রুকস্যাক থেকে টিভি বের করল। অন করামাত্রই উত্তেজনাময় রানিং কমেন্ট্রি। আর ক্লোজ-আপ ছবিতে প্রাোটন। পাথর খোদাই করা নিষ্প্রাণ মুখ।
‘…ফোকস, হাই অ্যাড্রিনালিন গেম এখন পিক-এ পৌঁছে গেছে। কারণ, সুপারহিরো জিশান এখন জোড়া পাহাড়ের হিল নাম্বার ওয়ান-এ, এইটি মিটার লেভেলে, আর কিলার প্রাোটন হিল নাম্বার ওয়ানের বেস-এ পৌঁছে গেছে।
‘হিল নাম্বার ওয়ান থেকে নামার পথ তিনটে। তার মধ্যে দুটো রাস্তা প্রাোটন গাড়ি দিয়ে ব্লক করে দিয়েছে। আর অন্য রাস্তা ধরে ও এখন মোটরবাইক নিয়ে পাহাড়ে উঠবে। সো, হেড টু হেড এনকাউন্টার ইজ ইনএভিটেবল। মোকাবিলা হচ্ছেই…।’
কিন্তু গাড়ি দিয়ে প্রাোটন দুটো রাস্তা ব্লক করল কেমন করে! ও একা দুটো গাড়ি আর একটা মোটরবাইক হিল নাম্বার ওয়ান পর্যন্ত নিয়ে এল কেমন করে! সুখারাম বা আরও কেউ কি ওকে হেলপ করেছে? এটাও কি শ্রীধর পাট্টার একটা সারপ্রাইজ?
এসব কথা ভাবতে-ভাবতে জিশান চটপট ট্র্যাকার বের করল। তারপর ট্র্যাকারের দিকে চোখ রেখেই হান্টিং নাইফ আর মিসাইল গান বের করে নিল রুকস্যাক থেকে।
ট্র্যাকারে সবচেয়ে কাছের লাল ডটটা ওর কাছ থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে রয়েছে। না, ‘দূরে’ রয়েছে না বলে ‘কাছে’ রয়েছে বলাটাই বোধহয় ভালো।
জিশান পাহাড়ের কিনারায় এসে খাদের দিকে তাকাল। পাহাড়ে ওঠার রাস্তাগুলোর শুরুর দিকটা দেখতে চাইল। কিন্তু না, দেখা যাচ্ছে না। গাছপালায় আড়াল হয়ে গেছে।
টিভিতে তখন জিশানের ছবি। পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সঙ্গে রানিং কমেন্ট্রি চলছে : ‘…নিজের মোটরবাইকের সঙ্গে দুটো গাড়ি চেন দিয়ে বেঁধে প্রাোটন টো করে হিল নাম্বার ওয়ান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তারপর রোড ব্লক করেছে। ঠিক যেন কোনও মানুষের মেইন আর্টারি ব্লক করে দেওয়া। সত্যি, বন্ধুগণ মানতেই হবে প্রাোটনের ব্রেন সুপারকুল…।’
জিশানের ঠিক পিছনে পাহাড়ের পাথুরে দেওয়ালে সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল।
ওর কানে তালা লেগে গেল। পাথরের ছোট-বড় টুকরো সপ্লিন্টারের মতো ছিটকে গেল চারিদিকে। ও চট করে একটা বোল্ডারের আড়ালে চলে গেল। প্রাোটনের অস্ত্রটা কী হতে পারে? লেসার টেলিশটার? নাকি হালকা, লং ডিসট্যান্স রাইফেল?
কয়েক সেকেন্ড পর গলা বাড়িয়ে নীচের দিকে দেখতে চেষ্টা করল। সঙ্গে-সঙ্গে ‘ক্র্যাক’ আওয়াজ। জিশান এক ঝটকায় মাথা নামাল। ওর পিছনের পাথর থেকে আবার স্টোন চিপস উড়ে গেল নানান দিকে।
জিশানও পালটা জবাব দিল মিসাইল গান দিয়ে। নীচের দিকে আন্দাজ করে চকিতে পরপর তিনবার ট্রিগার টিপল। তারপর ছুটে চলে গেল টিভি সেটের কাছে। হ্যাঁ, ওর আর প্রাোটনের অ্যাকশনের লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। প্রাোটনের কানে স্যাটেলাইট ফোন। বোধহয় সুখারামের সঙ্গে কথা বলছে। প্ল্যান আঁটছে।
এবার জিশানের ক্লোজ-আপ দেখা যাচ্ছে। সারা মুখে ঘাম। কোথাও-কোথাও রক্তের ছিটে। চুলে ধুলোর আস্তরণ।
কিন্তু সুখারাম এখন কোথায়? কতটা দূরে?
ট্র্যাকার দেখল। সুখারামের লাল ডটটা বেশ কিছুটা দূরে, কিন্তু এগিয়ে আসছে সবুজ ডটের দিকেই।
না, আর দেরি নয়। চটপট রুকস্যাকে ট্র্যাকার, টিভি সব গুছিয়ে নিল। হান্টিং নাইফ আর মিসাইল গান কোমরে গুঁজে নিল। তারপর রুকস্যাক পিঠে বেঁধে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করল। ছোট-বড় বোল্ডারকে ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, গাছের ঝুঁটি ধরে নিজেকে সামলে জিশান নামতে লাগল। নামার সময় প্রাোটনের পজিশন আন্দাজ করে নিজেকে পাথর কিংবা গাছের আড়ালে-আড়ালে রাখতে লাগল।
নামতে-নামতে ভাবছিল জিশান। পথ দিয়ে নয়, বিপথ দিয়েই ওকে পালাতে হবে, কিলার প্রাোটনকে এড়াতে হবে। তারপর অন্ধকারের অপেক্ষা।
কিন্তু জিশান যেরকম ভাবল, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম হল না।
নামার সময় বেশ বিপজ্জনক ঢাল ওকে ম্যানেজ করতে হচ্ছিল। ওর হঠাৎই মনে হল, যদি কোনওভাবে ওর পা স্লিপ করে তা হলে বিপদ তো হবেই, তার ওপর রুকস্যাকের টিভি, ট্র্যাকার, স্যাটেলাইট ফোন সবকিছুর বারোটা বাজবে। নতুন করে টিভি আর ট্র্যাকার জোগাড় করার ঝঞ্ঝাটের ব্যাপারটা মনে-মনে ভাবল। তারপর রুকস্যাকটা খুলে নামিয়ে দুটো বড় পাথরের খাঁজে লুকিয়ে ফেলল। জায়গাটা ভালো করে নোট করে মাথায় গেঁথে নিল। এবার মিসাইল গান আর হান্টিং নাইফ সম্বল করেই নামা যাক।
জিশান নামতে লাগল। পড়ে যেতে-যেতে টাল সামলাতে লাগল বারবার। আর দু-চোখ সরু করে প্রাোটনকে খুঁজতে লাগল।
প্রাোটনও জিশানকে খুঁজছিল। কিন্তু ও ভেবেছিল, জিশান তিনটে পাকদণ্ডীর একটা বেয়ে নামবে। ও যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার ঝুঁকি নেবে সেটা ভাবেনি। তাই জিশানকে প্রাোটন ট্র্যাক করতে পারেনি। মিনিট কয়েক খোঁজাখুজির পর প্রাোটন চুপ করে ভাবতে শুরু করল। জিশানের বুদ্ধির সঙ্গে নিজের বুদ্ধি খাপ খাওয়াতে লাগল। জিশানের স্ট্র্যাটেজি কী হতে পারে সেটা আঁচ করতে লাগল। আর চিবুক তুলে শকুনের চোখে পাহাড়ের ঢালের প্রতিটি কণা ছানবিন করতে লাগল।
প্রাোটন ভাবতে লাগল, ‘আমি জিশান হলে কোন এসকেপ রুট ব্যবহার করতাম?’ এবং মনে-মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলল।
একটু পরেই প্রাোটন যে-উত্তরটা খুঁজে পেল সেটা জিশানের সঙ্গে মিলে গেল। তাই পাহাড়ের গা বেয়ে প্রাোটন উঠতে শুরু করল। পিঠে রুকস্যাক। স্যাটেলাইট ফোনটা রুকস্যাকে চালান করে দিয়েছে। লেসার টেলিশটার আড়াআড়িভাবে দাঁতে চেপে ধরা। চোয়ালের রেখা উঁচু হয়ে চেয়ে আছে। লম্বা-লম্বা হাত-পা ব্যবহার করে এমনভাবে ও পাহাড় বেয়ে উঠছে যেন একটা কালো রঙের মাউন্টেন লায়ন।