- বইয়ের নামঃ প্রেতের অভিশাপ
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
প্রেতের অভিশাপ
লস অ্যাঞ্জেলেসের সীমানা প্রায় ছাড়িয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা।
জানো কোথায় এলাম? গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ বলে উঠল মুসা।
তন্ময় হয়ে প্রকৃতি দেখছিল তার পাশে বসা কিশোর পাশা। ফিরে তাকাল। ফ্লেমিং রক?
মুসার কথায় পেছনে বসা রবিনও কৌতূহলী হয়ে উঠল। পিঠ খাড়া করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কেন, ভুলে গেছ, পত্রিকায় সেদিন যে আর্টিক্যালটা পড়েছিলাম সেটার কথা? সেই যে, সেই শহরটার কথা, অদ্ভুত ভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল যেখানকার সমস্ত মানুষ।
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। একটা রূপার খনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শহরটা। পর্বতের গভীরে। সবচেয়ে কাছের লোকালয়টাও যেখান থেকে দুশো মাইল দূরে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। সিবিল ওঅয়েরর সময় আবিষ্কৃত হয় খনিটা। আর খনিটাকে ঘিরে শহরের সুদিন ছিল আঠারোশো তেষট্টি থেকে আঠারোশো পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত। তারপর রাতারাতিই একদিন গায়েব হয়ে গেল শহরের সব লোক।
আর বলতে হবে না, কিশোর বলল। সবটাই এখন মনে পড়েছে। খবরটা দিয়েছিল এসে একজন স্বর্ণসন্ধানী। ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর পরিশ্রমে আধপাগল হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এসে ঢুকেছিল টাকসন শহরে। ফ্লেমিং রকের পাশ দিয়ে নাকি এসেছিল সে। জানিয়েছিল, শহরটার সমস্ত লোক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
আর নিরুদ্দেশটাও স্বাভাবিক উপায়ে হয়নি, কিশোরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল রবিন। গোছগাছ করে চলে যাওয়া যাকে বলে তা নয়। বাড়িঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে গেছে। আসবাব, কাপড়-চোপড় যেখানে যা ছিল, সব রয়েছে। স্বর্ণসন্ধানী লোকটা যখন শহরে ঢুকেছিল, খাবারের পাত্রও তখন স্টোভে চাপানো। গরম। যেখানে যা থাকার কথা সব কিছুই ছিল, ছিল না কেবল মানুষ।
লোকটার কথায় কান দিল না কেউ, রবিনের মুখ থেকে আবার কথা কেড়ে নিল কিশোর। ভাবল, অতিরিক্ত রোদ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর একাকিত্ব লোকটার মাথার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। পাগল হয়ে গিয়েছিল সে।
একজন রিপোর্টার তো গিয়েছিল ফ্লেমিং রকে খোঁজ নিতে, মুসা বলল, তাই না?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। কয়েকজন অভিযাত্রীকে সঙ্গে দিয়ে নিজের ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন একজন খবরের কাগজের সম্পাদক। বেরোনোর জন্যে উপযুক্ত সময় ছিল না সেটা। শীত আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। ফলে তুষারপাতের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল ওরা। বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বসন্তকালে আবার চালাল অভিযান। কিন্তু শহরবাসীদের খুঁজে পাওয়া তো পরের কথা, শহরটাই খুঁজে বের করতে পারেনি ওরা।
দুনিয়ার বুক থেকে স্রেফ উধাও হয়ে গেল পুরো একটা শহর ভর্তি লোক। মুসা বলল। আশ্চর্য!
এখন অবশ্য লোকে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিতে আরম্ভ করেছে, কিশোর বলল। একেকজন একেক কথা বলছে। ইনডিয়ানদের যারা দেখতে পারে না, তাদের বক্তব্য, খুনে ইনডিয়ানরা এসে চড়াও হয়েছিল শহরবাসীর ওপর। মেরেকেটে সাফ করে দিয়ে গেছে ওদের। এটা মেনে নেয়া যায় না। তার কারণ ওই এলাকার আশেপাশে যত ইনডিয়ান বসতি আছে বা ছিল, তাদের কেউই তেমন শত্রু ছিল না শেতাঙ্গদের, ঘৃণা করত না। তা ছাড়া এতবড় একটা ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালানোর পর সেটা গোপন করে ফেলা সম্ভব ছিল না কোনমতেই।
কেউ বলে প্লেগ ছড়িয়েছে, রবিন থামতে কিশোর বলল। মড়ক লেগে সাফ হয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। দুচারজন অধিবাসী অবশিষ্ট যা ছিল তারা মড়ক ছড়ানোর ভয়ে লাশগুলোকে কবর দিয়ে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু এ রকম কিছু ঘটলে কোন না কোনভাবে সেটা বাইরের জগতে চলে আসতই, রবিন বলল। এমন একটা খবর চাপা থাকতে পারে না। কিন্তু কারও মুখে কখনও এ ধরনের কোন খবর শোনা যায়নি। আবার কেউ কেউ বলছে আরও অদ্ভুত কথা। সরকার নাকি ওখানে গোপন কোনও গবেষণা চালানোর জন্যে লোকগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে অন্য জায়গায়। সেটাও চাপ থাকার কথা নয়। কি গবেষণা, কোথায় সরানো হলো, কিছুই জানা যায়নি কোনদিন।
হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। পুরো ঘটনাটাই রহস্যাবৃত থেকে গেল এ শতকের গোড়া পর্যন্ত। তারপর আবার নতুন করে শুরু হলো ফ্লেমিং রক নিয়ে আলোচনা। ঘটনাচক্রে দুজন লোক গিয়ে ঢুকে পড়ল ওই শহরে। পরস্পরকে চিনত না ওরা। বিভিন্ন সময়ে শহরে ঢুকেছিল দুজনে। ফিরে এসে অবিকল এক গল্প বলেছে। দুজনেই শহরটা দেখেছে রাতের বেলা। প্রথমে ওদের চোখে পড়ে একটা আলো, অনেক ওপর থেকে ঝুলছে। আলো দেখে দেখে কাছে গিয়ে দেখে ফ্লেমিং রক হোটেলের টাওয়ারে ঝুলছে একটা লণ্ঠন…
থাক থাক, আর বলার দরকার নেই। বাধা দিল মুসা। বলেই করলাম ভুল। এ সব ভূতুড়ে কান্ডকারখানা…
মুসার কথা কানে তুলল না কিশোর। তাকে এখন কথার নেশায় পেয়েছে। পেছন ফিরে রবিনের দিকে তাকাল। আর্টিক্যালে কি লিখেছে, মনে আছে না? ওই লোকগুলো ঘরে ঢুকে দেখে এক আজব দৃশ্য। স্বর্ণসন্ধানী লোকটা যা যা বলেছিল, অবিকল এক রকম কাণ্ড। স্টোভে হাঁড়ি চাপানো, খাবার রান্না হচ্ছে। বাড়িঘরের নমুনা দেখে মনে হচ্ছিল মাত্র কয়েক মিনিট আগে বাসিন্দারা জায়গা ছেড়ে গেছে। সবই আছে, নেই কেবল কোন জীবন্ত প্রাণী। মানুষ তো নেইই, একটা কুকুর কিংবা মরুভূমির একআধটা কাঁকড়াবিছেও চোখে পড়ল না তাদের। পুরোপুরি একটা মৃত শহর।