উপত্যকার মাঝামাঝি জায়গায় পাফিনের ছবি তুলছিল রবিন, বাকিরা ওকে পরামর্শ দিয়ে ছবির মান উন্নয়নের চেষ্টা করছিল, মাঝে মাঝে পোজ দিচ্ছিল পাখির পাশে বসে; এমনি সময়ে দেখা গেল একটা প্লেন আসছে সোজা এই দ্বীপের দিকে।
সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়লেন ডিক কার্টার। মাথার উপর তিনটে চক্কর দিয়ে চলে গেল প্লেন।
তাঁবুটা মনে হয় দেখতে পায়নি, বলে উঠে বসলেন ডিক।
দেখে থাকলেও আমাদের করার কিছু নেই, বলল কিশোর।
এত থাকতে এই দ্বীপটাই পরীক্ষা করতে এল কেন? প্রশ্ন তুলল মুসা।
বোটটা, বলল রবিন। ওটা দেখা যাচ্ছে বহুদূর থেকে।
প্লেন দেখলেই এখন থেকে গা ঢাকা দিতে হবে আমাদের, বললেন। আঙ্কেল। আর ধোয়া উঠতে পারে এমন আগুন জ্বালানো যাবে না। খুঁজতে এসে যখন তিন-তিনবার চক্কর দিল, লক্ষণটা ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।
দিনটা আনন্দেই কাটল, কিন্তু বেলা যতই বাড়ল, ততই বাড়ল গরম; খানিক পরপরই নামল ওরা সাগরে। কিশোরের সঙ্গে সখা-সখিও নামে, খেলে, ডুব দিয়ে মাছ ধরে আনে। বার কয়েক পানির নীচ থেকে উঠে কিশোরের মুখের দিকে চেয়েছে সখা। একবারও কিশোরের মুখে মাছ দেখতে না পেয়ে। হঠাৎ করেই বুঝে ফেলেছে সে, তার বন্ধু ডুব দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাছ ধরতে পারছে না একটাও। পরের বার লম্বা ঠোঁটে করে তিনটে মাছ সাজিয়ে নিয়ে এল সে কিশোরের জন্য, কিশোর না নেওয়া পর্যন্ত ছাড়ল না।
ভালোই হলো, কিশোর, হাসিমুখে বললেন আঙ্কেল, দিচ্ছে যখন নিয়ে নাও। সাপারে ভেজে খাওয়া যাবে।
খাওয়ার ভান করে পকেটে পুরল কিশোর মাছগুলো। যখন সাগর থেকে উঠল তখন ওর হাফপ্যান্টের দুই পকেট ভর্তি ডজনখানেক মাছ। সন্ধ্যায় খাওয়ার সময় লেজ ধরে ঝুলিয়ে একটা ভাজা মাছ সাধল কিশোর পাফিনদের। সখি মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু সখা গপ করে গিলে নিল ভাজা মাছটা। তারপর একটু দূরে গিয়ে বসল। তার মানে, আর খাবে না; ভাজা মাছ একটুও ভালো। লাগেনি তার, বন্ধু সেধেছে বলে অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছে।
আকাশের দিকে চেয়ে চিন্তায় পড়লেন আঙ্কেল। মেঘের গতিবিধি সুবিধের ঠেকছে না। ঝড় বোধহয় এসেই গেল! বললেন তিনি। ভাবছি তবুটা টিকবে তো?
আকাশে মেঘ থাকায় আঁধার ঘনিয়ে এল আজ সন্ধে লাগতেই। খাওয়া সেরেই শুয়ে পড়ল ওরা। খানিক গড়িয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখলেন ডিক কার্টার।
যাই, বললেন তিনি। রোজকার মেসেজ পাঠাতে হবে। ভালো কোন খবরও পেয়ে যেতে পারি। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। আমার আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা লাগবে বড়জোর।
ঘুম জড়ানো গলায় মুসা জিজ্ঞেস করল, আমরা কেউ আসব সাথে?
না-না, কোনও দরকার নেই। আমি এই যাব আর আসব।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন ডিক কার্টার। ডানার নীচ থেকে মাথাটা বের করে ঘাড় কাত করে দেখল কিকো, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল ডানার ভিতর মাথা গুঁজে।
এদিকে মোটর-বোটের ক্যাবিনে বসে অনেক চেষ্টা করেও হেড-অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না ডিক কার্টার। আসন্ন ঝড়ের কারণে রেডিও থেকে কেবল সাই-সুই, খড়খড়-ঘড়ঘড় স্ট্যাটিক শব্দ আসছে। অথচ আজ খুবই জরুরি কিছু কথা আছে তার।
দশ মিনিট বিফল চেষ্টার পর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, এই খোলা জায়গা থেকে মেসেজ পাঠানোও যাবে না, রিসিভও করা যাবে না। প্রথম যেখানে বোট ভিড়িয়েছিলেন সেই গোপন চ্যানেলে যেতে হবে। সেখানে জায়গাটার তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে যোগাযোগ করা খুব সম্ভব সহজ হবে।
ইঞ্জিন চালু করে সাবধানে সরু চ্যানেলের ভিতর ঢুকে পড়লেন ডিক কার্টার। বোটটা শক্ত করে বেঁধেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ট্রান্সমিটারের উপর। রেডিওর নব নাড়াচাড়া করতে করতে একবার তার মনে হলো খোলা সমুদ্রের দিক থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ যেন এগিয়ে আসছে। এদিকে। ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিয়ে কান পাতলেন তিনি। বাতাস বাড়ছে, চোখা পাথরে বেধে শিসের মত শব্দ হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ কানে এল না।
আবার রেডিও অন করে মেসেজ পাঠালেন তিনি। হেড-কোয়ার্টার থেকে জরুরি একটা মেসেজের জন্য ট্রান্সমিটারের সামনে অপেক্ষা করতে বলা হলো। তাকে। ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন ডিক কার্টার, সেই সঙ্গে নবগুলো সামান্য নেড়েচেড়ে ফাইন টিউন করবার চেষ্টা করছেন। এমনি সময়ে ডেকে পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ তুললেন। ধরেই নিয়েছেন, তার দেরি দেখে ছেলেদের কেউ উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে।
মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও স্থির হয়ে গেলেন ডিক কার্টার। ক্যাবিনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেদের কেউ নয়, নাকের হাড় ভাঙা, কঠোর চেহারার এক দীর্ঘদেহী, কুৎসিতদর্শন লোক। আঙ্কেলকে দেখেই চমকে উঠল লোকটা, আঙ্কেলও চমকে গেছেন ওকে দেখে।
আরে! আপনি! বলে উঠল লোকটা। আপনি কী করছেন এখানে? কতটা জেনে ফেলেছেন…
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝপ দিলেন ডিক কার্টার। কিন্তু প্রস্তুত ছিল লম্বা লোকটা। সাঁই করে চালাল হাতের মোটা লাঠি। খটাশ শব্দে ছেলা চাদিতে পড়ল বাড়িটা। কাটা কলাগাছের মত মেঝেতে পড়লেন ডিক, তার আগেই জ্ঞান হারিয়েছেন।
পকেট থেকে একটা হুইসেল বের করে বাজাল কুৎসিতদর্শন লোকটা। প্রায় একই চেহারার গাট্টাগোট্টা আরেকজন এসে মাথা গলাল ক্যাবিনের দরজা দিয়ে।
দেখেছ কে? লাঠি দিয়ে ঠেলে ডিককে চিৎ করল প্রথম লোকটা। এখানে এই লোক! তাজ্জব কারবার না? তোমার কি মনে হয় কিছু সন্দেহ করেছে?