তিনজনের অবিকল এক রকম কল্পনা?
পকেট থেকে হেডব্যান্ডটা টেনে বের করল মুসা। তা ছাড়া এটা কি? কল্পিত জিনিস কি বাস্তবে আসতে পারে?
দেখতে তো জিনিসটা নতুনই লাগছে, টম বলল। কয়েক বছরের বেশি ব্যবহার করেনি।
হ্যাঁ, তাই, মাথা ঝাঁকাল মুসা। ভেতরের দিকটায় অ্যাপাচি ইনডিয়ানদের কিছু শব্দ লেখা রয়েছে। একজন ইনডিয়ান বন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম অনুবাদ করানোর জন্যে। তাতে যার নামটা লেখা রয়েছে তিনি একজন ইনডিয়ান সর্দার। ফ্লেমিং রকে খুন করা হয়েছিল তাঁকে এপ্রিলের চার তারিখে, আঠারোশো বায়ার সালে। মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ খনিশ্রমিকেরা।
মুসার হাত থেকে হেডব্যান্ডটা নিয়ে দেখতে লাগল টম। ভেতরের লেখাটা দেখে বলল, যদূর জানি, ইনডিয়ানরা লেখার জন্যে এ ধরনের কালি ব্যবহার করে না। তারমানে বোকা বানানো হয়েছে তোমাদের।
উঁহু, মাথা নাড়ল রবিন। বোকা বানানো হয়নি। ইনডিয়ানরা সাদা মানুষের কালি ব্যবহার করত সেখানে। সাদা মানুষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর। তারপরেও সন্দেহ নিরসনের জন্যে সব রকম পরীক্ষা আমরা চালিয়েছি। একজন কেমিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্যান্ড। কালি পরীক্ষা করে তিনি জানিয়েছেন, দেখতে নতুনের মত লাগলেও এ ধরনের কালি উৎপাদন আঠারোশো আশি সালের পরে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
জবাব হারাল টম। কিশোরের দিকে তাকাল। যে দুটো লোক তোমাদের আগে ফ্লেমিং রকে গিয়েছিল, তাদের কি হয়েছে কোন খোঁজ পেয়েছ?
নাহ। ওরা স্রেফ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কোন সূত্র রেখে যায়নি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল টম। উঠে রওনা হলো টেলিফোনের দিকে।
কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
চেনাজানা সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দিতে, জবাব দিল টম, যাতে সর্বক্ষণ নজর রাখে তোমাদের ওপর। আমরা যারা ফ্লেমিং রকে যাইনি তাদের কাউকে সঙ্গে না নিয়ে কিছুদিন বেরোতে পারবে না তোমরা। বলা যায় না, কখন গায়েব হয়ে যাও।
.
কাকতাড়ুয়া
ইঞ্জিনে বোধহয় কোন সমস্যা হয়েছে, মুসা, বিরক্তকণ্ঠে বলল কিশোর পাশা।
পিকনিক করতে পাহাড়ে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা। সারাদিন ওখানেই ছিল। এখন বাড়ি ফিরছে। সাঁঝ ঘনিয়েছে। আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ। রাস্তার পাশের যব খেত ঝলমল করছে চাঁদের আলোয়। মনের আনন্দে গাড়ি চালাচ্ছিল মুসা, হঠাৎ ইঞ্জিনে গোলমাল। থেমে গেছে গাড়ি।
গ্যাস পেডালে চাপ দিল মুসা। ইঞ্জিনে কোন সাড়া নেই।
হতাশ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল সে। মাঝ রাস্তায় এমন ঝামেলার কোন মানে হয়। একশো মাইলের মধ্যে কোন মানুষজন আছে বলে তো মনে হয় না।
হঠাৎ বিদঘুটে আওয়াজ করে উঠল ইঞ্জিন। তারপর চুপ। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। স্পোর্টস সেডানটাকে ঠেলতে ঠেলতে রাস্তার ধারে একটা খাদের কাছে নিয়ে এল। টর্চ লাইট দিয়ে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে দেখল। স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল আরেকবার। লাভ হলো না।
বৃথা চেষ্টা। হাল ছেড়ে দিল কিশোর। গ্যারেজে নিয়ে যেতে হবে।
ঠেলে তো আর নিতে পারব না, মুসা বলল। রশি বেঁধে টেনে নিতে হবে। কিন্তু এখানে গ্যারেজ কই?
চারদিকে চোখ বোলাল রবিন। উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ভাগ্যটা ভালই বলতে হবে, কিশোর। ওই দেখো, মাঠে একজন লোক। চাষা-টাষা হবে হয়তো। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে, গ্যারেজ কোথায় আছে। গাড়িটাকে টেনে নেয়ার ব্যবস্থাও হয়তো করতে পারবে।
হাত দিয়ে যব খেত দেখাল মুসা।
মাঠের মাঝখানে লম্বা একটা আকৃতি দেখতে পেল কিশোর। দাঁড়িয়ে আছে। মানুষই মনে হচ্ছে। দূর থেকে ভাল বোঝা যাচ্ছে না।
চলো, লোকটার কাছে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা।
পরামর্শটা মনে ধরল কিশোরের। রাস্তা পার হয়ে মাঠে নেমে পড়ল তিনজনে। এখানে ওখানে খোঁড়া গর্ত। চাষ করা জমিন। মাঠের মাঝখানে চলে এল ওরা। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।
ঠিক এই সময় কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে লাগল চাঁদ। তবে লোকটাকে দেখতে অসুবিধে হলো না কারও। চেহারা দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেল ওদের।
লোকটার মাথায় বালতির মত উঁচু হ্যাট, গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া কালো কোট প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো। কালো চোখে কটমট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। লম্বা, বাঁকানো নাক, মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। লম্বা হাত সোজা সামনে ধরে রেখেছে। বাঁকা আঙুল। যেন শিকারী পাখির নখওয়ালা থাবা।
গা ছমছম করে উঠল মুসার। কিশোরের মনে হলো শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা পানির স্রোত নামছে। রবিনেরও কেমন যেন লাগতে লাগল। নিজেদের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল ওরা।
চাঁদকে গ্রাস করে ফেলেছে প্রকাণ্ড কালো মেঘটা। অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। চোখ কুঁচকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছে।
অদ্ভুত লোক, বিড়বিড় করল মুসা। বাজি ধরে বলতে পারি ব্যাটা কোন ভূতুড়ে বাড়িতে থাকে।
আশপাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, ফিসফিস করল কিশোর। অদ্ভুত মনে হলেও ওর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।
পা বাড়াল কিশোর। তার সঙ্গে রবিন।
মুসা লোকটার কাছে গিয়ে বলল, এই যে ভাই, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। ওটাকে গ্যারেজে নিয়ে যাবার জন্যে সাহায্য দরকার।
কোন জবাব নেই। বাতাস শব্দ তুলে বয়ে গেল যব খেতের ওপর দিয়ে। বুক ঢিবঢিব করছে ওদের। ভয় লাগছে।