- বইয়ের নামঃ রক্তমাখা ছোরা
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
রক্তমাখা ছোরা
০১.
কাঁসার ঘণ্টার মত বেজে উঠল জোরাল কণ্ঠস্বর টুউউউ বিইইই…
কে? চমকে উঠল কিশোর।
শোনার জন্যে রবিন আর মুসাও কান পাতল।
…অর নট টুউউউ বিইইই…
রবিন বলল, কে জানি পদ্য বমি করছে!
জুনের চমৎকার রোদেলা দিন। হাতে কাজকর্ম নেই। বনের ভেতরে বেড়াতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। সাথে করে খাবার নিয়ে এসেছে, লাঞ্চটা এখানেই সারবে। খাবার খুলে সবে খেতে বসেছে, এ সময় এই কাণ্ড!
দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন… বলে চলেছে কণ্ঠটা।
না না, পদ্য নয়, ভুরু কুঁচকে বলল কিশোর। হ্যামলেটের ডায়ালগ। তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য, আত্মহত্যা করতে চলেছে হ্যামলেট।
মনে হয় কোন হতাশ অভিনেতার কাজ।
অভিনেতা না ছাই, মুসা বলল। আমার তো মনে হচ্ছে পাগল।
গমগম করে উঠল কণ্ঠটা, টু ডাই, টু স্লীইইপ-নো মোর!…
অবাক কাণ্ড! রবিন বলল। কিন্তু…
চলো তো দেখি। উঠে পড়ল কিশোর। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল নদীর দিকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে অনুসরণ করল রবিন।
কণ্ঠটা বলছে, ফর ইন দ্যাট স্লীপ অভ ডেথ হোয়াট ড্রীমস মে কাম…
এবার সত্যি সত্যি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার! মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি।
নদীর একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। সামনে একটা কাঠের সেতু। ঝুলে রয়েছে যেন নদীর ওপর, যে কোন মুহূর্তে ঝুপ করে খসে যেতে পারে। খুঁটিগুলোর অবস্থা করুণ। সেতুর মাঝের অনেক কাঠ নেই, কিছু কিছু জায়গা থেকে সরে গিয়ে ঝুলছে, নাড়া লাগলেই খুলে পড়ে যেতে পারে। দুপাশে দড়ির রেলিঙ।
নদীতে তীব্র স্রোত। মাথা খারাপ না হলে ওই সেতু দিয়ে এখন নদী পারাপারের চেষ্টা করবে না কোন মানুষ।
কিন্তু লোকটার বোধহয় মাথাই খারাপ। সব চুল সাদা। কালো পোশাক পরনে। দাঁড়িয়ে রয়েছে সেতুর মাঝখানে। চোখ আরেক দিকে।
বলল, ফর হুউউ উড বিয়ার দা হুইপস অ্যান্ড স্করনননস অভ টাইম…
বদ্ধ উন্মাদ! ফিসফিসিয়ে বলল রবিন। বলে কি শুনছ!
দুহাত ওপরে তুলে ফেলেছে লোকটা। চলার গতি বাড়াল কিশোর। বলল, শুনছি। হ্যামলেট এ-সময় জীবন শেষ করে দেয়ার কথা ভাবে…
হোয়েন হি হিমসে মাইট হিজ কোয়ায়েটাস মেইক উইথ…
কি করার ইচ্ছে ওর? বুঝতে পারছে না রবিন।
জানি না…
আ বেয়ার বড়কিন!
বেয়ার বডকিনটা আবার কি জিনিসরে বাবা! মুসার প্রশ্ন।
সেতুর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে কিশোর। একটা ড্যাগার! ছুরি! লোকটা সত্যিই কিছু করবে!
চেঁচিয়ে উঠল মুসা, না, কিছু করবেন না, স্যার! সব ঠিক হয়ে যাবে!
চমকে ফিরে তাকাল লোকটা। তিন গোয়েন্দাকে দৌড়ে আসতে দেখল। মুখে অসংখ্য ভাঁজ। বয়েসের। চেহারা বিধ্বস্ত, কিন্তু মাথার চুল সব ঠিক আছে, এলোমেলো নয়। একঘেয়ে গলায় বলল, আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। নিজের হাতেই জীবন দিয়ে দেব আমি।
ঝট করে একটা ছুরি বের করল। তুলে আনল বুকের ওপর।
কিশোর বুঝল, সেতুতে চড়ার সময় নেই। নদীর কাদাটে ঢাল পাড়ে ধপ করে বসে পিছলে নেমে গেল একটা খুঁটির কাছে।
ইনটু দা গ্রেট এভারলাসটিং আই কমেন্ড মাই স্পিরিট! ভারী গলায় চিৎকার করে উঠে ছুরিটা বুকে বসাতে তৈরি হলো লোকটা।
নাআআআ! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
নড়বড়ে খুঁটিটা দুহাতে চেপে ধরল কিশোর। গায়ের জোরে ঝাঁকাতে শুরু করল। কাঁচম্যাচ করে দুলে উঠল পুরানো সেতু। তাল সামলাতে না পেরে তাড়াতাড়ি একদিকের দড়ির রেলিঙ আঁকড়ে ধরল লোকটা। ঝুলে থাকা কয়েকটা তক্তা খসে পড়ল পানিতে।
ঝাঁকিয়েই চলেছে কিশোর। মড়াৎ করে ভাঙল সেতুর একটা বীম, পুরানো আরেকটা বীম ভার রাখতে পারল না, ভেঙে গেল ওটাও। বিকট শব্দ করে ঝটকা দিয়ে পড়ে গেল সেতুর একপ্রান্ত। দড়িটড়ি কোন কিছু ধরেই আর কাজ হলো না। সামলাতে পারল না লোকটা। ঝপাং করে পড়ল পানিতে। ছুরিটা তখনও ধরে রেখেছে শক্ত করে।
ডুবে যাওয়ার আগে লোকটার রক্ত পানি করা চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল নদীর দুই তীর আর পাহাড়ে। মাঝপথে থেমে গেল চিৎকারটা, যেন গলা টিপে থামিয়ে দেয়া হলো। আতঙ্কিত চোখে মুসা দেখল, তীব্র স্রোত লোকটাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে তার দিকে।
চলে যাবে! মরবে! পাথরে গিয়ে বাড়ি খাবে!
মুসার চিৎকার কানে পৌঁছল কিনা বোঝা গেল না, তবে কোনমতে মা তুলল লোকটা। বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও! সাঁতার জানি না…! নাকে মুখে পানি ঢুকে গেল বোধহয় ওর।
প্রায় একই সঙ্গে পানিতে ডাইভ দিল তিন গোয়েন্দা। মাথা তুলল লোকটা, আবার ডুবে গেল। এরই মাঝে পলকের জন্যে নজরে পড়ল তার আতঙ্কিত দৃষ্টি। তীব্র স্রোত ঠেলে তার কাছে পৌঁছল ওরা। হাত বাড়িয়ে কাধ ধরতে গিয়েও ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল মুসা। মুখ সরাল। আরেকটু হলেই তার গাল চিরে দিয়েছিল চুরির তীক্ষ্ণ ফলা।
কাছেই তো যেতে পারছি না! বলল সে।
শান্ত হোন, স্যার! অনুরোধ করল কিশোর! হাত নাড়বেন না। চুপচাপ ভেসে থাকার চেষ্টা করুন।
আমি…আমি…সাঁতার… আবার পানির নিচে ডুবে গেল লোকটার মাথা।
লোকটা সহযোগিতা করতে পারবে না, চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে, বুঝল মুসা। হঠাৎ চার হাত পায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে আগে বাড়ল, লোকটার বুক জড়িয়ে ধরল। লাথি মেরে, ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল যেন লোকটা, ছুরি নাচাল অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।
সাবধান! চেঁচিয়ে মুসাকে সাবধান করল কিশোর।
ডান হাতে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে রেখে অন্য হাতে লোকটার ডান কব্জি চেপে ধরল মুসা। একটা বিশেষ দুর্বল জায়গায় বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই নিমেষে খুলে গেল ছুরি ধরা আঙুলগুলো পানিতে পড়ে গেল ছুরিটা।
ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে এসেছে লোকটা। নড়াচড়া আর তেমন করছে না। তাকে নিয়ে সঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা চালাল মুসা। মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে রয়েছে চোখা পাথরের দেয়াল, দুপাশ থেকে চেপে এসেছে, মাঝের সরু ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে পানি। লোকটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মুসা দেখল না সেটা, কিন্তু রবিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
ছেড়ে দাও, মুসা, ছেড়ে দাও! তুমিও মরবে!
জলদি এসে ধরো! আমি একলা পারছি না!
কিছুতেই ছাড়বে না মুসা, বুঝতে পেরে প্রাণপণে সাঁতরে এগোল অন্য দুজনে। কোনমতে কাছে এসে চেপে ধরল লোকটার হাত।
তিনজনে মিলে টেনেটুনে তীরের কাছে নিয়ে এল লোকটাকে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল লোকটা। চোখা পাথরের দেয়াল থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে তীরে এসে উঠল ওরা।
ভেজা মাটিতে চিত করে শুইয়ে দেয়া হলো লোকটাকে। চোখ মুদে রয়েছে সে। বেহুশ হয়ে গেছে বোধহয়। তাড়াতাড়ি ওর মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের চেষ্টা চালাল কিশোর।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কেশে উঠল লোকটা। আ-আমি…কো-কোথায়…
চোখ মেলল লোকটা। ঘোলাটে দৃষ্টি। শূন্য চাহনি। ঠিক হয়ে এল ধীরে ধীরে। আমি বেঁচে আছি, তাই না?
আছেন। অল্পের জন্যে বেঁচেছেন, জবাব দিল কিশোর। সময় খারাপ যাচ্ছে নাকি আপনার?
খারাপ? বিড়বিড় করল লোকটা। দুর্বল কণ্ঠ, কিন্তু রাগ চাপা পড়ল না, বলল, শুধু খারাপ বললে কম বলা হবে। কোনমতে জীবনটাকে টিকিয়ে রেখেছি আমি!
আস্তে। আস্তে। হাত নাড়ল কিশোর, সহজভাবে কথা বলুন। আপনি কে? এখানে কি করতে এসেছেন?
আমি একজন বিপদে পড়া মানুষ, স্যার, নাটক করতে করতে যেন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা অভাস হয়ে গেছে লোকটার। মাথা ঝাড়ল, যখন তাকে তুলে বসানোর চেষ্টা করল রবিন। নাম আমার নিভার ব্রাউন। চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল বিষণ্ণ ভঙ্গিতে। হ্যাঁ, থিয়েটার আর সিনেমার সেই নিভার ব্রাউন। চমকে গেলে তো?
কারও কাছ থেকে জবাব না পেয়ে মুখ তুলে দেখল ওদের শূন্য দৃষ্টি। আর্ট ফিল্ম বোধহয় দেখো না তোমরা!
মাথা নাড়ল তিনজনেই।
তাহলে আর চিনবে কিভাবে? পচা নাটক আর সিনেমা দেখলে আমার নাম জানার কথা নয়। যাকগে! এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। কেন বাধা দিলে আমাকে?
আত্মহত্যা একটা অপরাধ, মিস্টার ব্রাউন, কোমল গলায় বলল রবিন। আপনার পরিবারের কথা ভাবুন…
কঠিন হয়ে গেল লোকটার ধূসর চোখজোড়া, দৃষ্টি যেন ধারাল ছুরির ফলার মত ভেদ করে ঢুকে গেল রবিনের অন্তরে। পরিবার? সেই চরিত্রহীন মেয়ে মানুষটার কথা বলছ, যে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে হলিউডের এক ফিল্ম এডিটরের সঙ্গে!
স-সরি, মিস্টার ব্রাউন, আমি সত্যি দুঃখিত।
আরে শোনোই না, আমার দুঃখের ইতিহাস শুরুই তো করিনি এখনও। আর্ট ফিল্ম আর খুব একটা হয় না আজকাল, ফলে কাজ পাওয়া যায় না। একজন নিয়মিত একটা বেতন দিয়ে যাচ্ছিলেন, এখন সেটাও গেছে। তা ছাড়া মনের খোরাকই যদি গেল একজন মানুষের, বেঁচে থাকার আর কি অর্থ বলো? জীবনের সব কিছু হারিয়ে আমার বয়েসী একজন মানুষ বেঁচে থেকে কি করবে? আঁ! কি করবে? আশপাশে মাটিতে চোখ বোলাল সে। আমার ছুরি কই?
পানির তলায়, কিশোর জানাল। নদীতে। শুনুন, ওসব পাগলামি চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন। গাড়ি আছে। বাড়ি পৌঁছে দেব। বিশ্রাম নিলেই মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছেন এখন আপনি।
হবে না, হবে না! ওই ছুরিটা হারিয়ে তো মন আরও খারাপ হয়ে গেল! ওই ছুরিটা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। আমার বাবার বাবা, তার বাবা, তার বাবার কাছ থেকে এসেছে! করলে কি তোমরা! আমাকে মরে তোত বাঁচতে দিলেই না, মাঝখান থেকে ওরকম একটা সম্পদ খোয়ালাম…।
দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। তারপর জোর করে ধরে তুলল ব্রাউনকে। কিছুতেই যাবে না লোকটা। শেষে অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভান করে ঘুরে দাঁড়াল তিনজনে। পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল।
একবার দ্বিধা করে পিছু নিল ব্রাউন। অভিযোগের পর অভিযোগ করে চলল। সমস্ত দুনিয়ার ওপর তার ঘৃণা জন্মেছে। তবে থামল না আর। বন পেরিয়ে এসে দাঁড়াল মুসার ভটভটানি জেলপি গাড়িটার কাছে।
ট্রাংক থেকে উলের একটা শাল বের করল মুসা। ব্রাউনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ভেজা শরীর জড়িয়ে নিতে ইশারা করল লোকটাকে।
মুসা যখন ইঞ্জিন স্টার্ট দিল; শাল জড়ানো, এমনকি পেছনের সীটে রবিনের পাশে উঠে বসার কাজটাও সমাপ্ত হয়েছে লোকটার, ফোঁপাতে আরম্ভ করল। যেন কত কষ্ট।
প্লীজ, মিস্টার ব্রাউন, মুসা বলল, এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় থাকেন, বলবেন?
নাইনটি ফোর লেকভিউ এভিন্য! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল বেচারা ব্রাউন। আমার জীবন যদি রক্ষাই করলে, আরেকটু উপকার করো, দয়া করে একটা টিস্যু পেপার দাও।
একটা টিস্যু পেপার বের করে দিল কিশোর।
গাড়ি চালিয়ে রকি বীচের একটা পুরানো অঞ্চলে ঢুকল মুসা। শহরতলি দিয়ে চলেছে। সারা দুনিয়ার প্রতি এক নাগাড়ে অনর্গল অভিযোগ করে চলেছে ব্রাউন।
মিস্টার ব্রাউন! আর সইতে না পেরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল মুসা, দয়া করে একটু থামবেন? গাড়ি চালাতে পারছি না…
মাছ ধরার সরঞ্জামের একটা দোকানের পরেই তীক্ষ্ণ মোড়। উইন্ডশীল্ডের ওপাশে চোখ পড়তেই মুখ থেকে রক্ত সরে গেল ব্রাউনের।
সাবধান! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
ভুল সাইড দিয়ে ধেয়ে আসছে আরেকটা লাল স্পোর্টস কার। নাক বরাবর ছুটে আসছে যেন ওদেরকে তো মারার জন্যেই!
.
০২.
শাই করে ডানে স্টিয়ারিং কাটল মুসা। নাকের একপাশ দিয়ে একটা গার্ড রেইলে গুঁতো মারল গাড়িটা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেলো। টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে পাশ দিয়ে প্রায় গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল লাল ল্যামবোরগিনি গাড়িটা।
বিচ্ছিরি একটা ধাতব আওয়াজ ভরে দিল যেন বাতাসকে। পথের পাশে গাড়ি থামিয়ে দিল মুসা। ফিরে তাকিয়ে দেখল একটা টেলিফোন পোস্টে ধাক্কা লাগিয়েছে লাল গাড়িটা।
ঠিক আছে তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আছি। উফ, বড় বাঁচা বেঁচেছি! মুসা বলে উঠল।
দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে লাল গাড়িটার দিকে দৌড় দিল তিন গোয়েন্দা। ক্ষতি তেমন হয়নি, শুধু সামনের দিকে খানিকটা জায়গার ছাল উঠে গেছে।
আমিও ভাল আছি, বুঝলে! জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল পেছনের সীটে বসা ব্রাউন। কিছুই জিজ্ঞেস করলে না আমাকে। আমার জীবনের কি কোন দাম নেই?
কানেও তুলল না তিন গোয়েন্দা। ওরা গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে, এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল বাঁ পাশের দরজা। শোনা গেল তীক্ষ্ণ মেয়েলী চিৎকার, এই, দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারো না?
গাড়ি থেকে নেমে এল এক তরুণী। বয়েসে ওদের একআধ বছরের বড় হতে পারে। লাল চুল। গলার তিনটে সোনার হারকে ঠিক করল। হাত দিয়ে ডলে সমান করে দিল আঁটো জাম্পসুটের ভাঁজ। নাকে সানগ্লাস বসানোর আগে একবার বিষদৃষ্টি হানল কিশোর, রবিন আর মুসার ওপর। তারপর গটমট করে এগিয়ে এল। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগল কিশোরের।
দেখো, আমার গাড়ির কি করেছ! ধমক দিয়ে বলল মেয়েটা। একেবারে শেষ!
না, খুব একটা ক্ষতি হয়নি, মুসা বলল। তবে দোষটা তো আপনার…
তোমার দোষ!
দোষ যারই হোক, মেয়েটাকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল কিশোর, এখন আর বলে লাভ নেই। আর গাড়ির যা ক্ষতি হয়েছে, তার জন্যেও চিন্তা নাই। বীমা কোম্পানিই যা করার করে দেবে। আসল জিজ্ঞাসাটা হলো, আপনি জখম-টখম হয়েছেন কিনা। ভাল আছেন?
দাঁত খিঁচিয়ে বলল মেয়েটা, তোমাদের চাঁদমুখ দেখার আগে তো ছিলামই! কি যে বিপদে ফেলে দিলে! এখন গ্যারেজে খবর দিতে হবে। ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হবে আমাকে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। ভাল ঝামেলা বাধিয়েছ।!
আবার ড্রাইভিং সীটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। ভেতর থেকে বের করল একটা মোবাইল টেলিফোন। কিশোর মনে করার চেষ্টা করছে, মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে।
হাল্লো, মারলিন? ফোনে বলল মেয়েটা হাল্লো, আরে জোরে বলো না! হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি….ডায়না, ডায়না!…কী? হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে টেলিফোনটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। যাই কি করে এখন? হাঁটব!
দৌড়ে যাও! মুখে এসে গিয়েছিল কথাটা মুসার। কিন্তু বলল না। তার বদলে বলল, আমার গাড়িতে করে যাবেন?
তুমি চালাবে? তিক্তকণ্ঠে বলল মেয়েটা।
হ্যাঁ।
যেতে পারি, যদি ও চালায়, বুড়ো আঙুল দিয়ে কিশোরকে দেখাল ডায়না। কারণ আমার মনে হচ্ছে ও ভাল চালাবে। তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। আবার গুঁতো লাগাবে কারও গাড়ির সঙ্গে।
কিশোরের দিকে একটা অদ্ভুত চাহনি দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল মুসা। ফিরে চলল গাড়ির কাছে।
মুচকি হাসল রবিন।
মেয়েটার ব্যাপারে কৌতূহল বাড়ছে কিশোরের। কোথাও দেখেছে। ডাকল, আসুন।
ঝাঁকুনি দিয়ে মুখের ওপরে এসে পড়া সিল্কের মত নরম লাল চুলগুলো সরিয়ে দিল ডায়না। এগোল মুসার গাড়ির দিকে।
আপনাকে চিনে ফেলেছি আমি, বলে উঠল কিশোর। আপনি ডায়না মরগান। পত্রিকায় পড়েছি…
…পারসোনালিটি ম্যাগাজিনে, কিশোরের বাক্যটা শেষ করে দিল ডায়না। হ্যাঁ, আমিই সেই মেয়ে। উদ্ভট আর্টিকেল, তাই না? হেডিংটা কি দিয়েছে। পড়লেই গা জ্বলে! ওটা একটা লেখা হয়েছে। গরু ছাগল কতগুলোকে নিয়ে ভরেছে পত্রিকা অফিসে। আহারে, আমার জন্যে কি দুঃখ ওদের, আমার বাবা মায়ের অকাল মৃত্যুতে কেঁদেকেটে অস্থির। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। যত্তোসব!
কাছেই একটা ফোন বুঁদ দেখে এগিয়ে গেল ডায়না। ফোন সেরে ফিরে এসে উঠল গাড়িতে, সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে। এমন ভঙ্গি করল, যেন মিউনিসিপ্যালিটির ময়লার গাড়িতে উঠেছে। নাক কুঁচকে নির্দেশ দিল কিশোরকে, রকি বীচ মিউজিয়ামে যাও। জলদি।
পেছনের সীটে তখন একেবারে গুটিয়ে গেছে ব্রাউন। মুসার দেয়া শাল দিয়ে ঢেকে ফেলেছে আপাদমস্তক। মুখও দেখা যায় না।
সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাল ডায়না। ব্যাপার কি? রোগী নাকি! এই, কি রোগ? এইডস
ব্রাউনের প্রতিক্রিয়া খুব একটা হলো না, সামান্য নড়েচড়ে বসল শুধু শালের তলায়। তার পাশে গাদাগাদি করে বসল মুসা ও রবিন।
না, রোগী না, জবাবটা দিল কিশোর। খুব দুর্বল। তা মিউজিয়ামে কেন? মরগানদের কালেকশন চেক করা হচ্ছে?
মুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করল ডায়না। চেক-ফেক না। যেখানকার জিনিস সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তাই নাকি? আগ্রহ দেখাল কিশোর। পারসোনালিটি তো বলছে, মিউজিয়ামের অর্ধেক জিনিসই নাকি আপনাদের। নিয়ে গেলে খালি হয়ে যাবে তো।
তা যাবে। পত্রিকা ভুল তথ্য দিয়েছে। অর্ধেক নয়, ষাট ভাগই আমাদের। এখন ওগুলো সব আমার সম্পত্তি। মিউজিয়ামে ফেলে রাখার পক্ষপাতি নই আমি। বাড়ি সাজাব। নিজের বাড়ির দেয়ালে ঝোলাব পেইন্টিংগুলো। ওদেরকে দিয়ে রাখব কেন শুধু শুধু?
অর্ধেকের বেশি জিনিস মিউজিয়াম থেকে চলে যাচ্ছে দেখে কিউরেটরের মুখটা কেমন হবে, আন্দাজ করতে চাইল কিশোর।
নিজের চোখেই দেখতে পেল খানিক পরে। মিউজিয়ামের কাছে চলে এসেছে গাড়ি। দেখা গেল, বাড়িটার পাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ওটার পেছনে জড়ো হয়েছে পাঁচজন লোক। চারজনের পরনে ধূসর রঙের ইউনিফর্ম। বড় একটা বাক্স ট্রাকে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। পঞ্চমজনের গাট্টাগোট্টা শরীর, নীল সুট পরেছে, চোখে সরু তারের চশমা। চারজনে ধরাধরি করে বাক্সটা ট্রাকের পেছনে নিয়ে গেছে। চেঁচিয়ে চলেছে নীল সুট। বার বার হাত নেড়ে কি বোঝাতে চাইছে, রাগে লাল হয়ে উঠেছে চোখমুখ। পাতলা হয়ে আসা সোনালি চুলের কয়েকটা গোছা এসে লেপটে রয়েছে ঘামে ভেজা কপালের ওপর। লোকগুলোকে কাজ থেকে, অর্থাৎ ট্রাকে বাক্স ভোলা থেকে বিরত রাখতে চাইছে।
এটাই বোধহয় শেষ বাক্স, আনমনে বিড়বিড় করল ডায়না। হুকুমের সুরে কিশোরকে বলল, আহ, তাড়াতাড়ি চালাও না। মোটোর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ধনুকের মত বাঁকা ড্রাইভওয়ে ধরে বাড়িটার পাশে এনে গাড়ি রাখল কিশোর। একটানে দরজা খুলে লাফিয়ে নামল ডায়না। কি হলো জুভেনার, ওদের ধমকাচ্ছেন কেন?
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল লোকটা। সরে যাওয়া চশমাটা আবার ঠেলে দিল নাকের ওপর। সি মরগান, আপনার নিশ্চয় মনে আছে এই জিনিসগুলো মিউজিয়ামকে দান করে দেয়া হয়েছে। তিরিশ বছর আগে দলিল সই করে দিয়েছেন আপনার দাদা। কিউরেটর হয়ে কি করে আমি এগুলো নিয়ে যেতে দিই
অসহিষ্ণুতা চলে গেছে ডায়নার। শান্তকণ্ঠে বলল, জুভেনার, আপনিই বলেছেন, ওই দলিলটা পাওয়া যাচ্ছে না। ছিল যে তার ঠিক কি?
ছিল, নিশ্চয় ছিল! খুঁজে বের করার জন্যে সময় তো দেবেন? গত বছর আগুন লেগেছিল, জানেন। তখন সমস্ত পুরানো ফাইল সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
ওসব কথা অনেক শুনেছি, বাধা দিয়ে বলল ডায়না। আমার বাবার উইলের কপি আপনি দেখেছেন। জিনিসগুলো এখন আমার সম্পত্তি। এবং আমি ওগুলো ফেরত চাই। অনেক দিন তো রাখলেন, আর কত? নতুন করে সাজিয়ে নিন আবার।
নতুন করে! মাই ডিয়ার লেডি, এটা মিউজিয়াম, বেডরূম নয় যে বললেই সাজানো হয়ে যাবে। এত দামী দামী ছবি, শিল্পকর্ম, চাইলেই কি পাওয়া যায়? আর ওসব জিনিস ছাড়া মিউজিয়াম বাতিল।
মোলায়েম হেসে পরিবেশ হালকা করে ফেলতে চাইল ডায়না। কিশোর যতটা মাথামোটা ভেবেছিল মেয়েটাকে, এখন দেখল ততটা নয়। বরং বয়েসের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতী।
আহহা, এত মন খারাপ করছেন কেন? ডায়না বলল। অন্য ভাবেও তো ভেবে দেখতে পারেন। তিরিশটা বছর অন্যের জিনিস দিয়ে মিউজিয়ামের মান বাড়িয়েছেন, নাম কামিয়েছেন, এটা কি কম পাওয়া হলো?
ওগুলো রাখতে পারলেই শুধু খুশি হব আমি। আপনি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করছেন। আপনার বাবাও মেনে নিতেন না এটা।
লোকটাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করল চারজনের একজন। আহহা, মিস্টার জুভেনার, কি শুরু করলেন? সরুন না! ভীষণ ভারী এটা। সরুন, জায়গা দিন। ম্যাডাম যা বলছেন, শুনুন।
না, নিতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে নেবে। ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিতে গেল জুভেনার।
আরেকজনের পায়ে পা বেধে গিয়ে উল্টে পড়ে গেল লোকটা। গেল রেগে। গাল দিয়ে লাফিয়ে উঠে ঘুসি মেরে বসল জুভেনারের চোয়ালে।
পড়ে গেল জুভেনার।
কিউরেটরকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এল মিউজিয়ামের তিনজন কর্মচারী। এসেই যে লোকটা জুভেনারকে মেরেছে তার পেটে ঘুসি মারল একজন। আরেক ঘুসি মেরে ফেলে দিল একটা বাক্সের ওপর।
চোয়াল ডলতে ডলতে চিৎকার করে উঠল কিউরেটর, এই কি করছ নিক, ওটা রডিনের স্ট্যাচু! ভাঙবে তো!
তার চিৎকার কানেই তুলল না কেউ। পাইকারী মারামারি শুরু হয়ে গেছে। মিস ডায়না মরগানের শ্রমিক বনাম মিউজিয়ামের কর্মচারী। টেনে-হিঁচড়ে বাক্স সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জুভেনার।
এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনা, কিছুক্ষণের জন্যে যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল কিশোর। তারপর সংবিৎ ফিরল। দেখি, থামাই! রবিন, জলদি পুলিসকে ফোন করো! মুসা, এসো আমার সঙ্গে! বলেই দৌড় দিল সে।
একজন শ্রমিকের ওপর থেকে নিককে টেনে সরিয়ে আনল মুসা। ঘুরতেই দেখল, ঘুসি পাকিয়ে তারই দিকে ছুটে আসছে আরেকজন শ্রমিক। ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। ঘুসিটা চলে গেল তার কাঁধের ওপর দিয়ে। সোজা হয়েই জুজিৎসুর প্যাঁচ মেরে মাটিতে ফেলে দিল লোকটাকে।
আরে থামুন, থামুন আপনারা! শুরু করলেন কি! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পেছন থেকে এসে তাকে জাপটে ধরল মিউজিয়ামের এক কর্মচারী। মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। কারাতের প্যাঁচে কুপোকাৎ হলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ডায়নার, এ রকম কিছু ঘটবে আশা করেনি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে মুসার গাড়িটার দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইরেনের শব্দ যেন মধু বর্ষণ করল কিশোরের কানে। পুলিসের সাইরেন। ড্রাইভওয়ের দিকে ফিরে তাকাল সে। দুটো গাড়ি চোখে পড়ল। পুলিসের। আগেরটাতে ড্রাইভারের পাশে অফিসার পল নিউম্যানকে বসে থাকতে দেখল।
ব্যস, ব্যস, অনেক হয়েছে! বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল টঙটঙে যান্ত্রিক কণ্ঠ, পেট্রোল কারের মেগাফোনে কথা বলছে পল। পুলিসের নির্দেশ উপেক্ষা করার সাহস হলো না কারও। লড়াই থামিয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল, যেন গোবেচারা, কিছু করেনি।
গাড়ি থেকে নেমে এল পল আর তার সহকারী। আরেক দিক থেকে এল রবিন, ফোন করতে গিয়েছিল রাস্তার মোড়ের একটা ফোন বুদে। ভ্যান থেকে নেমে লাফাতে লাফাতে ছুটে এল মু।
মিস্টার জুভেনার, জিজ্ঞেস করল পল, কি হয়েছে? মালগুলো কার, মরগানদের না?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিউরেটর। জোর করে নিয়ে যেতে এসেছে এই লোকগুলো।
নাকি আপনি জোর করে রেখে দিতে চাইছেন? মিস মরগানের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে আমার। দলিল যতক্ষণ দেখাতে না পারছেন, জিনিসগুলো রাখতে পারছেন না আপনি। বাধা দেয়ার কোন অধিকার নেই।
কিন্তু…কিন্তু…
যা বলার আদালতে গিয়ে বলবেন। আমাকে বলে লাভ হবে না।
পলের সঙ্গে তর্ক করছে কিউরেটর, রবিন চলে এল কিশোরের পাশে। জোর একটা লড়াই যে হয়ে গেছে, লোকগুলোর নাকমুখের অবস্থা দেখেই আন্দাজ করতে পারল। শিস দিয়ে উঠল আপনমনে। মাথার চুলে হাত বোলাল। মনে হয় মিসই করলাম! কেমন চলল?
দারুণ, জবাব দিল মুসা। মুখে মৃদু হাসি। ছড়ে যাওয়া কনুই ডলছে। তুমি ছিলে না বলে আমারও দুঃখ হচ্ছিল। কারাত আর জুজিৎসুর কি প্যাঁচগুলোই না কষলাম। দেখলে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যেতে…
কথা শেষ হলো না তার। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল। ঝট করে ফিরে তাকাল সবাই ড্রাইভওয়ের শেষ মাথার দিকে।
মুসার গাড়ির গায়ে যেন সেঁটে রয়েছে ডায়না। পেছন থেকে তার গলা চেপে ধরেছে একজোড়া হাত।
দৌড় দিল দুই ভাই। পেছনে রবিন। চেঁচিয়ে উঠল, আরে ব্রাউন তো মেরে ফেলল মেয়েটাকে!
.
০৩.
ডায়নাকে সাহায্য করছে কিশোর, ইতিমধ্যে ব্রাউনের কলার ধরে টেনে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে এল মুসা।
ডায়না, লেগেছে কোথাও? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, না, আ-আমি ঠিক আছি! ফুঁপিয়ে উঠল একবার ডায়না। হাত চলে গেছে গলায়, যেখানটায় চাপ লেগেছে। শুধু মাথাটা কেমন যেন করছে!
অনেক সহ্য করেছি আমি, ডায়না মরগান, চিৎকার করে বলল ব্রাউন, নাটকের সংলাপ বলছে যেন, আর নয়। তোমাকে ছাড়ব আমি ভেবেছ! সর্বনাশ করে দেব। খুন করব! দুই হাত বাড়িয়ে এগোল সে।
ভয় পেয়ে গেল ডায়না। পিছিয়ে এল এক পা। লাফ দিয়ে তার আর ব্রাউনের মাঝে চলে এল কিশোর। বাধা হয়ে দাঁড়াল মাঝখানে। পল আর তার সহকারীও পৌঁছে গেল ওখানে। ব্রাউনকে টেনে সরিয়ে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিল তার হাতে। কিশোরের দুপাশে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।
আমাকে ছাড়ুন অফিসার, আমার কোন দোষ নেই, সংলাপ চালিয়ে গেল অভিনেতা। ও আমাকে বাধ্য করেছে এসব করতে। স্বপ্নেও যা ভাবতে পারিনি, তা-ই করিয়ে ছেড়েছে আমাকে দিয়ে।
ব্রাউনের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পল। চকচক করে উঠল চোখ। ও, আপনিই সেই লোক, না? হরর হাই স্কুল স্ত্রী নাটকটার বারোটা বাজিয়েছেন?
আমার কোন দোষ ছিল না, মাটির দিকে তাকিয়ে বলল ব্রাউন। পার্টটাই ছিল এরকম, বাজে।
ডায়নার দিকে নজর দিল কিশোর। সত্যি ঠিক আছেন তো আপনি?
হ্যাঁ, ভালই আছি, গলায় জোর নেই। কিশোরের চোখে চোখে তাকাল, দৃষ্টিতে স্বস্তি দেখা গেল এতক্ষণে। থ্যাংকস।
হাত ডলছে মুসা। দাঁতের দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। কামড়ে দিয়েছে ব্রাউন। জলাতঙ্কই না হয়ে যায় শেষে-ভাবল সে। পাগলই মনে হচ্ছে লোকটাকে! পাগলা কুকুরে কামড়ায়নি তো!
ধন্যবাদটা কিন্তু আমাকে দেয়া উচিত ছিল, হালকা গলায় বলল মুসা। আপনাকে ছাড়িয়ে আনার সময় কামড়টা ব্রাউন আমাকে দিয়েছে, কিশোরকে দেখাল সে। ওকে নয়।
শূন্য দৃষ্টিতে মুসার দিকে একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল ডায়না। তারপর কিশোরকে বলল, লোকটা সাংঘাতিক! বদ্ধ পাগল…
এই, আমি সব শুনছি কিন্তু! গর্জে উঠল ব্রাউন। মাত্র তো কয়েকটা বছর। এর মধ্যেই আমার সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেল?
আপনি শান্ত হোন, মিস্টার ব্রাউন, বলে ডায়নার দিকে ফিরল কিশোর। একে চেনেন নাকি?
শীতল দৃষ্টিতে ব্রাউনের দিকে তাকাল ডায়না। চিনি না মানে। ওর নাম ব্রাউন না, এনুডা, বার্ব এনুডা। আব্বার কাছে চাকরি করত…
ওই পাপ মুখে ওঁদের নাম আর নিও না, চেঁচিয়ে উঠল এনুডা। সাহেব আর মেমসাহেব কত ভাল ছিলেন। তাদের ঘরে যে তোমার মত একটা খাণ্ডারনী কি করে জন্মাল বুঝতে পারি না! বিশটা বছর ওদের গাড়ি চালিয়েছি, অথচ একটা দিনের জন্যেও অসুখী হইনি। কত ভালবাসতেন আমাকে, যেন একেবারে আপন ভাই। প্রাসাদ ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে দিতেন না। আরে মেয়ে, এত যে বড় বড় কথা বলল, তোমাকেও কি কম আদর করেছি নাকি আমি? কোলেপিঠে করে মানুষ করিনি? তোমাদের জন্যে আমার থিয়েটারের ক্যারিয়ার নষ্ট করলাম। কড়া চোখে তাকাল ডায়নার দিকে। বিনিময়ে কি পেয়েছি? একটা আজীবন ভাতার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন তোমার বাবা, সেটাও তুমি বন্ধ করে দিয়েছ। তুমি কি মানুষ?
যারা কাজ করে না তাদেরকে বেতন দিই না আমি, ডায়না বলল। আপনারাই বলুন, বসে বসে কারও টাকা নেয়া কি উচিত? কিছু করে না। দিন রাত চব্বিশটা ঘন্টা টিভির সামনে বসে থাকে, আর পুরানো ছবির ডায়লগ নকল করে।
বেশ, আমি নাহয় কাজ করি না, কিন্তু বাড়িতে অন্য যে সব কাজের লোক ছিল? তাদেরকে তাড়িয়েছ কেন? সবাই কি অকাজের? তাড়াবেই তো। সবাই বাপের আমলের লোক যে। তোমার পাটিতে যাওয়া, আড্ডা মারা, অকাজ-কুকাজ সইতে না পেরে কিছু বলতে আসে যদি…
হয়েছে, হয়েছে, থামুন, হাত তুলল পল। মিস, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান?
হঠাৎ ভয় দেখা দিল এনুর চেহারায়। দোহাই তোমার ডায়না, এই কাজটা অন্তত কোরো না! আমাকে রেহাই দাও। তুমি জানো, আমি লোক খারাপ নই। মাঝে মাঝে মাখাটা বিগড়ে যায়, তখন কি যে করে বসি!…সময় খুব খারাপ যাচ্ছে
মাথা নাড়ল ডায়না। না, অফিসার, ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। আমি আশা করব, এরপর থেকে ভাল হয়ে যাবে এনুডা। আমার ব্যাপারে আর নাক গলাতে আসবে না।
অবাক হলো পল। বেশ, আপনি যখন বলছেন… হাতকড়া খুলে দিল এনুডার।
থ্যাংক ইউ, মৃদু স্বরে বলল এনুডা। ঝাড়া দিয়ে কাপড়ের ময়লা পরিষ্কার করল, যদিও লাভ হলো না খুব একটা, ভালমতই লেগে গেছে। চিবুক সোজা করে, কারও দিকে না তাকিয়ে হেঁটে চলে গেল।
ওকে ছাড়াটা বোধহয় ঠিক হলো না, কিশোর বলল। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
মাথা ঝাঁকাল ডায়না। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাঝে মাঝেই করে ওরকম। দেখে নেয়, কাছাকাছি লোক আছে কিনা। থাকলে করে, যাতে সময়মত ওকে থামাতে পারে ওরা। অভিনয় করতে পারেনি বলেই বোধহয় ওর এই ক্ষোভ। মাথায় ছিট আছে, তবে কারও কোন ক্ষতি করে না।
এনুডা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে পল বলল, লোকটাকে একটুও ভাল লাগল না আমার। হশিয়ার থাকবেন। কিছু করলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন আমাদেরকে। কিশোর, মিস মরগানকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে? মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল একবার, হাসল, তারপর সহকারীকে নিয়ে এগিয়ে গেল নিজেদের গাড়ির দিকে।
উষ্ণ, উজ্জ্বল একটা হাসি উপহার দিল কিশোরকে ডায়না। যে ভাবে সামলেছ না পাগলটাকে, খুব ভাল লেগেছে আমার। আর ওই মিউজিয়ামের শয়তানগুলোকে যে সামাল দিলে, সে তো অবিশ্বাস্য।
ও কিছু না, মুসার জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর।
শোনো, কিশোরের হাত ধরে বলল ডায়না, আজ রাতে বাড়িতে একটা বিরাট পার্টি দিচ্ছি। তুমি এলে খুব খুশি হব।
অযথাই কাশল কিশোর। মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল, চোখে অস্বস্তি। সেটা নজরে পড়ে গেল ডায়নার। তাড়াতাড়ি বলল, তোমার বন্ধুদের নিয়ে আসবে।
মুহূর্তে চোখের আগুন নিভে গেল মুসার। চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল, আমি মুসা আমান।
খুশি হলাম, ডায়না বলল। ও কে?
ওর নাম রবিন মিলফোর্ড, কিশোর বলল।
পরিচয়ের পালা শেষ হলে ডায়নাকে বলল কিশোর, এখনও কি আমি গাড়ি চালাব? মুসা কিন্তু অনেক বেশি ভাল চালায়। তা ছাড়া গাড়িটাও ওর।
তা চালাক, নিমরাজি হলে, ডায়না। কিন্তু ও চালালে ভটভটানি কি কিছুটা কমবে?
হাসি চাপতে পারল না রবিন।
কিশোর বলল, কি জানি, কমতেও পারে। হাজার হোক, ওর গাড়ি যখন, ওর কথা শুনতেও পারে। কি বলো, মুসা?
মাথা নাড়ল মুসা, সরি। আমি চালালে আওয়াজ বরং আরও বাড়বে। কিশোর গাড়িটার কাছে পর মানুষ, ওর সঙ্গে তো রাগ-ঝাল দেখাতে পারে না। তবে আমার সঙ্গে হরহামেশাই দেখায়।
আঁতকে উঠল ডায়না। বলে কি! আরও বেশি শব্দ করবে! থাক বাবা, থাক। কিশোর, তুমিই চালাও।
হাসিমুখে গিয়ে পেছনের সীটে উঠে বসল মুসা। পাশে রবিন। ব্রাউন নেই। ঠাসাঠাসি হলো না আর। আরামেই বসতে পারল।
*
পার্টিটা নিশ্চয় দারুণ জমবে আজ! বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল মুসা।
পায়ের মোজা খুলে কার্পেটে ছুঁড়ে ফেলল কিশোর। কি জানি। তোমার মত এতটা ভাবতে পারছি না। তাক থেকে একটা পার্সোনালিটি ম্যাগাজিনের কপি নিয়ে এসে ছানায় বসল।
বলতে বিশ্বাস করবে না, বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল মুসা। যা-ই বলল, অত বড় বাড়ি কমই দেখেছি। বনের মধ্যে এ রকম বাড়ি বানিয়ে বসে আছে কেউ, কল্পনাই করতে পারিনি!
হুমম! ছবি আছে এখানে। পত্রিকাটা নাড়ল কিশোর। সেজন্যেই বের করলাম। তা ছাড়া আরও একটা জিনিসের কথা মনে পড়ল।
কিশোরদের বাড়িতে কিশোরের বেডরূমে কথা বলছে ওরা।
কী? কৌতূহলী হয়ে ফিরে তাকাল রবিন।
মরগানদের আরেক সংহ-মারাত্মক বোরজিয়া ড্যাগার! পত্রিকাটা উল্টে দেখাল কিশোর। এই দেখো হেডলাইন। ওটাও ছিল মিউজিয়ামে। রত্ন বসানো একটা ছুরি। চারশো বছর আগে ওটার প্রথম মালিক ছিল সেই নিষ্ঠুর ইটালিয়ান পরিবার, বোরজিয়ারা, নাম শুনেছ নিশ্চয়। গোড়া ধার্মিক ছিল ওরা, সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল, সবচেয়ে বড় কথা, ওরা ছিল ভয়াবহ খুনী। শোনা যায়, ওদের এই ড্যাগারটা নাকি অভিশপ্ত।
কি অভিশাপ।
কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে, যেন ভয়াবহতা বোঝানোর জন্যেই ফিসফিসিয়ে বলল মুসা, ছুরিটা ছোঁয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যাবে ছুরির মালিক।
*
অন্ধকারে ম্যানশনের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা।
প্রাসাদের ছাত থেকে উঠে গেছে চারটে মোচা আকৃতির মিনার, দুর্গের টাওয়ারের মত। বিশাল গাড়িবারান্দাকে ঘিরে রেখেছে আঙুরলতা আর ফুলের বেড়। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, ছড়ানো লন গিয়ে মিশেছে বনের সঙ্গে। আর কোন বাড়িঘর চোখে পড়ে না। রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে জোরাল বাজনার শব্দ। দোতলার মস্ত চারটে জানালা দিয়ে উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে বাইরে, ভোরের রোদের মত।
ইয়ার্ডের পিকআপটা পার্ক করে রেখে ভেতরে ঢুকল তিনজনে। মুসার গাড়িটা আনার সাহস পায়নি। প্রচণ্ড শব্দে পাড়া জাগিয়ে দিতে চায়নি। বলা যায় না, পাটির লোকে খেপেও উঠতে পারে।
ঢুকেই যেন ধাক্কা খেলো মুসা, তার নীল সুট বেমানান লাগল তার নিজের কাছেই। দুই ধরনের মেহমান আছে পার্টিতে, পরনে দুই ধরনের পোশাক। একদলের পরনে অতিরিক্ত দামী টাক্সিডো আর ইভনিং গাউন, আরেক দলের পরনে সুট, তবে ওগুলোর দামও কম নয়। মুসারটা ওগুলোর কাছে কিছুই না। ফিটফাট পোশাক পরা, রগ বের হওয়া একজন লোক মেহমানদের মাঝে দাঁড়িয়ে হলদে প্যাডে কি যেন লিখছে।
খবরের কাগজের লোক হবে, ফিসফিস করে বলল মুসা। সোসাইটি কলামিস্ট।
আরি, কিশোর। এসে গেছ। এসো, এসো, জোর গুনকে ছাপিয়ে ভেসে এল ডায়নার কণ্ঠ। রবিন। মুসা। এসো তোমরা।
অকারণেই হাসছে একঝাক লোক, তাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে এল সে। চমৎকার পোশাক পরেছে ডায়না। ঘরের এই পরিবেশে পরী মনে হচ্ছে তাকে। কিশোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কালচে বাদামী চুলওয়ালা এক তরুণের কাছে। ছয় ফুটের ওপরে লম্বা। সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছে যেন।
কিশোর…রবিন…মুসা, পরিচয় করিয়ে দিল ডায়না। আর এ হলো ডিন রুজভেল্ট।
হাল্লো, বলে হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ডিন। ঝিক করে উঠল সাদা দাঁত। এত সাদা, চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চায়।
তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটখাট একজন মহিলা। সাদা চুল। বয়েস ষাটের কাছাকাছি। তিন গোয়েন্দাকে যখন পরিচয় করিয়ে দিল ডায়না, মহিলার ভারী লেন্সের চশমার পাশে ঝিলমিল করে উঠল যেন ধূসর-সবুজ চোখ।
আর ইনি হলেন, মহিলার পরিচয় দিল ডায়না, ডক্টর নরিয়েমা ডিলারয়, আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনজন। এই দুনিয়ার সবার চেয়ে বেশি চিনি আমি একে।
হাসার সময় কাঁধে ঝাঁকি লাগে ডক্টর ডিলারয়ের। ও আমার ব্যাপারে সব কিছুই খুব বাড়িয়ে বলে। ওয়েলকাম টু ক্লিফসাইড হাইটস। দিনের বেলা এসো একদিন। কি সুন্দর বাগান আছে ডায়নার, দেখবে।
আরেকটা পরিচয় আছে ইনার, ডায়না বলল। ইনি আমার খালা, নরিখালা। চাকরি থেকে অর্ধেক অবসর নিয়েছেন বলা যায়। ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে এখন পার্টটাইম কাজ করেন। বাকি সময় বাগানের যত্ন করেন। আমার বাগানেও, নিজের বাগানেও। ফুল গাছের পাগল।
সৌজন্য দেখিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চারপাশে তাকাল। বিশাল এক পারলারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। দেয়ালে ঝোলানো অসংখ্য ছবি, সোনালি ফ্রেমে বাঁধাই, ঠাই নেই ঠাই নেই অবস্থা। এককোণে বুককেস আর সাইডবোর্ডের মাঝের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে গ্রীক যোদ্ধার একটা মার্বেলে তৈরি বিশাল মূর্তি।
এই সময় দরজার ঘন্টা বাজল।
ডিন, রান্নাঘর থেকে আরও কয়েকটা কাপ নিয়ে এসো, প্লীজ, ডায়না বলল। তারপর এক্সকিউজ মি, বলে দরজা খুলতে এগোল।
কালেকশনগুলো দেখলে এসো, তিন গোয়েন্দাকে আমন্ত্রণ জানালেন নরিয়েমা। ডায়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, এগুলো এখানে রাখা ঠিক না, মিউজিয়ামেই ভাল। তবে এখানে যতক্ষণ আছে দেখতে অসুবিধে নেই। এসো।
ঘরের মাঝখান থেকে শুরু করে মার্বেলের মৃর্তিটার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা টেনিস কোর্টের সমান খাবার টেবিল। সেটার দিকে লোলুপ নয়নে একবার তাকিয়ে নরিয়েমার সঙ্গে পুরানো সাইডবোর্ডটার দিকে এগোল মুসা।
খোদাই করা কাঠের বেদির ওপর রাখা হয়েছে একটা কাঁচের বাক্স। ওটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চামড়ার জ্যাকেট পরা দুজন তরুণ আর একজন তরুণী।
এক্সকিউজ মি, নেলি, মেয়েটাকে বললেন ডক্টর।
সরে দাঁড়াল তিনজনেই।
এগিয়ে গিয়ে আঙুল তুলে বাক্সের ভেতরটা দেখালেন তিনি। ভেতরে বেগুনী মখমলের গদির ওপর শুয়ে আছে চমৎকার একটা ছুরি। লম্বা ফলা, আর মূল্যবান পাথর বসানো সোনার বাট ঝকঝক করছে উজ্জ্বল আলোয়।
মরগান কালেকশনের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস এটা, নরিয়েমা জানালেন। বোরজিয়া ড্যাগার। নিশ্চয় নাম শুনেছ।
ও, এটাই? সাংঘাতিক! বলে বাক্সের ডালা তুলে ছুরিটা বের করে আনল নেলি।
হঠাৎ গমগম করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ, বলেছিলাম না, এই রকমই করবে। করছে কি দেখো না! খেলনা ভেবেছে এত দামী দুর্লভ জিনিসগুলোকে?
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। ছুটে আসছে জুভেনার, পেছনে ডায়না। নেলির হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিল কিউরেটর।
বাধা দিয়ে তখন অন্যায় করেছি, মিস মরগান, জুভেনার বলল। ভাবলাম, যাই। গিয়ে মাপ চেয়ে, শান্ত ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি আপনাকে, যে এ সব জিনিস ঘরে রাখা ঠিক নয়। ইশারায় ছুরিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, দাম কল্পনা করতে পারেন ওটার?
মিষ্টি হাসল ডায়না। নিশ্চয়ই। ছুরিটা বের করে হাতে নিল সে। ফলাটা ওপরের দিকে তুলে ধরে ওটা নিয়ে এগোল খাবার টেবিলের দিকে, মেহমানরা যেখানে রয়েছে। চোখের পলকে থেমে গেল গুঞ্জন। একেবারে চুপ সবাই, ফিসফিসানিটুকুও নেই।
স্তব্ধতা ভাঙতে ভয় লাগছে যেন, এমনি ভঙ্গিতে খুব নরম গলায় বলল এক তরুণ, ডায়না, অভিশাপের কথা ভুলে গেছ! ওটার মালিক…
ঝটকা দিয়ে পেছনে মাথা কাত করে ফেলল ডায়না, নেচে উঠল লাল চুল। হা-হা করে হাসল সে। জুভেনারের দিকে ফিরে ছুরিটা তার বুকে বসিয়ে দেয়ার ভান করে বলল, জুভেনার, খুব খিদে পেয়েছে মনে হয়? দেব খাইয়ে?
সাদা হয়ে গেল কিউরেটরের মুখ।
ছুরি দিয়ে এক টুকরো পনির কাটল ডায়না। সেটাকে ছুরির মাথায় গেঁথে বাড়িয়ে দিল জুভেনারের দিকে। মুখে ব্যঙ্গের হাসি।
আধ সেকেন্ড পর দপ করে নিবে গেল ঘরের সমস্ত বাতি। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল বাজনা। নিঃশ্বাস ফেলতে যেন ভুলে গেছে পার্টির সব লোক, যেন কোনদিনই আর ফেলতে পারবে না।
অন্ধকারে ধড়াস করে পড়ে গেল কি যেন!
তারপরেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার!
ডায়নার!
.
০৪.
আবার আলো জ্বলল। দেখা গেল, মার্বেলের মূর্তিটা ভেঙে পড়ে আছে মাটিতে। সাইডবোর্ডের খানিকটা ভাঙা। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কাঁচের টুকরো।
সাইডবোর্ডের নিচে জবুথুবু হয়ে বসে আছে ডায়না। চেহারা সাদা। হাতে ধরে রেখেছে এখনও ছুরিটা।
তার পাশে গিয়ে বসল কিশোর, মুসা আর ডক্টর নরিয়েমা।
লেগেছে কোথাও? ডায়নাকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মূর্তির টুকরোগুলোর কাছে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে জুভেনার, গেল তো তেইশশো বছরের পুরানো… গলা ধরে এল তার। মূর্তির শোকে চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।
ভয় পেয়ে গেছে ডায়না। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। ফুঁপিয়ে উঠে হাত থেকে ছেড়ে দিল ছুরিটা। তারপর লাফিয়ে উঠে এসে আঁকড়ে ধরল কিশোরের হাত, আরেকটু হলেই মারা গেছিলাম আজ!
গুঞ্জন করে উঠল মেহমানরা।
গলায় সহানুভূতি ঢেলে কিশোর বলল, কিছুই হয়নি আপনার। আসুন। বসুন এখানে।
একটা সোফায় প্রায় জোর করে ডায়নাকে বসিয়ে দিল সে। তারপর চারপাশে তাকাতে লাগল। অস্বস্তি বোধ করছে।
এই যে, কি হয়েছে? ওপর থেকে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ।
চোখ তুলে কিশোর দেখল, ডিন কথা বলছে। দাঁত বের করা সেই ঝকঝকে হাসিটা উধাও, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে।
অ্যাক্সিডেন্ট, কিশোর জবাব দিল।
কিছুই বুঝতে পারছি না, ডিন, ডায়না বলল। আলো নিবে গেল। কে যেন ফেলে দিল রোমান মৃর্তিটা…
রোমান না, গ্রীক! শুধরে দিল জুভেনার। মূর্তি ভাঙার কষ্ট সইতে না পেরে দুহাতে মাথা চেপে ধরে মেঝেতেই বসে পড়েছে।
ছুরিটা তুলে নিয়ে গিয়ে আবার কাঁচের বাক্সে ভরে রাখল রবিন।
একটা তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এলেন নরিয়েমা। ডায়নার পাশে বসে তার কপালে চেপে ধরলেন। তাদেরকে ঘিরে দাঁড়াল মেহমানেরা।
ডায়নার হাত ধরে স্নেহের হাসি হেসে কোমল গলায় ডক্টর বললেন, দেখো, ভয়ের কিছু নেই। কুসংস্কার বিশ্বাস করা উচিত না। ওসব অভিশাপ-টভিশাপ সব ফালতু। মেহমানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন আবার। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করে বসে আছে দেখছি।
ঢোক গিলল ডায়না। ভুরুর ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অভিশাপের কথা জানো তুমি, নরিখালা?
ওসব চিন্তার দরকার নেই এখন।
প্লীজ, খালা, আমি ভয় পাব না। তুমি বলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নরিয়েমা। বেশ, শুনতেই যখন চাও… সোফায় হেলান দিলেন তিনি। চুপচাপ ভাবছেন যেন কোথা থেকে শুরু করবেন। আরও কাছে ঘেঁষে এল মেহমানেরা।
কুসংস্কার বিশ্বাস করলে এই গল্প শুনে ভয়ই পাবে মানুষ, বলতে শুরু করলেন ডক্টর। ষোলোশো শতকে ইটালির অত্যন্ত ধনী আর ক্ষমতাশালী পরিবার ছিল রেজিয়ারা। তাদের কয়েকজন তো ছিল ভয়াবহ, প্রায় উন্মাদ। আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি। ইতিহাস অবশ্য স্বীকার করে না সে কথা। তবে লোকের মুখ তো আর বন্ধ থাকে না। গুজব ছড়ায়ও বেশি এবং রঙ ছড়িয়ে। কিংবদন্তী আছে, বোরজিয়াদের যে লোকটার নাম শুনলেই কেঁপে উঠত লোকে, তার নাম অবমান্ডো বোরজিয়া। ডিউকের ভাইপো ছিল বেসমেন্টে চমৎকার একটা কালেকশন ছিল তার, স্টাফ করা মানবদেহের কালেকশন।
মুসা লক্ষ করল, কেঁপে উঠছে ডায়না।
ডায়নার কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিন ডক্টর, অমন করছ কেন? এটা নিছকই গল্প, একটা হরর স্টোরি আরকি, আর কিছু নয়া। ঠিক আছে, ভয়ই যখন পাচ্ছ, আর বলব না!
না না, বলো! আমি ভয় পাব না
ডানার চেহারার ভয় ভয় ভান চোখ এড়াল না মুসার বুঝতে পারল, গল্পটা চলতে থাকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে মেয়েটা।
ব্যাপারটা নিয়েও লক্ষ করলেন। বললেন, অনেক সময় ভয়ের গল্প পুরোটা এনে ফেললে ভয় কেটে যায়। বলেই ফেলি।
হ্যাঁ, বলো তুমি, ডায়না বলল। আমি ভয় পাব না।
আবার গল্প বলতে লাগলেন ডক্টর, বলা হয়, আরমান্ডো বোরজিয়া ছিল ইটালির সবচেয়ে নিষ্ঠুর জমিদার। এমন ভাবে করের বোঝা চাপিয়ে দিত গরীব প্রজাদের ওপর, সেটা শোধ করতেই হিমশিম খেয়ে যেত তারা। কোনদিনই পুরোপুরি শোধ করতে পারত না। বিয়ে করেছিল অনেকগুলো। যতক্ষণ ভাল লাগত, রাখত। অপছন্দ হলেই ঘাড় ধরে বের করে দিত রাস্তায়। এমনকি তখনকার বিখ্যাত সুন্দরী ম্যারিজল অ্যাগ্রোর বরাতেও এইই জুটেছিল…
ছুরিটার কথা বলো, খালা। এ সব শুনতে ভাল লাগে না।
হ্যাঁ, বলছি। নিজের প্রাসাদ আর বাগানের বাইরে খুব কমই বেরোত আরমাভো। একদিন বেরিয়ে ভীষণ চমকে গেল। রাস্তায় শুধু ভিখিরি আর ভিখিরি। এক সময় ভালই ছিল লোকগুলো, জমিজমা ছিল, ওদেরকে পথে নামতে বাধ্য করেছে আরমান্ডোই, এ কথা জানা ছিল না তার। জানার চেষ্টাও অবশ্য করল না। তার কাছে মনে হলো ওগুলো শুধুই জঞ্জাল, মানব-জঞ্জাল।
মেরে ফেলল? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ডায়না।
সব কজনকে, এক এক করে। ওদেরকে প্রাসাদে দাওয়াত দিল সে। গোসল করতে দিল, পেট ভরে খাওয়াল। কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে চোখে পানি এসে গেল ওদের। তারপর ওদেরকে মদের ভাড়ার দেখার দাওয়াত দিল আরমান্ডো। দেখতে নামল ওরা, কিন্তু একজনও উঠতে পারল না আর। শোনা যায়, প্রত্যেকটা মানুষকে আরমান্ডো খুন করেছে একটা রত্নখচিত ছোরা দিয়ে। হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়েছে ছুরি। লাশগুলো ফেলে রেখেছে মাটির নিচের ঘরে। সাতদিন পর একটামাত্র কবরে দাফন করা হয়েছিল ওগুলো।
চোখের কোণ দিয়ে কিশোর দেখল, ঝড়ের গতিতে হলুদ প্যাডে লিখে যাচ্ছে। সোসাইটি কলামিস্ট।
বাইরের কেউ কিছু জানল না, বলে গেলেন ডক্টর নরিয়েমা। তবে সবাই একদিন দেখল, রাস্তা ভিখিরি মুক্ত হয়ে গেছে। একজনও নেই।
হঠাৎ খাদে নেমে গেল ডক্টরের কণ্ঠ। শ্রোতারা ভালমত শোনার জন্যে আরও কাছে সরে এল।
একরাতে তন্দ্রা লেগেছে আরমান্ডোর। তার দরজা খুলে গেল। সে ভাবল, চাকর। ঘুমের ঘোরেই গাল দিয়ে পাশ ফিরল সে। কিন্তু চাকর নয়। মাটির নিচের ঘরে নিয়ে যাওয়া এক ভিখিরি। ছুরিটা তার হৃৎপিণ্ডে লাগেনি, ফলে মরেনি সে। একে জখম, তার ওপর না খেয়ে খেয়ে কাহিল হয়ে পড়েছে। তবু শরীরে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে কোনমতে উঠে এসেছে ভাড়ার থেকে। রক্তমাখা ছুরিটা ফেলে এসেছিল আরমাভো, সেটা তুলে নিয়ে এসেছে ভিখিরি।
কিন্তু আরমান্ডোর বেডরূম চিনল কি করে, বালা? ডায়নার প্রশ্ন। প্রাসাদটা নিশ্চয় অনেক বড় ছিল, আর অনেক ঘর ছিল…
ছিল। অন্য কেউ হলে হয়তো চিনত না। কিন্তু ভিখিরি আসলে ভিখারিনী। ম্যারিজল। আরমান্ডোর ত্যাগ করা স্ত্রীদের একজন। রাস্তায় থেকে থেকে শেষ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। চেহারা শরীর সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আরমান্ডোও চিনতে পারেনি তাকে ছুরি মারার সময়। জানালা দিয়ে তখন চাঁদের আলো আসছে। ছুরি মারার সময় আরমাভোর নাম ধরে এত জোরে গাল দিয়েছিল ম্যারিজল, লোকে বলে, সেই শব্দে জানালার কাঁচ নাকি চুরচুর হয়ে গিয়েছিল।
পারলারে স্তব্ধ নীরবতা। থমথমে পরিবেশ। সবাই যেন শুনতে পাচ্ছে নিজেদের হৃৎপিরে ধুকপুকানি।
চাকরেরা এসে দেখল, নরিয়েমা বললেন, বিছানায় পড়ে আছে দুটো লাশ। মরার আগে নিজের নিয়তি বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হয়েছিল আরমাভো। বড় বড় হয়ে গিয়েছিল চোখ। তার কপালে ছুরি দিয়ে কেটে একটা অক্ষর, বি লিখে দিযেছিল ম্যারিজল। বি বোরজিয়ার নামের আদ্যক্ষর। নাকি ব্যাড বোঝাতে চেয়েছিল সে-ই জানে। এরপর থেকেই গুজব রটে যায়, ওই ছুরিটার মালিক যে-ই হবে, ছোঁয়ার চার মাসের মধ্যেই অপঘাতে মৃত্যু হবে তার।
শ্রাগ করলেন ডক্টর। ফিক করে ছোট্ট একটা হাসি দিলেন। আরে, মুখ অমন করে কেন রেখেছ তোমরা? এ-তো একটা গল্প। সত্যি না-ও হতে পারে। আর অভিশাপের কথা যে ঠিক নয়, তার তো প্রমাণই রয়েছে। কত দিন ধরে মিউজিয়ামে রইল ছুরিটা, কিন্তু কই, মালিক তো মরল না। কি বলেন, জুভেনার?
টেনেটুনে টাইয়ের নট ঢিলে করল কিউরেটর। আমতা আমতা করে বলল, সত্যি কথাটাই বলি। মিউজিয়ামে থাকার সময় কেউ ওটা ছুঁতে সাহস করেনি।
*
মেহমানদের যাবার সময় হলো।
ডায়না বলল, নরিখালা, গেস্টদের এগিয়ে দিয়ে এসো, প্লীজ। আমি এখানেই থাকি। শরীরটা ভাল্লাগছে না!
নিশ্চয়ই, ডক্টর নরিয়েমা বললেন। এত ভয় কেন? কিচ্ছু হবে না, দেখো। সব ফালতু কথা।
আমরা আরও কিছুক্ষণ থাকি? অনুরোধের সুরে বলল কিশোর। সাহায্য টাহায্য লাগতে পারে।
আড়চোখে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, ওদের মনোভাবটা কি। মুখ দেখেই বুঝল, সম্মতি আছে।
ডায়নাও আপত্তি করল না।
মেহমানদের মধ্যে প্রথম যে মানুষটা বেরিয়ে গেল, সে কিউরেটর জুভেনার। রাগে, ক্ষোভে গটমট করে চলে গেল সে। তারপর একে একে গেল অন্যেরা। সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন ডক্টর নরিয়েমা, ডায়নার হয়ে গুডবাই জানাচ্ছেন সবাইকে।
পার্টিতে কাজ করার জন্যে ভাড়া করে তোক আনা হয়েছে। ওদেরকে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। টেবিল থেকে সমস্ত বাসন-কোসন সরাতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল না। সোফাতেই গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ডায়না। অভিশাপের ভয়ে কাবু হয়ে গেছে। তাকে বিরক্ত করল না গোয়েন্দারা। বেরিয়ে এল বারান্দায়।
কি ভাবে থাকা যায় এখানে বলো তো? কিশোর বলল। খানসামা-টানসামা হয়ে যাব নাকি?
মুসা বলল, থাকাটা কি ঠিক হবে? ছুরির গল্পটা শুনলে না! রোম খাড়া করে দেয়।
আমার কাছে যেন কেমন কেমন লাগছে! কিশোর বলল।
জুভেনারের কথা বলছ? রবিনের প্রশ্ন। ও এখানে আসার আগে কিন্তু সব ঠিকঠাকই ছিল।
হ্যাঁ। আর ডায়না এত ভয় পাচ্ছে দেখেও গল্পটা চালিয়েই গেলেন ডক্টর নরিয়েমা। থেমে যাওয়া উচিত ছিল। না বললেও পারতেন।
একবার ভেবেছি, নিষেধ করি বলতে… থেমে গেল মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বাড়ির পাশের দিকে।
কি হলো?
শশশ! সার্ভেন্টস কটেজ!
ঘুরে তাকাল কিশোর। কটেজের জানালা গলে কালো পোশাক পরা একটা মূর্তিকে নামতে দেখল। বাড়ির সামনের দিকে যাচ্ছে, ফিসফিসিয়ে বলল সে। চলো, চমকে দিই।
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়ল তিনজনে। ঝোঁপঝাড়ের অভাব নেই। লুকিয়ে পড়ল একটার ভেতরে।
আমাদের দেখল নাকি? মুসার প্রশ্ন।
বোঝা যাবে এখুনি।
বোঝা গেল। হঠাৎ বরফের মত জমে গেল তিন গোয়েন্দা।
ঠিক ওদের মাথার পেছনে ধরা একটা সিলভার-প্লেটেড রিভলভারের নল।
বেরিয়ে এসো, মোলায়েম গলায় আদেশ হলো। ছায়ার কাছ থেকে সরে গেল লোকটা, কিন্তু রিভলভার উদ্যতই রয়েছে। ট্রিগার ছুঁয়ে আছে আঙুল। বার্ব এনুডা।
.
০৫.
গুলি করার দরকার নেই, হাত তুলে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল মুসা।
সাহস আছে তোমাদের, বলল এনুডা। তবে একটা উপদেশ মনে রাখবে। এ কথা যেন ডায়না না শোনে…
কে ওখানে? সিঁড়ির ওপর থেকে জিজ্ঞেস করল ডায়না। বার্ব, করছ কি? ওটা নামাও!
না, নামাব না! তোমার সব কথাই মানতে হবে নাকি?
ডায়নার পাশে এসে দাঁড়াল ডিন। এনুডার হাতে রিভলভার দেখে ভয় দেখা দিল চোখে। এই, সরাও, সরাও ওটা?
খবরদার! ওভাবে কথা বলবে না আমার সঙ্গে! ডায়না….
তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, বার্ব, কোমল কণ্ঠে বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল ডায়না। হাত বাড়িয়ে দিল। দাও। নইলে আবার পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে। এবার কিন্তু আর বাঁচাতে পারব না। বেআইনী ভাবে ঢুকে চুরির দায়ে হাজতে ঢোকাবে।
চুরি! চমকে গেল এডা। এটা তোমার আব্বা আমাকে দিয়েছেন, তুমি জানো। এখানে ফেলে গিয়েছিলাম। আমার জিনিস আমি নিতে এসেছি, একে কি চুরি বলে? হঠাৎ নাটকীয় ভাবে নষ্টটা নিজের মাথায় ঠেসে ধরল সে। থাক, আর কাউকে মরতে হবে না, আমিই মরব। এইবার আর আমাকে বাঁচাতে পারবে না কেউ…
মরতে চাইলে কিছু গুলি কিনে আনতে হবে তোমাকে। আশ্চর্য শান্ত ডায়নার কণ্ঠ। আব্বা এটা তোমাকে দিয়েছিলেন চোর-ঘঁচোড়কে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যে। গুলি ভরে দেননি, আমি জানি। আর দ্বিতীয় কথা হলো, এটা তোমাকে একেবারে দিয়ে দেননি আব্বা। আর আব্বার জিনিস মানেই আমার জিনিস। পুলিশের সঙ্গেও তোমার সম্পর্ক ভাল না। কাজেই বুঝতেই পারছ, হাতের তালু মেলে ধরল ডায়না। প্লীজ!
চঞ্চল হয়ে উঠল এনুডার চোখের তারা।
দিয়ে, ভাগো এখান থেকে, সিঁড়ির গোড়ায় ডায়নার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ডিন। গিয়ে ঘুমাও। বিশ্রাম দরকার তোমার।
নেহায়েত নিরুপায় হয়েই যেন অস্ত্রটা নামাল এমুডা। বেশ, গলা কাঁপছে তার, জাহান্নামেই ফিরে যাচ্ছি আমি! বাড়ি তো না, নরক! গুলি খেয়ে নাহয় নাই মরলাম। মরার আরও পথ আছে। শুয়ে শুয়ে গিয়ে সেই উপায়ই ভেবে বের করব এখন।
যেন ছবিতে অভিনয় করছে, এমন ভঙ্গিতে রিভলভারটা ডায়নার ছড়ানো তালুতে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এনু। লম্বা লম্বা কদমে হাঁটতে শুরু করল ড্রাইভওয়ে ধরে।
সে চোখের আড়ালে চলে গেলে ডায়নাকে বলল কিশোর, একা থাকতে আপনার অসুবিধে হবে না তো? আমরা…
একা থাকছে না ও, বাধা দিয়ে বলল ডিন। আজ রাতে যাচ্ছি না। আমি থাকছি, ডক্টর নরিয়েমা থাকবেন। কাল যাতে সারাদিন ক্লাবে গিয়ে মন ভাল করতে পারে ডায়না, সেই ব্যবস্থাও করব। ওর কোন অসুবিধে হবে না।
বেশ, বলে দুই সহকারীর দিকে ফিরল কিশোর। এসো, যাই। গুড নাইট, ডায়না। দাওয়াতের জন্যে ধন্যবাদ।
এসেছ, খুশি হয়েছি। সময় পেলে আবার এসো। যে কোন সময়।
পিকআপে এসে উঠল ওরা।
কিশোর বলল, যে কোন সময় এমো কথাটা কি সত্যি সত্যি বলল? নাকি কথার কথা?
কিছু একটা ভাবছ তুমি, রবিন বলল। কি, বলো তো?
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। বড় ধরনের কোন একটা গোলমাল ঘটছে এখানে। গোলমালটা কি ঠিক বুঝতে পারছি না।
চলতে শুরু করেছে গাড়ি। মুসা চালাচ্ছে। সামনের পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিকই বলেছ। এডাকেই বেশি সন্দেহ হচ্ছে। তার পাগলামিটা অভিনয়ও হতে পারে।
হ্যাঁ। ফিউজ বক্সটা কোথায় আছে, তার জানার কথা। আলো নেভাতে অসুবিধে হবে না তার। আর রিভলভার নিতে এসেছে রাতের বেলা চুরি করে, এটাও খোঁড়া যুক্তি মনে হয়েছে আমার।
তবে সে একলা পারেনি, দুজনের দরকার। সে যদি আলো নিভিয়ে থাকে, মূর্তিটা ঠেলে ফেলেছে আরেকজন। আরেকজন কে, বোধহয় আন্দাজ করতে পারি…
জুভেনার! বলে উঠল রবিন।
পথে আর কথাবার্তা তেমন হলো না। মুসা নীরবে গাড়ি চালাল, আর চুপচাপ বসে বসে ভাবল কিশোর। রবিন পেছনের সীটে বসে চিলতে একটুকরো ঘুম দিয়ে নিল।
কিশোর ভাবল, শুধু ডায়নাকে ভয় দেখানোর জন্যেই ওরকম একটা দুর্লভ মূর্তি ভেঙে ফেলল জুভেনারের মত অ্যানটিক-পাগল একজন মানুষ? আর যদি এনুডার কাজই হয়ে থাকে, কাজ সেরেই পালাল না কেন সে, দেখা দেয়ার জন্যে কেন বসে থাকল?
আরও অনেক প্রশ্ন জাগল তার মনে। জবাব মিলল না কোনটারই। ভাবছে মুসাও। দুজনের ভাবনার মধ্যে একটা ব্যাপারে মিল রয়েছে সেটা হলো, বোরজিয়া ড্যাগারের অভিশপ্ততার কাহিনী কি শুধুই গল্প? না কিছুটা সত্য রয়েছে এর মধ্যে?
*
কিশোর, ওই ডক্টর মহিলাকেও কিন্তু খুব একটা সুবিধের লাগেনি আমার। এত কথা বলতে গেল কেন? রবিন বলল কিশোরকে।
ফ্রিজ থেকে খাবার বের করছে কিশোর। স্যান্ডউইচ। ফলের রস।
কথা হচ্ছে কিশোরদের বাড়িতে। পরদিন সকালে। খাবার বের করে নিয়ে রান্নাঘরের টেবিলে এসে বসল কিশোর। রবিনের প্রশ্নের জবাব দিতে যাবে, এই সময় ঘরে ঢুকল মুসা। শুরু করে দিয়েছ দেখি তোমরা। দেরি করে ফেললাম না তো? খাওয়ার আগে, না পরে?
ঠিক সময়েই এসেছ। এসো, বসে পড়ো, কিশোর বলল।
তা জরুরী তলব কেন? চেয়ারে বসতে বসতে বলল মুসা।
যাব এক জায়গায়।
কোথায়? আবার ডায়নার ওখানে?
নাহ, ভাবছি মিউজিয়ামে যাব
সরু হয়ে এল মুসার চোখের পাতা। কি দেখতে যাবে? অ, বুঝেছি। জুভেনারের সঙ্গে কথা বলতে। দেখো কিশোর, আমার ভাল্লাগছে না। কেস আমরা অনেক পাব ভবিষ্যতে। কিন্তু অভিশপ্ত ওই ছুরির কুদৃষ্টিতে না পড়লেই কি নয়?
অভিশপ্ত বলেই তো তদন্তটা আরও বেশি করে করব। দেখব, সত্যি সত্যি অভিশাপ বলে কিছু আছে কিনা।
*
মিনিট কয়েক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
কিশোর আর মুসা ইয়ার্ডের একটা পিকআপে উঠল।
রবিন ওদের সঙ্গে যাবে না। সে বাড়ি যাবে। জরুরী কাজ আছে। সে গেটের দিকে এগোল।
এঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। পাশে বসা কিশোরের দিকে তাকাল। আগে কোথায় যাব?
রকি বীচ মিউজিয়াম।
গাড়িটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাল রবিন।
*
মিউজিয়ামের কাছাকাছি এসে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়ল ওদের, তা হলো পার্কিং লট প্রায় শূন্য।
রোববারে তো খোলাই থাকে, তাই না? মুসার প্রশ্ন।
থাকে। ঘড়ি দেখল কিশোর। এগারোটা তিরিশ। এখন লোকের কাজের সময়।
ভ্যান থামাল মুসা। গাড়ি থেকে নেমে মিউজিয়ামে ঢুকল দুজনে। টিকিট কেটে এসে ঢুকল মেইন একজিবিট রূমে।
ঢুকেই বুঝতে পারল জুভেনারের এতখানি মর্মপীড়ার কারণ। দেয়ালগুলো প্রায় শূন্য। বড় বড় ছবি ঝোলানো ছিল ওসব জায়গায়, দাগ দেখেই বোঝা যায়। অসংখ্য কাঁচের বাক্স খালি পড়ে রয়েছে। এক কোণে আরামে চেয়ারে বসে দিবান্দ্রিা দিচ্ছে মিউজিয়ামের দারোয়ান।
কবরও তো এর চেয়ে ভাল! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।
জিনিস নেই, কে আসবে পয়সা খরচ করে? মরগানদের কালেকশনগুলোই ছিল এই মিউজিয়ামের মেরুদণ্ড।
ওদের পেছনে হলওয়েতে পদশব্দ শোনা গেল।
বাড়ি চলে যাও, নিরো, বলে উঠল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
চমকে জেগে গেল দারোয়ান।
বসে থেকে আর কি করবে। ভাবছি, বন্ধই করে দেব… কিশোর-মুসার ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল কিউরেটর। আরি, দর্শক আছে দেখছি! অন্তত আজকের ইলেকট্রিক বিলের পয়সাটা পাওয়া গেল। কেন এসেছ তোমরা? মিউজিয়াম দেখতে? নাকি ডায়না পাঠিয়েছে। আবার কিছু নষ্ট করেছে?
মূর্তিটার জন্যে সত্যিই খারাপ লাগছে, মিস্টার জুভেনার, সহানুভূতি দেখিয়ে বলল কিশোর। আমরা এসেছি আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করতেই।
আমার সঙ্গে দেখা করে আর কি হবে! চুপ হয়ে গেছে জুভেনার। একবার কিশোরের দিকে, আরেকবার মুসার দিকে তাকাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে কিছু। অবশেষে হাত নাড়ল, এসো। বরং আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলি।
হল পেরিয়ে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। চৌকাঠের ওপরে সাদা পাস্টিকের ফলকে লেখা: অথরাইজড পার্সনস ওনলি।
ভেতরে মস্ত অফিস, ছয়টা ডেস্ক। ঘরের অন্য প্রান্তে ওদেরকে নিয়ে এল জুভেনার। আরেকটা দরজা পড়ল, পুরোটাই কাঁচের। তার ওপাশে কয়েকটা আলাদা আলাদা অফিস, প্রতি রূমে একজন করে বসার ব্যবস্থা।
নিজের অফিসে ঢুকল জুভেনার। কিশোররা ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিল। জানালার পর্দা টেনে দিল।
বসো। তা তোমাদের কথাটা আগে বলো। কি জানতে চাও?
প্রথমেই আপনার মিউজিয়ামটার কথা বলুন, অনুরোধের সুরে বলল কিশোর।
ডেস্কে কনুই রেখে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকল জুভেনার। দেখো, সোজা করেই বলি। মিউজিয়ামের এখন সময় খুবই খারাপ। টেকে কিনা সন্দেহ। জিনিসগুলো ফেরত না পেলে লোকে দেখতে আসবে না। নেইই কিছু, কি দেখতে আসবে? লোক না এলে বিগড়ে বসবে কোম্পানি আর এজেন্সিগুলো, আমাদেরকে ফান্ড দিতে চাইবে না আর। কতবড় সর্বনাশ হয়ে যাবে ভাববা! আর এর সব কিছুর
মূলে ওই ডায়না মরগান। বেআইনী ভাবে জিনিসগুলো জোর করে নিয়ে গেছে। সে।
দলিলটা খুঁজে বের করতে বলেন আমাদেরকে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
না, চেয়ারে হেলান দিল জুভেনার। লোক লাগিয়ে দিয়েছি আমি। পাবে কিনা জানি না। আমার ভয় হচ্ছে, একেবারেই হারিয়ে গেছে ওটা, কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে। ফেরত পাব না। চুপ করে থাকল এক মুহূর্ত। অন্য কথা ভাবছি আমি। তোমরা তো ডায়নার বন্ধু?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তবে পরিচয়টা নতুন হয়েছে।
নতুন হলেও তোমাদেরকে বেশ গুরুত্ব দেয় ডায়না, দেখেই বুঝেছি আমি। তোমাদেরকে একটা কাজ করে দেয়ার অনুরোধ করব আমি। ডেস্কের সবচেয়ে ওপরের ড্রয়ারটা খুলল কিউরেটর। মিউজিয়ামের একটা ইমারজেন্সী ফান্ড আছে। খুব অল্পই টাকা। কয়েক বছর ধরে তিল তিল করে জমানো হয়েছে। এতদিন ওটা থেকে খরচের দরকার পড়েনি কখনও। এই টাকাটা আমি তোমাদের দিয়ে দেব। বিনিময়ে তোমরা ডায়নাকে বোঝাবে কালেকশনগুলো আবার মিউজিয়ামকে ফেরত দিতে। কি করে বোঝাবে জানি না আমি, কিন্তু বোঝাবে।
ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করল সে। বেশ পুরু। মুখ খুলে উপুড় করল ডেস্কের ওপর। ঝরে পড়ল অনেকগুলো কড়কড়ে একশো ডলারের নোট।
দশ হাজার ডলার আছে এখানে। আমার কাজটা করে দাও। এগুলো সব তোমাদের হবে।
.
০৬.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা।
তারপর কথা বলল কিশোর, দশ হাজার ডলারের বিনিময়ে, আপনি বলছেন ডায়নার সঙ্গে কথা বলব আমরা। দরকার হলে তার বাড়িতে থাকব। একসঙ্গে বসে খাবার খাব। তাকে বোঝাব কালেকশনগুলো ফেরত দিতে।
হ্যাঁ, হাসল জুভেনার।
তারমানে ঘুস দিচ্ছেন।
ঘুস ভাবছ কেন? বরং ভাবো না, তোমরা একটা কাজ করে দিয়ে টাকাটা কামিয়ে নিচ্ছ।
চেয়ারে হেলান দিল দুজনেই। কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কি বুঝলে?
যা বোঝার বুঝলাম, কিশোর বলল।
অস্বস্তিতে পড়ে গেল জুভেনার। ওদের কথাবার্তার মানে বুঝতে পারছে না। দেখো, দশ হাজার ডলার অনেক টাকা, অনেক কিছু কিনতে পারবে তোমরা। এই বয়েসে কত কিছুই তো কিনতে ইচ্ছে করে। দুজনের মুখের দিকে তাকাল একবার করে। তোমাদের বয়েসে আমি হলে এক লাফে রাজি হয়ে যেতাম।
কিন্তু আমরা ওরকম লাফাতে রাজি নই, জবাব দিয়ে দিল কিশোর।
বুঝেছি, আরও বেশি চাও! রেগে গেল জুভেনার। থাবা মারল ডেস্কে। এত্তো লোভ! ওই মেয়েটার মতই চামার! সব এক! কি ভেবেছ এটাকে? ব্যাংক…
আপনি ভুল করছেন, আর চুপ থাকতে পারল না মুসা। দশ হাজার অনেক টাকা। কিন্তু ঘুস দিয়ে কিনতে পারবেন না আমাদের। মানুষের জন্যে কাজ আমরা করি, তবে অন্য ভাবে।
কোন্ ভাবে শুনি?
আর যে ভাবেই হোক, বেআইনী ভাবে নয়।
কোনটাকে বেআইনী বলছ? মুসার দিকে আঙুল তুলে বাতাসে খোঁচা মারল জুভেনার। ডায়না যে কাজটা করল, সেটা বেআইনী নয়?
আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি আমরা, মিস্টার জুভেনার, কিশোর বলল। বুঝি, কালেকশনগুলোর কোন দরকার নেই ডায়নার। কিন্তু মিউজিয়ামের আছে। আমি সত্যিই চাই, দলিলটা আপনি পেয়ে যান। আর যদি না পান, আদালতে গিয়ে নালিশ করুন…
স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল জুভেনার। বেরোও! দরজা দেখাল সে। ভাগো! আর যেন এখানে না দেখি! আমাকে উপদেশ দিতে আসো! মাসের পর মাস ধরে শুধু আদালতে যেতে থাকি আর আসতে থাকি আমি। আর ওদিকে সব ভেঙেচুরে জিনিসগুলোর সর্বনাশ করে দিক মাথামোটা মেয়েটা। পাগল!
বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা।
পেছনে এত জোরে দরজা বন্ধ করল জুভেনার, শব্দ শুনে মনে হলো বন্দুকের গুলি ফাটল।
*
এসে কোন লাভ হলো না, তাই না? মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে বলল মুসা। একসারি নিউজপেপার ভেনডিং মেশিনের পাশ দিয়ে চলেছে। ঘুস দিতে চায় আমাদেরকে! মরিয়া হয়ে গেছে লোকটা!
কয়েকটা খুচরো পয়সা মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়ে একটা রকি বীচ টাইমস-এর কপি বের করে নিল কিশোর। লোকটা ছ্যাচড়া!
কিন্তু খুন পর্যন্ত কি এগোবে? এত প্রিয় যে সব জিনিস, তারই একটা ভেঙে ফেলবে খুন করার জন্যে? ভাঙা মূর্তিটাকে দেখে তার মুখের কি অবস্থা হয়েছিল লক্ষ করেছ?
সেটা অভিনয়ও হতে পারে। নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্যে করে থাকতে পারে কাজটা। ডায়নাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে জিনিসগুলো ফেরত নেয়ার চেষ্টা হতে পারে। আর যদি মৃর্তি গায়ে পড়ে ডায়না মরেই যেত…
…আরও সহজ হয়ে যেত কাজটা। অনেকটা আপনা থেকেই জিনিসগুলো আবার ফিরে যেত মিউজিয়ামে।
ঠিক। চল বাড়ি যাই। কম্পিউটারের ক্রাইম ডাটা বেজ দেখি জুভেনারের কথা কি বলে। বেরিয়েও যেতে পারে চমকপ্রদ কোন তথ্য।
পিকআপে উঠল দুজনে।
পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে আনল মুসা।
সীটে হেলান দিয়ে খবরের কাগজটা খুলল কিশোর। হেডলাইনের দিকে তাকিয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ। এই, শোনো, শোনো! লিখেছে: অভিশাপ, না কাকতালীয় ঘটনা? অভিশপ্ত বোরজিয়া ড্যাগার ছুঁয়ে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছেন মরগানদের উত্তরাধিকারী?
রসাল গল্প লিখেছে মনে হয়। পড়ো তো শুনি।
গতরাতে ক্লিফসাইড হাইটসের মরগান ম্যানশনে এক সাংঘাতিক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে। তখন রাত প্রায় এগোরোটা। আকাশে ভরা চাঁদ, ঘরের ভেতরে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। যারা উপস্থিত ছিল ওখানে তখন, কেউ ভুলতে পারবে না…
বাহু, গরুও পেয়েছে, টিটকারির সুরে বলল মুসা, দুধও ভালই দুইয়েছে।
হ্যাঁ। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা লিখেছে এরপর। শেষটুকু পড়ি। কিছু মেহমান তখন বেরিয়ে গেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে ওরা। ওদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে, অভিশাপের কবল থেকে মুক্তি নেই মিস ডায়না মরগানের। মিস মরগানকেও বলতে শোনা গেছে-বাকি জীবনটা কি আমি এই অভিশাপ নিয়েই কাটাব? টাইমসকে কথা দিয়েছেন মিস মরগান, আজ ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে একটা সাক্ষাৎকার দেবেন…।
উচিত হবে না, আবার বাধা দিল মুসা। পত্রিকাওলাদের কাছ থেকে দূরে থাকা উহত ৩র, যেকথা বোঝাতে হবে। রিপোটাররা সারাক্ষণ লেগে থাকলে তদন্ত করতে অসুবিধে হবে আমাদের।
হ্যাঁ। বোয়জিয়া ড্যাগারেরও বিজ্ঞাপন হয়ে যাচ্ছে খুব বেশি। কে কখন আবার কোত্থেকে এর মালিকানা দাবি করতে চলে আসে কে জানে। ঝামেলা পাকাবে।
না-ও আসতে পারে। অভিশাপের ভয় আছে।
বাড়ি পৌঁছেই সোজা নিজেদের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে গেল দুই গোয়েন্দা।
কম্পিউটার নিয়ে বসল কিশোর। পাশে বসল মুসা।
জুভেনারের বিরুদ্ধে কিছুই বলল না কম্পিউটারের ডাটা বেজ।
মুসা বলল, বার্ব এনুডার কথা কি বলে, দেখো তো?
কিছুটা অবাক হয়েই পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। জোরে জোরে তথ্যগুলো পড়ল মুসা, বিশ বছর আগে এক দোকান থেকে এক টিন মাছ চুরি করেছিল…এগারো বছর আগে চেঁচিয়ে সংলাপ বলে পড়শীদের শান্তি নষ্ট করেছিল…দুই বছর আগে, নো-পার্কিং জোন থেকে একটা লিমোজিন গাড়ি সরানোর সময় একজন টো-ট্রাকের অপারেটরকে মেরে বসেছিল।
নাহ, খুনীর সারিতে পড়ে না, মাথা নাড়ল কিশোর।
বাইরে থেকে মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল, কিশোর, কিশোর!
তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে এল কিশোর ও মুসা।
তোর ফোন, মেরিচাচী বললেন। থানা থেকে করেছে। পল নিউম্যান।
দৌড় দিল দুই গোয়েন্দা।
রান্নাঘরে এসে ঢুকল।
রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর। হালো?
কে, কিশোর? পল নিউম্যান বলল। খবর শুনেছ?
কিসের খবর?
ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
ডায়না মরগান না তো? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। গুলি করা হয়েছে। ভাবলাম, খবরটা তোমাকে জানানো দরকার।
.
০৭.
ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। পিকআপে উঠল। টায়ারের ওপর অত্যাচার চালিয়ে গাড়ি ঘোরাল রবিন। ছুটল পুবমুখো।
রাস্তায় সাইনবোর্ড রয়েছে: এনটারিং ক্লিফসাইড হাইটস।
তারপর থেকে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে এলাকার চেহারা। শহরতলির ছিমছাম সুন্দর বাড়িগুলোর পরেই শুরু হয়েছে ঘন বন। রাস্তায় তীক্ষ্ণ মোড় রয়েছে, ফলে সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে মুসাকে। তবে কিছুতেই গতি কমাল সে।
বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আলসেদের জন্যে তৈরি করেছে এই রোড! এ ভাবে চালানো যায়?
আরও খানিকদূর এগিয়ে আরেকটা সাইনবোর্ড দেখা গেল। তাতে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে লেখা: সি সি সি। তীর চিহ্ন এঁকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোনদিকে যেতে হবে। বাঁয়ের খোয়া বিছানো পথটায় গাড়ি নামাল মুসা।
কায়দা-টায়দা তো বেশ ভালই করেছে।
করবে না? কিশোর বলল। এত দামী ক্লাব।
রাস্তার মাথায় বন কেটে সাফ করা হয়েছে। ঘোরানো একটা ড্রাইভওয়ে। হাসিখুশি, বাদামী ইউনিফর্ম পরা একজন লোক ওদের পথ আটকাল।
ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল মুসা। জানালার পাশে এসে দাঁড়াল লোকটা। কার কাছে…?
ডায়না মরগান, বলেই ব্রেক ছেড়ে দিল মুসা। লাফিয়ে সরে গেল গার্ড।
ক্লাবহাউসের সামনে এসে আবার জোরে ব্রেক কষল মুসা। পাথরের তৈরি তিনতলা একটা বাড়ি। চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। দুদিকের দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল দুজনে। পেছনে শুনতে পেল গার্ডের চিৎকার, এই শুনুন, শুনে যান!
কিন্তু কে শোনে কার কথা। সামনে কথা শোনা যাচ্ছে। বাড়ির পাশ ঘুরে এল দুজনে। বেশ বড় ছড়ানো একটা চতুর, ঘাসে ঢাকা, চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে বন। চত্বর না বলে মাঠই বলা যায় ওটাকে। মাঠের মাঝখানে অনেক মানুষ, কয়েকজন পুলিস অফিসারও আছে। ওদের কাছ থেকে দূরে একটা অস্থির ঘোড়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে জিনস পরা একজন লোক। আর ভিড়ের মাঝে সেই রিপোর্টারকে দেখা গেল, সোসাইটি কলামিস্ট, ঘুরে ঘুরে লোকের কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করছে।
বার বার এক্সকিউজ মি বলতে বলতে লোকজনকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে ভিড়ের মাঝখানে এসে ঢুকল কিশোর-মুসা। ডায়নাকে শুয়ে থাকতে দেখল ঘাসের ওপর। ফোপাচ্ছে। পাশে বসে আছেন ডক্টর নরিয়েমা। ভেজা একটা কাপড় দিয়ে তার কপালের রক্ত মুছে দিচ্ছে ডিন।
কেমন আছে ও? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মুখও তুলল না ডিন, কথাও বলল না। তবে ডক্টর হাসলেন। অ, তোমরা! তোমরাও যে মেম্বার, জানতাম না। ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে ডায়না। ভাগ্য ভাল, ব্যথা তেমন পায়নি।
পায়নি, পেতে পারত, থমথমে হয়ে আছে ডিনের মুখ। মরেও যেতে পারত। খুন করার চেষ্টা করেছে কেউ!
কি হয়েছে বলতে পারব না, কাঁপা গলায় বলল ডায়না। ভীষণ ভয় পেয়েছে। সাক্ষাৎকার দেয়ার পর থেকেই খারাপ লাগছিল। ভাবলাম, ঘোড়ায় চড়ে খানিকক্ষণ ঘুরলে ঠিক হয়ে যাবে। ঘুরছি, এই সময় শুনলাম গুলির শব্দ।
লেগেছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
না। ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠল। পড়ে গেলাম।
কে করেছে দেখেছেন? মুসার প্রশ্ন।
না, পুলিশকে বললাম…
দূরে চিৎকার করে উঠল কেউ। ঝট করে বনের দিকে ঘুরে গেল সব কটা চোখ। তিনজন পুলিশ অফিসার, দুজন লোক, আর একটা ছেলে বেরিয়ে এসেছে। একজন সিভিলিয়ানের হাতে সিলভারপ্লেটেড একটা রিভলভার। দুজন অফিসার জোর করে টেনে আনছে রবিনকে।
আরি! রবিন! মুসা অবাক।
অবাক কিশোরও হয়েছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না। ও কি করে এল!
হাতকড়া লাগিয়েছেন কেন? চিৎকার করছে রবিন। খুলুন, খুলুন বলছি! আমি কি করলাম?
অনেক কিছুই করেছ, একজন অফিসার বলল। বেআইনী ভাবে ঢুকেছ বনের ভেতর। এটা প্রাইভেট প্রপার্টি। হাতে রিভলভার। গুলি ছোঁড়া হয়েছে ওটা থেকে। অ্যারেস্ট করার জন্যে যথেষ্ট নয় কি?
কিশোর-মুসাকে দেখে উজ্জ্বল হলো রবিনের চোখ। কিশোর, ওদেরকে বলো না, আমি কে!
একজন অফিসার চিনে ফেলল কিশোরকে। বাহ্, গন্ধ পেয়ে গেছ! রবিনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা তোমাদের দলের নাকি?
হ্যাঁ, কিশোর বলল।
অফিসার বলল, আমাদেরকে ও অবশ্য তোমাদের কথা বলেনি। বলেছে, একটা জুনিয়র ডিটেকটিভ টীমের মেম্বার।
ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল রবিন। এই সময় ঘটল আরেক ঘটনা। ভিড় ঠেলে ভেতরে এসে ঢুকল দুজন গার্ড, ওদের মাঝে সেই লোকটাও রয়েছে, যে কিশোরদের ভ্যান থামিয়েছিল। দুজনকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, যা, এই তো! এদের কথাই বলেছি। পুলিস অফিসারদেরকে বলল, না বলে জোর করে ঢুকে পড়েছে। ওদের আটকান।
গুঞ্জন করে উঠল লোকেরা। জোরে সবাইকে শুনিয়ে বলল অফিসার রিম্যান, আপনারা অস্থির হবেন না। এরা গোয়েন্দা। এদের একজনকে আমি ভাল করেই চিনি। মিস মরগানও ভালই আছেন।
আশ্বস্ত হয়ে এক এক করে সরে যেতে লাগল সদস্যরা।
ভিড় কমে গেলে কিশোর বলল, থ্যাংকস, মিস্টার রিম্যান। রবিনের দিকে ফিরল। তুমি ওখানে কি করছিলে?
জিজ্ঞেস করেছি সে-কথা, জবাবটা দিল রিম্যান। লুকিয়ে মিস মরগানের ওপর নজর রাখছিল। বলল, বনের ভেতর নাকি কুড়িয়ে পেয়েছে রিভলভারটা। আপাতত ছেড়ে দিচ্ছি, তবে শহর ছেড়ে যেতে পারবে না। তোমাকে আমাদের দরকার হতে পারে। রিভলভারটা নিয়ে যাচ্ছি, পরীক্ষা করতে হবে। রবিনের চোখে চোখে তাকাল অফিসার, মিথ্যে বলে থাকলে বিপদে পড়বে বলে দিচ্ছি।
নিজেদের গাড়ির দিকে এগোল পুলিসের। ডায়নার দিকে বুক কিশোর। আমাদের পরিচয় তো জানলেন। বুঝতেই পারছেন এখন, আপনাকে সত্যিই সাহায্য করতে চাইছি। কেউ লেগেছে আপনার পেছনে, খুন করতে চায়।
বাধা দিয়ে বলল ডায়না, আমি আগেই আন্দাজ করেছি, এ ধরনেরই কোন কাজ করো তোমরা। আচমকা কিশোরের হাত চেপে ধরল, আমাকে সত্যিই সাহায্য করবে।
গাল চুলকাল কিশোর। করব। আর সেলে আপনাদের বাড়িতে আমাদের থাকা দরকার। কোনও একটা ছুতোয় যদি
ছুতো করা লাগবে না। খুব সহজেই ব্যবস্থা করা যায়। আমার সিকিউরিটি অফিসার হয়ে যাও। জুনিয়র সিকিউরিটি। চাইলে বেতনও দেব। আমার নিরাপত্তা দরকার, বুঝতেই পারছ। থাকতেও পারবে, তদন্তও করতে পারবে।
এখানে এ ভাবে বসে থাকলে তো হবে না, তাড়া দিলেন নরিয়েমা। আমার অফিসে নিয়ে যাওয়া দরকার তোমাকে। কিছু ওষুধপত্র তো লাগবে।
মুসা, ডিন আর নরিয়েমা সাহায্য করলেন ডায়নাকে। ধরে ধরে তাকে নিয়ে চলল ক্লাবহাউসের দিকে। কয়েক গজ পেছনে রইল কিশোর আর রবিন। কিশোর জিজ্ঞেস করল, বনের মধ্যে কি করছিলে, বলো তো?
রবিন বলল, বাড়ি যেতেই মা বলল, কাজটা করা লাগবে না। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ইয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম, তোমরা চলে গেছ। মেরিচাচী বললেন, পুলিস ফোন করেছিল। ডায়না নামে কে নাকি গুলি খেয়েছে। ঠিকানা বলতে পারলেন না। টেবিলে ফেলে রাখা পেপারের দিকে চোখ পড়ল। দেখি, তাতে লেখা, আজ এই ক্লাবটাতে আসবে ডায়না, সাক্ষাৎকার দেবে। বুঝলাম, অঘটনটা এখানেই ঘটেছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম। গার্ডের ভেতরে ঢুকতে দিল না। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ঢুকে পড়লাম বনের মধ্যে। ভাবলাম, চুরি করে ঢুকব।
দম নেয়ার জন্যে থামল রবিন।
তারপর? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
বনে ঢোকাটাও সহজ হলো না। বেড়া ডিঙিয়ে বনে ঢুকলাম। ক্লাবহাউসটাকে খুঁজতে লাগলাম, এই সময় কানে এল ঘোড়র পায়ের শব্দ। এগিয়ে দেখি, ডায়না ঘোড়ায় চড়েছে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ গুলির শব্দ হলো। লাফ দিয়ে পেছনের পায়ের ওপর খাড়া হয়ে গেল ঘোড়াটা। মাটিতে পড়ে গেল ডায়না। বুঝলাম, গুলি তার গায়ে লাগেনি। তাই সেদিকে না গিয়ে গেলাম যেদিক থেকে গুলির শব্দ শোনা গেছে সেদিকে। কে গুলি করেছে দেখলাম না, তবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম রিভলভারটা।
এনুডারটার মতই দেখাত, আনমনে বলল কিশোর।
দ্রুত হেঁটে অন্যদের কাছে চলে এল দুজনে। হাত তুলে বাগানের একটা জায়গা দেখাচ্ছেন ডক্টর নরিয়েমা। বেশ খানিকটা জায়গার মাটি কোপানো। কাছে পড়ে আছে হোস পাইপ, নানা রকমের বোতল, বীজের প্যাকেট। কোপানো জায়গায় ঘাস ছিল, কিছু নষ্ট হয়েছে কোপানোয় বাকিগুলো ওকেমন জ্বলা জ্বলা।
আর্সেনিকের কাজ, বুঝিয়ে বললেন ডক্টর। ঘাস সহজে রে না। কুপিয়ে নষ্ট করে ফেললেও আবার ওঠে। তাই মাটি যাবে আর্সেনিক ঢেলে দিয়েছিলাম। মরেছে এখন, আর উঠবে না। ভাবছি, এ বছর ওখানে টমেটো লাগাব।
ভাল। গুভিয়ে উঠল ডায়না। বডদ খারাপ লাগছে, খালা! শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
ক্লাবহাউসের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। নিচতলায় উক্টরের অফিস। সুন্দর করে সাজানো গোছানো। একটা সিংক, একটা চেয়ার, একটা ডেস্ক, একটা কট, আর কয়েকটা তাক বোঝাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
কটে শুয়ে পড়ল ডায়না। গুঙিয়ে উঠল আবার। উফ, মাথার ব্যথায় মরে গেলাম!
দাঁড়াও, এখুনি সব ঠিক হয়ে যাবে, কোমল গলায় বললেন নরিয়েমা। দুটো ব্যথার বড়ি খেলেই, ব্যস…।
তাকগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। একটা শিশি পাড়লেন। চুপ করে থাকো, ডায়নার দিকে তাকালেন না তিনি, যা করার আমি করছি। ডিন, এক গেলাস পানি।
ঘরটায় চোখ বোলাচ্ছে রবিন।
বড় একটা গেলাস ভর্তি করছে ডিন।
ডায়নার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে আরামে শোয়ার ব্যবস্থা করছে মুসা।
আর পুরো ব্যাপারটাই কেন যেন অপছন্দ হচ্ছে কিশোরের। চেহারায় যেন শ্রাবণের কালো মেঘ জমছে। তাকিয়ে আছে ডায়নার দিকে।
বড়িগুলো হাতে নিয়েছে ডায়না। মুখে তুলতে যাবে। হঠাৎ কি ভেবে তাক থেকে শিশিটা পাড়ল কিশোর। লেভেলটা পড়ল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ, যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে।
শিশির গায়ে লেখা রয়েছে: আর্সেনিক!
০৮.
সাবধান করে থামানোর সময় নেই। লাফ দিয়ে এসে ডায়নার হাতে থাবা মারল কিশোর। মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল বড়িগুলো।
চিৎকার দিয়ে উঠল ডায়না।
কিশোরের কলার চেপে ধরল একটা হাত। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল ডিন, এটা কি করলে?
ওর প্রাণ বাঁচালাম। আর্সেনিকের বোতলটা তুলে ধরল কিশোর।
নীরব হয়ে গেল ঘরটা।
ককিয়ে উঠল ডায়না। কটে বিছানো চাদরের মতই সাদা হয়ে গেছে মুখ।
সর্বনাশ! কিশোরের হাত থেকে ছোঁ মেরে শিশিটা কেড়ে নিলেন নরিয়েমা। আ-আ…আমি এটা কি করছিলাম!
আর্সেনিকের বোতল কেন এখানে? জানতে চাইল কিশোর।
সর্বনাশ! কি করছিলাম আমি! সর্বনাশ! কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যেন নরিয়েমা। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। কতবার ভেবেছি, কোন দিন এ রকম কিছু ঘটে যাবে! তবু সাবধান হলাম না। আজকে তো দিয়েছিলাম শেষ করে! ওষুধের দোকান থেকে আমিই কিনে আনি ওগুলো, পানিতে মিশিয়ে জমিতে ছিটাই আগাছা মারার জন্যে। অন্যান্য কেমিক্যাল আর ওষুধের সঙ্গে এখানেই রাখি। উচিত হয়নি, একেবারেই উচিত হয়নি। এই পোড়া চোখেও আজকাল আর ভাল দেখি না ছাই!…ডায়না, তোর কিছু হয়ে গেলে কি করতাম আমি, মা!
তো-তোমার কোন দোষ নেই খালা, পানিতে ভরে গেছে ডায়নার চোখ। আমার কপাল! তোমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে কোনও একটা শক্তি, বাধা দেয়ার ক্ষমতাই ছিল না তোমার! জাস্ট করে ফেললে কাজটা!
কি বলতে চাস?
বোরজিয়া ড্যাগারের অভিশাপ! তোমার ওপর ভর করেছিল! চেঁচিয়ে উঠল ডায়না, হতাশায় ভরা কণ্ঠ, শেষ হয়ে গেছি আমি! একবার যখন ছুঁয়ে ফেলেছি, আর কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাকে! কেউ না! কোথাও গিয়ে আর বাঁচতে পারব
কিছুই হবে না, অভয় দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর। সাধারণ দুর্ঘটনা এগুলো। অভিশাপ বলে কিছু নেই।
ও ঠিকই বলেছে, ডায়না, নরিয়েমা বললেন। ভুলটা আমারই। আরও সাবধান হব। এখন ঘুমাও। ঠিক হয়ে যাবে।
মাথার নিচে বালিশটা ঠিকঠাক করে দিলেন তিনি। ঘুমাও। আমি আর ডিন রইলাম, কোন ভয় নেই। এখানে কিশোরদের না থাকলেও চলবে।
পরিশ্রমে যতটা না তার চেয়ে বেশি ভয়ে কাহিল হয়েছে ডায়না। চোখের পাতায় কাঁপন জাগল। মুদে এল আপনাআপনি। ডিন আর নরিয়েমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর, মুসা আর রবিন।
বুড়িটাকে এক বিন্দু বিশ্বাস করি না আমি, হাঁটতে হাঁটতে বলল রবিন। বলছে ভুল হয়েছে। কি করে হলো? সব সময় কেমিক্যাল নিয়ে ঘাটাঘাটি করে যে, তার এ রকম ভুল হয় কি করে?
কি জানি, গাল চুলকাল মুসা, ভুল সব মানুষেরই হতে পারে। যে রকম নার্ভাস হয়ে পড়ল, তাতে তো মনে হলো সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট। আসলে কি দিচ্ছে খেয়ালই করেনি।
আমিও মানতে পারছি না ব্যাপারটা, যোগ করল কিশোর।
*
চল্লিশ মাইল গতিতে বিপজ্জনক মোড় নিল পিকআপ।
করছে কি বলো তো! গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর আত্মহত্যা করতে চায় নাকি।
ক্লিফসাইড রোড ধরে ছুটছে দুটো গাড়ি। আগেরটা নীল কভারটিবল, পেছনেরটা সবুজ পিকআপ। আগের গাড়িটার খোলা ছাত। ড্রাইভারের সীটে বসা মেয়েটার লাল চুল লম্বা হয়ে উড়ছে বাতাসে।
ওটা ওর দুই নম্বর গাড়ি, মুসা বলল। আর কটা আছে এ রকম?
আছে নিশ্চয় অনেকগুলো টাকার তো অভাব নেই। তবে তৃতীয় গাড়িটা একটা মডেল টী হলে খুশি হতাম। বিশ মাইলের বেশি স্পীড তুলতে পারত না। আসলে, ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া উচিত ছিল আমাদের।
বললাম তো কত করে, রাজি হলো না।
ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছে ডায়না। কমলা রঙের রোদ পড়েছে বনের গাছে গাছে। পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য। মরগানদের সীমানায় ঢুকে পড়ল নীল গাড়িটা। খোয়া বিছানো পথে ধুলোর ঝড় তুলে এগিয়ে গিয়ে স্কিড করে থামল। একটা গ্যারেজের সামনে। চারটে গাড়ি রাখার জায়গা আছে ওটাতে।
পিকআপের গায়ে হালকা ধুলো জমেছে। রঙ কালো বলে ধুলোগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বেশি। উইন্ডশীল্ড ওয়াইপারটা চালু করে দিয়েছে মুসা, কাঁচ থেকে ধুলো মোছার জন্যে।
ডিরেক্টরি ঘেঁটে ইচ্ছে করলে ডায়নার ফোন নম্বরটা বের করে নিতে পারবে রবিন, তাই না? কিশোর বলল।
পারবে। আমাদেরকে খুঁজে বের করাও কঠিন হবে না। মরগান ম্যানশনটা কোথায়, ডিরেক্টরি খুললেই জেনে যাবে।
তুমিই কিন্তু ডায়নার বডিগার্ড সাজতে রাজি করালে আমাকে, আরেক দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।
আমি মুসা অবাক। এই, কি বলছ…
ওয়েলকাম! ওয়েলকাম! গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল ডায়না।
ডায়না…
কিশোরকে কুথা শেষ করতে দিল না মেয়েটা। ঘুম থেকে উঠে খুব ভাল লাগছে। কটেজে গিয়ে ঘর দেখে এসো। আমাকে আসতে হবে?
মাথা নাড়ল দুজনেই।
আর কিছু বলল না ডায়না। দ্রুত রওনা হয়ে গেল ম্যানশনের দিকে।
জড়তার লেশও নেই, পিকআপের দরজা খুলতে বলল কিশোর।
গাড়ি থেকে নামল দুজনে। বাড়ির আশপাশে ঘুরল খানিকক্ষণ। তারপর চলল ডায়না কি করছে দেখার জন্যে। কটেজে পরেও যাওয়া যাবে, ভাবল। বসার ঘরে পাওয়া গেল ডায়নাকে। একটা টেলিফোন অ্যানসারিং মেশিনের ক্যাসেট রিওয়াইনড করছে।
খুব ভাল লাগে আমার এ সব যন্ত্র, ডায়না বলল। সেক্রেটারির চেয়ে অনেক ভাল। ভুল করে না, ছুটি চায় না, খিদে পেয়েছে বলে বেরিয়ে যায় না। যখনই দরকার, পেয়ে যাবে। তার খরচও অনেক কম
প্লে টিপতেই চালু হয়ে গেল মেসেজঃ হালো, মিস মরগান। জুভেনার বলছি। আপনার দাদার দলিলটা খুঁজে পেয়েছে আমাদের কর্চারী। অনেকগুলো ফাইলের নিচে চাপা পড়েছিল। কাল নাগাদ হাতে পেয়ে যাব। মঙ্গলবারে দয়া করে বাড়িতে থাকবেন, জিনিসগুলো ফেরত আনতে যাব। আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, মূর্তিটার দামও আপনাকেই শোধ করতে হবে। গ্রীক মূর্তিটার কথা বলছি। ওটা ভাঙার জন্য আপনাকেই দায়ী করব আমি। আপনিই জোর করে জিনিসটা নিয়ে গেছেন মিউজিয়ম থেকে। ভাল থাকুন।
চামড়ায় মোড়া গদিওয়াল আর্মচেয়ারে নেতিয় পড়ল ডায়না। চকের মত সাদা হয়ে গেছে গাল।
এ রকম কিছু হবে, আমি জানতাম, মুসা বলল। খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্যে।
জানতে, না? কেঁকিয়ে উঠল ডায়না। তা তো জানবেই। তোমার তো আর কিছু না।
সরি, ডায়না। ওভাবে বলতে চাইনি-
জানি, জানি! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ডায়না। একদিক থেকে ভালই হলো। হতচ্ছাড়া এই জিনিসগুলো শুধু ভোগাচ্ছেই আমাকে, ক্ষতিই করছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোর ওপর চোখ বোলাল সে। ওগুলো ফেরত দিতে কষ্ট হবে, চোখ দেখেই বোঝা গেল।
জিনিসগুলো দেয়ার পরও কিন্তু আমাদের তদন্ত বন্ধ হবে না, কিশোর বলল।
অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছিল যেন ডায়না, বাস্তবে ফিরে এল। ঠিক? কিশোরের চোখে চোখে তাকাল। এরপর কি করবে?
পারলারে খুঁজতে যাব…
না!
না কেন?
ডায়নার নিচের ঠোঁট সামান্য কাপল। আহত দৃষ্টিতে তাকাল কিশোরের দিকে। তুমি আমাকে একা ফেলে যাবে না। সিকিউরিটি অফিসার হয়েছ, মনে আছে?
তা আছে। মুসার দিকে তাকাল কিশোর। শ্রাগ করল। ঠিক আছে, তোমার ওপরই ছেড়ে দিলাম। সূত্র খুঁজে বের করা। পারবে তো?
পারব। দরজার দিকে এগোতে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, তুমি তো গার্ড দেবে ওকে, তোমাকে গার্ড দেবে কে?
কি বললে?
না, কিছু না। বেরিয়ে গেল মুসা।
*
কাঁচের বাক্সে আগের জায়গায়ই রয়েছে বোরজিয়া ড্যাগার। সাবধানে ডালাটা তুলল মুসা। অস্বাভাবিক কোন কিছু নেই তো বাক্সটায়? এই যেমন ইলেকট্রিক সুইচ, চোর ঠেকানোর কোন যন্ত্র…
আস্তে করে ছুরিটা তুলে আনল সে। মখমলের গদির নিচে খুঁজল হাত দিয়ে টিপে টিপে। কিছু নেই। ছুরিটা আবার রেখে দিয়ে এসে দেখল মূর্তিটা যেখানে ছিল সেখানটা। না, এখানেও চোখে পড়ার মত কিছু নেই।
তার মনে হচ্ছে, কিছু না কিছু আছেই ঘরে। ও দেখতে পাচ্ছে না এই যেমন সার্কিট ব্রেকারের বাক্স, লুকানো টেলিভিশন ক্যামেরা
এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওক কাঠে তৈরি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বোলাচ্ছে সারা ঘরে। নড়তে গিয়ে খোদাই করা একটা জিনিসে কনুই লাগল। সরে গেল ওটা।
লাফিয়ে সরে এল মুসা। আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে জিনিসটা।
কিরিচ করে একটা শব্দ হলো, তারপর ঝাঁকুনি। অবাক হয়ে দেখল সে, বুককেসটা সরে যাচ্ছে, নাড়া লেগে পড়ে গেল কয়েকটা বই। পেছনে দেয়াল টেয়াল কিছু নেই, শুধু গাঢ় অন্ধকার।
একটা গোপন কুঠুরি, ভাবল মুসা। পুরানো গোয়েন্দা গল্পের সিনেমাগুলোতে যেমন থাকে।
অতি সাবধানে ভেতরে পা বাড়াল সে। মনে করল, সিঁড়িটিড়ি। আছে। কিন্তু কিছুই ঠেকল না পায়ে। শুধু মাকড়সার জাল। এত সতর্ক থেকেও দুর্ঘটনা এড়াতে পারল না। পড়ে গেল, গিলে ফেলল যেন তাকে অন্ধকার!
.
০৯.
সিমেন্টের মেঝেতে পড়ল সে। একটা মুহূর্ত পড়ে থাকল চুপচাপ। দম নিল। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। নেড়েচেড়ে দেখল হাত-পা। না, ঠিকই আছে, ভাঙেনি।
ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। চারপাশে তাকাল সে। যেখান দিয়ে পড়েছে, সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছে আবছাভাবে। বেশ বড় একটা ঘরে পড়েছে সে। জিনিসপত্র নেই। অন্য পাশের দেয়ালে একটা ছোট দরজা।
উঠে এসে দাঁড়াল ওই দরজাটার কাছে। ঢোকার আগে দ্বিধা করল একবার। দরজাটা এত নিচু, মাথা নুইয়ে ঢুকতে হলো তাকে। খুব সতর্ক রইল যাতে আগের বারের অবস্থায় না পড়ে। দুই পাশে হাত ছড়িয়ে দেখল, দেয়ালের খসখসে পাস্টার লাগে হাতে। মাথা সোজা করতে যেতেই ছাতে বাড়ি লাগল, নিচু করে ফেলল আবার। একটা সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছে সে, বুঝতে পারল। আলোর অভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পা বাড়াল সামনে। কোথায় যাচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। শুধু এটুকু বুঝল, ঢালু হয়ে নেমে গেছে সুড়ঙ্গটা।
মাথা নিচু করে রেখে, দুহাতে দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোল সে। প্রথমে ধীরে, তারপর গতি বাড়াল। কোন একটা জায়গায় নিশ্চয় পৌঁছবে, ভাবল সে। স্টোররূম, বয়লার রূম, কিংবা…
ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই কিসে যেন বাড়ি খেলো। কপাল ডলল, যেখানে লেগেছে। আরেক হাত বাড়িয়ে দিল সামনে, একটা দরজা লাগল হাতে। হাতড়ে বের করল নব। ওটা ঘুরিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা।
আরেকটা অন্ধকার ঘর। ভেতরে পা দিল সে। পায়ের নিচে পড়ল কি যেন, আরেকটু হলেই উল্টে পড়ে যেত, সময়মত ধরে ফেলল দরজার পাল্লাটা। সুইচবোর্ডের আশায় হাতড়াতে লাগল দেয়ালের পাশে।
হাতে ঠেকল ধাতব বোর্ডটা। সুইচ টিপতে উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্ট আলোয় ভরে গেল ঘর। এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে এই আলো অসহ্য লাগল চোখে, বন্ধ করে ফেলল। আবার খুলে মিটমিট করল। ঠিক হয়ে এল ধীরে ধীরে। নানা রকম জিনিসে বোঝাই। ট্রাংক, বাক্স, বাগানে কাজ করার যন্ত্রপাতি, আরও নানা রকম জিনিস। দেখল, যেটাতে পা দিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, সেটা একটা ধাতব রোলার-টে।
একপাশের দেয়ালে দেখতে পেল সার্কিট ব্রেকারের ধাতব বাক্সটা। বাক্সের সামনে দরজাটা টেনে খুলল সে। সুইচ আছে মোট বিশটা। নিচে লেখা রয়েছে কোনটা কোন্ ঘরের: রান্নাঘর, বসার ঘর, পারলার…। সুইচগুলোর নিচে একটা বড় মেইন সুইচ। এখান থেকেই ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে, বিড়বিড় করে বলল সে নিজেকেই। পুরো ম্যানশন অন্ধকার করে দেয়া হয়েছিল, সুইচ অফ করে দিয়ে!
আরেক পাশের দেয়ালে দুটো কাঠের সিঁড়ি লাগানো। ওপরে দুটো দরজা। কোথায় ঢুকেছে সে, বুঝতে অসুবিধে হলো না। সুড়ঙ্গ দিয়ে বেসিমেন্টে চলে এসেছে, মাটির তলার ঘরে। সার্কিট ব্রেকার বক্সের দরজাটা আবার লাগিয়ে দিয়ে এসে একটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। ঠেলা দিতেই খুলে গেল একটা দরজা। নাকে এসে লাগল ফুলের সুবাস। বাল্কহেড ডোর দিয়ে মাথা বের করল রোদের মধ্যে।
পেছনে তাকাতে চোখে পড়ল মরগানদের প্রাসাদটা। ওর দুই পাশেই ফুলের বাগান। সামনে খোয়া বিছানো রাস্তা। চলে গেছে ওটা গেস্ট কোয়ার্টার পর্যন্ত।
এক চিলতে হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। প্রায় দৌড়ে চলল প্রাসাদের দিকে। বসার ঘরের একটা জানালার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কানে এল ডায়নার কণ্ঠ, একটা কথা বলি, শোনো, সিকিউরিটি অফিসার হয়ে…
মাথা তুলে দেখল মুসা, কাউচের কিনারে সোজা হয়ে বসে আছে কিশোর। অস্বস্তি বোধ করছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে হাত রাখল ডায়না।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। চোখ পড়ল জানালার দিকে। মুসা! ওখানে কি করছো?
বিরক্ত করলাম না তো? মুচকি হেসে বলল মুসা।
না না, এসো, ভেতরে এসো।
ঘুরে এসে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল মুসা।
ছিলে কোথায় এতক্ষণ? সেই কখন থেকে ভাবছি আসবে, আসবে…
কোথায় ছিলাম, চলো, দেখাব। ডায়নার দিকে তাকাল মুসা। ডায়না, টর্চ আছে?
আছে। লাগবে?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
তাড়াতাড়ি টর্চ আনতে চলে গেল ডায়না। ফিরে এল বড় একটা টর্চ নিয়ে।
এসো আমার সঙ্গে, কিশোরকে বলে পারলারের দিকে এগোল মুসা। কিশোর আর ডায়না তার পিছে পিছে চলল।
বুককেসের কাছে ফোকরটা দেখে হা হয়ে গেল ডায়নার মুখ।
নিচে একটা ঘর আছে। ফোকর দিয়ে ভেতরে আলো ফেলল মুসা। বেশি নিচে না। লাফ দিলেই নামা যায়। সিঁড়ি থাকলে আর লাফানোর দরকার পড়ত না।
ফোকরের মুখে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা আলো ফেলে দেখল সে। একপাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে একটা লোহার মই।
সব বুঝলাম, বলল মুসা। এই ঘর থেকে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে স্টোর রূমে। সার্কিট ব্রেকার আছে ওখানে। ডায়নাকে যে খুন করতে চেয়েছে, সুড়ঙ্গ ধরে উঠে এসেছে এই ঘরে। তারপর মই বেয়ে উঠে ঠেলে ফেলে দিয়েছে মূর্তিটা।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল ডায়না।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দুজন নয়, একজনেই করেছে কাজটা।
হ্যাঁ, মুসাও একমত। আস্ত শয়তান। প্রথমে আলো নিভিয়েছে। তারপর সুড়ঙ্গ দিয়ে দৌড়ে চলে এসেছে এই ঘরে, মই বেয়ে উঠেছে, বুককেসটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে মূর্তিটা ফেলেছে, তারপর আবার বুককেসটা আগের জায়গায় সরিয়ে রেখেছে। নেমে গিয়ে সুইচ অন করে আলো জ্বেলে দিয়েছে।
তার মানে এমন একজন লোক কাজটা করেছে, এই বাড়ির সমস্ত গলিঘুপচি যার চেনা…
এবং অন্ধকারেও যে কাজ সারতে পারে, কিশোরের কথার পিঠে বলল মুসা। ডায়নার দিকে ফিরল। বুককেসটা যে আসলে দরজা, জানেন আপনি?
হাত নাড়ল ডায়না। জানলে কি আর বলতাম না? মূর্তিটা পড়ার পরপরই আগে ওটা সরিয়ে দেখতাম।
তা ঠিক।
এ সব ভাল লাগছে না আমার, শিউরে উঠল ডায়না। গোপন দরজা, গোপন সুড়ঙ্গ-নাহ, একেবারে ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছে! কালই দেয়াল তুলে ওই ফোকর বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি। যথেষ্ট হয়েছে…
ডায়নার হাত ধরল কিশোর। এত ভয়ের কিছুই নেই। যেভাবে আছে থাকুক। সতর্ক করার দরকার নেই। ভুল করে বসতে পারে লোকটা। আর তাতে সুত্র পেয়ে যাব আমরা।
ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ। মুখের কাছে হাত তুলল সে। হাই মাসছে।
আরও বিশ্রাম দরকার আপনার, কিশোর বলল। ঘুমানগে। আমাদের কাজ কালও করতে পারব।
মাথা ঝাঁকাল ডায়না। হ্যাঁ, আর দাঁড়াতে পারছি না আমি। কটেজে চলে যাও। সকালে দেখা হবে।
দোতলায় চলে গেল ডায়না। নিচতলার জানালাগুলো ভালমত বন্ধ করল দুই গোয়েন্দা মিলে। বেরিয়ে এসে ঘরে ঢোকার সমস্ত দরজা আটকে তালা লাগিয়ে দিল। তারপর ওদের ব্যাগ বের করল পিকআপ থেকে।
কটেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মুসা বলল, কার কাজ, আন্দাজ করতে পারছি।
জুভেনার আর ডক্টর নরিয়েমাকে সন্দেহ থেকে বাদ দেয়া যায়। ঘটনাটা ঘটার সময় পারলারেই ছিল দুজনে।
দাঁড়িয়ে গেল মুসা। ওই দেখো।
কি দেখব? একটা রাস্তা, মাথা চুলকাল কিশোর। খোয়া বিছানো। কি বলতে চাও?
পার্টি শেষে এই পথ দিয়ে কাকে আসতে দেখেছিলাম?
এনুডা! বার্ব এনুডা! তাই তো! এ পথে এসে সহজেই স্টোর রূমে ঢুকে মেইন সুইচ অফ করে দিতে পারে!
ঠিক। জুভেনার কিংবা নরিয়েমার হয়েও কাজটা করতে পারে সে। মুসার দিকে তাকাল কিশোর। ভাবছি, কাল একবার গিয়ে দেখা করে আসব এনুডার সঙ্গে।
*
পঁচাশি ডিগ্রি।
চোখ ডলল মুসা। আউটডোর থারমোমিটারের রীডিং বিশ্বাস করতে পারছে না। বাপরে বাপ! বলল সে। সকাল বেলাও তো এত ছিল না! পুড়ে যাব আজকে!।
তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিয়ে ডায়নাকে খুঁজতে চলল দুই গোয়েন্দা। দেখল, কাপড় পরে বসে আছে ডায়না, ওদের জন্যেই। গুড মনিং, টেনে টেনে সুর করে বলল সে, তারমানে মেজাজ ভাল। আমিই যাচ্ছিলাম সাঁতার কাটতে যাবে কিনা তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করতে।
সাঁতার? মুসা বলল। পোশাক তো…
আছে, অনেক। কটেজের চেঞ্জিং রূমে খুঁজলেই পেয়ে যাবে। মেহমানদের জন্যে এক্সট্রা বেদিং সুট রেখে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু তারচেয়ে
কনুইয়ের তো মেরে মুসাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলল, না, সাঁতারই কাটতে যাব।
ঠিক আছে। তোমরা গিয়ে কাপড় বদলে এসো। আমি ডিনকে ফোন করছি। সকালে সাঁতার কাটতে পছন্দ করে ও।
ফোন করতে গেল ডায়না। বেরিয়ে এল কিশোর-মুসা। সিটিং রূমের পাশ দিয়ে যাবার সময় কানে এল ডায়নার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ, ছেলেমানুষী কোরো না!…নিশ্চয়ই না!…নির্বোধ ভাবছ কেন ওদের? আমার তো ধারণা, তোমার চেয়ে অনেক চালাক ওরা!
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। কিশোর বলল, সমস্যাটা আমাদেরকে নিয়ে।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। ভেবেছিলাম ডিনের সাহায্য পাব। কিন্তু ও তো আমাদের শত্রু ভারছে। এসো।
দ্রুত বেদিং সুট পরে নিল দুজনে।
চেঞ্জিং রূম থেকে আগে বেরোল কিশোর। দৌড়ে চলল সুইমিং পুলের দিকে। ডাইভিং বোর্ডে উঠে ঝাঁপ দেয়ার জন্যে তৈরি হলো। ঠিক ওই সময় পুলের নিচে ইলেকট্রিকের তারটা চোখে পড়ল তার। স্বচ্ছ পানিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তারের একটা মাথায় লাগানো প্রাগ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে একটা আউটডোর সকেটে।
শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। ঝাঁপ দেয়া থেকে বিরত থাকল। তার পেছনেই উঠে এসেছে মুসা। পাশ কাটিয়ে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গেল।
নাআ! নাআ! বলে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে ডাইভ দিল মুসা।
.
১০.
বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মরবে তার বন্ধু, তারই চোখের সামনে, অথচ সে কিছুই করতে পারবে না, এ-দৃশ্য সইতে পারবে না সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
ঝুপ করে শব্দ হলো পানিতে পড়ার। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর হুসস করে ভেসে ওঠার শব্দ। বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মরার পর কি সাথে সাথেই ভেসে ওঠে লাশ? কতটা কুৎসিত লাগে দেখতে ওটাকে?
কিশোর, চোখ বুজে আছো কেন? মুসার ডাক শোনা গেল।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। আস্তে চোখ মেলে তাকাল। মুসাই। পানিতে মাথা তুলে ডাকছে। বহাল তবিয়তেই আছে। কিছুই হয়নি ওর!
ডাইভিং বোর্ড থেকে নেমে পড়ল কিশোর। দৌড়ে পুলের একপাশে এসে সকেট থেকে একটানে খুলে ফেলল প্লগটা।
সর্বনাশ! চোখ বড় বড় করে ফেলল মুসা। মরলাম না কেন?
আল্লাহই জানে!
ডায়না এসে হাজির হলো। পরনের বেদিং সুটটা লাল-কমলা ডোরাকাটা। এই, কি হয়েছে? কিসের কথা বলছ?
এই তারটা পানিতে ছিল, দেখিয়ে বলল কিশোর। প্লগ সকেটে ঢোকানো।
নিশ্চয় রাতের বেলা পাতা হয়েছে, বলল মুসা। মৃত্যুফাঁদ!
স্ট্রেঞ্জ! নিমেষে সাদা হয়ে গেছে ডায়নার মুখ, হাঁসি উধাও। আমার জন্যে পেতেছিল! জানে, সকালবেলা সাঁতার কাটতে নামি! ঢোক গিলে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল পুলের পাশের একটা চেয়ারে। হাত-পা কাঁপছে। কে.কে খুন করতে চায় আমাকে?
বলতে পারব না, ডায়না, কিশোর বলল। তবে এনুডাকে সন্দেহ করা যায়।
মুসা পানিতে নামার আগেই তারটা খুলেছ?
না। পরে। কি করে যে বেঁচে গেল, বুঝতে পারছি না!
আমি পারছি, ডায়না বলল। স্বস্তি ফিরে এসেছে কিছুটা। আমি নামলেও মরতাম না। সকেটটা খারাপ কয়েক বছর ধরেই। সারাবে সারাবে করেও সারায়নি বাবা। ভাগ্যিস ভুলে গিয়েছিল।
সাঁতার আপাতত থাক, কিশোর বলল। এনুডাকে গিয়ে ধরব এখন।
মাথা নাড়ল ডায়না। আমার মনে হয় না ওর কাজ। আমাকে দেখতে পারে, ঠিক, কিন্তু খুন করতে আসবে না।
চলুন না গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখি?
না। আমি ওর সামনে আর যাব না।
কিশোর, তুমিই যাও, পানি থেকে উঠতে উঠতে বলল মুসা। আমি ডায়নাকে পাহারা দিই।
তাই করো, প্রস্তাবটা পছন্দ হলো কিশোরের। আমি রবিনকে ফোন করছি। ওকেও যেতে বলব। দরকার হতে পারে।
মুসা চলে গেল চেঞ্জিং রূমে, কাপড় বদলাতে। আর কিশোর গেল কটেজে রবিনকে ফোন করতে। এনুডার ঠিকানা দিয়ে বলল, রবিন যেন ওখানে দেখা করে। তারপর তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। দৌড়ে চলল ড্রাইভওয়ের দিকে।
পিকআপে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ডায়নাকে ডেকে বলল, ডায়না, দুশ্চিন্তা করবেন না। চলে আসব কাজ শেষ করেই।
পিকআপ ছেড়ে দিল কিশোর। ড্রাইভওয়েতে থাকতেই দেখল উল্টো দিক থেকে আরেকটা গাড়ি আসছে। ব্রেক কষল সে। গাড়িটা কাছে আসতেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে হেসে বলল, গুড মর্নিং, ডিন। খুব গরম, না?
জবাব দিল না ডিন। মুখ কালো করে রেখেছে। হুস করে পিকআপের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।
*
ক্লিফসাইডের মাইল চারেক দূরে থাকে এনুডা। রকি বীচের একটা পুরানো এলাকা এটা। বাড়িঘরগুলো সব পুরানো, কোন কোনটা ধসে পড়েছে ইতিমধ্যেই, বাকিগুলোর অবস্থাও কাহিল। কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আছে। এক সময় লন ছিল সামনে, এখন সেখানে ঘাস আর আগাছার রাজত্ব, ফুলের নামগন্ধও নেই। বাতাস ভীষণ গরম। বাইরে কেউ নেই। মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলের চিৎকার আর নেড়ি কুকুরের ডাক ছাড়া কোন শব্দও নেই। দুচারটে জানালায় মানুষের মুখ দেখা গেল। একটুখানি হাওয়ার আশায় বসেছে খোলা জানালার ধারে। হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করছে। পিকআপের শব্দ পেয়ে কিশোরের দিকে তাকাচ্ছে কঠিন দৃষ্টিতে। কেন এই বিরক্তি, ওরাই জানে।
ডানে মোড় নিল কিশোর। বাড়ির নম্বর খুঁজতে লাগল। তার আগেই এসে হাজির হয়েছে রবিন। কিশোরকে আসতে দেখে গাড়ি থেকে নামল। হাত নেড়ে ডাকল। এমুডার বাসার সামনেই পার্ক করেছে সে।
কিশোর গাড়ি থেকে নামতেই বলল, এত দেরি করলে।
তোমার চেয়ে দূর থেকে আসতে হয়েছে আমাকে।
ডায়না কেমন আছে? একটা ভুরু উঁচু করল রবিন।
আছে বোধহয় ভালই। এতক্ষণে নিশ্চয় হেভি মারপিট লাগিয়ে দিয়েছে ডিন আর মুসা, হেসে রসিকতা করল কিশোর।
ভাল। তুমি মুক্তি পেলে। বলে কিশোরের হাত ধরে এনুডার ঘরের দিকে টেনে নিয়ে চলল রবিন।
ছোট্ট একটা বাড়ি। দেয়ালে কতদিন রঙ পড়ে না কে জানে। একপাশের দেয়াল ধসে পড়েছে। সামনের খুদে চত্বর ঘিরে বেড়া দেয়া। পুরানো সেই বেড়ায় কাত হয়ে ঝুলছে একটা টিনের প্লেটে লেখা সাইনবোর্ড।
পড়তে পারছ? জিজ্ঞেস করল রবিন। সামনের দরজাটা ঠেলে খুলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও! লেখা আছে…হইতে সাবধান!
কি হতে সাবধান?
সেটুকু তো মুছে গেছে। বোধহয় কুকুর…
এই, কুত্তা! সাবধান! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
বিশাল কালো একটা প্রাণী ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে আসছে।
ধক করে উঠল কিশোরের বুক। পাগলের মত এদিক ওদিক তাকাল একটা হাতিয়ারের জন্যে। মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল একটা ডাল। তুলে নিল ওটা। দৌড়ে এসে দাঁড়াল রবিনের সামনে, কুকুরটার মুখোমুখি।
এই, এই কুত্তা! সর, সর! ধমক দিয়ে বলল সে।
দাঁড়িয়ে গেছে জানোয়ারটা। দাঁত খিচাল বিকট ভঙ্গিতে।
এক পা আগে বাড়ল কিশোর। ডাল নেড়ে হুমকি দিল। গর্জে উঠল কুকুরটা। তবে পিছিয়ে গেল এক পা।
রবিন, সরে যাও! আস্তে করে বলল কিশোর। সামনের দরজাটা গিয়ে খোলো। আমি আটকে রাখছি এটাকে!
পারবে?
চেষ্টা করি। যাও!
কিশোরের পেছন থেকে বেরিয়ে রবিন পা বাড়াতেই লাফ দিয়ে এগোল কুকুরটা।
কষে ওটার নাকেমুখে এক বাড়ি মারল কিশোর। কেউ করে পিছিয়ে গেল কুকুরটা। আবার বাড়ি তুলল কিশোর। লাঠির দিকে তাকিয়ে আছে ওটা, আর এগোনোর চেষ্টা করছে না।
অবাক কাণ্ড তো! ওরকম করে তাকাচ্ছে কেন? আরে, আবার লেজও নাড়তে আরম্ভ হরেছে! কি ভেবে লাঠিটা একপাশে নাড়ল কিশোর। ঠিক সেই দিক সই করে লাফ দেয়ার ভঙ্গি করল কুকুরটা। দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরের গায়ে এসে পড়ার কোন ইচ্ছে নেই।
কি কুত্তা ওটা? রবিনও অবাক হয়েছে। ওরকম করছে কেন?
বোধহয় রিট্রিভার! ঝুঁকিটা নিল কিশোর। লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায়। বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন কুকুরটার শরীরে। চোখের পলকে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল কুড়িয়ে আনার জন্যে। ওটা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গেটটা লাগিয়ে দিল কিশোর।
রিট্রিভারই। চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়ল কিশোর। দাঁত আছে প্রচুর ওটার, মগজ নেই।
সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। হলদে একটা কাগজে নোট লিখে টেপ দিয়ে সাঁটানো রয়েছে দরজায়:
ডিয়ার ফ্র্যাঙ্ক,
মলে যাচ্ছি আমি। পাঁচতলায় পাবে। ওখানে শূটিং হতে পারে আজ।
৬টায় দেখা হবে।
এন.বি.
গাধা নাকি লোকটা? কিশোর বলল। এ ভাবে খোলাখুলি লিখে রেখে যায় কেউ?
জলদি চলো! খুন করে ফেলার আগেই ধরা দরকার! শুটিং হতে পারে বলছে…, গেটের দিকে দৌড় দিল রবিন। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই থমকে গেল। গেটের বাইরে দাঁতের ফাঁকে লাঠি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরটা। ফিরে চেয়ে বলল, এই কিশোর, কি করব?
দাঁড়াও। গেটের কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। আমি খুললেই তুমি বেরিয়ে যাবে। সোজা গাড়িতে!
তোমাকে যদি কামড়ায়?
কামড়াবে না। গেটটা সামান্য ফাঁক করতেই ঢুকে পড়ল কুকুরটা। লাঠিটা ধরল কিশোর। এই সুযোগে চট করে বেরিয়ে গেল রবিন।
কুকুরের মুখ থেকে লাঠি নিয়ে দূরে আরেকদিকে ছুঁড়ে দিল কিশোর। জানোয়ারটা সেটা আনতে ছুটতেই বাইরে এসে গেট লাগিয়ে দিল সে। পিকআপে উঠে পড়ল।
*
রবিনের গাড়িকে অনুসরণ করে মলে চলে এল কিশোর। ইনডোর লটে গাড়ি পার্ক করে রেখে এলিভেটরের কাছে চলে এল। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দরজা। ভেতরে লোক ঠাসাঠাসি।
দরজা টেনে ধরল কিশোর। এক্সকিউজ আস! বলেই কারও প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। রবিনও ঢুকল। কেউ পছন্দ করল না ব্যাপারটা। তবে কিছু বলল না।
পাঁচতলা, মিষ্টি করে হেসে বলল রবিন। অপারেটরের মন ভেজানোর জন্যে।
গোমড়া মুখে সামান্যতম হাসি ফুটল না ছিপছিপে রোগাটে মানুষটার। বোতাম টিপে দিল।
ওই কয়টা তলা পেরোতেই যেন সারা জীবন লেগে যাবে, কিশোরের মনে হলো। প্রতিটি তলায় থামছে লিফট। গাদাগাদি হয়ে থাকা মানুষের মধ্যে দিয়ে গুতাগুতি করে নামছে পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলো।
অবশেষে পাঁচতলায় পৌঁছল লিফট। দরজা খুলল। নামতে যাবে দুজনে, হাত বাড়িয়ে ঠেকাল ওদেরকে একজন দাড়িওয়ালা লোক।
ঠিক এই মুহূর্তে দুটো গুলির শব্দ হলো! দাড়িওয়ালার পেছনের নীল সুট পরা একটা লোক দিল খিচে দৌড়, যেন এই ছোটার ওপরই জীবন নির্ভর করছে তার।
অটোম্যাটিক পিস্তল হাতে তার পেছনে ছুটল বার্ব এনুডা।
.
১১.
ধরো, ধরো ওকে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। থামাও।
যেও না, যেও না! বাধা দিতে গেল কিশোর। ওর হাতে পিস্তল…
শুনতে পেল না বোধহয় রবিন। দাড়িওয়ালার হাত ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে গেল, দৌড় দিল এনুডার পেছনে।
চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে লোকে, বাজার করতে এসেছে ওরা মলে। কেউ কেউ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে মেঝেতে। কারও দিকেই তাকাচ্ছে না এনুডা। চোখ লাল, কঠিন চেহারা, তার নজর নীল সুট পরা লোকটার দিকে। মুহূর্তের জন্যেও সরাচ্ছে না। রবিনের বাড়িয়ে দেয়া পা-টাও দেখতে পেল না সে-জন্যে।
পায়ে পা বেধে উড়ে গিয়ে পড়ল এনু। ধড়াস করে পড়ল যেন ময়দার বস্তা। হাত থেকে ছুটে উড়ে চলে গেল পিস্তলটা। দোকানের জানালা-দরজা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে খরিদ্দারেরা। বাধা দিতে বা কোন কিছু করতেই এগোচ্ছে না কেউ।
এই, থামো! খ্যাখ্যান করে উঠল একটা কণ্ঠ। ছেলেটা কে?
চিনি না, টম, জবাব দিল দাড়িওয়ালা লোকটা। আমার হাত সরিয়ে দৌড় দিল।
ঘুরে তাকাল রবিন। সার্চলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলো প্রতিটি কোণ থেকে এসে পড়েছে তার ওপর। মেঝেতে এঁকেবেঁকে পড়ে রয়েছে ইলেকট্রিকের তার। হেসে উঠল কয়েকজন মানুষ, টিভি ক্যামেরা হাতে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন চিৎকার করে বলল, ফিল্মটা রেখে দিও টম। দারুণ দৃশ্য! কাজে লাগবে পরে!
যথেষ্ট হয়েছে, বলল প্রথম কণ্ঠটা। এই সরাও তো সব, পরিষ্কার করো। দশ মিনিটের মধ্যেই আবার শূটিং করব।
গুঞ্জন উঠল জনতার মাঝে। এদিক ওদিক সরে যেতে লাগল ওরা। কয়েকজন এগিয়ে গেল একটা টেবিলের দিকে, হালকা খাবার আর কোমল পানীয় রাখ ওটাতে।
ঢোক গিলল রবিন। দাড়িওয়ালা লোকটাকে তার দিকে আসতে দেখে লাল হয়ে গেল গাল। সব ভজকট করে দিয়েছ। আবার নতুন করে করতে হবে পুরো দৃশ্যটা।
সরি, স্যার, আমি ভেবেছিলাম…
যা করার করেছ। আর করবে না।
দাড়িওয়ালা লোকটা চলে গেলে ফিরে তাকাল রবিন। কিশোর এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। রবিন কাঁধে হাত রেখে সান্তুনার সুরে বলল, ওরকম ভুল সবাই করতে পারে। তুমি না করলে আমি করতাম, বাধা দিতে যেতাম এনুডাকে।
পেছন থেকে বলে উঠল এনুডা, আবার আমার পেছনে লেগেছ!
ফিরে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, ভুল হয়ে গেছে, মিস্টার এনুডা। দেখলেনই তো…
একেবারে স্পষ্ট দেখেছি! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল এনুডা, এনুডা এনুডা করবে না। এখানে আমি নিভার ব্রাউন। আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে এসেছ নাকি?
না, মিস্টার এনুডা। জানতে এলাম, ডায়না মরগানকে খুনের চেষ্টা আপনি কেন করছেন?
বড় বড় হয়ে গেল এডার চোখ। বুক চেপে ধরে মাতালের মত টলে উঠল। ইংরেজি নাটকের সংলাপ নকল করে বলে উঠল, ইউ ভাইল, ইভিল জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্ট! এত্তোবড় সাহস তোমার, আমাকে খুনী বলতে এসেছ…
করব না-ই বা কেন? প্রাসাদে সে-রাতে রিভলভার হাতে কাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি? যে পথে দেখা গেছে আপনাকে, ওই পথ দিয়েই সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে এসে প্রাসাদের বেসিমেন্টে নামা যায়, সার্কিট ব্রেকারগুলো যেখানে আছে।
সার্কিট ব্রেকার? কি বলছ!
আরও বলতে পারি। আপনার সিলভার-প্লেটেড রিভলভারটাই বনের মধ্যে পাওয়া গেছে। গতকাল। ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে ডায়নাকে গুলি করার পর।
ফালতু কথা রাখো! আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হওয়ার ভয় আছে, নইলে ধরে তোমাকে এখন এমন ধোলাই দিতাম! তুমি বলছ কান্ট্রি ক্লাবে গিয়েছিলাম, আর আমি বলছি সারাদিন আমি এখানে ছিলাম। আমার পার্ট আসার অপেক্ষায়। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে একটা খাতা নিয়ে এল। ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, এই যে দেখো, আমার হাজিরা।
কিশোর পড়ল:
ব্রাউন, নিভার।
এসেছে-সকাল ৭.৩০।
বেরিয়েছে-বিকাল ৬.৩৫।
বিশ্বাস হলো তো? আরেকটা কথা, আমি বেসিমেন্টে ঢুকিনি।
কি করে বুঝব? সেরাতে গিয়েছিলেন ম্যানশনে। চাকরদের ঘরে ঢুকেছিলেন…
পার্টি চলছিল। সবার চোখ এড়িয়ে কটেজে ঢোকার উপযুক্ত সময় ছিল ওটা।
পাঁচ মিনিট! চিৎকার করে বলল একটা ভারী কণ্ঠ। আর মাত্র পাঁচ মিনিট। সবাই রেডি?
গুঙিয়ে উঠল এনুডা। হায়, হায়, অনেক সময় নষ্ট করলাম বকবক করে! আমি যাই! তাড়াহুড়ো করে চলে গেল সে।
এখনও আমি বিশ্বাস করি না ওকে, কিশোর বলল।
এখানে থেকেও আর লাভ নেই। এনুডার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। চলো।
ওদের পেছনে হুস করে খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। ঢুকে পড়ল দুজনে। এবার ভেতরে আর একজনও নেই, শুধু ওরাই।
আমার অন্য কাজ আছে, কিশোর বলল। তুমি এখানে থেকে এনুডার ওপর নজর রাখতে পারবে?
খুব পারব, আগ্রহের সঙ্গে বলল রবিন।
ও কি করে না করে সব দেখবে। দরকার হলে ওর বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করে যাবে। সাবধান, ও যেন তোমাকে চিনতে না পারে।
পিকআপের মধ্যে প্রয়োজনীয় নানা রকম জিনিস আছে। বাক্স খুলে একটা সবুজ ইউনিফর্ম বের করল কিশোর, শ্রমিকের কাজের পোশাক। নাও, পরে ফেলো। একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে নিয়ে ময়লা টোকানোর ভান করবে। পারবে তো?
দেখোই না, হেসে বলল রবিন। পোশাকটা হাতে নিয়ে বলল, আসছি। এক মিনিট। মহিলাদের টয়লেটের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
ফিরে এল একটু পরেই। ঠিকমত লাগেনি পোশাকটা। সামান্য ঢলঢলে হয়েছে। হাত আর পায়ের নিচের অংশ ভাজ করে মুড়ে রাখতে হয়েছে।
হেসে ফেলল কিশোর। দেখো, টিভির পরিচালক না আবার দেখে ফেলে। অভিনয়ের জন্যে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তাহলে।
ভালই হবে, হাসতে হাসতে বলল মেয়ে সেজে আসা রবিন।
তাকে রেখে পিকআপ নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। রকি বীচ মিউজিয়ামে রওনা হলো। শহরের ঠিক মাঝখানে এসে লাল আলো দেখে থামল সে। এই সময় একটা লাল গাড়ি চোখে পড়ল, একধারে থেমে রয়েছে। পরিচিত লাগল গাড়িটা। ল্যামবোরগিনি।
চিনে ফেলল। ডায়নার গাড়ি। সামনে না এগিয়ে গাড়িটার পেছনে এনে পিকআপ রাখল কিশোর। কাছের একটা স্টোর থেকে বেরিয়ে এল ডিন রুজভেল্ট, হাতে একগাদা পত্র-পত্রিকা।
হাত নেড়ে ডাকল কিশোর, হাই, ডিন!
ফিরে তাকাল ডিন। কিশোরকে দেখেই চোখ জ্বলে উঠল। কী?
ডায়না এসেছে নাকি?
না, এল আর কই? বডিগার্ডের সঙ্গে রয়ে গেছে! বডিগার্ড শব্দটা ব্যঙ্গের সুরে বলল সে।
আমাদের ওপর অযথাই রেগে আছো। হাহ হাহ! তা কি জন্যে এসেছ?
গারেজ থেকে গাড়িটা নিতে, ল্যামবোরগিনটা দেখাল ডিন। ডায়নাই অনুরোধ করল।
পিকআপ থেকে নামল কিশোর। এত পত্রিকা কার জন্যে?
ওর জন্যেই। আজকের কাগজেও ওর ছবি বেরিয়েছে। বলল সব কটার একটা করে কপি কিনে নিয়ে যেতে।
ওর কাজ করে দিতে আপনার ভাল লাগে, না?
লাগলেই বা কি? তোমার জ্বালায় কিছু করতে পারব নাকি? আর তোমাকেই বা দোষ দিয়ে কি হবে? যতবারই ওর কাছাকাছি যেতে চাই, কেউ না কেউ এসে মাঝখানে পড়ে বাগড়া দেবেই।
এ-জন্যেই আমার ওপর রাগ, না? হেসে বলল কিশোর। বিশ্বাস করুন, বাগড়া দিয়ে শয়তানি করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই।
তাহলে ওভাবে পিছে লেগে রয়েছ কেন?
রহস্যের লোভে। দারুণ একটা কেস পেয়ে গেছি। বোরজিয়া ড্যাগারকে ঘিরে জমে উঠেছে রহস্য। এর কিনারা করার জন্যেই ঘোরাফেরা করি ম্যানশনে।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইল ডিন। মনে হলো না, কথাটা বিশ্বাস করেছে।
ডিন, আপনাকে পেয়ে ভালই হলো। হয়তো বুঝতে পারছেন, ডায়নাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে। আমাদেরকে সাহায্য করেন না কেন?
ডায়নার ওপর কড়া নজর রাখছি আমি।
কই আর রাখলেন? এই তো, চলে এলেন এখানে। যদি এই সময়ের মধ্যে কিছু হয়ে যায়?
কেন, তোমার বন্ধু আছে না ওখানে?
হ্যাঁ, আছে। সেজন্যেই তো বলছি, চোখ রাখার দরকার নেই। অন্যভাবে সাহায্য করুন আমাদেরকে।
কি ভাবে?
আসুন আমার সঙ্গে। রকি বীচ মিউজিয়ামে যাব। এ সবের পেছনে জুভেনারের হাত থাকতে পারে। তাহলে তাকে ঠেকাতে হবে। সাহায্য দরকার আমার। আপনি এলে ভাল হয়।
কি যেন ভাবল ডিন। তারপর মাথা নাড়ল, বেশ, চলুন তাহলে।
*
মিউজিয়ামে ঢোকার সময় চুলে হাত চালাল ডিন, অস্বস্তি বোধ করছে। শেষে বলেই ফেলল, কিশোর, আমি গোয়েন্দা নই। এ সব কাজ আমাকে দিয়ে কি হবে? তারচেয়ে আমি ম্যানশনে চলে যাই, ডায়নার কাছে কাছে থাকলে কাজ হবে।
আসুন। বেশিক্ষণ লাগবে না। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব শুধু জুভেনারকে।
রিসিপশনিস্ট জানাল, অফিসে নেই জুনোর। কোথায় গেছে, বলতে পারল না। ফিরতে দেরি হবে। বসা যাবে কিনা, জিজ্ঞেস করল কিশোর। রিসিপশনিস্ট বলল, ঠিক আছে, ওর অফিসে গিয়ে বসো।
এসে বসে আছে তো আছেই ওরী। জুভেনারের দেখা নেই।
উঠে যাবে কিনা ভাবছে কিশোর, বিশেষ করে ডিনের চাপাচাপিতে বিরক্ত হয়েই অনেকটা, এই সময় দরজা খোলার শব্দ হলো। ফিরে তাকাল দুজনে।
জুভেনার নয়। বাদামী সুট এ দুজন বিশালদেহী লোক।
জুভেনার কই? জিজ্ঞেস করল একজন।
তার জন্যেই তো বসে আছি আমরা, জবাব দিল কিশোর।
আসবে কখন?
জানি না। সেক্রেটারি বলল, দেরি হবে। কোথায় গেছে, জানে না।
হারামজাদাকে পেলে মজা দেখাতাম আজ! হাত মুঠো করে ফেলেছে লোকটা। টাকা দেবে না, ওর বাপ দেবে।
এই, কি বলছ! ধমক দিয়ে বলল দ্বিতীয়জন। মাথা সব সময়ই গরম হয়ে থাকে! চলো, পরে আসা যাবে।
প্রথম লোকটাকে প্রায় টেনে বের করে নিয়ে গেল দ্বিতীয়জন।
টানাটানিতে একজনের কোটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হোলস্টার, কিশোরের চোখ এড়ায়নি সেটা। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, দেখলেন?
কী? অবাক হলো ডিন।
পিস্তল। দুজনের কাছেই পিস্তল আছে।
বলে কি! ভয় পেয়ে গেল ডিন। তবে কি জুভেনারকে খুন করতে এসেছিল?
কি জানি!
আমি আর বসব না। চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ঘড়ি দেখল কিশোর। হ্যাঁ, সাড়ে চারটে বাজে। চলুন।
সেক্রেটারির কাছে এসে জুভেনারের বাড়ির ঠিকানা চাইল কিশোর।
একটা কাগজে খসখস করে কিছু লিখে বাড়িয়ে দিল সেক্রেটারি।
লেখাটা পড়ে কিশোর বলল, হার্ড লেক। পাশের শহরটাই। ডায়নাদের বাড়ি থেকে দূরে না। ডিনের দিকে তাকাল। যাবে নাকি?
না, বাবা, আমি পারব না! দুহাত নাড়ল ডিন। পারলে তুমি যাও। আমি ম্যানশনে যাচ্ছি।
হাসল কিশোর। এত ভয় পেলেন? চলুন, আমিও যাব। মুসার সঙ্গে কথা আছে। রসিকতার ভঙ্গিতে চোখ টিপল সে। দেখি, ও সরতে রাজি হয় কিনা। তাহলে খানিকক্ষণের জন্যে একলা পাবেন আপনি ডায়নাকে। ওর বডিগার্ড হওয়ার খায়েশটা পূরণ হবে।
*
মরগান ম্যানশনের কাছে পৌঁছল দুটো গাড়ি। লাল ল্যামবোরগিনিটা আগে আগে রয়েছে, পেছনে কিশোরের পিকআপ।
ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে আসতেই গাড়ি-বারান্দায় আরেকটা গাড়ি চোখে পড়ল।
ওটার কাছে এসে পিকআপ থামিয়ে নামল কিশোর।
এই যে, তোমরা এসেছ। ডায়না কোথায়?
ফিরে তাকল কিশোর। প্রাসাদের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়লেন তার দিকে ডক্টর নরিয়েমা। প্রশ্নটা তিনিই করেছেন।
ল্যামবোরগিনির দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল ডিন। কেন, মুসার সঙ্গেই তো ছিল! এখানেই থাকার কথা!
অবাক হলেন ডক্টর। বলো কি? আমি এসে দেখি, দরজা খোলা। ওরা নেই!
কিশোর আর ডিনও অবাক হলো। শঙ্কা ফুটল ডিনের চোখে।
খোঁজ করা দরকার। জরুরী কণ্ঠে বলল কিশোর। ডিনকে পাঠাল প্রাসাদে খুঁজতে। সে চলল গ্যারেজে দেখতে।
চারটে দরজাই খোলা। লনে কাজ করার যন্ত্রপাতি আর কিছু গ্রিল পড়ে থাকতে দেখা গেল গ্যারেজের দুটো ঘরের ভেতরে, বাকি দুটো পুরো খালি।
গাড়ি নিয়ে গেছে, ভাবল কিশোর। ফিরে চলল প্রাসাদে।
মাঝপথে থাকতেই দরজায় দেখা দিল ডিন। উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে ডাকল
দৌড় দিল কিশোর।
ড্যাগার! ড্যাগার! চেঁচিয়ে বলল ডিন।
কি হয়েছে? কিশোর জানতে চাইল।
ডিনের চোখে ভয়। নেই ওটা!
ডিনের পাশ কাটিয়ে ছুটে পারলারে ঢুকল কিশোর। আবার জায়গামত ঠেলে সরিয়ে রাখা হয়েছে বুককেসটা, ছবিগুলো ঝোলানো রয়েছে ঠিকমতই। সোজা সাইডবোর্ডের দিকে এগোল সে। পড়ে রয়েছে কাঁচের বাক্স। ডালা খোলা। ছুরিটা নেই ভেতরে। দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টর নরিয়েমার দিকে তাকাল সে!।
ডিন, ওপরতলায় খুঁজুন, কিশোর বলল। ডক্টর, আপনি হলওয়ে আর সিটিংরূমে দেখুন। আমি এখানে দেখছি। বলা যায় না, মুসাও লুকিয়ে রেখে যেতে পারে।
সমস্ত পারলারে তন্নতন্ন করে খুঁজল কিশোর। ড্রয়ার, কার্পেটের নিচে, বইয়ের ফাঁকে-মোট কথা ছুরি লুকানো যায় এ রকম কোন জায়গা বাদ দিল না
নেই।
ডিন আর ডক্টর নরিয়ে ফিরে এল শূন্য হাতে। দুজনেই মাথা নাড়ল।
কি হতে পারে বলো তো? ডিনের প্রশ্ন। ডায়নাকে কিডন্যাপ করল নাকি কেউ? সেই সাথে ছুরিটাও নিয়ে গেল?
আমার তা মনে হয় না। গাড়ি নেই যেহেতু মুসাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরোতে পারে। বসে থেকে থেকে বের হয়ে গিয়েছিল হয়তো। কোথায় যেতে পারে, বলুন তো?
কান্ট্রি ক্লাব! সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল ডিন।
কিংবা মলে!
বেশ। ডক্টর, আপনি আর আমি চলুন ক্লাবে যাই। ডিন, আপনি মলে যান।
বাইরে বেরোতেই দেখা গেল একটা গাড়ি আসছে। ডায়নার গাড়িবারান্দায় এসে থামল ওটা। দরজা খুলে নেমে এল ডায়না আর মুসা। অবাক দৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।
ডায়না জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
কোথায় গিয়েছিলেন? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
ঘুরতে। ভাল্লাগছিল না বসে থেকে থেকে। কিন্তু হয়েছেটা কি? মুখ অমন করে রেখেছ কেন? কি ব্যাপার?
আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।
আমার জন্যে? কেন? সাথে তো মুসাই আছে। আর আমি কচি খুকি না। বেরোতেই পারি যখন খুশি।
তা পারেন। ভাবতাম না, যদি বোরজিয়া ড্যাগারটা গায়েব না হয়ে যেত।
কি বললে!
ঠিকই বলছে, বললেন নরিয়েমা। খুলে বললেন, কি হয়েছে।
থমথমে হয়ে গেছে ডায়নার চেহারা। একটা কথাও আর না বলে চুপচাপ ঘরে ঢুকল, ছুরির বাক্সটা দেখার জন্যে।
*
আমি জুভেনারের ওখানে যাচ্ছি, ঘোষণা করল কিশোর। সারাটা বিকেল ওর অফিসে বসে থেকে এসেছি। ফেরেনি। সে-ও এসে ছুরিটা চুরি করে নিয়ে পালাতে পারে।
তা পারে, ডায়না বলল। কারণ বাড়ির দরজা-জানালা খোলাই ছিল।
ভুল করেছ, গম্ভীর হয়ে বললেন ডক্টর। এত দামী দামী জিনিস রয়েছে ঘরে। তালা দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
যায়নি যখন, কি আর করা? কিশোর বলল। জুভেনারের বাসার ঠিকানা নিয়ে এসেছি। কারও ইচ্ছে করলে আসতে পারেন আমার সঙ্গে।
মাথা নাড়ল ডায়না আর ডিন। আর ডায়না যেহেতু থাকছে, মুসাও যাবে না। ডক্টর নরিয়েমা বললেন, আমি যাব। লোকটার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া আছে আমার। জিজ্ঞেস করব, মেয়েটাকে এত জ্বালাচ্ছে কেন?
ক্লিফসাইড হাইটস পেরিয়ে এল ওরা। শর্ট নেক চেনেন নরিয়েমা, কিশোরকে পথ বলে দিতে থাকলেন। পথের দুধারে এখন ঘোট ঘোট বাড়ি আর টাওয়ারের মত উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া বিশাল ম্যাপল গাছ। বাড়িঘরগুলো দেখতে সব প্রায় একই রকম। সাদা রঙ করা দেয়াল, ছিমছাম সন আর সুন্দর ফুলের বাগান। ঠিকানাটা তার হাতে তুলে দিয়েছে কিশোর। নম্বর দেখছেন নরিয়েমা। একটা বাড়ি দেখিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ওটাই।
অন্য বাড়িগুলোর মত পরিচ্ছন্ন নয় এটা। আগাছা সাফ হয় না বহুদিন। সর্বত্র। অযত্নের ছাপ।
গাড়িটাড়ি তো দেখছি না, কিশোর বলল। বোধহয় বাড়ি নেই।
এখন কি করবে তাহলে?
আপনি গাড়িতে বসুন। আমি দেখে আসি।
শূন্য ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে চলা কিশোর। প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ময়ল, জল ফেলে রেখেছে যেখানে সেখানে। নোংরা করে রেখেছে জায়গাটা।
সামনের দরজায় এসে ঘন্টা বাজল সে।
জবাব নেই।
আবার বাজাল। সাড়া মিলল না এবারেও। তুতীয়বার বাজিয়ে, জবাব না পেয়ে পাশে একটা জানালার কাছে চলে এল। ভেতরে উকি দিয়ে দেখল কেউ নেই। ফিরে এল পিকআপের কাছে।
কি আছে? জিজ্ঞেস করলেন নরিয়েমা।
না। বিছানা এলোমেলো। টেবিলে পড়ে আছে অধোয়া থালা-বাসন দেখে মনে হয়, তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে।
তার মানে পালিয়েছে। ছুরিটা চুরি করে।
হতে পারে। কিন্ত এর কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না আমি! জুভেনার চায় সময় জিনিস যেগুলো মিউজিয়াম থেকে নিয়ে এসেছে ডায়না। শুধু একটা ছুরি চুরি করে পালাবে কেন? প্রশ্নটা এখন হঠাৎ করেই উদয় হলো কিশোরর মাথায়।
.
১২.
একটা মুহূর্তও আর এ ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার, ডায়না বলল। কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব।
তা ঠিক, মাথা দোলালেন নরিয়েমা। ভাল না লাগলে, চলো, বাইরে থেকে ঘুরে আসি। রাতের খাওয়াটাও কোন রেস্টুরেন্টে সেরে নেয়া যাবে। চলো, আজ আমিই খাওয়াব তোমাদের।
আইডিয়াটা মন্দ না, কিশোর বলল। কোন রেস্টুরেন্টে যাবেন?
ডিলমারস প্লেস।
চমৎকার জায়গা!তুড়ি বাজাল মুসা। রান্না খুবই ভাল। দামও বেশি।
দামের জন্যে ভাবতে হবে না তোমাদের, হাসলেন ডক্টর।
মুসার দিকে ফিরে বলল কিশোর, ঠিক আছে, তুমি যাও ওদের সঙ্গে। আমি রবিনকে নিয়ে চলে আসব সময়মত। মলে রেখে এসেছি ওকে, এনুডার ওপর নজর রাখার জন্যে।
*
পিকআপটাকে দেখে হাসল রবিন। তার গাড়ির পেছনে পিকআপ থামাল কিশোর। এনুডার বাড়ি থেকে ব্লকখানেক দূরে।
নেমে এগিয়ে এল সে। জানালার কাছে ঝুঁকে বলল, মলে গিয়েছিলাম। দেখলাম, শূটিং শেষ। তুমি নেই, এনু নেই। ভাবলাম, এখানেই এসেছ। তা খবর কি?
বিরক্ত হয়ে গেছি। শুটিং শেষ করে সোজা বাড়ি চলে এসেছে এনুডা। তারপর সেই যে গিয়ে ঘরে ঢুকেছে, বেরোনোর আর নামই নেই।
সন্দেহ হয় এমন কিছু চোখে পড়েছে?
নাহ্। একটা দৃশ্যেরই ছবি তোলা হলো কয়েকবার করে। অনেক দর্শক ভিড় করে বসে থাকল চারপাশে গোল হয়ে। কাজ শেষ করে ঘণ্টা দুয়েক আগে বাড়ি চলে এসেছে এনুডা।
কেউ দেখা করেছে তার সঙ্গে?।
করেছে, একটা মোটা লোক। মাথায় টাক। চোখে ভারী চশমা ছটার সময় ওকেই দেখা করতে বলেছে বোধহয় এনূড়া। ওর নামই হয়তো ফ্র্যাঙ্ক।
হু। ভেতরেই আছে এখনও?
না। এসে, কয়েক মিনিট থেকেই চলে গেছে।
বোঝা গেছে। এখানে আর কিছু করার নেই আমাদের। ভুরু নাচিয়ে মিটিমিটি হাসল কিশোর। রাতে খাবে কোথায়?
কেন, বাড়িতে! অবাকই হলো রবিন।
চলো না, কোন রেস্টুরেন্টে চলে যাই?
কিশোরের দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রবিন। ব্যাপারটা কি, বলো তো? হঠাৎ এ ভাবে খাওয়ার দাওয়াত
খুলে বলল সব কিশোর, ছুরি হারানো থেকে শুরু করে, সব।
*
ডায়নার মনমেজাজ খারাপ থাকায় খাওয়াটা তেমন জমল না। বিল মিটিয়ে দিলেন নরিয়েমা। জিজ্ঞেস করলেন, এখন কোথায় যাবে?
বাড়ি, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল ডায়না। ঘুম পেয়েছে আমার।
গাড়ি মোট তিনটে। ডায়নার ল্যামবোরগিনি, কিশোরের পিকআপ, আর রবিনের গাড়ি। তিনজনকে ড্রাইভ করতে হবে।
কিশোরকে অনুরোধ কবে বসল ডায়না, কিশোর, তুমি চালাও না আমারটা! আমার চালাতে ইচ্ছে করছে না!
ঝট করে ডিন আর রবিনের দিকে চোখ চলে গেল কিশোরের। ডিনের চোখে রাগ। রবিনের মিটিমিটি হাসি। বোধহয় কিশোরকে ডায়নার শোফার হিসেবে কল্পনা করেই হাসি পাচ্ছে তার।
নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ডিন আর রবিনের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসল কিশোর।
কিশোর আর ডায়না উঠল ল্যামবোরগিনিতে। রবিনের গাড়িতে রবিন একা। পিকআপে মুসা আর ডক্টর নরিয়েমা। ডিন কারও গাড়িতে উঠল না। সে আশা করেছিল গাড়িটা চালাতে বলবে ওকে ডায়না। সে-অপেক্ষাতেই ছিল। সেটা যখন হলো না, মেজাজ খারাপ করে চলে গেল সে। হুমকি দিয়ে গেল, ছুরিটা আর ফেরত পাবে না ডায়না!
সবাই চলল ওরা মরগান ম্যানশনের দিকে। ডিনই বা এ কথা বলল কেন, আর ডায়নাই বা ডিনকে উঠতে না দিয়ে কিশোরকে গাড়ি চালাতে বলল কেন, দুর্বোধ্য ঠেকল সবার কাছে। তবে এ নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামাল না কেউ।
পথে নরিয়েমার বাড়িতে তাঁকে নামিয়ে দেয়া হলো।
রাস্তায় কোন অঘটন ঘটল না।
তবে বাড়ি পৌঁছে ডিনের ছুরি না দেয়ার কথাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলল কিশোর। প্রথমে রেগে উঠল ডায়না। তারপর আমতা আমতা করতে লাগল। চেপে ধরল তাকে কিশোর, ছুরিটা কোথায় আপনারা জানেন, তাই না?
না না…আ-আমি…কিছু… থেমে গেল ডায়না। তারপর রেগে উঠল, আমাকেই চোর ভাবছ?
সব কথা জানতে চাই আমি, ডায়না, ভারী হয়ে গেছে কিশোরের কণ্ঠস্বর। খুলে বলুন।
এমন কিছু ছিল কিশোরের কণ্ঠে, প্রতিবাদ করার সাহস করল না আর ডায়না। ঠোঁট কেঁপে উঠল তার। ধপ করে বসে পড়ল একটা সোফায়। আঁকুনি লেগে চুল এসে পড়ল মুখের ওপর, সরানোর চেষ্টা করল না। আমাকে খুন করার চেষ্টা কে করেছে, জানি, মোটা খসখসে হয়ে গেছে তার কণ্ঠ।
কে? এনুডা?
মাথা নাড়ল ডায়না। না। এনুডাও নয়, জুভেনারও না।
তাহলে?
দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল ডায়না। চোখে পানি নিয়ে তাকাল কিশোরের দিকে, যেন করুণার আশায়।
কে, ডায়না? কোমল গলা জিজ্ঞেস করল কিশোর।
চোখের পানি আর ঠেকাতে পারল না ডায়না। আমি আর ডিন! সমস্ত ব্যাপারগুলো ছিল সাজানো!
চমকে যাওয়া সব কটা মুখের দিকে এক এক করে তাকাল সে। আর পেটে রাখতে পারল না কথা, গড়গড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল সব, আব্বার রেখে যাওয়া সব টাকা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে, বেহিসেবী খরচ করে শেষ করেছি। আমি। উড়িয়ে দিয়েছি কিছুদিনের মধ্যেই। টাকা ওড়ানো যে এত সহজ, জানতাম না! হঠাৎ একদিন দেখি খালি হয়ে গেছে অ্যাকাউন্ট। চাকর-বাকরের খরচ দিতে পারছি না। বিদেয় করে দিতে হলো ওদেরকে। শুধু যে অ্যাকাউন্টই খালি হয়েছে, তা নয়, ধারও হয়েছে অনেক। ম্যানশনটা বিক্রি করে দিলেও সে-ধার শোধ করে খুব সামান্যই বাকি থাকে। ওই টাকা দিয়ে রকি বীচে কোনমতে ছোটখাট একটা বাড়ি কেনা যায়। খাওয়া-পরার জন্যে একটা কাজ জুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না আমার। সেজন্যেই মিউজিয়াম থেকে আর্ট কালেকশনগুলো ফেরত নিয়ে এসেছি আমি, বলে গেল ডায়না। জানি, বেআইনী ভাবেই করেছি কাজটা। দলিলটা হারিয়ে ফেলেছে জুভেনার, এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি। নিয়ে এসেছি বিক্রি করার জন্যে। চোখের পানির সঙ্গে কালো মাসকারা গাল বেয়ে নামছে তার।
বলে যান, কিশোর বলল। এর সাথে ড্যাগার চুরি আর খুনের চেষ্টার সম্পর্ক কি?
নোরজিয়া ড্যাগারটা নিয়ে বিজ্ঞাপন করা হয়েছে বেশি, নানা রকম ভাবে, গল্প বলে, সিনক্রিয়েট করে। খুনের চেষ্টাগুলো সব সাজানো-বন থেকে আমাকে সই করে গুলি ছোঁড়া, সুইমিং পুলে তার ফেলে রাখা, সব।
কেন?
বললাম না, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের জন্যে। রিপোর্টাররা এসেছে। ফলাও করে খবর ছেপেছে। বিখ্যাত হয়ে পড়েছে বোরজিয়া ড্যাগার। ভাল দাম আশা করেছিলাম আমরা। তা-ই হতে যাচ্ছিল। দুএকজন টো টাকা অফারও দিয়ে ফেলেছে। ডিন আমাকে ভালবাসে, চোখ নামিয়ে দিল ডায়না। আমি বাসি না। কিন্তু তার এই দুর্বলতাটা কাজে লাগিয়ে তাকে দিয়ে এ সব করিয়ে নিয়েছি আমি। একটা মানুষকে কতদিন আর গাধা বানিয়ে রাখা যায়? বুঝতে পেরে সরে গেছে সে!
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।
তারপর মুসা জিজ্ঞেস করল, ছুরিটা কোথায়?
বাগানে। একটা ফুলের বেডের মধ্যে রেখেছিলাম…
কখন?
তুমি তখন বাথরূমে গিয়েছিলে। এই সুযোগে ওটা বাক্স থেকে বের করে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। দরজার দিকে রওনা হলো।
কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল ডায়না। পাবে না। এতক্ষণে নিয়ে গেছে নিশ্চয় ডিন।
তাহলে তাকে খুঁজে বের করব।
ঠিক এই সময় দপ করে নিভে গেল সমস্ত আলো।
.
১৩.
ডিন, ডিনের কাজ! চিৎকার করে বলল ডায়না। আমাকে খুন করবে এবার! প্রতিশোধ নেবে! পাগল হয়ে গেছে!
আল্লাহই জানে, কি করবে? বিড়বিড় করল মুসা। হতে ছুরি আছে যখন..
আছে কোথায় ও রবিনের প্রশ্ন।
আউফ! করে উঠল অন্ধকারে মুসা।
কি হলো? কিশোর উদ্বিগ্ন।
কে যেন পা মাড়িয়ে দিল! ডায়নাই হবে!
তোমার পা? জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ডায়না। আমি টর্চ খুঁজছি…
ড্রয়ার খোলার শব্দ হলো। অন্ধকার চিরে দিল টর্চের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।
দুটো আছে, ডায়না বলল।
আমাকে একটা দিন, বলল মুসা।
এই, চুপ! শোনো! ফিসফিসিয়ে বলল রবিন। সবাই শুনতে পেল বিচিত্র শব্দটা। থেমে গেল হঠাৎ।
এল কোত্থেকে? বুঝতে পারছে না ডায়না।
কি জানি! বুঝতে পারল না মুসাও। মনে হয় নিচে কোন জায়গা থেকে। দেখি, আলোটা জ্বালানো যায় কিনা।
সেলারের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। টান দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকল। সারকিট ব্রেকারের বাক্সটার কাছে এসে আলো ফেলল। মেইন সুইচ অফ করা। টান দিয়ে তুলে দিল ওটা। নিশ্চয় আলো জ্বলেছে, নিজেকে বলল সে।
বাইরে বেরিয়ে দেখল আগের মতই অন্ধকারে রয়েছে প্রাসাদ। আলো জ্বলেনি।
মেইন লাইনের তারটার কেটে দিয়েছে, অনুমান করল কিশোর আলো নেভাল, চিন্তিত শোনাল কিশোরের কণ্ঠ, অথচ আসছে না! ও কিছু করার আগে আমাদেরই ওকে খুঁজে বের করা উচিত। এসো তো।
টর্চের আলোয় পথ দেখে সামনের দরজার দিকে এগোল চারজনে। গ্রীষ্মের রাতের ভ্যাপসা গরম, আঠা আঠা করে দেয় ঘাম। এই পরিবেশে ওদের মনে হলো সব কিছুই যেন খুব ধীরে ঘটছে, স্লো মোশন ছায়াছবির মত। পুরানো কাঠ আর ধুলোয় ঢাকা কার্পেটের গন্ধ ভাসছে ঘরের বাতাসে। একের পর এক ঘরে ঢুকছে ওরা, আর একই রকম গন্ধ পাচ্ছে।
হঠাৎ থ্যাক করে একটা শব্দ হলো। ঝটকা দিয়ে মুখ তুলল কিশোর। ওপরে তাকাল। এক দৌড়ে হল পেরিয়ে এসে উঠল সিঁড়িতে। ঠিক পেছনে রয়েছে মুসা। সিঁড়ির মাথায় উঠে হলঘরে টর্চের আলো ফেলে দেখল। শূন্য ঘর।
ভুল করছেন আপনি, ডিন, চেঁচিয়ে বলল কিশোর। আমরা চারজন, আর আপনি একা। কিছুতেই পারবেন না। গোলমাল না করে বেরিয়ে আসুন। কিছু বলব না আপনাকে।
সাড়া নেই।
ডান দিকে হয়েছিল শব্দটা, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
দেয়ালের দিকে পিঠ করে পা টিপে টিপে সেদিকে এগোল সে আর মুসা। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বন্ধ। পাথর হয়ে পঁড়িয়ে রইল কয়েকটা সেকেন্ড।
তারপর হঠাৎ এক লাথি মেরে পাল্লা খুলে ফেল্প কিশোর। পরক্ষণেই সেটে গেল দেয়ালের সঙ্গে।
ঝটকা দিয়ে খুলে দেয়ালের সঙ্গে খটখট করে বাড়ি খেলো পাল্লাটা। কেউ বেরিয়ে এল না ঘর থেকে। টর্চ জ্বেলে ঘরে আলো ফেলল কিশোর। বড় একটা বিছানা রয়েছে, চানপাশে বেশ কিছু আসবাবপত্র। একটা আলমারির কাছে এসে টান দিয়ে খুলল দরজা। ভেতরে তিনটে কোট ঝুলছে হ্যাঁঙারে।
পালিয়েছে, মুসা বলল।
কিন্তু কোন পথে? কিশোরের প্রশ্ন। আবার বেরিয়ে এসে হলঘরে আলো ফেলল। ডায়না আর রবিনই বা কোথায়? কোন সাড়া নেই!
তার কথার জবাবেই যেন উল্টো দিক থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ চিৎকার।
দৌড় দিল দুজনে। একটা ঘরে শব্দ শোনা গেল। ছুটে ভেতরে ঢুকল ওরা। মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে একটা দেহ, টর্চের আলো পড়ল তার ওপর।
রবিন! উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর। কি হয়েছে, রবিন? হাঁটু মুড়ে বসল তার পাশে।
উফ, কানটা…! কান চেপে ধরে আছে রবিন।
দেখি তো, রবিনের হাতটা সরিয়ে দিয়ে কানের দিকে তাকাল কিশোর। আরি, রক্ত পড়ছে তো! অবশ্য বেশি কাটেনি।
এখানে কি করছিলে তুমি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
তোমরা চলে যাওয়ার পর আমি আর ডায়না ভাবলাম পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই। ও সোজা তিনতলায় উঠে গেল। আমি দোতলায় উঠতেই একটা শব্দ কানে এল।
তারপরেই তুমি এখানে এসে ঢুকেছ? কিশোর বলল। টর্চ ছাড়া?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। এখানে ঢুকতেই শুনলাম, পেছনে কে যেন ফিসফিস করে ডায়নার নাম ধরে ডাকছে। ফিরে চেয়ে আবছা একটা মৃর্তিকে দেখলাম, ডিনের মতই লাগল। ছুরি চালাল। সরে গিয়েছিলাম, ফলে শুধু কানে একটু খোঁচা লেগেছে। চিৎকার করে উঠলাম। ও বুঝে ফেলল আমি কে। গাল দিয়ে উঠে দৌড়ে চলে গেল। কেঁপে উঠল রনি। লোকটা পুরো পাগল হয়ে গেছে।
ভাগ্যিস কান ছাড়া আর কিছু কাটতে পারেনি, কিছুটা রসিকতা করেই বলল মুসা।
কান দিল না রবিন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না! ডিনের মাথা এখন খারাপ! ডায়াকে পেলে ছাড়বে না। জলদি চলো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো!
ওপরতলা থেকে হঠাৎ আরেকটা চিৎকার শোনা গেল, প্রতিধ্বনি তুলল প্রাসাদের দেয়ালে। ছুটতে আরম্ভ করেছে ততক্ষণে কিশোর, মুসা আর রবিন। বড় একটা চিলেকোঠায় এসে ঢুকল।
ঢালু হয়ে নেমে গেছে কাঠের সিলিং। শেষ প্রান্তে একটা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ডিন আর ডায়না।
সরো, জানোয়ার কোথাকার! হিস্টিরিয়া রোগীর মত চেঁচিয়ে উঠল ডায়না। ছুরিটা তুলে ধরেছে ডিন। এবার টেবিলের এ পাশ ঘুরে, আরেকবার ওপাশ ঘুরে পৌঁছতে চাইছে ডায়নার কাছে।
এই, ফেলো ওটা! দরজার কাছ থেকে বলল কিশোর।
ঝট করে ঘুরে তাকাল ডিন। মুখে পড়েছে কিশোরের টর্চের আলো।
বিকট চিৎকার করে টেবিলের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ডিন। প্রায় পিছলে চলে এল আরেক পাশে। ছুরি তুলে ছুটে এল কিশোরকে মারার জন্যে। কাছে এসে প্রথমেই থাবা দিয়ে কিশোরে হাত থেকে টর্চটা ফেলে দিল। মেঝেতে গড়াতে শুরু করল ওটা, তবে আলো নিভল না। থাবা দিয়ে ধরতে গিয়েও পারল না কিশোর, চলে গেছে আওতার বাইরে।
বোরজিয়া ড্যাগারের স্বাদ দেখে কেমন লাগে! সাপের মত হিসহিস করে উঠল ডিন।
দাঁড়িয়ে রইল না মুসা। তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলে নিল টর্চটা, দুজনের গায়ের ওপর ফেলে দেখল, ডিনের ছুরিধরা হাতটা ধরে ফেলেছে কিশোর। কব্জির ওপরটায় একহাতে ধরে মোচড় দিয়ে আরেক হাতে কিছু একটা করল সে, ছুরিটা প্রায় উড়ে চলে গেল ডিনের হাত থেকে। খটাং করে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
ঘরের সবাই ছুটল ওটার দিকে। কিশোর, ডিন, রবিন, মুসা, ডায়না, সব্বাই। একসাথে হাত বাড়াল ওটা তুলে নেয়ার জন্যে। শুধু একজনের হাত পৌঁছল ওটার ওপর।
সরো! সরে যাও! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল রবিন আর ডায়নাকে।
মাথার ওপর ছুরিটা তুলে ঘোরাতে লাগল ডিন।
হঠাৎ লাফিয়ে এসে পড়ল ডায়নার ওপর। বাহু দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরল। চেঁচানোর চেষ্টা করল ডায়না, সুর বেরোল না ঠিকমত, আ-আ-মার…দম…
ছুটে গেল কিশোর-মুসা।
সরো! ছুরিটা ডায়নার গলায় ঠেকিয়ে ধমক দিয়ে বলল ডিন।
মাঝপথেই দাঁড়িয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
এ রকম হওয়ার কথা তো ছিল না, ডায়না! তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে ডিনের কণ্ঠ। কত কষ্ট করে, আলাপ-আলোচনা করে প্ল্যান করেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা সুখে কাটাব দুজনে। কিন্তু তুমি সব নষ্ট করেছ। সব শেষ করে দিয়েছে তোমার লোভ। কি, করেনি?।
ডি-ডিন, ছড়ো…! শরীর মুচড়ে গলা ছাড়ানোর চেষ্টা করল ডায়ণ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি পাগল হয়ে গেছ!
প্যাঁচ আরও শক্ত করল ডিন। আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছ, স্বীকার করো সে-কথা! করতে লজ্জা লাগছে? বলো, নীলামের সমস্ত টাকা মেরে দেয়ার ফন্দি করোনি তুমি? আমাকে কি দিতে চাওনি?
নাআআ…! হাঁসফাঁস করছে ডায়না। ছাড়ো, প্লীজ…
ঠেলে নিয়ে চলল তাকে ডিন। ধাক্কা দিয়ে ফেলল একটা কেবিনেটের ওপর। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ওটার দরজা। অসংখ্য প্লেট আর রূপার তৈজসপত্রের ফোয়ারা ঝরতে লাগল যেন। ওপর দিকে তাকাল সে। কিছুটা ঢিল হয়ে গেল বাহুর বাধন।
সুযোগটা কাজে লাগাল ডায়না। ঝাড়া মেরে গলা ছোটাল, তবে বাসনে পা পিছলে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। ঝনঝন করে পড়ছে জিনিসপত্র।
আলো নিভিয়ে দিল মুসা। নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল যেন।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলে লড়াই। শেষ হলো ভোতা একটা ধুপ শব্দ দিয়ে।
আবার যখন আলো জ্বালল মুসা, দেখা গেল ডিনের ভূপাতিত নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। ডান হাতের আলগা মুঠোয় পড়ে আছে বোরজিয়া ড্যাগার।
বেশি জোরে মারলাম না তো? হাতের টর্চটা নেড়ে হেসে বলল মুসা। মরে না গেলেই বাঁচি।
আরে নাআহ, ঠিক হয়ে যাবে, ডায়নাকে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলল কিশোর।
মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই! ফুঁপিয়ে উঠল ডায়না।
আর পারবে না, অভয় দিল কিশোর।
বাইরে একটা গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।
কে এল? রবিনের প্রশ্ন।
কি জানি! মুসা বলল।
এখনও কাঁপছে ডায়না। ধরে ধরে তাকে এনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল কিশোর।
সব আমার দোষ, কিশোর, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ডায়না। আমি আর ডিনই সব করেছি…
এক মিনিট, হাত তুলল রবিন। হাতের টর্চটা ঘোরাল ডায়না আর ডিনের ওপর। একটা ব্যাপার বাদ পড়ে যাচ্ছে। ধরলাম, বনের ভেতর থেকে গুলি করেছিল ডিন। সুইমিং পুলে বিদ্যুতের তার ফেলে রাখাটাও ওর কাজ। কিন্তু সেদিন পার্টিতে ইলেকট্রিসিটি অফ করে দিয়ে মূর্তিটা ঠেলে ফেলল কে সেটা তো তার কাজ হতে পারে না?
ডায়নার দিকে তাকাল কিশোর-মুসা। পেছনের সিঁড়িতে মৃদু পায়ের শব্দ হলো।
কি, জবাব দাও? ডায়নার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন। দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল ডায়না। ঘরে স্নান আলো এসে পড়ল।
ফিরে তাকাল অন্যরা।
হাতে একটা কেরোসিনের বাতি নিয়ে গড়িয়ে আছেন ডক্টর নরিয়েমা। মুখে কুৎসিত হাসি। হাতের পিস্তলটা তুলে বললেন, এই যে তোমার জবাব।
.
১৪.
ডায়না, সব ভণ্ডুল করে দিয়েছ তুমি, নিমের তেতো করল যেন ডক্টরের কণ্ঠে। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। সব ঠিকঠাক চলছিল। এ রকম যে ঘটবে ভাবতেই পারিনি।
আমাদেরকে খুন করবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল।
ডায়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াও তোমরা তিনজন, তিন গোয়েন্দাকে নির্দেশ দিলেন তিনি। ডিনের কাছে। ডায়না, সরো। সেটটা এমনভাবে সাজাব, যাতে মনে হয়, তিনজনকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে ডিন। খিকখিক করে হাসলেন তিনি। খবরের কাগজে হেডিং কি বেরোবে, এখনই আন্দাজ করতে পারছি। দারুণ খবর ছাপবে ওরা। সব দোষ পড়বে ছুরিটার ঘাড়ে। ফলাও করে ওরা লিখবে, বোরজিয়া ড্যাগারের রক্তলালসার কারণে মারা পড়ল এতগুলো তরুণ প্রাণ। আহারে! পিস্তল নাড়লেন তিনি। দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।
ধীরে ধীরে ডিনের দিকে এগোল ওরা।
প্লীজ, খালা…
চুপ! এখানে এসো! আমার পাশে!
পিস্তলটা এখন কিশোরের দিকে ধরে রেখেছেন ডক্টর। উঠে দাঁড়াল ডায়না, টলমল করছে শ, যেন যে কোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। আমি…আমি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, খালা। আপনার কথা বলিনি ওদেরকে। কেন এলেন? কারোই তেমন কোন ক্ষতি হত না…
আমার হত! সব টাকা পানিতে যেত! জুভেনার সমস্ত মাল ফিরিয়ে নিয়ে গেলে আমার টাকাগুলোর কি হত? মাথা নাড়লেন ডক্টর। আমি তা হতে দিতে পারি না।
ভাবনার ঝড় বইছে কিশোর-মুসার মাথায়। চোখ বোলাচ্ছে সারা ঘরে। মুক্তির উপায় খুঁজছে।
হাত তোলো! কড়া আদেশ দিলেন ডক্টর। সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমাদের ফন্দি বুঝতে পারছি না আমি মনে করেছ?
কিছু করার নেই ওদের। আদেশ মানতে বাধ্য হলো। হারিকেনের আলো কেমন ভূতুড়ে ছায়া ফেলেছে ঘরের ভেতর। ডিনের কাছাকাছি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিনজনে। ডায়না এগোল দরজার দিকে।
এই মেয়ে, জলদি করো না! বেঁকিয়ে উঠলেন ডক্টর। সারারাত দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?
বুকের ওপর ঝুলে পড়তে চাইছে ডায়নার মাথা, এতই ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাকে। তবে নরিয়েমার আদেশ পালন না করে পারল না।
ধরো, হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর। শক্ত করে ধরে রাখে। খবরদার, ছাড়বে না! ডায়না বাতিটা হাতে নিতেই দুহাতে ধবলেন পিস্তলটা, যাতে গুলি করার সময় না নড়ে। প্রথমে কিশোরের দুচোখের মাঝখানে নিশানা করলেন।
মারতে খারাপই লাগছে। চালাক-চতুর ছিল। স্বভাবও ভাল, জোরে নিঃশাস ফেললেন ডক্টর। কিন্তু উপায় নেই।
তারপর ঘটতে লাগল একের পর এক ঘটনা। অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেল ঘরের আলো। গুলির শব্দ হলো। শোনা গেল আরেকটা চিৎকার।
দরজার দিকে ঘুরে গেল কয়েক জোড়া চোখ। হ্যারিকেনের সাতে পুরো বাড়িয়ে দিয়েছে ডায়না। ডক্টরের চোখের সামনে ধরে রেখেছে।
শয়তান! উন্মাদ হয়ে গেছে ডায়না। যত নষ্টের গোড়া তুমি! ডিনকে জানোয়ার বানিয়ে ছেড়েছ! আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছ। তোমাকে শেষ করব এবার আমি…।
হ্যারিকেনটা ডায়নার হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেন নরিমো। টানাটানিতে ছুটে গেল ওটা ডায়নার হাত থেকে, উরও ধরে রাখতে পারলেন না, মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল কাঁচ, গড়িয়ে চলে গেল টেবিলটার তলায়। তবে আলো নিভল না।
ভেবেছিলাম তোকে কিছু করব না! ভীষণ রেগে গেছে নরিয়েমা। এবার তোকেও শেষ করব।
ডায়নার দিকে পিস্তল যোরালেন তিনি।
এটাই সঠিক সময়। নড়ে উঠল রবিন। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল চারের সামনে। দা চালানোর মত করে কোপ মারল আর হতে। খসে পড়ে গেল।
আহত বিড়ালের মত চিৎকার করে উঠ পিলটা তুলে নেয়ার জন্যে পা বাড়ালেন ডক্টর। লাথি মেরে পিলটা সরিয়ে দিল রবিন। হ্যারিকেনের কাছে গিয়ে পড়ল ওটা।
দেখে প্রথমটায় কিছুক্ষণের জন্যে হয়ে গেল সবাই। পুরনো কাঠের মেঝেতে কেরোসিন পড়েছে, আগুন ধরে গেছে তাতে। শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে টেবিলের পায়া, তাতেও আগুন ধরল।
নেভাও! নেভাও! চিৎকার করে বলল ডায়না।
ফায়ার এক্সটিংগুইশার কোথায়! মুসা জিজ্ঞেস করল।
আমি জানি না…
এর বেশি আর শোনার অপেক্ষা করল না কিশোর-মুসা। যেভাবে শুকিয়ে রয়েছে কাঠ, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে দেরি হবে না। একটানে রবিনকে নিয়ে দরজার দিকে এগোল কিশোর। বেরোনোর আগে ডক্টরের হাত চেপে ধরল। দুজনকেই টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মুসাও দাঁড়িয়ে নেই। ডিনকে তুলে নিয়ে দৌড় দিয়েছে।
ডায়নাকে কিছু বলতে হলো না। সে নিজে নিজেই ছুটে বেরোল দরজা দিয়ে।
যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি দিয়ে নামল ওরা। সদর দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল কামানের গোলার মত সবাই, শুধু মুসা বাদে। ডিনকে বয়ে নিতে হচ্ছে তাকে।
বাইরে বেরিয়ে দেখল পুলিসের একটা গাড়ি এসে গেমেছে। দুজন পুলিস নেমে দৌড়ে এল প্রাসাদের দিকে।
বেরিয়েছে! চেঁচিয়ে বলল একজন।
কিশোরকে গালাগাল করতে করতে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন নরিয়েমা।
ছাড়ল না কিশোর। টানতে টানতে তাকে নিয়ে এগোল পুলিসের গাড়ির দিকে। দুজন পুলিসের একজন ওদের চেনা, পল নিউম্যান। উত্তেজিত কণ্ঠে তাকে জানাল কিশোর, তিনতলায় আগুন লেগেছে!।
দেখেছি, জবাব দিল পল। ফোন করে দিয়েছি দমকলকে। ভুরু কোঁচকাল সে। গুলির শব্দ শুনলাম মনে হলো?
দেখুন অফিসার, অভিযোগ শুরু করলেন ডক্টর, এই গুণ্ডাটা আমাকে…
কিশোর, ওভাবে টানাহেঁচড়া করছ কেন মহিলাকে? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার? ছাড়ো, ছাড়ো…
মিস্টার নিউম্যান, কিশোর বলল, গুলি যেটা শুনেছেন, এই মহিলাই ছুঁড়েছে। আমাকে মারার জন্যে।
সন্দেহ মেশানো বিস্ময় দেখা দিল পলের চোখে। একবার মুসার দিকে একবার কিশোরের দিকে তাকাতে লাগল। এই মহিলা!
হ্যাঁ। মুসা জবাব দিল। তা আপনি এলেন কি করে এখানে?
পাতলা পলিথিনের ব্যাগে করে সিলভার-প্লেটেড একটা রিভলভার নিয়ে এসেছে পল। সেটা দেখিয়ে বলল, ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে বনের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল এটা, তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়। আমাদের ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট পরীক্ষা করে বলেছে, এটা মিস্টার মরগানের জিনিস। সেজন্যেই আমরা এসেছি, মিস মরগানকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে।
হ্যাঁ, এটা এখন ডায়নারই! চেঁচিয়ে উঠলেন নরিয়েমা। অ্যারেস্ট করুন ওকে, অ্যারেস্ট করুন!
হুমম, বুঝলাম, মাথা দোলাল পল। আনমনে বিড়বিড় করল, পুরানো অভিশাপ…একজন বৃদ্ধা মহিলা, তরুণকে গুলি…এবং একটা মেয়ে, যাকে তার নিজের রিভলভার দিয়েই গুলি করা হয়েছে..তারমানে…
…ব্যাপার আছে, ফস করে বসল মুসা।
চোখ স্থির হলো পলের। হ্যাঁ, ব্যাপার আছে। লম্বা কোন গল্প। খপ করে হাত চেপে ধরল ডায়না আর নরিয়েমার। আপনাদেরকে থানায় যেতে হবে। সারারাতই থাকতে হতে পারে ওখানে।
পলের কথায় বিশেষ কান নেই ডায়নার। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে তিনতলার দিকে। ঘন ধোঁয়া উড়ছে এখন ওখান থেকে। আমি যাব না…যেতে পারব না…! প্রায় ফিসফিসায় বলল সে।
ওর বাড়ি পুড়ছে তো, বুঝতে পেরে বলল দ্বিতীয় অফিসার। দাঁড়াও খানিকক্ষণ। দমকল আসুক। দেখেই যাই, কি হয়।
দমকল! বিরক্ত ভঙ্গিতে নাক কুঁচকালেন নরিয়েমা। ওদের বুদ্ধি তোমাদের মত হলে আর দেখতে হবে না! সারারাতই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এখানে।
হাতকড়া বের করল পল। দেখে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত নিয়ে গেলেন ডক্টর।
কমলা আগুন নাচানাচি শুরু করেছে প্রাসাদের ছাতে।
পাহাড়ের গোড়া থেকে ভেসে এল সাইরেনের শব্দ।
কিশোরের পেছনে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে রবিন। কিশোর তাকাতে বলল, না, কিছু না। শক পেয়েছি তো, সামলাতে সময় লাগছে।
তা লাগবেই। রবিনের হাত ধরে কিশোর বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার জনেই এখনও বেঁচে রয়েছি আমি।
প্রাসাদের ছাতে আগুন বাড়ছে। বিষণ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে ডায়না। কারও দিকেই নজর নেই তার।
*
জ্যাকেটের বোম এঁটে পিকআপের জানালা খুলে দিল মুসা। তাহলে কি জিনিস তোমার পছন্দ?।
দেখো, মুসা, কিশোর বলল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, আর যা-ই হোক, এই হ্যালোইন ক্যান্ডি অন্তত নয়। ওগুলো বাচ্চাদের খাবার। কতবার বলেছি, তোমার ইচ্ছে হলে খাও যত খুশি, আমাকে সাধাসাধি কোরো না। আমার ভাল্লাগে না।
ভাল, খুব ভাল। স্টিয়ারিং ঘোরাল মুসা। অক্টোবরের চমৎকার বাতাস। মলের দিকে চলেছে ওরা। তোমাকে অন্য কিছুই কিনে দেয়া হবে। রবিন, তুমি?
আমার ক্যান্ডি খেতে আপত্তি নেই, হেসে বলল রবিন। কিশোরের মত তো আর ওজন বাড়ার আতঙ্ক নেই আমার।
পার্কিং লটে এসে গাড়ি রাখল মুসা। তিনজনেই নামল। এলিভেটরে উঠল শুধু ওরাই, আর কেউ নেই। চারতলায় এসে আস্তে করে থামল কোন ঝাঁকুনি ছাড়া।
খবরদার, মুসা! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। দরজা খুলতেই এলিভেটরের অন্য পাশে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে গেছে সে। লাফিয়ে সরে এল মুসাও।
খাটো, টাকমাথা একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে মেশিনগান নিয়ে। মুখে মুখোশ। চুপ! ধমক দিয়ে বলল কিচকিচে কণ্ঠ, একদম নড়বে না!
এই, কি করছ? লোকটার পেছন থেকে বলল এক মহিলা। ঠেলে লোকটাকে এলিভেটরে ঢোকানোর চেষ্টা করল। ওদের ভয় দেখাচ্ছ কেন? বাজার করতে এসেছে বেচারারা। দাঁড়াও, আজ বাড়ি গিয়ে নিই। পাগলামি তোমার ছাড়াব ভালমত। খেলনা কেনার শখ বের করব!
এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এসে হাসল তিন গোয়েন্দা।
চিড়িয়া একেকটা, হেসে বলল মুসা। পাগল যে কত আছে এদেশে। বাচ্চাদের মত ছিনতাইকারী সাজার শখ হয়েছে।
হ্যাঁ। আরেকটা জুভেনার।
যা-ই বলো, কিশোর, ওটা অনেক বেশি বড় পাগল। মিউজিয়ামের জিনিস ফেরত নেয়ার জন্যে কি কাণ্ডটাই না করল। যেন ওর নিজের জিনিস। ফিরিয়ে নিয়ে তারপর ছাড়ল।
ছাড়ল আর কই? মূর্তিটার জন্যেও কেস করে দিয়েছে ডায়নার বিরুদ্ধে। টাকা আদায় করে তবে ছাড়বে।
মেয়েটার জন্যে খারাপই লাগে। শেষ পর্যন্ত বাপদাদার বসতবাড়িটাও বিক্রি করতে হবে। ভাগ্যিস আগুনটা নেভাতে পেরেছিল দমকল বাহিনী। নইলে বিক্রির জন্যে ওটাও থাকত না।
কোনও চাকরি-টাকরি এখন পেলে হয়।
পাবে। পেয়ে যাবে। পত্রিকায় অনেক বিজ্ঞাপন হয়েছে তো। টিভিতেও চান্স পেয়ে যেতে পারে। অনেক দিন দেখা নেই, ভাবছি দেখা করব…।
ইলেকট্রনিক্সের একটা দোকানের পাশ দিয়ে চলেছে ওরা, তীক্ষ্ণ চিৎকারে থেমে গেল। দোকানের ভেতর টিডি চলছে, চিৎকারটা এসেছে ওটার ভেতর থেকেই। পর্দায় দেখা গেল, পাগলের মত মাথার চুল ছিঁড়ছে আর চেঁচামেচি করছে এটা মেয়ে।
খাইছে। বলতে না বলতেই হাজির! অবাক হয়ে বলল মুসা। চিনেছ? আমাদের ডায়না মরগান! সত্যি সত্যি অভিনয় শুরু করে দিয়েছে টিভিতে!
ঘরময় ছোটাছুটি করছে ডায়না। চেঁচাচ্ছে, কাপ-প্লেট ছুঁড়ছে, চেয়ার উন্টে ফেলছে। হাতের কাছে একটা ফুলদানী পেয়ে সেটা নিয়ে তেড়ে গেল কাঁচুমাচু হয়ে থাকা খানসামার দিকে।
একেবারে নিজের জীবনের ঘটনা, কিশোর বলল। সেজন্যেই এত জীবন্ত।
যা-ই বলো, ট্যালেন্ট আছে মেয়েটা। নাম করে ফেলবে।
খানসামাটি কে, চিনতে পেরেছ ভুরু নাচাল রবিন।
আরে তাই তো, বার্ব এনুডা!
দুজনের অভিনয় দেখতে দেখতে হাসি ফুটল মুসার মুখে। ঠিকই হয়েছে। যেখানে যাওয়ার কথা ওদের, ঠিক সেখানেই গেছে।
এক পর্যায়ে হাসি আর চেপে রাখতে পারল না কিশোর। হো হো করে হেসে উঠল। চমৎকার হাসির অভিনয় করছে ডায়না আর এনুডা। হাসল মুসাও। তারপর হঠাই যেন সংবিৎ ফিরল। আরে, দাঁড়িয়ে আছি কেন এখনও! চলো! চলো!
একটা দোকানের দিকে ছুটল সে। হালউইন ক্যাভি কেনার জন্যে।