ওদের কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। একটা লাকড়ি হাতে তুলে নিল। খটখটে শুকনো। হাসিমুখে ফিরে তাকিয়ে বলল, এবার আর আগুন জ্বালতে কোন অসুবিধে নেই।
কিন্তু কার লাকড়ি? জোরে কথা বলতে সাহস করছে না মুসা।
যারই হোক, আমাদের এখন দরকার, নিয়ে আগুন জ্বালব। তারপর দেখা যাবে।
তারমানে গুহাতেই থাকবে তুমি?
তো কি বাইরে গিয়ে সারারাত ধরে ভিজব নাকি? বোকামি করতে ইচ্ছে করলে তুমি করোগে, আমি যাচ্ছি না।
আমিও না,বলে দিল রবিন।
অগত্যা আর কি করে মুসা। বাইরে একা থাকার চেয়ে ভূতের ভয় নিয়েও গুহায় থাকা ভাল। সঙ্গে অন্তত দুজন সঙ্গী তো থাকছে। কোন কথা না বলে লাকড়ি জড় করে আগুন জালার ব্যবস্থা করতে লাগল সে। খিদে পেয়েছে।
ব্যাকপ্যাক খুলে ভেজা কাপড় খুলতে শুরু করল রবিন।
আগুন ধরিয়ে ফেলল মুসা। ধোঁয়া উঠছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর আগুন তো জ্বালা হলো, ধোঁয়া যাবে কোথায়? বেরোনোর পথ না থাকলে অক্সিজেন শেষ করে দিয়ে দম আটকে মারবে ওদের।
কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে দেখল, সোজা ওপরে উঠে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। তারমানে ফাটল আছে পাহাড়ের গায়ে, চিমনির কাজ করছে।
ভেজা কাপড় বদলে, শরীরে কম্বল জড়িয়ে, আগুনে হাত-পা সেকে গরম করতে লাগল ওরা। কিশোর ভাবছে, কে লাকড়ি রাখল এখানে? এর সঙ্গে কি রহস্যময় চিৎকার আর গুলির কোন সম্পর্ক আছে?
উঁকি দিয়ে গিয়ে গুহার বাইরেটা দেখে এল রবিন। বৃষ্টি একবিন্দু কমেনি। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি জোয়ারের পানি ঢোকে?
মনে হয় না। মেঝে তো শুকনোই দেখছি।
খাবারের টিন আর ফ্রাইং প্যান বের করে রান্না করতে বসল মুসা। তাকে সাহায্য করল রবিন। মাংস ভাজার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। মুসার ক্ষুধা দশগুণ বাড়িয়ে দিল। চমৎকার জমল খাওয়া। গুহার মাঝখানে অগ্নিকুণ্ড, দেয়ালে আর ছাদে লালচে আলোয় ছায়ার নাচন, বাইরে ঝড়বৃষ্টি। দারুণ এক পরিবেশ। আগুনের সামনে বসে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল তিনজনেই।
রবিন বলল, কম্বলের বদলে এখন পশুর ছাল পেলে ভাল হত। গুহামানব হয়ে যেতাম।
খাওয়ার পর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। সারাদিনে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। বুজে আসছে চোখ। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল বলতে পারবে না।
চড়চড়, ফুটফাট, নানা রকম বিচিত্র শব্দ করে পুড়তে থাকল লাকড়ি।
এক ঘণ্টা কাটল।
দুই ঘন্টা।
হঠাৎ জেগে গেল রবিন। অলস ভঙ্গিতে ঘুরে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে পুরো সজাগ হয়ে গেল। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে।
কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুলে কে আসছে দেখার চেষ্টা করল। আগুন নিভে গেছে। পুড়ে শেষ হয়ে গেছে কাঠ। কেবল কয়লার আগুন লালচে একটা আভা তৈরি করে অতি সামান্য আলো দিচ্ছে।
কাউকে না দেখে ভাবল রবিন, কিশোর উঠেছে বুঝি, প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্যে। ডেকে জিজ্ঞেস করুল, কে, কিশোর?
সাড়া দিল না কিশোর। জবাবে চাপা শব্দ করে উঠল কে যেন। মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। মেঝের ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল পদশব্দ।
.
০৯.
কে? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন।
জবাব নেই।
কিশোর! মুসা! জলদি ওঠো! অন্ধকারে টর্চটার জন্যে হাতড়াতে শুরু করলা সে।
কি হয়েছে? ঘুমজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা। সকাল হয়ে গেল নাকি? এত তাড়াতাড়ি
ওঠো, জলদি! কে জানি ঢুকেছে!
কি করে বুঝলে?
হাঁটতে শুনলাম।
কিশোর হবে হয়তো। টয়লেট করতে বেরিয়েছিল।
আমি বেরোইনি, জবাব দিল কিশোর।
খাইছে? তাহলে কে? চমকে উঠে বসল মুসা। বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। আগুনটার কি হলো টর্চ জালছ না কেন?
হাতের কাছেই টর্চ রেখেছে কিশোর তুলে নিয়ে জালল। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল গুহার দেয়ালে, ছাদে। অপরিচিত কাউকে দেখা গেল না।
চোখ পিটপিট করছে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি শুনেছিলে, বলো তো?
খুলে বলল রবিন ৷
সামনের দিকে গেছে? জানতে চাইল কিশোর।
মাথা নাড়ল রবিন, না, পেছনে। সুড়ঙ্গের ভেতরে।
ওঠো, দেখে আসি।
এই এখন, অন্ধকারের মধ্যে..চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার।
সুড়ঙ্গের মধ্যে দিনের বেলাও যা রাতেও তাই, সব সময়ই অন্ধকার, ভোরের জন্যে বসে থেকে লাভ নেই।
উঠে পড়ল কিশোর। টর্চ হাতে এগোল গুহার পেছন দিকে।
তিরিশ কদম এগোনোর পর সামনে একটা খিলান দেখা গেল, ওপরটা ধনুকের মত বাকা। গুহা থেকে সুড়ঙ্গে ঢোকার প্রবেশপথ। পেছনে তাকিয়ে দুই সহকারীর দিকে নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সামনে টর্চ অব্রে রেখে সাবধানে এগোল। খেয়াল রাখল যাতে চোরা গর্তে না পড়ে।
খুব খাটো সুড়ঙ্গ, লম্বায় বড়জোর পনেরো ফুট, মেঝে থেকে ছাদ ছয় ফুট উঁচু কঠিন পাথুরে মেঝেতে পায়ের ছাপ পড়ে না। সুতরাং কেউ এসে থাকলেও ছাপ দেখে বোঝার উপায় নেই।
সুড়ঙ্গটা দিয়ে আরেকটা গুহায় ঢোকা যায়।
রবিন বলল, মনে হয় অনেক গুহা আছে এখানে। সুড়ঙ্গ দিয়ে যুক্ত। কোনটা দিয়ে কোনটায় ঢুকে গেছে লোকটা কে জানে।
আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল এক গুহায় ঢুকেছে। চারপাশের দেয়ালে অনেক গর্ত, সুড়ঙ্গমুখ ওগুলো, বুঝতে অসুবিধে হলো না।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। আনমনে বিড়বিড় করল, একডজন গর্ত। কোনটা দিয়ে ঢুকেছে লোকটা, কি করে বুঝব?