- বইয়ের নামঃ বাড়িটায় কেউ যেয়ো না
- লেখকের নামঃ অনীশ দেব
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
বাড়িটায় কেউ যেয়ো না
এক যে ছিল চোর (গল্প)
সোমপ্রকাশ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিলেন৷ গায়ে জড়ানো শাল৷
ঘর অন্ধকার৷ মাথার কাছে একটা জানলা খোলা৷ জানলা দিয়ে গাছের কয়েকটা পাতা, ডালপালা দেখা যাচ্ছিল৷ তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ছিল একটুকরো রাতের আকাশ৷ আর সেই আকাশে দু-একটা ফুটফুটে তারা৷
শীতের সময়েও সোমপ্রকাশের অন্তত একটা জানলা খোলা রাখা চাই৷ নইলে ওঁর মনে হয় দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে৷
কিন্তু এখন, একটা জানলা হাট করে খুলে রাখা সত্ত্বেও, সোমপ্রকাশের দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷
ওঁর এমনটা হওয়ার কথা নয়৷ আর সন্ধে সাতটায় ঘর আঁধার করে বিছানায় শুয়ে পড়ার কথাও নয়৷
এমনটা হয়েছে একটা কবিতার লাইন শুনে৷
পাশের ঘরে ছেলে সুমিতাভকে ওর মা কবিতা মুখস্থ করাচ্ছেন৷ এসময়টায় সুমিতাভ মায়ের কাছে পড়তে বসে, আর সোমপ্রকাশ পাশের বেডরুমে জুত করে টিভি দেখতে বসেন৷
আজও তাই বসেছিলেন, কিন্তু ওই কবিতার লাইনগুলো সব এলোমেলো করে দিল৷ মনটা ফিরে গেল অনেক পুরোনো সময়ে৷ সোমপ্রকাশ যখন সুমিতাভর বয়েসে ছিলেন৷ ক্লাস সিক্সে পড়তেন৷ গ্রামের স্কুলে৷
সে প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ বছর আগের কথা৷
বেড়ার ঘর৷ টালির চাল৷ ঘরের সামনে বড় উঠোন৷ উঠোনে বড়-বড় আমগাছ, জামগাছ আর কাঁঠালগাছ৷ একপাশে টিউবওয়েল৷ টিউবওয়েল ডিঙিয়ে গোয়ালঘর৷ গোয়ালঘরে গোরু-বাছুর৷
সেসব কথা মনে পড়তেই সোমপ্রকাশ আলো-টালো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন৷ খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনের ছবি দেখতে লাগলেন৷ গ্রামের বাড়িটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷
সেদিনটাও ছিল শীতের রাত৷ সন্ধে সাতটা কি সওয়া সাতটা হবে৷ ছেঁড়া ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে দিয়ে খাটের ওপরে বসে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ছিলেন সোমপ্রকাশ৷ পড়ছিলেন মানে দুলে-দুলে কবিতা মুখস্থ করছিলেনঃ
‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’
ওঁর কাছ থেকে হাতখানেক দূরে বসে ছোটভাই জয়প্রকাশ ‘কিশলয়’ বই নিয়ে বাংলা পড়া তৈরি করছিল৷ ও ক্লাস ফোরে পড়ে৷
একটু আগেই দু-ভাই টিফিন খাওয়া শেষ করেছে৷ তেল দিয়ে মাখা মুড়ি আর পেঁয়াজের টুকরো৷ খালি বাটি দুটো মা এখনও নিয়ে যাননি৷ মা রান্নাঘরে রান্না করছেন৷ কোলের ছোটবোনটা মায়ের কাছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও, কেন কে জানে, চেঁচিয়ে কাঁদছে৷ এ-ঘর থেকে সোমপ্রকাশ ছোটবোনের কান্না দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলেন৷
‘ভাই, যা তো—বোনুকে একটু ধর গিয়ে৷ মা-কে জ্বালাচ্ছে…৷’
দাদার কথায় বারকয়েক গাঁইগুঁই করে জয় বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে কি দেয়নি, হঠাৎই শোনা গেল কয়েকজনের চিৎকার: ‘চোর! চোর!’
চিৎকারটা ভেসে এল খুব কাছ থেকেই৷ যেন সামনের দাওয়া কিংবা উঠোন থেকে৷
সোমপ্রকাশ আর দেরি করেননি৷ ‘চোর! চোর!’ চিৎকারের সঙ্গে নিজের কচি গলার চিৎকার মিলিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমেই দে ছুট৷
ঘরের দরজা খুলে বেরোনোর সময় ওঁর মনে হয়েছিল রাতের অন্ধকারে চোরের মোকাবিলা করতে গেলে যা হোক একটা হাতিয়ার সঙ্গে থাকা দরকার৷ তাই যেতে-যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা নিজের ক্রিকেট ব্যাটটা এক ছোবলে তুলে নিয়েছিলেন৷
পিছন থেকে জয় ‘দাদা! দাদা!’ বলে চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু সে-ডাকে সোমপ্রকাশ ফিরে পর্যন্ত তাকাননি৷
ছোটবেলায় সোমপ্রকাশ খুব দুরন্ত এবং ডাকাবুকো ছিলেন৷ সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ করতেন৷ গ্রামের হরিমোহন সরখেল স্মৃতি পাঠাগার থেকে নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চারের বই নিয়ে আসতেন৷ লাইব্রেরির মেম্বার ছিলেন বাবা, কিন্তু সেই মেম্বারশিপের দৌলতে বাবার হয়ে সোমপ্রকাশই লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতেন এবং নিজের পছন্দসই বই নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতেন৷ বই পড়তে-পড়তে ওঁর সাহসটা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গিয়েছিল৷
তাই এখন চোখের পলকে ঘর পেরিয়ে দাওয়া, দাওয়া পেরিয়ে অন্ধকার উঠোন৷
কিন্তু কেউ তো নেই! তা হলে চিৎকারটা শোনা গেল কোত্থেকে? প্রথমবার শুনে তো মনে হয়েছিল খুব কাছ থেকেই আওয়াজটা এসেছে!
ঘরের তুলনায় বাইরের খোলা উঠোনে শীত অনেক বেশি৷ কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হওয়ার আগ্রহে শীতের ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের মাথাতেই ছিল না৷
উঠোনের বাঁ-দিকে আম, জাম আর কাঁঠালের বড়-বড় গাছ৷ সেদিকটায় অন্ধকার আরও গাঢ়, আরও মিশকালো৷ টিউবওয়েলটাকে দেখা যাচ্ছে না৷
উঠোনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোম৷ না, ওঁর ভূত-টুতের ভয় ছিল না৷ বাবা সেই ছোট্ট বয়েস থেকে ওঁকে চার লাইনের একটা ছড়া শিখিয়ে দিয়েছেন৷ সেই ছড়ায় রাম-লক্ষ্মণ থাকায় ভূত কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে পারবে না৷
শুধু বাবা কেন, ছোটকাকা, মেজকাকা, মা—সব্বাই সোমকে একই আশ্বাস দিয়েছেন৷
এখন উঠোনে দাঁড়িয়ে সোম সেই চারলাইনের ছড়াটাই মনে-মনে আওড়াচ্ছিলেন এবং অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিলেন৷
ঠিক সেই সময়েই আবার ‘চোর! চোর!’
এবারের সমবেত চিৎকারে গলার সংখ্যা অনেক বেশি—তাই শব্দের ডেসিবেল মাত্রাও অনেক বেশি৷
চিৎকারটা সোমদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে ছুটে চলে গেল৷ চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেল অনেকগুলো টর্চের আলো৷ ছোটার তালে-তালে আলোগুলো নাচছে৷