটা ঘণ্টা দিচ্ছে। আবার, তারপর আবার। তিনটে বাজে। মাঝরাত। এজন্যই সব কিছু কেমন ভুতুড়ে লাগছে। বুক ধড়ফড়ানি কমে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে খানিক সময় লাগল।
এবার দেখতে পেলাম ওটাকে-গ্রীনহাউসে যে ম্লান আলোটাকে জ্বলতে দেখেছিলাম। আলোটা যেন ভাসছে। মার স্কার্ফ বাতাসে ছেড়ে দিলে যেভাবে ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসে ঠিক সেরকম। বুকের ভিতরে ধড়াস করে উঠল।
আলোটা জ্বলছে হেডস্টোনটা যেখানে ছিল সেখানে!
লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আতঙ্কিত। একটা টুলে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে পড়েই যেতাম। হাত কাঁপছে, শক্ত করে ফ্ল্যাশলাইটটা চেপে ধরে রেখেছি। একইসঙ্গে ওটাকে জ্বেলে রেখে পিছাতে চাইছি।
হেডস্টোনটা যেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মা তো মিশেলকে কদিন আগেই পৌঁছে দিয়েছে ইউনিভার্সিটিতে এবং বাইরে থেকে প্রতিফলিত করার মত যথেষ্ট আলো জ্বলছে না, মিশেল যদি এখনও ওখানে থেকেও থাকে।
নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে উড়ে গিয়ে বিছানায় পড়লাম। থরথর করে কাঁপছি। বোঝার চেষ্টা করছি ঘটনাটা কী। গ্রীনহাউসে কিছু একটা ছিল, এবং সেটা সামান্য একটা আলো নয়। এমন কিছু জ্বলছিল আগে যেটা ওখানে ছিল না।
ঘড়ির দিকে চাইলাম। পিটপিট করছে। তারমানে কারেন্ট এসেছে। ল্যাম্প জ্বেলে রাতের টেবিলে খুঁজে পেলাম ঘড়িটাকে। তিনটা দশ। ঘড়িটাকে রিসেট করলাম। এবার বিছানায় শুয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। আশা করছি সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।\
স্বস্তির ভাবটা বেশিক্ষণ থাকল না। বালিশটা ঠিকঠাক করে মাথা রাখতে যাব এসময় কানে এল শব্দটা। দুম! দুম! তড়াক করে সিধে হয়ে বসলাম। চোখ বিস্ফারিত। শব্দটা এবার আর বাইরে থেকে নয়, কাছ থেকে আসছে। ঠিক আমাদের ভাড়া করা সিনেমার হানাবাড়িটার মতন।
ঘরের অপর প্রান্তের উদ্দেশে ভীতিমাখা চোখে চেয়ে রয়েছি আমি। শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি যেন। শব্দটা আসছে বাড়ির ভিতর থেকে! ঢোক গিলোম। আসলে শব্দটা আসছে আমার ক্লজিট থেকে!
চার
পরদিন সকালে টলতে টলতে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। রোদ ঝলসাতে দেখে বুকে সাহস পেলাম। মা ফোনে কথা বলছে।
কিন্তু এটা কী করে হয়, গ্রীনহাউস থেকে তাকে বলতে শুনলাম।
আমরা ওঁর সাথে কথা বলেছি, গোরস্থানটা একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। মিস্টার ম্যাকয়। সাদাচুলো বয়স্ক ভদ্রলোক। ১ ক্যাবিনেটে হাতড়ালাম সিরিয়ালের খোঁজে। মা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল।
একটু কুঁজো মত মানুষটা। চমৎকার ব্যবহার। কালো সুট পরা ছিল। না, টাক্সেডো নয়। আমরা ওঁকে মিনিস্টার-টিনিস্টার কিছু ভেবেছিলাম, মা বলে চলেছে।
সিরিয়ালের বাটি নিয়ে গ্রীনহাউসের দিকে এগিয়ে গেলাম, যাতে মার কথা-বার্তা শুনতে পাই। মাকে বিস্মিত শোনাচ্ছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিরিয়াল খাচ্ছি আমি। রাতে যা-ই দেখি না কেন, এখন সব কিছু স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, মেরামতের কাজ ভালভাবে এগোচ্ছে, মা বলে চলেছে।
আমি মিস্টার ম্যাকয়কে নিজের মুখে বলতে চেয়েছিলাম কথাটা। হেডস্টোনগুলোর ব্যাপারে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন ভদ্রলোক।
মা আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর বলল, হ্যাঁ। আমি মিস্টার ম্যাকয়কে বলেছিলাম গ্রামের পুরানো রেকর্ড ঘাঁটব। হেডস্টোনগুলোর বেশিরভাগকেই জায়গামত বসাতে পারব বলে মনে করছি।
আরও কিছু কথার পর মা ফোন রেখে দিল। এবার আমার দিকে চাইল। চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি।
মিস্টার ম্যায়ের কথা মনে আছে?
কী হয়েছে তার?
গির্জার কেউ নাকি এই নামের কাউকে চেনে না, মা বলল।
খাইছে!
কী হলো?
কিছু না। আমি…আমরা… রাতের ঘটনাটা কীভাবে বলব ভাবলাম।
কী হয়েছে রে তোর? মা প্রশ্ন করল। আমার কাঁধ চাপড়ে দিল।
তারমানে মিস্টার ম্যাকয় বলে কেউ নেই, তাই তো?
হ্যাঁ। তার সাথে দেখা করে বলতে চেয়েছিলাম কাজ ভালভাবে এগোচ্ছে। যাকগে, আমি এখন হিস্টোরিকাল সোসাইটিতে যাব। প্রাচীন ভিলেজ রেকর্ড দেখতে। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তুই যাবি আমার সাথে? মা বলল।
রাজি হয়ে গেলাম।
সঙ্গে কী কী নেব জড় করে ফেলি, মা বলল। পরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা ব্যাগে ম্যাগনিফাইং গ্লাস, রুলার, কলম, নোটবুক আর কপি মেশিনের জন্য ভাঙতি নিয়ে নিল। জর্জ ওয়াশিংটনের চেয়েও প্রাচীন কারও কোনও লেখা পড়তে চলেছে মা। এ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গ্রীনহাউস থেকে বেরিয়ে পড়ল মা। পা বাড়াল গ্যারেজের দিকে।
আচ্ছা, কাল রাতে আমি ভূত দেখিনি তো? ম্লান আলোটা তা কীসের? আর মি. ম্যায়ের ব্যাপারটা আসলে কী?
কিন্তু গ্রীনহাউসের আলোটা নয়, আমাকে ভাবাচ্ছে ক্লজিটের দুম, দুম! শব্দটা। একমাত্র আমিই শুনতে পাচ্ছি আওয়াজটা। রাতের বেলা অমন শব্দ হতে থাকলে আমি ঘুমাব কীভাবে?
একটু পরে, রওনা হলাম আমরা। পৌঁছেও গেলাম। মা পুরানো দলিলের পাতা উল্টে যাচ্ছে একের পর এক। আমি খানিকটা বিরক্তি বোধ করছি।
মা হঠাৎই চমকে উঠল।
আশ্চর্য তো। এটা কীভাবে সম্ভব? ফিসফিস করে বলল। দৌড়ে গেলাম মার কাছে।
কী হলো? কিছু জানতে পারলে? প্রশ্ন করলাম।
অবিশ্বাস্য। এটা দেখ, মুসা, মা বলল, হলদেটে কাগজে হাতের লেখায় নাম আর তারিখের সারি। সাবধান, কাগজটা ধরিস না। দেখতে পাচ্ছিস? মার নির্দেশিত জায়গাটায় চোখ রাখলাম। কী লিখেছে পড়।
রয়…ম্যাকয়… মেরুদণ্ড বেয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল আমার। মা
আরেকটু পড়লাম। ১৭০৩। মা-মিস্টার ম্যাকয়। কিন্তু এর মানে…
মুসা, বলে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মা। এরমানে আমরা ভূতের দেখা পেয়েছি।
মিস্টার ম্যাকয়? ঢোক গিলোম। কিন্তু আমরা ওঁকে দেখেছি। ওঁর সাথে কথাও বলেছি। আমরা
আমরা সত্যিকারের এক ভূতের সঙ্গে কথা বলেছি, মা বলল। তার চোখে দূরের দৃষ্টি। টেবিলে আঙুলের তবলা বাজাচ্ছে। চিন্তামগ্ন।
মা, মিস্টার ম্যাকয় বলছিলেন আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
আমরা বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন?
সঙ্গের ভূতেদের, বলল মা। বাহু ঘষল। হঠাত্র ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। উনি এখানে আছেন, মুসা।
খাইছে।
কাছেপিঠে ভূত থাকলে ঘর হঠাৎ করেই ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।
ভয় পাচ্ছি আমি। এখন বুঝলাম গ্রীনহাউস কেন সেদিন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। তারমানে কাল রাতে ওখানে অদ্ভুতুড়ে কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছিল! মাকে বলতে চাই না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার দফা রফা।
আজব না ব্যাপারটা? মা বলল।
আজব বলে আজব। বাসায় যে ঘটনাগুলো ঘটল তার সঙ্গে মি. ম্যায়ের কোন সম্পর্ক নেই তো? যদি থেকে থাকে তা হলে মি. ম্যায়ের দলে ভূতের সংখ্যা কত?
এটুকু জানি, রাতে শোয়ার সময়টা আমার জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠবে। কে জানে, জেগেই রাত কাটাতে হয় কিনা।
পাঁচ
শোনো না, বাবাকে ডিনারের টেবিলে বলল মা। হলদে কাগজে বাদামি কালিতে লেখা ছিল ওটা। আমরা দুজনেই দেখেছি। তাই না রে, মুসা? আমার দিকে চেয়ে বলল। এ হু? ও হ্যাঁ, ঘরের মধ্যে বললাম। শোয়ার সময় কী হবে তাই নিয়ে চিন্তিত আমি।
দলিলটা খাঁটি কিনা আমি বলে দিতে পারব, বাবা বলল মাকে।
আমার কাছে অনেক পুরানো রেকর্ড আছে।
কিন্তু, বাবা, দলিলটা যদি ভুয়াও হয়, মিস্টার ম্যায়ের ব্যাপারটা কী হবে? আমরা তাঁকে দেখেছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি। এবং রেকর্ডে তার নামটাও লেখা আছে।
বাবা শ্রাগ করল।
জানি না, স্বীকার করল। এখন তো হ্যালোউইন না যে কেউ মান্ধাতা আমলের ড্রেস পরে চার্চে যাবে।
বুড়ো মানুষটাকে আমার খুব সিনসিয়ার মনে হয়েছিল। ওরকম কেউ একজন নেই শুনে দুঃখ পেয়েছি, থাকলেই খুশি হতাম, মা বলল।
মার কথা শুনে শিউরে উঠলাম। মনে পড়ল মি. ম্যাকয় আমার উদ্দেশে মৃদু হেসে কাঁধ চাপড়ে দিয়েছিলেন, অথচ আমি তার হাতের স্পর্শ অনুভব করিনি। এর মানে একটাই…এবং আমি সেটা ভাবতে চাই না।
কালকে দলিলগুলো দেখব, বলল বাবা। মিসেস ফিনলেকে বলব দোকানটা দেখে রাখতে।
নীরবে বসে রইলাম। খাবার নাড়াচাড়া করছি। এবার হঠাই একটা বুদ্ধি ঘাই মারল মাথায়।
মা, আজ রাতে আমি বাসায় বন্ধুদেরকে ডাকতে পারি? থাকার জন্যে! প্রশ্ন করলাম। স্কুল বসতে আরও সপ্তাহখানেক বাকি। সময়টা মোক্ষম। আওয়াজটা একা সহ্য করতে হবে না আমাকে। কিংবা গ্রীনহাউসের আলোটা।
বাবা-মা আপত্তি করল না। তড়াক করে টেবিল ছেড়ে কিশোর আর রবিনকে ফোন করলাম। ওরা বাসায় অনুমতি নিয়ে চলে আসবে। যাক, এবার অন্তত একা থাকতে হবে না আমাকে।
সে রাতে নীচে বাবার কম্পিউটার রুমে কম্পিউটার গেম খেলে। কিছু সময় পার করলাম আমরা।
হঠাই অনুভব করলাম কেমন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে। খাইছে! অদৃশ্য কেউ এসে হাজির হলো নাকি?
তোমরা ভূতে বিশ্বাস করো? মাউস নেড়েচেড়ে বলল কিশোর।
অনেকেই করে, বলল রবিন। তা ছাড়া নানারকম অভিজ্ঞতা তো আমাদের নিজেদেরই হয়েছে।
তা ঠিক, বলল কিশোর।
বোর্ড গেম খেলে, কিচেনে স্ন্যাক খেয়ে শেষমেশ আমার ঘরে চলে এলাম তিনজনে।
টিভিতে সত্যিকারের ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চার শশা এখুনি শুরু হবে, বলল কিশোর।
আমার ঘরে যখন শব্দটা শুরু হবে তখন দেখা যাবে কার কত বড় বুকের পাটা, মনে মনে বললাম।
তোমাদেরকে একটা কথা বলতে চাইছিলাম, শুরু করেছিলাম।
শো শুরু হচ্ছে, বলল রবিন। পর্দায় চোখ সঁটা। পলায়নপর এক লোককে ধাওয়া করছে আধ পচা এক জীব।
কিশোর আর রবিনকে বার দুয়েক বলার চেষ্টা করলাম, আমরা শুয়ে পড়ার পর এঘরে ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা ঘটতে পারে, কিন্তু কোন সুযোগই দিল না ওরা। খানিক পরে, ক্লান্ত হয়ে পড়লাম সবাই। এবার শোয়ার আয়োজন করতে হয়।
ঝড়টার কথা মনে আছে? চিত হয়ে শুয়ে আরেকবার চেষ্টা করলাম। বলেছিলাম না একটা দুম, দুম শব্দ শুনেছি, যেটা আমি ছাড়া আর কেউ শোনেনি?
হ্যাঁ, তো? কিশোর বলল।
মানে
কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমি এখনও ওটা শুনতে পাচ্ছি, বলে ফেললাম ফস করে।
এখন শুনলে? রবিনের প্রশ্ন।
না, মানে প্রতিদিন গভীর রাতে শুনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আর শব্দটা শুনতে পাই।
হয়তো বাড়ির পিছনে রেকুনেরা শব্দ করে, বাতলে দিল কিশোর।
বাইরেটা চেক করে দেখেছি আমি, বললাম। যাকগে, শব্দটা কিন্তু আসছে আমার ক্লজিটের ভিতর থেকে।
চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল ওদের। হাঁ করে ক্লজিটের দিকে চেয়ে রইল। ওদের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো ভিতর থেকে এই বুঝি একটা ভিনগ্রহী বেরিয়ে এল!
তোমার কাছে ফ্ল্যাশলাইট আছে? প্রশ্ন করল কিশোর। আমি আমারটা নিয়ে এসেছি।
আমিও, জানাল রবিন।
গুড। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। তা হলে কিছু ঘটলে তৈরি থাকতে পারব, বলল কিশোর।
হঠাই ঘর ঠাণ্ডা হয়ে উঠলে কেঁপে উঠলাম আমরা। প্রদীপটা নিভু নিভু হয়ে এল। পরস্পর মুখ তাকাতাকি করলাম তিন বন্ধু।
দুম!
শব্দটা শুরু হয়েছে।
আঁতকে উঠল রবিন।
কিশোরের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে।
জিনিসটা কী দেখা দরকার, বললাম।
বাতি জ্বলছে, কাজেই ফ্ল্যাশলাইটের প্রয়োজন নেই
অন্তত এখনও না।
এসো, ডাকলাম ওদেরকে। ক্লজিটের দরজাটা খুলি। ক্লজিটের কাছে হেঁটে গেলাম। বন্ধুরা আমার সঙ্গে আসেনি।
দুম!
ভিতরে কী আছে জানতেই হবে, জোর গলায় বললাম।
এবার একটানে ক্লজিটের দরজাটা খুললাম। সভয়ে ঢোক গিলোম। বিশাল ক্লজিট, ভিতরে হেঁটে ঢুকে পড়া যায়। দূরের কিনারা থেকে স্নান আলো আসছে। ওখানে আমার ক্যাম্পিং গিয়ার রয়েছে। মুখের সামনে থেকে কাপড়-চোপড় সরালাম। পরমুহূর্তে যা দেখলাম, কেউ বিশ্বাস করবে না।
কোঁকড়াচুলো এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আমার ক্লজিটে। পরনে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুল-খাওয়া প্রাচীন পোশাক। ক্লজিটের ভিতরে ফ্রীজারের হিম। থরথর করে হাঁটু কাঁপছে আমার। তবে সে সঙ্গে মাথাও কাজ করছে। আলোটা কোথায় দেখেছি মনে পড়ে গেছে। আতঙ্ক চেপে বসল বুকে।
ছয়
ক্লজিটের কাছ থেকে পিছাতে শুরু করলাম। মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না, আবার মুখে কথাও জোগাচ্ছে না।
শেষমেশ মুখ খুলতে পারলাম।
কে… কে তুমি?
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটি।
আমি মিশেল। তোমাকে আমার দরকার, জন!
বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। মিশেল তো মারা গেছে।
আমি জন নই। কে জন? প্রশ্ন করলাম।
আমার ভাই, জবাব এল। ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। মাকেও পাচ্ছি না। তুমি আমার মাকে দেখেছ?
মেয়েটি ওর প্রিয়জনদের খুঁজছে। শিউরে উঠলাম।
পিছিয়ে এসে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। ভয় পেলাম, শব্দে বাবা-মা জেগে না যায়। ক্লজিটের দরজায় হেলান দিয়ে হাঁপাচ্ছি। চোখ বিস্ফারিত।
আমার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর আর রবিন।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভূত দেখেছ, বলল কিশোর।
ঠিকই বলেছ। তোমরা দেখতে চাও? ক্লজিটের দরজা খুললেই দেখতে পাবে। লম্বা ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছে, জবাবে বললাম।
অসম্ভব, বলল রবিন।
মোটেই না। নিজের চোখেই দেখো।
আচ্ছা, দেখছি, বলে ফ্ল্যাশলাইটটা তুলে নিল কিশোর।
ওটার দরকার হবে না, জানালাম।
আমার দিকে চেয়ে রইল ওরা, কী বলছি বুঝতে পারছে না। তবে শীঘ্রিই টের পাবে। ক্লজিটের উদ্দেশে এগোল দুজনে।
আমিও যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে। নিজেই খুলে দিলাম দরজাটা। উঁকি মারলাম ভিতরে।
আলোটা তখনও জ্বলছে। ঠাণ্ডা বাতাসে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে পাচ্ছি। ভিতরে পা রাখলাম। মিশেলকে খুঁজছি। কোথায় গেল, ও! পিছনের কোনার দিকে এগোলাম, ওকে যেখানে দেখেছিলাম। বন্ধুরা অনুসরণ করল আমাকে।
কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, বলল কিশোর।
ও এখানেই আছে, বললাম। এবার অনুভব করলাম আমাকে কীসে যেন টানছে, অনেকটা গায়ের চামড়ার কাছে আসা ভ্যাকিউম ক্লিনারের হোসের মতন। আমাকে কাছে টানছে ওটা।
হাত বাড়ালাম অনুভব করার জন্য। বরফ পানি চলকে উঠল বুকের মধ্যে। হাতটা স্রেফ দেয়াল ভেদ করে চলে গেছে।
খাইছে!
আরি, এটা দেখো, বন্ধুদেরকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলাম।
তোমরা নাও বিশ্বাস করতে পারো, কিন্তু এই দেয়ালে একটা গর্ত আছে। দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু হাতটা যদি এভাবে বুলাতে থাকো…
দেয়ালে হাত বুলালাম, এবার বাহু থেকে কাঁধ অবধি ঢুকিয়ে দিলাম ভিতরে।
দেখেছ? এখানে এক ধরনের ওপেনিং আছে, বললাম।
কিশোর আর রবিনের চোখ ছানাবড়া।
কোথায় ওপেনিং? রবিনের প্রশ্ন।
আমার ধারণা এটা চলে গেছে আত্মাদের জগতে-মানে ওপারে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আগে কেন ভাবিনি জানি না, কিন্তু আমি মাথা গলিয়ে দিলাম ফাঁকটার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওপাশে কী আছে বলতে পারার আগেই ধপাস করে পড়ে গেলাম। আর পড়েছি আত্মাদের পৃথিবীতে। সে
অন্যপাশে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেলাম না। আতঙ্কিত হয়ে চারধারে নজর বুলালাম। বহুদূর থেকে প্রতিধ্বনির মত কানে আসছে কিশোর আর রবিনের ডাক।
মুসা, কোথায় তুমি? মুসা! আমার নাম ধরে ডাকছে।
ভয়ে আর ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার দশা। খোলা জায়গাটা খুঁজে পেলে আবারও ক্লজিটে ফিরে যেতে পারতাম কিন্তু কোথায় সেই ওপেনিং? কানে আসছে শুধু দূরাগত ডাক। হারিয়ে গেছি আমি।
আমি, মুসা আমান, ওপারে-জীবিত-এবং-নিখোঁজ।
সাত
কোন কিছুতে হোঁচট খাইনি আমি, তারপরও পড়ে গেছি ফোকরটা দিয়ে। মনে হচ্ছে ভ্যাকিউম ক্লিনারের মাধ্যমে আমাকে শুষে নেওয়া হয়েছে।
ভীত আর বোকা-বোকা লাগছে। হাত দিয়ে চারধার চাপড়াচ্ছি। মার বাগানের মত স্যাঁতসেঁতে ভাব আর ধুলোর গন্ধ এখানে। মনে হচ্ছে ভেজা মাটিতে বসে আছি। ঠাণ্ডাটা অনুভব করতে পারছি। অন্ধকার সত্ত্বেও হলদেটে আকাশ দেখতে পাচ্ছি। পেটের ভিতরটা হঠাই গুলিয়ে উঠল।
এবার একটা আলো দেখতে পেলাম। মনে হলো একটা গাড়ি। আলোটা কাছিয়ে এলে ভাল করে দেখা গেল। চারধারে নজর বুলালাম। খাইছে, বাড়িগুলো কোথায়? আর রাস্তাটাই কেন ধুলোয় ভরা? এবার চাকার কাঁচকোচ শব্দ শুনতে পেলাম। ক্যারিজ বয়ে দুলকিচালে আমার দিকে ছুটে আসছে এক ঘোড়া। আজব কাণ্ড, ভাবলাম। কেউ তো আজকাল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে না। এ শহরের কেউ না। এ শতাব্দীরই কেউ না…
আরি! ক্যারিজটার পথ থেকে ঝট করে পা সরিয়ে নিলাম। চালকের দিকে মুখ তুলে চাইলাম। হাস্যকর পোশাক তার পরনে। লোকটার মুখের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠলাম।
ফ্যাকাসে মুখে চোখ নেই, শূন্য কোটর!
কিশোর, রবিন, তোমরা কোথায়? আর্তনাদ ছাড়লাম।
গাড়ির হেডলাইট নয়, ওয়াগনের এক পোল থেকে একটা লণ্ঠন ঝুলছে। চোখ সরু করে চাইলাম। ক্যারিজের পিছনে বসে এক মহিলা। এ-ও ফ্যাকাসে। ছোট এক বনেট পরা। খাইছে, এরও চোখ নেই।
তারমানে গোরস্থানে পৌঁছে গেছি আমি! দুপাশ হাতড়ালাম। ঘাস, শুকনো পাতা, আর একটা হেডস্টোন। সভয়ে হাত সরালাম। আঠাল ভাব! এটা গোরস্থান ঠিকই-তবে ১৬৯০ সালের! মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন। দেখছি, কিন্তু আসলে তা না। ক্লজিট থেকে এখানে এলাম কীভাবে?
শার্টের বুকে হাত মুছলাম। নিজের দিকে চাইলাম।
এ হতে পারে না! চেঁচিয়ে উঠলাম। হাত-শরীর ভেদ করে মাটি অবধি দেখতে পাচ্ছি। ভূত হয়ে গেছি আমিও!
মুসা, আমি তোমার সাথে আছি, হঠাই এক লোকের কণ্ঠস্বর বলে উঠল। ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম কণ্ঠটা লক্ষ্য করে। অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাস ভেদ করে মিটমিট করে চাইলাম, ভাল করে দেখতে চেষ্টা করছি। একণ্ঠটা আগেও শুনেছি।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করো, কণ্ঠটা বলল। কেউ একজন আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। হাতটা অসম্ভব হালকা। এরমানে ___।
মিস্টার ম্যাকয়? ককিয়ে উঠলাম, মুখে কথা ফুটছে না। ___ থেকে দেখলাম। মি. ম্যাকয়। মা ঠিকই বলেছিল। এটা অন্য ভুবন। মি. ম্যাকয় আসলেই ভূত! এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য ভূতেরা আছে!
মিস্টার ম্যাকয়? আমি এখান থেকে ফিরে যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন, জড়ানো গলায় বললাম। আমি বাড়ি যাব!
চিন্তা কোরো না, মৃদু হেসে শান্ত স্বরে বললেন মি. ম্যাকয়।
ভয়ের কিছু নেই। শুধু দরজাটা খুঁজে নিতে হবে। ওটা কাছেপিঠেই, আছে।
একটু স্বস্তিবোধ করলাম। আশ্বাস পেয়েছি মি. ম্যায়ের কথায়।
কিন্তু দরজাটা কীসের? জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
যেটা দিয়ে আমরা এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাই, জবাব পেলাম।
আমরা বলতে কারা?
হেসে উঠলেন মি. ম্যাকয়।
সবাই, মুসা, প্রত্যেকে।
আপনি আমাকে শিগগির পার করে দিন, মিস্টার ম্যাকয়, অধৈর্য হয়ে বললাম। আগামী সপ্তাহে আমার স্কুল। তা ছাড়া সাঁতারের দলে নাম লিখিয়েছি আমি।
আবারও হেসে উঠলেন মি. ম্যাকয়।
ঘাবড়িয়ো না। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি এসো।
কী জন্যে?
দরজাটা খুঁজব না? ওটা মনে হয় এপাশেই আছে। বাতাসে হাত খ. চালালেন মি. ম্যাকয়। ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো মাকড়সার জাল সরাচ্ছেন। একবার, দুবার, তিনবার চেষ্টা করলেন।
মিয়া এবার সহসাই ওঁর হাত ও কব্জি অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক আমার ক্লজিটের গর্তটার মত একটা ফাঁক। হাতটা টেনে বের করে আবারও বাড়িয়ে দিলেন। ফের উধাও হয়ে গেল ওটা। টি
ওটা এখানে, বললেন, আমার চোখে চোখ রাখলেন। শিউরে উঠলাম।
মুসা, মুসা, তুমি শুনতে পাচ্ছ? জবাব দাও! কিশোরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ এখনও দূরাগত প্রতিধ্বনির মত শোনাচ্ছে।
মি. ম্যাকয়ের দিকে চাইলাম।
জবাব দাও, বাছা। ওরা শুনতে পাবে, বললেন তিনি।
আমি এখানে! চেঁচালাম। দরজাটা খুঁজে পেয়েছি! এখুনি আসছি! মি. ম্যাকয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। আচ্ছা, মিশেলের ব্যাপারটা কী? আমরা ওর হেডস্টোন খুঁজে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে ও আমার ক্লজিটে দেখা দিচ্ছে।
মি. ম্যাকয়কে গম্ভীর দেখাল। ভয় পেয়ে গেলাম।
কী হলো? ত্রস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম। আশঙ্কা করছি, ভয়ঙ্কর কিছু একটা শুনব।
তোমরা যখন মিশেলের হেডস্টোনটা বাসায় নিয়ে গিয়েছ তখন মিশেলও তোমাদের সাথে বাসায় চলে গেছে, ব্যাখ্যা দিলেন।
কিন্তু কেন?
ও তোমার মাধ্যমে আসতেই থাকবে, বাছা। ওর হেডস্টোনটা কোথায় ছিল খুঁজে পাচ্ছি না আমরা। মিশেল কারও সঙ্গ চাইছে, কেয়ার চাইছে। চাইছে কেউ একজন ওর সাথে থাকুক-এপারে।
একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম মি. ম্যাকয়ের দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
এটা অনেকটা ঘুমের মধ্যে হাঁটার মত ব্যাপার। নিজের মা আর পরিবার হারিয়ে অস্থির হয়ে আছে মিশেল। ও একজন বন্ধু খুঁজছে, যার সাহায্যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আমাদের এখানে চলে আসতে পারে, বলে গেলেন মি. ম্যাকয়। ইজি।
আমি ওর বন্ধু হতে চাই না। আমাকে আমার জগতে ফেরত পাঠান, মি. ম্যাকয়কে বললাম।
শরীরটা ঠেলে দাও, যেখান থেকে এসেছ আবার সেখানে ফিরে যেতে পারবে।
মাথাটা গলাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ক্লজিটের ভিতরে। কিন্তু মি. ম্যাকয় কী যেন বলছেন শুনে ঘুরে চাইলাম।
সাবধান, মুসা! অন্য দরজাগুলো দিয়ে ঢুকে পোডড়া না যেন!
অন্য দরজা মানে? চেঁচিয়ে উঠলাম। সেগুলো আবার কোথায়?
কিন্তু জবাব পাওয়ার আগেই বন্ধুরা টেনে বের করে নিল আমাকে।
আট
তোমার সাথে জরুরী আলাপ আছে, বলল কিশোর।
কী এত জরুরী আলাপ? ডুগি প্রশ্ন করল। সকালে উঠেই ওকে ফোন করেছি আমরা, ঝটপট চলে আসতে বলেছি।
কুঁকড়ে গেলাম আমি। ডুগি কি বিশ্বাস করবে এসব কথা? আমাকে পাগল ঠাওরাবে না তো?
কসপ্তা আগে ঝড়টা হয়ে যাওয়ার পর থেকে এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে, বললাম ডুগিকে।
যেমন? অ্যামপ্লিফায়ার অফ করে প্রশ্ন করল ও।
সত্যিকারের ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চারের মত, বলল রবিন।
হ্যাঁ, একেবারে সত্যি। এবং ঘটছে মুসার ক্লজিটের ভিতরে, জানাল কিশোর।
ডুগিকে কাল রাতের ক্লজিটের ঘটনা, মি. ম্যাকয় ও মিশেলের কথা, গোরস্থানে আমার অভিজ্ঞতা সবই খুলে বললাম আমরা। কীভাবে। আমি দরজা গলে পড়ে যাই-এবং কোথায় হাজির হই তাও জানালাম।
আজ রাতে আবারও মুসার ঘরে থাকব আমরা, বলল রবিন। তবে এবার আমরা তৈরি থাকব।
কীসের জন্য তৈরি, খোদা মালুম।
আমিও থাকব, বলে উঠল ডুগি।
ভেরি গুড, খুশির গলায় বললাম আমি।
.
আরি, আন্টির গ্রীনহাউসে ওটা কীসের আলো? প্রশ্ন করল রবিন।
আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না, মনে মনে বললাম। মি. ম্যাকয় কি এটার কথাই বলতে চেয়েছিলেন?
সাবধান, মুসা! অন্য দরজাগুলো দিয়ে ঢুকে পোডড়া না যেন! এখনও তার কথার প্রতিধ্বনি কানে বাজছে।
আমি থামাতে পারার আগেই সোজা গ্রীনহাউসে গিয়ে ঢুকল ডুগি। একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আলোটার দিকে। এ দাঁড়াও! ফিসফিস করে পিছু ডাকলাম। চাই না বাবা-মা জেগে যাক। ডুগি!
দৌড়ে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ডুগি অদৃশ্য। গ্রীনহাউসে আরেকটা দরজা ছিল! তার ভিতর দিয়ে পড়ে গেছে ডুগি!
গলা শুকিয়ে গেল। কাঠ-পুতুল হয়ে গেছি। ওপারে পৌঁছে কতটা আতঙ্কিত বোধ করবে ডুগি কল্পনা করলাম। এখন আমাদের সমস্যা শুধু ভূতেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া নয়। ডুগিকে যেভাবে তোক ফিরিয়ে আনতে হবে।
কিন্তু কীভাবে?
নয়
মুসা, আমি কোথায়? চেঁচিয়ে উঠল ডুগি। সন্ত্রস্ত। ওপার থেকে প্রতিধ্বনি তুলছে ওর কণ্ঠ। বাঁচাও! জলদি এসো! আমাকে নিয়ে যাও! আমি হাত-পায়ের ভিতর দিয়ে মাটি দেখতে পাচ্ছি। বাঁচাও!
চারধারে নজর বুলিয়ে বন্ধুদেরকে খুঁজলাম। কোথায় ওরা? ডেনে আলো জ্বলছে। কম্পিউটার অন করেছে ওরা। ওখানে ভয়ানক ঠাণ্ডা। তার মানে ভূত এবং আরও দরজা, মি. ম্যাকয় যেমনটা বলেছিলেন।
কী করছ তোমরা? চেঁচালাম। এখন গেম খেলার সময় নয়। ডুগি ওপাশে পড়ে গেছে!
শান্ত হও, মুসা, বলল কিশোর। আমি তোমার উপকারই করছি। এই ভূতের গেম থেকে বের করে ফেলব ওদের পরের মুভটা কী।
এটা কি যুদ্ধ নাকি? শীঘি এসো তোমরা। ডুগি পড়ে গেছে। এখানে আরেকটা ওপেনিং আছে! ওকে খুঁজতে যেতে হবে। রবিন কোথায়?
তারমানে? ও তো এখানেই আছে।
চারপাশে দৃষ্টি বুলালাম। কামরাটা ঠাণ্ডা আর ফাঁকা। পরস্পরের দিকে চাইলাম আমরা। উপলব্ধি করলাম, রবিনও পড়ে গেছে। আরেকটা দরজা! আমাদের অজানা এরকম আরও কটা দরজা আছে? কাল সকালে বাবা কিংবা মা যদি কোনও একটার ভিতর দিয়ে পড়ে যায়?
কিশোর, মুসা, বাঁচাও! আমি পড়ে গেছি! রবিনের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলল।
তোমরা আমাকে বাঁচাও! আমি ভূত হয়ে যাচ্ছি! আর্তনাদ ছাড়ল ও। এরপর আর ওর গলা শুনলাম না।
হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না। কিশোর বাক্যহারা।
আমাদেরও ওখানে ঢুকতে হবে, বললাম ওকে।
তাই তো মনে হচ্ছে, বলল ও।
রবিন! চেঁচালাম, তুমি কথা বলতে থাকো যাতে আমরা তোমার গলা পাই। ডুগিও ওখানে আছে, খুঁজে দেখো! বেশি দূরে কোথাও যেয়ো না। ডুগিকে খুঁজে নিয়ে এক সাথে থাকো। আমরা আসছি!
আমরা আমার রুমে দৌড়ে এলাম ফ্ল্যাশলাইট নিতে। তারপর ক্লজিটের ভিতরে ডাইভ দিলাম পানিতে ঝাপানোর ভঙ্গিতে। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছতে হবে ওপারে।
গোরস্থানের ভেজা মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম আমরা। কেমন পুরানো ছাতা গড়া গন্ধ ভক করে নাকে এসে লাগল।
অদ্ভুত জায়গা, চারধারে চেয়ে মন্তব্য করল কিশোর।
ভয় পাচ্ছ?
না, তুমি তো ঠিকমতই ফিরে গিয়েছিলে।
হ্যাঁ, এসো ওদেরকে খুঁজে নিয়ে এখান থেকে জলদি সটকে পড়ি।
ফ্ল্যাশলাইট চেপে ধরলাম আমরা। আমার শার্ট ধরে থাকল কিশোর, আমরা যাতে আঁধারে আলাদা হয়ে না যাই।
কিশোর, মুসা! রবিনের গলা।
নোড়ো না! আমরা এখুনি আসছি, অভয় দিয়ে বললাম।
সামনেটা হাতড়াচ্ছি, সামনে-পিছনে ফ্ল্যাশলাইট বুলাচ্ছি। ঠিকমত দৃষ্টি চলছে না।
কিশোর, মুসা! আমাদের বাঁচাও। আমরা- ফের রবিনের কণ্ঠ।
বাঁচাও, মুসা! আমি হারিয়ে যাচ্ছি! ককিয়ে উঠল ডুগি। রবিন! রবিন!
তোমরা একসাথে আছ? চেঁচালাম আমি।
ছিলাম, কিন্তু রবিন একটা গর্তে পড়ে গেছে! হায়, খোদা, ওটা একটা কবর! খোলা এক কবরে আটকা পড়েছে ও! চেঁচাল ডুগি। কী বিপদেই না পড়া গেছে। কি আরেকটু সামনে বেড়ে হাতড়াতে লাগলাম অন্ধের মতন। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। ভোলা কোন কবরে পড়ে গেলে মহাবিপদ হয়ে যাবে! আমি এখনই কবরে যেতে চাই না।
শেষমেশ ধাক্কা খেলাম ডুগির সঙ্গে।
মুসা! থ্যাঙ্ক গড! এটা কোন্ জায়গা? কুঁপিয়ে উঠল ও।
এটা ওপারের ভুবন, ডুগি, বললাম।
কিন্তু তারমানে এরা সব ভূত! আর আমরাও ভূত হয়ে যাচ্ছি। বাপ রে, আমি বাড়ি যাব!
সাহস হারিয়ো না। একটা ওপেনিং খুঁজে পেলেই ফিরে যেতে পারব আমরা। রবিনকেও উদ্ধার করতে হবে। তুমি শান্ত থাকো।
বুক ভরে শ্বাস টানল ও।
ঠিক আছে, বলল। কিন্তু হঠাই এক হাত তুলে চোখ ঢাকল ডুগি। অপর হাতে নির্দেশ করছে অন্য কিছু একটা। মুসা, ওরা কারা?
মুসা! ওরা আমাদের দিকেই আসছে! পিছন থেকে চেঁচাল কিশোর।
একদল ছায়ামূর্তিকে আমাদের উদ্দেশে আসতে দেখলাম।
খাইছে, কারা ওরা? কী ওরা?
মিস্টার ম্যাকয়, আর্তনাদ ছাড়লাম। আমাদের বাঁচান! শুনতে পাবেন কিনা জানি না, কিন্তু চেঁচাতেই লাগলাম।
কিশোর, ডুগি আর আমি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছি। নিস্পন্দ। ছায়ামূর্তিগুলোকে আমাদের দিকে ভেসে আসতে দেখলাম। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। মুখ দেখতে পাচ্ছি-ফ্যাকাসে, চোখ নেই। ওরা সব ওপারের জীব!
মুসা, আমাকে এখান থেকে বের করো! গর্তের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
হ্যাং অন পাল্টা চেঁচালাম। হাল ছেড়ো না!
এসময় রক্ত হিম করা এক গোঙানির শব্দ কানে এল। পরক্ষণে ওদের ফ্যাকাসে, চোখহীন মুখগুলোকে কাছিয়ে আসতে দেখলাম। হাঁ করা মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
আআহহহহ, চোয়াল ঝুলিয়ে গুঙিয়ে উঠল ওরা। বীভৎস দৃশ্য। টিভি শো হলে সুইচ অফ করে দিতাম।
আআহহহহ!
চোখ ঢেকে আর্তনাদ ছাড়লাম আমরা।
হল ধারাল নখ বাগিয়ে আমাদের দিকে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে কুৎসিত মূর্তিগুলো। ওদের ফ্যাকাসে, হাড্ডিসার মুখের চেহারা কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি। টলতে টলতে আরও খানিকটা এগিয়ে এল। চোখের কোটর থেকেও পচা গন্ধ বেরোচ্ছে নরকের জীবগুলোর। মি. ম্যাকয় আর মিশেলকে দেখলে ভয় করে না, অথচ এরা যে কী ভয়ঙ্কর বলে বোঝানো যাবে না!
প্রেতাত্মাগুলো এগিয়ে আসছে, চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা পরস্পরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। এবার হঠাই পিছন থেকে চেনা এক কণ্ঠ কানে এল।
তোমরা এক পাশে সরে যাও, বাছারা, মি. ম্যাকয় বললেন। ভাগ্যিস উনি আমার ডাক শুনতে পেয়েছেন। ওরা চটপটে না। এসো আমার সাথে।
না! চেঁচিয়ে উঠল ডুগি। আপনার সাথে কেন যাব? আপনি কে না কে।
উনি আমার পরিচিত, ডুগি, বলে ওর বাহু ধরে টানলাম। বন্ধু মানুষ।
আমাদেরকে ধরতে যাবে এসময় আমরা ছায়ামূর্তিগুলোর হাত এড়ালাম। সামনে হাত বাড়িয়ে, গোঙাতে গোঙাতে চলে গেল ওরা, মুখ-চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়।
ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওরা এত কুৎসিত কেন? মি. ম্যাকয়কে প্রশ্ন করলাম।
এরা স্রেফ ঘুরে বেড়ায়। বেঁচে থাকতে এরা চোর-ডাকাত জলদস্যু ছিল। তাই এখানে এসে শান্তি পায়নি। অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অন্যদেরকেও দলে টানতে চায়। কাজেই ওদেরকে দেখলে পথ ছেড়ে দৌড়ে সরে দাঁড়াবে।
শিউরে উঠলাম। কুৎসিত জীবগুলো যখন আমাদেরকে ধরতে আসছিল তখন ফ্ল্যাশলাইট হারিয়ে ফেলেছি কিশোর আর আমি।
এসো, তোমাদের বন্ধুকে সাহায্য করতে হবে, মি. ম্যাকয় বললেন।
আমাদের বন্ধু একটা কবরে পড়ে গেছে। ওকে বের করে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই, মি. ম্যাকয়কে বললাম।
তা হলে দেরি করা যাবে না, গম্ভীর দেখাল মি. ম্যাকয়কে।
পেট মুচড়ে উঠল।
কেন?
দরজাগুলো শীঘ্রিই বন্ধ হয়ে যাবে, কেন বলতে পারব না। তোমরা যদি আজ রাতে ফিরে যেতে না পারো তবে আমাদের সাথে, থেকে যেতে হবে। চিরদিনের জন্যে।
দশ
এবার আসল কথা জানা গেল! ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। মি. ম্যাকয় কখনোই বলেননি দরজাগুলো বন্ধ হওয়ার কথা…বলেননি আমরা চিরজীবনের জন্য আটকা পড়তে পারি ওপারের ভুবনে!
একথা আগে বলেননি কেন? পা চালিয়ে তাঁর নাগাল ধরে প্রশ্ন করলাম আমি।
তোমরা ভয় পাবে বলে, বললেন মি. ম্যাকয়। এক জগৎ থেকে অন্য জগতে চলাচলের সময় মনটাকে স্বচ্ছ রাখতে হয়।
কিশোর! মুসা! জলদি এসো! এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা! রবিনের চিৎকার।
মি. ম্যাকয় অদৃশ্য হয়ে গেলেন মুহূর্তের মত, তারপর ফিরে এলেন একটা মই নিয়ে। খাইছে, ঠিক একজন জীবিত মানুষের মত লাগছে এখন তাঁকে।
এই যে, মই নামিয়ে রবিনের উদ্দেশে বললেন, এটা দিয়ে উঠে এসো, বাছা!
মই বেয়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে এল রবিন। ও পুরোটা উঠতে পারার আগেই কিশোর, ডুগি আর আমি মিলে টেনে তুললাম ওকে।
জলদি করো! হাতে সময় নেই! দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে! তাগাদা দিয়ে বললাম।
কী বললে? রবিন কিছুই বুঝতে পারছে না।
চলে এসো! বললাম।
তাড়াহুড়ো করতে হবে, তারপরও পৌঁছতে পারব কিনা জানি না। দরজাগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। নতুন দরজা প্রতিনিয়ত খুলছে আর পুরানোগুলো বুজে যাচ্ছে। বাবা-মার জন্য ভয় পাচ্ছি। তারা হয়তো কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেদেরকে আবিষ্কার করবে সপ্তদশ শতাব্দীতে।
মিস্টার ম্যাকয়, সবচেয়ে কাছের দরজাটা কোথায়? আমরা রেডি! চেঁচিয়ে বললাম।
পরমুহূর্তে আমার পাশে উদয় হলেন তিনি।
এদিকে, ইঙ্গিত করে অনুসরণ করতে বললেন। গোরস্থানের মাঝামাঝি পৌঁছে হাত উপরে-নীচে নাড়তে লাগলেন। আমার ধারণা এটা তোমার বেডরুম।
রবিন আতঙ্কিত।
যদি না হয়? বলল। মি. ম্যাকয়কে অনুসরণ করতে রাজি নয় ও।
আমাদের এখন যেতে হবে, তাড়া দিলাম। জলদি করো!
হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে মি. ম্যাকয়, আমরা অনুগমন করব বলে অপেক্ষা করছেন।
এসো, হাতে সময় কম, বললেন তিনি।
রবিন দ্বিধা না করলে এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যেতাম আমরা। ওকে অনুরোধ-উপরোধ করছি, কিন্তু বান্দা নড়বে না। বিরাট ভুল। দু সেকেণ্ডের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস আর পচা দুর্গন্ধ অনুভব করলাম আমরা।
ওই দেখো, ওরা আমাদের দিকেই আসছে, চেঁচিয়ে উঠল ডুগি।
লাথি মেরে কবরস্থানের মাটি ছিটিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
দুর্গন্ধময় প্রেতাত্মারা। আমরা সরে যাওয়ার আগেই আমাদের গায়ের উপর এসে পড়ল। আমাদেরকে ফেলে দিল মাটিতে। চারদিক অন্ধকার। দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। আমি এখন বলতে গেলে অদৃশ্য। এতটাই স্বচ্ছ, মিলিয়ে গেছি প্রায়!
আর দেরি কোরো না। এখানে থাকলে আমরাও ভূত হয়ে যাব! চিৎকার ছাড়লাম বন্ধুদের উদ্দেশে।
ডুগির হাত আর রবিনের বাহু চেপে ধরলাম। ওদেরকে যে ধরেছি টেরই পেলাম না প্রায়। ওরাও অদৃশ্য মত হয়ে গেছে। কিন্তু কিশোর কোথায়? হঠাৎ ওর চাপা গোঙানি কানে এল।
বাঁচাও! ভূতগুলো আমাকে ধরে ফেলেছে! নড়তে পারছি না আমি!
এগারো
আমরা আর বাড়ি ফিরে যেতে পারব না, হাহাকার করে উঠল রবিন। ডুগি নিপ। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ।
তোমরা এখান থেকে নোডড়া না, ওদেরকে বললাম। কিশোরকে উদ্ধার করতে হবে। ওকে আমিই টেনে এনেছি এসবের মধ্যে।
প্রেতাত্মাদের হাত থেকে ওকে বাঁচাব কীভাবে জানি না, কিন্তু যা করার দ্রুত করতে হবে এটা জানি। দরজার কাছে মি. ম্যাকয় আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন?
রবিন বেয়ে উঠেছিল সেই মইটা আঁকড়ে ধরলাম। ভূতের দল মেঘের মত ভেসে চলে যাচ্ছে। কিশোর ওদের আলখিল্লা কিংবা অন্য কোন কিছুর আড়াল থেকে সাহায্যের জন্য চেঁচাচ্ছে। ওর গলা পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।
মইটা হিঁচড়ে ওদের পিছনে দৌড়ে গেলাম। নাগাল পেয়ে মইটা তুলে প্রেতেদের উপর নামিয়ে আনলাম। জিনিসটা ভারী হলেও আমি সর্বশক্তিতে আঘাত করেছি।
ভূতের দলকে ভেদ করে চলে গেল মইটা। ওরা যেন দুর্গন্ধময় মাকড়সার ঝুলের কালো এক মেঘ। কিন্তু এতে কাজ হলো! বিচ্ছিন্ন কুয়াশার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল ওরা। মইটা আবারও তুলে ধরলাম। আবারও কুয়াশার মত ছড়িয়ে গেল ভূতগুলো। এবার মাটিতে বসে থাকতে দেখলাম কিশোরকে। দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। প্রকাণ্ড এক বুদ্বুদের মতন স্বচ্ছ দেখাচ্ছে ওকে। ভূতগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে দেখার জন্য দাঁড়ালাম না।
দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।
উঠে পড়ো! তুমি এখন ফ্রী! এসো! বাহু ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ওজনহীন মনে হলো ওকে।
এবার রবিন আর ডুগির কাছে দৌড়ে গেলাম।
জলদি করো! মি. ম্যাকয়ের ডাক কানে এল। কোন ভূতকে দেখে আগে কখনও এতটা স্বস্তি পাইনি। পরস্পরকে চেপে ধরে যথাসম্ভব দ্রুত টলতে টলতে তাঁর কাছে পৌঁছলাম।
এটাই কি দরজা? প্রশ্ন করলাম।
ঢুকে পড়ো, বাছা। দেরি কোরো না। ঢুকে পড়ো! ঢুকলেই বুঝতে পারবে কোথায় রয়েছে।
জন!
খাইছে! কণ্ঠটা চিনতে পারলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম ধীরে ধীরে।
মিশেল! ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা! মিশেল, ওর হেডস্টোন আর আমার ভূতশিকারি মা ছিল বলেই এই ভূতের রাজ্যে আটকা পড়েছি আমরা।
লম্বা ড্রেস পরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটি, মুখের চেহারা বিষণ্ণ।
জন! আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! প্লিজ! কেঁদে উঠল। ওর চোখজোড়া ছায়াময়, গভীর আর অতলস্পর্শী। ওর এখনও ধারণা আমি জন-ওর ভাই। ভাবনাটা ঘাবড়ে দিল আমাকে। ও ছোট হলে কী হবে ওকেও ভয় পাই আমি।
মিস্টার ম্যাকয়! অনুনয় করলাম। ওকে নিয়ে কী করব? আমি এখানে ওর সাথে থাকতে পারব না, আবার সাথে করে নিয়েও যেতে পারব না!
তুমি তোমার মত চলে যাও, মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি। আমরা মিশেলকে বাড়ি পৌঁছে দেব। তোমার মার কাজের ফলে মিশেলের মাকে খুঁজে বের করা গেছে। এখন এসো! হয়।
অদৃশ্য ফোকরের ভেতরে অলিম্পিক সাঁতারুদের মত করে ডাইভ দিলাম আমরা। জীবন-মৃত্যুর মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে আমাদের। এমনকী রবিনও এবার আর ইতস্তত করল না।
.
ডুগি মাথা ডলছে।
মুসা, ক্লজিটে এত জিনিস ঠুসেছ কেন? তোমার স্কেটে লেগে মাথায় ব্যথা পেয়েছি। বলল।
গুণে ফেললাম ঝটপট। চার! সবাই ঠিকঠাক মত ফিরতে পেরেছি।
এতক্ষণ এসব কী ঘটল বলো তো? কিশোর বলল।
এ নিয়ে কালকে কথা বলা যাবে, বলল রবিন।
বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম আমরা। বুজে এল চোখ।
.
বাসার কাউকে কিছু বলিনি আমরা। বললে বিশ্বাস করবে না, অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? আসলে কেউই বুঝবে না এবং বিশ্বাসও করবে না। ওখানে নিজেরা গেলে বিশ্বাস করত।
তা তোমাদের ভাগ্য ভাল, তোমরা অমন বিপদে পড়নি। যারা পড়েছে। তাদের পরামর্শটা নাও। মাঝরাতে যদি তোমার ক্লজিট থেকে দুপ-দাপ শব্দ আসে তা হলে স্রেফ উপেক্ষা করবে।
আমারও তা-ই করা উচিত ছিল।