মাথা ঝাঁকাল মুসা আর রবিন দুজনেই। মনে আছে।
অদ্ভুত দোকানটা মুসার চোখে পড়ল প্রথমে। দোকানের সামনে বড় একটা জানালা। কালো রং করা। এক কোনায় প্রমাণ সাইজের একটা নরকঙ্কাল ঝুলছে। ডিসপ্লেতে ঝাড়ফুক, ভূত-প্রেত, জাদু-মন্ত্র ইত্যাদির ওপরে নানা বই সাজানো।
অ্যাই, কিশোর, আঙুল তুলে দেখাল মুসা, দেখো দেখো, সাইনবোর্ডটা: এখানে হাত দেখা হয়। চলো না, আমাদের ভাগ্যে কি আছে জেনে আসি।
মুচকি হাসল কিশোর। আবারও ভাগ্য গণনা! গত বারের কথা ভুলে গেছ? জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, আমাদের মাথায় শিং গজাবে। তিনজনেরই।
সম্ভাবনা এখনও ফুরিয়ে যায়নি, হাসল রবিন। এবার হয়তো বলবে লেজ গজাবে।
স্টোরের ভেতরে ঢুকল ওরা। ডাইনীর গুহার আদলে সাজানো হয়েছে ঘরটা। মৃদু আলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে, আশপাশের সব কিছু ভূতুড়ে লাগছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে রোমাঞ্চকর মিউজিক। ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত সব জিনিস সাজানো। কতগুলো বার দেখা গেল। সেগুলোতে নানা ধরনের লেবেল সটানোপ্রেমের আরক, ঘৃণার আরক, কর্মজীবনে উন্নতির আরক, ইত্যাদি। বড় বড় ভোলা পাত্র আছে কতগুলো। অদ্ভুত সব জিনিসে ভরা। লেখা দেখে বোঝা যায় ওগুলোতে আছে কুকুরের চুল, গোসাপের চোখ, ময়ূরের যকৃৎ, সাপের খোলস এবং ম্যানড্রেক গাছের শিকড়।
শুকনো মাথাগুলো দেখো, একটা কাঁচের বাক্সে আঙুল দিয়ে দেখাল মুসা। ভয়ঙ্কর লাগছে না?
সাবধান না হলে আমাদের দশাও ওগুলোর মতই হতে পারে, ঠাট্টা করল কিশোর।
মুসা বলল, জায়গাটা জানি কেমন লাগছে আমার। ঠিক বোঝাতে পারব না
হুঁ, তা ঠিক, মাথা দোলাল রবিন। এই ভূতুড়ে আবহর মধ্যে গা ছমছম করছে ওরও; ভয়ের কিছু নেই, এখানকার সব কিছুই সাজানো, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।
মনে হচ্ছে যেন অ্যাজটেকের মন্দির। বলি দেয়ার ঘর, মন্তব্য করল কিশোর। এদিক ওদিক তাকাল। কিন্তু কেউ নেই নাকি এখানে?
যেন তার কথার জবাবেই খসখসে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ঘরের দূর প্রান্ত থেকে। কি চাই?
পাক খেয়ে ঘুরে গেল ওরা। দেখল ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মহিলা। পরনে গোড়ালি ঢাকা কালো আলখেল্লা, লম্বা কালো চুল ঢেকে রেখেছে মুখের একটা পাশ। মহিলার কালো চোখের তির্যক দৃষ্টি, সবুজ আইশ্যাডো আর ঠোঁটের লাল টকটকে লিপস্টিকে তাকে ভ্যাম্পায়ারের মত লাগছে।
হাত দেখাতে চাই, ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। কত লাগবে?
দশ ডলার, জবাব দিল মহিলা।
আমার কাছে চার ডলার আছে, বলল মুসা। চলবে এতে?
ইঙ্গিতে কিশোর আর রবিনকে দেখিয়ে মহিলা বলল, তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে নিতে পারো না?
তিনজনে মিলিয়ে তিরিশ তো? মাথা নাড়ল কিশোর। আমাদের কাছেও অত টাকা নেই। চলো, মুসা, আজ আর হাত দেখানো হলো না।
হাত তুলল মহিলা। তাড়াতাড়ি বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমাদেরকে আমার ভাল লেগেছে। যা আছে, তাতেই দেখে দেব। কে আগে দেখাবে রু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল মহিলা। তুমি?
মাথা কাত করল কিশোর। আমার আপত্তি নেই।
এসো আমার সঙ্গে।
দরজার পর্দা সরিয়ে ওদেরকে নিয়ে পেছনের ঘরে ঢুকল মহিলা।
খাইছে! চমকে গেল মুসা।
এ ঘরটা আগেরটার চেয়েও ভূতুড়ে। পুরো ঘর কালো মখমলে মোড়া। একটা বেগুনি রঙের বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে সবার দাঁত আর চোখের মণিও বেগুনি দেখাল। ভয়ঙ্কর লাগল তাতে। হঠাৎ করেই মনে হতে লাগল তিন গোয়েন্দার, এখান থেকে আর বেরোতে পারবে না কোনদিন। সময় থাকতে পালাবে কিনা চিন্তা করতে লাগল মুসা। কিন্তু মহিলা ততক্ষণে নিচু একটা টেবিলে বসে পড়েছে। কিশোরকে ইশারা করল তার পাশে বসতে। টেবিলটা কালো মখমলে মোড়া। ওপরে একটা কাঁচের বড় বল।
কিশোরের হাতের তালু মেলে ধরল মহিলা। চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। টেবিলের সামনে দুটো কুশনে বসেছে রবিন আর মুসা। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে মহিলার কাজকর্ম।
তোমার বয়স আঠারো, কিশোরের হাত দেখে অবশেষে বলতে শুরু করল মহিলা। তুমি সাগরের ধারের কোনও শহরে, বড় একটা বাড়িতে বাস করো। সাংঘাতিক বুদ্ধিমান তুমি, ছাত্র হিসেবে ভাল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র আর কম্পিউটারে আগ্রহ। আরও একটা কাজে তুমি খুব দক্ষ, কারও ওপর নজর…অর্থাৎ সতর্ক দৃষ্টি রাখা…।
এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল নিল সে। তোমার জন্ম তারিখ কবে বলো।
বলল কিশোর। মহিলা তারিখটা লিখে কাগজের ওপর কতগুলো লাইন টানল। লাইনগুলো কাটাকুটি করে তারপর আঁকল একটা বৃত্ত।
ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাও! হঠাৎ বলে উঠল সে।
তাকাল কিশোর। তবে ভেতরে ভেতরে সতর্ক। জানে ক্রিস্টাল বল দিয়ে জ্যোতিষীরা সম্মোহন করে ফেলে।
কিন্তু মহিলা সম্মোহন করল না কিশোরকে। সে-ও চেয়ে রইল ক্রিস্টাল বলের দিকে। ঝাড়া এক মিনিট ওদিকে তাকিয়ে থাকার পরে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।
তুমি গোয়েন্দা! রেগে গেছে মহিলা। তোমরা এখানে কেন এসেছ? আমার লাইসেন্স আছে। আমি অন্যায় কিছু করছি না। পুলিস আমার কিছু করতে পারবে না।
আমি পুলিসের লোক নই, ম্যাম, তাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। আমরা আসলে শখের গোয়েন্দা। আপনার কাছে এসেছি শুধুই হাত দেখাতে। অন্য কোন মতলব নেই আমাদের।
অ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা। তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। আমার কাছে অনেক প্রাইভেট ডিটেকটিভ আসে। আমি তাদের নানা সাহায্য করি। দরকার হলে তোমরাও আমাকে ভাড়া করতে পারো। তোমাদের রহস্য উঘাটনে অনেক সাহায্য করতে পারব।