- বইয়ের নামঃ ডট কম রহস্য
- লেখকের নামঃ অনীশ দেব
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ, রোমাঞ্চকর গল্প, ভূতের গল্প
ডট কম রহস্য
অনিন্দ্যসুন্দরের অপমৃত্যু (নভেলেট)
‘মৃত্যুর সময়ে বয়স কত হয়েছিল? বাহান্ন—তাই তো?’ দেবদূত সূর্যকান্ত প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ—বাহান্ন’। শ্রান্ত স্বরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী। তাঁর মনে হল, সেই এসে থেকে যেন শুধু প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
‘মৃত্যুর কারণ?’ দেবদূত বলে চলল।
‘হার্ট অ্যাটাক। অন্তত আমার তাই ধারণা।’ অনিন্দ্যসুন্দর উত্তর দিলেন।
‘হুম।’ দেবদূতকে যেন সামান্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হল, ‘এইবারে শেষ প্রশ্ন। খাতায় লেখা আছে, হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক কারণ, যে-কোনও একটায় দাগ দিন: আত্মোৎসর্গ, দুর্ঘটনা, রক্তচাপ, কায়িক শ্রম, নির্বুদ্ধিতা, খুন ইত্যাদি। এখানে দেখছি ”খুন” শব্দটায় টিক মার্ক দেওয়া আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর সোজা হয়ে উঠে বসলেন ‘খুন?’
‘হ্যাঁ,’ সুর্যকান্ত বলল, ‘খাতার এই পাতাটা আপনার নামে। এখানে তো দেখছি, খুনই বলা আছে। অবশ্য আমার ভুল হলে আপনি ধরিয়ে দেবেন বইকী। আপনি তো খুনই হয়েছেন, তাই-না, মিস্টার চৌধুরী?’
‘না, মানে, আমি তো সেরকম ভাবিনি। আমি…।’
‘তার মানে, আপনি যে খুন হয়েছেন, তা আপনি জানেন না?’ সহানুভূতির সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘না, এ-আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!’
সূর্যকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল: ‘হ্যাঁ, কখনও-কখনও যে এরকম হয় না তা নয়। তবে খুন হলে বেশিরভাগ লোকই সেটা বুঝতে পারে। অন্তত শেষ মুহূর্তে হলেও টের পায়। এধরনের খুনের খবর যে কীভাবে মোলায়েম করে ভাঙতে হয়, তা আমি আজও শিখলাম না।’
‘এ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ বেশ কয়েকবার এই কথাটা আপনমনে উচ্চারণ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘আপনাকে আঘাত দেওয়ার জন্যে দুঃখিত, মিস্টার চৌধুরী। তবে জানবেন, এখানে এসবে কিছু যায় আসে না।’
‘মনে আছে, আমি স্টাডি-রুমে বসেছিলাম। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ এক সাংঘাতিক যন্ত্রণায় আমার ঘুম ভেঙে যায়…ঠিক বুকের ভেতর…তারপর আর কিছু ভেবে ওঠার সময় পাইনি।’
‘এছাড়া আরও একটা কথা এখানে লেখা আছে,’ খাতায় চোখ বুলিয়ে সূর্যকান্ত বলল, ‘আঘাতটা আপনার হার্টেই লেগেছিল, মিস্টার চৌধুরী। আপনারই কাগজ-কাটার ছুরি দিয়ে আপনাকে আঘাত করা হয়েছে…পিঠে…।’
‘এতো রীতিমতো পৈশাচিক,’ বিস্মিত সুরে বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘আমার কাগজ-কাটার ছুরিটা কী সুন্দর…ওটার হাতলটা সত্যিকারের হাতির দাঁতের তৈরি…কে এ-কাজ করেছে?’
‘তার মানে? কে কী কাজ করেছে?’
‘কে আমাকে খুন করেছে?’
‘সেকী! আমি কী করে জানব?’
‘আপনি না জানলে, কে জানবে! আমি তো ভেবেছি আপনার ওই নরকের খাতায় সব খবরই লেখা আছে।’
‘এটা নরকের খাতা নয়।’
‘সে যাই হোক, বলুন, কে আমাকে খুন করেছে?’
‘মিস্টার চৌধুরী!’ কঠোর স্বরে বলে উঠল সূর্যকান্ত, ‘প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ইত্যাদিকে এখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না—এটা আপনার জানা উচিত।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি এমনিই জানতে চাই।’
‘আপনাকে কে খুন করেছে, আমি জানি না, মিস্টার চৌধুরী। আমি দেবদূত হতে পারি, তাই বলে সবজান্তা নই। কারও সম্পর্কে আমরা সমস্ত তথ্য জানতে পারি তার মৃত্যুর পর। তখনই তার নামে খাতা তৈরি হয়। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার খুনের জন্যে যে দায়ী তার মৃত্যুর পর সব তথ্য আমার হাতে আসবে, তখন সহজেই আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’
‘সেটা কবে?’
‘যদি খুনি ধরা পড়ে এবং তার ফাঁসি হয়, তা হলে—বলতে পারেন, খুব শিগগিরই জানতে পারব। আর খুনি যদি সেরকম চালাক হয়ে থাকে এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারে, তা হলে অনেক বছরের ধাক্কা।’
‘অতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না! আমি এক্ষুনি জানতে চাই।’ অনিন্দ্যসুন্দর উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন।
‘মিস্টার চৌধুরী, আমি দুঃখিত…।’
‘এখানে এমন কেউ নেই, যিনি সব জানেন?’
‘অবশ্যই আছেন, দেবরাজ। উনি সব জানেন।’
‘তা হলে তাঁকেই জিগ্যেস করুন।’
‘অসম্ভব। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করতে পারি না। মিঃ চৌধুরী, বসুন।’
কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করলেন না অনিন্দ্যসুন্দর, পায়চারি করেই চললেন। তারপর হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, এখানে আমি সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারব?’
‘নিশ্চয়ই।’ গভীর আশ্বাসের সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘কে আমাকে খুন করেছে সেটা না-জানতে পারলে কী করে আমি সুখে-শান্তিতে থাকব বলতে পারেন?’
‘তাতে অসুবিধেটা কী আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না, মিস্টার চৌধুরী!’
বেশ চেষ্টা করে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, তারপর সোনার চেয়ারে আবার বসলেন। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘সূর্যকান্তবাবু, দয়া করে বলবেন, আপনার খাতায় আমার পেশার জায়গায় কী লেখা আছে?’
‘আপনি রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের লেখক ছিলেন।’
‘ঠিক তাই। সুন্দর সান্যাল ছদ্মনামে আমি পঁচাত্তরটা রহস্য উপন্যাস লিখেছি—তার একডজনেরও বেশি সিনেমা হয়েছে—এ ছাড়া অসংখ্য ছোট গল্প তো আছেই। এ থেকে কিছু আঁচ করতে পারছেন, সূর্যকান্তবাবু?’
‘না, মানে, ঠিক…।’
‘এখনও বুঝতে পারছেন না?’ অনিন্দ্যসুন্দর প্রায় ধৈর্য হারালেন: ‘আমি কে, না, প্রখ্যাত রহস্যকাহিনীকার সুন্দর সান্যাল, বিগত তিরিশ বছর ধরে যে শুধু প্রশ্ন করে গেছে, কে খুন করেছে? এবং বারবার তার উত্তরও দিয়েছে। আর, এখন! আমি নিজেই খুন হলাম অথচ জানি না, কে আমাকে খুন করেছে!’
দেবদূত সূর্যকান্ত হাসল। বলল, ‘এবার আপনার কথা ধরতে পেরেছি, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু যে-প্রশ্নের উত্তর আপনি জানতে চান তা যথাসময়ে আমাদের হাতে আসবে। এখন একটু ধৈর্য ধরে শান্ত হোক—।’
‘খুনির পরিচয় আমাকে জানতেই হবে,’ অনিন্দ্যসুন্দর উদ্দেশ্যে অটল, ‘সেটা না-জানা পর্যন্ত আমার সুখ নেই, শান্তি নেই। পিঠে ছুরি মেরে খুন করেছে! ওঃ কী আস্পর্ধা!’
সূর্যকান্ত সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, অল্পেতে হতাশ হবেন না। আগে এ-জায়গাটা ঘুরে-ফিরে দেখুন। যেসব সুখ-সুবিধে এখানে আছে…।’
অনিন্দ্যসুন্দর চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন, মেঝের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না। এসব সুখ-সুবিধে শুধু কথার কথা।’
‘মিস্টার চৌধুরী!’
‘মিথ্যে। সব মিথ্যে। সুখ! শান্তি! আমার মনে এতটুকু সুখ নেই। আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
‘এখানে আপনার ভালো লাগতে বাধ্য,’ সূর্যকান্তের স্বরে আতঙ্ক উঁকি মারল ‘এখানে সুখী না-হওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ এটা স্বর্গ—আপনি স্বর্গে রয়েছেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘স্বর্গ না ঘেঁচু! আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
দেবদূত উঠে দাঁড়াল। সুন্দর মার্বেল পাথরের মেঝেতে নগ্ন পায়ে নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল। আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করে বলল, ‘কী অদ্ভুত কাণ্ড! নাঃ, এ অসম্ভব!’ তারপর অনিন্দ্যসুন্দরের দিকে ফিরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, আর-একবার ভেবে দেখুন। আপনি…।’
‘না, আমার একটুও ভালো লাগছে না।’
‘দয়া করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, মিস্টার চৌধুরী।’ সূর্যকান্ত অনুনয় করল, ‘আপনি যদি এভাবে সারা স্বর্গে ঘুরে বেড়ান আর বলতে থাকেন, আপনার মনে এতটুকু সুখ-শান্তি নেই, তা হলে আমাদের সম্মান, সুনাম সব কোথায় যাবে বলুন তো? স্বর্গে এসে আপনার মনে সুখ নেই এ-কথা শুনলে, লজ্জায়, অপমানে দেবরাজ ইন্দ্রের যে মাথা কাটা যাবে!’
‘বিশ্বাস করুন, আমার মনে এতটুকু শান্তি নেই।’ অনিন্দ্যসুন্দর আবার বললেন, এবং তাঁর অভিব্যক্তিতেও সে-ইঙ্গিত স্পষ্ট।
‘ঠিক আছে, আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে জিগ্যেস করে দেখছি।’ সূর্যকান্ত বলল। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল, এইমুহূর্তে সুখ এবং শান্তি তার মন থেকেও উবে গেছে। একটু ইতস্তত করে সে আবার বলল, ‘দেবরাজ এত ব্যস্ত থাকেন…তা ছাড়া আজকাল তাঁর মেজাজটাও ভালো নেই। কিন্তু তাঁকে তো বলতেই হবে। নইলে তিনি যদি একবার জানতে পারেন যে, স্বর্গে এসেও একজন মানুষ অসুখী, তা হলে আমাকেই দোষ দেবেন। আমি এই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার, মিস্টার চৌধুরী। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখানকার সব দায়দায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে।’
‘ভালো না-লাগলে কী করব বলুন!’
শিউরে উঠে দেবদূত আবার পায়চারি শুরু করল। খোলা জানলা দিয়ে মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে উচ্ছ্বল হাসির টুকরো শব্দ, কখনও-বা সঙ্গীতের হালকা সুর। কিন্তু ঘরের ভেতরে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী গম্ভীর হতাশ মুখে বসে।
হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখে হাসি ফুটে উঠল। দ্রুতপায়ে নিজের টেবিলের কাছে ফিরে গেল সে, বসল চেয়ারে।
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি তো রহস্য গল্পের লেখক,’ দ্রুত স্বরে বলতে শুরু করল দেবদূত, ‘সূত্র তৈরি করতে বা খুনিদের ফাঁদে ফেলতে আপনার জুড়ি নেই, কী বলেন?’
‘তা বলতে পারেন।’
সূর্যকান্ত বলে চলল, ‘যে-মতবলটা আমার মাথায় এসেছে সেটা পুরোপুরি বেআইনি, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ ছাড়া পথ নেই। মিস্টার চৌধুরী, যদি আপনাকে আবার পৃথিবীতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তা হলে আপনি পারবেন নিজের হত্যা-রহস্যের সমাধান করতে? কী মনে হয় আপনার?’
‘সে আমি বোধহয়…।’
‘এর বেশি আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ কঠোর স্বরে বলল সূর্যকান্ত।
‘চেষ্টা করে দেখতে পারি, কিন্তু আমি কীভাবে…?’
‘খুব সহজ।’ বাধা দিয়ে বলল সূর্যকান্ত, ‘আপনি এখন পরলোকে বাস করছেন, সুতরাং সময় বলে এখানে কিছু নেই। আমরা শুধু যা করব, তা হল, একটা সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাব, মানে, অ্যাকশন রিপ্লে করব…ধরুন, একটা দিন। আপনি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আপনার মানবজীবনের শেষ দিনটা আবার নতুন করে বাঁচবেন। দেখুন…এই যে! আপনি মারা গেছেন রাত ঠিক এগারোটায়। সেইদিন সকাল ঘুম ভাঙার পর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সময় আপনাকে দেওয়া হল।’
‘মাত্র একটা দিন?’ অনিন্দ্যসুন্দরের ভুরু কুঁচকে উঠল: ‘ওইটুকু সময়ে কি পারব?’
‘তা যদি না-পারেন, তা হলে চেষ্টা করে আর…।’
‘না, পারব।’ ঝটিতি বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘বলুন, কখন যেতে হবে?’
‘এক্ষুনি। কিন্তু প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি, মিস্টার চৌধুরী। জীবনের শেষ দিনটার প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা এই খাতায় লেখা রয়েছে, সুতরাং সেরকম কোনও তথ্যগত পরিবর্তন আপনি করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি তো আপনাকে করতেই হবে, যেটা আপনি প্রথমবারে করতে পারেননি। আর, দরকার হলে খাতায় অল্পস্বল্প মোছামুছি আমি করে নেব, কিন্তু সেরকম বড় কিছু পালটাতে গেলে ভীষণ মুশকিলে পড়তে হবে।’
‘কিন্তু—।’
‘সোজা কথায়, বড়সড় কোনও ওলটপালট ছাড়াই আপনাকে ম্যানেজ করতে হবে। এতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মনে রাখবেন, মরণশীল প্রাণীদের যে-বর ক্বচিৎ-কখনও দেওয়া হয়, সেই অমূল্য বর আপনাকে দেওয়া হবে।’
‘ভবিষ্যৎদৃষ্টি!’ বিস্ময়ে বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘হ্যাঁ। কিন্তু, মিস্টার চৌধুরী, আগেই বলে রাখি, আপনাকে কিন্তু আবার একইভাবে খুন হতে হবে।’
অনিন্দ্যসুন্দরের উজ্জ্বল চোখ মুহূর্তে নিভে গেল। হতাশ সুরে তিনি বললেন, ‘আবার সেই পিঠে ছুরি খেয়ে মরতে হবে—।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল দেবদূত। বলল, ‘খাতায় তাই লেখা আছে।’ তারপর অমোঘ নির্ঘোষের মতো গর্জে উঠল তার মন্দ্রস্বর, ‘আমার প্রস্তাবে রাজি হওয়া-না-হওয়া সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছে। মত দেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে দেখুন।’
‘না…আমি রাজি। কে আমাকে খুন করেছে জানতেই হবে।’
‘বেশ, তা হলে তাই হোক। আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন, মিস্টার চৌধুরী। এখানে সমস্ত আত্মাই সুখী হোক, সেটাই আমরা চাই।
‘ধন্যবাদ।’ অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর এবং বিশাল সোনার দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
…ঘুম ভাঙল তাঁর নিজের বিছানায়, নিজের বহুপরিচিত শোওয়ার ঘরে। বাড়িটা অন্ধকার ছায়াময় এক প্রাচীন প্রাসাদ। অনিন্দ্যসুন্দরের অত্যন্ত প্রিয়। কারণ, তাঁর ধারণা, কোনও রহস্যকাহিনিকারের পক্ষে এ-বাড়ির প্রকৃতি ও পরিবেশ যথেষ্ট মানানসই। বসবার ঘরের সুপ্রাচীন পিতামহ-ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। শুয়ে-শুয়েই ঘণ্টার শব্দ গুনে চললেন তিনি, এবং হঠাৎই তাঁর মনে হল, এ-হয়তো রাত এগারোটার ইঙ্গিত—কিন্তু সে-এক ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্য। তারপরই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন অনিন্দ্যসুন্দর। দেখলেন, পরদার ফাঁক দিয়ে তীব্র সূর্য ঘরের মেঝেতে জায়গা করে নিয়েছে। এখন তা হলে বেলা এগারোটা। সুপ্রসিদ্ধ লেখকের ঘুম থেকে ওঠার উপযুক্ত সময়ই বটে। অনিন্দ্যসুন্দর বরাবরই রাত জেগে লেখেন, ফলে এগারোটায় ভোর হওয়া তাঁর কাছে রোজকার ব্যাপার। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। ইস, কতটা সময় শুধু-শুধু নষ্ট হল। হাতে আর মাত্র বারোটা ঘণ্টা। মনে-মনে আপশোস করে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।
দরজায় অনেকক্ষণ ধরেই কেউ নক করছিল।
‘ভেতরে এসো।’ অনিন্দ্যসুন্দর বললেন।
দরজা খুলে তাঁর সেক্রেটারি কিংশুক বোস ঘরে ঢুকল। বলল, ‘একটু আগেই চিঠিপত্র এসেছে—।’
‘তা কী হয়েছে?’
‘দেখলাম, রমেন গুপ্তর একটা চিঠি রয়েছে।’ কিংশুক একটা চিঠি এগিয়ে দিল অনিন্দ্যসুন্দরের দিকে।
রমেন গুপ্ত ‘লহরী প্রকাশন’-এর মালিক এবং অনিন্দ্যসুন্দরের বহু রহস্য উপন্যাসের প্রকাশক। চিঠিটা হাতে নিয়ে কিংশুককে আবার নতুন করে জরিপ করলেন তিনি। কিংশুক বোস শিক্ষিত, নম্র স্বভাবের মানুষ। তাঁর বাড়িতেই থাকে। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। কদাচিৎ হাসে। এখন, এই মুহূর্তে, ওর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ছোঁয়া। ও বলল, ‘সাধারণ চিঠি ভেবে আমি ওটা খুলে পড়েছি। মনে হল, চিঠিটা আপনার পড়ে দেখাটা খুব জরুরি।
চিঠিটায় চোখ রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর:
প্রিয় অনিন্দ্য,
আশা করি, কুশলে আছ। জরুরি প্রয়োজনে তোমাকে এ-চিঠি লিখছি। যা বলবার খোলাখুলিই বলব। তোমার শেষ উপন্যাসটা, ‘খুনের নাম পাপ’, রীতিমতো দোনোমনো করেই আমি ছেপেছি। হয়তো ভালোই বিক্রি হবে—যদি হয় তা শুধু তোমার নাম আর খ্যাতির জন্যে। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয়, ইদানীং তোমার লেখা বেশ ঢিলে হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটা বই তার আগের বইয়ের চেয়ে দুর্বল। তোমার প্লটের সমুদ্র কি শুকিয়ে এসেছে? মনে হয়, তোমার একটা লম্বা বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু তোমার সঙ্গে আরও তিনটে বই ছাপার চুক্তি থাকায় আমি তো মহা মুশকিলে পড়েছি। সেই নিয়েই কথাবার্তা বলতে বৃহস্পতিবার সকাল দশটা নাগাদ তোমার বাড়িতে যাব। প্রীতি ও শুভেচ্ছা নিও। ইতি—
তোমার রমেন
‘তোমার রমেন,’ তিক্ত হাসি হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। প্রকৃত বন্ধুই বটে! হঠাৎই তাঁর খেয়াল হল কিংশুক এখনও দাঁড়িয়ে।
‘আমার একটা সাজেশন আছে।’ ও বলল।
‘তাই নাকি!’ কঠোর স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘রমেনবাবুর মত, আপনি কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিন। আমারও তাই মত। কিন্তু যে-কদিন আপনি বিশ্রাম নেবেন, বিখ্যাত সুন্দর সান্যালের রহস্য উপন্যাসের আনন্দ থেকে পাঠক-পাঠিকাদের বঞ্চিত করার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘তার মানে?’ বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নেমে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দর।
শান্ত স্বরে কিংশুক বলল, ‘সুন্দর সান্যাল ছদ্মনামে আমিই নতুন-নতুন বই লিখতে থাকব। রমেন গুপ্তকে জানানোর কোনও দরকার নেই। আর, আমাদের পাঠক-পাঠিকাদেরও জানিয়ে কোনও লাভ নেই।’
‘আমাদের পাঠক-পাঠিকা! তোমার কি ধারণা, আমার মতো ভাষা আর স্টাইলে তুমি লিখতে পারবে?’
‘তার চেয়েও বেশি পারব, মিস্টার চৌধুরী। আপনার চেয়ে আমি অনেক ভালো লিখব।’
‘কী—এতখানি আস্পর্ধা তোমার! এত দুঃসাহস!’
‘মিস্টার চৌধুরী, মনে করে দেখুন তো, আপনার শেষ কয়েকটা বইতে আমি কীভাবে আপনাকে হেল্প করেছি? প্লট নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে শুরু করে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্পাদনা—সবই আমি করেছি।’
‘বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে। গেট আউট!’
‘…সুন্দর সান্যালের সুনাম বজায় রাখতে গেলে এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। বইয়ের রয়্যালটি যা পাব, আমি আর আপনি আধাআধি ভাগ করে নেব।’
‘কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না। তোমার ছুটি!’
‘মিস্টার চৌধুরী…।’
‘বেরিয়ে যাও!’
‘আমার মতো কাজের লোক আর আপনি পাবেন না। তা ছাড়া, আমি না-হলে আর একটা বইও আপনি নিজে লিখতে পারবেন না।’
‘শিগগির মালপত্র গুছিয়ে রওনা হও, কিংশুক, নইলে তোমাকে আমি ঘাড় ধরে বের করে দেব!’
‘আপনাকে এর জন্যে পস্তাতে হবে।’ এই কথা বলে কিংশুক ঘরে ছেড়ে চলে গেল।
হ্যাঁ, এইভাবেই অনিন্দ্যসুন্দরের জীবনের শেষ দিনটা শুরু হয়েছিল। রমেন গুপ্তর চিঠি এবং কিংশুকের সঙ্গে ঝগড়া। একই ঘটনা হুবহু দুবার ঘটলে কীরকম অদ্ভুতই না-লাগে। যেন এ-ঘটনা আগেও ঘটেছে—হয়তো কোনও স্বপ্নে…।
এ-চিন্তায় চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। স্বপ্ন? দেবদূত সূর্যকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই কোনও স্বপ্ন নয় তো?’
তাঁর অভিনব চিন্তাধারায় বাধা দিয়ে ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। এক্সটেনশান ফোনটা তাঁর হাতের কাছেই। সুতরাং যান্ত্রিকভাবেই ফোন তুললেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘হ্যালো?’
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘কে সূর্য—ও হ্যাঁ, কী ব্যাপার? কোত্থেকে বলছেন?’
‘কোত্থেকে বলছি।’ সূর্যকান্ত অপরপ্রান্তে যেন অবাক হল: ‘বোকার মতো প্রশ্ন করছেন কেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘কী—কী চাই বলুন?’
‘দেখলাম, ঠিকমতো পৃথিবীতে পৌঁছেছেন কিনা। কেমন চলছে?’
‘সবে তো এলাম—এখনও তো ভালো করে শুরুই করতে পারিনি!’
‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ুন, মিস্টার চৌধুরী। জানেন তো, হাতে সময় বেশি নেই। বিদায়।’
‘বিদায়।’ ফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
যাক, একটা ব্যাপারের অন্তত নিষ্পত্তি হল। কোনও স্বপ্ন তিনি দেখেননি। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে নেমে পড়া যাক। কিন্তু সূর্যকান্ত যদি সর্বক্ষণ এরকম উঁকি মেরে দেখেন, তা হলে কি স্বস্তিতে কাজ করা যাবে?
পরবর্তী তিরিশ মিনিট তাঁর কেটে গেল হাত-মুখ ধোওয়া, দাড়ি কামানো ও পোশাক-পরিচ্ছদ পালটানোর ব্যস্ততায়। কিংশুকের কথা ভাবছিলেন তিনি—শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী কিংশুক তার জঘন্য স্বরূপ প্রকাশের জন্য। এতদিন থাকতে আজকের দিনটাই বেছে নিল! হ্যাঁ, সুন্দর সান্যালের নাম ও খ্যাতির প্রতি কিংশুকের নির্লজ্জ লোভ রয়েছে—যে সুন্দর সান্যাল তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। না, কিংশুক বোসের যথেষ্ট খুনের মোটিভ রয়েছে।
এরপর কী যেন হয়েছিল?
সবিস্ময়ে অনিন্দ্যসুন্দর আবিষ্কার করলেন, তাঁর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, ঠিক রাত এগারোটায়, স্টাডি-রুমে, হাতির দাঁতের হাতলওলা কাগজ-কাটার ছুরিতে তাঁকে খুন হতে হবে। তাছাড়া আর কিছুই তাঁর মনে পড়ছে না। দেবদূতের কাছ থেকে আরও কিছু খবরাখবর নিয়ে এলে ভালো হত।
কিন্তু অন্যদিকে ভাবতে গেলে, এই বেশ হয়েছে। ভবিষ্যতের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আগে থেকে দেখতে পেলে তিনি হয়তো শিউরে উঠতেন। আর, এভাবে তিনি বেশ খোলা মনে তদন্তের কাজ করতে পারবেন।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, তাঁর খিদে পেয়েছে। খাওয়ার ঘরে ঢুকে দেখেন, রাঁধুনি সীতার মা তার মেয়ে সীতাকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরির কাজে ইতি টানতে ব্যস্ত। সীতার মায়ের মোটাসোটা ঘামে ভেজা শরীরের দিকে তাকালেন তিনি। তার শ্রান্ত মুখটা তীক্ষ্ন নজরে জরিপ করলেন। ওদিকে মেয়ে সীতা মা-কে টুকিটাকি সাহায্য করতে ব্যস্ত। মেয়েটা বেশিরভাগই তাঁর স্ত্রীর ফাইফরমাশ খাটে। কিন্তু তাঁকে খুন করার মতো কোনও কারণ ওদের দুজনের মধ্যে খুঁজে পেলেন না অনিন্দ্যসুন্দর। তা ছাড়া প্রতিদিন রাতে ওরা বাড়ি চলে যায়। সুতরাং সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে ওদের দুজনের নাম তিনি স্থির বিশ্বাসে বাতিল করলেন।
‘তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নিন, বড়বাবু,’ সীতার মা পাঁউরুটি ও ডিমের পোচ তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘রান্নাবান্না সময়মতো শেষ করতে হবে। দুপুরে বৌদিমণি একজনকে নেমন্তন্ন করেছেন।’
‘কাকে?’
‘রণবিলাসবাবুকে।’
এইবার মনে পড়েছে! এ-ঘটনাও প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। রণবিলাস দত্ত। বিশাল চেহারার যুবক। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল।
‘গুডিমর্নিং, ডার্লিং।’
একটা ঠান্ডা চুম্বনের চকিত হালকা ছোঁয়ায় ঘুরে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। একটা তীক্ষ্ন চিন্তা বর্শার মতো হাওয়া কেটে ছুয়ে গেল তাঁর মনের ভেতর দিয়ে—এ-চুম্বন বিশ্বাসঘাতী। কিন্তু নম্রস্বরেই তিনি উত্তর দিলেন, ‘গুডমর্নিং, তৃণা।’ বিব্রত অপ্রস্তুত চোখে একবার দেখলেন সীতা ও তার মায়ের দিকে। ওরা তখন চলে যাচ্ছে রান্নাঘরে।
প্রাতরাশের দিকে ক্ষণেকের জন্য অমনোযোগী হয়ে নিজের স্ত্রীকে চোখের নজরে ব্যবচ্ছেদ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা চৌধুরী। আটাশের উগ্র যুবতী—প্রায় তাঁর অর্ধেক বয়েস। হাবেভাবে চলনে-বলনে যেন বিদেশি আধুনিকা। সর্বদা ভীষণ সেজেগুজে থাকে। তবে অপূর্ব সুন্দরী। সেই কারণেই ওকে বিয়ে করেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর। নিজের বয়েসের কথাটা খেয়াল করেননি। তৃণার চোখে দেখতে চেয়েছেন নিজের সর্বনাশ। তাঁর সাধের তৃণা। কিন্তু…।
‘রণবিলাস তা হলে দুপুরে খেতে আসছে?’
‘তোমার কি আপত্তি আছে, ডার্লিং?’
‘হ্যাঁ, আপত্তি আছে। একটা কপর্দকহীন ইয়াং অ্যাথলিট আমার বাড়িতে ঘুরঘুর করে বেড়াবে আর আমার বউয়ের দিকে হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকবে, তাতে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে।’
‘তোমার কল্পনাশক্তির তুলনা নেই, ডার্লিং!’
‘ওকে তুমি ভালোবাসো, তৃণা?’
‘মোটেই না।’
‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ, তৃণা। কাল আমি সব দেখেছি।’
অনিন্দ্যসুন্দর নিজেকে অবাক করলেন। কথাগুলো মুখ থেকে বেরোনোমাত্র, হঠাৎই তাঁর সব মনে পড়ে গেল। খুন হওয়ার উত্তেজনায় তিনি নিশ্চয়ই এসব ভুলে বসেছিলেন। এ সমস্ত ঘটনা হুবহু আগে একবার ঘটে গেছে!
‘বাগানে তোমাদের আমি দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ততটা অবাক হইনি। কারণ আগেও তোমরা কখনও তেমন সাবধান হওনি।’
তৃণার সমস্ত রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে, ও বসে পড়ল শ্লথ ভঙ্গিতে।
‘অবাক হলে, তৃণা? তা হলে একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। রণবিলাস দত্ত আজ দুপুরে নেমন্তন্ন খেতে এলে আমার একটুও আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কি, আমার পরামর্শ যদি শোনো, তা হলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর তোমরা দুজনে একটু আলোচনা করে দেখো। আমি যে তোমাদের ব্যাপার সব জানি, সে-কথা ওকে বলো। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করো কী করবে। এখন তোমার মাত্র দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমটা হল, আমাকে ছেড়ে রণবিলাসের সঙ্গে চলে যাওয়া। অবশ্য, এটা মনে রেখো, ওর পকেটে একটা ফুটো পয়সাও নেই, আর আমি নিজের পয়সা খরচ করে তোমাদের প্রেমকুঞ্জ বানিয়ে দেব, এ-আশা তুমি নিশ্চয়ই করো না। রণবিলাসের সঙ্গে উপোস করে-করে যখন তোমার সমস্ত শখ মিটে যাবে, তখন ইচ্ছে করলে আমার কাছে আবার ফিরে আসতে পারো। আর তোমার দ্বিতীয় পথ হল, এখানে থেকে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আমি চাইব তোমার বিশ্বাস, সততা। আর শ্রীরণবিলাস দত্তকে অন্য কোনও আস্তানা থেকে দু-বেলা দু-মুঠোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
অনিন্দ্যসুন্দর মনে-মনে ভাবলেন, এতেই রণবিলাস-অধ্যায়ের একটা হেস্তনেস্ত হবে। তৃণা শুধুমাত্র ভালোবাসা অবলম্বন করে বেঁচে থাকার মেয়ে নয়। আয়েস-স্বাচ্ছন্দ্যে থেকে-থেকে ওর অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে—প্রাচুর্য আর বিলাসিতা ওর জীবনের সঙ্গে আন্তরিকভাবে জড়িত। কিন্তু এই চূড়ান্ত নোটিস তিনি আগেও একবার দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিস তখন ভাবেননি। এখন ভাবছেন। তৃণার খুন করার মোটিভ।
সারাটা জীবনে লেখক হিসেবে যে-সুপ্রচুর অর্থ-প্রতিপত্তি তিনি অর্জন করেছেন, তার অর্ধেকের উত্তরাধিকারিণী এখন তৃণা। তাঁর উইলে সেই কথাই লেখা আছে। রণবিলাস যদি সে-কথা জানত! তাঁর তৃণা যদি সত্যিই ছেলেটাকে নিজের করে চায়, আর একইসঙ্গে তাঁর উইলে নিজের উত্তরাধিকারও বজায় রাখতে চায়, তা হলে ওর সামনে মাত্র একটা পথই খোলা আছে…।’
‘তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে তো?’ তৃণা তাঁকে প্রশ্ন করছে।
‘না,’ উদার স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘শুধু-শুধু তোমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তা ছাড়া, এই তো, এত বেলায় জলখাবার খাচ্ছি। তারপর কিছু দরকারি কাজও আছে।’
এরপর তৃণা চলে গেল। অনিন্দ্যসুন্দর তাকিয়ে রইলেন ওর অপস্রিয়মাণ তন্বী শরীরের দিকে। তারপর মনোযোগ দিলেন ডিম ও পাঁউরুটির প্রতি, দ্রুতহাতে প্রাতরাশ শেষ করলেন।
মধ্যাহ্নভোজের অতিথির জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজনের দায়িত্ব সীতার মায়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন ডাইনিংরুম থেকে।
এবার তিনি হাজির হলেন স্টাডি-রুমে—তাঁর রক্তে রঞ্জিত অকুস্থলে।
নিজের মরণ-কামরায় ঢুকে ভয় পেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। সমস্ত জানলায় পরদা টানা থাকায় গোটা ঘরটা ছায়াময় রহস্যে ছমছমে। অস্বস্তিভরে পরদাগুলো সরিয়ে দিলেন তিনি। সূর্যের আলো ঠিকরে এল ঘরের ভেতরে। এবার তিনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।
ওই তো তাঁর মজবুত মেহগনি কাঠের টেবিল। নিশ্চয়ই তিনি টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে ছিলেন। হয়তো, প্রায়ই যেমন ঘুমিয়ে পড়েন, সেরকমই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন—টেবিলে দু-হাত ছড়িয়ে এবং মাথা হাতের ওপরে এলিয়ে। সোজা কথায় খুনিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন। আর, ওই তো সেই কাগজ-কাটার ছুরিটা। অনিচ্ছাভরে ছুরিটা তুলে নিলেন তিনি, যেন ওটার ফলায় লেগে রয়েছে শুকনো কালচে রক্ত।
অবশ্য রক্ত থাকার কথা নয়…অন্তত এখন!
না, জিনিসটা খুনের এক কুৎসিত হাতিয়ার, মনে-মনে ভাবলেন অনিন্দ্যসুন্দর। ছুরির হাতলটা মসৃণ ভারি হাতির দাঁতের তৈরি, প্রায় ইঞ্চিচারেক লম্বা। খুনি যদি অসতর্ক হয়, তা হলে তার স্পষ্ট হাতের ছাপ রেখে যাবে এই ছুরির বাঁটে। চকচকে ফলাটা বেশ লম্বা—কিন্তু খুব ধারালো কিংবা ছুঁচলো নয়। তবে অব্যর্থ নিশানায় উপযুক্ত শক্তিতে প্রোথিত হলে কার্যসিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট—কোনও মানুষের হৃৎপিণ্ড সহজেই স্তব্ধ হবে।
শিউরে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
দরজায় কারও নক করার শব্দে তাঁর চিন্তার ঘোর বিচ্ছিন্ন হল। কোনওরকম আমন্ত্রণের অপেক্ষা না-করেই যে নক করেছে সে ঘরে ঢুকল।
‘ব্যস্ত আছ, সুন্দরকাকা?’
‘না, না। আয় অভী, ভেতরে আয়।’
অভীক ভেতরে ঢুকে লাফিয়ে উঠে বসল টেবিলের ওপর। ওর শরীরের ওজনে আর্তনাদ করে উঠল মজবুত মেহগনি টেবিল। অভীকের প্যাঁচার মতো ছোট-ছোট চোখ পুরু চশমার কাচের পিছন থেকে জুল-জুল করে চেয়ে রইল।
‘টাকা-পয়সার অবস্থা কীরকম, সুন্দরকাকা?’
‘এবার কত লাগবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
‘তিনহাজার।’
রিভলভিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। টেবিলের ওপরে বসা মাংসের স্তূপটিকে লক্ষ করতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, ‘অভী, আগেরবারই তো তোকে বলেছি, এভাবে তোর ধার-দেনা আর আমি শোধ করতে পারব না। অন্তত, যদ্দিন না তুই একটা চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছিস। সুতরাং আমার সোজা উত্তর হল, না।’
‘আমার অবস্থা খুব খারাপ, সুন্দরকাকা।’
‘সে তুই বুঝবি।’
‘তা কী করব বলবে তো?’
‘সেও তোর ব্যাপার।’
‘তা হলে আমাকে হুট করে যা-হোক একটা কিছু করতে হবে…।’
এই মন্তব্যে চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা ও কিংশুকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার মতো অভীকের সঙ্গে তাঁর এই আলোচনা আগেও একবার হয়ে গেছে! তাঁর সম্পত্তির বাকি অর্ধেকের উত্তরাধিকারী অভীক—না, অনিন্দ্যসুন্দর ভালোবেসে এই অংশ ওকে দেননি, তাঁর একমাত্র আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এই সম্পত্তি অভীকের প্রাপ্য। আর এখন সেই অকালকুষ্মাণ্ড ভাইপো তাঁর কাছে এসে টাকা চাইছে।
খুনের আরও একটা মোটিভ।
‘হুট করে কিছু…করে বসবি…এর…এর মানে কী, অভী?’
‘জানি না। কিন্তু তুমি টাকা না-দিলে যা-হোক একটা কিছু তো আমাকে করতে হবে—আর তার জন্যে পুরোপুরি দায়ী হবে তুমি।’
বিশাল স্তূপটা টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল দরজার দিকে, এবং নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে। এত মোটা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভাইপো অভীকের চলাফেরায় কেমন একটা চাবুকের ভঙ্গি রয়েছে। আশ্চর্য, কই আগে তো কখনও অনিন্দ্যসুন্দর এটা খেয়াল করেননি। অবশ্য, আজ তিনি এমন-এমন সব জিনিস আবিষ্কার করছেন, যা আগে কখনও লক্ষই করেননি।
জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ হঠাৎই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। না, এই মুহূর্তে ঘরটা তাঁর একটুও ভালো লাগছে না। বরং বাইরের খোলা হাওয়ায় একটু ঘুরে এলে কেমন হয়! তা ছাড়া শীতের মধ্যে রোদের আমেজটা ভালোই লাগবে—আর ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা-ভাবনারও প্রয়োজন আছে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
বাগানে এসে নির্জনতার পরিবর্তে হীরা সিংকে আবিষ্কার করলেন তিনি। বৃদ্ধ হীরা সিং বাগানের মালি, কেয়ারটেকার, ড্রাইভার—একাধারে সব, এবং কখনও-সখনও সীতা ও সীতার মায়ের অনুপস্থিতিতে রান্নাবান্নাও করে। এ ছাড়া হীরা সিংয়ের আরও-একটা পরিচয় হল, সে জেলখাটা কয়েদি। এখানে এসে অনিন্দ্যসুন্দরকে সে অনেক ভাবে সাহায্যও করেছে। মালিকের দেওয়া তরল নেশা গলায় ঢেলে ঘোরের মাঝে নিজের জীবনের বহু অপকীর্তির কথাই অনিন্দ্যসুন্দরকে শুনিয়েছে। আর অনিন্দ্যসুন্দর সেইসব কীর্তিকাহিনী টুকে নিয়েছেন নিজের ডায়েরিতে। বাড়িয়েছেন তাঁর প্লটের সঞ্চয়। তিনি জানতেন, এর কিছু-কিছু ঘটনা এখনও পুলিশের অজানা, এবং সেই অপরাধগুলোর জন্য কোনও শাস্তি পায়নি হীরা সিং। বহু জায়গাতে এখনও তার নামে হুলিয়া ঝুলছে।
এইমুহূর্তে প্লট সংগ্রহের মরজি অনিন্দ্যসুন্দরের ছিল না। কিন্তু হীরা সিংয়ের মনে বুঝি অন্য অভিসন্ধি ছিল।
‘নানা রকোম কোথা কানে আসছে, বড়েসাব।’
‘কী কথা, হীরা সিং?’
‘আপনার কিতাবের কোথা—।’
‘আমার বইয়ের কথা? কী হয়েছে আমার বইতে?’
‘শুনেছি কি আপনি আর কিতাব লিখবেন না?’
ও, কিংশুক দেখছি সবাইকে বলে বেড়িয়েছে! রমেন গুপ্তর চিঠির সারমর্ম তা হলে বাড়িতে আর কারও জানতে বাকি নেই। তৃণা জানে, রণবিলাস জানে, এমনকী অভীকও জানে।
‘সে-কথা যদি সত্যিও হয়, তা হলে তোমার কী আসে-যায়, হীরা সিং? চাকরি খোয়া যাবে?’
আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাল বৃদ্ধ হীরা সিং। প্রখর সূর্যের আলোয় তার কুৎসিত চেহারা আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে। সে উত্তর দিল, ‘নোকরির কোথা ভাবছি না, বড়েসাব, ভাবছি আপনাকে যে-সব কহানী সুনিয়েছি তার কোথা। যতোদিন আপনি কিতাব লিখছিলেন, ততোদিন সব ঠিক ছিল। কিন্তু আভি কিতাব লিখা বন্ধো হয়ে গেলে, আপনি হয়তো পুলিশের সাথে বাতচিত করতে পারেন। তাদের বোলতে পারেন আমার পুরানা কিসসার কোথা—।
‘সে আমি কেন বলতে যাব, হীরা সি? তুমি কবে কী করেছ, তাতে আমার কী? তুমি এখন ভালো হয়ে গেছ, আমার এখানে চাকরি করছ, সৎভাবে জীবনযাপন করছ।’
‘পুলিশ ওসব শুনবে না।’
‘আমি তো আর পুলিশকে কিছু বলতে যাচ্ছি না…হীরা সিং, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
স্পষ্টই বোঝা গেল বিশ্বাস সে করেনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুড়ো লোকটা কোদাল দিয়ে আবার মাটি কোপাতে লাগল। তার কোদাল চালানোর ভঙ্গি বলিষ্ঠ, ক্ষিপ্র, নিখুঁত। আর ভাঁজ-পড়া মুখ অন্ধকার এবং ভয়ঙ্কর।
অদ্ভুতভাবে অনিন্দ্যসুন্দরের আবার মনে পড়ল, এসবই আগে একবার ঘটে গেছে। নিজের বাগানে কবর খুঁড়ে এইমুর্হতে তিনি আবিষ্কার করেছেন এক ভয়ঙ্কর সম্ভাব্য খুনিকে।
স্টাডি-রুমে টেবিলের কাছে আবার ফিরে এলেন তিনি, শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন চেয়ারে। আশ্চর্য, প্রথমবারে যখন জীবনের শেষ দিনটা এইভাবে তিনি কাটিয়েছিলেন তখন তো এসব কথা তাঁর মনে আসেনি! তখন কেন বুঝতে পারেননি, তাঁকে ঘিরে রয়েছে এমন সব ভয়ঙ্কর মানুষেরা, যারা তাঁর মৃত্যুতে লাভবান হবে? একমাত্র সীতা আর সীতার মা ছাড়া তাঁকে খুন করবার উপযুক্ত মোটিভ প্রত্যেকেরই রয়েছে। এবং তাদের অন্তত একজনের সে-কাজ সম্পন্ন করবার দুঃসাহসও রয়েছে।
টেলিফোন বেজে উঠল। কোনওরকম চিন্তা-ভাবনা না-করেই অনিন্দ্যসুন্দর টেলিফোনটা তুলে নিলেন।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ও…বলুন।’
‘কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি, মিস্টার চৌধুরী? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মুষড়ে পড়েছেন?’
‘ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘দুজন ঠিকে কাজের লোক ছাড়া আমার বাড়ির প্রত্যেকে আমি মরলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।’
‘এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘নেই?’
‘যদি বোঝেন পৃথিবীতে কেউ আপনাকে চায় না, তা হলে এখানে ফিরে আসতে আপনার একটুও দুঃখ হবে না।’
‘হুম। ঠিকই বলেছেন।’
‘আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো, মিস্টার চৌধুরী?’
‘সত্যি বলতে কি, একটা অসুবিধে হচ্ছে। কোনও সূত্র এখনও পাইনি।’
‘খোঁজার চেষ্টা করুন।’
‘সেইখানেই তো হয়েছে বিপদ। এমনিতে আমার বইয়ে—কিংবা বাস্তবেও—সূত্র পাওয়া যায় খুনের পরে, আগে নয়। খুন করার পরেই খুনি সমস্ত সূত্র ফেলে যায়। এবার বলুন, এখন তা হলে আমি কী করি?’
‘আমি কী-করে বলব, মিস্টার চৌধুরী? এখান থেকে রওনা হওয়ার আগে সে-কথা আপনার ভাবা উচিত ছিল।’
‘সেটা করলেই বোধহয় ভালো হত।’
‘এখন চুপচাপ বসে রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আপনার উপায় নেই। তা হলে তখনই দেখা হবে। চলি।’
ফোন নামিয়ে রেখে ফ্রিজ থেকে সামান্য হুইস্কি আর সোডা নিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। দুর্ভাবনার সময় মদ তাঁকে স্বস্তি এবং শান্তি দেয়। এখন দেবে কি না কে জানে!
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল চারটে। তাঁর নির্ধারিত পুনর্জীবনের পাঁচ ঘণ্টা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। মাত্র আর সাত ঘণ্টা বাকি। বিষণ্ণ মনে জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে।
খুন করার পক্ষে উপযুক্ত রাত।
এইভাবে, আকস্মিক এক দুর্ঘটনাচক্রে, জানলায় আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা এবং রণবিলাস। তরুণ অ্যাথলিট রণবিলাস তাঁর স্ত্রীকে অটুট মনোযোগে চুম্বন করতে ব্যস্ত।
সেইমুহূর্তে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর মনের গভীরে জন্ম নিল এক নতুন প্রতিজ্ঞা।
সাধারণ আবেগতাড়িত মানুষের মতো জানলার কাচে ঘুষি বসালেন না তিনি, মাথার চুলও ছিঁড়লেন না। পরিবর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। ইতিমধ্যে চুম্বন-অধ্যায় শেষ করে রণবিলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দরের এই প্রশান্তির কারণ, তাঁর মনে এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ক্রমে চেহারা নিয়েছে।
একটু পরে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন তিনি। সীতার মাকে উদ্দেশ্য করে সরবে ঘোষণা করলেন, ‘সীতার মা, রণবিলাসবাবু রাতে খেয়ে যাবেন। সেইসঙ্গে কিংশুক এবং অভীকও। আর হীরা সিংকে বোলো, রাতের খাবার যেন সে-ই পরিবেশন করে।’
কিংশুকের ঘরে পৌঁছে তিনি দেখেন, সে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে।
‘সুটকেসটা এখন রেখে দাও, কিংশুক।’
‘কিন্তু আপনিই তো আমাকে চলে যেতে বলেছেন।’ তাঁর সেক্রেটারি গম্ভীর মুখে জবাব দিল।
‘তা বলেছি। কিন্তু আমার ইচ্ছে, আজকের রাতটা তুমি থেকে যাও। তাতে তোমার ভালোই হবে, কিংশুক।’
অভীক চৌধুরী তখনও দিবানিদ্রায় অচেতন ছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন।
‘আজ রাতে তোর কোথাও যাওয়ার থাকলে, ক্যান্সেল কর, অভী। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। তাতে তোর লাভই হবে।’
এবার অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিত হলেন বাগানে।
‘দুপুরে আপনার সঙ্গে খেতে বসতে পারিনি বলে মাপ চাইছি, রণবিলাসবাবু,’ তৃণার ঠোঁটে চুমু এঁকে দেওয়া শিল্পীকে লক্ষ করে বললেন তিনি, ‘কিন্তু রাতে আপনাকে না-খাইয়ে ছাড়ছি না।’
রণবিলাসের সুন্দর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কিন্তু দ্বিধাভরা অস্ফুট স্বরে সে বলল, এ তো তার সৌভাগ্য। আর তৃণা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।
গোপন উত্তেজনায় ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যদি তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়…।
নৈশভোজপর্ব শুরু হল রাত ঠিক সাড়ে আটটায়।
অন্ধকার এবং শীতের তীব্রতা এখন চরম অঙ্কে। সীতা ও সীতার মা চলে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে অপ্রত্যাশিত অঝোর বৃষ্টি। এখনও থামেনি। হীরা সিং নীরবে পরিবেশন করছে। তার মুখে করাল ছায়া থমথম করছে।
একমাত্র অনিন্দ্যসুন্দরই খুশি মনে খেয়ে চলেছেন। অন্যেরা যান্ত্রিকভাবে হাত ওঠা-নামা করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের মন অন্য দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। তৃণার চঞ্চল চোখ থেকে-থেকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে রণবিলাসের মুখ, আর রণবিলাসও সে-দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে। কিংশুকের শুকনো মুখ ভাবলেশহীন এক মুখোশ। সেই মুখোশ চিরে মাঝে-মাঝে ঝিলিক মারছে বিরূপ মনোভাবের ইশারা। সাধারণত অভীকের খাওয়া ‘পেটুক’ আখ্যা দেওয়ার মতো, কিন্তু আজ তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। চোরা দৃষ্টিতে সকলেই অনিন্দ্যসুন্দরকে লক্ষ করছে।
নটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হল। উঠে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন: ‘ঘণ্টাখানেক পরে তোমরা সবাই স্টাডি-রুমে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বিশেষ কিছুই না, বিদায় দেওয়ার আগে সকলের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করা—অনেকটা ফেয়ারওয়েল পার্টির মতো।’
এই সাংকেতিক মন্তব্যে সকলেই নিষ্পলক চোখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর, একটা সুটকেস গুছোতে শুরু করলেন। দু-জোড়া মোজা সবে সুটকেসে ভরেছেন, টেলিফোন বেজে উঠল।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ভাবছিলাম, আপনি বোধহয় এখুনি ফোন করবেন।’
‘শেষ কয়েকটা ঘণ্টা ধরে দেখছি, আপনার মেজাজ একদম পালটে গেছে।’
‘হ্যাঁ তা গেছে।’
‘ওই সুটকেস নিয়ে কোথায় চলেছেন?’
‘একটু পরেই তো আমাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই না?’
‘এখানে বাড়তি মোজার দরকার নেই, মিস্টার চৌধুরী। সবকিছুই আমরা দিয়ে দিই।’
‘আপনি আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছেন—।’
‘আমার গোয়েন্দাগিরি করবার দরকার হয় না।’
‘আপনি কি ভাবছেন, আপনাকে আমি ঠকাব—ফাঁকি দেব?’
কোনও উত্তর নেই। টেলিফোন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই একরকম স্পষ্ট উত্তর। দেবদূত চিন্তায় পড়েছে। যদি ঠকানোর কথায় সে দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকে, তা হলে তাকে ঠকানো নিশ্চয়ই সম্ভব! গোছগাছ করতে-করতে চাপা হাসিকে প্রশ্রয় দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সুটকেসে দিনকয়েকের মতো জামা-কাপড় ভরে নিলেন তিনি। টুথব্রাশ ও শেভিং কিট নিতেও ভুললেন না। একটা দেওয়াল-সিন্দুকের কাছে গিয়ে সেখান থেকে দশ হাজার টাকা বের করে নিলেন। এটা তাঁর বিপদের সঞ্চয়। ড্রেসিং-টেবিলের ড্রয়ার থেকে তুলে নিলেন নিজের অটোমেটিক পিস্তল—পরীক্ষা করে দেখলেন গুলি ভরা আছে কি না। হ্যাঁ, আছে। এই অটোমেটিক পিস্তল তাঁর অতিরিক্ত জীবনবীমা।
কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি নীচে নামলেন না। সন্দেহভাজনদের তিনি উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখতে চান। তিনি জানেন, ওরা অপেক্ষা করবে। বিশেষ করে খুনি, সে…তাকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। নরম সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, মুখে ধূমায়িত পাইপ, মনে ভবিষ্যতের নতুন পরিকল্পনা।
প্রায় সওয়া দশটা নাগাদ সুটকেস হাতে নীচে স্টাডি-রুমে এলেন তিনি। উপস্থিত হলেন তৃণা ও অতিথিদের সামনে। আবিষ্কার করলেন, ওরা প্রত্যেকেই তাঁর পছন্দমাফিক কম-বেশি বিচলিত। কিংশুকের ফরসা মুখে লালচে আভা। অভীক বদমেজাজি শুয়োরের মতো মুখ কালো করে এককোণে বসে আছে। একটা সেটিতে নির্লজ্জভাবে ঘন হয়ে বসে আছে তৃণা ও রণবিলাস। আর বৃদ্ধ হীরা সিং বাইরের বারান্দায় থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ভেতরে ডেকে নিলেন। তারপর পকেট থেকে একটা তালা ও চাবি বের করে ঘরের দরজায় ভেতর থেকে তালা দিয়ে দিলেন। এবার তিনি এসে বসলেন নিজের মেহগনি-টেবিলে—ওদের মুখোমুখি।
‘তোমাদের কেউ কি আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছ,’ বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘যেদিনটা আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শেষ হয়ে যাবে?’
ওরা স্বাভাবিকভাবেই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কয়েকমুহূর্ত তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিল বাড়ির গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার ধারাবাহিক শব্দ, এবং কখনও-কখনও বজ্রপাতের তীব্র সংঘাত।
‘কীসব বলছ, ডার্লিং, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ তাঁর স্ত্রী তৃণা। ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এক-পা এগিয়ে এসেছে।
শীতল দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করলেন তিনি। ওর পরনে আঁটোসাঁটো স্বচ্ছ জাপানি জর্জেট শাড়ি। সুগভীর নাভির ওপরে ও নীচে তিন ইঞ্চিব্যাপী মসৃণ ত্বক উন্মুক্ত। ব্লাউজের আকৃতি ও প্রকৃতি দেখে মনে হয়, শুধুমাত্র তৃণার শরীরের গঠন সেটাকে স্বস্থানে বজায় রেখেছে। এসবই নিঃসন্দেহে রণবিলাস দত্তের উপকারের জন্য।
‘বোসো, তৃণা, উত্তেজিত হোয়ো না।’ তাঁর স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে তৃণা পিছিয়ে গেল, ‘ভেবেছিলাম, অন্য কেউ না-পারলেও তুমি হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ করবে। মেয়েদের সহজাত ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে।’
‘কী লক্ষ করব, অনিন্দ্য?’
‘আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত ব্যাপার তুমি খেয়াল করোনি? একবারও তোমার মনে হয়নি, আজ সারাদিন ধরে তুমি যা-যা করছ, বলছ, সবই তোমার খুবই চেনা? হুবহু এসব কাজ তুমি আগেও একবার করেছ, বলেছ এই একই কথা?’
মুখভাবে স্পষ্টতই বোঝা গেল উপস্থিত সবাই তাঁকে মাতাল ভাবছে, কিংবা ভাবছে তিনি ওদের সঙ্গে রসিকতা করছেন।
একচিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে বলে চললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘গতকাল রাতে আমি…না, হয়তো কাল রাতে নয়। কারণ, মরণোত্তর জগতে সময়ের হিসেব রাখা খুব শক্ত—অবশ্য আমি সেখানে খুব বেশিক্ষণ ছিলাম না, সুতরাং আমার বিশ্বাস, হয়তো কাল রাতেই হবে। কাল রাতেই আমি খুন হয়েছি।’
এক রুদ্ধশ্বাস অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তৃণার ঠোঁট চিরে।
‘বাঃ, তোমার তা হলে মনে পড়েছেন সোনা?’ প্রশ্ন করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘মনে পড়েছে?’
অর্থাৎ, অনিন্দ্যসুন্দর কী বিষয়ে কথা বলছেন, সেটা তৃণা একটুও বুঝতে পারছে না। ওর মুখভাব দেখে তাঁর মনে হল, না, অভিনয় নয়। তিনি অন্যান্যদের দিকে তাকালেন, ওরা সকলেই অবাক অবুঝ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
সুতরাং তিনি খুলে বললেন। বললেন, সূর্যকান্তের কথা, কেন তিনি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন, সেই কথা। ওরা গভীর মনোযোগে শুনল, মাঝে-মাঝে এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল।
তাঁর কাহিনি শেষ হলে অভীক বলে উঠল, ‘সুন্দরকাকা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখাও।’
‘রমেন গুপ্ত বলেছে আপনার কিছুদিন বিশ্রামের দরকার,’ প্রতিহিংসার ব্যঙ্গে তীক্ষ্ন হল কিংশুকের কণ্ঠস্বর, ‘এখন দেখছি ঠিকই বলেছে!’
‘এ নেহাত পাগলের আড্ডাখানা!’ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত: ‘আমি চললাম।’
‘বোসা সবাই।’ পকেট থেকে অটোমেটিকটা বের করে উঁচিয়ে ধরলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর অভিব্যক্তিতে স্থির প্রতিজ্ঞা।
ওরা সবাই আবার বসল। একইসঙ্গে টেলিফোন বেজে উঠল।
অনিন্দ্যসুন্দর ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্তে কেউ বলতে শুরু করল, ‘কী হচ্ছে এসব, মিস্টার চৌধুরী?’
‘নিতান্তই সস্তা প্যাঁচ,’ সহজ সুরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘সব রহস্য উপন্যাসেই এরকমটা হয়। একেবারে শেষ পরিচ্ছেদে ডিটেকটিভ সন্দেহভাজন সকলকে একটা ঘরে জড়ো করে। তারপর নিজের তদন্তের কাহিনি শোনায়, আর তখন খুনি সাধারণত নিজের দোষ স্বীকার করে, কিংবা বেহিসেবি হয়ে ধরা পড়ে যায়। আপনাকে ওই খাতায় শুধু একটু মোছামুছি করতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আপনার কথাই বিশ্বাস করলাম, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার হাতে আর মাত্র কুড়িমিনিট সময় আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর ফোন নামিয়ে রাখতেই রণবিলাস মন্তব্য করল, ‘নিশ্চয়ই ওই দেবদূত ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’ অনিন্দ্যসুন্দর বললেন।
রণবিলাস চুপ করে গেল।
‘আমার হাতে যে আর সময় বেশি নেই, সেটাই সে মনে করিয়ে দিল।’ অনিন্দ্যসুন্দর বলতে শুরু করলেন, ‘যাই হোক, আমার গল্প তোমাদের বিশ্বাস হয়নি মানলাম, কিন্তু এবারে আমি তথ্যের দিকে নজর দেব। আশা করি, সেগুলো তোমরা বিনা বিতর্কে মেনে নেবে। এই ঘরে তোমরা পাঁচজন রয়েছ। এবং পাঁচজনের প্রত্যেকেই মনে-মনে চাও, আমার মৃত্যু হোক। কিন্তু তার মধ্যে একজন সেটা এত বেশি করে চায় যে, সে—খুন করতেও পেছপা হবে না।
‘এই যে আমার প্রিয় ভাইপো অভীক। দেনায় ও গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ-দেনার হাত থেকে ওর রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশা, আমার উইলের উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু অর্থ লাভ করা। মানছি, অভীকের টাকার প্রয়োজনটা এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি যদি মারা যাই, তা হলে উইলের প্রবেট নেওয়া হবে, আর ওর পাওনাদাররাও সাময়িক ধৈর্য ধরবে।
‘তারপর রয়েছে কিংশুক, আমার প্রাক্তন সেক্রেটারি। কিংশুকের ধারণা, আমি পথ থেকে সরে গেলে, সুন্দর সান্যালের উন্নতি ও খ্যাতির দায়িত্ব সে একাই নিতে পারবে। আগামীকাল আমার প্রকাশক দেখা করতে আসছে, আর সেটাই হল কিংশুকের মস্ত সুযোগ—যদি আমি মারা যাই, তবেই।
‘এবার আসছে হীরা সিং। ওর বিশ্বাস, আমি লেখা ছেড়ে দিলে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। কারণ তখন ওর অতীতের কীর্তিকলাপ আমার গল্পে আর কাজে আসবে না।
‘সবশেষে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী তৃণা এবং ওর বন্ধু শ্রীযুক্ত রণবিলাস দত্ত। রণবিলাসবাবুর হাতে যদি সুপ্রচুর অর্থ থাকত, তা হলে তৃণা কবে আমাকে ছেড়ে চলে যেত। আমার সম্পত্তির অর্ধেক যদি ও হাতে পায়, তা হলে আমার কাছে যেমন সুখ-প্রাচুর্যে ছিল, সেরকম ভাবেই ওর জীবন কাটাতে পারবে। সুতরাং ওদের একজনের হয়তো মনে হতে পারে, আমাকে খুন করাটা জরুরি।’
‘তোমার মনমেজাজ দেখছি ভালো নেই, সুন্দরকাকা।’ অভীক শান্ত স্বরে বলল।
‘মনমেজাজ ভালো নেই, তবে মাথার ঠিক আছে, অভী। এটা হল আমার কাগজ-কাটার ছুরি। হিসেব মতো, এই টেবিলে বসে আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক এগারোটায় খুনি—তোদের পাঁচ জনের একজন—এই কাগজ-কাটা ছুরিটা নিয়ে আমার পিঠে বসিয়ে দেবে, আমাকে খুন করবে।’
কিংশুক এখন ভীষণ মনোযোগে সব শুনছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অদ্ভুত রহস্য ওকে মুগ্ধ করেছে। ও বলে উঠল, ‘মিস্টার চৌধুরী, ধরে নিলাম, আপনি যা-যা বললেন সব সত্যি। কিন্তু আপনি কি সময়মতো টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে খুনিকে খুন করার সুযোগ দেবেন?’
‘কক্ষনও না, কিংশুক, কক্ষনও না। যখন আমি জেনেই ফেলেছি যে, আমি খুন হব, তখন চট করে ঘুমিয়ে পড়াটা কী খুব সহজ হবে? আমার তো মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে ঘুম পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব, কি বলো?’
‘তা হলে আর প্রথমবারের মতো ঠিক এগারোটার সময় আপনার খুন হওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।’
‘এগজ্যাক্টলি, কিংশুক। এই রহস্যের আসল অর্থটা তুমি নির্ভুলভাবে ধরতে পেরেছ। না, খুনটা এখন প্রথমবারের মতো নিয়ম মেনে আর হতে পারে না। খুনের পদ্ধতির সামান্য এদিক-সেদিক করতেই হবে। অবশ্য তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, দেবদূত বলেছিল, প্রয়োজন হলে তার খাতায় একটু-আধটু মোছামুছি করে নেবে।’
ঘরের প্রত্যেকে অধীর কৌতূহলে প্রতিটি কথা শুনছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, পরিস্থিতির বৈচিত্র্য ওদের সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
‘মিস্টার চৌধুরী,’ কিংশুক বলে চলল, ‘কী করে যে আপনি নিজের খুনের তদন্ত করবেন, সেটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সাধারণত আমাদের বইতে—মানে, আপনার বইতে—খুন হয়, খুনি সূত্র ফেলে যায়, এবং তারও পরে ডিটেকটিভ এসে তার কাজ শুরু করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন সূত্র ধরে আপনি এগোবেন? একটা সাদামাটা উদাহরণ আপনাকে দিই—ওই কাগজ-কাটা ছুরিতে খুব সুন্দর হাতের ছাপ পড়বে, কিন্তু খুন করার আগে তো খুনি সে-হাতের ছাপ ফেলবে না। আর যখন ফেলবে, তখন আপনার তদন্তের পক্ষে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
‘ভালো সমস্যা তুলে ধরেছ, কিংশুক। আমার সঙ্গে থেকে-থেকে তোমার উন্নতিই হয়েছে দেখছি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, একেবারে প্রথমে এই অসুবিধেটার কথা আমার মনে পড়েনি। সত্যিই তো, খুন হওয়ার আগে সেই খুনের সমাধান আমি করব কেমন করে?’
‘আর তোমার হাতে মাত্র দশমিনিট সময় আছে, সুন্দরকাকা।’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল অভীক।
‘বড়েসাব, আপনি কি ভাবছেন, খুন করবার আগে খুনি সব কবুল করবে?’ এ-প্রশ্ন এল হীরা সিংয়ের কাছ থেকে।
‘তা হয়তো করতে পারে,’ সুষম কণ্ঠে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু সে-ভরসায় আমি বসে নেই।’
‘তা হলে আপনি এভাবেই বসে অপেক্ষা করবেন—দেখবেন, খুনি আপনাকে আক্রমণ করতে আসছে। তখনই খুনিকে চিনতে পারবেন এবং আপনার কৌতূহলও মিটে যাবে।’ এ-প্রস্তাব রণবিলাস দত্তের।
হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যেন বন্ধুমহলে কোনও তর্কের উত্তরে বলছেন এমন সুরে জবাব দিলেন, ‘না, তা নয়। সেরকম সাহস আমার নেই, রণবিলাসবাবু, যে শান্তভাবে টেবিলে বসে দেখব, খুনি এসে আমার পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, এবং তারপর, তার ছুরির সামনে নিজেকে উৎসর্গ করব।’
‘তা হলে আর কী পথ আছে, আমি তো বুঝতে পারছি না।’ বিরক্ত তীক্ষ্ন স্বরে তৃণা বলল।
‘সত্যিই তো, তুমি বুঝবে কেমন করে। মন দিয়ে শোনো, স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলছি। এতক্ষণে এটুকু নিশ্চয়ই আঁচ করেছ, একটা মতলব আমার মাথায় আছে। সূর্র্যকান্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করব না—কারণ সে আমার সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেছে—এমনকী এই মাঝরাতে আমার এই স্টাডি-রুমে এসে পর্যন্ত আমার ওপর নজর রাখছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, খুনটা মোটেই আর হবে না!’
নিজেদের হতাশা ওরা গোপন রাখতে পারল না। অনিন্দ্যসুন্দর আবার হাসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘এগারোটার পরে দেবদূতের কাছে আমার আর কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না। নিয়মিত ছকে তার নির্ধারিত সময়টা খুনি কাজে লাগাতে পারছে না, ফলে আমি বেঁচেই থাকব—বহু বছর বাঁচব। কিন্তু যেহেতু তোমাদের আসল পরিচয়টা এখন আমার কাছে স্পষ্ট, সেহেতু এই বাড়িতে আর একটা দিনও আমি থাকব না। দেখতেই পাচ্ছ, আমার সুটকেস গুছিয়ে নিয়েছি! এ-জায়গা ছেড়ে আমি চলে যাব দূরে—বহুদূরে। তারপর, কী-করে, তৃণা, তোমাকে, আর অভী, তোকে, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়, সে-ব্যবস্থা আমি করছি। আর লেখক হিসেবে আমার ভবিষ্যতের কথা যদি তোল, তা হলে বলে রাখি, আজকের এই ঘটনা নিয়ে একটা নতুন বই লেখার কথা আমার মাথায় এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কাহিনির অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য সুন্দর সান্যালের টলে যাওয়া আসনকে আবার নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। তুমি তোমার নিজের পথ বেছে নাও, কিংশুক। আর হীরা সিং, একজন দায়িত্বশীল আইন-মেনে-চলা নাগরিক হিসেবে আমাকে আমার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’
আরও একবার হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সন্দেহের ছায়ায় আবৃত পাঁচটি মানুষই নিস্পন্দ, নীরব। দেওয়াল-ঘড়িতে এগারোটা বাজতে ঠিক সাত মিনিট বাকি।
বৃদ্ধ হীরা সিংই প্রথম মুখ খুলল, ‘বন্দুক দেখিয়ে এইভাবে আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখছেন, বড়েসাব? তা হলে ওই চাকু দিয়ে কোই ভি আপনাকে খুন করতে পারবে না। আপনি শেষ পর্যন্ত দেবতার সোঙ্গে বেইমানি করবেন?’
‘বেইমানি আমি করব না।’ শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘তোমাদের বন্দুক দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।’ নিজের বক্তব্য যেন প্রমাণ করতেই পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি: ‘আমার পরিকল্পনা অনেক সহজ-সরল, তাতে বন্দুক-ছুরির কোনও ব্যাপার নেই।’
‘সে-পরিকল্পনাটা কী আমরা জানতে পারি?’ কিংশুক দাবি করল।
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এইতো আমি, নির্ধারিত জায়গায় নির্ধারিত সময়ে চুক্তিমতো বসে আছি। আর একইসঙ্গে, আমাকে যারা খুন করতে পারে, তাদেরও আমি এখানে হাজির করেছি। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?’
‘এর মধ্যে কোথাও একটা চালাকি আছে।’ তাঁর ভাইপো বলে উঠল।
‘থাকাই তো উচিত, অভী। তোদের পাঁচজনের একজন হচ্ছে খুনি। এবার খুনি মহোদয়, আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে। ঠিক এগারোটায় আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে খুন করতে পারেন—এই উজ্জ্বল আলোয়, আমাকে বাদ দিয়েও চার-চারজন সাক্ষীর সামনে। সেক্ষেত্রে পুলিশের হাতে আপনাকে ধরা পড়তেই হবে, কারণ আমি হলফ করে বলতে পারি, বাকি চারজন জঘন্য চরিত্রের মানুষ আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে ভয়ঙ্কর ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু দ্বিতীয় একটা পথও আপনার আছে আমাকে খুন করার সুযোগটা আপনি ছেড়ে দিতে পারেন। সুতরাং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দায়ী হচ্ছেন আপনি নিজে, এবং সূর্যকান্তের সঙ্গে কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা আমি করছি না। এগারোটা বেজে একমিনিটে এই বাড়ি ও তোমাদের জীবন ছেড়ে আমি চিরদিনের মতো চলে যাব।’
সশব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘হ্যালো দেবদূতসাহেব—কী ব্যাপার?’
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন! দেবদূত বলে উঠল।
‘উঁহু, মোটেই না। খুনিকে বের করার এটাই হচ্ছে একমাত্র পথ। খুনের আগে কোনও সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়, এবং খুনের পরে আমি আর বেঁচে থাকছি না। যদি খুনি নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আমাকে খুন করবে না, তা হলে আপনি আমাকে দোষ দিতে পারেন না।’
‘আপনি খুব চালাক, মিস্টার চৌধুরী!’
‘ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু সেরকম চালাক নন। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, রাত এগারোটায় খুনিকে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে—আপনার মতো তাকেও সময় দেওয়া রয়েছে। সুতরাং তার একটা পালটা মতলব থাকতে পারে।’
টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। এ-কথা তিনি একবারও ভাবেননি। মনোযোগী দর্শকদের কাছে তাঁর টলে যাওয়া আত্মবিশ্বাস গোপন রইল না।
‘কটা বাজে?’ অভীক প্রশ্ন করল। ও চোখে ভালো দেখতে পায় না।
‘এগারোটা বাজতে তিন।’ দেওয়াল-ঘড়ির সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিংশুক বোস।
একটা ভারী নিস্তব্ধতা ঘরে জাঁকিয়ে বসল। তৃণা ও রণবিলাস চকিত দৃষ্টি বিনিময় করল। অন্যান্যরা অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে। ওদের অবিশ্বাসী অভিব্যক্তি এখন পুরোপুরি অদৃশ্য। আর ওদেরই মাঝে বসে খুনি মনে-মনে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত, লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ঘরের দরজার কাছে। ওর চলার শিকারি চিতার ক্ষিপ্রতা এবং এতটুকু পায়ের শব্দ নেই। সতর্ক হয়ে ওকে লক্ষ করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, অনুভব করলেন অটোমেটিকের স্পর্শ।
দরজার কাছে গিয়ে থামল রণবিলাস, চকিতে ঘুরে দাঁড়াল।
‘মিস্টার চৌধুরী একটা কথা ঠিকই বলেছেন,’ রণবিলাস দত্ত ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করল, ‘অন্যান্যদের চোখের সামনে খুনি যদি খুন করে, তা হলে তাঁরা সাক্ষী দিতে পারবে। এবং তাঁদের নিরাপত্তা পুরোপুরি বজায় থাকবে। কিন্তু যদি সকলের চোখ এড়িয়ে খুনটা করা যায়, তা হলে? তখন কেউই সঠিক বলতে পারবে না, কে খুন করেছে। এ-কথা সত্যি যে, আমাদের প্রত্যেকেরই খুনের মোটিভ রয়েছে, আমাদের সবাইকেই পুলিশ সন্দেহ করবে—এমনকী এরকমভাবেও তারা কেস সাজাতে পারে যে, আমরা পাঁচজনে মিলে প্ল্যান করে মিস্টার চৌধুরীকে খুন করেছি। কিন্তু পুলিশ যদি এই ঘরোয়া বৈঠকের কথা একেবারেই না জানতে পারে? তা হলে আমাদের কারওরই কোনও ভয় নেই, আর খুনি ঠিক প্রথমবারের মতোই আইনের চোখে ধুলো দেওয়ার একই ঝুঁকি নেবে। শুধু যা করতে হবে, তা হল, কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষী না-রেখে রাত ঠিক এগারোটায় মিস্টার চৌধুরীকে খুন করতে হবে।’
এগারোটা বাজতে একমিনিট।
‘কিন্তু সেটা খুনি করবে কীভাবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী তীব্র স্বরে জানতে চাইলেন, কিন্তু সবিস্ময়ে উপলব্ধি করলেন, তাঁর গলার স্বর কাঁপছে, ‘একঘর লোকের সামনে প্রত্যক্ষ সাক্ষী না- রেখে কী করে আমাকে খুন করবে সে?’
রণবিলাস দত্ত হাসল। ঘোরতর শত্রুর হাসি।
‘কেন, সে তো খুব সহজ,’ উত্তর দিল সে, ‘শ্রীযুক্ত সুন্দর সান্যাল, রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের প্রখ্যাত লেখক, এটা কী করে আপনার চোখ এড়িয়ে গেল বলুন তো? আমাকে কাজের কাজ যা করতে হবে, তা হল, টুক করে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেওয়া!’
অনিন্দ্যসুন্দর কিছু করে ওঠার আগেই রণবিলাসের আঙুল পৌঁছে গেল আলোর সুইচে। অন্ধকার নেমে এল চকিতে, অস্তিমান রইল। যে-বিদ্যুতের ঝলক এতক্ষণ প্রায় ধারাবাহিকভাবে আলোর বর্শা নিক্ষেপ করে চলেছিল, এখন, এইমুহূর্তে, উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্তের মতো স্তব্ধ হল। উত্তাল আক্রোশে বাইরের দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দে লোপ পেল সমস্ত পায়ের শব্দ।
নিজের পরিচয় অজ্ঞাত রেখে চলাফেরায় খুনির আর কোনও অসুবিধে নেই!
বিস্ময়ে সাময়িকভাবে বিমূঢ় হয়ে না-পড়লে অনিন্দ্যসুন্দর হয়তো কিছু করতেন। কিন্তু তিনি নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে।
কেউ একজন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত তাঁর মাথাটা ঠেলে দিল সামনে, টেবিলের ওপর। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে ঠিক যেমনটা হত। অনিন্দ্যসুন্দর বুঝলেন, অন্য হাতটা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে কাগজ-কাটা ছুরিটা…খুঁজে পেল…শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল।
আঘাতটায় সেরকম যন্ত্রণা অনুভব করলেন না তিনি।
আবছাভাবে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, যে-হাতটা তাঁর মাথাটা টেবিলে ঠেলে ধরেছিল, সেটা এখন তাঁর প্যান্টের বাঁ-পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছে, তুলে নিচ্ছে তাঁর রুমালটা…এবার খুনি ছুরির হাতল থেকে মুছে ফেলছে তার আঙুলের ছাপ…।
অনিন্দ্যসুন্দরের মাথার মধ্যে যেন তীক্ষ্ন শব্দে ঘণ্টা বেজে চলেছে…।
নাকি সেটা টেলিফোন বেজে ওঠার শব্দ…।
‘সুস্বাগতম, মিস্টার চৌধুরী। একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ফিরে এসেছেন।’
সূর্যকান্তের টেবিলের সামনে সোনার সিংহাসনে শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘পৃথিবীতে কেমন কাটালেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘আমি আবার খুন হয়েছি!’
‘নিশ্চয়ই!’
‘কে খুন করেছে আমাকে?’
দেবদূত সশব্দে হেসে উঠল। সেই হাসিতে গমগম করে উঠল শ্বেতপাথরে অলঙ্কৃত প্রাসাদ।
‘সেটা জানতেই তো আপনি আবার ফিরে গেলেন পৃথিবীতে! আর এখন কিনা সেই একই প্রশ্ন করছেন? আপনি নিশ্চয়ই তৃতীয়বার পৃথিবীতে যাওয়ার কথা ভাবছেন না?’
‘না, ধন্যবাদ,’ শ্রান্ত স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু এখানে আমি এতটুকু শান্তি পাব না—।’
‘আবার সেই পুরোনো কথা!’ তড়িঘড়ি বলে উঠল দেবদূত, ‘তার চেয়ে আসুন আপনার খুনের রহস্যটা নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। নিজেকে খুনির জায়গায় কল্পনা করুন, মিস্টার চৌধুরী। যখন রণবিলাসবাবু আলো নিভিয়ে দিলেন, তখন আপনি হলে কি টেবিলের কাছে গিয়ে খুনটা করতেন?’
দু-হাতে মাথা রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তারপর বললেন, ‘না, আমি সেটাকে একটা ফাঁদ বলে সন্দেহ করতাম। কারণ, ছুরি বসানোর সময় কেউ হয়তো আলোটা আবার জ্বালিয়ে দিতে পারত, এবং আমি হাতেনাতে ধরা পড়তাম।’
‘ঠিক বলেছেন, মিস্টার চৌধুরী। সেটা প্রচণ্ড ঝুঁকির কাজ হত। এবারে আর-একটা প্রশ্ন। আপনি যদি খুনি হতেন, তা হলে যাকে খুন করলেন তারই পকেট থেকে রুমাল বের করে ছুরি থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছে ফেলার কী কারণ আপনার থাকতে পারে?’
‘এর একটাই উত্তর,’ বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘নিশ্চয়ই আমার কাছে কোনও রুমাল ছিল না।’
‘ঠিক।’ সম্মতি জানাল দেবদূত: ‘এবার বলুন তো, ওই পাঁচজনের মধ্যে কে জানত যে, আপনি সবসময় প্যান্টের বাঁ-পকেটে রুমাল রাখতেন?’
‘বুঝেছি, আপনি কি বলতে চান!’ অনিন্দ্যসুন্দরের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
প্রত্যুত্তরে সূর্যকান্তও হাসল: ‘এবারে নিশ্চয়ই আপনি এখানে সুখী হবেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘তৃণার তরুণ প্রেমিক রণবিলাস ছিল আলোর সুইচের কাছে, ‘আত্মগতভাবেই বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘খুনটা ও শেষ না-করা পর্যন্ত রণবিলাস যে আলো জ্বেলে দেবে না, সে-ভরসা তৃণার ছিল। তা ছাড়া, তৃণার সঙ্গে কোনও রুমাল ছিল না। ছুরির হাতলটা যদি ও শাড়িতে মুছতে যেত, তা হলে শাড়িতে রক্ত লেগে যাওয়ার ভয় থাকত। সুতরাং আমার রুমালটাই ও বেছে নিয়েছে। আমি রুমাল কোথায় রাখি, সেটা সবচেয়ে ভালো জানত তৃণাই—আর কেউ নয়!’
‘ঠিক আমি যা ভেবেছি তাই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘গোয়েন্দাগিরিতে আপনি দেখছি নেহাত কম যান না!’
দেবদূত কষ্টকৃত বিনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলল। নরম সুরে স্বীকার করল, ‘এখানে থাকতে-থাকতে টুকটাক কিছু শিখেছি আর কী। বলতে পারেন একরকম সঙ্গগুণ বা মেলামেশার ফল—।’
‘সঙ্গগুণ? মেলামেশা?’
‘কেন, আপনাকে বলিনি, মিস্টার চৌধুরী? ওঃ হো। প্রথমেই যদি বলতাম, তা হলে আপনি হয়তো এতটা অসুখী হতেন না, বরং খুশিই হতেন। ঠিক আছে, আর দেরি নয়। আসুন, সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হলেন পাঁচকড়িবাবু, ইনি দীনেন্দ্রবাবু আর ইনি শরদিন্দুবাবু…।’
‘পাঁচকড়িবাবু, দীনেন্দ্রবাবু, শরদিন্দুবাবু!’
‘হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী। কেন, আপনি জানেন না, রহস্য-সাহিত্যিকরা মারা গেলে স্বর্গে আসেন!’
অনির্বাণ ছাই
আমাকে নামিয়ে দিয়ে লজঝড়ে বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
ধুলোর কুয়াশা ফিকে হলে চোখের সামনে যা দেখলাম তা যেন ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই টিয়াপাখি-রঙের ধানখেত। বিকেলের রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। তারই মধ্যে কোথাও-কোথাও বড়-বড় গাছ। দু-একটা পাকা বাড়ি।
পিচের রাস্তা থেকে একটা চওড়া মোরাম বিছানো পথ ডানদিকে চলে গেছে। সেই পথের পাশে একটা বড় জামগাছ। অনির্বাণ এই গাছটার কথা বলেছিল। বলেছিল, ওই গাছের নীচে ও দাঁড়িয়ে থাকবে।
কিন্তু এতবছর পর ওকে কি আমি চিনতে পারব? ও-ও বোধহয় আমাকে চিনতে পারবে না। স্কুলে আমরা একসঙ্গে অনেক বছর পড়েছি বটে, কিন্তু স্কুল ছেড়েছি প্রায় বারো বছর হয়ে গেল। আমাদের দুজনের চেহারাই নিশ্চয়ই অনেক পালটে গেছে।
দেখলাম, গাছতলায় একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা রোগা, কালো, মাথার চুল উড়ছে, হাতে ভাঁজ করা একটা কালো ছাতা। এছাড়া ধু-ধু রাস্তায় আর কেউ নেই। দুটো গাঙশালিক পথের ধারে ঘাসঝোপের মধ্যে খেলা করছিল।
আমি হাঁটতে-হাঁটতে পকেট থেকে সেলফোন বের করলাম। অনির্বাণের নম্বর দেখে ডায়াল করলাম।
দেখলাম, গাছতলার লোকটা পকেট থেকে ওর সেল বের করে কানে দিল।
আমি কথা বললাম, ‘অনির্বাণ?’
‘হ্যাঁ। তুই অনির্বাণ?’
‘অফ কোর্স—অনির্বাণ নাম্বার ওয়ান।’
‘আমি তোর জন্যে গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি। তুই কোথায়?’
‘তোর দিকেই এগোচ্ছি—পায়ে হেঁটে…।’
এ-কথা যখন বললাম তখন আমাদের মধ্যে মাত্র হাতপাঁচেকের তফাত।
গাছের ছায়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে আমি লোকটার একেবারে মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। সেলফোন অফ করে পকেটে ঢুকিয়ে অবাক সুরে চেঁচিয়ে বললাম, ‘তুই অনির্বাণ দুই?’
লোকটা হেসে আমাকে বুকে জাপটে ধরো: ‘ঠিক বলেছিস। আজ কতবছর পরে একের সঙ্গে দুইয়ের দেখা হল বল তো! ভীষণ ভালো লাগছে রে—নতুন করে আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে।’
প্রথম আবেগের ঝাপটা কেটে গেলে হারানো বন্ধুর দিকে ভালো করে তাকালাম। ও-ও আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
স্কুলে আমাদের স্কুলে একটা বিরল ঘটনা ছিলাম আমরা দুজন। কারণ, আমাদের দুজনেরই নাম অনির্বাণ সরকার। তাই গুলিয়ে যাওয়ার সমস্যা এড়াতে স্কুলের স্যাররা কখন যেন আমাকে অনির্বাণ ওয়ান, আর ওকে অনির্বাণ টু করে দিয়েছিলেন। আমি মাথায় একটু বেশি লম্বা ছিলাম। হয়তো সেইজন্যেই ‘ওয়ান’ উপাধি পেয়েছিলাম। স্কুলের বন্ধুরা সংক্ষেপে আমাদের বলত ‘ওয়ান’ আর ‘টু’।
টু আমার চেয়ে মাথায় খাটো হলে কী হবে ওর মাথা—মানে, ব্রেন—ছিল নাম্বার ওয়ান। তা ছাড়া ওর রং ছিল টকটকে ফরসা, আর আমি তার ঠিক উলটো—একেবারে কেষ্ট ঠাকুর।
ক্লাসে আমাদের বন্ধুত্বটা কী করে যেন বেশ আঠালো হয়ে গিয়েছিল। মনের সব কথা আমি ওকে খুলে বলতাম। আর ও-ও আমাকে সব কথা খুলে বলত।
নীচু ক্লাসে থেকে ওপরে উঠতে-উঠতে আমরা এক সঙ্গে বড় হচ্ছিলাম। সুখ-দুঃখগুলোকে নতুন করে চিনতে পারছিলাম, আর সেগুলো দুজনে মিলে ভাগ করে নিচ্ছিলাম। সবমিলিয়ে দিনগুলো বেশ কাটছিল।
তারপর স্কুল একদিন ফুরোল। চলে এল এক আর দুইয়ের ছাড়াছাড়ির দিন। বেশ মনে আছে, সেদিন স্কুল ছুটির পরে আমরা দুজনে বোসদের পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসেছিলাম। অনেক গল্প করেছিলাম। কেঁদেও ছিলাম।
আজও সব মনে আছে আমার।
তারপর কত মাস কত বছর যে কেটে গেছে! দুইয়ের কথা না ভুললেও স্মৃতির পাতা অনেকটা আবছা হয়ে এসেছিল। মনে-মনে শুধু চাইতাম ও যেখানেই থাক খুশিতে থাক, আনন্দের ধুলো মাখা থাক ওর কপালে। কারণ, অনির্বাণ বেশিরভাগ সময়েই খুব মনমরা হয়ে থাকত। আর একটু যেন চাপা স্বভাবের ছিল।
কলেজের পাট শেষ করে আমি যখন চাকরি করছি তখন আমাদেরই এক স্কুলের বন্ধু কমলেশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। ও বলল, ‘টু, ওয়ান তোকে ফোন করবে। কোত্থেকে যেন আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন করেছিল। নেক্সট উইকে শনিবার ওর বিয়ে। আমাকে যেতে বলেছে। তোকে বলবে। তবে আমার বোধহয় যাওয়া হবে না। কোন ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর—মানে, আসনপুর না কেশবপুর—কোথায় যেন থাকে। যাকগে, তোকে ও ফোন করবে।’
অনির্বাণ আমাকে ফোন করেছিল। বিয়েতে নেমন্তন্নও করেছিল। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। অফিসের কাজের চাপ আর কেশবপুরের দূরত্ব—এই দুটো ফ্যাক্টরই বাদ সেধেছিল।
বিয়েতে যাইনি বলে অনির্বাণ টু অভিমান করে আমাকে আর কখনও ফোন-টোন করেনি। আমিও সংকোচে ওকে ফোন করে উঠতে পারিনি।
এরপর বছর ছয়েক কেটে গেছে। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। কেমন একটা ‘কিন্তু-কিন্তু’ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময়টা কেটে গেছে। তারপর হঠাৎই ওর ফোন এল। মাত্র তিনদিন আগে।
‘ওয়ান?’
‘হ্যাঁ—।’
‘টু বলছি।’
‘অনির্বাণ। কেমন আছিস? শোন, আমি এক্সট্রিমলি সরি। তোর বিয়েতে যেতে পারিনি রে। এমন কাজের প্রেশার পড়ল যে, কী আর বলব। আমি…।’
‘ওসব ফালতু কথা ছাড়, ওয়ান।’ আমাকে রুক্ষভাবে থামিয়ে দিল অনির্বাণ: ‘ওসব তো হাফডজন বছরের পুরোনো কথা। আজ খুব জরুরি দরকার তোকে ফোন করেছি। তোকে আমার বাড়িতে একবার আসতেই হবে। ভীষণ দরকার। কবে আসবি বল?
আমি ওকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, ‘যাব, যাব। কিন্তু তোর কী হয়েছে বল তো? তোর কথা শুনে তোকে ভীষণ আপসেট বলে মনে হচ্ছে…।’
‘তুই এলে সব বলব। তোর কাছে তো আমার গোপন কিছুই নেই! বল, কবে আসবি?’
একটু চিন্তা করে আমি বললাম, ‘পরশু যাব। তা তোর ফ্যামিলি লাইফ কেমন চলছে বল। ওয়াইফ কেমন আছে? ছেলেমেয়ে ক’টা?’
অনির্বাণ টু চুপ করে গেল। কয়েকসেকেন্ড পর একটু যেন বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘ওদের নিয়েই তো প্রবলেম। ওয়াইফ…আর আমার চার বছরে ফুটফুটে মেয়েটা। তুই পরশু আয়, ওয়ান। আমাকে ঝোলাস না যেন! তুই এলে সব বলব। তোর হেলপ না পেলে আমার সর্বনাশ হবে…।’
আরও কয়েকটা কথার পর আমি শপথ করে বলছিলাম, ‘…পরশু বিকেলে তা হলে তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রমিস।’
‘থ্যাংকু ইউ, ভাই। আমি তোর জন্যে কেশবপুর মোড়ে জামগাছতলায় ওয়েট করব…।’
এখন জামগাছতলায় দাঁড়ানো লোকটাকে আমি খুঁটিয়ে দেখছিলাম। নাঃ, অনির্বাণ টু আগের চেয়ে অনেক কালো হয়ে গেছে। চেহারাও অনেক শুকিয়ে গেছে। এই বয়েসেই গাল বসে গেছে। ঠোঁট খসখসে। চোখগুলো বড় বেশি সাদাটে।
ও আমাকে বাড়ির পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল। আমি বারবার বারণ করা সত্ত্বেও ছাতাটা খুলে মাথার ওপরে ধরে রইল।
চওড়া রাস্তা ছেড়ে আমরা সরু পথে ঢুকে পড়লাম। দুপাশে বাঁশগাছ, জবাফুলের গাছ, ভেরেন্ডার বেড়া। কয়েকটা ছোট-ছোট ডোবা। সেখানে লুকোনো চুনোমাছ বুড়বুড়ি কাটছে।
পথে বেশ কয়েকটা কুঁড়েঘর চোখে পড়ল। বাখারির কাঠামোয় গোবর আর মাটির চাপান দেওয়া দেওয়াল। কোথাও-কোথাও মাটির চাঙড় খসে পড়েছে। সেই কুঁড়েঘরের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
উঁচু-নীচু কাঁচা পথ পেরিয়ে একটা সমতল মাটির উঠোনে এসে দাঁড়ালাম। আরও একটু এগোতেই একটা মামুলি দোতলা বাড়ি। তার একটা অংশ পুড়ে কালচে হয়ে ধসে পড়েছে।
সেই বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে অনির্বান টু বলল, ‘আয়, এটাই আমার বাড়ি। দেখেছিস, কীরকম ড্যামেজ হয়ে গেছে!’
পথে আসার সময় অনির্বাণ ওর স্ত্রী আর মেয়ের কথা বলছিল। কাঞ্চন আর কাঞ্চি। ওদের নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকাটাই একটা স্বপ্নের মতো। কী দারুণ জীবন! অনেক ভাগ্য করে মানুষ এরকম জীবন পায়। আরও কত ভালো-ভালো কথা।
ওর কথা শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল এবার বাবা-মায়ের কথা মেনে নিয়ে বিয়েটা করে নিলেই হয়! স্বপ্নের মতো দারুণ জীবন তো সবাই চায়!
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ পেলাম। দুধ উথলে উনুনে পড়লে যেমন পোড়া গন্ধ বেরোয়।
আমি নাক টেনে গন্ধটা কোনদিক থেকে আসছে সেটা ঠাওর করতে চেষ্টা করছিলাম। অনির্বাণকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী পুড়ছে রে?’
ও নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার বাড়ি। বাড়িটা পুড়ছে।’
আমি ওর ঠাট্টার মানে বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল মুখটা যেন বিষণ্ণ পাথর দিয়ে তৈরি।
বাড়িতে ঢুকে অনির্বাণ দোতলার সিঁড়ি দিকে এগোল। আমি বাধ্য অতিথির মতো ওর পিছু নিলাম। আমাদের পায়ের শব্দ কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল।
আমি কান পেতে কাঞ্চন বা কাঞ্চির গলার আওয়াজ শুনতে চাইলাম, কিন্তু পেলাম না। লক্ষ করলাম, যে-অনির্বাণ এতক্ষণ ধরে এত কথা বলছিল সে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে কীরকম যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।
আমরা দোতলায় উঠে এলাম।
সামনেই চওড়া বারান্দা। চকচকে লাল মেঝে। রেলিঙের ওপরে গ্রিল দেওয়া।
বারান্দার ডানদিকে একটা পোড়া দরজা। সেটা পেরিয়ে একটা ঘর। তার দেওয়ালগুলো কালো, ফাটল ধরা, কোথাও-কোথাও ধসে পড়েছে।
পোড়া গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে নাকে ধাক্কা মারল।
সেই ঘরটার মধ্যে আমাকে নিয়ে ঢুকল অনির্বাণ। সঙ্গে-সঙ্গে পোড়া গন্ধটা শ্মশানের গন্ধ হয়ে গেল।
আমার চারপাশে পোড়া ক্যালেন্ডার, পোড়া দেওয়াল-ঘড়ি, পোড়া খাট-বিছানা, পোড়া জানলা, পোড়া আলনার জামাকাপড়, পোড়া ড্রেসিংটেবিল, আর পোড়া ফটোগ্রাফ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না।
অনেকক্ষণ পর প্রায় ফিসফিস করে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘কবে হল?’
ও বলল, ‘হয়েছে। দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই। যে জন্যে তোকে এতদূর ডেকে এনেছি…।’
কথাগুলো বলতে-বলতেই ঘরটার আর-একটা পোড়া দরজা দিয়ে অনির্বাণ টু চট করে কোথায় চলে গেল।
আমার কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগছিল। লোকের বাড়িতে এলে আগে লোক একটু জলখাবারের ব্যবস্থা করে, চা-টা দেয়—তারপর…। তার বদলে ও এসব কী করছে!
বাড়িটায় কোনও লোকজনের আওয়াজ নেই। চারপাশে পোড়া গন্ধ। ওর আচরণও কেমন অদ্ভুত। তা ছাড়া…।
একটা টিনের বাক্স হাতে ফিরে এল অনির্বাণ। বাক্সটা কালচে, তোবড়ানো। জুতোর বাক্সের চেয়ে মাপে খানিকটা বড়। দেখেই বোঝা যায় বাক্সটা অনেক পুরোনো।
অনির্বাণ বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘ওয়ান, তোকে এটা দেব বলে এতদিন ওয়েট করেছি। স্কুলে তুই আর আমি ছিলাম যাকে বলে হরিহর আত্মা। তাই এটা আমি তোর জন্যে রেখেছি। তুই এটার একটা গতি না করলে আমি শান্তি পাচ্ছি না। প্লিজ, ওয়ান, তুই আমাকে এইটুকু হেলপ কর…।’
বাক্সটা ও আমার হাতে দিল। আমি ওর কথা শুনতে-শুনতে যেন হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিলাম।
বাক্সটা বেশ হালকা কিন্তু হাতে গরম ঠেকল। হাত পুড়ে যাওয়ার মতো নয়, কিন্তু বেশ গরম।
কী আছে বাক্সের ভেতরে?
সেই প্রশ্নটাই করলাম ওকে, ‘এর ভেতরে কী আছে রে?’
অনির্বাণ প্রশ্ন শুনে উসখুস করে উঠল। বারকয়েক মেঝের দিকে তাকাল। আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে নখের ডগা খুঁটতে লাগল।
‘কী আছে বলবি তো!’
একটু ইতস্তত করে ও বিড়বিড় করে বলল, ‘ওয়ান, কিছুদিন আগে আমার ফ্যামিলিতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। আচমকা এই ঘরটায় আগুন লেগে যায়। আমি বাড়িতে ছিলাম না। তারকেশ্বরে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি সব শেষ! কাঞ্চন…আর কাঞ্চি…আমার পুতুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটা…ওরা আর নেই। আগুন…আগুন ওদের খেয়ে ফেলেছে…খেয়ে চেটেপুটে সব শেষ। শেষ!’ কথা বলতে-বলতে কেঁদে ফেলল অনির্বাণ।
‘সে কী রে! বলিস কী! আশপাশের কেউ কিছু করতে পারল না?’
মাথা নাড়ল অনির্বাণ: ‘নাঃ। কিছু করে ওঠার আগেই সব শেষ। সব জ্বলে-পুড়ে খাক।’
হঠাৎই ঘরের ভেতরটা আঁধার হয়ে এল। একইসঙ্গে মেঘের ডাক কানে এল।
অবাক হয়ে একটা জানলার দিকে তাকালাম।
আশ্চর্য! একটু আগেই খোলা জানলা দিয়ে একটা নারকেল গাছ আর বিকেলের রোদ দেখা যাচ্ছিল—এখন নারকেল গাছটা আছে, তবে রোদ লুকিয়ে পড়েছে। আর গাছটাও অস্পষ্ট, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
অনির্বাণ দেওয়ালের পোড়া সুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে বোধহয় একটা সুইচ টিপে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে একটা বালব হলদেটে আলো ছড়িয়ে দিল ঘরে।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পোড়া ঘর, বাইরের আঁধার, বালবের আলোয় তৈরি হওয়া কালো-কালো ছায়া, আর সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরকম অনির্বাণ আমাকে কেমন যেন ভয় পাইয়ে দিল।
‘কী আছে এই বাক্সের ভেতরে?’ ফাঁপা গলায় ওকে প্রশ্ন করলাম।
‘বাক্স খুলে দেখ…।’
আমার ভেতরে একটা জেদ তৈরি হচ্ছিল। ভয় পেলেও সেই জেদের জোরেই একটানে বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেললাম।
বাক্স ভরতি কালো ছাই।
‘ওগুলো কাঞ্চন আর কাঞ্চির ছাই…।’ অনির্বাণ টু বলল।
আমি সম্মোহিতের মতো ছাইগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘এগুলো তুই গঙ্গায় ভাসিয়ে দিস…।’ ঠোঁট টিপে ও কান্না চাপতে চাইল। তারপর আর্ত সুরে বলল, ‘দিবি তো?’
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ—দেব।’ তবে একইসঙ্গে ভাবছিলাম, ওর বউ আর মেয়ে কবে আগুনে পুড়ে মারা গেছে? ও বলছিল, ‘কিছুদিন আগে।’ তা হলে ছাইগুলো এখনও গরম থাকে কেমন করে?
আমার অবাক ভাবটা অনির্বাণের চোখে পড়ল। ও বলল, ‘ভাবছিস ছাইগুলো এখনও গরম আছে কেমন করে, তাই না? তা হলে শোন, ওই ছাইয়ের আগুন এখনও নেভেনি। এখনও আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, তোর যদি এমন হত তুই কী করতিস? যদি তোর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুজন এরকম আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যেত তা হলে তোর মনের অবস্থাটা কী হত? বল, সত্যি করে বল। একটিবার বল…।’
ওর প্রত্যাশা ভরা সজল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হল। কে যেন আমাকে দিয়ে আচমকা বলিয়ে নিল, ‘কিছু মনে করিস না। ওরকম হলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করত না…।’
‘ঠিক বলেছিস।’ তর্জনী তুলে উত্তেজিতভাবে সায় দিল অনির্বাণ। তাড়াতাড়ি কথা বলতে গিয়ে ওর জিভ জড়িয়ে গেল: ‘তাই কী করেছিলাম জানিস?’ কথাটা বলেই ও একছুটে ভেতরের দরজা পেরিয়ে কোথায় চলে গেল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা প্লাস্টিকের জেরিক্যান হাতে আবার ঘরে ফিরে এল। ক্যানের ছিপি খুলতে-খুলতে বলল, ‘কেরোসিন নিয়ে নিজের গায়ে মাথায় ঢালতে শুরু করেছিলাম…’ জেরিক্যান উলটে পাগলের মতো নিজের শরীরে কেরোসিন ঢালতে লাগল ও। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলতে লাগল, ‘এই যে—এইভাবে। এইভাবে…ঢালছিলাম…।’
কেরোসিনে ওর মাথার চুল ভিজে গেল। ভিজে গেল সারা শরীর, গায়ের জামাকাপড়। ঘরের মেঝেতে কেরোসিনের বন্যা বয়ে গেল। তীব্র গন্ধে চারদিক ভেসে গেল।
‘অনির্বাণ! অনির্বাণ! কী করছিস তুই?’ আমি ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম।
আমার চিৎকার অনির্বাণ টু শুনতে পেল বলে মনে হল না। কেরোসিনের ক্যানটা ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে তরলের শেষ ফোঁটাটুকু পর্যন্ত নিজের গায়ে ঢেলে দিচ্ছিল।
‘…তারপর ছুটে রান্নাঘরের গিয়ে দেশলাইটা নিয়ে এলাম…’ কথা বলতে-বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল ও। এবং কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে ফিরে এল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তারপর…তারপর…।’
ফস করে দেশলাই জ্বলে উঠল। তার সঙ্গে জ্বলে উঠল অনির্বাণ। দাউদাউ আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাক হতে লাগল।
হঠাৎই এক দমকা বাতাস কোথা থেকে যেন ছুটে এল। ঘরের ভেতরে পাগল করা ঝড় তুলল। সেই ঝড়ে আমার হাতে ধরা বাক্সের ছাই উড়তে লাগল। ছাইয়ের গুঁড়োয় তৈরি কালো মেঘ খ্যাপা মোষের মতো ঘরে বাতাসে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল।
উড়ে বেড়ানো ছাইয়ের কালো কুয়াশা ভেদ করে জ্বলন্ত অনির্বাণকে দেখা যাচ্ছিল। ওর উজ্জ্বল শরীরটা শূন্যে ভেসে উঠে এপাশ-ওপাশ দুলতে লাগল। ওর যন্ত্রণায় ডুকরে ওঠা স্বর শোনা গেল: ‘ওদের ছেড়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম রে। তাই…তাই…তোর হাতের ওই বাক্সের ভেতরে আমিও আছি। কাঞ্চন আর কাঞ্চির সঙ্গে মিশে আছি…মিশে আছি…। আর আজও জ্বলে-পুড়ে মারছি। ওই ছাইয়ের আগুন আজও নেভেনি রে…।’
অন্ধকার রঙের কুকুর
বহু বছর আগের ঘটনা হলেও সেই সন্ধেটার কথা আমি ভুলিনি।
আমার সামনে ছিল আঁকাবাঁকা শীর্ণ নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের গাছপালা। ঝাঁকড়া গাছের পাতার ফাঁকে আগুন রঙের সূর্য ঢলে যাচ্ছিল। আর শীতের ঘোলাটে সন্ধ্যা চুপিচুপি সূর্যকে চাদর মুড়ি দিতে আসছিল।
ঠিক সেই সময়েই আমি শিসের শব্দগুলো শুনতে পেয়েছিলাম। জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ন শব্দগুলো আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল ওরা ছুটে আসছে।
তারপরই যা হয়েছিল সে-কথা মনে পড়লেই ভয়ে আমার শরীরটা ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায় সেই মুহূর্তেই।
কী করব এখন!
এত বছর পর যখন ছোটবেলার ওই ঘটনাটার কথা ভাবি তখনও যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেই সন্ধের দৃশ্যটা জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। হিংস্র পশুগুলোর গায়ের বুনো গন্ধ নাকে স্পষ্ট টের পাই।
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বয়েস কতই বা হবে! বারো আর তেরোর মাঝামাঝি। শীতের ছুটিতে বড়কদমগাছি বেড়াতে গিয়েছিলাম—আমার বড়মাসির কাছে।
বড়কদমগাছি জায়গাটা রানাঘাট থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটা স্কুলে আমার বড়মাসি বাংলার টিচার ছিলেন। আর বড়মেসো জমিজিরেত মাপজোখের কী একটা চাকরি করতেন যেন।
ক্লাস সিক্স থেকেই ডিসেম্বরের শেষে বড়কদমগাছি বেড়াতে যাওয়াটা নিয়মমাফিক শুরু হয়েছিল। বাপি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন বড়মাসি আর মেসোর কাছে। বলতেন, ‘শুধুই কি আর খেলাধুলোয় মেতে থাকবি? এই ক’দিনের ছুটিতে তোর মাসির কাছে বাংলাটাও একটু জোরদার করে নে—।’
তো বাংলা জোরদার কতটা করতাম কে জানে! তবে খেলাধুলোর ব্যাপারটায় মোটেও ফাঁকি দিতাম না। আর সেইসঙ্গে মাছ ধরা।
খেলাধুলোর আমার সঙ্গী ছিল রাহুল আর পিংকি। বড়মাসির ছেলে আর মেয়ে।
রাহুল আমার চেয়ে মাসছয়েকের ছোট। আমরা তিনজনের মিলে কী হুড়োহুড়িই না করতাম! আর মাছ ধরার নেশায় আমার মাস্টারমশাই ছিলেন বড়মেসো।
বড়কদমগাছি জায়গাটা গ্রাম হলে কী হবে, ছবির মতো সুন্দর। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। টালির চাল আর টিনের চালের মাটির বাড়িগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে এখানে-ওখানে কতরকমের ছোট-বড় গাছ।
আমরা তিনজনে ঘোর দুপুরে সেইসব গাছের আড়ালে লুকোচুরি খেলতাম, গাছের পেয়ারা, কুল, জারুল পেড়ে ইচ্ছেমতো খেতাম। আর বিকেলে রাহুলের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতাম।
সবমিলিয়ে দিনগুলো ছিল দারুণ।
বড়কদমগাছিতে একটিমাত্র নদী ছিল। নাম বউনি। বহুকাল আগে গ্রামের এক নতুন বউ বিয়ের সাজগোজসমেত ওই নদীতে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকেই ওই নাম—বউনি। লোকজনের কাছেই শুনেছি, এই সরু নদীটা নাকি চুর্নি নদীতে গিয়ে মিশেছে।
বউনি নদীর এপারে আছে শ্মশান। আর ওপারটায় ঘন জঙ্গল। তাই খুব একটা কেউ নদীর দিকে যায় না। আর যদি বা যায়, তা হলে সন্ধের আগেই ফিরে আসে।
বড়মেসোর ভীষণ মাছ ধরার শখ। ছুটির দিন হলেই মেসো টোপ-বঁড়শি নিয়ে বউনির পাড়ে গিয়ে হাজির। কাপড়ের সাদা টুপি মাথায় দিয়ে নদীর পাড়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর দিনের শেষে ছ’ইঞ্চি কি আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একপিস মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
কিন্তু তাতেই দেখেছি মেসোর কী আনন্দ! বঁড়শিতে ধরা মাছ নিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে-গাইতে বাড়ি ফেরেন। তারপর সেই মাছ কী-কী পদ্ধতিতে রান্না করতে হবে তা নিয়ে বড়মাসিকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। তখন মাসি আর মেসোয় তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। আর আমি, রাহুল, পিংকি সেই মজার ‘আলোচনা’-র নীরব দর্শক।
মেসোর কাছেই শুনেছি ছিপের ইংরেজি ‘অ্যাংগল’, আর যারা ছিপ দিয়ে মাছ ধরে তাদের বলে ‘অ্যাংলার’।
মেসো আমাকে সবসময় বলতেন, ‘বুঝলি, মাছ ধরায় যে কী আনন্দ সেটা নিজে হাতে মাছ না ধরলে কখনও বুঝবি না। এ একটা দারুণ পজিটিভ নেশা। এতে কনসেনট্রেশান বৃদ্ধি পায়।’
সে যাই হোক, মেসোর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি একদিন মেসোর সঙ্গে চলে গেলাম বউনি নদীর তীরে। জায়গাটা স্বপ্নের মতো, তবুও কেন যেন গা-ছমছম করে।
বিশাল কয়েকটা চাষের খেত পেরিয়ে তারপর নদীটার দেখা মেলে। নদীর আঁকাবাঁকা পার ধরে আমি আর মেসো হেঁটে চললাম। এবড়োখেবড়ো জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে। শীতের সময় নদীর জল কমে এসেছে। সূর্যের আলোয় বয়ে যাওয়া জলের স্রোত চিকচিক করছে। তারই মধ্যে কয়েক জায়গায় মাছ বুড়বুড়ি কাটছে বলে মনে হল।
নদীর ওপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। সেখানে গাঁয়ের কেউ-কেউ কাঠ কাটতে যায়। মেসো বললেন, ওই জঙ্গলে শেয়াল, ভাম, বুনো কুকুর আর ছোটখাটো জন্তুজানোয়ার আছে। ওরা সন্ধের পর বউনি নদীতে জল খেতে আসে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল বটগাছের নীচে আমরা মাছ ধরতে বসলাম। মেসো আমাকে ছিপ, বঁড়শি আর টোপের ব্যাপারে নানান কথা বোঝাচ্ছিলেন। কীভাবে কেঁচোগুলো বঁড়শিতে গাঁথতে হয়, ময়ূরের লেজের পালকের সাদা ‘কাঠি’টা দিয়ে কীভাবে ফাতনা তৈরি করতে হয়, কীভাবে ছিপ বাগিয়ে জলে ভেসে থাকা ফাতনার দিকে নজর রাখতে হয়—এইসব।
আমি হাঁ করে মেসোর কথা গিলছিলাম আর ফাতনার দিকে নজর রাখছিলাম।
হঠাৎই কানে এল ‘বলো হরি, হরিবোল’ ধ্বনি। মুখ ফিরিয়ে দেখি একদল লোক ওপরের মেঠো পথ ধরে খাটিয়া বয়ে নিয়ে আসছে। আমাদের কাছ দিয়ে ওরা চলে গেল।
মেসো কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘ওইদিকে আরও খানিকটা এগিয়ে তারপর শ্মশান—’ আঙুল তুলে সেদিকটা দেখালেন: ‘ওই দিকটায় লোকজন কম যায়…।’
এরই মধ্যে কখন যেন ফাতনা নড়ে উঠেছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে ‘অ্যাংলার’ মেসো ছিপ ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছে।
তখন আমার আনন্দ আর দ্যাখে কে!
কারণ, মেসোর বঁড়শিতে তখন ছটফট করছে ফুটখানেক লম্বা একটা আস্ত রুইমাছ।
সেই মাছটাকে ঘিরে আমার কী উত্তেজনা! বেশ বুঝতে পারছিলাম, নিজের হাতে মাছ ‘শিকার’ করে বাড়ি ফেরার সময় মেসো কেন আনন্দে টগবগ করে ফুটতে থাকেন, কেন চেঁচিয়ে হেঁড়ে গলায় গান করেন।
এমনসময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে হিংস্র গর্জন ভেসে এল।
ছটফট করা মাছটা তখন মেসো নাইলনের থলেতে ঢোকাচ্ছিলেন। থলের মুখটা চেপে ধরে মুখ তুলে নদীর ওপারে নজর দিলেন।
আমিও গর্জনের ব্যাপারটা বোঝার জন্যে জঙ্গলের ওপরে চোখ বোলাতে লাগলাম।
হঠাৎই একপাল কুকুর বেরিয়ে এল গাছপালার আড়াল থেকে। গুনে দেখলাম পাঁচটা। ওরা একটা কুকুরকে তাড়া করে ঘিরে ফেলেছে। কুকুরটার রং হালকা বাদামি আর সাদা। তার ওপরে ছোপগুলো যে রক্তের দাগ সেটা নদীর এপার থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
আমি মেসোকে বললাম, ‘ওই কুকুরটা নিশ্চয়ই অন্য এলাকার—তাই ওই কুকুরগুলো ওকে অ্যাটাক করেছে।’
বড়মেসো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ভয়ের গলায় বললেন, ‘কুকুর নয় রে, বুনো কুকুর। এখানকার মানুষরা ঢোল বলে। দেখছিস না, সবক’টা একইরকম দেখতে—।’
সত্যিই তাই। পাঁচটা বুনো কুকুরই একইরকম দেখতে। গায়ের রং গাঢ় বাদামি। মুখটা ছুঁচলো। লেজটা সাধারণ কুকুরের চেয়ে বেশ মোটাসোটা। আর লেজের ডগায় কালো ছোপ।
এরপর চোখের সামনে যা হল তা দেখা যায় না।
নদীর পাড়ে পাঁচটা কুকুর বাদামি-সাদা কুকুরটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর নানান দিক থেকে বেচারা কুকুরটাকে হিংস্র আক্রমণ করতে লাগল। একবার ছুটে গিয়ে এ কামড়ায় তো পরমুহূর্তেই ছুটে গিয়ে আর-একজন কামড় দেয়। একটা তো এক কামড়ে এক চাকা মাংস খুবলে নিল।
আমার চক্রব্যূহে অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে গেল।
বুনো কুকুরগুলোর ধারালো দাঁতের পাটি দেখা যাচ্ছে। শিকারের দিকে প্রখর চোখে তাকিয়ে ওরা অদ্ভুত স্বরে গর্জন করছে।
ওদের ফাঁদে পড়া কুকুরটা তখন মরিয়া। সে-ও হিংস্র গর্জন করে পালটা কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এরকম অসম লড়াই বেশিক্ষণ চলার কথা নয়—তাই চললও না। কামড়ে-কামড়ে বাদামি-সাদা কুকুরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। বুনো কুকুরগুলোর আক্রমণের বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসতে লাগল। তারপর একসময় পাঁচটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারের ওপরে। ওদের শরীরে কোণঠাসা কুকুরটার শরীর ঢাকা পড়ে গেল। শুধু শোনা যেতে লাগল ওর মরণ আর্তনাদ।
ততক্ষণে পাঁচটা বুনো কুকুর ওদের হিংস্র মহাভোজ শুরু করে দিয়েছে।
হঠাৎই খেয়াল করে দেখি বড়মেসোর চোখে জল। মাছ ধরার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে তিনি বললে, ‘শিগগির চল, ফিরে যাই। ওই কুকুরগুলো নদী পার হয়ে এপাশে এলেই বিপদ।’
‘ওরা নদী পার হয়ে চলে আসে?’ আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
‘হ্যাঁ, আসে। একে তো সরু নদী—তার ওপর শীতকাল। কতটুকুই বা জল থাকে! তা ছাড়া ওরা সাঁতারে ওস্তাদ। নদী পার হয়ে ওরা শ্মশানের বেওয়ারিশ মড়া খেতে যায়। তবে সাধারণত রাতে যায়—খুব খিদে না পেলে ওরা দিনের বেলা এপারে আসে না।’
আমরা নদীর পাড় ধরে ফিরে যাচ্ছিলাম। তবে আমি বারবার পেছন ফিরে বুনো কুকুরগুলোকে দেখছিলাম। ওরা তখন খিদে মেটাতে ব্যস্ত। একটা বুনো কুকুরকে দেখলাম জল খেতে নদীর কিনারায় নেমে এসেছে। ওর গায়ে এখানে-ওখানে রক্ত লেগে রয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর যখন আমরা একটা ধানখেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, ‘মেসো, তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?’
মেসো চোখের কোণ মুছে হেসে বললেন, ‘কাঁদছিলাম? আমি? দূর!’
আমি মেসোর হাতে আবদারের ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ কাঁদছিলে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বলো—তোমাকে বলতেই হবে—।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেসো নীচু গলায় বললেন, ‘আসলে বিলটুর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।’
‘বিলটু? কে বিলটু?’
‘আমার পোষা কুকুর। ও কুকুর নয় রে—আগের জন্মে আমার কেউ ছিল। ও আমাকে এত ভালোবাসত…।’ মেসোর চোখের কোণ জলে ভরে গেল আবার।
সবুজ ধানখেতের ওপারে সূর্য ঢলে পড়েছে। টিয়াপাখির ঝাঁক উড়ে গেল ঘোলাটে আকাশে। একটু আগেই যে-দৃশ্যটা মন ভরিয়ে দিচ্ছিল এখন সেটাই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সূর্যের লাল রংটা ওই হতভাগ্য কুকুরটার কথা মনে পড়িয়ে দিল।
চোখ মুছে নিয়ে বড়মেসো আবার বলতে শুরু করলেন।
‘শোন, বিলটুর কথা পিংকি আর রাহুলও জানে না। ওদের কখনও বলিনি। তা ছাড়া এসব ওদের জন্মের আগের ব্যাপার তখন তোর বড়মাসি সবে স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছে।
‘বিলটুকে আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। তখন ও এই এত্তটুকুন ছিল। কী সুন্দর দেখতে ছিল, জানিস? আর কী সাহস! ক্রস ব্রিডের কুকুরছানা। ভেলভেটের মতো লোম। ছাইরঙের ওপরে এলোমেলো ছোট-ছোট সাদা ছোপ। ওর কথা বলতে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মানে…।’
‘থাক, তোমাকে তা হলে বলতে হবে না।’
বড়মেসো জেদের গলায় বললেন, ‘না, বলব। তোকে বললে আমার ভেরতটা অনেক হালকা হবে। তা ছাড়া তুই তো নিজের চোখে ঢোলগুলোর কাণ্ড দেখলি। কীরকম নিষ্ঠুরভাবে ওই গোবেচারা কুকুরটাকে শেষ করে দিল। বিলটুকেও ওরা ঠিক এইভাবে খতম করে দিয়েছিল—তবে বিলটু এই কুকুরটার মতো ভিতু ছিল না। ও দলটার সঙ্গে বীরের মতো লড়াই করেছিল। কিন্তু…কিন্তু…শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি।’ কথা বলতে-বলতে মেসোর গলা ধরে এল। একটু সামলে নিয়ে মেসো বললেন, ‘ওর জন্যে আমি আর তোর বড়মাসি কত যে চোখের জল ফেলেছি…।’
আমরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। মেসো চোখ মুছে জোর করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘নাঃ, এখন আর না। আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিলটুর ব্যাপারটা তোকে বলব। শুধু তোকে কেন, একইসঙ্গে পিংকি আর রাহুলকেও শোনাব। আমার যত কষ্ট হয় হোক। বিলটুর সাহসের গল্প ওদেরও শোনা দরকার।’
এরপর বড়মেসো অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। এগারো ইঞ্চি লম্বা রুইমাছটা কী-কী মশলাপাতি সহযোগে রান্না হবে তাই নিয়ে বড়মাসির সঙ্গে তর্কবিতর্ক জুড়ে দিলেন। পিংকি আর রাহুলকে আমি বললাম যে, আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মেসো একটা সত্যি ঘটনা শোনাবেন।
ওরা হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিল। বলল, ওদের বাপিকে ওরা ভালো করে চেনে। ওদের বাপি কখনও ওদের সত্যি ঘটনা কিংবা মিথ্যে ঘটনা—কিছুই নাকি শোনাননি।
কিন্তু সে-রাতে বড়মেসো বিলটুর গল্প আমাদের তিনজনকে শোনালেন।
মাছ ধরা আমার ছোটবেলাকার নেশা। বউনি নদীতে আমি মাছ ধরি প্রায় বিশ বছর ধরে। ছিপ, বঁড়শি, টোপ নিয়ে ওই নদীর পাড়ে ধৈর্য ধরে বসাটা আমার বরাবরের অভ্যেস। বিলটুও ধীরে-ধীরে এই অভ্যাসটা রপ্ত করে নিয়েছিল। ও আমার সঙ্গে বলতে গেলে পায়ে-পায়ে ছুটত। তারপর নদীর পাড়ে গিয়ে যখন আমি ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম তখন ও এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করত। কোনও একটা মাছ ধরে ডাঙায় তুললেই ওর সে কী উত্তেজনা আর লাফালাফি! যেন মাছটা আমি নয়—ও-ই ধরেছে।
এইভাবে বছরখানেকের বেশি কেটে গেল। বিলটু চেহারায় বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। ওকে দেখে নেড়িকুকুররা বেশ সমীহ করে—আর লোকজন বেশ ভয়-টয় পায়।
আমাদের গ্রামে একবার চুরির হিড়িক শুরু হয়েছিল। তখন মাঝরাতে বিলটু হঠাৎই এক চোর ধরে ফেলল। তার পায়ে আর ঊরুতে ও এমন বাঘা কামড় বসাল যে, একেবারে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। সে-কথা চাউর হতেই গ্রামে চুরি-টুরি সব বন্ধ।
একদিন সকাল বউনি নদীর তীরে ছিপ ফেলে বসে আছি, হঠাৎই ফাতনা নড়ে উঠল। দেখেশুনে মনে হল, বেশ বড় সাইজের মাছ টোপ গিলেছে। তো আমি সেদিকে মনোযোগ দিয়ে ছিপটাকে খেলাচ্ছি, হঠাৎই কানে এল অদ্ভুত শিসের শব্দ। তারপরই কয়েকটা চাপা গর্জন।
ছিপটা বাগিয়ে ধরে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা বুনো কুকুর ওপারে দাঁড়িয়ে। বিলটুকে লক্ষ করে ওরা চাপা গোঙানির শব্দ করছে।
আমি বিলটুকে সাবধান করার আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। বিলটু ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগল। তারপর আমি কিছু করে ওঠার আগেই ভয়ংকর তেজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে গেল ওপারে।
আমি ছিপ-বঁড়শি সব ছুড়ে দিয়ে বিলটুকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিলটু ওপারে পৌঁছে গেল। এবং শুরু হয়ে গেল দাঁত-নখের প্রচণ্ড লড়াই। বিলটু ঘুরে-ঘুরে ওঁদের আক্রমণ ঠেকাতে লাগল। শূন্যে বারবার লাফিয়ে শত্রুদের মরণকামড় বসাতে লাগল। কুকুরের লোম উড়তে লাগল শূন্যে।
আমি অসহায়ের মতো এপারে দাঁড়িয়ে বারবার বিলটুর নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আর কিছুক্ষণ লড়াই চললেই বিলটুকে ওরা শেষ করে দেবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিলটু শেষ পর্যন্ত জিতে গেল। বুনো কুকুরগুলো হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিল। বিলটুর দূরন্ত আক্রমণের মুখে পড়ে ওরা ভয়ের চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে।
বিলটু ওপার থেকে তাকাল আমার দিকে। ওর সারা গা ক্ষতবিক্ষত। কাঁধ আর গলার কাছ থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে বুনো কুকুরের দল। শরীরের নানা জায়গায় লেপটে আছে রক্তের দাগ। ও জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে, ধুঁকছে।
ওই ক্লান্ত অবস্থাতেই আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বিলটু ঘেউঘেউ করে উঠল। মনে হল, ও যেন বলছে, ‘দ্যাখো প্রভু, আমি ওদের হারিয়ে দিয়েছি।’
ওর দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি আকুল হয়ে ওকে এপারে আসার জন্যে ডাকতে লাগলাম।
আমার কথা বিলটু বোধহয় বুঝতে পারল। ও নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে এল এপারে। কিন্তু তারপর আমার কাছে না এসে ও চলে গেল বউনির কিনারায় এক কাদার গর্তে। সেখানে থকথকে কাদার ওপরে শুয়ে পড়ে প্রাণভরে গড়াগাড়ি খেতে লাগল।
গ্রামের বয়স্ক মানুষদের মুখে বহুবার শুনেছি এই কাদার নাকি এক অদ্ভুত গুণ আছে। এই কাদা গায়ে মেখে নিলে কাটাছেঁড়া, ঘা, এসব নাকি চট করে সেরে যায়। জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায় বা নদীতে যেসব জেলেরা মাছ ধরে তারা কেটে-ছড়ে গেলে এই কাদা গায়ে লেপে নেয়। পোষা গরু-মোষ-ছাগলের জন্যেও তারা এই ‘ওষুধ’ ব্যবহার করে।
কিন্তু বিলটু কী করে এই কাদার গুণের কথা জেনেছিল তা বলতে পারব না। তবে কাদায় লুটোপুটি খেয়ে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে যখন ও খোঁড়াতে-খোঁড়াতে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, তখন ওর অদ্ভুত চেহারা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম।
ওর কপাল থেকে গলা পর্যন্ত এক লম্বা গভীর ক্ষতচিহ্ন। বুনো কুকুরের নখের টানে বাঁ-দিনের চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাকের পাশে মাংস ফাঁক হয়ে গেছে। চোয়ালের নীচে নরম মাংস ফালা-ফালা হয়ে ঝুলছে।
আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। হাঁটুগেড়ে বসে কাদা-মাখা বিলটুকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর চিৎকার করে লোকজনকে ডাকতে লাগলাম।
বিলটু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ‘কুঁইকুঁই’ করে চাপা আওয়াজ করতে লাগল।
তারপর আমার আর ভালো করে কিছু মনে নেই। পরে জেনেছি, আমার চিৎকার শুনে দু-চারজন চাষি ছুটে এসেছিল। ওরাই আমাকে আর বিলটুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
না, ওই কাদা বিলটুকে বাঁচাতে পারেনি। আটদিন কষ্ট পাওয়ার পর বিলটু মারা যায়। ওর গায়ের কাটা জায়গাগুলো পেকে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে পচা দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করেছিল।
আমি আর তোদের মা—মানে, তোর বড়মাসি—বিলটুকে ওই বউনি নদীর পাড়েই কবর দিয়ে এসেছিলাম।
তারপর থেকে বউনির তীরে মাছ ধরতে গেলে আমার মনে কষ্ট হয়। কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়, এই বুঝি বিলটুকে দেখতে পাব। আমার ধরা ছটফটে মাছ দেখে ও লেজ নাড়তে-নাড়তে খুশিতে ছুটোছুটি করবে। একবার মাছটার কাছে ছুটে আসবে, আর একবার দূরে ছুটে যাবে।
ওর কথা ভাবি বলেই বউনিতে মাছ ধরার অভ্যেসটা ছাড়তে পারিনি।
বড়মেসোর গল্পটা শুনেছিলাম। প্রথমবারে বড়কদমগাছিতে গিয়ে। শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রাহুল আর পিংকিও খুব দুঃখ পেয়েছিল গল্পটা শুনে। ওরা বড়মেসোর কাছে আবদার করল সেই জায়গাটা দেখতে যাবে—যেখানে বিলটু শেষ লড়াই করেছিল। আর একইসঙ্গে ওই কাদার গর্ত আর বিলটুর কবর দেখবে।
বড়মেসো উদাস গলায় বললেন, ‘চল, কালই চল। তবে সব কী আর আগের মতন আছে রে!’
পরদিন দুপুরে আমরা তিনজনে বড়মেসোর সঙ্গী হলাম নদীর পাড় ধরে হেঁটে-হেঁটে মেসো জায়গাগুলো আমাদের দেখতে লাগলেন। বিলটুর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানালাম। যদিও মনে হল, এরকম একজন ‘বীর’কে সেলাম জানালেই বোধহয় বেশি মানানসই হত।
কাদার গর্তটাও দেখলাম আমরা। মেসোর কাছেই শুনলাম, জোয়ারের সময় জল জমে গিয়ে এই গর্তটায় কাদা হয়। শীতকালে সেখানে নেমে গাঁয়ের বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কাদা ঘেঁটে ল্যাটা মাছ, গেঁড়ি, গুগলি, শামুক—এসব খুঁজে বেড়ায়। এখনও নজরে পড়ল তিনটে ছেলে কাদা হাতড়ে-হাতড়ে সেই কাজ চালাচ্ছে। একজনের গায়ে তো বুক পর্যন্ত কাদার ছোপ। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, কাদা রঙের জামা-প্যান্ট পরেছে।
মেসোর সঙ্গে বেশ ক’দিন মাছ ধরতে গিয়ে আমার মধ্যে মাছ ধরার নেশাটা চারিয়ে গেল। মাছ ধরার প্রথমদিন ওরকম একটা বীভৎস দৃশ্যের সাক্ষী হলেও বিলটুর ব্যাপারটা আমাকে কী করে যেন বউনি নদীর দিকে টেনেছিল। তা ছাড়া মেসোর বলা কথাগুলো ‘দারুণ পজিটিভ নেশা’, ‘কনসেনট্রেশান বৃদ্ধি পায়’ আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
অনেকসময় মেসো না গেলেও আমি রাহুল কিংবা পিংকি—অথবা দুজনকেই সঙ্গী করে ছিপ-বঁড়শি নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসতাম।
মাছ ধরতে বসে ফাতনার দিকে নজর থাকলেও আমার চোখ মাঝে-মাঝেই ছিটকে যেত জঙ্গলের দিকে। যদি কখনও একটা বুনো কুকুরের ছায়াও দেখি তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে ছিপ-টিপ নিয়ে ছুট লাগাব বাড়ির দিকে।
পিংকিটা ছিল রামভিতু। সবসময় রাহুল কিংবা আমার জামা খামচে ধরে বসে থাকত। তবে মাছ ধরার ব্যাপারটা দেখার লোভ ও কিছুতেই ছাড়তে পারত না।
রাহুল তুলনায় বেশ সাহসী। ও আত্মরক্ষার জন্যে একটা পেয়ারা কাঠের গুলতি আর পোড়ামাটির গুলি সবসময় পকেটে রাখত। আমি ছিপ নিয়ে বসলে ও গুলতি বাগিয়ে বসত। আর কখনও যদি ও ছিপ হাতে নিত তা হলে আমাকে পাহারাদারের ভূমিকায় বসাত।
ঘটনাটা ঘটেছিল পরের শীতে—তখন আমি ক্লাস সেভেনে।
দুপুরবেলা নদীতে ছিপ ফেলে বসে আছি। আমার একপাশে পিংকি, আর একপাশে রাহুল।
হঠাৎ ওপারের জঙ্গল থেকে শিসের শব্দ ভেসে এল। আমি চমকে মুখ তুলে তাকালাম। মেসোর কাছেই শুনেছি বুনো কুকুরগুলো শিস দেওয়ার মতন করে অদ্ভুতভাবে ডাকতে পারে। কিন্তু কোনও কুকুর আমার নজরে পড়ল না। তখন আবার ফাতনার দিকে মন দিলাম।
এমনসময় সমু নামে একটা ছেলে হাঁপাতে-হাঁপাতে রাহুলকে ডাকতে এল। বলল, ভীষণ দরকার। কাল সকালের ট্রেনে পরেশদা নামে একজন কলকাতা যাবে। তার হাত দিয়ে ক্লাবের ক্রিকেট ব্যাটটা কলকাতার দোকান থেকে আনানো হবে। তার চাঁদা তোলার জন্যে সুবিন আর তোতন রাহুলকে এক্ষুনি ডাকছে। ওদের সঙ্গে কথা সারতে দশ-পনেরোমিনিটের বেশি লাগবে না।
রাহুল উঠে দাঁড়িয়ে সমুর সঙ্গে রওনা হয়ে গেল।
আমাদের সশস্ত্র পাহারাদার চলে যাওয়াতে পিংকি বেশ ভয় পেয়ে গেল। ও আমার গা ঘেঁষে বসে জামা খামচে ধরল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘কোনও ভয় নেই…।’
কিন্তু আমার কথায় ও খুব একটা ভরসা পেল বলে মনে হল না।
একটু পরেই বেশ কয়েকবার শিসের শব্দ শোনা গেল আবার। ব্যস, তাতেই হয়ে গেল। হঠাৎই পিংকি আমার পাশ থেকে উঠে একেবার দে ছুট।
আমি হকচকিয়ে গিয়ে ওকে চিৎকার করে ডাকলাম, ফিরে আসার জন্যে বারবার বললাম। কিন্তু কোনও লাভ হল না।
রাহুল এক্ষুনি ফিরে আসবে এই ভরসায় আমি ছিপ নিয়ে বসে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল কিন্তু রাহুল ফিরল না। ততক্ষণে আমি একটা চারাপোনা ধরেছি এবং প্রবল উৎসাহে আবার নদীতে ছিপ ফেলেছি।
মাছ ধরার দিকে মনোযোগ দিয়ে মনে-মনে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। চোখ ছিল ফাতনার দিকে, কিন্তু মনে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। রাহুল বা পিংকি যে ফিরে আসেনি সেটা যেমন খেয়াল ছিল না, তেমনই সূর্য যে জঙ্গলের মাথায় হেলে পড়েছে সেটাও নজর করিনি।
জঙ্গল থেকে হিংস্র ডাকগুলো কানে আসতেই আমার ঘোর কাটল। ডাকগুলো বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একটানে ছিপ তুলে নিলাম নদী থেকে। নাইলনের থলেটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাব, অমনি পাথর হয়ে গেলাম।
কখন যেন ছ’টা বুনো কুকুর পেছন থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। এতই চুপিসাড়ে ওরা কাজটা সেরেছে যে, আমি একটুও টের পাইনি। মনে হয়, ওরা আধপোড়া মড়ার খোঁজে নদী পেরিয়ে শ্মশানের দিকে এসে উঠেছিল। তারপর শিকারের খোঁজে নদীর পাড় ধরে হেঁটে এদিকটায় চলে এসেছে।
কয়েকটা ঢোল শিস দেওয়ার মতো শব্দ করছিল। আর কয়েকটা হিসহিস শব্দ করছিল। আবার কখনও-বা চাপা গর্জন।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কিন্তু শরীরটা পুরো অবশ হয়ে পড়েনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার জন্যে তৈরি হলাম। আমার হাতের অস্ত্র বলতে পলকা একটা ছিপ।
এগিয়ে আসা কুকুরটাকে ছিপের এক ঘা বসিয়ে দিলাম। ওটা ‘কেঁউ’ শব্দ করে দু-পা পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু পাশ থেকে একটা কুকুর সাপের ছোবল মারার ঢঙে আমার ডানপায়ে এক কামড় বসিয়ে দিল।
সেদিকে ঘুরে তাকাতেই বাঁ-দিকে কোমরের কাছটায় একটা কামড় টের পেলাম। প্যান্টের মোটা কাপড় ফুটো করে ধারালো দাঁত বসে গেল শরীরে। আমি যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠলাম। ডান পা থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে মাটিতে। কোনদিক সামলাব আমি? আমাকে ঘিরে হিংস্র কুকুরগুলো যেন ব্যালে নাচছে। একবার ছুটে এসে এ কামড়ায় তো আর-একবার ও কামড় দেয়।
আমি ছিপটাকে এলোপাতাড়ি চালাতে লাগলাম, আর প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু শুকনো গলা দিয়ে যে-স্বর বেরিয়ে এল তা কারও কান পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব নয়।
বুনো কুকুরগুলো আঁচড়ে-কামড়ে আমাকে ঘায়েল করে চলল। নদীর পাড়ে রক্ত ছিটিয়ে পড়তে লাগল এখানে-ওখানে। আমার মাথা টলে গেল। নিজের ভাঙা গলার চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল আমি নয়, অন্য কেউ চিৎকার করছে।
আর সহ্য করতে পারলাম না। অবশ হাত থেকে ছিপ খসে পড়ল। আমিও কাত হয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। একটা কুকুর আমার বাঁ-পায়ের ডিম থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিল। মনে হল, আমার শরীরে কেউ একটা গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দিল।
ঠিক তখনই নদীর পাড় ধরে সে উঠে এল।
সর্বাঙ্গে কাদা-মাখা অন্ধকার রঙের এক বিশাল কুকুর। সে বিদ্যুতের মতো ছুটে এল শিকারি কুকুরগুলোর দিকে। হিংস্র চোয়াল আর ধারালো নখ দিয়ে ওদের শরীর ছিন্নভিন্ন করতে লাগল।
বাতাস লোম উড়তে লাগল। দাঁতে দাঁত লাগার খটাখট শব্দ শোনা গেল। সেইসঙ্গে ছোট-বড় গর্জন।
ছ’জন শত্রুর সঙ্গে একাই লড়তে লাগল সেই অন্ধকার কুকুর। একবার এর ওপর লাফিয়ে পড়ে তো আর-একবার ওর ওপর।
আমি অসাড় শরীরে শুয়ে-শুয়ে সেই আশ্চর্য লড়াই দেখতে লাগলাম। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এসে গেল।
তিনটে বুনো কুকুর পড়ে গেল মাটিতে। আর উঠতে পারল না। বাকি তিনটে প্রাণভয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে। তখন দেখি আরও তিনটে বুনো কুকুর নদীর ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে। বোধহয় সঙ্গীদের অবস্থা দেখে ওরা আর লড়াইয়ে সামিল হয়নি।
লড়াই শেষ হলে জিভ বের করে বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল কাদা-মাখা কুকুরটা। আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল, অদ্ভুতভাবে তাকাল।
আমি যেন মনে-মনে শুনতে পেলাম, ‘দ্যাখো প্রভু, আমি ওদের হারিয়ে দিয়েছি।’
আর তখনই দেখতে পেলাম, ওর কপাল থেকে গলা পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষত। বাঁ-দিকের চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। নাকের পাশে মাংস ফাঁক হয়ে গেছে। চোয়ালের নীচে নরম মাংস ফালা-ফালা হয়ে ঝুলছে।
তারপরই কাদা-মাখা কুকুরটা নদীর পাড় বেয়ে নেমে গেল নীচে। আমার চোখের আড়ালে চলে গেল।
কয়েক সেকেন্ড পরেই শুনতে পেলাম লোকজনের চিৎকার—আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে বড়মেসো আর রাহুলের গলা আমি চিনতে পারলাম।
বোধহয় আমার ভাঙা গলার চিৎকার কেউ শুনতে পেয়েছিল।
অপরূপ অন্ধকার
বিশ্বনাথকে গোপন খবরটা দিয়েছিলেন ওঁরই বন্ধু সন্দীপন।
তবে সেটা মোটেই সহজে দেননি। ওঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেক চাপাচাপি করতে হয়েছিল, সঙ্গে ঘুষ দিতে হয়েছিল এক প্যাকেট বিদেশি সিগারেট। তারপর একটু-একটু করে ব্যাপারটা ফাঁস করেছিলেন সন্দীপন।
ফাঁস করেছিলেন আরও একটা কারণে। বিশ্বনাথের রোজকার হেনস্থার কথা শুনে সন্দীপনের মনটা নরম হয়েছিল। বন্ধুর দুঃখ-কষ্ট দাগ কেটেছিল মনে। তাই গোপন কথাটা আর গোপন রাখতে পারেননি।
শুনে থ’ হয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। এরকমটাও হয়।
‘হয় মানে!’ চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, সন্দীপন, ‘হচ্ছে! এই তো আমি জলজ্যান্ত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তারপরেও তুমি অবিশ্বাস করবে?’
না, শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস করতে পারেননি বিশ্বনাথ। কিন্তু অভিনব ধাক্কাটা সামলাতে সময় লেগেছিল। আর সেই বেসামাল অবস্থাতেই একটা গোপন ইচ্ছে মনের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছিল।
সন্দীপনকে আর কিছু বলেননি বিশ্বনাথ। শুধু একটা ঝিম ধরা ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।
সেদিন রাতে ছেলের বউ পারমিতা যখন ওঁর সামনে খাবারের থালা রেখে দিয়ে চলে গেল তখন বিশ্বনাথ বিরক্ত হতেও ভুলে গেলেন। সন্দীপনের কথাগুলো ওঁকে এমনই মশগুল করে রেখেছিল।
খানিকক্ষণ পর খেয়াল হতেই থালায় সাজানো পদগুলো দেখতে পেলেন। তিনটে রুটি, বেগুনপোড়া, একটা সবজি, আর একটা ছোট্ট বাটিতে দই।
ওঁর মতো ষাট পেরোনো বৃদ্ধের স্বাস্থ্যরক্ষা করতে এই ধরনের মেনুই নাকি ডাক্তারের পরামর্শ।
বিশ্বনাথের মনে হল, পাশেই ডাইনিং স্পেসে গিয়ে পারমিতা আর আলোকের পাতটা দেখে আসেন। ডাক্তাররা কোন ধরনের মেনু সাজেস্ট করেছেন বত্রিশ আর সাতাশের স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর ডাইনিং স্পেসের পাশের বারান্দায় গিয়ে দেখে আসেন, আলোকের পোশা অ্যালসেশিয়ান ভিক্টরের জন্য কোন মেনু বরাদ্দ হয়েছে।
স্ত্রী রেণুকণা বেঁচে থাকলে বলতেন, ‘ছেড়ে দাও! এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কিছু বোলো না। সবাই তোমাকে ছোট ভাববে। তার চেয়ে বরং একটু না হয় স্যাক্রিফাইস করলে…।’
স্যাক্রিফাইস! আলোক আর পারমিতা জানে এই শব্দটার মানে?
রেণুকথার কথা মনে পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের জমাট অন্ধকার ঠেলে বেরিয়ে এল বাইরে।
দীর্ঘশ্বাসের আর দোষ কী! রেণুকথা চলে যাওয়ার পর গত পাঁচ বছর ধরে এটা বিশ্বনাথের গা সওয়া হয়ে গেছে।
বেশ মনে পড়ে, আলোকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ও কলেজ থেকে বি. এসসি. পাশ করে বেরোনোর পর-পর।
এমনিতে ছোটবেলা থেকেই ও বেশ আদরে-আদরে মানুষ হয়েছে—একমাত্র সন্তান হলে সাধারণত যেমনটা হয়। তবে ও যতই বড় হয়েছে ওর মধ্যে জেদ আর স্বার্থপর ভাব ততই মাথাচাড়া দিয়েছে।
বিশ্বনাথ ব্যাপারটা ভীষণ অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন।
রেণুকথা আলোককে যেমন স্নেহ করতেন, তেমন শাসনও করতেন। তবে দুটোর মাত্রা বোধহয় সঠিক অনুপাতে ছিল না। অথবা বোধহয় ভাবতেন, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু হয়নি।
আলোকের সঙ্গে যেদিন বিশ্বনাথের প্রথম সরাসরি সংঘর্ষ বাধে সেদিনটা বিশ্বনাথ ভোলেননি। কারণ, দিনটা ছিল আলোকের জন্মদিন। তখন ও থার্ড ইয়ারে পড়ে।
বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করেছিল আলোক। আর ভ্যাপসা গরমের মধ্যে সারাটা দিন ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাত পুড়িয়ে ছ’-সাত পদ রান্না করেছিল রেণুকথা। ফ্রায়েড রাইস, চাইনিজ আলুর দম, চিনি চিকেন, আরও কত কী!
জন্মদিন আসার দিনসাতেক আগে থেকেই মায়ের কাছে বায়না করেছিল আলোক। বলেছিল, ‘মা, কলেজে এবারই আমাদের লাস্ট ইয়ার—এরপর বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে যাবে। এবারের বার্থডেটা একটু জোরদার করতে হবে। আমার খুব ক্লোজ পাঁচ-ছ’জন বন্ধুকে সেদিন নেমন্তন্ন করব—রাতে এখানে খেতে বলব।’
রেণুকথা হেসে রাজি হয়েছিলেন। কারণ, আলোকের সেই কোন সাত বছর বয়েসে বেশ ঘটা করে ওর জন্মদিন উদযাপন করা হয়েছিল। তারপর থেকে প্রায় সব বছরেই শুধু ওরা তিনজন। আর রেণুকণার হাতে তৈরি পায়েস, সঙ্গে মাংস, কিংবা চিংড়ি মাছের মালাইকারি।
তাই সেবার খাওয়াদাওয়ার আয়োজনটা ভালোই হয়েছিল। বিশ্বনাথ নিজের হাতে চুটিয়ে বাজার করেছিলেন।
সন্ধেবেলা আলোকের পাঁচজন বন্ধু এসে হাজির হল। তিনজন ছেলে, দুজন মেয়ে। ওদের পোশাক বেশ আধুনিক ফিটফাট। চেহারাও টগবগে, তরতাজা। মুখে হাসি লেগেই আছে। আর হাতে গিফটের প্যাকেট।
বিশ্বনাথ আর রেণুকণার সঙ্গে বন্ধুদের আলাপ করিয়ে দিল আলোক। ওরা সবাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করল।
বিশ্বনাথের ব্যাপারটা ভালো লেগেছিল। যদিও যুগ এখন অনেক এগিয়ে গেছে, চারপাশটা অনেক আধুনিক, তা সত্ত্বেও এই সেকেলে অভ্যাসটা বিশ্বনাথকে তৃপ্তি দিয়েছিল।
সারা সন্ধে ধরে আলোকের ঘরে ওরা হুইহুল্লোড় করল। সাউন্ড সিস্টেমে চড়া আওয়াজে গান বাজিয়ে নাচল। গোটা ফ্ল্যাটে আনন্দ আর খুশির পাগলা হাওয়া উদ্দামভাবে ছুটে বেড়াতে লাগল।
পাশের ঘরে বসে বিশ্বনাথ আর রেণুকণা উৎসবের এই মেজাজটা বেশ ভালোই উপভোগ করছিলেন। কয়েকটা গানের সঙ্গে রেণুকথা গুনগুন করে গলাও মেলাচ্ছিলেন।
বিশ্বনাথের বয়েসটাও পিছিয়ে যাচ্ছিল দ্রুতবেগে। তিনি রেণুর হাত চেপে ধরে একটা গোপন ইশারা করলেন, তারপর হো-হো করে হাসিতে ফেটে পড়লেন।
কিন্তু রাতের খাওয়াদাওয়ার পরেও ওদের হুইহুল্লোড় চলতে লাগল।
বিশ্বনাথের ভুরু কুঁচকে গেলেও ব্যাপারটা অতটা গায়ে মাখেননি। শুধু ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হতেই রেণুকণাকে বললেন, ‘দশটা বেজে গেছে…এখনও এরকম শোরগোল হচ্ছে…আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এবার মাইন্ড করতে পারে…।’
রেণু বললেন, ‘তুমি গিয়ে একবার আলোকে বলো না…।’
বিশ্বনাথ বেঁকে বসলেন। রেণুকণাকেই বললেন দায়িত্বটা নিতে। কিন্তু রেণুও গাঁইগুঁই করে বিশ্বনাথের কোর্টে বল পাঠাতে চাইলেন।
এইভাবে বেশ কয়েকবার বল চালাচালির পর বিশ্বনাথ হেরে গেলেন। ব্যাজার মুখে উঠে দাঁড়ালেন। রওনা হলেন আলোকের ঘরের দিকে।
ওর ঘরে যেতে-যেতে মনে-মনে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। ঠিক কীভাবে কথাটা বলবেন আলোকে? ঘরের বাইরে ইশারায় ডেকে নেবেন? তারপর চাপা গলায় বলবেন, ‘আলো, রাত হয়েছে—এবার বন্ধুদের বাড়ি যেতে বলো।’
নাঃ, এটা একটু শাসনের মতো শোনাচ্ছে। ছেলে বড় হয়েছে। ওর ইগো এতে হার্ট হতে পারে।
তার চেয়ে এরকম করে বললে হয়: ‘আলো, সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজটা একটু আস্তে করে দাও। অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন হয়তো ডিসটার্বড হচ্ছে…।’
হ্যাঁ, এটা অনেক বেটার। এ-কথা বলে আলোক মোটেই বিশ্বনাথের ওপরে রাগ করবে না।
সুতরাং রিহার্সাল দেওয়া সংলাপটা একরকম মুখস্থ করে বিশ্বনাথ আলোকের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
ঘরের বাইরের বারান্দার আলোটা নেভানো ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের আলো আর শব্দ চলকে পড়ছে বাইরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ইশারা করে ডাকার জন্য আলোর এলাকায় মাথাটা বাড়িয়ে দিলেন বিশ্বনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর ভেতরকার ছন্দ-তাল সব গরমিল হয়ে গেল।
কারণ, যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
মিউজিক সিস্টেমের ঝংকারের তালে-তালে ছ’টা ছেলেমেয়ে উদ্দামভাবে নাচছে। মেঝেতে ওদের এলোমেলো পা ফেলার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছিল, পায়ের সঙ্গে মাথার তেমন সুষম যোগযোগ নেই।
আলোককে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটি রোগা, লম্বা, থুতনিতে এক চিলতে দাড়ি। আর মেয়েটি মাথায় খাটো, ফরসা মুখের দুপাশে কোঁকড়া চুলের ঢল, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, গায়ে লাল রঙের থ্রি-কোয়ার্টার হাতা টপ, পায়ে স্কিন-টাইট জিনস।
আলোককে ওরা ধরে রেখেছে কারণ আলোক ঠিকঠাক অবস্থায় নেই। ও চোখ বুজে জিভটা লম্বা করে বাইরে বের করে রেখেছে। আর ওর জিভের সামনে লকলক করছে ছোট্ট একটা সবুজ সাপ। সাপটাকে আলোকের জিভের কাছাকাছি ধরে রেখেছে কালো মতন কদমছাঁট চুল একটি ছেলে। ছেলেটির চুলের ডানপাশটা সাপটার মতোই সবুজ। আর হাতে চামড়ার দস্তানা।
বেসামাল নাচের তালে-তালে আলোকের জিভ এপাশ-ওপাশ সরে যাচ্ছিল। আর সাপটাও জিভের নিশানা ঠিক রাখতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছিল।
বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো সবুজ হিলহিলে সাপটা আলোকের জিভে ছোবল মারল।
ছোবল এসে পড়ল বিশ্বনাথের বুকেও। যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। ভেজা কাপড় নিংড়ানোর মতো ওঁর হৃৎপিণ্ডটা অমানুষিক শক্তিতে মোচড় দিচ্ছিল কেউ, আর টপটপ করে রক্ত ঝরছিল।
পৃথিবীর যত বয়েস বাড়ছে ততই সে আধুনিক হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বয়েস আসলে যেন কমছে। কিন্তু বিশ্বনাথের বুকের ভেতরটা হুহু করছিল।
একটু-আধটু নেশা করা হয়তো দোষের নয়। কিন্তু তাই বলে সাপের ছোবল!
ছোবলটা জিভে পড়ার পরই পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল আলোক। ওর শরীরটা বেপরোয়াভাবে ছটফট করতে লাগল। ব্যাপারটা যন্ত্রণার না আনন্দের সেটা আলোকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝতে চাইলেন বিশ্বনাথ। কিন্তু পারলেন না।
শুধু দেখলেন, আলোকের দুপাশের ছেলেটা আর মেয়েটা শক্ত করে আলোককে চেপে ধরে আছে। আর আলোকের ঠোঁটের কোণ থেকে লালা ঝরছে। একটা তৃপ্তির গোঙানিও যেন শোনা যাচ্ছে ওর মুখ থেকে।
ভাঙা বুক নিয়ে সরে এসেছিলেন বিশ্বনাথ। অন্ধকার বারান্দায় শুরু হয়ে গিয়েছিল ওঁর নতুন রিহার্সাল। রেণুকণাকে গিয়ে এখন কী বলবেন? বলবেন সাপের ছোবলের কথা? রেণুকণার সমস্ত আনন্দ আর সুখ শেষ করে দেবেন এক ছোবলে?
না, বিশ্বনাথ সেটা পারেননি। ফিরে এসে মিথ্যে কথা বলেছিলেন স্ত্রীকে: ‘আলো বলল, একটু পরেই ওরা চলে যাবে…।’
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সেই শুরু।
রেণুকণা বিশ্বনাথের কাছ থেকে আলোককে আড়াল করেছেন। আর বিশ্বনাথ পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আলোর কালো দিকগুলো লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
এইভাবে দুজনে গোপনে সাপের ছোবল খেয়ে চলেছেন বরাবর।
সময় বদলে যাচ্ছিল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে আলোকও। কিন্তু বিশ্বনাথ আর রেণুকণা নিজেদের বদলে ফেলতে পারছিলেন না মোটেই। যখনই ওরা শক্ত হয়ে কোনও একটা রুক্ষ সিদ্ধান্তের কথা ভাবছিলেন, তখনই ম্যাজিকের মতো ছোট্টবেলার আলোক হাসিমুখে আধো-আধো কথা নিয়ে ওঁদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল। আর সেই স্নেহের তাপে বরফের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গলে জল হয়ে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে।
শেষ পর্যন্ত ওঁরা আড়ালে শুধু চোখের জল ফেলেছেন।
আলোক বড় হয়ে উঠছিল আর চারপাশের উচ্ছৃঙ্খলতার সঙ্গে দিব্যি নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল।
ওকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। সে-টাকা নষ্ট হলেও কোনও প্রশ্ন করেননি ছেলেকে—কোনও জবাবদিহি চাননি। শুধু রেণুকণার কাছে আড়ালে আক্ষেপ করেছেন।
আলোক ওর ইচ্ছেমতো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আউটিং-এ গেছে। সারা রাত ধরে নাইটক্লাবে গিয়ে হুল্লোড় করেছে। কিংবা বাড়িতে ইয়ার দোস্তদের ডেকে রঙ্গিলা পার্টির আয়োজন করেছে।
একইসঙ্গে আলোকের পোশাক-আশাক, চুলের ছাঁট ইত্যাদি পালটে গিয়েছিল।
কখনও লম্বা-লম্বা চুল, এক কানে দুল, বুড়ো আঙুলে সোনার আংটি নিয়ে ও হাজির হয়েছে বিশ্বনাথের সামনে। আবার কখনও-বা জুলপি-হীন কদমছাঁট, হাতে রিস্ট ব্যান্ড, গলায় সরু চেন—তার লকেটে কঙ্কালের মাথা। আবার কোনওদিন নাভি পর্যন্ত খোলা থ্রি-কোয়ার্টার হাতা ফিনফিনে কাপড়ের জামা, বুকে নানান রঙের উল্কি, ডানবুকের নিপলে আটকানো সোনার রিং।
এইভাবে ছেলেটা ধীরে-ধীরে অচেনা হয়ে যাচ্ছিল বিশ্বনাথের কাছে। আলোক থেকে স্রেফ লোক হয়ে যাচ্ছিল।
জীবনের শেষ ক’টা বছর রেণুকণার বেশ কষ্টে কেটেছিল। চাপা গলায় আপনমনে প্রায়ই বলতেন, ‘আমাদের সেই আগের সময়টাই ছিল ভালো— যখন আর কেউ ছিল না…শুধু তুমি আর আমি…।’
কথাটা বলতে গিয়ে রেণুকণার গলা ধরে যেত। তিনি সবসময় বিশ্বনাথকে যেমন ছেলের কাছ থেকে আড়াল করতেন, একইসঙ্গে নিজেও ছেলের জীবন থেকে সরে থাকতে চাইতেন। গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকের মতো ওঁরা আলোকের জীবনযাপন দূর থেকে দেখতেন।
আলোক একটা ওষুধকোম্পানিতে প্রথম চাকরি নিয়েছিল। তারপর অত্যন্ত কম সময়ে উঠে গেল ওপরদিকে। হঠাৎ একদিন ও একটা এসি প্রিমিয়াম গাড়ি কিনে ফেলল—গাড়িটার রং তেল চকচকে কালো—ছ’টা দরজা। আর তার সপ্তাহদুয়েক পরেই একটা সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। রেণুকণাকে ডেকে বলল, ‘মাম, এ হল পারমিতা। আজ থেকে আমার সঙ্গে থাকবে—।’
ঘটনাটা রেণুকণাকে নতুন করে তেমন ধাক্কা দেয়নি। আধুনিক টিভি প্রোগ্রামের দৌলতে সবাই জানে যে, শাঁখা-সিঁদুর-বিয়ে বহুবছর ধরে মাথায় উঠেছে। এখন শুধু থাকাথাকির যুগ। যতদিন পোষায় একসঙ্গে থাকো। তারপর ইচ্ছে হলে একা চলে যাও।
কিন্তু বিশ্বনাথ বা রেণুকণা ব্যাপারটাকে ‘বিয়ে’ বলেই ভেবেছেন। পারমিতা আজও বিশ্বনাথের চোখে আলোর ‘স্ত্রী’।
আলোকের বিয়ের—অথবা, ওইরকম কিছুর—বছরখানেক পর রেণুকণা চলে গেলেন। চলে যাওয়ার সময় নিজে যেমন কষ্ট পাননি, তেমনিই কাউকে কষ্ট দেননি। রাতে ঘুমিয়েছিলেন। সকালে সেই ঘুম আর ভাঙল না। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, সিভিয়ার সেরিব্রাল অ্যাটাক। হাই ব্লাড প্রেশারের সমস্যা ছিলই—সম্ভবত সেটাই ঘুমের মধ্যে লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
রেণুকণা চলে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন না—তাই কিছুই গুছিয়ে যেতে পারেননি। বিশ্বনাথকে আচমকা ফাঁকা মাঠে একা দাঁড় করিয়ে চলে গেলেন। ঢেউয়ের দাপটে লাট খাওয়া মানুষের মতো বিশ্বনাথের সব ওলটপালট হয়ে গেল। তিনি হতবুদ্ধি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন।
তার পর থেকে পাঁচটি বছরে সবকিছুই কেমন বদলে গেল।
ফ্ল্যাটের সবচেয়ে ছোট ঘরটায় বিশ্বনাথের ঠাঁই হল। সরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে সিনিয়ার সুপারিটেন্ডেন্ট হিসেবে রিটায়ার করলেন এবং ছোটবেলার মতো বেকার হয়ে গেলেন।
টিভি দেখে, রেণুকণার কথা ভেবে, আর বই পড়ে সময় কাটাতে লাগলেন বিশ্বনাথ। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দিলেন। চারপাশের জীবন থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে তিনি যেন কোনও চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলেন। একটা অপ্রয়োজনীয় জীবনকে বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি আর গ্লানি বিশ্বনাথকে কুরে-কুরে খেতে লাগল।
সামনে রাখা থালার দিকে হাত বাড়ালেন। একটুকরো রুটি ছিঁড়ে নিয়ে সেটা দিয়ে খানিকটা বেগুনপোড়া মুড়ে নিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘দ্যাখো রেণু, কপালপোড়া দিয়ে রুটি খাচ্ছি—।’
গ্রাসটা মুখে পুরে দিলেন। একইসঙ্গে চোখ ফেটে জল এল। খাবারটা চিবিয়ে ঢোঁক গিলতে কষ্ট হল।
রেণুকণা ওঁর বুকের ভেতর থেকে বকুনি লাগালেন: ‘কী ছেলেমানুষের মতো করছ! কী খেলে সেটা বড় কথা নয়—শরীর রাখাটাই বড় কথা। ভুলে যাও কেন, তোমার বয়েস হয়েছে? নাও, খেয়ে নাও…কেঁদো না, লক্ষ্মীটি…।’
গলা ব্যথা করলেও খাওয়া শেষ করলেন বিশ্বনাথ। অনেকটা জল খেয়ে গলা সাফ করে তবেই ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারলেন আবার। পারমিতার ছকে দেওয়া নিয়ম মতো এঁটো থালা আর গ্লাসটা টয়লেটের কাছে ওয়াশবেসিনের নীচে রেখে দিলেন। তারপর বেসিনে হাত-মুখ ধুচ্ছেন, হঠাৎই একটা চাপা গরগর শব্দ শুনে বেসিনের সামনে আয়নার দিকে তাকালেন।
আলোকদের বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্টর।
লোমে ঢাকা ভারী শরীর। গলার কাছটায় লোমগুলো এত ঘন যে, গলার বেলটটা লোমে ডুবে গেছে। দুটো হলদে চোখ কী তীব্র! কপাল থেকে ছাই রং নেমে এলেও পরে সেটা গাঢ় হয়ে ছুঁচলো মুখের কাছে কালো হয়ে গেছে। চোয়াল দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। নাকের ডগাটা কুঁচকে ওপরের পাটির কয়েকটা দাঁত বের করে রেখেছে বলে হিংস্র আর ভয়ংকর লাগছে।
তার সঙ্গে ওই গরগর শব্দ।
রোজকার রুটিন থেকে বিশ্বনাথ জানেন, ভিক্টর এখন টয়লেটে যাবে। পারমিতা ট্রেনিং দিয়ে ওকে এটা অভ্যেস করিয়েছে। টয়লেট ব্যবহার করার সময় ভিক্টর একা থাকতে চায়—আশপাশে লোকজন চায় না। অর্থাৎ বিশ্বনাথকে এখন টয়লেটের কাছ থেকে সরে যেতে হবে।
বিশ্বনাথ সরে এলেন।
ভিক্টরের কাছাকাছি হতে ওঁর ভয় করে। কারণ, মাসকয়েক আগে ভিক্টর ওঁর হাতেকামড়ে দিয়েছিল। আলোক আর পারমিতার কাছে সে ঘটনা জানানোর পর ওদের যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল!
আলোকের কথাগুলো মনে পড়তেই বিশ্বনাথের কান গরম হয়ে উঠল। অপমান আর ধিক্কারের জ্বালা নতুন করে ছুঁচ ফোটাল বুকে।
ঘরে এসে অলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন বিশ্বনাথ। আজ আর বই পড়তে কিংবা টিভি দেখতে ইচ্ছে করল না।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে একটা হাত মাথার ওপরে রেখে অন্ধকার সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আলোক আর পারমিতার কাছে বিশ্বনাথের পরিচয় প্রয়োজনহীন নিষ্কর্মা একজন বাড়তি মানুষ। বিশ্বনাথ থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী! বিশ্বনাথ যে বেঁচে আছেন সেটা কেউ টের পায় না। আবার চলে গেলেও কেউ যে ওঁর অভাব টের পাবে তাও মনে হয় না।
সব মিলিয়ে এক হতচ্ছাড়া জীবন।
সেইজন্যই সন্দীপনের কথাটা মনে পড়ছিল বারবার।
সত্যিই তো! যে-জীবনটা অবহেলা আর অপমানে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে সেটাকে একটু বদলে নিলে ক্ষতি কী!
বিশ্বনাথের ইচ্ছে হল, এক মুহূর্তে সন্দীপনকে একটা ফোন করেন। কিন্তু উপায় নেই। বেস ফোন আলোকদের ঘরে। আর বিশ্বনাথের মোবাইল ফোন নেই।
কিন্তু সন্দীপনের আছে।
এই নতুন ‘চাকরি’টা নেওয়ার পরই বোধহয় তিনি মোবাইল ফোন কিনেছে।
কমিউনিটি পার্কে রিটায়ার্ড বৃদ্ধদের আড্ডায় সন্দীপন বিশ্বনাথের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কারণ, দুজনের জীবনে অনেকটা মিল আছে।
সন্দীপন বিপত্নীক। ওর এক ছেলে। ছেলে যেমন একরাশ মেয়েবন্ধু জুটিয়ে ফূর্তিফার্তা করে, ছেলের বউও একই টাইপের। দুজনে একেবারে যেন রাজযোটক। সন্দীপন ওদের সঙ্গে কোনওরকমে টিকে আছেন।
সেইজন্যই বিশ্বনাথের সঙ্গে সন্দীপনের সুখ-দুঃখের কথা হয় বেশি।
আজ সন্ধেবেলা পার্কে বসে সন্দীপনের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর বিশ্বনাথ হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একটা ভয়ংকর ধাক্কা খেয়েছিলেন।
কিন্তু যতই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছেন ততই মনে হচ্ছে, সন্দীপন ঠিকই করেছেন।
প্রথমত, এই ‘চাকরি’টা নিলে একটা কাজের মধ্যে থাকা যাবে। আর দ্বিতীয়ত, আর্থিক টানাপোড়নের জায়গাটা অনেক নরম আর সহজ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, এখন যে-জীবনে বিশ্বনাথ হাঁটছেন—হাঁটছেন কি না কে জানে!—তার ডাকনাম হয়তো ‘জীবন’, কিন্তু পোশাকী নাম যে ‘মরণ’ সেটা ক’জন বুঝবে!
বিশ্বনাথ ভেবে দেখলেন, মরে থাকা মানুষ আর মরতে পারে না। তাই ঠিক করলেন, কাল রাস্তায় বেরিয়ে সন্দীপনকে ফোন করবেন।
বাড়িটার বাইরের চেহারাটা যে ছদ্মবেশ সেটা বোঝা গেল ভেতরে ঢোকার পর। বাইরেটা যেমন জরাজীর্ণ, আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো, ভেতরটা ততটাই উলটো—ঝকঝকে, স্মার্ট। এটাই ‘শটস অ্যান্ড বিকস’-এর অফিস।
রাস্তার ফোনবুথ থেকে সন্দীপনকে ফোন করে একটা কোম্পানির নাম আর একটা সেল ফোনের নম্বর নিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। তারপর দুরুদুরু বুকে সেই নম্বরে ফোন করেছেন।
‘হ্যালো…”শটস অ্যান্ড কিকস”?’
‘ইয়েস।’ একটা মেয়েলি গলা উত্তর দিল, ‘আপনি কে বলছেন?’
বিশ্বনাথ নাম বললেন।
‘এই ফোন নাম্বারটা আপনাকে কে দিয়েছেন—রেফারেন্সটা কাইন্ডলি বলবেন?’
বিশ্বনাথ সন্দীপনের নাম-ঠিকানা বললেন।
সঠিক রেফারেন্স না দিতে পারলে কথাবার্তা যে সেখানেই শেষ সেটা সন্দীপন বারবার করে বিশ্বনাথকে বলে দিয়েছেন। বলেছেন যে, ওরা স্রেফ ‘রং নাম্বার’ বলে লাইন কেটে দেবে।
ও-প্রান্তে মেয়েটি একটু সময় নিচ্ছিল। বোধহয় কম্পিউটারের ডেটাবেস-এ সন্দীপনের নাম-ঠিকানাটা ক্রসচেক করে নিচ্ছিল।
একটু পরেই: ‘ও. কে., মিস্টার বোস, বলুন কীভাবে আপনাকে আমরা হেলপ করতে পারি—।’
বিশ্বনাথ বেশ চেষ্টা করে বললেন, ‘আমি সি. ভি. অপারেশান করাতে চাই।’
এ-কথা শুনে মেয়েটির যান্ত্রিক গলা একটুও কাঁপল না। ও বলল, ‘আপনার ফুল পোস্টাল অ্যাড্রেস দিন আর আপনার মায়ের বিয়ের আগের পদবী বলুন।’
বিশ্বনাথ নিজের পুরো ঠিকানা বললেন। তারপর আমতা-আমতা করে জানতে চাইলেন, ‘আমার মায়ের মেইডেন সারনেম? মা তো বহু বছর আগে মারা গেছেন…তাঁর বিয়ের আগের…।
মেয়েটি বিশ্বনাথকে বাধা দিয়ে বলল, ‘একটা-দুটো অফবিট পারসোনাল ইনফরমেশান আমরা ডেটাবেস-এ স্টোর করে রাখি, মিস্টার বোস। আমাদের কোনও পেশেন্ট ওভার দ্য ফোন কোনও ইনফরমেশান চাইলে আমরা তাঁর টেলিফোনিক পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশান নাম্বার ছাড়াও দু-একটা পারসোনাল ইনফো ক্রসচেক করে নিই—সেইজন্যেই আপনার মায়ের মেইডেন সারনেমটা দরকার। যদি বাই চান্স কেউ আপনার টি-পিন নাম্বারটা জেনেও যায়, সে আপনার নাম করে ফোন করেও আমাদের কাছ থেকে আপনার কোনও প্রাইভেট ইনফো বের করতে পারবে না।’ একটু দম নিল মেয়েটি। তারপর বলল, ‘দিস ইজ অ্যাবসোলিউটলি ফর প্রোটেকশান অফ ইয়োর প্রাইভেসি, মিস্টার বোস। আই হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড…।’
বিশ্বনাথ বুঝলেন, কিন্তু একইসঙ্গে অবাকও হলেন। এত সতর্কতা কীসের জন্য?’
একটু পরেই ওঁর মনে হল, অপারেশানটা হয়তো ইল্লিগাল—তাই এত সাবধান হতে চায় ওরা।
বিশ্বনাথ ওঁর মায়ের বিয়ের আগের পদবি বললেন।
তখন মেয়েটি ওঁকে একটা নম্বর দিয়ে বলল, ‘এটা আপনার রেফারেন্স নাম্বার। আমাদের অফিসের রিসেপশানে এসে এই রেফারেন্স নাম্বারটা বলবেন, আর আপনার ফোটো আই-ডি কার্ড দেখাবেন। তা হলেই আপনাকে একজন এক্সিকিউটিভ অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে। আপনার দেখা করার সময় হল সন্ধে সাতটা থেকে ন’টা। যদি আজ থেকে ঠিক সাতদিনের মধ্যে আপনি যোগাযোগ না করেন তা হলে আপনার সমস্ত রেকর্ডস আমাদের ডেটাবেস থেকে অটোমেটিক্যালি ইরেজড হয়ে যাবে। তখন আপনাকে পুরো কেসটা রিওপেন করতে হবে। ‘ইজ ইট ক্লিয়ার, মিস্টার বোস?’
এত কথা বলার সময় মেয়েটির গলায় এতটুকু ওঠা-পড়া হয়নি। মনে হচ্ছিল, টেলিফোনে মেয়েটি পড়া মুখস্থ বলছে।
এরপর মেয়েটি বিশ্বনাথকে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর ঠিকানা দিল। তারপর বলল, ‘উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট ইন ইয়োর পসিবল নিউ লাইফ, মিস্টার বোস। থ্যাংক ইউ ফর কলিং। হ্যাভ আ নাইস ডে।’
টেলিফোনে কথা বলার পর বেশ কয়েকদিন তীব্র দোটানায় ভুগেছেন বিশ্বনাথ। অপারেশান করাবেন—না কি করাবেন না? রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে রেণুকণার সঙ্গে অনেক কাল্পনিক তর্ক-বিতর্ক করেছেন, নিজের সঙ্গেও অনেক লড়াই করেছেন। কারণ, এই সি. ভি. অপারেশানটা পারমানেন্ট—রিভার্সিবল নয়। একবার অপারেশান হয়ে গেলে আর ফেরা যায় না।
বিশ্বনাথ অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এলেন, তিনি আর ফিরতে চান না।
সুতরাং বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে যাওয়ার কোনও ঝটকা টের পেলেন না বিশ্বনাথ। বরং মনে হল, সামনেই নতুন জীবন।
বাড়িটার রং চটে গেছে, নানান জায়গায় ফাটল। তার কোনও-কোনও জায়গা থেকে উঁকি মারছে বট-অশ্বত্থের চারা। রাস্তার ভেপার ল্যাম্পের কটকটে আলোয় বাড়িটাকে শতচ্ছিন্ন পোশাক পরা ভিখারি মনে হচ্ছে।
বাড়ির সদর দরজার মাথায় ছোট্ট ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ড। তাতে ইংরেজি হরফে লেখা: ‘শটস অ্যান্ড কিকস’। তার নীচে ছোট-ছোট হরফে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ।’
চারপাশে ড্রাগের নেশা কীরকম জাঁকিয়ে বসেছে সেটা বিশ্বনাথ ভালোই জানেন। সরকার ড্রাগ অ্যাবিউজের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত। খবরের কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেল খুললে ড্রাগের বিষয়ে খবর অন্তত শতকরা দশ ভাগ। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স থেকেই ঝাঁকে-ঝাঁকে ছেলেমেয়েরা ড্রাগের খপ্পরে পড়ছে। সেটা সামাল দিতে সরকার যে-স্পেশাল নারকোটিকস ডিপার্টমেন্ট খুলেছে তারা দিন-রাত হিমশিম খাচ্ছে। সেইসঙ্গে নাজেহাল হচ্ছে পুলিশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির সমস্যা থেকেই এই সমস্যাটা মাথাচাড়া দিয়েছে। আর অর্থনীতির সমস্যার শিকড়ে রয়েছে তীব্র বেকার সমস্যা।
না, এতসব জটিলতা বিশ্বনাথ বোঝেন না। তিনি শুধু দেখছেন, চারপাশের ছেলেমেয়েরা দিন-দিন কেমন উচ্ছৃঙ্খল বেপরোয়া হয়ে উঠছে, নিত্যনতুন নেশার পিছনে পাগলের মতো ছুটছে। ওদের সামনে নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে ঝকঝকে তকতকে একটা অফিসের মুখোমুখি হলেন বিশ্বনাথ। চারপাশে শুধু কাচের দেওয়াল, সৌখিন রাবার উডের ফার্নিচার, ল্যাপটপ কম্পিউটার আর টেলিফোন। কোথাও-কোথাও মিহি সুরে ফোনের রিং বাজছে—এ ছাড়া এয়ার কন্ডিশান্ড অফিসটায় আর কোনও শব্দ নেই।
সব পার্টিশান কাচের হাওয়ায় অফিসের ভেতর অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
বিভিন্ন কাচের দেওয়ালে যেসব স্লোগান আর পোস্টার লাগানো রয়েছে তাতে মনে হবে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর আসল কাজ হল ড্রাগের মারাত্মক নেশা ছাড়ানো। প্রতিটি পোস্টারে ওদের লোগো—’এস’, ‘এ’, ‘কে’ অক্ষর তিনটে সুন্দর জড়ানো কায়দায় লেখা।
বিশ্বনাথের অবাক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এটাও আর-একটা ছদ্মবেশ।
রিসেপশানে অনেক লোকের ভিড়। বেশিরভাগই কমবয়েসি ছেলেমেয়ে—সঙ্গে ওদের বাবা-মা কিংবা গার্জেন। ওঁরা সত্যি-সত্যি হয়তো ছেলেমেয়ের ড্রাগের নেশা ছাড়াতে এসেছেন।
ওই ভিড়ের মধ্যে দুজন বয়স্ক মানুষকে দেখে বিশ্বনাথের সন্দেহ হল। ওঁরা দুজন সি. ভি. অপারেশানের জন্য আসেননি তো!
কে জানে, ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ হয়তো ড্রাগের দু-দিকেই কাজ করে: ড্রাগের নেশা ধরানো এবং ছাড়ানো।
রিসেপশানিস্ট মেয়েটি ফুটফুটে দেখতে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। লম্বা-লম্বা নখে একই রঙের নেইলপালিশ। কানের লতিতে বিশাল মাপের দুটো রুপোলি রিং। ওর পিছনের দেওয়ালে জ্বলন্ত সিগারেটের ওপরে লাল কাটা চিহ্ন দেওয়া একটা পোস্টার।
রিসেপশানে বিশ্বনাথ নিজের নাম লেখা স্লিপ জমা দিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পালা আসতেই রিসেপশানিস্ট মেয়েটি ওঁর নাম ধরে ডাকল।
বিশ্বনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠে মেয়েটির কাছে গেলেন। নিজের রেফারেন্স নম্বর বললেন, ফটো আই-ডি কার্ড দেখালেন।
মেয়েটি ভাবলেশহীন মুখে ল্যাপটপের বোতাম টিপতে লাগল। কালো কিবোর্ডের ওপরে ওর নড়েচড়ে বেড়ানো লাল নখগুলোকে ফুলের পাপড়ি বলে মনে হচ্ছিল।
ল্যাপটপের পরদায় মেয়েটি কী দেখল কে জানে! শুধু চোখ তুলে বিশ্বনাথের দিকে কয়েকপলক তাকাল। তারপর বলল, ‘আপনি বসুন, মিস্টার বোস। আপনাকে নিতে লোক আসবে।’
তারপরই মেয়েটি কিবোর্ডের বোতাম টেপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বেশিক্ষণ বসতে হল না। সাদা অ্যাপ্রন পরা একটি ছেলে অফিসের ভেতর থেকে হেঁটে আসছিল রিসেপশানের দিকে। কাচের দরজা ঠেলে সে রিসেপশান জোনে এল। রিসেপশানিস্টের কাছে গিয়ে চাপা গলায় কী যেন জিগ্যেস করল। উত্তরে রিসেপশানিস্ট চোখের ইশারায় বিশ্বনাথকে দেখিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটি স্মার্টভাবে চলে এল বিশ্বনাথের কাছে। নীচু গলায় বলল, ‘মিস্টার বোস?’
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে উঠে দাঁড়ালেন।
‘কাইন্ডলি আমার সঙ্গে আসুন—।’
ছেলেটির সঙ্গে এগোলেন বিশ্বনাথ। ওকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। চোখের আধুনিক পলিমার লেন্সের চশমা। ফরসা, রোগা চেহারা। এতই রোগা যে, চোয়াল এবং কণ্ঠা বিশ্রীভাবে নিজেদের জাহির করছে। তবে ছেলেটির মাথার চুল অস্বাভাবিক ফোলানে-ফাঁপানো। ওর রোগা চেহারার সঙ্গে ভীষণ বেমানান লাগছে। ওর পা ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁকড়া চুলগুলো নড়ছে।
ছেলেটির সঙ্গে অনেকগুলো কাচের দরজা পেরোলেন বিশ্বনাথ। তারপর একটা পরদা ঘেরা কাচের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ছেলেটি বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল: ‘ভেতরে যান, মিস্টার বোস। ডক্টর মালাকার আপনার জন্যে ওয়েট করছেন।’
হাত বাড়িয়ে কাচের দরজা ঠেলে খুলল ছেলেটি। চোখের ইশারায় বিশ্বনাথকে ভেতরে যেতে ইশারা করল।
বিশ্বনাথ যখন ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকছেন তখন ছেলেটি চাপা গলায় বলল, ‘অল দ্য বেস্ট, স্যার—।’
ছেলেটি ‘স্যার’ বলায় বিশ্বনাথ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন। ছেলেটি মুচকি হেসে চলে গেল।
এতক্ষণ বিশ্বনাথের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছিল। যদিও জেদটা মনের ভেতরে ভালোমতোই জাঁকিয়ে বসেছিল। ছেলেটির বলা ‘স্যার’ শব্দটা বিশ্বনাথকে যেন নতুন এক ভরসা দিল। নতুন এক মর্যাদাও যেন অনুভব করলেন।
ভাবার সময় আর বেশি ছিল না। শক্ত পায়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন বিশ্বনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে ডক্টর মালাকার ওঁকে খুব চেনা আত্মীয়ের মতো অভ্যর্থনা জানালেন।
‘আরে, ‘আসুন…আসুন, বিশ্বনাথবাবু…’ একগাল হেসে দু-হাত বাড়িয়ে বিশ্বনাথের হাত চেপে ধরলেন মালাকার: ‘বলুন, কেমন আছেন? সব কুশল মঙ্গল তো!’
বিশ্বনাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাঠ-কাঠ হাসলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি—।’
ডক্টর মালাকার কি অন্য কোনও সূত্রে ওঁকে চেনেন? এমনভাবে ভদ্রলোক কথা বলছেন যেন কতদিনের চেনা!
‘বসুন, বসুন—’একটা শৌখিন রিভলভিং চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন ডক্টর মালাকার। তারপর একই ঢঙে উচ্চারণ করলেন, ‘হুম। তো আপনি ভ্যাম্পায়ার হতে চান? মানে, সি. ভি. অপারেশান করাতে চান—মানে, যেটাকে আমরা কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার বলি…।’
বিশ্বনাথ চেয়ারে বসলেন বটে, কিন্তু ওঁর গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
মালাকার তাঁর চেয়ারে বসে হাসি-হাসি মুখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোধহয় উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন।
আশ্চর্য! কী সহজে কথাগুলো বললেন মালাকার! যেন ব্যাপারটা রোজকার দাড়ি কামানোর মতোই মামুলি।
ঠান্ডা ঘরের মধ্যেও ঘেমে গেলেন বিশ্বনাথ। অবাক চোখে মালাকার এবং তাঁর অফিসটাকে দেখতে লাগলেন। যেন পুরোটাই অন্য কোনও গ্রহের ব্যাপার।
ডক্টর মালাকার বেশ মোটাসোটা। কোমরের বেলটের ওপর থেকে মাঝারি মাপের ভুঁড়ি উপচে পড়ছে। মাথায় মসৃণ টাক—শুধু কানের ওপরটায় কয়েক খাবলা কাঁচাপাকা চুল। আর কানের পাশ দিয়ে অনেকটা গালপাট্টার মতন পাকা জুলপির জঙ্গল নেমে এসেছে।
মালাকারের রং ফরসা—তবে কিছুটা রোদে পোড়া। কপালে কয়েকটা ভাঁজ। ছোট মাপের ভুরু। তার নীচেই মেটাল ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। দু-দিকে ফোলা গানের মাঝে নাকটা বক্সারদের মতো থ্যাবড়ানো। গোঁফ-দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। থুতনির নীচে দু-থাক চর্বি। সবমিলিয়ে মুখে একটা কমিক ভাব আছে। ফলে এই লোক যে সি. ভি. অপারেশন করেন সেটা ভাবাটা বেশ কঠিন।
মালাকারের চেম্বারটা মাপে বেশ বড়। দেখে ডক্টরস চেম্বার বলেই মনে হয়। দু-দেওয়াল জুড়ে ‘এল’ কাউন্টার। তাতে বেশ কয়েকটা মোটা-মোটা বই আর কাগজপত্র রাখা। তার পাশেই একটা এলসিডি মনিটারওয়ালা কম্পিউটার। মনিটারে কারসর দপদপ করছে।
কাউন্টারের বাঁদিকে প্রচুর ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। অপারেশানের জন্য সেগুলো ব্যবহার হয় কি না বিশ্বনাথ ঠিক বুঝতে পারলেন না। তার ঠিক ওপরেই কাচের দেওয়ালে একটা ইলেকট্রনিক ক্যালেন্ডার—তাতে আজকের তারিখটা লাল রঙে জ্বলছে।
ডক্টর মালাকারের সামনে রাবার উডের বড়সড় টেবিল। টেবিলের একপাশে ল্যাপটপ কম্পিউটার। হয়তো বিশ্বনাথ ঘরে ঢোকার আগে মালাবার এই কম্পিউটারেই কাজ করছিলেন।
কম্পিউটারের পাশে একটা বেঁটেখাটো প্ল্যাস্টিকের স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের একইঞ্চি ওপরে একটা ডাম্বেল আকৃতির রোটর শূন্যে ঘুরছে। আর স্ট্যান্ডের একপাশে লেখা ‘এস. এ. কে’।
এ ছাড়া টেবিলে পড়ে আছে রঙিন কয়েকটা পেন, দুটো মোবাইল ফোন, আর চার-পাঁচটা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন।
মালাকার আবার জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি সি. ভি. অপারেশানটা করাতে চান তো, বিশ্বনাথবাবু?’
বিশ্বনাথ মাইক টেস্ট করার মতো গলাখাঁকারি দিয়ে গলা টেস্ট করলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, চাই…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…।’
উত্তর শুনে মালাকার হাসলেন, বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! আপনার মতো কনফিডেন্ট পেশেন্ট আমরা খুব বেশি পাই না। বেশিরভাগই দোটানায় ভোগে।’
বিশ্বনাথ অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর কী করতে হবে সেটা ডক্টর মালাকার তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই ভালো। সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েই গেছে তখন আর দেরি করে লাভ কী!
সন্দীপন এখানকার কনট্যাক্ট নম্বর বিশ্বনাথকে দিয়েছেন, আর দু-চার লাইনে অপরেশানটার কথা বলেছেন। এও বলেছেন, ‘আর বেশি জানতে চেয়ো না। ওরা পুরো ব্যাপারটাই কনফিডেনশিয়াল রাখতে বলেছেন। তুমি আগে ডিসাইড করো কী করবে—তারপর ওখানে গেলে ওরাই সবকিছু তোমাকে ডিটেইলসে বলে দেবে…।’
এখন সেই ডিটেইলস শোনার পালা।
ডক্টর মালাকার টেবিলে রাখা ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালালেন। এলসিডি পরদার দিকে কয়েক সেকেন্ড আড়চোখে তাকালেন। তারপর বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন।
‘বিশ্বনাথবাবু, আমরা আপনার একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনটা বদলে দেব—নতুন থ্রিলিং জীবনের দরজা খুলে দেব আপনার সামনে।’ টেবিলের ওপরে ঝুঁকে এলেন মালাকার: ‘না, না—এগুলো মোটেই সেলস টক নয়। এগুলো হার্ড রিয়েলিটি। তা ছাড়া অপারেশানের জন্যে আমরা তো পয়সা নেব—সো ইউ শুড নট বি গ্রেটফুল টু আস। ইটস আ প্রফেশনাল ডিল। আপনি যা চান—আমরা দেব।
‘আপনি তো জানেন, এই টুয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরিতে টেকনোলজি বুম যেমন হয়েছে তেমনই হয়েছে অ্যাডিকশান বুম—স্ম্যাক বুম। এখনকার ইয়াং জেনারেশানের টুয়েন্টি এইট পার্সেন্ট অ্যাডিকটেড। মদ, গাঁজা, চরস, হ্যাশিশ, এলএসডি, মারিজুয়ানা, কোকেন, মরফিন, মিথাডেন, মেস্কালাইন—এরকম কত নাম আর বলব! এর কোনওটা স্টিমুল্যান্ট, কোনওটা নারকোটিক, আবার কোনওটা বা হ্যালুসিনোজেন। এরকম আরও অনেক টাইপ আছে। কিন্তু লাস্ট পনেরো কি বিশ বছরে আরও অনেক নতুন-নতুন নেশা ইনট্রোডিউসড হয়ে গেছে…।’
ডক্টর মালাকারকে বাধা দিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ—যেমন সাপের ছোবল।’
হাসলেন মালাকার: ‘ঠিকই বলেছেন। তবে সাপের ছোবলেই ব্যাপারটা থেমে থাকেনি। সাপের পাশাপাশি চালু হয়েছে পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে, গিরগিটি আর বেজির কামড়—এ ছাড়া যদিও খুব রেয়ার এবং কস্টলি, কেউ-কেউ নেশার জন্যে অ্যামেরিকার অ্যারো-পয়জন ফ্রগের বিষ ডাইলুট করে ব্যবহার করে। আপনি জানেন কি না জানি না—বহুবছর আগে কাফ সিরাপ আর ঘুমের ট্যাবলেটও এসব কাজে ব্যবহার হত—’
বিশ্বনাথ মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, তিনি শুনেছেন।
ডক্টর মালাকার ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু এখন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে কোন নেশা জানেন?’
বিশ্বনাথ জানেন। সন্দীপনের কাছে শুনেছেন। কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। ডক্টর মালাকারের কাছ থেকেই উত্তরটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
‘ভ্যাম্পায়ারের ছোবল।’ চোখ বড়-বড় করে বললেন মালাকার, ‘এটাই এখন ট্রেন্ডি। বড়লোকের নেশা করা ছেলেমেয়েরা এই ছোবলের জন্যে পাগল। বুঝতেই পারছেন, এই নেশাটা কস্টলি—তাই একটু অ্যাফ্লুয়েন্ট ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরাই এই নতুন নেশায় হ্যাবিচুয়েটেড…। চলতি কথায় এটাকে আমরা বলি ”ভি-স্টিং”। আফটার সি. ভি. অপারেশান স্টিং প্রোভাইড করাটাই হবে আপনার প্রফেশান। তাতে খুব একটা খারাপ ইনকাম হবে না আপনার। তা ছাড়া বোনাস হিসেবে কতকগুলো বাড়তি সুবিধে পাবেন…থাক—সেগুলো পরে জানবেন।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে হাত বোলালেন মালাকার: ‘মোট কথা, আমি আপনাকে বলছি, আফটার অপারেশান, দিস নিউ লাইফ ইজ গোয়িং টু বি ভেরি-ভেরি ইন্টারেস্টিং। রিয়েলি ইট ইজ—কারণ, এ পর্যন্ত আমরা কোনও কমপ্লেইন পাইনি।’
টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সেইসঙ্গে কেঁপে উঠে নড়তে লাগল টেবিলের ওপরে।
ডক্টর মালাকার ফোনটা তুলে কথা বললেন, ‘হ্যাঁ’, ‘হ্যাঁ’, করে কিছুক্ষণ কথা বলে শেষে বললেন, ‘হ্যাঁ, পেশেন্টের সঙ্গে ফাইনাল কথা বলে অপারেশানের ডেট ফিক্স করে নিচ্ছি। ও. কে.।’
মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে ওটা টেবিলে আবার রেখে দিলেন মালাকার। তারপর স্থির চোখে তাকালেন বিশ্বনাথের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘মিস্টার বোস, লেট আস নাউ কাম ডাউন টু বিজনেস। লেট মি টেল ইউ দ্য ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস অ্যাবাউট দ্য সি. ভি. অপারেশান…।’
ডক্টর মালাকার বলে গেলেন, বিশ্বনাথ শুনে গেলেন।
অপারেশানটার জন্য খরচ দু-ঘণ্টা সময়, আর চল্লিশ হাজার টাকা। তবে হিসেব করলে অপারেশানটা মোটেই কস্টলি নয়। কারণ, অপারেশনের পরে বিশ্বনাথ যখন ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর মাধ্যমে নেশার ক্লায়েন্ট পাবেন, তখন ক্লায়েন্টপিছু এক-একটা রাতের জন্য তিনি পাবেন একহাজার টাকা। তার মধ্যে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ কেটে নেবে থার্টি পার্সেন্ট। সুতরাং অঙ্ক কষলে দেখা যাবে, মাত্র আটান্ন রাতের কাজ পেলেই বিশ্বনাথের অপারেশানের খরচ উঠে আসবে। তা ছাড়া অপারেশানের পর বিশ্বনাথ কিছু নতুন-নতুন ক্ষমতার মালিক হবেন। সেগুলো বোনাস বলেই ভাবেন।
‘আমাদের এই অপারেশান বা রিলেটেড ব্যাপারগুলো কিন্তু অ্যাবসোলিউটলি কনফিডেনশিয়াল। আমাদের যে-এগ্রিমেন্ট তৈরি হবে তার একটা মেজর কন্ডিশানই হচ্ছে সিক্রেসি। কারণ, জেনে রাখুন, এই সি. ভি. অপারেশানটা পানিশেবল আন্ডার ইন্ডিয়ান পিনাল কোড। যদি অপারেশানের পরে আমাদের সিক্রেট পুলিশ কিংবা সিকিওরিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট আপনার খোঁজ পায়…যদি জানতে পারে যে, আপনি কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে আপনাকে অ্যারেস্ট করবে। তা ছাড়া ভ্যাম্পায়ারের ছোবল দিয়ে নেশা করা বা করানো—দুটোই ইল্লিগাল।’ মালাকার আবার চওড়া হাসলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো ভুঁড়ির ওপরে রাখলেন। একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন, ইল্লিগাল হলে এই কাজটা আমরা করছি কেন। করছি কারণ, এই অপারেশানটা বায়োটেকনোলজির একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট। তা ছাড়া আমরা ভালো কাজও তো করছি! এই যে, কত ছেলেমেয়েকে ড্রাগের সর্বনাশা নেশা থেকে বাঁচাচ্ছি! আসলে একগাদা পুণ্যের সঙ্গে ছিটেফোঁটা পাপ মিশে থাকলে ওটা হিসেবের মধ্যে আসে না।
‘মোট কথা, মিস্টার বোস, আপনি এখন ”এস এ সি”-র টপ সিক্রেট জোনে ঢুকে পড়েছেন। এবার আপনাকে এগ্রিমেন্ট ফর্ম আর বন্ড সই করতে হবে। তারপর আপনার রুটিন মেডিকেল চেক-আপ করা হবে। এই ইসিজি, ইইজি, ব্লাডপ্রেশার, ইউএসজি এইসব আর কী!
‘এবারে বলুন, আপনি কবে অপারেশানটা করাতে চান?…
বিশ্বনাথ যে সি. ভি. অপারেশানটা করিয়েছেন সেটা আলোক বা পারমিতা টের পেল না। কারণ, অপারেশানটা এমন যে, অপারেশানের পর ঘণ্টাতিনেক রেস্ট নিলেই রুগি চাঙ্গা হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। ফলে বিশ্বনাথও অপারেশানের পর ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ থেকে দিব্যি পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এসি ট্রলি বাস ধরে বাড়ি চলে এসেছেন। ওরা কেউ কিছু টের পায়নি।
তবে ভিক্টর বিশ্বনাথকে দেখে একটু যেন বাড়তি গরগর করেছিল। তাতে ভয় পেয়ে সাততাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।
বিশ্বনাথের কেমন যেন গা গুলোচ্ছিল। তাই রাতে আর কিছু খাননি। ডক্টর মালাকার বলেছেন, ক’টা দিন ঠান্ডা নরম জিনিস খেতে—তার সঙ্গে দুধ বা ফলের রস।
তেতো হাসি আঁকা হয়ে গেল বিশ্বনাথের ঠোঁটে। দুধ বা ফলের রস! মালাকার তো আর জানেন না ও-দুটো জিনিসের বন্দোবস্ত করতে গেলে অকর্মণ্য বেকার বুড়ো বাপের জন্য আলোর যা বাজেট সেটা ছাড়িয়ে যাবে!
ডক্টর মালাকার বন্ধুর মতো সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বনাথকে। সাতদিন বিশ্রাম। তারপর ‘এস এ কে’-তে গিয়ে ডক্টর মালাকারের কাছে পোস্ট অপারেশনাল চেক-আপ। এই রুটিন চলবে টানা বত্রিশ দিন। তারপর বিশ্বনাথ নতুন জীবনের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবেন।
যেহেতু অপারেশানটা রিভারসিবল নয় সেহেতু মালাকার বারবার করে বলেছেন, নতুন জীবন নিয়ে কখনও কোনওরকম আক্ষেপ না করতে। এও বলেছেন, ‘…আপনার যা বয়েস তাতে দুঃখ বা আক্ষেপ হলেও খুব বেশিদিন সেটা আপনাকে সইতে হবে না। সবসময় অপটিমিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলবেন, বিশ্বনাথবাবু। ইট উইল বি গুড ফর ইয়োর নিউ লাইফ।’
আলোক আর পারমিতার জীবন ওদের ছন্দে চলছিল। আর বিশ্বনাথ থেকেও-না-থাকার ঢঙে দিন কাটাতে লাগলেন। শুধু অপারেশানের উপসর্গগুলো ওঁকে কষ্ট করে সইতে হচ্ছিল। দাঁতে আর মাড়িতে অসহ্য ব্যথা, কান ভোঁ-ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, গলা শুকিয়ে আসা। মালাকার ওঁকে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। বলেছেন, ‘দরকার মনে করলেই আমাকে ফোন করবেন। আমার ফোন চব্বিশ ঘণ্টা অন থাকে—।’
অপারেশানের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বনাথের কোনও জ্ঞান ছিল না। তবে অপারেশানের আগে ডক্টর মালাকার সংক্ষেপে সহজে ব্যাপারটা ওঁকে মোটামুটি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
বিশ্বনাথের ক্যানাইন টুথ বা শ্বদন্ত দুটো আধুনিক কৌশলে রিস্ট্রাকচারড করা হয়েছে। ফলে দাঁত দুটো এখন আরও চোখা হয়েছে। আর ও-দুটোর ভেতরে সূক্ষ্ম চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। ওর লালা গ্রন্থির মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট করা হয়েছে একটা স্পেশাল ভ্যাম্পায়ার সিরাম গ্ল্যান্ড। এ ছাড়া নার্ভাস সিস্টেমটাকেও রিমডেল করে ভাইটালাইজ করা হয়েছে। আর মাসল স্ট্রেংথ অনেক বাড়ানো হয়েছে—সেই সঙ্গে কমানো হয়েছে যন্ত্রণা অনুভবের ক্ষমতা।
ডক্টর মালাকারের ভাষায়, ‘…পুরো ব্যাপারটাই এটা হাই-টেক ইনট্রিকেট কোঅর্ডিনেটেড অপারেশান। গত পাঁচ দশকে বায়োটেকনোলজির ফেনোমেনাল বুম না হলে এই অপারেশানটা শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানের বইয়ে পাওয়া যেত—বিজ্ঞানের বইয়ে নয়।’
বিশ্বনাথ বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অপারেশানের পর আমি তা হলে কী হব? মানুষ, না ভ্যাম্পায়ার?’
‘দুটোই—।’ হেসে বলেছেন মালাকার, ‘ইউ উইল হ্যাভ দ্য বেস্ট অফ বোথ ওয়ার্ল্ডস।’
তারপর তাঁর সে কী মজার হাসি!
হতভম্ব বিশ্বনাথের চোখের সামনে সন্দীপনের মুখটা ভেসে উঠেছিল। সন্দীপন বলেছিলেন, তিনি বেশ মজায় আছেন। কোনও সমস্যা নেই। যেহেতু এই সিক্রেট অপারেশানটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করাটা স্ট্রিকটলি বারণ, তাই সন্দীপন সব খুলে বলতে পারছেন না। শুধু বিশ্বনাথের দুরবস্থা দেখে বন্ধু হিসেবে মনে কষ্ট পেয়েছেন বলেই পথের নিশানাটুকু জানিয়েছেন।
অপারেশানের সাতদিন পর থেকেই বিশ্বনাথ পরিবর্তনগুলো টের পেতে লাগলেন।
আগে অন্ধকারের সময় কাটাতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। কারণ, একরাশ বিষণ্ণতা মনটাকে ঘিরে ফেলত। রেণুকণার সঙ্গে মনে-মনে কথা বলা শুরু করে দিতেন—সেই কথার বেশিরভাগটাই ছিল আক্ষেপের।
কিন্তু এখন ধীরে-ধীরে সব কেমন পালটে যাচ্ছে। অন্ধকারের আকর্ষণ ক্রমশ টের পাচ্ছেন বিশ্বনাথ। সন্ধের পর নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে উঠে সময় কাটাতে বেশ লাগে। খুব প্রয়োজন না হলে ঘরের আলো জ্বালেন না। আর সেই অন্ধকারে চোখ মেলে কত না নতুন-নতুন রূপ দেখতে পান বিশ্বনাথ। ওঁর চোখের সামনে জমাট অন্ধকার কেমন সুন্দর-সুন্দর ছবি তৈরি করে। তখন রেণুকণার সঙ্গে কথা বলেন বিশ্বনাথ। আক্ষেপের নয়—আনন্দের কথা। যেমন, আর কিছুদিন পর থেকেই বিশ্বনাথের টাকাপয়সার টানাপোড়েন আর থাকবে না। তখন অনেকটা নিজের মতো করে বাঁচতে পারবেন। রাস্তার হোটেল-রেস্তরাঁয় ইচ্ছেমতো ভালো-মন্দ কিছু খেতে পারবেন। কোনও দুঃস্থ মানুষকে পাঁচটা টাকা ভিক্ষে দিতে পারবেন। কমিউনিটি পার্কে খেলতে আসা ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের লজেন্স বা চকোলেট বিলি করতে পারবেন।
বিশ্বনাথের খুশি-খুশি ভাব দেখে রেণুকথা খুশি হন। নিশ্চিত হন।
ঘ্রাণশক্তিও কি খানিকটা বেড়ে গেছে বিশ্বনাথের? পারমিতার ঠিকে কাজের লোক যখন রান্নাঘরে রান্না করে তখন ঘরে বসেও সে-রান্নার গন্ধ তিনি পান কেমন করে? ভিক্টরের গন্ধও বা মাঝে-মাঝে নাকে আসে কেন?
আগে তো এমন আসত না!
নতুন এই ক্ষমতাগুলোকে বিশ্বনাথ উপভোগ করছিলেন আর বত্রিশ দিন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ডক্টর মালাকারের রুটিন চেক-আপ চলছিল। প্রতিটি চেক-আপের পর তিনি দিলখোলা ঢঙে হেসে বলেন, ‘ইউ আর হিলিং আপ একসিলেন্টলি। আই অ্যাম রিয়েলি সারপ্রাইজড।’
ডক্টর মালাকার একদিন বললেন, ‘আপনার হিলিং আপ প্রসেস শেষ হয়ে গেলে আমাকে মোবাইলে মাঝে-মাঝে ফোন করবেন। আমি আপনাকে প্রথম ক্লায়েন্ট দেব। আর ভি-স্টিং এর প্রসেসটাও ভালো করে বুঝিয়ে দেব। ও. কে.?
বিশ্বনাথ বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে, ‘এস এ কে’ থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কিন্তু বিশ্বনাথের দাঁত নিয়ে কৌতূহল ছিল। রোজ সকালে ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজার সময় শ্বদন্ত দুটোকে পরখ করেন। দেখেন তার ওপরের মাড়ির অবস্থাটা। চোয়াল নাড়িয়ে দাঁতে-দাঁতে আলতো করে ঠোকাঠুকি করেন। না, তেমন ব্যথা আর নেই।
শুধু এতেই থামেননি বিশ্বনাথ। লুকিয়ে-লুকিয়ে কামড় দিয়েছেন বিছানার তোশকে। সেটা সে শুধু দাঁতের জোর পরীক্ষার জন্য তা নয়। দাঁত কেমন যেন সুড়সুড় করছিল কামড় দেওয়ার জন্য—কুকুরছানাদের যেমন করে।
অস্বীকার করে লাভ নেই, তোশকে কামড় দিয়ে একটু যেন তৃপ্তিও পেয়েছেন। যদিও জিভে তোশকের স্বাদটা মোটেই ভালো ঠেকেনি।
সেরে ওঠার বেশ কিছুদিন পর প্রথম ক্লায়েন্টের ডাক পেলেন বিশ্বনাথ। ডক্টর মালাকার বিশ্বনাথকে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ‘এস এ কে’-র স্পেশাল সেল’-এ। ওরাই ক্লায়েন্টদের ফাইল মেনটেইন করে।
স্পেশাল সেল-এর কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে ক্লায়েন্টের ঠিকানায় পৌঁছে গেলেন।
শশিভূষণ দে স্ট্রিটের একটা অন্ধকার বাঁকে দাঁড়িয়ে একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ি। বাড়ির একতলায় একটি মলিন মিষ্টির দোকান। তার রং-চটা সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে একমাত্র ভগবানই জানেন। দোকানের ময়লা শো-কেসের বেশিরভাগটাই খালি। যে-ক’টা মিষ্টি চোখে পড়ছে সেগুলো মনে হয় বেশ পুরোনো। দোকানের দেওয়ালে ঝুল-কালির ছোপ। একটি নাদুসনুদুস লোক খালি গায়ে শো-কেসের পিছনে বসে আছে।
এই মিষ্টির দোকানটাই বিশ্বনাথের ল্যান্ডমার্ক। এই দোকানেই ক্লায়েন্ট ব্রতীন সরকারের খোঁজ করতে হবে।
খোঁজ করলেন বিশ্বনাথ। তারপর দোকানের পাশের ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
সিঁড়িতে ওঠার আগে বাঁ-দিকে একটা তালিমারা কাঠের দরজা। তাতে নতুন রং করা হয়েছে। দরজার পাল্লায় একচিলতে কম্পিউটার প্রিন্টআউট আঠা দিয়ে সাঁটা। তাতে ব্রতীন সরকার নামটা ছাপা রয়েছে।
দরজায় টোকা মারলেন বিশ্বনাথ। একইসঙ্গে স্পেশাল সেল-এর নির্দেশ মনে পড়ল: ‘ভি-স্ট্রিং-এর কাজটা সারতে আড়াই মিনিট মতো লাগে। কোনও অবস্থাতেই ক্লায়েন্টের সঙ্গে পাঁচমিনিটের বেশি কাটাবেন না। মনে রাখবেন, যে-সার্ভিসটা আমরা ক্লায়েন্টদের প্রোভাইড করছি সেটা অ্যাবসোলিউটলি ইল্লিগাল। সিক্রেট পুলিশ কিংবা সিকিওরিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের হাত থেকে আপনাকে বাঁচতে হবে। আপনি যে-কাজে যাচ্ছেন সেটা একটা কাজ। এখানে পারসোনাল রিলেশানের কোনও জায়গা নেই।’
দরজা খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে পঁচিশ-ছাব্বিশের ছিপছিপে এক ফরসা যুবক। মাথার চুল কদমছাঁট। দু-গালে কুণ্ডলী পাকানো সাপের উল্কি। বাঁ ভুরুর শেষে একটা ছোট আংটি।
ব্রতীনের চোখ ঢুলুঢুলু। তবে সেটা নেশার জন্য নাও হতে পারে। কারণ, বিশ্বনাথ কোনওরকম গন্ধ পেলেন না।
ওর গায়ে লাল স্যান্ডো গেঞ্জি, আর পরনে সাদা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট—যাকে সবাই থ্রি-কিউ বলে।
‘কী চাই?’ ভারী গলায় প্রশ্ন করল ব্রতীন।
স্পেশাল সেল-এর বলে দেওয়া কোড নম্বরটা বললেন বিশ্বনাথ।
ঠোঁটে হাসল ব্রতীন। ওর চোখের মণি প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হল। ঘষা নার্ভাস গলায় বলল, ‘আসুন, ভেতরে আসুন—।’
পাশের কোনও ঘর থেকে কড়াইয়ে ফোড়ন দেওয়ার ‘ছ্যাঁক’ শব্দ পেলেন বিশ্বনাথ। ওঁর বুকের ভেতরটাও কেমন যেন ‘ছ্যাঁক’ করে উঠল। সামনেই প্রথম পরীক্ষা। বিশ্বনাথ ঠিকঠাক পারবেন তো?
রান্নার গন্ধ নাকে গিয়ে ব্রতীনের ঘরে ঢুকলেন।
ছোট্ট অগোছালো ঘর। চারপাশে কড়া সিগারেটের গন্ধ। রঙিন জামা-প্যান্ট এখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। একটা ছোট্ট টেবিল বইপত্রে পাহাড় হয়ে রয়েছে। খাট বিছানা প্রায় লন্ডভন্ড। তার ওপরে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, তিনটে রঙিন সলিউবল প্লাস্টিকের প্যাকেট আর বেশ কয়েকটা একশো টাকার নোট এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। একদিকের দেওয়ালে দড়িতে একরাশ জামাকাপড় ঝুলছে। তার পাশেই মাঝারি মাপের একটা শৌখিন আয়না।
ব্রতীন ঘরের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিল। বোধহয় ওরও এটা প্রথমবার।
বিশ্বনাথ কাঁপা হাতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে খিল এঁটে দিলেন। তারপর ব্রতীনের দিকে হাত বাড়ালেন: ‘টাকাটা?’
বাইটের ফি-টা আগে চেয়ে নেওয়াটাও নিয়মের মধ্যেই পড়ে। স্পেশাল সেল থেকে এটা বিশ্বনাথকে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে।
ব্রতীন বিছানার ওপরে হুমড়ি খেয়ে খামচে-খামচে একশো টাকার নোটগুলো তুলে নিল। কাঁপা হাতে খসখস শব্দ করে গুনে নিল। তারপর বিশ্বনাথের দিকে এগিয়ে দিল: ‘ওয়ান থাউজ্যান্ড…।’
বিশ্বনাথ টাকাটা গুনে পকেটে রাখলেন। টাকাটা নেওয়ার সময় ওঁর কানদুটো কেমন গরম হয়ে উঠল। মনে হল যেন, পৃথিবীর আদিম ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। টাকার বিনিময়ে খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করা।
‘কনভার্টেড ভ্যাম্পায়াররা এরকম এজেড হয় নাকি?’ ব্রতীন নার্ভাসভাবে জিগ্যেস করল।
বিশ্বনাথ ওর দিকে তাকাতেই খেয়াল করলেন, ব্রতীন ওঁকে খুঁটিয়ে দেখছে।
বিশ্বনাথ ধীরে-ধীরে নার্ভাস ভাবটা কাটিয়ে উঠছিলেন। নিজেকে বুড়ো ভাবতে এখনও রাজি নন। তাই ব্রতীনের কথার ‘এজেড’ শব্দটা ওঁকে একটু খোঁচা দিয়েছিল।
‘তা আপনি কি পঁচিশ-ছাব্বিশের টগবগে ইয়াং লেডিকে আশা করেছিলেন নাকি?’
ব্রতীন এই পালটা প্রশ্নে মোটেই আহত হল না। বরং সরলভাবে বলল, ‘না, আমি তো ঠিক জানি না…মানে, আগে কখনও বাইট নিইনি…তাই। আপনি কিছু মাইন্ড করবেন না, প্লিজ…।’
ছেলেটার কথায় বিশ্বনাথের কেমন যেন মায়া হল। বুঝতে পারলেন, এটাই ওর ভার্জিন বাইট। বিশ্বনাথের আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বললেন না। স্পেশাল সেল-এর নির্দেশ মনে পড়ল: ‘ক্লায়েন্টদের সঙ্গে প্রফেশন্যাল প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও নয়। ডোন্ট ওয়েস্ট আ সিঙ্গল মোমেন্ট। ইট ইজ অ্যান ইমপরট্যান্ট সেফটি রুল…।’
বিশ্বনাথ চোখ থেকে চশমাটা খুলে পকেটে ভরে নিলেন। তারপর ব্রতীনের কাছে এগিয়ে গেলেন।
টের পেলেন ঘামতে শুরু করেছেন। বুকের ভেতরে হাপর চলছে। রেণুকণার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। এরকমই হাপর চলেছিল ওকে প্রথম জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার সময়।
ব্রতীন ঠিক বুঝতে পারছিল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কী ওর করার আছে। ওর চোখের নজরে কেমন যেন একটা হতবুদ্ধি ভাব ছায়া ফেলছে। একজন কিশোরীর মতো অস্বস্তি নিয়ে ও ভার্জিন বাইটের জন্য অপেক্ষা করছিল।
ব্রতীন মাথাটা ডানদিকে সামান্য হেলিয়ে দিল। বিশ্বনাথ ওর কণ্ঠার হাড় দেখতে পেলেন। বাঁ কানের লতির ইঞ্চিতিনেক নীচে ফরসা কোমল জায়গাটায় মনোযোগ দিয়ে তাকালেন। এইরকম জায়গায় ঠোঁট রেখে রেণুকণাকে আদর করেছেন অসংখ্যবার। কখনও-কখনও মৃদু দংশনও করেছেন।
আজ রেণুকণার বদলে একজন পুরুষ। আর দংশনও বিষাক্ত।
আর দেরি করলেন না বিশ্বনাথ। ব্রতীনের দু-কাঁধে হাতের ভর রেখে মুখ নীচু করলেন। ঠোঁট ছোঁয়ালেন ঘাড় আর কাঁধের জোড়ের কাছটায়। তারপর ঠোঁট ফাঁক করে শ্বদন্ত উঁচিয়ে ধরলেন।
ঠিক তখনই আড়চোখে আয়নাটার দিকে কেন তাকিয়েছিলেন কে জানে! সেখানে দেখা গেল একজন সুঠাম প্রৌঢ়ের মুখ। হাঁ করার ফলে মুখের চারপাশে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বাঁ-গালে একটা ছোট তিল।
সবই ঠিক ছিল—শুধু একটা জায়গায় বিশ্বনাথ ধাক্কা খেলেন। আয়নার প্রৌঢ়ের চোখে তৃষ্ণা মেটানোর আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।
বিশ্বনাথ আর ভাবতে চাইলেন না। ওঁর নাকে ব্রতীনের ঘামের গন্ধ আসছিল। সেই গন্ধটাই কোন অজানা কৌশলে ফেরোমোনের কাজ করছিল যেন। বিশ্বনাথকে টানছিল।
আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। দাঁত বসালেন।
ছোট্ট করে ‘আঃ’! শব্দ করল ব্রতীন। যন্ত্রণা আর আমেজে ওর চোখ বুজে গেল।
ভালো করে কামড় দিলেন বিশ্বনাথ। বুঝতে পারলেন, ভ্যাম্পয়ার সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ পড়ছে। একইসঙ্গে টের পেলেন, কামড়টা তোশকের তুলনায় অনেক—অনেক ভালো লাগছে। একটা উত্তেজনার ঢেউও যেন খেলা করছে বিশ্বনাথের শরীরে।
ব্রতীনকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন। দুটো পুরুষ-শরীর ক্রমে জট পাকিয়ে যেতে লাগল। কেউ দেখলে ভাববে, সমকামী টানে শঙ্খ লাগা দুটো মানুষ।
আবার কামড় বসালেন বিশ্বনাথ। তারপর আবার।
স্পেশাল সেল-এর এটাই নিয়ম। মোট তিনবার। বোধহয় নেশাটাকে সুনিশ্চিত করার জন্য।
দ্বিতীয় কামড়ের পরেই রক্তের নোনা স্বাদ পেলেন। এই স্বাদটা যতটা জঘন্য লাগার কথা ততটা লাগল না। বরং ব্রতীনের ঘাড় থেকে মুখ তোলার পর দাঁতে এবং ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত জিভ দিয়ে দিব্যি চেটেপুটে মুছে নিলেন।
বিশ্বনাথের হাতের বাঁধনে ব্রতীন এলিয়ে পড়েছিল। বিশ্বনাথ অনায়াসে ওর শরীরটা তুলে নিয়ে বিছানায় ঢেলে দিলেন। পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে দিলেন। তারপর সঙ্গে তার নিয়ে আসা স্টিকিং প্লাস্টার এঁটে দিলেন ব্রতীনের ক্ষতচিহ্নের ওপরে।
শরীরটা একটু দুর্বল লাগছিল। মাথাটাও যেন ঝিমঝিম করছিল খানিকটা। এগুলো বাইটের আফটার এফেক্ট। স্পেশাল সেল তাই বলেছিল।
নিজেকে সামলাতে দশ কি পনেরো সেকেন্ড সময় নিলেন। বিছানায় শিশুর মতো অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা ব্রতীনের দিকে একবার তাকালেন। ঘুমন্ত ছেলেটার মুখ দিয়ে তৃপ্তির একটা ‘উঁ-উঁ’ শব্দ বেরিয়ে আসছে।
বিশ্বনাথ হঠাৎই অবাক হলেন। গায়ের শক্তি কি বেড়ে গেছে? নইলে ব্রতীনকে এত সহজে পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন কীভাবে? ডক্টর মালাকার তো গায়ের জোর বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনও কথা বলেননি! তা হলে কি এটা হিসেবের বাইরের কোনও ঘটনা? সি. ভি. অপারেশানের পর যে-যে পরিবর্তনগুলো হওয়ার কথা তার বাইরেও কি কিছু-কিছু হয়ে যায়? ব্যাপারটা কি চান্স ফ্যাক্টর, না হিউম্যান ফ্যাক্টর?
বিশ্বনাথ আর সময় নষ্ট করলেন না। চুপিসারে ব্রতীনের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজাটা আলতো করে টেনে ভেজিয়ে দিলেন। তারপর চলে এলেন রাস্তায়।
ওঁর প্রথম বাইটের অ্যাডভেঞ্চার বেশ নিশ্চিন্তেই শেষ হল বলা যায়। তাই বাড়ি ফেরার পথে বিশ্বনাথ হালকা মনে রেণুকণার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকিতে মেতে উঠলেন। শুধু ওঁর মুখের ভেতরে একটা আঁশটে গন্ধ লেগে ছিল। গন্ধটা বিশ্বনাথের খুব একটা খারাপ লাগছিল না।
তিতলির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা বিশ্বনাথের জীবনে একটা অলৌকিক ঘটনা। আর দেখা হলও এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। চৌরঙ্গি এলাকার বারগুলো তখন সবে সন্ধে শুরু করেছে। প্রতিটি বারের বাইরে লাল-নীল-সবুজ নিওন সাইন। তার পাশেই হলোগ্রাম ছবিতে প্রায়-নগ্ন ক্যাবারে নাচের বিজ্ঞাপন। হলোগ্রাম-নর্তকী সুরের ঝংকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরের নানান প্রত্যঙ্গ নাচিয়ে চলেছে। আলো আর সুরের মেলা জাঁকিয়ে বসেছে রাস্তাটায়।
বিশ্বনাথ আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। চারপাশের প্রাপ্তবয়স্ক জগৎ দেখছিলেন।
বারগুলোর বাইরে মানুষজনের জটলা। কেউ হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। কেউ চাপা গলায় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে, কেউ-বা ঢলানি সঙ্গিনীর কোমর জড়িয়ে ধরে অসভ্যতায় মেতেছে।
আনমনা হাঁটতে-হাঁটতে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামটা সবে ছাড়িয়েছেন, হঠাৎই দেখলেন একটা গাড়ি ছুটে এসে একটা গাড়ির গায়ে রুক্ষভাবে ধাক্কা মারল। ধাতু আর প্লাস্টিক ভেঙে পড়ার শব্দ হল। তারপর চেঁচামেচি।
জায়গাটায় আলো বেশি ছিল না। কিন্তু বিশ্বনাথের দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতাটা ওঁর দিনকেদিন জোরালো হয়েছে। চশমা ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন সপ্তাহদুয়েক আগেই। আলোক আর পারমিতা এতে অবাক হলেও কোনও মন্তব্য করেনি।
বিশ্বনাথ দেখলেন, প্রথম গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে চট করে রাস্তায় বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। তারপর পাশের একটি সরু রাস্তা ধরে প্রাণপণে ছুট লাগাল।
পিছনের গাড়ির দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ হল। তিনটি লোক নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। নেমেই ধাওয়া করেছে ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে পালানো মেয়েটিকে।
বিশ্বনাথের ভেতরে একটা ভ্যাম্পায়ার জেগে উঠল। তিনি ছুটলেন লোকগুলোর পিছনে।
শরীরের এই জোর কোথা থেকে পেলেন সে-প্রশ্নের উত্তর দিকে পারেননি মালাকার। শুধু বলেছেন, ‘দেখুন, এটাকে আমরা বলি এক্স-ফ্যাক্টর। হিউম্যান ফ্যাক্টর, চান্স ফ্যাক্টর, আননোন ফ্যাক্টর—এইসব মিলেমিশেই এক্স-ফ্যাক্টর তৈরি। তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই—শুধু বলব, এনজয় ইয়োর নিউ লাইফ, বাট প্লে ইট সেফ। বুঝতেই তো পারছেন…।’
এখন সেই এক্স-ফ্যাক্টর নিয়েই ছুটছিলেন বিশ্বনাথ।
রাস্তার দুপাশে পুরোনো আমলের বড়-বড় বাড়ি। তার সীমানায় বিশাল-বিশাল অন্ধকার গাছ। গাছের অচেনা ফুলের গন্ধ বিশ্বনাথের নাকে আসছিল।
রাস্তা নির্জন বলে ছুটন্ত পায়ের শব্দ দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলেন। এ ছাড়া আরও শব্দ কানে আসছিল। কুকুরের ঘেউঘেউ, গাছের পাতার খসখস, রাতপোকার ডাক। অপারেশানের পর থেকে এরকম কত সূক্ষ্ম শব্দই যে শুনতে পান!
সত্যি, এই জীবনটা একদম নতুন—মানে, নতুন ধরনের।
গত দু-মাসে বেশ কয়েকজন ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করেছেন বিশ্বনাথ। তাই হাতে টাকাও এসেছে ভালোই। আর যতই টাকা এসেছে বিশ্বনাথের স্বাধীনচেতা মন ততই মাথাচাড়া দিয়েছে। আলোক আর পারমিতার শাসন থেকে অল্প-অল্প করে বেরিয়ে এসেছেন বাইরে।
এখন খুশিমতন বাইরে বেরোন, পছন্দসই খাবার মাঝে-মধ্যে কিনে খান, হলে গিয়ে সিনেমাও দেখে ফেলেন টুকটাক।
আলোক বা পারমিতার বেশিরভাগ অভিযোগেরই কোনও উত্তর দেন না। এক কান দিয়ে ঢোকান, অন্য কান দিয়ে বের করে দেন। আর ভিক্টরকে একটু সামলে চলেন। কারণ, এখন ওঁকে দেখলেই ভিক্টর কেমন যেন লোম খাড়া করে চাপা গরগর শব্দ করতে থাকে। ঠোঁট পিছনে টেনে ধারালো দাঁতের পাটি হিংস্রভাবে মেলে ধরে।
যত যা-ই হোক, নতুন জীবনটার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চ আছে সেটা বিশ্বনাথ স্বীকার করেন।
এখন, অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে যেতে-যেতে, সেই রোমাঞ্চটাই টের পাচ্ছিলেন।
একটু পরেই রাস্তাটা একটা গলির মুখে এসে পড়ল। আর তখনই লোক তিনটে মেয়েটাকে ধরে ফেলল।
মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। রাস্তার আলোয় ওর ভয় পাওয়া ফরসা মুখ ঝলসে উঠল।
বিশ্বনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বড়-বড় শ্বাস নিতে লাগলেন।
এতক্ষণ একটা ঝোঁকের মাথায় ছুটে এসেছেন। বয়েসটার কথা ভাবেননি। এখন যেন হঠাৎই খেয়াল হল, ওরা তিনজন, আর বিশ্বনাথ একা।
লোক তিনটে তখন মেয়েটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আর মেয়েটা প্রতিবাদ আর যন্ত্রণার চিৎকার করে উঠছিল বারবার।
রেণুকণা যে পাশেই ছিলেন বিশ্বনাথ টের পাননি। হঠাৎই শুনলেন ওঁর চাপা ফিসফিসে গলা: ‘কী হল, যাও—মেয়েটাকে বাঁচাও…।’
‘ওরা তিনজন—আর আমি একা…।’ কাতর গলায় মিনমিন করে বললেন বিশ্বনাথ।
খিলখিল করে হাসলেন রেণুকণা: ‘আরে পাগল! ওরা মানুষ—আর তুমি ভ্যাম্পায়ার! এই নতুন জীবনটাকে ভালো কাজে লাগানোর চেষ্টা করো। যাও!’
এই আদেশের পর আর কোনও কথা চলে না।
বিশ্বনাথ চোখের পলকে ছুটে চলে গেলেন জটলার কাছে। সামনে যে-লোকটাকে পেলেন তার হাত ধরে এক টান মারলেন।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বিশ্বনাথের দিকে ঘুরে তাকাল। এবং বিশ্বনাথের চেহারা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
কোন আক্কেলে এই বুড়োটা এই সংঘর্ষে নাক গলাচ্ছে?
বিশ্বনাথের বুকে সজোরে ধাক্কা দিল লোকটা। কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে উঠল, ‘আবে সুড্ডা লাল্লু, ফাট। সালা রাস্তা মাপ—নইলে দোকানের ঝাঁপ খুলে দেব।’
কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা একটা ছুরি বের করে ফেলেছে লোকটা।
রাস্তার আলোয় ওকে ভালো করে দেখলেন বিশ্বনাথ।
এমনিতে ভদ্রলোকের মতো চেহারা, তবে কুতকুতে চোখে শয়তানির ছাপ রয়েছে। চোয়াল চওড়া, কাঠের মতো শক্ত। মুখ থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।
বোঝাই যাচ্ছিল, এসব কাজে লোকটা পুরোনো পাপী।
মেয়েটা বাকি দুজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিল আর ‘ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!’ বলে চিৎকার করছিল। দুজনের একজন পিছন থেকে মেয়েটাকে কষে জাপটে ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে আসছিল।
অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিশ্বনাথের নজরে পড়েছিল। এও খেয়াল করেছিলেন, এত হইচই সত্ত্বেও কোনও লোক অকুস্থলে এসে হাজির হয়নি। বরং দু-একজন রাতচরা মানুষ যা চোখে পড়ছিল তারা চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছিল।
প্রথম লোকটা বিশ্বনাথকে লক্ষ্য করে ছুরিসমেত হাত চালাল। ছুরির ধারালো ডগাটা বিশ্বনাথের বুক ছুঁয়ে গেল।
গায়ের জামাটা চিরে গেল কিনা বিশ্বনাথ বুঝতে পারলেন না, তবে একটা জ্বালা টের পেলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। সামনে গলা বাড়িয়ে লোকটার ছুরি ধরা হাতে ভয়ংকর এক কামড় বসালেন। বাইটের নিয়ম মতো একটা কামড় বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড। কিন্তু এখন বিশ্বনাথ নিয়ম-টিয়ম সব ভুলে গেলেন। কচ্ছপের কামড়ের মতো চোয়াল চেপে রইলেন—যেন মেঘ না ডাকলে ছাড়বেন না।
লোকটা কিছুক্ষণ ঝটপট করল। কামড় ছাড়ানোর জন্য হাতটা একবার ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
তারপরই লোকটা ফুটপাথের ওপরে খসে পড়ল। যন্ত্রণার চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে-চিৎকার জড়িয়ে গিয়ে আলতো হয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল।
বিশ্বনাথ অদ্ভুত ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও!’
বাকি দুজনের মধ্যে যার হাতে কাজ কম ছিল সে একটা ছোট টর্চ বের করে বিশ্বনাথকে তাক করে বোতাম টিপল।
আসলে লোকটা বোতাম টিপেছিল কৌতূহল আর বিস্ময়ে। কারণ, আধো-আঁধারিতে বিশ্বনাথকে দেখে ওর কমজোরি প্রৌঢ় বলেই মনে হয়েছিল। তার সঙ্গে মোকাবিলায় সঙ্গীর এই হাল লোকটা মানতে পারছিল না।
কিন্তু টর্চের আলো বিশ্বনাথের মুখের ওপরে পড়তেই পলকে সবকিছু মেনে নিল।
বিশ্বনাথের ঠোঁটের কোণ থেকে রক্তের রেখা গড়িয়ে নেমে এসেছে থুতনির দিকে। বুকের কাছে জামাটা রক্তে ভেজা। মানুষটার চোখে অমানুষিক দৃষ্টি। আর ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে থাকায় রক্ত মাখা দাঁত দেখা যাচ্ছে, সেইসঙ্গে জিভেরও খানিকটা।
ফুটপাথে পড়ে থাকা সঙ্গীর দিকে ঘুরে গেল টর্চের আলো। আর সেই মুহূর্তে বিশ্বনাথ ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রাণের মায়া ভুলে।
ওই যে মাথার ভেতরে রেণুকণা বলছিলেন, ‘…নতুন জীবনটাকে ভালো কাজে লাগানোর চেষ্টা করো…।’
ভয় পাওয়া লোকটা হাত বাড়িয়ে আক্রমণটা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল। বিশ্বনাথ পাগলের মতো ওর ডানহাতের কড়ে আঙুলটা কামড়ে ধরলেন। দু-হাতে আঁকড়ে ধরলেন শত্রুর ডানহাত। এবং এক ঝটকায় হাতটাকে বেঁকিয়ে দিলেন অন্যদিকে।
‘মটাস’ শব্দ হল একটা। বিশ্বনাথ আঙুল ভাঙার শব্দ আগে কখনও শোনেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা।
এবার লোকটার চিৎকারের পালা।
ওর হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ল। সাঁড়াশি দিয়ে গলা চেপে ধরা শুয়োরের মতো বীভৎস আর্তনাদ করে উঠল। ছুটও লাগাল একইসঙ্গে।
নিজের অজান্তেই বিশ্বনাথ দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে গেলেন সামনের দিকে। তিননম্বর লোকটা বুঝল গল্প শেষ। তাই একটুও দেরি না করে মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে পালাল।
বিশ্বনাথ বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে নিলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। লজ্জায় গ্লানিতে একেবারে মরে যাচ্ছিলেন। পাগলের মতো এসব কী করলেন তিনি? ওই তো লোকটা পড়ে রয়েছে ফুটপাতে! বেঁচে আছে, না মরে গেছে? যদি সিক্রেট পুলিশ দেখে ফেলে এখন!
বিশ্বনাথ কী এক লজ্জায় মেয়েটার দিকে তাকাতে পারছিলেন না। বোকার মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠান্ডা বাতাস ওঁকে ঘিরে খেলা করতে লাগল। বাতাস বলছিল, ‘শীত আসছে। বিশ্বনাথের গা শিরশির করছিল। একইসঙ্গে হালকা মদের গন্ধ নাকে আসছিল। বুঝলেন, মেয়েটা নেশা করেছে।
‘শিগগির পালিয়ে চলুন! পুলিশ দেখতে পেলে কেলেঙ্কারি হবে।’
মেয়েটার কথায় বিশ্বনাথ যেন জেগে উঠলেন। মেয়েটা ওঁর হাত ধরে টান মারল: ‘শিগগির ছুট লাগান! এদিকে—।’
অন্ধকার রাস্তা ধরে দৌড়তে শুরু করল মেয়েটি। আর ওর পিছন-পিছন বিশ্বনাথ।
একটু পরেই ওরা বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল।
মেয়েটার গাড়িটা জায়গামতো দাঁড়িয়ে। তবে যে-গাড়িটা ওঁকে ধাক্কা মেরেছিল সেটাকে দেখা গেল না।
ঝটপট গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল মেয়েটি। উলটোদিকের দরজাটা খুলে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল বিশ্বনাথকে: ‘কুইক!’
বিশ্বনাথ সিটে বসে দরজা বন্ধ করেছেন কি করেননি এক হ্যাঁচকায় গাড়িটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। তারপর ফাঁকা রাস্তা ধরে বিপজ্জনক গতিতে ছুটে চলল।
রাস্তার দিকে চোখ রেখেই মেয়েটি বলল, ‘থ্যাংকস ফর সেভিং মাই লাইফ।’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর: ‘আমার নাম তিতলি। আপনার?’
‘বিশ্বনাথ। আপনাকে ওরা অ্যাটাক করেছিল কেন?’
‘সে অনেক ব্যাপার—পরে কখনও বলব।’ হঠাৎ বিশ্বনাথের জামার দিকে নজর গেল তিতলির: ‘আরে! আপনার জামাটা তো রক্তে ভিজে গেছে! শিগগির নার্সিংহোমে চলুন—একটা ব্যান্ডেজ-ফ্যান্ডেজ বেঁধে না দিলে…।’
বিশ্বনাথ সামান্য কাত হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। রুমালটা বাঁ-হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। চাপা শান্ত গলায় বললেন, ‘না, না, সেরকম কিছু হয়নি। জাস্ট একটু চিরে গেছে।’
কাটা জায়গাটা এখন বেশ চিড়বিড়-চিড়বিড় করছিল। ছুরিটা ধারালো হওয়ায় প্রথমটা কিছু টের পাননি। তবে জ্বালাটা সহ্য করতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল না। পুরোনো জীবন হলে এই জ্বালাই হয়তো অসহ্য ঠেকত। তা ছাড়া বিশ্বনাথ জানেন, এই কাটা-ছেঁড়া নিয়ে নার্সিংহোমে যাওয়া মানেই সিক্রেট পুলিশকে নেমন্তন্ন করা।
‘শিয়োর আপনার কষ্ট হচ্ছে না?’ তিতলি উদ্বেগের গলায় জানতে চাইল আবার।
‘উঁহু। একদম না…।’
তিতলি সন্দেহের চোখে কয়েক পলক বিশ্বনাথের দিকে চেয়ে রইল।
তিতলির ফরসা মুখের ওপরে রাস্তার আলো পড়ছিল, সরে যাচ্ছিল। বিশ্বনাথ ওকে খুঁটিয়ে দেখলেন।
বয়সে কুড়ি কি বাইশ। গোল টলটলে মুখ। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত—মাথা নাড়লেই এপাশ-ওপাশ নড়ছে। চুলের একটা পাশ বোধহয় সোনালি রং করা।
তিতলির গলায় ফ্লুওরেসেন্ট পুঁতির মালা—আধো-আঁধারিতে লাল-নীল-সবুজ রং জ্বলছে। কানে একই ধরনের দুল। গায়ে কালো পোশাক। কবজিতে প্লাটিনামের ব্রেসলেট আর ঘড়ি। ডানহাতের আঙুলে পাশাপাশি একইরকম দুটো আংটি।
উইন্ডশিল্ডের সামনের তাকে রাখা ছিল একটা পারফিউমের শিশি। সেটা বাঁ-হাতে তুলে নিল তিতলি। ‘শ-শ-শ’ শব্দ করে নিজের গায়ে পারফিউম স্প্রে করল। তারপর সামনের রাস্তার দিকে আড়াচোখে নজর রেখে দেখল বিশ্বনাথের দিকে: ‘পারফিউম নেবেন?’
বিশ্বনাথ হকচকিয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না—না।’ পারফিউমের কড়া গন্ধে বিশ্বনাথের অস্বস্তি হচ্ছিল।
‘ওইরকম তিনটে ইয়াংম্যানের সঙ্গে এরকম ম্যাজিকের মতো লড়ে গেলেন কেমন করে?’
ওর কথাতেই জবাব দিলেন বিশ্বনাথ, ‘সে অনেক ব্যাপার—পরে কখনও বলব।’
পারফিউমের শিশিটা তাকে ফিরিয়ে দিল তিতলি: ‘চমৎকার। আমার কথায় আমাকেই দিলেন!’
‘আমার দেওয়ার মতো কিছু নেই—।’
‘তা হলে কি শুধু নেওয়া বাকি?’
‘সেটাই বা পারছি কই?’
হেসে ফেলল, তিতলি: ‘আপনার কথাবার্তা বেশ ইন্টারেস্টিং। আপনার সঙ্গে আমার জমবে।’
বিশ্বনাথ ওর কথা বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
‘আপনি কি ভি-স্টিং প্রোভাইডার?’ আচমকা প্রশ্ন করল তিতলি।
‘হ্যাঁ—, এক সেকেন্ড সময় নিয়ে স্পষ্ট জবাব দিলেন বিশ্বনাথ। মেয়েটা তা হলে লড়াইয়ের সময় বিশ্বনাথকে ভালোভাবেই লক্ষ করেছে।
‘আমি আগে কখনও কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার দেখিনি। আমার এক বন্ধু বাইট নেয়—আমি কখনও নিইনি। একবার চেখে দেখলে হয়!’
‘নেশা করা খারাপ…।’
‘এটা কি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ?’ ব্যঙ্গের সুরে কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল তিতলি।
একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘নেশা করা খারাপ তো সো হোয়াট? আমার এই লাইফটাও তো খারাপ। যদিও তার জন্যে কোনও স্ট্যাটিউটরি ওয়ার্নিং দেওয়া ছিল না…।’
মেয়েটার লাইফটা খারাপ?
বিশ্বনাথ নিজের জীবনের কথা ভাবলেন—রেণুকণা চলে যাওয়ার পরের জীবনের কথা। সেটাকে মোটেই ভালো বলা যায় না। বরং ডক্টর মালাকারের দেওয়া এই নতুন জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে খারাপ লাগছে না।
‘আপনাকে কোথায় নামাব?’
‘যেখানে খুশি। তবে থাকি শ্যামবাজারে—নিউ টাউন, ফেস ফোর-এ।’
ব্রেকে চাপ দিল তিতলি, গাড়ির মুখ ঘোরাল: ‘চলুন, শ্যামবাজারেই আপনাকে নামিয়ে দিই। আমার হাতে কোনও কাজ নেই…।’
‘থ্যাংকস।’
‘আশ্চর্য।’ ভুরু উঁচিয়ে তাকাল: আপনি আমার জীবনদাতা—আর বলছেন ”থ্যাংকস”!’
‘অভ্যেস সহজে মরতে চায় না।’ বুকের জ্বালাটা হঠাৎ খোঁচা দিল। বিশ্বনাথ যন্ত্রণায় চোখ বুজলেন একবার।
‘আমি কোথায় থাকি জিগ্যেস করলেন না তো?’
‘আমার বয়েস বাষট্টি। ছাব্বিশ হলে জিগ্যেস করতাম—।’
খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল তিতলি। সে-হাসি আর থামতেই চায় না।
বিশ্বনাথ চুপ করে ওকে দেখতে লাগলেন।
‘ওঃ, আপনি তো দারুণ কথা বলেন! বাষট্টি উলটো ছাব্বিশ…’ হাসির দমকে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল তিতলি, ‘এনিওয়ে, আমি থাকি লালা লাজপত রায় সরণিতে। আর আমার বয়েস বাইশ—ওলটালেও একই থাকে।’
‘এত রাতে চৌরঙ্গিতে কী করছিলেন?’ কৌতূহল বিশ্বনাথকে কাঁটা ফোটাচ্ছিল।
‘সেসব কথা পরে হবে—’ মাথা ঝাঁকিয়ে চুল ওড়াল তিতলি: ‘দিন, আপনার ফোন নাম্বার দিন।’
‘আমার পারসোনাল কোনও ফোন নেই।’
তিতলি এক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকাল বিশ্বনাথের দিকে। তারপর সহজভাবে বলল, ‘তা হলে আমার মোবাইল নম্বরটা লিখে নিন—।’
বিশ্বনাথের কাছে কাগজ-পেন ছিল না। তাই রাস্তার ধারে গাড়ি সাইড করল তিতলি। গাড়ির গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট থেকে পেন আর কাগজ বের করে রাস্তার আলোতেই ফোন নম্বর লিখে দিল।
কাগজের টুকরোটা বিশ্বনাথের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ফোন করবেন কিন্তু।’
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।
‘প্রমিস?’ বিশ্বনাথের ডানহাতের পাতাটা নিজের মুঠোয় নিয়ে আন্তরিকভাবে জানতে চাইল।
বিশ্বনাথ অদ্ভুত মেয়েটার চোখে তাকালেন। বললেন, ‘গড প্রমিস।’
আবার গাড়ি ছোটাল তিতলি।
গাড়ির গতি আর দুরন্ত বাঁক নেওয়ার মধ্যে একটা খুশির ছাপ খুঁজে পেলেন বিশ্বনাথ। বুকের জ্বালাটা তখন আর টের পাচ্ছিলেন না।
বেশ মনে আছে, ব্রতীনকে সার্ভিস দিয়ে আসার পর রাতে ভালো করে দাঁত মেজেছিলেন। সেদিন রাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি। আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। তারপর রেণুকণার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন।
‘আমি আজ যা করে এলাম সেটা কি পাপ?’
‘কে বলেছে পাপ! হঠাৎ এসব আজেবাজে কথা তোমার মনে হচ্ছে কেন?’
‘না…মানে…একটা অল্পবয়েসি ছেলেকে নতুন একটা নেশায় নামিয়ে দিলাম…।’
‘তুমি না গেলে, ”শটস অ্যান্ড কিকস” অন্য কোনও সি. ভি.-কে পাঠাত। তাছাড়া ব্রতীন তো আর মরে যায়নি। বরং কিছুটা আনন্দ পেয়েছে।’
শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ রেণুকণার যুক্তির কাছে হেরে গেছেন।
কিন্তু আজ? আজ কী বলবেন রেণু?
আজ রাতে বাড়িতে এসে কলিংবেল বাজাতেই আলোক বিরক্তভাবে দরজা খুলে দিল।
‘কী যে তোমার একটা বাজে অভ্যেস হয়েছে! নিশাচর প্রাণীর মতো রাত করে বাড়ি ফেরা!’ তারপরই রক্তে ভেজা শার্টটা চোখে পড়ল ওরঃ ‘কী ব্যাপার? রক্ত কিসের?’
বিশ্বনাথ শুধু ছোট্ট করে বললেন, ‘গুণ্ডারা অ্যাটাক করেছিল—।’
‘চমৎকার!’ আলোক ঠোঁটের কোণ দিয়ে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে শূন্যে হাত নাড়ল: ‘এখন সিক্রেট পুলিশের ঝুটঝামেলা সামলাবে কে?’
‘কোনও ঝুটঝামেলা হবে না…।’ নীচু গলায় কথাটা বলে ছেলের কাছ থেকে সরে গেলেন বিশ্বনাথ। তিতলির মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। অপলকে সেটাই দেখছিলেন।
আশ্চর্য! যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক, বিশ্বনাথের আঘাত নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই তার—বরং পুলিশি ঝামেলার ভয়ে সে অনেক বেশি ব্যতিব্যস্ত।
আর যাকে তিনি চেনেন না জানেন না সে বলেছিল, ‘…শিগগির নার্সিহোমে চলুন…।’
একদলা থুতু এসে গেল মুখের ভেতরে। নিজের ঘরের দিকে যেতে-যেতে আড়চোখে দেখলেন পারমিতা ওদের শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে ঘেন্না এবং বিরক্তি।
নিজের ঘরে ঢোকার পর নতুন জীবনের অলৌকিক শ্রবণক্ষমতায় শুনতে পেলেন পারমিতার কথা, ‘বুড়োটা দেখছি লায়েক হয়ে গেছে!’
জামা-টামা খুলে কাটা জায়গাটা ভালো করে পরখ করলেন। না, বিশেষ কিছু হয়নি—ইঞ্চিচারেক সামান্য চিরে গেছে। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে। তবে চিড়চিড়ে জ্বালাটা এখনও আছে।
তুলো দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করলেন বিশ্বনাথ। তারপর অ্যান্টিসেপটিক হিলার স্প্রে করে দিলেন। জ্বালাটা বেশ কমে গেল।
রাতে অন্ধকার বিছানায় শুয়ে আবার রেণুকণার সঙ্গে কথা-যুদ্ধ।
ব্রতীনের বেলায়—যা ব্রতীনের মতো আরও অনেক ক্লায়েন্টের বেলায়—রেণুকণার যুক্তির কাছে কাবু হয়ে গেছেন বিশ্বনাথ।
কিন্তু আজ?
রেণুকণা বরাবর শান্ত, বুদ্ধিমতী। মৃত্যুর আগেও—পরেও। আজ বিশ্বনাথকে সুন্দর ঠান্ডা যুক্তি শোনালেন রেণুকণা।
একটা বাইশ বছরের মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে বিশ্বনাথ যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। তা ছাড়া ফুটপাথে পড়ে যাওয়ার লোকটা যে মরে গেছে সে-কথা কে বলেছে! লোক তিনটে যেরকম ক্রিমিনাল টাইপের তাতে মনে হয় তারা এর আগে প্রচুর খুন-জখম-ডাকাতি করেছে। অনেক আগেই ওদের মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিত ছিল। আক্ষেপ এটাই যে, দুটো গুণ্ডা প্রাণে বেঁচে পালিয়েছে।
ব্যস। বিশ্বনাথ আবার ঠুঁটো জগন্নাথ।
সুতরাং পরদিন সকালে যখন রাস্তায় বেরোলেন তখন বিশ্বনাথ পালকের মতো হালকা। বড় রাস্তার মোড়ে সিক্রেট পুলিশের দুজন অফিসারকে দেখে মোটেই ঘাবড়ে গেলেন না। বরং ওদের একজনকে সময় জিগ্যেস করে ঘড়ি মেলালেন। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে একটা পাবলিক ফোন বুথে ঢুকে পড়লেন।
কাগজের চিরকুটটা দেখে তিতলির নম্বর ডায়াল করলেন বিশ্বনাথ। ও-প্রান্তে ‘হ্যালো’ শোনামাত্রই বললেন, ‘বাইশ, কেমন আছ?’
‘হু ইজ ইট?’ ঘুমজড়ানো স্বরে তিতলি জিগ্যেস করল।
‘বাষট্টি বলছি—।’
সঙ্গে-সঙ্গে চিনে ফেলার খিলখিল হাসি। তারপর: ‘ও, আপনি!’
‘কী করছ এখন, বাইশ?’
‘ঘুমোচ্ছি—।’
‘ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা বলা যায় না কি?’
‘যায় বলছি তো!’ আবার হাসি।
‘আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন কেন?’
‘আজ দুপুরে আমার এখানে খাবেন। আমরা খেতে-খেতে গল্প করব।’
‘ওখানে আর কে-কে আছে?’
‘কেউ না। আমি একা থাকি—আমার আর কেউ নেই…।’
তিতলির গল্পটা জানতে ইচ্ছে করল বিশ্বনাথের। মনে পড়ল, কাল রাতে ও বলেছিল, ‘…সে অনেক ব্যাপার…।’
বিশ্বনাথ যেতে রাজি হলেন। তিতলি ওঁকে বলে দিল কীভাবে ওর ফ্ল্যাটটা চিনে নেওয়া যাবে। তারপর জিগ্যেস করল, ‘শিয়োর আসছেন তো? প্রমিস?’
বিশ্বনাথ হেসে বললেন, ‘গড প্রমিস—।’
বাড়ি ফিরে বিশ্বনাথ শেভ করলেন। অনেক বাছাবাছির পর একটা শার্ট প্যান্ট পছন্দ করে পরে নিলেন। বহুদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন। মুখে পাউডার, ক্রিম লাগালেন। তারপর অযত্নে পড়ে থাকা একটি পারফিউমের শিশি খুঁজে বের করে জামায় বেশ কয়েকবার স্প্রে করলেন।
মনের ভেতরে একটা খুশি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এমন খুশি যে-খুশি সবাইকে ক্ষমা করতে শেখায়। হয়তো সেইজন্যই বেরোনোর সময় পারমিতার ভ্রূকুটি আর ভিক্টরের গজরানিকে ক্ষমা করে দিলেন।
পারমিতার দিকে না তাকিয়েই আলতো করে বললেন, ‘একটু বেরোচ্ছি। দুপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন…।’
পারমিতার দিকে না দেখলেও বুঝতে পারলেন বউমা কী নজরে গলগ্রহ অকর্মণ্য শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তিতলির ফ্ল্যাটে পৌঁছতে খুব একটা অসুবিধে হল না বিশ্বনাথের। কলিংবেল বাজাতেই দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ পেলেন। ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় গেল বোধহয়। তারপর দরজা খুলে গেল, সামনে তিতলি।
‘আমার দেরি হয়নি তো, বাইশ?’ বিশ্বনাথ হেসে জিগ্যেস করলেন।
‘একটুও না। আসুন, ভেতরে আসুন—।’
ফ্ল্যাটের ভেতরে পা দিলেন বিশ্বনাথ। চারপাশটা দেখে মনে হল স্বর্গ। কিন্তু স্বর্গটা নরকের মতো লন্ডভন্ড, অগোছালো।
আসার সময় বিশ্বনাথ বাইশটা লাল গোলাপ দিয়ে একটা সুন্দর তোড়া তৈরি করিয়েছিলেন। সেটা তিতলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা নাও। বাইশকে বাইশটা গোলাপ দিয়ে অভিনন্দন।’
তিতলি তোড়াটা দু-হাত বাড়িয়ে নিল। লম্বা শ্বাস টেনে গন্ধ শুঁকল। বলল, ‘আঃ দারুণ। বেশিক্ষণ শুঁকলে নেশা হয়ে যেতে পারে।’
তিতলির সঙ্গে বসবার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ। চারপাশে ভালো করে নজর বোলাতে লাগলেন।
ঘরের সর্বত্র বিস্তর খরচের ছাপ। সোফা সেট, চায়ের টেবিল, ক্যাবিনেট সবই স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। তার সঙ্গে অতি আধুনিক ট্যাপেস্ট্রি।। ডিজিটাল প্লেট টিভি, সারাউন্ড থিয়েটার, ওয়ালস্ক্রিন টেলিফোন—কী নেই ঘরে! কিন্তু সব জিনিসই এলোমেলোভাবে রাখা। ওদের ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখার জন্য কেউ সময় দেয়নি। আর ধুলোও ছড়িয়ে আছে নানান জায়গায়।
বিশ্বনাথ লক্ষ করলেন, দেওয়ালে মাস্টারদের গোটাতিনেক ওরিজিন্যাল অয়েল পেইন্টিং। ঘরের এক কোণে ব্রোঞ্জের একটা মডেল। আর জানলায় রঙিন সুতোর বল দিয়ে তৈরি অদ্ভুত ধরনের ঝুলন্ত পরদা।
সারা ঘরে মোলায়েম একটা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিশ্বনাথ কয়েকবার নাক টেনে ঘ্রাণ নিলেন। তারপর একটা সোফায় বসে পড়লেন। তাকালেন তিতলির দিকে।
ঘরটার মতো তিতলিও অগোছালো, কিন্তু ওকে দারুণ লাগছিল বিশ্বনাথের।
বোধহয় একটু আগে স্নান করেছে। কানের দুপাশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো যে ভিজে সেটা বোঝা যাচ্ছে। গায়ে একটা গোলাপি শার্ট, পায়ে সাদা পাজামা। গলায় সরু প্লাটিনামের চেন, কানের লতিতে সরষের মতো দুটো প্লাটিনামের ফুটকি।
তিতলি জিগ্যেস করল, ‘কাটা জায়গাটা কেমন আছে?’
‘ঠিক আছে।’ বিশ্বনাথ বুকে দুবার আলতো চাপড় মেরে প্রমাণ দিলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি ফুল ভালোবাসো?’
‘কেন বাসব না! সবাই ভালোবাসে।’ ফুলের তোড়াটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখল তিতলি: ‘তা ছাড়া আমার হাতে তো বেশি সময় নেই! তাই আমার সবকিছু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।’
‘কেন, সময় বেশি নেই কেন? তুমি তো সবে বাইশ!’
মলিন হাসল তিতলি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বিশ্বনাথের মুখোমুখি বসে পড়ল। বিশ্বনাথ কাল রাতের পারফিউমের গন্ধটা পেলেন। সেইসঙ্গে সিগারেটের গন্ধও।
‘বলছি। আগে একটু কফি খান।’ চট করে উঠে পড়ল। হেসে বলল, ‘আমি রান্নাবান্না কিছু জানি না। শুধু চা আর কফি বানাতে পারি।’
‘তা হলে দুপুরে খাব কোথায়? বাইরে?’
‘না, এখানে। কাছেই একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে। বেশ ভালো। ওখানে ফোন করে বলে দিয়েছি। একটা নাগাদ খাবার এসে যাবে। এক মিনিট বসুন, কফিটা করে নিয়ে আসি—।’
প্রায় পাঁচমিনিট পরে কফির কাপ আর বিস্কুট ট্রে-তে সাজিয়ে হাজির হল। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই বিশ্বনাথের চোখে পড়ল কফির কাপের পাশেই বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট আর শৌখিন লাইটার।
সোফায় বসে বিশ্বনাথের হাতে কফির কাপ এগিয়ে দিল তিতলি। নিজেও নিল। কফির কাপে কয়েক চুমুক দেওয়ার পরই সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার তুলে নিল। বিশ্বনাথের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল: ‘লাইক আ স্মোক?’
মাথা নেড়ে ‘না’ জানালেন বিশ্বনাথ। আগে সিগারেটের নেশা ছিল। রেণুকণা তাই নিয়ে দিনরাত আপত্তি করতেন। রেণুকণা মারা যাওয়ার পর ওই নেশাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
তিতলি মাথা নীচু করে সিগারেট ধরাল।
‘নিন, কফি খান। বোধহয় তেমন ভালো হয়নি।’
‘তা কেন? ভালোই তো হয়েছে!’ কাপে লম্বা চুমুক দিলেন বিশ্বনাথ।
‘কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ারের লাইফ আপনার কেমন লাগছে?’ ধোঁয়া ছেড়ে জিগ্যেস করল তিতলি।
‘আগের লাইফের চেয়ে অনেক ভালো…।’
‘আগের লাইফ মানে?’
কফি খেতে-খেতে বিশ্বনাথ তার আগের লাইফের গল্প বলতে লাগলেন।
বাষট্টির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বাইশ সেই গল্প শুনতে লাগল। শুনতে-শুনতে এতই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে, সিগারেটটা কখন ছোট হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতেই চমকে জেগে উঠল তিতলি।
কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বনাথ তখনও গল্প বলেছিলেন। হঠাৎ, কী মনে হল কে জানে! তিতলির কাছ থেকে চেয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তিতলিও একটা ধরাল।
রেণুকণার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বনাথের চোখে জল এসে গেলে। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুছলেন। ঘষা গলায় বললেন, ‘এখনও আমি মনে-মনে ওর সঙ্গে কথা বলি। ও-ই আমার কথা বলার লোক।’
সব শোনার পর তিতলি অনেকক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, ‘বাষট্টি, আমার ওসব প্রবলেম নেই। কারও সঙ্গে রিলেশান থাকলে—তারপর সেটা কেটে গেলে, তবে না তাকে মিস করব…।’
বিশ্বনাথ ওর গলায় বাষট্টি শোনামাত্রই চোখ তুলে তাকালেন। ওর কথার পিঠে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কারও রিলেশান হয়নি…সেটা ভাবা যায় না। তুমি এত সুন্দর…।’
‘আপনি দেখছি ছাব্বিশের মতো কথা বলছেন!’
‘সরি।’ ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন বিশ্বনাথ। একটু থেমে বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। একটা বয়েসের পর সত্যি কথা বলতে নেই—বেমানান লাগে—।’
‘আমি কিন্তু হার্ট করতে চাইনি। জাস্ট একটু মজা করছিলাম—।’
‘আগের প্রশ্নটা আবার করতে পারি?’ অনুমতি চাওয়ার ঢঙে বললেন বিশ্বনাথ।
‘কোন প্রশ্ন?’
‘কারও সঙ্গে রিলেশান হয়নি কেন?’
একটু ইতস্তত করে তিতলি বলল, ‘আপনাকে সত্যি কথাটা বলছি। কাল আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তা না হলে আজ এত কথা কার সঙ্গে বলতাম।’ মাথার চুলে হাত বোলাল। ভঙ্গিটা বিশ্বনাথের ভালো লাগল। আরও মনে হল, একটা বয়েসের পর এই ভালো লাগাটা অন্যায়।
তিতলি সময় নিচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ তাকাল অকারণেই। তারপর খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলার ঢঙে আলতো স্বরে বলল, ‘সেই ছোটবেলায় একজনের সঙ্গে রিলেশান হয়েছিল। তখন আমি পনেরো। ও-ই আমাকে আমার শরীরটাকে চিনিয়েছিল। ও ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসত না—আমার বাবা-মাও না।’
বিশ্বনাথের দিকে চোখ ফেরাল। চোখের কোণে হিরের কণা।
‘কেন? বাবা-মা নয় কেন?’
‘বাবা মেয়ে চায়নি। আমার জন্মের পর যখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে তখন একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছিল…।’ আবার জানলার দিকে তাকাল তিতলি।
বিশ্বনাথ ওর মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
চট করে বিশ্বনাথের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল: ‘এসব কথা আপনাকে বলছি…এগুলো ভীষণ পার্সোনাল…মানে…।’
বিশ্বনাথ বুঝলেন তিতলির ভেতরে একটা লড়াই চলছে। ও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। বিশ্বনাথ সুবোধ ছাত্রের মতো অপেক্ষা করে চললেন।
একসময় মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বলল, ‘টু হেল উইথ সো কলড সিক্রেটস!’ মুখ তুলল, ঠোঁট কামড়াল। তারপর: ‘আমাদের রিলেটিভসরা সবাই আমাকে আর মা-কে দেখতে এসেছে। আমার এক মাসি হঠাৎ বাবাকে লক্ষ করে বলল, ‘কী সুন্দর দেখতে হয়েছে না! ঠিক মন্দিরার মুখটা যেন বসানো। কী দারুণ লাগছে, তাই না!”
‘মন্দিরা আমার মায়ের নাম। বাবা ”মণি” বলে ডাকত। তো মাসির কথা শুনে বাবা সেই কথাটা বলেছিল…।’
‘কী কথা?’ আড়ষ্ট গলায় জানতে চাইলেন বিশ্বনাথ।
‘বাবা মাসিকে বলেছিল, ”পরীক্ষায় ফেল করলে যেমন লাগে আমার ঠিক সেরকম লাগছে।” কথাটা শুনে মা নাকি সবার সামনে কেঁদে ফেলেছিল।’
‘তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি বড় হওয়ার পর বাবার সঙ্গে মায়ের একদিন তুমুল ঝগড়া লেগেছিল। বাবা রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তখন মা হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে…কথাগুলো …বলেছিল আমাকে…।’
চোখে জল জমে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিতলি চোখ না বুজে জোর করে তাকিয়ে রইল। জলের ফোঁটা ওর গালে গড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। সিগারেটটা বিশ্বনাথের তেতো লাগছিল। ওটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তিতলিও কখন যেন হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছে।
বিশ্বনাথ নরম গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘মা ভালোবাসত না?’
‘বাসত—’ ধরা গলায় তিতলি বলল।
‘তারপর?’
‘আমার জন্মের পর থেকে মায়ের সঙ্গে বাবার রিলেশানটা ধীরে-ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েক বছর পর মায়ের মনে হল, আমার জন্যেই এমনটা হচ্ছে—আমি নাকি অপয়া।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মুখ ভার করে বসে রইল। তারপর: ‘কী আর বলব! বাবার বাইরের টান ছিল…মা সেটা জানত। আমি তো ছোট ছিলাম…অতসব বুঝতাম না। মা বলত, ”পরীক্ষায় ফেল করার পর থেকে তোর বাবার বাইরের নেশা বেড়েছে। এখনও বুঝিসনি তুই অপয়া!” আমি আস্তে-আস্তে বুঝতে শিখছিলাম…। তারপর কয়েক বছরের মধ্যে মনে-মনে অনেক দূরে চলে গেলাম…একা হয়ে গেলাম…।
‘তারপর…পনেরোয় পা দিলাম। ও এল…চলেও গেল। ব্যস, গল্প শেষ!’
বিশ্বনাথের দিকে মুখ তুলে হাসল তিতলি। চোখে তখনও জল। জল মুছল। তারপর দু-হাত শূন্যে ঘুরিয়ে আনন্দের ভঙ্গি করে বলল, ‘দুর! ওসব পুরোনো কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। হাতে বেশি সময় নেই, বাষট্টি। তাই আমি লাইফের সবরকম দেখতে চাই…।’
বিশ্বনাথের মনে হল, তিতলি এখন আর মুখ খুলবে না। তাই স্বাভাবিক গলায় ফিরে আসার চেষ্টা করে বললেন, ‘কেন লাইফ কি সিনেমা নাকি? যেখানে সবরকম মশলা পাওয়া যায়?’
‘না তো কী!’ একলাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
বিশ্বনাথ দেখছিলেন, মেয়েটা কেমন পালটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ওর একটু আগের কষ্টমাখা মুখটাকে বদলে ফেলতে চাইছে একপলকে।
‘কাল রাতে লোকগুলো তোমাকে অ্যাটাক করেছিল কেন?’ সেই পুরোনো প্রশ্নে ফিরে গেলেন বিশ্বনাথ।
‘ওসব পরে হবে। চলুন, আপনাকে আগে ফ্ল্যাটটা ভালো করে দেখাই—’ তিতলি ওর শোওয়ার ঘরের দিকে রওনা হল। বিশ্বনাথকে আসার জন্য ইশারা করে বলল, ‘ফ্ল্যাটটা নেহাত খারাপ না—কী বলেন!’
‘দারুণ ভালো—’ ফ্ল্যাটের তারিফ করলেন বিশ্বনাথ, ‘শুধু একটু অগোছালো—।
‘হ্যাঁ। জাস্ট লাইক মাই লাইফ।’
এরপর ওরা দুজনে এ-ঘর সে-ঘর ঘুরে দেখতে লাগল।
বিশ্বনাথ ফ্ল্যাটের মার্বেল করা মেঝেতে বেশ সহজভাবেই ঘোরাফেরা করছিলেন। ওঁকে মোটেই অতিথি বলে মনে হচ্ছিল না।
ড্রইংরুম, ডাইনিং স্পেস, বেডরুম, গেস্টরুম—সবই ঝকঝকে, সর্বত্র বিলাসের আদর মাখানো।
বিশ্বনাথ তিতলির বিছানা দেখলেন, আধুনিক খাট দেখলেন, জামাকাপড় রাখার শৌখিন আলনা দেখলেন, এয়ারকুলার দেখলেন, দেখলেন পড়াশোনার টেবিল-চেয়ার। কিন্তু টেবিলে বইপত্রের বদলে পড়ে আছে সিগারেটেরপ্যাকেট, মদের বোতল, স্ম্যাকের পুরিয়া।
বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল বিশ্বনাথের। ওর দিকে তাকিয়ে অকারণেই জিগ্যেস করলেন, ‘এসব নেশার জিনিস কার?’
‘কার আবার? ইউ গেস।’ থুতনি উঁচিয়ে বিদ্রোহী সুরে বলল তিতলি।
বিশ্বনাথ চুপ করে গেলেন। সামনের খোলা জানলার দিকে তাকালেন। সামনের বাড়ির দেওয়ালে রোদ পড়েছে, কার্নিশে দুটো চড়ুই।
ওরা আবার ড্রইংরুমে এসে পড়ল। সোফায় অলসভাবে বসে নানান গল্প শুরু করল।
সন্ধের মুখে তিতলির ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে তিতলি ‘আবার আসবেন কিন্তু’ বলছিল। হঠাৎই ও ‘একমিনিট—’ বলে ছিটকে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে গেল।
একটু পরেই একটা গোলাপ নিয়ে ফিরে এল। বলল, ‘আপনার দেওয়া বাইশটা থেকে একটা নিয়ে এলাম—আমার জীবনদাতার জন্য। এটা রাখুন—।’
বিশ্বনাথ হেসে বলনে, ‘কোনও মানে হয়!’
অথচ বিশ্বনাথ কল্পনায় একটা সাদা কার্ড দেখতে পাচ্ছিলেন—ফুলটার বোঁটার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আর কার্ডে গোটা-গোটা হরফে লেখা: ‘বাষট্টিকে বাইশ।’
ফুলটা পকেটে নিয়ে এক অনুপম ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলেন।
দিনগুলো কীভাবে কাটছিল বিশ্বনাথের ঠিক ঠাহর হচ্ছিল না।
ক্লায়েন্টদের ভি-স্টিং দেওয়ার কাজ যেমন চলতে লাগল তারই সঙ্গে চলল তিতলিকে নিয়ে ব্যস্ততা।
প্রথম দিন ওর ফ্ল্যাট থেকে ফিরে প্রায় সারা রাত গোলাপটাকে নিয়ে কত কী না ভেবেছেন বিশ্বনাথ! রেণুকণার সঙ্গেও অনেক কথা বলেছেন।
রেণুকণা বলেছেন, ‘দ্যাখো, ভালো-মন্দ পাপ-পুণ্যের ব্যাপার নয়—তোমাকে খুশি দেখলেই আমি খুশি। এর বেশি আমি কিছু চাই না…।’
পরদিন রাস্তায় বেরিয়ে ফোনবুথ থেকে তিতলিকে ফোন করেছিলেন বিশ্বনাথ।
আজ সকালে বাইরে বেরিয়েও বিশ্বনাথের মনে হল, বাইশকে ফোন করলে কেমন হয়।
সঙ্গে-সঙ্গে ফোন বুথ। নম্বর ডায়াল। ক্রি-রি-রিং। এবং ‘হ্যালো’।
‘বাইশ, কেমন আছ?’
‘ভালো। সবে ঘুম থেকে উঠছি।’
‘এখন দশটা বাজে—।’
‘অনেক রাতে শুয়েছি যে।’
‘আমিও। তুমি এত রাত পর্যন্ত কী করছিলে?’
‘ভাবছিলাম। আর নেশা করে বুঁদ হয়ে ছিলাম। এখনও হ্যাং-ওভার কাটেনি…।’
‘নেশা করা খারাপ।’
‘আবার গোরু রচনা! আমার সবচেয়ে খারাপ নেশাটা করতে ইচ্ছে করছে—দারুণ জমবে।’
‘সেটা কী?’
‘আহা! জানেন না যেন!’ একটু হাসল। তারপর: ‘ভি-স্টিং…বাইট। এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে মারাত্মক নেশা। টিভিতে বলছিল…।’
‘নেশা করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।’
‘ওঃ! মাই গুডনেস!’
‘যাকগে—আজ কী আমাদের দেখা হচ্ছে?’
‘অফ কোর্স…সন্ধেবেলা চলে আসুন…।’
বিশ্বনাথ একলহমা চিন্তা করে নিলেন। ঠিক করলেন, বিকেলে কমিউনিটি পার্কে বেড়ানো আর আড্ডা দেওয়ার পর অনায়াসে তিতলির ফ্ল্যাটে যাওয়া যেতে পারে।
‘যাব। সাতটা নাগাদ। অসুবিধে হবে?’
খিলখিল হাসি। তারপর: ‘ভদ্রতা লিমিট ছাড়িয়ে গেলে তাকে ন্যাকামি বলে। অফ কোর্স সাতটায় আসবেন…।’
‘ছাড়ছি তা হলে…।’
‘না, না—একটা জরুরি কথা আছে।’ সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল।
‘কী?’
‘কাল রাতে একটা লোক ফোন করেছিল। ফোনে থ্রেট করছিল…।’
‘চেনা?’
‘না—।’
‘তো আগে জানালেই পারতে…।’
‘কী করে জানাব?’
বিশ্বনাথ যেন হঠাৎই বুঝতে পারলেন, ওঁর কোনও ফোন নেই।
তিতলি তক্ষুনি ওঁর মনের কথাটা উচ্চারণ করল, ‘আপনি একটা মোবাইল ফোন কিনে নিন—আজকেই।’
‘ঠিক বলেছ।’
‘সেদিন রাতে আপনাকে সামনে পেয়ে আজেবাজে সব ভাট বকে গেছি। হেভি বোর করেছি। কিছু মাইন্ড করবেন না।’
‘সে তো আমিও বেশ লম্বা অটোবায়োগ্রাফি রিডিং পড়ে শুনিয়েছি।’ একটু থামলেন। তারপরে: ‘এবার আজকের কথা বলো…।’
‘সাতটায় মনে করে আসবেন। আমরা আজ গাড়ি নিয়ে যেদিকে দু-চোখ-যায় ঘুরতে বেরোব। রাস্তায় কোথাও ডিনার করে নেব।’
‘তাই হবে। কিন্তু ওই ফোনটার কথা শুনে ভয় করছে…।’
হাসল তিতলি। বলল, ‘ভয় পাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।…মনে থাকে যেন। সাতটায়।’
তিতলি ‘বাই’ বলে লাইন কেটে দিল।
বিশ্বনাথ চিন্তা করে দেখলেন, ওঁর এখন যা আর্থিক অবস্থা তাতে অনায়াসেই একটা মোবাইল ফোন কেনা যায়।
সন্ধেবেলা তিতলির ফ্ল্যাটে রওনা হওয়ার আগে সত্যি-সত্যিই একটা মোবাইল ফোন কিনলেন। বাড়তি টাকা দিয়ে নম্বরটা এমন বাছলেন যেন বাইশ আর বাষট্টি সংখ্যা দুটো নম্বরে পাশাপাশি থাকে। দোকানদারের কাছ থেকেই মোবাইলের প্রাথমিক কলাকৌশল শিখে নিলেন।
বাস স্টপেজ থেকে এসি চেয়ার কারে ওঠার আগে দুটো গোলাপ কিনলেন বিশ্বনাথ। দুটোই তিতলিকে দেবেন—তারপর একটা ফিরিয়ে নেবেন নিজের জন্য।
তিতলির ফ্ল্যাটে পৌঁছে মোবাইল ফোন আর গোলাপ দেখিয়ে ওকে চমকে দিলেন বিশ্বনাথ। গোলাপ দুটো ওর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে একটা আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব…আমার জন্যে…।’
বিশ্বনাথকে ভেতরে ডেকে নিল তিতলি। মোবাইল ফোনের নম্বর নিয়ে ওঁকে ঠাট্টা করল।
ওকে নয়ন মেলে দেখতে লাগলেন বিশ্বনাথ।
কালো আর ছাই রঙের ছক কাটা ছোট হাতার একটা টপ পরেছে। তার বুকের কাছটায় লাল হরফে লেখা: ‘আই অ্যাম মি।’ পায়ে হলদে প্যান্ট, তাতে কালি ছেটানোর মতো কালো-কালো স্পট। গলায় অন্যরকম একটা চেন, কানের লতিতে ঝুরির মতো দুল, হাতে ব্রেসলেট।
বাইরের সন্ধের সঙ্গে মেয়েটা বেশ মানিয়ে গেছে। ওকে ঘিরে একটা সুগন্ধী বাতাস খেলে বেড়াচ্ছিল।
তিতলি আর দেরি করল না—বিশ্বনাথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ও যে গাড়ি চালানোয় বেশ পটু তা আগের দিনই টের পেয়েছিলেন বিশ্বনাথ। আজও ওকে লক্ষ করছিলেন। কী সহজ অনায়াস ভঙ্গিতে স্টিয়ারিং, ব্রেক, ক্লাচ, অ্যাকসিলারেটর নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে!
বিশ্বনাথকে প্রথমে একটা গেমস পারলারে নিয়ে গেল তিতলি।
বিশাল মাপের তিনতলা পারলার। তাতে নানান ধরনের চোখধাঁধানো খেলা চারপাশে রঙিন আলো। লোকজনের ভিড়। চারটে ট্রান্সপারেন্ট এলিভেটর ব্যস্তভাবে ওঠা-নামা করছে। মাঝে-মাঝে মেগাফোনে নানারকম অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। সারি-সারি ক্যাশ-কাউন্টার থেকে ইলেকট্রনিক স্মার্ট কার্ড কুপন বিক্রি হচ্ছে। কোনও নির্দিষ্ট গেমের স্লটে কার্ডটা টানলেই গেমের চার্জ বিয়োগ হয়ে যাবে।
এলিভেটরে দোতলায় উঠে ‘নাইন স্টিকস’ নামে একটা খেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। ন’টা রং-বেরঙের লাঠি পাশাপাশি দাঁড় করানো আছে। প্রায় ছ’-সাত মিটার দূর থেকে একটা বড় মাপের বল গড়িয়ে দিতে হবে লাঠিগুলোর দিকে। লাঠিগুলোর মধ্যে একটা কাঠের, আর বাকিগুলো হলোগ্রাম ইমেজ। কিন্তু দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। পাঁচবার বলটা গড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে খেলোয়াড়। তার আসল কাজ হল, কাঠের লাঠিটায় বল লাগানো। সেটায় ধাক্কা লাগলেই ‘ঠক’ করে শব্দ হবে। প্রথম তিনটে থ্রো-র মধ্যে আসল লাঠিটা হিট করতে পারলে পাওয়া যাবে পুরস্কার।
হইহই করে খেলায় নেমে পড়ল তিতলি। বিশ্বনাথকেও নামিয়ে দিল। একবার এই খেলা, আর একবার সেই খেলায় নাম দিয়ে বিশ্বনাথকে পাগল করে দিল। ওর সঙ্গে দৌড়-ঝাঁপ করতে-করতে বিশ্বনাথও যেন বাইশ হয়ে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক পর গেমস পারলার থেকে ওরা বেরিয়ে এল রাস্তায়। বেশ কিছু টাকা প্রাইজমানি হিসেবে পেয়েছে তিতলি। ও খুশিতে বিশ্বনাথকে একটা আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘বাষট্টি, আপনি ভীষণ পয়া। দেখলেন, কত টাকা প্রাইজ পেলাম!’
বিশ্বনাথ হাসলেন।
আবার গাড়িতে চড়ে ওরা ছুট লাগাল।
এবারে তিতলি গিয়ে থামল ‘রিল্যাক্স’ নামের একটা অ্যাডিকশান জয়েন্টে। এখানে নেশার সবরকম খোরাক পাওয়া যায়।
তিতলি বলল, ‘এখানে আমি প্রায়ই আসি—।’
‘রিল্যাক্স’-এর বাইরে লাল-নীল নিওন সাইন দিয়ে বিরাট হরফে লেখা রয়েছে: ‘ইউ মাস্ট বিএইটিন টু এনটার’ তার মধ্যে ‘এইটিন’ কথাটা লাল রঙে সংখ্যায় লেখা।
ভেতরে ঢুকে বেশ অবাক হলেন বিশ্বনাথ। যদিও জানতেন চারপাশে এসব চলছে, তবুও নিজে কখনও এরকম আস্তানায় আগে আসেননি।
চতুর্দিকে আলোর মেলা। তারই মধ্যে আলো দিয়ে ছবি আঁকা সব বিজ্ঞাপন। বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনই নানান লিকার কোম্পানির। তা ছাড়া আছে নেশা করার কিছু ড্রাগের বিজ্ঞাপন। আর লুকোনো স্পিকার থেকে ভেসে আসছে রক মিউজিক।
সত্যি, নেশা-প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে!
একটা রঙিন ফুলের ছবি চোখে পড়ল। সেটা রোজ দু-মিনিট করে শুঁকলেই অদ্ভুত নেশা হবে। আর মাসে একবার ফুলটাকে রিচার্জ করে নিতে হবে। সেইরকম দাবি করেছে একটি কোম্পানি।
বিশ্বনাথ অবাক শিশুর চোখে জগৎটাকে দেখছিলেন।
বিশাল হলঘরের নানা জায়গায় দাঁড় করানো আছে মদের স্লট মেশিন। তাতে বোতাম টিপে স্মার্ট কার্ড টানলেই গ্লাসে পরিমাণ মতো তরল পাওয়া যাবে। একটা কোণে ওয়াইড স্ক্রিন প্লেট টিভি-তে সিনেমা চলছে। ডানপাশের একটা লম্বা কাউন্টারে ড্রাগের সুদৃশ্য পলিপ্যাক বিক্রি হচ্ছে। কাউন্টারের মাথায় নিওন সাইনে লেখা ‘স্ম্যাক জ্যাক’। আর কাউন্টারের সামনে উঁচু টুলে বসে আছে ঝিম মেরে যাওয়া খদ্দেররা।
হলে সাজানো চেয়ার-টেবিলের মেলা ছাড়িয়ে দূরের একটা অঞ্চলে লাল নিওন সাইনে লেখা ‘হট স্পট’। সেখানে সিলিং থেকে লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলো ঠিকরে পড়েছে। সেই আলের নীচে চলেছে মাতালদের ছন্দহীন উদ্দাম নাচ।
বিচিত্র সব নেশার গন্ধে বিশ্বনাথ পাগল হয়ে গেলেন। তেজি ঘ্রাণশক্তি ওঁকে আরও বিব্রত করে দিচ্ছিল। ভাবছেন বেরিয়ে যাবেন কি না, ঠিক তখনই ওঁর হাত ধরে টান মারল তিতলি।
‘চলুন, ওইখানে গিয়ে বসি—।’ একটা খালি টেবিলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল মেয়েটা।
‘বসব? কেন’ বিশ্বনাথের গলায় আপত্তির ছোঁয়া।
‘ভী-ষণ তেষ্টা পাচ্ছে।’ অনুনয় করে বলল। একটা কাউন্টারে সাজানো রঙিন বোতলের সারির দিকে দেখাল।
‘না!’
‘না কেন? আমার যে অভ্যেস…। তা ছাড়া এখানে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা…।’
একটু চুপ করে রইলেন বিশ্বনাথ। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি তা হলে বোসো—আমি যাই!’
তিতলি এবার বিশ্বনাথের হাত ধরে ফেলল: ‘সেটা কখনও হয় নাকি! আপনি আমার গেস্ট…।’
‘তা হলে চলো…চলে যাই। এখানে আমার ভালো লাগছে না!’
ছোট বাচ্চার বায়না করার ভঙ্গিতে তিতলি বলল, ‘একবার—জাস্ট একবার!’
বিশ্বনাথ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন।
তিতলি কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর বিশ্বনাথের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কথা শুনব, যদি আপনি আমার কথা শোনেন—।’
‘কী কথা?’
‘আমি আপনার কাছে বাইট নেব—আজ রাতে।’
বিশ্বনাথ একটা জোরালো ধাক্কা খেলেন। বাইশ বলে কী!
কিন্তু বাইশ জেদ ধরে বসে রইল। বিশ্বনাথের কোনও জ্ঞানের কথা সে শুনতে রাজি নয়।
কথা কাটাকাটি করতে-করতেই ওরা ‘রিল্যাক্স’-এর বাইরে বেরিয়ে এল।
শেষ পর্যন্ত তিতলি এমন কথাও বলে বসল, ‘আপনি এত আপত্তি করছেন কেন বুঝতে পারছি না। যা চার্জ লাগে আমি দেব…।’
বিশ্বনাথ যে বেশ আহত হলেন সেটা ওঁর মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গেল। আর কোনও তর্কাতর্কির মধ্যে গেলেন না। তিতলির সঙ্গে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমার ফ্ল্যাটে—এখন বাইরে ডিনার করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে ফ্রিজের লেফট ওভার গরম করে দুজনে খেয়ে নেব, কেমন।’ গাড়ি চালাতে-চালাতে বলল তিতলি। চোখ সামনের রাস্তার দিকে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। কখন যেন ধরিয়েছে।
বিশ্বনাথ কয়েক পলকে ওকে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘আমি নেমে যাব। বাইট কোথায় পাওয়া যায় সে-কনট্যাক্ট নম্বর তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে নামিয়ে দাও…।’
তিতলি তাকাল। হাসল। বলল, ‘রাগ হয়েছে? অন্য কারও কাছে বাইট নেব না—আপনার কাছেই নেব।’
‘কেন?’
‘আপনি স্পেশাল, তাই—।’
‘কেন, স্পেশাল হতে যাব কেন?’
খিলখিল করে হাসল তিতলি। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘রিল্যাক্স-এ তো প্রচুর লোক নেশা করছিল—আপনি শুধু আমাকে বারণ করলেন কেন?’
বিশ্বনাথের মুখে রক্তের ঝলক ছুটে এল। লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলেন।
তিতলি থুতনি উঁচু করে বলল, ‘আপনাকে আমি গাড়ি থেকে নামতে দেব না। দেখি আপনি কী করেন।’
বিশ্বনাথ একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি কিছুই করব না। হেরে ভূত হয়ে গেছি।’
‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। আমি চাই আমাকে আজ রাতে ভূতে ধরুক।’
বিশ্বনাথ চমকে উঠে তিতলির দিকে তাকালেন। ও তখন একমনে সিগারেটের টান দিয়ে চলেছে।
ফ্ল্যাটে এসে ওদের আর-একদফা তর্কাতর্কি শুরু হল। চলল জেদ আর বায়নার দড়ি টানাটানি।
শেষে তিতলি চোখ কুঁচকে, ঠোঁট উলটে, একটা আঙুল দেখিয়ে আন্তরিকভাবে বলল, ‘বাষট্টি, প্লিজ…একবার। জাস্ট একবার…।’
বিশ্বনাথ তা সত্ত্বেও গাঁইগুঁই করছিলেন।
তখন তিতলি ব্যথা পাওয়া গলায় বলল, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার হাতে বেশি সময় নেই। হয়তো বাইট কেমন সেটা আর জানাই হবে না কখনও…। একটা দুঃখ থেকে যাবে, বাষট্টি।’
‘কেন, সময় নেই কেন?’ বিশ্বনাথের জেদ নমনীয় হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, এর আগেও একদিন তিতলি এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়েও দেয়নি।
সোফাতে হেলান দিয়ে হাতদুটো ওপরে তুলে সোফার পিছনে ঝুলিয়ে দিতে চাইল মেয়েটা। তারপর ঘষা কাচের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল বিশ্বনাথের দিকে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে যেন অনেক কষ্টে বিশ্বনাথকে ফোকাস করল। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আজ আপনাকে বলব…সব বলব।’
বিশ্বনাথ চুপ করে রইলেন। অপলকে বাইশকে দেখতে লাগলেন। ওঁর বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল।
বাইশ বলতে শুরু করল।
‘আপনাকে কখনও বলা হয়নি। আমরা…আমরা জঘন্য বড়লোক। আমাদের দুটো কয়লা খনি, আর একটা অভ্র খনি আছে। এ ছাড়া আর যা-যা থাকে…বড়লোকের। মানে, কলকাতায় তিনটে বাড়ি, রাজারহাটে একটা বাগানবাড়ি। আর তিনটে গাড়ি…আমারটা নিয়ে।
‘যদিও ”আমাদের”, ”আমাদের” বলছি…আসলে এসবের মালিক এখন আমি একা। সব আমার। কারণ, দু-বছর আগে আমার মা-আর বাবা হাইওয়েতে…এনএইচ-থার্টিফোর-এ…একটা হরিবল অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। স্পট ডেড।
‘আগে মনে-মনে একা ছিলাম, অ্যাক্সিডেন্টটার পর সত্যি-সত্যি একা হয়ে গেলাম। এক কাকা ছাড়া আর কেউ রইল না। আর সেই কাকা…কাকা আমাকে পাগলের মতো তাড়া করে বেড়াতে লাগল।’
তিতলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডানহাত নামিয়ে চোখ ঢাকল।
বিশ্বনাথ বিড়বিড় করে বললেন, ‘…তাড়া করে বেড়াতে লাগল কেন?’
চোখ ঢেকে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল তিতলি। ওর বুকের ওঠা-নামা দেখে সেটা বুঝতে পারছিলেন বিশ্বনাথ।
একটু পরেই ও চোখ থেকে হাত সরাল। তারপর বারদুয়েক নাক টেনে বলল, ‘কাকা আসানসোলে থাকতেন। মাইনগুলো দেখাশোনা করতেন। তার জন্যে বাবা টাকা দিত মাসে-মাসে। কিন্তু ওই রোড অ্যাক্সিডেন্টটার পর কাকা একেবারে খেপে গেলেন। একে ওই কোটি-কোটি টাকার প্রপার্টি…আর তার সঙ্গে লোভ। বছরদেড়েকের মধ্যেই আমার কাছে তিনি ধরা পড়ে গেলেন। আমাকে বোকা বানিয়ে তিনি সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার তাল করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পেরে বাধা দিলাম। লোকজানাজানি হয়ে গেল। আর তখনই বাধল ঝামেলা।
‘আমাকে কিডন্যাপ করে কাকার একটা লুকোনো আস্তানায় তোলার জন্যে কাকা সুপারি দিয়ে প্রফেশন্যাল হুডলামদের লাগিয়ে দিলেন। কারণ, কাকা সম্পত্তি আইনমাফিক কবজা করতে গেলে কয়েকটা ডকুমেন্টে আমার সাইন দরকার। তো সেই লোকগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সুযোগ খুঁজছে। ওরা কখনও আমাকে ফোন করে ভয় দেখায়। কখনও ফলো করে। কখনও-বা ফ্ল্যাটের দরজায় এসে সময়ে-অসময়ে কলিংবেল বাজায়।
‘প্রথম-প্রথম আমি ভীষণ ভয় পেতাম। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। বুঝলাম, ফালতু ভয় পেয়ে আর লাভ নেই—মরতে হবেই। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। তা ছাড়া একে-একা কারই-বা সেরকম বাঁচতে ইচ্ছে করে!’
তিতলি একটু থামতেই বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘কেন? তুমি তো পুলিশে খবর দিতে পারো…।’
‘দিয়েছিলাম’। তেতো হাসল: ‘কোনও লাভ হয়নি। ওরা কাউকে ট্রেস করতে পারেনি। খুন-টুন হলে তারপর ক্লু পাওয়া যায়। খুনের আগে থেকেই এগুলো এক্সপেক্ট করাটা বড্ড বাড়াবাড়ি। এ-কথা একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন।’
‘প্রথম-প্রথম আমি এ-শহর থেকে ও-শহর পালিয়ে বেড়াতাম। দু-মাস পর ক্লান্ত হয়ে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি। আর কোথাও আমি পালাতে চাই না। টু হেল উইথ দৌজ সুপারি কিলার্স। আই ওয়ান্ট টু ডাই ইন মাই ওন সিটি। যা হবে দেখা যাবে।’ বিরক্তি আর ঘেন্না নিয়ে কথা শেষ করল তিতলি।
‘তোমার কোনও বন্ধু নেই।’
‘এখন?’
ওর প্রশ্নে বিশ্বনাথ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘না, আগে হোক, এখন হোক…।’
‘তিনজন কপালে জুটেছিল। কিলারদের কথা শোনামাত্রই দুজন সটকে পড়েছে। আর-একজন তো একটা এনকাউন্টারের মাঝে পড়ে গিয়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।’
‘এনকাউন্টার?’
‘হ্যাঁ। সেদিন রাতে জওহরলাল নেহরু রোডে যেমন হয়েছিল। দুটো লোক একটা গাড়ি নিয়ে আমাকে চেজ করেছিল। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম, শুভ্র আমার পাশে বসে ছিল। হেকটিক কার চেজের পর কোনওরকমে ওদের কাটিয়ে দেখি শুভ্র ফেইন্ট হয়ে গেছে।’
হাসল তিতলি। বলল, ‘আর কিছু জানতে চান?’
বিশ্বনাথ মাথা নাড়লেন: ‘না!’
‘একমাত্র আপনাকেই দেখলাম, অকারণে ছুটে এসে বোকার মতো ডেঞ্জারাস সিচুয়েশানে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন…।’
‘হয়তো আমি বোকা, ডেঞ্জারাস, তাই।’
‘আপনি কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার। সেজন্যেও হতে পারে।’
‘কে জানে! হতেও পারে—।’
‘কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমার কথায় বারবার সায় দিচ্ছেন কেন?’
‘সায় দিতে ভালো লাগছে।’
অবাক হয়ে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল তিতলি। তারপর উঠে দাঁড়াল: ‘চলুন, এবার শুরু করুন…।’
‘কী?’
‘আহা! ন্যাকা! বাইট।’
হতাশভাবে মাথা নাড়লেন বিশ্বনাথ। সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। বললেন, ‘তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। চলো, বেডরুমে চলো…।’
বিশ্বনাথ যেরকম সহজভাবে ‘বেডরুম’ কথাটা বললেন, তিতলি তার চেয়েও সহজভাবে বলল, ‘এই ফ্ল্যাটের রুমগুলোর মধ্যে বেডরুমটা আমার সবচেয়ে ফেবারিট।’
ওরা শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
অন্ধকার ঘরে ঢুকেই তিতলি সুইচ টিপল। ঘরের সিলিং-এ ছড়িয়ে পড়ল নীল আলোর আভা। কিন্তু ল্যাম্পটা বিশ্বনাথের চোখে পড়ল না। শুধু দেখলেন, অদ্ভুত এক নীল মায়া ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
আর-একটা সুইচ টিপল তিতলি।
খুব নীচু লয়ে কোমল সুর জেগে উঠল কোথা থেকে। ঠিক যেন মায়ের আদর মাখা ঘুমপাড়ানি গান।
বিশ্বনাথ তিতলিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। গাঢ় নীল অন্ধকার দিয়ে সেজে উঠেছে মেয়েটা।
ও হাতছানি দিয়ে ডাকল বিশ্বনাথকে।
বিশ্বনাথ পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন ওর কাছে। কাঁধ আর গলার খাঁজে ঝুঁকে পড়লেন। পারফিউমের চড়া গন্ধ নাকে এল।
এক অদ্ভুত বিষণ্ণ আনন্দ বিশ্বনাথের মনে ঢেউ তুলছিল। আঙুলের ডগা দিয়ে কাঁধের কাছ থেকে ওর পোশাকটা একটু সরিয়ে দিলেন। তারপর আরও ঝুঁকে ঠোঁট রাখলেন ওর কোমল ত্বকে।
তিতলি হঠাৎই বিশ্বনাথকে জাপটে ধরল। চাপা গলায় বলল, ‘ওঃ, সিক্সটি টু!’
বিশ্বনাথ নাভিমূল থেকে কেঁপে গেলেন। পলকে যেন ছাব্বিশ হয়ে গেলেন। ওর উষ্ণ ঘনিষ্ঠতা বিশ্বনাথকে উষ্ণ করে তুলল। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল, সব কেমন গুলিয়ে গেল।
ভ্যাম্পায়ারদেরও তা হলে নেশা হয়!
ঠোঁট ফাঁক করে কামড় বসালেন বিশ্বনাথ। এক অলৌকিক চরম তৃপ্তি ওঁর ভেতরে কাজ করে চলল। তিতলির রক্তের স্বাদ জিভে টের পাচ্ছিলেন। একইসঙ্গে সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ পড়ছিল। নেশা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঢুকছিল তিতলির শরীরে।
আগে খেয়াল করেননি, বিশ্বনাথ কখন যেন আঁকড়ে ধরেছেন মেয়েটাকে। দুজনের বুক প্রবল চাপে মিশে যাচ্ছিল। তার পরেও মেয়েটা বিশ্বনাথকে কাছে টানতে চাইছিল, পাগলের মতো করছিল।
সেই সময় বিশ্বনাথের ধারালো দাঁতের চাপে একটা রক্তের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ওঁর মনে হল, এইরকম একটা আশ্লেষের আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ বছর বেঁচে থাকা যায়। ওঁর জীবনে পশ্চিমদিকটা আচমকা পুবদিক হয়ে গেল যেন। যে-সূর্যটা অস্ত যাচ্ছিল, সেটা যেন কোন এক ম্যাজিকে ভোরের সূর্য হয়ে গেল।
তিতলির ঠোঁট চিরে একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে আসছিল। ঘুমিয়ে পড়ার ঘোরে বাচ্চারা যেমন আলতো ‘উঁ-উঁ’ শব্দ করে সেইরকম।
শব্দের তেজ ক্রমশ কমতে-কমতে শেষে একেবারে মিলিয়ে গেল। তিতলি শরীরের ভার ছেড়ে দিল বিশ্বনাথের হাতে।
বিশ্বনাথ ওকে যত্ন করে ধরে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। পকেট থেকে স্টিকিং প্লাস্টার বের করে লাগিয়ে দিলেন ক্ষতের ওপরে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন ওর ঘুম-ঘুম মুখের দিকে।
বিশ্বনাথ বিছানায় বসে পড়লেন। তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুখের ভেতরের নোনা আঁশটে স্বাদটা বারবার জিভ বুলিয়ে থুতু গিলে কমাতে চাইলেন।
বিশ্বনাথ নিজের নতুন জীবনের কথা ভাবছিলেন। কোথায় ছিলেন, আর কোথায় এসে পড়লেন। যে-জীবনটাকে প্রতিদিন ঘেন্নায় দূরে ঠেলতে চাইতেন, সেটাকে এখন তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল।
ঘোর ভেঙে গিয়ে চমকে উঠলেন বিশ্বনাথ। কে এল এ সময়? তিতলি তো বলেছিল, ওর সেরকম কোনও আত্মীয় কিংবা বন্ধু নেই!
ঝরনার শব্দ তুলে বেল বাজাল আবার।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তাড়াতাড়ি পা চালালেন ফ্ল্যাটের দরজার দিকে।
ডাইনিং রুমে কোনও আলো জ্বলছিল না। তবে ড্রইংরুমে জ্বলছিল। বিশ্বনাথ দরজার ম্যাজিক আই-তে চোখ রাখলেন।
দুটো অচেনা লোক দরজায় দাঁড়িয়ে। একজন বেশ লম্বা, আর-একজন বেঁটে। বেঁটে লোকটার মুখ লেন্স দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বড্ড বেশি নির্লিপ্ত কাঠখোদাই মুখ। বিশ্বনাথের ওকে পছন্দ হল না।
লম্বা লোকটা একপাশে মুখ ঘুরিয়ে কান চুলকোচ্ছিল। তাই ওর মুখটা দেখতে পেলেন না। কিন্তু ওর কান চুলকোনোটা অভিনয় হতে পারে বলে মনে হল।
কী ভেবে ঘরে আলো নিভিয়ে দিলেন বিশ্বনাথ। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন।
সঙ্গে-সঙ্গে বেঁটে লোকটা একটা লম্বাটে রঙিন কৌটো বিশ্বনাথের মুখের সামনে উঁচিয়ে ধরল। এবং বিশ্বনাথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যাটমাইজারের বোতাম টিপল।
‘স-স-স-স’ শব্দ করে মিহি রেণুর শঙ্কু ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশ্বনাথের মুখে।
মিষ্টি গন্ধ পেলেন। বুঝতে পারলেন, স্প্রে করা তরলটা ক্লোরোফর্ম কিংবা ওই জাতীয় কিছু হতে পারে।
তিতলি যেহেতু একা থাকে তাই বেঁটে লোকটা ভেবেছে তিতলিই দরজা খুলবে। ফলে দরজা খোলামাত্রই সময় নষ্ট না করে অ্যাটমাইজারের বোতাম টিপেছে। তিতলি অজ্ঞান হয়ে গেলেই ওরা দুজনে ওকে তুলে নিয়ে যাবে।
বিশ্বনাথ দরজা খোলায় গল্পটা ভেস্তে গেল।
যে-পরিমাণ তরল বেঁটে লোকটা স্প্রে করেছ তাতে কমপক্ষে দুজন মানুষের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু সি. ভি. বিশ্বনাথ অজ্ঞান হলেন না। চোখের নিমেষে ডানহাত বাড়িয়ে বেঁটে লোকটার টুঁটি খামচে ধরলেন।
লোকটার হাত থেকে রঙিন কৌটোটা খসে পড়ে গেল। ও চোখ বড় করে হাঁসহাঁস করতে লাগল। দু-হাতে বিশ্বনাথের কবজি চেপে ধরল। প্রাণপণ চেষ্টায় টুঁটির বাঁধন ছাড়াতে চাইল।
কিন্তু কোনও কাজ হল না।
বিশ্বনাথ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি একটা কামড় দিলে তুমি খতম হয়ে যাবে।’
এ-কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল।
পিছনের লম্বা লোকটা সবে কী করবে ভাবতে শুরু করেছিল। ও সঙ্গীকে ফেলে রেখে সটান সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল। বিশ্বনাথের হঠাৎই মনে হল, লম্বা লোকটা বোধহয় আগের দিন সংঘর্ষের সময় হাজির ছিল। বিশ্বনাথের কামড়ে কী হতে পারে ও হাড়ে-হাড়ে জানে।
বেঁটে লোকটার অবস্থা তখন মরা নেংটি ইঁদুরের মতো। বিশ্বনাথ ওকে পিছনে ঠেলে দিলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘তিতলির গায়ে হাত দিতে গেলে আমাকে ডিঙিয়ে যেতে হবে…।’
বিশ্বনাথের ধাক্কায় লোকটা পড়ে গিয়েছিল। গলায় হাতে বোলাতে-বোলাতে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল।
বিশ্বনাথ বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে যেন আমার আর দেখা না হয়।’
লোকটা কোনও জবাব না দিয়ে ছুটে পালাল। কিন্তু ওর ছুটটা এক-পা খোঁড়া কুকুরের মতো দেখাল।
বিশ্বনাথ হাঁপাচ্ছিলেন। একটু-আধটু ভয়ও করছিল। এরা যদি সেই সুপারি কিলার হয় তা হলে সহজে হাল ছাড়বে না—ওরা আবার আসবে, এবং তৈরি হয়ে আসবে।
ঘুমপাড়ানি ওষুধের কৌটোটা মেঝেতে পড়ে ছিল। বিশ্বনাথ সেটা কুড়িয়ে নিলেন। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ড্রইংরুমে সোফায় বসে কৌটোটা টেবিলে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। টেলিফোনের পাশ থেকে কাগজ আর পেন নিয়ে তিতলিকে দু-লাইন নোট লিখলেন:
বাইশ,
একটা বিপদ এসেছিল। রুখেছি। চলে যাচ্ছি। কাল কথা হবে।
বাষট্টি
কাগজটা নিয়ে বেডরুমে গেলেন। ঘুমন্ত তিতলিকে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। তারপর কাগজের টুকরোটা রেখে দিলেন ওর হাতের কাছে।
তিতলির ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর এক অদ্ভুত ক্লান্তি টের পেলেন। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল হঠাৎই। তখনই রেণুকণার গলা পেলেন, ‘সারা সন্ধে যা ধকল গেল! তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো—।’
বিশ্বনাথ একটু অন্যমনস্ক ছিলেন বোধহয়। তাই রেণুকণার গলা পেয়ে চমকে চারপাশে তাকালেন। তারপরই বুঝতে পারলেন, রেণুকণার কথাগুলো এসেছে ওঁর বুকের ভেতর থেকে।
তিতলিকে গাঢ় আবেগে জড়িয়ে ধরেছেন। ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে আছেন গলা। পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছেন—সেইসঙ্গে তিতলির গন্ধও। বুঝতে পারছিলেন, এই বাইট অন্তত—কিছুতেই শেষ হবে না।
জীবনের টান ভোরবেলায় বিশ্বনাথকে এই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। যখন জেগে উঠলেন তখনও স্বপ্নটা আদর মাখা চাদরের মতো বিশ্বনাথকে জড়িয়ে ছিল।
বেলা হতেই রোজকার মতো রাস্তায় বেরোলেন বিশ্বনাথ। এটিএম থেকে পেনশনের টাকা তুলতে হবে। তারপর ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর স্পেশাল সেল-এ একবার ফোন করতে হবে। নিজের জন্য টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে আর ওষুধ কিনতে হবে। তারপর সন্দীপনের সঙ্গে একবার দেখা করবেন। সি. ভি. জীবনের সুঃখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলবেন।
রোদে হাসিখুশি রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে মনে হল তিতলিকে একটা এসএমএস করা যাক। এখন সওয়া দশটা বাজে—নিশ্চয়ই ঘুম ভেঙেছে ওর।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে এসএমএস করলেন বিশ্বনাথ:
বাইশ জেগে ওঠো। তবে না ‘গুড মর্নিং’ বলব।
তাকিয়ে দ্যাখো, একটা দিন আমাদের জীবন থেকে
কমে যাচ্ছে।
বিশ্বনাথ যখন ওষুধের দোকানে তখন এসএমএস-এর উত্তর এল:
বাষট্টি, জেগেছি। গুড মর্নিং বলবেন না?
বিশ্বনাথ ভাবলেন, ওষুধের দোকানে কাজ মিটিয়ে তারপর ওকে ফোন করবেন।
প্রায় দশমিনিট পর দোকান থেকে বেরোতে না বেরোতেই আবার তিতলির এসএমএস:
কী ব্যাপার? হারিয়ে গেলেন নাকি?
বিশ্বনাথ হেসে ফেললেন আপনমনে। কী অল্পেতে ঠোঁট ফোলায় মেয়েটা! আসলে ওর কোনও দোষ নেই। সারা জীবনে কারও কাছ থেকে ও কিছু পায়নি। যা ওর পাওনা ছিল তাও না। না পাওয়ার যন্ত্রণা ওকে অভিমানী করে তুলেছে।
বিশ্বনাথ মোবাইল বের করে ওকে ফোন করলেন।
‘হ্যালো, বাইশ। কেমন আছ?’
‘কী ব্যাপার? হারিয়ে গেলেন নাকি?’ তিতলি নয়, ওর অভিমান কথা বলল বলে মনে হল বিশ্বনাথের।
‘গুড মনিং, বাইশ—।’
‘গুড না ছাই! ফোন করতে আর-একটু দেরি হলেই মর্নিংটা ব্যাড হয়ে যেত।’
‘কেন? তুমি তো ফোন করতে পারতে আমাকে—।’
‘পারতাম। কিন্তু সকালের প্রথম ফোনটা আপনার কাছ থেকে পেতে ভালো লাগে।’ হাসল তিতলি: ‘থ্যাংকস ফর দ্য সুইট বাইট লাস্ট নাইট।’
মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। বিশ্বনাথ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। নীল আলোয় যা আকাঙ্ক্ষার মনে হয়েছিল এখন ঝকঝকে রোদে সে-কথা মনে পড়তেই বিব্রত হয়ে পড়লেন হঠাৎ।
তারপর উঠল বিশ্বনাথের লিখে আসা দু-লাইন চিঠিটার কথা। কথা চলল, এবং চলতেই থাকল।
সময় ভুলে গেলেন বিশ্বনাথ। আর তিতলিও।
বিশ্বনাথের মনে পড়ল, বাড়িতে যেদিন ওঁর মোবাইল ফোনের রিং-এর শব্দ আলোক প্রথম শুনতে পেয়েছিল সেদিন ওর মুখের অবস্থাটা কী বিচ্ছিরিই না হয়েছিল। বিশ্বনাথের ঘরে ছুটে এসে গায়ের ওপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ছেলে। অবাক গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘এ কী, বাবা, তুমি মোবাইল ফোন কিনেছ?’
‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’ শান্ত গলায় পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বিশ্বনাথ।
‘না, অনেক টাকার ব্যাপার…তাই…।’
‘ঘরে যাও। পারমিতা তোমাকে বোধহয় ডাকছে।’
ভিক্টরের মতো গরগর করতে-করতে চলে গিয়েছিল আলোক।
পারমিতার কাছে অনেক খবরই ও পাচ্ছে আজকাল।
বিশ্বনাথ বড্ড বেশি বাড়ির বাইরে-বাইরে কাটাচ্ছেন। নতুন-নতুন জামাকাপড় তৈরি করাচ্ছেন। পারফিউম স্প্রে করছেন। আগে তিন-চারদিন পরপর শেভ করতেন—এখন রোজ করছেন। দু-একদিন ওঁকে ফুল হাতে নিয়ে ঢুকতে দেখেছে পারমিতা।
ছেলে আর বউমার বিস্ময় অবশ্যই টের পান বিশ্বনাথ। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ করেননি। পুরোনো জীবনকে তোয়াক্কা না করাটা এখন ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
তিতলির সঙ্গে, বলতে গেলে রোজই দেখা করেন বিশ্বনাথ। ওর সঙ্গে পথে বেরিয়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। তিতলির যেমন খেয়াল হয় সেভাবেই ওদের পা চলে।
একদিন তিতলি বলল, কলকাতার টুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে-ঘুরে দেখবে। ব্যস, অমনই ওদের ট্যুর শুরু হয়ে গেল। পুরো চারদিন লেগেছিল সবগুলো দেখে শেষ করতে।
ওর ছেলেমানুষি দেখে বিশ্বনাথ মজা পান। সেইসঙ্গে ভালোও লাগে। ওর মনের সমস্ত ভাবনা, খামখেয়ালিপনা, এত স্পষ্ট, এত খাঁটি যে, তার তুলনা নেই। মনটা পড়ে নেওয়া যায় খোলা খাতার মতো।
একদিন সন্ধেবেলা ময়দানে হাঁটতে-হাঁটতে তিতলি বলল, ‘হাতে আমার যদি বেশি সময় থাকত তা হলে ভালো হত…।’
‘তার মানে?’ বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন।
‘মানে বাইশ থেকে বাষট্টিতে পৌঁছতে ইচ্ছে করছে। সবকিছু ছেড়ে চট করে চলে যেতে মন চাইছে না…।’
‘কোথায় চলে যাবে?’
চলতে-চলতে হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখাল।
‘এসব পাগলামি ছাড়ো! কে তোমাকে চলে যেতে দিচ্ছে?’
‘কে আটকাবে? আপনি?’
‘যদি বলি হ্যাঁ—আমি।’ বেশ জোর করে বললেন বিশ্বনাথ।
মনমরা হাসল তিতলি: ‘আপনি পারবেন না। ওরা প্রফেশন্যাল। ডেঞ্জারাস।’
‘আর তুমি তো জানো, আমি বোকা এবং ডেঞ্জারাস—।’
তিতলি কোনও জবাব দিল না। ঠোঁটের কোণ দিয়ে হাসল শুধু।
বিশ্বনাথ তিতলির জন্য ভীষণ চিন্তা করছিলেন।
গত দশ-বারোদিন ধরে হুমকি-ফোনের ব্যাপারটা বেশ বেড়ে গেছে। তিতলিও ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে যেন। যখন ও মরতে ভয় পেত না তখন ওর কোনও ভয় ছিল না। যেদিন থেকে ওর বাষট্টি হতে ইচ্ছে করছে, একটু-আধটু বাঁচতে ইচ্ছে করছে, সেদিন থেকে ভয় চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে ওর ভেতরে।
সন্ধে হয়ে আসছে দেখে বিশ্বনাথ বললেন, ‘বাইশ, এবার বাড়ি ফেরা যাক—।’
পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে তিতলি বলল, ‘এখনও সূর্য অস্ত যায়নি।’
‘দেরি করার কী দরকার!’ বিশ্বনাথের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিলেন।
লাল সূর্যের দিকে চোখ রেখে তিতলি বলল, ‘বাষট্টি, কাল আমরা দূরে কোথাও বেড়াতে যাব।’
‘কোথায়?’
‘কাল ভোরে উঠে যেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে হবে সেদিকে…।’
হঠাৎই বিশ্বনাথ দেখলেন, তিনটে লোক মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। তার মধ্যে একজন একটু বেশি লম্বা।
ভয় চলকে উঠল। অদৃশ্য গিটারের মোটা তার ঝংকার তুলল বিশ্বনাথের বুকের ভেতরে।
মাঠে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও লোকজন রয়েছে। বিপদে পড়ে চিৎকার করে উঠলে তারা নিশ্চয়ই ছুটে আসবে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
বিশ্বনাথ এ-কথা ভাবছিলেন এবং আড়চোখে লোক তিনটের দিকে নজর রাখছিলেন।
তিতলি লাল-হয়ে-যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনাভাবে নানান কথা বলছিল। কিন্তু সব কথা বিশ্বনাথের মাথায় ঢুকছিল না। কারণ, লোক তিনটের দিকে লক্ষ করছিলেন।
হঠাৎই বিশ্বনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।
লোক তিনটে মোটেই ওদের দিকে আসছিল না। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে একটা গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। সেই গাছ-বরাবর তাকালে দূরের রাস্তায় তিতলির শ্যাওলা রঙের গাড়িটা চোখে পড়ছে। অর্থাৎ, গাড়ির কাছে যেতে হলে লোকগুলোকে ডিঙিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বনাথ আরও লক্ষ করলেন, গাছের নীচটায় ছায়া নেমে এসেছে। মাঠের লোকজনও কমে যাচ্ছে দ্রুত।
আর ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানে হয় না। তিতলিকে হাত ধরে টান মারলেন বিশ্বনাথ, ‘বাইশ, চলো, আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
তিতলি বায়নার সুরে হলল, ‘কেন? আর একটু থাকি…।’
‘না।’
তিতলির হাত টেনে নিয়ে এগোতে লাগলেন। লক্ষ করলেন, আকাশের লাল আভা মলিন হয়ে সেখানে ছায়া-ছায়া তুলির আঁচড় পড়েছে। ঘরে ফেরা কাক-চড়ুইয়ের দল ঝাঁকড়া গাছগুলোয় বসে তুমুল হল্লা করছে। রাস্তার ধারে পার্ক করা তিতলির গাড়িটাকে বেশ কষ্ট করে দেখতে পাচ্ছেন।
সেইসঙ্গে এও দেখতে পেলেন, লোক তিনটে বৃত্তচাপের ঢঙে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা কালো বাজপাখি যেন ডানা ছড়াচ্ছে।
বিশ্বনাথের আর সন্দেহ রইল না। চট করে চলার দিক পালটালেন। একইসঙ্গে গতিও বাড়ালেন।
তিতলি বারবার জিগ্যেস করছিল, ‘কী হয়েছে?’
বিশ্বনাথ চাপা গলায় বললেন, ‘সুপারি কিলার্স।’
তিতলির গলা দিয়ে একটুকরো ভয়ের শব্দ বেরিয়ে এল।
সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বনাথ বললেন, ‘চুপ! আমি তো আছি!’
‘ওদের সঙ্গে বোধহয় আর্মস আছে…।’
ওকে সাহস দিতে বিশ্বনাথ হাসলেন: ‘আর্মস আমারও আছে—তুমি জানো।’ দাঁতের পাটি ফাঁক করলেন বন্ধ করলেন।
‘আজ রাতে একটা বাইট প্রেজেন্ট করা যাবে?’
কী অদ্ভুত কথা! মেয়েটার কি মতিগতির ঠিক নেই? এই সাংঘাতিক মুহূর্তে নেশার আবদার করছে!
‘ওসব পরে হবে। আগে…।’
বিশ্বনাথ লক্ষ করলেন, লোকগুলো আর দাঁড়িয়ে নেই। দুজন জায়গা বদলে গাড়ির দিকে এগোনোর পথটা আগলাচ্ছে। আর তিন নম্বর লোকটা জোর পায়ে ছুটে আসছে বিশ্বনাথ আর তিতলির দিকে।
‘রান!’ বিশ্বনাথ গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘ছুট লাগাও জলদি—।’
ওরা ছুটতে শুরু করল। কিন্তু কিছুটা দৌড়ে যাওয়ার পরই তিননম্বর লোকটা ওদের ধরে ফেলল। একটা খাটো রড উঁচিয়ে ধরল মাথার ওপরে।
বিশ্বনাথ হাতের এক ঝটকায় তিতলিকে ছিটকে দিলেন ঘাসের ওপরে। আর একইসঙ্গে লোকটার নেমে আসা হাতটা রুখে দিলেন। কিন্তু আঘাতটা পুরোপুরি এড়াতে পারলেন না।
রডটা মাথার পাশে এসে লেগেছিল। তখনই বুঝতে পেরেছেন ওটা লোহার। একটা ভোঁটা যন্ত্রণা মাথায় চারিয়ে গেল। পুরোনো বিশ্বনাথ হলে হয়তো অজ্ঞানই হয়ে যেতেন। নতুন বিশ্বনাথ ব্যথাটা সামলে নিলেন।
লোকটা মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করেনি। বিশ্বনাথও না।
লোকটাকে দেখলেন।
ছোট-ছোট চুল। পুরু গোঁফ। গাল ভাঙা। দাঁতে রঙিন ছোপ। গলায় সোনালি চেন। পোশাক বলতে চাপা প্যান্ট আর টি-শার্ট।
না, এই লোকটা সেদিন তিতলির ফ্ল্যাটে অ্যাটাক করতে আসেনি। এটা নতুন।
লোকটাকে দেখতে একপলক লাগল। আর ওর গলায় কামড় বসাতে আর এক পলক।
ভিক্টরের মতো অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বনাথ। তারপর হিংস্রভাবে কামড় বসিয়েছেন। কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার যে আসল ভ্যাম্পায়ারের চেয়ে কিছু কম নয়, সেটাই যেন মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন।
এতক্ষণ কথা না-বলা লোকটা এবার গুঙিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। ঢলে পড়ে গেল ঘাসের ওপর। কিন্তু বিশ্বনাথ কামড় ছাড়েননি। লোকটার সঙ্গে-সঙ্গে সমান তালে ঝুঁকে পড়েছিলেন। শেষে হুমড়ি খেয়ে রইলেন ওর গলার ওপর।
নোনা। নোনা। নোনা।
গোটা সমুদ্রটা যেন ঢুকে পড়ছিল বিশ্বনাথের মুখের ভেতরে। সেইসঙ্গে যেন সমুদ্রের মাছগুলোও। কারণ, জোরালো আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিলেন। শুনতে পেলেন, রেণুকণা বলছেন, না, এ কোনও অন্যায় নয়। একটা শয়তানকে মেরে তুমি একটি দুঃখী মেয়েকে বাঁচাচ্ছ। বাঁচাও! বাঁচাও!
তার মানে, শয়তানটাকে মারো, মারো!
বিশ্বনাথ তাই করছিলেন। লোকটা গলা কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছিল। আর একইসঙ্গে ওর প্রাণটা ধীরে-ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ময়দানের ঘাষ ভিজে যাচ্ছিল।
মিনিটখানেক পর লোকটাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন, কাছেই তিতলি দাঁড়িয়ে। চোখ বড়-বড় করে বিশ্বনাথের কাণ্ডকারখানা দেখছে।
‘শিগগির ছোটো গাড়ির দিকে! গাড়ি নিয়ে পালাও। কুইক!’
কিন্তু তিতলি বিশ্বনাথের কথা যেন শুনতেই পেল না। বলল, ‘ওই দ্যাখো, ওই দুটো লোক আসছে…।’
‘আসুক। ওদের আমি রুখে দিচ্ছি। বাট ইউ রান লাইক হেল। আমার কথা শোনো, বাইশ, প্লিজ! গাড়ি নিয়ে স্ট্রেট বাড়ি চলে যাও। সিক্রেট পুলিশকে ইনফর্ম করো। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বসে থাকো। খবরদার, আমার কথা বলবে না কিছুতেই। যাও!’
‘আর তুমি?’ কাঁদতে-কাঁদতে জিগ্যেস করল তিতলি।
‘আমি তোমাকে ফোন করব। তারপর কাল হয়তো তোমার আস্তানায় গিয়ে হাজির হব।’ কথাটা শেষ করে বিশ্বনাথ হাসতে চাইলেন। কিন্তু হাসি এল না। ঠোঁট-মুখ চটচট করছে। থুতনি, গলা বেয়ে আঠালো তরল গড়িয়ে নামছে। হয়তো জামাতেও লেগে গেছে।
ছায়া-ছায়া আঁধারে ঠিক কী যে হচ্ছিল বাকি দুটো লোক সেটা ঠিকমতো ঠাহর করতে পারেনি। তা ছাড়া ওরা গাড়ি আগলাবে না সাহায্যের জন্য ছুটে যাবে, সেটা নিয়েও দোটানায় ছিল। তাই ওদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লেগেছে। এখন ওরা জোরকদমে এগিয়ে আসছে বিশ্বনাথের দিকে।
তিতলি কান্না-ভেজা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি একা যাব না—তুমিও চলো।’
বিশ্বনাথ তিতলিকে রুক্ষভাবে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি গাড়ি নিয়ে পালাও। আমি এদের ব্যবস্থা করে তারপর…।’
বিশ্বনাথ লম্বা-লম্বা শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছিলেন। আবার বললেন, ‘বাইশ, লক্ষ্মীটি—আমার এই কথাটা রাখো—প্লিজ। যাও—।’
‘বাষট্টি!’ বলে ডুকরে উঠল তিতলি। তারপর ঘুরপথে ছুট লাগাল গাড়ির দিকে।
লোক দুটো তখন বিশ্বনাথের হাতদশেকের মধ্যে এসে গেছে। সাবধানে সতর্ক পা ফেলে এক পা এক পা করে শিকার ধরতে এগিয়ে আসছে।
দুজনের মধ্যে লম্বা লোকটাকে একটু যেন চেনা মনে হল বিশ্বনাথের। তিতলির ফ্ল্যাটে কি লোকটা এসেছিল? তা হলে তো বিশ্বনাথকে ও চিনবে।
একটা লোকের গলা শোনা গেল, ‘ছামিয়াটা যে ওদিক দিয়ে ছুট লাগাচ্ছে, বস—।’
‘আগে এই ঢ্যামনাটাকে কোতল কর। হারামিটা রামাইয়াকে লুটিয়ে দিয়েছে। আমাদের অপারেশানে বারবার দখল দিচ্ছে। আর ওই ছামিয়া পালাবে কোথায়! ওর তো ওই একটাই ঠেক—।’
কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। এক্স-ফ্যাক্টর ওঁকে চমৎকার সাহায্য করছিল। ওঁর বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক, তিতলিকে আজ ওরা রেহাই দিচ্ছে। এই একটা দিনই বিশ্বনাথের দরকার। সন্দীপনের এক শালা সিক্রেট পুলিশে আছে। কাল সকালেই ওর সঙ্গে দেখা করে তিতলির ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। আগেও বিশ্বনাথ সন্দীপনকে এ-ব্যাপারে রেখে-ঢেকে একটু ইশারা দিয়েছেন, কিন্তু ইমার্জেন্সি ভেবে সেরকম তাগাদা করেননি।
লোকদুটো কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল শত্রু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পায়ের কাছে রামাইয়ার দেহ—অথবা, মৃতদেহ—অসাড় হয়ে পড়ে আছে।
বিশ্বনাথ তিতলির দিকে লক্ষ করছিলেন। দেখলেন, ও গাড়িতে উঠে পড়ল। হেডলাইট জ্বলে উঠল। তারপর হেডলাইট দুটো দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল।
আঃ—!
পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেললেন বিশ্বনাথ। এখন আর কাউকে তিনি ভয় পান না। সামনের এই জঘন্য লোকদুটোকেও না।
দুটো লোকের গায়েই ঢোলা শার্ট। প্যান্টের ওপর দিকে ঝোলানো। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলেও বিশ্বনাথ ওদের দেখতে পাচ্ছিলেন। একজনের বাচ্চা-বাচ্চা লালিপপ মুখ। বাঁ ভুরুর ওপরে কাটা দাগ। গা থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে।
আর অন্যজন সেই লম্বা লোকটা। শিকারি বাঘের মতো সামান্য ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম সুযোগেই ক্ষিপ্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
দুটো লোকই কোমরের কাছে হাত গুঁজে রেখেছিল। বোধহয় লুকোনো অস্ত্র হাতে ছুঁয়ে ভরসা খুঁজছিল। আর বিশ্বনাথের দু-পাটি অস্ত্র মুখের ভেতরে খটাখট শব্দ তুলে আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছিল।
একটা হাত বেরিয়ে এল ঢোলা শার্টের আড়াল থেকে। হাতে ধরা ফুটখানেক লম্বা একটা চওড়া ব্লেডের ছুরি।
বিশ্বনাথ হিসেব কষছিলেন। এই হতচ্ছাড়া দুটোকে যেভাবে হোক আটকাতে হবে। খতম না হোক, অন্তত ঘায়েল করতে হবে। যাতে ওরা বাইশকে আর জ্বালাতে না পারে।
হিসেবের উত্তর অনুযায়ী বিশ্বনাথ ছুরিওয়ালার ছুরি লক্ষ করে ঝাঁপ দিলেন। ভঙ্গিটা এমন, যেন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন।
সঙ্গে-সঙ্গে ছুরি চলল বাতাসে। বিশ্বনাথের বাঁ-হাতে, কুনুইয়ের ঠিক ওপরে, কেটে বসল ছুরিটা। বিশ্বনাথ লোকটার কান ধরলেন মুঠো করে। এক হ্যাঁচকায় ওকে টেনে নিলেন নিজের কাছে। এবং ওর ডান কাঁধে মরণ কামড় বসালেন।
শুয়োরের বাচ্চাটা বুঝুক ভ্যাম্পায়ারের কামড় কাকে বলে!
বাঁ-হাতে বসানো ছুরির ফলা। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু বাষট্টির কোনও তোয়াক্কা নেই। বরং কামড়টা ঠিকঠাক দিতে পেরেছে বলে বেজায় খুশি।
ঠিক সেই মুহূর্তে যন্ত্রণায় ছটফট করা লোকটা এক প্রবল ধাক্কা দিল বিশ্বনাথকে। বিশ্বনাথ ছিটকে পড়লেন বটে, তবে লোকটার কাঁধের খানিকটা মাংস ছিঁড়ে চলে এল দাঁতে।
আঁশটে গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। থু-থু করে সব ফেলে দিলেন। তারপর নজর ফেরালেন লোকদুটোর দিকে। দেখলেন আহত লোকটা টলছে—যে-কোনও মুহূর্তে খসে পড়বে জমিতে।
কিন্তু দু-নম্বর লোকটা কোথায় গেল?
ওই তো! আহত সঙ্গীকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঘাসের ওপরে চিত হয়ে পড়ে দেখতে লাগলেন বিশ্বনাথ। ওঁর একটা পা লম্বা হয়ে আছে রামাইয়ার গায়ের ওপরে। আর-একটা পা হিম-ভেজা ঘাসে।
আকাশের দিকে চোখ গেল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে চাঁদকে উজ্জ্বল করে দিয়েছে। চাঁদের খাঁজ এবং বাঁকগুলো মুগ্ধ করল বিশ্বনাথকে। যে-বাতাস হঠাৎ বইতে শুরু করেছে তাতে শীতের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তবে তার মধ্যে যেন আলতো করে মৃত্যুর পারফিউম মিশিয়ে দিয়েছে কেউ।
ওই তো লম্বা লোকটা! ও একটা দাঁড়িয়ে আছে। ওর শাগরেদ—কাঁধে কামড় খাওয়া লোকটা—নির্ঘাত খসে পড়েছে মাটিতে।
শরীরের সব শক্তি জড়ো করে উঠে বসলেন বিশ্বনাথ। বাঁ-হাতটা অসম্ভব জ্বালা করছে। এবার শেষেরটাকে খতম করার পালা। তা হলেই নিশ্চিন্ত। অন্তত কিছুদিনের জন্য।
লম্বা লোকটা কোমরের কাছ থেকে কী একটা বের করে শূন্যে তুলল।
অস্ত্রটা চিনতে পারলেন বিশ্বনাথ। খাটো হাতলের একটা কুড়ুল। কিন্তু ততক্ষণে অস্ত্রটা বাতাস কেটে শূন্যে বৃত্তচাপ এঁকে ধূমকেতুর মতো ছুটে আসতে শুরু করেছে বিশ্বনাথের দিকে।
কুড়ুলটা বিশ্বনাথের বুকে এসে আছড়ে পড়ল। সংঘর্ষের ভোঁতা শব্দ হল। ফলার অর্ধেকটা গেঁথে গেল ওঁর পাঁজরে। আর উঠে-বসতে-চাওয়া বিশ্বনাথ কুড়ুলের ধাক্কায় সটান চিত হয়ে পড়ে গেলেন।
হেঁচকি তোলার একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল মুখ থেকে। চেষ্টা করেও বিশ্বনাথ মর্মান্তিক শব্দটা চাপা দিতে পারেননি। একইসঙ্গে বুকের ভেতরে দম বন্ধ হয়ে এল। একটা প্রকাণ্ড পাথর যেন শ্বাসনালীতে আটকে গেছে।
ঝাপসা চোখে লম্বা লোকটার দাঁড়ানো সিল্যুট দেখতে পেলেন। ওর মাথার পাশ দিয়ে উঁকি মারছিল শুক্লপক্ষের চাঁদ।
সামনে ঝুঁকে পড়ে কুড়ুলের হাতল ধরে প্রকাণ্ড এক হ্যাঁচকা মারল শত্রু। বোধহয় ইচ্ছে ছিল কুড়ুলের দ্বিতীয় আঘাত হানবে বিশ্বনাথকে বুকে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। কারণ, কুড়ুলের ফলাটা কিছুতেই ছাড়ানো গেল না বিশ্বনাথের পাঁজর থেকে।
বিশ্বনাথের সারাটা শরীর চটচট করছিল। আঁশটে গন্ধ তুফান ছুটিয়ে দিয়েছে চারপাশে। কুড়ুলের কাঠের হাতলটা কোনওরকমে চেপে ধরলেন। তারপর ওঁর আঙুলগুলো কাঁকড়ার দাঁড়া হয়ে হাতল বেয়ে উঠতে লাগল। লম্বা লোকটা তখনও হাতল ধরে টানাটানি করছে। বিশ্বনাথের আঙুল ওর আঙুলের নাগাল পেয়ে গেল।
ব্যস। সঙ্গে-সঙ্গে তিতলিকে নিরাপদ করার তীব্র অভিলাষ বিশ্বনাথকে পেয়ে বসল। লোকটার আঙুল আঁকড়ে ধরে এক হিংস্র টান মারলেন। লোকটা নিমেষের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিশ্বনাথের বুকের ওপর। বিশ্বনাথ এক মুহূর্তও দেরি না করে লোকটার গাল কামড়ে ধরলেন। সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ দিলেন প্রাণপণে।
হে ভগবান, একে খতম করার পুঁজি যেন থাকে আমার অলৌকিক জীবনে! বিড়বিড় করে বারবার এই প্রার্থনা জানাতে চাইলেন বিশ্বনাথ।
লোকটা এলোপাথাড়ি ছটফটাচ্ছিল। কিন্তু একটু পরেই দম-ফুরিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেল। টাল খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল বিশ্বনাথের গায়ের ওপর থেকে।
বিশ্বনাথের মনটা পালকের মতো হালকা হয়ে গেল। চিত হয়ে শুয়ে কুড়ুলের কালো হাতল আর চাঁদ দেখতে লাগলেন। হাতলটা যেন ওঁর শরীরেরই একটা বিচিত্র প্রত্যঙ্গ—আকাশের দিকে প্রতিবাদে উঁচিয়ে আছে।
ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল হঠাৎই। বিশ্বনাথের জ্বালায় আলতো প্রলেপ লাগাল।
সঙ্গে-সঙ্গে পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল আনন্দের সুরে।
অতি কষ্টে ডানহাত পকেটে ঢুকিয়ে বের করে নিলেন ফোনটা। সুইচ টিপে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, ‘হ্যালো—।’
‘বাষট্টি, তুমি ঠিক আছ তো? আর ইউ ও. কে.?’ উদ্বেগে পাগল তিতলির গলা।
‘আমি ঠিক আছি।’ কোনওরকমে বললেন বিশ্বনাথ। প্রাণপণে কষ্ট চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন: ‘আর কোনও ভয় নেই, বাইশ…।’
‘তুমি শিগগির আমার এখানে পালিয়ে এসো। এখানে কেউ তোমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না—।’
‘যাচ্ছি।’ বিশ্বনাথের গলা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল।
‘শিগগির চলে এসো।’ উচ্ছ্বল গলায় বলল তিতলি, ‘আমি তো ওয়েট করছি! আজ রাতে আমার ফ্ল্যাটে তুমি থেকে যাবে—।’
‘যাচ্ছি—।’ আবার বললেন বিশ্বনাথ। বইপত্র পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে যেটুকু তিনি জেনেছেন, তাতে কুড়ুলের ঘায়ে ভ্যাম্পায়াররা খতম হয় না। কাঠের বল্লম দিয়ে ফুঁড়ে দিতে হয় তাদের হৃৎপিণ্ড। সুতরাং কোনও ভয় নেই। এক্ষুনি ওর বীভৎস ক্ষতের জায়গাটা অলৌকিক ম্যাজিকে মোলায়েম হয়ে জুড়ে যাবে। তারপর, বিশ্বনাথ উঠে বসবেন। তিতলির…।
কিন্তু গল্পের সঙ্গে, সিনেমার সঙ্গে, ব্যাপারটা মিলছিল না। শরীরটা কাহিল হয়ে আসছিল, হাঁ করে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন, আর চোখের নজর দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।
বোকার হদ্দ মেয়েটা তখনও ফোনে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছিল, ‘বাষট্টি, তুমি আসছ তো? বাষট্টি! বাষট্টি…।’
বিশ্বনাথের শিথিল হাত থেকে মোবাইল ফোনটা খসে পড়ে গেল ঘাসের ওপরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাচ্ছি…।’
অপারেশান দাঁড়কাক
কথায় বলে কাক কাকের মাংস খায় না।
আমিও এতদিন তাই-ই জানতাম। কিন্তু একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক নিয়ে মহিন রায়ের আবির্ভাবের পর থেকে ওপরের প্রবাদ-বাক্যটা এই অধম ভুলতে বসেছে। লোকটা এমন এলোপাতাড়িভাবে ডাইনে-বাঁয়ে খুন করে যাচ্ছে যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আমার ক্লায়েন্ট কমে যাওয়ায় আমি যত না আঘাত পেয়েছি, তার চেয়েও বেশি পেয়েছি ওই ‘খুন’ শব্দটাকে মহিন রায় যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করছে বলে।
অর্থাৎ মোদ্দা কথা, এতদিনের পর সতীশ দেবনাথ—অথবা ‘শার্প’ দেবনাথ একজন উন্মাদ প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছে।
আমি সাধারণত এইসব মোক্ষলাভ করানোর (‘খুন’ শব্দটাকে আমি আবার ঠিক পছন্দ করি না) ব্যাপারে শিল্পীসুলভ মন নিয়ে কাজ করি। ডিটেলের দিকে দিই অখণ্ড গভীর মনোযোগ—যার জন্যে পুলিশ চিরকালই মুখোমুখি হয়েছে এক অদ্ভুত সমস্যার: সেটা হল, খুনের পদ্ধতি তারা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে প্রফেশনাল কিলার হিসেবে আমার নামডাক বেড়েছে বই কমেনি।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, একটা নিখুঁত খুনের পেছনে দরকার সময়, অধ্যবসায় ধৈর্য এবং সবার ওপরে বুদ্ধি। অন্য সবকিছুতে আমার চেয়ে ছোট হলেও একটা ব্যাপারে মহিন রায় আমাকে ভীষণভাবে হারিয়ে দিয়েছে।
সে জিনিসটা হল সময়।
একটা নিখুঁত খুনের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সময়। মহিন সময়ের ধার ধারে না—যার ফলে ওর খুনগুলো ঠিক নিখুঁত নয়। যেমন কোনও পাঁচিলের আড়ালে বা ঝোপের ফাঁকে লুকিয়ে থেকে ভিকটিমকে গুলি করে স্রেফ চম্পট দেওয়া—এই টাইপের। না, মহিনকে প্রথম শ্রেণির খুনি বলতে আমি একেবারেই নারাজ। সুতরাং, এই অপরাধের জগতে একমেবাদ্বিতীয়ম নিখুঁত প্রফেশনাল কিলার সতীশ দেবনাথ যেমন চিরকাল দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে এসেছে, তেমনি আজও করবে। সেখানে মহিন রায়ের মতো একটা থার্ড গ্রেড কিলারের কোনও জায়গা নেই। কারণ সবকিছু সহ্য করলেও খুন-শিল্পের অপমান আমি কিছুতেই সহ্য করব না।
মহিনকে সরানোর প্ল্যান আমার তৈরিই ছিল। শুধু লাগসই জায়গা দেখতে-দেখতে কেটে গেল একটা মাস। মঞ্চ-সজ্জার কাজ নিখুঁতভাবে শেষ করে নাটকের প্রথম দৃশ্যের জন্যে তৈরি হলাম। কিন্তু তখনও জানি না মহিন রায় আমার বিরুদ্ধের কী চক্রান্ত করে চলেছে!
রোজ রাতের মতো চৌরঙ্গি এলাকার একটি বিশেষ ল্যাম্পপোস্টের নীচে অলসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল মহিন রায়।
মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো। মেয়েদের মতো মাঝখান দিয়ে সিঁথি করা। চওড়া কপালের ডানদিকে একটা আঁকাবাঁকা নীলচে শিরার আভাস। ঘন ভুরুর নীচে ছোট-ছোট হায়েনা-চোখ। ভোঁতা নাকের নীচে গোঁফ। ক্ষুর দিয়ে চেরা কাটা দাগের মতো পাতলা ঠোঁট। গলায় রঙিন মাফলার। গায়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট। কোমরে চওড়া বেল্ট—তার গায়ে মনোগ্রাম করা ‘এম. আর।’ অর্থাৎ, মহিন রায়।
রায় তার লোমশ ফরসা হাত দুটো পকেটে ভরে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চোখজোড়া বেজির মতো চঞ্চল। কিন্তু ওর চোখে পড়েনি, রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে একজন লম্বা, রোগা-সোগা চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক ওকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছে। হঠাৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটা রাস্তা পার হতে লাগল। তার হাঁটার ভঙ্গিতে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব মহিনের নজর এড়াল না। লোকটা চকিতে একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর ধীরে-ধীরে মহিনের কাছে এগিয়ে এল। একটা নিওন সাইনকে তীক্ষ্ন মনোযোগে লক্ষ করতে-করতে ক’টা শব্দ ছুড়ে দিল, ‘এম. আর.? পি. কে.?’
মহিন জানে, এর অর্থ ‘মহিন রায়? প্রফেশনাল কিলার? তাই ও ছোট করে জবাব দিল, ‘এল ০.৪৫৭।’ ‘যার অর্থ, লুগার ০.৪৫৭।’
রায়ের সম্মতি পেয়ে ভদ্রলোক ওর মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ালেন ‘আমার নাম কাকু শর্মা। আপনার সঙ্গে কয়েকটা প্রাইভেট কথা আছে।’
শর্মা চট করে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন: ‘প্লিজ কাম উইথ মি।’ একটা চলন্ত ট্যাক্সিতে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালেন শর্মা। তারপর মহিনের দিকে ফিরে বললেন, ‘লেটস গো।’
ট্যাক্সিতে উঠে শর্মা হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, ‘মিস্টার রায়, আপনাকে একটা লোককে—।’
‘শাট আপ, প্লিজ।’ ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে ইশারা করে শর্মাকে থামতে বলল মহিন।
ভদ্রলোক বারকয়েক ঢোঁক গিলে চুপ করে গেলেন। তাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত মনে হল। মুখময় দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। অনিদ্রায় চোখজোড়া করমচার মতো লাল। চুল উসকোখুসকো—চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ডান গালে একটা ছোট্ট তিল। সারা মুখে কেমন একটা হিংস্র, রুক্ষ ভাব।
মহিনের ইশারা কাকু শর্মা বুঝতে পারলেন। তাই চুপচাপ বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
শর্মার নির্দেশে একসময় ট্যাক্সি এসে থামল পার্ক সার্কাসের একটা ফ্ল্যাটের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দুজনে পা বাড়ালেন অটোমেটিক এলিভেটরের দিকে।
চারতলায় পৌঁছে কাকু শর্মা পকেট থেকে চাবির গোছা বের করলেন। তাতে কম করেও প্রায় একডজন চাবি। মহিন পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে সবই লক্ষ করতে লাগল। দরজা খুলে মহিনকে ভেতরে ডাকলেন শর্মা, ‘আসুন—ভেতরে আসুন।’
মহিন ঢুকতেই অতি সাবধানে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন রহস্যময় ভদ্রলোক। কিন্তু দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই এক চরম বিস্ময়ের মুখোমুখি হলেন। তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। কোনওরকমে তোতলা স্বরে বলে উঠলেন, ‘মি—মিস্টার রায়! এ—এ কী?’
মহিন তখন দাঁত বের করে হিংস্রভাবে হাসছে। ওর ডানহাতের অভ্যস্ত মুঠোয় এক বিচিত্র ভারসাম্য নিয়ে কাঁপছে একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক। তার নলটা কাকুর চোখে যেন বড় বেশি কুৎসিত মনে হল।
শর্মার দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে এল রায়। পেটে রিভলভার দিয়ে এক খোঁচা মারল: ‘চলুন—ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসুন।’
শর্মা বিনা প্রতিবাদে মহিনের আদেশ পালন করলেন। মহিন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শর্মার জামাকাপড় সার্চ করতে শুরু করল। কিন্তু কিছু না পেয়ে একটু দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল, ‘মিস্টার শর্মা, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। এসবই হল প্রফেশনাল ব্যাপার। যাকগে, এবার আপনার দরকারটা খুলে বলুন।’
নির্বিকার ভঙ্গিতে রিভলভারটা জামার খাপে চালান করে দিল রায়। কাকু শর্মাকে এবার অনেকটা সহজ মনে হল। তিনি কাষ্ঠহাসি হাসলেন। মুখের চিন্তার ভাবটা আরও গভীর হল। তিনি থেমে-থেমে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন, ‘মিস্টার রায়, আমি একটা লোককে খুন করাতে চাই।’
‘দু-হাজার লাগবে।’ মহিন শান্তভাবে জবাব দিল।
‘জানি। আমার চেনা একজনের কাছ থেকে আমি আপনার সব খবর পেয়েছি। কিন্তু এই ব্যাপারটা একটু কমপ্লেক্স—।’
মহিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল: ‘তার মানে?’
‘মানে—এই খুনটায় আপনি রিভলভার ব্যবহারের চান্স পাবেন না। তাই আমার সাজেশান অনুযায়ী আপনাকে খুনটা করতে হবে।’
‘কারণ?’
‘কারণ আমার ভিকটিম বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বেরোয় না। আর যখনই বেরোয় আর্মস নিয়ে বেরোয়।—অর্থাৎ সেও আপনারই মতো একজন প্রফেশনাল কিলার।’
‘কী বলছেন আপনি? প্রফেশনাল কিলার?’
‘হ্যাঁ—তার নাম সতীশ দেবনাথ। তবে শার্প ব্রেনের জন্যে সকলে তাকে শার্প দেবনাথ বলে ডাকে।’
মহিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে ফুটে উঠল আবেগহীন হাসি। শূন্য দৃষ্টিতে ও কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দেওয়ালের দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করল, ‘মিস্টার শর্মা, আমার উত্তর শুনলে আপনি হয়তো খুব অবাক হবেন—।’
শর্মা জিজ্ঞাসার চোখে মহিনের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
‘এ-খুনটার জন্যে একটা পয়সাও আমি আপনার কাছ থেকে নেব না। কারণ, সতীশ দেবনাথ আমার একনম্বর রাইভাল।’
‘ডোন্ট গেট এক্সাইটেড, মিস্টার রায়।’ হাত তুলে মহিনকে বসতে অনুরোধ করলেন কাকু শর্মা: ‘পুরো ঘটনাটা আগে আপনার শোনা দরকার—।’
মহিন রায় ধীরে-ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। কিন্তু ওর ডান হাত বুকের কাছে লাগানো রিভলভারে খামচি মেরে রইল।
‘মিস্টার রায়, রিমা কাশ্যপকে আপনি চেনেন?’ হঠাৎই প্রশ্ন করলেন শর্মা।
‘উঁহু।’ মাথা নাড়ল মহিন।
‘রিমা কাশ্যপ ছিল একজন ক্যাবারে ড্যান্সার—”অশোক” বারে ও নাচত। ওর ক্যারেকটার খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু তবুও আমি ওকে ভালোবাসতাম। হ্যাঁ, শুনে আপনার হয়তো অবাক লাগছে, মিস্টার রায়—বাট ইট ওয়াজ আ ফ্যাক্ট। বিয়ে-শাদি আমি করিনি। একা থাকি, দু-হাতে পয়সা খরচ করি। তাই জীবনের একমাত্র শখ হিসেবে পুষেছিলাম রিমাকে। কিন্তু তার বছরখানেক পরে, এই গত জুলাইয়ে, একটা ঘটনা ঘটল। এক ভদ্রলোক একটা ইন্টারন্যাশনাল র্যাকেটে রিমাকে জড়িয়ে ফেললেন। রিমা নিজে জানতেও পারল না, কখন ও এক ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যখন জানল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
‘সেই সময়েই এক ক্লায়েন্টের কথায় সতীশ দেবনাথ ওকে খুন করে। সতীশ রিমার জুতোর তলায় দুটো ছোট-ছোট স্টিলের বল লাগিয়ে দেয়। তাতে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পা পিছলে রিমা এক প্যাথেটিক অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। পুলিশ ঘটনাটাকে নিছক অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে দেখেছিল, কারণ, পরে রিমার জুতোর নীচে সেই স্টিলের বলদুটো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘মিস্টার রায়, রিমা ছিল আমার সব। একজন তিনকুলে-একা পুরুষকে ও লোনলিনেস ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং সামবডি মাস্ট পে ফর রিমাজ অ্যাক্সিডেন্ট। এবং সেই সামবডি সতীশ দেবনাথ ছাড়া আর কেউ নয়। মানি ইজ নো প্রবলেম, মিস্টার রায়—তাই সতীশকে সরানোর দায়িত্ব আমি আপনাকেই দিতে চাই। এবং ইট মাস্ট লুক লাইক অ্যান অ্যাকসিডেন্ট—নট মারডার। যেমনটা হয়েছিল রিমার বেলায়।’
মহিন একমনে কাকু শর্মার কথা শুনছিল। শর্মা থামতেই ও নিচু গলায় বলে উঠল, ‘আমার ০.৪৫৭ ছাড়া আমি এক পা-ও চলি না—সেটাই আমার শেষ কথা।’
‘আমি তা জানি, মিস্টার রয়। আপনার মেশিন আপনি ইচ্ছে করলে সঙ্গে রাখতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই সেটা ইউজ করতে পারবেন না। আশা করি সেরকম দরকারও হবে না। উহুঁ, ব্যস্ত হবেন না। আগে ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন। পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান, সতীশ দেবনাথ বাড়িতে সবসময় রিভলভার সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না। নাম্বার টু, আপনি যখন ওকে ধাক্কা দিয়ে চারতলার ওই বারান্দা থেকে নীচে ফেলে দেবেন, তখনও ওর কাছে আর্মস থাকবে না। সুতরাং আপনি নির্ভয়ে এ-কাজটা হাতে নিতে পারেন। রিমার মৃত্যুর বদলা নিতে যত টাকা লাগে, আমি খরচ করব। না, না—টাকা নিতে আপনার আপত্তি থাকলেও আমি শুনব না। কাজ শেষ হয়ে গেলে দু-হাজার টাকা আপনাকে আমি গিফট হিসেবে দিতে চাই।’
মহিন নীরব। একদৃষ্টে ও চেয়ে রইল শর্মার মুখের দিকে।
‘আপনার যদি এ-কাজে আপত্তি না থাকে তো বলুন—’ শর্মা বলে চললেন, ‘—কালই প্রিলিমিনারি ইনস্পেকশানটি সেরে ফেলি।’
‘প্রিলিমিনারি ইনস্পেকশান?’ ভীষণ অবাক হল রায়: ‘তার মানে?’
‘সেটা আপনাকে জানাব—যদি কাজটা আপনি হাতে নেন। তার আগে নয়।’
‘ভালো।’ বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সম্মতি জানাল মহিন।
‘ধন্যবাদ।’ পকেট থেকে এক প্যাকেট ক্যাপস্টান আর দেশলাই বের করে মহিনের দিকে এগিয়ে দিলেন শর্মা। মহিন মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তখন নিজেই একটা ধরিয়ে প্যাকেট এবং দেশলাই আবার পকেটে চালান করলেন।
অলসভাবে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, ‘মিস্টার রায়, আমার একটা আশ্চর্য গুণ আছে। তা হল, পৃথিবীর যে-কোনও তালাই আমি মিনিটদুয়েকের মধ্যে খুলে ফেলতে পারি।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে খুনের কি সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারছি না?’ শর্মাকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল মহিন।
‘আছে, মিস্টার রায়, আছে। বহু কষ্টে আমি সতীশ দেবনাথের ফ্ল্যাটের ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। কাল সতীশ যখন থাকবে না, তখন আপনাকে নিয়ে আমি একবার সতীশের ফ্ল্যাট ইনস্পেকশানে যেতে চাই। স্পটটা আগে থেকে দেখা থাকলে আপনার অনেক সুবিধে হবে, তাই না?’
‘হয়তো তাই।’ অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল মহিন। ওর মন তখন চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
‘ঠিক আছে। তা হলে কাল সন্ধে সাতটায় আপনি আমার এখানে আসুন। তারপর এখান থেকে একসঙ্গেই বেরোনো যাবে। ইন দ্য মিন টাইম আমি ফোন করে জেনে নেব সতীশ কখন বাইরে বেরোবে। ব্যস, তারপর আর কোনও চিন্তা নেই।’ হিংস্র উল্লাস খেলা করল কাকু শর্মার মুখে। আনমনে তিনি বলে চললেন, ‘রিমার আত্মা এবার শান্তি পাবে—।’
‘তা হলে কাল সন্ধে সাতটা।’ মহিন চেয়ারে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে চলল দরজার দিকে।
কাকু শর্মা তখন টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে ফেললেন। ড্রয়ারে থরে-থরে সাজানো নোটের বান্ডিল। আর তার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা ০.৩৮ পুলিশ স্পেশাল। রিভলভারের গায়ে একটা হাত রাখলেন কাকু। দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করলেন, ‘মিস্টার দেবনাথ, এবার তোমার পালা।’
পরদিন রাত আটটায় কাকু শর্মা আর মহিন রায় এসে দাঁড়াল সতীশ দেবনাথের বাড়ির সামনে। অন্ধকার এলাকায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার কোনও স্পষ্ট আদল পাওয়া গেল না। নীরবে দুজনে এগিয়ে চলল লিফটের দিকে।
লিফটে উঠে তিননম্বর বোতাম টিপলেন কাকু শর্মা। নিঃশব্দে উঠতে শুরু করলে লোহার খাঁচা। মহিনকে দেখে একটু উত্তেজিত মনে হল শর্মার। ওর হাত পোশাকের আড়ালে—বোধহয় রিভলভারের ওপরে। শর্মা ওর কাঁধে হাত রাখলেন ‘টেক ইট ইজি। আমি এখানে আসার আগেই ফোন করে জেনে নিয়েছি সতীশ দেবনাথ ওর ফ্ল্যাটে নেই। অতএব রিল্যাক্স।’
‘এটা জাস্ট প্রিকশন।’ বরফশীতল স্বরে জবাব দিল রায়।
মৃদু হেসে ঘাড় ঝাঁকালেন কাকু।
লিফট থামতেই সন্তর্পণে করিডরে পা দিলেন তিনি। মহিন রায়কে ইশারায় আহ্বান জানালেন। সামনেই একটা ফ্ল্যাটের দরজা। মহিন লক্ষ করল ফ্ল্যাটের নম্বর ১২। দরজার ডান পাশে একটা কলিংবেল। শর্মা বারকয়েক কলিংবেলে চাপ দিলেন। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না ভেতর থেকে।
শর্মা ঘাড় ফিরিয়ে মহিনের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন চাবিভরতি রিংটা।
রায় চুপচাপ লক্ষ করে চলল শর্মার কার্যকলাপ।
মিনিটদুয়েক ধরে চাবির গোছা নিয়ে কীসব খুটখাট করলেন তিনি। তারপরই হাতল ঘুরিয়ে একটু-একটু করে খুলে ফেললেন ফ্ল্যাটের দরজা।
অভ্যাসবশে মহিন নিমেষের মধ্যে হোলস্টার থেকে বের করে নিল ওর লুগার অটোমেটিক। শর্মা কিন্তু ফিরেও তাকালেন না। আস্তে-আস্তে ঘরে ঢুকে পড়লেন। অতি সাবধানে তাকে অনুসরণ করল মহিন রায়।
শর্মা আলোর সুইচ অন করে অল্প পাওয়ারের একটা আলো জ্বেলে দিলেন।
একইসঙ্গে মহিনও ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল ফ্ল্যাটের দরজা।
‘মিস্টার রয়, এই হল সতীশের ঘর। ভালো করে দেখে রাখুন।’
মহিন পেশাদার চোখে ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র খুঁটিয়ে লক্ষ করতে লাগল।
দরজার ডান পাশে একটা ছোট টেবিল। তার ওপর অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে খানকতক ক্রিমিনোলজির বই। টেবিল থেকে, হাততিনেক দূরে একটা স্টিলের আলমারি। ডানদিনের দেওয়ালের ঝুলছে তিনটে ক্যালেন্ডার। ছবিগুলো নেহাতই ঠাকুর-দেবতার। দরজার মুখোমুখি একটা ছোট বারান্দা।
বারান্দার দু-দিকের দেওয়ালে দুটো জানলা। অত্যন্ত ছোট মাপের—গরাদ দেওয়া।
বাঁদিকের জানলার পাশে একটা বড় ওয়াল ক্লক। তার রেডিয়াম দেওয়া কাঁটা এই অল্প আলোতেও জ্বলজ্বল করছে। ঘড়ির দিকে নীচেই একটা টিপয়। তার ওপরে একটা টেলিফোন, সাদা রঙের।
ঘরের বাঁদিকে একটা লম্বা-চওড়া খাট। বিছানার সাদা চাদর বহু ব্যবহারে ময়লা হয়ে গেছে। একজোড়া বালিশ খাটের ও-মাথায় পড়ে রয়েছে। তার পাশে কিছু জামাকাপড়। আর এ-মাথায় পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ভাঁজ করা চাদর। খাটের নীচ থেকে উঁকি মারছে একটা সুটকেস, একটা ট্রাঙ্ক। দরজার বাঁদিকে একটা বড় কাঠের বাক্স তালাবন্ধ। তার পাশে একটা কুঁজো—কাচের গ্লাস দিয়ে ঢাকা দেওয়া। আর চোখে পড়ছে একটা ছোট দরজা। সম্ভবত বাথরুম।
প্রতিটি জিনিসের ওপরে চোখ বুলিয়ে মহিন রায়ের চোখ এসে স্থির হল কাকু শর্মার চোখে। কাকু বুঝতে পারলেন মহিনের নীরব প্রশ্ন। তাই জবাব দিলেন, ‘এই জিনিসগুলো ভালো করে দেখার ভীষণ দরকার আছে, মিস্টার রায়। এই ঘরের প্রতিটি ফার্নিচার এবং তাদের পজিশান আপনাকে এমনভাবে মনে রাখতে হবে, যাতে কেউ এ-বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলে আপনি তার কারেক্ট আনসার দিতে পারেন।’
‘কিন্তু কেন?’ মহিন জিগ্যেস করল।
‘কারণ, অপারেশান সতীশ এক্সিকিউট করতে হবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। সুতরাং ওই অন্ধকারে আপনার নিজের পজিশান সঠিক রাখার জন্যে অন্যান্য আসবাবপত্রের পজিশান আপনাকে মেমোরাইজ করতেই হবে।’
‘তারপর?’
‘এবার আমি খুনের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো আপনাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিই।’
মহিন সোজা গিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ল। রিভলভারটা আবার হোলস্টারে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর উৎসুক চোখ মেলে তাকাল কাকুর দিকে।
‘রাত ঠিক বারোটার সময় আমি আপনাকে এই ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছে দেব। আর সঙ্গে দিয়ে দেব এই ফ্ল্যাটের দরজার চাবি। তারপর, আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, আপনি এক থেকে একশো পর্যন্ত গুনবেন। কারণ ওই সময়ের মধ্যেই আমি রাস্তার ওপারে যে-ডাক্তারখানা আছে, সেখান থেকে সতীশকে ফোন করব। তখন আপনি ফোনের শব্দ শুনতে পাবেন। তারপর কথাবার্তায় যখনই বুঝবেন সতীশ রিসিভার টেবিলে রেখে বারান্দার কাছে যাচ্ছে, তখনই আপনি নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওর ঘরে ঢুকে পড়বেন।’
‘কিন্তু আপনি কী করে শিয়োর হচ্ছেন যে, মিস্টার দেবনাথ বারান্দার কাছে যাবেন?’
‘অধৈর্য হবেন না, মিস্টার রায়। বাইরের করিডর পুরো অন্ধকার থাকবে। অতএব সতীশ আপনাকে দেখতে পাবে না। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তবে সতীশ রিসিভার তুলে কথা বলার পর নিশ্চয়ই বারান্দার কাছে যাবে। কারণ, আমি তাকে ফোনে বলব, একটা লোক পাইপ বেয়ে তার বারান্দায় ওঠার চেষ্টা করছে: সম্ভবত লোকটার মতলব ভালো নয়—।’
‘ও—। তা হলে দেবনাথ তখন বারান্দায় যাবেই। দেখতে চেষ্টা করবে, পাইপ বেয়ে সত্যিই কেউ ওঠার চেষ্টা করছে কি না। আর তখনই আমি…।’
‘ছুটে গিয়ে ওকে বাইরে পড়তে সাহায্য করবেন। ক্লিয়ার?’
‘অ্যাবসলিউটলি!’ দাঁতে দাঁত ঘষে জবাব দিল মহিন।
‘তা হলে নেক্সট উইকে, এই একই দিনে, আমরা এখানে আসব, আর সেটাই হবে সতীশ দেবনাথের শেষ রাত।’
কাকুর কথা শেষ হতে-না-হতেই একটা সামান্য শব্দে ওরা দুজনেই তড়িৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠল। কাকু তিরবেগে ছুটে গেলেন আলোর সুইচের দিকে। আর একইসঙ্গে রিভলভারটা বের করে মহিন দৌড়ল আলমারি লক্ষ করে।
রায় আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পড়ামাত্রই নিভে গেল ঘরের আলো। অন্ধকারে ও কাকুকে দেখতে পেল না।
এদিকে বাইরের পায়ের শব্দ এসে থেমেছে দরজার কাছে। তারপর শোনা গেল দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ।
একটু পরেই সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে দরজার পাল্লা ফাঁক হতে শুরু করল।
বাইরের আলোর পটভূমি দেখা গেল দরজায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় এক ছায়ামূর্তি।
হঠাৎ রায় অনুভব করল কার হাতের স্পর্শ। ও চমকে উঠতেই কানে এল কাকুর ফিসফিসে চাপা গলা, ‘সতীশ দেবনাথ!’
ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর এগিয়ে গেল আলোর সুইচের দিকে। আর সৌভাগ্যবশত ঠিক সেই মুহূর্তে ঝনঝন করে বেজে উঠল ঘরের টেলিফোন। ছায়ামূর্তি আলো না জ্বেলে ফোনের দিকে পা বাড়াতেই বিদ্যুৎঝলকের মতো দরজা লক্ষ করে ছুটে গেল মহিন আর কাকু। পলকের মধ্যে দরজা খুলে ওরা করিডরে পা দিল।
মহিন কাকুর আগে আগে ছুটছিল। ও দৌড়ে লিফটে উঠতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ভীষণভাবে নিজেকে সামলে নিল।
লিফটের জায়গায় লিফট নেই। অথচ কোলাপসিবল গেটটা হাট করে খোলা। উঁকি মেরে দেখল, লিফট দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই একতলায়।
তা হলে কোলাপসিবল গেটটা খুলল কী করে? কে-ইবা খুলল?
মুহূর্তের মধ্যে সিঁড়ি লক্ষ করে দৌড়তে শুরু করল মহিন। ওর পিছনে-পিছনে কাকু। তার পিছনে কি কারও পায়ের শব্দ ভেসে আসছে?
কীভাবে যে ওরা শেষ পর্যন্ত রাস্তায় এসে পৌঁছল, তা ওদের মনে নেই। সতীশের বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে ওরা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। আজ খুব জোর বেঁচে গেছে!
চলে যাওয়ার আগে কাকু মহিনের কাঁধে টোকা মেরে মনে করিয়ে দিলেন, ‘আগামী শুক্রবার রাত এগারোটায় আমরা বেরোব। আপনি আমার বাড়িতে সময়মতো আসবেন, মিস্টার রায়। কারণ, পাংচুয়ালিটি আমি পছন্দ করি।’
ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলল মহিন রায়। লুগার অটোমেটিক তখন ওর হোলস্টারে পরম নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করছে। কিন্তু ওর কপালে জমে ওটা ঘামের ফোঁটা রাস্তার আলোয় চকচক করছিল।
শুক্রবার। রাত সাড়ে এগারোটা।
সতীশ দেবনাথের ফ্ল্যাট থেকে কিছুটা দূরে একটা লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কাকু। তার পাশে মহিন। ওর পরনের পোশাকে কোনও পরিবর্তন হয়নি। বুকের বাঁ-পাশটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে। না, অটোমেটিক লুগারকে মহিন রায় কোনও অবস্থাতেই কাছ ছাড়া করতে রাজি নয়।
দুজনের নজরই চারতলার অন্ধকার জানলার দিকে।
‘এই নিন। সতীশের ফ্ল্যাটের চাবি।’
চুপচাপ কাকুর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে ডান পকেটে ভরে ফেলল রায়। এই উৎকণ্ঠাময় অপেক্ষা ও একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। শুধু ভাবছে, ঘড়ির কাঁটা কখন গিয়ে ঠেকবে বারোটার ঘরে।
‘মিস্টার রায়, বিরক্তিকর মনে হলেও ছোটখাটো ব্যাপারগুলো আরও একবার আপনাকে মনে করিয়ে দিই।’ কেশে গলা ঝাড়লেন কাকু: ‘ঠিক বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিটের সময় আমি আপনাকে সতীশের ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে দেব। করিডর অন্ধকার থাকবে। আশা করি আপনার চলাফেরায় কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আপনি এক থেকে একশো পযর্ন্ত মনে-মনে গুনবেন। তারপর চাবি নিয়ে ঘরে ঢোকার জন্যে তৈরি হবেন। ঠিক সেই সময়ে আপনি শুনতে পারেন টেলিফোনের শব্দ। টেলিফোনের কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর ঠিক তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে আপনি দরজা খুলবেন। আর আমার অঙ্কে যদি ভুল না হয় তবে দরজা খুলেই আপনি দেখবেন বারান্দায় দাঁড়ানো অসতর্ক সতীশকে। ব্যস, বাকি কাজটুকু এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই আপনাকে সারতে হবে। তারপর—’ পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোটের বান্ডিল বের করে মহিনের চোখের সামনে নাচালেন কাকু: ‘আপনি নিন বা না নিন, আমার ডিউটি আমি করব।’
‘ক’টা বাজে এখন?’ নিরুত্তাপ গলায় জানতে চাইল মহিন।
‘পৌঁনে বারোটা। আর মাত্র দশ মিনিট।’
ধীরে-ধীরে সময় গড়িয়ে চলল।
‘জিরো আওয়ার। চলুন যাওয়া যাক।’ কাকু শর্মা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললেন। মহিনের ডানহাতের পাঁচ আঙুল অনুভব করল লুগারের অস্তিত্ব। তারপর চুপচাপ ও কাকুকে অনুসরণ করল।
নিঝুম বাড়ি। সদর দরজার তালা খুলতে কাকুর লাগল মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ভেতরটা একেবারে অন্ধকার।
আন্দাজে ভর করে দুজনেই এগিয়ে চলল।
হাতড়ে-হাতড়ে লিফটের দরজা হাতে ঠেকল কাকুর।
‘এদিকে—’ চাপাস্বরে হতভম্ব মহিনকে আহ্বান জানালেন তিনি।
লিফটে ঢুকেই সুইচ অন করে অল্প পাওয়ারের আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন কাকু। তারপর চারনম্বর বোতাম টিপলে।
ওপরের দিকে নিঃশব্দে ছুটে চলল লোহার খাঁচা।
লিফট থামতেই সুইচ অফ করে কাকু আলো নিভিয়ে দিলেন। তারপর খুব সাবধানে দরজা খুলে মহিনকে এগোতে ইশারা করলেন: ‘যান—দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক থেকে একশো পর্যন্ত গুনবেন। তারপর—।’
‘আপনি আপনার কাজ করুন।’ মৃদু খসখস শব্দ করে অন্ধকার করিডরে পা রাখল মহিন।
কাকু লিফটের দরজা বন্ধ করে—গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপলেন।
লিফট নামতে শুরু করল।
নিঃশদে সতীশের ফ্ল্যাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মহিন। লুগার অটোমেটিক হোলস্টার থেকে বের করে দু-হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ও। তারপর রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল। মনে-মনে গুনতে শুরু করল, এক—দুই—তিন—।
রাস্তায় লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি দেখলেন কাকু। তাঁর হাতঘড়িতে কাঁটায়- কাঁটায় বারোটা বাজতেই এগিয়ে গেলেন কাছেই এক ডাক্তারখানার দিকে। তাঁর কঠিন মুখে সিদ্ধান্তের আভাস।
ডাক্তারখানায় ঢুকে কাউন্টারের ওপর একটা আধুলি ছুড়ে দিলেন তিনি। কোনও কথা না বলে এগিয়ে গেলেন কাউন্টারের বাঁ-পাশে রাখা টেলিফোনের দিকে।
রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন। ডাক্তারখানার শীর্ণ চেহারার কর্মচারীটি জুলজুল করে কাকুকে দেখতে লাগল।
ঠিক বারোটা বাজতেই দরজার বাইরে দাঁড়ানো মহিনের কানে এল দেওয়ালঘড়ির স্পষ্ট গম্ভীর আওয়াজ। ঢং—ঢং—ঢং—।
রাত্রির নিটোল নিস্তব্ধতা চুরমার করে বারোবার বাজার পর থামল সেই দেওয়ালঘড়ির শব্দ।
তারপরই মহিনের কানে এল ভেতরে কারও নড়াচড়ার শব্দ। লুগার আঁকড়ে ধরে ওত পাতা জাগুয়ারের মতো সামনের দিকে একটু ঝুঁকে এল মহিন। অস্পষ্টভাবে ওর নজরে পড়ল কলিংবেলের সুইচ, রুম নম্বরের ঝাপসা সাদা অক্ষর দুটো: ১২। কিন্তু ওর কান সজাগ। শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি টান-টান।
হঠাৎই টেলিফোনের কর্কশ বেসুরো ঝনঝন শব্দে মহিন ভীষণ ভাবে চমকে উঠল। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে পকেট থেকে বের করল সতীশের ফ্ল্যাটের চাবি। ঘরের ভেতর কেউ রিসিভার তুলে নিল।
‘হ্যালো—’
…
‘কে কথা বলছেন?’ এ-প্রান্তে দেবনাথের স্বর উত্তেজিত।
…
‘অসম্ভব। বাইরের পাইপ বেয়ে ওঠা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়!’
…
‘হতেই পারে না। ঠিক আছে, তবু একবার দেখছি। হ্যালো? হ্যালো? হ্যা—।’
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ। মহিন একমনে দেওয়ালে কান পেতে সব শুনছিল। সতীশের দ্বিতীয় কথা শোনামাত্রই চাবি ঢুকিয়ে দিয়েছিল দরজার ফুটোয়।
সতীশ রিসিভার নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গে মহিনের পেশাদার হাতের নিখুঁত চাপে নিঃশব্দে দরজা খুলতে শুরু করল।
দরজা পুরোটা খুলতেই মহিন একপলক থমকাল। লুগারটা হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল। দেখল…।
সামনের রাস্তায় অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করছেন কাকু শর্মা। বারোটা পাঁচ বাজতেই তিনি সতীশের বাড়ির দিকে হেঁটে চললেন। পকেট থেকে বের করে নিলেন একটা পেনসিল টর্চ। তার আলোয় পথ দেখে তিনি খোলা সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে। লিফটে উঠে চারনম্বর বোতাম টিপলেন। লিফট নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল।
মহিনের প্রথম নজর গেল বারান্দায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি। দেখা যাচ্ছে বাইরের খোলা আকাশ। তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঠিক জমাট পাথরের মতো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই জায়গাতে। ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে।
বাঁ-পাশে চোখ সরাতেই নজরে পড়ল ছোট্ট জানলা। পাল্লা দুটো না দেখা গেলেও, গরাদের ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাইরের কালো আকাশ। তার সামান্য পাশেই দেওয়ালে চকচক করছে দেওয়ালঘড়ির কাঁটা। ছোট কাঁটা আর বড় কাঁটা দেখে বোঝা যায় রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটের কিছু বেশি। তার নীচেই আবছাভাবে চোখে পড়ছে টিপয়ের ওপরে বসানো টেলিফোন। ছোট জানলার সঙ্গে বারান্দার ডানদিকের জানলার তেমন কোনও তফাত নেই। ওটাও হাট করে খোলা। বাইরের সামান্য আলোয় খাট, বালিশ, বিছানাও মহিনের চোখ এড়াল না।
এইসব চোখ বুলিয়ে দেখতে মহিনের লাগল ঠিক ছ’সেকেন্ড। পরমুহূর্তেই ও জীবনপণ করে ছুটল ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব প্রতি মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে কমতে লাগল।
হঠাৎই মহিন আবিষ্কার করল ও ঠিক সতীশের পিছনে দাঁড়িয়ে। সর্বশক্তি দিয়ে সামনে হাত বাড়িয়ে ও ঝুঁকে পড়া সতীশকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল। সঙ্গে-সঙ্গেই কী যেন হয়ে গেল। দুলে উঠল বারান্দা, জানলা, ঘড়ি—এমনকী গোটা দেওয়ালটা। মহিন হঠাৎ যেন অনুভব করল ও শূন্যে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপর আকাশ। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস। জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররা প্রতিফলিত হল মহিনের চোখের তারায়।
সমস্ত পৃথিবীটা মহিনের চোখের সামনে ঘুরপাক খেয়ে হঠাৎই উলটে গেল। দুটো ডিগবাজি খেয়ে ‘জ্যাক নাইফ’ ডাইভিং-এর মতো ও সোজা এসে পড়ল বাইরের বাঁধানো রাস্তায়। তখনও পুরো ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা, বিস্ময় ওর মনকে ছুঁয়ে রেখেছে।
মহিনের কালো পোশাক পরা চেহারাটা ঠিক মরা দাঁড়কাকের মতো হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল। ঘাড় মটকে মাথাটা এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় পিছনদিকে চেয়ে রয়েছে। হাঁ করা মুখের ফাঁক দিয়ে জিভটা বেরিয়ে এসেছে। রক্তাক্ত মুখে নিষ্প্রাণ চোখজোড়ায় শুধুই বিস্ময়। মরে গিয়েও মহিন যেন এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
লিফট পাঁচতলায় এসে থামতেই কাকু শর্মা করিডরে পা দিলেন। পেনসিল টর্চের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে গেলেন ফ্ল্যাটের খোলা দরজার দিকে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর পেনসিল টর্চ পকেটে রেখে দেশলাই বের করলেন। অন্ধকার হাতড়ে-হাতড়ে ঘরের এক কোনায় রাখা একটা হ্যারিকেন নিয়ে এলেন। বোঝা গেল, এ-ঘরের সঙ্গে তিনি ভীষণভাবে পরিচিত। হ্যারিকেনের আলো জ্বালতেই কতকগুলো জিনিস চোখে পড়ল।
খাট, বিছানা, বালিশ ও টিপয়ের ওপরে রাখা টেলিফোন ছাড়া পুরো ঘরটাই ফাঁকা। ঘরে আর কোনও আসবাবপত্র নেই। ঘরের সিলিং ঢালাই করা সিমেন্টের নয়—প্লাইউডের তৈরি বারান্দার দিকের দেওয়ালও দেওয়াল নয়—কালো রং করা প্লাইবোর্ড। বারান্দার জায়গাটা প্লাই কেটে তৈরি করায় বাইরের আকাশ চোখে পড়ছে। বারান্দার দু-পাশের জানালাও একইভাবে প্লাইউড কেটে গরাদের মতো করা। জানলায় কোনও পাল্লা নেই। দেওয়ালঘড়ির জায়গায় কালো প্লাইয়ের ওপরে লুমিনাস পেইন্ট দিয়ে মিনিটের কাঁটা আর ঘণ্টার কাঁটা আঁকা রয়েছে—এমনভাবে, যাতে অন্ধকারে বারোটা বেজে পাঁচ-সাত মিনিট বলে মনে হয়।
জিনিসগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে কাকু মুচকি হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বালিশের নীচ থেকে টাইম অ্যান্ড ক্লক ডিভাইস অটোমেটিক টেপ রেকর্ডার বের করলেন। রেকর্ডারের টেপ তখনও ঘুরে চলেছে। কাকু উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিলেন টেপের গতি। তারপর একসময় সুইচ টিপে প্রথম থেকে চালাতেই—কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ ‘ঢং—ঢং—ঢং—।’ দেওয়ালঘড়ির ঘণ্টায় শব্দ। ঠিক বারোবার বাজল। তারপর শোনা গেল কারও চলাফেরার শব্দ। তারও কিছু পরে টেলিফানের ‘ক্রিং—রিং—রিং—ক্রি—রিং—রিং’, এবং সবশেষে মহিনের শোনা কথাবার্তা আবার হুবহু শোনা গেল। এমনকী রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দও বাদ গেল না।
কাকুর তৈরি এই নাটুকে ঘরের একদিকে দরজা, তার দু-পাশে দেওয়াল, কিন্তু আর-একটা দিকে এখনও দেওয়াল গাঁথা হয়নি—যেদিক দিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েছে মহিন রায় এবং বারান্দায় দাঁড় করানো কার্ডবোর্ডের মূতিটা।
এবার ক্লান্তভাবে খাটের ওপরে বসলেন কাকু। বহুদিনের প্রতীক্ষার পর তার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল স্বস্তির নিশ্বাস।
ঠিকই আন্দাজ করেছেন আপনারা। সতীশ দেবনাথ এবং কাকু শর্মা এক ও অভিন্ন। আগেই তো বলেছিলাম, এই ‘শার্প’ দেবনাথের সঙ্গে বুদ্ধির লড়াইয়ে কেউ পেরে ওঠেনি—পারবেও না।
মহিনের মোক্ষলাভের ব্যাপারে কতকগুলো ব্যাপারে হয়তো আপনাদের ধন্দ লাগছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, একটা বড় সূত্র অনেক আগেই আপনাদের জানিয়ে দিয়েছিলাম। আজ যখন মহিনকে নিয়ে আমি লিফটে উঠলাম, তখন কত নম্বর বোতাম টিপেছি বলতে পারেন? চার নম্বর। অথচ প্রথমদিন ওকে যখন আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি, তখন টিপেছিলাম তিননম্বর। তা হলে? ব্যাপারটা একটু গোমেলে ঠেকছে না আপনাদের কাছে?
তা হলে প্রথম থেকেই বলি।
আপনাদের হয়তো মনে আছে, মহিনকে সরানোর ব্যাপারে লোকেশান ঠিক করতে আমার সময় লেগেছিল একটি মাস। কারণ, তৈরি হচ্ছে এইরকম একটা ফ্ল্যাট-বাড়ি আমার প্রয়োজন ছিল। এবং প্ল্যানমতো পাঁচতলার একটা আধা-তৈরি ঘরের ঠিক নীচে, চারতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। আসবাবপত্রে সাজিয়ে ফেললাম ঘরটা। আর ওপরতলার মরণ-ফ্ল্যাটের ‘সেট’ তৈরির সরঞ্জাম জোগাড় করে ফেললাম।
প্রথমে পরদাটাকে কাঁচি দিয়ে এমনভাবে কাটলাম, যাতে অন্ধকারে টাঙিয়ে রাখলে মনে হয় একটা বারান্দার দুপাশে দুটো জানলা (ঠিক আমার ফ্ল্যাটের মতো)। ব্যস, প্রাথমিক কাজ শেষ হল।
সুতরাং, তারপরই আমি দেখা করলাম মহিনের সঙ্গে। ও এই ‘কিলিং বিজনেস’-এ নামার পর থেকেই মোটামুটি ওই একই জায়গায় ঘোরাফেরা করে। তাই ওকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না। তারপর কায়দামতো সাজিয়ে গুজিয়ে একটা ভুয়ো গল্প ফেঁদে বসলাম। আর সেই ফাঁদেই মহিন পা দিল।
প্রথম দিন ওকে নিয়ে গেলাম সেই মরণ-ফ্ল্যাট পরিদর্শনে। এমনভাবে ঘরের প্রতিটি জিনিস ওর মনে গেঁথে দিলাম, যাতে অন্ধকারেও ওর কোনও অসুবিধে না হয়। আমি যে সতীশ নই, সেটা প্রমাণের জন্যে একজন পেশাদার অভিনেতাকে ওই সময়ে আমার ফ্ল্যাটে আসার জন্যে বলে রেখেছিলাম। তা ছাড়া কী-কী করতে হবে তাও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে যে কীরকম কাজ হয়েছে তা তো আপনারা ভালোভাবেই জানেন। আজ অন্ধকারে মহিন যখন দেখল খাট, বিছানা, বালিশ, টেলিফোন, জানলা, বারান্দা, ঘড়ি—সবই ঠিক জায়গায় ঠিকমতোই রয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওর অবচেতন মন ধরে নিল, সেই একই ঘরে ও এসেছে। যে-যে ফার্নিচার ঘরে নেই, সেগুলোও আছে বলে ওর মন কল্পনা করে নিল। একে বলে সাইকোলজিক্যাল ইলিউশান, অথবা, সাইকোলজিক্যাল ইমপ্লিকেশান।
ঠিক একইভাবে অন্ধকারে প্লাইয়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো একটা কার্ডবোর্ডের মূর্তিকে ও আসল মানুষ বলে ভুল করল। কারণ, আমার শোনানো সেই টেলিফোন করার গল্প। তার ওপর সাইকোলজিক্যাল কনভিকশানের জন্য সামান্য টেপরেকর্ডারের ব্যবস্থা। ব্যস। আমার বলে যাওয়া গল্প আর আপাতদৃষ্টিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা যোগ করে ও ধরে নিল, ও সেই একই ঘরে এসেছে, এবং সেই ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সত্যিই একটি জলজ্যান্ত মানুষ।
তারপর যা হওয়ার তাই হল। ছুটে গিয়ে ওই মূর্তিটাকে ধাক্কা দিতেই ও পলকা প্লাইয়ের বাঁধন ছাড়িয়ে শূন্যে পা দিল।
ও যদি অন্ধকার ঘরে একটু ঘুরে-ফিরে দেখত, তা হলে বুঝত—ওই খাট, টেলিফোন ছাড়া আর কোনও ফার্নিচারই ঘরে নেই। আর ঘড়ির কাঁটার জায়গায় রয়েছে লুমিনাস পেইন্ট দিয়ে আঁকা দুটো সরলরেখা। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করায় রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ি বলে ভুল হয়। কিন্তু টেপরেকর্ডারের বারোটা বাজার ঘণ্টা, আর দেওয়ালের বারোটা পাঁচের লুমিনাস পেইন্টের দাগ দেখে ও ধরে নিল ওটা সত্যিই একটা দেওয়াল-ঘড়ি।
সুতরাং আপনারাই বলুন, এইরকম একটা বুদ্ধিদীপ্ত সাইকোজিক্যাল মার্ডার আমি ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব?
তবে মহিনকে একটা সূত্র দিয়েছিলাম লিফটের বোতাম টেপার সময়। আমার ফ্ল্যাট যদি চারতলায় হয়, তবে আমাকে তিন নম্বর বোতাম টিপতে হবে। কিন্তু মহিন বোঝেনি, চার নম্বর বোতাম টেপার পর যে-তলায় গিয়ে লিফট থেমেছে, সেটা আমার ফ্ল্যাট নয়। সেটা পাঁচতলার সেই অসম্পূর্ণ মরণ-ফ্ল্যাট। কিন্তু সেই অসম্পূর্ণ দরজায় লাগিয়ে দিলাম প্লাস্টিকের ১২ নম্বর ও একটা কলিংবেলের ক্যাপ—কারণ, ডিটেলের প্রতি আমি গভীর মনোযোগ দিই।
অতএব মনে রাখবেন বন্ধুগণ, প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম ‘শার্প’ দেবনাথ। এই কিলিং মার্কেটে যিনি মনোপলি বিজনেস করে চলেছেন। সুতরাং তার সঙ্গে দুশমনির কথা ভুলেও মনে আনবেন না। তা হলে আপনাদেরও অবস্থা হবে ওই মহিন রায়ের মতো। কাউকে মোক্ষলাভ করানোর পর আমি মনে-মনে ভীষণ দুঃখ পাই, বিশ্বাস করুন। কিন্তু কী করব, আমি নিরুপায়। আফটার অল, আই অ্যাম দ্য কিং অফ প্রফেশনাল কিলার্স। দ্য গ্রেট ‘শার্প’। সুতরাং—।
অপারেশান ভারচুরিয়্যালিটি
অনেকক্ষণ ধরে ফোন করব কি করব না ভেবে শেষ পর্যন্ত নম্বরটা ডায়াল করেই ফেলল অভিলাষ।
কয়েক সেকেন্ড পার হতে-না-হতেই ও-প্রান্তে রিং বাজতে শুরু করল। অভিলাষের বুকের ভেতরে ধুকপুক শুরু হয়ে গিয়েছিল। লাইনটা কি এখনই কেটে দেবে? নাকি…।
না, না—লাইন কাটার কী দরকার! একটু কথাবার্তা বললে খোঁজখবর করলে ক্ষতি কী? আসল কাজে না এগোলেই হল।
‘হ্যালো—’ একটি মেয়ের গলা।
‘এটা কি ”এন্ড গেম”-এর অফিস?’ প্রশ্নটা করতে গিয়ে অভিলাষের গলা কেঁপে গেল।
‘হ্যাঁ—বলুন…।’ রোবটের মতো গলায় মেয়েটি বলল।
‘আ-আমি কয়েকটা ইনফরমেশান চা-চাই…।’
‘এর জন্যে আপনাকে আমাদের অফিসে এসে কোনও একজন এক্সিকিউটিভের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাদের অফিসটা হল থারটি ফাইভ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। ”দ্য টাওয়ার্স” বিল্ডিং-এর সেভেনটিনথ ফ্লোর। উই আর ওপেন টুয়েন্টিফোর ইনটু সেভেন।’একটু দম নিয়ে মিষ্টি গলার মেয়েটি জিগ্যেস করল, ‘মে আই নো হু ইজ মেকিং দিস কল?’
কয়েকবার ঢোঁক গিলে অভিলাষ বলল, ‘মানে…আপনাদের একটা এসএমএস দেখে আ-আমি কল করেছি। আই মিন…।’
‘ইটস ও. কে., স্যার। ইমপরট্যান্ট পারসনসদের মোবাইল ফোনে কনট্যাক্ট করাটা আমাদের অ্যাড ক্যামপেইনেও খুব হেলপ করে। আমাদের কোম্পানির মরাল হচ্ছে, ”আ ক্লায়েন্টস সিক্রেট ইজ অলওয়েজ আ সিক্রেট।” ক্লায়েন্টদের সব ব্যাপার আমরা গোপন রাখি। ফর এক্স্যাম্পল, এই যে আপনি আমাদের ফোন করেছেন, এটা কেউ জানতে পারবে না। ইভন দ্য পুলিশ ক্যান নট ট্রেস দিস কল। বিকজ মোবাইল ফোন সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে আমাদের স্পেশাল এগ্রিমেন্ট আছে। উই পে দেম বিগ মানি। সো এভরিথিং ইজ হাশ-হাশ।’ একটু থামল মেয়েটি। বোধহয় অভিলাষকে সাহস জোগানোর সময় দিল। তারপর: ‘আই হোপ ইউ আর স্যাটিসফায়েড, স্যার। নাউ মে আই নো হু ইজ কলিং?’
অভিলাষ ঘামতে শুরু করেছিল। ওর দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ও তাড়াতাড়ি লাইনটা কেটে দিল।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে কাল সকাল থেকে। ঘুম থেকে উঠেই চায়ের টেবিলে রঙ্গনার সঙ্গে প্রবল খটাখটি হয়ে গেল। ইস্যুটা খুবই সামান্য: অভিলাষের একটা নীলচে ফুলহাতার শার্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা রঙ্গনাকে জিগ্যেস করতেই ও ঠোঁট উলটে বলে বসল, ‘তো আমাকে কী করতে হবে?’
তাতে বিরক্ত হয়ে অভিলাষ বলেছে, ‘কেন, তোমাকে জিগ্যেস করাটা কি অন্যায় হয়েছে?’
‘অন্যায় না হলেও ন্যায়ের বেসিসটাও তো খুব একটা খুঁজে পাচ্ছি না। শার্টটা নিয়ে কি আমি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি?’ ভুরু উঁচিয়ে একটু তেরছা হাসি ছুড়ে দিয়েছে রঙ্গনা। তারপর: ‘তুমি তো জানো, আমার ভাইয়েরা এত কম দামি শার্ট পরে না। দে অলওয়েজ গো ফর সুপারব্র্যান্ডস…।’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল।
ওদের বিয়েটা প্রেম করে হয়েছিল ঠিকই, তবে রঙ্গনা একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না ওরা ব্যাপক বড়লোক। বিয়ের প্রথম তিন-চার বছরে সেরকম কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুরু হয়েছে পাঁচে পা দেওয়ার পর। ওদের মধ্যে কোনওরকম ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হলেই দু-চার লাইন কথা চালাচালির পর রঙ্গনা ওর সেই গোরু রচনায় ফিরে আসে। অভিলাষকে মনে করিয়ে দেয় যে, ওরা টগবগে বড়লোক।
তো সকালের ঝগড়ার প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর অভিলাষের মোবাইলে এসএমএস-টা আসে।
অভিলাষ তখন অফিসে। ল্যাপটপ কম্পিউটারের কিবোর্ডে ওর আঙুল চলছিল। মোবাইল ফোনটা রাখা ছিল একটা পেন ড্রাইভের পাশে। হঠাৎই এসএমএস-এর রিং বেজে ওঠায় কাজ থামিয়ে ও মেসেজটা দ্যাখে। অচেনা নম্বর থেকে আসা এক অদ্ভুত এসএমএস:
Harassed with any nagging problem? Call us, the PROBLEM
SOLVER. We’re the best.—END GAME (9832100051)
এসএমএস-টার মানে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি অভিলাষ। যে-কোনও ঘ্যাপচানো সমস্যায় ব্যতিব্যস্ত হলে ‘এন্ড গেম’ সব সমস্যার সমাধান করে দেবে? যে-কোনও সমস্যা বলতে…ওদের সমস্যার এলাকাটা ঠিক কতটা বড়? গ্যাসট্রিক আলসার থেকে কিডন্যাপিং বা মার্ডার পর্যন্ত কি?
বলতে গেলে ঠিক তখনই রঙ্গনাকে খুন করার ব্যাপারটা প্রথম ওর মাথায় আসে।
ওদের বিয়েটা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে অনায়াসেই বলা যায়, সম্পর্কটা উচ্ছে, পলতা পাতা, চিরতা, কালমেঘ, কি নিমপাতা—সবাইকেই ছাড়িয়ে গেছে।
অভিলাষ মুখে তেতো স্বাদ পেল। এইভাবেই কি কাটবে বাকি দিনগুলো? নাকি…।
হঠাৎই দেখল সুমিতি ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।
সুমিতির সঙ্গে জ্যামিতির যে একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে সেটা ওর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। শরীরের ঠিক-ঠিক জায়গায় ঠিক-ঠিক মাপের বৃত্ত, উপবৃত্ত আর ত্রিভুজ বসানো রয়েছে।
সুমিতির পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি। তার সঙ্গে হালকা ছাই রঙের ব্লাউজ। গলায় একটা সাধারণ কালো পুতির মালা—কিন্তু অসাধারণ লাগছে। ওর লম্বা কাঠামোর সঙ্গে বিদেশিনী মডেলদের মিল। গায়ের রং-ও সেইরকম। এমনভাবে অভিলাষের দিকে হেঁটে আসছে যেন মাটিতে পা পড়ছে না—ভেসে আসছে।
সুমিতি সিস্টেমস রিসার্চ ডিভিশানের প্রজেক্ট লিডার—এবং কোম্পানির অ্যাসেট। ওকে মনে-মনে অনেকেই চায়, কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই। কারণ, ওর ব্যক্তিত্ব সহজে ভেদ করা যায় না।
অভিলাষের সঙ্গে কাজের কথা বলতেই এসেছিল সুমিতির। আলতো নরম গলায় ও কথা বলছিল। হালকা পারফিউমের গন্ধ অভিলাষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
কাজের কথা শেষ করে চলে যাওয়ার ঠিক আগে সুমিতি বলল, ‘আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করব…?’
‘কী?’
‘মুখটাকে এরকম প্যাঁচার মতো করে রাখবেন না। যদিও এত হ্যান্ডসাম প্যাঁচা আমি আগে কখনও দেখিনি—।’
সুমিতি ঠোঁটের কোণে হেসে চলে গেল।
অভিলাষের সঙ্গে মাঝে-মাঝে এরকম হালকা মজা করে সুমিতি। হয়তো অভিলাষকে ও কিছুটা পছন্দও করে। কিন্তু শত সাধ থাকলেও অভিলাষ কখনও পা বাড়ায়নি, নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেনি।
কারণ রঙ্গনা। অভিলাষ জানে, ওকে ডিভোর্সের কোনও প্রস্তাব দিলে ও সেটাকে এ-পাড়া থেকে শুরু করে বাপের বাড়ি পর্যন্ত রাষ্ট্র করে ছাড়বে। কথার খোঁচায় অভিলাষকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। কিন্তু ডিভোর্স দেবে না।
রঙ্গনা এইরকম। কারণ, ওর লোভ—অর্থ আর শাসনের। অভিলাষের যা-কিছু আছে তার ওপরে দখল রাখতে রঙ্গনা ভালোবাসে, আর অভিলাষের ওপরে দখল রাখতে তার চেয়েও আরও অনেক বেশি ভালোবাসে।
এই দখলদারির বেড়া ভাঙতে চাইছিল অভিলাষ। তা হলেই ও অনেক স্বপ্ন দেখতে পারবে। এমনকী সুমিতিকে নিয়েও।
আরও আধঘণ্টা চিন্তাভাবনার পর অভিলাষ ঠিক করল 9832100051 নম্বরটায় ও ফোন করবে।
অভিলাষ ফোনটা করেছিল এসটিডি বুথ থেকে, যাতে কলার আইডি দেখে ‘এন্ড গেম’ ওকে ট্রেস করতে না পারে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও অভিলাষ যেভাবে ঘেমে নেয়ে উঠল তা রীতিমতো লজ্জা পাওয়ার মতন। রঙ্গনা এ-দৃশ্য দেখলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর সেই হাসির এক-একটা কণা ধারালো ছুঁচের ডগা হয়ে ওকে রক্তাক্ত করত।
রঙ্গনা আপাদমস্তক আকাঙ্ক্ষাময় যুবতী। অভিলাষ ওকে কখনওই ঠিকমতো সন্তুষ্ট করতে পারেনি—না দিনে, না রাতে। ওর ছোটখাটো চেহারা আর ছোটখাটো প্রত্যঙ্গ নিয়ে কম খোঁটা দেয়নি রঙ্গনা। অতৃপ্ত অবস্থায় স্বামীর কাছ থেকে বিযুক্ত হওয়ার পর রঙ্গনা প্রায়ই ওকে ‘খোকা মেশিন’ বলে ব্যঙ্গ করত। বলত, ‘…একে তোমার খোকা মেশিন, তাতে আবার আধখানা গুলি ভরা আছে!’
অভিলাষের বুকের ভেতরটা জ্বলতে লাগল। ও ধীরে-ধীরে বুঝতে পারল, ওর ভেতরে একটা খুনি জন্ম নিচ্ছে।
মোবাইল ফোনের এসএমএস-টা বারবার দেখতে লাগল অভিলাষ। আচ্ছা, ন্যাগিং প্রবলেম সলভ করতে ‘এন্ড গেম’ ঠিক কত টাকা নেয়?
টুয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরিতে এ ধরনের একটা অফিস ঠিক যতটা আধুনিক হওয়া সম্ভব ‘এন্ড গেম’-এর অফিস ঠিক ততটাই আধুনিক।
মোলায়েম ঠান্ডা পরিবেশ। চারিদিকে ধবধবে সাদা আলো—তবে লুকোনো লুমিনেয়ারগুলো চোখে পড়ছে না। মসৃণ আলোর দীপ্তি থাকলেও বিরক্তিকর চোখধাঁধানো ব্যাপার নেই। গোটা অফিসটাই কাচ আর আয়না দিয়ে সাজানো। ফলে অবজেক্ট আর ইমেজ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ইলিউশান তৈরি হয়েছে।
রিসেপশান থেকে প্রায় পুরো অফিসটাকেই দেখতে পাচ্ছিল অভিলাষ। টেবিল, চেয়ার, ফাইলিং ক্যাবিনেট, ল্যাপটপ কম্পিউটার, হলোগ্রাম ক্যালেন্ডার, আরও কত কী!
কাচ আর আয়না ঘেরা সরু-সরু অলিপথ ধরে তরুণ-তরুণীরা ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। তবে কে যে অফিসের স্টাফ আর কে যে ক্লায়েন্ট সেটা একটুও বোঝার উপায় নেই।
হঠাৎই অভিলাষের মনে হল, ‘এন্ড গেম’-এর যা ব্যবসা তাতে এই ব্যাপারটা যত গুলিয়ে যায় ততই ভালো। ক্লায়েন্টদের সেফটি আরও জোরালো হবে। তা ছাড়া নানান জায়গায় নানান অ্যাঙ্গেলে দাঁড় করানো আয়নার জন্য সব মানুষের চলাফেরার গতিপথ ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল রাতে আরও দুবার ‘এন্ড গেম’-এর অফিসে ফোন করেছিল অভিলাষ। দুবার-ই ও মাঝপথে ফোন কেটে দিয়েছে। কিন্তু তৃতীয়বারে সাহস করে মেয়েটির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা চালাতে পেরেছে।
অভিলাষকে একজন এক্সিকিউটিভের নাম আর মোবাইল নম্বর দিয়েছে মেয়েটি। বলেছে, ‘এখন থেকে হি উইল বি ইয়োর ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। ইউ মাস্ট ডিপেন্ড অন হিম। উই উইল গিভ ইউ ভ্যালু ফর মানি…।’
‘এন্ড গেম’এর অফিসে ঢুকে সেই এফপিজি—মানে, ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইডকে ফোন করল অভিলাষ। সঙ্গে-সঙ্গে আশ্বাসের হাসি, সুপ্রভাত, আর ‘কোনও চিন্তা নেই’-এর বন্যা বয়ে গেল। একইসঙ্গে গাইড্যান্সও পাওয়া গেল।
মোবাইল ফোনে পরের পর নির্দেশ দিয়ে অভিলাষকে গাইড করতে লাগলেন তিনি। আয়না আর কাচের গোলকধাঁধায় অভিলাষ অন্ধের মতো পথ খুঁজতে লাগল। বারবার ধাক্কা খেতে লাগল কাচে অথবা আয়নায়। নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে ধাক্কা এড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার নাকাল হল। তারপর, বহু ধস্তাধস্তির পর ও কিউব- ১১০১১-এ পৌঁছতে পারল।
তখনই ও ওর এফপিজি-কে প্রথম দেখতে পেল।
বেঁটে চেহারার মোটাসোটা মানুষ। ফরসা, গালে সাহেবদের মতো লালচে আভা। মাথার প্রায় পুরোটাই টাক। চোখে চৌকো কাচের শৌখিন চশমা। চোখজোড়া গোল-গোল। তাতে সবসময়েই একটা অবাক ভাব। নাকের নীচে ছোট চওড়া গোঁফ। আর থুতনির নীচে গলকম্বল।
গোটা অফিসটা এসি হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রলোকের কপালে আর টাকে বিনবিনে ঘাম। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে ঘন-ঘন ঘাম মুছছেন।
এফপিজির চেহারা অভিলাষকে হতাশ করল। এ যে দেখছি বোকা-বোকা একটা জোকার! যার সঙ্গে বুদ্ধির বা আই. কিউ-র কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিলাষ। ভদ্রলোককে কয়েকবার জরিপ করল।
না, ভদ্রলোকের পোশাক বেশ স্মার্ট। ঘিয়ে রঙের ফুলশার্ট। গাঢ় নীল রঙের টাই। আর গাঢ় নীল টেরিউলের প্যান্টের ওপরে সরু-সরু সাদা স্ট্রাইপ।
এফপিজির নাম কমলপাণি। অভিলাষের সঙ্গে হাতমোলানোর সময় শুধু প্রথম নামটাই বললেন তিনি। তারপর ওকে নিয়ে কাচ আর আয়নায় ঘেরা একটা কিউবিকল-এ বসলেন।
অভিলাষ আগেই লক্ষ করেছিল, কিউবিকলগুলোর নম্বর ডেসিম্যাল নাম্বারে না লিখে বাইনারিতে লেখা। ও যখন এর কারণ ভাবছিল তখন কমলপাণি হাতে হাত ঘষে একটু খসখসে গলায় ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘বলুন, স্যার, আপনার ন্যাগিং প্রবলেমটা কী? আপনাকে এটুকু অ্যাশিয়োর করছি, নেচার অফ প্রবলেম যা-ই হোক না কেন, উই উইল সলভ ইট ফর গুড।’
অভিলাষ আর দেরি করল না। সমস্যাটা ও বলতে গেলে কমলপাণির মুখের ওপরে উগরে দিল।
‘সমস্যাটা আমার ওয়াইফ। আই ওয়ান্ট টু বাম্প আর অফ—ওকে একেবারে খতম করতে চাই…।’
‘গুড!’ কমলপাণি চাপা হেসে মাথা নাড়লেন ‘আপনার ওয়ে অফ এক্সপ্রেশান আমার ভালো লেগেছে, স্যার। বি ডায়রেক্ট অ্যান্ড টু দ্য পয়েন্ট। সেভস টাইম।’ কাচের টেবিলে আলতো করে আঙুলের টোকা মারতে শুরু করলেন কমলপাণি। সাদা সিলিং-এর দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে রইলেন। আস্তে-আস্তে বললেন, ‘ওয়াইফকে…খুন…করতে…চান। তাই তো?’ চোখ নামালেন অভিলাষের দিকে ‘মোস্ট কমন প্রবলেম। হ্যাঁ, সলভ হয়ে যাবে। তবে মার্ডার করতে চান কোন মোডে—ভারচুয়াল মোড, না রিয়েল মোড?’
‘তার মানে?’
‘দেখুন, আমরা মার্ডার করি দু-ভাবে—ইন ভারচুয়ালিটি, অ্যান্ড ইন রিয়েলিটি…।’
অভিলাষ ফ্যালফ্যাল করে কমলপাণির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথায় তখনও ভালো করে কিছু ঢুকছিল না। ভারচুয়াল? রিয়েল? এসব কী বলছে ওর এফপিজি! তাছাড়া মানুষটা মার্ডার করার ব্যাপারটা এমন মামুলিভাবে উচ্চারণ করেছে যে, অভিলাষের স্পাইনাল কর্ড বেয়ে বরফজলের হিমস্রোত নেমে গেল।
কমলপাণি যতই কথা বলছিলেন অভিলাষ ততই বুঝতে পারছিল বোকা-বোকা জোকার-জোকার ভাবটা ওঁর ছদ্মবেশ। ক্ষুরধার বুদ্ধি না থাকলে ‘এন্ড গেম’-এর এক্সিকিউটিভ হওয়া যায় না।
‘…ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে দিই, স্যার…’ দু-হাত নেড়ে বললেন কমলপাণি, ‘ধরুন, আপনাদের কনজুগাল লাইফ একদম ঘেঁটে গেছে। মানে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা একেবারে বিষিয়ে গেছে—মিউচুয়াল হেট্রেড ছাড়া আর কিছু বাকি নেই। তখন, ধরুন, আপনি ডিসাইড করলেন যে, আপনার ওয়াইফকে মার্ডার করবেন—এই যেমন আপনি ডিসাইড করেছেন।
‘আমাদের সাইকোলজি ডিভিশান স্টাডি করে দেখেছে যে, এরকম কেস-এ প্রায় এইটিথ্রি পারসেন্ট মানুষের বেলায় রিয়েল মার্ডারের দরকার হয় না। ভারচুয়াল মার্ডার করলেই কাজ হয়ে যায়। মানে, য়ু গেট ইয়োর হেট্রেড আউট অফ ইয়োর সিস্টেম। তখন স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর রিলেশানটা আবার রিপেয়ার হয়ে যায়। এভরিথিং এন্ডস ওয়েল। ঠিক আছে?’
‘ভারচুয়াল মার্ডার মানে?’ হতবাক অভিলাষ জিগ্যেস করল।
কমলপাণি হাসলেন, ওঁর ভুঁড়ি হাসির দমকে কেঁপে উঠল আঙুলের ডগা খুঁটতে-খুঁটতে তিনি বললেন, ‘ভারচুয়াল মার্ডার মানে নকল খুন। কিন্তু আপনি ভাববেন আসল খুনই হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের কোম্পানির ইনভেনশান—ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্টও নেওয়া আছে। এর ডিটেইল-এ এখন যাচ্ছি না—পরে আপনি দেখতেই পাবেন—যদি অবশ্য আপনি ভারচুয়াল মোডে যান।
‘আমাদের কোম্পানির নিয়ম হল, ভারচুয়াল মার্ডার হলে সেটা অবশ্যই ক্লায়েন্টকে নিজের হাতে করতে হবে। আর…ইফ এনিবডি গোজ ফর রিয়েল মোড, ”এন্ড গেম” টেকস কেয়ার অফ এভরিথিং। ক্লায়েন্টকে কোনও ঝামেলা ঘাড়ে নিতে হবে না। বরং আমরা ক্লায়েন্টকে জবরদস্ত অ্যালিবাই তৈরি করে দেব—পুলিশের বাবাও তাকে সেই মার্ডারের সঙ্গে জড়াতে পারবে না। তা ছাড়া মার্ডারটা আমরা এমনভাবে কমিট করব যে, সেটা একটা পারফেক্ট অ্যাক্সিডেন্টের মতো দেখাবে। এই ধরুন কার অ্যাক্সিডেন্ট, কিংবা মালটিস্টোরিড বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া—এই টাইপের। অ্যাবসোলিউটলি নো উয়ারিজ ফর দ্য ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্টকে শুধু আমাদের প্রপার ফি-টা ক্রেডিট কার্ডে জমা করতে হবে। ব্যস…।’
ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে অভিলাষকে সব বুঝিয়ে দিলেন কমলপাণি। তারপর ওকে একপৃষ্ঠার একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে দিলেন। বললেন, ‘শুনুন স্যার, একটা রিকোয়েস্ট আপনাকে করব। তাড়াহুড়ো করে কোনও ডিসিশান নেবেন না। গো হোম। রিল্যাক্স। আপনার স্ত্রী যখন আপনার প্রেমিকা ছিল—আই হোপ শি ওয়াজ—সেইসব মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবুন। ভাবুন আরও মিষ্টি রাতগুলোর কথা। ওহ! দৌজ ওয়ান্ডারফুল নাইটস!…এখন তো হতেই পারে, ওসব কথা ভাবতে-ভাবতে একসময় আপনার মনে হবে, ইউ ডোন্ট নিড আস অ্যাট অল।
‘একটা কথা আপনাকে বলি, স্যার—উই ডোন্ট বেগ ফর বিজনেস। যদি আপনি আমাদের হেলপ না নেন, তা হলে আমরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু যদি তিনদিন পর আপনি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসেন তা হলে বুঝতে হবে আপনার ডিসিশানটা জেনুইন। তখন আপনিই ঠিক করবেন কোন মোডে আপনি কাজটা করতে চান—ভারচুয়াল, না রিয়েল। যদি ভারচুয়াল অপারেশানে যান, তা হলে ওয়াইফকে আবার ফিরে পাবেন। আর যদি রিয়েল অপারেশানই আপনার ডিমান্ড হয়, তা হলে…ওয়েল শি উইল বি গন ফর গুড।’ একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন কমলপাণি: ‘তা হলে বাড়ি যান…ভাবুন…তিনদিন পর আমাদের দেখা হবে। সি য়ু…।’
ফর্মটা ফিল-আপ করার সময় মোডের জায়গায় ‘ভারচুয়াল’ লিখল অভিলাষ।
গত তিনদিন ধরে অনেক ভেবেছে ও। কমলপাণির কথাগুলো ওকে বেশ নাড়া দিয়েছে। কমলপাণি বলেছেন মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবতে—যখন রঙ্গনা ওর প্রেমিকা ছিল। মিষ্টি দিন। আরও মিষ্টি রাত।
প্রথম যেদিন ওরা সবচেয়ে কাছাকাছি আসে সেদিন রঙ্গনা কী বলেছিল আজও অভিলাষের মনে আছে।
অভিলাষের ফ্ল্যাটে ওরা দুজনে সন্ধেটা কাটাচ্ছিল। অভিলাষ একটা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। একটু আগেই ওর তৃতীয় পেগ শেষ হয়েছে। মাথায় ঝিমঝিম ভাব, মনের মধ্যে নানান রঙের স্বপ্নের ওড়াউড়ি। মিউজিক সিস্টেমে রঙ্গনার ফেবারিট জিমি এক্স-এর ‘ক্লোজ টু ইয়োর হার্ট’ বাজছিল। আর রঙ্গনা বসেছিল অভিলাষের হাতের নাগালে।
সুতরাং হাত হাতের কাজ করছিল, মন মনের।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই রঙ্গনা এসে গিয়েছিল অভিলাষের বুকের ওপরে। তারপর, দু-চার প্রস্থ আদরের পর, রঙ্গনা অভিলাষের বুকে মুখ গুঁজে মিনমিনে জড়ানো স্বরে বলেছিল, ‘তোমার নামের মানে জানো?’
‘হ্যাঁ—জানি।’ নীচু গলায় জবাব দিয়েছিল অভিলাষ।
‘তা হলে আর দেরি করছ কেন?’
‘না, আর দেরি করেনি অভিলাষ।
সেইদিন, আর তার পরের দিনগুলো! নাম অনুযায়ী কাজ করে চলেছিল।
ভাবতে-ভাবতে নরম হয়ে যাচ্ছিল অভিলাষ। আচ্ছা, রঙ্গনা কি নিজেকে একটু বদলে নিতে পারে না? দরকার হয় অভিলাষও নিজেকে একটু-আধটু বদলাবে।
সুতরাং, রঙ্গনার সঙ্গে কথাবার্তায় বা ব্যবহারে সচেতন হয়ে উঠল অভিলাষ। ওর সঙ্গে অতিরিক্ত মোলায়েম সুরে কথা বলতে লাগল, সংঘর্ষ এড়াতে নিজে হার মানল বহুবার। রঙ্গনা বেশ অবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগল। একসময় তো বলেই বসল, ‘কী ব্যাপার বলো তো? কোনও ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট খেয়েছ নাকি? তোমাকে ভারি পিকিউলিয়ার লাগছে…।’
অভিলাষ তাও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর ওর মনটা ধীরে-ধীরে পালটাতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, রঙ্গনাকে আর-একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। দেখাই যাক না!
তাই কমলপাণির কাছে এসে ফর্মে মোডের জায়গায় ও লিখেছে, ‘ভারচুয়াল।’
খুব তাড়াতাড়ি সবরকম ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে দিলেন কমলপাণি। চোখ তুলে দেখলেন অভিলাষের দিকে, বললেন, ‘ইট ওয়াজ আ গুড ডিসিশান, স্যার। ইউ উইল ফাইন্ড দ্য ভারচুয়াল মোড নো লেস এফেকটিভ দ্যান দ্য রিয়েল মোড…।’
অভিলাষ শুনল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। শুধু মনে-মনে ও ভারচুয়াল মার্ডারের এফেকটিভনেসটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল।
কমলপাণি অভিলাষের ফ্ল্যাটের ঠিকানা এবং মোটামুটি লোকেশান জেনে নিলেন। তারপর হাতঘড়ির ডায়ালে তারিখ দেখে অভিলাষকে সাতদিন পরের একটা তারিখ আর সময় জানালেন, বললেন, ‘আরও সাতদিন সময় হাতে পেলেন। কিপ ইয়োর কুল। ওইদিন ঘড়ি ধরে চলে আসুন। কমিট দ্য ক্রাইম অ্যান্ড বি হ্যাপি। ও. কে?’
‘ও. কে.—’ বলল অভিলাষ।
অন্ধকার ঠান্ডা ঘরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে রঙ্গনাকে দেখছিল অভিলাষ।
ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এফপিজি কমলপাণি।
ওদের সামনে একটা বিশাল কাচের জানলা। জানলার ওপাশেই একটা আলো-ঝলমলে বেডরুম—অভিলাষের বেডরুম।
সুন্দর করে সাজানো বেডরুমের মোলায়েম বিছানায় আলুথালুভাবে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে রঙ্গনা। একহাতে ধরা একটা ইংরেজি পেপারব্যাক।
রঙ্গনার গায়ে লেসের কাজ করা গোলাপি রঙের একটা নাইটি। পোশাকটা ঠিকঠাক ওর গায়ে নেই। একটা পা ভাঁজ করা—পোশাকটা উঠে গিয়ে হাঁটু এবং ঊরুর খানিকটা দেখা যাচ্ছে। মাথার চুল বালিশের ওপরে ছড়ানো। বাঁ হাতে কোমরের কাছটা চুলকোচ্ছে।
কমলপাণি ফিসফিস করে বললেন, ‘স্যার, এটা আপনার বেডরুমের হলোগ্রাফিক লাইভ টেলিকাস্ট। আপনি যা দেখছেন সবটাই হলোগ্রাফিক ইমেজ—মানে মায়া। আমাদের ক্যামেরা এখন থেকে প্রতিমুহূর্তে আপনার ওয়াইফকে ফলো করবে। এই মুহূর্তে আপনার স্ত্রী ফ্ল্যাটে যা-যা করবেন তার প্রতিটি কণা আমাদের থ্রি-ডি ক্যামেরা সিস্টেম লাইভ টেলিকাস্ট করে আপনাকে দেখাবে…।’
অভিলাষের তাজ্জব লাগছিল। কারণ, ওরা ওর ফ্ল্যাট থেকে অনেক দূরে ‘এন্ড গেম’-এর অফিসে একটা স্পেশাল রুমে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কমলপাণি বোধহয় অভিজ্ঞতা থেকেই অভিলাষের অবাক হওয়াটা টের পেলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আপনি যা দেখছেন, পুরোটাই ভারচুয়াল রিয়্যালিটি। কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রীকে আপনি যেন সত্যি-সত্যি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখছেন। আসলে যে-কোঅর্ডিনেটে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এগজ্যাক্টলি সেই কোঅর্ডিনেটে আপনার ফ্ল্যাটের বেডরুমে একটা জানলা আছে— ফ্রস্টেড গ্লাস লাগানো জানলা। আমরা যেন সেই জানলার কাচ সরিয়ে আপনার ওয়াইফের প্রাইভেসিতে ইনভেড করছি। ইটস সো-ও-ও রিয়েল!’ হঠাৎই কথা থামিয়ে অন্ধকারে অভিলাষকে ছুঁলেন কমলপাণি। চাপা গলায় বললেন, ‘নিন—এটা ধরুন….’
জিনিসটা কমলপাণির হাত থেকে নিল অভিলাষ।
একটা রিভলভার।
আন্দাজে বুঝল, অস্ত্রটার ওজন প্রায় কেজিখানেক হবে।
‘এটা আপনার মার্ডার ওয়েপন। মডার্ন। ইমপোরটেড। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, মডেল ফোর জিরো জিরো সিক্স। জিরো পয়েন্ট ফোর জিরো ক্যালিবার। ডাবল-অ্যাকশান। এর ম্যাগাজিনে এগারো রাউন্ড বুলেট আছে। এই হ্যান্ডগানটার নল-টল সব স্টেইনলেস স্টিলের—আর গ্রিপটা ব্ল্যাক, সিনথিটিক। প্রথম কয়েকটা শটে আপনার স্ত্রীকে মিস করলেও এগারোবার তো আর মিস করবেন না! নিন, এবার রেডি হোন…।’
অভিলাষ রিভলভারটা উঁচিয়ে রঙ্গনার দিকে তাক করল। ও অ্যামেচার হলেও এত ক্লোজ রেঞ্জে রঙ্গনাকে মিস করা প্র্যাকটিক্যালি অসম্ভব।
রঙ্গনার সমস্ত খোঁচা, উপহাস আর ব্যঙ্গগুলো মনে পড়ল ওর। খোকা মেশিন…আধখানা গুলি ভরা…। আর এখন। অভিলাষের হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ মেশিন—তাতে এগারোখানা গুলি ভরা আছে।
‘কাচ সরিয়ে দিলাম কিন্তু! গেট রেডি!’ কমলপাণির গলা।
অভিলাষের হাত কাঁপছিল। ও মুঠো শক্ত করল বাঁটের ওপর।
‘সড়সড়’ শব্দ করে কাচের প্যানেল সরে গেল।
অভিলাষের মাথার মধ্যে খতমের সুর বাজছে।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কমলপাণি বললেন, ‘ওয়ান, টু, থ্রি—ফায়ার!’
অভিলাষ ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ফায়ারিং-এর শব্দে ওর কানে তালা লেগে গেল।
প্রথম বুলেটটা রঙ্গনার কোমরে গিয়ে লাগল। ওর হাতের বইটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ও চমকে ফিরে তাকাল জানলার দিকে…অভিলাষের দিকে। ওর অবাক হওয়া মুখটা পলকে ব্যথায় কুঁচকে গেল। কোমর থেকে চুঁইয়ে-চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে এল গোলাপি নাইটি লাল হতে লাগল। বিছানার চাদরও।
অভিলাষ কিন্তু থামেনি। চোখ বুজে পাগলের মতো ফায়ার করেই চলল। রঙ্গনার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত দেখে ওর খুনে মেজাজ যেন আরও চড়ে গেল। ও ভুলে গেল, এটা ভারচুয়াল মার্ডার।
বুলেটের ধাক্কায় রঙ্গনা বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিল। মেঝেতে পড়ে থাকা ওর চিতপাত শরীর আর রক্ত দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, ও আর বেঁচে নেই।
অভিলাষের মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। ও হঠাৎই টলে পড়ে গেল মেঝেতে। কমলপাণি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়লেন ওর ওপরে। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলেন, নাড়ি দেখলেন। তারপর পকেট থেকে নিমপাতার মতো ছোট্ট আর পাতলা একটা মোবাইল ফোন বের করে কথা বললেন, ‘আমি ক্লায়েন্ট নাম্বার ট্রিপল ওয়ান ট্রিপল জিরো ডাবল ওয়ানকে নিয়ে ভারচুয়াল মার্ডার এক্সিকিউশান রুমে আছি। ভদ্রলোক সাডেন ট্রমায় সেন্সলেস হয়ে গেছেন। হেলপলাইনকে অ্যাকটিভ হতে রিকোয়েস্ট করছি।’
অভিলাষ সুস্থ হয়ে উঠল আধঘণ্টার মধ্যেই। ও শুধু রঙ্গনার কথা ভাবছিল। জ্ঞান ফেরার পর কমলপাণি ওকে বারবার আশ্বাস দিয়েছেন যে, রঙ্গনার কোনও ক্ষতি হয়নি। ইট ওয়াজ ওয়ান হান্ড্রেড পারসেন্ট আ ভারচুয়াল মার্ডার।
শি ইজ পারফেক্টলি সেফ অ্যান্ড সাউন্ড। অভিলাষ ইচ্ছে করলে এখনই ওর স্ত্রীকে ফোন করতে পারে।
কিন্তু তবুও অভিলাষের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তাই রঙ্গনাকে ফোনই করল অভিলাষ।
‘রঙ্গনা—।’
‘হু ইজ দিস?’
‘আমি—অভি। তুমি ঠিক আছ তো?’
‘ক’ পেগ খেয়েছ?
আহ! একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল অভিলাষ। এটাই তো রঙ্গনার ক্যারেক্টারিস্টিক আনসার! দিস প্রূভস শি ইজ অ্যালাইভ অ্যান্ড ও. কে.।
‘রঙ্গনা, আই লাভ ইউ, বেবি—।’
‘কখন বাড়ি ফিরছ?’
ঘড়ি দেখল অভিলাষ, বলল, ‘এই ধরো সাড়ে দশটা নাগাদ—।’
‘সাড়ে দশটাই কোরো। তার চেয়ে বেশি দেরি যেন না হয়…।’
এই কথায় প্রেমিকা রঙ্গনার ছায়া দেখল অভিলাষ। কমলপাণিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কারণ, তিনিই প্রথম ভারচুয়াল মার্ডারের সাজেশান দিয়েছিলেন।
রাস্তায় নেমে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসল অভিলাষ। গাড়ি ছুটিয়ে দিল। রাতের বাতাস ওর গালে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
রাতটা কী সুন্দর! আকাশের চাঁদটাও।
অভিলাষ যখন ওদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় এসে পড়ল তখনই একটা মালবোঝাই ফুল পাঞ্জাব ট্রাক পাগলাঘোড়ার মতো ছুটে এল ওর দিকে।
প্রবল সংঘর্ষের শব্দে নিঃস্তব্ধ রাত থরথর করে কেঁপে উঠল।
ট্রাকটা একটুও না থেমে উদ্দামগতিতে ছুটে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
অভিলাষের গাড়িতে আগুন ধরে গেল। তার একটু পরেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ।
অ্যাকশান ছবির দৃশ্যের মতো অভিলাষের গাড়িটা শূন্যে ছিটকে উঠল, আবার আছড়ে পড়ল রাস্তায়।
রঙ্গনা টেনশানে পায়চারি করছিল। হঠাৎই ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল রঙ্গনা। দশটা চল্লিশ।
তাড়াতাড়ি বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতেই ও-প্রান্ত থেকে রোবটের গলায় একজন মহিলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, ”এন্ড গেম” থেকে বলছি। আপনার কাজটা হয়ে গেছে। যেমন বলেছিলাম, ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট রোড অ্যাক্সিডেন্ট…। একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায়…।
অবচেতন
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আলতো করে হাত রাখলেন তার পোষা অ্যালসেশিয়ানের লোমশ পিঠের ওপরে। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। বিস্তৃত কপালে উড়ে আসা কয়েকগুচ্ছ রুপোলি চুলকে স্বস্থানে ফেরত পাঠিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন।’
আমি পাঁচফুট চওড়া টেবিলের এ-প্রান্তে বসে বলে উঠলাম, ‘ডক্টর, স্বপ্ন হোক, দুঃস্বপ্ন হোক—এর মানে কী?’
আমার স্বরে উত্তেজনার আভাস পেয়ে কুকুরের পিঠ থেকে হাত তুললেন ডক্টর সমাদ্দার। সাইন পেনটা উচিয়ে ধরে সাদা প্যাডের ওপরে কিছু লেখার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার রায়, আপনার গল্পটা আমি প্রথম থেকে আর-একবার শুনতে চাই। কাইন্ডলি একটু স্লোলি বলবেন। নিন, শুরু করুন—।’
আমি, সুদর্শন রায়, চেয়ারে গুছিয়ে বসলাম। ঘরে এয়ারকুলার থাকা সত্ত্বেও মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। ঘর এবং আসবাবপত্রের রং নিষ্কলঙ্ক, সাদা। ডক্টর সমাদ্দারের গায়েও সাদা স্ট্রেচলনের স্যুট। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। হাতের অনামিকায় হিরের আংটি।
একমাত্র ব্যতিক্রম ‘দুশমন’: ডক্টর সমাদ্দারের সাড়ে চারফুট লম্বা বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর। ওর রং কুচকুতে কালো। কাচের গুলির মতো চোখদুটো সবসময় ধকধক করে জ্বলছে।
ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে আমি আগেও কয়েকবার এসেছি। কারণ, আমার মাঝে-মাঝে দেখা দুঃস্বপ্নগুলো। তাই দুশমন এবং তার প্রভু, দুজনের সঙ্গেই আমি যথেষ্ট পরিচিত।
আমার আগের দেখা দুঃস্বপ্নগুলো যেমনই অবাস্তব, তেমনই উদ্ভট। প্রথম দুঃস্বপ্নে দেখেছি, একটা এরোপ্লেন থেকে আমি একজন পাইলটকে ধাক্কা দিয়ে শূন্যে ফেলে দিচ্ছি। দ্বিতীয় স্বপ্নে দেখেছি জলের তলায় একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আমার মরণপণ যুদ্ধ চলছে। অবশেষে তাকে গলা টিপে খুন করে আমি জলের ওপরে ভেসে উঠছি (এবং একইসঙ্গে হাঁপাতে-হাঁপাতে বিছানায় উঠে বসেছি)।
দুঃস্বপ্ন হলেও সেগুলো কখনও স্থায়ী হয়নি। ক্ষণিকের দেখা, এবং ক্ষণিকেই তা মিলিয়ে গেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার বলেছিলেন, এ-দুঃস্বপ্ন দেখার কারণ মনের অবচেতনে অপরাধ করার সুপ্ত বাসনা—এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ চিন্তার কোনও কারণ নেই।
এসব ঘটনা প্রায় বছরখানেক আগের।
কিন্তু গত সাতদিন ধরে এক অদ্ভুত ধারাবাহিক স্বপ্ন আমি দেখে চলেছি। যা প্রথমে ছিল অর্থহীন, কিন্তু পরে…।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলাম। রুমাল বের করে চোখ মুছলাম। ডক্টর সমাদ্দার নীরবে আমার কথা বলার অপেক্ষায় রইলেন। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করলাম, ‘ডক্টর, সবকিছুর শুরু লাস্ট মঙ্গলবার। আমি বিয়ে করিনি। শুতে-শুতে রোজই বেশ রাত হয়। সেদিনও রাত হয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসতে আমার কখনও দেরি হয় না। সুতরাং মিনিটকয়েকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ডুবে গেছি। সে-রাতেই অদ্ভুত স্বপ্নটা প্রথম দেখলাম।
‘দেখলাম, আমি একটা বিশাল বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে ব্যস্ত লোকজন সাদা পোশাকে চলাফেরা করছে। ফ্লুওরেসেন্ট আলো-ঝলমলে তেলচকচকে করিডর ধরে আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলেছি। কাজে ব্যস্ত লোকজন কেউ যেন আমাকে দেখেও দেখছে না। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। সে-ঘরে সাজানো সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে নানান বয়েসের নারী-পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে।
‘প্রথম দিনের স্বপ্ন এখানেই শেষ!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, ‘কিন্তু দ্বিতীয় দিন এই স্বপ্ন আমি আবার দেখেছি! কিন্তু সেদিনের স্বপ্ন আমাকে আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেল। দেখলাম, সেই বিশাল সাদা ঘরটার একপ্রান্তে একটা ছোট দরজা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো যান্ত্রিকভাবে সেই ছোট দরজাটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম।
‘দরজার চৌকাঠ পেরোতেই নজরে পড়ল একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা হয়তো রান্নাঘর, হয়তো বাথরুম, হয়তো ভাঁড়ার ঘর—ঠিকমতো কিছু বলতে পারব না। কারণ, ঘরের শুধুমাত্র ডানদিকের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছে। সেটা একটা সাদা বেসিন। স্টিলের কল থেকে টইটম্বুর বেসিনে টপটপ করে জল পড়ছে। আর আমি যেন নেশার ঘোরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই জল পড়ার শব্দ শুনছি…।
‘তৃতীয় দিনের স্বপ্নে প্রথম থেকে শুরু করে সেই বেসিন পর্যন্ত আসার পর খেয়াল করলাম, ঘরে আমি একা নই। একজন লম্বা মানুষ, পরনে সাদা ধবধবে আলখাল্লা, বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার মুখে ব্যঙ্গের হাসি। বিশ্বাস করুন ডক্টর, সেই সাদা পোশাক পরা ভদ্রলোকের চেহারা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে! যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার কালো জোড়া ভুরু, টিকোলো নাক, কালো কুচকুচে শৌখিন গোঁফ, ছোট-ছোট চোখ, ফরসা গালের বাঁ-দিকে একটা আঁচিল তিরতির করে কাঁপছে।’
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার এবার নড়েচড়ে বসলেন। বাঁ-হাতটা দুশমনের পিঠে রেখে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি ফর দ্য ইন্টারাপশন, মিস্টার রায়। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। একটা জিনিস আপনার জানা প্রয়োজন। সাধারণত কোনও স্বপ্নে আমরা যখন আমাদের অচেনা কোনও মানুষকে দেখি, তখন চেতনা ফিরে সেই স্বপ্নে দেখা মানুষের চেহারার নিখুঁত বর্ণনা আমরা কখনও দিতে পারি না। ইটস আউট অ্যান্ড আউট ইমপসিবল সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই লম্বা লোকটিকে আপনি আগে কোথাও দেখেছেন। ইউ মাস্ট হ্যাভ সিন হিম সামহোয়্যার। আই অ্যাম শ্যুওর অফ ইট!’
আমার পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে সম্ভবত একটা বিহ্বল ভাব ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘মিস্টার রায়। যেটা হওয়া উচিত সেটাই আপনাকে এক্সপ্লেইন করলাম। নাউ গেট অন উইথ ইয়োর স্টোরি—’ বলে চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে সাদা ফ্লানেলে লেন্সদুটো ঘষে নিলেন। তারপর চশমা চোখে দিলেন।
আমি ঘটনা-পরম্পরা একবার ভেবে নিয়ে বলে চললাম, ‘তৃতীয়দিনের স্বপ্ন সেখানেই শেষ। চারনম্বর দুঃস্বপ্ন দেখলাম আরও দু-দিন পরে, এবং আগের মতোই তিননম্বর স্বপ্নের অসমাপ্ত অংশ এবারেও শেষ হল চারনম্বরে গিয়ে।’
একটু ইতস্তত করে আবার বলতে শুরু করলাম, ‘ডক্টর, আমাকে দেখে সেই ভদ্রলোক হাসলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস্টার রায়। আই অ্যাম ডক্টর শঙ্করদাস গিরি। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর ডক্টর গিরি ঘুরে গেলেন বেসিনের দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়ালেন কলের সামনে। বাঁ-পাশের ছোট্ট তাক থেকে একটা সাদা রঙের সাবান নিয়ে তিনি মুখে ঘষতে লাগলেন। আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার মুখ ধোওয়া লক্ষ করে চললাম। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেলাম। আমার হাতদুটো যেন অধৈর্য আর চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। শেষে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম ডক্টর গিরির কাছে—খুব কাছে। তারপর বিদ্যুৎঝলকের মতো ক্ষিপ্রতায় বেসিনের ওপর ঝুঁকে থাকা তাঁর মাথাটা চেপে ধরলাম। ডক্টর গিরির শরীরটা ঝটকা দিয়ে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। উনি প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও তারপরেই সর্বশক্তি দিয়ে আমার সঙ্গে যুঝতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর মাথাটা বেসিন-ভরতি জলের দিকে ঠেলে নিয়ে চললাম। আমি পেছনে থাকায় ডক্টর গিরি বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না। একসময় হেরে গেলেন।
‘ডক্টর গিরির মাথাটা জলে ডুবিয়ে চেপে ধরতেই তাঁর শরীরটা প্রচণ্ড আক্ষেপে কেঁপে উঠতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলল শরীরের ঝটাপটি। একসময় সব থেমে গেল।
‘দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়ে যখন জেগে উঠলাম, তখন আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। অসহায় চোখে তাকালাম অম্বিকা সমাদ্দারের দিকে। তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাঝে-মাঝে প্যাডের কাগজে কী যেন লিখছেন।
হঠাৎই মুখ তুলে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর?’
আমি মৃদুস্বরে জবাব দিলাম, ‘তারপর, গতকাল, অর্থাৎ, সোমবার, স্বপ্নটা আবার শুরু থেকে দেখতে শুরু করলাম। সেই করিডর, সেই ঘর, সেই ছোট দরজা—অবশেষে ডক্টর গিরির নিথর শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি।
‘আমি গিরির বডিটা একটা ঘোরের মধ্যে কাঁধে তুলে নিলাম। ওঁর মাথার ভিজে চুল থেকে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে।
‘আগে খেয়াল করিনি, এখন দেখলাম, ছোট ঘরটার ডানপাশে, বেসিন থেকে কিছুটা এগিয়ে, একটা খোলা দরজা। আমি একটুও ভয় না পেয়ে শঙ্করদাসকে কাঁধে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের বালব জ্বলছিল। সেটা পেরোতেই চোখে পড়ল একটা ছোট দরজা। দরজা খুলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে অন্ধকার খোলা মাঠ। দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি একটুও না থেমে হেঁটে চললাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না।
‘একসময় দেখলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কয়েকটা বড়-বড় গাছ। কী গাছ জানি না। শঙ্করদাসের দেহটা ঘাসছাওয়া মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। তারপর একটা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। কোদালটা কোত্থেকে যে আমার হাতে এল বলতে পারি না।
‘মাটি খোঁড়া শেষ হল। সেই গর্তে ডক্টর গিরিকে আমি শুইয়ে দিলাম। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, তাঁর চোখদুটো কোটর ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ওঁর ডানহাতের শক্ত মুঠোয় ধরা রয়েছে সেই সাদা সাবানটা।
‘কেমন একটা ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তাড়াহুড়ো করে গর্তে মাটি ঢালতে লাগলাম। একসময় ভরাট হল গর্ত। কোদালটা হাতে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসছি, তখনই আমার নজরে পড়ল, ডক্টর গিরির ডানহাতটা কবরের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। সে-হাতের শক্ত মুঠোয় তখনও ধরা রয়েছে সাদা সাবানটা। আমি ভয় পেয়ে খোলা মাঠ ধরে ছুটতে শুরু করলাম। কোদালটা কোথায় হারিয়ে গেল জানি না…।
‘একটু পরেই দেখি, আমি সেই বিশাল ঘরটায় দাঁড়িয়ে। যে-ঘরে সারি-সারিভাবে স্প্রিং-এর খাট সাজানো রয়েছে। ঘরে একটা নীল রঙের আলো জ্বলছে। সাদা চাদরে ঢাকা মানুষগুলোকে পেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। দেখলাম, একেবারে শেষে একটা খাট খালি। কোনও লোক সেখানে শুয়ে নেই। আমি বাধ্য শিশুর মতো গিয়ে সেই ধবধবে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চাদরে ঢেকে ফেললাম আমার শরীর। ক্রমশ ঘুমে চোখ বুজে এল…।
‘স্বপ্নটা এখানেই শেষ, ডক্টর।’ আমার গলার স্বর যেন আশঙ্কায় কেঁপে উঠল: ‘কিন্তু আজ দুপুরে ঘুমের মধ্যে আবার এই একই স্বপ্ন। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিছানায় শোওয়া পর্যন্ত, আবার দেখলাম। আমার ভয় হচ্ছে, এবার থেকে হয়তো এই দুঃস্বপ্নটা রোজ রাতে আমাকে দেখা দেবে।’
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার ডানহাত আর বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল পরস্পরের মাথায় ছুঁইয়ে কয়েকমুহূর্ত নীরব রইলেন। আপনমনেই বারকয়েক মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনার অনুমান ভুল নয়। আমারও বিশ্বাস এ-দুঃস্বপ্ন রোজ রাতে আপনাকে দেখা দেবে। আপনার স্বপ্ন নিয়ে আমাকে দুটো দিন ভাবার সময় দিন। তারপরই আমি আপনাকে এর রিমেডি জানাব। আজ তা হলে—।’
আমি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গুনে-গুনে চৌষট্টি টাকা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। ডক্টর সমাদ্দার মাথা ঝুঁকিয়ে বিলটা লিখতে-লিখতে বললেন, ‘আপনি বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় আসুন। আর এর মধ্যে যদি ওই নাইটমেয়ার আবার দেখেন তা হলে আমাকে জানাবেন, কেমন?’
‘ইয়েস, ডক্টর।’ বিলটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে পকেটে ভরলাম। যথাক্রমে দুশমন এবং তার প্রভুর সঙ্গে নজর মিলিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। স্প্রিং-এর দরজা আপনাথেকেই বন্ধ হয়ে গেল।
সিঁড়ি নামতে-নামতে মনের আয়নায় ভেসে উঠল শঙ্করদাস গিরির মুখ। এবং পরক্ষণেই যেন দেখতে পেলাম কবরের বাইরে বেরিয়ে থাকা তাঁর সাবান-ধরা ডানহাতটা…।
বৃহস্পতির বিকেল ঠিক পাঁচটায় ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে হাজির হলাম। আমাকে দেখে পরিচিতের হাসি হেসে তিনি বলতে বললেন। দুশমন যথারীতি তার প্রভুর পাশে বসে। ডক্টর সমাদ্দারকে জানালাম তাঁর অনুমানই ঠিক। এই দু-দিনে সেই স্বপ্ন আমি আরও দুবার দেখেছি।
উত্তরে মনের বক্তব্যকে যেন গুছিয়ে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। মাথার রুপোলি চুলে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মিস্টার রায়, এ দু-দিন আমি আপনার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। তাতে যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তার খানিকটা আমি আগেরদিনই আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। অর্থাৎ, ডক্টর শঙ্করদাস গিরিকে আপনি সত্যি-সত্যি কোথাও-না-কোথাও দেখেছেন।’
আমি বিহ্বলভাবে মাথা নাড়লাম।
ডক্টর সমাদ্দার বলে চললেন, ‘তা ছাড়া আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। মিস্টার রায়, কখনও কি আপনি কোনও হসপিটাল, নার্সিং হোম বা মেন্টাল হোমে ছিলেন?’
আমি স্পষ্টস্বরে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, ছিলাম। সামান্য মেন্টাল প্রবলেম হওয়ার জন্যে আমাকে মাসখানেক মাইথনের একটা মেন্টাল হোমে কাটাতে হয়।’
‘কবে?’
‘গতবছর শীতে।’
‘সেই মেন্টাল হোমের নাম আর অ্যাড্রেস আপনার মনে আছে?’
‘আছে।’ আমি নাম ও ঠিকানা বললাম।
প্যাডের কাগজে সেটা টুকে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। তারপর বললেন, ‘এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন: স্বপ্নে দেখা সেই বাড়ির সঙ্গে মাইথনের সেই হোমের কি কোনও মিল আছে? ভালো করে ভেবে জবাব দিন—।’
‘অত ভাবার দরকার নেই, ডক্টর—’ বিনা দ্বিধায় জবাব দিলাম, ‘অনেকটাই মিল আছে।’
‘তা হলে আমার অনুমানই ঠিক।’ ধীরে-ধীরে বললেন অম্বিকা সমাদ্দার, ‘কারণ, বাড়িটার এমন বর্ণনা আপনি দিয়েছেন, যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় কোনও হসপিটাল বা নার্সিং হোমের। সুতরাং, এখন আপনার উচিত মাইথনের সেই মেন্টাল হোমে যাওয়া, এবং স্বপ্নে দেখা ব্যাপারগুলো মিলিয়ে নেওয়া। যেমন ধরুন, সত্যিই শঙ্করদাস গিরি নামে কোনও ডক্টর সেখানে আছেন কিনা। অথবা সেই জঙ্গল, মাঠ—সত্যিই এসবের কোনও অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে কিনা। তা হলেই আপনার কনশাস আর সাবকনশাস মাইন্ডের গরমিলগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে আপনার খোঁজখবরের রেজাল্ট আমাকে জানাতে ভুলবেন না, কেমন?’
আলোচনা-শেষের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু আমি বসেই রইলাম। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললেন না। অভিব্যক্তিতে একটি নীরব প্রশ্নচিহ্ন ফুটিয়ে অপেক্ষায় রইলেন।
‘ডক্টর, আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।’ একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘মাইথনে আমার সঙ্গে আপনাকেও আসতে হবে। ওখানে একা যেতে হলে আমি খুব শেকি ফিল করব। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—এ জন্যে আপনার ফিজ যা লাগে দেব। প্লিজ, ডক্টর, প্লিজ, আমার সঙ্গে আপনি চলুন। একটা দিনের তো ব্যাপার!’
ডক্টর সমাদ্দার কয়েকমিনিট চুপ করে রইলেন। কী যেন ভাবলেন মনে-মনে। অবশেষে মুখ খুললেন, ‘আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি, মিস্টার রয়, কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া একটু প্রবলেম। আমার চেম্বার রয়েছে, রয়েছে দুশমন, তা ছাড়া—।’
‘আপনি করবেন না, ডক্টর।’ অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘প্লিজ, একটা দিন আপনি আমার জন্যে সময় দিন। বললাম তো, আপনার প্রপার ফিজ আমি নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। প্লিজ।’
‘কিন্তু দুশমন?’ দুশমনের পিঠে হাত রাখলেন ডক্টর সমাদ্দার, ‘আমাকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না। আমি ছাড়া কারও কথা ও শোনে না, কারও হাতে খাবার খায় না।’
মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, ‘ওকেও তা হলে সঙ্গে নিন। আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ডক্টর, প্লিজ, ওখানে আমাকে একা যেতে বলবেন না—।’
ডক্টর সমাদ্দার দুশমনের লোমশ কালো পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘আপনার কথাই থাক। দুশমনও আমাদের সঙ্গী হোক।’ তারপর দুশমনের পিঠে চাপড় মেরে: ‘গেট রেডি দুশমন, কাল আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।’
উত্তরে দুশমনের হিংস্র দাঁতের ফাঁক থেকে একটা চাপা গরগর শব্দ ভেসে এল।
‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ডক্টর।’ আবেগে ডক্টর সমাদ্দারের হাত চেপে ধরলাম। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভিজিট-এর চৌষট্টি টাকা তুলে দিলাম তাঁর শীর্ণ হাতে। বললাম, ‘তা হলে আগামীকাল দুপুরের ট্রেনে আমরা রওনা হচ্ছি।’
মৃদু হেসে ঘাড় হেলালেন অম্বিকা সমাদ্দার।
ওঁর চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম।
মাইথনের সেই মেন্টাল হোমের দরজায় যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ছ’টা।
বর্ষার শেষ এবং শরতের শুরু। হয়তো সেই কারণেই বেলাশেষের আলোটুকু পশ্চিমপ্রান্তে অদৃশ্য হওয়ার আগে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধাগ্রস্ত আমিও। এই নির্জন পরিবেশে দাঁড়িয়ে সেই দুঃস্বপ্ন যেন ফিরে আসছে বারবার।
সদর দরজায় লাগনো নামের ফলকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম, ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দারের স্বরে চমক ভাঙল, ‘মিস্টার রায়, অকারণে সময় নষ্ট করে লাভ কী? চলুন, ভেতরে যাওয়া যাক।’
অতএব আমরা এবং দুশমন—তিনজনেই পা বাড়ালাম অন্দরমহলের দিকে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় নির্জন ধু-ধু প্রান্তরে দাড়িয়ে থাকা বাড়িটায় আলো জ্বলছে। সারি-সারি জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলো যেন মাঝপথেই অন্ধকারের কাছে হার মেনে থমকে দাঁড়িয়েছে। চোখে এসে পড়ছে শুধুমাত্র তাদের মলিন আকৃতিটুকু।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই টানা করিডর। তার দু-পাশে কিছুদূর পরপর পরদাঢাকা দরজা। দরজার মাথায় সাইনবোর্ডের মতো বেরিয়ে থাকা কাঠের ফলকে অফিস, এনকোয়ারি, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইত্যাদি স্পষ্ট ইংরেজি হরফে লেখা। করিডরে নজরে পড়ছে সাদা-পোশাকে ফিটফাট কর্মীদের আনাগোনা।
করিডর ধরে অফিসরুমে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে অনুসরণ করলেন ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার। সঙ্গে দুশমন।
অফিস বলতে যা বোঝায়, ঘরটা ঠিক তাই। একেবারে নিখুঁত।
খুঁত শুধু টেবিলের ওপারে বসে থাকা ভদ্রলোকের ডানচোখে। চোখটা কালো প্যাচ দিয়ে ঢাকা। হয়তো কোনও দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ল, গত শীতে এঁকে আমি দেখিনি।
আমাদের বসতে অনুরোধ করে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’
জবাব দিলেন ডক্টর সমাদ্দার। যদিও প্রশ্নটা করা হয়েছিল আমাকে লক্ষ্য করেই। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমার নাম ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার, সাইকিয়াট্রিস্ট। মিস্টার সুদর্শন রায় আমার পেশেন্ট। গতবছর, শীতের সময়, ইনি আপনাদের কেয়ারে কিছুদিন ছিলেন। এখন এঁর ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে আপনাদের একটু কোঅপারেশান দরকার—যেমন, প্রথমে মিস্টার রায়কে নিয়ে এই গোটা বিল্ডিংটা আমি একবার ঘুরে দেখতে চাই। তারপর—।’
ডক্টর সমাদ্দারকে বাধা দিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘এক্সকিউজ মি, এখানে ডক্টর শঙ্করদাস গিরি নামে কেউ আছেন?’
‘শঙ্কর-দাস-গিরি?’ নামটা আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করলেন ভদ্রলোক। তারপর বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন।
পরক্ষণেই সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন বেয়ারা দরজায় এসে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে একচক্ষু ভদ্রলোক আদেশ করলেন, ‘ভাটিয়াসাব কো সেলাম দো—।’
মিনিটকয়েক নীরবতার পর বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। বারদুয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একচক্ষু ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার, মিস্টার মহাজন?’
‘আসুন, মিস্টার ভাটিয়া।’ ইশারায় তাঁকে চেয়ারে বসতে বললেন মহাজন: ‘এঁরা জানতে চাইছেন শঙ্করদাস গিরির কথা। আমি তো এখানে নতুন, তাই ভাবলাম, খবরটা আপনিই ভালো দিতে পারবেন।’
ভাটিয়া চেয়ারে বসলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘দেখুন, ডক্টর শঙ্করদাস গিরির ব্যাপারটা একটু মিস্টিরিয়াস। মাসছয়েক আগে, গত শীতে, হঠাৎই একদিন তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বহু চেষ্টা করেও তাঁর কোনও খবর আমরা পাইনি।’
আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেন আচমকা গা-ঝাড়া দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করল। শরীরে রক্তের চাপ হঠাৎ বেড়ে ওঠায় ভাটিয়ার আর কোনও কথা আমার কানে ঢুকল না। শুধু শঙ্করদাস গিরির নিখোঁজ হওয়ার খবরটা আমার মাথার ভেতরে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল।
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘বি স্টেডি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
নিজেকে সামলে নিয়ে দেখি ভাটিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। মহাজন আমাদের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে। ডক্টর সমাদ্দার তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। দুশমনও উঠে পড়ল।
ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ডক্টর সমাদ্দার মহাজনকে জানালেন তাঁর খুব বেশি হলে আধঘণ্টা সময় লাগবে।
করিডর ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। এক-এক পা এগোচ্ছি আর আমার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার কিন্তু নির্বিকার। দুশমনও নীরবে তার প্রভুকে অনুসরণ করে চলেছে।
মিনিটতিনেক হাঁটার পর চোখে পড়ল, আর-একটা করিডর আড়াআড়িভাবে প্রথম করিডরকে কেটে এগিয়ে গেছে। সেই চৌরাস্তায় পৌঁছে আমি একবার ডানদিকে এবং বাঁ-দিকে তাকালাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ডানদিকে এগোলাম। ডক্টর সমাদ্দারও আমাকে অনুসরণ করলেন।
কয়েক পা যেতেই বাঁ-দিকে একটা খোলা দরজা আমার নজরে পড়ল। দরজা পেরোতেই একটা বিশাল ঘর। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সাজানো রয়েছে সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে বিভিন্ন বয়েসের পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে খানিকটা করে ঢাকা। দেখে তাদের অসুস্থ বলেই মনে হচ্ছে।
বিশাল ঘরটার ডানকোণে একটা ছোট দরজা দেখে আমি একটুও অবাক হলাম না। কারণ, এখন বুঝতে পারছি, এরপর কোন-কোন দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ছোট দরজা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। পেছনে অম্বিকা সমাদ্দার ও দুশমন।
ছোট দরজায় দাঁড়িয়ে আমার আর ডক্টর সমাদ্দারের চোখাচোখি হল। কারণ, দরজা পেরিয়েই একটা ছোট ঘর। সেই ঘরের ডানদিকে রয়েছে আর-একটা দরজা, আর দরজার পরে দেওয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে একটা ধবধবে সাদা বেসিন। সেটা জলে টইটম্বুর। কল থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল টপটপ করে বেসিনে পড়ছে। বেসিনের বাঁ-পাশে ছোট তাকে একটা সাবান রয়েছে: তার রং নীল—সাদা নয়।
এবার আমি সম্মোহিতের মতো ডানদিকের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকালাম না। কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলাম ডক্টর সমাদ্দারের ভারী বুটের শব্দ।
সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেটার শেষ প্রান্তে একটা খাটে দরজা। ধরজাটা ভেজানো ছিল, আমি সেটা খুলে বাইরের অন্ধকার খোলা মাঠে পা রাখলাম।
অন্ধকারের মধ্যেই দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি অক্লান্ত পায়ে হেঁটে চললাম। গন্তব্যস্থল কোথায় জানি না।
হঠাৎই পায়ের কাছে একটা আলোর বৃত্ত দেখে চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে দেখি ডক্টর সমাদ্দার পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বেলেছেন। এই ঘন অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলা দুশমনকে স্পষ্টভাবে নজরে পড়ছে না।
আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বলে উঠলেন অম্বিকা সমাদ্দার, ‘মিস্টার রায়, একমিনিট। আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আপনার স্বপ্নের সঙ্গে এইসব মিলে যাচ্ছে?’
আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা ঝাঁকালাম।
ডক্টর সমাদ্দার থমকে দাঁড়ালেন। আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম তাঁর মুখোমুখি।
‘আমার মনে হয়, আপনার অন্য স্বপ্নগুলের মতো এটাও আপনার কল্পনা। শুধু এই হোমের পটভূমি আপনার কল্পনাকে স্বপ্নে গড়ে তুলতে হেলপ করেছে, তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং, আমার মনে হয়, আর সময় নষ্ট না করে আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো। বাড়ি ফিরে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করুন, ঘুরে বেড়ান, দেখবেন দু-দিনেই ওই নাইটমেয়ার কোথায় মিলিয়ে গেছে। সো, লেটস গো ব্যাক—।’
ডক্টর সমাদ্দার ঘুরে দাঁড়াতেই আমি চাপা গলায় বলে উঠলাম, ‘নো ডক্টর, নেভার। আমি এর শেষ দেখতে চাই।’
অন্ধকারে সমাদ্দারের অভিব্যক্তি আমার নজরে পড়ল না। শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘শেষ মানে? ও. কে.—অ্যাজ ইউ উইশ। কাম অন, দুশমন—।’
আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।
আচ্ছন্নের মতো চলতে-চলতে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভিজে হাওয়ার ঝাপটা আমার চোখে-মুখে ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে চেয়ে দেখি কয়েকটা বড়-বড় গাছ: কী গাছ জানি না। তারই মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পায়ের কাছে টর্চের আলোর বৃত্তে নজরে পড়ল ঘাসে ছাওয়া মাটি।
আমাকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অম্বিকা সমাদ্দার কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দুশমনের চাপা হিংস্র গর্জন তাঁকে থামিয়ে দিল। দুশমন আমাদের ছাড়িয়ে চট করে কিছুটা এগিয়ে গেল। ছটফটে পায়ে ফাঁকা জায়গাটাতে পায়চারি করতে লাগল।
আমার বুকের ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা যেন পাকে-পাকে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে।
দুশমনের গর্জন একটু জোরালো হল। অন্ধকারে ওর আবছায়া শরীরটা ঘাস-ছাওয়া জমিতে নড়াচড়া করছে।
কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম নড়াচড়া নয়, দুশমন প্রাণপণে মাটি আঁচড়াচ্ছে।
ডক্টর সমাদ্দারের টর্চ-ধরা হাত কেঁপে উঠল। তারপর গিয়ে স্থির হল দুশমনের কালো বিশাল শরীরের ওপরে। ওর তীক্ষ্ন থাবার আঁচড়ে ওপরের ঘাস ছিঁড়ে নীচের মাটি ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে।
মাত্র কয়েকমিনিট। তারপরই যে-দৃশ্য দুশমন দেখাল, তাতে আমি অবাক না হলেও ডক্টর সমাদ্দার চমকে উঠলেন। তাঁর মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। গর্জন করে উঠল দুশমন। আমি নিশ্চুপ, নিথর। ডক্টর সমাদ্দারের টর্চের আলো খাবলানো মাটির ওপরে থরথর করে কাঁপছে। তবুও দেখতে আমাদের কোনও অসুবিধে হল না। স্পষ্ট দেখলাম, সামান্য খোঁড়া মাটি থেকে বেরিয়ে রয়েছে পচে যাওয়া একটা হাত। সে-হাতের কোনও-কোনও জায়গায় সাদা হাড়ের আভাস নজরে পড়ছে। আর সেই বিধ্বস্ত হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ময়লা সাদা সাবান।
অমানুষিক হাত (নভেলেট)
সকলে মিলিয়া বাসর জাগিতেছিলাম।
এই বাসর-জাগরণ অনুষ্ঠানে আমার মতো পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের সম্ভবত স্থান হইবার কথা নহে, কিন্তু বরপক্ষের একান্ত অনুরোধ ও দলবদ্ধ আড্ডার প্রতি আমার অনমনীয় আকর্ষণ এড়াইতে পারি নাই। বরপক্ষের একান্ত অনুরোধের একটি বিশেষ কারণ ছিল। কীরূপে যেন তাহারা জানিতে পারিয়াছিল আমার কণ্ঠসঙ্গীত তাবৎ কোকিল জাতিকে নিমেষে ব্রীড়াময় করিয়া তুলতে পারে। যদিও আমার স্ত্রী মালতী ওই মতের ঘোরতর বিরোধী, তবুও বাহিরের অভ্যাগতদের সম্মুখে নিজের স্বামীর প্রশংসা শুনিয়া সর্বসমক্ষে তাহার মত আর জাহির করে নাই। পরিবর্তে আমার কানের নিকটে মুখ লইয়া আসিয়া বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে এই কথা কয়টি উচ্চারণ করিয়া দ্রুতগতিতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছে।
বিবাহ আমার কনিষ্ঠা শ্যালিকা মাধবীর। অন্যান্য তিন শ্যালিকা অপ্রত্যাশিত তৎপরতায় নিজ-নিজ স্বামীগৃহে রিজার্ভেশন পাইলেও মাধবীকে তিনটি বৎসর ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখাইয়া রাখিতে হইয়াছিল। অবশেষে প্রজাপতির নির্বন্ধে ও মাধবীর পিতা-মাতার অনলস প্রচেষ্টায় কলিকাতা হইতে এই যমুনাপুর নামক অজ পাড়াগাঁয়ে ইঞ্জিনিয়ার পাত্র শ্রীমান চন্দ্রমোহন বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে এই ঘোরতর শীতকালে হ্যাজাক লন্ডনের আলোয় বিবাহকার্য সুসম্পন্ন করিতে আসিয়াছে।
এখন রাত্রি প্রায় বারোটা। অতএব বিবাহ এবং নিমন্ত্রণের পাট শেষ করিয়া সকলেই শয্যাভিমুখী হইয়াছে। বরযাত্রীদের অন্য বাড়িতে শয়নের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল–কেবলমাত্র চন্দ্রমোহনের তিন বন্ধু ও জনৈক আত্মীয় বিশ্বনাথবাবু বাসর-ঘরে চন্দ্রমোহনকে সঙ্গ দিতে থাকিয়া গিয়াছেন। কন্যাপক্ষের একমাত্র পুরুষ প্রতিনিধি আমি স্বয়ং, ইহা ছাড়া যে কয়েকজন বালিকা, কিশোরী ও তরুণী ঘরে উপস্থিত, তাহারা মৌমাছির ন্যায় মধুভাগুরূপ মাধবীকে ঘিরিয়া নানান জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত। কেবল মধ্যে-মধ্যে তাহাদের হাস্যরোল ও কলগুঞ্জন কানে আসিতেছে।
চন্দ্রমোহন ও তাহার তিন বন্ধু আমার সহিত অনেক গল্প করিলেও বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ করিলাম একেবারে নিশ্চুপ। শুধু প্রয়োজনমতো আমাদের বক্তব্য সমর্থন করিতেছেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় আমারই সমান। শান্ত দুইটি চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখে এক অদ্ভুত প্রচ্ছন্ন দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞার ছাপ। জুলপির চুলে বোধ করি তাঁহার অজ্ঞাতসারে পাক ধরিয়াছে। পরনের ধুতি পাঞ্জাবিকে বেষ্টন করিয়া সাদা রঙের লোভনীয় কাশ্মীরি শাল। অভিব্যক্তিতে অস্বস্তি ও বিষণ্ণতা আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুদের সহিত বিশ্বনাথবাবুকে আমি ঠিক মিলাইতে পারিতেছি না। যেন সিঁড়ি-ভাঙা কোনও সরল অঙ্কের উত্তর বারংবার ভুল হইয়া যাইতেছে।
আমার কৌতূহলী দৃষ্টি ও দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব সম্ভবত চন্দ্রমোহনের দৃষ্টি এড়ায় নাই। সুতরাং উপযাচক হইয়া সে আমাকে বিশ্বনাথবাবুর পরিচয় দিল। কহিল, সমীরদা, বিশ্বনাথদা আমার পিসতুতো ভাই–বলতে গেলে এক মহাপুরুষ। সারা ভারতের আনাচেকানাচে বহু ঘুরেছেন। ওঁর ঝুলিতে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। তা ছাড়া খুব ভালো হাত দেখতে জানেন…।
উত্তরে বিশ্বনাথবাবু মাথা নীচু করিয়া সলজ্জ হাসিলেন। মৃদু কণ্ঠে বলিলেন, তেমন কিছুই না, বই পড়ে শেখা বিদ্যে–
ভদ্রতাবশে আমার ডান হাতটি তাঁহার সম্মুখে বাড়াইয়া দিলাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া তিনি আলোয়ানের ফাঁক হইতে নিজের ডান হাতখানি সামান্য বাহির করিলেন। আমার হাত টানিয়া লইয়া তাহাতে মনোনিবেশ করিলেন। অতঃপর চশমাটি ঈষৎ বিন্যস্ত করিয়া বলিলেন, আপনার ভাগ্যরেখা খুব ভালো। সচরাচর দেখা যায় না।
অনুভব করিলাম, বিশ্বনাথবাবুর হাতটি অত্যন্ত কর্কশ। অনুমান হয়, তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ। তাহার কথার জবাবে কহিলাম, সে তো নিশ্চয়ই, নইলে মালতীর মতো বউ পেয়েছি!
চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা হাসিয়া উঠিল। বিশ্বনাথবাবু আরও যোগ করিলেন, আপনার যশ-রেখাও ফ্যালনা নয়।
চন্দ্রমোহন কহিল, তাও তো হ্যাঁজাকের আলোয় ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ইলেকট্রিকের আলোয় আরও জোরদার দেখাত।
চন্দ্রমোহনের এক বন্ধু, অবিনাশ, আক্রমণাত্মক সুরে কহিল, দাদা, আর ছাড়ছি না। নিন, শুরু করুন। একটা অভাবনীয় সংগীতের মূর্ঘনায় আমাদের মূর্ছা ঘটিয়ে বিশ্বনাথদাকে প্রমাণ দিন যে আপনার যশ-রেখা সত্যিই জোরদার।
ব্যস, এইটুকুই যথেষ্ট। অতএব সকলের পীড়াপীড়িতে গান ধরিলাম ।
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান…।
বান যখন মধ্যপথে, তাহাকে বাধা দিল মালতী। লক্ষই করি নাই, কখন সে দরজার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এক্ষণে তাহার দশম বর্ষীয়া একমাত্র কন্যাসহ ঘুমাইয়া পড়িবার কথা। অতএব চন্দ্রমোহন যখন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিল, তখন স্বভাবতই অবাক হইলাম। গান থামিল। সকলের দৃষ্টিতেই নীরব প্রশ্ন ফুটিয়া উঠিল। মালতী সমস্ত কিছু উপেক্ষা করিয়া মৃদু কণ্ঠে আমাকে ডাকিল, একটু শুনবে?
আদেশ নীরবে পালন করিলাম। আমি নিকটে আসিলে সে ফিশফিশ করিয়া কহিল, আমার সীতাহারটা খুঁজে পাচ্ছি না!
লক্ষ করিলাম, তাহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। স্বাভাবিক। কারণ সীতাহারটি একাধারে আমাদের বিবাহের যৌতুক, মালতীর মাতৃবংশের ঐতিহ্যবাহী এবং সাড়ে নয় ভরি সোনায় তৈয়ারি। সর্বোপরি, উহা যে পুনরায় গড়াইয়া দেওয়া আমার ন্যায় চাকুরিজীবীর পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব, ইহা মালতী ও আমি উভয়েই সবিশেষ জানি।
প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, কন্যাকে ঘুম পাড়াইয়া সে যখন নিত্যকার অভ্যাসমতো শয়নের আগে কানের দুলজোড়া খুলিয়া আলমারিতে রাখিতে যায়, তখনই সবিস্ময়ে লক্ষ করে যে, সীতাহারটি যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। বিস্ময়ের কারণ, আলমারি সর্বদাই চাবিবন্ধ থাকে, এবং খুলিবার সময় মালতীকেও চাবি ব্যবহার করিতে হইয়াছে। বন্ধ আলমারি হইতে হার চুরি! এ ঘটনা যেমন অভিনব, তেমনই আশঙ্কাজনক। আলমারিতে টাকাপয়সাও ছিল, কিন্তু তাহাতে হাত পড়ে নাই।
আমাদের দুজনের নিম্নই আলোচনা যখন অপর সকলের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইবার মতো যথেষ্ট হইয়াছে, এবং আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সর্বশেষ সীমায় পৌঁছিয়াছি, তখন চন্দ্রমোহন প্রশ্ন করিল, কী হয়েছে, দাদা?
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া পড়িলাম। এই ঘটনা ব্যক্ত করিয়া বর ও বরযাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত করিয়া লাভ কী? কিন্তু সীতাহার-শোকে বিহ্বলা মালতী নিজেকে সংবরণ করিতে পারিল না। প্রায় কঁদো কঁদো হইয়া কহিল, দ্যাখো না ভাই, আলমারি থেকে আমার বিয়েতে পাওয়া সাড়ে নভরির সীতাহারটা চুরি গেছে। অথচ আলমারিটা তালাবন্ধ ছিল। তা ছাড়া, ঘণ্টাখানেক আগেও হারটা আমি দেখেছি।
ঘরে যেন বজ্রপাত হইল। সকলের মনোযোগ মুহূর্তে আকৃষ্ট হইল মালতীর দিকে। হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোছায়ায় সকলেরই মুখমণ্ডলে ত্রাস ও বিস্ময়ের লুকোচুরি খেলা।
চন্দ্রমোহন হঠাৎই অস্বাভাবিক গম্ভীর স্বরে বলিল, বিশ্বনাথদা–।
বিশ্বনাথবাবু মুখ তুলিলেন। তাহার বিষণ্ণ মুখমণ্ডলে জটিল চিন্তার অসংখ্য রেখা। যেন ম্লান হ্রদের জলে মাছ-ধরা জাল বিছানো রহিয়াছে। তিনি চন্দ্রমোহনের সম্বোধনের কোনও জবাব দিলেন না। বরং পালটা প্রশ্ন করিলেন, আমি কি এই ঘর ছেড়ে এর মধ্যে বেরিয়েছিলাম?
একটু আগে বাথরুমে গেলে না?
ও..হ্যাঁ…। বিশ্বনাথবাবু স্বস্তির সুরে কহিলেন, ঠিকই বলেছিস, চাঁদু, আমার খেয়াল ছিল ।
কথা শেষ করিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
আমাদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছিল। চন্দ্রমোহন ও বিশ্বনাথবাবুর কথোপকথন কেমন অদ্ভুত হেঁয়ালি মিশ্রিত, রহস্যময়।
রহস্যের গভীরতা দ্বিগুণ করিয়া বিশ্বনাথবাবু আমার স্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। হয়তো হারটা খুঁজে বের করে দিতে পারব।
মালতীকে লইয়া ঘর ছাড়িবার পূর্বে বিশ্বনাথবাবু আমাকে প্রশ্ন করিলেন, এখানে কাছাকাছি কোথাও পুকুর আছে?
আমি বললাম, বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা ছোট ডোবা আছে।
যাক, তা হলে বেশি দূর যেতে হবে না। এই কথা বলিয়া বিশ্বনাথবাবু আমার স্ত্রী-কে একটি টর্চ বা লণ্ঠন আনিতে অনুরোধ করিলেন।
মালতী টর্চ লইয়া আসিলে অপর একজন মহিলা সঙ্গীসহ তাহারা দুইজন সীতাহার অনুসন্ধানের কাজে নিষ্ক্রান্ত হইল।
আমি যৎপরোনাস্তি হতভম্ব হইয়া চন্দ্রমোহনের নিকটে আসিয়া পুনরায় আসন গ্রহণ করিলাম। লক্ষ করিলাম, চন্দ্রমোহনের মুখভাবে অপরাধবোধের ছায়া। সে মাথা নীচু করিয়া নীরবে হাতের নখ খুঁটিতেছে। তাহার বন্ধুরা অপ্রস্তুত হইয়া পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। মাধবীকে ঘিরিয়া যে-মধুমক্ষিকার গুঞ্জন শুরু হইয়াছিল, তাহাও এখন স্তব্ধ। সীতাহার-দুর্ঘটনা কম-বেশি সকলকেই আঘাত করিয়াছে।
মিনিট কুড়ি পরে বিশ্বনাথবাবু ফিরিলেন। সঙ্গে মালতী। তাহাকে দেখিয়াই বুঝা যায় অভিযান সফল হইয়াছে। বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ করিয়া সে কহিল, আপনি হাত-পা ধুয়ে নিন। বাথরুমের দেওয়ালের দড়িতে গামছা টাঙানো আছে।
বিশ্বনাথবাবু দরজার নিকট হইতে চন্দ্রমোহনকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, হারটা পাওয়া গেছে, চাঁদু। পুকুরপাড়েই ছিল। আমি হাত-পা ধুয়ে আসছি। তিনি বাথরুম অভিমুখে রওনা হইলেন।
আমি উঠিয়া মালতীর নিকটে আসিলাম। সে অস্ফুট কণ্ঠে যাহা বিবৃত করিল তাহার সারমর্ম এই : টর্চ হাতে করিয়া বিশ্বনাথবাবুই পুকুরপাড়ের সর্বত্র অনুসন্ধান করিয়াছেন। মালতী অত্যন্ত সাহসী। সুতরাং এক মুহূর্তের জন্যও সে ভয় পায় নাই। কিছুক্ষণ অনুসন্ধানের পর একস্থানের মাটি যথেষ্ট আলগা বলিয়া মনে হওয়ায় মালতীর হাতে টর্চ দিয়া বিশ্বনাথবাবু স্বয়ং মাটি খুঁড়িতে শুরু করেন। আপনমনে শুধু একবার উচ্চারণ করেন, জানতাম, এখানেই এনে লুকোবে।
অতঃপর অল্প সময়ের মধ্যেই সীতাহার স্বমহিমায় প্রকাশিত হইয়া পড়ে এবং তাহারা ফিরিয়া আসে।
এমন সময়, যাঁহাকে লইয়া আলোচনা, তিনি উপস্থিত হইলেন। বিশ্বনাথবাবুকে দেখিয়া সকলের কৌতূহল সীমা ছাড়াইবার উপক্রম করিল। মালতী চলিয়া যাইতেছিল, বিশ্বনাথবাবু তাহাকে ডাকিলেন, গম্ভীর স্বরে কহিলেন, মালতীদেবী, যাবেন না। আসুন, এ-ঘরে বসুনকথা আছে।
তাহার স্বরে এমন কোনও প্রচ্ছন্ন জাদু ছিল, যাহাতে মালতী নীরবে সেই আদেশ পালন করিল। আমিও ঘরে আসিয়া বসিলাম। বিশ্বনাথবাবু আমার নিকটে বসিলেন। দেখিলাম, তাহার ধবধবে ধুতির শরীরে কাদার ইতস্তত কলঙ্ক লাগিয়াছে। কাশ্মীরি শালটিও পুরাপুরি রক্ষা পায় নাই। যে নীরব প্রশ্ন ও কৌতূহল আমি এ পর্যন্ত সকলের দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, সম্ভবত তাহা বিশ্বনাথবাবুর নজরে পড়িল। তিনি উপস্থিত সকলের মুখের উপর পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া হঠাৎই মালতীকে লক্ষ করিয়া বলিলেন, মালতীদেবী, হারটা যে আপনি পেয়েছেন, সবাইকে দেখান।
বিস্মিত মালতী শাড়ির আঁচল খুলিয়া হারটি বাহির করিল এবং ঘরে উপস্থিত সকলের নিকট দৃশ্যমান হয় এমনভাবে উহা তুলিয়া ধরিল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হ্যাঁজাকের ছায়া-পরিম্নান আলোয় বিদ্ধ হইয়া সীতাহারটি ঝকমক করিয়া উঠিল।
মালতী হারটি পুনরায় যথাস্থানে বাঁধিয়া রাখিলে বিশ্বনাথবাবু কহিলেন, সমীরবাবু, একমাত্র চঁদুর সম্মান রক্ষার জন্যেই মালতীদেবীকে সীতাহারটা সকলকে দেখাতে অনুরোধ করলাম। তা ছাড়া, এই হার চুরিতে, আর বিশেষ করে তার উদ্ধারে, আপনারা সবাই যে ভীষণ অবাক হয়েছেন, তা বেশ বুঝতে পারছি। বিশ্বনাথবাবু একটু থামিলেন। চন্দ্রমোহনকে কিয়ঙ্কাল নিরীক্ষণ করিলেন। তাহার মুখমণ্ডলে এখন সামান্য স্বস্তির আভাস পাওয়া যাইতেছে। সে নতুন বর, ফলে তাহার সঙ্কট ও লজ্জা সর্বাপেক্ষা অধিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন সেই সঙ্কট ও লজ্জার মেঘ অদৃশ্য হইয়া চতুর্দশীর চাঁদ স্বস্তির ইঙ্গিত বহন করিয়া প্রকাশিত হইয়াছে। বিশ্বনাথবাবু আমাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, এই চুরি ও তার বিচিত্র আবিষ্কারের পেছনে আরও বিচিত্র এক কাহিনি আছে। কখনও সে কাহিনি কাউকে বলিনি। কিন্তু আজ বলব। কারণ, এর আগে কখনও আজকের মতো এমন অসম্মানজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। আপনারা বরপক্ষের লোকদের চোর ভেবে বসে থাকবেন, এটা চাদুর পক্ষে খুব একটা সম্মানের নয়।
আমি তাহার কথার প্রতিবাদে সৌজন্যমূলক কিছু একটা বলিতে মুখ খুলিতেই বিশ্বনাথবাবু বাধা দিলেন, বিব্রত হওয়ার কিছু নেই, সমীরবাবু। যা সত্যি, তাই বলছি। একটু আগেই চাঁদু বলছিল, আমি নাকি এক মহাপুরুষ– বিশ্বনাথবাবু হাসিলেন, পুনরায় কহিতে লাগিলেন, তা মহাপুরুষ আমি না হতে পারি, কিন্তু ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ঘুরে বহু মহাপুরুষের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি।
বর্তমানে আমি লোহার ব্যাবসা করলেও বছর কয়েক আগে পর্যন্ত কাঠ নিয়েই ছিল আমার কারবার। তখন আমি চাকরি করতাম–আধা-সরকারি চাকরি বলতে পারেন। সরকারের ইজারা নেওয়া বিভিন্ন জঙ্গলে যখন গাছ কাটা হত, তখন আমি তদারকিতে থাকতাম। আর এই কাজেই আমাকে দেশের আনাচেকানাচে গিয়ে ডেরা বাঁধতে হয়েছে।
বছর তিনেক আগে ঝাড়গ্রামে আমাকে যেতে হয় অফিসের কাজে। সেখানে তখন শালগাছ কাটার মরশুম চলছে। ফলে অফিসের কাজ শেষ হতেই আমার কাঁধে তুলে দেওয়া হল পুরোনো দায়িত্ব। অর্থাৎ, জঙ্গলে গিয়ে গাছ কাটার সময় তদারকির কাজ করতে হবে। কর্তার ইচ্ছা, অতএব কর্ম না করে উপায় নেই। উপস্থিত হলাম গিয়ে জঙ্গলের তাঁবুতে। যে-অফিসারটি সরেজমিনে ছিলেন, আমাকে দেখেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সব দায়-দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়ে সোজা রওনা হলেন দেশে। কালই নাকি চিঠি এসেছে, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী হাসপাতালে ভরতি হয়েছেন। ফলে আমি পড়লাম ফ্যাসাদে। তখনও বুঝিনি, কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে।
তাঁবুতে ক্যাম্বিসের খাট, বিছানা, ছোট টেবিল, হ্যারিকেন, পথ-ভুলে-চলে-আসা শেয়াল বা হায়েনার জন্যে শক্তপোক্ত লাঠি–সবকিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে দেখলাম। আমি বাউণ্ডুলে ব্যাচিলার মানুষ–কোনও অবস্থাকেই আর ভয় পাই না। সুতরাং তাঁবু আমার কাছে রাজবাড়ি বলে মনে হল। দেখলাম, ঝাড়গ্রামের প্রচণ্ড মশাকে প্রতিরোধ করার জন্যে একটা মশারির ব্যবস্থাও রয়েছে। আর কী চাই!
বিশ্বনাথবাবু এক মুহূর্ত থামিলেন। ঘড়ি দেখিলাম, রাত দেড়টা। চন্দ্রমোহন তাঁহার নিকট অনুমতি লইয়া একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিল। দেখাদেখি অবিনাশও তাহার অনুসরণ করিল। বিশ্বনাথবাবু ধূমপানের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখান করিয়া পুনরায় বলিতে শুরু করিলেন, যে-ছেলেটা তাঁবুতে আমার ফাইফরমাশ খাটত, সে ছিল স্থানীয় আদিবাসী। নাম ঝুমনা। বয়েস বছর ষোলো। কালো তেলতেলে রোগা চেহারা। কর্মঠ এবং চটপটে। জঙ্গলে যারা গাছ কাটে তারাও ওই আদিবাসী দলেরই, এবং তাদেরই একজনের–পরে জেনেছি, তার নাম রমেশকীরকম যেন আত্মীয় হয় ছেলেটা। সুতরাং ঝুমনা আমার কাছে যেন দেবদূত হয়ে দেখা দিল। ওপরওয়ালার অযাচিত আশীর্বাদ।
এহেন কর্মে সুপটু ছেলেটার একটা খারাপ অভ্যেস ক্রমে ক্রমে ধরা পড়তে শুরু করল। আমার গলায় একটা বিছেহার সব সময় পরা থাকত–শুধু রাতে ওটা আমি খুলে রাখতাম গলায় ফুটত বলে। একদিন সকালে বিছানা ছেড়ে রোজকার অভ্যেসমতো হাত বাড়িয়েছি পাশের ছোট টেবিলটার দিকে–এবং বিছেহারটা না পেয়ে চমকে উঠেছি। চমকে ওঠার দুটো কারণ আছে : এক, হারটা সোনার। দুই, ঝাড়গ্রামের মতো এই সঙ্গীবর্জিত নির্জন গ্রামে এসে কলকাতার মতো শহুরে চোরের উৎপাত পাব, আশা করিনি। অবাক হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়টা কেটে যেতেই মনে স্বাভাবিক প্রশ্নটা জেগেছে : কে চুরি করল হারটা? ঝুমনা? বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু পরিস্থিতি নিরুপায়। সুতরাং ওকে ডেকে সরাসরি হারটার কথা জিগ্যেস করলাম, এবং ও যথারীতি উচ্চস্বরে জটিল ভাষায় জানাল, হারটার কথা ও কিছুই জানে না। আমাকে তখন চুপ করে যেতে হল। কারণ, কোনও প্রমাণ আমার হাতে নেই।
সেইদিনই গাছ ফেলার সময় রমেশের কানে আমি কথাটা তুললাম। ও কিন্তু আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী বিস্মিত হল না, বরং বিড়বিড় করে বলল, ও কি চুরি করছ্যা? কু-দেবতা ভর করছ্যা বটে!… এরপর ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল।
দ্বিতীয় চুরিটা হল দিন চারেক পরেই। এবারের শিকার পাঞ্জাবির সোনার গিলটি করা বোতাম। ঘটনা ও পরিণতি প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি–এতটুকু তফাত নেই। কিন্তু এরপর থেকে আমি সতর্ক হলাম। ছেলেটাকে যথাসম্ভব চোখে-চোখে রাখতে শুরু করলাম। রসুল নামে যে আরদালিটি কাগজপত্র নিয়ে প্রতিদিন জঙ্গল-আপিস করত, সে একদিন আমাকে জানাল যে, আগের যে-বাবু ছিলেন, তারও নাকি একটা আংটি চুরি গিয়েছিল–কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। রসুল আরও বলল, বাবু, জেনে রাখবেন, এ ওই ঝুমনা ছোকরারই কাজ।…দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমাকে মনে-মনে রসুলের কথায় সায় দিতে হল। এমনিতে এই আদিবাসী লোকগুলো খুব সৎ, সাদামাঠা আর সরল। শিক্ষাদীক্ষা ও সভ্যতার বিষ এখনও ওদের ছোবল দিতে পারেনি। কিন্তু তারই মাঝে আশ্চর্য ব্যতিক্রম এই কিশোর।
তৃতীয় চুরির সময় ঝুমনা হাতেনাতে ধরা পড়ল। আমিই ধরলাম। সকালে উঠে হাত-মুখ ধুতে তাঁবুর বাইরে বেরিয়েছিলাম। ফিরে গিয়ে দেখি আচমকা আমার সামনাসামনি পড়ে গিয়ে ঝুমনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে। যেন এক পাথরের মূর্তি। ওর একটা হাত তখনও আমার বালিশের তলায় ঢোকানো। অর্থাৎ, কীভাবে ও জানতে পেরেছে আমার হাতঘড়িটা বালিশের তলায় রেখেই আমি শুয়ে থাকি, এবং সেটা সরানোর সুযোগ পেয়ে বিন্দুমাত্রও দেরি করেনি।
আমাকে দেখেই ও সরাসরি ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার পায়ে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। চিৎকার করে বলতে লাগল, হাই বাবু, গড় করি, মোকে ছেঁড়া দে! ই কাজ আর হবেক লাই! আর হবেক লাই! বিশ্বাস কর, এ মোর দোষ লয়! কু-দেবতা আছে বটে!.. কিন্তু আমি ওকে আর ক্ষমা করতে পারি না। বিশেষ করে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরে। তা ছাড়া ওর কু-দেবতার কথা আমার বিশ্বাস হয় না। নির্ঘাত নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই ছেলেটা ওই কু-দেবতার ধুয়ো ধরেছে। সুতরাং যা করণীয় তাই করলাম…।
বিশ্বনাথবাবু থামিলেন। লক্ষ করিলাম, ইত্যবসরে মাধবীর জনপ্রিয়তা যথেষ্টই ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। তাহার গুণমুগ্ধ সকলেই, বয়সের সীমারেখা নির্বিচারে, বিশ্বনাথবাবু, অথবা তাঁহার কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে নববধূ মাধবীকেও বিশেষ বিচলিত বলিয়া বোধ হইল না, কারণ সেও বর্তমানে একই কাহিনি-স্রোতে অতি-মনোযোগে সন্তরণশীল।
আমি বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, ছেলেটাকে কী করলেন? পুলিশে দিলেন?
না, পুলিশে নয়–দিলাম ওদের সর্দারের হাতে। বিশ্বনাথবাবু উত্তর দিলেন, জঙ্গলে যেসব আদিবাসীরা গাছ কাটে, ওদের টাকাপয়সা কাজিয়া সব কিছুর সমাধান করে দেয় ওদের সর্দার বিজয় কাহার। বিজয় কাহারের বয়েস পঞ্চান্ন-ষাট হবে। মাথায় যেকটা চুল আছে সবই সাদা। পেটানেনা সমর্থ চেহারা বয়েস অনুমানে ভুল করিয়ে দিতে চায়। ঝুমনাকে নিয়ে আমি তার হাতেই তুলে দিলাম। একে-একে বললাম, হার, বোতাম ও ঘড়ি চুরির চেষ্টার কথা। বিজয় আমাকে তাঁবুতে ফিরে যেতে বলল। বলল, ছেলেটার ঘাড় থেকে ও ভূত নামিয়ে ছাড়বে। আমি তাবুতে ফিরে এলাম। মনে-মনে ঝুমনার জন্যে একটু যে কষ্ট হল না, তা নয়। কে জানে, ওরা বেচারা ছেলেটাকে কী শাস্তি দেবে!
তাঁবুতে ফিরে এসে বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করলাম। আমার অনেক সাধের ঘড়ি। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবা কিনে দিয়েছিলেন। রোল্ডগোল্ডের কেস, সঙ্গে সুদৃশ্য বাদামি চামড়ার ব্যান্ড। সুইজারল্যান্ডে তৈরি বিদেশি ঘড়ি। পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ইচ্ছে করলে ওটাতে অ্যালার্ম বাজানোর ব্যবস্থা করা যায়। এমনি দামের চেয়েও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ওটার দাম আমার কাছে অনেক বেশি। কারণ, ঘড়িটা আমাকে উপহার দেওয়ার মাস তিনেক পরেই থ্রম্বসিসে বাবা মারা যান। ঘড়ি নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতেই বাতাস কেটে আছড়ে পড়া চাবুকের প্রথম সপাং শব্দটা আমার কানে এল।
ঝুমনার শাস্তি শুরু হয়েছে। পরপর শোনা যাচ্ছে চাবুকের শব্দ ও পরক্ষণেই ঝুমনার কিশোর কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সে-চিৎকার অমানুষিক। শত হলেও বিজয় সর্দারের এই শাস্তি বরদাস্ত করা যায় না। ঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে বেরিয়ে এলাম তাঁবুর বাইরে। শব্দ ও চিৎকার লক্ষ করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললাম। পায়ের তলায় শুকনো শালপাতার পাঁজর ভাঙার শব্দ আমাকে এতটুকু অমনোযোগী করতে পারল না। অসংখ্য শালগাছের গোলকধাঁধা পার হয়ে অবশেষে ঘটনাস্থলে পৌঁছোলাম।
সম্প্রতি গাছ কাটার ফলে পরিষ্কার হয়েছে এমন একটা জায়গায় সব আদিবাসীরা জটলা করে দাঁড়িয়ে। ওরা পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় চাপা গলায় কীসব বলাবলি করছে। একজন আদিবাসী একটা শালগাছের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তার হাতে লম্বা সরু একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি। এটাকেই আমি চাবুক ভেবেছিলাম। আর সেই শালগাছের গোড়ায় গাছের গুঁড়িকে বেড় দিয়ে ঝুমনার দু-হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। কাছেই দাঁড়িয়ে বিজয় কাহার। সে চিৎকার করে এক-একটা সংখ্যা গুনছে আর সপাং করে কঞ্চির বাড়ি গিয়ে পড়ছে ছেলেটার হাতে–যে-হাত দিয়ে ও চুরি করেছে। ঝুমনার হাত কেটে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। মনে হল, হাত দুটো যেন বেশ ফুলেও উঠেছে।
আমি চিৎকার করে বিজয়কে থামতে বললাম। ও চমকে ফিরে তাকাল আমার দিকে। যে আদিবাসীটি বিজয়ের নির্দেশে কঞ্চির আঘাত করছিল, সে-ও থেমে গেল। একবার আমার দিকে একবার বিজয়ের দিকে দেখতে লাগল । অর্থাৎ, সে এখন কী করবে? কার কথা শুনবে? পরক্ষণেই বিজয় ইশারায় তাকে থামতে বলল। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে যা বলল তার সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় ও বাবু, একে আমি একশো বেত মারার শাস্তি দিয়েছিলাম, সবে আঠেরোটা হয়েছে– তাও আস্তে-আস্তে মেরেছে। আর আপনিই এখন শাস্তি দিতে বারণ করছেন? তা হলে ছেলেটার চুরির ব্যারাম সারাব কী করে?…তবুও আমার অনুরোধে বিজয় সর্দার গজগজ করতে করতে ঝুমনাকে ছেড়ে দিল। ওর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। রক্তাক্ত হাত নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল ছেলেটা।
এখানেই এ-কাহিনির শেষ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হল না। কারণ সেইদিনই সন্ধ্যায় সারাদিনের কাজ শেষ করে হিসেবপত্রের পাট চুকিয়ে ক্যাম্পখাটে শরীর এলিয়ে একটা গল্পের বইয়ের পাতায় চোখ বুলোচ্ছি, তাঁবুর দরজায় একটা খসখস শব্দ পেয়ে চমকে তাকালাম। কষ্ট হলেও হ্যারিকেনের আলোয় ঠাহর করতে অসুবিধে হল না। ঝুমনা। সকালের ঘটনার পর এই ওকে প্রথম দেখলাম। ও দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইল, ও ভিতরে আসতে পারে কি না। তারপর অনুমতি পেয়েই ভিতরে এসে সটান আমার পা জড়িয়ে ধরল। কৃতজ্ঞতা জানাল সকালে শাস্তির হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছি বলে। আমার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে ও যা বলল, তাতে বুঝলাম, এর মধ্যেই ওর হাত দুটো ভীষণ ছটফটে অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ওপর যদি হাত দুটোকে মারধোর করা হয়, কাটা-ছেঁড়া করা হয়, তা হলে মরিয়া হয়ে ওরা যে কী করবে বলা মুশকিল।…ওর দু-গাল বেয়ে অঝোরে নেমে এল অশ্রুর ধারা।
হাঁটুতে দু-হাত রেখে ছেলেটা বসেছিল। আমার নজর পড়ল ওর হাত দুটোর দিকে। হ্যারিকেনের আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে দেখলাম। হাত দুটোকে দেখে কোনও বৃদ্ধের বলে মনে হয়। কুৎসিত কদাকার বড়-বড় আঙুলের গাঁট। খসখসে ভাঁজ পড়া চামড়া। নখগুলো মোটা বাঁকানো, তাতে আবার কালচে ছোপ। শিরাগুলো ফুলে উঠে পার্চমেন্ট কাগজের মতো চামড়াকে থেকে-থেকে উঁচু-নীচু করে দিয়েছে। অবশ্য সকালের শাস্তির জন্যেও শিরাগুলো ফুলে উঠতে পারে।
জলভরা চোখ নিয়ে ঝুমনা বলল, এ আমার হাত নয় বাবু। এ আমার শরীরের কেউ লয়। কিন্তু আমার আর কুননা পথও লাই। তোকে তো আগেও বলেছি, অথচ তুই বিশ্বাস করিসনি। তোকে দিব্যি করে বলেছি, এসব চুরি এই হাত দুটো নিজে নিজে করে–আমি জানতেও পারি না।
বলাবাহুল্য, ওর কথা আমার এখনও বিশ্বাস হল না। ওকে বললাম, এসব কথা আর চিন্তা না করাই ভালো। কারণ, ও চুরি করেছিল এবং তার শাস্তিও পেয়ে গেছে।
ঝুমনা ওর হাত দুটো আমার কাছে তুলে ধরল : তুই নিজের চোখেই দ্যাখ, বাবু, এ আমার হাত লয়। তবে তুকে কথা দিচ্ছি, এরা আর চুরি করবেক নাই। তোর বিছেহার, বোতাম, সব এরাই চুরি করেছে। আগের বাবুর আংটিও এরা লিয়েছে। সোনার জিনিসে এদের বেশি লোভ। তবে সোনার জিনিস না পেলে হাতের কাছে যা পায়, তাই চুরি করে।
ওকে প্রশ্ন করলাম, তাই নাকি? আর কী চুরি করেছে এরা?
ও বলল, অনেক জিনিস। প্লেট, চামচ, রুমাল, সাবান…।
ওগুলো নিয়ে কী করেছিস?
মাটিতে পুঁতে রেখেছি। বেশিরভাগ সময়েই এই হাত দুটো যা চুরি করে, নিয়ে গিয়ে কোনও পুকুরপাড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলে। জঙ্গলের বাইরে যে-বড় দিঘিটা আছে, তারই পাড়ে সমস্ত জিনিস পোঁতা আছে। তোকে আমি জায়গাটা দেখিয়ে আনতে পারি। বিশ্বাস কর, একটা জিনিসও আমি বিক্রি করিনি। ওরা চুরি করে সব মাটিতে পুঁতে রাখে।
বলছিস তা হলে তোর কোনও দোষ নেই?
না! এ আমার হাত নয়!
তবে কার হাত?
নতুন করে কান্নায় ভেঙে পড়ল ঝুমনা। লজ্জায় মাথা নীচু করে অস্ফুট স্বরে বলল, আমার বাবার হাত।
কিন্তু রমেশ যে বলছিল, তোর বাবা মারা গেছে?..আমি ভীষণ অবাক হলাম।
হ্যাঁ, আমার জন্মের আগেই বাবা মারা গেছে।..ঝুমনা উত্তর দিল।
কী করে মারা গেল?
বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে সর্দারের হুকুমে।
হয়তো বিজয় কাহারের আগে যে-সর্দার ছিল তারই আদেশে। কিন্তু কেন? সে-প্রশ্ন ঝুমনাকে করতেই ও মাথা নীচু করল। আস্তে-আস্তে বলল, চুরির জন্যে, বাবু।…তারপর মুখ তুলে সরাসরি তাকাল। আমি আবার চোখ ফেরালাম ওর হাতের দিকে।
হাত দুটোর কদাকার-কুৎসিত চেহারা সত্যিই অতুলনীয় এবং ষোলো বছরের একটা ছেলের পক্ষে হাত দুটোর বয়েস অনেক বেশি। কিন্তু এগুলো যে ওর হাত নয়, ওর কথা না শুনে স্বাধীনভাবে কাজ করে বেড়ায়, একথা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। এ-গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। লক্ষ করে দেখি, ঝুমনা তখনও কাঁদছে।
বিশ্বনাথবাবু ঈষৎ থামিয়া ঘরের পরিবেশ নিরীক্ষণ করিলেন। ছোটরা প্রায় সকলেই তন্দ্রা অথবা নিদ্রায় আংশিক অথবা পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন। মাধবীও নিস্তার পায় নাই। কিন্তু আমি ও মালতী যতখানি সজাগ ততোধিক কৌতূহলী। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা গম্ভীর হইয়া নিবিষ্ট মনে বিশ্বনাথবাবুর কাহিনি শুনিতেছে। সম্ভবত বর্তমান ঘটনার সহিত ইহার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যোগাযোগের সূত্রটি নির্ণয়ের চেষ্টা করিতেছে। আমি বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ্য করিয়া প্রশ্ন করিলাম, তারপর? তারপর কী হল?
তিনি কহিলেন, ছেলেটাকে বললাম, এবার থেকে টুকিটাকি কিছু দরকার হলে যেন। আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সে বারবার করে প্রতিজ্ঞা করল, পুরোনো ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। সে একটা হেস্তনেস্ত করবেই করবে। তারপর হঠাৎ বলল, বাবু, আমাকে একটা বাক্স দিবি?
অফিসে কাঠের স্যাম্পেল পাঠানোর জন্যে মাঝারি সাইজের একরকম পিচবোর্ডের বাক্স আমরা ব্যবহার করতাম। তারই কয়েকটা তাবুর এক কোণে স্তূপাকারে পড়ে ছিল। সেদিকে আঙুল দেখিয়েই অনুরোধটা ঝুমনা করেছে। নির্বিবাদে একটা বাক্স ওকে দিয়ে দিলাম। তা দিয়ে ও কী করবে ও-ই জানে! বাক্সটা নিয়ে ও ছুটে বেরিয়ে গেল তাবু থেকে। মিলিয়ে গেল জঙ্গ লের গভীরে।
পরদিন খুব সকালে তাঁবুর বাইরে থেকে একটা হইচই গণ্ডগোলের শব্দ শুনতে পেলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেই এক ভয়ংকর দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। ঝুমনা আচ্ছন্নের মতো টলছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কবজি ও কনুইয়ের মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওর হাত দুটো কেউ কেটে নিয়েছে, আর রক্তাক্ত ভোতা প্রান্ত দুটো কাদামাটি মাখা ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে টপটপ করে তখনও ঝরে পড়ছে কাঁচা রক্ত। সে-নৃশংস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।
সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানকার এক তরুণ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে সঙ্গে-সঙ্গে ভরতি করে দেওয়া হল। রমেশ একসময় আমার পাশে এসে বলল, কু-দেবতার অভিশাপেই নাকি এমনটা হয়েছে।…ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম। আদিবাসীরা রোজকার মতো জঙ্গলে কাঠ কাটতে লেগে গেল। কিন্তু ঝুমনাকে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা দুশ্চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে সরাতে পারলাম না।
বিকেল হতে না হতেই হাসপাতালে রওনা হলাম ওকে দেখতে। ওর কাটা হাত দুটোয় এখন নতুন করে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তরুণ ডাক্তারটি আমাকে আশ্বাস দিল, রক্তপাত প্রচুর হয়েছে, তবে বিশেষ ভয় নেই। ও সেরে উঠবে। আমাকে দেখেই ঝুমনা ব্যান্ডেজ করা হাত দুটো উঁচিয়ে ধরল আমার মুখের সামনে। যেন হাত দুটো কেটে ফেলায় ও ভীষণ খুশি হয়েছে এবং একই সঙ্গে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু কে কাটল ওর হাত দুটো? কেমন করেই বা কাটল? একটু পরেই সে-প্রশ্নের উত্তর পেলাম।
ওকে জিগ্যেস করলাম, এসব কেমন করে হল রে, ঝুমনা? কে এ কাজ করল?
ও জবাব দিল, এ আজ নয় কাল আমাকে করতেই হত, বাবু। তোকে কথা দিয়েছি, আর আমি চুরি করব না। সে কথা রাখতে গেলে হাত দুটো কেটে ফেলা ছাড়া আর পথ কোথায়? এ-হাত যে আমার নয়! এদের আমি বিশ্বাস করি কেমন করে?
বুঝলাম, যা হয়েছে, ওর সম্মতিতেই হয়েছে। ওকে বললাম, এ তোর ভুল ধারণা। তোর শরীরের সবই তো তোর, অন্য কারও কি হতে পারে? কিন্তু এ কাজ করল কে?
উত্তরে ও জানাল, জঙ্গলের শেষে যে বোঙার মন্দির আছে, তার গুনিন রতন মাণ্ডি এ কাজ করেছে। কারণ সে হাত দুটোকে আগে থেকেই চিনত।
কী করে চিনল?–আমি জানতে চাইলাম।
আগেও এই হাত দুটো সে দেখেছে, ঝুমনা উত্তর দিল, অনেক বছর আগে…সে আমার বাপকে চিনত…।
এরপর কথা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কোনও ওষুধ নেই। সুতরাং ডাক্তারবাবুকে ওর দিকে নজর রাখার অনুরোধ করে আমি চলে এলাম। চলে আসার সময়েও শুনলাম ঝুমনা বলছে, আর আমার কোনও দুঃখ নেই রে, বাবু। আমার চোখে আর জল আসবে না।…কিন্তু দেখলাম, একথা বলার সময় ওর চোখ জলে ভেজা। হয়তো এর কারণ ওর শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। ডাক্তারবাবুর মতে ওর এখন প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন। কারণ, যে-পরিমাণ রক্তক্ষরণ ওর হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। অন্তত মাসখানেক সময় তো লাগবেই।
সে-রাতে একরকম বিষণ্ণ মনেই শুতে গেলাম। মশারির ভিতরে শুয়ে উথালপাতাল দুশ্চিন্তা করতে করতে শুনতে লাগলাম বাইরের উড়ন্ত মশার মিহি গুঞ্জন। এবং একসময় ঘুমিয়েও পড়লাম।
ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক খসখস শব্দে। মনে হল, তাঁবুর গায়ে বাইরে থেকে কেউ যেন আঁচড় কেটে চলেছে। আর মাঝে-মাঝে টোকা মারার ভেঁতা শব্দ। হয়তো কোনও পাচা কিংবা বাদুড় পথ ভুলে তাঁবুর গায়ে এসে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? মশারি ভেদ করে তাঁবুর খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের খোলা আকাশ ও সেখানে মেঘের আস্তরণে ঢাকা ঘোলাটে পূর্ণিমার চাঁদ। আর তার কিছুটা নীচেই শুরু হয়েছে আঁকড়া-মাথা শালগাছগুলোর অন্ধকার ছায়াপ্রাচীর।
শত চেষ্টাতেও চোখে আর ঘুম নামল না। বেচারা ঝুমনার কথা বারেবারেই মনে পড়তে লাগল এবং চোখের সামনে থেকে-থেকেই ভেসে উঠতে লাগল ওর কাটা হাত দুটোর ভয়াবহ দৃশ্য। আর একইসঙ্গে কানে আসছে টোকা দেওয়ার হালকা শব্দ, আঁচড় কাটার শব্দ–তাঁবুর চাদরে খসখস শব্দে কেউ যেন ছুটে বেড়াচ্ছে। কোনদিক থেকে যে শব্দটা আসছে, ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন অনুভূতি, সব যেন মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। এ কীসের শব্দ এমন বিচিত্রভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে?
রহস্যের গভীরতা ক্রমেই যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে, তখন শব্দের ধরনটা হঠাৎই পালটাল। সবসময় হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে তাবুতে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ছিল। বেশিরভাগ সময়েই তাতে জল ভরা থাকে। তখনও ছিল। জল ফুরিয়ে গেলে ঝুমনাই আবার জল এনে ভরতি করে রাখত। ওর বীভৎস দুর্ঘটনার পর রমেশই অনুগ্রহ করে সে কাজটুকু করে দিচ্ছিল। সুতরাং গামলার জলে ছলাৎ শব্দ শুনেই আমি চমকে উঠেছি। তার কারণ দুটো ও এক, শব্দের চরিত্র এককথায় অভিনব ও চূড়ান্ত রহস্যময়। দুই, এই প্রথম বুঝলাম, শব্দটা তাবুর বাইরে নয়, হচ্ছে তাঁবুর ভিতরে। সোজা কথায়, গামলার জলে কিছু একটা পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে গামলা বেয়ে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে আসতে। শোনা যাচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের ওপর খরখর আঁচড়ের অতিব্যস্ত শব্দ।
বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে ঘড়িটা বের করে নিলাম। রেডিয়াম ডায়ালে চোখ রেখে দেখলাম, রাত তিনটে বাজে। সুতরাং ঘুমোনোর চেষ্টা এখন বৃথা। মশারির বাইরে বেরিয়ে নীচু হয়ে ক্যাম্পখাটের কাছে রাখা হ্যারিকেনটা তুলে নিলাম। সলতে নামিয়ে আলোটা প্রায় নিবুনিবু করা ছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটাকে বাড়িয়ে দিলাম। সেই মুহূর্তেই হ্যারিকেন-শিখার আবছা আলোয় একটা জিনিস দেখতে পেলাম…এবং হ্যারিকেন আমার হাত থেকে খসে পড়ল মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাচের চিমনি। আলোয় শিখাও পলকে নিভে গেল।
আলো জ্বালিয়ে ওই অল্প সময়েই আমি দেখেছি, গামলার ভিতর থেকে পড়িমরি করে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছে কালো কঁকড়ার মতো অদ্ভুত দুটো প্রাণী। ছিটকে লাফিয়ে পড়েছে মেঝেতে, তারপর বিদ্যুৎগতিতে রওনা হয়েছে তাঁবুর দরজা লক্ষ্য করে। প্রাণী দুটোর রং গাঢ় বাদামি, পিঠ দুটো মাকড়সার মতো উঁচু হয়ে রয়েছে, এবং তার ওপরে পার্চমেন্ট কাগজের মতো চামড়ার আস্তরণ। প্রত্যেকটা প্রাণীর পাঁচটা করে পা, এবং তাদের ছুঁচোলো ডগায় কালচে ছোপ ধরা মোটা বাঁকানো নখ। না, দেখতে আমার ভুল হয়নি। এ ঝুমনার কেটে ফেলা সেই দুটো হাত! গামলার জলে ভিজে গিয়ে সেগুলোকে কেমন অদ্ভুত চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, ততক্ষণে হাত দুটো তাঁবুর বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে আমি এক ভয়ংকর অবাস্তব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে পড়েছি। এ যে আমি বিশ্বাসও করতে পারছি না!
দ্বিতীয় একটা হ্যারিকেন তাঁবুতে ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে সেটাকে খুঁজে বের করে জ্বেলে দিলাম। দেখলাম, আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাচের চিমনির ভাঙা টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আরও নজরে পড়ল, গামলা থেকে তাবুর দরজা পর্যন্ত একটা ভিজে দাগ। গামলার কাছে গিয়ে দেখি, সেটা জল কাদায় নোংরা ঘোলাটে হয়ে গেছে, এবং জলে তখনও ঢেউ খেলছে। যেন এইমাত্র কেউ জলে আলোড়ন তুলে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
যেসব আদিবাসী গাছ কাটত, তাদের কয়েকজন–জনা-চার-পাঁচ হবে কাজের শেষে আর ঝোঁপড়িতে ফিরে যেত না। আমার তাঁবুর লাগোয়া একটা তাঁবু তৈরি করে সেখানেই রান্নাবান্না করে, খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ত। হ্যারিকেনের চিমনি ভাঙার শব্দে ও আমার চলাফেরার আওয়াজে ওদের ঘুম হয়তো ভেঙে গিয়ে থাকবে। কারণ, একটু পরেই দুজন আদিবাসী আমার তাঁবুতে এসে হাজির হল। চিমনির ভাঙা কাচগুলো নজরে পড়তেই সেগুলো বঁট দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। কিন্তু মেঝেতে ভিজে দাগের ও গামলার ঘোলাটে জলের কোনও সহজ-সরল ব্যাখ্যা ওরা দিতে পারল না। ওদের বললাম যে, প্রাণীটাকে আমি ভালো করে দেখতে পাইনি, কারণ সত্যি কথাটা আমি নিজে তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। অন্য কেউ ওরকম গল্প আমাকে শোনালে আমি নিশ্চয়ই তার মুখের ওপর হো-হো করে হেসে উঠতাম।
তা যাই হোক, ওদের বললাম চোখ-কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে শুতে। কারণ সেই রাতের আগন্তুক চোরও হতে পারে, কিংবা শেয়াল অথবা হায়েনাও হতে পারে।
পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম, আদিবাসীদের তাঁবুতে আমাদের গাছকাটার যন্ত্রপাতি যে-জায়গাটায় থাকত, সে-জায়গাটা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে। রমেশ অনেক খোঁজাখুঁজির পর বলল, দু-একটা জিনিস চুরি গেছে। অথচ আশ্চর্য, কেউ কোনও শব্দ পায়নি, এক মুহূর্তের জন্যে কারও ঘুমও ভাঙেনি। আমি ব্যাপারস্যাপার কিছুটা অনুমান করতে পারলেও চুপচাপ রইলাম।
বেলা একটু বাড়তেই হাসপাতালে ঝুমনাকে দেখতে গেলাম। ডাক্তারের কাছে শুনলাম, ওর সামান্য জ্বর হয়েছে। তা ছাড়া শরীর খুব দুর্বল। ওকে শুধু দুধ-বার্লি আর ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে দেওয়া হচ্ছে। আমাকে দেখেই ও ব্যান্ডেজ বাঁধা দুহাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করল। ডাক্তারবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই আমি ঝুমনাকে প্রশ্ন করলাম, তোকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করলে কি জবাব দিতে খুব কষ্ট হবে?
ও বলল, না বাবু, যা প্রাণ চায় জিগ্যেস কর। এখন আমার তো কোন দুখ লাই।
ওকে বললাম, হাত দুটো কেটে ফেলে তুই কী করেছিস?
তোর দেওয়া বাক্সটায় রতন গুনিন ওগুলো রেখেছিল।
তারপর?
তারপর বাক্সটা সমেত মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ওইটুকুই আমার জানার দরকার ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে এলাম।
সে-রাতে আর দু-চোখের পাতা এক করিনি। শেয়াল কিংবা হায়না তাড়ানোর লাঠিটা হাতের কাছে নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু কিছুই হল না। তার পরের রাত, এমনকী তৃতীয় রাতেও কিছু হল না। আমি ভাবলাম, হয়তো হ্যারিকেনের আলোতে ওই মহাচোর হাত দুটো দেখা দিতে লজ্জা পাচ্ছে। সুতরাং পরের রাতে আলো নিভিয়েই শুয়ে পড়লাম।
এক অদ্ভুত শব্দে ঘুমটা ভাঙল। আমার কানের ঠিক নীচেই আমার হাতঘড়িটার অ্যালার্ম বাজছে। বালিশ ভেদ করেও চাপা শব্দটা আমার কানে আসছে। পাথরের মূর্তির মতো নিঃসাড়ে শুয়ে রইলাম। ধীরে-ধীরে হয়তো মিনিট পনেরো কেটে গেল। কারণ, তারপরই আমার কানে এল দ্বিতীয় অ্যালার্মের শব্দ। রাত এখন কটা বাজে কে জানে! কিন্তু অ্যালার্মটা নিজে থেকে বাজছে কেমন করে? আমি তো অ্যালার্মের চাবিতে দম দিইনি!
ধীরে-ধীরে একটা হাত বালিশের তলায় ঢুকিয়ে দিলাম। পরমুহূর্তেই এক অমানুষিক বিকৃত চিৎকার বেরিয়ে এল আমার ঠোঁট চিরে। বালিশের তলাতেই ওরা রয়েছে। সেই হাত দুটো! আর আমার হাতঘড়িটা সেই হাতের মুঠোর মধ্যে।
ঘড়ির চামড়ার ব্যান্ডের একটা প্রান্ত সামান্য বেরিয়ে ছিল। আমি সেটা ধরেই প্রাণপণে এক হ্যাঁচকা মারলাম। কিন্তু ওই হাতের আঙুলগুলো ভীষণ শক্ত, এবং আমার আঙুলগুলো ওরা সাঁড়াশির মতো তীব্রতায় আঁকড়ে ধরল। আমি আবার চিৎকার করে উঠলাম।
আমার চিৎকারে আদিবাসীদের তাবু থেকে অন্তত তিনজন ছুটে এসে হাজির হল। তাদের একজনের হাতে জ্বলন্ত হ্যারিকেন। কীসের সঙ্গে যে আমার আপ্রাণ ধস্তাধস্তি চলছে সেটা ওরা প্রথমটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারল না। কিন্তু আলোয় ইশারা পেয়ে হাত দুটো বোধহয় ভয় পেল এবং ঘড়িটা হঠাৎই ছেড়ে দিল। আমি চেষ্টা করেও ওদের আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলাম না। কালচে বাদামি হাত দুটো বিছানার সাদা চাদরের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎগতি কঁকড়ার মতো ছুটে গেল, মশারি ফাঁক করে ধপ শব্দে ছিটকে পড়ল মেঝেতে, তারপর ছুটে চলে গেল তাঁবুর দরজা লক্ষ করে।
ততক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে খাটের তলা থেকে লাঠিটা তুলে নিয়েছি এবং দুটো হাতের মধ্যে যেটা একটু পিছিয়ে পড়েছিল, সেটাকে লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করেছি। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা শূন্যে প্রায় হাতখানেক লাফিয়ে উঠল, তারপর চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। মুহূর্তের জন্যে হাতটা হতচকিত হয়ে থমকে রইল। যেন চিন্তা করল, সেই আকস্মিক আঘাতের প্রতিবাদে কী করা উচিত। তারপর হঠাৎই আমাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এল…অনেকটা তেড়ে আসার মতো। কিন্তু কী ভেবে এক ঝটকায় দিক পালটে করে আবার ছুটে চলল দরজার দিকে। তারপর একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের জঙ্গলের আড়ালে, অন্ধকার রাতের পরদার গোপন ভঁজে।
আমি আদিবাসী তিনজনকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললাম, শিগগির বিজয় সর্দারকে খবর দাও। এক্ষুনি!
ওরা ছুটে বেরিয়ে গেল বিজয় কাহারকে খবর দিতে।
বিজয় সর্দার এসে যখন পৌঁছোল, তখন আকাশ ভোরের ইশারা নিয়ে ধূসর ইস্পাতের ছাউনির মতো হয়ে উঠেছে–শুরু হয়েছে অসংখ্য পাখির মিলিত প্রভাতী গুঞ্জন। বিজয়কে সমস্ত ঘটনা প্রথম থেকে খুলে বললাম। ও গম্ভীরভাবে সব শুনল। তারপর বলল, ঝুমনাকে নিয়ে মন্দিরে যেতে হবে। সুতরাং সবাই মিলে ছুটলাম হাসপাতালে।
তরুণ ডাক্তারটিকে অনেক অনুরোধ করার পর বিজয়ের কথায় সে নিমরাজি হল। অর্থাৎ, ঝুমনাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আমাদের সঙ্গে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। জঙ্গলের পথ ধরে আমি, রমেশ ও বিজয় কাহার আগে আগে হেঁটে চলেছি, পেছনে আদিবাসীদের বয়ে আনা স্ট্রেচারে শুয়ে ষোলো বছরের অসুস্থ ছেলেটা। অবশ্য এখন ও আগের চেয়ে অনেকটা সেরে উঠেছে।
মন্দিরের কাছাকাছি এসে পৌঁছোতে জনদুয়েক আদিবাসী ছুটে এগিয়ে গেল মন্দিরের দিকে হয়তো রতন গুনিনকে খবর দিতে। কিন্তু একটু পরেই তারা উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। জানাল, আমরা আসছি খবর পেয়েই রতন গুনিন ভয়ে মন্দির ছেড়ে কোথায় পালিয়েছে–তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা শুনে বিজয় বলল, গুনিনের দরকার নেই, ঝুমনা দেখিয়ে দিলেই হবে। তারপরই সে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা ছেলেটার কাছে গিয়ে জানতে চাইল, হাত দুটোকে কেটে ফেলার পর রতন গুনিন সেগুলো কোন জায়গায় পুঁতেছে। উত্তরে ইশারা করে মাটিতে একটা নরম জায়গা দেখাল ঝুমনা। তখন বিজয় সবাইকে মাটি খোঁড়ার নির্দেশ দিল। প্রায় হাত আড়াই মাটি খোঁড়ার পর অতি পরিচিত পিচ-বোর্ডের বাক্সটার দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু সে বাক্স খোলা, কাদায় মাখামাখি। তার ভিতরে কোনও কাটা হাত খুঁজে পাওয়া গেল না!
হাত দুটোর সন্ধানে আমরা সকলে মিলেই খোঁজাখুজি শুরু করলাম, কিন্তু বৃথাই। আমার কেবলই মনে হতে লাগল, হাত দুটো আমার পিছু ছাড়েনি। লাঠির আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে ওরা তক্কেতক্কে রয়েছে।
তাঁবুতে ফিরে এসেও হাত দুটোর অদৃশ্য উপস্থিতি আমি টের পেলাম। আমার তাঁবুতে, আদিবাসীদের তাবুতে, গাছ কাটার যন্ত্রপাতির ওপরে, প্রায়ই হামলা হতে লাগল। তখন আমরা চারদিকে ইঁদুর-ধরা জাতিকল এনে পেতে রাখলাম। একদিন সকালে একটা জাতিকল বন্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। কিন্তু তার লোহার দাঁতে সামান্য একটু ছেঁড়া চামড়া ও কালচে রক্ত ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। বুঝলাম, একটা হাত ফাঁদে ধরা পড়েছিল। তখন দ্বিতীয় হাতটা এসে তাকে ফঁদ থেকে সহজেই উদ্ধার করেছে।
টোপ হিসেবে আমার হাতঘড়িটাকে বেশ কয়েকদিন খোলা জায়গায় রেখে দিলাম, কিন্তু বৃথাই। তবে যত্রতত্র হাত দুটোকে দেখা যেতে লাগল। গাছের ডালে, আমার মশারির চালে, ঘাসের ওপর, তাঁবুর গায়ে, শুকনো শাল গাছের পাতার ফাঁকে। আদিবাসীরা এত ভয় পেয়ে গেল যে, বিজয় কাহার শত বুঝিয়েও ওদের শান্ত করতে পারল না। ওরা একে-একে কাজ ছেড়ে পালাতে লাগল। তখন বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে গাছ কাটার কাজ বন্ধ রেখে আমরা ক্যাম্প গুটিয়ে ফিরে এলাম। ফেরার সময় আমার প্রতিটি জিনিস বারবার করে নেড়েচেড়ে আমি দেখে নিয়েছি কোনও কিছুর ফাঁকে সেই ধূর্ত হাত দুটো লুকিয়ে আছে কি না। অবশেষে স্থানীয় অফিসে কাজের সমস্ত দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি কলকাতা রওনা হলাম।
ট্রেনে ফেরার সময় হঠাৎই আমার নজরে পড়ল, শক্তপোক্ত করে বাঁধা বেডিংয়ের ভিতরে কিছু একটা যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। কারণ বেডিংয়ের কাপড়ের একটা জায়গা অদ্ভুতভাবে কেমন উঁচু ঢিবির মতো হয়ে রয়েছে, এবং সেই ঢিবিটা যেন কষ্টেসৃষ্টে চলে বেড়াতে চেষ্টা করছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বেডিংটা খুলে ফেলেছি, কিন্তু ট্রেনের কমজোরি আলোয় ভালো করে কিছু দেখতে পাইনি। একটা অজানা আতঙ্ক আমাকে ধীরে-ধীরে ঘিরে ধরেছে। হাত দুটো কি আমাকে ছাড়বে না? ওরা কি প্রতিশোধ চায়? কিন্তু কীভাবে ওরা প্রতিশোধ নেবে? বিজয় কাহার আমাকে বলেছিল, ওই হাত শুধু চুরি করে, কাউকে খুন করার ক্ষমতা ওদের নেই। আর সেরকম ক্ষমতা থাকলে বহু আগেই আমি ওদের শিকার হতাম। সুতরাং দুশ্চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় আমি যেন পাগল হয়ে উঠলাম। তারপর–
বিশ্বনাথবাবু হঠাৎই থামিলেন। চোখ হইতে চশমাটি খুলিয়া নিবিষ্ট মনে উহার কাচ দুটি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আমরা কৌতূহলে নীরব ও রুদ্ধশ্বাস। মালতী সভয়ে আমার আরও নিকটে ঘেঁষিয়া বসিল। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধু অবিনাশ এতক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন ধূমপানে ব্যস্ত ছিল, এখন উভয়েই হস্তধৃত সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজিয়া নির্বাপিত করিল। বিশ্বনাথবাবু আমাদের দিকে পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি রাখিলেন। হ্যাঁজাকের আলো তাঁহার মুখমণ্ডলকে ছায়াময় করিয়া তুলিয়াছে।
অবশেষে চশমা যথাস্থানে ফিরাইয়া তিনি কহিলেন, আজকের ঘটনার বুঝতেই পারছেন, সেই হাত এখনও আমার পেছু ছাড়েনি। সোনার জিনিসের প্রতি ওদের লোভ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। সেইজন্যেই আত্মীয়স্বজন কারও বাড়িতে আমি যাই না। চাকরিবাকরি ছেড়ে শুধু নিজের ব্যাবসা নিয়ে আছি। তিনি এইবার চন্দ্রমোহনের দিকে ইশারা করিয়া কহিলেন, চাদু আমার এই একাচোরা স্বভাবের কথা জানে, এমনকী চুরির ব্যাপারটাও জানে। কিন্তু কোনওদিন ওকে তার কারণ খুলে বলিনি। আজ বললাম, কারণ, এরকম অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে আগে কখনও পড়িনি। এইজন্যেই সঁদুকে আমি বারবার বলেছি, বরযাত্রী আমি যাব না। তুই বউ নিয়ে আয়, তখন আশীর্বাদ করব, কিন্তু কে শোনে কার কথা! ও বলল, তুমি চলো, আমি তোমাকে নজরে-নজরে রাখব।…আসলে চঁদুরও দোষ নেই। ও কী করে জানবে যে, যখন ওই হাত দুটো চুরি করে, তখন আমি এতটুকুও টের পাই না? কী করে জানবে, কত ভয়ংকর প্রতিশোধ ওই হাত দুটো আমার ওপরে নিয়েছে। কী করে জানবে, কত বিষাক্ত ছোবলে ওরা আমার গোটা জীবন নীল করে দিয়েছে! এই তো সেই হাত! এই তো সেই হাত! এই তো—
কাশ্মীরি আলোয়ান সরাইয়া বিশ্বনাথবাবু তাঁহার হাত দুইখানি প্রকাশিত করিলেন। গায়ের রঙের তুলনায় তাহার হাতের রং অনেক বেশি কৃষ্ণকায়। বলা যাইতে পারে, গাঢ় বাদামি। হত দুইখানির চামড়া অত্যন্ত কর্কশ। প্রতিটি শিরা-উপশিরা স্থূলভাবে প্রকট। কুৎসিত কদাকার আঙুলের গ্রন্থিগুলি অদ্ভুতরকম বেমানান। নখগুলি অত্যন্ত পুরু, গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছাপে কলঙ্কিত, এবং কোনও মাংসাশী জন্তুর নখের ন্যায় বক্র।
হাত দুইখানি হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোয় ভয়ংকর দেখাইতেছিল। বাহিরে কোথাও হইতে কর্কশ স্বরে কোনও পাচা ডাকিয়া উঠিল। ঠান্ডা বাতাসের ঝড় উন্মুক্ত জানলা দিয়া প্রবেশ করিয়া হু হু করিয়া ঘর তোলপাড় করিল। বিশ্বনাথবাবু উন্মাদের ন্যায় হাত দুইখানি দিয়া মেঝেতে আঘাত করিতে লাগিলেন। হাত ক্ষত-বিক্ষত হইয়া রক্তের ধারা বহিতে শুরু করিল। তিনি চিৎকার করিয়া কহিলেন, এ-হাত নিয়ে আমি কী করি! একে আমি না পারি রাখতে, না পারি ফেলতে! ওই ষোলো বছরের ছেলেটার মতো অত সাহস যে আমার নেই! ওঃ ভগবান, আমি এখন কী করি! আমার এ-শাস্তির কি শেষ নেই। বিশ্বনাথবাবু হাত দুইখানি ওইরূপে আঘাত করিতে করিতেই কান্নায় ভাঙিয়া পড়িলেন। কান্নার দমকে তাহার শরীর ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।
মালতী অস্ফুটে এক ভয়ার্ত চিৎকার করিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিল। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা বিশ্বনাথবাবুকে সংযত করিতে মনোযোগী হইল। বিবাহোৎসবের আনন্দ মুহূর্তে মৃত্যুর বিষাদে পর্যবসিত হইয়া গেল। আমার বাকশক্তি যেন কোনও অদৃশ্য ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে রোধ করিয়া দিয়াছে…।
.
চার মাস পরে চন্দ্রমোহনের নিকট হইতে সংবাদ পাইলাম, বিশ্বনাথবাবু নিজ বাড়ির ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন।
অয়স্কান্তের অন্তিম ইতিহাস
(অয়স্কান্ত রুদ্রের কুয়াশাচ্ছন্ন অপমৃত্যুর সম্ভাব্য সমাধান কেউই করতে পারেননি। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য মৃত্যুকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করে দিনের পর দিন মানসিক কুরুক্ষেত্রের অংশীদার হয়েছে তার স্ত্রী অরুণা রুদ্র। অবশেষে কতকগুলো সাদা কাগজের পৃষ্ঠায় খুঁজে পাওয়া গেছে অয়স্কান্তের জীবনের অন্তিম দিনগুলোর কালো সাদা সাক্ষ্য। যেমন বিক্ষিপ্তভাবে তার শুরু, তেমনি বিক্ষিপ্তভাবে তার শেষ। তবু কি ফুটে ওঠে না এক অবিশ্বাস্য অশুভ ইঙ্গিত? ঘটনা ও ফলাফলকে আঙ্কিক নিয়মে যোগ করে অরুণার অন্তত তাই মনে হয়েছে।)
৫ মে, রাত দশটা
ক্লাব থেকে ফিরতে আজ অনেক রাত হয়ে গেল। অরুণা মনে হয় বেশ কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে। কারণ সংক্ষিপ্তভাবে বহু প্রচলিত এবং বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো (খাবার ঢাকা আছে) বলে ও শোওয়ার ঘরে চলে গেল। ভেবেছিলাম খাওয়াদাওয়ার পর মানভঞ্জনে আজকের রাতটা খরচ করব, কিন্তু শ্রীকান্তর কথাগুলো মনে পড়ায় তা আর হয়ে উঠল না। টেবিলে বসে খালি ওর কাছে শোনা কথাগুলোই ভেবেছি। জানি, ক্লাবের আর সকলে ওর কথায় তেমন আমল দেয়নি, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তা পারছি কই? সত্যিই কি সামান্য এক টুকরো সুতোর মধ্যে অত শক্তি আছে? ওই এক টুকরো সুতোর চাপে কেউ কখনও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়? কে জানে! শ্রীকান্ত বলছিল, স্ত্রী-হত্যার অপরাধে সেই ভদ্রলোকের কোনও শাস্তি হয়নি। কারণ সামান্য একগাছা সুতো দিয়ে যে কাউকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা যায়, আদালত সে কথা একেবারেই বিশ্বাস করেনি। ওই অবিশ্বাস্য ঘটনার পর ভদ্রলোক পাগল হয়ে যান। তিনি তো সত্যিই স্ত্রীকে খুন করতে চাননি। নিছক একগাছা সুতো গলায় জড়িয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!
না, এই সুতোর ঘটনাটা অরুণাকে বলা ঠিক হবে না। ও হয়তো ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, এই অবাস্তব ব্যাপারটা শুধু আমাকেই কেন এরকমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে?
৬ মে, রাত দশটা
আজ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় একটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। ধুতিটা আলমারি থেকে নিয়ে পরতে যাব, দেখি, একগাছা সরু কালো সুতো সাদা ধবধবে ধুতির ওপর সাপের মতো এঁকেবেঁকে পড়ে রয়েছে। জিনিসটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঘর আঁট দেওয়ার সময় আপদ দূর হবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, অফিস থেকে ফিরে এসে টেবিলের ওপর আবিষ্কার করলাম ওই কালো সুতোটাকে। আমার ফাউন্টেন পেনটার পাশে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে। জানি না কেন, ওটাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে শিউরে উঠেছিলাম। তা হলে কি আমার হঠাৎই মনে পড়ে গিয়েছিল বিশ বছর আগেকার স্মৃতির কথা? আমার ছোটবেলার কথা? নিশীথের কথা?
৮ মে, রাত বারোটা
বলব না বলব না করেও অরুণাকে আমার অস্বস্তির কথাটা জানিয়ে ফেলেছি। ও ব্যাপারটাকে যথারীতি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। তা তো দেবেই। ও তো আর জানে না বিশ বছর আগেকার ছোট্ট ঘটনাটা। জানে না নিশীথের আকস্মিক অপমৃত্যুর কথা! তা ছাড়া শ্রীকান্তর বলা গল্পটাও তো ওকে আর বলিনি!
১০ মে, রাত একটা
রাত দশটায় খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুম আসেনি। কারণ, কালো সুতোটা এখনও আমার সঙ্গ ছাড়েনি। আজ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ওটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে এসে দেখি সেই আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সুতোটা আমার ড্রয়ারের ভিতরে নিরীহভাবে পড়ে রয়েছে। তা হলে নিশীথ কি এতদিন পরে ওর প্রতি অবিচারের ন্যায়বিচার চাইতে এসেছে? আজও আমি ভুলিনি বিশ বছর আগের সরস্বতী নদীর কথা, তার ওপরের তালগাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি সাঁকোটার কথা। আর ভুলিনি এক লাটাই কালো সুতোর কথা। ওই সামান্য সুতো নিয়েই এক ধূসর সন্ধ্যায় নিশীথের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়, তারপর অনিবার্যভাবে হাতাহাতির শুরু। ওই ধস্তাধস্তির মধ্যে নিশীথ কীভাবে যে জলে পড়ে গেল, আমার মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, ডান হাতের শক্ত মুঠোয় লাটাইটা আঁকড়ে ও ছিটকে পড়েছিল সাঁকোর ওপর থেকে। সাঁতার জানত না নিশীথ। তাই অসহায়ভাবে হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে গেছে ঘোলা জলের নীচে। সন্ধের ঝাপসা অন্ধকারে নিঃসঙ্গ আমি শ্রান্ত পায়ে ফিরে এসেছি ঘরে। নিশীথের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার ঘটনা একেবারেই চেপে গেছি। কিন্তু দিন তিনেক বাদে মাইল দুয়েক দুরে ভেসে উঠল নিশীথের মৃতদেহ। সাত গাঁয়ের লোক ছুটল ওকে দেখতে। আমিও গেলাম। নিশীথের সারা শরীর গ্যাসবেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। চোখের জায়গায় দুটো বীভৎস কোটর। দেহের জায়গায় জায়গায় মাংস খোবলানো। কিন্তু ওর ডান হাতের শক্ত মুঠোয় লাটাইটা তখনও ধরা ছিল।
নিশীথের মৃতদেহের নৃশংস স্মৃতি আমাকে একটি রাতের জন্যেও মুক্তি দেয়নি। তখন আমার বয়স ছিল বছর বারো-চোদ্দো। আরও বছর পনেরো পর যখন অরুণাকে বিয়ে করলাম, তখন সে স্মৃতি বেশ ধূসর হয়ে এসেছে। তারপর এই পাঁচ বছরে নিশীথকে একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু শ্রীকান্তর বলা গল্পটা, আর এই সামান্য কালো সুতোটা, আমাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে সেই ভুলে যাওয়া বিষণ্ণ ধূসর সন্ধ্যার কথা। নিশীথের লাটাইয়ের কথা। কালো সুতোর কথা।
তা হলে কি এই সুতোই সেই সুতো? যে-সুতো আর সরস্বতী নদী সাক্ষী ছিল সেই বিয়োগান্ত নাটকের চরম পরিণতির?
১৩ মে, দুপুর দুটো
আমার টেবিলে একটা ছোট কাঠের মূর্তি আছে। হানিমুনের সময় কাশ্মীর থেকে অরুণাই ওটা পছন্দ করে কিনেছিল। মূর্তিটা একজন পুরুষের। কালো মিশমিশে তার সুগঠিত দেহের রং। দুটো হাত জয়ের ভঙ্গিতে মাথার ওপরে তোলা।
প্রথমটা আমি ঠিক খেয়াল করিনি। রাত তখন এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। শনিবার বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে অরুণাকে নিয়ে একটা বাংলা ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। সুতোটাকে তখনও ড্রয়ারেই দেখে গেছি। কিন্তু ফিরে এসে খাওয়ার পাট সেরে টেবিলে গিয়ে বসতেই লক্ষ করলাম ড্রয়ারটা হাট করে খোলা। অরুণাও সেটা লক্ষ করে বলে উঠল চোর-টোর এসেছিল কি না। কিন্তু আমি জানি, আসেনি। অরুণাকে শুতে যেতে বলে আমি ড্রয়ারটা পুরোটা খুললাম। ঠিক যা ভেবেছিলাম, তাই। সুতোগাছাটা ড্রয়ারে আর নেই।
ড্রয়ার বন্ধ করে টেবিলের ওপরে রাখা কালো মুর্তিটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। টেবিল ল্যাম্পের আলো সরাসরি গিয়ে পড়েছে মূর্তিটার ওপরে। তারই আলোর স্পষ্ট দেখলাম, মূর্তির যে-হাত দুটো জয়ের ভঙ্গিতে ওপরে তোলা ছিল, তাদের অর্থ কেমন যেন পালটে গেছে। হাতের ভঙ্গিতে কোনও রদবদল না হলেও এখন মনে হচ্ছে, মূর্তিটা যেন নিদারুণ আতঙ্কে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নিঃশব্দ চিৎকারে ঘর ভরিয়ে ফেলছে। ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ল কালো সুতোটা। মূর্তিটার গলায় সাপের মতো পাকে-পাকে জড়িয়ে রয়েছে সেই কালান্তক সুতো।
ভয়ে-ভয়ে হাত বাড়িয়ে সুতোটা খুলে নিতে চেষ্টা করলাম।
আশ্চর্য! অনায়াসেই ওটা খুলে চলে এল আমার হাতে। আরও আশ্চর্য, একইসঙ্গে যেন ফিরে এল মূর্তিটার আগের জয়োল্লাস। আতঙ্কের জমাট পরদাটা তার মুখ থেকে একেবারে নিঃশেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। এ কীসের ইঙ্গিত? শ্রীকান্তর বলা গল্পটা আরও একবার মনে পড়ল।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ঠিক করলাম, অরুণাকে সব জানানো দরকার। তাই রাতে শোওয়ার সময় ওকে বললাম, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী কথা?–ঘুমজড়ানো স্বরে অরুণা জানতে চাইল।
আবছা অন্ধকারে শূন্য দৃষ্টি মেলে ওকে শ্রীকান্তর বলা গল্পটা জানালাম।
ও প্রচণ্ড হাসিতে ভেঙে পড়ল, বলল, সুনু, তুমি ঠাট্টাও করতে পারো।
নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হতে লাগল। তা হলে এই বিপদের মুহূর্তে আমার পাশে কেউ নেই। অরুণার হাসির কোনও জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। সুতোটাকে কালো মূর্তিটার গলা থেকে খুলে কোথায় যে রেখেছি, আর মনে করতে পারছি না।
একটা সামান্য সুতো আমার জীবনকে যেন অদৃশ্য ফঁসে বেঁধে ফেলতে চাইছে।
১৪ মে, সন্ধ্যা সাতটা
ক্লাবে আজ আর যাইনি। একটু আগেই চেহারা খারাপ হয়ে গেছে বলে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়ার জন্যে শাসন করছিল অরুণা। তারপর পাশেই যেন কোন প্রতিবেশিনীর বাড়িতে গেছে সান্ধ্য পরনিন্দাচক্রে যোগ দিতে। ওকে নিশীথ বা কালো সুতোটা সম্পর্কে আর কোনও কথাই বলিনি। এও বলিনি যে, অফিস থেকে ফিরে একটু আগেই আমি কালো সুতোটাকে আবার খুঁজে পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি ভারি অদ্ভুত জায়গায়, ভারি অদ্ভুতভাবে।
অরুণার ড্রেসিং টেবিলে আমাদের বিয়ের (গলায় মালা দেওয়া অবস্থায়) একটা ফ্রেমে বাঁধানো বড় ফটো আছে। অফিস থেকে ফিরে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখি কালো সুতোটা অরুণা আর আমার ফটোর মাঝখানে পাঁচিল হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় অলসভাবে ঝুলছে। হাত বাড়িয়ে সুতোটাকে খুলে নিতে গিয়ে টের পেলাম, আমার কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এমনকী ফটোতে আমার মুখের হাসিখুশি ভাবটা পর্যন্ত মিলিয়ে গেছে। সেখানে ফুটে উঠেছে অনিশ্চয়তায় ভরা এক হতবুদ্ধি যুবকের আতঙ্কিত মুখ। হঠাৎ কী হয়ে গেল, পাগল করা রাগে সুতোটাকে দু-হাতের মুঠোয় ধরে আমি টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়তে লাগলাম। পাঁচ মিনিট পর যখন সংবিৎ ফিরে পেলাম, দেখি সুতোটা পাঁচ টুকরো হয়ে আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মনে হল, সুতোর টুকরোগুলো যেন কেঁচোর মতো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। হাজারো চিন্তায় আমার যুদ্ধক্লান্ত মস্তিষ্ক যেন অবশ হয়ে পড়েছে। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় নদীর জলের বাষ্প অনুভব করলাম। শুনলাম, কিছু একটা জলে আছড়ে পড়ার ঝপাং শব্দ। আমি কি ধীরে ধীরে কারও সুপ্ত অপূর্ণ ইচ্ছের শিকার হতে চলেছি।
১৪ মে, রাত একটা
শোওয়ার পর আজ কিছুতেই ঘুম এল না। সুতোটার অশরীরী উপস্থিতি আমাকে চঞ্চল করে তুলেছে। নিশীথের জলে ভেজা ফুলে ওঠা মুখটা এই মুহূর্তে যেন আরও বেশি করে মনে পড়ছে। ওর হাতের লাটাইয়ের কালো সুতো তো এত সহজে শেষ হওয়ার কথা নয়! সরস্বতী নদীর ঘোলাটে জলে সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আমার প্রতিবিম্ব নিশীথের জল-তল স্পর্শের আলোড়নে একই ছন্দে কাঁপছে। নিঃসঙ্গ আমি ধানখেতের আল ধরে আনমনাভাবে হেঁটে চলেছি। সন্ধের অন্ধকার চেপে বসেছে মাথার ওপরে। চোখের সামনে ভাসছে নিশীথের কালো সুতোয় ভরা লাটাইটা। আমি যেন…।
কীসের একটা যেন শব্দ হল। হালকা অথচ স্পষ্ট শব্দ। ঘরের অন্ধকারের ভিতরে যেন ফুটে উঠল নিশীথের ক্ষত-বিক্ষত চোখের মণিহীন মুখটা। শব্দটা কি ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে? কে যেন আমাকে চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াতে বলছে, কানের কাছে জলের নেশা-ধরানো কল্লোল, আমার হাত যেন শিথিল হয়ে আসছে, গলায় কীসের যেন অস্পষ্ট সুড়সুড়ি, বেশ শীত শীত করছে। আমার, কই অরুণা তো ঘুম ভেঙে উঠে এল না…একটা…একটা সাপিনীশীতল পরিবেশ আমাকে পরতে-পরতে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। নিশীথ, আমি তো তোকে খুন করিনি, নিশীথ, নিশীথ…।
(আচমকা এক চিৎকারে নাকি সে-রাতে অরুণার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই ও বুঝতে পারে সে-চিৎকার সুনুর, অর্থাৎ, তার স্বামী অয়স্কান্তের। পাশের ঘরে এসেই অরুণা আবিষ্কার করল ঘর অন্ধকার। কোনওরকমে হাতড়ে হাতড়ে ও যখন আলোর সুইচ জ্বালল, তখন দেখল ভারি অদ্ভুত এক দৃশ্য। অয়স্কান্ত রুদ্রের বিশাল দেহটা ঘরের সিলিং থেকে শূন্যে ঝুলছে। দেহটা দুলছে–ঠিক পেন্ডুলামের ধাতব দোলকের মতো। তখনই একটা ছোট্ট জিনিস নজরে পড়েছিল অরুণার। ঝুলন্ত দেহ ও সিলিংয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে শুধু একটা সরু কালো সুতো।)
অর্ধেক পুরুষ (নভেলেট)
সুপ্রতিম একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর মন বলছিল, ফোনটা আসবে। যদিও স্টুডিয়োতে লাইন পাওয়া বেশ ঝকমারি, তবুও ওর মনে হচ্ছিল সেই মেয়েটি যেরকম নাছোড়বান্দা তাতে লাইন ও পাবেই।
সন্ধে ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা—এই আধঘণ্টা ধরে ‘সাইবার চ্যানেল’-এর মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠান টিভিতে দেখানো হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সুপ্রতিম আর ওর অনুষ্ঠান-সঙ্গিনী মোনা। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে। মাত্র চারমাসেই ‘মুশকিল আসান’ সকলের মন কেড়ে নিয়েছে।
দর্শকরা নানান প্রশ্ন পাঠান সুপ্রতিমদের কাছে। সুপ্রতিম আর মোনা পালা করে সেসবের উত্তর দেয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠান চলার সময় বহু ফোনও আসে ওদের স্টুডিয়োতে। কেউ-কেউ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন, আর কেউ-বা নিজের কোনও সমস্যা তুলে ধরেন ওদের কাছে।
চিঠিপত্রের উত্তরগুলো ‘সাইবার চ্যানেল’-এর অফিসে কয়েকজন বসে ঠিক করেন। সেখানে সুপ্রতিম আর মোনাও থাকে। তবে টেলিফোনে পাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সুপ্রতিম বা মোনাকেই চটজলদি করে সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হয়। এর জন্য যে-বুদ্ধি এবং স্মার্টনেস দরকার, সেটা সুপ্রতিম আর মোনা দুজনেরই আছে।
সুপ্রতিমের চেহারা বেশ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে কীরকম যেন একটা বনেদি ঢং আছে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। স্বাস্থ্য মাঝারি। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। দাড়ি সুন্দর করে কামানো হলেও ফরসা গায়ে, থুতনিতে, নীলচে আভা থেকে গেছে। ঠোঁটের ওপরে কালো গোঁফ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। বয়েস পঁয়তিরিশ হলেও অনেক কম দেখায়।
সুপ্রতিম যত না সুন্দর তার চেয়েও অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে। ওকে ঘিরে অনেক দর্শকেরই কৌতূহল—বিশেষ করে মেয়েদের। অনেকেই ওকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি দেয়। আবার কেউ-কেউ ওকে নানান ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায়। সেইসব প্রশ্নের পাশকাটানো মজার উত্তর দেয় সুপ্রতিম।
ওর ডান ভুরুর ওপরে একটা কাটা দাগ আছে। সেটা নিয়ে এক তরুণী জিগ্যেস করেছিল, ‘আপনার ডান ভুরুর ওপরে ওই লাভলি কাটা দাগটা হল কেমন করে?’
সুপ্রতিম জবাব দিয়েছিল, ‘ছোটবেলায় এভারেস্ট থেকে পড়ে গিয়ে।’
একজন কিশোরী চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘আপনার নামটা দারুণ। ভীষণ এক্সাইটিং।’
জবাবে সুপ্রতিম বলেছিল, ‘মোটেই তা নয়। সুপ্রতিম মানে হচ্ছে ভালোর মতো—কিন্তু পুরোপুরি ভালো নয়।’
একজন পুরুষের কৌতূহল: ‘আপনি কি বিয়ে করেছেন?’
সুপ্রতিমের উত্তম: ‘করিনি বললে আমার ছ’জন ওয়াইফ রেগে আগুন হয়ে যাবেন। আর বিয়ে করেছি বললে অনেক দর্শক দুঃখ পাবেন। তাই এই সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।’
আসল ঘটনা হল সুপ্রতিম বিয়ে করেছে। স্ত্রী নয়নার সঙ্গে ওর পরিচয় সাত বছরের। তার মধ্যে প্রথম তিনবছর ওর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে, আর বাকি চারবছর চুটিয়ে সংসার করেছে। এখনও করছে। সুপ্রতিম যা-কিছুই করে, সবসময় চুটিয়ে করতে চায়। তাই নিয়ে নয়নার সঙ্গে মাঝে-মাঝে বেশ ঝামেলাও হয়।
নয়না দেখতে বেশ সুশ্রী, মিষ্টি মেয়ে। তবে সুপ্রতিমের চেহারার পাশে নিজের চেহারা নিয়ে সবসময় ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। সুযোগ পেলেই ওই প্রসঙ্গ তুলে ঠাট্টা করে। সুপ্রতিম রোজ যখন অফিসে রওনা হয়, নয়না তখন আকুল চোখে স্বামীকে দ্যাখে।
সুপ্রতিম অবাক হয়ে বলে, ‘কী ব্যাপার! এমনভাবে তাকিয়ে আছ যেন এই প্রথম চার চোখের মিলন হল!’
নয়না ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায় ওর দিকে, বলে, ‘ইচ্ছে করছে, থুতু ছিটিয়ে কানের লতিতে কুট করে কামড়ে দিই।’
সুপ্রতিম ওর দিকে বাঁ-কান এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও, তাই দাও। পারলে কপালের পাশে একটা কাজলের টিপও বসিয়ে দাও।’
নয়না ওর কানটা কষে মুলে দিয়ে বলে, ‘সাবধান! কারও দিকে বেশিক্ষণ তাকাবে না। কেউ যেন নজর না-দেয়। তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যবে।’
‘টিভির মধ্যে দিয়ে কারও দিকে তাকানো যায়! তবে মোনা তো পাশে থাকে, ওর দিকে না-তাকিয়ে উপায় নেই…।’
‘মোনা খুব ভালো মেয়ে। বরং তোমাকেই বিশ্বাস নেই।’
মোনার সঙ্গে নয়নার পরিচয় আছে। মোনা অনেকবার সুপ্রতিমের বাড়িতে এসেছে। দরকারে-অদরকারে প্রায়ই ফোন করে। নয়না ওকে খুব পছন্দও করে।
মোনা এলাহাবাদের চৌকস মেয়ে। বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ। সুন্দর, স্মার্ট। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলে সামান্য লালচে ভাব। টানা-টানা চোখ। শুধু ওর বাংলায় সামান্য টান আছে।
ও সুপ্রতিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। ওর কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তেই শেখার চেষ্টা করে। কথায়-কথায় বলে, ‘সুপ্রতিমদা, ইউ আর সিম্পলি লাজবাব। আপনি ”সাইবার চ্যানেল”-এর অ্যাসেট।’
‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সুপ্রতিমের দারুণ লাগে। অনুষ্ঠানের কিছুটা অংশ আগে রেকর্ড করা হয়। আর খানিকটা লাইভ। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নামী-দামি ডাক্তার-উকিল-জ্যোতিষী ইত্যাদি নানান পেশার মানুষ পালা করে এই অনুষ্ঠানে আসেন। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ এঞ্জিনিয়ারদেরও নিয়ে আসা হয় বিশেষ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। তবে সবশেষে থাকে মজাদার প্রশ্ন-উত্তরের পালা। তখন সুপ্রতিম আর মোনা যেন আরও স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে।
সব মিলিয়ে ‘মুশকিল আসান’ একেবারে সুপারহিট।
দিনকুড়ি আগে একটা খাম এসে পৌঁছয় সুপ্রতিমদের দপ্তরে। খাম খুলেই সুপ্রতিম দ্যাখে ভেতরে একটা টাটকা লাল গোলাপ, আর একটা চিঠি। খামের ওপরে কোনও ডাকটিকিট ছিল না। বোধহয় কেউ কুরিয়ারে পাঠিয়েছে।
চিঠিটা পড়েই সুপ্রতিমের কেমন অস্বস্তি হল।
প্রিয় সুপ্রতিম,
তোমাদের অনুষ্ঠান আমি সবসময় দেখি। খুব ভালো লাগে। তবে তার চেয়েও ভালো লাগে তোমাকে। শুধু তোমাকে দেখার জন্যেই অনুষ্ঠানটা প্রাণভরে দেখতে হয়। অনুষ্ঠানগুলো আমি সবসময় ভিডিয়ো ক্যাসেটে ধরে রাখি। তারপর যখনই মনখারাপ লাগে, তখনই ওগুলো চালিয়ে তোমাকে দেখি। তোমার সব সুন্দর—নাক, মুখ, চোখ, ঠোঁট, এমনকী ভুরুর কাটা দাগটাও। জানো, তোমার ওই কাটা দাগটা নকল করে আমি আমার বুকের বাঁ-দিকে একটা কাটা দাগ এঁকেছি! তোমার প্রতিটি অঙ্গের জন্যে আমার প্রতিটি অঙ্গ সবসময় কাঁদে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু অনুষ্ঠান চলার সময় কিছুতেই স্টুডিয়োর ফোনের লাইন পাই না। তাই বলে চেষ্টা ছাড়িনি। আবার চিঠি দেব। সঙ্গে যে- গোলাপটা পাঠালাম, সেটার কথা টিভিতে বলবে তো! বললে বুঝব আমার ভালোবাসা তুমি ফিরিয়ে দাওনি। অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো—
ঝুমুর চৌধুরী
কলকাতা-১৪
‘সাইবার চ্যানেল’-এর দপ্তরে প্রচুর ‘প্রেমপত্র’ আসে। তাতে মোনার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করতে চাওয়া চিঠিই বেশি, সুপ্রতিমের কম। মোনাকে বিয়ে করতে চেয়েও বেশ কয়েকজন ‘সুপাত্রের’ চিঠি এসেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ওরা কেউই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কারণ, এ-ধরনের স্পন্সরড প্রোগ্রামে এসব উৎপাত খুবই মামুলি ব্যাপার। কিন্তু এই চিঠিটা যেন ঠিক মামুলি নয়। কেমন যেন একটু অন্যরকম।
মোনা চিঠিটা নিয়ে সুপ্রতিমের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকি করে পিছনে লেগেছিল। কিন্তু সুপ্রতিম পুরোপুরি সহজ হতে পারেনি। দু-একদিন চিন্তা করার পর ও মোনার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিঠিটার একটা নির্দোষ উত্তর দিয়ে দেবে।
সাধারণত অফিসের সমস্যা বাড়িতে খুব একটা আলোচনা করে না সুপ্রতিম। কিন্তু ঝুমুর চৌধুরীর চিঠিটার কথা বলল।
নয়না সেটাকে কোনও গুরুত্বই দিল না। বলল, ‘ওর আর কী দোষ বলো! টিভিতে অমন হেসে-হেসে সুন্দর-সুন্দর করে কথা বলবে, আর প্রেমপত্র আসবে না—এ তো হতে পারে না! তুমি বরং বেচারিকে একটা সান্ত্বনাপত্র লিখে দিয়ো। আর শোনো, তোমাকে একটা গুড নিউজ দেব। আমি একটা বই লিখতে শুরু করেছি। নাম দিয়েছি ”সুন্দর সোয়ামীর সমস্যা”—।’
‘ঠাট্টা কোরো না, নয়না।’ কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছে সুপ্রতিম, ‘চিঠিটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।’
নয়না একটা হাতব্যাগে সুতোর নকশা বুনছিল, সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। খামের মধ্যে ফুল পাঠানো, ভুরুর ওই কাটা দাগ নকল করা…। তুমি বরং একটা মামুলি উত্তর দিয়ে দিয়ো। উত্তর না-দিলে আবার যদি কিছু হয়…।’
পরের ‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠানে উত্তর দিয়েছিল সুপ্রতিম।
‘কলকাতা চোদ্দো থেকে গোলাপফুল পাঠিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানকে ভালোবাসা জানিয়েছেন ঝুমুর চৌধুরী। তাঁকে আমাদের শুভেচ্ছা জানাই। আর আপনারা, যাঁরা এখন এই অনুষ্ঠান দেখছেন, আপনাদের জানাই—আপনারা যত খুশি প্রেমপত্র পাঠান, তবে মনে রাখবেন, সেগুলো যেন শুধু এই অনুষ্ঠানের নামেই হয়। আমার বা মোনার নামে নয়। কারণ, আমাদের জীবনে প্রচুর প্রেম আছে। আর বাড়তি প্রেম আমরা চাই না।’ হেসে মোনার দিকে তাকিয়ে সুপ্রতিম জিগ্যেস করেছে, ‘কী বলো, মোনা।’
‘ঠিকই বলেছেন, সুপ্রতিমদা—এই অনুষ্ঠানের জন্যেই প্রেমপত্র দরকার। আর সেইসঙ্গে সমালোচনা। কারণ, এই অনুষ্ঠানকে আমরা আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই। আমরা চাই, এই অনুষ্ঠান হয়ে উঠুক আপনাদের আরও-আরও প্রিয়।’
এই উত্তর ঝুমুর চৌধুরীকে যে খুশি করতে পারেনি, বরং ব্যথা দিয়েছে, সেটা বোঝা গেল ওর পরের চিঠিতে।
প্রিয় সুপ্রতিম,
কিছু দিতেই যদি চাও, তা হলে দুঃখ দাও কেন! তোমার এড়িয়ে যাওয়া উত্তরে খুব দুঃখ পেয়েছি আমি। সারাদিন, সারারাত শুয়ে-শুয়ে কেঁদেছি। তোমাদের অনুষ্ঠানকে ভালোবেসে আমি গোলাপ পাঠাইনি, তোমাকে ভালোবেসে পাঠিয়েছি। তুমি বলেছ তোমার জীবনে প্রচুর প্রেম আছে, বাড়তি প্রেম তুমি চাও না। তোমার মতো সুপুরুষ দেবতাকে অনেকেই যে ভালোবাসবে, সে তো স্বাভাবিক। তাই এ-কথায় দুঃখ পাইনি। তবে তুমি জেনে রাখো, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। আমার বুকের কাটা দাগটায় আমি যখন আঙুল বোলাই তখন বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। মনে হয় যেন আমি তোমার ভুরুতে আলতো করে আঙুলের ছোঁওয়া এঁকে দিচ্ছি। তোমাদের স্টুডিয়োর লাইনটা কবে পাব বলতে পারো! সবসময় খালি এনগেজড! ভাবছি, এবার থেকে বাড়ির ফোনেই তোমাকে ধরার চেষ্টা করব। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে তোমার নাম্বারটা পাব তো! বাড়িতে ফোন করলে তুমি কি রাগ করবে? আমি জানি, তুমি রাগ করবে না—বরং খুশিই হবে। তারপর…একদিন…যখন আমাদের দেখা হবে…ওঃ! আমি আর ভাবতে পারছি না। বিশ্বাস করো সুপ্রতিম, তোমাকে না-পেলে আমি বাঁচব না—তুমিও না। আজ শেষ করছি। অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো—
তোমার, শুধু তোমার
ঝুমুর
চিঠিটা পড়ার পর সুপ্রতিম কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে বসে রইল। ঝুমুরকে ঘিরে এলোমেলো চিন্তা ছুটোছুটি করতে লাগল ওর মাথার ভেতরে। মেয়েটি কেমন যেন অস্বাভাবিকরকম নাছোড়বান্দা। তা ছাড়া চিঠির কোনও-কোনও জায়গায় কি পাগলামির লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে? নইলে সুস্থ কোনও মেয়ে হলে প্রথম চিঠির এড়িয়ে যাওয়া উত্তরেই তো সব বুঝতে পারত, আর তার ভালোবাসার অসুখটাও সেরে যেত।
ঝুমুর বাড়িতে ফোন করতে পারে ভেবে সুপ্রতিম একটু ভয়ও পেল। যদি ও সত্যিই পাগল এবং নাছোড়বান্দা হয় তা হলে তো ফোন করে-করে জ্বালিয়ে মারবে। তখন হয়তো পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া গতি থাকবে না। আর পুলিশে খবর দিলেই তো যত ঝামেলা। বাজে পাবলিসিটি।
আচ্ছা, ও যদি টেলিফোন ডিরেক্টরিতে সুপ্রতিমের ঠিকানা জেনে বাড়িতে এসে হাজির হয়! তা হলে তো আবার সেই থানা-পুলিশ!
প্রায় দু-দিন নানান দুশ্চিন্তার পর সুপ্রতিমের আশঙ্কা ধীরে-ধীরে কেটে গিয়েছিল। ও নয়নাকে বলে রাখল ঝুমুর চৌধুরী নামের কেউ ফোন করলে নয়না যেন বলে দেয় সুপ্রতিম বাড়ি নেই।
পরের দু-দিনে তিনবার ঝুমুরের ফোন এল। তার মধ্যে দুবার সুপ্রতিম সত্যিই বাড়ি ছিল না। আর একবার নয়না আড়চোখে সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে ফোনে বলে দিল, ‘উনি তো এখন বাড়ি নেই।’
‘কখন ওঁকে পাওয়া যাবে বলুন তো?’
‘ওঁর তো ফিরতে-ফিরতে রাত এগারোটা মতন হবে। আপনি বরং প্রোগ্রাম চলার সময় স্টুডিয়োতে ট্রাই করে দেখুন—।’
‘ঠিক আছে। স্টুডিয়োতেই ট্রাই করব।’ রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল ঝুমুর।
নয়না সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, ‘মেয়েটার গলাটা কেমন যেন পিকিউলিয়ার।’
‘পিকিউলিয়ার মানে?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেছে সুপ্রতিম।
‘কেমন যেন আদুরে, খসখসে।’
হো-হো করে হেসে উঠেছে সুপ্রতিম। হাসতে-হাসতেই বলেছে, ‘আদুরে! খসখসে! মাই গুডনেস! কী বিচিত্র অ্যাডজেকটিভ! তুমি সেলাই ছেড়ে সাহিত্য করলে পারতে।’
একটু পরে হাসি থামিয়ে সুপ্রতিম সিরিয়াস ঢঙে জানতে চাইল, ‘অ্যাই, মেয়েটার বয়েস কীরকম হবে বলো তো? আঠেরো-উনিশ? নাকি চল্লিশ-বিয়াল্লিশ?’
‘ঠিক বোঝা গেল না। সাতাশ-আটাশ হবে বোধহয়।’ ইতস্তত করে নয়না বলল।
তারপর থেকেই সুপ্রতিম কেমন এক অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে লাগল। ঝুমুর চৌধুরীর ছবিটা ওর কাছে কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। এ-ধরনের গায়ে-পড়া প্রেমিকাদের ও বহুবার সামাল দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম ও যেন ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শুরু করার পর থেকেই ও স্টুডিয়োতে ঝুমুরের ফোনের জন্য ভয়ে-ভয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
আজ ওর মন বলছে, ফোনটা আসবে। আজ ওদের স্টুডিয়োর ব্যস্ত লাইনে টুক করে ঢুকে পড়বে ঝুমুর।
এবং সুপ্রতিমের আশঙ্কাই সত্যি হল। ঝুমুর যে ফোনটা করেছে সেটা ফোনে সাড়া দেওয়ার পরই ও বুঝতে পারল।
‘হ্যালো—”মুশকিল আসান”—।’
‘সু-সুপ্রতিম! আমি গো…আমি বলছি….ঝুমুর…।’
নয়না ঠিকই বলেছিল। খসখসে আদুরে গলা কেমন যেন ফিসফিসে সুরে কথা বলছে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে পেশাদারি ঢঙে কথা বলল সুপ্রতিম, ‘কাইন্ডলি আপনার পুরো নাম বলুন।’
ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর একটু ধাক্কা খেল: ‘আমায়…আমায় চিনতে পারছ না! আমি ঝুমুর চৌধুরী। কলকাতা চোদ্দো থেকে বলছি। কত কষ্ট করে তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম।’
ওদের টেলিফোন-ব্যবস্থাটা এমন যে, সব কথাবার্তাই টিভির দর্শকরা শুনতে পান। সেইজন্যে সুপ্রতিম বেশ বিব্রত হয়ে পড়ছিল। ও ভাবছিল, কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে টেলিফোনের কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দেবে কি না। না কি রিসিভার নামিয়ে রেখে লাইন কেটে দেবে? কিন্তু পাগল মেয়েটা তো রোজ ফোন করার চেষ্টা করে জ্বালাতন করে মারবে!
এইসব ভাবতে-ভাবতেই সুপ্রতিম কষ্ট করে পেশাদারি হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে। তারপর ওর নিজস্ব ঢঙে জানতে চাইল, ‘বলুন ম্যাডাম, কী আপনার সমস্যা? ”মুশকিল আসান” নিশ্চয়ই তার সমাধান বাতলে দেবে।’
‘আমার…আমার প্রবলেম তুমি। আমি তোমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করব। যখন…যখন আর কেউ থাকবে না। বাড়িতে তিনবার ফোন করেছিলাম…তোমাকে পাইনি। কে ফোন ধরেছিল? তোমার…তোমার ওয়াইফ?’
শেষ প্রশ্নটা দর্শকরা শুনতে পাওয়ার আগেই কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ টিপে কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দিল সুপ্রতিম। কিন্তু রিসিভার নামিয়ে রাখল না। ঝুমুর চৌধুরী সম্পর্কে একটা কৌতূহল ওর মধ্যে মাথাচাড়া দিল।
‘হ্যাঁ—আমার বউ—নয়না। ওকে আমার ভীষণ ভালোবাসি।’ কথাটা বলার সময় আড়চোখে মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল সুপ্রতিম। ওকে হাত নেড়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
‘হুঁঃ! জানতাম!’ বিরক্তি ফুটে উঠল ঝুমুরের গলায়। কিন্তু তারপরই ও কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। খসখসে আদুরে গলার হাসি?
একটু পরে হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কাউকে আমি পরোয়া করি না। কেন জানো? কারণ, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। কবে তোমার বাড়িতে যাব বলো?’ শেষ প্রশ্নটায় যেন কোনও কিশোরীর মিনতি ঝরে পড়ল।
সুপ্রতিমের মন খুব দ্রুত চিন্তা করছিল।
মেয়েটি তো মনে হচ্ছে নিশ্চিত পাগল। ওর সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি বুঝিয়ে বললে কি ওর এই প্রেমের পাগলামি সারতে পারে? ওকে বলবে একবার বাড়িতে আসতে? কিন্তু নয়না যদি কিছু মাইন্ড করে!
প্রতি মঙ্গলবার সন্ধেবেলা নয়না কাছাকাছি একটা সেলাই-স্কুলে এমব্রয়ডারির কাজ শেখাতে যায়। ছ’টায় বেরোয়, দু-আড়াই ঘণ্টা পর ফেরে। ওর হাতের কাজ খুব ভালো। তা ছাড়া সূক্ষ্ম সেলাই নিয়ে সময় কাটাতে ওর বেশ লাগে। মঙ্গলবার সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ তা হলে ঝুমুরকে আসতে বলবে সুপ্রতিম! তখন ফ্ল্যাট ফাঁকাই থাকবে। ঠিকে কাজের লোক বিমলামাসিও রোজ সন্ধেবেলা বাসন মেজে, ঘর মুছে ছ’টার মধ্যেই চলে যায়।
কিন্তু ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে মেয়েটা কোনও কাণ্ড বাধিয়ে বসবে না তো! দুর, কী আর করবে! সুপ্রতিম নিজে ঠিক থাকলে আর ভয় কীসের! কিন্তু মেয়েটার বয়েস কত? সতেরো, আঠেরো, কুড়ি হলে তো ইমোশনাল প্রবলেম হতে পারে।
সুপ্রতিম কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ঠিকমতো আর ভাবতে পারছিল না।
‘কবে যাব বলো?’ খসখসে আদুরে গলায় আবার জানতে চাইল ঝুমুর।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলা। ঠিক সাতটায়।’ সুপ্রতিমের মুখ দিয়ে কেমন যেন আলতোভাবে খসে পড়ল কথাগুলো।
‘তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়িটা আমি দেখে এসেছি। কাঁকুড়গাছিতে।’ সামান্য হাসল ঝুমুর। একটু থেমে তারপর বলল, ‘তোমার ফ্ল্যাটটা তো একতলায়…।’
পলকে ঘাম ফুটে উঠল সুপ্রতিমের কপালে। এর মধ্যেই ওর ঠিকানা বের করে বাড়িটা চিনে এসেছে মেয়েটা! মেয়েটাকে বাড়িতে ডেকে আবার কোনও বিপদ হবে না তো! তখন হয়তো সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে। কিন্তু আর তা ফেরার পথ নেই! তির ছিটকে গেছে হাত থেকে।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলা যাব। ঠিক…সাতটায়…। দেখা হওয়ার আগে আর তা হলে ফোন করব না।’ একটু চুপচাপ। তারপর: ‘আমাকে একপলক দেখলেই তুমি বুঝবে কেন আমার ভালোবাসা অন্যরকম।’ চাপা গলায় কথাগুলো বলে অল্প হাসল ঝুমুর: ‘আই লাভ ইউ, লাভ। তুমি অপেক্ষা কোরো । ঠিক সাতটায়…।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল সুপ্রতিম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্মার্ট ঢঙে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেল। তা সত্ত্বেও সুপ্রতিম মোনার সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে সহজভাবে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল।
‘মোনা, তুমি ভীষণ সেলফিশ।’
‘কেন?’ মোনা দুষ্টু হেসে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে।
‘পাগলের প্রবলেমগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দিব্যি মজায় আছ।’ তারপর দর্শকদের লক্ষ করে: ‘কী, আপনারাই বলুন—।’
মোনাও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, ‘যারা অন্যকে পাগল করে সেইসব পাগলের প্রবলেম তাদেরই সলভ করতে হবে। এটা আপনাদের সকলের প্রতি আমার উপদেশ। আশা করি ঠাট্টা করলাম বলে আপনারা কিছু মনে করবেন না।’ বড় করে হাসল মোনা। তারপর সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, ‘সুপ্রতিমদা, এবার সাক্ষাৎকার-পর্ব শুরু করুন। হাতে আর সময় বেশি নেই—।’
‘হ্যাঁ। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে এসেছেন ডক্টর পার্থসখা মণ্ডল। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। উনি শিশু ও কিশোরদের মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেবেন…।’
এরপর শুরু হয়ে গেল আগে রেকর্ড করা ডক্টর মণ্ডলের সাক্ষাৎকার।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সুপ্রতিম ঠিক করল ঝুমুরের বাড়ি আসার ব্যাপারটা ও নয়নাকে জানাবে না। মোনা ওকে টেলিফোনের কথাবার্তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করেছিল। সুপ্রতিম ওকে সবই বলেছে। শুধু মঙ্গলবার সন্ধে সাতটার ‘সাক্ষাৎকার’-এর কথা বলেনি।
সুপ্রতিম হিসেব করে দেখল মঙ্গলবার আসতে এখনও ঠিক তিনদিন বাকি। সেদিন ওকে স্টুডিয়ো থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
দরজায় কেউ ‘টুং-টাং’ করে কলিংবেল বাজাতেই সুপ্রতিম চমকে উঠল। চকিতে ওর নজর চলে গেল দেওয়ালে টাঙানো শৌখিন ইলেকট্রনিক পেন্ডুলাম ঘড়ির দিকে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়িও শব্দ করে ওকে জানিয়ে দিল এখন ঠিক সাতটা।
ড্রইংরুমের সোফায় বসে ঝুমুরের জন্য অপেক্ষা করছিল সুপ্রতিম। অপেক্ষা করতে-করতে ওর টেনশান ক্রমে বাড়ছিল। নয়না, বিমলামাসি, অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। তখন থেকে সুপ্রতিম ফ্ল্যাটে একা। হাতে সময় পেয়ে সামান্য একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। শরীরের এখানে-ওখানে ডিওডোরান্ট স্প্রে করেছে। হয়তো অবচেতনে ঝুমুরের আসার ব্যাপারটা মাথায় ছিল।
আবার বেজে উঠল কলিংবেল।
ঘোর কাটল সুপ্রতিমের। চটপট উঠে দরজার কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক আই’-এ চোখ রাখল।
ঝুমুর নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। ‘ম্যাজিক আই’-এর লেন্স দিয়ে যেটুকু বিকৃত ছবি দেখা গেল তাতে বলা যায় লোকটি ফরসা, দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখে যেন একটা ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ ভাব।
দরজা খুলল সুপ্রতিম। সঙ্গে-সঙ্গে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ওকে ভাসিয়ে দিল।
লোকটি, অথবা ছেলেটি, সামান্য হাসল। হাসিতে লজ্জা, সঙ্কোচ। কোনওরকমে বুকের কাছে হাত তুলে সৌজন্যের নমস্কারের ভঙ্গি করল। তারপর এক পা বাড়িয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়ল, বলল, ‘একটু কথা আছে।’
উচ্চারণগুলো এতই অস্পষ্ট যে সুপ্রতিমকে বেশ কষ্ট করে কথাগুলো বুঝতে হল।
কখনও-কখনও দু-একজন যশোপ্রার্থী মানুষ সুপ্রতিমের সঙ্গে দেখা করতে আসে। কী করে টিভিতে চান্স পাওয়া যায় তার কৌশল বা সুলুক-সন্ধান জিগ্যেস করে সুপ্রতিমকে বিব্রত করে, বিরক্ত করে। ইনিও বোধহয় সেই দলের—ভাবল ও।
লোকটি বেশ রোগা, উচ্চতায় নিতান্তই খাটো, তবে মাথার চুল বেশ বড়—কষে তেল মেখে কীর্তনীয়াদের মতো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখ টানা-টানা—কেমন এক তন্দ্রার ভাব সেখানে জড়িয়ে আছে। বাঁ-গালে, চোখের সামান্য নীচে, সরষের মাপের একটা কালো জড়ুল। পুরুষটি মেয়ে হলে ওটাকে বিউটি স্পট বলা যেত। পরনে সাদার ওপরে হালকা নীল স্ট্রাইপ দেওয়া ফুল শার্ট, আর নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট।
আর বয়েস কতই-বা হবে! বড় জোর তেইশ-চব্বিশ।
‘বুলন, কী দরকার?’ সুপ্রতিম জিগ্যেস করল।
এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে গেল।
সুপ্রতিমের চোখে চোখ রেখে লোকটি ডানহাতে খোলা দরজার পাল্লাটাকে ঠেলে বন্ধ করে দিল। ‘ক্লিক’ শব্দে নাইট ল্যাচ আটকে গেল।
তারপর আদুরে খসখসে গলায় বলল, ‘তোমাকে চাই গো, তোমাকে চাই—।’
এবং তাড়া-খাওয়া হরিণের ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সুপ্রতিমের গায়ে। ওকে আঁকড়ে ধরে ‘চকাৎ’ শব্দে এক তীব্র চুমু খেল ওর ঠোঁটে।
গায়ে আরশোলা বা মাকড়সা পড়লে মানুষ যেমন ঘেন্না, অস্বস্তিতে শিউরে ওঠে, ঠিক সেইরকম এক প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল সুপ্রতিম। ওর গা ঘিনঘিন করছিল। হাতের পিঠ দিয়ে বারবার করে ঘষে-ঘষে ঠোঁট মুছল।
ছেলেটি পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে উঠে বসে কাতর আকুল চোখে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে। অদ্ভুত এক মেয়েলি সুরে বলল, ‘আমাকে তুমি…চিনতে পারোনি! আমি…আমি…ঝুমুর…ঝুমুর চৌধুরী।’
সুপ্রতিম ভীষণ একটা ধাক্কা খেল।
এতদিন এই ছেলেটাই ওকে মেয়ে সেজে চিঠি দিয়েছে, ফোন করেছে! একটা জঘন্য বৃহন্নলা! এইজন্যই পাগলটা চিঠিতে লিখেছিল: ‘…আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি।’
সুপ্রতিমের গা গুলিয়ে উঠল। ‘ওয়াক’ উঠতে চাইল গলা দিয়ে।
ঝুমুর তখন পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গোলাপ ফুল আর একটা রঙিন কাগজে মোড়া বাক্স বের করে ফেলেছে। সে-দুটো সুপ্রতিমের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই ফুল আর একটা পার্কার পেন…তোমার জন্যে এনেছি। তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না…প্লিজ…।’
ঝুমুর যদি পুরুষ হয় তা হলে ওর গলাটা মেয়েলি। আর যদি ও মেয়ে হত তা হলে বলা যেত গলাটা কেমন যেন পুরুষালি। কিন্তু আসলে ও কী?
ঝুমুর উঠে দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে এল সুপ্রতিমের কাছে। মিষ্টি করে হেসে উপহার দুটো বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি একটুও রাগ করিনি গো। আমার ভালোবাসায় প্রথম-প্রথম এরকম হয়—পরে সব ঠিক হয়ে যায়। এই নাও—।’
সুপ্রতিম কেমন এক অশুভ হাওয়া-বাতাসের ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুমুরের কথায় ঘোর কাটতেই প্রচণ্ড রাগে সপাটে এক ঘুষি বসিয়ে দিল ওর মুখে।
বিশ্রী একটা শব্দ হল। ঝুমুরের ঠোঁট থেঁতলে রক্ত বেরিয়ে এল। ও আবার ছিটকে পড়ল মেঝেতে। উপহারগুলো হাত থেকে পড়ে ছড়িয়ে গেল।
সুপ্রতিম ভেতরে-ভেতরে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছিল। একসঙ্গে অনেক কথা বলতে গিয়ে সব কথা কেমন যেন আটকে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরে অনেক কিছু দপদপ করছে। এখুনি যেন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে।
‘এইমুহূর্তে বেরোও। জানোয়ার কোথাকার! আউট!’ হাঁপাতে-হাঁপাতে চেঁচিয়ে বলল সুপ্রতিম।
কিন্তু ঝুমুর ওর ধমক গ্রাহ্য করল বলে মনে হল না।
রক্তাক্ত মুখে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা। ওর সাদা জামায় রক্তের ছিটে লেগেছে। সেই অবস্থাতেই বিচিত্র বিভঙ্গে শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হসে উঠল ও। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘আমি কিচ্ছু মনে করিনি, হানি। তোমাকে আমি চাই—সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই। হাজার টরচার করেও তুমি আমাকে টলাতে পারবে না। তোমার হাতের ছোঁওয়া আমার কাছে যে কী, তা তুমি জানো না। আর…আর এইটা দ্যাখো—।’ বলে একটানে জামাটা ছিঁড়ে দিল ঝুমুর। কয়েকটা বোতাম ছিঁড়ে ছিটকে গেল। বুকের কাছটায় অনেকখানি ফেঁসে গেল জামাটা। আর তখনই ঝুমুরের খালি বুক দেখা গেল।
ওর ঈষৎ মেয়েলি ঢঙের বুকে বাঁদিকে সত্যিকারের একটা ছোট্ট কাটা দাগ। সুপ্রতিমের ডান ভুরুর দাগটার তো।
ঝুমুর চিঠিতে লিখেছিল, ও বুকে একটা কাটা দাগ ‘এঁকে’ নিয়েছে। কিন্তু এ তো সত্যিকারের কাটা দাগ ব্লেড, ছুরি অথবা ক্ষুর দিয়ে চিরে ও তৈরি করেছে!
আবার খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুমুর। রক্তমাখা মুখে ওর হাসি কেমন অলৌকিক দেখাচ্ছিল।
হঠাৎই ও আবার ঝাঁপিয়ে এল সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম খপ করে এক হাতে ওর গলা চেপে ধরল। তারপর ওর পলকা শরীরটাকে পিছনদিকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে গেল দরজার কাছে।
‘য়ু সান অফ আ বিচ! ফাকিং গে বাস্টার্ড! আর কখনও যদি আমাকে ডিসটার্ব করো তা হলে একেবারে খুন করে ফেলব!’
দরজা খুলে ঝুমুরের দেহটাকে বলতে গেলে বাইরে ছুড়ে দিল সুপ্রতিম। ওর মাথাটা সিঁড়ির রেলিঙে ঠুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। ও কাত হয়ে টলে পড়ে যেতে গিয়েও সিঁড়ির রেলিং ধরে কোনওরকমে সামলে নিল। ঘোলাটে নজরে তাকাল ওর ভালোবাসার পুরুষের দিকে। জড়ানো খসখসে গলায় বলল, ‘আমি কিছুই মাইন্ড করিনি। যতই ফিরিয়ে দাও, আবার আমি আসব। একদিন-না-একদিন তুমি আমাকে মেনে নেবেই…।’
ওর গায়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল সুপ্রতিম। তারপর দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিমের সারা শরীর অবসাদ আর ক্লান্তিতে কেমন ভারী হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ও চোখ বুজে হাঁপাতে লাগল।
এক অদ্ভুত গ্লানি সুপ্রতিমকে জড়িয়ে ধরেছিল। বারবার ‘ওয়াক’ উঠে আসতে চাইছিল ওর গলা দিয়ে। এরকম গা-ঘিনঘিনে ঘটনার কথা কাউকে কি বলা যায়! শেষ পর্যন্ত কি সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে?
ঝুমুরকে ঘুষি মেরে সুপ্রতিমের ডানহাতের পিঠটা ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছিল। ছড়ে যাওয়া জায়গাটা ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে-জোরে কয়েকবার চুষল ও। তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা দলিত গোলাপ আর রঙিন প্যাকেটটার দিকে তাকাল। ঝুমুরের রক্ত-মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল আবার।
গোপনে কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা করলে সে ঘটনাটা নয়নার কাছে ও অবশ্যই গোপন করতে চাইত। কিন্তু এই ব্যাপারটা এত অস্বস্তির আর এত লজ্জার যে, এটা আরও বেশি করে গোপন করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু নয়নাকে বলতে হবেই—সে ও যা-ই ভাবুক।
সব রকম দ্বিধা কাটিয়ে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেল সুপ্রতিম। নয়নাকে সেলাই-স্কুলে ফোন করে এখনই বাড়ি আসতে বলবে। তারপর…।
নয়নাকে সব কথা খুলে বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের কান্না পেয়ে গেল। একটা অসহ্য রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ওর ভেতরে দলা পাকিয়ে উথলে উঠছিল। নয়নাকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রতিম বাঁচার একটা পথ খুঁজছিল। সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত ওর শত্রু হয়ে দাঁড়াল! এমনই সুপুরুষ-সৌন্দর্য যে, একজন পুরুষও তার প্রেমে পড়ে যায়!
সারাটা রাত ওদের উথালপাথালভাবে কাটল। শেষ পর্যন্ত নয়না ওকে বলল, ব্যাপারটা থানায় জানানো দরকার।
সুপ্রতিম রাজি হল। তারপর মোনাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আপাতত সাত-দশদিন ওর পক্ষে অফিস করা সম্ভব হবে না। না, না, তেমন সিরিয়াস কোনও ব্যাপার নয়। পারিবারিক কয়েকটা ব্যাপারে হঠাৎই চাপ এসে পড়েছে। ওরা যেন সুপ্রতিমের বদলে আর কাউকে দিয়ে কটা দিন কাজ চালিয়ে নেয়।
সুপ্রতিম জানে, ওরা বিপ্লব সরকার কিংবা অনির্বাণ পুরকায়স্থকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবে। আগেও দু-একবার এরকম হয়েছে।
মোনা অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সুপ্রতিম ঝুমুরের ব্যাপারে মোনাকে বিন্দুবিসর্গও বলল না। ও চাইছিল না ব্যাপারটা বেশি জানাজানি হোক। অদ্ভুত এক লজ্জা আর সঙ্কোচ ওর গলা টিপে ধরছিল।
নয়না আর সুপ্রতিম বেলা বারোটা নাগাদ থানায় পৌঁছল।
বাইরের ঘরটায় কয়েকটা লম্বা-লম্বা বেঞ্চি পাতা। একপাশে বড় মাপের একটা টেবিল। তাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। টেবিলে পুরোনো আমলের টেলিফোন, কিছু ফাইলপত্র, বড় কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল।
ঘরটা এমন অন্ধকার-অন্ধকার যে, দিনের বেলাতেও দু-দুটো টিউব লাইট জ্বেলে রাখতে হয়েছে। সিলিং-এ সাবেকি একটা বেঢপ পাখা ঢিমে তালে ঘুরছে। তার হাওয়ায় দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে-থেকে কেঁপে উঠছে।
টেবিলের ওপাশে সাদা ইউনিফর্ম পরে একজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। বয়েস বড়জোর পঁয়তিরিশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে উদাসীন বিরক্ত ভাব।
টেবিলে রাখা কাঠের নেমপ্লেট পড়ে জানা গেল অফিসারের নাম টি. দাস, সাব-ইনস্পেকটর।
সুপ্রতিম আর নয়না বসল।
দাসবাবু সপ্রশ্ন নজরে ওদের দিকে তাকালেন।
একটু ইতস্তত করে সুপ্রতিম বলল, ‘আমি…আমি…একটা ডায়েরি করতে চাই।’
কথা বলতে-বলতে ও চারপাশে দেখছিল। দু-একজন লোক এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। তাদের চোখেমুখে ব্যস্তসমস্ত ভাব।
সুপ্রতিমের মনে হল, দাসবাবু ছাড়া আর কেউ ওদের কথা শুনতে পাবে না। তাই দাসবাবু যখন ডায়েরি-বই নিয়ে ডটপেন বাগিয়ে বললেন, ‘বলুন—।’, তখন ও প্রথমে নিজের পরিচয় দিল, তারপর সহজভাবেই ঝুমুরের ব্যাপারটা বলে গেল। টেবিলের আড়ালে নয়না ওর একটা আঙুল ছুঁয়ে ওকে সাহস জোগাচ্ছিল। ও টের পেল, সুপ্রতিমের আঙুল কাঁপছে।
কিছু লেখার আগে দাসবাবু ব্যাপারটা শুনে নিচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝে ছোটখাটো শব্দ করছিলেন, আর ডনপেনটা ডায়েরি-বইয়ের পাতায় ঠুকছিলেন।
শুনতে-শুনতে একসময় তাঁর মুখে মজা পাওয়ার ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
হঠাৎই একজন সাদা-পোশাকের অফিসার সিগারেট টানতে-টানতে এগিয়ে এলেন। ধপ করে বসে পড়লেন দাসবাবুর পাশের চেয়ারটায়। আড়চোখে নয়নার সৌন্দর্য চেটে নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, ‘কী কেস, দাস?’
‘হোমো কেস।’ দাস মুচকি হেসে বললেন।
নয়না আর সুপ্রতিম ‘হোমো’ শব্দটা শুনে কেমন যেন সিঁটিয়ে গেল।
‘বলুন, তারপর কী হল—’ সুপ্রতিমকে তাড়া দিলেন দাস।
খুঁড়িয়ে চলা ছ্যাকড়াগাড়ির মতো থতিয়ে-থতিয়ে কথা শেষ করল সুপ্রতিম। টের পেল, ওর ঘাড়ে, গলায়, কপালে ঘাম জমছে।
ওর কথা শেষ হওয়ামাত্রই সাদা-পোশাকের অফিসারটি বলে উঠলেন, ‘এ-ডায়েরি নিয়ো না, দাস—এই ভদ্রলোক ফেঁসে যাবেন।’
দাসবাবু ওঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, শঙ্করদা।’
নয়না অবাক চোখে জানতে চাইল, ‘কেন? ডায়েরি নেবেন না কেন? লোকটা আমাদের লাইফ হেল করে দিচ্ছে…।’
‘সবুর, ম্যাডাম, সবুর…।’ সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে সাদা-পোশাকের অফিসারটি বললেন, ‘একটু মাথা খাটান, তা হলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। একটা ইয়াং ছেলে আপনার হাজব্যান্ডকে ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছে। মানছি, অন্যায় করেছে। কিন্তু তার বদলে আপনার হ্যাজব্যান্ড কী করেছেন? না ছেলেটাকে তুলোধোনা করে মুখ-মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছেন। কী, ঠিক বলছি তো?’ শেষের প্রশ্নটা সুপ্রতিমকে লক্ষ করে।
সুপ্রতিম কোনও জবাব না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইল। নয়নাও ঠিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
সাদা-পোশাকের অফিসারের কথায় খেই ধরে দাস সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই ছেলেটা যদি থানায় এসে আপনার নামে ডায়েরি করে তা হলে তো আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন। তখন বিচ্ছিরিরকম স্ক্যান্ডাল হবে, লোকজানাজানি হবে—একটা কেলো হয়ে যাবে।’ একটু সময় দিলেন ওদের। তারপর: ‘তার চেয়ে বরং বাড়ি যান। ছেলেটা আবার এলে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে নিন। ওর সঙ্গে মিউচুয়াল করে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনও ওয়ে আউট দেখছি না। শঙ্করদা কী বলেন?’ সাদা-পোশাকের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন দাস।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে-দিতে শঙ্করবাবু বললেন, ‘এ ছাড়া কোনও পথ নেই। এসব হোমো কেস নিয়ে ক্যাচাল যত কম হয় আপনাদের পক্ষে ততই ভালো। তবে এরপর কী হয়-না-হয় সেটা আমাদের ইনফর্ম করতে পারেন। সিরিয়াস কোনও টার্ন নিলে তখন…।’
সুপ্রতিম আর নয়না ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অফিসাররা যে ঠিক কথাই বলছেন, সে নিয়ে ওদের মনে কোনওরকম সন্দেহ ছিল না।
এক অদ্ভুত আতঙ্কে অবশ হয়ে শোলার পায়ে ওরা বাড়ি ফিরে এল। নয়না মনে-মনে ভাবছিল, কেমন দেখতে এই ঝুমুর চৌধুরীকে?
সুপ্রতিম যখন ফ্ল্যাটের দরজায় নাইট ল্যাচের চাবি ঘোরাচ্ছে তখন শুনতে পেল ঘরের ভেতর টেলিফোন বাজছে।
দরজা খুলে তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরল সুপ্রতিম।
‘হ্যালো—।’
‘সুপ্রতিম…মাই লাভ…আই লাভ য়ু…।’
নয়না স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখল ওর মুখটা চোখের পলকে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নয়না বুঝতে পারল, সুপ্রতিমকে কে ফোন করেছে।
ঝুমুরের টেলিফোনের উৎপাত চলতেই থাকল, কিন্তু সুপ্রতিম কিছুতেই আর বিরক্ত হল না। থানার দুই অফিসারের কথা ওর মনে ছিল। তাই ও মোলায়েমভাবে কথা বলে ঝুমুরকে নিরস্ত করতে চাইল। ওকে অনুনয় করে বলল, ‘তুমি যেরকম ভালোবাসা চাও আমার মধ্যে সেরকম ভালোবাসা নেই। তুমি ভুল করছ—।’
ওকে বাধা দিয়ে আদুরে ঢঙে ঝুমুর বলল, ‘না, না, ভুল নয়। তুমি আমার কাছে ধরা দিলেই বুঝবে আমি ভুল করিনি। আমি মনের মতো মনের মানুষ পেয়েছি।’
সুপ্রতিম অনেক চেষ্টা করেও গা-ঘিনঘিন করা ভাবটা চেপে রাখতে পারেনি। এবং টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
কিন্তু পরে আবার ঝুমুরের ফোন এসেছে।
সুপ্রতিম প্রতিবারই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ফল হয়েছে উলটো। ফোনের ও-প্রান্তে ঝুমুর কেঁদে ভাসিয়েছে। আত্মহত্যা করবে বলে ওকে ভয় দেখিয়েছে। কখনও বলেছে, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। কখনও বলেছে, ট্রেনের তলায় মাথা দেবে। আবার কখনও-বা বলেছে, গলায় দড়ি দেবে।
সুপ্রতিম বেশ বুঝতে পারছিল, ওর জীবনের কোথায় যেন পূর্ণগ্রাস গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে।
ঝুমুরের নিয়মিত ফোন আর ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম সুপ্রতিমকে অতিষ্ঠ করে তুলল। কয়েকদিন পর ওর মনে হতে লাগল ও বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সত্যি-সত্যিই ঝুমুরের ‘অন্যরকম’ ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।
সুপ্রতিমের এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধে সাতটা নাগাদ ওদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।
নয়না বাড়িতে নেই। সেলাইয়ের স্কুলে গেছে। সুপ্রতিমকে একা রেখে ও যেতে চায়নি, কিন্তু সুপ্রতিমই জোর করে ওকে পাঠিয়েছে, বলেছে, ‘আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! তা ছাড়া ওই ঝুমুর চৌধুরীকে ভয়ের কী আছে! আগের দিন তো ওকে বেধড়ক ঠেঙিয়েছি। আজ যদি হতচ্ছাড়াটা আসে তা হলে হকি স্টিক দিয়ে পেটাব।’
সুপ্রতিম একসময় হকি খেলত। ওর হকি স্টিকটা বেডরুমের দেওয়ালের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা থাকে। সেটা এখন ও ড্রইংরুমের সোফার তলায় এনে রেখেছে। কারণ, ওর মন বলছিল, ঝুমুর যেরকম খ্যাপা তাতে ও মঙ্গলবার সন্ধে সাতটায় আবার ওদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দিতে পারে—সুপ্রতিমকে একা পাওয়ার জন্য।
তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই চমকে উঠেছিল সুপ্রতিম। তারপর সর্তক পায়ে দরজার কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক আই’ দিয়ে উঁকি মেরেছে।
না, ঝুমুর চৌধুরী নয়। দরজায় দাঁড়িয়ে ন্যাড়া মাথা গোঁপওয়ালা একজন লোক।
দরজা খুলে দিল সুপ্রতিম।
রোগা ছোটখাটো চেহারার লোকটি ঘরে ঢুকে পড়ল। তার হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস। শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে একেবারে ফিটফাট। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি।
সেলসম্যান নাকি! ভাবল সুপ্রতিম। কিন্তু এই সন্ধে সাতটায় কী বিক্রি করতে এসেছে?
সুপ্রতিম ভদ্রতা করে বলল, ‘বলুন, কী চাই?’
‘খুব ইম্পর্ট্যান্ট বিজনেস।’ চাপা গলায় অস্পষ্টভাবে বলল লোকটি। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিম লোকটির দিকে পিছন ফিরে সোফার দিকে একটা পা বাড়িয়েছিল, দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ভুরু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
ততক্ষণে ঝুমুর ওর নকল গোঁফটা একটানে খুলে ফেলে দিয়েছে ঘরের মেঝেতে। আর হাতের ব্রিফকেসটাও একপাশে নামিয়ে রেখেছে।
‘তুমি!’
‘হ্যাঁ, গো, আমি। তোমার কাছে না এসে থাকতে পারলাম না। ফোনেই তো বলেছিলাম, তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যদি তুমি মুখের ওপরে দরজা দিয়ে দাও, তাই মাথা ন্যাড়া করে নকল গোঁফ লাগিয়ে আসতে হয়েছে…।’
ঝুমুর বিচিত্র ঠমক-ঠামক করে কথা বলছিল। কটাক্ষ হানছিল। ঠোঁটের কোণ কামড়াচ্ছিল।
সুপ্রতিম পাথর হয়ে তাকিয়ে ছিল অদ্ভুত এই প্রাণীটার দিকে। আর প্রাণপণে গা-ঘিনঘিন করা ভাবটাকে সামাল দিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল।
‘তুমি রাগ করলে না তো! তোমার ওপরে আমার কোনও রাগ নেই। যাকে ভালোবাসি তার ওপরে কি রাগ করে থাকা যায়!’
কথাগুলো বলেই সুপ্রতিমের দিকে ঝাঁপিয়ে এল ঝুমুর। সুপ্রতিম ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই ও আবেগজর্জর প্রেমিকার মতো সুপ্রতিমের বুকে মুখ ঘষতে লাগল, আর ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগল, ‘আমায় আদর করো। লক্ষ্মীসোনা, আমায় আদর করো। আমি আর পারছি না। প্লিজ…প্লিজ…। আমার শুধু বাইরেটা পুরুষ—ভেতরটা নয়।’
সুপ্রতিম মুখ নামিয়ে দেখল একটা ন্যাড়া মাথা ছেলে ওর বুকে মুখ ঘষছে। ও এমন নির্লিপ্তভাবে দেখছিল, যেন ওটা ওর বুক নয়—অন্য কোনও পুরুষের বুক।
হঠাৎই বিকট শব্দে ‘ওয়াক তুলল সুপ্রতিম। ওর সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। এবং একইসঙ্গে এক ঝটকায় ঝুমুরকে ছিটকে ফেলে দিল ও। তারপর মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বারবার বমির হেঁচকি তুলতে লাগল।
ওর গলার পাশে শিরা ফুলে উঠল। খানিকটা জল আর লালা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
ঝুমুর তখন মেঝেতে সোজা হয়ে বসেছে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে সুপ্রতিমের দিকে। আর গুনগুন করে গাইছে, ‘…তোমার আদর পেলে আমি স্বর্গে চলে যাই/মর্ত্যে যে আর আমার কিছু নাই…।’
একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল সুপ্রতিমের মাথায়। ওর চোখ চলে গেল সোফার নীচে—হকি স্টিকের দিকে। হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে ওটা। চুলোয় যাক দাসবাবু আর শঙ্করবাবুর হিতোপদেশ! দাঁত বের করে বসে থাকা ওই জানোয়ারটা ওঁদের তো কিছু করেনি! শুধু সুপ্রতিমের জীবনটাকে নরক করে তুলেছে।
কয়েকসেকেন্ড নিজের সঙ্গে লড়াই করল সুপ্রতিম। তারপর ডানহাত বাড়িয়ে দিল হকি স্টিকটার দিকে। ওটা আঁকড়ে ধরল শক্ত মুঠোয়।
আজ শুয়োরের বাচ্চাটার একদিন কি আমার একদিন। দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল ও।
তারপর হকি স্টিক হাতে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। দু-পা ফেলে পৌঁছে গেল ঝুমুরের কাছে। এবং খ্যাপা দাঁতালো শুয়োরের রাগ নিয়ে হকি স্টিক চালাতে শুরু করল।
ছোটবেলায় ধুনুরিদের লেপ-তোশক তৈরি করতে দেখেছে সুপ্রতিম। শীতের রোদে ছাদে বসে জমাট বাঁধা শক্ত তুলোকে তারা পিটিয়ে-পিটিয়ে নরম করে। এখন হকি স্টিক চালাতে-চালাতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। তবে ধুনুরিদের শব্দ যদি সত্তর-আশি ডেসিবেল হয় তা হলে সুপ্রতিমের আঘাতের শব্দ কম করেও একশো ডেসিবেল। তা ছাড়া ধুনুরিদের বেলা এমন রক্তারক্তি ব্যাপারটা ছিল না।
সুতরাং মেঝেতে বসে থাকা ছোটখাটো ছেলেটাকে নিষ্ঠুরভাবে তালগোল পাকিয়ে দিল সুপ্রতিম। ঝুমুর ওর পায়ের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে কুকুরছানার মতো কেঁউকেঁউ করতে লাগল। শব্দটা কেমন কান্না মেশানো গোঙানির মতো লাগছিল। ওর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, জামায় রক্তের ফোঁটা ছিটকে লেগেছে, শরীরটা যেন ভাঙাচোরা ‘দ’ হয়ে গেছে।
উন্মত্ত রাগ কমে এলে সুপ্রতিম হকি স্টিকটা একপাশে ছুড়ে ফেলে দিল। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাপরের মতো হাঁপাচ্ছিল ও। ভাবছিল, এত শব্দ-টব্দ পেয়ে লোকজন না ছুটে আসে ওর ফ্ল্যাটে। তারপর থানা-পুলিশ…।
কয়েকসেকেন্ড অন্যমনস্ক হয়েছিল সুপ্রতিম। সেই ফাঁকেই ওর ঊরুতে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
তালগোল পাকানো ছেলেটা বিদ্যুৎগতিতে হাত চালাল। একবার, দুবার, তিনবার। প্রথম দুবার ঊরুতে, তৃতীয়বার হাঁটুর নীচে।
সুপ্রতিমের মনে হল ওর পায়ে জ্বলন্ত কয়লা ঘষে দিয়েছে কেউ। ও ঝুঁকে পড়ে পা চেপে ধরল।
আর তখনই ওর কোমরে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
যত না যন্ত্রণা পেল তার চেয়ে বেশি অবাক হল সুপ্রতিম। ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না ওর পায়ের কাছে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ক্ষীণজীবী মাংসপিণ্ডটা এইরকম ভয়ানক কাজ করতে পারে।
সুপ্রতিম পড়ে গেল মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই পাগলটা লাফিয়ে উঠে এল ওর শরীরের ওপরে। ডানহাতে ধরা ক্ষুরটা চেপে ধরল সুপ্রতিমের বাঁ-কানের নীচে, খসখসে আদুরে গলায় বলল, ‘ভালোবাসা আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই গো। তোমাকে খতম করে দিলে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা না-পেলে কষ্ট যে আরও বেশি! আই লাভ য়ু, ডার্লিং…।’
খুব কাছ থেকে ঝুমুরের মুখটা লক্ষ করে এই প্রথম ওকে ভয় পেল সুপ্রতিম। ওরা দুজনেই হাঁপাচ্ছিল। একজনের নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই-অক্সাইড ঢুকে পড়েছিল আর-একজনের নাকে। তাই ওদের দুজনেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।
এক অজানা ভয়ে সুপ্রতিম কাঠ হয়ে গেল। ও টের পাচ্ছিল, ওর কোমর, ঊরু, পা থেকে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। নয়না এখনই এসে পড়ছে না কেন! নয়নার ফিরে আসার জন্য মনে-মনে আকুল প্রার্থনা করতে লাগল ও।
ঝুমুর হিসহিস করে বলল, ‘অসভ্যতা করলে গলা ফাঁক করে দেব। আর যদি চেঁচাও, তা হলে চিৎকারটা মুখ দিয়ে বেরোবে না—গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে।’
ঝুমুর সুপ্রতিমের বুকের ওপরে উঠে বসল। বাঁহাতে টান মেরে সুপ্রতিমের জামা ছিঁড়ে দিল। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর বুকে ক্ষুর চালিয়ে আড়াআড়ি দাগ টেনে দিল।
সুপ্রতিম যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল।
ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করে ঝুমুর বলল, ‘চুপ, সোনামণি। অনেক কষ্ট সয়ে তবেই আসল ভালোবাসা পাওয়া যায়।’
প্যান্টের পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করল ঝুমুর। ডান হাতে ক্ষুর নাচাতে-নাচাতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা সুপ্রতিমের মাথার দিকটায় গেল। তারপর উবু হয়ে বসে পড়ল। ক্ষুরটা হাতের কাছেই নামিয়ে রেখে ‘নোড়ো না, লক্ষ্মীটি। নইলে বিপদ হবে।’ বলতে-বলতে সুপ্রতিমের দুটো হাত বাঁধতে শুরু করল।
হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেলে দড়িটা প্রান্তটা বেঁধে দিল একটা সোফার দু-পায়ার সঙ্গে। এখন অনেক চেষ্টা করে সুপ্রতিম সোফাটাকে সামান্য নাড়াতে পারবে হয়তো, কিন্তু সুপ্রতিম কোনওরকম চেষ্টা করছিল না। ও চোখ ঘুরিয়ে ‘অন্যরকম’ ঝুমুরকে লক্ষ করছিল, আর মৃত্যুভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল।
দড়ির বাকি অংশটা ক্ষুর দিয়ে কেটে নিল ঝুমুর। চলে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। পা দুটো জোড়া করে শক্ত করে বাঁধল।
এমন সময় ঘরের টেলিফোন বাজতে শুরু করল।
ঝুমুর টেলিফোনটার দিকে একবার তাকাল শুধু। তারপর টেলিফোনের শব্দ কোনওরকম গ্রাহ্য না করে আর-একটা সোফা টেনে নিয়ে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। জোড়া পা বাঁধা পড়ল সোফার দু-পায়ার সঙ্গে।
ঝুমুর এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে অদ্ভুতভাবে হাসল। ক্ষুরটা রেখে দিল সোফার ওপরে। তারপর নিজের পোশাক খুলতে শুরু করল। সুপ্রতিম ভয়ার্ত চোখে ওকে দেখতে লাগল।
বাজতে-বাজতে ক্লান্ত হয়ে টেলিফোন থেমে গেল একসময়।
ততক্ষণে সুপ্রতিমের চোখের সামনে প্রকাশিত হয়েছে প্রায়-নগ্ন ঝুমুর। ওর পরনে শুধু একটা গাঢ় নীল রঙের জাঙ্গিয়া।
ফরসা ফ্যাকাসে রোগা শরীর, ন্যাড়া মাথা, মাথায় রক্তের দাগ, গলায় সামান্য রক্তের ছিটে, মুখে চওড়া হাসি, অথচ ঠান্ডা চোখ। ঝুমুরকে কেমন যেন অলৌকিক প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল।
এইবার ব্রিফকেসটা টেনে নিয়ে মেঝেতে বসল ঝুমুর। ওটা খুলতেই দেখা গেল মেয়েলি প্রসাধনের নানান জিনিস। একটা হাত-আয়না নিয়ে ঝুমুর সাজতে বসল। আর একইসঙ্গে গুনগুন করে গাইতে লাগল: ‘ভালোবাসার তুমি কী জানো? ভালোবাসার তুমি কী জানো? উঁ…উঁ…উঁ…পায়ের উপর পা-টি তুলে/হিসাবের খাতা খুলে/ বসে রও আপন ভুলে/যত বলি ঢের হয়েছে/মানা না মানো।/ভালোবাসার তুমি…উঁ…উঁ…উঁ…।’
মুখে পাউডার-ক্রিম ইত্যাদি মাখা হয়ে গেলে চোখে কাজল পরতে শুরু করল। তারপর চোখের পাতার ওপরে রং ঘষতে লাগল। মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান দিক থেকে নিজের প্রসাধন আয়নার পরখ করল।
প্রসাধনে সন্তুষ্ট হয়ে হাতে লিপস্টিক তুলে নিল ঝুমুর। লাল ডগাটা বের করে ঠোঁটে ঘষতে লাগল। এবং সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েকবার কোমর বেঁকিয়ে-চুরিয়ে মেয়েলি নাচের ভঙ্গি করল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে এল অসহায় রক্তাক্ত সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম শুয়ে-শুয়েই স্নো-পাউডারের গন্ধ পেল।
সুপ্রতিমের ঠোঁটে, মুখে, বুকে লিপস্টিক ঘষে দিল ঝুমুর। তারপর লিপস্টিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওকে কষে চটকাতে লাগল, আর জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি তোমায় বড় ভালোবাসি/তোমার বড় ভালোবাসি…আমি তোমায় বড় ভালোবাসি…।’
সুপ্রতিম ভাবছিল, ও কি বেঁচে আছে? এই ঘটনাগুলো কি সত্যি? না কি দুঃস্বপ্ন!
‘বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো। একবার বলো, আমায় ভালোবাসো। তুমি আমার—আর কারও নয়। শুধু একবার বলো…।’
অসুস্থ উন্মত্ত ছেলেটা সুপ্রতিমের জামা সরিয়ে দিয়ে খোলা বুকে মুখ ঘষছে। ঠোঁটে, গালে, চোখে যথেচ্ছ চুমু খাচ্ছে। হাতড়াচ্ছে যেখানে-সেখানে। আর অনর্গল ভালোবাসার কথা বলছে।
ঝুমুর ওর প্যান্টের বোতাম খোলা শুরু করতেই সুপ্রতিম চাপা চিৎকার করে উঠল।
‘কী, কষ্ট হচ্ছে?’ ঝুমুর নিষ্পাপ স্বরে জিগ্যেস করল, ‘তুমি শুধু একবার বলো, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে…তা হলেই তোমার সব বাঁধন খুলে দেব। তুমি শুধু আমায় একটা চুমু খাও…একটা…তা হলেই আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে যাব।…শুধু একবার…।’
সুপ্রতিমের গলা দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু গলা ফাঁক হয়ে যাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো।। ওর মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা করা দরকার…।
দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রতিম কোনওরকমে বলল, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি, ঝুমুর।’
প্যান্টের জিপার খুলতে গিয়ে ঝুমুরের হাত থেমে গেল। ও আদুরে গলায় বলল, ‘কী বললে গো? আর-একবার বলো। প্লিজ…।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরও ভালোবাসতে চাই…। আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও, প্লিজ…।’ কথা বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের দম আটকে যাচ্ছিল।
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো চট করে উঠে পড়ল ঝুমুর। হাঁপাতে-হাঁপাতে সুপ্রতিমের বাঁধন খুলতে শুরু করল। উত্তেজনায় ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
বাঁধন খোলা হতেই সুপ্রতিমের কপালে হাত বুলিয়ে নরম সুরে ঝুমুর বলল, ‘নাও, এবার ওঠো।’
ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে বসল সুপ্রতিম। কাটা জায়গাগুলো ভীষণ জ্বালা করছে।
ঝুমুরের আর তর সইছিল না। ও সুপ্রতিমের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। ওর কোলে উঠে বসল একেবারে।
সুপ্রতিমের মনে হল একটা কোলাব্যাঙ ওর কোলে বসে আছে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ও ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে-গালে চুমু খেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আই লাভ য়ু, ঝুমুর…।’
শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসা বমির দমক রুখে দিয়ে সুপ্রতিম ভাবল, নয়না এখনও আসছে না কেন।
আর ঠিক তখনই ঝুমুরের নগ্ন কাঁধের ওপর দিয়ে সোফার ওপরে পড়ে থাকা ক্ষুরটা ও দেখতে পেল। হাতের প্রায় নাগালে রয়েছে ওটা।
ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে কোনওরকমে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুপ্রতিম। পলকা ছেলেটা সুপ্রতিমের আশ্লেষে আনন্দে টইটম্বুর হয়ে ভালোবাসার প্রলাপ বকছে শুধু। আর সুপ্রতিম নিজের প্রাণ বাঁচাতে একের-পর-এক চুমু খেয়ে চলেছে ওর স্নো-পাউডার মাখা মুখে।
ক্ষুরটা এখন পুরোপুরি সুপ্রতিমের হাতের নাগালে।
ও মুঠো করে অস্ত্রটা ধরল। তারপর ঝুমুরকে আদর করতে-করতে ক্ষুরটা দিয়ে এল ওর গলার খাঁজের কাছে।
কতক্ষণ আর সুপ্রতিমের শক্তি থাকবে কে জানে! মাথা ঝিমঝিম করছে। রক্তে চটচট করছে হাত-পা-বুক।
চুলোয় যাক ভদ্রতা, সভ্যতা, নীতি, দয়া ইত্যাদি।
আত্মরক্ষা মানুষের একটা আদিম ধর্ম।
বাঁহাতে ঝুমুরের মাথাটা পিছনে ঠেলে দিয়েই ডান-হাতে ক্ষুর টেনে দিল সুপ্রতিম।
ঝুমুরের ভালোবাসার প্রলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। তার বদলে ঘরঘর শব্দ বেরোতে লাগল মুখ আর গলা দিয়ে।
রক্তে মুখ-গলা-বুক ভেসে গেল সুপ্রতিমের। ওর মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ও জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝুমুরের মৃতদেহ তখনও ওকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
একটি অচেতন দেহ ও একটি মৃতদেহ অসাড় হয়ে নয়না অথবা আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রক্তের ধারা তখন মেঝেতে গড়িয়ে-গড়িয়ে সময়ের হিসেব রাখছিল।
অশ্লীল-বিলাস
বড় রাস্তার ওপরেই দোকানটা। ফুটপাথ থেকে তিনটে ধাপ উঠে গেছে দোকানের কার্পেট পাতা মেঝে পর্যন্ত। বিশাল দরজা। দু-পাশের দ্রষ্টব্য শো-কোসে সাজানো রঙিন প্রচ্ছদের দেশি-বিদেশি বই। দরজার ওপরে মস্ত সাইনবোর্ডে। এবং তাতে মস্ত-মস্ত অক্ষরে লেখা, ‘যোশি বুক শপ।’ সাইনবোর্ডের চটকদার রং যে-কোনও কালার-ব্লাইন্ড লোককেও দোকানের কাছে টেনে আনবে।
মালিক মিস্টার যোশির নামটা কোন অক্ষর দিয়ে শুরু হবে ভাবতে-ভাবতে দোকানে ঢুকলাম। দোকানের ভেতরে আলো রেস্তোরাঁগোছের—বিশাল কিন্তু প্রায় টিমটিমে কয়েকটি ঘষা কাচের গ্লোব সিলিং থেকে ঝুলছে। দোকানের র্যাকগুলো বিভিন্ন ধরনের বইয়ে (‘ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট’ থেকে শুরু করে ‘ফ্রয়েড’ পর্যন্ত) ঠাসা। ভেতরে কোনও খদ্দের নজরে পড়ল না। তা ছাড়া বেলা বারোটায় এই ঠা-ঠা রোদ্দুরে কে-ই বা বই কিনতে বেরুবে! অবশ্য বই কিনতে আমিও বেরোইনি—।
যথেষ্ট খোঁজাখুঁজির পর একটা বইয়ের র্যাকের পেছনে ‘লুকিয়ে’ বসে থাকা জনৈক প্রৌঢ়কে আবিষ্কার করলাম। তার সামনে একটা টেবিলে বিভিন্ন কাগজপত্র—এমন কি খবরের কাগজ পর্যন্ত—ছড়ানো। টেবিলের কাছাকাছি আর কোনও চেয়ার নেই। সুতরাং আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।
তিনি তখন ফোনে কথা বলছেন।
‘হ্যাঁ—কবে মারা গেছেন খোঁজটা নাও। আর ঠিকানাটা আমাকে বলো—লিখে নিই।’
উত্তরে সম্ভবত ঠিকানাটাই শোনা গেল, কারণ উনি খসখস করে একটা সাদা কাগজে কী যেন লিখে নিলেন। তারপর বারকয়েক ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তাকালেন আমার দিকে।
প্রথমে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমার সাদা গোঁফ, পেটানো শরীর। তারপর চোখ নেমে এল আমার হাতে ধরা রুপোবাঁধানো লাঠিটার দিকে।
আমিও তাঁর চশমা, টাক, ঈগল-নাক, থ্যাবড়া থুতনি, চঞ্চল কণ্ঠা ইত্যাদি জরিপ করে তাকালাম অস্থির, ধুরন্ধর চোখজোড়ার দিকে।
আমার সাহেবি পোশাক দেখেই তিনি বোধহয় কিছুটা আশান্বিত হলেন। বিগলিত স্বরে বললেন, ‘বলুন স্যার, কী চাই?’
সামনের ছড়ানো কাগজগুলো একপাশে ঠেলে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তুষার-মানব দেখার মতো বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার গোঁফজোড়া দেখতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ একচোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘মিস্টার যোশি?’
‘হ্যাঁ, আমিই যোশি—বিলাস যোশি।’
‘ও।’ সত্যি কথা বলতে কী, এই বিলাস যোশিকে পার্ক স্ট্রিটের একটা বড় বইয়ের দোকানের মালিক বলে কল্পনা করতে আমার বেশ কষ্ট হল: ‘আমার নাম সেনবর্মা—প্রকাশ সেনবর্মা।’
‘বলুন মিস্টার সেনবর্মা, কী বই চাই আপনার?’
‘ও, আপনি দেখছি ”সেনবর্মা” পদবিটা বেমালুম ভুলেই গেছেন!’
‘তা—তার মানে?’ চোখ থেকে সরু ফ্রেমের চশমাটা নামিয়ে উৎসুকভাবে তাকালেন বিলাস যোশি: ‘না, নামটাতো ঠিক মনে পড়ছে না। সেনবর্মা? উঁহু, এ নামে কাউকে তো চিনি না।’
‘তাই নাকি?’ হাতের লাঠিটা বগলে পাচার করে পকেটে হাত ঢোকালাম। একটা মুখ ছেঁড়া সাদা খাম বের করে তার ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করলাম। কাগজটা একপলক দেখে ছুড়ে দিলাম টেবিলের ওপরে।
‘দেখুন—এবার হয়তো মনে পড়বে।’
বিলাস যোশি চশমাটা নাকে লাগিয়ে তড়িঘড়ি আবার চেয়ারে বসলেন। হাতে নিলেন কাগজটা। কঠিন দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে সশব্দে নাক টানলেন।
‘হুম—’ কাগজটা গভীরভাবে দেখতে লাগলেন তিনি: ‘এটা দেখছি একটা বিল।…আপনি হয়তো জানেন না, মিস্টার সেনবর্মা, আমি সাধারণত পোস্টেই খদ্দেরদের বইপত্তর পাঠিয়ে থাকি। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার সামনাসামনি কোনও আলাপ নেই। তাই—’ বিলের ওপর লেখা নামটা তিনি বিড়বিড় করে পড়লেন, ‘প্রফেসর সুরপতি সেনবর্মা। ছয়ের তিন, গোলক মিত্র রোড। কলকাতা বারো। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে—।’
‘তা পড়বারই কথা। স্বর্গীয় ডক্টর সুরপতি সেনবর্মা আমার বড় ভাই ছিলেন। তিনি—মারা গেছেন।’
‘ডক্টর সেনবর্মা মারা গেছেন?’ ভীষণ অবাক হওয়ার ভান করল বিলাস যোশি ‘সেইজন্যেই বোধহয় শেষ কয়েকটা চিঠির জবাব পাইনি। কিন্তু আপনারা তো আমাকে তাঁর মারা যাওয়ার খবরটা অন্তত জানাতে পারতেন…।’
‘পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করেই জানাইনি।’ রূঢ় স্বরে জবাব দিলাম, ‘কারণ আপনি হয়তো ভুল করে এই বিলটা পাঠিয়েছেন। আমার দাদা কোনওদিন এ ধরনের বইয়ের জন্যে অর্ডার পাঠাননি, আর কেনেনওনি। তা ছাড়া তাঁর লাইব্রেরি ঘেঁটেও আমরা এসব বইয়ের একটা কপিও খুঁজে পাইনি।’
বিলে লেখা বইয়ের লম্বা লিস্টটার ওপরে চোখ চালিয়ে বিলাস যোশি ‘হুম’ করে একটা শব্দ করলেন। তারপর অস্বস্তিতে কাশলেন বারকয়েক: ‘মিস্টার সেনবর্মা, বইগুলো আমি সত্যিই পাঠিয়েছি। সুরপতিবাবু বইগুলো পেয়েছেন জানিয়ে আমাকে চিঠিও দেন। কিন্তু দামটা পেতে দেরি হওয়ায় আমি বেশ কয়েকটা রিমাইন্ডার তাঁকে দিই। অথচ কোনও রিপ্লাই পাইনি। তাই এই লাস্ট চিঠিটায় আমি রিমাইন্ডার বলে ভয় দেখিয়ে বিলটা পাঠিয়েছি—মাত্র সাতশো টাকার।’
এবার ‘হুম’ শব্দটা বলার পালা আমার।
আমাকে বিলাস যোশি বলতে লাগলেন, ‘দাঁড়ান, আমি খাতা-পত্র দেখে আপনাকে কারেন্ট পজিশানটা জানাচ্ছি।’ পাশের শেলফ থেকে একটা মোটা বিধ্বস্ত ফাইল বের করলেন তিনি:’সেনবর্মা—কিউ, আর, এস—এই তো!’
‘অতসব ফাইল ঘাঁটাঘাঁটির কোনও দরকার নেই।’ ঠান্ডা গলায় বিলাস যোশির উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিলাম, বললাম, ‘আপনার কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আর ভুলটা একটু পিকিউলিয়ারও বটে। সুতরাং, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ভুল আর না হয়, সে বিষয়ে আমি আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি। যদি আপনি এই ছবির বইয়ের নোংরা ব্যাবসা চালিয়ে যেতে চান, চালিয়ে যান—আমি বাধা দেব না। কিন্তু তাই বলে—।’
বিলাস যোশি বারকয়েক মাথা নাড়লেন, হেলান দিয়ে বসলেন চেয়ারে: ‘মিস্টার সেনবর্মা, আপনার কথার ওপরে কথা বলা ঠিক নয়। তা ছাড়া খদ্দের হল গিয়ে লক্ষ্মী। কোনও খদ্দেরের পছন্দ নিয়ে সমালোচনা করা আমার কাজ নয়। তা হলে আমাকে বইয়ের দোকান তুলে দিয়ে তেলেভাজার দোকান দিতে হয়। সে যাক, আমি শুধু এটুকু জানি, এই ঠিকানা থেকে…’ আঙুল দিয়ে বিলটার ওপর ঠোকর মারলেন বিলাস যোশি: ‘…এই বইগুলো চেয়ে মিস্টার সেনবর্মা নামে একজন আমাকে অর্ডার পাঠান। এবং গত পনেরোই ডিসেম্বর বইগুলো আমি ওই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। তারপর বইগুলোর কী হয়েছে না হয়েছে তা আমার জানার কথা নয়, আর জানতেও চাই না। তবে এটা তো বুঝতেই পারছেন যে, এসব বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খোলা জায়গায় ফেলে রাখার বই নয়। সাধারণত লুকিয়ে দেখা এবং রাখার জন্যেই এ বইয়ের জন্ম।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন বিলাস যোশি: ‘তবে আমি জানতাম না আপনার দাদা মারা গেছেন—জানলে এ-চিঠি আর বিল এভাবে পাঠাতাম না। আই অ্যাম সরি, মিস্টার সেনবর্মা।’
‘আপনার ভবিষ্যৎ ভেবে আমিও কম দুঃখিত নই।’ আমার কণ্ঠস্বরে দুঃখের লেশমাত্র নেই। কর্কশ গলায় খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘আপনি এখনও বলছেন প্রফেসর সেনবর্মা নিজে এসব বাজে বইয়ের অর্ডার দিয়েছিলেন? আপনার সাহস তো কম নয়! আপনি জানেন, আমার দাদা…?’
‘উত্তেজিত হবেন না, স্যার।’ দু-হাত তুলে মোলায়েম স্বরে আমাকে বাধা দিলেন বিলাস যোশি: ‘আমাকেও কথা বলার একটু সুযোগ দিন। আপনি কী করে এত শিওর হচ্ছেন যে, আপনার দাদা এসব বইয়ের অর্ডার দিতে পারেন না? পৃথিবীতে কত বিচিত্র মানুষই না রয়েছে। ফ্রয়েড বলে গেছেন…।’
‘থামুন!’ গর্জে উঠলাম আমি, ‘ঢের ন্যাকামো হয়েছে, স্কাউড্রেল কোথাকার!’
‘আপনিও স্যার ন্যাকামো কিছু কম করছেন না।’ সরল মুখে মন্তব্য করলেন বিলাস যোশি, ‘আপনার দাদার চরিত্র জানতে আমার বিন্দুমাত্রও উৎসাহ নেই। আমি শুধু জানি, মাল যখন পাঠিয়েছি তখন তার দাম আমার পাওনা। আমি গরিব মানুষ। এই দোকান থেকেই আমার সংসার চলে। সুতরাং যদি কোনও খদ্দের আমাকে ফাঁকি দেয়, তা হলে—।’
‘ফাঁকি? কীসের ফাঁকি? আপনাকে কতবার বলব এসব বই একটাও আমার দাদা কেনেননি।’
বিলাস যোশি ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করলেন, ‘আপনি যে খুব ভদ্র ব্যবহার করছেন সেটা বলতে পারছি না বলে দুঃখিত, মিস্টার সেনবর্মা। এই বিলের টাকা বহুদিন বাকি থাকা সত্ত্বেও আমি কোনওরকম কেসকামারি করিনি। কারণ, আমি জানি, এ ধরনের বইয়ের ক্যাচাল একবার চাউর হলে আমার খদ্দেরদের সুনাম নিয়ে টানাটানি হবে। তা ছাড়া শুধু আপনার দাদাই নন, এরকম অনেক খদ্দেরই আমার আছে। তাদের নামধাম আমি সবসময় গোপন রাখার চেষ্টা করি—।’
‘তা হলে দাদার লেখা চিঠিগুলো আমাকে দেখান।’
আমার শান্ত স্বরে বিলাস যোশি একটু অবাক হলেন। বললেন, ‘এবার আমাকে হাসালেন। কারণ, এটুকু আপনার বোঝা উচিত, এমন কোনও জিনিস আমি দোকানে রাখি না যাতে আমার খদ্দেরদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হয়। তা ছাড়া এ-ব্যবসায় সিক্রেসিই হল ক্যাপিটাল। অবশ্য চালানের কার্বন কপিটা আমি আপনাকে দেখাতে পারি। আমার মনে হয়, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না।’
‘উহুঁ, আপনাকে বুঝতে আমার এতটুকুও ভুল হয়নি।’ আমাকে হাসতে দেখে আবারও অবাক হলেন বিলাস যোশি: ‘এবং ভুল হয়নি বলেই এই মুহূর্তে আপনার কোমল শরীরে কিঞ্চিৎ লাঠ্যেïষধ প্রয়োগ করতে আমি উদগ্রীব।’
আমার বক্তব্যের গূঢ় অর্থ যতটা না কথায় তার চেয়ে বেশি প্রকাশ পেল আমার লাঠি বাগিয়ে ধরার ভঙ্গিতে।
আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন বিলাস যোশি। একহাতে তুলে নিলেন টেলিফোনের রিসিভার এবং তাঁর অন্য হাতে মুহূর্তের মধ্যেই গজিয়ে উঠল একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক।
দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলেন বিলাস যোশি: ‘আপনি বোধহয় এটাই চাইছিলেন, তাই না? কিন্তু এখন আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এতক্ষণ ধরে ঢের আমড়াগাছি হয়েছে—আর নয়।’
দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই শুনলাম, তিনি পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে একজন অফিসারকে জরুরি স্বরে ডেকে পাঠালেন, তারপর বললেন, ‘আমি আপনাকে যেতে দিতে পারি, তবে একটি শর্তে। আপনাকে কথা দিতে হবে যে, আমার পাওনা টাকা আমাকে মিটিয়ে দেবেন। আর ভবিষ্যতে দোকানে এসে এ ধরনের অসভ্যতা করবেন না। আর তা যদি না চান, তবে একজন পুলিশ অফিসারের জন্যেই ওয়েট করুন—।’
শক্ত মুঠোয় লাঠিটা চেপে ধরে জবাব দিলাম, ‘আমার মনে হয় অফিসারের জন্