চারটি রহস্য উপন্যাস
আমি পিশাচ
৷৷এক৷৷
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷ কবে কীভাবে আমার জন্ম তা জানি না৷ আমার বয়েস কত তাও জানা নেই৷ শুধু জানি, রক্ত আমার একমাত্র খাদ্য৷ রক্তের পিপাসা আমাকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ এখনও যে পথ চলছি সেও ওই রক্তের টানে৷ পিপাসায় বুক শুকিয়ে আসছে আমার৷
আমাকে কেমন দেখতে?
বলছি৷ তবে শুনে যেন অবাক হয়ে যেয়ো না৷
আমার কোনও নির্দিষ্ট চেহারা নেই৷ যখন যেখানে থাকি সেইরকম চেহারা নিয়ে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিই৷ যেমন, যখন জঙ্গলে থাকি তখন গাছের পাতা কিংবা গাছের বাকল হয়ে যাই৷ পুকুরপাড়ে থাকলে ঘাস-পাতা, আগাছা, কিংবা মাটির চেহারা নিই৷ এটা ছদ্মবেশ যদি বলো তো তাই৷
ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, নোংরা জায়গায় আমি থাকতে ভালোবাসি৷ তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল মানুষ বা পশুর শরীর৷ ওদের শরীরের ভেতরটা নরম, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধময়, নোংরা—আবার একইসঙ্গে রক্তের তাপে উষ্ণ৷ ওদের শরীরে আমি নিশ্চিন্তে বহুদিন থাকতে পারি৷ আর ওদের দিয়ে আমার রক্তের তৃষ্ণা মেটাই৷ আমার ইচ্ছেয় ওরা অন্যের শরীরে ধারালো দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে নেয়৷ ওরা বুঝতেও পারে না, ওরা আসলে আমার তেষ্টা মেটাচ্ছে৷ কারণ, ওদের শরীরে ঢুকে পড়ার পর থেকেই ওদের মস্তিষ্ক চলে আমার কথায়৷ অর্থাৎ, ওদের শরীর আর মন—দুই-ই দখল করে ফেলি আমি৷
তবে পশুর চেয়ে মানুষই আমার বেশি পছন্দ৷ কারণ, মানুষের রক্তের স্বাদ সবার সেরা৷ আর মানুষ শিকার করাও সহজ৷ তারপর, আমার হয়ে সেই মানুষ—কিংবা অমানুষ রক্তপিশাচ—যখন মানুষ শিকার করে, তখন তার কাজটাও সহজ হয়ে যায়৷
আঃ! ভাবতেই কত তৃপ্তি!
কিন্তু এ-কাজে বিপদও আছে৷
আমার দখলে থাকা অমানুষগুলো যখন ধরা পড়ে যায় তখন ওরা শাস্তি পায়৷ অন্যান্য সুস্থ মানুষ ওদের খতম করে৷ তখন আমাকে পালিয়ে বাঁচতে হয়৷ এক দেহের আশ্রয় ছেড়ে ছুটতে হয় অন্য আস্তানার খোঁজে৷
বুঝতেই পারছ, মানুষ-পিশাচগুলোর বিনাশ হলেও আমার বিনাশ নেই৷
তা হলে কি আমি অমর? কে জানে!
তবে আত্মা যদি অমর অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মা কিংবা পিশাচের অমর হতে অসুবিধে কী!
পথ চলতে-চলতে যখন ভীষণ একঘেয়ে আর ক্লান্ত লাগছে ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ সকাল থেকেই মেঘের সাজ-সাজ রব চোখে পড়েছিল, দুপুর পেরোতেই তার কান্নাকাটি শুরু হল৷
চলতে আর ইচ্ছে করছিল না৷ তেষ্টায় আমার ভেতরটা ছটফট করছিল৷ তাই সামনের দোতলা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম৷
প্রকাণ্ড বাড়ি৷ তার লাগোয়া খেলার মাঠ আর বাগান৷ মাঠে বর্ষার সবুজ ঘাস৷ কোথাও-কোথাও জল জমে আছে৷ ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে৷ ওরা বোধহয় এই তুমুল বর্ষার জন্যেই অপেক্ষা করছিল৷ এখন খুশিতে টগবগে হয়ে কলরোল শুরু করে দিয়েছে৷
যাক, এবার আমার কাজ হল বিশ্রাম আর আরাম৷ আর তার জন্যে চাই একজন মানুষ—যার শরীরে আমি আশ্রয় নেব৷ তারপর…৷
.
৷৷দুই৷৷
সত্যবানস্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ কালো বোর্ডের ওপরে ওঁর চক-ধরা আঙুল তাড়াহুড়ো করে আলপনা এঁকে চলেছে৷ অঙ্ক যেন স্যারের পোষা পাখি৷ কী সুন্দর স্যারের কথা শোনে! কোনও অঙ্কই স্যারের আটকায় না৷ ধরেই স্যাটাস্যাট করে দেন৷ সেইজন্যেই অচ্যুত, ঋদ্ধিমান, বাসব, সৌরভরা সত্যবানস্যারের নাম দিয়েছে ‘স্যাটাস্যাট’৷
স্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ আর ক্লাস নাইনের ছেলেরা মাথা নীচু করে চুপচাপ সেটা খাতায় টুকে নিচ্ছিল৷ অচ্যুত অঙ্কে দারুণ—সবসময় একশোয় একশো পায়৷ কিন্তু বীজগণিতের এই অঙ্কটা ওরও আটকে গেছে৷ হল অ্যান্ড নাইটের ‘হায়ার অ্যালজেব্রা’ থেকে এই অঙ্কটা স্যার আগের দিন করতে দিয়েছিলেন৷
মাথা ঝুঁকিয়ে অঙ্ক টোকা শেষ হতেই কন্দর্প অচ্যুতকে আলতো করে খোঁচা মারল৷
অচ্যুত পাশে ফিরে তাকাতেই কন্দর্প ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, আমার ব্যাগ থেকে সাত টাকা চুরি গেছে৷’
অচ্যুত অবাক হল না৷ কারণ, গত সাত-আটদিন ধরে ওদের সেকশানে এই চুরির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে৷
প্রথম যে-চুরিটা ওদের নজরে পড়েছিল সেটা ঋদ্ধিমানের ব্যাগ থেকে চার টাকা উধাও হওয়ার ঘটনা৷ সেটা ওরা কেউই খুব একটা আমল দেয়নি৷ ভেবেছে ঋদ্ধিমানের হয়তো ভুল হয়েছে৷ ভুল করে টাকাটা অন্য কোথাও রেখে এসেছে৷
কিন্তু তারপর, ওদের বন্ধু কুলদীপের ব্যাগ থেকে বারো টাকা উধাও হতেই অচ্যুতরা নড়েচড়ে বসেছে৷
ক্লাসে কুলদীপের গায়ের জোরই সবচেয়ে বেশি৷ ওর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কেউ পারে না৷ তা ছাড়া ও রোজ ব্যায়াম করে, বক্সিং ক্লাবে বক্সিং শেখে৷
টাকা চুরি যেতেই কুলদীপ তো রেগে আগুন৷ ও সবাইকে শাসিয়ে বলল, ‘চোর ধরা পড়লে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে বারো টাকার শোধ নেব৷’
কিন্তু চুরির ব্যাপারটা থামল না৷ যেমন আজ কন্দর্পের টাকা চুরি গেছে৷ সুতরাং দুটো পিরিয়ডের ফাঁকে ওরা চার-পাঁচজন মিলে টিচার্স রুমে গিয়ে বাংলার অমিয়স্যারকে সব জানাল৷ স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘হাতেনাতে তস্করকে না ধরা পর্যন্ত তো কোনও প্রমাণ নেই! যদি তোরা নক্তচরকে লাল হাতে ধরতে পারিস, তা হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে আদ্যোপান্ত অবধান করিয়ে শাস্তি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷’
অচ্যুতরা আন্দাজ করতে পারল ‘তস্কর’ আর ‘নক্তচর’ মানে চোর৷ অমিয়স্যারকে নিয়ে এই এক মুশকিল! বাংলার স্যার বলে বড্ড বেশি বাংলায় কথা বলেন৷
পরদিন থেকে ওরা পাঁচজন—অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, আর সৌরভ—চোর ধরার নানান মতলব আঁটতে লাগল৷
এসব ব্যাপারে কুলদীপ ওদের লিডার৷ আর প্রতীক কুলদীপের সর্বক্ষণের সাথী৷ মাঝে-মাঝে কুলদীপকে দুষ্টু বুদ্ধির জোগান দেয় বলে প্রতীকের একটু কুখ্যাতি আছে৷ বাসব ক্লাসের মনিটর, এন. সি. সি-র ক্যাডেট৷ ডিসিপ্লিন নিয়ে সবসময় মাথা ঘামায়৷ হাঁটা-চলা করে সৈনিকের ঢঙে—যেন লেফট-রাইট করে প্যারেড করছে৷ ক্লাসের অনেকেই ওর হাঁটার ঢং নকল করে ওকে ব্যঙ্গ করে—তবে আড়ালে৷ নইলে ও স্যারদের কাছে কমপ্নেন করে দেবে৷ আর যেহেতু সৌরভের ব্যাগ থেকে চবিবশ টাকা চুরি গিয়েছিল, তাই চোর ধরার মতলবে ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷
টিফিনের সময় স্কুলের লাগোয়া খেলার মাঠে জামগাছতলায় বসে ওদের প্ল্যান আঁটার কাজ শুরু হল৷
টিফিনের সময় অচ্যুতরা বেশির ভাগই ক্লাসরুম ছেড়ে খেলার মাঠে বেরিয়ে আসে৷ টিফিনটা কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে ওদের কলরোল খেলাধুলো শুরু হয়৷ ওদের চেঁচামেচিতে গাছে বসে থাকা বুলবুলি, শালিখ, বসন্তবৌরি আর দোয়েল পাখিরা উড়ে পালায়৷ আধঘণ্টা পর ক্লাস বসলে মাঠটা হঠাৎ আবার ফাঁকা নির্জন হয়ে যায়৷ তখন পাখিরা বোধহয় হাঁফ ছেড়ে ফিরে আসে৷
চুরির ঘটনাগুলো খতিয়ে বিচার করার পর প্রতীক বলল, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, টাকাটা যে নেয় সে টিফিনের সময় নেয়৷ ক্লাসে তখন যদি অন্যরা কেউ বসে থাকে তা হলে নেয় না৷ কিন্তু ফাঁক পেলেই ব্যাগ হাতড়ায়৷ টিফিনের সময় ক্লাসরুমটা ওয়াচ করতে হবে৷’
তখন ঠিক হল, রোজ টিফিনের সময় সৌরভ ওদের ক্লাসরুমে ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে৷ ক্লাসে কেউ ঢুকলে সৌরভগেক দেখতে পাবে না৷ ফলে চোরবাবাজি ধরা পড়বেই৷
যেমন মতলব তেমনি কাজ৷ এবং ফল পাওয়া গেল তিনদিনের মধ্যেই৷
সৌরভ ক্লাসরুমে লুকিয়ে ছিল৷ ওদের ক্লাসে দুটো করে ডেস্ক পাশাপাশি তক্তা দিয়ে জুড়ে দুজনের বসার মতো ব্যবস্থা করা আছে৷ সেই জোড়া ডেস্কগুলোকে আবার পাশাপাশি সাজিয়ে ডেস্কের সারি তৈরি করা হয়েছে৷ আর ক্লাসরুমের মাঝ-বরাবর রয়েছে যাতায়াতের প্যাসেজ৷
সৌরভ ক্লাসরুমের একেবারে শেষে এককোণে একটা জোড়া ডেস্কের নীচে লুকিয়ে ছিল৷ অত বড় ঘরে আর কেউ নেই৷ সব চুপচাপ৷ শুধু তিনটে সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ হচ্ছে৷ ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে সৌরভের বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ কিন্তু একটা জেদ ওকে দিয়ে এই কষ্ট সইয়ে নিচ্ছিল৷
আগের দু-দিন কোনও ঘটনা ঘটেনি৷ কিন্তু আজ ঘটল৷
মিনিটদশেক যেতে না যেতেই একজোড়া পা দেখতে পেল সৌরভ৷
খুব সাবধানে দুটো ডেস্কের পায়ার একচিলতে ফাঁক দিয়ে ও উঁকি মারল৷ দেখল, ওদেরই ক্লাসের রাজীব দাস প্রথম সারির ডেস্কের ব্যাগগুলো ব্যস্তভাবে হাতড়াচ্ছে৷ কোনও-কোনও ব্যাগের ভেতর থেকে কী যেন মুঠো করে নিয়ে পকেটে ঢোকাচ্ছে৷ আর মাঝে-মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে৷
মাত্র পাঁচমিনিট৷ তার মধ্যেই দুটো ডেস্কের সারির তল্লাশি চটপট সেরে ফেলল রাজীব৷ যা পেল পকেটে গুছিয়ে নিল৷ তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল৷
না, সৌরভ ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচায়নি৷ কারণ, সেইরকমই কথা ছিল৷ ও শুধু চুরির ঘটনাটা কুলদীপ, অচ্যুতদের জানিয়ে দিল৷ বলল, এই কুকীর্তি কার৷
এই খবরটা জানার পর কুলদীপরা চোর ধরার ফাঁদ পাতল৷ ওরা পাঁচজন টিফিনের সময় ক্লাসরুমের পাঁচ জায়গায় ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে রইল৷
ওদের হতাশ হতে হল না৷ কারণ, চোর এল এবং চটপট কাজ সারতে লাগল৷
কুলদীপ সকলের আগে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল৷ ওর পিঠের ধাক্কায় একজোড়া ডেস্ক দড়াম করে মেঝেতে উলটে পড়ল৷
ও চিৎকার করে রাজীবকে জাপটে ধরল, ‘ব্যাটা চোর, রোজ বন্ধুদের টাকা চুরি করিস—লজ্জা করে না!’
ততক্ষণে সৌরভ, বাসব, প্রতীক আর অচ্যুত ওদের লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ ওরা সবাই রাজীবকে ঘিরে ধরল৷ তারপর রাজীবকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল টিচার্স রুমে৷
এখন টিফিনের সময়৷ একটা প্রকাণ্ড টেবিল ঘিরে স্যারেরা বসেছিলেন৷ কয়েকজন গল্পগুজব করছিলেন, কেউ-কেউ টিফিন সারছিলেন৷ বেয়ারা সেবকরাম একপাশে দাঁড়িয়ে চক-ডাস্টার গুছিয়ে রাখছিল৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কুলদীপরা চট করে ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ ওদের ক্লাসটিচার ভূগোলের কালীপদস্যারকে ওরা দেখতে পেল না৷ বোধহয় কোনও কাজে বাইরে বেরিয়েছেন৷ তবে অমিয়স্যার আর সত্যবানস্যার ছিলেন৷ সত্যবানস্যার টিফিন করছিলেন৷ আর অমিয়স্যার খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷
টিচার্স রুমের দরজায় ওদের জটলা দেখে কেউ-কেউ অবাক হয়ে দেখছিলেন৷
বাসব অমিয়স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসব, স্যার?’
অমিয়স্যার কাগজ থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালেন৷ কুলদীপ, সৌরভ, বাসবদের দেখে বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে৷ কারণ, কুলদীপ রাজীবের কবজি শক্ত করে চেপে ধরে ছিল৷
চেয়ার ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অমিয়স্যার৷ খবরের কাগজটা একটা ডাস্টার চাপা দিয়ে রেখে চটপট চলে এলেন দরজার কাছে৷
‘কী রে, কী হয়েছে!’
ওরা হাঁফাতে-হাঁফাতে রাজীব দাসের কীর্তির কথা বলল৷
অমিয়স্যার ধৈর্য ধরে সব শুনলেন৷ ব্যাপারটা ওঁর মনে পড়ে গেল৷ তিনিই ওদের বলেছিলেন চোরকে হাতেনাতে ধরার কথা৷
তিনি রাজীবকে বললেন, ‘তুই এখানে থাক৷’ তারপর অচ্যুতদের দিকে ফিরে : ‘তোরা শ্রেণিতে যা৷ আমি ব্যাপারটা দেখছি—৷’
এমন সময় সত্যবানস্যার ওদের পাশ দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন৷ কিন্তু আশ্চর্য, ওদের জটলা নিয়ে কোনওরকম কৌতূহল দেখালেন না৷ একজন অচেনা মানুষের মতো পাশ দিয়ে চলে গেলেন৷ অথচ দু-তিনদিন আগেও অচ্যুতকে দেখলে হেসে বলতেন, ‘কী রে, দিনরাত শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে আছিস, নাকি অঙ্ক-টঙ্কও একটু-আধটু হচ্ছে? ভালো করে পড়৷ মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া চাই-ই চাই৷’
অচ্যুত বেশ অবাক হয়ে গেল৷ কয়েক সেকেন্ড ধরে ও সত্যবানস্যারের চলে যাওয়া দেখল৷
আর ঠিক তখনই টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠল৷ ঢং-ঢং-ঢং-ঢং৷ স্কুলের দারোয়ান বানজারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল পিতলের ঘণ্টায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে তাল ঠুকে জানিয়ে দিচ্ছে টিফিনের আধঘণ্টা শেষ হয়েছে৷ এখন আবার ক্লাস শুরু হবে৷
ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় অচ্যুতের এরকম একটা পিতলের ঘণ্টা কেনার খুব শখ হয়েছিল৷ কিন্তু বাপি আর মা সেই শখের কথাটা শুনে হেসে এমন গড়িয়ে পড়েছিল যে, অচ্যুতের আর ঘণ্টা কেনা হয়ে ওঠেনি৷
স্কুলের চওড়া বারান্দা ধরে ওরা ক্লাসের দিকে ফিরে যাচ্ছিল৷ এখন দুপুর হলেও আকাশ মেঘলা৷ যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে৷ গত ক’দিন ধরেই ঝেঁপে বৃষ্টি চলছে৷ মাঝে-মাঝে এক-আধ-ঘণ্টার বিরতি৷ বৃষ্টিও বোধহয় তখন টিফিন করতে যায়—নয়তো ঘুমিয়ে পড়ে৷
স্কুলের মাঠটা বৃষ্টিতে যাচ্ছেতাই হয়ে থাকে বলে এখন টিফিনের সময়ে খেলার হুল্লোড় অনেকটা মিইয়ে গেছে৷ আর সবসময় মেঘলা থাকলে অচ্যুতের কেমন যেন মনখারাপ লাগে৷
ফিফথ পিরিয়ডের দশ-পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজীব ক্লাসে এসে ঢুকল৷
রমেশস্যার তখন ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন, আর ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তন্দ্রার টানে ঢুলছিল৷ ঘন-ঘন হাই উঠছিল সকলের৷
কিন্তু রাজীব দাসকে দেখেই সবাই সোজা হয়ে বসল৷
রাজীবের রং টকটকে ফরসা৷ ঘি-মাখন খাওয়া গোলগাল নধর চেহারা৷ চোখে চশমা৷ সবসময় ফিটফাট থাকে৷ কিন্তু এখন ওর চুল উসকোখুসকো, চোখের জল চশমার ফাঁক দিয়ে গাল বেয়ে নেমে এসেছে, হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷
রমেশস্যার দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্যের সাতকাহন থামিয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রশ্নটা করে কুতকুতে তীক্ষ্ণ চোখে তিনি রাজীবকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন৷
‘অমিয়স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন৷’ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল রাজীব৷
‘কেন রে? কী করেছিস তুই?’
রাজীব চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷
অচ্যুতের ভীষণ খারাপ লাগছিল৷ আহা রে! হেডস্যার মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওকে বেত দিয়ে মেরেছেন৷ কিন্তু রাজীবই-বা টাকা চুরি করে কেন? ওরা তো বেশ বড়লোক! রেল স্টেশনের কাছে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়ি৷ মারুতি জেন গাড়ি করে স্কুলে আসে৷
মনিটর বাসবকে ডেকে রমেশস্যার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন৷ রাজীবকে বললেন, ‘তুই ডেস্কে গিয়ে বোস৷’
রাজীব মাথা নীচু করে ডেস্কের দিকে এগোল৷
অচ্যুতের ডেস্কের সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাজীব ওকে মিনমিনে গলায় বলল, ‘ছুটির পর তোকে অমিয়স্যার দেখা করতে বলেছেন৷’
অচ্যুত ঘাড় নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল৷
রমেশস্যার বাসবের কাছে গোটা গল্পটা শুনে তারপর আবার সাতবাহন রাজবংশের কাহিনি শুরু করলেন৷
রমেশস্যারের পিরিয়ড শেষ হতেই সবাই রাজীবকে ছেঁকে ধরল৷ কেউ-কেউ ওকে সান্ত্বনা দিল৷ আবার কেউ বলল, ‘ঠিক হয়েছে—অন্যায় করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে৷’
কুলদীপ, সৌরভ, বাসবরা খুঁটিয়ে জানতে চাইল অমিয়স্যার ওকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ঠিক কী-কী হয়েছে৷
রাজীব থতিয়ে-থতিয়ে বলছিল আর ফুঁপিয়ে উঠছিল৷ হেডস্যারের দশ ঘা বেতের বাড়ি খেয়ে ও সহ্য করেছে৷ কিন্তু হেডস্যার বলেছেন, কাল ওর বাবা-মাকে স্কুলে এসে দেখা করতে৷ এটা ওকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে৷ বাপি-মাম্মি এসব ঘটনা জানতে পারলে ওকে হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দেবে৷ রাজীব তাই ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে সিঁটিয়ে গেছে৷
কুলদীপদের ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল৷ ওরা রাজীবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, দেখছি কী করা যায়৷ তুই চিন্তা করিস না৷’
সব শুনে অচ্যুত বলল, ‘অমিয়স্যার তো আমাকে ছুটির পর ডেকেছেন৷ তখন আমি স্যারকে বলব৷ হেডস্যারকে যেন রিকোয়েস্ট করেন—যাতে গার্জেন কল না হয়৷’
অচ্যুতের কথায় রাজীব তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না৷
চারটে বেজে দশমিনিটে বানজারা ছুটির ঘণ্টা বাজাল৷
বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নানান ক্লাসের ছেলের দল পিলপিল করে বেরিয়ে এল ক্লাসরুমের বাইরে৷ তারপর স্কুল-বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমে এল ‘সাদা জামা কালো প্যান্টের’ ভিড়৷ সেখান থেকে সদরের লোহার গেট৷ আবার গেট পেরিয়ে রাস্তা৷
আকাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে৷ এখনই বোধহয় আবার বৃষ্টি নামবে৷
স্কুলের মাঠের একপাশে সারে-সারে দাঁড় করানো সাইকেল৷ এক ঝাঁক ছেলে হইহই করে ছুটল সাইকেলের দিকে৷ নীচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে জল-কাদাভরা মাঠে ছুটোছুটি করে খেলতে লাগল৷ মাঠের এখানে-ওখানে জমে থাকা জলের ওপর পা ফেলে দাপিয়ে ছুটে গিয়ে কাদা-জল ছিটকে দিতে লাগল চারপাশে৷
সদরের গেটের বাইরে বাবা-মায়েদের ভিড়৷ তাঁদের চোখ সাদা-কালো পোশাকের ভিড়ে নিজের-নিজের ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷
স্কুল ছুটির সময় এই ভাঙাচোরা সরু রাস্তাটা সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর স্কুটারে ছয়লাপ হয়ে যায়৷ যানজট চলে অন্তত আধঘণ্টা৷ এখন, বর্ষার সময়, তাই অবস্থা একেবারে বেহাল৷
স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও অচ্যুতরা কয়েকজন ক্লাস থেকে বেরোয়নি৷ অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাজীবের ব্যাপারে অচ্যুত ঠিক কী কী বলবে তাই নিয়েই জল্পনা-কল্পনা চলছিল৷ রাজীব কুলদীপ-অচ্যুতদের হাত ধরে একেবারে কেঁদে পড়ল : ‘তোরা আমাকে যেভাবে হোক সেভ কর৷’ প্রায় আধঘণ্টা পর ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরোল৷
কুলদীপরা সবাই চলে গেল৷ পিঠে বই-খাতার ব্যাগ ঝুলিয়ে অচ্যুত একা রওনা হল টিচার্স রুমের দিকে৷ যাওয়ার আগে ও কুলদীপকে বলল, ‘রাজীবের ব্যাপারে অমিয়স্যারের সঙ্গে কী কথা হল আমি তোকে রাতে ফোন করে জানাব৷ টা-টা!’
অচ্যুত খেয়াল করেনি কখন যেন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷ একটু আগের হুল্লোড় হইচই থেমে গিয়ে এখন সব একেবারে নিঝুম! শুধু বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ছে৷ বাইরে কলাগাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটার টপটপ শব্দ হচ্ছে৷ দূর থেকে সাইকেল রিকশার ‘প্যাঁকপ্যাঁক’ ডাক শোনা যাচ্ছে৷ আর কখনও-কখনও মেঘের ‘গুডুম-গুডুম’৷
ছুটির পর স্কুল থেকে সবাই চলে যায়৷ তখন বানজারা স্কুলের সব ঘর ঘুরে-ঘুরে আলো আর পাখা অফ করে, দরজায়-দরজায় তালা দেয়৷ তারপর স্কুল বিল্ডিং-এর কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে নিজের ঘরে যায়৷ ওর ছোট্ট ঘর স্কুল-বাড়ির লাগোয়া, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া৷ পাশেই একটা টিউবওয়েল৷ আর তাকে ঘিরে নানান গাছপালা৷ বর্ষায় সেগুলো সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷
টিউবওয়েল থেকে একটু দূরেই একটা ছোট গোয়ালঘর৷ সেখানে বানজারার পোষা গোরু রামুয়া আর ছোট একটা বাছুর আছে৷ ওরা বেশির ভাগ সময়েই মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ঘাস-পাতা খায়৷
বানজারা বউ নিয়ে থাকে৷ ওর বউ স্কুলের সুইপারের কাজ করে৷ সবসময় পান খায়, আর মাথায় ঘোমটা টেনে থাকে৷
টিচার্স রুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অচ্যুতের বুটজুতোর খটখট শব্দ করিডরে কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল৷ একতলা থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল৷ বানজারা ওর কাজ শুরু করে দিয়েছে৷
টিচার্স রুমের কাছে এসে অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷ ঘর খাঁ-খাঁ করছে৷ কেউ নেই৷
ঘরে আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে৷ খোলা জানলা দিয়ে ঘোর কালো মেঘ, গাছপালা আর বৃষ্টি চোখে পড়ছে৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা হাওয়ায় উড়ছে৷
তা হলে কি বৃষ্টি আসার ভয়ে অমিয়স্যার একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছেন?
এমন সময় একটা শব্দ অচ্যুতের কানে এল৷
মেঝেতে খুচরো পয়সা পড়ে যাওয়ার শব্দ৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে নজর ধারালো করল অচ্যুত৷ সামান্য কুঁজো হয়ে টেবিলের নীচ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল৷
খুচরো পয়সা কোথায় পড়ল? কার পকেট থেকে পড়ল?
ঝুঁকে পড়ে নীচু হতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার দেওয়ালের গায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছেন!
মেঝে থেকে অন্তত হাতদুয়েক ওপরে মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্যারের শরীরটা আঠার মতো আটকে রয়েছে৷ ঠিক সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে চলেছেন৷
এরকম একটা মজার দৃশ্য দেখে অচ্যুতের হাসি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু ও ভয় পেল৷ ওর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরে বাতাস আটকে গেল৷ কারণ, সত্যবানস্যারের মুখে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর উল্লাস৷ ঠোঁটজোড়া লাল টুকটুক করছে, চোখে এক অলৌকিক সবুজ আলো৷
আর ঠিক তখনই কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷ অচ্যুত চমকে উঠল৷ ওই অবস্থাতেও ও বুঝতে পারল খুচরো পয়সাগুলো স্যারের পকেট থেকেই পড়েছে৷
এরকম একটা বিচিত্র ভয়ংকর দৃশ্য অচ্যুতকে পাগল করে দিল৷ ও হেঁচকি তুলে শ্বাস টানল, বুক ভরে বাতাস নিতে চাইল৷ তারপরই ছুট লাগাল দোতলার বারান্দা ধরে৷ ওর বুটের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পাগলা ঘোড়া মৃত্যুভয়ে ছুটে পালাচ্ছে৷
অচ্যুত যদি পিছন ফিরে তাকাত তা হলে দেখতে পেত সত্যবানস্যার ওর হেঁচকির শব্দে দেওয়ালের গা থেকেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন৷ সবুজ আগুনভরা চোখে ওর ছুটে পালানো দেখছেন৷
আর স্যারের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি৷
.
৷৷তিন৷৷
পরদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেটে পৌঁছে অচ্যুতের মনে হচ্ছিল গতকাল ও যা দেখেছে সবটাই স্বপ্ন—অথবা দুঃস্বপ্ন৷
রং-চটা সীমানা-পাঁচিলের গায়ে বসানো জং-ধরা লোহার গেটের একটা পাল্লা খোলা৷ অচ্যুত সাইকেল থেকে নেমে পড়ল৷ তারপর সাইকেলটা হাঁটিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
মাঠের এখানে-সেখানে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে৷ মাঝখানের খানিকটা ফাঁকা জায়গা বাদ দিলে মাঠের বাকি অংশে বড়-বড় ঘাস আর আগাছা৷ এ ছাড়া পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কয়েকটা বট, অশ্বত্থ, কদম, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু গাছ৷ আর প্রকাণ্ড জামগাছটা আছে বানজারাদের ঘরের কাছাকাছি৷ গরমকালে পাকা জাম পড়ে-পড়ে গাছের নীচটা বেগুনি হয়ে থাকে৷ গাছটার নীচে বসার জন্য কয়েকটা সিমেন্টের বেদি আছে৷
বৃষ্টি না হলে এই মাঠেই স্কুলের প্রেয়ার হয়৷ আর বৃষ্টি হলে যার-যার ক্লাসরুমে৷
মাঠের বাঁদিকে একটা দোলনা আর স্লিপ—নীচু ক্লাসের ছেলেদের খেলার জন্য৷ আর তার পিছনেই সাইকেল রাখার জায়গা৷
সাইকেল রেখে অচ্যুত স্কুল-বাড়ির দিকে এগোল৷
বড় মাপের ছড়ানো দোতলা বাড়ি৷ তার পলেস্তারা-খসা রং-চটা চেহারার দিকে খুব খুঁটিয়ে নজর করলে বোঝা যায় একসময়ে বাড়িটার রং গোলাপি ছিল৷
স্কুল-বাড়ির একতলার দেওয়ালে তেল রঙে বড়-বড় করে আঁকা মনীষীদের রঙিন ছবি৷ বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, রামমোহন, সবাই সেখানে হাজির৷ বৃষ্টির জলে ধোয়া ছবিগুলো ঝকঝক করছে৷
ওঁদের ছবির দিকে তাকিয়ে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা অচ্যুত কিছুতেই সত্যি বলে মেনে নিতে পারছিল না৷
গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই আকাশের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ আবার শুরু হল৷ এবার পুজোয় বৃষ্টির পিছু ছাড়াতে পারলে হয়৷ ও একতলার বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷
বানজারার ঘণ্টার পর ক্লাস শুরু হল বটে তবে অচ্যুত ভীষণ আনমনা হয়ে রইল৷ গতকালের ঘটনাটা ওর বুকের ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷
প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়তেই ও চমকে উঠল৷ কারণ, সেকেন্ড পিরিয়ডটা অঙ্কের—সত্যবানস্যারের ক্লাস৷
অচ্যুত কুলদীপের দিকে তাকাল৷ কুলদীপ দুটো সারি পিছনে বসে৷ ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কুলদীপ ইশারা করল৷ যার অর্থ, এক্ষুনি স্যাটাস্যাট আসছেন৷
এখনও পর্যন্ত অচ্যুত শুধু কুলদীপকেই ঘটনাটা বলেছে৷ আর কাউকে নয়৷ এমনকী বাপি-মা-কেও নয়৷
সত্যবানস্যার ক্লাসে এসে ঢুকলেন৷
টকটকে ফরসা রং৷ পিছনদিকে টেনে আঁচড়ানো তেলচকচকে চুল৷ চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা৷ গাল সামান্য ভাঙা—চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে৷ লম্বাটে নাকের নীচে সরু গোঁফ৷ গালে দাড়ির নীলচে আভা৷
সত্যবানস্যারের পরনে সাদা হাফশার্ট আর গাঢ় বাদামি প্যান্ট৷ চেহারা বেশ রোগা হওয়ায় প্যান্টটা ঢলঢল করছে৷ গতকাল স্যার এই পোশাকই পরেছিলেন৷
অচ্যুত খুব খুঁটিয়ে স্যারকে দেখছিল৷ অঙ্ক করতে-করতে মাঝে-মাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন আর জিভ বের করে ঠোঁটজোড়া চেটে নিচ্ছেন৷ তেষ্টা পেলে মানুষ যেমন করে৷
কিন্তু এরপরই এক অবাক কাণ্ড হল৷
বীজগণিতের অনুপাত আর সমানুপাতের কুড়ি প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো বোর্ডে স্যার বোঝাচ্ছিলেন৷ সেই অঙ্ক হঠাৎই আটকে গেল!
অচ্যুত যতদূর জানে সত্যবানস্যারের অঙ্ক কখনও আটকায়নি৷ কিন্তু আজ এ কী কাণ্ড!
সত্যবানস্যার বোর্ডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন৷ আঙুলে ধরা চকটা শূন্যে ঘুরিয়ে মনে-মনে যেন অঙ্কটা কষে ফেলতে চাইলেন৷
অচ্যুতের মনে পড়ে গেল গতকালের কথা৷ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে সত্যবানসার একজন অচেনা মানুষের মতো ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপর স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমের দেওয়ালে ওই কাণ্ড! আর এখন, বরাবর যিনি স্যাটাস্যাট অঙ্ক করেন, তাঁর অঙ্ক গেছে আটকে!
স্যারের কি তা হলে কিছু হয়েছে?
সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চেয়ারে বসে পড়লেন৷ অঙ্ক কষা নিয়ে এলোমেলো ধানাইপানাই করে চললেন৷ তারপর, ক্লাস শেষ করে চলে যাওয়ার সময়, কুলদীপকে বললেন, ‘কুলদীপ, তোরা কাল সন্ধেবেলা তো কোচিং-এ আসছিস, তখন ভালো করে এটা বুঝিয়ে দেব৷’
অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, রাজীব আর সৌরভ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ একই ব্যাচে পড়ে৷ স্যারের বাড়ি নৈহাটি৷ তবে প্রতিদিন স্কুলের পর কোচিং সেরে রাতের ট্রেন ধরেন৷ তবে কখনও-কখনও রাত হয়ে গেলে কোচিং-এর ঘরটাতেই থেকে যান৷
পরের দুটো পিরিয়ড অচ্যুতের আর কাটতে চাইছিল না৷ ও ভাবছিল, কতক্ষণে টিফিন হবে আর ও কুলদীপকে নিয়ে আলোচনায় বসবে৷
গতকাল বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের দেওয়ালে হাঁটার দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল৷ একটা লতানে গাছ যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে সড়সড় করে বেড়ে চলেছে৷
লেখাপড়ার চেষ্টা ছেড়ে টিভিতে ই. এস. পি. এন. আর স্টার স্পোর্টস চ্যানেল দেখতে বসে গিয়েছিল, কিন্তু স্যার টিভির পরদাতেও হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷
মা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে ওকে দেখছিল৷ অনেকক্ষণ দেখার পর কাছে এসে জিগ্যেস করল, ‘তোর কী হয়েছে রে?’
‘কিচ্ছু না৷’ অচ্যুত মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারল না৷ শূন্য দৃষ্টিতে টিভির পরদার দিকে চেয়ে রইল৷
‘তখন থেকে দেখছি কেমন উসখুস করছিস?’
কোনও জবাব দিল না অচ্যুত৷
‘স্কুলে ঝগড়া-মারপিট করেছিস?’
‘না৷’ মাথা নাড়ল অচ্যুত৷ টিভির দিক থেকে চোখ সরাল না৷
মা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ ছেলের মনের ভেতরটা বুঝতে চেষ্টা করল৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেল রান্না-ঘরের দিকে৷ ভাবল অচ্যুতের বাবা এলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলবে৷ ছেলে বড় হচ্ছে৷ স্কুলে কী সমস্যা বাধিয়ে এসেছে কে জানে!
অচ্যুতের বাবা এখন বাড়িতে নেই৷ অফিস থেকে ফিরে বটতলার মিষ্টির দোকানের কাছে তাসের আড্ডায় মেতে আছে৷ ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা৷
অচ্যুত যখন টিভি, রেডিয়ো, ওয়াকম্যান, বারান্দা, এ-ঘর, ও-ঘর করে ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে, ঠিক তখনই কুলদীপের ফোন এল৷
অচ্যুত ফোন করেনি দেখে কুলদীপই ওকে ফোন করেছে৷
নীচুগলায় ওর সঙ্গে কথা বলল অচ্যুত৷
বলল, অমিয়স্যারের দেখা পায়নি৷ আর সত্যবানস্যারকে ওইরকম করতে দেখেছে৷
কুলদীপ ও-প্রান্তে শিস দিয়ে উঠল, বলল, ‘কীসব যা-তা বলছিস!’
অচ্যুত বলল, ‘মা-কালীর দিব্যি—৷’
কুলদীপ আবার চাপা শিস দিল৷ উত্তেজিত হয়ে উঠলে ও শিস দেয়৷ আর মেজাজ ভালো থাকলে শিস দিয়ে গান শোনায়৷
অচ্যুত এলোমেলোভাবে ওকে সব খুলে বলল৷ জট পাকানো হলেও গোটা গল্পটা বুঝতে কুলদীপের অসুবিধে হল না৷ সব শোনার পর ও বিড়বিড় করে শুধু বলল, ‘স্যাটস্যাট আগের জন্মে বোধহয় টিকটিকি ছিল…’
কুলদীপের রসিকতায় অচ্যুতের হাসি পেল না৷ ওর মনে পড়ল, টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হাত-পা ঠকঠক করে কেঁপেছিল৷
টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই অচ্যুতের চমক ভাঙল৷
ক্লাসের অন্যান্য ছেলে বই-খাতা ডেস্কে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ করিডরে ওদের হুটোপাটি ছুটোছুটিতে হুল্লোড় বেধে গেল৷ কার টিফিন বক্স ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷ ঠং করে আওয়াজ হল৷ লুচি আর আলুভাজা ছড়িয়ে পড়ল৷ বুট পরা ছুটন্ত পা-গুলো নিমেষে সেগুলো মাড়িয়ে চলে গেল৷ কারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ কতক্ষণে নীচের মাঠে গিয়ে পৌঁছবে সেই চিন্তায় সব মশগুল৷
কুলদীপ আর অচ্যুত বেরোল সকলের শেষে৷ ওদের হাতে টিফিন বক্স৷
সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে রাজীব দাসের সঙ্গে ওদের দেখা হল৷ মুখ কালো করে এক পা এক পা করে নামছে৷
গতকাল অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় হেডস্যারকে ম্যানেজ করার ব্যাপারটা ভেস্তে গেছে৷ অচ্যুত রাজীবকে সেটা বলতেই ও কাচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আমি স্কুলে এসেই হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করেছি৷ বলেছি, আজ মাম্মি আর বাপি কলকাতায় গেছে, কাল এসে দেখা করবে৷ বিপদে পড়ে মিছে কথা বলতে হল৷ তোরা আমাকে সেভ কর৷ তোরা আজ অমিয়স্যারকে একটু বল—প্লিজ! আচ্ছা, মানুষের কি ভুল হয় না?’
রাজীবের চোখে জল এসে গেল৷
কুলদীপ বলল, ‘অ্যাই, বাংলা সিনেমার লাস্ট সিনের মতো কাঁদবি না৷ আজ তোর ব্যাপারটা ফয়সালা করে দেব৷ এখন টিফিন খেয়ে বল খেল গিয়ে৷’
অচ্যুত আর কুলদীপ জামগাছতলার সিমেন্ট বাঁধানো বেদির ওপরে গিয়ে বসল৷ প্রতীক ওদের কাছে বসতে এসেছিল, কিন্তু কুলদীপ ওকে বলল, ‘কিছু মনে করিস না—অচ্যুতের সঙ্গে আমার একটু প্রাইভেট টক আছে৷’
প্রতীক সন্দেহের চোখে কুলদীপকে দেখল৷ আজকাল ওকে মাঝে-মাঝেই ‘কমলাবালা গার্লস হাইস্কুল’-এর গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সে-ব্যাপারে প্রাইভেট কথা কি না কে জানে!
কিছু না বলে প্রতীক ভুরু উঁচিয়ে ঘাড় নেড়ে চলে গেল৷
মিহি বরফের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি পড়ছে৷ বাদলা হাওয়ায় সেই গুঁড়ো মুখে উড়ে এসে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ মেঘের চাপা গুড়গুড় শোনা যাচ্ছে কখনও-কখনও৷ একটু দূরে, স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে, বানজারার গোরু রামুয়া আর তার বাছুর আপনমনে ঘাস খাচ্ছে৷
দুজনের টিফিন মিলিয়ে-মিশিয়ে খেতে-খেতে কুলদীপ বলল, ‘স্ট্রেটকাট বল তো, স্যাটাস্যাটের এগেইনস্টে কী অ্যাকশন নিতে চাস?’
অচ্যুত কুলদীপের চোখে তাকাল : ‘অ্যাকশন নেব কী, ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না৷’
‘স্যাটাস্যাটকে একটু ওয়াচ রাখতে হবে৷’
‘যদি আমাকে ধরে কিছু বলে?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে কেমন যেন শব্দ হচ্ছিল৷
‘ধুস, কী আর বলবে! বলবে যে, আমি দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো হাঁটছিলাম! তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না৷…তা ছাড়া তোকে তো আর একা পাচ্ছে না যে বলবে!’
অচ্যুতের মুখ দেখে মনে হল না খুব ও একটা ভরসা পেয়েছে৷ ও চুপচাপ বসে বর্ষাভেজা প্রকৃতি দেখতে লাগল৷
কিছুক্ষণ পর কুলদীপ তাড়া লাগাল, ‘চল, অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করে তারপর ক্লাসে যাব৷ রাজীবের ব্যাপারটা আগে বলা দরকার৷ নইলে ওর প্রবলেম হয়ে যাবে৷’
বেদি ছেড়ে ওঠার সময় অচ্যুত বলল, ‘সত্যবানস্যারের কেসটা কিন্তু কাউকে বলিস না৷’
কুলদীপ মাথা নেড়ে সায় দিল৷
মনিটর বাসব আর প্রতীককে সঙ্গে নিয়ে অচ্যুত আর কুলদীপ টিচার্স রুমে গেল৷ অমিয়স্যারকে অনেক করে বলে-কয়ে ওরা রাজীবের গার্জেনকল ঠেকাল৷ অমিয়স্যার অচ্যুতকে বললেন, ‘অ্যাই, তোর বাংলা খাতাটা আমার দেখা হয়ে গেছে৷ এত বানান ভুল করিস কেন রে? অভিধান অবলোকন করবি৷ ছুটির পর এসে খাতাটা নিয়ে যাস৷ কাল বর্ষণের জন্যে আমি একটু আথিবিথি বেরিয়ে গিয়েছিলাম৷’
আবার সেই ‘ছুটির পর’! তার ওপর আবার ‘আথিবিথি’! অমিয়স্যারের সঙ্গে পরিচয় না হলে অচ্যুত কোনওদিন জানতেই পারত না ওর মাতৃভাষায় এত মারপ্যাঁচ আছে৷
অচ্যুতের চোখ অনেকক্ষণ ধরেই চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ স্যারদের বসার বিশাল টেবিলের শেষ প্রান্তে সত্যবানস্যার বসে আছেন৷ কী একটা বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন৷ চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কোনও হুঁশ নেই৷
অচ্যুত অমিয়স্যারের কথার ওপরে কথা বলতে পারল না৷ শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল৷ ছুটির পরই ও স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসবে৷
টিফিন শেষের ঘণ্টা একটু আগেই বেজেছে৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ক্লাসে ফিরে চলল৷
অচ্যুতের মনে অশান্তির ঝড় দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও কি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে একা যাবে, নাকি কুলদীপ, বাসব, কিংবা সৌরভকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? কিন্তু সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলে অমিয়স্যার বিরক্ত হতে পারেন৷ তা ছাড়া টিচার্স রুমে সত্যবানস্যার তো ওকে আর একা পাচ্ছেন না!
সুতরাং ছুটির ঘণ্টা পড়তে-না-পড়তেই অচ্যুত পা চালাল টিচার্স রুমের দিকে৷ দেরি করে গেলে টিচার্স রুম ফাঁকা হয়ে যেতে পারে৷ সেই ঝুঁকি অচ্যুত নিতে চায় না৷
টিচার্স রুমে গিয়ে দেখল অমিয়স্যার ছাড়া আরও অনেক স্যারই তখন সেখানে রয়েছেন৷ যদিও সত্যবানস্যারকে অচ্যুত দেখতে পেল না৷
অনুমতি নিয়ে অমিয়স্যারের কাছে গেল অচ্যুত৷ স্যারের কাছ থেকে খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে করিডর ধরে হাঁটা দিল৷
সিঁড়ি নামার সময় ওর কাঁধে কে যেন হাত রাখল৷
মুখ তুলে তাকাল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চাটছেন৷
আশেপাশে আরও কয়েকজন ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে৷ কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেই মশগুল৷
সত্যবানস্যার ওর সঙ্গে-সঙ্গে নামতে লাগলেন, আর চাপা গলায় কথা বলতে লাগলেন৷
‘জানিস তো, মানুষ অনেক সময় ভুল দ্যাখে! যেমন, তুই কাল বিকেলে যা দেখেছিস ভুল দেখেছিস৷ কারণ, তুই যা দেখেছিস সেটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ আর প্রমাণ দিতে না পারলে কেউ তোর কথা বিশ্বাসও করবে না৷’ স্যার হিসহিস শব্দ করে হাসলেন : ‘এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷’
গলা শুকিয়ে কাঠ৷ কাঁধের ওপরে স্যারের আঙুলের চাপে ব্যথা লাগছে৷ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে৷ অচ্যুতের মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে৷
একতলায় নেমে সত্যবানস্যার বাঁদিকে কয়েক পা হেঁটে গেলেন৷ ক্লাস ফাইভের বি সেকশানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷
অচ্যুত কাঠের পুতুলের মতো স্যারের পাশে-পাশে হাঁটছিল৷ স্যার থমকে দাঁড়াতেই ও-ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷
এদিকের বারান্দাটা এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ সুতরাং ওদের কথা শুনতে পাবে কাছাকাছি এমন কেউ নেই৷
ক্লাসরুমের দরজার কাছটায় অচ্যুতকে একরকম ঠেলেই নিয়ে গেলেন সত্যবানস্যার৷ চাপা গলায় বললেন, ‘শোন, কাউকে কোনও কথা বলবি না৷ অবশ্য বললেও কেউ আমল দেবে না৷ ওরে, মানুষের কি ভুল দেখার কোনও শেষ আছে! এই দ্যাখ—!’ বলেই স্যার অচ্যুতের চোখে তাকালেন৷
অচ্যুত দেখল, সেখানে ধকধক করছে দুটো সবুজ টুনি বালব৷ আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি হল চোখের মণি৷
‘এটাও তুই ভুল দেখছিস৷’ মিহি সুরেলা গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘কারণ, তুই এটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ সুতরাং তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সত্যবানস্যার৷ তার হিমেল ঝাপটা অচ্যুতের মুখ ছুঁয়ে গেল৷ অচ্যুতের গায়ে কাঁটা দিল৷
ও লক্ষ করল, স্যারের চোখের সবুজ রং ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে সাদাটে হয়ে গেল৷ তারপর সামান্য ছাই-রং হয়ে কটা চোখের চেহারা নিল৷ তারপর কালচে হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷
সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘তুই কাউকে কিচ্ছু বলবি না! কারণ, তুই আসলে কিছুই দেখিসনি৷ কাল সন্ধেবেলা কোচিং-এ আসবি, কামাই করবি না৷ ভাবিস না, তুই পালিয়ে বাঁচবি৷ আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
অচ্যুত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল৷ ওর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না৷ কাঁধের ওপর স্যারের বাঁকানো আঙুলের চাপ যেন ছুরি বিঁধিয়ে দিচ্ছিল৷
‘এখন যা৷’ সত্যবানস্যার ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওকে আলতো করে ঠেলে দিলেন : ‘তুই কিন্তু কিছুই দেখিসনি—৷’
অচ্যুত আর-একটু হলে টলে পড়ে যাচ্ছিল৷ কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ও মাঠে নামার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷ ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতে পারল না৷
জল-কাদা পেরিয়ে যখন ও সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছল তখন প্রতীক ওকে পিছন থেকে ডাকল৷
অচ্যুত ফিরে তাকাতেই প্রতীক জিগ্যেস করল, ‘তোকে স্যাটাস্যাট ওরকম হাসতে-হাসতে কী বলছিল রে?’
‘কিছু না৷ কাল কোচিং-এর খাতা-বই ঠিকমতো নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল৷’ অচ্যুতের গলা সামান্য কেঁপে গেল৷
‘তোকে স্যার হেভি ফেভার করে৷’ বেজার মুখে বলল প্রতীক, ‘অবশ্য ফেভার তো করবেই! তুই অঙ্কে একশোয় একশো পাস, আর আমার নম্বরটা চার কি পাঁচ দিয়ে গুণ করলে তবে একশো হয়৷ তবে অঙ্ককে আমি মোটেই ভয় পাই না৷ পারি-না-পারি, লড়ে যাই৷’
অচ্যুত হাসতে পারল না৷
কারণ, সত্যবানস্যারের একটা কথা বারবার ওর মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল৷
বাড়ি ফিরেও ওর খচখচানিটা গেল না৷
স্যার বলেছেন, ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
এর মানে কী?
.
৷৷চার৷৷
অচ্যুত রাতে কুলদীপ আর সৌরভকে ফোন করল৷ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলল, কোচিং নিয়ে কথা বলল, কিন্তু সত্যবানস্যারের কথা বলল না৷ বরং কুলদীপ উৎসাহ নিয়ে সত্যবানস্যারের রহস্য ভেদ করার ব্যাপারে নানান উদ্ভট পরামর্শ দিল৷ বলল, ‘স্যারকে ফলো করতে হবে, বুঝলি! সবসময় নজরে-নজরে রাখতে হবে৷ তা হলেই কেসটা বোঝা যাবে৷’
অচ্যুত তখন ভাবছিল, কুলদীপ তো আর স্যারের সবুজ চোখ দ্যাখেনি! দেখলে বোঝা যেত ওর এখনকার এত সাহস কতটা চুপসে যায়৷
রাতে বিছানায় শুয়ে অচ্যুত একরকম জেগেই রইল৷ ওর ভেতর থেকে ভয়টা কিছুতেই যেতে চাইছিল না৷ পরদিন স্কুলে যাওয়া নিয়ে সামান্য ভয় করলেও সেটা মা-বাপিকে বুঝতে দিল না৷ মনে-মনে ঠিক করল, স্কুলে কখনও ও আর একা থাকবে না৷ যেখানেই যাক, দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নেবে৷ এমনকী টয়লেটে গেলেও৷
স্কুলের সময়টা শান্তিমতোই কেটে গেল৷ তবে একবার সত্যবান-স্যার করিডরে অচ্যুতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন—কিন্তু ওকে চিনতে পারেননি৷
অচ্যুতের সঙ্গে প্রতীক ছিল৷ পরশুদিন সত্যবানস্যারের এরকম অদ্ভুত আচরণ ও নিজের চোখে দেখেছে৷ স্যার চলে যাওয়ার পর ও চাপা গলায় বলল, ‘যা-ই বল, স্যাটাস্যাট কিন্তু একেবারে চেঞ্জ হয়ে গেছে!’
অচ্যুত চুপ করে রইল৷ এই দেড় দিনে চুপ করে থাকাটা ওর দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে৷
স্কুল ছুটির পর একটা বিচিত্র দৃশ্য অচ্যুতের চোখে পড়ল৷ ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখল সত্যবানস্যার মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বানজারার গোরু আর বাছুরকে আদর করছেন৷ ওদের গলার কাছে কুঁচি দেওয়া যে নরম চামড়া থাকে—যাকে গলকম্বল বলে—সেখানে হাত বোলাচ্ছেন৷ আর অবোলা জীব দুটো চুপটি করে দাঁড়িয়ে স্যারের আদর খাচ্ছে৷
গোরু-বাছুরকে আদর করা নিশ্চয়ই খারাপ নয়৷ কিন্তু সত্যবানস্যারকে আগে কখনও কেউ এরকম আদর করতে দ্যাখেনি৷
সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নানান দুশ্চিন্তা অচ্যুতের মাথার ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷
ঘণ্টাদুয়েক পর যখন ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ রওনা হল তখনও চিন্তাগুলো ওর মাথা থেকে যায়নি৷
আকাশ ঘোলাটে মেঘলা৷ ভেজা মেঘের আড়ালে আবছাভাবে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ বেহিসেবি বাদলা হাওয়া কখনও-কখনও গাছগাছালির পাতা দুলিয়ে দিচ্ছে৷ ভাঙাচোরা রাস্তায় এখানে-ওখানে জল-কাদার নকশা৷ দোকানপাটে খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই৷
পথচলতি সাইকেল রিকশা আর স্কুটারকে পাশ কাটিয়ে সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছিল অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ স্কুলের পাশ দিয়েই যেতে হয়৷ যাওয়ার সময় দেখল, অন্ধকারে ভূতের মতো দোতলা স্কুল-বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ শুধু বানজারার ঘরে আলো জ্বলছে৷
কোচিং-এ পৌঁছে প্রথম-প্রথম একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোচিং-এর সময়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই কাটল৷ গত সপ্তাহের মতো তুখোড় পেশাদার ঢঙেই পড়ালেন সত্যবানস্যার৷ অচ্যুতের অঙ্ক কষার কেরামতিকে তারিফ করলেন, ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন৷ প্রতিটা অঙ্ক বেশ সহজ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন৷ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখে দিলেন৷ সব মিলিয়ে কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই৷
তবে একটা ব্যাপারে সামান্য খটকা লাগল অচ্যুতের৷
রাজীবের অঙ্কের অবস্থা প্রতীকের মতোই৷ তার ওপর রাজীবের আবার অঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক আছে৷ অঙ্ক কষতে গিয়ে ও ঘন-ঘন আটকে যাচ্ছিল৷ সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ ধরে ওকে লক্ষ করছিলেন৷ তারপর ওর কাছে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ে হাত বোলাতে লাগলেন : ‘চেষ্টা কর, ঠিক পারবি৷ পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়—৷’
রাজীবকে আজ যেন স্যার বড্ড বেশি যত্ন নিয়ে অঙ্ক দেখাচ্ছেন৷ আগে কখনও এই যত্ন অচ্যুতের চোখে পড়েনি৷ তার ওপর ঘাড়ে যেরকম মোলায়েম করে হাত বোলাচ্ছেন তাতে বানজারার গোরু-বাছুরকে আদর করার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷
অচ্যুত মনে-মনে নিজেকে ধমক দিল৷ আজকাল ওর কী হয়েছে! সবকিছুতেই শুধু খটকা লাগছে! একজন স্যার কি হঠাৎই স্নেহপ্রবণ হতে পারেন না?
কিন্তু ধমক খেয়েও অচ্যুতের মন মানতে পারছিল না৷ বরং ভাবছিল, হঠাৎ করে কেউ যদি দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তার আচমকা স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠতে বাধা কী!
কোচিং শেষ করে ফেরার সময় রাজীব বলল, ‘অচ্যুত, আমি তোর সঙ্গে যাব৷ আমাকে পরেশদার কেকের দোকানে নামিয়ে দিবি৷’
রাজীবের সাইকেল নেই৷ অ্যাক্সিডেন্ট হবে এই ভয়ে বাবা-মা কিনে দেননি৷
কুলদীপ কোচিং ক্লাস চলার সময় অনেকবার অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে ইশারা করেছে৷ ঠোঁট উলটে মাথা নেড়েছে৷ অর্থাৎ, সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ছে না৷
অচ্যুত কোনও উত্তর দেয়নি৷
কোচিং-এর বাইরে বেরিয়ে অচ্যুতের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কুলদীপ বলল, ‘ধৈর্য চাই, ধৈর্য৷ সহজে এ-রহস্যের জট খুলবে না৷’
অচ্যুত ‘হুঁ—’ বলে সায় দিল৷
ওর সাইকেলে সামনের রডে বসার সময় রাজীব জিগ্যেস করল, ‘আমাকে ক্যারি করতে পারবি তো? এই জল-কাদায় যদি ফেলে দিস তা হলে জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যাবে৷ তারপর মাম্মির হাজারটা কোশ্চেন—৷’
‘তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি তিনমাস ধরে ডাবল ক্যারি করছি৷’
ওকে বসিয়ে নিয়ে অচ্যুত সাবধানে সাইকেল চালাতে লাগল৷
এখন বৃষ্টি নেই৷ তবে কখন শুরু হবে কেউ বলতে পারে না৷ কাগজে লিখেছে কোথায় যেন নিম্নচাপ হয়েছে—তার জন্যই নাকি এরকম বাজে অবস্থা৷
একটু পরেই ওরা স্কুলের কাছাকাছি চলে এল৷
স্কুলের একরকম পাশেই এক প্রকাণ্ড পুকুর৷ তার ঢালু পাড়ে বড়-বড় মানকচু গাছ আর আগাছার ঝোপ৷ নাম-না-জানা লতানে গাছের দল আধো-অন্ধকারে সাপের মতো জড়াজড়ি করে রয়েছে৷
পুকুরপাড়ের বেড়ে ওঠা আগাছার রমরমাকে রুখে দিয়েছে ছোট-ছোট চার-পাঁচটা দোকান৷ দরমা, বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘেরা চা-সিগারেট-পান-বিড়ির দোকান৷ সেখানে হ্যারিকেন বা কুপির আলো জ্বলছে৷
দোকানগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অন্ধকার আর কচু পাতার কালো ছায়া৷ সেখান থেকে নানান সুরে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক৷
পুকুর পেরিয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোরুর ‘হাম্বা’ ডাক অচ্যুতের কানে এল৷
অচ্যুত বলল, ‘স্যাটাস্যাট আজ তোকে ব্যাপক আদর করছিল৷’
‘হ্যাঁ রে, আমিও তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি৷ অন্যদিন কীরকম বকুনি দেয়! বলে, বাপিকে রিপোর্ট করবে…৷’
‘এবার তুই অ্যানুয়ালে অঙ্কে এইট্টি পারসেন্ট পাবি৷’
‘ভ্যাট!’
‘দেখিস…৷’
পরেশদার কেকের দোকান এসে গিয়েছিল৷ অচ্যুত দোকানের কাছ ঘেঁষে সাইকেল থামাল৷ কাঁচা ড্রেনের ওপরে পাতা সিমেন্টের স্ল্যাবে ওর সামনের চাকা ঠেকে গিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি লাগল৷
রাজীব সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল : ‘কাল টিফিনের জন্যে কেক আর প্যাটিস কিনব৷’
অচ্যুত টিফিনে মায়ের হাতে তৈরি লুচি কিংবা পরোটা নিয়ে যায়—সঙ্গে আলুর তরকারি বা আলুভাজা৷ মাসে দু-একদিন কেক বা প্যাটিস৷ আর দু-তিন টাকা পকেটে থাকলে টিফিনের সময় স্কুলের দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো বিভিন্ন ‘ওলাদের’ কাছ থেকে ঝালমুড়ি, ঘুগনি বা বাদাম খায়৷
রাজীব হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘একটা সিগারেট টেস্ট করে দেখবি নাকি?’
‘না না—আমার ওসব ভালো লাগে না৷’
‘সেদিন কুলদীপ দু-চার টান দিয়েছিল৷ মন্দ নয়৷ জানিস তো, ও মাঝে-মাঝে স্মোক করে!’
‘জানি!’
রাজীব আবদারের গলায় বলল, ‘যাই বল, আজ এরকম বৃষ্টি-বাদলার দিন…একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে৷ অচেনা দোকান থেকে কিনব৷ তারপর দুটো টফি খেয়ে বাড়ি যাব—কেউ গন্ধ পাবে না৷ তুই খাবি না—শিয়োর?’
অচ্যুত হেসে বলল, ‘না৷’
তারপর রাজীবকে টা-টা করে চলে গেল৷
রাজীব পরেশদার দোকানে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ওকে নাম ধরে ডাকল৷
ঘুরে তাকাল রাজীব৷
সত্যবানস্যার৷ সাইকেল পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ রাজীবের দিকে তাকিয়ে অল্প-অল্প হাসছেন৷
রাজীব স্যারের কাছে এগিয়ে গেল, ‘কিছু বলবেন, স্যার?’
‘হ্যাঁ৷ কী কিনবি কিনে নে, তারপর চল, যেতে-যেতে বলছি৷ তোর বাড়ি তো স্টেশনের দিকে৷ চল, তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দেব৷’
‘সিগারেট খাওয়াটা ভোগে গেল’, মনে-মনে ভাবল রাজীব৷ স্যার যে পিছন-পিছন আসবেন তা ও কেমন করে জানবে! এরকম আগে কখনও হয়নি৷
কিন্তু রাজীব অবাক ভাবটা চেপে রাখল৷ ছোট্ট করে বলল, ‘একমিনিট ওয়েট করুন, স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি৷’
তারপর ছুট্টে ঢুকে পড়ল পরেশদার দোকানে৷
পরদিন স্কুলে ঢুকে অচ্যুত দেখল বানজারার ঘরের সামনে অনেক ছাত্রের ভিড়৷ দু-একজন গার্জেন আর স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে৷
সাইকেল জায়গামতো রেখে মাঠের কোণের দিকটায় ছুটে গেল অচ্যুত৷ ভিড় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
দৃশ্যটা দেখার আগেই বানজারার বউয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছিল অচ্যুত৷ কাঁদছিল আর দেশোয়ালি ভাষায় বিলাপ করছিল৷ ওর কথার একটি বর্ণও অচ্যুত বুঝতে পারছিল না৷ শুধু ‘রামুয়া’ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল আর এটুকু বুঝতে পারছিল, ভালোবাসার কেউ মারা গেলে মানুষ এরকম বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷
বৃত্তের ভেতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখতে পেল অচ্যুত৷
রামুয়া আর ওর বাছুর মাটিতে পাশাপাশি পড়ে আছে৷ ওদের চোখ বোজা৷ বানজারার বউ ওদের ওপর শরীর এলিয়ে কাঁদছে৷
বানজারা একপাশে বেজার মুখে উবু হয়ে বসে ছিল৷ চোখ ছলছল৷ মাথাটা ডানহাতে ভর দিয়ে হেলানো৷
অচ্যুত অবাক হয়ে দেখল, রামুয়ার ধপধপে সাদা গলায় রক্তের দাগ৷ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ওর বাছুরের দশাও তাই৷ ঠিক মনে হচ্ছে, কোনও হিংস্র জন্তু ওদের নরম গলায় কামড় দিয়েছে৷
কিন্তু এই সামান্য ক্ষত থেকে কি এতবড় মাপের একটা গোরু মরে যেতে পারে?
তা ছাড়া কোন জানোয়ারই-বা গোরুর গলায় এভাবে কামড়ায়? সাপ, নাকি কুকুর?
বানজারা এবং আশেপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কথাবার্তার টুকরো জুড়ে গোটা গল্পটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল অচ্যুত৷
আজ ভোর-রাতের দিকে গোয়ালঘর থেকে একটা ঝটাপটির শব্দ বানজারা শুনতে পায়৷ ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে৷ কিন্তু ততক্ষণে সব আবার চুপচাপ হয়ে গেছে৷ তখন বানজারা আর ঘর ছেড়ে বেরোয়নি৷ অনেক সময় রামুয়া আচমকা খেপে উঠে পা ছোড়াছুড়ি করে৷ ব্যাপারটা সেইরকম কিছু একটা ভেবে বানজারা আবার শুয়ে পড়ে৷ পাশে ঘুমিয়ে থাকা বউকেও আর ডাকেনি৷
সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েই বানজারার বউ চিৎকার করে ওঠে৷ সেই চিংকার শুনে বানজারা ছুটে যায়৷ দ্যাখে রামুয়া গোয়ালঘরের বাইরে জলকাদার ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে—তখনও দেহ একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি৷ আর ওর বকনা বাছুরটা গোয়ালঘরের ভেতরে চোখ কপালে তুলে শেষ৷
বানজারা আর ওর বউ মিলে বাছুরটার দেহ গোয়ালঘরের গুমোট অন্ধকার থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় নিয়ে আসে৷ তারপর ঘটির পর ঘটি জল ঢেলে মা-মেয়েকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সবই বেকার৷ দুজনেরই দেহান্ত হয়ে যায়৷
অচ্যুতের দৃশ্যটা ভালো লাগছিল না৷ ও ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল৷
পিছন থেকে কুলদীপ ওর কাঁধে হাত দিল৷
অচ্যুত চমকে উঠল৷ কুলদীপ কখন এসেছে ও টের পায়নি৷
কুলদীপ হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘চল, ক্লাস বসে যাবে৷ আজ তো আর ঘণ্টা পড়বে না৷’
‘ওই গোরু আর বাছুরটার কী করে এমন দশা হল বল তো!’
‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল কুলদীপ : ‘শোন, আজ সকালে মউলি ফোন করেছিল৷ ও আজ হিস্ট্রি কোচিং-এ যাবে না৷ তোর নোটটা নেক্সট উইকে ফেরত দেবে৷’
অচ্যুতরা কয়েকজন সুপারমার্কেটের কাছে ইতিহাস পড়তে যায়৷ ওখানে নগেনস্যারের কোচিং আছে৷ নগেনস্যার চিত্তরঞ্জন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন—প্রায় বছরদশেক হল রিটায়ার করেছেন৷ নগেনস্যার যখন ইতিহাস পড়ান তখন অচ্যুতদের মনে হয় ওরা যেন সিনেমা দেখছে৷ ওদের চোখের সামনে চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য, মেগাস্থিনিস চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে৷
মউলি কমলাবালা গার্লস হাইস্কুলে পড়ে৷ অচ্যুতদের পাশের বাড়িতেই থাকে, অথচ সবসময় কুলদীপকে ফোন করে অচ্যুতকে খবর দেয়৷
মউলি খুব ছটফটে, শাড়ি পরতে ভালোবাসে না, বেণী দুলিয়ে হাঁটে৷ একদিন বিকেলে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল অচ্যুত৷ খেয়াল করেনি যে, ওদের ছাদে দাঁড়িয়ে মউলি ওর ঘুড়ি ওড়ানোর হাস্যকর চেষ্টা দেখছে৷
‘যারা সবসময় লেখাপড়া করে তারা ঘুড়ি ওড়াতে গেলে এরকমই হয়—৷’
ঘুড়ি ওড়ানো থামিয়ে ফিরে তাকাল অচ্যুত৷ ওর ময়ূরপঙ্খী ঘুড়িটা গোঁত খেয়ে সামনের বাড়ির শিউলি গাছে আটকে গেল৷
তাই দেখে মউলি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল৷
অচ্যুত বলল, ‘আমি মোটেই সবসময় লেখাপড়া করি না—তা হলে এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি কী করে৷’
ঠোঁট বেঁকাল মউলি : ‘আজকের ব্যাপারটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷ তুমি দিনরাত লেখাপড়া করো বলেই তো আমার পড়ায় মন বসে না—৷’
ধুত, যত্তসব উলটোপালটা কথা৷ ওর অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল অচ্যুত৷ বলল, ‘এরকম আবার হয় নাকি!’
‘হয়৷ দেখবে, আজ আমার কী দারুণ পড়ায় মন বসবে৷ মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…তা হলে সব কাজে আমার মন বসবে৷’
অচ্যুত কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ ও ছাদের পাঁচিলের কাছে এসে সাত-আট ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মউলিকে দেখছিল৷ মউলির মাথার পিছনে সূর্য অস্ত যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল৷
মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷ তার মানে?
মউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘সকালে আর বিকেলে ছাদে এসে একটু ফ্রেশ বাতাস তো নিতে পারো৷ তা হলে দেখবে, ভালো হবে৷’
‘কার?’
‘দুজনেরই৷’
মউলির মুখে সূর্যের তেরছা আলো পিছলে গেল৷ ও চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে একরকম ছুটেই চলে গেল৷
সেদিন অচ্যুত ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছিল৷ ঘুড়ি-লাটাই হাতে নিয়ে মউলির এলোমেলো কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেছিল৷
তারপর থেকে অচ্যুত লক্ষ করেছে, মউলির কাজের কিছু বলার থাকলে ও কুলদীপের মারফত বলে পাঠায়৷ ইতিহাস কোচিং-এ যখন পড়তে যায় তখনও ও অচ্যুতের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না৷ বরং ছাদে যখন দেখা হয় তখন অনেক সহজভাবে অনেক উলটোপালটা অকাজের কথা বলে৷ বলে, ‘তুমি ভিতু, তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই৷ কী করে অঙ্কে একশোয় একশো পাও কে জানে!’
অচ্যুত জবাব না দিলেও ওর কথাগুলো নিয়ে চুপচাপ বসে ভাবে৷
এখন কুলদীপ যে-নোটটার কথা বলেছে সেটা মউলি চেয়ে পাঠিয়েছিল কুলদীপের মারফত৷ আবার সেটা ফেরতও আসবে কুলদীপের হাত দিয়ে৷ তা হলে তো মউলি কুলদীপের কাছ থেকেই নোটটা নিতে পারত! কারণ, নগেনস্যারের ডিকটেশান থেকে ওরা সবাই নোট নিয়েছিল৷ সেদিন মউলি আসেনি৷
আবার একদিন ছাদে দেখা হতে অচ্যুত এই অদ্ভুত ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল৷ উত্তরে মউলি হেসে বলেছিল, ‘এতে একটা অন্যরকম মজা আছে—তুমি বুঝবে না৷’
ওর ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পরে মউলি বলেছে, ‘ঠিক আছে, আমি দুটো এক্স্যাম্পল দিয়ে তোমাকে বোঝাচ্ছি৷ সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে টেলিফোনে কথা বললে কত ভালো লাগে৷ আবার সেই কথাগুলো চিঠি দিয়ে বলাবলি করলে…ওঃ, ফ্যান্টাস্টিক৷’
একটু চুপ করে থেকে অচ্যুতকে দেখল মউলি৷ তারপর জিগ্যেস করল, ‘কিছু বুঝলে?’
অচ্যুত মাথা নাড়ল৷ সত্যিই ও কিছু বোঝেনি৷
তাই এখন কুলদীপের কথায় ও শুধু ঘাড় হেলাল৷
তখনই ওর চোখ গেল স্কুলের দোতলার বারান্দার দিকে৷
সত্যবানস্যার বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট খাচ্ছেন৷ নীচে বানজারার ঘরের কাছে যে অত হইচই, ভিড়, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপও নেই৷
হঠাৎই মাঠে একটা শোরগোল ব্যস্ততা শুরু হল৷ ছাত্রের দল প্রায় ছুটে চলে গেল স্কুল বিল্ডিং-এর কাছে৷ হুড়মুড় করে যার-যার ক্লাসরুমের দিকে রওনা হল৷
ওদের কথাবার্তার টুকরো শুনে অচ্যুতরা বুঝল হেডস্যার এসে গেছেন৷ পিছন ফিরে তাকাতেই ওরা হেডস্যারকে দেখতে পেল৷
হেডস্যার মোহনলাল পুরকায়স্থ রোগা শরীরটাকে টান-টান করে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন৷ মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা গাল, চোয়াল শক্ত৷ দেখলেই বোঝা যায় বেশ কড়া ধাতের মানুষ৷ সবসময় ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে চান৷ কিন্তু আজ প্রেয়ার হবে কি না কে জানে! বানজারা ঘণ্টা বাজাতে পারেনি৷ তা ছাড়া অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে৷
কিন্তু প্রেয়ারের ঘণ্টা বাজল—দেরিতে হলেও৷ হেডস্যার পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন৷ এখন বানজারার গোরু-বাছুরের মৃতদেহের নিশ্চয়ই একটা গতি হবে৷ কিন্তু কোন প্রাণী ওদের গলার অমন হিংস্র কামড় বসিয়েছে সেটা জানা যাবে কী?
ক্লাস বসল৷ অচ্যুত ভালো করে পড়ায় মন দিতে পারছিল না৷ বারবার ভাবছিল, স্কুলে হঠাৎ এসব কী শুরু হল!
টিফিনের সময় প্রতীক ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, রাজীব আজ এল না?’
অচ্যুত বলল, ‘দেখছি তো আসেনি—৷’ একইসঙ্গে ওর মনে পড়ে গেল, রাজীব আজ টিফিনের জন্য কেক-প্যাটিস কিনতে পরেশদার দোকানে নেমেছিল৷
তা হলে কি হঠাৎ করে ওর জ্বর-টর হল!
চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ার পর থেকে রাজীব ওদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে৷ নিজের অন্যায়ের জন্য বারবার ওদের কাছে দুঃখ করেছে, ক্ষমা চেয়েছে৷ অচ্যুত ভাবল, রাতে একবার ফোন করে রাজীবের খবর নেবে৷ কিন্তু তখনই খেয়াল হল, ওর কাছে তো রাজীবের ফোন নম্বর নেই৷ তখন ও প্রতীককে বলল ফোন করে রাজীবের খবর নিতে৷
টিফিনের সময় প্রতীক পকেট থেকে একটা পাতলা ক্যালকুলেটার বের করে অচ্যুতদের দেখাল : ‘আমার ছোটমামা পরশু আমেরিকা থেকে ফিরেছে—আমার জন্যে এটা নিয়ে এসেছে৷’
ওরা একে-একে ওটা হাতে নিয়ে বোতাম টিপে দেখতে লাগল৷
কুলদীপ বলল, ‘এই, তোরা ক্যালকুলেটর পরে দেখবি—আগে শোন৷ সামনের শনিবার দুটোর সময় ‘সি’ সেকশনের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ ঠিক করেছি৷ আজ ছুটির পর টিম ফাইনাল করে ফেলতে হবে৷’
বাসব আর সৌরভ হইহই করে উঠল৷ ওরা দুজনে ফুট-বলের পোকা৷
তারপর ফুটবল নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়ে গেল৷ কিছুক্ষণের জন্য বিপজ্জনক অশুভ ঘটনাগুলো মুছে গেল ওদের মন থেকে৷
সেদিন ছুটির পর অচ্যুত যখন সাইকেল করে বাড়ি ফিরছিল তখন ওর মনটা বেশ হালকা লাগছিল৷ আজ সাতটার সময় নগেনস্যারের কাছে পড়া আছে৷ মউলি আজ আসবে না৷ কুলদীপকে দিয়ে মউলি যেমন খবর পাঠায়, অচ্যুতেরও কি পালটা কোনও খবর পাঠানো উচিত? নাকি কাল বিকেলে ছাদে উঠে ওর জন্য অপেক্ষা করবে? যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়! মউলিকে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা একটুও বলা হয়নি৷ বলতে পারলে অচ্যুতের মন হালকা হত৷
ইতিহাসের কোচিং সেরে অচ্যুত বাড়ি ফিরল প্রায় পৌনে নটা নাগাদ৷ আর ফিরেই শুনল প্রতীক ওকে ফোন করেছিল৷ কোচিং থেকে ফিরলে ফোন করতে বলেছে৷ খুব জরুরি দরকার৷
বই-খাতা গুছিয়ে রেখে প্রতীককে ফোন করল অচ্যুত৷
একবার রিং বাজতে-না-বাজতেই প্রতীক রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলল৷
‘আমি অচ্যুত—৷’
‘ওঃ, তোর ফোনের জন্যেই ওয়েট করছিলাম৷ এক্ষুনি রাজীবের বাড়িতে যেতে হবে৷’
‘কেন?’ অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷
‘সে অনেক ব্যাপার—গেলে সব জানতে পারবি৷ আমি কুলদীপকে ফোন করে দিচ্ছি, ও দশ মিনিটের মধ্যে রাজীবের বাড়ি পৌঁছে যাবে৷ তুইও চলে আয়৷’
অচ্যুতের বুকের ভেতরে একটা ধকধকানি শুরু হল৷ রাজীব কাল টিফিনের কেক-প্যাটিস কিনেছিল, কিন্তু আজ স্কুলে আসেনি! ওর কি কোনও বিপদ হয়েছে?
‘কী হয়েছে রাজীবের?’ অচ্যুতের গলার স্বরটা খসখসে হয়ে গেল৷
‘বললাম তো, গিয়ে সব শুনবি—৷’
ফোন রেখে দিল প্রতীক৷
অচ্যুত মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমাকে এখুনি একবার সাইকেল নিয়ে বেরোতে হবে৷’
‘কেন রে, রাত নটার সময় কোথায় বেরোবি?’
অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে মিথ্যে কথা বলল অচ্যুত, ‘প্রতীকের কাছে আমার একটা নোট রয়ে গেছে৷ সেটা আজ রাতেই লাগবে—পড়তে হবে৷ বেশিক্ষণ লাগবে না—আমি দশটার মধ্যেই ফিরে আসব৷’
সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরোল অচ্যুত৷ আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ সেখানে ঘোলাটে লালচে মেঘ অপেক্ষা করছে৷
তখনই চোখ গেল মউলিদের বারান্দায়৷ একটা মেয়েলি ছায়া সেখানে দাঁড়িয়ে আছে—হাতে ধরা রেডিয়ো বাজছে৷
সাইকেল চালিয়ে রাজীবদের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় অচ্যুত বেশ বুঝতে পারছিল ওর বুকের হালকা ভাবটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে৷ তার বদলে মেঘলা আকাশটা চুপিচুপি সেখানে ঢুকে পড়েছে৷
.
৷৷পাঁচ৷৷
রাজীবদের বাড়িতে পৌঁছে দেখল কুলদীপ আর প্রতীক আগেই সেখানে হাজির৷ অল্প আসবাব দিয়ে ছিমছামভাবে সাজানো ড্রয়িং- ডাইনিং-এ ওরা বসে রয়েছে৷ ওদের সামনে আখরোট কাঠের কারুকাজ করা টেবিলে কমলা রঙের শরবতের গ্লাস৷ ঘরের এককোণে রঙিন টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল চলছে৷
অচ্যুত ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসতে-না-বসতেই দেখল, রাজীব আসছে৷
রাজীবের গায়ে একটা নীলরঙের চাদর জড়ানো৷ ওর মাম্মি ওকে ধরে-ধরে নিয়ে আসছেন৷
রাজীবের ফরসা মুখ বেশ ফ্যাকাশে৷ অচ্যুতদের দেখে মলিন হাসল৷
মাম্মি ওকে যত্ন করে সাবধানে একটা সোফায় বসালেন৷ অচ্যুতদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল রাত থেকে হাই ফিভার—মাথা তুলতে পারছে না৷ ডক্টর দেখিয়ে আজ সন্ধের পর জ্বর একটু কমেছে৷ ওর ঘাড়ে পোকা-টোকা কী একটা কামড়েছে—তাই থেকেই হয়তো ইনফেকশান হয়েছে৷ এখানকার ড্রেনেজ সিস্টেমটা তো একেবারেই প্রিমিটিভ, নন-হাইজিনিক…সাফার করা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই…৷’
রাজীবের মাম্মির সাজগোজ বেশ নজরে পড়ার মতো৷ ডানহাতের দু-আঙুলে দুটো পাথর বসানো সোনার আংটি৷
‘তোমাদের সঙ্গে রাজুর কী ইমপর্ট্যান্ট ডিসকাশন আছে—সেই সন্ধে থেকে ও একেবারে ছটফট করছে৷ তোমরা কথা বলো…’, অচ্যুতের দিকে ফিরে : ‘আমি তোমার শরবত পাঠিয়ে দিচ্ছি—৷’
চলে যেতে-যেতে রাজীবের দিকে ঘুরে তাকালেন মাম্মি : ‘রাজু, বেশি স্ট্রেইন কোরো না৷ ডক্টর ব্যানার্জি তোমাকে অ্যাবসলিউট রেস্ট নিতে বলেছেন…৷’
মাম্মি চলে যেতে রাজীব শব্দ করে হাঁফ ছাড়ল৷ তারপর ওদের তিনজনের চোখের দিকে পালা করে তাকিয়ে বলল, ‘আসল ব্যাপারটা আমি মাম্মি-বাপি কাউকে বলিনি৷ বললে শোরগোল করে থানা-পুলিশ ঘেঁটে একেবারে দুনিয়া মাথায় তুলবে৷ আমার বিপদের কথাটা ভাববে না৷’
‘কীসের বিপদ?’ এক চুমুকে শরবত শেষ করে কুলদীপ জানতে চাইল৷
‘বলছি৷’ ঢোঁক গিলল রাজীব৷ ওর মুখে একটা আলতো ভয়ের ছায়া নেমে এল৷ ও অচ্যুতের দিকে তাকাল : ‘তুই কাল আমাকে পরেশদার দোকানে নামিয়ে দেওয়ার পর স্যাটাস্যাটের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল…৷’
কুলদীপ চোখ বড়-বড় করে চাপা শিস দিয়ে উঠল৷
অচ্যুত অপেক্ষা করতে লাগল৷ প্রতীক গালে হাত দিয়ে কৌতূহলভরা মুখে রাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আর মাঝে-মাঝে আনমনাভাবে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল৷
‘সত্যবানস্যারের সঙ্গে সাইকেল ছিল৷ বললেন, আমার সঙ্গে কী কথা আছে…যেতে-যেতে বলবেন৷ আমি কেক-টেক কিনে ওঁর সাইকেলে উঠলাম—সামনে রডের ওপরে বসলাম৷ স্যারের চোখে-মুখে একটা চাপা ফুর্তি টের পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারিনি৷
‘…সাইকেল চালিয়ে যেতে-যেতে স্যাটাস্যাট অঙ্ক নিয়ে খুব জ্ঞান দিতে লাগল৷’ অচ্যুতের দিকে ইশারা করে রাজীব বলল, ‘তোর অঙ্কের মাথা নিয়ে খুব প্রেইজ করছিল৷ আর কথা বলতে-বলতে…৷’ রাজীবের চোখ সরু হয়ে এল : ‘আমার ঘাড়ের কাছে বারবার ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিল৷ আমার বিরক্ত লাগছিল…কিন্তু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন পড়ে গিয়েছিলাম৷ স্যাটাস্যাটের জড়ানো গলায় কথা শুনতে-শুনতে আমার ঝিম ধরানো নেশা মতন হয়ে গেল৷ ততক্ষণে সাইকেল ঘোষদের বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে পুকুরের পাশের অন্ধকার রাস্তায় চলে এসেছে৷ আমি বললাম, ‘‘স্যার, এ-রাস্তা দিয়ে এলেন কেন?’’ আমার মাথার পেছন থেকে স্যাটাস্যাট খিলখিল করে হাসল৷ তারপর বলল, ‘‘এটাই তো তোর বাড়ি যাওয়ার শর্টকাট রে বোকা!’’
‘আমি কিন্তু জানতাম যে, ওটা শর্টকাট নয়—তবুও কিছু বলতে পারলাম না৷ কেমন যেন হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম৷ নিজের ওপরে আর কোনও কন্ট্রোল ছিল না৷
‘স্যাটাস্যাট একটা বটগাছের তলায় ঝুপসি অন্ধকারে সাইকেলটা দাঁড় করাল৷ বটগাছের ঝুরির ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল৷ চারপাশে কেউ কোথাও নেই৷ পুকুরের দিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছিল৷
‘আমার বেশ ভয় করছিল, কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলাম না৷ গলার ভেতরে কেউ যেন খানিকটা তুলো গুঁজে দিয়েছে৷ এমন সময় পুকুরের কালো জলে কোনও মাছ বোধহয় ঘাই মারল—ছপাৎ করে শব্দ হল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড়ে কাঁটা ফোটার মতো ব্যথা পেলাম৷ তারপরই জায়গাটা চিনচিন করতে লাগল৷ আমি…৷’
ডিসকভারি চ্যানেলে আচমকা বাঘের গর্জন শোনা গেল৷ ওরা চারজনেই সামান্য চমকে উঠল৷ এই গরমের মধ্যেও অচ্যুতের কেমন যেন শীত করছিল৷
ওরা টিভির দিকে তাকিয়েছিল৷ তখনই দেখল, একজন মহিলা একগ্লাস শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকছেন৷
শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চলে গেলেন৷ রাজীব গ্লাসটা তুলে নিয়ে অচ্যুতের হাতে দিল, ‘নে, শরবত খা৷’
অচ্যুত এক ঢোঁকে শরবতের গ্লাস অর্ধেকটা শেষ করে জানতে চাইল, ‘তারপর?’
রাজীব দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল :
‘…আমি অসাড় হয়ে সাইকেলের রডের ওপরে বসে রইলাম৷ নড়াচড়ার শক্তি নেই৷ স্যারও কোনও কথা বলছিলেন না৷ একটা ঘোরের মধ্যে সময় কেটে যেতে লাগল৷ চোখের সামনে থেকে চাঁদ মুছে গেল৷ ব্যাঙের ডাক আর শুনতে পাচ্ছিলাম না৷ শুধু চিনচিনে ব্যাপারটা টের পাচ্ছিলাম৷
‘…ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না৷ একসময় আবার চাঁদ দেখতে পেলাম, ব্যাঙের ডাকও শুনতে পেলাম৷ শরীরটা খুব উইক লাগছিল৷ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল৷ টের পেলাম, স্যার আমার ঘাড়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ জামার কলারটা তুলে দিয়ে ঘাড়ের কাছটা ভালো করে ঢেকে দিতে চাইলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘আমার দিকে একবার তাকা…৷’’ আমি অন্ধ ভক্তের মতো ওঁর হুকুম মেনে তাকালাম…৷’
রাজীব হঠাৎই শিউরে উঠল৷ পাশে বসে থাকা অচ্যুতের হাত খপ করে চেপে ধরল৷ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘বাড়িতে এসব কথা একদম বলিনি৷ তোদের বলছি—৷’
‘তাকিয়ে কী দেখলি?’ প্রতীক জিগ্যেস করল৷
‘দেখলাম…৷’ চোখ গোল-গোল করে তাকাল রাজীব৷ ওর মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল : ‘দেখলাম, স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ—ধকধক করে জ্বলছে—আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি৷ ঠিক যেন বেড়াল বা চিতাবাঘের চোখ৷ চোখ তো নয়, মার্বেল পাথর বসানো! স্যার অদ্ভুতভাবে হেসে ভয়ানক গলায় বললেন, ‘‘কাউকে এসব বলবি না৷ তুই এখন আমার! আমার কথায় উঠবি, আমার কথায় বসবি, আমার কথায় চলবি৷ আমার ইশারা তোর কাছে আদেশ৷ এ-কথা মনে রাখিস৷’’
‘আশ্চর্য! বিশ্বাস কর, স্যারের ওপরে আমার একটুও রাগ হল না৷ ছুটে পালাতেও ইচ্ছে করল না৷ পাথরের স্ট্যাচুর মতো স্যারকে দেখছিলাম, স্যারের কথা শুনছিলাম৷
‘এরপর স্যার সাইকেল চালিয়ে আমাকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিলেন৷ কানের কাছে মুখ এনে সাপ-খেলানো সুরে অনেক কথা বললেন৷ কথাগুলো সব আমার মনে নেই৷ তবে একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে আমি বাড়ি এলাম৷ গলার পাশে, ঘাড়ের কাছটায় চুলকোচ্ছিল৷ হাত দিতেই কেমন চটচটে লাগল৷ দেখি রক্ত৷ তখনই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছি৷ তারপর বাপি-মাম্মির হইচই, ডাক্তার ডাকাডাকি, কত কী কাণ্ড!
‘বাড়িতে আমি ভয়ে কোনও কথা বলিনি৷ বলেছি, অন্ধকারে ওই পুকুরের কাছটায় কী একটা পোকা যেন কামড়ে দিয়েছে৷ কিন্তু তোদের সত্যি কথা বলছি, সত্যবানস্যারের ভয়ে আমি একেবারে কাঁটা হয়ে আছি৷ বারবার মনে হচ্ছে, কাল রাতের ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বপ্ন—একবর্ণও সত্যি নয়৷ কিন্তু আসলে তো সত্যি! এখন তোরা আমাকে বাঁচা৷ কী করব বলে দে—৷’
রাজীবের কথা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল৷ কুলদীপ ওর কদমছাঁট চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রতীক বয়স্ক মানুষের মতো ভুরু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে বসে৷ আর অচ্যুতের মনের ভেতরে তোলপাড় চলছিল৷
কী করা উচিত এখন?
প্রতীক বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যাটাস্যাট আসলে ড্রাকুলা! আজকের যুগে এ তো বিশ্বাস করা মুশকিল!’
অচ্যুত ধীরে-ধীরে বলল, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ব্যাপারটা বোধহয় মিথ্যে নয়৷ তা ছাড়া পিশাচের আবার যুগ আছে নাকি!’
কুলদীপ বলল, ‘আমি ওসব ভূত-টুতে বিশ্বাস করি না৷ রাজীব, তোর মনে হয় ভুল হয়েছে৷ তোকে সত্যি-সত্যিই কোনও পোকা-টোকা কামড়েছে৷’
রাজীব চোখ বড় করে জানতে চাইল, ‘তা হলে ওই সবুজ চোখ দুটোও ভুল?’
‘না, মোটেই ভুল নয়,’ জবাব দিল অচ্যুত, ‘আমিও ওই সবুজ চোখ দেখেছি৷ স্যারের মধ্যে যে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে সেটা আঁচ করেছিলাম৷ কিন্তু সেটা যে এইরকম তা বুঝতে পারিনি৷ রাজীব, তুই এখন যা—শুয়ে পড় গিয়ে৷ কয়েকটা দিন রাস্তায় বেরোস না৷ আমরা একটু ভেবে দেখি, কী করা যায়৷ তোর ফোন নাম্বারটা আমাকে দে—৷’
রাজীব ফোন নম্বর বলল৷ অচ্যুত সেটা কয়েকবার বিড়বিড় করে আওড়ে মুখস্থ করে নিল৷
এমন সময় রাজীবের মাম্মি ঘরে ঢুকলেন৷ রাজীবকে লক্ষ করে বললেন, ‘রাজু, চলো, অনেকক্ষণ গল্প হয়েছে৷ এবারে ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট নেবে৷ কাল ডক্টর ব্যানার্জি আবার চেক আপে আসবেন৷ তোমরা শরবত খেয়েছ তো?’
শেষ প্রশ্নটা অচ্যুতদের লক্ষ করে৷
প্রতীক আর অচ্যুত গ্লাসের বাকি শরবত শেষ করে উঠে দাঁড়াল৷
কুলদীপ হাঁ করে টিভিতে বাঘ আর বাইসনের লড়াই দেখছিল, অচ্যুত ওকে খোঁচা মারল৷ কুলদীপ ফিরে তাকাতেই ওকে উঠতে ইশারা করল৷
‘আসি, আন্টি৷’
রাজীবকে ‘টা-টা’ করে ওরা তিনজন দরজার দিকে এগোল৷ হঠাৎই প্রতীক ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজীবকে বলল, ‘কাল তোকে ফোন করব—৷’ তারপর মাম্মিকে আড়াল করে এক চোখ টিপে হাতের ইশারায় বলতে চাইল, ‘কোনও ভয় নেই৷’
রাস্তায় বেরোতেই কুলদীপ অচ্যুতকে বলল, ‘কী রে, স্যাটাস্যাটের সবুজ চোখের ব্যাপারটা আমাদের বলিসনি তো!’
‘ভয়ে বলিনি৷ আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷’
প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাট হেভি ডেঞ্জারাস৷ কিন্তু কী করে হঠাৎ এরকম চেঞ্জ হয়ে গেল বল তো?’
‘হয়তো ওর ওপরে পিশাচ ভর করেছে৷’ অচ্যুত বলল, ‘রক্তপিশাচ ড্রাকুলা যেমন ভর করত—আমি টিভিতে দেখেছি৷’
প্রতীক কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘বানজারার গোরু-বাছুরকেও কি তা হলে পোকা কামড়েছে?’
কুলদীপ আর প্রতীকের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যাটাস্যাট-পোকা৷’
ওর কথায় কেউ হাসল না৷
আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল৷
ওরা তিনজন যে-যার সাইকেলে উঠে রওনা হয়ে পড়ল৷ যেতে-যেতে কুলদীপ চেঁচিয়ে বলে গেল, ‘কাল স্কুলে দেখা হবে—৷’
রাস্তার দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার আরও বেড়ে গেছে৷ সাইকেল রিকশা, স্কুটার, বা লোকজন চোখে পড়ে কি পড়ে না৷ অচ্যুত সাইকেল চালাচ্ছিল বটে, কিন্তু ওর মন রাস্তার দিকে ছিল না৷ দুটো ধকধকে ক্ষুধার্ত সবুজ চোখ ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল৷
ও মনে-মনে ঘটনাগুলো যতই চিন্তা করছিল ততই যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছিল৷
পুলিশে খবর দেওয়ার কোনও মানে হয় না, কারণ, কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করবে না৷
তা হলে কী করা যায়? সত্যবানস্যারকে ওরা দশ-পনেরোজন মিলে ঘিরে ধরে কোণঠাসা করবে? জবাবদিহি চাইবে? নাকি হেডস্যারের কাছে দলবেঁধে গিয়ে সত্যবানস্যারের নামে নালিশ করবে?
তখনই অমিয়স্যারের কথা মনে পড়ল৷
প্রমাণ চাই, প্রমাণ৷ স্যাটাস্যাটকে লাল হাতে ধরতে হবে৷ কিন্তু সেই সুযোগ কি কখনও পাওয়া যাবে?
এইসব এলোমেলো চিন্তা করতে-করতে অচ্যুত যখন বাড়ি ফিরল তখন দেখল মা একরাশ দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে৷
একইসঙ্গে ও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, মউলিদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় সেই মেয়েলি ছায়াটা এখনও একইরকমভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে৷
মা বলল, ‘সেই কখন থেকে তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি! একে রাত হয়েছে, তার ওপর বৃষ্টি—একটা বিপদ হলে তখন কী হবে বল তো!’
অচ্যুত সামান্য হাসল৷ সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে মা-কে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল৷ মা-কে ও বলতে পারল না, ‘বিপদ হলে তখন কী হবে’ নয়—এর মধ্যেই ও বিপদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে৷ অভিমন্যুর মতো ওকে চক্রব্যূহ ভেদ করার চেষ্টা করতে হবে৷ যদি ভেদ করতে না পারে, তা হলে অভিমন্যুর মতোই হয়তো ওর…৷
অচ্যুত আর ভাবতে পারল না৷
রাজীবের ঘটনাটা ওর শিরদাঁড়ায় বরফ জমিয়ে দিয়েছে৷
.
৷৷ছয়৷৷
পরদিন স্কুলে গিয়ে অচ্যুতরা জোট পাকাতে শুরু করল৷
ও, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, সৌরভ সবাই বন্ধুদের রাজি করিয়ে কাছাকাছি ডেস্কে বসল৷ আর ক্লাসের মাঝে ফাঁক পেলেই ফিসফাস করে আলোচনা করতে লাগল৷
একটার পর একটা ক্লাস হয়ে যাচ্ছে, ওদের সেদিকে মন নেই৷ আনমনা হওয়ার জন্য বাসব ভূগোলের পিরিয়ডে কালীপদস্যারের কাছে বকুনিও খেল৷ কিন্তু সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা এত সাঙ্ঘাতিক যে, ওরা কেউই পড়াশোনায় মন দিতে পারছিল না৷
টিফিনের ঘণ্টা যখন পড়ল তখনও ওরা ক্লাসে বসে রইল৷ যে দু-তিনজন ঘরে বসেই টিফিন খায়, কুলদীপ তাদের মাঠে যেতে বলল, ‘তোরা নীচে গিয়ে টিফিন খা৷ আমাদের একটু প্রাইভেট কথা আছে৷’
কুলদীপকে সবাই একটু সমীহ করে৷ তাই কেউই কথা বাড়াল না৷
অচ্যুতের কাছে সব শোনার পর বাসব আর সৌরভ তো একেবারে থ হয়ে গেল৷
প্রতীক বলল, ‘সেইজন্যেই তুই আর কুলদীপ অত গুজগুজ করতিস!’
কুলদীপ একটু হাসল৷ বলল, ‘চিন্তা করে দেখ, ব্যাপারটা কীরকম আজগুবি আর সিরিয়াস৷’
বাসব বলল, ‘কুলদীপ বলছে স্যাটাস্যাটকে চোখে-চোখে রাখতে—যদি হাতেনাতে ধরা যায়৷’
প্রতীক গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়ল : ‘হুঁ—প্রমাণ না পেলে কিছু করা মুশকিল…৷’
‘স্যাটাস্যাটও আমাকে এই কথা বলেছিল—সবুজ চোখ দেখানোর সময়৷ প্রমাণ না পেলে কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না৷’
সৌরভ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘আমার ছোট একটা অটোমেটিক ক্যামেরা আছে৷ ফটো তুলে নিলে কেমন হয়৷ সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ—৷’
প্রতীক হাসল, ‘স্যাটাস্যাট কি তোর ক্যামেরার সামনে চোখ সবুজ করে পোজ দিয়ে দাঁড়াবে?’
‘কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে!’
বাসব হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলল৷ তারপর বলল, ‘আমাদের পাঁচজনের কাজ এখন একটাই—প্রমাণ খোঁজা৷ সৌরভ যদি ক্যামেরা নিয়ে কিছু করতে পারে তো করুক৷ আর আমরা সত্যবানস্যারের ওপরে কড়া নজর রাখব৷ শুধু স্কুলে নয়, স্কুলের বাইরেও৷ এই নজরদারির কাজে দরকার হলে আরও কয়েকজনকে দলে নেব৷’
বাসবের কথাটা কুলদীপের মনে ধরল৷ প্রতীকও মাথা নেড়ে সায় দিল৷ বলল, ‘স্যার একা—আর আমরা অনেক৷ আমাদের সুবিধে অনেক বেশি৷’
অচ্যুত বলল, ‘আমাদের গ্রুপের বাইরে কেউ যেন কিছু না জানতে পারে৷ ক্লাস টেনের দাদাদেরও কিছু বলার দরকার নেই৷ এখন সবকিছু সিক্রেট রাখাটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট৷’
‘তুই বাড়িতে কিছু বলিসনি?’ কুলদীপ জিগ্যেস করল৷
‘না, এখনও বলিনি৷ বললে পর হইচই বেধে যাবে—হয়তো এ-স্কুল ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য স্কুলে ভরতি করে দেবে৷ আমার মা যা ভিতু!’
টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা না বাজা পর্যন্ত ওদের জল্পনা-কল্পনা চলল৷ স্কুল ছুটির পর মাঠের সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ওরা না-ফুরোনো কথা বলছিল৷
কুলদীপ বলল, ‘আগামীকালের ম্যাচ বাতিল করতে হবে৷’
সৌরভ বলল, ওর ক্যামেরাটায় নতুন ফিল্ম ভরে ও তৈরি হবে৷
বাসব বলল, সত্যবানস্যারের ওপরে সবসময় নজর রাখার জন্য পাড়ার বন্ধুবান্ধবদেরও বলতে হবে৷ কারণ, বাসবরা যদি রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, সব জায়গায় স্যারের পিছু নেয় তা হলে স্যার সহজেই গোলমালটা ধরে ফেলবেন৷
ওরা চারজন বাসবের কথায় সায় দিল৷
অচ্যুত আনমনা হয়ে কী ভাবছে দেখে প্রতীক ওকে ঠেলা মারল : ‘কী রে, কী ভাবছিস?’
‘ফটো তোলা যাবে কী করে তাই ভাবছি৷ সৌরভ, তোর ক্যামেরা যেন সোমবার থেকে রেডি থাকে—৷’
সৌরভ প্রবল উৎসাহে ঘাড় কাত করে বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই৷ কালকেই ফিল্ম কিনে ক্যামেরা লোড করে নেব৷’
অচ্যুত বলল, ‘রাতে সবাই রাজীবকে ফোন করে একটু সাহস দিস…নইলে ওর ভয় কাটবে না৷ তা ছাড়া ওর শরীর কেমন আছে, সেটাও জানা দরকার৷’
কুলদীপ, প্রতীক আর সৌরভ ঘাড় নাড়ল৷ বাসবের বাড়িতে ফোন নেই৷
ছুটির পর ছেলের দল স্রোতের মতো মাঠ পেরিয়ে লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ সেই স্রোত এখন একেবারে ফিকে হয়ে এসেছে৷
ওরা দেখল, সত্যবানস্যার আরও দুজন স্যারের সঙ্গে স্কুল থেকে বেরোচ্ছেন৷ ওঁদের সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলছেন৷ দেখে মনেই হয় না এতগুলো ভয়ংকর ঘটনা সত্যি৷
কুলদীপ হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘অ্যাই, নেক্সট উইকে স্যাটাস্যাটের কোচিং-এর কী হবে?’
অচ্যুত বলল, ‘আমরা যেমন যাই যাব৷ শুধু রাজীবকে যেতে বারণ করব৷ আর শোন, স্যার যদি কাউকে একা ডাকেন তা হলে কেউ যাবি না৷ স্কুলে অতটা ভয় নেই…বেশি ভয় বাইরে৷’
অচ্যুত লক্ষ করল, সত্যবানস্যার যেতে-যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের জটলার দিকে একবার তাকালেন৷ ছোট্ট করে হাসলেন বলেও মনে হল৷ অবজ্ঞার হাসি৷
একটু পরেই ওরা যার-যার বাড়ির দিকে রওনা হল৷
আকাশে মেঘ আছে, তবে তেমন ঘন নয়৷ বাতাস বইছে, এলোমেলো৷ অচ্যুতের চুল হাওয়ায় উড়ছিল৷ মাঠে-ঘাটে কাশফুল ফুটেছে৷ জানিয়ে দিচ্ছে পুজোর আর খুব দেরি নেই৷ কিন্তু বর্ষার যা ঢং এবার, মনে হয়, মা দুর্গাকে প্রণাম না করে সে বাড়ি ফিরবে না৷
দোকানপাটে ভিড় তেমন নেই৷ পুজোর বাজার এখনও লাগেনি৷ পুজো-পুজো গন্ধটাও অচ্যুতের নাকে আসছে না৷ অথচ আর কিছুদিন পরেই পুজোর ছুটি পড়বে৷ ওর বন্ধুদের অনেকেই বাইরে বেড়াতে যাবে৷ অচ্যুতরা খুব একটা যায় না৷ গতবারে শুধু দিঘা গিয়েছিল৷
পথে একটা চুড়িদারের দোকান দেখতে পেল অচ্যুত৷ সেখানে অনেক বাহারি রঙের চুড়িদার ঝুলছে৷ তার মধ্যে একটা ওকে মউলির কথা মনে পড়িয়ে দিল৷ মউলির ওইরকম রঙের একটা চুড়িদার আছে৷
কাল রাতে মউলি অতক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল কেন? অচ্যুত কখন ফেরে সেটা দেখার জন্য?
মউলিকে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা বলতে পারলে ভালো লাগত৷ কিন্তু অচ্যুত তো এখনও পর্যন্ত মা-বাপিকেও কিছু বলেনি৷
সময় আসুক, তখন বলবে৷
রবিবার সকালে একটা ভয়ানক খবর অচ্যুতদের এলাকাটাকে একেবারে ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিল৷
ওদের বাড়ি থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার দূরে একটা বড় ধানকল আছে৷ তার পাশেই প্রকাণ্ড মাঠ৷ জেলা চ্যাম্পিয়ানশিপের বড়-বড় খেলা সব এই মাঠে হয়৷ এলাকার লোকজন মাঠটাকে ধানকলের মাঠ বলে৷
সেই মাঠে ভোরবেলা দু-দুটো মৃতদেহ পাওয়া গেল৷
দুটো মৃতদেহই রক্তহীন, ফ্যাকাশে৷ তাদের ঘাড়ের পাশে গভীর দুটো দাঁতের দাগ৷
এরকম অদ্ভুত মৃতদেহ এলাকার কেউ কখনও দেখেনি৷
যারা নিজের চোখে মৃতদেহ দুটো দেখেছে, তারা বলল, ‘ঠিক মনে হবে ঘাড়ে পাইপ ঢুকিয়ে কোনও পিশাচ কোক কিংবা পেপসি খাওয়ার মতো রক্ত টেনে নিয়েছে৷’
অচ্যুত পাড়ার হারানদার মুদিখানা দোকানে গুঁড়ো হলুদ আর চিঁড়ে কিনতে গিয়েছিল৷ সেখানে খবরটা শুনেই ওর গা গুলিয়ে উঠল৷ রাজীবের কথাগুলো মনে পড়ে গেল পলকে৷
যারা মারা গেছে তারা বিহারি৷ ধানকলে কাজ করত, মাঝে-মাঝে ছুটি-ছাটায় দেশে যেত৷ দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে জোট বেঁধে ধানকলের কাছাকাছি ঝুপড়িতে থাকত৷
কাল রাতে ওরা দুজনে হয়তো নেশা-টেশা করতে বেরিয়েছিল…তারপর রাত করে মাঠের ওপর দিয়ে ফেরার সময় ওইরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে৷
বহু চেষ্টা করেও খুনের উদ্দেশ্য কেউ খুঁজে পেল না৷ নেশাগ্রস্ত দুজন গরিব দেহাতিকে কে খুন করতে চাইবে? তা ছাড়া ঘাড়ের পাশে ওইরকম বীভৎস একজোড়া গর্তই বা কে করবে?
অনেকেই ধরে নিল, এ কোনও অপদেবতার কাজ৷
পুলিশ ফাঁড়ির বড়বাবু স্থানীয় লোকজনকে মামুলি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ডেডবডি চালান করে দিয়ে দায় সারলেন৷
অচ্যুত বাড়ি ফিরে মা-বাপিকে এই জোড়া-খুনের খরব দিল৷
মা তো ভয়েই সারা৷ বলল, ‘কোচিং থেকে ফেরার সময় একা-একা ফিরবি না৷ এরকম কাণ্ড জীবনে শুনিনি বাবা!’
বাপি বলল, ‘দ্যাখো গিয়ে, কারা হয়তো রক্তের ব্যাবসা করার জন্যে সিরিঞ্জ দিয়ে সব রক্ত টেনে নিয়েছে!’
অচ্যুত বলল, ‘তা হলে এক-একজনের ঘাড়ে দুটো করে সিরিঞ্জের ফুটো কেন?’
‘কেন আর, দুটো সিরিঞ্জে তাড়াতাড়ি রক্ত টানা যাবে—৷’
বাপির স্বভাব হচ্ছে যে-কোনও সমস্যাকে চটজলদি সমাধান করে দেওয়া৷ যেমন এখন৷ বাপি যুক্তি দিয়ে ঠিক বুঝিয়ে দেবে রক্তের চোরাব্যবসার জন্যই ওই দুজন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে৷ যদি প্রত্যেকের ঘাড়ে পাঁচটা করেও ফুটো থাকত, তা হলেও বাপির ব্যাখ্যা করতে কোনওরকম অসুবিধে হত না৷
এই জোড়া খুনের ঘটনাটার কথা শুনে অচ্যুত বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ও ভেবেছিল, আজই স্কুলের ব্যাপারগুলো মা-বাপিকে খুলে বলবে৷ কিন্তু বাপির দায়সারা যুক্তি আর ব্যাখ্যা শুনে ও দমে গেল৷ কে জানে, ওর কথা শুনে বাপি হয়তো আজগুবি বলে হেসেই উড়িয়ে দেবে!
সত্যবানস্যার ঠিক বলেছিলেন৷ এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চাইবে৷ প্রমাণ না দিতে পারলে অচ্যুতের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷ এমনকী মা-বাপিও হয়তো বিশ্বাস করবে না৷
কিছুক্ষণ কী ভাবল ও৷ তারপর ভেতরের ঘরে গিয়ে সৌরভকে ফোন করল৷
ফোন করতেই সৌরভ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘জোড়া মার্ডারের খবর পেয়েছিস তো?’
‘হ্যাঁ—৷’
‘শোন, কুলদীপ আমাকে ফোন করেছিল, ওর পাড়ার দু-বন্ধুকে ও স্যাটাস্যাটের পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিল৷ তারা স্যাটাস্যাটকে কাল রাতে ধানকলের মাঠে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে৷’
‘ক’টার সময়?’
‘এই ধর দশটা৷ মাঠের ধারে জঙ্গলের কাছটায় স্যাটাস্যাট ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল৷ ওর সঙ্গে আরও একজন ছিল—তবে সে অন্ধকারে গাছের আড়ালে থাকায় ওরা লোকটাকে দেখতে পায়নি৷ স্যাটাস্যাট লোকটার সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছিল৷ কুলদীপের বন্ধুরা কোনও কথা শুনতে পায়নি৷ তারপর…রাত বাড়ছিল বলে ওরা ভয়ে পালিয়ে এসেছে…৷’
তা হলে কি দুটো খুন দুজনের কীর্তি? স্যাটাস্যাট একা করেনি?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর অচ্যুত বলল, ‘শোন, তোকে যে-জন্যে ফোন করেছি৷ তোর ক্যামেরাটা রেডি আছে তো?’
‘হ্যাঁ রেডি—৷’
‘কাল স্কুলের পর তোর বাংলা কোচিং আছে না?’
‘হ্যাঁ—তো কী হয়েছে?’
‘তুই কোচিং সেরে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে আমাকে মিট করবি৷ পরেশদার কেকের দোকানের সামনে৷ সেখান থেকে আমরা স্যাটাস্যাটের কোচিং-এ যাব…শুধু তুই আর আমি…তার বেশি গেলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে৷’
সৌরভ বলল, ‘ও. কে.৷’
‘শোন, ক্যামেরা নিয়ে যে আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা আমাদের গ্রুপের বাইরে কাউকে বলবি না৷’
‘আচ্ছা৷’ একটু চুপ করে থেকে তারপর সৌরভ জানতে চাইল, ‘কাল স্যাটাস্যাটের ফটো তুলবি?’
‘হ্যাঁ৷ কাল তা হলে ঠিক সাতটায়…৷’ রিসিভার নামিয়ে রাখল অচ্যুত৷
তারপর পড়াশোনা নিয়ে বসল৷
বই-খাতা চোখের সামনে খোলা, অক্ষর কিংবা শব্দগুলো দিব্যি নজরে পড়ছে—কিন্তু মাথায় সেগুলোর কোনওরকম অর্থ তৈরি হচ্ছিল না৷ সেখানে মাইলের পর মাইল লম্বা ঘুড়ির সুতো যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ আর জটের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে অচ্যুত হাঁসফাঁস করছিল৷
বারবার রাজীবের কথা মনে পড়ছিল৷ খুব কপালজোরে ও বেঁচে গেছে৷ নইলে ধানকলের মাঠের ঘটনার মতোই ওকে পুকুরপাড়ে আগাছার জঙ্গলে ভোরবেলা পাওয়া যেত৷
অচ্যুতের বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠল৷
রাজীবও নিশ্চয়ই ধানকলের মাঠের খবরটা শুনেছে! ছোট জায়গায় খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগে না৷
এ খবর কানে গেলে রাজীব হয়তো আরও ভয় পেয়ে যাবে৷
নানান চিন্তায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই রাজীবকে ফোন করল অচ্যুত৷
‘হ্যালো—৷’
ওপাশ থেকে কোনও মহিলা ইংরেজিতে রাজীবদের ফোন নম্বরটা বললেন৷ গলা শুনে মনে হল রাজীবের মাম্মি৷
‘রাজীব আছে?’
‘হু ইজ স্পিকিং প্লিজ?’
‘আমি অচ্যুত—রাজীবের ক্লাসমেট…৷’
‘হ্যাঁ, ধরো—৷’
একটু পরেই রাজীব ফোনে কথা বলল, ‘অচ্যুত, খবরটা শুনেছিস?’
‘ধানকলের মাঠের কেসটা?’
‘হ্যাঁ৷’ রাজীবের গলায় চাপা উত্তেজনা৷
‘সেইজন্যেই তোকে ফোন করেছি৷ একটুও ভয় পাবি না—আমরা শিগগিরই যা-হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করছি৷ স্যাটাস্যাটের কেসটা আমরা এসপার-ওসপার করে ছাড়ব৷’
‘শোন…একটা ব্যাপার…মানে…৷’ থতিয়ে থতিয়ে বলতে চাইল রাজীব৷
‘কী হয়েছে?’
‘স্যাটাস্যাট কাল রাতে আমাকে ফোন করেছিল…৷’
‘বলিস কী!…কী বলল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে ড্রাম বাজতে শুরু করল৷
‘আমাকে ওর কোচিং-এ যাওয়ার কথা বলছিল৷’
‘সে কী! কাল তো কোচিং ছিল না৷’
‘সেইজন্যেই তো ডাকছিল৷ বলছিল, আমার সঙ্গে ওর একা-একা কী দরকার…তাই…৷’
‘খবরদার যাবি না!’ চেঁচিয়ে উঠল অচ্যুত৷
‘শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে যাইনি৷ তবে…তবে ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল…৷’ অপরাধীর সুরে বলল রাজীব, ‘তুই বিশ্বাস করবি না, স্যার কীরকম অদ্ভুত গলায় আমাকে ডাকছিলেন৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা গল্পের নিশির ডাকের মতো৷ বারবার বলছিলেন, ‘‘আসতে তোকে হবেই৷ আমার ডাক তুই ফিরিয়ে দিতে পারবি না৷ আজ না হয় কাল তোকে আসতেই হবে৷ আমার তেষ্টা তোর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, তোকে পাগল করে দেবে৷ তোর আমার যে রক্তের সম্পর্ক, তাকে কখনও ছিন্ন করা যায় না৷ কখখনও না৷’’
‘…তুই বিশ্বাস কর, অচ্যুত—আমি তখন মাতালের মতো হয়ে গিয়েছিলাম৷ স্যার ছাড়া আমি আর তখন কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না৷ মাথাটা হঠাৎ কেমন টলে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম৷ টেবিলের একটা কোনা ধরে সামলে নিলাম৷ মাম্মি একটু দূরে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল৷ আমাকে টলে যেতে দেখেই ছুট্টে আমার কাছে এসে আমাকে ধরে ফেলল৷ তারপরই..৷’
‘তারপর কী?’
‘তারপর মাম্মির সঙ্গে আমার কী ঝামেলা! মাম্মি আমাকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না, আর আমি বেরোবই! শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে…৷’
রাজীব হঠাৎ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল৷
অচ্যুত ওকে কী বলবে ভেবে পেল না৷ রাজীব কাঁদছে কেন সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷
কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় রাজীব বলল, ‘কাল আমি খুব জোর বেঁচে গেছি, না রে?’
অচ্যুত অবাক হয়ে গেল, ‘কেন বল তো?’
‘আমি গেলাম না বলেই হয়তো ধানকলের মাঠের লোক দুটো খতম হয়ে গেল৷’
‘এসব তুই কী বলছিস!’
‘ঠিকই বলছি৷ স্যারের সেই ডাকের টান যে কী মারাত্মক সে তোকে আমি বলে বোঝাতে পারব না৷’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাজীব ধরা গলায় জানতে চাইল, ‘তোরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে রাখতে পারবি তো? তোদের ব্যাগ থেকে আর কখখনও আমি টাকা চুরি করব না…বিশ্বাস কর৷’ রাজীব আবার কাঁদতে শুরু করল৷
ওর কান্নাটা এমন যেন ও জেনে গেছে, ওর কপালে কেউ সুনিশ্চিতভাবে কাটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে৷
অচ্যুতের খুব কষ্ট হল৷ ও বলল, ‘তুই মিছিমিছি কাঁদছিস৷ তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি এক্ষুনি কুলদীপ, প্রতীকদের ফোন করছি৷ আধঘণ্টার মধ্যে আমরা তোর বাড়িতে যাচ্ছি৷ আন্টিকে আমাদের জন্যে শরবত তৈরি করে রাখতে বল…৷’
ফোন ছেড়ে দিল অচ্যুত৷
ওর শরীরটা কেমন অবশ লাগছিল৷ দিশেহারাভাবে ও যে-কোনও একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল৷
.
৷৷সাত৷৷
সোমবার সন্ধে সাতটার সময় সৌরভ পরেশদার কেকের দোকানের সামনে এল৷
অচ্যুত আগে থেকে সাইকেল নিয়ে কেকের দোকানের পাশে একটা সাইকেল সারানোর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সৌরভকে দেখেই ওর দিকে এগিয়ে গেল৷ চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘ক্যামেরা এনেছিস তো?’
সৌরভ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷
‘চল যেতে-যেতে প্ল্যানটা বলছি…৷’
সাইকেলে উঠে পড়ল অচ্যুত৷ সৌরভও সাইকেল নিয়ে ওর পাশে-পাশে চলল৷
সরু রাস্তায় ওদের বেশ কসরত করে সাইকেল চালাতে হচ্ছিল৷ আজ সারাদিনে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি, তাই রাস্তা মোটামুটি শুকনো৷ তবে বাতাস থমকে গিয়ে একটা গুমোট গরম চেপে বসেছে৷
রাস্তায় মোটামুটি ভিড়৷ তারই মধ্যে দুটো সাইকেল-ভ্যান মাইক লাগিয়ে আগামী রবিবারে কী একটা মিটিং হবে বলে প্রচার চালাচ্ছে৷ ‘দলে-দলে যোগ দিন’ কথাটা বারবার ওদের কানে এসে ঝাপটা মারছিল৷
কোনওরকম যানজট কাটিয়ে সাইকেল-ভ্যানে দুটোকে পেরিয়ে গেল ওরা৷ তারপর জোরে প্যাডেল করতে শুরু করল৷
কাল বিকেলে অচ্যুত, প্রতীক, কুলদীপ আর বাসব রাজীবের বাড়িতে গিয়েছিল৷ ওকে যতটা সম্ভব ভরসা দিয়ে এসেছে৷ কিন্তু অচ্যুত বুঝতে পারছিল, একটা সাংঘাতিক ভয় রাজীবের মনে গেঁথে গেছে৷ ওর কাছে ঘণ্টাদেড়েক থেকে তারপর অচ্যুতরা যার-যার বাড়ি ফিরে গেছে৷
সাইকেল চালাতে-চালাতে সৌরভ আর অচ্যুত স্কুলের কাছে চলে এল৷ স্কুল পেরিয়ে, পুকুর পেরিয়ে, যতই এগোতে লাগল রাস্তার লোকজন ততই ফিকে হতে লাগল৷ সেই সঙ্গে আলোও৷
বর্ষার টইটম্বুর নালা থেকে ব্যাঙের দল ডাকছিল৷ তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ঝিঁঝির দল সঙ্গত করছিল৷ বড়-বড় গাছের মাথা আকাশের মেঘের সঙ্গে কখন যে মিশে গেছে সেটা ঠাহর করা যাচ্ছিল না৷ পথের এখানে-ওখানে কয়েকটা ঝুপড়ি-দোকানে পান-বিড়ি-সিগারেট আর চা বিক্রি হচ্ছে৷ তার টিমটিমে আলো দোকান ছাড়িয়ে রাস্তায় পৌঁছতে পারছে না৷
একটু পরেই সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল ওরা৷
দেড়খানা ঘর নিয়ে পলেস্তারা-খসা একটা একতলা বাড়ি৷ তার একপাশে টিনের চাল৷ বাড়ির ডানপাশে আর পিছনদিকে গাছ-আগাছার দল যেমন খুশি বেড়ে উঠেছে৷ আর বাঁ-দিকে একটা জং-ধরা ঘাড় কাত করা টিউবওয়েল৷
বাড়ির বাইরে আলো বলতে হাতদশেক দূরে ইলেকট্রিক পোস্টের মাথায় ঝোলানো একটা বালব৷
এই আস্তানাটা ভাড়া নিয়ে সত্যবানস্যার কোচিং চালান৷
বড় ঘরটার চারটে ছোট-ছোট জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছিল৷ জানলাগুলো একটু উঁচুতে হাওয়ায় শুধু ঘরের ড্যাম্প ধরা দেওয়াল চোখে পড়ছে৷
কোচিং-এর ঘর থেকে একটু দূরে সাইকেল থামাল অচ্যুত আর সৌরভ৷ আগাছার জঙ্গলের ওপরে সাইকেল দুটো ওরা কাত করে শুইয়ে দিল৷ তারপর অচ্যুত নীচু গলায় সৌরভকে বলল, ‘তুই আস্তে- আস্তে পেছনদিকে চলে যা৷ সাবধানে জানলা দিয়ে উঁকি মারবি৷ যেই দেখবি স্যাটাস্যাট পিকিউলিয়ার কিছু করছে অমনি ফটো তুলে নিবি৷ শিয়োর হওয়ার জন্যে দরকার হয় দু-তিনটে শট নিবি৷ তারপর সোজা সাইকেল নিয়ে পালাবি—কোনওদিকে তাকাবি না৷ রাতে তোর সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলে নেব৷’
সৌরভের মুখে আলো-ছায়া নড়ছিল৷ ওকে একটু যেন বিভ্রান্ত দেখাল৷ ও জিগ্যেস করল, ‘স্যাটাস্যাট হঠাৎ পিকিউলিয়ার কিছু করবে কেন?’
অচ্যুত কোচিং ক্লাসের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘সে-দায়িত্ব আমার৷ তুই যা—রেডি হয়ে থাক…৷’ সৌরভকে ঠেলা মারল অচ্যুত৷
সৌরভ পা টিপে-টিপে বাড়ির পিছনদিকে চলে গেল৷
আর অচ্যুত সটান হেঁটে গিয়ে কোচিং ক্লাসের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল৷ ওর বুকের ভেতরে যে মেঘ গুড়গুড় করছিল সেটাকে ও জোর করে ভুলে যেতে চাইল৷
‘স্যার—৷’
অচ্যুতের ডাকে সত্যবানস্যার চোখ তুলে তাকালেন৷
ঘরে আর কেউ নেই৷ মেঝেতে পাতা শতরঞ্চির ওপরে বসে স্যার খাতা দেখছেন৷
খুব শিগগিরই স্কুলে কোনও পরীক্ষা হয়নি৷ এগুলো নিশ্চয়ই স্যারের কোচিং-এ নেওয়া পরীক্ষার খাতা৷
‘তুই হঠাৎ এসময়ে?’
‘স্যার, আপনার কথা আমি কাউকে বলিনি৷’
হাসলেন সত্যবানস্যার : ‘আয়, আয়—এখানে এসে বোস৷’
অচ্যুত দরজার কাছে চটি ছেড়ে শতরঞ্চির ওপরে গিয়ে বসল৷ চোখের আন্দাজে মেপে দেখল স্যারের কাছ থেকে ওর দূরত্ব মাত্র তিন হাত৷
স্যারকে লক্ষ করছিল অচ্যুত৷ তেলচকচকে চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো৷ কিন্তু মাথা ঝুঁকিয়ে থাকায় কয়েকগোছা চুল চশমার ওপরে ঝুলে পড়েছে৷ পাশ থেকে স্যারের নাকটাকে আরও খাড়া মনে হচ্ছে৷ আর গলার পাশে একটা শিরা ফুলে রয়েছে৷
শিরাটার ওপরে চোখ পড়তেই অচ্যুতের বুকের ভেতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল৷ ওর ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল৷ কিন্তু মনের জোরে ইচ্ছেটাকে ও রুখে দিল৷ রাজীবের কথা মনে করে ও চোয়াল শক্ত করল৷
সত্যবানস্যার আবার মাথা নীচু করে খাতা দেখছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই জিগ্যেস করলেন, ‘তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? তুই আমার সবচেয়ে ফেভারিট স্টুডেন্ট…৷’
‘পড়াশোনায় একদম মন বসছে না, স্যার৷’ অনুযোগ করে বলল অচ্যুত৷
‘কেন রে?’ স্যার খাতার দিক থেকে চোখ সরালেন না৷
‘আপনার জন্যে৷’
চমকে চোখ তুলে তাকালেন : ‘তার মানে!’
‘আপনার…ইয়ে…ওইগুলো আমি এখনও…মানে…বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে, আমি সত্যি-সত্যিই ভুলভাল দেখেছি৷ আপনি কী করে দেওয়ালে হাঁটবেন! কী করে আপনার চোখ সবুজ হবে! অসম্ভব!’ একদমে কথাগুলো বলে গেল অচ্যুত৷
‘ভুলভাল? অসম্ভব?’ হাতে ধরা লাল পেন ছেড়ে দিলেন সত্যবানস্যার৷ ওঁর টকটকে ফরসা গালে অপমানের রক্ত ছুটে এল৷ কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কোমলভাবে হাসলেন : ‘যাকগে, ওসব কথা ছাড়৷ তুই কী দরকারে এসেছিল বল…৷’
‘আপনি রাগ করবেন না, স্যার৷ ওরকম অলৌকিক ব্যাপার…তাই সত্যি বলে মানতে কষ্ট হচ্ছে৷ আমি এরকম ভুল দেখলাম! আমি, স্যার, ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না…৷’
সত্যবানস্যার স্নেহের হাসি হাসলেন৷ বললেন, ‘বুঝেছি…বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে তোর মেন্টাল ডিসটারবেন্স হচ্ছে৷ তা কী করলে তুই খুশি হবি? কী করলে তোর পড়ায় মন বসবে?’
কয়েকবার ঢোঁক গিলল অচ্যুত৷ তারপর দমকা হাওয়ার মতো বলে বসল, ‘আমাকে আর-একবার করে দেখাবেন, স্যার?’
অদ্ভুত হেসে সত্যবানস্যার উঠে দাঁড়ালেন৷ স্যারকে অনেক লম্বা দেখাচ্ছিল৷ অচ্যুতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ব্যস, এই?’
অচ্যুত দম বন্ধ করে ঘাড় নাড়ল৷ বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ—এই৷’
স্যার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন৷ তারপর শূন্যে কয়েকবার হাত নেড়ে দরজার পাশের দেওয়ালে থাবা বসিয়ে দিলেন৷ এবং টিকটিকির মতো দেওয়ালে শরীরটাকে লেপটে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে এগোতে লাগলেন৷
অচ্যুতের শীত করতে লাগল৷ ওর মনে হল, একটা কদাকার সরীসৃপ দেওয়ালে কিলবিল করছে৷ একটা ভয়ের চিৎকার ওর গলা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ প্রাণপণ চেষ্টায় অচ্যুত সেটাকে রুখে দিল৷ আর মনের জোরে শতরঞ্চির ওপরে স্থির হয়ে বসে রইল৷
মাথার ওপরে পুরোনো সিলিং পাখার খটখট আওয়াজ হচ্ছিল৷ কিন্তু তারই মধ্যে অচ্যুত যেন কয়েকবার অটোমেটিক ক্যামেরার ‘চিঁউ-চিঁউ’ শব্দ শুনতে পেল৷
স্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই ঘাড় কাত করে হাসিমুখে অচ্যুতের দিকে তাকালেন : ‘কিছুদিন আগে যখন এই ক্ষমতাটা আবিষ্কার করি তখন খুব তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি৷ তারপর খেয়াল করলাম, আমার মনের ভেতরে কেমন একটা তোলপাড় চলছে৷ কখনও অঙ্ক মনে থাকে, কখনও থাকে না৷ কখনও চেনা লোককে চিনতে পারি, কখনও পারি না৷ প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সয়ে গেল৷ আর…৷’ স্যার সিলিং-এর দিকে বেয়ে উঠতে লাগলেন : ‘…আর অদ্ভুত একটা তেষ্টা শুরু হল৷ যখন তেষ্টা পায় তখন কোনও জ্ঞান থাকে না৷ তখন তো আর আমি আমি থাকি না! আবার যখন তেষ্টা পায় না তো পায় না৷ অ্যাই, রাজীব কেমন আছে রে?’
‘ভ-ভালো আছে৷’ চাপা শব্দের টুকরোগুলো অচ্যুতের ঠোঁট থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এল৷
‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি৷ অবশ্য তোকেও ভালোবাসি…৷’ স্যার দেওয়াল বেয়ে মেঝের দিকে নেমে আসতে লাগলেন : ‘তোকে ভালোবাসি তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান বলে৷ আর রাজীবকে…থাকগে, সে অন্য ব্যাপার৷’
সার্কাস শেষ করে সত্যবানস্যার শতরঞ্চির ওপরে নেমে এলেন৷ হাততালি দেওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে হাত ঝাড়লেন৷ চশমাটা ঠিক করে নাকের ওপরে সেট করে বললেন, ‘কী রে, এবার তুই খুশি তো? এখন থেকে পড়ায় মন বসবে তো?’
অচ্যুত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ বাতাসে ঘরের জানলার পাল্লা নড়ে উঠল৷ একটা জংলি গন্ধ ঘরে ঢুকে পড়ল যেন৷
‘সবুজ চোখ কী আর দেখতে চাস?’
অচ্যুত মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ৷ না, ও দেখতে চায় না৷
‘আসলে কী জানিস, এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷ তাই আমার এসব নিজের চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ প্রথম-প্রথম তো আমারই বিশ্বাস হতে চায়নি৷’ বলে মিহি গলায় খিলখিল করে হেসে উঠলেন সত্যবানস্যার৷
স্যারের গলাটা হঠাৎ বদলে যাওয়ায় অচ্যুত একটু চমকে গেল৷ দেখল, স্যার হাসতে-হাসতেই মাথাটা এপাশ-ওপাশ দোলাচ্ছেন৷ স্যারের চোখ দুটো নিজে থেকেই কেমন কটা রঙের হয়ে যাচ্ছে৷
স্যারের হাসিটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোঙানির মতো হয়ে গেল৷ তিনি খপ করে অচ্যুতের ডান হাতের কবজি চেপে ধরলেন৷ তীব্র চোখে তাকালেন ওর দিকে৷
স্যারের হাতটা কী গরম! যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!
অচ্যুত ঝটকা মেরে হাতটা টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করল৷ পারল না৷
কেমন যেন ভাঙা খনখনে গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘বাঁচতে চাস তো এক্ষুনি পালা৷ তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান৷ তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না৷’ ওর হাতটা ছেড়ে দিলেন স্যার৷ একরকম যেন ছুড়ে দিলেন অচ্যুতের কোলে : ‘পালা! পালা শিগগিরই!’
অচ্যুত লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ একছুটে চলে গেল দরজার কাছে৷
সত্যবানস্যার তখন শরীরটাকে পিছনদিকে বেঁকিয়ে বুকে হাত বোলাচ্ছেন আর বুক-ফাটা তেষ্টায় চাপা শব্দ করছেন, ‘ওঃ! ওঃ!’
হঠাৎই নিজের ডানহাতে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷
অচ্যুতের মাথাটা যেন ঘুরে গেল, দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিল৷
স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ হয়ে গেল৷ হাত কামড়ে ধরা অবস্থাতেই তিনি অচ্যুতের দিকে মুখ তুলে তাকালেন৷ গোঙানির মতো শব্দ করে কিছু একটা বলতে চাইলেন৷ তারপর কামড়ে ধরা জায়গাটা প্রবল টানে শব্দ করে চুষতে লাগলেন৷
এতক্ষণ গলা টিপে ধরে রাখা চিৎকারটা এইবার অচ্যুতের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল৷ একটানে দরজা খুলে ও ছিটকে চলে এল বাইরে৷ চোখ-মুখে অসহ্য তাপ৷ মাথা ঝিমঝিম করছে৷ কোনওরকমে ও ছুটে গেল শুইয়ে রাখা সাইকেলের কাছে৷ তারপর অচ্যুত নামের একটা রোবট অমানুষিক গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে দিল৷
ঠিক তখনই ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমে পড়ল আকাশ থেকে৷
অচ্যুতের ভয় ক্রমশ কমছিল৷ কারণ, ও বোধহয় পালটে যাওয়া সত্যবানস্যারের ধরনধারণ এখন অনেকটা স্পষ্টভাবে আঁচ করতে পারছিল৷ বুঝতে পারছিল, সত্যবানস্যারের একটা ভয়ানক অসুখ হয়েছে৷ এ-অসুখ কখনও সারে কি না অচ্যুতের জানা নেই৷
মঙ্গলবার স্কুলের দিনটা বেশ উত্তেজনার মধ্যে কাটল৷ কারণ, পরদিনই ওরা সৌরভের তোলা ফটো দেখতে পাবে৷
অচ্যুত টিফিনের সময় সৌরভকে বলল, ‘তুই ফটোর দোকানে বলবি, ওগুলো আমাদের স্কুলের একটা নাটকের রিহার্সালের ফটো—এমার্জেন্সি প্রিন্ট দরকার৷’
প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাটকে যদি চিনে ফ্যালে?’
বাসব বলল, ‘তোদের কাছে যা শুনলাম তাতে মনে হয় স্যাটাস্যাটের মুখ ভালো করে দেখা যাবে না৷’
কুলদীপ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চিনতে পারল তো বয়েই গেল—৷’ তারপর বাসবের টিফিন বক্স থেকে আধখানা সন্দেশ নিয়ে মুখে পুরে দিল৷
সৌরভ বলল, ‘ফটোর প্রিন্ট হাতে এলে অমিয়স্যারকে ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়?’
অচ্যুত বলল, ‘জানালে অমিয়স্যার হয়তো হেডস্যারকে জানাতে বলবেন৷ হেডুর সঙ্গে দেখা করতে আমার ভয় করে৷’
কুলদীপ বলল, ‘ভয়ের কী আছে! স্যাটাস্যাটের ফটো নিয়ে আমি তোর সঙ্গে হেডুর কাছে যাব৷’
‘ঠিক আছে প্রিন্টটা আগে হাতে আসুক…৷’
ওদের আলোচনা-পরিকল্পনার যেন কোনও শেষ নেই৷ স্কুলে যে-কথা শেষ হয় না সেগুলো রাতে টেলিফোনে চলতে থাকে৷
অচ্যুত যে ইদানীং ফোন বড্ড বেশি করছে সেটা ওর মায়ের নজরে পড়ল৷ এমনিতে ওরা খুব দরকার ছাড়া ফোন ব্যবহার করে না৷ কারণ, অচ্যুতের বাপিকে বেশ কষ্ট করেই ফোনের খরচ চালাতে হয়৷ তাই বাড়াবাড়িরকম ফোন করা নিয়ে মা অচ্যুতকে বারদুয়েক বকাবকি করল৷
‘মা যদি জানত কেন এত ফোন করতে হয়, তা হলে ভয়ে কেঁপে উঠত৷’ মনে-মনে ভাবল অচ্যুত৷
বুধবার সকালে ও ফোন করে রাজীবের খবর নিল৷ রাজীব এখন পুরোপুরি সেরে উঠেছে৷ তবে মনের জোর ততটা ফিরে পায়নি৷
সেদিন সন্ধেবেলা সত্যবানস্যারের কোচিং-এ সময়টা বেশ সহজ-স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল৷ স্যারকে দেখে কে বলবে, গত পরশু রাতে এই কোচিং-ঘরের দেওয়ালে তিনি বুকে হেঁটে বেড়িয়েছেন!
স্যার দু-তিনবার রাজীবের কথা জিগ্যেস করলেন৷ তারপর আচমকা মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে বুকে কয়েকবার হাত বোলালেন৷
কোচিং-এর শেষে বাড়ি ফেরার সময় ওরা সৌরভের সঙ্গে ফটোর দোকানে গেল৷ ফটোগুলো ডেলিভারি নিয়ে ওরা একটু দূরে সরে গেল৷
ধীরে-ধীরে খাম থেকে প্রিন্টগুলো বের করল সৌরভ৷
ওরা সবাই হাঁ করে সত্যবানস্যারের ছবিগুলো গিলতে লাগল৷
অচ্যুত একটা প্রিন্ট নিজের কাছে রেখে দিল৷ মউলিকে ঘটনাগুলো যখন বলবে তখন ছবিটা দেখাবে৷
কুলদীপ বলল, ‘আমি বাসবকে একটা ফটো দেখিয়ে দেব৷’
প্রতীক বলল, ‘তোরা যদি বলিস, তা হলে রাজীবকেও দেখাব৷’
অচ্যুত বলল, ‘না, না—রাজীবকে এক্ষুনি দেখানোর দরকার নেই৷ ও আগে সেরে উঠুক, রেগুলার স্কুলে আসুক—তখন দেখানো যাবে৷’
তারপর ওরা যার-যার বাড়ির দিকে রওনা হল৷
রাজীবের কথা ভাবতে-ভাবতে অচ্যুত বাড়ি ফেরামাত্রই মা বলল, ‘একটু আগেই রাজীবের মা ফোন করেছিলেন৷ জানতে চাইছিলেন, রাজীব আমাদের বাড়িতে এসেছে কি না৷’
‘তার মানে!’ চমকে উঠল অচ্যুত৷
সঙ্গে-সঙ্গে ও রাজীবের বাড়িতে ফোন করল৷
‘হ্যালো, আন্টি, আমি অচ্যুত বলছি৷’
‘দ্যাখো না, রাজু আধঘণ্টা মতন আগে কাউকে না বলে কোথায় বেরিয়ে গেছে৷ আমি ওর ফোনবুক দেখে পসিবল সব জায়গায় ফোন করলাম৷ বাট নোবডি নোজ হোয়্যার হি ইজ৷ রাজু এখনও ভালো করে সেরে ওঠেনি—শরীর এখনও উইক…আমি যে এখন কী করি! ওর বাপি গতকাল ভাইজাগ গেছে—ফ্রাইডেতে ফিরবে…৷’ রাজীবের মাম্মির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে গেছে৷ ওঁর গলা বেশ অসহায় শোনাচ্ছে৷
‘আচ্ছা, আজ সন্ধের পর রাজীবের কি কোনও ফোন এসেছিল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে গুমগুম শব্দ শুরু হয়ে গেল৷ ও উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল৷
‘হ্যাঁ…কে একজন ফোন করেছিলেন৷ বলছিলেন, রাজুর স্যার…৷’
‘ক’টার সময় ফোনটা এসেছিল?’
‘অ্যাবাউট এইট থারটি…৷’
অচ্যুতদের কোচিং শেষ হয়েছে আটটা নাগাদ৷ তা হলে তার পরে সত্যবানস্যার রাজীবকে ফোন করে থাকতে পারেন৷
রবিবার রাজীবের সঙ্গে অচ্যুতের ফোনে কথা হয়েছিল৷ রাজীব তখন কান্নাকাটি করছিল৷ বলছিল, স্যাটাস্যাট ওকে অদ্ভুত গলায় ডাকছিল৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা নিশির ডাকের মতো৷
সেদিনটা ছিল শনিবার৷
তা হলে আজও কি সেইরকম কিছু হয়েছে? রাজীবের মাম্মি আজ আর ছেলেকে আটকাতে পারেননি৷
‘কী হল?’ রাজীবের মাম্মি ওপাশ থেকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কিছু বলছ না কেন?’
অচ্যুত ঠোঁট কামড়াল৷ একপলক তাকিয়ে রইল ফাঁকা দেওয়ালের দিকে৷ তারপর বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমি খোঁজ করে দেখছি৷ কোনও খবর পেলে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেব৷’
‘তুমি একটু সিরিয়াসলি দ্যাখো, অচ্যুত৷ আমি ভীষণ উয়ারিড হয়ে আছি৷’
ওঁকে আবার আশ্বাস দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল অচ্যুত৷
ওর মন বলল, সত্যবানস্যারের কোচিং-ঘরে গিয়ে একবার খোঁজ করা দরকার৷
ও চটপট কুলদীপ, প্রতীক আর সৌরভকে ফোন করল৷
প্রতীককে বাড়িতে পাওয়া গেল না৷ বাকি দুজনকে ও তৈরি হয়ে সত্যবানস্যারের কোচিং-এ আসতে বলল৷
তারপর শোওয়ার ঘরে গিয়ে বাপির বালিশের পাশ থেকে তিন ব্যাটারির টর্চটা তুলে নিল৷ একবার ‘অন’ করে দেখে নিল ঠিকঠাক জ্বলছে কি না৷
টর্চ হাতে নিয়ে বেরোনোর সময় রান্নাঘরের দিকে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘মা, আমি একটু কুলদীপের বাড়ি যাচ্ছি৷ তাড়াতাড়ি ফিরে আসব৷ তুমি দরজাটা দিয়ে দাও৷’
মা তাড়াতাড়ি খুন্তি-কড়াই সামলে রান্নাঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে অচ্যুত সাইকেল টেনে নিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে৷
মা সদর দরজার কাছে যখন এল তখন অচ্যুতের সাইকেল অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ মায়ের পিছুডাক ও শুনতে পেল না৷ দরজা বন্ধ করতে-করতে মা ভাবল, অচ্যুতের বাবার কী যে এক তাসের নেশা! সে বাড়িতে থাকলে যা-হোক করে ছেলেটাকে হয়তো আটকাতে পারত৷ এই বয়েসটা যে ভালো নয়, সেটা মানুষটা বুঝলে আর চিন্তা ছিল না৷ ছেলেটা এমন তাড়াহুড়ো করে কুলদীপের বাড়ি গেল কেন, কে জানে!
মায়ের জন্য অচ্যুতের খারাপ লাগছিল৷ কিন্তু আরও খারাপ লাগছিল রাজীবের জন্য৷
জোরে প্যাডেল করে দশমিনিটের মধ্যেই ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল৷ দেখল, কুলদীপ আর সৌরভ তখনও এসে পৌঁছয়নি৷
বাড়িটার কাছ থেকে একটু দূরে সাইকেল থামিয়ে দিল অচ্যুত৷ অবাক হয়ে দেখল, কোচিং-ঘরের জানলাগুলো খোলা, কিন্তু কোনও জানলাতেই আলো চোখে পড়ছে না৷
আলো নেভানো অথচ জানলা খোলা কেন?
সাইকেল থেকে নেমে পা টিপে-টিপে কোচিং-এর দরজার দিকে এগোল অচ্যুত৷ ডানহাতের শক্ত মুঠোয় টর্চটা ধরা রয়েছে৷
রাত সবে ন’টা পেরিয়েছে, কিন্তু এই অঞ্চলটা এমন যেন ঘড়ির কাঁটা তিন ঘণ্টা এগিয়ে গেছে৷ চারপাশে অন্ধকার গাছপালার মাঝে একতলা বেখাপ্পা বাড়িটাকে আরও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল৷
কোচিং-এর দরজার কাছে পৌঁছে অচ্যুত একটা হাসির শব্দ শুনতে পেল৷
এ-হাসি ওর চেনা৷ মিহি খিলখিল হাসি৷
যতটা ভয় পাওয়ার কথা অচ্যুত ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, সত্যবানস্যার নিজেই পরশুদিন বলেছেন, ‘তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না…৷’
স্যার নিশ্চয়ই অচ্যুতের কোনও ক্ষতি করবেন না৷
কৌতূহল ওকে টানতে লাগল৷ ঘরের ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে কেন? কুলদীপ, সৌরভ যখন আসে আসুক—ওর একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ঘরের ভেতরের রহস্যটা কী৷
দরজায় আলতো করে চাপ দিল অচ্যুত৷ দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল৷
ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার৷ তারই মধ্যে জ্বলছে দুটো সবুজ চোখ৷ বোধহয় দরজার শব্দ পেয়েই এদিকে তাকিয়েছে৷
সেদিকে তাক করে অচ্যুত টর্চ জ্বালল৷ এবং দৃশ্যটা ওকে পাথর করে দিল৷
রাজীব উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে৷ ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে রয়েছেন সত্যবানস্যার৷ স্যারের দাঁতের সারি চকচক করছে৷ ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ তার আশেপাশে কয়েক জায়গায় লিপস্টিকের মতো লালচে ছোপ৷ সবুজ চোখ দুটো তীব্রভাবে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে৷
স্যার তখনও খিলখিল করে হাসছেন৷
অচ্যুত বুকফাটা চিৎকার করে উঠল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঝুঁকে পড়া নেকড়েটা সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ এবং অচ্যুতকে তাক করে লাফিয়ে পড়ার জন্য সামান্য কুঁজো হল৷
অচ্যুত পাগলের মতো ছুট লাগাল৷ ওর হাতের টর্চ কোথায় যেন ছিটকে পড়ল৷ টর্চের আলোর বৃত্তটা পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের গায়ে এপাশ-ওপাশ দুলে আগাছার জঙ্গলে কোথায় হারিয়ে গেল৷
ভয়ংকর মৃত্যু তেড়ে এলে মানুষ যেভাবে মরিয়া হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়, ঠিক সেভাবে দৌড়ল অচ্যুত৷ হাঁকপাঁক করে পৌঁছে গেল সাইকেলের কাছে৷ সাইকেল টানতে-টানতেই একলাফে তাতে চড়ে বসল৷ তারপর শুরু হল একা-একা সাইকেল রেস৷
তারই মধ্যে পিছনে তাকিয়ে দেখল সত্যবানস্যার আর-একটা সাইকেলে চড়ে ছুটে আসছেন৷ অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান হয়েও আজ আর অচ্যুতের রক্ষা নেই৷
প্যাডেল করতে-করতে ভয়ে কান্না পেয়ে গেল অচ্যুতের৷ মায়ের পিছুডাকটা না শুনে ও আজ মারাত্মক ভুল করেছে৷ পোষা সাইকেলটাকে ও মনে-মনে বলতে লাগল, ‘আজ আমাকে বাঁচাতেই হবে৷ নইলে আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব মিথ্যে৷ ছোট—ছোট…আরও জোরে ছোট…৷’
রাস্তার দু-চারজন লোক অচ্যুতের ছুটন্ত সাইকেল দেখে ভাবল, এক্ষুনি ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে৷ কয়েকটা সাইকেল রিকশা চটপট পাশে সরে গিয়ে ওর বেপরোয়া গতির সাইকেলকে পথ করে দিল৷
বাড়ির কাছে পৌঁছে সাইকেলে ব্রেক কষল অচ্যুত৷ একলাফে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা ঠেলে ফেলে দিল একপাশে৷ তারপর দুমদুম করে দরজায় ধাক্কা দিল আর একইসঙ্গে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মা! মা! দরজা খোলো—জলদি৷’
বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অচ্যুত উসখুস করতে লাগল৷ গলা উঁচু করে দেখল, সত্যবানস্যার তিরবেগে সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসছেন৷ ওঁর সবুজ চোখ এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে৷
দরজা তখনও খুলছে না দেখে একলাফে মউলিদের দরজায় চলে গেল অচ্যুত৷ ঠেলা মারতেই দরজা খুলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে ঝটপট দরজায় খিল তুলে দিল৷ তারপর দরজায় পিঠ দিয়ে হাপরের মতো হাঁফাতে লাগল৷
.
৷৷আট৷৷
দরজা বন্ধ করার সময় দড়াম করে শব্দ হয়েছিল৷ খিল দেওয়ার সময়েও৷
অচ্যুত চোখ বুজে হাঁফাচ্ছিল৷ আর ভাবছিল, সত্যবানস্যার ওকে মউলিদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন কি না৷ মউলিদের বাড়িতে এর আগে কোনওদিন ও ঢোকেনি৷
এমন সময় দরজার কাছটায় একটা জোরালো আলো জ্বলে উঠল৷
‘এ কী, তুমি! এ সময়ে!’
মউলি৷
চোখ খুলল অচ্যুত৷ কয়েক হাত দূরেই চোখ বড়-বড় করে দাঁড়িয়ে মউলি৷ পরনে সাদা টপ, নীলচে স্কার্ট, কপালে টিপ, আর জোড়া বিনুনি৷
এই বিপদের মুহূর্তে মউলিকে সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে হল অচ্যুতের৷ ও হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, ‘শিগগির ওপরে চলো—৷’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘পরে বলব৷ আগে চলো, দোতলা থেকে উঁকি মেরে একটা জিনিস দেখতে হবে৷’
অচ্যুতের মুখ-চোখ দেখে মউলি আর কথা বাড়াল না৷ ওকে নিয়ে ওপরে উঠল৷ উঠতে-উঠতে বলল, ‘তুমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছ…৷’
অচ্যুত কোনও জবাব দিল না৷
দোতলায় উঠে মউলির মা-কে দেখতে পেল ও৷ মউলি মায়ের কাছে গিয়ে চাপা গলায় কী যেন বলল৷ তারপর অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে, ‘এসো৷’
একটা ঘরে ঢুকল ওরা৷ ঘরের লাগোয়া বারান্দা৷ সেখানে দাঁড়ালে রাস্তা দেখা যায়৷ গত বৃহস্পতিবার রাতে মউলি এই বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল৷
অচ্যুত চাপা গলায় মউলিকে বলল, ‘সাবধানে উঁকি মেরে দ্যাখো তো, আমাদের বাড়ির দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না…৷’
ওকে বিছানার ওপরে বসতে বলে মউলি বারান্দায় গেল৷
অচ্যুত ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখল৷
দেওয়ালে তিনটে রঙিন পোস্টার৷ এক কোণে পড়ার টেবিল—বই- খাতায় ভরতি৷ তার পাশে বইয়ের
র্যাক৷ র্যাকের পাশে দড়িতে মউলির জামাকাপড় ঝুলছে৷
অচ্যুত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল৷ বুঝল, ও মউলির ঘরে বসে আছে৷
পড়ার টেবিলের পাশে মেঝেতে একটা জলের জগ ছিল৷ অচ্যুতের বুকটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছিল৷ জগটা দেখে তেষ্টাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও উঠে গিয়ে জগ থেকে ঢকঢক করে জল খেল৷
জগটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল মউলি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকছে৷
অচ্যুতের কাছে এসে মউলি বলল, ‘একজন ফরসা রোগামতন লোক তোমাদের দরজায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তোমার মায়ের সঙ্গে কীসব কথা বলছে৷ আর রাস্তায় পড়ে থাকা একটা সাইকেল দেখিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে—যেন কাউকে খুঁজছে৷’
‘লোকটার চোখে চশমা আছে?’
‘হ্যাঁ—৷’
‘রাস্তায় যে-সাইকেলটা পড়ে আছে, ওটা আমার—৷’
মউলি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘লোকটা কে?’
‘আমাদের স্কুলের অঙ্কস্যার৷ ওর তাড়া খেয়েই তো আমি তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি৷ মা দরজা খুলতে দেরি করছিল…৷’
মউলির মাথায় কিছুই ঢুকছিল না৷ ও হাঁ করে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে রইল৷
অচ্যুত মউলিকে দেখছিল৷ ডিয়োডোর্যান্টের হালকা গন্ধ কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল৷
একটু পরে ও মউলিকে বলল, ‘দ্যাখো তো, লোকটা চলে গেছে কি না৷’
মউলি আবার বারান্দায় গেল৷
মিনিটপাঁচেক পর ও ফিরে এল, বলল, ‘চলে গেছে৷ তবে কাকিমা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন৷’
‘আমি তা হলে এখন যাই৷ মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে৷’
‘তুমি আমাদের বাড়িতে আজ প্রথম এলে৷ চা-টা কিছুই…৷’
‘এটা আবার আসা না কি!’ হেসে বলল অচ্যুত, ‘এটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷’
‘অ্যাক্সিডেন্ট?’ তারপর নীচু গলায় সেই পুরোনো কথাটাই বলল মউলি, ‘মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷’
‘আজ আসি৷ তুমি আমাদের বাড়িতে একদিন এসো৷’
অচ্যুত চলে যাচ্ছিল৷ মউলি ওকে পিছন থেকে জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের ওই অঙ্কস্যার তোমাকে তাড়া করছিল কেন বললে না তো? অঙ্ক পারোনি?’
পিছন ফিরে তাকাল অচ্যুত, হাসল : ‘হ্যাঁ, খুব কমপ্লিকেটেড অঙ্ক৷ পরে সব বলব৷ অনেক সময় লাগবে৷’
অনেকটা জেদি ভঙ্গিতে মউলি অচ্যুতের কাছে এগিয়ে এল৷ খপ করে ওর হাত চেপে ধরল৷ তারপর বেশ চাপা গলায় বলল, ‘তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছ৷ সেদিন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম…দেখলাম, তুমি সাইকেল নিয়ে কোথায় বেরোলে…বেশ রাত করে ফিরলে৷ তারপর…তারপর…আজকে এইরকম…কী হয়েছে, অচ্যুত?’
অচ্যুত অবাক হয়ে মউলির মুখের দিকে তাকাল৷ ওর মুখে নিজের নামটা এই প্রথম শুনল…শুনে খারাপ লাগল না৷ সত্যি, এই মুহূর্তে মউলিকে সব বলতে পারলে খুব ভালো লাগত৷ ওর চোখে কী সাংঘাতিক আত্মবিশ্বাসের ছাপ! কী আশ্বাসে ভরা ওর দৃষ্টি!
অচ্যুত দোটানায় দুলছিল৷ মউলিকে সবকিছু খুলে বলবে? এখনই?
‘আমাকে তুমি সব বলবে না?’ মউলির গলায় একইসঙ্গে শাসন আর অভিমানের ছোঁওয়া৷
‘বলব৷ সত্যি বলছি, বলব৷ আজ নয়৷ এখন অনেক রাত হয়ে গেছে৷ মা চিন্তা করছে৷…আসি৷’ বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল অচ্যুত৷
তরতর করে সিঁড়ি নামার সময় চেঁচিয়ে বলল, ‘কাকিমা, আমি যাচ্ছি—৷’
ওর মনে হল, মউলির ডিয়োডোর্যান্টের গন্ধটা ওর সঙ্গে যেন সদর দরজা পর্যন্ত এল৷
দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই বলতে গেলে মায়ের মুখোমুখি৷
অচ্যুতকে দেখামাত্রই মায়ের চোখে জল এসে গেল৷ অভিমানভরা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে মা বলল, ‘কোথায় ছিলি তুই? আমি…৷’ আর বলতে পারল না…গলা ভেঙে গেল৷
‘ভেতরে চলো, সব বলছি—৷’
সাইকেলটা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকল অচ্যুত৷ রাজীবের কথা ভেবে ও শিউরে উঠল৷
রাজীব বোধহয় আর…৷
রাজীবের কথাগুলো ওর মনে পড়ল, ‘তোরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে রাখতে পারবি তো?’
ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে গুছিয়ে বসতে-না-বসতেই মা আর বাপি এসে হাজির৷
মা বলল, ‘তলে-তলে তুই কী করছিস বল তো? আজ তোকে সব খুলে বলতেই হবে৷’
বাপি কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ নিশ্চয়ই ও-ঘরে বসে টিভি দেখছিল, মা জেদ করে ডেকে এনেছে৷ ছেলেকে শাসন করে না বলে দু-চার কথা হয়তো বাপিকে শুনিয়েও দিয়েছে৷
আমতা-আমতা করে বাপি বলল, ‘শেষকালে আবার কী-না-কী বিপদে পড়বি…৷’
অচ্যুত হাত নেড়ে বলল, ‘সব বলছি৷ শুধু তার আগে রাজীবের বাড়িতে একটা ফোন করতে দাও—৷’
অচ্যুতের কথায় কী যেন ছিল, মা-বাপি ওকে বাধা দিল না৷ ও রাজীবের বাড়িতে ফোন করে বলল, ‘অঙ্কস্যারের কোচিং-এ গিয়ে রাজীব বিপদে পড়েছে৷’
রাজীবের মাম্মি খবরটা শুনেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন৷ অচ্যুতকে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগলেন৷
অচ্যুত দিশেহারাভাবে বলল, ‘অ্যান্টি, আমি এর বেশি কিচ্ছু জানি না৷ আপনি শিগগিরই পুলিশে খবর দিন! দেরি করবেন না…এক্ষুনি…কে জানে, এখনও হয়তো সময় আছে!’
ফোন নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ হাঁফ ছাড়ল অচ্যুত৷ লক্ষ করল, মা-বাপি ওর দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে যেন ও ভিনগ্রহের প্রাণী৷
একটু পরে আবার রিসিভার তুলল ও৷ একে-একে প্রতীক, সৌরভ আর কুলদীপকে খবর দিতে চাইল৷ সৌরভ আর কুলদীপকে বাড়িতে পেল না—তবে প্রতীক বাড়িতে ছিল৷ ওকে সংক্ষেপে রাজীবের বিপদের কথা জানাল অচ্যুত৷ বলল, ‘কাল স্কুলে জরুরি মিটিং করতে হবে৷’
ফোনের পালা শেষ হলে ও মা-কে বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে৷ খেতে দাও৷ খেতে-খেতে ব্যাপারটা বলছি…৷’
মা আর বাপি অবাক হয়ে অচ্যুতের কাছে গোটা গল্পটা শুনল৷
শুনে মায়ের মুখ ভয়ে বদলে গেল৷
বাপি বলল, ‘হাতে-পায়ে ফেভিকল লাগিয়ে তোর অঙ্কস্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়ায়নি তো! টিভিতে ফেভিকলের যেরকম বিজ্ঞাপন দেখায়!’
এত সমস্যার মধ্যেও অচ্যুত হেসে ফেলল৷ বলল, ‘না, একেবারে জেনুইন ম্যাজিক৷’
তারপর ফটোগ্রাফটা বের করে মা আর বাপিকে দেখাল৷
বাপিকে তার জায়গা থেকে নড়ানো মুশকিল৷ কারণ, ফটোটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখার পর বাপি বলল, ‘তুই ঠিক জানিস, তোদের স্যারের ব্লাড ব্যাঙ্ক টাইপের কোনও সাইড বিজনেস নেই!’
অচ্যুত মাথা নেড়ে ‘না’ বলল৷
‘এখন কী করবি?’ মা ভয়-পাওয়া গলায় জিগ্যেস করল৷
‘এই টাইপের ব্লাডসাকারদের আগুন ছাড়া খতম করা যায় না…৷’ বিড়বিড় করে বলল বাপি৷
মা বলল, ‘কাল থেকে তুই স্কুলে যাস না—৷’
‘কখখনও না!’ রুখে দাঁড়াল অচ্যুত : ‘এইজন্যেই তোমাদের কিছু বলতে নেই! ভুলে যেয়ো না, স্যার একা, আর আমরা অনেক! কাল স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটা অন্য স্যারদেরও জানাব৷ রাজীবের যদি কিছু হয়…৷’
রাত বারোটার পর কুলদীপ অচ্যুতকে ফোন করে খবর দিল, রাজীব মারা গেছে৷
অচ্যুত ভেবেছিল, এইবার বুঝি সত্যবানস্যারকে নিয়ে পুলিশ টানাটানি করবে, হাজাররকম জিজ্ঞাসাবাদ করবে৷ কিন্তু তার কিছুই হল না৷
কারণ, রাজীবের মৃতদেহ পাওয়া গেল স্যারের কোচিং থেকে অন্তত বিশ হাত দূরে আগাছার ঝোপের ভেতরে৷ ফলে পুলিশের কাছে সমস্যাটা ধানকলের মাঠের জোড়া খুনের মতোই দাঁড়াল৷
এলাকায় খবরটা খুব তাড়াতাড়ি চাউর হয়ে গিয়েছিল৷ স্কুলে গিয়ে অচ্যুত শুনল ক্লাস হবে না৷ রাজীবের জন্য শোকপালন করে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে৷
শোকসভায় দাঁড়িয়ে রাজীবের জন্য নীরবতা পালন করার সময় অচ্যুতের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল৷ একইসঙ্গে ভীষণ রাগ হল ওর৷ ওরা এতজন বন্ধু মিলে শেষ পর্যন্ত রাজীবকে ধরে রাখতে পারল না!
শোকপালন শেষ হলে অচ্যুত, কুলদীপ, বাসবরা জোট পাকাল৷
অচ্যুত গতকালের ঘটনাটা ওদের খুলে বলল৷
কুলদীপ জিগ্যেস করল, ‘রাজীবের বডিটা কোচিং-এর বাইরে গেল কী করে?’
‘হয়তো স্যারই ওটা বাইরে আগাছার ঝোপের মধ্যে ফেলে এসেছেন৷’
কুলদীপ শিস দিয়ে উঠল৷
বাসব অচ্যুতকে বলল, ‘এইবার পুলিশ তোকে হ্যারাস করবে৷’
‘সে করে করুক—যা সত্যি তাই বলব৷’
‘আমার মনে হয়, ব্যাপারটা এবার স্যারদের জানানো উচিত৷’
প্রতীক আর সৌরভও বাসবের কথায় সায় দিল৷
অনেক তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল ওরা অমিয়স্যারকে পুরো ব্যাপারটা জানাবে৷
স্কুলের ভিড় ফিকে হয়ে এসেছিল৷ স্যাররাও অনেকে বাড়ি চলে যাচ্ছেন৷ হঠাৎই বাসবের নজরে পড়ল, একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অমিয়স্যার দুজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছেন৷
বাসব বলল, ‘চল, এখনই যাই—স্যারকে গিয়ে বলি৷’
অচ্যুত আর প্রতীক ইতস্তত করছিল৷ কিন্তু কুলদীপও যেন খেপে গেল : ‘আর দেরি করলে হবে না, অচ্যুত৷ রাজীব গেছে, এরপর কার পালা কে জানে! যা করার এখনই করতে হবে৷ চল—৷’
ওরা পাঁচজন অমিয়স্যারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷
স্যার ওদের দিকে একবার জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়ে অন্য দুজন ছাত্রকে ছেড়ে দিলেন৷
‘কী ব্যাপার রে! রাজীবের জন্যে দুঃখ হয়৷ কী অরুন্তুদ ঘটনা বল তো!’ হাতের একটা ভঙ্গি করে মাথায় চুল ঠিক করলেন অমিয়স্যার৷
‘স্যার, রাজীবের ব্যাপারেই কয়েকটা কথা আমরা আপনাকে বলতে চাই৷’ মনিটর বাসব বলল৷
‘তার মানে!’ অমিয়স্যারের ভুরু কুঁচকে গেল৷
‘হ্যাঁ, স্যার৷’ অচ্যুতের দিকে আঙুল তুলে দেখাল বাসব : ‘ও আপনাকে সব বলবে৷ আপনাকে যে-করে-হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে৷ নইলে আমাদের স্কুল ছারখার হয়ে যাবে৷’
‘বলিস কী রে! আমাদের স্কুল অবনমিত হয়ে যাবে!’
‘হ্যাঁ, স্যার—ভীষণ বিপদে পড়ে আপনাকে এসব কথা বলছি৷ প্লিজ, ওই জামগাছটার তলায় চলুন৷’ অচ্যুত অনুনয় করে বলল৷
অমিয়স্যার বেশ হকচকিয়ে গেলেন৷ কিন্তু পাঁচটা নিষ্পাপ মুখের আকাঙ্ক্ষায় তিনি জল ঢেলে দিতে পারলেন না৷ আলতো করে বললেন, ‘চল…৷’
আকাশ ঘোলাটে৷ বৃষ্টি হবে কি হবে না বোঝা যাচ্ছে না৷ কোথা থেকে যেন বুলবুলির ডাক ভেসে আসছিল৷ একটু দূরে ইলেকট্রিকের তারে একটা বাঁশপাতি পাখি পোকার আশায় বসে আছে৷ দুটো ছোট মাপের হলদে প্রজাপতি স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে এলোমেলোভাবে উড়ে যাচ্ছে৷
অচ্যুত ভাবছিল, প্রকৃতি আমাদের সুখ-দুঃখের কোনও খবর রাখে না৷ তাই এরকম বিপদের সময়েও উদাসীন হয়ে সেজেগুজে বসে আছে৷
ভিজে স্যাঁতসেঁতে ঘাসের ওপরে পা ফেলে ওরা সবাই জামগাছ-তলার বেদির কাছে গেল৷ স্যারকে বসিয়ে শুরু করল ওদের রোমাঞ্চকর কাহিনি৷
মনোযোগী ছাত্রের মতো অমিয়স্যার গোটা গল্পটা শুনলেন৷ তারপর ‘হুম’ শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷
‘সবাই বলবে, এ তোদের খপুষ্প কল্পনা৷ কোনও প্রমাণ কি তোদের কাছে আছে?’
এ-কথা বলামাত্রই তিনটে হাত ছিটকে এল অমিয়স্যারের চোখের সামনে৷ তিনটে হাতে ধরা রয়েছে তিনটে রঙিন ফটোগ্রাফ৷ সত্যবানস্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছেন৷
অমিয়স্যার অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না৷ তারপর ধীরে-ধীরে উচচারণ করলেন, ‘তোরা আজকালকার ছেলে—ভূত-প্রেত-পিশাচে তোদের তেমন বিশ্বাস নেই৷ এখন বুঝতে পারছিস তো, বিজ্ঞানটাই সব নয়, যুক্তি-প্রযুক্তিই সব নয়! তার বাইরেও একটা রহস্যময় অন্ধকার জগৎ আছে৷ তোদের কাছে যা শুনলাম তাতে…৷’ কিছুক্ষণ যেন চিন্তা করলেন অমিয়স্যার৷ তারপর : ‘মনে হয়…একমাত্র বীতিহোত্র ছাড়া এ-পিশাচকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়৷’
‘বীতিহোত্র! সেটা কি কোনও ফলের বীজ বা গাছের শিকড়?’ ভাবল অচ্যুত৷
কুলদীপ জিগ্যেস করল, ‘বীতিহোত্র কী, স্যার…কোনও মন্ত্র?’
অমিয়স্যার মোলায়েম হেসে কুলদীপের দিকে তাকালেন : ‘ওঃ, বীতিহোত্র জানিস না! বীতিহোত্র মানে আগুন!’
ওরা পাঁচজন লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ বাব্বাঃ, স্যার পারেনও বটে!
অচ্যুত বলল, ‘স্যার, আমার বাপিও তাই বলছিল…৷’
অমিয়স্যার সামান্য ঘাড় দোলালেন৷ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘ব্যাপারটা স্কুলকে জড়িয়ে৷ আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আগে পুরকায়স্থবাবুকে জানানো দরকার৷ তোরা আমার সঙ্গে চল, ওঁকে এখনই গিয়ে এইসব সান্নিপাতিক ঘটনাবলির কথা খুলে বলি৷’
ওরা স্যারের সঙ্গে স্কুল-বাড়ির দিকে হাঁটা দিচ্ছিল, দেখল সত্যবানস্যার হাসিমুখে ওদেরই দিকে এগিয়ে আসছেন৷
‘কীরে, তোরা সব কোথায় চললি? এখনও বাড়ি যাসনি? যা-যা, বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা কর৷’
এত স্বাভাবিক কথা বলার ঢং, এত সহজ পা ফেলার ভঙ্গি যে, অচ্যুতরা স্তম্ভিত হয়ে গেল৷
অমিয়স্যার অপছন্দের চোখে সত্যবানস্যারের দিকে তাকালেন৷ একটু বোধহয় ভয়ও পেলেন৷ কারণ, অমিয়স্যারের মোটাসোটা শরীরটা পলকের জন্য কেঁপে উঠল৷
অচ্যুত বেপরোয়া ঢঙে এক পা এগিয়ে গেল সত্যবানস্যারের দিকে৷ বেশ জোরালো গলায় বলল, ‘স্যার, শুনেছেন তো, রাজীব মারা গেছে!’
সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘হ্যাঁ রে, শুনেছি৷ ভেরি স্যাড৷ তবে চিন্তার তো কিছু নেই! তোরা তো আছিস!’
কথাটা বলেই সত্যবানস্যার আচমকা ঘুরে চলে গেলেন৷
অমিয়স্যার রাগে ফেটে পড়লেন : ‘চোরের মায়ের বড় গলা! কী স্পর্ধা! কী আটোপটংকার! চল, এখনই হেডস্যারের কাছে চল!’
স্যারের কথায় ওরা পা বাড়াল৷
স্কুল এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে এসেছে৷ ওরা দেখল, বানজারা নীচের ক্লাসরুমগুলোর দরজা বন্ধ করে তালা লাগাচ্ছে৷
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে-উঠতে অমিয়স্যার বললেন, ‘পুরকায়স্থবাবুকে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে বলব ভাবছি৷ উনি বোধহয় বিশ্বাস করতে চাইবেন না৷ হয়তো বলবেন…৷’
‘কেন, স্যার, ফটো তো আছে!’ বাসব বলল৷
‘হুঁ, তা আছে৷ আসলে কী জানিস, আমারই বিশ্বাস হতে চাইছে না৷ যদিও জানি, তোরা সব সত্যি কথাই বলছিস৷’
কথা বলতে-বলতে হেডস্যারের ঘরের দরজায় চলে এল ওরা৷
ঘরের বাইরে কালো কাঠের নেমপ্লেট—তার ওপরে সাদা হরফে নাম লেখা : মোহনলাল পুরকায়স্থ, এম. এসসি., এম. এড.৷
দরজায় খয়েরি রঙের ভারী পরদা ঝুলছে৷ পরদার পাশ দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না৷
অমিয়স্যার একটু উসখুস করতে লাগলেন৷ বললেন, ‘এতজন একসঙ্গে ঢোকার দরকার নেই৷ উনি হয়তো কিছু মনে করবেন৷ বাসব আর অচ্যুত আমার সঙ্গে আয়৷’ হাতের ইশারায় ওদের কাছে ডাকলেন স্যার৷ প্রতীক, কুলদীপ, আর সৌরভকে লক্ষ করে বললেন, ‘তোরা বাইরে প্রতীক্ষমাণ হয়ে থাক৷ দরজা ছেড়ে কোথাও যাবি না, বুঝলি…৷’
ওরা তিনজন পরদা সরিয়ে হেডস্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল৷
ছোট্ট ঘর৷ রং-খসা ড্যাম্প-ধরা দেওয়াল৷ সিলিং-এ কাঠের কড়িবরগা৷ শুধু জানলা-দরজার পরদাগুলোই যা বেমানানরকম আধুনিক৷
পুরোনো কাঠের চৌকো টেবিলের ওপারে বসে মোহনলালবাবু কী একটা ফাইল খুলে পড়ছিলেন৷ আঙুলের ফাঁকে সিগারেট৷
‘আসতে পারি, স্যার?’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অমিয়স্যার কুণ্ঠিতভাবে জিগ্যেস করলেন৷
হেডস্যার মুখ তুলে তাকালেন৷ হেসে বললেন, ‘আসুন, আসুন—বসুন…৷’
তারপরই বাসব আর অচ্যুতকে দেখে বললেন, ‘আরে তোরা! কী ব্যাপার?’
‘ওরা আমার সঙ্গে এসেছে৷ ক্লাস নাইনের ‘‘এ’’ বিভাগের ছেলে—অচ্যুত আর বাসব৷’ ওদের পিঠে একে-একে হাত দিয়ে অমিয়স্যার বললেন, ‘ইস্কুলের ভয়ংকর বিপদ, স্যার…আপনাকে কিছু একটা করতে হবে৷ ওরা আপনাকে সব…৷’
‘কী, রাজীবের ব্যাপারে কিছু?’ হেডস্যার সিগারেটে টান দিলেন৷
‘হ্যাঁ, স্যার৷’ অচ্যুতের গলা কেঁপে গেল৷
‘ফাঁড়ি থেকে বড়বাবু আমাকে ফোন করেছিলেন৷ আমি বলেছি, আজ কনডোলেন্স-এর ব্যাপার আছে—স্কুল তাড়াতাড়ি ডিজলভ করে যাবে৷ কাল দুপুরে ওঁর সঙ্গে কথা বলব৷’
অমিয়স্যার বললেন, ‘মাত্র পাঁচ-দশমিনিট সময় নেব, স্যার৷ অচ্যুত, তুই বল—সংক্ষেপে বলবি৷’
অচ্যুত ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করল৷ রাজীবের মায়া মাখানো করুণ মুখটা কল্পনা করে ও নিজেকে জেদ আর সাহস জোগাল৷
একটানা গল্পটা ও বলে গেল৷ আগ্রহ আর চাপা কৌতুক নিয়ে মোহনলালবাবু ওর সব কথা মন দিয়ে শুনে গেলেন৷
গল্প বলা শেষ হলে পকেট থেকে সত্যবানস্যারের ফটোগ্রাফটা বের করল অচ্যুত৷ ঘন-ঘন শ্বাস নিয়ে বলল, ‘যদি স্যার, আপনার বিশ্বাস না হয়, স্যার…তা হলে এটা দেখুন…সত্যবানস্যার দেওয়ালে হাঁটছেন…৷’ ফটোটা হেডস্যারের দিকে এগিয়ে দিল ও৷
অমিয়স্যার বললেন, ‘একেবারে অবিশ্বসনীয় ঘটনা, স্যার…৷’
‘অবিশ্বাসের কী আছে!’ টেবিলের অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন হেডস্যার৷ বললেন, ‘আপনারা কি আর আমার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলবেন!’
‘আপনার অবাক লাগছে না?’
‘না, অবাক লাগবে কেন! পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য কত কী আছে৷ সেগুলো কি মিথ্যে, বলুন?’
অমিয়স্যার থতমত খেয়ে চুপ করে রইলেন৷ মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওঁদের সবাইকে পাগল ভাবছেন৷ মনস্তত্ত্ববিদরা যে-ঢঙে কথা বলেন উনি অনেকটা যেন সেই ঢঙে কথা বলছেন৷
‘দেওয়ালে সত্যবানবাবু ঠিক কেমন করে হাঁটছিল বল তো? এইরকম?’
ওরা অবাক হয়ে দেখল, হেডস্যার সিগারেটটা ঠোঁটে নিলেন৷ তারপর দু-হাত টান-টান করে পিছনের দেওয়ালের দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ হাতের পাতা দুটো চুম্বকের মতো দেওয়ালে সেঁটে গেল৷ তারপর ওঁর গোটা শরীরটা যেন বাতাসে ভেসে দেওয়ালে পৌঁছে গেল৷
ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা অবস্থায় তিনি টিকটিকির মতো দেওয়ালে হাঁটতে লাগলেন৷ তারপর সিগারেটটা ডানহাতে নিয়ে ঘাড় কাত করে তাকালেন অচ্যুতদের দিকে৷ খিলখিল করে হেসে বারবার জিগ্যেস করতে লাগলেন, ‘দ্যাখ তো, এইরকম?’
অমিয়স্যার চেয়ারে কাত হয়ে পড়লেন৷ ওঁর মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল৷
বাসব অচ্যুতকে ভয়ে জাপটে ধরল৷ ফটো দেখা আর সামনাসামনি দেখায় অনেক তফাত আছে৷
অচ্যুত অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভয় ততটা পায়নি৷ এই কসরত দেখে-দেখে ওর গা-সওয়া হয়ে গেছে৷ সত্যবানস্যারের কথাটা ওর মনে পড়ল : ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না…৷’ ‘আমাদের’ মানে তা হলে হেডস্যার আর সত্যবানস্যার! ধানকলের মাঠে কুলদীপের বন্ধুরা নিশ্চয়ই স্যাটাস্যাটের সঙ্গে হেডস্যারকেই দেখেছিল! আর তারপরই জোড়া খুন!
অচ্যুত আর ভাবতে পারছিল না৷
হেডস্যার তখন দেওয়াল থেকে সিলিং-এ চলে গেছেন৷ হাতের সিগারেটে টান দিতে-দিতে তিনি শরীরটাকে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ঝুলিয়ে দিলেন৷ পায়ের চেটো সিলিং-এ এঁটে আছে, মাথাটা নীচের দিকে৷
সেই অবস্থাতেই সিগারেটে টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন মোহনলালবাবু৷ ধোঁয়াটা ওঁর পায়ের দিকে যেতে শুরু করল৷
‘দ্যাখ তো, এইরকম সবুজ চোখ?’
অচ্যুত দেখল, কখন যেন হেডস্যারের চোখ স্যাটাস্যাটের মতো সবুজ হয়ে গেছে৷ ও সেই সবুজ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল৷ একটা নেশার ঘোর ওকে ধীরে-ধীরে জড়িয়ে ধরছিল৷
‘আমি আর তোদের অঙ্কস্যার—আমরা অনেক কিছু পারি৷ আসলে আমরা কিন্তু আলাদা নই, বুঝলি…একই…৷’ মিহি খিলখিল হাসি৷ তারপর : ‘এ নিয়ে পাঁচকান করে কোনও লাভ নেই, শোরগোল কিংবা থানা-পুলিশ করেও কোনও লাভ নেই৷ এ পর্যন্ত যা-কিছু দেখেছিস, বা এখন দেখছিস—সবকিছু ভুলে যাওয়াই ভালো৷’
স্রেফ পায়ে হেঁটে সিলিং থেকে দেওয়ালে, এবং দেওয়াল থেকে মেঝেতে নেমে এলেন মোহনলালবাবু৷ টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে ছোট- হয়ে-যাওয়া সিগারেটটা গুঁজে দিলেন৷ তারপর ধীরেসুস্থে চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷
অমিয়স্যার তখন থরথর করে কাঁপছেন৷ বাসব চোখ বুজে অচ্যুতকে জাপটে ধরে রয়েছে৷ অচ্যুত সোজা হয়ে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে—একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না৷
ওর রাজীবের কথা মনে পড়ছিল, আর উলটোদিকের চেয়ারে বসা টাকমাথা, চশমা পরা লোকটাকে দেখে বমি পাচ্ছিল৷ ভাবছিল, কীভাবে এই একজোড়া রক্তপিশাচকে খতম করা যায়৷
মোহনলালবাবুর চোখ এখন কটা রং থেকে ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ তিনি হাতছানি দিয়ে অচ্যুতকে কাছে ডাকলেন৷
ডাকটা অনেকটা নিশির ডাকের মতন৷ অচ্যুতের সেরকমই মনে হল৷
অতিকষ্টে বাসবের বাঁধন ছাড়িয়ে ও টেবিলের পাশ ঘুরে হেডস্যারের কাছে গেল৷ বাসব ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল৷
হেডস্যার ছোবল মারার মতো পলকে হাত বাড়িয়ে অচ্যুতের চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকায় ওকে কাছে টেনে নিলেন৷ ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে দাঁত খিঁচিয়ে হিসহিস করে বললেন, ‘তুই-ই যত নষ্টের গোড়া! তোকে ছেড়ে রেখে আমরা ভুল করেছি৷ তোকে কতকগুলো জরুরি কথা বলার আছে…৷’ ওকে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে গালে হাত বুলিয়ে আদর করলেন হেডস্যার৷ আচমকা পালটে গিয়ে স্নেহ আর ভালোবাসার হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে৷ থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই বড় দুরন্ত আর দুষ্টু৷ তবে লেখাপড়ায় ফার্স্টক্লাস৷ দেখবি, সামনের পরীক্ষায় তুই ফার্স্ট হবি—আমরা তোকে ফার্স্ট করাব৷ কোনও চিন্তা নেই৷ আজ রাত আটটার সময়ে ধানকলের মাঠে চলে আয় দেখি৷ আমি আর সত্যবানস্যার থাকব৷ তোর সঙ্গে আমাদের খুব জরুরি আলোচনা আছে৷ মনে করে আসবি কিন্তু৷’ অচ্যুতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন বারবার : ‘অবশ্য না এসে তুই পারবি না…আসতে তোকে হবেই…৷ আমি জানি তুই আসবি৷’
সম্মোহন করার ভঙ্গিতে একদৃষ্টে অচ্যুতের চোখে তাকিয়ে রইলেন হেডস্যার৷ আর সাপ-খেলানো সুরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘লক্ষ্মী ছেলে…আসবি কিন্তু…লক্ষ্মী ছেলে…আসবি কিন্তু…আসতে তোকে হবেই…না এসে তুই পারবি না…৷’
অচ্যুতের কেমন ঘোরের মতো লাগছিল৷ ও ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার, যাব৷ যাব, যাব, যাব৷’
‘লক্ষ্মী ছেলে৷’ হেডস্যার আদরের গলায় বললেন, ‘তুই এখন যা৷ আর শোন, আমি এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যে, অমিয়বাবু আর বাসবের এসব কিছুই মনে থাকবে না৷ তবে তুই কিন্তু কাউকে কোনও কথা বলবি না৷’
অচ্যুত টেবিলের কাছ থেকে পায়ে-পায়ে সরে এল৷
হেডস্যার এবার অমিয়স্যার আর বাসবের দিকে পালা করে তাকালেন৷ ওঁর চোখ আবার সবুজ হয়ে গেল৷ অমিয়স্যার আর বাসব অপলকে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে রইল৷
অচ্যুতের মনে হল, কোনও অদৃশ্য রশ্মি যেন হেডস্যারের চোখ থেকে বেরিয়ে অমিয়স্যার আর বাসবের চোখ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে৷
প্রায় একমিনিট পর হেডস্যারের চোখ আবার স্বাভাবিক হল৷ তিনি বেশ সহজ গলায় অমিয়স্যারকে বললেন, ‘ঠিক আছে, অমিয়বাবু… আপনারা তা হলে আসুন৷ ওই কথাই রইল…৷’
অমিয়স্যার ঘাড় নেড়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন৷ বাসবের হাত ধরে সাবধানে পা ফেলে ঘরের দরজার দিকে এগোলেন৷ অচ্যুত ওঁদের পাশে-পাশে হেঁটে চলল৷
বাসব আর অচ্যুতের দিকে পালা করে তাকিয়ে অমিয়স্যার যান্ত্রিক স্বরে মিনমিন করে বললেন, ‘তা হলে ওই কথাই রইল, বুঝলি?’
বাসব ফ্যালফ্যাল করে অমিয়স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ অচ্যুতের মাথায় কিছুই ঢুকল না৷
ওর মনে শুধু পাগলাঘণ্টি বাজছিল : ধানকলের মাঠ, রাত আটটা…ধানকলের মাঠ, রাত আটটা…ধানকলের মাঠ, রাত…৷
ওরা তিনজন হেডস্যারের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল৷
প্রতীক, কুলদীপ আর সৌরভ দেখল যে-তিনজন মানুষ হেডস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে তাদের মুখ-চোখ দেখে মনে হয় এইমাত্র ওরা সর্বস্বান্ত হয়েছে৷
প্রত্যেকেরই চোখে হতভম্ব শূন্য দৃষ্টি৷ যেন অন্য কোনও গ্রহ থেকে এসে সদ্য পা ফেলেছে পৃথিবীর মাটিতে৷
ওদের পাশাপাশি হেঁটে যেতে-যেতে একের পর এক প্রশ্ন করে চলল কুলদীপ৷
উত্তরে অচ্যুত অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে কীসব বলে একরকম দৌড়ে চলে গেল ওর সাইকেলের দিকে৷
কুলদীপরা এবার বাসবকে ছেঁকে ধরল৷ কিন্তু বাসবও কোনও কথা বলতে পারল না৷ ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ ও কাঁদতে শুরু করে দিল৷
সৌরভ একটু রুক্ষভাবেই অমিয়স্যারকে বলল, ‘স্যার, হেডস্যার কী বললেন? সত্যবানস্যারের ব্যাপারে উনি কি কোনও স্টেপ নিচ্ছেন?’
অমিয়স্যার সিঁড়ি নামতে-নামতে খোলা উঠোনের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন চোখ খোলা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না৷ সেই অবস্থাতেই আলতো করে বললেন, ‘ওই কথাই রইল…ওই কথাই রইল৷…বীতিহোত্র, বীতিহোত্র…বীতিহোত্র ছাড়া নিস্তার নেই রে…নিস্তার নেই৷’
ওদের তিনজনকে বোকার মতো মাঠের ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখে অমিয়স্যার চলে গেলেন৷ বাসবও ওঁর পিছন-পিছন ছুট লাগাল৷
কুলদীপরা বুঝল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে৷ ওরা তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল৷ তারপর একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জটলা শুরু করল৷
হঠাৎ ওরা দেখল, সত্যবানস্যার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন৷
প্রতীক আর সৌরভকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে কুলদীপ সত্যবানস্যারের পিছু নিল৷
দোতলায় এসে সত্যবানস্যার সটান এগিয়ে গেলেন হেডস্যারের ঘরের দিকে৷ এবং পরদা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন৷
কুলদীপও পা টিপে-টিপে পৌঁছে গেল হেডস্যারের ঘরের কাছে৷ তারপর ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে দরজার পাশে আড়ি পাতল৷
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ৷ তারপর ঘরের ভেতরে থেকে রক্ত-হিম-করা খিলখিল হাসি শোনা গেল৷
হেডস্যার বলছেন, ‘ছেলেটাকে আজ রাত আটটায় ধানকলের মাঠে আসতে বলেছি…৷’
সত্যবানস্যার বলছেন, ‘হ্যাঁ, অচ্যুতটা বড্ড ডিসটার্ব করছে৷ ভেবেছিলাম ওকে কিছু করব না…কিন্তু ও এমন শুরু করেছে যে, এখান থেকে হয়তো পাততাড়ি গোটাতে হবে৷’
হেডস্যার হেসে বললেন, ‘তোমার ছবি তুলেছে দেখলাম৷ তুমি দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছ৷’
‘তাই! কখন তুলল কে জানে! অবশ্য ও-ছবি দেখিয়ে কোনওরকম সুবিধে করতে পারবে না৷ যদি পুলিশে গিয়ে জানায় তা হলে পুলিশও কোনও আমল দেবে না…৷’
‘কিন্তু বারবার যদি ও পুলিশকে বিরক্ত করতে থাকে তা হলে একসময় পুলিশও আমল দেবে৷ তখন…৷ প্র্যাকটিক্যালি সেইজন্যই একটা কড়া স্টেপ নিতে হল৷ তুমি সময়মতো গৌরী বস্ত্রালয়ের মোড়ে চলে এসো৷ দুজনে একসঙ্গে ধানকলের মাঠে যাব৷’
‘ওঃ…দারুণ হবে৷ একইসঙ্গে তেষ্টার তৃপ্তি, আর ছেলেটার হাত থেকে নিষ্কৃতি…৷’
‘তোমার দেখছি জিভে জল এসে গেছে৷’ খিলখিল করে হাসলেন হেডস্যার৷
‘আর তোমার আসেনি বুঝি!’ সত্যবানস্যারও খিলখিল করে হাসলেন৷
দুজনের হাসি যেন আর থামতেই চায় না৷ দুই পিশাচের রক্ত-হিম-করা হাসি৷
কুলদীপ বেড়ালের পায়ে ছুট লাগাল৷ ঘাম ফুটে বেরোল ওর কপালে৷ উত্তেজনায় ও চাপা সুরে শিস দিয়ে উঠল৷
দুদ্দাড় করে একতলায় নেমে এসেই ও সৌরভ আর প্রতীকের হাত ধরে টান মারল৷ দৌড়ে সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে যেতে-যেতে বলল, ‘শিগগিরই আয়…সামনে এখন অনেক কাজ…৷’
সাইকেল চালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ওরা মরিয়া হয়ে একটা সমাধান খুঁজতে লাগল৷
ভেতরে-ভেতরে ওরা ভয় পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আরও ভেতর থেকে কে যেন বলছিল, ‘কিছুতেই হার মানা চলবে না! কিছুতেই না!’
অমিয়স্যারের কথাগুলো কুলদীপের মনে পড়ছিল বারবার৷
.
৷৷নয়৷৷
চাঁদ মেঘে ঢাকা ছিল৷ হয়তো সেইজন্যই জোনাকির ঝাঁক বাড়াবাড়িরকম উড়ছিল৷
অচ্যুত যখন সাইকেল নিয়ে ধানকলের মাঠে পৌঁছল তখন উড়ন্ত আলোর বিন্দুগুলো ওর প্রথম চোখ টানল৷ একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও ও মুগ্ধ হয়ে জোনাকির খেলা দেখতে লাগল৷
আশপাশের অন্ধকারে আরও অন্ধকার গাছপালা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ বাদলা বাতাস ওদের পাতায় ঝাপটা মারতেই ফিসফাস শুরু হল৷
অচ্যুতের মনে হল, ওরা বলেছে, ‘অচ্যুত এসে গেছে…অচ্যুত এসে গেছে…৷’
ঠিক সেইসময়ে ওর ঠিক পাশ থেকে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, ‘এসে গেছিস! গুড বয়৷ সাইকেল রেখে দিয়ে মাঠের মাঝে চল৷ হেডস্যার ওখানে অপেক্ষা করছেন…৷’
অচ্যুত মোটেই চমকে উঠল না৷ ধীরে-ধীরে পাশ ফিরে তাকাল৷
সত্যবানস্যার ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ ওঁর নিশ্বাস অচ্যুতের গায়ে এসে পড়ছে৷ ঠান্ডা নিশ্বাস৷ কিন্তু তাতেও অচ্যুত অবাক হল না৷ ওর মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি৷
বিকেলে দু-পশলা বৃষ্টি হয়েছিল৷ তারপর একটু রোদও দেখা গিয়েছিল—শরতের রোদ৷ তখন অচ্যুত একটা পুজো-পুজো গন্ধ টের পেয়েছিল৷
ওর ভীষণ মন খারাপ লাগছিল৷ মনের ভেতর থেকে ফিসফিস করে কেউ যেন বলছিল, ‘এ-পুজো আর দেখা হবে না৷’ তাই রোদ উঠতেই ও ছাদে গিয়েছিল বিকেলের শেষ রোদটা গায়ে মাখতে৷
‘এই যে, মিস্টার অ্যাক্সিডেন্ট!’
মউলি৷ হলুদরঙের একটা চুড়িদার পরেছে৷ ঝকঝক করছে৷ মনে হচ্ছে, বিকেলের রোদ দিয়ে তৈরি৷
অচ্যুত ওর দিকে তাকাল৷ কোনও কথা বলল না৷
‘কাল রাতে কী হয়েছিল? অঙ্কস্যারকে দেখে পালিয়েছিলে কেন বলো৷ তোমার মতো গুড বয়রা কখনও এমন পালায়! তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ আমাকে সব বলবে৷ কখন বলবে বলো৷’
অচ্যুতের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ও কিছুই বলতে পারল না৷ কয়েকবার ঠোঁট নড়ল শুধু৷
মউলি অপেক্ষা করতে লাগল৷
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত অচ্যুত বিড়বিড় করে বলতে পারল, ‘বলব৷’
কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মউলির ভুরু কুঁচকে গেল৷ পাঁচিলের কাছে এসে অচ্যুতদের ছাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল৷ তারপর অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘অ্যাই, তোমার কী হয়েছে বলো তো?’
অচ্যুত সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘পুজোয় তুমি নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করবে?’
‘হ্যাঁ৷ তুমি করবে না?’
ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ সেদিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওটা কী আনন্দ?’
‘কী ব্যাপার! তোমার কী হয়েছে?’
অচ্যুতের চোখে জল এসে গেল৷ হাতের পিঠ দিয়ে মোছার চেষ্টা করে জড়ানো গলায় বলল, ‘কিচ্ছু না৷ তোমার কথা বলো৷’
‘হঠাৎ আমার কথা জানতে চাইছ?’ চোখ পাকিয়ে হাসল মউলি৷
‘আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে৷ পরে যদি আর জানতে না পারি…৷’
‘ও—৷ ঠিক আছে, বলছি৷’ স্বামী বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে বুকের কাছে হাত জড়ো করে সোজা হয়ে দাঁড়াল মউলি৷ তারপর পড়া মুখস্থ বলার ঢঙে বলল, ‘আমার নাম মউলি মিত্র৷ তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকি৷ পড়াশোনায় মন নেই৷ রোজ বিকেলে অ্যাক্সিডেন্টের লোভে ছাদে উঠে ঘোরাঘুরি করি৷ ব্যস! আপাতত এইটুকুই৷’
ঠিক এইসময় সিঁড়ির কাছ থেকে মা অচ্যুতকে ডাকল৷
অচ্যুত ঘাড় ঘুরিয়ে ছাদের দরজার দিকে একবার তাকাল৷ তারপর হাত নেড়ে মউলিকে ‘টা-টা’ করে বলল, ‘কাল যদি ছাদে দেখা হয় বেশ হবে…৷’
বলেই দৌড়ে চলে গেল ছাদ থেকে৷
মউলি অবাক বিষণ্ণ চোখে অচ্যুতের চলে যাওয়া দেখল৷ ও যেন কতকিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু বলতে পারল না৷
সত্যবানস্যারের গুড বয় কথাটা মউলিকে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল৷ তাই আশপাশের অন্ধকার, জঙ্গলের গন্ধ, সব কিছু কেমন ভুলে গিয়েছিল অচ্যুত৷ ভুলে গিয়ে মউলির কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল৷
কিন্তু ঝিঁঝিপোকার কান্না, ব্যাঙের ডাক, জোনাকির আলো, সত্যবানস্যারের ঠান্ডা নিশ্বাস, অচ্যুতকে আচমকা ঝাঁপিয়ে ঘিরে ধরল৷
স্যারের হাত ধরে ও মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল৷ বড়-বড় ঘাস কিংবা জল-কাদা টের পেল কি পেল না৷
বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ও হেডস্যারের কালো ছায়াটা ঠাহর করতে পারল৷
ওকে দেখেই হেডস্যার দু-হাত শূন্যে তুলে নাচের ভঙ্গি করলেন৷
সত্যবানস্যার অচ্যুতের ঠিক পিছনে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন৷ তারপর হিসহিস করে বললেন, ‘আজ আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক তৈরি হবে…তেষ্টার সম্পর্ক…রক্তের সম্পর্ক৷ তারপর…তারপর তুই মুক্তি পাবি৷’
অন্ধকারে হেডস্যারের ধূসর ছায়া খিলখিল করে হাসল৷
আকাশের তুলো-তুলো মেঘ জায়গায়-জায়গায় ছিঁড়ে গেছে৷ কয়েকটা দলছুট তারা চোখে পড়ছে৷ চোখে পড়ছে পালাই-পালাই চাঁদের একটা টুকরো৷
প্রবল বাতাসের ঝাপটা হঠাৎই ওদের ঘিরে পাক খেয়ে গেল৷
অচ্যুতের চুল উড়তে লাগল৷ মায়ের কথা মনে পড়ল৷ বাপির কথা মনে পড়ল৷ মউলির কথাও৷
আর ঠিক তখনই দুটো রক্তপিশাচ অচ্যুতকে ঘিরে নাচ শুরু করল৷
অন্ধকারের ওদের সিলুয়েট ছায়ামূর্তিগুলো কীরকম লম্বাটে দেখাচ্ছে৷ লিকলিকে হাতগুলো আকাশের দিকে তুলে আঙুলে নানারকম মুদ্রা ফুটিয়ে ওরা পাগলের মতো নাচছে…নাচছে৷
অচ্যুত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ‘মা…মা…মাগো…৷’
ওর বুকের ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল৷ ও উবু হয়ে ভিজে মাঠের ওপর বসে পড়ল৷
সাপ-খেলানো সুরে হেডস্যার তখন ফিসফিস করে বলছিলেন, ‘এ আমাদের বলির নাচ৷ তোর জীবন আমাদের তেষ্টা মেটাবে৷ আমাদের পরমায়ু বাড়িয়ে দেবে…৷’
অচ্যুত জড়ভরতের মতো ফ্যালফ্যাল করে ওঁদের নাচ দেখছিল৷ আর শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল৷
একটু পরে ওঁরা অন্ধকার মাঠের ওপরে শুয়ে পড়লেন৷ সাপের মতো বুকে হেঁটে অচ্যুতকে ঘিরে পাক খেতে লাগলেন৷
একসময় হেডস্যার গলা উঁচু করে অচ্যুতের ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন৷ অচ্যুত সাপের মুখে-পড়া ব্যাঙের মতো নিশ্চল হয়ে গেল৷
ঠিক তখনই ধানকলের মাঠের সীমানায় ফুলঝুরির মতো একটা সাদা আলো ফিনকি দিয়ে জ্বলে উঠল৷
প্রথমে একটা৷
তারপর আর-একটা৷
তারপর একে-একে অসংখ্য৷
সাদা, সবুজ, নীল, লাল—নানান রঙের রংমশাল জ্বলে উঠল মাঠের কিনারায়৷
কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাঠ ঘিরে রংমশালের রঙিন আলোর এক বৃত্ত তৈরি হয়ে গেল৷
শ’য়ে শ’য়ে রংমশাল উদ্দাম ফুর্তিতে জ্বলছে৷ অন্ধকার মাঠে আলোর উৎসব শুরু হয়ে গেল যেন৷
‘দুর্গাপুজো কি এসে গেছে? নাকি কালীপুজো!’ ঝাপসাভাবে ভাবতে চেষ্টা করল অচ্যুত৷
ও চমকে তাকিয়েছিল আলোর দিকে৷ ঝলসানো আলোয় অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে অনেকগুলো মুখ৷ ঝাঁকে-ঝাঁকে ছেলের দল হাজারো রংমশাল জ্বেলে নতুন এক অকালবোধন শুরু করে দিয়েছে৷
সত্যবানস্যার আর হেডস্যারও থমকে গেলেন৷ ওঁরা চটপট সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আলোর রেখার দিকে৷
রংমশালের আলোগুলো এবার তিরবেগে ছুটে আসতে শুরু করল ওঁদের দিকে৷ আলোর বৃত্তটা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট হয়ে আসতে লাগল৷
অচ্যুত ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না৷ চোখ কচলে ও ছোট হয়ে আসা বৃত্তটাকে ভালো করে দেখতে লাগল৷
অসংখ্য ছেলে, তাদের হাতে জ্বলন্ত রংমশাল—চিৎকার করতে-করতে ছুটে আসছে ওদের দিকে৷
একটু পরে চিৎকারটা বুঝে উঠতে পারল অচ্যুত৷ জিহাদ মিছিলের স্লোগানের মতো ওরা গলায় গলা মিলিয়ে বারবার বলছে, ‘রক্তপিশাচ নিপাত যাক! রক্তপিশাচ নিপাত যাক!’
আনন্দে কান্না পেয়ে গেল অচ্যুতের৷ পুজোয় ও তা হলে মউলির মতো আনন্দ করতে পারবে!
ওই তো কুলদীপ! ওই তো সৌরভ! ওই তো বাসব!
সঙ্গে আরও অসংখ্য চেনা-অচেনা মুখ৷
হইহই চিৎকার এতক্ষণে একেবারে কাছে এসে গেছে৷ জায়গাটা আলোয় আলো হয়ে উঠেছে৷ সত্যবানস্যার আর হেডস্যার ফাঁদে পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো ভয়ে এলোমেলো দৌড়চ্ছেন৷
অচ্যুত দৌড়ে গেল কুলদীপের কাছে৷
কুলদীপ রংমশাল একহাতে সামলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল৷ অচ্যুত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ এক অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ ওর বুকের ভিতরে উথলে উঠে ওকে একেবারে ভাসিয়ে দিল৷
আর ঠিক তখনই কয়েকশো জ্বলন্ত রংমশাল ছুটন্ত সত্যবানস্যার আর হেডস্যারকে ছুঁয়ে ফেলল৷
রক্ত-হিম-করা এক ভয়ংকর আর্তনাদ ধানকলের মাঠের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল৷ দপ করে জ্বলে উঠল দুই পিশাচের অভিশপ্ত শরীর৷ ওদের শরীরের ধুনি থেকে কালো ধোঁয়ার গাঢ় কুণ্ডলী পাক খেয়ে উঠতে লাগল আকাশের দিকে৷
সবাই মুখ তুলে সেই ধোঁয়ার দিকে দেখতে লাগল৷
রংমশালের আগুন নিভলে অন্ধকারে কয়েকটা টর্চ এদিক-ওদিক জ্বলে উঠল৷ দেখা গেল দুই পিশাচের তালগোল পাকানো মৃতদেহ জড়াজড়ি করে পড়ে আছে৷ দুটো সাপবাজির ট্যাবলেট পাশাপাশি পোড়ানোর পর যেরকম দশা হয় অনেকটা সেইরকম৷
আকাশে ভেসে যাওয়া কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে তখনও আর্তকান্না শোনা যাচ্ছে৷
সৌরভ, প্রতীক আর বাসব অচ্যুতকে একেবারে জাপটে ধরল৷
অচ্যুতের চোখের জল বাঁধ মানছিল না৷ কাঁদতে-কাঁদতেই ও বলল, ‘তোরা আমাকে এত ভালোবাসিস!’
কুলদীপ হাতের মাসল ফুলিয়ে বলল, ‘এসবের জন্যে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে জানিস! রাজীবের মাম্মি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন রংমশাল কেনার জন্যে৷ পাড়ার দোকানে পাওয়া যায়নি—তাই বাজির আড়তে যেতে হয়েছে৷’
আবেগে অচ্যুত কোনও কথা বলতে পারছিল না৷ ও কুলদীপের গালে একটা চুমু খেল৷
এমন সময় কে একজন ওদের কাছে এসে দাঁড়াল৷ বলল, ‘বলেছিলাম না, বীতিহোত্র!’
ওরা পাঁচজন অন্ধকারেই হেসে উঠল৷ তারপর কী ভেবে অমিয়স্যারকে ঢিপ-ঢিপ করে প্রণাম করে ফেলল৷
অমিয়স্যার অচ্যুতকে লক্ষ করে বললেন, ‘তুই শুধু যে ভালো ছেলে তা নয়—অসাধ্বসও বটে!’
বাসব জিগ্যেস করল, ‘অসাধ্বস মানে কী, স্যার?’
অমিয়স্যার হেসে বললেন, ‘এও জানিস না! অসাধ্বস মানে হল সাহসী, শঙ্কাহীন৷’
অচ্যুত চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ওর শরীরটা সামান্য কেঁপে-কেঁপে উঠছিল৷ অমিয়স্যারের ‘ভালো ছেলে’ কথাটা থেকে ওর ‘গুড বয়’ মনে পড়ল৷ তারপর ‘গুড বয়’ থেকে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’৷ আর সবশেষে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ থেকে একজনের কথা মনে পড়ে গেল৷
ওকে এবার সব খুলে বলতে হবে৷
.
৷৷দশ৷৷
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷
এখন আমাকে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হবে৷
আগেই তো বলেছি, আত্মা যদি অমর অবিনশ্বর হয় তা হলে আমার অমর হতে অসুবিধে কী! গীতার সাংখ্যযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷’ অর্থাৎ, কোনও শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করিতে পারে না৷ অগ্নি ইহাকে দহন করিতে পারে না৷
তা হলে আমাকে অগ্নি দহন করবে কেমন করে!
তাই আকাশে, বাতাসে, ধুলোয় মিশে আবার শুরু হোক আমার পথ চলা৷
চলতে-চলতে আবার আমাকে খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়৷ নিতে হবে আবার কোনও নতুন পরিচয়৷ তারপর আবার বিশ্রাম আর আরাম৷
নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, শুরু হবে আমার নতুন জীবন৷
আঃ, ভাবতেই কী তৃপ্তি!
সমাপ্ত
তুমি পিশাচ
৷৷এক৷৷
আমার চলার কোনও শেষ নেই৷ আমি সত্যিকারের পথিক—পথই যার জীবন৷ আমার চলার পথের যেমন কোনও শেষ নেই, তেমন আমারও কোনও শেষ নেই৷ এমনই আমার জীবন৷
মানুষের সঙ্গে আমার মিল অনেক—কিন্তু আবার গরমিলও প্রচুর৷ আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি৷ তাই বুঝতে পারি মানুষ কেমন হয়৷ অর্থাৎ, মানুষের মন আর চেহারা দুই-ই দেখতে পাই৷ কিন্তু আমাকে কেউ দেখতে পায় না—শুধু অনুভব করতে পারে৷
মানুষ আমার খুব পছন্দের, খুব প্রিয়৷ তাই মানুষ দেখলে আমি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ি৷ এক অদ্ভুত টানে দু, তিন, কিংবা চার টুকরো হয়ে নানান মানুষের ভেতরে আশ্রয় নিই৷ তাই আমার বাসা হল মানুষ—মানুষই আমার ঠিকানা৷ কারও মধ্যে আমি পঞ্চাশ, ষাট কি একশো বছর ধরে থাকি৷ আবার কারও শরীরে থাকি পাঁচ, সাত কি দশ দিন৷ কতদিন কোথায় থাকব সেটা নির্ভর করে আমার মরজির ওপরে৷
যে-যে মানুষের মধ্যে আমি আশ্রয় নিই তাদের মধ্যে অনেকগুলো নতুন-নতুন গুণ দেখা যায়৷ কিন্তু সেই গুণগুলো হয়তো মানুষের চোখে দোষ৷ তাই আমি খুব চেষ্টা করি গুণগুলো আড়াল করে রাখতে৷
কী আশ্চর্য আমার জীবন! মানুষের এত কাছাকাছি আমি বাস করি অথচ তা সত্ত্বেও মানুষ আমাকে ভাবে অমানুষ৷ আমাকে কিছুতেই আপন করে নিতে পারে না৷
আমি জানি, এক ঠান্ডা গভীর অন্ধকার থেকে আমার উৎপত্তি৷ তারপর পথ চলা৷ শুধু পথ চলা৷ আমার বিনাশ বলে কিছু নেই৷ মানুষ আমাকে কখনও-কখনও ধ্বংস করে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই সাময়িক৷ তখন আমি ফিরে যাই সেই ঠান্ডা অন্ধকার গহ্বরে৷ শীতঘুমে সময় কাটিয়ে দিই৷ তারপর…৷
তারপর? তারপর যখন আবার খিদে টের পাই, তেষ্টা টের পাই, মানুষের টান টের পাই—তখন আমি জেগে উঠি৷ শীতঘুম ছেড়ে বেরিয়ে আসি বাইরের আলোর জগতে, লোকালয়ে৷ যেমন এখন৷
ওই তো চোখে পড়ছে একটা বিশাল পাঁচিল ঘেরা এলাকা৷ তার ভেতরে, অনেকটা দূরে, একটা বাড়ি৷ বাড়ি তো নয়, যেন প্রাসাদ৷ না, শুধু প্রাসাদও নয়—তার সঙ্গে রয়েছে ছোট-ছোট কয়েকটা বাড়ি আর ঘিরে থাকা বাগান৷ বাগানে কত বড়-বড় গাছ৷ গাছে কত পাতা৷ সেই পাতার ছায়ায় গাছের নীচটা দিনের আলোতেও অন্ধকার-অন্ধকার দেখাচ্ছে৷ আর সেই অন্ধকারে মাথাচাড়া দিয়েছে অজস্র আগাছা৷
প্রকাণ্ড এলাকাটা রং-চটে-যাওয়া পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ তারই এক জায়গায় সিং-দরজা৷ সব কিছু দেখে মনে হয় রাজা-রাজড়াদের ফেলে যাওয়া বাগান আর প্রাসাদ৷ এককালে তাদের হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া৷ আজ সবই পুরোনো স্মৃতি৷ শুধু রাজবাড়িটা অতীতের সাক্ষী হয়ে চুপচাপ মনের দুঃখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আর তাকে ঘিরে বিষণ্ণ গাছগুলো৷
কিন্তু তাই কী? এখানে এখন কেউ থাকে না তা তো নয়!
কারণ, আমি মানুষের ঘ্রাণ পাচ্ছি৷ একটা-আধটা নয়, অনেক মানুষের৷
শুধু তাই নয়, এত দূর থেকেও আমি কত মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি ছেলেদের গলা, মেয়েদের গলা৷
উঁহু, বাড়িটা পুরোনো জীর্ণ হলেও এখানে অনেক মানুষ থাকে৷ আমাকে ওরা কোন অদৃশ্য টানে টানছে—কাছে টানছে৷
আমি আকাশের দিকে তাকালাম৷
আকাশে মেঘ জড়ো হচ্ছিল সকাল থেকেই৷ তার সঙ্গে দম আটকানো গুমোট৷ বৃষ্টি যে হবে তার গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম৷ এও বুঝতে পারছিলাম, মেঘ আরও ঘন হবে, আরও কালো হবে৷ এখন দেখলাম আকাশটা একেবারে ছাই রঙের হয়ে গেছে৷ আর সেই রং-টা ক্রমশ কালোর দিকে ঢলে পড়ছে৷
বৃষ্টির জল আমার ভালো লাগে না৷ বৃষ্টির জল ওপর থেকে আসে৷ প্রাকৃতিক পবিত্র জল৷ ওই জল গায়ে লাগলে আমরা—মানে, আমি আর আমার মতো যারা—নিস্তেজ হয়ে পড়ি৷ তাই ঠিক করলাম, আপাতত এই বাড়িটায় আমি আশ্রয় নিই৷ অনেক মানুষে ভরা এই আস্তানাটা আমার মন্দ লাগবে না৷
সেদিকে এগোতে গিয়েই সিং-দরজার মাথায় বসানো হোর্ডিং-টা আমার চোখে পড়ল৷ তাতে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে :
রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল
ও, এটা তা হলে স্কুল!
ওঃ, ক’শো বছর আগে যে আমি স্কুলে পড়তে গিয়েছিলাম তা মনে নেই৷ কিন্তু যুগে-যুগে আমি মানুষের কাছ থেকে শিখেছি৷ যখনই আমি কোনও মানুষের শরীর আর মন দখল করেছি তখনই তার সব অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে৷ আমি বহু শতকের প্রাচীন হলেও সবসময় নবীনের কাছাকাছি থেকে শিখেছি৷ তাই প্রাচীন হলেও আমি সবসময় আধুনিক৷
এখনও চিনতে পারোনি আমাকে?
আমি একজন পিশাচ—যার মধ্যে রয়েছে অতি প্রাচীন এক অমানুষ প্রেতাত্মা৷
আমি একা৷ তবে ইচ্ছে হলেই অনেক হতে পারি—অ্যামিবার মতো৷
আর যদি আমি তোমার ওপরে ভর করি, তোমার মধ্যে বাসা বাঁধি, তা হলে তখন তুমি পিশাচ৷ হ্যাঁ, হ্যাঁ—তুমি৷
আকাশ থেকে বৃষ্টির দু-একটা ফোঁটা পড়ল৷
নাঃ, আর দেরি নয়৷ আমি সিং-দরজার দিকে এগোলাম৷ তালাবন্ধ দরজার জং ধরা লোহার রডের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ দারোয়ানরা কেউ আমাকে দেখতে পেল না—কারণ, আগেই বলেছি, আমাকে দেখা যায় না—শুধু টের পাওয়া যায়৷
সুন্দর পিচবাঁধানো রাস্তা আর ঘাসজমির ওপর দিয়ে প্রাচীন বাড়িটার দিকে যাওয়ার সময় আমি হঠাৎই একটা চেনা গন্ধ পেলাম৷ স্কুলবাড়ির দিক থেকেই আসছে গন্ধটা৷
চমকে উঠলাম আমি৷ এ তো আমার মতোই গন্ধ! আমার একজন বন্ধু তা হলে রয়েছে ওই স্কুলবাড়িতে! আমার আগেই আমার মতো কেউ এসে আশ্রয় নিয়েছে এখানে! অথবা আস্তানা গেড়েছে ওই বাড়ির মানুষজনের ভেতরে! আনন্দ আর খুশিতে মনটা নেচে উঠল৷
বৃষ্টির ফোঁটা হঠাৎই জোরে ঝরতে লাগল৷
আর আমিও দেরি না করে ঢুকে পড়লাম স্কুলবাড়ির ভেতরে৷
.
৷৷দুই৷৷
ইতিহাসের ক্লাস এমনভাবে চলছিল যেন টিভির নিউজ চ্যানেলে কোনও রোবট পরপর দুঃখের খবর পড়ে চলেছে৷
রনিতা ম্যাডাম এভাবেই ক্লাস নেন বরাবর৷ আর সেই জন্যই পড়ার দিকে ইলিনার মন ছিল না৷ ও অনুষ্কার কথা ভাবছিল৷ মাত্র সাতদিন হল অনুষ্কা ওদের ক্লাসে ভরতি হয়েছে৷
ইলিনার ডেস্কের ওপরে ইতিহাস বইয়ের পাতা খোলা ছিল৷ তার নীচে একটা রাফ খাতা৷ সেই খাতার শেষ পাতায় ইলিনা বারবার নিজের নাম লিখছিল৷ একবার ইংরেজিতে, আর-একবার বাংলায়৷ বেশ সুন্দর ডিজাইন করে অক্ষরগুলো তৈরি করছিল ও৷ সেগুলোর দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় ওর অলঙ্করণের হাত বেশ ভালো৷
ইলিনার খুব শখ ও ট্যাটু আর্টিস্ট হবে৷ এ পর্যন্ত ও প্রায় চল্লিশটা ট্যাটুর ডিজাইন এঁকেছে—লাল আর নীল কালি দিয়ে৷ সেগুলো একটা বাঁধানো ড্রইং খাতায় আঁকা আছে৷ সেটার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর নিত্য-নতুন নকশার আইডিয়া মাথায় আসে৷
মাঝে-মাঝে ও বন্ধুদের হাতে বা পায়ে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে ছোট-ছোট ট্যাটু এঁকে দেয়৷ অবশ্য বন্ধুদের পারমিশান নিয়ে তবেই৷ একবার গীতাঞ্জলির কনুইয়ের ওপরদিকটায় একটা বাজপাখির ডিজাইন এঁকে দিয়েছিল৷ সেটা রনিতা ম্যাডামের চোখে পড়ে গিয়েছিল৷ গীতাঞ্জলিকে তিনি বেশ বকুনি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু গীতাঞ্জলি ইলিনার নাম বলেনি৷ বরং ট্যাটু আঁকার দায়টা ওর এক কাল্পনিক ভাইয়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল৷
ইলিনার নামের অক্ষরের ডিজাইনগুলো অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো দেখাচ্ছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা সেগুলো বেশ খুঁটিয়ে বিচার করছিল৷ হঠাৎই ক্লাসরুমের খোলা জানলায় একটা শালিখ এসে বসায় ওর সেদিকে চোখ গেল৷
ক্লাসরুমের বাইরের দিকের দেওয়ালে দুটো বড়-বড় জানলা৷ তাতে ঝিলমিল লাগানো বিশাল পাল্লা৷ পাল্লার ওপরে ফুটদুয়েক চওড়া ঝিলমিল বসানো কাঠের পাটি৷ বহু পুরোনো আমলের রাজা-রাজড়াদের বাড়িতে যেমন থাকত৷ রাজা চন্দ্রভানুও বোধহয় সেরকম কেউকেটা কোনও রাজা কিংবা মহারাজা ছিলেন৷ তাঁর সেই রাজপ্রাসাদ প্রায় একশো বছর আগে স্কুল হয়ে গেছে৷
শালিখ দেখতে গিয়ে ইলিনার চোখ গেল অনুষ্কার দিকে৷ মনে হল, ইলিনার মতো ওরও ইতিহাসে মন নেই, আর ও-ও যেন আনমনাভাবে খাতায় আঁকিবুকি কেটে চলেছে৷
অনুষ্কাকে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হয় ইলিনার৷ মাত্র সাতদিন আগে মেয়েটা ক্লাস টেন-এ ওদের সেকশানে এসে ভরতি হয়েছে৷ ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন৷ ঝাড়খণ্ড থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় এসে পড়েছেন৷ তাই অনুষ্কা এই স্কুলে ভরতি হতে পেরেছে৷ নইলে ইলিনাদের স্কুলে ক্লাস টেন-এ কাউকে ভরতি নেওয়া হয় না৷
অনুষ্কাকে দেখতে খুব সুন্দর৷ এত সুন্দর যে, অন্য মেয়েরা যখন-তখন ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ ইলিনার খুব বিশ্বাস, কোনও ফিল্ম ডিরেক্টর ওকে দেখামাত্র সিনেমা কি টিভি-তে চান্স দিয়ে দেবে৷
রনিতা ম্যাডাম আনমনা অনুষ্কাকে খেয়াল করেছিলেন৷ তাই ওকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য ওর দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘অনুষ্কা, তুমি বলো..৷’
অনুষ্কা শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল৷ নিষ্পাপ ফুটফুটে মুখে তাকাল ম্যাডামের দিকে৷
রনিতা ম্যাডাম ক্লাস নাইন-এর কয়েকটা চ্যাপ্টার রিভাইজ করাচ্ছিলেন৷ তাই সম্রাট অশোকের ধর্মের বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন৷
অনুষ্কাকে রনিতা ম্যাডাম জিগ্যেস করলেন, ‘সম্রাট অশোক যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম তফাত কোথায় ছিল?’
রনিতা ম্যাডামের রোগা চেহারা৷ চশমার পিছনে চোখ দুটো বেশ রাগি৷ কপালে ভাঁজ৷ সবসময় ছাত্রীদের হেনস্থা করেন, শাস্তি দেওয়ার ফিকির খোঁজেন৷
ইলিনা বুঝল, আজ অনুষ্কার রেহাই নেই৷ কপালে চূড়ান্ত বকুনি আছে৷ তারপর, যদি কপাল আরও খারাপ হয়, তা হলে ক্লাস সিক্সের রুমের সামনে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷
ইলিনার বুকের ভেতরটা অকারণেই ঢিপঢিপ করতে লাগল৷ ও স্থির চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ অপেক্ষা করতে লাগল৷
কিন্তু কী আশ্চর্য!
অনুষ্কা মিষ্টি গলায় ধীরে ধীরে উত্তর দিল, ‘ম্যাডাম, বৌদ্ধধর্মের তুলনায় অশোকের প্রচার করা ধর্ম অনেক বেশি উদার আর মানবতাবাদী ছিল৷ অশোক তাঁর ধর্মে ব্যক্তিগত জীবন আর সমাজজীবনকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন৷ সেই কারণেই তিনি দান, দয়া প্রভৃতি বারোটি গুণের অনুশীলন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তাঁর প্রচলিত ধর্মে নানা ধর্মের সার কথাগুলো জায়গা পেয়েছিল…৷’
রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন৷ শিকার হাতছাড়া হওয়ার দুঃখের চেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটাই বেশি করে ফুটে উঠল ওঁর মুখে৷ তিনি স্পষ্ট দেখেছেন, মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে খাতায় কী যেন করছিল৷ তা হলে কী করে ওঁর এইমাত্র পড়ানো লাইনগুলো হুবহু বলে দিল!
অনুষ্কা কি ওঁর বলা কথাগুলো খাতায় টুকছিল? তারপর প্রশ্নের উত্তরে সেই লেখাগুলোই রিডিং পড়ে দিল?
কিন্তু উত্তর দেওয়ার সময় মেয়েটা তো খাতার দিকে তাকায়নি!
মরিয়া হয়ে ডায়াস থেকে নেমে এলেন রনিতা ম্যাডাম৷ মেয়েটার খাতাটা একবার দেখা দরকার৷
‘দেখি, তোমার খাতাটা দেখি—৷’ চটপটে পায়ে জানলার পাশ দিয়ে হেঁটে অনুষ্কার কাছে চলে এলেন৷
অনুষ্কা কোনও কথা না বলে ডেস্কের ওপরে রাখা খোলা খাতাটা দিদিমণির দিকে এগিয়ে দিল৷
রনিতা ম্যাডাম দেখলেন৷ পাতা দুটোয় কিছু লেখা নেই৷ শুধু ডানদিকের পাতার নীচের কোনার দিকে কয়েকটা হিজিবিজি দাগ৷
খাতাটা ওকে ফেরত দিয়ে সামান্য ধমকের সুরে ‘বোসো’ বলে ডায়াসের দিকে ফিরে গেলেন৷ ওঁর ফিরে যাওয়ার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা ‘হেরে যাওয়া’ ভাব ছিল৷
ইলিনার খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ ওর মনে হল অনুষ্কা যেন রনিতা ম্যাডামকে পালটা একটা ‘শিক্ষা’ দিল৷ অনুষ্কাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করল ওর৷ ওর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করতেও ইচ্ছে করল৷
কিন্তু সেটা বোধহয় সম্ভব নয়৷ কারণ, প্রথম দিন থেকেই ইলিনা লক্ষ করেছে, অনুষ্কা ভীষণ একা-একা আর চুপচাপ থাকে—কারও সঙ্গে মিশতে চায় না৷ ইলিনা দু-একবার আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কথাবার্তা তেমন এগোয়নি৷
রনিতা ম্যাডাম মঞ্চে উঠে আবার পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ওঁর যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে কেমন যেন চিড় ধরে গিয়েছিল৷ তাই পড়ানোর তাল আর লয় বারবার গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল৷
ইলিনা ভাবছিল, পিরিয়ডটা শেষ হলে বাঁচি৷ কারণ, তারপরই টিফিন৷ তখন অন্তত আধঘণ্টা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে৷
আজ ওর পড়াশোনার মুড নেই৷ শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করছে আর গান শুনতে ইচ্ছে করছে৷ কে জানে কেন—হয়তো আকাশটা মেঘলা বলেই৷ আর তার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মনখারাপের ইন্ধন জোগাচ্ছে৷
হঠাৎই টিফিনের ঘণ্টা পড়ল৷ টিফিনের ঘণ্টার একটা বিশেষ ঢং আছে৷ ছুটির ঘণ্টারও তাই৷ ঠিক ফুটবল খেলায় হাফটাইম আর গোলের বাঁশি বাজানোয় যেমন তফাত থাকে৷
ওদের স্কুলের ঘণ্টাটা দারুণ৷ একতলার বারান্দায় সিলিং থেকে ঝোলানো বড় পিতলের ঘণ্টা—ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো৷ বৃদ্ধ বলাইদা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে সেই ঘণ্টাটা টাইমে-টাইমে বাজিয়ে দেয়৷
টিফিন হতেই গোটা ক্লাসটা স্বাধীন এবং এলোমেলো হয়ে গেল৷ কেউ-কেউ জানলার কাছে চলে গেল৷ আকাশ, বৃষ্টি আর গাছপালা দেখতে লাগল৷ বেশ কয়েকজন মেয়ে স্কুলব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বের করে টিফিন খেতে বসল৷
আজ বৃষ্টির মধ্যে অন্য দিনের মতো একতলার উঠোনে কিংবা বাগানে গিয়ে ছুটোছুটি করে খেলার উপায় নেই৷ তাই অনেকে ক্লাসরুমের লাগোয়া করিডরে গিয়ে হইহুল্লোড় করতে লাগল৷
ইলিনা টিফিনবক্সটা ব্যাগ থেকে বের করে নিল৷ তারপর তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
অনুষ্কা একটা খাতা খুলে তাতে মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছিল৷ ওর দু-পাশে পারমিতা আর সুচন্দ্রা বসে৷ এখন ওরা কেউ সিটে নেই৷ বোধহয় টিফিন খেতে বাইরের করিডরে কোথাও গেছে৷
ইলিনার কেমন একটা জেদ চেপে গেল৷ আজ ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করবেই৷ গায়ে পড়ে হলেও ওর সঙ্গে আজ আলাপ করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷
তাই ইচ্ছে আর জেদ সঙ্গী করে ও সরাসরি অনুষ্কার কাছে চলে গেল৷ ওর ডানপাশের খালি চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘কী করছ?’
অনুষ্কা চোখ তুলে তাকাল ইলিনার দিকে৷
কী সুন্দর গভীর দুটো চোখ! টানা-টানা, ঘন চোখের পাতার সীমানায় ঘেরা৷ হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কাজল পরে এসেছে৷ ওর চোখের মণির ভেতরে চক্রের মতো অনেকগুলো বৃত্ত৷ সেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় বৃত্তগুলো কোন পাতালে চলে গেছে৷
‘একা-একা বসে কী করছ?’ ইলিনা আবার জিগ্যেস করল৷
‘কিছু না৷’ নীচু গলায় অনুষ্কা বলল৷
ওর খাতার দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ সেখানে অদ্ভুত একটা ছবি বারবার আঁকা—ছোট-বড় নানান মাপে৷ একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷
দেখে কোনও একটা প্রতীকচিহ্ন গোছের ছবি বলে মনে হয়৷ অথবা কোনও ট্যাটুর নকশা৷
‘এটা কীসের ছবি?’ ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানতে চাইল৷
‘ও কিছু না…৷’
‘দারুণ হয়েছে কিন্তু৷ অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো৷ তুমি তো জানো আমি ট্যাটুর ডিজাইন আঁকি৷ খাতাটা পরে আমাকে দিয়ো—আমি ডিজাইনটা তুলে নেব৷’
কথাটা শুনেই শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল অনুষ্কা৷ কেমন একটা ভয়ের চোখে তাকাল ইলিনার দিকে : ‘না, না—এটা বাজে ছবি৷ এটার কোনও মানে হয় না৷ ওয়ার্থলেস—৷’
এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্কা ছবিগুলোর ওপরে এলোমেলো কাটা-কুটি দাগ আঁকতে লাগল৷ ছবিগুলো নিপুণভাবে নষ্ট করতে লাগল৷
‘কী করছ! কী করছ! সুন্দর ছবিগুলো নষ্ট করছ কেন?’
কিন্তু অনুষ্কা ইলিনার কথায় মোটেই কান দিল না৷ কাটাকুটি দাগ কাটতে-কাটতেই বিড়বিড় করে বলল, ‘সুন্দর নয়, বাজে ছবি…বাজে ছবি…৷’
ইলিনা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ ওর আলাপের শুরুটা এভাবে ধাক্কা খাবে ও ভাবেনি৷
প্রসঙ্গ পালটাতে ও টিফিনবক্স খুলে ফেলল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ফ্রেঞ্চ টোস্টের জিভে-জল-আনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল৷ মা-মণি টিফিনবক্সে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে৷ একটা খোপে চার পিস ফ্রেঞ্চ টোস্ট৷ তার পাশের খোপে একটা মিষ্টি৷ আর একটা ছোট পলিপ্যাকে টমেটো সস৷
‘এসো, আমার টিফিন শেয়ার করো…৷’
‘টিফিন?’ খানিক যেন দিশেহারা হয়ে ইলিনার দিকে তাকাল অনুষ্কা : ‘টিফিন তো আমার খাওয়া হয়ে গেছে…৷’
ইলিনা বেশ অবাক হয়ে গেল৷ স্কুল বসেছে সকাল এগারোটায়৷ তারপর, চারটে পিরিয়ড শেষ হলে এই টিফিন ব্রেক৷ সুতরাং টিফিন ব্রেকের আগে টিফিন খাওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷ তাহলে অনুষ্কা এসব কী বলছে? ওর টিফিন খাওয়া হয়ে গেছে!
‘কখন টিফিন খেলে তুমি! আমাকে এত বোকা পেয়েছ!’ বন্ধুত্বে ভরা মজার সুরে বলল ইলিনা, ‘নাও, ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাও! আমার মা-মণি ভেজে দিয়েছে—৷’
‘না, মানে…আমার ঠিক খিদে নেই৷’ নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ, তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না…৷’
অনুষ্কার মিষ্টি মুখে কাতর এক অনুনয় ফুটে উঠেছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা আর কিছু বলতে পারল না৷ তবে একইসঙ্গে ওর মনে পড়ল এই ছ’দিনে অনুষ্কাকে ও কোনওদিন টিফিন খেতে দেখেনি৷ অর্থাৎ, অনুষ্কা টিফিন খাচ্ছে এমন দৃশ্য ওর চোখে পড়েনি৷
মুহূর্তের মধ্যে খটকাটা ডিঙিয়ে ও ফ্রেঞ্চ টোস্ট টমেটো সস-এ ছুঁইয়ে কামড় বসাল৷ খেতে-খেতে প্রসঙ্গ পালটে চলে গেল রনিতা ম্যাডামের দিকে৷
‘রনিতা ম্যাডামকে তুমি আজ দারুণ টাইট দিয়েছ৷ আমি ভাবতেই পারিনি তুমি ওই সাডেন অ্যাটাকের মুখে ওরকম ঠিক-ঠিক আনসার দিতে পারবে…৷’
‘উঁ৷’ বলে ছোট্ট একটা শব্দ করল অনুষ্কা৷
‘কী করে পারলে বলো তো!’ ইলিনা বলেই চলল, ‘ফ্যানট্যাস্টিক! তুমি যে ক্লাসে এত মনোযোগ দিয়ে শোনো সেটা তোমাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না…৷’
অনুষ্কা শান্ত চোখে তাকাল ইলিনার দিকে৷ বলল, ‘মনোযোগ দিতে হয় না৷ আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’
ইলিনা ফ্রেঞ্চ টোস্টে কামড় দিতে গিয়ে থমকে গেল৷
‘আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে’ মানে?
সে-কথাই ও জিগ্যেস করল, ‘ ‘‘আমাদের’’ বলছ কেন? আমাদের মানে?’
চমকে উঠল অনুষ্কা৷ তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘আমাদের মানে আমার৷ আমার এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’ কথা শেষ করে হাসল৷
ইলিনা অবাক চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ একে তো অপরূপ সুন্দরী, তার ওপর এত গুণ! বাব্বাঃ! এমনিতেই সব মনে থাকে!
ভগবানের ওপরে রাগ হল ইলিনার৷ একজনকে উজাড় করে সবকিছু দেওয়ার কী দরকার ছিল? মনে থাকার ব্যাপারটা তিনি যদি কাইন্ডলি ইলিনাকে দিতেন তা হলে পরীক্ষার রেজাল্টটা অনেক ভালো হতে পারত৷ বাপি আর মা-মণির কাছ থেকে রেগুলার বকাবকি শুনতে হত না৷
জানলার ফ্রেমে বাঁধানো আকাশটা আরও কালো হয়ে গিয়েছিল৷ বিদ্যুৎ সেই কালোর ওপরে মাঝে-মাঝেই সাদা তরোয়াল ঘোরাচ্ছিল৷
ইলিনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখবে, ছুটির সময় ঠিক বৃষ্টি হবে৷ তুমি ছাতা এনেছ তো? আমি এনেছি…৷’
অনুষ্কা হাসল : ‘হ্যাঁ, এনেছি৷ ছাতা ছাড়া আমি চলতেই পারি না৷ তা ছাড়া বৃষ্টি আমার একদম ভালো লাগে না…৷’
‘কেন?’
বৃষ্টি পড়ছিল—তবে তেমন জোরে নয়৷ সেদিকে অপছন্দের চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ বলল, ‘পরিবেশবিদরা বলেন, বৃষ্টির জলে অ্যাসিড থাকে…৷’
‘যাঃ, সে তো রেয়ার! তোমার এটা ভুল ধারণা—৷’
‘ভুল ধারণা হোক আর যা-ই হোক, বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’
মেঘের গর্জন শোনা গেল আকাশে৷
.
৷৷তিন৷৷
স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান আর বেশি দূরে নেই—মাত্র দু-মাস বাকি৷ নাচ, গান, আবৃত্তি আর নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে৷ স্কুলের যে-কোনও কালচারাল প্রোগ্রামে শম্পা ম্যাডাম আর কাকলি ম্যাডাম সবসময় দায়িত্ব নেন৷
শম্পা ম্যাডাম বেশ লম্বা, খুব সুন্দর নাচতে পারেন৷ আর সবসময় মুখে হাসি৷
কাকলি ম্যাডাম মাথায় খাটো৷ মোটাসোটা৷ মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন ফাটাফাটি৷ কিন্তু ওঁর ভীষণ ভূতের ভয়৷
ইলিনাদের কালচারাল প্রোগ্রামের রিহার্সাল হয় ফেস্টিভ্যাল হলে৷ হলটা বিশাল বড়৷ ওলটানো ‘ভি’ অক্ষরের মতো টিনের চালে ঢাকা৷ অনেক সময় ছোটখাটো প্রোগ্রাম হলে এই হলঘরটাতেই সেরে নেওয়া হয়৷ কিন্তু স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান মানে ঘ্যাম ব্যাপার৷ তখন খেলার মাঠে প্রকাণ্ড প্যান্ডেল বাঁধা হয়৷
গত বছর ইলিনারা ফেস্টিভ্যাল হলে সন্ধেবেলা গানের রিহার্সাল দিচ্ছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ওদের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র গানগুলো তোলাচ্ছিলেন৷ তখন পাশের বাস্কেটবল গ্রাউন্ড থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে এসেছিল৷
স্কুলের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডটা বড় মাপের, কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো৷ তার চারপাশটা লোহার জালের উঁচু রেলিং-এ ঘেরা৷ যখন খেলা-টেলা থাকে না তখন গ্রাউন্ডে ঢোকার লোহার গেটটায় তালা দেওয়া থাকে৷ সেদিনও তাই ছিল৷ তবুও সেখান থেকে ভেসে আসছিল খটখট-খটখট শব্দ৷ যেন অনেকগুলো টগবগে ঘোড়া বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিটের মেঝেতে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে৷
এরপর ওদের গানের রিহার্সাল ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল৷
ইলিনা স্কুলের কাজের মাসি আশাদির কাছে শুনেছে, এই স্কুলটা নাকি সাহেবি আমলে সৈন্যদের ছাউনি ছিল৷ স্কুলের বিশাল এলাকার নানান সব বিল্ডিং-এ সৈন্যরা থাকত৷ আর মেইন স্কুল বিল্ডিংটা ছিল হেস্টিংস সাহেবের কোয়ার্টার৷ একসময় হেস্টিংস রাজা চন্দ্রভানুকে এই বিশাল সম্পত্তি নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেন৷
এই স্কুল ক্যাম্পাসে যে সন্ধেবেলা কখনও-সখনও ভূতুড়ে কাণ্ড শুরু হয় এমন দুর্নাম বরাবরই ছিল৷
কখনও মাঠের বড়-বড় গাছপালার ফাঁকে আলোর ফুটকি দেখা যায়৷ সেগুলো খসে পড়া তারার মতো ছুটোছুটি করে বেড়ায়৷
কখনও বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়৷
একবার ক্লাস টেন-এর একটা মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে আর-একটা মেয়েকে নীচে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল—কিন্তু মেয়েটির পড়ার কোনও শব্দ শোনা যায়নি বা একতলায় ছুটে গিয়ে কোনও বডি পড়ে থাকতে দেখা যায়নি৷
কিন্তু এতসব গুজব, রটনা কিংবা দুর্নাম থাকলেও স্কুলটা যে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার কারণ পড়াশোনা৷ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুলের রেজাল্ট বরাবরই ঈর্ষা করার মতো৷
আজ অ্যানুয়াল ফাংশানের গানের রিহার্সাল চলছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে একটা গান তোলাচ্ছিলেন৷ পাশে বসেছিলেন শম্পা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ রবিনা ম্যাডাম খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারেন৷ ইলিনাদের প্রোগ্রামে সঞ্চালনা আর আবৃত্তির ব্যাপারটা তিনিই দেখাশোনা করেন৷ ম্যাডামের বয়কাট চুল আর মুখে কয়েকটা বসন্তের দাগ আছে বলে ওঁকে একটু রুক্ষ দেখায়৷ তবে ওঁর ব্যবহার খুব মিষ্টি আর দারুণ সাহস৷ একবার নাকি হেডমিসট্রেসের ভূতের ভয় তাড়াতে সন্ধে সাতটার সময় টর্চ ছাড়াই অন্ধকারে গোটা ক্যাম্পাসটা চক্কর দিয়ে এসেছিলেন৷
রবিনা ম্যাডাম ইলিনাদের সবসময় বলেন, ‘শোন, ভূত বলে কিছু নেই৷ আসলে তোরাই এক-একটা ভূত৷’
তখন ক্লাসের আর-একটি মেয়ে, সজনী, ফোড়ন কেটে বলে উঠেছিল, ‘ভূত না, ম্যাডাম—পেতনি…৷’ তাতে ক্লাসের সবাই হেসে উঠেছিল৷ আর রবিনা ম্যাডামও হাসি চাপতে পারেননি৷
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল৷ মেঘও ডাকছিল আপন খেয়ালে৷ হলের টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ হচ্ছিল৷ খোলা জানলা দিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিক চোখে পড়ছিল৷
হলের মেঝেতে বিশাল মাপের তিনটে শতরঞ্চি পাতা৷ তার ওপরে সবাই বসেছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে গান তোলাচ্ছিলেন আর ইলিনারা দশ-বারো জন একটু দূরে বসে নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় গল্পগুজব করছিল৷
হঠাৎই ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওদের৷ মনে হল, বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিট বাঁধানো চাতালে যেন অনেকগুলো ঘোড়া এলোমেলোভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে৷
ইলিনা চমকে উঠল৷ ওর মনে পড়ল, প্রায় বছরখানেক এই শব্দটা শোনা যায়নি৷
শব্দটা যে কাকলি ম্যাডামও শুনতে পেয়েছেন সেটা বোঝা গেল৷ কারণ, তিনি গান থামিয়ে দিয়েছেন৷ আশা-আশঙ্কার চোখে রবিনা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ যেন ভূত তাড়াতে রবিনা ম্যাডামই একমাত্র ভরসা৷
ইলিনার পাশে বসে ছিল সমর্পিতা—সম্পি৷ ওর দশাসই মোটাসোটা চেহারা, আর ডাকাবুকো বলে স্কুলে বেশ খ্যাতি আছে৷
সমর্পিতা এমন লম্বা-চওড়া যে, স্কুল-ইউনিফর্ম পরে থাকলেও ওকে ইলিনাদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড় বলে মনে হয়৷ লেখাপড়া ছাড়া অন্য যে-কোনও কাজে ওর উৎসাহ অনেক বেশি৷ স্কুলের সবরকম অ্যাক্টিভিটিতে সম্পি সবার আগে হাজির৷ দিদিমণিদের কোনও ব্যক্তিগত কাজের জন্যেও ওর ডাক পড়ে৷ দিদিরা সবাই ওকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন৷ আর বন্ধুদের মতো ওর বড় মাপের নামটাকে ছোট করে ‘সম্পি’ বলে ডাকেন৷
ইলিনা সম্পির গায়ে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে বলল, ‘কী রে, কীসের আওয়াজ?’
সম্পি বলল হাত নেড়ে, ‘ছাড় তো, ও কিছু নয়৷ ওই লাস্ট ইয়ারে যেমন শোনা গিয়েছিল৷ তারপর খোঁজ নিয়ে দেখবি হয়তো কাকু কিংবা মাসিদের কোয়ার্টারে কোনও ছেলেপিলে মেঝেতে নারকোলের মালা ঠুকে আওয়াজ করে খেলছে…৷’
এটা ঠিকই যে, স্কুলের অনেক কর্মী—বলাইদা কিংবা আশাদির মতো—ক্যাম্পাসের মধ্যেই সংসার নিয়ে কোয়ার্টারে থাকে৷ টিনের চালে ছাওয়া ছোট-ছোট পাকা ঘরগুলোই ওদের কোয়ার্টার৷ ওদের কোনও ছেলেমেয়ে এই ভূতুড়ে কাণ্ড করতেই পারে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ইলিনার তেমন ভরসা হচ্ছিল না৷
যেন ওকে সাহস দিতেই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল৷ তারপর গটগট করে পা ফেলে এগিয়ে গেল খোলা জানলার দিকে৷
কাকলি ম্যাডাম ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সম্পি, কী করছ! যেয়ো না, যেয়ো না…৷’
ম্যাডামের কথা সমর্পিতা শুনল না৷ জানলার কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং ওর পিছু-পিছু রওনা হল ইলিনা, সজনী আর অঙ্গনা৷
ভয় যে ওদের করছিল না তা নয়—কিন্তু কৌতূহলটাও কিছু কম ম্যাথাচাড়া দিচ্ছিল না৷
রবিনা ম্যাডামের ভয়-টয়ের কোনও বালাই নেই৷ তিনিও কখন যেন ইলিনাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ অন্য মেয়েরা তখন শতরঞ্চিতে বসে ভয় আর কৌতূহলের চোখে ইলিনাদের দিকে দেখছে৷
জানলার বাইরে বৃষ্টি আর অন্ধকার৷ আকাশে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক৷ তারই মধ্যে নজর চালিয়ে সম্পি ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ আসছে ঠিকই, কিন্তু সাদা আলোর দু-একটা বিন্দুও চোখে পড়ছে যেন৷ মাপে জোনাকি পোকার মতো, কিন্তু অনেক উজ্জ্বল৷ বিন্দুগুলো চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক ছিটকে বেড়াচ্ছে৷
আকাশে গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকল৷ কিন্তু তাতে ঘোড়ার টগবগ শব্দ চাপা পড়ল না৷
অঙ্গনা জিগ্যেস করল, ‘ওই আলোগুলো কীসের? মনে হচ্ছে কারা যেন মিনি সার্চলাইট জ্বেলেছে৷’
একইসঙ্গে ইলিনা টের পেল অঙ্গনা ওর গায়ের কাছে সরে এসেছে৷
সমর্পিতা বলল, ‘কীসের আলো সেটা গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে৷’
কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়ামের কাছে বসেছিলেন৷ সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না, না—যাওয়ার কোনও দরকার নেই৷ তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে দেখছ না!’
রবিনা ম্যাডাম জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন৷ সেদিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘এমন কিছু বৃষ্টি পড়ছে না—৷’
এ-কথা শেষ হতে-না-হতেই সম্পি দৌড়ল হলের দরজার দিকে৷
পিছন থেকে কাকলি ম্যাডাম, অঙ্গনা, ইলিনা সবাই ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে ডাকতে লাগল৷
কিন্তু সেসব ডাক সম্পির কানে বোধহয় ঢুকল না৷ ও ততক্ষণে হলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে৷
রবিনা ম্যাডাম আর দেরি করলেন না৷ সম্পির পিছন-পিছন দৌড়লেন৷ আর ওঁর সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল ইলিনা আর সজনী৷
বাইরেটা অন্ধকার, জলে ভেজা৷ সামনে পিচের রাস্তা, তারপর ছোট্ট একটা পার্কের মতো৷ এই পার্কে পতাকা তোলার ফাংশান হয়৷
পার্কের চারপাশের রেলিং বেশ খাটো৷ ওরা দেখল, শর্টকাট করার জন্য সম্পি লাফিয়ে পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছে গেছে৷ ইলিনা আর রবিনা ম্যাডামরা পার্কটাকে পাশ কাটিয়ে সম্পিকে ধরার জন্য দৌড়ল৷
পার্ক পেরিয়ে একটা সবুজ মাঠ৷ তারপর বাস্কেটবল গ্রাউন্ড৷ সম্পি সেখানে পৌঁছে কয়েক লহমা দাঁড়াল৷ তারপর রেলিং ঘিরে দৌড়তে যাবে তখনই রবিনা ম্যাডাম ওকে ধরে ফেলল৷ একটু পরেই ইলিনা আর সজনী সেখানে পৌঁছে গেল৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের রেলিং উঁচু, তাই সেটা ডিঙোনোর প্রশ্ন ওঠে না৷ সেইজন্যই সম্পি বোধহয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ ভাবছিল এরপর কী করবে৷ তা ছাড়া ঘোড়ার খুরের আওয়াজটা এখন আর শোনা যাচ্ছিল না৷
কিন্তু সাদা আলোর বিন্দুগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷
স্কুল-ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে৷ রাস্তার একপাশে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইটপোস্ট৷ তার ঝিমিয়ে পড়া আলো অন্ধকারের সঙ্গে অসম লড়াই করছে৷
ওরা সবাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভিজছিল আর হাঁপাচ্ছিল৷ তাকিয়ে ছিল খাঁ-খাঁ বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে৷ রাস্তার আলো সেখানে ছিটকে এসে পড়েছে৷ কংক্রিটে বাঁধানো গ্রাউন্ড বৃষ্টির জল পড়ে চকচক করছে৷
রবিনা ম্যাডাম বললেন, ‘এবার ফিরে চল৷ ওই ঘোড়ার খুরের শব্দ…ওটা হয়তো ভুল শুনেছি৷ তা ছাড়া ওটা শুধু শব্দ…ভয়ের কিছু নেই৷ তোদের কাকলি ম্যাডাম একটুতেই ভয়-টয় পায়৷ চল…৷’
রবিনা ম্যাডামের কথার পিঠে সমর্পিতা বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম, ম্যাডাম৷ কিন্তু ওই আলোগুলো কীসের? এখন দেখছেন, ওগুলো কেমন এদিক থেকে ওদিকে লাফাচ্ছে!’
সত্যিই তাই৷ আলোগুলো এখন লাফিয়ে উঁচু থেকে নীচে নামছে, আবার নীচ থেকে লাফিয়ে ওপরে উঠছে৷ কখনও ওগুলো আবার দপ করে নিভে যাচ্ছে৷
রবিনা ম্যাডাম একটু ইতস্তত করলেন৷ বোধহয় ভাবলেন, ছাত্রীর কাছে সাহসের পরীক্ষায় তিনি হেরে যেতে চান না৷ তাই বললেন, ‘চল তা হলে, একবার কাছ থেকে দেখে আসি…৷’
বাস্কেটবল গ্রাউন্ডকে পাশ কাটিয়ে ওরা এগিয়ে গেল৷ সামনে বড়-বড় গাছপালা, আর তার পরেই বিশাল খেলার মাঠ৷ এই মাঠে খেলাধুলো ছাড়াও স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস হয়৷ সেই মাঠটার একপাশে প্রায় তিনতলা সমান উঁচু একটা প্রকাণ্ড গাছ আছে৷ ওই গাছটা দেখলেই ইলিনার ভয় করে৷ কারণ, অত বড় গাছটায় একটিও পাতা নেই৷ শুধু অসংখ্য শুকনো ডালপালা কঙ্কালের মতো আকাশের দিকে ছড়িয়ে গেছে৷ হঠাৎ করে মনে হয়, কেউ যেন একশো হাতের পাঁচশো আঙুল আকাশের দিকে তুলে ভগবানের কাছে মুক্তি চাইছে৷
বাস্কেটবল গ্রাউন্ড পেরিয়ে গাছপালার গাঢ় অন্ধকার এলাকায় ঢুকে পড়ল ওরা৷ ইলিনার এবার বেশ ভয় করছিল৷ মনে হচ্ছিল, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ওরা কোনও অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে৷
গাছপালার পাতায় বৃষ্টি আটকালেও পাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছিল৷ সজনী ইলিনার হাত চেপে ধরেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এইভাবে ওদের শরীরে আর মনে ভরসার আদানপ্রদান হচ্ছিল৷
সমর্পিতা রবিনা ম্যাডামকে বলল, ‘ওই দেখুন ম্যাডাম, আলোগুলো আরও কতটা দূরে…৷’
‘মনে হয়, ওই মরা গাছটার কাছে…৷’ রবিনা ম্যাডাম বললেন৷
ওরা জলের ওপরে পায়ের ছপছপ শব্দ তুলে এগোতে লাগল৷
আরও অনেকটা এগোতেই ওরা দৃশ্যটা ঠিকঠাক দেখতে পেল৷ কারণ, সেই মুহূর্তেই আকাশে নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে, আর বাজ পড়ার শব্দ কানে আসার আগেই ওরা শুনতে পেল খিলখিল হাসির শব্দ৷
মরা গাছটা ইলিনাদের কাছ থেকে এখন অন্তত তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে৷ কিন্তু তার জন্য দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
তিনটে প্রাণী ওই মরা গাছটার ডালে নানান উচ্চতায় উবু হয়ে বসে আছে৷ তাদের প্রত্যেকের মাথায় ছাতা৷ আর ছাতার নীচের অন্ধকারে দুটো করে সাদা আলোর চোখ জ্বলছে৷
ওরা খিলখিল করে হাসছে আর বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো এ-ডাল থেকে সে-ডাল লাফাচ্ছে৷ কখনও লাফিয়ে ভিজে মাঠে নেমে আসছে, কখনও-বা মাঠ থেকে সোঁ করে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে ডালে৷ ওদের হাতে ধরা ছাতাগুলো অনেকটা প্যারাশুটের মতো লাগছে৷
সজনী ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠতেই ইলিনা চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিল৷
রবিনা ম্যাডাম মরা গাছটার দিকে চোখ রেখেই ভয়ের গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ওগুলো কী—মানুষ, না পশু?’
প্রশ্নটা কাকে লক্ষ্য করে সেটা বোঝা যায়নি বটে কিন্তু সমর্পিতা উত্তর দিল, ‘ওগুলো মানুষ নয়, ম্যাডাম৷ মনে হচ্ছে, খারাপ কিছু…৷’
সেই ‘খারাপ কিছু’-টা যে কী সেটা ওরা চারজন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল৷
এমন সময় আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল৷ ওদের হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল৷ তারপরই বাজ পড়ার বিকট শব্দে সেটা কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়ে গেল৷
ইলিনারা অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে সেই অলৌকিক সার্কাস দেখতে লাগল৷
সজনী কাঁপা গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ফিরে চলুন৷ আমার…আমার ভয় করছে…৷’
‘ফিরে যাব কেন?’ বকুনির সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রবিনা ম্যাডাম৷ আঁচলে জড়ানো হাতের মুঠোয় ধরা টর্চটা বের করে মাটির দিকে তাক করে জ্বেলে ধরলেন৷ টর্চের জোরালো সাদা আলোয় বৃষ্টি-ভেজা ঘাস আর পাতা চোখে পড়ল৷ রবিনা বললেন, ‘আমরা চারজন আছি—ভয় কীসের! আমরা সবাই মিলে তাড়া করলে ওরা…মানে, ওই অ্যানিম্যালগুলো পালাবে৷’
রবিনার কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটা চমকে ওঠা ঘটনা ঘটে গেল৷ সমর্পিতার ভেতরে কেউ যেন আচমকা সাহস এবং অ্যাকশনের সুইচ অন করে দিল৷ মেয়েটা ‘অ্যাই, তোরা কে রে?’ বলে কান-ফাটানো চিৎকার করে ভেজা মাঠের ওপর দিয়ে মরা গাছটা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচাতে লাগল৷
রবিনা ম্যাডাম ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন৷ তারপর টর্চ জ্বেলে সেটাকে সামনে পিস্তলের মতো বাগিয়ে ধরে সম্পির পিছন-পিছন ছুটতে শুরু করলেন৷ অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা চেহারায় দশাসই হলেও বেশ জোরে ছুটতে পারে দেখছি!
রবিনা ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করছিলেন আর ইলিনাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সার যাচ্ছিলেন৷
ইলিনা আর সজনী ভয় পেয়ে গেল৷ কারণ, ওদের দুই সাহসী সদস্য এখন আর ওদের পাশে নেই৷ তাই ওরাও রবিনা ম্যাডামকে লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করতে লাগল৷
ওদের চারজনের চিৎকারে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে লোকজন বেরিয়ে এল৷ কিন্তু অন্ধকার আর বৃষ্টির জন্য ওরা ভালো করে কিছু ঠাহর করতে পারছিল না৷
সম্পিদের ‘চোর! চোর!’ চিৎকারে প্রাণীগুলো কিন্তু মোটেই ভয় পায়নি৷ বরং ওদের হাসাহাসি আর লাফালাফির খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সম্পি খুব কাছাকাছি এসে পড়তেই ওরা লাফিয়ে মাটিতে নামল৷ তারপর হাসি বন্ধ করে মাথার ওপরে ছাতা ধরে স্থির হয়ে দাঁড়াল৷
রবিনা ম্যাডাম সম্পিকে প্রায় ধরে ফেলেছিলেন৷ শাড়ি পরে থাকলেও ওঁর অ্যাথলেটিক শরীর ওঁকে দ্রুত দৌড়তে সাহায্য করছিল৷
ঘোলাটে অন্ধকারে রবিনা প্রাণীগুলোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলেন না৷
সম্পি রবিনার তুলনায় খানিকটা এগিয়ে ছিল৷ কিন্তু ও-ও ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিল না৷ শুধু গাঢ় কালচে তিনটে ছাতার নড়াচড়া বুঝতে পারছিল৷
যদি ওরা প্রাণীগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পেত তাহলে আর এগোত না৷
এমন সময় আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরপর দু-বার৷
সম্পিরা দেখতে পেল ওদের৷ সঙ্গে-সঙ্গে ডাকাবুকো সম্পি আর রবিনা ম্যাডাম থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ ওঁদের চিৎকার থেমে গেল৷
ছাতার নীচে তিনটে ফ্যাকাশে সাদা বিকৃত মুখ৷ চোখগুলো পুরোটা কালো—তাতে সাদা অংশ বলে কিছু নেই৷ শুধু মাঝখানে দুটো উজ্জ্বল আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ ওদের ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল—যেন লিপস্টিকে রাঙানো৷ তিনজনেরই ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে আছে৷ আর সেই ফাঁক দিয়ে ওদের দাঁত দেখা যাচ্ছে৷ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসানো ঝকঝকে ইস্পাতের দাঁত৷ দাঁতগুলো মাপে ছোট, কিন্তু অসংখ্য৷
এরা কারা? কোথা থেকে এল এখানে?
বিদ্যুতের আলো নিভে গেল৷ চারপাশ আবার ছায়া-অন্ধকার৷
রবিনা ম্যাডামের হাত থরথর করে কাঁপছিল৷ সেই কাঁপা হাতে তিনি টর্চের আলো ছুড়ে দিলেন একজনের মুখে৷ তারপর আর-একজনের৷ তারপর…৷
আবার দেখা গেল সেই ভয়ংকর মুখ৷ আরও ভয়ংকর ওদের পোশাক৷
একজনের পরনে রঙিন শাড়ি৷ আর অন্য দুজনের গায়ে স্কুল-ড্রেস৷ সবুজ স্কার্ট আর সাদা টপ৷ মাথায় জোড়া বিনুনি করে ফিতে বাঁধা৷
টর্চের আলোয় সাদা টপে রক্তের দাগ চোখে পড়ল যেন৷
সঙ্গে সঙ্গে সম্পি ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷
রবিনা ম্যাডামের গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছিল না৷ ওঁর হাতে ধরা টর্চের আলোটা ভীষণ কাঁপছিল৷ তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল আবার৷ তারপর কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল৷ বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হল৷
তিনটে মানুষ—কিংবা অমানুষ—আচমকা শূন্যে লাফ দিল৷ হাউইবাজির মতো ছিটকে চলে গেল দূরে৷
তারপর আবার লাফ৷ আরও দূরে৷
শেষে মিশে গেল অন্ধকারে৷
এরকম লাফ মানুষ দিতে পারে না৷
একটা অদ্ভুত ‘গোঁ-গোঁ’ শব্দ করে রবিনা ম্যাডাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন৷ ওঁর হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল দূরে৷
সম্পি ওঁর শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়ে ‘ম্যাডাম! ম্যাডাম!’ বলে ডাকতে লাগল৷ পিছনে তাকিয়ে দেখল অনেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ ফেস্টিভ্যাল হলের আলো আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের আলোর পটভূমিতে মানুষগুলোর ছায়া দেখা যাচ্ছে৷
.
৷৷চার৷৷
পরদিন স্কুলে হইচই যেটা হল সেটার ধরনটা অনেকটা ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো৷
মেয়েদের মধ্যে চাপা ফিসফাস, তর্কবিতর্ক চলতে লাগল৷ আর সমর্পিতাকে ঘিরে যত উত্তেজনা, যত আলোড়ন৷ ও যেন সাহসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছে৷ ওকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ভিড়৷ তারপর হালকাভাবে ঘেরাও হয়েছে ইলিনা, সজনী, আর রিহার্সালে হাজির থাকা বাকি মেয়েরা৷
ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে কিংবা ক্লাসের মধ্যেই সম্পিকে একই কাহিনি বারবার বলতে হচ্ছে৷ অন্য মেয়েরা এক-একটা ক্লাসের পর পালা করে বসার জায়গা পালটে সম্পির পাশে গিয়ে বসছে৷ এইভাবে গতকাল রাতের ভয়ংকর কাহিনি ছড়িয়ে গেল প্রায় সব ক্লাসেই৷
স্কুলের হেডমিসট্রেস মিসেস প্রীতি দত্ত বেশ রাশভারী মানুষ৷ মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা৷ ওঁকে খুব কম সময়েই হাসতে দেখা যায়৷
তিনি সকাল থেকে প্রতিটি ক্লাসে ভিজিট করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি গুজব না ছড়ায়৷
ইলিনাদের ক্লাসে হেডমিসট্রেস এলেন৷ তখন কাকলি ম্যাডামের বাংলা ক্লাস চলছিল৷ ছাত্রীদের লক্ষ করে বড়দি বললেন, ‘শোনো, মেয়েরা৷ কাল রাতে যা হয়েছে সেটা আমার কানে এসেছে৷ ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, সিম্পলি একটা…মানে…অ্যাক্সিডেন্ট৷ একে তো রাত, তার ওপরে মেঘ-বৃষ্টি৷ বুঝতেই পারছ ব্যাপারটা হ্যালুসিনেশান…মানে, দেখার ভুল হতে পারে৷ তা ছাড়া রবিনার তো শরীর ভালো নয়—লো প্রেশারে ভোগে৷ তাই ও হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেছে…৷
‘যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে তোমরা কারও সঙ্গে আর আলোচনা কোরো না৷ বরং বেস্ট হবে, যদি তোমরা সবাই এই ইনসিডেন্টটা ভুলে যাও৷ তা না হলে কথার পিঠে কথা ছড়াবে…তারপর কোন সময় দেখবে পুলিশ আর টিভি চ্যানেলের লোকজন স্কুলে এসে হাজির হবে, আর হাজারটা কোয়েশ্চেন করে আমাদের সবাইকে জ্বালিয়ে খাবে৷ তা ছাড়া আমাদের স্কুলের একটা নামডাক আছে৷ সম্মান আছে৷
‘তা হলে মনে থাকবে তো? ব্যাপারটা আর কিছুই নয়…রাতবিরেতে দেখার ভুল৷ বুঝলে?’
ক্লাসের সব মেয়ে একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মনে থাকবে, বড়দি৷’
কাকলি ম্যাডামও কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় কাত করলেন৷
হঠাৎই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল : ‘বড়দি—৷’
প্রীতি দত্ত ভুরু কুঁচকে বড়সড় চেহারার ছাত্রীটির দিকে তাকালেন৷
ইলিনা আর সজনীর বুক দুরদুর করে উঠল৷ ওরা আঁচ করতে পারল সম্পি কী বলতে চলেছে৷ এই বোধহয় ও বড়দির বকুনি খেল!
‘বড়দি, আমি কাল রাতে রবিনা ম্যাডামের সঙ্গে ছিলাম৷’
‘হ্যাঁ৷ জানি৷ তো?’ ভুরুজোড়া আরও কাছাকাছি চলে এল৷
‘রবিনা ম্যাডাম…অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন৷ আমি হইনি৷ আমি…সবটা নিজের চোখে দেখেছি—৷’
‘হ্যাঁ, শুনেছি৷ রবিনা বলেছে৷ কিন্তু এখন আর কোনও কথা শুনতে চাই না৷ তুমি, ইলিনা আর সজনী বরং টিফিনের সময় আমার রুমে এসো—তখন সব শুনব, আর আমার যা বলার বলব৷’ চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে নাকের ওপরে বসালেন প্রীতি দত্ত : ‘মোট কথা, এ-ব্যাপারে যেন একটা শব্দও বাইরে না যায়৷ আমাদের স্কুলের সুনামই হচ্ছে প্রথম এবং শেষ কথা৷ বুঝেছে?’ শেষ শব্দটায় ধমকের সুর আরও স্পষ্ট শোনাল৷
সমর্পিতা বেশ দমে গেল৷ ওর মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল৷ আর কোনও কথা না বলে ও গুম হয়ে বসে পড়ল৷ কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে একটা রাগ তৈরি হল৷ সবকিছু ও নিজের চোখে দেখেছে৷ তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা ওকে ‘দেখার ভুল’ বলে মানতে হবে!
এটা ঠিকই যে, আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল, অন্ধকার ছিল৷ কিন্তু বিদ্যুতের আলোও তো ছিল! তার সঙ্গে টর্চের আলো৷ তা ছাড়া ওদের চোখগুলো জ্বলছিল!
বড়দি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সজনী আর ইলিনা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে সম্পির দু-পাশে এসে বসে পড়ল৷ তারপর চাপা গলায় ফুসুর-ফুসুর শুরু করল৷ টিফিনের সময় বড়দির মুখোমুখি হওয়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ কাকলি ম্যাডামের ক্লাসের দিকে ওদের আর মন রইল না৷
সম্পি চাপা গলায় ইলিনাকে বলল, ‘আমি স্পষ্ট দেখেছি, দুজনের গায়ে আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস ছিল৷ আর-একজনের ছিল শাড়ি৷’
সম্পিদের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও স্কুল-ড্রেস-এর ব্যাপারটা ইলিনা আর সজনীরও নজরে পড়েছিল৷ তাই ‘হুঁ’ বলে ওরা দুজনে ঘাড় নাড়ল৷
সম্পি বলল, ‘তার মানে, দুজন আমাদের স্কুলেরই স্টুডেন্ট—নাইন অথবা টেন-এর…৷’
ওর এ-কথা বলার কারণ, সিনিয়ার স্কুলের ক্লাস নাইন আর টেন-এর স্টুডেন্টদের ড্রেস সাদা টপ আর সবুজ স্কার্ট৷ ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত স্কুল-ড্রেসটা অন্যরকম—সাদা ফ্রক, সবুজ টিউনিক৷ আর জুনিয়ার স্কুলের বিল্ডিংও আলাদা, ড্রেসও আলাদা : সবুজ পাড় আর পাইপিং লাগানো সাদা ফ্রক৷
সম্পি আবার বলল, ‘আর শাড়িটা দেখেছিলি? ওটার রং ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি, তবে পাড়ের চওড়া ডিজাইনটা আমার মনে আছে…৷’
‘তাতে কী হয়েছে?’ ইলিনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল৷
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সম্পি ফিসফিস করে বলল, ‘কাল ওই ডিজাইনের শাড়ি পরে আমাদের একজন ম্যাডাম স্কুলে এসেছিল…৷’
ইলিনা আর সজনীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল৷
কাল ওদের একজন ম্যাডাম সেই একই ডিজাইনের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন? তারপর সেই ম্যাডাম অন্ধকার আর বৃষ্টির মধ্যে খেলার মাঠের ওই মরা গাছটার ডাল থেকে ডালে ছাতা মাথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলেন? এ কী সর্বনেশে ব্যাপার!
‘তুই জানিস কে সেই ম্যাডাম?’ উত্তেজনায় কেঁপে যাওয়া গলায় জানতে চাইল সজনী৷
‘হ্যাঁ, জানি৷’ দুষ্টুমির চোখে একে-একে ইলিনা আর সজনীকে দেখল সম্পি৷ তারপর : ‘কিন্তু নামটা তোদের এখন বলব না৷ আমি চুপচাপ থেকে ক’টা দিন ওই ম্যাডামের ওপরে নজর রেখে দেখি৷ তারপর…৷’
ইলিনা সম্পির দিকে তাকাল৷
সম্পির ফোলা-ফোলা গাল, অথচ তা সত্ত্বেও চোয়ালের শক্ত রেখা বেশ স্পষ্ট৷ ক্লাসরুমের পাখা বনবন করে ঘুরছে, কিন্তু সম্পির গালে, কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম৷
দেখে মনে হচ্ছিল, সম্পি ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো ছানবিন করবে বলে শপথ নিয়েছে৷
ইলিনার ভয়-ভয় করে উঠল৷ কারণ, কাল রাতের তিনটে প্রেতিনীর মড়ার মতো মুখ ও অস্পষ্টভাবে হলেও দেখতে পেয়েছে৷ তা ছাড়া ওই খিলখিল হাসি!
ইলিনা আমতা-আমতা করে জিগ্যেস করল, ‘বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবি?’
‘এসব কিচ্ছু বলব না৷ বলব আমি যা দেখেছি…৷’
কথাটা সম্পি আর শেষ করল না৷ কারণ, ঠিক তখনই বাংলার ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷
টিফিনের স্বতঃস্ফূর্ত হইচই আজ বেশ কম মনে হল৷ কারণ, গতকালের অদ্ভুত খবরটা ফিসফিসে প্রচারে অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে৷
অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ ও আজ আসেনি৷ সকাল থেকেই ইলিনার চোখ বারবার অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চলে যাচ্ছে৷ কেন কে জানে!
ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা তাড়াহুড়ো করে টিফিন খাওয়া শেষ করল৷ বড়দির ঘরে ডাক পড়েছে বলে তিনজনের বুক দুরদুর করছিল৷ ইলিনা ক্লাসরুমের বড় জানলা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল৷ আকাশ মেঘলা৷ তার সঙ্গে সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷
বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবে সেটা সম্পি, ইলিনা আর সজনী বেশ কয়েকবার চাপা গলায় রিহার্সাল দিল৷ সম্পি বারবার বলছিল, ‘আমি যা দেখেছি সেটাই স্ট্রেটকাট বড়দিকে বলব৷ যা সত্যি, তাই৷ লুকোনোর কী আছে?’
ইলিনা আর সজনী ওকে বোঝাতে লাগল৷
এ নিয়ে অনেক সময় কেটে গেল৷ শেষ পর্যন্ত ওরা তিনজনে প্রায় হাতে হাত ধরে বড়দির ঘরের দিকে রওনা হল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল৷
একতলায় প্রীতি দত্তর বিশাল ঘর৷ ঘরের দু-পাশে দুটো করে জানলা৷ তাদের মাপ এত বড় যে, সাধারণ বাড়ির দরজাকেও হার মানায়৷ ডানদিকের খোলা জানলা দিয়ে স্কুলের লাগোয়া ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে৷ বাগান পেরোলেই চোখে পড়ছে খাটো পাঁচিল ঘেরা এলাকা—তার ভেতরে ছোট-ছোট সার্ভেন্টস কোয়ার্টার৷
সময়ের আঁচড়ে ময়লা হয়ে যাওয়া একটা প্রকাণ্ড মাপের সেক্রেটারিয়াট টেবিল৷ তার পিছনে বড়দি মুখ ভার করে বসে আছেন৷ টেবিলের ওপরে পেন স্ট্যান্ড, রাইটিং প্যাড, একটা মোবাইল ফোন, আর রাজ্যের খাতাপত্র ছড়ানো৷ টেবিলের একপাশে একটা পুরোনো মডেলের কম্পিউটার৷ আর বড়দির সামনে একটা গোলাপি রঙের কোঁচকানো রুমাল, তার পাশে একটা প্লাস্টিকের চাকতি দিয়ে ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল৷
বড়দির মুখোমুখি চারটে হাতল-ওয়ালা কাঠের চেয়ার৷ চারটেই খালি৷ চেয়ারের পিঠ ধরে ইলিনারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বড়দির কথার অপেক্ষা করতে লাগল৷
মাথার ওপরে কাঠের ব্লেডওয়ালা ঢাউস সিলিং ফ্যান ‘ক্যাঁচক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরছিল৷ সেই বাতাসের ঝাপটায় ট্যালকাম পাউডারের হালকা গন্ধ ওদের নাকে আসছিল৷ আর বড়দির গলায় পাউডারের ছোপ চোখে পড়ছিল৷
প্রীতি দত্ত ঠান্ডা চোখে সম্পির দিকে তাকালেন৷ অন্তত দশ সেকেন্ড স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন—যেন ওকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করছেন৷
তারপর অতিরিক্ত মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘সমর্পিতা…তাই তো নাম তোমার?’
সম্পি চুপচাপ মাথা নাড়ল৷ যার মানে, হ্যাঁ৷
‘…এবার বলো তো, কাল রাতে তুমি ঠিক কী দেখেছ?’
ইলিনা বড়দির শাড়িটা লক্ষ করছিল৷ আজ বড়দি একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরে এসেছেন৷ চওড়া পাড়ে গাঢ় সবুজ রঙের নকশা তোলা৷ হালকা সবুজ জমির ওপরে গাঢ় সবুজের কলকা বোনা৷
‘মনে হয়…মনে হয়…’ মেঝের দিকে তাকিয়ে আঙুল খুঁটতে লাগল সম্পি৷ বারকয়েক হোঁচট খেয়ে বলল, ‘মনে হয়…মনে হয় আমি…ভুল দেখেছি, বড়দি৷ ওই অন্ধকার, মেঘ, তার ওপরে বৃষ্টি…৷’
ইলিনা আর সজনী অবাক চোখে সমর্পিতার দিকে তাকাল৷
এসব কী বলছে সম্পি? একটু আগেই না বলছিল, একজনের শাড়ির পাড়ের ডিজাইনটা ও লক্ষ করেছে! গতকাল একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন৷ সেই ম্যাডামের ওপরে ও নজর রাখছে৷ এবং যা সত্যি তাই বলবে বড়দিকে৷
তা হলে?
ইলিনা আর সজনীকে আরও অবাক করে দিয়ে সম্পি বড়দিকে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, বড়দি৷ কাল রাতে আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল৷ মানে, ব্যাপারটা মনে হয় আমার দেখার ভুল৷ মানে…ওই যে আপনি বললেন না…হ্যালু…৷’
‘হ্যালুসিনেশান৷’ একগাল হেসে ওকে কথাটা ধরিয়ে দিলেন প্রীতি দত্ত, ‘এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা৷ গুড গার্ল৷’ এবার তিনি ইলিনা আর সজনীর দিকে তাকালেন : ‘তোমরা কিছু বলবে?’
অবাক ভাবটা কাটিয়ে ইলিনা আর সজনী একইসঙ্গে মাথা নাড়ল : ‘না, বড়দি, আমরা কিছুই দেখতে পাইনি—৷’ ওরা তখনও আড়চোখে বারবার সম্পিকে দেখছিল৷
‘গুড৷’ খুশির গলায় বললেন প্রীতি৷ তারপর স্নেহমাখা মোলায়েম গলায় আরও বললেন, ‘তোমরা এখন বড় হয়েছ৷ স্কুলের ভালোমন্দ অনেকটাই বুঝবে৷ জানো, সুনাম তৈরি করতে বহু বছর লেগে যায়! কিন্তু দুর্নাম?’ একটু থামলেন৷ তারপর : ‘দুর্নাম হওয়ার জন্যে একটা দিনই যথেষ্ট৷ আসলে…৷’
বড়দির বক্তব্যের স্রোতে বাধা পড়ল৷ কারণ, মলিনাদি ঘরে এসে ঢুকল৷
মলিনাদি বড়দির খাসবেয়ারা৷ তা ছাড়া ক্লাসে-ক্লাসে নোটিস নিয়ে যায়৷
মলিনাদি বেশ মোটাসোটা৷ রং কালো, মাথায় কাঁচাপাকা চুল৷ চোখে কালো ফ্রেমের চশমা—তার একটা ডাঁটিতে তাপ্পি লাগানো৷
ইলিনারা লক্ষ করল মলিনাদি বেশ হাঁপাচ্ছে, আর চোখগুলো গোল-গোল৷
‘কী হয়েছে, মলি?’ কথা থামিয়ে প্রীতি দত্ত প্রশ্ন করলেন৷
বড়-বড় শ্বাস টেনে-টেনে মলিনা বলল, ‘বলাইদার ছেলে…বলাইদার ছেলে…পরান…পরান…৷’
‘কী হয়েছে পরানের? কী হয়েছে?’ বড়দি প্রশ্ন করতে-করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷
‘পরান…পরান মারা গেছে গো, দিদি, মারা গেছে!’ এ-কথা বলেই মলিনা চাকরিজীবনে কখনও যা করেনি তাই করে বসল৷ বড়দির সামনেই ধপাস করে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল এবং বুকে দু-হাত চেপে উত্তেজনাটাকে সামাল দিতে চেষ্টা করল৷
মলিনার অসংলগ্ন কথা থেকে প্রীতি দত্ত অনেক কষ্টে গোটা গল্পটা উদ্ধার করলেন৷
স্কুলের ঘণ্টা বাজায় যে-বলাইদা, সে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে৷
তার বয়েস অনেক৷ মাথার মাঝখানে টাক৷ তার চারদিকে সাদা ঝালরের মতো চুল৷ মুখে খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি৷ খানিকটা কুঁজো হয়ে থাকা বৃদ্ধ শরীর৷ ধীরে-ধীরে হাঁটা-চলা করে৷ কিন্তু বলাইদার ঘণ্টা বাজানোর জোর অবাক করে দেওয়ার মতো৷
সেই বলাইদার জোয়ান ছেলে পরান কাছাকাছি একটা রেশন-দোকানে চাকরি করে৷ অনেক সময় হিসেবনিকেশের চাপে পরান রাতে সেই দোকানেই থেকে যায়৷ কাল রাতেও সেরকম কিছু একটা হয়েছে বলে বলাইদারা ভেবেছিল৷ কিন্তু আজ সকালে পরান না ফেরায় বলাইদারা অপেক্ষা করে-করে শেষ পর্যন্ত বেলায় পরানের খোঁজ করতে সেই দোকানে যায়৷ গিয়ে শোনে, গতকাল রাতে পরান বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি রওনা হয়ে গিয়েছিল৷ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য ও দোকান থেকে শুধু একটা পলিথিনের প্যাকেট নিয়েছিল৷
তখন বলাইদারা পাগলের মতো পরানের খোঁজ করতে থাকে৷ হাসপাতালে, থানায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে—সব জায়গায়৷
কিন্তু পরানকে পাওয়া যায়নি৷
তারপর, একটু আগে, কোয়ার্টারের একটা বাচ্চা ছেলে স্কুলের পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে ‘ছোট বাইরে’ করতে গিয়ে পরানের ডেডবডি দেখতে পায়৷
চারটে বড়-বড় আমগাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছের মাঝে বৃষ্টির জলে ভেজা আগাছা আর ঘাস-পাতার ওপরে পরানের দেহটা পড়ে ছিল৷ ওর মাথাটা ছিল একটা পলিথিনের প্যাকেটে ঢাকা৷
বাচ্চা ছেলেটা বুঝতে না পেরে ‘পরানদা, পরানদা—’ বলে পলিথিনের প্যাকেটটা ধরে টান মারে৷ জলে ভেজা প্যাকেটটা খুলে আসতেই পরানের ফ্যাকাশে মুখটা দেখা যায়৷
পরানের গায়ের রং শ্যামলা হলেও দেখা গেল, ওর সারাটা শরীর সাদাটে, রক্তশূন্য৷ চোখ দুটো বড়-বড়, যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে৷ আর ঘাড়ে-গলায় চার-পাঁচ জায়গায় গভীর ক্ষতের দাগ৷ সেখানে কালচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷
এসব কথা শুনে প্রীতি দত্তের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল৷ তার ওপর মলিনাদি বলল, সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের কারা যেন বড়দির পারমিশান না নিয়ে এর মধ্যেই পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছে৷
ইলিনা, সম্পি আর সজনী ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিল৷ পরানের মৃতদেহের যে-সংক্ষিপ্ত বর্ণনা মলিনাদি দিয়েছে তাতেই ওরা রক্তশূন্য ছাইরঙা ডেডবডিটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল৷
প্রীতি দত্ত টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে দু-ঢোঁক জল খেলেন৷ কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নেওয়ার পর কিছুটা সামলে উঠলেন৷ তারপর তড়িঘড়ি সম্পিদের বিদায় দিলেন৷ আপনমনেই বললেন, ‘কী-সর্বনাশ! মনে হচ্ছে, স্কুল ক’দিন ছুটি দিতে হবে…৷’
মলিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আমি বডিটা স্বচক্ষে দেখে এলুম, দিদি৷ এ একেবারে অপঘাতে মিত্যু৷ নিঘঘাৎ ডাকিনি-পিশাচের কাজ৷ সারা শরীরটায় রক্ত নেই৷ একেবারে সাদা৷ এবারে কী হবে, দিদি?’
মলিনার আর্ত আবেদন বড়দির কানে পৌঁছল কি না বোঝা গেল না৷ তিনি তখন টেবিল থেকে মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিয়েছেন৷ কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে মলিনার উচচারণ করা মারাত্মক দুটো শব্দ নিয়ে ভাবছেন৷
এই স্কুলে ডাকিনি আর পিশাচ এল কোথা থেকে?
.
৷৷পাঁচ৷৷
তিন দিন স্কুল ছুটি দেওয়া হল৷ তার সঙ্গে রবিবার জুড়ে গিয়ে চার দিন৷ সেই চারদিনে পুলিশি তদন্ত মোটামুটি একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল৷ কিন্তু পরানের দেহের রক্তশূন্যতার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না৷ পুলিশের রিপোর্টে হায়েনা, গোসাপ কিংবা বড়সড় কোনও বেজির আক্রমণের সম্ভাবনার কথা বলা হল—যদিও পুলিশের লোকজনের কাছে প্রচুর প্রশ্নচিহ্ন থেকে গেল৷
ব্যাপারটা নিয়ে জল ঘোলা যাতে কম হয় সেইজন্য প্রীতি দত্ত পুলিশের কাছে স্টেটমেন্টে শুধু রবিনা ম্যাডামের কথা বলেছেন৷ বলেছেন, সেই রাতে ওইসব আজগুবি কাণ্ডকারখানা রবিনা ম্যাডাম একা দেখেছেন—ছাত্রীরা কেউ দেখেনি৷ তাই ইলিনারা পুলিশের জেরা থেকে রেহাই পেয়ে গেছে৷
সোমবার স্কুলে গিয়ে স্কুলটাকে নতুন চোখে দেখতে চাইল ইলিনা৷
আজ বৃষ্টি নেই৷ আকাশে মেঘের চেহারা অনেক ফিকে৷ কিন্তু সেই রাতের ঘটনাটা চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরে যাচ্ছে না৷
কালো মেঘ৷ লিকলিকে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো মরা গাছ৷ অন্ধকার রাত৷ আর সেই উজ্জ্বল আলোর চোখ৷
ঘটনার পরদিন সকালে স্কুলের দিকে আসার সময় মরা গাছটার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ইলিনা৷ ওটার চারপাশে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নজর বুলিয়েছিল৷ কিন্তু গতকাল রাতের ওই ঘটনার কোনও চিহ্ন খুঁজে পায়নি৷ তা সত্ত্বেও ওর গা ছমছম করছিল৷
তারপর, পরানের অপঘাতে মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর, ওর মনে হয়েছে, ওই ‘খারাপ’ প্রাণীগুলো কখনও চিহ্ন রেখে যায় না৷
আজ সকালেও স্কুলে আসার সময় দূর থেকে ওই মরা গাছটার দিকে ইলিনা তাকিয়ে থেকেছে৷ আর তখনই এক অদ্ভুত শিরশিরানি টের পেয়েছে শরীরে৷
আজ ক্লাসে ঢুকে অনুষ্কাকে দেখতে পেয়ে ওর খুব ভালো লাগল৷ সুন্দর টলটলে মুখটি নিয়ে চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে আছে৷ ওর মুখের ডানপাশে জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে৷ সেই আলোয় ওকে কেমন যেন স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে৷ নিজের চিন্তায় ডুবে থাকা এক রূপসী৷
অনুষ্কার দু-পাশে রেখা আর সঞ্চিতা বসে৷ দুজনের মধ্যে রেখার সঙ্গে ইলিনার রিলেশানটা বেটার৷ তাই ও রেখাকে বলে বসার জায়গা অদলবদল করল৷ পিঠের ব্যাগ হাতে নিয়ে অনুষ্কার পাশের ডেস্কে বসে পড়ল৷
‘অনেকদিন তোমাকে দেখিনি৷’ ইলিনা হেসে বলল৷
‘স্কুল তো ছুটি ছিল৷ তা ছাড়া সেই বাজে দিনটায় আমি তো আসিনি…তার পরের দিনও আসিনি৷’
না এলেও অনুষ্কা ফোনে-ফোনে সব ঘটনাই জেনে গেছে৷ বড়দি যতই বারণ করে থাকুন, এই ভয়ংকর বিচিত্র ব্যাপারটা নিয়ে চাপা কথাচালাচালি মোটেই বন্ধ হয়নি৷
ইলিনাও এই ছুটির মধ্যে অনুষ্কাকে ফোন করেছিল৷ ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইলিনার মনে হয়েছিল অনুষ্কা যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না৷
ক্লাস শুরু হতে এখনও সাতমিনিট বাকি৷ তাই গোটা ক্লাসে ভোমরার গুনগুন চলছিল৷ ইলিনা অনুষ্কার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘জানো, আমার না এখন স্কুলে আসতে ভয় করে…৷’
‘কেন?’ অনুষ্কা ভুরু তুলে তাকাল৷
‘ওই রাতটার কথা বারবার মনে পড়ে…৷’
অনুষ্কা একটা হাত রাখল ইলিনার হাতে৷ ওর ছোঁয়া ইলিনার ভালো লাগল৷ সেই ছোঁয়ায় কেমন যেন একটা ভরসা ছিল৷
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ ছুটির পর তুমি বরং আমার বাড়িতে চলো৷ বাপি গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসবে৷ তারপর বাড়িতে গিয়ে আমরা অনেক গল্প করব৷ সময়টা দারুণ কাটবে৷ তুমি—৷’
‘তোমার কোনও প্রবলেম হবে না তো!’ ইলিনা কথাটা বলল বটে, কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ সেই প্রথম দিন থেকেই ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে, বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে৷ আর আজ অনুষ্কা নিজে থেকেই ওকে ওর বাড়িতে যেতে বলছে! এই প্রথম৷
‘না, না, প্রবলেম কীসের!’ অনুষ্কা তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমিই তো তোমাকে আসার জন্যে রিকোয়েস্ট করছি৷’
‘কিন্তু বাড়িতে ফোন করে একটু বলতে হবে—নইলে মা ভীষণ টেনশান করবে৷’
স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শুধু নয়, সঙ্গে করে নিয়ে আসাটাই বারণ৷ এ নিয়ে গত বছরে একটা বড়সড় গোলমাল হয়েছিল৷ সুতরাং ইলিনার মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল৷ ওদের কারও কাছে সেলফোন নেই৷ মা-কে ফোন করে খবরটা দেবে কেমন করে!
ওর মনের কথা অনুষ্কা বোধহয় টের পেল৷ বলল, ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই৷ বাপির সঙ্গে মোবাইল থাকে৷ ছুটির পর বাপির ফোন থেকে তুমি আন্টিকে ফোন করে দিয়ো৷ তার সঙ্গে বোলো, আন্টি যেন তোমার ফেরার চিন্তা না করেন৷ বাপি তোমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসবে—অবশ্য বাপির সঙ্গে আমিও থাকব৷’ হেসে কথাটা শেষ করল অনুষ্কা৷ কিন্তু তারপরই হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ‘আমার বাড়িতে যাচ্ছ এ-কথাটা কাউকে এখন বোলো না…প্লিজ…৷’
‘বলব না৷’ মাথা হেলিয়ে বলল ইলিনা৷ ভাবল, অনুষ্কাটা এত মুখচোরা কেন কে জানে! তা ছাড়া ওর বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা গোপন করারই বা কী আছে?
ইলিনার একটু অবাক লাগছিল৷ যে-অনুষ্কা সবার সঙ্গে আলাপ-টালাপ করার ব্যাপারটা সবসময় এড়িয়ে চলে সে হঠাৎ ইলিনাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করছে! এ-ক’দিনে ও হঠাৎ পালটে গেল কেন?
সে যাই হোক, ইলিনার মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ আর তখনই স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷
একটার পর একটা ক্লাস পেরিয়ে সময়টা ক্রমশ বিকেলের দিকে গড়াতে লাগল, আর ইলিনার উৎফুল্লতা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগল৷
টিফিনের সময় অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে ইলিনা বুঝল, এমনিতে সবাই চুপচাপ থাকলেও পরানের ব্যাপারটা নিয়ে ভালোরকম ফিসফাস কানাকানি হচ্ছে৷
খবরটা কোনও নিউজ চ্যানেলে দেখায়নি কিংবা কাগজেও ছাপেনি৷ হয়তো প্রীতি দত্তের অনুরোধে কিংবা প্রভাবে পুলিশ মুখে কুলুপ এঁটেছে আর মিডিয়া হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে৷ কিন্তু ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেন’ বসে থাকেনি৷
টিফিনের সময় ইলিনা একা-একাই টিফিন খেল৷ ওর শত অনুরোধেও অনুষ্কা ওর টিফিন শেয়ার করল না৷ বারবার সুন্দর করে হেসে বলল, ‘আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি৷ তা ছাড়া আমার চট করে খিদে পায় না৷’
ইলিনার বেশ খটকা লাগলেও কিছু বলল না৷
ছুটির সময় যতই এগিয়ে এল আকাশ ততই কালো হয়ে উঠল৷ মেঘও ডেকে উঠল দু-চারবার৷ অনুষ্কা অপছন্দের মুখে জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বর্ষাকালটা খুব বিচ্ছিরি৷ আমার ভাল্লাগে না৷’
ইলিনা ওর দিকে তাকাল শুধু—কিছু বলল না৷
সাড়ে চারটের সময় ছুটির ঘণ্টা পড়তেই ওরা সিঁড়ি নেমে চলে এল একতলায়৷ গাড়িবারান্দার বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ মেঘের যা চেহারা তাতে মনে হচ্ছে জলকণার ভারে মেঘের দল কাবু হয়ে পড়েছে৷ যে-কোনও মুহূর্তে মেঘের চাদর ফুঁড়ে জলের ধারা নীচে নামবে, পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে৷
অনুষ্কা ইলিনার হাত ধরে টান মারল : ‘শিগগির চলো৷ বাপি গাড়িটাকে ওপাশটায় দাঁড় করায়—৷’
পিচের রাস্তা ধরে ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি পা চালাল৷ অন্য মেয়েরাও চটপট এগিয়ে চলেছে মেন গেটের দিকে৷ কেউ-কেউ আবার ছুটছে৷ নিউ কাটের খটখট শব্দে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের ভূতুড়ে ঘোড়সওয়ারদের কথা মনে পড়ে গেল ইলিনার৷
পিচের রাস্তার বাঁ-দিকটা বলতে গেলে জঙ্গলে ঢাকা৷ আগাছার জংলা ঝোপ, আর তার মাঝে-মাঝে কয়েকটা বড়-বড় গাছ৷ গাছের পাতার আড়াল থেকে কোকিল ডাকছে৷ দুটো ফিঙে ঘূর্ণি নাচের ভঙ্গিতে উড়ছে৷ বোধহয় উড়ন্ত পোকামাকড় ধরছে৷ একটা কাঠবিড়ালি একটা বড় গাছের ডালে বসে ইলিনাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তবে সামান্য ছুতোয় ছুটে পালানোর জন্য সে বেশ তৈরি বলেই মনে হল৷ মেঘলার জন্য ঘোলাটে ছায়া থাকলেও কাঠবিড়ালিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷
অনুষ্কা কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল৷ ওর চোখে আকাঙ্ক্ষার আলতো ছোঁয়া দেখতে পেল ইলিনা৷ জিগ্যেস করল, ‘কাঠবিড়ালি তুমি ভালোবাসো?’
অনুষ্কা চমকে ঘুরে তাকাল : ‘দারুণ ভালোবাসি৷’
‘তা হলে ধরে নিয়ে চলো—পুষবে৷’
কথাটা ইলিনা খুব হালকাভাবেই বলেছিল৷ কিন্তু ওর কথা শেষ হতে না হতেই অনুষ্কা একটা আজব কাণ্ড করে বসল৷
রাস্তা ছেড়ে পলকে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে৷ এবং কাঠবিড়ালিটাকে লক্ষ্য করে শূন্যে লাফ দিল৷
কাঠবিড়ালিটা আর দেরি করেনি৷ অনুষ্কা তাকে তাক করে লাফানোমাত্রই সে গাছের ডাল বেয়ে সড়সড় করে আরও ভেতরদিকে ছুটে গেল৷
কিন্তু অনুষ্কাও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়৷ ও-ও তৎপর ভঙ্গিতে লাফের পর লাফ মেরে আগাছা আর গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল৷
ইলিনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ পিঠে স্কুল-ব্যাগের বোঝা চাপানো অবস্থায় অনুষ্কা যে-স্পিডে কাঠবিড়ালিটাকে তাড়া করল তাতে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ মনে হল, অনুষ্কা যেন লং জাম্প আর ট্রিপল জাম্পে তুখোড় কোনও অ্যাথলিট৷
অনুষ্কার ব্যাপারটা আরও দু-চারজন মেয়ের চোখে পড়েছিল৷ তারাও মজা দেখার লোভে ইলিনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়েছে৷
আগাছার ঝোপ আর গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল৷ কিন্তু মেঘলা ছায়াতে অনুষ্কাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না৷ তবে ওর সাদা টপের ঝলক দেখা যাচ্ছিল৷
একটু পরেই অনুষ্কা গাছপালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল৷ ওর স্কার্ট আর টপের এখানে-সেখানে গাছের পাতার টুকরো-টাকরা লেগে আছে৷ আর ডানহাতের মুঠোয় ধরা একটা কাঠবিড়ালি৷ চিঁ-চিঁ করে ডাকছে৷
ইলিনা তো অবাক৷ ছুটে গিয়ে কেউ কাঠবিড়ালি ধরেছে এমনটা ও কখনও শোনেনি৷ আর অনুষ্কার ক্ষিপ্রতা কোনও শিকারি চিতাকেও হার মানাবে!
অবাক হল বাকি সব মেয়েরাও৷ ওরা অনুষ্কাকে ঘিরে কাঠবিড়ালি দেখতে লাগল৷
অনুষ্কা বাঁ-হাতে স্কার্ট ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল, ‘কী কিউট, না? এটা আমি পুষব৷’
ইলিনা বলল, ‘বাব্বা, তোমার কী স্পিড! স্পোর্টসে নাম দিলে তুমি অনেক প্রাইজ পাবে৷’
অনুষ্কা হাসল শুধু—কোনও কথা বলল না৷
এমন সময় মেঘ ডাকল আবার৷ দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল৷
সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্কা যেন শক খেয়ে চমকে উঠল৷ ‘শিগগির চলো—বৃষ্টি পড়ছে’ বলে পিচের রাস্তা ধরে ছুট লাগাল৷
অন্য মেয়েগুলো একটু অবাক হয়ে গেল৷ এ-বৃষ্টি ভেজার মতন কিছু নয়৷ তাই অনুষ্কার দৌড়টা ওদের বেখাপ্পা মনে হল৷ আর ইলিনার মনে পড়ে গেল প্রথম দিন আলাপের সময় অনুষ্কা বলেছিল, ‘…বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’
ইলিনা একটুও দেরি না করে অনুষ্কার পিছন-পিছন দৌড়ল৷
দূরে মরা গাছটা দেখা যাচ্ছে৷ সেই রাতের দৌড়টার কথা ওর মনে পড়ে গেল৷
পিচের রাস্তা ধরে বাঁ-দিকে বাঁক নিতেই সার বেঁধে পার্ক করা কয়েকটা প্রাইভেট কার চোখে পড়ল৷ তার পাশে হলদে রঙের তিনটে স্কুলবাস৷
একটা সাদা গাড়ির সামনে বড় একটা ছাতা মাথায় দিয়ে সুপুরুষ একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ ভদ্রলোকের মাথায় কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, আর মুখে একগাল হাসি৷ ওঁকে দেখতে এত সুন্দর যে, স্রেফ দেখেই বোঝা যায় উনি অনুষ্কার বাবা৷
ছুটন্ত অনুষ্কার দিকে ছাতা বাড়িয়ে ধরলেন তিনি৷ আর একইসঙ্গে গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা খুলে ধরলেন৷ ইলিনা লক্ষ করল, গাড়ির জানলায় টিন্টেড গ্লাস লাগানো৷
গাড়িতে উঠতে-উঠতে অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, ও ইলিনা—আমার ক্লাসমেট…আমার খুব বন্ধু৷ ও আমাদের সঙ্গে এখন যাবে—৷’
‘তাই?’ চওড়া করে হাসলেন অনুষ্কার বাপি : ‘গুড—ভেরি গুড৷ এসো, এসো—উঠে পড়ো গাড়িতে৷ বৃষ্টিতে ভিজো না৷’ পিছনের একটা দরজা খুলে ইলিনাকে গাড়িতে ওঠার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন৷
ইলিনা গাড়িতে উঠে পিঠের স্কুল-ব্যাগটা খুলে সিটের ওপরে রাখতেই বাপি দরজাটা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলেন৷ গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময় ছোট্ট কাঠবিড়ালিটা বাপিকে দেখাল অনুষ্কা৷
‘এই দ্যাখো, বাপি, এই কাঠবিড়ালিটা স্কুলের বাগান থেকে ধরেছি৷ এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুষব…৷’
কাঠবিড়ালিটা তখন কিচকিচ করে শব্দ করছে, ওর কালো চোখের তারা চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক দেখছে৷
কাঠবিড়ালিটার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বাপি৷ তারপর জোরে হেসে বললেন, ‘ওটা আগেই আমি দেখেছি৷ বাঃ, গুড—ভেরি গুড৷ কিন্তু কত কিছুই তো তুমি পুষবে বলে ধরে আনো৷ তারপর কতটুকু কী পোষা হয় তা তুমি ভালোই জানো!’ মেয়ের দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে কী এক গোপন রসিকতায় হেসে উঠলেন৷ তারপর একপলক ইলিনাকে দেখে নিলেন৷
কাঠবিড়ালিটার গায়ে একবার আদরের হাত বুলিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন বাপি৷
অনুষ্কা বলল, ‘বাপি, তোমার ফোনটা দাও৷ ইলিনা ওর বাড়িতে একটা ফোন করবে—নইলে ওর মা-বাবা চিন্তা করবে…৷’
‘ওহ শিয়োর—এই নাও৷’ জামার বুকপকেট থেকে রুপোলি রঙের একটা ছোট্ট মোবাইল ফোন বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন৷
অনুষ্কা আর ইলিনা চটপট বোতাম টিপে ফোনের কাজটা সেরে নিল৷
গাড়ির ভেতরে একটা অদ্ভুত পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিল ইলিনা৷ মনে হচ্ছিল, মিহি দারচিনি গুঁড়ো কেউ বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে৷
এই গন্ধটা ও অনুষ্কার কাছে কখনও পায়নি৷ তা হলে কি ওর বাপি এরকম অফবিট পারফিউম লাগিয়েছেন? নাকি এটা স্পেশাল টাইপের কোনও কার পারফিউম?
অনুষ্কার বাপি গাড়ি চালাতে-চালাতে নানান বিষয়ে বকবক করছিলেন আর মাঝে মাঝেই হেসে উঠছিলেন৷ তবে ওঁর বেশি আগ্রহের বিষয় যে সিনেমা আর নাটক সেটা বোঝা যাচ্ছিল৷ গল্প করার ফাঁকে তিনি থেকে-থেকেই বলছিলেন, ‘এই তো, এসে গেলাম…৷’
গাড়ি নানান রাস্তা ধরে চলছিল৷ ইলিনা কোনও রাস্তাই চিনতে পারছিল না৷ অবশ্য ওর চেনার কথাও নয়৷ ওর শুধু মনে হচ্ছিল, অনুষ্কা ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হতে চলেছে৷ আর সেই চিন্তাটা ওর মনে খুশির বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছিল৷
একটু পরেই গাড়ি যে-বাড়িতে এসে ঢুকল সেটা মাপে ছোট হলেও অনায়াসে তাকে বাগানবাড়ি বলা যায়৷ কারণ, অবহেলায় ফেলে রাখা বাগানের একপাশে একটা ছোট দোতলা বাড়ি৷ বাড়ি আর বাগান জং ধরা রেলিঙে ঘেরা৷ তার কোথাও-কোথাও এমনভাবে ভাঙা যে, কুকুর-বেড়াল কি অন্যান্য ছোট প্রাণী সহজেই ঢুকে পড়তে পারে৷
বাড়িটা পুরোনো ধাঁচের, তবে সদ্য রং করা হয়েছে৷ সেই রংটা গরিব পথশিশুর গায়ে ঝকঝকে নতুন জামা-প্যান্টের মতো দেখাচ্ছে৷
বাড়ির ছাদের কার্নিশে অনেক গোলাপায়রা বসে আছে৷ মাঝে-মাঝে পায়রাগুলো এদিকে-ওদিকে উড়ে যাচ্ছে৷
আকাশ মেঘে-মেঘে কালো৷ বৃষ্টি এখন নেই, কিন্তু যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷
গাড়ি বাড়ির কাছে গিয়ে থামল৷ ওরা তিনজনে নেমে বাড়িতে ঢুকল৷ অনুষ্কার হাতে ধরা কাঠবিড়ালিটা তখনও কিচকিচ করে শব্দ করছে৷
বাড়িতে ঢোকার সময় অনুষ্কার বাপি ইলিনাকে বললেন, ‘ওয়েলকাম, ইলিনা—ওয়েলকাম টু আওয়ার লিটল হাউস৷ যাও, অনুষ্কার সঙ্গে ওপরে যাও৷ ওর ঘরে বসে গল্প করো, টিভি দ্যাখো, চুটিয়ে আড্ডা মারো—এনজয় করো…৷’ একটু থেমে অনুষ্কার দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘দাও, ওটা আমাকে দাও৷ জায়গামতো রেখে দিই…৷’
অনুষ্কা কোনও কথা না বলে কাঠবিড়ালিটা বাপির হাতে দিল৷ ওটার মাথায় ছোট্ট করে হাত বুলিয়ে বাপি বললেন, ‘সুইট স্কুইরেল…৷’
এই কথা বলে বাপি একতলার একটা ঘরে ঢুকে গেলেন৷ আর ওরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল৷
বাড়িটা নতুন রং করা হয়েছে বলে ইলিনা রঙের গন্ধ পাচ্ছিল৷ কিন্তু তার সঙ্গে দারচিনির মিষ্টি গন্ধটাও ওর নাকে আসছিল৷
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিল ইলিনা৷ ছিমছাম সাজগোজে বাড়িটাকে যথেষ্ট আধুনিক করার চেষ্টা হয়েছে৷
দরজা-জানলায় ভারী পরদা, দেওয়ালে ওয়াল হ্যাঙার, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ পেইন্টেড পট৷
এসব দেখতে-দেখতে অনুষ্কার ঘরে পৌঁছে গেল ইলিনা৷
অনুষ্কা আলো জ্বালতেই ঘরটা চোখের সামনে প্রকাশিত হল৷
একটা আলমারি, বুককেস, এল. সি. ডি টিভি আর পড়াশোনার টেবিল৷ তার পাশে কম্পিউটার টেবিল৷ ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে পাতা সিঙ্গল খাট৷ তার বিছানার রঙিন চাদর এলোমেলো৷ তার ওপরে পড়ে আছে একটা বড়সড় হেডফোন৷
বিছানার একটু ওপরে দেওয়ালে জন আব্রাহাম আর মাইকেল জ্যাকসনের বিশাল পোস্টার৷ তার পাশেই একটা অন্যরকম ডিজিটাল প্রিন্ট৷
এই অন্যরকম ছবিটায় দেখা যাচ্ছে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া প্রান্তরে একটা বিশাল প্রাসাদ অতিকায় ডাইনোসরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রাসাদের একটা ঘরে শুধু আলো জ্বলছে—বাকিটা ছায়া-ছায়া অন্ধকার৷
সেই ছবিটার পাশে একটা ছোট কাগজ দেওয়ালে সেলোটেপ দিয়ে লাগানো৷ তাতে লাল কালিতে একটা প্রতীক চিহ্ন আঁকা : একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ, তাদের লেজের ডগা দুটো জড়াজড়ি করে আছে৷ এই ছবিটা ইলিনা আগে অনুষ্কার খাতায় দেখেছে৷
হেডফোনটা ছুড়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে অনুষ্কা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানার কোণে রাখল৷ তারপর ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল, ইলিনাকেও বসতে বলল৷
ইলিনা স্কুল-ব্যাগটা খুলে বিছানায় নামিয়ে রাখল৷ তারপর হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল৷ কিন্তু বারবার ওর চোখ চলে যাচ্ছিল ফুল আর সাপের ছবিটার দিকে৷
ইলিনা স্বপ্নেও ভাবেনি হঠাৎ করে এরকমভাবে অনুষ্কা ওকে এত কাছে টেনে নেবে৷ তাই একটা অপ্রত্যাশিত খুশির ঢেউ ওকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল৷ অনুষ্কার ‘আহা মরি’ মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ওর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷
দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা দুজনে প্রাণখোলা গল্পে মেতে উঠল৷ আর তারই মধ্যে কখন যেন ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷
ওদের গল্প আর হাসাহাসির ঢেউয়ের মাঝে হঠাৎ করেই পরানের ডেডবডির কথা ভেসে উঠল৷
অনুষ্কা টেলিফোনে ব্যাপারটা জেনেছে ঠিকই, কিন্তু মনে হল তাতে ওর কৌতূহল মেটেনি৷ কারণ, ও ইলিনাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করতে লাগল৷
সেই রাতের ঘটনা খুব ধীরে-ধীরে স্লো-মোশান সিনেমার মতো পরপর দু-বার বলতে হল ইলিনাকে৷
কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে গভীর মনোযোগে ইলিনার কথামালা শুনল অনুষ্কা৷
‘তোমরা ঠিক দেখেছ, দুজন টপ আর স্কার্ট পরে ছিল? মানে, আমাদের স্কুল-ড্রেস?’
‘হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি৷’
‘আর-একজন শাড়ি?’
‘হ্যাঁ৷ আমাদের একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে সেদিন স্কুলে এসেছিল৷ পাড়ের ডিজাইনটা দেখে সম্পি চিনতে পেরেছে৷’
‘কোন ম্যাডাম?’
‘সম্পি জানে৷ ও আমাদের এখনও বলেনি৷ লাস্ট দিন যখন ওর সঙ্গে কথা হয় তখন ও বলেছিল, ম্যাডামের নামটা এখন ও কাউকে বলবে না৷ কয়েকটা দিন ও ম্যাডামের ওপরে নজর রাখতে চায়…৷’
এ-কথা শুনে অনুষ্কা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও আনমনাভাবে বলল, ‘এতে তো সম্পির বিপদ হতে পারে! যদি সেই ম্যাডাম সম্পির ব্যাপারটা জানতে পেরে যায় তা হলে…৷’
ইলিনা হাত নেড়ে বলল, ‘জানলে জানবে! সম্পির গায়ে অনেক জোর—ও কাউকে ভয় পায় না…৷’
ইলিনার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ মলিন হেসে বলল, ‘সম্পি ওদের সঙ্গে পারবে না৷ ওদের গায়ে অমানুষিক শক্তি৷ ওরা লোহা চিবিয়ে গুঁড়ো করে দিতে পারে—৷’
ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল : ‘তুমি জানলে কী করে?’
অনুষ্কা চুপ করে রইল৷ ওরা দুজনে বৃষ্টির ধারাপাত শুনতে লাগল৷
কিছুক্ষণ পর ইলিনা আবার জিগ্যেস করল, ‘তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
‘কী জানো, বলো—৷’ অনুষ্কার আরও কাছে সরে এল ইলিনা৷
‘পরান ছেলেটা কীভাবে মারা গেছে আমি জানি৷’
বাইরে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷ পড়ল ইলিনার বুকের ভেতরেও৷ উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডের ধকধক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ও৷
ফ্যালফেলে মুখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে ছিল ইলিনা৷ হোঁচট খাওয়া গলায় কোনওরকমে প্রশ্ন করল, ‘কী-কীভাবে ম-মারা গেছে পরান?’
‘ওর সব রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ…৷’
ইলিনার শীত-শীত করে উঠল৷
ঘরের দুটো জানলাতেই কাচের শার্সি লাগানো৷ বৃষ্টির ফোঁটা কাচের ওপরে আছড়ে পড়ছিল৷ তারপর কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল৷ ল্যাম্পপোস্টের ছিটকে আসা আলোয় মনে হচ্ছিল কাচ বেয়ে কতকগুলো স্বচ্ছ ব্যাঙাচি সাঁতরে নামছে৷
ইলিনা শুধু যে অনুষ্কার কথায় ভয় পেয়েছে তা নয়৷ অনুষ্কা কী করে এসব জানল সে-কথা ভেবেও ওর ভয় করছে৷ অথচ অনুষ্কার প্রতি ওর টানটাও তো মিথ্যে নয়! তাই ভয় পেলেও ইলিনা এক অদ্ভুত টানে অনুষ্কার কাছে বসে রইল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আর নানান কথা ভাবতে লাগল৷
তা হলে সেই ছাতাওয়ালা প্রাণীগুলো পিশাচ? ওরাই কি পরানের রক্ত শুষে নিয়েছে? কিন্তু ওদের স্কুলের দুজন ছাত্রী আর একজন ম্যাডাম ওরকম পিশাচ হয়ে গেল কী করে?
ইলিনার চিন্তাগুলো দিশেহারাভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল আর বারবার অদৃশ্য এক পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷
অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, তুমি ভয় পেয়ো না৷ আমি তো আছি! শুধু সম্পিকে বোলো খুব কেয়ারফুল থাকতে৷ ও যেন বেশি রিসক না নেয়৷’
ইলিনা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ দারচিনির মিষ্টি গন্ধটা ওর নাকে এল আবার৷
অনুষ্কা প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য জানলার কাচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বৃষ্টিটা যে কখন থামবে কে জানে! রেইনি সিজনটা খুব বিচ্ছিরি৷’ মুখ ফিরিয়ে ইলিনার দিকে তাকাল : ‘আমার মায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ হল না৷ মা বিকেলে কীসব কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে—মনে হয়, বৃষ্টিতে আটকে গেছে৷ একটু পরে বাপি মা-কে ফোন করে দেখবে৷ যদি মায়ের ফিরতে প্রবলেম হয় তা হলে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে বাপি মা-কে গিয়ে নিয়ে আসবে৷’
‘তোমার মা একা বেরিয়েছেন? রাত হয়ে গেলে যদি কোনও বিপদ-আপদ হয়! তার চেয়ে আমি এখনই চলে যাই—তোমার মা তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন…৷’
‘তুমি শুধু-শুধু চিন্তা করছ—’ মিষ্টি করে হাসল অনুষ্কা : ‘বিপদ-আপদকে আমরা ভয় পাই না৷ তা ছাড়া বাপি এখুনি তোমার জন্যে স্ন্যাক্স-ট্যাক্স কিছু নিয়ে আসবে৷ আর বাড়িটাও তো তোমাকে ঘুরিয়ে দেখানো হয়নি—চলো৷’ অনুষ্কা ওর হাত ধরে টানল৷ তারপর ঘর ছেড়ে ওরা চলে এল বাইরে, অলিন্দে৷
বাড়ির সব জায়গাতেই উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল৷ সাদা টিউবলাইট অথবা নানান চেহারার সি. এফ. এল.৷ দোতলার ঘরগুলো দেখাতে- দেখাতে অনুষ্কা বলল, ‘আমাদের বাড়ির দুটো ফ্লোর একই প্যাটার্নে তৈরি৷ একতলার দুটো ঘরে উলটোপালটা জিনিস বোঝাই করা আছে, আর থার্ড ঘরটায় আমার…পোষা…মানে, পেটসরা থাকে৷ কাঠবিড়ালি, পায়রা, শালিখ, চড়াই এসব৷’
দোতলার তিনটে ঘর শেষ হতেই অনুষ্কা বলল, ‘ওপাশে ওই যে দুটো ছোট-ছোট ঘর—ওগুলো টয়লেট আর কিচেন—দেখানোর কিছু নেই৷’
ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি রান্না জানো?’
‘ওরে বাবা!’ ভয় পাওয়ার কপট ভঙ্গি করল অনুষ্কা : ‘রান্না-টান্না আমি একটুও জানি না৷’
‘তোমার মা—মানে, আন্টি নিশ্চয়ই ভালো রান্না জানেন?’
‘উহুঁ—’ অনুষ্কা মাথা নাড়ল : ‘মা রান্না-টান্না তেমন জানে না…৷’
‘সে কী? তা হলে রোজ রান্না করে দেয় কে? তোমার স্কুলের টিফিন কে তৈরি করে? রান্নার মাসি?’
অনুষ্কাকে দেখে মনে হল, ও কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে৷ কী বলবে ভাবছে৷
‘না, মানে…রান্নার মাসি…আমাদের রান্নার মাটি-টাসি কেউ নেই৷’
অনুষ্কার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখেছে ইলিনা৷
এবং বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে৷
রান্নাঘর একেবারে পরিষ্কার৷ কয়েকটা থালা-বাসন ছুরি-চামচ ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই৷ তাকে মশলাপাতির কোনও কৌটো নেই৷ এমনকী কোনও উনুন, স্টোভ, গ্যাস আভেন, গ্যাস সিলিন্ডার, বা মাইক্রোওয়েভ আভেন—কিচ্ছু নেই৷
বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে ইলিনা ঘুরে তাকাল বন্ধুর দিকে৷
দুজনেই চুপচাপ৷ যেন ক্যামেরার ফ্রিজ শটে দুজনে ধরা পড়েছে৷ ওদের মুখে কোনও কথা নেই৷ শুধু বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজছিল৷
‘আমাদের রান্নাবান্নার কোনও ব্যাপার নেই৷ আমরা সবসময় কেনা খাবার খাই—৷’
অনুষ্কা এ-কথা বলতে না বলতেই ওর বাপির গলা পাওয়া গেল৷
‘ইলিনা, এই কেনা খাবারগুলো খেয়ে দ্যাখো—দারুণ লাগবে৷ খুব ফেমাস দোকান থেকে কেনা…৷’
কথার দিকে লক্ষ করে চোখ ফেরাল ইলিনা৷ এবং সরাসরি অনুষ্কার বাবাকে দেখতে পেল৷
অনুষ্কার ঘরের দরজায় বাপি দাঁড়িয়ে৷ হাতে একটা খাবারের প্লেট৷
ওরা বাপির কাছে এগিয়ে গেল৷ বাপি খাবারের প্লেটটা অনুষ্কার হাতে দিলেন : ‘নাও, বন্ধুকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াও৷’ ইলিনার দিকে তাকালেন : ‘লজ্জা কোরো না, ইলিনা—পেট ভরে খাবে৷ তা কেমন লাগছে বলো৷ এনজয় করছ তো?’
ইলিনা সামান্য হেসে ঘাড় নাড়ল৷ নীচু গলায় বলল, ‘করছি—এনজয় করছি৷’
‘গুড—ভেরি গুড৷’ জোরে হেসে উঠলেন বাপি৷ তারপর চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন : ‘হ্যাঁ, ভালো কথা৷ তুমি ফেরার সময় হলে বোলো৷ তোমাকে বাড়িতে ড্রপ পরে দেব…৷’
বাপি সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলেন৷
ঘরে ঢুকে ইলিনার সামনে প্লেটটা এগিয়ে দিল অনুষ্কা : ‘নাও—খেয়ে নাও৷’
ইলিনা প্লেটটা নিয়ে বিছানায় বসল৷ ওর খুব খিদে পাচ্ছিল৷ খাবারগুলো সামনে পেয়ে খিদেটা যেন অনেক বেড়ে গেল৷ মনজিনিসের ফিশ এনভেলাপ, চিকেন বার্গার—তার পাশে দুটো বড় সন্দেশ৷
খাওয়া শুরু করার আগে ও অনুষ্কাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি খাবে না?’
ইলিনা জানত অনুষ্কা কী বলবে৷ কারণ, স্কুলে টিফিন শেয়ার না করার ব্যাপারটা ওর মনে ছিল৷
অনুষ্কা ঠিক তাই বলল, ‘নাঃ, আমার খিদে নেই—৷’
ইলিনা চিকেন বার্গারে কামড় বসিয়ে হাসল : ‘তোমার দেখছি কখনও খিদে-টিদে পায় না৷’
অনুষ্কা অস্বস্তি পেয়ে হাসল, বলল, ‘বোধহয় তাই৷ ডাক্তার দেখাব ভাবছি—৷’
এরপর ওদের গল্প ঘুরে গেল গানের দিকে৷ বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখন অনেকটা কমে এসেছে৷
অনুষ্কা যে মাইকেল জ্যাকসনের ভক্ত সেটা দেওয়ালের পোস্টারটা দেখেই বোঝা গিয়েছিল৷ তার সঙ্গে জানা গেল ও নিজেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের চর্চা করে৷
ইলিনার গানের ‘চর্চা’ বলতে শুধু গান শোনা৷ ওর প্রিয় বিষয় হল ছবি আঁকা আর ট্যাটুর ডিজাইন৷ দেওয়ালে লাগানো পূর্ণিমার রাতের ছবিটা অনেকক্ষণ ধরেই ওর চোখ টানছিল৷ তাই ও হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘এই ছবিটা এখানে কী জন্যে লাগিয়েছ? এটার কি স্পেশাল কোনও ব্যাপার আছে?’
অনুষ্কা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘না, মানে… স্পেশাল কোনও ব্যাপার নেই৷ ছবিটা আমার ভালো লাগে, তাই—৷’
‘ওরে বাবা, আমার তো ওটার দিকে তাকালেই গা-টা কেমন শিরশির করছে! ভয়-ভয় করছে৷ ওই বাড়িটা যেন কেমন৷’
হাসল অনুষ্কা : ‘আমার ভয়-টয় একটু কম…৷’
অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ হঠাৎই ওর মনে একটা প্রশ্ন উঠে এল৷
অনুষ্কা ওকে আজ হঠাৎ বাড়িতে ‘নেমন্তন্ন’ করল কেন? আগে ও যখন গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেছে তখন অনুষ্কা এতটুকুও আগ্রহ দেখায়নি৷ অথচ আজ হঠাৎ উলটো ব্যাপার৷
তা হলে কি অনুষ্কা স্কুলের ওই ভয়ানক কাণ্ডটা ইলিনার কাছ থেকে সামনাসামনি বসে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে শুনতে চেয়েছিল? সব শোনার পর সেটা নিয়ে গোয়েন্দার মতো অনেক প্রশ্নও করেছে ও৷ ওর কথাবার্তায় ইলিনার মনে হয়েছে অনুষ্কা যেন এই রহস্যের গভীর পর্যন্ত জানে৷ কারণ, ও বলেছে, ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
খাওয়া শেষ করে ইলিনা উঠে দাঁড়াল৷ পড়ার টেবিলে রাখা একটা জলের বোতল ওর দিকে এগিয়ে দিল অনুষ্কা৷ আলতো গলায় বলল, ‘তুমি খুব সাবধানে থেকো৷’
ঢকঢক করে জল খেল ইলিনা৷ তারপর বিছানা থেকে ওর স্কুল-ব্যাগটা তুলে নিল : ‘রাত হয়ে যাচ্ছে—এবার আমি যাই…৷’
ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা দুজনে সিঁড়ির দিকে এগোল৷
.
৷৷ছয়৷৷
অনুষ্কাকে ঘিরে ইলিনার মনে কিছু প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা আর রহস্য তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু ওর প্রতি অলৌকিক এক টান এইসব দ্বিধা আর সংশয়কে ফিকে করে দিয়েছিল৷ শুধু একটা কথা ওর কানে বারবার বেজে উঠছিল : ‘আমি জানি৷ সব জানি—৷’
ক্লাসের পড়ায় ইলিনার মন বসছিল না৷ ও একটা খাতার শেষ পাতায় একটা ট্যাটুর ডিজাইন আঁকছিল : একটা ফুল—তাকে ঘিরে দুটো সাপ৷ এই নকশাটার মধ্যে কী আছে কে জানে! এটা অনুষ্কার এত প্রিয় কেন?
ইলিনা আজ সমর্পিতা আর সজনীর মাঝে বসেছে৷ ক’দিন ধরেই তাই বসছে৷ সমর্পিতার পাশে বসলে ও কেমন যেন ভরসা পায়৷ ওর মনে হয়, কোনও বিপদ-আপদ হলে দশাসই সম্পি সেটা ঠিক রুখে দেবে৷ কিন্তু ঠিক কীরকম বিপদ-আপদ সেটা ইলিনা জানে না৷
অরুণিমা ম্যাডাম বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন৷ ওঁর ভীষণ রোগা চেহারা, মাথায় অনেক সাদা চুল৷ খুব শিগগিরই রিটায়ার করে যাবেন৷ ক্লাসে শুধু হাই তোলেন আর চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েন৷
অরুণিমা ম্যাডাম খুব ঠান্ডা আর ভালোমানুষ টাইপের৷ পড়া না পারলে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা বকাবকিও করেন না৷ শুধু ক্লাসে গোলমাল না করলেই হল৷
সেই ‘নিয়ম’ মেনে ইলিনারা চাপা গলায় কথা বলছিল৷
ইলিনা ট্যাটু আঁকা থামিয়ে হঠাৎ বলল, ‘সম্পি, তোর সেই শাড়ির পাড়ের ডিজাইনের গল্পটা তো দেখলাম অনেকেই জেনে গেছে৷ বড়দিকে তুই কী বলেছিলি মনে নেই—যে সবটাই তোর দেখার ভুল?’
সম্পি বাঁকাভাবে হাসল৷ বলল, ‘সবাই যা বলে তাই করে নাকি? আমি ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা একটু রটিয়ে দিয়েছি৷’
সজনী জিগ্যেস করল, ‘কেন রে?’
‘যাতে কথাটা সেই শয়তান ম্যাডামের কানে যায়৷ তা হলে সেই ম্যাডাম একটু চাপে থাকবে৷’
‘চাপে থাকলে কী হবে?’
‘দেখাই যাক না কী হয়৷’ ঠোঁট টিপে বলল সম্পি, ‘হয়তো শয়তান ম্যাডামটা চালে কোনও ভুল করে ফেলতে পারে…৷’
হঠাৎই সম্পি প্রসঙ্গ পালটে ইলিনাকে জিগ্যেস করল, ‘সেদিন দেখলাম তুই ছুটির সময় অনুষ্কার গাড়িতে উঠলি…৷’
ইলিনা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না৷ ওকে বলেছিলাম—তাই ও আমাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়েছে৷’
‘ওরা খুব বড়লোক, না রে?’ সজনী গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল৷
‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল ইলিনা : ‘তবে অনুষ্কা বলছিল, ও সব জানে৷ ও তোকে—’ সম্পির দিকে তাকাল ইলিনা : ‘খুব কেয়ারফুল থাকতে বলেছে, কোনও রিসক নিতে বারণ করেছে৷’
সম্পি এ-কথায় ভয় তো পেলই না, উলটে ‘ডোন্ট কেয়ার’ হাসি হাসল৷ তারপর কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করল, ‘অনুষ্কা সব জানে মানে?’
‘কী জানি! সেসব ক্লিয়ার করে বলেনি৷’
‘তোরা চিন্তা করিস না৷ ব্যাপারটার পেছনে আমি লেগে আছি৷’
‘তুই কিন্তু কেয়ারফুল থাকিস…৷’ ইলিনা ফিসফিস করে সম্পিকে আবার বলল৷
সম্পি কোনও কথা বলল না৷ শুধু চোখের ইশারায় বোঝাল, ও কেয়ারফুল থাকবে৷
বাংলা ব্যাকরণের পর আরও দুটো ক্লাস পার হয়ে গেল৷ সম্পি কেমন যেন ছটফট করছিল৷ কোনও কিছুতেই ঠিকমতো মন বসাতে পারছিল না৷
ইলিনা খেয়াল করেছে, সম্পি ক’দিন ধরেই স্কুল ক্যাম্পাসের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ওই মরা গাছটার কাছে গিয়ে তার আশপাশটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে৷ গত পরশু স্কুল ছুটি হওয়ার পর ও সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলাইদার সঙ্গে কীসব যেন কথাবার্তা বলছিল৷ তারপর গতকাল টিফিনের সময় আগাছার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক চষে বেড়াচ্ছিল৷
ব্যাপারস্যাপার দেখে ইলিনার মনে হচ্ছিল, সমর্পিতা যেন শখের গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে৷ এটা যেমন ইলিনাদের চোখে পড়ছে তেমন অন্যদেরও নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে৷ তা হলে সেই রাতের ওই ভয়ংকর তিনজন…তারাও নিশ্চয়ই সমর্পিতার পাগলামো দেখছে৷ তারপর যদি…৷
ইলিনা আর ভাবতে পারছিল না৷ অনুষ্কার রহস্যময় কথাগুলো ওর মাথার ভেতরে ঝড় তুলছিল৷
টিফিনের পরের পিরিয়ডটায় রনিতা ম্যাডামের ইতিহাস৷ তিনি ক্লাসে এসে নিজস্ব বিরক্তিকর স্টাইলে পড়াতে লাগলেন৷ তারপর আজকের ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে সম্পিকে বেছে নিলেন৷ যত কঠিন-কঠিন প্রশ্ন ওর দিকে ছুড়ে দিলেন৷
সম্পি প্রায় কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছিল না৷ ফলে ওকে হেনস্থা করার সাফল্যে রনিতা ম্যাডামের চোখ চকচক করছিল৷
সমর্পিতাকে বাঁচানোর জন্য অনুষ্কা বারবার উত্তর দিতে চেয়ে হাত তুলছিল, কিন্তু রনিতা ম্যাডাম সেটা যেন দেখেও দেখছিলেন না৷
একসময় তিনি ঠান্ডা চোখে অনুষ্কার দিকে তাকালেন৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধারালো গলায় কেটে-কেটে বললেন, ‘আমি জানি তুমি সব জানো৷ কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি কিছু জানতে চাইছি না৷’
সম্পিকে যাচ্ছেতাইভাবে নাস্তানাবুদ করার পর ওকে ভালোরকম বকাবকি করলেন রনিতা ম্যাডাম৷ তারপর বললেন, ‘তুমি ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবে৷ তোমাকে ঠিক পথে আনা দরকার…৷’
সম্পি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ল৷
ইলিনা লক্ষ করল, সম্পির মুখচোখ লাল৷ প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা৷
রনিতা ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর সম্পি ইলিনাকে বলল, ‘সবাই জানে আমি পড়াশোনায় বাজে…তাও কেন যে আমাকে রনিতা ম্যাডাম হ্যারাস করলেন কে জানে! আমার কপালে নির্ঘাত গার্জেন কল ঝুলছে৷’
ইলিনা আর সজনী ওকে ভরসা দিতে লাগল৷
আকাশে কালো-কালো মেঘের ছানা ভেসে বেড়াচ্ছিল৷ বৃষ্টি এখনও শুরু হয়নি—তবে যে-কোনও সময় শুরু হতে পারে৷ জানলা দিয়ে বড়-বড় গাছের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছিল৷ এলোমেলো বাতাসে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে৷
সম্পিকে দেখে মনে হল, ও যেন একটু দমে গেছে৷ চুপচাপ কী যেন ভাবছে৷
ইলিনা বারবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, কী হয়েছে?’
সমর্পিতা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, কিছু না…৷’
ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইলিনা৷ ওর মনে হল, ডাকাবুকো সম্পি ভয় পেয়েছে৷
শেষ পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে সম্পি একবার টয়লেটে যাওয়ার নাম করে বেরোল৷
ইলিনার কী মনে হল, সম্পির পিছন-পিছন ও-ও বেরিয়ে এল বারান্দায়৷ দেখল, সম্পি বারান্দার রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে ক্লাস নাইন-বি-র একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷
মেয়েটার নাম নিনা৷ সম্পিদের পাড়ায় থাকে—ওর বন্ধুও৷ আর সম্পির মতো নিনারও একটু ভয়ডর কম৷
ইলিনা চটপট ক্লাসে ফিরে এল আবার৷ একটু পরে সম্পি ফিরে এসে ওর পাশে বসল৷
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শম্পা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন৷
শম্পা ভূগোল পড়ান এবং খুব ভালো পড়ান৷ কিন্তু শেষ পিরিয়ডে ইলিনার হাই উঠছিল৷ ভাবছিল কখন ছুটি হবে, স্কুল বাসে করে বাড়ি যাবে৷
ও সম্পিকে বলল, ‘নিনার সঙ্গে কী কথা বলছিলি?’
সম্পি কী যেন চিন্তা করছিল, চটকা ভেঙে বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের কাছে যাওয়ার সময় ওকে সঙ্গে নেব ভেবেছিলাম৷ তাই ওকে বলছিলাম৷ কিন্তু ওর কাজ আছে—বাড়ি ফেরার তাড়া আছে…৷’
‘ওকে সঙ্গে নিবি কেন?’
‘না, মানে…যদি কোনও প্রবলেম হয়…৷’
‘কী প্রবলেম?’
‘যদি বকাবকি করে, মারধর করে………তারপর গার্জেন কল……৷’ একটু থেমে সম্পি আবার বলল, ‘যাকগে, যা হয় হবে৷’
‘আমি তোর সঙ্গে যাব?’ ইলিনা জিগ্যেস করল৷
সমর্পিতা একলহমা কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ‘নাঃ, থাক—দরকার নেই৷ দেখি না কী হয়!’
এরপর ও আর কোনও কথা বলল না৷ অন্যমনস্কভাবে শম্পা ম্যাডামের ভূগোল পড়ানো শুনতে লাগল৷
ইলিনা বুঝতে পারছিল, সম্পি কেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে৷ কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না৷
কিন্তু কোনও টিচার পড়া না পারার জন্য সম্পিকে টিচার্স রুমে ডেকে পাঠাচ্ছেন এটা তো সম্পির কাছে নতুন নয়! তা হলে ও এরকম ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?
এসব ভাবতে-ভাবতে ইলিনা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল৷ আকাশের কালো-কালো মেঘের ছানাগুলো কখন যেন একজোট হয়ে পড়েছে৷ এখন ওদের কালো দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে৷ ওদের ঘন কালো শরীর ভেদ করে বিদ্যুতের রুপোলি তরোয়াল মাঝে-মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে৷ আর তারপরই গম্ভীর চাপা গর্জন৷
কখন যেন ছুটির ঘণ্টা পড়ল৷ গোটা ক্লাস সঙ্গে-সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল৷ কথার ফুলঝুরি ছিটকে পড়তে লাগল চারিদিকে৷
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি রওনা হতে হবে এই চিন্তায় সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিল৷ কিন্তু সম্পি চুপচাপ বসে রইল৷ ধীর স্থির গম্ভীর৷
ইলিনা আর সজনী ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সম্পির দিকে একবার তাকাল৷ ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘কী রে, তোর সঙ্গে থাকব?’
‘না, না—তুই বাড়ি যা৷’ চটপট বলল সম্পি, ‘আমি একা ম্যানেজ করে নেব৷’
ইলিনার মনে হল, সমর্পিতা চায় না ওকে কেউ ভিতু বলুক৷
ও এখন মনের ভেতরে বাড়তি সাহস তৈরি করছে৷
ক্লাসরুম যখন ফাঁকা হয়ে গেল তখন সম্পি উঠে দাঁড়াল৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে চলে এল বাইরের অলিন্দে৷ অলিন্দ ধরে খানিকটা এগোলেই একটা বড় চৌকো চাতাল৷ তাকে ঘিরে কাস্ট আয়রনের ঢালাই করা নকশা কাটা রেলিং৷
দোতলার এই চাতালটাকে অনেকটা ছাদের মতো দেখায়৷ চাতালের গা ছুঁয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া আর একটা কাঁঠাল গাছ উঠেছে৷
চাতালের একপাশে বেশ বড়সড় টিচার্স রুম৷ সম্পি কোনাকুনিভাবে চাতালটা পেরিয়ে টিচার্স রুমের কাছে গেল৷ তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷
রুমের চওড়া দরজায় বাদামি রঙের ভারী পরদা ঝুলছে৷ পরদার পাশ দিয়ে ঘরটা একচিলতে দেখা যাচ্ছে৷ আর ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷
চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল সমর্পিতা৷ নিজেকে সাহস জোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল৷ রনিতা ম্যাডাম আর যা-ই করুন নিশ্চয়ই মারধোর করবেন না!
বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সম্পি৷ ওর হাত সামান্য কাঁপছে নাকি?
দূর! যা হয় হবে!
এক হাতে ভারী পরদা সরাল ও৷ তারপর জুতোয় শব্দ তুলেই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল৷
ঘরে মাত্র দুজন টিচার : রনিতা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ ওঁরা পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে হোম লোন আর ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট নিয়ে কীসব আলোচনা করছিলেন৷ সমর্পিতাকে দেখেই ওঁরা চুপ করে গেলেন৷ তারপর রনিতা বললেন, ‘এসো, সমর্পিতা, এসো…৷’
রবিনা ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন৷ ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সমর্পিতা ছোট্ট করে হাসল৷ কিন্তু ম্যাডাম ওর দিকে তাকালেন শুধু—হাসলেন না৷ টেবিলে রাখা নস্যি রঙের কাঁধব্যাগটা তুলে নিয়ে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ ওঁর হাবভাব দেখে মনে হল তিনি যেন সমর্পিতার ঘরে ঢোকার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷ নিশ্চয়ই রনিতা ম্যাডাম ওঁকে বলে রেখেছিলেন যে, সম্পিকে তিনি কথা বলার জন্য টিচার্স রুমে ডেকে পাঠিয়েছেন৷
টিচার্স রুমে ঢুকে সবচেয়ে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল প্রকাণ্ড একটা টেবিল৷ টেবিলটা প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া৷ মেহগনি কাঠের তৈরি, ঝকঝকে পালিশ৷ টেবিলের আটটা পায়া আটটা সিংহের থাবা৷ টেবিলের নানান নকশা আর কারুকাজ দেখে বোঝা যায় এ টেবিল ব্রিটিশ আমলের কনফারেন্স টেবল৷
ঘরের একপাশে চারটে কাঠের আলমারি, আর তার পাশে একটা স্টিলের আলমারি৷
তার ঠিক বিপরীতে একটা কাঠের র্যাক—তাতে অনেকগুলো ক্লাস রেজিস্টার, চকের বাক্স আর ডাস্টার৷ র্যাকের পাশে বড়-বড় তারিখওয়ালা একটা ক্যালেন্ডার৷
ঘরে তিনটে চার ব্লেডের সিলিং ফ্যান—তবে এখন একটা চলছে৷ তার হাওয়ায় রনিতা ম্যাডামের কানের পাশে চুল উড়ছে৷
আকাশ মেঘলা থাকায় ঘরে দুটো টিউবলাইট জ্বলছে৷ রনিতা ম্যাডামের পিছনে তিনটে বিশাল-বিশাল জানলা—সম্পিদের ক্লাসরুমের মতো৷ খোলা জানলা দিয়ে আকাশের মেঘ দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাতাসে মাথা ঝাঁকানো পাগল গাছপালা৷
কোকিলের ডাক শুনতে পেল সম্পি৷ এই ডাকটা ওকে যেন ভরসা জোগাল৷
সম্পি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বসেনি৷ কারণ, ম্যাডাম ওকে বসতে বলেননি৷
টেবিলের এপার থেকে ও রনিতা ম্যাডামকে দেখছিল৷
রনিতা ম্যাডামের সামনে তিন-চার ভাগে ভাগ করে রাখা ক্লাস টেস্টের খাতা৷ খাতার ওপরে লোহার পেপার-ওয়েট চাপানো৷ খাতার পাতার কোনাগুলো পাখার হাওয়ায় উড়ছে৷
খাতাগুলোর পাশে রনিতার কাঁধ-ব্যাগ৷ গাঢ় নীল রঙের ব্যাগ—ব্যাগের খোলা মুখ দিয়ে ছাতার রঙিন বাঁট দেখা যাচ্ছে৷
‘এদিকে এসো, সমর্পিতা—এপাশটায় এসো…৷’ হাতের ইশারায় ওকে নিজের কাছে ডাকলেন ম্যাডাম৷
‘না, ম্যাডাম—এখানেই ঠিক আছি৷’ কথা বলতে-বলতে হাতে ঝোলানো স্কুল-ব্যাগটা টেবিলের ওপরে রাখল সম্পি৷
হাসলেন রনিতা ম্যাডাম৷ বললেন, ‘কোনও ভয় নেই, সমর্পিতা— এপাশটায় এসো, আমার কাছে এসো৷ তোমাকে আমি কানও মুলব না, মারধোরও করব না৷ তবে হ্যাঁ—’ চওড়া করে হাসলেন রনিতা : ‘একটু বকাবকি হয়তো করব৷ এসো…এপাশটায় এসো—৷’
এরপর আর আপত্তি করা যায় না৷
টেবিলের পরিসীমা ধরে ধীরে-ধীরে এগোতে শুরু করল সমর্পিতা৷ ম্যাডাম মুখে বলছেন বটে ‘কোনও ভয় নেই’, কিন্তু যদি রাগের মাথায় কান-টান মুলে দেন! তা হলে কিন্তু বড় প্রেস্টিজের ব্যাপার হবে৷
‘আজকাল তোমার পড়াশোনায় একটুও মন নেই কেন বলতে পারো?’ বকুনির পালা শুরু করে দিলেন রনিতা : ‘ক্লাসে সবসময় দেখি অন্যমনস্ক৷ এরকম করলে তো তোমার রেজাল্ট অনেক নীচে নেমে যাবে!’
সমর্পিতা ততক্ষণে ম্যাডামের বেশ কাছে পৌঁছে গেছে—তবে মোটেই হাতের নাগালের মধ্যে নয়৷ কাঁচমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ও ম্যাডামের ভর্ৎসনা গায়ে মাখছিল৷
‘আজও ক্লাসে দেখলাম তুমি কোনও পড়া বলতে পারছ না৷ ইতিহাস বলে যে একটা সাবজেক্ট আছে সেটাই বোধহয় তুমি ভুলে গেছ৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন রনিতা : ‘সত্যি করে বলো তো, তোমার কী প্রবলেম হয়েছে? লেখাপড়া ছেড়ে তুমি এখন কী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?’
সমর্পিতা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ মিনমিনে গলায় বলল, ‘কিছু নিয়ে তো মাথা ঘামাচ্ছি না, ম্যাডাম—পড়ছি…৷’
‘ছাই পড়ছ!’ ধমকে উঠলেন রনিতা, ‘আসলে তুমি স্কুলের ওই অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে বড্ড বেশি ইনভলভড হয়ে পড়েছ, তাই না?’
সমর্পিতা চুপ করে রইল৷
জানলার বাইরে মেঘ ডাকল৷ বৃষ্টিও জোরে শুরু হল৷ রনিতা বৃষ্টির শব্দে জানলার দিকে একবার তাকালেন৷ তারপরই ব্যাগ থেকে ছাতাটা টেনে বের করে নিজের হাতের কাছে রাখলেন৷
সম্পিকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যাডামের ধৈর্য কয়েক ডিগ্রি কমে গেল৷
‘চুপ করে আছ কেন? বলো৷ পরানের অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথটা নিয়ে তুমি একটু বাড়াবাড়ি রকমের ইনভলভড হয়ে পড়েছ না?’
সমর্পিতা আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ আলতো গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ নয়—মার্ডার৷’
‘তোমাকে কে বলেছে মার্ডার?’ ধৈর্য আরও কমে গেল : ‘পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে যা রিপোর্ট দেওয়ার দিয়ে দিয়েছে৷ তা ছাড়া সবাই জানে এই স্কুলটা একটু ইয়ে…মানে, ভূতুড়ে…একটু দোষ আছে৷ আর সেদিন রাতে তুমি বা রবিনা যা দেখেছ সবটাই—৷’
‘হ্যালুসিনেশান৷ আমাদের দেখার ভুল—তাই তো?’ ম্যাডামের কথার খেই ধরে সমর্পিতা বলল৷
সম্পির কথার সুরে ব্যঙ্গ আর বিদ্রোহের ছোঁয়া পেয়ে রনিতা খেপে উঠলেন : ‘তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! শিক্ষা-দীক্ষা পাওনি? বাজে নোংরা মেয়ে!’
সম্পির মাথায় আগুন জ্বলে গেল৷ ও ভুলে গেল কাকে কী বলছে৷ ক্ষিপ্ত গলায় ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি বাজে নোংরা মেয়ে! তুই কী? তোর সেই শাড়িটা কোথায়? ওই যে, পাড়ের কাছে শঙ্খের ডিজাইন করা৷ যেটা পরে সেদিন অন্ধকারে ছাতা মাথায় দিয়ে ওই মরা গাছটায় হনুমানের মতো লাফাচ্ছিলি৷ শাড়িটা আছে, না পুড়িয়ে ফেলেছিস?’
ঘরের ভেতরে যেন বাজ পড়ল৷ সম্পির কথাগুলো বুলেটের মতো বিঁধে গেল রনিতা ম্যাডামের গায়ে৷
.
৷৷সাত৷৷
ওঁর মুখটা অলৌকিকভাবে পালটে যেতে লাগল৷ গাল দুটো বসে গেল৷ রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল! ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গিয়ে দুটো কালো অন্ধকার গর্ত তৈরি হল৷ সেই গর্তের কেন্দ্রবিন্দুতে দুটো উজ্জ্বল সাদা ফুটকি—হাই পাওয়ারের জোনাকির মতো জ্বলছে৷
রনিতা ম্যাডাম অদ্ভুত এক কর্কশ গলায় বললেন, ‘তোর লপচপানি বড্ড বেড়েছে৷ তোকে ঠিক পথে আনা দরকার৷ আমাদের যে কতটা শক্তি তুই জানিস না…৷’
সম্পি ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল৷ গল্পে পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা আজগুবি ব্যাপারটা যে ওর চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে সেটা কিছুতেই ও বিশ্বাস করতে পারছিল না৷ ওর ভেতর থেকে সমস্ত বেপরোয়া ভাব আর সাহস চুঁইয়ে-চুঁইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল৷ ভয়ে ওর জিভ শুকিয়ে গেছে, পা দুটো মেঝেতে এঁটে বসেছে৷
খপ করে হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা একটা পেপারওয়েট তুলে নিলেন রনিতা৷ ওঁর হাতের আঙুলগুলো কেমন কালো-কালো হাড্ডিসার হয়ে গেছে৷ আর আঙুলের নখগুলো এখন কেমন লম্বা আর বাঁকানো৷
রনিতা খলখল করে হাসলেন৷ তারপর কর্কশ গলায় বললেন, ‘এটা খুব ছোঁয়াচে রোগ৷ কী করে কখন যে হয়ে গেছে একটুও টের পাইনি৷ তোর গায়ে একটা কামড় বসালে তুইও একপলকে আমাদের মতন হয়ে যাবি৷ তখন তেষ্টায় পাগল হয়ে ঘুরবি…আর যদি মরণকামড় দিই তা হলে তুই পরানের মতো শেষ হয়ে যাবি৷ সে-রাতে পরানকে শুষে শেষ করে আমরা আনন্দে ওই মরা গাছটায় নাচানাচি করছিলাম৷ তুই কি চাস আরও একবার তাই করি?’
আকাশে এমনভাবে বিদ্যুৎ চমকাল যেন মেটাল হ্যালোজেন বাতি ঝলসে উঠল৷ সমর্পিতা আর রনিতা ম্যাডামের মুখে-গায়ে সাদা আলো ঝিলিক মেরেই মিলিয়ে গেল৷
সমর্পিতা অনেক কিছুই করার কথা ভাবছিল, কিন্তু কোন এক অলৌকিক অভিশাপ ওকে যেন পায়ে পেরেক ঠুকে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷
ও একবার খোলা দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, আর-একবার জানলার দিকে৷ ও কি একছুটে বাইরের চাতালে চলে যেতে পারবে? তারপর চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারবে না? কিন্তু এখন কি ম্যাডামরা কেউ আছেন? বড়দিও হয়তো বাড়ি চলে গেছেন৷ এখন শুধু সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের লোকজনই যা ভরসা৷ কিন্তু এখান থেকে চিৎকার করলে সেই আওয়াজ কি সার্ভেন্টস কোয়ার্টার পর্যন্ত পৌঁছবে? এই বৃষ্টিতে কেউ কি আসবে?
সম্পি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল৷ ওই তো, রনিতা পিশাচটা খলখল করে হাসছে৷ ওকে ঠেকাতে কিছু একটা করতে হবে, করতেই হবে৷
সম্পি হঠাৎ কোথা থেকে শক্তি খুঁজে পেল কে জানে! ও দু-হাতের দুটো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিল টেবিলে৷ ভয়ংকর শব্দ হল৷ বিশাল টেবিলটা থরথর করে কেঁপে উঠল৷
আর রনিতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠলেন৷ তারপর বড় করে হাঁ করলেন৷
টিউবলাইটের আলোয় পিশাচের দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল৷ সম্পির দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
রনিতার দু-পাটিতেই হাঙরের মতো কয়েক সারি করে ইস্পাতের দাঁত৷ ঝকঝকে এবং ছুঁচলো৷
পপকর্ন খাওয়ার ভঙ্গিতে লোহার পেপারওয়েটটা হাঁ করা মুখের ভেতরে ছুড়ে দিলেন৷ তাপর কড়মড়-কড়মড় করে ওটা চিবোতে লাগলেন৷ ঠিক যেন তালমিছরির ডেলা চিবিয়ে গুঁড়ো করছেন৷
একটু পরেই লোহার গুঁড়ো থু-থু করে টেবিলে উগরে দিলেন রনিতা৷ তারপর পাতলা ঠোঁটের ওপরে কয়েকবার জিভ বুলিয়ে নিয়ে সম্পিকে লক্ষ করে হাসলেন৷
সম্পির শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজলের স্রোত নেমে গেল৷ এই পিশাচের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব৷ সম্পি একমাত্র পালানোর চেষ্টা করতে পারে৷ কিন্তু পা দুটো যে কিছুতেই নড়তে চাইছে না৷
টেবিলে ঘুসি মারার পর থেকেই সম্পির দু-হাতের মুঠো ব্যথা করছিল৷ ও হাত কচলে ব্যথা তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ কিন্তু ভয়…ভয়টা তাড়ানো যায় কেমন করে?
রনিতা ঘষা-ঘষা গলায় বললেন, ‘শোন মেয়ে, এই মুহূর্তে তুই যা-যা দেখছিস সবই তোর দেখার ভুল৷ এ-কথা মনে থাকে যেন! সব হ্যালুসিনেশান৷’ তারপর একটু রাগি কর্কশ স্বরে বললেন, ‘তোর সাহস তো কম নয়! আমাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে আসিস! এই দেখ…৷’
সমর্পিতাকে দিশেহারা কাবু অবস্থায় পেয়ে রনিতা যেন বেশ মজা পেয়ে গেছেন৷ ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে টিউবলাইটগুলোর দিকে একবার তাকালেন৷ তারপর ক্ষণপ্রভার গতিতে চোখের পলকে পৌঁছে গেলেন দেওয়ালে গাঁথা ইলেকট্রিক ওয়ারিং-এর কাছে৷ তারগুলোর ওপরে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷
আলোর ফুলকি ছিটকে বেরোল৷ ‘ফট’ করে একটা শব্দ হল৷ এবং ঘরের আলো নিভে গেল৷ ঘুরন্ত পাখার গতি কমতে লাগল৷
ঘরটা কেমন অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেল৷ জানলার বাইরে মেঘ আর বৃষ্টি যেন অকালসন্ধ্যা তৈরি করে দিয়েছে৷ সম্পির চোখের সামনে রনিতা ম্যাডামের অপচ্ছায়া৷ তাঁর চোখের অন্ধকার কোটরে দুটো সাদা আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ আর একইসঙ্গে শোনা যাচ্ছে চাপা খিলখিল হাসি৷
কর্কশ গলায় পিশাচটা বলল, ‘এবার বুঝেছিস, আমাদের কী শক্তি! আজকের এসব ব্যাপার কাউকে বলবি না৷ কাউকে না৷ যদি বলিস, তা হলে—যা বললাম—তুইও পরানের মতো হয়ে যাবি…৷’
এমন সময় তীব্র বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷
সেই কানফাটানো আওয়াজে সম্পির আতঙ্কের ঘোরটা হঠাৎই কেটে গেল৷ ও ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করতে শুরু করল এবং কোন এক শক্তিতে খোলা দরজার দিকে মরণপণ ছুট লাগাল৷
পিশাচটা ছুটন্ত সম্পিকে লক্ষ করে লাফ দিল৷ দু-লাফে পৌঁছে গেল দরজার কাছে৷
কিন্তু সম্পি ততক্ষণে বাইরের চাতালে এসে পড়েছে৷ ঝুপুস বৃষ্টি ওকে যেন হারানো শক্তি ফিরিয়ে দিল৷ ও ফিরে তাকাল টিচার্স রুমের দরজার দিকে৷
রনিতা ম্যাডাম সম্পিকে তাড়া করার ঝোঁকে টিচার্স রুম ছেড়ে চাতালে এসে পড়েছিলেন৷ কিন্তু বৃষ্টির জল গায়ে পড়তেই আঁতকে উঠলেন৷ এমনভাবে কাতরে উঠলেন যেন বৃষ্টির ফোঁটায় গায়ে ফোসকা পড়ছে৷
যন্ত্রণার ‘উঃ! আঃ!’ শব্দ করে রনিতা একলাফে টিচার্স রুমে আবার ঢুকে গেলেন৷
সম্পি সেটা দেখে অবাক হয়ে অঝোর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল৷ বৃষ্টির জলে কী এমন শক্তি আছে যে, এই পিশাচগুলো বৃষ্টির জলের ‘জ্বালা’ সইতে পারে না?
টিচার্স রুম এখন বেশ অন্ধকার৷ তাই রনিতা ম্যাডামকে সম্পি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না৷ কিন্তু ম্যাডাম ঘরে ঢুকে পড়ার আগে সম্পি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে৷ ওঁর শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ামাত্রই সেখান থেকে সাদা ধোঁয়া বেরিয়েছে৷ গরম লোহার শিক আচমকা জলে ডোবালে যেমনটা হয়৷
তা হলে কি সত্যি-সত্যিই বৃষ্টির ফোঁটায় এই পিশাচগুলোর ছ্যাঁকা লাগে? সেইজন্যই কি সেই ভয়ংকর রাতে এদের মাথায় ছাতা ছিল?
সম্পি তখনও চিৎকার করছিল : ‘কে কোথায় আছ, শিগগির এসো! দোতলায় আগুন লেগেছে—আগুন!’
কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাপারটা বুঝে ফেলার পর ওর হারানো সাহস খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল৷ তা ছাড়া ও লোকজনের ছুটে আসার শব্দ পাচ্ছিল৷
সম্পি আঁজলা করে বৃষ্টির জল ধরতে লাগল৷ এবং এগোতে লাগল টিচার্স রুমের দিকে৷ ওর ভেতরে এখন একটা রাগ টগবগ করে ফুটছিল৷
রনিতা ইলেকট্রিকের তারে কামড় বসানোমাত্রই শর্ট সার্কিট হয়ে স্কুল বিল্ডিং-এর অনেকটা অংশের আলো নিভে গেছে৷ সেই সময় দুজন দারোয়ান রোজকার মতো একতলার ঘরগুলোর জানলা-দরজা বন্ধ করে দরজায়-দরজায় তালা দিচ্ছিল৷ আচমকা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ওরা হকচকিয়ে যায়৷ আর তারপরই সম্পির চিৎকার ওদের কানে এল৷
সম্পির চিৎকার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারেও পৌঁছেছিল৷ সেখান থেকে বলাইদা আর মলিনাদি হন্তদন্ত হয়ে এসে দারোয়ানদের সঙ্গে জড়ো হল৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করল৷ বুঝতে পারল, চিৎকারটা দোতলার চাতাল থেকে আসছে৷
তা হলে কি দোতলাতেই আগুন লেগেছে?
কিন্তু ওরা চারজনে চাতালে এসে কাউকে দেখতে পেল না৷ আর আগুনও দেখতে পেল না৷
কারণ, সম্পি তখন বৃষ্টির জল আঁজলা করে নিয়ে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷ ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ সারা গা সপসপে ভেজা৷ মাথার চুল থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে৷ চুলের গোছা কপালের ওপরে নেমে এসেছে৷ আর সেই ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে ওর দুটো রাগি চোখ দেখা যাচ্ছে৷
‘কোথায় গেলি? আয়, সামনে আয়—’ পিশাচকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল ডাকাবুকো মেয়েটা৷
রনিতা তখন একটা আলমারির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লুকোতে চেষ্টা করছেন৷ ওঁর অন্ধকার গর্তের মতো চোখ দুটো সম্পির দিকে তাকিয়ে স্থির৷ আসলে ওরা তখন সম্পির আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের দিকে লক্ষ রাখছিল৷ অপেক্ষা করছিল, কখন সেই চুঁইয়ে পড়া বন্ধ হবে৷ অর্থাৎ মেয়েটার এক আঁজলা জল কখন শেষ হবে৷
জল শেষ হয়ে যাবে বলে সমর্পিতার মনে কিন্তু ভয় ছিল না৷ ও জানে ওর পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ বৃষ্টির জলে ভিজে সপসপে৷ এই অবস্থায় ওর পিশাচটাকে জড়িয়ে ধরার খুব সাধ জাগছিল৷
সম্পি হঠাৎই খেয়াল করল, আলমারির পাশে দাঁড়ানো রনিতার চেহারা ধীরে-ধীরে বদলে যাচ্ছে—স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে আবার৷ একইসঙ্গে দোতলার চাতালে অনেকের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে—কথা বলতে-বলতে কারা যেন টিচার্স রুমের দিকে এগিয়ে আসছে৷
সম্পির হাতের জল শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ রনিতাকে ও এখন আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল৷
রনিতা হিসহিস করে চাপা গলায় বললেন, ‘আজকে যা কিছু দেখলি কাউকে বলবি না৷ তা হলে তোর সর্বনাশ হবে৷ মনে রাখিস, আমি একা নই—আমরা সবাই মিলে তোকে অনায়াসে খতম করে দেব…৷’
রনিতা ম্যাডাম স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে এলেন৷ ঠোঁটে আঙুল তুলে ইশারায় সমর্পিতাকে চুপচাপ থাকতে বললেন৷
‘কই, কোথায় আগুন লেগেছে?’ পুরুষের গলা : ‘ঘর অন্ধকার কেন?’
‘কে অমন চিৎকার করছিল গো?’ মহিলার কণ্ঠস্বর : ‘কী-করে আগুন লাগল বলো দেখি…৷’
সমর্পিতা পিছন ফিরে চারজনকে দেখতে পেল৷ ওরা তখন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হুড়মুড় করে টিচার্স রুমে ঢুকে পড়েছে৷
সমর্পিতা কিছু বলে ওঠার আগেই মানুষের ছদ্মবেশে থাকা পিশাচটা বলে উঠল, ‘এই তো, এই তারটা শর্ট সার্কিট হয়ে আর-একটু হলেই আগুন লেগে যাচ্ছিল৷ ভাগ্যিস আমি এই ডাস্টারটা দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে চেপে ধরেছি—৷’
টেবিল থেকে একটা ডাস্টার তুলে নিয়ে দেখালেন রনিতা৷
সম্পি স্থির চোখে ওঁকে দেখছিল৷ পিশাচরা তা হলে অভিনয়টা ভালোই জানে!
রনিতা বললেন, ‘সমর্পিতা থাকায় একটা বড় হেলপ হয়েছে৷ ও সঙ্গে-সঙ্গে ওরকম না চেঁচালে তোমরা কি এত চটপট আসতে?’ সমর্পিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন : ‘থ্যাংক য়ু, সমর্পিতা৷ তোমাকে আমি কাল একটা রিওয়ার্ড দেব…৷’
ঠিক তখনই সাদা আলোর ঝলকানি, আর তারপরই কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷
.
৷৷আট৷৷
সমর্পিতা স্কুল বিল্ডিং-এর বাইরে এসে দাঁড়াল৷ বৃষ্টির তেজ খানিকটা কমে এসেছে৷ মেঘলা আকাশের সঙ্গে সন্ধের অন্ধকার মিশে গিয়ে ছাই রং অনেক গাঢ় হয়েছে৷
সমর্পিতার ব্যাগে ছাতা আছে কিন্তু ও ছাতা বের করল না৷ একে তো ওর সর্বাঙ্গ চুপচুপে ভেজা—ছাতা ওকে নতুন কোনও নিরাপত্তা দিতে পারবে না৷ বরং বৃষ্টির জল ওকে রনিতা ম্যাডামের মতো ভয়ংকর প্রাণীগুলোর হাত থেকে বাঁচাবে৷
সমর্পিতা বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল, থরথর করে কাঁপছিল৷ ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করে শব্দ হচ্ছিল৷ তার সঙ্গে বেশ শীত করছিল৷
ও কালো আকাশের দিকে তাকাল৷ বৃষ্টি উপহার দেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে মনে-মনে কৃতজ্ঞতা জানাল৷
স্কুল বিল্ডিং-এর কাছ থেকে পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেন গেটের দিকে৷ সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল সম্পি৷ হেঁটে যাওয়ার সময় ও বারবার বাঁ-দিকের ঝোপঝাড় আর গাছপালার দিকে তাকাচ্ছিল৷ এই গাছপালার আড়ালে রনিতা ম্যাডামের মতো কেউ লুকিয়ে নেই তো?
কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই ওর মনে হল, যেরকম জোরে বৃষ্টি পড়ছে তাতে খোলা জায়গায় ওরা থাকতে সাহস পাবে না৷ বৃষ্টিতে গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে৷ আর যদি সেদিনের মতো ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরাঘুরির কথা ভাবে তাতেও লাভ নেই৷ কারণ, এ-বৃষ্টি ছাতায় তেমন মানবে না৷
সম্পি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল৷ বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে৷ স্কুল থেকে বেরিয়েই বাস কিংবা অটো পেলে হয়৷
ভেজা পিচের রাস্তায় বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে৷ রাস্তার ধারে লাগানো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলো রাস্তায় পড়ে কমলা রঙের আলোর ফুলকি তৈরি করছে৷ স্কুলের দু-চারজন মেয়ে তাদের গার্জেনের সঙ্গে ফিরছে৷ এ ছাড়া রাস্তাটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা৷ আর দূরের খেলার মাঠটা বৃষ্টিতে ঝাপসা৷
‘এই, সম্পি—৷’
সমর্পিতা চমকে উঠল৷ বুক ধড়াস করে উঠল৷ ডাক লক্ষ্য করে ফিরে তাকাল৷
ও খেয়ালই করেনি, একটা বড় নিমগাছের নীচে দুটো মেয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
ইলিনা আর সজনী৷
ওরা দুজনে সম্পির কাছে এগিয়ে এল৷
‘তোর জন্যে চিন্তা হচ্ছিল৷ তাই বাড়ি যাইনি—ওয়েট করছি৷’ ইলিনা বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম কী শাস্তি দেয় না দেয়৷ আমি ওয়েট করব শুনে সজনীও থেকে গেল৷’
‘তুই ভিজছিস কেন? ছাতা নেই?’ সজনী জিগ্যেস করল৷
‘তুই এরকম কাঁপছিস কেন?’ ইলিনা৷
সমর্পিতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না৷ ইলিনাকে জাপটে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷
ইলিনা হকচকিয়ে গেল৷ কোনও-রকমে ছাতা সামলে সম্পির ভেজা পিঠে হাত বোলাতে লাগল আর বারবার বলতে লাগল, ‘কী হয়েছে রে, সম্পি—কী হয়েছে?’
সম্পি কাঁদতেই থাকল৷ ওর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল৷ আর একইসঙ্গে পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলতে লাগল, ‘কিছু হয়নি, কিছু হয়নি৷’
ইলিনা আর সজনী কিছুতেই ওকে শান্ত করতে পারছিল না৷
একটু পরে দু-পাশ থেকে সম্পিকে জাপটে ধরে ওরা মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল৷ ইলিনার মনে হল, রনিতা ম্যাডাম নিশ্চয়ই সম্পিকে সাংঘাতিক অপমান করেছেন, কিংবা চড়-থাপ্পড় মেরেছেন বা কান মূলে দিয়েছেন৷
ওরা যখন স্কুলের গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন একটা গাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলো ওদের চোখে-মুখে এসে পড়ল৷
আলোর দিকে তাকিয়ে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ওরা স্পষ্ট দেখতে পেল৷ কিন্তু আলোর পিছনে সব অন্ধকার—কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷
গাড়িটা ওদের দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল৷
সেটা দেখে ইলিনারা পিচের রাস্তার পাশে ঘাসজমির দিকে সরে গেল৷ কিন্তু গাড়িটা গতিপথ বদলে ওদের মুখোমুখি এসে পথ আগলে দাঁড়াল৷
ইলিনা একটু ভয় পেয়ে গেল৷ সজনীও৷ গাড়িটা ওদের পথ আগলে দাঁড়াল কেন?
ঠিক তখনই গাড়ি থেকে কে যেন ডেকে উঠল, ‘ইলিনা, এসো—সবাই গাড়িতে উঠে এসো…৷’
অনুষ্কার গলা৷
অনুষ্কা এখনও বাড়ি যায়নি? ছুটির পর এতক্ষণ ধরে ও কী করছে?
ওরা তিনজনে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ দেখল সামনের জানলার কাচটা সামান্য নামানো৷ সেখানে আবছাভাবে অনুষ্কার মুখ দেখা যাচ্ছে৷ ওর পাশেই স্টিয়ারিং-এ ওর বাবা৷
‘তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে এসো—৷’ অনুষ্কা তাড়া দিল৷ গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে গেল৷
সম্পিকে গাড়িতে উঠতে বলল ইলিনা৷ তারপর ছাতা বন্ধ করে নিজে উঠল৷
সজনী ইতস্তত করছিল৷ বলল, ‘আমি বাড়ি যাব—৷’
অনুষ্কা বলল, ‘চিন্তা কোরো না—আমি সবাইকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব৷’
ওরা তিনজনে পিছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল৷
অনুষ্কা ওর বাবার সঙ্গে সম্পি আর সজনীর পরিচয় করিয়ে দিল৷ ওর বাবা গাড়িটা ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বৃষ্টি! তোমরা সব একেবারে ভিজে গেছ দেখছি!’
ইলিনা সৌজন্যের ঢঙে বলল, ‘ও কিছু না, কাকু—বাড়িতে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেব৷’
সমর্পিতার গা ঘেঁষে বসেছিল ইলিনা৷ তাই টের পাচ্ছিল সম্পি তখনও তিরতির করে কাঁপছে৷
ও চাপা গলায়, প্রায় ফিসফিস করে, জিগ্যেস করল, ‘সম্পি তোর কী হয়েছে রে? এবার শান্ত হ৷’
সমর্পিতা অস্পষ্টভাবে বলল, ‘কিচ্ছু না—৷’
অনুষ্কা ওদের কথা শুনতে পেয়েছিল৷ ও নরম সুরে বলল, ‘এখন ওকে ডিসটার্ব কোরো না৷ আমি সব জানি৷ পরে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলব…৷’
সমর্পিতা অবাক হয়ে অনুষ্কার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না৷
ভিজে রাস্তায় গাড়ি চলতে লাগল৷
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সম্পি৷ বৃষ্টি এখনও পড়ছে৷ সেই বৃষ্টির ফোঁটার ঝিলিমিলির আড়ালে রনিতা ম্যাডামের পালটে যাওয়া মুখটা ও দেখতে পাচ্ছিল৷
আজ বৃষ্টি নেই৷ খোলা জানলার বাইরে অন্ধকার৷ বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে৷
জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অনুষ্কা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ কী দেখছিল কে জানে!
হঠাৎ করে ও ঘুরে দাঁড়াল৷ বিছানায় বসে থাকা ইলিনার দিকে সরাসরি তাকাল৷
বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর গায়ের সবুজ রঙের টপটা কোমরের কাছ থেকে ইঞ্চিচারেক ওপরে তুলে ধরল ও৷
ওর নাভির ঠিক ওপরে কালো রঙে আঁকা একটা ছবি : একটা ফুলকে ঘিরে আছে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷
ঠিক এই ছবিটাই লাগানো রয়েছে ওর ঘরের দেওয়ালে৷ এই ছবিটাই ওকে খাতার পাতায় আঁকতে দেখেছিল ইলিনা৷ তখন ওর ছবিটা ভালো লেগেছিল৷ ও তা থেকে ট্যাটুর ডিজাইন করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু অনুষ্কা তাতে সায় দেয়নি৷ বাজে ওয়ার্থলেস ছবি বলে কাটাকুটি দাগ দিয়ে ছবিটা নষ্ট করে দিয়েছিল৷
অথচ সেই ছবিটাকেই বডি ট্যাটু করে বসে আছে ও!
‘এই ছবিটাকে তুমি বাজে ওয়ার্থলেস বলেছিলে—’ অভিযোগের সুরে বলে উঠল ইলিনা, ‘আর সেই ছবিটাকেই ট্যাটু করে বসে আছ! আশ্চর্য!’
অনুষ্কা অল্প হাসল৷ টপটা তুলে ধরা অবস্থায় কয়েকটা পা ফেলে ইলিনার খুব কাছে এগিয়ে এল৷ বলল, ‘তুমি ভুল করছ, ইলিনা—এটা মোটেই ট্যাটু নয়৷ হাত দিয়ে দ্যাখো…৷’
সত্যিই ইলিনা আঙুল ছোঁয়াল ছবিটায়৷ ছবিটা যে উল্কি নয় সেটা বুঝতে চাইল : ‘ট্যাটু নয় তো এটা তা হলে কী?’
‘এটা জন্মদাগ৷ মানে, জন্মচিহ্ন৷ আমাদের সবার পেটে আছে৷’
‘জন্মচিহ্ন মানে?’
‘জন্মচিহ্ন মানে জন্মের সময় থেকেই এই দাগটা আমাদের সবার পেটে থাকে…৷’
‘আমাদের সবার মানে কারা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ইলিনা৷
‘আমি, বাপি, মা—আমাদের সবার পেটে এই ছবি আছে—জন্মদাগ৷’
‘কেন? এ কী পিকিউলিয়ার ব্যাপার!’
টপটা ছেড়ে দিল অনুষ্কা৷ ওটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিল৷ তারপর ইলিনার চিবুকে হাত দিয়ে বলল, ‘পিকিউলিয়ার নয়, ইলিনা৷ ভ্যাম্পায়ারদের এটাই নিয়ম…৷’
‘ভ্যাম্পায়ার?’ ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ইলিনা৷ অনুষ্কার হাতটা সরিয়ে দিল : ‘কী বলছ তুমি!’
‘হ্যাঁ, ইলিনা—’ নীচু গলায় বলল, ‘ভ্যাম্পায়ারদের চেনার এটাই সবচেয়ে বড় চিহ্ন৷ তা ছাড়া এই সিম্বলটা আমাদের কাছে খুব পবিত্র…’ দেওয়ালে লাগানো সাপ আর ফুলের ছবিটার দিকে দেখাল : ‘এটা আমাদের পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে৷ তাই আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়…৷ অবশ্য এটা দেখতে পেলেও সবাই ট্যাটু ভাববে৷’
ইলিনা কাঁপছিল৷ ওর চোখ বড়-বড় হয়ে গিয়েছিল৷ ও ভয়ের চোখে সহপাঠীকে দেখছিল৷
অনুষ্কা ভ্যাম্পায়ার!
‘ইলিনা, প্লিজ…ভয় পেয়ো না৷ মানুষের মতো…আমাদের মধ্যেও… ভালো-খারাপ আছে৷ আমরা ভালো, ইলিনা, বিশ্বাস করো—৷’
ইলিনার মাথা ঝিমঝিম করছিল৷ চোখে ঝাপসা দেখছিল৷ ও মাথা পিছনে হেলিয়ে বিছানায় দু-হাতে ভর দিল৷
ওর চোখ গেল দেওয়ালে টাঙানো রাতের ছবিটার দিকে৷ জ্যোৎস্না ধোওয়া রাত৷ বিশাল প্রাসাদ৷ পূর্ণিমার চাঁদ৷
আগের দিন ছবিটা যেমন দেখেছিল আজ যেন একটু বদলে গেছে৷ প্রাসাদের ছায়ার পাশ থেকে চাঁদটা যেন অনেকটা দূরে সরে গেছে৷ আর আগের দিন, যতদূর ইলিনার মনে পড়ছে, বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷
আজ আলো জ্বলছে দুটো জানলায়!
নিজেকে সামলে নিল ইলিনা৷ মাথা ঝিমঝিম করলে চলবে না৷ চোখে ঝাপসা দেখলে চলবে না৷
ও তাকাল অনুষ্কার মুখের দিকে৷
এই অপরূব রূপসী মেয়েটা ভ্যাম্পায়ার!
আজ টিফিনের সময় অনুষ্কা ইলিনাকে ডেকেছিল৷
ইলিনা ওর কাছে যেতেই ও বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে৷ ভীষণ ইমপরট্যান্ট কথা৷ তুমি আজ ছুটির পর আমাদের বাড়ি চলো—প্লিজ৷’
অনুষ্কার মুখে আকুতির ভাব ফুটে উঠেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এমন সব কথা ও ইলিনাকে বলতে চায় যেগুলো না বলতে পারলে ও কষ্ট পাবে৷
ইলিনা রাজি হয়েছিল৷ একইসঙ্গে ওর মনে হয়েছিল, রনিতা ম্যাডামের সমস্যাটা যদি সমাধান করতে হয় তা হলে অনুষ্কার সাহায্য দরকার৷ কারণ, সমর্পিতার ব্যাপারটা যে ইলিনা জানতে পেরেছে সেটা শুধু অনুষ্কার জন্য৷
ওই ঘটনার পর সমর্পিতা এক সপ্তাহ স্কুলে আসেনি৷ ওর বাড়িতে ফোন করে ইলিনা জেনেছে, পরদিন ভোরবেলা থেকে সম্পির খুব জ্বর৷ সেই জ্বর এতটাই খামখেয়ালিভাবে ওঠানামা করছিল যে, সম্পির মা-বাবা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ তা ছাড়া সম্পি জ্বরের মধ্যে ভুল বকছিল৷ সবকিছু মিলিয়ে ওর মা-বাবা ভাবছিলেন ব্যাপারটা ভাইরাল ফিভার নয়—অন্য কিছু৷
ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা একদিন স্কুলের পর সম্পিকে দেখতে গিয়েছিল৷ তখন ও অনেকটা সামলে উঠেছে৷
ইলিনা আর সজনী ওকে সেদিন টিচার্স রুমের ব্যাপার নিয়ে অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সম্পি গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ ঠিকঠাক কোনও জবাব দিল না৷
ওর মা নানান কথা বলছিলেন৷
‘দ্যাখো না, যে-মেয়ে সবসময় সাহসের বড়াই করে সে কেমন ভয়ে চুপসে গেছে৷ এই তো, গত পরশু—যখন জ্বরটা খুব বেড়েছিল—তখন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিল৷ বারবার বলছিল, ‘‘বৃষ্টির জল৷ বৃষ্টির জল দিয়েই খতম করতে হবে…বৃষ্টির জল চাই…বৃষ্টি চাই৷’’
‘আমি ওকে মাথায় জলপটি দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে সাড় ফেরাতেই কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল৷ অনেকবার জিগ্যেস করলাম, ‘‘বৃষ্টির জল দিয়ে কী করবি বলছিলি?’’ তো ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল—কোনও জবাব দিল না৷ বলো দেখি, কী মুশকিল!
‘তা ছাড়া ক’দিন ধরে খাবারদাবার কিছু মুখে তুলছে না৷ শুধু বলছে খিদে নেই৷ তোমরা ওকে একটু বুঝিয়ে বলো তো৷ ঠিকঠাক না খেলে শরীরে জোর পাবে কেমন করে?’
সম্পির মা একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন৷ আর অনুষ্কা শান্ত চোখে সম্পির দিকে তাকিয়ে ওকে দেখছিল৷
‘ও, হ্যাঁ৷ তোমাদের একজন দিদিমণি বাড়িতে ফোন করেছিলেন৷ সম্পি কেমন আছে সে-খবর নিচ্ছিলেন৷ বললেন, সম্পি ওঁর খুব প্রিয় স্টুডেন্ট…৷’ মেয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন : ‘অ্যাই, কী নাম যেন ওই দিদিমণির? তোকে যে সেদিন বললাম…৷’
সম্পি নিষ্প্রাণ স্বরে বলল, ‘রনিতা ম্যাডাম৷’
ইলিনা আর সজনী মুখচাওয়াচাওয়ি করল৷ কিন্তু কোনও কথা বলল না৷
একটু পরে সম্পির মা ঘর ছেড়ে চলে যেতেই অনুষ্কা বলল, ‘সম্পি, রনিতা ম্যাডাম তোমাকে থ্রেট করেছেন?’
সম্পি চুপ করে রইল৷ বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আঙুল খুঁটতে লাগল৷
‘আমি সব জানি, সম্পি৷ রনিতা ম্যাডাম এখন আর মানুষ নেই— অন্য কিছু হয়ে গেছেন৷ পরানের মার্ডারে রনিতা ম্যাডাম ইনভলভড…৷’
সমপির্তা চমকে মুখ তুলে তাকাল৷ ইলিনা আর সজনীও তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
‘তুমি কেমন করে জানলে?’ সম্পি অস্পষ্ট গলায় জিগ্যেস করল৷
‘আমি জানি—’ আত্মবিশ্বাসের জোর ফুটে বেরোল অনুষ্কার উত্তরে : ‘সেদিন ঠিক কী হয়েছিল আমাকে খুলে বলো৷’ অনুষ্কা সম্পির কাঁধে একটা হাত রাখল : ‘কোনও ভয় নেই৷ আমরা তোমাকে হেলপ করতে চাই…৷’
তিনজনে মিলে আরও খানিকক্ষণ বোঝাতেই সম্পি নরম হল৷ ও দুর্বল গলায় ধীরে-ধীরে সেদিনকার সব ঘটনা খুলে বলল৷
শুনতে-শুনতে ইলিনা আর সজনীর ভেতরে ভয়ের হিমেল স্রোত ছড়িয়ে পড়ল৷ এসব কী বলছে সম্পি!
ওর কাহিনি শুনতে-শুনতে অনুষ্কা উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ ওর ফরসা গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ল৷
একসময় ওরা তিনজন উঠে পড়ল৷ বাড়ি ফিরতে হবে৷ বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে৷
ক’দিন ধরেই রোজ ভালো বৃষ্টি হচ্ছে৷ রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে৷
আজ সম্পির বাড়ি আসার ব্যাপারে অনুষ্কা একটু কিন্তু-কিন্তু করেছিল৷ বলেছিল, যদি সম্পির বাড়ির রাস্তায় জল জমে যায় তা হলে কিছুতেই ও গাড়ি থেকে নামতে পারবে না৷
শেষ পর্যন্ত সেরকম বৃষ্টি হয়নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুষ্কা রেনকোট এবং ছাতা দুটোই নিয়ে বেরিয়েছে৷ এ নিয়ে ইলিনা আর সজনী ওকে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি৷ কিন্তু অনুষ্কা সেই পুরোনো কথাই বলেছে : বৃষ্টি ওর ভালো লাগে না৷
সম্পির বাড়ি থেকে ফেরার পর তিনটে দিন অনুষ্কা কীরকম যেন আনমনা ছিল৷ তারপর আজ ইলিনাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছে৷
ইলিনা অন্ধকার প্রাসাদের ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ না, ও মোটেই ভুল দেখছে না৷ আজ সত্যি-সত্যিই দুটো জানলায় আলো জ্বলছে!
‘এই ছবিটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও মিস্ট্রি আছে৷’ প্রাসাদের ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ইলিনা বলল, ‘আজ দেখছি দুটো জানলায় আলো জ্বলছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন তোমার বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন…৷’
ওকে থামিয়ে দিয়ে অনুষ্কা বলল, ‘বাড়িটার একটা জানলায় আলো জ্বলছিল৷’ তারপর ইলিনার পাশে বসে পড়ল : ‘সেদিন তোমাকে বলিনি—আজ বলছি৷ এই বাড়িটা আমাদের পূর্বপুরুষের—তিনহাজার বছরের পুরোনো৷ আমাদের মতন যারা…মানে, ইয়ে…তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে এই ছবিটা লাগানো আছে৷ এই ছবিটার একটা সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ ওটা নিজে-নিজে অনেক কিছু করতে পারে—৷’
কথা বলতে-বলতে অনুষ্কা লক্ষ করল ইলিনার মুখে ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে৷ ও বিছানায় ঘষটে অনুষ্কার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে চাইছে৷
অনুষ্কা ওর হাত চেপে ধরল৷ অনুনয়ের গলায় বলল, ‘ইলিনা, প্লিজ… বিলিভ মি৷ আমি তোমার বন্ধু—বেস্ট ফ্রেন্ড৷ এটা ঠিকই যে, আমাদের লাইফ আর লাইফ স্টাইল তোমাদের চেয়ে আলাদা৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা কখনও মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারি না৷ তুমি কি বিশ্বাস করবে, আমরা প্রায় চারশো বছর ধরে মানুষের রক্তের তেষ্টা ভুলে গেছি! তার বদলে আমরা ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, চড়াই, পায়রা এসব দিয়ে খিদে-তেষ্টা মেটাই! আমার বাপি আর মা কী বলেন জানো? বলেন, আমাদের অবজেকটিভ হল রেগুলার চেষ্টা করে-করে ফাইনালি ভেজিটারিয়ান হয়ে ওঠা৷ হ্যাঁ, এটাই আমাদের চরম মুক্তি৷’
অনুষ্কার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল৷ বড়-বড় শ্বাস নিয়ে ও বলল, ‘আমাদের প্রবলেম একটাই : আমরা সেদ্ধ, ভাজা, পোড়ানো—মানে, রান্না করা খাবার একদম খেতে পারি না৷ আমাদের সিস্টেম নেয় না৷ তাই আমরা সবকিছু কাঁচা খাই৷
‘কিন্তু তা বলে আমরা হাল ছাড়িনি৷ আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি৷ মানুষের বন্ধু হতে চেষ্টা করছি৷ মানুষের মতো হতে চাইছি৷ বিশ্বাস করো, প্লিজ…৷’
অনুষ্কার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল৷ যেন হিরের কুচি ওর ফরসা গালের ওপরে চিকচিক করছিল৷
ওর দুঃখী মুখের দিকে তাকিয়ে ইলিনার মনে হল, এ চোখের জল মিথ্যে হতে পারে না৷ এর মধ্যে কোথায় যেন সত্যের ঝিলিক আছে৷
মুহূর্তের মধ্যে ইলিনার মনে এক আশ্চর্য আবেগ তৈরি হয়ে গেল৷ ও সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুষ্কাকে জাপটে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ওর চোখেও জল এসে গেল৷ কান্না জড়ানো গলায় ও বারবার বলতে লাগল, ‘তুমি আমার বন্ধু, অনুষ্কা৷ তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড…বেস্ট ফ্রেন্ড…৷’
.
৷৷নয়৷৷
সমর্পিতা যখন স্কুলে আবার এল তখন ওর জ্বর সেরে গেছে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল৷ আগের চেয়ে রোগা দেখাচ্ছে ওকে৷ পিঠের স্কুল-ব্যাগটা প্রকাণ্ড আর বেঢপ মনে হচ্ছে৷
সমর্পিতা এখন অনুষ্কার পাশে বসে৷ ফাঁক পেলেই ওর সঙ্গে গল্প করে৷ আর রনিতা ম্যাডামের ভয়ের কথা আলোচনা করে৷
অনুষ্কার অন্যপাশে বসে ইলিনা৷ অনুষ্কার পাশে বসতে ওর ভালো লাগে তাই৷
অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সমর্পিতা বুঝতে পেরেছে, অনুষ্কার বুদ্ধি অনেক তীক্ষ্ণ এবং গভীর৷
অনুষ্কার পরামর্শেই এখন ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসে৷ সেটা হয় সাইলেন্ট মোডে রাখে অথবা অফ করে রাখে৷ কারণ দিদিমণিরা টের পেলেই শাস্তি পেতে হবে৷
সেদিন অনুষ্কার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ইলিনা রাতে ঘুমোতে পারেনি৷ অন্ধকারে জেগে থেকে শুধু ওই অদ্ভুত মেয়েটার কথা ভেবেছে৷
ভ্যাম্পায়ারের গল্প ইলিনা বইয়ে পড়েছে, দু-একটা সিনেমাতেও দেখেছে৷ কিন্তু বাস্তবে ভ্যাম্পায়ার হয় বলে কখনও ভাবেনি৷ তা ছাড়া ভ্যাম্পায়াররাও যে খারাপ এবং ভালো দু-রকমের হতে পারে সেটাও কখনও ভেবে দেখেনি৷
অনুষ্কা ওকে বলেছে, ‘আমরা কখনও কারও ক্ষতি করি না৷ আমাদের ধর্মে অকারণে শক্তি ব্যবহার করা বারণ৷ আমাদের অনেকরকম সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে৷ কিন্তু সেগুলো খুব জরুরি সিচুয়েশান না হলে আমরা ইউজ করি না৷ আমরা সবসময় চুপচাপ থাকি, কারও ব্যাপারে নাক গলাই না৷ কারণ, আমরা…আমরা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’
অনুষ্কার গোপন কথা ইলিনা কাউকে বলেনি৷ এমনকী মা-বাবাকেও নয়৷
স্কুলে অনুষ্কার পাশে রোজ বসতে পেরে ইলিনার নিজেকে অনেক বেশি সাহসী, শক্তিশালী আর বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, রনিতা ম্যাডাম—কিংবা ওইরকম কোনও পিশাচ—ওর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না৷
ইলিনা পরানের কথা ভাবছিল৷
পরান মারা যাওয়ার পর যে-ঢেউ উঠেছিল সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে সেটা থিতিয়ে গেল৷ রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল৷ এবং স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হয়ে গেল৷ হেডমিসট্রেস প্রীতি দত্ত নোটিশ জারি করে সে-কথা সব ক্লাসে জানিয়ে দিলেন৷
সমর্পিতা মাঝে-মাঝে রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে৷ বন্ধুদের বলে ইতিহাস পড়া বুঝতে যাচ্ছে৷ আসলে ও এ-কথাই বলতে যায় যে, ও সেদিনকার কথা কাউকে বলেনি৷
রনিতা ম্যাডামকে দেখে ও অবাক হয়ে যায়৷ এত স্বাভাবিক, এত স্নেহ-মাখানো ব্যবহার! সেদিন কর্কশ-স্বরে-কথা-বলা ভয়ংকর চেহারার যে-পিশাচকে সমর্পিতা দেখেছিল সেটা মনে হয় যেন সত্যি-সত্যি দেখার ভুল, হ্যালুসিনেশান৷
রনিতা ম্যাডামের ওপর নজরদারির কাজটা ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা—তিনজনে মিলে করতে লাগল৷ ওরা চোখ-কান খোলা রেখে খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগল৷ আর অনুষ্কাকে সব খবর জানাতে লাগল৷
স্কুলের পিছনদিকে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে অনেক বড়-বড় গাছ আছে৷ সেখানে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অনেক পুরোনো টিন, অ্যাসবেস্টস শিট, ভাঙা কাঠ, আর শ্যাওলা ধরা কয়েকশো ইট ডাঁই করে রাখা আছে৷
একদিন টিফিনের সময় বাইরের মাঠে অনুষ্কা আর ইলিনা গল্প করছিল৷ হঠাৎ কোকিলের মিষ্টি ডাক শোনা গেল৷
স্কুলের বাগানে সবসময়েই কোকিলের ডাক শোনা যায়৷ শুনে মনে হয় কোকিলরা শুধু বসন্তকাল নয়, বর্ষাকালেরও ইজারা নিয়ে নিয়েছে৷ ইলিনার খুব ইচ্ছে যে, ও ‘ডাকন্ত’ কোকিল দেখবে৷ ওর চোখ প্রায়ই সেই দৃশ্যটা খুঁজে বেড়ায়৷ কিন্তু সেই ‘দুর্লভ’ দৃশ্যটা ও আজও খুঁজে পায়নি৷
তাই টিফিনের সময় কোকিলের ডাক শুনেই ইলিনা একেবারে লাফিয়ে উঠল৷ ও অনুষ্কার হাত ধরে টানতে-টানতে ডাকের উৎস লক্ষ করে ছুট লাগাল৷
আন্দাজে ভর করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত ওরা চলে এল স্কুলের পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে৷ গাছপালার অঞ্চলে ঢুকে ওপরদিকে মুখ তুলে গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকে কোকিলটা খুঁজতে লাগল৷
অনুষ্কাই প্রথম দেখতে পেল পাখিটাকে৷ কুচকুচে কালো রং৷ একটা লম্বা গাছের ওপরদিকে একটা ডালের একেবারে গোড়ায় বসে আছে পাখিটা৷ ‘কু-উ, কু-উ’ করে ডাকছে৷
ইলিনা কোকিলটাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল৷ বলল, ‘আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছে আজ ফুলফিলড হল—৷’
একটু পরেই পাখিটা উড়ে চলে গেল অন্যান্য গাছের আড়ালে৷
ওরা যখন ফিরে আসছে তখনই ইলিনার চোখে পড়ল, ইট-কাঠের স্তূপের পাশে দুটো লোমশ প্রাণী পড়ে আছে৷
দেখে চেনা গেল৷ একটা কাঠবিড়ালি, আর একটা বেজি৷ দুটো প্রাণী যেন পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে৷
ওরা চট করে সেগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ ঝুঁকে পড়ে কাঠবিড়ালির দেহটা হাতে তুলে নিল অনুষ্কা৷
হালকা৷ ফাঁপা৷ বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরে সারবস্তু কিছু নেই৷ গলার কাছটায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷
ইলিনা বেজির দেহটা একবার তুলেই ফেলে দিল৷ সেটাও চরিত্রে কাঠবিড়ালিটার মতো৷
অনুষ্কা বলল, ‘বুঝতে পারছ, ডেডবডিগুলো অন্যরকম?’
‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি—পরানের মতন৷’
‘এগুলো বেশি পুরোনো নয়৷ গন্ধ থেকে বুঝতে পারছি…’ কাঠবিড়ালিটা ফেলে দিল : ‘কিছু একটা করা দরকার…৷’
ইলিনা ঘড়ি দেখল৷ এখুনি টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়বে৷ রবিনা ম্যাডামের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে৷ তাই ওরা স্কুল বিল্ডিং-এর দিকে প্রায় ছুট লাগাল৷
ওদের এই কয়েকদিনের গোয়েন্দাগিরিতে একটা ব্যাপার ওরা লক্ষ করেছে৷ ক্লাস নাইনের ‘এ’ সেকশানের একজন ছাত্রী আর ক্লাস টেন ‘সি’ সেকশানের একজন ছাত্রী প্রায়ই রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যায়৷
ইলিনা, সজনী, সমর্পিতা আর অনুষ্কা ওরা যে যখন যা জানতে পারে সেটা এস-এম-এস করে বা ফোন করে বাকিদের জানিয়ে দেয়৷
পরানের মৃত্যুর ঘটনার পর স্কুলের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে অনেকগুলো বাড়তি আলো লাগানো হয়েছে৷ স্কুল ক্যাম্পাসের রাস্তায় যেসব ল্যাম্পপোস্টের আলো খারাপ ছিল সেগুলো পালটানো হয়েছে৷ এ ছাড়া বড়দি উদ্যোগ নিয়ে জঙ্গলের কিনারায়, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড আর ফেস্টিভ্যাল হলের চারপাশে অনেকগুলো নতুন আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷
এই চেষ্টা দেখে রনিতা ম্যাডাম একদিন ব্যঙ্গ করে সম্পিকে বলেছেন, ‘আলো দিয়ে ভূত তাড়ানোর কনসেপ্ট বহুকাল হল বাতিল হয়ে গেছে৷ আলোয় আমাদের কোনও প্রবলেম নেই৷’ হাসলেন ম্যাডাম৷ তারপর : ‘যখন আমাদের তেষ্টা পায় তখন কীসের আলো আর কীসের অন্ধকার! তুই-ই বল…৷’
সম্পি কোনও জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল৷ তারপর স্কুল ছুটির সময় বাকি তিনজন বন্ধুকে খবরটা জানিয়েছিল৷ তারপর বলেছিল, ‘ওর কথার টোনে আমার মনে হয়েছে খুব শিগগিরই ওরা আর-একটা বড় কুকীর্তি করতে চলেছে…৷’
ইলিনা ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘রিহার্সাল আবার শুরু হয়েছে৷ আমার মনে হচ্ছে, ওই পিশাচটা যতই বলুক, রাতের আলোতেই ওদের অ্যাক্টিভিটি বেশি…৷’
এই দুশ্চিন্তাটা ইলিনার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল৷ চিন্তায়-চিন্তায় বহুক্ষণ একা-একা ছটফট করার পর ও অনুষ্কাকে ফোন করেছে৷
অনুষ্কা ফোন ধরতেই ইলিনা বলেছে, ‘শোনো, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করব—৷’
‘বলো৷’
‘কাল থেকে অ্যানুয়াল ফাংশানের রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তুমি কাল থেকে রিহার্সালে চলো…৷’
অনুষ্কা ইতস্তত করল : ‘কী করে যাই বলো তো! একে তো কোনও প্রোগ্রামে আমি নাম দিইনি, তার ওপর আমি—মানে, আমরা—মানুষদের এড়িয়ে চলি৷ নইলে ধরা পড়ে যেতে হয়৷ যেমন তোমার কাছে ধরা পড়ে গেলাম৷’
‘কিন্তু তুমি যদি হেলপ না করো তা হলে কেমন করে হয়! তুমিই তো বলেছ, তুমি সব জানো৷ তুমি ভরসা দিয়ে বলেছ ‘‘আমি তো আছি!’’ ফাংশানের রিহার্সাল রোজ সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলবে৷ যদি কারও কোনও বিপদ হয়! যদি সম্পির আবার কোনও বিপদ হয়! ও তো রনিতা ম্যাডামের টার্গেট হয়ে আছে…৷’
অনুষ্কা চুপ করে ভাবছিল৷
ইলিনা আবার বলল, ‘ওসব জানি না, তুমি কাল রিহার্সালে যাবে৷ আর কিছু না পারো অন্তত একটা আবৃত্তি করবে৷ রবিনা ম্যাডামকে বলবে৷ তুমি রিহার্সালে থাকলে আমরা সবাই ভরসা পাব…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনুষ্কা বলেছে, ‘ঠিক আছে—কাল থেকে আমি রিহার্সালে যাব৷’
আনন্দে ফুলঝুরি হয়ে গেল ইলিনা৷ বলল, ‘থ্যাংক য়ু, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড৷’
পরদিন অনুষ্কাকে রিহার্সালে দেখে অনেকেই অবাক হল৷ এই মুখচোরা ইনট্রোভার্ট মেয়েটা অ্যানুয়াল ফাংশানে পার্টিসিপেট করবে! কিন্তু ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারল না৷
ইলিনা জানে, অনুষ্কার মধ্যে এমন অনেক নাম-না-জানা গুণ আছে যার জন্য ওকে কেউ অপছন্দ করতে পারে না৷
অনেকদিন পর ফেস্টিভ্যাল হলটা জমজমাট হয়ে ওঠায় ইলিনাদের খুব ভালো লাগছিল৷ ওরা সবাই মিলে কলকল করে এমন গল্পে মেতে উঠল যে, ওদের চুপ করানোর জন্য শম্পা ম্যাডাম, রবিনা ম্যাডাম, কাকলি ম্যাডামকে বেশ কয়েকবার বকুনি দিতে হল৷ তাতে গুঞ্জনের আওয়াজ কমল বটে কিন্তু থামল না৷
রিহার্সালের তদারকিতে সমর্পিতা, অঙ্গনা, সজনী, রবিনা ম্যাডাম সবাই এদিক-ওদিক ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছিলেন৷ কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তোলানো শুরু করে দিয়েছেন৷ শম্পা ম্যাডাম ক্লাস টেনের মধুরিমা আর শ্রাবন্তীকে নাচের একটা মুদ্রা বোঝাচ্ছেন৷
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হচ্ছে বটে!
একটা অশুভ ঘটনার পর রিহার্সাল আবার শুরু হচ্ছে৷ তাই বড়দি বলেছেন তিনি রিহার্সালে আজ আসবেন—তা হলে সবাই উৎসাহ পাবে৷ তা ছাড়া আগে রিহার্সালে শুধু চা-বিস্কুট খাওয়ানো হত—আজ থেকে বড়দি টিফিন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছেন৷ বলেছেন, রিহার্সাল অনেকদিন বন্ধ থাকায় হাতে সময় অনেক কমে গেছে৷ তাই রোজ একটু বেশিক্ষণ ধরে রিহার্সাল করতে হবে আর সেইজন্যই ‘স্পেশাল’ টিফিন৷
রিহার্সাল পুরোদমে শুরু হয়ে গেল৷ প্রীতি দত্ত এখনও আসেননি৷ অফিসে কী যেন কাজ করছেন—সেটা সেরেই আসবেন৷ বড়দি যেহেতু রিহার্সালে কখনও আসেন না তাই ওঁর আসাটা একটা বড় ঘটনা৷
ইলিনারা বলাবলি করতে লাগল যে, এবার হয়তো রাশভারী বড়দিকে একটু-আধটু হাসতে দেখা যাবে৷ এ নিয়ে সজনী আর সমর্পিতা বাজিও ধরে ফেলল৷
আজকের সন্ধেটা খুব সুন্দর৷ কোনও বৃষ্টি নেই৷ সূর্য ডোবার পর হালকা ছাই রঙের আকাশ৷ তার ওপরে গাঢ় স্লেট রঙের লম্বা-লম্বা আঁচড়৷ বাতাসে গাছপালার পাতা নড়ছে৷
রিহার্সাল দিতে-দিতে বাইরেটা কখন যেন আঁধার হয়ে গেল৷
ইলিনা অনুষ্কার সঙ্গে গল্প করছিল৷ গত বছরের অ্যানুয়াল ফাংশানের কথা বলছিল৷ কে আবৃত্তি করতে গিয়ে কবিতার লাইন ভুলে গেছে, কে গানে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে, কাকলি ম্যাডামের গলা কী মিষ্টি—এই সব গল্প করছিল৷
এর মধ্যে আশাদিকে সঙ্গে করে প্রীতি দত্ত চলে এলেন৷ তিনি এসে পড়ায় অনেকেই তটস্থ হল, আবার খুশিও হল৷ তারপর টিফিনের প্যাকেট আর চা সবাইকে বিলি করা হল৷ সকলেই আনন্দ আর ফুর্তির মেজাজে টগবগ করছিল৷
ইলিনার বেশ ভালো লাগছিল৷ অনুষ্কাও জমজমাট ব্যাপারটা এনজয় করছিল৷ ও কখনও ভাবেনি এত মানুষের মাঝে ও এরকম অস্বস্তিহীনভাবে বসে থাকতে পারবে৷
ইলিনা লক্ষ করল, সম্পি ওর ব্যস্ততার ফাঁকে-ফাঁকে ফেস্টিভ্যাল হলের জানলার কাছে চলে যাচ্ছে৷ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দেখছে৷ হয়তো সেই বিপজ্জনক সন্ধেটার কথা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷
হলের টিনের চালে থেকে-থেকেই খড়মড় আওয়াজ হচ্ছিল৷ ইলিনা জানে, ওগুলো গাছের শুকনো পাতা আর সরু ডালপালার শব্দ৷ হল ঘিরে যেসব বড়-বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো থেকে প্রায়ই ডালপাতা খসে পড়ে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই আওয়াজগুলো ইলিনাকে অল্প-অল্প ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল৷
প্রথমদিন বলে বড়দি সাতটা নাগাদ রিহার্সাল শেষ করে দিতে বললেন৷ ভয় এড়াতে সবাই দলবেঁধে হল থেকে বেরিয়ে মেন গেটের পথ ধরল৷
ইলিনার সঙ্গে পিচের রাস্তা ধরে এগোতে-এগোতে অনুষ্কা বলল, ‘মনে হয়, ভয় কেটে গেছে৷ ওই পিশাচরা ঘুমিয়ে পড়েছে…৷’
‘কী করে বুঝলে?’ ইলিনা অবাক হয়ে তাকাল বেস্ট ফ্রেন্ড-এর দিকে৷
অনুষ্কা বলল, ‘ওদের কেউ হয়তো আমাকে ফেস্টিভ্যাল হলে চিনে ফেলেছে৷ ওরা জানে, আমাদের মতো ভ্যাম্পায়াররা কখনও মানুষের প্রবলেমে ইনভলভড হয় না৷ কিন্তু আমাকে দেখে নিশ্চয়ই ওদের কেউ একজন বুঝেছে আমি তোমাদের প্রবলেমে জড়িয়ে পড়েছি—তোমাদের পাশে দাঁড়িয়েছি…৷’
‘তোমাকে ওরা এত ভয় পায়!’ অবাক হয়ে বলল ইলিনা৷
অনুষ্কা হাসল : ‘খারাপ ভ্যাম্পায়াররা ভালোদের সবসময় ভয় পায়৷ ওরা আমাদের ক্ষমতার কথা জানে৷ তবে এটাও জানে, আমরা সবসময় নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চাই৷’
‘ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় না?’
‘চায়—কিন্তু পারে না৷ রক্তের তেষ্টা ওদের পাগল করে দেয়৷ মানুষের গন্ধ ওদের মাথা খারাপ করে দেয়৷ তা ছাড়া পূর্ণিমার সময় ওদের এই পাগলামিটা মারাত্মক বেড়ে ওঠে৷ তখন ওরা পশু কিংবা মানুষ মেরে তেষ্টা মিটিয়ে উল্লাসে নেচে বেড়ায়—কোনও জ্ঞান থাকে না৷’
‘যেদিন রাতে আমি ওরকম তিনটে পিশাচকে গাছে নাচানাচি করতে দেখেছিলাম সেদিন কি তা হলে পূর্ণিমা ছিল?’
‘বোধহয় ছিল৷ সেদিন মেঘ-বৃষ্টি ছিল—তাই হয়তো বুঝতে পারোনি৷’
ইলিনা কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল৷ তারপর ভয়ে-ভয়ে আকাশের দিকে তাকাল৷
দূরে খেলার মাঠের কিনারায় শুকনো মরা গাছটা দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ডালপালার আড়ালে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ প্রায় গোল হয়ে এসেছে৷ কয়েকদিন পরেই শুক্লপক্ষের শেষ—তারপর পূর্ণিমা৷
চাঁদটা অনুষ্কাকে দেখাল ইলিনা : ‘ওই দ্যাখো—ক’দিন পরেই পূর্ণিমা৷’
‘কী করে বুঝলে?’ চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কা জানতে চাইল৷
‘খুব সোজা৷’ ইলিনা বলল, ‘চাঁদের ওপরদিকটা যদি ডানদিকে হেলে থাকে, তা হলে শুক্লপক্ষ চলছে৷ আর যদি বাঁ-দিকে হেলে থাকে তা হলে কৃষ্ণপক্ষ৷ চাঁদের নীচের দিকের বাঁকটা সেই অনুযায়ী কৃষ্ণপক্ষের ‘ঋ’-ফলা আর শুক্লপক্ষের হ্রস্ব ‘উ’-কারের বাঁকের সঙ্গে বেশ মিলে যায়৷ এটা আমাকে মা শিখিয়ে দিয়েছে—৷’ ইলিনা হাসল৷ কিন্তু তারপরই আসন্ন পূর্ণিমার কথা ভেবে ভয়ের গলায় বলল, ‘পূর্ণিমার সময় ওরা কিছু করতে পারে…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুষ্কা বলল, ‘শুধু পূর্ণিমা কেন? ভয় তো এমনিতেই আছে, কিন্তু পূর্ণিমার সময় ভয়টা আরও বেশি—’
হঠাৎই একটা ব্যাপার মনে পড়ে যাওয়ায় ইলিনা জিগ্যেস করল, ‘তুমি যে বললে তোমাকে ওরা চিনে ফেলেছে—কী করে চিনতে পারল?’
অনুষ্কা আলতো গলায় বলল, ‘আজ রিহার্সালে আমি টিফিন খাইনি—চা-ও খাইনি৷ সেটা হয়তো ওদের কেউ লক্ষ করেছে৷ তা ছাড়া আমাদের দেখতে খুউব সুন্দর হয়৷ আর আমাদের গা থেকে একটা গন্ধ বেরোয় অনেকটা দারচিনির গন্ধের মতো…৷’
চেনার চিহ্নগুলো মনে-মনে খতিয়ে দেখল ইলিনা৷ তারপর গন্ধটার কথা ওর মনে পড়ল৷ ও অনুষ্কার গাড়িতে আর বাড়িতে এইরকম গন্ধ পেয়েছিল৷ কিন্তু গা থেকে ওরকম গন্ধ বেরোলে তো এখনও সেই গন্ধ ইলিনার নাকে আসার কথা!
ওর মনের কথা কী করে যেন টের পেয়ে গেল অনুষ্কা৷ বলল, ‘ইলিনা, তোমার সঙ্গে আমার একটা মেন্টাল ম্যাচিং হয়ে গেছে৷ অনেকটা যেন রেডিয়ো স্টেশান ধরার টিউনিং-এর মতো৷ তাই তুমি হয়তো দু-একবার আচমকা ওই স্মেলটা পেয়ে গেছ৷ আসলে ওই গন্ধটা কুকুরের নাকে ধরা পড়ে—আর ওই পিশাচদের নাকেও৷ কুকুর প্রায় ন’হাজার রকম গন্ধ চিনতে পারে, মনে রাখতে পারে৷ আমরা প্রায় পাঁচশো রকম গন্ধ চিনতে পারি৷ রনিতা ম্যাডামের মতো পিশাচরাও তাই৷ তবে…৷’
‘আর আমরা? আমরা কতরকম গন্ধ চিনতে পারি?’
হাসল অনুষ্কা : ‘কিছু মনে কোরো না৷ তোমাদের বেলায় সংখ্যাটা মাত্র সত্তর থেকে আশি৷ আর তার মধ্যে এই দারচিনির মতো গন্ধটা পড়ে না৷ যেমন, তুমি এখন এই গন্ধটা পাচ্ছ না, তাই না?’
বিহ্বলভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল ইলিনা৷ সত্যিই ওই গন্ধটা ও এখন পাচ্ছে না৷ ওই দু-বার ছাড়া কখনও পায়নি৷
হঠাৎই অনুষ্কার জন্য ভয় পেল ইলিনা৷ যদি ওই পিশাচগুলো অনুষ্কার কোনও ক্ষতি করে?
সে-কথাই জিগ্যেস করল ওকে৷
অনুষ্কা ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ সেটা কিছুতেই পারবে না৷’
ওরা গাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল৷ অনুষ্কা ইলিনাকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দেবে এরকমই কথা হয়েছিল৷ তাই দুজনেই উঠে বসল গাড়িতে৷
অনুষ্কার বাবা গাড়ি স্টার্ট দিলেন৷ হেডলাইট জ্বেলে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন, ‘কী, ফাংশানের রিহার্সাল কেমন হল?’
দুজনেই বলল, ‘ভালো—৷’
‘গুড—ভেরি গুড৷’ বলে অনুষ্কার বাবা হাসলেন৷
.
৷৷দশ৷৷
চাঁদকে দেখে পূর্ণিমা বোঝার উপায় ছিল না, কারণ, আকাশের মেঘ পুরু আড়াল তৈরি করেছিল৷ গতকাল থেকেই বৃষ্টির আশা তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু বৃষ্টি এখনও সবাইকে অপেক্ষায় রেখেছে৷
ফেস্টিভ্যাল হলে রিহার্সাল চলছিল৷ যাদের হাজির থাকার কথা তারা সবাই হাজির৷ দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে মেয়েরা কাকলি ম্যাডাম আর শম্পা ম্যাডামের কাছে তালিম নিচ্ছিল৷ রবিনা ম্যাডাম একপাশে বসে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা ওলটাচ্ছিলেন আর মাঝে-মাঝে কয়েকটা সাদা পাতায় কী যেন টুকে নিচ্ছিলেন৷
বড়দি আজ আসেননি, তবে ওঁর চালু করে দেওয়া টিফিন আর চায়ের নিয়মটা পালটায়নি৷
আজও যথারীতি অনুষ্কা চা-টিফিন খায়নি৷ ‘বাইরের জিনিস খাওয়া ডাক্তারের বারণ’ বলে এড়িয়ে গেছে৷
ও একটা কাগজ হাতে ধরে বসেছিল৷ তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা লেখা৷ রবিনা ম্যাডাম ওকে এই কবিতাটা তৈরি করতে বলেছেন৷
রিহার্সালের জন্য সামান্য হট্টগোল চলছিল৷ তার মধ্যে হঠাৎই একটা শব্দ সমর্পিতার কানে গেল৷ হলের টিনের চালে একটা জোরালো শব্দ হয়েছে৷ বোধহয় বড় মাপের কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে৷
সম্পি বোধহয় ওর ডাকাবুকো স্বভাবের পুরোটা ছাড়তে পারেনি৷ আর তার সঙ্গে ওর শখের গোয়েন্দা হয়ে ওঠার শখ৷ তাই ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ ওর ঢাউস স্কুল-ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল হলের বাইরে৷
ইলিনা ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল৷ ও অনুষ্কাকে বলল, ‘যাই, কী ব্যাপার একবার দেখে আসি—৷’ তারপর উঠে রওনা হল৷
হলের বাইরে বেশ কয়েকটা আলো লাগানো, কিন্তু উঁচু চালের কাছটায় অন্ধকার৷ চালের ওপরে গাছের ডালপালা আর পাতা ঝুঁকে পড়েছে৷ কিন্তু তারই মধ্যে কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, গাছের ডাল আর পাতা সরিয়ে খুব ক্ষিপ্রভাবে এদিক থেকে ওদিক চলাফেরা করছে৷
সম্পিকে দেখতে পেল ইলিনা৷ ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে৷
রনিতা ম্যাডামের সঙ্গে টিচার্স রুমের সেই ঘটনার পর থেকে সম্পির একটা ব্যাপার ইলিনা লক্ষ করেছে : সম্পি কখনও ওর স্কুল-ব্যাগটা কাছ-ছাড়া করে না৷
ইলিনা সম্পির কাছে গিয়ে দাঁড়াল : ‘কিছু দেখতে পেলি?’
‘হ্যাঁ—কিছু একটা হলের চালের ওপরে ঘোরাফেরা করছে৷’
‘বোধহয় ভাম-টাম কিছু হবে৷’
ইলিনা এ-কথা বলল কারণ, স্কুল চত্বরে মাঝে-মাঝে ভাম দেখা যায়৷
ওর কথার উত্তরে সম্পি বলল, ‘হ্যাঁ, ভাম হতে পারে৷ তবে প্রবলেমটা হল ভামটা আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস পরে রয়েছে৷’
ইলিনা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল সম্পির দিকে৷ তারপর মোবাইল ফোন উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘অনুষ্কাকে ফোন করে ডাকব?’
‘না, না—এখনও সেরকম কিছু সিচুয়েশান হয়নি৷’ সম্পি হাত নেড়ে বারণ করল : ‘তা ছাড়া অন্য সবাই সন্দেহ করতে পারে৷ তারপর রনিতা ম্যাডাম জানতে পারবেন…৷ চল, ফিরে যাই৷’
ওরা দুজন হলে ফিরে চলল৷
সম্পি বলল, ‘রনিতা ম্যাডামের সঙ্গের দুটো মেয়েকে আমরা চিনতে পারিনি৷ তা ছাড়া এর মধ্যে কারও ঘাড়ে ওরা কামড় বসিয়েছে কি না কে জানে! সংখ্যাটা তা হলে তিন থেকে আরও বেড়ে যাবে…৷’
ইলিনার অনুষ্কার কথা মনে পড়ল৷ মনে পড়ল, পূর্ণিমার রাতে ওই পিশাচগুলো পাগলের মতো হয়ে ওঠে৷ আজ ওরা একটা কিছু করবেই৷ অনুষ্কাকে ছাড়া আর কাউকে ওরা ভয় পায় না৷ ওরা এখন বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় আছে৷
ইলিনা আর সমর্পিতা ফেস্টিভ্যাল হলে ঢুকে পড়ল৷ অনুষ্কা আর সজনীর কাছে গিয়ে বসে পড়ল৷
সম্পি চাপা গলায় চালে শব্দ হওয়ার ব্যাপারটা ওদের বলল৷
একটু পরেই সম্পি বলল, ‘অ্যাই, আমাকে টয়লেটে যেতে হবে৷’ ও ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াল৷
সঙ্গে-সঙ্গে বাকি তিনজনও উঠে পড়ল, বলল, ‘চল আমরাও যাই—৷’
অনুষ্কা রবিনা ম্যাডামের কাছে গিয়ে চাপা গলায় টয়লেটে যাওয়ার পারমিশান নিল৷ তারপর ওরা চারজন আবার বেরিয়ে এল হলের বাইরে৷
আকাশে এখনও মেঘ৷ চাঁদ মেঘের আড়ালে থাকলেও চাঁদের ঘোলাটে জ্যোতি দেখা যাচ্ছে৷ বাতাস বেশ জোরে বইছে৷ বড়-বড় গাছের পাতা এলোমেলো নড়ছে, পাতায়-পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে৷
ফেস্টিভ্যাল হল থেকে বেরিয়ে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিটার দূরে টয়লেট৷ জায়গাটা স্কুল-বিল্ডিং-এর পিছনদিক৷ টয়লেটের বাঁ-দিকে রেলিং ঘেরা বাগান৷ আর ডানদিকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি৷
এই টয়লেটটা সাধারণত তালা দেওয়া থাকে৷ এখন রিহার্সাল চলছে বলে বড়দির নির্দেশে তালা খুলে দেওয়া হয়েছে৷ মাঠে যখন প্যান্ডেল বেঁধে স্কুলের কোনও ফাংশান-টাংশান হয় তখন এই টয়লেটটা গেস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়৷
ওরা চারজন টয়লেটের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল৷ ঝিলমিল লাগানো বিশাল দরজা—প্রায় দেড়মানুষ উঁচু৷ তিনটে সিঁড়ির ধাপ উঠে তারপর টয়লেটে ঢুকতে হয়৷
সম্পি বলল ও আগে যাবে৷ তখন ইলিনা বলল, ‘তোর ব্যাগটা আমার কাছে দিয়ে যা—৷’
তাতে ও স্পষ্ট জবাব দিল, ‘না রে, ব্যাগ আমার সঙ্গে থাক…৷’ তারপর দরজা ঠেলে ঢুকে গেল৷
ব্রিটিশ আমলের টয়লেট৷ তার সিলিং যেমন উঁচু, আকারও তেমনি বিশাল৷ তবে মাত্র একজন ব্যবহার করতে পারে৷
টয়লেটে চল্লিশ ওয়াটের দুটো বালব জ্বলছে৷ বাঁ-দিকের দেওয়ালে বড় ওয়াশ বেসিন৷ তার ওপরে বিরাট মাপের বেলজিয়ান আয়না৷ তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বাথটাব৷ লম্বায় প্রায় আট ফুট হবে৷ তার সাদা রং অনেক জায়গায় চটে গিয়ে জং ধরা লোহা বেরিয়ে পড়েছে৷
ডানদিকে বড় মাপের ইউরিনাল কিউবিকল, আর তার পাশে একটা ছোট ঘর হল ল্যাট্রিন৷
টয়লেটের দেওয়ালে-দেওয়ালে ঝুল-কালি আর মাকড়সার জাল দেখে বোঝাই যায় এটা খুব কম ব্যবহার হয়৷
টয়লেটের দরজা বন্ধ করল সম্পি৷ তারপর দু-পাল্লার ঝিলমিলের ওপরে কাঠের লক আটকে দিল৷
এবার ও টয়লেটের প্রতিটি আনাচকানাচ খতিয়ে দেখে নিল যে, টয়লেটে সত্যিই ও একা৷
সিলিং-এর দিকে তাকাল সম্পি৷ অনেক উঁচুতে চার দেওয়ালে চারটে বড় মাপের ভেন্টিলেটার৷ তার চারপাশে মোটা-মোটা ঝুল জমে আছে৷
সম্পির একটু ভয়-ভয় করছিল৷ ও ব্যাগটা শুকনো মেঝেতে নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ইউরিনাল কিউবিকল-এ ঢুকল৷ তখনই যেন একটা ছোট্ট কাশির শব্দ শুনতে পেল৷
ও গলা বাড়িয়ে বাইরেটা আবার দেখে নিল৷ কেউ নেই৷
ভাগ্যিস ও ভয়ে চিৎকার করে ওঠেনি! স্কুলে ডাকাবুকো বলে যার পরিচয় তাকে সবাই ভিতুর ডিম বলে ডাকুক এটা ও কিছুতেই চায় না৷
কিন্তু ইউরিনাল কিউবিকল থেকে ও যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন টয়লেটে ও একা নয়৷ টয়লেটের দরজার কাছে রনিতা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ ওঁর মুখটা এখনও পালটে যায়নি, কিন্তু দু-চোখে সাদা আলো জ্বলছে৷
ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে৷ সম্পি ওর নাম জানে না, তবে মুখটা চেনে৷ যতদূর মনে পড়ছে, মেয়েটা ক্লাস নাইনের ‘সি’ সেকশানে পড়ে৷ ওর চোখেও সাদা আলো ধকধক করে জ্বলছে৷
যতটা ভয় পাওয়ার কথা সম্পি ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, দরজার বাইরে ওর তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে আবার অনুষ্কা রয়েছে৷
কিন্তু এই পিশাচ দুটো কোথায় লুকিয়ে ছিল? সম্পি তো এদের খুঁজে পায়নি! তা হলে কি ল্যাট্রিনের ছাদের ওপরে লেপটে শুয়ে ছিল?
সম্পি চিৎকার করার কথা ভাবল৷ কিন্তু দরজার ঠিক বাইরেই যখন তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে তখন চিৎকার না করে ওদের স্বাভাবিক গলায় ডাকলেই হয়৷ তা হলে ওরা বুঝবে, সম্পি ভিতু নয়৷
সম্পি ‘ইলিনা! ইলিনা!’ বলে ডেকে উঠল৷ ডাকটা সম্পির অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকারের মতো হয়ে গেল৷
কিন্তু কোনও সাড়া পেল না৷
পিশাচ দুটো চাপা খিলখিল হাসিতে ঢলে পড়ল৷ গোপন রসিকতায় এ ওর গায়ে ঠেলা মারতে লাগল৷ রনিতা ম্যাডাম ওঁর ছাত্রীর যেন ইয়ার-দোস্ত হয়ে গেছেন৷
‘ওরা কেউ নেই রে৷ ওরা চলে গেছে৷’ হেসে বললেন রনিতা৷ ওঁর গলাটা অস্বাভাবিকরকম মিহি শোনাল : ‘আমাদের মতো আর-একজন ওদের মিছে কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে৷ তোর পাহারা থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷’
পিশাচের কথা বিশ্বাস করল না সমর্পিতা৷ ও আবার ইলিনা আর অনুষ্কার নাম ধরে জোরে-জোরে ডেকে উঠল—একবার, দু-বার, তিনবার৷
না, কেউ সাড়া দিল না৷ সম্পির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল৷
পিশাচ দুটো আবার খিলখিল করে হেসে উঠল৷ কাচের চুড়ির সঙ্গে কাচের চুড়ি ঠোকাঠুকি লাগল যেন৷ তারপর আহ্লাদে আটখানা হয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগল৷
‘কেউ নেই—’ আঙুল ঘুরিয়ে ব্যঙ্গের গলায় বললেন রনিতা, ‘তুই এখন আমাদের৷ তোর বন্ধু অনুষ্কা—ওই ন্যাকা ভ্যাম্পায়ারটা—ওকেও আজ আমরা খতম করব৷ ভ্যাম্পায়ার, কিন্তু মানুষ ধরা পছন্দ করে না৷ ন্যাকাষষ্ঠী! বেড়াল বলে মাছ ছোঁব না! তার উপর আমাদের পিণ্ডি চটকানোর প্ল্যান আঁটছে! আজ দেখব কত দৌড়!’
‘তোকে আজ কেউ বাঁচাতে পারবে না৷’ রনিতার সঙ্গী পিশাচটা বলল, ‘আজ আমাদের পূর্ণিমা ফেস্টিভ্যাল…৷’
সম্পি ঝুঁকে পড়ে ওর ব্যাগ খুলল৷ একটা জলের বোতল বের করে ছিপি খুলল৷ ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে৷
পিশাচ দুটো বিদ্যুৎঝলকের মতো লাফ দিল৷ এক লহমায় চলে এল সম্পির কাছে৷ ওর দু-পাশে ঘন হয়ে দাঁড়াল৷ লম্বা জিভ বের করে ওর ঘাড়-গলা চাটতে লাগল৷ আর মুখ থেকে জড়ানো গলায় ‘আঃ—! আঃ—!’ করে লোভের শব্দ বের করতে লাগল৷
সমর্পিতার গা ঘিনঘিন করছিল কিন্তু একইসঙ্গে আরাম কিংবা তৃপ্তির ঝিমুনি লাগছিল৷ সেই অবস্থাতেই ওর মনে প্রশ্ন জাগল : এই পিশাচগুলো কি সম্মোহন জানে?
রনিতা ম্যাডাম সম্পির হাতের জলের বোতলের দিকে তাকিয়ে নেশা-ধরা গলায় বললেন, ‘সম্পি, তোর তেষ্টা পাচ্ছে, তেষ্টা?…আমাদেরও পাচ্ছে…দারুণ তেষ্টা…তেষ্টা—আ—আ—আঃ…!’
রনিতা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলের বোতলটা ওঁর মাথায় উপুড় করে দিল সম্পি৷ তাই রনিতার শেষ দিকের ‘আঃ!’-টা আরামের শীৎকার থেকে যন্ত্রণার চিৎকারে বদলে গেল৷
মানুষের মাথার ওপরে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের বোতল উপুড় করে দিলে যে-দশা হয় রনিতা ম্যাডামের দশা তার চেয়েও দশগুণ খারাপ হয়ে গেল৷
ওর শরীর গাঢ় ধোঁয়ায় ঢেকে গেল৷ গরম তেলের ওপর জলের ফোঁটা পড়ল যেরকম চড়বড়-চড়বড় শব্দ হয় সেরকম শব্দ হতে লাগল৷ তার সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণার মরণ আর্তনাদ৷
ধোঁয়াটে রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন দলা পাকিয়ে খসে পড়ল মেঝেতে৷
বৃষ্টির জলের সত্যি-সত্যি এত শক্তি!
সম্পি তাজ্জব হয়ে গেল৷ এই পিশাচটাকে নিকেশ করার জন্য ও কতদিন ধরে বৃষ্টির জল জমিয়ে রেখেছিল৷ দুটো প্লাস্টিকের বোতলে সেই জল ভরে ও সেই কবে থেকে স্কুল-ব্যাগে বোতলগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!
আজ সেটা কাজে এল৷
ধেড়ে পিশাচ তো পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে, কিন্তু কচিটা?
সেটা তখন সম্পিকে জাপটে ধরে ইস্পাতের দাঁতের পাটি ফাঁক করেছে৷ এবং সেই ধারালো দাঁত বসিয়ে দিতে চাইছে সমর্পিতার গলায়৷
সম্পি এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল—অনেকটা যুদ্ধের ডাকের মতো৷ তারপর বোতলে যে-সামান্য জল ছিল সেটা ছুড়ে দিল দ্বিতীয় পিশাচের গায়ে৷
পিশাচটার গা থেকে ধোঁয়া বেরোল৷ ওটা চকিতে দু-পা পিছিয়ে গেল সম্পির কাছ থেকে৷
সমর্পিতা এইটুকু সময়ই চাইছিল৷ যন্ত্রের মতো নির্ভুল দ্রুতগতিতে ও ব্যাগ থেকে দ্বিতীয় জলের বোতলটা বের করে নিল৷ একলাফে আহত পিশাচটার কাছে পৌঁছে গেল৷ ছিপি খুলে বোতলের জল ঢেলে দিল ওটার মাথায়৷
ধোঁয়া৷ চড়বড় শব্দ৷ যন্ত্রণার চিৎকার৷
পিশাচটা পড়ে গেল মেঝেতে৷ ধোঁয়ায় মাখামাখি হয়ে ছটফট করতে লাগল৷
দুটো ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে পিছনে ফেলে দরজার দিকে পাগলের মতো ছুট লাগল সম্পি৷ একইসঙ্গে খ্যাপাটে চিৎকার করতে লাগল৷ হাতের খালি বোতলটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে টয়লেটের দরজার কাছে পৌঁছে গেল৷ তারপর ছিটকিনি খুলে সোজা বাইরে৷
সম্পি বাইরে এলেও ওর চিৎকার থামেনি৷ চিৎকার করতে-করতে ও ছুটে গেল ফেস্টিভ্যাল হলের দরজার দিকে৷
ওর চিৎকার শুনে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু দরজার কাছে ভিড় করে সবাই দাঁড়িয়ে৷ পুরোনো ঘটনার কথা মনে রেখে কেউই এগোতে সাহস পায়নি৷
সম্পি ছুটতে-ছুটতে এসে কাকলি ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে ওঁর ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ বিকৃত গলায় হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘পিশাচ! পূর্ণিমা! পিশাচ! টয়লেটে৷ রনিতা…রনিতা ম্যাডাম…পিশাচ!’
এটুকু শুনেই কাকলি ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷
সম্পি টাল সামলাতে না পেরে আর-একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল— কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল৷
মেয়েরা কাকলি ম্যাডামকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল৷
অন্যরা সমর্পিতাকে ঘিরে ধরে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল৷
ও বড়-বড় শ্বাস টেনে অনেক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে জড়ানো এলোমেলো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল৷
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে সম্পি টয়লেটের ভয়ংকর ঘটনা সবাইকে খুলে বলল৷ তারপর জিগ্যেস করল, ইলিনা, সজনী, অনুষ্কা ওরা কোথায়৷
কেউই কিছু বলতে পারল না৷ সবাই শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল৷ ভয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে রইল৷
হঠাৎই একটি মেয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গেই তো ওরা তিনজন হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর তো আর দেখিনি—৷’
তা সত্ত্বেও সম্পির চোখ ভিড়ের মধ্যে তিন বন্ধুকে খুঁজতে লাগল৷ কোথায় গেল ওরা? ওদের ফোন করার কোনও উপায় নেই, কারণ মোবাইল ফোন ও টয়লেটে ব্যাগে ফেলে এসেছে৷
সম্পি এতক্ষণে ভয় কাটিয়ে দম ফিরে পেয়েছিল৷ ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে জুতসই একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগল৷ ইলিনাদের খোঁজার জন্য কয়েকজনকে ও সঙ্গে নিতে চায়৷
ও সামনে দাঁড়ানো দুজন মেয়েকে বলল, ‘আমি ইলিনাদের খুঁজতে যাব৷ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?’
ওর কথায় দুজনের জায়গায় ছ’জন ওর কাছে এগিয়ে এল : ‘চলো, আমরা যাব…৷’
সম্পির চোখ সাহসী রবিনা ম্যাডামকে খুঁজল কিন্তু দেখতে পেল না৷
কয়েকজনকে জিগ্যেস করে জানল, মিনিট পনেরো-কুড়ি আগে ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে এসে রবিনা ম্যাডামকে কোথায় যেন ডেকে নিয়ে গেছে৷
সম্পি আর দাঁড়াল না৷ ওর মন কু-ডাক ডাকতে লাগল৷ ওর মনে হল, রবিনা ম্যাডাম, ইলিনা, সজনীদের খুব বিপদ৷ কারণ আজ পূর্ণিমা৷
অনুষ্কা কি পারবে সবাইকে বিপদ থেকে বাঁচাতে?
সম্পি পিচের রাস্তা ধরে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে রওনা হল৷ প্রায় সাত-আটজন মেয়ে দল বেঁধে ওর সঙ্গী হল৷ শম্পা ম্যাডাম বারবার সম্পিকে ডাকলেন, অন্ধকারে এসব খোঁজাখুঁজির কাণ্ড থামাতে বললেন৷ কিন্তু সম্পির আজ কোনও বারণ না শোনার দিন৷
নিরুপায় শম্পা ম্যাডাম তখন মোবাইল ফোন নিয়ে বড়দিকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷
সম্পিরা তখন হইহই করে এগিয়ে চলেছে৷ থেকে-থেকে ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কার নাম ধরে ডাকছে৷
আকাশের চাঁদের দিকে সম্পির চোখ গেল৷
মেঘের আড়াল সরিয়ে ফ্যাকাশে হলদে চাঁদ কখন যেন বেরিয়ে এসেছে৷
.
৷৷এগারো৷৷
উদভ্রান্তের মতো যে-মেয়েটি ওদের কাছে ছুটে এল ইলিনারা ওর মুখ চেনে, কিন্তু নাম জানে না৷ ক্লাস টেন-এর-ই অন্য কোন একটা সেকশানে যেন পড়ে৷
ইলিনা, সজনী আর অনুষ্কা টয়লেটের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সমর্পিতার বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল৷
মেয়েটা হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তোমাদের তিনজনকে…রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন৷ তোমাদের নাম ইলিনা, সজনী আর…আর অনুষ্কা তো?’
ওরা মাথা নাড়ল৷ হ্যাঁ৷
‘তোমাদের…তোমাদের রবিনা ম্যাডাম…এক্ষুনি ডাকছেন…খুব দরকার৷’
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যতটুকু দেখা গেল তাতে ‘খুব দরকার’ ভাবটা মেয়েটির চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছিল৷
‘ম্যাডাম কোথায়? ফেস্টিভ্যাল হলে?’
‘না, ম্যাডাম হল থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে গেলেন৷ তোমাদের তিনজনকে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বললেন…৷’
ইলিনারা ইতস্তত করল৷ এ ওর দিকে তাকাল৷ রবিনা ম্যাডাম হঠাৎ ক্যাম্পাসের পিছনদিকে কী করতে গেলেন?
অনুষ্কা বলল, ‘ইলিনা, সজনী—তোমরা বরং যাও, আমি এখানে থাকছি৷’
মেয়েটি অসহায়ের মতো বলল, ‘কিন্তু ম্যাডাম যে তিনজনকেই ডেকেছেন—বলেছেন ভীষণ আর্জেন্ট…৷’
তখন অনুষ্কা ওকে বুঝিয়ে বলল, ‘আমাদের এক বন্ধু টয়লেটে গেছে৷ আমরা ইন ফ্যাক্ট ওর জন্যেই ওয়েট করছি৷ ও বেরোলে আমরা…৷’
মেয়েটি বেশ বিপন্ন গলায় বলল, ‘তা হলে তো খুব প্রবলেমে পড়লাম! ম্যাডাম যেভাবে বললেন…৷’
ইলিনা মোবাইল ফোন বের করে সমর্পিতাকে ফোন করতে লাগল৷
রিং বেজে গেল, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না৷ তখন ইলিনা ফোন কেটে দিল৷
‘ফোন বেজে যাচ্ছে৷ ও ধরছে না—৷’
সজনী বলল, ‘ওর ফোনটা নিশ্চয়ই সাইলেন্ট মোডে আছে—৷’
অনুষ্কা বলল, ‘ঠিক আছে৷ তোমরা দুজন যাও—নিশ্চয়ই ওখানে কোনও প্রবলেম হয়েছে৷ আমি এখানে থাকছি৷ সম্পি টয়লেট থেকে বেরোলে তারপর আমি যাব৷ কোনও ভয় নেই—৷’
‘ভয়? ভয় কীসের?’ অন্য মেয়েটি কৌতূহলে জানতে চাইল৷
ইলিনা আর সজনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না—এমনি৷ চলো, যাই…৷’
ওরা দুজনে যখন মেয়েটির সঙ্গে এগোচ্ছে তখন অনুষ্কা ডেকে বলল, ‘কোনও প্রবলেম হলেই আমাকে সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কোরো৷ সম্পি বেরোলেই আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি—৷’
‘ঠিক আছে৷’ বলে ওরা জোর পায়ে হাঁটা দিল৷
দু-পাশে গাছপালা, মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা৷ ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো এখানে-সেখানে ছিটকে পড়েছে৷ অন্ধকার আর আলো দাবার ছক তৈরি করেছে যেন৷
রিহার্সালের গানের আওয়াজ কানে আসছে৷ তার সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ৷
অনুষ্কা আনমনাভাবেই আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী সুন্দর গোল আর স্পষ্ট৷ ওর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল৷ ছবির চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়েছে কি না কে জানে! প্রকৃতির সঙ্গে ওই ছবিটা সবসময় মেলে না৷
চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনুষ্কার কেমন ঘোর লেগে গেল৷ ও অপলকে তাকিয়ে নিশিনাথকে দেখতে লাগল৷
হঠাৎই অনুষ্কার হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন থরথর করে কেঁপে উঠল৷ ও চমকে উঠে ফোনের পরদার দিকে তাকাল৷
ইলিনা৷
ফোন ধরতেই ইলিনার বিপন্ন গলা শোনা গেল৷ শুধু বিপন্ন নয়, ওর গলা কাঁপছে৷
‘অনুষ্কা, শিগগির এসো—সর্বনাশ হয়েছে!’
‘তোমরা কোথায়?’
‘পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে—যেখানে তুমি আর আমি কোকিল দেখতে গিয়েছিলাম৷ সেই ইটের পাঁজা…৷’
আর শোনার দরকার মনে করল না অনুষ্কা৷ ফোন কেটে দিয়ে পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে শুরু করল৷
আলো আর অন্ধকারে ওর শরীরটা একবার দেখা যাচ্ছিল, একবার মিলিয়ে যাচ্ছিল৷ যেন ওর ছুটন্ত শরীরটা জ্বলছে-নিভছে৷
ছুটতে-ছুটতে অনুষ্কার মনে হল, টয়লেটের দিক থেকে একটা মিয়োনো ডাক যেন ভেসে এল৷ ইলিনার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠল যেন৷
কিন্তু ওর সামনে দু-বন্ধুর ডাক, পিছনে এক বন্ধুর ডাক৷ তাই অনুষ্কা দৌড় থামাল না—ছুটতেই থাকল৷ সেই অবস্থাতেই ও লম্বা-লম্বা লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে উঠে অলৌকিক গতিতে দুরত্ব কমাতে লাগল৷
মনে হচ্ছিল যেন ও উড়ে চলেছে৷ অন্ধকার কিংবা গাছপালা ওর গতি রুখতে পারছিল না৷ ওকে এই অবস্থায় দেখলে যে-কেউ স্তম্ভিত হয়ে যেত, ভয় পেত৷
অকুস্থলে পৌঁছতে অনুষ্কার সময় লাগল আট সেকেন্ডেরও কম৷ রাস্তা ছেড়ে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ও৷
ওই তো, পুরোনো টিন, কাঠ আর অ্যাসবেস্টস৷ তার পাশে ইটের পাঁজা৷ ইটের পাঁজার ওপরে শুয়ে আছে ওরা দুজন কে? শুয়ে-শুয়ে ছটফট করছে? গায়ে স্কুল-ড্রেস?
জায়গাটা অন্ধকার৷ গাছপালার পাতার আড়াল থাকায় চাঁদের আলোও সেখানে ঢোকেনি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ভ্যাম্পায়ার মেয়ের দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷
চিত হয়ে শুয়ে আকুলিবিকুলি করছে ইলিনা আর সজনী৷ ওরা যে চিৎকার করতে পারছে না তার কারণ স্কুল-ড্রেস পরা একটা পিশাচ ওদের ওপর উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে৷ পিশাচটার মুখ ভয়ংকর, চোখ জ্বলছে, ইস্পাতের দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে৷
কিন্তু রবিনা ম্যাডাম কোথায়?
প্রশ্নটা অনুষ্কার মনে ঝলসে গেলেও একইসঙ্গে ও প্রতিরক্ষার কাজ শুরু করল৷
ও ইলিনাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ-ছ’ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেই দূরত্বটাকে ও মোটেই কমাতে চেষ্টা করল না৷ ওখানে দাঁড়িয়েই ওর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল৷
হাতটা পলকে রবারের মতো লম্বা হয়ে গেল৷ একইসঙ্গে হাতের পেশি, শিরা-উপশিরা সব দেখা গেল৷ যেন অনুষ্কার হাতটা স্বচ্ছ কাচের তৈরি৷
পিশাচটা ততক্ষণে ইলিনার গলার খাঁজে কামড় বসিয়েছে৷ আর ঠিক তখনই অনুষ্কার হাতের চেটোতে কতকগুলো কাঁটা গজিয়ে গেছে—ছুচলো ইস্পাতের কাঁটা৷
সেই হাতে বজ্রমুঠিতে পিশাচটার ঘাড় চেপে ধরল অনুষ্কা৷ শরীর থেকে যেমন করে জোঁক ছাড়ায় সেভাবে পিশাচটাকে ইলিনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল, এক হ্যাঁচকায় টেনে নিল নিজের কাছে৷
ইলিনা আর সজনী এবার প্রাণপণ চিৎকার জুড়ে দিল৷ সেই চিৎকারে গাছপালার ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠে ডাকতে লাগল, ওড়াউড়ি শুরু করল৷
ইলিনারা টের পেল দারচিনির গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে৷
ইলিনার গলা থেকে রক্ত পড়ছিল, মাথা টলে যাচ্ছিল৷ ও কোনওরকমে উঠে বসল৷ তাকাল অনুষ্কার দিকে৷
সজনীও তাকাল৷
ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইলিনার প্রিয়তম ভ্যাম্পায়ার! শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছে৷
অনুষ্কার হাতের মুঠোয় পিশাচটার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ ওটা হাঁ করে বাতাস টানার চেষ্টা করছিল৷ যন্ত্রণার চিৎকার করছিল৷ ইস্পাতের দাঁতের পাটি ঝকঝক করছে৷ আর তার ফাঁকে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকানো একটা কালো রঙের জিভ৷ সেটা কখনও-কখনও লম্বা হয়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে৷
অনুষ্কার শক্তি এতটাই যে, পিশাচটা তার কানাকড়িও ডিঙোতে পারছিল না৷ তাই জেতার চেষ্টা করতে-করতে ওটা কাহিল হয়ে পড়ল৷
অনুষ্কা মোবাইল ফোন ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে পিশাচটার নাক চেপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত একটা গোঙানির শব্দ করে পিশাচটার মাথা কাত হয়ে গেল একপাশে৷
অনুষ্কা ওটাকে ছেড়ে দিল৷ ওটার নিষ্প্রাণ শরীরটা ভেজা কাপড়ের মতো খসে পড়ল মাটিতে৷ পড়েই রইল৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল৷
ইলিনা আর সজনী থরথর করে কাঁপছিল৷ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷
এই তা হলে অনুষ্কার গোপন শক্তি! অনুষ্কা না থাকলে ইলিনারা আজ বাঁচত না৷
কৃতজ্ঞতার আবেগে ইলিনার কান্না পেয়ে গেল৷ একইসঙ্গে গলার অসহ্য যন্ত্রণা ওকে অজ্ঞান করে দিতে চাইছিল৷ ও সজনীকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল৷
সজনীর অবস্থা তখন সাংঘাতিক৷ ওর বুক ধড়াস-ধড়াস করছিল৷ আধো-অন্ধকারে এইমাত্র ও কী দেখল? ওদের বন্ধু অনুষ্কা! সে কেমন পালটে ভয়ংকর হয়ে গেল! অমানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অমানুষিক লড়াই করল!
সজনীর বুক ঠেলে কান্না উথলে উঠছিল৷ একইসঙ্গে একটা অচেনা ভয় ওকে অবশ করে দিচ্ছিল৷
ইলিনা আর সজনী নেমে এল ইটের পাঁজা থেকে৷ দুজনেই ভয়ে কাঁপছে, কাঁদছে৷
ইলিনার স্কুল-ড্রেস রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ ও সজনীকে আঁকড়ে ধরে পা ফেলছিল৷ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠছিল৷
অনুষ্কা ছুটে গিয়ে ওদের জাপটে ধরল৷ ওরা তিনজনেই হাঁপাচ্ছিল৷ কাঁদছিল৷ আর সজনী শিউরে উঠছিল৷
একটু পরে অনুষ্কা সজনীকে বলল, ‘শিগগির সম্পিকে একটা ফোন করো…৷’ কথাটা বলেই ও ইলিনার গলায় নিজের রুমালটা চেপে ধরল৷ যে করে হোক রক্তটা বন্ধ করা দরকার৷
সজনী কান্না-ভাঙা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমাদের দুজনের কারও মোবাইল নেই৷ গণ্ডগোলের সময় কোথায় ছিটকে পড়েছে জানি না…৷’
‘আমার ফোন থেকে ফোন করো৷ ওই তো আমার ফোন ওখানে পড়ে আছে৷’
সজনী এগিয়ে গেল সামনে৷ অন্ধকারে হাতড়ে অনুষ্কার মোবাইলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল৷
সম্পিকে ও ফোন করতে যাবে, তখনই অনুষ্কা জিগ্যেস করল, ‘আমরা যে পিশাচটাকে খতম করলাম সেটাই কি টয়লেটের ওখানে আমাদের ডাকতে গিয়েছিল?’
সজনী নাক টেনে-টেনে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘না, ও ভালো মেয়ে৷ এখানে এসে দূর থেকে জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েই ও ছুটে আবার ফেস্টিভ্যাল হলে চলে গেছে৷ আমরা এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে খুঁজছি, তখনই ওই শয়তান পিশাচটা এগিয়ে এল৷ তারপর…৷’
সজনী কথা বলছিল আর একইসঙ্গে সম্পির নম্বর ডায়াল করে মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরেছিল৷
রিং হয়ে যাচ্ছে৷ ফোন কেউ ধরছে না৷
সে-কথাই ও বলল অনুষ্কাকে৷
অনুষ্কা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওঃ, আবার সেই সাইলেন্ট মোড! শিগগিরই চলো, ইলিনাকে এখুনি ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে৷ কুইক—৷’
ইলিনা অনুষ্কার গায়ে প্রায় এলিয়ে পড়েছিল৷ চোখ বুজে ‘ও—ওঃ! ও—ওঃ!’ শব্দ করে কাতরাচ্ছিল৷
ওকে যে করে হোক সুস্থ করে তুলতে হবে৷ অনুষ্কা ভাবল৷ আরও গাঢ় করে ইলিনাকে জাপটে ধরল ও৷
সজনীকে ডেকে নিয়ে ও এগোতে যাবে তখনই ওর মনে পড়ল রবিনা ম্যাডামের কথা৷ যাঁর নাম করে সেই মেয়েটা ওদের ডেকে নিয়ে এল সেই রবিনা ম্যাডাম কোথায়? আর কোন আর্জেন্ট কাজের জন্য তিনি ওদের তিনজনকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সজনীকে রবিনা ম্যাডামের কথা জিগ্যেস করতেই ও বলল, ‘জানি না৷ এখানে এসে রবিনা ম্যাডামকে আমরা একবারও দেখিনি৷ যখন ম্যাডামকে খোঁজাখুঁজি করছি তখন ইটের পাঁজার আড়াল থেকে ওই ভয়ংকর পিশাচটা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ তারপর তো তুমি এলে…৷’
ইলিনা যন্ত্রণায় রুদ্ধ গলায় কোনওরকমে বলল, ‘অনুষ্কা, রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো?’
সজনী সে-কথায় সায় দিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘আমিও ঠিক এই কথাটাই বলছিলাম৷ রবিনা ম্যাডামের কোনও বিপদ হয়নি তো!’
‘না রে, আমার কোনও বিপদ হয়নি৷’ উত্তর দিলেন রবিনা ম্যাডাম নিজেই, ‘এখন আমার আর কোনও বিপদের ভয় নেই…৷’
ওরা তিনজনে চমকে উঠল৷ শব্দ লক্ষ করে তাকাল৷
কাছেই একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে রবিনা ম্যাডামের দেহটা লেপটে আছে৷ মাটি থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাত উঁচুতে ওঁর শরীরটা উলটোভাবে শূন্যে ঝুলছে৷ পা ওপরে৷ মাথা নীচের দিকে৷
বোধহয় অন্ধকারে ঢাকা কোনও জুতসই ডালে রবিনা পা দুটো আঁকশির মতো আটকে রেখেছেন৷
রবিনার শরীর থেকে একটা নীলচে আভা বেরোচ্ছে৷ সেই আভার জন্যই ওঁকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উলটো হয়ে থাকার জন্য স্পষ্টভাবে চেনা যাচ্ছে না৷
রবিনার গাল বসে গিয়ে চোয়ালটা সামনে বেরিয়ে এসেছে৷ চোখ দুটো অন্ধকার কৃষ্ণগহ্বর৷ আর তার কেন্দ্রে সার্চলাইটের মতো উজ্জ্বল সাদা আলোর বিন্দু৷
‘তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে রে…অসম্ভব পাগল করা তেষ্টা৷’ গাছের গায়ে উলটো হয়ে ঝুলে থাকা পিশাচটা বলল, ‘সেদিন রনিতাদি কী যে কামড় বসাল ঘাড়ে, তারপর থেকেই যত অশান্তি আর ভোগান্তির শুরু৷ তোরা তো আর বুঝবি না, পূর্ণিমার তেষ্টা কী জিনিস! আয়, তোরা কাছে আয়…আয়…৷’
এইসব কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে রবিনার শরীরটা পেন্ডুলামের মতো অল্প-অল্প দুলতে লাগল৷ ঠিক যেন হাওয়ায় দুলছে৷ আর ওঁর মুখটা হাঁ হয়ে গেল৷
ইস্পাতের দাঁতের পাটি দেখা গেল৷ তার ফাঁক দিয়ে একটা লম্বা কালো জিভ সাপের মতো সড়সড় করে বেরিয়ে এল৷ ঝুলে পড়ল নীচের দিকে৷ তারপর সেই দেড়ফুট লম্বা জিভটা নড়তে লাগল, দুলতে লাগল৷
পিশাচটার চোখের দৃষ্টিতে বোধহয় সম্মোহন ছিল৷ কারণ, ইলিনা আর সজনী উলটোভাবে ঝুলে থাকা রবিনার নীল আলো মাখা দেহের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল৷
অনুষ্কা ওদের হাত ধরে টেনে আটকে রাখল৷ চিৎকার করে বলল, ‘যেয়ো না—এখানে চুপ করে দাঁড়াও! যেয়ো না! আমার কথা শোনো—!’
হঠাৎই দারচিনির গন্ধে বাতাস মিষ্টি হয়ে গেল৷ এক ঝটকায় ইলিনা আর সজনীকে ছিটকে ফেলে দিল অনুষ্কা৷ তারপর ওর ডানহাত চোখের পলকে লম্বা হয়ে ছোবল মারল রবিনা ম্যাডামের গলায়৷ এবং একটানে পিশাচটাকে গাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল৷
ইলিনা আর সজনী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওদের বন্ধুর অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখছিল৷ মনে হচ্ছিল, ওদের চোখের সামনে যা-যা ঘটে চলেছে সেগুলো বাস্তব নয়, একটা গাঁজাখুরি সিনেমা৷
সেই ‘সিনেমা’-য় অনুষ্কার হাতের ইস্পাতের কাঁটাগুলো পিশাচটার গলায় আমূল গেঁথে গেল৷ ওর হাতের টানে পিশাচটা রবারের সুতোয় বাঁধা বলের মতো ছিটকে চলে এল অনুষ্কার কাছে৷
পিশাচটা যন্ত্রণার হাহাকার তুলছিল৷ মাথাটা এপাশ-ওপাশ নাড়ছিল৷ অনুষ্কা বাঁ-হাতে খপ করে পিশাচটার নাক টিপে ধরল৷ সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল পিশাচটার মরণ গোঙানি৷ বারবার হাঁ করে বাতাস নিতে চাইল৷
একটু পরেই ওটার সব লড়াই শেষ হয়ে গেল৷ সব তেষ্টা মিটে গেল৷
অনুষ্কা ছেড়ে দিতেই ওটা এক টুকরো কাঠের মতো খসে পড়ে গেল মাটিতে৷
অনুষ্কার ডানহাতটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷ ও এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল৷ ঘোর কেটে যেতেই ওর বন্ধুদের কথা মনে পড়ল৷ ও ফিরে তাকাল ইলিনার দিকে, সজনীর দিকে৷ ওদের বিপদে কাজে লাগতে পেরে মনটা ভীষণ ভালো লাগছে৷ এই ভালো লাগা আগে কখনও ও টের পায়নি৷
অনুষ্কা ইলিনাকে তুলে ধরল৷ তারপর ওকে বুকে জড়িয়ে নিল : ‘শিগগির চলো, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে…৷’
সজনী নিজে থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ ও অনুষ্কার কাছে এসে ওর হাত ধরল৷ চাপা গলায় বলল, ‘থ্যাংক য়ু—৷’
ইলিনাও অনুষ্কার কানে-কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ও যা বলল, তাই…৷’
অনুষ্কার কানে এল অনেকের হইচই চিৎকার৷
ও চাঁদের দিকে তাকাল৷ কী স্পষ্ট, কী সুন্দর!
চাঁদকে এই মুহূর্তে ওর ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করল৷
ঠিক তখনই সম্পির গলা কানে এল৷ ওদের তিনজনের নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছে৷
.
৷৷বারো৷৷
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷
এখন আমাকে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হবে৷
আত্মা যদি অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মার অবিনশ্বর হতে অসুবিধে কী! সুতরাং আমি অমর৷
তোমার কি মনে নেই, গীতার সাংখ্যযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷’ অর্থাৎ, কোনও শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করিতে পারে না৷ অগ্নি ইহাকে দহন করিতে পারে না৷
তিনি আরও বলেছেন, জল ইহাকে আর্দ্র করিতে পারে না, বায়ু ইহাকে শুষ্ক করিতে পারে না৷
তা হলে আমার ‘মৃত্যু’ হবে কেমন করে?
তাই আকাশে, বাতাসে ধুলোয় মিশে আবার শুরু হোক আমার পথ চলা৷
চলতে-চলতে আবার আমাকে খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়৷ নিতে হবে আবার কোনও নতুন পরিচয়৷ তারপর আবার বিশ্রাম আর আরাম৷
নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, নতুন করে শুরু হবে আমার নতুন জীবন৷
আঃ, ভাবতেই কী তৃপ্তি!
বজ্রগোলাপ
৷৷এক৷৷
ঘিয়া নদীর পাড়ে রাহুলের সঙ্গে কোকোর প্রথম দেখা হয়েছিল৷ ভিজে জামা-কাপড়ে একটা বটগাছের নীচে কোকো অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল৷
সেদিন আকাশে অনেক মেঘ ছিল৷ তাই বৃষ্টির আশায়-আশায় ছিল সবাই৷ কিন্তু সন্ধে পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি৷ অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থোকা-থোকা ঘন মেঘ মাথার ওপরে ঝুলছিল৷ আর তারই ফাঁকে-ফাঁকে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠছিল৷ আলোর পরই গুড়-গুড়াম৷ মেঘের ডম্বরু বাজছিল৷
মোহনকুমার স্মৃতি চ্যালেঞ্জ শিল্ড-এর ফাইনাল ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল রাহুল৷ সঙ্গে তিন বন্ধু—গোপাল, নিধু, আর দীপায়ন৷ খেলাটা ছিল ওদের পাশের গ্রামে—যে-গ্রামটার নাম ভারী অদ্ভুত : তিনমাইল৷ এই নামটার কারণ বাপির কাছে জানতে চেয়েছিল রাহুল৷ সে বেশ কয়েকবছর আগে—যখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত৷ তখন বাপি বলেছিল, ‘সাত বছর আগেও গ্রামটার কোনও নাম ছিল না৷ সবাই বলত মণিমেলার পাশের গ্রাম৷ তারপর ঘিয়া নদীতে নতুন ব্রিজ তৈরি হল৷ সেটা থেকে ওই গ্রামটার দূরত্ব মোটামুটি তিনমাইল৷ লোকের মুখে-মুখে ওই তিনমাইল দূরত্বের ব্যাপারটা ঘুরতে-ঘুরতে তা থেকে শেষ পর্যন্ত ওটা গ্রামের নাম হয়ে গেছে৷’
তিনমাইলের ফুটবল খেলায় রাহুলরা কোনও দলের সাপোর্টার ছিল না৷ স্রেফ ফুটবল খেলার নেশাতেই ওরা চারজন ফাইনাল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল৷ ম্যাচ শেষ করে ফেরার সময় আকাশের অবস্থা ঠিক যেন বৃষ্টি হব-হব৷ তাই কখনও হেঁটে কখনও ছুটে ওরা মণিমেলার দিকে ফিরছিল৷
একটু পরেই ওরা ঘিয়া নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল৷ এবার নদী পেরোলেই মণিমেলা৷ উঁচু পাড় থেকে মাটির ঢাল জলের দিকে নেমে গেছে৷ নদীতে জল এখন বেশি নেই৷ গত দু-সপ্তাহে দু-তিনদিন বৃষ্টি হলেও বর্ষা সেরকমভাবে এখনও শুরু হয়নি৷ তাই ঘিয়া এখন শান্ত, নিরীহ৷ বর্ষার দাপটে এই শান্তশিষ্ট নদীটার রূপ বদলে যায়৷ তখন ঘিয়ার এত স্রোত থাকে যে, সাঁতরে এপার-ওপার করতেও ভয় হয়৷
রাহুলরা নদীর পাড়ে যেখানটায় এসে দাঁড়াল সেখানে কোনও ব্রিজ নেই৷ তবে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা আছে৷ ছোট ডিঙিনৌকো—বড়জোর দশ-বারোজন দাঁড়াতে পারে৷ খেয়া পার হয়ে গেলে রাহুলদের বাড়িটা কাছাকাছি হয়৷ ব্রিজ দিয়ে ঘিয়া পেরোতে হলে অনেকটা ঘুরপথ হয়ে যায়৷
রাহুল-গোপালরা সবাই সাঁতার জানে৷ তাই বেশ সহজভাবে ওরা নৌকোর ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল আর ফাইনাল খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল৷
কথা বলতে-বলতে রাহুল বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যদি বৃষ্টি নামে তা হলে আর রক্ষে নেই৷ না, বৃষ্টিতে ভেজার ভয় ও করছে না৷ আসলে স্কুল-লাইব্রেরির দুটো গল্পের বই ও টেবিলের খোলা জানলার কাছে রেখে এসেছে৷ ওগুলো যদি ভিজে যায়!
ঘিয়া পার হয়ে ওরা চারজন নদীর পাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ ঠিক তখনই আচমকা ঝড় উঠল৷ ঠান্ডা বাতাস ওদের ঘিরে পাক খেতে লাগল আর কালো আকাশ থেকে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি টপাটপ করে পড়তে শুরু করল৷
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ ঝোড়ো বাতাসে হেলে পড়েছিল৷ ওদের ডালপালা-পাতা পতাকার মতো উড়ছিল৷
চোখে হাত চাপা দিয়ে রাহুল ধুলো আটকাচ্ছিল৷ সেই অবস্থায় পা হড়কে গিয়ে ও বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ল৷ ততক্ষণে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন নদীর ঢাল পেরিয়ে ওপরের কাঁচা রাস্তায় উঠে পড়েছে৷
নিধু একবার চেঁচিয়ে রাহুলকে ডাকল, ‘জলদি আয়৷ এখুনি জোরে বৃষ্টি আসবে…৷’
সেই চেষ্টাই করছিল রাহুল৷ এছাড়া খোলা জানলার কাছাকাছি রাখা বইগুলো ভিজে যাবে, এই ব্যাপারটাও মাথায় ছিল৷ তাই আরও জোরে পা চালাল৷ আর ঠিক সেই সময়েই সীসের মতো আকাশে নীলচে সাদা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পলকের জন্য চারপাশটা আলোয় আলো হয়ে গেল৷ আর তখনই লোকটাকে দেখতে পেল ও৷ সঙ্গে-সঙ্গে বিকট শব্দে বাজ পড়ল৷
নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঝুরি-নামা একটা বটগাছের নীচে পড়ে আছে একটা মানুষ৷ রাহুলের কাছ থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে৷ এই মেঘলা কমজোরি আলোয় লোকটাকে হয়তো চোখেই পড়ত না যদি না ওর শরীর থেকে চকচকে কিছু একটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠত৷
রাহুলের পথ বেঁকে গেল৷ ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে৷ ওর ওপরে ঝুঁকে পড়ল৷
বৃষ্টি এখনও না পড়ার মতন, অথচ মানুষটার জামা-প্যান্ট সব জলে ভিজে সপসপে৷ পায়ে জুতো নেই৷ গায়ের রং ফরসা৷ তাই শরীরের কাটা দাগগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে৷ ছুরির ডগা দিয়ে কেউ যেন ওর হাত-পায়ে দাগ কেটেছে৷ সেই চেরা জায়গাগুলো থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে৷
পাশ ফিরে মাটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে অসাড়ভাবে পড়ে আছে লোকটা৷ বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝার উপায় নেই৷
যে-জিনিসটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠেছিল এবার সেটার দিকে তাকাল রাহুল৷ গলায় আটকানো একটা মেটাল ব্যান্ড৷ অনেকটা কুকুরের বকলসের মতো৷ এক কি দেড় সেন্টিমিটার চওড়া৷
রাহুলের একবার মনে হল, লোকটা কি নেশা করে পড়ে আছে? আবার মনে হল, লোকটা ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসেনি তো? ও ঝুঁকে পড়ে লোকটাকে ডাকল : ‘এই যে, শুনছেন! এই যে—৷’
কোনও সাড়া নেই৷
লোকটা কি মরে গেছে? নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে?
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মরিয়া হয়ে লোকটাকে ঠেলা মারল রাহুল : ‘এই যে, শুনছেন!’
না, কোনও সাড়া নেই৷ শুধু বাতাসের সোঁ-সোঁ শব্দ আর গাছের পাতার ছটফটানির আওয়াজ৷
এদিকে রাহুলকে পিছনে দেখতে না পেয়ে নিধু-গোপালরা ফিরে আসছিল৷ রাহুলের নাম ধরে বারবার ডাকছিল৷
দু-হাতে লোকটার ডানকাঁধ ধরে টান মারল রাহুল৷ লোকটার শরীরটা আধপাক ঘুরে চিত হয়ে গেল৷
লোকটাকে ভালো করে দেখল রাহুল৷
বয়েস কত হবে, বড়জোর সাতাশ-আটাশ৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ ছোট-ছোট চোখ৷ নাকটা সামান্য থ্যাবড়া৷ ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁত দেখা যাচ্ছিল৷
রাহুল লক্ষ করল, লোকটার দু-গালে নতুন দশ পয়সার মাপের তিনটে কালচে গোল দাগ৷ কেউ যেন কড়ে আঙুল দিয়ে কাজলের টিপ পরিয়ে দিয়েছে৷
লোকটার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল৷ একইসঙ্গে রাহুল ওকে ধাক্কা দিচ্ছিল, ডাকাডাকি করছিল৷
এমন সময় গোপালরা রাহুলের কাছে পৌঁছে গেল৷ লোকটাকে দেখে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল, তর্ক জুড়ে দিল৷ আর লোকটার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল৷ থুতনি ধরে এপাশ-ওপাশ নাড়তে লাগল৷ বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল৷
ওরা এটুকু বুঝল, জামা-প্যান্ট ভিজে থাকলেও লোকটার শরীরে তাপ আছে৷ বুকে কান পেতে ধরলে ধুকপুকুনি দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে৷ লোকটা যে বেঁচে আছে তাদে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু ওর শরীরের কাটা দাগগুলো এল কেমন করে? আর ওর গলার মেটাল ব্যান্ডটাই বা কী?
এর মধ্যেই ঝড় কিছুটা কমে গেছে৷ বৃষ্টি একটু জোরালো হয়েছে৷ গাছের পাতার খসখসানি শব্দও খানিকটা স্তিমিত৷ ওরা তখনও লোকটাকে জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল৷
হয়তো বৃষ্টির জল মুখে পড়ার জন্যই হঠাৎ লোকটা চোখ খুলে তাকাল৷ চারটে মুখ ওর ওপরে ঝুঁকে রয়েছে দেখে ভয়ের একটা চাপা চিৎকার করে উঠল৷
নিধু ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ কোনও ভয় নেই৷’
দীপায়ন জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে? নদীর পাড়ে এখানে কোত্থেকে এলে?’
লোকটা ভয়ের চোখে ওদের মুখগুলোর ওপরে একবার নজর বুলিয়ে নিল৷ তারপর ডানহাতটা শূন্যে তুলে নদীর দিকে দেখাল৷ যেদিক থেকে ঘিয়া নদী বয়ে আসছে সেদিকে৷ রাহুল লক্ষ করল, লোকটার হাত কাঁপছে৷
রাহুল তাকাল নদীর উজানের দিকে৷ তা হলে কি লোকটা নদীর জলে ভেসে এসেছে?
রাহুল জিগ্যেস করল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
লোকটা সরল চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল রাহুলের দিকে৷ তারপর দু-হাতের আঙুল এমনভাবে ঘোরাল যার মানে কোথায় যাবে ও জানে না৷
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ গোপাল জানতে চাইল৷
লোকটা কোনও উত্তর দিল না৷ শূন্য চোখে গোপালের দিকে তাকিয়ে রইল৷
‘আপনার সঙ্গে আর কেউ আছে?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷
ভাঙা কর্কশ গলায় লোকটা টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কেউ…নেই৷’ মনে হচ্ছিল ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে৷
রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই লোকটা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল৷
‘কেউ…নেই৷ কেউ…নেই৷’ বলতে লাগল বারবার এবং হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ রাহুলের পায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ পাগলের মতো পায়ে মাথা ঘষতে লাগল আর কাঁদতে লাগল৷
রাহুল কোনওরকমে এক পা পিছিয়ে এল৷ সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে দাঁড় করাল৷ লোকটা তখনও মুখ বিকৃত করে কাঁদছে৷ গুঙিয়ে-গুঙিয়ে কী বলছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না৷
রাহুল অবাক হয়ে লোকটার সরল কান্না-ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷
দীপায়ন, নিধু আর গোপাল তখন নিজেদের মধ্যে কথাবলাবলি করতে লাগল৷
কী করা যায় লোকটাকে নিয়ে?
কেউ বলল, ‘ছাড় তো৷ ও এখানেই পড়ে থাক৷ পরে যেখানে যায় যাবে৷’
একজন বলল, ‘চল, আমরা গিয়ে থানায় খবর দিই…৷’
আর-একজন বলল, ‘দাদাদের ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে হত৷’
‘না, তার চেয়ে বরং পার্টি অফিসে নিয়ে চল৷ ওরা থানা-পুলিশ যা করার করবে৷’
বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এরকম এলোমেলো কথাবার্তা শোনার পর রাহুল ফস করে বলে উঠল, ‘আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে যাব৷’
সঙ্গে-সঙ্গে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন চুপ করে গেল৷ ওরা এমন চোখে রাহুলের দিকে তাকাল যেন রাহুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷
রাহুল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া আহত লোকটার দিকে তাকাল৷ হাত বাড়াল ওর দিকে৷ সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা এমনভাবে ওর হাতটা আঁকড়ে ধরল যেন এটা ছেড়ে দিলে ও আর বাঁচবে না৷ ভয়ের চোখে রাহুলের দিকে তাকাল৷
রাহুল চাপা গলায় ওকে বলল, ‘কোনও ভয় নেই৷’
নিধু, গোপাল আর দীপায়নের সঙ্গে তর্ক করতে-করতে রাহুল এগোল৷ ওর হাত আঁকড়ে ধরে মাথা নীচু করে লোকটাও এগোল৷
বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে৷ ওদের জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে৷ গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে৷ ভেজা মাটি থেকে বৃষ্টির অদ্ভুত গন্ধ উঠছে৷
দীপায়নদের নানান উপদেশ আর খোঁচার জবাবে রাহুল বলল, ‘আজ রাতটা তো ও আমাদের বাড়িতে থাক৷ কাল সকালে বাপি যা করার করবে…৷’
কাঁচা রাস্তায় বৃষ্টির জল পড়ে কাদা তৈরি হচ্ছিল৷ তার ওপরে ওরা ছপছপ শব্দে পা ফেলে এগোচ্ছিল৷ খালি পায়ে চলার জন্য লোকটার বেশ অসুবিধে হচ্ছিল৷ কারণ, পথের নানা জায়গায় ইট-পাথরের টুকরো, গাছের ভাঙা ডাল মাড়িয়ে চলতে হচ্ছিল৷ কিন্তু লোকটা মুখে টুঁ শব্দটিও করছিল না৷ সরল মুখে মাথা নীচু করে হাঁটছিল৷
একটা পুকুরের কাছে এসে রাহুলের পথ আলাদা হয়ে গেল৷ ও লোকটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল৷ গোপালদের বলল যে, কাল কী হয় না হয় সেটা কাল ওদের জানাবে৷
রাহুল বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গেছে৷ ও বাঁ-হাতের পাতা কপালের সামনে গাড়িবারান্দার মতো রেখে বৃষ্টির ছাট আটকাতে চেষ্টা করছিল৷ লক্ষ করল, এতটা পথ আসার সময় লোকটা একবারও বৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করেনি৷ বরং এমনভাবে ও পথ চলছে যেন বৃষ্টি পড়ছেই না৷
রাহুল হঠাৎই ওকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
লোকটা ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷ ভাবলেশহীন নিষ্পাপ মুখ৷ কোনও উত্তর দিল না৷
রাহুল আবার একই কথা জিগ্যেস করল৷
কোনও উত্তর নেই৷
তবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে হল, ও যেন তীব্রভাবে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে৷ হয়তো ওর নামটাই মনে করার চেষ্টা করছে৷
রাহুল হাল ছাড়ল না৷ তৃতীয়বার ওর নাম জানতে চাইল৷
এবার লোকটা ভাঙা কর্কশ গলায় টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কোকো৷ আমার নাম কোকো৷ কো-কো…৷’
কোকো! কী অদ্ভুত নাম! আপন-মনেই ভাবল রাহুল৷
কালচে আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ তারপরই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷
বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল রাহুল৷ বাউন্ডারির গ্রিলের গেটের হুড়কো খুলে ভেতরে ঢুকল৷ ওর হাত আঁকড়ে থাকা কোকোও ঢুকে পড়ল ওর সঙ্গে৷
বাউন্ডারির গেট থেকে ইট-পাতা পথ চলে গেছে একতলা বাড়িটা পর্যন্ত৷ বাড়ির বাঁ-দিকটায় বেশ কয়েকটা গাছপালা৷ অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগান৷ তার একটা ছোট অংশে অনেক ফুলগাছ৷ আর তার পাশে একটা টিউবওয়েল৷
ইট-পাতা পথ ধরে এগোতে-এগোতেই রাহুল চেঁচিয়ে মা-কে ডাকল, ‘মাম, শিগগির দরজা খোল৷ একেবারে ভিজে গেছি৷’
বাড়ির দরজায় পৌঁছে মা-কে আরও একবার ডাকল রাহুল৷ একইসঙ্গে কলিংবেল টিপল৷
দরজা খুলে গেল৷ মা দরজায় দাঁড়িয়ে৷ ওকে দেখেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক জানতাম আজ তুই বৃষ্টিতে ভিজবি৷ তোর বাপিকে বলছিলাম…’ মায়ের কথা মাঝপথেই থেমে গেল, কারণ কোকোকে তিনি এইমাত্র খেয়াল করেছেন৷
রাহুলের মা গলা নামিয়ে ছেলেকে জিগ্যেস করলেন, ‘এ কাকে সঙ্গে এনেছিস?’
রাহুল বলল, ‘মাম, ওর নাম কোকো৷ ওর খুব বিপদ৷ ঘিয়ার পাড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’
৷৷দুই৷৷
পরদিনটা ছিল রবিবার৷ রবিবারটা সবসময়েই রাহুলের কাছে কেমন যেন অন্যরকম দিন বলে মনে হয়৷ সেদিন সকালে যে-সূর্যটা ওঠে সেটা অন্যরকম৷ সকালে যে-পাখিগুলো ডাকে তাদের ডাকগুলো আলাদা৷ ওদের বাগানে যে-ফুলগুলো ফোটে রবিবার তাদের একটু বেশি হাসিখুশি বলে মনে হয়৷
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাহুল সেই ‘অন্যরকম’ সকালটাকে অনুভব করল৷ তারপরই ওর মনে পড়ে গেল কোকোর কথা৷
জানলা দিয়ে আকাশ দেখল রাহুল৷ ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-রঙা মেঘ৷ তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ভোরের খবর পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে৷ গাছের চকচকে সবুজ পাতায় সেই আলো ঠিকরে যাচ্ছে৷ কাল সন্ধের বৃষ্টিতে পাতাগুলো স্নান-টান সেরে আজ একেবারে ঝক-ঝকে হয়ে সেজে উঠেছে৷ তারই ফাঁকে-ফাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে পাখির ডাক৷
আজ সকালটাকে দেখে মনেই হয় না কাল সন্ধেয় ওরকম ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল৷
বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল রাহুল৷ আর তখনই কোকোকে দেখতে পেল৷
বারান্দার ডানদিকে ফুলের বাগান৷ সেখানে অনেকগুলো সূর্যমুখী ফুলের গাছ৷ এখন দু-চারটে ফুল ফুটেছে—বাকি সব কুঁড়ি৷ তার পাশেই কয়েকটা বেলফুল আর গোলাপের গাছ৷ তাতে সাদা আর গোলাপি ফুল৷ নাকে না হলেও মনে-মনে ফুলের গন্ধ পেল রাহুল৷ নাক টেনে চোখ বুজল ও৷
চোখ খুলতেই কোকোকে দেখতে পেল৷ একটা জামগাছের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল৷ তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াতে লাগল আর একই সঙ্গে হাততালি দিতে লাগল৷
ভালো করে খেয়াল করতেই রাহুল একটা হলদে-কালো প্রজাপতিকে দেখতে পেল৷ প্রজাপতিটা ফুলের বাগানে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে আর কোকো তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওটার পিছন-পিছন ছুটছে৷
না, প্রজাপতিটা ধরার জন্য ও মোটেই ছুটছে না৷ বরং এক বিচিত্র উল্লাসে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ওটাকে অনুসরণ করছে৷
সাতাশ-আটাশ বছরের ছেলেটাকে একটা বাচ্চা ছেলে বলে মনে হল রাহুলের৷ সরল ভোলাভালা চোখ, শরীরের কাটা-ছেঁড়া সম্পর্কে উদাসীন, কোথা থেকে ও এসেছে, কোথায় যাবে, সে-সম্পর্কে ওর চিত্ত ভাবনাহীন৷
বারান্দার গ্রিলের দরজা ঠেলে সরিয়ে দু-ধাপ সিঁড়ি নামল রাহুল৷ পায়ে-পায়ে বাগানের দিকে এগোল৷
বাগানের মাটি ভেজা৷ কোথাও-কোথাও কাদা প্যাচপেচে হয়ে আছে৷
ফুলগাছগুলোর দিকে তাকাল রাহুল৷ হলদে-কালো প্রজাপতিটা ছাড়াও কয়েকটা ফড়িং ওড়াউড়ি করছে সেখানে৷ কিন্তু কোকোর যত আগ্রহ প্রজাপতিটাকে নিয়ে৷
রাহুলকে দেখতে পেয়েই খুশিতে উজ্জ্বল হল কোকোর মুখ৷ ও চেঁচিয়ে বলল, ‘এই…দ্যাখো৷ প্রজা…পতি৷ হলুদ…আর…কালো৷ প্রজা…পতি৷’
একইরকম কর্কশ স্বর আর টেনে-টেনে কথা বলা৷ যেন ঠান্ডা লেগে বরাবরের জন্য গলা ভেঙে গেছে৷
কোকোর উৎসাহ, খুশি, আর কথা বলার ঢং রাহুলের সমবয়েসি কোনও বন্ধুর মতন৷ কাল সন্ধে থেকেই ব্যাপারটা রাহুল লক্ষ করেছে৷ তাতে ও বেশ মজাও পেয়েছে৷
প্রথমটায় কোকোকে দেখে রাহুলের মাম আর বাপি খুব অবাক হয়েছিলেন৷ কোকোকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরের ঘরে রাহুলকে ডেকে নিয়ে মাম ওকে অনেক প্রশ্নও করেছেন৷
সেসব কথা শুনতে পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বাপিও সেখানে এসে হাজির হয়েছেন৷ দুজনের প্রশ্নের ঠেলায় রাহুলের তো অবস্থা কাহিল!
বাপি বললেন, ‘বোঝোই তো…দিন-কাল ভীষণ খারাপ৷ ওকে তুমি চেনো না, জানো না…৷’
সেইসঙ্গে মাম যোগ করলেন : ‘তা ছাড়া ওর গায়ে অত জায়গায় কাটা…রক্ত পড়ছে৷ কে জানে খুন-টুন করে পালিয়ে এসেছে কি না৷ তারপর থানা-পুলিশ হয়ে একেবারে কেলেংকারি হবে৷’
রাহুল অবাক হয়ে বলল, ‘তা হলে কোকো এখন কোথায় যাবে, মাম? ওর তো কেউ নেই! ও মনে হয় ঘিয়ার জলে ভেসে এসেছে৷ বললাম তো, ভিজে জামাকাপড়ে একটা গাছের তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’
বাপি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘কাল থেকে সবাই তো ওর কথা জিগ্যেস করবে৷ তখন কী জবাব দেব?’
‘কেন বাপি, যা সত্যি তাই বলবে!’ রাহুল সঙ্গে-সঙ্গে সমাধান জুগিয়ে দিল, ‘কোকো আমাদের কাছে থাকলে তাতে কার কী!’
‘এভাবে বলতে নেই, রাহুল৷’ মাম ওকে শাসনের গলায় বললেন, ‘তা ছাড়া তুমি তো জানো, এখন চার-পাশে যা চলছে তাতে কোনও অচেনা লোককে এভাবে শেলটার দেওয়া ঠিক নয়৷ কে বলতে পারে যে, লোকটা চোর কিংবা ডাকাত নয়! কাল বরং থানায়…৷’
‘আমি…চোর…না৷ আমি…ভালো৷’
এ-কথা শুনে তিনজনেই চমকে ঘুরে তাকিয়েছে৷
কোকো বাইরের ঘর ছেড়ে কখন যেন ঢুকে পড়েছে ভেতরের ঘরে৷ তারপর ওর ভাঙা গলায় নিজের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট নিজেই প্রচার করে চলেছে৷
‘বিশ্বাস…করো৷ আমি…চোর…না৷ আমি…খুব…ভালো৷’
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সরল ছেলেটার মুখে এ-কথা শুনে বাপি হেসে ফেললেন৷
রাহুল ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘কোকো, তুমি খুব ভালো৷ গুড বয়৷’
কোকো হাসল : ‘আমি…গুড…বয়৷ আমি…গুড…বয়৷’
মাম কোকোর দিকে চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷
রাহুল মামের কাছে এল আবার৷ মামের হাত ধরে আবদারের গলায় বলল, ‘মাম, ওকে শিগগির শুকনো জামাকাপড় দাও৷ ওর যে ঠান্ডা লেগে যাবে!’
মাম চমকে উঠে ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠলেন৷
বাপিও বললেন, ‘রাহুল ঠিক বলেছে৷ ওকে আগে শুকনো জামা-প্যান্ট দাও৷ রাহুলেরটা ওর গায়ে হবে না—আমার একটা পাজামা আর শার্ট দাও৷ তারপর ওর কাটা জায়গাগুলোয় লাল ওষুধ আর ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিচ্ছি৷’
রাহুল কৃতজ্ঞতার চোখে বাপির দিকে তাকাল৷
বাপি বললেন, ‘শোন, ওকে আগে ড্রেস-ট্রেস দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে কিছু খাওয়াই৷ বোধহয় বেচারা অনেকক্ষণ না খেয়ে আছে৷ তারপর…৷’
রাহুল অবাক চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘তারপর কী?’
‘তারপর ওকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে৷ ওর হিস্ট্রিটা জানার চেষ্টা করতে হবে, বুঝলি?’
রাহুল কী বুঝল কে জানে! কিন্তু ও আলতো করে ঘাড় নাড়ল৷
কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি…গুড… গুড…বয়…৷ ভেরি…গুড…বয়৷’
রাহুল হেসে বলল, ‘ভেরি গুড বয়৷’
সেই ‘ভেরি গুড বয়’ এখন বাপির একটা নীল হাফশার্ট আর পাজামা পরে বাগানে প্রজাপতির পিছনে ছুটছে৷
বাপি কাল রাতেই কোকোর ‘হিস্ট্রি’ জানার চেষ্টা করেছেন৷ যেটা নিয়ে বাপির বিশেষ কৌতূহল ছিল সেটা নিয়েও ওকে প্রশ্ন করেছেন৷ সেই জিনিসটা নিয়ে মাম আর রাহুলেরও ভীষণ কৌতূহল ছিল৷ তাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ওরা তিনজনে কোকোকে নিয়ে বসেছে৷
কোকো বসবার ঘরের একটা চেয়ারে হাঁটু মুড়ে বাবু হয়ে বসেছিল৷ ও আরামের শব্দ করে কয়েকবার ঢেঁকুর তুলল৷ রাহুল, বাপি আর মামের মুখের দিকে একবার করে তাকাল৷
রাহুলরা তিনজন কোকোকে প্রায় ঘিরে বসেছিল৷ ওকে কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো, তোমার গলায় ওটা কীসের ব্যান্ড?’
কোকো কোনও জবাব দিল না৷ ওর ডানহাতটা গলার কাছে চলে গেল৷ স্টিলের ব্যান্ডটার ওপরে ও আঙুল বোলাতে লাগল৷
বাপি আবার জিগ্যেস করলেন, ‘ওটা কীসের বেল্ট, কোকো? বলো—কোনও ভয় নেই৷ তুমি তো গুড বয়৷’
অল্প হাসল কোকো৷ অস্পষ্টভাবে বলল, ‘আমি তো…গুড বয়৷’
এবার রাহুল ওকে জিগ্যেস করল, তোমার গলার এই ব্যান্ডটা কীসের, কোকো?’
কোকো তেরছা চোখে সিলিং-এর দিকে তাকাল৷ একমনে কী যেন ভাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ খুশির সুরে বলে উঠল, ‘মনে…পড়েছে৷ এটা কন্ট্রোল…ব্যান্ড৷ আমি..গুড…বয়৷’
কন্ট্রোল ব্যান্ড! কীসের কন্ট্রোল ব্যান্ড? রাহুল অবাক চোখে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল৷
জিনিসটা চেহারায় অনেকটা ঘড়ির ব্যান্ডের মতো৷ তবে মসৃণ গোল নয়৷ চার জায়গায় কবজার জোড় রয়েছে৷ আর ব্যান্ডটার ডানদিকে—মানে, কোকোর বাঁ-কানের ঠিক নীচে—একটা চ্যাপটা চৌকোনা মেটাল বক্স লাগানো রয়েছে৷ বক্সটার মাপ অনেকটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো৷ তবে মাত্র পাঁচ কি ছ’মিলিমিটার পুরু৷ সেই বাক্সের ওপরে চারটে খুদে এল. ই. ডি. ল্যাম্প৷ এখন নিভে আছে৷
‘এই কন্ট্রোল ব্যান্ডটা তুমি কী জন্যে গলায় পরে আছ?’ রাহুল জিগ্যেস করল, ‘কে তোমার গলায় এটা পরিয়ে দিয়েছে?’
আবার চিন্তায় পড়ে গেল কোকো৷ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বলল, ‘মনে পড়েছে৷ এটা মাস্টারজি…পরিয়ে…দিয়েছে৷ মাস্টারজি…দিয়েছে৷’
‘কে মাস্টারজি?’ মাম জিগ্যেস করলেন৷
কোকো একগাল হেসে বলল, ‘মাস্টারজি৷ মাস্টারজি৷’
বাপি আর রাহুলও বারকয়েক একই প্রশ্ন করল কিন্তু কোকোর সেই একই উত্তর৷
তখন বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘এটা তুমি গলায় পরেছ কেন?’
কোকো দু-পাশে মাথা নাড়ল৷ ও জানে না৷
‘এটার নাম কন্ট্রোল ব্যান্ড কে বলল?’
‘মাস্টারজি—’
‘মাস্টারজির নাম কী?’
‘মাস্টারজি৷’
‘মাস্টারজি কোথায় থাকেন?’
‘অনেক…দূরে৷ অনেক…দূরে৷’
বাপি কী মনে করে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে হাত বাড়ালেন : ‘তোমার ব্যান্ডটা একটু দেখি তো…৷’
সঙ্গে-সঙ্গে সাপের ছোবল খাওয়া মানুষের মতো পিছনে ছিটকে গেল কোকো৷ ভয় পাওয়া চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না…না৷ এটায়…কেউ…হাত দেবে না৷ মাস্টারজির বারণ৷’
‘মাস্টারজির বারণ’ শব্দ দুটো বারবার আওড়াতে লাগল কোকো৷ ঠিক যেন পুজোর মন্ত্র পড়ছে৷
বাপি, মাম, আর রাহুল চোখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ মাম চাপা গলায় বাপিকে বললেন, ‘ছেড়ে দাও৷ মনে হয় ব্যান্ডটা নিয়ে ওর কোনও মেন্টাল প্রবলেম আছে৷ পরে কখনও সুযোগ পেলে ওটা দেখো…৷’
বাপি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন৷
রাহুল কোকোর হাত-পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘তোমার হাতে-পায়ে কেটে গেল কী করে?’
রাহুলের কথায় আবার সোজা হয়ে বসল কোকো৷ পায়ের ভাঁজ খুলে মেঝের দিকে পা ঝুলিয়ে দিল৷ তারপর অবাক হয়ে নিজের হাতে আর পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে দেখল, সেগুলোর ওপরে আঙুল বোলাল৷ কিন্তু কোনও উত্তর দিল না৷
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাহুল আবার একই প্রশ্ন করল৷
রাহুলের দিকে সরল চোখে তাকাল কোকো৷ ধীরে-ধীরে বলল, ‘মাস্টারজি মেরেছে৷ খুব…মেরেছে৷’
রাহুলের মনে কষ্ট হল৷ ও মাম আর বাপির দিকে তাকাল৷
মাম বললেন, ‘আহা রে, এভাবে কেউ মারে?’
বাপি বিড়বিড় করে বললেন, ‘ব্যাপারটা আমার তো খুব মিস্টিরিয়াস লাগছে৷ যাকে ও ‘‘মাস্টারজি’’ বলছে সে কোথাকার মাস্টার? স্কুল- কলেজের, না অন্য কিছুর?’
রাহুল এবার কোকোর গালের চাকা-চাকা দাগগুলোর দিকে দেখাল৷ আঙুল বাড়িয়ে একটা দাগ সামান্য ছুঁতেই কোকো ‘উঃ!’ করে উঠল৷
‘কোকো, এই দাগগুলো কী করে হয়েছে? এখানে ব্যথা নাকি?’
কোকো নিষ্পাপ সরল চোখে কয়েক মুহূর্ত রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর কী বুঝল কে জানে! আলতো করে বলল, মাস্টারজি৷ সিগারেট খায়৷ সিগারেটের ডগায়…আগুন থাকে৷ সেই আগুন দিয়ে…ছ্যাঁকা দিয়েছে৷ ছ্যাঁকা৷ তিনবার৷ আরও দিত৷ আমি…আমি…৷’
‘‘‘আমি’’ কী?’ রাহুল ওকে কথা ধরিয়ে দিতে চাইল৷
‘আমি কেউ না৷ আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’
কোকো হঠাৎই কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷
সেটা লক্ষ করে বাপি বললেন, ‘রাহুল, ওকে এবার রেস্ট নিতে দাও৷ আমার মনে হচ্ছে, ও বেশ ট্রাবলড৷ মেন্টালি আপসেট হয়ে আছে৷ তা ছাড়া ওর বুদ্ধির ব্যাপারটাও বোধহয় স্বাভাবিক নয়৷’
মাম বাপিকে বললেন, ‘ও ক’টা-দিন আমাদের কাছে থাকুক৷ একটু সেরে-টেরে উঠুক—তারপর পুলিশে খবর দিয়ে ওর বাড়ির খোঁজখবর করা যাবে৷ এখন ওকে থানা-পুলিশে দিলে ওকে পাগলদের হোমে পাঠিয়ে দেবে৷’
‘না, না, ওখানে কিছুতেই ওকে পাঠিয়ো না, বাপি!’ রাহুল প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল৷
খবরের কাগজ আর টিভি দেখে রাহুল জানে ওই সব সরকারি হোমে আবাসিকদের কী দুরবস্থার মধ্যে রাখা হয়৷ কেউ চরম হেনস্থা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে, আর কেউ-বা ওই হোম থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়৷
বাপি রাহুলের পিঠে আশ্বাসের হাত রেখে বললেন, ‘তুই কি খেপেছিস? ওকে ওই নরকে পাঠাব! ওর বাড়ি আর রিলেটিভদের ঠিকঠাক খবর না পাওয়া পর্যন্ত কোকোকে আমরা ছাড়ছি না৷’
রাহুল বাপির হাতটা জড়িয়ে ধরল৷ ভাবল মনে-মনে, বাপি কী ভালো!
কোকো ধীরে-ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল৷ রাহুল ওর দিকে লক্ষ রাখছিল৷ দেখল, ওর শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ মুখটা যেন চার-পাঁচ বছরের কোনও শিশুর মুখ৷ সেই ফরসা টুকটুকে মুখে সিগারেটের ছ্যাঁকা! মাস্টারজির কাছে কী অন্যায় করেছিল কোকো যে ওকে এমন করে নৃশংসভাবে শাস্তি দিয়েছে? রাহুলের টিচাররা তো রাহুলকে কত ভালোবাসেন৷ ওঁদের সঙ্গে থাকতে রাহুলের কত ভালো লাগে!
কোকো হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি টিভি দেখব৷’
এ-কথায় বাপি আর মাম হেসে উঠলেন৷ বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওকে এবার ছেড়ে দাও৷ একটু টিভি-ঠিভি দেখুক—রিল্যাক্স করুক৷ রাহুল—’ রাহুলের কাঁধে হাত রাখলেন বাপি : ‘ওকে নিয়ে টিভি দ্যাখো৷ ওর সঙ্গে থাকো৷ তবে বেশি রাত কোরো না…৷’
কাল রাতে কোকোর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে রাহুল৷ ওর সঙ্গে টিভি দেখেছে৷ তারপর কয়েকটা রঙিন কমিকস-এর বই ওকে দেখতে দিয়েছে৷ শেষে ক্লান্ত হয়ে কোকো যখন হাই তুলছিল তখন ওরা শুয়ে পড়েছে৷
রাহুলের ঘরেই মাম কোকোর জন্য বিছানা পেতে দিয়েছিল৷ সেখানে গা এলিয়ে দেওয়ামাত্রই কোকো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ অথচ কোকোর কথা ভেবে-ভেবে রাহুলের ঘুম এসেছে অনেক দেরিতে৷
এখন সেই শিশু-যুবক একগাল খুশি নিয়ে হলদে-কালো প্রজাপতির পিছনে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াচ্ছে৷
রাহুলকে কাছে আসতে দেখে কোকো আবার বলে উঠল, ‘রাহুল, এই দ্যাখো…প্রজাপতি৷ প্রজা…পতি৷’
রাহুল হেসে ঘাড় নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ, প্রজাপতি৷ প্রজাপতি…সুন্দর৷’
‘প্রজাপতি…সুন্দর৷’ রাহুলের কথার প্রতিধ্বনি তুলল কোকো৷
৷৷তিন৷৷
বাজারের থলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাপি রাহুলকে ডাকলেন৷
রাহুল ওর ঘরে কোকোকে নিয়ে বসেছিল৷ ওর বইপত্র, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, এটা-সেটা কোকোকে দেখাচ্ছিল৷ সেই সময় বাপি দরজায় এসে হাজির হলেন৷
‘কী রে, রাহুল—আমার সঙ্গে বাজারে যাবি তো!’
প্রত্যেক রবিবারে রাহুল বাপির সঙ্গে বাজারে যায়৷ এমনিতে বাপির সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে বাজার করতে রাহুলের ভালো লাগে৷ তা ছাড়া রবিবারে বাপি একটু বেশি করে বাজার করেন—যাতে পরের তিনদিন বাজারে না গেলেও চলে৷ সেইজন্য রবিবারে বাপি তিনটে থলে নিয়ে বেরোন৷ ফেরার সময় থলেগুলো বেশ ভারীও হয়৷ রাহুল সঙ্গে থাকলে সবচেয়ে কম ওজনের থলেটা বয়ে বাপিকে সাহায্য করে৷
রাহুল কোকোকে ছেড়ে চটপট উঠে পড়ল৷ হাতে তালি দিয়ে হাত ঝেড়ে নিয়ে বলল, ‘চলো, বাপি—’ দরজার দিকে এগোতে-এগোতে কোকোকে লক্ষ করে বলল, ‘কোকো, তুমি এগুলো নিয়ে খেলা করো, আমি বাপির সঙ্গে বাজার করে এক্ষুনি ফিরে আসছি৷’
কোকো কিন্তু ততক্ষণে মেঝে থেকে উঠে পড়েছে৷ রাহুলের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলে উঠেছে, ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব৷’
কোকো ওদের সঙ্গে গেলে রাস্তায় পাঁচজন পাঁচকথা জিগ্যেস করবে৷ সে-কথা ভেবেই রাহুল সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, কোকো—এরকম জেদ করতে নেই৷ তুমি না গুড বয়?’
‘আমি…গুড…বয়৷ কিন্তু তোমাদের সঙ্গে…বাজারে…যাব৷’ গোমড়া মুখ করে কোকো বলে উঠল৷
বাপি এবার বললেন, ‘না, কোকো৷ গুড বয়রা কথা শোনে৷ তুমি এখানে থাকো—খেলা করো—আমরা এক্ষুনি ফিরে আসব৷’
কোকো পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো অভিমানী মুখ করে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি…বাজারে…যাব৷ আমি…বাজারে…যাব…৷’
রাহুলের মাথায় হঠাৎই একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ শেষ অস্ত্র হিসেবে সেটা প্রয়োগ করল ও৷
‘তোমার তো চটি-জুতো কিচ্ছু নেই—আমাদের সঙ্গে তুমি যাবে কেমন করে! বাজারে ভীষণ জল-কাদা…৷’
এ-কথা শোনামাত্রই কোকোর মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ ও রাহুল আর রাহুলের বাপিকে অবাক করে দিয়ে ‘চটি…আছে! চটি…আছে!’ বলে গ্রিল দেওয়া বারান্দার দিকে ছুট লাগাল৷
রাহুল আর বাপিও ওর পিছন-পিছন এগোল৷
গ্রিল ঘেরা বারান্দার একপাশে রাহুলদের সবার চটি-জুতো থাকে৷ সেটা গতকালই বোধহয় কোকোর নজরে পড়েছে৷ রাহুলরা যখন বারান্দায় এসে পৌঁছল ততক্ষণে রাহুলের মায়ের একজোড়া চটি পায়ে দিয়ে কোকো একেবারে বাউন্ডারির গেটে পৌঁছে গেছে৷ সেখান থেকে কোকো দু-হাতে হাতছানি দিয়ে রাহুলকে ডাকছে : ‘এই তো চটি পরেছি! রাহুল, তাড়াতাড়ি এসো…তাড়াতাড়ি…৷ আমি… বাজারে…যাব৷ বাজারে…৷’
ওর কাণ্ড দেখে রাহুল হেসে ফেলল৷ বাপিও আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না৷ রাহুলের মা কখন যেন রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ কোকোর কাণ্ড দেখে হেসে বললেন, ‘ওইটুকু বাচ্চা! ও কখনও বোঝে কোন চটিটা ছেলেদের আর কোনটা মেয়েদের!’
‘ওইটুকু বাচ্চা!’ বাপি অবাক হয়ে মামের দিকে তাকালেন : ‘কী বলছ তুমি? ওর বয়েস কম করেও পঁচিশ কি ছাবিবশ হবে৷’
মাম কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বললেন, ‘সে হোক গে৷ ক্যালেন্ডার দিয়ে কি সবসময় বয়েস মাপা যায় নাকি! ও আসলে একটা বাচ্চা ছেলে…৷’
তো সেই পঁচিশ-ছাবিবশ বছরের ‘বাচ্চা’ ছেলেটা রাহুল আর বাপির সঙ্গে বাজারের পথ ধরল৷ রাহুল লক্ষ করল, চলার পথে কোকো অবাক হয়ে সব কিছু দেখছে৷ যেন ও সদ্য পৃথিবীতে এসে একের পর এক নতুন আবিষ্কার করে চলেছে৷ চকচকে উদগ্রীব চোখে ও দেখছে আকাশ, সূর্য, গাছপালা, ফুল, পাখি, সাইকেল রিকশা, গোরুর গাড়ি, সাইকেল, মোটরবাইক, ভ্যান-রিকশা, টালির দোচালা-চারচালা ঘর, জল-কাদা, ঘাস, মানুষজন—আরও কত কী!
কোকোর চোখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে অনেক প্রশ্ন জাগছিল৷ মাস্টারজি, সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ, হাত-পায়ের ক্ষতচিহ্ন, কন্ট্রোল ব্যান্ড, ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসা একটা মানুষ…আরও কত বিষয় ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন৷ আবার একইসঙ্গে মনে পড়ছিল গতকালের সেই হাহাকার : ‘আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’ শিশু-যুবকটির তখনকার সর্বহারা অসহায় মুখের কথা মনে করে রাহুলের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল৷ ও তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর মুখে এখন নতুন পৃথিবীর নতুন-নতুন জিনিস আবিষ্কারের আনন্দ৷
বাজারে পৌঁছে অন্যান্য রবিবারের মতো বাপি প্রথমে আনাজপাতি কিনতে শুরু করলেন৷ সরু-সরু বাঁশের ডগায় পলিথিনের ছাউনি খাটিয়ে দোকানিরা বসেছে৷ কেউ রাস্তার ধারে, কেউ-বা রাস্তার লাগোয়া মাঠে৷ চারদিকের নানারকম শব্দ বলে দিচ্ছিল এটা একটা ব্যস্ত জায়গা৷ লোকজনের কথাবার্তা, সাইকেলের ঘণ্টি, ভ্যান-রিকশার প্যাঁক-প্যাঁক, মোটরবাইকের আওয়াজ—কতরকমের শব্দ! তিন-চাররকম সবজি কেনা হতেই কোকো জেদ করে, বায়না করে, সেই থলেটা বাপির হাত থেকে নিয়ে নিল৷ বলল, বাজারের একটা থলে ও বইবে, কারণ, ওর গায়ে জোর আছে৷
এ-কথায় রাহুল যখন হেসে বলেছে, ‘তোমার গায়ে জোর আছে মানে?’
তখন কোকো জবাব দিয়েছে, ‘মাস্টারজি বলে৷ আমার…গায়ে খুব…জোর৷’
রাহুল তখন অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়েছে শুধু—কোনও কথা বলেনি৷
ঘুরে-ঘুরে বাজার করার কাজ শেষ হল একসময়৷ বাপি, রাহুল আর কোকো বাড়ির পথ ধরল৷ অন্যান্য রবিবার রাহুল আর বাপি সাইকেল-রিকশায় ফেরেন৷ কিন্তু আজ কোকো সঙ্গে আছে—রিকশায় তিনজন আঁটবে না৷ তার ওপর তিন-তিনটে থলে৷
ফেরার পথে রাহুল আর কোকো গল্প করছিল৷ রাহুল বলছিল, কোকো অবাক হয়ে শুনছিল৷ আর মাঝে-মাঝে চারপাশটা দেখছিল৷
হঠাৎই দূরে একটা গোরুর গাড়ি দেখতে পেল রাহুল৷ অনেকগুলো বস্তা বোঝাই করে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে৷ রাস্তার খানাখন্দে পড়ে চাকাগুলো একবার ডানদিকে একবার বাঁ-দিকে হেলে যাচ্ছে৷
রাহুল আঙুল তুলে গোরুর গাড়িটা কোকোকে দেখাল, বলল, ‘ওই দ্যাখো, গোরুর গাড়ি…৷’
‘আমি…আগে…গোরুর গাড়ি…দেখেছি৷’ স্মৃতি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে কোকোর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷
বাপি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ নীল আকাশে ছোট-ছোট মেঘ ভেসে আসছে সূর্যের কাছাকাছি৷ কয়েকটা লম্বা-লম্বা গাছ মাথা তুলে রয়েছে আকাশের দিকে৷ বাতাসে অল্প-অল্প নড়ছে৷
বাপি মুগ্ধ চোখে আকাশটাকে দেখছিলেন৷ রাহুল বুঝতে পারছিল বাপির এখনই রং-তুলি নিয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করছে৷ ছবি আঁকা বাপির একমাত্র শখ৷ সময় পেলেই জল রং আর তুলি নিয়ে বসে পড়েন৷ মাঠ, ঘাট, নদী, গাছপালা আঁকেন৷ বাপির কাছে রাহুল শুনেছে, এ ধরনের ছবিকে ল্যান্ডস্কেপ বলে৷
রাহুল একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল৷ হঠাৎই লোকজনের হইচই চিৎকারে ও চমকে উঠল৷ আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে৷
গোরুর গাড়িটার একটা চাকা আচমকা ভেঙে কাত হয়ে গেছে৷ ফলে বস্তা-বোঝাই গাড়িটা হেলে পড়েছে রাস্তার ধারের নালার দিকে৷ কয়েকটা বস্তা ধীরে-ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নালার গর্তে৷ মাথায় গামছা জড়ানো গাড়োয়ান হাতের ছিপটি ছুড়ে ফেলে লাফ দিয়েছে রাস্তায়৷ বলদ দুটো ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে৷
লোকজন ছুটে যাচ্ছিল বিপজ্জনক-ভাবে হেলে পড়া গাড়িটার দিকে৷ মনে হচ্ছিল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোরুর গাড়িটা বস্তাসমেত নালায় গড়িয়ে পড়বে৷ গতকালের বৃষ্টির জল নালায় জমে আছে৷ এর মধ্যেই গড়িয়ে পড়া তিনটে বস্তা জলে ভিজে একসা৷ ভেজা বস্তা দেখে রাহুল বুঝল, বস্তায় আলু আছে৷
হাতের থলেটা রাস্তায় নামিয়ে রেখে কোকো কখন যেন ছুট লাগিয়েছিল৷
রাহুল পিছন থেকে ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগল৷ কিন্তু ছেলেটা শুনলে তো!
রাহুল দেখল, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কোকো হেলে পড়া গোরুর গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে গাড়িটার লম্বা বাঁশের কাঠামোর নীচে কাঁধ লাগিয়ে প্রাণপণে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ ওর ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল, চোখ-মুখ বিকৃত হয়ে গেল৷ মরিয়া হয়ে ও হেলে পড়া গাড়িটাকে চাগিয়ে তুলতে লাগল৷
রাস্তার একপাশে বাজারের থলে নামিয়ে রেখে বাপির দিকে একবার তাকিয়েই রাহুল ছুটতে শুরু করেছিল৷ ও যখন গোরুর গাড়িটার কাছে এসে পৌঁছল তখন গাড়ির হেলে পড়া দিকটা অনেকটা সোজা হয়ে গেছে৷ কোকোর হাতের শিরা ফুলে উঠেছে, গলার শিরা ফুলে উঠেছে৷ ও দম বন্ধ করে অবাক করা শক্তিতে গাড়িটাকে ঠেলে তুলে একটু-একটু করে সোজা করছে৷
ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে৷ লোকজন হইহই চিৎকার করে কোকোর এই অলৌকিক কাণ্ড দেখছে৷ বলদ দুটোর ঘাড়ের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় ওরা চিৎকার বন্ধ করেছে৷
ভিড়ের মধ্যে কে একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘সবাই কাঁধ লাগাও, ভাই—এসো!’
সঙ্গে-সঙ্গে শোরগোল উঠল৷ পাঁচ-ছ’জন মানুষ ছুটে গিয়ে কোকোর পাশাপাশি কাঁধ লাগাল৷ আওয়াজ তুলল, ‘মারো জোয়ান হেঁইয়ো…৷’
গাড়ির বিশাল চাকাটা নালার ঢালে কাত হয়ে পড়েছিল৷ কয়েকজন সেটা তুলে এনে গাড়ির পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা রডে লাগিয়ে দিল৷ গোরুর গাড়িটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওটার চাকার হুড়কোটা ভেঙে গিয়েছিল৷ তাই নতুন একটা লোহার হুড়কো জোগাড় করতে দুজন সাইকেল চেপে রওনা হয়ে গেল৷
কোকো গাড়িটা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল৷ হাঁপাচ্ছিল আর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে দু-হাত জামায় ঘষে-ঘষে মুছছিল৷
রাহুল চেঁচিয়ে ওকে ডাকল, ‘কোকো…এদিকে এসো…৷’
কোকো ফিরে তাকাল৷ রাহুলকে দেখতে পেল৷ হেসে হাত নাড়ল৷ তারপর রাহুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷
কিন্তু ও আসবে কী! লোকজন ওকে ঘিরে ধরে সাবাশ দিতে লাগল৷
‘বাব্বাঃ, তোমার গায়ে তো হেভি জোর!’
‘তুমি কে হে? তোমার নাম কী? তোমাকে তো এ এলাকায় আগে দেখিনি! তবে হ্যাঁ, তোমার হিম্মত আছে বটে!’
‘সাবাশ, ভাই! একটা দারুণ জিনিস দেখালে৷’
‘ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত৷’
‘তোমার গলায় ওটা কী বলো তো? এরকম পিকিউলিয়ার হার তো আগে দেখিনি…৷’
রাহুল তাড়াতাড়ি জটলার মধ্যে ঢুকে পড়ে কোকোর হাত ধরল৷ ওকে টেনে নিয়ে এল বাইরে৷ জনতার মধ্যে থেকে উৎসাহী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে কোকোর পিঠ চাপড়ে দিল৷
বাপি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওদের কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘শিগগির বাজারের থলে দুটো তুলে নিয়ে চল৷ এক্ষুনি নানানজন এসে কোকোকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করবে…তখন মুশকিল হবে…৷’
রাহুল আর কোকো চটপট ওদের থলে দুটো তুলে নিয়ে এল৷ তারপর ওরা তিনজনে জলদি পায়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির দিকে৷
কিন্তু নিরাপদে বাড়ি পৌঁছনো হল না৷
গোরুর গাড়ির ঘটনার জায়গা ছেড়ে বিশ-পঁচিশ পা যেতে না যেতেই রথপতি গুপ্তর সঙ্গে দেখা৷ ভদ্রলোক একসময়ে পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন৷ এখন আর নেই৷ রেডিমেড জামা-কাপড়ের ব্যবসা করেন৷ কলকাতার কয়েকটা নামী দোকানে ছেলেমেয়েদের শৌখিন পোশাক সাপ্লাই করেন৷
রাহুলের বাপির সঙ্গে রথপতির বেশ ভালোই আলাপ৷ ভদ্রলোক সবসময় পাড়াপড়শির হাঁড়ির খবরের খোঁজ করে বেড়ান৷ সেটা বিরক্তিকর হলেও লোকজনের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান৷ বিপদে আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন৷
রাহুলের বাপির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন রথপতি৷ হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কেমন আছেন, কল্যাণবাবু?’
‘ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?’
‘চলে যাচ্ছে আর কী!’ কোকোর দিকে তাকালেন রথপতি৷ আঙুল নেড়ে বললেন, ‘এই ছেলেটির জন্যে আজ গর্বে বুক ফুলে উঠছে৷ আমি ওই রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি৷ ওর সাহস আর শক্তির প্রশংসা করতে হয়৷ পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া একটা বিশাল গুণ৷ কী নাম তোমার?’
কোকো কর্কশ গলায় বলল, ‘কোকো…৷’
‘সাবাশ, কোকো!’ কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি৷ তারপর চোখ সরু করে কল্যাণবাবুর দিকে তাকালেন : ‘কোকো আপনার কে হয়? ওকে তো আগে কখনও মণিমেলায়…মানে, আমাদের এ-গাঁয়ে দেখিনি—৷’
কল্যাণবাবু উত্তর দিতে একটুও দেরি করলেন না৷ গতকাল রাতে ভেবে-ভেবে তিনি গল্পটা তৈরি করে নিয়েছেন৷
‘ও আমার পিসতুতো দাদার ছেলে—শ্রীরামপুরে থাকে৷ ওর একটু সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম আছে৷ ওখানে ডক্টরের ট্রিটমেন্টে আছে৷ তিনিই বলেছেন, কিছুদিন গ্রামের হাওয়া খেয়ে আসতে৷ মানে, গাছপালা মাঠঘাটের কাছাকাছি থাকলে ওর প্রবলেমটা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে…৷’
‘কী প্রবলেম ওর?’
এতটা খোঁচানো কোশ্চেন রাহুলের বাপি আশা করেননি৷ তাই একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘এই…মানে…ওর মধ্যে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আছে৷ যদিও ওর বয়েস প্রায় সাতাশ৷ তা ছাড়া গলাটা কেমন হোর্স… ধীরে-ধীরে কথা বলে…৷’
রথপতি গুপ্ত ভুরু কোঁচকালেন৷ আজব প্রাণী দেখার দৃষ্টিতে কোকোর দিকে তাকালেন : ‘ওর গলার ওই লোহার বালাটা কীসের?’
কল্যাণবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ওটা একটা মেডিক্যাল ইলেকট্রনিক ব্যান্ড৷ ট্রিটমেন্টের জন্যে ওর ডক্টর দিয়েছেন৷’
‘বাব্বা! এসব তো বাপের জন্মে কখনও দেখিনি৷ এ আবার কী ধরনের রোগ?’
‘অ্যাকিউট মালটিপল সাইকো-প্যাথলজিক্যাল চাইল্ড সিনড্রোম৷ মানে, ওর সাইকিয়াট্রিস্ট তাই বলেছেন…৷’
এত লম্বা-চওড়া নামে রথপতি বেশ ঘাবড়ে গেলেন৷ আর কোনও প্রশ্ন করলেন না৷
কল্যাণ জানতেন যে, রথপতি বেশিদূর লেখাপড়া শেখেননি৷ তাই ওঁর অন্তর-খোঁচানো প্রশ্নমালা ঠেকানোর জন্য যা পেরেছেন বানিয়ে একটা খটমট রোগের নাম বলে দিয়েছেন৷ এ-নামে সত্যিই কোনও রোগ হয় কি না তিনি জানেন না৷
‘ও, আচ্ছা৷ তা ও তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক৷’ আবার কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি : ‘তুমি বড় ভালো ছেলে, বাবা৷ তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো৷’
সামান্য হেসে রথপতি গুপ্ত চলে গেলেন৷
রাহুল বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো, বাপি৷ নইলে কোকোকে নিয়ে আরও সবাই প্রশ্ন করবে৷’
বাপি ‘হ্যাঁ—চল৷’ বলে তাড়াতাড়ি পা চালালেন বটে, কিন্তু ওঁর মনে উদ্বেগ থেকেই গেল৷
বাজারে কয়েকজন কোকোর কথা জিগ্যেস করেছে৷ তখন মোটামুটি এরকম সাফাই দিয়েই ম্যানেজ করেছেন কল্যাণ৷ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, এই উত্তরে বেশিদিন চলবে না, কারণ, কোকোকে যে ঘিয়া নদীর পাড়ে পাওয়া গেছে এ-কথা আজ নয় কাল জানাজানি হবেই৷ তখন কী হবে?
বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷ আনমনা ভাবে পা ফেলতে লাগলেন৷
রাহুল আর কোকো পাশাপাশি হাঁটছিল৷ কোকো হঠাৎই রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘রাহুল আমার অ্যাকিউট…চাইল্ড হয়েছে৷ আমার সাইকিয়া…বলেছে৷’
ওর দিকে তাকিয়ে রাহুল আর বাপি দুজনেই হেসে ফেললেন৷
কোকো বাঁ-হাতটা পেটে দিয়ে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে…৷’
‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলো, বাড়ি গিয়ে খাবে৷’ রাহুল বলল৷
কোকো খুশিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : ‘কী মজা! আমি…বাড়ি…গিয়ে খাব…খাব৷’
৷৷চার৷৷
কোকোকে নিয়ে ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেল রাহুল৷ ও কিছুতেই রাহুলকে কাছ-ছাড়া করতে চায় না৷ সোমবার রাহুল স্কুলে যাওয়া শুরু করতেই কোকোরও বায়না শুরু হয়ে গেল : ‘আমি রাহুলের সঙ্গে যাব৷ আমি…যাব৷’
শেষ পর্যন্ত ব্যাপার এমন দাঁড়াল যে, কোকো বাচ্চা ছেলের মতো কান্নাকাটি দাপাদাপি শুরু করে দিল৷
বাপি আগেই অফিসে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ বেগতিক দেখে রাহুলের মা কল্যাণবাবুকে ফোন করলেন৷
সব শুনে বাপি বললেন, ‘ঠিক আছে, বায়না করছে যখন তুমি আর ও রাহুলের সঙ্গে যাও৷ রাহুলকে স্কুলে দিয়ে তোমরা আবার ফিরে এসো৷ কোকো তো আসলে বাচ্চা ছেলে৷ শুধু দেখতেই যা বড়সড়৷ ও কি অত বোঝে?’
অগত্যা তাই হল৷ মাম, কোকো আর রাহুল স্কুলের পথ ধরল৷
স্কুল বেশি দূরে নয়৷ হাঁটা পথে স্কুলে যেতে-যেতে রাহুল কোকোকে অনেক গল্প বলছিল৷ স্কুলের গল্প, ফুটবল খেলার গল্প, গাঁয়ের মেলার গল্প, দুর্গাপুজোর সময় যে বিশাল উৎসব হয় তার গল্প৷
কোকোর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী৷ এসব ব্যাপার যেন ও প্রথম জানছে রাহুলের কাছে৷
রাহুলকে স্কুলে দিয়ে মাম কোকোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ কোকো বারবার জিগ্যেস করতে লাগল, রাহুল কখন ফিরবে৷ মাম ওকে কোনওরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন৷
কোকো কিন্তু বাড়িতে বসে-বসে সময় কাটাল না৷ রাহুলের মা-কে সাহায্য করার জন্য পাগল হয়ে উঠল৷ মামের কোনও বারণ শুনল না৷
টিউবওয়েল পাম্প করে-করে ও বালতি-বালতি জলের জোগান দিতে লাগল৷ কাচা জামাকাপড় দড়িতে ছড়াতে লাগল৷ ঘরোয়া ফাইফরমাশ খাটতে লাগল৷ এ ছাড়া বাকি সময়টা কোকো বাগানে ঘুরে কাটাল৷ কখনও ফুল দেখতে লাগল, আবার কখনও পাখির খোঁজে হাঁ করে গাছের ঘন পাতার দিকে চেয়ে রইল৷ বিকেলের দিকে ও বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম সেরে নিল৷
রাহুলের মা কোকোর ‘কীর্তি’ দেখছিলেন৷
দেখছিলেন কত সহজে আর কত তাড়াতাড়ি ও টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলছে৷ ওর সহজ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও একটা খেলনা টিউবওয়েল পাম্প করছে৷ এ ছাড়া ঘরের ভেতর থেকে কোকোর ব্যায়ামও দেখছিলেন৷ জামা খুলে খালি গায়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারিফ করার মতো ঝকঝকে স্বাস্থ্য—সিনেমায় যেমন দেখা যায়৷ শুধু ফরসা বুকে কয়েকটা সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ৷ মাম বুঝলেন, মাস্টারজি মানুষটি এই ভোলাভালা শিশু-যুবকের ওপরে কম অত্যাচার করেননি!
কোকো প্রথমে খালি হাতে ব্যায়াম শুরু করল৷ ডন-বৈঠক ইত্যাদি শেষ করার পর ও বাগানের পাঁচিলের পাশ থেকে শ্যাওলা পড়া দুটো থান ইট তুলে নিল৷ সেগুলোকে ডাম্বেলের মতো ব্যবহার করে ও আবার শরীরচর্চা শুরু করল৷ ওর সারা গা ঘেমে উঠল, শরীরটা চকচক করতে লাগল৷
রাহুল স্কুল থেকে ফেরার পর কোকো আবার ওর ল্যাংবোট হয়ে ঘুরতে শুরু করল৷ ওর সঙ্গে খেলার মাঠে গেল৷ তারপর ওর সঙ্গে পড়তে বসে গেল৷ রাহুল একটা খাতা দিয়ে ওকে ‘অ-আ-ক-খ’ লিখতে বলল৷ কোকো অনভ্যস্ত হাতে আঁকাবাঁকা রেখায় বর্ণগুলো লিখে চলল৷
কয়েকদিনের মধ্যেই কোকো রাহুলের স্কুল ভালোমতন চিনে নিল৷ এখন আর মামকে ওর সঙ্গে যেতে হয় না৷ কোকো যদি সুস্থ স্বাভাবিক হত তা হলে বলা যেত ও-ই রাহুলকে স্কুলে দিয়ে আসে, আবার ছুটির সময় নিয়ে আসে৷ রাহুলের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে যায়, তারপর সন্ধেবেলা পড়তে বসে৷ ‘অ-আ-ক-খ’, ‘এ-বি-সি-ডি’ কিংবা ‘১ থেকে ১০০’ লিখতে শেখে৷ ওর লেখাপড়ার ধরন দেখে বোঝা যায়, কোকো কয়েক বছর স্কুলে গিয়েছিল৷ তারপর কোনও কারণে ওর পড়াশোনা থেমে যায়৷
কখনও-কখনও কোকো রাহুলের বাপি কিংবা মামের কাছেও পড়তে বসে৷ আবার বাপি যখন জল রং সাজিয়ে নিয়ে ছবি আঁকতে বসেন তখন কোকো বাপির পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে৷ মুগ্ধ হয়ে ছবি আঁকা দ্যাখে৷
একদিন ছবি আঁকতে-আঁকতে বাপি ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি ছোটবেলায় ছবি আঁকতে?’
‘না…আমি…আঁকতাম না৷’
তুলি হাতে নিয়ে হ্যান্ডমেড পেপারে হালকা নীলের ওয়াশ টেনে বাপি বললেন, ‘তুমি ছবি ভালোবাসো?’
‘হ্যাঁ৷’ ঘাড় কাত করে কোকো বলল৷
‘তুমি ছবি আঁকা শিখবে?’
আবার ঘাড় কাত করল কোকো৷ হ্যাঁ, ও ছবি আঁকা শিখবে৷
‘গুড বয়৷ কাল থেকে তোমাকে আমি আঁকা শেখাব৷’
‘আমার…মা…আমাকে ছবি আঁকা…শেখাত৷ মা খুব সুন্দর ছবি…আঁকত৷ মা…আর…নেই৷’
বাপি অবাক হয়ে দেখলেন কোকোর চোখে জল৷
ওকে কাছে টেনে নিলেন কল্যাণবাবু৷ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার মা-কে মনে আছে?’
কোকো বিহ্বলভাবে মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না…মনে নেই৷ শুধু ছবি আঁকা…মনে আছে৷’
তারপরই কোকো চুপ করে গেল৷ গুম হয়ে বসে রইল৷ অনেক প্রশ্ন করেও কল্যাণবাবু ওর কাছ থেকে আর কোনও কথা বের করতে পারলেন না৷
এর আগেও কোকোকে ওর বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা অনেকবার জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও স্পষ্ট উত্তর পাননি৷ রাহুল আর ওর মা-ও বহুবার সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কোকোকে ওর বাড়ির কথা জিগ্যেস করেছেন, বাবা-মায়ের কথা জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও জবাব পাননি৷
আজ প্রথম বাপি জানতে পারলেন, কোকোর মা ছবি আঁকতেন৷
হয় সবকিছু কোকোর ধীরে-ধীরে মনে পড়ছে, অথবা, ও ধীরে-ধীরে নিজেকে মেলে ধরছে৷ ঠিক যেভাবে একটা গোলাপ কুঁড়ি থেকে ধীরে-ধীরে পাপড়ি মেলে ধরে৷
রাহুলের বাপি আর মাম কোকোকে ওঁদের স্বাভাবিক জীবনে মিশিয়ে নিলেন৷ কেন জানি না, ওঁদের মনে হয়েছিল, এতে কোকো তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ যদি কোনও পুরোনো স্মৃতি ওর হারিয়েও গিয়ে থাকে, তা হলে সেটা ফিরে আসবে৷
কোকো ওঁদের কথা শুনে চলত বটে তবে দুটি ব্যাপার ছাড়া৷ প্রথমটা হল, রাহুলের পাশে-পাশে ছায়ার মতো ঘোরা৷ আর দ্বিতীয়টা ঘরের নানান কাজে মাম এবং বাপিকে সাহায্য করা৷
একদিন রাহুলের সঙ্গে মাঠে খেলতে গিয়ে এক কাণ্ড হল৷
এমনিতে রোজ যে কোকো যায় ও কিন্তু খেলতে নামে না৷ মাঠের ধারে চুপচাপ বসে রাহুলদের ফুটবল খেলা দ্যাখে৷ আর গোল-টোল হলে হাততালি দেয়৷ হাত ছুড়ে চেঁচামেচি করে৷
কিন্তু সেদিন ওর কী খেয়াল চাপল, ও রাহুলের কাছে বায়না করে বসল৷
‘রাহুল, আমি…তোমার মতো…বল খেলব৷’
ওর বায়নার ধরন রাহুল জানে৷ একটা কিছু মাথায় ঢুকলে ও সেটাই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে৷ তাই ও বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে কোকোকে নিজের দলে নিল৷ ও ভেবেছিল, মিনিট পাঁচ-দশ খেলানোর পর কোকোকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেবে৷ কিন্তু কাজে সেটা করা গেল না৷ কারণ, কোকোর খেলা রাহুলকে অবাক করে দিল৷
না, কোকো ফুটবল খেলতে জানে না৷ তবে কচ্চিৎ কখনও পায়ে বল পেয়ে গেলে ও যে-অসম্ভব জোরে শট মারছে তা দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া৷
কোকোর একটা জোরালো শট কোমরে লেগে নিধু ছিটকে পড়ে গেল৷ পড়ে ছটফট করতে লাগল৷
রাহুলরা সবাই ছুটে গেল ওর তদারকি করতে৷
গোপাল, রাহুল বেশ অবাক হয়ে গেল৷ নিধু ফুটবল খেলে ভালো৷ চেহারাও গাঁট্টাগোঁট্টা, পেটানো, সহজে ওকে কেউ কাবু হতে দেখেনি৷ কিন্তু আজ ওর অবস্থা ভেজা তুলোর মতো৷
নিধুকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল৷ কোকো একাই ওকে চাগিয়ে কাঁধে তুলে নিল৷ মাঠের ধারে ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাই মিলে পরিচর্যা করতে লাগল৷
একটু পরে খেলা আবার শুরু হল৷
কোকো হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে তিরবেগে ছুটতে শুরু করল৷ সেরকম অভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই না থাকায় বল ওর পা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু ও একছুটে বলের কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং শট মারল৷
বলটা গোলে ঢুকল৷ শুধু ঢুকল নয়, একেবারে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল৷
গোলপোস্টের দশ-বারো হাত পিছনেই ছিল স্বদেশ মণ্ডলদের বাঁখারির বেড়া৷ জাল ছিঁড়ে বেরোনো বলের ধাক্কায় সেই বেড়াটাও কাত হয়ে গেল৷
গোলের আনন্দে রাহুলদের দলের সবাই হইহই করে উঠেছিল৷ কিন্তু দেখা গেল গোল খাওয়া দলের বন্ধুরাও স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে কোকোকে ঘিরে উৎসব শুরু করে দিল৷ কারণ, এরকম ভয়ংকর তীব্র শট মণিমেলায় আগে কেউ কখনও দেখেনি৷ মণিমেলায় শট মারার একটা প্লেয়ার পাওয়া গেল বটে! কোকো ফুটবল খেলতে না জানুক, শট তো মারতে পারে! ওকে রাহুলরা প্র্যাকটিস করিয়ে-করিয়ে খেলাটা একটু-আধটু রপ্ত করিয়ে দেবে৷ তারপর ও দু-চারটে শট মেরে বাজিমাত করবে৷ মণিমেলার ফুটবল টিমে ওকে খেলাতে হবেই৷
খেলার শেষে রাহুল, দীপায়ন আর কোকো বাড়ির দিকে ফিরছিল৷
মাঠ ছেড়ে ওরা পিচের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল৷ হঠাৎই একটা বিশাল মোটর-বাইক গাঁক-গাঁক শব্দ তুলে ওদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল৷ বাইকে তিনটে ছেলে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল৷ তিনজনেরই গায়ে স্লিভলেস ভেস্ট, আর বারমুডা৷ কী এক উল্লাসে চিৎকার করছে৷
বাইকটা যেভাবে কাত করে-করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওরা চালিয়ে গেল তাতে রাহুল ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ওর মানে হল, এক্ষুনি বুঝি বাইকটা উলটে যাবে৷
দীপায়ন বলে উঠল, ‘কী রাফ চালাচ্ছে! আর-একটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট করত৷’
রাহুল বলল, ‘মাকুর বাইক৷ বাইকে মাকু, ওর ভাই নেনে, আর বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা—কী নাম যেন—ওটা বসে আছে৷ মাকু তো এভাবেই বাইক চালায়—৷’
‘মাকু’ নামটা শোনামাত্রই দীপায়ন চুপ করে গেল৷ কোনও এলাকায় যে-নাম শোনামাত্র সবাই মুখে কুলুপ আঁটে ‘মাকু’ সেরকমই একটা নাম৷ ওর চ্যাংড়া ছোটলোক সাঙ্গোপাঙ্গদের সবাই এড়িয়ে চলে৷ বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা এ-দলে নতুন জুটেছে৷ ছেলেটা এখনও স্কুলে যায়, তবে চালচলন বড়লোকের বখাটে ছেলের মতন৷
রাহুল আর দীপায়ন নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় মাকুর সমালোচনা করছিল৷ তার সঙ্গে বলছিল নেনের কীর্তিকথা৷ ওরা খেয়াল করেনি, কোকো হাঁ করে ওদের কথাগুলো গিলছিল৷
বিকেল ফুরিয়ে এলেও আলো ফুরোয়নি৷ খেলা শেষ করে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির দিকে ফিরছে৷ নিজেদের মধ্যে ওরা যেরকম কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সন্ধেবেলা বটগাছের আশ্রয়ে ফেরার পর পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে৷
হঠাৎই মোটরবাইকটা আবার ফিরে এল৷ মনে হল, বাইকটা একই রাস্তা ধরে চক্কর কাটছে৷ সেই সাপের মতো আঁকাবাঁকা গতি৷ সঙ্গে হইহই চিৎকার৷
বাইকটার বিকট হর্ন বাজছিল৷
ওটা আচমকা এসে পড়ায় বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারল ছিটকে গেল৷ বাইকটার সর্পিল গতি ওদের ভয় পাইয়ে দিল৷ ওরা মিহি গলায় চিৎকার করতে লাগল৷
বাইকটা একটা বাচ্চা মেয়েকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে মাকু ব্রেক কষে বাইকটাকে থামাল৷
বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল৷ চিত হয়ে বাইকটার চাকার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলল৷
বাচ্চাদের ভয় পেয়ে দৌড়োদৌড়ির কাণ্ড দেখে আর কান্না শুনে মাকুরা বোধহয় মজা পেল৷ ওরা তিনজনে বাইকে বসে-বসেই হাসতে শুরু করল৷ তারই মাঝে মাকু রাস্তায় পড়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে লক্ষ করে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘কাঁদে না, খুকু৷ তোমার কিচ্ছু হয়নি৷ তুমি মিছিমিছি কাঁদছ৷ এসো…হাত ধরো৷ উঠে পড়ো…৷’
বাচ্চা মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল৷ নিজের হাত-পা জামা ঝাড়তে লাগল৷
মাকুদের হাসি রাহুলের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল৷ ও তেমন করে কিছু না ভেবেই বাইকটার কাছে এগিয়ে গেল৷ মাকুকে লক্ষ করে জেহাদি প্রশ্ন ছুড়ে দিল৷
‘এসব কী হচ্ছে?’
‘তোর বাপের বিয়ে হচ্ছে৷’ বলেই বাইকে বসা অবস্থাতেই রাহুলের বুকে পা তুলে দিল মাকু৷ সজোরে এক ঠেলা মারল৷
লাথি খেয়ে রাহুল ছিটকে পড়ল রাস্তায়৷ মাথা ঠুকে গেল৷ যন্ত্রণার একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷
রাহুল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল৷ দীপায়ন তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে তুলতে লাগল৷
মাকুরা বাইকে বসে মজা দেখছিল৷ ওদের বাইকের ইঞ্জিন ভটভট শব্দ করছিল৷ রাহুল উঠে দাঁড়াতেই মাকু আর নেনে ওকে নোংরা ভাষায় গালাগাল দিল৷ তারপর মাকু বলল, ‘এই আজব ভেড়াটাকে মেপে রাখ৷ পরে একে কড়া পালিশ দেব৷ সালার এত হিম্মত যে, আমার সঙ্গে মুখ লাগাতে আসে!’
রাহুল হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়ছিল আর ঘেন্না-মেশানো প্রতিবাদের চোখে মাকুর দিকে দেখছিল৷
সেটা লক্ষ করে ভাইয়ের দিকে ঘাড় ঘোরাল মাকু : ‘অ্যাই নেনে, নাম তো বাইক থেকে৷ দ্যাখ, ব্যাটা ড্যাবড্যাব করে কেমন তাকাচ্ছে! মালটাকে একটু পাঁচালি পড়ে দে…৷’
নেনে হাসল৷ হাসতে-হাসতেই বাইক থেকে নামল৷ তারপর রাহুলের দিকে পা বাড়াল৷
কোকো এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ খানিকটা বিভ্রান্তভাবে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যেন কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷
কিন্তু নেনে রাহুলের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে এগোতেই কোকো নড়েচড়ে উঠল৷ একছুটে নেনের সামনে গিয়ে ওর পথ আগলে দাঁড়াল৷ কর্কশ গলায় টেনে-টেনে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’
‘তাই?’ বলে নেনে ডানহাতে সপাটে এক ঘুসি বসিয়ে দিল কোকোর মুখে৷
কোকো ঘুসির অভিঘাতটা নিল, কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না—দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো৷ ওর ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল৷
ও আবার বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’
রাহুল ‘কোকো! কোকো, চলে এসো—’ বলে অস্থিরভাবে ওকে ডাকছিল৷ কিন্তু কোকো তাতে এতটুকু কান দিল বলে মনে হল না৷
‘রাহুলকে…মারবে না৷’ একঘেয়েভাবে আবার বলল কোকো৷
ওর অদ্ভুত কথা বলার ঢঙে নেনে হেসে উঠল : ‘কে রে আমার তোতলা কাত্তিক?’ তারপর ভেংচিয়ে বলল, ‘রাহুলকে মাবব না, ছোনা?’
কথা বলতে-বলতেই নেনে হাত তুলেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই৷
রাহুলরা অবাক হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখতে লাগল৷
এক ঝটকায় নেনের কোমর জাপটে ধরল কোকো৷ তারপর অবলীলায় ওকে শূন্যে তুলে ফেলল৷
নেনে দাপাদাপি করছিল৷ কোকোকে কিল-চড়-ঘুসি মারছিল৷ কিন্তু কোকো সেসব গ্রাহ্য করছিল না৷ ও অনায়াস ভঙ্গিতে হেঁটে গেল রাস্তার কিনারায়৷ তারপর নেনেকে স্রেফ ছুড়ে দিল নালার ওপারে৷ নেনে গিয়ে আছড়ে পড়ল একটা পরিত্যক্ত জমিতে৷
বাইকে বসে মাকু গর্জন করে উঠল৷ সেইসঙ্গে গালাগালের ফোয়ারা ছোটাল৷ কিন্তু ও বাইক থেকে নামেনি৷ বোধহয় শত্রুর এইরকম ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না সে-কথাই ভাবছিল৷ আর বাইকের পিছনে বসে থাকা বড়লোকের বখাটে ছেলেটা ভয়ের চোখে কোকোর দিকে তাকিয়ে ছিল৷
কোকো অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় মাকুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়াল৷
মাকু গিয়ার বদল করে বাইক ছুটিয়ে দিল৷ ওর বোধহয় কোকোকে চাপা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু সেটা হল না৷
কারণ, কোকো শক্ত দু-হাতে বাইকের হাতল চেপে ধরেছে৷ মাকুর হাতের পাশেই কোকোর নীল শিরা ওঠা দুটো হাত৷
বাইকটা গোঁ-গোঁ গর্জন করছিল, কিন্তু নড়তে পারছিল না৷ কোকো সামনে ঝুঁকে পড়ে চোয়ালে চোয়াল চেপে বাইকের অশ্বশক্তির টক্কর নিচ্ছিল৷ রাহুল আর দীপায়ন স্তম্ভিত হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখছিল৷
রাস্তায় ভিড় জমছিল৷ বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো তো ছিলই, তার সঙ্গে জুটে গেল পথচারীরা৷ কেউ হেঁটে যাচ্ছিল, কেউ-বা সাইকেলে৷
বাইকটাকে ক্ষমতার শেষ সীমায় নিয়ে গেল মাকু৷ আকাশফাটানো গোঁ-গোঁ গর্জন৷ ধোঁয়া৷ পেট্রলের গন্ধ৷
কিন্তু কোকো অবিচল৷ সবার চোখের সামনে ও যেন এক রূপকথার সার্কাস দেখাচ্ছে৷
ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বাইকের…স্টার্ট বন্ধ…করো৷ নইলে বাইক…উলটে…দেব…৷’
ওর কথায় বোধহয় ম্যাজিক ছিল, কারণ, মাকু কী একটা সুইচ ঘোরাতেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাইকের ইঞ্জিন থেমে গেল৷ কোকো বাইকের হ্যান্ডেল ধরে হাঁপাতে লাগল৷
নেনে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু নালা পেরিয়ে কোকোর আক্রমণের আওতায় আসতে ভয় পাচ্ছিল৷ আর বর্মনবাড়ির ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে৷
রাহুলই প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল৷ ও ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ছুটে এল ওর ‘অলৌকিক’ বন্ধুর কাছে৷ ওকে পিছন থেকে একেবারে জাপটে ধরল৷
‘কোকো! কোকো!’ আবেগে রাহুলের চোখে জল এসে গেল৷
কোকো বাইক ছেড়ে দিয়ে রাহুলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমাকে যে মারবে…তাকে ছাড়ব না৷ ছাড়ব না৷’
কোকোকে অন্যমনস্ক দেখে নেনে সামান্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে নালা পেরোল৷ তারপর চট করে বাইকে উঠে বসল৷ সুযোগ বুঝে মাকুও বাইকে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ তবে যাওয়ার আগে কোকো আর রাহুলকে লক্ষ করে গালাগাল দিয়ে গেল৷ চিৎকার করে বলে গেল, ‘ওয়েট কর—তোদের হিসেব হবে৷’
রাহুল আর কোকো মাকুদের চলে যাওয়া দেখল৷
রাস্তার লোকজন এতক্ষণ যেন রুদ্ধশ্বাসে কোনও সিনেমা দেখছিল৷ বাইকটা চলে যেতেই সবাই কোকোর কাছে ছুটে এল৷ আলোচনা করতে লাগল, হইচই করতে লাগল, কোকোর সাহস আর শক্তির তারিফ করতে লাগল৷
কোকোকে নিয়ে প্রশ্নও করতে লাগল কেউ-কেউ৷
‘একে তো এ-গাঁয়ে আগে দেখিনি!’
‘ছেলেটার গলায় ওটা কী?’
‘ও কাদের বাড়িতে এসেছে?’
‘ওর নাম কী?’
কোকো কোনও কথায় কর্ণপাত করছিল না৷ ও এমনভাবে রাহুলের একটা হাত জড়িয়ে ধরে ছিল যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই ও হারিয়ে যাবে৷ দীপায়নও রাহুলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল৷ ও রাহুলকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগাচ্ছিল৷
রাহুল কোকোর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, কোকো৷ ওই বাজে ছেলেগুলোর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে কেন? জানো, ওরা গুন্ডা-মাস্তান?’
‘গুন্ডা কাকে বলে? মাস্তান…কী?’ সরল মুখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল কোকো৷
রাহুল ওকে হাত ধরে টানল৷ হাঁটতে শুরু করল৷ পিছনে দীপায়ন৷
হাঁটতে-হাঁটতেই রাহুল বলল, ‘গুন্ডা৷ মাস্তান৷ ওদের সঙ্গে ছোরা থাকে, রিভলভার থাকে৷ ওরা খারাপ৷’
কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজির কাছে…রিভলভার আছে৷ মাস্টারজি…খারাপ৷’
রাহুল অবাক হলেও কোনও কথা বলল না৷ ওকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল৷
দীপায়ন রাহুলকে জিগ্যেস করল, ‘মাস্টারজি আবার কে?’
ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য রাহুল ঠোঁট উলটে বলল, ‘কী জানি! ও মাঝে-মাঝে ওরকম উলটোপালটা কথা বলে৷’
দীপায়ন বলল, ‘আমার তো চিন্তা হচ্ছে রে৷ মাকুরা সহজে ছাড়বে না৷’
চিন্তা রাহুলেরও হচ্ছিল৷ মাকু, নেনে ওরা মোটেই সুবিধের নয়৷ ওরা দোকানদারদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় করে৷ সুযোগ পেলে ছিনতাই করে, ওয়াগন ভাঙে৷ রেল-লাইনের ধারে ওদের আসল ঠেক৷ সেখানে রাতে ওরা নেশা-ভাং-এ চুর হয়ে হইহুল্লোড় করে৷
রাহুল আপনমনেই বলল, ‘আমিই ভুল করলাম৷ কেন যে প্রোটেস্ট করতে গেলাম!’
দীপায়ন বলল, ‘তুই লাথিটা খাওয়ার পর চেপে গেলেও হত৷’
‘আমি তো চেপেই গেছিলাম৷ এই যে কোকোটা!’ কোকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে রাহুল কপট রাগের গলায় বলল, ‘কোকোটাই তো নেনের সঙ্গে ঝামেলা করল!’
কোকো নির্বিকার সুরে বলল, ‘ছেলেটা তোমাকে…মারতে যাচ্ছিল…৷’
দীপায়ন বলল, ‘হ্যাঁ—তা যাচ্ছিল৷ কিন্তু…৷’
দীপায়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোকো বলে উঠল, ‘রাহুলকে যে…মারবে তাকে আমি…ছাড়ব না৷ কিছুতেই ছাড়ব না৷’
বিকেলের শেষ আলো এসে পড়েছিল কোকোর মুখে৷ ও এক অদ্ভুত মমতা মাখা সরল চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ একটা আন্তরিক টান টের পেল রাহুল৷ এই বোকা-হাবা ভোলাভালা ছেলেটা মাত্র দু-সপ্তাহে বিচিত্র এক আত্মীয়তার অদৃশ্য সুতোয় রাহুলদের কখন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে৷
রাহুলের মনে হচ্ছিল, ঢলে পড়া সূর্যের আলো পড়ে নয়—কোকোর মুখটা এমনিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷
৷৷পাঁচ৷৷
দু-সপ্তাহে কোকোর কথা গ্রামের যে-ক’জন জেনেছিল, মাকুদের সঙ্গে মোকাবিলার পর সেই সংখ্যাটা প্রায় পঞ্চাশ গুণ হয়ে গেল৷
যে-বাচ্চা মেয়েটা মাকুর বাইকের তলায় আর-একটু হলেই চাপা পড়ছিল, তার বাবা-মা ঘটনার পরদিন সন্ধেবেলা রাহুলদের বাড়িতে এলেন—সঙ্গে মেয়েটি৷ ওঁদের খুব সাধ জেগেছে রাহুল আর কোকোকে স্বচক্ষে একবার দেখেন৷ ঘোর কলিযুগে এখনও এমন লোক আছে যারা অচেনা-অজানা কাউকে বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবাদ করে, ঝুঁকি নেয়!
ওঁদের সঙ্গে গল্প করে কোকো দারুণ খুশি৷ ওর কথাবার্তা শুনে রাহুল অবাক হল৷ ওর মনে হল, কোকো যেন প্রথমদিককার তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷
প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলতে-খেলতে কোকো রাহুলদের ক্লাবে নিয়মিত ফুটবল প্লেয়ার হয়ে উঠল৷ শুধু রাহুলরা ওকে অনেক করে অনুরোধ করেছে ও যেন জোরে শট না মারে৷ কারণ, রোজ-রোজ ফুটবল ফেটে গেলে ফুটবল কেনার পয়সা জোগাবে কে!
মাকুদের সঙ্গে এনকাউন্টারের ব্যাপারটা রাহুল ইচ্ছে করেই মাম কিংবা বাপিকে প্রথমে বলেনি৷ ভুল একটা যখন হয়ে গেছে তখন শুধু-শুধু ওঁদের টেনশান বাড়িয়ে লাভ কী! কিন্তু বাপি পরদিন সকালে খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ফলে সেদিন রাতে রাহুলকে মাম আর বাপির জেরার মুখে পড়তে হল৷
রাহুল লুকোচুরি না করে সব কথা খুলে বলল৷
শুনে বাপি ওকে বললেন, খুব সাবধানে চলাফেরা করতে৷ সবসময় কেউ না কেউ যেন সঙ্গে থাকে—একা-একা রাহুল যেন কোথাও না যায়—বিশেষ করে রেললাইনের দিকে৷
কোকো একবার বলে উঠল, ‘আমি তো রাহুলের সঙ্গে সবসময় থাকি…৷’
বাপি আর মাম স্নেহভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ মাম বললেন, ‘তোমারও তো বিপদের ভয়, কোকো৷ রাহুল স্কুলে যাওয়ার সময় আর ফেরার সময় আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব৷ আর খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময়—’ রাহুলের দিকে তাকালেন মাম : ‘দু-চারজন বন্ধু-বান্ধবকে সঙ্গে নিবি৷ বলবি একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে৷’
কোকো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাহুল হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিল৷
এই নিয়মেই কয়েকদিন চলল৷ মাকু বা ওর দলের ছেলেদের সঙ্গে রাহুলদের দেখা হয়, কিন্তু ওরা কিছু বলে না৷ সাইকেল, বাইক নিয়ে রাহুলদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়৷ তবে আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে৷
রাহুলের মনে হয়, কোকোর সুখ্যাতির জন্যই মাকুর দলবল ‘বদলা’ নেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে পড়ছে৷
কোকোর কথা এখন মণিমেলার প্রায় সবাই জানে৷ তা ছাড়া মাকুদের কাজকর্ম কেউই পছন্দ করে না৷ ওদের ওপর সবাই বিরক্ত৷ সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে যদি কোকো বা রাহুলের গায়ে হাত পড়ে তা হলে মাকুদের বিপদ হতে পারে৷
এসব কথা ভেবেই মাকু অপেক্ষা করছিল৷ আর একইসঙ্গে সুযোগ খুঁজছিল৷
রাহুল কোকোর জন্য দুশ্চিন্তা করলেও কোকো একেবারে চিন্তাভাবনাহীন৷ ও ওর মতোই দিন কাটাতে লাগল৷ টিউবওয়েল পাম্প করে জল তোলা, বাগানে পাখি কিংবা প্রজাপতির পিছনে ছুটোছুটি, ব্যায়াম করা, রাহুলের স্কুলে যাওয়া-আসা, কখনও-কখনও বাপির সঙ্গে বাজারে যাওয়া, বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলা, আর বাপির সময় হলেই বাপির কাছে বসে ছবি আঁকা শেখা৷
কোকোর দিকে তাকিয়ে মাম আর বাপি অবাক হয়ে ভাবেন৷ ছেলেটা কেমন শিশুর মতো নিশ্চিন্ত আরামে রয়েছে! ওকে দেখে মাঝে-মাঝে মনে হয়, ও যেন প্রকৃতিরই একটা অংশ৷
রাহুলরা বহুদিন ধরেই ভাবছিল ওদের ক্লাব থেকে একটা লাইব্রেরি তৈরি করবে৷ এবার ওরা একটা ঘরের সন্ধান পেয়েছে৷ মণিমেলার সবচেয়ে পুরোনো ডাক্তার ডক্টর পরমেশ হালদার ওঁর দোতলা বাড়ির একতলার একটা ঘর রাহুলদের ছেড়ে দিয়েছেন৷ সেখানে ওদের লাইব্রেরি হবে—‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’৷
ঘর হাতে পাওয়ার পর রাহুলরা চাঁদা তুলতে শুরু করেছে৷ তারপর সেই টাকায় ঘর সারানোর কাজেও হাত দিয়েছে৷ একইসঙ্গে রাহুলরা রবিবার বা ছুটির দিনে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গল্পের বইয়ের খোঁজ করছে৷ বলছে, ‘আমাদের লাইব্রেরিতে গল্পের বই ডোনেট করুন৷’
ওদের উদ্যোগে বহু মানুষ সাড়া দিয়েছে৷ চাঁদার পাশাপাশি বইও পাওয়া যাচ্ছে অনেক৷
এসব কাজে রাহুলদের সঙ্গে কোকোও টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ডোনেশানে পাওয়া বইয়ে থলে ভরতি করে দু-হাতে দুটো থলে ঝুলিয়ে ও রাহুলদের সঙ্গে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি অক্লান্তভাবে হেঁটে চলেছে৷
এরকমই এক রবিবার৷ বেলা প্রায় একটা বাজে৷ মাথার ওপরে গনগনে সূর্য৷ চারপাশে গরম বাতাস বইছে৷ রাহুলরা দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি ঘুরছে৷ ওদের দলে রাহুল, নিধু, গোপাল আর কোকো ছাড়া ছিল ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি ঝন্টুদা৷ ঝন্টুদা ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ চাকরি করে৷
একসময় ক্লান্ত হয়ে ওরা ক্ষান্ত হল৷ একটা বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দাঁড়াল৷ কোকো হাতের ভারী থলে দুটো নামিয়ে রাখল মাটিতে৷ বটগাছের লাগোয়া একটা বড়-সড় পানের দোকান৷ দোকানের বাইরে থরে-থরে সাজানো কোল্ড ড্রিঙ্কের পেটি৷
ঝন্টুদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘অ্যাই, তোরা সবাই একটা করে পেপসি খা৷ আমি খাওয়াচ্ছি৷’
রাহুলরা সবাই মিলে ‘ঝন্টুদা, জিন্দাবাদ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ তারপর দোকানদারের কাছ থেকে পাঁচটা ঠান্ডা পেপসি নিল৷ একটা বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল : ‘নাও, পেপসি খাও—৷’
কোকো বোতলটা নিয়ে অনভ্যস্ত ঢঙে সিপ করতে শুরু করল৷
সবার আগে কোকোর পেপসি খাওয়া শেষ হল৷ পরপর দুটো ঢেঁকুর তুলল ও৷
রাহুলের কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়া শেষ হলে কোকো বলল, ‘রাহুল… পেপসি…খেতে খুব ভালো৷ মিষ্টি৷ ভালো৷’
ঝন্টুদা ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি আর-একটা খাবে?’
কোকো মাথা হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ…খাব৷’
আর-একটা পেপসির বোতল নিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল৷ কোকো পরম উৎসাহে স্ট্র মুখে চেপে ধরে পেপসি খাওয়ায় মন দিল৷ আর রাহুলরা লাইব্রেরির নানান পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷
এমন সময় মাকুর বাইক দেখা গেল৷ ভটভট আওয়াজ তুলে ধুলো উড়িয়ে আসছে৷
রাহুলদের কাছে এসে বাইকটা থামাল মাকু৷ ওর পিছনে বসে আছে নেনে৷ মাকুর গায়ে টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট৷ আর নেনে একটা হলুদ শার্ট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে৷
মাকু বাইকের স্টার্ট বন্ধ করেনি৷ বরং মাঝে-মাঝে হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন রেস করছে৷
নেনের আঙুলে সিগারেট ধরা ছিল৷ ঝন্টুদাকে দেখে ও উদ্ধত রুক্ষ ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিতে লাগল৷ ঝন্টুদা অস্বস্তিতে মুখটা ঘুরিয়ে নিল৷
নেনে বাইক থেকে নেমে পড়ল৷ চোখ সরু করে সিগারেটে টান মারতে-মারতে এগিয়ে এল রাহুলদের দিকে—অথবা পানের দোকানের দিকে৷
রাহুল চট করে তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর বুক কেঁপে উঠল৷ যদি আগের দিনের মতো কিছু একটা হয়! রাহুলের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি নেনে ওর বুকের ভেতরে হওয়া ধড়াস-ধড়াস শব্দ শুনতে পাবে৷
ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল পানের দোকানের সামনে থেকে পায়ে-পায়ে সরে যেতে লাগল৷ রাহুলও সেই চেষ্টাই করল৷ নেনের নজর এড়িয়ে কোকোর জামা ধরে চোরা টান মারল৷ কিন্তু কোকো সেটা টের পেলে তো! ও তখন পেপসি খেতে মশগুল৷ স্ট্র-এর টানে বোতলের তরলে চড়বড়-চড়বড় শব্দ হচ্ছে৷
নেনে ঝন্টুদার সামনে এসে দাঁড়াল৷ ওর বাঁ-হাতে সিগারেট, ডানহাতটা পকেটে গোঁজা৷
ঝন্টুদার মুখে পরপর দুবার ধোঁয়া ছুড়ে দিল নেনে৷ ঝন্টুদা মুখে কিছু বলল না—শুধু নাক টিপে এক ঝটকায় মুখটা পাশে ফেরাল৷
‘কী, সেক্রেটারিবাবু! শুনলাম, ডাক্তার হালদারের একতলার ঘরটা তোমরা লপকে নিয়েছ—লাইব্রেরি না কীসব করবে৷’
মুখটা ঘুরিয়ে রেখেই চাপা গলায় ঝন্টুদা জবাব দিল, ‘আমাদের গ্রামে একটা লাইব্রেরি হওয়া খুব দরকার৷ অনেকদিন ধরে সবাই বলছে…তাই ডক্টর হালদারের কাছে আমরা রিকোয়েস্ট করেছিলাম৷ লাইব্রেরিটার নাম হবে ‘‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’’৷ ডক্টর হালদার বলেছেন…৷’
‘ওসব ঢপের কেত্তন ছাড়ো!’ নেনে খিঁচিয়ে উঠল, ‘পাঠাগার হবে না কাঁচকলা হবে৷ ও-ঘরটা আমরা টার্গেট করেছিলাম…ক্লাবঘর করব৷ তো বুড়োটাকে তোমরা টুপি দিয়ে ঘরটা হড়কে নিলে?’
নিধু ভয় পেলেও মিনমিন করে পাশ থেকে বলল, ‘সত্যি বলছি—লাইব্রেরি হবে৷ এই তো—’ গাছতলায় রাখা বইভরতি থলে দুটো দেখাল : ‘আমরা সবার কাছ থেকে চেয়ে-চেয়ে গল্পের বই জোগাড় করছি…৷’
নেনে সিগারেট ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে খপ করে নিধুর কলার চেপে ধরল : ‘তুই কি সালা ঝন্টুর উকিল না কি?’
মাকু বাইকে গরগর আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল নেনের কাছে৷ বাইক থামাল৷
নেনের কথায় রাহুলের গা জ্বালা করছিল৷ কিন্তু মাকুদের সঙ্গে ওদের লড়ার ক্ষমতা কতটুকু! তা ছাড়া মাম আর বাপি বলেছেন, এসব ঝামেলা এড়িয়ে থাকতে৷
রাহুল মারপিটকে ভয় পায়৷ তাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷ নেনেরা বোধহয় এক্ষুনি গায়ে পড়ে একটা গন্ডগোল তৈরি করবে৷
ও কোকোর দিকে তাকাল৷ নির্বিকারভাবে পেপসি খেয়ে চলেছে৷
নিধুকে কলার ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল নেনে৷ আর মাকু দাঁত বের করে হাসছিল৷
রাহুল ভয় পেলেও প্রতিবাদ না করে থাকতে পারল না৷
‘নিধুকে ছেড়ে দাও!’ ও চেঁচিয়ে বলল৷
সঙ্গে-সঙ্গে নিধুকে ছেড়ে দিল নেনে৷ এবং রাহুলের দিকে ঘুরল৷ কিন্তু রাহুলের দিকে এক পা এগিয়েই থেমে গেল ও৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কোকোর দিকে৷ ও তখন পেপসি খাওয়া শেষ করে খালি বোতলটা দোকানির হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে৷
‘এই তোতলা কাত্তিক!’ বাজেভাবে হাত নেড়ে কোকোকে কাছে ডাকল নেনে৷ তারপর রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘তোর গায়ে হাত তুললেই তো আবার ওই ক্যালানে কাত্তিক রুখতে আসবে৷ এলে আজ ওকে মজা দেখাব৷ সেদিন কিছু বলিনি…৷’
কোকো নেনের কাছে এগিয়ে আসছিল৷ তাই দেখে রাহুল আর থাকতে পারল না৷ ও নেনের হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বলল, ‘ওকে কিছু বোলো না৷ ওর অসুখ আছে…৷’
‘সব অসুখ আজ ঝেড়ে সারিয়ে দেব৷’ ঠোঁট বেঁকিয়ে কথাটা বলে এক ঝটকায় রাহুলের হাত ছাড়িয়ে নিল৷ শব্দ করে হেসে উঠল : ‘সেদিন মওকা পেয়ে আমাকে হেভি বেইজ্জত করেছিস…৷’
মাকু বাইকে বসা অবস্থাতেই চেঁচিয়ে বলল, ‘মালকে একটু বাইক দিয়ে চেটে দেব নাকি?’
ঝন্টুদা নেনের কাছে এগিয়ে এল : ‘এসব কী হচ্ছে? কেন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছ, ভাই? তোমাদের ক্লাবঘরের জন্যে অন্য আর-একটা ঘর…৷’
ঝন্টুদার মুখে থুতু ছুড়ে দিল নেনে৷ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘ফোট সালা! কাঁঠালের আঠা মারতে এসেছে! এখুনি বডি নামিয়ে দেব৷ ফোট!’
ঝন্টুদার মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল৷ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল৷ ঘৃণার চোখে নেনেকে দেখল৷ তারপর এক-পা পিছিয়ে এল৷
কোকোকে আদুরে গলায় কাছে ডাকল নেনে৷ ডানহাতটা পকেট থেকে বের করে নিল৷
সঙ্গে-সঙ্গে রাহুল ভয়ে কাঠ হয়ে গেল৷
নেনের হাতে প্রায় ছ’ইঞ্চি ফলার একটা চকচকে ছুরি৷ বাতাসে ফলাটা ধরে সাপের ফণার মতো নাচাচ্ছে৷
ছুরিটা দেখামাত্রই কোকো কেমন যেন হয়ে গেল৷ কাতর চোখে নেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার…সঙ্গে…আমি মারপিট করব না…৷’
‘কেন রে, তোতলা কাত্তিক? লড়বি না কেন?’
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল কোকো : ‘আমি…আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে…কষ্ট দেব না৷ আমি…আর মারপিট…করব না৷ কাউকে… কষ্ট…দেব না৷’
এ-কথায় মাকু আর নেনে হো-হো করে হেসে উঠল৷
রাহুল বিপন্ন মরিয়া চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল৷ যদি কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই দুপুরে পথে তেমন লোকজন নেই৷ আর যে-দু-একজন পথচারী চোখে পড়ছে তারা মাকুর মার্কামারা মোটরবাইক দেখেই সটকে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে রাহুল এটাও লক্ষ করল যে, পানের দোকানের দোকানদার তার বসার জায়গা ছেড়ে মেঝেতে নেমে পড়েছে৷ ধীরে-ধীরে পা বাড়াচ্ছে দোকানের খিড়কি-দরজার দিকে৷ এই জায়গাটাকে সে আর নিরাপদ মনে করছে না৷
নেনে কোকোর দিকে আরও এক-পা এগিয়ে যেতেই কোকো দু-পা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল : ‘আমি আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে কষ্ট দেব না৷ মাস্টারজিকে আমি বলেছি৷ মারপিট করতে আমার ভালো লাগে না৷ আমি…বাড়ি…যাব৷’
অন্য সবার কাছে কোকোর কথাগুলো পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু রাহুল যেন কিছু-কিছু বুঝতে পারছিল৷
কোকো পিছোতে-পিছোতে একটা গাছে গিয়ে ধাক্কা খেল৷ তারপর চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে গাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল৷
মাকু আর নেনে এই পাগলামি দেখে আবার হেসে উঠল৷ আর রাহুলরা কোকোর কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল৷
যে-ছেলেটার গায়ে এত শক্তি সে কি না এরকম ভয় পেয়ে গেছে!
রাহুল আন্দাজ করল, কোকোর ভয়টা আসলে নেনের হাতের ছুরিটার জন্য৷ এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷
কোকো তখন গাছের একটা ডালে বসে আপনমনে বলে চলেছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’
নেনে হাতের ছুরিটা শূন্যে নাচিয়ে কোকোকে দু-চারবার নকল ভয় দেখাল৷ যেন এই ও কোকোর গায়ে ছুরি বসাল বলে৷ কোকো সেই ভয় দেখানোর তালে-তালে সিঁটিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷ সেটা দেখে নেনে আর ওর দাদা বেশ মজা পাচ্ছিল৷
রাহুল কোকোর হেনস্থা আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘ওকে শুধু-শুধু ভয় দেখাচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে নেনের হাসিটা বদলে গেল হিংস্র কুটিল মান-চিত্রে৷ ও চট করে চলে এল রাহুলের কাছে৷ ছুরির ডগাটা ছুঁইয়ে দিল ওর গলায়৷ নোংরা গালাগাল দিয়ে বলল, ‘একদম চুপ৷ নইলে…৷’
নইলে কী হবে সেটা আর নেনের বলা হল না৷
কারণ, চোখের পলকে গাছ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়েছে কোকো৷ একটা ডিগবাজি খেয়ে শরীরটা গড়িয়ে নিয়ে এসেছে নেনের কাছে৷ দু-হাতে ওর দুটো পা ধরে প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টান মেরেছে৷
নেনে উপুড় হয়ে উলটে পড়ল মাটিতে৷ কোকো একলাফে চড়ে বসল ওর শরীরের ওপরে৷ ছুরি-ধরা হাতটাকে মোচড় দিয়ে চেপে ধরল পিঠের দিকে৷ তারপর জোরে একটা ঝটকা দিল৷ ছুরি খসে পড়ল নেনের মুঠো থেকে৷ ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷
কোকো চিৎকার করে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷ যে মারবে তাকে আমি…মেরে ফেলব৷’
কথা শেষ করেই নেনের চুলের মুঠি খামচে ধরল ও৷ মাথাটা টেনে শূন্যে তুলল৷ তারপর ভয়ংকর জোরে ঠুকে দিল মাটিতে৷
নেনে গোঁ-গোঁ করতে লাগল৷ মাকু বাইকে বসে হতবুদ্ধি হয়ে ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখতে লাগল৷
‘রাহুলকে মারবে না৷ রাহুলকে…’ নেনের দিকে আগুন-ঝরা চোখে তাকিয়ে ছিল কোকো৷ নেনের চুলের মুঠিটা ওর হাতে ধরা ছিল৷ সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিল৷
রাহুল ছুটে গিয়ে কোকোর হাত চেপে ধরল : ‘কোকো! কোকো! কী করছ! ছাড়ো—ও যে মরে যাবে!’
রাহুলের দেখাদেখি ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল ওরাও কোকোর কাছে ছুটে এসেছিল৷ কোকোকে থামাতে চেষ্টা করছিল, ওকে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করছিল৷
অনেক কষ্টে কোকোকে শান্ত করা গেল৷ নেনেকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও৷ তারপর রাহুলের একটা হাত চেপে ধরল৷ ভাবটা এমন যেন এই হাতটা ও আর ছাড়বে না৷
রাহুল ওকে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল৷
কোকো হাঁপাচ্ছিল৷ নেনের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ ঝন্টুদারা তখন নেনেকে ধরে তুলে দাঁড় করাচ্ছে৷
নেনে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল৷ ওর কপালে রক্ত৷ কোকোর দিকে ও এমনভাবে চেয়ে আছে যেন অন্য গ্রহের প্রাণী দেখছে৷
ঝন্টুদা পকেট থেকে রুমাল বের করে নেনের কপালের রক্ত মুছে দিল৷ বলল, ‘ফেরার পথে একটু ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ো—৷’
নেনে কোনও জবাব দিল না৷
ঝন্টুদারা নেনের জামাকাপড় হাত দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে ওকে মাকুর বাইকের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল৷
মাকু বাইক থেকে নামেনি৷ আগের দিনের মতো ও আর তর্জন-গর্জন করছিল না৷ নেনেও একেবারে চুপ৷ ভালো করে কারও দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত৷
ঝন্টুদা মাকুকে বলল, ‘মাকু, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে৷ কোকো তো অত বোঝে না৷ আসলে রাহুলকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে৷ রাহুলকে কেউ কিছু করলে ও কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়৷ যাকগে, তুমি ব্যাপারটা ভুলে যাও৷ আর একটা কথা : এটা নিয়ে থানা-পুলিশ কোরো না৷ আমরাও ব্যাপারটা আর মনে রাখব না৷’
মাকু ছোট্ট করে ঘাড় নাড়ল৷
ঝন্টুদা আর নিধু নেনেকে ধরে বাইকে বসাল৷ ঝন্টুদা মাকুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমরা তো ক্লাব-ঘর করবে৷ আমি দেখছি—সুটেবল কোনও ঘর পাওয়া যায় কি না৷ আর শোনো…’ মাকু তাকাল ঝন্টুদার দিকে৷ ঝন্টুদা বলল, ‘আমরা তোমার শত্রু নই৷ প্লিজ, আজকের ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো৷’
মাকু আর নেনে চলে গেল৷ ওদের ছুটন্ত বাইকের পিছনে ধুলোর মেঘ তৈরি হল৷
ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ আর রাহুল কোকোর হাত ধরা অবস্থায় ভাবছিল ওর অদ্ভুত আচরণের কথা৷ এই বলছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’ আবার পরক্ষণেই রাহুলকে ‘রক্ষা’ করতে সে পেশাদার যোদ্ধার তৎপরতায় শত্রুকে ঘায়েল করছে!
কোকোর লড়াই দেখে রাহুলের মনে হচ্ছিল শুধু সিনেমায় এরকম লড়াই দেখা যায়৷ তা ছাড়া বহুদিন প্র্যাকটিস না করলে কারও পক্ষে এরকম দক্ষতায় পৌঁছনো সম্ভব নয়৷
বাড়ি ফেরার পথে রাহুল কোকোকে জিগ্যেস করল, ‘কোকো, এরকম ফাইটিং তুমি কোথায় শিখলে?’
‘শিখেছি ভগবতীপ্রসাদের কাছে৷’
‘কে ভগবতীপ্রসাদ?’
‘আমার ট্রেনার৷ আট বছর…আমি ট্রেনিং নিয়েছি৷ তারপর…৷’ হঠাৎ চুপ করে গেল কোকো৷ ওকে দেখে রাহুলের মনে হল, ও কী যেন ভাবছে৷ বোধহয় কোনও কিছু মনে করার চেষ্টা করছে৷
‘আট বছর ট্রেনিং নেওয়ার পর কী করেছ? তারপর কী?’
কোকো রাহুলের দিকে তাকাল৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তারপর অনেক ফাইট করেছি৷ অনেক লড়াই…করেছি৷ অনেক জিতেছি৷ অনেক ফাইট করেছি…৷’
রাহুল অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল৷
৷৷ছয়৷৷
কয়েকদিন পর এক অদ্ভুত ঘটনায় মাঝরাতে রাহুলের ঘুম ভেঙে গেল৷
ও অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিল৷ যন্ত্রণার শব্দ—তার সঙ্গে কথা৷
‘ওঃ! ওঃ! মাস্টারজি! ছেড়ে দাও! আমি…আর…করব না৷ আমাকে…ছেড়ে দাও৷ ওঃ…৷’
দু-হাতে চোখ ডলে অন্ধকার মেঝের দিকে তাকাল রাহুল৷ চাপা কর্কশ গলায় টুকরো কথাগুলো কে বলছে ও ভালোই বুঝতে পারল৷ কিন্তু ও অন্ধকারে কোকোর শরীরটা ভালো করে ঠাহর করতে পারছিল না৷
লাল আর সবুজ রঙের আলোর ঝিলিক চোখে পড়ল রাহুলের৷ ছোট-ছোট রঙিন আলোর বিন্দু জোনাকির মতো জ্বলছে-নিভছে৷
রাহুলের ঘুম ছুটে গেল৷ ভালো করে চোখ রগড়ে বিছানায় উঠে বসল ও৷ চাপা গলায় ডাকল, ‘কোকো! কোকো! কী হয়েছে?’
কোকোর কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না৷ ওর যন্ত্রণার আর্তনাদ আর টুকরো কথা চলতেই লাগল৷
রাহুল এবার বিছানা থেকে নেমে পড়ল৷ বহুদিনের অভ্যাসে ওর ডানহাত সহজেই পৌঁছে গেল আলোর সুইচের কাছে৷ আলো জ্বালতেই কোকোকে দেখতে পেল ও৷
কোকোর দু-চোখ বোজা৷ শরীরটা মেঝের বিছানা থেকে গড়িয়ে চলে এসেছে বাইরে৷ গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও ছটফট করছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডের গায়ে লাল আর সবুজ আলো দপদপ করে জ্বলছে৷ ইলেকট্রনিক খেলনায় যেমন ছোট-ছোট রঙিন বাতি থাকে সেইরকম৷
রাহুল ছুটে গেল কোকোর কাছে৷ ঝুঁকে পড়ে ওকে জোরে ধাক্কা দিল : ‘কোকো! কোকো!’
কয়েকবার ধাক্কা দিতেই কোকো চোখ খুলল৷ ওর ছটফটানি থেমে গেল৷ রাহুল দেখল, ও কুলকুল করে ঘামছে৷
কোকো উঠে বসল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলছে৷ চোখে-মুখে ভয়৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডটা এখনও দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আছে৷ ওটার লাল-সবুজ বাতি এখন নিভে গেছে৷
রাহুল বসে পড়ল ওর পাশে৷
‘কী হয়েছে, কোকো? কী হয়েছে?’ ওর ঘামে ভেজা গালে হাত বোলাতে-বোলাতে রাহুল বলল, ‘কোনও বাজে স্বপ্ন দেখেছ?’
কোকো ভয়ার্ত চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি… আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’
‘তোমার গলার ওই ব্যান্ডটাতে আলো জ্বলছিল৷ লাল…সবুজ…৷’
কোকো ব্যান্ডটা ছেড়ে দিল৷ হাত দিয়ে মুখ মুছল৷ চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…কাছে এসে গেলে ওরকম…আলো জ্বলে৷ আর…মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়…৷’
কোকোর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রাহুল৷ এই শিশু-যুবকের আতঙ্ক আর কষ্ট দেখে ওর মায়া হচ্ছিল৷ ‘মাস্টারজি…আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’ এর মানে কী? মাস্টারজি কাছে এসে গেলে ওই লাল-সবুজ আলোগুলো জ্বলে, কোকোর মাথায় যন্ত্রণা হয়?
ভেবে-ভেবে কোনও থই পাচ্ছিল না রাহুল৷ ও উঠে গিয়ে জলের বোতল নিয়ে এল৷ ছিপি খুলে বোতলটা এগিয়ে দিল কোকোর হাতে : ‘নাও—জল খাও৷’
ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল কোকো৷ তখনও ও অল্প-অল্প হাঁপাচ্ছে৷ বোধহয় মাস্টারজির আতঙ্কের রেশ এখনও কাটেনি৷
বেশ কিছুক্ষণ পর কোকো শান্ত-স্বাভাবিক হল৷ তখন রাহুল আলো নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল৷
কোকো আপনমনে ছবি আঁকছিল৷ রাহুল ওর পাশে বসে ছবি আঁকা দেখছিল৷
যে-ছবিটা কোকো আঁকতে চেষ্টা করছিল সেটা রাহুলদের স্কুল৷ যদিও ছবিটা দেখে সেটা বোঝা খুব শক্ত৷ তবে রাহুল যে স্কুলটাকে একটু-একটু চিনতে পারছিল তার কারণ, ওদের স্কুল বিল্ডিং-এর পাশে চারটে বড়-বড় গাছ আছে৷ আর তার পাশ ঘেঁষেই একটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং৷ কোকোর ছবিতে—বিমূর্ত এবং বিকৃত চেহারায় হলেও—সেগুলো আঁকা আছে৷ যদি তারপরেও কারও বুঝতে অসুবিধে হয় সেইজন্য ছবির মাথায় আঁকাবাঁকা হরফে লেখা আছে : ‘রাহুলের ইশকুল৷’
রাহুলের আজ স্কুল ছুটি৷ স্কুলের ফাউন্ডেশান ডে৷ তাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ও কোকোর সঙ্গে গল্প করতে বসেছে৷ ওর ইচ্ছে, কোকোর মাস্টারজি সম্পর্কে আরও কিছু খবর জেনে নেয়৷
কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলার পর কোকো ছবি আঁকার বায়না ধরল৷ তখন রাহুল ওকে জল রং আর কাগজ দিয়ে ছবি আঁকতে বসিয়েছে৷ আর ছবি আঁকা নিয়ে টুকটাক কথা বলার ফাঁকে মাস্টারজি সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করেছে৷ কোকো ওর খেয়াল মতো কখনও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কখনও দিচ্ছে না৷ ও মেঝেতে ‘বাবু’ হয়ে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কাগজের ওপরে রং বুলিয়ে চলেছে৷
রাহুল ওর আঁকা ছবিটা দেখছিল৷ কোকোর আঁকা দেখে বোঝা অসম্ভব যে, ওর মা ভালো ছবি আঁকত৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, লাল রংটায় আর-একটু জল মেশাও—হালকা করে নাও৷ মাস্টারজি কোথায় থাকে?’
‘অনেক দূরে৷ এখন…কাছে…এসে গেছে৷ এইখানটায় সবুজ রং দিই?’
রাহুল ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷ ওর মনে পড়ল, শুরু থেকে কোকো সবসময় বলে এসেছে মাস্টারজি দূরে থাকে৷ কিন্তু ইদানীং ও বলছে, মাস্টারজি কাছে এসে গেছে৷ সেই কাছে এসে যাওয়াটা কি কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডে ধরা পড়েছে?
‘না, না—নীল রং দিয়ো না৷ তুমি তো জানো গাছের পাতা সবুজ হয়৷’
কোকো ছবি থেকে মুখ তুলে তাকাল রাহুলের দিকে৷ হেসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ৷ গাছের…পাতা…সবুজ হয়৷ সবুজ…৷’
‘মাস্টারজির কাছে আর কে-কে আছে, কোকো?’
‘আকাশ তো নীল৷ তাই…না, রাহুল?’
‘হ্যাঁ, নীল৷ আর কে-কে আছে মাস্টারজির কাছে?’ রাহুল আবার জানতে চাইল৷
‘আকাশ নীল৷ আকাশ…নীল৷ রাহুল বলেছে৷’ আপনমনেই খুশি হয়ে মাথা নাড়ল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘সুলতানদা আছে৷ রামুদা…আছে৷ ময়না…আছে৷’
অবাক হল রাহুল৷ সুলতানদা, রামুদা, ময়না—এরা কারা?
বারবার প্রশ্ন করেও কোকোর কাছ থেকে আর কোনও সূত্র পাওয়া গেল না৷
‘এটা তো গাছের গুঁড়ি৷ এটা ব্রাউন রং দাও৷ বাদামি৷’
কোকো গাছের গুঁড়িতে সবুজ রং দিতে যাচ্ছিল৷ রাহুলের কথায় ও নতুন উৎসাহে বাদামি রং গুলতে শুরু করল৷
‘এই গাছের গুঁড়িটাও বাদামি রং হবে৷’ ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল রাহুল, ‘আচ্ছা কোকো, মাস্টারজি তো বলছ কাছে এসে গেছে৷ যদি তোমার একেবারে সামনে এসে পড়ে তা হলে কী হবে?’
ছবি আঁকা থামিয়ে দিল কোকো৷ চোখ বড়-বড় করে তাকাল রাহুলের দিকে : ‘আমার…তখন…খুব ভয় করবে৷’ বাঁ-হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল ও৷ রাহুলের দুটো আঙুল চেপে ধরে আস্তে-আস্তে বলল, ‘কিন্তু…রাহুলকে ছেড়ে…আমি যাব না৷ মাস্টারজি ভয় দেখালেও… না৷ যাব না৷’
রাহুল কোকোর মুঠোর মধ্যে অদ্ভুত এক উষ্ণতা খুঁজে পেল৷ ও আঙুল দুটো ছাড়িয়ে নিল না৷ কোকোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷
কিছুক্ষণ পর রাহুলের হাত ছেড়ে দিল ও৷ আবার ছবি আঁকায় মন দিল৷
গত একসপ্তাহে চারবার কোকোর কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল-সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলে উঠেছে৷ আর একইসঙ্গে কোন এক রহস্যময় যন্ত্রণায় কোকো ছটফটিয়ে উঠেছে৷ রাহুল ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না৷ কেনই বা আলো জ্বলছে, আর কেনই বা কোকো ছটফট করে উঠছে? মাস্টারজির সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্কই বা কী?
কোকো যে ধীরে-ধীরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সেটা রাহুল বেশ বুঝতে পারছিল৷ ঘিয়া নদীর পাড়ে কোকোকে প্রথম যখন রাহুল দেখেছিল তখন ওকে দিগভ্রান্ত, জড়বুদ্ধি, মানসিক রোগী বলে মনে হয়েছিল৷ এখন ও কত পালটে গেছে! সবসময় হাসিখুশি৷ হাসিমুখে কত না পরিশ্রমের কাজ করে ও! ওর গায়ের জোর গ্রামে একরকম কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ গ্রামের সবাই কোকোকে ভালোবাসে৷ ঝন্টুদা দেখা হলেই কোকোকে আইসক্রিম কিংবা পেপসি খাওয়ায়৷ ঝন্টুদা লাইব্রেরির কোনও কাজের কথা বললেই কোকো একপায়ে খাড়া৷ তবে ওকে বুদ্ধির কাজ কেউ দেয় না—দেয় শক্তির কাজ৷
কোকো সবসময় রাহুলের পিছন-পিছন ঘোরে৷ রাহুলকে চোখের আড়াল হতে দেয় না৷ রাহুল কখনও বারণ করলেও ও শোনে না৷ রাহুলকে মাকু আর নেনের কথা বলে৷ বলে, ‘আমি সঙ্গে থাকলে… তোমাকে কেউ কিছু করবে না৷ আমার গায়ে…জোর আছে৷’
ওর কথায় রাহুল হাসে৷
এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন নেনে আর মাকুর সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে৷ কিন্তু মাকুরা গায়ে পড়ে কোনও কথা বলেনি৷ চুপচাপ এড়িয়ে গেছে৷
কোকোকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে রাহুল একদিন চলে এসেছিল ঘিয়া নদীর পাড়ে৷
বর্ষা কবেই এসে গেছে৷ সেই বর্ষার জলে নদী ফুলে উঠেছে৷ দুপাশের গাছপালার দল সবুজে-সবুজে মাতোয়ারা৷
রাহুল কোকোকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল৷ নদীর ঘোলাটে জল ওদের পাশে-পাশে ছুটছে৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, মনে পড়ে, এই নদীতে তুমি ভেসে এসেছিলে? ওই গাছটার নীচে—’ আঙুল তুলে গাছটা দেখাল রাহুল : ‘—তুমি পড়ে ছিলে৷’
কোকো নদী বরাবর তাকাল৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ তারপর আস্তে-আস্তে বলল, ‘মনে…আছে৷ আমি…সাঁতার…জানি…৷’
‘আমিও সাঁতার জানি৷’ বলল রাহুল, ‘তুমি কি মাস্টারজির কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলে?’
রাহুলের দিকে তাকাল কোকো৷ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ৷
‘কেন, পালিয়ে এসেছ কেন?’
কোকো চুপ করে রইল৷ ওর শূন্য চোখ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিন্তু রাহুল বুঝতে পারল ও নদীর জল দেখছে না—অন্য কিছু ভাবছে৷
আকাশ মেঘলা৷ বৃষ্টি নেই৷ কিন্তু শেষ বৃষ্টির জল এখনও মাটি ভিজিয়ে রেখেছে৷ গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে কোথায় যেন বুলবুলি আর দোয়েল ডাকছে৷ নদীর সঙ্গে বয়ে আসা এক অদ্ভুত হাওয়া রাহুলের মনখারাপ করে দিচ্ছিল৷
কোকো হঠাৎ নদীর পাড়ে বসে পড়ল৷ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল৷
রাহুলও বসে পড়ল ওর পাশে৷ ওর পিঠে হাত রাখল : ‘কোকো, তুমি পালিয়ে এসেছিলে কেন?’
কোকো আলতো ফিসফিসে গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…আমাকে…মারত৷ সিগারেটের…ছ্যাঁকা দিত৷ তাই নদীতে…ঝাঁপ দিয়ে…পালিয়ে এসেছি৷’
‘তোমাকে মারত কেন মাস্টারজি?’
‘আমি আর লড়তে চাইনি…তাই৷’ কথাটা বলে কোকো বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷
‘কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’ রাহুলের ভেতরে কৌতূহলের ঘূর্ণিপাক শুরু হয়ে গিয়েছিল৷
‘কারও সঙ্গে না৷ আমি বলেছি…আমি আর…লড়ব না৷ কাউকে…মারব না৷ কষ্ট…দেব না৷’
রাহুল আবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’
কোকো কোনও জবাব দিল না৷ শুধু রাহুলের হাতটা পিঠ থেকে নামিয়ে জোরে আঁকড়ে ধরল৷ ফিসফিস করে বলল, ‘আমার মা নেই৷ বাবা নেই৷ কেউ…নেই৷’
একই কথা বারবার বলতে লাগল কোকো৷ বলতে-বলতে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ রাহুলের দিকে আর্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, রাহুল৷’
রাহুল ছোট বাচ্চাটাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল৷
কোকোকে নিয়ে রথের মেলায় গিয়েছিল রাহুল৷ রেললাইন পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা গেলে একটা বিশাল মাঠ৷ মাঠটার নাম ‘শকুন্তলার মাঠ’৷ কেন যে এরকম নাম কেউ জানে না৷ সেই মাঠে প্রতি বছরেই রথের মেলা বসে৷
মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দৈত্যের মতো নাগরদোলা৷ এ ছাড়া রয়েছে অনেক মণিহারী দোকান, খাবারের স্টল, খেলনাপাতির দোকান, পাঁপড়ভাজা আর তেলেভাজার দোকান৷ এসবের সঙ্গে এই মেলা উপলক্ষ্যেই থাকে পাখির হাট৷ নানান ধরনের রঙিন পাখির পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা৷ টিয়া, চন্দনা, বদ্রিকা থেকে শুরু করে আরও কতরকম পাখি!
চারপাশে লোকজনের হইচই, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার কান্না, মাইকের হিন্দি গান, সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত শব্দব্রহ্ম তৈরি হয়েছিল৷ তারই মধ্যে কোকো আর রাহুল মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷
বাপি আর মামের কাছে বায়না করে রাহুল কোকোকে নিয়ে মেলায় এসেছে৷ বাপিকে ও বোঝানোর চেষ্টা করেছে কোকো যত স্বাভাবিক জীবনে মিশবে তত তাড়াতাড়ি ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ মেলায় আসার সময় বাপি রাহুলের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন৷
এখন সেই পঞ্চাশ টাকা ভাঙিয়েই ওরা মেলার আনন্দ কুড়োচ্ছিল৷ নাগরদোলায় চড়া, তেলেভাজা আর পাঁপড়ভাজা খাওয়া, তার সঙ্গে কোকোর প্রিয় পেপসি—একের পর এক চলছিল৷
একটা খেলার দোকানে বল ছুড়ে ন’টা কাঠের পুতুলকে কাত করে দেওয়ার কমপিটিশান হচ্ছিল৷ তিনবারের চেষ্টায় ন’টা পুতুলকে শুইয়ে দিতে পারলেই পাওয়া যাবে পুরস্কার—মাঝারি মাপের স্টেইনলেস স্টিলের একটা বাটি৷
রাহুল পাঁচ টাকা দিয়ে কমপিটিশানে নাম দিল৷ তিনবার বল ছুড়ে ও সাতটা পুতুলকে কাত করে দিল বটে কিন্তু পুরস্কার জিততে পারল না৷
রাহুল বল ছোড়ায় নাম দেওয়ার জন্য কোকোকে বলল৷ কিন্তু কোকো বারবার মাথা নেড়ে জানাল যে, ওর হাতে একদম টিপ নেই৷
এরপর ওরা এয়ারগান শুটিং-এর স্টলে গেল৷ দেওয়ালে লাগানো নানা রঙের বেলুন৷ তারই একপাশে বেলুন লাগানো চক্র ঘুরছে, সুতোয় বাঁধা প্লাস্টিকের বাঘ-সিংহ, এমনকি জ্বলন্ত মোমবাতি আর পেরেকও ঝুলছে৷
রাহুল পাঁচবার ফায়ার করে দুটো বেলুন ফাটাতে পারল৷ কিন্তু কোকো এবারেও রাজি হল না৷ মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার…হাতে টিপ নেই৷’
মেলায় ঘুরতে-ঘুরতে কখন যেন সন্ধে নেমে এসেছে৷ চারপাশের খুঁটিতে লাগানো হ্যালোজেন আলো জ্বলে উঠেছে৷ স্টলে জ্বলে উঠেছে বালব আর টিউবলাইট৷ লোকের ভিড় আরও বাড়ছে৷ মাইকে মেলার কর্তৃপক্ষ কীসব যেন ঘোষণা করছে৷
একটা স্টলের সামনে বহু মানুষের ভিড় দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কোকোকেও হাত ধরে টেনে থামাল৷
ভিড় ঠেলে রাহুল আর কোকো কয়েকটা স্তর এগিয়ে গেল৷ দেখল, স্টলে একটা বিচিত্র কমপিটিশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
স্টলের ঠিক মধ্যিখানে একটা পুরোনো টিউবওয়েল পোঁতা আছে৷ টিউবওয়েলের কলের মুখে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতি বসানো৷ আর টিউবওয়েলের গায়ে, হাতলে, ফুলের মালা জড়ানো৷ স্টলের কাপড়ের দেওয়ালে বেশ কয়েকটা পোস্টার আঁটা৷ পোস্টারে যা লেখা আছে তার সারমর্ম হল : এই টিউবওয়েলটা পাম্প করে সহজে জল তোলা যায় না; যদি কেউ দশবার পাম্প করে তার মধ্যে এই কল থেকে জল বের করতে পারে তা হলে পুরস্কার একশো টাকা৷
প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার এন্ট্রি ফি দশ টাকা৷
স্টলের মালিক চিৎকার করে চ্যালেঞ্জারকে আহ্বান জানাচ্ছিল : ‘আসুন, দেখিয়ে দিন আপনার গায়ে কত জোর! এই বেয়াদব টিপকলটাকে শায়েস্তা করুন—!’
রাহুল দেখল, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার অনেকেই বেশ আশা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে নামছে, কিন্তু হার মেনে ফিরে আসছে৷ কলের মুখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বেরোচ্ছে না৷
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলল, ‘তোমার এই টিপকল থেকে জল আদৌ বেরোয় তো?’
অমনি স্টলের মালিক তার পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে কাকে যেন ইশারা করল৷ স্যান্ডো গেঞ্জি পরা স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে কলের সামনে এগিয়ে গেল৷ মালিকের নির্দেশে জোরালো হ্যাঁচকা দিয়ে টিউবওয়েলটা পাম্প করতে লাগল৷ আর মালিক চিৎকার করে এক থেকে দশ গুনতে লাগল৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে পাবলিকও হইহই করে গলা মেলাল৷
আটবারের বার কলের মুখ থেকে সরু সুতোর মতো জল বেরোল৷ তারপরের দুবারে জলের ধারাটা লাঠির মতো মোটা হল৷
তারপর ছেলেটা থামল৷ জনতা চিৎকারে ফেটে পড়ল৷
রাহুল কোকোকে ঠেলা মারল : ‘কোকো নাও—এবার নাম দাও…৷’
কোকো কিন্তু মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না, রাহুল—না৷’
রাহুল ওকে ছাড়ল না৷ বলল, ‘কেন, ‘‘না’’ কেন? এবারে তো আর টিপের ব্যাপার না—গায়ের জোরের ব্যাপার৷ তুমি যে বল তোমার গায়ে অনেক জোর! তা হলে ‘‘না’’ বলছ কেন?’
‘না, সেজন্যে না—৷’ আলতো করে বলল কোকো৷
‘তা হলে কী জন্যে?’
‘দোকানদারের একশো টাকা…মার যাবে৷ তাই—৷’
রাহুল হেসে ফেলল৷ কোকোকে বোঝাল যে, দোকানদার ইতিমধ্যেই অনেক টাকা লাভ করেছে৷ এখন একশো টাকা গেলে তার কোনও ক্ষতি হবে না৷
রাহুল কোকোর হয়ে এন্ট্রি ফি জমা দিল৷ তারপর কোকোকে ঠেলে টিউবওয়েলটার দিকে এগিয়ে দিল৷
কোকো টিউবওয়েলের হাতলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পাবলিক হইহই করে উঠল৷ কোকো হাতলটা ধরে সামান্য ঝুঁকে পজিশন নিল৷
দোকানদার চিৎকার করে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে নানান ঘোষণা করছিল৷ কোকো হাতলটা ধরে দাঁড়াতেই সে বলল, ‘আপনি রেডি? এ—ক৷’
কোকো টিউবওয়েল পাম্প করা শুরু করল, আর দোকানদারও গোনা শুরু করল৷
কোকো যেটা করছিল সেটা হাই স্পিড সিনেমার মতো৷ ওর তিন নম্বর পাম্পের সঙ্গে-সঙ্গে জল বেরোতে শুরু করল৷ কিন্তু কোকো না থেমে পাম্প করে চলল৷ ছ’নম্বর পাম্পে জলের ধারাটা ময়াল সাপের মতো মোটা হয়ে গেল৷
রাহুল চিৎকার করছিল, ‘কোকো৷ থামো! থামো!’ কিন্তু পাবলিকের হল্লায় ওর কথা চাপা পড়ে গেল৷
দোকানদার ব্যস্তভাবে কোকোর কাছে গিয়ে ওকে থামাল৷ ওকে শাবাশ দিয়ে একশো টাকা পুরস্কার তুলে দিল ওর হাতে৷ তারপর চেঁচিয়ে বলতে লাগল কোকোর কৃতিত্বের কথা : ‘এইমাত্র একজন পালোয়ান জিতে নিয়েছেন এ-ক-শো টাকা৷ ভাইসব, আমার এই কমপিটিশানে কোনও কারচুপি নেই, কোনও চিটিংবাজি নেই৷ আপনারা এগিয়ে আসুন…৷’
কোকো আর রাহুল ভিড় ঠেলে বাইরে এল৷ রাহুল কোকোর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কনগ্র্যাচুলেশান, কোকো—শাবাশ!’
কোকো একশো টাকার নোটটা রাহুলের দিকে এগিয়ে দিল : ‘এটা রেখে দাও৷’
রাহুল টাকাটা পকেটে রেখে বলল, ‘এই টাকাটা মাম আর বাপিকে দেব৷ বলব, কী সহজে তুমি প্রাইজ জিতেছ—৷’
ওরা দুজনে গল্প করতে-করতে ‘শকুন্তলার মাঠ’ ছেড়ে বেরিয়ে এল৷
ফেরার পথে রেললাইনটা পেরোতেই ওরা মাকুদের দেখতে পেল৷ আগাছার ঝোপের পাশে একটা টালির ছাউনি দেওয়া ঘর৷ তার ভেতরে বসে মাকুরা তাস খেলছে৷ ঘরের ভেতর থেকে টিভির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷
‘তাড়াতাড়ি পা চালাও’ বলে রাহুল কোকোর হাত ধরে টানল৷ মাকুদের বিশ্বাস নেই৷ যখন-তখন ঝামেলা বাধাতে পারে৷
ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন কোকো হঠাৎই এক অদ্ভুত কাণ্ড করল৷
রাস্তার ওপরেই সদানন্দদার চায়ের দোকান৷ বেড়া আর খুঁটির মাথায় টিনের চাল৷ দোকানের সামনে দুপাশে দুটো বেঞ্চি৷ তাতে জনা-চারেক খদ্দের—খবরের কাগজ পড়ছে, চা খাচ্ছে৷
সদানন্দদার দোকানের পাশেই নীলুকাকুর লন্ড্রি৷ নীলুকাকুর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা৷ রোগা দুর্বল চেহারা৷ গায়ে ফুলশার্ট আর পাজামা৷ ওর দোকানটার চেহারা ওর মতোই পুরোনো৷ শোকেসের কাঠ কালচে হয়ে গেছে৷ কাচের ওপরে বাদামি ছোপ পড়েছে৷ দোকানের শাটার রং চটা, জং ধরা৷
দোকান বন্ধ করার জন্য সেই শাটারটাই টেনে নামাতে চেষ্টা করছিল নীলুকাকু৷ কিন্তু পারছিল না৷ সেইজন্য চেঁচিয়ে সদানন্দদাকে ডাকছিল—যদি সে একটু হাত লাগিয়ে দেয়৷ কিন্তু সদানন্দদা চা তৈরিতে ব্যস্ত—নীলুকাকুর ডাকে সাড়া দিয়ে সে বারবার বলছিল, ‘একটু সবুর করো, কাকা—যাচ্ছি৷’
পথ চলতে-চলতে কোকো এসব দেখছিল, শুনছিল৷ হঠাৎই ও রাহুলের পাশ থেকে ছুট লাগল নীলুকাকুর লন্ড্রির দিকে৷ কর্কশ গলায় বলল, ‘সরে দাঁড়াও, কাকা৷ আমি…আমি শাটার নামিয়ে…দিচ্ছি৷’
কথাগুলো বলতে যতক্ষণ লাগল তার অনেক কম সময়ে শাটারের কাছে পৌঁছে গেল কোকো৷ বাঁ-হাতে শাটার ধরে অনায়াসে টান মারল৷ প্রতিবাদের ধাতব জিগির তুলে জং ধরা শাটার অটোমেটিক এলিভেটরের মতো নেমে এল৷ শাটারের ঘর্ঘর শব্দে চায়ের দোকানের খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷
নীলুকাকু তখন কোকোর থুতনিতে আঙুল দিয়ে ওকে আহ্লাদ করছে৷ বলছে, ‘ও, তুই! তোকে আগে দেখতে পাইনি রে৷ পেলে তোকেই বলতাম৷ লক্ষ্মী ছেলে! তোর ভালো হোক৷’
কোকো হেসে ‘আসি’ বলল৷ তারপর ছুট্টে চলে এল রাহুলের কাছে৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, তোমাকে নিয়ে আর পারি না! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ছুট লাগালে?’
‘নীলুকাকুর শাটারটা…খুব শক্ত৷ আগেও দু-দিন আমি…ওটা টেনে নামিয়ে দিয়েছি…৷’
রাহুল অবাক হয়ে কোকোর মুখের দিকে তাকাল৷
বেশ কিছুদিন ধরেই কোকো একা-একা রাস্তায় বেরোয়, মামের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুদিখানার জিনিস কিনতে যায়৷ বলতে গেলে মণিমেলার সব রাস্তাই ও এখন চিনে গেছে৷ তা ছাড়া ওকে এলাকার সবাই ভালো করে চেনে, ভালোও বাসে৷
আবার রাহুলের পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল কোকো৷ ওদের পাশ দিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন বাজিয়ে একটা সাইকেল রিকশা চলে গেল৷ একটা সাইকেল ভ্যান নানারকম শাকসবজি নিয়ে রাস্তার ধারের লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার পাশেই একটা টাইমকল৷ তার সামনে ভিড়৷ জল নেওয়ার জন্য চার-পাঁচজন লোক কলসি, বালতি, জলের বোতল নিয়ে লাইন দিয়ে আছে৷ আকাশে মেঘের পাতলা ঝালর৷ তার আড়ালে অসম্পূর্ণ চাঁদ৷
আজ বিকেল থেকে গুমোট ভাব ছিল৷ এখন হঠাৎ যেন হাওয়ার সুড়সুড়ি টের পেল রাহুল৷ ওর মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ ও ভাবছিল, বাড়িতে ঢুকে বাপি আর মামকে ঠিক কীভাবে কোকোর টিউবওয়েল কমপিটিশান জেতার খবরটা জানাবে৷
ঠিক তখনই একটা অশ্বত্থগাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ছায়া৷ কোকোর নাম ধরে ডাকল৷
‘অ্যাই, কোকো!’
রাহুল আর কোকো দুজনেই চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে৷
জায়গাটা অন্ধকার৷ রাস্তার আলো ভালো করে পৌঁছয়নি সেখানে৷ গাছের কালো গুঁড়ির পাশে অস্পষ্ট একটা কালো ছায়া৷
‘কোকো—’ আবার ডাকল সেই ছায়া৷
কোকো এগিয়ে গেল অশ্বত্থগাছটার কাছে৷ পিছনে রাহুল৷
ছায়াকে চিনতে পারল কোকো : ‘সুলতানদা! তুমি!’
‘হ্যাঁ—আমি৷’ বলে সুলতান ওকে জড়িয়ে ধরল : ‘তুই কেমন আছিস?’ ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখটা ভালো করে দেখতে লাগল সুলতান৷
‘ভালো…আছি৷’ কোকো বলল৷
‘শোন—তোর খুব বিপদ৷ মাস্টারজি তোকে খুঁজছে৷’
সঙ্গে-সঙ্গে কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল আর সবুজ আলো জ্বলে উঠল৷ এবং কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল৷ ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে লাগল৷ ছটফট করতে-করতে ওর শরীরটা মাটিতে পড়ে গেল৷ যন্ত্রণার টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে৷
৷৷সাত৷৷
সে-রাতটা রাহুলদের বলতে গেলে না ঘুমিয়েই কাটল৷ কারণ সুলতান যে-কাহিনি শোনাল তারপর রাহুল, ওর বাপি আর মামের দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক৷
কোকোকে সামলে নিয়ে ধরে-ধরে বাড়ির দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল রাহুল—সঙ্গে সুলতান৷ যেতে-যেতে সুলতান রাহুলের সঙ্গে অল্প-অল্প কথা বলছিল৷
‘কোকো হারিয়ে যাওয়ার পর মাস্টারজি খেপে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল৷ তখন আমাদের পাঁচজনকে পাঁচদিকে খুঁজতে পাঠায়৷ সে তার রাগ কী! রেগে একেবারে আগুন৷ আমাকে বলে কি ‘‘জাহান্নম থেকে হলেও ওই মেড়াটাকে খুঁজে নিয়ে আয়৷’’ রাগে একদম গরগর করছিল৷’
‘এখন কী হবে?’ ভয় পেয়ে জিগ্যেস করল রাহুল৷
‘দেখি কী হয়৷’ চিন্তার সুরে বলল সুলতান৷ কোকোর কাঁধে আলতো চাপড় মেরে হাসল : ‘আসলে এই খোকাটাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি৷ ও খুব ভালো ছেলে৷ কিন্তু ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড…৷’
‘কন্ট্রোল ব্যান্ড কী?’
‘ওই…মাস্টারজির কন্ট্রোল৷’
ওরা ততক্ষণে রাহুলদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল৷
একটু পরে ওরা সবাই বসবার ঘরে গুছিয়ে বসল৷ কল্যাণবাবু বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলেন৷ রাস্তার দিকের জানালাগুলোও ভেজিয়ে দিলেন৷ তারপর সুলতানের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন৷ রাহুলের মাম স্বামীকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার তো বুক কাঁপছে৷ রাহুল এই লোকটাকে কোথা থেকে জুটিয়ে নিয়ে এল? কী হবে এখন? তুমি বরং পুলিশে খবর দাও—৷’
কল্যাণবাবু স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এখন না৷ আগে এর সঙ্গে কথা বলে দেখি৷ লোকটা এমনিতে খারাপ না৷ কোকোকে খুব ভালোবাসে—’ স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কল্যাণবাবু অনুরোধ করলেন, ‘আমাদের একটু চা-টা খাওয়াবে না?’
রাহুলের মাম ‘নিয়ে আসছি’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন৷
কল্যাণবাবু সুলতানের মুখোমুখি বসলেন৷ ভাবলেন, লোকটাকে দেখে তো শয়তান বলে মনে হচ্ছে না৷ একটু কথা বলে দেখা যাক না৷ কোকোকে সহজে আমরা ছাড়ব না৷
সুলতানের বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশ৷ চেহারা মাঝারি৷ রং ময়লা৷ গাল বসা৷ থুতনিতে কাঁচাপাকা দাড়ি৷ কথা বলার সময় মাঝে-মাঝেই ভুরুজোড়া ওপরদিকে তোলে৷ গায়ে হালকা সবুজ হাফশার্ট আর ময়লা হয়ে যাওয়া জিনসের প্যান্ট৷
একটু পরেই মাম চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন৷ বাপিকে চা দিলেন৷ সুলতানকে দিলেন৷ নিজেও নিলেন৷ তারপর কোকোর পাশে গিয়ে বসলেন৷
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুলতান মাস্টারজির কাহিনি বলতে শুরু করল৷
‘স্যার, কলকাতার কাছাকাছি খড়দায় মাস্টারজির একটা অনাথ আশ্রম আছে৷ ‘‘করুণাময়ী’’ নাম৷ সেখানে বাপ-মা মরা হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেরা থাকে৷ মাস্টারজি ওদের দু-বেলা খেতে দেয়, থাকতে দেয়—আর কাজ শেখায়৷ কাজ তো সব নানারকমের : রাজমিস্ত্রির কাজ, ছুতোরমিস্ত্রির কাজ, লেদ কারখানার কাজ, গেঞ্জির কল চালানোর কাজ, আরও কতরকম৷
‘মাস্টারজির অনেক কলকারখানা আছে, ব্যবসা আছে, কলকাতার সল্টলেকে তিনতলা জমকালো একটা বাড়ি আছে৷ লোক বলে, মাস্টারজি বহুরকম দু-নম্বরি ব্যবসার সঙ্গে মিলেজুলে আছে৷ একবার জাল নোট মার্কেটে ছাড়তে গিয়ে গোয়েন্দা-পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল৷ তিনমাস জেলও খেটেছিল৷ তারপর জেল থেকে বেরিয়ে কীভাবে যেন পুলিশের সঙ্গে লাইন করে নিয়েছিল৷’
বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো ওই ‘‘করুণাময়ী’’-তে গেল কীভাবে?’
‘কীভাবে আবার! ওর নসিব৷’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল সুলতান৷ একটু উসখুস করল৷ তারপর : ‘মাস্টারজির দলে অনেক আড়কাঠি আছে—দালাল৷ ওরা সব হ্যান্ডিক্যাপ ছেলের খবর আনে৷ তারপর ওই আশ্রমে ওদের ভরতি করে মাস্টারজি কমসেকম একটা বছর ঠিকঠাক চালায়৷ দ্যাখে যে, কেউ ওই ছেলেগুলোর খোঁজখবর করতে আসছে কি না৷ মানে, বাবা, মা, রিলেটিভ কেউ আসছে কি না৷ তারপর কেউ না এলে তখন মাস্টারজি নিশ্চিন্ত হয়৷ নিজের মতো করে ওদের ট্রেনিং চালু করে৷’
‘কীসের ট্রেনিং?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷
উত্তরে মলিন হাসল সুলতান৷ বলল, ‘ওই হরেকরকম কাজ শেখানোর ট্রেনিং৷ কলকারখানার কাজের ট্রেনিং৷ এ ছাড়া আছে ফাইটিং-এর ট্রেনিং…৷’
‘ফাইটিং-এর ট্রেনিং!’ মাম অবাক হয়ে বললেন৷
‘হ্যাঁ৷ অনাথ আশ্রমে মাস্টারজির একটা ইল্লিগাল ক্লাব আছে৷ নাম ‘‘ফাইট ক্লাব’’৷ এই ক্লাবের কথা অনেকে জানে৷ পুলিশও জানে৷ তবে ওই টাকাপয়সা দিয়ে সেখানে মাস্টারজি লাইন করে রেখেছে আর কী! তো ওই ক্লাবে সপ্তাহে দু-দিন কি তিনদিন ফাইট কমপিটিশান হয়৷ দুজন ফাইটার বাজি ধরে লড়াই করে৷ সে-লড়াই নিয়ে দর্শকরাও বাজি ধরে৷ লড়াইয়ের পর ফাইটারদের টাকা দেওয়া হয়৷ যে জেতে সে পায় বেশি৷ যে হারে সে পায় কম৷ তবে কম পেলেও সে-টাকা অনেক৷ এর লোভে অনেকেই লড়াইয়ে নাম দেয়৷
‘আশ্রমের ছেলেদের বাচ্চা বয়েস থেকেই মাস্টারজি ট্রেনিং করায়৷ রেগুলার ব্যায়াম শেখায়, মারপিটের হরেক টেকনিক শেখায়৷ একজন ট্রেনার তাই-কোন্ডো শেখায়৷ নাম ভগবতীপ্রসাদ৷ ব্ল্যাক বেল্ট৷ একবার শুনেছি এশিয়ার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল৷ কোকো ওর খুব ফেবারিট ছাত্র৷ আট বছর ধরে কোকোকে লড়াই শেখাচ্ছে৷’
সুলতান একবার কোকোর দিকে তাকাল৷ কোকো শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সরল মুখে বসে আছে৷ ওর চোখ সুলতানের দিকে৷
সুলতান আপনমনে মাথা ঝাঁকাল৷ সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল৷
‘ট্রেনিং দেওয়া ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে মাস্টারজি ‘‘ফাইটার বয়’’-দের বেছে নেয়৷ তারপর ওদের খালি হাতে লড়াইয়ের স্পেশাল ট্রেনিং করায়৷ তারপর…তারপর ওরা ওই ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এর জুয়ায় নাম দেয়৷ সেখান থেকে মেলা টাকা ইনকাম করে৷ ওদের সামান্য হাতখরচা দিয়ে বাকি টাকা মাস্টারজি চোট করে দেয়৷ তাই ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মাস্টারজি সহজে হাতছাড়া করে না৷
‘আর কোকো?’ কোকোর দিকে ইশারা করে আক্ষেপের হাসি হাসল সুলতান : ‘ও এ পর্যন্ত একটাও লড়াই হারেনি৷ ও হচ্ছে ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে গোল্ডেন বয়৷ জুয়েল৷ সুপার হিরো৷ ওকে লড়াইয়ে নামিয়ে মাস্টারজি লক্ষ-লক্ষ টাকা ইনকাম করেছে৷ তাই কোনও অবস্থাতেই ওকে হারাতে চায় না মাস্টারজি৷ ওর খোঁজে মাস্টারজি আমাদের পাঁচজনকে লড়িয়ে দিয়েছে৷ আমিই সবার আগে কোকোকে খুঁজে পেলাম…কিন্তু মাস্টারজিকে সে-কথা কেমন করে জানাব! এই ছেলেটাকে আমি যে বড় ভালোবাসি…৷’ কথা বলতে-বলতে কোকোর দিকে তাকাল সুলতান৷ ওর চোখে স্নেহ আর আদর ঝরে পড়ছিল৷
হঠাৎই মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ আচমকা এই সুরেলা আওয়াজে সবাই চমকে উঠল৷
সুলতান তড়িঘড়ি পকেটে হাত ঢোকাল, ফোন বের করল৷ ইনকামিং কলের নম্বরটা দেখার পর ও এমনভাবে ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল যেন হাতের মুঠোয় একটা ঝুমঝুমি সাপ ধরে আছে৷
ওর হাবভাব দেখে কারও আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ফোনটা কে করেছে৷
বাপির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল সুলতান৷ চোখে জিজ্ঞাসা : এখন কী করবে?
বাপি ইশারায় ওকে ফোনটা ধরতে বললেন৷
‘হ্যালো—৷’ ফোনটা ধরেই সুলতান লাউডস্পিকার অন করে দিল—যাতে সবাই ও-প্রান্তের কথা শুনতে পায়৷
‘কে, সুলতান? মেড়াটাকে খুঁজে পেলি?’ মাস্টারজির ক্ষিপ্ত গলা৷
‘না, মানে…এখনও পাইনি৷ খুঁজছি৷’ ইতস্তত করে বলল সুলতান৷
‘তুই এখন কোথায়?’
‘মণিমেলায়…৷’
ও-প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ৷ তারপর : ‘আমরা মণিমেলা থেকে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার মতো দূরে আছি৷ আমার গাড়িতে একজন লোকাল লোককে তুলে নিয়েছি—লোকটা ঘিয়া নদীর আশপাশের গ্রামগুলো সব চেনে৷ তুই ভালো করে বিচ্ছুটাকে খোঁজ৷ ওটাকে পেলে আর লড়াব না৷ ‘‘করুণাময়ী’’-তে এনে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব—যাতে আর কোনও ‘‘ফাইটার বয়’’ এরকম বেয়াদপি না করে৷’
মাস্টারজির শাস্তির কথাটা শুনে মামের মুখ থেকে ভয়ে একটা হেঁচকির শব্দ বেরিয়ে এল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাম মুখে হাত চাপা দিলেন—পাছে আবার কোনও শব্দ হয় এবং সেটা ফোনে শোনা যায়৷
সুলতানের মোবাইল সেটটা নিশ্চয়ই বেশ দামি, কারণ মাস্টারজি যে মামের চাপা আর্তনাদটা ফোনে শুনতে পেয়েছে সেটা পরের কথাতেই বোঝা গেল৷
‘সুলতান, তুই এখন কোথায়? কার বাড়িতে, উঁ?’ প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটু ব্যঙ্গের খোঁচা৷
‘না, না—কারও বাড়িতে নয়৷ একটা…চায়ের দোকানে…৷’
‘হুঁ—বুঝেছি৷’
ফোন ছেড়ে দিল মাস্টারজি৷
সুলতান ভয় পেয়ে গেল : ‘এখন কী হবে? মাস্টারজি যদি এখানে চলে আসে?’
মাম বললেন, ‘শিগগির পুলিশে খবর দাও৷’
‘দাঁড়াও৷’ হাতের ইশারা করলেন বাপি : ‘আমাকে একটু ভাবতে দাও—৷’
কোকো এবার কথা বলল : ‘না, আমি এ-বাড়ি ছেড়ে…কোথাও যাব না…৷’
বাপি ওর দিকে একবার তাকালেন শুধু—কোনও কথা বললেন না৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন৷
মাম বললেন, ‘মণিমেলায় মাস্টারজি যদি আসেও আমাদের বাড়ি কেমন করে খুঁজে পাবে? কোকো এখানেই থাক৷ যদি কোনও বিপদ-আপদ হয় তখন বরং থানায় খবর দেওয়া যাবে৷’
সুলতান মাথা চুলকোচ্ছিল৷ কী যেন ভাবছিল৷
রাহুল এতক্ষণ চুপ করে ছিল৷ কোকোকে দেখছিল৷ ও বাপিকে লক্ষ করে বলে উঠল, ‘কোকোকে আমরা ছাড়ব না, বাপি৷ ও আমাদের কাছে থাকবে৷’
বাপি পায়চারি করতে-করতে থুতনিতে কয়েকবার আঙুল বোলালেন৷ থানা-পুলিশ করলে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কী করবে কে জানে! হয়তো জেলখানাতে রেখে দেবে৷ নয়তো ফাইল চালাচালি করে কোনও পাগলা-গারদেই পাঠিয়ে দেবে৷
বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷
সুলতান বলল, ‘স্যার, আমি পাপী-তাপী মানুষ৷ মাস্টারজির পয়সা খেয়ে বেঁচে আছি৷ কিন্তু এই ছেলেটা বড় ভালো৷ মানে, ওকে আমার খুব ভালো লাগে৷ ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি৷ আপনারা ওকে কাছছাড়া করবেন না৷ মাস্টারজি এখানে আসে আসুক৷ তখন দেখা যাবে৷ যা হয় হবে…৷’
সুলতানের কথাটা সবার মনে ধরল৷ মামের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ রাহুলও ওর খুশির ভাবটা চেপে রাখতে পারছিল না৷
বাপি চেয়ারে বসে পড়লেন আবার৷ সুলতানকে বললেন, ‘আচ্ছা, ওই মাস্টারজি তো আমাদের বাড়িটা খুঁজে নাও পেতে পারে…৷’
মাথা নেড়ে হাসল সুলতান : ‘উঁহু—সেটা হওয়ার জো নেই৷ ওই যে, ওর গলার ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড৷ মাস্টারজির কাছে একটা রিমোট আছে৷ ওটার রেঞ্জ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার৷ ওই রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল ব্যান্ডটাকে কন্ট্রোল করা যায়৷ ওই ব্যান্ডটা যদি কারও গলায় পরানো থাকে তা হলে ওই রিমোটের বোতাম টিপে বোঝা যায় লোকটা কত দূরে আছে৷ আর যার গলায় ওটা পরানো থাকে তাকে ওই রিমোটের বোতাম টিপে শায়েস্তা করা যায়…৷’
‘শায়েস্তা মানে?’ বাপি জিগ্যেস করলেন৷
‘মানে, রিমোটের বোতাম টিপলে কোকোর বডির ভেতর দিয়ে কীসব ওয়েভ যাবে৷ তাতে কোকোর যন্ত্রণা হবে, ও কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করবে৷ আর-একটা লাল রঙের বোতাম আছে—সেটা টিপলে মাথা ধরবে, মাথার যন্ত্রণা হবে, মাথা ঘুরবে৷ মাস্টারজি ফরেন থেকে এরকম মেশিন বেশি কয়েকটা আনিয়েছে৷ ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে যারা একটু বেয়াড়া, এই মেশিনগুলো তাদের জন্যে৷ গলার ওই ব্যান্ডগুলো এমন যে, রিমোটের ঠিকঠাক বোতাম না টিপে ওগুলো গলা থেকে খুলতে গেলে অসহ্য পেইন হবে৷ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাবে…৷’
রাহুলের মনে পড়ল, কোকো ওর গলার ওই ব্যান্ডটায় কাউকে কখনও হাত দিতে দেয় না৷ মরিয়া হয়ে বাধা দেয়৷
‘কোকোকে নিয়ে মাস্টারজির কি প্রবলেম হচ্ছিল যে, ওর গলায় কন্ট্রোল ব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছে?’ মাম সুলতানকে জিগ্যেস করলেন৷
সায় দিয়ে মাথা নাড়ল সুলতান : ‘হ্যাঁ—প্রবলেম হচ্ছিল৷’ কোকোর দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ও৷ নরম গলায় বলল, ‘কোকো ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এ আর লড়তে চাইছিল না৷ ও আমাকে আড়ালে বলত ওর মনের কথা৷ বলত, ‘‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে আর মারব না৷ কষ্ট দেব না৷’’ এইসব কথা বলত সবসময়…৷
‘একদিন ও বেঁকে বসল৷ বলল, কিছুতেই ও আর লড়বে না৷ মারপিট করতে ওর আর ভালো লাগে না৷ মাস্টারজির সামনে রুখে দাঁড়াল৷ সেদিন থেকেই মাস্টারজি ছেলেটার ওপরে টরচার শুরু করল৷ মারধোর…সিগারেটের ছ্যাঁকা…কী না সয়েছে এই ভোলাভালা ছেলেটা…৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়াল সুলতান৷ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওর মাথায় হাত রাখল : ‘মাস্টারজির চামচেগিরি করে আমিও ওকে কম টরচার করেছি! কিন্তু আশ্রমে একদিন দেখি ছেলেটা আমার ঘরে ঢুকে আমার মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে কাঁদছে৷ আমার আম্মি বহুদিন আগেই মারা গেছে৷ কোকো সেটা জানত৷
তো আমি তাজ্জব হয়ে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘‘কী রে, কী ব্যাপার? আমার মায়ের ফটো নিয়ে কাঁদছিস কেন?’’
‘ছেলেটা…এই হ্যান্ডিক্যাপ পাগলটা…আমাকে কী বলল জানেন, স্যার? বলল, ‘‘সুলতানদা, আমার মা নেই৷ মায়ের কোনও ফটোও নেই৷ তাই তোমার মায়ের ফটোটা নিয়েছি…৷’’
‘সেইদিন থেকে…সেইদিন থেকে, স্যার…আমি ওকে আমার ‘‘ভাই’’ ডেকেছি৷’ সুলতান চোখে কিছু একটা পড়েছে এমন ভান করে চোখ মুছল৷ একটু বসা গলায় বলল, ‘জানেন স্যার, অনেকবার ভেবেছি মাস্টারজির দল ছেড়ে দেব৷ কোকোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব—কিন্তু পারিনি৷ পাপী পেট কা সওয়াল৷ ক’টা টাকার লোভে মাস্টারজির দলে পড়ে থেকেছি৷ মাস্টারজির আর-পাঁচটা পোষা গুন্ডার মধ্যে আমিও একটা হয়ে গেছি৷ কোকোকে সেভ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি৷ ওর ব্যাপারে মাস্টারজি আমাকে সন্দেহ করত৷ তাই কোকো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর পর মাস্টারজি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আরও চারজনকে কোকোর খোঁজে লড়িয়ে দিয়েছে৷’
মাম জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো নদীতে ঝাঁপ দিল কেমন করে?’
সুলতান ফিরে এসে ওর চেয়ারে বসল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘কয়েকজনের টিম নিয়ে মাস্টারজি বর্ধমানের একটা ফাইট কমপিটিশানে যাচ্ছিল৷ যারা গান-টান গায় তারা যেমন ফাংশান-টাংশান করতে যায় সেরকম মাস্টারজিও ‘‘ফাইট বয়’’-দের নিয়ে মাঝে-মাঝে গ্রামে-গঞ্জে যেত৷ বড়-বড় টাকার বাজি হত সেখানে৷ কোকো যেতে চায়নি, কিন্তু ওকে জোর করে গাড়িতে তুলেছিল মাস্টারজি৷ গাড়িতে আমিও ছিলাম৷ শিবাইচণ্ডীর কাছে—একটা নদীর ব্রিজ সবে পেরিয়েছি—আমাদের গাড়ির টায়ার পাংচার হল৷ তো আমরা কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে নদীর ধারে পায়চারি করছিলাম৷ আগের দিন রাতে মাস্টারজি আর ওর পোষা গুন্ডাগুলো কোকোকে কয়েকঘণ্টা ধরে টরচার করেছিল৷ কারণ সেই একই—ও আর লড়তে চাইছিল না৷ এমনি-এমনি কাউকে ও আর মারতে চাইছিল না৷
‘তো আমরা কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম৷ মাস্টারজি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে টায়ার পালটানো দেখছিল৷ তখন কোকো হঠাৎ নদীতে ঝাঁপ দেয়৷ সেটা খেয়াল করতেই আমরা চেঁচিয়ে উঠি৷ মাস্টারজি ছুটে আসে নদীর পাড়ে৷ তারপর দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে রিমোটটা নিয়ে আসে৷ পাগলের মতো এ-বোতাম সে-বোতাম টিপতে থাকে৷ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি৷ কোকো ততক্ষণে নজরের বাইরে চলে গেছে৷
‘ওকে হারিয়ে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই৷ দুশ্চিন্তাও হয়েছিল৷ কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়বে হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেটা! দু-বেলা কীভাবে ওর খাবার জুটবে! আবার খুশিও হয়েছিলাম, স্যার৷ যে মাস্টারজির হাত থেকে খোকাটা আজাদ হতে পেরেছে…৷’
সুলতান উঠে দাঁড়াল৷ চারপাশে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলল, ‘এখানে দেখছি কোকো খুব ভালো আছে৷ আপনারা ওকে ঘরের একজন করে নিয়েছেন…৷’ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল সুলতান৷ ওর গালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘কোকো, তুই এখানে থেকে যা৷ এখান থেকে আর কোথাও যাস না৷ এটা জন্নত৷’
কোকো হেসে বলল, ‘রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷’
মাম উঠে দাঁড়ালেন৷ কোকোর মাথাটা মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিলেন৷ বললেন, ‘তোকে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারব না৷ তুই এত ভালো৷ এ-গ্রামের সবাই তোকে ভালোবাসে…৷’
কথায়-কথায় রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল৷ সুলতান হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘স্যার, সব তো আপনাদের খুলে বললাম—এবারে বলুন আপনারা কী করবেন…৷ আমি কি চলে যাব—না আপনারা আমাকে পুলিশে দেবেন?’
মাম আর বাপি মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন৷
সুলতান আক্ষেপের গলায় বলল, ‘লাইফে অনেক পাপ করেছি৷ কিন্তু এই অনাথ ছেলেটার হেনস্থা আমার আর সহ্য হচ্ছে না৷ মাস্টারজি আমাকে পেলে হয়তো মার্ডারই করে ফেলবে৷ সে করুক৷ কিন্তু কোকোর…৷’
রাহুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না, সুলতানদা, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো৷ মাস্টারজি এলে আমরা মাস্টারজিকে বোঝাব…বলো না, বাপি—৷’ বলে বাপির দিকে তাকাল রাহুল৷
বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ—রাহুল ঠিকই বলেছে৷ মাস্টারজিকে আমরা বোঝাব…বলব যে…’, স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকালেন : ‘বলব যে, কোকো আমাদের সঙ্গে থাকুক৷ দরকার হয় মাস্টারজিকে আমি টাকা অফার করব…৷’
মাম মাথা নেড়ে বাপির কথায় সায় দিলেন৷ বললেন, ‘মাস্টারজি আসা অবধি সুলতানভাইয়ের থাকা দরকার৷’ সুলতানের দিকে তাকিয়ে মাম বললেন, ‘আপনি আজকের রাতটা আমাদের কাছে থেকে যান—৷’
সুলতান হেসে বলল, ‘থ্যাংকস—৷’
রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল৷ ওর গলার ব্যান্ডের লাল আর সবুজ বাতি দপদপ করে জ্বলতে শুরু করেছে৷
বাপি আর মাম ওকে জাপটে ধরলেন৷ সামলাতে চেষ্টা করলেন৷ রাহুল অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল৷
সুলতান চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি মনে হয় আরও কাছে এসে গেছে৷’
সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানের মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল৷
৷৷আট৷৷
গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন রাহুলকে জাগিয়ে দিল৷ তখন সবে রাতের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে৷ আকাশে চাপ-চাপ মেঘ থাকায় জায়গায়-জায়গায় গাঢ় ছাই রং জমাট বেঁধে ছিল৷ তা ছাড়া বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছিল রাহুল৷ পাশের বাড়ির টিনের চালে আর গাছের পাতায় একই বৃষ্টি দুরকমের আওয়াজ তুলছিল৷ ব্যাপারটা অনেকটা যুগল-বন্দির মতো শোনাচ্ছিল৷
কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট সেরে রাহুলরা যখন বিছানায় শুয়েছে তখন রাত অনেক গড়িয়ে গেছে৷ তারপর অন্ধকার ঘরে টেনশানে জেগে ছিল তিনটি মানুষ : রাহুল, সুলতান, আর কোকো৷ কিছুতেই ওরা দু-চোখের পাতা এক করতে পারছিল না৷
পাশের ঘরে বাপি আর মামেরও একই অবস্থা৷ কোকোকে নিয়ে টানাপোড়েনের যন্ত্রণা ওঁদের দু-জনকেই কষ্ট দিচ্ছিল৷ কোকোকে হারানোর আতঙ্কে মাম ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন৷
রাহুল এখন শুধু ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনেনি, হেডলাইটের আলোও দেখতে পেয়েছিল৷ কারণ, খোলা জানলার পরদা ভেদ করে আলোর ছটা ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতরে৷ তারপর গাড়ির চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোর জ্যামিতিটা দেওয়ালে ধীরে-ধীরে সরে গিয়ে রাহুলের বুককেসের ওপরে থেমেছে৷ এবং পরক্ষণেই নিভে গেছে৷
রাহুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করে উঠল৷ আবছা আলোয় ও তাকাল মেঝেতে শুয়ে থাকা সুলতান আর কোকোর দিকে৷ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে-থেকে ওরা এখন ঘুমোচ্ছে৷ বোধহয় ক্লান্তিতে আর জেগে থাকতে পারেনি৷ শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে৷
ইঞ্জিনের শব্দটা বাড়ির কাছ ঘেঁষে এসে থামল৷
রাহুল বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল৷ বেশ টের পেল ওর হাত-পা কাঁপছে৷
ও সুলতানের কাছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে জোরে ঠেলা মরাল ওকে : ‘সুলতানদা! সুলতানদা! ওঠো—ওঠো!’
সুলতান ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল৷ অন্ধকারে রাহুলকে ঠাহর করতে চেষ্টা করল৷
‘শ-শ-শ-শ’ শব্দ করে সুলতানকে চুপ করে থাকতে ইশারা করল রাহুল৷ তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘জানলা দিয়ে দ্যাখো তো৷ একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম—৷’
ঘুম কেটে গেল সুলতানের৷ ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ খুব সাবধানে জানলার কাছে গেল৷ দু-চোখে হাত ঘষে পরদা সরিয়ে উঁকি মারল৷
রাহুলদের বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কোয়ালিস গাড়ি৷ হালকা আলোয় গাড়ির রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে সাদা, কি ছাই, অথবা রুপোলি রঙের হতে পারে৷
বুকটা ধক করে উঠল সুলতানের৷ মাস্টারজির রুপোলি রঙের একটা কোয়ালিস গাড়ি আছে!
রাহুল সুলতানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখল, গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল চারজন লোক৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই ওরা ব্যস্ত-ভাবে রাহুলদের গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ চার-জনের মধ্যে একজনের হাঁটার ভঙ্গিটা কেমন যেন চেনা মনে হল রাহুলের৷
আর দেরি করল না রাহুল৷ ছুটে চলে গেল ঘরের দরজার কাছে৷ এক্ষুনি বাপি আর মামের ঘরে গিয়ে ডাকা দরকার৷
দরজা খুলতেই বাপি আর মামকে দেখতে পেল ও৷ লোহার গেটের শব্দে ওঁরা জেগে উঠেছেন৷ জানলা দিয়ে লোকগুলোকে দেখেওছেন৷
চাপা গলায় দ্রুত পরামর্শ করল সবাই৷ মাম বাপিকে বললেন, ‘কী হবে এখন? থানায় ফোন করবে?’
বাপি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল৷
দু-তিন সেকেন্ড চুপ করে থেকে বাপি চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘আর কিছু করার নেই৷ মোকাবিলা করতে হবে৷’
কথাগুলো বলেই বাপি সুইচবোর্ডের কাছে গেলেন৷ আলোর সব ক’টা সুইচ জ্বেলে দিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘বাড়ির সব আলো এক্ষুনি জ্বেলে দে৷ আর কোকো কোথায়?’
‘ঘুমোচ্ছে৷’
‘ওকে শিগগির ডেকে তোল—৷’
রাহুল ব্যস্তভাবে ছুট লাগাল৷ ওর সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানও ছুটল৷
এর মধ্যেই কলিংবেল আরও তিনবার বেজে উঠেছে৷ বেল বাজানোর ঢঙেই বোঝা গেল যারা এসেছে তারা বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে৷
এবার বন্ধ দরজায় ধাক্কা পড়ল—পরপর তিনবার৷
তার একটু পরেই রাহুলের নাম ধরে কে ডেকে উঠল : ‘রাহুল! রাহুল!’
রাহুল চমকে উঠল৷ চেনা গলা৷ কিন্তু কে যেন?
এর মধ্যেই ও কোকোকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে ঘুম থেকে তুলেছে৷
সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িটা আলোয় আলোময়৷ বন্ধ দরজা থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সবাই৷ যেন কোনও একটা মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল৷
আবার ধাক্কা৷ আবার ‘রাহুল৷ রাহুল৷’
কোকো ভয় পেয়ে রাহুলের হাত জড়িয়ে ধরল৷
বাপি কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ বললেন, ‘খুলে দিই৷ নইলে ওরা দরজা ভেঙে ফেলবে৷’
দরজা খুলতেই ওপিঠ থেকে জোরালো ধাক্কা মারল কেউ৷ একটা পাল্লা দেওয়ালে বাড়ি খেল৷ আর বাপি ছিটকে গেল একপাশে৷ একঝলক জোলো বাতাস ছুটে এল ভেতরে৷
বাপিকে তাচ্ছিল্যের ধাক্কায় সরিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল চারজন৷
চারজনের শরীরই জলে ভেজা৷ তার মধ্যে শুধু প্রথমজনকে চিনতে পারল রাহুল৷ মাকু৷ ভিজে চুল কপালে নেমে এসেছে৷ মুখে-চোখে বৃষ্টির জল পড়লেও ঘুমের ছাপ এখনও মুছে যায়নি৷ ওর চোয়াল নড়ছে৷ কী যেন চিবোচ্ছে৷
দ্বিতীয় লোকটা টাকমাথা৷ বেঁটে৷ দাড়ি-গোঁফ কামানো৷ ময়লা রোগাটে চেহারা৷ কুতকুতে চোখ৷ কালো প্যান্টের ওপরে একটা ঢোলা খয়েরি শার্ট৷ শার্টটা জলে ভিজে গাঢ় রঙের দেখাচ্ছে৷ হাতে সোনালি ব্যান্ডের একটা ঘড়ি৷
লোকটার সামনের ওপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু৷ ফলে একটা খরগোশ-খরগোশ ভাব এসেছে৷ হঠাৎ করে দেখলে মজার কমেডিয়ান বলে মনে হয়৷
কিন্তু আসলে যে তা নয় সেটা ওর হাতের গাঢ় নীল পিস্তলটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷
মাকু দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি—ওই যে রাহুল৷’ একইসঙ্গে রাহুলের দিকে চোখের ইশারা করল ও৷
মাস্টারজি কাশল দুবার৷ বাঁ-হাত দিয়ে বৃষ্টি-ভেজা মুখ মুছল৷ তারপর রাহুলদের দিকে চোখ রেখেই খেঁকিয়ে উঠে হুকুম দিল, ‘শিকলি, দরজাটা ভালো করে এঁটে দে৷ যেন পাবলিক ডিসটারবেন্স না হয়…৷’
হুকুমটা শোনামাত্রই সবচেয়ে পিছনে যে ছিল—শিকলি—সে দরজাটা বন্ধ করে খিল আর ছিটকিনি ভালো করে এঁটে দিল৷
মাস্টারজি ভেতরে ঢুকে এল৷ সুলতানের কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে নীচু গলায় একটা গালাগাল দিল৷ তারপর ওর থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে চওড়া হেসে বলল, ‘সালা, এটা তোর চায়ের দোকান?’ পরক্ষণেই গলা মিহি করে সুলতানকে নাটুকে ঢঙে ভেংচাল : ‘কোকোকে এখনও পাইনি, মাস্টারজি—খুঁজছি৷’
একটু থেমে শাসানির গলায় মাস্টারজি বলল, ‘‘করুণাময়ী’’-তে চল—তোর হিসেব নিচ্ছি৷’
সুলতান কাঁচুমাচু মুখে হাতজোড় করে বলল, ‘মাস্টারজি, মাপ করে দিন৷ গলতি হয়ে গেছে৷ প্লিজ, মাস্টারজি…৷’
মাস্টারজি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ‘মাপ করে দেব—অ্যাঁ? এতবড় গুস্তাকি মাপ করে দেব?’
চোখের পলকে হাতের পিস্তলটা সাঁ করে ঘুরিয়ে সুলতানের গালে বসিয়ে দিল মাস্টারজি৷
কালীপটকা ফাটার মতো শব্দ হল৷ সুলতানের গালে রক্তের রেখা দেখা দিল৷ সুলতান ‘ইয়া আল্লা’ বলে দু-হাতে মুখ চেপে মেঝেতে বসে পড়ল৷
মাম আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন৷ মাকুর চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া৷ আর বাপি তো পাথর!
রাহুল স্পষ্ট টের পেল কোকোর হাতটা থরথর করে কাঁপছে৷ ও মনে-মনে চাইছিল, মামের চিৎকারটা যেন প্রতিবেশীদের কেউ শুনতে পায়, যেন তারা সাহায্যের জন্য ছুটে আসে৷
কিন্তু কাকভোরে এই বৃষ্টির মধ্যে কে আসবে!
মাস্টারজি পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিল৷ অস্ত্রটা ঢোলা শার্টের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল৷
পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করল হিংস্র লোকটা৷ ঘাড় কাত করে সিগারেট ধরাল৷ ‘উঁ-উঁ’ করে শব্দ করল মুখে৷ তারপর ধোঁয়া ছাড়ল৷ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইয়ের বাক্স পকেটে ভরে কয়েকবার হেঁচকি তুলে হাসল৷
হঠাৎই যেন মাকুর কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভাব করে পিছনে তাকাল মাস্টারজি৷ তারপর ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ যেতে-যেতে পিস্তলটা আবার বের করে নিল৷
সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে মাকুর পিঠ চাপড়ে দিল মাস্টারজি : ‘ভাগ্যিস রেললাইনের ধারে এই ছোঁড়াটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ ওরা বসে-বসে তাস পিটছিল…’ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করল মাস্টারজি৷ ওটা মাকুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, ভাই—তোমার প্রাইজ মানি৷ তাস খেলায় তুমি জিতছিলে—আমার সঙ্গে এসে তোমার তো লস হয়ে গেছে৷ তো এই নোটটা দিয়ে পুষিয়ে নিয়ো—কেমন?’
মাকু টাকাটা পকেটে ভরে কাঠ-কাঠভাবে হেসে ঘাড় কাত করল : ‘থ্যাংকস—৷’
শুরুতে মাস্টারজির পিস্তলটা দেখামাত্রই বাপি আর মাম ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ওঁদের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি মাস্টারজি রাহুল কিংবা কোকোকে লক্ষ্য করে গুলি করে বসবে৷
কিন্তু এতক্ষণে বোধহয় বাপি একটু সাহস জুগিয়ে উঠেছিলেন৷ কোনও-রকমে আমতা-আমতা করে বললেন, ‘মাস্টারজি, আসুন—ঘরে এসে বসুন…৷’
‘হ্যাঁ, যাব…যাব৷’ সিগারেটে টান দিল৷ তারপর কোকোর দিকে তাকিয়ে : ‘কী, কোকো, কেমন আছিস?’
‘ভালো৷’ রাহুলের হাতটা পেঁচিয়ে ধরে থাকা অবস্থাতেই কর্কশ গলায় বলল কোকো৷ অনুভবে রাহুলের মনে হল, কোকোর কাঁপুনিটা এখনও রয়েছে৷
কোকোর দিকে এগোতে শুরু করল মাস্টারজি৷ সুলতান তখনও মেঝেতে বসে গোঙাচ্ছিল৷ মাকু, শিকলি, আর নাম-না-জানা একজন শাগরেদ বন্ধ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল৷
কোকোর গালে দুবার আদরের আলতো চাপড় মেরে মাস্টারজি বলল, ‘কোকো, মাই ডার্লিং৷ অ্যাদ্দিন পালিয়ে থেকে তোর কত লস হয়ে গেল বল তো! আমারও তো বহুত টাকা লোকসান হয়ে গেল৷ এখন চল, ওই লস পুষিয়ে দিবি…৷’
বাপি মাস্টারজির কাছে এসে অনুনয় করে বললেন, ‘আপনি প্লিজ ঘরে এসে বসুন৷ কোকোর ব্যাপারটা আপনাকে খুলে বলছি…৷’
কৌতুকের চোখে বাপির দিকে তাকাল : ‘কোকোর ব্যাপার খুলে বলবেন? আমাকে?’ শব্দ করে হাসিতে ফেটে পড়ল মাস্টারজি৷ সিগারেটে ঘন-ঘন টান মারল৷ সিগারেটের আগুনটা সেই টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল৷
‘না, না, আমাকে কিছু খুলে বলতে হবে না৷ আমি শুধু কোকোকে নিয়ে যেতে এসেছি৷ ও আমার৷’
মাস্টারজির কথার শেষে ‘ও আমার’ শব্দ দুটো মাম আর বাপিকে ভীষণ ধাক্কা দিল৷ রাহুলকেও৷ একইসঙ্গে ওর হাতের ওপরে কোকোর হাতের চাপ যে বেড়ে উঠল সেটাও রাহুল টের পেল৷
মাম প্রায় কান্না-কান্না গলায় মাস্টারজিকে বললেন, ‘ঘরে একটু বসুন৷ কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই৷ কোকোর…৷’
হাতের ইশারায় মামকে থামিয়ে দিল মাস্টারজি৷ পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, ‘বুঝেছি কী বলবেন৷ চলুন, ঘরে বসছি৷ কিন্তু আমার তাড়া আছে৷ বেশিক্ষণ টাইম দিতে পারব না৷’
বসবার ঘরে এসে বসল মাস্টারজি৷ বাপি সিলিং পাখাটা অন করে মাস্টারজির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন৷ মাম বাপির পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ রাহুল আর কোকো হাত-ধরাধরি করে ঘরে ঢুকল৷ দরজার কাছটিতে দাঁড়িয়ে রইল৷
খোলা দরজার দিকে একবার তাকাল মাস্টারজি৷ শিকলি, মাকু, সুলতান—ওদের দেখা যাচ্ছে৷ সুলতান এখনও বসে আছে, তবে গালে একটা রুমাল চেপে ধরেছে৷
জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা ঘরের এককোণে ছুড়ে দিল মাস্টারজি৷ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘জলদি বলুন—কী বলবেন৷’
‘কোকো আমাদের কাছে এই তিনমাস হল…’ বাপি শুরু করলেন, ‘ওকে আমরা…মানে…৷’
‘থাক, আর বলতে হবে না৷ বুঝেছি৷’ জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মাস্টারজি৷ একগোছা পাঁচশো টাকার নোট মুঠো করে বের করে নিয়ে এল৷
টাকাগুলো দেখেই বাপির মুখ লাল হয়ে উঠল৷ মাম ঘেন্নায় বলে উঠলেন, ‘ছিঃ! ছিঃ!’ তারপর আর সামলাতে পারলেন না—কেঁদে ফেললেন৷
বাপি এবার চোয়াল শক্ত করলেন৷ সুলতানের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো এবার বোধহয় মাস্টারজিকে বলা দরকার৷ মাস্টারজির কাছে যতই পিস্তল থাকে, ‘করুণাময়ী’র ওই নরকে কোকো কিছুতেই ফিরে যাবে না৷
‘আপনি কোকোকে নিয়ে গিয়ে কী করবেন আমরা জানি…’ এইটুকু বলার পরই সুলতানের দিকে চোখ পড়ল বাপির৷ সুলতান তখন বাপিকে কিছু না বলার জন্য কাতরভাবে ইশারা করছে৷
মাস্টারজি মামের দিকে দেখছিল, তাই সুলতানের সূক্ষ্ম ইশারা খেয়াল করেনি৷ বিরক্তভাবে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে : ‘এখন এসব সেন্টিমেন্টাল নাটক দেখার টাইম নেই৷’ হাতঘড়ির দিকে তাকাল৷ তারপর কোকোর দিকে : ‘অ্যাই! চল৷ ফালতু দেরি হচ্ছে—৷’
‘না, কোকো যাবে না৷’ রাহুলের মুখ দিয়ে কথাগুলো ফস করে বেরিয়ে এল৷
মাস্টারজি অবাক হয়ে রাহুলের দিকে তাকাল৷ সাপের মতো ঠান্ডা চোখে ওকে কিছুক্ষণ দেখল৷ তারপর ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘কোকো তোমার কে হয়, খোকা? বন্ধু? ওর সঙ্গে ভালোবাসা হয়েছে? লাভ স্টোরি?’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল মাস্টারজি৷
সেই হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কোকো কর্কশ গলায় বলে উঠেছে, ‘আমি যাব না৷ রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না—৷’
কোকোর কথায় মাস্টারজি হতবাক হয়ে গেল৷ চোখ গোল-গোল করে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল—যেন ভূত দেখছে৷
‘জানোয়ারটা দেখি কথা বলতে শিখে গেছে!’ চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলো বলল মাস্টারজি৷ নোটের গোছা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখল৷ তারপর পায়ে-পায়ে কোকো আর রাহুলের দিকে এগোল৷
খোলা জানলা দিয়ে সকালের আলো দেখা যাচ্ছে৷ বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক জোরে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে হাওয়ার ঝাপটা৷ কোথাও একটা খোলা জানলার পাল্লা দেওয়ালে মাথা কুটছিল৷ বৃষ্টির জলের রেণু বাতাসের তোড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছিল৷
রাহুলের কাছে এসে ওর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এল৷ রাহুল সিগারেটের কড়া গন্ধ পেল৷ সেইসঙ্গে মদের হালকা অপবাস৷
ও মুখ সরিয়ে নিতে গেল৷ তখন মাস্টারজি হিংস্র চাপা গলায় বলল, ‘কোকো আমার৷ ও আমার সঙ্গে যাবে৷ তুই ‘‘না’’ বলার কে রে?’
রাহুল একটুও দমল না৷ জেদি বাচ্চার মতো আবার বলল, ‘না, কোকো যাবে না!’
মাস্টারজি মাথা পিছিয়ে নিল৷ ভয়ংকর একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল রাহুলের গালে৷
সাইকেলের টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল৷ রাহুল কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে৷
মাম চিৎকার করে উঠলেন৷ সেইসঙ্গে বাপিও৷
আর কোকোর হাত বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল৷ পলকে মাস্টারজির টুঁটি চেপে ধরল৷ মাস্টারজি জলে তলিয়ে যাওয়া মানুষের মতো দু-হাত শূন্যে ছুড়ে খাবি খেতে লাগল৷
‘রাহুলকে মারবে না!’ কোকো পশুর মতো গর্জন করে উঠল৷
‘শিকলি! শিকলি!’ মাস্টারজি চেঁচিয়