- বইয়ের নামঃ বিকল্প বিপ্লব : যে ভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব
- লেখকের নামঃ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
বিকল্প বিপ্লব : যে ভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব
০. ভূমিকা / মুখবন্ধ
এই সংকলনের প্রবন্ধগুলি ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে লেখা হয় এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সাতটি প্রবন্ধ দুই লেখক একসঙ্গে লেখেন, বাকিগুলি তাঁরা এককভাবে লিখেছেন। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে লেখাগুলি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে প্রকাশের স্থান-কাল দেওয়া রইল।
সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে অনেক সময়েই কোনও ঘোষণা বা ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ধরা থাকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন বিষয় সামনে আসে, নতুন কোনও বিশ্লেষণ বেশি গুরুত্ব দাবি করে। কিন্তু তাকে জায়গা দিতে হলে তৎকালীন প্রতিক্রিয়ার স্বাদ-গন্ধ আর থাকে না। তাই প্রবন্ধগুলির মূল রূপটিই সংকলনে রাখা হল। প্রবন্ধের প্রেক্ষিতটুকু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন মতো তখনকার ঘটনা, আর তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রইল।
নানা সময়ে, নানা বিষয় নিয়ে লেখা হলেও এই সংকলনের সব প্রবন্ধের মূল প্রশ্ন এক। তা হল, দারিদ্র কমানোর জন্য যে সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যে টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে, তা বাস্তবিক গরিবের কতটা কাজে লাগছে? যেখানে তেমন কাজে লাগছে না, সেখানে কেন লাগছে না? এর কোনও বাঁধাধরা উত্তর নেই। কী কাজ করে, কী করে না, তার উত্তর খুঁজতে হলে বার বার যেতে হবে গ্রাম-শহরে গরিবের কাছে। নীতি-নির্ধারক, গবেষক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, কেউ এমন সরেজমিনে তদন্তের কাজটা এড়াতে পারেন না। ‘ফ্রি’-তে কিছু দিলে সেটা কাজে লাগবে না, কিংবা গরিবের মতামতকে গুরুত্ব দিলে কাজ ভাল হবে, এমন কোনও বাঁধাধরা ফর্মুলা যে কাজ করে না, তা নানা সমীক্ষা-বিশ্লেষণে বার বার স্পষ্ট হয়েছে। কী কাজ করে, তা একটি বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কষ্টিপাথরে বিচার করে নেওয়া দরকার। যে পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দর্শন এই যে, হাতেকলমে পরখ না করে দারিদ্র-নিরসনের প্রকল্পের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুরূহ। এই ধারণা থেকে অর্থনীতিতে গবেষণার একটি বিশিষ্ট ধারা ক্রমশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের বাইরেও, দারিদ্র-সম্পর্কিত নানা ধরনের কাজে যে তার চর্চা, অনুশীলন প্রয়োজন, সেই বিশ্বাস থেকে গণমাধ্যমের জন্য লেখা এই প্রবন্ধগুলি বই আকারে প্রকাশের এই উদ্যোগ।
আমরা ধন্যবাদ জানাই সেই সব গবেষকদের, যাঁদের কাজ থেকে নিষ্কাশিত সিদ্ধান্ত এইসব প্রবন্ধে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। সরকারি দফতর, বেসরকারি সংস্থার যে সব সহযোগীরা গবেষণা, সাংবাদিকতার কাজে সাহায্য করেছেন, তাঁদেরও কৃতজ্ঞতা জানাই। সর্বোপরি, গ্রাম-শহরের যে গরিব মানুষেরা নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, অসময়ে এসে-পড়া সাংবাদিক-গবেষকদের নানাভাবে সমাদর করেছেন, তাঁদের কাছে আমরা চিরঋণী।
ভূমিকা
অনাহারে দেহ যখন ভেঙে পড়ে, তখন মাথাও আর কাজ করে না। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে কলকাতার হাসপাতালে এমন এক উন্মাদকে দেখেছিলেন বাংলার সার্জেন-জেনারেল। দেহ কঙ্কালসার, ক্ষয়া দাঁতের অনেক উপরে গুটিয়ে আছে শুকনো ঠোঁট, গা-ময় ঘা। সামনে রাখা ভাত-তরকারির থালা। কিন্তু সে খাচ্ছে না, একটানা চেঁচিয়ে চলেছে। সাহেব ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন, ভাত চাইছে সে। সামনেই ভাত, তা বোঝার অবস্থা তার নেই।
তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি কম নেই। কলকাতার ফুটপাথে মৃতদেহ, মৃত শিশু কোলে মা, লঙরখানার লাইন, ডাস্টবিনে কুকুরে-মানুষ লড়াই। চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিনের স্কেচে, সোমনাথ হোরের ভাস্কর্যে, দ্য স্টেটসম্যান কাগজের ফটোগ্রাফে সেই নামহীন মুখহীন মানুষগুলো আকালের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। আজকের আলো-ঝলমলে কলকাতার পিছনে, ছবির নেগেটিভের মতো, সেই মন্বন্তরের শহর। রাজভবনের পরিধি ঘিরে সেদিন কে বা কারা মৃত আর মৃতপ্রায়দের পরপর শুইয়ে রেখে গিয়েছিল। পথে যেতে যেতে এক মেমসাহেব সেই কিলোমিটার-দীর্ঘ শবমালা দেখেছিলেন। তবু সার্জন-জেনারেলের রিপোর্টে যে লোকটিকে পাওয়া যায়, সে-ই যেন দুর্ভিক্ষের আসল ছবি। সেদিনও খাবার তো ছিল। প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নির্দেশে বাংলার বাজার থেকে, চাষির ঘর থেকে চাল কিনে নেওয়া হয়েছিল জোর করে। কাজে লাগতে পারে, এই ভেবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রয়োজনের চাইতে বেশি চাল মজুত করেছিল ব্রিটেন। খাস কলকাতার সরকারি গুদামে মজুত ছিল চাল, কালোবাজারি হয়েছিল দেদার। চাল পৌঁছয়নি শুধু বাংলার গ্রামে। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল ১৯৪২-৪৩ সালের মন্বন্তরে, সে চালের অভাবে নয়। চাল না পেয়ে।
দুর্ভিক্ষের পঁচাত্তর বছর হতে চলেছে। ভারত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েছে প্রায় সত্তর বছর। দেশের সরকার অনেক টাকা বরাদ্দ করে গরিবের জন্য। গরিবের অন্ন-আবাস-রোজগার, তার মেয়ের বিয়ে থেকে ছেলের ব্যবসা, সব কিছুর জন্য সরকার উপুড়হস্ত। ক্ষুধাকাতর মানুষের সংখ্যাও দ্রুত কমেছে— যাঁরা মনে করেন তাঁরা যথেষ্ট খেতে পান না, এমন মানুষ ১৯৮৩ সালে ছিল ১৭ শতাংশ, ২০০৪ সালে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। কিন্তু ভাতের থালার সামনে ভাতের জন্য আর্তনাদ আজও যেন দারিদ্রের প্রতীক। বিপুল বরাদ্দ সত্ত্বেও আজও এ দেশে, এ রাজ্যে, শিশুরা অপুষ্ট। আফ্রিকার গরিব দেশের তুলনায় ভারতের আর্থিক অবস্থা অনেক ভাল, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের চাইতে রোগা, বেঁটে, হালকা। ঘানার শিশুপুষ্টির হারে পৌঁছতে ভারতের ২০৩০ সাল হয়ে যাবে, চিনকে ছুঁতে ২০৫৫। আমাদের গরিব ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ স্কুল শেষ করে না। যারা স্কুলে যায়, তাদেরও অনেকের অক্ষর পরিচয় হয় না। পাকা বাড়ি, ভাল স্বাস্থ্য, নিয়মিত রোজগার, সুলভ ঋণ, যা কিছু গরিবকে স্বস্তি দিতে পারে, তার দারিদ্র কমাতে পারে, তার একটা বড় অংশই গরিব ছুঁতে পারেনি। অথচ থালা-ভরা ভাত-তরকারির মতো, তার জন্য সাজানো ছিল সব কিছুই। এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এক টাকা খরচ করা হলে ১৭ পয়সা পৌঁছয় গরিবের কাছে। দীর্ঘ উপবাসে উন্মত্ত মানুষ নয় ভাত চিনতে ভুল করেছিল। হৃষ্টপুষ্ট নেতা-আমলাদের কোথায় ভুল হচ্ছে? সরকার টাকা ঢালার পরেও গরিব কেন গরিব থেকে যাচ্ছে?
একটা মত হল, ভুল হচ্ছে রাজনীতিতে। রাজনীতির আদর্শ, তার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া ঠিক না হলে গরিবের জন্য ভাল ভাল প্রকল্প তৈরি করে লাভ নেই। রাজনৈতিক আদর্শ ঠিক হলে প্রকল্পও ঠিক হবে। তা যদি না হয়, তা হলে নীতি-প্রকল্প কখনওই ঠিকমতো কাজ করবে না। আগে রাজনীতি, তারপর অর্থনীতি। গরিবের কাছে কোনও দিন ৮৩ পয়সা যদি না পৌঁছয় তা হলে এক টাকা খরচ করার সেরা পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী করবেন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা? রাজনৈতিক ব্যবস্থার খোল-নলচে পালটে না দিলে গরিবের লাভ নেই। এক কথায়, বিপ্লব করতে হবে। তা সহজ নয়। কিন্তু দারিদ্রের মতো বৃহৎ সমস্যার সমাধান ছোটখাটো উপায়ে হবে না, তার জন্য সামাজিক বিপ্লবের মতো ‘বৃহৎ’ উত্তরই চাই। সরকার ফেলে দিতে হতে পারে, আইন বা বিধিব্যবস্থা বদলাতে হতে পারে।
সার্বিক বিপ্লবের কথা অনেকে বলেছেন, অন্তত কার্ল মার্ক্সের সময় থেকে তা রীতিমতো পরিচিত হয়ে উঠেছে। তারপরেও অর্থনীতির চর্চায় এমন ‘সার্বিক পরিবর্তন’-এর পক্ষে সওয়াল করেছেন অনেকে। যদিও তা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে।
একটি মত বলে, গরিব দেশ যে গরিব থেকে যায়, তার কারণ তাদের বিধিব্যবস্থাগুলো খারাপ। আইন, সরকারি নীতি, সামাজিক নীতি, এগুলো বৈষম্য, নির্যাতন, অদক্ষতা, আলস্যকে প্রশ্রয় দেয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন, আফ্রিকা বা এশিয়ার যেসব দেশে রোগের আধিক্য বা অন্যান্য কারণে ইউরোপীয়রা নিজেরা বসবাস করেনি, দূর থেকে শাসন চালিয়েছে, সে সব কলোনিতে বিধিব্যবস্থা ছিল অতি খারাপ। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ ইউরোপীয়রা সে সব দেশ থেকে যথাসম্ভব কম খরচে যথাসম্ভব বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে সব জায়গায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা, আইনের শাসন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ, কিছুরই ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। বেলজিয়মের কলোনি আফ্রিকার কঙ্গো দেশটি এর একটা উদাহরণ। সে দেশ থেকে নিয়ে-যাওয়া সম্পদের হিসেব করে এক গবেষক বলেছিলেন, ১৯২০-৩০ সালে কঙ্গোর মানুষ কার্যত নিজেদের আয়ের ৬০ শতাংশ কর দিচ্ছিল। ভারতে নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের কথা মনে করলে এর খানিকটা আন্দাজ মেলে। সাধারণত ইউরোপীয়রা কিছু ক্ষমতাশালী স্থানীয় লোকের হাতে কলোনি চালানোর ভার দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ওই সব লোকেরা আগের ব্যবস্থাই চালিয়ে গেল, কারণ সেটাই তাদের কাছে লাভজনক। সিয়েরা লিয়ন, সেনেগাল, কঙ্গো, আফ্রিকার এই সব দেশে বিধিব্যবস্থাগুলো কার্যত আগের মতোই রয়ে গেল, দারিদ্রও ঘুচল না।
তবে কি খারাপ বিধিব্যবস্থা, আর তা থেকে দারিদ্র, এই চক্র থেকে বেরোনোর উপায় নেই? অর্থনীতির দুই অধ্যাপক ডারন অ্যাসেমোলু এবং জেমস রবিনসন মনে করেন, অসম্ভব নয়, তবে কঠিন। সমাজের নানা শক্তি যদি একত্র হয়, আর ভাগ্যও যদি সহায় হয়, তবে হতে পারে। পরিবর্তনের দুটি উদাহরণ তাঁরা দিয়েছেন, ইংল্যান্ডের ‘গৌরবময় বিপ্লব’ আর ফরাসি বিপ্লব। দু’দেশেই বিপ্লবের ফলে রাজার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা খর্ব হয়, নাগরিকের অধিকার বাড়ে। দেশের বিধিব্যবস্থার মোড় ঘুরে যায়। মুশকিল হল, দুটো উদাহরণই কয়েকশো বছর আগের। এমন বিপ্লব আবার কবে হবে, আমাদের কারও জীবদ্দশায় হবে কিনা, তা বলা মুশকিল।
মন্দ বিধিব্যবস্থার বদলানো যে সহজ নয়, তা স্বীকার করেছেন অ্যাসেমোলু আর রবিনসন। তাঁদের চাইতে বেশি আশাবাদী পল কোলিয়র। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের বক্তব্য, চ্যাড, কঙ্গোর মতো গোটা ষাটেক দেশ মন্দ বিধিব্যবস্থার জন্য দারিদ্রের কবলে পড়ে থাকছে। দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন একশো কোটিরও বেশি মানুষ। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর কর্তব্য সে দেশগুলোর ব্যবস্থাগুলো বদলিয়ে দারিদ্র দূর করা। দরকার হলে সামরিক সাহায্য পাঠিয়ে তা করতে হবে। ব্রিটেন ২০০০ সালে সিয়েরা লিয়নে গৃহযুদ্ধের সময়ে সৈন্য পাঠিয়েছিল বলেই না সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার টিকে গিয়েছিল।
কিন্তু বাইরে থেকে কি এমন করে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া চলে? সে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ইস্টারলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিল। তার ফল কী ভয়ানক হয়েছিল তা কারও জানতে বাকি নেই। ইস্টারলির আপত্তি, উপর থেকে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? কেন ধরে নেব, একই ছাঁচে পরিবর্তন সবার জন্য কাজ করবে? কিছু ‘এক্সপার্ট’ লোক স্থানীয় পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করে বাইরে থেকে সব কিছু বদলে দিতে গেলে তাতে হিতে বিপরীত হবে। সংস্কার যদি হয়, তা হবে ধীরে ধীরে। স্থানীয় মানুষের ভিতর থেকেই তা আসবে।
ইস্টারলি তাই বিদেশি অনুদান দিয়ে দারিদ্র ঘোচানোর ঘোর বিরোধী। কারণ গরিব দেশকে অনুদানের টাকা যে দেয়, সে ওই দেশের রীতিনীতিও বদলানোর চেষ্টা করে। তাঁর মতে, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকেই বরং ‘এক্সপার্ট’ বা বিশেষজ্ঞ বলে ধরে নেওয়া হোক, যাঁরা নিজেদের প্রয়োজন মতো নিজেরাই সংস্কার আনবেন। তাঁদের শুধু দরকার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যা দেবে মুক্ত বাজার। দক্ষতার অভাব, পুঁজির অভাবের জন্য গরিবের পক্ষে বাজারে যোগ দেওয়া সহজ নয়। তাদের সেই সক্ষমতা আনতে সরকারি সহায়তা চাই। বাজার যাতে যথার্থই বিঘ্নহীন, পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে পারে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাও সরকারের কাজ। ব্যস, ওইটুকুই। আর কোনও বদল চাপানো যাবে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু পরিবর্তন, তা উঠে আসবে নীচ থেকে। সকলকে সমান সুযোগ, সমান অধিকার দেওয়ার জন্য প্রচার চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বাইরে থেকে আর কিছু করার নেই।
ইস্টারলি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কয়েক কিলোমিটার দূরে নিউ ইয়র্ক শহরেই রয়েছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার অর্থনীতির অধ্যাপক জেফ্রি সাকসের তাত্ত্বিক অবস্থান কিন্তু ইস্টারলির থেকে হাজার মাইল দূরে। ইস্টারলির বক্তব্যের অনেকটাই বস্তুত জেফ্রি সাকসের তত্ত্বের বিরোধিতা।
সাকসের মতে, দারিদ্র ঘোচাতে হলে বাইরে থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া নেহাতই আবশ্যক। মন্দ আর্থিক দশার জন্যই গরিব দেশের প্রশাসন এত মন্দ। গরিব দেশে মানুষের শিক্ষা কম, সামাজিক সংগঠনগুলো দুর্বল। ফলে যে টাকায় গরিবের উন্নয়ন হতে পারত, তা নষ্ট হয় দুর্নীতিতে। দারিদ্র থেকে দুর্নীতি, আর দুর্নীতি থেকে দারিদ্রের একটা দুষ্টচক্র চলে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ সংস্থা দুর্নীতির নিরিখে সব দেশের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে গরিব দেশগুলিই যে নীচের দিকে থাকে (সব শেষে বাংলাদেশ আর আফ্রিকার চ্যাড) সেটা কাকতালীয় নয়। যেখানে মানুষের টাকা কম, সেখানে তাদের শিক্ষা কম, মিডিয়া কমজোরি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দুর্বল। ফলে সরকারের উপর নজরদারির ক্ষমতা কম। তাই সে সব দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বেশি। তাঁর প্রস্তাব, গরিব দেশকে ধনী দেশ টাকা দিক দারিদ্র কমাতে। টাকা আসুক একেবারে নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য, যেমন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, বেশি খাবার উৎপাদন, বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচ ও নিকাশির উন্নতি। তার সুবিধে, কাজ হচ্ছে কিনা তা সহজেই নজর করা যাবে। এমন নানা প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে গরিবের জীবনের মানে উন্নতি হলে দেশের নাগরিক সমাজ শক্তিশালী হবে। সরকারের উপর তার নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি বাড়বে। সরকারের পক্ষেও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হবে। দুর্নীতিও কমবে, দারিদ্রও কমবে।
এমন ভাবে এক একজন এক-একটা পদ্ধতির কথা বলেছেন। কিন্তু এঁরা সকলেই ‘আমূল সংস্কার’ চান। রাজনৈতিক অভ্যুত্থান থেকে অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার মোড় ঘোরানো, যুক্তির দিক থেকে কোনওটাই মন্দ নয়। কিন্তু একটু ভাবলে স্পষ্ট হয়, এর সবগুলোই খুড়োর কল। সার্বিক পরিবর্তনের লক্ষ্য সামনে রেখে হেঁটেই যেতে হবে। তার নাগাল পাওয়া যাবে কবে তা কেউ জানে না। ফরাসি বিপ্লবের মতো আর একটা বিপ্লব আবার কবে হবে, কে বলতে পারে? যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন চালাচ্ছেন, তাঁরাও বলতে পারবেন না কখন তা সামগ্রিক বিপ্লবে পরিণত হবে। বলশেভিক বিপ্লব তার ইঙ্গিত দেয়। কমিউনিস্ট বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল এমন দেশে যেখানে পুঁজিবাদ চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে। গোটা বিশ্বে তা একসঙ্গে হবে, মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ১৯২০ সালে তা ঘটল কেবল রাশিয়ায়, যেখানে পুঁজিবাদ সেভাবে কায়েমই হয়নি। বলশেভিকদের জয় যে অপ্রত্যাশিত ছিল, তাঁরা যে তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, একথা লেনিনই লিখে গিয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন কবে সার্বিক বিপ্লবে পরিণত হবে, কবে তা সমাজের সব বিধিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বড়সড় একটা আন্দোলন যদি বা ঘটে, যদি তা দেশের প্রতিষ্ঠিত বিধিনিয়মকে আঘাতও করে, তা হলেও শেষ অবধি তার ফল কী হবে তা বলা কঠিন। যে উদ্দেশে আন্দোলন শুরু হয়, প্রায়ই দেখা যায় তার উলটোটা হয়। হিটলার নিজেকে ‘সোশ্যালিস্ট’ বলে দাবি করেছিলেন, তাঁর দলের নামও ছিল ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি।’ গোড়ার দিকে সে দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা তাঁকে সমর্থনও করেছিলেন। প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের সমর্থনে ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্ট এবং সোশ্যালিস্টদের উপর হিটলার যে নির্যাতন চালিয়েছিলেন, তাঁদের যেভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তা কারও অজানা নয়।
বিধিব্যবস্থার খোলনলচে বদলের চেষ্টা কার্যকরী হবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ‘হোলসেল’ পরিবর্তন আনার চেষ্টাতে যেমন বিপদ আছে, তেমনই ‘কোনও একদিন ভিতর থেকে বদল আসবে’ বলে কোনও কিছু না করার বিপদও থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসের একটা শিক্ষা হল, খারাপ বিধিব্যবস্থা একবার চালু হয়ে গেলে তা আর সহজে নড়ানো যায় না। আইন-বিধি বদলে দিলেও সামাজিক সম্পর্কে, প্রশাসনের কাঠামোয়, রাজনৈতিক রীতিনীতিতে তার রেশ থেকে যায়। যা গরিবের প্রতি বৈষম্য, বঞ্চনাকে জিইয়ে রাখে। প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেমন আফ্রিকার কিছু দেশের কথা বলা হয়েছে আগেই। অন্য দিকে, এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, খারাপ বিধিব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে ভিতর থেকেই। যেমন ১৮৮০ থেকে ১৯২০, এই সময় জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল দুর্নীতির রমরমা। যে সব বড় বড় ব্যবসায়ী তখন দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, স্টিল, কয়লা, তামাক, তেল, রেল রাস্তা নির্মাণের সেই কারবারিদের তখন বলাই হত ‘ডাকাতে ব্যবসায়ী’ (রবার ব্যারন)। কিন্তু সেই ব্যাপক দুর্নীতি বেশি দিন চলতে পারেনি। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রচেষ্টায় যে দুর্নীতি কমেছিল, তা কিন্তু নয়। বরং ওই সময়ে অনেকগুলো পরস্পর সম্পর্কহীন পরিবর্তন ঘটেছিল। যেমন ইউরোপ থেকে প্রচুর মানুষ এলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যাঁদের একটা বড় অংশ শিক্ষিত এবং বামপন্থী মানসিকতার লোক। তাঁরা ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং দুর্নীতিকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ওই সময়ে শিক্ষার হারও দ্রুত বেড়েছে। লোকে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল বেশি। খবরের কাগজগুলিও পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করে দুর্নীতির খবর ছাপতে শুরু করল। ভিতর থেকেই ক্রমশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করল। তখনও অসৎ উদ্দেশ্যে, অসৎ উপায়ে পরিবর্তন রুখে দেওয়ার চেষ্টা খুব কম লোকে করেনি। কিন্তু পরিবর্তন রুখতে পারেনি। আজও যে কোনও বিধিব্যবস্থাকে বিকৃত, অকেজো, অদক্ষ করে রেখে নিজের কোলে ঝোল টানার মতো লোক কম নেই। তাদের অনেকে মস্ত ক্ষমতাবান, তা-ও সত্যি। কিন্তু একটা দেশ, একটা সমাজের ব্যবস্থা এত বিচিত্র ও বহুমাত্রিক যে তার সম্পূর্ণটা নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। নানা পরিবর্তন ক্রমাগত ঘটতেই থাকে, এবং কোনও এক সময়ে নানা সু-সংযোগের ফলে তা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও তখন পরিবর্তন রোখা যায় না।
সমাজ ও দেশের এই বিচিত্র, বহুমুখী, সতত-পরিবর্তনশীল চরিত্রকে হিসেবের মধ্যে না ধরে যাঁরা মনে করেন, কোনও এক ভাবে ঘটনাস্রোতকে বইয়ে দিতে পারলে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাবে, সমাজ কোনও এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, তাঁরা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন বারবার। কার্ল মার্ক্স শ্রেণি সংঘাতের যে তত্ত্ব দিয়েছেন, সেখানে সমস্যা নেই। সমস্যা ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণা, যা প্রশ্নাতীতভাবে দেখিয়ে দিতে চায় ইতিহাস কোন পথে চলবে।
জেফ্রি সাকস বিপুল আর্থিক অনুদান দিয়ে দারিদ্র ঘোচানোর যে পথ দেখিয়েছেন, সেখানেও তেমন গোল বেধেছে। মার্ক্সের মতোই সাকস-ও মনে করেন যে ইতিহাসের গতি কোন দিকে তার সুনির্দিষ্ট ধারণা করা সম্ভব। কোন সময়ে, কী পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলে কোন দিকে ভবিষ্যতের ঘটনাক্রম যাবে, তা বলে দেওয়া যায়। গোল বাঁধে তখন, যখন দেখা যায় যে তেমন বাতলে-দেওয়া পদ্ধতি প্রয়োগ না করেও পরিবর্তন আসছে।
যেমন, গরিবের জীবনের মান ভাল করতে যেসব প্রকল্পের কথা তিনি বলেছেন তা যে দারিদ্র, দুর্নীতিপূর্ণ দেশে ব্যাপক আকারে প্রয়োগ করা যাবে, তা কি ধরে নেওয়া চলে? অথচ তা না করে গেলে পরিবর্তন কী করে সম্ভব? ধরা যাক একটা দেশের কথা— উগান্ডা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসেব মতো ২০১০ সালে উগান্ডা ছিল দুর্নীতির সূচকে ১৭৮টা দেশের মধ্যে ১২৭। সাকসের দারিদ্র-দুর্নীতি চক্রের তত্ত্ব মেনে নিলে বলতে হয়, যতদিন না দুর্নীতি কমছে, ততদিন গরিবের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়।
॥ ২ ॥
অথচ আমাদের চারদিকে তেমন ‘অসম্ভব’ ঘটনাই ঘটে চলেছে। ধরা যাক উগান্ডার গল্পটাই।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি আফ্রিকার উগান্ডাতে কাজ করতে গিয়ে ইউরোপের দুই গবেষক দেখেন, সে দেশে সরকার স্কুলগুলোর উন্নয়নের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করছে, গড়ে তার মাত্র ২৪ শতাংশ পৌঁছচ্ছে তাদের কাছে। গরিব স্কুলগুলো পাচ্ছে আরও কম টাকা। বহু স্কুল কোনও টাকাই পাচ্ছে না। যেমনটা হয়ে থাকে, তা-ই হচ্ছে— সরকারি কর্মী আর নেতারা সরিয়ে ফেলছে বেশির ভাগ টাকা। বিষয়টা জানাজানি হতে সে দেশের সরকার একটা অন্য ধরনের উদ্যোগ নিল। কোন স্কুলের জন্য কত টাকা মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে, তা প্রতি মাসে ছেপে দিতে লাগল খবরের কাগজে। এ হল ১৯৯৬ সালের কথা। ২০০১ সালে ফের খোঁজ করে ওই গবেষকরা দেখলেন, এখন গড়ে স্কুলগুলো পাচ্ছে মঞ্জুর-করা টাকার ৮০ শতাংশ। যে স্কুল খবরের কাগজের দোকানের যত কাছে, সে তত বেশি টাকা পাচ্ছে। আরও দেখা গেল, কম টাকা পাওয়ার জন্য যে হেডমাস্টার মশাইরা অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই শেষ অবধি প্রাপ্য টাকা পেয়েছেন। তার জন্য তাঁদের কোনও হয়রানি সইতে হয়নি। যে সব খবরের কাগজগুলো স্কুলের বরাদ্দ নিয়ে রিপোর্ট ছেপেছিল, তাদেরও কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। বোঝা গেল, কেউ যে স্কুলের জন্য বরাদ্দ টাকার বিষয়টা খেয়াল করছিল না, তার সুযোগ নিয়ে নির্ভয়ে চুরি চালাচ্ছিল সরকারি কর্মীরা।
এই গবেষণা কেবল চুরি কমায়নি, তা একটা অন্য সম্ভাবনার নির্দেশ করছে। দুর্নীতির তালিকায় একেবারে নীচের দিকে ছিল উগান্ডা। সেই দেশেও হেডমাস্টার মশাইরা দুর্নীতি রুখে দিতে পেরেছেন। রাজনৈতিক বিপ্লব হয়নি, সার্বিক বিধিব্যবস্থার বদল হয়নি। তবু পরিবর্তন হয়েছে।
এমন দৃষ্টান্ত চারপাশে। গরিব দেশগুলোতেও মানুষের আয়ু বাড়ছে, সাক্ষরতার হার বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে। যে দিক থেকেই হিসেব করা যাক, চরম দারিদ্রে বাস করা মানুষের সংখ্যা গত দশ বছরে অনেকটাই কমেছে। সে দিনের মতো দুর্ভিক্ষ আজ নেই, প্লেগ কিংবা কলেরায় গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হওয়ার ঘটনাও এখন অতীত। অথচ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর রয়ে গিয়েছে, দুর্নীতি উপড়ে ফেলা যায়নি, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যের মতো সামাজিক সমস্যাও থেকে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও গরিবের জীবনে যতখানি উন্নতি হয়েছে, কোনও বিচারেই তাকে নগণ্য বলা চলে না।
কী করে এই উন্নতি আসছে? গরিবের জীবনে এমন উন্নতি আসছে ছোট ছোট পরিবর্তন থেকে। উগান্ডায় খবরের কাগজে মঞ্জুর-করা টাকার পরিমাণ ছাপার ফলে প্রকল্পের ফাঁকটা ভরে গিয়েছিল, তাই দুর্নীতি বন্ধ হয়েছিল। তেমনই, গরিবের জন্য তৈরি করা প্রকল্পের নকশায় কোথায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা যদি চিহ্নিত করে সেগুলো আটকানো যায়, তা হলে টাকা অপচয় আটকানো যাবে। যদি প্রকল্পের নিয়মিত মূল্যায়ন হয়, টার্গেটের সঙ্গে বাস্তবটা মিলিয়ে দেখা হয় বারবার, তা হলে ফাঁকগুলো ধরা পড়বে। প্রকল্পের পরিকল্পনায়, রূপায়ণে, মূল্যায়নে যদি অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া যায়, তা হলে অপচয়, অদক্ষতা অনেকটাই রুখে দেওয়া যাবে। গত বছর পনেরো যা কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে বিশ্বের নানা গরিব দেশ থেকে, তাতে ইঙ্গিত মিলছে যে দারিদ্র কমানোর জন্য কার্যকর উপায় এমন ছোট ছোট পরিবর্তন নিয়ে আসা, যা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বাড়াতে পারে, দুর্নীতি কমাতে পারে। এগুলো করা গেলে বিধিব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তন না এলেও দারিদ্র কমানো যাচ্ছে।
যেমন ব্রাজিলে দেখা গিয়েছে, প্রযুক্তিতে সামান্য পরিবর্তন অনেকটা বদল আনতে পারে গরিবের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতায়। সে দেশে আগে ভোট দেওয়ার নিয়ম ছিল, প্রার্থীদের নামের লম্বা তালিকা পড়ে নিজের প্রার্থীর নাম বা নম্বরটি বেছে নিয়ে তা লিখতে হবে। তারপর সেই ব্যালট পেপার বাক্সে ফেলতে হবে। স্বভাবতই এই ব্যবস্থায় সব চাইতে অসুবিধে গরিবের, কারণ লিখতে-পড়তে অসুবিধে তাদেরই বেশি। যে-কোনও নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোট বাতিল হত। অর্থাৎ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কার্যত ভোটাধিকার ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শেষে ইলেকট্রনিক ভোট মেশিন এল। প্রধানত গোনার সুবিধের জন্যই তা আনা হল, কিন্তু তাতে সুবিধে হল গরিবের। ভোট দেওয়া সহজ হওয়ায় তাদের ভোট আগের চাইতে অনেক বেশি গোনা হল। তাদের পছন্দের প্রার্থী— যাঁরা নিজেরা গরিব— আরও বেশি নির্বাচিত হলেন। জনস্বাস্থ্যমূলক প্রকল্পে টাকা খরচ বাড়ল। ১৯৯৪-২০০৬ সালের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে গবেষকরা বললেন, গরিব মায়েদের কম-ওজনের সন্তান প্রসবের হার কমেছে। নতুন প্রযুক্তিতে ভোটের জন্যই এমন হচ্ছে, দাবি করেছেন তাঁরা।
এমনকী অগণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও যখন নির্বাচনের কিছু কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে গরিবের প্রতি দায়বদ্ধতা বেড়েছে। চিনের গ্রামীণ প্রশাসনে নির্বাচন, সুহার্তোর অধীনে ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন, কিংবা আরও সম্প্রতি সৌদি আরব, ইয়েমেন, ভিয়েতনামে একেবারে নীচের স্তরে নির্বাচন শুরু হয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে এই সব নির্বাচন বিদ্রুপের বিষয়। যেখানে দল বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসক প্রার্থী ঠিক করে দিচ্ছে, নির্বাচন কর্মীদের স্বাধীনতা নেই, নির্বাচনে যথেচ্ছ রিগিং হয়, সে আবার কী নির্বাচন? কিন্তু এমন আধখ্যাঁচড়া নির্বাচনের পরেও দেখা গিয়েছে, নিচুস্তরের সেই প্রশাসন গরিবের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে। চিনে দেখা গিয়েছে, যে সব জায়গায় ভোট করে স্থানীয় সরকার নির্বাচিত হয়েছে সেখানে এক-সন্তান নীতি শিথিল হয়েছে, চাষের জমি বণ্টনে ছোট চাষি লাভবান হয়েছে বেশি।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো একেবারেই একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। আধুনিক বিশ্বের সব চাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের একজন তিনি। কিন্তু তেল থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে তিনি দেশে প্রচুর স্কুল খুলেছিলেন, শিশুপুষ্টিতেও বহু টাকা খরচ করেছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় শিশু অপুষ্টি অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। যে প্রজন্ম শিক্ষার এই সুবিধে পেল, পরবর্তীকালে তাদের রোজগার অনেকটাই বেড়েছিল, তার সাক্ষ্য মিলেছে গবেষণায়।
তার মানে এই নয় যে, চিন বা ইন্দোনেশিয়ার অগণতান্ত্রিক প্রশাসন সে দেশের গরিবের পক্ষে ভাল ছিল। গণতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। তার স্বতন্ত্র মূল্য রয়েছে। গণতন্ত্র, সাম্য, বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকারকে পূর্ণ মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে। তবে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও নেতারা কখনও কখনও এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে দারিদ্র দ্রুত কমেছে। গরিবের বাস্তবিক উপকার হয়েছে। দারিদ্র নিরসনের উপায় নিয়ে চিন্তা করতে হলে গণতন্ত্র কবে আসবে, ভূমিসংস্কার কবে হবে, লিঙ্গবৈষম্য কবে ঘুচবে, সে প্রশ্নগুলোতে আটকে গেলে চলে না। বৃহৎ, মৌলিক এই বিধিব্যবস্থাগুলোর পরিবর্তন কবে হবে, সে আশায় বসে থাকার দরকারও নেই। স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরাও কখনও কখনও এমন সিদ্ধান্ত নেন, যাতে গরিবের জন্য কাজ করার একটা সুযোগ তৈরি হয়। গণতন্ত্র অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দারিদ্র নিরসনের উপায় যিনি খুঁজছেন, তিনি এ কথা ভেবে বসে থাকতে পারেন না যে ‘গণতন্ত্র কবে আসবে’ বা ‘দেশের সব মানুষ কবে শিক্ষিত হবে’ সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে। উপায় সন্ধান করে লাভ নেই। বিশেষত যাঁরা সার্বিক পরিবর্তন বা বিপ্লবের কোনও না কোনও মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন তাঁদের কেউ কেউ ভাবেন, বড় পরিবর্তন না আনতে পারলে ছোট ছোট সমস্যার ছোট ছোট সমাধান খোঁজ করে কী লাভ? কোন দিকে পরিবর্তন যাচ্ছে তা না বুঝে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে কী হবে? এ হল হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা। হাতের কাছে যে উপায়গুলো রয়েছে, যে সামর্থ্য-সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে দারিদ্র নিরসনের কাজ শুরু করা জরুরি। এবং সেটা ‘সামান্য’ না-ও হতে পারে। সে প্রসঙ্গ একটু পরেই আসছে।
এখানে যা স্পষ্ট করা দরকার তা হল, দারিদ্র কমানোর নীতি বা প্রকল্প যে সম্পূর্ণ রাজনীতি দিয়ে নির্ধারিত হয়, এমনটা নয়। মন্দ রাজনৈতিক আবহেও ভাল নীতি তৈরি হতে পারে। আবার অতি উত্তম রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থাতেও (যেখানে নিয়মিত ভোট হয়, বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত, বিকেন্দ্রীকরণ রয়েছে) অকেজো, অপচয়বহুল নীতি তৈরি হতে পারে। তার কারণ, ‘সর্বশিক্ষা’ বা ‘জননীসুরক্ষা’-র মতো প্রকল্প বাস্তব রূপ পায় অগণিত ছোট ছোট বিধিব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। সরকারি কর্মীদের দৈনন্দিন কাজের অভ্যাস কী, তাঁদের থেকে দফতরের প্রত্যাশা কী, শিক্ষক বা চিকিৎসক-নার্সদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত (বা প্রশ্রয়প্রাপ্ত) কাজের রীতিনীতি কী, প্রকল্পের উপর নজরদারির জন্য পঞ্চায়েত, পুরসভা, স্কুল-হাসপাতালের কমিটি তৈরির রীতিনীতি, প্রকল্পের অডিট করা ও তার ফল প্রকাশের নিয়ম, এই সব কিছুর উপরেই প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করবে। এই সব ছোট ছোট বিধিব্যবস্থার ফাঁকফোকর ভরে দিতে পারলে প্রকল্পের সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়। কখনও প্রযুক্তি বদলে, কখনও মানুষকে বাড়তি তথ্য দিয়ে, কখনও নিয়ম-কানুনে সামান্য রদবদল করতে পারলে শিশুমৃত্যু কমতে পারে, শিশুরা লিখতে-পড়তে পারে বেশি। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলিতে যে সব গবেষণার উল্লেখ রয়েছে, সেগুলি এমন কার্যকরী বদলের দৃষ্টান্ত।
মনে হতে পারে, দারিদ্রের মতো বিপুল, গভীর সমস্যার সমাধান কি এমন ছোটখাটো পরিবর্তনের দিয়ে আসতে পারে? তার উত্তর: হ্যাঁ, পারে। কারণ কোন পরিবর্তনটা ছোট, আর কোনটা বড়, তা ইতিহাসই স্থির করে। দীর্ঘদিন পরে। আজ যেটাকে সামান্য মনে হচ্ছে, কোনও একদিন দেখা যেতে পারে সেটা বৃহৎ, মহৎ পরিবর্তন। আজ তার মহত্ত্ব আন্দাজ করার কোনও উপায় নেই। ধরা যাক পরিবর্তনের একটা দৃষ্টান্তের কথা, যা অ্যাসেমোলু এবং রবিনসন উল্লেখ করেছেন: ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব। সেই সময়ের দৃষ্টিতে যদি দেখা যায়, তবে উত্তেজিত হওয়ার মতো সামান্যই ঘটেছিল সে বছর। কয়েকটা ছোটখাটো সংঘর্ষের পর রাজা দ্বিতীয় জেমস ইংল্যান্ড ছেড়ে চম্পট দিয়েছিলেন ফ্রান্সে। প্রাণক্ষয় হয়েছিল অতি সামান্যই, যার জন্য অনেকে একে ‘রক্তহীন বিপ্লব’ বলতেন। তখনও কিন্তু লোকের স্মৃতিতে জাগরূক ব্রিটেনের গৃহযুদ্ধ, পার্লামেন্টের সৈন্যদের হাতে ১৬৪৭ সালে রাজা প্রথম চার্লসের পরাজয়, এবং শেষ অবধি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে রাজার মুণ্ডচ্ছেদ। সেদিন নিশ্চয়ই সেটা অনেক বেশি ভয়ানক, অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ ঐতিহাসিকরা যাকে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ বলেন, তার শুরু হয়েছিল প্রায় রক্তপাতহীন যুদ্ধে। তার জেরে ‘বিল অব রাইটস’ বা নাগরিকের অধিকারের সনদ লেখা হয় ১৬৮৯ সালে, যাকে ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র সূচনা বলে দেখা যেতে পারে। অতএব ইতিহাস কোন পথে যাচ্ছে, কোন মোড় ঘুরে কোথায় পৌঁছবে, তা আগাম আন্দাজ করার চেষ্টা না করাই ভাল।
বরং হাতের কাছে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, ছোটবড় বিচার না করে তার সমাধান খোঁজা চাই। কিংবা, সেই সব সমস্যার সমাধানে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কেন কাজ করছে না তা বোঝা চাই। সেই চেষ্টা শুরু করলে দেখা যায়, বহু প্রকল্প যে সদিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয় তার কারণ তিনটি— আদর্শ, আন্দাজ আর আলস্য।
আমাদের দেশে ‘পলিসি’ বা নীতি বলতে লোকে যেটা বোঝে, প্রায়ই সেটা একটা আদর্শগত, তাত্ত্বিক ধারণা। কাজে প্রয়োগ করার মতো বস্তু নয়। যেমন ‘শিক্ষার প্রসার করতে হবে,’ এটাকেই অনেকে মনে করেন শিক্ষানীতি। কোনও এক মন্ত্রী এই ‘নীতি’ ঘোষণা করার পর কোনও এক আমলা তাঁর মর্জিমতো কোনও একটি পদ্ধতি ঠিক করেন। প্রায়ই সেটা তাঁর আদর্শগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। যেমন, গরিবের প্রকল্পে গরিবের যোগদান জরুরি। আমাদের দেশে সর্বশিক্ষা মিশনের অধীনে এমন কমিটি তৈরি হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে অধিকাংশ অভিভাবক কমিটির কথা জানেনই না। যাঁরা কমিটির কথা জানেন, তাঁরাও জানেন না যে বাড়তি শিক্ষক নিয়োগ করা বা খারিজ করার অধিকার কমিটির আছে। আর জানলেই বা কী? একা একা গিয়ে চেঁচামেচি করলে লোক হাসানোই হয়। তাই যদি সবাই যোগ না দেয় তা হলে কেউই এগিয়ে আসবে না। ফলে গ্রাম শিক্ষা কমিটি প্রায় সর্বত্র অকেজো থেকে গেল, সর্বশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হল না।
দুঃখের বিষয়, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তারা অনেকেই বোঝেন না যে নীতির উদ্দেশ্য ভাল হলেই তা ভাল নীতি হয় না। যখন বলা হয় যে নীতিটা কাজ করছে না, তখন তাঁরা যারপরনাই চটে যান। একে বলা চলে অজ্ঞতার ঔদ্ধত্য— “আমার তৈরি নীতি কাজ করছে কি না আমি জানি না?” আবার তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে নীতির ব্যর্থতা প্রমাণ করে দিলে তাঁরা খুব পরিচিত কিছু কথা বলেন। যেমন, ‘সিস্টেম কাজ করে না,’ কিংবা ‘বড় বেশি দুর্নীতি।’ বা ‘দারিদ্র না কমলে কোনও কাজই হবে না।’ অনেকে আবার নানা দার্শনিক ব্যাখ্যা শোনান। যেমন ‘গাঁধীর আদর্শ না মানলে উন্নয়ন হবে না’, বা ‘যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ চাই।’ এ কথাগুলো অন্তঃসারশূন্য। গাঁধীর পথে কী করে চলা যায়, কী করলে যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ হবে, এগুলো স্পষ্ট না করে আদর্শের কথা বলা আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছু নয়।
অর্থনীতিবিদরাও নানা ‘গ্র্যান্ড ফর্মুলা’ তৈরি করেন। যেমন, ‘বাজারের উপর সব ছেড়ে দেওয়া হোক,’ বা ‘বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক।’ এর ফলে এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে প্রশ্ন করার অভ্যাসটাই তৈরি হচ্ছে না। গরিবের জন্য পুষ্টি বা শিক্ষার প্রকল্প আদৌ অপুষ্টি, অশিক্ষা কমাচ্ছে কিনা, সে প্রশ্ন যিনি তুলবেন, তাঁকেই বরং ‘গরিব-বিরোধী’, ‘সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক’ ‘কিংবা ‘সিআইএ-র চর’ বলে তকমা দেওয়া হয়। তার কারণ, ‘কী হচ্ছে,’ সেই প্রশ্নের চাইতে ‘কী হওয়া উচিত’, তার আলোচনাতেই আমরা আটকে রয়েছি। যে কোনও নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা দরকার, এটা যে কাজ করবে তা মনে করার কী কী কারণ আছে? অন্য ভাবে টাকাটা খরচ না করে এ ভাবে করব কেন? এই প্রশ্নগুলো করা হয় না বলে কোনও নীতি কাজ না দিলেও তাকে বাতিল করা আমাদের দেশে দুঃসাধ্য।
দ্বিতীয় সমস্যা, আন্দাজে নীতি বা প্রকল্প তৈরি করা। অপুষ্টি কমাতে চাল বিলি করার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে বারবার। সস্তায় চাল পেলে অনেক সুবিধে হয়তো হয়, কিন্তু তাতে অপুষ্টি কি কমে? এত দিন চাল বিলি করার ফলে সত্যিই কি অপুষ্টি কমেছে? যেখানে অপুষ্টি কমেছে, সেখানে চাল বিলি করার জন্যই যে তা কমছে, তা কি নিশ্চিত? চাল বিলি না করে, কৃমি সংক্রমণ কমানো কি শিশুর অপুষ্টি কমাতে বেশি কাজ দিতে পারে? এমন কোনও প্রশ্নের উত্তর না জেনেই, স্রেফ আন্দাজে প্রকল্প তৈরি করা হয়। এর ফলে যদি বা চাল পৌঁছয়, অপুষ্টি কমে না। কারণ আরও কিছু চাল দেওয়া অপুষ্টি কমানোর উপায় নয়।
নীতি প্রয়োগের আগে প্রায়ই ‘পাইলট’ পরীক্ষা হয়। কিন্তু তা কেবল নিয়মরক্ষার জন্য। যে সতর্কতা, নিপুণতার সঙ্গে নীতির পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হয় না। ধরা যাক আমরা দেখতে চাই, দুঃস্থ পরিবারকে বিনামূল্যে ছাগল-গোরু দিলে, পশুপালনের প্রশিক্ষণ দিলে তাদের আর্থিক উন্নতি হতে পারে কিনা। প্রকল্প শুরুর কিছু দিন পরে আর্থিক উন্নতি প্রমাণ পেলেই হবে না। একশো দিনের কাজ ভাল হওয়ার জন্য, কিংবা এলাকায় নতুন কারখানা খোলার জন্যও উন্নতি হয়ে থাকতে পারে। সেই সব সম্ভাবনাকে বাদ দিতে হবে। প্রকল্পই যে পরিবর্তন এনেছে, নীতি যে প্রত্যাশিত ফল দিচ্ছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ পেতে হবে।
তৃতীয় সমস্যা আলস্য। স্কুল কমিটি যে কাজ করছে না, চাল বিলি করে যে অপুষ্টি কমছে না, সেদিকে কেউ কখনও মন দেয়নি। ‘চলছে চলবে’ করে চলে যাচ্ছে প্রকল্পগুলো। কোনও এক আমলা কোথাও বসে কেবল দেখে যাচ্ছেন, কমিটি তৈরি হয়েছে কিনা, চাল সরবরাহ হচ্ছে কিনা। এর কোনওটা আদৌ অভীষ্ট কাজটা (লেখাপড়ার মান বাড়ানো, অপুষ্টি কমানো) করছে কিনা, তা কেউ খেয়াল করছে না।
এই যে ‘চলছে চলবে’ করে চলা, সরকারি প্রকল্পে এটাই মস্ত বড় ঝুঁকি। কেউ ইচ্ছে করে প্রকল্পগুলো ব্যর্থ করে দিচ্ছে, এমনটা বেশির ভাগ সময়েই হচ্ছে না। এ ভাবেই আগে এমন কাজ করা হয়েছে, তাই এ ভাবে এখনও করা হচ্ছে। এমন শিথিলতাই গরিবকে তার বরাদ্দ সুযোগ-সুবিধে পেতে দিচ্ছে না।
॥ ৩ ॥
বিপ্লবের ধাঁচে কোনও সার্বিক, আমূল পরিবর্তন না করেও যে গরিবের জীবনে পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে, তা এই জন্যই যে সুচিন্তিত কোনও ষড়যন্ত্র দারিদ্রের মূল কারণ নয়। দারিদ্র তৈরি হয়, টিকে যায়, অগণিত ছোট ছোট ভুলভ্রান্তির জন্য। যেগুলো আসলে চিন্তার অভাবের জন্য রয়ে যাচ্ছে। অতিশয় সদিচ্ছা থেকে তৈরি প্রকল্প-পরিকল্পনাতেও তেমন ফাঁকফোকর থেকে যায় বলে দারিদ্র যতটা কমা উচিত ছিল ততটা কমে না। যেমন সংযোগের অভাবে উগান্ডার স্কুল ও ছাত্রদের বঞ্চনা। আবার জনগণের নিপীড়নে পিছপা নয় যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসক, সে-ও এমন নীতি নিতে পারে যা বাস্তবিক দারিদ্র কমায়। যেমনটা ঘটেছে ইন্দোনেশিয়ায়।
তার মানে দাঁড়ায়, কোথাও নাছোড় দারিদ্র দেখলে প্রশ্ন করতে হবে, কেন দারিদ্র ঘুচছে না? কোথায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে? সেগুলো চিহ্নিত করে তা ‘সারাই’ করাই হল আসল কাজ। কু-অভিসন্ধি, কিংবা মন্দ বিধিব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলে ‘এমন তো হবেই’ বলে বসে থাকা অর্থহীন। কেমন নকশা তৈরি হলে গরিব তার প্রাপ্য পেতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
কোন প্রকল্প কাজ করবে, কোনটা করবে না, বুঝতে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি প্রয়োজন। এমন একটি পদ্ধতি ‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’, সংক্ষেপে আরসিটি। এই পদ্ধতিটা শুরু হয়েছিল নতুন ওষুধের কার্যকারিতা বুঝতে। কিছু রোগীকে নতুন ওষুধটি দেওয়া হত। কিছু রোগীকে তা দেওয়া হত না। দু’দলকে নিয়মিত পরীক্ষা করে শেষে স্পষ্ট হত, ওষুধটা সত্যিই কাজ করেছে কিনা। উন্নয়নের প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তাই। ধরা যাক স্কুল-পড়ুয়াদের লিখতে-পড়তে পারার ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। শিক্ষকদের উপস্থিতি বাড়ালে কি তা সম্ভব? তা বুঝতে চেয়ে ‘র্যান্ডাম কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে একটি রাজ্যের কিছু বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিত থাকার জন্য বাড়তি টাকা দেওয়া হল। কিছু বেসরকারি স্কুলে তা দেওয়া হল না। দু’বছর পরে দেখা গেল, বাড়তি টাকার জন্য শিক্ষকদের উপস্থিতি সত্যিই বেড়েছে। যে সব স্কুলে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়নি, সেখানে তা বাড়েনি। যে সব স্কুলে শিক্ষকদের উপস্থিতি বেড়েছে, সেখানে ছাত্রদের নম্বরও বেড়েছে। তারা আগের চাইতে ভাল লিখতে পড়তে পারছে। রাজস্থানের এই পরীক্ষাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষকদের বেতনের একটি অংশ যদি তাঁদের উপস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়, ‘উৎসাহভাতা’-র মতো, তবে তা পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। আবার এই ধরনের ‘উৎসাহভাতা’ কখন বেশি ভাল কাজ করবে, তা বোঝার জন্যও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে একই পদ্ধতিতে। অন্ধ্রপ্রদেশে কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের সব শিক্ষককে বাড়তি অনুদান দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে বাড়তি অনুদান দিয়ে দেখা হয়েছে, কোথায় লেখাপড়ার উন্নতি হচ্ছে বেশি। দেখা গিয়েছে, ব্যক্তিগত অনুদানই বেশি ভাল ফল দিচ্ছে। এই বইয়ের একটি প্রবন্ধে এ বিষয়টি বিস্তারিত বলা হয়েছে।
আরসিটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিশ্রমসাধ্য, খরচসাধ্যও বটে। অনেকদিন ধরে, অনেক বিষয়ে নিয়মিত তথ্যসংগ্রহ করতে হয়। বারবার মূল্যায়ন করতে হয়। চার-পাঁচ বছরও লাগতে পারে। গোটা সময়টিতে খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ দিতে হয় পূর্ণমাত্রায়। তত্ত্ব-নির্ভরতার চাইতে এই পদ্ধতি অনেক বেশি প্রত্যক্ষ-নির্ভর। আগাগোড়া বেশি জোর দিতে হয় তথ্য সংগ্রহ আর বিশ্লেষণে। গরিবের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে যে আবেগ কাজ করে, অনেক মানুষ একত্র হওয়ার যে উদ্দীপনা কিংবা দারিদ্র নিরসনের নতুন তত্ত্ব-মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার উত্তেজনা, কিছুই এর মধ্যে তেমন ভাবে নেই।
তা হলে হবে কী, নেহাৎ কেজো এই পদ্ধতি গরিবের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে দিব্যি কাজে দিচ্ছে। এই বইয়ে প্রবন্ধগুলিতে বেশ কিছু গবেষণার কথা বলা হয়েছে, যাতে গরিবের কীসে লাভ হচ্ছে, কীসে হচ্ছে না, তা এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার সেই গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে নীতি তৈরি করেছে। উদাহরণ—
নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়ালে স্কুলে আসার হার অনেকটা বাড়ে। এটা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে সরকার নিয়মিত স্কুলপড়ুয়াদের কৃমির ওষুধ খাওয়াচ্ছে।
বয়স অনুসারে পড়ুয়াদের বিভাজন না করে, লেখাপড়ার স্তর অনুসারে বিভাজন করে পড়ালে তারা বেশি দ্রুত শেখে। এটা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ভারতের একাধিক রাজ্যে রাজ্য সরকারের সহায়তায় এই পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে শিশুদের।
বিনা পয়সায় সরকার কিছু দিলে তার হেলাফেলা হবে, এমন আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আফ্রিকার কিনিয়াতে দেখা গিয়েছে, ওষুধ লাগানো মশারির সামান্য দাম রাখলেও তার ব্যবহার কমে যায়। বিনা পয়সায় দিলে তা অব্যবহৃত পড়ে থাকে না, কাজেই লাগে। এই ফল মেলার পর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ বিনা পয়সায় ওষুধ-দেওয়া মশারি বিতরণ শুরু করে।
গরিবের জন্য সরকারি প্রকল্পে চুরি আটকাতে ইন্দোনেশিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে তাদের এমন পরিচয়পত্র বিলি করা হয়েছিল, যাতে ছাপা ছিল গরিবের জন্য কী কী প্রকল্প রয়েছে, আর তা পাওয়ার শর্ত কী। এতে চুরি অনেক কমে যাওয়ায় গোটা দেশের জন্য এমন কার্ড তৈরি করে বিলি করেছে সরকার।
আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যে সব উদ্যোগ কাজ করতে পারে বলে ভাবা গিয়েছিল, সেগুলো কাজ করেনি। উদাহরণ—
ওড়িশায় বাড়িতে রান্নার জন্য ধোঁয়াহীন উনুন দেওয়া হয়েছিল আড়াই হাজার পরিবারকে। তাতে নিশ্বাসের সঙ্গে অতিরিক্ত কার্বন ঢোকা বন্ধ হবে, রান্নার খরচ ও সময় কমবে, এমনই আশা ছিল। দেখা গিয়েছে, প্রথম এক বছর প্রত্যাশামতো ফল দিলেও, তারপর থেকে উনুন না সারানো, এবং ঠিকমতো ব্যবহার না করার জন্য দূষণ ও খরচ বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে সাধারণ উনুনের জায়গাতেই।
প্রাইভেট স্কুলে পড়লে শিশুরা আরও বেশি শিখবে, মনে করেন অনেকে। এই ধারণা ঠিক কিনা, তা বোঝার জন্য অন্ধ্রপ্রদেশের নানা গ্রামে দেড় হাজার পরিবারকে লটারির মাধ্যমে ‘ভাউচার’ বিলি করা হয়েছিল, যা ব্যবহার করে তাঁরা সন্তানকে প্রাইভেট স্কুলে পাঠাতে পারেন। এক বছর পরে দেখা গিয়েছে, ভাউচার পেয়ে যারা প্রাইভেট স্কুলে পড়ছে, আর যারা সরকারি স্কুলে পড়ছে, তাদের অঙ্ক ও মাতৃভাষার দক্ষতা এক মানের। ইংরেজিতে প্রাইভেট স্কুলের পড়ুয়ারা সামান্য ভাল করেছে।
আমরা যে ভাবে রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে ভাবতে অভ্যস্ত, পরীক্ষা-ভিত্তিক পরিবর্তনের এই রীতি হয়তো ঠিক তেমন নয়। কিন্তু এই পদ্ধতি যে আশ্বাস নিয়ে আসে, তা-ও খুব কম মূল্যবান নয়। যে-কোনও বড় আকারের দুর্নীতি, অপচয়, অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অসহায়তার ভাব জাগে। মনে হয়, কী করতে পারি? প্রতিপক্ষ যেখানে সার্বভৌম রাষ্ট্র, প্রভাবশালী নেতা, বহুজাতিক সংস্থা, সেখানে জনাকয়েক নাগরিকের পক্ষে কী করা সম্ভব? উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, সাংবাদিকদের প্রায়ই শুনতে হয় যে মালিকানা যারই হোক, সব কর্পোরেট মিডিয়া আসলে দারিদ্র দূর করার নামে দরিদ্রকে লোকচক্ষু থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্রে সামিল। নেতা-আমলা, বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা আর মিডিয়া মালিক, সবাই এক গেলাসের ইয়ার। এতে অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই সাংবাদিকের। নিচুস্তরের সরকারি কর্মী, অসরকারি সংস্থার ফিল্ড ওয়ার্কার, পঞ্চায়েত সদস্য, গবেষণা সংস্থার কর্মী, সকলের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব আসে।
পরীক্ষা-ভিত্তিক পরিবর্তনের পদ্ধতি কিন্তু বলে, যদি মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায়, যদি ঠিক প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়, যদি অপচয়-দুর্নীতির উৎস খোঁজার চেষ্টা করা যায়, তা হলে অল্প পরিসরে হলেও বদল আনা যেতে পারে। সব স্তরে সব সমস্যা তাতে এক ঝটকায় চলে যাবে না। কিন্তু পরিবর্তনের সূচনা একটা হবে।
তার মানে এই নয় যে সমাজে অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সার্বিক আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। শুধু কিছু প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত কলকব্জা নেড়ে কিছু বিশেষজ্ঞ সব ঠিক করে ফেলবে, এমন নয়। যেখানে মানুষ সজাগ ও সচেতন, যেখানে সে তার অধিকার বোঝে, ছুড়ে-দেওয়া টুকরো কুড়িয়ে নেয় না, অপমান হজম করে না, যেখানে তারা নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম ও আগ্রহী, সেখানে গোটা ব্যবস্থাটা অনেক ভাল কাজ করে। যে সমাজে এমনটা হবে বলেই ধরেই নেওয়া চলে, তেমন সমাজ তৈরিতে সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। সে সত্যকে মেনে নিয়ে, তাকে সম্মান জানিয়েও বলতে হয়, যতদিন না তেমন সমাজ তৈরি হচ্ছে, ততদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা চলে না। দারিদ্র কমাতে যা করা যায়, তা করতে হবে। এখনই।
১. নীতি ও গণতন্ত্র
গণতন্ত্র কেন মূল্যবান
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ৬৪ বছর পরেও, গণতন্ত্র ভারতকে কী দিয়েছে, সে-প্রশ্নটার তীক্ষ্ণতা কমেনি। এর কোনও একটা উত্তর হয় না ঠিকই, তবু কিছু ইঙ্গিত এমন পাওয়া যায় যা খুব অর্থবহ। যেমন, ভারতে যাঁরা প্রধান শিল্পপতি, যাঁদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণ হিন্দু, তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে কাকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চান, অধিকাংশই বলবেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নাম। এঁরা দু’জনেই ‘ও বি সি’ নীতীশ কুর্মি, নরেন্দ্র মোদী তেলি। ভারত যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন এমন ‘নিচু’ জাতের কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য বলে বিত্তবান, উচ্চবর্ণ মানুষ মনে করবেন, তা অকল্পনীয় ছিল। আজ তা সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যেই। আগে যেসব সম্ভাবনা ওঠার আগেই বাতিল হয়ে যেত, এখন সহজেই গ্রহণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই।
দলিতদের নেতৃত্ব যেমন ‘অসম্ভব’ থেকে ‘আকাঙ্ক্ষিত’ হয়ে উঠেছে, তেমনই ঘটেছে মেয়েদের ক্ষেত্রেও। রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখা গিয়েছে, যেখানে পরপর দু’বার প্রধান ছিলেন মহিলা, সেখানে মহিলাদের নেতৃত্বে মানুষের আস্থা অনেক বেশি। এই সব পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষিত না থাকলেও মেয়েদের ভোটে লড়াই করে জিতে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অন্তত যেখানে কখনও মহিলা প্রধান ছিলেন না, সেই সব গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, বিত্তবান উচ্চবর্ণ-প্রভাবিত শিল্পজগতেই হোক, আর দরিদ্র-প্রধান গ্রামসমাজই হোক, নেহাত কেজো নিয়মগুলো মেনে গেলেও গণতন্ত্র সম্ভব-অসম্ভবের নকশায়, বৈষম্যের চেনা ছবিতে অনেকখানি পরিবর্তন আনতে পারে। সব পরিবর্তন যে ভাল তা বলা চলে না, অনেকে বলবেন মোদীর সাফল্য গণতন্ত্রের ভয়াবহ দিকটাই দেখায়। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে যে এটা হতে পারত না, এবং হতে পারত না আমাদের বন্ধ মনের জন্য, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
গণতন্ত্র থেকে আমাদের অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক বড় ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্র কী করতে পারে, করতে পেরেছে, তা-ও চিন্তা করা দরকার। আজ থেকে দশ বছর আগেও সব ছেলেমেয়ের স্কুলে একসঙ্গে মিড-ডে মিল খাওয়া নিয়ে নানা আপত্তি উঠত, আজ আর সেগুলো শোনা যায় না। ভারতের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা কখনও অস্পৃশ্যতা মানেনি, জল-অচল বলে কোনও জাতকে চিনতে শেখেনি। সেই সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, দলিত-জনজাতির শিশুরা প্রায় সকলেই স্কুলে যাচ্ছে। সেখানে তারা আদৌ কিছু শিখছে কি না, কে ক’বছর স্কুলে পড়ছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকতেই পারে। কিন্তু হাড়ি-ডোম-চামার ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই যে এখন ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা খুব কম কথা নয়।
আমরা বলছি না যে গণতন্ত্র ছাড়া এসব পরিবর্তন কোনও ভাবেই আসতে পারত না। কিন্তু এটা বোধ হয় বলা যায় যে গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভেদাভেদ বেশি দিন চলতে পারে না।
এটাও লক্ষ করা দরকার যে, গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার যে সব নিয়মকানুন রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান তার পরিচালনা করে, এত বছরে ভারতে সেগুলির নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে ভোটে রিগিং হচ্ছে বলে মাতামাতি হত, তাই গণতন্ত্রের একটা প্রধান শর্তই মার খেয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন ভোটদানের বৈধতা বাড়াতে পেরেছে। যার জেতার কথা ছিল না সে জিতেছে, এমন অভিযোগ আজ সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও একটা মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে মানুষের যতই ক্ষোভ থাক, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছেন। গ্রামসভায় লোক যতই কম আসুক, সেখানেই গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। এই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নানা অকর্মণ্যতা-অক্ষমতা সত্ত্বেও এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেউ কাজ করতে পারছেন না।
তা বলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ক্ষোভও কম নেই। বিপুল দারিদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কী পেলাম? গণতন্ত্র মানে যদি হয় মানুষের শাসন তা হলে যে-দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব, সে-দেশে গরিবের রুটি-কাপড়-বাসস্থান জুটল না কেন? যে দেশের অর্ধেক ভোটার মহিলা সেখানে মেয়েরা কেন অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় ভোগে? কেন শিক্ষাহীন, শ্রমসর্বস্ব মানুষদের অধিকাংশ দলিত কিংবা আদিবাসী? যাদের যা প্রাপ্য তাদের যদি তা না-ই দেওয়া গেল, তা হলে কী লাভ হল গণতন্ত্রে?
এই বিরক্তি, ক্ষোভ থেকে সম্প্রতি আন্দোলনের একটা ধারা লক্ষ করা গিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে আদালতকে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি, কাকে কী দিতে হবে, কতটা দিতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছিল আদালত। আবার প্রাপ্য জিনিস বা পরিষেবা যদি প্রার্থীর কাছে না পৌঁছয়, তার জন্য রাষ্ট্রকে ধমক দিতেও রয়েছে আদালত। এই ভাবধারায় আন্দোলনই বলছে যে, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির মতো একটি অনির্বাচিত কমিটির সুপারিশে কিছু অনির্বাচিত লোক নিয়ে তৈরি হবে লোকপাল, যা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারি কর্মীদের দ্রুত এবং কঠোর শাস্তি দেবে। এমন আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো তৈরি করার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন না যে, ‘কোথায় কী দুর্নীতি হচ্ছে আমরা সব প্রকাশ করে দেব, তারপর মানুষই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-আমলাদের ব্যবস্থা করবেন, সে ভোটের বাক্সেই হোক আর রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেই হোক।’ বরং অণ্ণা হজারে, জঁ দ্রেজ, অরুণা রায়ের মতো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নতুন নতুন ‘অধিকার’ তৈরি করে, খানিকটা গণতন্ত্র ডিঙিয়ে, মানুষের কাছে প্রাপ্য পৌঁছে দিতে চাইছেন।
এই কাজ অনেকগুলি দিক থেকে গণতন্ত্রের বিরোধী। এক, বিচারব্যবস্থা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতারা। কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার বলেছিলেন যে, খাদ্যের অধিকার বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই। তাঁর কথায় কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হল না এই অগণতান্ত্রিক চাপের নীতির জন্যই। মানুষের চাহিদা অনুসারে মানুষের প্রতিনিধি নীতি তৈরি করবেন, গণতন্ত্রের এই ‘ক্লাসিকাল’ ধারণা থেকে সরে যাচ্ছেন নেতারা। দুই, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তাঁরা নিজেদের মতকে ‘জনমত’ বলে দাবি করছেন, এবং দিল্লিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন, দরিদ্র নাগরিকের অধিকারের উপর জোর দিতে গিয়ে তাঁরা হয়তো খেয়াল করছেন না যে নিরপেক্ষ বিচার পাবার অধিকার গণতন্ত্রে একেবারে প্রাথমিক অধিকার। বিশেষত সরকারি ব্যবস্থার নিচুতলার কর্মীরাও নাগরিক, এবং তাঁদের নানা অনাচার সত্ত্বেও নাগরিক হিসেবে তাঁদের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘জনস্বার্থে’ চটজলদি শাস্তি দিতে হবে, এই ধারণা উত্তর কোরিয়ায় মানানসই, ভারতে নয়।
গণতন্ত্র যা পারে, তা হল মানুষের দাবি নিয়ে সরব হতে। সরকারি হাসপাতালে কম দামে ওষুধ চাই, রেশনে এ পি এল গ্রাহকদেরও গম দিতে হবে, অমুক জনগোষ্ঠীকে ‘জনজাতি’ বলে গণনা করতে হবে, রাতবিরেতে গ্রামে তল্লাশি চলবে না, এই চাহিদাগুলিকে গণতন্ত্র ব্যক্ত করে। অনেকের চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করা, এবং তা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা এগুলো গণতন্ত্রের মৌলিক কাজ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি মেনে রাষ্ট্র যে গরিবের জন্য কিছু প্রাপ্য নির্দিষ্ট করেছে, ভারতে গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।
সমস্যা হল, একজন গরিব মানুষ যখন তাঁর প্রাপ্য দাবি করেন, সে রেশন দোকানেই হোক বা সরকারি হাসপাতালেই হোক, তখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি খুব সহজেই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে। হবে না, আজ নেই, কখনও পাওয়া যায় না, অমুকের সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন এমন নানা অজুহাতের জাল বোনা হয়। এর প্রতিকার কী? গণতন্ত্রে এটার প্রতিকার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকভাবে আদালতকে। তা এই আশঙ্কা থেকে যে, একজনের প্রতি বিচার করতে গিয়ে অন্য একজনের প্রতি অন্যায় না হয়ে যায়। ‘জনস্বার্থ’ প্রতিষ্ঠা করার যে গণ-উত্তেজনা, তা থেকে দূরে থেকে ঠান্ডা মাথায় বিচার করবে আদালত। গণতন্ত্রের নামে যেমন আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করা চলে না, তেমনই এমন কোনও বিচারব্যবস্থার সুপারিশও করা চলে না, যেখানে বিচারকই তদন্ত করবেন।
সেই সঙ্গে, ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ দিয়ে সরকারি কর্মীর উপর চাপ সৃষ্টি করা, তাকে শাস্তি দেওয়াটাকেও সমর্থন করা চলে না। অণ্ণা হজারে সংগঠিত ‘গ্রাম সভা’ কিংবা অরুণা রায় সংগঠিত ‘জন সুনওয়াই’ যে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা প্রকাশ করেছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অভিযুক্ত প্রধানকে বা সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত করে দেওয়াটা ভোটের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব। স্বনির্বাচিত জনগণের নেতারা জনগণের নামে কারও হাতে মাথা কাটবেন, এটা গণতন্ত্রের পদ্ধতি নয়। এটা নীতিগত সমস্যা। তা ছাড়া বাস্তব সমস্যাও রয়েছে। ‘সংগঠিত প্রতিবাদ’ তৈরি করা কত কঠিন, তা নাগরিক সংগঠন মাত্রই জানেন। একত্র হবার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রাপ্য আদায় করবেন, এই ধারণা যদি ঠিক হত তা হলে গ্রাম সভা, স্কুল শিক্ষা কমিটি, রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটি, এমন অজস্র তৃণমূল স্তরের জনমঞ্চ এতদিনে গ্রামীণ প্রশাসনের মুখটাই বদলে দিত। এতদিনে বোঝা গিয়েছে যে, যোগদান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও জটিল, শ্রমসাধ্য, ব্যয়সাধ্য। সে অমনি হবার নয়। অরুণা রায়, অণ্ণা হজারে যা করেছেন, আটপৌরে জনজীবনে গণতন্ত্র তা করে না। তাই তাঁরা ‘দৃষ্টান্ত’ হলেও ‘মডেল’ নন।
তা হলে শূন্য রেশন ব্যাগ-হাতে গরিব লোকেদের কী হবে? গণতন্ত্র তাঁদের প্রাপ্য লাভ নিশ্চিত করার জন্য কী করতে পারে?
ভারতে আমরা প্রতিনিধিত্ব-মূলক গণতন্ত্র মেনে নিয়েছি। তার মূল কথা, নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখবেন, সরকারি কর্মী যাতে মানুষের প্রয়োজনে কাজ করেন, তাঁদের প্রাপ্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন। আমলাদের কাজের হেরফের গরিবের লাভের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই। তাঁদের তৎপর, দায়বদ্ধ করা যায় কী করে, সেটা বরাবরই একটা চ্যালেঞ্জ। সরকারি কর্মী যে নিয়মিত নিজেদের কাজ করছে, আলস্য বা দুর্নীতি করে নাগরিককে ঠকাচ্ছে না, তা নিশ্চিত করাই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। খাদ্য, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো প্রভৃতি যা কিছু ‘সার্বিক অধিকার’ বলে রাষ্ট্র স্বীকার করেছে, সেই সব প্রাপ্য বস্তু বা পরিষেবা পাবার এটাই উপায়। আজ ‘শিক্ষার অধিকার’ কাল ‘খাদ্যের অধিকার’ এমন নতুন নতুন অধিকার তৈরি করে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে কর্মীদের কাজ করানো গণতান্ত্রিক উপায় নয়। তার প্রধান কারণ (যা আগেই আলোচিত) গণতন্ত্রের মূল ধারণা অভিযুক্তের সুবিচার নিশ্চিত করা। সকলের প্রাপ্য দ্রুত পাইয়ে দেওয়ার স্বার্থে সরকারি কর্মীদের উপর শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না দেওয়া, গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটার পিছনে আছে গণতন্ত্রের মৌলিক কথা। ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থের একটা ভারসাম্য রাখতে হয় গণতন্ত্রে। আমাদের দেশে তা নিশ্চিত করা হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থকে বিচারব্যবস্থার, এবং সার্বিক স্বার্থকে আইন বিভাগ-শাসন বিভাগের বিষয় করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য এবং ভারসাম্য রাখার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থে ভারসাম্য রাখা হবে, এই ধারণাই কাজ করছে ভারতে।
গণতন্ত্রের ধারণা মেনে গরিবের কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছতে যা দরকার, তা হল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। সমর্থন আদায় করার জন্য যেখানে বিজলি-সড়ক-পানি, কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো জনসম্পদ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলবে, সেখানেই গরিবরা লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। গণতন্ত্রে আমলাদের উপর চাপটা এভাবেই আসার কথা। কিন্তু তা হয় না, কারণ ভোটের লড়াইটা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দিয়ে, কিংবা ভয় দেখিয়ে সমর্থন আদায় করার প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে গরিবের ক্ষতি বেশি, কারণ অতি সামান্য কিছু দিয়ে তার ভোট আদায় করা সম্ভব।
যেখানে সত্যিই গরিবের উন্নয়নকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে আনা হয়েছে, সেখানে রাজনীতি গরিবের সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে। যেমন দলিত-আদিবাসী স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিতরণ করে নীতীশ কুমার মেয়েদের শিক্ষাকে রাজনীতির বিষয় করে তুললেন। এখন প্রায় প্রতিটি রাজ্যে দরিদ্র মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। গরিবের লাভে নেতার লাভ হওয়ার একটা প্রক্রিয়া তৈরি হল, তাই প্রতিযোগিতায় কাজ হচ্ছে গরিবের।
গরিব তার প্রাপ্য পাবে কি না, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে, ভোটের লড়াইকে গরিবের প্রাপ্য পৌঁছে দেওয়ার লড়াইয়ে টেনে আনা যাবে কি না। তামিলনাড়ুতে যে দারিদ্র কমে এসেছে, তার কারণ সেখানে ভোটের লড়াইকে অনেকটাই আনা গিয়েছে সেই ময়দানে। যে অঙ্গনওয়াড়িতে শিশুদের ডিম দেওয়া বন্ধ করবে, যে রেশন ব্যবস্থা সংকুচিত করবে কেবল বি পি এল-দের মধ্যে, সে-ই যে ভোটে হারবে তা প্রায় নিশ্চিত। তামিলনাড়ুতে তাই দ্রুত দারিদ্র কমছে। সে-রাজ্যের নেতারা দুর্নীতিতে কিছু কম যান না, কিন্তু গরিবের উন্নয়ন তাতে আটকায়নি।
এখানে বলা দরকার, মত প্রকাশের অধিকারও গণতন্ত্রে মূল্যবান। নির্ভয়ে রাষ্ট্রের সমালোচনা করা গণতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বারাসতে এক স্কুল ছাত্রী দুষ্কৃতীদের হাতে হয়রান হলে এক বিধায়ক তার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করলেন। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে আর এক নেতা ধর্ষিতা মেয়েটির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। দু’বারই এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ করে নানা সংগঠন মিছিল, সভা করল। এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ তা শাসকদের কাছে মানুষের ক্ষোভ পৌঁছে দেয়। কিন্তু মিছিল করে নির্যাতিত মেয়েদের ন্যায় বিচার পাওয়ার কাজটা সহজ করতে আমরা পারব না। ধর্ষণের বিচার করতে আদালতে বহু মাস, বছর কেটে যাবে। এতে বিচারব্যবস্থার ঘাটতি আছে বিলক্ষণ, এবং সেই ঘাটতিগুলো নিয়ে সরব হওয়াও গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু আদালতের পাশ কাটানো চলে না, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা চলে না। তার জায়গায় ‘জন-আদালত’ তৈরি করার চেষ্টা আরও ভয়ানক।
কোনও ব্যক্তির অপ্রাপ্তির প্রতিকার করা বিচারব্যবস্থার কাজ। যাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করা হয়েছে, যার উপর নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ নেয়নি, তার ক্ষেত্রে সেটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে গরিব গ্রাহককে তার প্রাপ্য চাল-কেরোসিন না দিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে রেশন দোকান, গরিব মেয়েটির স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দেয়নি ব্যাঙ্ক, গরিব শিশুটি স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পারেনি শিক্ষকের অনুপস্থিতি কিংবা অমনোযোগিতার জন্য। ব্যক্তির কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছোনোর ইচ্ছাটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে জন্মানো ইচ্ছা। কিন্তু তার প্রক্রিয়াতে গণ-আন্দোলনের ভূমিকা যে সীমিত, তা আগেই লেখা হয়েছে।
এ কথাটা অন্যভাবেও বোঝার চেষ্টা করা যায়। প্রশ্ন করা যাক, যেখানে কোনও জনগোষ্ঠী তার প্রাপ্য পেয়েছে, সেখানে কি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই তা পাইয়ে দিয়েছে? ধরা যাক দলিত শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিই। দলিত ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই এখন নিয়ম হয়ে উঠেছে, তাদের পড়াশোনা না-শেখা এখন সমাজের চোখে একটা সমস্যা। ভারতে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ স্কুলের সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, দলিত শিশুদের বাড়ির কাছেই তৈরি হয়েছে স্কুল। কিন্তু শিক্ষার জন্য দলিতদের নানা আন্দোলনমূলক কর্মসূচির জন্যই যে তাঁরা অনেক স্কুল পেয়েছেন, কিংবা দলিত-প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই যে দলিতদের জন্য প্রচুর স্কুল তৈরি করেছে, এমন কিন্তু নয়। যে-কোনও জনপদের এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে, এই সরকারি নীতি কাজে পরিণত হওয়ায় সব চাইতে লাভবান হয়েছেন দলিতরা। তাঁদের জনপদগুলিতেই বরাবর সব চাইতে কম স্কুল ছিল, তাই এই নীতি মেনে সব চাইতে বেশি স্কুল পেয়েছেন তাঁরা। এই সরকারি কার্যসূচি নেওয়া হয় ইন্দিরা গাঁধীর আমলে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর যাঁর আস্থা খুব বেশি ছিল না। নিতান্ত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে প্রাপ্য পাইয়ে দেওয়ার কাজে সফল হতে পারে। এটা অবশ্যই দাবি করা যায় যে ইন্দিরা গাঁধীর দারিদ্র বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়ার পিছনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপ ছিল। কিন্তু জনতার চাহিদার চাপ অগণতান্ত্রিক দেশেও রাষ্ট্রপ্রধানকে জনমুখী কার্যসূচি নিতে বাধ্য করতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতে সুহার্তোর সময়ে শিক্ষার প্রসার হয়েছিল সর্বাধিক। মোট কথা, গরিবের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে অতিক্রম করা চলে, দুর্বল করা চলে, এ যুক্তি আমরা মানতে পারছি না।
গরিবের স্বার্থরক্ষায় ভোটের প্রতিযোগিতাকে গরিবের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আনতে হবে। সে-কাজটা অনেকটাই পারে মিডিয়া। মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতাদের কাজের বিষয়ে তথ্য যত বেশি প্রকাশিত হবে, তত বেশি সেই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন সাধারণ নাগরিক। দিল্লি এবং বিহারে দুটি পরীক্ষানিরীক্ষায় এমনই পাওয়া গিয়েছে। দিল্লির বস্তিবাসী যখন মিডিয়া থেকে জানতে পারছেন কোন নেতা বস্তির জন্য কত টাকা খরচ করেছেন, তখন তাঁরা যে বেশি খরচ করেছে তাকে বেশি ভোট দিচ্ছেন। আবার রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটির মিটিং-এ যে নেতা বেশি উপস্থিত থাকছেন, তিনি ভোট পাচ্ছেন বেশি। আরও দেখা যাচ্ছে যে, যিনি ক্ষমতাসীন নেতা তিনি যদি কোটিপতি হন, আর বিরোধী যদি তা না হয়, তা হলে ক্ষমতাসীনের ভোট কমে যাচ্ছে। এই গবেষণাগুলি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, জনসম্পদ কে কেমন খরচ করছেন, বিলিবণ্টন করছেন, সে-বিষয়ে তথ্য ভোটদাতাদের হাতে এলে তাঁদের ভোটের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়। এটা যত বেশি ঘটবে, তত বেশি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আসবে উন্নয়নের প্রতিযোগিতার মঞ্চে। ‘সব নেতাই এক’ এমন একটা আবছা ধারণা কেটে গিয়ে কে কোন কাজে কত খরচ করছে, সে-বিষয়ে তথ্য আসবে হাতে। তখন উন্নয়নের প্রশ্নে ভোট দিতে পারবেন গরিব মানুষ। দলিত, মহিলা, গরিবদের কাছে তাদের প্রাপ্য পৌঁছনোর এটাই গণতন্ত্রের পথ।
অন্য যে-কোনও নাগরিকের মতো, নাগরিক সংগঠনগুলির নেতা-সদস্যদেরও সে-পথে নেতাদের অনুগামী হতে হবে। নেতা ডিঙিয়ে নেতৃত্ব দেবার কাজ তাদের নয়। নেতাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজও নয়। নাগরিক সংগঠন যা পারে, তা হল পক্ষপাতহীনভাবে পরখ করে দেখা যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে-পথে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ সে-পথে যথার্থই তার প্রাপ্য পাচ্ছে কি না। নেতার মূল্যায়নের সঙ্গে নাগরিকের অভিজ্ঞতার কোথায় তফাত হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখিয়ে দেওয়া তার কাজ। এ কাজটা করেছে বেঙ্গালুরুর ‘সিটিজেন্স রিপোর্ট কার্ড’ যা জল, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি প্রধান নাগরিক পরিষেবাগুলি নিয়ে সে-শহরের মানুষের কতটা সন্তুষ্টি, কতটা ক্ষোভ, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
নাগরিকদের সমস্যা কোথায় তা জানার পর অনেক সরকারি দফতর, সংস্থা তাদের পরিষেবাকে নতুন করে সাজিয়েছে। নীতি তৈরিতে পরামর্শ দিতে পারে নাগরিক সংগঠন। কিন্তু নীতি নির্ধারণ করা, কিংবা যেন-তেন-প্রকারেণ একটি নীতি পাশ করিয়ে ফেলার জন্য নেতাদের চাপ দেওয়া তাদের কাজ নয়।
গণতন্ত্র যেখানে কাজ করবে, সেখানে মানুষ নিজের জোরে, নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার জোরে তার প্রাপ্য পাবে। সে প্রাপ্য তার ‘অধিকার’ বলে আইন-আদালত স্বীকার করল কি না, তার পরোয়া করতে হবে না। মাসে চার দিন মিছিল-অবরোধ করতে হবে না। সরকারি দফতরের দৈনন্দিন ফাইলের পাতাগুলোতে তা-ই লেখা হবে, যা গরিব মানুষ চায়। সেই সব লেখাই ক্রমশ তৈরি করবে পরিবর্তনের ছবি। যে-কোনও নাগরিক আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতার কল্পনার ছবির চাইতে অনেক বৃহৎ, অনেক আশ্চর্য সেই পরিবর্তন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ ও ১৫ অগস্ট, ২০১২
তথ্যের সম্মান
২০১২ সালের জয়পুর সাহিত্য উৎসবে সাহিত্যিক সলমন রুশদি আসবেন, তা ঘোষিত হতে দেওবন্দ মাদ্রাসার আব্দুল কাসিম নোমানি ভারতে রুশদির আসার বিরোধিতা করেন। উৎসব কর্তৃপক্ষ শেষ দিনে ভিডিও-সংযোগের মাধ্যমে রুশদির বক্তব্য প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নোমানির সমর্থকদের বাধায় তা-ও বন্ধ করে দিতে হয়।
এ বছর জয়পুরের সাহিত্য উৎসব চমৎকার জমে গিয়েছিল। খচখচ করেছে কেবল সেন্সরশিপের কাঁটা। সলমন রুশদি আমন্ত্রিত হলেন, তারপর অনাহুত হলেন। তাঁর হয়ে যাঁরা কথা বললেন, তাঁদের জেলে ভরার হুমকি দিয়ে চুপ করানো হল। ভিডিয়োতে রুশদির কথা শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ অবধি তা রাখা হল না। গোটা ব্যাপারটায় রাজস্থান সরকার যে একবারও দুঃখপ্রকাশ করল না, সেটাই যেন আরও বিশ্রী করে তুলল বিষয়টিকে। সরকারের উদ্বেগ বোঝা কঠিন নয়: কিছু মাথা-গরম মুসলিমকে খেপিয়ে তুললে নানা ক্ষতির সম্ভাবনা-যদি কিছু নিরপরাধ মানুষ আহত হয়, সেই চিন্তা তো থাকেই। কিন্তু আমরা একবারও ‘দুঃখিত’ কথাটা শুনলাম না কেন? রুশদির মতো একজন মস্ত লেখকের কথা শোনার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার (এবং রুশদির কথা বলার অধিকার) সরকার যদি রক্ষা করতে না পারে, তা হলে সেই অক্ষমতা স্বীকার করার কি প্রয়োজন ছিল না? অধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে সরকার যদি এমন গা ছাড়া ভাব দেখায়, সেটা কি অধিকারের প্রতি অসম্মান নয়?
আমি রুশদি নই। আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করে কেবল আমার ছাত্ররা, যে সব দিনে ক্লাসে আমার লেকচার একটু বেশি রকম দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আর এক ধরনের সেন্সরশিপ কাজ করে, যখন মানুষ কথা শোনে কিন্তু কানে তোলে না: উৎসবে আমাদের আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে এক তরুণী খানিকটা উত্তেজিতভাবে হাত তুললেন। আমার বক্তব্যে আমি খানিকটা বিশদে বলেছিলাম, কীভাবে উত্তরপ্রদেশের গ্রাম শিক্ষা কমিটিগুলো বেশির ভাগ কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে। তা শুনে বিচলিত ওই তরুণী বলেন, তিনি হরিয়ানায় বেশ কিছু গ্রাম শিক্ষা কমিটির বৈঠকে গিয়ে দেখেছেন সেগুলো রীতিমতো প্রাণবন্ত, অনেক মহিলা এসে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগ জানিয়েছেন। তারপরেই ওই তরুণী প্রশ্ন করলেন, আমার লুকোনো উদ্দেশ্যটা কী? আমি কি সব সরকারি পরিষেবা বাতিল করতে চাই, যাতে সব কিছু বেসরকারি হয়ে যায়?
আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওই একটা উদাহরণ থেকে খুব বেশি ধরে নেওয়া চলে না। উত্তরপ্রদেশের ওই গল্পটা বলে আমি কেবল এটুকুই বোঝাতে চেয়েছি যে, সদিচ্ছা থাকলেই ভাল একটা প্রকল্প খাড়া করা যায় না। তবে এ দিনের ব্যাপারটা আমাকে একটু ধাক্কা দিয়েছিল, মানতেই হবে। উৎসবের নানা আকর্ষণে হয়তো তরুণীকে ভুলেই যেতাম, যদি না সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় আর একটা কথাবার্তায় জড়াতাম। আমি যখন কোনও মতে কাবাবের প্লেট ব্যালান্স করার চেষ্টা করছি, তখন সদ্য-আলাপী এক ভদ্রলোক তাঁর বন্ধুদের বোঝাচ্ছিলেন, আমি আলোচনায় কী বলেছি। তিনি বললেন, আমি নাকি বলেছি দারিদ্র দূর করার উপায় আঁতেপ্রেনিয়রশিপ। আমার এই ‘বক্তব্য’ তিনি সমর্থন করেন, তা-ও জানালেন ভদ্রলোক। ঘটনা হল, আমি আঁতেপ্রেনিয়র বা উদ্যোগপতিদের কথা একবারও বলিনি, কেবল ছোট চাষিদের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছি। গরিবদের ‘আঁতেপ্রেনিয়র’ করে তোলা নিয়ে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা আজকাল দেখা যাচ্ছে, আমার নানা লেখায় আমি বরং তাতে জল ঢেলেছি। কিন্তু যেহেতু আমি সরকারি প্রকল্পের সমালোচনা করেছি, তাই ধরেই নেওয়া হল আমি গরিবদের স্ব-উদ্যোগ সমর্থন করি। ওই তরুণীর মতো এই ভদ্রলোকও আমার কথার মধ্যে কোনও অকথিত বিষয় খুঁজছিলেন, যা সব কিছু ব্যাখ্যা করে দিতে পারে। যখন মনে হয়েছে তা পাওয়া গিয়েছে (‘বেসরকারিকরণ’, কিংবা ‘আঁতেপ্রেনিয়রশিপ’) তখন তাঁরা সেখানেই থেমে গিয়েছেন।
যেখানে শ্রোতারা তথ্য, যুক্তি শোনার চাইতে বক্তার মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করে বেশি, সেখানে বক্তার উপরেও চাপ তৈরি হয় শ্রোতাদের সঙ্গে ভাবনাচিন্তা আদানপ্রদানের চাইতে গোড়াতেই কোনও একটা অবস্থান নিয়ে নেওয়ার। তখন সব বক্তব্যই রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে যেতে চায়, কারণ শেষ অবধি শুধু সেটাই টিকবে। সেই জন্যই ওই তরুণীর মনে হয়েছে তাঁর জানা দরকার, ‘গোপন উদ্দেশ্যটা কী?’
বরাবরই কি এমনই ছিল? হয়তো না। সত্তরের দশকে ভারতে দারিদ্র এবং কৃষির উপর সব চাইতে ভাল কাজ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টি এন শ্রীনিবাসন সগর্বে নব্য উদারনীতি সমর্থন করতেন, অশোক রুদ্র ছিলেন অ-মার্কসবাদী, আর প্রণব বর্ধন বামপন্থী। কখনও তিনজনে, কখনও কোনও দু’জন একসঙ্গে কাজ করেছেন। কেউ কি তাঁদের প্রশ্ন করেছিল, কোন গোপন উদ্দেশ্যে তিনজন কাজ করছেন? প্রশ্ন করলে তাঁরা কী-ই বা বলতে পারতেন? কেবল বলতেন, ‘কী ঘটছে, আমরা আসলে সেটুকু জানতে চাই।’
কেন আজ আর লোকে তথ্য জানতে আগ্রহী নয়? হয়তো তার একটা কারণ, ভারতে সরকারি তথ্যের মান ক্রমশ পড়ছে। একটা সহজ কিন্তু উদ্বেগজনক উদাহরণ দেওয়া যাক— জাতীয় আয়। কেউ যদি জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান থেকে তা গণনা করে (যা করা যেতে পারে, যেহেতু এটা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা), তা হলে যে-সংখ্যা পাওয়া যাবে, তা সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজেশনের দেওয়া সংখ্যার অর্ধেক। দ্বিতীয়টিই আমরা বিশ্বকে জানাই। যা আরও উদ্বেগের তা হল, জাতীয় আয় নিয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া হিসেবের মধ্যে ফারাক গত ২০ বছর ধরে ক্রমে বেড়েই চলেছে। তা হলে কোন হিসেবটার উপর ভরসা করব?
তবে সমস্যার মূল আরও গভীরে। শিশুদের পড়তে পারা-অঙ্ক কষতে পারার মূল্যায়নের জন্য একটি রিপোর্ট (অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট বা ‘অসর’) তৈরির কাজের তত্ত্বাবধান করেন রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুরা কী শিখছে, তা বুঝতে ভারতের ৬০০ জেলার প্রতিটিতে প্রায় হাজার শিশুকে পরীক্ষা করা হয় এই রিপোর্ট বানাতে। সম্প্রতি এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয় রুক্মিণীর। তাঁকে সমীক্ষা থেকে পাওয়া কিছু উদ্বেগজনক ফলাফলের কথা বলছিলেন রুক্মিণী (শেখার মান নিচু থেকে আরও নিচু হচ্ছে) যা শুনে ওই অর্থনীতিবিদ হাত নেড়ে বলেন, আপনাদের ফল কেউ বিশ্বাস করে না। ভদ্রলোক কিন্তু এমন বলছেন না যে, তাঁরাও কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়েকে নিয়ে একই ধরনের সমীক্ষা করে ভিন্ন ফল পেয়েছেন। স্রেফ, ‘কেউ বিশ্বাস করে না আপনাদের ফল।’ যদিও ‘অসর’ রিপোর্টের ফল অন্য অনেকে ফের পরীক্ষা করেছে, যদিও ‘প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতেও ভারতের ফল ‘অসর’-এর ফলের মতোই খারাপ হয়েছে। যদি সততার সঙ্গে সংগৃহীত পরিসংখ্যান, আর তার স্বচ্ছ বিশ্লেষণে উত্তর খুঁজে না পাওয়া যায়, তা হলে আপনার-আমার গোপন অভিসন্ধি ছাড়া থাকে কী?
আমার অন্তত মনে হয়েছে, এবার জয়পুর সাহিত্য উৎসবের সব চাইতে ভাল আলোচনাটি হল সাহিত্য সাংবাদিকতা নিয়ে। বিশ্বের পাঁচজন সেরা সাংবাদিক সেখানে তথ্যকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার কথা বললেন। আশা করি অন্তত তরুণ-তরুণীরা সেটা শুনেছেন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
শ্রমের জয়
শ্রম এব জয়তে। স্বর্গে হয়তো এমনটা হতে পারে, এই ভারতে ‘শ্রম’ জিনিসটার স্থান সবার শেষে। আমার যে-বন্ধুরা কর্মী নিয়োগ করেন, তাঁরা নালিশ করেন যে দৌড়োদৌড়ি করে কাজ করার লোক পাওয়াই মুশকিল। সকলেই খোঁজে চেয়ার-টেবিলে বসে করার কাজ। তার মানে কেবল বসে কাজ করতে হবে, এমন নয়। কল সেন্টারে কাজ করতে হয় চেয়ারে বসে, কিন্তু সারাদিনে অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাদের চেঁচামেচি শুনতে হয়। এদেশে পছন্দের কাজ মানে, শান্তিতে টেবিলে বসে ফাইল ঠেলার কাজ। তার জন্য রোজগারে ঘাটতিও মানতে রাজি অনেকে। বেকারত্বের জ্বালায়, বা কিছু টাকার লোভে যাঁরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ শুরু করেন, তাঁদের অধিকাংশ মাস তিনেকের মধ্যে তা ছেড়ে দেন। ফলে নিয়োগযোগ্য লোকের সংখ্যার নিরিখে আমরা চিনকেও ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বরে যেতে চলেছি বটে, কিন্তু আমাদের দেশের নিয়োগকর্তারা হন্যে হয়ে এমন লোক খুঁজে চলেছেন যাঁরা কঠোর পরিশ্রমের, বিরক্তিকর বা একঘেয়ে কাজও করতে রাজি আছেন। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমন কাজই বেশি।
কেবল কম টাকার কাজকেই বা ধরা কেন? গোটা ব্যবস্থাটাই ঠেলে দিতে চায় শারীরিক পরিশ্রমের উলটো দিকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেরা ছাত্ররাও কারখানায় কাজ করার চাইতে ফিনান্স মার্কেটে কাজ করেন (ফিনান্স সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো মাইনে যে আপত্তিকর রকম ভাল দেয়, সেটাও সমস্যার একটা অংশ)। কথা ছিল, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা আইটিআইগুলো দেশকে এমন ছেলেমেয়ে দেবে যাদের চিন্তার ক্ষমতা আর হাতেকলমে কাজের দক্ষতা, দুটোই থাকবে। দেখা যাচ্ছে, আইটিআই থেকে যত ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোয়, তার পাঁচগুণ বেরোয় কলেজ গ্র্যাজুয়েট হয়ে। অথচ কলেজে ভর্তি হওয়ার চাইতে আইটিআইতে পড়াশোনার শর্ত অনেক সহজ, তাই অনেক বেশি ছেলেমেয়ে আইটিআইতে আবেদন করতে পারত। ‘আর্টস’ নিয়ে পড়ে যত ছেলেমেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়, তা আইটিআই-পাশ পড়ুয়াদের দ্বিগুণ। সেটা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের ইতিহাস বা সাহিত্যের প্রতি বেশি অনুরাগের জন্য? নাকি ‘হাত নোংরা’-করা কাজ এড়ানোর জন্য?
এ দেশে যা কিছু গোলমাল, তার দায় জাতপাত ব্যবস্থা আর ব্রিটিশ শাসনের ঘাড়ে চাপানোই দস্তুর। দুঃখের বিষয়, আমিও এ ক্ষেত্রে তা-ই করব। যাঁরা গতর খাটিয়ে কাজ করেন, কয়েক হাজার বছর ধরে তাঁদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক প্রজন্মে এই মনোভাব দূর করা সহজ নয়। হাতের কাজকে অশ্রদ্ধার নিয়ম, আর সেই নিয়ম চাপানোর জন্য গায়ের জোর, এ দুটোই হয়তো আজ আর আগের মতো অত জোরদার নেই। কিন্তু সেই সংস্কৃতির ছাপ রয়েই গিয়েছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে (না হলে আমিই বা অধ্যাপক হলাম কেন?)। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই সব আকাঙ্ক্ষায় দাগ বুলিয়ে চলেছে। ব্রিটিশরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল অল্প কিছু কেরানি নিয়োগ করার তাগিদে। তারা এমন লোক চেয়েছিল যারা পরীক্ষায় পাশ করতে ওস্তাদ, প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারবে, আর অন্য সময়ে মুখ বন্ধ রাখবে। এখনও শিক্ষাব্যবস্থা সেই উদ্দেশেই কাজ করে চলেছে— অন্তত আমি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখনও করত (সেটা যদিও বেশ কিছুদিন আগে, কিন্তু অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্কুল সহজে বদলায় না)। আমরা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল না করলে, বা আচরণ যথেষ্ট সুবোধ না হলে, আমাদের শিক্ষকরা আমাদের সবার সামনে অপদস্থ করার জন্য বলতেন, স্কুল থেকে আধ কিলোমিটার দূরের ওই আইটিআইতে পড়া লেখা রয়েছে আমাদের কপালে। এরপর আর কে সেখানে পড়তে চাইবে?
হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের জীবন থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছেন যে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে সব খামতি, সব বাধা, জয় করা যায়। যদি তাই হয়, তা হলে বলতে হবে যে আমরা, ভারতের অধিকাংশ মানুষ, তাঁর সেই বিশ্বাসের অংশীদার নই। আমরা বরং বারবার চাকরির পরীক্ষায় বসব, বা একটার পর একটা কোর্স করব, এই আশায় যে-কোনও মতে একবার একটা চেয়ার-টেবিলে বসার চাকরি মিলে যাবে। বা অন্তত যে দিন মেনে নিতে হবে যে তেমন চাকরি আর পাব না, সে-দিনটা একটু দূরে ঠেলা যাবে।
সমস্যা হল, ভারতকে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ বা উৎপাদনের কেন্দ্র করে তোলার যে স্বপ্ন মোদী দেখছেন, আমাদের শ্রম-বিমুখতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি কায়িক পরিশ্রমের কাজ মানুষ করতে না চায়, তা হলে মজুরির হার চড়া থাকবে। ফলে প্রতিযোগিতায় আমরা তেমন এগোতে পারব না।
এ ব্যাপারে কী করা যেতে পারে? প্রথমত, আমরা আমাদের চাহিদায়, পছন্দে, পরিবর্তন আনতে পারি। কেবল মোদীই নয়, তরুণ প্রজন্ম যাঁদের পছন্দ করে সেই সব মানুষদের শ্রমের পক্ষে সওয়াল করতে হবে। যদি ক্রিকেট ছেড়ে হকি নিয়ে বলিউডের ছবি হতে পারে, তা হলে সততা, কঠোর পরিশ্রমের গুণগান গেয়েই বা ছবি হবে না কেন? দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় হাতের কাজের চাইতে মাথার কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বহু সহপাঠীর চাইতে নিজেকে ভাল মনে করার ইচ্ছেটা আমার অনেকটাই কমে যেত, যদি জানতাম যে তারাও কাঠের কাজ বা সেলাইয়ের ফোঁড় তোলায় আমার ডাহা অপদার্থতা দেখছে। অবশ্যই যদি না শিক্ষকরা ‘ও কাজগুলো সময় নষ্ট’ বলে পুরো ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দেন। সেটাই তাঁরা করেছিলেন, যখন আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি পাঠ্যক্রমে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’ ঢোকানো হল।
তৃতীয়ত, আমাদের রাস্তাঘাট, অফিস-কাছারি আরও নিরাপদ করতে হবে, বাড়ির কাজ সকলের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে, যাতে মেয়েদের প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের পোশাকের কারখানাগুলোয় শ্রমিকের কাজ করছে প্রধানত মেয়েরা। এদেশেই বা তা হবে না কেন?
শেষ, এবং সব চাইতে কঠিন পদক্ষেপ হল, আমাদের সরকারি চাকুরেদের কম কাজ-বেশি মাইনে দেওয়া বন্ধ করা। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাঙ্কের রিঙ্কু মুরগাই এবং ল্যান্ট প্রিচেট হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা (চুক্তিতে নিযুক্ত নয়, পুরো সময়ের শিক্ষক) গড়ে প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদের চাইতে সাতগুণ বেশি মাইনে পান। এটা ঠিকই যে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা গড়ে বেশি। কিন্তু তার জন্য প্রাপ্য বাড়তি সুবিধে যদি হিসেব কষে বাদ দেওয়া হয়, তা হলেও বেতনে তফাতটা দাঁড়ায় প্রায় আড়াইগুণ। তার সঙ্গে পেনশন ও অন্যান্য সুবিধে তো আছেই। অথচ বাড়তি অভিজ্ঞতা থাকলেও তাঁরা যে আরও ভাল পড়াচ্ছেন, তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। বরং উলটো প্রমাণই মিলেছে। তাঁদের চাকরি যে সুরক্ষিত, ফলে ভাল পড়ানোর, এমনকী নিয়মিত ক্লাসে আসার কোনও তাগিদ তাঁদের নেই, তা সম্ভবত সেগুলোর প্রতিফলন। (তাঁদের বাড়তি অভিজ্ঞতাকেও এর নিরিখে দেখতে হবে। তাঁদের মতো কর্মীরা প্রাইভেট স্কুল থেকে ছাঁটাই হয়ে যাবেন, অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগই পাবেন না।) সরকারি চাকরির সব সুবিধেগুলো যদি কেউ মিলিয়ে দেখে— বেসরকারি চাকরির চাইতে অনেক বেশি মাইনে, অন্যান্য বাড়তি সুবিধে, চাকরির সুরক্ষা, কাজ করার বাধ্যবাধকতা সামান্য— তা হলে স্পষ্ট হয় আমাদের তরুণ-তরুণীরা গা ঘামিয়ে কাজ করার চাইতে কেন বছরের পর বছর সরকারি চাকরি পাওয়ার ফাটকা খেলেন। আরও একটা কোর্স করলে, আরও একটা পরীক্ষা দিলে, যদি এমন চমৎকার চাকরি পাওয়ার মাত্র এক শতাংশ সুযোগও থাকে, তা ছাড়া যায় নাকি? যে সব কাজ তাঁরা করতে চান না, সেগুলো তো আর পালাচ্ছে না। সরকারি চাকরি পাওয়ার আশা ছেড়ে একদিন ভাঙা মনে তাঁরা সেই সব কাজে নাম লেখাবেন। ততদিন দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির স্বপ্ন না হয় অপেক্ষা করে থাক।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৭ অক্টোবর ২০১৪
সম্পদ ও সংকট
নব্বই বছর আগে বিশ্বের গড়পড়তা মানুষের জীবন যেমন ছিল, আজ তার চাইতে অনেক ভাল। সত্যি বলতে কী, তার আগে যে-কোনও সময়ের চাইতে আজ সাধারণ মানুষ ভাল আছে। এই ১৯৫৫ সালেও বিশ্বে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৮ বছর (ওই বছর থেকেই গোটা বিশ্বের তথ্য দিতে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। পেনিসিলিনের মতো শক্তিশালী ওষুধ ব্যাপক হারে ব্যবহারের পরেও এই ছবি ছিল। সুতরাং ১৯২৩ সালে আয়ু আরও কম ছিল নিশ্চয়ই। এখন গড় আয়ু ৭০ বছরের কাছাকাছি। ১৯৫৫ সালে প্রতি সাতজন শিশুর একজন এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। এখন মারা যায় তার এক-তৃতীয়াংশ।
কেবল স্বাস্থ্যই নয়। ১৯৫০ সালেও বিশ্বের ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিরক্ষর ছিলেন। এখন সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশে। যাঁরা তীব্র দারিদ্রে বাস করেন, ১৯৮১ থেকে আজকের মধ্যে তাঁদের অনুপাত ৫০ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উন্নয়নের এই কাহিনি কেবল চিন আর পূর্ব এশিয়ার নয়। ভারতের মতো দেশেও ১৯২০-র দশকে গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৭ বছর। এখন তা ৬৬ বছর। আফ্রিকাতে ১৯৫০-এর দশকে ৩৮ বছর আয়ু থেকে এখন ৫৫ বছরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার সময়েও ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশ। এখন তা ৭৫ শতাংশ। ভারতের জাতীয় দারিদ্রসীমা (যা বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার খুবই কাছাকাছি) অনুসারে এখন ২২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ১৯৪০-এর দশকের কিছু কিছু এমন হিসেব দেখেছি, যা অনুসরণ করলে দারিদ্রের অনুপাত দাঁড়ায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।
কিন্তু সম্ভবত যা আরও বেশি বদলে গিয়েছে, তা হল আমাদের বিশ্বকে দেখার চোখ। ১৯২৩ সালে সব জায়গায় আধিপত্য ছিল সাদা লোকেদের— অন্তত যদি জাপানিদের শ্বেতাঙ্গ বলে ধরা হয়, যেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে জাপানে, পাশ্চাত্যেও। যেখানে তাঁরা সরাসরি শাসন করেনি, সেখানেও তাঁরাই বিধিব্যবস্থা ঠিক করত। বেশির ভাগ মানুষ মনে করতেন, এমনই হওয়ার কথা। ১৯২৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বরাজ চেয়েছিল, কয়েক দশক আগেই যা দেওয়া হয়ে গিয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াকে, তখন ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য স্পেকটেটর’ সেই দাবিকে বলেছিল ‘পাগলের পরিকল্পনা’।
১৯৩১ সালের গোলটেবিল বৈঠকে গাঁধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সমানে সমানে দরদস্তুর করছেন দেখে চার্চিল এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি গাঁধীকে ‘অর্ধনগ্ন’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী ফকির’ বলেছিলেন। আজকের দুনিয়াতেও যে কিছু কিছু দেশ মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব খাটাচ্ছে না, তা নয়। তবে সেটা তাদের অর্থনীতির জোরে, সামরিক জোরে, কিংবা অনুদানের টাকার জোরে। উন্নততর সভ্যতার দাবির জোরে নয়। আর ওই সব দেশও ভালই জানে, চিন, ব্রাজিল, কিংবা হয়তো ভারত তাদের জায়গায় চলে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
আরও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে দেশের অভ্যন্তরে। ১৯২৩ সালেও অম্বেডকর দলিতদের নেতা হয়ে ওঠেননি। আরও পরে তিনি গাঁধী ও কংগ্রেসের সংশ্রব ত্যাগ করবেন, কারণ ‘তাঁর লোকেদের’ জন্য কংগ্রেস কিছু করতে পারবে, সে-আস্থা তাঁর ছিল না। পরে দেখা গেল, যে সব দলে উচ্চবর্ণের নেতৃত্ব, সেগুলোই জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য জারি রাখলেও, পরিবর্তন এল দলিতদের জীবনেও। নিঃসন্দেহে অম্বেডকরের নিজের তৈরি করা নীতির জন্যেও তা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে তফশিলি জাতি, জনজাতির মানুষ অন্যদের চাইতে ৩৬ শতাংশ কম রোজগার করতেন। ২০০৪-০৫ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, ওই ফারাক প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, শিক্ষায় (কত বছর স্কুলে পড়ছে, তার হিসেবে) দলিত-জনজাতির মানুষ অন্যদের কাছাকাছি চলে আসা এই ফারাক কমার অন্যতম কারণ। ভুলে যাওয়া চলে না, ওই ১৯২৩ সালেই মুম্বইয়ের সিডেনহ্যাম কলেজের অধ্যাপকরা আন্দোলন করেছিলেন অম্বেডকরকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করার দাবিতে, যে হেতু বর্ণপ্রথা অনুসারে অম্বেডকরের কাছাকাছি যাওয়াই নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের জন্য। আজ এ দেশের স্কুলের ক্লাসঘরে সব জাতের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে খাবার খায়।
এমন পরিবর্তন গোটা বিশ্বেই ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিম ক্রো আইন কার্যকর ছিল ১৯২৩ সালেও। ওই আইন সাদা লোকের ‘সুরক্ষা’ দিত কালো লোকেদের থেকে, তাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে, স্টেশনে-ক্লাবঘরে এক জায়গায় বসার থেকে। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর আগে, বুশ প্রশাসনে প্রেসিডেন্টের ঠিক পরের পদটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা কন্ডোলিজা রাইসের। ১৯২০ সাল অবধি কোনও মহিলাই আমেরিকায় ভোট দিতে পারত না, কৃষ্ণাঙ্গ তো দূর অস্ত্। ফ্রান্সে ১৯৪৪ সাল অবধি মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোট দেওয়ার জন্য।
সত্যি বলতে কী, মানুষের ভোটে না জিতলে সরকার তৈরি করা যাবে না, এই ধারণাটাই খুব পুরনো নয়। ১৯২৩ সালে হিটলার আর তাঁর সঙ্গী গুন্ডারা বাভারিয়ার নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল (তখনকার মতো)। বামপন্থী আর দক্ষিণপন্থী, দু’তরফেই তখন এই ধারণাটাই ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে যে রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্বশক্তিমান, আর তা চালানোর দায়িত্বে থাকতে হবে এমন কোনও অভিজাত নেতাকে যিনি ‘বোঝেন’ কী ভাবে দুনিয়াটা চলছে। ১৯২৩ সালে লেনিন ক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে চলেছেন, মুসোলিনি নিজেকে ১৯২৫ সালে একনায়কতন্ত্রের শাসক বলে ঘোষণা করবেন, হিটলার করবেন ১৯৩৩ সালে। এ সবের জন্য বিশ্ব যতই যন্ত্রণাদীর্ণ হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও প্রায় ৫০ বছর কেটে গেল গোটা বিশ্বের মানুষের, সেই সব ‘মহান নেতা’-র উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে, যাঁদের বুকে প্রায়ই গাদাগুচ্ছের মেডেল সাঁটা থাকত, যাঁরা নির্বাচন নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। আজকের বিশ্ব আগেকার চাইতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক।
এর প্রতিটিকেই মস্ত সাফল্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, রাজনৈতিক যোগদান, এমন সব বিষয় নিয়ে বহু সহস্র বছরের ধারণা আমূল বদলে গিয়েছে মাত্র কয়েক দশকে। এমনকী অর্থনৈতিক পরিবর্তন যা ঘটেছে, তারও নজির নেই ইতিহাসে। আমার নিজের (অপেশাদার) ইতিহাস পাঠ থেকে মনে হয়েছে, যদিও গরিবের জীবনযাত্রার মানে এর আগেও নানা হেরফের হয়েছে, কিন্তু গত ৩০ বছরে দারিদ্র যত কমেছে তেমন অতীতে কখনও হয়নি।
কিন্তু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, হয়তো এই উন্নতি ধরে রাখা যাবে না। এমন এক সংকট আসবে, যা উন্নয়নের সব লাভ ধুয়েমুছে দিয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী করবে। সম্প্রতি সাক্ষ্য মিলেছে যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রায় দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি ঘটেছে। যে আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা এতদিন করছিলেন, তা আর এড়ানো যাবে না। এখন আমরা চার ডিগ্রি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করছি, যা প্রায় নিশ্চিতভাবে এক ভয়ঙ্কর পরিণাম তৈরি করবে। অতিবৃষ্টি, জলস্ফীতি, বন্যার ধ্বংসলীলায় প্রায় অকল্পনীয় প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি হবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু উন্নয়ন চাওয়া মানেই কি এমন ধ্বংসকে ডেকে আনা? যে সব উন্নয়নের খতিয়ান এতক্ষণ দিচ্ছিলাম, মহাপ্লাবন কিংবা প্রবল খরা কি তার অপরিহার্য পরিণতি? অনেকেই ভোগের তাগিদ-চালিত উন্নয়নকে পরিবেশের ভারসাম্যের বিরোধী বলে মনে করেন। সেটা নিয়ে একটু প্রশ্ন থাকে। এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সমাজ-অর্থনীতিতে পরিবর্তন ও উন্নয়নের যে সব দৃষ্টান্ত, তার অনেকগুলির ক্ষেত্রেই এ যুক্তি চলে না। যে দলিত-আদিবাসীরা নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, যে-মেয়েরা ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেন, যাঁরা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ভোগবাদ ও তজ্জনিত পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী করা কখনওই চলে না। আবার জনস্বাস্থ্যে, চিকিৎসায় যে উন্নতি হয়েছে, তা পাশ্চাত্যে দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি ছড়ানোর ভয়, যুদ্ধে জেতার আগে অসুখে সৈন্য মারা যাওয়ার ভয় থেকেও হয়েছে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য রোগকে আরও ভাল বুঝতে পারার ক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। তা হলে ভোগবাদ-তাড়িত হয়েই উন্নয়ন হয়, তাই উন্নয়নকে সমর্থন করা মানেই পরিবেশের সর্বনাশ ডেকে নেওয়া, তা বলি কী করে? এক কথায়, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে বাধ্য, তা আমি বিশ্বাস করি না।
আসল সমস্যা হল, এখন উন্নয়নের যে মডেলগুলো আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, সেগুলো যে সময়ে তৈরি হয়েছিল তখন পুঁজিবাদী, মার্ক্সবাদী, কেউই প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। এখনকার জীবনযাত্রায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগে যদি আমরা পরিবেশের সংকট বিষয়ে জানতাম, এবং সেই অনুসারে কাজ করতাম, তা হলে হয়তো আজ জীবনটাই অন্য রকম হত। তার মানে এই নয় যে, জীবনে দারিদ্র আরও বেশি থাকত। এ কথাটা মনে রাখা জরুরি, কারণ আমরা যদি মনে করি, কোনও একটা বিকল্প অর্থনীতির মডেলের বিষয়ে সকলে সহমত না হলে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না, সেটা মস্ত ভুল হবে।
যদি নিজেদের বাঁচাবার সুযোগ পেতে হয়, তা হলে আমাদের এখনই কাজে নামতে হবে, এবং তা সকলকে নিয়ে। আর তা করতে হলে আমাদের আজকের সংকট, আজকের সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। গত ৯০ বছরে আমার যা করতে পেরেছি, তার সাফল্য উদযাপন করতে হবে। আর্থিক মন্দা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, আরও যা যা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো মাথায় রেখেও উদযাপন করতে হবে। কারণ, সাফল্যের সম্পদ থেকে সাহস সঞ্চয় না করলে ত্যাগ স্বীকার করা কঠিন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
দরিদ্রের সংখ্যা, সংখ্যার দারিদ্র
২০১১ সালে যোজনা কমিশন দারিদ্রসীমা ধার্য করে, পাঁচজনের পরিবারের জন্য মাসে ৪৮২৪ টাকা শহরে, আর ৩৯০৫ টাকা গ্রামে। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম আপত্তি তোলে যে, মাথাপিছু দৈনিক ৩২ টাকায় শহরে জীবনধারণ সম্ভব নয়।
সংখ্যার সম্মান কি আমরা ভুলতে বসেছি? গত এক বছরে দারিদ্রসীমা নিয়ে জনসমাজে যে বিতর্ক হল, তাতে মনে হয় উন্নয়নে সংখ্যার প্রয়োজন কী, প্রয়োজন কেন, তার ধারণা আবছা হয়ে এসেছে। অথচ এই ভারতেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে তাঁর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কর্মীরা বিশ্বের প্রথম বৃহৎ মাপের সমীক্ষা করেছিলেন। তা থেকেই শুরু হয় জাতীয় নমুনা সমীক্ষা। এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করে বার করা হয়েছিল, দেশে কত গরিব মানুষ আছে। দারিদ্রসীমা নির্দিষ্ট করার কাজেও ভারতই প্রথম ছিল। যোজনা কমিশনের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৯৬০-৬১ সালের বাজারদরে মাসে ২০ টাকা ব্যয় ক্ষমতাকে ‘দারিদ্রসীমা’ বলে নির্দিষ্ট করেন। বাঁচার জন্য যে পুষ্টি প্রয়োজন তার জন্য কত খরচ না করলেই নয়, এবং আরও দু-চারটি বিষয়ের হিসেবের ভিত্তিতে, যথেষ্ট চিন্তা আর পরিশ্রম করে তাঁরা এই সীমা নির্দিষ্ট করেছিলেন ১৯৬২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দারিদ্রসীমা তৈরি করেছিল এর তিন বছর পর, ১৯৬৫ সালে।
দারিদ্রসীমা একটি সংখ্যা। উন্নয়ন সম্পর্কিত এমন নানা সংখ্যা অঙ্ক কষে বের করা অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের কাজ। সেই সংখ্যাকে মর্যাদা দেওয়া মানে, সংখ্যা যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের পেশাদারিত্ব স্বীকার করা। তাঁদের মতামত যা-ই হোক না কেন, যে-প্রশ্নটা তাঁদের করা হয়েছে (যেমন, ভারতে কত গরিব মানুষ আছে?) সেটার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর দেওয়াটা যে তাঁদের কাজ, এবং সেই কাজ যে তাঁরা সততার সঙ্গে করছেন, এটা মেনে নেওয়া। অর্থনীতির জগতে সদ্য প্রয়াত সুরেশ তেণ্ডুলকরকে সেই মর্যাদা দেওয়া হত। টি এন শ্রীনিবাসনকে সেই মর্যাদা দেওয়া হয়। এঁদের মতামতের সঙ্গে যাঁদের মতের অমিল রয়েছে, তাঁরাও এঁদের সততা বা সামর্থ্যকে সন্দেহ করেন না। এই ট্র্যাডিশনই এ দেশে তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু গত বছর দারিদ্র নিয়ে দেশে বিতর্ক-বিক্ষোভের যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, তাতে মনে হচ্ছে সেই ঐতিহ্য যেন আমরা হারাতে বসেছি। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল কয়েকটি সংখ্যা। ভারতে গরিব মানুষ কত শতাংশ, তা ছিল একটা সংখ্যা। আর দুটো সংখ্যা ছিল দৈনিক খরচের। শহরে আর গ্রামে সর্বোচ্চ কত টাকা ব্যয় করলে তাকে গরিব বলা চলে, সেই টাকার অঙ্ক। এই সংখ্যাগুলো কী করে পাওয়া গেল, কী উদ্দেশ্যে এগুলো কষে বার করা হল, কোন দুঃসাহসে এগুলো আনা হল জনসমক্ষে, এমন সব প্রশ্ন তুলে যে হইচইটা বেধে গেল, তাতে বন্যার বছরে ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক, কিংবা নির্বাচনের বছরে ঋণ মকুবের টাকার অঙ্ক ঠিক করার সঙ্গে দরিদ্রের ন্যূনতম মাসিক খরচের টাকার অঙ্ক ঠিক করার কোনও তফাত রইল না। যেন কেউ খেয়ালই করলেন না যে, রাজনীতির অঙ্ক কষার সঙ্গে অর্থনীতির অঙ্ক কষার কোনও তফাত রয়েছে।
এই গোলমালে মিডিয়া, নাগরিক সমাজ আর রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই দাঁড়ালেন যোজনা কমিশনের বিরুদ্ধে। এমনকী কংগ্রেসেরও দু’-চার জন মন্ত্রী মুখরক্ষার মতো কয়েকটা কথা বলে চুপ করে গেলেন। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মনমোহন সিংহ নিজে মিডিয়ার কাছে, সংসদে কিংবা জনসভায় দারিদ্রসীমার সপক্ষে একটি কথাও বললেন না। কংগ্রেসের শরিক দলগুলোও সংসদে দারিদ্রসীমাকে আক্রমণ করল, বিরোধীরা তো বটেই। ফলে ‘বাইট’ যাঁরা দিলেন, আর যাঁরা নিলেন, তাঁরা প্রায় সকলে দাঁড়ালেন এক দিকে। অন্য দিকের মুখপাত্র বলতে যোজনা কমিশনের ডেপুটি কমিশনার মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, যাঁর গ্রহণযোগ্যতা মিডিয়া কিংবা সাধারণ নাগরিকের চোখে কখনওই খুব উঁচু মাপের ছিল না। যোজনা কমিশনের অন্য দু’চারজন কর্তার বক্তব্য উদ্ধৃত হল মিডিয়াতে, তাঁরাও কেউ খুব পরিচিত ব্যক্তি নন। দারিদ্রসীমার সমর্থনে দু’চারজন যাঁরা কলম ধরলেন ইংরেজি পত্রপত্রিকাতে, তাঁরা পেশাদার অর্থনীতিবিদ। অধিকাংশই খোলা বাজারের সমর্থক বলে চিহ্নিত। ইংরেজি কাগজে তাঁদের নিবন্ধগুলো ‘পাবলিক’ খেয়ালও করল না। যোজনা কমিশনের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমা বাতিল হল, নতুন বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হল, আর এক দফা সমীক্ষার পরে (আর্থ-সামাজিক ও বর্ণ সমীক্ষা) নতুন দারিদ্রসীমা ঠিক হবে বলে রফা হয়েছে। সেই সমীক্ষা এখনও চলছে। কে গরিব, তা ঠিক করার কোনও মাপকাঠি দেশের কর্তাদের হাতে এই মুহূর্তে নেই।
এই গোটা ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। এক, বড় মিডিয়া সংস্থাগুলি প্রায় সব ক’টিই কেন দারিদ্রসীমার ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াল? এদের মধ্যে অধিকাংশই মূলস্রোতের অর্থনীতির সমর্থক, উন্নয়নের যে ধারণায় দারিদ্র কমানোর পরিকল্পনা করা হয়, তার সঙ্গে টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা ইন্ডিয়া টুডে কাগজের নীতিগত বিরোধ নেই। দারিদ্রসীমার ধারণা উন্নয়নের সেই মূলস্রোতের নকশার বিরোধী নয়। দারিদ্রসীমা মিডিয়ার কাছে নতুন কোনও ধারণাও নয়, যে ভাবে যোজনা কমিশন তা নির্ধারণ করেছে সেই পদ্ধতিতেও খুব নতুনত্ব কিছু নেই। তা হলে প্রায় গোটা মিডিয়া যোজনা কমিশনের ঘোষিত দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করল কেন?
দুই, রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কিংবা নীরব থাকলেন। কেন? দারিদ্রসীমা প্রয়োগ করলে গরিব রাজ্যগুলো অনেক বেশি টাকা পেত তুলনায় ধনী রাজ্যের চাইতে, কারণ এই সূচক অনুসারে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসমের মতো রাজ্যে গরিবের সংখ্যা বেশি থাকত। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বহু দিন ধরে বিহারে দারিদ্র বেশি, এই যুক্তি দেখিয়ে বেশি টাকা দাবি করে আসছেন কেন্দ্রের থেকে। অথচ তাঁর দলের সাংসদ শারদ যাদব দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন সংসদে। বেশি টাকা পাওয়ার চাইতে চিরাচরিত রাজনৈতিক বিরোধিতাই কি তাঁদের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল? নাকি দারিদ্রসীমা সমর্থন করা মানে দরিদ্রকে অসম্মান করা, এমন কোনও ধারণা চাউর হয়ে যাওয়ায় দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করা তাঁদের কাছে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল?
আর তিন, এই বিতর্ক (নাকি বিতর্কের অভাব?) থেকে দারিদ্র নিয়ে জনসমাজে (public sphere) আলাপ-আলোচনার ধরনধারণ সম্পর্কে কী ছবি স্পষ্ট হল? কী ভাবে ভারতে নীতি বিষয়ক আলোচনার গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট হয়? তা থেকে আমাদের জনসমাজে, বিশেষত মিডিয়াতে, ডিসকোর্স সম্পর্কে কী বোঝা যায়?
এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে। যোজনা কমিশনের নির্ধারিত দারিদ্রসীমা ঠিক কিনা, সেটা এখানে আলোচনার বিষয় নয়। সাংবাদিকরা, বা রাজনৈতিক বিরোধীরা যে সরকারকে বা যোজনা কমিশনকে সমালোচনা করবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কমিশনের বক্তব্য কী, আর জনসমাজের আলোচনায় সে-সম্পর্কে কী বলা হল, তা মিলিয়ে দেখা দরকার।
আলোচনার গোড়ায় দারিদ্রসীমা সম্পর্কিত ঘটনাপঞ্জি দেওয়া দরকার।
২০১১, ২৯ মার্চ: খাদ্যের অধিকারের বিষয়ে পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজ (PUCL) ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টে যে-মামলা করেছিল, তারই সূত্রে সুপ্রিম কোর্ট যোজনা কমিশনের কাছে জানতে চায়, ভারতে অপুষ্টির হার খুবই বেশি, কিন্তু যাঁরা স্বল্পমূল্যে রেশন থেকে চাল-গম পেতে পারেন, সেই গরিবদের সংখ্যা কেন সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছে?
১০ মে: তার উত্তরে হলফনামায় যোজনা কমিশন জানায়, সুরেশ তেণ্ডুলকর কমিটি ২০০৯ সালে যে পদ্ধতিতে দারিদ্রসীমা নির্ণয়ের প্রস্তাব করেছিল, যোজনা কমিশন সেটাই মেনে নিয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা ছিল দৈনিক ভোগ ব্যয় (consumer expenditure) মাথাপিছু শহরে ২০ টাকা এবং গ্রামে ১৫ টাকা। সেই অনুসারে অঙ্ক কষলে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ গরিব। এই দারিদ্রসীমায় বা তার উপরে যাঁরা রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা FAO-র বিধি অনুসারে তাঁদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরির ঘাটতি হবার কথা নয়।
১৪ মে, ২২ জুলাই: হলফনামা পেশ করার তিন দিন পরে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট দৈনিক ২০ টাকা বা ১৫ টাকায় ২০১১ সালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সম্ভব নয়। যোজনা কমিশনকে ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে মাথাপিছু প্রয়োজনীয় টাকার অঙ্ক নির্দিষ্ট করতে হবে। আবার ২২ জুলাই একটি নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা হিসেবে নির্দিষ্ট মাসিক ভোগ ব্যয় (শহরে ৫৭৯ টাকা, গ্রামে ৪৪৭ টাকা) ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট করতে হবে।
২০ সেপ্টেম্বর: যোজনা কমিশন সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিল। কমিশন হিসেব কষল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা মূল্যস্ফীতির পর ২০১১ সালে কত হওয়া উচিত। সেই অনুসারে বলা হল, পাঁচজনের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে শহরে ৪৮২৪ এবং গ্রামে ৩৯০৫ দারিদ্রসীমা বলে মানতে হবে। মাথাপিছু হিসেব করলে শহরে তা দাঁড়ায় ৩২ টাকা এবং গ্রামে ২৬ টাকা। এত কম টাকা খরচ করে কেউ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে পারে কি না, এই প্রশ্নে ঝড় উঠল মিডিয়াতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৩ অক্টোবর প্রেস কনফারেন্স করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, তাতে সমালোচনার ধার কমল না।
২০১২, ১৯ মার্চ: নতুন হলফনামা পেশ করল কমিশন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কোর্টে হলফনামা দেওয়ার সময়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০০৯-১০ সালের পারিবারিক ভোগ ব্যয় সমীক্ষার ফল হাতে আসেনি। ২০১২ সালে সেই তথ্য-পরিসংখ্যান হাতে এসে যাওয়ায় তার ভিত্তিতে অঙ্ক কষে দেখা গেল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা ২০০৯-১০ সালে দাঁড়িয়েছে দৈনিক মাথাপিছু শহরে ২৮ টাকা ৬৫ পয়সা, গ্রামে ২২ টাকা ৪৩ পয়সা। এই অঙ্ক অনুসারে ভারতে গরিবের অনুপাত ৩৭.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৮ শতাংশে। সংখ্যার হিসেবে গরিব মানুষ ৪০.৭ কোটি থেকে ৩৫.৫ কোটিতে নেমে এসেছে। এই হলফনামা দেওয়ার দু’দিন পরেই (২১ মার্চ) লোকসভায় প্রায় সব দলের নেতারা যোজনা কমিশনকে তুলোধোনা করে এই দারিদ্রসীমাকে উড়িয়ে দিলেন।
২৪ মে: প্রবল সমালোচনার মুখে নতুন একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করা হল অর্থনীতিবিদ সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে। কমিটি দারিদ্রসীমা নির্ণয় করার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করছে।
‘নিষ্ঠুর রসিকতা’: দারিদ্র ও মিডিয়া
ইংরেজি কাগজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, একটি সংখ্যাকেই দারিদ্রসীমার আলোচনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তা হল মাথাপিছু দৈনিক ব্যয়। ‘দিনে ৩২ টাকায় কী হয়?’ সুপ্রিম কোর্টের কাছে কমিশনের সেপ্টেম্বরের হলফনামার পর এই ছিল মিডিয়ার সমালোচনার মূল সুর। কখনও অবিশ্বাস, কখনও ক্ষোভ, কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে দিয়ে এই কথাটিই ঘুরে-ফিরে এসেছে। বত্রিশ টাকা ঠিক কীসের মাপ, সেটাও গুলিয়ে যেতে লাগল। হিন্দুস্তান টাইমস হেডলাইনে লিখল, ‘যোজনা কমিশনের রসিকতা: দিনে ৩১ টাকা পাঁচজনের পরিবারের জন্য যথেষ্ট।’ যদিও দিনে ৩১ টাকা ছিল মাথাপিছু হিসেব, পরিবারের জন্য নয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার হেডলাইন, ‘দিনে ৩২ টাকা খরচ করেন? সরকারের মতে আপনি গরিব নন।’ আউটলুক পত্রিকায় শিরোনাম, ‘কম, আরও কম।’ টেলিভিশন চ্যানেলগুলি দেখাতে লাগল, ৩২ টাকায় (মার্চের হলফনামার পর, ২৮ টাকায়) বাজার থেকে কী কী খাবার কেনা সম্ভব, তাতে কী করে পেট চালানো যেতে পারে।
মিডিয়াতে এই সমালোচনা হয়তো আকস্মিক নয়, নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে এর একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। যাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে এই মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়, সেই PUCL সদস্যরা যোজনা কমিশনের প্রথম হলফনামার পর দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে যোজনা কমিশনের প্রত্যেক সদস্যের নাম করে ২০ টাকার বাজার করে এনেছিলেন। এই বিক্ষোভের ধরনের দু’টি দিক আছে— এক, বক্তব্যের ভাল-মন্দের আলোচনায় না গিয়ে বক্তাকে দোষী ঠাহর করে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এবং দুই, বক্তব্যকে বিদ্রুপ করে তাকে ভুল প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। ভাবটা এই যে, যদি দেখিয়েই দেওয়া যায় যে ২০ টাকায় হাফ কেজি আলু, চারটে পটল ছাড়া কিছু হয় না, আর তা দিয়ে কারও পেট ভরা সম্ভব নয়, তা হলে আর বলার থাকেটা কী? নাগরিক আন্দোলনের শরিকদের কাছে অবশ্য এই ধরনের স্ট্র্যাটেজি খুব অপ্রত্যাশিত নয়, হয়তো অনভিপ্রেতও নয়। যেখানে কোনও সরকারি নীতি বা গাফিলতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা হয়, সেখানে বিমূর্ত নীতিকে প্রত্যক্ষ চেহারা দেবার একটা তাগিদ থাকে। তাই ‘মৃত’ টেলিফোনের ‘শবযাত্রা’ বার করা হয়, কিংবা ক্রেতা সুরক্ষা আইনে চিকিৎসকদের আনার প্রতিবাদে ডাক্তাররা আলু-পটল বেচেন।
কিন্তু অস্বস্তি জাগে যখন দেখি যে, আন্দোলনে যার নির্মাণ করা হয়েছিল প্রতীকী অর্থে বা বিদ্রুপের অস্ত্র হিসেবে, মিডিয়া যেন তাকেই হুবহু গ্রহণ করল। তাই বাজারের প্রায়-শূন্য থলি, আর ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ, এই দুটোই মিডিয়াতে সব কথাবার্তা ছাপিয়ে উঠল। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখল, চাল-গমের জন্য দিনে সাড়ে পাঁচ টাকা, ডালের জন্য এক টাকা দুই পয়সা কিংবা দুধের জন্য দু’টাকা তেত্রিশ পয়সার বেশি খরচ করলে আপনি দারিদ্রসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন। গোটা রিপোর্ট (সেপ্টেম্বর ২১, ২০১১) যোজনা কমিশনের হিসেবকে তুলে দিয়েছে, প্রায় কোনও মন্তব্য ছাড়াই, কিন্তু রিপোর্টারদের বক্তব্য স্পষ্ট— দেখে নাও এই হিসেব কতটা আজগুবি। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার রিপোর্টার (সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১) বেঙ্গালুরুর এক বিধবা গৃহস্থালি কর্মীর সাক্ষাৎকার নিলেন, ৩২ টাকায় বাঁচা যায় কি না। সেই মহিলা চোখের জলে ভেসে বললেন, সনিয়া গাঁধী ৩২ টাকায় বেঁচে দেখাক। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র সাংবাদিক দিল্লির নানা বস্তির বাসিন্দাদের প্রশ্ন করলেন, দিনে ৩৪ টাকায় বাঁচলে তাকে গরিব বলা ভুল কি না (২১ মার্চ, ২০১২)। আউটলুক (এপ্রিল ২, ২০১২) পত্রিকার সাংবাদিক নিজে ২৮ টাকায় এক দিন বাঁচার চেষ্টা করে দেখলেন। তিন কাপ চা, দু’টুকরো পাঁউরুটি আর এক প্লেট কুলচা-ছোলার বেশি সারা সকাল কিছু খেতে না পেরে ‘অ্যাংরি অ্যান্ড হাংরি’ অবস্থায় দুপুরবেলা রিপোর্ট লিখলেন তিনি।
সরকারি দাবি পরখ করতে সাংবাদিকদের যে ক’টা অস্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে একটা অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা দিয়ে মিলিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি। বন্যায় ত্রাণ সত্যিই গরিব পাচ্ছে কি না, রেশন সত্যিই মিলল কি না, স্কুল-হাসপাতাল খোলা কি না, এ সবই গ্রামে গিয়ে নিজে দেখে, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রকাশ করলে সরকারি কর্তাদের দাবি কতটা ধোপে টেকে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উন্নয়নের নানা ‘jargon’ (‘women’s empowerment’, ‘participatory democracy’, ‘community ownership’) বাস্তবে কতটা অর্থপূর্ণ হচ্ছে, তা-ও এ ভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া যায়। কিন্তু দারিদ্রসীমার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা, কিংবা গরিবের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাংবাদিকরা ঠিক কী চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন, তা হয়তো নিজেদের কাছেই তাঁরা স্পষ্ট করেননি। তাঁরা প্রশ্ন করেননি, যে দৈনিক খরচের অঙ্কে পৌঁছলে বেঙ্গালুরুর গৃহস্থালি কর্মীর (যিনি মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন) কিংবা ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকের (যিনি গৃহস্থালি শ্রমিকের অন্তত দশগুণ রোজগার করেন) অভাবের বোধ থাকবে না, সেই অঙ্কটি কেমন হবে? তাকে দারিদ্রসীমা ধরলে ভারতে প্রায় সব মানুষই কি ‘গরিব’ পর্যায়ভুক্ত হবেন না? আর তা হলে দারিদ্রসীমা তৈরি করারই কি কোনও প্রয়োজন থাকবে?
আউটলুক-এর সাংবাদিক নিজের অর্ধদিন অল্পাহারের পর দাবি করেছেন, দৈনিক ২৮ টাকায় দরিদ্রতম (‘poorest of the poor’) মানুষও বাঁচতে পারে না। খিদের কামড়েই হয়তো খেয়াল করেননি, অন্তত ৩৫-৪০ কোটি এমন মানুষ রয়েছেন এ দেশে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দারিদ্রসীমার কাছাকাছি মানুষরা কত চাল, ডাল, তেল খান, তার হিসেব স্পষ্টই ধরা রয়েছে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেই তথ্য একবার মেলানো হল না কোনও সাংবাদিকের। অথচ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা অন্য রকম ‘স্টোরি’ সাংবাদিকরা করতে পারতেন। তা হল, বাস্তবিক যাঁরা দারিদ্রসীমার তলায় রয়েছেন তাঁরা কী খেয়ে রয়েছেন, কেমন করে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন, আমোদ-আহ্লাদও করছেন। দারিদ্রসীমা ২০ টাকা নাকি ২৮ টাকা, নাকি আরও বেশি বা কম, সে-প্রশ্নটার গুরুত্বই নষ্ট হত মানবজীবনের এই বিপুল সংকটের সামনে। দারিদ্রসীমা যে গরিবের সম্পর্কে খুব সামান্যই বলতে পারে, সে-কথাটাই বিপাকে ফেলত সরকারের উন্নয়নের নীতিকে। সংখ্যাটা ফালতু, তা বলার দরকার হত না।
পেটের খিদে, মুখের কথায় একটি সংখ্যাকে বাতিল করার মধ্যে পরিণামচিন্তার অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে এক ধরনের ঔদ্ধত্য— অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না, তাঁদের অঙ্ক ভুল, অভিপ্রায় মন্দ। ‘ক্যালাস’ আর ‘ক্রুয়েল’ শব্দ দুটো নানা মিডিয়া রিপোর্টে ঘুরে-ফিরে এসেছে। ‘ট্র্যাজিক জোক’, ‘ক্রুয়েল জোক’ কথাগুলো বারবার ব্যবহার করা হয়েছে, শেষের কথাটা হেডলাইনেও ব্যবহার হয়েছে (ইন্ডিয়া টুডে, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। সেই সঙ্গে দারিদ্রসীমার সামান্যতা নিয়ে বিক্ষুব্ধ বিস্ময় যোজনা কমিশনের প্রতি, এবং সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি আক্রমণের চেহারা নিয়েছে। এ বিষয়ে মিডিয়াকে একরকম নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংবাদিক পি সাইনাথ। মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া বিদেশে ভ্রমণের সময়ে দিনে দু’লক্ষ টাকা খরচ করেন, ইউ পি এ সরকারের মন্ত্রীরা নিজেদের সম্পদ বিপুল হারে বাড়াচ্ছেন প্রতি বছর, এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর বক্তব্য, যাঁরা নিজেরা বিপুল বিলাসিতায় রয়েছেন তাঁরাই দেশবাসীকে দৈনিক ২৩ টাকায় জীবন চালাতে বলছেন (দি হিন্দু, ২১ মে, ২০১২)। অর্থাৎ মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির সীমা নেই বলে তাদের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমাও বাতিল করতে হবে। নানা দৈনিক, সাময়িকীর পাতায় সাংবাদিকরা দাবি করলেন যে দরিদ্রের সংখ্যা কম দেখাতে, দরিদ্রের জন্য বরাদ্দ কমাতে যোজনা কমিশন ‘তেণ্ডুলকর পদ্ধতি’ কাজে লাগিয়ে দারিদ্রসীমা তৈরি করেছে। সুরেশ তেণ্ডুলকর মানুষটি কে, কী তাঁর জীবনের কাজ, তা না জেনেই তাঁকে প্রায় ষড়যন্ত্রকারীর পর্যায়ে ফেলা হল।
এদিকে মিডিয়ার নানা রিপোর্টে কিছু ভুল বারবার উঠে এসেছে, যা এতই মৌলিক যে আশ্চর্য না করে পারে না। যেমন, দৈনিক ১.২৫ ডলার খরচের নীচে বাঁচলে গরিব, বিশ্বব্যাঙ্কের এই নিরিখে অনেকেই ৩২ টাকাকে আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার কম বলেছেন। এমনকী টাইমস ম্যাগাজিন-এও ৩২ টাকাকে ৬৫ সেন্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে (৪ অক্টোবর, ২০১১)। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার সমতার হিসেবে মার্কিন ডলার ভারতে ১৯ টাকা। সে হিসেবে ভারতের দারিদ্রসীমার সব ক’টি প্রস্তাবিত অঙ্কই ছিল আন্তর্জাতিক সীমার উপরে। আবার, ২০১২ সালে যোজনা কমিশন শহরের দারিদ্রসীমা ২৮.৬৫ টাকা ঘোষণা করার পর মিডিয়াতে অনেক হইচই হল যে, ২০১১ সালের হলফনামার ৩২ টাকার চাইতে কমিশন আরও কমিয়ে দিয়েছে দারিদ্রসীমা। অথচ ৩২ টাকার অঙ্ক ছিল ২০১১ সালের বাজার দর অনুসারে, আর ২৮ টাকার অঙ্ক ২০০৯-১০ সালের দর অনুসারে। নানা সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, তেণ্ডুলকর কমিটির পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে দরিদ্রের সংখ্যা কমাতে। বাস্তব ঠিক উলটো, তেণ্ডুলকর কমিটি গ্রামীণ দারিদ্রসীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, এবং যোজনা কমিশন তা মেনেও নেয়। তার ফলে ২০০৯ সালে গরিবের সংখ্যা বাড়ে প্রায় ১২ কোটি।
এমন নানা ভ্রান্তি কেবল যে মিডিয়ার মনোযোগের অভাব নির্দেশ করে, তা নয়। সংখ্যার প্রতি সম্মানের অভাবও নির্দেশ করে, যা এক বৃহত্তর সমস্যার প্রকাশ। বড় মাপের সমীক্ষা এবং তার ফলের উপর অঙ্ক কষে পাওয়া সংখ্যার অর্থ, বা তার প্রয়োজন সম্পর্কে খুব কিছু চিন্তা না করেই তা নিয়ে মন্তব্য করা, এই সবটাই অবৈজ্ঞানিক মন, প্রশিক্ষণহীন চিন্তার ইঙ্গিত দেয়। এম জে আকবরের মতো শ্রদ্ধেয় সাংবাদিকও এর ব্যতিক্রম নন। ২০০৯ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি লিখলেন, ইউ পি এ-র সময়ে ভারতে দারিদ্র বেড়ে গিয়েছে ২০ শতাংশ। বাড়তি ৫৫ মিলিয়ন মানুষ চলে গিয়েছেন দারিদ্রসীমার তলায় (দ্য পায়োনিয়র, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০০৯)। এই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক বুদ্ধদেব ঘোষ কিন্তু জানিয়েছেন, আকবরের এই তথ্যগুলি তাঁদের বক্তব্য নয়। ‘আমাদের রিপোর্টে ২০০৯-১০ সালের তথ্য-পরিসংখ্যান কিছুই ছিল না। দারিদ্র কত শতাংশ বেড়েছে, বা কত বাড়তি লোক গরিব হয়ে গিয়েছে, তা কিছুই বলার মতো সংখ্যা হাতে ছিল না তখন।’
মিডিয়ার এমন নানা মৌলিক ভ্রান্তি নিয়ে তখন বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ কলম ধরেছিলেন। হিন্দুস্থান টাইমস-এ কিরীট পারিখ, টাইমস অব ইন্ডিয়াতে-এ অরবিন্দ পানাগড়িয়া, ইকনমিক টাইমস-এ স্বামীনাথন আয়ার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ পার্থ মুখোপাধ্যায়, ডেকান হেরাল্ড-এ অলোক রায় প্রমুখ চেষ্টা করেছেন তেণ্ডুলকর পদ্ধতি এবং দারিদ্রসীমার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু তাঁদের কথা বুঝতে সময়, ধৈর্য লাগে। সাংবাদিকরাই সেই ধৈর্য দেখাননি, সাধারণ পাঠক-দর্শক দেখাবেন তা আশা করা যায় না। বরং ‘২৮ টাকায় পেট ভরে না’ কথাটা চট করে বোঝা যায়। অর্থনীতিবিদরা পালটা অভিযোগ করেছেন, টি ভি অ্যাঙ্কর আর পত্রিকা সাংবাদিকরা কি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি মাইনে দেন বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভারকে? মনে রাখতে হবে ড্রাইভার তার মাইনেতে চার-পাঁচটা পেট চালায়। রিপোর্টারদের ‘কপট ক্ষোভ’ বিষয়টাকেই গুলিয়ে দিল মানুষের কাছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘গরিবদের গুলি করুন, বিষ দিন’: দারিদ্রের রাজনীতি
এমনই নাটকীয় ভাষায় সংসদে দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করেছিলেন শারদ যাদব। তিনি সংযুক্ত জনতা দলের সদস্য এবং এন ডি এ-র আহ্বায়ক। তেণ্ডুলকর পদ্ধতি অনুসারে যোজনা কমিশন ২০০৯-১০ সালের জন্য শহরে দারিদ্রসীমা ২৮ টাকা বলে নির্দিষ্ট করায় রাজনৈতিক দলগুলি হইচই জুড়ে দেয়। শরদ যাদব বলেন, ‘এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে কেউ এক মত নয়।’ অথচ আশ্চর্য এই যে, এই তথ্যের সঙ্গে এক মত হওয়ার সব চাইতে বেশি কারণ ছিল বিহার আর উত্তরপ্রদেশের। কারণ দরিদ্রের সংখ্যা অনুপাতে রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পায়। যে রাজ্যে বেশি গরিব, সেই রাজ্যে বেশি টাকা পৌঁছয়। যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা ধরলে শতাংশের হিসেবে রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক গরিব রয়েছে বিহারে (জনসংখ্যার ৫৩.৫ শতাংশ, ৫.৪৩ কোটি মানুষ) আর সংখ্যার হিসেবে সর্বাধিক গরিব রয়েছে উত্তরপ্রদেশে (৭.৩৭ কোটি মানুষ, জনসংখ্যার ৩৭.৭ শতাংশ)। অতএব যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান মানলে অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি কেন্দ্রীয় অনুদান আসত বিহার এবং উত্তর প্রদেশে। যদি যোজনা কমিশনের নির্দিষ্ট দারিদ্রসীমা না মানা হয়, কিংবা যদি ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা দারিদ্রসীমা ধরা হয়, তা হলে কার্যত সব রাজ্যে গরিবের সংখ্যা এক হয়ে যাবে। তখন রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পদবণ্টনের কোনও মাপকাঠি থাকবে না, এক মাত্র উপায় হবে সব রাজ্যে সমান অনুপাতে বণ্টন। হিসেব কষলে দেখা যাবে, সব রাজ্যে সমান অনুপাতে মানুষ বি পি এল ধরে কেন্দ্র অনুদান দিলে যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা অনুসারে বণ্টনের চাইতে উত্তরপ্রদেশ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম পাবে, বিহার পাবে সাত হাজার কোটি টাকা কম। তাই সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা মানার জন্য জোর সওয়াল করবেন বিহার, উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধিরা। অথচ সংসদে শারদ যাদব বললেন, ‘বাস্তব থেকে দূরে রয়েছেন আলুওয়ালিয়া। তিনি কথা বললেই গণ্ডগোল বেধে যায়। তিনি কখনও একটা ভাল কথা বলেননি… এ ভাবে দারিদ্র দূর করার চাইতে গরিবদের গুলি করে, বিষ দিয়ে মেরে দেওয়া ভাল।’ উত্তরপ্রদেশের সাংসদ, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং বললেন, যোজনা কমিশন দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বত্রিশ টাকায় জলখাবারও হয় না, মানুষ তাতে বাঁচবে কী করে? তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উন্নয়নের অনুদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে কেন্দ্রের উপর। দরিদ্রের মোট সংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে পঞ্চম (২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ), কিন্তু সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে বললেন, যোজনা কমিশনকে আবার পুরো বিষয়টা চিন্তা করতে হবে।
কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস কেরলের মানুষ, তেণ্ডুলকরের হিসেবে তাঁর রাজ্যে গরিব জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। দারিদ্রসীমা উঠে যেতে রাজনৈতিক ফায়দা হল তাঁর। কোথায় কত গরিব তা যে হেতু আর নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, তাই সব রাজ্যে এখন দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে স্বল্পমূল্যের শস্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ দারিদ্রসীমা থাকলে কেরল যত শস্য পেত, তার অন্তত আড়াই গুণ বেশি পাবে।
সব রাজ্যকে সমান সুবিধে দেওয়া হবে, এ কথাটা শুনলে আপাতদৃষ্টিতে ন্যায্য বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু নেই। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০০৯-১০) অনুসারে বিহারের গ্রামবাসীদের প্রায় ৯০ শতাংশ, আর উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, কর্ণাটক এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাসীদের প্রায় ৮০ শতাংশ বাঁচেন দিনে ৩৫ টাকারও কমে। সেখানে হিমাচল, পঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরলে (সম্ভবত দিল্লি আর গোয়াতেও) অর্ধেকেরও কম গ্রামবাসী ওই টাকায় দিন চালান, এ সব রাজ্যে অধিকাংশের ব্যয়ক্ষমতা বেশি। এদেরকেও যদি গরিব রাজ্যদের সঙ্গে সমান করে দেখা হয়, তার মানে দাঁড়াবে এই যে, কেরলে যাঁরা দিনে ৩৫ টাকার বেশি খরচ করতে পারেন এমন অনেক মানুষও সস্তায় চাল-গম পাবেন। আর বিহার-উত্তরপ্রদেশে বহু মানুষ যাঁদের ৩৫ টাকাও খরচের সাধ্য নেই তাঁরা ভর্তুকির চাল-গম পাবেন না। গরিব মানুষটি কেরলে না জন্মে উত্তরপ্রদেশে জন্মেছেন বলে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলেন, এটা কেমন ন্যায়?
দারিদ্রসীমা যত নীচে নামানো হবে, তত বেশি সহায়তা পাবে গরিব-প্রধান রাজ্যগুলো। যত তা উপরে ওঠানো হবে, দারিদ্রসীমা রাখা হবে ৫০, ৮০ বা ১০০ টাকায়, তত বেশি সুবিধে পাবে তুলনায় ধনী রাজ্যগুলো। দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা করে যাঁরা গরিবের জন্য দরদ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য এমন এক নীতির সূচনা হয়েছে যাতে এখন মার খাচ্ছে গরিবই।
নীরবতার শব্দ
ভারতে রাজনৈতিক নেতারা অর্থনীতি বোঝেন না, এমন নয়। দারিদ্রসীমা থেকে খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্পকে বিযুক্ত করে দিলে তার ফল কী হবে, তা-ও তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন। একশো দিনের কাজের পর ইউ পি এ সরকারের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা খাদ্য নিরাপত্তা আইন। অথচ তার যথাযথ রূপায়ণ করার তাগিদে, কিংবা যোজনা কমিশনের মর্যাদা (বা সুরেশ তেণ্ডুলকরের মর্যাদা) রক্ষার তাগিদে, এমনকী বিরোধীদের আক্রমণ ঠেকাতেও মুখ খুললেন না প্রধান নেতারা। তাই এই বৎসর-ব্যাপী বিতর্কের দিকে তাকিয়ে ‘কী হল, কেন হল’ বোঝার চেষ্টা করলে মনে পড়ে যায় গল্পের গোয়েন্দা শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘কিন্তু কুকুরটা ডাকল না কেন?’ কোথায় ভুল হচ্ছে, কী ভুল হচ্ছে, তা বুঝেও চুপ করে থাকলেন মনমোহন সিংহ, প্রণব মুখোপাধ্যায় কিংবা পি চিদাম্বরমের মতো প্রথম সারির নেতারা। দারিদ্রসীমার প্রয়োজন নিয়ে তাঁরা মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিলে আলোচনার ধারা-প্রকৃতির উপর একটা প্রভাব পড়তে পারত। তাঁদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে মিডিয়া বাধ্য থাকায় দারিদ্রসীমার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো জনসমাজের নজর এড়িয়ে যেতে পারত না।
কেন তাঁরা মুখ খোলেননি, তা আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন নয়। ২০১১ ছিল একের পর এক ‘স্ক্যাম’ ফাঁস হওয়ার বছর। টু-জি কাণ্ডে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার হলেন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা, এপ্রিলে কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির দায়ে সুরেশ কালমাডি। এপ্রিলের গোড়ায় অণ্ণা হজারে তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন দিল্লিতে, অপ্রত্যাশিত সাড়া জাগাল তাঁর অনশন। দুর্নীতিগ্রস্ত, দরিদ্রের শত্রু বলে সরকারের গায়ে যে দাগ লাগল, ‘গরিব-বিরোধী’ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করে সেই দাগকে আরও গাঢ় করার ঝুঁকি কোনও নেতা নিতে চাইবেন না, সেটাই প্রত্যাশিত। পঞ্চায়েত মন্ত্রী জয়রাম রমেশ কেবল একবার সাংবাদিক বৈঠক করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে, বললেন রাজ্যগুলো কেন্দ্রের থেকে বেশি করে টাকা আদায় করতে দারিদ্র বেশি দেখাতে চায়। এ নেহাত চাপান-উতোরের কথা, এবং পুরো সত্যি নয়। বেশি টাকাই বিরোধিতার মূল কারণ হলে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করত।
তা তারা করেনি, কারণ রাজনৈতিক বিরোধিতা দারিদ্রসীমা বিরোধিতার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, চারটি রাজ্যই রয়েছে বিরোধী জোট এন ডি এ-র শাসনে। ওড়িশায় বিজুর জনতা দল আগে এন ডি এ-র শরিক ছিল, এখন তৃতীয় ফ্রন্টে। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে সুবিধেমতো হাত মিলিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে কংগ্রেসকে অপদস্থ করে চাপ সৃষ্টি করেছেন। মিডিয়া এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতারা যেখানে যোজনা কমিশন এবং সরকারকে শূলে চড়িয়েই রেখেছে, সেখানে সরকারকে সমর্থন করে তাঁরা নিজেদের ঝুঁকি টেনে আনবেন, তার কোনও সম্ভাবনা ছিল কি? বরং একজন দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে সুর চড়ালে অন্যদের আরও সুর চড়ানোই নিরাপদ বলে মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের তত্ত্ব বলে, ভোটদাতার স্বার্থরক্ষাই নেতাদের কাজ। এখানে রাজনীতি ঘুরে গেল উলটো দিকে— গরিব রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা নিজের রাজ্যের অধিকাংশ ভোটদাতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে দরিদ্রের উন্নয়নের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার সম্ভাবনাকে কার্যত বাতিল করে দিলেন।
গত এক বছরে ভারতের জনসমাজের ডিসকোর্স থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়। অণ্ণা হজারে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলনে মহারাষ্ট্রে দুর্নীতি কত কমাতে পেরেছেন, তা প্রায় কেউ জানত না। দুর্নীতি কমানোর যে-দাওয়াই তিনি দিয়েছেন, সেই লোকপাল-এর ঝুঁকি কী, সুবিধে কী, তা নিয়েও মিডিয়া বা জনসমাজে খুব বেশি কিছু আলোচনা হয়নি। তবু তিনিই যে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠলেন, সে তাঁর সন্ত-সদৃশ জীবনযাত্রার দৌলতে। বহু মানুষের চোখে সততার ‘প্রতীক’ তিনি, তাঁর ইমেজ একটা সময়ে প্রায় সব জননেতাকে অতিক্রম করে গেল। সেই জন্যই তাঁর প্রস্তাবিত ‘লোকপাল বিল’ জনসমাজে মান্যতা পেল। তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে রয়েছেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া। তাঁর জীবনযাত্রায় দারিদ্রের কোনও ছাপ নেই, গরিবের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খেতে দেখা যায়নি তাঁকে, আগাগোড়া মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করায় তিনি বামপন্থীদের চক্ষুশূল, ‘গণশত্রু’ বলে এক রকম চিহ্নিতই হয়ে ছিলেন বহুদিন। গরিবের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য নন বলেই তাঁর পেশ করা দারিদ্রসীমা গ্রহণযোগ্য হল না। তিনি যে দারিদ্রসীমার যুক্তি-তর্ক খুব প্রাঞ্জলভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এমন নয়। বরং তাঁর নানা মন্তব্য, যেমন, ‘যে ভাবেই বিচার করো, দারিদ্র কমেছে’ বিরোধীদের আরও চটিয়ে দিয়েছে। তিনি আগাগোড়াই প্রতিপক্ষকে ‘ডিসমিস’ করে দিয়েছেন, বোঝাপড়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু চেষ্টা করলেও ফল হত কি? মন্টেক খারিজ হয়েই ছিলেন, তাই দারিদ্রসীমা খারিজ হল।
এটা ভারতের জনসমাজে ডিসকোর্সের সমস্যা, নীতি তৈরিরও সমস্যা। ঠিক নীতি কী, তা বিচার করতে গেলে ‘কী বলা হচ্ছে’ তা না দেখে ‘কে বলছে’ সেটা বড় হয়ে ওঠে। বক্তার অবস্থানের চাইতে তার অভিব্যক্তি গুরুত্ব পায় বেশি। নীতি বা প্রকল্পের দ্বারা প্রার্থিত ফল কতটা হবে, কেমন করে হবে, সে-বিচারের চাইতে নীতি বা প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মহানুভবতা যেন আরও বড় বিচার্য। যে জনস্বার্থ মামলার সূত্রে দারিদ্রনীতি নিয়ে এত বিতর্ক হল, সেই খাদ্য নিরাপত্তার দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট হয়ে যায়। গরিব যথেষ্ট পুষ্টি পায় না, তাই তার হাতে প্রতি সপ্তাহে খাদ্যশস্যই তুলে দিতে হবে। পুষ্টির ব্যবস্থা হয়তো আরও সহজে, কম খরচে, দ্রুত করা যেত যদি রাজ্যগুলো তাদের সুবিধে অনুসারে গরিবদের ফুড স্ট্যাম্প দিত, বা টাকা দিত, কিংবা রেশন ব্যবস্থাই চালু রাখত। কিন্তু এমন কেজো সমাধানে কেউ খুশি হয় না। রাশি রাশি চাল-গমই তুলে দেওয়া চাই গরিবের ঝুলিতে, কারণ সরকারের সদিচ্ছার সেরা অভিব্যক্তি হবে সেটাই। যা শুনতে ভাল, যা দেখতে ভাল, যা বলতে ভাল, সেটাই ভাল নীতি। মুশকিল হল, জনসমাজের ডিসকোর্সের এই রীতিতে আর যারই ভাল হোক, গরিবের হয় না। গরিবকে মর্যাদা দিতে হলে তার পছন্দ-অপছন্দ, আশঙ্কা-উচ্চাশা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। দারিদ্র কমানোর প্রকল্পের কার্যকারিতা বিষয়ে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। ভাল সংখ্যা না হলে ভাল নীতি তৈরি করা অসম্ভব।
এই উপলব্ধি বিশেষজ্ঞদের একটা ছোট বৃ্ত্তে রয়ে গিয়েছে, জনসমাজের বৃহত্তর পরিধিতে এখনও ছড়িয়ে যায়নি। আমাদের জনসমাজের ডিসকোর্স বৃহৎ সমীক্ষালব্ধ, জটিল বিচারলব্ধ সংখ্যাকেও সম্পদ মনে করে না। বরং তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে তাকে সন্দেহ করে, তাচ্ছিল্য করে। চিন্তার এই দারিদ্রেই নোঙর গেঁথেছে ভারতের দারিদ্র।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য, বারোমাস, ২০১২
২. শিক্ষা
বকের নেমন্তন্ন
ক্লাস সেভেনে পড়াশোনা ছেড়েছে বাবাই দাস। মুকুন্দপুর বাজারে বাবার দোকানে বসে চানাচুর-বিস্কুট বিক্রি করছিল। চানাচুর প্যাকেট কত করে, প্রশ্ন করতেই একটা তুলে পিছনের ঝাপসা বেগুনি কালির ছাপা লেখা পড়ে বলে দিল, ‘আড়াইশো ৩০ টাকা।’ এক কিলোগ্রাম কত হল তা হলে? ‘কেন, ১২০ টাকা?’ তখন পাশে একজন ২৮ টাকার জিনিস কিনে ৫০ টাকার নোট দিলেন, বাবাই ফেরত দিল ১৬ টাকা। ‘গতবারের ছ’টাকা বাকি ছিল না?’
রবি পড়ুয়ার বয়স ১৩, রিকশা চালায় পূর্বালোক কালীবাড়ি থেকে সিংহবাড়ি বাসস্টপ। পড়া ছেড়েছিস কবে? ‘অনেক দিন, সে-ই ক্লাস ফাইভ।’ ভাড়া আট টাকা, সকালটা স্ট্যান্ডে দাঁড়ালে সওয়ারি হয় গোটা বারো, নিজেদের রিকশা বলে ৯৬ টাকাই ঘরে নিয়ে যেতে পারে, প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে দিল রবি।
স্কুলের বাইরে এই ছেলেরা কী সুন্দর মুখে-মুখে অঙ্ক কষে। স্কুলে থাকলে আরও কত শিখত, তাই না?
না, শিখত না, সেই সম্ভাবনাই বেশি। ভারতে যে ছেলেরা যায় স্কুলে, তাদের দশজনে চারজন চতুর্থ শ্রেণি পেরিয়েও সরল বিয়োগ কষতে পারে না, মাতৃভাষায় লেখা সরল বাক্য পড়তে পারে না। এমনকী অষ্টম শ্রেণি পাশ করে গিয়েও অন্তত ১৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে এগুলো পারে না। পরপর কয়েক বছর একটি সর্বভারতীয় সমীক্ষা থেকে (ASER) এই ছবিটা বেরিয়ে আসছে।
আরও দেখা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা যত উঁচু ক্লাসে উঠতে থাকে, তত তাদের শেখার সম্ভাবনা কমতে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির উপযোগী লিখতে-কষতে না-পেরেই যত ছেলেমেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছিল, তাদের চারজনে মাত্র একজন তৃতীয় শ্রেণিতে সেই ক্ষমতা তৈরি করতে পারছে। শিশুটি যখন রয়েছে চতুর্থ শ্রেণিতে, তখনও হয়তো তার আশা আছে, কেউ খেয়াল করবে সে লিখতে-পড়তে পারছে না, তাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু আবারও পিছিয়ে-পড়া ছাত্রদের চার জনে মাত্র একজন বিয়োগ কষতে, পড়তে-লিখতে শিখছে চতুর্থ শ্রেণিতে। শেষ অবধি দেখা যাচ্ছে, তিনজনে একজন শিশু প্রাথমিকে প্রায় পাঁচ হাজার ঘণ্টা স্কুলে বসে থেকেও পড়তে-লিখতে, অঙ্ক কষতে শিখছে না।
লজ্জায়, বিরক্তিতে যারা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের অনেকেই কিন্তু কাজ করতে গিয়ে হিসেব করছে দিব্যি, কাজ-চালানোর মতো পড়তে-লিখতেও পারে। যার কথাবার্তায় জড়তা নেই, মুখে-মুখে অঙ্ক করায় ভয় নেই, পাঁচজনের সঙ্গে মিশে নিজের কাজ হাসিল করার মতো জটিল কাজও যে করতে পারে, তার খাতায় বছর বছর কেন পড়ত লাল কালির দাগ? ওই খোকা-খুকুরা ফেল করছে, নাকি ফেল করছে শিক্ষা দফতরের বুড়ো খোকারা?
শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, ‘কী পড়ানো হবে,’ সেই প্রশ্নটা আলোচনার জমির প্রায় সবটা দখল করে বসে রয়েছে। এ রাজ্যে নতুন সরকার এসেই প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠক্রমে কী কী পড়ানো হবে তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছিল। তার নানা প্রস্তাবের মধ্যে কতগুলো সরকার গ্রহণ করেছে, কতগুলো করেনি, কমিটি থেকে কাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, কারা ঢুকেছে তা নিয়ে মিডিয়াতে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। কিন্তু যেটা শিক্ষার একেবারে গোড়ার কথা— ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়েও কেন বই পড়তে, অঙ্ক কষতে শিখছে না, সে-প্রশ্নটা প্রায় না-ছোঁয়া রয়ে যাচ্ছে। দেখেশুনে শেয়ালকে সূপ খাওয়াতে বকের নেমন্তন্ন করার গল্প মনে পড়ে যায়। কুঁজোর ভিতরের বস্তুটি অতিশয় পুষ্টিকর হতে পারে, কিন্তু পাত্রটি এমনই যে শেয়াল বেচারিকে পাত্রের গা চেটে খিদে-পেটে ফিরতে হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরাও তেমনি পাঁচ-আট-দশ বছর স্কুলে বসেও অঙ্ক-বাংলা-ইংরেজির নাগাল না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
এ বার ‘কী পড়ানো উচিত’ তা নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ করে ‘কী করে পড়ানো উচিত’ সেই প্রশ্নে আসতে হবে। অক্ষর চিনে শব্দ, শব্দ জুড়ে বাক্য পড়তে শেখাটাই যদি প্রথম দরকার হয়, তা হলে কোন বই পড়ে শিশু তা শিখছে, সেটা অত কিছু জরুরি নয়। যদি ‘হাঁদা-ভোদা’ কমিকস পড়তে শিশুরা ভালবাসে, তা হলে তা থেকেই শিক্ষক প্রশ্ন করবেন না কেন? সব শিশুকে একই পাঠ্যবই থেকে পড়তে শিখতে হবে, এটাও জুলুম ছাড়া কিছু নয়। যা ভাল লাগবে, তা-ই পড়বে। ‘সহজ পাঠ’ যে সফল, তার কারণ রবীন্দ্রনাথের অসামান্য শব্দচয়ন শিশুদের কান, মন টেনে আনে অক্ষরগুলোর দিকে। তবু আজকের শিশুর কাছে যদি ‘বড় বৌ মেজ বৌ মিলে, ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে’ তেমন ইন্টারেস্টিং ছবি তৈরি না করে, তা হলে তাকে অন্য বই পড়াতে হবে। বাঁকুড়ায় যা পড়ানো হবে, জলপাইগুড়িতে তা পড়ানো না-ও হতে পারে। ‘কী পড়ল’ সেই ছুতমার্গে না গিয়ে, কতটা শিখল, সেটাই দেখার দরকার শিক্ষা দফতরের। পড়তে যদি সে শেখে, পড়ার আগ্রহ যদি তার জন্মায়, তবে আখেরে সে পড়বে এবং জানবে অনেক বেশি। স্কুলের গোড়াতেই তার মগজে বিগ ব্যাং থেকে শ্রেণি সংগ্রাম পর্যন্ত সব গুঁজে দেওয়া অর্থহীন। অন্তত প্রাথমিকের ক্ষেত্রে শিক্ষা দফতর কেবল দক্ষতার ন্যূনতম মাপকাঠি স্থির করে দিলেই যথেষ্ট— দ্বিতীয় শ্রেণিতে একটি ছাত্রকে কী কী পারতে হবে, তৃতীয় বা চতুর্থতে আরও কী কী তার করতে পারা দরকার। কোন কোন বই পড়ে, কতগুলো অনুশীলনী কষে সে ওইসব দক্ষতা আয়ত্ত করবে, সেটা শিক্ষক বুঝবেন। ‘কী কী জানল’ সেটা শিক্ষার মাপকাঠি নয়, ‘কী কী পারে,’ সেটাই মাপকাঠি।
কী পারছে, তা বুঝতে পরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেই পরীক্ষার দরকার শিক্ষাপদ্ধতির মূল্যায়ন করতে। ছাত্ররা কে কত পেল, সে-তালিকা প্রকাশেরই দরকার নেই। দরকার শ্রেণির সাফল্য-ব্যর্থতার মোট ছবিটা তুলে ধরা। দ্বিতীয় শ্রেণির ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়ে যদি ৬৪ থেকে ৩১ বিয়োগ করতে ভুল করে, কিংবা ৬০ শতাংশ ‘কাল ছিল ডাল খালি’ ছড়াটা গড়গড় করে পড়তে না পারে, তা হলে বাপ-মায়ের ‘চেতনার অভাব’ কিংবা শিশুর বেয়াড়াপনার উপর দায় চাপানো চলবে না আর। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্লাসের পড়ানোয় গলদ আছে।
কেন পড়াশোনা হচ্ছে না, সেটা শিক্ষক ক্লাসে আসছেন না বলে, নাকি ক্লাস ঘর নেই বলে, সে-খবর শিক্ষা দফতরের রাখা চাই। ‘স্কুল ইনস্পেকটর’ স্কুলগুলিতে গিয়ে নিয়মিত পরিদর্শন করার যে রীতি আগে প্রচলিত ছিল (যার জন্য স্কুলগুলোকে কত সাজগোজ করে তৈরি থাকতে হত তার বিবরণ বহু গল্পে পাওয়া যায়) এখন তা প্রায় উঠে গিয়েছে। অথচ নিয়মিত স্কুল পরিদর্শনের কোনও বিকল্প নেই। কী পড়া হবে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, কেমন পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ রাখা শিক্ষা দফতরের কাছে অনেক জরুরি কাজ।
অন্য কাজটি হল, শেখার তাগিদ, শেখানোর তাগিদ কী করে বাড়ে, তার উপায় খোঁজা। সত্তর-আশির দশকে মনে করা হয়েছিল, যত বেশি স্কুল খোলা হবে, যত শিক্ষক রাখা হবে, যত বেশি শিশুদের আনা যাবে স্কুলে, তত প্রসার হবে শিক্ষার। গত দুই দশকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকায় প্রচুর স্কুল খোলা হয়েছে, বহু দরিদ্র দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ ছোট ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। অথচ নানা সমীক্ষায় ধরা পড়ছে যে, ছেলেমেয়েরা শিখছে সামান্যই। কেবল স্কুল খুলে রাখলেই শিশুরা যথেষ্ট লেখাপড়া শিখবে না, সেটা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তাই নানা দেশে-প্রদেশে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, কীভাবে শেখালে কাজ হয়। শিক্ষক-অভিভাবক-ছাত্রদের কী ধরনের পুরস্কার দিলে (বা শাস্তি দিলে) তারা পড়ায় আগ্রহী হবে। কীসে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বেশি— স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ, নাকি পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ, নাকি শিক্ষকদের বাড়তি অনুদান? ছেলেমেয়েরা কত সামান্য শিখছে সে-বিষয়ে বাবা-মাকে জানালে কি তাঁরা স্কুলের উপর চাপ তৈরি করেন? নাকি ভাল নম্বর-পাওয়া ছাত্রদের স্কলারশিপ দিলে বাবা-মা বেশি যত্ন নেবেন সন্তানের পড়াশোনায়? এ সব প্রশ্নের নানা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। ভাল পড়াশোনা শেখার সূত্র যদি বার করতে হয়, তবে হাতে-কলমে এমন সব কাজের থেকেই তা বেরোবে। রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স, বিবেকানন্দ কী বলে গিয়েছেন সেই ‘শিক্ষার আদর্শ’ থেকে নয়, কেরল মডেল বা ব্রিটিশ মডেল থেকে নয়, ‘আমরা তো এমন করেই শিখেছি’ গোছের আলগা বিশ্বাস থেকে নয়। কীসে কাজ হয়, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখে নীতি তৈরি করতে হবে।
সে-কাজ হচ্ছেও। আফ্রিকার কিনিয়াতে দেখা গিয়েছে, অসুস্থতা শিশুদের স্কুল কামাই করার একটি বড় কারণ। বছরে দু’বার কৃমির ওষুধ খাওয়ালে স্কুল-কামাই কমে অন্তত ২৫ শতাংশ। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের নানা দেশে স্কুলছাত্রদের কৃমির ওষুধ দেওয়ার কাজ চলছে, ভারতে প্রকল্প চলছে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারে। ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের উৎসাহ ভাতা দেওয়ার পরীক্ষা হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে, তাতেও সুনির্দিষ্ট ফল পাওয়া গিয়েছে (বক্স দেখুন)।
নীতি যদি ক্লাসঘরের বাস্তব সমস্যাগুলোর দিকে না তাকায়, তা হলে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সদিচ্ছা জমে পাথর হবে কেবল। তাতে চাপা পড়বে বাবাই, রবির মতো শিশুদের লেখাপড়া শিখে গাড়িঘোড়া চড়ার স্বপ্ন।
কেমন করে নম্বর বাড়ে: অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরীক্ষা
ছাত্রদের ফল ভাল হলে যদি শিক্ষকদের বাড়তি টাকা মেলে, তা হলে কি ছাত্ররা আরও ভাল শেখে? তা বুঝতে পাঁচ বছর ধরে অন্ধ্রপ্রদেশের তিনশোটি গ্রামীণ প্রাথমিক স্কুলে (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি) চলে একটি পরীক্ষা। নিয়ম হয়, ছাত্রদের গড় নম্বর এক শতাংশ বিন্দু বাড়লে শিক্ষকরা পাবেন ‘বোনাস’ ৫০০ টাকা। একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘গ্রুপ বোনাস’— স্কুলের গড় নম্বর বাড়লে সব শিক্ষক সমান বোনাস পাবেন। অন্য একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘ব্যক্তিগত বোনাস’-যে ছাত্রদের একজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন, তাদের গড় নম্বর বাড়লে সেই শিক্ষক বোনাস পাবেন। শেষ একশোটি স্কুলে (‘কন্ট্রোল গ্রুপ’) কোনও বোনাস দেওয়া হয়নি।
• ব্যক্তিগত উৎসাহ ভাতা কাজ দিয়েছে সবচেয়ে ভাল। পাঁচ বছর পরে এইসব স্কুলের ছাত্ররা অন্য ছাত্রদের চেয়ে অঙ্ক এবং ভাষায় বেশি নম্বর পেয়েছে।
• ‘গ্রুপ বোনাস’ স্কুলের ছাত্ররা প্রথম বছর উন্নতি করলেও, পাঁচ বছর পর ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’-এর ছাত্রদের মতোই নম্বর পেয়েছে।
• ব্যক্তিগত বোনাস কেবল অঙ্ক আর ভাষার নম্বরের জন্য দেওয়া হলেও, ওই স্কুলগুলোতে ছাত্রদের বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের নম্বরেও উন্নতি হয়েছে।
এই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের বেতনের কিছু অংশ দিলে স্কুলে ছাত্রদের আরও ভাল শেখার সম্ভাবনা বেশি। দুর্বল ছাত্ররাও বেশি শিখছে এই ব্যবস্থায়।
আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব-এর তরফে এই পরীক্ষাটি করেন কার্তিক মুরলীধরন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ এপ্রিল ২০১২
যাচ্ছে কিন্তু শিখছে না
গরিবের ছেলেকে কত কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়, তার গল্প কে না শুনেছে। বালক ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় রাস্তার গ্যাসের আলোর নীচে বসে পড়া মুখস্থ করেছেন। মেঘনাদ সাহা সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হতে দূরের গ্রামে আশ্রয়দাতার পরিবারের বাসন মেজেছেন পুকুরের ঘাটে। ঘরে-ঘরে অমন গল্পও কম নয়। ‘আমরা সাত ভাই-বোন একটা হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছি। আজ তোমাদের পড়ার টেবিল, টিউটর, লোডশেডিঙে ইমার্জেন্সি ল্যাম্প, তা-ও পড়াশোনা হয় না’, শুনে শুনে কত কান পচে গিয়েছে, ঠিক নেই।
এখন দেখা যাচ্ছে, কথাটা খুব ভুল নয়। দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে স্কুল শিক্ষা খতিয়ে দেখে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকার এবং পরিবার আগের চাইতে ঢের বেশি খরচ করছে স্কুলের পড়াশোনার জন্য। হয়তো উন্নত দেশগুলোর মতো অতটা নয়। কিন্তু যত স্কুল তৈরি হয়েছে, যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে গত দশ বছরে, আগে কখনও হয়নি। ভারতের কথাই ধরা যাক। প্রথমে সর্বশিক্ষা মিশন (২০০১), পরে শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) কার্যকর হওয়ার পরে গ্রামেও এখন এক কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল। স্কুলে বাড়তি ক্লাসঘর, বাড়তি শিক্ষক, বিনা পয়সায় পাঠ্যবই, শৌচাগার, মিড-ডে মিল, সব জোগানো হচ্ছে। ইস্কুলে যাওয়া আজও সহজ নয় অনেকের কাছে, কিন্তু আগের মতো কঠিনও নয়।
অথচ ছেলেমেয়েরা শিখছে অতি সামান্য। এক শ্রীলঙ্কা ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে স্কুলপড়ুয়ারা আন্তর্জাতিক গড়ের চাইতে অনেক পিছিয়ে। প্রাথমিক স্কুল থেকে যারা বেরোচ্ছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ লেখা, পড়া, অঙ্ক কষার গোড়ার কাজগুলো পারছে না।
কথাগুলো খুব নতুন নয়। তবে তার ব্যাখ্যাটা সাধারণত হয় এ রকম, ‘ওরা গ্রামের গরিব ছেলেমেয়ে। বাপ-মা কোনও দিন পড়াশোনা করেনি। স্কুলে নাম লেখাতে পেরেছে, তা বলে পড়াশোনা কি আর করতে পারবে? অতই সোজা?’ তাই না-শেখার সংকট নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত বিশেষ মাথা ঘামায় না। এই রিপোর্টে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চিন্তার কারণ আছে।
শিক্ষকরা যখন তাঁদের পড়ানোর বিষয়টি সম্পর্কে জানেন (অনেকেই জানেন না— বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক প্রাথমিকের অঙ্ক ঠিক কষতে পেরেছেন), তখন তাঁরা অনেকেই বিষয়টি ছাত্রদের বোঝাতে পারছেন না।
একটি সমীক্ষায় পাকিস্তানের মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষক দু’সংখ্যার যোগ বোঝাতে পেরেছেন ছাত্রদের। নামীদামি স্কুলের শিক্ষকরাও কিন্তু একই প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছেন। ফলে নামী স্কুলের পড়ুয়াও ক্লাসের পড়া বুঝতে পারছে না। আমরা বলছি, ছেলেমেয়ের মন নেই, মাথা নেই। কিন্তু পাঠদানেই দক্ষিণ এশিয়ায় খামতি রয়ে গিয়েছে, বলছে রিপোর্ট। চিনের সাংহাইয়ের উদাহরণ দিয়ে বলা হচ্ছে, সেখানে নতুন শিক্ষকরা অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানবিশি চলতে থাকে। একই বিষয়ের শিক্ষকরা একসঙ্গে বসে পাঠ-পরিকল্পনা করেন। ফলে পড়ানো ভাল করার দিকে সহায়তা, সচেষ্টতা থাকছে শিক্ষকদের। যেটা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না, বলছে রিপোর্ট।
কিন্তু শিক্ষকরা বোঝাতে পারছেন না কেন, সেই মৌলিক প্রশ্নটা কেউ তেমন করছে না। তার কারণ, ক্লাসে কে কতটা বুঝল তা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। আমাদের স্কুলে গোটা পড়াশোনাটাই সিলেবাস-মুখী। ছাত্রমুখী নয়। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট এই বিষয়টিকে ছুঁয়ে গিয়েছে কেবল, কিন্তু এটা সম্ভবত ছাত্রদের না-শেখার প্রথম এবং প্রধান কারণ। এ বিষয়ে শিক্ষক এবং বাবা-মা, দু’তরফেই একটা মোহান্ধতা কাজ করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যতটা পারা যায় শিখিয়ে দিতে হবে, এই তাগিদ থেকে সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, সকলেই সিলেবাসে যত পারে বিষয় ঠাসে। এ রাজ্যে যেমন প্রাথমিকেই ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ঠুসে দেওয়া হয়। বেসরকারি ইংরেজি স্কুলগুলোতে সেই সঙ্গে মরাল সায়েন্স বা সিভিক্সও বাদ যায় না। পারলে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বা শেক্সপিয়ারের নাটকও আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়িয়ে দিই। আমাদের দৃষ্টিতে দেখলে, পাশ্চাত্যে স্কুলে কিছুই শেখায় না। তিন-চারটে বই, হোমওয়ার্ক নেই, পরীক্ষাও নামমাত্র।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট ‘স্কুল লার্নিং ইন সাউথ এশিয়া’ যা বলছে | শেখার মান বাড়াতে যা করতে হবে | |
• দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ২০০১ সালে প্রাথমিক স্কুলে নাম লেখাত ৭৫ শতাংশ শিশু। সেকেন্ডারি স্কুলে ৪৪ শতাংশ। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৯ শতাংশ এবং ৫৮ শতাংশ। ওই সময়ে স্কুলছুট পড়ুয়াদের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি থেকে কমে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লক্ষ। | কিন্তু প্রাথমিকের পড়ুয়াদেরএক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ পড়তে-লিখতে, অঙ্ক কষতে শিখছে না। এতে আর্থিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, কারণ দক্ষ কর্মী না থাকলে শিল্পোদ্যোগীরা বিনিয়োগ করতে চান না। | প্রাক্-প্রাথমিক বয়সের শিশুদের যথাযথ পুষ্টি জোগানো। • শিক্ষকদের বোঝানোর দক্ষতা এবং দায়বদ্ধতা বাড়াতে ‘পারফর্ম্যান্স’-ভিত্তিক পারিশ্রমিক। • স্কুলের আর্থিক বরাদ্দকে প্রয়োজন এবং ‘পারফর্ম্যান্স’-এর সঙ্গে যুক্ত করা। সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলে ছাত্রদের উন্নতির মূল্যায়নের ব্যবস্থা তৈরি করা এবং ক্রমাগত তার পরিমার্জনা করা। |
কিন্তু সে সব দেশে পুরো জোরটা দেওয়া হয় পড়ুয়ার লেখার ক্ষমতা, নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতার উপরে। গরমের ছুটিতে কী করেছ, লিখে এনে পড়ে শোনাও— এমনই স্কুলের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে যেমন ইচ্ছে, যা ইচ্ছে লিখতে বাধা নেই। এখানকার বহু স্কুলে দাবি, ক্লাসে দিদিমণি যা পড়ান তা-ই লিখতে হবে। এমনকী উচ্চশিক্ষিত বাবা-মাও বলেন, ‘আন্টি যা লেখাবেন, ক্লাসে সেটাই লেখো।’ স্কুল এখানে শিশুদের বাধ্যতার পরীক্ষা, দক্ষতার পরীক্ষা নয়। এক স্কুলছাত্রী ক্লাসে তার শিক্ষিকার পড়ানো তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলায় শিক্ষিকা পালটা প্রশ্ন করেন, ‘তুই দিদিমণি, না আমি?’ প্রশ্ন করার ইচ্ছেটাই দমিয়ে দেওয়া হয় স্কুলে। কোনও সমস্যার সমাধান করা, যুক্তি দিয়ে মত প্রতিষ্ঠা, ভাষায় আবেগের প্রকাশ, এগুলো শিশুরা পারছে কি না, তা নিয়ে আমাদের স্কুল মাথাই ঘামায় না। রাতদিন পড়াশোনা করেও যে পড়ুয়াদের দক্ষতা বা ‘স্কিল’ তৈরি হয় না, এতে মধ্যবিত্ত-গরিব, সব ছেলেমেয়েই কর্মক্ষেত্রে মুশকিলে পড়ছে।
কী করলে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে আরও ভাল শিখতে পারে, তা নিয়েও চিন্তা দরকার। ফিনল্যান্ডে প্রতি ৪৫ মিনিট ক্লাসের পর ১৫ মিনিট ‘ফ্রি টাইম’ দেওয়া হয় ছাত্রদের। দেখা গিয়েছে, তার ফলে তারা ক্লাসে আরও বেশি মন দিতে পারে। জাতীয় স্তরে শুধু দক্ষতার প্রত্যাশিত পরিমাপ (ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড) দেওয়া থাকে। কী ভাবে সেই পরিমাপে ছাত্রদের পৌঁছনো যাবে, ঠিক করেন শিক্ষকরা। কী বই পড়া হবে, তা-ও তাঁরাই ঠিক করেন। ‘এখানে ও সব সম্ভব নয়’ বলে কথাটা উড়িয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু কী করলে পড়ুয়ারা আরও সহজে আরও ভাল শিখতে পারবে, সে-প্রশ্ন এড়ানো চলে না। যদি দেখা যায়, কম পড়ালে শিশুরা বেশি শেখে, তবে বেশি পড়াতে যাব কেন?
এ দেশে এই কথাগুলো শুরু করলেই কোরাস ওঠে— এখানে ক্লাসে ঠাসাঠাসি ছাত্র, ব্ল্যাকবোর্ড অবধি নেই, বাথরুম নেই। চারটে ক্লাসে তিন জন কি দু’জন শিক্ষক। এখানে ও সব বড় বড় বুলি কপচে কী লাভ? যেমন চলছে, তেমনই চলবে। এ কথাটা মানতে গেলে অনেকগুলো হোঁচট খেতে হয়। এক, এর মানে দাঁড়ায়, আজও শিশুরা কিছু শিখছে না, কালও শিখবে না। এটা মেনে নেওয়া কেবল অন্যায় নয়, অপরাধ। দুই, যেখানে বাবা-মা মোটা টাকা খরচ করছেন পড়াশোনার জন্য, সেই সব স্কুলেও ‘কী করলে পড়ুয়ারা আরও ভাল শেখে,’ সে-চিন্তা থেকে পড়ানো হয় না। বরং ‘পড়ার চাপ’ বাড়ানো ভাল স্কুলের লক্ষণ বলে মনে করা হয়। তিন, সরকারি স্কুলের অবস্থা খুব কিছু না বদলেও দেখা যাচ্ছে, পড়ুয়াদের শেখার মান অনেকটা বাড়ানো সম্ভব। যেমন, ছাত্রদের শেখায় (লার্নিং আউটকাম) উন্নতি আনতে অন্ধ্রপ্রদেশের ৫০০টি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে চারটি পদ্ধতি আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কোনও শিক্ষকের অধীনে শেখার উন্নতি হলে শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে বোনাস দেওয়া, স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীর উন্নতি হলে সব শিক্ষককে বোনাস দেওয়া, স্কুলে একজন বাড়তি চুক্তি-শিক্ষক নিয়োগ, এবং স্কুলকে এককালীন একটি অনুদান। খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, দু’বছর পরে (’০৯-’১১) সব ক’টি পদ্ধতিতেই পড়ুয়াদের উন্নতি হয়েছে, সবচেয়ে কাজ দিয়েছে শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে বাড়তি টাকা দেওয়া। অল্প বোনাসও (বার্ষিক বেতনের ৩ শতাংশ) ছাত্রদের দক্ষতা যথেষ্ট বাড়িয়েছে। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, ঠাসা ছাত্র, নড়বড়ে ঘরদোর সত্ত্বেও শিক্ষকের বাড়তি উদ্যোগ ছাত্রদের লিখতে পড়তে শেখায় উন্নতি আনতে পারে।
আর একটা পদ্ধতি পরীক্ষা করা হয়েছে হরিয়ানা, গুজরাত, বিহারের জেহানাবাদে। স্কুলের গোটা সময়ের থেকে নির্দিষ্ট কিছু মিনিট রেখে দেওয়া হচ্ছে কেবল লেখা আর পড়ার দক্ষতা তৈরির জন্য। ওই সময়ে প্রতিটা ছাত্রকে লিখতে আর পড়তে অভ্যাস করানো হচ্ছে। এর ফলে খামতি থাকার জন্য যারা পিছিয়ে যাচ্ছিল, তারাও দ্রুত উঠে আসছে। অর্থাৎ স্কুলের পঠনপাঠনে খুব বড় বদল না এনেও শেখানোয় উন্নতি করা যাচ্ছে। লিখতে-পড়তে শেখানোকে স্কুলের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে গেঁথে দেওয়ায় খুব বাড়তি কোনও বোঝা চাপছে না, কিন্তু কাজ অনেক ভাল হচ্ছে। এমন ছোট ছোট পরিবর্তন করা খুব কঠিন নয়।
বড় পরিবর্তনও যে আসেনি, তা তো নয়। স্বাধীনতার সময়ে অক্ষরপরিচয় ছিল দশ জনে এক জনের। সত্তরের দশকেও দশ জনে তিন জনের। গত বছর দশ-পনেরোয় সে-ছবি আমূল বদলে গিয়েছে। এখন কার্যত ১০০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে নাম লেখায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। আজকের দুর্গা স্কুলে গিয়ে গরম খিচুড়ি-সবজি খেয়ে অপুর পাশে বসে বই খুলে পড়ছে। আপার প্রাইমারি স্কুল দূরে হলে আজকের মেঘনাদের জন্য বাড়ির কাছে তৈরি হচ্ছে মধ্যশিক্ষা কেন্দ্র। বদল তো হচ্ছেই। প্রশ্ন হল, যাঁরা সেই বদলকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে পারছেন, স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষা দফতর, অভিভাবক, সবাই তাঁদের থেকে পাঠ নিতে রাজি কি না। ছেলেমেয়েরা না-ই যদি শিখল, তবে ‘শিক্ষা’ কীসের?
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ অগস্ট ২০১৪
বেঞ্চে বসার অধিকার
শিক্ষার জন্য জওহরলাল নেহরু কম করেননি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম), ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই), এবং এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের তিনিই রূপকার। অথচ যাঁর জন্মদিনে শিশু দিবস পালন করা হয়, সেই মানুষটি প্রাথমিক স্কুলের প্রসারের জন্য সামান্যই করেছেন। দু’হাজার কোটিরও বেশি টাকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মাত্র ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল প্রাথমিক শিক্ষার জন্য। সেটা এই জন্য নয় যে নেহরু শিশুদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না— উলটোটাই সত্যি— কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাকে তাঁর এমন কোনও বড় সমস্যা বলে মনে হয়নি, যা নিয়ে তক্ষুনি কিছু করা দরকার।
মুক্ত বাজারে বিশ্বাস করেন যে অর্থনীতিবিদরা, তাঁদের সঙ্গে নেহরুর খুব বেশি মতের মিল ছিল না। কিন্তু তাঁদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, লোকে কোনও-না-কোনও ভাবে সন্তানদের ঠিক লেখাপড়া শেখাবে। মুক্ত বাজারের প্রবক্তারা বলেন, বাজারই স্কুল জোগাবে। তবে নেহরুর মাথায় সম্ভবত ছিল স্থানীয় মানুষ পরিচালিত স্কুল, বা অসরকারি সংস্থার স্কুলের কথা। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই মূল কথা এক— বাবা-মা জানেন তাঁর সন্তানের জন্য কোনটা ভাল, আর সেটাই তাঁরা করতে চান।
এক অর্থে বলা চলে, কথাটা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে এখন স্কুলে যাচ্ছে। দেশ জুড়ে গজিয়ে-ওঠা স্বল্প মাইনের বেসরকারি স্কুলে শিশুকে পাঠাচ্ছেন গরিব বাবা-মায়েরাও। বেসরকারি স্কুলে যাঁদের ভরসা, গরিবদের মধ্যেও তেমন বাবা-মায়েদের অনুপাত বাড়ছে। ছেলেমেয়ের জন্য বাবা-মায়ের সক্রিয়তার এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
এই আশা-জাগানো ছবিটা আঁকতে গিয়ে একটা জায়গাতেই হোঁচট খেতে হয়— ছেলেমেয়েরা কিছু শিখছে না। শিশুদের পড়তে-অঙ্ক কষতে পারার মূল্যায়ন করে অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (অসর)। ‘প্রথম’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা এই রিপোর্ট বার করে। পরপর বেশ কয়েক বছর ধরে ‘অসর’ রিপোর্টের ফল দেখাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিশু দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না। অঙ্কের ফল তো আরও খারাপ।
কেন শিখছে না শিশুরা, তা নিয়ে নানা কথাবার্তা চলছে। আজকাল সরকারি স্কুলের ব্যর্থতার নানা ব্যাখ্যা কান পাতলেই শোনা যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যত ঘণ্টা পড়ানোর কথা, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন স্রেফ তার অর্ধেক। বেসরকারি স্কুলে অবশ্য শিক্ষকদের উপস্থিতির হার অনেক ভাল। বাবা-মায়েরাও বলছেন, সেই কারণেই বেসরকারি স্কুল তাঁদের বেশি পছন্দ।
কিন্তু শিশুদের শেখানোর প্রশ্নে সরকারি স্কুলের চাইতে খুব কিছু এগিয়ে নেই বেসরকারি স্কুলগুলো। এটা ঠিকই যে, গড়পড়তা ফল বেসরকারি স্কুলে ভাল হয়। কিন্তু তা থেকে ধরে নেওয়া চলে না, সেখানে শিক্ষকরা আরও ভাল শেখাচ্ছেন। কারণ, এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে বেসরকারি স্কুলে যাঁরা পাঠান সন্তানকে, সেই বাবা-মা তুলনায় বিত্তবান, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার প্রতি অধিক মনোযোগী। অনেক ক্ষেত্রে দুটোই সত্যি। তাই বেসরকারি স্কুল আর সরকারি স্কুলে ছাত্রদের লেখাপড়ার মানের আসল ছবিটা কী, বোঝার জন্য ‘প্রথম’-এর পক্ষ থেকে রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগীরা একই লিঙ্গের সহোদরদের পরীক্ষার ফলের তুলনা করেন। অর্থাৎ দুই ভাইয়ের একজন যখন সরকারি, আর একজন বেসরকারি স্কুলে যাচ্ছে, তখন তাদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় কতটা তফাত হচ্ছে, সেটা তুলনা করে দেখেন। স্কুলের পড়ানোর মানের তফাত বোঝার আদর্শ উপায় অবশ্য একে বলা চলে না। কারণ, বেসরকারি স্কুলে যে ভাই যাচ্ছে, সে আরও নানা বাড়তি সুবিধে হয়তো পাচ্ছে (যেমন পড়াশোনার সময় বেশি পেতে পারে)। কিন্তু এমন ঢিলেঢালা পরিমাপে পরীক্ষা করেও দেখা যাচ্ছে, লিখতে-পড়তে পারার নিরিখে বেসরকারি স্কুলে গিয়ে শিশুদের বাড়তি লাভ হচ্ছে সামান্যই। গরমের ছুটির সময়ে বিহারে কোনও কোনও স্কুলে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পাঠ-শিবির করেন। সেখানে যোগ দিলে সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় কিছুটা উন্নতি হয়। ওই সব স্কুলে শিবিরের আগে-পরে পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় যে ফারাক দেখা গিয়েছে, সেটা বরং সরকারি স্কুল-বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় ফারাকের চাইতে বেশি।
কেন গড়পড়তা ছাত্রদের আর একটু বেশি শেখাতে পারছে না বেসরকারি স্কুলগুলো? এর সম্পূর্ণ উত্তর সহজ নয়। তবে আমি যেটুকু যা জানি, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, এর অন্তত একটা ব্যাখ্যা খুব সোজা। তা হল, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, সেই শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসক, সকলেই বিশ্বাস করেন যে শিক্ষা গড়পড়তা স্কুলের গড়পড়তা পড়ুয়ার জন্য নয়। তাঁদের দৃষ্টিতে স্কুলশিক্ষার উদ্দেশ্য হল সব চাইতে সফল ছাত্রছাত্রীদের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষার জন্য তৈরি করা, যাতে তারা তাদের পরম অভীষ্ট— সরকারি চাকরি, কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে আসন— লাভ করতে পারে। বাদবাকি পড়ুয়ারা যে খরচের খাতায়, সে এক রকম ধরেই নেওয়া হয়।
তাই স্কুল সরকারি হোক বা বেসরকারি, শিক্ষক তাঁর ক্লাসের অধিকাংশ মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পান না। তিনি জানেন, পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ লিখতে-পড়তে না শেখা সত্ত্বেও বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাসের ক্লাসে বসে থাকছে। কিন্তু তাদের কথা ভাবার সময় তাঁর নেই। তাঁকে পড়িমরি করে সিলেবাস শেষ করতে হবে, যাতে যে ক’জন পড়ুয়া এগোতে পারছে তারা নিশ্চিতভাবে সাফল্যের চৌকাঠে পা রাখতে পারে। অভিভাবকরা শিক্ষকের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করেন, ঊর্ধ্বতন কর্তারাও তাতেই খুশি।
অথচ যারা শেষ ধাপ পার করতে পেরেছে, স্কুলশিক্ষা কেবল তাদেরই কাজে লাগে, এমন কিন্তু নয়। এ বিষয়ে যেটুকু তথ্য-পরিসংখ্যান আছে, তা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে স্কুলে কয়েক বছরের শিক্ষাও লাভজনক। দেখা যাচ্ছে, যে কখনও স্কুলে যায়নি, তার চাইতে চতুর্থ শ্রেণি অবধি পৌঁছনো পড়ুয়া যতটা লাভবান হচ্ছে, একই অনুপাতে অষ্টম-উত্তীর্ণর চাইতে দ্বাদশ-উত্তীর্ণ লাভবান হচ্ছে। সাধারণত অভিভাবকরা এই লাভকে তেমন পাত্তা দেন না। চতুর্থ শ্রেণি শেষ করার পর তো আর কোনও লোক-দেখানো কাগজ মেলে না। কিন্তু চাষবাস, দোকানদারি, যে কাজই কেউ করুক না কেন, লিখতে-পড়তে পারা, অঙ্ক কষতে পারা তাতে অনেকটা সাহায্য করে।
শিক্ষার অধিকার নিয়ে যখন কথা উঠল, তখন আশা জেগেছিল যে স্কুলে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা এবার গুরুত্ব পাবে। সাফল্যের চাবি বলে শিক্ষাকে দেখার যে অযৌক্তিক উন্নাসিকতা, তা বন্ধ হবে। দুঃখের কথা, আইন তৈরি হতে দেখা গেল সেই পুরনো মানসিকতা আরও গভীর হয়েছে। কেউ কিছু শিখুক আর না-শিখুক, সিলেবাস শেষ করা এখন আইন। স্কুলের বিল্ডিং-এর চেহারা কেমন হওয়া দরকার, তা নিয়ে আইনে অনেক কথা রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি শিশুর কয়েকটি ন্যূনতম দক্ষতা তৈরি করার জন্য স্কুলকে কী কী করতে হবে, সে-বিষয়ে একটা কথাও নেই। অথচ আইনটা স্কুলের বেঞ্চে বসে থাকার অধিকারের নয়, শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আইন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ১৩ নভেম্বর ২০১১
৩. স্বাস্থ্য
বড় হাসপাতাল, নাকি বড় রাস্তা
গোটা লন্ডন শহরের বাসিন্দাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ভার তিন দশক ধরে যাঁর কাঁধে, তাঁর কাঁধ দুটি পাতলা, কোমরটি সরু, আর সটান পা দু’টি হাই-হিল জুতোয় চটপটে। হঠাৎ মনে হয়, সদ্য কলেজ-পেরনো তরুণী বুঝি। যে বিশাল ও জটিল ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের খরচে গোটা দেশের মানুষের চিকিৎসা হয়, তার অনেকটা ভার বয়েছেন এই তন্বী, তা বিশ্বাসই হতে চায় না। কেবল মুখের দিকে নজর করলে বোঝা যায়, ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস যতবার ঢেলে সাজা হয়েছে, ততবার এক একটি রেখা বুঝি আঁকা হয়েছে ওই মুখে। নয় বারের বার বিরক্ত হয়ে ৫৬ বছর বয়সে ইস্তফা দিয়েছেন ‘ডেম’ রুথ কারনেল। এখন নানা দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে পরামর্শ দেন। ‘সবার জন্য চিকিৎসা’ নিয়ে বলতে এসেছিলেন কলকাতায়। সবার জন্য ভাল চিকিৎসা কি সম্ভব? সরকারি পয়সায়? হোটেলের লবিতে বসে চিনি-ছাড়া কফিতে চুমুক দিয়ে রুথ বললেন, ‘বেজায় বড়লোক ছাড়া ব্রিটেনে সকলেই কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাতেই চিকিৎসা করায়। আমার পরিবারকে উচ্চবিত্ত বলতে পারেন। আমাদেরও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা নেই, এনএইচএস ভরসা।’ একটু থেমে বললেন, ‘আসলে চিকিৎসায় কতটা উপকার হবে, সেটা ধনী কি গরিব, তার উপর অতটা নির্ভর করে না। করে হাসপাতাল কেমন, তার উপর। ধরুন কারও স্ট্রোক হল। যেখানে স্ট্রোকের স্পেশালাইজড কেয়ার রয়েছে, সেখানে গেলে তার দ্রুত, যথাযথ চিকিৎসা হবে। পাড়ার ছোট হাসপাতালে তা সম্ভব নয়।’
মনে হয়, এ আর কে না জানে। কিন্তু এই কথাটাকেই স্বাস্থ্যনীতির মূল কথা করতে ঢের লড়াই করতে হয়েছে রুথকে। লড়াই রাজনীতির নেতাদের সঙ্গে, ডাক্তারদের সঙ্গে, আমজনতার সঙ্গেও। ‘সবাই চান, বাড়ির কাছের হাসপাতালে সব চিকিৎসা যেন পাওয়া যায়। আসলে তার মানে দাঁড়ায়, সেরা চিকিৎসা না পাওয়া।’ স্ট্রোকের চিকিৎসারই উদাহরণ দিলেন রুথ। পাড়ার হাসপাতালগুলোতে স্ট্রোক চিকিৎসার বিশেষ ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে লন্ডনের লোকে বিরক্ত। তাঁদের বোঝানো যাচ্ছে না, স্ট্রোকের চিকিৎসা কেন্দ্রিকরণ করলে ফল হয় অনেক ভাল।
কেমন সেই ব্যবস্থা?
শহরের আটটি হাসপাতালে ‘হাইপার অ্যাকিউট স্ট্রোক ইউনিট’ তৈরি করে, ৯৯৯ ডায়াল করলেই সেখানে রোগী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম তৈরি করেছেন রুথ। যেতে লাগে বড়জোর ৪০ মিনিট। তিন দিন পর স্থানীয় হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। ‘এই ব্যবস্থায় স্ট্রোকে মৃত্যুহার কমেছে ২৫ শতাংশ, টাকাও বেঁচেছে। ব্রিটেনের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লন্ডনে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড কম খরচ হয়।’
শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার কথা। হাসপাতালে প্রসব বাড়ছে অথচ মায়ের মৃত্যু কমছে না কেন, প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, ‘তাকিয়ে দেখুন কলকাতা থেকে বারাসত যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। প্রতি দু-আড়াই কিলোমিটার অন্তর একটা হাসপাতাল, প্রতিটিতে দু’-তিনজন গাইনোকলজিস্ট, এক-দু’জন অ্যানেস্থেটিস্ট। জেনারাল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় এই ডাক্তারদের সব রকম রোগী দেখতে হয়। ফলে কোনও হাসপাতালেই ২৪ ঘণ্টা সিজারিয়ান হয় না।’ এলাকার কোনও একটি হাসপাতালে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাখা হলে কলকাতায় রেফার করার হাঙ্গামা, বিলম্বের জন্য মৃত্যু এড়ানো যেত না কি?
সে-প্রশ্নটা তোলাই হয় না, কারণ প্রতিটি সাংসদ, বিধায়ক, পুরপিতা তাঁর নিজের এলাকার হাসপাতালে ‘সিজার’ চালু করবেনই করবেন। ওদের আছে, আমাদের নেই কেন, এই হল যুক্তি। স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করার দিনে বিধানসভায় সেই একই দৃশ্য দেখা যায়। কেন মহকুমা হাসপাতালে এমআরআই হবে না, কেন কার্ডিয়াক সার্জারি হবে না স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, তাই নিয়ে শোরগোল চলে। সব হাসপাতালে সব পরিষেবা চালু করা সম্ভব কি না, করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তা করে কে?
গণস্বাস্থ্যের নীতিতে জনমতকে কতটা পাত্তা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরাও। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন, নানা দেশে গরিব মানুষ সাধ্যাতিরিক্ত খরচে চিকিৎসা করান, কিন্তু টিকাকরণ, পরিশোধিত জল খাওয়া কিংবা মশারি টাঙানোর জন্য সামান্য খরচ করেন না। রোগ প্রতিরোধের বরাদ্দ কাজে না লাগিয়ে জনমত যদি ক্রমাগত আরও সস্তায় আরও ভাল চিকিৎসা চায়, সেই দাবিকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া চলে? জিষ্ণু দাশ দেখিয়েছেন, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিৎসার মান হাতুড়েদের চিকিৎসার চাইতে উঁচু দরের নয়। আরও, আরও বেশি পাশ-করা ডাক্তারকে গ্রামে পাঠালে গণস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এই কথা মানলে কেবল অপচয় বাড়বে, অসুখ কমবে না।
এ কথাগুলো নেতারাও বোঝেন, বললেন রুথ। ‘আমার সবচেয়ে বিরক্ত লাগে যখন নেতাদের দেখি একান্তে বলছেন, “আমার পরিবারের জন্য এমন চিকিৎসাই চাই, কিন্তু বাইরে তো আর বলতে পারি না।” কেন পারেন না? কী করলে কম খরচে বেশি রোগী নিরাময় হন, সে-বিষয়ে হাতেকলমে যা জানা গিয়েছে তা সবাইকে বোঝানোর কাজটা তো নেতাদেরই।’ আরও অনেক বড় হাসপাতাল তৈরি করার চাইতে ৯৯৯ ডায়াল করে যে-পরিষেবা পাওয়া যায় তাকে উন্নত করলে, ছোট হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সি বিভাগকে উন্নত করলে উপকার হবে অনেক বেশি, তা কে বোঝাবে ব্রিটেনের আম-ভোটারকে?
কে-ই বা বোঝাবে বাংলার নাগরিককে? কল্পচক্ষে দেখার চেষ্টা করুন, বিধানসভায় নেতারা তর্ক করছেন, কী করে নবজাতকের মৃত্যু কমানো যায়। মহকুমা কি ব্লক স্তরে নবজাতক ইউনিট তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্স জোগান দেওয়ার জন্য বিপুল খরচ (গত এপ্রিল মাসে সরকার ১৬১ জন শিশুবিশেষজ্ঞ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কেবল সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটগুলোর জন্য) করাই কি উচিত? নাকি নিচুতলার স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে মায়ের অপুষ্টি কমালে শিশুমৃত্যু দ্রুত কমত? না, বহু চিন্তা করেও ২৯৫টা মুখের মধ্যে থেকে একটা মুখ ভাবা গেল না যিনি বলবেন, আমার এলাকার হাসপাতালে এসএনসিইউ খোলার দরকার নেই, ভাল হাসপাতালে পৌঁছনোর রাস্তা আরও ভাল করুন।
নেতারা সব দেশেই সমান। ‘টপ-ডাউন প্ল্যানিং হঠিয়ে রোগীকে বেশি “চয়েস” দেওয়া, চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ, এই বদলগুলো আনা হচ্ছে এনএইচএস-এ। শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কাছে “চয়েস” বড় কথা নয়। বড় কথা দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত রেফারাল,’ বললেন রুথ। নতুন ব্যবস্থা মানতে না-পেরে চাকরি ছেড়েছেন তিনি।
এ রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্তা, ডাক্তার, ফিল্ডকর্মীরা চাকরি ছেড়ে দেন না, তবে গা ছেড়ে দেন। যতই কাজ করো, কাজের কাজ হবে না, তা মনে মনে জেনে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক কাজ করে যান। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল, আর ফল কী হল, তার কোনও মূল্যায়নও হয় না, কারও জবাবদিহিও চাওয়া হয় না। কেউ প্রশ্ন করতে গেলে উলটে ধমক খান— যা বলা হয়েছে করুন, অত জানার কী দরকার? শেষে শিশুমৃত্যু, প্রসূতিমৃত্যু, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গিতে মৃত্যু নিয়ে ফের প্রবল হইচই হলে নতুন একখানা প্রকল্প ঘোষণা হয়। উপরের চেয়ারে বসানো হয় নতুন লোক। ওতেই ভোট পাওয়া যায়।
কিন্তু নবজাতক, প্রসূতি বা স্ট্রোক-আক্রান্তের প্রাণ বাঁচানো যায় না। সীমিত টাকায় কী করে সেরা ফল দেওয়া যায় সর্বাধিক রোগীকে, সেটা জনমত ঠিক করতে পারে না। নেতা-নেত্রী কিংবা তাঁদের চামচে ডাক্তাররাও নয়। তার জন্য চাই সমীক্ষা-নিষ্কাশিত, পরীক্ষাসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি। আর চাই বুকের পাটা। জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও জনস্বার্থে কাজ করে যাওয়ার সাহস।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ জুন ২০১৩
ফ্রি পেতে গেলে কত দিতে হয়?
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নইলে অনাদীশ বাগদিকে সাত দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা কেন খরচ করতে হল সরকারি হাসপাতালে? বছর পঁয়ষট্টির এই চাষি বিপিএল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক নিয়ে। ১০ জানুয়ারি। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় ৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু। তার পর স্যালাইন, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, খরচ বেড়েই চলেছে। তবু বহু অনুরোধে বর্ধমানে রেফার করা আটকেছেন তাঁর ছেলে। আরও খরচ টানতে পারতেন না তাঁরা। লিভারের অসুখে আক্রান্ত অবনী সিংহের দশা আরও খারাপ। পনেরো দিনে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে তাঁর, ওই সিউড়ি হাসপাতালেই।
অসুখ জটিল বলেই কি খরচ করতে হচ্ছে? তা-ও মনে হয় না। দশ মাসের প্রিয়ম সাহা কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫ জানুয়ারি, নেহাতই ডায়ারিয়া নিয়ে। দু’দিন ভর্তি থাকে ওই শিশু। স্যালাইন, ওষুধ মিলিয়ে চারশো টাকা খরচ করতে হয়েছে পরিবারকে।
এরা সকলেই দরিদ্র, সকলেই ভর্তি হয়েছিল সরকারি হাসপাতালের ফ্রি বেডে। তবু যে এমন খরচ, সে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গবেষণা তা বলছে না। অর্থনীতির শিক্ষক অরিজিতা দত্ত ও দিল্লির এক গবেষণা সংস্থার গবেষক মন্টু বসু তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কেমন, তা খতিয়ে দেখেছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য থেকে তাঁরা বলছেন, এ রাজ্যে গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীরা ওষুধের জন্য গড়ে খরচ করেন সাড়ে তিনশো টাকা। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রায় ৬০০ টাকা। সেখানে তামিলনাড়ুর গ্রামে ওষুধের গড় খরচ— প্রায় অবিশ্বাস্য— চার টাকারও কম। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার খরচ ২২ টাকা ৩৫ পয়সা। এ হিসেবও হল সব রকম সংগতির রোগীর জন্য। কেবল গরিব রোগীর কথা ধরলে (মাসিক ব্যয়ের নিরিখে চারটি ভাগ করলে, ‘গরিব’ হল সবচেয়ে নীচের এক-চতুর্থাংশ) তামিলনাড়ুতে গ্রাম কিংবা শহরে বাস্তবিক ওষুধের জন্য একটি টাকাও খরচ হয় না।
সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গরিবের ওষুধের খরচ ৩০২ টাকা, আর শহরে ১৯১ টাকা।
তা হলে কি ‘ফ্রি’ কথাটার মানে বুঝতেই পশ্চিমবঙ্গে ভুল হচ্ছে? তামিলনাড়ুতে ফ্রি চিকিৎসা মানে ওষুধ, টেস্ট, রক্ত, স্যালাইন সব ফ্রি, আর এ রাজ্যে ফ্রি চিকিৎসা মানে কেবল বেডটাই ফ্রি, সঙ্গে বড়জোর স্যালাইন আর দু’-চারটে ওষুধ-ইঞ্জেকশন?
এই গবেষণার পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু পুরনো, ২০০৪ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে নেওয়া। তার পরে সরকার চিকিৎসার খরচ কমানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তা হল ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। অনাদীশ বাগদি তাঁর কিছু ওষুধ সিউড়ি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কিনেছিলেন। না হলে তাঁর খরচ আরও খানিকটা বেশি হত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিনা পয়সায় হত না, সেটা নিশ্চিত। নানা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করা গেল, এখন ফ্রি বেডের রোগীদের জন্য জরায়ু বাদ (হিস্টরেকটমি) দেওয়ার খরচ চার-পাঁচ হাজার টাকা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত (হেমাচুরিয়া) চিকিৎসার খরচ সাত থেকে দশ হাজার, রেডিয়োথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করতে লাগে ২৫-৩০ হাজার। এর মধ্যে ওষুধ-ইঞ্জেকশন, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, রক্ত, মেডিক্যাল টেস্টের খরচ আছে, বাড়তি থাকতে পারে আয়ার খরচ, কারণ দু’জন নার্স প্রায়ই দেড়শো রোগীর ওয়ার্ড সামলান। সরকারি কর্তাদের যুক্তি, এ সব চিকিৎসা বাইরে করাতে গেলে পাঁচ-দশগুণ বেশি খরচ হত। সরকারি হাসপাতাল বলেই এত কমে মিলছে। কিন্তু ডিসকাউন্ট মধ্যবিত্তের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে, গরিবের কাছে হবে কেন? তার তো শূন্য খরচে পাওয়ার কথা ছিল। যেমন তামিলনাড়ুর গরিবরা পান। যে উদ্দেশ্যে গরিবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া, সে যাতে খরচের ভয়ে চিকিৎসা এড়িয়ে না যায়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণে ডুবে না যায়, ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিলেও সে-উদ্দেশ্য ১০০ শতাংশ ব্যর্থ হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য যা মন্দের ভাল, গরিবের জন্য তা পুরোই মন্দ।
এই ভুলটা স্পষ্ট হচ্ছে না, কারণ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের খরচের তুলনা করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট হবে যখন এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সরকারি চিকিৎসার তুলনা করা হবে। কেন এ রাজ্যের হাসপাতালে ভর্তি গরিব রোগীদের ৫৮ শতাংশ ওষুধ পায়, তামিলনাড়ুতে ৯৮ শতাংশ? আমাদের ৫৪ শতাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল টেস্ট করান, আর ওদের ৮৮ শতাংশ? অথচ সেই ২০০৪ সালেও তামিলনাড়ুর ৯৭ শতাংশ সরকারি বেড ফ্রি ছিল। এ রাজ্যে তখন ফ্রি বেড মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এখন অবশ্য জেলায় সব বেড ফ্রি। গত অক্টোবর মাসে তেমনই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে হাসব, না কাঁদব? অরিজিতা এবং মন্টুর গবেষণা দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গরিব রোগীদের ৮০ শতাংশই ভর্তি হন সরকারি হাসপাতালে, কিন্তু হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ সুযোগসুবিধের ২২-২৫ শতাংশ জোটে তাঁদের। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী, দুই শ্রেণি মিলে পাচ্ছে ভর্তুকির ৪৪-৪৫ শতাংশ সুযোগ। এই অনুপাত যদি না বদলায়, তা হলে ফ্রি বেড বাড়লে গরিবের চাইতে বিত্তবানের জন্য ঢের বেশি খরচ হবে সরকারের। গরিবের উপকার করতে চাইলে হয়তো ফ্রি বেডের সংখ্যা কমিয়ে, সেই সব বেডের রোগীদের জন্য ওষুধ, টেস্ট-এর ব্যবস্থা বাস্তবিক ফ্রি করা বেশি দরকার ছিল।
এমন গরিব-উপযোগী ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে না, তা কি কেবলই গরিবের শেষ সম্বলটাও কেড়ে নেওয়ার কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য? তা হয়তো নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, গরিবকে সুবিধে না-দেওয়াতে নানা লোকের নানা ছোট ছোট সুবিধে তৈরি হয়ে আছে। যে-দালাল দুশো টাকায় জোগাড় করেন বিপিএল সার্টিফিকেট, যে-কাউন্সিলর, বিধায়ক কলমের আঁচড়ে (বা ফোনের ধমকে) পেয়িং বেডকে ফ্রি করে প্রভাব দেখান, তাঁরা গরিবের মন্দ চান না। ডাক্তারও গরিব-বিদ্বেষী নন। কিন্তু সব বেড ফ্রি হলে তাঁর সুবিধে, এক বিভাগে রোগী উপচে পড়লে সহজেই অন্য বিভাগের বেড নিতে পারবেন। অ-গরিব রোগীর আত্মীয়দের সুবিধে, বেড ফ্রি হলে খরচ কমে, হ্যাপাও কমে। পেয়িং বেড হলে রোগীর তরফে কাউকে সারাক্ষণ হাজির থাকতে হবে, স্লিপ দিলেই ওষুধ, ইঞ্জেকশন, গজ-ব্যান্ডেজ জোগাতে হবে। হাসপাতাল থেকে এগুলো দিয়ে পরে দাম নেওয়ার নিয়ম নেই। তা ছাড়া, ‘সরকারি হাসপাতালে এসেছি, ফ্রি পাব না কেন,’ এই মনোভাবটাও কাজ করে। এত লোকের এত সুবিধের চাপে এমনিতেই পেয়িং বেডের সংখ্যা কমছিল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর জেলা স্তর পর্যন্ত হাসপাতালে পেয়িং বেড ছিল বড়জোর ১০-২৫ শতাংশ। এবার সেটুকুও ফ্রি হয়ে গেল। তাতে ঝামেলা কমল ঠিকই, কিন্তু বেড ফ্রি করার সুবিধে কে পাচ্ছে, কে দেখতে যাচ্ছে?
এ কেবল স্বাস্থ্যের ছবি নয়। স্কুলশিক্ষাতেও ছবিটা কাছাকাছি। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকাশিত ‘অসর ২০১৪’ সমীক্ষায় প্রকাশ, এ রাজ্যে সরকারি স্কুলের প্রাথমিকে অর্ধেকেরও বেশি পড়ুয়া, উচ্চ প্রাথমিকে ৭৬ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশন নিচ্ছে। সেখানে তামিলনাড়ুতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে টিউশন নেওয়ার অনুপাত ৬-৭ শতাংশ। এবং, এ রাজ্যে টিউশন ফি সে-রাজ্যের চাইতে বেশি। খরচ বেশি করে বাড়তি লাভ কী হচ্ছে? মাতৃভাষায় রিডিং পড়তে পারার ক্ষেত্রে গ্রামের পড়ুয়ারা এ রাজ্যে একটু এগিয়ে, কিন্তু অঙ্কে ওরা গোড়ায় পিছিয়ে থাকলেও পরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজিতে আবার আগাগোড়াই ওরা এগিয়ে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ইস্কুলে আমাদের পড়ুয়ারা যাচ্ছেই কম। সমীক্ষার দিন মাত্র ৫৬ শতাংশ পড়ুয়াকে ক্লাসে দেখা গিয়েছে। তামিলনাড়ুতে ক্লাসে ছিল ৮৭-৮৯ শতাংশ পড়ুয়া। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, যে-কোনও কারণেই হোক, এ রাজ্যে শিক্ষকদের কাছে ক্লাসে না-পড়ানোর সুবিধেটা বড় হয়ে উঠছে। ছাত্রের কাছেও টিউশনে গিয়ে পড়া বোঝা বেশি সুবিধেজনক মনে হচ্ছে।
এর ফলে অসুবিধেয় পড়ছে গরিব। যে-সম্পদ গরিবের জন্য বরাদ্দ, সে ওষুধপত্রই হোক আর মানবসম্পদ (শিক্ষক, ডাক্তার) হোক, গরিব তা পাচ্ছে না, কিংবা সামান্যই পাচ্ছে। কিন্তু গরিবের না-পাওয়া, আর তার ফলে সরকারের অপচয়ের হিসেবটা কষার চাড় নেই কারও। নেতারা আরও ফ্রি পণ্য, ফ্রি পরিষেবা ঘোষণা করতে চান। বিরোধীরা চেঁচান, অত দেবে বলেছিলে, দিলে মোটে এত! মিডিয়া খোঁজে, অত দিতে গিয়ে কত কার পকেটে গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গরিবকে ফ্রি পরিষেবা দেওয়ার চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজে। অনাদীশ বাগদিদের কী হল, কতটুকু পেল তারা, খোঁজ করতে ভুল হয়ে যায়।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
এখানে সস্তায় জরায়ু বাদ দেওয়া হয়
গরিবের জন্য খরচ হচ্ছে অঢেল। কিন্তু সে-টাকা গরিবের কাজে লাগছে কি? প্রশ্নটা ফের উসকে দিচ্ছে গরিবের স্বাস্থ্যবিমা। গরিব যাতে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত না হয়, তার জন্য বছর বছর স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম (পাঁচ জনের পরিবার-পিছু ৭৫০ টাকা) মেটাচ্ছে সরকার। বছর সাতেক আগে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’ শুরু হওয়ায় এখন সরকারি বা বেসরকারি, যে-কোনও হাসপাতালে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বিনা খরচে করাতে পারে গরিবরা। কিন্তু বিমার সুবিধে নিয়ে হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা হচ্ছে, তার নকশাটা সন্দেহজনক। অ্যাপেনডিক্স, গল-ব্লাডার, ছানি কাটার যত কেস দেখা যাচ্ছে, তার তুলনায় ম্যালেরিয়া বা ডায়েরিয়া অনেক কম। রোগীর চাহিদার চেনা নকশার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমায় চিকিৎসা জোগানের নকশার কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনই ছবি উঠে এসেছে বীরভূম থেকে, পরপর দু’বছরের তথ্য তুলনা করে। ২০১২ সালে চারটি ব্লকে বারো হাজারেরও বেশি বাড়িতে সমীক্ষা করে দেখা হয়েছিল, কতজন কী কী কারণে গত এক বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরের বছর (২০১৩) ওই বাড়িগুলির মধ্যেই ১৫০টিতে গিয়ে ফের দেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা কী কী কারণে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। এই দুইয়ের নকশায় বিস্তর ফারাক উঠে আসে। সেই নকশা সম্প্রতি তুলে ধরলেন দুই গবেষক, দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর সুমিত মজুমদার এবং পশ্চিমবঙ্গের সোসাইটি ফর হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্র্যাফিক সার্ভেইলন্স-এর অনমিত্র বারিক। ‘জনস্বাস্থ্য এবং সরকারি নীতি’ নিয়ে ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’-য় (আইডিএসকে) দু’দিনের আলোচনায় তাঁরা পেশ করেন এই গবেষণা।
কী দেখছেন গবেষকরা? স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এমন চারশোরও বেশি রোগীর বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখছেন, নব্বই শতাংশ রোগীই ভর্তি হয়েছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। অস্ত্রোপচারগুলির মধ্যে প্রধান হল ছানি কাটা, আর তারপরেই মেয়েদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া (হিস্টরেকটমি)। আরও চিন্তার বিষয়, যে সাতান্ন জন মহিলার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আঠারো জনেরই (৩১ শতাংশ) বয়স চল্লিশের নীচে। ডাক্তাররা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত সহজে জরায়ু কেটে বাদ দিতে চান না। ছানি কাটার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, দশ জনে এক জনের বয়স পঞ্চাশের নীচে। অন্য যে প্রধান অস্ত্রোপচার, সেগুলো যথাক্রমে গল-ব্লাডার বাদ দেওয়া, হার্নিয়া-হাইড্রোসিল, অর্শ এবং অ্যাপেনডিক্স। প্রসঙ্গত, জরায়ু, অ্যাপেনডিক্স, আর গল-ব্লাডার, এই প্রত্যঙ্গগুলিকে ‘বাদযোগ্য’ বলা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। অর্থাৎ এগুলোকে বাদ দিলে স্বাস্থ্যের খুব বড় ক্ষতি কিছু হয় না। গরিবের স্বাস্থ্যবিমা আসায় এই তিনটিকেই বাদ দেওয়া জরুরি হয়ে উঠছে।
অথচ খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আগের রোগগুলোর। ২০১২ সালে যে সব অসুস্থতার কারণে লোকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান ছিল জ্বর, টাইফয়েড, পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া। কেবল বীরভূমের সমীক্ষাতেই নয়, গোটা দেশেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রধান কারণ নানা ধরনের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, রক্তসঞ্চালনে সমস্যা, দুর্ঘটনা বা হিংসাজনিত আঘাত। নানা বছরের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফল থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু বিমার স্মার্টকার্ডে এগুলোর প্রায় দেখাই মিলছে না। ‘তার মানে, এগুলোর জন্য ভরসা সেই সরকারি হাসপাতালের, নইলে হাতুড়ের,’ বলছেন সুমিতবাবু।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার পরিসংখ্যানের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছে। দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রোপচারই নব্বই শতাংশ, জরায়ু বাদ দেওয়ার সংখ্যা অত্যধিক, যে সব ভাঙা হাড় প্লাস্টার করলে সেরে যেত তারও অস্ত্রোপচার হচ্ছে। ‘ইঙ্গিত উদ্বেগজনক,’ বলেন দফতরের এক কর্তা।
এত অস্ত্রোপচার কেন? মেদিনীপুর শহরের ২০ শয্যার একটি নার্সিংহোমের মালিকের উত্তর, ‘আমাদের বেড অল্প, ইমার্জেন্সি নেই। জ্বরজারি কেস ভর্তি করা যায় না।’ উলুবেড়িয়ার একটি হাসপাতালের মালিক অবশ্য আরও সোজাসাপটা, ‘ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়ার জন্য বিমা কোম্পানি যা টাকা দেয়, তাতে ওষুধের দাম উঠবে না। তার ওপর টিপিএ বারবার প্রশ্ন করবে, কেন ভর্তি করলেন? আউটডোরেই চিকিৎসা করলেন না কেন?’ পেট খারাপ, জ্বরের জন্য হাসপাতালের পাওনা স্রেফ বেড চার্জ। পড়তায় পোষায় না।
ওই দুই হাসপাতালেই জরায়ু বাদ দেওয়া স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে একটি প্রধান অস্ত্রোপচার। মেদিনীপুরের ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, বিমা কোম্পানি তো ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেই অনুমতি দিচ্ছে, তা হলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের অভিযোগ ওঠে কী করে? হাওড়ার ডাক্তারবাবু অবশ্য স্পষ্টই বলে দিলেন, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা শ্বেতস্রাবের চিকিৎসা অন্য ভাবেও করা যায়। তবে অনেক সময়ে রোগীর তরফ থেকেও ‘ঝামেলা শেষ’ করার চাপ থাকে। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলির বিষয়ে না বোঝালে জরায়ু অপ্রয়োজনেও বাদ যেতে পারে।
তার পরিমাণ কত? শিউরে ওঠার মতো কথা বললেন কলকাতার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। ‘কান্দির এক ডাক্তার সেদিন বড়াই করে বললেন, এক মাসে ৪৫টা জরায়ু বাদ দিয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব? এক জন ডাক্তার সাধারণত তাঁর গোটা ডাক্তারি জীবনে ৪৫টা হিস্টরেকটমি করে উঠতে পারেন না,’ বললেন এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ডাক্তার।
একে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া গেলে ভাল হত। কিন্তু অন্য রাজ্যে এমন ইতিমধ্যেই ঘটেছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালে বিহারের সমস্তিপুরে স্বাস্থ্যবিমার অধীনে মোট ১৪,৮৫১ কেসের মধ্যে ৫৫০৩ ছিল জরায়ু বাদ দেওয়া।
রাজস্থানের দাউসা জেলা থেকেও অত্যধিক হিস্টরেকটমির নালিশ আসে। পেট ব্যথা, ঋতুচক্রে গোলমাল, যে-কোনও সমস্যা নিয়ে গেলেই জরায়ু বাদ দেওয়া হচ্ছে এটা প্রকাশ পেলে ২০১৩ সালের জুনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দুই জেলাশাসকের রিপোর্ট তলব করে। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দু’জনেই মহিলা। বিষয়টি নজর করছেন কি?
তার মানে এই নয় যে, স্বাস্থ্যবিমা গরিবের কোনও কাজে লাগে না। বীরভূমের সমীক্ষা বলছে, বিমার স্মার্টকার্ড ব্যবহার করলে গরিবকে সত্যিই পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে কম, গড়ে ৩৬৩৪ টাকা কম। এটা সামান্য কথা নয়। একটি হিসেব বলছে, অতি-দরিদ্র মানুষদের এক মাসে রোজগার যত টাকা, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে গড় খরচ তার দশ গুণ, বেসরকারিতে পঁচিশ গুণ। ঋণে ডুবে যাওয়া এড়াতে গরিবরা এত দিন হাসপাতাল এড়িয়ে চলে যে, তার পর আর ডাক্তারের বিশেষ কিছু করার থাকে না। প্রাণে মরা, নইলে ভাতে মরা, এই দুই থেকে গরিবকে নিষ্কৃতি দিতে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা শুরু হয়েছিল। এ রাজ্যের বিপিএল জনসংখ্যার প্রায় ষাট শতাংশ ইতিমধ্যেই এই বিমার আওতায় এসেছে। এখনও অবধি সাড়ে আট লক্ষেরও বেশি ‘কেস’ হয়েছে বিমার স্মার্টকার্ডে। নিঃসন্দেহে এমন অনেক অস্ত্রোপচার এর মধ্যে রয়েছে, যা বিমা না থাকলে করাতেন না গরিব মানুষ। ব্যথার ওষুধ বা নানা টোটকা-মাদুলির ভরসায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে, কোনও মতে বেঁচে থাকতেন।
অথচ যে ভাবে বিমার রূপায়ণ হচ্ছে তাতে বেশ কিছু ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। এক, স্বাস্থ্য দফতর থেকে স্বাস্থ্যবিমার প্রচুর তথ্য নিয়মিত ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে সবই হল ক’জন কার্ড পেল ক’জন ভর্তি হল, কত টাকা ক্লেম করে কত পেল, তার হিসেব। রোগীরা কী কী কারণে ভর্তি হচ্ছেন, কী চিকিৎসা পাচ্ছেন, তা জানার উপায় নেই। তাই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
দুই, গরিব জেলাগুলোতে নার্সিংহোম কম। যেমন, বর্ধমানে গরিবের স্বাস্থ্যবিমার নেটওয়ার্কে রয়েছে ৬৬টি হাসপাতাল, বাঁকুড়ায় ৩১ আর পুরুলিয়ায় ৯। এ থেকেই বোঝা যায় যে স্বাস্থ্যবিমা দিয়ে গরিবকে চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়ার বিপদ কোথায়। যে জেলা যত গরিব, বিমা কাজে লাগানোর সম্ভাবনা তার তত কম।
তিন, বিপুল অপচয় হচ্ছে। গরিবকে চিকিৎসা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে নার্সিংহোমকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল, আর তা থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম, দুটোই স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। সরকারি সূত্রে খবর, চলতি অর্থবর্ষে হাসপাতাল ১৬টি কেস করে বিমা কোম্পানি থেকে পেয়েছে ৪০,৯১২ টাকা (গড়ে ২৫৫৭ টাকা); ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম করেছে ৪৯৫টি কেস, পেয়েছে প্রায় ২৫,১৪,০০০ টাকা (গড়ে ৫০৭৮ টাকা)। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার আক্ষেপ, জেলায় জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি-হওয়া রোগীকে পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন সরকারি ডাক্তার। স্বাস্থ্যবিমা আছে, রোগীর চিন্তা কী? প্রাণে যদি বা বাঁচে, ঠকে মরবেই গরিব।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪
৪. সুশাসন
কেমন করে ফসল ফলে মরুভূমিতে
২০১৫ সালে ইজরায়েলে ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ প্রযুক্তির পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়। ওই বছরই টেল আভিভে কৃষিপ্রযুক্তির একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়েছিল।
যুদ্ধটা জিতেই গেল ইজরায়েল। যাতে মানুষ মারা পড়ে, তেমন যুদ্ধ নয়। পড়শি দেশগুলোর সঙ্গে ইহুদিদের সে-যুদ্ধ আরও একশো বছর চলতে পারে। ইজ়রায়েল জিতেছে জল বাঁচানোর যুদ্ধে। অতি সামান্য জলে প্রচুর ফলন করে দেখিয়ে দিয়েছে। বিন্দু সেচ (ড্রিপ ইরিগেশন) প্রযুক্তি, যার উদ্ভাবন ও প্রয়োগে ইজরায়েল বিশ্বে পথিকৃৎ, এ বছর পড়ল ৫০ বছরে। চিন, ভারত, রাশিয়া, যে সব দেশে বড় বড় নদীর অভাব নেই, তারাই এখন চাষ শিখতে আসে এই মরুভূমির দেশে। তিন বছর অন্তর রাজধানী টেল আভিভ-এ কৃষিপ্রযুক্তির যে প্রদর্শনী (অ্যাগ্রিটেক) হয়, এ বছর এপ্রিলের শেষে (ওখানে এখনও বসন্ত) তা জমজমাট হয়ে উঠেছিল আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশের ভিড়ে। ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক থেকে চাষিরা এসেছিলেন। কনফারেন্স সেন্টারে ঘন রঙের কোট-টাইয়ের ভিড়ে গাঁধী-টুপি, পিরান-ধুতির দল যেন ছোট ছোট চলন্ত সাদা দ্বীপ।
তা দেখে ভারী তৃপ্ত ন্যাটি বরাক। আধুনিক বিন্দু সেচ প্রযুক্তি গোটা বিশ্বে বিক্রি করে তাঁর সংস্থা, ‘নেটাফিম’। এলোমেলো সাদা চুলে হাত বুলিয়ে বরাক বললেন, ‘প্রথমটা বিন্দু সেচ কাজে লাগাতেন ধনী দেশের ধনী চাষিরা। ওয়াইনের জন্য আঙুর, পেস্তা, গ্রিন হাউসে দামি সবজি, ফলের জন্য। এখন কিন্তু তা বেশি কাজে লাগছে তৃতীয় বিশ্বে, আলু, ভুট্টা, ধান, গম, কাসাভার চাষে।’ ভারতে বিন্দু সেচ বেশি হয় তুলো আর আখ চাষের ক্ষেত্রে। মহারাষ্ট্রের একটি গবেষণা বলছে, সাবেকি সেচের চাইতে বিন্দু সেচে আখের ফলন বাড়ে ২৩ শতাংশ, জল বাঁচে ৪৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ বাঁচে প্রতি হেক্টরে ১০৫৯ কিলোওয়াট।
খেত জুড়ে জল দিলে (ফ্লাড ইরিগেশন) যত জল লাগে, বিন্দু সেচ পদ্ধতিতে লাগে তার এক-তৃতীয়াংশ, বা তারও কম। খেতের উপর জলের পাইপের ‘জাল’ এমনভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পাইপের গায়ের ফুটোয় লাগানো মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে ঠিক গাছের উপর। যতটুকু জল প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই পড়ে, আর তা যায় একেবারে শিকড়ে।
জলের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে সারও সেভাবেই শিকড়ে পৌঁছে যায়। জল, সার, তেল-বিদ্যুতের খরচ, মজুরি বাঁচে, উৎপাদনও বাড়ে। যে-জমিতে জলের অভাবে সেচ হয় না, বিন্দু সেচ দিলে সেই জমিও দোফসলি, তেফসলি জমি হয়ে উঠতে পারে। এ রাজ্যে অন্তত চারটে জেলা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বীরভূমে চাষের ছবি বদলে যেতে পারে, বলছেন ক্ষুদ্র সেচ দফতরের কর্তারা।
কিন্তু কেবল এক টুকরো প্রযুক্তিকে তুলে এনে এ দেশে বসিয়ে দিলে কাজের কাজ হবে কি? ইজরায়েলের চাষবাস দেখে সেই প্রশ্নটাই বারবার খোঁচা দেয়। এ দেশে যে আবেগে মানুষ পুজো-পরবে নির্জলা উপোস করে, তেমনই নিবেদিত হয়ে ওঁরা জল বাঁচান। পঞ্চাশের দশকে এক ইহুদি নেতা কুড়ুল দিয়ে টয়লেটের ‘ফ্লাশ’ ভেঙে দিয়েছিলেন, পশ্চিমি কেতায় বিলাসী অপব্যয় ঠেকাতে। ‘যেমন দরকার তেমন, যতটুকু দরকার, ততটুকু’, এই হল ওঁদের জীবনদর্শন। যার মূল কথা, ‘মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট’। ষাটের দশকে ইজরায়েলের এক বাণিজ্যমন্ত্রী নাকি এক একটি কারখানার জন্য ডলারের এক এক রকম বিনিময়মূল্য চালু করেছিলেন।
চাষের ক্ষেত্রে ‘মাইক্রো’ পদ্ধতি স্পষ্টতই এসেছে ইহুদি চাষিদের জীবনযাত্রা থেকে। সেখানে চাষ চালায় প্রধানত ‘কিবুৎজ’। এ হল রুশ কমিউনের মতো। যেখানে জমি, বাড়ি, গাড়ি কোনও কিছুর মালিকানা ব্যক্তির নয়, সব কিবুৎজের। চাষি পরিবারের কেউ অন্য সূত্রে রোজগার করলে সবটা জমা পড়ে কিবুৎজে। যেমন ন্যাটি বারাকের স্ত্রী সাইকোলজিস্ট। তাঁর প্র্যাকটিস-প্রাপ্ত টাকার সবটাই যায় কিবুৎজে। সেখান থেকে যাকে যতটুকু দরকার, ততটুকু টাকা দেওয়া হয়। যিনি কিবুৎজের মার্কেটিং ম্যানেজার, আর যিনি কিবুৎজের রাস্তা ঝাঁট দেন, সবাই নিজের প্রয়োজন অনুসারে সমান হারে টাকা পান।
যেমন মানুষ, তেমনই গাছও। জমিতে বালি বেশি না কাদা, জলে খনিজ বেশি না কম, আবহাওয়া গরম না ঠান্ডা, তা দেখে ঠিক হয় প্রতি বিন্দু সেচে ঘণ্টায় ক’ফোঁটা জল পড়বে। পাইপে কত দূরত্বে ছিদ্র, তা ঠিক হবে কোন ফসল তা দেখে। ফসল ওঠার পরেও কী ভাবে সংরক্ষণ করলে সব চাইতে কম অপচয় হয়, কোন বাজারে বিক্রি করলে সব চাইতে বেশি দাম মেলে, তার খোঁজ চলে। কত কম থেকে কত বেশি পাওয়া সম্ভব, প্রতিদিন তার সাধনা চলছে। যার সাধন প্রযুক্তি। এক ফোঁটা জলের জায়গায় দু’ফোঁটা কিছুতেই দেবে না ইজরায়েল। কিন্তু দু’ফোঁটার কাজ কী করে আধফোঁটায় করা যায়, তা বার করতে অকাতরে টাকা খরচ করবে রিসার্চে। গোটা টেল আভিভের সমস্ত ব্যবহৃত জল, মায় পয়ঃপ্রণালীর জলও পরিস্রুত করে ফের ব্যবহার করা হয়। তার ৮০ শতাংশ পান চাষিরা।
১৯৯৯ থেকে ২০০৯, এই এক দশকে ইজরায়েলে চাষিরা জলের ব্যবহার ১২ শতাংশ কমিয়েছেন, ফলন বাড়িয়েছেন ২৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে ‘লেবার’-এর প্রয়োজনও কমেছে। চাষির সংখ্যা সাড়ে ২৩ হাজার থেকে কমে এখন ১৭ হাজার। জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ চাষ করে, তাতেই গোটা দেশের খাবারের চাহিদার ৯৫ শতাংশ মিটে যায়, আবার ফল, সবজি, রফতানিও হয় ইউরোপের নানা দেশে।
এ যে গল্পের গোরু নয়, মালুম হল সত্যি গোরু দেখে। টেল আভিভ থেকে মিনিট চল্লিশের দূরত্বে এক ডেয়ারি ফার্মে দুগ্ধবতী গাভী, বাছুর নিয়ে দু’হাজার প্রাণী। দেখাশোনা করেন ২০ জন। দিনে এক একটা গোরু দুধ দেয় ৭২ কিলোগ্রাম অবধি, গড়ে ৪১ কিলোগ্রাম। গোরু-পিছু দুধ উৎপাদনে বিশ্বে সেরা ইজরায়েল। দুধ (মেশিনে) দোওয়ার পর তা পাইপে যাওয়ার আগে একটি যন্ত্র বিশ্লেষণ করে বলে দেয়, কতটা ল্যাকটোজ, ফ্যাট, প্রোটিন, ইউরিয়া আছে তাতে। সংক্রমণের ফলে দুধে রক্ত এলে আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে দোওয়ার যন্ত্র। বারোশো গাভীর প্রতিটির সামনের ডান পায়ে লাগানো ‘মনিটর’ থেকে অন্তত ১০০টি ডেটা নিরন্তর বলে দিচ্ছে, কোন গোরু কেমন আছে, কার কী চিকিৎসা, পরিচর্যা দরকার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই আহ্লাদি ভঙ্গিতে ভিজে নাক বাড়িয়ে দেয় সাদা-কালো ইজরায়েলি হলস্টেইন। নাকে হাত রেখে মনে হয়, কেন ভারতে এমন হয় না?
সমস্যাটা ঠিক প্রযুক্তির নয়। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তিতে ভারত কম যায় না, তার প্রমাণ সবুজ বিপ্লব। তফাত মনে হয় এখানেই যে, ও দেশে ল্যাবরেটরির কাজ থেকে চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না-পড়া পর্যন্ত ‘চাষ’ নামক কাজটি চলতে থাকে। আর এখানে বিজ্ঞানী চাকরি করেন, ফড়ে ব্যবসা করেন, চাষ করেন কেবল চাষি। চাষির ক্ষতি হলেও ব্যবসায়ীর লাভ, আর বিজ্ঞানীরা ফসলের বাজারদর জানেনই না। চাষ করে লাভ হল কি না, সে-প্রশ্নে ও দেশে সবাই তটস্থ। এ দেশে লাভ-ক্ষতি চাষির ভাগ্যের ব্যাপার।
চাষিও তা-ই বিশ্বাস করেন। তাই লাভ অনিশ্চিত জেনেও আড়াই-তিন বিঘে জমি চাষ করেন তিনি, তবু সমবায় তৈরি করে অনেকের জমি একসঙ্গে চাষ করে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করেন না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কোনওটাই ছোট চাষির জন্য নয়, জেনেও জোট বাঁধতে পারেন না। স্বনির্ভর হওয়ার চাইতে সরকার-নির্ভর হওয়া তাঁদের নিরাপদ মনে হয়।
সরকারও তাই চায়। এ দেশে চাষি আর বাজারের মাঝখানে সরকার। কম সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে (কিংবা বিনামূল্যে) জল, বিদ্যুৎ, সার। শেষ অবধি ন্যূনতম মূল্যে খরিদ। ও দেশে চাষির সামনে বাজার, পিছনে সরকার। ইজরায়েলের চাষি জল, বিদ্যুৎ সব কেনেন বাজারদরে। ভর্তুকির কোনও ধারণাই চালু নেই। কৃষিমন্ত্রী ইয়ায়ের শমির বললেন, ‘প্রাইভেট সেক্টর যাতে সারা বিশ্বে বাজার ধরতে পারে, তার জন্য সহায়তা করে সরকার।’ এ দেশে সরকার প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করে চাষিকে, ও দেশে প্রতিযোগিতায় জেতাতে চাষিকে পিছন থেকে ঠেলে সরকার। এমনকী ক্রেতার স্বার্থেও চাষিকে দাম কমাতে বলে না ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েলে উৎপন্ন ফসলের দাম সে দেশের চাইতে জার্মানিতে বেশ খানিকটা কম কেন, ক’দিন আগে তা নিয়ে খানিক বিক্ষোভও হয়ে গিয়েছে টেল আভিভে। দাম অবশ্য কমেনি।
কৃষি না শিল্প, আমাদের এই নিয়ে বিতর্ক। ইজরায়েলে প্রশ্নটাই অর্থহীন। লাভজনক কৃষি আসলে শিল্পই। দুটোর উৎপাদন, বিপণন হতে হবে এক নীতিতে। এ কথাটা হজম না করে কেবল মেশিন, প্রযুক্তি আনলে জল হয়তো একটু বাঁচবে, চাষি বাঁচবে না।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ মে ২০১৫
আত্মঘাতী চাষির খোঁজে
২০১৫ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১৩ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি।
শেষ শ্রাবণের বর্ধমান। চাষিকে পথে বসিয়ে এখন রূপ দেখাচ্ছে বেহায়া আকাশ। ফাঁপানো মেঘ, গিল্টি-করা রোদ, ফিচেল বৃষ্টি। উপরমহলে যখন এমন নির্লজ্জ উৎসব, নীচে তখন ঢিবি-ভাঙা পিঁপড়ের মতো চাষিদের ছোটাছুটি। পুরুষ মেয়েরা মাথায় করে, ভ্যানরিকশা করে ধানের চারার বান্ডিল বয়ে এনে ফের পুঁতছেন জমিতে। পলিথিনের নীচে আবার তৈরি করছেন সবজির চারা। বাড়তি খরচ, বাড়তি পরিশ্রমেও অনেক দেরিতে, অনেক কম পরিমাণ ফসল মিলবে। তবু মাথায়-পিঠে বৃষ্টি নিয়ে চারদিকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। তার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে হল, চাষি মরে কেন?
উত্তরের খোঁজ শুরু করা চলে হরগোবিন্দপুরে, যেখানে সুশান্ত রুইদাসের বাড়ি। জামালপুর ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা জানালেন, সুশান্ত রুইদাস মদ খেতেন বলে ছেলেদের সঙ্গে অশান্তি লেগেই থাকত। এক দিন মা বাড়ি ছিল না, সেই সুযোগে ফুচকা-বিক্রেতা ছেলেরা বাপকে পেটায়। অভিমানে আত্মহত্যা করেন জামালপুর ব্লকের হরগোবিন্দপুরের বছর পঁয়তাল্লিশের সুশান্ত। নিজে গ্রামে গিয়ে ও স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে এমনই তিনি লিখেছেন রিপোর্টে।
সুশান্তের স্ত্রী পূর্ণিমা তাঁদের ইট-গাঁথা দেওয়াল, টিনের চালের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলছিলেন, পটল খেতে জল জমেছে দেখেই মুষড়ে পড়েছিল লোকটা। অনেক ধার হয়েছিল কিনা। কত ধার, প্রশ্ন করতেই গুটিয়ে গেলেন পূর্ণিমা। ঘিরে-থাকা প্রতিবেশীরা বলতে লাগলেন, ‘না না, ও সব ওরা কিছুই জানে না।’
যার কাছে তাঁর ধার, সেই তারক সাহানা ছিপছিপে যুবক, প্রায় ৪৭ বিঘা জমির মালিক। নিজে চাষ করেন ২০ বিঘে, বাকিটা ঠিকায় দিয়েছেন আট জন চাষিকে। তাঁদেরই এক জন সুশান্ত রুইদাস। এক মরশুম থেকে অন্য মরশুম, এক বছরের জন্য জমি নিয়েছিলেন। শীতে আলু মার খেয়েছে। বর্ষায় ১০ কাঠা জমিতে বাদাম, ১০-১৫ কাঠা জমিতে পটল বসিয়েছিলেন। বাদাম বীজ, পটলের কীটনাশক, লেবার খরচ, সবই ধারে। কেবল তারকের কাছেই ১৫ হাজার টাকার বেশি দেনা সুশান্তর, সব মিলিয়ে তার ডবল তো হবেই। টানা বৃষ্টিতে বাদামের কল বেরিয়ে গিয়েছে, অর্ধেক খেত থেকে তোলাই যায়নি। পচেছে পটল। ঠিকা চাষিদের ঢ্যাঁড়শ, লঙ্কা সব নষ্ট হয়েছে, বললেন তারক।
ভাতারের সোনা দাসও আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর জমি ছিল বিঘে পাঁচেক, ঠিকা নিয়েছিলেন তিন বিঘে, আর ভাগে চাষ করছিলেন দু’বিঘে আট কাঠা। তাঁর পরিবারও বলছে, বোরো ধান শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে, যা ধান উঠেছিল তা মাত্র ৪০০-৪৩০ টাকা বস্তা (৬০ কেজি) দরে বিক্রি করতে হয়েছিল। মহাজনের কাছে হাজার দশেক টাকা, সারের আড়তদারের কাছে সাত হাজার টাকা বাকি, জলের দাম, লেবারের টাকা বাকি, ঘরের সোনা বন্ধক দেওয়া আছে।
সরকার বলছে, সুশান্ত, সোনা, তাঁদের মতো আলু, ধান চাষিরা মারা গিয়েছেন পারিবারিক অশান্তিতে। নইলে ছ’কাঠা কি আড়াই বিঘের ফসল কতটুকু? তার উপর নির্ভর করে কে-ই বা বাঁচতে পারে, যে তার জন্য মরতে যাবে?
ভাতার, জামালপুরের গ্রামে গ্রামে কথা বলে দেখা গেল, যে-চাষির জমি নেই, বা সামান্য জমি, চাষ করতে গিয়ে তাঁর ঋণের বোঝা বড় সামান্য হয় না। ধরা যাক হরগোবিন্দপুরের কথাই। গ্রামে কেবল চার-পাঁচ ঘর আছেন, যাঁদের জমি ১০ বিঘার বেশি। শ’দুয়েক পরিবারের জমি দু’তিন বিঘে, আরও আড়াইশো পরিবার জমিহীন, খাতায়-কলমে খেতমজুর। কিন্তু সরকারি নথি, ব্যাঙ্ক-সমবায়ের খাতা, আর চাষের জমির হিসেব এক নয়। সুশান্তের মতো যাঁদের জমি নেই, বা সোনা দাসের মতো অতি সামান্য জমি, সেই খেতমজুর বা প্রান্তিক চাষি মুখের চুক্তিতে জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করেন। মূলধন বলতে কায়িক পরিশ্রম। খরচ-মুনাফার হিসেব করতে গিয়ে যার কোনও মূল্য এঁরা ধরেন না। সরকারি খাতায় এঁরা জমির মালিকও নন, বর্গাদারও নন, ভাগচাষিও নন। ‘চাষি’ স্বীকৃতি না পাওয়ায় চাষিদের জন্য সরকারের যা কিছু সুযোগসুবিধে— সামান্য সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, ট্র্যাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র কেনার অনুদান, ফসলের সরকারি সহায়ক মূল্য— কিছুই এদের জোটে না। উলটে ঋণ নিতে হয় মহাজনি সুদে, মালপত্র বাজার থেকে কিনতে হয় বেশি দামে, আর ফসল বিক্রি করতে হয় বাজারদরের কম দামে।
কত বেশিতে কেনা? কত কমে বিক্রি? ঠিকাচাষির চাষবাস নিয়ে কথা হচ্ছিল ভাতারের কালীটিকুরি গ্রামের এক চাষিবাড়ির দাওয়ায়। চাষিরা জানালেন, বোরো মরশুমে বিঘে-প্রতি ৩ হাজার টাকা, আমনে ৪ হাজার টাকা দিতে হয় জমির মালিককে। মহাজনি সুদ খাতায়-কলমে ১৬ শতাংশ, হিসেব হয় প্রধানত মালের নিরিখে। সারের আড়তদার (তথা মহাজন) ধারে সার দেয় বাজারের চাইতে বস্তায় (৫০ কেজি) ২০ টাকা বেশিতে। ধান উঠলে মাঠ থেকে কিনে নেয় বাজারদরের চাইতে বস্তায় (৬০ কেজি) ২০ টাকা কম দিয়ে। বীজের হিসেবও হয় সে ভাবেই। বাজারদরে কিনতে হয় জল, লেবার। এ ছাড়া রয়েছে বন্ধকিতে ধারের কারবার। ‘এক ভরি সোনার ২৫ হাজার টাকা বাজারদর, আপনাকে দেবে ১০ হাজার টাকা, আবার মাসে ১০ শতাংশ সুদ নেবে,’ বললেন শেখ মফিজুল হক। বন্ধকি কারবার আবার গোপনীয়। পাঁচকান হলেই আর মিলবে না ধার। অথচ ধার করে বীজ, সার, কীটনাশক, মজুরি, জল, ট্র্যাক্টর ভাড়া, সব বিনিয়োগ ঠিকাচাষির। সবই মুখচুক্তি।
কথা চলছে, আর ঘন ঘন চোখ মুছছেন বাড়ির বিধবা মালকিন। তাঁর ছেলে সবর মোল্লা মাত্র ১৮ বছর বয়সে কীটনাশক খেয়েছিল। চাষ করতে গিয়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা ধার করে ফেলেছিল বাপ-মরা ছেলে। সুদ মেটাতে ফের ধার করে শেষে আর সামলাতে পারেনি। তখন গ্রামে অনেক রিপোর্টার এসেছিল। কে কী লিখেছে তাঁরা জানেন না, কিন্তু আজও কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পায়নি পরিবার।
অতিরিক্ত চড়া সুদে অতিরিক্ত ধার করে ফেলে শেষে আত্মহত্যা, এই সংকটে ভুগছেন সব ধরনের চাষি। এই শ্রাবণেই আরামবাগের লক্ষ্মীকান্ত পাশাড়ি ১২ বিঘে জমির মালিক হয়েও ঋণের বোঝা (ব্যাঙ্কের কাছে ১ লক্ষ, সমবায়ের কাছে ৬০-৭০ হাজার, সার-জল-লেবারের ধার) সামলাতে না পেরে বিষ খেয়েছেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রক গত জুন মাসে জানিয়েছে, গত তিন বছরে এদেশে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩১৩ চাষি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বড় চাষি-ছোট চাষি, জমির মালিক-ভূমিহীন ঠিকাচাষি, তুলো-ভ্যানিলার মতো দামি ফসলের চাষি থেকে পটল-তিলের মতো সস্তার ফসলের চাষি, সব ধরনের চাষিই ঋণে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। চাষি বন্যা, খরা, বাজারের ওঠা-পড়ায় মরে না। চাষি মরে ঋণে। অন্য রাজ্য অন্তত সেটা স্বীকার করে। পঞ্জাব আত্মঘাতী চাষির পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা দেয়, অন্ধ্রপ্রদেশ দেয় দেড়-দু’লক্ষ টাকা, মহারাষ্ট্র ৫ লক্ষ টাকা বিমা পলিসি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যে চাষির আত্মহত্যাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, সে কি কেবল ক্ষতিপূরণ এড়ানোর জন্য? যে-রাজ্য চোলাই মদ খেয়ে মরলেও ২ লক্ষ টাকা দেয়, ক্লাবকে দেয় ২ লক্ষ, সেখানে টাকা বাঁচানো খুব বড় কথা মনে হয় না। তবে কি ৯০ শতাংশ চাষিকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়ার সরকারি রূপকথা টোল খেয়ে যাওয়ার ভয়? বহু চাষিকে যে আজও মহাজনি সুদ নিতে হয়, সে-সত্য ঢাকতে চাষিমৃত্যুর ব্যাখ্যায় বাড়ির ঝগড়ার গল্প ফাঁদা?
হয়তো এই পাইকারি অস্বীকৃতি আসছে আরও গভীর কোনও ভয়, অস্বস্তি থেকে। এ রাজ্যের গ্রামে যে এক শ্রেণির চাষি তৈরি হয়েছে, যাঁরা চাষের সমস্ত ঝুঁকি বহন করেন, কিন্তু চাষিদের প্রাপ্য সরকারি নিরাপত্তার কুটোটিও পান না, সে-সত্যটা সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর। আজ যদি সরকার উদারতা দেখিয়ে কৃষিঋণ মকুব করে, কিংবা বিমা কোম্পানি ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে মাঠে নামে, তাতে ৩০-৫০ শতাংশ চাষির কানাকড়িও লাভ হবে না। চাষের শ্রমের সঙ্গে জমির স্বত্বের দূরত্ব যে বেড়ে চলেছে, এটা বাম-তৃণমূল, দু’পক্ষের কাছেই মারাত্মক। তাই শাসক বা বিরোধী, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিকাচাষিদের কথা কেউ মুখেও আনছেন না।
এত ফাটকা কেন
চাষির দারিদ্র কী করে দূর করা যায়? বামফ্রন্ট সরকার উত্তর দিয়েছিল, চাষিকে জমির অধিকার দাও। জমির পাট্টার হাত ধরে এসেছিল আরও নানা সুযোগসুবিধে: স্বল্পহারে সুদ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, বিনামূল্যে বা অল্পমূল্যে বিমা। কিন্তু একুশ শতকে এসে বোঝা যাচ্ছে, আবার সে এসেছে ফিরিয়া। সুদপীড়িত, হতদরিদ্র চাষির একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গিয়েছে, নিয়মের ফাঁদে-পড়া সরকার যাদের ছুঁতেও পারছে না।
সিপিএম-এর বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক মনে করেন, এই ‘ঠিকা চাষি’ (মুখের কথায় জমি ঠিকা নিয়ে, সম্পূর্ণ নিজের খরচে চাষ করেন যাঁরা) শ্রেণির উদ্ভব আট-দশ বছর আগে। ‘বামফ্রন্টের আন্দোলনের ফলে খেতমজুরদের মজুরি একটা স্থিতাবস্থায় আসে। তার পর দেখা গেল, খেতমজুররা বোরো চাষের সময় জমির একটা অংশ ঠিকা নিল।’ ক্রমশ ধান থেকে আলু, বোরো থেকে আমন, তার পর সব ধরনের চাষই করতে শুরু করল এই ঠিকাচাষিরা।
এখন এমন চাষি কত? অচিন্ত্যবাবুর মতে, বর্ধমানে জমির মালিক, যিনি নিজে বা খেতমজুর দিয়ে চাষ করান, এমন চাষি ৫০ শতাংশ। বর্গাদার ২৫ শতাংশ। ঠিকাচাষি বাকি ২৫ শতাংশ। ‘খেতমজুরদেরই এক অংশ ঠিকা নিচ্ছে,’ বললেন তিনি। তাঁর আন্দাজ মিলে গেল জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের সঙ্গে। জেলার কৃষি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেলাশাসক বললেন, জেলায় নথিহীন বর্গাচাষি অন্তত ২৫ শতাংশ। জামালপুরের চকদিঘি সমবায় সমিতির (যার সদস্য প্রয়াত ঠিকাচাষি সুশান্ত রুইদাসের জমিমালিক তারক সাহানা) সভাপতি গৌরাঙ্গ মুখোপাধ্যায়ের আন্দাজ, ভূমিহীন খেতমজুর ঠিকাচাষি অন্তত ৩০ শতাংশ, আর প্রান্তিক চাষি যাঁরা বাড়তি জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন, এমন অন্তত ১৫-২০ শতাংশ।
হরেদরে অর্ধেক চাষি জীবিকার জন্য ঠিকার উপর নির্ভর। প্রশাসনের খাতায় যাঁরা খেতমজুর, যাঁরা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, তাঁদের একটা বড় অংশই ঠিকাচাষি। চাষের শ্রম ও আর্থিক বিনিয়োগের অনেকটাই তাঁদের। ঠিক কতটা, সে-তথ্য কারও কাছে নেই। তবে চাষে বিনিয়োগ হয় যে-টাকা, তার অনেকটাই যে মহাজনি ঋণ, তার ইঙ্গিত মেলে। বর্ধমানের লিড ব্যাঙ্ক ইউকো ব্যাঙ্ক। কৃষিঋণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুজিত সরকার জানালেন, খাতায় রয়েছেন পাঁচ লক্ষ চাষি। কিন্তু মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ স্রেফ ২৫ হাজার টাকা। বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চলতি মরশুমে (এপ্রিল-জুলাই, ২০১৫) যত চাষি ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২০,৩৮৪ টাকা।
ঠিকাচাষি বর্গাদার নন। জমি চাষের আইনি অধিকার আছে বর্গাদারের, তাই বর্গা রেকর্ড দেখিয়ে তিনি ঋণ থেকে বিমা, সবই পাবেন। ঠিকাচাষির কোনও আইনি অধিকার নেই জমিতে। ভাগচাষির জমির অধিকার নেই, কিন্তু বিনিয়োগও তিনি করেন না। করেন জমির মালিক। চাষের সব কাজ দেখাশোনার জন্য ভাগচাষি নেন ফসলের অর্ধেক। ঠিকাচাষি কিন্তু চাষের জমিতে বিনিয়োগ করেন ১০০ শতাংশ। সাধারণত চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে। বিঘে প্রতি ৭০-৭৫ বস্তা আলু উৎপন্ন হলে, খেতমালিককে চার বস্তা দিয়ে, বাকিটা তাঁর থাকে। বাজার ভাল থাকলে সব ধার চুকিয়েও তাঁর হাতে থাকে কিছু টাকা, যেমন ছিল ২০১৪-১৫ সালের আলু মরশুমে। পরের মরশুমেই বিঘে প্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরপর দুটো মরশুম ক্ষতি হলেই কার্যত মারা পড়ে ঠিকাচাষি, গলায় কীটনাশক ঢালুক আর না-ই ঢালুক। তা হলে কেন চাষ করা? ‘আশায় বাঁচে চাষা’ কথাটা অনেকেই শোনালেন। যদি সারা বছরের চালটুকু মিলে যায়, যদি এবার আলুর বাজার ভাল হওয়ায় আগের ধার শোধ হয়ে যায়, হাতে কিছু টাকা আসে সেই আশায় চাষ করে চাষি।
এ এক ধরনের ফাটকা তো বটেই। প্রাণ বাজি রেখে চাষ। কিন্তু কথা হল, চাষ যাঁদের জীবিকা, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক যদি ফাটকায় নামতে বাধ্য হন, তা হলে কি চাষির চরিত্রদোষ খুঁজব? নাকি খুঁজব, কেন ফাটকা না খেললে চাষ করা যাচ্ছে না? ঠিকাচাষির জন্য তবে কী করছে রাজনীতি? কী করছে ব্যাঙ্ক, সমবায়?
করার আছে অনেক কিছুই। ভূমিহীন চাষিরা ব্যাঙ্কের অধীনে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ তৈরি করে নাবার্ডের ঋণ পেতে পারে। কিন্তু চাষের খাস জেলা বর্ধমানে তেমন গ্রুপ নেই বললেই চলে। কেন নেই? শুনে একটি সমবায় সমিতির কর্তা হাসলেন। বললেন, ‘বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মীরা বসিরহাট, দমদম, বেহালার লোক। জামালপুরের ঠিকাচাষিদের গ্রুপ তৈরি করে ঋণ দেওয়া গেল কি না, তা নিয়ে কেন মাথা ঘামাবেন? তাঁরা ট্রান্সফার হওয়ার চেষ্টায় আছেন।’
বর্ধমানের সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে গিয়ে জানা গেল, সমবায় থেকে যাঁরা কৃষিঋণ নিতে পারেন, তাঁদের মধ্যেও মৌখিক ঠিকাচাষি (‘ওরাল লেসি’) বলে একটি শ্রেণি রয়েছে। জমির মালিক শুধু যদি লিখে দেন, অমুক আমার জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছে, তবে ১৬ শতাংশ সুদের মহাজনি ঋণের জায়গায় ৪-৭ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ পেতে পারে ঠিকাচাষি। কত ঠিকাচাষির কাছে তেমন নথি আছে? ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান জওহরলাল মুখোপাধ্যায় জানালেন, ২০১৪-১৫ সালে কৃষিঋণ নিয়েছেন ১ লক্ষ ৫৫ হাজার চাষি। তাঁদের মধ্যে ‘মৌখিক ঠিকাচাষি’ ১৮ হাজার ৩০৪। মানে ১২ শতাংশ।
বাস্তবে ঠিকাচাষি যখন প্রায় ৫০ শতাংশ, তখন সমবায়ের খাতায় কেন এত কম? দুটো উত্তর পাওয়া গেল। এক, পরপর তিন বছর কোনও ব্যক্তি একই জমিতে ঠিকাচাষ করছে, প্রমাণ দেখাতে পারলে সে বর্গার জন্য আবেদন করতে পারে। তাই লেখাপড়া করে ঠিকা দিতে চান না জমির মালিক। আর দুই, জমির মালিক স্বল্প সুদের লোভে নিজেই ওই জমির জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নেন। স্রেফ ফিক্সড ডিপোজিট রাখলেও লাভ। শোনা গেল, ঠিকাচাষিদের মধ্যে মহাজনি কারবারও চলে ‘কেসিসি’-র টাকায়। সরকারের থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে ঠিকাচাষিদের মধ্যে ১৬ শতাংশ হারে খাটানো হচ্ছে। চাষির জন্য ভর্তুকির এই হল গতি।
যার কেউ নেই, তার আছে রাজনীতি। সরকারি সুবিধে যাতে প্রকৃত চাষি পায়, তার জন্য নেতারা কী করছেন? সিপিএম নেতা অচিন্ত্য মল্লিক, জামালপুরের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ পাল, দু’জনেই বললেন, পঞ্চায়েতে বীজ, সার এলে পঞ্চায়েত সদস্য মধ্যস্থতা করে মালিকের ভাগের জিনিস কিছুটা পাইয়ে দেন ঠিকা চাষিকে। ‘একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে,’ বললেন অচিন্ত্যবাবু। সোজা কথায় যার মানে, সরকারি অনুদান আর গরিব চাষির মধ্যের জায়গাটুকু আনুগত্যের পরিসর, অধিকারের নয়।
রাজনীতি অধিকার দিতে পারলে জমির মালিক ঠিকাচাষির সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে বাধ্য হত। নয়তো সমবায় কর্তা, পঞ্চায়েত সদস্যরা লিখে দিতেন, সুশান্ত রুইদাস চাষি। তা দেখিয়ে ঋণ মিলত সমবায় থেকে। কিন্তু এখন সমবায়ের কর্তারাও জমির মালিক। দলের নেতারাও। তারা সুশান্তদের কেউ নয়। অচিন্ত্যবাবু বললেন, ‘ঠিকাচাষি বেশি বিপন্ন। তবে তাদের জন্য আলাদা কোনও কর্মসূচি নয়। সব চাষির জন্য এক আন্দোলন।’ সেটা কী? সরকারকে ফসলের সহায়কমূল্য বাড়াতে হবে, যাতে জমির মালিক চাষে ফের উৎসাহী হয়। তাতে ঠিকাচাষির কী সুবিধে? ‘তাকে পাট্টা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হবে।’
আরও দার্শনিক কথা বললেন ভাতারের বিধায়ক বনমালী হাজরা, ‘এই চাষিদের কী হবে, এ হল চিরন্তন প্রশ্ন। মা মাটি মানুষের সরকার এদের জন্য ভাবছে।’ কী ভাবছে? ‘কে কী চাষ করবে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৈলবীজ, ভুট্টা…’ কিন্তু বিকল্প চাষ করেও বা ঠিকাচাষির সুবিধে কোথায়? গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন বনমালীবাবু। তাঁর নিজের সাতটি ধানের মরাই, তিনটি পুকুর, ৬০ বিঘে জমি, পাঁজা করে রাখা সারের বস্তা, কোথাও উত্তর মিলল না।
ঠিকাচাষিদের পাশে যে রাজনৈতিক দল নেই, তা স্পষ্ট করে দিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। বললেন, ‘বহু দাবি নিয়ে লোকে ডেপুটেশন দিতে আসে। ‘ওরাল লেসি’-দের দাবি নিয়ে কেউ আসে না। ওঁরা সংগঠিত নন। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনও আছে বলে চোখে পড়ছে না।’
যে বাজার ধরতে পারে না, নেতাও ধরতে পারে না, তার মরা ছাড়া গতি কী?
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
কী পাওয়ার কথা, কত দিনে, কত মঞ্জুর হল
দুর্নীতি-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মহারাষ্ট্রের অণ্ণা হাজারে লোকপাল বিলের দাবিতে দিল্লিতে অনশনে বসেন ৫-৯ এপ্রিল, ২০১১। বহু মানুষ তাঁর আন্দোলনে সামিল হন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে লোকপাল বিল পাশ করে সংসদ।
যে দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে, সেই দেশ প্রজাতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দেশে সেই ইচ্ছার প্রকাশ ও রূপায়ণ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। ক্ষোভ দেখা দেয় যখন জনপ্রতিনিধিরা সেই ইচ্ছার মর্যাদা দেন না। যেখানে গরিব ঘুস দিতে বাধ্য হয়, নেতা-আমলারা বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করে, তেমন দেশকে ‘আমার দেশ’ বলে মেনে নেব কেন? সেই রাগেই লক্ষাধিক ভারতবাসী এক স্বল্প-পরিচিত, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের সঙ্গে অনশনে বসলেন, স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হলেন। তাগিদ ছিল তীব্র, প্রকাশও হয়েছে জোরালো। এবার চিন্তার প্রয়োজন মানুষের মূল ইচ্ছাটি নিয়ে। দুর্নীতি দূর হোক, এই যদি হয় দেশের মানুষের চাহিদা, লোকপাল আইন পাশের দাবিই কি তা পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি উত্তরপ্রদেশের বিধায়কদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা গিয়েছিল, যাঁদের ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নিজের বা পরিবারের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে,’ তাঁরা প্রায় ৪০ শতাংশ। ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নতুন ব্যবসা কিংবা ঠিকাদারির কাজ শুরু হয়েছে বা বেড়েছে’ ৫৪ শতাংশের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন অন্তত ৪২ শতাংশ। সংখ্যাগুলি খানিকটা অনুমান-ভিত্তিক, তবু এ-ও ঠিক যে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতে দুর্নীতি দ্রুত বেড়েছে। লোকপাল আইন হলে বহু সাংসদ বেকায়দায় পড়বেন। জেলের টিকিট কে-ই বা কাটতে চায়?
এই সাংসদদের খুব বেশি দোষও দেওয়া চলে না। সবাই জানে, ভোটে লড়তে যে বিপুল টাকা লাগে তার কোনও বৈধ উৎস অধিকাংশ প্রার্থীই দেখাতে পারবেন না। ভোটের আগে প্রকাশ্যে টাকা বিলি হয় বহু রাজ্যের নির্বাচনে। টাকাগুলো আসে কোথা থেকে? যে-কোনও সাংসদ ধরেই নেন, তাঁর দল আইনের বাইরে গিয়েও তাঁর জন্য টাকা তুলবে। আর নির্বাচনের জন্য যখন টাকা তুলতেই হচ্ছে, তখন যারা টাকা তুলছে তারা যে কিছু টাকা নিজের পকেটে পুরবে, তাতে কি আশ্চর্য হওয়া চলে? সাংসদ নিজে সৎ হলেও তাঁকে পার্টির তোলা টাকার উপর নির্ভর করতেই হবে। তাই কোন সাংসদ সৎ আর কে অসৎ, বিচার করে লাভ হয় না। সাংসদ নির্বাচনের যে-ব্যবস্থা বহাল, সেটাই দুর্নীতিকে অবধারিত করে তোলে।
নির্বাচনে দুর্নীতি রোধ করা যায় কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় কর্পোরেটগুলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী খরচ দেয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট যেমন রায় দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, যে-কোনও কোম্পানি তার পছন্দের দলকে যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারে, যদি তারা তা খোলাখুলি ঘোষণা করে দেয়। ভারতে (বা ফ্রান্স-জার্মানিতে) ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হবে, একে পয়সা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো বলেই ধরে নেবেন অনেকে। কেউ হয়তো বলবেন, দল যখন টাকা নেবেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, তখন লুকোছাপা না করে খোলাখুলি বলতে দোষ কী? অন্য পক্ষ আপত্তি করবেন, কে কাকে কত দিচ্ছে, সে-তথ্য এত জটিল যে তা জানিয়ে দিলেও হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তের পক্ষে তার তাৎপর্য উদ্ধার কঠিন।
ভারতে অন্য সংস্কারের কথা ভাবা যায়। যেমন, রাষ্ট্রই নির্বাচনে প্রচারের খরচ দিক প্রতি রাজ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি (বা তিনটি বা পাঁচটি) রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের। টাকার অঙ্ক না হয় দরাজভাবেই ঠিক হোক। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো, টাকা ঢেলে টাকার অপচয় আটকাতে হবে। অবশ্যই এই প্রস্তাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে: নতুন দলগুলোর কী হবে? বিধানসভা নির্বাচনের টাকা কে দেবে? উত্তর খোঁজা দরকার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের খরচে স্বচ্ছতা আনতে টাকা দিতে হবে রাষ্ট্রকে, এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জরুরি।
লোকপাল আইন নিয়ে আপত্তি একেবারে গোড়ায়। এ আইনের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র সম্পর্কে অণ্ণা হজারের ধারণা: ‘রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। তাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যতটা সম্ভব ভয়ে রাখা, চাপে রাখা দরকার।’ কিন্তু রাষ্ট্রকে যতই নির্মম মনে হোক, শেষ অবধি তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় সেতু তৈরি হবে, পানীয় জল পরিস্রুতির সেরা উপায় কী, শিক্ষা নীতি কী হবে। সরকারের কাজ হয়তো আরও সরল, আরও সীমিত করা যেতে পারে। কিন্তু তার পরেও বহু কাজ থেকে যাবে, যা সরকারকেই করতে হবে, এবং ভাল করে করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়লেই যে অন্য কাজগুলো আরও ভাল ভাবে হয়ে যাবে, এমন নয়। বরং লোকপাল ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে জানলে সরকারি কর্মীদের কম টাকায় ভাল কাজ করানোর উদ্যোগটাই চলে যাবে। সরকারি টাকা বাঁচানোর ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না।
সরকারি দফতরগুলোয় বজ্র-আঁটুনি কষতে গিয়ে ফসকা-গেরো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে তহবিলের টাকা, এমন দেখা গিয়েছে অনেক দেশে। যেমন, ইতালিতে সরকারি কর্তারা দু’ভাবে জিনিস কিনতে পারেন। এক, সরকার-নির্দিষ্ট সরবরাহ সংস্থা ‘কনসিপ’-এর থেকে। কনসিপ ঘোষিত দামে জিনিস দেবে, ঘুস দেবে না। দুই, বাজার থেকে সরাসরি দরদাম করে, সে ক্ষেত্রে ঘুস খেয়ে বরাত পাইয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইতালি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে পরিচিত, সেখানে সরকারি কর্তারা বাজার থেকে জিনিস কিনতে আগ্রহী হবেন, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা কনসিপ থেকেই কিনছেন, বাজারের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দাম দিয়েও। অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে গা বাঁচাতে। অকারণ ব্যয়ের ফলে ইতালি সরকারের মোট জাতীয় উৎপাদনের দুই শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। লোকপালের কড়াকড়িতে ভারতেও এমন ঘটতে পারে।
সরকারি দফতরের উপর নজরদারি অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে সব দেশে আমলাতন্ত্র কাজ ভাল করে, সেখানে দেখা যায় কর্মীরা নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রকের চেয়ে দফতরের ভিতরের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছেন বেশি। বাইরে থেকে কেবল দেখা যায় অমুক নিয়মটা মানা হচ্ছে না। ভিতরের লোকেরা বোঝে কে নিয়মের এদিক ওদিক করছে কাজটা আরও দ্রুত করার জন্য, আর কে তা করছে নিজের পকেট ভরার জন্য। কী করে সেচের কাজ ঠিক সময়ে হবে, পোস্ট অফিস আর একটু ভাল কাজ করবে, তার উত্তর লোকপালের কাছে নেই। বরং যে দক্ষ, সৎ লোকগুলো এ সব কাজ করতে পারতেন তাঁরা দমে যাবেন। লোকপাল কাজে লাগবে সেই রাঘববোয়ালদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, যাঁরা আইনকে পরোয়া না করেও পার পেয়ে যান।
কেবল ঘুসখোরকে শাস্তি দিয়ে স্বচ্ছ, দক্ষ ও তৎপর প্রশাসনের দাবি পূরণ করা যাবে না। বাড়ির সামনে মরা কুকুর পচছে, পুরসভার কর্মী তুলে নিয়ে যাচ্ছেন না। শিক্ষক মাইনে পাচ্ছেন, ক্লাসে আসছেন না। এগুলোও দুর্নীতি, যা ঘুসের চেয়ে বেশি বিপন্ন করে সাধারণ মানুষকে। প্রাপ্য যথাসময়ে না পেলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। অথচ এ দেশে যা পাওয়ার কথা তা পাওয়া একটা বিরল ঘটনা। একটা বড় কারণ, কোন পরিষেবা কার, কোন সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা, স্পষ্ট করে জানানো হয় না নাগরিকদের।
২০০৭-এ পশ্চিমবঙ্গের রেশন রোষে স্পষ্ট হয়েছিল যে, গ্রাহকদের কত চাল-গম কোন দরে পাওয়ার কথা, ক’দিন খোলা থাকার কথা রেশন দোকান, তা অনেকে জানেন না। ফলে ‘সাপ্লাই আসেনি’ বলে পার পেয়ে যান ডিলাররা, গ্রামবাসী জানেন না কোথা থেকে তার সত্যতা জানা যাবে। তাই কোন ডিলারটা চোর, শুধু সেটা খুঁজে লাভ নেই। বদলাতে হবে ব্যবস্থাটাই।
একটা উপায়, নাগরিকদের কী কী প্রাপ্য, কোন শর্তে, তা স্পষ্ট জানানোর পদ্ধতি তৈরি করা। বহু রাজ্যে তৈরি হয়েছে ‘নাগরিক সনদ’ (সিটিজেন্স চার্টার), নাগরিকদের অধিকারগুলি যেখানে বিশদে বলা হচ্ছে। যেমন, জমির নথির জন্য আবেদন করলে কত দিনের মধ্যে দফতর তা দিতে বাধ্য। এর ফলে সরকারি দফতরগুলোর অদক্ষতা বোঝার একটা মাপকাঠি আসে নাগরিকদের হাতে, তাই চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও বাড়ে। এদেশে সেটা হতে দেন না সরকারি কর্মীরাই। বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে তথ্যগুলি তাঁরা অস্পষ্ট করে রাখেন, আর প্রায়ই বদলান, ফলে ধন্দ তৈরি হয়। মিড-ডে মিল প্রকল্পটি যে অন্য অনেক প্রকল্পের তুলনায় নিয়মিত ও কার্যকর তার একটা কারণ এটার বিষয়ে কোনও ধন্দ নেই। সকলেই জানেন, স্কুল খোলা থাকলেই মিড-ডে মিল পাওয়ার কথা প্রতিটি ছাত্রের, এবং তার দায়িত্ব মাস্টারমশাইদের।
আমজনতার কাছে তথ্য প্রকাশের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকলে সেই চাপে দুর্নীতিও কমে আসে। উগান্ডায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর অনুদান পাঠাত স্কুলগুলির জন্য, কিন্তু বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নেতা-আমলারা বেশির ভাগই আত্মসাৎ করতেন। শেষে সরকার কোন স্কুলে কত অনুদান গেছে, খবরের কাগজে ছেপে দিতে লাগল। হাতে হাতে ফল: ’৯৫ সালে স্কুলগুলোয় গড়ে বার্ষিক অনুদানের ২৪ শতাংশ টাকা পৌঁছোত, ২০০১-এ পৌঁছোল ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দেশে যদি নিয়মিত জানানো হত কোন ব্লকে রেশনে কত চাল এসেছে, বা সেচ বা রাস্তা তৈরির খাতে পঞ্চায়েতে কত টাকা এসেছে, তা হলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার দরকার হত না। ব্যবস্থার চাপে দুর্নীতি কমত।
নেতাদের ইচ্ছা যখন মানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে না, তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে জনস্বার্থের বিরোধ বাধবে না পদে পদে, তখন সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য শাসনতন্ত্র।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১২
সাবানের কাজ
সাধারণ পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো ছাত্ররা কতটা জানে, কতটা পালন করে, তা বুঝতে বীরভূমের কয়েকটি স্কুলে একটা সমীক্ষা হয়েছিল ২০১১ সালের শেষে। সর্বশিক্ষা মিশনের অনুদানে ‘আশা’ সংস্থার এই সমীক্ষায় পাঁচশোর উপর ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাদের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর। তাদের মধ্যে তফশিলি জাতি-জনজাতির ছাত্ররাও ছিল বেশ কিছু।
প্রাথমিক ফলাফল দেখে আঁতকে উঠতে হয়। দশ জনে আট জনই রাতে খাবার পরে দাঁত মাজে না, অর্ধেকেরও বেশি শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। বড় হতে হতে তারা যে এগুলো শিখে যাচ্ছে, এমনও নয়। দেখা যাচ্ছে, দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েদের ৮৪ শতাংশ খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। কোনও কোনও বিষয়ে খানিক উন্নতি হচ্ছে। প্রাথমিকের তুলনায় উচ্চ প্রাথমিকে থুতু ফেলার মতো বদ অভ্যাস কমছে, কাশির সময়ে মুখের উপর হাত চাপা দেওয়ার ভাল অভ্যাস বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, দশ জনে চার জন ছেলেমেয়ের মধ্যে খারাপ অভ্যাসগুলো থেকেই যাচ্ছে।
এ তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভারতের সামগ্রিক ছবিটাও এর কাছাকাছি। একটি বেসরকারি সংস্থার তৈরি ‘হাংগার অ্যান্ড ম্যালনিউট্রিশন রিপোর্ট’ (সংক্ষেপে ‘হাংগামা রিপোর্ট’) নয়টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় সমীক্ষা করেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িতে সাবান আছে, কিন্তু শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার, আর খাবার আগে ১০ শতাংশ। সাবানের দরকার স্নানের জন্য, এটাই চলতি ধারণা। উদ্বেগ কিশোরী মেয়েদের নিয়েও। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে, দশ জনে ছ’জনই ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে ‘ন্যাপকিন’ হিসেবে যা ব্যবহার করছে, তা দোকান থেকে কেনাই হোক বা বাড়িতে তৈরিই হোক, স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেকেই ব্যবহৃত জিনিসটি আবার ব্যবহার করছে, সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় অনেক ছাত্রী মাসে চার-পাঁচ দিন স্কুলে যাচ্ছে না।
এই তথ্যগুলো বীরভূমের, কিন্তু বাকি রাজ্যে ছবি খুব আলাদা নয়। তার একটা ইঙ্গিত ডায়ারিয়ার প্রকোপ। সরকারি হিসেবে, এ রাজ্যে প্রতি বছর অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষ ডায়ারিয়ার জন্য সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন, মারা যান পাঁচশোরও বেশি। শিশুদের মধ্যে ডায়ারিয়ার প্রকোপ জাতীয় হারের চাইতে বেশি। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলেই ৪২ শতাংশ কমে যায় ডায়ারিয়া। স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্যে এত সামান্য দূরত্ব, অথচ তা ঘোচানো আর যাচ্ছে না।
কেন এই সহজ উপায়গুলো মানা হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, স্বাস্থ্যের কোনও নিয়মই মানছে না শিশুরা। তারা রোজ সকালে দাঁত মাজে, প্রায় সকলেই নিয়মিত নখ কাটে, চোখ ধোয় পরিষ্কার জলে, পানীয় জল ঢাকা দিয়ে রাখে। এমনকী ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ (২৯৪ জনের মধ্যে ২৫২ জন) জানিয়েছে, তারা নিয়মিত মশারি ব্যবহার করে। এই বার্তাগুলো তাদের কাছে কোনও-না-কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ পৌঁছয়নি রাতে দাঁত মাজা, কিংবা শৌচের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা।
অন্য দিকে, সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার অনেকটাই খরচ হয় না। কোন প্রকল্পে বরাদ্দের কী দশা, এক বার তাকিয়ে দেখা যাক।
তথ্য ও সংস্কৃতি: জনস্বার্থমূলক বার্তাগুলি প্রচারের মূল দায়িত্বে রয়েছে যে দফতর। এই দফতরের দেওয়া হোর্ডিং কিংবা কাগজ-টিভির বিজ্ঞাপনের বাইরেও, মুখোমুখি আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রচারের জন্য বরাদ্দ থাকে টাকা। ২০০৯-১০ সালের জন্য ছিল ৩৮ লক্ষ টাকা, ২০১০-১১ সালের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি নানা বিষয়ে এই টাকা খরচ হতে পারত। কিন্তু পর পর দু’বছর এই গোটা বরাদ্দই খরচ না হয়ে ফেরত চলে গিয়েছে। কী প্রকল্পে, কীসের প্রচারে খরচ হবে এই টাকা, তার পরিকল্পনা করে উঠতে পারেননি দফতরের কর্তারা।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন: এই দফতর পরিচালিত শিশুশিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষা সহায়িকাদের প্রশিক্ষণের জন্য, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মা ও শিশুদের শেখানোর জন্য ‘ফ্লিপ চার্ট’-এর জন্য, টাকা দেয় স্বাস্থ্য দফতর। ২০০৮-০৯ সালের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তিন কোটি ৮০ লক্ষ টাকার মধ্যে খরচ হয়নি দেড় কোটি টাকারও বেশি।
এ ছাড়া ‘টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন’-এর অধীনে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বদলের জন্য প্রচার করতে ২০০২ সাল থেকে এখনও অবধি মোট ১৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেবল ‘Information, Education, Communication’-এর জন্য ধার্য এই টাকার মাত্র ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে এ রাজ্যে। প্রতিটি জেলা বছরে এই বরাদ্দ থেকে দু’কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পায়। বীরভূম খরচ করেছে বরাদ্দের মাত্র ৬-৭ শতাংশ টাকা। ইউনিসেফ-এর এক প্রতিনিধি জানালেন, এর কারণ জেলাগুলোতে IEC-র জন্য ভারপ্রাপ্ত কেউ নেই, স্থানীয় এনজিও দিয়ে কাজ চালানো হয়। তারা কখনও ছৌ নাচ, কখনও বাউল গান, কখনও পথনাটিকা করে স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা প্রচার করছে। কিন্তু তাতে কাজ কতটা হচ্ছে, তার নজরদারি (মনিটরিং) হচ্ছে না। এই ছবির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, বরাদ্দ খরচ না-হওয়ার সঙ্গে অসুস্থতার হারে বদল না-হওয়ায় একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্তত খরচ না-করলে যে শিশুরা সুস্থ থাকবে না, সেটা নিশ্চিত।
স্কুল শিক্ষা: সর্বশিক্ষা মিশন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের (জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন, রাজীব গাঁধী পানীয় জল প্রকল্প প্রভৃতি) টাকা সমন্বিত করে পরিচ্ছন্নতার প্রচার করতে পারে, তাই টাকার অঙ্কটা নির্দিষ্ট নয়।
শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রচার মিডিয়ার মাধ্যমে করার জন্য রাজ্য স্তরে দু’কোটি টাকা, এবং জেলাগুলির প্রতিটিতে প্রায় সমান পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। এই টাকা থেকে ব্যয় হতে পারে সু-অভ্যাসের প্রচারের জন্যও।
‘লার্নিং এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর অধীনে বই-বহির্ভূত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কাজের জন্য রাজ্যের হাতে গত বছর ছিল ১৩০ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও জেলায় জেলায় সর্বশিক্ষা মিশনের ‘প্রজেক্ট অফিস’ থেকে প্রকল্প রূপায়ণ বাবদ বরাদ্দ টাকার অনেকটাই স্কুলগুলির জন্য সাবান কেনা, এবং তার ব্যবহারের বিষয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমাজ কল্যাণ দফতর: Information, Education, Communication-এর জন্য প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বছরে হাজার টাকা পায়।
টাকার অভাব নেই। তা হলে শিশুদের কুঅভ্যাস বদলাচ্ছে না কেন? কারণ তা নিয়ে কারও খুব মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হল, তাঁদের তাগিদ দু’রকম। এক, স্কুলগুলোতে শৌচাগার তৈরি করা। ২০০৮ সাল অবধি নির্মাণের কাজই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দুই, কিছু কার্যসূচি পালন করে যাওয়া। যেমন ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-এর জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ৭-১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন প্রভৃতি। কিন্তু শিশুদের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর নিয়মিত নজরদারির কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তাদের মনোভাবটি এ রকম যে, ‘জানানো হচ্ছে যখন, শিশুরা তা করছে নিশ্চয়ই।’
কী ভাবে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বার্তা দিলে তাতে কাজ হবে, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনকে কাজে লাগিয়ে পোলিয়ো টিকার জন্য ‘দো বুঁদ জিন্দেগি কা’ প্রচারটি কার্যকর হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভরসায় বিদ্যা বালনকে দিয়ে ‘নির্মল ভারত অভিযান’ শুরু করছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রক। আবার সাধারণ মানুষ যাঁরা অভ্যাস পরিবর্তন করে ভাল ফল পেয়েছেন (‘পজিটিভ ডিভিয়ন্স’), তাঁদের সামনে রেখে প্রচার করে ফল মিলেছে পশ্চিমবঙ্গেই, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প দিয়ে অপুষ্টি মোকাবিলার ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট দলে ভাগ করে কথাবার্তা বললে কাজ হয়, যেমন গর্ভবতীদের কাছে স্বাস্থ্যের কথা পৌঁছতে হলে। কোথাও এলাকার বাসিন্দাদের সার্বিক অংশগ্রহণ দ্রুত ফল দেয়, যেমন ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য জমা জল পরিষ্কার করা।
কোন কৌশল কাজ দেবে, ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’-এর সেই উপায়টি ঠাহর করা সহজ নয়। তা পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং সময় দাবি করে। সেই দাবিই করছে পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা। তাদের শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অধিকার ঢোকানো অর্থহীন হয়ে যাবে যদি কেবল টয়লেট তৈরি করে, আর স্বাস্থ্য বিষয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা করে দায় সারা হয়। যদি পরিকল্পনার অভাবে প্রচারের টাকা ফিরে যায়। স্কুলগুলোতে শৌচাগারও রয়েছে, মিড-ডে মিলের খাওয়াদাওয়াও হচ্ছে, অথচ শিশুরা হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে পারছে না। অসুখ-অপুষ্টি-অশিক্ষার চক্র ভাঙছে না। এই একটি ব্যর্থতাই স্বাস্থ্য-শিক্ষা-তথ্য-পঞ্চায়েত-সমাজ কল্যাণ, সব দফতরকে ফেল করিয়ে দিচ্ছে।
ওই অ-ধোয়া হাতগুলোই এ রাজ্যে দারিদ্রের সূচক।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মে ২০১২
শুকনো পুকুর
এক কথায় প্রকাশ করুন: ‘মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প।’
উত্তর: ‘পণ্ডশ্রম।’
তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বুকে এত খাদ। ওগুলো হওয়ার কথা ছিল পুকুর। গ্রামের মানুষ পুকুর সংস্কার করে তাতে ধরে রাখবেন বৃষ্টির জল, মাটির তলা থেকেও জল উঠে এসে ভরে দেবে পুকুরকে, এমনই ভাবা হয়েছিল। ছয় মাসও যদি জল থাকে, সেচের জলের চাহিদা মেটে অনেকটা, শ্যালো চালিয়ে জলস্তর ক্ষয় করতে হয় না। বাসন-মাজা কাপড়-কাচার জলের চাহিদা মিটে মেয়েদের জীবনটা খানিক সহনীয় হয়। সেই উদ্দেশ্যে একশো দিনের প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই এ রাজ্যে হয়েছে জলাশয় সংস্কারের প্রকল্পে। খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। গত সাত-আট বছরে যত পুকুর কাটা হয়েছে, তাতে জল থাকলে বহু জমি দোফসলি হত, বৃষ্টির জন্য আকাশ-পানে তাকিয়ে বসে থাকতে হত না চাষিদের। বৃষ্টি যথেষ্ট না হলেও তা অনেক গা-সওয়া হত।
আসলে ঘটছে কী? আষাঢ়ের এক সকালে, উত্তরখরা গ্রামে তার একটা নমুনা দেখা গেল। বীরভূমের বাহিরি-পাঁচশোয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটির নামেও খরা, কাজেও খরা। পাঁচশোয়া গ্রামের পুবে, গাজিডাঙার উত্তরে আর বাহিরির দক্ষিণে বিস্তীর্ণ প্রায় হাজার বিঘে জমি, শ্যালো পাম্প বসাতে গিয়ে সেখানে জলের নাগাল মেলেনি। হারু বাউরি, চণ্ডী বাউরি, রতন বাউরিদের ভরসা আকাশ আর পুকুর। সাড়ে ন’শো ফুট লম্বা আর ১৪০ ফুট চওড়া উত্তরখরা খাল সংস্কার করতে তাঁদের মতো ২৬০ জন লেগে পড়েছিলেন একশো দিনের কাজে। খানিক বৃষ্টিতে এঁটেল মাটি একটু নরম হয়েছে, পুরুষরা কোদাল চালাচ্ছেন, মেয়েরা ঝুড়ি করে মাটি নিয়ে পাড়ে ফেলে আসছেন। মাথাপিছু গড়ে ৬২ ঘন ফুট মাটি কাটলে ওরা পাবেন ১৩৬ টাকা মজুরি। কাজ হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে। গরিবের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রোজগার যাতে হয়, তাই প্রকল্পটি মূলত শ্রমনির্ভর। যে-কোনও কাজের অন্তত ৬০ শতাংশ টাকা ধরতে হবে মজুরি খাতে।
আরও কতটা কাটতে হবে? ‘এখানে জলের লেয়ার আছে বারো ফুট তলায়। দশ ফুট মতো কাটলে খালে জল থাকত অন্তত অঘ্রান অবধি, আমন ধান ঘরে তুলেও গম, সর্ষে, আলু বোনা যেত,’ বললেন হারু, চণ্ডীরা। ‘কিন্তু তার জন্য ২০ দিন কাজ করতে হত কম করে। সে কি আর হবে? সাত দিনের বেশি কাজ হবে না।’ সুপারভাইজারও জানালেন, নয় দিন কাজ হওয়ার কথা এই খালে। সব গ্রামে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ করতে হবে, তাই এমন ‘রেশন’ হচ্ছে কাজ, যুক্তি দিচ্ছে পঞ্চায়েত। কিন্তু আসল কথাটা হল, জল নিয়ে মাথাব্যথা নেই কর্তাদের। বীরভূমেরই এক পঞ্চায়েত সচিব, যিনি পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন, স্পষ্ট বললেন, ‘এনআরইজিএ নীতিতে যদিও সেচের পুকুরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আসলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যার খেলা। মজুরিতে যত খরচ হবে তত ভাল। কত দিন কাজ দেওয়া হল, তা দেখতে গিয়ে জলসম্পদের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। ব্লকে নানা ওয়ার্কশপে যাই, কই সেখানেও তো জলের কথা শুনি না।’
অপর একটি পঞ্চায়েতের সচিবও বললেন, ‘পুকুরে জল উঠবে না জেনেও কাজ দিতে হয়। না হলে এত কাজ কোথায়? উপরওয়ালারা তো বলেই দিচ্ছেন, ৫০ দিন কাজ দিতে হবে, কেমন করে দেবে আমার দেখার দরকার নেই।’ বোলপুরের কাছে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন তিনি, বললেন ‘এই দুই অঞ্চলে ৪০ শতাংশ মতো পুকুরে জল আছে। বাকিগুলো জল থাকবে না জেনেও খোঁড়া হচ্ছে।’
উত্তরখরা খাল এ বারও ফুট ছয়েক গভীরতায় থমকে যাবে। তিন বছর আগে এই খালই কাটা হয়েছিল এনআরইজিএ’র টাকায়। খানিক দূরে আড়াই-তিন বিঘে জুড়ে শালুকগড়া খালও সংস্কার হয়েছিল। তারও আজ সেই একই দশা, নীচে পাঁকটুকুও শুকিয়ে কাঠ। এর আগে যা হয়েছিল, এ বারও তাই হবে, ধান রোয়ার সময়ে জল পাওয়া যাবে ওই খালগুলো থেকে, কিন্তু কার্তিকে ধান তোলার সময়ে খালে জল থাকবে না, বিঘে প্রতি ফলন হবে বড়জোর পাঁচ-ছয় বস্তা (তিন কুইন্টাল)। খালে জল থাকলে আশেপাশের ৩০ বিঘে জমিতে দুটো ফসল হতে পারত, আফশোস করছিলেন ওঁরা। ‘হয় আমাদের এক মাস খুঁড়তে দিক, নইলে মেশিন নামিয়ে তলাটা কেটে দিক। আমরা মাটি ফেলে দেব,’ বিড়িটা ছুড়ে ফেলে বললেন সন্ন্যাসী বাউরি। কিন্তু শ্রমিকদের সুযোগ বেশি দিতে হবে বলে বুলডোজার ব্যবহারের সুযোগ নেই প্রকল্পে। তাই কোনও গ্রামেই যতটা কাটা দরকার পুকুর, ততটা কাটা হয়ে ওঠে না।
মহাত্মা গাঁধীর নামাঙ্কিত প্রকল্প বাউরি, মার্ডি, হেমব্রমদের ‘লেবার’ করে রেখে দিল। দিন আনি দিন খাই-এর বাইরে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ করে দিল না।
এই চিত্র সর্বত্র। বীরভূমের ৪৪টি গ্রামে একটি সমীক্ষা করেন অর্থনীতির গবেষক শুভাশিস দে, ২০১০ সালে। সময়টা ছিল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, সে-বছর বর্ষা শেষ হওয়ার পরে পরেই। একশোটিরও বেশি এনআরইজিএ-র পুকুর তিনি নিজে দেখেন। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে তার আগের চার-পাঁচ বছরে পুকুরের কাজে খরচ হয়েছিল এনআরইজিএ-র জন্য বরাদ্দ টাকার ৭৪-৮৯ শতাংশ। তা সত্ত্বেও নতুন পুকুরের ৮৮ শতাংশে জল ছিল না, পুরনোগুলো তো প্রায় সবই শূন্য। সম্বৎসর জল থাকে, এমন পুকুর মেরেকেটে তিন শতাংশ। যদিও প্রায় ৩০ শতাংশ পুকুরের চারপাশে চাষের জমি ছিল, কিন্তু মাত্র ১১ শতাংশ পুকুরের জল পাচ্ছিলেন চাষিরা।
উত্তরখরার আদিবাসী পাড়ার মণি হাঁসদা, মালতী হেমব্রমদের গ্রামের ডোবা কোটালগড়ায় বছর দুই আগে সাত দিনের কাজ হয়েছিল, কিছু দিন জল ছিল। এখন একটা গামছা ধোয়ারও জল নেই। ‘আগুন লাগলে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে,’ বললেন ওঁরা। দেড়শো পরিবারের জন্য দুটি টিউবকল। পাশের ইটোন্ডা গ্রামের চন্দনা, তন্দ্রা রাজবংশীরা জানালেন, পাড়ায় দশ-বারোটা পুকুর, কোনওটায় জল নেই। সকাল ছ’টা থেকে ৯টা, দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা ওঁরা টিউবকলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ‘আর দু’তিন ফুট পুকুর কাটলে জল মিলত।’ উত্তরখরা খালের মাটি কাটতে কাটতে পঞ্চায়েত সদস্য সুন্দরী মার্ডি বললেন, ‘এখানে খানিক, ওখানে খানিক, এমনি কাজ দেয়। এক মাস কাজ না করলে জল দাঁড়াবে কী করে?’
যতটা মাটি কাটলে জল দাঁড়ায়, ততটা কাজ হয় না কেন? কী ভাবে স্থির হয় কতটা মাটি কাটা হবে? এক পঞ্চায়েত সচিব বললেন, ‘নির্মাণ সহায়ক পুকুরটা মেপে নেয়, জেনে নেয় কত টাকা চেয়েছি, তার পর ঠিক করে কতটা কাটা হবে। জলস্তর দেখে পুকুর কাটা, তেমন আমি দেখিনি।’ এনআরইজিএ কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার অবশ্য জানালেন, আট-দশ লক্ষ টাকার প্রস্তাব ব্লক বা জেলাকে দিয়ে মঞ্জুর করিয়ে দরকার মতো পুকুর খোঁড়া যায়। কিন্তু উপরের কর্তাদের দিয়ে কাজের প্রস্তাব অনুমোদন করানোর ঝামেলায় যেতে চায় না অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত। আড়াই লক্ষ টাকার মধ্যে কাজের প্রস্তাব মঞ্জুর করতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক, তাই তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় কাজ। তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, পুকুর কাটা হয়ে যাওয়ার পর তা সত্যিই জলসম্পদ তৈরি করে গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে কি না, তা পরখ করার কোনও ব্যবস্থাই চালু নেই। গ্রামে নয়, রাজ্যে নয়, কেন্দ্রে নয়।
গরিবের সঙ্গে এমনই রসিকতা করেন দেশের কর্তারা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঘোষণা করেছেন, এনআরইজিএ প্রকল্পে দুর্নীতি আটকাতে হবে। মানে সরকার আরও কোমর বেঁধে দেখবে, কাগজের সঙ্গে কম্পিউটার, কম্পিউটারের সঙ্গে কাজ মিলল কি না। কাটা-মাটি পুকুর হয়ে উঠল কি না, তা কিন্তু দেখবে না। জুয়াচুরি ভারী খারাপ, বোকামি আরও ভয়ানক।
দুপুর গড়াতে রোদ গনগনে, গরম বাতাস উপরে উঠছে, উত্তরখরা খালের সামনে সেই কাঁপা বাষ্পের পরদা চোখে যেন ধাঁধা লাগাল। ওই যে লোকটি কোঁকড়া চুল, কথা বলতে বলতে কোদাল চালাচ্ছেন ধাঁই ধাঁই, ওই আমাদের পঞ্চায়েত মন্ত্রী নয়? ওই যে সাদা-দাড়ি বৃদ্ধ মাথায় নীল গামছার ফেট্টি বেঁধেছেন, কাদামাটি তুলে দিচ্ছেন আর এক জনের ঝুড়িতে, ওনাকেই কি দেখিনি লালকেল্লায়? সাদা শাড়ি, কষে চুল-বাঁধা মেয়েটি ঝপ করে কাদামাটি ফেলে তরতর করে নেমে গেল নীচে, ওই দ্রুত হাঁটাচলা যে রোজ দেখা যায় টিভির পরদায়। এখানে এঁরা কেন? তবে কি এঁরা বুঝেছেন, নির্জলা পুকুর তৈরির সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির কোনও তফাত নেই? হয়তো ওঁরাও জানেন, জলহীন পুকুর কাটার মতোই লাভ নেই রেশন ব্যবস্থা চালু রেখে যদি তাতে অপুষ্টি দূর না হয়, সর্বশিক্ষা মিশন চালিয়ে যদি তা শিশুদের লিখতে-পড়তে না শেখায়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে যদি তা আরোগ্য না আনে। প্রকল্প মানুষের জন্য কী করতে পারল, সে-কথাটা ভুলে গিয়ে প্রকল্প চালানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন দেশের কর্তারা। তাঁদের ‘কাজ’ মানুষের কতটা কাজে লাগে, তা টের পেয়েই হয়তো চড়া রোদে নির্জলা পুকুর কাটছেন একটা দিন। নেতা হলেও, মানুষ তো।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ জুলাই ২০১২
লোকে কেন টয়লেট চায় না
ভারতে শুদ্ধ জীবনযাত্রার অন্যতম ‘রোল মডেল’ হিন্দু ঘরের বয়স্ক বিধবারা। ‘ছোঁয়ানেপা’ এড়াতে তাঁরা সব সময়ে কেমন কাঁটা হয়ে থাকতেন, তার গল্প পাওয়া যায় কল্যাণী দত্তের ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইটিতে। ‘গেরস্তের শোবার ঘরে বিছানা মাদুর সতরঞ্চি পরদা, সব এঁটোকাঁটা হয়ে যায় মায় দরজার কড়াটি পর্যন্ত। তক্কে তক্কে থেকে কোন ফাঁকে এঁরা লাফিয়ে বা ডিঙিয়ে কোনও সময় ঘরে ঢুকে কাঠের পিঁড়েয় উঁচু হয়ে বসতেন।’ এমন প্রাণপণ চেষ্টায় যিনি পবিত্র থাকতেন, তাঁরই আবার ‘পায়ে লম্বা লম্বা ফাটা, জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত-পায়ে হাজা, অর্দ্ধেক সময় ভিজে কাপড়ে থাকার জন্য সর্দিজ্বর লেগেই থাকে।’ বহু রকম এঁটো-সগড়ি মানতেন, কিন্তু শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি, আর ছেলের জন্মবারে নখ কাটা বারণ, তাই হাতে-পায়ে লম্বা নখ, পরনের কাপড়খানি আধময়লা। এঁরা জমিদার ঘরের বিধবা, বলছেন কল্যাণী। তাঁরা মলিন, রুগ্ণ থাকতেন অভাবে নয়, সংস্কারবশে।
সমাজ-পরিবারের চোখে যা ‘শুচি’, তার সঙ্গে যে পরিচ্ছন্নতা, সুস্বাস্থ্যের তেমন কোনও যোগই নেই, ‘স্বচ্ছ ভারত’ তৈরির পথে এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ দেশের এত মানুষ এখনও কেন টয়লেট ব্যবহার করছেন না, তা খুঁজতে গিয়ে এই কারণটাই ক্রমশ আর সব কারণকে ছাপিয়ে উঠছে। গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের গ্রামের মানুষ গবেষকদের বলেছেন, বাড়ির কাছে টয়লেট থাকাটাই তো নোংরা। অন্য দিকে, খোলা মাঠে যাওয়ার অনেকগুলো সদ্গুণ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। যে খোলা মাঠে যায় সে অলস নয়, নিয়ম করে ভোরে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, উন্মুক্ত পরিবেশ, খোলা হাওয়া পছন্দ করে। সে সতেজ, স্বাস্থ্যবান, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ বহু দিনের সংস্কার, অভ্যাস যা বলছে, সরকারি প্রকল্প বলছে তার ঠিক উলটো। তাই প্রকল্প যত টয়লেট তৈরি করছে, তত ব্যবহার হচ্ছে না।
গবেষকরা নানা রাজ্যে গ্রামের মানুষের সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলে জানছেন, যে সব বাড়িতে টয়লেট আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি (৫৬%) পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন কাজ সারতে। বলাই হয়, ‘বড় বাইরে’ আর ‘ছোট বাইরে’।
কংগ্রেস সরকারের ‘নির্মল ভারত’ প্রকল্পের সময়ে চিন্তাটা ছিল এইরকম: আহা গরিব মানুষ, বাড়িই নেই, টয়লেট পাবে কোথায়। ওদের টয়লেট বানিয়ে দাও, নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে। অতএব রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় টয়লেট নির্মাণ শুরু হল। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, জোগান যতই বাড়ুক, চাহিদা বাড়ছে না। বরং জোগান-দেওয়া টয়লেট অব্যবহারে, অনাগ্রহে অকেজো হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গেই যে ১০৭৭ গ্রাম পঞ্চায়েত ‘নির্মল গ্রাম’ বলে ঘোষিত হয়েছিল, সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িতেই টয়লেট আর কাজ করছে না। ফের এই সব গ্রামে অন্তত ১৪ লক্ষ টয়লেট তৈরি করতে হবে। ফলে বিজেপি-র ‘স্বচ্ছ ভারত’ পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে টয়লেট গড়া নয়, টয়লেট ব্যবহার।
টয়লেট থাকতেও কেন ব্যবহার হয় না, তা নিয়ে নানা আলগা গল্প হাওয়ায় ভাসে। যেমন, গরিব মানুষ একটা বাড়তি ঘর পেলে বরং তাতে ছাগল-মুরগি রাখবে, খড়বিচুলি রাখবে, টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করবে কেন? কিংবা, সরকারি টয়লেটের এমন খারাপ দশা, ব্যবহারই করা যায় না। কিংবা জলই নেই, টয়লেট ব্যবহার করবে কী করে? এগুলো কিন্তু ধোপে টেকে না তেমন। ধরুন, জলের কথাই। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে ‘মাঠে যাওয়া’ লোকেদের মধ্যে সমীক্ষায় মাত্র ৩ শতাংশ বলেছেন, জল না-থাকা টয়লেট এড়ানোর কারণ। যে সব বাড়িতে পাইপবাহিত জল আসে, সেখানেও বাড়ির টয়লেট ব্যবহারের হার অন্যদের প্রায় সমান। এ রাজ্যের বীরভূমে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাঁদের বাড়ির ভিতরে অথবা কাছে জলের উৎস রয়েছে। অথচ প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। গোটা ভারতেও এই ছবি: বাড়ির কাছে জল থাকলেও লোকে ছুটছে মাঠে। অথচ আফ্রিকায় সাহারার নীচের গরিব দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের চেয়ে ঢের কম লোক বাড়ির কাছাকাছি জল পান, কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন ঢের কম লোক। ভারতের গ্রামে ৬০ শতাংশ বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে ওসব দেশে ৩৫ শতাংশ।
দারিদ্রকেও দায়ী করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিশ্চয় ভারতের চেয়ে ধনী নয়। সেখানে মাত্র চার শতাংশ মানুষ মাঠে যান। ভারত সরকার যে-টয়লেট গরিবদের দেন, ইট-সিমেন্টের নির্মাণ থাকায় তা নাকি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি অনেক টয়লেটের চেয়ে বেশি দামি। আবার ভারতেই মুসলিমরা গড়ে হিন্দুদের চেয়ে গরিব হলেও, তাঁদের টয়লেট ব্যবহারের হার বেশি। গ্রামীণ হিন্দু পরিবারের ৭৭ শতাংশ বাইরে মলত্যাগ করেন, মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ। বাড়িতে সরকারের দেওয়া টয়লেট থাকা সত্ত্বেও বাইরে যান ৪০ শতাংশ হিন্দু, মাত্র ৭ শতাংশ মুসলিম। কেন এই তফাত?
কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডায়ান কোফি পাচ্ছেন সেই শুচিতার ধারণার গ্যাঁড়াকল। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে অস্পৃশ্যতার ভূত। টয়লেটের লাগোয়া নিকাশি নেই বহু বাড়িতে, ব্যবহার করতে হয় সেপটিক ট্যাঙ্ক। হিন্দুদের চোখে ট্যাঙ্ক সাফাই ‘ছোট জাত’-এর কাজ, যাঁদের তাঁরা সহজে বাড়ির কাজে ডাকতে চান না। দেখা গিয়েছে, ভারতে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি টয়লেটের সেপটিক ট্যাঙ্ক সাধারণ ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়, যাতে দীর্ঘ দিন পরিষ্কার না করলেও চলে। বহু স্কুলে টয়লেট তৈরি হয়ে পড়ে আছে, সে-ও এই মানসিকতা থেকেই। শিক্ষকদের প্রশ্ন, পরিষ্কার করবে কে? ‘ছোট’ কাজটিতে শামিল হতে তাঁদের বড় আপত্তি। যে-স্কুলে টয়লেট ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও ঝাড়ুটি হাতে ধরছেন। ‘কে করবে’ প্রশ্নটা আর রাস্তা আটকে দাঁড়াতে পারে না।
যা ছিল ‘বড় বাইরে’, তাকে ‘বড় ভিতরে’ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষ মারা যদি পাপ হয়, তা হলে মাঠে যাওয়ার চেয়ে বড় পাপ বোধহয় আর কিছু নেই। এই একটা কাজ যে কত শিশুর মৃত্যু ডেকে আনছে, আরও কত শিশুকে রোগা, বেঁটে করে রাখছে, গবেষকরা তার নতুন নতুন সাক্ষ্য বার করে আনছেন। এ দেশে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ শিশু উদরাময়ে মারা যায়। কয়েক কোটি অনবরত পেটের রোগে ভোগে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, যেখানে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস যত বেশি, সেখানে শিশু-অপুষ্টির হারও বেশি। মল থেকে ছড়ানো জীবাণুতে বারবার পেট খারাপ, তা থেকে এক রকম দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি তৈরি হচ্ছে। না হলে আফ্রিকার গরিবতর দেশের শিশুরা কী করে ভারতীয় শিশুদের চেয়ে লম্বা হয়? গবেষকরা অনেক মাপজোক, হিসেবনিকেশ করে বলছেন, ভারতে টয়লেট ব্যবহার বাড়লে শিশুরা আরও বেশ কিছুটা লম্বা হত। আর সুপুষ্ট, লম্বা শিশুরা লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারে আরও ভাল, সে-ও প্রমাণিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। সে-কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। কলুষের আশঙ্কায় ঘরে ছোট জাতকে ডেকে এনে ঘর অশুচি করার ভয়ের শেষ পরিণতি: সন্তানের রোগ, মৃত্যু। আর গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের পিছিয়ে পড়া। কী হবে তোমার মঙ্গলে গিয়ে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে, যদি শিশুদের বাঁচাতে না পারো? কী হবে আমেরিকা-চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যদি বাংলাদেশ-কিনিয়ার কাছে হেরে বসে থাকো?
এই প্রশ্নগুলো ‘স্বচ্ছ ভারত’ তুলবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। ‘নির্মল ভারত’-এও টয়লেট ব্যবহারের প্রচারকে খাতায়-কলমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজের বেলায় তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল টয়লেট তৈরির প্রকল্প। তাতে নেতা-অফিসার-ঠিকাদার চক্রের পোয়াবারো। এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ ‘মিসিং টয়লেট’ রয়েছে। মানে, হিসেবের খাতায় সেগুলো আছে, বাস্তবে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এও দেখা যাচ্ছে, মানুষের আচরণ বদলানোর কাজকে গুরুত্বের বিচারে এক নম্বরে রেখেও কাজের বেলায় বরাদ্দ কেবল ১৫ শতাংশ টাকা। তাড়া পড়ছে দিনে ৪৮ হাজার টয়লেট নির্মাণে। ক্রমাগত টয়লেট জোগান না দিয়ে, কী ভাবে টয়লেটের চাহিদা বাড়ানো যায়, সেটা চিন্তা না-করলে ফের একগাদা টাকা বাজে খরচ হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের নামে।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ নভেম্বর ২০১৪
৫. উন্নয়নের বিতর্ক
ভর্তুকি কী কাজে লাগে
বিশ্বায়নের একটা সমস্যা হল, ভাল আইডিয়াগুলোর চাইতে খারাপ আইডিয়াগুলো তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে চায়। গোড়ায় সব কিছুতে টম্যাটো কেচাপ মাখানো শুরু হল, তারপর চিরকালের হুইস্কি-সোডা ছেড়ে চিনিতে চোবানো ককটেল খাওয়া ধরা হল। আর এখন চলছে এই ধারণাটা যে, গরিবের মর্যাদা রাখতে হলে তাদের জন্য কিছু করা ঠিক নয়, ভাগ্যের উপর তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত। বরাবরই ভেবেছি, দারিদ্র সম্পর্কে এ দেশের বিত্তবানদের যথেষ্ট পোক্ত ধারণা রয়েছে, তাঁরা এমন বোকা বোকা মার্কিন কথাকে পাত্তা দেবেন না। কিন্তু গত কয়েক দিনে দিল্লিতে বেশ কয়েকবার কথাটা কানে এসেছে। যাঁরা বলেছেন, তাঁরা আর একটু বেশি জানেন বলে আশা ছিল।
ঘটনা হল, পচা আবর্জনার মধ্যে খাবার খোঁজার মধ্যে কোনও মর্যাদা নেই। কিন্তু টাকা না থাকায় অন্যের কাছে টাকা চাওয়াটাও সম্মানের কথা নয় (চাইবার আগেই যাঁরা অন্যকে টাকা দিয়েছেন, তাঁরা কখনও গ্রহীতার চোখের কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ভুলবেন না)। আমাদের ছেলেবেলার চাইতে এখন দারিদ্র কমেছে, আবর্জনায় খাবার খোঁজার মতো অসম্মানের কাজ করতে হচ্ছে অনেক কম মানুষকে। কিন্তু বাড়ির কাছের শৌচাগারে জল নেই, দুর্গন্ধে টেকা যায় না বলে ভোর চারটেয় উঠে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মাঠে যাওয়ার মধ্যেই বা কী এমন সম্মান রয়েছে?
গরিবকে ভর্তুকি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবশ্যই অনেক ভাল যুক্তি রয়েছে। ভর্তুকি দিলে বাজেটে ঘাটতি বাড়ে, যার ফল মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম কমলে গরিবের রোজগারও কার্যত কমে, তাই ভর্তুকি থেকে শেষ অবধি গরিবের লাভ হয় সামান্যই। এটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে ভর্তুকি যাদের পাওয়ার কথা তারা পায় না। যেমন রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি, যা কার্যত গরিবের জন্য নির্দিষ্ট টাকা বিলি করে মধ্যবিত্তকে। তবে গরিবকে ভর্তুকি দিতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, তার চাইতে অনেক বড় প্রশ্ন, কী ভাবে খরচ হচ্ছে টাকাটা। ঠিক মতো ব্যবহৃত হলে ভর্তুকির টাকা গরিব তার সীমিত সুযোগকে আর একটু কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনার ছক যদি ভুল হয়, তা হলে ভর্তুকির টাকা তার সামান্যই কাজে লাগবে, এমনকী পরিস্থিতি আরও খারাপও করে তুলতে পারে।
একটা দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। প্রায় কেউই প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তুকির বিরোধিতা করেন না। এমনকী মিলটন ফ্রিডম্যানের মতো যাঁরা মুক্ত বাজারের কট্টর সমর্থক, তাঁরাও মনে করেন যে গরিব পরিবারে জন্মানোর জন্য কোনও শিশু জীবনে পিছিয়ে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া চলে না। তাই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু একটা করা দরকার।
প্রাথমিক শিক্ষায় কত সরকারি টাকা খরচ হয়, নানা রাজ্যে তার নানা হিসেব পাওয়া যায়। তবে জাতীয় গড়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদনের যত শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষায় এ দেশে খরচ হয়, তা চিনের চাইতে বেশি, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনীয়। এই টাকার একটা বড় অংশ যায় শিক্ষকদের বেতন দিতে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা গড়ে যা বেতন পান, তা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের অন্তত চারগুণ। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, বা সরকারি স্কুলের প্যারাটিচার সেখানে সরকারি শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ মতো টাকা পান, যা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের কাছাকাছি। কিন্তু অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলিধরন এবং তাঁর সহকর্মীদের সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, প্যারাটিচার বা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা শিশুদের যা শেখান, তার মান অতটাই ভাল, অনেক সময়ে আরও ভাল। যদিও গড় মান খুব কিছু ভাল নয়। ‘অসর’ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক ছেলেমেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না। সম্ভবত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক বা প্যারাটিচার আরও ভাল পড়ানোর কারণ, তাঁরা চেষ্টা করেন আর একটু বেশি।
শিক্ষকরা যদি ক্লাসেই না আসেন, বা আসলেও খারাপ পড়ান, তা হলে কেন আমরা তাঁদের এমন ভাল মাইনে দিচ্ছি? একটা উত্তর মেলে, শিক্ষকদের ইউনিয়ন খুব জোরালো। কিন্তু শেষ অবধি যে এই ব্যবস্থাটা চলতে পারছে তার কারণ আমরা এটাতে আপত্তিকর কিছু দেখছি না। ‘শিক্ষা বিশেষজ্ঞ’-দের অনুসরণ করে আমরাও মনে করছি (এবং সরকারও মনে করছে), যে শিক্ষকের পরিচয় তাঁর ডিগ্রি এবং তাঁর বেতনে। তিনি কতটা শেখাতে পারছেন, সেটা দিয়ে তাঁর বিচার হয় না।
শিক্ষকদের বেতন যদি প্যারাটিচারদের বেতনের সমান করা হত, তা হলে মোট জাতীয় উৎপাদনের অন্তত ১ শতাংশ বাঁচত, যা গরিবদের ফিরিয়ে দেওয়া যেত। এতগুলো টাকা যে নষ্ট হচ্ছে, সে-সমস্যা তো রয়েইছে। কিন্তু তা নিয়ে যে রাজনীতিটা হল, সেটা আরও ভয়ঙ্কর। যখন দেখা গেল, সরকারি স্কুলে ছাত্রদের সংখ্যা দ্রুত কমছে (ভারতের গ্রামেও এখন তিনজন শিশুর একজন প্রাইভেট স্কুলে যায়), স্বাভাবিকভাবেই একটা আশঙ্কা দেখা দিল, কত দিন এ ভাবে সরকারি টাকা নেওয়া চলবে। তখন সরকারি শিক্ষক এবং তাঁর বেরাদরি ‘শিক্ষার অধিকার’ নামক কলটি ফেঁদে বসলেন।
ওই আইনে যে কিছু কিছু ভাল আইডিয়া নেই, এমন নয়। কিন্তু তার একটি বড় দাবি হল, বেসরকারি স্কুলগুলোকে সরকারি স্কুলের সমান বেতন দিতে হবে শিক্ষকদের। এই ধারা কার্যকর হওয়ার পর থেকে বেসরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হতে শুরু করেছে, কারণ প্রাইভেট স্কুলগুলোর পক্ষে অত বেশি টাকা দেওয়া অসম্ভব। গরিবের জন্য ভর্তুকি এই ভাবে উলটে গরিবকেই মারছে। কারণ গরিবের কথা ভেবে সরকারি শিক্ষককে যে টাকা দিচ্ছে সরকার, তার জেরে গরিবকে পরিষেবা দিত যে সব স্কুল সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তার মানে এই নয় যে গরিবের জন্য ভর্তুকি হল বাজে খরচ। আমরা যদি কেবল এটাই দেখি যে কোন সরকারি প্রকল্প গরিবের অনেকখানি উপকার করেছে (প্রকল্পের জন্য কত খরচ হয়েছে, সেই টাকা আর কোনও ভাবে খরচ করলে বেশি লাভ হত কি না, সে-প্রশ্নগুলো যদি না-ই ধরা হয়) তা হলেও বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের নাম সামনে আসে। যেমন যে সব কৃষি প্রকল্প উচ্চফলনশীল প্রজাতির গম, ও পরে ধান তুলে দেয় চাষিদের হাতে। সত্তর-আশির দশকে গ্রাম-মফস্সলে ব্যাঙ্কের শাখার বিস্তার। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিলির প্রকল্প বিহার সরকারের। আর সাম্প্রতিক, বিতর্কিত একশো দিনের কাজের প্রকল্প। এমনকী শিক্ষার অধিকার আইনও গরিবের উপকার করতে পারে, যদি নামীদামী বেসরকারি স্কুলগুলোতে গরিবের জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার শর্ত সর্বত্র পালন করা হয়। এখনও অবধি তা হয়নি।
তবে লক্ষ করা দরকার, এই সবগুলি প্রকল্পই কোনও-না-কোনও নির্দিষ্ট, পরিচিত সমস্যার সমাধান করেছে। গরিবের টাকা সঞ্চয়ের সুরক্ষিত জায়গার অভাবের সমস্যা ঘুচিয়েছে ব্যাঙ্কের শাখা। দূরের স্কুলে যাওয়ায় ছাত্রীদের সমস্যা অতিক্রম করেছে সাইকেল। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সরকারি হারে মাইনে দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত যখন এমন কোনও প্রমাণ মিলছে না যে বেশি বেতনের সরকারি শিক্ষকেরা আরও ভাল পড়াচ্ছেন— বরং বিপরীত সাক্ষ্যই মিলছে।
অর্থাৎ সমস্যাটা ভর্তুকি নয়। সরকারি প্রকল্প কী ভাবে পরিকল্পিত হচ্ছে, কাজ করছে, প্রশ্নটা সেখানে। দুর্বল পরিকল্পনা, ভুল রূপায়ণ অকস্মাৎ হয় না। ‘গরিবের জন্য’ কোনও প্রকল্প তৈরি হলেই সেখানে এমন একটা আত্মম্ভরিতা থাকে, ‘যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে’ এমন মানসিকতা কাজ করে, যে জরুরি প্রশ্নগুলো করা হয় না— এই প্রকল্প করার কি অর্থ হয়? এটা যে কাজ করবে, তার কি কোনও প্রমাণ মিলেছে? আর কোনও ভাবে কাজটা করলে কি এর উদ্দেশ্য আরও ভাল সাধিত হতে পারত?
জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প এর একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। একবার যেই ঘোষণা করা হল যে ক্ষুধার্ত জনগণকে খাবার দেওয়া হবে, আর এই আইনের যাত্রা ঠেকানো গেল না। কেউ প্রশ্ন করল না, এ দেশে অপুষ্টি কি খাদ্যের অভাবের জন্য হচ্ছে, নাকি খাদ্যাভ্যাসে নানা ত্রুটির জন্য? সস্তায় চাল-গম দিলে যে অপুষ্টি কমবে, তার কি প্রমাণ আছে? ওই চাল-গমের টাকা যে আরও মোবাইল ফোন বা অন্যান্য শখের জিনিসে ব্যয় হবে না, তা বুঝব কী করে? কিন্তু বিরোধী বিজেপি অবধি এই প্রশ্নগুলো না তুলে সমর্থন করল আইনকে। অভিযোগ করলেন কেবল কিছু অর্থনীতিবিদ, যাঁরা সব বিষয়েই আপত্তি তোলেন।
হাতের কাছে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, তার সবই এটাই ইঙ্গিত করে যে, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পে অপুষ্টির সমস্যা প্রায় কিছুই মিটবে না। বরং খাদ্যাভ্যাসের ত্রুটির দিক থেকে নজর সরিয়ে আরও ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু এর কার্যকারিতার কোনও বিচার না করেই আমরা এর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলাম।
হয়তো সমস্যার একটা কারণ হল, আমরা ভর্তুকিকে ‘দান’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। দান করার কাজটাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। যে গ্রহণ করল, সে তা নিয়ে কী করল, সে-প্রশ্নটা জরুরি নয়। তাই ভর্তুকিকে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা যদি মনে করি যে বর্ণ, জাতি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইতিহাসে কিছু মানুষ যে ভাবে বঞ্চিত হয়েছে, ভর্তুকি সেই ক্ষতির নিরসন করছে, তা হলে হয়তো আমাদের আত্মম্ভরিতা একটু কমবে। আমরা চিন্তা করতে বাধ্য হব, প্রতিটি শিশু সমান সুযোগ নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারার যে লক্ষ্য, তা বাস্তবিক ঘটছে কি না।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ অক্টোবর ২০১৪
কেন বিদেশি অনুদান প্রয়োজন
২০১২ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতকে আর্থিক অনুদান দেওয়া বন্ধ করা হবে।
ভারতে দারিদ্র কমাতে কি বিদেশি অনুদানের দরকার আছে? ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থা ‘ডিফিড’ (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) এই প্রশ্নে বেশ বিপাকে পড়েছে। ভারতীয় নেতারা প্রাক্তন শাসকদের এক হাত নেওয়ার সুযোগ ছাড়বেন না, ভারতীয় সাংবাদিকরাও ঘুরপথে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখার ফন্দির নিন্দে করে সম্পাদকীয় কলাম লিখছেন। ও দিকে ব্রিটেনের খবরের কাগজগুলো শোরগোল তুলছে, পয়সা দিয়েও যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি না মেলে তা হলে খয়রাতি করে লাভ কী?
অনুদানের যুক্তি একটাই হতে পারে। তা হল, গরিব মানুষেরা যে-ই হন, যেখানেই বাস করুন, তাঁদের নিয়ে আমরা চিন্তিত। এ দেশের রইস আদমিরা যা-ই বলুন, ভারতের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও অত্যন্ত দরিদ্র। দু’দশক ধরে ভারতের অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছে, বলিউডে একাধিক বিলিয়নেয়ার তৈরি হয়েছে, মহাকাশে যান পাঠানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতের মাথাপিছু রোজগার কার্যত ব্রিটেনের মাথাপিছু রোজগারের দশ শতাংশ। এটাই কি ডিফিড-এর এ দেশে কাজ করার যথেষ্ট যুক্তি নয়? দু’দশকে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার যে কথা চলছে (যা একটু বাড়াবাড়ি, কারণ বৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই কমে আসছে), তা এই কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ, ভারতের জনসংখ্যা ততদিনে ১৫০ কোটি দাঁড়াবে, যাঁদের অর্ধেক বেড়ে উঠবে অর্ধাহারে, সিকি-শিক্ষিত হয়ে।
যার মানে দাঁড়ায়, ব্রিটিশ সরকার যে সহায়তা করতে পারবে তা হবে সীমিত। ইচ্ছে থাকলেও অত টাকা তারা জোগাতে পারবে না। আমাদেরই ভারতের অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের কাজটা করতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি বরাবরই ধনীদের উপর বেশি কর চাপানোর পক্ষপাতী (যেমন, বিত্তকর বসিয়ে)। কিন্তু পুঁজি কত সহজে অন্য দেশে পাচার হয়, এবং কর আদায় করতে যা হ্যাপা, তা মাথায় রাখলে আশঙ্কা হয়, নিকট ভবিষ্যতে কর থেকে মোট জাতীয় আয় অল্প কয়েক শতাংশ বড়জোর বাড়তে পারে। টাকার অঙ্কে সেটা অনেক বড়, কিন্তু সমস্যাও খুব কম নয়— শিক্ষার দশা করুণ, স্বাস্থ্য পরিষেবাও তথৈবচ, আর পরিকাঠামোর কথা না-ই বা তুললাম। পুষ্টির বিষয়টাই ধরা যাক— ভারতের শিশুদের অর্ধেকেরই অপুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যার মানে, কয়েক কোটি শিশু। এ সবের সামনে দাঁড়িয়ে যে-কোনও সহায়তাই মূল্যবান মনে হয় না কি? কিছু নাক-উঁচু লোকের ‘ব্রিটিশ দাক্ষিণ্যে’ গোঁসা হয় বলে আমরা অনুদান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেব?
বিদেশি অনুদানের বিরুদ্ধে যুক্তি অবশ্য এখানেই শেষ হয় না। অনেক গবেষক (এবং বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখক) মনে করেন যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে দেওয়া হলেও, বিজাতীয় বলেই অনুদান কাজ করে না। অর্থনীতির আরও অনেক ধারণার মতোই, এ ধারণাটারও সমর্থনে বা বিপক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই। তাই এর উপর ভর করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না বলেই মনে হয়। উন্নত দেশেও দারিদ্র কমানোর অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত মিলবে। যেমন মিলবে সরকারি টাকায়, বা অন্য সূত্রে মেলা অনুদানে রূপায়িত প্রকল্পে ব্যর্থতার বহু দৃষ্টান্ত। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্পগুলোই ব্যর্থ হচ্ছে বেশি, এমন কোনও প্রমাণ হাতে নেই।
ভারতে ডিফিড যে-প্রকল্পগুলোর জন্য টাকা দিয়েছে, তাতে বিদেশি অনুদান-প্রাপ্ত প্রকল্পের পরিচিত ঝুঁকিগুলো এড়িয়েছে। গরিবের সব সমস্যার জন্য একটাই সমাধান চাপানোর চেষ্টা করেনি ডিফিড। মূলত পুষ্টি, শৌচাগার আর মা-শিশুর স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়েছে। কাজ করেছে বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশে, যেখানে বেশি সংখ্যায় গরিব থাকে। আর যা সবচেয়ে জরুরি কথা তা হল, তারা ‘রেডিমেড’ সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তাদের কাজের মূল কথাই ছিল, ‘আমরা জানি না কেন এই সমস্যাগুলো হচ্ছে, এবং সেই কারণের অনুসন্ধান সমস্যার সমাধান বার করার একটি প্রধান উপায়।’
এই শেষের বিষয়টিই ভারতে বিদেশি অনুদানের প্রধান অবদান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ভারতের বিভিন্ন সরকারি দফতরে যে কর্মসংস্কৃতি, তাতে কী করলে কাজটা ঠিকমতো হবে, তার চাইতেও বড় হয়ে ওঠে, কী করা সুবিধে সেই প্রশ্নটা। কাজের যে পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকে একটু জানাশোনা আছে, সেটাই কাজে লাগানোর ঝোঁক দেখা যায়। এই মানসিকতা হল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অবদান। ভারতে সরকারি দফতরের কর্মীরা তাঁদের কাজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, অধিকাংশই এক বছর কি দু’বছর কাজ করে অন্য দফতরে চলে যাবেন। ফলে কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করা দরকার, তা বোঝার সময়, ইচ্ছে, ক্ষমতা, কোনওটাই তাঁদের নেই। যদি বা তাঁদের কারও ইচ্ছে থাকে কাজটা ঠিকমতো করার, রাজনীতির চরিত্র এমনই যে ক্ষমতাসীন নেতারা নতুন কিছু করে ভুল প্রতিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন। বৃহৎ প্রকল্প শুরু করার উচ্চাশায় লাগাম পরিয়ে, ছোট পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে রাজি নন।
এইখানেই অনুদানের ভূমিকা। যে হেতু ভারতে ক্ষমতা সামলানোর দায় নেই, তাই ডিফিড-এর মতো বিদেশি অনুদান সংস্থা কোনও একটি বা দুটি সমস্যাকে চিহ্নিত করে, ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রচেষ্টা-ভ্রান্তির মাধ্যমে সমাধানের দিকে এগোতে পারে। হাতে সময় নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকে যে ধরনের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়, এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার দ্বারা অনুদান সংস্থা সেই সমাধানের দিকে এগোতে পারে। এবং তাদের সেই কাজের সংস্কৃতি থেকে হয়তো এদেশে প্রশাসনের এমন একটা মডেল, একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা শেষ অবধি ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যা সমাধানে সমর্থ করে তুলবে। ব্রিটিশ সরকার ভারতকে যে টাকা দিচ্ছে, শেষ বিচারে সেটা সব চাইতে জরুরি নয়। যা জরুরি, তা হল ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থার ধৈর্য ধরার ক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান খোঁজার ক্ষমতা। ফাঁপা জাতীয়তাবাদের কবলে পড়ে তা হারালে আফশোস করতে হবে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
‘নিরাপত্তা’ কতটা নিরাপদ
খাদ্য নিরাপত্তা অর্ডিনান্স পাশ করল ইউ পি এ। সবাই বুঝল, দেশের সব নাগরিক যাতে যথেষ্ট খাবার পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকার এখন আইনত বাধ্য। তবে তাতে হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের নতুন করে কী লাভ হল, তা ঠিক বোঝা গেল না।
ভারতে খাদ্যনীতি বলতে বোঝায়, গরিবের কাছে সস্তায় চাল-গম পৌঁছে দেওয়ার নীতি। সেই ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত আগাগোড়াই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজার দরের চাইতে কম দামে খাদ্যশস্য বিতরণের ব্যবস্থা করলে তাতে দেশে অপুষ্টি কমবে। ভারতে অপুষ্টি তীব্র এবং ব্যাপক, তাই দেশ জুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ রেশন দোকান তৈরি করে তাতে বিপুল পরিমাণ চাল-গম সরবরাহ করতে হবে, এমন যুক্তির উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে খাদ্যনীতি। আজ পর্যন্ত এই ধারণাকে কখনও কেউ প্রশ্ন করেনি।
অথচ সস্তায় চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমে, সেই ধারণার সপক্ষে কোনও প্রমাণ মিলছে না। গরিব মানুষকে সস্তায় চাল-গম দিলে তাঁর যে-টাকা বাঁচে, ধরেই নেওয়া হয় তা দিয়ে তিনি বাড়তি খাদ্যশস্য কিংবা অন্য পুষ্টিকর খাবার কিনবেন। বাস্তবে গরিব মানুষ তাই করেন কি না, সেটা কখনও দেখা হয় না। ধরুন আপনি পরিবারের জন্য মাসে চল্লিশ কিলোগ্রাম গম কেনেন বাজারদরে, তাতে আপনাদের চাহিদা কোনও মতে মেটে। আপনাকে বিশ কিলোগ্রাম গম খুব কম দামে দেওয়া হল। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন, কারণ আপনার মনে হবে, হাতে কিছু টাকা রয়েছে। নিজেকে একটু কম গরিব মনে হবে। কিন্তু ওই বাড়তি টাকা দিয়ে কি বাড়তি কুড়ি কিলোগ্রাম গমই কিনবেন? নাকি ছেলেমেয়ের জন্য লজেন্স-চানাচুর কিনবেন, বাড়ির মেয়েদের জন্য শখের টুকিটাকি, বা আপনার মোবাইলের টকটাইম? রেশনে চালের দাম যদি দু’টাকাও হয়, বাজারে দাম ২২-২৬ টাকাই থাকবে। তাই শেষ চার-পাঁচ কিলোগ্রাম চাল কেউ বাজারদরে কিনবেন, নাকি ওই টাকাটা অন্য কাজে খরচ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতেই হবে।
দশ বছর অন্তর গোটা দেশে একটা সমীক্ষায় দেখা হয়, নানা রাজ্যের শহরে-গ্রামে পরিবারগুলি কীসে কত খরচ করে (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার মাসিক ভোগব্যয় সমীক্ষা)। সেই সমীক্ষায় যে-ছবি উঠে আসে, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, কেবল অতি-দরিদ্র পরিবারগুলিই বেশি টাকা পেলে বেশি খাদ্যশস্য কিনছেন। তার চাইতে কিছু বেশি টাকা যাঁদের আছে, তাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে থাকলেও হাতে টাকা থাকলে খরচ করছেন চিনি, মাছ-মাংস, তেল কিনতে। অতি-দরিদ্র পরিবার জনসংখ্যার কমবেশি ১০ শতাংশ। অপুষ্টি তার চেয়ে অনেক, অনেক ব্যাপক। অন্তত ৪২ শতাংশ শিশুর ওজন যে কম, সে-কথা তো ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীই কবুল করেছেন। যার মানে, কেবল খাবার কেনার অক্ষমতা দিয়ে অপুষ্টির ব্যাখ্যা করা চলে না। একটা শিশুর পেট ভরাতে কতটাই বা চালডাল দরকার হয়? যে-বাড়িতে টিভি চলে, মোবাইল বসানো আছে চার্জে, সাইকেল ঠেস দেওয়া দাওয়ার গোড়ায়, চালডালের দামই কি তার সন্তানের অপুষ্টির কারণ? আফ্রিকার দক্ষিণের যে সব দেশে গড় আয় ভারতের চাইতে অনেক কম, সেখানেও শিশুদের পুষ্টি ভারতের শিশুদের পুষ্টির চেয়ে অনেক ভাল। কী করে হয়? তার একটা কারণ এই যে, ভারতে সামান্য টাকাতেও নানা লোভনীয় জিনিস কেনা যায়। পাঁচ টাকা-দশ টাকাতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিকের চিরুনি, শ্যাম্পুর খুদে প্যাকেট, টিপের পাতা। ভারতের দেশ-জোড়া মস্ত বাজার রয়েছে, তাই অনেক কম-দামি জিনিস তৈরি হয়, বিক্রি হয়। আফ্রিকার গরিব দেশগুলিতে এ সব শখের জিনিস গরিবের নাগালের বাইরে। খাদ্যশস্য ছাড়া খুব কিছু গরিব মানুষ কিনতে পারেন না। তাঁদের ‘চয়েস’ কম, পুষ্টি বেশি।
ভারতে ছয় দশক ধরে সস্তায় চাল-গম দিয়ে অপুষ্টি মেটেনি। এখন বলা হচ্ছে, আরও সস্তায় আরও বেশি চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমবে। গোড়ায় গলদ হচ্ছে কি না, মানে নীতিটাই ভুল কি না, তা কেউ ভাবতে রাজি নন।
যেমন ভাবতে রাজি নন পদ্ধতি নিয়ে। রেশন ব্যবস্থার মতো দুর্নীতি-জর্জরিত, অপচয়-বহুল ব্যবস্থা ভারতেও কম রয়েছে। কত চাল-গম নষ্ট হয় প্রতি বছর, তার আন্দাজ করতে গেলেও তাজ্জব হতে হয়। গোটা অস্ট্রেলিয়ায় যত গম উৎপন্ন হয়, ভারতের গুদামগুলোতে তা নাকি নষ্টই হয় প্রতি বছর। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চার বছরে ভারতে ৭৯৪২ কোটি টন গম নষ্ট হয়েছে, যা উৎপাদনের ৯ শতাংশ। তার সঙ্গে রয়েছে চুরি। প্রতি বছর অর্ধেকেরও বেশি গম, আর প্রায় ৪০ শতাংশ চাল, গরিবের কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হয়ে যায়। ২০০৬-০৭ সালে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই ১৯০০ কোটি টাকার চাল চুরি হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি হিসেবেই এই দশা। এখন আরও, আরও চাল-গম রেশন দোকানের মধ্যে দিয়ে বিতরণ হবে, শুনলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই লাইন:
এ যেন দিবারাত্রে
জল ঢেলে ফুটোপাত্রে
বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।
কেন তা হলে রেশন ব্যবস্থা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা?
বলা হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা এখন ‘অধিকার,’ তাই তা নিশ্চিত করতে সরকার দায়বদ্ধ। বাস্তব কিন্তু এই যে, রেশন দোকান পর্যন্ত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়াতেই সরকারের ‘খাদ্যের অধিকার’ বিষয়ে আইনি দায় শেষ হয়। ঠিক যেমন স্কুলের ক্লাসরুম-শৌচাগার তৈরি করে, শিক্ষক নিয়োগ করে, শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে ‘শিক্ষার অধিকার’ নিশ্চিত করার দায় শেষ হয়।
ছেলেমেয়েরা আদৌ অঙ্ক কষতে, বাক্য লিখতে শিখল কি না, তা জানবার কোনও পদ্ধতি সরকারের হাতে নেই। গরিব পরিবারগুলি পুষ্টিকর খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খেল কি না, তা টের পাওয়ার কোনও উপায়ও নেই সরকারের হাতে। ‘আমি যখন দিচ্ছি, তখন ওরা নিশ্চয়ই পাচ্ছে,’ এমন একটা আলগা ধারণার ওপর ভিত্তি করে বছরের পর বছর প্রকল্পগুলো কাজ করে, যদিও সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান, অভিযোগ-অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় সেই ধারণার বিপরীতে।
গরিবকে শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার দেওয়া হলে ঠিক কী দেওয়া হয়? যাঁরা অধিকার-আন্দোলনের শরিক, তাঁরা বলবেন, আইনি অধিকার পেলে আমজনতা আদালতে গিয়ে হকের পাওনা দাবি করতে পারেন। রাষ্ট্র সেই দাবিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু কে আদালতে যায় মেয়ের স্কুলে শৌচাগার তালা-আঁটা রয়েছে বলে? কে পুলিশে নালিশ করে, রেশনে ৩৫০ গ্রাম চাল কম পেলে? কিংবা বেলা ১২টায় রেশন দোকান বন্ধ হয়ে গেলে? আর সত্যিই যদি হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের অধিকারভঙ্গের প্রতিটি অভিযোগ দায়ের হয় আদালতে, বিচারব্যবস্থা কি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে না?
অনেকে বলবেন, অধিকার-টধিকার কথার কথা, এ হল ভোটের রাজনীতি। খুব সস্তায় অনেক চাল দেব, এ কথাটা বললে গরিব মানুষ ভোট দেবে, আর কে না জানে ভারতে গরিবের ভোটই বেশি। এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বোঝা গেল না ইউ পি এ সরকার কী করে খাদ্য নিরাপত্তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা আশা করছে। চাল-গমের বদলে গরিবের ভোট, এই হিসেব সে সব রাজ্যেই কাজ করবে যেখানে রেশনব্যবস্থা মোটামুটি ভাল কাজ করে। তার মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ। এই রাজ্যগুলি দীর্ঘ দিন ‘দু’টাকায় চাল’-এর রাজনীতি করেছে, এদের রেশনব্যবস্থাও অন্যদের তুলনায় ভাল। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়া অন্য রাজ্যগুলো চালাচ্ছে ইউ পি এ-র বিরোধী দলগুলো। তামিলনাড়ু বা ছত্তিশগড় যদি বা খাদ্যের বদলে ভোট ফর্মুলা কাজে লাগায়, তাতে ইউ পি এ-র সুবিধে কী? তামিলনাড়ুতে এক টাকায় ইডলি বিক্রির প্রকল্প চালু করে বিপুল জনপ্রিয়তা কুড়োচ্ছেন জয়ললিতা। ছত্তিশগড়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহকে লোকে বলে ‘চাওল বাবা।’
বরং ইউ পি এ-শাসিত রাজ্যগুলির সমস্যা তীব্র হতে পারে। বিপুল পরিমাণে চাল-গম কিনবে সরকার, সেই প্রত্যাশায় বাজারে শস্যের দাম বেড়ে যাবে। এদিকে সস্তার চাল-গম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে লেগে যাবে বেশ কয়েক মাস। এর মাঝের সময়টা গাঁটের কড়ি খরচ হবে বেশি। সেই রাগ গিয়ে পড়তে পারে ইউ পি এ সরকারের উপরেই। তা আন্দাজ করেই হয়তো সনিয়া-রাহুলের আগ্রহ সত্ত্বেও কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের রাজ্যে তড়িঘড়ি খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্প শুরু করতে গররাজি।
অনেকে অবশ্য খাদ্যের অধিকারকে কেবল কার্যকারিতার প্রশ্নে বেঁধে রাখতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্র যে নাগরিকের কাছে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, সে-কথাটা আরও জোরালো করতেই শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার তৈরি করা দরকার। মুশকিল হল, এতে গরিবের চেয়ে নেতাদের সুবিধে বেশি। আইন পাশ করে ‘অধিকার’ তৈরি করেই নৈতিকতার পরীক্ষায় পাশ করে যান তাঁরা। কাজটা আর করে দেখাতে হয় না। খাদ্যের অধিকার আইন হওয়ার আগে যে রেশনে চাল পায়নি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে চাল পাবে? শিক্ষার অধিকার আইন হওয়ার আগে যে স্কুলে গিয়েও নাম লিখতে শেখেনি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে শিখবে? এমন প্রশ্নগুলো স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া যায়। অধিকার-আন্দোলন দায়বদ্ধতা বাড়াতে গিয়ে আসলে দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে।
যে দিক দিয়েই দেখা যাক, খাদ্যের নিরাপত্তা আইন ইউ পি এ সরকারের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েই দিচ্ছে। গরিবের ঝুঁকিও কিছু কমাচ্ছে না। বেচারি গরিব। ‘নিরাপত্তা’-ও তার পক্ষে আর নিরাপদ নয়।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ জুলাই ২০১৩
আধার কী পারে
২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আধার কার্ড বিলি শুরু করে। ২০১৩ সালের পয়লা জানুয়ারি আধার কার্ডের নম্বর ব্যবহার করে ভর্তুকি, পেনশন, স্কলারশিপ প্রভৃতি সরকারি অনুদানের টাকা উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছনোর কাজ শুরু হয়। বর্তমানে একশো কোটি মানুষের কার্ড রয়েছে বলে দাবি করেছে সরকার।
আজ থেকে কিছু কিছু এলাকায় আধার কার্ড দিয়ে সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তাদের টাকা দেওয়া শুরু হবে, এই ঘোষণা শুনে রাজনৈতিক মহল বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বহু বছর পর সরকার এমন কোনও পদক্ষেপ করল, যা নিয়ে জমিয়ে তর্ক করা চলে। ব্যাপারটা ভাল না মন্দ, তা নিয়ে গলা ফাটানো যায়। অর্থনীতির লোকজন বলছেন, আধার খেলাটাই বদলে দিতে পারে। আর খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সমর্থকরা ফের জোট বাঁধছেন, ‘আধার কার্ড আর রেশনে খাবারের বদলে টাকা’ বিলির বিরুদ্ধে।
কিন্তু আধার নিয়ে যেটা একেবারে মূল প্রশ্ন, তা নিয়ে দু’পক্ষের কেউ কথা বলছে না। তা হল— ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার এই যে নতুন প্রযুক্তি হাতে এল, তা দিয়ে এবার পছন্দের প্রকল্পগুলোকে কী করে আরও কার্যকরী করা যায়? যাঁরা আধার-বিরোধী, তাঁদের অনেকের কাছে অবশ্য নতুন প্রযুক্তি জিনিসটাই সন্দেহজনক। তাঁরা মনে করেন, রেশন কার্ড চুরি যেতে পারে, ভিজে যেতে পারে, হারাতে পারে, ছিঁড়ে যেতে পারে, কিন্তু জিনিসটা অনেক দিনের পরিচিত তো বটে, তাই সেটাই ভাল। হতে পারে, রাম একটু চেষ্টা করলেই স্থানীয় পঞ্চায়েত বা পুরসভার সাহায্যে রঘুর নামে রেশন কার্ড করিয়ে নিতে পারে (সেই সঙ্গে তার নিজের নামেও একটা কার্ড থাকতে বাধা নেই)। সেই রঘু হয়তো মারা গিয়েছে, কিংবা জন্মই হয়নি তার। রেশন কার্ড থেকে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুঃসাধ্য।
আমার কাছে আধার কার্ডের এটাই মস্ত সুবিধে বলে মনে হয়। শেষ অবধি অন্তত আমার চোখের তারা, আর আঙুলের ছাপ, এ দুটোকে নিজের বলে দাবি করা যায়। আর কেউ নিজেকে আমি বলে দাবি করতে পারবে না, আমিও নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে প্রায় সব সময়েই পারব। ফলে রাম রঘুর নামে কার্ড করে রঘুর বরাদ্দের কেরোসিন তুলতে পারবে না। রঘুর ফুটো ছাদ দিয়ে জল এসে কার্ড নষ্ট করে দিলেও রঘুর চাল-গম মার যাবে না। সেই সঙ্গে, যে হেতু সব ধরনের সরকারি অনুদান একটি কার্ডে গ্রথিত থাকবে, তাই আইন যদি নিষেধ করে, তা হলে রাম একই সঙ্গে ভর্তুকির কেরোসিন, আর ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডার পেতে পারবে না।
ভারতে কোনও কিছুই একেবারে ঠিকঠাক, নিয়মমাফিক কাজ করে না। আধার কার্ডের ব্যবস্থাও করবে না। কারও কারও কাছে ঘুস চাওয়া হবে। তবে রেশন কার্ড যেমন নির্দিষ্ট ডিলারের সঙ্গেই যুক্ত, আধার কার্ড করানোর ক্ষেত্রে অন্য জায়গা থেকেও তা করানো চলে। সেটা কিছুটা সামাল দেবে ঘুসের দাপটকে। সরকারি নিয়ম, আধার কার্ড করতে চাইলে কারওকে ফেরানো চলবে না। তবু অনেককে হয়তো ফিরে যেতে হবে— কারও আঙুলের ছাপ উঠবে না, কারও ক্ষেত্রে কম্পিউটার আটকে যাবে, নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। তবে আধার কার্ড তৈরি করতে কতটা হয়রানি হচ্ছে, তার তুলনা করতে হলে করা দরকার রেশন কার্ড বা পাসপোর্টের মতো অন্য সরকারি পরিচয়পত্র তৈরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তাতেও ঝামেলা যে কিছু কম হয় না, সে তো জানা কথা।
আসলে আধারের প্রতি আপত্তির অনেকটাই কেবল এই কারণে নয় যে তা কাজ না-ও করতে পারে। রেশনে চাল-গম না দিয়ে, উপভোক্তার কাছে সরাসরি টাকা পৌঁছে দিতে পারে আধার কার্ড— সেই সম্ভাবনাতেই আপত্তি। বলা হচ্ছে, যে মানুষ নগদ টাকা চান না, তাঁরা কেরোসিন, খাদ্যশস্যই চান। জঁ দ্রেজ এবং রীতিকা খেরার একটি সমীক্ষায় এমন চাহিদাই নাকি ধরা পড়েছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই ফলে সে ভাবে আস্থা রাখতে পারছি না। গবেষকদের প্রতি আমার অনাস্থা নেই, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু এই ধরনের সমীক্ষায় কী উত্তর মিলবে, তা অবশ্যই নির্ভর করে কী ভাবে প্রশ্নগুলো তৈরি করা হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তার উপর। আমি চাল-গম চাইব, না নগদ চাইব, তা নির্ভর করে আমার ধারণার উপর— কতবার রেশন ডিলার আমাকে বরাদ্দ না দিয়ে ফিরিয়ে দেবে, আমার প্রাপ্য টাকা আমার কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হবে কি না, চালের দাম বাড়লে সরকার টাকা বাড়াবে কি না, এমন অনেক বিষয়ে ধারণা, যার অনেকগুলো সম্পর্কেই কোনও স্পষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই। ফলে আমার উত্তরটা নির্ভর করবে, যে ভাবে আমার কাছে নানা সম্ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে তার ভিত্তিতে আমার ধারণার উপর।
নগদ আর খাদ্যশস্যের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ বাস্তবিক কী করছেন, সেই সমীক্ষায় আমার ভরসা বেশি। গাঁধীবাদী শ্রমিক সংগঠন ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (সেবা) দিল্লির কিছু বস্তিতে সমীক্ষা করে দেখেছে, শস্যের বদলে টাকা দিলে লোকেদের চাল-গম খাওয়ার পরিমাণে হেরফের হচ্ছে না, তবে হঠাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সাহায্য হচ্ছে। মদ বেশি খাওয়া, বা অন্যান্য খারাপ আশঙ্কার কোনও সত্যতা মেলেনি। দেখা গিয়েছে, যে ১০০ জনকে খাদ্যের বদলে নগদ দেওয়া হচ্ছিল, ছ’মাস পরে ফের খাদ্যশস্য নেওয়ায় ফিরে আসার সুযোগ দিলে কেবল চার জন তাতে ফিরে গিয়েছে। এটা অবশ্য খুবই ছোট একটা সমীক্ষা, এবং অন্য নানা পরিস্থিতির রদবদল, যা সমীক্ষার ফলে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে, সেগুলোকে এড়ানোর কোনও চেষ্টাও সে ভাবে করা হয়নি। আরও বিধিসম্মত, আরও ভাল সমীক্ষার ফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
তবে সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা আসার বিষয়ে যে সব আশঙ্কা রয়েছে, তা-ও যে অনেকটা অমূলক তা দেখাচ্ছে আর একটি সমীক্ষা। অন্ধ্রপ্রদেশে একটি সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলীধরন ও তাঁর সহকর্মীরা দুটি প্রকল্পের টাকা স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি, এবং সামাজিক সহায়তা প্রকল্পের ভাতা। এই প্রকল্পে অবশ্য স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার সরকারি ব্যবস্থায় দুটি পরিবর্তন আনা হয়। এক, স্মার্টকার্ডে প্রাপকদের ‘বায়োমেট্রিক’ তথ্য (মুখের ছবি ও আঙুলের ছাপ) রাখা হয়। আর দুই, ডাকঘর থেকে টাকা সংগ্রহ করার রীতি বদলে, প্রতি এলাকায় স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা বণ্টন করা হয়। তাঁর কাছে একটি ছোট যন্ত্র থাকে, যা দিয়ে তিনি স্মার্টকার্ডের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে নিয়ে টাকা দেন। রশিদ ছেপে বার করে দেয় ওই যন্ত্রই। ওই সমীক্ষা প্রকল্পে দেখা গিয়েছে, স্মার্টকার্ডের ব্যবহারে আরও দ্রুত টাকা পৌঁছনো যাচ্ছে উপভোক্তাদের কাছে, টাকা হাপিশ হচ্ছে কম, উপভোক্তাদের সন্তুষ্টিও বেশি। প্রকল্পটি যে সব এলাকায় করা হয়, সেখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ উপভোক্তা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি স্মার্টকার্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ উপভোক্তা স্মার্টকার্ড বেছে নেন। যাঁরা মনে করছেন, রেশনে চাল-গম দেওয়াই ভাল, নগদ দেওয়া ভাল নয়, তাঁরাও কেন চিন্তা করবেন না, কী ভাবে আধার কার্ডের মাধ্যমে শস্য বণ্টন প্রক্রিয়া আরও উন্নত, দক্ষ করা যায়?
তবে আধার কার্ডের বিরোধিতার আরও গভীর একটা কারণ রয়েছে। তা হল, ‘নাগরিক সমাজ’ বলতে যা আমরা বুঝি তার একটা বড় অংশ মনে করে, রাষ্ট্র অত্যন্ত দরিদ্র-বিদ্বেষী। তাই রাষ্ট্র আগ্রহ নিয়ে কোনও কিছু করতে চাওয়া মানে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। এক একদিন সকালে কাগজ খুললে খানিকটা আন্দাজ করা যায়, কেন তাঁরা এমন মনে করছেন। তবে শেষ অবধি কথাটা বিশ্বাস করা চলে না। ভারতে রাষ্ট্রের উপর বরাবরই নানা দিক থেকে নানা পক্ষ প্রভাব কায়েম করতে চেয়েছে। সেই প্রতিযোগিতা হয়তো আগের চাইতে এখন আরও বেশিই তীব্র। গরিবের কাছে রাষ্ট্রের সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার যে ব্যবস্থা এখন চলছে, তা যে অতীতেও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্র বরাবর গরিবের জন্য চালিয়ে এসেছে, তা তো নয়। ইন্দিরা গাঁধী ‘গরিবি হঠাও’ ডাক দিয়েছিলেন, আবার তুর্কম্যান দরজাও বানিয়েছিলেন। রাষ্ট্র যে গরিবকে সম্পদ দিচ্ছে, তা বহু লড়াইয়ের ফল, যা গরিব মানুষ ও তাঁদের সমর্থকেরা লড়েছেন। আর সেই সঙ্গে ভোটে জেতার দায় থেকে মাঝেমাঝে খয়রাতি। রাষ্ট্র বরাবরই কোনও-না-কোনও চাপের মুখে গরিবকে কিছু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আধার কার্ডের চিন্তার মধ্যে এমন কী অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে, যে তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক, পরামর্শে যাওয়া চলে না? অন্য কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো, আধার কার্ডের সুযোগকেও ভাল উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো চলে না?
আমাদের মতো যাঁরা আধার নিয়ে উৎসাহী, তাঁদের ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনের প্রসঙ্গটি প্রযোজ্য। এটা হয়েই গিয়েছে বলে ধরে নেওয়া চলে না। ঠিক যেমন ধরে নেওয়া যায় না যে, সরকারি প্রকল্পে যা কিছু সমস্যা রয়েছে আধার সব ঠিক করে দেবে। আধার কার্যকর হলেও দেখতে হবে, কী করে বিপিএল তালিকায় অযোগ্য লোক ঢোকানো থেকে রাজনৈতিক নেতা আর তাঁদের বন্ধুদের আটকানো যায়। ওই কাজটাকে আরও কঠিন করার জন্য কী ভাবে নজরদারি আরও জোরদার করা যায়? আরও কেজো চিন্তা রয়েছে। তা হল, সরকারি প্রকল্পে প্রয়োগের আগে কি আধার কার্ডের ব্যবহারে কতটা কী সমস্যা হচ্ছে তা পরীক্ষামূলকভাবে দেখে নিলে ভাল হত না? মোবাইল ফোন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযোগ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা বোঝা গেলে ধারণা করা যেত, কী ভাবে একে কার্যকর করা যায়।
আর একটু দূর অবধি চিন্তা করলে আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। আধার ব্যবস্থা যদি কার্যকর হয়, তা হলে একটা বোতাম টিপেই লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে। ভোটের মরশুমে কিছু বাছাই নির্বাচন ক্ষেত্রের বাসিন্দাদের অ্যাকাউন্টে যদি আরও, আরও বেশি টাকা পাঠাতে থাকে ক্ষমতাসীন দল? টাকা দিয়ে ভোট কেনার জনমোহিনী রাজনীতিকে কী করে আটকানো যাবে? তা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও এটাই সময়। নগদেই হোক আর জিনিসপত্রেই হোক, জাতীয় আয়ের কত অংশ মানুষের মধ্যে বণ্টন করা যাবে, সে-বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একটা ঐক্যমত্যে আসতে হবে। সরকার যদি আরও বেশি নগদ সরাসরি মানুষকে দিতে চায়, তা হলে কোথাও একটা তাকে খরচ কমাতে হবে। হয়তো তখন সরকার বাধ্য হবে বিত্তবানের অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি কাটছাঁট করতে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ১ জানুয়ারি ২০১৩
গরিবের টাকা
একটা সময় ছিল, যখন গরিবকে অনেকে দেখত করুণার চোখে। আজকাল দেখে একটু বাঁকা নজরে। স্রেফ গরিব বলেই কি না পাচ্ছে লোকগুলো। জলের দরে চাল-গম পাচ্ছে, ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মাঠে গেলেই ১৭০ টাকা মজুরি জমা পড়ছে ব্যাঙ্কে। হাসপাতালে বাচ্চা হলে হাতে কড়কড়ে টাকা, তারপর বাচ্চার অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি থেকে মিড-ডে মিলের ভাত-ডাল, ইস্কুলের জুতো-জামা-বই-সাইকেল, মেয়ে হলে ইস্কুল শেষে ২৫ হাজার টাকা, সরকার হাত উপুড় করেই রয়েছে।
এত দেওয়া কি ভাল?
কেবল ঈর্ষার জ্বালা থেকে নয়, গরিবের ভাল চেয়েও প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা যেমন চিরকালই জোর গলায় বলে এসেছেন, গরিবকে দয়া করা মানে চিরকালের জন্য সরকার-নির্ভর করে তোলা। আর পাঁচজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রোজগারের তাগিদটাই তো হারিয়ে ফেলবে সে। অলস, অদক্ষ কিছু মানুষ তৈরি করাই কি সরকারের কাজ? আজ প্রায় সেই একই সুরে কথা বলেন এ দেশের মাঝারি চাষিরা। একশো দিনের কাজে গিয়ে দাঁড়ালেই টাকা মেলে যদি, ধান রোয়া, ধান কাটার কাজ করতে লোকে আসবে কেন? টাকা দিয়েও খেতমজুর মিলছে না।
তা ছাড়া, টাকাটা যে জন্য দেওয়া, সত্যিই কি সে কাজে লাগে? দু-টাকা কিলো চাল বাজারে ১৪ টাকায় বিক্রি হয়ে চোলাইয়ের ঠেকে খরচ হচ্ছে, এমন হরদম শোনা যায়। একশো দিনের মজুরির টাকার কতটা বিড়ি-মদে উড়ে যাচ্ছে, কে দেখছে? করদাতার টাকা গরিবকে দিয়ে ভোট-কুড়োনো নেতাদের লাভ হতে পারে, দেশের লাভ কী?
এমন উদ্বেগ কতটা ধোপে টেঁকে? তা বুঝতে অর্থনীতির বেশ কিছু গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, যখন গরিবকে টাকা (বা অধিক রোজগারের উপায়) দেওয়া হচ্ছে, তখন তা আদৌ কাজে লাগছে, না কি নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে সাতটি প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, টাকাটা নষ্ট হচ্ছে না, কাজেই লাগছে। সেই লাভ কেবল তাৎক্ষণিক, এমনও নয়। পাঁচ-সাত বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, টাকা পাওয়ার পর যারা রোজগার বাড়িয়েছিল, তারা তা ধরে রাখতে পেরেছে। ফের গরিব হয়ে যায়নি।
উদাহরণ আছে এ রাজ্যেই। ওই ছ’টি প্রকল্পের একটি হয় মুর্শিদাবাদে। অতি গরিব ৩০০টি পরিবারকে বেছে নিয়ে, তাদের রোজগার বাড়াতে ছাগল, শুয়োর, গোরু বিলি করা হয়েছিল বছর আট-দশ আগে। অন্য ভাবে রোজগার বাড়াতে চাইলে তার উপকরণও (যেমন ধান ভানার ঢেঁকি) দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারগুলিকে এক বছর ধরে দৈনিক ২১ টাকা করে দেওয়া হয়, যাতে অভাবের তাড়নায় তারা ছাগল-গোরু বিক্রি করে না ফেলে। সেই সঙ্গে প্রাণীপালন, টাকা-পয়সা জমা-খরচের ট্রেনিং, সাহস-সহায়তা জোগাতে প্রতি ৫০ পরিবার পিছু একজন প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ‘বন্ধন’ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার (এখন ব্যাঙ্ক) এই প্রকল্পের শেষে দেখা গেল, ৯৪ শতাংশ পরিবারই বাড়তি আয় করছেন। নিয়মিত ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে তা শোধ করে ফের ঋণ নেওয়ার চক্রে চলে এসেছেন। সাত বছর পরে মূল্যায়ন করে দেখা গিয়েছে, কেউ আগের অতি-দারিদ্রে ফিরে যাননি। এককালীন সম্পদ ও প্রশিক্ষণ দীর্ঘমেয়াদী ফল দিচ্ছে।
উত্তর উগান্ডায় প্রায় এমন ভাবেই অতি-দরিদ্র মেয়েদের হাতে দেওয়া হয়েছিল দেড়শো ডলার, ব্যবসার প্রশিক্ষণ। ব্যবসা শুরুর পর কিছুদিন দেখভালও করেন প্রশিক্ষক। তার ১৬ মাস পরে দেখা গেল, এই মেয়েদের রোজগার প্রায় ডবল হয়েছে, ব্যবসাও বেড়েছে দ্বিগুণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, পেরুতে অতি-দরিদ্রদের অনুদান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাতটি প্রকল্প থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরখানেক পর থেকেই রোজগার বাড়ছে, তিন-চার বছর পরেও সেই উন্নতি বজায় থাকছে। যার একটা লক্ষণ, আগের চাইতে ভাল খাওয়াদাওয়া করছে পরিবারগুলি। যাঁরা দিনে দু’বার খেতেন, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আরও একবার খাচ্ছেন। কোথাও বা গবেষকরা মেপে দেখেছেন, আগের চাইতে দিনে ৭০০ ক্যালোরি বেশি খাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। খাবারের জন্য খরচ হচ্ছে বেশি।
অনুদান দিয়ে দারিদ্র কমানোর এই যে মডেল, তার পথিকৃৎ কিন্তু বাংলাদেশ। সে দেশের একটি অসরকারি সংস্থা (BRAC) গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪০টি এলাকায় অতি-দরিদ্র, অক্ষরপরিচয়হীন মেয়েদের তাদের পছন্দের কাজের জন্য (ছাগল-মুরগি পালন, ছোটখাটো মুদির দোকান) এককালীন টাকা দেয়, সেই সঙ্গে প্রায় দু’বছরের প্রশিক্ষণ আর নজরদারি চলে। ২০০৭ সালে শুরু এই প্রকল্পের বেশ কয়েকবার মূল্যায়ন হয়েছে। তাতে কেবল যে বাড়তি রোজগার (৩৮ শতাংশ) ধরা পড়েছে তাই নয়। দেখা যাচ্ছে, এই মেয়েদের জীবনযাত্রাও বদলেছে। এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছাকাছি তাদের জীবনশৈলী।
যে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এই প্রকল্পটির উপর নজর রাখছেন, তাঁরা লিখছেন, “এই গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে অতি-দরিদ্রদের যে রোজগারের জন্য বা অন্যান্য কারণে, অ-গরিবদের উপর নির্ভর করতেই হবে এমন নয়। গ্রামীণ সমাজে গরিবদের অবস্থান যে নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয়, এমনও নয়। যদি তাঁদের জন্য যথেষ্ট পুঁজি এবং দক্ষতার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে অন্যান্য বাধা (সামাজিক বিধিনিষেধ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, ক্ষতিকর অভ্যাস, বিনিয়োগ-লাভ বিষয়ে ভুল বা অস্পষ্ট ধারণা) এত বড় হয়ে দাঁড়ায় না, যে তা অতি-বঞ্চিত মেয়েদের স্বাধীন, সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা আটকাতে পারে।” এ কথাটা যে সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে সত্য, গত বছর দশেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
আরও কয়েকটা চালু ধারণায় ধাক্কা দিয়েছে এই প্রকল্পগুলি। সাধারণত মনে করা হয়, এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে গরিব সামলাতে পারবে না। কিছু কিছু করে দেওয়াই ভাল। নানা প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, মাসে মাসে কিছু টাকা দিলেও রোজগার বাড়ে, কিন্তু তুলনায় সামান্য। এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে রোজগার বরং এক লাফে অনেকটা বাড়ছে।
টাকা পেলে গরিব অলস হয়ে যায় কিনা, তারও উত্তর মিলেছে। এক কথায় সে উত্তর— না। যারা প্রকল্পে টাকা পেয়েছে, আর যারা পায়নি, তাদের কাজের সময়ে (বাইরে ও ঘরে) হেরফের মেলেনি। বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে, টাকা-ট্রেনিং পাওয়া মেয়েরা বরং আগের চাইতে অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করছে। তবে মজুরি খাটার সময় কমিয়ে, প্রাণীপালনের মতো স্বরোজগারের কাজে বেশি সময় দিচ্ছে তারা। তাই বাইরে থেকে মনে হতে পারে, টাকা পেলে গরিব কাজে আসে না। আসলে হয়তো তারা আরও লাভজনক কাজ করছে।
তবে দুটো বিষয় খেয়াল করতে হবে। এক, এই সব প্রকল্পে গরিবকে যে টাকাটা গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনুদান। ফেরত দেওয়ার কোনও শর্ত সেখানে নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যাবসা করে গরিব দারিদ্র এড়াতে পারে কিনা, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বলা চলে যে, বাজারের নিয়মে এই ধরনের কাজ হবে না। সরকার বা অসরকারি সংস্থাকে দারিদ্র নিরসনের লক্ষ্যে গোড়ার পুঁজিটা দিতে হবে গরিবকে।
আর দুই, টাকার সঙ্গে সহায়তাও প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, নিয়মিত কাজের খোঁজখবর, পরামর্শ, বেশ কয়েক মাস এটা চালাতে হবে।
কিন্তু যখন প্রশিক্ষণের প্রশ্ন নেই? যখন খাদ্যের জন্য, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার জন্য স্রেফ টাকা দিচ্ছে সরকার? তখন কি মদ তামাকে নষ্ট হয় না টাকাগুলো?
উত্তর খুঁজতে বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষক ডেভিড ইভান্স নানা দেশের ১৯টি এমন প্রকল্প দেখেছেন, যেখানে শর্তসাপেক্ষে (যেমন, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্য), কিংবা শর্ত ছাড়াই, টাকা দেওয়া হচ্ছে গরিবকে। তিনি বলছেন, একজনও ওই টাকা মদ খেয়ে ওড়াচ্ছে না, তা বলা চলে না। কিন্তু তারা অতি সামান্য, হিসেবে আসে না। বাড়তি টাকা পাওয়ার পর মদ-তামাকের খরচ বাড়েনি, এমনই দাবি করছেন ইভান্স। “পেরুতে দেখা গিয়েছে বটে, হাতে টাকাটা এলেই লোকের রোস্টেড চিকেন, কিংবা চকোলেট কেনার একটা ঝোঁক থাকে। কিন্তু আশা করি পোড়-খাওয়া কর্তারাও সে জন্য গরিবকে দুষবেন না,” লিখছেন তিনি।
গত বছর দশ-বারো ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে, গরিবকে টাকা দেওয়া ‘বাজে খরচ’ নয়। বরং হাতে টাকা পেলে খাবারের জন্য সে বেশি খরচ করে। সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতি হয়। আর যদি এককালীন টাকার সঙ্গে প্রশিক্ষণও মেলে, তা হলে বাড়তি রোজগার করে আর্থ-সামাজিক অবস্থানে কয়েক ধাপ উঠে আসে সে। কয়েক বছরের মধ্যেই।
এমন ভাল খবরে মধ্যবিত্তের মন ভাল হবে কি? গরিবের রোজগার বাড়া মানে তার মজুরি, মাইনে বাড়া। সেই সঙ্গে তার সামাজিক উত্থানটাও অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। সে দিনই এক ‘কাজের মাসি’ দুঃখ করছিলেন, তিনি ছুটি চাইলে বাড়ির মালকিন বলেছেন, “তা হলে তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিও।” মেয়ে কলেজে পড়ে, বলতে মালকিনের প্রশ্ন, “তাতে কী হয়েছে?” গরিব যে বংশানুক্রমে খেতমজুরি, দিনমজুরি, ঝি-গিরি করবে, সেটাই ধরে নিয়েছেন পাকাবাড়ির কর্তা-গিন্নিরা। বর্ণব্যবস্থা আর দারিদ্র সেই ধারণাটা পোক্ত করেছে। এ বার হয়তো ধারণাটা নড়বড়ে হবে। গরিবের হাতে টাকা এলে সে অন্তত তার অনাদর করবে না।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ জুন ২০১৬