চুপ হয়ে গেছে সবাই। ডজ যতগুলো পেয়েছে, তার কোনোটাই এটার মতো নয়। অবশেষে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো সে, গোলাপী মুক্তো! নামই শুনেছি শুধু এতোদিন দেখিনি। প্যারিসে নিয়ে গেলে ঈশ্বরই জানে কতো পাওয়া যাবে!
খোসাটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে কিছু বলতে যাবে কিশোর, এই সময় আবার চোখ পড়লো ওটার ওপর। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। অন্যেরাও তাকালো। দেখলো ডালার ফাঁকে গোলাপী একটা জিনিস চকচক করছে। সবাই চুপ। কোনো শব্দ নেই। নীরবে গিয়ে দ্রুত ঝিনুকটা আবার কুড়িয়ে নিলো কিশোর, বের করে আনলো আরেকটা গোলাপী মুক্তো। বাঁ হাতের তালুতে দুটো মুক্তোই রেখে সবাইকে দেখালো।
কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন ডজ। যখন বললো, গলা কাঁপতে লাগলো তার, কি সুন্দর! ব্যাঙ ঢুকেছে যেন তার গলায়, ঘড়ঘড় স্বর বেরোচ্ছে। দেখ, দেখ সবাই ভালো করে! কারণ আর কোনোদিন এমন দৃশ্য দেখতে পাবে না। লক্ষ লক্ষ বছর বাঁচলেও না। বহু বছর ধরে এদিকের সাগরে মুক্তো খুঁজে বেরিয়েছি আমি। আমারই মতো অনেকেই খুঁজে বেড়িয়েছে, এখনও খুঁজছে। ওদের কেউ কেউ জীবনের পঞ্চাশ-ষাট বছর এর পেছনে খরচ করে দিয়েছে। তা-ও এরকম কেউ দেখেনি, অন্তত আমার জানা মতে নেই কেউ। ওরকম একটা মুক্তোই ঝিনুক থেকে বের করে দেখার ভাগ্য খুব কম মানুষের হয়, একসঙ্গে দুটোর কথা তো ভাবাই যায় না! আমার যে কেমন লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না!
ভালোই হয়েছে, কিশোর বললো। এখন একটা করে রাখতে পারবো আমরা।
মানে?
একটা আমাদের, আর একটা সাগরের হাসির। ঝিনুকটা সে-ই তুলেছে। একটা তার পাওয়া উচিত।
পাগল হয়েছে! গলা চেপে দম আটকে দেয়া হয়েছে যেন ডজের। ওরকম একটা জোড়া ভাঙবে? অসম্ভব! রীতিমতো অপরাধ হয়ে যাবে সেটা। একই সঙ্গে জন্মেছে মুক্তোদুটো, একই সঙ্গে থাকা উচিত। তুমি বুঝতে পারছে না দুটো একসাথে থাকার কি মানে। ওর একটা মুক্তোর দামই হবে পঞ্চাশ-ষাট হাজার পাউন্ড। আর দুটো একসাথে থাকলে যা দাম হাঁকবে তাতেই বিক্রি হয়ে যাবে। রাজা তার রাজত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যাবে ওদুটো পাওয়ার জন্যে!
হ্যাঁ, ওগুলোর একসাথেই থাকা উচিত, ডজের সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালো ওমর।
ঠিক আছে, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। তাহলে দুটোই সাগরের হাসিকে দিয়ে দিই। একসাথেই থাকুক।
আরে না না, পাগল নাকি… কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল ডজ। বোধহয় ছোট হতে চাইলো না।
ঠোঁট ওল্টালো সাগরের হাসি। সহজ কণ্ঠে বললো, আমার ওসব দরকার নেই। কি করব? তার চেয়ে পিং মিনের দোকান থেকে কিছু লাল পুঁতি যদি কিনে দাও, এদুটো তোমাদেরকে দিয়ে দিতে পারি।
নিশ্চয় দেবো! তাড়াতাড়ি বললো ডজ। যত চাও ততো দেবো!
দেবে! খুব খুশি সাগরের হাসি। চোখ জ্বলজ্বল করছে। যতো চাই, দেবে!
দেবো।
পাগল নাকি! বিড়বিড় করলো মুসা। কয়েকটা পুঁতি কিনে দিলেই ওরকম দুটো মুক্তো…
মুসার দিকে তাকালো সাগরের হাসি। ওগুলো দিয়ে কি করবো আমি? পুঁতি পেলে হার বানিয়ে গলায় পরতে পারবো। ওগুলো ফুটোও করা যাবে না, মালাও গাঁথা যাবে না।
এরকম যুক্তির পর আর কথা চলে না। চুপ হয়ে গেল মুসা।
ডজ বললো, এতো পুঁতি কিনে দেবো, যতো খুশি মালা বানাতে পারবে। রাটুনায় পিং মিনের দোকানে নিয়ে যাবো। তোমার ইচ্ছে মতো কিনে নিও। পাউডার, স্নাে, লিপস্টিক, যা খুশি।
গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। তার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে ঠকানো হচ্ছে।
সেটা বুঝতে পেরে হেসে ডজ বললো, তুমি ভাবছো ঠকাচ্ছি। তা ঠকাচ্ছি বটে। তবে দিতে তো চাইলে, নিলো না তো। এর চেয়ে অনেক বেশি খুশি হবে ও পুতি পেলে। মুক্তোগুলো জোর করে দিলে হয়তো নেবে, কিন্তু একটু পরেই ফেলে দেবে। ওর কাছে এগুলোর কোনো মূল্য নেই। তার চেয়ে ও যা পছন্দ করে সেটা দিলেই কি ভালো হয় না? মুক্তোগুলোও থাকবে।
আর কিছু বললো না কিশোর।
উঠে দাঁড়ালো ডজ। হাতটাত ধুয়ে গিয়ে চা খাওয়া দরকার। বাপরে বাপ, কি পচা গন্ধ! একেবারে গলার মধ্যে ঢুকে গেছে! বিস্কুটের টিনটা তুলে নিয়ে বললো, এগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার। প্লেনে রাখা ঠিক হবে না এখন, অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। একবারে যাওয়ার সময় তুলে নিলেই হবে।
লেগুনের ধারে ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা। নারকেল গাছের গোড়ায় বালির ওপরে পড়ে রয়েছে বিশাল একটা প্রবালের চাঙড়। কি করে এলো কে জানে। হয়তো ঝড়ে নিয়ে এসে ফেলেছে। যেভাবেই আসুক, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ডজের। টিনটা লুকানোর ভালো একটা জায়গা পেয়েই খুশি সে। চাঙড়ের তলায় বালিতে পুঁতে রাখলো টিনটা।
চা খাওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে নারকেল গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে আয়েস করে টানতে শুরু করলো ওমর। পাইপ ধরালো ডজ। ভালোই পেয়েছি, কি বল, বললো সে। বাকি ঝিনুকগুলো পচলে বের করে নিয়ে রওনা হতে পারি। যদি আবহাওয়া গন্ডগোল না করে।
আর যদি রেশনে টান না পড়ে, বললো ওমর। আরও তিনদিনের খাবার হবে বলে মনে হয় না। ছয়টা মুখ, কম তো নয়।
মাছ ধরতে পারি। পানিতে তো অভাব নেই। খাবারের অসুবিধে হবে না। তিনটে মাস কাটিয়ে দিয়েছি এখানে, কোনো সরঞ্জাম ছাড়া। এখন তো বড়শি সুতো সবই রয়েছে। কোন কোন মাছ খেতে ভালো, সাগরের হাসি আর ঝিনুক জানে। ওদের দিকে ফিরলো ডজ। এই, কিছু মাছ ধরে আনো না। খাওয়ার জন্য।