কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা গলা থেকে খুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর বললেন,–হা কাণ্ডই বটে। তবে একটা কথা আপনাকে বলা দরকার হালদারমশাই। অমন করে যেখানে-সেখানে ফায়ার আর্মস বের করবেন না।
গোয়েন্দাপ্রবর কঁচুমাচু হেসে বললেন,–হ! উচিত হয় নাই। আসলে আমাগো ভূতের ভয় দেখাইতে চায়–এত সাহস!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হ্যাঁ। আপনি একসময় পুলিশ অফিসার ছিলেন, আপনার রাগ হওয়ারই কথা। তবে ভাগ্যিস টিলগুলো সেইরকম নুড়িপাথর নয়! তাহলে আমাদের চোট লাগত।
জিগ্যেস করলুম,–ব্যাপারটা কী?
কর্নেল বললেন,–গঙ্গার ধারে বাঁধের পথে আমরা যাচ্ছিলুম। হঠাৎ গাছপালার আড়াল থেকে ঢিল এসে পড়তে শুরু করল। তবে মাটির ঢিল। গঙ্গার ধারের মাটি খুব নরম, তাই ঢিলগুলো
ভেঙে যাচ্ছিল। চণ্ডীবাবু ছিলেন আগে। তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। আর হালদারমশাই রিভলভার বের করে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন।
বলে কর্নেল তার অনুকরণ করে শোনালেন,–কোন হালা রে! দিমু মাথার খুলি ঝাঁঝরা কইর্যা। শুধু তাই নয়, তিনি বাঁধ থেকে নেমে ঝোঁপজঙ্গল ভেদ করে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে চণ্ডীবাবুই পেছন থেকে টেনে ধরেছিলেন। আর জায়গাটা কোথায় জানো? কালিকাপুরের শ্মশান। তাই ওখানে কোনও বসতি নেই। তা ছাড়া, গঙ্গার ভাঙন রোধে বনদপ্তর থেকে বাঁধের নীচে একটা শালবনও গড়ে তোলা হয়েছে।
হালদারমশাই যে মনে-মনে ক্ষুব্ধ তা বুঝতে পারছিলুম। তিনি নস্যির কৌটো বের করলেন। কিন্তু তখনই কার্তিক একটা বিশাল ট্রেতে কফি এবং স্ন্যাক্স এনে রাখল। তার পেছনে এলেন চণ্ডীবাবু।
কার্তিক চলে গেল। আমরা কফি পানে মন দিলুম। একসময় চণ্ডীবাবু হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,–মিস্টার হালদারকে আমি যদি না-আটকাতুম, তাহলে উনি নিশ্চয়ই এক রাউন্ড ফায়ার করে অন্তত একটা ভূতকে ধরাশায়ী করতেন।
হালদারমশাই বললেন,–ঠিক কইসেন। একখান গুলি অন্তত একজন ভূতের হাঁটুর নীচে লাগত।
চণ্ডীবাবু বললেন,–ওই ঘন কুয়াশার মধ্যে আপনারাও কিন্তু বিপদের আশঙ্কা ছিল।
কর্নেল বললেন,–একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে মিস্টার রায়চৌধুরী। কলকাতা থেকেই কেউ বা কারা আমাদের অনুসরণ করেছে। রাত্রে আমরা গাড়িতে আসায় তারা সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের একটু সতর্ক থাকা ভালো।
হালদারমশাই বললেন,–আর শচীনবাবুও যেমন কেমন বদলাইয়া গেসেন। কলকাতায় ওনাকে মনে হইত্যাসিল খুব সরল মনের মানুষ। কিন্তু এখানে মনে হইল য্যানো কিছু গোপন করবার চেষ্টা করত্যাসেন।
চণ্ডীবাবু জিগ্যেস করলেন, আপনি অভিজ্ঞ মানুষ, ঠিকই ধরেছেন। ওই শচীনই আমাকে ওর জ্ঞাতি অ্যাডভোকেট শরদিন্দুবাবুর কাছে রক্ষিত ওদের পূর্বপুরুষের একটা দলিলের কথা বলত। কিন্তু কর্নেলসাহেব যখন জানতে চাইলেন উনি কেন নিজে সেটা শরদিন্দুবাবুর কাছে স্বচক্ষে দেখতে চাননি, তখন শচীন ন্যাকা সেজে বলল ওটা তেমন কিছু নয়। তার বাবা নাকি বলেছে ওটার কোনও মূল্যই নেই।
কর্নেল বলে উঠলেন,–হা, শচীনবাবুর কথাটা আমাকে অবাক করেছে। আমি যখন ওঁকে সেই কাগজটা দেখিয়ে বললুম, এটা তিনি চেনেন কি না, এবং এও বললুম, এটা তাদের সেই পূর্বপুরুষের রক্ষিত কাগজে যা লেখা আছে তার কপি, তখন শচীনবাবু একবার চোখ বুলিয়েই বললেন, এটা বাজে। আসল কাগজটা নাকি শরদিন্দুবাবু আমাকে দেখাননি।
এই সময় কার্তিক পরদার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল,–কর্তামশাই, আপনার টেলিফোন এসেছে।
চণ্ডীবাবু তখনই তার কফির কাপে প্লেট ঢাকা দিয়ে আসছি বলে দ্রুত চলে গেলেন।
হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, আমার ধারণা, চণ্ডীবাবু আমাগো সঙ্গে থাকায় শচীনবাবু হয়তো মন খুইল্যা কথা কইতে পারেন নাই। কর্নেলস্যার যদি আমারে একটা শচীনবাবুর লগে দেখা করতে কন আমি যামু।
কর্নেল বললেন,–যেতে পারেন, কিন্তু খুব বেগতিক না দেখলে যেন রিভলবার বের করবেন না।
একটু পরে চণ্ডীবাবু ফিরে এসে বললেন,–থানা থেকে ওসি প্রণবেশবাবু ফোন করেছিলেন। উনি কর্নেলসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন।
.
চার
ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। চণ্ডীবাবু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে চললেন। কর্নেল তার অভ্যাসমতো সামনের সিটে বসলেন। আমি এবং হালদারমশাই ব্যাক সিটে বসলুম। এই এলাকাটা নিরিবিলি নির্জন। ঘন বসতি এলাকায় পৌঁছে হালদারমশাই বলে উঠলেন,–মিস্টার রায়চৌধুরী, আমাকে এখানেই নামাইয়া দেন।
কর্নেল কিছু বললেন না। কিন্তু চণ্ডীবাবু বললেন, আপনি কি চাটুজ্যে বাড়ি যেতে চান?
হালদারমশাই বললেন,–হ! আমি একবার নিজের বুদ্ধিতে পা ফালাইয়া দেখতে চাই।
আমি বললুম,–দেখবেন, আড়াল থেকে ভূতের হাতের ইট-পাটকেল যেন না এসে পড়ে।
গোয়েন্দাপ্রবর হাসি মুখে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। এখন তার মাথায় হনুমান টুপি নেই। গলা-বন্ধ পুরু সোয়েটার আর প্যান্ট পরা ঢ্যাঙা মানুষটি ঠিক পুলিশের ভঙ্গিতেই এগিয়ে গেলেন।
চণ্ডীবাবু গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,–যাই বলুন কর্নেলসাহেব, মিঃ হালদার খুব সাহসী মানুষ। পুলিশ জীবনে উনি সম্ভবত আরও জেদি আর দুঃসাহসী ছিলেন।
কর্নেল বললেন,–ওঁকে নিয়ে একটাই সমস্যা। অনেক সময়েই উনি ভুলে যান যে উনি এখন আর পুলিশ অফিসার নন।