মেসো চোখের কোণ মুছে হেসে বললেন, ‘কাঁদছিলাম? আমি? দূর!’
আমি মেসোর হাতে আবদারের ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ কাঁদছিলে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বলো—তোমাকে বলতেই হবে—।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেসো নীচু গলায় বললেন, ‘আসলে বিলটুর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।’
‘বিলটু? কে বিলটু?’
‘আমার পোষা কুকুর। ও কুকুর নয় রে—আগের জন্মে আমার কেউ ছিল। ও আমাকে এত ভালোবাসত…।’ মেসোর চোখের কোণ জলে ভরে গেল আবার।
সবুজ ধানখেতের ওপারে সূর্য ঢলে পড়েছে। টিয়াপাখির ঝাঁক উড়ে গেল ঘোলাটে আকাশে। একটু আগেই যে-দৃশ্যটা মন ভরিয়ে দিচ্ছিল এখন সেটাই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সূর্যের লাল রংটা ওই হতভাগ্য কুকুরটার কথা মনে পড়িয়ে দিল।
চোখ মুছে নিয়ে বড়মেসো আবার বলতে শুরু করলেন।
‘শোন, বিলটুর কথা পিংকি আর রাহুলও জানে না। ওদের কখনও বলিনি। তা ছাড়া এসব ওদের জন্মের আগের ব্যাপার তখন তোর বড়মাসি সবে স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছে।
‘বিলটুকে আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। তখন ও এই এত্তটুকুন ছিল। কী সুন্দর দেখতে ছিল, জানিস? আর কী সাহস! ক্রস ব্রিডের কুকুরছানা। ভেলভেটের মতো লোম। ছাইরঙের ওপরে এলোমেলো ছোট-ছোট সাদা ছোপ। ওর কথা বলতে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মানে…।’
‘থাক, তোমাকে তা হলে বলতে হবে না।’
বড়মেসো জেদের গলায় বললেন, ‘না, বলব। তোকে বললে আমার ভেরতটা অনেক হালকা হবে। তা ছাড়া তুই তো নিজের চোখে ঢোলগুলোর কাণ্ড দেখলি। কীরকম নিষ্ঠুরভাবে ওই গোবেচারা কুকুরটাকে শেষ করে দিল। বিলটুকেও ওরা ঠিক এইভাবে খতম করে দিয়েছিল—তবে বিলটু এই কুকুরটার মতো ভিতু ছিল না। ও দলটার সঙ্গে বীরের মতো লড়াই করেছিল। কিন্তু…কিন্তু…শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি।’ কথা বলতে-বলতে মেসোর গলা ধরে এল। একটু সামলে নিয়ে মেসো বললেন, ‘ওর জন্যে আমি আর তোর বড়মাসি কত যে চোখের জল ফেলেছি…।’
আমরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। মেসো চোখ মুছে জোর করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘নাঃ, এখন আর না। আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিলটুর ব্যাপারটা তোকে বলব। শুধু তোকে কেন, একইসঙ্গে পিংকি আর রাহুলকেও শোনাব। আমার যত কষ্ট হয় হোক। বিলটুর সাহসের গল্প ওদেরও শোনা দরকার।’
এরপর বড়মেসো অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। এগারো ইঞ্চি লম্বা রুইমাছটা কী-কী মশলাপাতি সহযোগে রান্না হবে তাই নিয়ে বড়মাসির সঙ্গে তর্কবিতর্ক জুড়ে দিলেন। পিংকি আর রাহুলকে আমি বললাম যে, আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মেসো একটা সত্যি ঘটনা শোনাবেন।
ওরা হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিল। বলল, ওদের বাপিকে ওরা ভালো করে চেনে। ওদের বাপি কখনও ওদের সত্যি ঘটনা কিংবা মিথ্যে ঘটনা—কিছুই নাকি শোনাননি।
কিন্তু সে-রাতে বড়মেসো বিলটুর গল্প আমাদের তিনজনকে শোনালেন।
মাছ ধরা আমার ছোটবেলাকার নেশা। বউনি নদীতে আমি মাছ ধরি প্রায় বিশ বছর ধরে। ছিপ, বঁড়শি, টোপ নিয়ে ওই নদীর পাড়ে ধৈর্য ধরে বসাটা আমার বরাবরের অভ্যেস। বিলটুও ধীরে-ধীরে এই অভ্যাসটা রপ্ত করে নিয়েছিল। ও আমার সঙ্গে বলতে গেলে পায়ে-পায়ে ছুটত। তারপর নদীর পাড়ে গিয়ে যখন আমি ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম তখন ও এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করত। কোনও একটা মাছ ধরে ডাঙায় তুললেই ওর সে কী উত্তেজনা আর লাফালাফি! যেন মাছটা আমি নয়—ও-ই ধরেছে।
এইভাবে বছরখানেকের বেশি কেটে গেল। বিলটু চেহারায় বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। ওকে দেখে নেড়িকুকুররা বেশ সমীহ করে—আর লোকজন বেশ ভয়-টয় পায়।
আমাদের গ্রামে একবার চুরির হিড়িক শুরু হয়েছিল। তখন মাঝরাতে বিলটু হঠাৎই এক চোর ধরে ফেলল। তার পায়ে আর ঊরুতে ও এমন বাঘা কামড় বসাল যে, একেবারে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। সে-কথা চাউর হতেই গ্রামে চুরি-টুরি সব বন্ধ।
একদিন সকাল বউনি নদীর তীরে ছিপ ফেলে বসে আছি, হঠাৎই ফাতনা নড়ে উঠল। দেখেশুনে মনে হল, বেশ বড় সাইজের মাছ টোপ গিলেছে। তো আমি সেদিকে মনোযোগ দিয়ে ছিপটাকে খেলাচ্ছি, হঠাৎই কানে এল অদ্ভুত শিসের শব্দ। তারপরই কয়েকটা চাপা গর্জন।
ছিপটা বাগিয়ে ধরে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা বুনো কুকুর ওপারে দাঁড়িয়ে। বিলটুকে লক্ষ করে ওরা চাপা গোঙানির শব্দ করছে।
আমি বিলটুকে সাবধান করার আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। বিলটু ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগল। তারপর আমি কিছু করে ওঠার আগেই ভয়ংকর তেজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে গেল ওপারে।
আমি ছিপ-বঁড়শি সব ছুড়ে দিয়ে বিলটুকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিলটু ওপারে পৌঁছে গেল। এবং শুরু হয়ে গেল দাঁত-নখের প্রচণ্ড লড়াই। বিলটু ঘুরে-ঘুরে ওঁদের আক্রমণ ঠেকাতে লাগল। শূন্যে বারবার লাফিয়ে শত্রুদের মরণকামড় বসাতে লাগল। কুকুরের লোম উড়তে লাগল শূন্যে।
আমি অসহায়ের মতো এপারে দাঁড়িয়ে বারবার বিলটুর নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আর কিছুক্ষণ লড়াই চললেই বিলটুকে ওরা শেষ করে দেবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিলটু শেষ পর্যন্ত জিতে গেল। বুনো কুকুরগুলো হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিল। বিলটুর দূরন্ত আক্রমণের মুখে পড়ে ওরা ভয়ের চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে।