অদলবদল

রোজ ভোরবেলা পার্কে কিছুক্ষণ বেড়ানো হরিপদবাবুর অনেককালের অভ্যাস। ৫ম পার্কটা বেশ বড়। কিন্তু হাঁটাচলার পর একটুখানি যে বসবেন কোথাও, তার উপায় নেই। এখানে-ওখানে যত বেঞ্চ আছে, কখন সবগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। ঘাসে বসারও বিপদ আছে। ছেলেপুলেদের যা পাঁয়তারা, কে কখন ঘাড়ে এসে পড়ে তার ঠিক নেই। তার চেয়ে বড় বিপদ ওদের ফুটবল। যেন কামানের গোলা।

তিতিবিরক্ত হরিপদ অগত্যা নিরিবিলি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বকুল গাছটার দিকে যান। বকুলতলায় এক টুকরো কালো পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, কখন পাথরটাও দখল হয়ে গেছে। হোঁতকা-মোটা, মাথায় টাক আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চ্যাপ্টা নাক, কুতকুতে চোখ নিয়ে একটা লোক আরামে বসে আছে।

যেদিনই যান, দেখেন তাঁর যাওয়ার আগে কখন লোকটা বকুলতলার আসনটা দখল করে ফেলেছে।

জায়গাটা যে এমন কিছু সুন্দর তাও নয়। একটু নিরিবিলি এই যা। ওদিকটায় বলের ঘা খাওয়া রিস্কও নেই। তবে ওখানে বসে আর কিছু না থোক, রেলগাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। রেলগাড়ি দেখতে ভালোই লাগে হরিপদবাবুর। মনে-মনে কঁহা কাহা মুল্লুক চলে যাওয়া যায়। কু-ঝিক-ঝিক…কু-ঝিক-ঝিক! কখনও রেলগাড়ির চাকা ছড়া বলে, টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিট বাবুর কত টাকা! ছেলেবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়।

শেষে জেদ চড়ে গেল হরিপদবাবুর। আগেভাগে গিয়ে পার্কের বকুলতলার পাথুরে আসনটা তাঁর দখল করা চাই-ই। সেদিন ভোরের আগে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিকঠিক চারটে। আবছা আঁধার লেগে আছে ঘরবাড়ির গায়ে। পার্কে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে। রাস্তায় কদাচিৎ চাপা গরগর শব্দে চলে যাচ্ছে একটা করে মোটরগাড়ি–তখনও হেডলাইট জ্বলছে। হরিপদবাবু পার্কে ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। বকুলতলা ঝুপসি হয়ে আছে আঁধারে– কুয়াশায়। ঘাসে শিশির চকচক করছে। পাথরটা খালি পড়ে আছে। হরিপদবাবু সিংহাসন দখল করার আনন্দে বসে পড়লেন তার ওপর। পাথরটা ঠান্ডা বটে, তাতে কিছু আসে যায় না। হরিপদবাবু খুশিতে বসে দুই পা দোলাতে থাকলেন। এমনকী গুনগুন করে গানও গাইতে লাগলেন।

আস্তে আস্তে কালচে রং ধূসর হতে থাকল। তারপর সাদা হল। একজন-দুজন করে লোক এসে পার্কে ভিড় করল। কেউ ধুকুরপুকুর দৌড়চ্ছে। কেউ যোগব্যায়ামেও বসে গেছে। কেউ কুকুর নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেঞ্চগুলোতে বুড়োরা এসে বসে পড়েছে। তারপর ছেলেপুলেদের পায়তারা শুরু হয়েছে ফুটবল নিয়ে। হরিপদ বাবু তেমনি নিরিবিলি বকুলতলায় গুনগুন করছেন আর ঠ্যাং দোলাচ্ছেন।

কতক্ষণ পরে আনমনে মাথায় হাত বুলোতে গিয়েই চমকে উঠলেন। এ কী! তার মাথাভর্তি একরাশ পাকা চুল ছিল। চুল কোথায় গেল?

বারবার হাত ঘষেও চুলের পাত্ত পেলেন না। চামড়ায় হাত ঠেকছে। তার মানে, হঠাৎ তার মাথায় টাক পড়ে গেল নাকি অবাক হয়ে মাথায় আঙুল ঠুকলেন। আরও চমকে গেলেন। সর্বনাশ! তার মাথাভর্তি টাক যে!

তারপর হাত গালে ঘষে ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিদিন দাড়ি কাটা অভ্যাস। পার্ক থেকে ফিরেই দাড়ি কাটেন। কালও কেটেছেন। চব্বিশ ঘণ্টায় এত দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল গজানো অসম্ভব। অথচ গজিয়েছে।

প্রচণ্ড আঁতকে উঠে হরিপদবাবু টের পেলেন, তাঁর গায়ের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি আঁটো হয়ে গেছে। চটিজুতোয় পা দুটো আর ঢুকছে না। এ তো ভারি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! আঙুল ফুলে কলাগাছ ব্যাপার কি একেই বলে?

হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছেন হরিপদবাবু। এমন সময় লাঠি ঠুকঠুক করে এক ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন,–ভোম্বলবাবু যে! আছেন কেমন? বহুদিন তো দেখাশোনাও নেই। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?

হরিপদবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন,–ভোম্বলবাবু কে মশাই? আমি হরিপদ তালুকদার।

ভদ্রলোক খিকখিক করে হাসলেন–চিরকাল থিয়েটারে অ্যাকটিং করে অভ্যাসটা এখনও ছাড়েননি দেখছি ডোম্বলবাবু! তা ইয়ে, আপনার জামাইবাবাজির খবর কী? শুনেছিলুম, পুলিশে নাকি…

হরিপদ তেড়ে উঠে বললেন,–কী যা তা বলছেন মশাই? আমার মেয়েই নেই তো জামাই।

আহা, ওতে লজ্জার কী আছে ডোম্বলবাবু?–ভদ্রলোক বললেন। পুলিশ কাউকে ধরলেই তো সে চোর হয়ে যায় না। আদালত আছে কী করতে?

হরিপদবাবু আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। তার জামাই নেই। যদি দৈবাৎ থাকতও, তাকে চুরির দায়ে পুলিশ ধরত-ভাবতেও মাথায় খুন চড়ে যায়। কথা না বাড়িয়ে তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে কেটে পড়লেন। ভদ্রলোক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

পার্ক থেকে বেরুবার মুখে আরেক ভদ্রলোক তাকে দেখে বলে উঠলেন, আরে ভোম্বলদা যে!

হরিপদবাবু কটমট করে তাকিয়ে জোরে হাঁটতে থাকলেন। পেছনে ভদ্রলোক তখন বলছেন,–হল কী ভোম্বলদা? আরে শোনো শোনো!

কোনদিকে না তাকিয়ে হরিপদবাবু গলিরাস্তায় পৌঁছলেন। তারপর নিজের বাড়ির দরজায় কলিংবেলের বোতাম টিপলেন। ততক্ষণে আরও টের পেয়েছেন, তাঁর গায়ে প্রচণ্ড জোরও এসে গেছে। কিন্তু বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। একটা দারুণ গণ্ডগোল নিশ্চয় ঘটে গেছে।

দরজা খুলে তার প্রিয় চাকর কাম-রাঁধুনি হরু গম্ভীরমুখে বলল, কাকে চাই?

হরিপদবাবু গর্জে উঠলেন এবার, কাকে চাই কী রে ব্যাটাচ্ছেলে? ভাঙ খেয়েছ সাতসকালে? তারপর হারুকে ঠেলে ঘরে ঢুকে গেলেন।

হারু হই-চই করে উঠল, আচ্ছা ভদ্রলোক তো মশাই আপনি! গায়ের জোরে পরের বাড়ি ঢুকে পড়লেন যে বড়? আরে! ও কী! কোথায় যাচ্ছেন?

হরিপদ সটান নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আঁতকে দেখলেন, রোজ পার্কের বকুলতলায় পাথরটার ওপর যে লোকটাকে বসে থাকতে দেখেছেন সেই লোকটাই বটে। হরিপদবাবু তার শরীটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু তার নিজের শরীরটা কোথায় গেল, সেটাই সমস্যা। আর ছ্যা ছ্যা, এমন বিচ্ছিরি নাক থাকতে আছে মানুষের।

হরু ততক্ষণে পাড়া মাথায় করে চেঁচাচ্ছে,–ডাকাত ডাকাত পড়েছে! এমন জোর করে শোওয়ার ঘরে ঢোকে যে, সে নিশ্চয় ডাকাত। হরিপদবাবু আয়নার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। পার্কে বেড়াতে গেলেন হরিপদবাবু হয়ে, ফিরে এলেন কোন হতচ্ছাড়া ডোম্বলবাবুটি হয়ে যিনি নাকি একসময় থিয়েটারে অ্যাকটিং করতেন এবং যাঁর জামাই লোকটা চোর না হয়ে যায় না! এ কী সর্বনেশে কাণ্ড রে বাবা!

কিন্তু তার চেয়ে সর্বনেশে কাণ্ড যে ঘটতে চলেছে, ঠাহর হল পাড়ায় লোকের হট্টগোলে। বাড়ির দরজায় ওরা চেষ্টাচ্ছে, কই ডাকাত? কোথায় ডাকাত? ধর ব্যাটাকে! মারমার! কেউ বলছে,-যাসনে, যাসনে! ভোজালি আছে। পুলিশ ডাক! তার মধ্যে হরু এন্তার চেঁচাচ্ছে, সব লুঠ হয়ে গেল যে! ওরে বাবা! এতক্ষণে সব লুঠ করে ফেললে রে!

সাহসী ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়ি ঢুকছে টের পেয়েই হরিপদবাবুর বুদ্ধি খুলে গেল। দড়াম করে দরজায় খিল এঁটে দিলেন। দরজার বাইরে ছেলেগুলো হল্লা করছে। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। হরিপদবাবু ভেতর থেকে শাসিয়ে বললেন, সাবধান! আমার কাছে বোমা আছে। উড়িয়ে দেব!

ছেলেগুলো ভয় পেয়ে গেল। বয়স্করা বললেন,–ওরে! সরে আয়! সরে আয়! পুলিশে খবর গেছে।

পুলিশের কথা শুনে হরিপদবাবুর বুকের ভেতর কাঁপুনি বেড়ে গেল। তখন ঘরের ভেতর থেকে করুণ স্বরে ডাকলেন, হরু! ওরে বাবা হারাধন! আমি তোর মনিব হরিপদ তালুকদার। সত্যি বলছি!

হরু বলল,–চালাকি হচ্ছে? আমার মনিবকে আমি চিনিনে? ওইরকম চেহারা নাকি ওনার? ওইরকম হেঁড়ে গলা নাকি? ছা-ছ্যা, যেন নিমতলার আস্ত পিচেশ!

গণ্ডগোল একটু থেমেছে। সবাই পুলিশের প্রতীক্ষা করছে। হরিপদবাবুর গলা আবার শোনা গেল ভেতর থেকে,–সত্যি বলছি আমি হরিপদ তালুকদার। দোহাই তোমাদের, এখন পুলিশ-টুলিশ ডেকো না! ও বাবা হারাধন! ওদের বুঝিয়ে বল না একটু। আমিই তোর কর্তাবাবু রে!

হারু তেড়েমেড়ে বলল, বলবটা কী মশাই! হরিপদবাবুর বাড়ি সেই এতটুকুন বাচ্চা বয়েস থেকে কাজ করছি। আমি কর্তাবাবুকে চিনিনে? থামুন, দারোগাবাবুকে আসতে দিন।

বলতে বলতে এসে গেলেন দারোগাবাবু। পেল্লায় গোঁফের ডগায় পাক খাইয়ে বললেন, কই? কোথায় ডাকাত?

সবাই একগলায় বলে উঠল,–ওই ঘরের ভেতর স্যার!

দাবোগাবাবু হাঁক মেরে বললেন,-গিরধর সিং! দরওয়াজা তোড়ো! জলদি তোড়!

শুনেই হরিপদবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে যাচ্ছেন, টাকে খাটের একটা ধার জোরে লাগল। উঃ করে ককিয়ে উঠলেন।

তারপর দেখলেন, প্রচণ্ড অবাক হয়েই দেখলেন, পড়ে গেছেন শিশিরভেজা ঘাসে এবং বকুলতলার সেই পাথরটাতে ঠোক্কর লেগেছে মাথায়। বেশ জোরেই লেগেছে।

এই সময় কেউ বলে উঠল, আহা! লাগল নাকি।

তাকিয়ে দেখে অবাক হরিপদ তালুকদার। সেই টাকওয়ালা লোকটা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল–রোজ যে এই পাথরের আসনটা দখল করে বসে থাকে এবং যে কিছুক্ষণ আগে তাকে সর্বনাশের মুখে ফেলে দিয়েছিল।

লোকটা হাসতে-হাসতে বলল,–ওখানে বসলেই কিন্তু ঘুম পায়। বুঝলেন?

হরিপদবাবু মনে-মনে বললেন, বুঝেছি। তার মানে পাথরটা দখল করার জন্য রাত চারটেয় শেষ ঘুম বরবাদ করার শাস্তিটা ভালোই পেয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–মশায়ের নাম কি ডোম্বলবাবু?

–আজ্ঞে না। আমার নাম হরিপদ চাকলাদার।

শুনেই হরিপদবাবু হনহন করে কেটে পড়লেন। আর কক্ষনো এ ভুতুড়ে পার্কে এত ভোরে বেড়াতে আসবেন না। বাড়ির কাছাকাছি হতে হঠাৎ মনে হল, নামটা কী হরিপদ চাকলাদার বলল, না তালুকদার বলল? চাকলাদার না তালুকদার? তালুকদার না চাকলাদার?

তালুকদার হলে বেটাচ্ছেলে আমার মতোই বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে হরিপদ শেষে খিকখিক করে হেসে উঠলেন।

অদ্ভুত যত ভূত

ছোটমামার সঙ্গে ছিপে মাছ ধরতে যাচ্ছিলুম। ছোটমামার ছিপটা বড় মাছধরা হুইল। আর আমারটা নেহাত পুঁটিধরা কঞ্চির ছিপ। বঁড়শিও খুদে।

ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। কদিন বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। ঝলমলে রোদে গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে সবুজ রঙের জেল্লা বেড়েছে। আমার মনও খুশিতে চঞ্চল। ছোটমামা বলেছেন, বুঝলি পুঁটু? আজ থেকে তোর ট্রেনিং শুরু। তোর ডাকনাম পুঁটু। তাই দেখবি, পুঁটিমাছেরা তোর বঁড়শির সঙ্গে ভাব জমাতে ভিড় করবে। ওরা কিন্তু বড় চালাক। ফাতনা নড়লেই ছিপে খ্যাচ মারবি।

–খ্যাঁচ কী মামা?

–ধুর বোকা! এ্যাচ বুঝিস না? ঠিক আছে। তোকে হাতেকলমে শিখিয়ে দেব।

গ্রামের শেষদিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেখানে আদ্যিকালের ভাঙা শিবমন্দির ঘিরে প্রকাণ্ড বটগাছ এবং ঝোঁপজঙ্গল গজিয়েছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল মোনা-ওঝার সঙ্গে।

মোনার মাথায় জটা। মুখে গোঁফ-দাড়ি। ওপর পাটির একটা দাঁত ভাঙা। তাই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর কপালে দগদগে সিঁদুরের ঘটা সত্ত্বেও হাসলে তাকে খুব অমায়িক ও সরল মানুষ মনে হয়। কিন্তু যখন সে গম্ভীর হয়ে থাকে, তখন তাকে দেখলে বড় গা ছমছম করে। তার চোখদুটো যে বেজায় লাল।

মোনা-ওঝা আমাদের দেখে কেন কে জানে ফিক করে হাসল। তারপর বলল,–ছোটবাবু, ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ছিপ ফেলতে বেরিয়েছেন বুঝি? ভালো! তা কোথায় ছিপ ফেলবেন?

ছোটমামা বললেন,–সিঙ্গিমশাইয়ের মাঠপুকুরে।

মোনা বলল,–ওই পুকুরে আর মাছ আছে নাকি? এই তো গত মাসে সিঙ্গিমশাই জেলেদের সব মাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। সারাদিন জাল ফেলে-ফেলে জেলেরা মাছের ছানাপোনাসুদ্ধ ঘেঁকে তুলে নিয়েছে।

ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–সে কী মোনাদা! সিঙ্গিমশাইয়ের কাছে আজ সকালে যখন ছিপ ফেলার জন্য পারমিশন চাইতে গেলুম, উনি বললেন, দুটোর বেশি ধোরো না যেন।

মোনা-ওঝা হেসে কুটিকুটি হল। –মিথ্যে! একেবারে মিথ্যে! বুঝলেন ছোটবাবু? চোরের জ্বালায় মাত্র আড়াইশো-তিনশো গ্রাম ওজন হলেই পোনামাছগুলো বিক্রি করে দেন সিঙ্গিমশাই। তাছাড়া আপনার হুইলে ধরার যোগ্য মাছ কি ওখানে কখনও ছিল? তবে হ্যাঁ। এই খোকাবাবুর ছিপে ধরার মতো পুঁটিমাছ থাকলেও থাকতে পারে।

ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-মিথ্যুক! হাড়কেল্পন! আমাকে খামোকা হয়রান করল! টাউন থেকে শখ করে এত দামি হুইল কিনে আনলুম। সকাল থেকে কতরকমের চার আর টোপ তৈরি করলুম!

মোনা বলল,–এক কাজ করুন ছোটবাবু! একটু কষ্ট করে দোমোহানির ঝিলে চলে যান। ঝিলে কিন্তু প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড মাছ আছে। ঝাঁপুইহাটির কালিবাবু এই তো দুহপ্তা আগে একটা পাঁচ কেজি রুই তুললেন। আমার চোখের সামনে, ছোটবাবু! মা কালীর দিব্যি!

ছোটমামা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু বড় দূরে যে!

দুর কী বলছেন? নাক বরাবর ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে ওই বাঁধে উঠুন। মাত্র আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।বলে মোনা আমার দিকে তাকাল, কি খোকাবাবু? যেতে পারবে না মামার সঙ্গে?

কী আর বলব? মাথাটা একটু কাত করলুম শুধু। পুঁটিমাছ ধরার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠেছে যে!

ছোটমামা হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। বললেন, আয় পুঁটু! মোনাদা ঠিকই বলেছে, মাছ পাই বা না পাই, একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাক না। তাছাড়া তোর ট্রেনিংটা ওইরকম ঝিল-জঙ্গলে শুরু করাই উচিত।

ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। পিছন থেকে মোনা-ওঝা বলল,–তবে একটা কথা ছোটবাবু! সূর্য ডোবার পর আর এখানে কিন্তু থাকবেন না। সঙ্গে খোকাবাবু আছে বলেই সাবধান করে দিলুম।

ছোটমামা বললেন,–ছাড় তো বুজরুকে কথা। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। তাই না পুঁটু? ওঁর কথায় অগত্যা সায় দিতেই হল। যদিও মোনা-ওঝার কথাটা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল।…

বাঁধের নিচে ঝিলটা বাঁকা হয়ে একটু দূরের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু ছিপ ফেলার মতো কঁকা জায়গা চোখে পড়ল না। ঝিলে ঘন দাম, পদ্ম আর শালুক ফুলের ঝাঁক। কোথাও শোলাগাছ গজিয়েছে দামের ওপর। ছোটমামা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছিপ ফেলার মতো খানিকটা কঁকা জায়গা আবিষ্কার করলেন। তারপর বললেন,–বুঝলি পুঁটু? এখানেই ঝাঁপুইহাটির কোন কালীবাবু ছিপ ফেলেছিলেন মনে হচ্ছে। এই দ্যাখ, এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ পড়ে আছে। হুঁ! সিগারেটের ফিল্টারটিপও অজস্র। কালীবাবু খুব সিগারেট খান বোঝা যাচ্ছে।

ঝিলের উত্তর পাড়ে এই জায়গাটা ছায়ায় ঢাকা। কারণ, বাঁধে একটা বটগাছ আছে। তার লম্বা ডালপালা ঝিলের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। ছোটমামা ঝটপট চার ফেলে ছিপ সোজা রাখার জন্য ঝোঁপ থেকে একটা আঁকশির মতো ডাল ভেঙে আনলেন। এক হাঁটু জলে নেমে সেটা কাদায় পুঁতে বললেন,–তোর ছিপটা ছোট্ট তো! ওটা হাতে ধরে থাকতে পারবি। আমারটা যে হুইল ছিপ। ডগাটা আঁকশির মাথায় রাখলে তবে ছিপটা সোজা থাকবে।

মাঝে-মাঝে শিরশিরে বাতাস বইছিল। রোদে হাঁটার কষ্টটা শিগগির দূর হয়ে গেল। মামা-ভাগ্নে দুজনে দুটো ছিপ ফেলে বসে রইলুম। ঝিলের ওপারে ঘন বাঁশবন। সেখানে একঝাক পাখি তুমুল হল্লা করছিল। জল-মাকড়শারা জলের ওপর তরতরিয়ে ছোটাছুটি করছিল। একটা লাল গাফড়িং ছোটমামার ছিপের ফাতনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একটা জলপিপি পাখি পিপি করে ডাকতে ডাকতে দূরে ঝিলের জলে কোথাও বসল।

এতক্ষণে মনে পড়ল, ছোটমামা আমাকে খ্যাচ মারা শেখাবেন। কিন্তু কথাটা তুলতেই উনি চাপাস্বরে বললেন, আমার চারে মাছ এসে গেছে। বুজকুড়ি দেখতে পাচ্ছিস না? মাছটা টোপ খেলেই আমি ছিপটা যেভাবে জোরে তুলব, সেটাই এ্যাচ। তুই লক্ষ রাখিস।

আমার ছিপের ফাতনা দুবার কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেল। খ্যাচ মারা ব্যাপারটা না দেখা পর্যন্ত কী আর করা যাবে!

কিছুক্ষণ পরে দেখি, ছোটমামার ছিপের ফাতনা নড়তে শুরু করেছে। ছোটমামা ছিপের হুইলবাঁধা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর ফাতনাটা যেই ডুবে গেল, অমনি ছোটমামা জোরে ছিপটা তুলে ফেললেন। সাঁই করে একটা শব্দ হল। কিন্তু কী অবাক! ছোটমামার বঁড়শিতে বিঁধে যে জিনিসটা ছিটকে আমাদের পেছনে গিয়ে পড়ল, সেটা তো মাছ নয়!

ছোটমামা ছিপ ফেলে এক লাফে পেছনে বাঁধের গায়ে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারপর ফাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ! এটা দেখছি একটা মড়ার খুলি!

কথাটা শুনেই আমি ওঁর কাছে চলে গেলুম। ছোটমামা একটা শুকনো কাঠি দিয়ে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, কোনও মানে হয়?

খুলিটা দেখেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর দেখি, খুলিটা লাফাতে লাফাতে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোটমামা গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তো ভয়ের চোটে এমন ভ্যাবলা হয়ে গেছি, যেন আমার পাদুটো মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকানো।

ছোটমামা বিড়বিড় করছিলেন, এ কী রে পুঁটু? এ কী রে! এ কী হচ্ছে? অ্যাঁ?

তারপর দেখলুম খুলিটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে জলে পড়ল। জলের ওপর কিছুদূর পর্যন্ত বুজকুড়ি উঠে সেগুলো ভেঙে গেল। ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন,–এ কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বল তো পুঁটু?

বললুম,–ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে। চলুন। আমরা এখান থেকে এখুনি চলে যাই।

ছোটমামার এই এক স্বভাব। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন। বললেন, ধুস! একটা মড়ার খুলি দেখে ভয় পাব আমরা? কী বলিস পুঁটু? বলেছিলুম না আমরা অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি?

বলে উনি আবার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে ছিপ ফেললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–দেখলি তো খ্যাচ মারা কাকে বলে?

তারপর বসে আছি তো আছি। কিন্তু আর ফাতনা নড়ে না। আমি জলের দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকাতে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। কে জানে বাবা! এবার যদি আমার বঁড়শিতে টোপ খেতে আসে খুলিটা!

তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, মড়ার খুলি একেবারে জ্যান্ত।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাদের বাঁদিকে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর কে ভরাট গলায় বলে উঠল,–তারা তারা তারা। তারা তারা তারা! ব্রহ্মময়ী মাগো!

আমরা চমকে উঠে ঘুরে বসেছিলুম। দেখলুম, মোনা-ওঝার মতোই জটাজুটধারী একটা মাথা ঝোঁপের ওপর দেখা যাচ্ছে। তারপর ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধুবাবা। পরনে হাঁটু অবধি পরা লাল কাপড়। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে কমণ্ডলু। তিনি অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন,-বাড়ি কোথায় গো তোমাদের?

ছোটমামা বললেন,-বাবুগঞ্জ।

–অতদূর থেকে তোমরা এখানে ছিপ ফেলতে এসেছ? ভালো করোনি।

–কেন বলুন তো?

–এটা শ্মশানকালীর এলাকা। ওই দেখছ ঘন গাছপালা। সেখানেই মায়ের মন্দির। তার পাশে শ্মশান। তোমরা এখানে বেশিক্ষণ থেকো না বাবারা!

ছোটমামা হাসতে-হাসতে বললেন, আপনি যা-ই বলুন সাধুবাবা! একটা মাছ ধরে এখান থেকে নড়ছি না।

–ওরে পাগল! এ ঝিলে আর মাছ কোথায়? যা দু-চারটে ছিল, কবে মারা পড়েছে।

–মাছ না পাই, মড়ার খুলিই বঁড়শি বিঁধিয়ে তুলব।

সাধুবাবা চমকে উঠে বললেন, তার মানে? তার মানে?

ছোটমামা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন,–এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা জ্যান্ত মড়ার খুলি টোপ খাচ্ছিল। এক খ্যাচ মেরে তাকে ডাঙায় তুললুম।

–তারপর? তারপর?

–খুলিটা থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিতেই ওটা লাফাতে লাফাতে জলে গিয়ে পড়ল।

–তোমরা তবু ভয় পেলে না?

ছোটমামা বললেন, নাহ। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে এসেছি যে সাধুবাবা! আমাদের অত সহজে ভয় পেলে চলে?

সাধুবাবা চাপাস্বরে বললেন,–কিন্তু তোমরা কি জানো ওই খুলিটা কার?

ছোটমামা তাচ্ছিল্য করে বললেন,–তা কেমন করে জানব? জানার দরকারই বা কী?

সাধুবাবা গম্ভীরমুখে বললেন, দরকার আছে। ওই খুলিটা পাঁচু নামে একজন চোরের। তোমরা তার নাম শোনোনি মনে হচ্ছে। পাঁচু ছিল এই তল্লাটের এক ধূর্ত সিঁধেল চোর। সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক রাত্রে পাঁচু গেরস্থবাড়িতে সিঁদ কাটতে বেরিয়েছে। এমনসময় পড়বি তো পড় একেবারে বন্ধু দারোগার মুখোমুখি।

বন্ধুবিহারী ধাড়া ছিলেন পুঁদে দারোগা। পাঁচুকে দেখে তিনি টর্চ জ্বেলে পাকড়ো পাকড়ো বলে তাড়া করলেন। তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল ছিল। তারাও পাঁচু চোরকে তাড়া করল। তারপর ঠিক এইখানে এসে যখন পাঁচুকে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন, অমনি পাঁচু লাফ দিয়ে ঝিলের জলে পড়ল। দারোগা পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। তখন পাঁচু জলে ডুব দিল।

ছোটমামার মন ফাতনার দিকে। শুধু বললেন, হুঁ।

গল্পটা আমি মন দিয়ে শুনছিলুম। তাই বললুম,–তারপর কী হল সাধুবাবা?

সাধুবাবা শ্বাস ছেড়ে বললেন,-পাঁচু ডুব দিল তো দিল। আর মাথা তুলল না। তখন দারোগাবাবু দুই কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে থানায় ফিরে গেলেন। রাত পুইয়ে সকাল হয়ে গেল। কিন্তু কোথায় পাঁচু? আসলে কী হয়েছিল জানো? ঝিলের জলের তলায় ঘন দাম আর শ্যাওলা আছে। বেচারা পাঁচু তাতে আটকে গিয়ে আর মাথা তুলতে পারেনি। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়েছিল।

এবার ছোটমামা বললেন, তারপর জেলে ডেকে এনে জাল ফেলে পাঁচুর মড়া ভোলা হয়েছিল বুঝি?

সাধুবাবা হাসলেন।ওরে পাগল! দেখতে পাচ্ছ না ঝিলের জলের অবস্থা? কত দাম, শ্যাওলা আর কতরকমের জলজ উদ্ভিদ। জাল ফেললে সেই জাল কি আর তোলা যেত? ছিঁড়ে ফর্দাই হয়ে যেত না? তাই কোনও জেলেই জাল ফেলতে রাজি হল না। পাঁচুর মড়া জলের তলায় আটকে রইল। তারপর এতদিনে তার খুলিটা তোমাদের বঁড়শিতে আটকে গিয়েছিল। বুঝলে তো?

ছোটমামা আনমনে আবার বললেন, হুঁ।

সাধুবাবা বললেন,–তো শোনো বাবারা! আবার যদি পাঁচুর খুলি তোমাদের ছিপে ওঠে, তাহলে খুলিটা আমাকে দিয়ে যেও। কেমন? ওই যে দেখছ জঙ্গল! ওর মধ্যে আছে শ্মশানকালীর মন্দির। ওখানে আমাকে পেয়ে যাবে। খুলিটার বদলে আমি তোমাদের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব। সেই মন্ত্র পড়ে বঁড়শিতে ফুঁ দিলেই তোমরা প্রচুর মাছ ধরতে পারবে। যাই হোক, এখন আমি যাই। মায়ের পুজোর সময় হয়ে এল।

বলে সাধুবাবা ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তারা তারা তারা বলতে-বলতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। গাছপালায় পাখিদের হল্লা গেছে বেড়ে। ছোটমামাকে বলতে যাচ্ছি, এবার বাড়ি চলুন ছোটমামা-এমন সময় ছোটমামার হুইলে ছিপের ফাতনা আচমকা ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমামা খ্যাচ মারলেন। আর অবাক হয়ে দেখলুম, আবার সেই মড়ার খুলিটা আমাদের পিছনে ঝোঁপের ভেতরে ছিটকে পড়ল। ছোটমামা দৌড়ে গিয়ে এবার খুলিটা চেপে ধরলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন,-এবার? এবার কী করে পালাবে বাছাধন?

বললুম,–ছোটমামা! চলুন। খুলিটা সাধুবাবাকে দিয়ে আসবেন।

তাই চলবলে ছোটমামা পা বাড়ালেন।

বললুম, ছিপদুটো পড়ে রইল যে?

–থাক না। ফেরার সময় নিয়ে যাব।

ঝোঁপঝাড়ের পর উঁচু-উঁচু গাছের ঘন জঙ্গল। এখনই জঙ্গলের ভেতর আবছা আঁধার জমেছে। ছোটমামা বললেন,–পুঁটু! শ্মশানকালীর মন্দির তো দেখতে পাচ্ছি না!

ওই সময় কানে এল কারা চাপাস্বরে কথা বলছে। ছোটমামা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চারজন লোক একটা খাঁটিয়া নিয়ে বসে আছে। খাঁটিয়াতে একটা মড়া।

খুলি হাতে নিয়ে ছোটমামা যেই বলেছেন,-এখানে শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায় বলতে পারেন? অমনি লোকগুলো লাফ দিয়ে উঠে ওরে বাবা! এরা আবার কারা? বলে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, যা বাবা! ওরা হঠাৎ অমন করে পালিয়ে গেল কেন? এই খুলিটা দেখে ভয় পেল নাকি?

তারপর তিনি মড়ার খাঁটিয়ার কাছে গেলেন। গলা অবধি চাদর ঢাকা মড়ার মাথাটা বেরিয়ে আছে। ছোটমামা বললেন,–বেশ শৌখিন লোক ছিল মনে হচ্ছে। বুঝলি পুঁটু! চুলগুলোর কেতা দেখছিস? চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা। গোঁফটার কেতাও আছে। দেখে কিন্তু মড়া বলে মনেই হয় না। আমার ধারণা হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে। আহা! এমন শৌখিন লোকের মারা যাওয়া উচিত হয়নি।

ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি এটা শ্মশান। এখানে-ওখানে চিতার পোড়া কাঠ আর ছাই। ভাঙা কলসিও পড়ে আছে। এই মড়াটার জন্য কোনও কাঠের পাজা দেখতে পেলুম না। খাঁটিয়ার কয়েক হাত দূরে ঝিলের জল আবছা দেখা যাচ্ছিল। মনে হল, লোকগুলো মড়া পোড়ানোর কাঠের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু একটা খুলি দেখে ওরা অত ভয় পেল কেন?

ছোটমামা মড়াটা দেখতে-দেখতে আনমনে বললেন, কিন্তু শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায়?

তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা ঠকাস করে খাঁটিয়ার মড়ার নাকের ওপর পড়ল। অমনি মড়াটা আর্তনাদ করে উঠল, উঁহু হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি! তারপর লাফ দিয়ে উঠে খুলিটা দেখামাত্র জ্যান্ত মানুষের মতো দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। আবছা আলোয় দেখলুম, পরনে ধুতি, গায়ে নকশাদার সিল্কের পাঞ্জাবি। ছোটমামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললুম,–ছোটমামা! ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে।

ছোটমামা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুলিটা চেপে ধরলেন। কারণ এই সুযোগে খুলিটা আবার পালিয়ে যাচ্ছিল।

এতক্ষণে সেই সাধুবাবার কণ্ঠস্বর কানে এল। তারা! তারা! তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!

তারপর একটু তফাতে গাছের ফাঁকে আগুনের আঁচ দেখতে পেলুম।

ছোটমামাকে সেটা দেখিয়ে দিলুম। উনি হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে এগিয়ে চললেন। গাছপালার ভেতর একটা জরাজীর্ণ মন্দির দেখা গেল। তার উঁচু চত্বরে ধুনি জ্বেলে বসে আছেন সেই সাধুবাবা।

ছোটমামা বললেন, সাধুবাবা! সাধুবাবা! এই নিন পাঁচু-চোরের খুলি।

সাধুবাবা ঘুরে খুলিটা দেখে সহাস্যে বললেন,–পেয়েছিস ব্যাটাছেলেকে? দে! শিগগির দে!

ছোটমামা খুলিটা দিতে যাচ্ছেন, আবার সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা সজোরে গিয়ে সাধুবাবার বুকে পড়ল। সাধুবাবা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করলেন,–উ হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি!

তারপর দেখলুম, তার জটার পেছনে আগুন ধরে গেছে। কারণ তিনি জ্বলন্ত ধুনির ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। জটায় আগুনের আঁচ টের পেয়ে সাধুবাবা লাফ দিয়ে চত্বর থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন। তারপর আবছা আঁধারে ঝপাং করে জলের শব্দ হল। বুঝলুম, সাধুবাবা আগুন নেভাতে ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।

এদিকে খুলিটাও সুযোগ বুঝে গড়াতে শুরু করেছে। ছোটমামা খুলিটা ধরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। ওটা কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, কখনও গড়িয়ে চলছে। আমরা যেখানে ছিপ ফেলেছিলুম, সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই জলের ভেতর থেকে একটা কঙ্কালের দুটো হাত ভেসে উঠল এবং খুলিটা লুফে নিয়ে আবার জলে ডুবে গেল। এতক্ষণে ছোটমামা ভয় পেয়ে কঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, পুঁটু রে! আর এখানে থাকা ঠিক নয়। ছিপ তুলে নে। মোনা-ওঝা ঠিকই বলেছিল রে! দুজনে ঝটপট ছিপ গুটিয়ে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাঁধের ওপর উঠলুম। তারপর বাঁধের পথে বাড়ি ফিরে চললুম। কিছুদূর চলার পর ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই হল রে পুঁটু। সাধুবাবার কাছে মাছ ধরার মন্ত্রটা শেখা হল না।

অন্ধকারে রাতবিরেতে

কেকরাডিহি যেতে হলে ভামপুর জংশনে নেমে অন্য ট্রেনে চাপতে হবে। কিন্তু ভামপুর পৌঁছতেই রাত এগারোটা বেজে গেল। ট্রেন ঘণ্টাছয়েক লেট। খোঁজ নিয়ে জানলুম, কেকরাডিহি প্যাসেঞ্জার রাত নটায় ছেড়ে গেছে। পরের ট্রেন সেই ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে নয়।

কনকনে ঠান্ডার রাত। এরই মধ্যে জংশন স্টেশন একেবারে ঝিম মেরে গেছে। তাছাড়া, তেমন কিছু বড় জংশনও নয়। লোকজনের ভিড় এমনিতে কম। চায়ের দোকানি ঘুমঘুম গলায় পরামর্শ দিল,–পাঁচ লম্বর পেলাটফরমে কেকরাডিহির টেরেন রেডি আছে। চোলিয়ে যান। আরামসে জুত করুন।

শুনে তো লাফিয়ে উঠলুম আনন্দে। ওভারব্রিজ হয়ে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি, সত্যি তাই। ইঞ্জিনবিহীন একটা ট্রেন কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মে জন মানুষটি নেই। মাথার ওপর ছাউনি বলতেও কিছু নেই। একফালি চাঁদ নজরে পড়ল, শীতে তার চেহারাও খুব করুণ।

কিন্তু যে কামরার দরজা খুলতে যাই, সেটাই ভেতর থেকে আটকানো। জানলাগুলোও বন্ধ। বুঝলুম ভেতরে বুদ্ধিমান লোকগুলো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রচুর লোক জমে উঠেছে! দরজা খুলে তা বরবাদ করার ইচ্ছে নেই কারুর। অবশ্য চোর-ডাকাতের ভয়ও একটা কারণ হতে পারে। দরজা টানাটানি করে কোথাও কোনও সাড়া পেলুম না।

হন্যে হয়ে শেষদিকটায় গিয়ে শেষ চেষ্টা করলুম। তখন আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। চাচামেচি করে বললুম, দরজায় বোমা মেরে উড়িয়ে দেব বলে দিচ্ছি। আমার কাছে বোমা আছে কিন্তু।

এই শাসানিতেই যেন কাজ হল। একটা জানালা একটু খুলে গেল। তারপর ভারি গলায় কে বলল, কী আছে বললেন?

কথাটা চেপে গিয়ে বললুম,–আহা, দরজাটা খুলুন না। ঠান্ডায় জমে গেলুম যে!

ভেতরের লোকটি বলল,–বোমা না কী বলছিলেন যেন?

আরে না, না। হাসবার চেষ্টা করে বললুম,–ওটা কথার কথা। দয়া করে দরজাটা খুলে দিন।

–মাথা খারাপ মশাই? বোমাওয়ালা লোককে ঢুকিয়ে শেষে বিপদে পড়ি আর কী! বোমা মারতে হয়, অন্য কামরায় গিয়ে মারুন। আমি ঝামেলা ভালোবাসি না।

লোকটা জানালার পাল্লা নামিয়ে দিল দমাস শব্দে। অদ্ভুত লোক তো! রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে কী করব ভাবছি, সেই সময় গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখলুম। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় গুনগুনিয়ে গান গেয়ে কেউ আমারই মতো এক বগি থেকে আরেক বগি পর্যন্ত ফুঁ মেরে বেড়াচ্ছে বুঝি। মিটমিটে আলোয় লোকটির চেহারা নজরে এল। ঢ্যাঙা, হনুমান-টুপিপরা লোক। গায়ে আস্ত কম্বল জড়ানো। লম্বা বিরাট একটা নাক ঠেলে বেরিয়েছে মুখ থেকে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল আমাকে দেখে। তারপর খি-খি করে হাসল।–ঢোকার ছিদ্র পেলেন না বুঝি? মশাই, এ লাইনের ব্যাপারই এরকম। সেজন্য সূচ হয়ে ঢুকতে হয়। তারপর দরকার হলে ফাল হয়ে বেরুন না কেন?

কথার মানে কিছু বুঝলুম না। পাগল-টাগল নয় তো? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে বলল, আপনি দেখছি একেবারে কচি খোকা! বুঝলেন না কথাটা?

ঠান্ডার রাত। জনহীন প্ল্যাটফর্মে পাগলকে ঘাঁটানো উচিত হবে না। বললুম, বুঝলুম বইকী!

কচু বুঝেছেন! এই দেখুন, সুচ হয়ে কেমন করে ঢুকতে হয়। বলে লোকটার সামনেকার একটা জানালা খামচে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওপরে ওঠাল।

তারপর আমাকে হকচকিয়ে দিল বলা যায়। জানালায় গরাদ আছে। অথচ কী করে সে তার অতবড় শরীরটা নিয়ে ভেতরে গলিয়ে গেল কে জানে! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

কিন্তু তারপরেই ভেতরে গণ্ডগোল বেধে গেছে। আগের লোকটা চেঁচিয়ে উঠেছে খ্যানখেনে গলায়,–এ কী মশাই! এ কী করছেন? একি! একি! আরে…

এবং কামরার দরজা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল। সম্ভবত আগের লোকটাই বোঁচকাকুঁচকি-বিছানাপত্র নিয়ে একলাফে নিচে এসে পড়ল। তারপর দুদ্দাড় শব্দ করে ওভারব্রিজের সিঁড়ির দিকে দৌড়ল।

দেখলুম, একটা বালিশ ছিটকে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু আর ফিরেও তাকাল না এদিকে। এবার সুচহওয়া লোকটিকে দেখতে পেলুম দরজায়। খিকখিক করে হেসে বলল,-বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। যাক গে, ভালোই হল। আসুন, আসুন। এক্ষুনি আবার কেউ এসে হাজির হবে। আর শুনুন, ওই বালিশটা কুড়িয়ে নিয়ে আসুন। আরামে শুতে পারবেন।

বালিশটা কুড়িয়ে নিলুম। ঠিকই বলেছে। বালিশটা শোয়ার পক্ষে আরামদায়কই হবে। এর মালিক যে আর এদিকে এ-রাতে পা বাড়াবে না, সেটা বোঝাই যায়। ব্যাপারটা যাই হোক, ভারি হাস্যকর তো বটেই।

কামরার ভেতরটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। লোকটা দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ছিটকিনি নামিয়ে আটকে দিল। দেশলাই জ্বেলে একটা খালি বার্থে বসে পড়লুম। লম্বানেকো লোকটা বসল পাশের বার্থে! তারপর আগের মতো খিকখিক করে হেসে বলল, খুব জব্দ হয়েছে। একা পুরো একটা কামরা দখল করে বসে ছিল ব্যাটাচ্ছেলে!

আমিও একচোট হেসে বললুম, ডাকাত ভেবেই পালিয়েছে, বুঝলেন!

–উঁহু, ডাকাত ভাবেনি। অন্য কিছু ভেবে থাকবে।

–কিন্তু আপনি গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকলেন কী করে বলুন তো?

–কিছু কঠিন নয়। সে আপনিও পারেন। তবে তার আগে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে।

আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, কী কষ্ট?

লোকটা অন্ধকারে অদ্ভুত শব্দে হাই তুলে বলল,-যাকগে ওসব কথা। বললেনও কি আপনি সে কষ্ট করবেন?

–কেন করব না? অমন সরু ফাঁক গলিয়ে ঘরে ঢোকাটা যে ম্যাজিক মশাই। আমার ধারণা, আপনি একজন ম্যাজিশিয়ান।

–তা বলতে পারেন। তবে আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।

অন্ধকারে নড়াচড়ার শব্দ হল। বুঝলুম ম্যাজিশিয়ান লোকটা শুয়ে পড়ল। বালিশটা পেয়ে আমার ভালোই হয়েছে। আমিও শুয়ে পড়লুম। কিন্তু অন্ধকারটা অসহ্য লাগছিল। দম আটকে যাওয়ার দাখিল। তা ছাড়া, বদ্ধ জায়গায় শোওয়ার অভ্যাস নেই। তাই একটু পরে উঠে পড়লুম। মাথার কাছের জানালাটা যেই ওঠাতে গেছি, লোকটা হাঁ-হাঁ করে উঠল।করেন কী, করেন কী। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুনোর মতো লোকের অভাব নেই বুঝতে পারছেন না? অসুবিধেটা কীসের?

–দেখুন, বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। বরং একটু ফঁক করে…

কথা কেড়ে লোকটা খাপ্পা মেজাজে বলল, ধ্যাতমশাই! বললুম না? আবার কে এসে ঢুকবে, তখন আমারই ঝামেলা হবে। আপনার আর কী! বন্ধ করুন বলছি।

অগত্যা ফের শুয়ে পড়লুম। কিন্তু ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। বদ্ধ ঘরের অন্ধকারে অস্বস্তি, তার ওপর প্রচণ্ড হিমকাঠ পিঠের তলায়। সঙ্গে গরম চাদরও নেই। প্যান্ট-কোট হিমে বরফ হয়ে গেছে। পাশের লোকটার গায়ে কম্বল। তাই আরামে ঘুমোচ্ছে। নাকও ডাকছে।

কতক্ষণ পরে চুপিচুপি উঠে বসলুম। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের জানালার পাল্লাটা প্রায় নিঃশব্দে ঠেলে ইঞ্চি দুই ফঁক করে রাখলুম। তারপর শুয়ে পড়লুম ফের। এবার বদ্ধ ঘরের সেই অস্বস্তিটা কেটে গেল।

হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন। হঠাৎ কী একটা দুদ্দাড় শব্দে উঠে বসলুম দুড়মুড় করে। কামরা আগের মতো ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। জানালার সেই ফঁকটা আর নেই। কিন্তু ভেতরে একটা ধস্তাধস্তি বেধেছে যেন। কে, কে বলে চেঁচিয়ে উঠে দেশলাই হাতড়াতে থাকলুম। খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদিকে দরজাটা দমাস করে খুলে গেল। বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেলুম। কে যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশের বার্থে কেউ এসে বসল। বললুম, কী ব্যাপার বলুন তো?

–কিছু না। আপনি শুয়ে পড়ুন। কেকরাডিহি লাইনে এমন হয়েই থাকে।

কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলুম। পাশের বার্থের লোকটার গলার স্বর ছিল একটু খ্যানখেনে। এটা কেমন গুরুগম্ভীর যেন। দেশলাইটা খুঁজে পাওয়া গেল এতক্ষণে। সিগারেট ধরানোর ছলে কাঠি জ্বেলে সেই মিটমিটে আলোয় যাকে দেখলুম, সে অন্য লোক। তবে তার গায়ের কম্বলটা আগের লোকেরই মনে হচ্ছে। এ লোকটার নাক বেজায় চ্যাপ্টা। তাছাড়া, মুখে একরাশ গোঁফদাড়ি। মাথার টুপিটাও অন্য রকম। গম্ভীর স্বরে বলল,–কী দেখছেন?

অবাক হয়ে বললুম, আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন বলুন তো?

–কেন? আমাকে কি সঙ্গী হিসেবে পছন্দ হচ্ছে না?

–না না–মানে, বলছিলুম কী, আপনিও কি জানালার ফাঁক গলিয়ে ঢুকেছেন?

–ঠিক তাই। বুঝলেন না? যা ঠান্ডা পড়েছে।

–তা পড়েছে। কিন্তু আপনিও দেখছি একজন ম্যাজিশিয়ান।

–তা বলতেও পারেন।

–আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?

হ্যা হ্যা করে হেসে নতুন সঙ্গী বলল,–বেজায় ভয় পেয়ে পালিয়েছে। ব্যাটাচ্ছেলে কাতুকুতুতে ওস্তাদ। কিন্তু আমি কী করি জানেন তো? কামড়ে দিই। আপনি?

আমি? আমি কিছুই পারি না বলে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। সিগারেটের আগুনে ঘড়ির কাঁটা দেখে নিলুম। দুটো পাঁচ। আর ঘণ্টাতিনেক এসব উপদ্রব সহ্য করে কাটাতে পারলে আর চিন্তা নেই। ঘুম আর এসে কাজ নেই।

পাশের নতুন সঙ্গীর কিন্তু নড়াচড়ার শব্দ নেই। শুয়ে পড়লে টের পেতুম।

তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ওই যে বলল কামড়ে দেওয়ার স্বভাব আছে! হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে দেবে না তো? ভাব করার জন্যে বললুম, কী? শুতে ইচ্ছে করছে না?

প্রকাণ্ড হাই তোলার শব্দ করে বলল, নাঃ। আপনি ঘুমোন।

–ঘুম আসছে কই? বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। সম্ভবত, জানালা খুললে আপনারও আপত্তি হবে। কাজেই…

–না, না। আপত্তির কারণটা বুঝলেন না? আবার কেউ ঢুকে গণ্ডগোল বাধাবে যে।

আগের ভদ্রলোক বলছিলেন, জানালার গরাদ গলিয়ে ঢোকা শিখতে হলে নাকি একটু কষ্ট করতে হবে। কিন্তু কষ্টটা কী, সেটা চেপে গেলেন। আপনি বলতে পারেন ব্যাপারটা কী?

–খুব পারি। তবে আপনি ভয় পাবেন যে!

–মোটেও না। দেখুন না, আমি কি ভয় পেয়েছি?

হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসল সে। যাক ওসব কথা। আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে লোভ হচ্ছে। একটা সিগারেট দিন, টানি।

সিগারেট দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ধরিয়ে দিতে গিয়ে আবার চমকে উঠলুম। আরে, এ তো সেই গোর্ফদাড়িওলা লোকটা নয়। কুমড়োর মতো মুখ, চকচকে টাক এ আবার কখন এল?

কিন্তু তক্ষুনি গণ্ডগোল বেধে গেল। পাশ থেকে কে চেঁচামেচি করে বলল, এই মশাই। আমার সিগারেট আপনি টানছেন যে। জিগ্যেস করুন তো ওঁকে, কে সিগারেট চাইল।

ফস করে আবার কাঠি জ্বাললুম দেখি, গোঁফদাড়িওলা লোকটি কুমড়ামুখো লোকটির পাশে বসে আছে। তার মুখে-চোখে রাগ ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, কী মুশকিল। আপনি আবার কীভাবে ঢুকলেন?

নতুন লোকটি অদ্ভুত হেসে বলল, আমি আগে থেকেই ছিলুম। অনেকক্ষণ থেকে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিলুম। সাহস করে আসতে পারছিলাম না। এ ভদ্রলোকের যে কামড়ে দেওয়া অভ্যেস।

গোঁফদাড়ি হেঁড়ে গলায় বলল,-এবার যদি কামড়ে দিই।

–সিগারেটের ছ্যাকা দেব। আসুন না কামড়াতে।

বিবাদ মিটিয়ে দিতে বললুম,–আহা, ঠান্ডার রাতে কামড়াকামড়ি ভালো কাজ নয়। নিন, আপনিও একটা সিগারেট নিন।

আমি আবার পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। চোখ দুটো পাশের বার্থের দিকে। দুটো সিগারেট জুলজুল করে জ্বলছে অন্ধকারে। এবার কেন কে জানে, ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর কখন সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি।

হইহট্টগোলে সেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন দেখি কামরা জুড়ে একদঙ্গল লোক। বোঁচকাকুঁচকিও কম নেই। এখন আলো জ্বলছে। জানালাগুলো হাট করে খোলা এই রে! সর্বনাশ হয়েছে তাহলে। গরাদ গলিয়েই পিলপিল করে এরা বুঝি ঢুকে পড়েছে। ধুড়মুড় করে উঠে বসলুম। অমনি খালি জায়গা পেয়ে একদল লোক হইহই করে এসে বসে পড়ল। দুজনকে সিগারেট দিয়ে সামলেছি, এতজনকে কীভাবে সামলাব ভেবে খুব ভয় পেয়ে গেলুম।

কিন্তু তারপর চোখ গেল দরজার দিকে। দরজা খোলা। অতএব এরা তারা নয়। তাদের তন্নতন্ন করে খুঁজে পেলুম না। তারা কোথায় গেল, গোঁফদাড়ি এবং কুমড়ো–অর্থাৎ সেই অন্ধকারের ম্যাজিশিয়ানরা?

আমার মাথার তলা থেকে বালিশটাও উধাও। যাক গে, একটা অভিজ্ঞতা হল তাহলে। টিকিটের ঘণ্টা দিচ্ছিল। পাঁচটা বাজে।

অলৌকিক আধুলি রহস্য!

ইদানীং রোজ ভোরবেলা জগিং শুরু করেছি। আমাদের এই ছোট শহরে অত সকালে রাস্তাঘাট একেবারে নিরিবিলি হয়ে থাকে। তাতে শীতকাল। খেলার মাঠ পেরিয়ে নদীর ধার অব্দি গিয়ে বাড়ি ফিরতে এক কিলোমিটার দৌড় হয়ে যায়। গা ঘেমে ওঠে।

আমার ভাগ্নে শ্ৰীমান ডন টের পেয়ে একদিন বলল,–চোরটাকে ধরতে পেরেছিলেন মামা?

চোর? কোথায় চোর? আকাশ থেকে পড়লুম। আমি তো জগিং করছিলুম, হতভাগা! চোর কোথায় দেখলি?

ডন আকাশ থেকে পড়ল, জগিং! ও মামা, জগিং মানে কী? তুমি তো দৌড়চ্ছিলে।

গম্ভীর হয়ে বললুম, জগিং মানে দৌড়-ব্যায়াম। এতে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। খিদে বাড়ে। জম্পেশ রকমের ঘুম হয়।

ডন খুশি হয়ে বলল, আমিও জগিং করব, মামা।

–বেশ তো। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠিস। তোর তো সাতটার আগে ঘুমই ভাঙে না।

পরদিন অবশ্য ওকে বিছানা থেকে টেনেই ওঠাতে হল। কিন্তু অতটুকু ছেলে। খেলার মাঠ অব্দি গিয়ে ধুস বলে নেতিয়ে বসল! আমি হাসতে-হাসতে ধুকুর-ধুকুর দৌড়ে নদীর ধারে রোজকার টারগেট পোডোমন্দির চক্কর দিলুম। তারপর খেলার মাঠে এসে দেখি, ডন। ফের পুরোদমে শুরু করেছে। মনে-মনে বললুম, ভালো! বাহাদুর ছেলে!

তারপর টের পেলুম ব্যাপারটা। ডন আসলে পাড়ার সেই বদরাগী নেড়ি কুকুরটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চলেছে। তার হাতে আধলা ইট। কুকুরটা লেজ গুটিয়ে ঝিলের ধারে রামু-ধোপার গাধার পেটের তলা দিয়ে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল।

এইতে বুঝি গাধাটা অপমানিত বোধ করে চার ঠ্যাং তুলে লাফ দিল। তখন শ্রীমান বেগতিক দেখে থমকে দাঁড়াল। কাছে গিয়ে বললুম, খুব হয়েছে। তোমার দ্বারা জগিং হবে না। বাড়ি এসো।

ডন ফিক করে হেসে বলল,–তখন অমন বসে পড়লুম কেন বলো তো মামা?

–দৌড়তে পারছিলে না বলে।

ডন বলল,-যাঃ! সেজন্যে নাকি! একটা আধুলি পড়ে ছিল যে ওখানে।

সে আধুলিটা দেখাল। চকচকে নতুন আধুলি। বললুম, কার পড়ে-উড়ে গেছে আর কী? ওটা দিয়ে যদি ফের ঘুড়ি কেনার মতলব করিস, গাঁট্টা লাগাব বলে দিচ্ছি। গাছে ঘুড়ি আটকাবে আর আমাকে গাছে চড়তে হবেকক্ষনো না।

ডন মনমরা হয়ে বলল, তাহলে কী করব বলল না মামা?

–বরং কোনও ভিখিরিকে দান করে দিস। পুণ্যি হবে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলুম শীতের রোদে রাস্তার মোড়ে সেই অন্ধ ভিখিরিটা বসে আছে–রোজই থাকে। ডনকে ইশারা করলে সে গম্ভীর মুখে আধুলিটা ভিখিরির মগে ঠকাস করে ফেলে দিয়ে এল। বোঝা যাচ্ছিল, আধুলিটা নিয়ে তার কোনও মতলব ছিল।

সন্ধ্যায় এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসে একটা গোয়েন্দা গল্পের পাতায় চোখ রেখেছি, ডন এসে বলল, মামা, ও মামা! দ্যাখো দ্যাখো–সেই আধুলিটা না?

ডনের হাতে একটা আধুলি ছিল। সেটা কুড়িয়ে-পাওয়া আধুলিটার মতোই নতুন এবং চকচকে বটে। বললুম,–সেই আধুলিটা, কী বলছিস? এটা তুই তো ঠকাস করে ভিখিরির মগে ফেললি সকালে?

ডন চোখ বড় করে বলল, অবাক, মামা অবাক! পিসিমা একটা টাকা দিয়েছিল আমাকে, জানো তো? টাকাটা নিয়ে গেলুম হাবুবাবুর দোকানে খাতা কিনতে। এই দ্যাখো খাতাটা।

সে খাতাটা দেখাল। বিশ্বাস করে বললুম, আধুলিটা বুঝি হাবুবাবু দিলেন?

ডন চাপা গলায় বলল, দিলেন তো! ও মামা, এটা সেই আধুলিটা সত্যি বলছি, দ্যাখো না ভালো করে। ঠিক সেইটে। কুড়িয়ে পেতে কতক্ষণ ধরে দেখেছিলুম না? সেই লাল ফুটকিটা পর্যন্ত। দেখতে পাচ্ছ?

তর্ক করে লাভ নেই ওর সঙ্গে। ঝামেলা বাড়বে। হাত বাড়িয়ে বললুম, ওটা আমায় দে। তার বদলে তোকে আট আনা দিচ্ছি।

ডন একপা পিছিয়ে বলল, উঁহু! এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক করব না বুঝি?

–বেশ, তাই করিস। যা এখন!

ডন বলল, তুমি বিশ্বাস করলে না তো? ঠিক আছে। কাল ভোরবেলা জগিং করবার সময় ফের এটা ভিখিরিকে দেব। দেখবে, ফের ঘুরে আসবে আমার হাতে।

পরদিন ওকে ঘুম থেকে ওঠাতে হল না। আমাকেই বরং ওই ওঠালে। মামা ভাগ্নে মিলে ঠান্ডা হিমে ভোরবেলায় ধুকুরপুকুর দৌড় শুরু করলুম। আজ ওর খাতিরে একটু আস্তে। নদীর ধারে পোডোমন্দির ঘুরে খেলার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে লক্ষ করলুম ডনটা একটুও কাবু হয়নি। রহস্যটা কী?

মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দেখে আধুলিটার কথা মনে পড়ল। বললুম,–হ্যাঁরে, আধুলিটা ওকে দিবি বলেছিলি যে?

দিচ্ছি।–বলে ডন ভিখিরির কাছে গেল।

ঠকাস শব্দ এবং ভিখিরির আশীর্বাদ শুনে বুঝলুম, মুদ্রাটি যথাস্থানে গেছে।

এদিন ছিল রবিবার। ডন একদফা পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছিল। এগারোটা নাগাদ তার পায়ের ধুপধুপ আওয়াজ শুনলুম। তারপর এক চিকুর, মামা! মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক। তারপর হাঁফাতে-হাঁফাতে ঘরে ঢুকে সে বলল, বলেছিলুম না! এই এই দ্যাখো।

ওর হাতে সেই আধুলিটার মতোই চকচকে নতুন আধুলি দেখে হাসতে-হাসতে বললুম,–চালাকি? কোত্থেকে নতুন একটা আধুলি এনে বলছ সেইটে?

ডন কঁদো-কঁদো মুখে বলল, তোমার দিব্যি, মামা! মা পান কিনতে পাঠিয়েছিল। পানওয়ালা এটা দিল। সে আমার হাতে ওটা গুঁজে দিল। তুমি দেখে রাখো না! এই লাল ফুটকিটা দেখছ-ওইটা দেখেই চিনতে পারছি!

–ঠিক আছে। আমার কাছে থাক এটা। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখবখন!

ডন ছোঁ মেরে আধুলিটা তুলে নিয়ে ছিটকে সরে গেল। রাগী মুখ করে বলল, দিচ্ছি তোমায়! অত করে মার কাছে বকুনি খেয়ে এটা ফিরে পেলুম। এ দিয়ে ম্যাজিক করব।

পরদিন ভোরে জগিং করতে গিয়ে নদীর ধারে পোড়োমন্দির চক্কর দিচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হল শ্রীমান সঙ্গে নেই। ঘুরে দেখি অনেকটা দূরে খেলার মাঠে ছোট্টটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেতেই ঊ্যা করে বলল,–আধুলিটা হারিয়ে গেছে মামা!

রাগ করে বললুম,–বেশ হয়েছে হতভাগা ছেলে! আধুলি হাতে নিয়ে কেউ দৌড়ায়?

ডন আমাকে খামচে ধরে থামাল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল,-খুঁজে দাও না মামা। আমার ম্যাজিক করা হবে না যে!

ঘাসে শিশির চকচক করছে। সূর্যটা সবে বিছানা থেকে উঠে বসে হাই তুলছে। পিটপিটে চাউনি। তার ওপর উত্তরে হাওয়ার ঠান্ডা হিম দুষ্টুমি। এমন সময় একটা আধুলি খুঁজে বের করা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। ডনের খাতিরে তবু অনেক কষ্ট করতে হল। কিন্তু তার পাত্র পাওয়া গেল না। ডনকে বললুম,–ঠিক এখানেই পড়েছে তার মানে কী? অন্য কোথাও ফেলেছিস তাহলে।

ডন জোরের সঙ্গে বলল,–এখানেই!

কিন্তু প্রচণ্ড খুঁজেও আধুলিটা পাওয়া গেল না। কাজেই আমাদের পায়ের শব্দে রাস্তার মোড়ের অন্ধ-ভিখিরি নড়েচড়ে বসলেও তার মগে ঠকাস করে সেই মিঠে শব্দটা বাজল না। বেচারা নিশ্চয় খুব মনমরা হয়ে গেল।

মনমরা হয়ে রইল শ্রীমানও। শরীর খারাপ বলে স্কুলে গেল না। বিকেল নাগাদ ভাবলুম ছেলেটাকে চাঙ্গা করা উচিত। আমার ডাক শুনে ডন চোখ পিটপিট করতে করতে ঘরে ঢুকল। তারপর নিজের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী?

ওকে টেনে আদর করে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে! ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। চল, বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। মন ভালো হয়ে যাবে।

ডন ঘাড় গোঁজ করে বলল, শ্যাব–একটা আধুলি দাও, নতুন আধুলি না হলে নেব না কিন্তু।

আধুলি? –চিন্তিত হয়ে বললুম। আধুলি যদি না থাকে, সিকি হলে চলবে না?

ডন ঠোঁটের কোণায় কেমন একটু হাসল,–তোমার টেবিলের ড্রয়ার খুঁজে দ্যাখো না।

টেবিলের ড্রয়ারে খুচরো পয়সা রাখি, একথা সত্য। ডনের এ খবর জানা থাকার কথা নয়–এ বাড়ির কারুরই নয়। খুঁজতে গিয়ে পেয়েও গেলুম একটা আধুলি। এবং চকচকে আনকোরা আধুলিটা। ডনের তর সইল না, খপ করে কেড়ে নিল। তারপর উল্টে-পাল্টে দেখতে-দেখতে আচমকা এক চিল-চিকুর ছাড়ল, মামা, ও মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক!

অবাক হয়ে বললুম, কী রে?

সেই লাল ফুটকিটা। ডন নাচতে নাচতে বলল, আমার আধুলি। আমার আধুলি। দ্যাখো, দ্যাখো!

হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। ওর হাত থেকে আধুলিটা নিয়ে আরও অবাক হলুম। এ কী! সত্যি সেই লাল ফুটকিওয়ালা আধুলিটা যে! কোথায় পেলুম এটা কার, কিছুতেই মনে পড়ল না। কিন্তু জিনিসটা যে অলৌকিক এতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

আর এত ঠিক, এই পড়ে পাওয়া অলৌকিক আধুলি যখন ডনকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে ডন এটা মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দিক কিংবা হারিয়ে ফেলুক, আবার তার কাছে এ-হাত সেহাত ঘুরে ফিরে আসবেই। নিজেকে চেনাবার জন্যে কপালে একটা লাল ফুটকি তো থাকবেই। সুতরাং ডন দৌড়ে বেরিয়ে গেলে ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। এমন ভাগ্নের মামা হওয়াটাও তো কম গর্বের কথা নয়।

আজমগড়ের অশরীরী

তখন আমি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সেই কাজে আমাকে আজমগড়ে যেতে হয়েছিল।

আজমগড় উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট শহর। সেখানে একটা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আছে। তবে ওটা দেখবার জন্য পর্যটকদের বিশেষ উৎসাহ নেই। ওখানে বিশাল গঙ্গার বুকে একটা চরে পক্ষীনিবাস আছে। পাখি দেখবার জন্যই শীতকালে পর্যটকদের ভিড় হয়। ধ্বংসস্তূপ দেখে কে-ই বা আনন্দ পায়?

আমি গিয়েছিলুম মার্চের গোড়ার দিকে। তখন আর তত শীত ছিল না। পর্যটকদের ভিড়ও ছিল না। ভাঙাচোরা নবাবি প্রাসাদের পাশে গঙ্গার তীরে প্যালেস হোটেলে উঠেছিলুম। পর্যটন মরশুমের শেষে এই দোতলা থ্রি-স্টারমার্কা হোটেলে তখন ঘরভাড়াও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

হোটেলের ম্যানেজার সুখলাল ঠাকুর খুব অমায়িক মানুষ। আমি সিপাহিবিদ্রোহ সম্পর্কে গবেষণা করছি জেনে খুব খাতির করেছিলেন। সিপাহিবিদ্রোহের অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। এসব গল্প নিছক গল্পই। আমার গবেষণায় তা কাজে লাগবে না। তবে ওঁর এ কথাটি অবশ্যই খাঁটি। এই আজমগড়ে সিপাহিদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে অনেক হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

মিঃ ঠাকুর শুধু একটা ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর আমি যেন কেল্লাবাড়ি এলাকায় না থাকি। তাঁকে প্রশ্ন করে কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাইনি। তিনি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে শুধু বলেছিলেন, সূর্যাস্তের পর ওই এলাকায় থাকলে বিপদ হতে পারে।

–কী বিপদ?

প্যালেস হোটেলের ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছেন, এমনসময় কজন সায়েব-মেম দলবেঁধে হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকলেন। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ক্যামেরায় কেল্লাবাড়ি আর গঙ্গার ছবি তুলে বেড়ালুম। কোথাও-কোথাও ধ্বংসাবশেষে ঝোঁপজঙ্গল আছে। গঙ্গার তীরে একস্থানে খাড়া পাথরের পাঁচিল নেমে গেছে জলের তলায়। কোথাও ভাঙাচোরা পাথরের ঘাট শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম সেই ফাঁসির মঞ্চটিকে, যেখানে ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ জন হকটন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিলেন। সেই বিদ্রোহীদের দলে ছিলেন নবাব আজম খানের কন্যা রেশমা বেগম। দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানার কাগজপত্রে এই পিতা-পুত্রীর নাম খুঁজে পেয়েছিলুম। আর পেয়েছিলাম একটা স্কেচম্যাপ। সেটা এঁকেছিলেন এক আইরিশ শিল্পী–টমাস পিট। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সেই শিল্পী এ অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলেন। স্কেচম্যাপে কেল্লাবাড়ির সীমানা ছাড়াও খুঁটিনাটি অনেকগুলি স্থান চিহ্নিত করা ছিল। সির মঞ্চ, বিদ্রোহীদের কবরখানা, রেশমা বেগমের গোপন অস্ত্রাগার–এরকম অনেককিছুই ছিল ওতে। আমি জীর্ণ ম্যাপ থেকে কপি করে এনেছিলুম।

সেই কপি থেকে স্থানগুলি খুঁজে বের করা দেখলুম অসম্ভব ব্যাপার। তবে একটা দৃশ্য আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ধ্বংসস্তূপগুলিতে শুধু লাল রঙের ফুলের সমারোহ চোখে পড়ে। আমি প্রকৃতিপ্রেমিক নই। ইতিহাসের একজন গবেষক মাত্র। জীবনে কত ঐতিহাসিক স্থানে আমাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু কোথাও এমন উজ্জ্বল লালরঙের ফুল চোখে পড়েনি। নানা আকৃতির এইসব ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ওগুলি কি ফুল, না চাপ-চাপ রক্ত? এখানে কি অন্যরঙের ফুল ফোটে না?

অবশ্য এখন বসন্তকাল। ফুল ফোটে। পাখিরা গান করে। কিন্তু এখানে পাখিরা কেন চুপ করে আছে?

পাখির কথা ভাবতেই গঙ্গার ধারে পক্ষীনিবাসের কথা মনে পড়ল। তখন ধরে নিলুম, এলাকার সব পাখি সেখানে গিয়েই জুটেছে। কোথায় সেই চর তা জেনে আসিনি। গঙ্গা এখানে প্রশস্ত। উত্তাল বাতাসে বড় বড় ঢেউ উঠে কেল্লার পাথুরে পাঁচিলে অদ্ভুত শব্দ করছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষের কোলাহল। ওপারে দূরে ঘন নীল পাহাড়গুলি দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি জেলেনৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে।

অন্যমনস্কভাবে গঙ্গার ধারে জীর্ণ শ্যাওলাধরা ঘাটের মাথায় একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। এই সময় আমার ডানদিকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একজন ফকির বেরিয়ে এলেন।

ফকিরের মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত লম্বা কালো আলখাল্লা। গলায় মোটা-মোটা রঙবেরঙের পাথরের মালা। তার এক হাতে প্রকাণ্ড চিমটে। চিমটেটার গোড়া রুপো আর তামার তারে বাঁধানো। ফকির ঘাটের কাছে এসে আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–কৌন হ্যায় তুম?

আমি যথাসাধ্য হিন্দিতে নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলুম। তারপর বললুম, রেশমা বেগমের ফাঁসির জায়গা আর তার কবর কোথায় তা কি আপনি জানেন? দেখিয়ে দিলে আপনাকে কিছু বখশিস দেব।

ফকির কিন্তু চটে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন,–কে চায় তোমার বখশিস? শিগগির এখান থেকে চলে যাও। না গেলে তোমার বিপদ হবে।

তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলুম, আমি সিপাহিবিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে চাই। কিন্তু ফকির আমাকে পাত্তা দিলেন না। মস্ত বড় চিমটেটা তুলে তেড়ে এলেন। চিমটের ডগা সূক্ষ্ম এবং ধারালো। বেগতিক দেখে আমি সরে এলুম।

একটু পরে দূর থেকে দেখলুম, ফকির আলখাল্লা খুলে রেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওখানে জল খুব গভীর। ফকির সেই জলে সাঁতার কাটছেন দেখে অবাক লাগল। একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফকির জল থেকে উঠে ভিজে গায়েই কালো আলখাল্লা পরে নিয়ে চিমটেসহ এগিয়ে গেলেন। তারপর ধ্বংসস্তূপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।

ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। ওঁকে অনুসরণের সাহস হল না। শুধু জায়গাটা চিনে রাখলুম। তারপর প্যালেস হোটেলে ফিরে গেলুম।

স্নান করার পর নিচের ডাইনিং হলে খেতে গেলুম। ডাইনিং হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলেন জনাচারেক বোর্ডার। ম্যানেজারের কাছে শুনেছিলুম, তাঁরা নানা জায়গা থেকে এসেছেন এবং বিত্তবান ব্যবসায়ী। সায়েব-মেমদের দলটি তখনও বাইরে থেকে ফেরেননি। পরিচারক আসলাম খান আমাকে সেলাম দিয়ে খাদ্য পরিবেশন করল। সেই সুযোগে তাকে কেল্লাবাড়ির সেই ফকিরের কথা বললুম। আসলাম খান একটু হেসে বলল,–ও তো পাগলাবাবা স্যার। ওখানে পিরের দরগা। আছে। সেখানে থাকে। একেবারে পাগল। খিদে পেলে তখন কিন্তু বেরিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় বসে শাপ দেয়, তাকে কেউ খেতে না দিলে তার বিপদ হবে। আবার খেতে দিলেও শাপশাপান্ত করে। ওকে কখনও ভয় করবেন না। শুধু বলবেন, সঙ্গে পিস্তল আছে। গুলি করে মারব। দেখবেন, তখন কীভাবে দৌড়ে পালায়। একেবারে শেয়ালের মতো কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে যাবে…

আসলামের কাছে এ কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তাই খাওয়ার পর ঘণ্টাটাক বিশ্রাম করে আবার কেল্লাবাড়িতে গেলুম। ফকির যেখানে ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে উধাও হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে সংকীর্ণ একফালি পায়ে-চলা পথ খুঁজে পেলুম। দুধারে ঝোঁপঝাড় আর পাথর। আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধার মতো পথে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় থমকে দাঁড়ালুম। সামনে একটা কাঠের বেড়া। বেড়াতে একটা ফলক আঁটা আছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, নিষিদ্ধ এলাকা। তার নিচে একটা মড়ার খুলি এবং খুলির তলায় আড়াআড়িভাবে দুটো হাড় আঁকা। এই চিহ্নের অর্থ সাংঘাতিক।

নিষেধাজ্ঞার তলায় ছোট অক্ষরে লেখা আছে, কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। ভারত সরকার।

বুঝতে পারছিলুম না কেন সরকারি পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই বিপদজ্ঞাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন।

বেড়ার ফাঁকে পা দিয়ে উঠে উঁকি মেরে ওদিকটা দেখতে পেলুম। খানিকটা ফাঁকা জমির পর নিচে গঙ্গার বুকে বালির চড়া। চড়াটা বহুদূর অবধি বিস্তৃত। বিকেলের রোদে চড়ার শেষপ্রান্তে কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ল। এবার বুঝতে পারলুম, ওই চড়ায় চোরাবালি আছে। তাই এই সতর্কতা।

কাঠের বেড়া থেকে নেমে যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে চললুম। একটু পরে দেখি, ডানদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তা চড়াইয়ে উঠে গেছে। রাস্তাটা লাল ধুলোয় ভরা। এটা কেন চোখে পড়েনি তখন?

আসলে লাল রাস্তাটা ঝোঁপের আড়ালে থাকায় লক্ষ করিনি। তা ছাড়া একটা প্রকাণ্ড চৌকো কালো পাথর রাস্তাটাকে আড়াল করেছিল। পাথরটাতে নকশার মতো আঁকা লিপি দেখে বুঝলুম আরবি হরফে কিছু লেখা আছে। তখনই ক্যামেরায় কালো পাথরটার কয়েকটা ছবি তুললুম।

তারপর পাথরের একপাশ দিয়ে এগিয়ে লাল রাস্তায় পৌঁছলুম। কিন্তু সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল ধুলোয় জুতো প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। প্যান্ট একটু গুটিয়ে নিতে হল। সাবধানে পা ফেলে একটুখানি এগিয়েছি, হঠাৎ চমকে উঠলুম। আমার প্রায় ফুটছয়েক দূরে চোখের সামনে এইমাত্র কার জুতোর ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে ভাবলুম চোখের ভুল। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, আমি আবার পা ফেলে এগোতেই আমার সামনে একই দূরত্বে বারবার আগে-পিছে জুতোর ছাপ ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হিম হয়ে গেল।

কোনও এক অশরীরী আমার সামনে হেঁটে চলেছে, এতে কোনও ভুল নেই। তার জুতোর ছাপগুলি আমার জুতোর ছাপের তুলনায় ছোট। কিন্তু কে সে?

চোখের ভুল কি না জানার জন্য দুঃসাহসী হয়ে আবার কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। আবার আমার সামনে একই দূরত্বে সেই অশরীরীর জুতোর স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল।

এবার আমার সব সাহস উবে গেল। শেষবেলার রোদে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। আমি দ্রুত পিছু ফিরে লাল ধুলোয় টলতে টলতে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলুম। তারপর বিভ্রান্তভাবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে দৌডুতে থাকলুম। একটু পরে গঙ্গার ধারে খোলা জায়গায় পৌঁছে পিছু ফিরে দেখে নিলুম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কি না।

এরপর কী করে যে হোটেলে ফিরেছিলুম, মনে পড়ে না।…

জীবনে বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ এবং দুর্গম স্থানে গেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কোথাও ঘটতে দেখিনি। হোটেলের লাউঞ্জে বসে ইশারায় একজন ওয়েটারকে ডেকে কফি আনতে বললুম।

সে কফি এনে দিল। কফি খেতে-খেতে ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় বোঝবার চেষ্টা করছিলুম। এমন সময় দেখি, লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিনস এবং টি-শার্ট। মুখে গোঁফ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হয়েও নয়, ভদ্রলোকের মুখে যেন একটা একটা বিরক্তির ছাপ এবং চোখদুটোও কুতকুতে। এরকম চেহারার মানুষ দেখলে অস্বস্তি জাগে।

ভদ্রলোক সম্ভবত প্যালেস হোটেলের লাউঞ্জে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে না পেয়ে হয়তো বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।

আমার চোখে চোখ পড়লে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর বাংলায় বলে উঠলেন, আপনি কি বাঙালি?

বললুম, হ্যাঁ।

ভদ্রলোক অমায়িক হেসে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। বললেন,–মশাই! বাঙালির চেহারা দেখলেই চেনা যায়। আমার ঠাকুরদা ওকালতি করতে আজমগড়ে এসেছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি। বাবাও ওকালতি করতেন। আমি কিন্তু ব্যবসা করি। আমার নাম অশোক রায়। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।

অশোকবাবুকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলুম, তাঁর অমায়িক হাবভাব এবং কথাবার্তা শুনে সেই ধারণা কেটে গেল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন,–কেল্লাবাড়ির ধ্বংস্কৃপের মধ্যে কোথায় কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। আমার ছেলেবেলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি।

ওয়েটারকে আবার ডেকে ওঁর জন্য কফি আনতে বললুম। তারপর অশোকবাবু আজ গড়ের পুরনো ঐতিহাসিক কাহিনি বলতে শুরু করলেন। ম্যানেজারের কাছে এসব গল্প শুনেছি। ওয়েটার কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফি খেতে-খেতে অশোকবাবু বললেন, আজ বিকেলে কলকাতা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আসার কথা। তার জন্য অপেক্ষা করে অস্থির। ছটা বেজে এল। সে এল না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, আর সে আসবে না। না আসুক। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী যে আনন্দ পেলুম, বোঝাতে পারব না। তা আপনি হোটেলে থাকবেন কে? খামোকা একগাদা টাকা খরচ! বরং আমার অতিথি হোন। আপনাকে দেখলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুব খুশি হবে।

এত অন্তরঙ্গতার পর বিকেলে কেল্লাবাড়ির ভেতরে সংকীর্ণ লাল রাস্তায় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তা অশোকবাবুকে না বলে থাকতে পারলুম না।

অশোকবাবু ঘটনাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ঐতিহাসিক পণ্ডিত। ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকেন। বাস্তব জগতে ভুলভাল দেখা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। দেখুন মশাই! আমি কত রাতদুপুরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও কিচ্ছু দেখিনি। হ্যাঁ–ওখানে এক পাগলা ফকির থাকে। আমাকে দেখলেই সে লেজ তুলে পালিয়ে যায়। তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন?

বললুম,–হ্যাঁ। দুপুরে ফকিরকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখেছি। আমাকে সে ভয় দেখাচ্ছিল।

অশোকবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পরশু দোলপূর্ণিমা গেছে। আজ কিছুক্ষণ পরে সঁদ উঠবে। কোনও ভয়ের কারণ নেই। আমার সঙ্গে কেল্লাবাড়িতে চলুন। দেখবেন, কোনও অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে না। আর পাগলা ফকিরের ডেরাতেও আপনাকে নিয়ে যাব। দেখবেন, আমাকে দেখে ব্যাটাচ্ছেলে কী করে।

এতক্ষণে সায়েব-মেমদের দলটি এসে পড়ল। অন্যান্য বোর্ডাররাও ততক্ষণে এসে গেছে। কেউ লাউঞ্জে, কেউ ডাইনিং হলে ঢুকে চা-কফি খাচ্ছে। অশোকবাবু বললেন, চলুন! জ্যোৎস্নারাতে আজমগড়ের গঙ্গার ধারে বসে গল্প করা যাবে। তারপর সেই লাল রাস্তায় যাব। আমার কাছে টর্চ আছে। আপনাকে আমি রেশমা বেগমের কবরও দেখিয়ে দেব। উঠে পড়ুন।

একটু অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে অশোকবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলুম। তারপর মনে হল, ইনি বাঙালি এবং এখানেই বড় হয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর বলিষ্ঠ গড়ন দেখেও শেষপর্যন্ত ভয়টুকু ঘুচে গেল…

কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকে গঙ্গার ধারে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি দুজনে বসলুম। অশোকবাবু কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে নিচ্ছিলেন। বহুবছর তার কলকাতা যাওয়া হয়নি।

কিছুক্ষণ পরেই চাঁদ উঠল। জ্যোত্সায় গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আর ধ্বংসস্তূপ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অশোকবাবু বললেন, আপনি যে লাল রাস্তাটা দেখেছিলেন, ওর পাশেই নাকি ইংরেজরা বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়েছিল। তবে আপনি যে অশরীরী জুতোর ছাপ দেখার কথা বললেন, ওটা চোখের ভুল। ওই রাস্তা দিয়ে পাগলা ফকির যাতায়াত করে। আপনাকে আড়াল থেকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যাটা নিশ্চয় কোনও কারচুপি করেছিল। এও হতে পারে পুরু ধুলোর তলায় লম্বা কোনও জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। তার ওপর আপনি পা ফেললেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে ধুলো ঠেলে তুলবে। স্রেফ ম্যাজিক! চলুন। পরীক্ষা করা যাক।

অশোকবাবু আমার হাত ধরে ওঠালেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললুম, কিন্তু আমি সত্যি জুতোর ছাপ দেখেছিলুম।

আরে মশাই! আমি তো সঙ্গে আছি আসুন না। বলে অশোকবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। আমার কাঁধে তার হাত চেপে বসল।

জ্যোৎস্নার জন্য ধ্বংসস্তূপের চকরাবকরা ছায়ার ভেতর দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে চললেন। একটু পরে দেখলুম, সেই আরবি লিপি খোদাই করা কালো পাথরটার কাছে এসে গেছি! অশোকবাবু টর্চের আলো ফেলে বললেন,–চলে আসুন। দেখা যাক কী হয়।

সংকীর্ণ চড়াই রাস্তায় কিছুটা উঠে টর্চের আলো ফেলে অশোকবাবু বললেন, কই? কোনও ভুতুড়ে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?

বললুম,–এখন পাচ্ছি না। কিন্তু–আমার কথা থেমে গেল। এরপর যা ঘটল তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে অশোকবাবু আমার কানের নিচে শক্ত এবং ঠান্ডা কী একটা জিনিস ঠেকিয়ে চাপা গর্জন করে বললেন,–টুঁ শব্দটি নয়। ট্রিগারে আঙুল আছে। একটু চাপ দিলেই তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে। আগে ক্যামেরাটা দাও। হ্যাঁ–তারপর রিস্টওয়াচ। আর মানিব্যাগটা বের করো।

মুহূর্তে আমি টের পেয়ে গেছি, এক ভদ্রবেশী গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছি। হোটেলের ম্যানজার মিঃ ঠাকুর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন কেন, এতক্ষণে তার মর্ম বুঝতে পারলুম। সেই ফকিরও হয়তো আমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। ক্যামেরাটা গলা থেকে ঝুলছিল। সেটা হাতে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, দয়া করে এটা নেবেন না। মানিব্যাগে হাজারখানেক টাকা আছে। তা নিন। ঘড়িটাও নিন। কিন্তু ক্যামেরায় লোড করা ফিল্মে অনেক ছবি আছে। দয়া করে অন্তত ফিল্মের রোলটা বের করে নিতে দিন আগে।

অশোকবাবুরূপী দুবৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্রের নল আমার কানের নিচে আরও চেপে হিসহিস করে বলে উঠল, চুপ! শিগগির! আর একটা কথা বললে তোমার লাশ পড়বে। আর সেই লাশের কথা কেউ জানতেও পারবে না। কারণ তোমার লাশ আমি চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আসব। চোরাবালিতে তোমার মতো কত লাশ আমি ফেলে দিয়ে এসেছি। সব তলিয়ে গেছে।

বলেই সে ধমক দিল,–আবে জলদি কর!

এতক্ষণে মনে হল, লোকটার মাতৃভাষা বাংলা নয়। তার বাংলা কথাবার্তায় কেমন যেন একটু হিন্দির টান ছিল। কিন্তু এবার ডান কানের নিচে ব্যথা পেয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিলুম। তারপরই আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা শপাং করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপর দেখলুম, দুবৃত্তটার হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়ল এবং সে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।

তারপর আবার শপাং করে প্রচণ্ড শব্দ হল। গুণ্ডাটা লাল ধুলোয় গড়াতে শুরু করল। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। কোনও অশরীরী অদৃশ্য চাবুক মেরে চলেছে তাকে। সে একবার কাত হচ্ছে। একবার উপুড় হচ্ছে। হাঁটু মুড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারপরই সেই প্রচণ্ড শব্দ এবং তার মুহুর্মুহু আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখছি, লোকটার গায়ের টি শার্ট ফালাফালা হয়ে কালো কালো ক্ষতরেখা ফুটে উঠছে।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লাল ধুলোভরা রাস্তায় নোকটা ক্রমাগত গড়াচ্ছে এবং তার গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে শুধু। অশরীরীর চাবুকের শব্দ ক্রমশ প্রচণ্ডতর হয়ে উঠছে।

লাল ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবার। তার আড়ালে চাবুকের ক্রমাগত শব্দ আর গোঙানি শুনতে-শুনতে একসময় আমার চেতনা ফিরে এল। তখনই দৌড়ে নেমে এসে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরোলাম। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ভোলা জায়গায় ছুটে চললুম।

কেল্লাবাড়ির ভাঙা ফটকের কাছে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে হোটেলে ফিরে চললুম। না, কাউকে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলা উচিত হবে না…

রাতে ডিনার খাইনি। ম্যানেজার খবর নিতে এসেছিলেন আমার রুমে। বলেছিলুম,–ঘুরে-ঘুরে খুব ক্লান্ত। খিদে নেই।

সারারাত যতবার ঘুম এসেছে, চমকে উঠেছি। আবার বুঝি কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। ভোর ছটায় আসলাম খান বেড-টি আনল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, খবর আছে স্যার! সুখবর। তাই বলা উচিত মনে হল।

বললুম, কী সুখবর আসলাম?

সে বলল,–আজমগড়ে একজন সাংঘাতিক গুণ্ডা ছিল। তার নাম কাল্প। সে আমাদের হোটেলে এসেও ম্যানেজারসায়েবের কাছে টাকা দাবি করত। কাল সন্ধ্যার আগে সে নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। ওয়েটার রমেশ দেখেছে। কিন্তু আপনাকে সাবধান করার সুযোগ পায়নি।

–কিন্তু সুখরবটা কী?

কাক্কু গুণ্ডাকে কে বা কারা রাত্রে মেরে কেল্লাবাড়ির ভেতরে লাশ ফেলে এসেছে। পাগলা ফকির খুব ভোরে সেই লাশ দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। আশ্চর্য ঘটনা স্যার, তার পিস্তল আর টর্চটা সেখানেই পড়ে ছিল।

–আচ্ছা আসলাম! কাল্লু কি বাঙালি ছিল?

–না স্যার। তবে সে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারত। কলকাতাতে নাকি তার ছোটবেলা কেটেছিল। স্কুলেও পড়েছিল। তাই বাংলাও বলতে পারত। আজমগড়ে বাঙালি আছে। তারা তো কাল্লুকে বাঙালি বলেই মনে করত। কাম্পু কখন কোন রূপ ধরত, চেনা কঠিন হতো।

–কাল্লুর লাশ কি পুলিশ নিয়ে গেছে?

–শুনলুম একটু আগে মর্গে নিয়ে গেছে। কাল্পর সারা শরীর নাকি রক্তে লাল।

ব্রেকফাস্টের পর সাড়ে নটায় আমি এবার সাহস করে কেল্লাবাড়িতে গেলুম। আমার মনে হচ্ছিল, কাল বিকেলে যে অশরীরীর জুতোর ছাপ আমার সামনে রাঙা ধুলোয় ফুটতে উঠতে দেখেছি, সেই ছদ্মবেশী অশোক রায় নামধারী দুবৃত্ত কাল্পর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। মনে-মনে তার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানালুম।

এবার নির্ভয়ে সেই কালো পাথরের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ লাল ধুলোভরা রাস্তায় পৌঁছলুম। চড়াই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আর সেই জুতোর ছাপ সামনে ফুটে উঠল না। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। নিচে নেমেই ঘন গাছপালার ভেতর সারসার কয়েকটা কবর দেখলুম। তারপর লাল পাথরের একটা কবর দেখে এগিয়ে গেলুম। সেই কবরের শিয়রে একটা রক্তকরবীর গাছ। কবরে লাল ফুল ঝরে পড়েছে। আমি বহুকাল আরবি লিপির ফলক দেখে-দেখে লিপি বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলুম। আরবিতে তিনটি হরফ চেনামাত্র বুঝতে পারলুম এটাই সেই সিপাহিবিদ্রাহীদের নেত্রী শাহজাদি রেশমা বেগমের কবর, যাঁর ডাকে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।

হঠাৎ আমার মাথায় কথাটা এসে গেল। তা হলে কি রেশমা বেগমের অতৃপ্ত আত্মাই আমাকে কাল বিকেলে পথ দেখিয়ে তার কবরের কাছে আনতে চেষ্টা করেছিল? সেই রেশমা বেগমের আত্মাই কি দুবৃত কাল্লুকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছিল?

শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়ল। পাশের একটা লাল ফুলের গুচ্ছ ডাল থেকে ভেঙে বিদ্রোহিনীর কবরে রেখে মাথা ঠেকালুম। সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধ একটা হাওয়া ভেসে এল। সেই হাওয়ায় যেন পুরোনো ইতিহাসের সুঘ্রাণ টের পেলুম। মনে-মনে বললুম, প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়িকা বীরাঙ্গনা তুমি! তোমার জীবনকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।

এই সময় পাগলা ফকির এসে গেল। অট্টহাসি হেসে সে বলল,–বাবুজি! আপকা উপ্লর রেশমা বেটি বহত খুশ যায়। তো আব আপ তুরন্ত হিয়াসে চলা যাইয়ে। রেশমা বেটিকো একেলা রহনে দিজিয়ে। বেটি জিন্দেগিমে বহত দুখ পায়ি। বহত দুখসে মর গেয়ি বেটিয়া!

তখনই নিঝুম কবরখানা থেকে চলে এলুম। ইতিহাসে এইসব আশ্চর্য ঘটনা লেখা যাবে না। সেগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনেই থেকে যাক।

হ্যাঁ–সেই অদ্ভুত ঘটনা এতদিন কাকেও বলিনি। এখন আমি বৃদ্ধ। মৃত্যুর আগে ঘটনাগুলি লিখে যাওয়া উচিত মনে করেই লিখে ফেললুম। এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমি নিরুত্তর থাকব।…

আধি ভৌতিক

জগনমামা বললেন, তাহলে বাবা ঝন্টু ততক্ষণ তুমি মামিমার সঙ্গে গল্পসল্প ( করো। আমি ঝটপট বাজারটা সেরে আসি।

বলে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে ডাকলেন, কই গো। ছাতিটা দাও বরং! এই সাতসকালেই রোদ্দুরটা বড় চড়ে গেছে।

জগনমামার মাথায় এমন প্রকাণ্ড টাক আমি আশা করিনি। এতকাল পরে ওঁকে দেখে খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। চেহারায় কী দারুণ অদলবদল না ঘটে গেছে। রোগা খটমটে চেহারার মানুষ ছিলেন। এখন বিশাল পিপে হয়ে উঠেছেন। মুখে এমন অশান্ত হাসিও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই মফস্বল শহরে এখন ওঁর উকিল হিসেবে বেজায় নামডাকও হয়েছে এবং তার কারণ সম্ভবত ওঁর চেহারার এই ভোলবদল। আগে ওই শুটকো চেহারা আর খিটখিটে মেজাজের জন্যে মক্কেল যেমন জুটত না, তেমনি হাকিমরাও নাকি ওঁকে এজলাসে দেখলে চটে যেতেন। অবিশ্যি, সবই শোনা কথা।

এও শোনা কথা যে জগনমামার স্ত্রী আত্মহত্যাই করেছিলেন। কৌশলে কলেরায় মৃত্যু বলে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। উকিল-মানুষদের তো পেটে-পেটে

বুদ্ধি।

বলে রাখা ভালো, জগনমামা কস্মিনকালে আমার মামাকুলের কেউ নন। ছেলেবেলায় আমার বাবা-মারা যান। পাড়াগাঁয়ে সম্পত্তি রাখার নানা ঝামেলা। মামলা মোকদ্দমার দায় সামলাতে হতো তাই মাকেই। সেই সুবাদে এই উকিল ভদ্রলোক মায়ের দাদা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবে পেলাম না জগনমামার মতো উকিল কেন ধরেছিলেন মা! তখন আরও কত জাঁদরেল উকিল এ শহরে তো ছিল। মামলায় হেরে গেলেও দেখতাম ফের এই ভদ্রলোকের কাছে এসে পড়েছেন।

হয়তো এটাই মানুষের অভ্যাস। চেনা-জানা ডাক্তারের হাতে মরতেও রাজি যেমন, তেমনি উকিল-মোক্তারের বেলাও তাই।

এখন মা নেই। আমি বিষয়সম্পত্তির হাল ধরেছি। আমি সেই একই অভ্যাসে এসে জুটেছি জগন-উকিলের দরজায়। মামলায় হার-জিত-ভবিষ্যতের কথা–ছোটবেলা থেকে যাঁকে মামা বলে জানি, তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালে মনের জোর ভীষণ বেড়ে যায়।

তবে তার চেয়ে বড় কথা, জগনমামার এখন নাকি নামডাক হয়েছে। কাজেই আমার মনের জোর অনেক বেশি করেই বেড়েছে। আজ রোববার। আগের দিন ও রাত্তিরটা জগনমামার বাড়ি কুটুম্বিতা এবং শলাপরামর্শ করা যাবে বলেই আসা। আগামীকাল ফার্স্ট আওয়ারে কেস ঠোকা যাবে।

বুঝতে পারছিলাম, জগনমামা আবার বিয়ে করেছেন। তবে অবাক হচ্ছিলাম নতুন মামিমা একবারও ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না দেখে। ভেতরের বারান্দার একটা চেয়ারে আমি বসে আছি। জগনমামা ওপাশের কিচেন থেকে চা এনেছেন। চায়ের খালি কাপ প্লেট-উনি রেখে এসেছেন। মামিমার পাত্তা নেই। জগনমামা ওঁর উদ্দেশে কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু কোনও সাড়া আসছে না।

তাই ভাবছিলুম, একটা দাম্পত্য কলহ-গোছের কিছু ঘটে থাকবে। নাকি মামিমা ঠাকুরঘরে পুজোয় বসে আছেন?

জগনমামা ছাতি চাইলেন। তবু মামিমার সাড়া এল না। তখন জগনমামা মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে উঠোন থেকে বারান্দায় উঠলেন। তারপর তির খোঁজে ঘরে ঢুকলেন। ঘর থেকে ওঁর চাপা গলা শুনতে পেলাম। একটু পরে বেরিয়ে এলেন ছাতি হাতে। মুখে অশান্ত কথাবার্তা-হাসি। বললেন, তাহলে গল্পসল্প করো তোমরা। আমি ঝটপট ফিরব।

উনি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওদিকটায় আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শর্টকাট পায়ে চলার পথ আছে। গিয়ে উঠেছে বাজারের চওড়া রাস্তায়। এদিকটা একেবারে নিরিবিলি নিঃঝুম জায়গা। আশেপাশে বাড়ি বিশেষ নেই। গঙ্গার ধারে শহরের একপ্রান্তে এই বাড়িটার বয়স প্রাচীন। একটু তফাতে হাসপাতাল এলাকা, অন্য দিকটায় গঙ্গার পাড়ে বনজঙ্গলের সঙ্গে সাজানো ঘন বন। ভাঙন আটকাতেই ওই নিরামিষ জঙ্গল, জগনমামার ভাষায় নৈমিষারণ্য।

বাড়ি একেবারে চুপচাপ। গ্রীষ্মের এই সাতসকালে গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এল শনশনিয়ে। হাওয়াটা খিড়কির দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে বই-বাই করে ঘুরতে থাকল। তারপর পাঁচিলের ধারে জবা ও শিউলির ঝোপে হুলুস্থুল করে পটাপট কিছু হলুদ পাতা ছিঁড়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল। এই সময় আমার মনে পড়ল যেদিকে হাওয়াটা গেল সেদিকটায় শ্মশানঘাট এবং একটু পরে সেই উঁচু বটগাছের মাথায় ঝাঁকুনি লাগল!

কিছু করার না থাকলে আমার উদ্ভট সব অনুভূতি জাগে। হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা মামির অর্থাৎ জগনবাবুর প্রথম স্ত্রীর কথা। আত্মহত্যা করলে মানুষ নাকি ভূত হয়। এমন নিরিবিলি বাড়িতে ভূতের পক্ষে হামলা করা ভারি সহজ। পুরোনো মামিমার ভূত নতুন মামিকে জ্বালায় না?

কে জানে কেন, এ বাড়িতে রাতে থাকতে হবে ভাবতেই এবার অস্বস্তি জাগল। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ভূতের ভয় আমার বেজায় রকমের।

একটু কাশলাম। ভেতরের ঘর একেবারে চুপচাপ। সিগারেট টানতে থাকলাম। জগনমামা বলছিলেন, সব সময় খালি তোদের গল্প করি। তোর মায়ের মতো মহীয়সী মেয়ে তো আর হয় না। আর এই টুকুন ছিলি জানিস বাবা ঝন্টু? এই অ্যাটুকুন। আর কী ভীতু কী ভীতু।

এত সব যদি শুনে থাকেন ভদ্রমহিলা, তাহলে আমাকে দেখার জন্যে বেরুলেন না কেন কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।

সিগারেট শেষ করে বাড়ি ঢুকে চমকে উঠলাম। কোথা থেকে একটা নেড়ি কুকুর ঢুকে পড়েছে যে। বারান্দায় গিয়ে ভেতরের ঘরের পর্দার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠলাম, মামিমা! কুকুর ঢুকছে। কুকুর!

তবু সাড়া নেই দেখে দৌড়ে এলাম। কুকুরটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল। লাথি খেয়ে কেঁউ-কেঁউ করে উঠল এবং ডিগবাজি খেতে-খেতে উঠোনে গিয়ে পড়ল। তারপর লেজ গুটিয়ে পালাল।

পর্দা তুলে উঁকি মেরে ডাকলাম, মামিমা! কিন্তু ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। সেকেলে পালঙ্কের ওপর জগনমামার লুঙ্গি পড়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকালাম। এক গুচ্ছের স্নো-পাউডার ইত্যাদি যথারীতি সাজানো। ওপাশে আলনায় কয়েকটা শাড়ি ও সায়া পর্যন্ত। সেগুলো অত ময়লা কেন ভেবে পেলাম না।

কিন্তু ঘরে একটা মেয়েলি গন্ধ টের পাচ্ছিলুম। আবছা মনে হল, মামিমার বয়স নিশ্চয় জগনমামার তুলনায় ঢের কম। মেয়েলি গন্ধটা কি চুলের? স্নানের পর মেয়েদের চুলের এমন গন্ধ হয়। একটু লজ্জা পেলাম! এ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ভদ্রমহিলা ওপাশে কোথাও আছেন। এসে গেলে অপ্রস্তুতের একশেষ হবে।

বেরিয়ে আসার আগে ড্রেসিং টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে চোখ পড়ল। পুরুষ ও মহিলার ছবি পাশাপাশি। কিন্তু চিনতে পারলাম না। শুধু দেখলাম, যুবতী মহিলাটি কেমন চোখে তাকিয়ে হাসছেন।

ঠিক এইসময় বাইরে জগনমামার সাড়া পেলাম।…বহু ভাগ্যে দুটো গলদা পেলাম, বুঝলে? মোট দুটো। থাকগে। এতেই হবে। আর ইয়ে, শানোর ছাই! ভুলে গেলাম যে!

ঝটপট বেরিয়ে শুনলাম, মামিমার গলা,–এ অসময়ে ওদের বাড়ি না গেলে চলত না? ঝটপট ফিরে এসো তাহলে। অবিশ্যি আজ রোববার। বেলা করেই খাওয়া যাবে।

নতুন মামিমা তাহলে কিচেনে ছিলেন।

ঘুরে জগনমামা একগাল হেসে বললেন,–এই যে ঝন্টু। আলাপ হল মামিমার সঙ্গে? গল্পের রাজা! থুড়ি রাণি! রাণি আর তুমি তো বরাবর ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসতে! এখন অবিশ্যি বড় হয়েছ। তাহলে মন্দ লাগবে না। কী বলো।

বলে চোখ নাচালেন,–রাত্তিরে শুনবেখণ…

বাইরের ঘরে জগনমামার ওকালতির আপিস। আজ ছুটির দিন বলে বুঝি ওঁর মুহুরিবাবু আসেননি। সেই ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বাইরে রোদ বেড়েছে। এখনই লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চারপাশে শুধু গাছপালার শনশন আর গঙ্গায় নাইতে যাওয়ার সরু গলিপথে আবর্জনার ঝড় বইছে শোঁশো করে। ভেতর থেকে জগনমামার কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। নতুন মামিমার সঙ্গে অনর্গল কথা বলছেন। ভদ্রমহিলাকে ভারি অদ্ভুত বলব। সম্ভবত শুনেই যাচ্ছেন মুখ বুজে।

আর কৌতূহল সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হল। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম। জগনমামা কিচেনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেবিলে তরকারি কুটছেন এবং কথা বলছেন। কিচেনের দরজা সামনাসামনি। ভেতরে কেরোসিন কুকার জ্বলছে। রান্না হচ্ছে। কিন্তু নতুন মামিকে দেখা যাচ্ছে না।

মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার সাড়া পেয়ে জগনমামা হেসে বললেন, এসো বাবাজি! তোমার মামিমাকে বলছিলাম, ঝন্টু তো পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বিশুদ্ধ জলবায়ু আর নির্ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ হয়েছে। এ ভূতের জায়গায় অখাদ্য কি ওর রুচবে?

বলেই ভেতরের সেই ঘরের দিকে তাকালেন।…তোমার অত কেন লজ্জা বলল তো? ঝন্টু বলতে গেলে আমার আপন ভাগনে। এসো। কই? বেশ, এসো না। ফিরে গিয়ে তোমারই বদনাম করবে! অচেনা তো নয়। সেই ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছ। বড় হয়েছে বলে লজ্জা! আশ্চর্য!

আপন মনে ফের গজগজ করতে থাকলেন।…তোমার এই একরোখামিই যত সর্বনাশের গোড়া।

আমি হকচকিয়ে গেছি ততক্ষণে। ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছে–এর মানে কী? তাহলে কি নতুন মামিমা আমার চেনাজানা কোনও মহিলা? জগনমামার হাবভাব দেখে কোনও কথা জিগ্যেস করতে সাহস হল না! বুঝলাম, আমার খুব পরিচিত মহিলাকেই বিয়ে করেছেন জগনমামা। এত পরিচিত যে মুখোমুখি হলে নিশ্চয়ই দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই উনি দেখা দিচ্ছেন না। খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। খুঁজেই পেলাম না, তেমন কে হতে পারেন নতুন মামিমা।

দুপুরে খাওয়ার সময়ও উনি এলেন না। জগনমামার মুখ গম্ভীর। সেটা খুবই স্বাভাবিক। টেবিলে সবই সাজানো ছিল! দুজনে চুপচাপ খেলাম। খাওয়া হলে জগনমামা বললেন,–ওপরে গিয়ে ঘুমিয়ে নাও। সাড়ে পাঁচটার আগে উঠো না। গরম কমলে বরং ঘুরে এসো গঙ্গার ধারে।

লম্বা হয়ে গেল ঘুমটা। উঠে দেখি টেবিলে চা ঢাকা আছে। নতুন মামিমা এসে দিয়ে গেছেন কি? বোধহয় জগনমামাই। বাড়ির ভেতর চুপচাপ। চা জুড়িয়ে গিয়েছিল। কল্পনা করলাম, নতুন মামিমা চা রেখে গেছেন, এবং আশ্চর্য, সেই মিষ্টি মেয়েলি গন্ধটা অবিকল টের পেলাম।

দরজা ভেজিয়ে গলিরাস্তায় গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেলাম। ঘণ্টা দুই পরে যখন ফিরে এলাম, তখন এদিকটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। লোডশেডিং। দরজা বন্ধ থাকবে ভেবেছিলাম। কিন্তু কড়া নেড়ে সাড়া না পেয়ে ঠেলতেই দেখি, তেমনি খোলা। ভেতরে ঢুকে ডাকলাম, জগনমামা।

সাড়া এল,–আয় ঝন্টু। এখানে আয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন জগনমামা কালো মূর্তিটি হয়ে। আলো নেই বাড়িতে। বললাম, আলো জ্বালেননি যে!

জগনমামা বললেন, অন্ধকার ভালো লাগে। আয় এখানে আয়। কী গো! এখন তো ঝন্টু তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না, এবার কথা বলবে না কী? অ ঝন্টু, মামিমার সঙ্গে কথা বল।

ডাকলাম,–মামিমা। তারপর টের পেলাম অন্ধকার উঠোনে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি শুধু আমি আর জগনমামা। হঠাৎ কেমন গা ছমছম করে উঠল। বললাম, জগনমামা, মামিমা কই?

এই তো! দেখতে পাচ্ছিস না? জগনমামা অস্বাভাবিক গলায় বললেন, কই গো, ঝন্টুকে ছুঁয়ে দাও তো! আহা দাও না বাবা! বলতে গেলে আপন ভাগ্নে ছোটবেলায় কত আদর করেছ!

অদ্ভুত হাসি হেসে জগনমামা আমার একটা হাত টেনে অন্য হাতে অন্ধকারে অদৃশ্য মামিমার হাত টানার ভঙ্গি করতেই আমার মাথা ঘুরে গেল এবং আচমকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক লাফে বারান্দা থেকে বাইরের ঘরে–তারপর ব্যাগট্যাগের কথা ভুলে দড়াম করে দরজা খুলে গলিতে গিয়ে পড়লাম। জগনমামা যে একজন বিদেহিনী স্ত্রীলোক নিয়ে ঘর করছেন, এতে আর সন্দেহ ছিল না।

.

মাস দুয়েক পরে একদিন শহরে গেছি। ব্যাগটা নিয়ে আসতে তো বটেই। জগনমামার অবস্থা দেখতেও তীব্র কৌতূহল হল। নিরিবিলি জায়গায় পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়িটা দেখে একটু গা ছমছম করছিল। কিন্তু দিনদুপুরে আশা করি আর ভূতের ভয়টা পাব না।

দরজায় কড়া নাড়ার পর খুলল। খুলতেই আমার বুকের ভেতর রক্ত চড়াৎ করে উঠল। হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার এক সুন্দরী মহিলা দরজার পাল্লায় হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন। যেই হাসিখুশি মুখে বলছেন,-কাকে চাই, অমনি আমি পিছিয়ে এসেছি। আর লাফ দিয়েই–

ইনিই যে সেই নিরাকার মামিমা, যাঁর সঙ্গে জগনমামা অনর্গল কথা বলতেন এবং যিনি আত্মহত্যা করে মারা যান, তিনি ছাড়া আর কে হতে পারেন? ভুল হয়েছে বলে আমি হনহন করে চলে এলাম, পা টলছিল। একবারও পিছু ফেরার সাহস হল না। নিরাকার আকার ধরেই সমস্যা।

কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া রহস্যময়। তবে এটুকু মনে পড়ছে, পেছনে জগনমামার যেন চিৎকার শুনছিলাম ঝন্টু ও ঝন্টু! চলে যাচ্ছিস কেন? তোর নতুন মামিমার সঙ্গে আলাপ করে যা! কানের ভুল হতেও তো পারে। নতুন শব্দটা কি সত্যি শুনেছিলাম…?

 আম কুড়োতে সাবধান

ফুটবলম্যাচ দেখতে যাব বলে সেজেগুজে তৈরি হচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে এসে বাধা দিল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন অবস্থাটা আরও সাংঘাতিক করে ফেলল। মনমরা হয়ে বসে রইলুম।

সন্ধ্যার দিকে ঝড়বৃষ্টির দাপট যখন কমে গেল, তখন দেখলুম ছোটমামা কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছেন। একটু পরে পোশাক বদলে একটা লণ্ঠন জ্বেলে ছোটমামা ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দেখে বললেন,–এ কী রে পুঁটু? তুই অন্ধকারে ভূতের মতো বসে আছিস যে?

বললুম, ধুস! ফুটবলম্যাচ পণ্ড হয়ে গেল।

ছোটমামা টেবিলে লণ্ঠন রেখে বললেন,-তাতে কী হয়েছে? যে আমার ঝাঁপুইতলা বনাম কঁকুড়হাটির খেলা! ও খেলা কি দেখার যোগ্য?

বলে উনি ফিক করে হসলেন। চাপাস্বরে ফের বললেন,–চল। বেরিয়ে পড়ি।

একটু অবাক হয়ে বললুম,–কোথায়?

ছোটমামা আরও চাপাস্বরে বললেন,–ফেরার সময় শর্টকাটে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ দিয়ে এলুম। বললে বিশ্বাস করবিনে পুঁটু, ঝড়বৃষ্টির চোটে বাগানের সব আম পড়ে গেছে। এই জষ্টিমাসের আম। বুঝলি তো? সবই গাছপাকা।

–অন্ধকারে কী করে দেখতে পেলেন ছোটমামা?

তুই একটা বোকর বোকা!–ছোটমামা একটু চটে গেলেন।–বিদ্যুতের ছটায় দেখলুম না? সারা বাগানের তলায় পাকা আম ছড়িয়ে আছে। চল। কুড়িয়ে আনি।

–কিন্তু ছোটমামা, বাগানে ভোলা আছে যে! ভোলা সাংঘাতিক লোক। ভোঁদা বলছিল, সিঙ্গিমশাই ভোলাকে নাকি তাঁর বন্দুকটা দিয়েছেন। দেখতে পেলেই

আমার কথায় বাধা দিয়ে ছোটমামা বললেন,–ভোঁদা তোর চেয়েও বোকা। সিঙ্গিমশাই বন্দুক দেবেন ভোলাকে ভোলা বন্দুক ছুঁড়তে জানে? তা ছাড়া বন্দুকটা বাড়িতে না থাকলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়িতে ডাকাত পড়বেই পড়বে, তুই জানিস? ওঠ। দেরি করা ঠিক নয়।

দোনামনা করে বললুম,–বন্দুক না পেলেও ভোলা খুব সাংঘাতিক লোক ছোটমামা! ওর গোঁফ আর চোখদুটো দেখলেই ভয় করে।

ছোটমামা আমার কথায় কান দিলেন না। কোত্থেকে একটা চটের থলে আর টর্চ নিয়ে এলেন। বললেন,-ভোলা এতক্ষণ খেতে গেছে। চলে আয়। আর শোন। জুতো খুলে ফ্যাল। খালি পায়ে যাব।

সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানটা গ্রামের শেষে মাঠের ধারে। বাগানের মধ্যিখানে একটা মাচার ওপর ছোট্ট ছাউনি আছে। ভোলা সেখানে বসে বাগান পাহারা দেয়। সে দারুণ ধূর্ত লোক। বাগানের আনাচে-কানাচে কেউ পা বাড়ালে কী করে সে টের পেয়ে যায় কে জানে! টের পেলেই এমন হক ছাড়ে যে পিলে চমকে যায়। গতমাসে কচি আম কুড়ানোর জন্য ভোঁদার সঙ্গে গিয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলুম!

আমি তো দিশেহারা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলুম। ওদিকে ভোঁদা ওর হাতে ধরা পড়ে সে এক কেলেঙ্কারি! ভোঁদাকে শাস্তিটা অবশ্যি দিয়েছিলেন ভোঁদার বাবা হাবুলবাবু! পাড়াসুদ্ধ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবোস করানোর শাস্তি-ঘ্যা-ছা! ভেঁদা কিছুদিন বাড়ি থেকে লজ্জায় বেরুতে পারেনি। স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা।

সেই কথা ভেবে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু ছোটমামার অবাধ্য হওয়ার সাহসও আমার নেই। তাছাড়া ছোটমামা না থাকলে কে আমাকে শহরে কিংবা গঞ্জের মেলায় নিয়ে যাবে? পৃথিবীতে সবসময় কোথাওনা-কোথাও কত সুন্দর সব ঘটনা ঘটছে। ছোটমামা না নিয়ে গেলে আমি একা সেসব দেখতেই যে পাব না।

সন্ধ্যার অন্ধকার আজ বেজায় গাঢ়। আকাশের কোণায় দূরে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক। চারদিকে ব্যাঙ, পোকামাকড় তুলকালাম গান জুড়ে দিয়েছে। সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানের দিকে যত এগোচ্ছি, তত অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছে। ছোটমামা পায়ের কাছে সাবধানে টর্চের আলো ফেলে হাঁটছেন। তাঁর পেছনে থলে হাতে আমি হাঁটছি। কতক্ষণ পরে ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললেন, ভোলার কুঁড়েঘরটাতে লণ্ঠন জ্বলছে বটে, তবে বাজি রেখে বলতে পারি, ব্যাটাচ্ছেলে নেই।

–কী করে বুঝলেন ছোটমামা?

–দিঘির পাড়ে টর্চের আলো দেখলুম না? ভোলা ওখান দিয়েই তো খেতে যায়।

–ভোলার টর্চ আছে বুঝি?

–থাকবে না? তুই বড্ড বোকা পুঁটু! রাতবিরেতে টর্চ ছাড়া কেউ বাগানে পাহারা দিতে পারে? তবে আর কথা নয়। আয়, তোকে বাগানের শেষ দিকটাতে একখানে বসিয়ে রাখব আর আমি আম কুড়িয়ে আনব। চুপচাপ বসে থাকবি কিন্তু!

ছোটমামা কথাটা বলতে গিয়ে পারলুম না। ভোঁদা বলেছিল, ওই বাগানের কোন গাছে কবে কে নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। আর ভূতটা এখনও আছে। তবে সে ভোলার ভয়ে বেরুতে পারে না। ভোলা বাগানে না থাকলে তবেই সে বেরিয়ে এসে লোকেদের ভয় দেখায়।

তো ছোটমামা ধমক দিলেন চাপাগলায়। চুপ! খালি ছোটমামা আর ছোটমামা! –বলে এবার আমাকে প্রায় টানতে-টানতে নিয়ে চললেন। জলকাদা জমে আছে ঘাসের ফাঁকে। পা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। প্রতিবারই ধমক খাচ্ছি। টর্চের আলোর দিকে চোখ রেখে হাঁটতে হচ্ছে।

ঠিক কথা। আসলে আমি সেই ভূতটার কথা ভেবে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিলুম। ভোলা যে এখন বাগানে নেই। কিছুক্ষণ পরে ছোটমামা আমাকে জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন,–তুই এইখানে বসে থাক। আমি গাছপাকা আম ছাড়া কুড়োব না। ওই দ্যাখ, কত পাকা আম।

টর্চের আলোয় হলদে কয়েকটা আম দেখতে পেয়েই আমি ভূতের ভয়টা ভুলে গেলুম। এইসব আম নাকি সেরা জাতের আম। একটুও আঁশ নেই। একেবারে ক্ষীরের সন্দেশের মতো নাকি স্বাদ।

থলে নিয়ে ভিজে ঘাসে বসে থাকা যায় না। তাই উঠে দাঁড়ালুম। ছোটমামা এদিক-ওদিক টর্চের আলা ফেলে পাকা আম কুড়িয়ে আনছেন। মিঠে গন্ধে আমার মুখে জল আসছে। কিন্তু এখন কি আম খাওয়ার সময়?

থলে প্রায় অর্ধেক ভরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ছোটমামা বললেন,–এবার আমি যাচ্ছি বাতাসাভোগ গাছটার কাছে। খাসা আম! বুঝলি পুটু? তুই চুপচাপ বসে থাক। তবে কান খাড়া রাখবি কিন্তু! ভোলা বাগানে আসার সময় গান গাইতে গাইতে। আসে। শুনতে পেলেই তুই ডাকবি।

ছোটমামা টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে আমগাছের অজস্র গুঁড়ির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কোনও গাছের মাথায় একটা পাখি ডানার জল ঝাড়ল। সেই শব্দেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। কিন্তু সুস্বাদু আমের মিঠে গন্ধ আমার ভয়টয় ক্রমশ তাড়িয়ে দিচ্ছিল।

কতক্ষণ পরে ধুপধুপ শব্দে ছোটমামা এসে গেলেন। নাহ। গাছটা খুঁজে পেলুম না। ওদিকে দিঘির পাড়ে টর্চের আলো দেখলুম, ভোলা আসছে।

–ছোটমামা! বড্ড অন্ধকার যে!

–হুঁ, টর্চ জ্বালি আর ভোলা দেখতে পাক! খালি বোকার মতো কথাবার্তা। থলেটা আমায় দে। আর আমার এই হাতটা ধরে থাক। ছাড়বিনে বলে দিচ্ছি।

ছোটমামা আমভর্তি থলেটা নিলেন, কিন্তু ওঁর একটা হাত ধরেই ছেড়ে দিলুম। উঃ! কী সাংঘাতিক ঠান্ডাহিম হাত!

ছোটমামা বললেন, কী হল? হাত ছাড়লি কেন?

–আপনার হাত যে বিচ্ছিরি ঠান্ডা!

–ধুর বোকা! জলকাদা ঘেঁটে আম কুড়িয়েছি, হাত ঠান্ডা হবে না? চলে আয় শিগগির!

এই সময় সত্যিই ভোলার হেঁডেগলার গান শুনতে পেলুম। ছোটমামার বরফের মতো ঠান্ডা হাতটা অগত্যা চেপে ধরে থাকতে হল। ছোটমামা এবার প্রায় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়চ্ছেন। আমিও দৌডুচ্ছি।

কতক্ষণ দৌড়েছি জানি না। আমি এবার হাঁপিয়ে পড়েছিলুম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম,–ছোটমামা। আমার পা ব্যথা করছে যে!

ছোটমামার মনে দয়া হল, বললেন, হুঁ। অনেকটা ঘুরপথে আসতে হল। কিন্তু কী আর করা যাবে? এবার আস্তেসুস্থে যাওয়া যাক।

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখানে-ওখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলছে। কাছে কোথায় আচমকা শেয়াল ডাকতে থাকল। একটু ভয় পেয়ে বললাম, আমরা কোথায় এসে পড়েছি ছোটমামা?

–নদীর ধারে। ঝুঝলি না? ভোলার চোখ রাতবিরেতেও দেখতে পায় তাই পুরো গ্রামটার পাশ দিয়ে ঘুরতে হল। বলে ছোটমামা অদ্ভুত শব্দে হাসলেন। –তা পুঁটু! এবার একটা আম টেস্ট করে দেখি। কী বলিস? সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের আমের এত নামডাক। দেখি, সত্যি কি না।

ছোটমামা সেখানেই বসে পড়লেন। তারপর তেমনি অদ্ভুত শব্দে আম খেতে শুরু করলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি, এবার আমাকেও একটা আম খেতে দেবেন ছোটমামা। কিন্তু উনি যেন আমার কথা ভুলেই গেছেন। ক্রমাগত আম খাচ্ছেন আর আঁটিগুলো ছুঁড়ে ফেলছেন। শব্দ শুনে বুঝতে পারছি, ওগুলো জলেই পড়ছে।

কিছুক্ষণ পরে না বলে পারলুম না, কেমন আম ছোটমামা?

জিভে একটা শব্দ করে ছোটমামা বললেন,-ফাস্টো কেলাস! তুই খেলে টের পেতিস পুঁটু! কিন্তু কী আর করা যাবে? সবগুলোই যে আমি কেঁকের বশে খেয়ে ফেললুম!

প্রায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠার মতো বললুম, স-ব?

–হ্যাঁ। তোর কথা মনেই ছিল না। বরং তার বদলে তোকে একটু আদর করি। বলে ছোটমামা আমার মাথায় তারপর মুখে হাত বুলোতে থাকলেন। কী অসহ্য ঠান্ডা হাত! আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,–আর না ছোটমামা! বড় ঠান্ডা লাগছে যে!

–আমের গন্ধ কেমন মিঠে টের পাচ্ছিস বল পুঁটু! এই নে। আমার হাত শোক।

ছোটমামার আঙুল আমার নাকে ঢুকতেই আঙুলটা চেপে ধরলুম। তারপরই টের পেলুম আঙুলটা বেজায় শক্তও বটে। আঙুল না হাড়ঃ রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেললুম। ছোটমামা আদুরে গলায় বললেন, কাঁদে না ছোঁড়া? কাল তোমায় আম খাওয়াব। এবার আমি নদীর জলে হাত ধুয়ে আসি।

ছোটমামা যে এমন অদ্ভুত কাণ্ড করবেন, কল্পনাও করিনি। উনি উঠে গেলেন হাত ধুতে, গেলেন তো গেলেনই। আর ফেরার নাম নেই। জলের ওপর এতক্ষণে তারা ঝিলমিল করছে দেখতে পেলুম। আবার একদল শেয়াল ডেকে উঠল। তখন ভয় পেয়ে ডাকলুম,–ছোটমামা! ছোটমামা!

কিন্তু কোনও সাড়া এল না। আমি এবার মরিয়া হয়ে আরও জোরে ওঁকে ডাকতে থাকলুম। কিছুক্ষণ পরে একটু দূরে টর্চের আলো ঝিলিক দিল। তারপর ছোটমামার গলা ভেসে এল, পুঁটু! পুঁটু!

সাড়া দিলুম। ছোটমামা দৌড়তে-দৌড়তে কাছে এলেন। তারপর টর্চের আলোয় খালি থলে দেখে প্রচণ্ড খাপ্পা হয়ে বললেন,–বিশ্বাসঘাতক! এইটুকু ছেলের হাড়ে হাড়ে এত বুদ্ধি! নদীর ধারে শ্মশানের কাছে আম নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তারপর হায়! হায়! সবগুলো আম একা সাবাড় করেছে!

অবাক হয়ে বললুম,–ছোটমামা! আপনিই তো—

উনি থাপ্পড় তুলে বললেন, আমিই তো মানে? মিথ্যুক কোথাকার!

-না ছোটমামা! আপনিই তো আমাকে এখানে এনে আমগুলো একা খেয়ে তারপর নদীর জলে হাত ধুতে গেলেন।

–শাট আপ! দেখি তোর মুখ খুঁকে!

আমার মুখে আমের গন্ধ পেয়ে ছোটমামা আরও তর্জন-গর্জন জুড়ে দিলেন। ওঁকে কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছিলুম না। একটু পড়ে উনি হতাশ হয়ে ভিজে ঘাসে বসে পড়লেন। বাতাসাভোগ আমগাছটা খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে দেখি, তুই নেই। ভাবলুম, ভোলা আসছে টের পেয়ে তুই বাড়ি চলে গেছিস। বাড়িতে তোকে পেলুম না। তারপর তোকে ডেকে ডেকে–ওঃ! পুটু রে! তুই এমন করবি ভাবতেও পারিনি।

–বিশ্বাস করুন ছোটমামা! আমি আম খাইনি। আপনিই খেয়েছেন।

–আবার মিথ্যে কথা? তোর মুখে আমের গন্ধ।

–আপনিই তো আদর করছিলেন এঁটো হাতে। কী সাংঘাতিক ঠান্ডা আপনার হাত!

আমার হাত ঠান্ডা? বাজে কথা বলবিনে!–বলে ছোটমামা ওঁর একটা হাত আমার গলায় ঠেকালেন।–বল এবার। আমার হাত ঠান্ডা না গরম?

কী আশ্চর্য! ছোটমামার হাত তত মোটেই তেমন ঠান্ডা নয়। অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাহলে কে ছোটমামা সেজে আমাকে নদীর ধারে শ্মশানে এনেছিল? তার আঙুলটা নিরেট হাড় কেন?

আর ভাবতে পারলুম না। কঁদো কাঁদো গলায় বললুম, ছোটমামা! তাহলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের সেই গলায়দড়ে ভূতটা আপনি সেজে আমাকে এখানে টেনে এনেছিল।

শাট আপ! –বলে ছোটমামা উঠে দাঁড়ালেন। খালি বাজে গল্প! মিথ্যুক! লোভী! বিশ্বাসঘাতক! তোর শাস্তি পাওয়া উচিত। থাক তুই শ্মশানে পড়ে। আমি চললুম।

ছোটমামা দৌড়তে থাকলেন। আমি মরিয়া হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলুম। ভাগ্যিস, ওঁকে টর্চ জ্বেলে দৌড়তে হচ্ছিল। তাই ওঁর নাগাল পেতে অসুবিধা হচ্ছিল না…

যাই হোক, বাড়ি ফিরে দুজনেই ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলুম। ছোটমামা বলে দিলে মা ওঁকে খুব বকাবকি করতেন। আমি বললে শুধু মা নন, বাবাও আমাকে মিথ্যকের চূড়ামণি বা আর পেটুক সাব্যস্ত করে একটা জব্বর শাস্তি দিতেন।

ছোটমামার রাগ পড়তে তিন দিন লেগেছিল। তবে আমার কথা উনি কিছুতেই বিশ্বাস করেননি। আমার মনে এই দুঃখটা আজও থেকে গেছে। তবে ঠকে শিখেছি, আম কুড়োতে গেলে সাবধান থাকাই উচিত। আর হ্যাঁ, ভোঁদাকে ঘটনাটা চুপিচুপি বলতেই সে আমায় চিমটি কেটে বলেছিল,–তুই সত্যি বড় বোকা পুঁটু। গলায়দড়ে ব্যাটাচ্ছেলে যখন আম সাবাড় করছিল, তুই রাম বললেই পারতিস! রাম নামে সব ভূত জব্দ। আমের বদলে রাম। মনে রাখিস।

কাটিহারের গঙ্গারাম

ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে বাইরে কোথাও গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড বেধে যায়। তাই ছোটমামা সাধাসাধি করলেও সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে কোথাও যেতুম না। সে কলকাতায় যাত্রা দেখতেই হোক, কী মেলা দেখতেই হোক। অবশ্য সব সময় দোষটা যে ছোটমামারই, এমন কিন্তু নয়। কোথাও দিনদুপুরে গিয়ে কোনও কারণে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত্রি তো হতেই পারে। তখন কী আর করা যাবে?

তেমনই একটা রাতের বিদঘুটে কাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। সেটা গোড়া থেকেই বলা যাক।

ঠাকুরদা সপ্তাহে তিনদিন দাড়ি কামাতেন। আর তাঁর দাড়ি কামাতে আসত ভোলারাম নরসুন্দর। ভোলারামকে নাপিত বললেই জিভ কেটে সে বলত, ছি-ছি! নাপিত বলতে নেই। নাপিত বললে কী হবে জানো খোকাবাবু? এই বয়সেই বড়বাবুর মতো তোমার গোঁফদাড়ি গজিয়ে যাবে। আমাকে বলবে নরসুন্দর। কেমন?

এই ভোলারামের অভ্যাস ছিল দাড়ি কামাতেকামাতে গাঁয়ের সবরকম খবর বলা। গাঁয়ের খবর ফুরিয়ে গেলে তখন সে অন্য গাঁয়ের নানারকম খবর বলা শুরু করত। ঠাকুরদা আরামে চোখ বুজে থাকতেন আর হুঁ দিয়ে যেতেন।

সেবার শরৎকালে এক রোববারের সকালে ভোলারাম ঠাকুরদার দাড়ি কামাতে এসেছে। উঠোনে পেয়ারাতলায় চেয়ারে বসে ঠাকুরদা পা ছড়িয়ে চোখ বুজে আছেন। ভোলারাম অভ্যাসমতো ঠাকুরদার গালে সাবান মাখাতে-মাখাতে বকবক করে চলেছে। দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে ঠাকুরদার গোঁফ ছাঁটতে কচি বের করল। তার খবরের এইখানটায় ছিল সিঙ্গিমশাইয়ের ঠাকরুনদিঘির মাছ। জেলেরা জালে একটা দশ কেজি মাছ তুলেছিল। মাছটার লেজের কাছে নাকি সিঙ্গিমশায়ের নাম লেখা। গাঁসুদ্ধু লোক ভিড় করে দেখতে গিয়েছিল।

এবার মাছের কথায় আরও কত খবর এসে গেল। গোঁফ ছাঁটা হয়ে গেলে আয়নায় গোঁফ দেখতে-দেখতে ঠাকুরদা বললেন, হ্যাঁ হে ভোলারাম! এরকম মাছের খবর তো দিচ্ছ। কিন্তু আজকাল আগের মতো বড়-বড় খয়রা মাছ দেখি না কেন? বড় খয়রা কেন, ছোট খয়রারও পাত্তা নেই।

ভোলারাম বলল, কী যে বলেন বড়বাবু? খয়রার পাত্ত থাকবে না কেন? আর ছোট খয়রা কী বলছেন, এই হাতের মতো বড়-বড় জ্যান্ত খয়রা বিক্রি হচ্ছে। দোমোহানির হাটে। বিলভাসানো জল টেনে নিচ্ছে মৌরি নদী। আর নদীর মুখে জাল পেতে বসে আছে জেলেরা। পেল্লায় সাইজের খয়রা জালে উঠছে। দেখলে চোখ জ্বলে যাবে বড়বাবু!

ঠাকুরদা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলো কী হে! শুনেছি দোমোহানিতে হাট বসে বিকেলবেলায়। তিন মাইল মেঠো রাস্তায় পায়ে হেঁটে তোমার পেস্লায় সাইজের খয়রা আনতে যাবে কে?

ছোটমামা সবে তখন বাড়ি ঢুকছিলেন। তাকে দেখিয়ে ভোলারাম বলল, ওই তো! নান্টুবাবুকে পাঠিয়ে দিলেই হল। দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবেন। পড়ন্ত বেলায় বিল থেকে মাছ আসতে শুরু করবে। সস্তার তিন অবস্থা বলে কথা আছে না? দশ টাকা কেজি দর হাঁকতে-হাঁকতে মেছুনিমাসিরা শেষ অবধি পাঁচ টাকায় দর নামাবে। অত খদ্দের কোথা?

ছোটমামার ডাকনাম নান্টু আর আমার ডাকনাম পুঁটু। ঠাকুরদার হুকুম না মেনে উপায় নেই। ছছাটমামা মুখ ব্যাজার করে ঘরে ঢুকলেন। বিকেলে স্কুলের মাঠে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট! আমিও মনমরা হয়ে গেলুম। একা-একা কি খেলা দেখতে ভালো লাগে?

ভোলারাম নরসুন্দর ছুরি-কাঁচি-নরুন গুটিয়ে ছোট্ট বাকসোতে ভরে আমার দিকে তাকাল। চোখ নাচিয়ে সে বললে,—পুঁটুবাবু! তুমিও মামার সঙ্গে যেও। দোমোহানির হাটতলায় ম্যাজিকবাজির তাঁবু বসেছে। কাটা মুণ্ডুর খেলা দেখলে তুমি একেবারে অবাক হয়ে যাবে। হ্যাঁ গো পুঁটুবাবু! দু-চোখের দিব্যি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, কাটামুণ্ডু কথা বলছে।

ঠাকুরদা সায় দিয়ে বললেন,বাঃ! এখন তো পুজোর ছুটি। পুঁটু! নান্টুর সঙ্গে দোমোহানি গিয়ে ম্যাজিক দেখে এসো। আমি বাড়তি টাকা দেব।…

পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের পায়ে হাঁটার অভ্যাস তখনও ছিল। এদিকের লোকে দূরত্ব মাপতে কিলোমিটার বলত না। কিলোগ্রাম বা কেজি অবশ্য চালু হয়েছিল। কিন্তু মাইল বা ক্রোশ কথাটা চালু ছিল। তিন মাইল মানে দেড় ক্রোশ।

মাটির রাস্তা শরৎকালে মোটামুটি শুকিয়ে খটখটে হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও একটু কাদা আছে। দুধারে আদিগন্ত ধানক্ষেত। কখনও গাছপালার জটলা বা ঝোপঝাড়। দোমোহানির হাটতলায় পৌঁছে দেখি সত্যি ম্যাজিকের তাঁবু বসেছে। একটু পরেই মাইকে গানবাজনা শুরু হয়ে গেল। মনটা নেচে উঠল। খয়রা মাছ কিনেই ম্যাজিকের টিকিট কাটতে বললুম ছোটমামাকে।

ছোটমামা যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছিল, সেখানে গেলেন। হাটে বড্ড ভিড়। ছোটমামার কোমরের কাছে শার্টটা আঁকড়ে ধরেছিলুম, পাছে হারিয়ে যাই।

একটু পরে দেখলুম, ভোলারাম মিথ্যা বলেনি। খয়রা মাছগুলো তার হাতের মতো বড় না হলেও আমার হাতের সাইজ। দরাদরি করে ছোটমামা সাত টাকায় এক কেজি খয়রা কিনে থলেয় ভরলেন। তারপর ভিড়ের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, বুঝলি পুঁটু, দর আরও কমবে। কিন্তু আমারও যে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখতে ইচ্ছে করছে। ওই শোন! কী বলছে ম্যাজিশিয়ান।

কালো প্যান্ট-কোট, শার্ট আর মাথায় টুপিপরা একটা লোক গেটের পাশে অঙ্গভঙ্গি করে চ্যাঁচাচ্ছিল,—আড়ম্ভ! আড়ম্ভ! একখুনি আড়ম্ভ হয়ে যাবে। আ–ড়— ম–ভো — ও—ও —ও!

আরম্ভ-কে আড়ম্ভ বলায় খুব মজা পাচ্ছিলুম। বললুম,—চলুন ছোটমামা। এখনই টিকিট কিনে সামনের সিটে বসে পড়ি। দেরি করলে পিছনে বসতে হবে।

ঠিক বলেছিস পুঁটু! বলে ছোটমামা মাছের থলেটা সাবধানে একটু গুটিয়ে নিয়ে দুটো টিকিট কাটলেন। তারপর আমাকে এক হাতে টেনে তাঁবুতে ঢুকলেন।

ভিতরে ঢুকে নিরাশ হলুম। কোনও চেয়ার-বেঞ্চ নেই। মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা আছে, কিন্তু ততক্ষণে সামনের দিকটা লোকেরা ঠাসাঠাসি করে বসেছে। ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, কোনও মানে হয়? তোর না হয় হাফপেন্টুল। আমার যে ফুলপ্যান্ট! শোন! এই পিছনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখব।

বাইরে সেই লোকটা, যাকে ম্যাজিশিয়ান ভেবেছিলুম, সে এবার চ্যাঁচাচ্ছে, কাটামুণ্ডু! কাটামুণ্ডু কথা বলবে,—এএ! আড়মভো-ও-ও-ও!

ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ছোটমামা আর আমার পিঠ তখন তাঁবুর কাপড়ে ঠেকেছে। এতক্ষণে স্টেজের পরদা উঠল। তারপর দেখি, আমি ম্যাজিশিয়ানকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলুম। সে কোন পথে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছে ভেবে পেলুম না। সে বলল, আমি প্রফেসর বংকারাম হাটি। আমি বাগে পেলেই লোকের মাথা কাটি।

সবাই হেসে উঠল। সে বেশ মিল দিয়ে কথা বলছিল। আমিও হেসে অস্থির হচ্ছিলুম; দেখলুম, ছোটমামাও খুব হাসছেন।।

প্রথমে কয়েকটা আশ্চর্য ম্যাজিক দেখানোর পর ম্যাজিশিয়ান বলল,-এবার আমি সেরা খেলাটা দেখাব। কাটামুণ্ডুর খেলা। কাটামুণ্ডুর গলায় দেখবেন চাপ-চাপ রক্ত। খোকাখুকুরা ভয় পেলে চোখ বুজে থেকো। ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করলেই খেলা পণ্ড হয়ে যাবে।

এবার দুটো লোক একটা টেবিলের মতো জিনিস স্টেজে আনল। জিনিসটার চারদিকে কালো কাপড়ে ঘেরা। ম্যাজিশিয়ান বলল,—তাহলে কাটামুণ্ডুর খেলা শুরু করি। ওয়ান টু থ্রি!

অমনি দেখি, ওপরের অংশে কালো কাপড় পরদার মতো গুটিয়ে গেল। তারপর যা দেখলুম, আঁতকে উঠে ছোটমামাকে আঁকড়ে ধরলুম।

টেবিলের ওপর একটা মানুষের মুণ্ডু। গলার কাছে চাপ-চাপ রক্ত। কিন্তু মুন্ডুটা দিব্যি হাসছে। চোখ নাচাচ্ছে। এ তো ভারি অদ্ভুত!

ম্যাজিশিয়ান বলল,-অ্যাই কাটামুণ্ডু! তোর নাম কী?

কাটামুণ্ডু বিদঘুটে গলায় বলল,—ঘংঘাড়াম।

—ভালো করে বল!

-বললুম তো। ঘংঘাড়াম!

ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে বলল,—গলাকাটা তো? তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওর নাম গঙ্গারাম। আচ্ছা বাবা গঙ্গারাম! তোর বাড়ি কোথায়?

—কাটিহাঁড়!

ম্যাজিশিয়ান লাফ দিয়ে সরে বলল, ওরে বাবা। এ যে বলছে কাটি হাড়। মানে হাড় কাটবে। অ্যাই গঙ্গারাম! ঠিক করে বল।

–কঁটিহাড়! কঁটিহাড়!

ম্যাজিশিয়ান কান পেতে শোনার ভঙ্গি করার পর হাসল,কাটিহার বলছে। বিহারে কাটিহার আছে না? সেই কাটিহার। তা বাবা কাটিহারের গঙ্গারাম, তোর মুণ্ডু কাটল কে?

কাটামুণ্ডু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বংকারাম!

ম্যাজিশিয়ান লাফিয়ে উঠল,ওরে বাবা! বংকারাম বলছে যে! আমিই তো বংকারাম! এক্ষুনি আমাকে পুলিশে ধরবে। ওরে! তোরা কাটামুণ্ডুকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখ!

আবার কালো পরদাটা টেবিলের ওপর ঘিরে ফেলল। সেই লোকদুটো পরদা টেবিলটা স্টেজের পিছনে নিয়ে গেল।

দর্শকরা হাততালি দিল। ম্যাজিশিয়ান হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে একটু ঝুঁকে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করল।..

ম্যাজিক শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে দেখি, হাট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মেছেমেছুনিরা পিদিম জ্বেলে তখনও মাছ নিয়ে বসে আছে। গ্যাসবাতি জ্বেলে বসে আছে কিছু পশারি। ম্যাজিক-দেখা লোকগুলো ছড়িয়ে পড়ল কে কোথায় কে জন। তবে মেছো-মেছুনিদের দিকে আবার ভিড় দেখলুম। ছোটমামা বললেন,একটু ভুল হয়ে গেছে, বুঝলি পুঁটু?

–কী ভুল ছোটমামা?

—এখন খয়রা মাছ কিনলে সস্তায় পেতুম। যাক গে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই! কিন্তু—বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন।

জিগ্যেস করলুম,–কী হল ছোটমামা?

—আরেকটা ভুল করে বসে আছি রে পুঁটু! টর্চ আনিনি যে!

এতক্ষণে আমিও একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড হয়। এতক্ষণ মনে ছিল না।

ছোটমামা বললেন, চাঁদ উঠতে দেরি আছে। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে তোর ঠাকুরদার পাতে রাত্রিবেলা এই খয়রা মাছ পড়বে না। বরং এক কাজ করা যাক। হাটে দেখছিলুম, একটা লোক বেতের ছড়ি বিক্রি করছে। আয় তো দেখি। একটা ছড়ি-টড়ি সঙ্গে থাকলে সাহস বাড়ে। বুঝলি পুঁটু?

মাত্র দুটাকায় একটা বেতের ছড়ি পাওয়া গেল। ছাতার বাঁটের মতো বাঁকানো হাতল আছে। ছড়িটা বগলদাবা করে মাছভর্তি থলে ঝুলিয়ে ছোটমামা হাঁটতে থাকলেন। আমি তাঁর কাছ ঘেঁষে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ চলার পর অন্ধকার স্বচ্ছ মনে হল। শরৎকালের আকাশে নক্ষত্ররা উজ্জ্বল হয়।

ছোটমামা একটু হেসে বললেন,-বুঝলি পুঁটু! ঠিক এমনি একটি ছড়ি সিঙ্গিমশাইয়ের আছে। দেখিসনি তুই?

বললুম, সিঙ্গিমশাই সবসময় ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটেন কেন ছোটমামা?

—ওটা স্টাইল! বুঝলি পুঁটু! সব মানুষ বুড়ো হলেই ছড়ি নিয়ে হাঁটে না। তোর ঠাকুরদা তো বুড়োমানুষ। তার হাতে ছড়ি দেখেছিস?

–না ছোটমামা!

—তাহলেই বুঝে দ্যাখ পুঁটু! সিঙ্গিমশাইয়ের ছড়ি হাতে হাঁটাটা আসলে স্টাইল! আমিও সেইরকম স্টাইলে হাঁটছি, দ্যাখ!

বলে ছোটমামা বাঁ-হাতে মাছের থলে নিয়ে ডানহাতে ছড়ির হাতল ধরে অবিকল সিঙ্গিমশাইয়ের মতো মাটিতে ছড়ির ডগা ঠেকালেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন।

একটু পরে দেখি, ছোটমামা মাটির রাস্তায় জোরে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমি দৌড়ে তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। রাগ করে চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! অত জোরে হাঁটছেন কেন?

ছোটমামা সামনের দিক থেকে কেন যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,আমি কি জোরে হাঁটছি রে পুঁটু? ছড়িটা আমাকে হাঁটাচ্ছে। মানে, ছড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে! এই! এই ছড়ি! আস্তে আস্তে!

আমি যথাসাধ্য দৌড়ে গিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছোটমামা! আমি দৌড়ুতে পারছিনে।

—ওরে পুঁটু! ছড়িটা সর্বনাশ! এই! এই ব্যাটাচ্ছেলে! রাস্তা ছেড়ে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

বলে ছোটমামা চ্যাঁচাতে থাকলেন,—পুঁটু! পুঁটু! আমাকে ছড়িটা ধানক্ষেতের আলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রে!

ততক্ষণে পিছনে উঁদ উঁকি দিয়েছে আবছা, জ্যোৎস্নায় দেখলুম, ছোটমামা বাঁ-দিকে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়িটা ফেলে দিচ্ছেন না কেন? এক্ষুনি ছড়িটা ফেলে দিন!

ছোটমামার করুণ চিৎকার শোনা গেল,—ওরে পুঁটু! ছড়ির হাত থেকে হাত ছাড়াতে পারছি না যে!

আতঙ্কে, দুর্ভাবনায় আমি এবার চেঁচিয়ে বললুম,ছোটমামা! গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকুন।

কথাটা আমার মাথায় কেমন করে এসেছিল কে জানে! আমার কথাটা শুনেই বাঁ-দিকে খানিকটা দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে ছোটমামা এবার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওরে গঙ্গারাম! গঙ্গারাম তোর কাটামুণ্ডুটা নিয়ে আয় তো! ছড়ি ব্যাটাছেলের মুন্ডু কেটে তোর মতো করে ফেলবি গঙ্গারাম! ওরে কাটিহারের গঙ্গারাম। শিগগির আয়

রে!

তারপরই ছোটমামার হাসি শুনতে পেলুম। আবছা জ্যোৎস্নায় ছোটমামাকে হাসতে-হাসতে ফিরে আসতে দেখলুম। তিনি বলছিলেন—কেমন জব্দ? আঁ? গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকতে ছড়িটা আমার হাত থেকে খসে ডিগবাজি খেতেখেতে পালিয়ে গেল!

ছোটমামার প্যান্টের নিচের দিকটা শিশিরে আর ঘাসের কুটোয় নোংরা হয়ে গেছে। ভিজে জবজব করছে। তিনি আমার কাছে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, ওঃ, কী সর্বনেশে ছড়ির পাল্লায় পড়েছিলুম রে পুঁটু! ভাগ্যিস, তুই বুদ্ধি করে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলি।

বললুম,—ছোটমামা! কিন্তু গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ছড়ির ভূত অত ভয় পেল কেন?

ছোটমামা বললেন,বুঝতে পারিসনি পুটু? ছড়ির ভূত নিশ্চয় ম্যাজিকের তাবুতে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু দেখেছিল।

এরপর ছোটমামা আমাকে মাছের থলে দিয়ে জুতোদুটো খুললেন তারপর প্যান্ট গুটিয়ে জুতো বাঁ হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন। ততক্ষণে জ্যোৎস্না উজ্জ্বল হয়েছে। জিগ্যেস করলুম, ছড়িটা অমন করে আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন?

ছোটমামা বললেন,—সেটাই তো বুঝতে পারছি না রে পুঁটু! ভূত কি ছড়ি হতে পারে? আমার মনে হচ্ছে, ওটা কোনও ভূতের ছড়ি! বুঝলি? ছড়িওয়ালা কোনও মরা মানুষের ছড়ি সস্তায় কিনে আমাকে বেচেছিল।

কথাটা বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন। জিগ্যেস করলুম,কী হল ছোটমামা?

—ওই দ্যাখ! দেখতে পাচ্ছিস? ছড়ি ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের আগে-আগে খুটখুট শব্দ করে হেঁটে চলেছে।

ভয় পেয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়ি হাঁটছে না। ভূত ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটছে।

এবার ছোটমামা হুংকার দিয়ে বললেন,আয় তত পুঁটু! দেখি ব্যাটাচ্ছলেকে। এখনও এত সাহস!

ছোটমামা বোকামিই করে ফেলতেন, কারণ ছড়িটা ডিগবাজি খেতে-খেতে তার দিকে আসছিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,—গঙ্গারাম! গঙ্গারাম! তোমার কাটামুণ্ডু নিয়ে এসো শিগগির!

অমনি দেখলুম ছড়িটা পাশের ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা বললেন,ধ্যাত্তেরি! কথাটা আমার কিছুতেই মনে থাকছে না। পুঁটু। আমরা দুজনে এবার গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর জয় দিতে-দিতে হাঁটি!

বলেই ছোটমামা স্লোগানের সুরে হাঁকলেন,–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু কী? আমি চেঁচিয়ে বললুম,—জয়!

–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!

এমন স্লোগান ওই বয়সে কত শুনতুম, তাই চেঁচিয়ে বললুম,অমর রহে। অমর রহে।

-–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!

—জিতা রহে! জিতা রহে!

—কাটিহারের গঙ্গারাম কী?

—জয়!

বাড়ি ঢােকার মুখে ছোটমামা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভাগ্যিস ছড়ির ভূতটা প্রফেসর বংকারামের ম্যাজিক দেখতে ঢুকেছিল। নইলে তোর ঠাকুরদার খয়রা মাছ আর খাওয়া হতো না। কাটামুণ্ডু দেখে ভূতটাও ভয় পেয়েছিল।

কিন্তু ম্যাজিক দেখতে আমরা না ঢুকলে আমাদের দুজনের অবস্থাটা কী হতো, সেটা আর ছোটমামাকে বলিনি।

 কালো ঘোড়া

ব্যাপারটা নিছক স্বপ্ন, নাকি সত্যি সত্যি ঘটেছিল, বলা কঠিন। শুধু এটুকুই বলতে পারি, এ ঘটনা আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না। যা-যা ঘটেছিল, অবিকল তাই-তাই বর্ণনা করছি।

গত শরৎকালের কথা। তখন আমি মার্কিন মুলুকের কান্ট্রি এলাকা অর্থাৎ পাড়াগাঁয়ে এক ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে আছি। ভদ্রলোকের নাম ডঃ হেরম্যান জুট্রাম! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে হিটলারের চেলারা ইহুদিদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে ডঃ জুট্রাম আমেরিকায় পালিয়ে আসেন। কারণ ইনি ইহুদি।

এলাকার নাম মুনভিলে। মানে করলে হয়তো দাঁড়ায় চন্দ্রপুরী। আসলে নিঃঝুম কয়েকটা বনে-ঢাকা ছোট্ট টিলার ওপর একটা করে বাড়ি। হাইওয়ে থেকে কষ্টেসৃষ্টে নজরে পড়ে। চারিদিকে ছড়ানো ঢেউ খেলানো মাঠ। কোথাও ধূসর হয়ে ওঠা ভূট্টাক্ষেত, কোথাও গোরু, শুয়োর বা ঘোড়ার বাথানচারিদিক কাঠের বেড়ায় ঘেরা।

–মুনভিলে কেন?

ডঃ জুট্রাম আমার প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন,–এই যে নিচের দিকে হ্রদটা দেখছ, ওটার গড়ন লক্ষ করো।

বাড়ির পূর্বে টিলাটা ফাঁকা এবং ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তারপর হ্রদ। পুবের ঘাসে লন ও ফুলবাগিচায় দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। দেখলাম, হ্রদটা অর্ধবৃত্তাকার, তার মানে অবিকল চন্দ্রকলার মতো। বলেছিলুম, হ্রদটার নাম হওয়া উচিত মুনলেক।

ঠিকই ধরেছ। ডঃ জুট্রাম হেসে উঠেছিলেন। ওটার নাম মুনলেক। তবে তার চেয়েও সুখের কথা, মুনলেকের ধারে জ্যোৎস্নারাতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করলে তুমি রূপকথার রাজপুকুরটি হয়ে উঠবে।

হাসতে-হাসতে বলেছিলাম, কিন্তু রাজপুতুরের যে একটা ঘোড়াও চাই। যেমন-তেমন ঘোড়া চলবে না, চাই একটি পক্ষীরাজ। সেই যে, যাদের ডানা আছে…

বলতে-বলতে একটু অবাক হয়ে থেমেছিলাম। ডঃ জুট্রামের লালচে মুখে হঠাৎ কেন অমন গাঢ় ছায়া। যেন হঠাৎ কী অসুখ বাধিয়ে বসেছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। চোখ নিষ্পলক।

ব্যস্ত হয়ে বলেছিলাম, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন ডঃ জুট্রাম?

উনি তখনই ঘুম থেকে ওঠার মতো কাঁধদুটো নাড়া দিয়ে আগের হাসিটা ফিরিয়ে এনেছিলেন।…হা, তুমি ঘোড়ার কথা বলছিলে তাই না?

–হ্যাঁ, ডঃ জুট্রাম।

–জানো? মুনলেকের অদ্ভুত-অদ্ভুত সব গল্প আছে। তার মধ্যে ওই ঘোড়ার গল্পটা সাংঘাতিক! মাঝে-মাঝে, বিশেষ করে জ্যোৎস্নার রাতে নাকি হ্রদের জল থেকে একটা কালো ঘোড়া উঠে আসে। ঘোড়াটা নাকি প্রাচীন যুগের এক রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের। নিছক ভুতুড়ে ব্যাপার।

বলে ডঃ জুট্রাম হাতঘড়িটা দেখে নিলেন এবং ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।কী কাণ্ড। আমাকে যে এক্ষুনি শহরে দৌডুতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সেমিনার আছে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

জুট্রাম পা বাড়িয়ে ফের বলেছিলেন, যাক গে, তোমার গিয়ে কাজ নেই। পণ্ডিতি কচকচি তোমার ভালো লাগবে না। তার চেয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোেগ করো। আয়ু বাড়বে।

হাসতে-হাসতে চলে গিয়েছিলেন ডঃ জুট্রাম। একটু পরে বাড়ির দক্ষিণে বনের গড়ানে রাস্তায় ওঁর সাদা গাড়িটা নেমে যেতে দেখেছিলাম। তখন বেলা সাড়ে তিনটে। টিলার মাথায় কাঠের দোতলা বাড়িটা আরও নিঃঝুম হয়ে গেল। গাছপালা থেকে ঝিঁঝিপোকার বিকট হাঁকডাক শোন যাচ্ছিল। মার্কিন ঝিঁঝিপোকার ডাক বড় বিরক্তিকর। মনেমনে খাপ্পা হয়ে বললাম, রোসো বাছাধনরা! পাতা ঝরার দিন শুরু হলেই তোমাদের বীরত্ব কোথায় থাকে, দেখা যাবে।

ডঃ জুট্রামের প্রকাণ্ড কুকুরটার নাম রেক্স। একে কুকুরে আমার প্রচণ্ড ভয়, তাতে রেক্স আমাকে যতবার দেখে, মাতৃভাষায় গালাগালি করে। বাঁধা না থাকলে আমাকে নিশ্চয় সোজা ভারতে ফেরত পাঠিয়ে ছাড়ত। কঁচুমাচু মুখে ডঃ জুট্রাম বলেছিলেন,-রেক্সের এই এক দোষ! বিদেশিদের দেখতে পারে না।

হাই তুলে ভয়ে-ভয়ে বারান্দায় উঠলাম। কিন্তু রেক্সের সাড়া পেলাম না। তখন দরজা খুলে বসার ঘরের ভেতর উঁকি দিলাম। সিঁড়ির পাশে কুকুরটা থাকে। সেখানে সে নেই। তাহলে ডঃ জুট্রামের লেকচার শুনতে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

দোতলায় আমার ঘর। বেলা দুটোয় লাঞ্চ খেয়েছি। বাঙালি স্বভাবে ভাতঘুম নামে আরাদায়ক একটা ব্যাপার আছে। সায়েবদের সংসর্গে সেটা বরবাদ হতে বসেছে। আজ এমন সুযোগ ছাড়া যায় না। অতএব সটান বিছানায় চিত হলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে বন্ধুবর ভাতঘুম এসে কোলাকুলি করলেন। তখন আঃ কী আনন্দ! কতদিন পরে দেখা।

কতক্ষণ পরে কার ডাকাডাকিতে চোখ খুলতে হল। তাকিয়ে দেখি, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আট-নয় বছরের একটা মেয়ে। গোলগাল পুতুল-গড়ন। একমাথা আঁকড়ামাকড়া সোনালি চুল। পরনে উজ্জ্বল নীল ফ্রক। গলায় সাদা স্কার্ফ জড়ানো। মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

তক্ষুনি মনে পড়ে গেল, আরে তাই তো! এরই ছবি বাড়ির ওপরে-নিচে সব ঘরে দেখেছি। ওই তো এ-ঘরের দেওয়ালেও রয়েছে।

ডঃ জুট্রামকে জিগ্যেস করব ভেবেছিলাম। ভুলে গেছি।

উঠে বসে মিষ্টি হেসে বললাম, হ্যালো।

আমার মার্কিনি সম্ভাষণের জবাবে ছোট্ট করে বলল, হাই। কিন্তু মুখের অবাক ভাবটা ঘুচল না। ঠোঁট কামড়ে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়ে একটু হাসল। হেসে বলল, তুমি নিশ্চয় বাবার অতিথি। তুমি কি বিদেশি?

সায় দিয়ে বললাম,-প্রথমে তোমার নাম বলল।

–জিনা।

তুমি নিশ্চয় শহরে থেকে পড়াশুনা করো, তাই না জিনা? ওর সঙ্গে খাতির জমাতে বসলাম।–তা এলে কার সঙ্গে? মায়ের সঙ্গে বুঝি? চলো, তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

ডঃ জুট্টাম তার স্ত্রী কিংবা মেয়ের কথা কিছু বলেননি। আমিও কিছু জানতে চাইনি। কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপার জানতে চাওয়া ভদ্রতাসম্মত নয়। উঠে দাঁড়িয়েছি, জিনা বলল, তুমি বললে না কোন দেশের লোক?

–আমি ইন্ডিয়ান। শু

নেই জিনা যেন চমকে উঠল। তুমি ইন্ডিয়ান কিন্তু!…

–কিন্তু কী বলল তো জিনা?

তোমার মাথায় পালকের টুপি নেই। গলায় রঙিন পাথরের মালা নেই। –জিনা বলতে থাকল, তোমার বর্শা কী হল, তোমার চুল কেটে ফেলেছ কেন? তুমি এমন বেঁটে মানুষ কেন?

ওকে থামিয়ে হাসতে-হাসতে বললাম, জিনা, জিনা! আমাকে বলতে দাও। ইন্ডিয়ান মানে আমি ইন্ডিয়া–ভারতের লোক। তুমি আমাকে রেড ইন্ডিয়ান ভেবেছ দেখছি। ভারতের নাম শোনোনি? পুবের দেশ।

জিনা কেমন যেন নিরাশ গলায় বলল,–ও! তুমি ওরিয়েন্টাল।

–ঠিক বলেছ। এবার চলল তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

জিনা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে বাস্কেটবল খেলবে?

–খেলব বইকী।

এসো। –বলে সে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। তার পেছনে-পেছনে নেমে নিচের ঘরে কাকেও দেখতে পেলাম না। ঘরের ভেতর ততক্ষণে হাল্কা আঁধার জমেছে। পুবের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি বেলা পড়ে গেছে, নীলচে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে, গাছপালার মাথায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে বুনো হাঁসের ঝাক। নিচের দিকে একটু দূরে মুনলেকের জলে তখনও লালচে ছটা ছড়িয়ে আছে।

–হেই! এখানে চলে এসো।

ঘুরে দেখি লনের কোনায় বাস্কেটবল নিয়ে জিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে খেলায় মেতে গেলাম। মেয়েটি বড় চঞ্চল প্রকৃতির। আমার আনাড়িপনায় খিলখিল করে হেসে উঠল। আমাকে গোহারা করে হারিয়ে ছাড়ল। আবছা আঁধার হয়ে এলে বললাম, এই যথেষ্ট। সকালে আবার হবে। তখন তোমায় হারিয়ে দেব।

জিনা লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন আনমনা।

বললাম, জিনা-জিনা! অবিকল তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার নাম কী জানো? নিনা। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। ভারি মজার। এসো না।

সে গেট খুলে ঢালু সবুজ ঘাস ঢাকা জমি দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। চেঁচিয়ে বললাম,–জিনা আস্তে, আস্তে। দৌড়িও না, আছাড় খাবে।

ততক্ষণে সে লেকের ধারে বালির চওড়া বিচে পৌঁছে গেছে। আমার যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। পোঁছে টের পেলাম কনকনে ঠান্ডায় রক্ত জমতে শুরু করেছে। মেয়েটা কিন্তু দিব্যি ছোটাছুটি করছে বালিতে। হঠাৎ চোখ গেল হ্রদের ওপারে টিলার মাথায়। বাঁকা এক টুকরো চাঁদ উঠেছে। তখুনি জুট্রামের গল্পটা মনে পড়ল। কেমন অস্বস্তি জাগল। বললাম,–জিনা! এবার ফেরা যাক।

জিনা জবাব দিল না। জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সেই সময় হু হু করে একটা বাতাস এল। ঠান্ডাটা বেড়ে গেল। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম। কী শীত, কী শীত! দস্যি মেয়েটার পাল্লায় পড়ে শেষ অবধি না নিমোনিয়া বাধাই।

হ্রদের জলটা কাঁপছে। আবছা জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে সারা হ্রদ। তারপর একসঙ্গে অসংখ্য বুনো হাঁস প্যাকপ্যাক করে ডেকে উঠল। তারপর যা দেখলাম সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। শীতের কথা ভুলে গেলাম। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। স্বপ্ন দেখছি না তো?

যেন জলের ওপর দিয়েই হেঁটে এল একটা কালো ঘোড়া। হ্যাঁ, জলজ্যান্ত একটা কালো ঘোড়া।

ঘোড়াটা বিচে আসতেই জিনা কী দুর্বোধ্য শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর দেখি, কালো কালো ঘোড়াটার সঙ্গে সে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কখনও আমার সামনে দিয়ে, কখনও পিছন দিয়ে দুজনে ছোটাছুটি করতে থাকল। ঘোড়াটা আমার ওপর এসে পড়বে ভেবে আমি আতঙ্কে কাঠ। কিন্তু গলায় কী আটকে গেছে। জিনাকে বারণ করার সাধ্য নেই।

একটু পরে দেখলাম, জিনা কালো ঘোড়াটার ওপর চেপে বসেছে। ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় সারা বিচ জুড়ে খালি ঘোড়ার পায়ে চাপা শব্দ।

তারপর পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে শুনলাম। সেই সঙ্গে কুকুরের গর্জনও শুনতে পেলাম। টর্চের আলো ছড়িয়ে পড়ল আমার গায়ের ওপর। সেই আলোর ছটায় আবছা দেখলাম কালো ঘোড়াটা জিনাকে নিয়ে হ্রদের জলে নেমে যাচ্ছে। এতক্ষণে গলা দিয়ে স্বর বেরুল। চেঁচিয়ে উঠলাম–জিনা-জিনা-জিনা।

পেছনে ডঃ জুট্রাম বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কাম ব্যাক। কাম ব্যাক, ইউ ফুল।

তারপর আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। রেক্স জলের ধারে দাঁড়িয়ে গরগর করছে।

ঘণ্টাখানেক পরে ফায়ারপ্লেসের সামনে দুজনে চুপচাপ বসে আছি। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডঃ জুট্রাম বললেন, তুমি, জিনা-জিনা বলে ডাকছিলে। তুমি কি ওকে সত্যিই দেখেছিলে? পরনে নীল ফ্রক, গলায় সাদা স্কার্ফ ছিল। তাই না?

–হ্যাঁ, আর সেই কালো ঘোড়াটাও।

কথা কেড়ে ডঃ জুট্টাম বললেন, দশ বছর আগে জিনা মুনলেকে ডুবে মরেছে। তার একবছর পরে ওর মা রোগে ভুগে মারা যায়। আমি মুনভিলেই মরতে চাই। তাই এখানে একা পড়ে আছি। বলতে পারো ওয়েটিং ফর দি ব্ল্যাক হর্স।

 কালো ছড়ি

মুরারিবাবু প্রতিদিনের মতো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ, এ বয়সে রোজ ভোরবেলা অন্তত একঘণ্টা হাঁটাচলা করলে হার্টের অবস্থা ভালো থাকে। আঁকাবাঁকা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায়। তারপর কিছুদূর হাঁটলেই একটা পার্ক। বার দুই-তিন পার্কটা চক্কর দিয়ে মুরারিবাবু একটা বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নেন। তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি ফেরেন।

একদিন পার্কে চক্কর দিয়ে তিনি জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা বেঞ্চে বসলেন। সবদিন অবশ্য বেঞ্চ খালি পাওয়া যায় না। না পেলে মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান।

আজ পুরো একটা বেঞ্চ খালি। মুরারিবাবু ঘড়ি দেখলেন। ছটা বেজে গেছে। আজ একটু বেশি হাঁটা হয়ে গেছে হয়তো। তাই ক্লান্তিটা যাচ্ছে না যেন। আরও মিনিট দশেক বসা যাক।

একটু পরে এক ভদ্রলোক এসে বেঞ্চটার অন্যপ্রান্তে বসলেন। একমাথা সাদা চুল। পাকানো গোঁফ। পরনে গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধাক্কাপাড় ধুতি। পায়ে চকচকে পামশু। হাতে একটা কালো ছড়ি। বেশ শৌখিন মনে হচ্ছিল তাকে। তাছাড়া মিঠে একটা সুগন্ধও টের পাচ্ছিলেন মুরারিবাবু। এ বয়সে সেন্ট মেখে মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক।

মনে-মনে হাসি এল মুরারিবাবুর। আড়চোখে ভদ্রলোককে লক্ষ করতে থাকলেন। এবার ভদ্রলোক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন। তারপর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং পাকাতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সিগারেটটা জুতোর তলায় ঘষটে নিভিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন এবং হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন।

মুরারিবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক পার্কের গেট গলিয়ে বড়রাস্তার ফুটপাতে পৌঁছেছেন, সেই সময় মুরারিবাবুর চোখে পড়ল ওঁর কালো ছড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছড়িটা তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়িটা ফেলে গেলেন যে!

ভদ্রলোক যেন শুনতেই পেলেন না। ফুটপাতের ওখানেই বাসস্টপ। প্রায় খালি একটা বাস এসে গেল এবং উনি বাসে উঠে গেলেন। বাসটা তক্ষুনি গর্জন করতে করতে জোরে চলে গেল।মুরারিবাবু ছড়িটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কালো ছড়িটা ওই ভদ্রলোকের মতোই শৌখিন বলা যায়। হাতলওয়ালা ছড়ি। হাতলে রুপোলি নকশা আছে। বাকি অংশ মসৃণ। তলার দিকটা ইঞ্চিটাক রুপোলি খাপে মোড়া।

মুরারিবাবু অগত্যা ছড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কাল মর্নিংওয়াকে গিয়ে যদি ওঁর দেখা পান, ফেরত দেবেন। কাল যদি দেখা না পান, পরশুও ছড়িটা নিয়ে যাবেন। যতদিন না ওঁর দেখা পান, ততদিন এটা সঙ্গে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুবেন।…

সেদিন রাত্রে কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুরারিবাবুর।

তারপর ঝাঝালো মিঠে সুগন্ধ টের পেলেন তিনি। প্রথমে ভাবলেন মনের ভুল। পরে বুঝলেন, মনের ভুল নয়। ঘরে সত্যিই সুগন্ধ মউ-মউ করছে। আজ ভোরবেলা পার্কের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক এই গন্ধটাই তখন টের পেয়েছিলেন মুরারিবাবু।

কিন্তু সেই সুগন্ধ এই ঘরের ভেতর কেন?

চমকে উঠে মুরারিবাবু সুইচ টিপে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। তারপর মশারি থেকে বেরিয়ে সুইচ টিপে টিউবলাইটটাও জ্বাললেন।

ঘরে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই। থাকবেই বা কেমন করে? মশার জন্য মাথার দিকের দুটো জানালা সন্ধ্যার আগে বন্ধ করে দেন মুরারিবাবু। পায়ের দিকে অর্থাৎ বাড়ির ভেতর দিকের দুটো জানালার মধ্যে একটা বন্ধ করেন, অন্যটা শুধু খোলা থাকে। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা এবং বারান্দায় যাওয়ার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। তাহলে সুগন্ধটা কি ভেতরের বারান্দা থেকে আসছে!

সেই খোলা জানালার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, দেয়ালের ব্র্যাকেটে হাতল আটকে সেই কালো ছড়িটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটা নেই।

অমনি বুক ধড়াস করে উঠল মুরারিবাবুর। ছড়িটা গেল কোথায়?

অবশ্য তত ভিতু মানুষ তিনি নন। রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই পৈতৃক একতলা বাড়িতে বসবাস করছেন মুরারিবাবু। যখন তিনি চাকরি করতেন, তখন তাঁর বিধবা দিদি এই বাড়িতে একমাত্র ছেলে নকুলকে নিয়ে থাকতেন। মুরারিবাবু রিটায়ার করার আগেই নকুলকে রেলে একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন। এতদিনে নকুল কোয়ার্টার পেয়ে তার মাকে নিয়ে গেছে। কাজেই মুরারিবাবু এ বাড়িতে একা থাকেন। স্বপাক খান। বরাবর তিনি স্বাবলম্বী মানুষ। জীবনে কখনও ভূতপ্রেত দেখেননি। ভূতপ্রেত আছে না নেই, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। অবশেষে এই বয়সে যে এমন একটা ভুতুড়ে ঘটনার মধ্যে তাকে পড়তে হবে, কোনওদিন কল্পনাও করেননি।

মাথা ঠান্ডা রেখে মুরারিবাবু ঘটনাটা বুঝতে চাইলেন। এ তো একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ভোরবেলা পার্কে দেখা সেই ভদ্রলোক জলজ্যান্ত মানুষ। রহস্য যেটুকু ছিল, সেটুকু তার আকস্মিক চলে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু এখন রহস্যটা রীতিমতো ঘোরালো হয়ে উঠল যে!

একটু পরে মুরারিবাবু টের পেলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে মশা তার দুপায়ে যথেষ্ট হুল ফোঁটাচ্ছে। এই তল্লাটে মশার উৎপাত প্রচণ্ড। দেয়ালের সুইচ টিপে টিউবলাইট বন্ধ করে মুরারিবাবু মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। তিনি এখন মরিয়া। যা ঘটে ঘটুক, তিনি গ্রাহ্য করবেন না। কিছুক্ষণ পরে মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অফ করলেন মুরারিবাবু।

মাথার ওপর নতুন সিলিংফ্যান নিঃশব্দে ঘুরছিল। সুগন্ধটা তখনও মউমউ করছিল। সেই সুগন্ধে যেন কী মাদকতা আছে। মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় ঘুমে তলিয়ে গেলেন রেলের এক প্রাক্তন গার্ড মুরারিমোহন ধাড়া…

ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভোর পাঁচটায় সেই অ্যালার্ম বাজলে মুরারিবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। অভ্যাসমতো শশব্যস্তে উঠে পড়লেন তিনি। তারপরই মনে পড়ে গেল রাত্রের সেই অদ্ভুত ঘটনার কথা। কিন্তু নাহ! এখন ঘরে সেই সুগন্ধ নেই।

আর কী আশ্চর্য, সেই কালো ছড়িটা ব্র্যাকেটেই ঝুলছে। তাহলে কি তিনি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন?

কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না মুরারিবাবু। প্রতিদিনের মতো মশারি খুলে সিলিংফ্যানের সুইচ অফ করে কালো ছড়িটা হাতে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুলেন তিনি। যথারীতি দরজায় তালা এঁটেই বেরুলেন।

পার্কে পৌঁছে চারদিকে লক্ষ রেখেছিলেন মুরারিবাবু। কিন্তু কোথাও সেই ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন না।

আজ চারবার চক্কর দিয়ে সেই বেঞ্চটার কাছে এসে দেখলেন, গাদাগাদি তার বয়সি ছ-জন বৃদ্ধ বসে আছেন। মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আজ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

তার দৃষ্টি চঞ্চল। চারদিকে তাকিয়ে সেই ভদ্রলোককে খুঁজছিলেন তিনি। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না।

অগত্যা ছড়িটা নিয়ে আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা দেয়ালে আঁটা ব্র্যাকেটে আগের দিনের মতো ঝুলিয়ে রাখলেন।…

এদিন রাত্রে মুরারিবাবু সতর্কভাবে জেগে ছিলেন। ফ্যানের বাতাসে মশারি দুলছিল। তাই ব্র্যাকেটে ঝোলানো ছড়িটাকে দেখা যাচ্ছিল না। ফ্যান বন্ধ থাকলে

টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মশারির ভেতর থেকে ওটা চোখে পড়ার কথা।

টেবিল ল্যাম্পটা আজ ইচ্ছে করেই জ্বেলে রেখেছিলেন। ক্রমে পাড়া নিঝুম হয়ে এল। গলিতে রিকশা চলাচলও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়। মুরারিবাবুর চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। তবু তিনি কষ্ট করে জেগে থাকলেন। রেলের গার্ড ছিলেন তিনি। ঘুম এলে মনের জোরে তাকে তাড়াতে পারেন। কতক্ষণ পরে হঠাৎ একটা শব্দ হল। গতরাত্রে যেমন হয়েছিল।

আজ জেগে আছেন বলে বুঝতে পারলেন, উঁচু থেকে যেন কোনও হাল্কা জিনিস পড়ে যাওয়ার মতো শব্দটা। খট খট খটাস!

তারপরই আচম্বিতে নাকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মাদকতাময় আশ্চর্য সুগন্ধ!

কয়েক মুহূর্তের জন্য অজানা আতঙ্কে তার শরীর ভারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ তিনি আরও মরিয়া। মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে মুরারিবাবু চাপা গর্জন করলেন, তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে!

তারপর টিউবলাইট জ্বেলে ব্র্যাকেটের দিকে তাকালেন। অমনি ভীষণ চমকে উঠলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা ব্র্যাকেট থেকে নিচে পড়ে গেছে।

তাহলে এই শব্দটাই কাল রাতে তার ঘুম ভাঙিয়েছিল এবং আজ রাতেও একই শব্দ তিনি শুনেছেন।

ব্র্যাকেট থেকে ছড়ি পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফ্যানের বাতাসের ধাক্কায় হয়তো ছড়িটা দুলতে-দুলতে পিছলে পড়ে গেছে।

কিন্তু এই সুগন্ধটা?

মুরারিবাবু ছড়িটা তুলে আবার ব্র্যাকেটে রাখার জন্য পা বাড়িয়েছেন, সেই সময় অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে গেল।

ছড়িটা মেঝে থেকে সটান সোজা হল। তারপর শূন্যে ভেসে খোলা জানালার গরাদের ফাঁকা দিয়ে ভেতরের বারান্দায় চলে গেল। এবার বারান্দায় চাপা খুটখুট শব্দ হতে থাকল।

মুরারিবাবু স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। একটু পরে তার মনে হল, কে যেন বারান্দায় ছড়ি ঠুকঠুক করে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।

সাহস করে জানালায় উঁকি দিলেন তিনি। বারান্দার ওপরে চল্লিশ ওয়াটের একটা বাধ সারা রাত জ্বলে। এলাকায় হিঁচকে চোরের উপদ্রব আছে।

হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। উঁকি মেরে মুরারিবাবু কাকেও দেখতে পেলেন না। তবে সেই সুগন্ধটা এখনও ঘরের ভিতর মউমউ করছে। ক্রমশ মাথাটাও যেন ঝিম ঝিম করছে। চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে ঘুমে।

টলতে টলতে মুরারিবাবু আলো নিভিয়ে গতরাতের মতো মশারিতে ঢুকে গেলেন এবং খুব শিগগির ঘুমিয়ে পড়লেন।

ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজল যথারীতি। মুরারিবাবুও মর্নিংওয়াকের জন্য তৈরি হালেন। আর কী আশ্চর্য! তিনি দেখলেন, কালো ছড়িটা কালকের মতোই ব্র্যাকেট থেকে ঝুলছে। ঘরে কোনও সুগন্ধও নেই।

হ্যাঁ, স্বপ্ন ছাড়া আর কী? মুরারিবাবুর মনে হল, পরপর দু-রাত্রি তিনি একই স্বপ্ন দেখেছেন। আসলে ছড়িটার রং কালো এবং সেই ভদ্রলোক ওইভাবে এটা ফেলে রেখে হন্তদন্ত এগিয়ে গিয়ে বাসে চেপে চলে গেলেন! তাই মনে একটা খটকা বেধেছিল এবং সেই খটকা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন।…..

এদিনও পার্কে সেই ভদ্রলোককে খুঁজে পাননি মুরারিবাবু। তবে সেই বেঞ্চে তার বসার মতো জায়গা ছিল। জনা চার তার বয়সি প্রবীণ ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে ছিলেন। কালো ছড়িটা একপাশে রেখে মুরারিবাবু ভাবছিলেন, পরপর দু-রাত্রি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। আজ রাত্রেও যদি ওই স্বপ্ন দেখেন?

অমন বিদঘুঁটে স্বপ্ন প্রতিরাত্রে দেখতে কি ভালো লাগে? তাছাড়া এভাবে কালো ছড়িটার রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সত্যিই যে পাগল হয়ে যাবেন!

তার চেয়ে ছড়িটা এখানে ফেলে রেখে সেই ভদ্রলোকের মতোই কেটে পড়া যাক।

এমন তো হতেই পারে, এই কালো ছড়িটা সেই ভদ্রলোকেরও নয় এবং তিনিও এর পাল্লায় পড়ে ভুতুড়ে স্বপ্নের চোটে নাকাল হয়ে এটা এখানে ফেলে কেটে পড়েছিলেন!

মুরারিবাবু ছড়িটা ফেলে রেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু বরাত অন্যরকম।

বেঞ্চের এক ভদ্রলোক ছড়িটা নিয়ে ছুটে এলেন।–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়ি! ছড়িটা ফেলে যাচ্ছেন যে!

বেগতিক দেখে মুরারিবাবু জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। ওটা আমার ছড়ি নয়।

ভদ্রলোক যেন তেড়ে এলেন–আমার নয় মানে? আপনিই এটা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসলেন। আবার বলছেন এটা আমার নয়!

মুরারিবাবু বললেন, আপনি ভুল দেখেছেন! আমি ছড়িহাতে বেঞ্চে বসিনি। ছড়িটা ওখানেই রাখা ছিল।

এবার তর্ক বেধে গেল। ভদ্রলোক চেঁচিয়ে ডাকলেন, অবিনাশদা! রঞ্জনবাবু! আপনারা শিগগির এখানে আসুন তো!

সেই বেঞ্চ থেকে চার প্রবীণ হন্তদন্ত এসে গেলেন। তারপর কথাটা শুনে সব্বাই একবাক্যে বললেন,–পরিতোষবাবু ঠিকই বলছেন। আমরাও দেখেছি আপনি এই কালো ছড়ি হাতে নিয়ে এসে বেঞ্চে বসলেন। এখন বলছেন, ওটা নাকি আপনার নয়। ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?

সবকথা খুলে বললে হয়তো এঁরা তাকে পাগল ভেবে ঠাট্টাতামাশা করবেন। এই ভেবে মুরারিবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে। ছড়িটা দিন।

বলে ছড়িটা নিয়েই তিনি হন্তদন্ত বেরিয়ে এলেন পার্ক থেকে। এঁরা চারজন ততক্ষণে হাসাহাসি করে সত্যিই বলছেন,–পাগল! পাগল! এক্কেবারে বদ্ধপাগল!

মুরারিবাবু মনে-মনে বললেন,–এখনও পাগল হইনি। তবে শিগগির যে পাগলা হয়ে যাব, তা ঠিক। ওঃ! হতচ্ছাড়া ছড়িটা!

গলিতে ঢুকে তিনি ঠিক করলেন, ছড়িটা বরং থানায় জমা দেবেন। শুধু বলবেন, এটা তিনি আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছেন।…..

বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট করে এবং তারিয়ে-তারিয়ে এক গেলাস চা খেয়ে মুরারিবাবু ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

কিন্তু থানায় গিয়ে আরেক কাণ্ড।

থানার বড়বাবু ছড়িটা দেখেই উত্তেজিতভাবে হাঁক দিলেন, সমাদ্দারবাবু! সমাদ্দারবাবু! শিগগির আসুন।

একজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত ঘরে ঢুকে বললেন, বলুন সার!

বড়বাবু বললেন, দেখুন তো এটা আঢ্যিবাবুর সেই ছড়িটা কিনা! ওঁর স্ত্রী বলেছিলেন, একটা কালো ছড়ি হাতানোর জন্যই ডাকাতরা আঢ্যিবাবুকে খুন করেছিল। ভদ্রমহিলা ছড়িটার যে ডেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এটা মিলে যাচ্ছে। তাই না?

সমাদ্দারবাবুও ছড়িটা দেখে চমকে উঠেছিলেন। ওটা হাতে নিয়ে হাতলের নিচে রুপোলি অংশটা খুঁটিয়ে দেখার পর তিনি বললেন, হ্যাঁ সার! এই তো এখানে খোদাই করা আছে এস, কে, আত্যি। তার মানে সুশীলকুমার আত্যি।

মুরারিবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বড়বাবু তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–দেখুন মশাই! এটা এক সাংঘাতিক মার্ডার কেস। ছেলেখেলা নয়। সত্যি করে বলুন তো আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?

সমাদ্দারবাবু বললেন,-সার! আগে দেখা যাক, এটার ভেতর হীরেগুলো আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে এই ভদ্রলোককে অ্যারেস্ট করতে হবে।

বলে তিনি ছড়ির হাতলটা ঘোরাতে শুরু করলেন। মুরারিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, পঁাচ খুলে হাতলটা আলাদা হয়ে গেল। তারপর সমাদ্দারবাবু ছড়ির মাথার দিকটা টেবিলে ঠুকতে থাকলেন। কয়েকবার ঠোকার পর খুদে তিন টুকরো উজ্জ্বল কী জিনিস বেরিয়ে এল। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছিল বড়বাবুর টেবিলে। সেই রোদে তিন টুকরো জিনিস থেকে চোখ ধাঁধানো দীপ্তি ঝলমলিয়ে উঠল। মুরারিবাবু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

এবার বড়বাবু সহাস্যে বললেন, আপনি এই ছড়িটা কোথায় পেলেন, বলুন তো মশাই?

মুরারিবাবু গুম হয়ে বললেন,–আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী সার?

বললুম না? মার্ডার কেস। বড়বাবু বললেন, কদিন আগে সুশীলকুমার আঢ্যি নামে এক ভদ্রলোক এই ছড়িহাতে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তারপর একটা গলির মোড়ে তাঁর ডেডবডি পাওয়া যায়।

সমাদ্দারবাবু বললেন, স্যার! আমার মনে হচ্ছে, যে কোনও কারণেই হোক, খুনিরা এই ছড়িটা হাতাতে পারেনি।

বড়বাবু বললেন, কারণটা এবার আসামীদুটোর মুখ থেকেই শোনা যাক। ওদের হাজত থেকে এখনই নিয়ে আসুন। ওরা এবার কী বলে শোনা যাক।

সমাদ্দারবাবুর নির্দেশে দুজন কনস্টেবল হাতকড়া এবং কোমরে দড়িবাঁধা দুটো লোককে টানতে-টানতে নিয়ে এল। একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা এবং অন্যজন রোগা। সমাদ্দারবাবু তাদের পেটে বারকতক বেটনের গুতো মেরে বললেন,–বল হতচ্ছাড়ারা! এই ছড়ির জন্যই তোরা সুশীলবাবুকে মার্ডার করেছিস। কিন্তু ছড়িটা হাতাতে পারিসনি কেন?

বেটনের গুতোর সঙ্গে চুল খামচে বেজায় টানাটানির চোটে অস্থির হয়ে বেঁটে লোকটা বলে উঠল, আমরা দুজনে সঙ্গে ছিলুম বটে, তবে খুনটা করেছিল বেচুলাল, সার! ছড়িটা সেই হাতিয়েছিল। পরদিন বেচুর কাছে গিয়ে শুনি, ছড়িটা নাকি তার ঘর থেকে নিপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। ওকে খুব শাসিয়েছিলুম। বেচু মা কালীর দিব্যি কেটে বলেছিল, রাতদুপুরে খুটখুট শব্দ শুনে সে আলো জ্বেলে দেখেছিল, ছড়িটা নাকি জানলা গলিয়ে পালিয়ে গেল। আর ঘরে নাকি ঝঝালো সেন্টের গন্ধ। আপনারা বেচুকে খুঁজে বের করুন সার!

এবার মুরারিবাবু চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, একটা কথা জিগ্যেস করি। সুশীলবাবুর মাথার চুল কি সাদা ছিল?

বেঁটে আসামী ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

–ওঁর পরনে কি গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি ছিল?

–আজ্ঞে।

–পরনে ধাক্কাপাড়ের ধুতি আর পায়ে পামশু ছিল?

–আজ্ঞে।

মুরারিবাবু চুপ করে গেলেন। বড়বাবু বললেন, আপনি সুশীলবাবুকে চিনতেন নাকি মশাই?

আস্তে মাথা নেড়ে মুরারিবাবু বললেন,-এবার কি আমি যেতে পারি সার?

–হ্যাঁ। তবে নাম-ঠিকানা আর একটা স্টেটমেন্ট লিখে দিয়ে যান। সমাদ্দারবাবু! এঁর স্টেটমেন্ট নিন।

কাঁপা কাঁপা হাতে মুরারিবাবু স্টেটমেন্টের তলায় নাম-ঠিকানা লিখে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ একটু থেমে গিয়ে ভাবলেন বড়বাবুকে কি বলে আসবেন, খুনি বেচুলাল ঠিক কথাই বলেছিল তার দুই স্যাঙাতকে!

কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পুলিশের আইনে ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই। তাছাড়া আসল ঘটনা খুলে বলতে গিয়ে হয়তো নিজেও এই খুনের কেসে জড়িয়ে যাবেন। পুলিশ ভূতপ্রেতের চেয়ে সাংঘাতিক। তার চেয়ে চুপচাপ কেটে পড়াই নিরাপদ।

তবে হ্যাঁ। একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সুশীলবাবুর আত্মা যেন ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। মুরারিবাবুর মতো ভালোমানুষ শেষ অবধি তার ছড়িটা থানাতে জমা না দিয়ে পারবেন না। তাই ছড়িটা ওইভাবে বেঞ্চে তাঁর কাছে ফেলে রেখে সুশীলবাবুর আত্মা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।…

কালো বেড়াল

এই নিয়ে পরপর তিন দিন। দিন না বলে সন্ধেবেলা বলাই উচিত। জগমোহন শবেড়াতে বেরিয়ে ঠিক একই জায়গায় একটা কালো বেড়াল দেখতে পেলেন।

কালো বেড়াল এমন কিছু বিদঘুঁটে প্রাণী নয়। কিন্তু একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আর জায়গাটাও তো সন্দেহজনক। গদাইবাবুর আমবাগানে। কিছুদিন আগে যেখানে মোনাই-ফকিরের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই।

মোনাই-ফকিরের আস্তানা একটু দূরে অবশ্য। সে নাকি লটারিতে অনেক টাকা পেয়েছিল। তারপর ডাকাত পড়েছিল রাত্রিবেলা। সকালে দেখা গেল ফকিরের লাশ পড়ে আছে গদাইবাবুর বাগানের ধারে। ধরো আর মুন্ডু আলাদা। সে এক বীভৎস দৃশ্য।

মোনাই-ফকির কালো আলখাল্লা পরে থাকত। মাথার টুপিও ছিল কালো। গাঁজার নেশায় সব সময় চোখদুটো রাঙা। আস্তানা বলতে একটা পুরানো বাদশাহি আমলের মুসলমান সাধুর কবরের ওপরের পাথরের একতলা ঘর। কবরের পাশেই মোনাই-ফকির খেত, ঘুমোত। ওখানেই তার সংসার আর সাধনভজন। হাটবারে লোকেরা এসে তার কাছে ওষুধ চাইত। ভূত-ভবিষ্যৎ জানতে চাইত। পয়সাকড়ি দিত।

এহেন ফকিরমানুষ লোভের বশে লটারির টিকিট কিনেছিল। একেবারে নাকি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। কমপক্ষে লাখ টাকা তো বটে। চারদিকে হইচই পড়ে গিয়েছিল এই খবরে।

কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ফকিরবেচারা প্রাণে মারা পড়ল।

জগমোহন রোজ নদীর ধার অবধি বেড়াতে যান বিকেলে। সন্ধেবেলা লাঠি ঠুকঠুক করে বাড়ি ফেরেন। ওই সব কথা ভাবতে-ভাবতেই হাঁটেন। আমবাগানের ধারে এসে একবার তাকান জায়গাটার দিকে এবং শিউরে ওঠেন। মনে হয়, আবছা আঁধারে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা রেখে ফকির শুয়ে আছে এবং মুন্ডুটা যেন মিটিমিটি হাসছে তাঁর দিকে তাকিয়ে।

অমনি জগমোহন চলার গতি বাড়ান। গলার ভেতর রামনাম দু-চারবার হয় না, এমন নয়!

তারপর এক সন্ধেয় হঠাৎ এই কালো বেড়ালের আবির্ভাব। প্রথম দিন বিশেষ গা করেননি। দ্বিতীয় দিন একটু চমকে উঠেছিলেন। তৃতীয় দিন তো ভীষণ ভড়কে গেলেন ফকিরের কালো আলখাল্লার কথা মনে পড়েই।

জগমোহন এই মফস্বল শহরের একজন রিটায়ার্ড উকিল। বয়স হয়ে গেছে। মাথার চুল তুলোর মতো সাদা। বিকেলবেলা কিছুক্ষণ নদীর ধারে পার্কে গিয়ে না বসলে জীবন বড্ড একঘেঁয়ে লাগে। রাশভারী চেহারার মানুষটি যখন মোটাসোটা ছড়ি অর্থাৎ রীতিমতো লাঠিটি নিয়ে ঠুকঠাক করে হেঁটে যান, পথে সবাই খুব সম্ভ্রম রেখে কথা বলে।

সন্ধেবেলা গদাইবাবুর বাগানের ওদিকটায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে মিটমিটে আলো ছড়ায়। সেই আলোয় কালো বেড়ালের জ্বলজ্বলে হলুদ চোখজোড়া যেন জগমোহনের মনে গেঁথে গেল। সে-রাতে আর ঘুমোতেই পারলেন না। চোখ বুজলেই দেখতেন যেন কালো বেড়ালের হলুদ চোখজোড়া। আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায় বুঝি।

পরদিন বিকেলে আর একা বেড়াতে যেতে ভরসা পেলেন না। ব্যাপারটা কাকেও যে বলবেন, তাও খুব লজ্জা করে। একসময়কার বাঘা উকিল জগমোহন বেড়ালের ভয়ে কাবু–এ বড় খিটকেলের কথা নয়? সবাই হাসাহাসি করবে, আদালতের তাবড় তাবড় দুদে হাকিমকে যিনি ভয় পেতেন না, তিনি সামান্য বিড়াল দেখে ভয়ে পেয়েছেন?

নাতি দিবু খুব ডানপিটে ছেলে। সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছে। এরই মধ্যে সবরকম খেলাধুলায় নাম কুড়িয়েছে। জগমোহন দিবুকে আজ সঙ্গে নিলেন। দিবু কি খেলা ছেড়ে বিকেলবেলাটা বুড়ো দারুর সঙ্গে বেড়াতে বেরোবার ছেলে? অনেক বলেকয়ে লোভ দেখিয়ে তবে সে রাজি হল। ফেরার পথে মেধোর বেঁস্তোরায় কাটলেট কিংবা অম্বুর মিষ্টান্নভাণ্ডারে যথেচ্ছ রসমালাই খাওয়াবার কথা দিলেন জগমোহন। দিবু কাটলেট আর রসমালাইয়ের ভীষণ ভক্ত।

দিবু যখন সঙ্গে আছে, জগমোহনের তখন ভয় কীসের? এখন তিনি আলেকজান্ডার দি গ্রেট। কই এবার আয় দেখি ব্যাটা কালো বেড়াল অথবা মোনাই ফকির আমার সামনে। মাথা ছাতু করে ফেলব না?

আজ পার্ক থেকে একটু দেরি করেই ফিরছিলেন জগমোহন। দিবুর সঙ্গে আদালতের গল্প করতে করতে আসছিলেন। কোন হাকিম এজলাসে বসে ঢুলতেন, কোন হাকিম মামলার রায় পড়ার আগে জোর হেঁচে ফেলতেন, এইসব ক্যারিকেচার শুনে দিবু হেসে খুন হচ্ছিল। রাশভারী, গম্ভীর চেহারার দাদুকে এমন রসিকতা করতে শোনেনি সে।

কখন গদাইবাবুর আমবাগানের কাছে এসে পড়েছেন খেয়াল নেই। এসে যেই ডাইনে মুখ ঘুরিয়েছেন আর দেখতে পেয়েছেন সেই বিদঘুঁটে কালো বেড়ালটাকে। একই ভঙ্গিতে বসে আছে। তীব্র জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। তেমন চাউনি। আর আজ যেন গোঁফের তলায় কেমন একটা হাসিও রয়েছে।

জগমোহন অমনি লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার। মার। মার।

দিবু অবাক হয়ে বলল, কী হল দাদু? কী হল? কাকে মারতে যাচ্ছ?

জগমোহন হাঁপাত-হাঁপাতে লাঠি তুলে বললেন,–ওইগুই কালো বেড়ালটাকে।

বেড়াল! –দিবু আরও অবাক।–কই, কোথায় বেড়াল?

–ওই তো! দেখতে পাচ্ছিসনে? ওই যে!

দিবু হাসতে লাগল।–তোমার চোখ খারাপ দাদু। ওটা তো একটা কালো কাঠ পড়ে রয়েছে। সে দৌড়ে গিয়ে একটুকরো কাঠে লাথি মারল।

জগমোহন দেখলেন, বেড়ালটা সত্যি কাঠ হয়ে গেছে। তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে পা বাড়ালেন। মনটা ভালো হয়ে গেল। একেই বলে রজুতে সর্পভ্রম অর্থাৎ দড়িকে সাপ মনে করা। ছ্যা-ছ্যা কী লজ্জার কথা।

কিন্তু কিছুটা গিয়েই হঠাৎ মনে হল, যেন চাপাস্বরে বেড়ালটা ডাকল–মিউ! অমনি ঘুরলেন। ঘুরেই আঁতকে উঠলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

সেই কালো বেড়ালটা পেছন পেছন আসছে!

জগমোহন ফের লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার! মার! মার!

দিবু এবার রেগে গেল! বলল,–ও দাদু! আবার কী মারতে যাচ্ছ?

জগমোহন কাঁপতে কাঁপতে বললেন,-বেড়াল! সেই কালো বেড়াল।

–কই বেড়াল?

–এই তো!

দিবু আরও রাগ দেখিয়ে বলল, তোমার মুন্ডু। আমি চললুম।

কালো বেড়ালটা এখন একটু সরে গিয়ে রাস্তার পিচে বুক ঠেকিয়ে বসেছে। এ রাস্তাটা খাঁ-খাঁ নির্জন। জগমোহন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, দিবু! দিবু যাসনে। কাটলেট, রসমালাই!

তখন দিবু দাঁড়াল। তারপর হাসতে-হাসতে বলল,–বেড়ালকে এত ভয় কীসের বলো তো? বেড়াল ইজ বেড়াল।

জগমোহন হাঁটেন আর বারবার পিছু ফেরেন। আশ্চর্য! কালো বেড়ালটার সঙ্গে তার দূরত্ব সেই একই থেকে যাচ্ছে! ভিড়ে ভরা বড়রাস্তায় পৌঁছে অবশ্য আর তাকে দেখতে পেলেন না।

সেই রাতে জগমোহন অস্থির। চোখে ঘুম নেই।

একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কালো বেড়ালটাকে তিনি একা দেখতে পান, আর কেউ পায় না। দিবু দেখতে পায়নি তো!

আর তার চেয়েও বড় কথা, দিবুকেও বেড়ালটা গ্রাহ্য করল না। একবার বেমালুম কাঠে রূপান্তরিত হল।

দ্বিতীয়বার তার সামনে অদৃশ্য হয়ে রইল। শুই তাই নয়, জগমোহনকে অনুসরণ করল কতদূর।

অতএব বেড়ালটা সেই মোনাইফকিরের আত্মা, অর্থাৎ ভূত। হায়-হায়! এতকাল পরে এই বুড়োবয়সে জগমোহন একটা ভূতের পাল্লায় পড়লেন?

কথাটা যত ভাবছেন, আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ফকিরের ভূত তার গলা কামড়ে ধরবেই ধরবে।

বাড়িটা শহরের শেষপ্রান্তে। জগমোহনের ঘরের পেছনে জঙ্গুলে জায়গা খানিকটা। তার ওধারে সেই নদী! এমন জায়গায় বাড়ি করাই ভুল হয়েছিল।

তার ওপর মশারও খুব উপদ্রব বারোমাস।

তবে একটা সুবিধে হয়েছে দেখা যাচ্ছে। মশারির ভেতর শুয়ে থাকার ফলে রাতের বেলা নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন। বেড়াল তোক আর ভূতপ্রেতই হোক, মশারির ভেতর ঢুকতে পারবে কি? না পারাই উচিত। কোন বইয়ে যেন পড়েছিলেন, মশারির ভেতর মানুষ খুব নিরাপদ!

দেয়ালঘড়িতে টকটক শব্দ। তারপর ঢংঢং করে রাত বারোটা বাজল। আর তারপরই জগমোহন শুনলেন, মিড। অমনি চমকে মুখ তুললেন।

বাইরে অন্য পাশের রাস্তার আলো ত্যারচা হয়ে একটা জানালায় পড়েছে। আর সেখানে ফের আবির্ভূত হয়েছে সেই কালো বেড়াল। জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। মশারির ভেতর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোঁফের তলায় তেমনি একটা হাসিও। হাসিটা এখন কেমন ক্রুর। কালো বেড়ালটা ফের বলল–মিউ।

জগমোহন ততক্ষণে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাঁদরের বেলায় যেমন, তেমন ভূতের বেলাতেও এক কথা। বেশি পাত্তা দিতে নেই। পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে বসবে। ভূতকে ভয় করলেই ভূত আরও পেয়ে বসবে।

অতএব জগমোহন ভয় চেপেচুপে রেখে সোজা ভেংচি কাটলেন ভূত অর্থাৎ কালো বেড়ালকে, মিউ।

কালো বেড়ালও সঙ্গে সঙ্গে বলল,-মিউ! আর এতক্ষণে জগমোহন টের পেলেন, তিনি বেড়ালের ভাষা বুঝতে পেরেছেন। কী বলছে, ঠাহর হচ্ছে। কালো বেড়াল বলছে, টাকা।

অ্যাঁ টাকা! জগমোহনের টনক নড়ল। বেড়ালের ভাষায় বলে উঠলেন, মিয়াও! মিয়াও! টাকা? কীসের টাকা?

কালো বেড়াল বলল,–ম্যাঁও! ম্যাঁও! কেন? লটারির টাকা?

ওরে বাবা! বলে কী ব্যাটা! লটারির টাকা মানেটা কী?

জগমোহন হতভম্ব হয়ে বললেন,–মিঁই-ই! অ্যাঁ! বলল কী হে?

মিঁ-ও-ও! মিঁ-ও-ও! কেন উকিলবাবু, আমার লটারিতে পাওনা টাকার কথা ভুলে যাচ্ছেন!

মিঁউ, মিঁউ! কী মুশকিল! তোমার লটারির টাকা তো তোমায় খুন করে ডাকাতব্যাটারা নিয়ে পালিয়েছে–জগমোহন বললেন, ও বুঝেছি। তা তুমি কি আমাকে মামলা করতে বলছ তোমার হয়ে? মলো ছাই! ডাকাতব্যাটাদের কি আমি চিনি! তুমি বরং দারোগাবাবুর কাছে যাও। তিনি তোমার টাকা উদ্ধার করে দেবেন। ও ব্যাটাদের জেলে পুরবেন। যাও দিকি বাবু দারোগার কাছে।

–ম্যাঁও-ম্যাঁও! ওকথা বললে তো চলবে না উকিলবাবু।

ম্যাঁ-অ্যাঁ-ও–চলবে না মানে? আমি তো কবে ওকালতি ছেড়ে দিয়েছি হে!

–মিঁউ মিঁউ মিঁউ। টাকা টাকা টাকা! কোনও কথা শুনব না। টাকা চাই।

জগমোহন বিব্রত হয়ে মানুষের ভাষায় বললেন, কী আপদ! ভাগো, ভাগো বলছি। নইলে লাঠিপেটা করব।

কালো বেড়াল এবার নিজের ভাষায় তবে রে, বুড়ো! বলে এক লাফে তাঁর মশারির ছাদে এসে পড়ল। অমনি পটাপট দড়ি ছিঁড়ে মশারি আর বেড়াল পড়ল জগমোহনের ওপর। মুহূর্তে হুলুস্থুল ঘটে গেল। জগমোহন আর্তনাদ করতে লাগলেন, বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও। মশারির ভেতর জড়িয়ে-মুড়িয়ে খাটের নিচে পড়ে গেলেন। বাড়ির সবাই জেগে গেল। দরজায় ধাক্কা দিতে থাকল। কিন্তু দরজা খুলবে কে? শেষে প্রচণ্ড ধাক্কায় কপাট ভেঙে ফেলা হল। তারপর মশারি থেকে উদ্ধার করা হল জগমোহনকে।

দিবুর বাবা প্রণবেশ বললেন, কী কাণ্ড! মশারির দড়ি ছিঁড়ল কীভাবে?

দিবুর মা অরুণা বললেন, নিশ্চয় বেড়াল পড়েছিল। আমি তো জেগেই ছিলুম। কখন থেকে শুনছিলুম, এ ঘরে যেন বেড়াল ডাকছে। ভাবলুম, দুই বেড়ালে ঝগড়া বেধেছে।

জগমোহন অতি কষ্টে বললেন,–এক গ্লাস জল।

হ্যাঁ, কথাটা তো ঠিক। দুই বেড়ালের ঝগড়া বলা যায়। কিন্তু ঝগড়াটা টাকা নিয়ে। লটারির টাকা। ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়। মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছেন না জগমোহন।

জল খেয়ে সুস্থ হয়ে জগমোহন বললেন, কী বলছিলে বউমা, বেড়ালের ঝগড়া না কী?

অরুণা বললেন, হ্যাঁ। মনে হচ্ছে দুটো বেড়াল ঝগড়া করতে করতে আপনার মশারির ওপর পড়েছিল।

জগমোহন জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না। টাকা! লটারির টাকা।

তার মানে?–প্রণবেশ অবাক হয়ে বললেন,–বাবা, লটারির টাকা মানে কী?

জগমোহন ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাঁটু মুড়ে খাটের তলায় ঢুকলেন। বাড়ির লোকেরা হতবাক। দিবু ঘুমজড়ানো চোখে তাকিয়ে বলল,–ও দাদু! ওখানে ঢুকছ কেন? বেড়ালের ভয়ে? হি হি হি হি।

তাই শুনে রাঁধুনি হরুঠাকুর, কাজের লোক আন্নাকালী আর চাকর নবা পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। অরুণা ধমক দিয়ে বললেন, এতে হাসির কী আছে? যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো সব। সকাল সকাল উঠতে হবে। দেওঘরের ঠাকুরপো আসবেন না কাল? কত কাজ?

ওরা ব্যাজার মুখে যে-যার জায়গায় চলে গেল।

খাটের তলায় ঘষটানো শব্দ হচ্ছিল। জগমোহন কী একটা টেনে বের করছেন।

একটা পুরোনো সুটকেস। একদিকে ছোট্ট তালা আটকানো। সুটকেসটা টেবিলে রেখে জগমোহন বললেন, একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হায় ভুলো মন! মোনাই ফকির খুন হওয়ার কদিন আগে এটা আমায় রাখতে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে, ডাকাতব্যাটারা খামোকা বেচারাকে খুন করে গেল। খামোকাও হয়তো নয়, রাগে। টাকাগুলো পেলে খুন করত না। পায়নি বলেই রেগেমেগে মুণ্ডু কেটে ফেলেছিল। কিন্তু দেখো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এই সুটকেসের মধ্যে…কী ভুল! কী ভুল!

প্রণবেশ বললেন,–ও বাবা, ব্যাপারটা কি বলবেন খুলে?

জগমোহন দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,–বলব আবার কী? মোনাই-ফকিরের টাকা। শিগগির একটা জাবির গোছা আন। তালা না খুললে ভাঙতেই হবে শেষপর্যন্ত।

.

মোনাই-ফকিরের আস্তানা ঘিরে জগমোহন একটা অনাথ আশ্রম বানিয়ে দিয়েছেন। অনাথ ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া শিখছে। কারিগরি কাজ শিখে মানুষ হচ্ছে।

মোনাইয়ের লটারির টাকা। জগমোহনও কিছু দিয়েছেন নিজের পুঁজি থেকে। আজকাল সেই অনাথ আশ্রম নিয়েই থাকেন তিনি! বাকি জীবনের জন্য একটা ভালো কাজ পেয়ে গেছেন।

আর কালো বেড়ালটা?

শেষবার দেখেছিলেন অনাথ আশ্রম উদ্বোধনের দিন। কলকাতা থেকে এক মন্ত্রীমশাই গিয়েছিলেন উদ্বোধন করতে। জগমোহন দেখেছিলেন অত ভিড়ের মধ্যে কালো বেড়ালটা দিব্যি এসে তাঁর দু-পায়ের ফাঁকে কিছুক্ষণ বসে থাকল। পা শিরশির করছিল। তবু আর ভয় পাননি জগমোহন। এমন কী যাওয়ার সময় বেড়ালটা মিউ বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল।

মোনাই-ফকিরের আত্মার শান্তি হয়েছে! আর জগমোহনকে জ্বালাতে আসে না।

অবশ্য জগমোহন এখন কদাচিৎ কালো বেড়াল দেখলে চমকে ওঠেন। তবে আর মারমার বলে তাড়া করেন না। এরা তো ভূত নয়, নেহাত পাড়ার হুলো। একটু হেসে বেড়ালের ভাষায় ধমক দিয়ে শুধু বলেন, মিউ। অর্থাৎ তুই আবার কে রে? ভাগ-ভাগ!…