- বইয়ের নামঃ কিশোর কর্নেল সমগ্র
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কর্নেল সমগ্র
১.০১ কোকোদ্বীপের বিভীষিকা
প্রজাপতি এবং হয়গ্রীব
ডঃ আলবের্তো ভাস্কোর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে। ওঁর মাতৃভাষা পর্তুগিজ। কিন্তু ভাল ইংরেজি জানেন। কর্মসূত্রে থাকেন প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপে। সেখানকার প্রকৃতি-পরিবেশ দফতরের অধিকর্তা। বাঙ্গালোরে এশিয়া পরিবেশ সংরক্ষণ সম্মেলনে এসেছিলেন।
আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, ডঃ ভাস্কো আমার মতোই একজন লেপিডপ্টারিস্ট।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার—আমাদের প্রিয় হালদারমশাই আমি যাওয়ার আগেই সেখানে হাজির। তিনি অবাক চোখে সম্ভবত সায়েব-দর্শন করছিলেন। বলে উঠলেন, কী কইলেন খ্যান?
হালদারমশাইয়ের মুখ থেকে মাঝে-মাঝে দেশোয়ালি ভাষা বেরিয়ে আসে। কর্নেল বললেন, লেডিপপ্টারিস্ট। যারা প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা করেন।
গোয়েন্দা-ভদ্রলোক যেন হতাশ হলেন। একটিপ নস্যি নিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখলেন। বুঝলাম, ডঃ ভাস্কো সম্পর্কে ওঁর আগ্রহ উবে গেছে।
কর্নেল ডঃ ভাস্কোকে বললেন, আপনি নেচার পত্রিকায় আউল বাটারফ্লাই সম্পর্কে আমার যে প্রবন্ধ পড়েছেন, তা কিছুটা স্মৃতিচারণা। কারণ আমি তখন বয়সে তরুণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রশান্ত মহাসাগরের ফাতু হিভা দ্বীপের সামরিক ঘাঁটি থেকে যুদ্ধজাহাজে দেশে ফিরছিলাম। কোকো দ্বীপের পাশ দিয়ে আসার সময় বাইনোকুলারে জনমানবহীন দ্বীপটিতে ঝাঁকে-ঝাঁকে আউল বাটারফ্লাই দেখেছিলাম। কালিগো আপ্রেউস প্রজাতির এই প্রজাপতি আকারে বিশাল। এক-একটা ডানা ছ ইঞ্চি চওড়া। ডানায় দুটো করে গোল চোখের মতো ছোপ। হঠাৎ দেখলে প্যাঁচা মনে হয়। তাই ওই নাম। তবে সেই প্রথম এবং শেষ দেখা।
ডঃ ভাস্কো বললেন, কোকো দ্বীপ সম্পর্কে আপনি একটা সাংঘাতিক গুজবের উল্লেখ করেছেন।
কর্নেল হাসলেন। গুজব এখনও চালু আছে নাকি?
আছে। এবং গুজবটা যে মিথ্যা নয়, সেই কথাটা ফেরার পথে আপনাকে জানিয়ে যাওয়া উচিত মনে করলাম। ডঃ ভাস্কো গম্ভীর হয়ে বললেন, জানুয়ারিতে আপনার প্রবন্ধ পড়ার পর ছোট একটা টিম নিয়ে কোকো দ্বীপে গিয়েছিলাম। দ্বীপটি এখনও নির্জন। টিমে ছিলাম আমি, আমার সহকারী বিজ্ঞানী পিটার গিলম্যান, রাঁধুনি আউ তিউ, দুজন গার্ড তিয়া এবং জুয়া। এরা তিনজন তাহিতির লোক। গিলম্যান মার্কিন। তো পরদিন রাঁধুনি আর দুজন গার্ড নিখোঁজ হয়ে গেল। ভাবলাম, ভূতুড়ে দ্বীপে আসতে ওদের খুব আপত্তি ছিল। তাই পালিয়ে গেছে। মোটরবোটটা বিচ থেকে টেনে এনে ক্যাম্পের সামনে রাখা ছিল। সেটা আছে। তবে ফাতু হিভা থেকে নারকোলছোবড়া আর শুটকি মাছ আনতে অনেক ছোট জাহাজ কোকোর পাশ দিয়ে যায়। কাজেই ওদের পালানোর সুযোগ আছে। কিন্তু বিকেলে ফার্নের ঘন জঙ্গলে তিনজনের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ আবিষ্কার করে চমকে গেলাম। গার্ডদের রাইফেল কোনও হিংস্র জন্তু যেন দাঁতে চিবিয়ে ভেঙেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, জন্তুটা মৃতদেহ থেকে মাংস খায়নি।
হালদার মশাই নড়ে উঠলেন। কন কী বলেই শুধরে নিলেন, ভেরি মিটিরিয়াস!
ডঃ ভাস্কো বললেন, আমাদের সঙ্গে পেট্রোম্যাক্স বাতি আর টর্চ ছিল। তখন আমরা নিরস্ত্র। দুটো ক্যাম্প গুটিয়ে জিনিসপত্র মোটরবোটে বোঝাই করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সবে জ্যোৎস্না উঠেছে। গিলম্যান এবং আমি মোটরবোট ঠেলতে-ঠেলতে বিচে নামাচ্ছি। হঠাৎ ঘোড়ার মতো বিকট চি-হি-হি ডাক শুনে টর্চের আলো ফেললাম। আশ্চর্য, কর্নেল সরকার। ঘোড়ার মতো মুখ, মানুষের মতো শরীর একটা জন্তুকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেলাম। জন্তুটা সম্ভবত আলো সহ্য করতে পারে না।
কর্নেল হাসলেন, কোকো দ্বীপে ঘোড়া-মানুষের গুজব তা হলে সত্যি?
নিজের চোখকে অবিশ্বাস করা যেত। কিন্তু গিলম্যানও দেখেছে।
আপনি আর কোকো দ্বীপে যাননি?
কোকো দ্বীপের মালিকানা নিয়ে ফরাসি এবং মার্কিন সরকারের মধ্যে বিতর্ক আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে চূড়ান্ত মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ওখানে কোনও দেশ সশস্ত্র বাহিনী পাঠাতে পারে না। এমনকী, কেউ সেখানে যেতে পারে না। আমরা গোপনে গিয়েছিলাম প্যাঁচা প্রজাপতির খোঁজে। নইলে তো সেনাবাহিনী নিয়ে গিয়ে হিংস্র ঘোড়া-মানুষটাকে খুঁজে বের করা যেত। যাই হোক, ঘটনাটা আমরা চেপে গিয়েছিলাম।
কর্নেল চোখ বুজে সাদা দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। বললেন, আবার একটা টিম নিয়ে গোপনে কোকো যাওয়া উচিত। আপনি আপনার দপ্তরকে বলে ব্যবস্থা করতে পারেন?
ডঃ ভাস্কো একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তা করা যায়। আপনি যেতে চান?
হ্যাঁ। আমি এবং আমার এই তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি…
হালদারমশাই বলে উঠলেন, কর্নেলসার, আমাকে বাদ দেবেন না। চৌত্রিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। তারপর ইংরেজিতে ডঃ ভাস্কোকে বললেন, সার, ইউ নিড অলসো এ প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
ডঃ ভাস্কো ঘড়ি দেখে বললেন, হোটেলে ফিরে ট্রাঙ্ক-কলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। তারপর জানাব। আমার ফ্লাইট বেলা একটা তিরিশে। এবার চলি, কর্নেল সরকার! সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারলে আবার দেখা হবে।
ডঃ ভাস্কো চলে যাওয়ার পর বললাম, আজগুবি ব্যাপার! ওঁরা কী দেখতে কী দেখেছেন।