- বইয়ের নামঃ দি আউটসাইডার
- লেখকের নামঃ আলবেয়ার কাম্যু
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
দি আউটসাইডার
১. প্রথম পর্ব – মা মারা গেলেন আজ
দি আউটসাইডার – আলবেয়ার কাম্যু
অনুবাদ মুনতাসীর মামুন
মুখবন্ধ
আলবেয়ার কাম্যু জন্মগ্রহণ করেছিলেন আলজিরিয়ায়, ১৯১৩ সনে। কৈশোর যৌবনের কিছুটা কেটেছিল তাঁর উত্তর আফ্রিকায় এবং প্যারিসে পা দেয়ার আগে জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উপায়। এর মধ্যে একটি ছিল আলজিয়ার্স ফুটবল দলের গোলরক্ষক।
প্যারিসে এসে বৃত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি সাংবাদিকতাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ফ্রান্স অধিকার করলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে। ঐ সময় তিনি বের করেছিলেন প্রতিরোধযুদ্ধের একটি মুখপত্র ‘কমব্যাট’। ইতিমধ্যে যুদ্ধের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গ্রন্থ, একটি নাটক ‘ক্যালিগুলা’ (১৯৩৯)। যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি গ্রন্থ ‘দি আউটসাইডার’ এবং ‘মিথ অফ সিসিফাস’। এর মধ্যে প্রথমোক্তটি তাঁকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
পরবর্তীকালে কাম্যু রাজনীতি ও সাংবাদিকতা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ সময়ের জন্যে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যে নতুন বাস্তবতা ও নতুন দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে জাঁ পল সার্ত্রর সঙ্গে তাঁর নামও উচ্চারিত হত। সাহিত্যের জন্যে ১৯৫৭ সনে কাম্যু লাভ করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। কাম্যু পরলোকগমন করেছিলেন ১৯৬০ সনের জানুয়ারি মাসে, এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়।
‘দি আউটসাইডার’-এর নায়ক মারসো। আলজিয়ার্সে সে সামান্য এক চাকুরি করে। ফরাসি আলজিরীয় মধ্যবিত্ত অবিবাহিত যুবক হিসেবে তার দিন কেটে যায় নিরানন্দ ফ্ল্যাটে, সপ্তাহান্তে মেয়েবন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু সমাজের চোখে সে দোষী, কারণ সমাজ মনে করে তার মধ্যে অভাব আছে মৌল আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার। দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে সে পর্যবেক্ষণ করে জীবন, যৌনতা, মৃত্যু। তারপর ঘটনাচক্রে সে খুন করে, সোপর্দ করা হয় তাকে আদালতে। আদালতের বিচার ও অন্তিমে মুত্যুদণ্ডের রায় পর্যবেক্ষণ করে সে নিরাসক্তভাবে। এ-সম্পর্কে সিরিল কনোলি লিখেছিলেন, ‘সে (মারসো) একটি নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক শক্তি, যে তুলে ধরে বুর্জোয়া এথিকসের অবাস্তবতা।’
মূল বইটি লেখা হয়েছিল ফরাসিতে, নাম ‘ল্য এত্রানজার’। ১৯৪৬ সনে স্টুয়ার্ট গিলবার্ট ‘দি আউটসাইডার’ নামে তা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। বর্তমান অনুবাদক উপরোক্ত ইংরেজি অনুবাদ (পেঙ্গুইন ১৯৬১) ব্যবহার করেছেন। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ইংরেজি অনুবাদের রীতিটি অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে, তবে সবক্ষেত্রে যে সে-প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘দি আউটসাইডার’ নামটিই ব্যবহৃত হল কারণ এ-নামেই গ্রন্থটি সমধিক পরিচিত।
অনুবাদ ও প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে সাহায্য করেছেন সর্বজনাব বশীর আলহেলাল, আবুল হাসানাত ও মুহম্মদ নুরুল হুদা। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মুনতাসীর মামুন
ঢাকা, ১৯৭৩
.
প্রথম পর্ব
১.
মা মারা গেলেন আজ। হয়তোবা গতকাল; আমি ঠিক জানি না। আশ্রম থেকে টেলিগ্রাম এসেছে : তোমার মা মারা গেছেন। আগামীকাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। গভীর সমবেদনা। সুতরাং ব্যাপারটা ঘোলাটে; হয়তো তিনি মারা গেছেন গতকাল।
বৃদ্ধদের জন্যে আশ্রমটি আলজিয়ার্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে, মারেনগোতে। যদি দুপুরের বাস ধরি তবে হয়তো রাত হবার আগেই সেখানে পৌঁছে যাব। তা হলে শবদেহের পাশে প্রথামতো পুরো রাতটা জেগে আগামীকাল বিকেলে আবার। ফিরে আসতে পারব। কর্তাকে বলে দুদিনের ছুটি নিলাম আর স্বাভাবিকভাবে এ অবস্থায় তিনি ‘না’ও করতে পারেন না। তবুও মনে হল তিনি যেন খানিকটা বিরক্ত হয়েছেন এবং আমি কিছু না-ভেবেই তখন তাকে বললাম : ‘দুঃখিত স্যার, কিন্তু আপনি জানেন দোষটা আমার নয়।’
পরে অবশ্য আমার মনে হল, কথাটা না-বললেও চলত। কৈফিয়ত দেয়ার কোনো কারণই আমার থাকতে পারে না; বরং তারই উচিত ছিল আমাকে সমবেদনা ইত্যাদি জানানো। বোধহয় পরশু তিনি তা আমাকে জানাবেন যখন দেখবেন আমি কালো। পোশাক পরে অফিসে এসেছি। কিন্তু এখন প্রায় মনে হচ্ছে মা যেন মরেননি। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, এই মারা যাওয়াটা সবার কাছে পরিষ্কার করবে।
দুটোর বাস ধরলাম। দুপুরটি ছিল গনগনে। রোজকার মতো, দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম সেলাস্তির রেস্তোরাঁয়। সবাই দুঃখ প্রকাশ করল এবং সেলাস্তি বলল, ‘মার মতো পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।’ বিদায় নেওয়ার সময় সবাই আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। রওনা দেওয়ার তাড়াহুড়োয়, শেষমুহূর্তে ইমানুয়েলের বাসায় যেতে হল কালো টাই আর শোকের কালো ফিতে ধার নেওয়ার জন্যে। মাত্র মাসখানেক আগে তার চাচা মারা গেছেন।
ছুটতে হয়েছিল বাস ধরার জন্যে। মনে হয়, অমনভাবে তাড়াহুড়ো করার জন্যে, এবং রাস্তা ও আকাশ থেকে ছিটকে-আসা আলোক-ঝলক, পেট্রোলের গন্ধ, বাসের ঝাঁকি সব মিলে আমাকে করে তুলেছিল তন্দ্রালস। যাহোক, প্রায় পুরোটা পথ ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি পাশে এক সৈনিকের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। হেসে সে জিজ্ঞেস করল, আমি বহুদূর থেকে আসছি কি না। কথা কমাবার জন্যে খালি মাথা নাড়লাম। কথা বলার ইচ্ছে তখন আমার ছিল না।
আশ্রমটি গ্রাম থেকে মাইলখানেকের কিছু বেশি দূরে। হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। পৌঁছেই ঠিক তখন-তখনই আমি মাকে দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু দারোয়ান জানাল, প্রথমে আমাকে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওয়ার্ডেন তখন ব্যস্ত, সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে খানিকটা। দারোয়ান এ সময়টুকু আমার সঙ্গে কথা বলে কাটাল, তারপর নিয়ে গেল অফিসে। ওয়ার্ডেন মানুষটি ছোটখাটো, মাথার চুল ধূসর আর বাটন-হোলে লাগানো লিজিয়ন অফ অনারের গোলাপ। তিনি তাঁর টলটলে নীল চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আমরা হাত মেলালাম এবং এত দীর্ঘক্ষণ তিনি। আমার হাত ধরে রাখলেন যে রীতিমতো অস্বস্তি লাগছিল। তারপর এক অফিস রেজিস্টার বের করে আমার সামনে রেখে বললেন :
‘মাদাম মারসো এ-আশ্রমে ভরতি হয়েছিলেন তিন বছর আগে। তার নিজের কোনো সামর্থ্য ছিল না এবং সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তিনি তোমার ওপর।‘
আমার মনে হল, তিনি বোধহয় আমাকে কোনোকিছুর জন্যে দোষ দিতে চাচ্ছেন, সুতরাং কৈফিয়ত দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু আমাকে তিনি থামিয়ে দিলেন, “তোমায় কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না হে! আমি পুরো কাগজপত্র দেখেছি, তোমার এমন কোনো ভালো অবস্থা ছিল না যে তুমি তোমার মা’র যত্ন নিতে পারো ভালোভাবে। সবসময় দেখাশোনার জন্যে তাঁর একজনের দরকার ছিল। আর তোমরা ছেলে-ছোকরারা যা চাকরি করো তাতে মনে হয় না তো খুব একটা রোজগার করো। যাহোক তোমার মা এখানে বেশ সুখী ছিলেন।
‘জি স্যার, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।’ বললাম আমি। তারপর তিনি যোগ করলেন : ‘এখানে তাঁর ভালো কিছু বন্ধু ছিল, তার মতোই বৃদ্ধ সব। আর বোধহয় জানো, সবাই নিজ নিজ জেনারেশনের লোকদেরই পছন্দ করে বেশি। বয়স তোমার কম সুতরাং তুমি তার খুব ভালো সঙ্গী হতে পারতে না।’
কথাটা আসলে ঠিক। যখন আমরা একসঙ্গে থাকতাম তখন মা সবসময় আমাকে নজরে রাখতেন ঠিকই তবে ক্বচিৎ আমরা কথা বলতাম। আশ্রমে প্রথম কয়েক সপ্তাহ তিনি বেশ কান্নাকাটি করেছিলেন, কারণ আশ্রমে তখনও তিনি অভ্যস্ত হননি। তার একমাস কি দুমাস পর যদি তাকে আশ্রম ত্যাগ করতে বলা হত তা হলে বোধহয় তিনি কাঁদতেন। তাই গত কয়েক বছর আমি তাকে চিৎ দেখতে যেতাম। কিন্তু তাতেও আমার রোববারটা নষ্ট হত বাস ধরার ঝামেলা, টিকিট করা, আসা-যাওয়ার দু-ঘণ্টার কথা নাহয় বাদই দিলাম।
ওয়ার্ডেন কথা বলে চলছিলেন। কিন্তু কান আমার সেদিকে ছিল না। অবশেষে তিনি বললেন, ‘এখন বোধহয় তুমি তোমার মাকে দেখতে চাও?’
কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে তিনি আমায় নিয়ে চললেন। কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় তিনি বললেন :
‘মৃতদেহ আপাতত আমি আমাদের ছোট শবাগারে সরিয়ে রেখেছি–বুঝতেই পারছ যাতে অন্যরা উতলা না হয়। এখানে কেউ মারা গেলে দুএকদিন সবাই বড় উদ্বিগ্ন থাকে, যার অর্থ অবশ্যই আমাদের কর্মচারীদের জন্যে বাড়তি কাজ আর ঝামেলা।’
আমরা একটা উঠোন পেরুলাম যেখানে বেশকিছু বৃদ্ধ ছোট ছোট জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমরা কাছে আসতেই তারা চুপ মেরে গেলেন। তারপর আমাদের পিছে আবার কথা শুরু হল। তাদের কণ্ঠস্বর আমাকে খাঁচায় বন্দি টিয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য তাঁদের গলার স্বর তত তীক্ষ্ণ ছিল না। আমরা গিয়ে থামলাম ছোট এক নিচু বাড়ির সামনে।
‘সুতরাং, তোমাকে আমি এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি সঁসিয়ে মারসো। কোনোকিছুর দরকার হলে বোলো, অফিসে আছি আমি। আগামীকাল সকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে আমরা ঠিক করেছি। সুতরাং পুরো রাতটাই তুমি তোমার মার কফিনের পাশে কাটাতে পারবে এবং তোমার ইচ্ছেও বোধহয় তা-ই। হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার মা’র বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তার ইচ্ছে ছিল তাঁকে যেন চার্চের নিয়ম অনুযায়ী কবর দেয়া হয়। আমি অবশ্য এর বন্দোবস্ত করে রেখেছি। তবুও কথাটা তোমাকে জানানো দরকার মনে করলাম।‘
ধন্যবাদ জানালাম তাঁকে। যদুর জানি, আমার মা জীবদ্দশায় নাস্তিক ছিলেন না, তবে ধর্মের প্রতি মনোযোগ দেননি কখনও।
শবাগারে প্রবেশ করলাম। উঁচু স্কাইলাইট দেয়া, চুনকাম করা, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে এক ঘর। আসবাবপত্রের মধ্যে আছে কয়েকটা চেয়ার আর কাঠের তৈরি কয়েকটা খুঁটি যার ওপর সাময়িকভাবে কিছু রাখা যেতে পারে। এরকম দুটো খুঁটির ওপর কফিনটা রাখা। কফিনের ঢাকনা বসানো কিন্তু আঁটা হয়নি স্ক্র এবং দাগপড়া আখরোট কাঠের ওপর সেগুলির ধাতুর মাথা জেগে আছে। একজন নার্স, বোধহয় কোনো আরব-রমণী, বসেছিল কফিনের পাশে, পরনে তার নীল স্মোক, চুল বাধা এক জমকালো স্কার্ফ দিয়ে।
ঠিক সে-সময় বুড়ো দারোয়ানটা এসে হাজির। বোধহয় দৌড়ে এসেছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত।
‘কফিনের ঢাকনা আমরা বন্ধ করে রেখেছি। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে আপনি এলে যেন ঢাকনা খুলে দিই যাতে আপনি তাকে দেখতে পারেন।’ বলে, যখন সে কফিনের দিকে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে কষ্ট করতে মানা করলাম।
‘অ্যাঁ, কী?’ একটু অবাক হল সে, ‘আপনি চান না যে আমি ….?’
‘না’, বললাম আমি।
স্ক্রু-ড্রাইভারটা পকেটে রেখে সে তাকাল আমার দিকে। বুঝলাম, আমার ‘না’ বলা উচিত হয়নি এবং ব্যাপারটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলল। কিছুক্ষণ আমাকে নিরীক্ষণ করে সে বলল, ‘কেন, না কেন?’ গলার স্বর তার ক্ষুব্ধ নয়, শুধুমাত্র জানতে চাওয়ার জন্যেই এ-প্রশ্ন।
‘দ্যাখো, আমি ঠিক বলতে পারছি না।’ উত্তর দিলাম আমি।
সে তার শাদা গোঁফজোড়া কিছুক্ষণ পাকাল। তারপর শান্তভাবে বলল: ‘আমি বুঝেছি।’
দারোয়ানটি দেখতে মন্দ নয়, চোখ তার নীল আর গালদুটো রক্তিম। আমাকে কফিনের পাশে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে নিজে ঠিক তার পিছে বসল। নার্স উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। যখন সে যাচ্ছিল তখন দারোয়ানটি আমার কানে কানে বলল:
‘আহ বেচারির টিউমার হয়েছে।‘ আমি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলাম নার্সটিকে। তার চোখের নিচ দিয়ে মাথার চারপাশে ব্যান্ডেজ বাধা। কেউ তার মুখের দিকে তাকালে শাদাই দেখবে।
নার্স চলে যেতেই দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। ‘এখন আপনাকে একলা ছেড়ে যাচ্ছি।’
জানি না আমি কোনো ইশারা করেছিলাম কি না কিন্তু দারোয়ান চলে যাওয়ার বদলে থামল। আমার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে এ-অনুভূতিটা মনে জাগতেই অস্বস্তি লাগল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। পুরো ঘরে অস্তগামী সূর্যের নরম আলো। মাথার ওপর স্কাইলাইটের কাছে গুঞ্জন করছিল দুটি ভ্রমর। খুব ঘুম পাচ্ছিল আমার, চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না। পেছন না-ফিরেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম ক’বছর এই আশ্রমে সে চাকরি করছে। ‘পাঁচ বছর।‘ এবং উত্তরটা এমনভাবে এল যে শুনে মনে হল, সে বুঝি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিল।
তারপর সে মুখ খুলল। দশ বছর আগে যদি কেউ তাকে বলত যে, মারেনগোর এই আশ্রমে সে একজন সাধারণ দারোয়ান হয়ে দিন কাটাবে, তা, হলে তখন হয়তো সে তা বিশ্বাস করত না। বয়স তার চৌষট্টি, বলল সে, আর জন্ম প্যারিসে।
সে একথা বলার পর কিছু না-ভেবেই মাঝখানে বলে বসলাম, ‘ওহ্, তা হলে। তুমি এখানকার লোক নও।’
আমার হঠাৎ করে তখন মনে হল, ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় মা’র সম্পর্কে আমাকে সে কিছু বলেছিল। বলেছিল, মাকে একটু তাড়াতাড়ি কবর দিতে, কারণ এ-জায়গায় গরমটা একটু বেশি। ‘প্যারিসে মৃতদেহ তারা তিনদিন পর্যন্ত রেখে দেয়, কোনো কোনো সময় চারদিন।‘ তারপর সে জানাল, জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে তার প্যারিসে, তাই প্যারিসকে সহজে সে ভুলতে পারে না। ‘এখানে সবকিছু তাড়াতাড়ি হয়। কেউ মারা গেলে সে যে মরেছে একথাটা ভাববার অবকাশ না দিয়েই মৃতদেহের সকার হয়ে যায়।‘ ‘অনেক হয়েছে।’ বলল ওর বউ, ‘এসব বাজে কথা এ-ভদ্রলোককে বলা কি তোমার উচিত হচ্ছে?’ সে তখন লজ্জা পেয়ে বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। বললাম, ‘এমন কিছুই হয়নি যার জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে।‘ আসল কথা, তার কথাবার্তা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। কারণ, এসব কথা আগে কখনও আমার মনে হয়নি।
তারপর সে বলল, প্রথমে এই আশ্রমে ঢুকেছিল সে সাধারণ একজন আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু শরীর মন সজীব ছিল তখনও, তাই দারোয়ানের চাকরিটা খালি হলে সে নিজেই তাতে বহাল হতে চেয়েছিল।
বললাম, তা হলেও, অন্যদের মতো সে-ও একজন আশ্রমবাসী। কিন্তু তাতে সে কোনো উত্তর দিল না। সে ‘একজন কর্মচারীর মতো।‘ আগেই খেয়াল করেছিলাম, তার বয়সী বৃদ্ধদের সে ‘তারা’ বা ‘সেইসব বুড়ো’ বলে সম্বোধন করছিল। তবুও তার মনোভাব অনুভব করতে পারছিলাম। দারোয়ান হিসেবে ছিল তার খানিকটা দাপট আর খানিকটা কর্তৃত্ব।
ঠিক সে-সময় নার্স ফিরে এল। সন্ধ্যা নেমে এল যেন খুব তাড়াতাড়ি। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে মনে হচ্ছিল কালো। দারোয়ান বাতি জ্বেলে দিল। বাতির প্রথম আলোয় চোখে ধাঁধা দেখলাম।
সে তখন প্রস্তাব করল খাবার-ঘরে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিতে। কিন্তু আমার খুব-একটা খিদে ছিল না। তখন সে প্রস্তাব করল, আমাকে সে এক কাপ কাফে অ ল্যা খাওয়াতে পারে। পানীয়টি আমার প্রিয়, তাই বললাম, ‘ধন্যবাদ’। কয়েক মিনিট পর সে ফিরে এল ট্রে-হাতে। কফি খাবার পর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মা’র সামনে–এই অবস্থায় সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে কি না। বুঝতে পারছিলাম না। খানিকটা ভেবে দেখলাম, না, এতে কিছুই যায় আসে না। তাই দারোয়ানকে একটা সিগারেট দিলাম, তারপর দুজনে তা টানতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার সে কথা বলা শুরু করল :
‘জানেন, আপনার মা’র বন্ধুরা এখুনি আসবে আপনার সঙ্গে মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগতে। আমাদের এখানে কেউ মারা গেলে আমরা তার মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগি। যাই দেখি, কিছু চেয়ার আর একপট কালো কফি জোগাড় করা যায় কি না।’
শাদা দেয়ালে বাতির উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হওয়ায় চোখে লাগছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা বাতি সে নিভিয়ে দিতে পারে কি না। ‘কিছুই করার নেই’, বলল সে, ‘তারা এমনভাবে বাতিগুলোর বন্দোবস্ত করেছে যে হয় সবকটিই জ্বলবে না-হয় একটিও জ্বলবে না।’ একথার পর আর তার দিকে নজর দিলাম না। সে বাইরে থেকে কিছু চেয়ার এনে কফিনের চারপাশে সাজিয়ে রাখল। একটিতে রাখল একপট কফি আর দশ-বারোটি পেয়ালা। সব গুছিয়ে রেখে, মা’র অন্যদিকে, আমার মুখোমুখি সে বসল। নার্সটি ঘরের অন্যপাশে, আমার দিকে ছিল তার পিঠ। সে কী করছিল তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না।
কিন্তু তার হাত নড়া দেখে মনে হল সে কিছু-একটা বুনছে। খুব আরাম লাগছিল আমার, কফি তুলেছিল আরো চাঙা করে। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছিল। ফুলের সুবাস, স্পর্শ পাচ্ছিলাম রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের। মনে হয়, কিছুক্ষণ ঝিমিয়েছিলামও।
সরসর এক আওয়াজে ঘুম ভাঙল। চোখ বন্ধ করার পর মনে হয়েছিল ঘরের বাতিগুলি যেন আরও জোরালো হয়ে জ্বলছে। কোথাও কোনো ছায়ার চিহ্নমাত্র নেই। এবং প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি বাঁক বা কোণের বহিঃরেখা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। মা’র বন্ধু, বৃদ্ধরা সব ঘরে ঢুকছিলেন। গুনলাম, মোট দশজন। প্রায় শব্দহীনভাবে সন্ধ্যা ছটায় যেন তারা ভেসে এলেন। চেয়ারে যখন তারা বসলেন তখন বিন্দুমাত্র শব্দ হল না। আমার জীবনে এত পরিষ্কারভাবে আমি আর কাউকে দেখিনি; তাঁদের কাপড়চোপড় বা চেহারার কোনো ডিটেল আমার নজর এড়াল না। কিন্তু, তবুও তাঁদের কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না, এবং বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে তারা সত্যিই বিদ্যমান।
প্রায় প্রতিটি মহিলার পরনে অ্যাপ্রন। কোমরে শক্ত করে বাঁধা ছিল অ্যাপ্রনের দড়ি। এতে তাঁদের পেটগুলোকে বেশ বড় লাগছিল। বৃদ্ধাদের এতবড় পেট আগে আমার নজরে পড়েনি। তবে অধিকাংশ বৃদ্ধই বেতের মতো শুকনো, এবং সবার হাতে লাঠি। তাদের যে-জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হল, তাদের মুখের দিকে তাকালে চোখ নজরে পড়ছিল না। চোখগুলিকে দেখা যাচ্ছিল বলিরেখার জালে আটকে-থাকা ঘোলাটে আলোর মতো।
চেয়ারে বসে তারা তাকালেন আমার দিকে। দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে ঠোঁট চুষতে চুষতে অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়লেন তাঁরা। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তারা কি আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, না কিছু বলতে চাইছেন, না এটা বয়সের দোষ। ভাবতে চাইলাম, তারা বোধহয় তাদের মতো করে আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ছিল অদ্ভুত। দারোয়ানকে ঘিরে-থাকা ঐ বৃদ্ধের দল নিষ্কম্প চোখে আমাকে দেখছে আর মাথা নাড়ছে। মুহূর্তের জন্যে মনে হল, তারা আমার বিচার করতে বসেছেন।
মিনিট কয়েক পর একজন মহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন তিনি। তাঁর সামনে একজন মহিলা থাকায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে থেমে তিনি ঢোক গিলছিলেন। মনে হচ্ছিল, তার এ- কান্না বোধহয় আর কখনও থামবে না। অন্যেরা এর প্রতি তেমন নজর দিচ্ছিল না। নিথর হয়ে বসেছিল তারা চেয়ারে, তাকাচ্ছিল কখনও কফিনের দিকে, কখনও-বা নিজেদের লাঠির দিকে অথবা অন্য কোনো জিনিসের দিকে। আর যেটার দিকেই তাকাচ্ছিল সেটা থেকে আর চোখ ফেরাচ্ছিল না। মহিলাটি কাঁদছিলেন তখনও। তাকে আমি চিনিনে কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিল তার কান্না থামানো উচিত। কিন্তু কিছু করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। খানিক পর, সেই দারোয়ানটি মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে তাকে যেন কী বলল। তিনিও মাথা নেড়ে অস্পষ্টভাবে কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি ঠিক আগের মতোই ফোঁপাতে লাগলেন।
দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। চেয়ার নিয়ে এসে বসল আমার পাশে। প্রথমে সে রইল চুপ করে, তারপর আমার দিকে না-তাকিয়ে বলতে লাগল:
‘আপনার মা’র খুব ভক্ত ছিলেন এই মহিলা। তাঁর মতে, এ-পৃথিবীতে আপনার মা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু। কিন্তু এখন তিনি একেবারে একেলা।’
কিছুই বলার ছিল না আমার। নিস্তব্ধতা বিরাজ করল কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে মহিলার ফোঁপানি ও ঢোক গেলাও কমে এল। এবং একসময় থেমে গেল ফোপানিও। নাক ঝেড়ে বসে রইলেন তিনি চুপচাপ।
আমার ঝিমুনি কেটে গিয়েছিল, ক্লান্ত লাগছিল খুব আর পা-টাও কামড়াচ্ছিল। ভীষণভাবে। এখন বুঝলাম, এই লোকদের নিস্তব্ধতা চেপে বসেছে আমার স্নায়ুর ওপর। খালি অদ্ভুত ধরনের একটা শব্দ হচ্ছিল, বেশ থেমে থেমে এবং প্রথমে তা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যাক, কিছুক্ষণ মনোযোগ দেয়ার পর বুঝলাম এ কিসের শব্দ।
বুড়ো লোকগুলি গালের ভেতরটা চুষছিলেন জিভ দিয়ে, তাই শব্দ হচ্ছিল অমন যা আমার কাছে হয়ে উঠেছিল রহস্যময়। নিজেদের চিন্তায় তারা এত মগ্ন ছিলেন যে, তারা কী করছেন তা তারা নিজেরাও খেয়াল করছিলেন না। আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, তাদের মাঝে রাখা মৃতদেহটাকে বুঝি তাঁরা আমল। দিচ্ছেন না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ধারণাটা ছিল ভুল।
দারোয়ান সবাইকে কফি দিলে আমরা তা পান করলাম। তারপর আমার আর তেমন কিছু মনে নেই; কোনোরকমে কেটে গেল রাতটা। একটা জিনিস শুধু মনে আছে। একসময় হঠাৎ আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম বুড়োরা সব ঘুমুচ্ছেন। জেগে রয়েছেন শুধু একজন। দুহাতে লাঠিটা চেপে ধরে তার ওপর থুতনি রেখে। কঠোরভাবে তাকিয়ে ছিলেন তিনি আমার দিকে যেন অপেক্ষা করছিলেন আমার ঘুম ভাঙার। তারপর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর কিন্তু আবার ঘুম ভেঙে গেল কারণ পায়ে ঝিঁঝি ধরেছিল।
ভোরের ম্লান আলো দেখা গেল স্কাইলাইট দিয়ে। কয়েক মিনিট পর জেগে উঠলেন একজন, তারপর শুরু করলেন কাশতে। বড় একটা নকশা-করা রুমালে মুখ রেখে কাশছিলেন তিনি। কাশির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল বুঝি তিনি বমি করার চেষ্টা করছেন। একে একে জেগে গেল সবাই তারপর। দারোয়ান বলল, যাবার সময় হয়েছে এখন।’ শুনে তারা সবাই উঠে দাঁড়ালেন। রাতে ভালো ঘুম না-হওয়ার ফলে মুখ তাদের হয়ে গেছে লম্বাটে আর পাঁশুটে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যাবার আগে সবাই তাঁরা করমর্দন করলেন আমার সঙ্গে, যেন একরাতে আমরা কত অন্তরঙ্গ হয়ে গেছি যদিও সারারাত আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।
বেশ ক্লান্ত লাগছিল। দারোয়ান আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলে নিজেকে খানিকটা পরিপাটি করে নিয়েছিলাম। আমাকে সে আরও খানিকটা দুধ-মেশানো কফি দিল যা আমাকে তুলেছিল চাঙা করে। বাইরে যখন বেরোলাম, সূর্য তখন বেশ উপরে উঠে গেছে। মারেনজো আর সমুদ্রের মাঝে পাহাড়চুড়োয় আকাশ হয়ে উঠেছে রক্তিম। ভোরের বাতাস বইছিল, যাতে ছিল স্নিগ্ধ লোনা স্পর্শ। মনে হচ্ছিল, দিনটা খুব ভালো যাবে। অনেকদিন গ্রামে আসিনি আমি। এবং দেখলাম ভাবছি, মা’র এই ব্যাপারটা না থাকলে কী চমৎকারভাবেই-না খানিকটা হেঁটে বেড়াতে পারতাম।
উঠোনের এক প্লেনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভিজে মাটির গন্ধ নিলাম আর তারপর দেখলাম, আমার আর ঘুম পাচ্ছে না। অফিসের সহকর্মীদের কথা চিন্তা করলাম এরপর। ঠিক এ-সময় ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্যে তারা তৈরি হচ্ছে। এ-সময়টা ছিল আমার জন্যে সবচেয়ে বিশ্রী সময়। দশ মিনিট কি আরও কিছুক্ষণ আমি এসব ভাবলাম। তারপর ঘরের ভেতর বেজে-ওঠা ঘণ্টার শব্দ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। জানলার বাইরে থেকে দেখছিলাম কারা যেন ভেতরে চলাফেরা করছে। ফের সব শান্ত হয়ে গেল। সূর্য উঠে গেল আরেকটু ওপরে, পা তেতে ওঠা শুরু করেছে। উঠোন পার হয়ে দারোয়ান কাছে এসে জানাল ওয়ার্ডেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। গেলাম তার অফিসে। কিছু কাগজপত্র দিলেন তিনি সই করার জন্যে। পিন-স্ট্রাইপ পাতলুন পরনে তাঁর, সবকিছু কালো। ফোনের রিসিভারটা তুলে তাকালেন তিনি আমার দিকে : শববহনকারী লোকেরা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। তারা এখনই কফিনের ভ্রু আটকাবে। আমি কি তাদের খানিকটা অপেক্ষা করতে বলব যাতে তোমার মাকে শেষবারের মতো দেখতে পাও?
‘না’, বললাম আমি।
গলা নামিয়ে কী যেন বললেন তিনি টেলিফোনে। ‘ঠিক আছে ফিজেক, লোকজনদের সেখানে যেতে বলো।’
তারপর তিনি জানালেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনিও যাবেন। ধন্যবান জানালাম তাঁকে। খাটো পা-দুটি মেলে দিয়ে, ডেস্কের পেছনে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, নার্স ছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি এবং তিনিই একমাত্র শোককারী। কারণ আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী আশ্রমের কেউ শবানুগমন করতে পারবে না। তবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগের রাত্রিতে মৃতদেহের পাশে বসে তারা রাত জাগতে পারে।
‘এটা তাদের জন্যেই’, ব্যাখ্যা করলেন তিনি, যাতে তারা কাতর না হয়ে পড়ে। কিন্তু আজ আমি তোমার মা’র পুরনো এক বন্ধুকে শবানুগমনের বিশেষ অনুমতি দিয়েছি। থমাস পিরেজ তার নাম’, হাসলেন ওয়ার্ডেন, ‘গল্পটা বেশ করুণ বটে। সে আর তোমার মা অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। আশ্রমের অন্য বৃদ্ধরা ঠাট্টা করে বলত যে, পিরেজ একজন ফিয়াসে পেয়েছে। তোমরা বিয়ে করেছ কবে? জিজ্ঞেস করত তারা। হেসে উড়িয়ে দিত সে প্রসঙ্গটি। অনেকটা তামাশার মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, তোমার মা’র মৃত্যুতে সে কতটা আঘাত পেয়েছে। ভেবে দেখলাম, শবানুগমনের অনুমতি না দিলে খারাপ দেখাবে। তবে আমাদের ডাক্তারের পরামর্শে তাকে রাত জাগতে দিইনি।‘
তারপর আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। খানিক পর ওয়ার্ডেন চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন।
বললেন : ‘আরে ঐ তো মারেনগোর পাদরি চলে এসেছেন! অবশ্য সময়ের খানিকটা আগেই এসেছেন।‘ তিনি আমায় জানালেন, হেঁটে গির্জেয় পৌঁছতে লাগবে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। কারণ, গির্জেটা গ্রামের একেবারে ভেতরে। তারপর নিচে নেমে এলাম আমরা।
সাময়িক শবাগারের দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাদরি। সঙ্গে তাঁর দুজন অধস্তন কর্মচারী। তাদের একজনের হাতে রুপোর ধূপধার। পাদরি তার উপর ঝুঁকে ধূপাধারের রুপোর শিকলটা ঠিক করছিলেন যেটার সঙ্গে তা লটকে ছিল। আমাদের দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, আমাকে ‘পুত্র’ বলে সম্বোধন করে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, চারজন লোক কালো পোশাক পরে কফিনের পিছে দাঁড়িয়ে আর কফিনের ঢাকনাটা আটকানো স্কু দিয়ে। ঠিক সে-সময় ওয়ার্ডেন বললেন, শবাধার নেওয়ার গাড়ি এসেছে। পাদরি শুরু করলেন তার প্রার্থনা। তারপর সবাই যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। সেই চারজন একটুকরো কালো কাপড় নিয়ে এগিয়ে গেল কফিনের দিকে আর আমি, পাদরি এবং অন্যান্যরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার পাশে। আগে কখনও আমি দেখিনি তাকে। ‘ইনি মঁসিয়ে মারসো’, ওয়ার্ডেন বললেন। মহিলাটিকে। আমি তার নামটা ঠিক ধরতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল তিনি বোধহয় এ-আশ্রমের নার্স। তার সঙ্গে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়া হল তখন মাথা নিচু করে তিনি আমায় অভিবাদন জানালেন। তাঁর দীর্ঘ কৃশমুখে বিন্দুমাত্র হাসির রেশ ছিল না। আমরা সব দাঁড়ালাম দরজার একপাশে; কফিন বের করা হলে পর পিছুপিছু গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। সেখানে শবাধার নেয়ার জন্যে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। গাড়িটা আয়তাকার, মসৃণ এবং কালো রঙের। গাড়িটা আমাকে মনে করিয়ে দিল অফিসের কলমদানির কথা।
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল ছোটখাটো এক মানুষ। পরনে সুন্দর অথচ অদ্ভুত পোশাক। বুঝলাম, তার কাজ হল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দেখাশোনা করা। অনেকটা অনুষ্ঠানের কোনো কর্তাব্যক্তির মতো। তার পাশে লাজুক এবং অপ্রতিভভাবে দাঁড়িয়েছিলেন মা’র বিশেষ বন্ধু থমাস পিরেজ। মাথায় তার নরম একটা ফেল্ট হ্যাট। চুড়োটা যার পুডিঙের মতো উঁচু আর ধারটা বেশ বড় কফিনটা দরজার কাছে আসতেই তিনি মাথা থেকে টুপি নামিয়ে নিলেন। পরনে তার কালো একটা টাই যা তাঁর উঁচু ডবল শাদা কলারের তুলনায় খুব ছোট। ব্রণময় গোল নাকের নিচে তার ঠোঁটদুটি কাঁপছিল। কিন্তু যা আমার দুষ্টি আকর্ষণ করল, তা হল তাঁর কান, দোদুল্যমান রক্তিম কান যা মোমের মতো হালকাভাবে তার গালের দুপাশে ঝুলে রয়েছে। আর কানের চারপাশে সিল্কের মতো শাদা পশম।
শববহনকারীদের একজন জায়গা ঠিক করে দিল আমাদের। শববহনকারীযানের আগে আগে পুরোহিত, দুপাশে কালো-পোশাক-পরা চারজন, তারপর আমি আর ওয়ার্ডেন এবং সবশেষে নার্স আর বুড়ো পিরেজ।
আকাশটা ভেসে যাচ্ছিল আলোর বন্যায়। বাতাসও উঠছিল তেতে। গরম বাতাসের হল্কা অনুভব করছিলাম পিঠে। আর আমার কালো স্যুট অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলেছিল। বুঝতে পারছিলাম না কেন এতক্ষণ সঙ্কারের জন্যে আমরা অপেক্ষা করলাম। টুপিটা পরেছিলেন বুড়ো পিরেজ, এখন আবার তা খুলে ফেললেন। একটু সরে আমি তাঁকে দেখছিলাম আর ওয়ার্ডেন আমাকে তার সম্পর্কে আরও কিছু বলছিলেন। মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, প্রায়ই নমিত বিকেলে আমার মা আর বৃদ্ধ পিরেজ একসঙ্গে দীর্ঘপথ হাঁটতেন। মাঝে মাঝে গ্রাম পর্যন্ত যেতেন হেঁটে। অবশ্য সঙ্গে থাকত একজন নার্স।
গ্রামের দিকে তাকালাম। সাইপ্রেসের সারি যেন পাহাড় আর তারপর দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে। উষ্ণ লাল মাটি মিশে গেছে সবুজের সঙ্গে। এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুএকটা নিঃসঙ্গ বাড়ি। মা’র অনুভূতিটা অনুভব করতে পারছিলাম। এদিকের বিকেলটা নিশ্চয় বোধহয় শোকের মতো। এখন সকালের প্রখর তাপে সবকিছু ঝলসাচ্ছে, তাই নিসর্গকে মনে হচ্ছে খানিকটা অমানুষিক, নিষ্ঠুর।
অবশেষে, আমরা একটা বাঁক পেরুলাম। আর তখনই লক্ষ করলাম, পিরেজ একটু খোঁড়াচ্ছেন। গাড়িটার গতি যতই বাড়ছিল বৃদ্ধ ততই তাল হারিয়ে ফেলছিলেন। আরেকজনও পিছিয়ে পড়ে আমার গতিতে চলে এলেন। সূর্যের খুব দ্রুত উপরে উঠে যাওয়া দেখে আশ্চর্য হলাম। বাতাসে পোকামাকড়ের শব্দ। ঘাসের তেতে ওঠার সরসর আওয়াজ। মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছিল। যেহেতু সঙ্গে আমার কোনো টুপি ছিল না, তাই রুমাল দিয়ে বাতাস খাবার চেষ্টা করছিলাম।
সেই পিছিয়ে-পড়া ভদ্রলোক কী যেন বললেন আমাকে। ঠিক ধরতে পারলাম। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে ধরে-থাকা রুমাল দিয়ে মাথা মুছলেন। ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন টুপিটা। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে কী বলছিলেন। উপরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন :
আজকের রোদটা খুব কড়া, তাই না?
‘হ্যাঁ’, বললাম আমি।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, যাকে কবর দেয়া হচ্ছে তিনি আপনার মা?
‘হ্যাঁ’, আবার বললাম আমি।
‘তাঁর বয়স হয়েছিল কত?’
‘এই আর-কি…’ আসলে আমি ঠিক জানতাম না মা’র বয়স কত ছিল।
তারপর চুপ করে রইলেন তিনি। পিছন ফিরে দেখলাম, প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছেন পিরেজ। একহাতে রাখা টুপিটা দোলাচ্ছেন, গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্যে। আমি ওয়ার্ডেনের দিকেও একবার তাকালাম। তিনি সতর্কভাবে মাপা পা ফেলে হাঁটছিলেন। কপালে তাঁর ঘামের ফোঁটা, কিন্তু তা মুছবার কোনো চেষ্টাই তিনি করছিলেন না।
মনে হল আমাদের মিছিলটা যেন একটু দ্রুত তালে এগুচ্ছে। যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, সেদিকেই দেখছিলাম আলোর বন্যায় ভেসে-যাওয়া গ্রামের নিসর্গ। আকাশটা এত ঝকঝকে যে উপরের দিকে চোখ ভোলার সাহস পাচ্ছিলাম না। শেষে, আমরা আলকাতরা-দেয়া এক নতুন রাস্তায় এসে উঠলাম। গরমে গলে যাচ্ছে আলকাতরা। আর যিনিই আলকাতরায় পা রাখছেন তারই পায়ের ছাপ পড়ছে সেখানে। উজ্জ্বল কালো ছাপ। গাড়োয়ানের আঁকালো কালো টুপিটাকে শবযানের মাথায় ঐ চটচটে বস্তুর স্তূপের মতো লাগছে। এটা সবাইকে এনে দিচ্ছে এক স্বপ্নিল ভাব। নীল-শাদা তাপের তরঙ্গ উপরে, আর চারদিকে এই কালো : শবযানের চকচকে কালো, লোকদের পোশাকের ম্লান কালো আর রাস্তায় পায়ের ছাপের রুপোলি কালো। এ ছাড়া আছে গন্ধ। গরম চামড়া এবং শবযানের ঘোড়ার মলের গন্ধ, আর ধূপের ধোয়ার সরু রেখা। এগুলো এবং গতরাতে না ঘুমানোর দরুন আমার চোখ আর ভাবনাগুলি যাচ্ছিল জড়িয়ে।
আমি আবার পিছন ফিরে তাকালাম। পিরেজকে যেন মনে হচ্ছিল বহুদূরে, চোখ-ঝলসানো রোদে প্রায় অস্পষ্ট। তারপর তিনি মিলিয়ে গেছেন একেবারে। এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম আমি। ভাবলাম, বুঝি পথ ছেড়ে তিনি ক্ষেতে নেমেছেন। সামনে নজর পড়ল রাস্তার একটি বাক। স্বাভাবিকভাবে পিরেজ, এ- অঞ্চল যার ভালোভাবে চেনা, আমাদের ধরার জন্যে শর্টকাট ধরছিলেন। বাঁক ঘোরার মুখে ধরে ফেললেন তিনি আমাদের, কিন্তু তারপর আবার পড়লেন পিছিয়ে। আরেকটা শর্টকাট মেরে আবার তিনি আমাদের ধরে ফেললেন। পরবর্তী আধঘণ্টা কয়েকবার এরকম হল। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই তার গতিবিধির ওপর আমার নজর রাখার আগ্রহটা কমে গেল। কপালের দুপাশের রগদুটো দপদপ করছিল। আমি আর চলতে পারছিলাম না বললেই হয়।
তারপর সবকিছু হঠাৎ করে হয়ে গেল। আর এত নিখুঁত এবং স্বাভাবিকভাবেই যে তার তেমন কোনো বিবরণ আমার মনে নেই। তবে মনে আছে, আমরা যখন গ্রামটা ছাড়িয়ে এসেছি তখন নার্স আমায় যেন কী বলেছিল। গলার স্বর তার আমাকে অবাক করেছিল, কারণ মুখের সঙ্গে স্বরের কোনো মিল নেই। স্বরটা একটু কাঁপা-কাঁপা। সে যা বলেছিল তা হল, কেউ যদি খুব আস্তে হাঁটে তবে তার সর্দিগর্মি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার যদি কেউ খুব তাড়াতাড়ি হাঁটে তবে ঘেমে যায় এবং পরে গির্জের ঠাণ্ডা বাতাস তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তার যুক্তিটা বুঝলাম। অর্থাৎ যে-কোনোভাবে সর্দিগর্মি হতে পারে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আরও দুএকটা ঘটনা আমার মনে আছে। সেই বৃদ্ধটির কথা ধরা যাক যখন তিনি শেষবারের মতো গ্রামের ঠিক বাইরে আমাদের ধরে ফেলেছিলেন। অত্যধিক পরিশ্রম বা দুঃখ বা হয়তো দুটোর জন্যেই চোখ তার ভরে গিয়েছিল জলে। কিন্তু মুখের বলিরেখার জন্যে চোখের পানি গাল বেয়ে নামতে পারছিল না–বরঞ্চ তার জরাজীর্ণ মুখের চারদিকে পড়ছিল ছড়িয়ে এবং প্রাচীন জীর্ণ মুখে সৃষ্টি করেছিল এক চকচকে ভাবের।
মনে পড়ছে আরও–গির্জের চেহারা, রাস্তার গ্রামবাসী, কবরের ওপর লাল জেরানিয়াম; পিরেজের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কাপড়ের পুতুলের মতো কুঁকড়ে মুকড়ে গিয়েছিলেন তিনি, মা’র কফিনের ওপর ঝরে-পড়া লাল মাটি যার সঙ্গে মিশে আছে শাদা শেকড়ের টুকরো; তারপর আরও লোক, গলার স্বর, কাফের বাইরে বাসের জন্য অপেক্ষা, ইঞ্জিনের গুঞ্জন, এবং যখন প্রথম আমরা ঢুকলাম আলজিয়ার্সের ঝলমলে রাস্তায় তখন মনে আনন্দের অল্প শিহরন এবং তারপর সোজা বিছানায় গিয়ে একটানা বারো ঘণ্টা ঘুম।
.
২.
ঘুম থেকে উঠেই বুঝলাম, দুদিন ছুটি নিতে চাওয়ায় কেন আমার ওপরঅলা মুখভার করেছিলেন। আজ শনিবার। শনিবার যে আজ হবে একথা আগে আমার মনে হয়নি। মনে হল তখন, যখন বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ওপরঅলা বুঝেছিলেন, একাধারে চারদিন আমি ছুটি পাচ্ছি, এবং এটা তাকে খুশি করবে এমন আশা করা যায় না। তবু বলব, দোষটা আমার নয়। মাকে গতকাল কবর না দিয়ে যদি আজ দেওয়া হত তা হলেও আমি শনিবার আর রোববার–এ-দুদিন ছুটি পেতাম। কিন্তু যাহোক, আমি আমার ওপরঅলার দিকটাও বুঝতে পেরেছিলাম। ঘুম থেকে ওঠাটা ছিল কষ্টকর, কারণ গতকালের অভিজ্ঞতা সত্যিই আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। দাড়ি কামাতে কামাতে ভাবছিলাম, কীভাবে দিনটা কাটানো যেতে পারে। ভাবলাম, বাইরে গিয়ে খানিকক্ষণ সাঁতার কাটলে বোধহয় ভালো লাগবে। সুতরাং পোতাশ্রয়ে যাবার ট্রাম ধরলাম।
আগের মতোই আছে সবকিছু। সুইমিং পুলে ছেলে-ছোকরার ভিড়, আর ঐ ভিড়ে ছিল আমার অফিসের এককালীন টাইপিস্ট মারি কারদোনাও। ঐ সময় আমি তার প্রতি বেশ উৎসুক ছিলাম এবং মনে হয় সেও আমায় পছন্দ করত। কিন্তু আমাদের অফিসে ছিল সে মাত্র কয়েকদিন, তাই কিছুই আর দানা বাঁধেনি।
ভেলায় তাকে ওঠাবার সময় হাত দিয়ে তার বুক ছুঁয়ে দিলাম। তারপর সে। নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আর আমি দাঁড় বাইতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর, পাশ ফিরে সে তাকাল আমার দিকে। চুলগুলি লুটোপুটি খাচ্ছিল তার চোখের ওপর এবং হাসছিল সে। দাঁড় রেখে দিয়ে এসে বসলাম তার পাশে। বাতাস বেশ আরামদায়ক-উষ্ণ। তামাশার ছলে আমার মাথা রাখলাম তার কোলে। সে কিছু বলল না দেখে আমিও আর মাথা সরালাম না। পুরো আকাশ আমার চোখে। নীল আর সোনালি। মাথার নিচে মারির পেটের ধীর ওঠানামা অনুভব করছিলাম। আধঘণ্টারও বেশি, আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে শুয়ে ছিলাম আমরা। তারপর রোদ আরও প্রখর হলে মারি ঝাঁপ দিল পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। সাঁতরিয়ে। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং হাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে দুজনে। পাশাপাশি সাঁতরাতে লাগলাম। সে তখনও হাসছিল।
সুইমিং পুলের কিনারে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নিজেদের শুকোচ্ছিলাম তখন মারি বলল, ‘দ্যাখো, আমি তোমার চেয়েও বাদামি।‘ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিকেলে সে আমার সঙ্গে সিনেমায় যাবে কি না। আবার হাসল সে। বলল, ‘হ্যাঁ’, যদি আমি তাকে ঐ হাসির বইটা দেখাতে নিয়ে যাই যাতে ফারনান্দল অভিনয় করছে এবং যার কথা এখন সবাই আলোচনা করছে।
কাপড় পরা যখন আমরা শেষ করলাম তখন সে আমার কালো টাই দেখে জিজ্ঞেস করল, আমি কারও জন্যে শোক পালন করছি কি না। জানালাম তাকে যে আমার মা মারা গেছেন। কখন?’ জিজ্ঞেস করল সে। গতকাল’, বললাম আমি। কিছু সে বলল বটে কিন্তু মনে হল খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে সে। আমি তাকে প্রায় বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে দোষটা আমার নয়। কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ, একথাটা আগেও একবার ওপরঅলাকে বলেছিলাম, এবং বুঝেছিলাম কথাটা শুনতে বোকার মতো। বোকামি হোক বা না-হোক, এরকম একটা ঘটনা ঘটলে সবাই নিজেকে খানিকটা দোষী মনে না করে পারে না।
যাহোক, বিকেলের দিকে মারি সব ভুলে গেল। মাঝে মাঝে ছবিটাতে কিছু হাসির খোরাক ছিল, কিন্তু পুরোটা যাচ্ছেতাই। সিনেমাহলে, সে তার পা দিয়ে আমার পা টা চেপে ধরছিল এবং আমি তার বুকে হাত বুলোচ্ছিলাম। ছবিশেষে তাকে চুমো খেলাম খানিকটা আনাড়ির মতো। তারপর সে আমার সঙ্গে ফিরে এল ঘরে।
ঘুম থেকে জেগে দেখি, মারি চলে গেছে। সে বলেছিল, সকালে উঠে প্রথমেই তার খালা খোঁজ করবে। মনে পড়ল, আজ রোববার; বিরক্ত লাগল। রোববারের। জন্যে আমি কখনও হা-পিত্যেশ করি না। মাথা ফেরালাম এবং অলসভাবে মারির ছেড়ে-যাওয়া বালিশের গন্ধ নিলাম। বালিশে সমুদ্রের জলের গন্ধ। ঘুমোলাম দশটা পর্যন্ত; তারপর দুপুর পর্যন্ত শুয়ে-শুয়ে সিগারেট টানলাম। ঠিক করলাম, প্রতিদিনের মতো সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় আজ আর খাব না। কারণ, সেখানে গেলেই তারা আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবে এবং কেউ জেরা করুক তা আমার অপছন্দ। সুতরাং কড়াইয়ে কয়েকটা ডিম ভেজে খেয়ে নিলাম। রুটি ছাড়াই খেলাম ডিমগুলি। কারণ ঘরে রুটি ছিল না আর নিচে গিয়ে তা তামাকঅলার দোকানের পাশের ছোট রেস্তোরাঁ সে পিয়েরো-র বেয়ারা খালি রেস্তোরাঁর ধুলো ঝাড়ছে। রোববারের একটি আদর্শ বিকেল।
চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমি তামাকঅলার মতো বসলাম। এভাবে বসা আরামদায়ক। বসে বসে কয়েকটা সিগারেট শেষ করার পর ঘরে গেলাম। সেখান থেকে একটুকরো চকোলেট নিয়ে এসে বসলাম জানালার কাছে। খাবার জন্যে। একটু পরেই আকাশটা ঢেকে গেল মেঘে। ভাবলাম, বুঝি কালবৈশাখি এল। যাক, কিছুক্ষণ পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল, পরিষ্কার হল বটে কিন্তু মনে হতে লাগল যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এবং এ-ভাবটা চারদিকে বেশ অন্ধকার করে তুলল। বেশ কিছুক্ষণ আমি আকাশ দেখলাম।
পাঁচটার সময় ট্রামের বিকট আওয়াজ শোনা গেল। শহরতলির স্টেডিয়াম থেকে তা আসছে যেখানে একটা ফুটবল ম্যাচ ছিল। পুরো ট্রামভরতি লোক, এমনকি পাদানিতে পা রেখেও লোক ঝুলছিল। তারপর আরেকটা ট্রামে এল খেলোয়াড়রা। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটা করে ছোট সুটকেস যা দেখে বুঝলাম এরা খেলোয়াড়। দলের গান গাইছিল তারা ‘কিপ দা বল রোলিং বয়েজ’। তাদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, তাদের একচোট নিয়েছি। আমি হাত নাড়লাম। বললাম, ‘চমৎকার!’ তারপর প্রাইভেট গাড়ির স্রোত বইতে লাগল রাস্তায়।
আকাশটা গেল আবার বদলে; বাড়িগুলির চুড়োর পিছনদিকটায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল একটা লালচে আভা। সঁঝ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাগুলি আবার ভরে উঠতে লাগল। লোকজন তাদের বৈকালিক ভ্রমণশেষে ফিরছিল এবং এসব ফিরতি লোকদের মধ্যে আমি সেই ছোটখাটো ভদ্রলোক ও তার স্থূলাঙ্গী স্ত্রীকে দেখতে পেলাম। ছেলে মেয়ে দুজন মা-বাবার পিছে পিছে ক্লান্তস্বরে প্যানপ্যান করতে করতে আসছিল। কিছুক্ষণ পর, কাছেপিঠের সিনেমাহলগুলি তাদের দর্শকদের উগরে দিল। লক্ষ করলাম, ছেলে-ছোকরারা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে এবং অন্যান্য সময় থেকে জোরেশোরে হাত নাড়ছে। তারা যে মার্কামারা একটি পশ্চিমা বুনো’ ছবি দেখে এসেছে সে-সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শহরের মাঝখানের সিনেমাহলগুলির দর্শকরা ফিরল কিছুক্ষণ পর। তাদের বেশির ভাগেরই মুখ গোমড়া, যদিও কয়েকজন। তখনও হাসছিল। যাহোক, মোটকথা, তাদের পরিশ্রান্ত লাগছিল। কয়েকজন আমার জানালার নিচে ঘোরাফেরা করতে লাগল। একদল মেয়ে এল হাতে হাত রেখে। আমার জানালার নিচের ছোকরারা তাদের পাশ ঘেঁষে যাবার জন্যে তাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগল এবং চেঁচিয়ে মজার মন্তব্য করল যা শুনে মেয়েরা পিছন ফিরল, হাসল। মেয়েগুলিকে চিনলাম। পাড়ারই মেয়ে, তাদের দুএকজনের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, দেখে হাত নাড়ল।
ঠিক সে-সময় একসঙ্গে রাস্তার বাতিগুলি জ্বলে উঠল। রাতের আকাশে যে তারাগুলি মাত্র জ্বলে উঠেছিল সেগুলি আরও নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বাতি এবং একটানা রাস্তার এত খুঁটিনাটি দেখার জন্যে চোখটা টনটন করছিল। বাতিগুলির নিচে খানিকটা জায়গা উজ্জ্বল। কোনো ট্রাম যখনই সে-জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল তখনই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল কোনো মেয়ের চুল, বা হাসি বা রুপোর চুড়ি।
তার পরই কমে গেল ট্রামের আনাগোনা। বাতি আর গাছের ওপর আকাশকে দেখাচ্ছিল কালো ভেলভেটের মতো। রাস্তা খালি হতে লাগল। এবং এমন এক সময় এল যখন রাস্তায় কাউকে দেখা গেল না এবং বিকেলের দেখা প্রথম বেড়ালটা ধীরস্থিরভাবে নির্জন রাস্তাটা পার হল।
আমার মনে হল, এখন রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করা উচিত। চেয়ারে ঝুঁকে নিচে এতক্ষণ দেখছিলাম যে দাঁড়াতেই ঘাড়টা ব্যথা করে উঠল। নিচে নেমে খানিকটা রুটি আর স্নগেটি কিনলাম, তারপর রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই খাওয়াটা সারলাম। ভাবছিলাম, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আরেকটা সিগারেট খাব, কিন্তু হিমেল হয়ে আসছিল রাতটা। তাই ইচ্ছেটা দমন করলাম। জানালা বন্ধ করে যখন ফিরছিলাম তখন তাকালাম আয়নার দিকে, দেখলাম আয়নায় আমার টেবিলের এক কোনা, তার ওপর স্পিরিটল্যাম্প ও পাশে ছড়ানো কয়েক টুকরো রুটি ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মনে হল, আরেকটা রোববার কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে এবং কাল থেকে আমি আবার আগের মতো অফিস যেতে শুরু করব। সত্যি, আমার জীবনের কিছুই বদলায়নি।
.
৩.
সকালটা খুব ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। আমার কর্তাও ছিলেন বেশ খোশমেজাজে। এমনকি তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ক্লান্ত কি না এবং তার পিঠেপিঠেই প্রশ্ন, মার বয়স ছিল কত। খানিক ভেবে বললাম, ষাটের কাছাকাছি। কারণ, আমি আরেকবার ভুল করতে চাচ্ছিলাম না। এটা শুনে তিনি কেমন যেন নিশ্চিন্ত হলেন। কেন, আমি জানি না–ভাবলাম, যাক ইতি হল বিষয়টার।
টেবিলে আমার বিল অফ লেডিঙের পাহাড় আর এসবগুলি দেখতে হবে আমাকে। দুপুরে খেতে যাবার আগে হাত ধুলাম। প্রতিদিন দুপুরে হাত ধুতে আমার বেশ ভালো লাগে। বিকেলে ব্যাপারটা কিন্তু বিরক্তিকর। কারণ, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত লোকজনের ব্যবহারের ফলে তোয়ালেটা ভিজে জবজব করে। ব্যাপারটা একবার কর্তার নজরে এনেছিলাম। এটা যে নিতান্ত বাজে সে বিষয়ে তিনি একমত হয়েছিলেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর কাছে এটা সামান্য ব্যাপার। অন্যদিনের চেয়ে আর-একটু দেরি করে অফিস ছাড়লাম। সাড়ে বারোটায় ফরোয়ার্ডিং ডিপার্টমেন্টের ইমানুয়েলের সঙ্গে বেরোলাম। অফিস থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বন্দরের জাহাজের মালপত্রের ওঠানামা দেখলাম। সূর্য হয়ে উঠছিল উত্তপ্ত। ঠিক সে-সময় ইঞ্জিন ও শেকলের শব্দ করতে করতে একটা ট্রাক এল। ইমানুয়েল বলল ট্রাকটাতে লাফিয়ে উঠতে। দৌড়োতে শুরু করলাম আমি। ট্রাকটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। আমাদের তাই বেশকিছুটা পথ ধাওয়া করতে হল পিছু-পিছু। ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দের জন্যে সবকিছু খানিকটা গুলিয়ে ফেলছিলাম। সচেতন ছিলাম, শুধু একপাশে জাহাজগুলির গাঢ় রঙের নোঙর ও অদূরে দোলায়মান মাস্তুল এবং ক্রেন ও যন্ত্রপাতির ভিড়ের মাঝ দিয়ে জলের ধার-বরাবর পাগলের মতো দৌড় সম্পর্কে। আমিই প্রথম ধরলাম ট্রাকটাকে, তারপর লাফ দিয়ে ওপরে উঠে টেনে-হেঁচড়ে তুললাম ইমানুয়েলকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছিলাম আমরা। তা ছাড়া এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলার ফলে ঝাঁকুনি অবস্থা আরও সঙ্গিন করে তুলল। ইমানুয়েল ঢোক গিলে কানে-কানে বলল, শেষ পর্যন্ত উঠলাম তা হলে।
সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেখি দরদর করে ঘামছি আমরা। সেলেস্তে সবসময় যেখানে বসে সেই সেখানে ঢোকার দরজার সামনে বসে আছে। স্থূলকায়। পেটের ওপর তার শাদা অ্যাপ্রন আর শাদা গোঁফজোড়া পাকানো। আমাকে দেখে সহানুভূতি জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার খুব খারাপ লাগছে কি না। বললাম, ‘না’। কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছিল আমার। গোগ্রাসে খাওয়ার পর কফি দিয়ে শেষ করলাম খাবার-পর্ব। তারপর ঘরে ফিরে খানিকটা ঘুমালাম, কারণ বেশ মদ গিলেছিলাম। ঘুম থেকে জেগে, বিছানা ছেড়ে উঠবার আগে সিগ্রেট খেলাম একটা। খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই ট্রাম ধরার জন্যে দৌড়াতে হল। পুরোদমে চলছিল অফিস আর সারাটা বিকেল কেটে গেল তার সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে। অফিস-ছুটিটা তাই এল স্বস্তি হয়ে এবং ঠাণ্ডায় জেটির ধারে পায়চারি করছিলাম আস্তে আস্তে। আকাশটা সবুজ এবং এই নিরেট অফিসের পর বাইরে বেরনোটা ভীষণ আরামপ্রদ। যাক, সোজা ফিরলাম বাসায়, কারণ কিছু আলু সেদ্ধ করার দরকার ছিল।
হলঘরটা আঁধার, তাই যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম তখন বুড়ো সালামানোর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খেলাম। সে আমার সঙ্গে একই তলায় থাকে। সবসময়ের মতো তার কুকুরটাও আছে তার সঙ্গে। আট বছর ধরে এ-দুজন অবিচ্ছিন্ন। সালামানোর স্প্যানিয়েলটা কুৎসিত এক জন্তু। সারা শরীরে চর্মরোগ; আমার মনে হয় খোসপাঁচড়া। কুকুরটার গায়ে এখন পশম নেই বিন্দুমাত্র, বদলে আছে বাদামি বাদামি চাকতি। মনে হয় কুকুরটার সঙ্গে ছোট ঘরটাতে একসঙ্গে থাকার দরুন সালামানোর আকৃতিও হয়ে গেছে অনেকটা এর মতো। তার চুল ভীষণ পাতলা আর গালে লালচে দাগ। আর কুকুরটাও মনে হয় মনিবের মতো বিশ্রী কুঁজোভঙ্গিতে হাঁটাটা আয়ত্ত করেছে। কারণ, সবসময় সে মাথাটা যতদূর সম্ভব সামনে বাড়িয়ে নাকটা মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে হাঁটে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তারা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করে।
দিনে দুবার, এগারোটা আর ছ’টার সময়, বুড়োটা তার কুকুরকে নিয়ে বেড়াতে বের হয় আর আট বছর ধরে এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। রু দ্য লিয়তে আপনি তাদের দেখতে পাবেন, কুকুরটা যত জোরে পারে তাকে টেনে নিয়ে। চলছে, যতক্ষণ-না বুড়ো মনিবটি পা হড়কে পড়ো-পড়ো হচ্ছে। তখন সে তাকে পেটায়, গাল দেয়। কুকুরটা দুটো পা পিছনে দিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। এবার তার প্রভুর পালা তাকে টেনে নেয়ার। খানিক পর কুকুরটা আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে ফের জোরে জোরে শেকল টানতে থাকে। ফলে, আরও কিছু প্রহার, গালিগালাজ। তারপর তারা দাঁড়ায় ফুটপাতে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে, কুকুরটার দৃষ্টিতে ভয় এবং মানুষটির দৃষ্টিতে ঘৃণা। যখনই তারা বের হয় তখনই এটা ঘটে। কুকুরটা যখন আবার কোনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়াতে চায় তখন তার মনিব তাকে দাঁড়াতে না দিয়ে টেনে নিতে থাকে। আর। হতভাগ্য স্প্যানিয়েলটা রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা জলের দাগ রেখে যায়। কিন্তু ব্যাপারটি যদি ঘরে ঘটে, তার অর্থ আরেকচোট প্রহার।
আট বছর ধরে হয়ে আসছে এরকম। সেলেস্তে তো এটাকে বিষম লজ্জার কথা বলে উল্লেখ করে। বলে, এ-ব্যাপারে কিছু করা উচিত। কিন্তু কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যখন হলের ভেতর সালামানোর সঙ্গে আমার দেখা হল। তখন সে কুকুরটার ওপর হম্বিতম্বি করছিল। কুকুরটা ঘেউঘেউ করছিল আর সে। জারজ ‘নোংরা খচ্চর ইত্যাদি বলে গাল দিচ্ছিল। “শুভ সন্ধ্যা’ বললাম আমি, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সে কুকুরটাকে গাল দিয়ে যেতে লাগল। সুতরাং ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি কুকুরটা কী করেছে। কিন্তু এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে সে চিৎকার করতে লাগল, ব্যাটা খেকি কুত্তা…’ ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মনে হল, কুকুরটার গলায় সে কিছু লাগাবার চেষ্টা করছে। গলাটা খানিকটা উঁচুতে তুললাম। পিছন না-ফিরেই সালামানো চাপা রাগে স্বগতোক্তি করতে লাগল, ব্যাটা সবসময় এরকম করে। শিক্ষা দেয়া উচিত ব্যাটাকে। তারপর সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল, কিন্তু কুকুরটি চেষ্টা করল প্রতিরোধ করার, শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে, ফলে তাকে শেকল ধরে ধাপে-ধাপে টেনে নিতে হল।
আমার সঙ্গে একই তলায় যে-লোক থাকে সে ঠিক এ-সময় নিচে থেকে উপরে উঠে এল। বেশির ভাগ লোকের মতে, সে একজন বেশ্যার দালাল। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কী করে, তখন সে উত্তরে বলে, মালগুদামের দারোয়ান। তবে এটা ঠিক, পাড়ায় সে লোকপ্রিয় নয়। কিন্তু প্রায়ই আমার সঙ্গে তার কিছু-না-কিছু কথা থাকে এবং মাঝে মাঝে ঘরে এসে অল্পস্বল্প কিছু বলে সে চলে যায়, কারণ আমি তার কথা শুনি। আসল ব্যাপার, তার কথা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। সুতরাং তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। নাম তার সেনতেস; রেমন্ড সেনতেস। বেঁটে পুষ্ট গড়ন। নাক তার মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো এবং পোশাকআশাকে সে ফুলবাবুটি। সেও আমাকে একবার সালামানোর কথা বলেছিল। সালামানো তার কুকুরের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করে তা খুবই লজ্জার বিষয় এবং তার এরকম ব্যবহারে আমি বিরক্ত হই কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না’।
দুজনে সিঁড়ি বেয়ে একসঙ্গে উপরে উঠলাম। সেনতেস এবং আমি। তারপর আমি যখন ঘরের দিকে মোড় নিচ্ছি তখন সে বলল, আমার সঙ্গে খাবে খানিকটা? ঘরে একটা কালো পুডিং আর মদ আছে কিছু।
আমার তখন খেয়াল হল, এর ফলে আমাকে আর রাতের খাবার তৈরি করতে হবে না, সুতরাং বললাম, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’
তারও ঘর একটা। সঙ্গে রান্নাঘর। জানালা নেই। দেখলাম, তার খাটের মাথায় গোলাপি আর শাদা প্লাস্টারের একটা পরী আর ওপাশের দেয়ালে কিছু চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলেট ও নগ্ন মেয়ের ছবি সঁটা। বিছানাটা এলোমেলো, ঘরটা অপরিচ্ছন্ন। প্যারাফিনের একটা বাতি জ্বালাল সে; তারপর পকেট হাতড়িয়ে একটা ময়লা ব্যান্ডেজ বের করে ডানহাতে জড়াল। ‘ব্যাপারটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে জানাল, এক ছোকরা তাকে খানিকটা বিরক্ত করায় তার সঙ্গে একচোট হয়ে গেছে।
‘গণ্ডগোল করার মতো লোক আমি নই’, বোঝাল সে, ‘শুধু খানিকটা রগচটা।‘ ছোকরা আমায় বলল, চ্যালেঞ্জ করল এভাবে, ‘যদি ব্যাটাছেলে হয়ে থাকো তবে। ট্রাম থেকে নেমে এসো।‘ বললাম, “চুপ থাকো। আমি তোমার কিছু করিনি।” তখন সে বলল, আমার সাহস নেই। ব্যস, তারপর মীমাংসা হয়ে গেল সবকিছুর। ট্রাম থেকে নেমে তাকে বললাম “ভালো চাও তো মুখ বন্ধ করো নয়তো তোমার ভালোর জন্য মুখ বন্ধ করে দেব।” “চেষ্টা করেই দ্যাখো-না!” বলল সে। তারপর মুখে এক জবর ঘুসি মেরে ভালো করে শুইয়ে দিলাম তাকে। খানিকপর তাকে ওঠাতে গেলাম। এর বদলে শুয়ে থেকেই সে আমায় লাথি মারল। সুতরাং একবার হাঁটু দিয়ে এবং তারপর হাত দিয়ে তাকে আরও খানিকটা ধোলাই দিলাম। যখন ধোলাই শেষ করলাম তখন শুয়োরের মতো তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হয়েছে?” সে বলল, “হ্যা”।
সেনতেস কথা বলছিল আর ব্যস্তভাবে হাতে ব্যান্ডেজ জড়াচ্ছিল। আমি বসেছিলাম ওর বিছানায়।
‘সুতরাং তুমিই দ্যাখো, বলল সে, দোষটা আমার নয়। সে-ই চাচ্ছিল ব্যাপারটা, ঠিক না?’ আমি মাথা নাড়লাম এবং সে যোগ করল, ‘আসল কথা তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাচ্ছি, এ-ব্যাপারটার জন্যেই। তুমি তো সংসারের কিছু জানো, সুতরাং তুমিই পারো আমায় সাহায্য করতে। তা হলে সারাজীবন আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকব। কেউ যদি আমার উপকার করে তার কথা আমি ভুলি না।’
আমি যখন কোনো উত্তর দিলাম না তখন সে জিজ্ঞেস করল বন্ধু হিসেবে নিতে তাকে কোনো আপত্তি আছে কি না। উত্তরে যখন জানালাম আপত্তি নেই তখন মনে হল সে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। কালো পুডিংটা বের করে সে ফ্রাইং প্যানে গরম করল, তারপর দু-বোতল মদ বের করে টেবিল সাজাল। এসব করার সময় সে। চুপ করে ছিল।
খেতে বসলাম আমরা। তারপর খানিক ইতস্তত করে সে পুরো ঘটনাটা আমাকে বলল। ‘সচরাচর যা হয়ে থাকে, তেমনি এ-ঘটনার সঙ্গে একটি মেয়ে জড়িত। প্রায়ই আমরা একসঙ্গে ঘুমোতাম। বলতে গেলে আমি তাকে রেখেছিলাম কারণ সে মোটামুটি মানানসই টাকা চাইত। যে-ছোকরাটিকে ধোলাই করেছি সে ওর ভাই।‘
লক্ষ করল সে আমি চুপ করে আছি। তখন বলল, প্রতিবেশীরা তার সম্পর্কে কী বলে তা সে জানে। কিন্তু কথাগুলি জঘন্য রকমের মিথ্যে। অন্য সবার মতো তারও নিজস্ব একটা নীতি আছে আর আছে গুদামঘরে একটা চাকরি।
‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘তারপর কী হল বলি… হঠাৎ একদিন দেখি মেয়েটা আর আগের মতো আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। চলার মতো সে তাকে যথেষ্ট টাকা দিত, তবে হয়তো তা তেমন বড় অঙ্কের নয়; তার ঘরের ভাড়া গুনত, প্রতিদিনের খাওয়ার জন্যে দিত কুড়ি ফ্রা। তিনশো ফ্রা ভাড়া, আর ছ’শো ফ্রা খাওয়া এবং যখন-তখন ছোটখাটো উপহার, কখনও একজোড়া মোজা, কখনও-বা অন্যকিছু। ধরো মাসে এক হাজার ফ্রা। কিন্তু আমার ভদ্রমহিলার জন্যে তাও যথেষ্ট নয়। সবসময় প্যানপ্যান করে বলত, যা দিচ্ছি তাতে সে কুলোতে পারছে না। সুতরাং একদিন তাকে বললাম, ‘দিনে ঘণ্টাখানেকের জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করো না কেন? তাতে আমারও সুবিধা হয়। এ-মাসে আমি তোমায় একটা নতুন ফ্রক কিনে দিয়েছি। শুনছি ঘরভাড়া আর প্রতিদিন কুড়ি ফ্রা তো দিচ্ছিই। কিন্তু তুমি একদঙ্গল মেয়ে নিয়ে কাফেতে গিয়ে সব উড়িয়ে দাও। তাদের তুমি কিনে দাও কফি, চিনি। আর পয়সাগুলি তো আসে আমার পকেট থেকে। আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করি আর প্রতিদানে এই পাই।‘ কিন্তু সে কোনো কাজ করবে না। অথচ প্রতিদিন বলবে আমি যা দিচ্ছি তাতে আর কুলোচ্ছে না। তারপর একদিন দেখলাম সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
সে ব্যাখ্যা করতে লাগল। একদিন তার ব্যাগে একটা লটারির টিকিট দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, লটারির টিকিট কেনার টাকা সে পেল কোত্থেকে? মেয়েটি চুপ করে রইল। তারপর আরেকবার তার কাছে পেয়েছিল সে দুটি ব্রেসলেট বন্ধক দেয়ার রসিদ। অথচ, ব্রেসলেট দুটি সে কোনোদিন দেখেনি পর্যন্ত।
‘সুতরাং বুঝলাম, ভিতরে ভিতরে নোংরা কিছু-একটা চলছে। তাই তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হওয়া উচিত। তবে তার আগে তাকে নিয়ে নিলাম একচোট, শক্ত শক্ত কিছু কথাবার্তাও শোনালাম। বললাম, একটিমাত্র জিনিসই তার প্রিয়, তা হল সুযোগ পেলে যার-তার সঙ্গে ঘুমানো। সোজাসুজি বললাম তাকে, বুঝলে বোকা মেয়ে, আমার জন্যে কষ্ট পেতে হবে একদিন। তখন আমার কাছেই ফিরে আসতে চাইবে। রাস্তার সব মেয়ে তোমাকে হিংসে করে, কেন জানো? খালি এজন্যে যে আমি তোমাকে রাখছি।’
রক্ত বের না-হওয়া পর্যন্ত পিটিয়েছিল সে মেয়েটিকে। এর আগে কখনও সে তাকে মারেনি। ‘মানে খুব জোরে নয় আর-কি, অনেকটা আদরের মারের মতো। কিছুক্ষণ চাঁচাত এবং আমাকে জানালাগুলি বন্ধ করে দিতে হত। তারপর সচারাচর যা হয় তেমনি ব্যাপারটার ইতি হত। কিন্তু এবার যা-ই বলো, তার থেকে আমার মন উঠে গেছে। খালি মনে হচ্ছে তাকে ভালো করে শাস্তি দেয়া হল না। আমি কী বলছি, বুঝছ তো?’
সে জানাল, এ-ঘটনাটার জন্যেই আমার পরামর্শ চাচ্ছে। ধোঁয়া বেরুচ্ছিল বাতি থেকে। বাতির সলতেটা কমিয়ে দেয়ার জন্যে সে পায়চারি করতে করতে থামল। আমি কিছু না বলে খালি শুনলাম। পুরো এক বোতল মদ খেয়েছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। কারণ, আমার ব্রান্ডের সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ায় রেমন্ডেরটা খাচ্ছিলাম। রাতের শেষ ট্রাম চলে গেল, এবং এর সঙ্গে রাস্তার কলরবও থেমে গেল। রেমন্ড কথা বলে চলছিল। যে-জিনিসটা তাকে খোঁচাচ্ছিল তা হল মেয়েটার ওপর তার খানিকটা ঝোঁক ছিল। কিন্তু মেয়েটিকে যে একচোট শিক্ষা দিতে হবে সে-ব্যাপারে সে দৃঢ়।
তার প্রথম পরিকল্পনা হল, বলল সে, মেয়েটিকে একটি হোটেলে নিয়ে তোলা এবং স্পেশাল পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশদের সে তাল দেবে যাতে মেয়েটার। নাম খাতায় সাধারণ পতিতা হিসেবে তোলা হয়। মেয়েটা তা হলে নিশ্চয় খেপে যাবে। তারপর, অন্ধকার জগতের বাসিন্দা তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে সে। পরামর্শ চেয়েছিল যারা মেয়ে রাখে তাদের থেকে যা পারে নিংড়ে নেয়ার জন্যে। কিন্তু, তারাও এমন কোনো পরামর্শ দিতে পারেনি। তবুও সে দেখল, তারা যা বলছে তা তাদের লাইনে হয়তো ঠিক; কিন্তু যখন তুমি জানো না, তোমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকে কী করবে তখন ঐ লাইনে গিয়ে লাভ কী? এটা যখন সে তাদের জানাল তখন তারা পরামর্শ দিল তার শরীরে ‘দাগ’ দিয়ে দিতে। কিন্তু এটাও সে চাচ্ছে না। এর জন্যে অনেক চিন্তাভাবনা দরকার…কিন্তু, প্রথমে, সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। তবে তা জিজ্ঞেস করার আগে যে কাহিনীটা সে শোনাল সে-সম্পর্কে সাধারণভাবে সে আমার মতামত জানতে চায়।
বললাম, আমার কোনো মতামত নেই তবে গল্পটা বেশ মজাদার।
তোমার কি মনে হয় মেয়েটা সত্যিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
আমাকে স্বীকার করতে হল যে ব্যাপারটা অনেকটা ঐরকমই বইকি। তখন সে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার শাস্তি হোক এ যদি আমি না চাই তবে তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম। বললাম, এ-অবস্থায় পড়লে কী করা উচিত সে-সম্পর্কে কেউই কিছু বলতে পারে না। তবে আমি এটা বুঝেছি যে সে চায় মেয়েটা কষ্ট পাক।
আমি আরও কিছু মদ খেলাম আর রেমন্ড আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সে কী করতে চায় তার ব্যাখ্যা শুরু করল। সে তাকে একটা চিঠি লিখতে চায়, সত্যিকারের জঘন্য ভাষায় যা তাকে অকূল পাথারে ফেলবে আর সঙ্গে সঙ্গে এটা পড়ে সে আগের ঘটনার জন্যে অনুশোচনা করবে। তারপর মেয়েটি যখন ফিরে আসবে তখন সে তার সঙ্গে বিছানায় যাবে এবং মেয়েটি একটু তেতে উঠলেই সে তার মুখে থুতু দিয়ে ঘরের বার করে দেবে। আমি তার সঙ্গে একমত হয়ে বললাম, প্ল্যানটা মন্দ নয়; এই তার উপযুক্ত শাস্তি।
কিন্তু রেমন্ড বলল, যেরকমভাবে চিঠিটা লেখা উচিত সেরকমভাবে তা সে লিখতে পারছে না এবং এখানেই আমি তাকে সাহায্য করতে পারি। যখন আমি চুপ করে রইলাম তখন সে বলল, এটা করতে কি আমি কিছু মনে করব। বললাম, ‘না’। চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।
এক পাত্তর মদ খেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্লেট এবং কিছু ঠাণ্ডা পুডিং যা পড়ে ছিল সরিয়ে টেবিলে জায়গা করে দিল। এরপর যত্ন করে অয়েলক্লথটা মুছে বেডসাইড টেবিল থেকে একটুকরো কাগজ আনল। তারপর আনল একটি খাম, ছোট লাল কলমদানি এবং চৌকো এক দোয়াতদানি যাতে কালো কালি ভরা। যে মুহূর্তে সে মেয়েটার নাম বলল সে-মুহূর্তে বুঝে ফেললাম যে মেয়েটি একজন মুর।
লিখলাম চিঠিটা। খুব বেশি ঝামেলা হল না। কিন্তু রেমন্ডকে আমি খুশি করতে চাইছিলাম যেহেতু ওকে অখুশি করার কোনো কারণ নেই। তারপর আমি কী লিখছি তা পড়লাম। সিগারেট টানতে টানতে এবং মাথা নাড়তে নাড়তে শুনল সে। ‘দয়া করে আবার পড়ো’, বলল সে। মনে হল সে খুশি হয়েছে। ‘আহ্ এই তো চাই।’ জিভ দিয়ে শব্দ করল সে। আরে ইয়ার তোমার তো দারুণ বুদ্ধি, কত ধানে কত চাল তা দেখি তুমি জানো।
‘ইয়ার’ শব্দটি প্রথমে খেয়াল করেনি। সেটা খেয়াল করলাম তখন, যখন সে আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘এখন থেকে আমরা বন্ধু, কী বলো?’ চুপ করে রইলাম। কথাটা আবার বলল সে। অবশ্য এতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন সে কথাটার উপর জোর দিল তখন মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’।
চিঠিটা সে খামে পুরল এবং আমরা মদ শেষ করলাম। তারপর নিঃশব্দে আমরা কয়েক মিনিট সিগ্রেট টানলাম। রাস্তা বেশ শান্ত, খালি কখনও কখনও দুএকটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ। অবশেষে বললাম, রাত হয়ে যাচ্ছে। রেমন্ডও তা স্বীকার করল। ‘আজকের বিকেলটা বেশ দ্রুত কেটে গেল’, যোগ করল সে, এবং একদিক থেকে কথাটা সত্যি। আমি বিছানায় যেতে চাইছিলাম যদিও মনে হচ্ছিল ওঠার কোনো শক্তি নেই। আমাকে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, কারণ রেমন্ড বলল, ‘একজনকে অযথা বিরক্ত করা উচিত নয়।‘ প্রথমে কথাটার মানে বুঝলাম না। তখন সে জানাল আমার মায়ের মৃত্যুর খবর সে শুনেছে; যাক, বলল সে, এটা একসময়-না-একসময় ঘটতই। কথাটা আমার পছন্দ হল এবং তাকে তা জানালাম।
যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন রেমন্ড বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমার করমর্দন করে বলল যে, মানুষ সবসময় একে অন্যকে বুঝতে পারে। দরজা ভেজিয়ে ল্যান্ডিঙে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সমস্ত বাড়িটা কবরের মতো নিঃশব্দ। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। আমি আমার কানে রক্তের দপদপানি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তা ই শুনলাম। তারপর বুড়ো সালামানোর ঘরে তার কুকুরটা ফোঁপাতে লাগল। এবং এই ঘুমন্ত বাড়ির মাঝে শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল, অন্ধকার আর নৈঃশব্দে একটি ফুল ফুটে ওঠার মতো।
.
৪.
পুরো সপ্তাহটা বেশ ব্যস্তভাবে কাটল অফিসে। রেমন্ড একবার এসে বলে গেল যে, চিঠিটা সে ডাকে দিয়েছে। ইমানুয়েলের সঙ্গে দুবার গিয়েছিলাম সিনেমায়। পরদায় কী ঘটছে তা সে প্রায়ই বুঝতে পারে না এবং অনবরত তাকে তা বুঝিয়ে বলার অনুরোধ করে। গতকাল ছিল শনিবার এবং কথামতো মারি এল। পরনে তার চমকার লাল-শাদা ডোরাকাটা পোশাক, পায়ে স্যান্ডেল, এত সুন্দর লাগছিল যে, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল তার ছোট দৃঢ় স্তনরেখা আর তার রোদে-পোড়া মুখটাকে লাগছিল বেগুনি বাদামি রঙের ফুলের মতো। বাসে করে, আলজিয়ার্স থেকে কয়েক মাইল দূরে এক পরিচিত সৈকতে গেলাম আমরা। দুপাশে ছোট টিলার মাঝে বালির একটা টুকরো যেন, জলের ধার-ঘেঁষে পেছনে নল-খাগড়ার ঝোঁপ। গরম লাগছিল না তেমন আর পানিটাও ছিল কুসুম কুসুম। ছোট ছোট ঢেউগুলি অলসভাবে হামাগুড়ি খাচ্ছিল বালির ওপর।
মারি আমাকে নতুন এক খেলা শেখাল। খেলাটা হল, সাঁতার কাটার সময়, ঢেউ থেকে ফেনাটা মুখে নেয়া এবং মুখভরতি ফেনা নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুলকুচা করা। পানিটা শূন্যে কেমন একটা আবছায়া ভাব সৃষ্টি করত, নয়তো উষ্ণ প্রস্রবণের স্রোতের মতো মুখে এসে পড়ত। কিন্তু শীঘ্রই নুনের জন্যে আমার মুখ জ্বালা করতে লাগল; তারপর মারি এসে জলের ভিতর আলিঙ্গন করে আমায় চুমো খেল। তার জিভ শীতল করে তুলল আমার ঠোঁট এবং সাঁতরে তীরে ফেরার আগে মিনিট দুএক ঢেউগুলিকে খেলা করতে দিলাম আমাদের নিয়ে।
কাপড় পরা হলে পরিপূর্ণ চোখে মারি তাকাল আমার দিকে। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ। চুমো খেলাম তাকে; তারপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কথা বললাম না। মারির কোমর জড়িয়ে এগোতে লাগলাম। দুজনই ব্যস্ত ছিলাম বাস পরার জন্যে। এবং বাসায় ফিরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। আমি আমার জানালা খুলে রেখেছিলাম, এবং খুব আরাম লাগছিল যখন অনুভব করলাম আমাদের সূর্যস্নাত শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া।
মারি জানাল, আগামীকাল সকালে তার কোনো কাজ নেই, সুতরাং দুপুরের খাবারটা আমার সঙ্গেই সারার প্রস্তাব করলাম। রাজি হল সে, এবং আমি নিচে নেমে গেলাম কিছু মাংস কিনতে। ফেরার সময় রেমন্ডের ঘরে এক মেয়ের গলা শুনলাম। কিছুক্ষণ পর বুড়ো সালামানো শুরু করল তার কুকুরের ওপর হম্বিতম্বি এবং খানিক পরই কাঠের সিঁড়িতে বুট এবং থাবার শব্দ, তারপর ‘নোংরা জানোয়ার! চল ব্যাটা খেকি কুত্তা। তারা দুজনই বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। মারিকে বুড়োর এই অভ্যাসের কথা জানালাম এবং তা শুনে সে হাসল। পরনে তার আমার একটা পাজামা সুট এবং জামার হাতা গোটানো। সে যখন হাসল তখন আমি তাকে আবার চাইলাম। খানিক পর সে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। বললাম, এরকম প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না; তবে আমার মনে হয় না তাকে আমি ভালোবাসি। একথা শুনে সে কিছুক্ষণের জন্যে মুখভার করে রইল। কিন্তু যখন আমরা দুপুরের খাবার ঠিক করছিলাম তখন সে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং হাসতে শুরু করল। সে যখন হাসে তখন তাকে আমার চুমো খেতে ইচ্ছে করে। আর ঠিক তখন রেমন্ডের ঘরে শুরু হল চাচামেচি।
প্রথমে শুনলাম গলা চড়িয়ে উত্তপ্তস্বরে একটি মেয়ে যেন কী বলল; তারপর রেমন্ডের তর্জনগর্জন, তুই আমাকে অপমান করেছিস্ কুত্তি। এর শোধ কীভাবে নিতে হয় তা তোকে শেখাচ্ছি। ধুপধাপ কিছু আওয়াজ শোনা গেল, তারপর এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ-এ-ধরনের চিৎকার মানুষের রক্ত হিম করে দেয়–কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ডিঙে ভিড় জমে গেল। মারি এবং আমি বের হলাম দেখতে। মেয়েটা তখনও চাঁচাচ্ছিল এবং রেমন্ড তখনও তাকে পেটাচ্ছিল। মারি বলল, ব্যাপারটা কি বীভৎস নয়? উত্তরে কিছুই বললাম না। তারপর সে আমায় বললে পুলিশ ডেকে আনতে, কিন্তু আমি জানালাম, পুলিশ আমি মোটেই পছন্দ করি না। যাহোক, একজন এল অবশেষে, তার সঙ্গে দোতলার বাসিন্দা এক মিস্ত্রি। দরোজায় টোকা পড়তেই ভেতরের হৈচৈ থেমে গেল। আবার সে টোকা দিল, কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটা ফের কান্না শুরু করল এবং রেমন্ড খুলে দিল দরজা। ঠোঁটে তার আলগোছে ধরা একটা সিগারেট, মুখে পাঞ্জু হাসি। তোমার নাম?’ নিজের নাম বলল রেমন্ড। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের সিগারেট নামাও।’ বিরক্তির সঙ্গে বলল পুলিশটা। ইতস্তত করল রেমন্ড, তাকাল আমার দিকে এবং সিগারেট মুখেই রাখল। পুলিশটা নিপুণভাবে তার বা চোয়ালে ঘুসি চালাল। সিগারেটটা তার ঠোঁট থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল কয়েক গজ দূরে। বিনীতভাবে তারপর সে জিজ্ঞেস করল, সিগারেটটা কি সে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে পারে? অফিসারটি বলল, ‘নাও’, এবং যোগ করল, ‘খেয়াল রেখো, এরপর এধরনের কোনোকিছু সহ্য করতে আর আমরা রাজি নই, বিশেষ করে তোমার মতো ব্যাটাচ্ছলে থেকে।‘
মেয়েটা ইতিমধ্যে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল, ‘কাপুরুষটা আমায় মেরেছে। বেশ্যার একটা দালাল।’
‘মাপ করবেন অফিসার’, বলল রেমন্ড, ‘আইনে কি আছে যে সাক্ষীদের সামনে একটি লোককে বেশ্যার দালাল বলা যেতে পারে?
পুলিশ তাকে তার ‘রকবাজি’ থামাতে বলল।
রেমন্ড তখন মেয়েটার দিকে ফিরে বলল, ‘কিছু ভেবো না সজনী, আবার দেখা হবে।‘
‘ব্যস, যথেষ্ট’, বলল পুলিশটি এবং মেয়েটিকে সেখান থেকে চলে যেতে হুকুম করল। যতক্ষণ থানা থেকে সমন না আসছে ততক্ষণ রেমন্ডকে ঘরে থাকতে হবে। ‘তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।’ বলল পুলিশটি, ‘এত কী টেনেছ যে দাঁড়াতেও পারছ না! কী ব্যাপার, টলছ কেন এত?’ রেমন্ড বলল, ‘টানিনি। যখন দেখি আপনাদের কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তখন কাঁপতেই হয়। সেটাই স্বাভাবিক।‘
তারপর সে দরজা বন্ধ করল এবং আমরা সবাই চলে এলাম। মারি আর আমি আমাদের দুপুরের খাবার ঠিক করলাম। কিন্তু তার খিদে ছিল না তাই প্রায় পুরোটাই আমি খেলাম। একটার সময় সে চলে গেল এবং তারপর আমি খানিকক্ষণ ঘুমোলাম।
তিনটের সময় দরজায় টোকা, রেমন্ড ঢুকল ভেতরে। বসল সে আমার খাটের কোনায় এবং দুএক মিনিট কিছু বলল না। কীভাবে সব হল, জিজ্ঞেস করলাম তাকে। বলল সে, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে বেশ মসৃণ গতিতেই কাজ এগোচ্ছিল; কিন্তু মেয়েটা যখন তাকে চড় মারল এবং চোখে সে সর্ষেফুল দেখতে পেল, ঠিক তখনই মেয়েটাকে ধরে সে পেটাতে লাগল। তার পরের ঘটনা। আমাকে বলার কোনো দরকার নেই। কারণ তখন আমি ছিলাম সেখানে।
‘ভালো’, বললাম আমি, ‘তুমি তাকে একচোট নিয়েছ এবং তোমার ইচ্ছেও ছিল তা-ই, ঠিক না?’
একমত হল সে এবং বোঝাল, পুলিশ যা-ই করুক না কেন তার শাস্তি সে। পেয়েছে। পুলিশের কথা ধরলে, তাদের কীভাবে ঢিট করতে হয় তা তার ভালো জানা আছে। কিন্তু সে জানতে চাইল, পুলিশ যখন তাকে ঘুসি মেরেছিল তখন কি আমি ভেবেছিলাম যে বিনিময়ে সেও একটা মারবে।
আমি তাকে বললাম যে আমি কিছুই ভাবিনি এবং পুলিশের ব্যাপারে মাথা ঘামাতেও আদৌ রাজি নই। মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছে রেমন্ড। জিজ্ঞেস করল, আমি তার সঙ্গে বেড়াতে যাব কি না। বিছানা ছেড়ে উঠে আমি চুল আঁচড়াতে লাগলাম। তারপর রেমন্ড বলল, সে যা চায় তা হল আমি যেন তার হয়ে সাক্ষী দিই। জানালাম, আমার কোনো আপত্তি নেই; তবে আমি বুঝতে পারছি না তার হয়ে আমাকে কী বলতে হবে।
‘এ তো সামান্য ব্যাপার’, উত্তর দিল সে, তোমাকে শুধু তাদের বলতে হবে যে মেয়েটা আমাকে অপমান করেছিল।
সুতরাং আমি তার সাক্ষী হতে রাজি হলাম।
একসঙ্গে বেরুলাম আমরা এবং রেমন্ড এক কাফেতে আমাকে ব্রান্ডি খাওয়াল। তারপর এক গেম বিলিয়ার্ড খেলোম আমরা; খেলাটা বেশ জমেছিল এবং মাত্র কয়েক পয়েন্টে হারলাম। তারপর সে প্রস্তাব করল বেশ্যালয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমি আপত্তি জানালাম; আমার ইচ্ছে করছিল না। আস্তে আস্তে হেঁটে যখন আমরা ফিরছিলাম তখন সে বলল, তার রক্ষিতাকে একচোট নিতে পারায় সে খুব সন্তুষ্ট হয়েছে। নিজেকে সে অত্যন্ত আন্তরিক করে তুলল আমার কাছে এবং আমাদের বেড়ানোটা আমি বেশ উপভোগ করলাম। বাসার কাছে যখন এলাম তখন দেখি বুড়ো সালামানো দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। দেখলাম তার কুকুরটা নেই তার সঙ্গে। লাটুর মতো ঘুরে ঘুরে সে দেখছিল চারদিক এবং মাঝে মাঝে রক্তিম চোখ নিয়ে তাকাচ্ছিল হলঘরের অন্ধকারের দিকে। এবং তারপর বিড়বিড় করে পায়চারি করছিল রাস্তায়।
রেমন্ড ব্যাপারটা জানতে চাইল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর পেল না। তারপর শুনলাম, ঘোঁতঘোঁত করে সে বলছে, ‘জারজ নোংরা জানোয়ার!’ যখন জিজ্ঞেস করলাম তার কুকুরটা কোথায় তখন ভ্রুকুটি করে সে আমার দিকে তাকাল এবং রুক্ষস্বরে বলে উঠল, ‘চলে গেছে!’ খানিক পর হঠাৎ করে সে সব বলতে লাগল।
‘যথারীতি আমি তাকে প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে গেছিলাম। আজ এক মেলা বসার দরুন সেখানে দারুণ ভিড় হয়েছিল। এত ভিড় যে চলাফেরা করাই মুশকিল। আমি এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম হাতবন্ধ রাজাকে দেখতে। তারপর যখন আবার রওনা হব তখন দেখি কুকুরটা উধাও। ভাবছিলাম ছোট্ট একটা কলার কিনব কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি ব্যাটা এভাবে কলারের ফাঁক দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।‘
রেমন্ড তাকে আশ্বাস দিল যে কুকুরটি পথ খুঁজে ফিরে আসবে এবং তাকে সে সেইসব কুকুরের গল্প শোনাল যারা মাইলের পর মাইল হেঁটে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ মনিবের কাছে। কিন্তু এসব শুনে মনে হল বুড়োটা আরও চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
‘বুঝতে পারছ না, তাকে তো মেরে ফেলবে; মানে পুলিশের কথা বলছি। আর ঐ ঘেয়ো কুকুরটাকে নিয়ে গিয়ে কেউ যত্নআত্তি করবে তাও তো মনে হয় না।’
আমি তাকে জানালাম, পুলিশস্টেশনে একটি খোয়াড় আছে। সেখানে সব হারানো কুকুর নিয়ে রাখা হয়। তার কুকুর নিশ্চয় আছে সেখানে। কিছু জরিমানা দিলেই তারা কুকুর দিয়ে দেবে। জিজ্ঞেস করল সে, কত জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু আমি তা বলতে পারলাম না। সে আবার রেগে গেল। ‘ঐ হতচ্ছাড়া কুত্তাটার জন্যে বুঝি আমি টাকা দেব? মোটেই না। তাকে মেরে ফেললেই আমি খুশি হব।’ অতঃপর কুকুরটাকে সে তার পুরনো গালিগালাজ শুরু করল।
রেমন্ড হেসে ঢুকে পড়ল হলে। দোতলা পর্যন্ত আমি অনুসরণ করলাম তাকে এবং ল্যান্ডিঙের কাছে এসে আলাদা হলাম দুজনে। মিনিট দুএক পর সিঁড়িতে শোনা গেল সালামানোর পদশব্দ। তারপর আমার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
আমি যখন দরজা খুলোম তখন সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।
‘মাপ করো… আমি বোধহয় তোমাকে বিরক্ত করছি না।’
ভিতরে আসতে বললাম তাকে, কিন্তু সে মাথা নাড়ল। সে তাকিয়ে ছিল তার পায়ের দিকে এবং শিরাবহুল হাতটা তার কাঁপছিল। আমার চোখ এড়িয়ে সে বলতে লাগল :
‘তারা নিশ্চয় আমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে যাবে না, তাই না সঁসিয়ে মারসো? নিশ্চয় তারা ও-ধরনের কোনো কাজ করবে না। যদি তারা তা করে তবে আমার যে কী হবে তা আমি ভাবতেও পারছি না।’
তাকে বললাম, যদুর জানি, হারানো কুকুর তারা তিনদিন খোয়াড়ে রাখে তাদের মনিবদের জন্য। তারপর তাদের ইচ্ছেমতো কুকুরগুলির ব্যবস্থা করে।
একমুহূর্ত নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘শুভরাত্রি’। তারপর বেশ কিছুক্ষণ তার ঘরে পায়চারির আওয়াজ পেলাম। এরপর তার বিছানার শব্দ। দেয়ালের ওপাশ থেকে শোনা গেল ফোঁপানির আওয়াজ। অনুমান করলাম, সে কাঁদছে। কী কারণে জানি না, হঠাৎ আমি আমার মার কথা ভাবতে লাগলাম, কিন্তু আগামীকাল আমাকে উঠতে হবে খুব ভোরে, এবং খিদে যেহেতু ছিল না, সেহেত খাবার না-খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
.
৫.
অফিসে টেলিফোন করল রেমন্ড। তার এক বন্ধুর কাছে আমার কথা বলেছিল সে, জানাল রেমন্ড, এবং সেই বন্ধু আলজিয়ার্সের বাইরে সমুদ্রতীরে তার ছোট বাংলোয় আমাকে আগামী রোববারটা কাটাতে নিমন্ত্রণ করেছে। জানালাম আমি, যেতে পারলে খুবই খুশি হতাম, কিন্তু একটি মেয়েকে কথা দিয়েছি রোববারটা তার সঙ্গে কাটাব বলে। সঙ্গে সঙ্গে রেমন্ড জানাল, তাকে নিয়ে এলেও ক্ষতি নেই। আসলে মেয়েটিকে নিয়ে এলে তার বন্ধুর বউ খুবই খুশি হবে, পুরুষদের পার্টিতে একা মেয়ে না-হওয়ার জন্যে।
তখুনি আমি ফোনটা রেখে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, আমার কর্তা ব্যক্তিগত আলাপের জন্যে অফিসের ফোন ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। কিন্তু রেমন্ড আমায় ধরে রাখতে বলল; আমাকে আরও কিছু তার বলার আছে এবং সেজন্যেই আসলে টেলিফোন করা, নয়তো নিমন্ত্রণটা পৌঁছে দেয়ার জন্যে বিকেল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারত। ব্যাপারটা হল, বলল সে, সকাল থেকে কয়েকটা আরব আমাকে অনুসরণ করছে। তার মধ্যে সে-মেয়েটির ভাইও আছে যার সঙ্গে আমার। একচোট হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে যদি তাকে তুমি বাসার সামনে ঘোরাফেরা করতে দ্যাখো, তা হলে আমাকে জানিয়ো।’
বললাম, ঠিক আছে।
আর ঠিক ঐ সময়ই কর্তা আমাকে ডেকে পাঠালেন। অল্পক্ষণের জন্যে অস্বস্তি লাগল, কারণ মনে হল, তিনি আমায় ডেকে বলবেন বন্ধুর সঙ্গে গালগল্প করে অযথা সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করতে। যাহোক, সেরকম কিছুই হল না। একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তিনি আমায় ডেকেছিলেন, কারণ তিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলেন না। পরিকল্পনাটা হল, ডাকের ঝামেলা এড়িয়ে, বড় বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাৎক্ষণিক লেনদেনের জন্যে প্যারিসে একটা শাখা খোলা হবে এবং তিনি জানতে চান, আমি সেখানে কাজ করব কি না।
‘তোমার বয়স কম’, বললেন তিনি, ‘এবং আমি নিশ্চিত যে প্যারিসে তুমি চমৎকারভাবে দিন কাটাতে পারবে। তা ছাড়া বছরের কয়েক মাস তো ফ্রান্সের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারছই।’
বললাম, যেতে আমার বিশেষ কোনো আপত্তি নেই, তবে সত্যি বলতে কি আমাকে পাঠানো হোক বা না-হোক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।
তারপর তিনি, জীবন বদলানো, কথাটাকে ওভাবেই বললেন তিনি, কি আমার কাছে কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না। উত্তরে বললাম, কেউ কারো সত্যিকার জীবন বদলাতে পারে না; যাহোক, এক জীবন আরেক জীবনের মতোই ভালো এবং আমার বর্তমান চমৎকারভাবে খাপ খাচ্ছে আমার সঙ্গে।
এতে মনে হল, তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং বললেন, আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না এবং কোনো উচ্চাশাও নেই আমার, যা তার মতে অতি মারাত্মক দোষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে।
নিজের কাজে ফিরে এলাম। তাকে অসন্তুষ্ট করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, কিন্তু জীবন-বদলাবার’ কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। আমার বর্তমান জীবন মোটেই অসুখী নয়। তিনি যে-ধরনের উচ্চাশার কথা বলেছিলেন, ছাত্র থাকাকালীন সে-ধরনের প্রচুর উচ্চাশা আমার ছিল। কিন্তু পড়াশোনায় যখন ইস্তফা দিতে হল তখন শীঘ্রই বুঝলাম এ সবকিছুই নিরর্থক।
মারি সেদিন বিকেলে এসে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে বিয়ে করব কি না। জানালাম, আমার কোনো আপত্তি নেই; বিয়েতে সে যদি এতই ইচ্ছুক হয় তা হলে আমরা বিয়ে করব।
তখন সে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। প্রায় আগের মতোই আমি উত্তর দিলাম, তার প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না– তবে আমার মনে হয় তাকে আমি ভালোবাসি না।
‘তুমি যদি তাই মনে করো’, বলল সে, ‘তবে আমায় বিয়ে করছ কেন?’
বললাম, এর কোনো গুরুত্ব নেই। তবে বিয়েটা যদি তাকে আনন্দ দেয় তা হলে এক্ষুনি আমরা বিয়ে করতে পারি। তাকে জানালাম, প্রস্তাবটা তার কাছ থেকেই এসেছে; আমার কথা ধরলে আমি শুধু বলব ‘হ্যাঁ।‘
তখন সে বলল, বিয়েটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।
উত্তরে আমি বললাম : ‘না’।
তারপর সে নিঃশব্দে বিচিত্র দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। এবং খানিক পর জিজ্ঞেস করল :
‘আরেকটি মেয়ে এসে যদি তোমাকে বিয়ে করতে বলে তাকে, মানে, এমন একটি মেয়ে যাকে তুমি আমার মতোই পছন্দ করো তা হলে কি তুমি “হাঁ” বলবে?’
‘স্বাভাবিকভাবেই।‘
তখন সে বলল, ভেবে সে অবাক হচ্ছে সত্যিই কি সে আমাকে ভালোবাসে, না বাসে না। আমার পক্ষে এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে ‘আমি যে এক অদ্ভুত লোক’ সে-সম্পর্কে সে কিছু বলল। বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সেজন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি’, বলল সে, কিন্তু একদিন এজন্যেই বোধহয় তোমাকে ঘৃণা করা শুরু করব।’
এর উত্তরে আমার আর কিছুই বলার ছিল না, সুতরাং আমি কিছুই বললাম না।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল মারি। তারপর হাসতে শুরু করল এবং আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, সে অত্যন্ত আন্তরিক; সত্যিই সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
‘ঠিক আছে’, বললাম আমি, ‘তুমি যে-সময় বলবে সে-সময়ই আমাদের বিয়ে হবে।’ তারপর আমার কর্তা আমাকে যে-প্রস্তাব জানিয়েছেন মারিকে তা বললাম। এবং মারি জানাল, প্যারিস যেতে পারলে সে খুবই খুশি হবে।
আমি যখন তাকে জানালাম, প্যারিসে আমি কিছুদিন ছিলাম তখন সে জিজ্ঞেস করল, শহরটা দেখতে কেমন। শহরটা ঘিঞ্জি বলেই তো আমার মনে হয়। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এবং অসংখ্য কবুতর। লোকগুলোর মুখ ফ্যাকাশে যেন সবাই ব্যর্থ হয়েছে সব কাজে।
তারপর শহরের মাঝ দিয়ে যে সদর রাস্তা চলে গেছে সে-রাস্তা ধরে আমরা বেড়াতে বের হলাম। মহিলারা বেশ সেয়ানা এবং মারিকে জিজ্ঞেস করলাম এটা সে লক্ষ করেছে কি না। হ্যাঁ, বলল সে, আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা সে বুঝেছে। এরপর কয়েক মিনিট আমরা কোনো কথা বললাম না। যাহোক, আমি চাচ্ছিলাম না মারি আমাকে এখন ছেড়ে যাক। তাই প্রস্তাব করলাম, সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে। আমার সঙ্গে খেতে পারলে খুবই খুশি হত সে, জানাল মারি, কিন্তু আগে থেকেই বিকেলে তার প্রোগ্রাম করা আছে। আমরা প্রায় আমার বাসার কাছাকাছি এলে আমি বললাম; তা হলে বিদায়!
আমার চোখে চোখ রাখল সে।
তুমি কি জানতে চাও না আজ বিকেলে আমি কী করছি?
জানতে চাচ্ছিলাম না আমি এবং সেটা তাকে জিজ্ঞেস করতেও আমার মনে ছিল না, কিন্তু মনে হল এজন্যে বুঝি মারি অভিযোগ জানাচ্ছে। নিশ্চয় আমাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল কারণ হঠাৎ সে হাসতে শুরু করল এবং আমার দিকে নুয়ে চুমোর জন্যে ঠোঁট বাড়িয়ে দিল।
সেলেস্তের ওখানে আমি একাই গেলাম। তখন মাত্র আমি খাবারে হাত দিয়েছি। এমন সময় কুৎসিত ছোটখাটো এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি আমার টেবিলে বসতে পারেন কি না। নিশ্চয় পারেন। মুখ তার গোলগাল, পাকা আপেলের মতো। উজ্জ্বল চোখ, এবং চলাফেরা করছিলেন তিনি অদ্ভুত এক লাফানোর ভঙ্গিতে, যেন দাঁড়িয়ে আছেন তারের ওপর। নিজের আঁটসাট জ্যাকেটটা খুলে তিনি বসে মনোযোগের সঙ্গে খাবারের দাম দেখছিলেন। তারপর সেলেস্তেকে ডেকে অর্ডার দিলেন বেশ দ্রুতভাবে, কিন্তু পরিষ্কার করে; প্রত্যেকটি শব্দ বোঝা যায় মতো। হর্স দ্য অভরের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তিনি তার ব্যাগ খুলে একটা পেনসিল আর একটুকরো কাগজ বের করে খাবারের দাম হিসেব করলেন। তারপর আবার ব্যাগ হাতড়িয়ে ছোট একটি পার্স বের করে নির্দিষ্ট দামের সঙ্গে অল্পকিছু বখশিশ যোগ করে রাখলেন নিজের সামনে কাপড়ে।
ঠিক তখুনি ওয়েটার ‘হর্স দ্য অভর’ এনে হাজির করলে মহিলা প্রায় নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে তা খেতে শুরু করলেন। তারপর দ্বিতীয় পদের জন্যে অপেক্ষা করার সময় আরেকটা পেনসিল, এবারেরটা নীল রঙের এবং সামনের সপ্তাহের একটা রেডিও ম্যাগাজিন বের করে প্রতিদিনের প্রায় প্রতিটি প্রোগ্রামের পাশে দাগ দিতে লাগলেন। ম্যাগাজিনে প্রায় ডজনখানেক পৃষ্ঠা ছিল এবং খাবারের পুরোটা সময় তিনি তা দেখলেন অতীব মনোযোগের সঙ্গে। আমি যখন আমার খাবার শেষ করলাম তখনও তিনি সেই অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে দাগ দিয়ে চলেছেন। তারপর উঠলেন, ঠিক আগের মতোই রোবটের ভঙ্গিমায় জ্যাকেট গলিয়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
কিছুই করার ছিল না বলে আমি তাকে খানিকটা পথ অনুসরণ করলাম। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে সোজা তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন, পিছন না-ফিরে, কোনো দিকে না-তাকিয়ে এবং ছোটখাটো আকার সত্ত্বেও যেরকম দ্রুতভাবে তিনি হাঁটছলেন তা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। আসলে তার গতির সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারছিলাম না এবং শীঘ্রই আমি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। তাই ফিরে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণের জন্যে এই ‘ছোট রোবট’ (তাঁকে দেখে আমার তা-ই মনে হয়েছিল) আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমি তার কথা ভুলে গেলাম।
যখন আমি আমার ঘরের দিকে এগোচ্ছি তখন দেখা হল সালামানোর সঙ্গে। আমি তাকে ঘরে আসতে বললাম এবং সে জানাল তার কুকুরটা নিশ্চয় হারিয়ে গেছে। সে গিয়েছিল খোয়াড়ে খোঁজ নিতে কিন্তু ওখানে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং কর্মচারীরা জানিয়েছে, কুকুরটা বোধহয় মারা পড়েছে রাস্তায়। যখন সে জিজ্ঞেস করল, থানাতে খোঁজ নিলে কোনো লাভ হবে কি না তখন তারা জানাল, রাস্তার কুকুর মারা পড়ল কি পড়ল না তার খোঁজ রাখার চেয়েও জরুরি কাজ তাদের করতে হয়। আমি প্রস্তাব করলাম আরেকটি নতুন কুকুর আনতে। কিন্তু যুক্তিসহ সালামানো বোঝাল এটার সঙ্গে থাকতে থাকতে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল; আর নতুন একটা আনলেও ঠিক আগের মতো হবে না।
আমি আমার বিছানায় বসেছিলাম পা তুলে আর সালামানো বসেছিল টেবিলের পাশে হাঁটুতে হাত রেখে। তার জীর্ণ ফেল্টহ্যাটটা ছিল তার কাছেই এবং ধুলোটে ও হলদেটে গোঁফের আড়ালে সে বিড়বিড় করছিল। আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছিল তার সান্নিধ্য, কিন্তু কিছুই করার ছিল না এবং ঘুমও আসছিল না। সুতরাং কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি তাকে তার কুকুর সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম–কতদিন কুকুরটা তার কাছে ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলল সে, তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরই কুকুরটা পেয়েছিল সে। বিয়ে করেছিল সে বেশ বয়সে। যুবক থাকাকালীন সে চেয়েছিল অভিনেতা হতে; সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার সময় প্রায়ই সে সৈন্যদের মঞ্চে অভিনয় করত এবং অভিনয় মোটামুটি ভালোই করত, অন্তত লোকে তা-ই বলত। শেষে সে চাকরি নিয়েছিল রেলওয়েতে এবং সেজন্যে তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ এ-চাকরির জন্যেই সে এখন ছোটখাটো একটা পেনশন পাচ্ছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনাবনি তার ছিল না, কিন্তু তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল একে অন্যের সঙ্গে থাকতে এবং স্ত্রী মারা গেলে সে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকে। তার রেলওয়ের এক বন্ধুর কুকুরের কয়েকটা বাচ্চা হওয়াতে সে তাকে একটি বাচ্চা দিতে। চেয়েছিল এবং সঙ্গী হিসেবে তখন সে তা গ্রহণ করেছিল। প্রথমে সে বাচ্চাটাকে বোতলে করে দুধ খাওয়াত। কিন্তু মানুষের চাইতে কুকুরের জীবন ছোট, তাই বলতে গেলে তারা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে।
‘কুকুরটা ছিল বদমেজাজি’, বলল সালামানো, ‘যখন-তখন আমাদের মধ্যে একচোট হয়ে যেত, কিন্তু তবুও বদমাশটা ছিল ভালো।’ বললাম, কুকুরটাকে দেখে বেশ ভালো জাতের মনে হত এবং একথা বুড়োকে বেশ সন্তুষ্ট করল।
‘আহ্, তার অসুখের আগে তাকে দেখা তোমার উচিত ছিল’, বলল সে, ‘যা চমৎকার পশম ছিল ওর এবং ঐটেই ছিল দেখার জিনিস। অনেক চেষ্টা করেছি তাকে ভালো করতে। চর্মরোগ হওয়ার পর প্রতিরাতে তার চামড়ায় আমি মলম লাগাতাম। কিন্তু আসল কথা হল বয়স এবং তার কোনো ওষুধ নেই।’
ঠিক সে-সময় আমি হাই তুললাম। এবং বুড়ো বলল, তার এবার ওঠা উচিত। তাকে বললাম, আরও খানিকটা সে বসতে পারে এবং তার কুকুরের ব্যাপারটার জন্যে আমি দুঃখিত। ধন্যবাদ জানিয়ে সালামানো জানাল, আমার মা কুকুরটাকে খুব পছন্দ করতেন। মাকে সে ‘তোমার বেচারি মা’ বলে উল্লেখ করল এবং বলল তাঁর মৃত্যু নিশ্চয় আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। আমি যখন বললাম, না, তখন সে খানিকটা দ্রুত এবং খানিকটা অপ্রতিভভাবে বলল, রাস্তায় কিছু লোক আমার সম্পর্কে বেশ আজেবাজে কথা বলছে যেহেতু মাকে আমি আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো জানে আসল ব্যাপারটা; মা’র আমি কী দারুণ ভক্ত ছিলাম।
উত্তর দিলাম–কেন, আমি এখনও জানি না লোকদের মনে যে আমার। সম্পর্কে এরকম বাজে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা আমাকে অবাক করছে। আমি যেহেতু তাঁকে এখানে রাখতে পারছিলাম না সেহেতু বাধ্য হয়েই তাঁকে আশ্রমে পাঠাতে হয়েছিল। সে যাহোক, বললাম, বহু বছর ধরে আমাকে বলার আর তার কোনো কথা ছিল না এবং আমি লক্ষ করছিলাম কথাবলার লোকের অভাবে তিনি। সদা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন।
‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘আশ্রমে যে-কেউ সহজেই বন্ধু যোগাড় করে ফ্যালে।
উঠে দাঁড়াল সে। বলল, অনেক রাত হয়েছে। এখন তার ঘুমানো দরকার। এবং এই নতুন ব্যবস্থা তার জীবনে খানিকটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এতদিনের পরিচয়ের মধ্যে এই প্রথম সে হাত বাড়িয়ে দিল–খানিকটা লাজুকভাবে–তাই মনে হল আমার এবং আমি তার চামড়ার কর্কশতা অনুভব করতে পারছিলাম। দরজার বাইরে পা রাখার সময় ঘুরে দাঁড়াল সে, একটু হেসে বলল : ‘আশা করি আজ রাতে কুকুরগুলি আর চাচাবে না। আমার সবসময় মনে হয় আমারটার ডাকই বোধহয় শুনছি—’
.
৬.
রোববার সকালে ওঠা যে কী কষ্টকর; মারিকে তো আমার খানিকক্ষণ নাম ধরে কাঁধ ঝাঁকাতে হল। ভোরে-ভোরেই আমরা পানিতে নামতে চাচ্ছিলাম, তাই নাশতার ঝামেলা আর করলাম না। মাথাটা আমার একটু কামড়াচ্ছিল এবং প্রথম সিগারেটের স্বাদ বিস্বাদ লাগল। মারি বলল, আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোককারীদের মতো লাগছে এবং আমার সত্যিই অবসাদ লাগছিল। মারির চুল খোলা এবং পরনে শাদা পোশাক। আমি বললাম, এ-পোশাকে তাকে দারুণ লাগছে এবং এতে সে খুশি হয়ে হাসল।
যাবার পথে ধাক্কা মারলাম রেমন্ডের জায়গায় এবং সে চিৎকার করে বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নামছে। রাস্তায় নেমে এলাম আমরা। আমার ঘরের পরদা ছিল টানা আর তা ছাড়া এ আবহাওয়ায় খানিকটা অস্বস্তিও লাগছিল, তাই সকালের সূর্য যেন মুষ্ট্যাঘাতের মতো বাড়ি মারল আমার চোখে।
মারি কিন্তু আনন্দে প্রায় নাচছিল এবং বারবার বলছিল, ‘কী চমৎকার দিন!’ কিছুক্ষণ পর ভালো লাগতে লাগল আমার এবং নিজেকে মনে হল ক্ষুধার্ত। মারিকে কথাটা জানালাম কিন্তু সে তা কানেই তুলল না। হাতে তার একটা অয়েলক্লথের ব্যাগ যার মাঝে আছে আমাদের স্নানের পোশাক আর একটা তোয়ালে। একসময় শুনলাম রেমন্ড তার ঘরের দরজা বন্ধ করল। পরনে তার নীল প্যান্ট, শাদা হাফশার্ট এবং মাথায় খড়ের টুপি। লক্ষ করলাম হাতটা তার বেশ লোমশ কিন্তু হাতের নিচের দিকটা ফরসা। খড়ের টুপি দেখে মুচকি হাসল মারি। তার পোশাকআশাক দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, বেশ স্ফুর্তিতেই আছে সে এবং শিস দিতে দিতে সে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। আমাকে ‘কী খবর ইয়ার’ আর মারিকে ‘মাদমায়োজেল’ বলে সম্বোধন করল সে।
আমরা থানায় গিয়েছিলাম আগের দিন বিকেলে, সেখানে রেমন্ডের হয়ে সাক্ষী দিয়ে আমি বলেছিলাম–মেয়েটা ঠকিয়েছিল রেমন্ডকে। সুতরাং তারা তাকে সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার বিবৃতিটাকে খতিয়েও দেখেনি।
দরোজার সামনে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ঠিক করলাম বাসে যাব আমরা। অতি সহজে সেখানে হেঁটেও যাওয়া যায়। তবে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি তত ভালো। আমরা যখন বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছি তখন রেমন্ড আমার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বলল রাস্তার অপরদিকে তাকাতে। দেখলাম, কয়েকজন আরব দাঁড়িয়ে আছে তামাকঅলার জানলার সামনে। তারা নীরবে আমাদের দেখছিল যেন আমরা পাথরের চাঙড় বা মরা গাছ। ফিসফিস করে রেমন্ড বলল, বামদিকের দ্বিতীয় লোকটিই হল তার সেই লোক এবং মনে হল। সে বেশ চিন্তিত। যাহোক, বোঝাতে চাইল সে, এগুলি সব পুরনো ব্যাপার। মারি এ-মন্তব্যটা ধরতে পারেনি তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললে?’
ব্যাখ্যা করে বললাম, রাস্তার ওপাশের আরবগুলি রেমন্ডের ওপর খেপে আছে। মারি আমাদের সেখান থেকে জলদি চলে যাওয়ার ওপর জোর দিল। রেমন্ড তখন হাসল, কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ভদ্রমহিলা ঠিকই বলেছেন’, বলল সে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।’ বাসস্টপে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তায় পিছন ফিরে তাকাল সে এবং বলল, লোকগুলি অনুসরণ করছে না। আমিও ঘুরে তাকালাম। তারা ঠিক আগের মতোই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে একইভাবে।
বাসে ওঠার পর স্বস্তি পেয়ে রেমন্ড মারিকে হাসাবার জন্যে ঠাট্টা করতে লাগল। মনে হল, মারিকে তার ভালো লেগেছে। কিন্তু মারি তাকে পাত্তাই দিল না। যখন-তখন সে হাসছিল আমার চোখে চোখ রেখে।
আলজিয়ার্সের ঠিক বাইরে নামলাম আমরা। সমুদ্র বাসস্টপ থেকে খুব দূরে নয়; শুধু মালভূমির মতো একটা উঁচু জায়গা পেরুতে হয় যার ওপর থেকে দেখা যায় সমুদ্র। তার পরেই মালভূমি ঢালু হয়ে মিশে গেছে বালিতে। এখানকার জমি ভরা। বন্য লিলি আর হলদে নুড়িতে। নীল আকাশের পাশে বন্য লিলিগুলিকে লাগছিল শাদা। তুষারের মতো। গরমের দিনে আকাশটা যেভাবে ঝলসায় ঠিক সেভাবে ঝলসাচ্ছিল। মারি ফুলগুলির ওপর ব্যাগ দুলিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছিল আর ফুলের পাপড়িগুলি ব্যাগের বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ছিল চারদিকে। তারপর আমরা দুপাশে সবুজ বা শাদা খুঁটির বেড় দেয়া, কাঠের ব্যালকনিসুদ্ধ ছোট ছোট বাড়ির মাঝ দিয়ে হেঁটে এলাম। কিছু আবার ঝাউঝোঁপের আড়ালে আধা-লুকানো। আমরা সে-সারি পেরুতে-না পেরুতে সমুদ্র পুরো শরীর নিয়ে দেখা দিল; কাঁচের মতো মসৃণ হয়ে পড়েছিল সমুদ্র; কিছুদূরে একটা বড় অন্তরীপ বেরিয়ে এসেছে তার কালো ছায়া নিয়ে। মৃদু বাতাসে ভেসে আসছিল একটা মোটর-এঞ্জিনের অস্পষ্ট গুঞ্জন এবং দেখলাম, বহুদূরে একটা জেলে-নৌকা অতীন্দ্রিয়ভাবে সেই ঝলসানো মসৃণতার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মারি কিছু ছোট নুড়ি কুড়োল। সমুদ্রে যাবার ঢালুপথ ধরে নামবার সময় দেখলাম সৈকতে ইতোমধ্যে বেশকিছু মানার্থী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
সৈকতের প্রায় শেষ মাথায় রেমন্ডের বন্ধুর নিজের কাঠের বাড়ি। টিলার কোলে বাংলোটি, সামনের দিকটা স্থাপিত কাঠের স্তম্ভের ওপর, সমুদ্রের জল স্পর্শ করছিল তখন যেখানে। রেমন্ড তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের। নাম তার ম্যাসন। কাধ তার প্রশস্ত, দেখতে সে লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। বউ তার মোটাসোটা ছোটখাটো এক হাসিখুশি মহিলা, কথা বলেন প্যারিসীয় ঢঙে।
ম্যাসন তক্ষুনি তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে নিতে বলল। বলল সে, সকালে উঠেই প্রথম সে গিয়েছিল মাছ ধরতে। আমাদের দুপুরের খাবারে মাছভাজা থাকবে। আমি তার ছোট বাংলোটার জন্যে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বলল সে, তার সপ্তাহান্ত এবং ছুটিছাটা এখানে কাটায়। ‘অবশ্যই বউয়ের সঙ্গে’ যোগ করল সে। আমি তার বউয়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম মারি এবং তার মধ্যে বেশ খাতির হয়ে গেছে; কথা বলছে তারা, হাসছে। এই প্রথম। বোধহয় সিরিয়াসলি আমি চিন্তা করলাম তাকে বিয়ে করার।
ম্যাসন তখুনি সাঁতার কাটতে যেতে চাইছিল কিন্তু তার বউ বা রেমন্ডের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সুতরাং আমরা তিনজন মারি, আমি এবং সে সৈকতের দিকে এগোলাম। মারি সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে কিন্তু আমি আর ম্যাসন অপেক্ষা করলাম খানিকক্ষণ। কথা বলে সে ধীরে ধীরে এবং কথার ফাঁকে ফাঁকে এবং তা ছাড়া কথাটা বলবেই সংগতি থাকুক বা না থাকুক। মারি সম্পর্কে সে বলল, সে খুব সুন্দর মেয়ে এবং তা ছাড়া মিষ্টিও।
এরপর আমি আর তার এ-ধরনের কথাবার্তার প্রতি নজর দিলাম না; নিজেকে ছেড়ে দিলাম রোদের কাছে এবং তাতেও বেশ ভালো লাগতে লাগল। পায়ের নিচে তপ্ত হয়ে উঠছিল বালি, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হয়ে উঠেছিলাম উগ্রীব, কিন্তু তবুও আরও মিনিট দুএক অপেক্ষা করলাম। শেষে ম্যাসনকে জিজ্ঞেস করলাম, এবার আমরা নামব কি?’ এবং ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। ম্যাসন হাঁটতে লাগল ধীরস্থিরে এবং যখন আর থই পেল না তখন ধীরে ধীরে সাঁতার কাটা শুরু করল, সুতরাং আমি তাকে ছাড়িয়ে চলে এলাম মারির কাছে। পানিটা ঠাণ্ডা এবং সেজন্য বেশ ভালো লাগছিল। আমি আর মারি সাঁতার কাটলাম। বেশ দূর পর্যন্ত পাশাপাশি এবং আমাদের একই রকম সাঁতার কাটার ভঙ্গি দেখে ভালো লাগছিল। মনমেজাজ দুজনেরই ছিল একই রকম এবং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম।
সাঁতারশেষে বালুতে শুয়ে পড়লাম, তাকালাম আকাশের দিকে এবং অনুভব করছিলাম সূর্য আমার ঠোঁটের গালের লবণজল শুষে নিচ্ছে। দেখলাম, ম্যাসন সাঁতার কেটে তীরে ফিরে সূর্যের নিচে শুয়ে পড়ল। দূর থেকে তাকে লাগছিল অনড় এক বিশাল তিমির মতো। তারপর মারি প্রস্তাব করল আমাদের আগুপিছু সাঁতার কাটা উচিত। মারি আগে, পিছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছি আমি এবং সে যখন হাত দিয়ে পানি ঠেলে সামনে এগোচ্ছিল তখন আমি পিছন থেকে পা মেরে তাকে সাহায্য করছিলাম।
জল ছিটাবার আওয়াজ এতক্ষণ ধরে কানে বাজছিল যে, মনে হল যথেষ্ট হয়েছে। সুতরাং মারিকে ছেড়ে দীর্ঘ এবং গভীর শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে ফিরে এলাম। তীরে পা ঠেকতেই ম্যাসনের পাশে বালিতে মুখ রেখে উলটো হয়ে শুয়ে পড়লাম। তাকে বললাম, জায়গাটা বেশ চমৎকার এবং সে একমত হল। একসময় ফিরে এল মারি। তাকে দেখার জন্যে মাথা তুললাম। চুল তার পিছে ঠেলে দেয়া এবং নোনাজলের জন্যে তাকে দেখাচ্ছে চকচকে। তারপর সে শুয়ে পড়ল আমার পাশে এবং সূর্য ও আমাদের শরীরের মিলিত উত্তাপের জন্যে মনে হল আমি ঘুমিয়ে পড়ব।
কিছুক্ষণ পর আমার হাত টেনে ধরে মারি বলল, ম্যাসন তার বাসায় চলে গেছে; এবং এখন নিশ্চয় দুপুরের খাবার সময়। ক্ষুধার্ত থাকায় আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু মারি বলল, সকাল থেকে তাকে আমি একটি চুমোও খাইনি। কথাটা আসলে ঠিক–যদিও কয়েকবার তাকে আমার চুমো খাবার ইচ্ছে হয়েছিল। চলো ফের জলে নামি’, বলল সে এবং দৌড়ে সমুদ্রে নামলাম ও ছোট ছোট ঢেউয়ের মাঝে কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে পড়ে রইলাম।
ফিরলাম যখন, তখন দেখি ম্যাসন তার বাংলোর সিঁড়িতে বসে আমাদের ফিরে আসতে বলে চিৎকার করছে। বললাম তাকে আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং সে তখুনি তার বউয়ের দিকে ফিরে বলল আমাকে তার বেশ মনে ধরেছে। রুটিটা ছিল চমৎকার আর আমার ভাগের পুরো মাছই আমি সাবাড় করলাম। তারপর আনা হল ‘স্টিক’ এবং চিপস’। খাবার সময় আমরা ছিলাম নিশ্চপ। ম্যাসন প্রচুর মদ খেল এবং যখনই আমার গ্লাস খালি হতে লাগল তখুনি সে তা পুরো করে দিতে লাগল। সবাইকে যখন কফি দেয়া হচ্ছিল তখন আমার কেমন ঝিমঝিম লাগছিল এবং আমি একটার পর একটা সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। ম্যাসন, আমি এবং রেমন্ড সবাই মিলে খরচা ভাগ করে পুরো আগস্ট মাসটা এখানে কাটাবার একটা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলাম।
হঠাৎ মারি অবাক সুরে বলল, এই দ্যাখো! বলো তো কটা বাজে? মাত্র সাড়ে এগারো।
একথায় আমরা অবাক হয়ে গেলাম এবং ম্যাসন মন্তব্য করল, আমাদের খাওয়াটা খুব সকাল-সকাল হয়ে গেছে, কিন্তু যা-ই বলো লাঞ্চ হল ‘মোভেবল ফিস্ট’, যখন যার ইচ্ছে তখন সে খেল।
একথায় মারি হাসতে লাগল। জানি না কেন। মনে হল বেশ একটু টেনেছে।
তারপর ম্যাসন জিজ্ঞেস করল, সৈকতে তার সঙ্গে আমি একটু বেড়াতে বের হব কি না।
‘দুপুরের খাবারের পর আমার স্ত্রী সবসময় একটু ঘুমোবে’, বলল সে, ‘আমার আবার তা পছন্দ নয়, আমার দরকার অল্প একটু বেড়ানো। সবসময় তাকে বলে আসছি স্বাস্থ্যের জন্যে এটা ঢের উপকারী। কিন্তু স্বভাবতই সে নিজের মত আঁকড়ে থাকে।‘
মারি জানাল সে ঘরেই থাকবে এবং ধোয়ামোছায় সাহায্য করবে। ম্যাসনের বউ হাসল, বলল, ‘তা হলে সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে পুরুষদের বের করে দেয়া।’ সুতরাং একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজন।
রোদ এখন প্রখর এবং জলের ওপর তার প্রভাব যে-কোনো লোকের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেবে। সৈকত প্রায় খালি। তীরের বাংলো থেকে খালি ছুরি-কাটা, বাসনকোসনের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিলাগুলি থেকেও যেন ভাপ বেরুচ্ছে এবং বেশ কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে।
প্রথমে রেমন্ড এবং ম্যাসন এমন সব লোকের কথা আলোচনা করল যাদের আমি চিনি না। মনে হল তারা বেশ কিছুদিন ধরে পরস্পরের পরিচিত, এমনকি একসঙ্গে থেকেছেও কিছুদিন। জলের ধার ঘেঁষে আমরা হাঁটতে লাগলাম, যখন-তখন ঢেউ এসে আমাদের ক্যানভাসের জুতোগুলি ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিছুই ভাবছিলাম না আমি। সূর্যের পুরো উত্তাপ আমার খালিমাথায় পড়ায় তন্দ্রালস হয়ে উঠলাম।
ঠিক তখন রেমন্ড ম্যাসনকে কিছু বলল যা আমি ধরতে পারলাম না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম দূর-সৈকতে দুজন আরব নীল পোশাক পরে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। রেমন্ডের দিকে তাকালাম এবং সে মাথা নেড়ে বলল, এই সে’। আমরা দৃঢ়ভাবে হাঁটতে লাগলাম। কীভাবে তারা আমাদের খুঁজে পেয়েছে সেকথা ভেবে ম্যাসন অবাক হল। আমার মনে হল তারা আমাদের বাসে চড়তে দেখেছিল এবং মারির স্নানের অয়েলক্লথ ব্যাগও নজরে পড়েছিল তাদের, কিন্তু কিছু বললাম না।
আরবরা যদিও হাঁটছিল আস্তে আস্তে কিন্তু তবুও তারা প্রায় চলে এসেছিল আমাদের কাছে। আমরা হাঁটার গতি পরিবর্তন করলাম না; কিন্তু রেমন্ড বলল :
‘শোনো যদি কিছু হয়, ম্যাসন তুমি দ্বিতীয়টাকে সামলিয়ো, আমার পিছনে যে লেগেছে তাকে আমি সামলাব। আর যদি আরেকটা আসে তা হলে মারসো। তুমি সামলাবে।‘
বললাম, ঠিক আছে। এবং ম্যাসন পকেটে তার হাত পুরল।
বালু আগুনের মতো গরম এবং শপথ করে বলতে পারি সবকিছু কেমন লালচে ঠেকছিল। আমাদের সঙ্গে আরবদের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। যখন আমরা মাত্র কয়েক পা দূরে তখন তারা থামল। ম্যাসন আর আমি পদক্ষেপ ধীর করলাম আর রেমন্ড সোজা এগোল তার প্রতিপক্ষের দিকে। কী বলল সে তা শুনতে পেলাম না, কিন্তু দেখলাম লোকটা মাথা নিচু করছে যেন রেমন্ডের বুকে গুতো মারবে। রেমন্ড সঙ্গে সঙ্গে চড় লাগিয়ে ম্যাসনকে ডাকল। ম্যাসন এতক্ষণ যার দিকে নজর রাখছিল তার বরাবর গিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে দুবার ঘুসি মারল। লোকটা সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল এবং সেকেন্ড কয়েক চারপাশে ফেনিয়ে-ওঠা বুদবুদ নিয়ে পড়ে রইল। ইতিমধ্যে রেমন্ড বেশ করে দাবড়াচ্ছিল বাকিটাকে এবং তার মুখ ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। লোকটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল :
‘খালি নজর রেখো; আমি এখনও একে শেষ করিনি।’
‘সাবধান!’ চিৎকার করে বললাম, ‘ওর কাছে ছুরি আছে।’
চিৎকারটা একটু দেরিতে হয়েছে। লোকটা ইতিমধ্যে রেমন্ডের হাতে এবং মুখে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
ম্যাসন লাফিয়ে এগিলে এল। অন্যজন পানি থেকে উঠে এসে দাঁড়াল ছুরি হাতে-ধরা লোকটার পিছে। নড়বার সাহস পেলাম না আমরা। আমাদের দিক থেকে নজর না সরিয়ে এবং ছুরিটা সামনে ধরে লোকদুটো আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগল, যখন তারা বেশ নিরাপদ দূরত্বে তখন পিছন ফিরে দে দৌড়। প্রখর রোদের নিচে আমরা নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রক্ত ঝরছিল রেমন্ডের হাতের ক্ষত থেকে এবং মোচড়াচ্ছিল সে কনুইয়ের উপরদিকটা।
ম্যাসন বলল, একজন ডাক্তার আছেন যিনি প্রতি রোববার এখানে কাটান। রেমন্ড বলল, বেশ, চলো তার কাছে যাওয়া যাক। কথা বলতে পারছিল না সে, কারণ তার মুখের অন্য ক্ষত থেকে রক্তের বুদবুদ উঠছিল।
আমরা দুজন দুদিক থেকে ধরে তাকে বাংলোয় নিয়ে এলাম। সেখানে পৌঁছলে সে বলল, ক্ষতটা তত গভীর নয় এবং ডাক্তারের কাছে সে হেঁটেই যেতে পারবে। মারি বেশ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল আর মাদাম ম্যাসন তো কাঁদছিলেন।
ম্যাসন এবং রেমন্ড চলে গেল ডাক্তারের কাছে এবং আমি রয়ে গেলাম মহিলাদের কাছে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করার জন্যে। এ-ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না, তাই কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম।
ম্যাসনের সঙ্গে রেমন্ড ফিরে এল প্রায় দেড়টার সময়। হাতে তার ব্যান্ডেজ বাধা এবং মুখের এককোণে একটা স্টিচিং প্লাস্টার। ডাক্তার তাকে আশ্বাস। দিয়েছেন জখম তেমন গুরুতর কিছু নয়, কিন্তু তাকে বেশ বিষণ দেখাচ্ছিল। ম্যাসন তাকে হাসাবার চেষ্টা করে বিফল হল।
খানিক পর রেমন্ড বলল, সে একটু সৈকতে বেড়াতে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছে সে। এতে একটু আমতা আমতা করে বলল, এই একটু হাওয়া। খেতে যাচ্ছি। তখন আমরা ম্যাসন এবং আমি বললাম, তা হলে আমরাও তার সঙ্গে যাব। কিন্তু সে চটে উঠে আমাদের নিজের চরকায় তেল দিতে বলল। ম্যাসন তার অবস্থা দেখে বলল আমাদের জোর করা উচিত নয়। যাহোক, যখন সে বের হল তখন আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
ঘরের বাইরের অবস্থা তখন জ্বলন্ত চুল্লির মতো এবং সূর্যের আলো আগুনের ফুলকির মতো সমুদ্র আর বালিতে ঝরছে। নিচুপে আমরা হাঁটলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল আমার, রেমন্ড কোথায় যাবে সে-সম্পর্কে নিশ্চয় সে কিছু ভেবেছে; কিন্তু এ-সম্পর্কে আমার ধারণা বোধহয় ছিল ভুল।
সৈকতের শেষমাথায় একটা ছোট ঝরনার সামনে এসে পৌঁছলাম যেটা বেশ বড় একটা টিলার পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে আমরা আরব দুজনকে দেখলাম নীল আলখাল্লা পরে শুয়ে আছে বালিতে। যে-লোকটি রেমন্ডকে ছুরি মেরেছিল সে নীরবে তাকাল রেমন্ডের দিকে। অন্যজন ছোট এক বাঁশিতে একটি সুরের তিনটি গত বাজাচ্ছে। বারবার সে এটা বাজাচ্ছিল এবং আড়চোখে দেখছিল আমাদের।
কিছুক্ষণ আমরা কেউই নড়লাম না। শুধু ঝরনার কলতান এবং বাঁশির সেই তিনটি বিরহী শব্দ ছাড়া চারদিকে শুধু সূর্যের আলো আর নৈঃশব্দ। তারপর রেমন্ড হাত দিল তার রিভলবার-রাখা পকেটে, কিন্তু আরব দুজন নড়ল না বিন্দুমাত্র। খেয়াল করে দেখলাম, যে-লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল তার বিরাট পায়ের পাতা ডান কোণ-বরাবর পায়ের কাছে উলটানো।
তখনও তার প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে রেমন্ড আমায় জিজ্ঞেস করল : ‘শোধটা নিয়ে নেব নাকি?’
দ্রুত চিন্তা করলাম। যদি না’ বলি তা হলে সে যে-অবস্থায় আছে তাতে চটে উঠে হয়তো রিভলবার ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং মাথায় এখন যা এল তা ই বললাম, ‘সে এখনও তোমায় কিছু বলেনি। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় তাকে গুলি করা অতি নীচ কাজ হবে।‘
আবার কয়েক মুহূর্ত সব চুপ, খালি উষ্ণ ধীর বাতাসে বাঁশির শব্দ আর ঝরনার কলতান।
‘বেশ, বলল রেমন্ড আমাকে, যদি তুমি তা-ই মনে করো তবে প্রথমে তাকে কিছু অপমানকর কথা বলব। এবং সে যদি উত্তর দেয় তবে গুলি করব।’
‘বেশ’, বললাম আমি, ‘কিন্তু যতক্ষণ-না সে ছুরি বের করছে ততক্ষণ গুলি ছোঁড়ার কোনো অধিকার তোমার নেই।’
রেমন্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। যে-লোকটা বাজাচ্ছিল সে তখনও বাজিয়ে চলছে। এবং দুজনই নজর রাখছে আমাদের অবস্থানের দিকে। ‘শোনো’, বললাম রেমন্ডকে, তুমি ডান দিকেরটাকে সামলাও আর রিভলবারটা দাও আমাকে। যদি অন্যজন কিছু করে বা ছুরি বের করে তা হলে আমি গুলি করব।
রেমন্ড রিভলবারটা যখন আমার হাতে দিল তখন তা সূর্যের আলোয় ঝকমক করে উঠল। কিন্তু তখনও কেউ কিছু করেনি। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন চেপে বসছে আমাদের ওপর এবং তাই যেন কেউ নড়তে পারছি না। চোখ না-নামিয়ে শুধু আমরা নজরে রাখছি একে অপরের প্রতি : পুরো পৃথিবী যেন এসে থেমে গেছে সূর্যের আলো আর সমুদ্রের মাঝখানে এই ছোট সৈকতে, নলখাগড়া এবং ঝরনার দ্বিগুণ নৈঃশব্দে। এবং ঠিক তখন আমার মনে হল গুলি করা বা না-করা সমান, কারণ ফলাফল একই হবে।
তারপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল লোক দুজন; টিলার আড়ালে মিলিয়ে গেছে দুজন গিরগিটির মতো। সুতরাং আমি আর রেমন্ড আবার পিছু ফিরে হাঁটা শুরু করলাম। বেশ খুশি মনে হচ্ছিল তাকে এবং আমাদের ফেরার বাস সম্পর্কে সে কথা বলতে লাগল।
বাংলোয় যখন পৌঁছলাম তখন রেমন্ড দ্রুতগতিতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল উপরে, কিন্তু আমি বসে পড়লাম নিচের সিঁড়িতেই। মনে হচ্ছিল, রোদ আমার মাথায় বাড়ি মারছে এবং সেই উপরে উঠে মহিলাদের কাছে নিজেকে অমায়িক করে তোলাটা মনে হচ্ছিল কেমন যেন দুঃসাধ্য। কিন্তু রোদ এত কড়া যে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দাঁড়ানোটাও ছিল কষ্টসাধ্য। আকাশ থেকে ঝরে-পড়া এই অন্ধ-করা আলোর বন্যার নিচে থাকা বা বাইরে যাওয়া–একই কথা। কয়েক মুহূর্ত পর আমি সৈকতে ফিরে হাঁটা শুরু করলাম।
যতদূর চোখ যায় ততদূর সেই লাল ঝকঝকে আলো এবং ছোট ছোট ঢেউগুলি খানিক পরপর গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম বালিতে। সৈকতের শেষমাথায় সেই পাথরগুলির কাছে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল কড়া রোদের জন্যে আমার কপালের দুপাশের শিরা যেন ফুলে উঠছে। এটা আমাকে চেপে ধরে যেন আমার গতি রুদ্ধ করতে চাচ্ছে। এবং যখনই গরম বাতাসের ঝাঁপটা আমাকে বাড়ি মারছিল তখনই আমি দাঁতে দাঁত চেপে, পকেটে হাত মুঠি করে, প্রত্যেকটি স্নায়ুকে তৈরি রাখছিলাম সূর্য এবং যে অন্ধ-করা আলো আমার ওপর ঝরছে তাকে প্রতিহত করতে। যখনই বালিতে পড়ে-থাকা ঝিনুক বা ভাঙা কাঁচে আলো পড়ে ঝলক উঠছিল তখনই আমার চোয়াল হয়ে উঠছিল কঠিন। নিজেকে আমি কাবু হতে দিচ্ছি না। দৃঢ়ভাবে আমি হেঁটে যেতে লাগলাম।
সেই কালো ছোট কুঁজের মতো টিলাটা সৈকতের দূরে দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে আলোর বৃত্ত তার চারদিকে, কিন্তু আমি ভাবছিলাম এর পিছনের সেই ঠাণ্ডা পরিচ্ছন্ন ঝরনাটার কথা আর উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছিলাম বহতা পানির সেই মৃদু কলতান শোনার জন্যে। এই আলোর তীব্রতা কান্না-পাওয়া মহিলা, ক্লান্তি সবকিছু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সেই টিলার ছায়ায়, ঝরনা আর তার শীতল নৈঃশব্দে।
কিন্তু যখন কাছে পৌঁছলাম তখন দেখি রেমন্ডের সেই আরব ফিরে এসেছে। সে তখন একলা, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাতদুটি মাথার পেছনে, মুখটা টিলার ছায়ায়। বাকি শরীর কড়া রোদে। তার কাপড় মনে হচ্ছিল যেন সূর্যের আলোয় সিদ্ধ হচ্ছে। একটু আশ্চর্য হলাম। আমি ভেবেছিলাম, ঘটনাটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এখানে আসার পথে এ-ব্যাপারটার কথা আমার একবারও মনে হয়নি।
আমাকে দেখে আরবটি একটু উঁচু হল এবং হাত ঢোকাল পকেটে। স্বভাবতই পকেটে রেমন্ডের রিভলবারটা চেপে ধরলাম। তারপর আরবটা আবার শুয়ে পড়ল, হাত কিন্তু পকেটেই থাকল। আমি ছিলাম খানিকটা দূরে, দশ গজ হবে, এবং বেশির ভাগ সময়ই তাকে কালো এক টলটলায়মান বস্তুর মতো মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার নজরে পড়ছিল আধবোজা পাতার নিচের জলন্ত চোখদুটো। ঢেউয়ের শব্দগুলিকে মনে হচ্ছিল দুপুর থেকেও মদালসা এবং নমিত। রোদ কিন্তু কমেনি; তা তখনও সেই টিলা পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতকে ঝলসাছিল। দু-ঘণ্টায়ও সূর্যের কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না, যেন নিথর গলানো। ইস্পাতের সমুদ্র। লোকটার দিকে নজর রাখছিলাম এবং দূর দিগন্তে যে একটি স্টিমার যাচ্ছিল, আড়চোখে সেই চলন্ত কালো বিন্দুটাকে দেখছিলাম।
হঠাৎ মনে হল আমার এখন যা করা দরকার তা হল পিছু ফিরে চলে যাওয়া এবং এ ঘটনার কথা না-ভাবা। কিন্তু পুরো সৈকতটা যেন তাপে টগবগ করে পিছন থেকে আমাকে চেপে ধরছে। ঝরনার দিকে এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। নড়ল না আরবটা। তখনও আমাদের মধ্যে দূরত্ব আছে খানিকটা। তার মুখের ওপর ছায়া। পড়ার জন্যে মনে হচ্ছিল সে যেন ভেংচি কাটছে আমার দিকে তাকিয়ে।
অপেক্ষা করছিলাম। উত্তাপে আমার গাল যেন ঝলসাচ্ছিল, ঘামের ফোঁটা জমছিল ভুরুতে। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন ছিল যেরকম রোদ, এখনও রোদ ঠিক সেরকম এবং আমার মনে ঠিক সেরকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগছিল, বিশেষ করে কপালে, সেখানে মনে হছিল প্রত্যেকটি শিরা যেন চামড়া ফেটে বেরুবে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, এগিয়ে গেলাম আরেক পা। জানতাম বোকামি হচ্ছে কাজটা; দুএক পা এগিয়ে গেলেই তো আর সূর্যের আড়াল হব না। তবুও এক পা এগোলাম সামনে, ঠিক এক পা। আর তখুনি আরবটা ছুরি বের করে সামনে ধরল।
ইস্পাত থেকে একঝলক আলোর রশ্মি লাফিয়ে উঠল আর আমার মনে হল, যেন লম্বা একটি পাতলা ব্লেড স্থির হয়ে আছে আমার কপালে। সে-সঙ্গে আরও মনে হল চোখের ভুরুতে যত ঘাম জমেছিল সেসব চোখ বেয়ে ঝরছে। পানি ও ঘামের পরদার নিচে চাপা পড়ে গেছে দুই চোখ। সূর্য যে আমার করোটিতে দামামা বাজাচ্ছে সে-সম্পর্কে আমি সচেতন, কেবল ঝাঁপসা লাগছে ছুরি থেকে উৎক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ সেই আলোর রশ্মি, যেন তা ভুরু ফেড়ে গেঁথে যাচ্ছে চোখের মণিতে। তারপর সবকিছুই ঘুরতে শুরু করল আমার চোখের সামনে। সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এল আগুনের হলকা আর আকাশটা দিগন্ত থেকে দিগন্তে যেন হয়ে গেল দু-টুকরো। আর সেই গহ্বরে ঝরতে লাগল আগুনের শিখা। আমার শরীরের প্রতিটি তন্তু যেন ইস্পাতের মতো তীক্ষ্ণ আর তীব্র, রিভলবারের ওপর আমার মুঠি দৃঢ় হয়ে এল। ট্রিগার টিপলাম আর মসৃণ একটা ধাক্কা এসে স্পর্শ করল করতল। ঐ শব্দ থেকেই শুরু। আমি ঝেড়ে ফেললাম ঘাম আর আলোর পরদা। আমি। জানি, দিনের এই নিটোলতা আর সমুদ্রতীরের এই বিশাল প্রশান্তি আমি ফেলেছি ছিঁড়েখুঁড়ে যেখানে ছিল আমার সুখ। ঐ নিস্পন্দ শরীরে আমি আরও চারবার গুলি করলাম। আর প্রতিটি গুলি ছিল আমার নিয়তির দিকে সোচ্চার আওয়াজ।
২. দ্বিতীয় পর্ব – গ্রেফতারের পর
১.
গ্রেফতারের পর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তার সবই ছিল আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন, আমার পরিচয় ইত্যাদি সম্পর্কে। এর আগে থানায় এ-মামলা নিয়ে কেউ তেমন আগ্রহ দেখায়নি। যাক, এক সপ্তাহ পর যখন আমাকে বিচারকের সামনে হাজির করা হল তখন দেখলাম তিনি বেশ একটা আলাদা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে আমায় নিরীক্ষণ করছেন। অন্যান্য সবার মতো তিনিও আমার নাম, ঠিকানা, পেশা, জন্মতারিখ এবং জন্মস্থান দিয়ে শুরু করলেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে আমি কোনো উকিল নিয়োগ করেছি কি না। উত্তরে বললাম, ‘না’, এ বিষয়ে আমি কোনো চিন্তাই করিনি; এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম সত্যিই একজন উকিল নিয়োগ করার দরকার কি না। ‘তুমি এ প্রশ্ন করছ কেন?’ উত্তরে বললেন তিনি। বললাম, ‘মামলাটা আমার কাছে খুব সরল বলে মনে হয়েছে। তিনি হাসলেন। তা তোমার কাছে সরল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের তো আইন মেনে চলতে হয়। তুমি যদি নিজের জন্যে উকিল ঠিক না করো তবে আদালতকেই তোমার জন্যে উকিল ঠিক করতে হবে।’
কর্তৃপক্ষ যে এত খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে নজর রাখেন তা দেখে আমি চমৎকৃত হলাম এবং তাঁকে তা জানালাম। তিনি মাথা নাড়লেন এবং মেনে নিলেন যে আইন হচ্ছে সবকিছু যা আকাক্ষা করা যায়।
প্রথমদিকে আমি তাঁকে তেমন গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেনি। যে-ঘরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন তা ছিল সাধারণ বৈঠকখানার মতো। জানালায় পরদা, টেবিলে একটি বাতি। বাতির আলোটা পড়ছিল আরামকেদারার ওপর যেখানে তিনি আমাকে বসিয়েছিলেন আর তাঁর নিজের মুখ ছিল অন্ধকারে।
বইয়ে আমি এ-ধরনের দৃশ্যের বর্ণনা পড়েছি, এবং প্রথমে এ সবকিছু আমার কাছে খেলার মতো মনে হল। আমাদের কথোপকথন শেষ হলে আমি তার দিকে ভালো করে নজর দিলাম।
পরদিন আমার সেলে এলেন ছোটখাটো হৃষ্টপুষ্ট কালোচুলো কমবয়েসি এক উকিল। গরম থাকা সত্ত্বেও আমি পুরোহাতা শার্ট পরেছিলাম আর তার পরনে ছিল গাঢ় রঙের সুট, শক্ত কলার, চওড়া শাদা-কালো স্ট্রাইপের বাহারি টাই। অ্যাটাচি কেসটা আমার বিছানায় রেখে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার মামলার নথিপত্র উনি খুব সাবধানে দেখবেন। তাঁর মতে, ঐভাবে দেখা প্রয়োজনীয় এবং আমি যদি তাঁর উপদেশমতো চলি তবে ছাড়া পাওয়ার পুরোমাত্রায় আশা আছে। ধন্যবাদ জানালাম তাকে এবং তিনি বললেন, বেশ, এবার বসা যাক।
বিছানায় বসে তিনি বললেন, তারা আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য সন্ধান করছিলেন। তারা জেনেছেন, সম্প্রতি আমার মা মারা গেছেন আশ্রমে। মারেনগোতে তদন্ত হয়েছে এবং পুলিশ জানিয়েছে মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি ‘ভীষণ উদাসীনতা’ দেখিয়েছি।
‘তোমার বোঝা দরকার’, বললেন উকিল ভদ্রলোক, ‘ঐ ব্যাপারে প্রশ্ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এর গুরুত্ব আছে এবং উদাসীনতা–এই অভিযোগের বিরুদ্ধে যদি আমি যুক্তি খাড়া করতে না পারি তা হলে তোমার পক্ষ সমর্থন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। এবং এ-বিষয়ে তুমি, একমাত্র তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পারো।‘
তিনি জিজ্ঞেস করলেন ঐ ‘দুঃখজনক ঘটনায়’ আমি শোকাভিভূত হয়েছিলাম কি না। প্রশ্নটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকল। ব্যক্তিগতভাবে অন্য কাউকে যদি আমায় এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হত তা হলে আমি আরও বেশি অপ্রস্তুত হতাম।
উত্তরে আমি জানালাম সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিজের অনুভূতির দিকে নজর রাখার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে এবং সেজন্যে আমি কী উত্তর দেব জানি না। সত্যি করে বলতে গেলে বলব মা’র আমি বেশ ভক্ত ছিলাম। কিন্তু তার মানে খুব বেশি নয়; সব স্বাভাবিক লোক, যোগ করলাম, কোনো-না-কোনো সময় তাদের প্রিয়জনদের মৃত্যুর কথা কমবেশি চিন্তা করে।
এখানে আমার উকিল বাধা দিলেন। তাঁকে ভীষণ বিচলিত মনে হচ্ছিল।
‘তোমাকে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আদালতে বা বিচারককে তুমি এ-ধরনের কোনো কথা বলবে না।‘
তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমার শারীরিক অবস্থা আমার চিন্তাভাবনার ওপর প্রায়ই প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেদিন যোগ দিয়েছিলাম সেদিন এতই ক্লান্ত ছিলাম যে আমি আধোঘুমে ছিলাম। সুতরাং ঐ সময় কী কী ঘটেছে তার অনেককিছুই আমি জানি না। তবে তাকে একটি ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি : মা’র মৃত্যু হোক তা আমি চাইনি।
ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হল না। সংক্ষিপ্তভাবে তিনি বললেন, এটা যথেষ্ট নয়।’
ব্যাপারটা একটু চিন্তা করার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঐদিন আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম, একথাটা তিনি বলতে পারেন কি না।
‘না’, বললাম আমি, কথাটা সত্যি হবে না।’
একটু অবাক হয়ে তিনি তাকালেন আমার দিকে যেন আমি তার প্রতি খানিকটা বিতৃষ্ণ। তারপর প্রায় শত্রুতাপূর্ণ গলায় জানালেন, তা হলে আশ্রমের প্রধান এবং সেখানকার কয়েকজন কর্মচারীকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হবে।
‘এবং তুমি বিপদে পড়বে।’ কথা শেষ করলেন তিনি।
আমি বললাম, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সঙ্গে মার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। তখন তিনি উত্তর দিলেন, এই ধরনের মন্তব্যে বোঝা যায় আইনের মুখোমুখি আমি কোনোদিন হইনি।
কিছুক্ষণ পর বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি চেয়েছিলাম তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকুন। তা হলে হয়তো আমি তাকে বোঝাতে পারতাম যে আমি তার সহানুভূতি চাই, এজন্যে নয় যে আমার পক্ষসমর্থন জোরদার হোক, বরং এভাবে বলা চলে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাকে আমি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছি এবং তিনি আমাকে প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। স্বভাবতই ব্যাপারটা তাকে বিরক্ত করছিল। দুএকবার ভেবেছিলাম তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করি যে আমিও অন্যদের মতো সাধারণ একটি লোক। কিন্তু তাতে কোনো ফল হত বলে মন হয় না। সুতরাং খানিকটা আলস্য বা এ-ধরনের একটা ভাবের জন্যে আমি কিছু বলিনি।
ঐদিনই, পরে আমাকে আবার পরীক্ষাকারী বিচারকের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। বেলা তখন দুটো এবং এবার ঘরটি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল–জানলায় ছিল একটা পাতলা পরদা –সুতরাং ঘরটি হয়ে উঠেছিল বেশ গরম।
আমাকে বসতে অনুরোধ করে বিচারক অত্যন্ত নরম গলায় বললেন ‘অনিবার্য কারণবশত’ আমার উকিল উপস্থিত হতে পারেননি। আমার অধিকার আছে, তিনি যোগ করলেন, উকিল না-পৌঁছা পর্যন্ত তার প্রশ্নের উত্তর না-দেয়ার।
উত্তরে জানালাম, নিজের হয়ে আমি উত্তর দিতে পারব। টেবিলের ওপর রাখা ঘণ্টাটি তিনি বাজালেন এবং তরুণ একজন কেরানি এসে ঠিক আমার পিছে বসল। তারপর আমরা–আমি এবং বিচারক চেয়ারে আরাম করে বসলাম এবং প্রশ্ন শুরু হল। তিনি এবারে শুরু করলেন যে, স্বল্পভাষী এবং আত্মকেন্দ্রিক লোক হিসেবে আমার একটা খ্যাতি আছে, সুতরাং তিনি জানতে চান এ-ব্যাপারে আমার উত্তর কী হবে। বললাম :
‘মানে, খুব কম সময়ই আমার কিছু বলার থাকত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমি চুপ থাকতাম।‘
গতবারের মতোই তিনি হাসলেন এবং উত্তরটা যেন যথাযথ এব্যাপারে একমত হলেন। বললেন, ‘যাহোক, এর তেমন কোনো বা কোনো গুরুত্বই নেই।‘
খানিক নীরবতার পর হঠাৎ তিনি সামনে ঝুঁকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে বললেন :
‘আমাকে যা আগ্রহান্বিত করছে তা হল–তুমি!’
তিনি কী বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তাই কোনো মন্তব্য করলাম না।
‘তোমার অপরাধের ব্যাপারে তিনি বলে যেতে লাগলেন, কয়েকটি জিনিস আমাকে অবাক করছে। আমি নিশ্চিত যে এগুলি বোঝার ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’
উত্তরে যখন জানালাম যে ব্যাপারটা অত্যন্ত সোজা তখন তিনি আমাকে ঐদিনের একটি বিবরণ দিতে বললেন। যেদিন আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিনই সংক্ষিপ্তভাবে–রেমন্ড, সমুদ্রতীর, আমাদের সাঁতার কাটা, তারপর আবার সমুদ্রতীর এবং আমার পাঁচবার গুলি ছোঁড়া সম্পর্কে সব বলেছিলাম। কিন্তু আবার আমি সবকিছু বললাম এবং প্রতিটি কথার শেষে তিনি মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, ‘বেশ, বেশ’। যখন আমি বালিতে শায়িত দেহটির বিবরণ দিলাম তখন। তিনি আরও জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ভালো। ব্যক্তিগতভাবে একই ঘটনার বিবরণ আবার দিতে গিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিল এত কথা জীবনে আর কখনও বলিনি।
আরও কিছুক্ষণ নীরবতার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এবং বললেন, তিনি আমাকে সাহায্য করতে চান, আমি তাকে কৌতূহলী করে তুলেছি, ঈশ্বরের কৃপায়। আমার এই বিপদে তিনি কিছু সাহায্য করবেন। কিন্তু তার আগে তার আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
সোজাসুজি তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার মাকে ভালোবাসতাম কি না।
‘হ্যাঁ’, উত্তর দিলাম, অন্যান্য সবার মতো। পিছনে যে-কেরানি বসেছিল, এতক্ষণ সে মসৃণভাবে টাইপ করে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হল সে ভুল অক্ষরে টিপ দিয়েছে কারণ সে তখন তার যন্ত্রটি ঠিক করে ভুল-অক্ষরটি মুছে ফেলছিল।
এরপর আপাতসম্পর্কহীন আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি।
‘কেন তুমি পরপর পাঁচবার গুলি করেছিলে?’
কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম; তারপর বললাম, পরপর গুলিগুলো ছোঁড়া হয়নি। প্রথমে একবার গুলি ছুঁড়েছি এবং খানিক পর বাকি চারটি।
‘প্রথম এবং দ্বিতীয়বারের মাঝে থেমেছিলে কেন?’
সবকিছু যেন আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তীরের রক্তিম আভা, গালের ওপর সেই উষ্ণ তাপের ভাগ–এবং, এবার আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
এরপর যে-নীরবতাটুকু নামল, ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক ঐ সময় অস্থিরভাবে চুলের ভিতর আঙুল চালাতে লাগলেন। একবার অর্ধেক উঠে আবার বসে পড়লেন। অবশেষে টেবিলে কনুই রেখে একটু ঝুঁকে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কিন্তু কেন, কেন তুমি বালিতে পড়ে-থাকা একটি লোককে আবার গুলি করেছিলে?’
এবারও আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।
ম্যাজিস্ট্রেট কপালে একবার হাত বুলোলেন তারপর একটু ভিন্ন সুরে জিজ্ঞেস করলেন :
‘আমি জিজ্ঞেস করছি “কেন”? আমি এই উত্তরের জন্যে তোমাকে জোর করছি।’
তবুও আমি চুপ করে রইলাম।
হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। উলটোদিকের দেয়াল ঘেঁষে যে ফাইল-ক্যাবিনেট ছিল সেখানে গিয়ে ড্রয়ার খুলে একটি রুপোর ক্রুশ বের করলেন। তারপর ক্রুশটি দোলাতে দোলাতে ডেস্কের কাছে ফিরে এলেন।
‘তুমি জানো ইনি কে?’ তাঁর গলার স্বর তখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আবেগে কাঁপছে তা।
‘নিশ্চয় জানি।‘ উত্তর দিলাম আমি।
এবার যেন তার মুখ খুলে গেল। দ্রুত তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন। বললেন, ঈশ্বরে তিনি বিশ্বাসী এবং জঘন্য পাপীরাও ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা পেতে পারে। কিন্তু তার আগে এর জন্যে তাকে অনুতপ্ত হতে হবে এবং শিশুর মতো সরল ও বিশ্বাসী হয়ে যেতে হবে যাতে হৃদয় বিশ্বাসের জন্যে থাকে উন্মুক্ত। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমার চোখের সামনে কুশটি তিনি দোলাতে লাগলেন।
সত্যি বলতে কী তার মন্তব্যগুলি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। কারণ অফিসটা ছিল গরম আর শব্দ করে বড় বড় মাছি ঘুরছিল, গালের ওপর বসছিল; তা ছাড়া তিনি আমাকে খানিকটা সতর্ক করে তুলেছিলেন। অবশ্য আমি বুঝেছিলাম এ-ধরনের ভাবনা অবাস্তব, কারণ বলতে গেলে আমিই হলাম অপরাধী। যাহোক, তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন, আমি মনোযোগ দিয়ে তা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম এবং বুঝলাম আমার স্বীকারোক্তির একটি অংশ। আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার তা হল দ্বিতীয়বার গুলি করার আগে কেন বিরতি দিয়েছিলাম। বাকি সবকিছু বলতে গেলে ঠিকই আছে; কিন্তু এই ব্যাপারটা তাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে।
বলতে যাচ্ছিলাম, এ-ব্যাপারে জোর দেয়া ভুল; ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব নেই। কিন্তু বলার আগেই তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কি না। যখন বললাম না তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন।
অসম্ভব, বললেন তিনি; সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, এমনকি যারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে তারাও। এ-ব্যাপারে তিনি একেবারে নিশ্চিত; যদি এ-বিষয়ে কোনো দ্বিধা দেখা দিত তবে জীবন তার কাছে অর্থশূন্য হয়ে উঠত। ‘তুমি কি চাও’, ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘আমার জীবন অর্থশূন্য হয়ে উঠুক?’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমার ইচ্ছে কীভাবে এর ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং তা জানালামও তাকে।
আমি যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি আবার কুশটি আমার নাকের সামনে তুলে ধরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি, যেভাবেই হোক একজন খ্রিস্টান। তিনি যেন তোমার পাপ মার্জনা করেন সেজন্যে আমি তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি। মাই পুওর ইয়ংম্যান, তোমাদের জন্যেই যে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন তা কীভাবে অবিশ্বাস করছ?’
খেয়াল করলাম তিনি যখন ‘মাই পুওর ইয়ংম্যান’ বললেন তখন বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই বললেন। কিন্তু আমার জন্যে এসবই যথেষ্ট ছিল। আর ঘরটাও ক্রমশ আরও উষ্ণ হয়ে উঠছিল।
সাধারণত কারও কথাবার্তা যখন আমাকে বিরক্ত করে তোলে তখন রেহাই পাবার জন্যে যা করি, এক্ষেত্রেও তা করলাম–অর্থাৎ মেনে নেয়ার ভান করলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন দেখলাম এতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘দ্যাখো! দ্যাখো! তুমিও কি এখন তাকে বিশ্বাস করছ না বা তার ওপর। তোমার বিশ্বাস রাখছ না?’
আমি বোধহয় মাথা নেড়েছিলাম, কারণ দেখলাম হতাশ হয়ে তিনি আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।
কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নামল। আমরা যতক্ষণ কথা বলছিলাম টাইপরাইটারটা ততক্ষণ শব্দ করছিল, এবার নীরবতার মধ্যে শেষ মন্তব্যটুকু টাইপ করল। তারপর দেখলাম তিনি সরাসরি খানিকটা দুঃখীভাব নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।
‘আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় এর আগে তোমার মতো এত শক্ত লোক আর পাইনি।‘ নিচুগলায় বললেন তিনি, ‘এতদিন যেসব অপরাধী আমার সামনে এসেছে তারা প্রভুর ত্যাগের প্রতীক দেখে কেঁদেছে।’
আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে এর কারণ তারা অপরাধী। পরে অনুধাবন। করলাম যে আমি নিজেও ঐ শ্রেণীভুক্ত। এই একটি চিন্তার সঙ্গে কিছুতেই আমার সমঝোতা হচ্ছিল না।
সাক্ষাৎকার শেষ হয়ে গেছে, যেন একথা বোঝাবার জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট উঠলেন। সেই একই রকম বিষণ্ণস্বরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : যা করেছি তার জন্যে কি আমি অনুতপ্ত?
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললাম, আমি যা অনুভব করছি তা দুঃখ নয় বরং একধরনের বিরক্তি। এর জন্যে ভালো প্রতিশব্দ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু মনে হল না যে কথাটা তিনি বুঝেছেন। ঐদিন সাক্ষাৎকারে এসবই ঘটেছিল।
এরপর আমি অনেকবার তার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু প্রতিবারই আমার উকিল আমার সঙ্গে ছিলেন। প্রশ্নোত্তর সীমাবদ্ধ ছিল আমার পূর্বোক্ত স্বীকারোক্তির মধ্যে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং আমার উকিল টেকনিক্যালিটি নিয়ে আলাপ করতেন। ঐসময় তারা আমার দিকে খুব কমই নজর দিতেন।
যাহোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের ধরনও বদলাতে লাগল। ম্যাজিস্ট্রেট আমার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং আমার মামলার ব্যাপারেও একধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আর তিনি কখনও তোলেননি বা ধর্মীয় কোনো প্রতীকও আমাকে দেখাননি যা প্রথম সাক্ষাৎকারে আমাকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছিল। এর ফলে আমাদের সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়ে উঠল। আমার মামলা নিজ পথেই এগোচ্ছে, এভাবে বলতেন তিনি। দু-একটি প্রশ্নের পর আমার উকিলের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করে তিনি আমার প্রশ্নোত্তরে ইতি টানতেন। মাঝে মাঝে সাধারণ কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ চলত, তখন ম্যাজিস্ট্রেট ও উকিল আমাকে আলোচনায় যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। এতে আমি আরও সহজ হয়ে গেলাম। তাদের দুজনের কেউই ঐসময় আমার সঙ্গে প্রতিকূল কোনো আচরণ করেননি। সবকিছু এত মসৃণভাবে, এত প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে চলতে লাগল যে মাঝে মাঝে এক অবাস্তব ধারণা জন্মাত যে আমরা। সবাই একই পরিবারের সদস্য। সত্যি বলতে কি, প্রশ্নোত্তরের এই এগারো মাস। তাদের সঙ্গে আমি এতই একাত্মতা অনুভব করতাম যে মাঝে মাঝে তখন ভেবে অবাক হতাম, এর আগে এরচেয়ে দুর্লভ মুহূর্ত আর আমার জীবনে আসেনি। যখন ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের দোর পর্যন্ত আমার সঙ্গে আসতেন, তখন আমার কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বন্ধুভাবে বলতেন : ‘তা হলে, জনাব যিশু-বিরোধী, আজকের মতো এখানেই শেষ!’ এরপর আমাকে ওয়ার্ডারদের হাতে সমর্পণ করা হত।
.
২.
কিছু-কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আমি কখনও কিছু বলার কথা ভাবিনি। এবং জেলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর মনে হল জীবনের এই পর্যায়টুকু হচ্ছে ঐসব বিষয়ের একটি। যা হোক, সময় কাটার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এই বিতৃষ্ণার কোনো আসল সারবস্তু নেই। সত্যি বলতে কি, প্রথম কয়েকদিন আমি যে জেলে আছি। এ-সম্পর্কেই সচেতন ছিলাম না। সবসময় একটা অনিশ্চিত আশা ছিল কিছু একটা ঘটবে, আশাপ্রদ, অবাক-করা কিছু।
মারির প্রথম এবং একমাত্র সাক্ষাতের পরই পরিবর্তনটা এল। সেদিন আমি তার লেখা একটি চিঠি পেলাম, যাতে সে লিখেছিল তারা তাকে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না যেহেতু সে আমার স্ত্রী নয়। সেদিন থেকে বুঝলাম এই সেলই হচ্ছে আমার সর্বশেষ আস্তানা, যাকে অনেকে হয়তো বলবে অন্তিমতা।
আমার গ্রেফতারের দিন তারা আমাকে আরও কিছু কয়েদির সঙ্গে, যাদের বেশির ভাগই ছিল আরব, বিরাট এক ঘরে রেখেছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে ওরা জিজ্ঞেস করল, আমি কী করেছি। বললাম, আমি একজন আরবকে খুন করেছি। এটা শুনে ওরা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে গেল। আস্তে রাত নেমে এলে ওদের একজন দেখিয়ে দিল কীভাবে মাদুর বিছাতে হবে। একপ্রান্ত গুটিয়ে নিয়ে বালিশের কাজও চলে যায়। সারারাত অনুভব করলাম মুখের ওপর ছারপোকারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কয়েকদিন পর আমাকে একলা এক সেলে ঢোকানো হল যেখানে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটি তক্তার বিছানায় আমি শুতাম। অন্য আসবাবের মধ্যে ছিল মলত্যাগের জন্যে একটা বালতি এবং টিনের একটি বেসিন। সেটা ছিল একটু উঁচু জমিতে, ফলে ছোট জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখতে পেতাম। একদিন শিক ধরে কূলে ঢেউয়ের ওপর রোদের খেলা দেখছি এমন সময় ওয়ার্ডার এসে বলল, আমাকে একজন দেখতে এসেছে। মনে হল নিশ্চয় মারি এবং ঠিক তা-ই।
ভিজিটার-রুমে যাওয়ার জন্যে একটি করিডোর, কিছু সিঁড়ি, তারপর আরেকটি করিডোর পার হতে হল। ঘরটি বেশ বড়সড়, একটি বড় নিচু জানালা দ্বারা আলোকিত এবং উঁচু লোহার শিক আড়াআড়িভাবে ঘরটিকে তিনভাগে ভাগ করেছে। দুটো শিকের মাঝে ব্যবধান প্রায় ত্রিশ ফুট যা বন্দি এবং তার বন্ধুদের মাঝে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসেবে কাজ করছে। আমাকে ঠিক মারির বিপরীতে নিয়ে যাওয়া হল, পরনে ছিল তার ডোরাকাটা পোশাক। আমার পাশে রেলিঙে ছিল আরও ডজনখানেক বন্দি। বেশির ভাগই আরব। মারির দিকে যারা ছিল তারা প্রায় সবই মুর রমণী। একজন ছোটখাটো বৃদ্ধা এবং টুপি-ছাড়া মোটাসোটা একজন মেট্রনের মাঝে মারি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মেট্রনটি সবসময় অঙ্গভঙ্গি করে তীক্ষ্ণগলায় কথা এলছিল। সাক্ষাৎপ্রার্থী এবং বন্দিদের মধ্যে দূরত্ব থাকায় দেখলাম আমাকেও গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলতে হল।
ঘরের মধ্যে ঢোকার পর, শূন্য দেয়ালে কথার বুদ্বুদের প্রতিধ্বনি, সূর্যের আলো যার তীক্ষ্ণ শাদা দ্যুতির বন্যা ভাসিয়ে দিচ্ছিল সবকিছুকে, আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিল। সেলের নৈঃশব্দ এবং খানিকটা আঁধারে অভ্যস্ত থাকায় এ-অবস্থায় অভ্যস্ত হতে আমার কিছুটা সময় লাগল। কিছুক্ষণ পর, আমি সবার মুখ পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম যেন তাদের উপর স্পটলাইট ফেলা হয়েছে।
গ্রিলের মাঝে যে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ তার দুপাশে দেখলাম জেলের কর্মচারী বসে আছে। দেশী বন্দিরা ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা পরস্পরের বিপরীতে বসে আলাপ করছিল। গলার স্বর তাদের নিচু এবং হৈচৈ থাকা সত্ত্বেও তারা ফিসফিস করে আলাপ করছিল। নিচে থেকে উঠে-আসা স্বরের এই গুঞ্জন যেন সঙ্গত করছিল মাথার ওপর চলতে থাকা কথোপকথনের সঙ্গে। সবকিছুর ওপর দ্রুত নজর বুলিয়ে মারির দিকে এক পা এগিয়ে গেলাম। শিকের ওপর সে তার বাদামি, সূর্যস্নাত মুখটা চেপে ধরে যতটা সম্ভব হাসছিল। বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছিল তাকে কিন্তু কোনোরকমেই কথাটা তাকে বলতে পারলাম না।
বেশ উঁচুস্বরে সে জিজ্ঞেস করল, কী খবর? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? দরকারি সবকিছু পাচ্ছ তো?
হ্যাঁ, দরকারি সবকিছুই পাচ্ছি।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ; মারি হাসতে লাগল। আমার পাশে দাঁড়ানো বন্দিটিকে সেই মোটাসোটা মহিলা বকছিল, লম্বা, কমনীয় ফরসা লোকটি খুব সম্ভব তার স্বামী। জা’ তাকে নিতে চাচ্ছে না, চিৎকার করে সে বলল। ব্যাপারটা তা হলে তো খুব খারাপ। লোকটি উত্তর দিল-হ্যাঁ, আমি তাকে বলেছি তুমি বের হয়ে এলেই তাকে ফেরত নিয়ে নেবে, কিন্তু সে তা কানে তুলছে না।
মারি চেঁচিয়ে বলল, রেমন্ড আমাকে তার শুভেচ্ছা জানিয়েছে এবং উত্তরে আমি বললাম ‘ধন্যবাদ’, কিন্তু আমার প্রতিবেশীর প্রশ্নে আমার স্বর ডুবে গেল। তার শরীর ভালো তো? মোটা মহিলাটি হাসলেন, ভালো? সম্পূর্ণ সুস্থ। একেবারে নাদুসনুদুস।
অন্যদিকে আমার বাঁ-পাশের বন্দি, তরুণ, শীর্ণ, হাতগুলি মেয়েদের মতো, একটি কথাও বলেনি। বিপরীত দিকের বৃদ্ধার দিকে সে তাকিয়ে ছিল এবং তিনি ক্ষুধার্ত এক আবেগের সঙ্গে সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের দিকে আর তাকানো গেল না, কারণ মারি চিৎকার করে বলল, আমাদের আশা হারানো উচিত নয়।
‘নিশ্চয় নয়’। আমি উত্তর দিলাম। চোখ পড়ল তার কাঁধের দিকে, হঠাৎ ইচ্ছে হল পাতলা কাপড়ের ওপর দিয়ে ঐ কাঁধে একটু চাপ দিই। কাপড়টার সিল্কের মতো টেক্সচার আমাকে মুগ্ধ করে তুলছিল এবং মনে হল মারি যে আশার কথা বলেছে তা যে-করেই হোক যেন এখানেই কেন্দ্রীভূত। মনে হল মারিও বোধহয় একই কথা চিন্তা করছে, কারণ সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেই চলল।
‘তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর আমরা বিয়ে করব।’
আমি শুধু তার শাদা দাঁতের উজ্জ্বলতা এবং চোখের চারপাশের অল্প ভাজই দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হল আমার কিছু-একটা উত্তর দেয়া প্রয়োজন তাই উত্তর দিলাম : তুমি কি সত্যিই তা-ই বিশ্বাস করো?
সে সেই একই রকম উঁচুগলায় খুব তাড়াতাড়ি বলতে লাগল :
‘হ্যাঁ, তুমি ছাড়া পাবে আর আমরা আবার রোববারে একসঙ্গে সাঁতার কাটতে যাব।’
মারির পাশের মহিলাটি তখনও চাচাচ্ছিল, বলছিল যে তার স্বামীর জন্যে জেলঅফিসে একটি ঝুড়ি এবং জিনিসের ফর্দ রেখে যাবে, সে যেন ঠিকঠাক মতো সব মিলিয়ে নেয়, কারণ এগুলি কিনতে তার বেশকিছু খরচ করতে হয়েছে। অন্য পাশের যুবকটি এবং তার মা তখনও একজন আরেকজনের দিকে বিষণ্ণভাবে তাকিয়েছিল এবং আরবদের মৃদুস্বর আমাদের নিচে গুঞ্জন তুলছিল। বাইরে আলো যেন আছড়ে পড়ছিল জানলায়, ঢুকে পড়ছিল ভেতরে, এবং মুখোমুখি সবার মুখ আবৃত করে দিচ্ছিল যেন এক পরত হলুদ তেলে।
আমার একটু বমি-বমি লাগছিল, ইচ্ছে করছিল এখান থেকে চলে যাই। পাশের কর্কশ স্বর কানে বাড়ি মারছিল। কিন্তু অন্যদিকে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ মারির সান্নিধ্যে থাকতে ইচ্ছে করছিল। কতক্ষণ কেটে গেল খেয়াল ছিল না। একই হাসি মুখে রেখে মারি তার কাজের বিবরণ দিচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও কিন্তু চাচামেচি, পরস্পরের সঙ্গে কথা এবং সেই কর্কশধ্বনি বন্ধ হয়ে যায়নি। একমাত্র নীরবতার মরূদ্যান সৃষ্টি করেছিল সেই তরুণটি এবং তার বৃদ্ধা মা যারা নীরবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
তারপর একজন একজন করে আরবদের নিয়ে যাওয়া হল; প্রথমজন চলে। গেলে প্রায় সবাই নীরব হয়ে গেল। সেই ছোটখাটো বৃদ্ধা মহিলাটি জেলখানার শিকগুলি চেপে ধরলেন এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পাহারাদার তার ছেলের কাঁধে টোকা দিল। সে বলল, ‘বিদায় মা’, আর সেই মহিলা শিকের ভিতর হাত গলিয়ে আস্তে একটু হাত নাড়লেন।
তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টুপি-হাতে একজন তার জায়গা নিল। একজন বন্দিকে আমার পাশের খালি জায়গায় নিয়ে আসা হলে দুজনে আস্তে আস্তে কথা শুরু করল, কারণ ঘরটা তখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত। অন্য একজন এসে আমার ডানদিকের লোকটিকে সরিয়ে নিল। তার স্ত্রী চিৎকার করে বলল, যদিও চিৎকার করার কোনো দরকার ছিল না—’শোনো, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো লক্ষ্মীটি–তাড়াহুড়ো করে কিছু কোরো না!’
এরপর আমার পালা। মারি আমার উদ্দেশে চুমু ছুঁড়ে দিল। চলে আসার সময় পিছন ফিরে তাকালাম। সে তখনও চলে যায়নি, মুখ তার তখনও গরাদে সাঁটা, সেই হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁটদুটো তখনও আবেগে ফাঁক করা।
এর কিছুদিন পর আমি মারির চিঠি পেলাম। আর তখন থেকেই যেসব ব্যাপারে আমি আলোচনা পছন্দ করতাম না তা-ই শুরু হল। ব্যাপারগুলো খুব একটা ভয়ংকর কিছু নয়, কোনোকিছু বাড়িয়ে বলার ইচ্ছেও আমার ছিল না এবং অন্যদের তুলনায় আমি কষ্ট পেতামও কম; তবুও সেই পুরানো দিনগুলিতে একটা জিনিস ছিল যা সত্যিই বিরক্তিকর, তা হল স্বাধীন মানুষের মতো চিন্তা। যেমন, হঠাৎ সমুদ্রে গিয়ে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করত। পায়ের নিচের ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, শরীরে পানির কোমল স্পর্শ এবং এর আনন্দদায়ক অনুভূতির চিন্তা আমাকে আমার সেলের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলত।
অবশ্য এই পর্বটি অল্প কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল। এরপর বন্দির মতো চিন্তা করতাম। জেল-প্রাঙ্গণে প্রাত্যহিক ভ্রমণ এবং আমার উকিলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্যে প্রতীক্ষা করতাম। বাকি সময়টুকুও সত্যি সত্যি কাটিয়ে দিতাম। প্রায়ই মনে হত আমাকে আর কিছু করতে দেয়া ছাড়া, শুধু যদি মরাগাছের গুঁড়ির ভেতর শুইয়ে মাথার ওপরের একটুকরো আকাশ দেখতে বাধ্য করা হত তা হলেও আমি হয়তো এতে অভ্যস্ত হয়ে যেতাম। হয়তো আমি পাখিদের অথবা মেঘের আনাগোনা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যেতাম। যেভাবে আমি আমার উকিলের গলার অদ্ভুত নেকটাই নজর করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম অথবা অন্য এক জগতে, যেখানে রোববারে মারির সঙ্গে প্রেম করার জন্যে শান্তভাবে অপেক্ষা করতে হত।
অবশ্য এখানে ফাপা গাছের গুঁড়িতে আমাকে আটকে রাখা হয়নি। পৃথিবীতে আমার চাইতেও অনেক দুঃখী লোক আছে। মনে পড়ল, মায়ের একটি প্রিয় ধারণা ছিল–যা অহরহ তিনি বলতেন–যে একসময়ে-না-একসময় সবাই সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আমি কিন্তু তেমনভাবে কোনোকিছুই ভাবিনি। প্রথমদিকে অবশ্য সময়টা ছিল যন্ত্রণাদায়ক; কিন্তু সামান্য চেষ্টায়ই আমি এ-সময়টা পেরুতে পেরেছিলাম। যেমন, যে-কোনো নারীর সান্নিধ্যের জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলাম, অবশ্য এটা আমার বয়সের জন্যে ছিল স্বাভাবিক। মারির কথা বিশেষ করে ভাবিনি। এইসব মহিলার সঙ্গে আমি কীভাবে প্রেম করব বা তাদের পাব এইসব চিন্তা আমার মনকে আবিষ্ট করে রেখেছিল; বিভিন্ন মুখের ভিড়ে আমার সেল যেন ভরে গেল; আমার পুরানো আবেগের প্রেতাত্মা সব। এইসব চিন্তাভাবনা আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলত বটে কিন্তু এতে আমার সময়টা বেশ কেটে যেত।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান কারাধ্যক্ষের সঙ্গে আমার বেশ খাতির হয়ে গেল। প্রতিদিন খাবারের সময় তিনি তদারক করতে আসতেন। প্রথমে তিনিই মহিলাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। ‘এখানে সবাই এ নিয়েই বেশি মাথা ঘামায়’, বললেন তিনি। আমি জানালাম যে আমার নিজের বেলাতেও একই ব্যাপার ঘটছে। ‘এটা অন্যায়’, যোগ করলাম আমি, ‘এ যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা।’—’এখানেই তো মজা’, বললেন তিনি, ‘আর সেজন্যেই তো তোমাদের আটক রাখা হয়েছে।‘–’ঠিক বুঝতে পারলাম না।‘—‘স্বাধিকার’, বললেন তিনি, ‘মানে তা-ই। কিন্তু তোমাদের স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।‘ এ-জিনিসটা আগে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন তাঁর বক্তব্যটা ধরতে পারলাম। ‘সত্যিই তো’, বললাম আমি, ‘না হলে তো এটা শাস্তি হত না।‘ কারাধ্যক্ষ মাথা নাড়লেন, ‘তুমি একটু আলাদা, মাথা খাটাতে পারো। অন্যেরা তাও পারে না। কিন্তু তবুও তারা একটা পথ খুঁজে নেয়; নিজের চেষ্টায়ই তা করে।‘ এই বলে তিনি আমার সেল ছেড়ে চলে গেলেন। পরদিন আমিও অন্যদের পথ অনুসরণ করলাম।
সিগারেটের স্বল্পতাও ছিল একধরনের শাস্তি। বন্দি হিসেবে যখন আমাকে আনা হয়েছিল তখন আমার বেল্ট, জুতোর ফিতা, সিগারেটসুদ্ধ পকেটের যাবতীয় জিনিস নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেলে রাখার পর আমি আমার সিগারেট ফেরত চাইলাম। ধূমপান নিষিদ্ধ, তারা জানাল। এই ব্যাপারটাই আমাকে অসহায় করে দিয়েছিল; এবং সত্যি বলতে কি প্রায় কয়েকটা দিন আমার খুবই খারাপ কেটেছিল। এমনকি তখন আমার কাঠের বিছানা থেকে চেলা ছিঁড়ে চুষেছিলাম পর্যন্ত। সারাদিন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি, মেজাজটা পর্যন্ত খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কেন আমায় ধূমপান করতে দেয়া হবে না; এটা তো আর কারও ক্ষতি করছে না। পরে কারণটা বুঝলাম; এই কাপর্ণও ছিল আমার শাস্তির একটা অংশ। কিন্তু বুঝে উঠতে উঠতে ধূমপানের জন্যে আমার ব্যাকুলতা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং তখন আর এটা আমার জন্যে কোনো শাস্তি ছিল না।
এই অভাবগুলি ছাড়া আমি খুব-একটা অসুখী ছিলাম না। কিন্তু তবুও একটা বড় সমস্যা ছিল : কীভাবে সময় কাটানো যায়। কিন্তু যখন থেকে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার কায়দাটা রপ্ত করলাম তখন সময় কাটানোটা একটা সমস্যাই মনে হল না। মাঝে মাঝে আমার শোবার ঘরের কথা চিন্তা করতাম, এক কোণ থেকে শুরু করে আরেক কোণ অবধি চোখ বুলিয়ে যেতাম, চোখ বুলাতাম প্রতিটি আসবাবপত্রে। প্রথমদিকে এর জন্যে লাগত এক কি দু-মিনিট। কিন্তু এরপর যতবার ভাবতাম, সময়ের সীমাও তত বাড়তে লাগল। প্রতিটি আসবাবপত্রকে আলাদা আলাদাভাবে দেখতাম, এর ওপরে বা ভিতরে কী আছে তাও দেখতাম, তারপর প্রতিটি জিনিসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসগুলিতেও নজর দিতাম, যেমন : কোথাও একটি আঁচড় লেগেছে, কোথাও একটু ভেঙে গেছে, সেগুলির রং, সবকিছু নিয়ে ভাবতাম। আসবাবপত্রের তালিকাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, কোনো জিনিস না-ছেড়ে, মনে রাখার চেষ্টা করতাম। এর ফলে কয়েক সপ্তাহ পর থেকে আমি আমার শোবার ঘরের জিনিসপত্রের কথা চিন্তা করে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারতাম। যতই চিন্তা করতাম। ততই আধা-ভুলে-যাওয়া বা ভুলে-যাওয়া জিনিসের কথা, তাদের বিবরণ আমার স্মৃতিতে অনুরণন তুলত। এর কোনো শেষ ছিল না।
সুতরাং বুঝতে পারলাম কারও যদি বাইরের জগৎ সম্পর্কে একদিনের অভিজ্ঞতা থাকে তবে সে অনায়াসে একশো বছর জেলে কাটাতে পারবে। স্মৃতির ফোয়ারা তাকে হতাশ হতে দেবে না। একদিক দিয়ে, অবশ্যই, এটা ছিল একধরনের ক্ষতিপূরণ।
তারপর আসে ঘুমের পালা। প্রথমদিকে, রাতে আমার ভালো ঘুম হত না, দিনে তো না-ই। কিন্তু আস্তে আস্তে রাতগুলি চমৎকার হয়ে উঠল, দিনেও ঝিমোতে লাগলাম। সত্যি বলতে কি, শেষের দিনগুলিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। বাকি থাকত ছ’ঘণ্টা–এ সময়টা খাবার খেয়ে, প্রাতকৃত্যাদি সেরে, স্মৃতি রোমন্থন করে আর চেক গল্পটা পড়ে কেটে যেত।
একদিন, আমার মাদুরটা উলটেপালটে দেখার সময় নিচের দিকে দেখলাম পত্রিকার একটি টুকরো আটকে আছে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় কাগজটি হয়ে গেছে বিবর্ণ, হলুদ, কিন্তু তবুও অক্ষরগুলি পড়া যাচ্ছিল। গল্পটি ছিল অপরাধ-বিষয়ক। গল্পের প্রথম অংশটি ছিল না, তবুও অনুমান করে নেয়া যায় চেকোস্লোভাকিয়ার কোনো গ্রামে এই ঘটনার কিছু অংশ ঘটেছিল। জনৈক গ্রামবাসী ভাগ্যান্বেষণে গ্রাম ছেড়ে বিদেশ যাত্রা করেছিল। পঁচিশ বছর পর একজন অবস্থাপন্ন লোক হিসেবে স্ত্রী এবং পুত্রকন্যাদের নিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে তার মা ও বোন, সে যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিল সেখানে একটি ছোট হোটেল খুলে ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছিল। তাদের অবাক করে দেওয়ার জন্যে স্ত্রী-পুত্রদের অন্য একটি সরাইখানায় রেখে সে ছদ্মনামে তার মা’র হোটেলে একটি ঘর ভাড়া। করল। তার মা এবং বোন তাকে একেবারেই চিনতে পারেনি। সন্ধেয় খাবার সময় সে তাদের নিজের টাকার বেশকিছু দেখাল এবং রাতে তারা তাকে হাতুড়ির আঘাতে হত্যা করল। টাকাপয়সা সরিয়ে নেবার পর তার মৃতদেহটিকে নদীতে ভাসিয়ে দিল। পরদিন সকালে, লোকটির স্ত্রী এসে কোনোকিছু না-ভেবেই স্বামীর পরিচয় ফাঁস করে দিল। তার মা গলায় দড়ি দিল। বোন একটি কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাজারবার বোধহয় আমি গল্পটি পড়েছিলাম। একদিকে ব্যাপারটা যেমন অবিশ্বাস্য ঠেকত, অন্যদিকে আবার বিশ্বাসযোগ্যও মনে হত। যাহোক, আমার মতে লোকটি নিজেই তার বিপদ ডেকে এনেছিল; এ-ধরনের বোকামি করা কারও উচিত নয়।
সুতরাং, দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে, স্মৃতিচারণ করে, খবরের কাগজের টুকরোটা পড়ে, আলো-আঁধারের স্রোতে দিনগুলি কেটে যেতে লাগল। আগে পড়েছিলাম, জেলে থাকলে সময়ের হিসাব রাখা যায় না। অবশ্য এগুলি আমার কাছে তেমন কোনো অর্থ নিয়ে দাঁড়ায়নি। দিনগুলি ছোট কি বড় বুঝতাম না। সন্দেহ নেই দিনগুলি বড় ছিল, কিন্তু একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে যেত; এসব নিয়ে আমি ভাবিনি। দুটো শব্দ তখনও আমার কাছে অর্থবোধক ছিল : ‘গতকাল’ এবং ‘আগামীকাল’।
একদিন যখন ওয়ার্ডার এসে জানাল জেলে আমার ছ’মাস কেটে গেছে তখন তাকে বিশ্বাস করলাম–কিন্তু শব্দগুলি আমার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। আমার কাছে মনে হল, যেদিন থেকে সেলে আছি সেদিন থেকে এ-পর্যন্ত ঐ একটি দিনই কেটেছে, এবং আমিও সবসময় একটি কাজই করেছি।
কারাধ্যক্ষ চলে যাবার পর টিনের পেয়ালাটা পরিষ্কার করে তাতে নিজের মুখ দেখলাম। নিজের মুখাবয়ব ভীষণ সিরিয়াস মনে হচ্ছিল, এমনকি আমি যখন হাসবার চেষ্টা করলাম তখনও। বিভিন্ন কোণ থেকে পেয়ালাটা ধরে মুখ দেখলাম; কিন্তু বরাবরই সিরিয়াস বিষণ্ণ একটি চেহারা তাতে ফুটে উঠল।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে, এবং এই সময়টার কথা না-বললেই ভালো সময়টার নাম দিয়েছিলাম আমি ‘নামহীন সময়,–এই সময় বন্দিশালার চারদিক থেকে শব্দগুলি যেন সতর্ক মিছিলের মতো উঠে আসত। খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে দিনের শেষ আলোয় আবার নিজের মুখের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালাম। আগের মতোই সিরিয়াস; অবশ্য আশ্চর্যের কিছু ছিল না, কারণ তখন আমি নিজেই সিরিয়াস ছিলাম। কিন্তু এই সময় এমন কিছু শুনলাম যা গত কয়েকমাস শুনিনি। একটি গলার স্বর; আমার নিজের, এতে আর কোনো ভুল ছিল না। বুঝতে পারলাম, গত কয়েকদিন ধরে এই স্বরধ্বনিই আমার কানে গুঞ্জন তুলেছে। তার মানে এ কয়দিন সারাক্ষণ আমি নিজের সঙ্গে কথা বলেছি।
এবং তখন আমার পুরনো একটি কথা মনে হল। মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সেই নার্সটি মন্তব্যটি করেছিল। না, আর কোনো উপায় নেই এবং কেউ কল্পনাও করতে পারবে না বন্দিশালার বিকেলটা কেমন।
.
৩.
সব মিলিয়ে মাসগুলি যে তাড়াতাড়ি কেটে যায়নি এমন কথা বলতে পারি না; প্রথম গ্রীষ্ম পার হয়ে গেছে বোঝার আগেই আরেক গ্রীষ্ম এসে উপস্থিত। গ্রীষ্মের উষ্ণতা অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারলাম, নতুন কিছু খবর অপেক্ষা করে আছে। আমার মামলা এ-সাইজ কোর্টে শেষ সেশনের জন্যে তৈরি হয়ে আছে যা আগামী জুনের কোনো-এক সময় শেষ হবে।
রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিনে আমার বিচার শুরু হল। আমার উকিল জানালেন মামলাটা দুএকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বললেন তিনি, ‘যদ্দুর মনে হয় কোর্ট তোমার মামলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করে দেবে, কারণ গুরুত্বপূর্ণ মামলার তালিকায় এটা পড়ে না। এর ঠিক পরপরই আছে পিতৃহত্যা-সম্পর্কিত একটি মামলা যা শেষ হতে বেশকিছু সময় লাগবে।‘
সকাল সাড়ে সাতটায় তারা আমাকে নিতে এল এবং আসামিদের গাড়ি করে আমাদের ল’ কোর্টে নিয়ে যাওয়া হল। দুজন পুলিশ আমাকে নিয়ে এল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ঘরে। দরজার পাশে বসলাম আমরা যা দিয়ে গলার স্বর, চিৎকার, চেয়ার টানার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ-সমস্ত আমাকে মনে করিয়ে দিল মফস্বলের কোনো পার্টির কথা যেখানে কনসার্ট শেষ হওয়ার পর নাচের জন্যে হল পরিষ্কার করা হয়। পুলিশদের একজন জানাল বিচারকরা তখনও এসে পৌঁছাননি। আমাকে একটি সিগারেট সাধল সে যা আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। কিছুক্ষণ পর সে জিজ্ঞেস করল আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছি কি না। আমি বললাম, ‘না। বরং আদালতে বিচার দেখা আমাকে আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল; এর আগে কখনও আদালতের বিচার দেখিনি।’
‘হতে পারে’, বলল অন্যজন, ‘কিন্তু বিচারের দুএক ঘণ্টাই যথেষ্ট।‘
কিছুক্ষণ পর ঘরের মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক ঘণ্টা বেজে উঠল। পুলিশ দুজন আমার হাতকড়া খুলে ঘরের দরজা খুলল এবং আমাকে আসামির কাঠগড়ায় নিয়ে গেল।
আদালত দর্শকে পূর্ণ। জানালার ঝিলমিলিগুলি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সত্ত্বেও ফাঁকফোকর দিয়ে আলো ছিটকে আসছিল, এবং ইতোমধ্যে ঘরটি হয়ে উঠেছিল গরম। জানালাগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি বসে পড়লাম এবং পুলিশ অফিসাররা আমার চেয়ারের দুপাশে তাদের জায়গায় দাঁড়াল।
আর ঠিক তখনই উলটোদিকে একসারি মুখ আমার নজরে পড়ল। লোকগুলি কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাতে মনে হল তারা বোধহয় জুরি। কিন্তু আলাদা আলাদা ব্যক্তি হিসেবে তাদের আমি দেখছিলাম না। ট্রামে উঠলে হঠাৎ যেমন মনে হয় বিপরীত সারির বসে-থাকা লোকগুলি বুঝি কাউকে দেখে হাসির খোরাক খুঁজছে, আমারও তেমন মনে হয়েছিল। অবশ্য জানতাম এটা। একটি অবিশ্বাস্য তুলনা। এই লোকগুলি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল হাসির খোরাকের জন্যে নয়, বরং অপরাধের চিহ্নের জন্যে। তবুও তফাতটা খুব বেশি না, আমার অন্তত তা-ই মনে হয়েছিল।
দর্শক এবং বদ্ধ বাতাসের জন্যে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল। আদালতের চারদিকে চোখ বুলিয়েও আমি পরিচিত কারও মুখ খুঁজে পেলাম না। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এত লোক শুধু আমার জন্যেই এখানে এসেছে। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আমি–এই অভিজ্ঞতাটা আমার জন্যে নতুন; কারণ অন্য সময় কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাত না। বামপাশের পুলিশটির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলাম, ‘এত ভিড়!’ সে বললে, পত্রিকাগুলিই এর জন্যে দায়ী। জুরি-বক্সের ঠিক নিচে একদল লোককে দেখিয়ে সে বলল, ‘ঐ যে ওরা।’–কে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি, উত্তরে সে জানাল, ‘সাংবাদিক।‘ সে আরও জানাল তার একজন পুরনো বন্ধুও আছে তাদের মধ্যে।
কিছুক্ষণ পর পুলিশটির সেই পুরনো বন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এল এবং পুলিশটির সঙ্গে করমর্দন করল। সাংবাদিকটি বেশ বয়স্ক, খানিকটা গম্ভীর, কিন্তু তার ব্যবহার বেশ অমায়িক। লক্ষ করলাম আদালতে সমবেত প্রায় সবাই একে অপরের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ে ব্যস্ত দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কোনো একটি ক্লাবে জমা হয়েছে যেখানে যে যার রুচিমতো দলবেঁধে গল্প করছে। তাই মনে হচ্ছিল যেন আমি এখানে অনাহূত। যাহোক, সাংবাদিকটি বেশ অমায়িকভাবে আমাকে সম্বোধন করে আশা প্রকাশ করলেন সবকিছু আমার পক্ষে যাবে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম, প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে তিনি বললেন :
‘আপনি বোধহয় জানেন, আমরা আপনাকে নিয়ে বেশকিছু ফিচার লিখছি। গরমকালে সবসময় আমাদের খবরের ভাণ্ডার শূন্য থাকে; আর এখন আপনার এবং আপনার পরের মামলাটা ছাড়া লেখার মতো তেমন কিছু নেই। পরের মামলাটা বোধহয় শুনেছেন যে একটি পিতৃহত্যা মামলা।‘
প্রেস-টেবিলে বসে-থাকা একটি দলের দিকে তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, যেখানে মোটাসোটা ছোটখাটো একজন বসে ছিলেন। চোখে তার বড় কালো ফ্রেমের চশমা, দেখলেই পেটুক কোনো বেজির কথা মনে পড়ে।
‘ঐ লোকটি প্যারিসের একটি সংবাদপত্রের বিশেষ প্রতিনিধি। অবশ্য আপনার মামলার ব্যাপারে সে এখানে আসেনি। তাকে পাঠানো হয়েছিল পিতৃহত্যা মামলাটার ব্যাপারে কিন্তু তারা এখন তাকে আপনার মামলার ব্যাপারেও খবর পাঠাতে বলেছে।’
মুখ ফসকে প্রায় বলে ফেলেছিলাম, ‘তাদের অশেষ দয়া’, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল কথাটা হাস্যকর ঠেকবে। এরপর আন্তরিকভাবে হাত নেড়ে তিনি বিদায় নিলেন এবং তারপর কিছুক্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটল না।
এরপর আমার উকিল সহকর্মী-পরিবেষ্টিত হয়ে ব্যস্তভাবে গাউন পরে ঢুকলেন। সাংবাদিকদের টেবিলের কাছে গিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। যতক্ষণ-না তীক্ষ্ণভাবে ঘণ্টা বেজে উঠল ততক্ষণ তারা সবাই একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগলেন যেন তারা কোনো ঘরোয়া পরিবেশে আছেন, তারপর সবাই নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন। আমার উকিল কাছে এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করে উপদেশ দিলেন নিজ থেকে যেন আমি কিছু না বলি এবং সব প্রশ্নের উত্তর যেন সংক্ষেপে দিই। আমাকে তিনি তাঁর ওপর নির্ভর করতে বললেন।
আমার বামপাশে চেয়ার টানার শব্দ হল এবং লম্বা পাতলা, চশমা পরনে একজন ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে লাল গাউনের ভাজ ঠিক করলেন। আমার মনে হল ইনিই সরকারি উকিল। আদালতের একজন কেরানি ঘোষণা করল, মাননীয় বিচারকরা আসছেন এবং ঠিক সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরে দুটো বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরতে শুরু করল। তিনজন বিচারক, দুজন কালো এবং একজন লাল রঙের পোশাক পরে, হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঘরে ঢুকলেন এবং তাদের আসনের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে গেলেন; আসনটি আদালতের মেঝ থেকে বেশ কয়েক ফুট উঁচু। লাল-পোশাক-পরা জন মাঝখানে উঁচু পিঠের চেয়ারটিতে বসে টেবিলের ওপর আদালতের বিশেষ টুপিটি রাখলেন, ছোট্ট টাকপড়া মাথায় রুমাল বুলোলেন এবং অতঃপর ঘোষণা করলেন, এখন শুনানি শুরু হবে।
সাংবাদিকরা কলম নিয়ে প্রস্তুত হলেন। তাদের সবার মুখের ভাব একই রকম বিদ্রুপাত্মক, নিস্পৃহতা মাখানো। শুধু একজন, পরনে তার ধূসর ফ্লানেলের পোশাক ও লাল টাই এবং বয়সে অন্যদের তুলনায় বেশ ছোট, কলমটি টেবিলের ওপর রেখে কঠোরভাবে আমাকে দেখছিল। মুখ তার গোলগাল, কিন্তু আমাকে আকৃষ্ট করল তার চোখ যা স্নান, টলটলে; তার আবেগহীন চোখ আমাকে বিদীর্ণ করছিল। মুহূর্তে আমার মনে এক অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হল, আমি যেন নিজেকেই খুঁটিয়ে বিচার করছি। এ-ব্যাপারটা এবং আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার দরুন আদালতের প্রথমদিককার কার্যক্রম আমি ধরতে পারিনি। জুরি, সরকারি উকিল, জুরিদের ফোরম্যান এবং আমার উকিলের প্রতি প্রধান বিচারকের প্রশ্নাবলি (যখনই তিনি কিছু বলছিলেন তখনই জুরিরা উন্মুখ হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছিল), দ্রুত চার্জশিট পড়া–এসব চলাকালীন কিছু পরিচিত জায়গা এবং লোকের নাম চিনলাম, তারপর আমার উকিলের প্রতি কিছু সম্পূরক প্রশ্ন রাখা হল।
এরপর বিচারক ঘোষণা করলেন যে, সাক্ষীদের ডাকা হবে। কেরানি যেসব নাম পড়ল তার মধ্যে কিছু নাম আমাকে বিস্মিত করল। আদালতে দর্শক যারা তখন পর্যন্ত আমার কাছে অস্পষ্ট মুখের সারিমাত্র, তাদের মাঝ থেকে উঠে দাঁড়াল রেমন্ড, ম্যাসন, সালামানো, বাড়ির দারোয়ান, বৃদ্ধ পিরেজ, এবং মারি, যে পাশের দরজা দিয়ে বের হওয়ার জন্যে অন্যদের অনুসরণ করার আগে নার্ভাস হয়ে হাত নাড়ল। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই ভেবে যে সবশেষে সেলেস্তের নাম ডাকার আগ। পর্যন্ত আমি তাদের কাউকেই দেখিনি। সেলেস্তে উঠে দাঁড়াবার পর লক্ষ করলাম যে তার পাশে পুরুষদের কোট পরে নিরুত্তেজ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন একজন মহিলা যিনি রেস্তোরাঁয় এক টেবিলে বসে একবার আমার সঙ্গে খেয়েছিলেন। লক্ষ করলাম, স্থিরভাবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে ভাববার সময় আমার ছিল না, কারণ বিচারক আবার তার কথা শুরু করেছেন।
তিনি বললেন, বিচারের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে এবং বলা বাহুল্য দর্শকরা যে কোনো ধরনের মনোভাব প্রকাশে বিরত থাকবেন, এটাই তিনি আশা করেন। তিনি বললেন, বিচারের কার্যপ্রণালী পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি এসেছেন, অনেকটা আম্পয়ারের মতো এবং তিনি সাবধানতার সঙ্গে পক্ষপাতহীনভাবে বিচার করবেন। ন্যায়বিচারের আলোকে তিনি জুরিদের মত পর্যালোচনা করবেন। সবশেষে, বিন্দুমাত্র গণ্ডগোল হলে আদালত-কক্ষ থেকে তিনি সবাইকে বের করে দেবেন।
বেলা বাড়ছে। দর্শকদের কেউ-কেউ পত্রিকা দিয়ে বাতাস খাচ্ছে, কোঁচকানো কাগজের খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রধান বিচারকের নির্দেশে কেরানি তিনটি হাতপাখা নিয়ে এল। এবং বিচারক তিনজন সঙ্গে সঙ্গে এগুলি কাজে লাগালেন।
আর ঠিক তখনই আমার শুনানি শুরু হল। বিচারক শান্ত, সরলভাবে আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন; একসময় মনে হল এর মধ্যে কিছুটা সহৃদয়তা লুকানো আছে। প্রথমবারের মতো পরিচয় জানবার জন্যে আমাকে প্রশ্ন করা হল। মনে-মনে বিরক্ত হলেও বুঝলাম, এটাই স্বাভাবিক। আর যা-ই হোক, আদালত। যদি শেষে আবিষ্কার করে তারা একজন ভুল লোকের বিচার করছে তা হলে ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক হবে না।
বিচারক তারপর আমি কী কী করেছি তার একটা ফিরিস্তি শুরু করলেন, দু-তিনটি বাক্য শেষ হওয়া মাত্রই তিনি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ঠিক তো? প্রত্যুত্তরে আমি প্রত্যেকবার আমার উকিলের পরামর্শ অনুযায়ী বললাম, ‘জি, স্যার। প্রচুর সময় লাগল এতে, কারণ বিচারক প্রত্যেকটি ছোটখাটো ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। অন্যদিকে সাংবাদিকরা ব্যস্তভাবে কলম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে অনুভব করছিলাম সেই তরুণ সাংবাদিকের চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ। সেই ছোটখাটো রোবট মহিলাও তাকিয়ে ছিলেন ঐভাবে। জুরির সবাই তাকিয়ে ছিলেন লাল-পোশাকপরা বিচারকের দিকে এবং তখন আবার আমার ট্রামের একপাশে বসে থাকা আরোহীদের কথা মনে পড়ল। মৃদুভাবে একটু কেশে। তিনি ফাইলের কিছু পাতা ওলটালেন এবং আমাকে সম্বোধন করলেন।
তিনি এখন এমন কিছু ব্যাপারে আলোচনা করতে চান, বললেন তিনি, যা মামলার ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হতে পারে কিন্তু আসলে তা মামলার সঙ্গে যুক্ত। আমার মনে হল তিনি মা’র সম্পর্কে আলোচনা করবেন যা আমার কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। তাঁর প্রথম পশ্ন ছিল, কেন আমি মাকে আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম? উত্তরে আমি জানালাম, কারণটা খুবই সরল; বাড়িতে মাকে রেখে ভালোভাবে দেখাশোনা করার মতো যথেষ্ট টাকা আমার ছিল না। তখন তিনি জানতে চাইলেন আমাদের বিচ্ছেদ আমার জন্যে দুঃখজনক ছিল কি না। বললাম : মা এবং আমি পরস্পরের কাছ থেকে বেশিকিছু আশা করিনি, অন্য কারও থেকে তো নয়ই! দুজনেই নতুন ব্যবস্থায় সহজেই মানিয়ে নিয়েছিলাম। বিচারক তখন বললেন, এ-ব্যাপারে খুব বেশি জোর দেয়ার ইচ্ছে তাঁর নেই; সরকারি উকিলকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্যাপারে তার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
আমার দিকে আধাআধিভাবে পিছন ফিরে সরকারি উকিল বসে ছিলেন। আমার দিকে না-ফিরেই তিনি বললেন, মাননীয় বিচারকের অনুমতি নিয়ে তিনি জানতে চান আরবদের হত্যা করার জন্যে আমি ঝরনার ধারে গিয়েছিলাম কি না। বললাম, না। তাহলে কেন আমি রিভলভার নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় ফিরে গিয়েছিলাম? বললাম, ব্যাপারটা ছিল আকস্মিক। সরকারি উকিল তখন অত্যন্ত নোংরাভাবে বললেন, ভালো ভালো। ব্যস, এখন এ-পর্যন্ত হলেই চলবে।
এরপর কী হল বুঝতে পারলাম না। যাহোক, সরকারি উকিল, বিচারক এবং আমার উকিলের মধ্যে কিছু বাদানুবাদের পর প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করলেন, দুপুর পর্যন্ত আদালত মুলতবি থাকবে। তারপর আবার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
কী ঘটছে তা বোঝার আগেই আমাকে প্রিজনভ্যানে ওঠানো হল। ফিরে এলে আমাকে দুপুরের খাবার দেয়া হল। খানিক পর, ক্লান্তি অনুভব করার আগেই তারা এল আমাকে নিতে। আবার সেই আগের ঘরে ফিরে এলাম, আবার মুখোমুখি হলাম পুরনো মুখগুলির, আবার আগের মতো শুরু হল সবকিছু। কিন্তু এরই মধ্যে গরম বেড়ে গিয়েছিল এবং আমার উকিল, সরকারি উকিল এবং কিছু সাংবাদিকের জন্য পাখার ব্যবস্থা করা হল। সেই যুবকটি এবং রোবট মহিলাটি তখনও তাদের জায়গায় বসে ছিল। কিন্তু পাখা দিয়ে নিজেদের বাতাস না করে আগের মতোই তারা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মুখের ঘাম মুছে ফেললাম, কিন্তু আশ্রমের ওয়ার্ডেনকে সাক্ষী দিতে ডাকার আগ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আমার বিরুদ্ধে মা’র কোনো অভিযোগ ছিল কি না। বললেন তিনি, ‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা তেমন কিছু না; আশ্রমের প্রায় সব বাসিন্দারই তাদের আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে কিছু-না-কিছু অভিযোগ ছিল। বিচারক আরও স্পষ্টভাবে তাকে তার বক্তব্য পেশ করতে বললেন; মাকে আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেজন্যে কি আমার বিরুদ্ধে মা’র অভিযোগ ছিল? তিনি ফের একই উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।’ কিন্তু এবার তিনি আর তার উত্তরের ব্যাখ্যা করলেন না।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন যে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন আমার স্থৈর্য। দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল স্থৈর্য বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন তখন তিনি চোখ নিচু করে নিজের জুতোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, আমি মার মৃতদেহ দেখতে চাইনি, অথবা মার জন্যে একফোঁটা চোখের জলও ফেলিনি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পর তার কবরের কাছে একটুও না-থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছি। আরেকটি জিনিস তাকে অবাক করেছিল। মুদাফরাশদের একজন তাকে বলেছিল যে আমি আমার মার বয়েস জানতাম না। খানিকক্ষণ নীরবতা; তারপর বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি ধরে নেবেন যে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামি সম্পর্কেই এসব বলছেন? ওয়ার্ডেন এতে হকচকিয়ে গেলে বিচারক বললেন, ‘প্রশ্নটা আনুষ্ঠানিক আমাকে করতেই হবে।‘
এরপর সরকারি উকিলকে যখন জিজ্ঞেস করা হল তিনি কোনো প্রশ্ন করবেন কি না তখন তিনি উচ্চকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘বিন্দুমাত্র না; আমার যা দরকার তা পেয়ে গেছি।‘ তার গলার স্বর, মুখের উল্লসিত ভাব আমাকে সহসা বিমর্ষ করে তুলল। বোকার মতো আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। এই প্রথমবারের মতো বুঝলাম সবাই আমাকে কী ঘৃণার চোখে দেখছে।
জুরিদের এবং আমার উকিলের কোনো প্রশ্ন আছে কি না জিজ্ঞেস করার পর বিচারক দারোয়ানের সাক্ষ্য নিলেন। কাঠগড়ায় উঠে লোকটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। প্রশ্নোত্তরের সময় সে জানাল, আমি মাকে তো দেখতে চাইইনি, বরং সিগারেট খেয়েছি, কাফে অ ল্যা খেয়েছি এবং ঘুমিয়েছি। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল আদালতের ভিতর আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে এবং সেই প্রথমবারের মতো মনে হল আমি অপরাধী। সিগারেট খাওয়া এবং আমার ঘুমানো সম্পর্কে সে যা বলেছিল তাকে দিয়ে তা আবার বলিয়ে নেওয়া হল। সরকারি উকিল সেই আগের মতো উল্লসিত ভাব নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমার উকিল দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন সে নিজেও কি তখন ধূমপান করেনি? কিন্তু সরকারি উকিল এর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আপত্তি জানালেন। আমি জানতে চাই এখানে কার বিচার হচ্ছে? চিৎকার করে বললেন তিনি, অথবা আমার বন্ধু কি মনে করেন যে সাক্ষীর নিন্দা করে তিনি নিজের মক্কেলের বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণাদি ভূল বলে প্রতিপন্ন করবেন? বিচারক অবশ্য দারোয়ানকে প্রশ্নের উত্তর দিতে বললেন।
লোকটি একটু ইতস্তত করল, জানি এটি করা আমার উচিত হয়নি, তারপর থেমে বলল সে, কিন্তু ঐ তরুণ ভদ্রলোক যখন আমায় একটি সিগারেট নিতে অনুরোধ করলেন তখন নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই সিগারেটটি নিয়েছিলাম।
এ-ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য আছে কি না, জিজ্ঞেস করলেন বিচারক। ‘না’, বললাম আমি, সাক্ষী ঠিকই বলেছে। কথাটা সত্যি যে তাকে আমি সিগারেট নিতে অনুরোধ করেছিলাম।
দারোয়ান অবাক হয়ে এবং খানিকটা কৃতজ্ঞ-দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে জানাল যে সে-ই আমাকে কফি খেতে বলেছিল।
আমার উকিল উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘জুরিরা নিশ্চয় এ-স্বীকারোক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।‘
সরকারি উকিল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। ‘নিশ্চয়ই’, আমাদের মাথার ওপর তাঁর গর্জন শোনা গেল, ‘জুরিরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন। এবং তারা এই উপসংহারে পৌঁছবেন যে, বন্দির উচিত ছিল, যে-অসহায় মহিলা তাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন তাঁর মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে তৃতীয় ব্যক্তির কফি খাওয়াবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা।‘
এরপর দারোয়ান তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। থমাস পিরেজকে এরপর ডাকা হল এবং কাঠগড়ায় ওঠার সময় তাকে সাহায্য করতে হল। পিরেজ জানালেন যদিও আমার মা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিনই মাত্র দেখা হয়েছিল। ঐদিন আমার চালচলন কেমন ছিল সে-সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন : ‘দেখুন, আমার মেজাজ খুব ভালো ছিল না। মেজাজটা এতই খারাপ ছিল যে অন্যকিছু খেয়াল করার মতো অবস্থা আমার ছিল না। মনে হয় দুঃখ আমাকে ঢেকে দিয়েছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যু আমাকে খুব কাতর করে তুলেছিল। সত্যি বলতে কি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং তরুণ ভদ্রলোকটিকে আমি মোটেই খেয়াল করিনি।’
আমাকে তিনি কাঁদতে দেখেছেন কি না তা আদালতকে জানাবার জন্যে সরকারি উকিল তাকে বললেন। পিরেজ যখন বললেন ‘না’ তখন তিনি জোর দিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় জুরিরা এই উত্তর লক্ষ করবেন।’
আমার উকিল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, মনে হল, অনাবশ্যক আক্রমণাত্মক গলায় পিরেজকে জিজ্ঞেস করলেন :
ভালো করে ভেবে দেখুন। আপনি কি নিশ্চিত যে তাকে আপনি কাঁদতে দেখেননি।
পিরেজ বললেন, ‘না।’
উত্তর শুনে কিছু লোক মুখ টিপে হাসল এবং আমার উকিল তার গাউনের একটি আস্তিন গুটিয়ে কঠোরভাবে বললেন : ‘অদ্ভুতভাবে এই মামলা পরিচালিত হচ্ছে। আসল ঘটনা উদঘাটন করার কোনো চেষ্টাই হচ্ছে না!’
সরকারি উকিল এই মন্তব্যে কান দিলেন না, স্থিরভাবে ফাইলের মলাটের ওপর পেনসিল ঠুকতে লাগলেন।
পাঁচ মিনিটের বিরতি ঘোষণা করা হল, আর তখন আমার উকিল আমাকে জানালেন যে, সবকিছু খুব ভালোভাবে চলছে। এরপর সেলেস্তেকে ডাকা হল। তাকে আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হল। আসামি বলতে বোঝানো হল আমাকে।
সেলেস্তে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। সাক্ষ্য দেবার সময় সে হাতের মুঠোয় বারবার মোচড়াচ্ছিল পানামা টুপিটাকে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রবিবার রেসের মাঠে যাবার সময় তার সবচেয়ে সুন্দর যে-সুটটা পরত সেটাই সে এখানে পরে এসেছে। কিন্তু যে-কারণেই হোক সে তার কলার পরেনি। দেখলাম তার শার্টের ওপরটা একটা পিতলের বোতাম দিয়ে আটকানো। আমি তার খরিদ্দার ছিলাম কি না একথা জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, ‘হ্যাঁ, এবং একজন বন্ধুও ছিল বটে।’ তাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হলে সে বলল, আমি স্বাভাবিক লোক ছিলাম। তাকে এই কথা ব্যাখ্যা করতে বলা হলে সে জানাল যে, সবাই জানেন এই কথার মানে কী। ‘আমি কি চাপা-স্বভাবের লোক ছিলাম?’ ‘না’–উত্তরে সেলেস্তে বলল, ‘ঐরকম কোনো মন্তব্য আমি তার সম্পর্কে করব না। তবে অন্যান্য অনেকের মতো সে বাজে-কথা বলত না।’
সরকারি উকিল এবার জানতে চাইলেন যে, মাসিক বিল পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি তা পরিশোধ করতাম কি না। সেলেস্তে হাসল, ‘হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গে শোধ করে দিত। তবে ওগুলো আমার আর তার ব্যাপার।’ তখন তাকে আমার অপরাধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হল। সেলেস্তে কাঠগড়ার রেলিঙের ওপর হাত রাখল এবং বোঝা গেল কিছু বলার জন্য সে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছে।
‘আপনারা কী ভাববেন জানি না, তবে আমার মতে এটা একটা দুর্ঘটনা বা বলা চলে ভাগ্যদোষে এরূপ ঘটেছে। আর এ-ধরনের কিছু ঘটলে স্বভাবতই মাথার ঠিক থাকে না।‘
সেলেস্তে কথা চালিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তা-ই, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’ সেলেস্তেকে একটু বিরক্ত দেখাচ্ছিল। সে বলল, সে যা বলতে চেয়েছিল তা শেষ হয়নি। তারা তাকে সংক্ষিপ্তভাবে কথা শেষ করতে বললেন।
ঘুরেফিরে তার বক্তব্য আগের মতোই হল–যে এটা একটা দুর্ঘটনা।
‘হতে পারে’, বিচারক মন্তব্য করলেন। ‘কিন্তু এখানে আমরা আইন অনুযায়ী এইসব দুর্ঘটনার বিচার করতে এসেছি। আপনি এখন যেতে পারেন।‘
সেলেস্তে ঘুরে আমার দিকে তাকাল। চোখদুটো তার টলটল করছে, ঠোঁট কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন বলতে চাচ্ছে, বন্ধু তোমার জন্যে আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি কিন্তু মনে হয় না তাতে তেমন কিছু হবে। আমি দুঃখিত।
আমি কিছু বললাম না, নড়াচড়াও করলাম না। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার একজন পুরুষকে আমার চুম্বন করতে ইচ্ছে করছিল।
কাঠগড়া ত্যাগ করার জন্যে বিচারক তাকে আবার নির্দেশ দিলে সেলেস্তে ভিড়ের মধ্যে তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। বিচার চলাকালীন বাকি সময়টুকু সেখানেই হাঁটুর ওপর কনুই রেখে হাতের মধ্যে পানামা টুপিটা ধরে, সামনের দিকে ঝুঁকে শুনানির প্রতিটি কথা শুনছিল।
এরপর মারির পালা। মাথায় তার টুপি। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। অবশ্য খোলা-চুলেই তাকে আমার বেশি ভালো লাগে। যেখানে ছিলাম সেখান থেকেই তার বুকের কোমল রেখা, নিচের ঠোঁটের ফোলা ভাবটুকু দেখছিলাম। এ-ভাবটুকু সবসময় আমাকে মুগ্ধ করত। তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, কদ্দিন ধরে সে আমায় চেনে। উত্তরে সে জানাল, যেদিন থেকে সে আমাদের অফিসে ঢুকেছিল সেদিন থেকেই। তখন বিচারক জানতে চাইলেন, আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা কী ধরনের। মারি জানাল, সে আমার বান্ধবী। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে মারি স্বীকার করল যে, সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। সরকারি উকিল তার সামনে-রাখা একটি নথি পড়তে পড়তে খুব তীক্ষ্ণগলায় জানতে চাইলেন, আমাদের প্রেম কবে থেকে শুরু হয়েছিল। মারি সময়টা জানাল। একটু সবজান্তা ভাব করে তিনি জানালেন, তার মানে সময়টা মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরেই। তারপর একটু ব্যঙ্গোক্তি করে বললেন, বিষয়টা খুবই অস্বস্তিকর এবং এ-সম্পর্কে তরুণী ভদ্রমহিলার মনোভাবও তার অজানা নয় কিন্তু, তার গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠল–তার কর্তব্য তাঁকে বাধ্য করেছে। এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গের ওপর প্রশ্ন করতে।
এই মন্তব্য করার পর, তিনি, মারি যেদিন প্রথম আমার সঙ্গে শুয়েছিল সেদিনের পুরো বিবরণ দিতে বললেন। প্রথমে মারি উত্তর দিতে চাচ্ছিল না। কিন্তু সরকারি উকিল পীড়াপীড়ি শুরু করলে সে জানাল, স্নান করতে যাবার সময় আমরা দেখা করেছিলাম, তারপর সিনেমা দেখে আমার ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি তখন আদালতকে জানালেন যে মারির দেওয়া বিবরণের ভিত্তিতে তিনি আমাদের সিনেমায় যাবার ব্যাপারটা মনোযোগসহকারে বিবেচনা করেছেন। তারপর মারির দিকে ফিরে যে-সিনেমাটা আমরা দেখেছিলাম তার নাম জানতে চাইলেন। খুব নিচুগলায় সে জানাল যে এই ছবিতে ফার্নান্ডেল ছিল। যখন মারি তার কথা শেষ করল তখন আদালতে পিনপতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
সরকারি উকিল খুব গম্ভীরভাবে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন যে শপথ করে বলতে পারি তিনি বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন।
‘জুরি দ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদের লক্ষ করতে বলব যে, এই লোক তার মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরদিন সুইমিং পুলে গিয়েছিল, প্রেমে মত্ত হয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে এবং তারপর দেখেছিল হাসির ছবি। আমি শুধু এইটুকুই বলব।’
তিনি যখন বসে পড়লেন তখনও সেখানে আগের মতোই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। এবং ঠিক তখন হঠাৎ করে মারি কান্নায় ভেঙে পড়ল। তিনি সবকিছুই অন্যভাবে নিয়েছেন, বলল মারি, সে যা বলতে চেয়েছিল তার উলটোটাই তাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়া হয়েছে, আমাকে সে খুব ভালোভাবে চেনে এবং আমি যে অন্যায় কিছু করিনি সে-সম্পর্কে সে নিশ্চিত। প্রধান বিচারকের নির্দেশে আদালতের কর্মচারীদের একজন মারিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন এবং শুনানি চলতে লাগল।
এর পরের সাক্ষী ম্যাসনের কথা মন দিয়ে প্রায় কেউই শুনল না। ম্যাসন জানাল, একজন যুবক হিসেবে আমি শ্রদ্ধার পাত্র এবং ‘তার চেয়েও বড় কথা হল আমি খুব ভালো ছেলে।‘ সালামানো যখন জানাল যে আমি তার কুকুরের প্রতি খুব দয়ালু ছিলাম বা আমার মা এবং আমার মধ্যে তেমন মিল ছিল না, তখনও কেউ তার প্রতি তেমন গুরুত্ব দিল না। আমি আমার মাকে কেন আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম তাও সে ব্যাখ্যা করল। ‘আপনাদের বোঝা উচিত’, সে আবার বলল, ‘আপনাদের বোঝা উচিত।‘ কিন্তু কেউ বুঝল বলে মনে হল না। তারপর তাকে নেমে যেতে বলা হল।
পরবর্তী এবং শেষ সাক্ষী ছিল রেমন্ড। আমাকে দেখে সে একটু হাত নাড়ল এবং আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে নিশ্চিত মত দিল। বিচারক তাকে তিরস্কার করলেন। ‘তুমি এখানে সাক্ষ্য দিতে এসেছ, মামলা সম্পর্কে তোমার মতামত জানাতে নয়। তোমাকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হবে শুধু সেগুলির উত্তরই তুমি দেবে।’
এরপর নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল সে-সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে বলা হলে রেমন্ড পুরোপুরিভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। সে বলল, আমি নই, বরং রেমন্ডের বিরুদ্ধে নিহত ব্যক্তির ক্ষোভ ছিল কারণ সে তার বোনকে মেরেছিল। বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, নিহত ব্যক্তির আমাকে অপছন্দ করার। পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে কি না। রেমন্ড বলল, সেদিন ভোরে সমুদ্রসৈকতে আমার উপস্থিতি একটি আকস্মিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘তা হলে এটা কীভাবে সম্ভব যে, যে-চিঠিটা এই দুঃখজনক ঘটনার কারণ সেটা বন্দিরই হাতে লেখা?’ উত্তরে রেমন্ড জানাল এটাও একটি আকস্মিক ব্যাপার মাত্র।
সরকারি উকিল উত্তরে বললেন, এই মামলায় ‘দুর্ঘটনা’ এবং ‘আকস্মিক ব্যাপার’-এর একটা বিরাট ভূমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে। এটাও কি একটা দুর্ঘটনা যার জন্যে রেমন্ড যখন তার রক্ষিতাকে পেটাচ্ছিল তখন আমি হস্তক্ষেপ করিনি? সুবিধাজনক এই ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি কি পুলিশস্টেশনে রেমন্ডের জন্যে আমার প্রতীক্ষা এবং তার পক্ষে সুবিধাজনক জবানবন্দি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল? সবশেষে তিনি, রেমন্ডকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।
নিজেকে যখন সে গুদামের দারোয়ান হিসেবে পরিচয় দিল, তখন সরকারি উকিল জুরিদের জানালেন যে, এটা সবাই জানে যে সাক্ষী মেয়েদের অসৎ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ করে। আমি, তিনি বললেন, লোকটির ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং সহকারী ছিলাম; সত্যি বলতে কি, অপরাধের পটভূমিকা নোংরা ঘটনায় ভরপুর। এবং বন্দির ব্যক্তিত্ব নৈতিকজ্ঞানবিহীন, যা একমাত্র হৃদয়শূন্য দানবেরই থাকে, ঘটনাটিকে আরও ঘৃণিত করে তুলেছে।
রেমন্ড অনুযোগ তুলতে গেল এবং আমার উকিলও প্রতিবাদ জানালেন। তাদের বলা হল, সরকারি উকিলকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে দেয়া উচিত।
‘আমার প্রায় হয়ে গেছে’, তিনি বললেন, তারপর রেমন্ডের দিকে ফিরে বললেন, ‘বন্দি কি তোমার বন্ধু ছিল?’
‘নিশ্চয়ই। সবার মতে বন্ধুদের মধ্যে আমরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলাম।‘
সরকারি উকিল তখন আমাকেও একই প্রশ্ন করলেন। আমি রেমন্ডের দিকে কঠোরভাবে তাকালাম, সে তাতে বিচলিত হল না।
তারপর আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ।’ সরকারি উকিল জুরিদের দিকে তাকালেন।
‘আপনাদের সামনে দাঁড়ানো লোকটি তার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরদিন শুধু রাত্রিকালীন উৎসবে মত্ত হয়নি, নিচুতলার বেশ্যা এবং দালালদের মধ্যেকার নোংরা বিরোধে প্ররোচিত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করেছে। জুরিমহোদয়গণ, বন্দি এ-স্বভাবেরই লোক।’
সরকারি উকিল বসতে-না-বসতেই আমার উকিল, ধৈর্য হারিয়ে, হাত এত ওপরে ওঠালেন যে তাঁর আস্তিন সরে গিয়ে জামার ইস্ত্রি-করা হাতটার পুরোটাই দেখা গেল।
‘আমার মক্কেল কি তার মায়ের কবর দেবার জন্যে এখানে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন, না একজনকে খুন করার দায়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আদালতে চাপা-হাসির একটা ঢেউ বয়ে গেল। কিন্তু তখনই সরকারি উকিল লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং পোশাক ঠিক করতে করতে বললেন, মামলার এই দুটি উপাদানের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান সেটা তাঁর বন্ধু বুঝতে পারছেন না দেখে তিনি বিস্মিত হচ্ছেন। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তারা পাশাপাশি অবস্থান করছে যদি এদের সেইভাবে দেখা হয়। সংক্ষেপে, প্রবল আবেগের সঙ্গে তিনি শেষ করলেন, আসামিকে আমি এই বলে অভিযুক্ত করছি যে, তার মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সে যে-ব্যবহার করেছে তাতে প্রমাণিত হয় যে অনেক আগে থেকেই মনের দিক থেকে সে অপরাধী।
এই কথাগুলো জুরি এবং দর্শকদের নাড়া দিল বেশ গভীরভাবে। আমার উকিল শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। বোঝা যাচ্ছিল, তিনিও বেশ বেকায়দায় পড়েছেন এবং আমার মনে হল পুরো ব্যাপারটা ঠিক আমার অনুকুলে যাচ্ছে না।
এর পরপরই আদালতের অধিবেশন শেষ হল। আদালত থেকে যখন বন্দিদের গাড়িতে আমাকে তোলা হচ্ছিল তখন গ্রীষ্মের সন্ধ্যার পরিচিত একটা হালকা স্পর্শে সচেতন হয়ে উঠলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন চলন্ত সেলে বসে থাকার সময় শহরের বৈশিষ্ট্যধারক শব্দ যা আমি ভালোবাসতাম এবং দিনের বিশেষ এক সময় যা আমি সবসময় পছন্দ করতাম তা আমার ক্লান্ত মগজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নিস্তেজ বাতাসে বাচ্চা হকারদের চিৎকার, সরকারি বাগানে পাখিদের শেষ কাকলি, স্যান্ডউইচ বিক্রেতার চিৎকার, নতুন শহরের উন্নত অংশে ট্রামের শব্দ, বন্দরে যখন সন্ধ্যা আসন্ন তখন মাথার ওপরে মৃদু গুঞ্জন–সবকিছু আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, সবকিছু মিলে জেলখানায় ফেরা আমার কাছে মনে হচ্ছিল একজন অন্ধের এমন। একটি রাস্তা দিয়ে পথ চলা যার প্রতিটি ইঞ্চি তার মুখস্থ।
হ্যাঁ, সন্ধ্যাবেলা–যেন কতদিন আগের কথা! জীবন সম্পর্কে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এরপর আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকত সুন্দর রাত, স্বপ্নহীন ঘুম। এখন সেই একই সময়, কিন্তু একটু ভিন্ন। আমি ফিরে যাচ্ছি সেলে এবং সেখানে আমার জন্যে এমন এক রাত অপেক্ষা করছে যা আগামীদিনের অমঙ্গল আশঙ্কায় ভরপুর। এভাবেই বুঝলাম আমি যে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আবছায়াতে চলা পরিচিত পথগুলো জেলখানায় যেয়ে শেষ হতে পারে। যেমন। শেষ হতে পারে নিরীহ ভাবনামুক্ত ঘুমে।
.
৪.
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের সম্পর্কে কোনো আলোচনা শোনা যে খুবই মজার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং আমার উকিল ও সরকারি উকিল তাঁদের ভাষণে আমার অপরাধ থেকে আমার সম্পর্কেই বেশি বলেছেন।
অবশ্য দুজনের ভাষণে খুব-একটা তফাত ছিল না। আসামিপক্ষের উকিল স্বর্গের দিকে হাত তুলে দোষ স্বীকার করলেন, কিন্তু সেইসঙ্গে অপরাধের লঘুত্ব প্রমাণ করার জন্য যুক্তিও প্রদর্শন করলেন। সরকারি উকিলও একই ইঙ্গিত করলেন, তিনি স্বীকার করলেন যে আমি দোষী কিন্তু আমার অপরাধ যে লঘু সেটা অস্বীকার করলেন।
বিচারের এই পর্যায়টা ছিল খানিকটা বিরক্তিকর। প্রায়ই, তাঁদের তর্কাতর্কি শুনে আমার নিজের দুএকটি কথা বলতে ইচ্ছে হত। কিন্তু আমার উকিল এ-ব্যাপারে আমাকে আগেই বারণ করে দিয়েছিলেন। আমাকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, কথা বলে মামলার ক্ষতি কোরো না। সত্যি বলতে কি আমার মনে হচ্ছিল, সম্পূর্ণ বিচারক্রম থেকে আমাকে বাদ দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে; আমার নিজের বলার কিছু থাকবে না অথচ এদিকে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত বলি, যদিও সে ইচ্ছে সংবরণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন : ‘শিকেয় তুলে রাখো সব, আমি জানতে চাচ্ছি এখানে কার বিচার হচ্ছে? একজনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা তার জন্যে খুবই মারাত্মক ব্যাপার। এবং তোমাদেরকে বলার মতো সত্যিই আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।’
অবশ্য, পরে মনে হল, বলার মতো আমার কিছুই নেই। যাহোক, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে নিজের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা শোনার পর আর সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ থাকে না। বিশেষ করে সরকারি উকিলের বক্তৃতা অর্ধেক শেষ হবার আগেই আমি বিরক্তি বোধ করতাম। শুধু বক্তৃতার কিছু অংশ, তাঁর ভাবভঙ্গি এবং প্রচুর নিন্দাবাদ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল–কিন্তু এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা।
আমি যা ধারণা করেছিলাম তা হল, তিনি দেখাতে চাচ্ছেন যে অপরাধটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মনে পড়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘জুরি মহোদয়গণ, আগগোড়া আমি ব্যাপারটাকে প্রমাণ করতে পারি। প্রথমত অপরাধ সম্পর্কে আপনারা সমস্ত প্রমাণাদি পেয়েছেন যা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এবং এরপর আপনারা মামলার, যা আমার মতে অন্ধকার দিক অর্থাৎ অপরাধীর ঘৃণ্য মানসিকতা সম্পর্কেও জানতে পেরেছেন।’
মায়ের মৃত্যু থেকে তারপর যা ঘটেছে সবকিছুর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিয়ে। তিনি শুরু করলেন। আমার হৃদয়হীনতা, মা’র বয়স বলতে না-পারা, সুইমিং পুলে যাওয়া যেখানে মারির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, দুপুরে ফার্নান্ডেল অভিনীত ছবি দেখতে যাওয়া, সবশেষে মারিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে আসা সবকিছুর ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করলেন। প্রথমে আমি তার কথা ধরতে পারিনি, কারণ তিনি বারবার বন্দির রক্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার করছিলেন অথচ সে ছিল আমার কাছে শুধু মারি। এরপর তিনি এলেন রেমন্ডের ব্যাপারে। আমার মনে হল, পুরো ব্যাপারটা তিনি এমনভাবে বর্ণনা করছিলেন যাতে তাঁর ধূর্ততা প্রকাশ পাচ্ছিল। তার সব কথাই মনে হচ্ছিল বিশ্বাসযোগ্য। রেমন্ডের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আমি তার রক্ষিতাকে চিঠি লিখেছিলাম যাতে সে রেমন্ডের ঘরে আসে এবং কুখ্যাত একজন লোকদ্বারা নিপীড়িত হতে পারে। তারপর সৈকতে রেমন্ডের শক্রদের সঙ্গে আমি ঝগড়া বাধিয়েছিলাম, যার পরিণামে রেমন্ড আহত হয়েছিল। আমি তার রিভলবার চেয়ে তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আবার গিয়েছিলাম ফিরে। তারপর আমি লোকটিকে গুলি করেছি। প্রথমবার গুলি ছোঁড়ার পর আমি অপেক্ষা করেছি। তারপর কাজটা যাতে ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্যে ঠাণ্ডামাথায়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামনাসামনি আরও চারটি গুলি ছুঁড়েছি।
‘এই আমার বক্তব্য’, বললেন তিনি, ‘আমি আপনাদের কাছে সেই ঘটনাগুলো তুলে ধরলাম যা নিহত ব্যক্তিকে হত্যার জন্যে এই লোকটিকে প্ররোচিত করেছিল। এবং সে যা করতে যাচ্ছিল তা সম্পর্কে ছিল সে সম্পূর্ণ সচেতন। এই ব্যাপারটিতে আমি গুরুত্ব আরোপ করছি। এই হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি যার জন্যে অপরাধের গুরুত্ব লঘু করা যেতে পারে। জুরি মহোদয়গণ, আমি আপনাদের মনে রাখতে বলব যে, অপরাধী একজন শিক্ষিত লোক। তিনি যেভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তা আপনারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। তিনি খুব বুদ্ধিমান তাই মেপে কথা বলেছেন। আমি আবার বলছি, এটা কোনোরকমে মেনে নেওয়া যায় না যে, যখন তিনি অপরাধ করেছিলেন তখন তার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না।
লক্ষ করলাম তিনি আমার ‘বুদ্ধিমত্তা’র ওপর জোর দিলেন। এটা ভেবে অবাক হলাম, যে-জিনিসটা একজন সাধারণ মানুষের গুণ বলে বিবেচিত হয় সেই একই জিনিস এখন একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে তার অপরাধের প্রমাণ হিসাবে। যখন এ-ব্যাপারে ভাবছিলাম, তখন তিনি কী বললেন তা ধরতে পারলাম না। এরপর শুনলাম তিনি ক্রুদ্ধভাবে চিৎকার করে বলছেন : ‘তাঁর সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধের জন্যে কি তাঁকে একবারও অনুতাপ করতে দেখা গেছে? একটি কথাও? না। বিচার চলাকালীন এই ভদ্রলোকটি একবারের জন্যেও অনুতপ্ত হননি।’
কাঠগড়ার দিকে ফিরে, আমার দিকে আঙুল তুলে তিনি একই উদ্যমে বলে যেতে লাগলেন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন তিনি একই ব্যাপারে বারবার জোর দিচ্ছেন। অবশ্য স্বীকার করছি যে তিনি ঠিকই বলেছেন; যা করেছি তার জন্যে আমি খুব-একটা অনুতপ্ত হইনি। তবুও মনে হচ্ছিল তিনি ব্যাপারটিকে অতিরঞ্জিত করেছেন। সুযোগ পেলে বন্ধুর মতো নরমভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতাম যে, আমার পক্ষে সারাজীবন কোনোকিছুর জন্যে কখনও অনুতাপ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানকে নিয়ে সবসময় খুব বেশি ব্যতিব্যস্ত থেকেছি বা নিকট-ভবিষ্যৎকে নিয়ে, তাই পিছনে তাকাবার সময় পাইনি। অবশ্য বাধ্য হয়ে যে-অবস্থায় পড়তে হয়েছে তাতে করে এমনভাবে কারও কাছে কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না। বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ বা আমার কোনো ভালো উদ্দেশ্য থাকার অধিকার নেই। এরপর কী বলা হবে তা শুনতে চেষ্টা করলাম, কারণ সরকারি উকিল বিশ্লেষণ করছিলেন, যা তাঁর ভাষায় আমার ‘আত্মা’।
তিনি বললেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে এটা তিনি পরীক্ষা করেছেন এবং যা দেখেছেন তা সারশূন্য; ‘বলতে গেলে কিছুই না, জুরিমহোদয়গণ।’ সত্যিই, তিনি বললেন, আমার আত্মা নেই। মানবিকতা বলতে কোনো পদার্থ আমার মধ্যে নেই। স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে যেসব সদ্গুণাবলি থাকে তার কোনোটাই আমার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘’সন্দেহ নেই।’ যোগ করলেন তিনি, এ-ব্যাপারে আমি তার নিন্দা করব না। একজনের পক্ষে যা অর্জন করা সম্ভব নয়, তার সেই শক্তিহীনতার জন্যে নিন্দা করা উচিত নয়। ফৌজদারি আদালতে সহনশীলতার নিষ্ক্রিয় আদর্শকে জায়গা দিতেই হবে ন্যায়ের কঠোর উচ্চতর আদর্শের কাছে। বিশেষ করে এটা প্রযোজ্য, আপনাদের সামনে যে-ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে তার বেলায়, যার নেই কোনো সদ্গুণাবলি এবং যে সমাজের জন্যে হুমকিস্বরূপ।’ এরপর তিনি মা’র প্রতি আমার ব্যবহারের কথা তুললেন এবং শুনানির সময় যা বলেছিলেন তা-ই বারবার উল্লেখ করতে লাগলেন। কিন্তু আমার অপরাধ সম্পর্কে তিনি এত বেশি বললেন যে আমি সব সূত্র হারিয়ে ফেললাম, তখন শুধুমাত্র আমি ক্রমাগত বেড়ে-ওঠা তাপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিলাম।
একসময় সরকারি উকিল থামলেন এবং খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, খুব নিচু কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, এই একই আদালত আগামীকাল আরেকটি ঘৃণ্য মামলা, পিতৃহত্যার বিচার করবে।’ তাঁর কাছে এমন অপরাধ অকল্পনীয়। তবে তিনি নিশ্চিত যে, ন্যায়বিচারে কোনো সংশয় থাকবে না। তবুও, তিনি সোজাসুজিভাবে বলতে পারেন পিতৃহত্যা তাঁর মনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, আমার নির্দয়তা সেই আতঙ্ককে ম্লান করে দিয়েছে।
‘যে তার পিতাকে হত্যা করেছে তার মতো এই লোকটিও সমাজে উপযুক্ত নয় যে তার মা’র মৃত্যুর জন্যে নৈতিকভাবে দায়ী। এবং একটি অপরাধ সৃষ্টি করেছে আরেকটি অপরাধের। আমাকে যদি বলতে বলা হয় তা হলে বলব দুজন অপরাধীর প্রথমজন, যিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, একটি নজির স্থাপন করেছিলেন, এবং দ্বিতীয় অপরাধটিকে অনুমোদন করেছেন। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি এ-ব্যাপারে নিশ্চিত’–এখানে তিনি গলা উঁচু করলেন—’আমি যদি বলি আগামীকাল যে হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে তার জন্যেও এই লোক দোষী তা হলে অতিরঞ্জন করা হবে না। সুতরাং আশা করি আপনারা সে-অনুযায়ী রায় দেবেন।‘
সরকারি উকিল মুখের ঘাম মুছবার জন্যে আবার থামলেন। তারপর ব্যাখ্যা করে বললেন, বেদনাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার কর্তব্য সম্পন্ন করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। ‘আমি আবার বলছি, এই লোকটির সে-সমাজে কানো স্থান নেই যে সমাজের মৌল নীতিগুলিকে সে অনুতাপহীনভাবে বিদ্রূপ করে। আর সে যেরকম হৃদয়হীন তাতে অনুকম্পা পাবার কোনো অধিকারও তার নেই। আমি তাকে আইনের চরম শাস্তি দেয়ার জন্যে আপনাদের অনুরোধ করছি; এবং এ অনুরোধ করছি একেবারে মন থেকে। আমার দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে প্রায়ই আমাকে কর্তব্যের খাতিরে গুরুদণ্ড দেয়ার অনুরোধ করতে হয়েছে। কিন্তু এ-মামলা ছাড়া আর-কোনো মামলার ব্যাপারেই আমি এমন দ্বিধাহীনভাবে অনুরোধ করিনি। আমি এই হত্যাকাণ্ডের রায় দাবি করছি, কিন্তু এর গুরুত্ব যেন খাটো না করা হয়, এবং এক্ষেত্রে আমি শুধু আমার বিবেকের নির্দেশ এবং পবিত্র কর্তব্যকেই অনুসরণ করছি না, অনুসরণ করছি আমার স্বাভাবিক এবং চরম ঘৃণাকে যা মানবিক অনুভূতির ক্ষুদ্রতম কণাবর্জিত এই অপরাধীকে দেখলেই আমি অনুভব করি।‘
সরকারি উকিল বসে পড়লে দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। ব্যক্তিগতভাবে, গরম এবং বিমূঢ় হয়ে যা শুনছিলাম তা আমাকে কাবু করে দিয়েছিল। প্রধান বিচারক মৃদু কেশে, খুব নিচুস্বরে জানতে চাইলেন আমার কিছু বলার আছে কি না। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং কথা বলার মতো মনের অবস্থা ফিরে এলে, প্রথম যে-কথাটি মনে এল তা-ই বলে ফেললাম, আরবদের হত্যা করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। উত্তরে তিনি বললেন, আদালত এই বক্তব্য বিবেচনা করে দেখবে। তবে, আমার উকিল আদালতে তাঁর বক্তব্য পেশ করার আগে, আমি যদি হত্যার কারণগুলি বলি তা হলে তিনি খুশি হবেন। তার স্বীকার করতে বাধা নেই যে এখন পর্যন্ত আমার পক্ষ সমর্থনের ভিত্তি তিনি পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেননি।
ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলাম যে, সূর্যের আলোর জন্যেই ঘটনাটা ঘটেছিল। কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি কথা বলছিলাম যার জন্যে কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। আর পরে বুঝলাম যে, সবকিছু অর্থহীন শোনাবে এবং সত্যি বলতে কি, দেখলাম, সবাই মুখ টিপে হাসছে।
আমার উকিল কাঁধ ঝাঁকালেন। এরপর বক্তব্য পেশ করার জন্যে তাঁর পালা এল। কিন্তু তিনি শুধু সময়ের অপর্যাপ্ততার কথা তুলে আগামী দুপুর পর্যন্ত আদালত মুলতবি রাখার অনুরোধ জানালেন। বিচারকও রাজি হলেন।
পরদিন আমাকে যখন আবার আদালতে নিয়ে আসা হল তখন তাপ কমাবার জন্যে বৈদ্যুতিক পাখাগুলো চলছিল আর জুরিরাও তাদের জমকালো ছোট পাখাগুলো ধীরলয়ে দোলাচ্ছিলেন। আমার পক্ষ সমর্থন করে যে-বক্তৃতা দেওয়া হল মনে হল তা যেন আর ফুরাবে না। অবশ্য, একসময় কান খাড়া করলাম, যখন শুনলাম তিনি বলছেন, ‘এটা সত্যি যে আমি একজন মানুষকে খুন করেছি।‘ তিনি একই উদ্যমে বলে চললেন। আমাকে বোঝাতে তিনি ‘আমি’ বলছিলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে এত অদ্ভুত ঠেকল যে, ডানদিকের পুলিশটির দিকে ঝুঁকে তাকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে বললাম। সে আমাকে চুপ করতে বলল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওরা সবাই এরকম করে।‘ আমার মনে হল এর পিছনে যে-উদ্দেশ্য কাজ করছে তা হল, আমার বদলে উকিলকে দাঁড় করিয়ে, আমাকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া। আমাকে একেবারে সবকিছুর বাইরে রাখা। যাহোক, এতে তেমন কিছু আসে যায় না; কারণ তখন নিজেকে মামলার একঘেয়ে কার্যক্রম এবং অন্যান্য সবকিছু থেকে দূরে মনে হচ্ছিল।
যাহোক, আমার উকিলকে এতটা দুর্বল মনে হচ্ছিল যে তা প্রায় হাস্যকর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তিনি খুব উত্তেজিতভাবে তাড়াহুড়ো করে প্রতিপক্ষের জবাব দিলেন এবং আমার আত্মা সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমার মনে হল সরকারি উকিল তার থেকে ঢের বেশি বুদ্ধিমান। ‘আমিও’, বললেন তিনি, এই লোকটির আত্মা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছি, কিন্তু যেক্ষেত্রে বিপক্ষে আমার জ্ঞানী বন্ধু কিছু খুঁজে পাননি সেক্ষেত্রে আমি কিছু খুঁজে পেয়েছি। সত্যি বলতে কি অপরাধীর মনটাকে আমি খোলা বইয়ের মতো। পড়েছি।’ তিনি যা পড়েছেন তা হল, আমি একজন চমৎকার যুবক, স্থিরবুদ্ধি ধর্মভীরু কর্মচারী, পরিচিত মহলে আমি ছিলাম জনপ্রিয়, যে-কারও বিপদে সহানুভূতিশীল। তাঁর মতে আমি দায়িত্ববান পুত্র এবং যতদিন পেরেছি ততদিন মাকে দেখেছি। এবং বহুদিন উদ্বেগে কাটাবার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে, মাকে আমি ঘরে যে-আয়েশ দিতে পারব না, আশ্রমে গেলে তিনি তা পাবেন। ‘ভদ্রমহোদয়গণ’, যোগ করলেন তিনি, ‘আমার জ্ঞানী বন্ধু এই আশ্রমের উদ্দেশে যা বলেছেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। আশ্রমের উৎকর্ষ প্রমাণের দরকার নেই। আমাদের মনে রাখলেই চলবে যে, এর উন্নতিকল্পে সরকারি একটি বিভাগ টাকা ঢালছে।‘ লক্ষ করলাম, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কিছু বললেন যা আমার কাছে মারাত্মক ক্রটি বলে মনে হল। কিন্তু সারাদিন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা আমার ‘আত্মা’ নিয়ে এত কচকচি করলেন যে আমার কাছে সব ফাঁকাফকা ঠেকতে লাগল। মনের মধ্যে সবকিছু ধূসর পাণ্ডুর হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল।
একটি ঘটনা শুধু ব্যতিক্রম; শেষের দিকে আমার উকিল যখন এলোমেলো কথা বলছিলেন তখন হঠাৎ রাস্তা থেকে একজন আইসক্রিমঅলার টিনের শিঙা শোনা গেল। কথার তরঙ্গ ভেদ করা মৃদু তীক্ষ্ণ এক শব্দ। তখনই একরাশ স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলল সেইসব দিন যা আর এখন আমার নয়, যা থেকে আমি স্বাভাবিক সাধারণ আনন্দ পেয়েছিলাম–গ্রীষ্মের সুগন্ধ, প্রিয় রাস্তাঘাট, বিকেলের আকাশ। মারির পোশাক এবং হাসি। এখানে যা ঘটছিল তার নিরর্থকতা আমার টুটি চেপে ধরছিল, ইচ্ছে করছিল বমি করি; একটি ইচ্ছেই তখন ঘুরেফিরে মনে এল–সেলে ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া…শুধু ঘুম।
অস্পষ্টভাবে শুনলাম, আমার উকিল শেষবারের মতো আবেদন করছেন। ‘জুরি মহোদয়গণ, এক দুঃখজনক মুহূর্তে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যা করেছে তার জন্যে নিশ্চয় আপনারা এই কর্মঠ, ভদ্র যুবকটিকে মৃত্যদণ্ড দেবেন না! এজন্যে আজীবন তার যে মনস্তাপ রয়ে যাবে তা-ই কি তার শাস্তির জন্যে যথেষ্ট নয়? আমি দৃঢ়চিত্তে আপনাদের সেই রায়ের জন্যে অপেক্ষা করব যে-রায় অপরাধের গুরুত্বকে লঘু করে দেখবে।’
আদালতের কাজ শেষ হল এবং আমার উকিল বসে পড়লেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাঁর কিছু সহকর্মী কাছে এসে তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। আবার তুমি একটা খেল দেখালে বটে।’ একজনকে আমি বলতে শুনলাম। আরেকজন আইনজীবী আমাকে সাক্ষী মেনে বললেন, ‘চমৎকার হয়েছে, তা-ই না?’ কথাটা স্বীকার করলাম কিন্তু আন্তরিকভাবে নয়। ব্যাপারটা কি চমৎকার হয়েছে বা অন্যরকম হয়েছে তা বিচার করার মতো শক্তি আমার ছিল না।
এরইমধ্যে দিন ফুরিয়ে আসছিল। গরমও কমতে লাগল। রাস্তা থেকে যে শব্দ ভেসে আসছিল তাতে বুঝলাম সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা নেমে আসছে। আমরা সবাই। বসে ছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম। অবশ্য যেজন্যে অপেক্ষা করছিলাম তার জন্যে আমি ছাড়া কারও উদ্বিগ্ন হবার কথা নয়। আদালত-কক্ষের চারদিকে তাকালাম। প্রথমদিনের মতোই সব ঠিকঠাক। ধূসর পোশাক পরা সাংবাদিক এবং রোবট- মহিলাটির সঙ্গে চোখাচোখি হল। তাতে মনে পড়ল শুনানি চলাকালীন মারির চোখে চোখ রাখতে আমি একবারও চেষ্টা করিনি। এ নয় যে আমি তাকে ভুলে গেছিলাম, আসলে আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। এখন দেখলাম তাকে, সেলেস্তে এবং রেমন্ডের মাঝে বসে আছে। আমাকে দেখে সে একটু হাত নাড়ল, যেন বলতে চাইল, যাক তা হলে!’ হাসছিল সে, কিন্তু আমি জানি বেশ উদ্বিগ্ন সে। কিন্তু আমার হৃদয় যেন পাথর হয়ে গেছে, তার হাসির জবাবটা পর্যন্ত আমি দিতে পারলাম না।
বিচারপতিরা তাঁদের আসনে ফিরে এলেন। একজন খুব তাড়াতাড়ি জুরিদের উদ্দেশে কিছু প্রশ্ন পড়ে গেলেন। মাঝে মাঝে দুএকটা কথা বুঝতে পারলাম, যেমন শক্রতাবেশে হত্যা-প্ররোচনা, অপরাধের গুরুত্ব লঘু করা…। জুরিরা বাইরে। চলে গেলেন এবং আমাকে সেই ঘরটায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে আগেও আমি অপেক্ষা করেছি। আমার উকিল আমাকে দেখতে এলেন; যদিও খুব কথা বলছিলেন তবুও আগের থেকে বেশি দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা দেখালেন। আশ্বাস দিয়ে আমাকে বললেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং আমি হয়তো কয়েক বছরের বন্দিজীবন অথবা নির্বাসনের পর ছাড়া পেয়ে যাব। জানতে চাইলাম, শাস্তি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কীরকম। তিনি বললেন যে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি আইনের কোনো প্রশ্ন তোলেননি, কারণ এটা জুরিদের মন ঘুরিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া টেকনিক্যাল ভিত্তি ছাড়া একটা দণ্ডাজ্ঞা বাতিল করা খুবই অসুবিধাজনক। আমি তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারলাম এবং মেনে নিলাম। নিরপেক্ষভাবে ব্যাপারটা ভেবে আমি তার কথা মেনে নিলাম। এছাড়া মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো পথ নেই। ‘যাহোক’, উকিল বললেন, ‘তুমি পুনর্বিচারের জন্যে সাধারণভাবে আবেদন করতে পারো। কিন্তু আমার মনে হয় জুরিদের রায় সন্তোষজনক হবে।’
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, বলতে গেলে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। তারপর ঘণ্টা বেজে উঠল। আমার উকিল আমাকে ছেড়ে যাবার আগে বললেন, ‘জুরিদের মুখপাত্র উত্তর পড়ে শোনাবেন। তারপর রায় শোনার জন্য তোমাকে ডাকা হবে।’
শব্দ করে কয়েকটি দরজা বন্ধ হল। সিঁড়িতে শুনলাম দ্রুতপায়ের শব্দ কিন্তু তা দূরে না কাছে বুঝতে পারলাম না। তারপর আদালত-কক্ষে মৃদু একটি গলার আওয়াজ শুনলাম।
আবার ঘণ্টা বেজে উঠলে আমি কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম, আদালতের নীরবতা আমাকে ঘিরে ধরল এবং এই নীরবতার সঙ্গে সঙ্গে মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগল যখন দেখলাম এই প্রথমবারের মতো তরুণ সাংবাদিকটি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিল। মারির দিকে আমি তাকালাম না। অবশ্য তাকাবার সময়ও ছিল না, কারণ এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি তার রায় পড়া শুরু করেছেন; বললেন তিনি : ‘ফরাসি জনগণের নামে’ কোনো-এক প্রকাশ্য জায়গায় আমার শিরচ্ছেদ করা হবে।
সে-সময় আমার মনে হল দর্শকদের চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারছি; তা হল প্রায় এক সম্মানজনক সহানুভূতি। এমনকি পুলিশটিও খুব আস্তে আমায় স্পর্শ করল। উকিল ভদ্রলোক আমার কবজিতে হাত রাখলেন। চিন্তা করা তখন আমি একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। শুনলাম, বিচারপতি জিজ্ঞেস করছেন আমার আরও কিছু বলার আছে কি না। কয়েক মুহূর্ত চিন্তার পর বললাম, ‘না।’ এরপর পুলিশ দুজন আমাকে বাইরে নিয়ে এল।
.
৫.
এইমাত্র তৃতীয়বারের মতো আমি জেলখানার পাদরির সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলাম। তাঁকে বলার মতো আমার কিছুই নেই, কথা বলার ইচ্ছেই আমার নেই–আর তা ছাড়া কয়েকদিন পর তো তার সঙ্গে আরও ঘনঘন দেখা হবে। মনে আমার এখন একটিই চিন্তা : ভবিতব্য এড়াবার কোনো-একটি ফাঁক খুঁজে বের করা।
আমাকে অন্য একটি সেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে শুয়ে আকাশ দেখা ছাড়া দেখার মতো আর কিছু নেই। দিন রাতের দিকে এগোয় আর আমার পুরো সময়টা আকাশের রং বদলানো দেখে কাটে। মাথার নিচে হাত রেখে তাকিয়ে থাকি আর অপেক্ষা করি।
কৌশল আবিষ্কারের চিন্তা মন অধিকার করে রাখে; সবসময় ভাবি, শেষমুহূর্তে ন্যায়বিচারের নিষ্ঠুর যন্ত্র থেকে কেউ পালাতে পেরেছে কি না বা শিরচ্ছেদের ঠিক পূর্বমুহূর্তে অব্যাহতি পেয়েছে কি না। বারবার নিজেকে দোষ দিই, কেন কখনও প্রকাশ্য প্রাণদণ্ডের দিকে নজর দিইনি। এসব ব্যাপারে আগ্রহ থাকা উচিত। কখন যে কার কী প্রয়োজন হয় তা কেউ বলতে পারে না। অন্যান্য অনেকের মতো আমিও কাগজে শিরচ্ছেদের বিবরণ পড়েছি। কিন্তু এ-বিষয়ে নিশ্চয় কোনো টেকনিক্যাল বই আছে; শুধুমাত্র আমিই সেসবের দিকে কখনও আগ্রহ দেখাইনি। এইসব বইয়ে নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়ার গল্প পেতাম। নিশ্চয় এর যে-কোনো গল্পে দেখতাম চাকা যে-কোনোভাবে হোক থেমে গেছে; একবার, মাত্র একবার নিশ্চয়ই যে-কোনো গল্পে দেখতাম ঘটনাপ্রবাহের মাঝে এড়িয়ে যাবার একটি পথ খুঁজে পাওয়া গেছে। শুধু একবার! একটিমাত্র উদাহরণই আমাকে সন্তুষ্ট করত। বাকিটা নিজের কল্পনা দিয়ে ভরে নিতাম। পত্রিকাগুলো প্রায়ই একটা ব্যাপারে কচকচি করে, তা হল– ‘সমাজের নিকট ঋণ’–যে-ঋণ, তাদের মতে, অপরাধীদের পূরণ করতে হবে। এ-ধরনের কথা কল্পনাকে উজ্জীবিত করে না। না, যে-চিন্তাটা মনে তোলপাড় করছিল, তা হল এক আঘাতে তাদের রক্তপিপাসু যজ্ঞ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া; মুক্তির জন্যে পাগলের মতো পলায়ন যা জুয়ারির শেষ তাসের মতো আমাকে একবার একমুহূর্তের জন্যে হলেও সেই সুযোগ করে দেবে, কিন্তু সেই সুযোগ’ শেষ হত রাস্তার একপাশে ভূতলশায়ী হয়ে অথবা পিঠে গুলি খেয়ে। কিন্তু এসব পরিণামের কথা ভেবেও এই চিন্তা ছিল বিলাসিতা; কারণ আমি ইঁদুর-ধরা কলে আটকা পড়ে গেছি।
চেষ্টা করেও আমি এই নির্দয় নিশ্চয়তাকে মন থেকে তাড়াতে পারলাম না। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, যার ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হয়েছে এবং রায় দেওয়ার ঠিক পরপরই যেসব ঘটনাপ্রবাহের শুরু, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। রায় দেওয়ার কথা ছিল পাঁচটায়, তার বদলে রায় ঘোষণা করা হল আটটায়, তার মানে এর মধ্যে অন্য কোনো পরিবর্তন হওয়া ছিল সম্ভব, এবং এই রায় দিয়েছেন তাঁরা, যাঁরা নিজেদের স্বরূপও বদলাতে পারেন এবং শুধু তা-ই না, নিজেদের জাহির করেছেন ;ফরাসি জনগণের’ হয়ে–চীনা বা জার্মানরা কী দোষ করল?–এ সমস্তকিছু আদালতের রায়কে প্রভাবান্বিত করেছে, তার গাম্ভীর্য নষ্ট করেছে। তবুও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, যে-মুহূর্তে রায় ঘোষণা করা হল সে-মুহূর্ত থেকে এর ফলাফল এত অনিবার্য, এত বাস্তব হয়ে উঠল যে, উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়, যে-দেয়ালের পাশে শুয়ে আছি সে-দেয়াল যেন আমায় পিষে মারছে।
যখন এসব ভাবছি তখন বাবার সম্পর্কে মা’র বলা একটি গল্প মনে পড়ল। বাবাকে আমি কখনও দেখিনি। মা আমাকে তার সম্পর্কে যা বলেছিলেন আমি শুধুমাত্র তা-ই জানতাম। এর মধ্যে একটি গল্প হল, তিনি একবার এক খুনির প্রাণদণ্ড দেখতে গিয়েছিলেন। অবশ্য এটা চিন্তা করলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু ঘটনাটি তিনি পুরোপুরি দেখেছিলেন এবং বাড়িতে ফিরে এসে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সে-সময় বাবার ঐ আচরণ আমার কাছে খুব। ন্যক্কারজনক মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তখন বুঝতে পারিনি প্রাণদণ্ডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই; একদিক থেকে দেখতে গেলে সত্যিকারভাবে একমাত্র এটাই একজন মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। ঠিক করলাম, যদি কারাগার থেকে মুক্তি পাই তা হলে আমি প্রত্যেকটি প্রাণদণ্ড দেখতে যাব। এমনই বোকা ছিলাম আমি যে এই কথা কখনও ভাবিনি। একমুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলাম, আমি মুক্ত, দুসারি পুলিশের পিছে দাঁড়িয়ে আছি, একেবারে ঠিক জায়গায় নিজেকে একজন দর্শক হিসেবে চিন্তা করলাম, যে শুধু প্রাণদণ্ডদান দেখতে এসেছে এবং যে বাসায় ফিরে বমি করবে– এ-চিন্তা আমার মন এক অদ্ভুত বন্য উল্লাসে ভরে তুলল। এ-ধরনের চিন্তা করা বোকামি হয়েছিল; কারণ একটু পরেই যেন ঠাণ্ডায় শরীর শিউরে উঠল, ভালোভাবে নিজেকে কম্বলে জড়িয়ে নিলাম; কিন্তু দাতে ঠকঠক করা কিছুতেই থামানো গেল না।
তবুও, এটা মানতে হবে যে, একজনের পক্ষে সবসময় ঠিকভাবে চিন্তা করা সম্ভব নয়। আরেকটি হাস্যকর ভাবনা ছিল আমার, নতুন আইন তৈরি করে শাস্তি বিধান বদলে দেয়া। আমার মতে, আসলে যা প্রয়োজন তা হল অপরটাকে একটা সুযোগ দেয়া; সে যত সামান্যই হোক না কেন; ধরা যাক হাজারে একটি। এমন ওষুধ বা কয়েকটি ওষুধের সম্মিলনে একটি ওষুধ দরকার যা খেলে রোগী (তাকে আমি ‘রোগী’ হিসেবে ধরেছি) এক হাজারে নশো নব্বই বার মরবে। তাকে। জানতে হবে যে, এটার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। অনেক চিন্তা করে ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে গিলোটিনের একমাত্র দোষ হল, অপরাধী এতে কোনো সুযোগই পায় না, একেবারেই না। সত্যি বলতে কি, অপরিবর্তনীয়ভাবে রোগীর মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হয়। এটা আগে থেকে একটি স্থিরকৃত সিদ্ধান্ত। যদি কখনও হঠাৎ করে ছুরি ঠিকমতো কাজ না করে তা হলে তারা আবার সবকিছু শুরু করে। আমার মতে এটাই হল ক্রটি; এবং এই প্রেক্ষিতে আমার চিন্তা একেবারে ঠিক। আবার অন্যদিকে স্বীকার করে নিলাম, এটা সিস্টেমের দক্ষতাও প্রমাণ করে। ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম : দণ্ডপ্রাপ্ত লোকটি মানসিকভাবে সহযোগিতা করার জন্যে তৈরি থাকে, এবং তারই স্বার্থ চিন্তা করে সবকিছু নিখুঁতভাবে হওয়া উচিত।
আরেকটি জিনিস প্রমাণিত হল যে, এতদিন পর্যন্ত এ-বিষয়ে আমার ধারণা ছিল ভুল। কয়েকটি কারণে আমার ধারণা জন্মেছিল, গিলোটিনে শিরচ্ছেদের আগে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। খুব সম্ভব ১৭৮৯-এর বিপ্লব সম্পর্কে স্কুলে। যা পড়েছিলাম বা ছবি দেখে মনে হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই এ-ধারণা গড়ে উঠেছিল। একদিন সকালে, একটি ছবির কথা মনে হল যা পত্রিকাগুলো ছাপিয়েছিল এক কুখ্যাত অপরাধীর প্রাণদণ্ডের সময়। আসলে যন্ত্রটি থাকে মাটিতে এবং এটা তেমন চেয়ে দেখার মতো নয়। আর আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকে এটা অনেক বেশি অপ্রশস্ত। ভেবে অবাক লাগল ছবিটির কথা এতদিন আমার মনে হয়নি। সে-সময় আমাকে যা মুগ্ধ করেছিল তা হল গিলোটিনের ছিমছাম ভাব; বাইরের চকচকে ভাব এবং ফিনিশিং দেখে গবেষণাগারের যন্ত্রের মতো মনে হয়। যে যা জানে না তা সম্পর্কে তার অতিরঞ্জিত ধারণা থাকে। এখন। আমার মনে হল গিলোটিনে শিরচ্ছেদ অত্যন্ত সোজা; মানুষটির মুখোমুখি থাকে যন্ত্রটি এবং সে যখন তার দিকে হেঁটে যায় তখন মনে হয় সে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। অবশ্য একদিক থেকে, এটাও হতাশাব্যঞ্জক। বলতে গেলে, পৃথিবীকে নিচে রেখে ফাঁসির মঞ্চে উঠে যাওয়া একটা অন্য ধরনের। ব্যাপার। কিন্তু এখানে, যন্ত্রটিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখছে; তারা তোমাকে হত্যা করছে অপদস্থ করার মনোভাব নিয়ে, দক্ষতার সঙ্গে।
আরও দুটি জিনিস নিয়ে আমি সবসময় ভাবছিলাম; ভোরবেলা এবং আমার আপিল। যাহোক, এসব চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলার জন্যে সবসময় চেষ্টা করতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতাম এবং তা দেখতে নিজেকে বাধ্য করতাম। আলো যখন সবুজাভ হয়ে উঠত তখন বুঝতাম, রাত ঘনিয়ে আসছে। চিন্তাস্রোতকে আরেকদিকে ঘোরাবার জন্যে হৃদয়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করতাম। আমি কোনোদিন ভাবিনি এই মৃদু স্পন্দন, যা এতদিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে আছে। তা থেমে যাবে। কল্পনাপ্রবণতা কখনোই আমার প্রধান যুক্তি ছিল না। তবুও সেই মুহূর্তটিকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করতাম যে-মুহূর্ত থেকে হৃদয়ের স্পন্দন আর শোনা যাবে না। কিন্তু পারলাম না। ঘুরেফিরে সেই ভোরবেলা আর আপিলের। কথাই মনে হতে লাগল। বুঝে নিলাম, স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাধারাকে ভুলে থাকার জন্যে অন্য চিন্তার আশ্রয় নেওয়া বোকামি।
প্রতিদিন ভোরে তারা একজনকে নিতে আসত; আমি শুধু এটুকুই জানতাম। সুতরাং আমার প্রত্যেকটি রাতই সেই একটি ভোরের অপেক্ষায় কাটত। আমাকে অবাক করে দেওয়া হবে, এটা আমার কখনোই পছন্দ নয়। যা ঘটবে তার জন্যে আমি প্রস্তুত থাকতে চাই। সুতরাং দিনের বেলায় ঘুমোবার অভ্যাস করে নিয়ে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতাম, ওপরের অন্ধকার গম্বুজের মাথায় ভোরের প্রথম আলো দেখার জন্যে। রাতের সবচেয়ে বাজে সময় ছিল তখন, যখন তারা আসত; দুপুর-রাতের পর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কিছু শোনার চেষ্টা করতাম। এর আগে কখনও আমার শ্রবণশক্তি এত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেনি, এখন সামান্য একটু শব্দ হলেই টের পেতাম। তবু বলব, একদিক থেকে আমি। ভাগ্যবান। কারণ ঐ সময় কখনও পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসেনি। মা। বলতেন, শত দুঃখের সময়ও একটুখানি আশার আলো থাকে। এবং প্রত্যেকদিন। সকালে যখন আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, আলোর বন্যায় আমার সেল ভরে যেত, তখন আমি তার সঙ্গে একমত হতাম। যখন আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেতাম তখন আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হত। একটুখানি মৃদু শব্দও আমাকে দরোজার কাছে নিয়ে যেত, এবং রুক্ষ ঠাণ্ডা কাঠের গায়ে একাগ্রভাবে কান চেপে ধরতাম, ক্লান্ত কুকুরের দ্রুত এবং কর্কশ নিশ্বাসের শব্দের মতো নিজের নিশ্বাসের শব্দ কানে। বাজত। কিন্তু একসময় তাও শেষ হত; হৃৎকম্প থেমে যেত এবং আমি জানতাম আরও চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে আমি বেঁচে গেলাম।
তারপর সারাটা দিন পরে থাকত আপিলের চিন্তা করার জন্যে। হতাশ যাতে না হতে হয় সেজন্যে ফলাফল থেকে শুরু করে সবকিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ভাবতাম। শুরু করতাম খারাপ দিক ভেবে যে আমার আপিল বাতিল হয়ে গেছে। তার মানে অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। স্বভাবতই অন্যদের থেকে আগে। ‘কিন্তু নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতাম, এটা তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার যে জীবনে বেঁচে থেকে লাভ নেই। বিস্তৃতভাবে চিন্তা করে দেখলাম, ত্রিশ বছর বেঁচে থাকা বা তিন কুড়ি বছরে মরে যাওয়ার মধ্যে খুব বেশি একটা পার্থক্য নেই– কারণ, দুক্ষেত্রেই অন্যান্য মানুষ-মানুষীরা বেঁচে থাকবে, পৃথিবী আগের মতো চলবে। সুতরাং আমি এখন মারা যাই বা চল্লিশ বছর পর মারা যাই, একবার-না একবার আমাকে অবশ্যই এই মৃত্যু-ব্যাপারটার মুখোমুখি হতে হবে। তবুও এ ধরনের চিন্তায় যে-ধরনের সান্ত্বনা পাওয়া দরকার সেরকম সান্ত্বনা পেতাম না; আরও কতগুলি বছর হাতে থাকতে পারত–এ-চিন্তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চোখে। ভেসে উঠত। তবুও এভাবে সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করতাম যে, যদি আমার দিন ফুরিয়ে যেত, মৃত্যু এসে দাঁড়াত দরোজায় তখন আমার মনের অবস্থা কেমন হত। যখন কেউ মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তখন মৃত্যুর সঠিক ধরন প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে–সেজন্য ওর কাছে পৌঁছানোর বিতর্কের তন্তুজাল হারিয়ে ফেলা কঠিন নয়–আপিল যে প্রত্যাখ্যাত হবে সেজন্যে আমার তৈরি থাকা উচিত।
এক্ষেত্রে, শুধুমাত্র এক্ষেত্রে বলতে গেলে, আমার অধিকার ছিল আরেকটি বিকল্প বিবেচনা করা, যে, আমার আপিল সফল হয়েছে। তার পরের সমস্যা ছিল, এজন্যে সমস্ত শরীরে যে-আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, যে-আনন্দ চোখের জলের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাকে শান্ত করা। অবশ্য নিজেকে শান্ত করার দায়িত্বটা নিজেরই; আর এই সম্ভাবনা চিন্তা করার সময়ও প্রথমটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে ভেবে রাখতাম। যখন দ্বিতীয়টি জিতে যেত তখন ঘণ্টাখানেক অন্তত মনটা শান্ত থাকত; এবং তাও কম কিছু নয়।
এ-সময় আমি আরেকবার পাদরির সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলাম। শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম আকাশে একটা সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে, তার মানে গ্রীষ্মের বিকেল শেষ হয়ে এল প্রায়। এ-মুহূর্তে আমার আপিলকে আমি হারিয়ে দিয়েছি, অনুভব করছিলাম রক্তচলাচল পর্যন্ত মৃদু হয়ে গেছে। না, আমি পাদরিকে দেখতে। চাইনি…. তারপর আমি এমন কিছু করলাম যা বহুদিন করিনি অর্থাৎ মারির কথা। ভাবতে লাগলাম। অনেকদিন সে আমায় কিছু লেখেনি; মনে হল, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একটি লোকের রক্ষিতা হয়ে থাকা তার কাছে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। বা হয়তো তার অসুখ করেছে, বা মরে গেছে। এ-ধরনের কিছু যে ঘটতে পারে তা তো অস্বীকার করা যায় না। আমি কীভাবে জানব, যখন আমাদের দুটো শরীর ছাড়া, যা এখন পৃথক, আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, এমন কিছু নেই যা দিয়ে পরস্পরকে মনে করব? ধরা যাক তার মৃত্যু হয়েছে, তা হলে তার স্মৃতির কোনো। দাম নেই; মৃত একটি মেয়ে সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকবে না। এটা আমার কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হল; যেমন মনে হল আমি মরে গেলে সবাই আমার কথা ভুলে যাবে। অবশ্য এটাও বলতে পারি না যে জিনিসটা মেনে নেয়া কঠিন; সত্যিই এমন কোনো জিনিস নেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যা মেনে না নেয়।
যখন চিন্তাটা এই পর্যন্ত পৌঁছেছে তখন না-বলে পাদরি ঢুকলেন। তাঁকে দেখে চমকে না উঠে পারলাম না। তিনি যেভাবে তাড়াতাড়ি আমাকে ব্যস্ত হতে মানা করলেন তাতে বোঝা গেল আমার চমকে-ওঠা তার চোখ এড়ায়নি। তাকে মনে করিয়ে দিলাম এ-সময় তাঁর আসার কথা নয়; এবং এলেও চরম মুহূর্তের আগে আসেন। বললেন তিনি, এটা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার; এর সঙ্গে আমার আপিলের কোনো সম্পর্ক নেই এবং যা তিনি কিছুই জানেন না। তারপর তিনি আমার বিছানায় বসলেন এবং আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম না–এজন্যে নয় যে আমি তাকে অপছন্দ করছিলাম। বরং তাকে বেশ শান্তশিষ্ট এবং অমায়িক বলে মনে হল।
প্রথমে কিছুক্ষণ হাতদুটো হাঁটুর ওপর রেখে সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন। হাতদুটো, শীর্ণ শিরবহুল, যা আমাকে দুটো ছোট্ট চঞ্চল জন্তুর কথা মনে করিয়ে দিল। তিনি এতক্ষণ ধরে একইভাবে বসে রইলেন যে আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে তিনি এখানে আছেন।
হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি আমার চোখে চোখ রাখলেন।
‘কেন,’ বললেন তিনি, ‘আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে দিতে দাওনি?’
বললাম, ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না।
‘এ-বিষয়ে কি তুমি একেবারে নিশ্চিত?’
বললাম, এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমি দেখি না; আর আমার মতে, আমি বিশ্বাস করি বা না-করি তাতেও তাঁর তেমন কিছু আসে যায় না।
তিনি অতঃপর দেয়ালে হেলান দিয়ে হাতদুটো সমান করে জানুর ওপর রাখলেন। যেন আমাকে কিছু বলছেন না এমনভাবে তিনি বললেন, তিনি দেখেছেন, অনেকে অনেক বিষয় সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত, কিন্তু আসলে তা নয়। আমি নিশ্ৰুপ রইলে তিনি আবার আমার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন :
‘তুমি কি আমার সঙ্গে একমত নও?’
বললাম, এরকম হতে পারে। কিন্তু যদিও আমি জানি না কিসে কিসে আমার আগ্রহ তবুও কী কী আমাকে আগ্রহান্বিত করে না তা জোরগলায় বলতে পারি। এবং তিনি যে-প্রশ্ন তুলেছেন সে-সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
ভঙ্গিবদল না করে আনমনা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি দেখেই কি একথা বলছি? বললাম, হতাশ আমি হইনি, তবে ভয় পেয়েছি যা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
‘তা হলে’, বললেন তিনি দৃঢ়ভাবে, ‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করতে পারেন। যতজনকে আমি তোমার জায়গায় দেখেছি, বিপদের সময় তারা সবাই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছে।’
অত্যন্ত স্বাভাবিক, বললাম আমি, তাদের ইচ্ছে হলে ঐরকম করার অধিকার তাদের আছে বইকি। আমার বেলায়, আমাকে সাহায্য করা হোক তা আমি চাই না। আর তা ছাড়া যে-বিষয়ে আমার আগ্রহ নেই সে-বিষয়ে সময় খরচ করার মতো সময়ও আমার নেই।
ক্রুদ্ধভাবে হাত নাড়লেন তিনি; বসে পোশাক ঠিক করলেন। তারপর আমাকে আমার বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে আবার কথা শুরু করলেন বললেন। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছি বলে তিনি আমার সঙ্গে ঐভাবে কথা বলছেন না। তাঁর মতে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি লোকের ওপর প্রাণদণ্ডাজ্ঞা ঝুলছে।
এখানে আমি বাধা দিলাম; বললাম, ব্যাপারটা এক নয় এবং এটা কোনো সান্ত্বনার কথাও নয়।
মাথা নাড়লেন তিনি, ‘হতে পারে, এখন না হোক, একদিন-না-একদিন তোমার মৃত্যু হবে। এবং ঠিক তখনও প্রশ্ন উঠবে। তখন তুমি কীভাবে সেই ভয়ানক শেষ সময়ের মুখোমুখি হবে?’
বললাম, এখন যেভাবে মুখোমুখি হয়েছি তখনও ঠিক একইভাবে মুখোমুখি হব।
এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তাকালেন সোজাসুজি আমার চোখের দিকে। এটা যে একধরনের চালাকি তা আমি জানি। মাঝে মাঝে আনন্দ পাবার জন্যে ইমানুয়েল এবং সেলেস্তের ওপর এ-ধরনের চালাকি করতাম এবং দশবারের মধ্যে ন’বারই তারা অস্বস্তিকরভাবে চোখ সরিয়ে নিত। দেখলাম পাদরিমশায় এই খেলায় দড়, কারণ তার চোখের পাতা একবারও কাঁপল না। এবং যখন তিনি কথা বললেন তখনও দেখি তার গলার স্বর শান্ত : ‘তোমার কি কোনো আশা নেই? তুমি কি মনে করো যখন তুমি মৃত্যুবরণ করো তখন তুমি ঠিকঠিকই মৃত্যুবরণ করো এবং আর কিছুই থাকে না?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।‘
চোখ নামিয়ে তিনি আবার বসে পড়লেন। বললেন, আমার জন্যে সত্যিই তিনি দুঃখিত। আমি যে-ধরনের চিন্তা করছি সে-ধরনের চিন্তা মানুষের জীবন অসুখী করে তুলতে বাধ্য।
পাদরি আমায় বিরক্ত করে তুলেছিলেন। আর আমি ঠিক সেই স্কাইলাইটের নিচে বসে দেয়ালে কাঁধ রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। যদিও তিনি কী বলছিলেন তাতে কান দিচ্ছিলাম না, তবুও মনে হল তিনি আবার আমায় প্রশ্ন করছেন। তারপর তার গলার স্বর আরও জরুরি, তপ্ত হয়ে উঠল, বুঝলাম তিনি। সত্যিই দুঃখবোধ করছেন। তখন আমি তার দিকে আরও মনোযোগ দিলাম।
তিনি বললেন, তিনি নিশ্চিত যে, আমার আপিল সফল হবে। কিন্তু আমার ওপর অপরাধের বোঝা চেপে আছে যা থেকে অবশ্যই আমাকে মুক্তি পেতে হবে। তাঁর মতে মানুষের বিচার মূল্যহীন; শুধু ঈশ্বরের বিচারে যায় আসে। বললাম, পূর্বোক্তটি আমায় অভিযুক্ত করেছে। হ্যাঁ, একমত হলেন তিনি, কিন্তু তা আমাকে আমার পাপ থেকে মুক্তি দেয়নি। বললাম, কোনোরকম পাপ সম্পর্কে আমি সচেতন নই; যা জানি তা হল ফৌজদারি অপরাধের জন্যে আমি অভিযুক্ত। এবং আমি সেই অপরাধের দাম দিচ্ছি এবং কারও অধিকার নেই আমার থেকে এর চেয়ে বেশিকিছু আশা করা।
ঠিক তখনই তিনি আবার দাঁড়ালেন, এবং দেখলাম, তিনি যদি এই ছোট্ট সেলে ঘোরাফেরা করতে চান, তবে তাকে শুধু বসতে হবে আর উঠতে হবে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। এক পা এগিয়ে এলেন তিনি, যেন কাছে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তারপর শিকের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন।
‘বাবা, তুমি ভুল করছ’, গম্ভীরভাবে বললেন, “তোমার কাছে অনেক দাবি আছে। এবং হয়তো তা তোমার কাছে চাওয়া হবে।’
‘মানে?’
‘তোমাকে হয়তো দেখতে বলা হবে…’
‘কী দেখতে?’ আস্তে আস্তে তিনি আমার সেলের চারদিকে তাকালেন, এবং যখন কথা বললেন তখন তাঁর দুঃখিত স্বর শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
‘আমি ভালো করে জানি, পাথুরে এই দেয়ালগুলি মানুষের দুঃখে আবৃত হয়ে আছে। অবিচল থেকে কখনও আমি এদিকে তাকাতে পারিনি। এবং তবুও–বিশ্বাস করো, আমি একেবারে মনের ভিতরে থেকে বলছি–তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে অধম সেও মাঝে মাঝে দেখেছে এই ধূসর দেয়ালের মাঝে এক দিব্যজ্যোতি মুখ ফুটে উঠছে। এই মুখটি দেখতেই তোমাকে বলা হচ্ছে।’
এবার একটু কৌতূহলী হলাম। বললাম, এই দেয়ালগুলির দিকে কয়েকমাস ধরে তাকিয়ে আছি; এবং আমি এদের যেভাবে চিনি সেভাবে পৃথিবীতে আর কেউ তাদের চেনে না। এবং মাঝে মাঝে, বোধহয়, আমি এখানে একটি মুখের সন্ধান করি। সেটি হল সূর্যের মতো সোনালি, কামনায় ভরা একটি মুখ–মারির মুখ। আমার কপাল খারাপ; আমি কখনও তা দেখিনি এবং তাই সে-চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। এ ছাড়া তিনি যে ‘ফুটে ওঠার’ কথা বলছেন ঐ ধরনের কিছু এই ধূসর দেয়ালে ফুটে উঠতে আমি দেখিনি।
করুণভাবে তাকালেন তিনি আমার দিকে। দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিলাম আর কপালে এসে আলো আছড়ে পড়ছিল। বিড়বিড় করে তিনি কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে তিনি চুম্বন করতে পারেন কি না। বললাম, ‘না।‘ তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন, দেয়ালের কাছে এলেন এবং আস্তে আস্তে সেখানে হাত বুলোলেন। ‘পার্থিব এইসব জিনিস কি তুমি এতই ভালোবাস?’ নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কোনো উত্তর দিলাম না।
কিছুক্ষণ তিনি চোখ ফিরিয়ে রাখলেন। তার উপস্থিতি ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। এবং তাঁকে প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম চলে যেতে, আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতে, কিন্তু হঠাৎ তিনি আমার দিকে ফিরে আবেগভরে বলতে লাগলেন :
‘না, না, আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিশ্চিত যে তুমি প্রায়ই ভেবে থাকো পরকাল বলে কিছু থাকুক।‘
নিশ্চয়, বললাম আমি। মাঝে মাঝে সবারই ঐ ধরনের ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ধনী হতে চাওয়া, বা দ্রুত সাঁতার কাটতে চাওয়া, বা মুখের গড়ন ভালো হওয়া—এ-ধরনের ইচ্ছে থেকে এর বেশি গুরুত্ব নেই। এটা এগুলিরই সমগোত্র। আমি এ সূত্র ধরেই বলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু প্রশ্ন করে তিনি বাধা দিলেন। কবর দেয়ার পর আমার অবস্থা সম্পর্কে আমি কী ভেবেছি?
ধমকের সুরে বললাম, ‘যা জানি তা পার্থিব জীবন সম্পর্কেই জানি। এবং এতেই আমি সন্তুষ্ট।’ একটু থেমে বললাম, ‘যথেষ্ট হয়েছে।’
কিন্তু ঈশ্বর-বিষয়ে তার আরও কিছু বলার ছিল। তাঁর কাছে গিয়ে আমি শেষবারের মতো বোঝাতে চাইলাম, আমার সময় বেশি নেই এবং যেটুকু আছে সেটুকু আমি ঈশ্বরের পিছে নষ্ট করতে রাজি নই।
তারপর তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে বললেন, পাদরি জেনেও কেন আমি তাঁকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করিনি। একথা আমাকে আরও বিরক্ত করে তুলল এবং বললাম, তিনি আমার পিতা তো ননই বরং বলতে গেলে তিনি আমার বিপক্ষের লোক।
‘না, না, বাবা’, বললেন তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে, ‘আমি তোমার দিকে, যদিও তুমি তা বুঝছ না–কারণ হৃদয় তোমার কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও আমি তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।’
তারপর কী হল বুঝতে পারলাম না। ভিতরে ভিতরে বোধহয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল, তাই চিৎকার করে কথা বলতে লাগলাম। তাঁকে অপমান করতে শুরু করলাম; বললাম, তার ঐ বাজে প্রার্থনা আমার জন্যে না-করলেও চলবে, একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার চাইতে যন্ত্রণা ভালো। তাঁর ক্যাসোকের গলাটা ধরে একধরনের ক্রোধ এবং আনন্দের সঙ্গে যা মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল তা-ই বলতে লাগলাম। দেখুন-না, তিনি কী নিশ্চিত। অথচ তার একটি ধারণার দামও কোনো রমণীর একটি চুলের থেকে বেশি নয়। চিরদিন যেভাবে জীবনযাপন। করেছেন তা মৃতের মতো এবং তিনি যে বেঁচে আছেন সে-সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত না। মনে হতে পারে আমার অঞ্জলি শূন্য। কিন্তু আসলে নিজের ওপর আমার বিশ্বাস আছে, সবকিছু সম্পর্কে ধারণা আছে, তার থেকেও নিশ্চিত আমি বর্তমান জীবন এবং এগিয়ে-আসা মৃত্যু সম্পর্কে। আমি ঠিক বলেছিলাম, এখন ঠিক বলছি এবং সবসময় ঠিক বলে এসেছি। আমি একভাবে জীবনযাপন করে এসেছি, ইচ্ছে করলে অন্যভাবে জীবনযাপন করতে পারতাম। আমি ঐভাবে এ-কাজ। করেছিলাম, অন্যভাবে করিনি, আমি এমন করিনি বরং অমন করেছি। আর তার মানে কী? সবসময় আমি এই সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে আছি, আগামীকাল বা অন্য কোনোদিনের ঐ সকালের জন্যে, যা আমার যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে। কিছুরই, কোনোকিছুরই, তেমন গুরুত্ব নেই, এবং আমি ভালো করে জানি, কেন। তিনি নিজেও তা ভালো জানেন। আমার ভবিষ্যতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিগন্ত থেকে, অবিরতভাবে একধরনের মৃদু হাওয়া বয়ে আসছে আমার দিকে, সমস্ত জীবন ধরে, অনাগত দিন থেকে। এবং আসার পথে সে-হাওয়া আমার ভিতরের সমস্ত ধ্যানধারণা সমান করে দিয়েছে যা এতদিন ধরে মানুষরা আমার ভিতরে গড়ে তুলতে চেয়েছে, এমনকি সে-সময়ও যখন আমি একই ধরনের অবাস্তব। জীবনযাপন করে আসছিলাম। অন্য কারও মৃত্যু, বা কোনো মায়ের ভালোবাসা বা তার ঈশ্বর আমার কাছে এদের মূল্য কী? বা একজন যেভাবে জীবনযাপন। করতে চায়, একজন যেভাবে ভাগ্য বেছে নিতে চায়, সেই একই ভাগ্য আবার ‘বেছে’ নিতে বাধ্য হয় শুধু আমাকে নয়, আরও হাজার লক্ষ সুবিধাভোগী মানুষকে, যারা তাঁর মতো, আমাকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছে। অবশ্যই-অবশ্যই তাকে তা দেখতে হবে? প্রতিটি মানুষ যারা বেঁচে আছে তারা সবাই সুবিধাভোগী, শুধুমাত্র একটি মানবশ্রেণী আছে, সুবিধাভোগী শ্ৰেণী। একদিন তাদের সবাইকে একইভাবে মরতে হবে, অন্যান্যদের মতো তখন তার পালাও আসবে। তা ছাড়া খুনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর কাউকে যদি মরতে হয় মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় না-কাঁদার জন্যে, তাতেও-বা কী আসে যায়? কারণ। অন্তিমে তো দুটোর পরিণতি একই। সালামানোর স্ত্রী এবং সালামানোর কুকুর সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। সেই রোবট-মহিলাও অপরাধী’, যেমন অপরাধী প্যারিসের সেই মেয়েটি যে ম্যাসনকে বিয়ে করেছে; বা মারি, যে চেয়েছিল আমি তাকে বিয়ে করি। কী লাভ হত যদি সেলেস্তে থেকে রেমন্ড আমার আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হত, যার যোগ্য সে? কী আসে যায় যদি এ-মুহূর্তে মারি তার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে চুমো খেতে থাকে? এমন একজন হতভাগ্য হিসেবে কি তিনি বুঝতে পারছেন না আমার ভবিষ্যৎ থেকে যে ঝড়ো হাওয়া বয়ে আসছে তার মানে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি?…
আমি এত জোরে চিৎকার করছিলাম যে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, আর ঠিক তখনই ওয়ার্ডাররা ছুটে এসে আমার মুঠো থেকে পাদরিকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। একজন এমন ভঙ্গি করল যেন আমাকে মারবে। পাদরি তাদের শান্ত করে একমুহূর্তের জন্যে চুপচাপ আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম, তার চোখে পানি টলটল করছে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি সেল ত্যাগ করলেন।
তিনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু এ-উত্তেজনা আমায় ক্লান্ত করে তুলেছিল, তাই বিছানায় ঢলে পড়লাম। বোধহয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, কারণ জেগে দেখি তারারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে গ্রামের কোলাহল মৃদুভাবে শোনা যাচ্ছিল, আর মাটি ও লবণের গন্ধমাখা ঠাণ্ডা রাত্রির বাতাস আমার গালে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। ঘুমেলো গ্রীষ্মরাত্রির চমৎকার শান্তি আমাকে স্রোতের মতো আলোড়িত করে তুলল। এবং ঠিক ভোর হবার আগে কানে। ভেসে এল একটি স্টিমারের বাঁশির শব্দ। মানুষ-মানুষীরা এমন এক পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করছে যার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে আমার কাছে চিরদিনের জন্যে। এতদিনের মধ্যে এই প্রথমবার আবছাভাবে মায়ের কথা মনে পড়ল। এবং মনে। হল এখন বুঝলাম, কেন জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি একজন ‘ফিয়াঁসে’ বেছে। নিয়েছিলেন, কেন আবার নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েছিলেন। সেই আশ্রমেও যেখানে জীবনের শিখা প্রায় নিবুনিবু, সেখানেও সন্ধ্যা নামত বিষণ্ণ সান্ত্বনার মতো। মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে মা’র নিশ্চয় মনে হয়েছিল মুক্তির তীরে কারও পৌঁছে যাওয়ার মতো, যে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে প্রস্তুত। পৃথিবীর কারও কারও কোনো অধিকার নেই তার জন্যে অশ্রুবিসর্জনের। আমার নিজেকেও নতুন করে জীবন শুরু করার জন্যে তৈরি মনে হল। যেন এই বিশাল ক্রোধ আমাকে। পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে, আশা শূন্য করে দিয়েছে, এবং তারাভরা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে, এই প্রথম, প্রথমবারের মতো প্রকৃতির প্রসন্ন নির্লিপ্ততার কাছে মন। খুলে দিলাম। অমন অনুভব বস্তুতপক্ষে ভ্রাতৃসম, যে-অনুভূতি আমাকে সচেতন করেছে যে আমি সুখী এবং সুখী ছিলাম। সকল সিদ্ধি অর্জনের জন্যে, একটু কম নিঃসঙ্গতাবোধের জন্যে আমার কেবল আশা আছে যেদিন আমার শিরচ্ছেদ করা হবে সেদিন যেন দর্শকের এক বিশাল ভিড় থাকে, আর তারা যেন কুৎসিত চিৎকারে আমাকে বরণ করতে থাকে।