তারপর ক্যানুতে করে এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপ, সে দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ করতে করতে দুমাস পরে গিয়ে নুকা-হিভায় পৌঁছুলাম। ওই অঞ্চলের সব চেয়ে বড় দ্বীপ ওটা। আরও তিন মাস অপেক্ষা করতে হলো আমাকে জাহাজের জন্যে। জর্জি গ্রিম এলো তার স্কুনার নিয়ে, তুলে নিলো আমাকে। তাহিতিতে পৌঁছে দিলো। জানতে পারলাম, কারনেস ফিরে এসেছিলো, তারপর আবার চলে গেছে। এসেই তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ায় আমি ভাবলাম, নিশ্চয় মুক্তোর সন্ধানে গিয়েছে সে। যাবেই। তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এতো টাকার সম্পদ দেখে এসে কোন্ মানুষটা আনতে যাবে না? সে গেলেও আমি চিন্তা করলাম না। আসল অবস্থান জানা নেই তার। কিছুতেই বের করতে পারবে না অতো বড় মহাসাগরের মাঝে। শুধু আমি জানি কোথায় আছে সেই ঝিনুকের খেত। আর গাধাটা আমাকে খুন করতে না চাইলে অবশ্যই জানিয়ে দিতাম ওকে।
মুক্তোগুলো তুলে আনার জন্যে ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম। দ্বীপের এক জাহাজের মালিককে লোভ দেখানোর চেষ্টা করলাম। আমার সঙ্গে গেলে তাকে আধাআধি বখরা দেয়ার কথাও বললাম। রাজি হলো না। বিশ্বাসই করলো না আমার কথা। ওসব অঞ্চলে এরকম গল্প প্রায়ই এসে বলে নাবিকেরা, বেশির ভাগই মিথ্যে। তাই কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। হেসেই উড়িয়ে দেয়। আর ওদেরই বা দোষ দেব কি। আমি নিজের চোখে না দেখলে কেউ এসে যদি ওই গল্প আমার কাছে বলতো, আমিও বিশ্বাস করতাম না। আমিও মুখের ওপর হাসতাম। যদিও এরকম খেত অনেক পাওয়া গেছে। মুক্তোও তুলে নিয়ে এসেছে কেউ না কেউ।
রাটুনায় থাকার সময় স্থানীয়রা আমাকে কয়েকটা ছোট মুক্তো উপহার দিয়েছিলো। অন্যান্য দ্বীপেও পেয়েছি কিছু। বিক্রি করে টাকাও পেয়েছি। কিন্তু এততাই সামান্য, তা দিয়ে বড় ধরনের একটা অভিযান চালানো সম্ভব নয়। অনেক খরচ। জাহাজ ভাড়া করতে হবে, ডুবুরির পোশাক লাগবে, আরও অনেক জিনিস। তাহিতিতে বেশিদিন থাকতে সাহস হলো না। কোন দিন ফিরে চলে আসে কারনেস, ঠিক নেই। মুখোমুখি হলে আমাদের একজনকে মরতেই হতো, খুনের দায়ে অ্যারেস্ট হতো আরেকজন। টাকা জোগাড়ের জন্যে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেও একই অবস্থা। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। দুএকজন যা-ও বা করলো, এতো বেশি খবর জানতে চাইলো, বলাটা উচিত মনে করলাম না। ওরা একেবারে জায়গার ঠিকানাই চায়। বলে দিলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই যদি চলে যায় কিছুই করতে পারবো না। শেষে ভাবলাম, পৃথিবীতে এখন টাকার জায়গা বলতে আমেরিকা আর জাপান। জাপানীরা বেশি চালাক, ওদেরকে রাজি করাতে পারবো না। বাকি থাকলো আমেরিকা। চলে এলাম। মনে করলাম যদি কেউ ইনটারেস্টেড হয়…
তেমন কাউকে পেয়েছো? জানতে চাইলো ওমর।
না।
পাবে বলেও মনে হয় না। আসলে, কাউকে বিশ্বাসই করাতে পারবে না। আর কেউ যদি করেও, এতোবড় জুয়া খেলতে রাজি হবে না।
জুয়া! প্রায় চিৎকার করে উঠলো ডজ, জুয়া বলছে, কেন? সোজা আমি জায়গাটায় নিয়ে চলে যেতে পারি।
নোটবুক আর পেন্সিল বের করলো ওমর। তাহিতি থেকে তোমার দ্বীপটার দূরত্ব কতো? নাম কি?
কোনো নাম নেই। ম্যাপে বের করতে পারিনি। ওদিকের অনেক দ্বীপের নামই ম্যাপে নেই। নেভির চার্টে হয়তো থাকতে পারে।
হু। বেশ, তাহলে একটা নাম ঠিক করে ফেলা যাক। যাও, ওটার নাম রেখে দিলাম ডজ আইল্যাও। তাহিতি থেকে কদ্দূর?
আটশো মাইল মতো হবে।
লেগুনে জাহাজ ঢোকানো যাবে? নিরাপদ?
তা যাবে।
প্লেন তো নেয়া যাবে না। এক কাজ করা যেতে পারে। ফ্লাইং বোট। ল্যান্ড করা যাবে?
উড়ে যাওয়ার কথা ভাবছো নাকি?
কেন নয়?
গাল চুলকালো ডজ। না, তেমন অসুবিধে নেই। তবে একবারও কথাটা মনে আসেনি আমার। পকেটে টাকা না থাকলে বুদ্ধিও খোলে না। স্কুনারে করে যাওয়ার চেয়ে তাতে খরচ বেশি পড়বে।
কিন্তু যাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি।
তা যাবে।
ফ্লাইং বোট থেকে পানিতে নামা যাবে? ডুব দিয়ে ঝিনুক তোলার জন্যে?
যাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে। ওখানকার সাগর শান্তই থাকে দেখেছি।
ডাইভিঙের অভ্যাস তো নিশ্চয় করে ফেলেছো। এতোদিন ওখানে থেকে যখন মুক্তো তোলার কাজ করেছো।
ভালোমতো।
কি কি জিনিস লাগবে, জান তো? ভুলচুক করবে না?
নিশ্চয় জানি। করবো না।
তাহলে, ফ্লাইং বোটের ব্যবস্থা যদি করে দিই, আর সমস্ত খরচ-খরচা জোগাড় করে দিই, মুক্তোর বখরা দিতে রাজি আছো?
দেবো না মানে! নিশ্চয়ই দেবো! চেঁচিয়ে উঠলো ডজ। তুমি সব খরচ দেবে, আমি তুলে আনার ব্যবস্থা করবো। আধাআধি ভাগ হবে।
আধাআধিতে চলবে না। এতো টাকা আমি একলা দিতে পারবো না। কিশোরের সাহায্য লাগবে। কি কিশোর, তোমার চাচার কাছ থেকে কিছু জোগাড় করতে পারবে?
পারবো বলতে একটুও দ্বিধা করলো না কিশোর। চাচাকে চেনে সে। এরকম ঝুকি নেয়ার অভ্যাস আছে তার। অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন জীবনে। মেরিচাচীর বাধা না থাকলে এই অভিযানে শুধু টাকা দেয়াই নয়, তিনি নিজেও বেরিয়ে পড়তেন, জানে সে। তবে, তিন ভাগ করলে চলবে না। আমার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যাচ্ছে। পাঁচ ভাগ করতে হবে। কি বলো, মুসা?
আমি অবশ্যই যাবো, মুসা জবাব দিলো। তবে মুফতে বখরা নিতে চাই না। বাবাকে বলে, আমিও কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে পারবো আশা করি, যদি মাকে না শোনাই।