- বইয়ের নামঃ টুয়েস ডে ক্লাব মার্ডার
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
টুয়েস ডে ক্লাব মার্ডার
১. রেমণ্ড ওয়েস্ট
টুয়েস ডে ক্লাব মার্ডার (মিস মারপল)
রেমণ্ড ওয়েস্ট একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, নিজের ভেতর মগ্ন হয়ে কথাটা উচ্চারণ করল। চোখে মুখে একটা আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠল। অনুদঘাটিত রহস্যাবলী কথাটি আবার উচ্চারণ করে তৃপ্তি সহকারে ঘরের চারদিকটা দেখে নিল।
প্রাচীন ঘর। পুরানো ঐতিহ্যের সাক্ষী বিশাল কড়িবরগাগুলি। আবসুল কাঠের কারুকার্য করা আসবাবপত্রগুলো প্রাচীনতার সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে। বাইরে ঝরছে ঝির ঝির করে তুষার, আর ভেতরে বিরাট ফায়ার প্লেসের উষ্ণ আমেজ। রেমণ্ড একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। এই ধরনের ত্রুটিহীনতাই তার পছন্দ। পিসিমা জেন-এর প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়ি, ব্যক্তিত্বপূর্ণ চারিত্রিক দৃঢ়তা, সব কিছুর মধ্যে মাধুর্যতা আর লেখকমনের সন্তুষ্টি।
চুল্লীর পাশে বিশাল আরামকেদারায় বসে আছেন পিসিমা মিস জেন মারপল। কালো ব্রোকেডের পোশাক পরিহিতা। উর্ধাঙ্গে মেকলিন লেম, তুষার শুভ্র চুল ঢাকা পরেছে সূক্ষ্ম কাজের লেমের টুপিতে। সাদা পশমের পোশাক বুনছিলেন। আবছা নীল চোখ, স্নেহভরা দৃষ্টি, মুখে মৃদু হাসি। প্রশান্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ভাইপো এবং অতিথিদের দিকে।
রেমণ্ড একজন স্ফুর্তিবাজ আত্মসচেতন যুবক। পাশে জয়েস লেমপ্রিয়ের। জয়েস একজন চিত্র-শিল্পী। মরাল গ্রীবা, ছোট করে ছাঁটা রেশম কালো চুল, হালকা সবুজ চোখ, ধারালো নাকে-মুখে খুব আকর্ষণীয়া। তার দৃষ্টি পড়ল স্যার হেনরি ক্লিারিং নামে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভদ্রলোকের দিকে। তাছাড়া আছেন সৌম্য বৃদ্ধ যাজক ডাঃ পেনডার, আইনজীবী মিঃ পেথোরিক।
অনুদঘাটিত রহস্য না যেন কি বললে রেমণ্ড? ওটা কি ব্যাপার? অভ্যাসমতো কেশে গলা পরিষ্কার করে কথাগুলো বললেন।
আমার মনে হয় ওসব কিছু নয়। গুরুগম্ভীর রাশভারী শব্দ রেমণ্ডের পছন্দ। হয়তো কোনো মানেই নেই। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল তেমপ্রিয়ের। ভ্রু-কুঁচকে কপট ভঙ্গীতে তাকাল রেমণ্ড।
জয়েস চাউনি দেখে শব্দ করে হেসে বলল–আচ্ছা পিসি, রেমণ্ডের কথার কি মাথামুণ্ড আছে? আপনি সব জানেন?
জেন মারপল মৃদু হাসলেন। কিন্তু উত্তর দিলেন না।
যাজক মহাশয় শূন্যের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললেন–মানবজীবনটাই অজানা অনুদঘাটিত রহস্য।
রেমণ্ড অধৈৰ্য্য হয়ে বিরক্ত সহকারে সিগারেটটা ছাইদানিতে রেখে বললেন, আমি যেটা বলতে চাই সেটা অন্য ব্যাপার। দার্শনিক কথাবার্তা নয়। আমার বক্তব্য হল কিছু ঘটনা, যা সত্য, প্রকৃতই ঘটেছে এবং যার কোনো ব্যাখ্যা কেউ করতে পারেনি।
মিস মারপল বললেন, তুমি যা ববাঝাতে চাইছ; সেরকম ঘটনাও আমি জানি। মিসেস ক্যারুদারসের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তিনি এলিঘটের দোকান থেকে দুটো গলদা চিংড়ি কিনলেন। দুটো দোকান ঘুরে যখন বাড়ি ফিরলেন দেখলেন মাছ দুটো উধাও। কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবার দোকানে ফিরে গেলেন। না ওখানে ফেলে আসনেনি, গেল কোথায়? আমার তো বেশ আশ্চর্য মনে হচ্ছে।
স্যার হেনরি মন্তব্য করলেন, ঘটনাটা জোলো এবং একদম সাধারণ। অবশ্য এ ব্যাপারে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। মিস মারপলের গাল উত্তেজনায় লাল হল। যেমন ধরা যাক, কেউ…।
রেমণ্ড মজা পাওয়ার ভঙ্গীতে, পিসি আমি এইসব গ্রাম্য ঘটনায় যাচ্ছি না। বলছি সত্যি খুন বা নিরুদ্দেশের কিনারা না হওয়া ঘটনাগুলি। স্যার হেনরি যদি জানেন এবং হাতে সময় থাকে তবে অনুদঘাটিত ঘটনার কয়েকটা কথা বলুন। উল্লেখ্য স্যার হেনরি কিছুদিন আগেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন।
স্যার হেনরি বিনীতভাবে বললেন, নিছক গালগল্প আমি ভালো বলতে পারি না।
জয়েস বলল, আমার মনে হয় অনেক খুন বা রহস্য আছে যা পুলিশ এখনও কিনারা করতে পারেনি।
পেশাগত গাম্ভীর্যে মিঃ পেথোরিক বলেন, এটা একটি স্বীকৃত সত্য। ভাবতে আশ্চর্য লাগে রহস্যের জট ছাড়াতে যে ধরনের কল্পনাপ্রবণ বুদ্ধি বা চাতুর্যতা দরকার তার খুবই অভাব পুলিশের রেমণ্ড মন্তব্য করল।
তিক্ত কণ্ঠে স্যার হেনরি বলেন–আমি মানি না। এগুলো একান্তভাবে অজ্ঞ মানুষের ধারণা।
হাসতে হাসতে জয়েস বলল–তাহলে এসব বিচারের জন্য কমিটি বসাতে হয়। দর্শক কল্পনা এগুলো লেখকদের একচেটিয়া সম্পত্তি। মাথা ঝুঁকিয়ে রেমণ্ডের প্রতি কপট শ্রদ্ধা জানাল জয়েস।
রেমন্ড গম্ভীর হয়ে ফায়ার প্লেস থেকে জ্বলন্ত কাঠ তুলে সিগারেট ধরিয়ে বলল, লেখককে মানুষের প্রকৃতির ভেতরটা জেনে লিখতে হয়। ফলে এক ধরনের অন্তদৃষ্টি জন্মায়। সাধারণ লোকে যা লক্ষ্য করতে পারে না, যেমন কোনো ব্যক্তির অভিসন্ধি
মারপল স্নেহের দৃষ্টিতে বললেন, সোনা জানি তোমার বইগুলো বিদগ্ধ। তোমার চরিত্রগুলি সত্যিই অতটা খারাপ?
শান্তভাবে রেমণ্ড বলে–পিসিমণি জগৎ ও মানুষের প্রতি তোমার বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না।
মিস মারপল ভুরু দুটো কুঁচকে পশম বোনার ঘরগুলো মিশিয়ে বললেন, লোকগুলো সবাই খুব ভালো বা খুব খারাপ নয়, ভালো-মন্দ মিশিয়ে।
মিঃ পেথোরিক খুক খুক করে কেশে রেমণ্ডকে বলেন, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না–তুমি কল্পনা ব্যাপারটাতে বেশি জোর দিচ্ছ? আমরা আইনজীবীরা ভালোই বুঝি কল্পনা কতটা সাংঘাতিক। সত্যি বলতে কী, এটা জানতে হলে তোমাকে নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে হবে। বিচার বিবেচনা করে সত্যটা বের করতে হবে। এটাই তো বিচারের যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই পথেই সত্য প্রমাণিত হয়।
জয়েস রেশম কালো চুল ঝাঁকিয়ে হাত তুলে বলল-বাঃ, আমি কিন্তু আপনাদের হারাতে পারি। আমি একজন মেয়ে। মেয়েদের ঈশ্বর প্রদত্ত ষষ্ঠেন্দ্রিয় অনুভূতি কিন্তু ছেলেদের থাকে না। শিল্পী হয়ে চোখে যা দেখি না, কল্পনায় সেটা দেখি। বহু মানুষ, দেশ এবং জীবনকে যেভাবে জেনেছি, মারপল পিসিও বোধহয় তা জানেন না।
মিস মারপল উলবোনার থেকে মুখ তুলে বললেন–আমি সত্যিই জানি না সোনা। কিন্তু এই ছায়াঘেরা শান্ত মেরি মীড গ্রামেও মাঝে মাঝে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে।
মৃদু হেসে পেনডার বললেন–আমি কি বলব? আজকাল পাত্রী পুরোহিতদের অবজ্ঞা করা ফ্যাশন। কিন্তু আমরা এমন অনেক ঘটনা শুনি, চরিত্রের নানা দিক জানতে পারি যা বাইরের পৃথিবীতে কোনোদিনই পৌঁছাবে না।
উৎসাহ নিয়ে জয়েস বলল–ঠিক আছে, এখানে সব ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক মানুষ হাজির আছেন, আমরা সংঘ তৈরি করি? আজ মঙ্গলবার হওয়ায় সংঘের নাম মঙ্গলবারের সান্ধ্য বৈঠক। প্রত্যেক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিলিত হয়ে, প্রত্যেক সদস্য একটা করে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুদঘাটিত রহস্যের কথা বলবেন। যে রহস্য সম্পর্কে জানেন এবং নিজে সমাধান করতে পারবেন, সেই সব ঘটনা বলবেন। আমরা কতজন? পাঁচজন! আঃ ছয় জন হলে ভালো হত।
মিস মারপল হাসতে হাসতে বলেন–তুমি সোনা আমাকে ভুলে গেছ।
জয়েস হকচকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাঃ। তাহলে তো খুব ভালোই হয়। আমি ভাবলাম এ ধরনের খেলা ঠিক আপনার পছন্দ নয়।
মিস মারপল বলেন–আমার ধারণা ব্যাপারটা খুব আকর্ষণীয় হবে। এতজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সমাবেশ। আমি বুদ্ধিমতী না হলেও এত বছর সেন্ট মেরি মীডে থেকে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি জন্মেছে।
বিনীত হেনরি বলেন, আপনার সহযোগিতা খুবই মূল্যবান হবে।
জয়েস বলল, কে শুরু করবেন?
ডাঃ পেনডার বলেন, আমরা ভাগ্যবান, স্যার হেনরির মতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমাদের মধ্যে থাকতে কোনো দ্বিধাই থাকতে পারে না,…কথা শেষ না করে সম্মানের ভঙ্গীতে তাকালেন।
স্যার হেনরি মিনিট দুয়েক চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পা তুলে আরাম করে বসে আরম্ভ করলেন তার কাহিনী –
একটি দুঃখজনক ঘটনা :
আপনারা যে ধরনের কাহিনী শুনতে চান সেটা বাছাই করা সত্যিই অসুবিধাজনক। এমন ঘটনা যা অনুসন্ধিৎসা মেটাবে। এবং সে ঘটনা বছরখানেক আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রহস্যের কিনারা হয়নি। ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু দিনকয়েক আগে আমার হাতে এসে পড়ে সমাধান হল।
সহজ সরল ঘটনা। তিন জন রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। টিনে ভর্তি রান্না-করা গলদা চিংড়ি খেয়ে, রাত্রি বেলা তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল, দুজন সেরে উঠল। তৃতীয়জন মারা পড়েন, টোমেন জাতীয় বিষই মৃত্যুর কারণ। সেই মর্মে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাকে সমাধি করা হল। কিন্তু ঘটনাটা ওখানে থেমে থাকল না।
মিস মারপল বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলেন–নিশ্চয়ই, অনেক গুজব ছড়িয়ে ছিল যেভাবে ছড়ায়।
স্যার হেনরি বলে চলেন নাটকের কুশলীদের একটু পরিচয় দিই। তিনজনের এক দম্পতি ধরুন ওদের নাম মিঃ ও মিসেস জোনস, অপর জন মিস ক্লার্ক, শ্রীমতি জোনসের সাহচর্য সঙ্গিনী।
জোনস ওষুধ সংস্থার ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি। পঞ্চাশ বছর, সুদর্শন, সৌখিন। জোনসের স্ত্রীর পঁয়তাল্লিশ, সাদামাটা ধরনের। মিস ক্লার্কের বয়স ষাটের কোঠায়। শক্ত সামর্থ্য, লালচে মুখের মহিলা। এরা কেউই আকর্ষণীয় নয়। গোলমালের সূত্রপাত আশ্চর্যরকম ভাবেই।
জোনস ঘটনার আগের দিন রাত কাটান বারমিংহামের একটি হোটেলে। চিঠি লিখতে যে ব্লটিং পেপার ব্যবহার করেছিলেন সকালে সেটি পরিচারিকার হাতে পড়ে। মজা পাবার জন্য ব্লটিং পেপারটি আয়নার সামনে ধরলে কয়েকটি শব্দ তাতে ফুটে উঠে। কয়েকদিন পর কাগজে যখন চিংড়ি মাছ খেয়ে জোনসের মৃত্যুর সংবাদটা প্রকাশিত হয়, পরিচারিকাটির তখন ফুটে ওটা শব্দগুলি স্মরণ হয়। হোটেলের অন্যান্য কর্মীর কাছে ব্লটিং পেপার থেকে উদ্ধার হওয়া চিঠির কথাগুলি বলে। সেগুলি ছিল..সম্পূর্ণভাবে আমার স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল..যখন সে মারা যাবে তখন আমি..শয়ে শয়ে হাজার হাজার…।
আপনাদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে, কিছুদিন আগে কাগজে প্রকাশিত স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ঘটনাটি। ঘটনাটি পরিচারিকার মনে পড়ে এবং এই ব্যাপারে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। পরিচারিকার এক আত্মীয় জোনসের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে, চিঠিতে জানা যায়। জোনস স্থানীয় ডাক্তার কন্যার প্রতি আসক্ত। তেত্রিশ বছর বয়সী, সুন্দরী। গুজব নোক মুখে ছড়াতে লাগল।
শেষে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে দরখাস্ত গেল। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে অসংখ্য বেনামী চিঠি আসতে লাগল। বলে রাখি, অন্য কোনো সন্দেহ আমাদের মধ্যে ছিল না। নেহাতই গ্রাম্য গুজব মনে করেছিলাম। আদেশ হল কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তোলার। গুজবের সুদৃঢ় কোনো ভিত্তি নেই কিন্তু গুজব আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি প্রমাণিত হল। ময়না তদন্তে পাকস্থলিতে প্রচুর বিষ পাওয়া যায়। এবং মৃত্যুর কারণ ঠান্ডা মাথায় খুন। স্থানীয় প্রশাসন নয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর ভার পড়ল হত্যাকারীদের বা হত্যাকরীকে খুঁজে বের করার।
উল্লাসিত জয়েস বলল,-বাঃ, আমি এইরকমটাই চেয়েছিলাম। সত্যি রহস্যময় ঘটনা।
স্যার হেনরি আবার শুরু করলেন–সব সন্দেহই গিয়ে পড়ল স্বামীর উপর। তিনি আর্থিক ভাবে উপকৃত। রটেছিল হাজার হাজার, লাখ লাখ কিন্তু প্রায় আট হাজার পাউন্ডের মালিক হলেন। চাকুরির টাকা ছাড়া সঞ্চিত অর্থ ছিলই না। মহিলা সংসর্গে মুক্ত হস্তে খরচা করতেন। আমরা সন্তর্পণে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল এক সময় উভয়ের মধ্যে সত্যিই গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মাস দুয়েক আগে বিচ্ছেদ ঘটে। দুজনকে আর একসঙ্গে দেখা যায়নি। ডাক্তারবাবু ভোলামেলা সরল মানুষ, কোনোরকম সন্দেহই করা যায় না। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে হতবাক। ঘটনার দিন রাত্তিরে তাকে যখন ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি দেখেন তিন জনই অসুস্থ। মিসেস জোনসের অবস্থা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ একজনকে পাঠান কিছু আফিমের বড়ি আনতে। কিছুটা ব্যথা উপশমের জন্য। কিন্তু সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও মিসেস জোনস মারা গেলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর একটু খারাপ সন্দেহ হয়নি। খাবারের মধ্যে ছিল টিনে ভর্তি গলদা চিংড়ি। স্যালাড, ঝটি বিজ এবং প্রচুর সরে তৈরি মিষ্টি। টিনজাত চিংড়ি মাছই মৃত্যুর কারণ।
দুর্ভাগ্যবশত চিংড়ি মাছের এককণাও অবশিষ্ট ছিল না। সবটাই খেয়ে নিন ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারবাবু রাধুনি গ্ল্যাডিস লিচেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল। সবসময় কাঁদছিল আর উত্তেজিতও ছিল। গ্ল্যাডিসের কাছ থেকে কোনো হদিশ পাননি। কিন্তু গ্ল্যাডিস বলেছিল, ও মাছে হাতই দেয়নি আর মাছটা খুব ভালোই ছিল।
যার উপর নির্ভর করে আমরা এগোচ্ছিলাম এই হচ্ছে সেই সব তথ্য। যদি ধরে নিই যে, জোনস স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগ করেছিল এটা ঠিক যে জোনস খাবারে বিষ মেশায়নি। কারণ তারা খাবারগুলি খেয়েছিল। তাছাড়া আর একটা সূত্র যে, জোনস বারমিংহাম থেকে সোজা খাবার টেবিলে আসে সুতরাং আগে সে বিষ মেশাতে পারে।
জয়েস বলে ওঠে–ওই সঙ্গিনী হাসিমুখ ভদ্রমহিলাটির কি ব্যাপার?
সম্মতি জানিয়ে হেনরি বলেন, মিস ক্লার্ককেও অবজ্ঞা করিনি। কিন্তু তার কি উদ্দেশ্য, মিসেস জোনস তো তার উত্তরাধিকার নয় বরং মহিবাণীর মৃত্যুতে চাকরি খুঁজতে হয়েছিল।
জয়েস ভেবে বলল,–তাকে বাদ দিতেই হয়। স্যার হেননি বলে চলেন,এক ইনসপেক্টর একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করে। খাবার পর সেই রাত্রে জোনস একবাটি কর্নফ্লাওয়ার চেয়েছিল, স্ত্রী অসুস্থ বোধ করায়। গ্ল্যাডিস কর্নফ্লাওয়ার তৈরি করা পর্যন্ত জোনস রান্নাঘরেই ছিলেন। এরপর নিজে খাবার নিয়ে স্ত্রীর ঘরে যান। কেসটা নতুন মোড় নিল।
আইনজীবী পেথোরিক মাথা নাড়েন। কর গুনে বলেন এক নম্বর উদ্দেশ্য এবং দুই সুযোগ। ওষুধ সংস্থার কর্মী হিসেবে বিষ পাওয়া সহজ জোনসের।
যাজক পেনডার মন্তব্য করেন,–ভদ্রলোক যখন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ।
রেমণ্ড ওয়েস্ট হেনরির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,–এখানেই কোথাও জটটা আছে। আপনারা জোনসকে গ্রেপ্তার করলেন না কেন?
স্যার হেনরি হতাশভাবে হেসে বললেন,–দুর্ভাগ্যটা এইখানেই। এতক্ষণ সব কিছু ঠিক ঠিক এগোচ্ছিল, গ্রেফতারের জায়গায় হোঁচট খেলাম। মিস ক্লার্ককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম বাটিভর্তি কর্নফ্লাওয়ারটি খেয়েছেন তিনি, মিসেস জোনস নয়।
মিস ক্লার্ক যা বললেন তা হল, তিনি রোজকার মতো মিসেস জোনসের ঘরে গেলেন। মিসেস জোনস বলেন, মিলি (মিস ক্লার্কের ডাক নাম) আমি ভালো বোধ করছি না। চিংড়িটা আমার ছোঁয়া উচিত হয়নি। আমি অ্যালবার্টকে একবাটি কর্নফ্লাওয়ার দিতে বলেছি। কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
ক্লার্ক বলেন- গ্ল্যাডিস এত সুন্দর কর্নফ্লাওয়ার তৈরি করেছে। আজকাল মেয়েরা এত ভালো বানাতেই পারবে না। আমার তো দেখেই খিদে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে খেয়ে নিন, আমার খাওয়া উচিত নয়।
স্যার হেনরি একসময় বলেন,-মিস ক্লার্ক ওজন কমানোর জন্য ডায়েটিং করেন, মিসেস জোনস তাকে বলেন, তোমার ডায়েটিং করা উচিত নয়। ভগবান যদি মোটা দেখতে চান তবে তাই হও। তুমি কর্নফ্লাওয়ারটা খেয়েই নাও।
উপায়ন্তর না দেখে এক চুমুকে বাটি শেষ করলেন মিস ক্লার্ক। জোনসের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ নষ্ট হয়ে গেল। জোনসকে চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অস্ট্রেনিয়া তার এক ভাই অর্থ সাহায্যের জন্য চিঠি লেখায় তিনি এই উত্তর দেন। চিঠিতে লেখেন সম্পূর্ণভাবে তিনি স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি অর্থের মালিক হলে তখন কিছু সাহায্য করবেন। আরও লেখেন, পৃথিবীতে হাজার হাজার শয়ে শয়ে মানুষ এইরকম দুর্ভাগা।
ডাঃ পেনডার বলেন, তাহলে কেসটা একদম নস্যাৎ হল।
স্যার হেনরি বলেন, একেবারেই নস্যাৎ। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জোনসকে গ্রেফতার করা গেল না।
সবাই চুপচাপ নিথর নৈঃশব্দ। জয়েস বলে উঠল, সব শেষ, না কি?
স্যার হেনরি বলেন,–গত বছর পর্যন্ত এর বেশি জানা যায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সমাধানে পৌঁছে গেছে। দুই তিন দিনের মধ্যে কাগজে পড়বেন সবটা।
জয়েস বলে,–আসল রহস্যটা কি? মিনিট পাঁচেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেব।
রেমণ্ড মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ঘড়ি দেখল। পাঁচ মিনিট পার হলে ডাঃ পেনডারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি প্রথমে বলবেন?
বৃদ্ধ পেনডার হতাশভাবে বলল,-আমি স্বীকার করি আমি বিভ্রান্ত। আমার মনে হয় পতিটি কোনোভাবে দোষী। কিন্তু কি উপায়ে কার্য সমাধা করলেন তা জানি না। এখনও আবিষ্কৃত হয়নি কিভাবে বিষ প্রয়োগ করা হল। এতদিন পরে কি করে রহস্যের সমাধান হল তাও বোধগম্য হচ্ছে না।
এবার জয়েসের পালা। নিশ্চিতভাবে বলল-সঙ্গিনী ভদ্রমহিলাটিই অপরাধী। কি উদ্দেশ্যে কে জানে? বৃদ্ধা মোটাসোটা কুৎসিত হলেও জোনসের প্রেমে পড়তে বাধা কোথায়? কোনো কারণে মিসেস জোনসকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন। সদা হাস্যময়ী কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট চেপে রেখেছেন। আর একদিন না পেরে খুন করে বসলেন। সন্তর্পণে কর্নফ্লাওয়ারের বাটিতে আর্সেনিক মিশিয়ে এবং মিথ্যে রটিয়ে দিলেন উনি নিজেই সেটা খেয়েছেন বলে।
মিঃ পেথোরিক কোর্টে সওয়াল করার ভঙ্গীতে হাতজোড় করে বললেন, যা তথ্য জেনেছি তাতে এখন কিছু বলা উচিত নয়।
জয়েস জোসের সঙ্গে বলে উঠলেন আপনাকে বলতেই হবে। সব সময় আইন মেনে মতামত চেপে রাখতে পারেন না। এটা নিছক খেলা। আপনি খেলবেনই।
মিঃ পেথোরিক বলেন–বর্তমান তথ্যে কিছুই বলার নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হল এই ধরনের কেসে প্রকৃত দোষী স্বামী। তথ্য বিশ্লেষণে একটাই মত, সেটা হল মিস ক্লার্ক কোনো কারণে বা ইচ্ছাকৃতভাবে জোনসকে আড়াল করছেন।
তাদের হয়তো গোপন আর্থিক চুক্তি ছিল। জোনস জানত সেও সন্দেহভাজন তালিকায় এবং ক্লার্কের কষ্টের জীবন ফিরে আসছে বুঝে দুজনেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। টাকার বিনিময়ে কর্নফ্লাওয়ার খাওয়াতে নিজেকে জড়ায়, যদি এটাই সত্যি হয় তবে বুঝতে হবে ঘটনাটা খুবই গোলমেলে।
রেমণ্ড বলে উঠল, আমি একমত নই, আপনারা ভুলে গেছেন উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই। সেই টিনে ভর্তি গলদা চিংড়ি সত্যি খারাপ ছিল। বিষক্রিয়ার কারণে ডাক্তার ডাকা হলে তিনি দেখেন মিসেস জোনস প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর। অবস্থা বুঝতে পেরে আফিমের বড়ি আনালেন।কিন্তু নিজে যাননি। মেয়েটিই ওষুধপত্তর দিয়ে থাকে। তিনি ডাক্তারের প্রণয়ী। তখনই আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠল। মাহেন্দ্রক্ষণেই সে পাবে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। পাঠানো বড়িগুলি আর্সেনিকের, আফিমের নয়।
জয়েস ধৈৰ্য্য ধরতে না পেরে বলল–স্যার হেনরি বলে দিন না।
স্যার হেনরি বলেন–মিস মারপল কিছু বললেন না তো।
মিস মারপল এদিক ওদিক মাথা নেড়ে চোখ তুলে বললেন–হ্যায়রে গোনায় ভুল হল। এই দুঃখজনক ঘটনা আমাকে মিঃ হারগ্রেভের কথা মনে করিয়ে দিল। হারগ্রেভের মৃত্যুর পর সমস্ত টাকা পেল অন্য মহিলা। তাদের পাঁচটি সন্তান ছিল। একসময় মহিলা হারগ্রেভের পরিচারিকা ছিল।
রেমণ্ড অধৈৰ্য্য হয়ে বলল, পিসি, মৃত হারগ্রেভের সঙ্গে এর মিল কোথায়?
মারপল বলেন–মিলগুলি খুব আশ্চর্যজনক। বেচারী সব স্বীকার করায় আপনারা জানতে পারলেন। তাই না, মিঃ হেনরি।
রেমণ্ড বলল–পিসি তুমি কোন মেয়েটির কথা বলছ?
মারপল বললেন-বেচারী গ্ল্যাডিস লিচেন, ওকে যখন ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, উত্তেজিত হয়ে কেঁদেও ফেলেছিল। অসহায় মেয়েটিকে খুন করানোয় জোনসের ফাঁসি হবে। মেয়েটিরও ফাঁসি হবে।
মিঃ পেয়োরিক হতাশ হয়ে বললেন–আপনি ভুল বুঝলেন।
কিন্তু মিস মারপল জোরের সাথে মাথা নেড়ে হেনরির দিকে আশান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন–হাজার হাজার মিষ্টি খাবার এগুলি কিভাবে চোখ এড়াল।
রেমণ্ড প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল–কি বলছ তুমি, হাজার মিষ্টি খাবার…
মিস মারপল রেমণ্ডের দিকে ঘুরে বললেন, রাধুনীরা প্রচুর মিষ্টি তৈরি করে। এই ছোটো ছোটো পিঠের মতো মিষ্টিগুলির নাম শয়ে শয়ে, হাজার হাজার। যেগুলি ছিল ওদের খাদ্যতালিকায়। দুটো জিনিসকে একত্র করাতে বোঝা গেল আর্সেনিকের প্রয়োগ কৌশল। এবং ভার পড়ল রাঁধুনির উপর।
জয়েস তাড়াতাড়ি বলল–তিনজনেই তো মিষ্টি খেলল, কি করে সম্ভব?
মারপল বললেন, না না। মিস ক্লার্ক আহার প্রস্তুত করছিলেন। মেদ কমাতে চাইলে মিষ্টি ছোঁয়া উচিত নয়। আমার ধারণা খুব সুচতুরভাবে জোনস মিষ্টিগুলি সরিয়ে রাখে।
প্রত্যেকে হেনরির দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে বললেন–খুব আশ্চর্যজনকভাবে মারপল সত্য উদঘাটন করলেন। সন্তানসম্ভবা গ্ল্যাডিসকে জোনস বলেছিল স্ত্রীকে সরিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। আর্সেনিকের বড়ি তৈরি করে মিষ্টির সঙ্গে মেশাতে তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। গ্ল্যাডিসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গর্ভের বাচ্চাটিও মারা যায়। মৃত্যু শয্যায় গ্ল্যাডিস সব কিছু স্বীকার করে।
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জয়েস বলল–সাবাস পিসি, তুমি এক পয়েন্ট এগিয়ে রইলে। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে তুমি কি করে রহস্যটা ধরলে। কারণ রাঁধুনিটার সাথে এই ঘটনার মিল কোথায়?
মারপল বললেন-সোনা, মানুষকে আমি যতটা জানি তুমি ততটা জানো না। যখন শুনলাম গ্ল্যাডিস নামে একটি সুন্দরী যুবতী আছে, জোনসের মতো মানুষ তাকে ছাড়বে না। শয়তানের কবলে পড়ে একটি মেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করল। এটা বোঝাবার নয় যে, মিসেস হারগ্রেভের দুঃখে গ্রামের মানুষের বারুদ্ধ হয়েছিল।
রেমণ্ড উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আজকের মতো বৈঠক শেষ। রাত হয়েছে। পরের মঙ্গলবার কে বলবেন? চারিদিকে তাকিয়ে বলল–ডঃ পেনডার।
জয়েস তাকে সমর্থন করল।
পেনডার বললেন–জীবনে রহস্যময় ঘটনা বলতে কিছুই নেই তবুও আপনাদের অনুরোধে শোনাব।
.
অ্যাসটার্টের অভিশাপ–কুয়াশা ঘেরা :
দ্বিতীয় মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় একে একে সবাই এলেন। পেনডার এলেন শেষে, সবাই আছে কিনা দেখে কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেনরি বললেন, বলুন ডাঃ কি শোনাবেন?
বৃদ্ধ যাজক হেসে বলেন–আমার জীবন কেটেছে শান্ত পরিবেশে, ঈশ্বরের করুণায়। যখন তরুণ ছিলাম একটি বিষাদময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
পেনডার বলে চলেন–ওই ঘটনা আমার জীবনে এমন একটা দাগ ফেলেছিল সে স্মৃতি রোমন্থন করলেই এই সময়ের ভীতি ও বিভীষিকা আমি স্পষ্ট অনুভব করি। আপনারা একে অনুদঘাটিত বলবেন কি না জানি না। বাহ্যিক কোনো অস্ত্র ছাড়াই মানুষ খুন হল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ চিন্তাভাবনা করে কারণ খুঁজে পায়নি। এমন অনেক কিছু আছে যার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
অভিযোগের সুরে হেনরি বলেন–আপনি তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন?
ডাঃ পেনডার বলেন–আমার তাই হয়েছিল। পরিবেশের কথা উঠলে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না। আমার জীবনে এর প্রভাব যথেষ্ট। কিছু কিছু জায়গায় অশরীরী দৈবশক্তির বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে।
মিস মারপল মন্তব্য করলেন–হ্যাঁ, এরকম জায়গা বা বাড়ি আছে। লারশেদের বাড়িতে মিঃ স্মিারস সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ছাড়েন। সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে মিসেস ক্লারকে দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে গেছেন। বাড়ির মালিক বানডেরার বাড়িতে আসার পরেই শক্ত অপারশেন হয়েছে।
মিঃ পেথোরিক বলেন-কুসংস্কারে জড়িয়ে থাকার ঘটনায় কত বড়ো বড়ো ক্ষতি হতে পারে।
স্যার হেনরি বলেন–কড়া ধাচের ভূত বা ভুতুড়ে বাড়ির গল্প আমিও জানি। বলে হেসে উঠলেন।
রেমণ্ড মন্তব্য করলেন-পেনডারের গল্পটা বলতে দেওয়া হোক।
জয়েস উঠে দাঁড়িয়ে আলো দুটো নিভিয়ে দিল। শুধু ধিকিধিকি আগুনের আভা। আলো আঁধারী মায়াময় ঘর। জয়েস বলল–এটাই গল্প শোনার উপযুক্ত পরিবেশ।
পেনডার চশমাটা খুলে মৃদু হেসে জয়েসের দিকে তাকিয়ে শুরু করেন।
আপনারা ডার্টমুর জায়গার নাম শুনেছেন? যেই অঞ্চলটার কথা বলছি সেটা ডান্টমুট সীমান্তে। মনমুগ্ধকর পরিবেশ। সম্পত্তিটা অজ্ঞাত কারণে অবিক্রিত ছিল। শীতকালে নিসর্গ দৃশ্য মনোরম। সম্প্রতি আমার বন্ধু হেভেন জমিদারিটা কেনেন। কলেজ জীবনের বন্ধু। দেখা সাক্ষাৎ বহুদিন না হলেও অটুট বন্ধুত্ব। তাই সাইলেনট গ্রোভ-এর যাবার নিমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করি।
নিমন্ত্রিতদের মধ্যে হেভেনের খুড়তুতো ভাই এলিয়ট, লেডি ম্যানারিং, কন্যা ডায়োলেট। মেয়েটি সুশ্রী এবং সাধারণ ব্যক্তিত্বের। আর সস্ত্রীক ক্যান্টেন রজার্স। পোড়খাওয়া মানুষ রজার্স অশ্বারোহণ ও শিকার জীবনের প্যাশন। তরুণ হলেও ডঃ সাইমন্ড খ্যাতিবান প্রতিষ্ঠিত। অন্যজন মিস ডায়না অ্যালেলে, অসামান্য সুন্দরী। নানা ফ্যাসন পত্রিকায় ছবি ছাপত। আকর্ষণীয়া, দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রং তামাটে। মসৃণ কোমল ত্বক। দীর্ঘ আঁখি পল্লবের জন্য মনে হত যেন কোনো প্রাচ্য দেশীয় রমণী। দূরাগত ঘণ্টাধ্বনির মতো মধুর কণ্ঠস্বর।
ওখানে গিয়েই বুঝতে পারি রিচার্ড ডায়নার প্রতি আসক্ত। এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন সেইজন্য।
ডায়না আত্মসচেতন খেয়ালী মেয়ে। একদিন সারাক্ষণ রিচার্ডের সঙ্গে–তো অন্যদিন ভাই এলিয়টের সঙ্গে। পরের দিন ভুবনজয়া হাসিতে ভরাল তরুণ ডাক্তারকে।
যাবার পরদিন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। অদ্ভুত সুন্দর। ঝড়ঝঞ্ঝা উত্থান পতনের সাক্ষী গ্রানাইট পাথরে তৈরি প্রাসাদটি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে অলংকৃত ক্রেসকোর আয়না, দেওয়ালগিরী, পুরাতন অস্ত্রশস্ত্র, পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী। নানা জীবজন্তুর মাথা আর ঝাড়লণ্ঠনে সজ্জিত অলিন্দ। দরজা জানলায় গাঢ় রংয়ের ভারী পর্দা, অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলি সাজানো, উষ্ণ আরামদায়ক। জানলা দিয়ে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর, ঢেউ খেলানো পাহাড়গুলি। মেঘ পালক মেষ চড়াচ্ছে। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে ঈগল চিলের আনাগোনা। দূরে নিবিড় বনানী।
রিচার্ড বলছিল–প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পাহাড়ের ঢালু জায়গায় মানুষের ব্যবহৃত নিদর্শন পাওয়া যায়। খননে কিছু ব্রোঞ্জের সামগ্রী মিলেছিল। অতীত দিনের এইসব স্মারক বহুমূল্যে সংগ্রহ করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখত আগ্রহের সঙ্গে।
বাড়ির নামকরণ কেন সাইলেন্ট গ্রোভস বা নিস্তব্ধ অরণ্য রাখা হল তাও বোঝাল। বেশির ভাগ অংশ প্রস্তরাকীর্ণ হলেও কয়েকশ গজ দূরে একটা নিবিড় অরণ্য আছে। বহুবছর গাছপালা জন্মাচ্ছে, মরছে। আবার জন্মাচ্ছে। কিন্তু অরণ্যের আকার একই রয়েছে। জায়গাটা অজানা কারণে শব্দবিহীন। এই জন্যই নাম নিস্তব্ধ অরণ্য।
এখানে এসে ঘুরে বেড়িয়ে, গুহা দেখে কাটানোর পর অরণ্যে বেড়াতে এলাম। পা দিয়েই অদ্ভুত অপার্থিব অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম। থমথমে নিস্তব্ধতা। পাখিরা ডাকল না, ছমছমে পরিবেশ। জমা পাতা স্পঞ্জের মতো লাগছিল। অনেক ডুবে যাচ্ছিল। ডালপালা সরিয়ে পথ করলাম।
রিচার্ড কৌতূহলী হয়ে বলল–জায়গাটার বিশেষ অনুভূতি আছে না?
শান্তভাবে বললাম–অস্বস্তিকর। ঠিক ভালো নয়।
রিচার্ড বলেন–মনে হচ্ছে কেউ যেন নিষেধ করছে এটাই বহুশ্রুত দেবী অ্যাসটার্টের অরণ্য। কে তিনি? ডাক্তার সাইমণ্ডল জিজ্ঞেস করেন। রিচার্ড হলেন–অ্যাসটার্ট ফিনিশীয়দের দেবী। অনেক শতাব্দী আগে ফিনিশীয়রা অনেক দেব-দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। কালের প্রভাবে অন্যগুলি নষ্ট হলেও অরণ্যের দেবী অ্যাসটার্টের মন্দিরটি অক্ষত। সাক্ষ্য প্রমাণিত না হলেও অরণ্যটি দেবী অ্যাসটার্টের। ঘনবৃক্ষরাজরি মধ্যে হত দেবীর পূজার্চনা।
বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল অ্যালেলে পবিত্র লোকাঁচার, পূজার্চনার শব্দগুলি। লোকাঁচারের নিয়মগুলি কি? অস্ফুট স্বরে বলল ডায়না।
ক্যাপ্টেন উচ্চস্বরে হেসে বলেন–হয়তো নরবলি হত!
রিচার্ড ঠাট্টাকে অবজ্ঞা করে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন–অরণ্যের মাঝখানে মন্দির থাকাটা বইতে পড়েছিলাম। মাথাব্যথা না থাকলেও কল্পনা করতে দোষ কোথায়?
ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলামেলা জায়গার মাঝখানে দেখলাম, শ্বেত পাথরে কারুকার্য করা চূড়াযুক্ত মন্দির। স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন।
অবাক হয়ে আমরা দেখছিলাম। অনুসন্ধিৎসু চোখে ডায়না তাকাল রিচার্ডের দিকে।
প্রশ্নটা বুঝতে পেরে বলল–মনে হয় এটাই সেই মন্দির।
মন্দিরের ভেতরে মেহগনি কাঠের এবড়ো খেবড়ো থামের উপর বসানো ব্রোঞ্জের খোদাই করা অদ্ভুত মূর্তি চোখে পড়ল। সিংহের ওপর উপবিষ্টা, অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গবিশিষ্ঠা, ছোটো দেবী মূর্তি, অপূর্ব কারুকাজ করা।
রিচার্ড বললেন–ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বইয়ের পাতায় দেখা দেবীমূর্তি হলেন ফিনিশীয়দের চাঁদের দেবী।
চাঁদের দেবী? লাফিয়ে উঠল ডায়না। তন্ময়ভাবে বলল–আজ রাতে পুরানো আমলে ফিরে গিয়ে ধর্মীয় উৎসবে মেতে পুরানো দিনের পোশাকে সাজব। কেমন হবে? চাঁদ উঠলে সবাই মিলিত হয়ে দেবীর সামনে ধর্মীয় প্রথা পালন করব।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শরীরটা কেঁপে ওঠায় এলিয়ট বলে উঠল–এসব বোধহয় আপনার পছন্দ নয়?
গম্ভীরভাবে বললাম-পুরানো নিয়ে এসব করা আবার ঠিক নয়।
কৌতূহলী দৃষ্টিতে এলিয়ট আমাকে দেখে বলল–এটা যে প্রাচীন দেবীর পবিত্র অরণ্য কেউ সঠিক জানে? এটা রিচার্ডের কল্পনার বিলাস মাত্র।
ধরুণ যদি তাই-ই হয়?
আমার প্রশ্নে এলিয়ট হাসল–আপনি অবশ্যই এসব বিশ্বাস করতে পারেন না। একজন যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এগুলি বিশ্বাস করা যায় না। কবে মুছে গেছে প্রথাগুলি। চিন্তা করে বললাম–পরিবেশের প্রভাবে অভিভূত হওয়ার মানুষ আমি নই। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার চারদিকে অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অস্বস্তিকরভাবে এলিয়ট বলল–অদ্ভুতই বটে। আমার মনে অতিরিক্ত কল্পনাই এর জন্য দায়ী। তোমার কি মত সাইমণ্ডল?
তরুণ ডাক্তার কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল-বোঝাতে পারব না, আমার কেন ভালো লাগছে না। পরিবেশটা অস্বস্তিজনক।
সেই মুহূর্তে ডায়োলেট এগিয়ে এল আতঙ্ক চোখে। ফ্যাকাসে সাদা মুখে চিৎকার করে বলল–বিষম যাচ্ছেতাই জায়গা আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলুন চলে যাই।
আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগোলাম সবাই। কিন্তু ফিরে দেখি ডায়না নিবিষ্টি মনে মূর্তির দিকে তাকিয়ে। পরে আমার সঙ্গ নিলেও আনমনে হাঁটতে লাগল।
ফিরে আসার পথে মন্দির, দেবী, নিবিড় অরণ্যের বিশ্রী অনুভূতির কথা বলতে লাগল। বাড়ি ফিরে মজার পোশাক পরে চাঁদ উঠলে মন্দিরে যাবার আগ্রহে চলল কে কী পোশাক পড়বে। আড়াপাতা, ফিসফিসানি এইসব।
সবাই যখন নানা সাজে সজ্জিত হয়ে খাবার টেবিলে এল বিস্ময়ে আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গেল। ক্যাপটেন ও স্ত্রী পরেছেন নিতথিলিক যুগের গুহামানবদের পোশাক। রিচার্ড সেজেছেন ফিনিশীয় নাবিকের পোশাকে। এলিয়ট দস্যুদলের সর্দার। সাইমণ্ডল পাঠক সেজেছে, লেডি ম্যানারিং নার্স এবং কন্যা ডায়োলেট ক্রীতদাসীর বেশ, ক্রীশ্চান সাধুর বেশ ছিল আমার। সর্বশেষে নীল আলখাল্লা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে এল ডায়না।
চপল ভঙ্গিতে ডায়না বলে–হ্যাঁ, আমি অপরিচিতা, এখন খেতে চলুন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে গুমোট গরমের পর ঝির ঝির হাওয়ায় বেড়াতে বেরোলাম। আকাশের বুকে চাঁদ উঠেছে। এলোমেলোভাবে ঘুরে একঘণ্টা কাটাবার পর দেখলাম ডায়না নেই।
রিচার্ড বলল–ডায়না শুতে যায়নি নিশ্চয়।
মাথা ঝাঁকিয়ে ডায়োলেট বলল-পনেরো মিনিট আগে জঙ্গলের দিকে গেছে। আবছা আলোয় অরণ্য কালো অন্ধকারের রূপ নিয়েছে।
রিচার্ড বলল–দেখি তো গিয়ে–নিশ্চয় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি খেলেছে।
সবাই মিলে এগোতে গিয়ে ভাবছি–কি উদ্দেশ্য জঙ্গলে যাবার। আমার অনিচ্ছা ছিল, মনে হচ্ছিল শক্তিশালী কেউ যেন আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অনুভূতিটা প্রত্যেকের কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছি। মহীরুহ এমন ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, উজ্বল আলো তা ভেদ করতে পারল না। চারিদিকে মৃদু আওয়াজ ফিসফিসানো পরিবেশকে ভীতিপ্রদ করে তুলল।
হঠাৎ আমরা ভোলা জায়গায় এলাম। আর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে বাকরুদ্ধ..মন্দিরের সামনে উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব নারীমূর্তি। সর্বাঙ্গে স্বচ্ছ আবরণে সুগঠিত নারী দেহ। একরাশ চুল ভেদ করেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গ দুটি। সুন্দর আর ভয়ঙ্করের মিলন।
রিচার্ড বলল–কে এ? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
ডায়োলেট চেঁচিয়ে উঠে বলল–এ যে ডায়না। নিজেকে কেমন সাজিয়েছে।
তার দিকে এগিয়ে যেতেই সেই মূর্তি হাত উপরে তুলল। বেজে উঠল জলতরঙ্গের মতো কণ্ঠস্বর–আমি দেবী অ্যাসটার্টের যাজিকা। অগ্রসর হলে সাবধান। মৃত্যু আমার হাতে।
প্রতিবাদে লেডি ম্যানারিং বললেন–ডায়না তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিও না।
রিচার্ড ডায়নার দিকে এগিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ডায়না সত্যিই তুমি অপূর্ব।
চাঁদের আলোয় চোখ স্থির হল, পরিষ্কার দেখা গেল অন্য এক ডায়নাকে, ডায়না যেন চাঁদের দেবী ডায়না। দ্যুতিতে নিষ্ঠুরতা। অধর জুড়ে মোহময়ী হাসি।
হাত উঁচু করে আবার সতর্কবাণী–অগ্রসর হয়ো না। আমার অভিশাপে অঙ্গ স্পর্শ করলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
আবেগতাড়িত রিচার্ড বলল–আর নয় ডায়না, আমার ঠিক ভালো লাগছে না। বলতে বলতে তার দিকে এগোল।
ঠিক তখনই কঠিন স্বরে ডায়না বলল-স্থির হও। আর অগ্রসর হলেই অ্যাসটার্টের মোহিনী অস্ত্রে আঘাত হানব।
উচ্চস্বরে হেসে রিচার্ড এগিয়ে যেতে ঘটল আশ্চর্য ঘটনাটা। থমকে গিয়ে হোঁচট খাবার ভঙ্গিতে রিচার্ড পড়ে গেল। আর উঠল না।
হঠাৎ প্রাণহীন করা হাসির শব্দে কেঁপে উঠলাম। নির্জন বনানীতে ছড়িয়ে পড়ল সেই ভয়ঙ্কর হাসি।
চাপা শপথ বাক্য পাঠ করে এগিয়ে গেল এলিয়ট, আর সহ্য হচ্ছে না। রিচার্ড উঠে পড়ুন। রিচার্ড নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। রিচার্ডের কাছে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসে চিৎ করে শুইয়ে, ঝুঁকে পড়ল, পরমুহূর্তে ডাক্তার সাইমণ্ডল চিৎকার করে বলল, এদিকে আসুন। মনে হচ্ছে ও মারা গেছে। সাইমণ্ডল দৌড়ে গেল আর এলিয়ট ধীর পায়ে আমাদের দিকে এল। অদ্ভুতভাবে তাকাল হাত দুটোর দিকে।
সেই মুহূর্তে আর্তনাদ করে উঠল ডায়না, হায়! আমি খুন করেছি। এ আমি চাইনি। পরক্ষেণেই মূর্ছা গেল।
মিসেস রজার্স কান্নাভেজা গলায় বলল–অ্যাসটার্টের অভিশাপই কি মৃত্যুর কারণ? এই ভয়ঙ্কর জায়গা ছেড়ে চলুন–আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আগেই।
এলিয়ট কাঁধে হাত রেখে বিড় বিড় করে বলল–এ অসম্ভব। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে খুন হতে পারে?
আমি শান্ত করার চেষ্টার বললাম–রিচার্ডের হৃদপিণ্ড দুর্বল ছিল এবং আকস্মিক উত্তেজনায়
এলিয়ট শেষ করতে দিল না। হাত দুটি মেলল। বিস্ময়ে দেখলাম দুটো হাতে রক্তের ছাপ।
কোনো আকস্মিক ভয়ে মরেনি। ছুরিকাঘাতে মৃত্যু এবং সোজা হৃদপিণ্ডে। অস্ত্রের কোনো চিহ্ন নেই রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। এলিয়ট কষ্টবোধ করল।
সাইমণ্ডল রিচার্ডকে পরীক্ষা করে আমাদের কাছে এল। ফ্যাকাসে চোখ-মুখ। কাদস্বরে বলল–আমরা পাগল হয়ে গেলাম। বিশ্বাস করা যায় দেবীর অভিশাপের কথা! আজকের যুগে–কিন্তু যেটা ঘটল।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–সত্যি কি রিচার্ডমৃত? সম্মতি জানিয়ে সাইমণ্ডল বলল–তীক্ষ্ণ দীর্ঘ অস্ত্রের আঘাত। কিন্তু অস্ত্র তো দেখিনি।
এলিয়ট প্রায় চেঁচিয়ে বলল-কাছাকাছি কোনো অস্ত্র নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে দেখি চলুন–বৃথাই খোঁজা।
ডায়োলেট হঠাৎ বলল–জায়না যখন ভয় দেখাচ্ছিল ছড়ি জাতীয় জিনিস হাতে জ্বলছিল।
এলিয়েট মাথা নেড়ে বলল–রিচার্ড তিন গজের মধ্যে যায়নি।
লেডি ম্যানারিং ঝুঁকে ডায়নাকে দেখে বলল-হাতে কিংবা আশেপাশে কিছুই নেই। ডায়োলেট পেয়েছ কিছু?
ডাক্তার সাইমণ্ডল ডায়নাকে পরীক্ষা করে দেখল; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল, আস্তে নিশ্বাস পড়ছে। কপালে ঘাম। নার্ভের গতি ধীর। এখনি বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
লেডি ম্যানারিং, সাইমণ্ডল, রজার্স মিলে মূৰ্ছিতা ডায়নাকে নিয়ে গেল। মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছি আমি, ডায়োলেট আর রজার্স। অস্ত্রের সন্ধান করলাম। কিন্তু চাঁদের আলোতেও কোনো অস্ত্র পাওয়া গেল না। রিচার্ডের দেহ তোলার সময়ও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছিল। মিসেস রজার্স ডুকরে কেঁদে উঠল। ডায়োলেট যেন মূর্ছা যাবে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পেনডার বলেন, গোয়েন্দা গল্প পড়ে জানা যায় মৃতদেহ সরাতে নেই। তথ্যটি আমাদের অজানা ছিল। তাই রিচার্ডের দেহ বাড়িতে আনলাম।
মালিকের মৃত্যুতে পরিচারক-পরিচারিকা সবাই বারহিত। যে বৃদ্ধা পরিচারিকা ছোটোবেলা থেকে মানুষ করেছিল রিচার্ডকে, সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পুলিশ চৌকিতে খবর পাঠাল এক পরিচারক।
আমাকে ডেকে এলিয়ট বলল–সেই জঙ্গলে আবার যাবে। অস্ত্রটি খুঁজে বার করবেই। অস্ত্র না পাওয়ার সন্দেহের কথা জানিয়ে বললাম, ওখানে না যাওয়াই ভালো।
ঝাঁকুনি দিয়ে এলিয়েট বলল–আপনি মনে করেন অপ্রাকৃত শক্তিই মৃত্যুর কারণ। যে অস্ত্রটি মৃত্যুর কারণ সেটা খুঁজে বের করবই। এখন জঙ্গলে গিয়ে অস্ত্রটা নিয়ে ফিরব।
নানাভাবে এলিয়টকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলাম। অরণ্যের নিবিড়তায় মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর বিপদ ওত পেতে আছে। রহস্য ভেদের জন্য আলো নিয়ে এলিয়েট বেরিয়ে পড়ল।
ভয়ঙ্কর রাত্রি। কেউ ঘুমোতে পারিনি। সাইমণ্ডল এবং মেয়েরা ডায়নার পরিচর্যায় ছিল। সার্জেন্টের নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ ঘোড়ায় চড়ে এল, ঘটনাটা শুনে অবিশ্বাস্য ধরে নিয়েছিল। ডায়নাকে জিজ্ঞেস করার আগ্রহ দেখালে ডাঃ সাইমণ্ডল তীব্র প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের জন্য ডায়নার জ্ঞান ফিরলেও ঘুমের ওষুধ দিয়ে আবার ঘুম পাড়ালেন। মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য পুলিশ ডাক্তার আনবে এবং অকুস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান করবে।
পরদিন সাতটায় চায়ের টেবিলে খোঁজ পড়ল এলিয়টের। সাইমণ্ডলকে গত রাতের সব কথা জানালাম। গম্ভীর হয়ে বলল গিয়ে বোকামী করেছে। আমরা দুজনে অরণ্যে প্রবেশ করলাম। ডাকতে ডাকতে ভোলা জায়গাটায় এলাম। বিবর্ণ ভৌতিক জায়গা। বিস্ময়কর শব্দে সাইমণ্ডল হাত জাপটে ধরল। দেখি যেখানে রিচার্ডের মৃতদেহ ছিল, সেইখানে উপুড় হয়ে আর একটি দেহ।
দৌড়ে গিয়ে দেখি উপুড় হয়ে এলিয়ট। জামা ভিজে গেছে রক্তে, রক্ত মাটিতেও পড়েছে।
ডাক্তার সাইমণ্ডল নাড়ী ধরে দেখে বলল–মরেনি, নাড়ীর গতি ভালোই।
আমি নিচু হয়ে দেখি নিঃশ্বাস পড়ছে ধীরে। একটি সরু ব্রোঞ্জের অস্ত্র কাঁধে বিধে রয়েছে। অস্ট্রটায় হাত দিতে গেলে ডাঃ বলল–অস্ত্রটায় হাত দেবেন না। খুললেই রক্ত পড়তে শুরু করবে। আঘাত লেগেছে কাঁধে, হৃদপিণ্ডে নয়। সব ঘটনা ওর মুখেই শুনব।
ধরাধরি করে আনার পর সাইমণ্ডলের চিকিৎসার গুণে ব্রাণ্ডির প্রভাবে এলিয়ট সুস্থ হয়ে উঠল। আহত হওয়ার ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারল না। ভাসা ভাসা বিবরণ। অনেক খুঁজেও কোনো অস্ত্র পাইনি। শান্ত হয়ে মন্দিরের কাছে যেতেই মনে হল গাছের আড়াল থেকে কেউ যেন লক্ষ করছে। হঠাৎ কনকনে হাওয়া বইল, আমার মন হল মন্দির থেকে হাওয়াটা আসছে। ভেতরে উঁকি মারতেই কপালে প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়ে টের পেলাম কাঁধে প্রচণ্ড যন্ত্রণা।
যে ছুরিটি এলিয়টের কাঁধে বেঁধা ছিল সেটি ব্রোঞ্জের তৈরি প্রাচীন অস্ত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায়। হেভেন বহু টাকা দিয়ে অস্ত্রটি কেনেন, কিন্তু বাড়িতে না মন্দিরে রেখেছিলেন সঠিক বলতে পারলেন না।
পুলিশের ধারণা হয়েছিল যে, ডায়নাই রিচার্ডকে আঘাত করে। কিন্তু আমাদের দেখে তারা বুঝল এত লক্ষণীয় প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের বিরুদ্ধে ডায়নাকে অভিযুক্ত করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি রহস্যজনকই রয়ে গেল।
ডাঃ পেনডার অল্পক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। জয়েস লেমপ্রিয়ের বলে উঠল-চমৎকার কিন্তু বীভৎস ভৌতিক কাহিনী-আমি হত্যাকারীকে খুঁজে পেলাম না।–আপনি জানেন?
বৃদ্ধ পেনডার মাথা নাড়লেন। কার্যকারণ সম্পর্কে তখন একটা অদ্ভুত ধারণা তার হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।
প্রেতচর্চার বৈঠকে উপস্থিত থেকে এই ঘটনাকে জন-সম্মোহন জাতীয় কিছুকে হত্যার কারণ মনে হয়েছে। মেয়েটি অ্যাসটার্টের যাজিকায় রূপান্তরিত হয়ে রিচার্ডকে ছুরি বিদ্ধ করে, পরে ছুরিটি ফেলে দেয় এটুকু বলে জয়েস থামল।
রেমণ্ড মন্তব্য করে, চাঁদের আলোয় সব দেখা না গেলেও মনে হয় বর্শা জাতীয় অস্ত্র দূর থেকে ছুঁড়ে মারাত্মক আঘাত হানা যায়। উপস্থিত সবাই ঘটনাকে সম্মোহন বলে ধরে নিয়েছিল।
হেনরি বলেন, কোনো ওস্তাদ লোক গাছের আড়াল থেকে অস্ত্রটা ছুঁড়েছিল। এলিয়টের মনে হয়েছিল আড়ালে কেউ নজর রাখছে আর ডায়নার হাতে ছুরি ছিল কিনা এ নিয়ে মতভেদ রয়েছেই।
পেথোরিক কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন–আমরা একটা প্রয়োজনীয় তথ্য এড়িয়ে যাচ্ছি।
অস্ত্রটা ডায়না নিশ্চয় লুকোতে পারেনি, আর গুপ্ত ঘাতক অস্ত্রটা ছুঁড়লে রিচার্ডের দেহেই থাকত। যুক্তিপূর্ণ কারণ হচ্ছে রিচার্ড নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করেছে। এবং এটি আত্মহত্যাই।
অবিশ্বাসের সুরে রেমণ্ড বলল, উনি কেন আত্মহত্যা করবেন?
পেথোরিক বলেন, আমি অনুমানে না গিয়ে তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তেই আসতে পারি যে নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করার পর মাটিতে পড়ার সময় ছুরিটি ছিটকে পড়ে।
মারপল বলেন–আমি আপনার সঙ্গে একমতনই। ঘটনাটা বিভ্রান্তিজনক। সেদিন চড়ুইভাতিতে গলফ নম্বর প্লেট সাজাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে লোকটা পাঁচ মিনিট অজ্ঞান ছিল।
রেমণ্ড পিসিকে বলল-লোকটা তো ছুরিবিদ্ধ হয়নি।
পিসি বলেন–একজনেইর সুযোগ ছিল ছুরি মারার। সুযোগ উপস্থিত হতেই মানসিক ইচ্ছা পূরণ করতে রিচার্ডকে খুন করে। তার দৃষ্টি ছিল ডায়নার দিকেই, তাই গাছের শিকড়ে বা পাথরে হোঁচট খান।
পেনডনার বিস্মিত হয়ে মারপলের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি বললেন না একজনেরই সুযোগ ছিল।
মারপল বলেন–হ্যাঁ-এলিয়ট জনজাতি মানুষ ছিলেন তো? আমি নিশ্চিত; নিজেই নিজের কাঁধে ছুরি মেরেছিল। যেমন আবাস-এর যুদ্ধের পর জ্যাক বেনেস নিজের পায়ে নিজেই গুলি করেছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আর গোলাগুলি দেখে যাতে ওকে যুদ্ধে যেতে না হয়। হাসপাতালে সব খুলে বলে লজ্জিত হয়েছিল। এলিয়ট কি জঘন্য অপরাধটি করে খুব লাভবান হয়েছে।
এলিয়ট হেভেন?–চিৎকার করে ওঠে রেমণ্ড।
অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মারপল বলেন–অন্য কেউ খুন করতে পারে না। মিঃ পেথোরিক বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তাই প্রকৃত তথ্য হল মাটিতে পড়ার সময় প্রথম এলিয়েটই কাছে যায়। চিৎ করে শোয়ানোর সময় ঘটনাটি ঘটায়।
মারপলের কথা শেষ হলে পেনডার ধীরে ধীরে বলেন, সত্যটা পাঁচ বছর পর জানতে পারি। এলিয়টের মনে হয়েছিল প্রথম থেকেই ও সন্দেহের তালিকায় ছিল। তাৎক্ষণিক প্ররোচনায় ঘটে ব্যাপারটি, কারণ সে ডায়নাকে তীব্র ভালোবাসত। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ ব্যারিস্টার। রিচার্ড যদি মারা যায় উত্তরাধিকারী হবে এলিয়ট। পথের কাঁটা সরে যাবে। ডায়না তারই হবে।
রিচার্ডের কাছে উপুড় হয়ে বসতেই প্রলোভনে বিভ্রান্ত হয়ে রিচার্ডকে আচমকা ছুরিবিদ্ধ করে। স্বস্তি ফিরে আসতেই কোমর বন্ধনীতে ছুরি রেখে দেয়। সন্দেহমুক্ত হতে নিজেকে আহত করার মতলব আঁটে। নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে, যাতে সবার ধারণা হয় অশরীরী কেউ ফিনিশীয় অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে এসেছিল অরণ্যে প্রবেশ করার অপরাধে। ঘটনার পর ডায়না অপ্রকৃতিস্থ থাকলেও তার মনে হয়েছিল রিচার্ডকে সেই খুন করেছে।
দক্ষিণ মেরু অভিযানের সময় এলিয়ট চিঠিটা আমাকে দেয়। আশংকা ছিল অভিযান থেকে উনি ফিরবে না। সে ফিরে আসতে চাননি। মারপল ঠিকই বলেছেন, লাভ তো হয়নি বরং দুঃসহ নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। চিঠির শেষ কথাটি ছিল সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ সঠিক প্রয়াশ্চিত্ত। নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত কাটল।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার শুরু করলেন পেনডার-ঈশ্বরের কৃপায় কোনো অপরাধী ছাড়া পায় না। অপরাধ প্রমাণিত না হলেও কিংবা আইনের চোখে দোষী না হলেও ঈশ্বরের আদালতে শাস্তি পাবেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অশুভ পরিবেশই ঘৃণ্য কাজের জন্য দায়ী। মিস মারপলকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন–আপনি আবার রহস্যমোচন করলেন।
ঘটনার আশ্চর্য পরিসমাপ্তিতে সবাই চুপ। চুল্লির লালচে আভা সবার মুখে। জয়েস উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে পেনডারকে বলে–অদ্ভুত ঘটনা শোনানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। পরের মঙ্গলবার গল্পকার রেমণ্ড অনুদঘাটিত রহস্য গল্প শোনাবে।
পেথোরিক বললেন, আমি সমর্থন জানাচ্ছি।
রেমণ্ড বলল-জয়েসের ধারণা আমার জীবন পেশা সবই কল্পনাভিত্তিক। পরের মঙ্গলবার বাস্তব ঘটনা শোনাব।
২. স্বর্ণ তৃষা
মারপলের বসার ঘরে সবাই উপস্থিত। মিঃ পেনডার, মিঃ পেথোরিক এখন আসেনি। হেনরি, মিস মারপল নিচু স্বরে গল্প করছেন। জয়েস ও রেমণ্ড চুল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাকি দুজন একসাথে ঢুকলেন।
চা পর্ব চুকে গেলে রেমণ্ড তার কাহিনী শুরু করল।
আমি যে গল্পটা শোনাব এই পরিবেশে উপযুক্ত হবে কিনা জানি না। শেষ জানি না এবং পুরোটাই রহস্যময় রয়ে গেছে, আমার কাছে।
আমার কাছে কাহিনীটা আশ্চর্যজনক। পুরো কাহিনী শোনার পর আপনারা কেউ হয়তো রহস্য ভেদ করতে পারবেন। সমস্বরে সবাই তাকে গল্পটি বলার অনুরোধ করলো।
প্রায় ছবছর আগের ঘটনা। আমি তখন নিউম্যানের অতিথি।
জয়েস বলল–কর্নওয়ালে?
রেমণ্ড বলল, কেন?
না, তেমন কিছু নয়। আমার গল্পের পটভূমিও কর্নওয়াল। সমুদ্রতীরে জেলেদের একটা ছোটো গ্রাম রাদোল। তোমার গল্পটা নিশ্চয় ওখানকার নয়।
আশ্বস্ত করে বলল জয়েসকে, গ্রামটির নাম পলপেরানী। প্রাকৃতিক দিক থেকে রুক্ষ; পাথুরে, বন্য। যার অতিথি ছিলাম, তার সঙ্গে আলাপ বেশি দিনের নয়। অল্প দিনের বন্ধুত্ব। প্রথমদিনই ওর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া পাই। বেশিরকম কল্পনাপ্রবণ থাকায় মাথায় ঘুরত আজগুবি কল্পনা।
মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ছিল তার প্রচুর জ্ঞান। স্পেন থেকে যে জাহাজ ইংল্যান্ড আসত, বিশেষতঃ স্পেনীয় আর্মাডার যাত্রাপথ সম্পর্কে বহু গবেষণা করেছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যখন তিনি যাত্রাপথের বিবরণ দিতেন তখন মনে হত তিনি যেন সেই জাহাজের নাবিক ছিলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে হাত-পা নেড়ে গল্প করার সময় মনে হত সত্যিই উনি জাতিস্মর হয়ে এসেছেন এবং গতজন্মে দুর্ধর্ষ স্পেনীয় নাবিক ছিলেন।
মারপল সস্নেহে তাকিয়ে বলেন, ছোঁয়াচে কল্পনার ছায়া তোমার ভালোই লেগেছে।
বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করে রেমণ্ড বলল-না পিসি, আমি নই, তার কল্পনা জগতে তিনি নিমজ্জিত থাকেন।
নিউম্যানের মোদ্দা কথা হল, ওই বিখ্যাত আর্মাডার একটি জাহাজ প্রচুর সোনা ও ধনরত্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে আসার পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সর্পিল ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নিউম্যানের স্থির বিশ্বাস কর্নওয়ালের উপকূলে কোথায় জাহাজডুবি হয়।
একটা কোম্পানিও তৈরি হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য। অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়। নিউম্যানের কল্পনা ছিল গগনচুম্বী। ধনরত্ন উদ্ধারের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে জলের দরে কোম্পানিটা কিনে নেয়। ওর ধারণা স্প্যানিস জাহাজের স্বর্ণসম্পদ সাগরের তলায় আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে স্বর্ণ তুলে আনতে।
খেয়াল মেটাতে সেইখানে পল হাউস নামে একটি বাড়ির লিজ নেবেন। অবাক হয়ে গেলাম নিউম্যানের মতো ধনী ব্যক্তি টাকা উড়িয়ে হয়তো কয়েকশো টাকা দামের খেলো জিনিস পায়। তার অদ্ভুত খেয়াল আমাকেও প্রভাবিত করল। আমিও মনশ্চক্ষে দেখতাম ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তাদের এগিয়ে যাওয়া। তারপর পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ঘটে সলিল সমাধি।
নিউম্যানের আমন্ত্রণ যোড়শ শতাব্দীর পটভূমিকায় উপন্যাস লেখার উপযুক্ত রসদ।
শুক্রবার ভোরে প্যাডিংটন থেকে রওনা দিলাম কর্নওয়ালের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী লম্বা চেহারার মানুষটিকে প্রথমেই চেনা লাগছিল। মনে পড়ল ইনি হলেন পুলিশ ইনসপেক্টর ব্যাজওয়ার্থ এডার্সন, নিরুদ্দেশ মামলায় ওর সঙ্গে আলাপ। মামলা সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখার সময় ব্যাজওয়ার্থের শরণাপন্ন হতে হত।
পরিচয় দিতেই চিনতে পেরে সারা পথ গল্প করে কাটালাম। পলপেরানী যাচ্ছি শুনে বলেন–আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি।
আমি ও অঞ্চলে যাবার উদ্দেশ্য জানিয়ে ডুবে যাওয়া স্প্যানিস জাহাজ সম্পর্কে বন্ধুর আগ্রহের কথাও বললাম।
জাহাজের কথা আমিও জানি, নাম জুয়ান ফারনানডেস। অনেক মানুষ ব্যর্থ হয়েছে ডুবন্ত জাহাজের সন্ধান করতে গিয়ে।
আমি বললাম–সবই কল্পনা মাত্র। জাহাজ ডুবলেও কোনো ধনরত্ন তাতে ছিল না।
অবাক করেই ইনসপেক্টর বলেন–একটা নয় অনেক জাহাজডুবি হয়েছিল। আর ওইরকম ধ্বংসগ্রাপ্ত জাহাজ ওটারনাটো নামে একটা জাহাজে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়।
আমি বলি, ঘটনাটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ব্যাজওয়ার্থ বলেন, প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর সোনার বাট ছিল জাহাজে। ব্যাক অন্ ইংল্যান্ডের ভল্টে যাচ্ছিল।
ডুবুরি নামিয়েও সোনা উদ্ধার করা যায়নি।
অবাক হয়ে বললাম–সোনা তো উবে যেতে পারে না।
ব্যাজওয়ার্থ বললেন–ধাক্কা খাবার সময় স্ট্রংরুমে ফাটল ধরে, যেখানে সোনা মজুত ছিল। ডুবুরিরা ফাটলের মধ্যে স্ট্রংরুমে ঢুকে সোনা পায়নি। আসল প্রশ্ন হল সোনা অপহৃত হয় ডোবার আগে না পরে। নাকি সোনা জাহাজে আদৌ তোলা হয়েছিল।
অদ্ভুত ব্যাপার তো।
ব্যাজওয়ার্থ বলেন, কেউ পকেটে ভরে নিতে পারে না, কারণ প্রচুর সোনার বাট। হয়তো, জাহাজ যাত্রা করার আগে কোনো প্রতারক সোনা সরিয়ে ফেলেছিল বা কেউ বাটগুলি অপহরণ করে। এই রহস্য উন্মোচন করতেই পলপেরানী যাত্রা।
নিউম্যান এককোণে দাঁড়িয়েছিল। দেখেই হৈ হৈ করে এগোল। বলল, মেরামতির জন্য গাড়িটা আনতে না পারায় লরি নিয়ে এসেছি। থাকা খাওয়ার অসুবিধার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল।
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে লরি চলল। গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পর গাড়ি উপরে উঠল। উঁচুতে ওঠার পর সমতল জায়গা, সেখানেই পাথরের প্রাসাদ পল হাউস।
পল হাউস আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে খোদিত স্পেনীয় জাহাজও সুউচ্চ চূড়ায় বাড়িটি। তিন চারশো বছরের। সামনে প্রসারিত মহাসমুদ্র। পিছনে বিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র। পাহাড়, নিবিড় জঙ্গল। প্রকৃতির রূপে প্রশান্ত চিত্ত উপন্যাস শেষ করার আদর্শ জায়গা।
সন্ধ্যায় নিউম্যান যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে জুয়ান ফারনানডেস জাহাজ সম্পর্কে অনেক নথিপত্র দেখাল। মানচিত্র খুলে বোঝাল কোন অঞ্চল দিয়ে গিয়ে কোথায় ধাক্কা খায়। কোন যন্ত্রপাতি দিয়ে সোনা উদ্ধার করবে তাও বোঝাল। বিমোহিত হয়ে পড়লাম।
ব্যাজওয়ার্থের সঙ্গে আলাপের কথা বললাম, এবং তার আসার কারণটা। আগ্রহ সহকারে সব শুনে বলল-উপকূলভাগের লোকেদের রক্তের মধ্যে দসুতা এবং ধ্বংসের প্রবৃত্তি আছে। এই অঞ্চলে জাহাজ ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেলে, ডুবন্ত জাহাজের সম্পত্তি তাদের মনে করে, হস্তগত করতে কালক্ষেপ করে না।
এইরকম লোকের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব, যেন কোনো জলদস্যু।
পরদিন প্রথম সূর্যের আলোয় আমি আর নিউম্যান গ্রামে এলাম। একটু ফিরে গেলাম সমুদ্রতীরে কোম্পানির জাহাজঘাটায়, পরিচয় হল ডুবুরি হিগনিসের সঙ্গে, বিরাট চেহারার সঙ্গী, ধূসর পলকহীন ভাবলেশহীন মুখ। হ্যাঁ বা না ছাড়া কিছুই বলল না।
স্থানীয় রেস্তরাঁয় থ্রি অ্যাসকোরের বিয়ার খেতে গেলাম। বিয়ার খেতে খেতে আলাপ হল হিগনিসের সঙ্গে। নানা বিষয়ে কথা বলল।
জানতে চাইলাম কেমন দেখতে সমুদ্রের তলা। কি রকম মাছ ও গাছপালা আছে। ডুবুরির পোশাকে কেমন অনুভূতি।
শান্ত মেজাজেই উত্তর দিচ্ছিল। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল-লন্ডন থেকে গোয়েন্দা এসে জানবে নভেম্বরে ডুবে যাওয়া জাহাজে কত সোনা ছিল। বহু জাহাজও ডুবি হয়েছে। সরকারী সোনাও লুট হয়েছে।
হঠাৎ কার গলা শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, মিঃ কেলডিন।
আগ্রহের সঙ্গে কেলডিনকে দেখে বুঝলাম চেহারায় বিশেষ ছাপ আছে। পেশীবহুল তামাটে রং। রক্তবর্ণ চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেই মনে হল নিউম্যান বর্ণিত জলদস্যু সর্দার।
হঠাৎ তাকিয়ে বলল, বিদেশীদের নাক গলানো তারা সহ্য করবে না, শুধু পুলিশ নয় অন্যদেরও। এই বলে তীব্র দৃষ্টি ফেলে চলে গেল থ্রি-অ্যাসকোরের মালিক কেলডিন।
বাড়ি ফেরার পথে নিউম্যান কথাবার্তায় ভয় দেখানোর হুমকি দিল। তার কাজকর্ম সে পছন্দ করছে না। নিউম্যান ওর কথায় গা করল না।
মন থেকে সন্দেহ গেল না। মনে হল এই ধরনের লোক যে কোনো ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারে। মনে হল কোথাও গণ্ডগোল হতে পারে। এই আশঙ্কায় ঘুম এল না।
মেঘলা আকাশ। ঝড়বৃষ্টি নামতে পারে। সঙ্গে অজানা আশঙ্কায় মন ছিল ভারাক্রান্ত। প্রাতঃরাশের টেবিলে নিউম্যান জানতে চাইল মুখ গম্ভীর হওয়ার কারণ।
মনের কথা জানাতেই নিউম্যান গুরুত্ব না দিয়ে বলল–অবস্থার জন্য মেঘলা আকাশ দায়ী।
একটু বেড়াতে বেরিয়েও ফিরে আসতে হল। উপন্যাস লেখার চেষ্টা ব্যর্থ, গল্প শোনার আশায় হিগনিসের খোঁজ করা হল কিন্তু পাওয়া গেল না।
সন্ধেবেলা নিউম্যানের মোটর বোটে বেরিয়ে পড়লাম।ঝড়বৃষ্টির মুখে ফিরে আসি।কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের দাপাদাপিতে বন্ধ ঘরে থাকলাম।
ঘরে ফিরে অজানা আশংকায় মন ভার হয়ে গেল। বুকটা ভার। কাঁটা বিঁধছিল মনে। যেন কিছু ঘটবে। অবস্থান বোঝাবার নয়। দশটা নাগাদ ঝড় কমল।
জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে নিউম্যান বলল-কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্লান্ত হয়ে জানালাম–গত রাত্রে ঘুম না হওয়ায় প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। তাকে একাই যেতে বললাম।
ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। মনে হল গভীর গহ্বরের পাশ দিয়ে সে হাঁটছে। পা ফসকালেই মৃত্যু। বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম, একটা মানুষ বাগানের পিছনে কবর খুঁড়ছে। চোখ মুছে দেখি বাগানের মালী লম্বা গর্তটি খুঁড়ছে। পাশে রয়েছে কয়েকটা গোলাপের চারা।
মালী সুপ্রভাত জানিয়ে বলল–আজকের দিনটা ভালোই যাবে। প্রত্যুত্তরে আমিও সম্মতি জানালাম।
মেঘ কেটে ঝঝকে নীল আকাশ। সমুদ্রে বেড়াতে যাবার ইচ্ছা জাগল। গ্রাম থেকে আসা স্ত্রীলোক প্রাতঃরাশের টেবিল সাজাল।
সকালে নিউম্যানের খোঁজ করে জানা গেল, সে সকালেই বেড়িয়েছে।
কথাটা শুনেই ছুটলাম শোবার ঘরের দিকে। গিয়ে দেখলাম গতকালের নিউম্যানের পোশাক নেই। সম্ভবত কাল রাত্রে উনি বেরিয়েছেন।
আশংকায় মন দৃঢ় হল। বলেছিলেন ঝড় থামলে বেরোবেন। না ফেরার কারণ হিসেবে মনে হল পাহাড় থেকে পড়া বা কোনো দুর্ঘটনা।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিছু লোক জোগাড় করে বেরিয়ে নিউম্যানের খোঁজে চূড়া থেকে নেমে সমুদ্রতীরে তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও তাকে না পেয়ে ব্যাজওয়ার্থের শরণাপন্ন হলাম।
সব শুনে বললেন–নিশ্চয় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ সন্দেহজনক অপরাধী লোক প্রচুর রয়েছে। থ্রি-অ্যাসকোরের মালিকের সঙ্গে আলাপের কথা জানালাম। ব্যাজওয়ার্থ বলল-গুণ্ডামী এবং মারদাঙ্গার অভিযোগে সে জেল খেটেছে।
কেলডিনদের ধারণা বিদেশী হয়েও ওদের ব্যাপারে সে নাক গলাচ্ছে। ব্যাজওয়ার্থ যোগ দিল তল্লাশীতে। নতুন উদ্যোগে খোঁজা শুরু হল। বিকেলে সন্ধান পাওয়া গেল। বাগানে গভীর খাদে পড়েছিল। মুখ, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, যাতে আওয়াজ না করতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ বন্দী থাকায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে আমাকে এবং ব্যাজওয়ার্থকে সব বলল।
বলল–ঝড়জল থামলে বেড়াতে বেরিয়ে ভালোই লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে সমুদ্রতীরে পাহাড়ের গায়ে যে গুহা আছে যা চোরাচালানকারীদের গুহা বলে পরিচিত সেখানে চলে আসে।
হঠাৎ জ্বলা-নেভা আলো দেখে এগিয়ে দেখতে পেল কিছু লোক মোটর বোট থেকে ভারী জিনিস তুলে গুহার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে একটু বেশি এগোতেই কেউ একজন তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীদের সতর্ক করে দেয়। ওরা আসছে বুঝতে পেরে নিউম্যান পালাতে গেলে শক্ত দুটো হাত ওকে ধরে ফেলে। প্রচণ্ড আঘাতে সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে দেখল সে লরির ভিতর বন্দী। লরির গতিবিধি দেখে বুঝল লরিটা ওর বাড়ির গেটে ঢুকছে। কিছু দূর গিয়ে ওরা একটা গভীর খাদে তাকে ফেলে দিল।
সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও মনে হল তারা কর্নিল প্রদেশীয় নাবিক। তারা কিন্তু তাকে ভালোই চেনে।
বিবরণ শুনে ব্যাজওয়ার্থ বলেন–সোনাগুলি চোরাই। কিন্তু সোনার সন্ধানে বেরোলে বুঝতে পারি সোনা স্থানান্তরিত হচ্ছে। এবং সম্ভবত এই জায়গা থেকে সোনা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
লোকজন নিয়ে ইনসপেক্টর সেই গুহায় গেল। প্রমাণও পেল সোনা রাখার, কিন্তু সন্ধান পেল না কারণ বোঝা গেল দূরতম দ্বীপে বা গুহায় তা সরিয়ে ফেলেছে।
ব্যাজওয়ার্থের একটা ক্ষীণ সূত্র মিলল। গুহার পাশে চাকার দাগ এবং দাগটা নিউম্যানের বাড়ি পর্যন্ত গেছে। এবং লরিটা পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়েছে। নিউম্যান ছাড়া কেলডিনের একটি লরি আছে।
তরুণ বয়সে কেলডিন ডুবুরি ছিল জানতে পেরে অনুমান করল সেই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। সোনা তুলতে কেলডিনের মতো ডুবুরিই দরকার।
ধারণা বদ্ধমূল করতে তারা হাজির হল গ্যারাজে। তন্নতন্ন করে খুঁজে হঠাৎ উল্লসিত হয়ে পড়ল। বলল–যে ভাঙ্গা টায়ারের দাগ মিলেছে, এটি সেই টায়ার। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সোনার হদিশ মিলবে।
রেমণ্ড সবাইকে জিজ্ঞেস করল তারা কি কিছু অনুমান করতে পেরেছে? কারা পাচারকারী?
জয়েস অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, সোনা কি পাওয়া গেছে?
রেমণ্ড বলল, সোনা মেলেনি এবং কেলডিনকেও গ্রেফতার করা যায়নি। নির্দোষিতা প্রমাণের পক্ষে দুটি সাক্ষ্যই যথেষ্ট।
প্রথম প্রমাণ একজন নার্স। যিনি রাতের ডিউটিতে সারারাত বসেছিলেন জানালার ধারে। তিনি কোনো গাড়িকে বের হতে দেখেননি।
দ্বিতীয় হল, মহিলা শিল্পী স্বয়ং কোমরের ব্যথা বাড়ায় সে রাত্রে যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেনি।
রেমণ্ড বলল, টায়ারের ব্যাপার ছাড়া আর কোনো প্রমাণ কেলডিনের বিরুদ্ধে ছিল না।
হেনরি বলেন–ঘটনাটা সে আগাগোড়া জানে কারণ সেই সময় তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ছিলেন। রহস্য প্রকাশ এখন নয়।
রেমণ্ড মারপলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বন্ধু নির্বাচনে তার সতর্ক হওয়া উচিত; যে সবকিছু সহজেই বিশ্বাস করে তাই ঠকে যায়।
মিঃ হেনরি মারপলকে বলেন–তিনি নিউম্যানের আসল রূপটা ধরে ফেলেছেন। কি করে সম্ভব হল।
নিউম্যানের অতীত জীবন অন্ধকারময়। ডুবে যাওয়া ওটারনাটো জাহাজের সোনা চুরির পাণ্ডা সে। কারণ সোনাগুলির বেশির ভাগ মেলে পল হাউসের বাগানে।
জাহাজ উদ্ধারের নামে পুরানো কোম্পানিটা কিনে লোকজন লঞ্চ ডুবুরি এনেছিল নির্জন জায়গায়। পল হাউস কিনে ঘাটি গেড়ে বসে। যেন, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানোর কায়দায়। শুধু ছিল সাক্ষীর প্রয়োজন।
যখন জানতে পারল রেমণ্ড যোড়শ শতাব্দীর পটভূমিকায় উপন্যাস লিখতে বইয়ের সন্ধান করছিল, তখন মতলবটা তার মাথায় আসে। জাহাজ ডোবা নিয়ে রোমাঞ্চকর গল্প বানিয়ে পল হাউসে, তাকে নিমন্ত্রণ করল। গল্পের আসল উদ্দেশ্য ছিল ওটারনাটো থেকে সোনা অপহরণ।
খ্যাতনামা সাহিত্যিক হওয়ায় রেমণ্ডের সাক্ষ্য অত্যন্ত দামী ছিল, এবং পুলিশ যাতে তাকে সন্দেহ না করতে পারে সেইজন্য কেলডিনকে সামনে রাখে।
জয়েস, লরির চাকার প্রসঙ্গ তুলতেই মারপল বলেন–নিউম্যানের লোকেরাই কেলডিনের লরির চাকা খুলে তার লরিতে লাগিয়েছিল। ডুবুরি দিয়ে সোনা তুলে দুর্গম গুহায় রাখছিল।
ইনসপেক্টর ব্যাজওয়ার্থের আসার কথা জেনে ঝড়বৃষ্টিতে সুবর্ণ সুযোগ বুঝে গুহা থেকে লঞ্চে সোনা এনে লরি করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। টায়ারের দাগ স্পষ্ট করতেই লরিকে পেছন গেট দিয়ে বের করে তারপর চাকা যথাস্থান লাগিয়ে দেয়–যেন, সন্দেহ করে কেলডিনকেই।
মালী সাজা লোকটাকে যাতে সন্দেহ না হয় তাই খোঁড়ার সময় সামনে ছিল গোলাপ চারা। গর্তে সোনা রেখে চারাগুলি পোঁতা হয়। সুযোগ বুঝে পরে তুলবে। তার লোকেরাই হাত-পা বেঁধে তাকে গর্তে ফেলে দেয়।
রেমণ্ডের প্রশ্ন–লোকটা আসল মালী নয়?
উত্তরে মারপল বলল–সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় মালীরা সোমবার কাজ করে না।
জয়েস হাসতে হাসতে বলল-প্রমাণ হল, ঘটনাটা বাস্তব বলে বর্ণনা করলেও রেমণ্ড কল্পনা জাগতের মানুষ।
হেনরি বলেন–রেমণ্ড তাদের চমকপ্রদ রহস্যজনক গল্প শুনালে, দ্বিতীয় চিত্রশিল্পীর গল্প শোনার প্রস্তাব দিয়ে সভা শেষ করল।
.
ফুটপাথে রক্তের দাগঃ–
মারপল চুল্লীর পাশে চেয়ারে বোনার সরঞ্জাম নিয়ে হেনরির সঙ্গে গল্প করছেন। পোড়া পাইনের মৃদু সৌরভ। জয়েসের উচ্চকিত স্বর, এবং হাসি শোনা যায়। পরিচারিকা চা নিয়ে প্রবেশ করল। জয়েস পরিবেশন করল। দেরিতে আসার জন্য মিঃ পেথোরিক ক্ষমতা চাইলেন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। চায়ের কাপ হাতে পেনডার লেমিপ্রিয়েরকে অনুরোধ করেন গল্প শুরু করতে।
ঘটনাটা যে গ্রামে ঘটে তার নাম রাদোল। ধীবর প্রধান গ্রাম। শান্ত, যেন শিল্পীর তুলির জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ।
প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে পনেরো দিনের জন্য গেছিলাম ঐ গ্রামে। উঠেছিলাম পলবারুইথ আরমস পান্থশালায়। যেটি আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পায় আর্মাডার যুদ্ধ জাহাজের কামান দাগা থেকে। শুধু দিক নির্দেশিকা নষ্ট হয়।
রেমণ্ডের মন্তব্য, ইতিহাস কি তাই বলে?
রাস্তা পর্যন্ত ছড়ানো ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি জয়েস আঁকত।
একদিন রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে একটা গাড়ি পান্থশালায় এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল একজন পুরুষ এবং উজ্জ্বল পোশাক পরিহিতা মহিলা। পান্থশালা পার হয়ে এগোলেন সমুদ্রের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে অন্য গাড়ি থেকে নামলেন কমলা রংয়ের পোষাকে সজ্জিত এক মহিলা যিনি গাড়িটির চালক। মাথায় খড়ের টুপি তাতে বাঁধা ছিল হলুদ লাল ফিতে।
আগের গাড়িতে আসা ভদ্রলোক শব্দ শুনে তাকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলেন–তুমি ক্যারল না? আরও বললেন, তার স্ত্রী তাকে দেখে খুব অবাক হবে। এই বলে উপরে উঠে এল।
সুপুরুষ লোকটি জেনিস। তারা বেড়ানো, সমুদ্র স্নান নিয়ে কথা বলছিল। পান্থশালার থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা পাহাড়ের গুহা আছে যেখান থেকে পুরো অঞ্চল দেখা যায়। পরে স্থির হয় ক্যারল পদব্রজে এবং জেনিস মার্জারি বোটে করে গিয়ে সেখানে মিলিত হবে।
স্নানের পোশাক নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে জয়েসও স্নানের পোশাক এবং খাবার-দাবার নিয়ে বেরোল।
স্নান সেরে টিনের খাবার ও কফি দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ হল। অলস মহ্যাহ্নে গ্রামটি ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য পশ্চিম গগনে; আঁকার উপযুক্ত পরিবেশ।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলতেই দেখা গেল একটি লোক পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা ও পোশাক দেখে মনে হল তার পেশা মাছধরা। লম্বা কালো দাড়ি, চওড়া কাঁধওলা টুপিতে যেন ছবির জলদস্যু।
স্থির করলাম তার ছবি আঁকার। তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল সে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। আঁকা যখন প্রায় শেষ তখন দেখা গেল সে জয়েসের দিকে এগিয়ে আসছে। এবং বলল এই রদোল আকর্ষণীয় সুন্দর। ছবি আঁকার জন্য উপযুক্ত। তার নানা ঘটনা বলতে লাগল।
লোকটির বর্ণনা শুনে জয়েসের মনে হল তার চাউনি এবং বলার ভঙ্গিতে কোথাও যেন নিষ্ঠুরতার মানে লুকিয়ে আছে।
তার কথা শুনতে শুনতে আঁকতে লাগলাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সূর্য রশ্মির বদলে একেছি রক্তের ছাপ। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফুটপাথে লাল আভার পরিবর্তে রক্ত পড়ে রয়েছে। চোখ খুললেই দেখা যাচ্ছে রক্তের ছোপ। লোকটিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, আজকাল রক্ত দেখা যায় না। কারণ ঘটনাটা কয়েকশো বছরের পুরানো।
সেই সময় রাস্তায় বেরিয়ে এলেন জেনিস। বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে শুকনো জামাকাপড় তুলতে লাগলেন।
জেনিস কিছুটা এগিয়ে এসে দাড়িওলা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল তার সঙ্গী মহিলাটি ফিরেছেন কিনা? কিন্তু জানা গেল বহুক্ষণ আগেই তিনি ফিরে গেছেন। বহুক্ষণ হয়ে গেল তবুও সে ফিরল না। মনে হয় পাহাড়ের রাস্তা ছিল পিছল।
জেনিস তার স্ত্রীকে জানাল এখনও ক্যারল ফিরল না, তার কি করা উচিত। তারপর জেনিস বলল, তারা তার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না। পেরিনদার-এ আজকের মধ্যে যেতে হবে।
কিছুক্ষণ পরে কালো দাড়িওয়ালা লোকটির গলা তার কানে এল। জিজ্ঞেস করল জয়েসকে যে, তিনি সত্যিই রাস্তায় রক্তের দাগ দেখেছেন কিনা? যদি সত্যিই দেখেন তবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই কোনো জায়গায় রক্তপাত বা খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। লোকটি আরও বলল, এখানকার গীর্জায় একজন ব্যক্তির মৃত্যুর বর্ণনা আছে।
কিছুক্ষণ পরে জয়েস দেখতে পেল ক্যারল নামে ভদ্রমহিলাটি ফিরে আসছে কিন্তু মনে হল যেন উনি রক্ত মেখে আসছেন।
জয়েসের রক্ত শুনে রেমণ্ড বলল–যদি এটাই গল্পের শেষ হয় তবে বলতে হবে, সেটা তার মনের কল্পনা।
সঙ্গে সঙ্গে জয়েস বলল-ঘটনার কয়েকদিন পর নতুন একটা খবর, আনার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু।
গ্রাম থেকে কিছু দূরে সমুদ্রের তীরের কাছে একটা জায়গায় ক্যাপ্টেন জেনিস জ্যাক্রের স্ত্রী স্নান করতে গিয়ে ডুবে যান। প্রথমে তারা ঠিক করেছিলেন সমুদ্রে স্নান করবেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য না গিয়ে গলফ খেলতে গেলেন। কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হলে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্রে গেল। অনেকক্ষণ ধরে ফিরছে না দেখে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে স্ত্রীর খোঁজে বেরোল। কিন্তু কোন চিহ্ন খুঁজে পেল না। তিন চারদিন পর পেলেন মাছে ঠোকরানো স্ত্রীর মৃতদেহ। মাথায় ছিল গভীর ক্ষত। প্রথমে স্ত্রীকে চিনতে পারল না কিন্তু বিয়ের আংটি দেখে সনাক্ত করল। অনুমান করা হল ঝাঁপ দেবার সময় মাথায় আঘাত লেগে জ্ঞান হারিয়ে ভেসে যান।
হেনরি হাসতে হাসতে বলেন–এটি নিছক আদি ভৌতিক ব্যাপার। কিন্তু স্বভাবস্নিগ্ধ ভাবে কেশে বলেন, মাথার ক্ষতচিহ্নটি মামুলি নয়।
রেমণ্ড মন্তব্য করল, বদহজমের ফল এবং কাকতালীয়।
ডঃ পেনডার বলেন–বিশেষ কোনো সূত্র নেই যাতে রহস্য ভেদ করা যায়।
এরপর জয়েস আগ্রহ সহকারে মারপলের দিকে তাকাল। তিনি বললেন–এমন কিছু। পোশাক আছে তাতে কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে তা পুরুষের বোঝা অসম্ভব।
মারপলের মন্তব্য শুনে জয়েস বুঝতে পারল যে পিসি রহস্য ধরতে পেরেছে। কারণ ঘটনা শোনার পর আসল রহস্য বোঝা কঠিন হয়নি। কারণ ঝুল বারান্দা থেকে শুকোতে দেওয়া কাপড় থেকে জলমেশানো রক্ত বিন্দু। খুনীর অজান্তেই পোশাকে রক্তের দাগ লেগেছিল।
হেনরি মারপলকে বলে-পুরো ব্যাপারটা তার অন্ধকার লাগছে। তার মনে হল জয়েস এবং মারপল ব্যাপারটা বুঝেছে।
এরপর জয়েস শেষ পর্বটা বলা শুরু করল। আসল ঘটনা হল, জেনিস সব সময় সাদামাটা সরল চেহারার মহিলাকে বিয়ে করে স্ত্রীর নামে প্রচুর লাইফ-ইনস্যুরেন্স করত। স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে আসত সমুদ্রের কাছাকাছি কোনো জায়গায়। ঘটনাস্থলে হাজির থাকত আসল স্ত্রী। তারপর স্নানের অজুহাতে জলের ভিতর খুন করে ভাসিয়ে দিত জলে আর হোটেলে ফিরত। নববধূর সঙ্গে ক্যারলের পোশাকের মিল থাকায় কেউ সন্দেহ করত না। তারপর জেনিস পেয়ে যেত ইনস্যুরেন্সের সব টাকা। এইভাবে তারা চালাত হত্যাকাণ্ড।
রেমন্ডের প্রশ্নের উত্তরে মারপল বলেন, মার্গারিক যখন খুন হয় ওদের অজান্তেই রক্ত ছিটকে এসে পোষাকের লাল রংয়ের সঙ্গে মিশে যায়। ওরা বুঝতে পারেন। তাই ফুটপাতের উপর রক্তের দাগ দেখা যায়।
মারপলের রহস্য ভেদের প্রখর বুদ্ধি দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন সকলে।
পরিশেষে ভালো গল্প শোনাবার জন্য জয়েসকে ধন্যবাদ দিল না শুধু, বলল-সময়মতো পুলিশকে খবর দিয়ে অনেক নিরীহ মেয়ের জীবনও রক্ষা করেছে।
পরের মঙ্গলবার মিঃ পেথোরিককে রহস্য গল্প শোনাবার অনুরোধ জানিয়ে সভা শেষ করল।
.
নীল খাম :
ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বৃদ্ধ মানুষ। নাম সাইমন ক্লড। লন্ডনের অদূরবর্তী শহরতলীতে একটি প্রসাদোপম বাড়িতে বাস করেন।
ছোট্ট টিলার উপরে প্রাসাদ। বড় বড় গাছের বাগান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, চারপাশের দৃশ্য ছবির মতন।
বিত্তশালী লোক। সন্তান জন্মাবার সময়ে স্ত্রী মারা যায়। একমাত্র সন্তান প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত হয়। পুত্রবধূও সন্তান জন্ম দেবার সময় মারা যায় সুতরাং নাতনিই একমাত্র বৃদ্ধের অন্ধের ষষ্ঠি।
কিন্তু দুঃখের কথা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, ডাক্তারের সব চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে ক্রিস চলে গেল। ক্রিসের শোকে তিনি পাগলপারা। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল।
দুঃখ বোধহয় একা আসে না। কয়েক মাসের মধ্যে ক্লডের একমাত্র ভাই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। স্ত্রী আগেই মারা গেছে। গ্রেস, মেরী এবং ভাইপো জর্জকে নিয়ে এলেন তার শূন্য ঘরে।
কৈশোর অতিক্রম করে তারা যৌবনে পা দিল। কলেজের পড়াশুনা শেষ করে জর্জ ব্যাঙ্কে চাকরি নিল। কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ফিলিপের সঙ্গে গ্রেসের বিয়ে হল। মেধাবী ছাত্র, দুজনে লন্ডনে তাদের বাড়িতে থাকত।
সাইমনের স্ত্রী হল মেরী। শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। গেরস্থালিতে মনোযোগী। মেয়েটির পরিচর্যায় ক্রিসের শোক ক্রমে ভুলতে বসল।
উইল সংক্রান্ত ব্যাপারে একদিন তাকে ডেকে পাঠাল সাইমন। তার অগাধ সম্পত্তি জর্জ মেরী ও গ্রেসের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। এরপর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
হঠাৎ একদিন সাইমনের ভাইপো জর্জের সাথে তার দেখা হল। এবং জর্জের মুখ থেকে জানতে পারলাম তার কাকা বর্তমানে প্রেতচর্চার বিষয়ে খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এবং ইউরিডিস নামে এক মহিলা জিডিয়াসকেও সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন।
জর্জের মুখ থেকে সব শোনার পর হাজির হলাম সাইমনের বাড়িতে। ইউরিডিসকে দেখেই ধারণা হল যে, তিনি একজন চতুর প্রতারক মহিলা। তিনি এবং তার স্বামীটিও পাকাঁপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়েছেন এই বাড়িতে। পতিপ্রবরটির নাম অ্যাবসালোম প্রাগ, পাতলা দুঃখী দুঃখী চেহারা। কিন্তু ছাই রঙের চোখে প্রচ্ছন্ন লোভ।
ইউরিডিসের প্রসঙ্গ তুলতেই সে বলল–তার মতো মহিলা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করাই অসম্ভব। এত মহান যে তিনি-ক্রিসকেই দেখতে পাই না কিন্তু রোজ রাতে সেই সুরেলা গলা শোনেন। রোজ রাতে ক্রিসকে ডাকে ইউরিডিস। ক্রিস তাকে বলেছে সে প্রেতলোকে বাবা-মার সঙ্গে থাকে আর খুব আনন্দেই দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু একটা কথায় কাটা খচখচ করতে লাগল। যখন জানালাম ক্রিস বলেছে তার বাবা-মাও ইউরিডিস মাসিকে ভালোবাসে।
বুঝলাম ইউরিডিসের উপর থেকে বিশ্বাস ভাঙানো খুব শক্ত। এবং সে সত্যিই প্রতারক মহিলার পাল্লায় পড়েছে সুতরাং সাইমনকে বাঁচাতে গ্রেসের স্বামীর শরণাপন্ন হলাম। এবং বুঝিয়ে বললাম, বেশিদিল চললে গ্রেস ও তার ভাইবোনদের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। আরও বললাম যদি আধ্যাত্মিক বিষয়ক কোনো পণ্ডিতের সঙ্গে পরিচিত হয় তবে এই নেশা কাটবে।
তড়িঘড়ি ফিলিপ, প্রফেসর লঙম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে ইনি একজন পণ্ডিত। ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, স্পষ্টবক্তা এবং তথ্যানুসন্ধানী। প্রফেসর সাইমনের বাড়িতে দুটি প্রেতচর্চার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাইমন, ইউরিডিস, লঙম্যান এই বৈঠকে হাজির ছিলেন।
প্রফেসর ফিরে গিয়ে একটি চিঠির মাধ্যমে জানাল ইউরিডিস প্রতারক না হলেও ওর আত্মা আনবার পদ্ধতি সঠিক নয়। সাইমনের মত থাকলে তিনি একজন সুখ্যাত, সৎ মিডিয়াম পাঠাবেন।
সাইমনকে জানাতে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করল এবং অত্যন্ত অশ্লীল কথাবার্তা ফিলিপকে বলল। হতাশায় ফিলিপ বাড়ি ফিরে আসে, বুঝতে পারে সব চেষ্টা বৃথা।
ঘটনার কিছুদিন পর সাইমন পেথোরিককে ডেকে পাঠাল। গিয়ে দেখল সাইমন মৃত্যু শয্যায়। তাকে ডেকে নতুন উইলের কথা জানাল। নতুন উইল অনুসারে জর্জ মেরী এবং গ্রেস প্রত্যেকে পাবে পাঁচ হাজার পাউন্ড। বাকি অগাধ সম্পত্তি লেখা হয়েছে ইউরিডিস প্যাগের নামে। শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। বুঝতে পারলাম মহিলার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। তাছাড়া সাক্ষী হিসাবে রাখল পরিচারিকা এমা গনন্ট এবং অন্য যুবতী রাঁধুনি।
সই-সাবুদের পূর্বে উইলটা নীল খামে রাখার পর হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অসুস্থ লাগছিল। এসমার পরিচর্যায় সুস্থ হল।
কিছুক্ষণ থেমে ঘটনার পরের অংশ বলতে শুরু করল পেথোরিক। সাইমনের কাজ মিটিয়ে বেরোতে গেলে মেরীর সাথে দেখা হল। মেরী চায়ের আমন্ত্রণ জানাল। উত্তপ্ত আরামদায়ক ঘরে চা খাবার সময় জর্জ এসে পড়ল। জর্জ তাকে বলল–একটা সম্পত্তির ব্যাপারে তার পরামর্শ খুব জরুরী। কতগুলি শেয়ারের ব্যাপারে কোম্পানির কাগজপত্র সে বেশ দেখে দেয়। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে ঘর থেকে বেরোবার সময় মনে পড়ল ওভারকোটটার কথা। যেটা ফেলে এসেছে ড্রয়িংরুমে। মেরী এবং সে ঘুরে ঢুকতেই দেখল ওভারকোটের কাছে ইউরিডিস কি যেন করছে।
কথা না বাড়িয়ে ওভারকোটাটা পরে যাবার প্রস্তুতি নিতেই দেখা গেল উইলভরা নীল খামটা মাটিতে পড়ে আছে। ভেতরে কাগজটা আছে কিনা দেখে অফিসে ফিরে এল।
অফিসে ফিরে খামটা হাতে নেবার উদ্যোগ করতেই তার সহকারী জানাল তার একটি জরুরী ফোন এসেছে। ফোনে কথাবার্তা শেষ করে ঘরের দিকে এগোতেই বেয়ারা জানাল একজন ব্যক্তি তার সাক্ষাৎ প্রার্থী। গিয়ে দেখেন বসে আছেন স্বয়ং ইউরিডিসের স্বামী অ্যাবসালোম প্রাগ।
তার সঙ্গে বহু অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ খেয়াল হল উইলসুদ্ধ খামটা টেবিলে রেখে দিয়েছিল। সেটি তুলে সিন্দুক তালা বন্ধ করে দিলেন।
কিছুদিন পর সাইমন মারা গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন সিল ভেঙে খামটা খুলল দেখল খামে কোনো উইল নেই, আছে একটা সাদা কাগজ।
কারণটা মিস মারপেল ব্যাখ্যা করলেন। নানা ঘটনার ভিড়ে মিঃ পেথোরিক আসল রহস্যটা লুকিয়ে রেখেছেন। উকিল মানুষ তিনি; মারপ্যাঁচ ভালোই জানেন। এই বলে শেষ করলেন।
সবাই যখন ঘটনাটা সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করছেন তখন মিঃ পেথোরিক একটি গল্পের অবতারণা করলেন। সেটি হল–ফিলিপ একটি কাহিনী শোনাল তাকে।
তার এক বন্ধু বৃদ্ধ আত্মীয়ের থেকে বিপুল সম্পত্তি পাবে বলে আশা করে। পরে জানতে পারে বৃদ্ধ তাকে বঞ্চিত করে একজন অযোগ্য লোককে সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছে।
তখন সে পরিচারিকাকে কিছু নির্দেশ দেয় এবং কালি ভর্তি কলম দেয়। আরও বলেন যখনই বৃদ্ধ কলম চাইবে সে যেন তখন এই কলমটি দেয়। কারণ বৃদ্ধের পক্ষে নতুন কলম ধরা সম্ভব হবে না। কারণ দুটি দেখতে একইরকম।
পরিচারিকাটি নিপুণ বিশ্বাসের সঙ্গে কাজটি সমাধা করল। ফিলিপ তাকে প্রশ্ন করল সে তার বন্ধুকে চেনে কিনা, মিঃ পেথোরিক উত্তরে বলেছিল এইরকম কোনো ইচ্ছেই তার নেই, সবশেষে অন্য কথা বলে সে বিদায় নিল।
প্রশ্নের উত্তরে ফিলিপ বলেছিল বন্ধুটি স্বয়ং সে এবং পরিচারিকাটি এমা।
জয়েস অদৃশ্য কালির রহস্য জানতে চাইলে মিঃ পেথোরিক বর্ণনা করেন যে, একপ্রকার গাছের রস জলে গুলিয়ে তাতে আয়োডিন মেশালে এক প্রকার কালি তৈরি হয় সেই কালিতে লিখলে, লেখা পাঁচ দিনের মধ্যেই অদৃশ্য।
মারপলের দূরদর্শিতায় সকলে মুগ্ধ! সকলেই তার রহস্য উদ্ধারের আশ্চর্য ক্ষমতায় বিস্মিত কারণ আগেই একটি কাগজে তিনি লিখেছেন অদৃশ্য কালির বুদ্ধিটা বেরিয়েছে কেমিস্ট্রি ছাত্র ফিলিপ গ্যারোডের মাথা থেকে।
আগামী মঙ্গলবার সকলে আবার মিলিত হবে এবং সেই দিন মিস মারপলের কাছ থেকে জটিল রোমহর্ষক গল্প বলার সম্মতি নিয়ে সভা শেষ করল।
৩. অন্তর্গত প্রেমের ভিতর
মিস মারপলের জীবনে কোনো রোমহর্ষক ঘটনা নেই। তবু তিনি যা শোনেন দেখেন তার উপর ভিত্তি করেই তিনি রহস্য মনে করেন।
স্যার হেনরি কিন্তু মিস মারপলের অসাধারণ এক কীর্তির কথা জানেন। তাই বললেন, তার ভূমিকায় একজন নিরপরাধী ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যায়। সেই গল্পটা যদি অনুমতি করেন তবে তিনি সকলকে বলবেন।
মিস মারপল নিজের কীর্তির কথা বলতে সংকোচ করছেন। মিঃ পেনডোর মিঃ পেথোরিকের উৎসাহে শেষ পর্যন্ত স্যার হেনরি গল্প শুরু করেন।
ঘটনাটা ঘটেছিল তার রিটায়ার করার কয়েক মাসের মধ্যেই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কমিশনার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর এই গ্রামে পুরানো বন্ধু কর্নেল ব্যানট্রির বাড়িতে অতিথি হয়ে যান। মিসেস ব্যানট্রিও হাসিখুশিতে ভরা প্রাণবন্ত মহিলা। খেলা, বেড়ানো এবং মিসেস ব্যানট্রির নিত্য নতুন রান্না খেয়ে সুখেই দিন কাটছিল। শহরের ব্যস্ত ভিড় কর্মচাঞ্চল্য আর অপরাধ জগত থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছাড়লেন।
একদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে দেখেন গৃহকর্তা এবং গিন্নী দুজনেই গম্ভীর। মিসেস ব্যানট্রি খাবার গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কিন্তু এলেন না। অন্যদিন আমরা টেবিলে অন্তত ঘণ্টাখানেক গল্প করতাম। কফি খেতে খেতে ব্যানট্রি বলেন, তিনি যেন কিছু মনে না করেন, তার স্ত্রী ডলির মন ভোর থেকে খুবই খারাপ।
হেনরি জিজ্ঞাসা করেন, তার মন খারাপের কারণ তিনি কি কোনো দুঃসংবাদ পেয়েছেন?
তখন কর্নেল বলেন, তাদের গ্রামে একটি মেয়ে জলে ডুবে মারা গেছে। তার স্ত্রী ডলি এই সংবাদে খুব ভেঙ্গে পড়েছে। মেয়েটিকে তার স্ত্রী খুব স্নেহ করতেন।
হেনরি প্রশ্ন করেন, মেয়েটি কিভাবে জলে ডুবেছে। উত্তরে কর্নেল বলেন, মেয়েটি হল স্টু বোর সরাইখানার মালিক এমটকের মেয়ে। শোনা যায় মেয়েটি জলে ডোবেনি ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
হেনরি তাকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে আত্মহত্যা করল? কোথায় করল, কারণ সেখানে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার মতো কোনো বড় জলাশয় ছিল না।
দুঃখিত স্বরে কর্নেল বলল, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। রোজ সন্তানসম্ভবা ছিল। পরিণতির কথা না ভেবে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল ছেলেটির কাছে। এটাই বোধহয় যৌবনের ধর্ম। তার স্ত্রী ডলির সঙ্গে এই ব্যাপারে বহু মতানৈক্য হয়। স্ত্রীর বক্তব্য এই অবস্থার জন্য শুধু পুরুষরাই দায়ী। কর্নেল স্ত্রীকে বোঝালেন উভয় পক্ষই দায়ী মেয়েটির লজ্জাকর পরিস্থিতির জন্য।
ছেলেটির পরিচয় জানতে পাওয়ায় কর্নেল বলেন, সে এই গ্রামের ছেলে নয় তবে সেখানে থাকে। নাম স্যান্ডফোর্ড। কিন্তু ছেলেটি অসৎ চরিত্রের নয়। কর্নেলকে হেনরি প্রশ্ন করেন, তারা কি নিশ্চিত যে, মেয়েটির পরিণতির জন্য দায়ী ছেলেটি? কর্নেল বলেন তিনি নিশ্চিত নন। কারণ দুজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল, মেলামেশা ছিল। তাই পুরোটাই ছেলেটিকে অপরাধী ভাবা যায় না।
মানে ঘটনাটা গ্রাম্য গুজব। কারণ গ্রামে ঘটনা ঘটলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গ্রামের লোক স্যান্ডফোর্ডকেই দোষী করছে। ছেলেটি মেয়েটির সর্বনাশের কারণ, ময়নাতদন্তে সবই বোঝা যাবে।
হেনরি প্রশ্ন করেন, ময়নাতদন্ত কেন? তিনি, বলেন মেয়েটি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তদন্ত হবেই। এবং তা দরকারই।
হেনরি বলেন, এই ধরনের ঘটনা আজকাল প্রতিদিন ঘটছে কারণ এখন ছেলেমেয়েরা বাধাবন্ধনহীন মেলামেশা করেন। শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে এগুলি মামুলি ব্যাপার। কিন্তু মেয়েটি আত্মহত্যা না করে অন্যভাবেও ব্যাপারটা মেটাতে পারত।
কথার উত্তরে ব্যানট্রি বলে, মেয়েটির বাবা অত্যন্ত কড়া। এই ধরনের গুরুতর অন্যায় তার বাবা সহ্য করবেন না। তাই বাবার ক্ষমা না পাওয়ার আশংকায় নিজের জীবনকে বিসর্জন দেওয়াই শ্রেয় মনে করল।
মেয়েটি কোথায় ডুবেছে জানতে চাওয়ায় কর্নেল বললেন, গ্রামের কাছে যে কারখানাটি আছে তার কাছে নদীতে। নদীতে একটা কাঠের সাঁকো আছে। নির্জন ঘন জঙ্গলময় স্থান। প্রত্যেকের অনুমান সাঁকোর উপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছে।
মেয়েটিকে হেনরি চোখেই দেখেননি, কোনো দুঃখ না হলেও, যে কোনো অপরিণত মৃত্যুই শোকাবহ। বুঝলাম দম্পতিদের দুজনেই খুব আঘাত পেয়েছেন। তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবে হেনরি খবরের কাগজটি নিয়ে বাইরের লনে চেয়ার নিয়ে বসলেন। এমন সময় বেয়ারা বলল, মিস মারপল দেখা করার উদ্দেশ্যে বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন।
মিস মারপলের কথা হেনরি আগেই শুনেছিলেন। ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির, সাহস অসাধারণ, বুদ্ধিমতী। ব্যানট্রি দম্পতি এবং সেখানকার পুলিশ মহলও জানিয়েছে যে অনেক রহস্যময় অপরাধের জট এই শান্ত নিরীহ মহিলা অদ্ভুত অনায়াসেই খুলে ফেলেছেন। কিন্তু তার আসার কারণ বুঝতে পারলেন না।
সুন্দর প্রশান্ত মুখ। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে কৌতুকের হাসি, হাতে বড় সজির ব্যাগ। তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অসময়ে এসে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইলেন। আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন, তিনি তার জন্য কি করতে পারেন।
শান্ত গলায় মারপল বলেন, তার দেখা পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। তিনি শুনেছেন তিনি ব্যানট্রিদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন। এবং হঠাৎ আগমনের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। কিন্তু না এলেও উপায় ছিল না। বাধা দিয়ে হেনরি বলেন, তার বিব্রত হওয়ার কারণ অবান্তর। তার সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি খুব আনন্দিত। আরও জানালেন মিসেস ব্যানট্রি এসময় ঘরে উপস্থিত নেই। মারপল বলেন, প্রয়োজনটা মিসেস ব্যানট্রির সঙ্গে নয় তার সঙ্গেই। তার সঙ্গে প্রয়োজনের কথা বলতেই সে একটু অবাক হল। প্রকৃত কারণ হেনরি জানতে চাইল।
মারপল বলেন, তিনি এসেছেন রোজ এমটকের ব্যাপারে। ঘটনাটি তিনি নিশ্চয় শুনেছেন। হেনরি বললেন, কর্নেল ব্যানট্রির মুখে আজ তিনি শুনেছেন। হেনরি চিন্তা করতে লাগলেন এমটকের আত্মহত্যার সঙ্গে মারপলের আসার কোনো কার্যকারণ আছে কিনা। এই পর্যন্ত বলে হেনরি চুপ করলেন। এবং উৎসাহ নিয়ে প্রত্যেকের দিকে তাকালেন।
হেনরি আবার শুরু করলেন, গম্ভীর মুখে মারপল তাকে বলেন, তিনি তার মূল্যবান সময় নষ্ট করলেও তিনি কোনো ঘটনা ঘটলেই তার কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করেন এবং সে ব্যাপারে তিনি মোটামুটি সফল। তিনি মারপলকে অনুনয় করে বলেন তার আসার প্রকৃত কারণ বর্ণনা করতে।
তিনি তখন বলেন–তিনি যদি সাধারণভাবে থানায় জানান তবে ওরা উড়িয়ে দেবেন। এবং বিশ্বাস তার বক্তব্য তিনি গুরুত্ব সহকারে শুনবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
হেনরি মারপলকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি তার প্রত্যেকটি কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন এবং সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে মারপল বলেন, রোজ এমটক আত্মহত্যা করেনি। ওকে খুন করা হয়েছে এবং কে বা কারা খুন করেছে তাও তিনি জানেন। এই অদ্ভুত সংবাদে হেনরি বিমূঢ় হয়ে মারপলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হল কাল মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে বলে সবাই বলেছে আর আজ তিনি বলছেন যে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে অনেক সময় লাগল তার।
হঠাৎ স্বস্তি পেয়ে হেনরি বলেন, তিনি একটি গুরুতর অভিযোগ করলেন কিন্তু।
উত্তরে মারপল বলেন, অভিযোগটি গুরুতর বলেই তিনি তার কাছে এসেছেন।
তখন হেনরি বললেন, এই ব্যাপারে তার আর কিছু করণীয় নেই। সেটা এখন পুলিশি তদন্তের পর্যায়ে চলে গেছে। তিনি বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। স্থানীয় পুলিশ এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারেন।
তখন মারপল বলেন, তার পক্ষে এখনই পুলিশের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। তার কাছে অভিযোগ প্রমাণ করার যথেষ্ট প্রমাণ নেই।
তখন হেনরি বলেন, তিনি কি অনুমানের উপর নির্ভর করে অভিযোগ করলেন।
মারপল তখন বলেন, অভিযোগটা শুধু অনুমান ভিত্তিক নয়। তিনি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে বলেন যখন কোনো অংকের উত্তরটা এবং একটি সংখ্যা মিলে যায় তখন অন্য সংখ্যাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি যদি ইনসপেক্টর ড্রেউইটকে বলেন তার ধারণা অমুক ব্যক্তি এমটককে হত্যা করেছে তাকে গ্রেফতার করুন তবে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে উঠবে। তাকে দোষ দেওয়া যাবে না কারণ এই মুহূর্তে তিনি কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ দাখিল করতে পারবেন না। অনুভূতি এবং অপরাধীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাও বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পর্কে শুধুমাত্র একটা ধারণাই কি যথেষ্ট?
মিস মারপল বলেন, তিনি একটা ব্যাপারে খুব আগ্রহী তা হল মানুষকে বোঝার চেষ্টা।
এত বছর এই গ্রামে থেকে প্রত্যেকের স্বভাব আচার-আচরণ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। কোনো ঘটনাই তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। তিনি হেনরিকে প্রশ্ন করেন, তার উপর আস্থা রাখতে পারবেন কি না? মারপলের কণ্ঠে প্রত্যয়ের সুর।
মারপলকে আশ্বস্ত করে হেনরি বলেন, তার মতামতের উপর হেনরির যথেষ্ট আস্থা আছে কিন্তু তিনি কি ধরনের সাহায্য আশা করছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না।
মিস মারপল চুপ করে থেকে বলেন, যেহেতু তার সাক্ষ্য প্রমাণ নেই তাই এই ব্যাপার নিয়ে তিনি অনেক ভেবেছেন। পুলিশের পক্ষে অনুসন্ধান সম্ভব নয়। যদি তিনি অনুসন্ধান চালান তবে পুলিশ তার ব্যাপারে যেন কোনো অসুবিধা না করে বরঞ্চ ইনসপেক্টর ড্রেউইট বা মেলচেটের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন।
কিছুক্ষণ ভেবে হেনরি মারপলকে বললেন, মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে এবং কে খুন করেছে তাও তিনি জানেন। এবং তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা খুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু করার আগে কিছু তথ্যের দরকার, সেই ব্যাপারে মারপল কি তাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন?
মিস মারপল তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তিনি কোনো তথ্য দিতে পারবেন না। তবে একটা কাগজে খুনির নাম লিখে দেবেন। যাকে তিনি খুনি বলে ভেবেছেন। যদি অনুসন্ধান করে দেখা যায় তিনি প্রকৃত অপরাধী নন তবে পুরো ব্যাপারটা তিনি যেন ভুলে যান।
তিনি মনে করবেন তার অনুমান ভ্রান্ত। কিছুক্ষণ প্রায় অন্যমনস্ক থেকে বলেন, যদি একজন নিরপরাধ লোকের শাস্তি হয় এটা ভাবতেও তার শরীর শিউরে উঠছে। ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা হবে।
হেনরি বলেন, তিনি বুঝতে পারছেন না, তিনি ঠিক কি বলতে চাইছেন। মিস মারপল তার কথা শুনে যখন মুখ ফেরালেন তখন তার মুখ দেখেই বোঝা গেল তিনি খুব বিচলিত এই প্রসঙ্গে।
তিনি পুনরায় বলেন, যদিও তার ভুল হতে পারে কিন্তু মিঃ ড্রেউইট একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিঃসন্দেহে। তবুও কোনো ভুল সূত্র তাকে ভুল পথে চালিত করতে পারে। এবং তার আরও সন্দেহ যে, বুদ্ধি বা পরিশ্রম খরচ করা উচিত আসল তথ্য বের করতে, তিনি ততটা পরিশ্রম করবেন কিনা সন্দেহ। কারণ সময় সময় এইসব ব্যাপার খুব বিপদজনক হয়ে ওঠে।
কয়েক মিনিট সময় লাগল তার কথার মর্ম বুঝতে। হেনরি বুঝলেন মিঃ ড্রেউইটের তদন্তের উপর তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না। আরও ভয় পাচ্ছেন ইনসপেক্টর যদি ভুল পথে চালিত হয় তবে সে ক্ষেত্রে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন।
ইতিমধ্যে মারপল ব্যাগ থেকে একটি নোটবই থেকে পাতা ছিঁড়ে পেনসিল দিয়ে একটি নাম লিখলেন এবং সেটিকে ভাজ করে তার হাতে দিলেন।
হেনরি কাগজ খুলে নাম পড়লেন যার নাম লেখা আছে তাকে তিনি চেনেনও না জানেনও না। সুতরাং আবার ভাজ করে সেটি পকেটে রাখলেন। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে রহস্যময় লাগছে।
হেনরি মারপলকে বলেন, ম্যাডাম, এই ধরনের তদন্ত তিনি পুলিশ-জীবনে করেননি। যেহেতু তার অনুমানকে, তার বিচার-বিবেচনাকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না, তাই তিনি এই তদন্তের দায়িত্ব নিলেন।
পরদিন সকালে তিনি স্থানীয় থানায় গেলেন এবং দেখলেন সেখানে উপস্থিত ইনসপেক্টর মিঃ ড্রেউইট এবং থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ মেলচেট, দুজনে তাকে দেখে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। মিঃ মেলচেট খুবই যোগ্য অফিসার। চালচলন পুরোটাই ফৌজি অফিসারের মতন। ইনসপেক্টর ড্রেউইটকে আগে থেকে চিনতেন তিনি। খুঁটিনাটি সমস্ত ব্যাপারে তার ছিল সতর্ক। দৃষ্টি। তিনি তাদের তার আসার কারণ জানালেন। কারণ শুনে তারা অত্যন্ত হকচকিয়ে গেল। তিনি তখন বললেন, তাদের স্থানীয় ব্যাপারে নাক গলানোটা খুব অন্যায় কিন্তু ঘটনাটা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন নিজের অজান্তেই।
ড্রেউইট তখন বলেন, তার মতো একজন গুণী মানুষের সাহায্য পাবে জেনে তারা খুব আনন্দিত। মিঃ মেলচেটকে একটু চিন্তান্বিত দেখা গেল। যেন তিনি কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাকে সংশয়মুক্ত করতে হেনরি বলেন, ব্যানট্রিদের বাড়িতে গিয়ে বসে তার সময় কাটছিল না তাই সময় কাটাবার জন্য তাদের সঙ্গে তিনি ঘুরবেন এবং সময়ও ভালোই কেটে যাবে।
ড্রেউইট বলেন, কিন্তু একটা জলের মতো পরিষ্কার ব্যাপার ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামী মস্তিষ্ক, সাধারণ অনুসন্ধানে খরচ হবে।
মেলচেট ড্রেউইটের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, স্যার ঘটনাটি জলের মতো পরিষ্কার। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ায় খুবই বিপদে পড়েছিল। পুলিশ সার্জেন হেডক যিনি মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন তিনি মেয়েটির দুই বাহুতে জোড়ে চাপ দেবার চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। তার ধারণা কেউ মেয়েটিকে জোরে চেপে ধরে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
হেনরি প্রশ্ন করলেন, মেয়েটির চেহারা কেমন ছিল এবং তাকে ছুঁড়ে ফেলতে কতটা জোর খাটাতে হয়েছিল।
মিঃ মেলচেট বললেন, তার কিন্তু তা মনে হয়নি। মেয়েটিকে হঠাৎই আক্রমণ করা হয়েছিল। এবং সাঁকোটি কাঠের তৈরি। কাঠগুলি খুব পিছল। এবং সাঁকোর দুপাশে কোনো রেলিং ছিল না। তাই মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে খুব একটা শক্তির প্রয়োজন পড়েনি।
হেনরি প্রশ্ন করেন মেয়েটিকে কি সত্যিই সাঁকো থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এটাই কি তার বিশ্বাস?
মিঃ মেলচেট বলেন, এটাই তার স্থির বিশ্বাস। কারণ জিমি ব্রাউন নামে গ্রামের একটি ছেলে তখন নদীর অপর পারে উপস্থিত ছিল। সাঁকোর উপর থেকে সে আর্তনাদ শুনতে পায় এবং ঝপ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেল। তাকিয়ে দেখে সাদা মতো একটি জিনিস নদীতে ভেসে যাচ্ছে। ছেলেটি গ্রামবাসীকে জড়ো করে মেয়েটিকে জল থেকে তুলল। কিন্তু যখন তাকে ভোলা হল তখন সব শেষ।
হেনরি মেলচেটকে প্রশ্ন করে, ছেলেটি কি তখন সাঁকোর উপর কাউকে দেখেছিল?
মেলচেট সঙ্গে সঙ্গে বলল, না সে কাউকে দেখতে পাইনি। কারণ জায়গাটা নির্জন এবং সন্ধ্যার অন্ধকারে কুয়াশা থাকায় সব কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু ছেলেটির ধারণা মেয়েটি ঝাঁপ দিয়েছিল এবং গ্রামের লোকেরাও তাই বিশ্বাস করেছিল।
এই সময় ড্রেউইট বলে উঠল, আমরা কিন্তু মেয়েটির পোশাকের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ উদ্ধার করেছি। হেনরি মেলচেটের দিকে তাকাতেই সে বলল, যে কাগজটি পাওয়া গেছে তাতে শিল্পীরা যে ধরনের স্কেচ পেন ব্যবহার করে তা দিয়ে লেখা ছিল, ঠিক সাড়ে আটটায় সাঁকোতে তোমার সঙ্গে দেখা করব। নিচে নাম ছিল (আর.এস.)। আর.এস. স্যানফোর্ডের নামের আদ্যক্ষর। আর ঘটনাটি ঘটে ঠিক সাড়ে আটটায়।
হেনরি স্যানফোর্ডের সম্পর্কে জানতে চাইলে মেলচেট বলেন, কয়েক মাস হল সে এই গ্রামে এসেছে এবং নিজেকে একজন স্থপতি বলেই পরিচয় দেয়। এই গ্রামে অর্লিটনদের বাড়ি সে তৈরি করেছে। স্বভাবেও ছেলেটি ভালো নয়। আজকালকার আধুনিক ছেলেদের মতো। মেয়েটিকে স্যানফোর্ডই নষ্ট করেছে।
মিঃ হেনরি মৃদু হেসে বলেন মেলচেটকে, ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করাটা অপরাধ নিশ্চয়ই কিন্তু খুনের অভিযোগ বা ধর্ষণের অভিযোগের মধ্যে বিরাট তফাৎ।
মেলচেট বলল, সেটা অবশ্য সত্যি।
ড্রেউইট এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, তিনি যা তদন্ত করে জেনেছেন তাকে তা বলেছেন। প্রথমদিকে ছেলেটি রোজের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে। পরে ওর দুর্বলতার সুযোগ নেয়। এবং শেষে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে লন্ডনে আবার একটি মেয়েকে স্যানফোর্ড বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছে। ওদের বাগদানও হয়ে গিয়েছিল। এদিকে রোজ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ায় স্যানফোর্ড বিচলিত হয়ে পড়ে। রোজ তাকে বিয়ে করার জন্য কাকুতি-মিনতি করত। ওর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য চিঠি পাঠিয়ে তাকে সাঁকোর উপর ডেকে পাঠায়। এবং সুযোগ বুঝে নদীতে ঠেলে ফেলে দেয়। এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে তার ধারণাই সত্যি।
হেনরি চুপচাপ সব শুনল এবং বুঝল স্যানফোর্ডকেই তারা নিশ্চিত খুনি বলে ধরে নিয়েছে। তার মনে হল নব্য শহুরে যুবক গ্রামে খুব জনপ্রিয় নয় এবং তার ক্ষেত্রে গ্রাম্য সনাতন বিশ্বাসই কাজ করেছে। হেনরি জিজ্ঞেস করল, রোজের সন্তানসম্ভবার কারণ ছেলেটিই?
ড্রেট তখনই জবাব দিল, রোজ স্যানফোর্ডের সন্তানের মা হতে চলেছে, এই কথা তার বাবার কাছে স্বীকার করেছে। এবং আরও বলেছে স্যানফোর্ড তাকে বিয়ে করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
গ্রামের অবুঝ তরুণী, শহুরে নব্য প্রণয়ী, দৃঢ় চরিত্রের পিতা, সবই নাটকের মতে, এই নাটকে দরকার শুধু গ্রাম্য প্রেমিক। হেনরি ড্রেউইটকে জিজ্ঞাসা করল–এই গ্রামের মেয়েটির কোনো প্রণয়ী আছে নাকি?
ড্রেউইট তাকে বলল, তিনি জো এলিমের কথা বলছেন কিনা। এলিম ছেলেটি খুবই ভালো ছেলে, ছুতোর মিস্ত্রী। রোজ যদি জোকে ভালোবাসত তবে খুব ভালো হত। কারণ জো রোজকে খুবই ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটা একটা বাজে ছেলের পাল্লায় পড়ল। মেলচেটও ড্রেউইটের কথায় সায় দিল।
হেনরি মেলচেটকে জিজ্ঞাসা করল, জো মেরীর আত্মহত্যাকে কিভাবে গ্রহণ করেছে?
সেটা বলা তার খুব দুঃসাধ্য। জো ধীর-স্থির প্রকৃতির। যদিও মেরী জোকে ছেড়ে চলে গেছে তবুও তার মনে বিশ্বাস ছিল একদিন ঠিক মেরী তার কাছে আবার ফিরে আসবে। এত অটুট ছিল তার ভালোবাসা। ওর চোখে রোজ কোনো দোষী ছিল না।
হেনরি জো’কে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বললে মেলচেট উত্তরে বলেন–তা তারা তাকেও এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আরও বলেন প্রথমে এমটক, তারপর স্যানফোর্ড এবং সবশেষে জো-এর পালা। এইভাবে এগোলে তার আপত্তির কারণ না থাকার কথা।
হেনরি, ড্রেউইট এবং মেলচেট এই তিনজন জন ব্লু-বোর সরাইখানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সরাইখানাতেই টম এমটকের দেখা পাওয়া গেল। মধ্যবয়স্ক বিশাল চেহারার মানুষ। সন্দেহপ্রবণ ও কঠিন চোয়ালে বেশ রাগী প্রকৃতির মনে হল। তাদের দেখে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে বসাল। এবং তাদের খাদ্য বা পানীয় গ্রহণের অনুরোধ জানাল।
ভিতরে যেতেই টম এন্টক বলেন, তারা তার মেয়ের ব্যাপারে নিশ্চয় এসেছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তার কন্যা রোজ খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিল। স্যানফোর্ডই তার মেয়েকে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে তার জীবনের চরম সর্বনাশ ডেকে আনল। ছেলেটির জন্যই রোজ আত্মহত্যা করল শেষ পর্যন্ত। সে তাকে ছাড়বে না। কারণ তার পরিবারে কালি মাখিয়ে দিয়েছে সে।
টম এমটককে মেলচেট প্রশ্ন করে, তার মেয়ের এই পরিণতির জন্য সে স্যানফোর্ডকেই দায়ী করে কিনা।
টম উত্তেজিত হয়ে বলল, এই ঘরে বসেই তার মেয়ে বাবাকে সব খুলে বলেছে। হেনরি জিজ্ঞেস করেন, সব কথা শোনার পর তিনি কন্যাকে কি বলেছিলেন? আপনি কি তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন? হেনরি প্রশ্ন করেন।
এই ধরনের প্রশ্নের জন্য টম বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। নিজেকে ধাতস্ত করে বলল, ঘটনাটা তার কাছে এতই আকস্মিক যে প্রথমে তার বিশ্বাস করতেই মন চাইছিল না। খুব বকাবকি করার পর রাগের মাথায় বলেছিল যে তার মতো মেয়ের মুখ দর্শন করাও উচিত নয়। তার মরণই শ্রেয়। মা হারানো মেয়েকে সত্যি সত্যি যেতে বলিনি।
তারপর গম্ভীর হয়ে জোরের সঙ্গে বলল, এই ধরনের অপরাধীর কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। মেলচেট প্রশ্ন করেন, মেয়েকে কখন তিনি শেষ দেখেছিলেন?
টমের উত্তর, গত পরশুদিন চা খাবার সময়।
মেলচেট প্রশ্ন করেন, সে সময় তিনি তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পান?
উত্তরে টম বলেন, তেমন অস্বাভাবিকতা তিনি দেখেননি। যদি তিনি জানতেন যে, তার মেয়ে এই পথ বেছে নেবেন বলে কেঁদে ফেলেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মেলচেট বলেন,টম প্রচণ্ড রেগে রয়েছেন। স্যানফোর্ডকে বাগে পেলেই শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। হেনরি বলেন, টমের মধ্যে শোকের বিশেষ লক্ষণ দেখা গেল না। ব্যাপারটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।
টমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, তারা হাজির হল স্যানফোর্ডের বাড়িতে। ড্রেউইট এবং মেলচেটের মুখে যে বর্ণনা শোনা গিয়েছিল, গিয়ে দেখলেন কোনো মিল নেই বর্ণনার সঙ্গে। লম্বাটে গড়ন, চব্বিশ-পঁচিশের কাছাকাছি বয়স। স্বপ্নালু নীল চোখ, ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, এবং কণ্ঠস্বরটি খুব মোলায়েম। এই ধরনের পুরুষের প্রতি যে কোনো মেয়ের আকর্ষণ আসাটা প্রকৃতিগত ব্যাপার।
তাদের পরিচয় জানিয়ে তাদের আসার কারণ বর্ণনা করল। গত পরশু দিনের ঘটনার বিবরণ দিতে বলল, পুলিশি ভাবভঙ্গিতে এও জানাল এই ধরনের বিবৃতি দিতে সে অস্বীকার করতেও পারে। কিন্তু সে যা বলবে তার বিপক্ষে সাহায্য নেবার অধিকার পুলিশের আছে।
মেলচেটের কথা শুনে স্যানফোর্ড হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তিনি কি বলছেন তা সে বুঝতে পারছে না।
মেলচেট তাকে প্রশ্ন করল, সে কি জানে যে রোজ এমটক নামে একটি মেয়ে গত পরশু রাতে জলে ডুবে মারা গেছে?
এতক্ষণে স্যানফোর্ড ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে স্বীকার করল ঘটনাটা শোনার পর থেকে রাতে ঘুমোত পারে না। কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না। রোজ-এর শোচনীয় মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে দায়ী করল। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, রোজ নিজেকে এইভাবে শেষ করে দেবে। কিন্তু কিছু পরে সে দুচোখ মেলে তাকাল।
মেলচেট ধীর কণ্ঠে বলল, তাহলে কি তারা ধরে নেবে যে সে গত পরশু দিনের ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দেবে না?
স্যানফোর্ড বলল, সে পরশু রাতে বেড়াতে বেরিয়েছিল।
মেলচেট তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, সে রোজ-এর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল?
স্যানফোর্ড উত্তর দেয় না, সে একাই বেরিয়েছিল। নদীর ধার দিয়ে বনের অনেক ভিতর।
এমন সময় ড্রেইট তার কোটের পকেট থেকে একটা আধ ভেজা কাগজ বের করে তাকে বলল, এই চিঠিটা সম্পর্কে তার বক্তব্য কি? চিঠিটা পাওয়া গেছে মৃতা রোজ-এর পকেট থেকে। চিঠিটা তাকে আস্তে আস্তে পড়ে শোনায় এবং প্রশ্ন করে সে কি অস্বীকার করতে পারে যে চিঠিটা সে লেখেনি?
স্যানফোর্ড নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, চিঠিটা সেই লিখেছে। কারণ রোজ তার সঙ্গে দেখা করার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল।
স্যানফোর্ডের স্বীকারোক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ড্রেউইট তাকে বলল গত পরশু রাতে সাঁকোর উপর আসতে সেই অনুরোধ করেছিল।
স্যানফোর্ড বুঝল চিঠিটা লিখে সে বিপদে পড়েছে তাই উত্তরে বলল, সে নদীর পাড়ে যায়নি। না যাওয়াটাই তার পক্ষে মঙ্গল ছিল কারণ আগামীকাল তার লন্ডনে ফিরে যাবার কথা। তাই যাবার আগে দেখা করে তাকে কষ্ট দেবে না। লন্ডনে ফিরে গিয়ে তার জন্য কি ব্যবস্থা করা যায় তাও জানাবে।
মেলচেট গম্ভীরভাবে বলেন, তবে কি সে জানত তার পরিণতির জন্য সেই দায়ী?
অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে স্যানফোর্ড বলল, সেই দায়ী।
ড্রেউইটি হাল্কা স্বরে প্রশ্ন করল, যখন তিনি বেড়াতে বেরোচ্ছিলেন কেউ কি তাকে দেখেছিল বা তিনি কাউকে দেখেছিলেন কিনা?
স্যানফোর্ড উত্তর দেয়, কেউ তাকে দেখেছিল কিনা সে জানে না কিন্তু সে কাউকে দেখেনি। স্যানফোর্ড তাকে প্রশ্ন করে, তার বেড়ানোর সঙ্গে রোজ-এর মৃত্যুর সম্বন্ধ কোথায়, কারণ সে তো আত্মহত্যা করেছে।
ইনসপেক্টর গম্ভীরভাবে বলল, রোজ জলে ডুবে মারা যায়নি। কেউ জোর করে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। ঘটনাটা নির্মম হত্যা।
স্যানফোর্ড কথাটা শুনে আর্তনাদ করে উঠল।
এইভাবে কয়েক মিনিট কাটায় যখন তারা বেরিয়ে আসছেন তখন মেলচেট বলেন, এই অবস্থায় কালকে লন্ডনে যাওয়া তার পক্ষে নিরাপদ নয়। তাদের বিনা অনুমতিতে সে এখান থেকে যেতে পারবে না।
রাস্তায় পা দিয়ে ড্রেউইট বলল, তার তদন্তের প্রয়োজন নেই। সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের হাতের মুঠোয়। এবার স্যানফোর্ডের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে ওকে গ্রেফতার করতে হবে।
কিন্তু হেনরি ঠিক সন্তুষ্ট হলেন না, কতগুলো বিষয়ে তার মনে সন্দেহ ছিল। তাই মেলচেট এবং ড্রেউইটকে এগিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়ে স্যানফোর্ডের কাছে ফিরে এসে বলল, তিনি তাকে সাহায্য করতে চান কিন্তু রোজ-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং কি কি ঘটেছিল সব কথা তাকে খুলে বলতে হবে।
স্যানফোর্ড তার কাহিনী শুরু করল। এখানে আসার কিছু দিনের মধ্যে তার সঙ্গে মেয়েটির আলাপ হয়। রোজ ছিল সুন্দরী এবং অত্যন্ত ভালো মেয়ে। প্রথমদিনই বুঝতে পারি মেয়েটি আমার প্রতি আকৃষ্ট। তাছাড়া অজানা অচেনা জায়গায় ওর সাহচর্য তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে লন্ডনে তার বাগদত্তা আছে জেনেও সে কিছুই মানতে চাইল না। তার মতো প্রাণবন্ত মেয়ে তাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তাদের মিলনের ফলে সে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। তাই সে ভেবেছিল ব্যাপারটা যখন এমন গুরুতর মোড় নিয়েছে তখন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে শেষে একটা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ।
স্যানফোর্ড হেনরিকে বলে পুলিশ তাকে অকারণ সন্দেহ করছে। তার ধারণা রোজ আত্মহত্যাই করেছে।
হেনরি প্রশ্ন করে, রোজ কি তাকে এই আত্মহত্যার কথা কিছু বলেছিল? মাথা নেড়ে স্যানফোর্ড বলে এই ধরনের মানসিকতা তার ছিল না।
এরপর হেনরি জো-এর পরিচয় জানতে চাইল। উত্তর সে বলল, সে জোকে চেনে, ছেলেটি একটু বোকা ধরনের। রোজের জন্য সে পাগল ছিল। কথা বলার জন্য ছটফট করত কিন্তু রোজ তাকে পাত্তা দিত না।
হেনরি বলেন, তাহলে ঈর্ষান্বিত হয়ে জো রোজ-এর ক্ষতি করতে পারে, তখন স্যানফোর্ড বলে যদিও এটা হওয়া স্বাভাবিক তবুও ক্ষতি করার ছেলে জো নয়। হেনরি সব শুনে বিদায় নিলেন।
মেলচেট হেনরিকে স্যানফোর্ডের গ্রেফতারের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার কথা বলতেই তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। জো এলিম সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিতে হবে। যদি স্যানফোর্ডকে গ্রেফতার করার পর দেখা যায় সে নির্দোষ তবে ব্যাপারটা খুব অপমানজনক হয়ে দাঁড়াবে। হেনরির বারবার মনে হচ্ছিল স্যানফোর্ড সম্পর্কে তাদের ধারণা খুব মধুর নয়। এবং এই একটা সুযোগ; যাতে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরে যায়। তাই তিনি বলেন, জো এলিমকে সন্দেহের বাইরে রাখা উচিত নয় কারণ রোজকে সে ভালোবাসত। বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু রোজ তাকে পাত্তা দিত না। তাকে প্রত্যাখ্যান করে স্যানফোর্ডকে ভালোবাসত। সুতরাং খুনের পেছনে ঈর্ষাই অন্যতম কারণ হতে পারে।
এরপর জো-এর পালা এল। জো কোথায় থাকে হেনরি জিজ্ঞেস করলেন। মিঃ ড্রেউইট জানালেন সে থাকে মিসেস বারলেটের বাড়িতে। খুব সৎ মহিলা, ধোবীখানার মালিক। জো তার কাছে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকে।
পরদিন সকালে তিনজনে মিলে হাজির হল মিসেস বারলেটের বাড়িতে। ছোটোখাটো ঝকঝকে উঠোন সিঁড়ি। সর্বত্র পরিচ্ছন্নতার ছাপ, কড়া নাড়তেই একটি সুশ্রী মহিলা দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন। দুটি ঘন নীল চোখ, মুখে লাবণ্যের ছোঁয়া। মিঃ ড্রেউইট সুপ্রভাত জানিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল জো এলিম বাড়িতে আছে কিনা।
মিসেস বারলেট জানালেন দশমিনিট আগে সে ফিরেছে। তাদের আসন গ্রহণ করার অভ্যর্থনা জানিয়ে হাঁক দিলেন, জো তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একজন ভদ্রলোক এসেছেন, তাড়াতাড়ি এসো। উত্তরে জো জানাল, হাতমুখ ধুয়েই সে আসছে।
যথা সময়ে জো এলিম ঘরে প্রবেশ করল। লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা, নীল চোখে মাখানো লাজুক হাসি। মেলচেট জো-এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রোজ এমটক নামে যে মেয়েটি জলে ডুবে মারা গেছে তার তদন্তের ব্যাপারে তাদের এখানে আসা। সে তো মেয়েটিকে ভালোই চিনত।
ইতস্তত করে জো বলল, সে তাকে ভালোবাসত, ওকে বিয়ে করবে বলে ঠিকই করেছিল। মৃত্যুর সময় সে গর্ভবতী ছিল কথাটা শুনে হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল স্যানফোর্ড তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও সে তাকে গ্রহণ করত।
মেলচেট তাকে আবার প্রশ্ন করে, এই অবস্থাতেও কি সে তাকে গ্রহণ করত? উত্তরে জো জানাল, তার এই অবস্থার জন্য দায়ী স্যানফোর্ড। সেই রোজকে ভুলিয়ে তার সর্বনাশ করেছে, মেয়েটির কোনো দোষ নেই।
হেনরির প্রশ্ন গত পরশু রাতে সাড়ে আটটায় সে কোথায় ছিল। উত্তরে জো বলল, সে বাড়িতেই ছিল। রান্নাঘরের তাক বানাচ্ছিল। তার উত্তরে হেনরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না; মনে হল উত্তর আগে-ভাগে সাজানো।
তারপর হেনরির বাচ্চা ছেলেটির কথা মনে পড়ল, যে সাঁকোর উপর আর্তনাদ শুনেছিল। তার সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানাল। মিঃ ড্রেউইটি ছেলেটির সন্ধানে লোক পাঠাল। ছোটোখাটো বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। হেনির তাকে প্রশ্ন করে সে তখন নদীর ওপারে ছিল। কিন্তু সাঁকো পেরিয়ে বনের দিকে যাবার সময় সে কি কাউকে দেখেছিল–উত্তরে সে জানাল যে স্যানফোর্ড স্থপতি তাকে দেখেছিল এবং সে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল।
হেনরি প্রশ্ন করে, সে কি রোজকে সাঁকোর উপর দেখেছিল? সে ফিরবার সময় রোজ-এর আর্তনাদ শুনেছিল তার কত আগে স্যানফোর্ডকে বনের মধ্যে দেখেছিল?
সে উত্তর দিল, দশ মিনিট আগে। আবার প্রশ্ন, সে কি নদীর পাড়ে কাউকে দেখেছিল? জিমি উত্তরে বলল, আবছা অন্ধকারে একজন হেঁটে যাচ্ছিল। তার মনে হয়েছিল। যে লোকটি শিষ দিতে দিতে যাচ্ছিল সে জো এলিমই।
ড্রেউইট জিমিকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে, সে অন্ধকার কুয়াশায় কি করে বুঝল যে, লোকটি জো এলিম?
জিমির উত্তর–যে গানটা শিষ দিয়ে গাইছিল সেটা সাধারণত জো গায়।
মেলচেট আবার প্রশ্ন করে, সে ফিরে আসার সময় আর্তনাদ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখল নদীতে সাদা মতো কি ভেসে যাচ্ছে। তখন সাহায্যের জন্য গ্রামবাসীদের কাছে ছুটে যায়। দৌড়বার সময় সাঁকোর আশেপাশে কাউকে দেখেছিল কিনা?
একটু ভেবে জিমি বলল, সে দেখল দুজন লোক ছোটো ঠেলা গাড়ির মতো কি যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা দূরে থাকায় সে মিঃ জেলের বাড়িতে খবরটা দেয়।
জিমির সাক্ষ্যে স্যানফোর্ডই অপরাধী কিন্তু জো এলিমের সম্পর্কে তার যে ধারণা তা আইনসিদ্ধ নয়। শুধু শিষ শুনে কাউকে সনাক্ত করা যায় না।
হেনরি পকেট থেকে মিস মারপলের লেখা নামধারীকে অভিযুক্ত করতে না পেরে আবার মিস মারপলের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
গল্প শুনে হেনরির মুখের দিকে সবাই তাকাল, মিস মারপলের মুখে মৃদু হাসির রেখা।
আবার শুরু করেন হেনরি, মিস মারপলের মুখ দেখে বুঝলেন তিনি অধীর হয়ে আছেন এই তদন্তে তিনি কতটা অগ্রসর হয়েছেন জানার জন্য।
হেনরি দুঃখের সঙ্গে জানাল তার উল্লিখিত অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি। সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে স্যানফোর্ডের পক্ষে। তাই স্যানফোর্ডকে রক্ষা করা অসম্ভব।
মারপল আশাহত গলায় বলেন, তারই ভুলে হয়েছে। নতুবা তার মতো দক্ষ অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের চোখে নিশ্চয়ই কোনো সূত্র মিলত।
হেনরি বলেন, জো সেদিন রাত্রে তাক বানাচ্ছিল এবং মিসেস বারলেট সেখানে সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন।
কথাটা শুনেই মিস মারপল চমকে ওঠেন। বলেন, সেদিন শুক্রবার ছিল। হেনরি প্রশ্ন করল, শুক্রবারের সঙ্গে ঘটনার কি সম্পর্ক?
মারপল বলেন, মিসেস বারলেট বাড়িতে থাকতেই পারেন না। কারণ প্রতি শুক্রবার তিনি কাপড় বিলি করতে বেরোন।
পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। মিসেস বারলেট চোখে ধুলো দিতে এই গল্পের অবতারণা করেছেন। এবং দুজনের সম্পর্ক সম্বন্ধে তার একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেল।
সিদ্ধান্ত স্থির করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছালেন এবং সরাসরি জোকে প্রশ্ন করেন, জো সেদিন রান্না ঘরে তাক বানাচ্ছিল না সেদিন ঐসময় নদীর পাড় ধরে শিষ দিতে দিতে যাচ্ছিল।
কথাটা শুনে বজ্রাঘাতের মতো চুপ করে থেকে তারপর ভাঙ্গা গলায় বলল, রোজকে সে খুন করেনি। সে জানতই না রোজ সাঁকোর উপর আছে। সে রোজকে ভালোবাসত এবং তার ক্ষতি সে বিন্দুমাত্র চায়নি।
সে কেন মিথ্যে বলেছে জানতে চাওয়ায়, জো বলল-মিসেস বারলেট নদীর পাড়ে বেড়ানোর সময় তাকে দেখেছে এবং পুলিশ তাকে সন্দেহ করতে পারে। পুলিশের কানে খবরটা পৌঁছালে পুলিশ তাকে রেহাই দেবে না এবং রান্নাঘরের তাক বানানোর ফন্দিটা তার মাথা থেকেই এসেছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা বলবে তাক বানানোর গল্পটা। মিসেস বারলেট তাকে বিশেষ স্নেহ করেন বলে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছে। মিসেস বারলেট কোথায় আছে জেনে তার মুখোমুখি হলেন।
এবার আসল পরীক্ষার শুরু। তার কাছে জো এবং মিসেস বারলেটের সম্পর্ক জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল।
হেনরিকে দেখে অ্যানে হাত মুছে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি তাকে কিছু বলবেন? হেনরি কঠিন মুখে বলেন তিনি সব জানতে পেরেছেন।
তিনি না বোঝার ভান করে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কি জেনেছেন।
এবার হেনরি মোক্ষম অস্ত্রটি হানলেন। চোখের উপর চোখ রেখে বলেন, তিনি খুব ভালোই জানেন জো এলিম কোনো অপরাধ করেনি। তিনি কি চান তার ফাঁসি হোক?
মিসেস বারলেট নিচু স্বরে বলেন তাকে–তিনি কি জানতে পেরেছেন।
হেনরি ঘটনাটা সবিস্তারে বলতে শুরু করল–তিনি কাপড় বিলি করে ফেরার সময় দেখেন রোজ স্যানফোর্ডের জন্য সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্যানফোর্ড রোজকে বিয়ে করবেন না। অল্পদিনেই লন্ডনে ফিরে যাবেন। তখন রোজ আবার জো-র কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু জো-কে তিনি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেন এবং চার বছরে জো-কে আপনার ভাবতে শুরু করেছেন। রোজ জো-কে কেড়ে নেবে এই কথা চিন্তা করে অধীর হয়ে উঠলেন। রাত্রির অন্ধকারে নির্জন সাঁকোর উপর রোজকে দেখে তিনি তাকে সরিয়ে দেবার স্থির করলেন। জো চিরদিনের জন্য তারই থাকবে এই ভেবে তিনি চুপিসারে সাঁকোর উপর উঠে, রোজ-এর কাধদুটো ধরে ঠেলে নদীতে ফেলে দেন। তীব্র স্রোতে সাঁতার না-জানা মেয়েটি ভেসে গেল। ফেরার পথে জো এলিমের সঙ্গে তার দেখা হয়। তারপর তারা দুজনে পেরামবুলেটের ঠেলে গ্রামের দিকে আসছিল। জিমি দূর থেকে সব দেখেছিল কিন্তু ঘন কুয়াশার অন্ধকারে আপনাদের চিনতে পারেনি।
নদীতে ফেলে দেবার পর কেউ যদি জো-কে সন্দেহ করে, এই আশঙ্কায় তাক বানানোর গল্পটা তৈরি করেন এবং জো-কে রাজি করান। আসলে জো-কে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নয় নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতেই এই গল্প খাড়া করেছিলেন।
এরপর হেনরি প্রশ্ন করেন, তিনি সঠিক বলেছেন তো?
রুদ্ধ কণ্ঠে মিসেস বারলেট সব স্বীকার করে বলেন, এতকালের নিঃসঙ্গ একাকীত্ব জীবন স্নেহ ভালোবাসায় জো ভরিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পর স্বামী পঙ্গু হয়ে অল্প দিনেই মারা যায়। তার চুল পেকে গেলেও বয়স তিরিশের কোটায়। প্রেম ভালোবাসা পাবার আশায় যখন তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন তখন জো এল তার জীবনে। জো কে পেয়ে তার শূন্য মন ভরে উঠল। কিন্তু জো-কে তিনি কোনোদিন জানতে দেননি। মিসেস বারলেট বলেন, যদি তার বয়স পঁচিশ তবুও সে বাচ্চা ছেলের মতো। সব কিছুই তাকে হাতে ধরে দিতে হয়, তার উপর জো-এর অগাধ আস্থা। জো শুধুই তার–এই কথা বলতে বলতে গাল বেয়ে নামল অশ্রু বন্যা।
কিছুক্ষণ পর প্রকৃতিস্থ হতেইমিসেস বারলেট তাকে প্রশ্ন করেন এইসব তিনি কি করে জানলেন?
হেনরি পকেট থেকে মিস মারপলের লেখাটা তার হাতে দিলেন, যাতে লেখা ছিল রোজ-কে নদীতে ফেলে খুন করেছে বারলেট।
বারলেট হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল কাগজটার দিকে।
একনাগাড়ে গল্পটা বলে ক্লান্ত হয়ে হেনরি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। সবাই মুগ্ধ এই অদ্ভুত প্রেমের পরিণতি ও তার রহস্য উদঘাটনের চাতুর্যে।
ডাঃ পেনডার মৃদুস্বরে বলেন–আশ্চর্য গল্প শোনালেন মিঃ হেনরি। মানুষের অতলে কি যে লুকিয়ে থাকে কেউ জানেন না। আর ঈশ্বরের এক আশ্চর্য সৃষ্টি মানুষ। আর তিনি বুঝতেই পারছেন না; কি করে মিস মারপল বুঝতে পারলেন মিসেস বারলেটই খুনি। রেমণ্ড উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত অতিথিদের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আমাদের সান্ধ্য বৈঠকের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি।