- বইয়ের নামঃ ভৌতিক গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
অদলবদল
রোজ ভোরবেলা পার্কে কিছুক্ষণ বেড়ানো হরিপদবাবুর অনেককালের অভ্যাস। ৫ম পার্কটা বেশ বড়। কিন্তু হাঁটাচলার পর একটুখানি যে বসবেন কোথাও, তার উপায় নেই। এখানে-ওখানে যত বেঞ্চ আছে, কখন সবগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। ঘাসে বসারও বিপদ আছে। ছেলেপুলেদের যা পাঁয়তারা, কে কখন ঘাড়ে এসে পড়ে তার ঠিক নেই। তার চেয়ে বড় বিপদ ওদের ফুটবল। যেন কামানের গোলা।
তিতিবিরক্ত হরিপদ অগত্যা নিরিবিলি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বকুল গাছটার দিকে যান। বকুলতলায় এক টুকরো কালো পাথর পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, কখন পাথরটাও দখল হয়ে গেছে। হোঁতকা-মোটা, মাথায় টাক আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চ্যাপ্টা নাক, কুতকুতে চোখ নিয়ে একটা লোক আরামে বসে আছে।
যেদিনই যান, দেখেন তাঁর যাওয়ার আগে কখন লোকটা বকুলতলার আসনটা দখল করে ফেলেছে।
জায়গাটা যে এমন কিছু সুন্দর তাও নয়। একটু নিরিবিলি এই যা। ওদিকটায় বলের ঘা খাওয়া রিস্কও নেই। তবে ওখানে বসে আর কিছু না থোক, রেলগাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। রেলগাড়ি দেখতে ভালোই লাগে হরিপদবাবুর। মনে-মনে কঁহা কাহা মুল্লুক চলে যাওয়া যায়। কু-ঝিক-ঝিক…কু-ঝিক-ঝিক! কখনও রেলগাড়ির চাকা ছড়া বলে, টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিটবাবুর কত টাকা! টিকিট বাবুর কত টাকা! ছেলেবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়।
শেষে জেদ চড়ে গেল হরিপদবাবুর। আগেভাগে গিয়ে পার্কের বকুলতলার পাথুরে আসনটা তাঁর দখল করা চাই-ই। সেদিন ভোরের আগে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিকঠিক চারটে। আবছা আঁধার লেগে আছে ঘরবাড়ির গায়ে। পার্কে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে। রাস্তায় কদাচিৎ চাপা গরগর শব্দে চলে যাচ্ছে একটা করে মোটরগাড়ি–তখনও হেডলাইট জ্বলছে। হরিপদবাবু পার্কে ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। বকুলতলা ঝুপসি হয়ে আছে আঁধারে– কুয়াশায়। ঘাসে শিশির চকচক করছে। পাথরটা খালি পড়ে আছে। হরিপদবাবু সিংহাসন দখল করার আনন্দে বসে পড়লেন তার ওপর। পাথরটা ঠান্ডা বটে, তাতে কিছু আসে যায় না। হরিপদবাবু খুশিতে বসে দুই পা দোলাতে থাকলেন। এমনকী গুনগুন করে গানও গাইতে লাগলেন।
আস্তে আস্তে কালচে রং ধূসর হতে থাকল। তারপর সাদা হল। একজন-দুজন করে লোক এসে পার্কে ভিড় করল। কেউ ধুকুরপুকুর দৌড়চ্ছে। কেউ যোগব্যায়ামেও বসে গেছে। কেউ কুকুর নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেঞ্চগুলোতে বুড়োরা এসে বসে পড়েছে। তারপর ছেলেপুলেদের পায়তারা শুরু হয়েছে ফুটবল নিয়ে। হরিপদ বাবু তেমনি নিরিবিলি বকুলতলায় গুনগুন করছেন আর ঠ্যাং দোলাচ্ছেন।
কতক্ষণ পরে আনমনে মাথায় হাত বুলোতে গিয়েই চমকে উঠলেন। এ কী! তার মাথাভর্তি একরাশ পাকা চুল ছিল। চুল কোথায় গেল?
বারবার হাত ঘষেও চুলের পাত্ত পেলেন না। চামড়ায় হাত ঠেকছে। তার মানে, হঠাৎ তার মাথায় টাক পড়ে গেল নাকি অবাক হয়ে মাথায় আঙুল ঠুকলেন। আরও চমকে গেলেন। সর্বনাশ! তার মাথাভর্তি টাক যে!
তারপর হাত গালে ঘষে ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিদিন দাড়ি কাটা অভ্যাস। পার্ক থেকে ফিরেই দাড়ি কাটেন। কালও কেটেছেন। চব্বিশ ঘণ্টায় এত দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল গজানো অসম্ভব। অথচ গজিয়েছে।
প্রচণ্ড আঁতকে উঠে হরিপদবাবু টের পেলেন, তাঁর গায়ের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি আঁটো হয়ে গেছে। চটিজুতোয় পা দুটো আর ঢুকছে না। এ তো ভারি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! আঙুল ফুলে কলাগাছ ব্যাপার কি একেই বলে?
হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছেন হরিপদবাবু। এমন সময় লাঠি ঠুকঠুক করে এক ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন,–ভোম্বলবাবু যে! আছেন কেমন? বহুদিন তো দেখাশোনাও নেই। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?
হরিপদবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন,–ভোম্বলবাবু কে মশাই? আমি হরিপদ তালুকদার।
ভদ্রলোক খিকখিক করে হাসলেন–চিরকাল থিয়েটারে অ্যাকটিং করে অভ্যাসটা এখনও ছাড়েননি দেখছি ডোম্বলবাবু! তা ইয়ে, আপনার জামাইবাবাজির খবর কী? শুনেছিলুম, পুলিশে নাকি…
হরিপদ তেড়ে উঠে বললেন,–কী যা তা বলছেন মশাই? আমার মেয়েই নেই তো জামাই।
আহা, ওতে লজ্জার কী আছে ডোম্বলবাবু?–ভদ্রলোক বললেন। পুলিশ কাউকে ধরলেই তো সে চোর হয়ে যায় না। আদালত আছে কী করতে?
হরিপদবাবু আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। তার জামাই নেই। যদি দৈবাৎ থাকতও, তাকে চুরির দায়ে পুলিশ ধরত-ভাবতেও মাথায় খুন চড়ে যায়। কথা না বাড়িয়ে তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে কেটে পড়লেন। ভদ্রলোক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
পার্ক থেকে বেরুবার মুখে আরেক ভদ্রলোক তাকে দেখে বলে উঠলেন, আরে ভোম্বলদা যে!
হরিপদবাবু কটমট করে তাকিয়ে জোরে হাঁটতে থাকলেন। পেছনে ভদ্রলোক তখন বলছেন,–হল কী ভোম্বলদা? আরে শোনো শোনো!
কোনদিকে না তাকিয়ে হরিপদবাবু গলিরাস্তায় পৌঁছলেন। তারপর নিজের বাড়ির দরজায় কলিংবেলের বোতাম টিপলেন। ততক্ষণে আরও টের পেয়েছেন, তাঁর গায়ে প্রচণ্ড জোরও এসে গেছে। কিন্তু বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। একটা দারুণ গণ্ডগোল নিশ্চয় ঘটে গেছে।
দরজা খুলে তার প্রিয় চাকর কাম-রাঁধুনি হরু গম্ভীরমুখে বলল, কাকে চাই?
হরিপদবাবু গর্জে উঠলেন এবার, কাকে চাই কী রে ব্যাটাচ্ছেলে? ভাঙ খেয়েছ সাতসকালে? তারপর হারুকে ঠেলে ঘরে ঢুকে গেলেন।
হারু হই-চই করে উঠল, আচ্ছা ভদ্রলোক তো মশাই আপনি! গায়ের জোরে পরের বাড়ি ঢুকে পড়লেন যে বড়? আরে! ও কী! কোথায় যাচ্ছেন?
হরিপদ সটান নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আঁতকে দেখলেন, রোজ পার্কের বকুলতলায় পাথরটার ওপর যে লোকটাকে বসে থাকতে দেখেছেন সেই লোকটাই বটে। হরিপদবাবু তার শরীটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু তার নিজের শরীরটা কোথায় গেল, সেটাই সমস্যা। আর ছ্যা ছ্যা, এমন বিচ্ছিরি নাক থাকতে আছে মানুষের।
হরু ততক্ষণে পাড়া মাথায় করে চেঁচাচ্ছে,–ডাকাত ডাকাত পড়েছে! এমন জোর করে শোওয়ার ঘরে ঢোকে যে, সে নিশ্চয় ডাকাত। হরিপদবাবু আয়নার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। পার্কে বেড়াতে গেলেন হরিপদবাবু হয়ে, ফিরে এলেন কোন হতচ্ছাড়া ডোম্বলবাবুটি হয়ে যিনি নাকি একসময় থিয়েটারে অ্যাকটিং করতেন এবং যাঁর জামাই লোকটা চোর না হয়ে যায় না! এ কী সর্বনেশে কাণ্ড রে বাবা!
কিন্তু তার চেয়ে সর্বনেশে কাণ্ড যে ঘটতে চলেছে, ঠাহর হল পাড়ায় লোকের হট্টগোলে। বাড়ির দরজায় ওরা চেষ্টাচ্ছে, কই ডাকাত? কোথায় ডাকাত? ধর ব্যাটাকে! মারমার! কেউ বলছে,-যাসনে, যাসনে! ভোজালি আছে। পুলিশ ডাক! তার মধ্যে হরু এন্তার চেঁচাচ্ছে, সব লুঠ হয়ে গেল যে! ওরে বাবা! এতক্ষণে সব লুঠ করে ফেললে রে!
সাহসী ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়ি ঢুকছে টের পেয়েই হরিপদবাবুর বুদ্ধি খুলে গেল। দড়াম করে দরজায় খিল এঁটে দিলেন। দরজার বাইরে ছেলেগুলো হল্লা করছে। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। হরিপদবাবু ভেতর থেকে শাসিয়ে বললেন, সাবধান! আমার কাছে বোমা আছে। উড়িয়ে দেব!
ছেলেগুলো ভয় পেয়ে গেল। বয়স্করা বললেন,–ওরে! সরে আয়! সরে আয়! পুলিশে খবর গেছে।
পুলিশের কথা শুনে হরিপদবাবুর বুকের ভেতর কাঁপুনি বেড়ে গেল। তখন ঘরের ভেতর থেকে করুণ স্বরে ডাকলেন, হরু! ওরে বাবা হারাধন! আমি তোর মনিব হরিপদ তালুকদার। সত্যি বলছি!
হরু বলল,–চালাকি হচ্ছে? আমার মনিবকে আমি চিনিনে? ওইরকম চেহারা নাকি ওনার? ওইরকম হেঁড়ে গলা নাকি? ছা-ছ্যা, যেন নিমতলার আস্ত পিচেশ!
গণ্ডগোল একটু থেমেছে। সবাই পুলিশের প্রতীক্ষা করছে। হরিপদবাবুর গলা আবার শোনা গেল ভেতর থেকে,–সত্যি বলছি আমি হরিপদ তালুকদার। দোহাই তোমাদের, এখন পুলিশ-টুলিশ ডেকো না! ও বাবা হারাধন! ওদের বুঝিয়ে বল না একটু। আমিই তোর কর্তাবাবু রে!
হারু তেড়েমেড়ে বলল, বলবটা কী মশাই! হরিপদবাবুর বাড়ি সেই এতটুকুন বাচ্চা বয়েস থেকে কাজ করছি। আমি কর্তাবাবুকে চিনিনে? থামুন, দারোগাবাবুকে আসতে দিন।
বলতে বলতে এসে গেলেন দারোগাবাবু। পেল্লায় গোঁফের ডগায় পাক খাইয়ে বললেন, কই? কোথায় ডাকাত?
সবাই একগলায় বলে উঠল,–ওই ঘরের ভেতর স্যার!
দাবোগাবাবু হাঁক মেরে বললেন,-গিরধর সিং! দরওয়াজা তোড়ো! জলদি তোড়!
শুনেই হরিপদবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে যাচ্ছেন, টাকে খাটের একটা ধার জোরে লাগল। উঃ করে ককিয়ে উঠলেন।
তারপর দেখলেন, প্রচণ্ড অবাক হয়েই দেখলেন, পড়ে গেছেন শিশিরভেজা ঘাসে এবং বকুলতলার সেই পাথরটাতে ঠোক্কর লেগেছে মাথায়। বেশ জোরেই লেগেছে।
এই সময় কেউ বলে উঠল, আহা! লাগল নাকি।
তাকিয়ে দেখে অবাক হরিপদ তালুকদার। সেই টাকওয়ালা লোকটা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল–রোজ যে এই পাথরের আসনটা দখল করে বসে থাকে এবং যে কিছুক্ষণ আগে তাকে সর্বনাশের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
লোকটা হাসতে-হাসতে বলল,–ওখানে বসলেই কিন্তু ঘুম পায়। বুঝলেন?
হরিপদবাবু মনে-মনে বললেন, বুঝেছি। তার মানে পাথরটা দখল করার জন্য রাত চারটেয় শেষ ঘুম বরবাদ করার শাস্তিটা ভালোই পেয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–মশায়ের নাম কি ডোম্বলবাবু?
–আজ্ঞে না। আমার নাম হরিপদ চাকলাদার।
শুনেই হরিপদবাবু হনহন করে কেটে পড়লেন। আর কক্ষনো এ ভুতুড়ে পার্কে এত ভোরে বেড়াতে আসবেন না। বাড়ির কাছাকাছি হতে হঠাৎ মনে হল, নামটা কী হরিপদ চাকলাদার বলল, না তালুকদার বলল? চাকলাদার না তালুকদার? তালুকদার না চাকলাদার?
তালুকদার হলে বেটাচ্ছেলে আমার মতোই বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে হরিপদ শেষে খিকখিক করে হেসে উঠলেন।
অদ্ভুত যত ভূত
ছোটমামার সঙ্গে ছিপে মাছ ধরতে যাচ্ছিলুম। ছোটমামার ছিপটা বড় মাছধরা হুইল। আর আমারটা নেহাত পুঁটিধরা কঞ্চির ছিপ। বঁড়শিও খুদে।
ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। কদিন বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। ঝলমলে রোদে গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে সবুজ রঙের জেল্লা বেড়েছে। আমার মনও খুশিতে চঞ্চল। ছোটমামা বলেছেন, বুঝলি পুঁটু? আজ থেকে তোর ট্রেনিং শুরু। তোর ডাকনাম পুঁটু। তাই দেখবি, পুঁটিমাছেরা তোর বঁড়শির সঙ্গে ভাব জমাতে ভিড় করবে। ওরা কিন্তু বড় চালাক। ফাতনা নড়লেই ছিপে খ্যাচ মারবি।
–খ্যাঁচ কী মামা?
–ধুর বোকা! এ্যাচ বুঝিস না? ঠিক আছে। তোকে হাতেকলমে শিখিয়ে দেব।
গ্রামের শেষদিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেখানে আদ্যিকালের ভাঙা শিবমন্দির ঘিরে প্রকাণ্ড বটগাছ এবং ঝোঁপজঙ্গল গজিয়েছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল মোনা-ওঝার সঙ্গে।
মোনার মাথায় জটা। মুখে গোঁফ-দাড়ি। ওপর পাটির একটা দাঁত ভাঙা। তাই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর কপালে দগদগে সিঁদুরের ঘটা সত্ত্বেও হাসলে তাকে খুব অমায়িক ও সরল মানুষ মনে হয়। কিন্তু যখন সে গম্ভীর হয়ে থাকে, তখন তাকে দেখলে বড় গা ছমছম করে। তার চোখদুটো যে বেজায় লাল।
মোনা-ওঝা আমাদের দেখে কেন কে জানে ফিক করে হাসল। তারপর বলল,–ছোটবাবু, ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ছিপ ফেলতে বেরিয়েছেন বুঝি? ভালো! তা কোথায় ছিপ ফেলবেন?
ছোটমামা বললেন,–সিঙ্গিমশাইয়ের মাঠপুকুরে।
মোনা বলল,–ওই পুকুরে আর মাছ আছে নাকি? এই তো গত মাসে সিঙ্গিমশাই জেলেদের সব মাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। সারাদিন জাল ফেলে-ফেলে জেলেরা মাছের ছানাপোনাসুদ্ধ ঘেঁকে তুলে নিয়েছে।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–সে কী মোনাদা! সিঙ্গিমশাইয়ের কাছে আজ সকালে যখন ছিপ ফেলার জন্য পারমিশন চাইতে গেলুম, উনি বললেন, দুটোর বেশি ধোরো না যেন।
মোনা-ওঝা হেসে কুটিকুটি হল। –মিথ্যে! একেবারে মিথ্যে! বুঝলেন ছোটবাবু? চোরের জ্বালায় মাত্র আড়াইশো-তিনশো গ্রাম ওজন হলেই পোনামাছগুলো বিক্রি করে দেন সিঙ্গিমশাই। তাছাড়া আপনার হুইলে ধরার যোগ্য মাছ কি ওখানে কখনও ছিল? তবে হ্যাঁ। এই খোকাবাবুর ছিপে ধরার মতো পুঁটিমাছ থাকলেও থাকতে পারে।
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-মিথ্যুক! হাড়কেল্পন! আমাকে খামোকা হয়রান করল! টাউন থেকে শখ করে এত দামি হুইল কিনে আনলুম। সকাল থেকে কতরকমের চার আর টোপ তৈরি করলুম!
মোনা বলল,–এক কাজ করুন ছোটবাবু! একটু কষ্ট করে দোমোহানির ঝিলে চলে যান। ঝিলে কিন্তু প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড মাছ আছে। ঝাঁপুইহাটির কালিবাবু এই তো দুহপ্তা আগে একটা পাঁচ কেজি রুই তুললেন। আমার চোখের সামনে, ছোটবাবু! মা কালীর দিব্যি!
ছোটমামা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু বড় দূরে যে!
দুর কী বলছেন? নাক বরাবর ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে ওই বাঁধে উঠুন। মাত্র আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।বলে মোনা আমার দিকে তাকাল, কি খোকাবাবু? যেতে পারবে না মামার সঙ্গে?
কী আর বলব? মাথাটা একটু কাত করলুম শুধু। পুঁটিমাছ ধরার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠেছে যে!
ছোটমামা হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। বললেন, আয় পুঁটু! মোনাদা ঠিকই বলেছে, মাছ পাই বা না পাই, একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাক না। তাছাড়া তোর ট্রেনিংটা ওইরকম ঝিল-জঙ্গলে শুরু করাই উচিত।
ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। পিছন থেকে মোনা-ওঝা বলল,–তবে একটা কথা ছোটবাবু! সূর্য ডোবার পর আর এখানে কিন্তু থাকবেন না। সঙ্গে খোকাবাবু আছে বলেই সাবধান করে দিলুম।
ছোটমামা বললেন,–ছাড় তো বুজরুকে কথা। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। তাই না পুঁটু? ওঁর কথায় অগত্যা সায় দিতেই হল। যদিও মোনা-ওঝার কথাটা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল।…
বাঁধের নিচে ঝিলটা বাঁকা হয়ে একটু দূরের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু ছিপ ফেলার মতো কঁকা জায়গা চোখে পড়ল না। ঝিলে ঘন দাম, পদ্ম আর শালুক ফুলের ঝাঁক। কোথাও শোলাগাছ গজিয়েছে দামের ওপর। ছোটমামা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছিপ ফেলার মতো খানিকটা কঁকা জায়গা আবিষ্কার করলেন। তারপর বললেন,–বুঝলি পুঁটু? এখানেই ঝাঁপুইহাটির কোন কালীবাবু ছিপ ফেলেছিলেন মনে হচ্ছে। এই দ্যাখ, এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ পড়ে আছে। হুঁ! সিগারেটের ফিল্টারটিপও অজস্র। কালীবাবু খুব সিগারেট খান বোঝা যাচ্ছে।
ঝিলের উত্তর পাড়ে এই জায়গাটা ছায়ায় ঢাকা। কারণ, বাঁধে একটা বটগাছ আছে। তার লম্বা ডালপালা ঝিলের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। ছোটমামা ঝটপট চার ফেলে ছিপ সোজা রাখার জন্য ঝোঁপ থেকে একটা আঁকশির মতো ডাল ভেঙে আনলেন। এক হাঁটু জলে নেমে সেটা কাদায় পুঁতে বললেন,–তোর ছিপটা ছোট্ট তো! ওটা হাতে ধরে থাকতে পারবি। আমারটা যে হুইল ছিপ। ডগাটা আঁকশির মাথায় রাখলে তবে ছিপটা সোজা থাকবে।
মাঝে-মাঝে শিরশিরে বাতাস বইছিল। রোদে হাঁটার কষ্টটা শিগগির দূর হয়ে গেল। মামা-ভাগ্নে দুজনে দুটো ছিপ ফেলে বসে রইলুম। ঝিলের ওপারে ঘন বাঁশবন। সেখানে একঝাক পাখি তুমুল হল্লা করছিল। জল-মাকড়শারা জলের ওপর তরতরিয়ে ছোটাছুটি করছিল। একটা লাল গাফড়িং ছোটমামার ছিপের ফাতনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একটা জলপিপি পাখি পিপি করে ডাকতে ডাকতে দূরে ঝিলের জলে কোথাও বসল।
এতক্ষণে মনে পড়ল, ছোটমামা আমাকে খ্যাচ মারা শেখাবেন। কিন্তু কথাটা তুলতেই উনি চাপাস্বরে বললেন, আমার চারে মাছ এসে গেছে। বুজকুড়ি দেখতে পাচ্ছিস না? মাছটা টোপ খেলেই আমি ছিপটা যেভাবে জোরে তুলব, সেটাই এ্যাচ। তুই লক্ষ রাখিস।
আমার ছিপের ফাতনা দুবার কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেল। খ্যাচ মারা ব্যাপারটা না দেখা পর্যন্ত কী আর করা যাবে!
কিছুক্ষণ পরে দেখি, ছোটমামার ছিপের ফাতনা নড়তে শুরু করেছে। ছোটমামা ছিপের হুইলবাঁধা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর ফাতনাটা যেই ডুবে গেল, অমনি ছোটমামা জোরে ছিপটা তুলে ফেললেন। সাঁই করে একটা শব্দ হল। কিন্তু কী অবাক! ছোটমামার বঁড়শিতে বিঁধে যে জিনিসটা ছিটকে আমাদের পেছনে গিয়ে পড়ল, সেটা তো মাছ নয়!
ছোটমামা ছিপ ফেলে এক লাফে পেছনে বাঁধের গায়ে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারপর ফাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ! এটা দেখছি একটা মড়ার খুলি!
কথাটা শুনেই আমি ওঁর কাছে চলে গেলুম। ছোটমামা একটা শুকনো কাঠি দিয়ে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, কোনও মানে হয়?
খুলিটা দেখেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর দেখি, খুলিটা লাফাতে লাফাতে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোটমামা গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তো ভয়ের চোটে এমন ভ্যাবলা হয়ে গেছি, যেন আমার পাদুটো মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকানো।
ছোটমামা বিড়বিড় করছিলেন, এ কী রে পুঁটু? এ কী রে! এ কী হচ্ছে? অ্যাঁ?
তারপর দেখলুম খুলিটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে জলে পড়ল। জলের ওপর কিছুদূর পর্যন্ত বুজকুড়ি উঠে সেগুলো ভেঙে গেল। ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন,–এ কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বল তো পুঁটু?
বললুম,–ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে। চলুন। আমরা এখান থেকে এখুনি চলে যাই।
ছোটমামার এই এক স্বভাব। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন। বললেন, ধুস! একটা মড়ার খুলি দেখে ভয় পাব আমরা? কী বলিস পুঁটু? বলেছিলুম না আমরা অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি?
বলে উনি আবার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে ছিপ ফেললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–দেখলি তো খ্যাচ মারা কাকে বলে?
তারপর বসে আছি তো আছি। কিন্তু আর ফাতনা নড়ে না। আমি জলের দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকাতে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। কে জানে বাবা! এবার যদি আমার বঁড়শিতে টোপ খেতে আসে খুলিটা!
তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, মড়ার খুলি একেবারে জ্যান্ত।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাদের বাঁদিকে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর কে ভরাট গলায় বলে উঠল,–তারা তারা তারা। তারা তারা তারা! ব্রহ্মময়ী মাগো!
আমরা চমকে উঠে ঘুরে বসেছিলুম। দেখলুম, মোনা-ওঝার মতোই জটাজুটধারী একটা মাথা ঝোঁপের ওপর দেখা যাচ্ছে। তারপর ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধুবাবা। পরনে হাঁটু অবধি পরা লাল কাপড়। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে কমণ্ডলু। তিনি অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন,-বাড়ি কোথায় গো তোমাদের?
ছোটমামা বললেন,-বাবুগঞ্জ।
–অতদূর থেকে তোমরা এখানে ছিপ ফেলতে এসেছ? ভালো করোনি।
–কেন বলুন তো?
–এটা শ্মশানকালীর এলাকা। ওই দেখছ ঘন গাছপালা। সেখানেই মায়ের মন্দির। তার পাশে শ্মশান। তোমরা এখানে বেশিক্ষণ থেকো না বাবারা!
ছোটমামা হাসতে-হাসতে বললেন, আপনি যা-ই বলুন সাধুবাবা! একটা মাছ ধরে এখান থেকে নড়ছি না।
–ওরে পাগল! এ ঝিলে আর মাছ কোথায়? যা দু-চারটে ছিল, কবে মারা পড়েছে।
–মাছ না পাই, মড়ার খুলিই বঁড়শি বিঁধিয়ে তুলব।
সাধুবাবা চমকে উঠে বললেন, তার মানে? তার মানে?
ছোটমামা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন,–এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা জ্যান্ত মড়ার খুলি টোপ খাচ্ছিল। এক খ্যাচ মেরে তাকে ডাঙায় তুললুম।
–তারপর? তারপর?
–খুলিটা থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিতেই ওটা লাফাতে লাফাতে জলে গিয়ে পড়ল।
–তোমরা তবু ভয় পেলে না?
ছোটমামা বললেন, নাহ। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে এসেছি যে সাধুবাবা! আমাদের অত সহজে ভয় পেলে চলে?
সাধুবাবা চাপাস্বরে বললেন,–কিন্তু তোমরা কি জানো ওই খুলিটা কার?
ছোটমামা তাচ্ছিল্য করে বললেন,–তা কেমন করে জানব? জানার দরকারই বা কী?
সাধুবাবা গম্ভীরমুখে বললেন, দরকার আছে। ওই খুলিটা পাঁচু নামে একজন চোরের। তোমরা তার নাম শোনোনি মনে হচ্ছে। পাঁচু ছিল এই তল্লাটের এক ধূর্ত সিঁধেল চোর। সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক রাত্রে পাঁচু গেরস্থবাড়িতে সিঁদ কাটতে বেরিয়েছে। এমনসময় পড়বি তো পড় একেবারে বন্ধু দারোগার মুখোমুখি।
বন্ধুবিহারী ধাড়া ছিলেন পুঁদে দারোগা। পাঁচুকে দেখে তিনি টর্চ জ্বেলে পাকড়ো পাকড়ো বলে তাড়া করলেন। তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল ছিল। তারাও পাঁচু চোরকে তাড়া করল। তারপর ঠিক এইখানে এসে যখন পাঁচুকে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন, অমনি পাঁচু লাফ দিয়ে ঝিলের জলে পড়ল। দারোগা পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। তখন পাঁচু জলে ডুব দিল।
ছোটমামার মন ফাতনার দিকে। শুধু বললেন, হুঁ।
গল্পটা আমি মন দিয়ে শুনছিলুম। তাই বললুম,–তারপর কী হল সাধুবাবা?
সাধুবাবা শ্বাস ছেড়ে বললেন,-পাঁচু ডুব দিল তো দিল। আর মাথা তুলল না। তখন দারোগাবাবু দুই কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে থানায় ফিরে গেলেন। রাত পুইয়ে সকাল হয়ে গেল। কিন্তু কোথায় পাঁচু? আসলে কী হয়েছিল জানো? ঝিলের জলের তলায় ঘন দাম আর শ্যাওলা আছে। বেচারা পাঁচু তাতে আটকে গিয়ে আর মাথা তুলতে পারেনি। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়েছিল।
এবার ছোটমামা বললেন, তারপর জেলে ডেকে এনে জাল ফেলে পাঁচুর মড়া ভোলা হয়েছিল বুঝি?
সাধুবাবা হাসলেন।ওরে পাগল! দেখতে পাচ্ছ না ঝিলের জলের অবস্থা? কত দাম, শ্যাওলা আর কতরকমের জলজ উদ্ভিদ। জাল ফেললে সেই জাল কি আর তোলা যেত? ছিঁড়ে ফর্দাই হয়ে যেত না? তাই কোনও জেলেই জাল ফেলতে রাজি হল না। পাঁচুর মড়া জলের তলায় আটকে রইল। তারপর এতদিনে তার খুলিটা তোমাদের বঁড়শিতে আটকে গিয়েছিল। বুঝলে তো?
ছোটমামা আনমনে আবার বললেন, হুঁ।
সাধুবাবা বললেন,–তো শোনো বাবারা! আবার যদি পাঁচুর খুলি তোমাদের ছিপে ওঠে, তাহলে খুলিটা আমাকে দিয়ে যেও। কেমন? ওই যে দেখছ জঙ্গল! ওর মধ্যে আছে শ্মশানকালীর মন্দির। ওখানে আমাকে পেয়ে যাবে। খুলিটার বদলে আমি তোমাদের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব। সেই মন্ত্র পড়ে বঁড়শিতে ফুঁ দিলেই তোমরা প্রচুর মাছ ধরতে পারবে। যাই হোক, এখন আমি যাই। মায়ের পুজোর সময় হয়ে এল।
বলে সাধুবাবা ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তারা তারা তারা বলতে-বলতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। গাছপালায় পাখিদের হল্লা গেছে বেড়ে। ছোটমামাকে বলতে যাচ্ছি, এবার বাড়ি চলুন ছোটমামা-এমন সময় ছোটমামার হুইলে ছিপের ফাতনা আচমকা ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমামা খ্যাচ মারলেন। আর অবাক হয়ে দেখলুম, আবার সেই মড়ার খুলিটা আমাদের পিছনে ঝোঁপের ভেতরে ছিটকে পড়ল। ছোটমামা দৌড়ে গিয়ে এবার খুলিটা চেপে ধরলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন,-এবার? এবার কী করে পালাবে বাছাধন?
বললুম,–ছোটমামা! চলুন। খুলিটা সাধুবাবাকে দিয়ে আসবেন।
তাই চলবলে ছোটমামা পা বাড়ালেন।
বললুম, ছিপদুটো পড়ে রইল যে?
–থাক না। ফেরার সময় নিয়ে যাব।
ঝোঁপঝাড়ের পর উঁচু-উঁচু গাছের ঘন জঙ্গল। এখনই জঙ্গলের ভেতর আবছা আঁধার জমেছে। ছোটমামা বললেন,–পুঁটু! শ্মশানকালীর মন্দির তো দেখতে পাচ্ছি না!
ওই সময় কানে এল কারা চাপাস্বরে কথা বলছে। ছোটমামা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চারজন লোক একটা খাঁটিয়া নিয়ে বসে আছে। খাঁটিয়াতে একটা মড়া।
খুলি হাতে নিয়ে ছোটমামা যেই বলেছেন,-এখানে শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায় বলতে পারেন? অমনি লোকগুলো লাফ দিয়ে উঠে ওরে বাবা! এরা আবার কারা? বলে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, যা বাবা! ওরা হঠাৎ অমন করে পালিয়ে গেল কেন? এই খুলিটা দেখে ভয় পেল নাকি?
তারপর তিনি মড়ার খাঁটিয়ার কাছে গেলেন। গলা অবধি চাদর ঢাকা মড়ার মাথাটা বেরিয়ে আছে। ছোটমামা বললেন,–বেশ শৌখিন লোক ছিল মনে হচ্ছে। বুঝলি পুঁটু! চুলগুলোর কেতা দেখছিস? চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা। গোঁফটার কেতাও আছে। দেখে কিন্তু মড়া বলে মনেই হয় না। আমার ধারণা হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে। আহা! এমন শৌখিন লোকের মারা যাওয়া উচিত হয়নি।
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি এটা শ্মশান। এখানে-ওখানে চিতার পোড়া কাঠ আর ছাই। ভাঙা কলসিও পড়ে আছে। এই মড়াটার জন্য কোনও কাঠের পাজা দেখতে পেলুম না। খাঁটিয়ার কয়েক হাত দূরে ঝিলের জল আবছা দেখা যাচ্ছিল। মনে হল, লোকগুলো মড়া পোড়ানোর কাঠের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু একটা খুলি দেখে ওরা অত ভয় পেল কেন?
ছোটমামা মড়াটা দেখতে-দেখতে আনমনে বললেন, কিন্তু শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায়?
তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা ঠকাস করে খাঁটিয়ার মড়ার নাকের ওপর পড়ল। অমনি মড়াটা আর্তনাদ করে উঠল, উঁহু হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি! তারপর লাফ দিয়ে উঠে খুলিটা দেখামাত্র জ্যান্ত মানুষের মতো দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। আবছা আলোয় দেখলুম, পরনে ধুতি, গায়ে নকশাদার সিল্কের পাঞ্জাবি। ছোটমামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললুম,–ছোটমামা! ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে।
ছোটমামা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুলিটা চেপে ধরলেন। কারণ এই সুযোগে খুলিটা আবার পালিয়ে যাচ্ছিল।
এতক্ষণে সেই সাধুবাবার কণ্ঠস্বর কানে এল। তারা! তারা! তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!
তারপর একটু তফাতে গাছের ফাঁকে আগুনের আঁচ দেখতে পেলুম।
ছোটমামাকে সেটা দেখিয়ে দিলুম। উনি হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে এগিয়ে চললেন। গাছপালার ভেতর একটা জরাজীর্ণ মন্দির দেখা গেল। তার উঁচু চত্বরে ধুনি জ্বেলে বসে আছেন সেই সাধুবাবা।
ছোটমামা বললেন, সাধুবাবা! সাধুবাবা! এই নিন পাঁচু-চোরের খুলি।
সাধুবাবা ঘুরে খুলিটা দেখে সহাস্যে বললেন,–পেয়েছিস ব্যাটাছেলেকে? দে! শিগগির দে!
ছোটমামা খুলিটা দিতে যাচ্ছেন, আবার সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা সজোরে গিয়ে সাধুবাবার বুকে পড়ল। সাধুবাবা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করলেন,–উ হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি!
তারপর দেখলুম, তার জটার পেছনে আগুন ধরে গেছে। কারণ তিনি জ্বলন্ত ধুনির ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। জটায় আগুনের আঁচ টের পেয়ে সাধুবাবা লাফ দিয়ে চত্বর থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন। তারপর আবছা আঁধারে ঝপাং করে জলের শব্দ হল। বুঝলুম, সাধুবাবা আগুন নেভাতে ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।
এদিকে খুলিটাও সুযোগ বুঝে গড়াতে শুরু করেছে। ছোটমামা খুলিটা ধরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। ওটা কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, কখনও গড়িয়ে চলছে। আমরা যেখানে ছিপ ফেলেছিলুম, সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই জলের ভেতর থেকে একটা কঙ্কালের দুটো হাত ভেসে উঠল এবং খুলিটা লুফে নিয়ে আবার জলে ডুবে গেল। এতক্ষণে ছোটমামা ভয় পেয়ে কঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, পুঁটু রে! আর এখানে থাকা ঠিক নয়। ছিপ তুলে নে। মোনা-ওঝা ঠিকই বলেছিল রে! দুজনে ঝটপট ছিপ গুটিয়ে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাঁধের ওপর উঠলুম। তারপর বাঁধের পথে বাড়ি ফিরে চললুম। কিছুদূর চলার পর ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই হল রে পুঁটু। সাধুবাবার কাছে মাছ ধরার মন্ত্রটা শেখা হল না।
অন্ধকারে রাতবিরেতে
কেকরাডিহি যেতে হলে ভামপুর জংশনে নেমে অন্য ট্রেনে চাপতে হবে। কিন্তু ভামপুর পৌঁছতেই রাত এগারোটা বেজে গেল। ট্রেন ঘণ্টাছয়েক লেট। খোঁজ নিয়ে জানলুম, কেকরাডিহি প্যাসেঞ্জার রাত নটায় ছেড়ে গেছে। পরের ট্রেন সেই ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে নয়।
কনকনে ঠান্ডার রাত। এরই মধ্যে জংশন স্টেশন একেবারে ঝিম মেরে গেছে। তাছাড়া, তেমন কিছু বড় জংশনও নয়। লোকজনের ভিড় এমনিতে কম। চায়ের দোকানি ঘুমঘুম গলায় পরামর্শ দিল,–পাঁচ লম্বর পেলাটফরমে কেকরাডিহির টেরেন রেডি আছে। চোলিয়ে যান। আরামসে জুত করুন।
শুনে তো লাফিয়ে উঠলুম আনন্দে। ওভারব্রিজ হয়ে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি, সত্যি তাই। ইঞ্জিনবিহীন একটা ট্রেন কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মে জন মানুষটি নেই। মাথার ওপর ছাউনি বলতেও কিছু নেই। একফালি চাঁদ নজরে পড়ল, শীতে তার চেহারাও খুব করুণ।
কিন্তু যে কামরার দরজা খুলতে যাই, সেটাই ভেতর থেকে আটকানো। জানলাগুলোও বন্ধ। বুঝলুম ভেতরে বুদ্ধিমান লোকগুলো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রচুর লোক জমে উঠেছে! দরজা খুলে তা বরবাদ করার ইচ্ছে নেই কারুর। অবশ্য চোর-ডাকাতের ভয়ও একটা কারণ হতে পারে। দরজা টানাটানি করে কোথাও কোনও সাড়া পেলুম না।
হন্যে হয়ে শেষদিকটায় গিয়ে শেষ চেষ্টা করলুম। তখন আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। চাচামেচি করে বললুম, দরজায় বোমা মেরে উড়িয়ে দেব বলে দিচ্ছি। আমার কাছে বোমা আছে কিন্তু।
এই শাসানিতেই যেন কাজ হল। একটা জানালা একটু খুলে গেল। তারপর ভারি গলায় কে বলল, কী আছে বললেন?
কথাটা চেপে গিয়ে বললুম,–আহা, দরজাটা খুলুন না। ঠান্ডায় জমে গেলুম যে!
ভেতরের লোকটি বলল,–বোমা না কী বলছিলেন যেন?
আরে না, না। হাসবার চেষ্টা করে বললুম,–ওটা কথার কথা। দয়া করে দরজাটা খুলে দিন।
–মাথা খারাপ মশাই? বোমাওয়ালা লোককে ঢুকিয়ে শেষে বিপদে পড়ি আর কী! বোমা মারতে হয়, অন্য কামরায় গিয়ে মারুন। আমি ঝামেলা ভালোবাসি না।
লোকটা জানালার পাল্লা নামিয়ে দিল দমাস শব্দে। অদ্ভুত লোক তো! রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে কী করব ভাবছি, সেই সময় গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখলুম। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় গুনগুনিয়ে গান গেয়ে কেউ আমারই মতো এক বগি থেকে আরেক বগি পর্যন্ত ফুঁ মেরে বেড়াচ্ছে বুঝি। মিটমিটে আলোয় লোকটির চেহারা নজরে এল। ঢ্যাঙা, হনুমান-টুপিপরা লোক। গায়ে আস্ত কম্বল জড়ানো। লম্বা বিরাট একটা নাক ঠেলে বেরিয়েছে মুখ থেকে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল আমাকে দেখে। তারপর খি-খি করে হাসল।–ঢোকার ছিদ্র পেলেন না বুঝি? মশাই, এ লাইনের ব্যাপারই এরকম। সেজন্য সূচ হয়ে ঢুকতে হয়। তারপর দরকার হলে ফাল হয়ে বেরুন না কেন?
কথার মানে কিছু বুঝলুম না। পাগল-টাগল নয় তো? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে বলল, আপনি দেখছি একেবারে কচি খোকা! বুঝলেন না কথাটা?
ঠান্ডার রাত। জনহীন প্ল্যাটফর্মে পাগলকে ঘাঁটানো উচিত হবে না। বললুম, বুঝলুম বইকী!
কচু বুঝেছেন! এই দেখুন, সুচ হয়ে কেমন করে ঢুকতে হয়। বলে লোকটার সামনেকার একটা জানালা খামচে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওপরে ওঠাল।
তারপর আমাকে হকচকিয়ে দিল বলা যায়। জানালায় গরাদ আছে। অথচ কী করে সে তার অতবড় শরীরটা নিয়ে ভেতরে গলিয়ে গেল কে জানে! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
কিন্তু তারপরেই ভেতরে গণ্ডগোল বেধে গেছে। আগের লোকটা চেঁচিয়ে উঠেছে খ্যানখেনে গলায়,–এ কী মশাই! এ কী করছেন? একি! একি! আরে…
এবং কামরার দরজা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল। সম্ভবত আগের লোকটাই বোঁচকাকুঁচকি-বিছানাপত্র নিয়ে একলাফে নিচে এসে পড়ল। তারপর দুদ্দাড় শব্দ করে ওভারব্রিজের সিঁড়ির দিকে দৌড়ল।
দেখলুম, একটা বালিশ ছিটকে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু আর ফিরেও তাকাল না এদিকে। এবার সুচহওয়া লোকটিকে দেখতে পেলুম দরজায়। খিকখিক করে হেসে বলল,-বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। যাক গে, ভালোই হল। আসুন, আসুন। এক্ষুনি আবার কেউ এসে হাজির হবে। আর শুনুন, ওই বালিশটা কুড়িয়ে নিয়ে আসুন। আরামে শুতে পারবেন।
বালিশটা কুড়িয়ে নিলুম। ঠিকই বলেছে। বালিশটা শোয়ার পক্ষে আরামদায়কই হবে। এর মালিক যে আর এদিকে এ-রাতে পা বাড়াবে না, সেটা বোঝাই যায়। ব্যাপারটা যাই হোক, ভারি হাস্যকর তো বটেই।
কামরার ভেতরটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। লোকটা দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ছিটকিনি নামিয়ে আটকে দিল। দেশলাই জ্বেলে একটা খালি বার্থে বসে পড়লুম। লম্বানেকো লোকটা বসল পাশের বার্থে! তারপর আগের মতো খিকখিক করে হেসে বলল, খুব জব্দ হয়েছে। একা পুরো একটা কামরা দখল করে বসে ছিল ব্যাটাচ্ছেলে!
আমিও একচোট হেসে বললুম, ডাকাত ভেবেই পালিয়েছে, বুঝলেন!
–উঁহু, ডাকাত ভাবেনি। অন্য কিছু ভেবে থাকবে।
–কিন্তু আপনি গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকলেন কী করে বলুন তো?
–কিছু কঠিন নয়। সে আপনিও পারেন। তবে তার আগে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে।
আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, কী কষ্ট?
লোকটা অন্ধকারে অদ্ভুত শব্দে হাই তুলে বলল,-যাকগে ওসব কথা। বললেনও কি আপনি সে কষ্ট করবেন?
–কেন করব না? অমন সরু ফাঁক গলিয়ে ঘরে ঢোকাটা যে ম্যাজিক মশাই। আমার ধারণা, আপনি একজন ম্যাজিশিয়ান।
–তা বলতে পারেন। তবে আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
অন্ধকারে নড়াচড়ার শব্দ হল। বুঝলুম ম্যাজিশিয়ান লোকটা শুয়ে পড়ল। বালিশটা পেয়ে আমার ভালোই হয়েছে। আমিও শুয়ে পড়লুম। কিন্তু অন্ধকারটা অসহ্য লাগছিল। দম আটকে যাওয়ার দাখিল। তা ছাড়া, বদ্ধ জায়গায় শোওয়ার অভ্যাস নেই। তাই একটু পরে উঠে পড়লুম। মাথার কাছের জানালাটা যেই ওঠাতে গেছি, লোকটা হাঁ-হাঁ করে উঠল।করেন কী, করেন কী। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুনোর মতো লোকের অভাব নেই বুঝতে পারছেন না? অসুবিধেটা কীসের?
–দেখুন, বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। বরং একটু ফঁক করে…
কথা কেড়ে লোকটা খাপ্পা মেজাজে বলল, ধ্যাতমশাই! বললুম না? আবার কে এসে ঢুকবে, তখন আমারই ঝামেলা হবে। আপনার আর কী! বন্ধ করুন বলছি।
অগত্যা ফের শুয়ে পড়লুম। কিন্তু ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। বদ্ধ ঘরের অন্ধকারে অস্বস্তি, তার ওপর প্রচণ্ড হিমকাঠ পিঠের তলায়। সঙ্গে গরম চাদরও নেই। প্যান্ট-কোট হিমে বরফ হয়ে গেছে। পাশের লোকটার গায়ে কম্বল। তাই আরামে ঘুমোচ্ছে। নাকও ডাকছে।
কতক্ষণ পরে চুপিচুপি উঠে বসলুম। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের জানালার পাল্লাটা প্রায় নিঃশব্দে ঠেলে ইঞ্চি দুই ফঁক করে রাখলুম। তারপর শুয়ে পড়লুম ফের। এবার বদ্ধ ঘরের সেই অস্বস্তিটা কেটে গেল।
হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন। হঠাৎ কী একটা দুদ্দাড় শব্দে উঠে বসলুম দুড়মুড় করে। কামরা আগের মতো ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। জানালার সেই ফঁকটা আর নেই। কিন্তু ভেতরে একটা ধস্তাধস্তি বেধেছে যেন। কে, কে বলে চেঁচিয়ে উঠে দেশলাই হাতড়াতে থাকলুম। খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদিকে দরজাটা দমাস করে খুলে গেল। বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেলুম। কে যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশের বার্থে কেউ এসে বসল। বললুম, কী ব্যাপার বলুন তো?
–কিছু না। আপনি শুয়ে পড়ুন। কেকরাডিহি লাইনে এমন হয়েই থাকে।
কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলুম। পাশের বার্থের লোকটার গলার স্বর ছিল একটু খ্যানখেনে। এটা কেমন গুরুগম্ভীর যেন। দেশলাইটা খুঁজে পাওয়া গেল এতক্ষণে। সিগারেট ধরানোর ছলে কাঠি জ্বেলে সেই মিটমিটে আলোয় যাকে দেখলুম, সে অন্য লোক। তবে তার গায়ের কম্বলটা আগের লোকেরই মনে হচ্ছে। এ লোকটার নাক বেজায় চ্যাপ্টা। তাছাড়া, মুখে একরাশ গোঁফদাড়ি। মাথার টুপিটাও অন্য রকম। গম্ভীর স্বরে বলল,–কী দেখছেন?
অবাক হয়ে বললুম, আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন বলুন তো?
–কেন? আমাকে কি সঙ্গী হিসেবে পছন্দ হচ্ছে না?
–না না–মানে, বলছিলুম কী, আপনিও কি জানালার ফাঁক গলিয়ে ঢুকেছেন?
–ঠিক তাই। বুঝলেন না? যা ঠান্ডা পড়েছে।
–তা পড়েছে। কিন্তু আপনিও দেখছি একজন ম্যাজিশিয়ান।
–তা বলতেও পারেন।
–আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?
হ্যা হ্যা করে হেসে নতুন সঙ্গী বলল,–বেজায় ভয় পেয়ে পালিয়েছে। ব্যাটাচ্ছেলে কাতুকুতুতে ওস্তাদ। কিন্তু আমি কী করি জানেন তো? কামড়ে দিই। আপনি?
আমি? আমি কিছুই পারি না বলে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। সিগারেটের আগুনে ঘড়ির কাঁটা দেখে নিলুম। দুটো পাঁচ। আর ঘণ্টাতিনেক এসব উপদ্রব সহ্য করে কাটাতে পারলে আর চিন্তা নেই। ঘুম আর এসে কাজ নেই।
পাশের নতুন সঙ্গীর কিন্তু নড়াচড়ার শব্দ নেই। শুয়ে পড়লে টের পেতুম।
তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ওই যে বলল কামড়ে দেওয়ার স্বভাব আছে! হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে দেবে না তো? ভাব করার জন্যে বললুম, কী? শুতে ইচ্ছে করছে না?
প্রকাণ্ড হাই তোলার শব্দ করে বলল, নাঃ। আপনি ঘুমোন।
–ঘুম আসছে কই? বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। সম্ভবত, জানালা খুললে আপনারও আপত্তি হবে। কাজেই…
–না, না। আপত্তির কারণটা বুঝলেন না? আবার কেউ ঢুকে গণ্ডগোল বাধাবে যে।
আগের ভদ্রলোক বলছিলেন, জানালার গরাদ গলিয়ে ঢোকা শিখতে হলে নাকি একটু কষ্ট করতে হবে। কিন্তু কষ্টটা কী, সেটা চেপে গেলেন। আপনি বলতে পারেন ব্যাপারটা কী?
–খুব পারি। তবে আপনি ভয় পাবেন যে!
–মোটেও না। দেখুন না, আমি কি ভয় পেয়েছি?
হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসল সে। যাক ওসব কথা। আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে লোভ হচ্ছে। একটা সিগারেট দিন, টানি।
সিগারেট দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ধরিয়ে দিতে গিয়ে আবার চমকে উঠলুম। আরে, এ তো সেই গোর্ফদাড়িওলা লোকটা নয়। কুমড়োর মতো মুখ, চকচকে টাক এ আবার কখন এল?
কিন্তু তক্ষুনি গণ্ডগোল বেধে গেল। পাশ থেকে কে চেঁচামেচি করে বলল, এই মশাই। আমার সিগারেট আপনি টানছেন যে। জিগ্যেস করুন তো ওঁকে, কে সিগারেট চাইল।
ফস করে আবার কাঠি জ্বাললুম দেখি, গোঁফদাড়িওলা লোকটি কুমড়ামুখো লোকটির পাশে বসে আছে। তার মুখে-চোখে রাগ ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, কী মুশকিল। আপনি আবার কীভাবে ঢুকলেন?
নতুন লোকটি অদ্ভুত হেসে বলল, আমি আগে থেকেই ছিলুম। অনেকক্ষণ থেকে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিলুম। সাহস করে আসতে পারছিলাম না। এ ভদ্রলোকের যে কামড়ে দেওয়া অভ্যেস।
গোঁফদাড়ি হেঁড়ে গলায় বলল,-এবার যদি কামড়ে দিই।
–সিগারেটের ছ্যাকা দেব। আসুন না কামড়াতে।
বিবাদ মিটিয়ে দিতে বললুম,–আহা, ঠান্ডার রাতে কামড়াকামড়ি ভালো কাজ নয়। নিন, আপনিও একটা সিগারেট নিন।
আমি আবার পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। চোখ দুটো পাশের বার্থের দিকে। দুটো সিগারেট জুলজুল করে জ্বলছে অন্ধকারে। এবার কেন কে জানে, ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর কখন সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি।
হইহট্টগোলে সেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন দেখি কামরা জুড়ে একদঙ্গল লোক। বোঁচকাকুঁচকিও কম নেই। এখন আলো জ্বলছে। জানালাগুলো হাট করে খোলা এই রে! সর্বনাশ হয়েছে তাহলে। গরাদ গলিয়েই পিলপিল করে এরা বুঝি ঢুকে পড়েছে। ধুড়মুড় করে উঠে বসলুম। অমনি খালি জায়গা পেয়ে একদল লোক হইহই করে এসে বসে পড়ল। দুজনকে সিগারেট দিয়ে সামলেছি, এতজনকে কীভাবে সামলাব ভেবে খুব ভয় পেয়ে গেলুম।
কিন্তু তারপর চোখ গেল দরজার দিকে। দরজা খোলা। অতএব এরা তারা নয়। তাদের তন্নতন্ন করে খুঁজে পেলুম না। তারা কোথায় গেল, গোঁফদাড়ি এবং কুমড়ো–অর্থাৎ সেই অন্ধকারের ম্যাজিশিয়ানরা?
আমার মাথার তলা থেকে বালিশটাও উধাও। যাক গে, একটা অভিজ্ঞতা হল তাহলে। টিকিটের ঘণ্টা দিচ্ছিল। পাঁচটা বাজে।
অলৌকিক আধুলি রহস্য!
ইদানীং রোজ ভোরবেলা জগিং শুরু করেছি। আমাদের এই ছোট শহরে অত সকালে রাস্তাঘাট একেবারে নিরিবিলি হয়ে থাকে। তাতে শীতকাল। খেলার মাঠ পেরিয়ে নদীর ধার অব্দি গিয়ে বাড়ি ফিরতে এক কিলোমিটার দৌড় হয়ে যায়। গা ঘেমে ওঠে।
আমার ভাগ্নে শ্ৰীমান ডন টের পেয়ে একদিন বলল,–চোরটাকে ধরতে পেরেছিলেন মামা?
চোর? কোথায় চোর? আকাশ থেকে পড়লুম। আমি তো জগিং করছিলুম, হতভাগা! চোর কোথায় দেখলি?
ডন আকাশ থেকে পড়ল, জগিং! ও মামা, জগিং মানে কী? তুমি তো দৌড়চ্ছিলে।
গম্ভীর হয়ে বললুম, জগিং মানে দৌড়-ব্যায়াম। এতে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। খিদে বাড়ে। জম্পেশ রকমের ঘুম হয়।
ডন খুশি হয়ে বলল, আমিও জগিং করব, মামা।
–বেশ তো। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠিস। তোর তো সাতটার আগে ঘুমই ভাঙে না।
পরদিন অবশ্য ওকে বিছানা থেকে টেনেই ওঠাতে হল। কিন্তু অতটুকু ছেলে। খেলার মাঠ অব্দি গিয়ে ধুস বলে নেতিয়ে বসল! আমি হাসতে-হাসতে ধুকুর-ধুকুর দৌড়ে নদীর ধারে রোজকার টারগেট পোডোমন্দির চক্কর দিলুম। তারপর খেলার মাঠে এসে দেখি, ডন। ফের পুরোদমে শুরু করেছে। মনে-মনে বললুম, ভালো! বাহাদুর ছেলে!
তারপর টের পেলুম ব্যাপারটা। ডন আসলে পাড়ার সেই বদরাগী নেড়ি কুকুরটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চলেছে। তার হাতে আধলা ইট। কুকুরটা লেজ গুটিয়ে ঝিলের ধারে রামু-ধোপার গাধার পেটের তলা দিয়ে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল।
এইতে বুঝি গাধাটা অপমানিত বোধ করে চার ঠ্যাং তুলে লাফ দিল। তখন শ্রীমান বেগতিক দেখে থমকে দাঁড়াল। কাছে গিয়ে বললুম, খুব হয়েছে। তোমার দ্বারা জগিং হবে না। বাড়ি এসো।
ডন ফিক করে হেসে বলল,–তখন অমন বসে পড়লুম কেন বলো তো মামা?
–দৌড়তে পারছিলে না বলে।
ডন বলল,-যাঃ! সেজন্যে নাকি! একটা আধুলি পড়ে ছিল যে ওখানে।
সে আধুলিটা দেখাল। চকচকে নতুন আধুলি। বললুম, কার পড়ে-উড়ে গেছে আর কী? ওটা দিয়ে যদি ফের ঘুড়ি কেনার মতলব করিস, গাঁট্টা লাগাব বলে দিচ্ছি। গাছে ঘুড়ি আটকাবে আর আমাকে গাছে চড়তে হবেকক্ষনো না।
ডন মনমরা হয়ে বলল, তাহলে কী করব বলল না মামা?
–বরং কোনও ভিখিরিকে দান করে দিস। পুণ্যি হবে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলুম শীতের রোদে রাস্তার মোড়ে সেই অন্ধ ভিখিরিটা বসে আছে–রোজই থাকে। ডনকে ইশারা করলে সে গম্ভীর মুখে আধুলিটা ভিখিরির মগে ঠকাস করে ফেলে দিয়ে এল। বোঝা যাচ্ছিল, আধুলিটা নিয়ে তার কোনও মতলব ছিল।
সন্ধ্যায় এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসে একটা গোয়েন্দা গল্পের পাতায় চোখ রেখেছি, ডন এসে বলল, মামা, ও মামা! দ্যাখো দ্যাখো–সেই আধুলিটা না?
ডনের হাতে একটা আধুলি ছিল। সেটা কুড়িয়ে-পাওয়া আধুলিটার মতোই নতুন এবং চকচকে বটে। বললুম,–সেই আধুলিটা, কী বলছিস? এটা তুই তো ঠকাস করে ভিখিরির মগে ফেললি সকালে?
ডন চোখ বড় করে বলল, অবাক, মামা অবাক! পিসিমা একটা টাকা দিয়েছিল আমাকে, জানো তো? টাকাটা নিয়ে গেলুম হাবুবাবুর দোকানে খাতা কিনতে। এই দ্যাখো খাতাটা।
সে খাতাটা দেখাল। বিশ্বাস করে বললুম, আধুলিটা বুঝি হাবুবাবু দিলেন?
ডন চাপা গলায় বলল, দিলেন তো! ও মামা, এটা সেই আধুলিটা সত্যি বলছি, দ্যাখো না ভালো করে। ঠিক সেইটে। কুড়িয়ে পেতে কতক্ষণ ধরে দেখেছিলুম না? সেই লাল ফুটকিটা পর্যন্ত। দেখতে পাচ্ছ?
তর্ক করে লাভ নেই ওর সঙ্গে। ঝামেলা বাড়বে। হাত বাড়িয়ে বললুম, ওটা আমায় দে। তার বদলে তোকে আট আনা দিচ্ছি।
ডন একপা পিছিয়ে বলল, উঁহু! এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক করব না বুঝি?
–বেশ, তাই করিস। যা এখন!
ডন বলল, তুমি বিশ্বাস করলে না তো? ঠিক আছে। কাল ভোরবেলা জগিং করবার সময় ফের এটা ভিখিরিকে দেব। দেখবে, ফের ঘুরে আসবে আমার হাতে।
পরদিন ওকে ঘুম থেকে ওঠাতে হল না। আমাকেই বরং ওই ওঠালে। মামা ভাগ্নে মিলে ঠান্ডা হিমে ভোরবেলায় ধুকুরপুকুর দৌড় শুরু করলুম। আজ ওর খাতিরে একটু আস্তে। নদীর ধারে পোডোমন্দির ঘুরে খেলার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে লক্ষ করলুম ডনটা একটুও কাবু হয়নি। রহস্যটা কী?
মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দেখে আধুলিটার কথা মনে পড়ল। বললুম,–হ্যাঁরে, আধুলিটা ওকে দিবি বলেছিলি যে?
দিচ্ছি।–বলে ডন ভিখিরির কাছে গেল।
ঠকাস শব্দ এবং ভিখিরির আশীর্বাদ শুনে বুঝলুম, মুদ্রাটি যথাস্থানে গেছে।
এদিন ছিল রবিবার। ডন একদফা পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছিল। এগারোটা নাগাদ তার পায়ের ধুপধুপ আওয়াজ শুনলুম। তারপর এক চিকুর, মামা! মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক। তারপর হাঁফাতে-হাঁফাতে ঘরে ঢুকে সে বলল, বলেছিলুম না! এই এই দ্যাখো।
ওর হাতে সেই আধুলিটার মতোই চকচকে নতুন আধুলি দেখে হাসতে-হাসতে বললুম,–চালাকি? কোত্থেকে নতুন একটা আধুলি এনে বলছ সেইটে?
ডন কঁদো-কঁদো মুখে বলল, তোমার দিব্যি, মামা! মা পান কিনতে পাঠিয়েছিল। পানওয়ালা এটা দিল। সে আমার হাতে ওটা গুঁজে দিল। তুমি দেখে রাখো না! এই লাল ফুটকিটা দেখছ-ওইটা দেখেই চিনতে পারছি!
–ঠিক আছে। আমার কাছে থাক এটা। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখবখন!
ডন ছোঁ মেরে আধুলিটা তুলে নিয়ে ছিটকে সরে গেল। রাগী মুখ করে বলল, দিচ্ছি তোমায়! অত করে মার কাছে বকুনি খেয়ে এটা ফিরে পেলুম। এ দিয়ে ম্যাজিক করব।
পরদিন ভোরে জগিং করতে গিয়ে নদীর ধারে পোড়োমন্দির চক্কর দিচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হল শ্রীমান সঙ্গে নেই। ঘুরে দেখি অনেকটা দূরে খেলার মাঠে ছোট্টটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেতেই ঊ্যা করে বলল,–আধুলিটা হারিয়ে গেছে মামা!
রাগ করে বললুম,–বেশ হয়েছে হতভাগা ছেলে! আধুলি হাতে নিয়ে কেউ দৌড়ায়?
ডন আমাকে খামচে ধরে থামাল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল,-খুঁজে দাও না মামা। আমার ম্যাজিক করা হবে না যে!
ঘাসে শিশির চকচক করছে। সূর্যটা সবে বিছানা থেকে উঠে বসে হাই তুলছে। পিটপিটে চাউনি। তার ওপর উত্তরে হাওয়ার ঠান্ডা হিম দুষ্টুমি। এমন সময় একটা আধুলি খুঁজে বের করা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। ডনের খাতিরে তবু অনেক কষ্ট করতে হল। কিন্তু তার পাত্র পাওয়া গেল না। ডনকে বললুম,–ঠিক এখানেই পড়েছে তার মানে কী? অন্য কোথাও ফেলেছিস তাহলে।
ডন জোরের সঙ্গে বলল,–এখানেই!
কিন্তু প্রচণ্ড খুঁজেও আধুলিটা পাওয়া গেল না। কাজেই আমাদের পায়ের শব্দে রাস্তার মোড়ের অন্ধ-ভিখিরি নড়েচড়ে বসলেও তার মগে ঠকাস করে সেই মিঠে শব্দটা বাজল না। বেচারা নিশ্চয় খুব মনমরা হয়ে গেল।
মনমরা হয়ে রইল শ্রীমানও। শরীর খারাপ বলে স্কুলে গেল না। বিকেল নাগাদ ভাবলুম ছেলেটাকে চাঙ্গা করা উচিত। আমার ডাক শুনে ডন চোখ পিটপিট করতে করতে ঘরে ঢুকল। তারপর নিজের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী?
ওকে টেনে আদর করে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে! ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। চল, বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। মন ভালো হয়ে যাবে।
ডন ঘাড় গোঁজ করে বলল, শ্যাব–একটা আধুলি দাও, নতুন আধুলি না হলে নেব না কিন্তু।
আধুলি? –চিন্তিত হয়ে বললুম। আধুলি যদি না থাকে, সিকি হলে চলবে না?
ডন ঠোঁটের কোণায় কেমন একটু হাসল,–তোমার টেবিলের ড্রয়ার খুঁজে দ্যাখো না।
টেবিলের ড্রয়ারে খুচরো পয়সা রাখি, একথা সত্য। ডনের এ খবর জানা থাকার কথা নয়–এ বাড়ির কারুরই নয়। খুঁজতে গিয়ে পেয়েও গেলুম একটা আধুলি। এবং চকচকে আনকোরা আধুলিটা। ডনের তর সইল না, খপ করে কেড়ে নিল। তারপর উল্টে-পাল্টে দেখতে-দেখতে আচমকা এক চিল-চিকুর ছাড়ল, মামা, ও মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক!
অবাক হয়ে বললুম, কী রে?
সেই লাল ফুটকিটা। ডন নাচতে নাচতে বলল, আমার আধুলি। আমার আধুলি। দ্যাখো, দ্যাখো!
হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। ওর হাত থেকে আধুলিটা নিয়ে আরও অবাক হলুম। এ কী! সত্যি সেই লাল ফুটকিওয়ালা আধুলিটা যে! কোথায় পেলুম এটা কার, কিছুতেই মনে পড়ল না। কিন্তু জিনিসটা যে অলৌকিক এতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
আর এত ঠিক, এই পড়ে পাওয়া অলৌকিক আধুলি যখন ডনকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে ডন এটা মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দিক কিংবা হারিয়ে ফেলুক, আবার তার কাছে এ-হাত সেহাত ঘুরে ফিরে আসবেই। নিজেকে চেনাবার জন্যে কপালে একটা লাল ফুটকি তো থাকবেই। সুতরাং ডন দৌড়ে বেরিয়ে গেলে ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। এমন ভাগ্নের মামা হওয়াটাও তো কম গর্বের কথা নয়।
আজমগড়ের অশরীরী
তখন আমি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সেই কাজে আমাকে আজমগড়ে যেতে হয়েছিল।
আজমগড় উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট শহর। সেখানে একটা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আছে। তবে ওটা দেখবার জন্য পর্যটকদের বিশেষ উৎসাহ নেই। ওখানে বিশাল গঙ্গার বুকে একটা চরে পক্ষীনিবাস আছে। পাখি দেখবার জন্যই শীতকালে পর্যটকদের ভিড় হয়। ধ্বংসস্তূপ দেখে কে-ই বা আনন্দ পায়?
আমি গিয়েছিলুম মার্চের গোড়ার দিকে। তখন আর তত শীত ছিল না। পর্যটকদের ভিড়ও ছিল না। ভাঙাচোরা নবাবি প্রাসাদের পাশে গঙ্গার তীরে প্যালেস হোটেলে উঠেছিলুম। পর্যটন মরশুমের শেষে এই দোতলা থ্রি-স্টারমার্কা হোটেলে তখন ঘরভাড়াও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
হোটেলের ম্যানেজার সুখলাল ঠাকুর খুব অমায়িক মানুষ। আমি সিপাহিবিদ্রোহ সম্পর্কে গবেষণা করছি জেনে খুব খাতির করেছিলেন। সিপাহিবিদ্রোহের অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। এসব গল্প নিছক গল্পই। আমার গবেষণায় তা কাজে লাগবে না। তবে ওঁর এ কথাটি অবশ্যই খাঁটি। এই আজমগড়ে সিপাহিদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে অনেক হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
মিঃ ঠাকুর শুধু একটা ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর আমি যেন কেল্লাবাড়ি এলাকায় না থাকি। তাঁকে প্রশ্ন করে কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাইনি। তিনি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে শুধু বলেছিলেন, সূর্যাস্তের পর ওই এলাকায় থাকলে বিপদ হতে পারে।
–কী বিপদ?
প্যালেস হোটেলের ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছেন, এমনসময় কজন সায়েব-মেম দলবেঁধে হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকলেন। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ক্যামেরায় কেল্লাবাড়ি আর গঙ্গার ছবি তুলে বেড়ালুম। কোথাও-কোথাও ধ্বংসাবশেষে ঝোঁপজঙ্গল আছে। গঙ্গার তীরে একস্থানে খাড়া পাথরের পাঁচিল নেমে গেছে জলের তলায়। কোথাও ভাঙাচোরা পাথরের ঘাট শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম সেই ফাঁসির মঞ্চটিকে, যেখানে ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ জন হকটন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিলেন। সেই বিদ্রোহীদের দলে ছিলেন নবাব আজম খানের কন্যা রেশমা বেগম। দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানার কাগজপত্রে এই পিতা-পুত্রীর নাম খুঁজে পেয়েছিলুম। আর পেয়েছিলাম একটা স্কেচম্যাপ। সেটা এঁকেছিলেন এক আইরিশ শিল্পী–টমাস পিট। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সেই শিল্পী এ অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলেন। স্কেচম্যাপে কেল্লাবাড়ির সীমানা ছাড়াও খুঁটিনাটি অনেকগুলি স্থান চিহ্নিত করা ছিল। সির মঞ্চ, বিদ্রোহীদের কবরখানা, রেশমা বেগমের গোপন অস্ত্রাগার–এরকম অনেককিছুই ছিল ওতে। আমি জীর্ণ ম্যাপ থেকে কপি করে এনেছিলুম।
সেই কপি থেকে স্থানগুলি খুঁজে বের করা দেখলুম অসম্ভব ব্যাপার। তবে একটা দৃশ্য আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ধ্বংসস্তূপগুলিতে শুধু লাল রঙের ফুলের সমারোহ চোখে পড়ে। আমি প্রকৃতিপ্রেমিক নই। ইতিহাসের একজন গবেষক মাত্র। জীবনে কত ঐতিহাসিক স্থানে আমাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু কোথাও এমন উজ্জ্বল লালরঙের ফুল চোখে পড়েনি। নানা আকৃতির এইসব ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ওগুলি কি ফুল, না চাপ-চাপ রক্ত? এখানে কি অন্যরঙের ফুল ফোটে না?
অবশ্য এখন বসন্তকাল। ফুল ফোটে। পাখিরা গান করে। কিন্তু এখানে পাখিরা কেন চুপ করে আছে?
পাখির কথা ভাবতেই গঙ্গার ধারে পক্ষীনিবাসের কথা মনে পড়ল। তখন ধরে নিলুম, এলাকার সব পাখি সেখানে গিয়েই জুটেছে। কোথায় সেই চর তা জেনে আসিনি। গঙ্গা এখানে প্রশস্ত। উত্তাল বাতাসে বড় বড় ঢেউ উঠে কেল্লার পাথুরে পাঁচিলে অদ্ভুত শব্দ করছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষের কোলাহল। ওপারে দূরে ঘন নীল পাহাড়গুলি দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি জেলেনৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে।
অন্যমনস্কভাবে গঙ্গার ধারে জীর্ণ শ্যাওলাধরা ঘাটের মাথায় একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। এই সময় আমার ডানদিকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একজন ফকির বেরিয়ে এলেন।
ফকিরের মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত লম্বা কালো আলখাল্লা। গলায় মোটা-মোটা রঙবেরঙের পাথরের মালা। তার এক হাতে প্রকাণ্ড চিমটে। চিমটেটার গোড়া রুপো আর তামার তারে বাঁধানো। ফকির ঘাটের কাছে এসে আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–কৌন হ্যায় তুম?
আমি যথাসাধ্য হিন্দিতে নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলুম। তারপর বললুম, রেশমা বেগমের ফাঁসির জায়গা আর তার কবর কোথায় তা কি আপনি জানেন? দেখিয়ে দিলে আপনাকে কিছু বখশিস দেব।
ফকির কিন্তু চটে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন,–কে চায় তোমার বখশিস? শিগগির এখান থেকে চলে যাও। না গেলে তোমার বিপদ হবে।
তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলুম, আমি সিপাহিবিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে চাই। কিন্তু ফকির আমাকে পাত্তা দিলেন না। মস্ত বড় চিমটেটা তুলে তেড়ে এলেন। চিমটের ডগা সূক্ষ্ম এবং ধারালো। বেগতিক দেখে আমি সরে এলুম।
একটু পরে দূর থেকে দেখলুম, ফকির আলখাল্লা খুলে রেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওখানে জল খুব গভীর। ফকির সেই জলে সাঁতার কাটছেন দেখে অবাক লাগল। একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফকির জল থেকে উঠে ভিজে গায়েই কালো আলখাল্লা পরে নিয়ে চিমটেসহ এগিয়ে গেলেন। তারপর ধ্বংসস্তূপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।
ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। ওঁকে অনুসরণের সাহস হল না। শুধু জায়গাটা চিনে রাখলুম। তারপর প্যালেস হোটেলে ফিরে গেলুম।
স্নান করার পর নিচের ডাইনিং হলে খেতে গেলুম। ডাইনিং হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলেন জনাচারেক বোর্ডার। ম্যানেজারের কাছে শুনেছিলুম, তাঁরা নানা জায়গা থেকে এসেছেন এবং বিত্তবান ব্যবসায়ী। সায়েব-মেমদের দলটি তখনও বাইরে থেকে ফেরেননি। পরিচারক আসলাম খান আমাকে সেলাম দিয়ে খাদ্য পরিবেশন করল। সেই সুযোগে তাকে কেল্লাবাড়ির সেই ফকিরের কথা বললুম। আসলাম খান একটু হেসে বলল,–ও তো পাগলাবাবা স্যার। ওখানে পিরের দরগা। আছে। সেখানে থাকে। একেবারে পাগল। খিদে পেলে তখন কিন্তু বেরিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় বসে শাপ দেয়, তাকে কেউ খেতে না দিলে তার বিপদ হবে। আবার খেতে দিলেও শাপশাপান্ত করে। ওকে কখনও ভয় করবেন না। শুধু বলবেন, সঙ্গে পিস্তল আছে। গুলি করে মারব। দেখবেন, তখন কীভাবে দৌড়ে পালায়। একেবারে শেয়ালের মতো কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে যাবে…
আসলামের কাছে এ কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তাই খাওয়ার পর ঘণ্টাটাক বিশ্রাম করে আবার কেল্লাবাড়িতে গেলুম। ফকির যেখানে ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে উধাও হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে সংকীর্ণ একফালি পায়ে-চলা পথ খুঁজে পেলুম। দুধারে ঝোঁপঝাড় আর পাথর। আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধার মতো পথে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় থমকে দাঁড়ালুম। সামনে একটা কাঠের বেড়া। বেড়াতে একটা ফলক আঁটা আছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, নিষিদ্ধ এলাকা। তার নিচে একটা মড়ার খুলি এবং খুলির তলায় আড়াআড়িভাবে দুটো হাড় আঁকা। এই চিহ্নের অর্থ সাংঘাতিক।
নিষেধাজ্ঞার তলায় ছোট অক্ষরে লেখা আছে, কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। ভারত সরকার।
বুঝতে পারছিলুম না কেন সরকারি পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই বিপদজ্ঞাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন।
বেড়ার ফাঁকে পা দিয়ে উঠে উঁকি মেরে ওদিকটা দেখতে পেলুম। খানিকটা ফাঁকা জমির পর নিচে গঙ্গার বুকে বালির চড়া। চড়াটা বহুদূর অবধি বিস্তৃত। বিকেলের রোদে চড়ার শেষপ্রান্তে কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ল। এবার বুঝতে পারলুম, ওই চড়ায় চোরাবালি আছে। তাই এই সতর্কতা।
কাঠের বেড়া থেকে নেমে যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে চললুম। একটু পরে দেখি, ডানদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তা চড়াইয়ে উঠে গেছে। রাস্তাটা লাল ধুলোয় ভরা। এটা কেন চোখে পড়েনি তখন?
আসলে লাল রাস্তাটা ঝোঁপের আড়ালে থাকায় লক্ষ করিনি। তা ছাড়া একটা প্রকাণ্ড চৌকো কালো পাথর রাস্তাটাকে আড়াল করেছিল। পাথরটাতে নকশার মতো আঁকা লিপি দেখে বুঝলুম আরবি হরফে কিছু লেখা আছে। তখনই ক্যামেরায় কালো পাথরটার কয়েকটা ছবি তুললুম।
তারপর পাথরের একপাশ দিয়ে এগিয়ে লাল রাস্তায় পৌঁছলুম। কিন্তু সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল ধুলোয় জুতো প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। প্যান্ট একটু গুটিয়ে নিতে হল। সাবধানে পা ফেলে একটুখানি এগিয়েছি, হঠাৎ চমকে উঠলুম। আমার প্রায় ফুটছয়েক দূরে চোখের সামনে এইমাত্র কার জুতোর ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে ভাবলুম চোখের ভুল। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, আমি আবার পা ফেলে এগোতেই আমার সামনে একই দূরত্বে বারবার আগে-পিছে জুতোর ছাপ ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হিম হয়ে গেল।
কোনও এক অশরীরী আমার সামনে হেঁটে চলেছে, এতে কোনও ভুল নেই। তার জুতোর ছাপগুলি আমার জুতোর ছাপের তুলনায় ছোট। কিন্তু কে সে?
চোখের ভুল কি না জানার জন্য দুঃসাহসী হয়ে আবার কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। আবার আমার সামনে একই দূরত্বে সেই অশরীরীর জুতোর স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল।
এবার আমার সব সাহস উবে গেল। শেষবেলার রোদে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। আমি দ্রুত পিছু ফিরে লাল ধুলোয় টলতে টলতে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলুম। তারপর বিভ্রান্তভাবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে দৌডুতে থাকলুম। একটু পরে গঙ্গার ধারে খোলা জায়গায় পৌঁছে পিছু ফিরে দেখে নিলুম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কি না।
এরপর কী করে যে হোটেলে ফিরেছিলুম, মনে পড়ে না।…
জীবনে বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ এবং দুর্গম স্থানে গেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কোথাও ঘটতে দেখিনি। হোটেলের লাউঞ্জে বসে ইশারায় একজন ওয়েটারকে ডেকে কফি আনতে বললুম।
সে কফি এনে দিল। কফি খেতে-খেতে ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় বোঝবার চেষ্টা করছিলুম। এমন সময় দেখি, লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিনস এবং টি-শার্ট। মুখে গোঁফ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হয়েও নয়, ভদ্রলোকের মুখে যেন একটা একটা বিরক্তির ছাপ এবং চোখদুটোও কুতকুতে। এরকম চেহারার মানুষ দেখলে অস্বস্তি জাগে।
ভদ্রলোক সম্ভবত প্যালেস হোটেলের লাউঞ্জে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে না পেয়ে হয়তো বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।
আমার চোখে চোখ পড়লে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর বাংলায় বলে উঠলেন, আপনি কি বাঙালি?
বললুম, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক অমায়িক হেসে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। বললেন,–মশাই! বাঙালির চেহারা দেখলেই চেনা যায়। আমার ঠাকুরদা ওকালতি করতে আজমগড়ে এসেছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি। বাবাও ওকালতি করতেন। আমি কিন্তু ব্যবসা করি। আমার নাম অশোক রায়। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।
অশোকবাবুকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলুম, তাঁর অমায়িক হাবভাব এবং কথাবার্তা শুনে সেই ধারণা কেটে গেল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন,–কেল্লাবাড়ির ধ্বংস্কৃপের মধ্যে কোথায় কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। আমার ছেলেবেলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি।
ওয়েটারকে আবার ডেকে ওঁর জন্য কফি আনতে বললুম। তারপর অশোকবাবু আজ গড়ের পুরনো ঐতিহাসিক কাহিনি বলতে শুরু করলেন। ম্যানেজারের কাছে এসব গল্প শুনেছি। ওয়েটার কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফি খেতে-খেতে অশোকবাবু বললেন, আজ বিকেলে কলকাতা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আসার কথা। তার জন্য অপেক্ষা করে অস্থির। ছটা বেজে এল। সে এল না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, আর সে আসবে না। না আসুক। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী যে আনন্দ পেলুম, বোঝাতে পারব না। তা আপনি হোটেলে থাকবেন কে? খামোকা একগাদা টাকা খরচ! বরং আমার অতিথি হোন। আপনাকে দেখলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুব খুশি হবে।
এত অন্তরঙ্গতার পর বিকেলে কেল্লাবাড়ির ভেতরে সংকীর্ণ লাল রাস্তায় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তা অশোকবাবুকে না বলে থাকতে পারলুম না।
অশোকবাবু ঘটনাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ঐতিহাসিক পণ্ডিত। ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকেন। বাস্তব জগতে ভুলভাল দেখা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। দেখুন মশাই! আমি কত রাতদুপুরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও কিচ্ছু দেখিনি। হ্যাঁ–ওখানে এক পাগলা ফকির থাকে। আমাকে দেখলেই সে লেজ তুলে পালিয়ে যায়। তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন?
বললুম,–হ্যাঁ। দুপুরে ফকিরকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখেছি। আমাকে সে ভয় দেখাচ্ছিল।
অশোকবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পরশু দোলপূর্ণিমা গেছে। আজ কিছুক্ষণ পরে সঁদ উঠবে। কোনও ভয়ের কারণ নেই। আমার সঙ্গে কেল্লাবাড়িতে চলুন। দেখবেন, কোনও অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে না। আর পাগলা ফকিরের ডেরাতেও আপনাকে নিয়ে যাব। দেখবেন, আমাকে দেখে ব্যাটাচ্ছেলে কী করে।
এতক্ষণে সায়েব-মেমদের দলটি এসে পড়ল। অন্যান্য বোর্ডাররাও ততক্ষণে এসে গেছে। কেউ লাউঞ্জে, কেউ ডাইনিং হলে ঢুকে চা-কফি খাচ্ছে। অশোকবাবু বললেন, চলুন! জ্যোৎস্নারাতে আজমগড়ের গঙ্গার ধারে বসে গল্প করা যাবে। তারপর সেই লাল রাস্তায় যাব। আমার কাছে টর্চ আছে। আপনাকে আমি রেশমা বেগমের কবরও দেখিয়ে দেব। উঠে পড়ুন।
একটু অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে অশোকবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলুম। তারপর মনে হল, ইনি বাঙালি এবং এখানেই বড় হয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর বলিষ্ঠ গড়ন দেখেও শেষপর্যন্ত ভয়টুকু ঘুচে গেল…
কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকে গঙ্গার ধারে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি দুজনে বসলুম। অশোকবাবু কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে নিচ্ছিলেন। বহুবছর তার কলকাতা যাওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পরেই চাঁদ উঠল। জ্যোত্সায় গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আর ধ্বংসস্তূপ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অশোকবাবু বললেন, আপনি যে লাল রাস্তাটা দেখেছিলেন, ওর পাশেই নাকি ইংরেজরা বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়েছিল। তবে আপনি যে অশরীরী জুতোর ছাপ দেখার কথা বললেন, ওটা চোখের ভুল। ওই রাস্তা দিয়ে পাগলা ফকির যাতায়াত করে। আপনাকে আড়াল থেকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যাটা নিশ্চয় কোনও কারচুপি করেছিল। এও হতে পারে পুরু ধুলোর তলায় লম্বা কোনও জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। তার ওপর আপনি পা ফেললেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে ধুলো ঠেলে তুলবে। স্রেফ ম্যাজিক! চলুন। পরীক্ষা করা যাক।
অশোকবাবু আমার হাত ধরে ওঠালেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললুম, কিন্তু আমি সত্যি জুতোর ছাপ দেখেছিলুম।
আরে মশাই! আমি তো সঙ্গে আছি আসুন না। বলে অশোকবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। আমার কাঁধে তার হাত চেপে বসল।
জ্যোৎস্নার জন্য ধ্বংসস্তূপের চকরাবকরা ছায়ার ভেতর দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে চললেন। একটু পরে দেখলুম, সেই আরবি লিপি খোদাই করা কালো পাথরটার কাছে এসে গেছি! অশোকবাবু টর্চের আলো ফেলে বললেন,–চলে আসুন। দেখা যাক কী হয়।
সংকীর্ণ চড়াই রাস্তায় কিছুটা উঠে টর্চের আলো ফেলে অশোকবাবু বললেন, কই? কোনও ভুতুড়ে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?
বললুম,–এখন পাচ্ছি না। কিন্তু–আমার কথা থেমে গেল। এরপর যা ঘটল তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে অশোকবাবু আমার কানের নিচে শক্ত এবং ঠান্ডা কী একটা জিনিস ঠেকিয়ে চাপা গর্জন করে বললেন,–টুঁ শব্দটি নয়। ট্রিগারে আঙুল আছে। একটু চাপ দিলেই তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে। আগে ক্যামেরাটা দাও। হ্যাঁ–তারপর রিস্টওয়াচ। আর মানিব্যাগটা বের করো।
মুহূর্তে আমি টের পেয়ে গেছি, এক ভদ্রবেশী গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছি। হোটেলের ম্যানজার মিঃ ঠাকুর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন কেন, এতক্ষণে তার মর্ম বুঝতে পারলুম। সেই ফকিরও হয়তো আমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। ক্যামেরাটা গলা থেকে ঝুলছিল। সেটা হাতে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, দয়া করে এটা নেবেন না। মানিব্যাগে হাজারখানেক টাকা আছে। তা নিন। ঘড়িটাও নিন। কিন্তু ক্যামেরায় লোড করা ফিল্মে অনেক ছবি আছে। দয়া করে অন্তত ফিল্মের রোলটা বের করে নিতে দিন আগে।
অশোকবাবুরূপী দুবৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্রের নল আমার কানের নিচে আরও চেপে হিসহিস করে বলে উঠল, চুপ! শিগগির! আর একটা কথা বললে তোমার লাশ পড়বে। আর সেই লাশের কথা কেউ জানতেও পারবে না। কারণ তোমার লাশ আমি চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আসব। চোরাবালিতে তোমার মতো কত লাশ আমি ফেলে দিয়ে এসেছি। সব তলিয়ে গেছে।
বলেই সে ধমক দিল,–আবে জলদি কর!
এতক্ষণে মনে হল, লোকটার মাতৃভাষা বাংলা নয়। তার বাংলা কথাবার্তায় কেমন যেন একটু হিন্দির টান ছিল। কিন্তু এবার ডান কানের নিচে ব্যথা পেয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিলুম। তারপরই আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা শপাং করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপর দেখলুম, দুবৃত্তটার হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়ল এবং সে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
তারপর আবার শপাং করে প্রচণ্ড শব্দ হল। গুণ্ডাটা লাল ধুলোয় গড়াতে শুরু করল। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। কোনও অশরীরী অদৃশ্য চাবুক মেরে চলেছে তাকে। সে একবার কাত হচ্ছে। একবার উপুড় হচ্ছে। হাঁটু মুড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারপরই সেই প্রচণ্ড শব্দ এবং তার মুহুর্মুহু আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখছি, লোকটার গায়ের টি শার্ট ফালাফালা হয়ে কালো কালো ক্ষতরেখা ফুটে উঠছে।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লাল ধুলোভরা রাস্তায় নোকটা ক্রমাগত গড়াচ্ছে এবং তার গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে শুধু। অশরীরীর চাবুকের শব্দ ক্রমশ প্রচণ্ডতর হয়ে উঠছে।
লাল ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবার। তার আড়ালে চাবুকের ক্রমাগত শব্দ আর গোঙানি শুনতে-শুনতে একসময় আমার চেতনা ফিরে এল। তখনই দৌড়ে নেমে এসে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরোলাম। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ভোলা জায়গায় ছুটে চললুম।
কেল্লাবাড়ির ভাঙা ফটকের কাছে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে হোটেলে ফিরে চললুম। না, কাউকে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলা উচিত হবে না…
রাতে ডিনার খাইনি। ম্যানেজার খবর নিতে এসেছিলেন আমার রুমে। বলেছিলুম,–ঘুরে-ঘুরে খুব ক্লান্ত। খিদে নেই।
সারারাত যতবার ঘুম এসেছে, চমকে উঠেছি। আবার বুঝি কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। ভোর ছটায় আসলাম খান বেড-টি আনল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, খবর আছে স্যার! সুখবর। তাই বলা উচিত মনে হল।
বললুম, কী সুখবর আসলাম?
সে বলল,–আজমগড়ে একজন সাংঘাতিক গুণ্ডা ছিল। তার নাম কাল্প। সে আমাদের হোটেলে এসেও ম্যানেজারসায়েবের কাছে টাকা দাবি করত। কাল সন্ধ্যার আগে সে নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। ওয়েটার রমেশ দেখেছে। কিন্তু আপনাকে সাবধান করার সুযোগ পায়নি।
–কিন্তু সুখরবটা কী?
কাক্কু গুণ্ডাকে কে বা কারা রাত্রে মেরে কেল্লাবাড়ির ভেতরে লাশ ফেলে এসেছে। পাগলা ফকির খুব ভোরে সেই লাশ দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। আশ্চর্য ঘটনা স্যার, তার পিস্তল আর টর্চটা সেখানেই পড়ে ছিল।
–আচ্ছা আসলাম! কাল্লু কি বাঙালি ছিল?
–না স্যার। তবে সে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারত। কলকাতাতে নাকি তার ছোটবেলা কেটেছিল। স্কুলেও পড়েছিল। তাই বাংলাও বলতে পারত। আজমগড়ে বাঙালি আছে। তারা তো কাল্লুকে বাঙালি বলেই মনে করত। কাম্পু কখন কোন রূপ ধরত, চেনা কঠিন হতো।
–কাল্লুর লাশ কি পুলিশ নিয়ে গেছে?
–শুনলুম একটু আগে মর্গে নিয়ে গেছে। কাল্পর সারা শরীর নাকি রক্তে লাল।
ব্রেকফাস্টের পর সাড়ে নটায় আমি এবার সাহস করে কেল্লাবাড়িতে গেলুম। আমার মনে হচ্ছিল, কাল বিকেলে যে অশরীরীর জুতোর ছাপ আমার সামনে রাঙা ধুলোয় ফুটতে উঠতে দেখেছি, সেই ছদ্মবেশী অশোক রায় নামধারী দুবৃত্ত কাল্পর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। মনে-মনে তার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানালুম।
এবার নির্ভয়ে সেই কালো পাথরের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ লাল ধুলোভরা রাস্তায় পৌঁছলুম। চড়াই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আর সেই জুতোর ছাপ সামনে ফুটে উঠল না। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। নিচে নেমেই ঘন গাছপালার ভেতর সারসার কয়েকটা কবর দেখলুম। তারপর লাল পাথরের একটা কবর দেখে এগিয়ে গেলুম। সেই কবরের শিয়রে একটা রক্তকরবীর গাছ। কবরে লাল ফুল ঝরে পড়েছে। আমি বহুকাল আরবি লিপির ফলক দেখে-দেখে লিপি বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলুম। আরবিতে তিনটি হরফ চেনামাত্র বুঝতে পারলুম এটাই সেই সিপাহিবিদ্রাহীদের নেত্রী শাহজাদি রেশমা বেগমের কবর, যাঁর ডাকে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
হঠাৎ আমার মাথায় কথাটা এসে গেল। তা হলে কি রেশমা বেগমের অতৃপ্ত আত্মাই আমাকে কাল বিকেলে পথ দেখিয়ে তার কবরের কাছে আনতে চেষ্টা করেছিল? সেই রেশমা বেগমের আত্মাই কি দুবৃত কাল্লুকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছিল?
শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়ল। পাশের একটা লাল ফুলের গুচ্ছ ডাল থেকে ভেঙে বিদ্রোহিনীর কবরে রেখে মাথা ঠেকালুম। সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধ একটা হাওয়া ভেসে এল। সেই হাওয়ায় যেন পুরোনো ইতিহাসের সুঘ্রাণ টের পেলুম। মনে-মনে বললুম, প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়িকা বীরাঙ্গনা তুমি! তোমার জীবনকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।
এই সময় পাগলা ফকির এসে গেল। অট্টহাসি হেসে সে বলল,–বাবুজি! আপকা উপ্লর রেশমা বেটি বহত খুশ যায়। তো আব আপ তুরন্ত হিয়াসে চলা যাইয়ে। রেশমা বেটিকো একেলা রহনে দিজিয়ে। বেটি জিন্দেগিমে বহত দুখ পায়ি। বহত দুখসে মর গেয়ি বেটিয়া!
তখনই নিঝুম কবরখানা থেকে চলে এলুম। ইতিহাসে এইসব আশ্চর্য ঘটনা লেখা যাবে না। সেগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনেই থেকে যাক।
হ্যাঁ–সেই অদ্ভুত ঘটনা এতদিন কাকেও বলিনি। এখন আমি বৃদ্ধ। মৃত্যুর আগে ঘটনাগুলি লিখে যাওয়া উচিত মনে করেই লিখে ফেললুম। এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমি নিরুত্তর থাকব।…
আধি ভৌতিক
জগনমামা বললেন, তাহলে বাবা ঝন্টু ততক্ষণ তুমি মামিমার সঙ্গে গল্পসল্প ( করো। আমি ঝটপট বাজারটা সেরে আসি।
বলে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে ডাকলেন, কই গো। ছাতিটা দাও বরং! এই সাতসকালেই রোদ্দুরটা বড় চড়ে গেছে।
জগনমামার মাথায় এমন প্রকাণ্ড টাক আমি আশা করিনি। এতকাল পরে ওঁকে দেখে খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। চেহারায় কী দারুণ অদলবদল না ঘটে গেছে। রোগা খটমটে চেহারার মানুষ ছিলেন। এখন বিশাল পিপে হয়ে উঠেছেন। মুখে এমন অশান্ত হাসিও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই মফস্বল শহরে এখন ওঁর উকিল হিসেবে বেজায় নামডাকও হয়েছে এবং তার কারণ সম্ভবত ওঁর চেহারার এই ভোলবদল। আগে ওই শুটকো চেহারা আর খিটখিটে মেজাজের জন্যে মক্কেল যেমন জুটত না, তেমনি হাকিমরাও নাকি ওঁকে এজলাসে দেখলে চটে যেতেন। অবিশ্যি, সবই শোনা কথা।
এও শোনা কথা যে জগনমামার স্ত্রী আত্মহত্যাই করেছিলেন। কৌশলে কলেরায় মৃত্যু বলে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। উকিল-মানুষদের তো পেটে-পেটে
বুদ্ধি।
বলে রাখা ভালো, জগনমামা কস্মিনকালে আমার মামাকুলের কেউ নন। ছেলেবেলায় আমার বাবা-মারা যান। পাড়াগাঁয়ে সম্পত্তি রাখার নানা ঝামেলা। মামলা মোকদ্দমার দায় সামলাতে হতো তাই মাকেই। সেই সুবাদে এই উকিল ভদ্রলোক মায়ের দাদা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবে পেলাম না জগনমামার মতো উকিল কেন ধরেছিলেন মা! তখন আরও কত জাঁদরেল উকিল এ শহরে তো ছিল। মামলায় হেরে গেলেও দেখতাম ফের এই ভদ্রলোকের কাছে এসে পড়েছেন।
হয়তো এটাই মানুষের অভ্যাস। চেনা-জানা ডাক্তারের হাতে মরতেও রাজি যেমন, তেমনি উকিল-মোক্তারের বেলাও তাই।
এখন মা নেই। আমি বিষয়সম্পত্তির হাল ধরেছি। আমি সেই একই অভ্যাসে এসে জুটেছি জগন-উকিলের দরজায়। মামলায় হার-জিত-ভবিষ্যতের কথা–ছোটবেলা থেকে যাঁকে মামা বলে জানি, তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালে মনের জোর ভীষণ বেড়ে যায়।
তবে তার চেয়ে বড় কথা, জগনমামার এখন নাকি নামডাক হয়েছে। কাজেই আমার মনের জোর অনেক বেশি করেই বেড়েছে। আজ রোববার। আগের দিন ও রাত্তিরটা জগনমামার বাড়ি কুটুম্বিতা এবং শলাপরামর্শ করা যাবে বলেই আসা। আগামীকাল ফার্স্ট আওয়ারে কেস ঠোকা যাবে।
বুঝতে পারছিলাম, জগনমামা আবার বিয়ে করেছেন। তবে অবাক হচ্ছিলাম নতুন মামিমা একবারও ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না দেখে। ভেতরের বারান্দার একটা চেয়ারে আমি বসে আছি। জগনমামা ওপাশের কিচেন থেকে চা এনেছেন। চায়ের খালি কাপ প্লেট-উনি রেখে এসেছেন। মামিমার পাত্তা নেই। জগনমামা ওঁর উদ্দেশে কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু কোনও সাড়া আসছে না।
তাই ভাবছিলুম, একটা দাম্পত্য কলহ-গোছের কিছু ঘটে থাকবে। নাকি মামিমা ঠাকুরঘরে পুজোয় বসে আছেন?
জগনমামা ছাতি চাইলেন। তবু মামিমার সাড়া এল না। তখন জগনমামা মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে উঠোন থেকে বারান্দায় উঠলেন। তারপর তির খোঁজে ঘরে ঢুকলেন। ঘর থেকে ওঁর চাপা গলা শুনতে পেলাম। একটু পরে বেরিয়ে এলেন ছাতি হাতে। মুখে অশান্ত কথাবার্তা-হাসি। বললেন, তাহলে গল্পসল্প করো তোমরা। আমি ঝটপট ফিরব।
উনি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওদিকটায় আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শর্টকাট পায়ে চলার পথ আছে। গিয়ে উঠেছে বাজারের চওড়া রাস্তায়। এদিকটা একেবারে নিরিবিলি নিঃঝুম জায়গা। আশেপাশে বাড়ি বিশেষ নেই। গঙ্গার ধারে শহরের একপ্রান্তে এই বাড়িটার বয়স প্রাচীন। একটু তফাতে হাসপাতাল এলাকা, অন্য দিকটায় গঙ্গার পাড়ে বনজঙ্গলের সঙ্গে সাজানো ঘন বন। ভাঙন আটকাতেই ওই নিরামিষ জঙ্গল, জগনমামার ভাষায় নৈমিষারণ্য।
বাড়ি একেবারে চুপচাপ। গ্রীষ্মের এই সাতসকালে গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এল শনশনিয়ে। হাওয়াটা খিড়কির দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে বই-বাই করে ঘুরতে থাকল। তারপর পাঁচিলের ধারে জবা ও শিউলির ঝোপে হুলুস্থুল করে পটাপট কিছু হলুদ পাতা ছিঁড়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল। এই সময় আমার মনে পড়ল যেদিকে হাওয়াটা গেল সেদিকটায় শ্মশানঘাট এবং একটু পরে সেই উঁচু বটগাছের মাথায় ঝাঁকুনি লাগল!
কিছু করার না থাকলে আমার উদ্ভট সব অনুভূতি জাগে। হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা মামির অর্থাৎ জগনবাবুর প্রথম স্ত্রীর কথা। আত্মহত্যা করলে মানুষ নাকি ভূত হয়। এমন নিরিবিলি বাড়িতে ভূতের পক্ষে হামলা করা ভারি সহজ। পুরোনো মামিমার ভূত নতুন মামিকে জ্বালায় না?
কে জানে কেন, এ বাড়িতে রাতে থাকতে হবে ভাবতেই এবার অস্বস্তি জাগল। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ভূতের ভয় আমার বেজায় রকমের।
একটু কাশলাম। ভেতরের ঘর একেবারে চুপচাপ। সিগারেট টানতে থাকলাম। জগনমামা বলছিলেন, সব সময় খালি তোদের গল্প করি। তোর মায়ের মতো মহীয়সী মেয়ে তো আর হয় না। আর এই টুকুন ছিলি জানিস বাবা ঝন্টু? এই অ্যাটুকুন। আর কী ভীতু কী ভীতু।
এত সব যদি শুনে থাকেন ভদ্রমহিলা, তাহলে আমাকে দেখার জন্যে বেরুলেন না কেন কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
সিগারেট শেষ করে বাড়ি ঢুকে চমকে উঠলাম। কোথা থেকে একটা নেড়ি কুকুর ঢুকে পড়েছে যে। বারান্দায় গিয়ে ভেতরের ঘরের পর্দার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠলাম, মামিমা! কুকুর ঢুকছে। কুকুর!
তবু সাড়া নেই দেখে দৌড়ে এলাম। কুকুরটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল। লাথি খেয়ে কেঁউ-কেঁউ করে উঠল এবং ডিগবাজি খেতে-খেতে উঠোনে গিয়ে পড়ল। তারপর লেজ গুটিয়ে পালাল।
পর্দা তুলে উঁকি মেরে ডাকলাম, মামিমা! কিন্তু ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। সেকেলে পালঙ্কের ওপর জগনমামার লুঙ্গি পড়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকালাম। এক গুচ্ছের স্নো-পাউডার ইত্যাদি যথারীতি সাজানো। ওপাশে আলনায় কয়েকটা শাড়ি ও সায়া পর্যন্ত। সেগুলো অত ময়লা কেন ভেবে পেলাম না।
কিন্তু ঘরে একটা মেয়েলি গন্ধ টের পাচ্ছিলুম। আবছা মনে হল, মামিমার বয়স নিশ্চয় জগনমামার তুলনায় ঢের কম। মেয়েলি গন্ধটা কি চুলের? স্নানের পর মেয়েদের চুলের এমন গন্ধ হয়। একটু লজ্জা পেলাম! এ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ভদ্রমহিলা ওপাশে কোথাও আছেন। এসে গেলে অপ্রস্তুতের একশেষ হবে।
বেরিয়ে আসার আগে ড্রেসিং টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে চোখ পড়ল। পুরুষ ও মহিলার ছবি পাশাপাশি। কিন্তু চিনতে পারলাম না। শুধু দেখলাম, যুবতী মহিলাটি কেমন চোখে তাকিয়ে হাসছেন।
ঠিক এইসময় বাইরে জগনমামার সাড়া পেলাম।…বহু ভাগ্যে দুটো গলদা পেলাম, বুঝলে? মোট দুটো। থাকগে। এতেই হবে। আর ইয়ে, শানোর ছাই! ভুলে গেলাম যে!
ঝটপট বেরিয়ে শুনলাম, মামিমার গলা,–এ অসময়ে ওদের বাড়ি না গেলে চলত না? ঝটপট ফিরে এসো তাহলে। অবিশ্যি আজ রোববার। বেলা করেই খাওয়া যাবে।
নতুন মামিমা তাহলে কিচেনে ছিলেন।
ঘুরে জগনমামা একগাল হেসে বললেন,–এই যে ঝন্টু। আলাপ হল মামিমার সঙ্গে? গল্পের রাজা! থুড়ি রাণি! রাণি আর তুমি তো বরাবর ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসতে! এখন অবিশ্যি বড় হয়েছ। তাহলে মন্দ লাগবে না। কী বলো।
বলে চোখ নাচালেন,–রাত্তিরে শুনবেখণ…
বাইরের ঘরে জগনমামার ওকালতির আপিস। আজ ছুটির দিন বলে বুঝি ওঁর মুহুরিবাবু আসেননি। সেই ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বাইরে রোদ বেড়েছে। এখনই লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চারপাশে শুধু গাছপালার শনশন আর গঙ্গায় নাইতে যাওয়ার সরু গলিপথে আবর্জনার ঝড় বইছে শোঁশো করে। ভেতর থেকে জগনমামার কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। নতুন মামিমার সঙ্গে অনর্গল কথা বলছেন। ভদ্রমহিলাকে ভারি অদ্ভুত বলব। সম্ভবত শুনেই যাচ্ছেন মুখ বুজে।
আর কৌতূহল সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হল। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম। জগনমামা কিচেনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেবিলে তরকারি কুটছেন এবং কথা বলছেন। কিচেনের দরজা সামনাসামনি। ভেতরে কেরোসিন কুকার জ্বলছে। রান্না হচ্ছে। কিন্তু নতুন মামিকে দেখা যাচ্ছে না।
মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার সাড়া পেয়ে জগনমামা হেসে বললেন, এসো বাবাজি! তোমার মামিমাকে বলছিলাম, ঝন্টু তো পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বিশুদ্ধ জলবায়ু আর নির্ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ হয়েছে। এ ভূতের জায়গায় অখাদ্য কি ওর রুচবে?
বলেই ভেতরের সেই ঘরের দিকে তাকালেন।…তোমার অত কেন লজ্জা বলল তো? ঝন্টু বলতে গেলে আমার আপন ভাগনে। এসো। কই? বেশ, এসো না। ফিরে গিয়ে তোমারই বদনাম করবে! অচেনা তো নয়। সেই ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছ। বড় হয়েছে বলে লজ্জা! আশ্চর্য!
আপন মনে ফের গজগজ করতে থাকলেন।…তোমার এই একরোখামিই যত সর্বনাশের গোড়া।
আমি হকচকিয়ে গেছি ততক্ষণে। ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছে–এর মানে কী? তাহলে কি নতুন মামিমা আমার চেনাজানা কোনও মহিলা? জগনমামার হাবভাব দেখে কোনও কথা জিগ্যেস করতে সাহস হল না! বুঝলাম, আমার খুব পরিচিত মহিলাকেই বিয়ে করেছেন জগনমামা। এত পরিচিত যে মুখোমুখি হলে নিশ্চয়ই দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই উনি দেখা দিচ্ছেন না। খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। খুঁজেই পেলাম না, তেমন কে হতে পারেন নতুন মামিমা।
দুপুরে খাওয়ার সময়ও উনি এলেন না। জগনমামার মুখ গম্ভীর। সেটা খুবই স্বাভাবিক। টেবিলে সবই সাজানো ছিল! দুজনে চুপচাপ খেলাম। খাওয়া হলে জগনমামা বললেন,–ওপরে গিয়ে ঘুমিয়ে নাও। সাড়ে পাঁচটার আগে উঠো না। গরম কমলে বরং ঘুরে এসো গঙ্গার ধারে।
লম্বা হয়ে গেল ঘুমটা। উঠে দেখি টেবিলে চা ঢাকা আছে। নতুন মামিমা এসে দিয়ে গেছেন কি? বোধহয় জগনমামাই। বাড়ির ভেতর চুপচাপ। চা জুড়িয়ে গিয়েছিল। কল্পনা করলাম, নতুন মামিমা চা রেখে গেছেন, এবং আশ্চর্য, সেই মিষ্টি মেয়েলি গন্ধটা অবিকল টের পেলাম।
দরজা ভেজিয়ে গলিরাস্তায় গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেলাম। ঘণ্টা দুই পরে যখন ফিরে এলাম, তখন এদিকটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। লোডশেডিং। দরজা বন্ধ থাকবে ভেবেছিলাম। কিন্তু কড়া নেড়ে সাড়া না পেয়ে ঠেলতেই দেখি, তেমনি খোলা। ভেতরে ঢুকে ডাকলাম, জগনমামা।
সাড়া এল,–আয় ঝন্টু। এখানে আয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন জগনমামা কালো মূর্তিটি হয়ে। আলো নেই বাড়িতে। বললাম, আলো জ্বালেননি যে!
জগনমামা বললেন, অন্ধকার ভালো লাগে। আয় এখানে আয়। কী গো! এখন তো ঝন্টু তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না, এবার কথা বলবে না কী? অ ঝন্টু, মামিমার সঙ্গে কথা বল।
ডাকলাম,–মামিমা। তারপর টের পেলাম অন্ধকার উঠোনে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি শুধু আমি আর জগনমামা। হঠাৎ কেমন গা ছমছম করে উঠল। বললাম, জগনমামা, মামিমা কই?
এই তো! দেখতে পাচ্ছিস না? জগনমামা অস্বাভাবিক গলায় বললেন, কই গো, ঝন্টুকে ছুঁয়ে দাও তো! আহা দাও না বাবা! বলতে গেলে আপন ভাগ্নে ছোটবেলায় কত আদর করেছ!
অদ্ভুত হাসি হেসে জগনমামা আমার একটা হাত টেনে অন্য হাতে অন্ধকারে অদৃশ্য মামিমার হাত টানার ভঙ্গি করতেই আমার মাথা ঘুরে গেল এবং আচমকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক লাফে বারান্দা থেকে বাইরের ঘরে–তারপর ব্যাগট্যাগের কথা ভুলে দড়াম করে দরজা খুলে গলিতে গিয়ে পড়লাম। জগনমামা যে একজন বিদেহিনী স্ত্রীলোক নিয়ে ঘর করছেন, এতে আর সন্দেহ ছিল না।
.
মাস দুয়েক পরে একদিন শহরে গেছি। ব্যাগটা নিয়ে আসতে তো বটেই। জগনমামার অবস্থা দেখতেও তীব্র কৌতূহল হল। নিরিবিলি জায়গায় পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়িটা দেখে একটু গা ছমছম করছিল। কিন্তু দিনদুপুরে আশা করি আর ভূতের ভয়টা পাব না।
দরজায় কড়া নাড়ার পর খুলল। খুলতেই আমার বুকের ভেতর রক্ত চড়াৎ করে উঠল। হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার এক সুন্দরী মহিলা দরজার পাল্লায় হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন। যেই হাসিখুশি মুখে বলছেন,-কাকে চাই, অমনি আমি পিছিয়ে এসেছি। আর লাফ দিয়েই–
ইনিই যে সেই নিরাকার মামিমা, যাঁর সঙ্গে জগনমামা অনর্গল কথা বলতেন এবং যিনি আত্মহত্যা করে মারা যান, তিনি ছাড়া আর কে হতে পারেন? ভুল হয়েছে বলে আমি হনহন করে চলে এলাম, পা টলছিল। একবারও পিছু ফেরার সাহস হল না। নিরাকার আকার ধরেই সমস্যা।
কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া রহস্যময়। তবে এটুকু মনে পড়ছে, পেছনে জগনমামার যেন চিৎকার শুনছিলাম ঝন্টু ও ঝন্টু! চলে যাচ্ছিস কেন? তোর নতুন মামিমার সঙ্গে আলাপ করে যা! কানের ভুল হতেও তো পারে। নতুন শব্দটা কি সত্যি শুনেছিলাম…?
আম কুড়োতে সাবধান
ফুটবলম্যাচ দেখতে যাব বলে সেজেগুজে তৈরি হচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে এসে বাধা দিল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন অবস্থাটা আরও সাংঘাতিক করে ফেলল। মনমরা হয়ে বসে রইলুম।
সন্ধ্যার দিকে ঝড়বৃষ্টির দাপট যখন কমে গেল, তখন দেখলুম ছোটমামা কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছেন। একটু পরে পোশাক বদলে একটা লণ্ঠন জ্বেলে ছোটমামা ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দেখে বললেন,–এ কী রে পুঁটু? তুই অন্ধকারে ভূতের মতো বসে আছিস যে?
বললুম, ধুস! ফুটবলম্যাচ পণ্ড হয়ে গেল।
ছোটমামা টেবিলে লণ্ঠন রেখে বললেন,-তাতে কী হয়েছে? যে আমার ঝাঁপুইতলা বনাম কঁকুড়হাটির খেলা! ও খেলা কি দেখার যোগ্য?
বলে উনি ফিক করে হসলেন। চাপাস্বরে ফের বললেন,–চল। বেরিয়ে পড়ি।
একটু অবাক হয়ে বললুম,–কোথায়?
ছোটমামা আরও চাপাস্বরে বললেন,–ফেরার সময় শর্টকাটে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ দিয়ে এলুম। বললে বিশ্বাস করবিনে পুঁটু, ঝড়বৃষ্টির চোটে বাগানের সব আম পড়ে গেছে। এই জষ্টিমাসের আম। বুঝলি তো? সবই গাছপাকা।
–অন্ধকারে কী করে দেখতে পেলেন ছোটমামা?
তুই একটা বোকর বোকা!–ছোটমামা একটু চটে গেলেন।–বিদ্যুতের ছটায় দেখলুম না? সারা বাগানের তলায় পাকা আম ছড়িয়ে আছে। চল। কুড়িয়ে আনি।
–কিন্তু ছোটমামা, বাগানে ভোলা আছে যে! ভোলা সাংঘাতিক লোক। ভোঁদা বলছিল, সিঙ্গিমশাই ভোলাকে নাকি তাঁর বন্দুকটা দিয়েছেন। দেখতে পেলেই
আমার কথায় বাধা দিয়ে ছোটমামা বললেন,–ভোঁদা তোর চেয়েও বোকা। সিঙ্গিমশাই বন্দুক দেবেন ভোলাকে ভোলা বন্দুক ছুঁড়তে জানে? তা ছাড়া বন্দুকটা বাড়িতে না থাকলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়িতে ডাকাত পড়বেই পড়বে, তুই জানিস? ওঠ। দেরি করা ঠিক নয়।
দোনামনা করে বললুম,–বন্দুক না পেলেও ভোলা খুব সাংঘাতিক লোক ছোটমামা! ওর গোঁফ আর চোখদুটো দেখলেই ভয় করে।
ছোটমামা আমার কথায় কান দিলেন না। কোত্থেকে একটা চটের থলে আর টর্চ নিয়ে এলেন। বললেন,-ভোলা এতক্ষণ খেতে গেছে। চলে আয়। আর শোন। জুতো খুলে ফ্যাল। খালি পায়ে যাব।
সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানটা গ্রামের শেষে মাঠের ধারে। বাগানের মধ্যিখানে একটা মাচার ওপর ছোট্ট ছাউনি আছে। ভোলা সেখানে বসে বাগান পাহারা দেয়। সে দারুণ ধূর্ত লোক। বাগানের আনাচে-কানাচে কেউ পা বাড়ালে কী করে সে টের পেয়ে যায় কে জানে! টের পেলেই এমন হক ছাড়ে যে পিলে চমকে যায়। গতমাসে কচি আম কুড়ানোর জন্য ভোঁদার সঙ্গে গিয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলুম!
আমি তো দিশেহারা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলুম। ওদিকে ভোঁদা ওর হাতে ধরা পড়ে সে এক কেলেঙ্কারি! ভোঁদাকে শাস্তিটা অবশ্যি দিয়েছিলেন ভোঁদার বাবা হাবুলবাবু! পাড়াসুদ্ধ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবোস করানোর শাস্তি-ঘ্যা-ছা! ভেঁদা কিছুদিন বাড়ি থেকে লজ্জায় বেরুতে পারেনি। স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা।
সেই কথা ভেবে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু ছোটমামার অবাধ্য হওয়ার সাহসও আমার নেই। তাছাড়া ছোটমামা না থাকলে কে আমাকে শহরে কিংবা গঞ্জের মেলায় নিয়ে যাবে? পৃথিবীতে সবসময় কোথাওনা-কোথাও কত সুন্দর সব ঘটনা ঘটছে। ছোটমামা না নিয়ে গেলে আমি একা সেসব দেখতেই যে পাব না।
সন্ধ্যার অন্ধকার আজ বেজায় গাঢ়। আকাশের কোণায় দূরে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক। চারদিকে ব্যাঙ, পোকামাকড় তুলকালাম গান জুড়ে দিয়েছে। সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানের দিকে যত এগোচ্ছি, তত অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছে। ছোটমামা পায়ের কাছে সাবধানে টর্চের আলো ফেলে হাঁটছেন। তাঁর পেছনে থলে হাতে আমি হাঁটছি। কতক্ষণ পরে ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললেন, ভোলার কুঁড়েঘরটাতে লণ্ঠন জ্বলছে বটে, তবে বাজি রেখে বলতে পারি, ব্যাটাচ্ছেলে নেই।
–কী করে বুঝলেন ছোটমামা?
–দিঘির পাড়ে টর্চের আলো দেখলুম না? ভোলা ওখান দিয়েই তো খেতে যায়।
–ভোলার টর্চ আছে বুঝি?
–থাকবে না? তুই বড্ড বোকা পুঁটু! রাতবিরেতে টর্চ ছাড়া কেউ বাগানে পাহারা দিতে পারে? তবে আর কথা নয়। আয়, তোকে বাগানের শেষ দিকটাতে একখানে বসিয়ে রাখব আর আমি আম কুড়িয়ে আনব। চুপচাপ বসে থাকবি কিন্তু!
ছোটমামা কথাটা বলতে গিয়ে পারলুম না। ভোঁদা বলেছিল, ওই বাগানের কোন গাছে কবে কে নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। আর ভূতটা এখনও আছে। তবে সে ভোলার ভয়ে বেরুতে পারে না। ভোলা বাগানে না থাকলে তবেই সে বেরিয়ে এসে লোকেদের ভয় দেখায়।
তো ছোটমামা ধমক দিলেন চাপাগলায়। চুপ! খালি ছোটমামা আর ছোটমামা! –বলে এবার আমাকে প্রায় টানতে-টানতে নিয়ে চললেন। জলকাদা জমে আছে ঘাসের ফাঁকে। পা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। প্রতিবারই ধমক খাচ্ছি। টর্চের আলোর দিকে চোখ রেখে হাঁটতে হচ্ছে।
ঠিক কথা। আসলে আমি সেই ভূতটার কথা ভেবে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিলুম। ভোলা যে এখন বাগানে নেই। কিছুক্ষণ পরে ছোটমামা আমাকে জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন,–তুই এইখানে বসে থাক। আমি গাছপাকা আম ছাড়া কুড়োব না। ওই দ্যাখ, কত পাকা আম।
টর্চের আলোয় হলদে কয়েকটা আম দেখতে পেয়েই আমি ভূতের ভয়টা ভুলে গেলুম। এইসব আম নাকি সেরা জাতের আম। একটুও আঁশ নেই। একেবারে ক্ষীরের সন্দেশের মতো নাকি স্বাদ।
থলে নিয়ে ভিজে ঘাসে বসে থাকা যায় না। তাই উঠে দাঁড়ালুম। ছোটমামা এদিক-ওদিক টর্চের আলা ফেলে পাকা আম কুড়িয়ে আনছেন। মিঠে গন্ধে আমার মুখে জল আসছে। কিন্তু এখন কি আম খাওয়ার সময়?
থলে প্রায় অর্ধেক ভরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ছোটমামা বললেন,–এবার আমি যাচ্ছি বাতাসাভোগ গাছটার কাছে। খাসা আম! বুঝলি পুটু? তুই চুপচাপ বসে থাক। তবে কান খাড়া রাখবি কিন্তু! ভোলা বাগানে আসার সময় গান গাইতে গাইতে। আসে। শুনতে পেলেই তুই ডাকবি।
ছোটমামা টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে আমগাছের অজস্র গুঁড়ির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কোনও গাছের মাথায় একটা পাখি ডানার জল ঝাড়ল। সেই শব্দেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। কিন্তু সুস্বাদু আমের মিঠে গন্ধ আমার ভয়টয় ক্রমশ তাড়িয়ে দিচ্ছিল।
কতক্ষণ পরে ধুপধুপ শব্দে ছোটমামা এসে গেলেন। নাহ। গাছটা খুঁজে পেলুম না। ওদিকে দিঘির পাড়ে টর্চের আলো দেখলুম, ভোলা আসছে।
–ছোটমামা! বড্ড অন্ধকার যে!
–হুঁ, টর্চ জ্বালি আর ভোলা দেখতে পাক! খালি বোকার মতো কথাবার্তা। থলেটা আমায় দে। আর আমার এই হাতটা ধরে থাক। ছাড়বিনে বলে দিচ্ছি।
ছোটমামা আমভর্তি থলেটা নিলেন, কিন্তু ওঁর একটা হাত ধরেই ছেড়ে দিলুম। উঃ! কী সাংঘাতিক ঠান্ডাহিম হাত!
ছোটমামা বললেন, কী হল? হাত ছাড়লি কেন?
–আপনার হাত যে বিচ্ছিরি ঠান্ডা!
–ধুর বোকা! জলকাদা ঘেঁটে আম কুড়িয়েছি, হাত ঠান্ডা হবে না? চলে আয় শিগগির!
এই সময় সত্যিই ভোলার হেঁডেগলার গান শুনতে পেলুম। ছোটমামার বরফের মতো ঠান্ডা হাতটা অগত্যা চেপে ধরে থাকতে হল। ছোটমামা এবার প্রায় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়চ্ছেন। আমিও দৌডুচ্ছি।
কতক্ষণ দৌড়েছি জানি না। আমি এবার হাঁপিয়ে পড়েছিলুম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম,–ছোটমামা। আমার পা ব্যথা করছে যে!
ছোটমামার মনে দয়া হল, বললেন, হুঁ। অনেকটা ঘুরপথে আসতে হল। কিন্তু কী আর করা যাবে? এবার আস্তেসুস্থে যাওয়া যাক।
অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখানে-ওখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলছে। কাছে কোথায় আচমকা শেয়াল ডাকতে থাকল। একটু ভয় পেয়ে বললাম, আমরা কোথায় এসে পড়েছি ছোটমামা?
–নদীর ধারে। ঝুঝলি না? ভোলার চোখ রাতবিরেতেও দেখতে পায় তাই পুরো গ্রামটার পাশ দিয়ে ঘুরতে হল। বলে ছোটমামা অদ্ভুত শব্দে হাসলেন। –তা পুঁটু! এবার একটা আম টেস্ট করে দেখি। কী বলিস? সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের আমের এত নামডাক। দেখি, সত্যি কি না।
ছোটমামা সেখানেই বসে পড়লেন। তারপর তেমনি অদ্ভুত শব্দে আম খেতে শুরু করলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি, এবার আমাকেও একটা আম খেতে দেবেন ছোটমামা। কিন্তু উনি যেন আমার কথা ভুলেই গেছেন। ক্রমাগত আম খাচ্ছেন আর আঁটিগুলো ছুঁড়ে ফেলছেন। শব্দ শুনে বুঝতে পারছি, ওগুলো জলেই পড়ছে।
কিছুক্ষণ পরে না বলে পারলুম না, কেমন আম ছোটমামা?
জিভে একটা শব্দ করে ছোটমামা বললেন,-ফাস্টো কেলাস! তুই খেলে টের পেতিস পুঁটু! কিন্তু কী আর করা যাবে? সবগুলোই যে আমি কেঁকের বশে খেয়ে ফেললুম!
প্রায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠার মতো বললুম, স-ব?
–হ্যাঁ। তোর কথা মনেই ছিল না। বরং তার বদলে তোকে একটু আদর করি। বলে ছোটমামা আমার মাথায় তারপর মুখে হাত বুলোতে থাকলেন। কী অসহ্য ঠান্ডা হাত! আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,–আর না ছোটমামা! বড় ঠান্ডা লাগছে যে!
–আমের গন্ধ কেমন মিঠে টের পাচ্ছিস বল পুঁটু! এই নে। আমার হাত শোক।
ছোটমামার আঙুল আমার নাকে ঢুকতেই আঙুলটা চেপে ধরলুম। তারপরই টের পেলুম আঙুলটা বেজায় শক্তও বটে। আঙুল না হাড়ঃ রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেললুম। ছোটমামা আদুরে গলায় বললেন, কাঁদে না ছোঁড়া? কাল তোমায় আম খাওয়াব। এবার আমি নদীর জলে হাত ধুয়ে আসি।
ছোটমামা যে এমন অদ্ভুত কাণ্ড করবেন, কল্পনাও করিনি। উনি উঠে গেলেন হাত ধুতে, গেলেন তো গেলেনই। আর ফেরার নাম নেই। জলের ওপর এতক্ষণে তারা ঝিলমিল করছে দেখতে পেলুম। আবার একদল শেয়াল ডেকে উঠল। তখন ভয় পেয়ে ডাকলুম,–ছোটমামা! ছোটমামা!
কিন্তু কোনও সাড়া এল না। আমি এবার মরিয়া হয়ে আরও জোরে ওঁকে ডাকতে থাকলুম। কিছুক্ষণ পরে একটু দূরে টর্চের আলো ঝিলিক দিল। তারপর ছোটমামার গলা ভেসে এল, পুঁটু! পুঁটু!
সাড়া দিলুম। ছোটমামা দৌড়তে-দৌড়তে কাছে এলেন। তারপর টর্চের আলোয় খালি থলে দেখে প্রচণ্ড খাপ্পা হয়ে বললেন,–বিশ্বাসঘাতক! এইটুকু ছেলের হাড়ে হাড়ে এত বুদ্ধি! নদীর ধারে শ্মশানের কাছে আম নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তারপর হায়! হায়! সবগুলো আম একা সাবাড় করেছে!
অবাক হয়ে বললুম,–ছোটমামা! আপনিই তো—
উনি থাপ্পড় তুলে বললেন, আমিই তো মানে? মিথ্যুক কোথাকার!
-না ছোটমামা! আপনিই তো আমাকে এখানে এনে আমগুলো একা খেয়ে তারপর নদীর জলে হাত ধুতে গেলেন।
–শাট আপ! দেখি তোর মুখ খুঁকে!
আমার মুখে আমের গন্ধ পেয়ে ছোটমামা আরও তর্জন-গর্জন জুড়ে দিলেন। ওঁকে কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছিলুম না। একটু পড়ে উনি হতাশ হয়ে ভিজে ঘাসে বসে পড়লেন। বাতাসাভোগ আমগাছটা খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে দেখি, তুই নেই। ভাবলুম, ভোলা আসছে টের পেয়ে তুই বাড়ি চলে গেছিস। বাড়িতে তোকে পেলুম না। তারপর তোকে ডেকে ডেকে–ওঃ! পুটু রে! তুই এমন করবি ভাবতেও পারিনি।
–বিশ্বাস করুন ছোটমামা! আমি আম খাইনি। আপনিই খেয়েছেন।
–আবার মিথ্যে কথা? তোর মুখে আমের গন্ধ।
–আপনিই তো আদর করছিলেন এঁটো হাতে। কী সাংঘাতিক ঠান্ডা আপনার হাত!
আমার হাত ঠান্ডা? বাজে কথা বলবিনে!–বলে ছোটমামা ওঁর একটা হাত আমার গলায় ঠেকালেন।–বল এবার। আমার হাত ঠান্ডা না গরম?
কী আশ্চর্য! ছোটমামার হাত তত মোটেই তেমন ঠান্ডা নয়। অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাহলে কে ছোটমামা সেজে আমাকে নদীর ধারে শ্মশানে এনেছিল? তার আঙুলটা নিরেট হাড় কেন?
আর ভাবতে পারলুম না। কঁদো কাঁদো গলায় বললুম, ছোটমামা! তাহলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের সেই গলায়দড়ে ভূতটা আপনি সেজে আমাকে এখানে টেনে এনেছিল।
শাট আপ! –বলে ছোটমামা উঠে দাঁড়ালেন। খালি বাজে গল্প! মিথ্যুক! লোভী! বিশ্বাসঘাতক! তোর শাস্তি পাওয়া উচিত। থাক তুই শ্মশানে পড়ে। আমি চললুম।
ছোটমামা দৌড়তে থাকলেন। আমি মরিয়া হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলুম। ভাগ্যিস, ওঁকে টর্চ জ্বেলে দৌড়তে হচ্ছিল। তাই ওঁর নাগাল পেতে অসুবিধা হচ্ছিল না…
যাই হোক, বাড়ি ফিরে দুজনেই ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলুম। ছোটমামা বলে দিলে মা ওঁকে খুব বকাবকি করতেন। আমি বললে শুধু মা নন, বাবাও আমাকে মিথ্যকের চূড়ামণি বা আর পেটুক সাব্যস্ত করে একটা জব্বর শাস্তি দিতেন।
ছোটমামার রাগ পড়তে তিন দিন লেগেছিল। তবে আমার কথা উনি কিছুতেই বিশ্বাস করেননি। আমার মনে এই দুঃখটা আজও থেকে গেছে। তবে ঠকে শিখেছি, আম কুড়োতে গেলে সাবধান থাকাই উচিত। আর হ্যাঁ, ভোঁদাকে ঘটনাটা চুপিচুপি বলতেই সে আমায় চিমটি কেটে বলেছিল,–তুই সত্যি বড় বোকা পুঁটু। গলায়দড়ে ব্যাটাচ্ছেলে যখন আম সাবাড় করছিল, তুই রাম বললেই পারতিস! রাম নামে সব ভূত জব্দ। আমের বদলে রাম। মনে রাখিস।
কাটিহারের গঙ্গারাম
ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে বাইরে কোথাও গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড বেধে যায়। তাই ছোটমামা সাধাসাধি করলেও সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে কোথাও যেতুম না। সে কলকাতায় যাত্রা দেখতেই হোক, কী মেলা দেখতেই হোক। অবশ্য সব সময় দোষটা যে ছোটমামারই, এমন কিন্তু নয়। কোথাও দিনদুপুরে গিয়ে কোনও কারণে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত্রি তো হতেই পারে। তখন কী আর করা যাবে?
তেমনই একটা রাতের বিদঘুটে কাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। সেটা গোড়া থেকেই বলা যাক।
ঠাকুরদা সপ্তাহে তিনদিন দাড়ি কামাতেন। আর তাঁর দাড়ি কামাতে আসত ভোলারাম নরসুন্দর। ভোলারামকে নাপিত বললেই জিভ কেটে সে বলত, ছি-ছি! নাপিত বলতে নেই। নাপিত বললে কী হবে জানো খোকাবাবু? এই বয়সেই বড়বাবুর মতো তোমার গোঁফদাড়ি গজিয়ে যাবে। আমাকে বলবে নরসুন্দর। কেমন?
এই ভোলারামের অভ্যাস ছিল দাড়ি কামাতেকামাতে গাঁয়ের সবরকম খবর বলা। গাঁয়ের খবর ফুরিয়ে গেলে তখন সে অন্য গাঁয়ের নানারকম খবর বলা শুরু করত। ঠাকুরদা আরামে চোখ বুজে থাকতেন আর হুঁ দিয়ে যেতেন।
সেবার শরৎকালে এক রোববারের সকালে ভোলারাম ঠাকুরদার দাড়ি কামাতে এসেছে। উঠোনে পেয়ারাতলায় চেয়ারে বসে ঠাকুরদা পা ছড়িয়ে চোখ বুজে আছেন। ভোলারাম অভ্যাসমতো ঠাকুরদার গালে সাবান মাখাতে-মাখাতে বকবক করে চলেছে। দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে ঠাকুরদার গোঁফ ছাঁটতে কচি বের করল। তার খবরের এইখানটায় ছিল সিঙ্গিমশাইয়ের ঠাকরুনদিঘির মাছ। জেলেরা জালে একটা দশ কেজি মাছ তুলেছিল। মাছটার লেজের কাছে নাকি সিঙ্গিমশায়ের নাম লেখা। গাঁসুদ্ধু লোক ভিড় করে দেখতে গিয়েছিল।
এবার মাছের কথায় আরও কত খবর এসে গেল। গোঁফ ছাঁটা হয়ে গেলে আয়নায় গোঁফ দেখতে-দেখতে ঠাকুরদা বললেন, হ্যাঁ হে ভোলারাম! এরকম মাছের খবর তো দিচ্ছ। কিন্তু আজকাল আগের মতো বড়-বড় খয়রা মাছ দেখি না কেন? বড় খয়রা কেন, ছোট খয়রারও পাত্তা নেই।
ভোলারাম বলল, কী যে বলেন বড়বাবু? খয়রার পাত্ত থাকবে না কেন? আর ছোট খয়রা কী বলছেন, এই হাতের মতো বড়-বড় জ্যান্ত খয়রা বিক্রি হচ্ছে। দোমোহানির হাটে। বিলভাসানো জল টেনে নিচ্ছে মৌরি নদী। আর নদীর মুখে জাল পেতে বসে আছে জেলেরা। পেল্লায় সাইজের খয়রা জালে উঠছে। দেখলে চোখ জ্বলে যাবে বড়বাবু!
ঠাকুরদা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলো কী হে! শুনেছি দোমোহানিতে হাট বসে বিকেলবেলায়। তিন মাইল মেঠো রাস্তায় পায়ে হেঁটে তোমার পেস্লায় সাইজের খয়রা আনতে যাবে কে?
ছোটমামা সবে তখন বাড়ি ঢুকছিলেন। তাকে দেখিয়ে ভোলারাম বলল, ওই তো! নান্টুবাবুকে পাঠিয়ে দিলেই হল। দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাবেন। পড়ন্ত বেলায় বিল থেকে মাছ আসতে শুরু করবে। সস্তার তিন অবস্থা বলে কথা আছে না? দশ টাকা কেজি দর হাঁকতে-হাঁকতে মেছুনিমাসিরা শেষ অবধি পাঁচ টাকায় দর নামাবে। অত খদ্দের কোথা?
ছোটমামার ডাকনাম নান্টু আর আমার ডাকনাম পুঁটু। ঠাকুরদার হুকুম না মেনে উপায় নেই। ছছাটমামা মুখ ব্যাজার করে ঘরে ঢুকলেন। বিকেলে স্কুলের মাঠে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট! আমিও মনমরা হয়ে গেলুম। একা-একা কি খেলা দেখতে ভালো লাগে?
ভোলারাম নরসুন্দর ছুরি-কাঁচি-নরুন গুটিয়ে ছোট্ট বাকসোতে ভরে আমার দিকে তাকাল। চোখ নাচিয়ে সে বললে,—পুঁটুবাবু! তুমিও মামার সঙ্গে যেও। দোমোহানির হাটতলায় ম্যাজিকবাজির তাঁবু বসেছে। কাটা মুণ্ডুর খেলা দেখলে তুমি একেবারে অবাক হয়ে যাবে। হ্যাঁ গো পুঁটুবাবু! দু-চোখের দিব্যি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, কাটামুণ্ডু কথা বলছে।
ঠাকুরদা সায় দিয়ে বললেন,বাঃ! এখন তো পুজোর ছুটি। পুঁটু! নান্টুর সঙ্গে দোমোহানি গিয়ে ম্যাজিক দেখে এসো। আমি বাড়তি টাকা দেব।…
পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের পায়ে হাঁটার অভ্যাস তখনও ছিল। এদিকের লোকে দূরত্ব মাপতে কিলোমিটার বলত না। কিলোগ্রাম বা কেজি অবশ্য চালু হয়েছিল। কিন্তু মাইল বা ক্রোশ কথাটা চালু ছিল। তিন মাইল মানে দেড় ক্রোশ।
মাটির রাস্তা শরৎকালে মোটামুটি শুকিয়ে খটখটে হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও একটু কাদা আছে। দুধারে আদিগন্ত ধানক্ষেত। কখনও গাছপালার জটলা বা ঝোপঝাড়। দোমোহানির হাটতলায় পৌঁছে দেখি সত্যি ম্যাজিকের তাঁবু বসেছে। একটু পরেই মাইকে গানবাজনা শুরু হয়ে গেল। মনটা নেচে উঠল। খয়রা মাছ কিনেই ম্যাজিকের টিকিট কাটতে বললুম ছোটমামাকে।
ছোটমামা যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছিল, সেখানে গেলেন। হাটে বড্ড ভিড়। ছোটমামার কোমরের কাছে শার্টটা আঁকড়ে ধরেছিলুম, পাছে হারিয়ে যাই।
একটু পরে দেখলুম, ভোলারাম মিথ্যা বলেনি। খয়রা মাছগুলো তার হাতের মতো বড় না হলেও আমার হাতের সাইজ। দরাদরি করে ছোটমামা সাত টাকায় এক কেজি খয়রা কিনে থলেয় ভরলেন। তারপর ভিড়ের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, বুঝলি পুঁটু, দর আরও কমবে। কিন্তু আমারও যে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখতে ইচ্ছে করছে। ওই শোন! কী বলছে ম্যাজিশিয়ান।
কালো প্যান্ট-কোট, শার্ট আর মাথায় টুপিপরা একটা লোক গেটের পাশে অঙ্গভঙ্গি করে চ্যাঁচাচ্ছিল,—আড়ম্ভ! আড়ম্ভ! একখুনি আড়ম্ভ হয়ে যাবে। আ–ড়— ম–ভো — ও—ও —ও!
আরম্ভ-কে আড়ম্ভ বলায় খুব মজা পাচ্ছিলুম। বললুম,—চলুন ছোটমামা। এখনই টিকিট কিনে সামনের সিটে বসে পড়ি। দেরি করলে পিছনে বসতে হবে।
ঠিক বলেছিস পুঁটু! বলে ছোটমামা মাছের থলেটা সাবধানে একটু গুটিয়ে নিয়ে দুটো টিকিট কাটলেন। তারপর আমাকে এক হাতে টেনে তাঁবুতে ঢুকলেন।
ভিতরে ঢুকে নিরাশ হলুম। কোনও চেয়ার-বেঞ্চ নেই। মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা আছে, কিন্তু ততক্ষণে সামনের দিকটা লোকেরা ঠাসাঠাসি করে বসেছে। ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, কোনও মানে হয়? তোর না হয় হাফপেন্টুল। আমার যে ফুলপ্যান্ট! শোন! এই পিছনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটামুণ্ডুর খেলা দেখব।
বাইরে সেই লোকটা, যাকে ম্যাজিশিয়ান ভেবেছিলুম, সে এবার চ্যাঁচাচ্ছে, কাটামুণ্ডু! কাটামুণ্ডু কথা বলবে,—এএ! আড়মভো-ও-ও-ও!
ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ছোটমামা আর আমার পিঠ তখন তাঁবুর কাপড়ে ঠেকেছে। এতক্ষণে স্টেজের পরদা উঠল। তারপর দেখি, আমি ম্যাজিশিয়ানকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলুম। সে কোন পথে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছে ভেবে পেলুম না। সে বলল, আমি প্রফেসর বংকারাম হাটি। আমি বাগে পেলেই লোকের মাথা কাটি।
সবাই হেসে উঠল। সে বেশ মিল দিয়ে কথা বলছিল। আমিও হেসে অস্থির হচ্ছিলুম; দেখলুম, ছোটমামাও খুব হাসছেন।।
প্রথমে কয়েকটা আশ্চর্য ম্যাজিক দেখানোর পর ম্যাজিশিয়ান বলল,-এবার আমি সেরা খেলাটা দেখাব। কাটামুণ্ডুর খেলা। কাটামুণ্ডুর গলায় দেখবেন চাপ-চাপ রক্ত। খোকাখুকুরা ভয় পেলে চোখ বুজে থেকো। ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করলেই খেলা পণ্ড হয়ে যাবে।
এবার দুটো লোক একটা টেবিলের মতো জিনিস স্টেজে আনল। জিনিসটার চারদিকে কালো কাপড়ে ঘেরা। ম্যাজিশিয়ান বলল,—তাহলে কাটামুণ্ডুর খেলা শুরু করি। ওয়ান টু থ্রি!
অমনি দেখি, ওপরের অংশে কালো কাপড় পরদার মতো গুটিয়ে গেল। তারপর যা দেখলুম, আঁতকে উঠে ছোটমামাকে আঁকড়ে ধরলুম।
টেবিলের ওপর একটা মানুষের মুণ্ডু। গলার কাছে চাপ-চাপ রক্ত। কিন্তু মুন্ডুটা দিব্যি হাসছে। চোখ নাচাচ্ছে। এ তো ভারি অদ্ভুত!
ম্যাজিশিয়ান বলল,-অ্যাই কাটামুণ্ডু! তোর নাম কী?
কাটামুণ্ডু বিদঘুটে গলায় বলল,—ঘংঘাড়াম।
—ভালো করে বল!
-বললুম তো। ঘংঘাড়াম!
ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে বলল,—গলাকাটা তো? তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওর নাম গঙ্গারাম। আচ্ছা বাবা গঙ্গারাম! তোর বাড়ি কোথায়?
—কাটিহাঁড়!
ম্যাজিশিয়ান লাফ দিয়ে সরে বলল, ওরে বাবা। এ যে বলছে কাটি হাড়। মানে হাড় কাটবে। অ্যাই গঙ্গারাম! ঠিক করে বল।
–কঁটিহাড়! কঁটিহাড়!
ম্যাজিশিয়ান কান পেতে শোনার ভঙ্গি করার পর হাসল,কাটিহার বলছে। বিহারে কাটিহার আছে না? সেই কাটিহার। তা বাবা কাটিহারের গঙ্গারাম, তোর মুণ্ডু কাটল কে?
কাটামুণ্ডু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বংকারাম!
ম্যাজিশিয়ান লাফিয়ে উঠল,ওরে বাবা! বংকারাম বলছে যে! আমিই তো বংকারাম! এক্ষুনি আমাকে পুলিশে ধরবে। ওরে! তোরা কাটামুণ্ডুকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখ!
আবার কালো পরদাটা টেবিলের ওপর ঘিরে ফেলল। সেই লোকদুটো পরদা টেবিলটা স্টেজের পিছনে নিয়ে গেল।
দর্শকরা হাততালি দিল। ম্যাজিশিয়ান হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে একটু ঝুঁকে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করল।..
ম্যাজিক শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে দেখি, হাট প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মেছেমেছুনিরা পিদিম জ্বেলে তখনও মাছ নিয়ে বসে আছে। গ্যাসবাতি জ্বেলে বসে আছে কিছু পশারি। ম্যাজিক-দেখা লোকগুলো ছড়িয়ে পড়ল কে কোথায় কে জন। তবে মেছো-মেছুনিদের দিকে আবার ভিড় দেখলুম। ছোটমামা বললেন,একটু ভুল হয়ে গেছে, বুঝলি পুঁটু?
–কী ভুল ছোটমামা?
—এখন খয়রা মাছ কিনলে সস্তায় পেতুম। যাক গে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই! কিন্তু—বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন।
জিগ্যেস করলুম,–কী হল ছোটমামা?
—আরেকটা ভুল করে বসে আছি রে পুঁটু! টর্চ আনিনি যে!
এতক্ষণে আমিও একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড হয়। এতক্ষণ মনে ছিল না।
ছোটমামা বললেন, চাঁদ উঠতে দেরি আছে। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে তোর ঠাকুরদার পাতে রাত্রিবেলা এই খয়রা মাছ পড়বে না। বরং এক কাজ করা যাক। হাটে দেখছিলুম, একটা লোক বেতের ছড়ি বিক্রি করছে। আয় তো দেখি। একটা ছড়ি-টড়ি সঙ্গে থাকলে সাহস বাড়ে। বুঝলি পুঁটু?
মাত্র দুটাকায় একটা বেতের ছড়ি পাওয়া গেল। ছাতার বাঁটের মতো বাঁকানো হাতল আছে। ছড়িটা বগলদাবা করে মাছভর্তি থলে ঝুলিয়ে ছোটমামা হাঁটতে থাকলেন। আমি তাঁর কাছ ঘেঁষে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ চলার পর অন্ধকার স্বচ্ছ মনে হল। শরৎকালের আকাশে নক্ষত্ররা উজ্জ্বল হয়।
ছোটমামা একটু হেসে বললেন,-বুঝলি পুঁটু! ঠিক এমনি একটি ছড়ি সিঙ্গিমশাইয়ের আছে। দেখিসনি তুই?
বললুম, সিঙ্গিমশাই সবসময় ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটেন কেন ছোটমামা?
—ওটা স্টাইল! বুঝলি পুঁটু! সব মানুষ বুড়ো হলেই ছড়ি নিয়ে হাঁটে না। তোর ঠাকুরদা তো বুড়োমানুষ। তার হাতে ছড়ি দেখেছিস?
–না ছোটমামা!
—তাহলেই বুঝে দ্যাখ পুঁটু! সিঙ্গিমশাইয়ের ছড়ি হাতে হাঁটাটা আসলে স্টাইল! আমিও সেইরকম স্টাইলে হাঁটছি, দ্যাখ!
বলে ছোটমামা বাঁ-হাতে মাছের থলে নিয়ে ডানহাতে ছড়ির হাতল ধরে অবিকল সিঙ্গিমশাইয়ের মতো মাটিতে ছড়ির ডগা ঠেকালেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন।
একটু পরে দেখি, ছোটমামা মাটির রাস্তায় জোরে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমি দৌড়ে তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। রাগ করে চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! অত জোরে হাঁটছেন কেন?
ছোটমামা সামনের দিক থেকে কেন যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,আমি কি জোরে হাঁটছি রে পুঁটু? ছড়িটা আমাকে হাঁটাচ্ছে। মানে, ছড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে! এই! এই ছড়ি! আস্তে আস্তে!
আমি যথাসাধ্য দৌড়ে গিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছোটমামা! আমি দৌড়ুতে পারছিনে।
—ওরে পুঁটু! ছড়িটা সর্বনাশ! এই! এই ব্যাটাচ্ছেলে! রাস্তা ছেড়ে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
বলে ছোটমামা চ্যাঁচাতে থাকলেন,—পুঁটু! পুঁটু! আমাকে ছড়িটা ধানক্ষেতের আলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রে!
ততক্ষণে পিছনে উঁদ উঁকি দিয়েছে আবছা, জ্যোৎস্নায় দেখলুম, ছোটমামা বাঁ-দিকে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। চেঁচিয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়িটা ফেলে দিচ্ছেন না কেন? এক্ষুনি ছড়িটা ফেলে দিন!
ছোটমামার করুণ চিৎকার শোনা গেল,—ওরে পুঁটু! ছড়ির হাত থেকে হাত ছাড়াতে পারছি না যে!
আতঙ্কে, দুর্ভাবনায় আমি এবার চেঁচিয়ে বললুম,ছোটমামা! গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকুন।
কথাটা আমার মাথায় কেমন করে এসেছিল কে জানে! আমার কথাটা শুনেই বাঁ-দিকে খানিকটা দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে ছোটমামা এবার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওরে গঙ্গারাম! গঙ্গারাম তোর কাটামুণ্ডুটা নিয়ে আয় তো! ছড়ি ব্যাটাছেলের মুন্ডু কেটে তোর মতো করে ফেলবি গঙ্গারাম! ওরে কাটিহারের গঙ্গারাম। শিগগির আয়
রে!
তারপরই ছোটমামার হাসি শুনতে পেলুম। আবছা জ্যোৎস্নায় ছোটমামাকে হাসতে-হাসতে ফিরে আসতে দেখলুম। তিনি বলছিলেন—কেমন জব্দ? আঁ? গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকতে ছড়িটা আমার হাত থেকে খসে ডিগবাজি খেতেখেতে পালিয়ে গেল!
ছোটমামার প্যান্টের নিচের দিকটা শিশিরে আর ঘাসের কুটোয় নোংরা হয়ে গেছে। ভিজে জবজব করছে। তিনি আমার কাছে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, ওঃ, কী সর্বনেশে ছড়ির পাল্লায় পড়েছিলুম রে পুঁটু! ভাগ্যিস, তুই বুদ্ধি করে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলি।
বললুম,—ছোটমামা! কিন্তু গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ছড়ির ভূত অত ভয় পেল কেন?
ছোটমামা বললেন,বুঝতে পারিসনি পুটু? ছড়ির ভূত নিশ্চয় ম্যাজিকের তাবুতে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু দেখেছিল।
এরপর ছোটমামা আমাকে মাছের থলে দিয়ে জুতোদুটো খুললেন তারপর প্যান্ট গুটিয়ে জুতো বাঁ হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন। ততক্ষণে জ্যোৎস্না উজ্জ্বল হয়েছে। জিগ্যেস করলুম, ছড়িটা অমন করে আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন?
ছোটমামা বললেন,—সেটাই তো বুঝতে পারছি না রে পুঁটু! ভূত কি ছড়ি হতে পারে? আমার মনে হচ্ছে, ওটা কোনও ভূতের ছড়ি! বুঝলি? ছড়িওয়ালা কোনও মরা মানুষের ছড়ি সস্তায় কিনে আমাকে বেচেছিল।
কথাটা বলেই ছোটমামা থমকে দাঁড়ালেন। জিগ্যেস করলুম,কী হল ছোটমামা?
—ওই দ্যাখ! দেখতে পাচ্ছিস? ছড়ি ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের আগে-আগে খুটখুট শব্দ করে হেঁটে চলেছে।
ভয় পেয়ে বললুম,—ছোটমামা! ছড়ি হাঁটছে না। ভূত ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটছে।
এবার ছোটমামা হুংকার দিয়ে বললেন,আয় তত পুঁটু! দেখি ব্যাটাচ্ছলেকে। এখনও এত সাহস!
ছোটমামা বোকামিই করে ফেলতেন, কারণ ছড়িটা ডিগবাজি খেতে-খেতে তার দিকে আসছিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,—গঙ্গারাম! গঙ্গারাম! তোমার কাটামুণ্ডু নিয়ে এসো শিগগির!
অমনি দেখলুম ছড়িটা পাশের ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা বললেন,ধ্যাত্তেরি! কথাটা আমার কিছুতেই মনে থাকছে না। পুঁটু। আমরা দুজনে এবার গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর জয় দিতে-দিতে হাঁটি!
বলেই ছোটমামা স্লোগানের সুরে হাঁকলেন,–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু কী? আমি চেঁচিয়ে বললুম,—জয়!
–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!
এমন স্লোগান ওই বয়সে কত শুনতুম, তাই চেঁচিয়ে বললুম,অমর রহে। অমর রহে।
-–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু!
—জিতা রহে! জিতা রহে!
—কাটিহারের গঙ্গারাম কী?
—জয়!
বাড়ি ঢােকার মুখে ছোটমামা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভাগ্যিস ছড়ির ভূতটা প্রফেসর বংকারামের ম্যাজিক দেখতে ঢুকেছিল। নইলে তোর ঠাকুরদার খয়রা মাছ আর খাওয়া হতো না। কাটামুণ্ডু দেখে ভূতটাও ভয় পেয়েছিল।
কিন্তু ম্যাজিক দেখতে আমরা না ঢুকলে আমাদের দুজনের অবস্থাটা কী হতো, সেটা আর ছোটমামাকে বলিনি।
কালো ঘোড়া
ব্যাপারটা নিছক স্বপ্ন, নাকি সত্যি সত্যি ঘটেছিল, বলা কঠিন। শুধু এটুকুই বলতে পারি, এ ঘটনা আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না। যা-যা ঘটেছিল, অবিকল তাই-তাই বর্ণনা করছি।
গত শরৎকালের কথা। তখন আমি মার্কিন মুলুকের কান্ট্রি এলাকা অর্থাৎ পাড়াগাঁয়ে এক ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে আছি। ভদ্রলোকের নাম ডঃ হেরম্যান জুট্রাম! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে হিটলারের চেলারা ইহুদিদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে ডঃ জুট্রাম আমেরিকায় পালিয়ে আসেন। কারণ ইনি ইহুদি।
এলাকার নাম মুনভিলে। মানে করলে হয়তো দাঁড়ায় চন্দ্রপুরী। আসলে নিঃঝুম কয়েকটা বনে-ঢাকা ছোট্ট টিলার ওপর একটা করে বাড়ি। হাইওয়ে থেকে কষ্টেসৃষ্টে নজরে পড়ে। চারিদিকে ছড়ানো ঢেউ খেলানো মাঠ। কোথাও ধূসর হয়ে ওঠা ভূট্টাক্ষেত, কোথাও গোরু, শুয়োর বা ঘোড়ার বাথানচারিদিক কাঠের বেড়ায় ঘেরা।
–মুনভিলে কেন?
ডঃ জুট্রাম আমার প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন,–এই যে নিচের দিকে হ্রদটা দেখছ, ওটার গড়ন লক্ষ করো।
বাড়ির পূর্বে টিলাটা ফাঁকা এবং ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তারপর হ্রদ। পুবের ঘাসে লন ও ফুলবাগিচায় দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। দেখলাম, হ্রদটা অর্ধবৃত্তাকার, তার মানে অবিকল চন্দ্রকলার মতো। বলেছিলুম, হ্রদটার নাম হওয়া উচিত মুনলেক।
ঠিকই ধরেছ। ডঃ জুট্রাম হেসে উঠেছিলেন। ওটার নাম মুনলেক। তবে তার চেয়েও সুখের কথা, মুনলেকের ধারে জ্যোৎস্নারাতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করলে তুমি রূপকথার রাজপুকুরটি হয়ে উঠবে।
হাসতে-হাসতে বলেছিলাম, কিন্তু রাজপুতুরের যে একটা ঘোড়াও চাই। যেমন-তেমন ঘোড়া চলবে না, চাই একটি পক্ষীরাজ। সেই যে, যাদের ডানা আছে…
বলতে-বলতে একটু অবাক হয়ে থেমেছিলাম। ডঃ জুট্রামের লালচে মুখে হঠাৎ কেন অমন গাঢ় ছায়া। যেন হঠাৎ কী অসুখ বাধিয়ে বসেছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। চোখ নিষ্পলক।
ব্যস্ত হয়ে বলেছিলাম, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন ডঃ জুট্রাম?
উনি তখনই ঘুম থেকে ওঠার মতো কাঁধদুটো নাড়া দিয়ে আগের হাসিটা ফিরিয়ে এনেছিলেন।…হা, তুমি ঘোড়ার কথা বলছিলে তাই না?
–হ্যাঁ, ডঃ জুট্রাম।
–জানো? মুনলেকের অদ্ভুত-অদ্ভুত সব গল্প আছে। তার মধ্যে ওই ঘোড়ার গল্পটা সাংঘাতিক! মাঝে-মাঝে, বিশেষ করে জ্যোৎস্নার রাতে নাকি হ্রদের জল থেকে একটা কালো ঘোড়া উঠে আসে। ঘোড়াটা নাকি প্রাচীন যুগের এক রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের। নিছক ভুতুড়ে ব্যাপার।
বলে ডঃ জুট্রাম হাতঘড়িটা দেখে নিলেন এবং ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।কী কাণ্ড। আমাকে যে এক্ষুনি শহরে দৌডুতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সেমিনার আছে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে?
জুট্রাম পা বাড়িয়ে ফের বলেছিলেন, যাক গে, তোমার গিয়ে কাজ নেই। পণ্ডিতি কচকচি তোমার ভালো লাগবে না। তার চেয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোেগ করো। আয়ু বাড়বে।
হাসতে-হাসতে চলে গিয়েছিলেন ডঃ জুট্রাম। একটু পরে বাড়ির দক্ষিণে বনের গড়ানে রাস্তায় ওঁর সাদা গাড়িটা নেমে যেতে দেখেছিলাম। তখন বেলা সাড়ে তিনটে। টিলার মাথায় কাঠের দোতলা বাড়িটা আরও নিঃঝুম হয়ে গেল। গাছপালা থেকে ঝিঁঝিপোকার বিকট হাঁকডাক শোন যাচ্ছিল। মার্কিন ঝিঁঝিপোকার ডাক বড় বিরক্তিকর। মনেমনে খাপ্পা হয়ে বললাম, রোসো বাছাধনরা! পাতা ঝরার দিন শুরু হলেই তোমাদের বীরত্ব কোথায় থাকে, দেখা যাবে।
ডঃ জুট্রামের প্রকাণ্ড কুকুরটার নাম রেক্স। একে কুকুরে আমার প্রচণ্ড ভয়, তাতে রেক্স আমাকে যতবার দেখে, মাতৃভাষায় গালাগালি করে। বাঁধা না থাকলে আমাকে নিশ্চয় সোজা ভারতে ফেরত পাঠিয়ে ছাড়ত। কঁচুমাচু মুখে ডঃ জুট্রাম বলেছিলেন,-রেক্সের এই এক দোষ! বিদেশিদের দেখতে পারে না।
হাই তুলে ভয়ে-ভয়ে বারান্দায় উঠলাম। কিন্তু রেক্সের সাড়া পেলাম না। তখন দরজা খুলে বসার ঘরের ভেতর উঁকি দিলাম। সিঁড়ির পাশে কুকুরটা থাকে। সেখানে সে নেই। তাহলে ডঃ জুট্রামের লেকচার শুনতে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
দোতলায় আমার ঘর। বেলা দুটোয় লাঞ্চ খেয়েছি। বাঙালি স্বভাবে ভাতঘুম নামে আরাদায়ক একটা ব্যাপার আছে। সায়েবদের সংসর্গে সেটা বরবাদ হতে বসেছে। আজ এমন সুযোগ ছাড়া যায় না। অতএব সটান বিছানায় চিত হলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে বন্ধুবর ভাতঘুম এসে কোলাকুলি করলেন। তখন আঃ কী আনন্দ! কতদিন পরে দেখা।
কতক্ষণ পরে কার ডাকাডাকিতে চোখ খুলতে হল। তাকিয়ে দেখি, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আট-নয় বছরের একটা মেয়ে। গোলগাল পুতুল-গড়ন। একমাথা আঁকড়ামাকড়া সোনালি চুল। পরনে উজ্জ্বল নীল ফ্রক। গলায় সাদা স্কার্ফ জড়ানো। মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
তক্ষুনি মনে পড়ে গেল, আরে তাই তো! এরই ছবি বাড়ির ওপরে-নিচে সব ঘরে দেখেছি। ওই তো এ-ঘরের দেওয়ালেও রয়েছে।
ডঃ জুট্রামকে জিগ্যেস করব ভেবেছিলাম। ভুলে গেছি।
উঠে বসে মিষ্টি হেসে বললাম, হ্যালো।
আমার মার্কিনি সম্ভাষণের জবাবে ছোট্ট করে বলল, হাই। কিন্তু মুখের অবাক ভাবটা ঘুচল না। ঠোঁট কামড়ে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়ে একটু হাসল। হেসে বলল, তুমি নিশ্চয় বাবার অতিথি। তুমি কি বিদেশি?
সায় দিয়ে বললাম,-প্রথমে তোমার নাম বলল।
–জিনা।
তুমি নিশ্চয় শহরে থেকে পড়াশুনা করো, তাই না জিনা? ওর সঙ্গে খাতির জমাতে বসলাম।–তা এলে কার সঙ্গে? মায়ের সঙ্গে বুঝি? চলো, তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।
ডঃ জুট্টাম তার স্ত্রী কিংবা মেয়ের কথা কিছু বলেননি। আমিও কিছু জানতে চাইনি। কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপার জানতে চাওয়া ভদ্রতাসম্মত নয়। উঠে দাঁড়িয়েছি, জিনা বলল, তুমি বললে না কোন দেশের লোক?
–আমি ইন্ডিয়ান। শু
নেই জিনা যেন চমকে উঠল। তুমি ইন্ডিয়ান কিন্তু!…
–কিন্তু কী বলল তো জিনা?
তোমার মাথায় পালকের টুপি নেই। গলায় রঙিন পাথরের মালা নেই। –জিনা বলতে থাকল, তোমার বর্শা কী হল, তোমার চুল কেটে ফেলেছ কেন? তুমি এমন বেঁটে মানুষ কেন?
ওকে থামিয়ে হাসতে-হাসতে বললাম, জিনা, জিনা! আমাকে বলতে দাও। ইন্ডিয়ান মানে আমি ইন্ডিয়া–ভারতের লোক। তুমি আমাকে রেড ইন্ডিয়ান ভেবেছ দেখছি। ভারতের নাম শোনোনি? পুবের দেশ।
জিনা কেমন যেন নিরাশ গলায় বলল,–ও! তুমি ওরিয়েন্টাল।
–ঠিক বলেছ। এবার চলল তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।
জিনা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে বাস্কেটবল খেলবে?
–খেলব বইকী।
এসো। –বলে সে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। তার পেছনে-পেছনে নেমে নিচের ঘরে কাকেও দেখতে পেলাম না। ঘরের ভেতর ততক্ষণে হাল্কা আঁধার জমেছে। পুবের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি বেলা পড়ে গেছে, নীলচে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে, গাছপালার মাথায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে বুনো হাঁসের ঝাক। নিচের দিকে একটু দূরে মুনলেকের জলে তখনও লালচে ছটা ছড়িয়ে আছে।
–হেই! এখানে চলে এসো।
ঘুরে দেখি লনের কোনায় বাস্কেটবল নিয়ে জিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে খেলায় মেতে গেলাম। মেয়েটি বড় চঞ্চল প্রকৃতির। আমার আনাড়িপনায় খিলখিল করে হেসে উঠল। আমাকে গোহারা করে হারিয়ে ছাড়ল। আবছা আঁধার হয়ে এলে বললাম, এই যথেষ্ট। সকালে আবার হবে। তখন তোমায় হারিয়ে দেব।
জিনা লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন আনমনা।
বললাম, জিনা-জিনা! অবিকল তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার নাম কী জানো? নিনা। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। ভারি মজার। এসো না।
সে গেট খুলে ঢালু সবুজ ঘাস ঢাকা জমি দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। চেঁচিয়ে বললাম,–জিনা আস্তে, আস্তে। দৌড়িও না, আছাড় খাবে।
ততক্ষণে সে লেকের ধারে বালির চওড়া বিচে পৌঁছে গেছে। আমার যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। পোঁছে টের পেলাম কনকনে ঠান্ডায় রক্ত জমতে শুরু করেছে। মেয়েটা কিন্তু দিব্যি ছোটাছুটি করছে বালিতে। হঠাৎ চোখ গেল হ্রদের ওপারে টিলার মাথায়। বাঁকা এক টুকরো চাঁদ উঠেছে। তখুনি জুট্রামের গল্পটা মনে পড়ল। কেমন অস্বস্তি জাগল। বললাম,–জিনা! এবার ফেরা যাক।
জিনা জবাব দিল না। জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সেই সময় হু হু করে একটা বাতাস এল। ঠান্ডাটা বেড়ে গেল। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম। কী শীত, কী শীত! দস্যি মেয়েটার পাল্লায় পড়ে শেষ অবধি না নিমোনিয়া বাধাই।
হ্রদের জলটা কাঁপছে। আবছা জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে সারা হ্রদ। তারপর একসঙ্গে অসংখ্য বুনো হাঁস প্যাকপ্যাক করে ডেকে উঠল। তারপর যা দেখলাম সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। শীতের কথা ভুলে গেলাম। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। স্বপ্ন দেখছি না তো?
যেন জলের ওপর দিয়েই হেঁটে এল একটা কালো ঘোড়া। হ্যাঁ, জলজ্যান্ত একটা কালো ঘোড়া।
ঘোড়াটা বিচে আসতেই জিনা কী দুর্বোধ্য শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর দেখি, কালো কালো ঘোড়াটার সঙ্গে সে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কখনও আমার সামনে দিয়ে, কখনও পিছন দিয়ে দুজনে ছোটাছুটি করতে থাকল। ঘোড়াটা আমার ওপর এসে পড়বে ভেবে আমি আতঙ্কে কাঠ। কিন্তু গলায় কী আটকে গেছে। জিনাকে বারণ করার সাধ্য নেই।
একটু পরে দেখলাম, জিনা কালো ঘোড়াটার ওপর চেপে বসেছে। ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় সারা বিচ জুড়ে খালি ঘোড়ার পায়ে চাপা শব্দ।
তারপর পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে শুনলাম। সেই সঙ্গে কুকুরের গর্জনও শুনতে পেলাম। টর্চের আলো ছড়িয়ে পড়ল আমার গায়ের ওপর। সেই আলোর ছটায় আবছা দেখলাম কালো ঘোড়াটা জিনাকে নিয়ে হ্রদের জলে নেমে যাচ্ছে। এতক্ষণে গলা দিয়ে স্বর বেরুল। চেঁচিয়ে উঠলাম–জিনা-জিনা-জিনা।
পেছনে ডঃ জুট্রাম বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কাম ব্যাক। কাম ব্যাক, ইউ ফুল।
তারপর আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। রেক্স জলের ধারে দাঁড়িয়ে গরগর করছে।
ঘণ্টাখানেক পরে ফায়ারপ্লেসের সামনে দুজনে চুপচাপ বসে আছি। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডঃ জুট্রাম বললেন, তুমি, জিনা-জিনা বলে ডাকছিলে। তুমি কি ওকে সত্যিই দেখেছিলে? পরনে নীল ফ্রক, গলায় সাদা স্কার্ফ ছিল। তাই না?
–হ্যাঁ, আর সেই কালো ঘোড়াটাও।
কথা কেড়ে ডঃ জুট্টাম বললেন, দশ বছর আগে জিনা মুনলেকে ডুবে মরেছে। তার একবছর পরে ওর মা রোগে ভুগে মারা যায়। আমি মুনভিলেই মরতে চাই। তাই এখানে একা পড়ে আছি। বলতে পারো ওয়েটিং ফর দি ব্ল্যাক হর্স।
কালো ছড়ি
মুরারিবাবু প্রতিদিনের মতো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ, এ বয়সে রোজ ভোরবেলা অন্তত একঘণ্টা হাঁটাচলা করলে হার্টের অবস্থা ভালো থাকে। আঁকাবাঁকা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায়। তারপর কিছুদূর হাঁটলেই একটা পার্ক। বার দুই-তিন পার্কটা চক্কর দিয়ে মুরারিবাবু একটা বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নেন। তারপর ধীরেসুস্থে বাড়ি ফেরেন।
একদিন পার্কে চক্কর দিয়ে তিনি জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা বেঞ্চে বসলেন। সবদিন অবশ্য বেঞ্চ খালি পাওয়া যায় না। না পেলে মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান।
আজ পুরো একটা বেঞ্চ খালি। মুরারিবাবু ঘড়ি দেখলেন। ছটা বেজে গেছে। আজ একটু বেশি হাঁটা হয়ে গেছে হয়তো। তাই ক্লান্তিটা যাচ্ছে না যেন। আরও মিনিট দশেক বসা যাক।
একটু পরে এক ভদ্রলোক এসে বেঞ্চটার অন্যপ্রান্তে বসলেন। একমাথা সাদা চুল। পাকানো গোঁফ। পরনে গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধাক্কাপাড় ধুতি। পায়ে চকচকে পামশু। হাতে একটা কালো ছড়ি। বেশ শৌখিন মনে হচ্ছিল তাকে। তাছাড়া মিঠে একটা সুগন্ধও টের পাচ্ছিলেন মুরারিবাবু। এ বয়সে সেন্ট মেখে মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক।
মনে-মনে হাসি এল মুরারিবাবুর। আড়চোখে ভদ্রলোককে লক্ষ করতে থাকলেন। এবার ভদ্রলোক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন। তারপর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং পাকাতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সিগারেটটা জুতোর তলায় ঘষটে নিভিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন এবং হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন।
মুরারিবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক পার্কের গেট গলিয়ে বড়রাস্তার ফুটপাতে পৌঁছেছেন, সেই সময় মুরারিবাবুর চোখে পড়ল ওঁর কালো ছড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছড়িটা তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়িটা ফেলে গেলেন যে!
ভদ্রলোক যেন শুনতেই পেলেন না। ফুটপাতের ওখানেই বাসস্টপ। প্রায় খালি একটা বাস এসে গেল এবং উনি বাসে উঠে গেলেন। বাসটা তক্ষুনি গর্জন করতে করতে জোরে চলে গেল।মুরারিবাবু ছড়িটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কালো ছড়িটা ওই ভদ্রলোকের মতোই শৌখিন বলা যায়। হাতলওয়ালা ছড়ি। হাতলে রুপোলি নকশা আছে। বাকি অংশ মসৃণ। তলার দিকটা ইঞ্চিটাক রুপোলি খাপে মোড়া।
মুরারিবাবু অগত্যা ছড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কাল মর্নিংওয়াকে গিয়ে যদি ওঁর দেখা পান, ফেরত দেবেন। কাল যদি দেখা না পান, পরশুও ছড়িটা নিয়ে যাবেন। যতদিন না ওঁর দেখা পান, ততদিন এটা সঙ্গে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুবেন।…
সেদিন রাত্রে কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুরারিবাবুর।
তারপর ঝাঝালো মিঠে সুগন্ধ টের পেলেন তিনি। প্রথমে ভাবলেন মনের ভুল। পরে বুঝলেন, মনের ভুল নয়। ঘরে সত্যিই সুগন্ধ মউ-মউ করছে। আজ ভোরবেলা পার্কের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক এই গন্ধটাই তখন টের পেয়েছিলেন মুরারিবাবু।
কিন্তু সেই সুগন্ধ এই ঘরের ভেতর কেন?
চমকে উঠে মুরারিবাবু সুইচ টিপে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। তারপর মশারি থেকে বেরিয়ে সুইচ টিপে টিউবলাইটটাও জ্বাললেন।
ঘরে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই। থাকবেই বা কেমন করে? মশার জন্য মাথার দিকের দুটো জানালা সন্ধ্যার আগে বন্ধ করে দেন মুরারিবাবু। পায়ের দিকে অর্থাৎ বাড়ির ভেতর দিকের দুটো জানালার মধ্যে একটা বন্ধ করেন, অন্যটা শুধু খোলা থাকে। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা এবং বারান্দায় যাওয়ার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। তাহলে সুগন্ধটা কি ভেতরের বারান্দা থেকে আসছে!
সেই খোলা জানালার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, দেয়ালের ব্র্যাকেটে হাতল আটকে সেই কালো ছড়িটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটা নেই।
অমনি বুক ধড়াস করে উঠল মুরারিবাবুর। ছড়িটা গেল কোথায়?
অবশ্য তত ভিতু মানুষ তিনি নন। রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই পৈতৃক একতলা বাড়িতে বসবাস করছেন মুরারিবাবু। যখন তিনি চাকরি করতেন, তখন তাঁর বিধবা দিদি এই বাড়িতে একমাত্র ছেলে নকুলকে নিয়ে থাকতেন। মুরারিবাবু রিটায়ার করার আগেই নকুলকে রেলে একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন। এতদিনে নকুল কোয়ার্টার পেয়ে তার মাকে নিয়ে গেছে। কাজেই মুরারিবাবু এ বাড়িতে একা থাকেন। স্বপাক খান। বরাবর তিনি স্বাবলম্বী মানুষ। জীবনে কখনও ভূতপ্রেত দেখেননি। ভূতপ্রেত আছে না নেই, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। অবশেষে এই বয়সে যে এমন একটা ভুতুড়ে ঘটনার মধ্যে তাকে পড়তে হবে, কোনওদিন কল্পনাও করেননি।
মাথা ঠান্ডা রেখে মুরারিবাবু ঘটনাটা বুঝতে চাইলেন। এ তো একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ভোরবেলা পার্কে দেখা সেই ভদ্রলোক জলজ্যান্ত মানুষ। রহস্য যেটুকু ছিল, সেটুকু তার আকস্মিক চলে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু এখন রহস্যটা রীতিমতো ঘোরালো হয়ে উঠল যে!
একটু পরে মুরারিবাবু টের পেলেন, ঝাঁকে ঝাঁকে মশা তার দুপায়ে যথেষ্ট হুল ফোঁটাচ্ছে। এই তল্লাটে মশার উৎপাত প্রচণ্ড। দেয়ালের সুইচ টিপে টিউবলাইট বন্ধ করে মুরারিবাবু মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। তিনি এখন মরিয়া। যা ঘটে ঘটুক, তিনি গ্রাহ্য করবেন না। কিছুক্ষণ পরে মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অফ করলেন মুরারিবাবু।
মাথার ওপর নতুন সিলিংফ্যান নিঃশব্দে ঘুরছিল। সুগন্ধটা তখনও মউমউ করছিল। সেই সুগন্ধে যেন কী মাদকতা আছে। মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় ঘুমে তলিয়ে গেলেন রেলের এক প্রাক্তন গার্ড মুরারিমোহন ধাড়া…
ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভোর পাঁচটায় সেই অ্যালার্ম বাজলে মুরারিবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। অভ্যাসমতো শশব্যস্তে উঠে পড়লেন তিনি। তারপরই মনে পড়ে গেল রাত্রের সেই অদ্ভুত ঘটনার কথা। কিন্তু নাহ! এখন ঘরে সেই সুগন্ধ নেই।
আর কী আশ্চর্য, সেই কালো ছড়িটা ব্র্যাকেটেই ঝুলছে। তাহলে কি তিনি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন?
কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না মুরারিবাবু। প্রতিদিনের মতো মশারি খুলে সিলিংফ্যানের সুইচ অফ করে কালো ছড়িটা হাতে নিয়ে মর্নিংওয়াকে বেরুলেন তিনি। যথারীতি দরজায় তালা এঁটেই বেরুলেন।
পার্কে পৌঁছে চারদিকে লক্ষ রেখেছিলেন মুরারিবাবু। কিন্তু কোথাও সেই ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন না।
আজ চারবার চক্কর দিয়ে সেই বেঞ্চটার কাছে এসে দেখলেন, গাদাগাদি তার বয়সি ছ-জন বৃদ্ধ বসে আছেন। মুরারিবাবু পার্কের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আজ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
তার দৃষ্টি চঞ্চল। চারদিকে তাকিয়ে সেই ভদ্রলোককে খুঁজছিলেন তিনি। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না।
অগত্যা ছড়িটা নিয়ে আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা দেয়ালে আঁটা ব্র্যাকেটে আগের দিনের মতো ঝুলিয়ে রাখলেন।…
এদিন রাত্রে মুরারিবাবু সতর্কভাবে জেগে ছিলেন। ফ্যানের বাতাসে মশারি দুলছিল। তাই ব্র্যাকেটে ঝোলানো ছড়িটাকে দেখা যাচ্ছিল না। ফ্যান বন্ধ থাকলে
টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মশারির ভেতর থেকে ওটা চোখে পড়ার কথা।
টেবিল ল্যাম্পটা আজ ইচ্ছে করেই জ্বেলে রেখেছিলেন। ক্রমে পাড়া নিঝুম হয়ে এল। গলিতে রিকশা চলাচলও বন্ধ হয়ে গেল এক সময়। মুরারিবাবুর চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। তবু তিনি কষ্ট করে জেগে থাকলেন। রেলের গার্ড ছিলেন তিনি। ঘুম এলে মনের জোরে তাকে তাড়াতে পারেন। কতক্ষণ পরে হঠাৎ একটা শব্দ হল। গতরাত্রে যেমন হয়েছিল।
আজ জেগে আছেন বলে বুঝতে পারলেন, উঁচু থেকে যেন কোনও হাল্কা জিনিস পড়ে যাওয়ার মতো শব্দটা। খট খট খটাস!
তারপরই আচম্বিতে নাকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মাদকতাময় আশ্চর্য সুগন্ধ!
কয়েক মুহূর্তের জন্য অজানা আতঙ্কে তার শরীর ভারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ তিনি আরও মরিয়া। মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে মুরারিবাবু চাপা গর্জন করলেন, তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে!
তারপর টিউবলাইট জ্বেলে ব্র্যাকেটের দিকে তাকালেন। অমনি ভীষণ চমকে উঠলেন মুরারিবাবু। কালো ছড়িটা ব্র্যাকেট থেকে নিচে পড়ে গেছে।
তাহলে এই শব্দটাই কাল রাতে তার ঘুম ভাঙিয়েছিল এবং আজ রাতেও একই শব্দ তিনি শুনেছেন।
ব্র্যাকেট থেকে ছড়ি পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফ্যানের বাতাসের ধাক্কায় হয়তো ছড়িটা দুলতে-দুলতে পিছলে পড়ে গেছে।
কিন্তু এই সুগন্ধটা?
মুরারিবাবু ছড়িটা তুলে আবার ব্র্যাকেটে রাখার জন্য পা বাড়িয়েছেন, সেই সময় অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে গেল।
ছড়িটা মেঝে থেকে সটান সোজা হল। তারপর শূন্যে ভেসে খোলা জানালার গরাদের ফাঁকা দিয়ে ভেতরের বারান্দায় চলে গেল। এবার বারান্দায় চাপা খুটখুট শব্দ হতে থাকল।
মুরারিবাবু স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। একটু পরে তার মনে হল, কে যেন বারান্দায় ছড়ি ঠুকঠুক করে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
সাহস করে জানালায় উঁকি দিলেন তিনি। বারান্দার ওপরে চল্লিশ ওয়াটের একটা বাধ সারা রাত জ্বলে। এলাকায় হিঁচকে চোরের উপদ্রব আছে।
হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। উঁকি মেরে মুরারিবাবু কাকেও দেখতে পেলেন না। তবে সেই সুগন্ধটা এখনও ঘরের ভিতর মউমউ করছে। ক্রমশ মাথাটাও যেন ঝিম ঝিম করছে। চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে ঘুমে।
টলতে টলতে মুরারিবাবু আলো নিভিয়ে গতরাতের মতো মশারিতে ঢুকে গেলেন এবং খুব শিগগির ঘুমিয়ে পড়লেন।
ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজল যথারীতি। মুরারিবাবুও মর্নিংওয়াকের জন্য তৈরি হালেন। আর কী আশ্চর্য! তিনি দেখলেন, কালো ছড়িটা কালকের মতোই ব্র্যাকেট থেকে ঝুলছে। ঘরে কোনও সুগন্ধও নেই।
হ্যাঁ, স্বপ্ন ছাড়া আর কী? মুরারিবাবুর মনে হল, পরপর দু-রাত্রি তিনি একই স্বপ্ন দেখেছেন। আসলে ছড়িটার রং কালো এবং সেই ভদ্রলোক ওইভাবে এটা ফেলে রেখে হন্তদন্ত এগিয়ে গিয়ে বাসে চেপে চলে গেলেন! তাই মনে একটা খটকা বেধেছিল এবং সেই খটকা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন।…..
এদিনও পার্কে সেই ভদ্রলোককে খুঁজে পাননি মুরারিবাবু। তবে সেই বেঞ্চে তার বসার মতো জায়গা ছিল। জনা চার তার বয়সি প্রবীণ ভদ্রলোক বেঞ্চে বসে ছিলেন। কালো ছড়িটা একপাশে রেখে মুরারিবাবু ভাবছিলেন, পরপর দু-রাত্রি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। আজ রাত্রেও যদি ওই স্বপ্ন দেখেন?
অমন বিদঘুঁটে স্বপ্ন প্রতিরাত্রে দেখতে কি ভালো লাগে? তাছাড়া এভাবে কালো ছড়িটার রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সত্যিই যে পাগল হয়ে যাবেন!
তার চেয়ে ছড়িটা এখানে ফেলে রেখে সেই ভদ্রলোকের মতোই কেটে পড়া যাক।
এমন তো হতেই পারে, এই কালো ছড়িটা সেই ভদ্রলোকেরও নয় এবং তিনিও এর পাল্লায় পড়ে ভুতুড়ে স্বপ্নের চোটে নাকাল হয়ে এটা এখানে ফেলে কেটে পড়েছিলেন!
মুরারিবাবু ছড়িটা ফেলে রেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু বরাত অন্যরকম।
বেঞ্চের এক ভদ্রলোক ছড়িটা নিয়ে ছুটে এলেন।–ও মশাই! ও মশাই! আপনার ছড়ি! ছড়িটা ফেলে যাচ্ছেন যে!
বেগতিক দেখে মুরারিবাবু জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। ওটা আমার ছড়ি নয়।
ভদ্রলোক যেন তেড়ে এলেন–আমার নয় মানে? আপনিই এটা হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসলেন। আবার বলছেন এটা আমার নয়!
মুরারিবাবু বললেন, আপনি ভুল দেখেছেন! আমি ছড়িহাতে বেঞ্চে বসিনি। ছড়িটা ওখানেই রাখা ছিল।
এবার তর্ক বেধে গেল। ভদ্রলোক চেঁচিয়ে ডাকলেন, অবিনাশদা! রঞ্জনবাবু! আপনারা শিগগির এখানে আসুন তো!
সেই বেঞ্চ থেকে চার প্রবীণ হন্তদন্ত এসে গেলেন। তারপর কথাটা শুনে সব্বাই একবাক্যে বললেন,–পরিতোষবাবু ঠিকই বলছেন। আমরাও দেখেছি আপনি এই কালো ছড়ি হাতে নিয়ে এসে বেঞ্চে বসলেন। এখন বলছেন, ওটা নাকি আপনার নয়। ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?
সবকথা খুলে বললে হয়তো এঁরা তাকে পাগল ভেবে ঠাট্টাতামাশা করবেন। এই ভেবে মুরারিবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে। ছড়িটা দিন।
বলে ছড়িটা নিয়েই তিনি হন্তদন্ত বেরিয়ে এলেন পার্ক থেকে। এঁরা চারজন ততক্ষণে হাসাহাসি করে সত্যিই বলছেন,–পাগল! পাগল! এক্কেবারে বদ্ধপাগল!
মুরারিবাবু মনে-মনে বললেন,–এখনও পাগল হইনি। তবে শিগগির যে পাগলা হয়ে যাব, তা ঠিক। ওঃ! হতচ্ছাড়া ছড়িটা!
গলিতে ঢুকে তিনি ঠিক করলেন, ছড়িটা বরং থানায় জমা দেবেন। শুধু বলবেন, এটা তিনি আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছেন।…..
বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট করে এবং তারিয়ে-তারিয়ে এক গেলাস চা খেয়ে মুরারিবাবু ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
কিন্তু থানায় গিয়ে আরেক কাণ্ড।
থানার বড়বাবু ছড়িটা দেখেই উত্তেজিতভাবে হাঁক দিলেন, সমাদ্দারবাবু! সমাদ্দারবাবু! শিগগির আসুন।
একজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত ঘরে ঢুকে বললেন, বলুন সার!
বড়বাবু বললেন, দেখুন তো এটা আঢ্যিবাবুর সেই ছড়িটা কিনা! ওঁর স্ত্রী বলেছিলেন, একটা কালো ছড়ি হাতানোর জন্যই ডাকাতরা আঢ্যিবাবুকে খুন করেছিল। ভদ্রমহিলা ছড়িটার যে ডেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এটা মিলে যাচ্ছে। তাই না?
সমাদ্দারবাবুও ছড়িটা দেখে চমকে উঠেছিলেন। ওটা হাতে নিয়ে হাতলের নিচে রুপোলি অংশটা খুঁটিয়ে দেখার পর তিনি বললেন, হ্যাঁ সার! এই তো এখানে খোদাই করা আছে এস, কে, আত্যি। তার মানে সুশীলকুমার আত্যি।
মুরারিবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বড়বাবু তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,–দেখুন মশাই! এটা এক সাংঘাতিক মার্ডার কেস। ছেলেখেলা নয়। সত্যি করে বলুন তো আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?
সমাদ্দারবাবু বললেন,-সার! আগে দেখা যাক, এটার ভেতর হীরেগুলো আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে এই ভদ্রলোককে অ্যারেস্ট করতে হবে।
বলে তিনি ছড়ির হাতলটা ঘোরাতে শুরু করলেন। মুরারিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, পঁাচ খুলে হাতলটা আলাদা হয়ে গেল। তারপর সমাদ্দারবাবু ছড়ির মাথার দিকটা টেবিলে ঠুকতে থাকলেন। কয়েকবার ঠোকার পর খুদে তিন টুকরো উজ্জ্বল কী জিনিস বেরিয়ে এল। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছিল বড়বাবুর টেবিলে। সেই রোদে তিন টুকরো জিনিস থেকে চোখ ধাঁধানো দীপ্তি ঝলমলিয়ে উঠল। মুরারিবাবু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
এবার বড়বাবু সহাস্যে বললেন, আপনি এই ছড়িটা কোথায় পেলেন, বলুন তো মশাই?
মুরারিবাবু গুম হয়ে বললেন,–আজ ভোরবেলা পার্কে কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী সার?
বললুম না? মার্ডার কেস। বড়বাবু বললেন, কদিন আগে সুশীলকুমার আঢ্যি নামে এক ভদ্রলোক এই ছড়িহাতে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তারপর একটা গলির মোড়ে তাঁর ডেডবডি পাওয়া যায়।
সমাদ্দারবাবু বললেন, স্যার! আমার মনে হচ্ছে, যে কোনও কারণেই হোক, খুনিরা এই ছড়িটা হাতাতে পারেনি।
বড়বাবু বললেন, কারণটা এবার আসামীদুটোর মুখ থেকেই শোনা যাক। ওদের হাজত থেকে এখনই নিয়ে আসুন। ওরা এবার কী বলে শোনা যাক।
সমাদ্দারবাবুর নির্দেশে দুজন কনস্টেবল হাতকড়া এবং কোমরে দড়িবাঁধা দুটো লোককে টানতে-টানতে নিয়ে এল। একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা এবং অন্যজন রোগা। সমাদ্দারবাবু তাদের পেটে বারকতক বেটনের গুতো মেরে বললেন,–বল হতচ্ছাড়ারা! এই ছড়ির জন্যই তোরা সুশীলবাবুকে মার্ডার করেছিস। কিন্তু ছড়িটা হাতাতে পারিসনি কেন?
বেটনের গুতোর সঙ্গে চুল খামচে বেজায় টানাটানির চোটে অস্থির হয়ে বেঁটে লোকটা বলে উঠল, আমরা দুজনে সঙ্গে ছিলুম বটে, তবে খুনটা করেছিল বেচুলাল, সার! ছড়িটা সেই হাতিয়েছিল। পরদিন বেচুর কাছে গিয়ে শুনি, ছড়িটা নাকি তার ঘর থেকে নিপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। ওকে খুব শাসিয়েছিলুম। বেচু মা কালীর দিব্যি কেটে বলেছিল, রাতদুপুরে খুটখুট শব্দ শুনে সে আলো জ্বেলে দেখেছিল, ছড়িটা নাকি জানলা গলিয়ে পালিয়ে গেল। আর ঘরে নাকি ঝঝালো সেন্টের গন্ধ। আপনারা বেচুকে খুঁজে বের করুন সার!
এবার মুরারিবাবু চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, একটা কথা জিগ্যেস করি। সুশীলবাবুর মাথার চুল কি সাদা ছিল?
বেঁটে আসামী ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–ওঁর পরনে কি গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি ছিল?
–আজ্ঞে।
–পরনে ধাক্কাপাড়ের ধুতি আর পায়ে পামশু ছিল?
–আজ্ঞে।
মুরারিবাবু চুপ করে গেলেন। বড়বাবু বললেন, আপনি সুশীলবাবুকে চিনতেন নাকি মশাই?
আস্তে মাথা নেড়ে মুরারিবাবু বললেন,-এবার কি আমি যেতে পারি সার?
–হ্যাঁ। তবে নাম-ঠিকানা আর একটা স্টেটমেন্ট লিখে দিয়ে যান। সমাদ্দারবাবু! এঁর স্টেটমেন্ট নিন।
কাঁপা কাঁপা হাতে মুরারিবাবু স্টেটমেন্টের তলায় নাম-ঠিকানা লিখে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ একটু থেমে গিয়ে ভাবলেন বড়বাবুকে কি বলে আসবেন, খুনি বেচুলাল ঠিক কথাই বলেছিল তার দুই স্যাঙাতকে!
কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পুলিশের আইনে ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই। তাছাড়া আসল ঘটনা খুলে বলতে গিয়ে হয়তো নিজেও এই খুনের কেসে জড়িয়ে যাবেন। পুলিশ ভূতপ্রেতের চেয়ে সাংঘাতিক। তার চেয়ে চুপচাপ কেটে পড়াই নিরাপদ।
তবে হ্যাঁ। একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সুশীলবাবুর আত্মা যেন ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। মুরারিবাবুর মতো ভালোমানুষ শেষ অবধি তার ছড়িটা থানাতে জমা না দিয়ে পারবেন না। তাই ছড়িটা ওইভাবে বেঞ্চে তাঁর কাছে ফেলে রেখে সুশীলবাবুর আত্মা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।…
কালো বেড়াল
এই নিয়ে পরপর তিন দিন। দিন না বলে সন্ধেবেলা বলাই উচিত। জগমোহন শবেড়াতে বেরিয়ে ঠিক একই জায়গায় একটা কালো বেড়াল দেখতে পেলেন।
কালো বেড়াল এমন কিছু বিদঘুঁটে প্রাণী নয়। কিন্তু একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আর জায়গাটাও তো সন্দেহজনক। গদাইবাবুর আমবাগানে। কিছুদিন আগে যেখানে মোনাই-ফকিরের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই।
মোনাই-ফকিরের আস্তানা একটু দূরে অবশ্য। সে নাকি লটারিতে অনেক টাকা পেয়েছিল। তারপর ডাকাত পড়েছিল রাত্রিবেলা। সকালে দেখা গেল ফকিরের লাশ পড়ে আছে গদাইবাবুর বাগানের ধারে। ধরো আর মুন্ডু আলাদা। সে এক বীভৎস দৃশ্য।
মোনাই-ফকির কালো আলখাল্লা পরে থাকত। মাথার টুপিও ছিল কালো। গাঁজার নেশায় সব সময় চোখদুটো রাঙা। আস্তানা বলতে একটা পুরানো বাদশাহি আমলের মুসলমান সাধুর কবরের ওপরের পাথরের একতলা ঘর। কবরের পাশেই মোনাই-ফকির খেত, ঘুমোত। ওখানেই তার সংসার আর সাধনভজন। হাটবারে লোকেরা এসে তার কাছে ওষুধ চাইত। ভূত-ভবিষ্যৎ জানতে চাইত। পয়সাকড়ি দিত।
এহেন ফকিরমানুষ লোভের বশে লটারির টিকিট কিনেছিল। একেবারে নাকি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। কমপক্ষে লাখ টাকা তো বটে। চারদিকে হইচই পড়ে গিয়েছিল এই খবরে।
কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ফকিরবেচারা প্রাণে মারা পড়ল।
জগমোহন রোজ নদীর ধার অবধি বেড়াতে যান বিকেলে। সন্ধেবেলা লাঠি ঠুকঠুক করে বাড়ি ফেরেন। ওই সব কথা ভাবতে-ভাবতেই হাঁটেন। আমবাগানের ধারে এসে একবার তাকান জায়গাটার দিকে এবং শিউরে ওঠেন। মনে হয়, আবছা আঁধারে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা রেখে ফকির শুয়ে আছে এবং মুন্ডুটা যেন মিটিমিটি হাসছে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
অমনি জগমোহন চলার গতি বাড়ান। গলার ভেতর রামনাম দু-চারবার হয় না, এমন নয়!
তারপর এক সন্ধেয় হঠাৎ এই কালো বেড়ালের আবির্ভাব। প্রথম দিন বিশেষ গা করেননি। দ্বিতীয় দিন একটু চমকে উঠেছিলেন। তৃতীয় দিন তো ভীষণ ভড়কে গেলেন ফকিরের কালো আলখাল্লার কথা মনে পড়েই।
জগমোহন এই মফস্বল শহরের একজন রিটায়ার্ড উকিল। বয়স হয়ে গেছে। মাথার চুল তুলোর মতো সাদা। বিকেলবেলা কিছুক্ষণ নদীর ধারে পার্কে গিয়ে না বসলে জীবন বড্ড একঘেঁয়ে লাগে। রাশভারী চেহারার মানুষটি যখন মোটাসোটা ছড়ি অর্থাৎ রীতিমতো লাঠিটি নিয়ে ঠুকঠাক করে হেঁটে যান, পথে সবাই খুব সম্ভ্রম রেখে কথা বলে।
সন্ধেবেলা গদাইবাবুর বাগানের ওদিকটায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে মিটমিটে আলো ছড়ায়। সেই আলোয় কালো বেড়ালের জ্বলজ্বলে হলুদ চোখজোড়া যেন জগমোহনের মনে গেঁথে গেল। সে-রাতে আর ঘুমোতেই পারলেন না। চোখ বুজলেই দেখতেন যেন কালো বেড়ালের হলুদ চোখজোড়া। আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায় বুঝি।
পরদিন বিকেলে আর একা বেড়াতে যেতে ভরসা পেলেন না। ব্যাপারটা কাকেও যে বলবেন, তাও খুব লজ্জা করে। একসময়কার বাঘা উকিল জগমোহন বেড়ালের ভয়ে কাবু–এ বড় খিটকেলের কথা নয়? সবাই হাসাহাসি করবে, আদালতের তাবড় তাবড় দুদে হাকিমকে যিনি ভয় পেতেন না, তিনি সামান্য বিড়াল দেখে ভয়ে পেয়েছেন?
নাতি দিবু খুব ডানপিটে ছেলে। সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছে। এরই মধ্যে সবরকম খেলাধুলায় নাম কুড়িয়েছে। জগমোহন দিবুকে আজ সঙ্গে নিলেন। দিবু কি খেলা ছেড়ে বিকেলবেলাটা বুড়ো দারুর সঙ্গে বেড়াতে বেরোবার ছেলে? অনেক বলেকয়ে লোভ দেখিয়ে তবে সে রাজি হল। ফেরার পথে মেধোর বেঁস্তোরায় কাটলেট কিংবা অম্বুর মিষ্টান্নভাণ্ডারে যথেচ্ছ রসমালাই খাওয়াবার কথা দিলেন জগমোহন। দিবু কাটলেট আর রসমালাইয়ের ভীষণ ভক্ত।
দিবু যখন সঙ্গে আছে, জগমোহনের তখন ভয় কীসের? এখন তিনি আলেকজান্ডার দি গ্রেট। কই এবার আয় দেখি ব্যাটা কালো বেড়াল অথবা মোনাই ফকির আমার সামনে। মাথা ছাতু করে ফেলব না?
আজ পার্ক থেকে একটু দেরি করেই ফিরছিলেন জগমোহন। দিবুর সঙ্গে আদালতের গল্প করতে করতে আসছিলেন। কোন হাকিম এজলাসে বসে ঢুলতেন, কোন হাকিম মামলার রায় পড়ার আগে জোর হেঁচে ফেলতেন, এইসব ক্যারিকেচার শুনে দিবু হেসে খুন হচ্ছিল। রাশভারী, গম্ভীর চেহারার দাদুকে এমন রসিকতা করতে শোনেনি সে।
কখন গদাইবাবুর আমবাগানের কাছে এসে পড়েছেন খেয়াল নেই। এসে যেই ডাইনে মুখ ঘুরিয়েছেন আর দেখতে পেয়েছেন সেই বিদঘুঁটে কালো বেড়ালটাকে। একই ভঙ্গিতে বসে আছে। তীব্র জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। তেমন চাউনি। আর আজ যেন গোঁফের তলায় কেমন একটা হাসিও রয়েছে।
জগমোহন অমনি লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার। মার। মার।
দিবু অবাক হয়ে বলল, কী হল দাদু? কী হল? কাকে মারতে যাচ্ছ?
জগমোহন হাঁপাত-হাঁপাতে লাঠি তুলে বললেন,–ওইগুই কালো বেড়ালটাকে।
বেড়াল! –দিবু আরও অবাক।–কই, কোথায় বেড়াল?
–ওই তো! দেখতে পাচ্ছিসনে? ওই যে!
দিবু হাসতে লাগল।–তোমার চোখ খারাপ দাদু। ওটা তো একটা কালো কাঠ পড়ে রয়েছে। সে দৌড়ে গিয়ে একটুকরো কাঠে লাথি মারল।
জগমোহন দেখলেন, বেড়ালটা সত্যি কাঠ হয়ে গেছে। তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে পা বাড়ালেন। মনটা ভালো হয়ে গেল। একেই বলে রজুতে সর্পভ্রম অর্থাৎ দড়িকে সাপ মনে করা। ছ্যা-ছ্যা কী লজ্জার কথা।
কিন্তু কিছুটা গিয়েই হঠাৎ মনে হল, যেন চাপাস্বরে বেড়ালটা ডাকল–মিউ! অমনি ঘুরলেন। ঘুরেই আঁতকে উঠলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
সেই কালো বেড়ালটা পেছন পেছন আসছে!
জগমোহন ফের লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার! মার! মার!
দিবু এবার রেগে গেল! বলল,–ও দাদু! আবার কী মারতে যাচ্ছ?
জগমোহন কাঁপতে কাঁপতে বললেন,-বেড়াল! সেই কালো বেড়াল।
–কই বেড়াল?
–এই তো!
দিবু আরও রাগ দেখিয়ে বলল, তোমার মুন্ডু। আমি চললুম।
কালো বেড়ালটা এখন একটু সরে গিয়ে রাস্তার পিচে বুক ঠেকিয়ে বসেছে। এ রাস্তাটা খাঁ-খাঁ নির্জন। জগমোহন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, দিবু! দিবু যাসনে। কাটলেট, রসমালাই!
তখন দিবু দাঁড়াল। তারপর হাসতে-হাসতে বলল,–বেড়ালকে এত ভয় কীসের বলো তো? বেড়াল ইজ বেড়াল।
জগমোহন হাঁটেন আর বারবার পিছু ফেরেন। আশ্চর্য! কালো বেড়ালটার সঙ্গে তার দূরত্ব সেই একই থেকে যাচ্ছে! ভিড়ে ভরা বড়রাস্তায় পৌঁছে অবশ্য আর তাকে দেখতে পেলেন না।
সেই রাতে জগমোহন অস্থির। চোখে ঘুম নেই।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কালো বেড়ালটাকে তিনি একা দেখতে পান, আর কেউ পায় না। দিবু দেখতে পায়নি তো!
আর তার চেয়েও বড় কথা, দিবুকেও বেড়ালটা গ্রাহ্য করল না। একবার বেমালুম কাঠে রূপান্তরিত হল।
দ্বিতীয়বার তার সামনে অদৃশ্য হয়ে রইল। শুই তাই নয়, জগমোহনকে অনুসরণ করল কতদূর।
অতএব বেড়ালটা সেই মোনাইফকিরের আত্মা, অর্থাৎ ভূত। হায়-হায়! এতকাল পরে এই বুড়োবয়সে জগমোহন একটা ভূতের পাল্লায় পড়লেন?
কথাটা যত ভাবছেন, আতঙ্কে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ফকিরের ভূত তার গলা কামড়ে ধরবেই ধরবে।
বাড়িটা শহরের শেষপ্রান্তে। জগমোহনের ঘরের পেছনে জঙ্গুলে জায়গা খানিকটা। তার ওধারে সেই নদী! এমন জায়গায় বাড়ি করাই ভুল হয়েছিল।
তার ওপর মশারও খুব উপদ্রব বারোমাস।
তবে একটা সুবিধে হয়েছে দেখা যাচ্ছে। মশারির ভেতর শুয়ে থাকার ফলে রাতের বেলা নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন। বেড়াল তোক আর ভূতপ্রেতই হোক, মশারির ভেতর ঢুকতে পারবে কি? না পারাই উচিত। কোন বইয়ে যেন পড়েছিলেন, মশারির ভেতর মানুষ খুব নিরাপদ!
দেয়ালঘড়িতে টকটক শব্দ। তারপর ঢংঢং করে রাত বারোটা বাজল। আর তারপরই জগমোহন শুনলেন, মিড। অমনি চমকে মুখ তুললেন।
বাইরে অন্য পাশের রাস্তার আলো ত্যারচা হয়ে একটা জানালায় পড়েছে। আর সেখানে ফের আবির্ভূত হয়েছে সেই কালো বেড়াল। জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। মশারির ভেতর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোঁফের তলায় তেমনি একটা হাসিও। হাসিটা এখন কেমন ক্রুর। কালো বেড়ালটা ফের বলল–মিউ।
জগমোহন ততক্ষণে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাঁদরের বেলায় যেমন, তেমন ভূতের বেলাতেও এক কথা। বেশি পাত্তা দিতে নেই। পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে বসবে। ভূতকে ভয় করলেই ভূত আরও পেয়ে বসবে।
অতএব জগমোহন ভয় চেপেচুপে রেখে সোজা ভেংচি কাটলেন ভূত অর্থাৎ কালো বেড়ালকে, মিউ।
কালো বেড়ালও সঙ্গে সঙ্গে বলল,-মিউ! আর এতক্ষণে জগমোহন টের পেলেন, তিনি বেড়ালের ভাষা বুঝতে পেরেছেন। কী বলছে, ঠাহর হচ্ছে। কালো বেড়াল বলছে, টাকা।
অ্যাঁ টাকা! জগমোহনের টনক নড়ল। বেড়ালের ভাষায় বলে উঠলেন, মিয়াও! মিয়াও! টাকা? কীসের টাকা?
কালো বেড়াল বলল,–ম্যাঁও! ম্যাঁও! কেন? লটারির টাকা?
ওরে বাবা! বলে কী ব্যাটা! লটারির টাকা মানেটা কী?
জগমোহন হতভম্ব হয়ে বললেন,–মিঁই-ই! অ্যাঁ! বলল কী হে?
মিঁ-ও-ও! মিঁ-ও-ও! কেন উকিলবাবু, আমার লটারিতে পাওনা টাকার কথা ভুলে যাচ্ছেন!
মিঁউ, মিঁউ! কী মুশকিল! তোমার লটারির টাকা তো তোমায় খুন করে ডাকাতব্যাটারা নিয়ে পালিয়েছে–জগমোহন বললেন, ও বুঝেছি। তা তুমি কি আমাকে মামলা করতে বলছ তোমার হয়ে? মলো ছাই! ডাকাতব্যাটাদের কি আমি চিনি! তুমি বরং দারোগাবাবুর কাছে যাও। তিনি তোমার টাকা উদ্ধার করে দেবেন। ও ব্যাটাদের জেলে পুরবেন। যাও দিকি বাবু দারোগার কাছে।
–ম্যাঁও-ম্যাঁও! ওকথা বললে তো চলবে না উকিলবাবু।
ম্যাঁ-অ্যাঁ-ও–চলবে না মানে? আমি তো কবে ওকালতি ছেড়ে দিয়েছি হে!
–মিঁউ মিঁউ মিঁউ। টাকা টাকা টাকা! কোনও কথা শুনব না। টাকা চাই।
জগমোহন বিব্রত হয়ে মানুষের ভাষায় বললেন, কী আপদ! ভাগো, ভাগো বলছি। নইলে লাঠিপেটা করব।
কালো বেড়াল এবার নিজের ভাষায় তবে রে, বুড়ো! বলে এক লাফে তাঁর মশারির ছাদে এসে পড়ল। অমনি পটাপট দড়ি ছিঁড়ে মশারি আর বেড়াল পড়ল জগমোহনের ওপর। মুহূর্তে হুলুস্থুল ঘটে গেল। জগমোহন আর্তনাদ করতে লাগলেন, বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও। মশারির ভেতর জড়িয়ে-মুড়িয়ে খাটের নিচে পড়ে গেলেন। বাড়ির সবাই জেগে গেল। দরজায় ধাক্কা দিতে থাকল। কিন্তু দরজা খুলবে কে? শেষে প্রচণ্ড ধাক্কায় কপাট ভেঙে ফেলা হল। তারপর মশারি থেকে উদ্ধার করা হল জগমোহনকে।
দিবুর বাবা প্রণবেশ বললেন, কী কাণ্ড! মশারির দড়ি ছিঁড়ল কীভাবে?
দিবুর মা অরুণা বললেন, নিশ্চয় বেড়াল পড়েছিল। আমি তো জেগেই ছিলুম। কখন থেকে শুনছিলুম, এ ঘরে যেন বেড়াল ডাকছে। ভাবলুম, দুই বেড়ালে ঝগড়া বেধেছে।
জগমোহন অতি কষ্টে বললেন,–এক গ্লাস জল।
হ্যাঁ, কথাটা তো ঠিক। দুই বেড়ালের ঝগড়া বলা যায়। কিন্তু ঝগড়াটা টাকা নিয়ে। লটারির টাকা। ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়। মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছেন না জগমোহন।
জল খেয়ে সুস্থ হয়ে জগমোহন বললেন, কী বলছিলে বউমা, বেড়ালের ঝগড়া না কী?
অরুণা বললেন, হ্যাঁ। মনে হচ্ছে দুটো বেড়াল ঝগড়া করতে করতে আপনার মশারির ওপর পড়েছিল।
জগমোহন জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না। টাকা! লটারির টাকা।
তার মানে?–প্রণবেশ অবাক হয়ে বললেন,–বাবা, লটারির টাকা মানে কী?
জগমোহন ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাঁটু মুড়ে খাটের তলায় ঢুকলেন। বাড়ির লোকেরা হতবাক। দিবু ঘুমজড়ানো চোখে তাকিয়ে বলল,–ও দাদু! ওখানে ঢুকছ কেন? বেড়ালের ভয়ে? হি হি হি হি।
তাই শুনে রাঁধুনি হরুঠাকুর, কাজের লোক আন্নাকালী আর চাকর নবা পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। অরুণা ধমক দিয়ে বললেন, এতে হাসির কী আছে? যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো সব। সকাল সকাল উঠতে হবে। দেওঘরের ঠাকুরপো আসবেন না কাল? কত কাজ?
ওরা ব্যাজার মুখে যে-যার জায়গায় চলে গেল।
খাটের তলায় ঘষটানো শব্দ হচ্ছিল। জগমোহন কী একটা টেনে বের করছেন।
একটা পুরোনো সুটকেস। একদিকে ছোট্ট তালা আটকানো। সুটকেসটা টেবিলে রেখে জগমোহন বললেন, একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হায় ভুলো মন! মোনাই ফকির খুন হওয়ার কদিন আগে এটা আমায় রাখতে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে, ডাকাতব্যাটারা খামোকা বেচারাকে খুন করে গেল। খামোকাও হয়তো নয়, রাগে। টাকাগুলো পেলে খুন করত না। পায়নি বলেই রেগেমেগে মুণ্ডু কেটে ফেলেছিল। কিন্তু দেখো, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এই সুটকেসের মধ্যে…কী ভুল! কী ভুল!
প্রণবেশ বললেন,–ও বাবা, ব্যাপারটা কি বলবেন খুলে?
জগমোহন দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,–বলব আবার কী? মোনাই-ফকিরের টাকা। শিগগির একটা জাবির গোছা আন। তালা না খুললে ভাঙতেই হবে শেষপর্যন্ত।
.
মোনাই-ফকিরের আস্তানা ঘিরে জগমোহন একটা অনাথ আশ্রম বানিয়ে দিয়েছেন। অনাথ ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া শিখছে। কারিগরি কাজ শিখে মানুষ হচ্ছে।
মোনাইয়ের লটারির টাকা। জগমোহনও কিছু দিয়েছেন নিজের পুঁজি থেকে। আজকাল সেই অনাথ আশ্রম নিয়েই থাকেন তিনি! বাকি জীবনের জন্য একটা ভালো কাজ পেয়ে গেছেন।
আর কালো বেড়ালটা?
শেষবার দেখেছিলেন অনাথ আশ্রম উদ্বোধনের দিন। কলকাতা থেকে এক মন্ত্রীমশাই গিয়েছিলেন উদ্বোধন করতে। জগমোহন দেখেছিলেন অত ভিড়ের মধ্যে কালো বেড়ালটা দিব্যি এসে তাঁর দু-পায়ের ফাঁকে কিছুক্ষণ বসে থাকল। পা শিরশির করছিল। তবু আর ভয় পাননি জগমোহন। এমন কী যাওয়ার সময় বেড়ালটা মিউ বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল।
মোনাই-ফকিরের আত্মার শান্তি হয়েছে! আর জগমোহনকে জ্বালাতে আসে না।
অবশ্য জগমোহন এখন কদাচিৎ কালো বেড়াল দেখলে চমকে ওঠেন। তবে আর মারমার বলে তাড়া করেন না। এরা তো ভূত নয়, নেহাত পাড়ার হুলো। একটু হেসে বেড়ালের ভাষায় ধমক দিয়ে শুধু বলেন, মিউ। অর্থাৎ তুই আবার কে রে? ভাগ-ভাগ!…
কৃতান্তবাবুর কাঁকুলে যাত্রা
বাস থেকে নেমে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল কৃতান্তবাবুর। ভুল জায়গায় নামিয়ে দেয়নি তো কন্ডাক্টর! পাকা রাস্তার দুধারেই ধু-ধু মাঠ। দিগন্তে ধোঁয়ার মতো যা দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চয় গ্রাম। কিন্তু এই প্রখর রোদূরে পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছতে শরীরের অর্ধেক রক্ত ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাবে যে।
হ্যাঁ, ঘাম হয়ে। শরীরের রক্তই যে ঘাম হয়ে বেরোয়, তাতে কৃতান্তবাবুর এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। এই ধু ধু মাঠ, লোক নেই, জন নেই, গাছ নেই, পালা নেই, যাকে তেপান্তর বলা হয় রূপকথায়–সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক এমন কথাই মনে হবে মানুষের।
বৈকুণ্ঠবাবুকে না জানিয়ে এভাবে হুট করে এসে পড়াটা ভালো হয়নি। জানিয়ে এলে তিনি পাকারাস্তার মোড়ে গাড়ি-টাড়ি নিশ্চয় রাখতেন! বৈকুণ্ঠ পয়সাওলা মানুষ।
পরক্ষণে কৃতান্ত মোড়ের কাঁচারাস্তাটা দেখে ভাবলেন–হ্যাঁ, গাড়ি ঠিকই রাখত বৈকুণ্ঠ। তবে নির্ঘাৎ সেটা গরু বা মোষের গাড়ি। অবশ্য ওর জিপ থাকাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু যে কিপটে মানুষ, রিটায়ার করার পর দেশের বাড়ি গিয়ে জিপ কিনবে? তাহলেই হয়েছে।
কমাস আগে কলকাতায় দেখা হয়েছিল দুই বন্ধুর। দুজনেরই বয়স হয়েছে। চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। কৃতান্ত থাকেন বড়ছেলের কাছে। বৈকণ্ঠ গ্রামে পৈতৃক ভিটেয় গিয়ে উঠেছেন। কিছু জমিজমাও আছে। ছেলেপুলে নেই, আছে এক ভাগ্নে। সেই এতদিন সব দেখাশোনা করছিল। এখন মামা-ভাগ্নে মিলে নাকি উন্নত প্ৰথায় চাষবাস করছেন। কথায় কথায় বৈকুণ্ঠ বলেছিলেন, মন খারাপ করলে সোজা চলে যেও ভাই কেতো। কীভাবে যেতে হবে, বলে দিচ্ছি।
পথ ঠিকই বাতলে দিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠ। ওই তো কাঁচারাস্তা মাঠের বুকে সোজা চলে গেছে। ওই রাস্তায় তিন মাইল গেলেই বৈকুণ্ঠের গ্রাম কাকুলিয়া। কিন্তু বৈকুণ্ঠ সবই বলেছিলেন,–শুধু বলেননি মাঠটা অবিকল রূপকথার সেই তেপান্তর–আর এই এলাকার আকাশে সূর্যদেবও বেজায় রাগী। বাপ! সবে তো দশটা বেজেছে, এরই মধ্যে মেজাজ কী তিরিক্ষি। কটমট করে তাকাচ্ছেন কৃতান্তের দিকে রোস্ট করে খেয়ে ফেলবেন একেবারে।
তাও তো রূপকথার তেপান্তরে একটা গাছ ছিল শুনেছেন ছেলেবেলায়– যে গাছের ডালে বাস করত ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।
কিন্তু এ যেন মরুভূমি। ঢেউ খেলানো ধুধু মাঠ, রুক্ষ নীরস হয়ে পড়ে আছে। হুঁ! সব গুল বৈকুণ্ঠের। চাষবাস না হাতি। এই পাথুরে মাটিতে এক চিলতে ঘাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেনি, শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে আর কিনা ওঁরা মামা-ভাগ্নে নাকি ফসল ফলিয়ে মা-লক্ষ্মীর বরপুত্র হয়ে গেছেন? ধুর, ধুর! বয়স হলেও বৈকুণ্ঠ এমন মিথ্যুক, ভাবা যায় না।
কৃতান্তবাবুর রাগ হচ্ছিল। কিন্তু এসে যখন পড়েছেন, এবং বুড়োমানুষ হলেও এখনও শরীরে যুবকের মতো শক্তি আছে বইকী, তখন বৈকুণ্ঠের মুখোমুখি হয়ে ঝাল ঝেড়ে ছাড়বেন না।
অতএব কৃতান্ত মাথায় রুমাল জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। রুমাল না জড়ালে সূর্যদেবের দাঁতের কামড় খেয়ে প্রকাণ্ড টাকের অবস্থাটা ভারি কাহিল হয়ে যাবে। কাঁধে একটা ব্যাগ ছাড়া আর কোনও বোঝা নেই। সেই রক্ষে।
সত্যি বলতে কী, এই যে এমন করে বৈকুণ্ঠবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন, তার কারণ গত রাত থেকে তার মন খারাপ। বৈকুণ্ঠ বলেছিলেন, মন খারাপ হলেই চলে যেও। আনন্দ পাবে।
মন খারাপের কারণ আর কিছুই না, চা। নেপাল নামে যে ছোকরাটিকে উমা সম্প্রতি বাসায় বহাল করেছে, সে চোরের ওস্তাদ। তিরিশ টাকা কিলোর চা কিনতে গিয়ে পনেরো টাকা কিলোর চা এনে দেবে এবং তিরিশ টাকা দরেই হিসেব দেখাবে। আর সেই চা কুকুরও ছোঁয় না। কৃতান্তবাবুর বরাবর এই এক অভ্যাস। ভালো এবং দামি চা খাওয়া তার শখ ছিল। এখন নিজে চা কিনতে যান না। তার মানে, ছেলে কিংবা বউমা তাঁকে চা কিনতে যেতে দেবে না। ওদের সম্মান যাবে নাকি!
আসলে নেপাল ওদের মাথাটি খেয়েছে। গত রাতে পার্ক থেকে বেড়িয়ে এসে অভ্যাস মতো চা চাইলেন। চা ঠিকই এল কিন্তু সে কি চা, না শুকনো কচুরিপানা সেদ্ধ জল?
নেপালকে বকাবকি করতে গেলে উল্টে বউমা তার হয়ে সাফাই গেয়ে বলল কিনা,–আজকাল চায়ে বেজায় ভেজাল দিচ্ছে যে। নেপু কী করবে?
নেপাল হল নেপু! ন্যাপলা নয়, আদর করে নে-পু! কোনও মানে হয়?
বেশ, নেপু নিয়ে তোমরা ভেঁপু বাজাও। আমি চললুম যে-দিকে দুচোখ যায়।
কৃতান্তবাবু অবশ্য টেবিলে একটা চিরকুট সবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় রেখে এসেছেন। তাতে লিখে রেখেছেন : আমাকে খুঁজিও না। পাইবে না।
বাস থেকে কাকুলিয়া রাস্তার এই মোড়ে নেমে একটু পস্তানি অবশ্য হয়েছিল। এতটা করা কি ঠিক হয়েছে? বড়ছেলে প্রতুল কি চুপ করে থাকবে? হাজার হলেও বাবা। বাবা নিরুদ্দেশ হলে ছেলেদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব। থানা-পুলিশ করবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। খামোকা হয়রান হবে।
কিন্তু যা করার করে ফেলেছেন, আর পস্তিয়ে লাভ নেই। তবে যদি প্রতুল তার খোঁজ পেয়ে যায় এবং মুখোমুখি এসে পড়ে কৃতান্ত বলবেন,-হা, ফিরে যাব একটা শর্তে। ওই ন্যাপলাকে তাড়াতে হবে।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে কৃতান্তবাবু চলেছেন।
একটা সুবিধে, কঁকা মাঠ বলে হুহু করে বাতাস বইছে। তাই রোদ্দুরটা খুব একটা কষ্ট দিচ্ছে না।
কিন্তু রাস্তা যেমন এবড়ো-খেবড়ো, তেমনি ধুলোয় ভরা। হাঁটু অবধি ধুলোয় সাদা হয়ে যাচ্ছে। একদমে এতখানি হাঁটা অভ্যেস নেই বলে ক্লান্তিও আসছে।
বৈকুণ্ঠের দেশের লোকেরা এমন গবেট যে রাস্তার ধারে একটা গাছও লাগায়নি। একেই বলে পাণ্ডববর্জিত দেশ। আর সরকারি সড়কদফতরই বা কী করছে? প্রতি বছর ওই যে বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়, কত ধুমধাম শুনতে পাওয়া যায়, সে সব কঁকুলিয়া এলাকায় হয় না? আসলে তদ্বিরের লোক নেই এখানে। সরকার তো অন্তর্যামী ভগবান নন। গিয়ে সব জানাতে হবে তবে না! ছ্যা, ছ্যা, বৈকুণ্ঠের দেশের লোকেরা এখনও সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে।
কৃতান্ত তেতো মুখে এসব কথা ভাবছেন, এমন সময় আচমকা পেছনে আবছা শব্দ শুনতে পেলেন টংলং টংলংটংলং।
ঘোড়ার গাড়িটা দেখামাত্র রাস্তার ধারে সরে গেলেন কৃতান্ত। মনে ক্ষীণ আশা হল, গাড়িটা থামিয়ে বলবেন নাকি, একটা লিস্ট দিতে?
ঘোড়ার গাড়িটা যত কাছে আসছে, কৃতান্তবাবু কিন্তু তত অবাক। একালে এমন অজ পাড়াগাঁয়ে ঘোড়ার গাড়ি কেন, পালকি থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই গাড়িটা একেবারে রাজকীয়। সোনার মতো ঝকঝক করছে। কী অপূর্ব নকশা! ঘোড়াদুটোও প্রকাণ্ড এবং সাদা রঙের। তাদের সাজও দেখবার মতো। কোচোয়ানের দিকে তাকিয়ে কৃতান্ত আরও অবাক হলেন। জরি আর মখমলের পোশাক, মাথায় বিচিত্র উষ্ণীষ!
কৃতান্ত এত অবাক হয়েছিলেন যে গাড়িটাকে হাত তুলে থামাবার কথাই ভুলে গেছেন।
কিন্তু গাড়িটা আচমকা তার কাছে এসেই থেমে গেল। সাদা ঘোড়াদুটো সামনের দুই পা শূন্যে তুলে বিকট চিহিঁ করে উঠল।
যাকে কোচোয়ান ভেবেছিলেন, সে যে কোচোয়ান নয় বুঝতে দেরি হল না কৃতান্তের। কী সুন্দর বীরোচিত চেহারা! কী উজ্জ্বল গৌর গায়ের রং! আবার কোমরে খাপেভরা তরোয়ালও ঝুলছে।
কৃতান্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
এই মহাকাশযুগেও বৈকুণ্ঠবাবুর দেশের বড়লোকেরা এমন ঝলমলে সেকেলে পোশাক পরে কোমরে তরোয়াল ঝুলিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে বেড়ায়, ভাবলে অবাক লাগে না?
বোঝা যাচ্ছে, যে কারণেই হোক, কাঁকুলিয়া এলাকা এখনও সেই ঐতিহাসিক রাজরাজড়ার যুগেই পড়ে আছে। একে ঘোড়ার গাড়ি বলা উচিত নয়। এ তো অশ্বচালিত রথ!
কৃতান্তের শেষ অবধি ভালোই লাগল ব্যাপারটা। কথায় কথায় লোকে আপশোস করে বলে না–হ্যায় রে সেকাল? কৃতান্তবাবু কতবার বলেন কথাটা। অতএব, বৈকুণ্ঠবাবুর দেশে সত্যি সত্যি জলজ্যান্ত সেকাল যদি টিকেই থাকে, সে তো খাসা! আহা, সেকালে মানুষের নাকি কত আনন্দ, সুখসুবিধে ছিল! পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান, গামলা-গামলা দুধ! এই সে পরান গয়লার নর্দমার জল মেশানো দুধ নয়, হরিণঘাটায় বোতলের সর তুলে সাদা তরল পদার্থও নয়–খাঁটি দুধ।
আর ঘি? নির্ভেজাল প্রকৃত ঘৃত। কৃতান্তের নোলায় জল এসে গেল। হায় রে! কতকাল প্রকৃত ঘৃতপ লুচি আর খেতে পাওয়া যায় না। কৃতান্ত দীর্ঘশ্বাস না ফেলেও পারলেন না।
এবং মনে-মনে আনন্দে নেচেও উঠলেন। বৈকুণ্ঠের বাড়িতে প্রকৃত ঘৃতপক লুচির কথা ভেবেই।
এদিকে অশ্বচালিত রথে বসে রাজপুরুষটিও তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।
কৃতান্ত সৌজন্য দেখিয়ে করজোড়ে নমস্কার করলেন।
তখন রাজপুরুষ নমস্কার করে সংস্কৃত ভাষায় তাঁকে বললেন,–আর্য! ত্ব অভিনন্দতে কঃ ত্বাম্? কুত্র গচ্ছসি?
এই সেরেছে। কৃতান্তবাবু মুশকিলে পড়ে গেলেন। সেই পঞ্চাশ বছর আগে ম্যাট্রিকে সংস্কৃত পড়েছেন। তার কি মনে আছে কিছু? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ কৌমুদীখানা হাতের কাছে থাকলে বরং চেষ্টা করা যেত।
রাজপুরুষটি মনে হচ্ছে খুবই ভদ্র। মুখের হাসিটি দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু শাস্ত্রে আছে না? শৃঙ্গী প্রাণী আর অস্ত্রধারী মনুষ্য থেকে শতহস্ত দূরে থাকা উচিত। বলা যায় না, কখন কীসে মেজাজ চড়ে যায়।
কৃতান্তবাবু ঘাবড়ে গিয়ে–না, সংস্কৃত নয়–একেবারে ইংরেজিতে বলে ফেললেন, স্যার, আই অ্যাম কামিং ফ্রম ক্যালকাটা অ্যান্ড গোয়িং টু বৈকুণ্ঠবাবু হাউস। বাট স্যার, ভেরি হট ডে। ভেরি টায়ার্ড স্যার। ওল্ড ম্যান স্যার–
রাজপুরুষ হোহো করে হেসে ফেললেন। এবার বিশুদ্ধ বাংলায় তার মানে সাধুভাষায় বলে উঠলেন, বুঝিয়াছি মহাশয়! বুঝিতে পারিয়াছি। থাউক। ইংরাজি ভাষায় কথোপকথনের আবশ্যকতা নাই। আপনি স্বচ্ছন্দে বাংলা ভাষায় কথা কহিতে পারেন। তবে তার আগে আপনি আমার রথে আরোহন করুন। পশ্চাৎ যাহা কহিবার কহিবেন।
কৃতান্তবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এবং সাবধানে ময়ূরপঙ্খী রথের পেছনদিকের পাদানি দিয়ে অনেক কষ্টে চড়ে বসলেন। রাজপুরুষ তাঁর হাত ধরে পাশে বসিয়ে মৃদু হেসে ফের বললেন,–মনে হইতেছে আপনি ক্ষুধার্ত এবং যৎপরোনাস্তি ক্লান্ত। চিন্তা করিবেন না। আমার প্রাসাদে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া যথা ইচ্ছা গমন করিবেন।
কৃতান্ত খুশি হয়ে বললেন, আপনার প্রাসাদে আতিথ্যের আমন্ত্রণ আমি কি প্রত্যাখ্যান করতে পারি কি? হে ভদ্র! সেখান হইতে কাংকুলিয়া পল্লী কতদূর বলিতে পারেন কি?
কাঁকুলিয়া সাধুভাষায় কাংকুলিয়া হওয়াই উচিত বলে মনে করলেন কৃতান্ত। রাজপুরুষ তার কথা শুনে বললেন, কাংকুলিয়া? ওহো! বুঝিয়াছিকাংকালিয়ার কথা বলিতেছেন।
কৃতান্ত বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাংকালিয়াই বটে।
–কাংকালিয়া আমার পিতার রাজধানী। আপনি কাহার নিকট যাইবেন?
–আজ্ঞে বৈকুণ্ঠ। তিনি আমার সুহৃদ বটেন।
–বৈকুণ্ঠ। আহা বুঝিয়াছি। শ্ৰেষ্ঠীপ্রবর বৈকুণ্ঠের নাম এরাজ্যে কে না জানে– বলে রথের অশ্বকে কশাঘাত করলেন রাজপুরুষ।
রথ চলতে থাকল। ক্রমশ গতি বাড়ছিল। কিন্তু এতটুকু কঁকুনি নেই। অদ্ভুত রথ বানাতে পারে এরা ইতিহাসের দেশের লোকেরা। কৃতান্ত মনে-মনে তারিফ করছিলেন। কিন্তু বৈকুণ্ঠকে শ্রেষ্ঠীপ্রবর বলছেন কেন যুবরাজ? শ্ৰেষ্ঠী মানে তো বণিক বা ব্যবসায়ী। বৈকুণ্ঠ কি তাহলে এখন চুটিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছে?
দেখতে-দেখতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দিগন্তের সেই ধোঁয়াটে ব্যাপারটাতে অর্থাৎ গ্রামে এসে পড়ল। কিন্তু গ্রাম বলা কি ঠিক হচ্ছে? গাছপালার ফাঁকে সাদা-হলদে নীল, রংবেরঙের পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এ যে রীতিমতো শহর!
কিন্তু না–ইলেকট্রিক লাইন নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঘরবাড়িগুলোর গড়নও ছবিতে যেমনটি দেখা যায় তেমনি। আর ওই বুঝি রাজপ্রাসাদ! বিশাল তোরণ। সশস্ত্র প্রহরী। ওরে বাবা! কী পেন্নায় দানোর মতো ওদের চেহারা! মস্ত বল্লম কাঁধে। কোমরে চ্যাপ্টা খাঁড়ার মতো অদ্ভুত তরোয়াল ঝুলছে। মাথায় লোহার টুপি। ওদিকে উঁচুতে ফটকের মাথায় একদল প্রহরীর হাতে তীরধনুকও রয়েছে। ভুল করে শত্রু ভেবে তির ছুড়লেই হয়েছে! কৃতান্ত ভয়ে চোখ বুজলেন।
ফের যখন চোখ খুললেন, দেখলেন বিশাল এক প্রাঙ্গণে রথ ঢুকছে। প্রাঙ্গণে কত ফুলের গাছ, মর্মরমূর্তি, ফোয়ারা।
চওড়া মস্ত সিঁড়ি উঁচু, সোপান বলাই উচিত, তার ধারে রথ থামলে একদল পরিচারক আর সশস্ত্র প্রহরী এসে অভিবাদন জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
যুবরাজ কৃতান্তের একটা হাত ধরে বললেন, আর্য! গাত্রোত্থান করুন।
কৃতান্ত সাবধানে নামলেন।
সিঁড়ির ওপরদিকে চওড়া বারান্দার মতো জায়গায় বীণা বাজিয়ে কারা গান জুড়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। গানের ভাষা সংস্কৃত। মলোচ্ছাই! এত সংস্কৃতের মধ্যে বাংলা নিয়ে বিপদে পড়তে হবে যে! হিন্দি হলে ততটা অসুবিধে ছিল না। আজকালকার হিন্দি তো হ্যায়-ট্যায় এসব ক্রিয়াপদ বাদ দিলে খাঁটি সংস্কৃত। এদিকে বাংলার ক্রিয়াপদ বাদ দিলে তো স্রেফ ইংরিজি। এই যেমন আমি হাংগ্রি ফিল করছি!
কৃতান্ত সিঁড়িতে পা বাড়ালে বীণাবাদক আর বীণাবাদিকা মিলে জনা পনেরো পুরুষ ও স্ত্রীলোক দুধারে দাঁড়িয়ে গান করতে লাগল।
কৃতান্ত যুবরাজের পাশাপাশি সপ্রতিভ ভঙ্গিতে অর্থাৎ কিনা স্মার্ট হয়ে, রাষ্ট্রনেতারা যেভাবে গার্ড অফ অনার ভিজিট করেন, সেইভাবে উঠে গেলেন।
সামনে কারুকার্যময় সুদৃশ্য দরজার পরদা দুদিকে টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পরিচারিকা। আর ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন পরিচারক তার হাতে বিশাল রুপোর রেকাব, তার ওপর সোনার গেলাসে সম্ভবত সুশীতল শরবত-টরবত হবে। দেখামাত্র তৃষ্ণা বেড়ে গেল কৃতান্তবাবুর।
কিন্তু তারপরই থমকে দাঁড়ালেন।
সুশীতল পানীয় নিয়ে যে পরিচারক দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়– স্বয়ং নেপাল। সেই ন্যাপলা। বউমার আদরের নেপু। নেপু না বলে নেপো বলাই ভালো। যে নেপো দই মারে। কিন্তু অসম্ভব? একই চেহারার লোক তো থাকে। কৃতান্তবাবু হাত বাড়ালেন। প্রচণ্ড তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল।
কিন্তু শরবতের গেলাস নিতে গিয়ে দেখলেন, হা–এ ব্যাটা সেই ন্যাপলাই বটে, ফিক করে হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠল, কর্তাবাবু, ভালো আছেন।
অমনি ঝনঝন করে হাতের গেলাস মেঝেয় পড়ে গেল। যুবরাজ অবাক! পরিচারক, পরিচারিকারা অবাক। কৃতান্ত গর্জন করে বললেন, ন্যাপলা! তুই এখানে!
–আজ্ঞে হ্যাঁ কাবাবু।
কৃতান্ত রেগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,–গেট আউট। গেট আউট।
কাল রাত্তিরে চায়ের নামে শুকনো কচুরিপানার শেকড়সেদ্ধ জল ফুটিয়ে খাইয়েছিল। এখন এই কাংকালিকা রাজপ্রাসাদে শরবতের নামে নির্ঘাত নর্দমার জল এনেছে। স্বভাব যাবে কোথায়? আসল শরবতটুকু খেয়ে ফেলেছে ব্যাটা। এ ভেজাল মাল।
কৃতান্তের তাড়া খেয়ে যথারীতি নেপাল গ্রাহ্যই করল না। সে মুচকি হাসতে থাকল। যুবরাজ বললেন,–কী হল আর্য? খুলিয়া বলিবেন কি?
কৃতান্ত হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–এই দুবৃত্ত, দুর্জন ছোকরাকে এখনই বিদায় করুন যুবরাজ। এ ব্যাটা ভেজালরাজের গুপ্তচর।
অমনি যুবরাজ ফুঁসে উঠলেন, কী! ভেজালরাজের গুপ্তচর? আমার প্রাসাদে? সর্বনাশ! ভেজালরাজ ঝুনঝুনওয়ালা গুলঞ্চ প্রসাদ যে আমাদের শত্রু। এই কে আছে! ইহাকে বন্দি করো।
দুজন কালান্তক চেহারার প্রহরী এসে নেপালকে ধরে ফেলল। নেপাল তাও মুচকি মুচকি হাসে যে। কৃতান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন,–আবার হাসি হইতেছে? যুবরাজ! দেখিতে পাইতেছেন কি দুবৃর্ত্ত এখনও অম্লানবদনে হাসিতেছে?
যুবরাজ আরও রেগে হুকুম দিলেন, উহাকে এইখানেই বধ করো। এই মুহূর্তে দুবৃত্তের মস্তক ছেদন করো।
ওরে বাবা! সে বড় রক্তারক্তি কাণ্ড! এখানেই মুন্ডু কাটবে? কৃতান্ত ঘাবড়ে গেলেন। চোখ বুজে ফেললেন। নেপালটা কী গাড়োল! কেন এখনও ক্ষমা চাইছে।? দেখো দিকি, কী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতখানি হবে, ভাবতে পারেননি কৃতান্ত।
হঠাৎ তাঁর কানে এলা বউমারই গলা, তাতে কোনও ভুল নেই। কী হইল? কী হইয়াছে? আমার নেপু কী অপরাধ করিয়াছে শুনি?
চোখ খুলেই কৃতান্ত দেখতে পেলেন। বড়বউমাই বটে। কিন্তু এ কী বেশ! এ যে একেবারে রাজ্ঞীর পোশাক পরনে! মাথায় সোনার মুকুট পর্যন্ত। এসে যুবরাজের সামনে হাত-মুখ নেড়ে ফের বলে উঠল, নেপু আমার পিতার দেশের ভৃত্য। উহার মস্তক ছেদন করিলে আমি পিত্রালয়ে যাত্রা করিব, বলিয়া দিতেছি –হ্যা!
যুবরাজ বললেন, কিন্তু ও যে ভেজালরাজের গুপ্তচর।
বউমা বলিল,-হাতি! ঘোড়া! তোমার শ্রেষ্ঠীরাই ভেজালরাজের গুপ্তচর!
যুবরাজ্ঞীবেশিনী বউমা আবার বলল, এই তো আমি পাকশালা হইতে আসিতেছি। শ্ৰেষ্ঠীর বিপণী হইতে যে ঘৃত পাঠানো হইয়াছে, উহা ঘৃত নহে, অন্য কোনও বস্তু।
বন্দি নেপাল বলল, ডালডাও নহে। জলহস্তীর চর্বি।
যুবরাজ গর্জন করে বললেন, কে আছো? শ্ৰেষ্ঠীকে বন্দি করিয়া লইয়া আইস।
এবার যুবরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃতান্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন।
–প্রতুল! তুই।
–হ্যাঁ পিতা।
–ওরে হতভাগা। এতক্ষণ কহিস নাই কেন? আমি যে তোকে চিনিতে পারি নাই!
বড়ছেলে আর বড়বউমা ঢিপ করে একসঙ্গে কৃতান্তের পায়ে প্রণাম করতেই সব রাগ জল হয়ে গেল কৃতান্তের। আশীর্বাদ করে বললেন–সুখমস্তু! চিরজীবি হও!
তারপর নেপালও প্রহরীদের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে তাঁর পায়ে একটি প্রণাম ঠুকে বলল,–অপরাধ লইবেন না কর্তামশায়! আসুন, আপনাকে উৎকৃষ্ট চা পান করাইতেছি।
এই সময় বাইরে ভেরি, তুরি, কাড়াকাড়া বেজে উঠল। একজন দৌবারিক ঘরে ঢুকে প্রণাম করে বলল, মহারাজ! আপনি ফিরিয়া আসিয়াছেন শুনিয়া কাংকালিকার প্রজাবৃন্দ আপনার দর্শনপ্রার্থী।
কৃতান্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ছ্যা-হ্যাঁ, এই ধুলোময়লা নোংরা পাঞ্জাবি-ধুতি পরে কি প্রজাদের দর্শন দেওয়া যায়? কাঁধের ঝোলাটা ফেলে দিয়ে বললেন,–কে আছো? আমাকে উৎকৃষ্ট রাজবেশ পরাইয়া দাও।
সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড রেকাবে রাজবেশ নিয়ে পরিচারকবৃন্দ এসে দাঁড়াল। নেপাল একগাল হেসে বলল, আমি মহারাজের মস্তকে মুকুট পরাইব।
ইচ্ছে হয়েছে তো পরাক না। নেপাল ছেলেটা তো এমনিতে খারাপ নয়। বড় মধুর মিষ্টি স্বভাব। আসলে ভেজালরাজের চেলারা জিনিসিপত্রে ভেজাল দিলে ও বেচারা করবে কী?
বাইরে তুমুল বাদ্য বাজছে। প্রজারা জয়ধ্বনি দিচ্ছে। নেপাল কৃতান্তের মাথায় মুকুট পরিয়ে বলল,-এবার সুশীতল জল আনয়ন করি মহারাজ। আপনি তৃষ্ণার্ত।
দেরি হল না। নেপালচন্দ্র জলভরা সোনার গেলাস রূপোর রেকাবে রেখে সামনে তুলে ধরল। কৃতান্ত তৃষ্ণার্ত। হাত বাড়ালেন। হাতটা হঠাৎ বড় ভারী লাগছে। হা, লাগবেই তো। সোনা হীরে মানিক বসানো রাজপপাশাক। ওজন আছে।
বাইরে প্রজার মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি দিচ্ছে–জয় মহারাজ কৃতান্তদেব। তুরি, ভেরি কাড়ানাকাড়া বাজছে। তারপর কী একটা ঘটল। ঠিক বুঝতে পারলেন না কৃতান্ত। কিন্তু গুরুতর কিছু নিশ্চয় ঘটল।
কারণ কৃতান্তবাবুর মনে হল আচমকা বুঝি আছাড় খেয়েছেন। খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
কোথায় কী! কোথায় কাংকালিকা রাজপ্রাসাদ। কোথায় রাজপোশাক, ন্যাপলা, প্রতুল, বউমা, পরিচারক-পরিচারিকা, বীণা বাদক-বাদিকা, গায়ক-গায়িকা! কোথায় বা পেন্নায় চেহারা কালান্তক প্রহরীরা!
তবে ধুধু রোদ্দুরে নয়, ছায়াতেই শুয়ে আছেন। গাছটা বটগাছ। ডালে অজস্র পাখি লাল টুকটুকে বটফল ঠোকরাচ্ছে।
আর হ্যাঁ, আকাশের নিচু দিয়েই একটা এরোপ্লেন যাচ্ছে। তুরি ভেরি কাড়ানাকাড়া নয়। নিছক এরোপ্লেন।
আর কৃতান্তের পরনে ধূলিধূসর সেই পাঞ্জাবি-ধুতি, পায়ের পাম-শুজোড়া ব্যাগের তলায় রাখা আছে। ব্যাগটা দিব্যি বালিশ করে বটতলার শুকনো ঘাসে শুয়ে আছেন।
.
তাহলে নিছক স্বপ্নই দেখছিলেন।
দুঃখে ও রাগে মন খারাপ হয়ে গেল সঙ্গেসঙ্গে। কোনও মানে হয়? কৃতান্ত উঠে বসে হাই তুললেন। পাকারাস্তাটা দূরে দেখা যাচ্ছে। হু-হুঁ রোদ্দুরে কাঁচের মতো ঝকঝক করছে।
তাহলে কাঁচারাস্তায় আনমনে হাঁটতে-হাঁটতে কখন এই বটতলায় পৌঁছে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু তেষ্টায় গলা কাঠ। এখনই জল খাওয়া দরকার। কৃতান্ত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন, বটগাছেরই ডালে কে যেন বসে আছেন। আঁতকে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে! কালো কুচকুচে একটা লোক এখানে বসে কী করছে?
ভূতপ্রেত নয় তো? কিছু বলা যায় না। বৈকুণ্ঠের এই দেশে সব সম্ভব। কাঁপা কাঁপা গলায় কৃতান্ত বললেন,–কে? কে ওখানে?
ভূত অথবা লোকটা ঘুরে বসল। কালো মুখে সাদা দাঁত ঝকমক করছে। হাসছে, না ভয় দেখাচ্ছে?
কৃতান্ত ভয় পেয়েছেন বলেই ধমক দিতে পারলেন, দাঁত বের করছ কেন বাবা? আঁ? হনুমানের মতো ডালেই বা বসে আছো কেন শুনি?
না, ভূত নয়। নাকিস্বরে কথা বলল না। লোকটা বলল, আজ্ঞে, পাকা বটফল পাড়ছি।
–বটফল? খায় বুঝি?
–আজ্ঞে, পাখপাখালিতে খায়; আমি একটা পাখি পুষেছি কিনা। তার জন্যে বটফল পাড়ছি।
–তা কেশ করছ। এখানে জল আছে কোথায় বলতে পারো?
জল? এই যে এখানে একটা দিঘি আছে।লোকটা কথা বলতে-বলতে নেমে এল গাছ থেকে। এসে করজোড়ে প্রণামও করল–
–আপনি শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন দেখলুম। তা কোত্থেকে আসছেন বাবুমশাই? কোথায় যাবেন?
–কলকাতা থেকে। যাব কাকুলিয়া।
–কাকুলে? সে তো এখনও দু-মাইলটাক পথ বাবুমশাই।
–বলো কী হে। তা এ জায়গাটার নাম কী?
–বাজে-কাঁকুলে আজ্ঞে।
–বাজে কাকুলে! সে আবার কী হে?
–আজ্ঞে বাবুমশাই, শুনেছি কোন আমলে নাকি এখানেই আসল গেরামটা ছিল। এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। লোকে বলে বাজে কাঁকুলে।
কৃতান্ত উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমার বাড়ি কোথায়।
লোকটা জবাব দিল, আমার বাড়ি আজ্ঞে কঁকুলের পাশে আঁদুলে।
কী অদ্ভুত নাম সব। কঁকুলে-আঁদুলে। পুঁদুলে নামেও হয়তো গ্রাম আছে, বলা যায় না। কৃতান্ত মনে-মনে হেসে বললেন,–ওহে! আমাকে দিঘিটা দেখিয়ে দিয়ে এসো তো!
অমনি লোকটা হাতজোড় করে বলল, ক্ষমা করবেন বাবুমশাই! আমি যেতে পারব না। ওই তো দেখা যাচ্ছে উঁচু পাড়আপনি চলে যান। খুব ভালো জল আছে। টলটলে কালো জল। ঘাটও পাবেন।
কৃতান্ত একটু অবাক হয়ে বললেন,–কেন যেতে পারবে না?
লোকটা জবাব না দিয়ে আবার বটগাছে গিয়ে উঠল। অদ্ভুত লোক তো! বৈকুণ্ঠের দেশের লোক কিনা। এমনিই তো হবে। মনেমনে গজগজ করতে করতে কৃতান্তবাবু দিঘির পাড় লক্ষ করে এগিয়ে চললেন।
ক্ষয়াখবুটে ঝোঁপঝাড় গাছপালার জঙ্গল পেরিয়ে পাড়ে উঠে দেখলেন, প্রচুর ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর তার আগাছা গজিয়ে রয়েছে। ঘাটটাও পাথরে বাঁধানো। ধাপগুলো ভাঙাচোরা। শ্যাওলা জমে আছে। বিশাল দিঘিটা দামে ভর্তি। তাহলে কি এখানে ঐতিহাসিক যুগে এক সময় সত্যি-সত্যি রাজপ্রাসাদ ছিল?
সে পরে হবে। আপাতত জলতেষ্টা মেটানো যাক। সত্যি, জলটা যাকে বলে কাজলবৰ্ণ। স্বচ্ছ। আঁজলায় জল তুলে প্রাণভরে পান করলেন কৃতান্ত। সূর্য এখন একটু ঢলেছে। হাত-ঘড়িতে বেলা দেড়টা বাজে।
জল খেয়ে মুখ কাঁধ-হাত-পা রগড়ে ধুলেন কৃতান্ত। আঃ কী আরাম। বরং আরও কিছুক্ষণ ওই বটতলায় বিশ্রাম করে রোদের তেজ কমলে বৈকুণ্ঠের গ্রামের দিকে রওনা হবেন।
আরামে নিশ্বাস ফেলে কৃতান্ত ঘুরে সিঁড়ির ধারে পা ফেলেছেন, সেই সময় ধুপধাপ শব্দ হল সিঁড়ির ওপর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন কৃতান্ত।
রাত হলে কিছু বলার ছিল না। এ যে একেবারে দিনদুপুর! উজ্জ্বল রোদ্দুর।
তাছাড়া তখন না হয় ঘুমোচ্ছিলেন বটতলায়, তাই স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এখন? এখন তো স্বপ্ন নয়। তাহলে?
ঘাটের মাথায় সার-সার দাঁড়িয়ে আছে তিন-তিনটে কঙ্কাল।
হ্যাঁ, পুরোদস্তুর কঙ্কাল।
তারপর তারা চেরা-গলায় অমানুষিক চেঁচিয়ে উঠল,–পেয়েছি! পেঁয়েছি! পেয়েছি!
তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কৃতান্তের ওপর।
কৃতান্ত টের পেলেন তাকে অসম্ভব ঠান্ডা হাড়ের হাতে চ্যাংদোলা করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনবরত খটখটখটাখট শব্দও শোনা যাচ্ছে।
না–অজ্ঞান হলেন না। অজ্ঞান হওয়ার অভ্যাস নেই কৃতান্তের। ভয় পেলে মানুষের অজ্ঞান হওয়া স্বাভাবিক। কৃতান্ত ভয় পেয়েছেন বললে ভুল বলা হবে। কারণ, এ ব্যাপারটাও চরম মুহূর্তে স্বপ্ন বলে মেনে নিয়েছেন। এবং স্বপ্নে মুভুই কাটা যাক, আর ভূতেই ঘাড় মটকাক, ক্ষতি কী?
বরং এই গরমে ঠান্ডা হাড়ের ছোঁয়ায় আরামই লাগল। কৃতান্ত চোখ বুজে থাকলেন। দেখা যাক্ না স্বপ্নটা শেষ অবধি কোথায় দাঁড়ায়।…
কিন্তু একি সত্যি-সত্যি স্বপ্ন?
কঙ্কালগুলো কৃতান্তবাবুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা ঘরে ঢুকল। তারপর দুম করে ফেলে দিতেই আছাড় খেলেন কৃতান্ত এবং ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন। অতএব এটা স্বপ্ন নয়।
আছাড় খেলেই তো স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কথা। এতকাল কত ভীষণ সব স্বপ্ন দেখেছেন এবং আছাড়ও খেয়েছেন। তারপর দেখেছেন খাটের নিচে পড়ে গেছেন। ঘুমও ভেঙেছে।
এটা স্বপ্ন নয়। আসলে বৈকুণ্ঠবাবুর কাকুলিয়া গ্রামের ব্যাপারটাই এমনি বিদঘুঁটে। এ এক সৃষ্টিছাড়া দেশ।
কৃতান্ত আছাড় খেয়ে ব্যথায় কাতরে উঠলে কে নাকিস্বরে বলল, লাগল নাকি ভঁয়া?
ঘরের দেয়াল ভাঙা, ছাদও ফাটলধরা। তার ফাঁকে যেটুকু আলো আছে তাতেই কৃতান্ত অবাক হয়ে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা কঙ্কাল।
কঙ্কালের মুখে ভঁয়া বলা সহ্য করা যায় না। কৃতান্ত দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন,–থাক, আর সিমপ্যাথি দেখাতে হবে না। কে হে তুমি? এমন করে এদের পাঠিয়ে আমাকে জবরদস্তি ধরে আনলে। একি মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি?
কঙ্কালটা হিহি করে হেসে উঠল। তারপর বলল,–সে কি ভয়া! আঁমায় চিনতে পারছ না? আঁমি বৈকুণ্ঠ।
অ্যাঁ! বলে কী ব্যাটাচ্ছেলে ভূত! বৈকুণ্ঠ এখনও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন। ভাগ্নেকে গিয়ে এগ্রিকালচার ফার্ম খুলেছেন। কৃতান্ত হাত তুলে বললেন,-থাপ্পড় মারব বলে দিচ্ছি। ইয়ার্কির জায়গা পাওনি?
কঙ্কাল আবার হিহি করে হেসে উঠল। বলল,-মাইরি কেঁতো, তোমার দিব্যি। আঁমি তোমার বন্ধু সেঁই বোঁকা!
কৃতান্ত গোঁ ধরে বললেন,–মুখে বললে তো চলবে না। প্রমাণ চাই।
এদিকে যে তিনটে কঙ্কাল কৃতান্তবাবুকে ধরে এনেছে, তারা এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। এবার তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল,–ওঁরে বাবা, ঐ যে প্রমাণ চাইছে।
আরেকজন বলল,–তাঁহলে তোঁ মুশকিল বেঁধে গেঁল রে!
তৃতীয়জন বলল, কিঁচ্ছু নাঁ রেঁ! আঁয় আঁমরা এঁর মাঁথায় গাঁট্টা মারি। তাঁহলে প্ৰঁমাণ চাঁইবে না।
বৈকুণ্ঠবাবুর পরিচয় দিচ্ছিল যে কঙ্কালটা, সে বলল,–ওঁহে এবাঁর মাঁথা বাঁচাও! বলে সে হাড়ের হাতে তালি বাজিয়ে হিহি করে হাসতে লাগল।
তারপরই ভীষণ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। কৃতান্তবাবু বুড়োমানুষ হলে কী হবে? এখনও গায়ে জোর আছে। যৌবনে দস্তুরমতো ডনবৈঠক ভাঁজতেন। ফুটবলও খেলতেন। বক্সিং, জুডো এসবেও অল্পস্বল্প হাত ছিল। ওরা হাড়ের হাতে গাঁট্টা মারতে আসার সঙ্গেসঙ্গে এক প্যাঁচে সবাইকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। একজন তো উঁ হু হু করে ককিয়ে উঠল।
তারপর কৃতান্ত ধুন্ধুমার যুদ্ধ বাধিয়ে ফেললেন। স্রেফ ঘুসির চোটে কঙ্কালগুলোকে কোণঠাসা করে দিলেন। এমন আজব বক্সিং ক্যাসিয়াস ক্লে ওরফে মহম্মদ আলির লড়ারও সাধ্য ছিল না।
হ্যাঁ, খটখটে হাড়ে ঘুষি মারলে হাত ব্যথা তো করবেই। তাই বলে কৃতান্তবাবু দমবার পাত্র নন।
দেখা গেল, ভূত বা কঙ্কালগুলো বক্সিংয়ে একেবারে আনাড়ি। ওদের রাজ্যে বক্সিং নেই সম্ভবত। কাতুকুতু আছে। ঘাড় মটকানো আছে। চোখে আঙুল দেওয়া আছে। বক্সিং নেই। অবশ্য একটু-আধটু জুডো থাকলেও থাকতে পারে।
ঘুসির চোটে শেষ অবধি জানালা-দরজা গলিয়ে চারটে কঙ্কালই পালিয়ে গেল। তারপর হাত ব্যথা করতে থাকল কৃতান্তের।
তা করুক। ভূতের সঙ্গে লড়াইতে জিতেছেন। এই গর্বে বুক ফুলিয়ে বেরুলেন।
বেরিয়ে দেখেন দিঘির ঘাটের কাছে সেই বটগাছের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সে আগের মতো দাঁত বের করে হাসল।
কৃতান্ত তার কাছে গিয়ে বললেন,–হাসি কীসের? আঁ? তখন খুব তত দিঘি দেখিয়ে দিয়েই হনুমানের মতো গাছে চড়ে বসলে। ব্যাপার কী?
লোকটা চাপাগলায় এবং চোখ নাচিয়ে বলল, ওনাদের দেখা পেলেন নাকি বাবুমশাই!…ওনাদের ভয়েই তো আমি আসিনি।
–এখন এলে যে?
–আজ্ঞে, পরে ভেবে দেখলুম আপনি বিদেশি মানুষ। একা কোনও বিপদে পড়লেন নাকি। তাই এলুম। তা বাবুমশাই, ওনারা কেউ আসেনি?
কৃতান্ত ফের ঘাটে হাত ধুতে নামছিলেন। ছ্যাঃ, কঙ্কালের গায়ের ছোঁয়া লেগেছে, স্নান করতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু বিদেশ-বিভূঁয়ে পুকুরের জলে স্নানের অভ্যাস নেই। ঠান্ডা লেগে অসুখ-বিসুখ হতে পারে। তাই হাতদুটো রগড়ে বোবেন!
হাত ধুতে ধুতে কৃতান্ত লোকটার কথার জবাব দিলেন। ব্যাটারা এসেছিল হে। বুঝেছ? এলে কী হবে? হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছি।
লোকটা খুশি হয়ে বলল, ভালো করেছেন আজ্ঞে। খুব ভালো করেছেন।
কৃতান্ত এত কাণ্ডের মধ্যেও কাঁধের ব্যাগ কিন্তু ফেলেননি। তার ভেতর থেকে তোয়ালে বের করে হাত মুছে বললেন,–যাকগে। তোমার বাড়ি তো বৈকুণ্ঠবাবুদের পাশের গায়ে বলছিলে। চলো তো আমায় রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
–কী বললেন বাবু?
–বৈকুণ্ঠবাবু। কাকুলিয়ার বৈকুণ্ঠ তলাপাত্রের নাম শোনোনি?
লোকটা চোখ কপালে তুলে বলল,–বৈকুণ্ঠবাবু? মানে কাঁকুলের বোকা বাবুর কাছে যাবেন? ও বাবুমশাই, উনি যে গতকাল মারা গেলেন!
–অ্যাঁ! মারা গেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওনার ভাগ্নেবাবুরা কাল সন্ধেবেলা ওই শ্মশানে ওনাকে পুড়িয়ে গেলেন যে! বলে লোকটা দিঘির অন্যপাড়ে একটা ঝোঁপ ঝাড় ও শিমূলগাছের দিকে আঙুল তুলল।ওই যে দেখছেন, ওটাই শ্মশান।
কৃতান্তবাবু আস্তে-আস্তে ঘাটে বসে পড়লেন। তাহলে সত্যিসত্যি বৈকুণ্ঠের আত্মা বা ভূত কঙ্কালের রূপ ধরে দেখা দিয়েছিল তখন। তিনি প্রমাণ চেয়ে বসে খামোকা ঝামেলা বাধালেন।
আহা, বেচারা বৈকুণ্ঠকেও এন্তার ঘুসি মেরেছেন। না জানি কত ব্যথা সে পেয়েছে। বন্ধুর শোকে এবং তার ভূতের ব্যথা পাওয়ার দুঃখেও বটে, কৃতান্তবাবু কেঁদে ফেললেন, ওরে বোকা রে। তোকে খামোকা কেন অত ঘুসি মারলুম রে।…
লোকটা সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, আহা! কাঁদবেন না বাবুমশাই। আমারও কান্না পাচ্ছে যে। কাকেও কাঁদতে দেখলে আমারও কান্না পায়।
তারপর সে-ও বিকট ভ্যাঁ করে উঠল।
সঙ্গে-সঙ্গে কৃতান্তবাবু উঠে থাপ্পড় তুলে তার গালে মারলেন।–আমার বন্ধুর মরেছে এবং ভূত হয়েছে আমি কাঁদতে পারি। তাই বলে তুই ব্যাটা কঁদবার কে?
কিন্তু থাপ্পড় মেরেই দেখলেন–এতক্ষণে দেখলেন যে যাকে থাপ্পড় মেরেছেন, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং নেপাল। তার বউমার আদরের চাকর নেপু।
ব্যাপারটা কী—
.
ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়।
থাপ্পড় সত্যি তিনি নেপালচন্দ্রকেই মেরেছেন। তবে সেটা ওর গায়ে লাগেনি। লেগেছে চায়ের কাপে এবং কাপটা উল্টে গেছে। ঝনঝন শব্দ হয়েছে। বড়বউমা দৌড়ে এসেছে। নাতি-নাতনিরাও এসে পড়েছে।
নেপাল বলল,-দিলেন তো চা-টা ফেলে। অত ভালো চা সেই নিউমার্কেট থেকে খুঁজে আনলুম আপনার জন্যে। কাল সন্ধেবেলা বাজে চা খেয়ে বকাবকি করলেন বলে তক্ষুনি দৌড়েছিলুম নিউমার্কেটে। ভেবেছিলুম সকালবেলা কর্তাবাবুকে যদি ফাস্টকেলাস চা না খাওয়াতে পারি তো আমার নাম নেপালই নয়।
কৃতান্তবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
হ্যাঁ, নিজের ঘরের খাটেই সব কিছু ঘটেছে। তবে আগে এখনই টেবিলে রাখা চিরকুটটা হাতসাফাই করা দরকার। সেই যে লেখা আছে? আমাকে বৃথা খুঁজিও না। পাইবে না। রাতে মনের দুঃখে লিখে রেখেছিলেন। ভোরবেলা কেউ ওঠার আগে কেটে পড়ার মতলব করে শুয়ে পড়েছিলেন। তারপর কত কী ঘটেছে। স্বপ্ন ভেবেছিলেন, কিংবা স্বপ্ন নয় তাও-ভেবেছিলেন এ সবই স্বপ্নের মধ্যে ভাবা।
চিরকুটটা মুঠোয় লুকিয়ে ফেলে কৃতান্ত ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। বললেন, কী সব স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে হাত ছুঁড়ে চায়ের কাপ ফেলে দিয়েছি। বুঝলে বউমা?
বউমা হাসি চেপে চলে গেল। নাতি-নাতনিরা বলল, কী স্বপ্ন? কী স্বপ্ন দাদুভাই?
কৃতান্ত বললেন, শুধু কি স্বপ্ন? স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন। তার ভেতর স্বপ্ন। আয়নার ভেতর আয়না। তার ভেতর যেমন আয়না। বুঝলে তো?
এই সময় বাইরের ঘরে কে চড়া গলায় বলল,–কেতোভায়া, আছো নাকি?
কৃতান্ত আশ্বস্ত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, এসো, এসো বৈকুণ্ঠ এসো। আজ রাত্রে কী হয়েছে শোনো। অদ্ভুত সব স্বপ্ন
বৈকুণ্ঠ ঘরে ঢুকে বললেন,–পরে শুনব ওসব। কই, তুমি তো গেলে না। সন্ধেবেলা কলকাতা এসেছি। এসেই ঠিক করেছিলুম সকালে তোমার বাসায় আসব। তা এত বেলা অবধি শুয়ে থাকো আজকাল? বাতে ধরবে যে।
কৃতান্ত হাসতে-হাসতে বললেন, আরে আগে স্বপ্নটাই শোনো না। দেখলুম, তুমি মারা গেছ আর
বৈকুণ্ঠবাবু হোহো করে হেসে বললেন,–এ তো আমার পক্ষে সুস্বপ্ন। কারুর মারা যাওয়ার স্বপ্ন দেখা মানেই তার আয়ু বাড়ল।
কৃতান্ত যতের মুঠো দেখছিলেন। কিন্তু ব্যথা করছে যে? স্বপ্নে ঘুসি মারলে তো ব্যথা লাগা উচিত নয়।
অবশ্য নেপালের চায়ের কাপে হাত ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু তাতে ব্যথা হওয়ার কথাই ওঠে না। তাহলে?
কৃতান্তবাবু উদ্বিগ্ন হলেন। এবার যা দেখছেন, এও আগের স্বপ্নের মধ্যে আরেকটা স্বপ্ন নয় তো? যেমন আয়নার ভেতর আয়না, তার ভেতর আবার আয়না।
বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, কী হল ভায়া? হাতে কী হল? ব্যথা নাকি? চলো, আমার সঙ্গে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো। আমাদের কাকুলিয়ায় ভালো কবরেজ আছেন। চিন্তা নেই।
কৃতান্ত নিস্তেজ ভঙ্গিতে বললেন,–ও কিছু না।
তারপর আবার দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। এও যদি স্বপ্ন হয়?
হুঁ, এটা যে স্বপ্ন নয়, তার প্রমাণ কী? আগের স্বপ্নে এই বৈকুণ্ঠের ভূত ঠিক কথাই তো বলেছিল। প্রমাণ ব্যাপারটা সত্যি বড় কঠিন। বিশেষ করে নেপাল এইমাত্র যে ভালো চা এনে দিলে দুকাপ, তা সত্যি অপূর্ব বলেই ধাঁধা ঘুচছে না। নেপালের চা তো এত ভালো হয় না।
ও বেশি দামের চা এনেছে বলে আনে কম দামের। পয়সা মারে। তাই এমন ভালো চা যে খাওয়াবে, তা অবিশ্বাস্যই বলা যায়।
কৃতান্ত চা খেতে-খেতে বললেন, আচ্ছা বৈকুণ্ঠ, তোমাদের কাঁকুলিয়াকে কি লোকে কাকুলে বলে?
বৈকুণ্ঠ বললেন, হ্যাঁ। তুমি কেমন করে জানলে?
–আচ্ছা, একটা বাজেকাঁকুলেও আছে কি?
–আছে। জঙ্গলমতো একটা জায়গা
–সেখানে একটা দিঘি আছে। ভাঙা পাথুরে ঘাট আছে। দক্ষিণ পাড়ে শ্মশান আছে। পুবপাড়ে ভাঙা ঘরবাড়ি আছে। তাই না?
বৈকুণ্ঠ অবাক হয়ে বললেন, সব ঠিক। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে?
কৃতান্ত আরও উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কাঁচারাস্তার মোড়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে।
–আছে বইকী। খুব পুরোনো আমলের বটগাছ। পাঁচশো বছর–
–তোমাদের কঁকুলের পাশে আঁদুল নামে একটা গ্রাম আছে?
–হুঁ, আছে। কিন্তু তুমি–
কৃতান্ত সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন,–দেখো বৈকুণ্ঠ, আমার মনে হচ্ছে, কোনও গোলমেলে ধাঁধায় আটকে গেছি। স্বপ্নের গোলকধাঁধা বলতে পারো। কিংবা এমনও হতে পারে, আমি আর বেঁচে নেই। পরলোকে চলে এসেছি।
বৈকুণ্ঠ হোহো করে হেসে বললেন,–মাথা খারাপ! কী সব আবোল-তাবোল বলছ!
–তাহলে আমায় একটা চিমটি কাটো তো।
বৈকুণ্ঠ বললেন, নাঃ! আমার আঙুলে জোর নেই। তবে কাতুকুতু দিতে পারি। দেব নাকি!
–তাই দাও দিকি ভায়া।
বৈকুণ্ঠের কাতুকুতু খেয়ে কৃতান্ত হিহি করে হেসে আকুল হলেন। নাঃ আর স্বপ্ন নয়। নিশ্চয়ই নয়। তাহলে ঘুম ভেঙে যেত।
কিন্তু স্বপ্নে সত্যিকার একটা জায়গা দেখলেন–এর রহস্য কী? হঠাৎ চোখ গেল বালিশের পাশে রাখা বইটার দিকে। তক্ষুনি বুঝলেন কী ঘটেছে। সব মনে পড়ল। কৃতান্তবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে নড়েচড়ে বসলেন। বাপস! জোর বাঁচা গেল।
বুঝলেন বৈকুণ্ঠও। তিনিই বইটা তুলে নিয়ে দেখে বললেন,–তাই বলো। ওমালি সায়েবের পুরোনো জেলা গেজেটিয়ার পড়ছিলে রাত্রে?–এই যেআমাদের এলাকার ঐতিহাসিক বিবরণও আছে দেখছি। পাতা মুড়ে রেখেছ। বুঝলে ভাই কেতো? কঁকুলে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জায়গা। গুপ্তযুগে একসময় এক রাজার রাজত্ব ছিল। তার প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে। পাঁচশো বছরের অক্ষয় বটগাছ আছে। কত কী আছে। দিঘির ধারে শ্মশানটারই বয়স দুশো বছর হয়ে গেল।
কেংকেলাস
গদাধরবাবু বললেন, আমার ধানবাদের পিসিমাকে তো তোমরা দেখেছ। পিসিমার খুড়শ্বশুরের নাতির নাম ছিল অশ্বিনী। অশ্বিনীর সম্বন্ধীয় মাসতুতো দাদা হল গিয়ে নগেন। নগেনের মেজকাকার বড় ছেলে নিবারণ। নিবারণের শ্যালক হরেনের ছেলের নাম সত্যেন। সত্যেনের ভগ্নিপতির পিসতুতো ভাইয়ের…
সাতকড়ি গোঁসাই খেপে গিয়ে বললেন,–মলো ছাই! হলটা কী, তা বলবে না। খালি কার পিসি, কার দাদা, কার শ্যালক!
রমণী মুখুয্যে বললেন,–আহা! বলতে দাও, বাধা দিচ্ছ কেন? খোলাখুলি পরিচয় না দিলে বুঝবে কেন তোমরা? বলল হে গদাইভায়া, বলো।
গদাধর কিন্তু গোঁসাইয়ের ওপর চটেছেন বাধা পড়েছে বলে। বাঁকামুখে বললেন, আর বলব না।
অমনি হইচই উঠল আড্ডায়। রমণীবাবু, বটকুবাবু, বংশীলোচনবাবু একসঙ্গে বলে উঠলেন, বলো, বলল। আমরা শুনব।
একঘরে হয়ে যাচ্ছেন টের পেয়ে অগত্যা গোঁসাইও মিনমিনে গলায় বললেন,–আহা! গল্পের রস বলে একটা কথা আছে তো! তাই বলছিলাম, শর্টকাটে এলে রসটা জমে ভালো। গদাই, কিছু মনে কোরো না ভায়া। নাও, শুরু করো।
তখন গদাধর তার উল্লেখযোগ্য আরামকেদারায় একটু চিতিয়ে চোখ বুজে হঠাৎ বললেন,-কেংকেলাস!
আড্ডার সবাই থ। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন পরস্পর। তারপর বটুকবাবুই প্রশ্ন করলেন, কী বললে?
–কেংকেলাস!
রমণীবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, তার মানেটা তো বুঝতে পারলাম না গদাই! হঠাৎ কেং কৈলাস-টৈলাস…এর মানে?
গদাধর গম্ভীরমুখে বললেন,–কেংকৈলাস নয়, কেংকেলাস। গোঁসাই ওঁর দিকে ঝুঁকে বললেন,–কেংকেলাসটা কী শুনি?
গদাধর তেতোমুখে বললেন, তোমাদের মাথায় তো খালি গোবর পোরা। সহজে কিছু বোঝানো যাবে না। যার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কেংকেলাসের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তারই মারফত।
বংশীলোচনবাবু রাশভারী মানুষ। জমিদারি ছিল তার বাবার আমলে। এখনও সেই আমলের পাদানিওয়ালা কালো কুচকুচে ফোর্ড গাড়িটা আছে। সেটা হাঁকিয়েই এই আড্ডায় আসেন। তাকে সবাই খুব খাতির করেন। তিনি বললেন,–মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। শুরু করে গদাইভায়া।
গদাধর উৎসাহিত হয়ে বললেন, রহস্যময় মানে? রীতিমতো মিসট্রিয়াস। এই দেখো না! লোমগুলো কেমন সূচের মতো হয়ে গেল! দেখো, দেখো।
গোঁসাই বললেন, হ্যাঁ, ক্ষান্তপিসি অনায়াসে কথা সেলাই করতে পারবে। বলল, বলে যাও!
গদাধর ফের চটতে গিয়ে হেসে ফেললেন। বললেন, তুমি তো বরাবর অবিশ্বাসী। ভূত-ভগবান কি মানো না। তবে কেংকেলাসের পাল্লায় পড়লে ঠ্যালাটা বিলক্ষণ টের পেতে। যাকগে, তোমাকে কিছু বোঝানো বৃথা।
বলে একটিপ নস্যি নিয়ে বিকট একটা হচ্চো করে রুমালে নাক মোছর পর গদাধর বকসী শুরু করলেন।
–হ্যাঁ, কদ্দুর বলেছিলাম যেন? সেই সত্যেনের ভগ্নিপতির পিসতুতে ভাইয়ের নাম ছিল ভূতনাথ। এই ভূতনাথ বড় ডানপিটে সাহসী ছেলে ছিল। আর তখন আমার বয়স কম। আমার গায়েও তখন একটা খুদে পালোয়নের জোর। দুজনেই ক্লাস টেনের ছাত্র–তখন বলা হতো ফার্স্ট ক্লাস। তো সেবারে পুজোর ছুটিতে বেড়াতে গেছি ধানবাদ। ভূতনাথ আর আমি দিনরাত টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি এখানে-সেখানে। ওদিকে তো খালি খনি আর খনি। মাটির তলায় টন টন কয়লার চাঙড়। সেইসব কয়লা তোলা হচ্ছে সুড়ঙ্গ কেটে। আমি নতুন গেছি বলে ভূতনাথ ঘুরে-ঘুরে সব দেখাচ্ছে। ওর অনেক আত্মীয় খনিতে চাকরি করেন। তাই একেবারে খনির ভেতরে–মানে পাতালপুরীতে গিয়ে সব দেখছি-টেখছি। এইসময় একদিন হঠাৎ ভূতনাথ বলল,–গদাই, এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে সিন্দ্রির ওদিকে মাঠের মধ্যে একটা পোড়োখনি আছে, যাবে সেখানে? আমি উৎসাহে চনমন করে উঠলাম। পোড়ো-বাড়ির মতো পোড়োখনিও যে থাকে জানতাম না কিনা। এইসব খনি থেকে খনিজ জিনিস তুলে শেষ করা হয়েছে। তারপর আর সেখানে কেউ যায় না। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ, গুহা আর যেন পাতালপুরী শাখা করে। অবশ্য সেইসব পোড়োখনির মুখ বন্ধ করে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু ভূতনাথ যেটার কথা বলল, সেটা নাকি বন্ধ করা যায়নি। কেন যায়নি, সেটাই বড় রহস্যময়। যতবার বন্ধ করা হয়েছে, ততবার দেখা গেছে কে বা কারা মাটি-পাথর সরিয়ে ফেলেছে। তো এই খনিটা ছিল অভ্রের।
গোঁসাই বললেন,–অভ্রের?
হ্যাঁ, অভ্রের বলে গদাধরবাবু চোখ বুজলেন আবার। একটু-একটু দুলতেথাকলেন। এমন সময় ওঁর নাতি আর নাতনি, মুকুল আর মঞ্জুও এসে জুটল। তাদের সঙ্গে গদাধরের চাকর তিনকড়ি একটা ট্রে সাজিয়ে চা-চানাচুর আনল। সঙ্গে সঙ্গে খুব জমে উঠল আড্ডা।
মুকুল বলল, কীসের গল্প দাদু? ভূতের, না রাক্ষসের? আমি ভূতেরটা শুনব।
মঞ্জু বলল,-না, না দাদু। আমি শুনব রাক্ষসের।
গদাধর একটু হেসে বললেন, তাহলে চুপটি করে বোসো৷ গল্প নয়—একেবারে সত্যি ঘটনা। ভূতেরও বলতে পারো, রাক্ষসেরও বলতে পারো।
গোঁসাই ফিক করে হেসে বললেন,–তাহলে সন্ধি করে নাও। ভূত্রাক্ষসের গল্প। ভূত্রাক্ষস নিশ্চয় সাংঘাতিক ব্যাপারই হবে।
তুমি থামো তো!–ধমক দিয়ে গদাধর ফের শুরু করলেন। চায়ে চুমুক দিতেও ভুললেন না। ঘরে এখন শুধু চানাচুরের মুচমুচে শব্দ আর চায়ের সুড়সুড়! কে জানে কেন, মুকুল আর মঞ্জু দাদু আর তাঁর বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপিচুপি হাসতে থাকল। কিন্তু সে হাসি মিলিয়ে যেতে দেরি হল না অবশ্য।
গল্পটা আর গদাধরবাবুর মুখের কথায় না সাজিয়ে চলতি কায়দায় বলা যাক।…
.
তো কিশোর বয়সি গদাধর আর ভূতনাথ একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বেরিয়ে পড়ল সিন্দ্রির মাঠে। সেই পোড়ো অভ্রখনি দেখতে।
এখন সিন্দ্রিতে সার কারখানা হয়েছে। কত সব ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, লোকজন। বিশাল এলাকা জুড়ে শহর গড়ে উঠেছে। কিন্তু তখন একেবারে খাঁ-খাঁ মাঠ আর কোথাও-কোথাও জঙ্গল। কোথাও আদিবাসীদের বসতিও ছিল।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ইংরেজ ওই অখনির মালিক ছিলেন। খনির সব অভ্র শেষ হয়ে গেলে দুবছর পরেই তিনি খনিটা ছেড়ে দেন। সুদূর ভাগলপুরের এক রাজা নাকি ছিলেন ওইসব জমির মালিক। লিজ করা জায়গা আবার ফিরে এসেছিল সেই রাজার হাতে। তার কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে আদিবাসীরা খনির ওপরকার জমিতে চাষবাস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ফসল কাঁচা থাকতেই শুকিয়ে যেত। সব মেহনত বরবাদ। অগত্যা জমি ছেড়ে দিয়েছিল তারা। জঙ্গল-ঝোঁপঝাড় গজিয়ে গিয়েছিল আবার। তারই নিচে সুড়ঙ্গ আর পাতালপুরীর মতো পোড়োখনিটা রয়েছে।
গদাধর আর ভূতনাথ সেখানে গিয়ে হাজির হল।
ভূতনাথ বলল,-পোড়ো-খনিটার তিনটে মুখ আছে। আমি দুটোর মধ্যে ঢুকে অনেকটা দূর অবধি দেখে এসেছি। ভীষণ অন্ধকার কিন্তু। টর্চ ছাড়া যাওয়া যায় না। সেজন্যেই টর্চ এনেছি। আজ তোমাকে নিয়ে তৃতীয় সুড়ঙ্গটায় ঢুকব চললো।
তৃতীয় মুখটা ঘন ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা ঝাকড়া বটগাছের হাত বিশেক দূরে। মুখটা আন্দাজ হাত পনেরো চওড়া। দুজনে পাথরের খাঁজ আঁকড়ে ধরে অতি কষ্টে নামল।
বর্ষার জল তখন জমে আছে ডোবার মতো। সেই জলের ধার দিয়ে ওরা সুড়ঙ্গের দরজায় পৌঁছল। গদাধরের কেন যেন গা ছমছম করে উঠল। ভেতরটা কী অন্ধকার! টর্চ জ্বেলে আগে ঢুকল ভূতনাথ, পেছনে গদাধর।
সুড়ঙ্গটা বেশ চওড়া আর উঁচু। কিছুটা যেতেই হঠাৎ পোড়া গন্ধ লাগল নাকে। মনে হল ভেতরে কোথাও কে উনুন জ্বেলেছে যেন।
ভূতনাথ ফিসফিস করে বলল,-বুঝেছি। বাছাধনের ওই সুড়ঙ্গ দুটো পছন্দ হয়নি। এই তিন নম্বরে এসে জুটেছে।
গদাধর বলল,–কে? কার কথা বলছ ভুতু?
ভূতনাথ টর্চ নিভিয়ে বলল, কে জানে! ব্যাটার চেহারা বড় বিচ্ছিরি। একেবারে মামদো ভূতের মতো। আধপোড়া মাংস খায়। তবে ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর টর্চ জ্বালব না। তুমি আমাকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে এসো।
ঘুরঘুট্রি অন্ধকার। মাঝে-মাঝে মাকড়সার ঝুল জড়িয়ে যাচ্ছে গদাধরের মাথায়। আর কেমন বিচ্ছিরি গন্ধ। পায়ে গুঁতো মেরে কী একটা জন্তু দৌড়ে যেতেই গদাধর চেঁচিয়ে উঠেছিল আর কী! ভূতনাথ বলল, চুপ, চুপ। স্পিকটি নট।
কিছুটা এগোতেই বোঝা গেল সুড়ঙ্গটা ডাইনে ঘুরেছে। তারপর গদাধর যা দেখল, ভয়ে বিস্ময়ে মুখে কথা সরল না।
একটা মানুষ নাকি, মানুষই নয়–ভূতুড়ে চেহারা, সামনে গনগনে লাল আগুনের অঙ্গার থেকে একটা খেঁকশিয়ালের মতো খুদে জন্তু পুড়িয়ে কড়মড় করে খাচ্ছে। আগুনের ছটায় আবছা তার ভয়ংকর চেহারাটা ফুটে উঠেছে।
দুজনে বসে পড়েছিল চুপচাপ। একটু পরে কে জানে কেন, গদাধরের প্রচণ্ড হাঁচি পেল। কিছুতেই সামলাতে পারল না। হ্যাঁচ্চো করে একখানা জব্বর হাঁচি ঝেড়ে দিল।
অমনি ভুতুড়ে চেহারার সেই পোড়ামাংসখেকোটা এদিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে গর্জে উঠল চেরাগলায়–কেঁ রেঁ?
ওরে বাবা! ভূত নাকি নাকিস্বরে কথা বলে। তাহলে এ ব্যাটা সত্যি ভূত। গদাধর ঠকঠক কঁপতে শুরু করেছে।
কিন্তু ভূতনাথের গ্রাহ্য নেই। টর্চ জ্বেলে তার মুখের ওপর ফেলে বলল, ও কী খাচ্ছ মামা? খেঁকশিয়াল, না খরগোশ?
হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ! –সে কী পিলে চমকানো হাসি! ওই হাসি হেসে সে নাকিম্বরে বলল,–কেঁ রেঁ? ভুঁতুঁ নাঁকি? আঁয়, আঁয়!
বলে সে একটা কাঠ গুঁজে দিল আগুনে। হু-হুঁ করে জ্বলে উঠল কাঠটা। তার ফলে আলো হলো প্রচুর। ভূতনাথ গদাধরকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটু তফাতে বসল।
–ওঁটা কেঁ রেঁ?
ভূতনাথ বলল, আমার বন্ধু গদাই। তোমাকে দেখতে এসেছে, মামা।
আবার হিঁ হিঁ করে হেসে সে বলল, আঁমাকে দেঁখবি? তঁবে ভাঁলো কঁরে দ্যাঁখ! এঁই দ্যাঁখ!
বলেই সে গদাধরের চোখের সামনে একটা প্রকাণ্ড কালো বাদুড় হয়ে ছাদ আঁকড়ে ধরে দিব্যি দুলতে শুরু করল। গদাধর হাঁ করে তাকিয়ে আছে তো আছে। ভূতনাথের কাধ আঁকড়ে ধরেছে নিজের অজান্তে। কাঁপুনি সামলাতে পারছে না। এ কি সম্ভব!
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, খুব হয়েছে মামা। তোমার খাবার পড়ে রইল যে। এক্ষুনি কেংকেলাস এসে মেরে দেবে!
অমনি বাদুড়বেশী কিম্ভুত সেই প্রাণীটি ধুপ করে পড়ল। পড়ে আবার আগের চেহারা নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, কঁ, কঁ?
–কেংকেলাস এসে তোমার খাবার খেয়ে ফেলবে। ঝটপট শেষ করে নাও।
–ইঁস! কেঁংকেলাসকে তাঁহলে কুঁলে আঁছাড় মাঁরব নাঁ?
–পারবে না মামা। তার গায়ের জোর তোমার চেয়ে ঢের বেশি।
সে কোনও কথা না বলে কড়মড়িয়ে খুদে প্রাণীর রোস্টটা সাবাড় করতে ব্যস্ত হল। মাথাটি চিবিয়ে খাবার পর তৃপ্তিতে একটু ঢেকুর তুলে বলল, হ্যাঁ রে
–বলল মামা।
–কেঁংকেলাস কোথায় থাকে বেঁ?
–ওপরের বটগাছটায়। সেদিন শুনলে না? কেমন মনের আনন্দে ঠ্যাং ঝুলিয়ে গান গাইছিল!
গদাধরের মনে হল, মামদোটা কেমন মনমরা হয়ে গেল এই শুনে। হওয়ারই কথা। ওরা সুড়ঙ্গের মধ্যে যেখানে বসে আছে, হয়তো তার ছাদের ওপাশেই সেই বটগাছটা।
সে ভূতনাথের কথা শুনে বেজার মুখে বলল,–উঁতু! তাহলে আঁমি রং আঁন্য কোথাও চলে যাই রে।
তাই যাও মামা-ভূতনাথ বলল, চাসনালার ওখানে একটা পোড়া কয়লাখনি . আছে। সেখানে মনের সুখে থাকো গে!
নাঁ বেঁ! কয়লাখনির দিকে গেলেই আঁমি কালো হয়ে যাব। বলে মামদো তার লিকলিকে হাতের চামড়া থেকে ময়লা রগড়াতে থাকল।
ভূতনাথ বলল, এই সেরেছে! ও মামা, মনে হচ্ছে এই অভ্রখনির আসল বাসিন্দা ভদ্রলোক এসে পড়েছেন, পালাও, পালাও!
দুমদাম পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ক্রমশ শব্দটা এদিকেই আসছে। একবার ঘুরে অন্ধকারটা লক্ষ করেই মামদোটা চোখের পলকে একটা প্রকাণ্ড চামচিকে হয়ে গেল এবং সনসন করে গদাধরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল। কী বিচ্ছিরি গন্ধ তার গায়ের।
গদাধরের গালে একটুখানি ঠেকে গিয়েছিল সেই চামচিকের ডানার ডগাটা। আর তাই থেকেই এখন একটা মস্ত আঁচিল হয়ে গেছে।
তো একটু পরে বেঁটে গোলগাল গাঙফড়িং-এর ডানার মতো সাদা রঙের একটা মানুষ কিংবা মানুষ নয়, এমন এক প্রাণী এসে দাঁড়াল আগুনের কুণ্ডটার পাশে।
তার চুলগুলো খোঁচা-খোঁচা, লাল। গোঁফও তেমনি। কানদুটো প্রকাণ্ড। বড় বড় গোল চোখ। সে ভারিক্তি গলায় বলল,-কে রে তোরা?
ভূতনাথ গদাধরকে চিমটি কেটে সেলাম ঠুকল। গদাধরও বুঝল, তাকেও সেলাম ঠুকতে হবে। ভূতনাথ বলল, দাদামশাই, আমি ভুতু। আর এ আমার বন্ধু গদাই।
–আমার ঘরে তোরা কোন মতলবে রে?
ভূতনাথ বিনীতভাবে এবং চাপাগলায় বলল, দাদামশাই, তোমায় সাবধান করতে এলাম। কেংকেলাস তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অমনি কিম্ভুত প্রাণীটা চাপাগলায় বলে উঠল, কে, কে?
–কেংকেলাস, দাদামশাই।
এই আজব জীবটি কেংকেলাস শোনামাত্র থপথপ করে দৌড়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, খুব ভয় পেয়ে গেছে।
গদাধর এতক্ষণে জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল,–কেংকেলাস কে। কিন্তু সুযোগই পেল না। খনিমুখের দিকে আবছা চাচামেচি শোনা গেল।
তারপর কারা দৌড়ে আসছে মনে হল।
গদাধর হাঁ করে তাকিয়ে দেখল, গোটা পাঁচেক মানুষ কিংবা মানুষ নয় গোছের আজব প্রাণী এসে তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে আগুনের কুণ্ডটার দিকে ঝুঁকে রইল।
মাথায় তিন ফুট থেকে চার ফুট উঁচু এই জীবগুলো কালো পাকাটির মতো। কাঠির ডগার মুণ্ডু বসালে যেমন হয়, তেমনি। কিন্তু হাত-পা আছে দস্তুরমতো। চোখগুলো ড্যাবড়েবে, লালচে। গোঁফও আছে। তারা চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছিল না। মনে হল, সেই মামদোর এটো চিবুনো হাড়গুলো খুঁজছে তারা।
তারপর তাদের চোখ পড়ে গেল ভূতনাথদের দিকে। অমনি পাশটিতে দাঁড়িয়ে গেল। একসঙ্গে আঙুল তুলে এদের দিকে শাসানির ভঙ্গিতে বলতে লাগল, মুন্ডু খাব, ঠ্যাং খাব! ঘিলু খাব, ফুসফুস খাব। কলজে খাব, পিলে খাব। চোখ খাব, নাক খাব।
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল,–আর দাঁত? দাঁতগুলো খাবিনে?
সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার একসঙ্গে বলে উঠল, দাঁত খাব, দাঁত খাব।
ভূতনাথ কী বলতে যাচ্ছে, গদাধর ততক্ষণে ওইসব খাওয়ার শাসানি শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেলল,–কেংকেলাস আসছে! কেংকেলাস!
ব্যস! কাজ হয়ে গেল। প্রাণীগুলি অমনি চাঁ-া করতে করতে যে-যেদিকে পারল, অন্ধকারে পালাতে শুরু করল।
তিন ফুট উঁচু যেটা, সে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঊ্যা করে কেঁদে উঠেছিল। একজন এসে তাকে টানতে-টানতে নিয়ে পালাল।
ভূতনাথ বলল, বাঃ গদাই! তাহলে কেংকেলাসের মর্ম পেয়ে গেছ।
গদাধর ততক্ষণে অনেকটা সাহসী হয়েছে। বলল, ভাই ভুতু, আন্দাজে কিংবা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কেংকেলাস ব্যাপারটা কী? ওটা শুনেই ওরা পালিয়ে যাচ্ছে কেন?
ভূতনাথ বলল, যাদের দেখলে, এরা হল গিয়ে পোডো-খনির ভূত। কেংকেলাস তাদের থানার দারোগাবাবুর নাম।
গদাধর অবাক হয়ে বলল, আঁ! ভূতের আবার দারোগা! থানা-পুলিশ!
ভূতনাথ আগুনের কুণ্ডে একটা শুকনো কাঠ ফেলে বলল,-বাঃ! ওদের বুঝি থানা-পুলিশ থাকতে নেই? না থাকলে চলবে কেন? ভূতদের মধ্যে চোর-ডাকাত নেই বুঝি? চোর-ডাকাত থাকলেই পুলিশ থাকবে। সেই ভৌতিক পুলিশের দারোগাবাবুর নাম কেংকেলাস। খুব জাদরেল দারোগা।
গদাধর বলল,-বুঝলাম। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে ভাই ভুতু?
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, আমার নাম ভূতনাথ ওরফে ভুতু। আমি ভূতের খবর জানব না তো কে জানবে?
গদাধর আগ্রহ দেখিয়ে বলল, বলো না ভাই, শুনি?
ভূতনাথ বলল, মুখে শুনে কী হবে? চলো না, তোমার সঙ্গে কেংকেলাসের আলাপ করিয়ে দিই। না, না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অতি সজ্জন, ভদ্র, অমায়িক ভদ্রলোক। অবশ্য চোর-ডাকাতের সামনে কড়া না হলে তো চলে না। কই, ওঠো।
দুজনে টর্চের আলোয় সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে এল। পাথরের খাঁজ আঁকড়ে ধরে খোলা গর্তের মতো খনিমুখ বেয়ে ওপরে উঠল। তখন বেলা পড়ে এসেছে।
ভূতনাথ বটগাছটা দেখিয়ে বলল,–এই গাছের মধ্যিখানে আধপোড়া শুকনো ছাল ছাড়ানো ডালটা দেখতে পাচ্ছ? কেইকোস ওখানেই থাকে। একটু পরে সন্ধ্যা হবে। তখন সে চোর-ডাকাত ধরতে বেরোয়। এসো–এখন তার থাকার কথা।
গদাধরের গা ছমছম করছিল। তবে ভূতনাথের মতো সঙ্গী থাকতে যে তার এতটুকু ক্ষতি হবে না, টের পেয়ে গেছে ততক্ষণে।
দুজনে গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। অজস্র পাখি বটগাছের ডালে তখন এসে জুটেছে। কানে তালা ধরে যায়। ভূতনাথ ডালপালার ফাঁক দিয়ে সেই বাজপড়া ডালটার দিকে তাকিয়ে ডাকল,–কেংকেলাসবাবু আছেন নাকি? কেংকেলাসবাবু-উ-উ!
এ পর্যন্ত শুনেই সাতকড়ি গোঁসাই হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আচমকা তাল কেটে গিয়ে গদাধরবাবু খেপে গিয়ে বললেন, হাসবার কী আছে এতে? গোঁসাই, তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। আর যাই করো, কেংকেলাস শুনে হেসো না।
গোসাঁই বললেন,–কেন? হাসব না কেন শুনি? আর কোনও নাম পেল না– সব থাকতে কেংকেলাস।
রমণীবাবু বললেন,–আহা, ওটা যে ভূতপেরেতের নাম।
বংশীলোচন বললেন, তার চেয়ে বড় কথা, ওটা ভূতপ্রেতের দারোগাবাবুর নাম। অন্য নাম মানানসই হবে কেন?
মঞ্জু বলল, নাও! দিলে তো সবাই গল্পটা ভেঙে।
মুকুল বলল,-ও দাদু, কেংকেলাসবাবু কী করলেন বলল এবার।
গদাধর পাশের টেবিলের ড্রয়ার টেনে ছবির একটা অ্যালবাম বের করে বললেন,–গোঁসাই, সেই বটতলায় গত পুজোয় গিয়েছিলাম। এখনও ওটা সিন্দ্রি টাউনশিপের চৌরাস্তার ধারে রয়েছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। এই দেখো, সেই বাজপড়া ডালটা এখনও আছে। দেখতে পাচ্ছ?
সবাই ঝুঁকে পড়লেন ছবিটার দিকে। হ্যাঁ, ডালটা পরিষ্কার উঠেছে।
বংশীলোচন বললেন, তুমি নিজেই তুলেছ নাকি গদাই?
গদাধর বললেন, হ্যাঁ। তুলেছি, তার কারণ আছে। এখন তো জায়গাটা শহর হয়ে গেছে। লোকজন গাড়িঘোড়া চলছে। গতবছর গিয়ে একদিন দুপুরবেলা লোডশেডিং-এর সময় গায়ে হাওয়া দিতে বটতলায় দাঁড়িয়েছিলাম। রাস্তাঘাট তখন প্রায় কঁকা। একটা-দুটো গাড়ি বা রিকশো যাচ্ছে। লু হাওয়া উঠেছে। তাই সব দোকানপাটের সামনে তেরপল ঝুলিয়ে রেখেছে। হঠাৎ মনে হল মাথায় কী ঠেকছে। মুখ তুলে দেখি একটা পা।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন,–পা! কীসের পা?
বলছি। বলে গদাধর চোখ বুজে কয়েক দণ্ড চুপ করে থাকার পর মুখ খুললেন। তক্ষুনি বোঝা উচিত ছিল, পারিনি। সেই ছেলেবেলায় একবার মাত্র দেখেছিলাম।
–কাকে? কাকে?
–কেংকেলাসবাবুকে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, এখনও বেঁচে আছেন দারোগা ভদ্রলোক এবং ওই বটগাছের থানাতেই আছেন। বদলি হননি। মাথায় পা ঠেকতেই ওপর থেকে একটু হেসে বললেন, কী? চিনতে পারছ তো? তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। নমস্কার করে বললাম, ভালো আছেন স্যার? প্রমোশন হয়নি। নাকি হয়েছে? কেংকেলাসবাবু দুঃখিভাবে বললেন, ব্রাদার। সেই পোস্টেই আছি।
অবিশ্বাসী গোঁসাই আবার হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আবার বাধা পড়ে হইচই উঠল। গদাধর আবার খেপে উঠলেন।
এবং তিনকড়ি দ্বিতীয়বার চা আনল।
তারপর মঞ্জু আর মুকুল খেই ধরিয়ে দিল। সেই বটতলায় ভূতনাথ ডাকছিল,– কেইকোসবাবু, আছেন নাকি? তারপর?
গদাধর অগত্যা শুরু করলেন।…
খনি অঞ্চলে খুনোখুনি মারদাঙ্গা চুরি-ডাকাতি লেগেই আছে। এখন কথা হচ্ছে, ওইসব দাগি খুনি আর চোর-ডাকাতরা মরে কি স্বর্গে যাবে? তাদের মুক্তি অত সোজা? তাদের ভূতপ্রেত হয়েই থাকতে হয়।
কিন্তু স্বভাব যাবে কোথা? তাই ভূত হয়েও উপদ্রব বাধায় হামেশা। তাই কেংকেলাস দারোগা ছাড়া উপায় নেই।
এসব কথা ভূতনাথের কাছে শোনা। সেদিন তো সেই পড়ন্ত বেলায় সিন্দ্রি মাঠে বটতলায় ভূতনাথ অনেক ডেকে কেংকেলাসের সাড়া পেল।
ওপর থেকে খ্যানখেনে গলায় আওয়াজ এল,–কী, কী, কী?
ভূতনাথ বলল, আমি ভুতু, স্যার। সঙ্গে আমার বন্ধু গদাই আছে। ও আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
–সকালে এলেই পারতে বাবু! শুনছ না? এখন আমি রাগিণী ভাঁজছি! সোজা কথা নয়, পুরিয়াধানেশ্রী।
হ্যাঁ, তাই বটে। উনি বাতাসের সুরে রাগিণী ভাঁজছেন। এতক্ষণে কানে এল। তারপর বটগাছটায় হুলুস্থুলু করে একটা বাতাস এসে পড়ল। পাখিগুলো তুলকালাম চ্যাঁচিতে শুরু করল।
তারপর গদাধর কেংকেলাসকে দেখতে পেল।
তখন দেশে ইংরেজের শাসন চলছে। সে আমলের দারোগাবাবুদের নাম শুনলে চোর-ডাকাতের কাজে শুকিয়ে যেত। আর তখনকার ওনাদের চেহারাই বা কী ছিল? আজকাল তো সব ছেলে-ছোকরা দারোগা হয়ে যাচ্ছে।
কেংকেলাসের ভুঁড়িটা আড়াই বিঘৎ পরিমাণ। প্রকাণ্ড মাথা। পেল্লায় গোঁফ। কিন্তু রাগরাগিণী সেধে গলার অংশটা সরু। আর চোর-ডাকাতের সঙ্গে ছোটাছুটি করে পাদুটোও কাঠি-কাঠি। হ্যাট বগলে নিয়ে আর হোঁতকা মোটা বেটন হাতে ঝুলিয়ে দুম করে সামনে পড়লেন। পাখিগুলো চ্যাঁচিতে-চ্যাঁচিতে পালিয়ে গেল। গদাধর বলল, নমস্কার স্যার!
কেংকেলাস দারোগা মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, ভালো। খুশি হলাম তোমাকে দেখে। কোন ক্লাস পড়ছ?
গদাধর জবাব দিতে যাচ্ছে, হঠাৎ দূরে সেই খনির গর্তের কাছে কারা চেঁচিয়ে উঠল,–চোর! চোর! চোর! অমনি কেংকেলাস দারোগা ফুটবলের মতো শূন্যে উঠে সেদিকে হাইকিক হয়ে চলে গেলেন।…
.
আবার বাধা পড়ল। গদাধরবাবু হার্টের রুগি। ডাক্তারবাবু এসে পড়লেন ইঞ্জেকশন দিতে। গদাধর বললেন, আজকের মতো এই তোমরা এখন এসো ভায়া। মঞ্জু, ঠামাকে ডাক।…
সবাই উঠলেন। যেতে-যেতে গোঁসাই বলে গেলেন! কেংকেলাসই বটে। কাকে বললেন, কে জানে।
কেকরাডিহির দণ্ডীবাবা
কেবলরাম বলল, যখন-তখন গেলেই হল না মাঠান! বারবেলা তিথি নক্ষত্র বলে কথা আছে না? ঠিক সময় গেলে তবে দর্শন পাবেন।
রাঙা পিসিমা মুখ ভার করে বললেন,–যখনই বলি, তোর খালি ওই এক কথা। এদিকে রোগ বাড়তে বাড়তে মাথায় ঠেকেছে। কখন একটা কিছু সর্বনাশ হয়ে গেলেই হল। বাড়ির লোকের আর কী? আমার মরার পথ তাকিয়েই আছে সবাই। হাড় জুড়বে সব্বাইকার!
এমন কথা শুনে আর চুপ করে থাকা যায় না। বললুম,–ও কী বলছেন। পিসিমা। চলুন, আজই আপনাকে নিয়ে বেরুব।
কেবলরাম মাথা চুলকোতে-চুলকোতে মুখ বেজার করে বেরিয়ে গেল। পিসিমা আশ্বস্ত হয়ে লাঠি ঠুক ঠুক করে নিজের ঘরে গেলেন। কোণার দিকে চেয়ারে বসে ভবভূতি চুরুট টানছিলেন আর পুরোনো কাগজ পড়ছিলেন। এবার বললেন, কারও অসুখ-বিসুখ করেছে মনে হচ্ছে?
বললুম, আবার কার? রাঙা পিসিমার।
–কী অসুখ?
–বোঝা যাচ্ছে না ঠিক।
–ধুস! লক্ষণ-টক্ষণগুলো কী?
–এই ধরুন, রাত্তিরে ভালো ঘুম হয় না। যেটুকু হয়, সেটুকু নাকি ভয়ঙ্কর স্বপ্নে ভরা। কখনও দেখেন, রাক্ষস আসছে হাঁ করে তেড়ে। কখনও দেখেন, সাতটা ভালুক এসে দাঁত বের করে বেজায় ঝগড়াঝাটি করছে। এইসব আর কী!
ভবভূতি একটু হেসে বললেন,–ও কিছু না। বদহজম। হজমি ওষুধ খাইয়ে দিও।
বিরক্ত হয়ে বললুম, হজমি ওষুধ! গিয়ে দেখুন না ঘরভর্তি খালি নানারকম হজমি ওষুধের শিশি।
ভবভূতি চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–তোমার পিসিমার বয়স হয়েছে তো! এ বয়সে অমন হয়েই থাকে। আমার বারাসতের মাসিমার অবস্থা দেখলে তো চমকে উঠতে। বেশ বসে আছেন। হেসে কথা বলছেন। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠতেন, কী রে বংশীবদন? চল্লি কোথায়? জিগ্যেস করলে বলতেন, ওই আমাদের ঘুঘুডাঙার বংশী। বড় ভালো ছেলে ছিল। আহা! সাপের কামড়ে এই বয়সেই বেচারা মারা পড়ল।
ভবভূতি হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন,–তা পিসিমাকে কোথাও নিয়ে যাবে বুঝি? কোনও বড় ডাক্তারের সন্ধান পেয়েছ?
ভবভূতিবাবু লোকটিই এমন। কান করে কিছু শোনে না। বললুম,–পেয়েছি।
–কোথায় শুনি?
–কেকরাডিহিতে।
–কেকরাডিহি? সে আবার কোথায় হে?
–কেবলরামের দেশ।
ভবভূতি নাক সিঁটকে বললেন, হুঃ! নিশ্চয় বেহদ্দ পাড়াগাঁ। তোমাদের কেবলচন্দ্রটিকে দেখলেই বোঝা যায়, তার দেশটা কেমন। তা সেখানে বুঝি কোনো ওঝাটোঝার খবর পেয়েছ?
–কতকটা তাই জ্যাঠামশাই। তবে তিনি মানুষ নন।
ভবভূতি চমকে উঠে বললেন,–আঁ! মানুষ নন! তবে কী–
–পক্ষী।
পক্ষী! মানে পাখি? –ভবভূতি খিকখিক করে হাসতে লাগলেন। –পাখি করবে মানুষের চিকিৎসা! ওই ব্যাটা কেবলচন্দ্রটা বলেছে বুঝি? যেও না হে, মারা পড়বে।
গম্ভীর হয়ে বললুম, জ্যাঠামশাই। ব্যাপারটা বলি শুনুন। কেকরাডিহি গ্রামের কাছে একটা পোডড়া মাঠ আছে নাকি। সেখানে মাঝে-মাঝে একটা দাঁড়কাক আসে কোত্থেকে। মানুষের ভাষায় কথা বলে। রোগিদের রোগের কথা শুনে ওষুধ দেয়। কীভাবে খেতে হবে, তাও বলে দেয়।
ভবভূতি আরও হেসে বললেন, দাঁড়কাকটার সঙ্গে একটা ওষুধের বাকসোও থাকে বুঝি?
–না, না। কথাটা শুনুন আগে। রোগের কথা আঁতিপাতি জিগ্যেস করে দাঁড়কাকটা উড়ে যায়। চক্কর মেরে কোত্থেকে ঠোঁটে করে একটা শেকড়বাকড় নিয়ে আসে।
ভবভূতির চুরুট নিভে গিয়েছিল! ফের দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে ঠোঁটে চুরুট থাকা অবস্থায় বললেন,–গাঁজা! তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–গুল! শেষে বললেন,–বেঘোরে মারা পড়বে। যেও না।
তারপর যেন খাপ্পা হয়েই বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু দুপুরবেলা যখন গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছি সবে, দেখি ভবভূতি সেজেগুজে হন্তদন্ত হয়ে হাজির। মাথায় ফেল্ট টুপি, গায়ে বুশশার্ট, পরনে ব্রিচেসের মতো আঁটো প্যান্ট, পায়ে হাটিং বুট এবং কাঁধে কিটব্যাগ, পিঠে বন্দুক। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে একগাল হেসে বললেন,–চলল, আমিও যাই সঙ্গে। অনেকদিন শিকার-টিকার করিনি। হাতটা সুড়সুড় করছে।
রাঙাপিসিমা খুশি হয়ে বললেন, ভবদাকে পেয়ে মনে জোর এল। পাড়াগাঁয়ে আজকাল বড্ড নাকি ডাকাতের উপদ্রব।
ভবভূতি নাদুস-নুদুস হুঁড়িওয়ালা প্রকাণ্ড মানুষ কিন্তু বেজায় বেঁটে। আমার পাশে বসে বললেন, ক্যাবলা, পেছনে যা। কেবলপেছনে পিসিমার কাছে গিয়ে বসল। তারপর ভবভূতি বললেন, হ্যাঁ রে কেবলচন্দ্র, তোদের ওখানে বাঘ-টাঘ নেই?
কেবলরাম একগাল হেসে বলল,–নেই কী, তাই বলুন ছার।
ছার শুনে রাঙাপিসিমা খিকখিক করে হেসে উঠলেন। আমার ভালোই লাগল। অনেককাল পিসিমাকে হাসতে দেখিনি। ভবভূতি বললেন,–বাঘ আছে বলছিস? কিন্তু বাঘ মারা আজকাল যে বেআইনি। বাঘ মারব না। বরং দু-চারটে পাখিটাখি মারব।
কেবলরাম ভয় পাওয়া গলায় বলল, কক্ষনো ও কাজ করবেন না ছার! দণ্ডীবাবা খেপে যাবেন। শাপ দেবেন। শাপে কী হবে জানেন ছার?
ভবভূতি গোঁফ পাকিয়ে বললেন, কী হবে শুনি!
–মাথার সব চুল উড়ে যাবে।
ভবভূতি নিজের মাথার প্রকাণ্ড টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, ধুস! আমার তো চুলই নেই! পেছনে কয়েকগাছা আছে–্যায় তো তাও যাক। ক্ষতি কীসের?
আমাদের গাড়ি শহর ছাড়িয়ে নদীর ব্রিজে পৌঁছল। তারপর ফাঁকা রাস্তা একেবারে। সারা পথ ভবভূতি কেবলরামের সঙ্গে রসিকতা করতে করতে চললেন। পিসিমা খুব হাসলেন। তার ফলে কেকরাডিহির দণ্ডীবাবার প্রতি আমার ভক্তিটা ক্রমশ বেড়ে গেল। এই হাসিখুশিটা খুব শুভ লক্ষণ বইকী।
মাইল দশেক চলার পর কেবলরাম বলল,-এবার কাঁচা রাস্তা দাদাবাবু!
কাঁচা মানে কাঁচা। জীবনে এমন অখাদ্য রাস্তায় কখনও গাড়ি চালাইনি। ভয় হচ্ছিল, গাড়ি না বিগড়ে যায়। আরও মাইল চারেক এগিয়ে পড়ল বদিকে একটা বিশাল ডাঙাজমি। ঘুটিং কাকড় যত, তত ছোটবড় পাথরের টুকরো। বাংলা বিহারের সীমান্ত এলাকা এটা। কেবলরাম চেঁচিয়ে উঠল,–এইখানে! এইখানে! গাড়ি থামালুম।
কেবলরাম মাঠের ওধারে একটা গ্রাম দেখিয়ে বলল,–এই হল গে কেকরাডিহি, দাদাবাবু। আর এই হল গে দণ্ডীবাবার থান।
ভবভূতি বললেন,–থান? কোথায় থান?
একটা বাজপড়া ন্যাড়া তালগাছ দেখিয়ে কেবলরাম টিপ করে প্রণাম করল। রাঙাপিসিমাও তার দেখাদেখি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। ন্যাড়া তালগাছের পেছনে একটা মস্ত বড় পাথর রয়েছে। কেবলরাম বলল,-বাবার ভোগ রাখতে হবে ওই পাথরটার ওপর। আর বাবা উড়ে এসে বসবেন ওই মুড়ো তালগাছটার মাথায়। এসে যখনই কাকা করে ডাকবেন তখন ওনাকে সব বলতে হবে।
ভবভূতি বললেন, বাবার ভোগটা কী হে কেবলচন্দ্র?
–আজ্ঞে হঁদুর। মরা হলে চলবে না। জ্যান্ত চাই। লেজে সুতো বেঁধে পাথরটার ওপর রাখতে হবে। পালাতে পারবে না। সুতোটায় এক টুকরো পাথর চাপা দিয়ে রাখলেই চলবে।
পিসিমা ব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকা বের করে বললেন, তুই তাহলে শিগগির ইঁদুর নিয়ে আয় বাবা।
কেবলরাম টাকাটা ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে বলল, আপনি থানের সামনে গে বসুন পিসিমা। হাতজোড় করে চোখ বুজে বসে থাকবেন। ভাগ্যে দর্শন থাকলে পাবেন-শইলে পাবেন না। আমার কোনও দোষ নেই। বলেছিলুম, বারবেলা তিথি নক্ষত্র দেখে আসতে হবে।
পিসিমা বললেন,–তুই যেন শিগগির ভোগ নিয়ে আসবি। দেরি করিসনে বাবা!
কেবল যেতে-যেতে বলল, যাব আর আসব। নেতাইদার ঘরে ইঁদুর পোষা আছে না? লোকেরা হরদম কিনে এনে ভোগ দিচ্ছে বাবাকে।
সে চলে গেলে পিসিমা লাঠি ঠুকঠুক করে ন্যাড়া তালগাছটার গুঁড়ির কাছে গিয়ে করজোড়ে বসে পড়লেন। ভবভূতি চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন,–দেখি, কোথাও শিকার পাই-টাই নাকি।
উনি বন্দুক বাগিয়ে সামনে ছোটবড় পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গ্রীষ্মের বিকেল। কিন্তু খোলামেলা জায়গা বলে হু হু করে বাতাস বইছে। গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। দৃষ্টি তালগাছের মাথার দিকে। উঁহু মাথাই নেই তালগাছটার। একেবারে কবন্ধ। এখন শুধু ভাবনা, কেবলরাম ভোগ আনবার আগে বাবা এসে পড়লে পিসিমা কীভাবে ঠেকিয়ে রাখবেন।
একটু আনমনা হয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এল ভরাট গম্ভীর গলার ডাক, গা গা গা! তাকিয়ে দেখি তালগাছের বাজপড়া ডগায় কখন এসে গেছে এক দাঁড়কাক। পেন্নায় চেহারা। আর সে কী ডাক! কা কা নয়–একেবারে গা গা গাও গাও!
পিসিমা নিশ্চয় গাও গাও শুনেই ভজন গাইতে শুরু করেছেন। ভারি মিঠে গলা তো রাঙাপিসিমার! উনি যে এত সুন্দর গান গাইতে পারেন, জানতুম না তো!
দণ্ডীবাবা মুগ্ধভাবে বসে গান শুনছেন মনে হল। কিন্তু কেবলরাম আসছে না কেন? বাবা যদি রাগ করে চলে যান? পিসিমা যেন ওঁকে ঠেকিয়ে রাখতেই ভজন লম্বা করে চলেছেন। পিসিমার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে বলতে হয়। যখনই দম নিতে থামছেন, দণ্ডীবাবা ডেকে উঠছেন,–গা গা! গাও গাও!
এক সময় পা টিপেটিপে কেবলরাম এসে পড়ল। তার হাতে মোটা সুতোয় বাঁধা তিনটে নেংটি ইঁদুর ঝুলছে অথবা দুলছে। সুতো বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কেবলরামের ঝাঁকুনি খেয়ে ফের লম্বা হয়ে পা ছুঁড়ছে। লেজ নাচাচ্ছে।
সে ভক্তিভরে সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে পিসিমার কাছে ভোগ পৌঁছে দিতে গেল। এখন একটাই সমস্যা। পিসিমার ইঁদুর-আরশোলাতে বড্ড ভয়। কেবলরাম অবশ্য সেটা জানে। কিন্তু পিসিমার কাছাকাছি ভোগ রাখলে পিসিমা কতটা সামলাতে পারবেন জানি না। উত্তেজনায়-উদ্বেগে তাকিয়ে রইলুম।
ইঁদুর তিনটে দেখামাত্র পিসিমার গান থেমে গেল। তিনি ইশারায় কেবলরামকে দূরে ওগুলো রাখতে বলছেন এবং সেই সঙ্গে হাউমাউ করে দণ্ডীবাবার উদ্দেশে বলছেন, ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর স্বপ্ন বাবা! বড়-বড় রাক্ষস-খোক্ষস! হাঁ করে গিলতে আসে। আর একটা কালো কুচ্ছিত পেত্নি বাবা, সাদা থানের কাপড় পরে আমাকে ভেংচি কাটে। গাল দেয়। আমি কোনও দোষ করিনি বাবা, তবু আমাকে গালমন্দ করে। শোনো বাবা, একটা-দুটো নয়–সাত-সাতটা ভালুক এসে নাচে। আমার দম আটকে যায় বাবা!
দণ্ডীবাবা ডানা চুলকোচ্ছেন ঠোঁট দিয়ে। তারপর হঠাৎ ওপাশে ঘুরে কী যেন দেখতে থাকলেন। এবার ইঁদুর তিনটে দেখিয়ে মরিয়া হয়ে কেবলরাম চেঁচাল, ইদিকে দেখুন বাবা! ভোগ এনেছি আপনার!
কিন্তু বাবার মনে কী ছিল, হঠাৎ উড়ে চলে গেলেন। পিসিমা করুণ মুখে বললেন,–বাবা যে ভোগ ফেলে চলে গেলেন কেবলরাম। তাহলে আমার কী হবে?
কেবলরাম বলল,–কিছু ভাববেন না। ভোগ থানে ছেড়ে দিচ্ছি। বাবা যখন খুশি ফিরে এসে খাবেন। চলুন, এখন আর বসে থেকে লাভ নেই।
–আমার অসুখের ওষুধ যে দিয়ে গেলেন না?
–ওই তো ওষুধ আপনার মাথায়!
পিসিমা ঝটপট মাথায় হাত দিতেই পেয়ে গেলেন কিছু। সঙ্গে-সঙ্গে আঁচলে বাঁধলেন। কেবলরাম ইঁদুরগুলো ছেড়ে দিল পাথরের ওপর। পিসিমা গাড়ির কাছে এলে বললুম,–ওষুধটা দেখি, পিসিমা!
পিসিমা বললেন, এখন দেখতে নেই। পরে দেখিস। ও কেবল, ভবদাকে ডাক।
এই সময় ভবভূতির সাড়া পাওয়া গেল বন্দুকের আওয়াজে। নিশ্চয় পাখিটাখি মারলেন। কেবল ওঁকে ডাকতে গেল।
একটু পরে ফিরলেন দুজনে। দুজনেরই মুখ গম্ভীর। কিন্তু শিকার কই? জিগ্যেস করলে ভবভূতি শ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, খুঁজে পেলুম না। যা পাথর চারদিকে। যাকগে! খামোক একটা গুলি খরচ হল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আবার কাঁচা রাস্তায় নড়চড় করতে করতে গাড়িটা এগোল কষ্টেসৃষ্টে।
পিসিমা ওষুধটা দেখিয়েছিলেন। শুকনো এক টুকরো কাঠি কিংবা শেকড়, বুঝতে পারিনি। সেটা হামানদিস্তায় গুঁড়ো করে কেবলরামের নির্দেশ মতো রোজ সুচের ডগায় একবিন্দু তুলে জলের সঙ্গে খেতেন পিসিমা। আশ্চর্য ব্যাপার। আর রাক্ষস, ভাল্লুক বা পেত্নিটা এসে জ্বালাত না। দিব্যি ঘুমোতেন। সবসময় হাসিখুশি মেজাজ।
একদিন ভবভূতি এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে যাওয়ার পর কেবলরাম বলেছিল, ভবছরের মাথাটা দেখেছেন? পেছনে গোটাকতক চুল ছিল, তাও আর নেই! হুঁ–হুঁ বাবা, শাপ বলে কথা!
জিগ্যেস করেছিলাম, কীসের শাপ? কে শাপ দিল ওঁকে?
আবার কে? দণ্ডীবাবা! কেবলরাম গলা চেপে বলেছিল। বলতে বারণ করেছিলেন দুটো টাকা দিয়ে। তাই বলিনি। কিন্তু টাকা শোধ হয়ে গেছে অ্যাদ্দিনে। এবার বলে দিই দাদাবাবু ভবছার সেদিন কেকরাডিহির দণ্ডীবাবাকে গুলি করে মেরেছেন, জানেন?
–অ্যাঁ! বলিস কী রে?
–হ্যাঁ–দাদাবাবু। গিয়ে দেখি এই কাণ্ড। দণ্ডীবাবা পড়ে রয়েছেন গুলি খেয়ে। আর ভবছার মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে আমি হায়-হায় করে উঠলুম। তখন উনি বলেন কী, পানকৌড়ি উড়ে যাচ্ছে ভেবে গুলি করেছিলুম রে! তুই দুটো টাকা নেকাকেও যেন বলিস নে।
বলেছিলুম,–চেপে যা। আমায় যা বললি, বললি। কখনও পিসিমা যেন না শোনেন।
বুদ্ধিমান কেবলরাম কথাটা পিসিমাকে বলেনি আজও। তবে একথা সত্যি যে ভবভূতির মাথায় আর একগাছিও চুল নেই। কেকরাডিহির দণ্ডীবাবার অভিশাপ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?
খুলি যদি বদলে যায়
এই অদ্ভুত ঘটনাটা আমার ছোটবেলায় ঘটেছিল। তখন আমার বয়স মোটে দশ বছর। আমাদের গ্রামের হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি।
আমাদের গ্রামে আষাঢ় মাসে রথযাত্রা উপলক্ষে খুব ধুমধাম হতো। ঠাকরুনতলার খোলামেলা বিশাল চত্বরে মেলা বসত। আশেপাশের সব গ্রাম থেকে মানুষজন এসে ভিড় জমাত।
সেবার রথের মেলার সময় দিদিমা এসেছিলেন। তিনি রথের মেলা দেখতে যাবেন শুনে মায়ের প্রচণ্ড আপত্তি। না, না! মেলায় বড় ভিড় হয়। এদিকে বিষ্টিবাদলায় ঠাকরুনতলার চত্বরে বিচ্ছিরি কাদা। তা ছাড়া তোমার রোগা শরীর। দৈবাৎ পা পিছলে আছাড় খেলে কী হবে ভেবেছ?
দিদিমা মায়ের আপত্তি গ্রাহ্য করলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বললেন,–এই পুঁটুদাদা আমার সঙ্গী হবে। তুমি কিচ্ছু ভেব না।
বেগতিক দেখে মা ডাকলেন,–ছোটকু! ও ছোটকু!
ছোটকু মানে আমার ছোটমামা। ছোটমামা আমাদের বাড়িতে থেকে মহকুমাশহরের কলেজে পড়তে যেতেন। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গেছে। স্টেশনও আছে। ছোটমামা ট্রেনে চেপে কলেজ যেত।
মায়ের ডাকাডাকিতে ছোটমামার সাড়া পাওয়া গেল না। যাবে কী করে? ছোটমামাকে দুপুরে খাওয়ার পর সেজেগুজে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলুম। মাকে কথাটা জানিয়ে দিলুম। মা খাপ্পা হয়ে বললেন,–আসুক ছোটকু। দেখাচ্ছি মজা। ও থাকলে তোমাকে নিয়ে যেত।
দিদিমা বললেন,–আমার পুঁটুদাদামণিই যথেষ্ট। চলো ভাই!
মা আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, দিদার সঙ্গী হয়ে তুমি যেন ভিড়ে হারিয়ে যেও না। দিদার একটা হাত শক্ত করে ধরে থাকবে।
আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আমার মায়ের সাড়া পেলুম। দিদিমার কাছে এসে তিনি বললেন,–এই ছাতিটা নিয়ে যাও মা! বৃষ্টিতে ভিজলে রোগা শরীরে আবার কী রোগ বাধিয়ে বসবে।
এবার দিদিমা চটে গেলেন। রথযাত্রার মেলায় ছাতি মাথায় যাব? তুই জানিস? রথের পরবে বিষ্টিতে ভিজলে পুণ্যি হয়!
মা গম্ভীরমুখে বাড়ি ঢুকে গেলেন। দিদিমার একটা হাত ধরে আমি বললুম,– তুমি ঠিক বলেছ দিদা। বিষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভালো লাগে।
শর্টকাটে ঠাকরুনতলা আমাদের বাড়ি থেকে তত কিছু দূর নয়। সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানের পাশ দিয়ে একটা ঘাসে ঢাকা পোড়ো জমি পেরিয়ে আমরা শিগগির রথের মেলায় পৌঁছে গেলুম। তারপরই পাঁপড়ভাজার গন্ধে জিভে জল এসে গেল। বললুম,–ও দিদা! আগে পাঁপড়ভাজা খাব।
দিদিমা বললেন, খাবে বইকী। তুমি-আমি দুজনেই খাব। আগে রথদর্শন করি। তারপর অন্য কিছু।
এই মেলায় রথদর্শন ও প্রণাম ছিল মূল আকর্ষণ। জমিদারবাড়িতে একটা পেতলের রথ ছিল। সেটা রথযাত্রার দিন টেনে এনে ঠাকুরতলার শেষপ্রান্তে রাখা হতো। মাথায় লাল কাপড়ের ফেট্টিবাঁধা পাইকরা লাঠি উচিয়ে সেই রথ পাহারা দিত। ভক্ত মানুষজন দূর থেকে প্রণাম করত।
কিন্তু সেই রথের দিকে দিদিমা এগোতেই পারলেন না। মা যেমন বলেছিলেন,–বিচ্ছিরি কাদা! বড্ড বেশি ভিড়!
অগত্যা দিদিমা বললেন, আয় পুঁটুদাদা! ভিড় কমুক। তখন রথদর্শন করব।
আমি জেদ ধরলুম। তাহলে ততক্ষণ পাঁপড়ভাজা খাওয়াও দিদা! নইলে আমি তোমাকে একা রেখে দৌড়ে বাড়ি চলে যাব।
দিদিমা তখন আর কী করেন! ভিড় এড়িয়ে একটা পাঁপড়ভাজার দোকানে গেলেন। আমাকে একখানা পাঁপভাজা কিনে দিয়ে সম্ভবত লোভ সম্বরণ করতে, পারলেন না। নিজেও একখানা পাঁপড়ভাজা কিনে ফেললেন। আর সেই সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ মেলার মানুষজন সেই বৃষ্টিকে পাত্তা দেয়নি। ক্রমে বৃষ্টি বাড়তে থাকলে হইহট্টগোল শুরু হয়ে গেল। দিদিমা আমার হাত ধরে টানতে টানতে ভাগ্যিস মেলার একপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে দুজনেই ভিড়ের চাপে দলা পাকিয়ে কাদায় পড়ে থাকতুম।
বৃষ্টি যত বাড়ছিল, তত মেঘ গর্জে উঠছিল। বিদ্যুতের ঝিলিক এবং মুহুর্মুহু কানে তালাধারানো মেঘগর্জন। এদিকে দুজনেই ভিজে কাকভেজা হয়ে যাচ্ছি। দিদিমা ব্যস্তভাবে বললেন,–ও পুঁটু! বাড়ি ফিরে চলো।
আবার সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ গিয়ে দুজনে ফিরে আসছিলুম। হঠাৎ দিদিমা বললেন,–এখানে গাছতলায় একটুখানি দাঁড়াও পুঁটু! আমি যে আর হাঁটতে পারছিনে।
বলে তিনি বসে পড়লেন। ততক্ষণে চারদিক কালো হয়ে এসেছে। একটু দূরে মেলার আলোগুলো জুগজুগ করছে। আমার অবস্থা তখন ভ্যা করে কেঁদে ওঠার মতো। বললুম,–দিদা! এবার ওঠো!
দিদিমা কান্নাজড়ানো গলায় বললেন,–ও পুটু! আমি যে উঠতে পারছিনে। কোমরের পেছনে কে যেন কামড়ে ধরেছে।
শুনেই আমি প্রচণ্ড ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম,–ছোটমামা! ও ছোটমামা!
ছোটমামা কোথায় আছেন, তা জানতুম না। কিন্তু আমার গলা দিয়ে ওই কথাই বেরিয়ে গেল। দিদিমা যতবার ব্যথায় ককিয়ে উঠছিলেন, ততবার আমি ছোটমামাকে ডাকছিলুম।…
এরপর কীভাবে দিদিমা আর আমি বাড়ি ফিরেছিলুম, তা সবিস্তারে বলছি না। আমাদের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে মা ছোটমামা আর বাবাকে ঠাকরুনতলায় পাঠিয়েছিলেন। মেলায় আমাদের খুঁজে না পেয়ে তারা শর্টকাটে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ দিয়ে আসছিলেন। তারপর টর্চের আলোয় আমাদের দেখতে পান।
বাড়ি ফিরে ছোটমামা হাসতে-হাসতে মাকে বলেছিলেন,–জানো দিদি? টর্চের আলো ফেলে দেখি, পুঁটু তখনও পাঁপড়ভাজা খাচ্ছে আর আমাকে ডাকাডাকি করছে। এদিকে মা-ও কিন্তু হাত থেকে পাঁপভাজা ফেলে দেয়নি।
এই নিয়ে সে-রাত্রে বাড়িতে খুব হাসিতামাশা হল। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, দিদিমা যে ঘরে শুয়েছিলেন, সেই ঘরের দরজার সামনে পাড়ার মহিলাদের ভিড়। বাবা গম্ভীরমুখে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। দিদিমার ঘর থেকে চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। বাবাকে কিছু জিগ্যেস করতে সাহস হল না।
একটু পরে ছোটমামার সঙ্গে আমাদের গ্রামের ডাক্তার নাডুবাবু বাড়ি ঢুকলেন। ছোটমামার হাতে তাঁর ডাক্তারি বাকসো। নাড়ুবাবুকে দেখে পাড়ার মহিলারা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। সেই সুযোগে আমি গিয়ে দরজায় উঁকি দিলুম। দেখলুম, দিদিমা বিছানায় শুয়ে আছেন এবং মাঝে-মাঝে আর্তস্বরে বলছেন, উঁহুহুহু! ও ঠাকুর! এ কী হল? কে আমার কোমরে কামড়ে দিল?
নাড়ডাক্তার দিদিমাকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন,–পুরোনো বাত। সারতে একটু দেরি হবে।…..
যাই হোক, দিদিমা সেই যে শয্যাশায়িনী হলেন তো হলেন। নাড়ডাক্তারের মোক্ষম সব ইঞ্জেকশন আর ওষুধে কাজ হল না। এরপর শহরের ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন বাবা। তিনিও দিদিমাকে বিছানা থেকে ওঠাতে পারলেন না। কোমরের যন্ত্রণাও কমল না। শেষে এলাকার নামকরা কবিরাজমশাইকে আনা হল। লোকে তাকে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী বলত। কিন্তু তাঁর ওষুধেও কাজ হল না। আমার মনে পড়ে, প্রতিদিন ভোরবেলা হামানদিস্তার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। দেখতুম, মা বারান্দায় বসে ছোট্ট গোলাকার লোহার পাত্রে একটা ছোট্ট লোহার ডাণ্ডা দিয়ে কিছু পিষছেন। ছোটমামার কাছে শুনেছিলুম, ধন্বন্তরী কবিরাজমশাইয়ের দেওয়া ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে। সেই ওষুধ দিদিমার কোমরে প্রলেপ দেওয়া হবে।
কিছুদিন পরে এক রবিবার সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা দিদিমাকে দেখতে এলেন। তিনিই মাকে পরামর্শ দিলেন, সবরকম চিকিৎসা তো করা হল। কিন্তু কাজ হল না। এবার টোটকা ওষুধ বা তুকতাক, মন্তরতন্তরে যদি বাত সারে, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
মা বললেন,–আমিও তা-ই ভাবছিলুম। কিন্তু তেমন কাকেও পাচ্ছি কোথায়?
সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা বললেন,–কেন? তেমন লোক তো হাতের কাছেই আছে। কথায় বলে, গেঁয়ো যোগী ভিক্ষে পায় না।
–কে সে?
–মোনা-ওঝা। আবার কে? ওই যে তোমার মা বারবার বলেন, কোমরে কে কামড়ে ধরে আছে, তাতেই তো আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল। তোমরা কী ভাববে বলে কথাটা বলিনি। আমাদের আমবাগানে একটা গাছ আছে। সেই গাছের তলায় বৃষ্টির সময় তোমার মা-থাকগে ওসব কথা। মোনাকেই ডাকো!
কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলুম। আমার মনে পড়েছিল, সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে দুলেপাড়ার একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কী ভুল! কী ভুল! রথের মেলায় যাওয়ার দিন সেই কথাটা একেবারে মনে ছিল না! নির্ঘাত আমরা সেই গাছটারই তলায় বৃষ্টির সময় আশ্রয় নিয়েছিলুম।
ছোটমামা বিকেলে মোনা-ওঝাকে ডেকে নিয়ে এলে ওর প্রমাণ মিলল। মোনা ওঝার মাথায় জটা, মুখে গোঁফদাড়ি। কপালে লাল ত্রিপুক আঁকা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কাঁধের তাপ্লিমারা গেরুয়া রঙের ঝোলা থেকে সে একটা মড়ার খুলি বের করে দিদিমার ঘরে ঢুকল। তারপর মেঝেয় বসে মড়ার খুলিটা রেখে সে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ডাকল, ওগো মা! ও জননী! বলুন তো আপনার কোথায় ব্যথা?
দিদিমা ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বললেন,–কোমরের পেছনে।
–ব্যথাটা কীরকম বলুন তো মা?
দিদিমা একটু ককিয়ে উঠে বললেন,–কে যেন কামড়ে ধরে আছে।
মোনা-ওঝা হি-হি করে হেসে বলল,-বুঝেছি! বুঝেছি! এবার বলুন তো মা জননী, কবে কখন ব্যথাটা শুরু হয়েছিল?
মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মোনা তাঁকে চোখের ইশারায় চুপ করাল। দিদিমা অতিকষ্টে বললেন, পুঁটুর সঙ্গে রথের মেলায় গিয়েছিলুম। হঠাৎ বিষ্টি এল। আমরা সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে এসে–
মোনা-ওঝা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,–থাক, থাক। আর বলতে হবে না। বলে সে মড়ার খুলিটার দিকে রাঙা চোখে তাকাল। –শুনলি তো বাবা মা-জননীর কথাটা? এবার তুই আমার কানে কানে বলে দে, কী করে ওই হতচ্ছাড়ি পেতনিটাকে তাড়ানো যায়?
সে মড়ার খুলিটা কানের কাছে কিছুক্ষণ ধরে ফোঁস করে সশব্দে শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,–হুঁ। গলায় দড়ি দিয়ে মরা আত্মা। পেতনি হয়ে গেছে। মা-জননীর কোমর কামড়ে ধরে জ্যান্ত মানুষদের ওপর রাগ দেখাচ্ছে।
বলে মোনা-ওঝা মায়ের দিকে তাকাল,–দিদি! খুলেই বলছি। এ পেতনিকে তাড়ানো আমার কম্ম নয়। কালিকাপুরে বাবা কন্ধকাটার থান আছে। সেই থানের খানিকটা মাটি তুলে এনে মা-জননীর কোমরে মাখিয়ে দিলেই পেতনিটা পালিয়ে যাবে।
ছোটমামা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, কালিকাপুর আমি চিনি। গতবার ফুটবল খেলতে গিয়ে একটা রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলুম। জায়গাটা একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে।
মোনা-ওঝা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,–বাবা কন্ধকাটার থান সেই জঙ্গলের মধ্যিখানে। একটা ভাঙা দেউড়ি এখনও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা বটগাছ। বটগাছের তলায় বাবা কন্ধকাটার থান।
ছোটমামা বললেন, কুছ পরোয়া নেই। এখনই বেরিয়ে পড়ছি। সওয়া চারটের ট্রেনটা পেয়ে যাব। মোটে তিনটে স্টেশন।
মোনা জিভ কেটে বলল,–ওঁ হুঁ হুঁ হুঁ! কন্ধকাটা কথাটা দাদাবাবু কি বুঝতে পেরেছেন? মুন্ডু নেই। বুকের দুপাশে দুটো চোখ। সাংঘাতিক ব্যাপার! আপনাকে থানে দেখতে পেলেই সর্বনাশ। তিনি বটগাছে লুকিয়ে থাকেন।
মা করুণমুখে বললেন, তা হলে তুমি নিজেই সেই থানের মাটি এনে দাও না মোনা!
মোনা হাসল।-ওরে বাবা! আমাকে থানের ত্রিসীমানায় দেখলে বাবা কন্ধকাটা রে-রে করে তেড়ে আসবেন। তবে তাঁর থানের মাটি আনার সহজ উপায় আছে। বাবা কন্ধকাটা ছোটদের খুব ভালোবাসেন। এই খোকাবাবু থানে গিয়ে এক খাবলা মাটি তুলে রুমালে বেঁধে আনে, বাবা মোটেও রাগ করবেন না।
কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠে বললুম, আমি একা ওখানে যেতে পারব না।
ছোটমামা বললেন,–কী বোকার মতো কথা বলছিস পুটু? আমি তোর সঙ্গে যাব। তারপর আমি ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকব। তুই থানের মাটি নিয়ে আসবি। কিচ্ছু ভাবিস নে! কন্ধকাটা হোক, আর যে ব্যাটাচ্ছেলেই হোক, আমার সামনে এলে অ্যায়সা একখানা ঝাড়ব না–কথা শেষ না করে ছোটমামা ফুটবলে কিক করার ভঙ্গি তে শূন্যে লাথি ছুড়লেন।
তারপর ছোটমামা আমার একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বারান্দায় গেলেন। বললেন,-এক মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে। আমি রেডি হয়েই আছি। চারটে বাজে। স্টেশনে পৌঁছতে এখনও প্রচুর সময় আছে। এই ট্রেনটা দৈবাৎ লেট করলে তো ভালোই হবে।…
তখনকার দিনে ট্রেনে বা বাসে মোটেও ভিড় হতো না। লোকেরা পায়ে হেঁটেই যাতায়াত পছন্দ করত। ট্রেনে যে কামরায় আমরা উঠেছিলুম, তাতে মোটে জনাতিনেক যাত্রী। তারা পরস্পর দুরে জানালার কাছে বসে ছিল। ছোটমামা নিজে একটা জানালার ধারে বসে বললেন, তুই আমার পাশে বোস পুটু! জানালার ধারে বসলে কয়লার গুড়ো এসে চোখে ঢুকে যাবে।
একটু তফাতে এক ভদ্রলোক জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর মাথায় সিঁথিকরা লম্বা ঘাড় ছুঁই-ছুঁই কঁচাপাকা চুল। পরনে ধুতি আর ছাইরঙা পাঞ্জাবি। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর নাকের পাশে মোটা একটা জডুল। কাঁধের ব্যাগটা পাশে সিটের ওপর রেখে তিনি চিবুকে একটা হাত এবং মাথায় একটা হাত চেপে মাথাটা নড়িয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা ছোটমামারও চোখে পড়েছিল। ফিসফিস করে বললেন,-পাগল নাকি রে?
আশ্চর্য ব্যাপার! ট্রেনের তুলকালাম শব্দের মধ্যেও কথাটা কি ভদ্রলোকের কানে গেল? তিনি একটু হেসে বললেন, পাগল হইনি এখনও! তবে পাগল হতে বেশি দেরি নেই!
ছোটমামা বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি নিজের মুন্ডুটা ধরে অমন করে নাড়ানাড়ি করছেন কিনা? তাই মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে।
ভদ্রলোক এবার দুটো হাত দুই গালে চেপে মাথাটা কিছুক্ষণ নাড়ানাড়ি করে বললেন,–এই এক বিপদ হয়েছে আমার। মুন্ডুটা কিছুতেই ঘাড়ের সঙ্গে ফিট করছে না।
ছোটমামা জিগ্যেস করল, আপনার ঘাড়ে কি বাত হয়েছে?
–কেন? কেন?
–মানে আমার মায়ের কোমরে বাত হয়েছে তো! সাংঘাতিক বাত। মা দিদিকে বলেন, তার কোমর ধরে আপনার মতো নাড়ানাড়ি করো। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। তাই আমরা যাচ্ছি কালিকাপুরে বাবা কন্ধকাটার থানে।
ভদ্রলোক এবার খিকখিক করে হেসে বললেন, আরে! আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি।
ছোটমামা গম্ভীরমুখে বললেন,–বাবা কন্ধকাটা তার থানে বড়দের দেখতে পেলেই রে-রে করে তেড়ে আসেন। তাই এই যে দেখছেন ভাগনে পুটু। একে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। বাবা কন্ধকাটা ছোটদের খুব ভালোবাসেন।
–তাই বুঝি? তা তোমার ভাগ্নে সেখানে গিয়ে কী করবে?
–থানের মাটি খাবলে তুলবে। রুমালে বেঁধে নিয়ে আসবে। সেই মাটি গুলে মায়ের কোমরে মাখিয়ে রাখলে বাত সেরে যাবে, বুঝলেন?
ভদ্রলোক আবার দু-হাত দিয়ে তার মুন্ডুটা নাড়ানাড়ি শুরু করলেন। তারপর বললেন, উঃ! বড্ড জ্বালায় পড়া গেল দেখছি। মনে হচ্ছে যেন আমার মুভুটা ঘাড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছোটমামা বললেন, আপনি কিছু ভাববেন না। বাবা কন্ধকাটার থানে যাওয়া পর্যন্ত মুন্ডুটাকে চেপে ঘাড়ে বসিয়ে রাখুন। তারপর আপনি আর আমি ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকব। আর পুঁটু আপনার জন্যও খানিকটা মাটি এনে দেবে। ওখানে একটা ঝিল আছে দেখেছি। আপনি মাটিগুলো তুলে কাদা করে মুন্ডুর পেছনদিকে ঘাড় অব্দি মাখিয়ে রাখবেন। ব্যস!
ভদ্রলোক শুধু বললেন,–দেখা যাক।…
কালিকাপুর স্টেশনে নামবার পর একদল বরযাত্রী বরকনে নিয়ে হইহই করে ট্রেনে উঠছিল। সেই ভিড়ে ভদ্রলোককে আর দেখতে পেলুম না।
কথাটা ছোটমামাকে বললুম। ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,–ছেড়ে দে তো পাগলের কথা। দেখেই বুঝেছিলুম বদ্ধপাগল। পা চালিয়ে চল। সাড়ে ছটার ট্রেনে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।
কিছুক্ষণ পরে ছোটমামা হাঁটার গতি কমালেন। সামনেই ধ্বংসস্তূপ আর ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতরে উঁচু ভাঙা পাঁচিল দেখা যাচ্ছিল। সেটা লক্ষ করে দুজনে জঙ্গলে ঢুলুম। তারপর বটগাছটাও চোখে পড়ল। ছোটমামা একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে ফিসফিস করে বললেন, কুইক পুঁটু! মাটিটা বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে। এই রুমালটা নে। যতটা পারবি, খাবলে মাটি তুলে নিবি। চলে যা।
ভয়ে-ভয়ে এগিয়ে গেলুম। উঁচু ভাঙা পাঁচিলের পাশে বটগাছটার কাছে গিয়ে দেখলুম, গুঁড়ির নিচে একটা প্রকাণ্ড ইটের চাঙড়। তার ওপর একটা মড়ার খুলি।
খুলিটা দেখামাত্র আঁতকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এলুম। কিন্তু দিদিমার বাতের কষ্টের কথা মনে পড়ল। তখন সেখানেই গুঁড়ি মেরে বসে রুমাল বিছিয়ে কয়েক খাবলা মাটি তুলে নিলুম। তারপর মাটিগুলো রুমালে বেঁধে সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, তখনই দেখলুম ট্রেনের সেই ভদ্রলোক পাঁচিলের পাশ দিয়ে চুপিচুপি আসছেন। তাঁর দৃষ্টিটা মড়ার খুলির দিকে।
তারপর দেখলুম, ভদ্রলোক তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা মড়ার খুলি বের করলেন এবং ইটের চাঙড়ে সেই খুলিটা রেখে থানের মড়ার খুলিটা তুলে নিয়ে পাঁচিলের আড়ালে উধাও হয়ে গেলেন।
ছোটমামা ঝোঁপের আড়ালে থেকে ব্যাপারটা দেখছিলেন। এবার ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,–আয় তো পুঁটু! ব্যাপারটা দেখি।
ছোটমামা তখন বেপরোয়া। বাবা কন্ধকাটার কথা ভুলে ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে দৌড়ে গেলেন। আমিও ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। কিছুটা দৌড়ে গিয়েই ভদ্রলোককে দেখা গেল। তিনি সামনের দিকে হনহন করে এগিয়ে চলেছেন। ছোটমামা চেঁচিয়ে উঠলেন,–ও মশাই! ও মশাই! শুনুন! শুনুন!
ভদ্রলোক মুখটা ঘোরালেন। দেখে চমকে উঠলুম। এ মুখ তো সেই মুখ নয়। লম্বা চুল নেই। প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। ট্রেনের তিনি ছিলেন ফরসা। ইনি কুচকুচে কালো। অথচ সেই ছাইরঙা পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি।
ছোটমামার একরোখা জেদি স্বভাব আমার জানা। দৌড়ে তার কাছাকাছি গিয়ে আবার যেই বলেছেন,–ও মশাই। ব্যাপারটা কী? অমনি ভদ্রলোক আবার মুখ ঘোরালেন। বিকেলের রোদ পড়েছিল সেখানে। আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে দেখলুম, এবার আর মানুষের মুখ নয়। আস্ত মড়ার খুলি।
ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর তারপরই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। আমার পাশ দিয়ে কী একটা ছুটে গেল। আমি আতঙ্কে প্রায় কেঁদে উঠে ডাকলুম,– ছোটমামা! ছোটমামা!
ছোটমামাও যেন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার ডাক শুনে দৌড়ে চলে এলেন। তারপর দেখলুম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সেই কঙ্কালের সঙ্গে গেরুয়া খাটো লুঙ্গিপরা আর একটা কঙ্কালের ঘুষোঘুষি চলেছে। ছোটমামা হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, কী বিচ্ছিরি ব্যাপার! ছ্যা-ছ্যা! মরে গিয়েও কি মারামারি করা উচিত? বল তো পুঁটু!
কান্নাজড়ানো গলায় বললুম,–ছোটমামা! আমরা পালিয়ে যাই।
ছোটমামা আমার হাত থেকে রুমালে বাঁধা মাটিগুলো নিয়ে বললেন,–পালাব কেন রে? আস্তেসুস্থে যাব। মরুক ব্যাটাচ্ছেলেরা মারামারি করে! ছ্যা-ছা! এ কি ভদ্রলোকের কাজ? বাবা কন্ধকাটা হয়তো মজা দেখছেন।
চলে আসবার আগে দেখলুম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কঙ্কাল আর গেরুয়া খাটো লুঙ্গিপরা কঙ্কাল পরস্পরকে জাপটে ধরে একটা ঝোঁপের মধ্যে প্রচণ্ড লড়ে যাচ্ছে। আর ঝোঁপটা খুব নড়ছে।…
এসবের চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা কন্ধকাটার থানের মাটি দিদিমার কোমরে মাখিয়ে রাখার পরদিনই তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতে পেরেছিলেন। মোনা-ওঝা এসে ছোটমামার মুখে সব ঘটনা শুনে বলেছিল, লড়াইটা খুলি বদলের। বুঝলেন ছোটবাবু? গত বছর অনেক জায়গায় খুব বানবন্যা হয়েছিল। অনেক মানুষ জলে ডুবে মারা পড়েছিল। সে-ও তো অপঘাতে মরণ। আর অপঘাতে মরলেই মানুষ ভূত হয়ে যায়। কিন্তু ভূত হলে কী হবে? দেহের ওপর মায়া কি সহজে যায়? কিন্তু দেহ তো তখন কঙ্কাল! আমার মনে হচ্ছে, ওই দুই ভূতের মধ্যে খুলি বদল হয়ে গিয়ে গণ্ডগোল বেধেছিল।
ছোটমামা বলেছিলেন,–ঠিক বলেছ মোনাদা! একজন ছিলেন সাদাসিধে ভদ্রলোক। অন্যজন ছিলেন কোনও সাধুবাবা।
দিদিমা বলেছিলেন, তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু যে যার নিজের খুলি ফেরত পেয়ে মারামারি বাধাল কেন?
ছোটমামার অমনি জবাব, মনে হচ্ছে, সাধুবাবার ভূতের জন্য সেই ভূত ভদ্রলোক যে খুলিটা থানে রেখেছিলেন, সেটা সাধুবাবার খুলিই নয়। মাথায় ফিট করেনি বলেই দৌড়ে গিয়ে সাধুবাবা খটাখট ঘুষি মারছিল ভূত-ভদ্রলোককে।
মোনা-ওঝা খিকখিক করে হেসে বলেছিল,–ওসব কথা থাক। মা-জননীর কোমর থেকে পেতনিটা পালিয়ে গেছে। তবে জোরে কামড়ে ধরেছিল তো? তাই ব্যথা পুরোপুরি সারতে আর দিনতিনেক লাগবে।
হ্যাঁ। মোনা ঠিকই বলেছিল। তিনদিন পরে দিদিমা দিব্যি হাঁটাচলা করতে পেরেছিলেন।…
গেছোবাবার বৃত্তান্ত
ঝিলের ধারে বসে ছোটমামা মুগ্ধচোখে চঁদ দেখতে-দেখতে বলছিলেন,–আচ্ছা পুঁটু, সত্যি করে বল তো, ওই চাঁদে আমেরিকানরা হেঁটেছে, বিশ্বাস হয়? অসম্ভব পুঁটু, অসম্ভব। কবি লিখেছেন, এমন চাঁদের আলোয় মরি যদি সেও ভালো সে-মরণ স্বৰ্গসমান…।
ঠিক এই সময়ই বাঁ-দিকে কোথাও আবছা খসখস-মচমচ শব্দ শুনতে পেলাম। ভাঙা শিবমন্দির খুঁড়ে মস্ত বটগাছ। হাওয়া-বাতাস বন্ধ। সন্দেহজনক শব্দটা সেই গাছের ভেতর থেকে ভেসে এল।
গা ছমছম করতে থাকল। সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটমামাকে ইদানীং পদ্যে পেয়েছে। চাঁদ, ফুল, পাখি প্রজাপতি নিয়ে শখানেক পদ্য লিখে ফেলেছেন। কিন্তু নিছক লিখেও যেন ওঁর তৃপ্তি নেই, জিনিসগুলো অর্থাৎ ফুল, পাখি, প্রজাপতি, নেড়ে-ঘেঁটে দেখতে বেজায় তৎপর। এদিনই সকালে একটা প্রজাপতির পেছনে যেভাবে ছুটোছুটি করছিলেন! যাই হোক, তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমাকে নিয়ে টানাটানিতেই আমি অস্থির। নিরিবিলি শুনশান ঝিলের ধরে ভাঙা মন্দির নিয়ে কত ভুতুড়ে গল্প চালু আছে। দিনদুপুরেই সেদিকটাতে পারতপক্ষে কেউ পা বাড়ায় না। এখন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। জ্যোৎস্নায় চারদিকে যেন একশো ভূত। তার ওপর হঠাৎ বটগাছটটা থেকে ওইসব শব্দ।
ভয়ে-ভয়ে বললুম,–ছোটমামা, এবার বাড়ি ফেরা যাক।
ছোটমামা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিলেন। একটু রেগে গিয়ে বললেন,-দিলি তো পদ্যটা নষ্ট করে। বেশ একটা লাইন এসেছিল!
তখনই ধুপ করে শব্দ হল এবং চমকে উঠে দেখলুম, বটতলার চকরা-বকরা আলোছায়ায় কালো কী একটা পড়ল। তারপর সেটা চার পায়ে হেঁটে কঁকা জায়গায় গেল, সেখানে ঝলমলে জ্যোৎস্না। হনুমানই হবে তাহলে।
কিন্তু হঠাৎ প্রাণীটা দু-পায়ে সিধে হল এবং সোজা আমাদের দিকে হেঁটে এল। ছোটমামাকে আঁকড়ে ধরেছিলুম সঙ্গে-সঙ্গে। ছোটমামা পুঁটে-বলে হাঁক ছেড়েই চুপ করে গেলেন। এবার তিনিও প্রাণীটিকে দেখতে পেয়েছিলেন।
প্রাণীটি আমাদের অবাক করে বলে উঠল, কী রে? ভয় পেয়েছিস নাকি? পাসনে। আমি সেই গেছোবাবা।
মানুষের গলায় কথা শুনে ছোটমামার সাহস ফিরে তো এলই, পদ্যের লাইনে বাধা পড়ায় ভেতর-ভেতর খাপ্পা হয়েও ছিলেন। তেড়েমেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,–গেছোবাবা মানে?
গেছোবাবা খি-খি করে হেসে বলল,–সে কী রে? আমার কথা শুনিসনি? আমি গেছোবাবা, গাছে-গাছে থাকি। গাছেই আমার বসবাস। তবে তোরা আজকালকার ছেলে, আমায় চিনবিই বা কী করে? চিনত তোদের ঠাকুরদা, তাদের ঠাকুরদা, তস্য তস্য ঠাকুরদা! ওরে বয়েসটা তো কম হল না। সেই যেবার লর্ড ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধ জিতে তোদের এই টাউনে ঢুকল…
ওয়েট! ওয়েট!–ছোটমামা থামিয়ে দিলেন।–পলাশির যুদ্ধ? মানে…সেভেনটিন ফিফটি সেভেন! তার মানে তুমি বলতে চাও, তোমার বয়স…পুঁটে, হিসাব কর তো।
গেছোবাবা বলল, খামোকা ছেলেটাকে আঁক কষিয়ে হবেটা কী? তোরা এই যে আমার দর্শন পেলি, সেই তোদের বাপের ভাগ্যি। গড় কর এক্ষুনি! গড় কর!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গড় করতে যাচ্ছি, ছোটমামা আমার চুল খামচে ধরে আটকালেন। বললেন,–ওয়েট, ওয়েট। যাচাই করে নিই। ওহে গেছোবাবা, তুমি এতকাল বেঁচে আছো বলতে চাও? ফ্রম এইটিনথ সেঞ্চুরি। অমৃত খেয়েছিলে নাকি?
ছোটমামার বাঁকা হাসি শুনে গেছোবাবা বলল,–খেলেও খেয়েছি, না খেলেও না খেয়েছি।
ছোটমামা চার্জ করলেন, হেঁয়ালি ছাড়। কে তুমি? নাম কী?
নাম একটা ছিল বটে! ভুলে গেছি। –গেছোবাবা মাথা চুলকে বলল, গাছে বসত করতে গিয়ে গেছোবাবা নাম পেয়েছিলুম। তখনকার লোকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত। যে গাছে থাকতুম, তার তলায় খাবার রেখে যেত। আজকাল কী যে হয়েছে। লোকে আমাকে ভুলেই গেছে রে! বড় দুঃখ হয়।
লতাপাতা খাই। কখনও ফলমাকড়টা খাই। এই বলে গেছোবাবা পাশের একটা ঝোঁপ থেকে লতা-পাতা ছিঁড়ে চিবোতে শুরু করল। চিবোতে-চিবোতে বলল,–এগুলো একটু তিতকুটে। তবে মোটের ওপর মন্দ না। তোরাও খা না! খেয়ে দ্যাখ!
ছোটমামা কয়েক পা এগিয়ে গেলেন! বুঝলুম, গেছোবাবা সত্যিসত্যি পাতা খাচ্ছে কি না দেখতে গেলেন। আমি অবাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলুম। ছোটমামা বললেন, কী অদ্ভুত! তুমি যে দেখছি সত্যিই পাতা খাচ্ছ। ওহে গেছোবাবা, এগুলো খেয়ে তোমার বদহজম হয় না?
হলে হয়, না হলেও না হয়–গেছোবাবা ঢেকুর তুলে বলল। তা অত কথায় কাজ কী তোদের? বড় ভাগ্যে দর্শন পেলি। এবার গড় করে চলে যা। নইলে অমঙ্গল হবে।
ছোটমামা ফের চার্জ করলেন, কী অমঙ্গল হবে, শুনি?
গেছোবাবা বলল,–পুলিশ ধরবে। জানিস তো? বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো দুগুণে ছত্রিশ। নে, গড় কর। গড় কর!
গেছোবাবা নিজের পা দেখতে থাকল লম্বা হাতে। চেহারাও লম্বা। জ্যোৎস্নায় ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সন্ন্যাসীদের মতো ঝাকড়-মাকড় চুলদাড়ি, খালি গা, পরনে কৌপিন। ছোটমামা একটু দোনোমনো করে বললেন,–খামোকা পুলিশে আমাদের ধরবে কেন? আমরা চোর না ডাকাত?
গেছোবাবা হিঁ-হিঁ শব্দ করে ভুতুড়ে হাসল। পাঁচুকে জিগ্যেস করিস সেসব কথা। পাঁচুকে দর্শন দিয়েছিলুম। ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে গড় করেনি। তারপর আর কী! ছমাস ঘানি টানতে হয়েছিল জেলে। এক মাস পাথর ভেঙে-ভেঙে হাত দুখানায় কড়া পড়ে সে এক অবস্থা! গড় কর, গড় কর!
কথাগুলো শুনতে-শুনতে কী এক ভয়ে ঝটপট গড় করে ফেললুম। ছোটমামা একটু তফাতে, বাধা দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। গেছোবাবা আশীর্বাদ করলেন হাত তুলে,-জিতা রহো বেটা! আর ছোটমামার কী হল, জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
গেছেবাবা যেন রাগ করেই আগের মতো চার পা হল এবং ঠিক হনুমানের মতো দৌড়তে-দৌড়তে বটগাছের দিকে নিপাত্তা হয়ে গেল।
এবার ছোটমামা আরও অবাক হয়ে বললেন, কী অদ্ভুত! মানুষ না হনুমান? তারপর আমার দিকে তেড়ে এলেন, তুই ওই হনুমানটাকে গড় করলি। রামায়ণের হনুমানজি হলে কথা ছিল। তুই কী রে পুঁটু?
এই সময় পেছনে দিক থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল আমাদের ওপর। তারপর মাটি কাঁপিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে কেউ এগিয়ে আসতে-আসতে গম্ভীর গলায় বলে উঠল, কারা ওখানে? কী হচ্ছে রাতবিরেতে, আঁ?
ছোটমামা সঙ্গে সঙ্গে কেঁচো হয়ে গেলেন, বললেন, বড়বাবু নাকি? নমস্কার, নমস্কার!
থানার দারোগা বন্ধুবাবুর এমন অতর্কিত আবির্ভাবে আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠছিল। গেছোবাবার কথাটা তাহলে হাতেনাতে ফলতে চলেছে। লোকে বলাবলি করে, এমন ডাকসাইটে পুঁদে পুলিশ অফিসার নাকি কেউ কখনও দ্যাখেনি। চোর-ডাকাত তল্লাট ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। আমাদের ছোট্ট শহরে আজকাল প্রচুর শান্তি।
বঙ্কুবাবু প্রকাণ্ড মানুষ। টর্চ নিভিয়ে বললেন, হুম! আপনারা এখানে কী করছেন?
ছোটমামা কাচুমাচু হেসে বললেন, চঁদ দেখছিলুম সার! দেখুন না কেমন সুন্দর চাঁদ-ফুল-মুন। এমন নিরিবিলি জায়গায় চাঁদ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই…
বঙ্কুবাবু থামিয়ে দিয়ে বললেন,–সঁদ! চাঁদের কী দেখার আছে? আঁ? নিরেট পাথর। বাতাস নেই। প্রাণ নেই। যেন শ্মশান! চালাকি ছাড়ুন!
ছোটমামা বলে উঠলেন, আমি যে কবি, সার! পোয়েট!
পদ্য লেখেন? বন্ধু দারোগা অট্টহাসি হাসলেন, যেন ভূমিকম্প হতে থাকল। পদ্য লিখেই বাঙালি জাতটা উচ্ছন্নে গেছে। কখনও পদ্য লিখবেন না। আর একটু আধটু যদিবা লেখেন, দ-াদ নয়। চাঁদে আছেটা কী মশাই? বলে আমার ওপর টর্চের আলো ফেললেন। –এটি কে?
–আমার ভাগ্নে সার! পুঁটু।
–একেও লাইন ধরিয়েছেন দেখছি! অ্যাই থোকা, কোন ক্লাসে পড়ো?
ঢোক গিলে বললুম, ক্লাস এইট।
পড়াশোনা নেই? –বঙ্কুবাবু ধমক দিলেন। কতগুলো পদ্য লিখেছ অঙ্কের খাতায়? আমার ভাগ্নে পুঁচকে অঙ্কের খাতায় পদ্য লিখেছিল। তাকে কী করেছিলাম জানো?
ভয় পেয়ে বললুম,–আমি পদ্য লিখিনে। ছোটমামা বললেন, বেড়াতে যাচ্ছি, তাই সঙ্গে এলুম। এসেই গেছোবাবাকে দেখে
ছোটমামার চিমটি খেয়ে থেমে গিয়েছিলুম। বঙ্কুবাবু বললেন, কী বললে, কী বললে? গেছোবাবা না কী যেন?
আমি বলছি স্যার। ছোটমামা বললেন, একটা অদ্ভুত লোক সার। একটু আগে একটা লোক-জাস্ট একটা হনুমান সার!
–গাছেই নাকি থাকে। সেভেনটিন ফিফটি সেভেন–
এরপর কীভাবে এবং কী ঘটল গুছিয়ে বলতে পারব না। বন্ধুবাবু হুইসল বাজিয়ে দিলেন। আর ধুপধাপ শব্দে একদঙ্গল কনস্টেবল এসে পড়ল কোত্থেকে। বঙ্কুবাবু
ছোটমামাকে দেখিয়ে বললেন,-পাকড়ো ইসকো!
–খোকাবাবুকে নেহি। ঔর মরাধারি! তুম খোকাবুকো ঘর পঁহুচা দো!
.
বাবা আমার মুখে তার শ্যালকের খবর পেয়েই থানায় দৌড়েছিলেন। আমাকে ঘিরে ভিড় ঘরের ভেতর। মা, পিসিমা, দিদি, ঠাকুমা এবং শেষে ঠাকুরদা ও পিসেমশাইও চারদিক থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে আমাকে জেরবার করছিলেন। ছোটমামাকে কেন পুলিশে ধরল? চাঁদ দেখা কি বেআইনি? গেছোবাবার দর্শনও কি বেআইনি?
গেছোবাবার কথা বলতেই ঠাকুমা চমকে উঠে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। কপালে ঠেকান জোড়হাত, চোখ বন্ধ, ঠোঁট কঁপছিল। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঠাকুরদার দিকে তাকালেন। ঠাকুরদা আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠাকুমা আমাকে কাছে যেতে বললেন, আমি জানতুম! ঠিক জানতুম, বাবা ঝিলের ধারে শিবতলা তল্লাটেই আছেন। কেউ আমাকে পাত্তা দিত না।
পিসেমশাই বললেন,–এ গেছোবাবা ব্যাপারটা ঠিক মাথায় আসছে না। এটার সায়েন্টিফিক এক্সপ্লানেশন–
পিসিমা চোখ কটমট করে বললেন, তুমি তো নাস্তিক। তোমার মাথায় অনেক কিছুই-আসে না। সায়েন্টিফিক এক্সপ্লানেশন–সবখানেই সায়েন্স খাটে না। ও মা, বলো না!
উনি ঠাকুমার দিকে তাকালে ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে একটু করুণ হাসলেন। –তখন তোদের জন্মই হয়নি। ঝিলের ওদিকটায় সে কী জঙ্গল! দিনদুপুরে বাঘ বেরোত। সেই সময়কার কথা তো, প্রথমে দর্শন পেয়েছিল রামু-ধোপার বাবা রঘু। ঝিলে কাপড় কাঁচতে যেত সে। দিনমানে ঘাসের ওপর কাপড়গুলো শুকোতে দিত। শিবতলার ছায়ায় গিয়ে বসে থাকত। তারপর…।
দিদি বিরক্ত হয়ে বলল, আগে আসল কথাটা বলো!
রঘুই প্রথম দর্শন পায়। ঠাকুমা ভক্তিতে গদগদ হয়ে বললেন, ধুপ করে গাছ থেকে পড়লেন। রঘুকে বললেন, কী চাস বল? রঘুটা ছিল বড় বোকা। বলল। কী, টাউনের সব কাপড় যেন কাঁচতে পাই।
ঘর জুড়ে হাসি ফুটল। পিসিমা বললেন,–তাই বলল রঘু? কী বুদ্ধি!
ঠাকুমা বললেন,–তবে বাবার মাহাত্ম্য রে! রঘু যে কাপড়ই কাঁচত, তাই একেবারে ঝকমকে হয়ে উঠত। শেষে সোড়া না সাবান না, শুধু জলে চুবোলেই ময়লা কাপড় সাফ। এদিকে গেছোবাবার খবর রটে গেছে। টাউনসুদ্ধ লোক ঝিলের জঙ্গলে যায়। শিবতলায় যায়। কেউ দর্শন পায়। কেউ পায় না। বাবা থাকেন গাছে। গাছেই স্তবটব করেন। বলে ঠাকুরদার দিকে ঘুরলেন, বলো না, কীভাবে দর্শন পেয়ে ছিল?
ঠাকুরদা গম্ভীরমুখে বললে,–আমার ছিল শিকারের নেশা। সেবার ঝিলের জঙ্গলে একটা বাঘ বড় বেশি উপদ্রব করছিল। বন্দুক নিয়ে বাঘটা মারতে গেছি, হঠাৎ একটা গাছ থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। চমকে উঠে দেখি, গাছের ডালে এক সাধুবাবা। বললেন, খবরদার বাঘ মারবিনে। বাঘটা আমার এক চেলা। তারপর কথাটা বলেই এক গাছ থেকে আর-এক গাছে, ঠিক যেন–
দিদি বলে উঠল, টারজানের মতো! টারজানের মতো!
ঠাকুরদা তাঁর গল্পে বাধা পড়ায় খাপ্পা হয়ে ধমক দিতে যাচ্ছেন, এমনসময় বাবা তার ছোটশ্যালককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাবার মুখে হাসি। ছোটমামার তুষোমুখ।
বাবা বললেন,–বঙ্কুবাবুর কাণ্ড! আর ইনিও এমন বুন্ধু যে নিজের পরিচয়ও দেননি! –ছোটমামার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন বাবা, বলবি তো আমার সঙ্গে কী সম্পর্ক?
–বঙ্কুদারোগা আমার চেনা লোক।
পিসেমশাই বললেন, কিন্তু ওকে হঠাৎ অ্যারেস্ট করল কেন?
বাবা হাসতে হাসতে বললেন,–পাঁচু-চোরের ব্যাপার আর কী?
ঘরসুদ্ধ সব্বাই অবাক হয়ে একগলায় প্রশ্ন করলেন, তার মানে? তার মানে?
কী আশ্চর্য! বাবা একটু রেগে গেলেন, কমাস আগে পাঁচু আমাদের রান্নাঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল। হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। ভুলে গেলে? –ঘরসুন্ধু হাসলেন। সব্বাই। সেই পাঁচু! ভাত-চোর পাঁচু!
সেই পাঁচু। বাবা বললেন, বঙ্কুবাবুর হাতে খবর আছে, ফেরারি আসামী পাঁচু নাকি ঝিলের ওদিকে গাছে লুকিয়ে আছে। গাছে ডেরা বেঁধেছে। দৈবাৎ কেউ দেখে ফেললে বলে, আমি সেই গেছোবাবা।
মা ফোঁস করে উঠলেন,–তা নান্টুর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
বাবা ছোটমামার দিকে তাকিয়ে এবার মুচকি হাসলেন, বঙ্কুবাবু ভেবেছিলেন, নান্টু পাঁচুর কাছে হয়তো চোরাইমাল কিনে ঝিলের ধারে ঘাপটি পেতে ছিল।
ছোটমামা রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খুব হাসাহাসি চলতে থাকল। একফাঁকে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। তারপর বাগানের দিকে ঘরটাতে গিয়ে দেখি, ছোটমামা তুষোমুখে বসে আছেন। এই ঘরটাতে ছোটমামা আর আমি থাকি। বললুম,–ছোটমামা। পুলিশ আপনাকে মারেনি তো?
ছোটমামা ভেংচি কাটার ভঙ্গিতে বললেন,–অত সোজা? আমার গায়ে হাত তুললে কী হতো জানিস?
–কী হতো ছোটমামা?
ছোটমামা ভরাট গলায় বললেন, আমি কবি। কবির গায়ে পুলিশ হাত তুললে কী হতো, তুই-ই ভাব। বাহাত্তর লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার কবি হইহই মিছিল করে এসে… এত সোজা?
কথাটা মনে ধরল। বললুম-আচ্ছা, ছোটমামা, গেছোবাবা কি সত্যিই পাঁচু চোর?
হ্যাঁ, ছোটমামা বাঁকা হাসলেন। তুই তো হাদারাম। তাই একটা চোরের পায়ে গড় করলি। আমি ঠিকই টের পেয়েছিলুম বলে গড় করিনি।
কথাটা বিশ্বাস হয়নি। তা ছাড়া গেছোবাবা বলেছিল, তাকে গড় না করলে পুলিশ ধরে। ছোটমামাকে তার একটু পরেই পুলিশে ধরল। কিন্তু ছোটমামার এখন যা মুড, সে কথা বলা যাবে না। এও বলা যাবে না যে, গেছোবাবা যদি সত্যিই পাঁচু-চোর হয়, তাহলে গাছের পাতা কচমচিয়ে খায় কী করে? তার চেয়ে বড় কথা, গেছোবাবা নিজেই বলছিল, পাঁচু তাকে গড় করেনি বলে তাকে জেলে ঘানি টানতে আর পাথর ভাঙতে হয়েছিল। তাছাড়া একজন হিঁচকে চোর পলাশির যুদ্ধ আর লর্ড ক্লাইভের কথা জানবে কী করে? চোরেরা কি ইতিহাস-বই পড়তে পারে? বড় চোর হলেও কথা ছিল, পাঁচু তো নেহাত ছিঁচকে চোর। উঁহু, তাও না–স্রেফ ভাত-চোর।…
ছোটমামার এ রাতে মন খারাপ। দিদি কতবার খেতে ডাকতে এল। বললেন, খিদে নেই। শেষে মা এলেন। সাধাসাধি করার পর ছোটমামা বললেন,–পরে খাব খন! মা রাগ করে বললেন,–রাত দশটা বাজে। আর কতক্ষণ হেঁসেল পাহারা দেব?
তখন ছোটমামা বললেন, ঠিক আছে। টেবিলে রেখে যাও। সময়মতো খাব।
বাড়ির কাজের লোক ভুতো ছোটমামার রাতের খাবার নিয়ে এল। টেবিলে ঢাকা দিয়ে সে চলে যাচ্ছে, ছোটমামা ডাকলেন, ভুতো শোনো।
ভুতে বিনীতভাবে বলল,–মন খারাপ করতে নেই দাদাবাবু। নতুন দারোগাবাবু লোকটা ওইরকমই। যাকে-তাকে চোর বলে ধরে হাজতে ঢোকাচ্ছেন। পাঁচু কি কম দুঃখে–বলেই সে থেমে গেল। ছোটমামা গলা চেপে বললেন,-পাঁচুকে তুমি চেনো?
খুব চিনি-ভুতো ফিক করে হাসল। এ টাউনে ওকে কে না চেনে?
–পাঁচু গাছে চড়তে পারে?
–হুঁ।
–হনুমানের মতো চার পায়ে দৌড়তে পারে?
–হুঁ।
ছোটমামা ভেংচি কাটলেন, হুঁ! খালি হুঁ! তুমি দেখেছ কখনও?
ভুতো গেছোবাবার ভঙ্গিতে বলল, আজ্ঞে, দেখলেও দেখেছি, না দেখলেও না দেখেছি।
এইতেই ভীষণ চটে গিয়ে ছোটমামা বললেন, তুমিও দেখছি গেছোবাবার এক চেলা!
ভূতো তক্ষুনি কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকিয়ে বলল, রাতবিরেতে ও নাম মনে আনবেন না দাদাবাবু! আবার ঝামেলায় পড়বেন।
খুব হয়েছে যাও! ছোটমামা গম্ভীরমুখে বসে পা দোলাতে থাকলেন।
আমার ঘুম পাচ্ছিল। শুয়ে পড়ব ভাবছি, হঠাৎ ছোটমামা আস্তে ডাকলেন, পুঁটে! দেখি, ছোটমামা মিটিমিটি হাসছেন।
ফিসফিস করে বললেন,–চল, বেড়িয়ে পড়া যাক। গেছোবাবা ধরা কাঁদ পাতব, বুঝলি? সেজন্যই চালাকি করে আমার খাবারটা এ-ঘরে আনিয়ে রাখলুম। ওঠ, দেরি করা ঠিক নয়।
এমন একটা রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের লোভ সামলানো কঠিন। চুপিচুপি দুজনে বাগানের দিকের খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লুম। ছোটমামার হাতে তার খাবার থালা। ঝিলের কাছাকাছি গিয়ে বললে,–ফঁদটা বুঝতে পারছিস তো? না পারিস তো কথা নেই। চুপচাপ দেখবি, কী করি!
জ্যোৎস্নাটা এখন আরও ঝলমলে। ঝিলের ধার শিবতলার পর নবাবি আমলের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আর ঘন জঙ্গল। গা-ছমছম করছিল। এখানে খানিকটা খোলা ঘাসজমিতে পৌঁছে ছোটমামা দাঁড়ালেন। একটু কাশলেন। তারপর ডাকলেন, গেছোবাবা, আছো নাকি? ও গেছোবাবা!
কিন্তু কোনও সাড়া এল না। ছোটমামা একটু গলা চড়িয়ে বললেন, গেছোবাবা! তখন গড় করিনি তোমায়। তাই সত্যিই পুলিশে ধরেছিল। এবার দর্শন দাও, গড় করি। ও গেছোবাবা তোমার জন্য খাবারদাবার এনেছি! কাম ডাউন গেছোবাবা, কাম ডাউন!
এতক্ষণে গাছপালার ভেতর গাঢ় ছায়ায় ধুপ করে শব্দ হল। তারপর সত্যিই গেছোবাবা চায়পেয়ে প্রাণীর মতো বেরোল। খোলা জায়গায় দু-পেয়ে হয়ে প্রথমে অদ্ভুত হিহি হাসি হাসল। তারপর বলল, খাবার এনেছিস? দে, দে খাই। পরে গড় করিস। ওঃ কতকাল পরে মানুষের খাবার খাচ্ছি রে!
বলেই ছোটমামার হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে খুব শব্দ করে খেতে লাগল। ছোটমামা বললেন,–এবার গড় করি?
–তা করলেও করতে পারিস, না করলেও না পারিস।
ছোটমামা গড় করে বললেন–আচ্ছা গেছোবাবা, তুমিই কি পাঁচু?
–তা বললেও বলতে পারিস, না বললেও পারিস।
–তুমি গাছে বসত করলে কেন পাঁচু-সরি গেছোবাবা?
বন্ধুদারোগার ভয়ে।–গেছোবাবা ফোঁস করে নাকঝাড়ল খেতে-খেতে, পেটের বড় জ্বালা রে, বুঝলি তো?
–বুঝলাম। কিন্তু চুরিচামারি না করে কারও বাড়ি কাজকর্ম করলেই তো–
গেছোবাবা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, কাজ দিলে তো করব? একবার পেটের দায়ে একটা বদনাম রটে গেলেই কেলেঙ্কারি না? তার ওপর জেল খাটলে তো কথাই নেই।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। গেছোবাবা থালা চেটেপুটে শেষ করে চার পা হল। ঝিলের ধারে চলে গেল। ছোটমামা আর আমিও তার পিছু পিছু দৌড়ে গেলুম। জল খেয়ে থালা রগড়ে ধুয়ে ঢেকুর তুলে গেছোবাবা বলল,-বেঁচেবতে থাক বাবারা! এই নে তোর থালা, বাড়ি চলে যা। নইলে নতুন দারোগাবাবুর পাল্লায় পড়ে ঝামেলা হবে।
ছোটমামা বললেন,–যাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো মানুষ পাঁচু, সরি গেছোবাবা! তুমি এমন হনুমানের মতো দৌড়তে আর গাছে-গাছে বেড়াতে পারে কী করে?
–অভ্যেস রে, অভ্যেস। সার্কাস দেখিসনি? তাছাড়া কথায় বলে, ঠেলায় না পড়লে বেড়াল গাছে চড়ে না। আমি তো মানুষ।
–বুঝলুম। কিন্তু গাছের পাতা খাও কেন?
সেও অভ্যেস। টাউনে ঢুকতে না পেলে কী করব? গাছে-গাছে ঘুরি, গাছের পাতা খাই। বলে গেছোবাবা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল। বাবারা তাদের মনে বড় দয়া বাবারা। তোদের ভালো হবে। আমি যাই, বড় ঘুম পাচ্ছে। আহা! কতকাল মানুষের খাবার খাইনি রে! খাওয়ামাত্র ঢুলুনি চেপেছে।
বলে ফের একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে গেছোবাবা চার পা হল। জ্যোস্না পেরিয়ে গাঢ় ছায়ায় সে অদৃশ্য হয়ে গেছে ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, কী বুঝলি?
বললুম, কিছু না।
তুই একটা হাঁদারাম! আয় বাড়ি ফিরি।–বলে ছোটমামা হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলেন। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে কেন যেন ধরা গলায় ফের বললেন,-বড় হ। তখন সব বুঝবি। তবে বুঝলি পটু, বন্ধুবাবু তখন হয়তো ঠিকই বলছিলেন। চঁদ টাদ বোগাস! কী আছে চাদে? নিরেট পাথর। প্রাণ নেই। বাতাস নেই। শ্মশান।
ঘাড় ঘুড়িয়ে চাঁদটার দিকে একবার তাকালুম। অবিকল গেছোবাবার ভঙ্গিতে বলতে ইচ্ছে করছিল, তা হলেও হতে পারে, না হলেও না হতে পারে…
ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য
ভূতের স্বপ্ন তো সবাই দেখে! তাই বলে কি ভূত বিশ্বাস করতে হবে? এই হচ্ছে ভবভূতিবাবুর স্পষ্ট কথা। তিনি যৌবনে দুর্দান্ত শিকারি ছিলেন। বনে জঙ্গলে পোড়ো-বাংলোয় ঘুরেছেন। কোথায় ভূত?
তার বন্ধু গজপতি গোঁ ধরলেন,–আজকাল এই ভিড়-হল্লা-আলো আর যন্তরের ঠেলায় বেচারি ভূতেরা থাকবে কোথায়? তাই মানুষের স্বপ্নে গিয়ে আড্ডা নিয়েছে। গজপতি আরও বলেন, উপায়টা কী? মানুষের হাতে আজকাল কতরকম জব্বর অস্ত্রশস্ত্র। অ্যাটমবোমা, হাইড্রোজেন বোমা, নিউট্রন বোমা। তার ওপর কতরকম সাংঘাতিক ওষুধপত্র বেরিয়েছে। তাই ভূতেরা মানুষের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়ে নিরাপদে কাটাচ্ছে। স্বপ্নে মানুষ তো একেবারে অসহায় বুঝলে না?
ভবভূতি তা মানতে রাজি নন।
বলেন,–হ্যাঁ, একথা সত্যি, সুন্দরবন বাঘ প্রকল্পের মতো রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্পের এক অদ্ভুত অভয়ারণ্যের স্বপ্নে ভ্রমণ করে এসেছি। কিন্তু স্বপ্ন ইজ স্বপ্ন। অর্থাৎ স্বপ্ন জিনিসটা জলজ্যান্ত মিথ্যে। যাকে পদ্যে বলে, আপন মনের মাধুরী।
মাধুরী?–বলে গজপতি চোখ কটমট করে তাকান। মাধুরী বলছ?
গজপতিকে অমন করে তাকাতে দেখে ভবভূতি বাকা হেসে বলেন, আলবাত মাধুরী।
গজপতি বলেন,–মাধুরীকে তুমি চেনো?
ভবভূতি অবাক, কী কথায় কী বলেন তার মানে?
–মাধুরী ছিলেন আমার পিসতুতো দিদি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ঘুঘুডাঙায়! জামাইবাবু ছিলেন রেলের গার্ড। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর
কিস্যু বুঝলাম না। ভবভূতি বাধা দিয়ে বলেন।
বিরক্ত গজপতি বলেন, কথা শেষ করতে দেবে তো? খালি তক্ক আর তক্ক। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে এক একর জায়গায় একটা বাড়ি ছিল জামাইবাবুর। পৈতৃক বাড়ি। ওর মৃত্যুর পর সেই বিশাল বাড়িতে একা মাধুরীদিদি থাকতেন।
ভবভূতি খিকখিক করে বলেন আর থাকতেন তোমার জামাইবাবু, অর্থাৎ ভূত।
গজপতি রীতিমতো গর্জন করে বলেন, না ব্রহ্মদৈত্য।
ব্রহ্মদৈত্য! ভবভূতি তাজ্জব হয়ে যান।
–হ্যাঁ। উঠোনের কোনায় একটা বেলগাছ। সেই গাছ থেকে সে মাঝে-মাঝে রাতদুপুরে প্রায়ই উঠোনে পায়চারি করতে নামত। মাধুরীদি জেগে থাকলে বলতেন,–কী গো! গরম লাগছে বুঝি? ব্রহ্মদৈত্য বলত, না গো! আজ সন্ধেবেলা একটা ভোজ ছিল। খাওয়াটা বেজায় রকমের হয়ে গেছে। তাই হজম করার তালে আছি। তো তখন মাদুরীদিদি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হজমের গুলি দিতে ডাকছেন, নাও গো! টুক করে গিলে ফেলে এক গেলাস জল খেও। সব হজম হয়ে যাবে। ব্ৰহ্মদৈত্য মস্ত লম্বা কালো হাতখানা জানলা অবধি বাড়িয়ে দিত। হাতে কাড়ি কাড়ি লোম।
ভবভূতি আরও হেসে বলেন, তুমি দেখেছ?
না দেখেছি তো কি বানিয়ে বলছি? গজপতি গম্ভীরমুখে বলেন।-আমার বয়েস বারো-তেরো হবে। ক্লাস এইটে পড়ি। মাধুরীদির ছেলেপুলে ছিল না বলে আমাকে মাঝে-মাঝে নিয়ে যেতেন। খাটে শুয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে ওইসব কাণ্ডকারখানা দেখতুম। বলতুম,–ও কে দিদি, যাকে ইজমি গুলি দিলে? মাধুরীদি বলতেন, চুপ, চুপ। বলতে নেই।
ভবভূতি বলেন,–সে বাড়িটা এখনও নিশ্চয়ই আছে?
–হুঁ আছে। মাধুরীদি অবশ্য বেঁচে নেই।
–বাড়িতে কে থাকে এখন?
এবার গজপতি বাঁকা হেসে বলেন,–যাবে নাকি? বাড়িটা খালি পড়ে আছে। হানাবাড়ি হয়ে গেছে। কতবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল কাগজে। সস্তায় বেচে দিতে চেয়েছিল মাধুরীদির বড় জায়ের ছেলে ত্রিলোচন। সে-ই এখন বাড়ির মালিক। কিন্তু বাড়ির বদনাম শুনে সবাই পিছিয়ে যায়। তাই বাড়িটা তেমনি খালি পড়ে আছে।
ভবভূতি বলেন, বাড়িটা আমি কিনব।
–বলো কী?
–হ্যাঁ। কিছুদিন থেকে আমি নিরিবিলি জায়গায় একটা বাড়ি খুঁজছি। ইচ্ছে আছে, সেখানে একা থাকব এবং কিছু এক্সপেরিমেন্ট করব।
–কীসের এক্সপেরিমেন্ট, শুনি।
ভবভূতি ফের নিজস্ব বাঁকা হাসিটা হেসে বলেন, নিশ্চয় ভূত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট নয়, কুকুর নিয়ে।
গজপতি প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মতো বলেন, কুকুর নিয়ে মানে?
–তোমাকে বলিনি। কিছুদিন থেকে আমি কুকুর নিয়ে একটু-আধটু গবেষণা করছি। আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে, কুকুরের ভাষা। ওদের যে নিজস্ব ভাষা আছে, তাতে কোনও ভুল নেই, সেই ভাষা আমার শেখা চাই-ই।
গজপতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, তা হঠাৎ এই আজগুবি ব্যাপারটা তোমার মাথায় চাপল কেন শুনি?
ভবভূতি গম্ভীরমুখে বলেন, তুমি তো সারাজীবন খালি আইনের প্রকাণ্ড কেতাব পড়েই কাটালে! আদালত আর জজসায়েব ছাড়া কি বোঝোও না।
কৌতূহলী গজপতি বলেন, আহা, বুঝিয়ে বলল না একটু!
–বললেও বুঝবে কী? তুমি তো ঋগ্বেদ পড়োনি। সরমা ছিলেন কুকুরদের মা। সরমার ছেলেমেয়েদের নাম তাই সারমেয়। দেবতাধিপতি ইন্দ্র সরমাকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন–
গজপতি বাধা দিয়ে বলেন, আহা হলটা কী তাতে?
ভবভূতি চটেমটে বলেন,–হল তোমার মাথা আর মুন্ডু! সে যুগে কুকুররাই দূতের কাজ করত বুঝতে পারছ না? তাদের যদি ভাষা না থাকবে তাহলে তাদের দৃত করা হল কেন? তাছাড়া ঋগ্বেদের আরেক জায়গায় আছে, একদল কুকুর কোরাস গাইছে। ভাষা না থাকলে
ফের গজপতি বাধা দিয়ে খিকখিক করে হেসে বলেন, এখন আমাদের পাড়ায় রাতদুপুরে কুকুরেরা কোরাস গায়। বাপস! সে কী কোরাস!
ভবভূতির এবার গর্জনের পালা, তুমি মূর্খ। শাস্ত্রজ্ঞানহীন নিতান্ত ইয়ে। নইলে মহাভারতে মহাপ্রস্থান পর্বে স্বর্গপথে যুধিষ্ঠিরের পেছন-পেছন কুকুর যাওয়ার কারণটাও তুমি বুঝতে! বলো তো, কেন কুকুর পেছন-পেছন যাচ্ছিল?
কুকুর এখনও পেছন-পেছন যায়। সেদিন আমি কিলোটাক পাঠার মাংস কিনে আনছি, একটা কুকুর পিছু ধরেছিল–গজপতি হাসতে-হাসতে বলেন, নিশ্চয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাঁঠার মাংস ছিল। স্বর্গে তো জীবহত্যা নিষেধ। তাই মর্ত থেকে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
ভবভূতির পক্ষে এটা অসহ্য। রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন তক্ষুনি। গজপতির পরে হুঁশ হল। তখন বেরিয়ে গিয়ে আদুরে স্বরে ডাকে,–ভবী! ভব! ও ভবা!
কোথায় ভবভূতি! তাঁর মান্ধাতার আমলের খনখনে বিলিতি গাড়ির লেজের ডগাটুকু মোড়ে একবারের জন্যে দেখতে পেলেন গজপতি।
খুব রেগেছে। তা রাগুক–গজপতি মনে-মনে বললেন। একটু পরে জল হয়ে যাবে। দুই বন্ধুর এমন রাগারাগি দৈনিক পাঁচ-সাতবার হয়। আবার মিল হতেও দেরি হয় না!
তবে অন্যবারে রাগ পড়তে ভবভূতির যতটা সময় লাগে, এবার লেগেছিল তারও কম।
এর এক নম্বর কারণ, গজপতির পিসতুতো দিদির সেই হানাবাড়ি কেনার ইচ্ছে।
দুই নম্বর কারণ, ভবভূতি ভূত বিশ্বাস করেন না। গজপতির কাছে প্রমাণ করতে চাইছিলেন, ভূত বলতে কি নেই। সুতরাং গজপতি মিথ্যুক।
তিন নম্বর কারণ, ভবভূতির কুকুর নিয়ে নিরিবিলি গবেষণা!
বাড়িটার মালিক ব্রিলোচন থাকে হাজারিবাগে। ভবভূতির তর সইছিল না। গজপতিকে বলে টেলিগ্রাম করিয়ে তাকে কলকাতায় আনালেন এবং রাতারাতি বাড়িটা কিনে ফেললেন! সস্তায় কিনলেন বলা যায়। ত্রিলোচন যা পেল, তাই লাভ। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে কোন ভদ্রলোক গিয়ে বাস করতে চাইবেন? রেল ইয়ার্ডে হরদম ট্রেন, মালগাড়ি আর ইঞ্জিনের বিকট বাজখাই ভঁাচামেচি, তার ওপর ভূত ওরফে ব্রহ্মদৈত্যর গুজব। তবে হ্যাঁ, কারখানার জন্যে কেউ কিনতেও পারতেন। কিন্তু ত্রিলোচনের কাকিমা মাধুরীদেবী নাকি বলে গিয়েছিলেন, কলকারখানা হলে উনি অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য-মশাই রিফিউজি হয়ে যাবেন। খবরদার বাবা তিলু, এই কম্মটি কোরো না! ওতে পাপ তো হবেই, তার ওপর উনি রেগে গিয়ে তোমাদের পিছনে লাগবেন।
তিলু বা ত্রিলোচন গজপতির মতো ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী। এছাড়া সে ছেলেপুলে নিয়ে ঘরসংসার করে। ব্রহ্মদৈত্য-মশাইয়ের চেহারার যা বর্ণনা শুনেছে সে, তাতে তার হাজারিবাগে ছোট্ট বাড়িটার ওপর তিনি গিয়ে একখানা পা রাখলেই পৌরাণিক গল্পের সেই তিনপেয়ে বামনাবতারের বলিরাজার মাথায় পা চাপানোর ব্যাপারটাই ঘটে যাবে। অর্থাৎ চিড়েচ্যাপটা যাকে বলে।
যাই হোক, বাড়ি তো কিনে ফেললেন ভবভূতি। খুব পছন্দসই বাড়ি। কতকটা সেকালের কুঠিবাড়ির গড়ন। একতলা এবং উঁচু ছাদ। সাত-আট পাশাপাশি ঘর আছে। তার সঙ্গেই স্নানঘর, রান্নাঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। বাড়ির চারদিকে লম্বা-চওড়া প্রচুর জায়গা। গাছপালা আছে। ঝোঁপঝাড় গজিয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। চারদিকের পাঁচিল যথেষ্ট উঁচু। একদিকে মস্ত গেট, অন্যদিকে খিড়কির দরজা। গেটের সামনে খোয়াঢাকা অনেককালের অব্যবহৃত রাস্তা আছে একফালি। সেটা গিয়ে মিশেছে রেল ইয়ার্ডের কাছে চওড়া রাস্তার সঙ্গে। সেইদিকে একটু এগোলে ঘুঘুডাঙা রেলস্টেশন।
বিশাল উঠোনর কোনায় পাঁচিল ঘেঁষে সেই প্রকাণ্ড বেলগাছটা দেখতে পেলেন ভবভূতি। আনন্দে নেচে উঠলেন।
না, ব্রহ্মদৈত্যের জন্যে নয়। গাছটা ইয়া মোটা, বেলে ভর্তি। ভবভূতি বেলের সরবত পেলে আর কিছু খেতে চান না। একগাল হেসে গজপতিকে বললেন,–গজু, প্রতিদিন বেলের সরবতের নেমন্তন্ন রইল। এলেই পাবে।
গজপতি মুখে হ্যাঁ বললেন বটে, কিন্তু মনে-মনে বললেন–
–মাথা খারাপ? বেলের সরবতের জন্যে রোজ ট্রেনে চেপে ব্রহ্মদৈত্যর আখড়ায় আসব? আমি তো ভবুর মতো পাগল নই। ওই বেলে হাত দিলে ব্ৰহ্মদৈত্য মশাই খড়মপেটা করবে না?
ভবভূতিকে গৃহস্থ করতে এসেছিলেন সেই প্রথমদিন। তারপর আর তিনি আসেননি। তবে দৈনিক একটা করে চিঠি লেখেন। লিখেই আশা করেন, এ চিঠির জবাব ভবভূতির বদলে তার রাঁধুনিকাম-চাকর নরহরিই লিখবে। বড় দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি কর্তাবাবু গতরাতে বেলতলায় পটল তুলেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য তাঁর ঘাড়টি মটকে দিয়েছে।
কিন্তু কোথায় কী? দিব্যি ভবভূতিরই জবাব আসে। নিজের হাতে লেখা। প্রিয় গজু, তুমি কি সম্প্রতি ন্যাড়া হইয়াছ? নতুবা আসিতেছ না কেন? প্রচুর বেল পাকিয়াছে। তোমার ব্রহ্মদৈত্য ভদ্রলোকটি বেজায় ভদ্র। তাঁহার সঙ্গে ভাব জমিয়াছে। তিনি ন্যাড়া বলিয়াই কদাচ বেলতলায় অবতরণ করেন না। মগডালে বসিয়া পাকা লে পাড়িয়া দেন। আমি লম্বা বাঁশের ডগায় বাঁধিয়া অ্যালুমিনিয়ামের জগভর্তি সরবত পাঠাই। তিনি সরবত পান করিয়া জগটি নামাইয়া দেন। হা–গতকাল লিখিতে ভুলিয়াছি, তিনি তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। বলিলেন, আহা! বালকটিকে দেখিলে বড় আনন্দ পাইতাম। …
এই চিঠি পেয়ে গজপতি রেগে লাল,–চালাকি? ঠাট্টা করা হয়েছে বালক বলে? আমার বয়স পঁয়ষট্টি হয়ে গেল। আমাকে বালক বলা হচ্ছে? আমার গাল টিপলে দুধ বেরোয়, না আমি এখনও দুধুভাতু খাই যে আমাকে বালক বলেছে?
একটু পরে রাগ পড়ে গেল। না, হয়তো ঠিকই লিখেছে। ব্রহ্মদৈত্য-মশাই আমাকে সেই ছেলেবয়সে দেখেছেন। তাই বালক বলাটা স্বাভাবিক। হয়তো সত্যি সত্যি ভবভূতি ওনার দর্শন পেয়েছে। এবং পেয়ে এতদিনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাসও হয়েছে।
তাহলে ভয়ের কথা, ব্রহ্মদৈত্য এখনও মনে রেখেছেন গজপতিকে? ওরে বাবা, এ যে সাংঘাতিক কথা। আজই কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসতে হবে। হে মা কালী, যেন বেলগাছিয়াবাসী কালো কুচকুচে, সর্বাঙ্গে লোমওয়ালা এবং খড়ম-পরা ভদ্রলোকটি আমাকে ভুলে যান। ওনার স্মৃতিভ্রংশ করিয়ে দাও মা!
না ভুললেই বিপদ। হয়তো ভবভূতিই তাকে প্ররোচিত করবেন গজপতির বাড়ি আসতে এবং তিনি নিছক স্নেহ-প্রদর্শনেই খড়ম পায়ে খটখট করে রাতদুপুরে হাজির হয়ে হেঁড়ে গলায় ডেকে বলবেন,–জু! কেমন আঁছিস বাবা?
গজপতি আঁতকে উঠে তক্ষুনি কালীঘাট ছোটেন—
ওদিকে ভবভূতি চমৎকার কাটাচ্ছেন ঘুঘুডাঙার বাড়িতে।
বাড়ির নাম দিয়েছেন–সরমা। ঋগ্বেদের সেই কুকুর জননী সরমা। তলায় ব্র্যাকেটে ইংরেজিতে লেখা আছে :
দি ডগ রিসার্চ সেন্টার।
পূর্ব দক্ষিণের একটা ঘরে থাকেন ভবভূতি। তার পাশের ঘরে নরহরি ঠাকুর। তার ওপাশে রান্নাঘর। উত্তর পশ্চিমের মস্ত ঘরে রেখেছে পাঁচটা অ্যালসেশিয়ান, দুটো গ্ৰেহাউন্ড, তিনটে টেরিয়ার, আর সাতটা দিশি কুত্ত। এই সাতটা দিশি কুত্তার মধ্যে দুটো বাঘা, দুটো খেকি আর বাকি তিনটে নেড়ি। রীতিমতো আন্তর্জাতিক বাহিনী।
কদিনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ডেকে এনে ওই ঘরটা সাউন্ড প্রুফ করে নিয়েছেন। তার ফলে যতই চাচামেচি করুক, বাইরে থেকে একটুও শোনা যাবে না।
মোট সতেরোটা কুকুরের জন্যে সতেরেটা কাঠের খাঁচাঘর আছে। সামনে লোহার গরাদ। চিড়িয়াখানায় যেমন বাঘের খাঁচা দেখা যায়, ঠিক তেমনি।
দেখাশোনা, খাওয়ানো, স্নান করানো–সবকিছুর ভার ভবভূতি নিজে নিয়েছেন। নরহরি কুকুর দেখলেই উল্টোদিকে দৌড়ায়। তাই পারতপক্ষে এ ঘরে ঢোকে না। ভবভূতি একটা প্রকাণ্ড নোটবইতে দুবেলা কুকুরগুলোর হাবভাব টুকে রাখনে। টেপ রেকর্ডারে টেপ চালিয়ে শোনেন! গম্ভীর মুখে ভাবনা-চিন্তা করেন। লেখেন। রীতিমতো গবেষণা কিনা!
বেশ চলছিল এই রকম। রাতে কুকুরশালায় টেপরেকর্ডার চালিয়ে রাখছিলেন এবং সকালে নিয়ে এসে বাজিয়ে শুনছিলেন। নোট করছিলেন কোনও বৈশিষ্ট্য আছে নাকি। জীবজন্তুর ভাষা শেখা তো সহজ কথা নয়। টেপের একটা জায়গা বারবার বাজিয়ে শুনে তবে না কিছু বোঝা যাবে!
হঠাৎ একদিন সকালে টেপ বাজিয়ে শুনতে-শুনতে ভবভূতি অবাক হলেন।
টেপে সতেরোটা কুকুরের নানান হাঁকডাক অন্যদিন যেমন শোনেন, তেমনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তারপর কী একটা ঘটল। আচমকা ওরা চুপ করে গেছে। কোনও ডাক নেই! না ঘড়ঘড়, গরগর, গাঁগো, খ্যাক খ্যাক, ঘেউঘেউ, কিংবা ভ্যাকভ্যাক। হঠাৎ বেড়ালের মতো যেন মিউ গোছের নরম ডাক ডেকেই সবাই থেমে গেছে। গেছে তো গেছেই।
তারপর একটা কেমন শনশন শব্দে হল। তারপর ঘট ঘটাং!
তারপর খট খট, খট খট, খট খট–
শব্দটা ক্রমে ক্ষীণ থেকে জোরালো হয়ে বাজতে থাকল টেপে। তারপর থেমে গেল। কীসের শব্দ হতে পারে?
তারপর চকচক চকাম-কাম-কুকুরগুলো খাওয়ার সময় যেমন শব্দ করে, সেইরকম! বেশ তালে-তালে শব্দগুলো বাজছে। ভোজের আসরে শেষপাতে চাটনির সময় চোখ বুজলে যেমন শোনা যায়। এ তো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! কুকুরগুলোর তো এত রাতে কিছু খাওয়ার কথা নয়! খাবে যে, তা পাবেটা কোথায়?
অথচ শোনা যাচ্ছে, গত রাতে (হিসেব মতো তখন প্রায় বারোটা) ওরা খুব খাচ্ছে। খাচ্ছেটা কী? চাটনি? অসম্ভব। কুকুর তো চাটনি খায় না। চেটেপুটে খায় অবশ্য। কিন্তু চাটবেই বা কী? নিজের নিজের লেজ? মনে হয় না তা। ভবভূতি কুকুরের লেজ চেটে না দেখলেও জানেন, মোটেও সুস্বাদু নয়।
ভবভূতি টেপ বন্ধ করে কুকুরশালায় ঢুকলেন। তাঁকে দেখে কুকুরগুলো কিন্তু অদ্ভুত আচরণ শুরু করল! ঘণ্টাটাক আগে এ ঘরে ঢুকেছেন! খাইয়েছেন। টেপ রেকর্ডারটা তুলে নিয়ে গেছেন। তখন ওরা স্বাভাবিক ছিল। অথচ এখন ওঁকে দেখে প্রত্যেকটা কুকুর গরগর করে উঠেছে। কুকুরের ভাষা এতদিনে যতটা বুঝেছেন, ওদের এই শব্দে রীতিমতো রাগ আছে। সবচেয়ে বেশি আদরের অ্যালসেশিয়ানটার খাঁচার সামনে যেতেই সে দাঁত বের করে কামড়াতে এল। গ্রেউন্ড দুটো শরীর লম্বা করে গাঁ-গাঁ করতে থাকল।
তারপরই প্রত্যেকটি খাঁচায় প্রত্যেকটি কুকুর লাফালাফি জুড়ে দিল। যেন খাঁচা ভেঙে ফেলবে। তাকে পেলে যেন ওরা টুকরো-টুকরো করে খেয়ে ফেলবে। সে কী হিংস্র হাঁকরানি!
ভবভূতি বিলিতিগুলোকে ইংরিজিতে এবং দেশিগুলোকে বাংলায় তর্জন-গর্জন সহকারে ধমক লাগালেন। একটা লাঠি নিয়ে এসে খুব ঠোকাঠুকি করলেন খাঁচার সামনে। কিন্তু কেউ ভয় পেল না বরং আরও খেপে গেল। ভবভূতির কানে তালা ধরে যাচ্ছিল ওদের চ্যাঁচামেচিতে।
হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। এমন তো করে না ওরা। ব্যাপার কী?
অসহ্য লাগলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। খুব রাগ হয়েছে। বেইমান নেমকহারাম! এত যত্ন করে রাখা হয়েছে। রোজ কাড়িকাড়ি দুধ, মাংস এইসব খাওয়ানো হচ্ছে। আর তার বদলে এই ব্যবহার!
রোস, আজ সারাদিন খাওয়া বন্ধ।
নিজের ঘরে ফিরে আবার টেপ বাজিয়ে রাতের রেকর্ড হওয়া শব্দগুলো শুনতে থাকলেন ভবভূতি। এই খট খট খট খট শব্দটা কীসের হতে পারে?
হঠাৎ চমকে উঠলেন। তাহলে কি ওটা খড়মের শব্দ? অর্থাৎ বেলগাছের ব্রহ্মদৈত্য?
তাহলে কি সত্যি ব্রহ্মদৈত্য বলে কিছু আছে? এবং সেই ব্রহ্মদৈত্যই কি কুকুরগুলোকে রাতে কিছু খাইয়ে বশ করে ফেলেছে এবং তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে?
অথচ সকালে যখন দুধ-পাঁউরুটি খাওয়াতে গেলেন, তখন ওরা শান্তভাবে ছিল। এর মানে কী?
ভবভূতির মনে হল, নেহাত খাবার লোভে তখন জন্তুগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। নেমকহারাম লোভী স্বার্থপর।
ভবভূতি যত ভাবলেন ব্যাপারটা, বিচলিত বোধ করলেন। ঠিক আছে, আজ রাতে তিনি জেগে থেকে পাহারা দেবেন। নরহরিকে সঙ্গে নেবেন। এ রহস্যের ফর্দাফাই না করলেই চলে না।
নরহরিকে ডেকে সব খুলে বললে তার মুখ যেন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকে ওই বেলগাছের ব্যাপারটা এতদিন বলেননি। এটাকে যে হানাবাড়ি বলত লোকে, তাও জানে না সে। কেমন করে জানবে? সে বাঁকুড়ার লোক। ভবভূতির জামাই তাকে শ্বশুরের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জামাই ওখানে রোডস দফতরের ইঞ্জিনিয়ার। শশুরমশায়ের নানান উদ্ভট বাতিকের কথা জানেন তিনি। কেমন লোক পছন্দ হবে তাও জানেন। ভবভূতির কোনও কথায় না করবে না এবং কোনও ব্যাপারে অবাক হবে না–এমন লোক চাই। সেদিক থেকে নরহরি উৎকৃষ্ট। সবেতেই মুণ্ডু কাত করে বলে, ইয়েস স্যার!
কর্তাবাবুর কথার বিরুদ্ধে অন্য কথা বলার জো নেই। সে মুখে সায় দিল। বরং জাঁক দেখিয়ে বলল,–বেহ্মদত্যির টিকি আর টাক দুই-ই কেড়ে নেব স্যার।
খুশি হয়ে ভবভূতি বললেন,–একখানা মোটা লাঠি জোগাড় করে রাখো। আর একটা বস্তায় পাটকেল রাখো। টিকি আর টাক কাড়তে গিয়ে মামলায় পড়বে হে! গবুউকিল তাক করে বসে আছে ওদিকে।
ওদিকে কুকুরগুলো উপোস করছে। করুক। ভবভূতি রাতের খাওয়া শেষ করে নরহরিকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি ওপাশের দরজায় বের হলেন। জ্যোৎস্না রাত। সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেলগাছটার একটু তফাতে একটা জঙ্গল হয়ে যাওয়া জবাগাছের আড়ালে দুজনে ওৎ পেতে বসে রইলেন। সঙ্গে একটা বন্দুকও নিয়েছেন। লাঠি আর পাটকেলের বস্তাও আছে।
বসে আছেন তো আছেন। সব নিস্তব্ধ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে পশ্চিমের রেলইয়ার্ড থেকে রেলগাড়ির শব্দ কিংবা হুইসেল শোনা যাচ্ছে। আবার সব চুপ। হেমন্তকাল। শিশিরে ঘাস-গাছপালা ভিজে জবজব করছে। হাল্কা কুয়াশা জমেছে গাছপালায়। কিছুক্ষণ পরে বেলগাছ থেকে একটা পেঁচা ডাকলাও! ক্রাও! ক্রাও!
তারপর মনে হল বেলগাছটায় হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়া এসেছে। শনশন করে ডালপালা নড়ছে। তারপরই ভবভূতি দেখতে পেলেন, ঠিক মগডালে কালে প্রকাণ্ড একটা মানুষের মতো কে উঠে দাঁড়াল এবং ঈদের দিকে তাকিয়ে যেন হাই তুলে বারতিনেক বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর সাহায্যে তুড়ি দিল।
তারপর হেঁড়ে এবং চাপাগলায় সেই মূর্তিটা বলে উঠল, হরি হে দীনবন্ধু। পার করো হে ভবসিন্ধু।…তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো! জগদম্বা বলো মন হে! জগদম্বা বলো!
নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ভবভূতি। তাঁর পিছনে বসে নরহরি ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে চিমটি কেটে সাবধান করে দিলেন এবার।
একটু পরে মূর্তিটা গাছের ডগা থেকে লাফ দিয়ে নামল। মাটি কেঁপে উঠল যেন। জ্যোৎস্নায় এলে স্পষ্ট দেখা গেল, তার পরনে কেঁচা করে পরা খাটো ধুতি, খালি গা, বুকে পৈতে রয়েছে। মাথার চুল ছোট করে কাটা। একটা প্রকাণ্ড টিকি আছে।
হ্যাঁ, খড়মের শব্দ হচ্ছে। খট খট খট খট! ভবভূতি দেখলেন, সে তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে। শিউরে উঠলেন। কিন্তু তিনি এক সময়কার শিকারি মানুষ। এমনিভাবে বন্দুক হাতে কতবার গহন অরণ্যে বাঘের এলাকায় রাত কাটিয়েছেন। এ কিছু নতুন ব্যাপার নয় তার কাছে। দেখা যাক।
অবশ্য এবার বাঘ নয়, ব্রহ্মদৈত্য এই যা।
ব্রহ্মদৈত্যকে কাছে থেকে ভালো করে দেখবেন বলে চুপচাপ বসে আছেন ভবভূতি। নরহরির সাড়া নেই। চোখ বুজে ফেলেছে। নাকি ভিরমি গেল, ভবভূতির ঘুরে দেখার সময় নেই।
ব্ৰহ্মদৈত্য এসে ভবভূতির মাথার ওপর জবাগাছ থেকে টুপ করে একটা জবাফুল পেড়ে নিল। নিয়ে টিকিতে বোঁটাটা গিট দিয়ে বাঁধল। কী বোটকা গন্ধ। ভবভূতির অসহ্য লাগল। নাকে আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন। আর এতক্ষণে দেখলেন, ব্রহ্মদৈত্যের হাতে একটা হাঁড়ি রয়েছে। তারপর দেখলেন ব্রহ্মদৈত্য তাঁর কুকুরশালার দিকেই চলেছে। খড়মের শব্দ হচ্ছে খট খট খটাং! হাঁড়িতে কী থাকতে পারে? তাছাড়া ও ঘরে ঢুকবেই-বা কীভাবে? ভেবেই পেলেন না ভবভূতি।
কুকুরশালার বাইরে দরজার কাছে গিয়ে ব্রহ্মদৈত্য হেঁড়ে গলায় ফের বলে উঠল,–হরি হে দীনবন্ধু! পার করো হে ভবসিন্ধু।…তারা। তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!… জগদম্বা বলো মন হে, জগদম্বা বলো!
তারপর যেন তিনবার তুড়ি দিল সে। অমনি অবাক কাণ্ড! দরজা খুলে গেল। তখন ব্রহ্মদৈত্য হাঁড়িটা উঁচু করে ধরে যেই ঢুকতে যাচ্ছে, ভবভূতি আর সহ্য করতে পারলেন না। গর্জে উঠলেন, খবরদার!
সঙ্গে সঙ্গে আকাশমুখো বন্দুক তুলে ছুড়লেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, নরহরি! ঠিল ছোড়ো! লাঠি চার্জ করো! এক হাতে ঢিল, অন্য হাত লাঠি।
ঘুরে দেখেন, কোথায় নরহরি? কেউ নেই পিছনে। পাটকেলের বস্তা আর লাঠিটা পড়ে আছে। রাগে ভবভূতি বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে এবং লাঠি ও বন্দুক বগলদাবা করে উঠে দাঁড়ালেন।
এই অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে ফঁকায় দাঁড়ালেন। ওদিকে ব্রহ্মদৈত্য তখন দরজা থেকে কেটে পড়েছে। খড়ম পায়ে দৌড়ে আবার বেলগাছটার দিকে তাকে যেতে দেখলেন ভবভূতি।
একলাফে বেলগাছে উঠে পড়েছে ব্রহ্মদৈত্য।
ভবভূতি বস্তা নামিয়ে গাছের দিকে পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে গর্জাতে থাকলেন,–গেট ডাউন! গেট ডাউন রাস্কেল! নেমে এসো বলছি!
বস্তার পাটকেল শেষ হয়ে আসছে, এমন সময় গাছ থেকে ব্রহ্মদৈত্য করুণ স্বরে বলে উঠল, ভব! ভবী! ভবী! ভবু! আর ঢিল ছুড়ো না ভাই! মাইরি, মরে যাব!
ভবভূতি চমকে উঠলেন।
গলাটা এতক্ষণে চেনা মনে হচ্ছে। দৌড়ে গাছতলায় গিয়ে বললেন,–কে? কে তুমি?
আবার করুণস্বরে জবাব এল-আমি, আমি। উ হু হু হু! গেছিরে বাবা।
কে আমি? নেমে এসো বলছি! নইলে এবার লাঠিপেটা করব! বলে ভবভূতি সেই ইয়া মোটা লাঠিটা বাগিয়ে ধরল!
ব্রহ্মদৈত্য কান্নার সুরে বলল, নামতে পারছি না। তোমার ঢিল লেগে হাঁটুর বাতটা হঠাৎ চাগিয়ে উঠেছে! উঁহু হু হু!
এতক্ষণে ভবভূতির সংশয় ঘুচল। লাঠি ও বন্দুক মাটিতে রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হো-হো, করে হেসে বললেন,-রোসো৷ হাত বাড়াও। ধরে নামাচ্ছি।
ব্রহ্মদৈত্য গুঁড়ির ওপরে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে দিল। ভবভূতি তার হাত ধরে সাবধানে নামতে সাহায্য করলেন।
নেমেই ব্রহ্মদৈত্য হাঁটুর ব্যথা ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, এই সেরেছে। হাঁড়িটা পড়ে আছে যে! সর্বনাশ! নির্ঘাৎ ব্যাটা এতক্ষণে অর্ধেক সাবাড় করেছে।
বলে সে কুকুরশালার দরজার দিকে দৌড়ল। ভবভূতিও তার সঙ্গে দৌড়েছেন।
গিয়ে দেখেন, ব্রহ্মদৈত্য নরহরির কাঁধ আঁকড়ে ধরেছেন, আর নরহরি হাঁড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। টানাটানিতে তাকে নাড়ানো যাচ্ছে না। ভবভূতি দেখেশুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, রসগোল্লা নাকি?
–হ্যাঁ। পাক্কা তিন কিলো মাল। ব্যাটা সব সাবাড় করে ফেললে দেখছ না? এ যে আস্ত রাক্ষস!
বেশ করেছে। ভবভূতি রেগে বললেন।
ব্রহ্মদৈত্য বলল, ইয়ার্কি? ওর জন্যে এনেছিলুম নাকি?
ভবভূতি গর্জে উঠলেন,–তোমার নামে মামলা করব! তুমি আমার কুকুরগুলোকে রসগোল্লা খাইয়ে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছ। সকাল হতে দাও। দেখাচ্ছি মজা। সটান ঘুঘুডাঙা আদালতে গিয়ে তোমার নামে মামলা করব।
ব্ৰহ্মদৈত্য হাসল,–হুঁ! আমাকে মামলার ভয় দেখাচ্ছ। আমি চল্লিশ বছর ওকালতি করেছি জানো না বুঝি?
হ্যাঁ, তাও বটে। ভবভূতি ভড়কে গেলেন। বললেন,–তাই বলো, তো এই বুড়ো বয়সে কেলেঙ্কারি করতে তোমার লজ্জা হল না? ছিঃ!
কীসের লজ্জা? ব্ৰহ্মদৈত্য অর্থাৎ সাক্ষাৎ স্বয়ং গজপতি বাঁকা হেসে বললেন। তুমি যে ব্রহ্মদৈত্য মানে না। এবার মানলে তো?
ভবভূতি পাল্টা বাঁকা হেসে বললেন, , মানলুম। তবে যাও, এখন চান করে গায়ের কালো কালিগুলো ধুয়ে এসো। নইলে তোমায় বিছানায় শুতে দেব ভেবেছ? ছা-ছা!
নরহরি ঠাকুর হাঁড়ি শেষ করে এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন গো। টিউবেল থেকে জল টিপে দিই। চান করবেন। আমারও তেষ্টা পেয়েছে।…
এই ঘটনায় দুটো ফল হল। এক : নরহরি গোপনে গজপতির চক্রান্তে যোগ দিয়েছিল এবং কুকুরশালার চাবিও চুরি করে ওকে দিয়েছিল বলে তার এখানকার চাকরি গেল। সে অবশ্য গজপতির বাড়ি ফের চাকরি পেল। তাই কথা ছিল গজপতির সঙ্গে।
দুই : ভবভূতিকে কুকুরগুলোর জন্যে দৈনিক তিন কিলো করে রসগোল্লার ব্যবস্থা করতে হল। রসগোল্লার মজা ওরা পেয়ে গেছে। একদিন না পেলে ভবভূতির বিরুদ্ধে সেদিনের মতো প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখায়।
ভবভূতি নতুন লোক বহাল করেছেন। তার নাম কালীপদ। ডাক নাম কালো। বছর বিশ-বাইশ বয়সের এক ছোকরা। ভারি অমায়িক এবং বিশ্বাসী। তাকে কুকুরগুলো বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। এটা ভবভূতির বাড়তি লাভ বলা যায়।
আর গজপতির সঙ্গে সম্পর্ক? এবার চিড় খেয়েছে সত্যিসত্যি। গজপতির সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেছে ভবভূতির। ব্ৰহ্মদৈত্য আছে তা প্রমাণের জন্যে যে এমন কাণ্ড করতে পারে, সে কি মানুষ? সে নিজেই ভূত। অতএব ভূতে-মানুষে কি বন্ধুত্ব হয়? কিংবা হয়ে গেলেও তা বেশিদিন টেকে?
ভবভূতি মন দিয়ে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। গজপতিকে মন থেকে একেবারে মুছেই ফেলেন।
কিন্তু মাঝে-মাঝে হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা-বেলগাছে যদি গজপতির বদলে সে রাতে সত্যি সত্যি ব্রহ্মদৈত্যকেই দেখতে পেতেন, তাহলে কী ঘটত? একটু শিরশির করে শরীর। বিশেষ করে কোনও-কোনও রাতে লনে পায়চারি করতে করতে বেলগাছটার দিকে তাকালে যেন মনে হয় কেউ ওর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাগে পেলেই ঘাড় মটকাবে। তখন ভবভূতি বন্দুকটা নিয়ে এসে খামোকা আকাশে একটা গুলি ছোড়েন। সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে বেলগাছের পেঁচাটা চ্যাঁচিতে-চ্যাঁচিতে উড়ে পালায়।
ততদিনে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণায় অনেকটা এগিয়েছেন ভবভূতি। ইয়া মোটা লাল কাপড়ে বাঁধানো খেরোর খাতায় কুকুরের ডাকগুলো টুকেছেন এবং তার পাশে বাংলা অনুবাদও করে ফেলেছেন।
এমনকী ওদের সঙ্গে ইদানীং ওদের ভাষাতেই কথা বলার চেষ্টা করছেন।
অ্যালসেশিয়ানের খাঁচার সামনে গিয়ে বলেন,–গররর গঁঃ। অর্থাৎ কেমন আছো হে?
সে জবাব দেয়,–গর গরররর গা। ভালোই আছি। তবে খাঁচায় আটকে থাকাটা ভালো মনে হচ্ছে না।
ভবভূতি একটু হেসে বলেন,-ঘঃ ঘঃ। ঠিক আছে। শিগগির ছেড়ে দেব।
টেরিয়ার দুটো তাকে দেখে বলে–ঘেঃ ঘেঃ। ছেড়ে দাও না ব্রাদার!
ভবভূতি বললেন,–ঘঁঃ। সবুর, সবুর। দেব বইকী।
গ্ৰেহাউন্ড ভারি রাগী। বলে—খ্যাঁ খ্যাঁ খ্যাঁঃ খুঁঃ। ছেড়ে দাও, নয়তো ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
ভবভূতি বলেন,–ছু চুঃ। সোনা ছেলে, লক্ষ্মীছেলে। রাগ করে না।
দিশি কুকুর বাঘা, খেকি এবং নেড়ি তাঁকে দেখে চ্যাঁচিমেচি করে বলে, ভৌ ভৌ ভেউ ভু-উ-উ-উ। কেন আটকে রেখেছ। আমাদের কষ্ট হচ্ছে না বুঝি?
ভবভূতি জবাব দেন,–ঘেউ ঘেউ ঘেক ঘেক ঘুঃ? বেশি চেঁচিও না তো বাপু! সময় হলেই ছাড়ব।
নতুন রাঁধুনিকাম-চাকর কালীপদ ব্যাপার-স্যাপার দেখে হতভম্ব। আজকাল কর্তাবাবু আপনমনে ঘরের মধ্যে পায়চারি করেন আর কুকুরের মতো ডাকেন। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো?
সেদিন কালীপদ গেছে চা নিয়ে। ভবভূতি বই পড়তে-পড়তে বললেন,–গেঃ গেঃ! ঘেউ-উ-উ-উ!
কালীপদ হতভম্ব হয়ে বলেন, কী বলছেন স্যার?
ভবভূতি একটু হেসে বললেন,-তাইত! তুমি এ ভাষা জানো না বটে। শোন কালীপদ, আমি কুকুরের ভাষায় দিব্যি কথা বলতে পারি। একটা বই লিখব ভাবছি। ওটা পড়লে সবাই এ ভাষা শিখে নেবে। তা শোনো, তুমি বরং আমার কাছে রোজ এ ভাষাটা শিখতে থাকে। বেশি কথা খরচ করতে হবে না। একটুও ক্লান্ত হবে না কথা বলতে। কত সহজে একটা শব্দে অনেক বেশি কথা বলা যায় জানো?
কালীপদ ছেলেটি ভারি সরল। বলল, তাহলে আজই শেখাতে শুরু করুন স্যার।
ব্যাস, ভবভূতি ওকে নিয়ে পড়লেন। রোজ দু-ঘণ্টা করে মনোযোগী ছাত্রের মতো সে কর্তাবাবুর কাছে বসে কুকুরের ভাষা শেখে। রান্নাঘরে গিয়ে আপনমনে অভ্যাস করে। জিভ তালুতে ঠেকিয়ে কীভাবে কীভাবে ঘেউ করতে হয়, সহজেই রপ্ত করে নেয়। রান্নাঘর থেকে অনেক সময় তার সেই ঘেউ শোনা যায়। ভবভূতি তাঁর ঘর থেকে সাড়া দিয়ে বলেন,-ঘেউ ঘেউ ঘোঃ। বাঃ বহুত আচ্ছা। ঠিক হচ্ছে।
কিছুদিন পরে দেখা গেল, দুজনে আর মানুষের ভাষায় কথা বলছেন না। স্রেফ কুকুরের ভাষায় কথা চলছে।
কারণ ভাষাশিক্ষার তাই নিয়ম! যেমন কিনা ইংরাজি স্কুলে যারা পড়ে, তাদের সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। তাছাড়া সেই যে একটা কথা আছে–যদি ইংরেজি শিখতে চাও, তাহলে ইংরেজিতে কথা বলো, ইংরেজিতে স্বপ্নও দেখো।
কুকুরের ভাষায় আজকাল দুজনে স্বপ্ন দেখতেও চেষ্টা করেন বইকী?
আর এই ভাষার নামও খুঁজে পেয়েছেন ভবভূতি। শ্বানভাষা। শ হল কিনা কুকুর। তাদের ভাষার নাম শান ভাষা।
যে গোয়ালা রোজ সরমা অর্থাৎ ভবভূতিবাবুর বাড়িতে দুধ দিতে যায়, সে অবাক হয়ে শোনে, ভবভূতি বলছেন,–ঘৌ ঘৌ ঘঃ?
কালীপদ জবাব দিচ্ছে,–ঘরররর ঘ্যাঃ।
–ভেঁক ভেঁক।
–ভেউ—উ–উ।
–গ্যাঃ গ গাও!
–গ্যাঁ–আঁ অ্যাঁ।
গোয়ালা কালীপদকে চুপিচুপি বলে,–ব্যাপারটা কী ভাই কালীপদ?
কালীপদ মুচকি হেসে বলে,–গরগরর! ঘেউ!
গোয়ালা বেচারা ঘাবড়ে যায়। বাইরে ব্যাপারটা রটায় সে। তাই সরমার গেটে কৌতূহলী লোকেরা ভিড় জমায়। বিরক্ত ভবভূতি তাড়া করে বলেন,–ঘরররর ঘেঁউ ঘেঁউ। ঘ্যাঁ।
লোকেরা ভাবে নির্ঘাৎ পাগল এই ভদ্রলোক। তারা হো-হো করে হাসে এবং ভেংচি কেটে কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে। তখন ভবভূতি বন্দুক বের করেন। তারা পালিয়ে যায়।
এই খবর গিয়েছিল গজপতির কাছে। শুনে গজপতি তো ভাবনায় পড়ে গেলেন। হাজার হলেও তার ছেলেবেলার বন্ধু ভবভূতি। বুড়ো বয়সে হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়াটা মোটেও কাজের কথা নয়।
বুদ্ধি খাঁটিয়ে একদিন গজপতি এক সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে নিয়ে ঘুঘুডাঙায় হাজির হলেন। ইনি কুকুর সম্পর্কেও জ্ঞানী। হন্ডুরাসে তিনবছর কুকুরবিদ্যা শিখে এসেছেন।
সরমার গেটে গিয়ে ডাকলেন,-ভব! ভবী! ভবী! আছে নাকি ভায়া?
ভবভূতি কিন্তু গজপতির জন্যে মনে-মনে ছটফট করছেন। আহা, কত কালের বন্ধুত্ব। তার ওপর এমন শান ভাষায় তাঁর কৃতিত্ব গজপতির কাছে জহির না করলে কি চলে?
গজপতির ওপর সব রাগ ভুলে হাসিমুখে গেটে গিয়ে সম্ভাষণ করলেন, গররর গরর।
গজপতি ডাক্তারবাবুকে চিমটি কেটে দিলেন। অর্থাৎ দেখছেন এবং শুনছেন তো? ডাক্তার মুচকি হেসে ফিসফিস করে বললেন,–এই রোগের নাম কুকুরামি। দেখেছি হন্ডুরাসে অনেকেরই আছে।
গজপতিকে গেট খুলে ভবভূতি ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন–গঁঃ গঁঃ। ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন,–ঘঁ-গ-অ-অ। ঘ্যাঁ!
গজপতি অবাক। আরও অবাক হলেন ঘরে গিয়ে। ডাক্তার ভদ্রলোকও ভবভূতির মতো পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
ভবভূতি আর ডাক্তার কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ গরগর করে যাচ্ছেন সমানে। সেই সময় কালীপদ চা নিয়ে এসে বলল,-ভৌ ভৌ ভঃ।
গজপতির এতক্ষণে রাগ হল। আর রাগের চোটে ভেংচি কেটে বলে উঠলেন,-ভৌ ভৌ ভ্যাও।
অমনি কালীপদ তার পায়ের ধুলো নিল। আর ভবভূতি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলে উঠলেন,–ঘঁরররর গরররর গঁঃ।
এবার অসহ্য লাগল গজপতির। বললেন কী ব্যাপার বলো তো ভায়া ভব? তোমরা সবাই কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করছ কেন?
ভবভূতি মুচকি হেসে তার খেরোর খাতাটি সামনে খুলে ধরলেন।
চোখ বুলিয়ে গজপতি সব টের পেলেন এতক্ষণে। একের পর এক পাতা উল্টে গোটাটা দেখে নিলেন। তারপর হাসিমুখে ভবভূতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘউউ! ঘঁ!
গজপতির সঙ্গে ভবভূতির আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে গজপতি প্রায়ই সরমাতে বন্ধুর কাছে এক-এক বেলা কাটিয়ে যান এবং শান ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আর সেই কুকুর বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকের নাম ডাঃ লম্বোদয় হোড়। সংক্ষেপে ডাঃ এল হাউর। তাঁকে মোটা মাইনেতে বহাল করেছেন ভবভূতি। কুকুরগুলোর মাথাধরা, কান কটকট, পেটফাঁপা চিকিৎসা করতেন ভবভূতি। এখন ডাঃ হাউর তা করেন। উনি হন্ডুরাসী পদ্ধতিতেই চিকিৎসাটা করেন। তারই পরামর্শে কুকুর বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা খাঁচায় এতদিন বাস করে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চায় না। খাঁচায় গিয়ে ঢোকে। বাইরে যতক্ষণ থাকে, চুপচাপ উদাস চোখে শুধু আকাশ দেখে আর হাই তোলে। এতে একটা দারুণ রকমের কাজ হয়েছে। লোকেরা এই বাড়িটা পাগলাগারদ ভেবে পাগল দেখবার জন্যে ইদানীং গেটের পাশে উঁকিঝুঁকি মারত। এখন বাড়ির ত্রিসীমানায় এলেই সতেরটা কুকুর নিজ-নিজ কণ্ঠস্বরে গর্জন করে ওঠে। আর গ্ৰেহাউন্ড কী সাংঘাতিক কুকুর, সবাই জানে।
আর কেউ বাড়ির আনাচে-কানাচে আসতে সাহস পায় না। বিকেলে দেখা যায় ভবভূতি আর ডাঃ হাউর সতেরোটা দেশি-বিদেশি কুকুর নিয়ে বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে বেরিয়েছেন এবং কুকুরগুলোকে হা-ডু-ডু খেলা শেখাচ্ছেন। বিদেশি কুকুরগুলো দিব্যি হা-ডু-ডু হাঁকতে পারে। কিন্তু দিশি-বাঘা-নেড়ি-ঘেঁকিরা ওই ইংরিজি বলতেই পারে না। তারা দিশি ভাষাতেই বলে–চু কিট কিট কিট।…
সূর্য ডুবে যায় গাছপালার আড়ালে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা আসে। তখন ডাঃ হাউর কুকুরদের নিয়ে কুকুরশালায় ঢোকেন। আর ভবভূতি চুপচাপ পায়চারি করেন কতক্ষণ। চারদিকে নিঝুম। মনে কত কী আশা জেগে ওঠে। এবার নোবেল প্রাইজ ঠেকায় কে?
সেদিন সন্ধ্যায় ভবভূতি একা পায়চারি করছেন। মনে একটা নতুন ভাবনা গজিয়েছে। কুকুরগুলোকে রাষ্ট্রভাষা শেখালে কেমন হয়? অন্য ভাষার চাইতে ওটা খুব তাড়াতাড়ি শেখারই কথা। একটু রাগিয়ে দিয়ে শেখাতে শুরু করলেই ঝটপট শিখে নেবে। রাগ হলেই তো মুখ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে যায়।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সেই বেলতলায় গেছেন ভবভূতি। হঠাৎ মাথার ওপরে ডালপালার আড়াল থেকে কে ভারী গলায় বলে উঠল,-ঘরররর ঘূ-উ।
চমকে উঠলেন ভবভূতি। কথাটার মানে, কী ভায়া? ঘুরে বেড়াচ্ছ নাকি।
অন্ধকারে ভবভূতি কাকেও দেখতে পেলেন না। বললেন,–সঁঃ : ঘেউ উ। কে হে তুমি? গাছে কী করছ?
জবাব এল, ঘ্যাঁ-আঁ-আঁক ঘরররর…
কী?—ভবভূতি খাপ্পা। বলছে কিনা, আমি যাই করি, তাতে তোমার কী হে! ভবভূতির বেলগাছে বসে ভবভূতিকেই চোখ রাঙাচ্ছে–তাও এই রাতবিরেতে? –তিনি রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলেন মানুষের ভাষাতেই। এবং রাগ হলে বাঙালি ভদ্রলোক যা করেন, তাই করলেন অর্থাৎ গেট ডাউন। গেট ডাউন ইউ ব্লডি ফুল!
অমনি ধপ করে তার সামনে কে লাফিয়ে পড়ল। অন্ধকার গাঢ় হয়নি ততটা। আবছা দেখলেন, বেঁটেখাটো মোটাসোটা একটা লোক। খালি গা। পরনে খাটো ধুতি কেঁচা করে পরা। পায়ে যেন খড়মও আছে। গলায় পৈতেও ঝকমক করছে।
অবিকল সেই জ্যোৎস্নারাতে ব্রহ্মদৈত্যবেশী গজপতির মতো।
তাহলে আবার নির্ঘাৎ গজপতি রসিকতা করতে বেলগাছে চেপেছিলেন। এই ভেবে ভবভূতি হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,-গজু, তুই মাইরি আস্ত ভূত!
ভূত!–বেলগাছের লোকটা ঘুসি তুলে বলল, তুমি ভূত! তোমার চোদ্দপুরুষ ভূত! আর গজু বলছ, সেই গজু-টজকে আমি চিনি না!
ভবভূতি বললেন,–দেখো গজু, বাড়াবাড়ি কোরো না। গায়ে জল ঢেলে দেব বলছি!
–কেন? জল ঢালবে কেন?
–তোমার গায়ের কালো পেন্ট ধুয়ে যাবে সেদিনকার মতো।
–সেদিনকার মতো? কী বলছ! আমি আজ এক বছর কাশী-গয়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। সদ্য কাল সন্ধেবেলা ফিরেছি। ফিরেই তোমার কীর্তিকলাপ দেখছি।
ভবভূতি অবাক হয়ে গেছেন। বললেন, তুমি গজু নও?
বেঁটে মূর্তিটা জোরে বনবন করে লাটিমের মতো টিকিসমেত ঘুরপাক খেয়ে বলল,-না না না কভি নাহি!
–আলবাত গজপতি তুমি! চলো, আলোয় চলো! পরীক্ষা করে দেখব।
–আমার আলোয় যাওয়া বারণ আছে। যাব না। পরীক্ষা করে দেখতে হয়, এখানেই দেখো।
–ঠিক আছে। আগে এক বালতি জল আনি।
–সে কী! কেন, কেন?
–তোমার গায়ে কালো পেন্ট ধুতে হবে না? তখন তোমার ফর্সা রং বেরিয়ে পড়বে।
ভবভূতি পা বাড়াচ্ছিলেন, মূর্তিটা পিছু ডাকল,–শোনো, শোনো। বলছিলুম কী, জল না ঢাললে হয় না? বড্ড ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। মাইরি, শীতে জমে যাব। তুমি বরং কাছে এসে আমাকে টিপে দেখো! আমি তোমার গজু না টজু, সহজে বুঝতে পারবে।
ভবভূতি সটান গিয়ে ওর গোঁফ খামচে ধরলেন। মূর্তিটা চ্যাঁচিমেচি করে বলল, ওরে বাবা রে! গেছি রে! গেছি রে! ছাড়ো ছাড়ো! উঃ হু হু হু!
তাইতো! গজপতির তো গোঁফ নেই। সে রাতে নকল গোঁফ পরেছিলেন। কিন্তু এর গোঁফটা দেখা যাচ্ছে আসল। তার চেয়ে বড় কথা, আজ সকালে গজপতি এসেছিলেন। গোঁফ পরিষ্কার কামানো ছিল। সন্ধ্যার মধ্যে এমন পেল্লায় গোঁফ গজাতে পারে না তার। তাহলে এ গজপতি নয়, অন্য কেউ।
ভবভূতি গোঁফ ছেড়ে চুল ধরতে গেলেন। ধরা গেল না। ছোট-ছোট চুল যেন পেরেকের ডগার মতো। হাতে বিধতেই ভবভূতি হাত সরিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,–তাহলে তুমি কে শুনি?
মূর্তিটিও তাঁর মতো গম্ভীরগলায় জবাব দিল, আমার নাম বলা বারণ। তাছাড়া বললেই তুমি ভিরমি খাবে। কাজেই চেপে যাও।
–ইয়ার্কি? পুলিশে দেব তোমাকে। কেন তুমি আমার বাড়িতে ঢুকেছ?
–তোমার বাড়ি? তোমার বাড়িতে ঢুকলুম কোথায়? আমি তো গাছে ছিলুম।
–গাছটাও যে আমার।
–তোমার গাছ মানে? আজ তিনশো বছর এই গাছ আমার দখলে! আমি এই গাছে থেকে বুড়ো হয়ে গেলুম! আর তুমি বলছ আমার গাছ?
গাছে থাকো! এই বেলগাছে? রাগের মধ্যে ভবভূতি হেসে ফেললেন।
মূর্তিটি বলল, এতে হাসির কী আছে? যার যেখানে বাসা। তুমি মানুষ, তাই বাড়িতে থাকো। আমি ইয়ে, তাই বেলগাছে থাকি।
–ইয়ে মানে? তুমি কি ব্ৰহ্মদত্যি?
খবরদার নাম ধরে বলবে না! জানো না কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বললে রেগে যায়? ব্রহ্মদত্যিকে ব্রহ্মদত্যি বললে রাগ হবে–ভীষণ রাগ বলে সে দাঁত কিড়মিড় করে রাগটা দেখিয়ে দিল। টিকিটা কাঠির মতো সোজা দাঁড়িয়ে রইল।
ভবভূতি এবার একটু সংশয়ান্বিত হয়ে বললেন, তাহলে বলছ, তুমিই এই বেলগাছের ব্রহ্মদত্যি?
–আলবাত। আদি, আসল এবং অকৃত্রিম ব্ৰহ্মদত্যি। এতটুকু ভেজাল নেই।
–বিশ্বাস করি না। আজকাল সবকিছুতেই ভেজাল। –তাহলে প্রমাণ চাও?
–হুঁউ। চাই।
–বলো, কী প্রমাণ চাও?
–তুমি যদি আসল ব্ৰহ্মদত্যি, তাহলে…তাহলে…
কথায় বাধা পড়ল। গাড়িবারান্দা থেকে ডাঃ হাউরের গলা শোনা গেল, কার সঙ্গে কথা বলছেন ভবভূতিবাবু?
অমনি মূর্তিটা একলাফে গাছের ডালে উঠে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, এই? ওকে বোলো না মাইরি! ডাক্তার-টাক্তার দেখলেই আমার বড্ড বুক কাপে। ওরা যে ইনজেকশান দেয়।
ভবভূতি হাসি চেপে ডঃ হাউরকে বললেন,–ও কিছু না। আপনি বরং কালীপদকে কড়া করে কফি বানাতে বলুন। ঠান্ডা পড়েছে বেশ।
তাহলে আর শিশিরে ঘুরবেন না। বলে ডাঃ হাউর ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভবভূতি বললেন, কই হে ব্রহ্মদত্যি-মশাই, নেমে এসো!
–ডাক্তার আর আসবে না তো?
–না, না। তুমি নেমে এসো। উনি ডাক্তারও বটেন, ডক্টর-ও বটেন! কাজেই ভয় নেই।
ব্ৰহ্মদত্যি নেমে এল আবার। তারপর বলল-যাকগে। যেজন্যে তোমায় দেখা দিয়েছি, বলি! এতক্ষণ খালি বাজে বকবক কথা হল। ভবভূতিভায়া, তোমায় বন্ধু বলেই মেনে নিয়েছি! তো কথাটা হচ্ছে আমায় খানভাষাটা শেখাবে?
–নিশ্চয় শেখাব। ইতিমধ্যে শুনে-শুনে তো তুমি কিছু শিখেই ফেলেছ।
–হুঁউ। ভেউ উউ গ র র র র।
–উঁহু। ভেউ-উ-উ-উ র র র র। জিভ তালুতে ঠেকিয়ে উচ্চারণ করো।
–ভেউ-উ-উ-উ র র র র র র…
পরদিন গজপতি এসেছেন বন্ধুসকাশে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়াটা ভালোই হয়েছে। ভবভূতি ভাতঘুম দিচ্ছেন অভ্যাসমত। ডাঃ হাউরও পাশের ঘরে নাক ডাকছে। কালীপদর তো সবসময়ে ঢুলুনি। সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নেয়। সে শ্বান ভাষায় নাক ডাকছে– র র র র গো!
গজপতির দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই। বেরিয়ে গিয়ে রোদে দাঁড়িয়েছেন। সবে শীত পড়েছে। বেশ আরাম লাগে।
হঠাৎ কানে এল, বেলগাছ থেকে কে সুর ধরে আওড়াচ্ছে :
গর র র মানে এসো এসো–
ভেউ মানে কে রে?
ঘেঁউ মানে খবরদার–
যাব নাকি তেড়ে?
খ্যাঁক মানে কামড়াব
ভ্যাঁক মানে যাঃ।
আঁউ মানে পেটে ব্যথা–
কিছু খাব না…
গজপতি পা টিপে টিপে এগোলেন। নিশ্চয়ই ভবভূতির কোনও ছাত্র খান ভাষায় পড়া মুখস্থ করছে। পরীক্ষার সময় ছাত্ররা নিরিবিলিতে এমনি করেই তো মুখস্থ করে। গজপতি বেলতলায় গিয়ে মুখ তুলে দেখলেন, ঘন ডাল ও পাতার আড়ালে কালো কুচকুচে একটি বেঁটেখাটো টিকিওয়ালা মূর্তি আপনমনে বসে পড়াশুনো করছে। গজপতি বললেন,–কে হে তুমি? গাছের ডালে বসে ও কী মুখস্থ করছ?
মূর্তিটা পাতা সরিয়ে গজপতিকে দেখেই ফিক করে হাসল। তারপর হনুমানের মতো সড়-সড় করে নেমে এসে বলল,–গজু না তুমি? সেই অ্যাটুকুন দেখেছি ওরে বাবা! কত বড় হয়েছ তুমি? কত বুড়ো হয়েছ। সেই যে তোমার দিদি রাতের বেলা জানালায় দাঁড়িয়ে পান চিবুতে-চিবুতে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করত–আর তুমি বিছানায় শুনে টুক-টুক করে তাকিয়ে দেখতে। সে কি আজকের কথা? এসো গজু, তোমায় আদর করি। ওরে আমার গজু ছোনারে! তোমার চুল কেন পাক? ওরে গজু রে গজু রে!…।
গজপতি ততক্ষণে গেটের কাছে। গেট বন্ধ! তখন পাঁচিলে উঠে পড়লেন কোনওরকমে। তারপর লাফ দিলেন। তারপর পড়ি-কিমরি করে দৌড়! একদৌড়ে ঘুঘুডাঙা স্টেশনে। আর এ জীবনে ও বাড়িতে নয় বাপস!
ব্ৰহ্মদত্যি দুঃখিত মনে বেলগাছে উঠে আবার পড়ায় মন দিল।
গজপতি আর সত্যিই আসেন না ঘুঘুডাঙায় ভবভূতির সরমা ভবনে। ভবভূতি, ডাঃ হাউর আর কালীপদ, আর সতেরোটা কুকুর, আর বেলগাছের…ব্রহ্মদত্যিমশাই দিব্যি কাটাচ্ছে। কুকুরগুলো আজকাল মানুষের ভাষায় কথা বলতেও পারে নাকি। তোমরা কেউ ইচ্ছে করলেই ঘুঘুডাঙায় হাজির হতে পারে। তবে সাবধান, ব্রহ্মদত্যি মশায়ের জন্য সন্দেশ নিয়ে যেতে ভুলো না। নয়তো বেলগাছ থেকে শ্বানভাষায় গর্জন শুনবে,–ঘেঁউ গঁর র র র!…
চোর বনাম ভূত
আগের দিনে চোরেরা ছিল বেজায় ভিতু। যেমন আমাদের গ্রামের পাঁচু-চোর। সে নাকি চুরি করতে গিয়ে নিজের পায়ের শব্দে নিজেই ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে পালাত। দাদুর কাছে শুনেছি, একবার সে আমাদের বাড়ি চুরি করতে এসেছিল। পাঁচিল ডিঙিয়ে উঠোনে নামবার সময় হঠাৎ তার পা পিছলে যায়। তারপর সে ধপাস করে পড়েছে এবং তাতেই যা একটু শব্দ হয়েছে। সেই শব্দেই দিশেহারা পাঁচু উঠোনের কোণে তালগাছের ডগায় তরতর করে উঠে গেছে।
উঠে তো গেছে। কিন্তু নামতে সাহস পাচ্ছে না। নামতে গিয়ে যদি আবার পা পিছলে পড়ে যায়!
এদিকে রাত পুইয়ে ভোর হতে চলেছে। দিনের আলোয় কেউ-না-কেউ তাকে দেখতে পাবে। তখন তার কী অবস্থা হবে ভেবে পাঁচু-চোর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, কান্না শুনে দাদু টর্চ হাতে বেরিয়ে আসেন। তালগাছের ডগা থেকে কান্না। ভূতপ্রেত নাকি?
তখনকার দিনে পাড়াগাঁয়ের আনাচে-কানাচে ভূতেরাও ছোঁকছোঁক করে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু দাদু ছিলেন সাহসী মানুষ। তালগাছের ডগায় টর্চের আলো ফেলে তিনি অবাক হয়ে যান। জিগ্যেস করেন, তুই কে রে?
পাঁচু-চোর করুণ স্বরে বলে, আজ্ঞে আমি পাঁচু।
–তা তুই তালগাছের ডগায় কী চুরি করতে উঠেছিস? এখন তো আর একটা তালও নেই। নেমে আয় হতভাগা!
–আজ্ঞে বড্ড ভয় করছে।
দাদু বলেন,–তোকে মারব না। পুলিশেও ধরিয়ে দেব না। নেমে আয়। তারপর খুলে বল, তালগাছের ডগায় কেন চড়েছিস?
পাঁচু অনেক কষ্টে নেমে আসে এবং সবকথা খুলে বলে। তারপর দাদুর পা ছুঁয়ে বলে,–আর কক্ষনও আপনার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকব না।…..
দাদু গল্পটা খুব জমিয়ে বলতেন। শুনে আমরা ছোটরা হেসে অস্থির হতাম। তো সত্যিই আর পাঁচু কখনও আমাদের বাড়িতে চুরি করতে আসেনি। কিন্তু তার কপাল মন্দ। সেবার থানায় এসেছেন এক পুঁদে দারোগা বন্ধুবিহারী ধাড়া। কনস্টেবলরা এতকাল রাতবিরেতে টহল দিতে বেরুত না। চৌকিদার বড়জোর লণ্ঠন আর লাঠি হাতে এক চক্কর ঘুরে ঘরে গিয়ে নাক ডাকাত। বঙ্কুবাবুর তাড়ায় টহলদারি জোরালো হল।
তার ফলে পাঁচুর অবস্থা হল শোচনীয়। দিনদুপুরে তো আর চুরি করা যায় না। তার ওপর রাত্তিরে গিয়ে কনস্টেবলরা, আবার কখনও চৌকিদার হাঁকড়াক করে জেনে নেয় পাঁচু ঘরে আছে কি না। না থাকলেই তার বিপদ। অন্য কেউ কোথাও সে রাতে চুরি করলে দোষটা পড়বে পাচুরই ঘাড়ে। পাঁচু এক দাগি চোর।
এক রাত্তিরে মরিয়া হয়ে পাঁচু বেরুল। যে বাড়িতে সে চুরি করার ফন্দি এঁটেছে, সেই বাড়ির পেছনে ছিল কয়েকটা গাছ। তলায় শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। পা ফেলতেই সেইসব শুকনো পাতা মচমচখড়খড় শব্দ করেছে এবং পাঁচুও যথারীতি ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে দৌড়েছে।
সেদিন বঙ্কুবাবু নিজে টহলদারিতে বেরিয়েছেন। পাঁচু গিয়ে পড়বি তো পড় একেবারে বন্ধুবাবুর বুকে। আচমকা রাতবিরেতে দারোগাবাবুর বুকে কে এসে সেঁটে গেছে, এটা বিরক্তিকর ব্যাপার। অন্য কেউ হলে টাল সামলাতে পারত না। কিন্তু তিনি দশাসই বিশাল এক মানুষ। তবে এভাবে কী একটা জিনিস তার গায়ে সেঁটে যাবে, এটা চূড়ান্ত রকমের বেয়াদপিও বটে। বাঁ-হাতে এক ঝটকায় জিনিসটাকে ছাড়িয়ে টর্চ জ্বেলে দেখেন, এটা একটা মানুষ।
সেই সঙ্গে কনস্টেবলরা চেঁচিয়ে উঠেছে, পাঁচু! পাঁচু!
পাঁচু-চোর ধরা পড়ে গেল। তখনকার দিনে আইনকানুন ছিল কড়া। পাঁচুর নামে অনেকগুলো চুরির নালিশ ছিল পুলিশের খাতায়। আদালতে তার ছমাসের জেল হল।…
এসব গল্প দাদুর মুখেই শোনা। তখন আমি পাঠশালার পরুয়া। পাঁচু-চোরকে দেখতে ইচ্ছে করত খুব। কিন্তু তাকে পাচ্ছিটা কোথায়?
.
পরে আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ছি, তখন একদিন দৈবাৎ তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। যদিও সেই দেখা হওয়াটা মোটেও সুখের হয়নি।
পুজোর ছুটিতে স্কুল বন্ধ। প্রতি বছর পুজোর সময় বড়মামা আমাদের বাড়িতে আসতেন। সেদিনই বিকেলে তিনি এসেছেন। বড়মামা ছিলেন ভবঘুরে ধরনের মানুষ। দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানোর বাতিক ছিল তার। পুজোর সময় এসে ভাগনে-ভাগনিদের সেই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শোনাতেন। তা যেমন অদ্ভুত, তেমনই রোমাঞ্চকর। এসেই তিনি ঘোষণা করতেন কোন-কোন দেশে গিয়েছিলেন। তারপর সন্ধেবেলায় তাঁর গল্পের আসর বসত। এবার এসে বড়মামা বলেছিলেন, খুব রহস্যজনক একটা দেশ থেকে তিনি আসছেন। তবে না–আগেভাগে কিছু ফঁস করবেন না। সন্ধেবেলায় সবিস্তারে সেই দেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন। তখন যদি কেউ ভয় পেয়ে ভিরমি খায়, তার দোষ নেই কিন্তু।
ছোটরা ভয় পেতে তো ভালোই বাসে। আমরা কখন সূর্য ডুববে, সেই প্রতীক্ষায় চঞ্চল। এমন সময় বড়মামা হঠাৎ আমাকে বললেন,–পুঁটু! তোদের এখানকার ছানাবড়া খুব বিখ্যাত। এই নে টাকা। পাঁচ টাকার ছানাবড়া নিয়ে আয় শিগগির।
মা বললেন,-হারুর দোকানে যা। আজকাল হারুর মতো ছানাবড়া তৈরি করতে কেউ পারে না।
আমাদের গ্রামের শেষে পিচরাস্তার ধারে ছোট একটা বাজার ছিল। পাশে ছিল হাটতলা। সপ্তাহে দুদিন হাট বসত। বিকেলের দিকে ওখানটা বেশ ভিড়ভাট্টা হতো। হারু-ময়রার দোকান ছিল সেই বাজারে।
হারুই বড্ড দেরি করিয়ে দিল। অবশ্য ওর দোষ ছিল না। পুজোর সময় তার দোকানে খদ্দেরের খুব ভিড় হয়। তখনকার দিনে পাঁচ টাকা অনেক টাকা। টাকায় চারটে করে মোটাসোটা ছানাবড়া। মাটির হাঁড়িতে কুড়িটা ছানাবড়া আমার পক্ষে বেশ ভারী। হাঁড়ির মুখে শালপাতা চাপানো এবং মিশি পাটের দড়ি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা। দুহাতে দড়ি আঁকড়ে ধরে কুঁজো হয়ে হাঁটলাম। টাল খেয়ে পড়লে হাঁড়ি ফেটে যাবে।
এদিকে আঙুলও যেন কেটে যাচ্ছে মিহি দড়িতে।
অগত্যা শর্টকাট করার জন্য সিঙ্গিমশাইদের আমবাগানে ঢুকলাম। বাগান পেরুলেই ষষ্ঠীতলা। একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। তারপর কাঁচারাস্তায় একটুখানি হাঁটলে আমাদের বাড়ি।
ষষ্ঠীতলায় গেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা রোগা-ভোগা লোক। বটগাছের একটা ঝুরির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ছেঁড়া খাকি হাফ-প্যান্ট, খালি গা, মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কেমন জুলজুলে চাউনি লোকটার। মুখে কিন্তু মিষ্টি হাসি। তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। সে কাছে এসে মিষ্টি-মিষ্টি হেসে বলল, ওতে কী আছে খোকাবাবু? রসগোল্লা নাকি?
বললাম, না। ছানাবড়া।
–বাঃ ছানাবড়া রসগোল্লার চেয়ে ভালো। কার দোকান থেকে কিনলে?
–হারু-ময়রার।
–বাড়িতে কেউ এসেছে বুঝি?
–হ্যাঁ। বড়মামা এসেছেন।
–বলো কী! খুব ভালো! তা তুমি যে দেখছি হাঁড়িটা বইতে পারছ না। কষ্ট হচ্ছে। দেখো দিকি। এতটুকু ছেলে। আহা রে!
লোকটার কথাবার্তা ও হাবভাব অমায়িক। শুধু চাউনিটা কেমন যেন—
তো সে আমার হাত থেকে হাঁড়িটা সাবধানে ধরে বলল,–চলো! আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। এতটুকু ছেলে এত ভারী জিনিস বইতে পারে?
লোকটাকে বাধা দিতে পারলাম না। কিংবা সে পৌঁছে দিলে কষ্টটা থেকে বেঁচে যাই। যে কারণেই হোক, হাঁড়িটা আমার হাতছাড়া হল এবং সে নিমেষে বটগাছের অন্য পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতভম্ব হয়ে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর ঊ্যা করে কেঁদে বাড়ির দিকে দৌড়লাম।
পরে বাড়ির সবাই আমার মুখে লোকটার চেহারার বর্ণনা শুনে সাব্যস্ত করেছিলেন তাহলে এটা পাঁচুরই কাজ।…
.
বছর দুই পরের কথা। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে বইকী! তা না হলে কেমন করে বুঝব, আমি কী বোকাই না ছিলাম। অমন নিরিবিলি জায়গায় সন্ধ্যার মুখে অচেনা লোককে ছানাবড়ার হাঁড়ি বইতে দেয় কেউ?
তবে পাঁচু চোর ছিল বটে, কিন্তু নেহাত ছিঁচকে চোর। সে কোনও বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি করেছে বলে শুনিনি। দাদু আরও বুড়ো হয়েছেন তখন। লাঠি হাতে কষ্টেসৃষ্টে হাঁটাচলা করেন। সেই বছর হঠাৎ আমাদের গ্রামে শুধু নয়, এলাকা জুড়ে সিঁদ কেটে চুরি শুরু হল। দাদুর মতে, এ কক্ষনও পাঁচুর কাজ নয়। পাঁচু যা ভিতু সিঁদকাঠি দিয়ে ঘরের দেয়াল ফুটো করতে গেলে যেটুকু শব্দ হবে, তাতেই সে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যাবে। পাঁচু রাতবিরেতে এতটুকু শব্দ হলেই ভয় পায়।
একদিন বাবা বাইরে থেকে এসে বললেন,–সিঁদেল চোরের খোঁজ পাওয়া গেছে। দারোগাবাবুর মুখে শুনে এলাম, লোকটার নাম কি। কঁপুইহাটির দাগি চোর। সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছে।
দাদু বললেন, ঝাঁপুইহাটির কি?
–চেনেন নাকি তাকে?
চিনি বইকী।দাদু ফোকলা মুখে খুব হাসলেন। একেই বলে চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই। আমাদের গ্রামের পাঁচুর মাসির ছেলে হল কিনু। কাজেই পাঁচুর মাসতুতো ভাই। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে, পাঁচুকে কিনু ট্রেনিং দিয়ে তার চেলা করেনি তো?
পরদিন সকালে লালু-গয়লা দুধ দিতে এসে বলল,–গত রাত্তিরে সিঙ্গি মশাইয়ের বাড়িতে সিঁদ কাটছিল কিনু। সিঙ্গিমশাই জেগেই ছিলেন। জানালা দিয়ে টর্চের আলো ফেলে কিনুকে পালাতে দেখেছেন। তবে কিনুর সঙ্গে কে ছিল জানেন? হতচ্ছাড়া পাঁচু।
দাদু বললেন, তাহলে যা বলেছিলাম, মিলে গেল।
লালু বলল, বকুদারোগা থাকলে এক্ষুনি এর বিহিত হতো। শুনেছি উনি মন্তর তন্তর জানতেন। রাতবিরেতে বেরিয়ে মন্তর পড়লেই চোরেরা এসে শেয়ালের মতো ফঁদে পড়ত।
দাদু বললেন, আচ্ছা লালু, তুমি তো ঝিলের ওদিকে গোরু-মোষের পাল চরাতে যাও। পাঁচুর সঙ্গে দেখা হয় না?
–আজ্ঞে, রোজই যাই। কিন্তু পাঁচুকে আর দেখতে পাইনে। আগে কখনও সখনও দেখা হতো। তবে সেটা নেহাত চোখের দেখা। আপনি তো জানেন কর্তাবাবু, পাঁচু যা ভিতু। চোখে চোখ পড়তেই হাওয়া হয়ে যেত।
-পাঁচুর বাড়িটার কী অবস্থা এখন?
লালু হাসল। বাড়ি মানে তো একটা কুঁড়েঘর ছিল। কবে ওটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। জঙ্গল গজিয়েছে।
–বলো কী! তাহলে পাঁচু এখন থাকে কোথায়?
লালু গম্ভীর হয়ে চাপাগলায় বলল,–গত রাত্তিরে সিঙ্গিমশাই ওকে কিনুর সঙ্গে দেখেছেন। কাজেই পাঁচু কঁপুইহাটিতে কিনুর বাড়িতে থাকে।
হুঁ। চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই।-–বলে দাদু আবার একচোট হাসলেন।
লালু-গয়লা চলে যাওয়ার পর বাবা বললেন, কিনু পাঁচুকে তাহলে সত্যি ট্রেনিং দিয়েছে। তা না হলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়ির আনাচে কানাচে পা বাড়ানোর সাহস ছিল না পাঁচুর। সিঙ্গিমশাইয়ের বন্দুক আছে না? লালু শুনতে পায়নি। কাল রাত্তিরে আমি কিন্তু বন্দুকের গুলির শব্দ শুনেছিলাম। ট্রেনিং না পেলে পাঁচু গুলির শব্দ শুনে কোথাও ভিরমি খেয়ে পড়ে থাকত।
দাদু সায় দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছ। তবে আমাদের চিন্তার কারণ নেই। পাঁচু আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কক্ষনও আমাদের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকবে না। বলেছিলাম না সেই যে তালগাছের ডগায় চড়ার ঘটনাটা! মনে পড়ছে?
বাবা চুপ করে গেলেন। আমরা ছোটরা দাদুকে হইহই করে ঘিরে ধরলাম। বলুন না দাদু আবার সেই গল্পটা!
.
সেবার পুজোর সময় যথারীতি বড়মামা এলেন। এসেই ঘোষণা করলেন, সদ্য এমন একটা দেশ থেকে আসছেন, যেখানে খালি ভূত আর ভূত। রাজা মন্ত্রী সেনাপতি সব্বাই ভূত। সৈন্যেরাও ভূত। প্রজারাও ভূত। পণ্ডিতমশাইরা ভূত। ছাত্ররাও ভূত। দোকানদাররাও ভূত। খদ্দেররাও ভূত। অর্থাৎ ভূতে-ভূতে ছয়লাপ। তবে সেটা যে ভূতের দেশ, তা এমনিতে বোঝা যায় না। কিছুদিন থাকার পর ক্রমে-ক্রমে টের পাওয়া যায়।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় বড়মামার গল্পের আসর বসল। মা সকাল-সকাল রান্না সেরে আসরে এলেন। বাবা এ আসরে যোগ দিতেন না। কারণ নবমীর রাত্তিরে ক্লাবের থিয়েটার। তাই রিহার্সালের তাড়া থাকত। আমাদের বাড়ির কাজের লোক হারাধন বড়মামার গল্পের আসর শেষ হলে তবেই লণ্ঠন হাতে বাড়ি ফিরত। এমনকী কাজের মেয়ে সৌদামিনী, যার ডাকনাম ছিল সোদু, সে-ও আসরের একপাশে বসে অবাক চোখে তাকিয়ে গল্প শুনত। আসর ভাঙলে সে হারাধনকে কাকুতি-মিনতি করত তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। কারণ বড়মামার সব গল্পই ছিল সাংঘাতিক এবং গা-ছমছম করা।
ওই সময়টা দাদু তার ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোয় ধর্মকর্মের বই পড়তেন।
তো বড়মামা সেই আজব দেশে গিয়ে কীভাবে টের পেলেন এটা ভূতেরই দেশ, সেই ঘটনা সবে শুরু করেছেন, এমন সময় দাদু চাপাগলায় ডাক দিলেন, হারাধন! হারু!
হারাধন সাড়া দিল, আজ্ঞে!
দাদু তেমন চাপাগলায় বললেন,–দেখে আয় তো! কোথায় যেন কেমন একটা শব্দ হচ্ছে।
হারাধন বলল,–ও কিছু না। বাতাসের শব্দ কর্তামশাই!
দাদু ধমক দিলেন।–বাড়ির পেছনটা দেখে আয় না একবার।
গল্পে বাধা পড়ায় আমরা বিরক্ত। মা বললেন,-বেড়াল-টেড়াল হবে।
বড়মামা মুচকি হেসে বললেন, আমাকে ফলো করে সেই ভূতরাজ্যের কোনও গুপ্তচর এসেছে হয়তো। ওদের নিন্দে না প্রশংসা করছি, তার খোঁজ নিতে রাজামশাই চর পাঠিয়ে থাকবেন।
কিন্তু দাদুর ধমক খেয়ে অগত্যা হারাধনকে বেরুতেই হল। সে খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়েছিল। ওদিকটায় একটা ছোট্ট পুকুর আর তিনপাড়ে ফুলফল সবজির বাগান।
হঠাৎ হারাধনের চিৎকার শোনা গেল,–চোর! চোর! চোর!
তারপরই অদ্ভুত ঝনঝন ঠনঠন সব শব্দ। বড়মামা বেরিয়ে গেলেন। তার হাতে টর্চ ছিল। তাঁরও হেঁড়ে গলায় গর্জন শোনা গেল, ধর! ধর! মার! মার! পালাচ্ছে! পালাচ্ছে।
এক মিনিটেই হুলুস্থুল কাণ্ড। প্রতিবেশীরাও টর্চ হাতে বেরিয়ে পড়ল। সিঙ্গি মশাইয়ের বাড়ির দিক থেকে বন্দুকের গুলির শব্দ হল বার দুয়েক। ওই সময়টাতে সিঁদ কেটে চুরির উপদ্রব চলছিল। তাই এত শোরগোল।
অবশেষে দেখা গেল, পুকুরপাড়ে বাগানের মধ্যে একটা বস্তাভর্তি বাসনকোসন পড়ে আছে। আর আমাদের একটা ঘরের পেছনদিকে দেয়ালে সিঁদ কেটেছে চোর। নোনায় ধরা ইটগুলো নিচে পড়ে আছে।
আমাদের বাড়িটা ছিল একতলা এবং খুবই পুরোনো। পেছনদিকটায় এখানে ওখানে পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তলার দিকটা নোনাধরা। শ্যাওলা জমে সবুজ হয়ে গিয়েছিল। বাবা ছিলেন অলস প্রকৃতির মানুষ। মেরামত করব, করছি এই ধরনের ভাব দেখাতন।
তো সবাই একবাক্যে রায় দিলেন,–পাঁচু কিনু দুই মাসতুতো ভাইয়েরই কীর্তি। বড়মামা বললেন, দুই স্যাঙাত আমার গলা শুনে চুরির জিনিস ফেলে পালিয়েছে। রোসো, দেখাচ্ছি মজা! থানা-পুলিশ করে কাজ হবে না। এর মোক্ষম দাওয়াই শিগগির নিয়ে আসছি।
বড়মামা পরদিন ভোরে কোথায় চলে গেলেন কে জানে! বাবা এতদিনে বাড়ি মেরামতে মন দিলেন। দাদু খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে-মাঝে ক্ষুব্ধভাবে বলতেন, পাঁচু হতচ্ছাড়া প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করল? ওর কপালে এবার অশেষ দুঃখ আছে। কিনুর পাল্লায় পড়েই ওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে।
বড়মামা ফিরলেন পুজো শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে। বরাবর যেমন বিকেলের বাসে আসেন তেমনিই এলেন। মুখে রহস্যময় মিটিমিটি হাসি। বললেন,–আজ সন্ধ্যায় আর গল্পের আসর নয়। কিছু গোপন কাজকর্মে বেরুব। শুধু পুটুকে সঙ্গে নেব। পুঁটু। ভয় পাবিনে তো?
কথাটা শুনেই গা ছমছম করল। বললাম,-কোথায় যাবেন বড়মামা?
–চুপ। জিগ্যেস করবিনে। যাবি কি না, বল!
একটু দোনামনা করার পর বললাম,–যাব।
কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজোর পর কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়েছে। চাঁদ উঠতে দেরি আছে। বড়মামা চুপিচুপি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুলেন। গা ছমছম করা অন্ধকার। বড়মামার কাছ ঘেঁষে পা ফেলছি। তখন আমার হয়েছে পাঁচু-চোরেরই অবস্থা। একটু শব্দে চমকে উঠছি।
কিছুক্ষণ চলার পর ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি। বড়মামা?
বড়মামা তেমনই ফিসফিস করে বললেন,–চুপ।
তারপর টের পেলাম, আমরা ঝিলের ধারে এসে পড়েছি। ঝিলের জলে আকাশভরা তারার প্রতিবিম্ব ঝিকমিক করছে। কিন্তু এখানেই তো শ্মশান। শ্মশানে বড়মামা কেন এলেন বোঝা যাচ্ছে না।
হঠাৎ বড়মামা বসে পড়লেন। তারপর আমার হাতে তার টর্চ গুঁজে দিয়ে কানে কানে বললেন, তুই এখানে অপেক্ষা কর পুঁটু। আমি আসছি। আমার কাশি শুনতে পেলে টর্চ জ্বেলে আলো দেখাবি। নইলে ভুল করে শেয়াকুল কাটার জঙ্গলে ঢুকে পড়লেই গেছি। রক্তারক্তি হয়ে যাবে।
বড়মামা গুঁড়ি মেরে অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন। শ্মশানে এক জায়গায় একা আমি টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা পঁাচা ক্রাও-ক্রাও করে চেঁচিয়ে উঠতেই আমার বুক ধড়াস করে উঠল। সেই সঙ্গে কাছাকাছি কোথাও একদল শেয়াল ডাকতে শুরু করল। ভয়ে আমি বড়মামা বলে ডাকবার উপক্রম করেছি, সেইসময় পেছন থেকে কে বলে উঠল,–কে ওখানে?
চমকে উঠে বললাম, আমি পুঁটু।
–তা এখানে কী করা হচ্ছে শুনি?
–বড়মামার জন্য অপেক্ষা করছি।
–তোমার বড়মামা কোথায় গেছেন?
–জানি না। ওই দিকে কোথায় যেন গেলেন।
যে কথা বলছিল, তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার কথাটা শুনেই সে বলে উঠল, সর্বনাশ! তারপর মনে হল, অন্ধকারে কে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
ব্যাপারটা রহস্যময়। কী করব ভাবছি, সেই সময় বড়মামার কাশির শব্দ কানে এল। অমনি টর্চের আলো জ্বালোম। দেখলাম, বড়মামা হন্তদন্ত হেঁটে আসছেন।
কাছে এসে বললেন, ব্যস! কাজ শেষ। এবার বাড়ি ফেরা যাক।
ফেরার পথে সেই লোকটার কথা বললাম। বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, দুই স্যাঙাতের যে-কোনও একজন হবে। হয় পাঁচু, নয় তো কিনু।
–সর্বনাশ কেন বলল বড়মামা?
–বলবে না? ওদের গোপন ডেরায় একজনকে রেখে এলাম যে!
–কাকে রেখে এলেন?
বড়মামা কানে কানে বললেন,–আড়িপাতা ভূতকে। সেই ভূতের দেশে গিয়ে রাজার কাছে একজন ঝানু আড়িপাতা ভূত চেয়ে এনেছিলাম। বুঝলি? শিশিতে ভরে দিয়েছিলেন রাজামশাই। শিশিটা রেখে দিলাম। পরে দেখাব তোকে। পাঁচু-কিনু জব্দ হলে আড়িপাতা ভূতকে লোভ দেখিয়ে ফের শিশিতে ঢুকিয়ে ছিপি এঁটে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।
অবাক হয়ে বললাম, আড়িপাতা ভূত পাঁচু-কিকে কীভাবে জব্দ করবে?
–দেখবিখন। চোরের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার চেয়ে ভূত লেলিয়ে দিলে কী হয়…
শিশিটা পরে দেখিয়েছিলেন বড়মামা। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ছোট্ট শিশির মতো দেখতে। কিন্তু আড়িপাতা ভূতের কাণ্ডকারখানা ক্রমশ বুঝতে পারলাম।
পাঁচু-কিনুর গোপন ডেরার খবর বড়মামা নাকি লালু-গয়লার কাছে পেয়েছিলেন। তবে পাঁচু আর কিন্তু এই দুই চোর তাদের গোপন ডেরা বদলালে কী হবে? যেখানেই চুপিচুপি পরামর্শ করত, আজ রাতে তার বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি করতে যাবে, আড়িপাতা ভূত তা শুনে ফেলত। তারপর ঠিক সময়ে সেই বাড়ির কর্তাকে জানিয়ে দিত। বাড়ির কর্তা আলো জ্বেলে লোকজন নিয়ে তৈরি থাকতেন। দুই চোর সেই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারত না।
আড়িপাতা ভূত তার কাজটা কীভাবে করত, তা জানা গিয়েছিল পরে। যেমন, ওরা এক রাত্তিরে মল্লিকবাড়িতে সিঁদ কাটার পরামর্শ করেছে। সেদিন সন্ধ্যায় মল্পিকমশাই ক্লাবে তাস খেলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার কাছ ঘেঁষে যাওয়া এক ছায়ামূর্তি ফিসফিস করে বলে গেল, সাবধান মল্লিকমশাই! আজ রাতে আপনার বাড়িতে সিঁদ কাটতে চোর আসবে।
শোনামাত্র মল্লিকমশাই বাড়ি ফিরে পাড়ার লোকজন ডেকে হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে তৈরি হলেন। পাঁচু-কিনু বেজার হয়ে ফিরে গেল।
কেউ-কেউ থানায় খবর দিয়ে পুলিশও মোতায়েন করতেন। কিন্তু পাঁচু-কিনু তা ঠিকই টের পেত। তারপর থেকে আমাদের গ্রামে নয়, সারা এলাকায় দুই চোরের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে বড়মামা মাসখানেক কোথায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে সব শুনে খুশি হয়ে বললেন, যাক। তাহলে ওরা খুব জব্দ হয়েছে। আর এ তল্লাটে পা বাড়াবে না। এবার আড়িপাতা-ভূতকে শিশিতে ভরে ফেরত দিয়ে আসতে হবে। পুঁটু, সন্ধ্যাবেলা দুজনে বেরুব। তার আগে একটুখানি মধু চাই যে। একফোঁটাই যথেষ্ট।
দাদু রাত্তিরে মধু খেতেন। তাই বাড়িতে মধু রাখতেই হত। শিশিটাতে একফোঁটা মধু ভরে বড়মামা সন্ধ্যার পর আমাকে নিয়ে বেরুলেন।
আগের মতো ঝিলের ধারে শ্মশানের কাছে আমাকে টর্চ হাতে বসিয়ে রেখে বড়মামা অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন। তারপর সে-রাতের মতোই ক্রাও করে পেঁচা ডাল। শেয়ালেরা ডাকতে শুরু করল। আমি বসে আছি তো আছিই। বড়মামার পাত্তা নেই। মাঝে-মাঝে পিছু ফিরে দেখছি, সে-রাতের মতো পাঁচু বা কিনু এসে পড়বে নাকি। কিছু বলা তো যায় না।
বড়মামার ফিরতে বড্ড দেরি হচ্ছে। এদিকে এখন বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শীত করছে। ঝিলের জল ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
মরিয়া হয়ে বড়মামাকে ডাকব ভেবেছি, সে সময় সে-রাতের মতো পিছন থেকে কে বলে উঠল,–কে ওখানে?
ভয়ে-ভয়ে বললাম, আমি পুঁটু!
–এখানে কী করা হচ্ছে শুনি?
–বড়মামার জন্য অপেক্ষা করছি।
–কোথায় গেছেন তোমার বড়মামা?
–আড়িপাতা-ভূতটাকে শিশিতে ভরতে গেছেন।
তখনই সে সর্বনাশ বলে পালিয়ে গেল। তবে না–তার পায়ের ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেলাম না। একটা অদ্ভুত বাতাসের শব্দের মতো শনশন কিংবা ওইরকম কিছু কানে এল। সেই সঙ্গে কেমন একটা বিদঘুঁটে গন্ধও ভেসে এল।
আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ডাকলাম, বড়মামা! বড়মামা!
দূর থেকে তাঁর কথা শোনা গেল, কী হয়েছে পুঁটু? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?
–শিগগির আসুন। আমার ভয় করছে। বলে টর্চের আলো জ্বালোম। তারপর বড়মামাকে দেখতে পেলাম। রেগে খাপ্পা হয়ে গেছেন। কাছে এসে বললেন, ব্যাটাচ্ছেলেকে শিশিতে যে ভরব তা আর হল না। ডাকাডাকি না হয় করলি, কিন্তু আলো জ্বাললে ভূতেরা কি আর সে তল্লাটে থাকে?
–বড়মামা! সে রাতের মতো কে এসে আমাকে জিগ্যেস করছিল– বড়মামা আমার কথার ওপর বললেন, তুই কী বললি তাকে?
–বললাম বড়মামা আড়িপাতা-ভূতটাকে শিশিতে ভরতে গেছেন। তাই শুনে সে সর্বনাশ বলে পালিয়ে গেল।
বড়মামা হতাশ হয়ে বললেন,–পুঁটু! মনে হচ্ছে, ব্যাটাচ্ছেলে সেই আড়িপাতা ভূতটাই বটে। নাহ। পাঁচু বা কিনু নয়। এতক্ষণ তাদের সঙ্গেই তো কথা হচ্ছিল। আমাকে দেখেই দুজনে এসে কাকুতিমিনতি করতে লাগল। আড়িপাতা ভূতটার জন্য ওরা না খেয়ে মারা পড়তে বসেছে। তো আমার কথা শুনে ওরা আমাকে সাহায্য করবে বলল। আর সেই সময় তুই ডাকাডাকি শুরু করলি?
বললাম,-বড়মামা! পাঁচু-কি ফিরে এসেছে?
–আসবে না? হাজার হলেও নিজের এরিয়া। তাছাড়া বাইরের এরিয়ার চোরেরা এদের বরদাস্ত করবে কেন? চুরির ভাগে কম পড়বে না?
বড়মামা হাঁটতে-হাঁটতে ফের বললেন,–কিন্তু আড়িপাতা ব্যাটাচ্ছেলেকে যে ফেরত দিতেই হবে। ওদের রাজামশাইকে কথা দিয়ে এসেছি। বড় গণ্ডগোলে পড়া গেল দেখছি।
বাড়ি ফিরে ক্লান্ত বড়মামা মাকে চায়ের হুকুম দিলেন। মা বললেন, দাদা জানো কী হয়েছে? একটু আগে সিঙ্গিমশাই এসে বলে গেলেন, গতকাল পাঁচু আর কিনু মেদিগঞ্জে ওঁর জামাইয়ের বাড়িতে সিঁদ কাটতে গিয়েছিল। তাড়া খেয়ে দুজনে বিলের জলে ঝাঁপ দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে হাজার-হাজার জোঁক ওদের গায়ে সেঁটে যায়। রক্ত চুষে জোঁকগুলো বেচারাদের মেরে ফেলে। সিঙ্গিমশাই আজ সকালে ওদের মড়াদুটো দেখে এসেছেন।
বড়মামা হাঁ করে শুনছিলেন। বললেন,–সে কী! আমি তাহলে শ্মশানে কাদের সঙ্গে
বলেই থেমে গেলেন বড়মামা। আমিও হতভম্ব হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
দাদু তার ঘর থেকে একটু কেশে বললেন,–কিনুটা ফিচেল আর বদমাশ ছিল, ওর জন্য দুঃখ হয় না। তবে হতভাগা পাঁচুটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। কিনুর পাল্লায় পড়েই ওর এই সর্বনাশ হল।…
বড়মামা অনেক চেষ্টাও করেও আড়িপাতা-ভূতটাকে ধরতে পারেননি এবং তার ফলটাও শেষপর্যন্ত ভালো হয়নি। আমার সেই ছোটবেলার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আড়িপাতা-ভূতটা ওর কথা তাকে, তার কথা ওকে লাগিয়ে-ভাঙিয়ে গ্রামে বড্ড ঝগড়াঝাটি বাধাত। মামলা-মোকদ্দমাও বেড়ে গিয়েছিল। ওইরকম লাগানি ভাঙানি চলতে থাকলে গ্রামে দলাদলি না হয়ে পারে?
হ্যাঁ–এখনও হতচ্ছাড়া বজ্জাতটা আমাদের গ্রাম ছেড়ে পালায়নি। তাই এখনও সেই দলাদলি-হাঙ্গামা লেগেই আছে। ভয়ে আমি আর গ্রামে যেতে পারিনে। বলা যায় না, আড়িপাতা-ভূত ব্যাটাচ্ছেলে কী শুনতে কী শুনে আমার বিরুদ্ধে কার কান ভারী করবে, আর মাঝখান থেকে আমি পড়ব বিপদে। বড়মামা কাজটা ঠিক করেননি।…
চোর-পুলিশ
এ যেন সুকুমার রায়ের ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল, সেইরকম। ছিল তাল গাছ, হয়ে গেল বেড়াল। দুদে দারোগা বঙ্কুবাবু তো তাজ্জব। শুধু তাজ্জব নন, রীতিমতো হতবাক। থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন কেষ্টনগরের পুতুলটি হয়ে।
আসছিলেন কেকরাডিহি থেকে একটা তদন্ত সেরে। দুদিন আগে সেখানে দুদলে খুব মারপিট-রক্তারক্তি হয়ে গেছে। তদন্ত সারতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গের দুজন বন্দুকধারী সেপাইকে সেখানকার শান্তিরক্ষার ভার দিয়ে বন্ধুবাবু সাইকেলে চেপে একা থানায় ফিরছিলেন। কেকরাডিহির বিশাল মাঠের মাঝামাঝি পোঁছে চাঁদ উঠেছিল। কাঁচা রাস্তায় বড় ধুলো। তাই আস্তে সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন আর অভ্যাসবশত গুনগুন করে গানও গাইছিলেন। তারপর সামনে দেখলেন একটা বাজপড়া মুন্ডুহীন ঢ্যাঙা তালগাছ। সেই সময় হঠাৎ মনে পড়ছিল, আসার পথে তো এমন কোনও তালগাছ দেখেননি! সেজন্যই একটু অবাক হয়ে সাইকেলে ব্রেক কষেছিলেন। তারপর এই অদ্ভুত ঘটনা।
তাঁর চোখের সামনে জ্যোৎস্নারাতে ওই উটকো তালগাছটা হঠাৎ খাটো হতে হতে বেঁটে হতে-হতে মাটির ভেতর যেন সেঁধিয়ে যাচ্ছে। টর্চ আছে সঙ্গে। ঝটপট জ্বেলে দেখলেন। তালগাছটার জায়গায় একটা কালো বেড়াল নীল জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে তাঁকে দেখছে।
পুলিশকে ভূতের ভয় করতে নেই। তাছাড়া ওটা ভূত কি না সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বন্ধুবাবু সেজন্যেই খুব রেগে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, তবে রে!
কালো বেড়ালটা তবু গ্রাহ্য করল না। তার চেয়ে বিচ্ছিরি ব্যাপার, টর্চটাও গেল বিগড়ে। সুইচ টেপাটেপি করে আলো জ্বলল না! তখন সাইকেল থেকে নেমে বঙ্কুবাবু সাইকেলটা দাঁড়ি করিয়ে রেখে পিস্তল বের করলেন, পিস্তল তাক করে ট্রিগারও টানলেন। গুলি বেরুল! বিকট ফটাস আওয়াজও হল। কিন্তু বেড়ালটার গায়ে গুলি বিধল না। তখন আরও খাপ্পা হয়ে ফের গুলি ছুঁড়তে থাকলেন। পিস্তলটাতে আরেকটা গুলি। সাতটা গুলি খরচ হয়েছে, এমন সময় যেটা ছিল বেড়াল, সেটা হয়ে গেল একটা মানুষ। তারপর সেই মানুষটা খি-খি করে খুব হেসে বলে উঠল,–খামোকা গুলি খরচ করে কী লাভ দারোগাবাবু?
বন্ধুদারোগা মানুষের কথা শুনে ভড়কে গেলেন বটে, কিন্তু মুখে সাহস করে গর্জে উঠলেন, তুই কোন ব্যাটা রে?
–আজ্ঞে, আমি সেই পাঁচু।
বঙ্কুবাবু এতক্ষণে সঠিকভাবে বুঝতে পারলেন, তিনি ভূতের পাল্লায় পড়েছেন। তালগাছের বেড়াল হয়ে যাওয়া চোখের ভুল হতেও পারে, কিন্তু মানুষ হয়ে পাঁচুতে রূপ নেওয়াটা তো আর চোখের ভুল বলা যাবে না। তার ওপর কথাও বলছে। তার চেয়ে বড় কথা, এই পাচু ছিল ধড়িবাজ এক সিঁদেল চোর। সম্প্রতি রোগে ভুগে সে মারা পড়েছিল। তার সঙ্গে কেকরাডিহির মাঠে রাতবিরেতে দেখা হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। বন্ধু দারোগা মনে-মনে ঠিক করলেন, এসব ক্ষেত্রে আপস করাই ভালো। তাই তিনিও খিকখিক করে হেসে বললেন,–তুই তাহলে পাঁচু? তা এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস তুই?
পাঁচু-চোরের ভূত অবাক হয়ে বলল, আমাকে আপনার ভয় করছে না দারোগাবাবু?
–একটুও না। চোরকে পুলিশ কখনও ভয় করে? ভয় করলে পুলিশের চাকরি থাকে রে?
–কিন্তু ভূতকে? আমি যে মরে ভূত হয়েছি, দারোগাবাবু।
–মরলে লোকে ভূত হয়, এ আবার নতুন কথা কী? আমি মরলে আমিও ভূত হব।–বঙ্কুদারোগা খুব হেসে বললেন, তুই তো তালগাছ হয়েছিলি, তারপর বেড়াল হলি, শেষে ফের পাঁচু হয়ে গেলি। আর আমি হলে কী করব জানিস?
পাঁচুর ভূত আগ্রহ দেখিয়ে বলল, কী করবেন শুনি?
বঙ্কুবাবু ভরাট গলায় বললেন, কথায় আছে? স্বভাব যায় না মলে। বুঝলি কিছু?
–আজ্ঞে না।
–তুই একটা হাঁদারাম! আমি সারাজীবন দারোগাগিরি করছি। চোর-ডাকাত ধরা স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। আমি যখন মরব, তখন সে স্বভাব যাবে কোথায়? তোর মতো চোরদের ধরব। বেদম পিটুনি দেব। ঠ্যাংদুটো বেঁধে ওপরে ঝুলিয়ে
কথা শেষ হওয়ার আগেই পাঁচুর ভূত চেঁচিয়ে উঠল, আরে তাই তো! তাই তো!–তারপর একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বন্ধুদারোগা কিছু বুঝতে পারলেন না। বারকতক ওকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ধ্যাত্তেরি বলে সাইকেলে চাপলেন। রেগেমেগে এবার জোরে প্যাডেলে চাপ দিলেন। প্রচণ্ড বেগে থানায় ফিরে চললেন।…
পাঁচুর ভূত কেন এমন করে হঠাৎ উধাও হয়েছিল, বুঝতে কয়েকটা দিন দেরি হল বঙ্কুবাবুর। সিঁদেল চোর পাঁচুর মরার পর থেকে এলাকায় চুরিচামারি, বিশেষ করে সিঁদকাটা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই রাতের পর আবার থানার লোকেরা একের পর এক এসে চুরির নালিশ করতে শুরু করল। চুরিগুলোও ভারি অদ্ভুত রকমের। সিঙ্গিমশায়ের জামাই এসেছে বলে থলে ভর্তি বাজার করে ফিরছেন। হঠাৎ থলেতে হ্যাঁচকা টান এবং ঘুরে দেখেন থলেটি শূন্যে ভেসে উধাও হয়ে গেল। বিন্দু–ঝি পুকুরঘাটে বসে থালা-বাসন মাজছে আর পেছনে রাখছে। বোয়া শেষ করে ঘুরে দেখে বাসনকোসন নেই। এমনকী বন্ধুবাবুর কোয়ার্টারেই এক রাত্তিরে সিঁদ। বঙ্কুবাবুর বাবা অনিদ্রার রুগি। সিঁদ কেটে চোর যেই পা দুখানা ঘরে ঢুকিয়েছে, সুইচ টিপে আলো জ্বেলে খপ করে পা দুটো ধরে ফেলেছিলেন। লিকলিকে কালো দুটো পা। কিন্তু ধরামাত্র হাত ঠান্ডায় জমে গেল। বাপস বলে ছেড়ে দিলেন। পাদুটোও সিঁদের গর্ত দিয়ে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল।
এবার বঙ্কুবাবু বুঝলেন কী হচ্ছে। খুব আফসোস হতে লাগল তার। কেন যে বলেছিলেন পাঁচুর ভূতকে, স্বভাব যায় না মলে, ভুলটা সেখানেই হয়েছিল। পাঁচু ছিল চোর। কিন্তু মলেও চোরের চুরির স্বভাব যায় না, পাচুর ভূতকে প্রকারান্তরে মনে পড়িয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুদারোগা।
বড় ভাবনায় পড়ে গেলেন। চোর যতক্ষণ মানুষ থাকে, তাকে শায়েস্তা করতে পুলিশ ভূতই দরকার। বঙ্কুবাবু তো পাঁচু-চোরের ভূতকে পাকড়াও করার জন্য মরে যেতে পারবেন না! বালাই ষাট। এ বয়সে তিনি মরবেন কেন? স্বয়ং মহৎ কোনও কাজের জন্য প্রাণ দিয়ে মরা যায়, নেহাত একটা হিঁচকে চোরের জন্য প্রাণত্যাগ করার মানে হয়?
রোজ এদিকে নালিশেনালিশে জেরবার। জেলার ওপরওয়ালারাও চুটিয়ে ফলাও করে এই তল্লাটের চুরির খবর ছাপতে শুরু করেছে। সদর থেকে পুলিশ সুপার কড়া চিঠি লিখেছেন। স্থানীয় এম. এল. এ.-মশাইও বারবার এসে শাসিয়ে যাচ্ছেন। গণতন্ত্রের যুগ। গণ দরখাস্ত দিলে বন্ধুবাবুর চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। বড় ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন বঙ্কুবাবু। আসল সমস্যাটা হল, এসব চুরিচামারি যে ভূতের কীর্তি সেটা তো বিশ্বাস করবে না ওপরওয়ালারা। সংবিধানে ভূত বলে কোনও কথা নেই। কোনও আইনকানুনেও নেই। স্থানীয় লোকের মতে, পাঁচুর কোনও শাগরেদেরই কাজ। কিন্তু সে যে কে তাও কারুর মাথায় আসছে না।
একদিন দুপুরবেলা মনমরা হয়ে থানার পেছন দিকে নিরিবিলি একটা আমতলায় বঙ্কুবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, সেইসময় শনশনিয়ে বাতাস উঠল। একটা ঘূর্ণি হাওয়া ধুলোবালি শুকনো পাতা উড়িয়ে গাছটাকে নাড়া দিল। চোখে ধুলো ঢোকার ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলেন বঙ্কুদারোগা। চোখ খুলে হকচকিয়ে গেলেন। সামনে একটু তফাতে আছেন তাঁর বন্ধু করালীমোহন। তিনিও এক দারোগাবাবু। অন্য একটা থানায় ছিলেন বলে জানতেন। বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই দুজনে। বঙ্কুবাবু খুব খুশি হয়ে বললেন,–আরে? করালী যে! তুমি হঠাৎ কোত্থেকে?
করালীমোহন মিটিমিটি হেসে বললেন,–শুনলাম খুব ঝামেলায় পড়েছ চুরিচামারি নিয়ে। তাই ভাবলুম গিয়ে জেনে আসি ব্যাপারটা কী।
বঙ্কুবাবু বললেন,–বলছি। কিন্তু তুমি এখন কোন থানায় আছো? খোঁজখবর পাইনে। সদরে কনফারেন্সে গিয়েও তোমাকে দেখতে পাইনে। নিশ্চয়ই অন্য জেলায় বদলি হয়ে গেছ?
করালীমোহন বললেন, বদলি হয়েছি, সেটা ঠিক। তবে তোমার প্রবলেমটা আগে শুনি।
বঙ্কুবাবু সংক্ষেপে পাঁচুর ভূতের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সবটাই বললেন। শোনার পর করালীমোহন হেসে অস্থির,-এই কথা? ঠিক আছে? আমি দেখেছি ব্যাটাকে।
–কী করে দেখবে? ব্যাটা তো মানুষ নয়, ভূত।
করালীমোহন হাতের বেটন নাড়া দিয়ে বললেন,–ভূতকে শায়েস্তা করতে ভূত চাই। বুঝলে তো?
–কিন্তু সেটাই তো সমস্যা। পাচ্ছিটা কোথায়?
–আছে, আছে।
করালীমোহন কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা ঘূর্ণি বাতাস এল মাঠের দিক থেকে। ধুলো ঢোকার ভয়ে চোখ বুঝলেন বন্ধুবাবু। বাতাসটা চলে গেলে চোখ খুললেন। তারপর অবাক হয়ে গেলেন। করালীমোহন নেই।…
.
দিন দুই পরে বন্ধু দারোগা লক্ষ করলেন, থানায় আর একটাও চুরির নালিশ আসছে না। তারপর একদিন স্বয়ং এম. এল. এ.-মশাইও মিছিল করে এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। সদর থেকে পুলিশকর্তার প্রশংসার চিঠি এসে গেল। ব্যাপারটা কী?
করালীমোহন কি তাহলে ভূতের রোজা দিয়ে পাঁচুকে শায়েস্তা করে ফেলেছেন? করালীমোহন পাকা লোক বটে। তার চেয়ে আরও উঁদে দারোগা। তার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। নিশ্চয়ই রোজা লাগিয়ে ব্যাটাচ্ছেলেকে ঢিট করে ফেলেছেন। দুচ্ছাই, কেন যে ভূতের রোজার কথাটা তার মাথায় আসেনি।
তবে করালীমোহনের দৌলতে প্রমোশনের চিঠি পেয়ে গেলেন বঙ্কুবাবু। মফস্বলে শহরে একেবারে এস.ডি.পি.ও.-র পোস্টে প্রমোশন। অবিলম্বে জয়েন করতে হবে। রাত্তিরে জিনিসপত্তর বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। ভোরবেলা রওনা দেবেন! আনন্দে ও উত্তেজনায় ঘুম আসছে না চোখে। আনন্দ প্রকাশ করতে নিরিবিলি গুনগুন করে গান গাওয়া অভ্যেস বন্ধুবাবুর। তাই থানার প্রাঙ্গণ পেরিয়ে খেলার মাঠটাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। তেমনি জ্যোত্মারাত। বাতাস বইছে। সবে গুনগুনিয়ে রবীন্দ্রসংগীত ধরেছেন, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে…এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলেন কালো মতো কী একটা সামনে আসছে। গানভঙ্গ হওয়ায় খাপ্পা বঙ্কুবাবু বললেন,–কে রে?
কালো মূর্তিটা দাঁড়িয়ে গেল। বলল, আমি স্যার!
–আমি কে? কী নাম? বাড়ি কোথায়?
–স্যার, আমি সেই পাঁচু।
বঙ্কুবাবু খি-খি করে হেসে বললেন,–পাঁচু! আয়, আয়! কেমন জব্দ হয়েছিস বল।
পাঁচুর ভূতও পাল্টা হেসে বলল, জব্দ হয়েছিলুম বটে দিন কতক।
–তার মানে?
–বুঝলেন না? করালীদারোগার নাতিগয়ায় পিণ্ডি দিয়ে ফিরে এসেছে। এখন করালীবাবু উদ্ধার হয়ে স্বর্গে চলে গেছেন। আর আমায় ঠেকায় কে? যাচ্ছিলুম হরিবাবুর বাড়ি সিঁদ কাটতে, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভাবলুম খবরটা দিয়েই যাই।
বঙ্কুবাবু চমকে উঠে বললেন, করালীমোহনের পিণ্ডি! কী বলছিস রে? করালী মারা গিয়েছিল বলেনি তো সেদিন?
কবে মরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পাঁচ-চোর বেজায় হাসতে লাগল। আপনার অবস্থা দেখে আমার পেছনে লেগেছিলেন কিছুদিন। উঃ, খুব ঠেঙিয়েছে। এখনও গা ব্যথা করছে স্যার!
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বন্ধুবাবু বললেন, আমার প্রমোশন হয়ে তো বড় ভুল হল দেখছি। তুই তো আবার লোকেদের জ্বালাতে শুরু করবি। নতুন দারোগাবাবুটির বয়স কম। ওরে পাঁচু, দোহাই তোকে, এ বেচারাকে ঝামেলায় ফেলিসনে বাবা!
পাঁচু বলল,–তা কি হয় স্যার? আপনিই তো মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বভাব যায় না মলে।
বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্ধুদারোগা তার উদ্দেশ্যে হুংকার ছেড়ে বললেন,–ঠিক আছে। আমায় মরতে দে। তারপর মজা দেখাচ্ছি। উইল করে যাব, যেন কেউ আমার জন্য গয়ায় পিণ্ডি না দেয়।
রাগে-দুঃখে বন্ধুবাবুর আগের মুড নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন জায়গায় গিয়েই উকিল ডেকে উইল লিখিয়ে তবে শান্তি।
একটু উপসংহার আছে। মফস্বল শহরের বুদ্ধিমান উকিলরা বন্ধুবাবুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, নিজের পিণ্ডিদত্তের ব্যবস্থা বন্ধ করার বদলে পাঁচু চোরের পিণ্ডির ব্যবস্থা করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু দুঃখের কথা, বন্ধুবাবুর সে চেষ্টা সফল হয়নি। পাঁচুর ঝড়েবংশে কেউ ছিল না। তাছাড়া একজন চোরের নামে পিণ্ডি দেওয়ার লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে শোনে সেই বলে, পাঁচুর নামে পিণ্ডি দিতে গয়া প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে বসি, এদিকে আমার সর্বনাশ হয়ে যাক। আমি ওতে নেই বাবা! পিণ্ডি দেওয়ার আগেই পাঁচু ফতুর করে দেবে। ভূতের কান খুব সজাগ। নজরও কড়া।
সুতরাং বন্ধুবাবুর পক্ষে ভূত হওয়ার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই।
চোরাবালির চোর
ছোটমামার মাথায় বড়-বড় চুল। চুল নয়, যেন সজারুর কাটা। রকমারি শ্যাম্পু ঘেযেও ছোটমামা তার ওই নচ্ছার চুলগুলোকে বাগ মানাতে পারছিলেন না। শেষে বাবা পরামর্শ দিলেন, তার চেয়ে ন্যাড়া হচ্ছ না কেন ভায়া?
ছোটমামা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে-ভেতরে রেগে টাই হয়ে যেতেন। কদিন পরে দেখি, ছোটমামা স্নানের পর একটা শিশি থেকে লাল রঙের একটা তরল পদার্থ ঢেলে চুলে ঘষছেন। জিগ্যেস করলাম, গন্ধতেল নাকি ছোটমামা?
ছোটমামা গম্ভীর মুখে বললেন, কবরেজি আরক।
আরক থেকে কেমন যেন একটা বিদঘুঁটে গন্ধ বেরুচ্ছিল। মাথায় ঘষার পর ছোটমামা একটা বাঁকাচোরা কাস্তের গড়নের অদ্ভুত চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে শুরু করলেন। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম, ছোটমামার খাড়া চুলগুলো নেতিয়ে মাথায় সেঁটে গেল। ছোটমামা আয়নার দিকে চেয়ে নিজের মাথা দেখতে-দেখতে বাঁকাহাসি হেসে বললেন,–তোর বাবাকে এবার ডাক! ন্যাড়া হতে বলছিলেন না আমায়? হুঁ:!
বললাম,–আরকটা না হয় কবরেজি। এই চিরুনিটা কোথায় পেলেন ছোটমামা? এও কি কবরেজি চিরুনি!
ছোটমামা খুশিমুখে বললেন, নাবাবু কবরেজকে চিনিস তো? ওই যে মোড়ের মাথায় আয়ুর্বেদ ভবন।
ছোটমামার চুলের একটা হিল্লে হওয়ায় বাড়ির সবাই খুশি। বাড়িতে অসুখবিসুখ কারও নেই–অথচ একটা লোক সবসময় রোগীর মতো মুখ করুণ করে বেড়াচ্ছে। থেকে-থেকে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এই দেখে কার না খারাপ লাগে? এখন ছোটমামার মুখ আর করুণ নয়। সবসময় হাসিখুশি।
কিন্তু কদিন পরেই ছোটমামার সেই কবরেজি চিরুনিটা হারিয়ে গেল। ড্রয়ার, তাক, আলমারি, বিছানা তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। ছোটমামার মুখের চেহারা আবার করুণ হয়ে গেল। ঠাকুমা বললেন,–এ তাহলে শিঙ্গিদের হুলোবেড়ালের কাজ। ওর জ্বালায় কিছু থাকবার জো নেই। আমার জর্দার কৌটোটা সেদিন নিয়ে পালাচ্ছিল দেখলে না?
ঠাকুরদা বললেন, হুলোর পক্ষে জর্দা খাওয়া অসম্ভব নয়। গন্ধটা যে মিঠে। তাই বলে চিরুনি কি করবে ব্যাটাচ্ছেলে?
ঠাকুমা বললেন,–কেন? হুলোর গায়ের লোমগুলো দেখনি? নান্টুর চুলের চেয়ে খাড়া।
মা বললেন, উঁহু–বেড়াল নয়, কাক। সেদিন সাবানকৌটো নিয়ে পালিয়েছিল। আম গাছের ডগায় ওর বাসা থেকে খোকাকে দিয়ে পেড়ে আনালাম। তাই না রে খোকা?
খোকা, মানে আমি, সায় দিয়ে বললাম, কাকেরা কি সাবান মাখে মা?
মা বললেন,–কিছু বলা যায় না।
আমি বললাম, তাহলে কাকটা বেজায় বোকা। কৌটোয় তো সাবান ছিল না!
এইসব আলোচনা চলছে, ছোটমামা গম্ভীরমুখে শুনছেন! হঠাৎ আমাকে বললেন, আমার সঙ্গে একবার আয় তো পুঁটু। বলেই আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন।
ছোটমামার কথার অবাধ্য হওয়া কঠিন আমার পক্ষে, পুঁটু নামটা যতই অপছন্দ হোক না কেন। রাস্তায় যেতে-যেতে জিগ্যেস করলাম, কবরেজ মশায়ের কাছে যাবেন তো ছোটমামা?
ছোটমামা বললেন,–গিয়েছিলাম তো। নাড়ুকবরেজ বললেন, ওই একখানাই ছিল। আর পাওয়া যাবে না। এ তো যে-সে চিরুনি নয়। কামরূপকামাক্ষায় পাহাড়ি জঙ্গলে যে ডাকিনীরা থাকে, তাদের চিরুনি। বুঝলি পুটু? ডাকিনিদের চুল তো সহজ চুল নয়। খেজুরটা দেখেছিস? সেইরকম।
কথা বলতে-বলতে ছোটমামা খেলার মাঠের দিকে ঘুরলেন। আমি বললাম, মামা এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
ছোটমামা চাপাগলায় বললেন, আমার চিরুনি কে চুরি করেছে, বুঝতে পেরেছি। তাকে হাতেনাতে ধরব, আয়।
আমার বুক ঢিপঢিপ করল। বললাম,–ও ছোটমামা, তার চেয়ে থানায় গেলেই তো ভাল হতো।
ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,–তা মন্দ বলিসনি। ব্যাটাচ্ছেলে যদি ছুরিটুরি বের করে, বিপদ হবে। চল বরং থানাতেই যাই।
থানার দিকে যেতে-যেতে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু চোরটা কে ছোটমামা? কোথায় থাকে?
ছোটমামা বললেন,–কোথায় থাকে তা কি জানি? ওই নদীর ধারে ওকে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে দেখি।
–কেমন করে জানলেন, সে আপনার চিরুনি চুরি করেছে?
আমার কথায় ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,–তোর খালি প্রশ্ন করা অভ্যেস। কেমন করে জানলেন? লোকটার মাথায় যে আমার মতো চুল–বরং আমার চেয়ে আরও খোঁচা-খোঁচা। যেন পেরেক।
বুঝলাম, তাহলে ছোটমামা ঠিকই ধরেছেন।
আমাদের এই ছোট্ট শহরে বংকুবাবু দারোগার খুব নামডাক। বিশেষ করে আমার বাবার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ত্ব আছে। ছেলেবেলায় নাকি বাবার ক্লাসফ্রেন্ড ছিলেন। সেই খাতিরে মাঝে-মাঝে আমাদের বাড়িতেও আসেন। সব শুনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে ভাবলেন। তারপর বললেন,–হুম! কেমন চেহারা বললেন যেন? রোগা ঢ্যাঙা, পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথার চুল পেরেকের মতো?
ছোটমামা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়?
–আজ্ঞে।
–রোজ সন্ধ্যার একটু আগে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
বংকুদারোগা দুলতে-দুলতে বললেন,–হুম বুঝেছি। চোরাবালির গোবিন্দ।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–চোরাবালি মানে?
মিটিমিটি হেসে বংকুদারোগা বললেন,–এই চোরের সঙ্গে চোরাবালির সম্পর্ক আছে–খুব গূঢ় সম্পর্ক। আপনি ভাববেন না। দেখছি ব্যাটাছেলেকে। তবে কী জানেন? বড় ফিচেল।
ছোটমামা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার?
বংকুদারোগা বললেন, বুঝলেন না? ওই নদীতে একজায়গায় চোরাবালি আছে জানেন না?
এবার আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও ছোটমামা, সেই যে অনেকটা জায়গা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা আছে–লেখা আছে? সাবধান। আর…
ছোটোমামা নড়ে বসলেন,–আর একটা মড়ার খুলি আঁকা নোটিশ ঝোলানো আছে। দেখেছি বটে।
বংকুদারোগা বললেন,–গোবিন্দ আমার তাড়া খেয়ে কিছুদিন শ্মশানবটের কোটরে লুকিয়ে থাকত। টের পেয়ে হানা দিলাম। কী ধুরন্ধর চোর মশাই! মড়া সেজে একটা খাঁটিয়ার তালাই জড়িয়ে শুয়েছিল। এদিকে আসল মড়াটাকে খাঁটিয়ার তলায় লুকিয়ে রেখেছে। যারা মড়া পোড়াতে এসেছে, তারা বটতলায় এসে মুড়ি খাচ্ছে, লক্ষও করেনি। রাতটাও ছিল যে অমাবস্যা।
বংকুদারোগা একটিপ নস্য নিয়ে ফের বললেন,–মড়া পোড়াতে গিয়ে ধরা পড়ল ব্যাপারটা। গোবিন্দ তখন দৌডুচ্ছে। অন্ধকারে দৌডুতে-দৌডুতে পড়েছে একেবারে চোরাবালির ওপর। তখন ওখানে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। শুধু একটা নোটিশ লটকানো ছিল।
ছোটমামা বললেন, সর্বনাশ! চোরাবালিতে পড়ে তো তলিয়ে যাওয়ার কথা।
–হুঁ-উ, তলিয়ে গেল বইকী গোবিন্দচোর।
আমি বললাম, তারপর কে টেনে তুলল ওকে?
বংকুবাবু হাসলেন, তুলবে কী করে? আমি যখন পৌঁছলাম, তখন বালিতে তার মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। টর্চ জ্বেলে রেখেছিলাম। এক মিনিটের মধ্যে মুন্ডুটাও তলিয়ে গেল। তারপর যেমন বালি, তেমনি। বোঝবার উপায় নেই।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, তাহলে তো গোবিন্দ বেঁচে নেই।
নেই। আবার আছেও। বকুদারোগা গম্ভীর হয়ে বললেন। কথায় বলে না? অভ্যেস যায় না মলে। আমার মুশকিল কী হয়েছে জানেন নান্টুবাবু? তাড়া করলেই ব্যাটাচ্ছেলে কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঝাঁপ দেয়। চোরাবালির ভেতর আজ্ঞা এখন। ওর খুব নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। এখন ওকে ধরাই কঠিন। তবে যদি ওকে মাঝপথে পাকড়াও করতে পারা যায়। তাহলেই সুবিধে হয়। দেখা যাক, আপনি ভাববেন না।…
থানা থেকে ফেরার পথে ছোটমামা বললেন, তুই বংকুদারোগার কথা বিশ্বাস করলি পুটু? আসলে আজকাল পুলিশই এরকম। মনবোঝানো দুটো কথা বলে বিদায় করতে পারলে বেঁচে যায়। তোদের এই বংকুদারোগা দেখছি, আরও এককাঠি সরেস। গুলতাপ্পির রাজা। মানুষ মরে ভূত হতেই পারে। তাই বলে চোর মরেও কি চোর থেকে যায় কখনও? ভূত ঘাড় মটকাতে পারে বটে, চুরি করতে যাবে কোন দুঃখে?
বললাম, কেন ছোটমামা? ভূতের মাথায় পেরেকের মতো চুল থাকলে…
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-থাম তো। আজ ওবেলায় আমি নিজেই চিরুনিচোরকে হাতেনাতে ধরে ফেলব। সেজন্যই তো নদীর ধারে ওৎ পাততে যাচ্ছিলাম। খামোকা তোর কথায় থানায় গেলাম।
বেলা পড়ে এলে ছোটমামা আমাকে নিয়ে বেরুলেন আবার। ছোটমামা প্যান্টের পকেটে একটা দড়ি নিয়েছেন। আর আমাকে দিয়েছেন একটা কাগজ কাটা ছুরি। নদীর ধারে শ্মশানবটের কাছে গিয়ে চাপা গলায় বললেন, আমি ওকে ধরে ফেলব, আর তুই ছুরি বের করে চেঁচিয়ে বলবি, একটু নড়লেই পেট ফাঁসিয়ে দেব সাবধান!
এই বলে আমাকে রিহার্সাল দিইয়ে ছাড়লেন,-বলত শুনি, কেমন করে চোখ কটমটিয়ে বলবি?
অগত্যা ছোটমামার জেদে আমাকে ছুরি বাগিয়ে চিকুর ছেড়ে বলতে হল, একটু নড়েছ কি পেট ফাঁসিয়ে দেব সাবধান!
উঁহু সাবধানটা হবে আরও জোরে। এমনি করে।–বলে ছোটমামা বিকট গর্জালেন, সা—ব—ধা–ন।
বারকতক বলার পর উনি খুশি হলেন। ই ঠিক হয়েছে। বুঝলি পুটু? ভালোয় ভালোয় যদি কাজটা করে ফেলতে পারি, তোকে এক প্যাকেট লজেন্স দেব।
শ্মশানবটের এদিকটা নিঃঝুম। শ্মশানে আজ কেউ মড়া পোড়াতে আসেনি। নদীতে ধুধু চড়া পড়েছে। দেখতে-দেখতে সূর্য ডুবে গেল। আলো কমে এল। সেই সময় ছোটমামা হঠাৎ আমাকে খামচে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,–চলে আয়! ওই দ্যাখ, ব্যাটাচ্ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
চমকে উঠে দেখি, নদীর বালিতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম। পাড়ের নিচে একফালি জল তিরতির করে বয়ে হচ্ছে। তার ওধারে বালির চড়া ওপার অবধি ছড়িয়ে রয়েছে। কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম, আরে! লোকটা ছোটমামার সেই চিরুনিটা দিয়ে সত্যি সত্যি চুল আঁচড়াচ্ছে যে!
ছোটমামা দড়ি বের করে চলে যায় বলেই নিচে ঝাঁপ দিলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম। জলটুকু পেরিয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,–একপা নড়ছে কি মরেছ, সা—ব–ধা–ন!
ছোটমামা ফুঁসে উঠে বললেন,–ভ্যাট! দিলে সব ভেস্তে। এখন নয়, এখন নয়।
গোবিন্দ কিংবা যেই হোক, সে ঘুরে আমাদের দেখল তারপর দৌডুতে শুরু করল। ছোটমামা,–তবে রে ব্যাটা চোর, যাবি কোথায়–বলে দৌড়লেন তার পেছনে। আমিও।
তখনও দিনের আলো আছে, তবে খানিকটা আবছা হয়ে গেছে। কালো মূর্তিটাকে ছোটমামা প্রায় ধরে ফেলেন এমন অবস্থা। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সামনে সেই কাঁটাতারের বেড়া। একটা সাইনবোর্ড লটকানো আছে। তাতে একটা মড়ার খুলি।
হতভম্ব হয়ে দেখলাম, লোকটা বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে চলে গেল। তারপর ধীরসুস্থে বালিতে তলিয়ে যেতে থাকল। কালো মুখের সাদা দাঁতে সে নিঃশব্দে হাসছে দেখে ছোটমামা ভেংচি কেটে বললেন লজ্জা করে না হাসতে ব্যাটাচ্ছেলে চোর কোথাকার? ভালো চাও তো চিরুনিটা দাও বলছি! ছোটমামা আমার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে চ্যাঁচিমেচি করে বললেন,–ছুরি ছুড়ব বলে দিচ্ছি! চিরুনি দাও আমার। দেবে না? তবে রে! ওয়ান–টু–থ্রি।
গোবিন্দচোর হাত্তেরি বলে চিরুনি ছুঁড়ে দিল। সেটা ঘ্যাস করে ছোটমামার পায়ের সামনে বালিতে বিধে গেল কাস্তের মতো। চিরুনিটা তুলে ছোটমামা সম্ভবত শাসাতে যাচ্ছিলেন, তখন গোবিন্দের মডুটাও তলিয়ে গেল।
আমি বেজায় ভয় পেয়ে গেলাম,–ও ছোটমামা! আর এখানে নয়। বড্ড ভয় করছে যে!
ছোটমামা বললেন, ভয় তো আমারও করছে। দাঁড়া, আগে চুলগুলো ঠিক করে নিই! তারপর যাচ্ছি।…
ছক্কামিয়ার টমটম
এমুলুকে রাতবিরেতে বাস ফেল করলে ছক্কামিয়ার টমটম ছাড়া আর উপায় ছিল নো। ঝড়-বৃষ্টি হোক, মহাপ্রলয় হোক, রাতের বেলা ভীমপুর গদাইতলা দশমাইল পিচের সড়কে যদি কষ্ট করে একটু দাঁড়িয়ে থাকা যায়, ছক্কামিয়ার টমটমের দেখা মিলবেই মিলবে। অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে প্রথমে ঠাহর হবে এক চিলতে টিমটিমে আলো। তারপর আলোটা এগিয়ে আসবে আর মেমের ডাকাডাকি যতই থাক, কানে বাজবে অদ্ভুত এক আওয়াজ টং লং…টং লং…টং লং। বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ চোখে পড়বে কালো এক একৃাগাড়ি–তেরপলের চৌকা একটা টোপর চাপানো। সামনে কালো এক মূর্তি আর নড়বড় করে দৌড়নো এক টাট্টু!
মুখে কিছু বলার দরকার নেই। ছক্কামিয়ার টমটম সওয়ারি দেখামাত্র থেমে যাবে। তখন একলাফে পেছনের তেরপল সরিয়ে চৌকা টোপরে ঢুকলেই নিশ্চিন্ত। আবার টলতে-টলতে চলতে থাকবে ছক্কামিয়ার টমটম–টং…লং…টং লং।
টমটম কথাটা এসেছে ইংরেজি ট্যান্ডেম থেকে যে গাড়ির সামনে কয়েক সার ঘোড়া যেত। কিন্তু ভীমপুরের ছক্কামিয়ার একাগাড়ির ঘোড়া মোটে এক। তবু আদর করে লোকে নাম দিয়েছিল টমটম।
ছক্কামিয়ার চেহারাটি কিন্তু ভারি বদরাগী। ঢ্যাঙা, টিঙটিঙে রোগা, একটু কুঁজো গড়ন। লম্বাটে মুখের বাঁকানো নাকের তলায় পেল্লায় গোঁফ। চামড়ার রং রোদপোড়া তামাটে।
তেমনি তার টাট্টুও। যেমন মনিব, তেমনি ঘোড়া, হাড় জিরজিরে লম্বাটে গড়ন। ঠ্যাং চতুষ্টয় যেন চারখানি কাঠি। মাথাটা দেখে সময়-সময় ঠাহর করা কঠিন, এই প্রাণীটি সিঙ্গি, না প্রকৃত একটি ঘোড়া। হ্রেষাধ্বনি করলেই পিলে চমকে ওঠে। ভীমপুর বাজারের তাবৎ-তাবং নেড়িকুকুর দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায় লেজ গুটিয়ে।
লোকে আজকাল রাস্তা চলতে বাস-রিকশোই পছন্দ করে। ছক্কা মিয়ার টমটম চড়লে হাড়মাংস দলা পাকাতে থাকে বলেও না, কালের রেওয়াজ আসলে।
কিন্তু ওই যে বলেছি, রাতবিরেতে বাস ফেল করলে তখন উপায়? ছক্কামিয়া এটা বোঝে এবং দিনে তার টমটমের বাহনটিকে নিয়ে বনজঙ্গল বা ঝিলে চরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। রাতের বেলা ছোট্ট বাজারের চৌরাস্তায় শিরীষ গাছের তলায় ঘাপটি পেতে বসে থাকে। পাশেই টমটম রেডি।
সেবার পুজোর সময় কলকাতা থেকে ছোটমামার সঙ্গে আসছি। মাঝপথে একখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল তো রইল। আর নড়ার নাম নেই। ব্যাপার কী? না– আগের স্টেশনে মালগাড়ি বেলাইন। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। তারপর যখন ট্রেনের চাকা গড়াল, ছোটমামা বেজারমুখে বললেন,-বরাতে আমার হতচ্ছাড়া ছামিয়ার টমটম আছে। বাপস!
ওই টমটমে কখনও চাপিনি। তাই কথাটা শুনে আমার আনন্দ হয়েছিল। বললুম, খুব মজা হবে, তাই না ছোটমামা?
ছোটমামা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন,–মজা হবে! বুঝবে ঠ্যালাটাখন।
ঠ্যালাটা কীসের বুঝলাম না আগেভাগে। দেখলাম, ছোটমামা ট্রেনের জানলা দিয়ে মুন্ডু বাড়িয়ে বারবার যেন আকাশ দেখছেন। একটু পরে বললেন, খুব ঝড়বৃষ্টি হবে! কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলাম। বড়দা অত করে বললেন, তবু থামলুম না। ছ্যা-ছ্যাঁ, আমার কী আক্কেল!
ভীমপুর স্টেশনে যখন নামলুম, তখনও কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির পাত্তা নেই। রাত একটা বেজে গেছে। বাজার নিশুতি। চৌমাথায় শিরীষতলায় গিয়ে দেখি, ছক্কামিয়ার টমটম দাঁড়িয়ে আছে। বলা কওয়া নেই, দরদস্তুর নেই, ছোটমামা টমটমের পেছনদিকে তেরপল তুলে ঢুকে ডাকলেন, হাঁ করে দেখছিস কী? উঠে আয়। এখুনি একগাদা লোক এসে ভালো জায়গা দখল করে ফেলবে যে।
ভেতরে খড়ের পুরু গাদার ওপর তেরপল পাতা। কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ। অন্ধকারও বটে। যেন এক গুহায় ঢুকেছি। সামনে সরে গিয়ে ছোটমামা পরদাটা ফাঁক করে রাখলেন। একটু পরে আরও জনাদুই নোক ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে এক ঠাসাঠাসি অবস্থা।
আর তারপরই আচমকা চিকুর ছেড়ে মেঘ ডাকল এবং শনশন করে এসে গেল একটা জোরালো হাওয়া। ছোটমামা বললেন,–ওই যা বলেছিলুম। হল তো?
ছক্কামিয়া সামনের আসন থেকে ঘোষণা করল,–আরাম করে বসুন বাবু মশাইরা! এবার রওনা দিই। তার ঘোড়াটাও মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চি হি হি ডাক ছেড়ে যখন পা বাড়াল, তখন টের পেলাম কেন ছোটমামা বাপস বলে মুখখানা তুম্বো করেছিলেন।
সত্যি বাপস! হাড়গোড় মড়মড়িয়ে ভেঙে যাওয়ার দাখিল। বাইরে হাওয়ার হইচই মেঘের হাঁকডাক যত বাড়ছে, ছক্কামিয়ার ঘোড়াটাও তত যেন তেজি হয়ে উঠছে। একটু পরেই চড়বড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টোপরের তেরপলে পড়তে শুরু করল। ছোটমামা ফঁকটুকু বন্ধ করে দিলেন। আমি তখন অবাক। ছক্কামিয়া বাইরে বসে চাবুক হাঁকাচ্ছে। ওর বৃষ্টির ছাট লাগবে না?
রাস্তাটা ঘুরে রেল লাইন পেরুলে দুধারে বিশাল আদিগন্ত মাঠ। ফাঁকা জায়গায় ঝড়-বৃষ্টিটা মিয়ার টমটমকে বেশ বাগে পেল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি উল্টে গিয়ে রাস্তার ধারের গভীর খালে নাকানিচোবানি খাবে! আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে সেও ভাববার কথা।
কিন্তু আশ্চর্য, টমটম সমান তালে নড়বড়িয়ে টলতে-টলতে চলছে। মাঝে মাঝে ঝড়-বৃষ্টির শব্দের ভেতর শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত এক শব্দ–টংলং-টংলংটলং। কখনও ছক্কামিয়ার টাট্টুঘোড়া বিকট চি-হি করে চেঁচিয়ে উঠছে। তারিফ করে আমার পেছন থেকে এক সওয়ারি বলে উঠলেন,–পক্ষীরাজের বাচ্চা!
এতক্ষণে তেরপলের টোপর থেকে ফুটো দিয়ে জল চোয়াতে থাকল। সওয়ারিরা নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরবে কোথায়? বেহদ্দ ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছিল জামাকাপড়। একসময় ছোটমামা হঠাৎ বাজখাই চেঁচিয়ে বললেন, আঃ! হচ্ছে কী, হচ্ছে কী মশাই? আমার ওপর পড়ছেন কেন?
–আপনার ওপর আমি পড়লুম, না আপনি আমার ওপর পড়লেন?
–কী বাজে কথা বলছেন? আমায় ঠান্ডা করে দিয়ে আবার তক্ক? আপনি মানুষ, না বরফ?
–আমি বরফ? আপনিই তো বরফ। ইস। কী ঠান্ডা! হাড় অবধি জমে গেল দেখছেন না!
আমার পিছনের সওয়ারি চাপা খিকিখক করে হেসে আমার কানের ওপর বলল, ঝগড়া বেধে গেছে। বরাবর হয়, বুঝলেন তো মশাই? ছক্কামিয়ার টমটমের এই নিয়ম। খিক-খিক-খিক-খিক।
এমন বিদঘুঁটে হাসি কখনও শুনিনি। কিন্তু এর শ্বাস-প্রশ্বাসেও যে বরফের মতো হিম। বললুম, ইস। একটু সরে বসুন না। বড্ড ঠান্ডা করে যে!
লোকটা ভারি অদ্ভুত! সে ওই বিদঘুঁটে খিক খিকখিক হাসতে-হাসতে আরও যেন ঠেসে ধরল আমাকে। চেঁচিয়ে উঠলাম, ছোটমামা! ছোটমামা!
কিন্তু ছোটমামার কোনও সাড়া পেলাম না। টোপরের ভেতরটা ঘন অন্ধকার। ফের ডাকলুম–ছোটমামা! কোথায় তুমি?
লোকটা সেই খিকখিক হাসির মধ্যে বলল, আর ছোটমামা বড়মামা! মামারা এখন রাস্তায় পড়ে কুস্তি করছে।
হতভম্ব হয়ে হাত বাড়িয়ে ছোটমামাকে খুঁজলুম। সুটকেসটা হাতে ঠেকল। কিন্তু সত্যিই ছোটমামা নেই। তারপর পেছনের দিকে চোখ পড়ল। ওদিককার পরদাটা যেন ফর্দার্যাই। বৃষ্টির ছাট এসে ঢুকছে। আমি প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বললাম, ছামিয়া। ছক্কামিয়া! গাড়ি থামাও! গাড়ি থামাও।
পেছনের সওয়ারি ফের সেই বিদঘুঁটে হাসি হেসে উঠল। এবার আমি সামনের পরদা ঠেলে সরিয়ে ছক্কা মিয়ার ভেজা জামা খামচে ধরলুম। গাড়ি থামাও গাড়ি থামাও বলছি!
এতক্ষণে যেন ছক্কামিয়া আমার কথা শুনতে পেল। ঘুরে বলল, কী হয়েছে বাবুমশাই?
ছোটমামা পড়ে গেছেন কোথায়।
ছক্কামিয়া বলল, বালাই ষাটা পড়বেন কোথায়? ঠিকই আছেন, খুঁজে দেখুন ।
–নেই। তুমি গাড়ি থামাবে কি না বলো।
সামনে একটা মন্দির আছে। সেখানে থামাব। দুক্কামিয়া চাবুক মেরে ঘোড়াটাকে খুঁচিয়ে দিয়ে বলল,–যেখানে-সেখানে থামলে ঝড়-বৃষ্টিতে কষ্ট পাবেন বাবুমশাই। বুঝলেন না? ওইখানে থামিয়ে আপনার ছোটমামাকে খুঁজবেন বরঞ্চ।
মন্দিরের আটচালার সামনে গাড়ি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি ছক্কামিয়ার পাশ দিয়ে লাফ দিলাম। তারপর আটচালায় ঢুকে পড়লাম। বুদ্ধি করে ছোটমামার সুটকেস আর আমার কিটব্যাগটাও দু হাতে নিয়েছিলাম।
কিন্তু আটচালায় ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে দেখলুম, ছক্কামিয়ার টমটম বৃষ্টির মধ্যে আচমকা গড়াতে শুরু করেছে। ঘোড়াটা চি-হি ডাক ডেকে তেমনি নড়বড়ে পায়ে দৌড়তে লেগেছে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। মুখে কথাটি পর্যন্ত আর ফুটল না। ভারি অদ্ভুত লোক তো ছক্কামিয়া।
এখন ঝড়টা প্রায় কমে এসেছে। বৃষ্টি সমানে পড়ছে। নির্জন আটচালায় দাঁড়িয়ে আছি। প্যান্ট-শার্ট ভিজে চপচপ করছে। প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা আর কী!
কিছুক্ষণ পরে বিদ্যুতের আলোয় দেখি, কে যেন আসছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,–কে-কে?
ছোটমামার সাড়া এল, অন্তু নাকি রে?
আমি কাদ-কাদ গলায় বললুম,–হ্যা! তোমার কী হয়েছিল ছোটমামা? ছোটমামা আটচালায় ঢুকে বললেন, কী হবে আবার। যা হওয়ার, তাই হয়েছিল। তবে ব্যাটাকে এবার যা জব্দ করেছি, আর কক্ষনও ছক্কামিয়ার টমটমে ভুলেও চড়তে আসবে না।
–ছোটমামা আমার কাছে সুটকে দেখে খুশি হয়ে বললেন,–জানতুম, তুই ঠিকই নেমে পড়ে আমার অপেক্ষা করবি কোথাও।
–কিন্তু লোকটা কোথায় রইল?
হাসলেন ছোটমামা,–ওকে তুই লোক বলছিস এখনও? ওটা কি লোক নাকি?
–তবে কে?
–বুঝলিনে? ওর ঘাড়ে একটা চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দে, তাহলে বুঝবি। থাকগে, এখন রাতবিরেতে ও নিয়ে আলোচনা করতে নেই। ব্যাপারটা কী জানিস অন্তু? রাতবিরেতে অমন দু-একজন সওয়ারি ছক্কামিয়ার টমটমে উড়ে পড়বে। তারপর কী করবে জানিস? অন্ধকারে ঘাড় মটকানোর তাল করবে। যেই টের পেয়েছি আমার পেছনের লোকটার মতলব কী, অমনি ওকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যাটা পড়বার সময় অ্যায়সা হ্যাঁচকা টান মেরেছে যে আমিও ওর সঙ্গে তেরপলের ফাঁক দিয়ে নিচে পড়েছি।
–তারপর? তারপর ছোটমামা?
তারপর আর কী? ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় কুফু-জুডো যা সব অ্যাদ্দিন কষ্ট করে শিখেছি, চালিয়ে গেলুম। এক প্যাঁচে ওকে এমন করে ছুড়লুম যে একেবারে বিশ ফুট গভীর খাদে গিয়ে পড়ল। এতক্ষণ কোনও বাজ পড়া ন্যাড়া গাছের ডগায় বসে হিপিয়ে-হিপিয়ে কাঁদছে। ছোটমামা হাসতে-হাসতে গায়ের জামা খুলে নিঙড়ে নিলেন। তারপর বললেন,–ঘণ্টা তিন কাটাতে পারলেই ফার্স্ট বাস পেয়ে যাব। জামাটা নিঙড়ে নে। ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে মাথা মুছে ফেল। বাপস!
আমি শুধু ভাবছিলুম, তাহলে আমার পেছনকার সেই সওয়ারিও কি লোক নয়, সেই লোকটিও কি আমার ঘাড় মটকানোর তালে ছিল? অন্য লোকটার মতো?
আমার মুখ দিয়ে ছোটমামার প্রতিধ্বনি বেরিয়ে গেল, বাপস!…
.
ছক্কামিয়ার টমটমে তারপর ভুলেও চাপার কথা ভাবতুম না। কিন্তু বছর দশেক পরে, যখন কিনা আমি পুরোপুরি সাবালক, একরাতে ভীমপুর স্টেশনে নেমে শুনলুম লাস্ট বাস চলে গেছে।
স্টেশনবাজার তখন নিঃঝুম। সময়টা শীতের। আকাশে একটুকরো চাঁদও আছে। কিন্তু কুয়াশার ভেতর তার দশা বেজায় করুণ। একটা চায়ের দোকান খোলা ছিল। শীতের রাত বারোটায় চা-ওলা সবে ঝাঁপ ফেলার জোগাড় করছিল, আমাকে দেখে বুঝি তার দয়া হল। এক কাপ চা খাইয়ে দিল। শেষে বলল, বাবুমশাই তাহলে যাবেন কীসে গদাইতলা?
–কীসে আর যাব? বরং দেখি যদি ওয়েটিংরুমে রাতটা কাটানো যায়।
চা-ওলা মুচকি হেসে বলল,-ছক্কামিয়ার টমটমেও যেতে পারেন।
ছক্কামিয়ার টমটমের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম! সেবার ঝড়-বৃষ্টি ছিল কম। ছোটমামাও বড় গল্পের মানুষ ছিলেন।
হনহন করে চৌমাথায় চলে গেলুম। গিয়ে দেখি, শিরীষতলায় আগুন জ্বেলে বসে আছে সেই আদি অকৃত্রিম ছক্কামিয়া। পাশেই তার টমটম তৈরি। ঘোড়াটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। শীত বাঁচাতে তার পিঠে একটুকরো চটের জামা। বললুম,–গদাইতলা যাবে নাকি ছক্কামিয়া?
ছক্কামিয়া ইশারায় টমটমে চড়তে বলল।
আজ আর কোনও সওয়ারি এল না দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল। টমটম তেমনি নড়বড় করে চলতে শুরু করল। ঘোড়াটাও বিকট চি-হি-হিঁ ডাকতে ভুলল না। অবিকল সব আগের মতোই আছে। এমন কী ছামিয়ার পেল্লায় গোঁফটারও ভোল বদলায়নি। আর সেই অদ্ভুত ঘণ্টার শব্দ, টংলং টংলং টংলং!
কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তেরপলের ঘেরাটোপের ছ্যাদা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে উত্যক্ত করছিল। জড়সড় হয়ে কোনা ঘেঁষে রইলুম। সামনেকার মোটা হ্যাঁদা দিয়ে বাইরে কুয়াশামাখানো জ্যোৎস্নায় ঝিমধরা মাঠঘাট চোখে পড়ছিল। গাছগুলো আগাপস্তলা কুয়াশার আলোয়ান চাপিয়েছে; আর মাথায় পড়েছে কুয়াশার টুপি। টুকরো চঁদখানা ঘেঁড়া ঘুড়ির মতো একটা ন্যাড়া তালগাছের ঘাড়ে আটকে গেছে দেখতে পাচ্ছিলুম।
মাইলটাক চলার পর রাস্তার ধার থেকে কে বাজখাই হাঁক ছাড়ল,–রোকো, রোকো! অমনি টমটম থেমে গেল। ঘোড়াটাও স্বভাবমতো সামনে দু-ঠ্যাং তুলে একখানা চিঁ-হিঁ ছাড়ল। তারপর ছামিয়ার গলা শুনলুম, দারোগাবাবু নাকি? সেলাম, সেলাম।
মুখ বাড়িয়ে দেখি, বিশাল এক ওভারকোট পরা মূর্তি। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কোনও এক দারোগাবাবু। বললেন, রোসো। সাইকেলখানা তুলে দিলেন। তারপর যখন টোপরের ভেতরে ঢুকলেন, মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। ঢুকেই আমাকে টের পেয়ে চমকানো গলায় বলে উঠলেন,–কে? কে?
বললুম,–আমি।
আমি? আমি মানুষের নাম হয় নাকি? বলে দারোগাবাবু টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিলেন। নামধাম বলতেই হল। পুলিশের লোক বলে কথা। সব শুনে উনি বললেন, আমি আপনাদের গদাইতলা থানার চার্জে। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখিনি।
বেগতিক দেখে বললুম, কলকাতায় আছি বহুকাল। তাই দেখেননি। তা আপনার নামটা জানতে পারি স্যার?
–বংকুবিহারী রায়।
আসামী ধরতে বেরিয়েছিলেন বুঝি? –ওঁকে খুশি করার জন্যই বললুম।
বংকু দারোগা জলগম্ভীর স্বরে বললেন,–হুম! ব্যাটা এক দাগি বেগুনচোর ভীষণ ভোগাচ্ছে। আজ একটা বেগুনক্ষেতে দুজন সেপাই নিয়ে ওত পেতেছিলুম। তাড়া খেয়ে সটান একটা তালগাছের ডগায় উঠে গেল। তাকে আর নামাতে পারলুম না। তখন সেপাই দুজনকে তালগাছের গোড়ায় বসিয়ে রেখে এলুম। আসতে-আসতে হঠাৎ সাইকেলের বেয়াদপি।
দাগি বেগুনচোর এই শীতকালে সারারাত তালগাছের ডগায় বসে আছে। কিন্তু তার জন্য নয়, হতভাগা সেপাই দুজনের কথা ভেবে আমার উদ্বেগ হচ্ছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আহা!
আহা মানে? আমাকে ফের টর্চ জ্বেলে সন্দিগ্ধ নজরে দেখে বন্ধু দারোগা বললেন,–হুম! আপনি মশাই এই মড়া-বওয়া গাড়িতে এতরাতে চাপলেন যে! আপনি জানেন, আজকাল সওয়ারি জোটে না বলে ছক্কামিয়া মড়া বয়ে নিয়ে যায় গঙ্গার ঘাটে!
বলেন কী! তাহলে তো ভয়ের কথা। অবাক হয়ে বললুম, সত্যি ভয়ের কথা। আগে জানলে কথা কেড়ে বন্ধু দারোগা বললেন, হয়তো জেনেশুনেই চেপেছেন। কিছু বলা যায় না।
–কেন এ কথা বলছেন?
–বলছি আপনার চেহারা দেখে। এমন শুটকো রোগা চিপসে বাসি মড়ার মতো লোক সচরাচর দেখা যায় না কিনা।
এবার আমার খুব রাগ হল, কী বলতে চান আপনি?
–রাত-বিরেতে আজকাল ছক্কা মিয়ার টমটমে কে জ্যান্ত, কে মড়া বোঝা যায় না। মশাই!
হাত বাড়িয়ে বললুম,–এই আমার হাত! পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আমি মড়া না জ্যান্ত!
বন্ধু দারোগা আমার হাত সরিয়ে দিলেন জোরে, বাপস! এ তো বেজায় ঠান্ডা?
–ঠান্ডা হবে না? শীতের রাতে এই মাঠের মধ্যে হাত কি গরম থাকবে?
–না মশাই। এমন রাতে বিস্তর সিঁদেল চোরের হাত পাকড়েছি। তারা কেউ এমন ঠান্ডা ছিল না।
–কী? আমায় সিঁদেল চোর বললেন!
বংকু দারোগা গলাটা ভেতরে নিয়ে বললেন,–সিঁদেল চোরের ভূত হতেও পারেন। কিছু বলা যায় না। তখন আহা বলা শুনেই সন্দেহ জেগেছে।
আর সহ্য হল না। খাপ্পা হয়ে চ্যাঁচিলুম,–পুলিশ হোন, আর যাই হোন আপনাকে অমি সাবধান করে দিচ্ছি মশাই।
দাবোগাবাবু ফের মুখের ওপর টর্চ জ্বেলে বললেন,–ওঁ হুঁ হুঁ। বড্ড এগিয়ে এসেছেন। সরে বসুন! সরে বসুন বলছি!
মুখের ওপর টর্চের আলো কারই বা সহ্য হয়! টর্চ নেভান-বলে টর্চটা ঠেলে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলুম। টর্চটা নিভে গেল। এবং কোথায় ছিটকে পড়ল। কিন্তু এটাই বোধহয় ভুল হল। আর বন্ধু দারোগা বিকট গলায় ভূত! ভূত! বলে চিক্কুর ছেড়ে আমাকে এক রামধাক্কা মারলেন। টোপরের একপাশের জরাজীর্ণ তেরপলের ওপর কাত হয়ে পড়লুম। তেরপলটা ফরফর করে ছিঁড়ে গেল। এবং টাল সামলাতে
পেরে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলুম। কানের পাশ দিয়ে চাকা গড়িয়ে গেল প্রচণ্ড বেগে। পলকের জনা দেখলুম কুয়াশা-ভরা নীলচে জ্যোৎস্নায় কালো টমটম দূরে সরে যাচ্ছে। ভেসে আসছে অদ্ভুত এক শব্দ টংলং-টংলং টংলং!
ভাগ্যিস, রোডস দফতরের লোকেরা রাস্তা মেরামতের জন্য কিনারায় বালির গাদা রেখেছিল। আঘাত টের পেলুম না। সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। লোকেরা লণ্ঠন-লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে এল। তখন ঘটনাটা তাদের আগাগোড়া বলতে হল।
কিন্তু সব শুনে ওরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। একজন বলল, কী বলছেন বাবু? ছক্কামিয়ার টমটম পেলেন কোথায়? কাল ভীমপুরের কাছেই একটা ট্রাকের ধাক্কায় ছামিয়া আর তার ঘোড়াটা মারা পড়েছে যে! ভাগ্যিস, টমটমে একটা মড়া ছিল শুধু। সঙ্গের লোকেরা বাসে চেপে গঙ্গার ধারে গিয়েছিল। কিন্তু অবাক কাণ্ড দেখুন, মড়াটা একেবারে আস্ত ছিল। তুলে নিয়ে গিয়ে ভালোেয়-ভালোয় চিতেয় তুলতে পেরেছে।
বন্ধু দারোগার ওপর সব রাগ সঙ্গে সঙ্গে ঘুচে গেল। বরং উনি আমাকে বাঁচিয়েই দিয়েছেন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওঁর নিজের ভাগ্যে কী ঘটল কে জানে! আহা বেচারা!
কী ঘটল, তার পরদিন শুনলাম। বঙ্গুবাবু তখন হাসপাতালে। লোকে বলছে, আসামী ধরতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে কোমড়ের হাত ভেঙেছে। সাইকেলও অক্ষত নেই। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো আমি জানি। তবে যাই হোক, আমার ওপর যেটুকু ফঁড় গেছে, তার জন্য দায়ী স্টেশনবাজারের সেই ধড়িবাজ চা-ওলা। কেমন হেসে বলেছিল দুকালিমার টমটমেও যেতে পারেন। সব জেনে-শুনেও কী অদ্ভুত রসিকতা।
অবশ্য এমনও হতে পারে, সে বলেছিল,–ছামিয়ার টমটমেও যেতে পারতেন! আমিও হয়তো ভুল শুনেছিলুম। ক্রিয়াপদের গোলমাল স্রেফ…
ছুটির ঘণ্টা
আমাদের ছেলেবেলায় পাড়াগাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলকে বলা হতো পাঠশালা আর ক্লাসকে বলা হতো শ্ৰেণী। সব পাঠশালায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত থাকবে তার মানে নেই। আমি যে পাঠশালায় পড়তুম সেখানে ছিল শিশুশ্রেণী, প্রথম শ্রেণী আর দ্বিতীয় শ্রেণী। শিক্ষক মোটে একজন। তাকে বয়স্করা বলতেন নিসিং পণ্ডিত। আমরা বলতুম পণ্ডিতমশাই।
নিসিং পণ্ডিতের এক দাদা ছিলেন। তাঁর নাম গিরিজাবাবু, আড়ালে আমরা বলতুম গিজাংবাবু। মাটির ঘর আর খড়ের চালের পাঠশালার দাওয়ায় তালপাতার চাটাই পেতে শিশু শ্রেণীর বাচ্চারা স্বরে অ, স্বরে আ বলে বেদম চ্যাঁচিত। খুঁটিতে হেলান দিয়ে পিড়ির ওপরে বসে নিসিং পণ্ডিত নিমডালের ছিপটা তুলে বলতেন, আরও জোরে–আরও জোরে। আমরা প্রাণপণে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্ত করতুম। তার পরে এসে পড়তেন গিজাবাবু। লম্বা ঢ্যাঙা গড়নের মানুষ। খালি গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া নোংরা একটা পৈতে পেঁচানো থাকত। মাথার পেছনে খাড়া এক টিকি। গলায় তুলসি কাঠের মালা। পায়ে খড়ম আর হাতে হুঁকো। একটু তফাতে বসে ভুড়-ভুড় শব্দে হুঁকো টানতেন। তামাকের গন্ধটা ছিল ভারি মিঠে।
ঘরের ভেতর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেরা পড়ত। সম্ভ্রমের চোখে ভেতরটা দেখে ভাবতুম, কবে ঘরে ঢোকার দিন আসবে আমার? নিসিং পণ্ডিত সেই উঁচু শ্রেণীর ছাত্রদের পড়াতে ঘরে ঢুকলে তাঁর দাদা গিজাংবাবু দাওয়ার শিশু শ্রেণীর দিকে মুচকি হেসে তাকাতেন। তারপর বলতেন,–ও কী পড়ছিস রে? ওটা কী পড়া হচ্ছে? নে পড়।
স্বরে অ স্বরে আ
বাড়ি গিয়ে মুড়ি খা
হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
আমি হুঁকো খাচ্ছি
হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ
এর নাম তামাকু…
ঘর থেকে নিসিং পণ্ডিত শুনতে পেয়ে বলতেন, আবার তুমি গণ্ডগোল বাধাচ্ছ দাদা? ওদের পড়তে দাও তো।
রাগ করে গিজাংবাবু উঠে যেতেন। একটু তফাতে শিবমন্দিরের বটতলায় গিয়ে বসতেন। পাঠশালার চারপাশটা ছিল ভারি নিরিবিলি। নিমগাছের জঙ্গল, আমবাগান, একটা পুকুর-তার পাড়ে এক জরাজীর্ণ মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে একফালি রাস্তা ধরে আমি একা বাড়ি ফিরে যেতুম। কারণ ওটাই ছিল আমার শর্টকাট রাস্তা। ফেরার সময় মন্দিরের কাছে কোনওদিন দেখা হয়ে যেত গিজাংবাবুর সঙ্গে। লোকটিকে আমার ভালোই লাগত। ফিক করে হেসে বলতেন, কী খোকা? কোন শ্রেণীতে পড়ো?
বলতুম,–ছিছু ছেনি (অর্থাৎ শিশু শ্রেণী)।
অমনি হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়তেন গিজাংবাবু। হুঁকোর জলও গড়িয়ে পড়ত। সামলে নিয়ে বলতেন, ছিছু ছেনি। অ খোকা, বাড়ি গিয়ে মায়ের কোলে বসে দুধু ভাতু খাও গে।
একদিন ফেরার সময় গম্ভীর মুখে বললেন,–অ খোকা! নিসিং শটকে শেখায় না?
শটকে মানে শতকিয়া–এক থেকে একশো পর্যন্ত মুখস্থ করা। বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কই, বলল শুনি।
–একে চন্দ, দুয়ে পক্ষ। তিনে নেও…
গিজাংবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন,–থাক, থাক! ওই শটকে পড়াচ্ছে বুঝি নিসিং? শোন এমনি করে শটকে পড়বে।
একে চাঁদ মামা/রেতে দ্যায় আলো
দুয়ে দুই পক্ষ/রং সাদাকালো
তিনে তিন চোখো/শিব জটাধারী
চারে চার বেদ/জানে দর্পহারী
পাঁচে পঞ্চবাণ/বড় ভয়ংকর
ছয়ে ষড়ঋতু/শোভে মনোহর
সাতে সিন্ধু সপ্ত/আটে বসু অষ্ট
নয়ে গ্রহ নব/কুদৃষ্টিতে কষ্ট
দশে দশ দিক/করহ মুখস্থ
বাড়ি যাই দাদা/সূর্য গেল অস্ত…
এখন বুঝতে পারি গিজাংবাবুর পদ্য রচনার ক্ষমতা ছিল। অতটুকুন বয়সে তাঁর ছড়ার সুরে এসব আওড়ানো শুনে ভক্তি জাগত। কোনওদিন ডেকে বলতেন, অ খোকা। পণ্ডিত তোমায় আকার পড়িয়েছে তো? বলল দিকি কাক বানান কী?
বানান শুনে হেসে বলতেন,
কাক থাকে গাছে
জলে থাকে মাছ
বনে থাকে বাঘ
মনে থাকে রাগ…
পাঠশালায় ছুটির ঘণ্টা নিসিং পণ্ডিত নিজেই বাজাতেন। ওটা নাকি পোড়া শিবমন্দিরেরই পুজোর ঘণ্টা। চৈত্রের সংক্রান্তিতে মন্দিরে পুজো হতো-বছরের এই একটা দিনের ঘণ্টা। সেদিন ঘণ্টাটার দরকার হতো মন্দিরে। নিসিং পণ্ডিত নিজেই পূজারী। তাই ঘণ্টাটা তার কাছেই থাকত সারা বছর।
গ্রীষ্মের ছুটির পরে একদিন হঠাৎ নিসিং পণ্ডিতের ঘণ্টাটা গেল চুরি। মনমরা হয়ে পণ্ডিতমশাই মুখেই ছুটি ঘোষণা করলেন। কিন্তু সেই পাঠশালা থেকে ছেলেরা হইহই করে বেরিয়েছে, অমনি পুকুরপাড়ে জঙ্গলের ভেতর মন্দিরের ওখানে কোথায় ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল, ঢং, টং, ঢং!
নিসিং পণ্ডিত লাফিয়ে উঠে চেঁচালেন, ধরো, ধরো, পাকড়ো। তারপর মন্দিরের দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। পাঠশালার সর্দার পোডড়া মন্দিরের দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। পাঠশালার সর্দার পোডড়া ছিল বাবুল নামে একটা ছেলে সে বয়সেও সব ছেলের বড়। তাকে পণ্ডিতমশায়ের পেছনে-পেছনে ছুটতে দেখে আমরাও দৌড়লুম।
মন্দিরের ওখানে গিয়ে পণ্ডিতমশাই বললেন,–খোঁজ, খুঁজে দ্যাখ! এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
আমরা সবাই জঙ্গল তন্নতন্ন খুঁজে ঘণ্টা-চোর বা ঘণ্টার পাত্তা পেলুম না। শেষে হতাশ মুখে নিসিং পণ্ডিত বললেন, যাকগে। ওটা আর পাওয়া যাবে না। বরাবর ঘণ্টাটার ওপর লোভ ছিল যে। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলুম। সর্দার পোড় বাবুল ধমক দিয়ে বলল,-শিগগির বাড়ি চলে যা বলছি। আর এখানে থাকবি না…
সেদিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরদিন কানাকানিতে টের পেলুম, গিজাংবাবুই নাকি ঘণ্টাটা চুরি করে পালিয়েছেন। তাই আর তাকে গ্রীষ্মের ছুটির পর
থেকে পাঠশালার আনাচে-কানাচেও দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু মন্দিরের কাছ দিয়ে আসতে-আসতে তামাকের গন্ধ পাই, তাও তো সত্যি। নিশ্চয় তাহলে জঙ্গলে লুকিয়ে তামাক খান গিজাংবাবু।
তারপর প্রতিদিন বিকেলে বেশ মজার কাণ্ড শুরু হল। তখনও ছুটির সময় হয়নি–পড়াশুনো খুব জমে উঠেছে, হঠাৎ কোথাও ঘণ্টাটা বেজে ওঠে ঢং-ঢং করে। অমনি অভ্যাসে পাঠশালা থেকে ছেলেরা হইহই করে বেরিয়ে পড়ে। নিসিং পণ্ডিত আর বাবুল ছপটি তুলে সবাইকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কান ধরে সবাইকে বাকি সময়টা দাঁড়িয়ে শটকে আওড়াতে হয়।
প্রতিদিন এই কাণ্ড। বিকেল চারটে বাজলে ছুটির সময় নিসিং পণ্ডিত পকেট ঘড়ি বের করে আধঘণ্টা আগে থেকে সবাইকে সতর্ক করে দেন। খবরদার! দুকানে আঙুল গুঁজে পড়া মুখস্থ করো।
তাই শুনে আমরা সবাই দুকানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখি।
কিন্তু ঘণ্টাটা ঠিকই বাজে। অনেকক্ষণ ধরে বেজে তারপর থেমে যায় যেন হতাশভাবেই।
দিন কতক পরে মন্দিরের পথে বিকেলে বাড়ি ফিরছি একা। হঠাৎ দেখি মন্দিরের একপাশে বসে আছেন গিজাংবাবু। হুঁকো টানছেন, পাশে ঘণ্টাটা রাখা আছে। মুখটা গম্ভীর।
চলে আসব কিংবা ফিরে গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে খোঁজ দেব তাই ভাবছি। তখন একটু হেসে বললেন, কী খোকা? কেমন পড়াশুনো চলছে? কী বানান পড়াচ্ছে নিসিং?
বললুম, দীর্ঘ উকার।
হুঁকো নামিয়ে রেখে গিজাংবাবু বললেন, হুঁ, কই বলে দিকি ভূত বানান কী?
–ভয়ে দীর্ঘ উকার, তো, ভূত।
–কী বললে? ভয়ে দীর্ঘ উকার। ইভয়েই বটে। ভয়ের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আছে যে। তা অ খোকা, ভূত কখনও দেখেছ?
বিকেল পড়ে এসেছে। গাছপালার ভেতর পুরোনো মন্দির। গা ছমছম করে। একটু ভয় হল। বললুম, আজ্ঞে না।
ভয়ে দীর্ঘ ঊকার আছে বটে, ভূতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গিজাংবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, ভূত মানুষের মতোই দেখতে। কোও খায়। কথায় বলে না–অভ্যাস যায় না মলে। আমার অভ্যাস যায়নি। হুঁকো এখনও খাই। আর এই ঘণ্টাটার ওপর বড্ড লোভ ছিল। কেন জানোর নিসিংটার কাণ্ড দেখে। একদল বাচ্চা ছেলেকে সারাদিন খোঁয়াড়ে আটকে রেখেছে। এ কি তাদের ভালো লাগে? তাই ইচ্ছে করত, ঘন্টাটা পেলে আমি ঢং-ঢং করে ছুটি বাজিয়ে দিতুম।
আমি কিছু বুঝতে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলুম।
গিজাংবাবু হাই তুলে বললেন, বাড়ি যাও খোকা। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। তারপর আমাকে আরও অবাক করে পেছনে বটগাছটায় গিয়ে উঠলেন। ঘণ্টার দড়িটা কোমরে গোঁজা, হাতে হুঁকো। তারপর উঁচু ডালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজলেন। তারপর নাক ডাকতে বসলেন।
পণ্ডিতমশাইয়ের দাদার এরকম করে গাছে চড়ে ঘুমোনোটা আমার ভালো মনে হল না। ভাবতে-ভাবতে বাড়ি ফিরলুম।
পরদিন পাঠশালায় গিয়ে পণ্ডিতকে বলে ফেললুম ওঁর দাদার কথা। ভাবলুম ঘন্টাটা উদ্ধারের সূত্র পেয়ে উনি আমাকে পড়া বলতে না পারার শাস্তি কমিয়ে দেবেন।
কিন্তু শোনামাত্র খাপ্পা হয়ে নিসিং পণ্ডিত গর্জালেন, কান ধর! কান ধরে দাঁড়া হতচ্ছাড়া! অ বাবুল। এই বয়সেই কী জলজ্যান্ত মিথ্যে বলতে শিখেছে শুনছিস।
বাবুল ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে বলল, দু-ঘা ছিপটি।
আমি আঁতকে উঠে কেঁদে ফেললুম। বললুম, না পণ্ডিতমশাই! কাল বিকেলে আপনার দাদা…
মাটিতে ছিপটি ঠুকে নিসিং পণ্ডিত বললেন,–চোপরাও! দাদা একমাস আগে সানিপাতিক জ্বরে ভুগে মারা গেছে! তাকে গঙ্গার ধারে দাহ করে এসেছি। আর বাঁদর বলে কি না, তাকে মন্দিরে বসে হুঁকো খেতে দেখেছে। অ বাবুল, এই মিথ্যুকটা বড় হয়ে কী হবে বল দিকি?
বাবুল ভেতর থেকে বলল,–তিন ঘা ছিপটি।
যাই হোক, আর মন্দিরের পথে শর্টকাট করে পাঠশালা যাতায়াত সেই শেষ। তবে মাঝে-মাঝে পড়া মুখস্থ করতে করতে হঠাৎ তামাকের ভুরভুরে মিঠে গন্ধটা ভেসে আসত মন্দিরের দিক থেকে। আর যেন অবেলায় ঘন্টাটাও চাপা ঢং করে বাজত। আশ্চর্য ব্যাপার, আমি ছাড়া আর কেউ এসব টের পেত না।
কিন্তু ঘণ্টাটা শেষপর্যন্ত নিসিং পণ্ডিত ফেরত পেয়েছিলেন। শুনেছি গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসার পর একদিন মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টাটা কুড়িয়ে পান। শিবলিঙ্গের পেছনে লুকোনো ছিল। এবং কোটাও।
কারণ পিণ্ডি পেয়ে মানুষের আত্মা উদ্ধার হয়ে যায় বটে, কাঁসর-ঘণ্টা আর হুঁকোর যে আত্মা নেই। তাই তাদের পৃথিবীতে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
জটায়ুর পালক
সেদিন খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছি, পায়ে কুট করে যেন পিঁপড়ে কামড়াল। পা আলগোছে নাড়া দিয়ে ফের বইয়ের পাতায় ডুবে রইলাম। ভারি জমাটি গোয়েন্দা কাহিনি। গোয়েন্দা অফিসারকে বেঁধে ডাকাতরা বস্তায় ভরছে। এক্ষুনি সমুদ্রে ফেলে দেবে। কী হয় কী হয় অবস্থা। উত্তেজনায় আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে।
ফের কুটুস করে যেন পিঁপড়ের কামড়। এবার যেন গেঁয়ো পিঁপড়ে। বিরক্ত হয়ে থাপ্পড় মারতে গিয়ে দেখি, শ্রীমান ডন টেবিলের তলায় বসে এই কম্মটি করছে।
খপ করে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে তাকে বের করলুম। তারপর গর্জে বললুম,–তবে রে বাঁদর ছেলে! গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি!
ডন কাচুমাচু মুখে বলল,–অত যে ডাকলুম, তুমি তো শুনতেই পেলে না!
–তাই বলে তুই চিমটি কাটবি হতভাগা?
তোমার সঙ্গে যে আমার ভীষণ দরকার মামা! –ডন মুখে-চোখে কাকুতি মিনতি ফুটিয়ে বলল,–সত্যি বলছি, দারুণ দরকার!
ডনের দরকারে আমার সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। কারণ, তাহলে আর বইটি পড়াই হয়ে উঠবে না। পিঁপড়ের কামড় দিয়ে সবে তার জ্বালাতনের নমুনা শুরু। এরপর জানলা দিয়ে আস্ত ইটের টুকরো এসে পড়ারও চান্স আছে। যা বিচ্ছু ছেলে!
তাই বললুম, ঝটপট বলে ফেল তাহলে। দেরি কোরো না। দেখ না আমি এখন ব্যস্ত।
ডন তার পিঠের দিকের জামার ভেতর থেকে কী একটা টেনে বের করল। অবাক হয়ে দেখি, আন্দাজ ফুটখানেক লম্বা একটা সাদা-কালোয় চকরাবকরা পালক। জানলা দিয়ে উপচে আসা শেষবেলার রোদ্দুরে পালকটাতে ফিনফিনে সবুজ রঙও ঝিলমিলিয়ে উঠল একবার। ডন বলল, বলো তো মামা, এটা কোন পাখির পালক?
পালকটাও ওর হাত থেকে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললুম,–ঠিক বুঝতে পারছি না। সারস জাতীয় কোনও পাখির পালক হয়তো। এ তুই কোথায় পেলি রে?
ডন মুখ টিপে হাসল। বলতে পারলে না তো! মামা, তুমি রামায়ণের গল্প পড়োনি?
–রামায়ণের সঙ্গে এটার কী সম্পর্ক?
ডন ফিসফিস করে বলল, রাবণরাজা সীতাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই যে একটা পাখি এসে রাবণরাজার মাথায় করে দিল আর মুকুট পড়ে গেল–তখন রাবণরাজা মারল তলোয়ারের কোপ। এক কোপে পাখিটার ডানা কেটে গেল। কী যেন নাম পাখিটার, বলো না মামা? পেটে আসছে, মুখে আসছে না…
হাসতে হাসতে বললুম,–হুঁ–জটায়ু পক্ষী।
টায়ুর পালক
–পক্ষী না মামা, পাখি!
–বেশ তাই হল।
স্বীকার করে নিলুম। নইলে কথা বাড়বে। ডনটা যা তবাজ–তো, তুই কি বলতে চাস, এটা সেই জটায়ুর পালক-মানে, রাবণের তলোয়ারের কোপে যেটা কাটা পড়েছিল?
ডন রহস্যের ভঙ্গি করে বলল,–ঠিক বলেছ। সেজন্যই তো তোমার কাছে এলাম।
–ঠিক আছে। এখন যাও, আমি ব্যস্ত!
ডন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ধুস! এখনও আমার দরকারটা বলাই হয়নি। তুমি জিগ্যেস করো পালকক্টা কোথায় পেলুম!
তারপর সে আমার জিগ্যেস করার আগেই বলতে শুরু করল, পালটা পেয়েছিল হারু-গয়লা–ওই যার খাটাল আছে শিবমন্দিরের পেছনে। কোথায় পেল জানো? তার একটা গরু বেজায় দুষ্টু। চরতে-চরতে নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল। গরুটাকে খুঁজতে গিয়ে হারু পালকটা পেয়েছে।
–বুঝলুম। এবার এসো।
ডন গ্রাহ্য করল না। বলল,–এই পালটা যদি সুতো দিয়ে পিঠে বাঁধো মামা, তাহলে তুমি দিব্যি পাখির মতো উড়তে পারবে। দাও না মামা খানিকটা সুতো!
জানি, সুতো যেভাবে তোক জোগাড় করে দিতেই হবে। নইলে রেহাই পাব । কাজেই উঠতে হল। পাশের ঘরে ডনের দাদা শ্ৰীমান টমের ঘুড়ির লাটাই থেকে খানিকটা সুতো ছিঁড়ে আনতেই হল। টম এখন ক্রিকেট খেলতে গেছে। বাড়ি থাকলে কাজটা কঠিনই হতো।
ডন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, পালটা পিঠে বেঁধে দাও মামা। শক্ত করে বাঁধবে যেন। নইলে যদি খুলে যায়, পড়ে ছাতু হয়ে যাব।
কষে বেঁধে দিলুম ওর ডান কাঁধের কাছে পালকটা। তারপর ডন বলল,– এবার দেখ মামা, আমি উড়ে চললুম, রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…
সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তখন আমি ফের গোয়েন্দা কাহিনি পাতায় চোখ রাখলুম।…
ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এতদূর গড়াবে ভাবতে পারিনি। সন্ধ্যার মুখে টম ফিরে এসে যেভাবেই হোক টের পেল যে, তার লাটাইয়ের সুতো ছেঁড়া হয়েছে। খুব লম্ফঝম্প করে সে ডনকে খুঁজে বেড়াল। আলমারির পেছন, টেবিলের তলা, এমনকী খাটের তলা খুঁজে ডনকে পিট্টি দেওয়ার তাল করল। কিন্তু কোথায় ডন দিদি চেঁচামেচি করেও ছেলেকে শান্ত করতে পারলেন না। শেষে ওদের বাবার নামে শাসালেন। জামাইবাবু মফস্বল শহরের উকিল। কোর্ট থেকে ফিরে কোন ক্লাবে যেন দাবা খেলতে যান। ফেরেন রাত নটার পরে।
বেগতিক দেখে বললুম, উম! তোর সুতো ইঁদুরে ছিঁড়েছে। বাড়িতে কত ইঁদুর দেখতে পাসনে? থাম কালই একডজন বেড়াল এনে রাখব।
টম শান্ত হয়ে পড়তে বসল। এবার আমিই ডনকে খুঁজতে থাকলুম। টমের ভয়েই ডন নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে। বাড়ির চারধারে সবজি ও ফুলফলের বাগান। জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাগানে গিয়ে চাপা গলায় ডাকলুম,–ডন! ও ডন! বেরিয়ে আয়। অল ক্লিয়ার! তোর ভয় নেই। চলে আয়!
কিন্তু কোনও সাড়া পেলুম না। তাহলে কি পাশের বাড়ি ওর বন্ধুদের কাছে আছে? গিয়ে দেখি, সেখানেও নেই! গেল কোথায় ও? কাছাকাছি আরও কয়েকটা বাড়ি খোঁজাখুঁজি করলুম। কোথাও নেই। এবার একটু ভয় পেয়ে গেলুম। বাড়ি ফেরার মুখে নিশ্চয় টমের চেঁচামেচি শুনে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু কোথায়?
হঠাৎ মনে পড়ল নাদুবাবুর ছেলে ন্যাড়ার সঙ্গে ডনকে ঘুরে বেড়াতে দেখি। নিশ্চয় ন্যাড়ার কাছে আছে ও। নাদুবাবুর বাড়ি নদীর ধারে খেলার মাঠের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখি, ন্যাড়া তুষো মুখ করে পড়তে বসেছে। নাদুবাবু গম্ভীর গলায় ওকে মুখস্থ করাচ্ছেন, ক মূর্ধন্য ষয়ে টয়ে কষ্ট! জোরে-জোরে বল ক মূর্ধন্য ষয়ে… আমাকে দেখে মুখ নামিয়ে চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন,–কে হ্যাঁ?
–আমি জ্যাঠামশাই! ন্যাড়ার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
ন্যাড়ার সঙ্গে? খুব অবাক হয়ে নাদু সিঙ্গি অনেকটা হাঁ করে ফেললেন,–নেডুর সঙ্গে তোমার কী?
ঝটপট বললুম,–মানে ডনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই…
খাপ্পা হয়ে সিঙ্গিমশাই বললেন, বোলো না! ওই পাজি হতচ্ছাড়া ছেলেটার কথা আমায় বলতে এসো না?
–আজ্ঞে না জ্যাঠামশাই! আপনাকে বলতে আসিনি। ন্যাড়াকে জিগ্যেস করতে এসেছি।
–নেডু কিছু জানে না। দেখছ না এখনও পড়তে বসেছে? ওকে ডিসটার্ব কোরো না।
ন্যাড়া বইয়ের পাতায় চোখ রেখে পড়া মুখস্থ করার সুরে বলে দিল,-ডন জটায়ুর পালক পেয়েছে। ডন মাঠে উড়ে চলে গেল।
মাঠে! মানে খেলার মাঠে? –উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলুম। কিন্তু ও নেড়! উড়ে চলে গেল কী বলছ?
নাদুবাবু গর্জে উঠলেন, হয়েছে, হয়েছে। আর কোনও কথা নয়। কাজ নেই কম্ম নেই, রোজ খালি ডন ডন ডন। ডন ডন ডন ডন! হুঁ! উড়ে যাবে না তো কি হেঁটে যাবে? ভাগ্নের পিঠে ডানা গজিয়েছে যে। এবার চাদে গিয়ে বসে থাকবে।
হনহন করে খেলার মাঠে চলে গেলুম। তারপর যত জোরে পারি গলা ছেড়ে ডাকলুম, ডন! ডন! আচমকা একটা গাধা বিকট চেঁচিয়ে সাড়া দিল। পিলে চমকানো ডাক। আকাশে টোল-খাওয়া চকচকে উঁদ যেন মজা পেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। ঘাসে ভরা মাঠে জ্যোৎস্না ঝলমল করছিল। মাঠের শেষে নদীর ধারে পোড়া মন্দির ঘিরে একটা জঙ্গল। সেদিক থেকে ভেসে এল পেঁচার ক্রাও ক্রাও চেঁচানি। অমঙ্গলের ডাক! বুক কাঁপতে লাগল। ডনের কোনও বিপদ হয়নি তো?
এই রাতবিরেতে জঙ্গলটার দিকে পা বাড়াতে গা ছমছম করছিল। ভূত না থাকলেও ভূতের ভয়টা থাকে। কিন্তু ডন বেচারার জন্য তখন ভূতের সঙ্গে লড়াই করতেও তৈরি আছি। জঙ্গলের কাছাকাছি গিয়ে গলা ছেড়ে ফের ডাকলুম,–ডন! ডন!
এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কান্না-জড়ানো গলায় কেউ চি-চি করে সাড়া দিল যেন। আরও খানিকটা এগিয়ে ডাকলুম,–ডন! তুই কোথায়?
মাথার ওপর থেকে করুণ সুরে ডন বলল,–এই যে এখানে মামা!
–সর্বনাশ! তুই গাছের ডালে কেন রে?
নামতে পারছিনে মামা! –ডন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
রেগেমেগে ভেংচি কেটে বললুম, নামতে পারছিনে মামা! হতভাগা ছেলে! গাছে উঠতে গেলি কেন? উঠলি যদি নামতেই পারলিনে কেন?
ডন কান্না থামিয়ে বলল, আমি কি গাছে চড়তে পারি? জটায়ু পাখির পালক আমায় উড়িয়ে এনেছে না?
হাসতে হাসতে বললুম,–উড়ে-উড়ে নামলিনে কেন তাহলে?
গাছের ডালে লেগে পালকটা ভেঙে গেল যে! –ডন আবার চিকুর ছেড়ে কেঁদে উঠল।
–কই লাফ দে। তোকে ধরে ফেলব।
–পারব না।
–চেষ্টা কর বাঁদর! রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…
ডন মরিয়া হয়ে লাফ দিল এবং তাকে ধরে ফেললুম। তারপর ছায়াঢাকা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ মাথায় এল, তাই ত! ডন গাছটাতে চড়তে পারল কেমন করে? চড়তে পারলে নামতে পারাটা কি কঠিন হতো? বরং চড়াটাই কঠিন, নামাটা সোজা।
আমার গা শিউরে উঠল। তাহলে কি সত্যি পালকটার কোনও আশ্চর্য ক্ষমতা আছে? মাঠে জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে বললুম,–দেখি পালকটা!
সত্যি পালকটা ভেঙে গেছে। পস্তানি হল, পালকটা না ভাঙলে একবার আমি নিজে পরখ করে দেখতুম। কিন্তু কী আর করা যাবে।
হাঁটতে-হাঁটতে বললুম, এ্যারে বোকা! গাছ থেকে যে নামতে পারছিলিনে, চেঁচিয়ে কাউকে ডাকলিনে কেন? বুদ্ধি করে আমি না এলে সারা রাত্তির তোকে গাছের ভালে থাকতে হতো।
ডন এবার ফিক করে হাসল,–জানো মামা, রামু-বোপা ওর গাধার পিঠে কাপড় চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখে যেই ডেকেছি, ও রামুকাকা! আমায় নামিয়ে দেবে? অমনি রামু রাম-রাম বলতে বলতে গাধাটাকে ডাকিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল। আমি সন্ধ্যাবেলা গাছ থেকে ডেকেছি তো ভেবেছে ভূত! হি-হি-হি!
ডন খুব হাসতে লাগল। কথাটা কিন্তু ঠিক। ভাগ্যিস ডন আমার ভাগ্নে এবং তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। নইলে অন্য কেউ ওই পোডড়া মন্দিরের জঙ্গল থেকে ডাকলে আমিও বেজায় ভয় পেতুম না কি?
ডনকে সুতোর ব্যাপারে টমের কথাটা বললুম। তখন ডন বলল, সুতোগুলো খুল দাও মামা। শিগগির!
সুতো খুলে ফেলে দিলুম। ভাঙা পালকটা হাতে নিয়ে ফের আমার গা শিরশির করতে থাকল। বললুম,–পালকটা তাহলে সত্যি জটায়ুর! হারুর কাছে কত দিয়ে কিনেছিলি রে?
ডন আবার ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। জ্যোৎস্নায় ওর সাদা সরু দাঁতগুলো ঝিমিক করছিল। বললুম, হাসছিস যে?
ডন জবাব দিল না। গুলতির মতো হঠাৎ বোঁও করে ছুটে গেল। অদ্ভুত ছেলে তো! এমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পালকটার ওপর একটুও মায়া করল না দেখে অবাক লাগছিল।
কিন্তু হাসল কেন অমন করে? ভাঙা পালকটা পকেটে ভরে খুব ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে চললাম। হুঁ, ব্যাপারটা ভাববার মতো।…
জ্যোৎস্নায় মৃত্যুর ঘ্রাণ
কেকরাডিহাকে নেচারস ডেন বলা চলে।–ভদ্রলোক মিটিমিটি হেসে বললেন।
অপূর্ব মনোরম জায়গা কিন্তু…উনি হঠাৎ থেমে গেলে বললুম, কিন্তু কী? নামটা বড় বিচ্ছিরি। তাছাড়া…।
ওঁর কথার ঢংটিও বিচ্ছিরি। একটি বাক্য বলেই যেন সাসপেন্সের আলপিন দিয়ে একটু খোঁচা। বিরক্তি চেপে বললুম,–তাছাড়া কী?
একটু চুপ করে থাকার পর ফিক করে হাসলেননামেই মালুম। শেক্সপিয়ার যদিও বলেছেন নামে কী আসে-যায়! যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যায়। ট্রেন তখন একটা পাহাড়ের সুড়ঙ্গে সবে ঢুকেছে। গতিও মন্থর। কামরা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল।
অন্ধকারে ওঁর কথা অবশ্য থামল না,–এই যে দেখুন, আমি যাচ্ছি চরডিহায়। ঘন জঙ্গল এলাকা। সেখানে বসতি একেবারে কম। মানুষজনও কম। একটা কাঠগোলা। কিছু গোপ, মানে যাদের গরু-মোষ-ছাগল আছে আর কী! চাষবাস কদাচিৎ। খুব সজ্জন মানুস সব। তাহলে চোর শব্দটা কেন? হুঁ, মাঝে-মাঝে বাঘের উৎপাত হয়। এখন বাঘটাকে যদি গরুচোর বলা যায়, তাহলে আর কথা নেই। চোরডিহা নামটা মানিয়ে যায়। বলে উনি সেই ঘন জমাট অন্ধকারে হা-হা অট্টহাসি হেসে উঠলেন। এমন বিকট হাসি অন্ধকারে বড় অস্বস্তিকর। গা ছমছম করে।
বললুম, আলো জ্বালার ব্যবস্থা নেই ট্রেনে?
–মাত্র কয়েক মিনিট। এ সুড়ঙ্গটা তত কিছু লম্বা নয়। কেন? আপনার ভয় করছে নাকি?
–না। তবে অন্ধকারটর বিরক্তিকর। ট্রেনে কি ইলেকট্রিসিটি নেই?
–তাহলে কেকরাডিহায় যে বাড়িটাতে উঠবেন, সেটাও বিরক্তিকর মনে হবে।
–কেন বলুন তো?
মুনভিলায় আমিও একবার ছিলুম। ওখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। তাছাড়া বাড়িটা-বলে ফের উনি চুপ।
সাসপেন্সের খোঁচা মারা এঁর দেখছি বড্ড বদভ্যাস। বিরক্তিতে আর কিছু জানতে চাইলুম না। কিন্তু একটু অবাক হলুম। অরীন্দ্র বিদ্যুৎ না থাকার কথাটা বলেনি। হয়তো বলতে ভুলে গেছে। অরীন্দ্র আমার বন্ধু। রীতিমতো রাজা-মহারাজা লোকের বংশধর। বিশুদ্ধ প্রকৃতিকে এনজয় করতে হলে নাকি কেকরাডিহার মতো জায়গা নেই। ওদের মুনভিলা নামে বাড়িটা একটা টিলার গায়ে এবং চারদিকে প্রকৃতি! অরীন্দ্র বলেছিল এসব কথা।
ট্রেন সুড়ঙ্গ পেরুলে দিনের আলো এসে ঢুকল আবার। ভদ্রলোক তার লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হলেন। আসানসোলে এই ট্রেনে ওঠার পর ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। উনি শিকারি। নাম প্রশান্ত সিংহ। খুব আমুদে স্বভাবের মানুষ। বলেছিলেন, স্বয়ং সিংহ হয়েও সিংহ-টিংহ মারার সুযোগ পাইনি মশাই! গুজরাতের গির জঙ্গলে একদঙ্গল সিংহ আছে। কিন্তু একে হাঁদা-ভোঁদা, তায় গভমেন্টের পোষ্য। তবে বাঘ মেরেছি। ত্রিপুরার জঙ্গলে একটা গুন্ডা হাতি মেরেছিলুম। কাজেই নিজেকে সিংহ ভেবে গর্বিত হই।
চোরডিহার জঙ্গলে বাঘ আছে। সম্প্রতি একটা বাঘ খুব উৎপাত করছে। তাকে মারতেই উনি যাচ্ছেন। একটা শটগান আর একটা রাইফেল দুই কাঁধে আটকে প্রকান্ড ব্যাগ হাতে উনি দরজার দিকে এগোলেন। ট্রেন চোরডিহা স্টেশনের ডাউন সিগন্যাল পেরুচ্ছিল। ঘুরে মুচকি হেসে বিদায়সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন,–কেকরাডিহায় দেখা হতেও পারে। অবশ্য যদি বাঘটাকে মারতে পারি, তবেই। যাই হোক, একটু সাবধানে থাকবেন।
কথাটা শুনে চমকে উঠলুম। এবার সাসপেন্স নয়, শাসানি। কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ পেলুম না। শিকারি ভদ্রলোক ট্রেন থামার সঙ্গেসঙ্গেই নেমে প্ল্যাটফর্মে হস্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলেন। ওঁর শেষ বাক্যটি অস্বস্তিকর। তাছাড়া নামেই মালুম বলতে কী বোঝায়? মন থেকে অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছিলুম–তাছাড়া বাড়িটা… মানে কী? ভূতটুত আছে বুঝি! ধুস? মনে-মনে হেসে ফেললুম। এই মহাকাশযুগে ভূত!
ট্রেনের গন্তব্য গয়া। ফার্স্ট ক্লাসে আরও দুজন যাত্রী। চেহারা হাব-ভাব দেখে ব্যবসায়ী মনে হয়েছিল। হোঁতকা গোলা মানুষ। দুজনেই ঢুলছিলেন। আর একটা সুড়ঙ্গ এল। আবার সেই দম আটকানো অন্ধকার এবং গা ছমছম। কিন্তু এ সুড়ঙ্গটা শেষ হচ্ছে না। বারবার ট্রেনের তীক্ষ্ণ হুইল্প চাপা গুমগুম শব্দ, একটানা গাঢ় অন্ধকার, এসব সুড়ঙ্গে তো আলো থাকার কথা। ভাবলুম, চোরডিহার চোরেরা এসেই বাবগুলি খুলে নিয়ে গেছে, তা শিকারি ভদ্রলোক যাই বলুন। অথবা এলাকা এখনও বিদ্যুৎ পায়নি।
পাওয়ার কথাও না। পাহাড় আর জঙ্গল, জঙ্গল আর পাহাড় দুধারে। কাছাকাছি বসতিও চোখে পড়েনি। যদি বা পড়েছে, সেও নেহাত দেহাতি গ্রাম। আদিম ধরনের ঘরবাড়ি। মানুষজনও গরিব।
কতক্ষণ পরে সুড়ঙ্গ শেষ হল। আবার একটা স্টেশন এল। নিছক হল্ট। জনমানুষহীন নিচু প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু আমাকে অবাক করে পাখির মতো আলতো পায়ে এক যুবতী উঠে এল কামরায়। ছিমছাম স্মার্ট, ফর্সা, এবং এমন ফর্সা, যার সঙ্গে পাতাচাপা ঘাসই তুলনীয়, তাই পাণ্ডুর বলা চলে। জন্ডিসের রুগি নাকি? কক্ষনও না। ছটফটে, চঞ্চল, সতেজ। কালিদাস বর্ণিত সেই চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভি পীনোন্নতপয়োধরা ইত্যাদি মনে পড়ে যায়। পরনে ফিকে নীল শিফন জর্জেট শাড়ি ম্যাচিং চাইনিজ ছাঁট ব্লাউজ।
কামরা সৌন্দর্যময় সুগন্ধে ভরে গেল।
ব্যবসায়ীদ্বয়ের অবচেতনায় তার তীক্ষ্ণ বিচ্ছুরণ ঘটে থাকবে। কারণ দুজনেই চোখ খুলছেন এবং সোজা হয়ে বসলেন। জানলার দিকে ঘুরে আবার প্রকৃতি দর্শনে মন দিলুম।
–এক্সকিউজ মি! দ্রুত ঘুরে দেখি আমি তার লক্ষ্য। ভ্যাবার মতো হেসে বললুম,–বলুন!
–আপনি কি গয়া যাবেন?
–না। কেকরাডিহা।
–বাঃ! তাহলে একজন সঙ্গী পাওয়া গেল।
–আপনি কেকরাডিহা যাচ্ছেন? যুবতী ঠোঁটের কোণে হেসে মাথাটি একটু নাড়ল।
ব্যবসায়ীদ্বয়ের একজন বলে উঠলেন,–তো আপ হঁহা জংলি হল্টমে কাঁহা গেয়িথি ম্যাডাম?
জেরা সা ঘুমনে।–যুবতী আমার দিকে ঘুরল।–কেকারাডিহি কেন যাচ্ছেন?
প্রশ্নটা সোজা চার্জ। যেন মহিলা দাবোগা। তবু সৌন্দর্য এবং যৌবনের মর্যাদা রক্ষায় আস্তে-আস্তে বললুম,–জাস্ট সাইট-সিইং।
নেচার-লাভার! যুবতী উজ্জ্বল হাসল। বলতে পারেন, আমিও তা-ই।
–ও!
–ও কী? আমি প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিই মাঝে-মাঝে। কখনও বেরিয়ে আসি। ভয় পাই। দেয়ার ইজ সামথিং ভেরি ক্রুড ইন দা নেচার। দ্যাটস ডেঞ্জারাস। স্ট্রেঞ্জ! আপনাকে বোঝাতে পারব না।
এই দার্শনিক তত্ত্বটত্ত শুনে একটু সম্ভ্রম জাগল। শুধু বললুম,–তাই বুঝি?
একটু হেসে বললুম, আপনি স্কুলটিচার, নাকি অধ্যাপিকা?
–কেন এ কথা বলছেন?
এবার কণ্ঠস্বরে ঈষৎ নম্র ব্যাকুলতা ছিল। যেন সেন্টিমেন্টে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। বললুম,–আপনার চিন্তাভাবনার ডেপথ দেখেই।
যুবতী হাসল, ও নো নো! জাস্ট আ সিম্পল আইডিয়া। অ্যাসোসিয়েশন অব দা নেচার। আপনি একজন নিরক্ষর জংলি মানুষকে জিগ্যেস করুন। সেও বলবে, দা নেচার স্পিকস টু ম্যান। প্রকৃতি কথা বলে। যে কাছে থাকে, সে বোঝে।
–আপনার নামটা জানতে পারি কি?
–শিওর। পর্ণা চোধুরী।
একটু ইতস্তত করে বললুম, কেকরাডিহার মুনভিলার চৌধুরীদের সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই তো?
–আছে।
–অরীন্দ্র চৌধুরীকে তাহলে চেনেন?
–খু-উ-ব। আমার মাততুতো দাদা।
নড়ে উঠলুম, মাই গুডনেস! অরীন্দ্র আমার বন্ধু। আমি মুনভিলাতেই যাচ্ছি।
পর্ণা হঠাৎ ঠোঁট কামড়ে ধরল। আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে চাপা শ্বাস ফেলে বলল,–বাড়িটায় কেউ থাকে না আর। একজন আদিবাসী খ্রিস্টান কেয়ারটেকার রেখেছে। সে মাইনে নেয়! কিছু দেখাশোনা করে না। দূরে বসতি এরিয়ায় থাকে। আপনার অসুবিধে হবে।
–আপনাদের ফ্যামিলি…..
কথা কেড়ে পর্ণা বলল, একটা কথা, প্লিজ! কেয়ারটেকার ম্যাথু কিংবা অরুদাকে আমার কথা বলবেন না। প্লিজ, কথা দিন!
একটু অবাক হয়ে বললুম, ঠিক আছে। কিন্তু…
–কোনও কিন্তু নয়। কথা দিন।
–দিলুম।
ব্যবসায়ীদ্বয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন আর পরস্পর চোখে চোখে কথা বলছিলেন। বাঁকা ঠোঁট। ভাবখানা এরকম, যেন ওঁদের প্রাপ্য নাফা আমি হাতিয়ে নিয়েছি। কেকরাডিহা প্ল্যাটফর্মে ঢুকছিল। পর্ণা উঠে দরজার কাছে গেল এবং ট্রেন থামার আগেই পাখির মতো নেমে গেল। লাগেজ গুছিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে তাকে খুঁজলুম। দেখতে পেলুম না। ছোট্ট স্টেশন। মানুষজন কম। এদিকে-ওদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। স্টেশনের বাইরের চত্বরে কয়েকটা এক্কা আর সাইকেল রিকশা। ছোট্ট একটা বাজার।
কেয়ারটেকার ম্যাথু জেভিয়ারের থাকার কথা স্টেশনে। অরীন্দ্র চেহারার একটা বর্ণনা দিয়েছিল। রোগা, কালো, মাথায় ভীষণ সাদা চুল এবং মধ্যিখানে টাক। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, দাড়িটি নাকি কুচকুচে কালো। অরীন্দ্র বলেছিল,–ওকে মিঃ জেভিয়ার বলবি যেন। খুব কেতাদুরস্ত দিশি সাহেব, প্রাক্তন রেলকর্মী। সব সুব্যবস্থা করে দেবে খাতির দেখালে।
কিন্তু অরীন্দ্র তার মাসতুতো বোন পর্ণার কথা যেন বলল না? এতক্ষণে মনে হল, পর্ণা শিক্ষিত মেয়ে, কিন্তু একটু ছিটগ্রস্তা নির্ঘাত! হয়তো মানসিক রুগিই বা! তাই একা-একা যেখানে-সেখানে চলে যায়। জঙ্গলে ঘোরে। কিন্তু এ তো তার পক্ষে বড় বিপজ্জনক।
ফ্যামিলিতে কি ওকে শাসন করার কেউ নেই। নিশ্চয় নেই। কিংবা আছে। পর্ণা তাদের চোখের আড়ালে এভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাই আমাকে নিষেধ করছিল।
একটা সিগারেটের দোকানের সামনে যেতেই বাঁকের মুখে সাইকেলে একজনকে দ্রুত আসতে দেখলুম। কাছাকাছি আসতেই মনে হল, ম্যাথু জেভিয়ার না হয়ে যান না। ডাকলুম,–মিঃ জেভিয়ার!
হ্যাঁ, তিনিই। রীতিমতো ভদ্রলোক এবং দিশি সায়েব। স্যুট পুরোনো হলেও স্যুট। টাইটা অবশ্য নতুন। টুপিট জীর্ণ, সাইকেল থেকে নেমে জোরালো হ্যান্ডশেক করে বললেন,–ভেরি সরি স্যার! আপনার রুম গোছাতে একটু দেরি হয়ে গেল। রান্নার জন্য লোক খুঁজে সারা। তেমন কাউকে পেলুম না। ও নো, নো। ডোন্ট ওরি, স্যার! আমি আছি। আমি আপনার সেবা করতে পারলে ধন্য হব। তবে ভেরি লোনলি প্লেস! লোনলিনেস যাঁদের পছন্দ, তাঁরা মুনভিলাকে ভালো না বেসে পারবেন না। জাস্ট সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন!
জেভিয়ার একটু বেশি কথা বলেন, সেটা ঠিক। তবে মানুষটিকে ভালো লাগল।…
সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন! জেভিয়ারের মুখ থেকে উচ্চারিত পুরোনো এই বিলিতি প্রবচনটি মাথার ভেতরে ধ্বনিত হয়েছিল বাড়িটাকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই। সত্যিই কি মুনভিলা প্রতীক সাইলেন্স, সুবর্ণ মৌন। জীর্ণ স্থাপত্যটি সারা ধূসর শরীরে শব্দময়। যে ভাষা আমি বুঝি না, তেমনি এক আদিম কোনও ভাষায় যেন কথা বলছে। শুনছি, বুঝতে পারছি না।
আর পর্ণা বলেছিল–পা তুললেই ঘাস গজায়। প্রকৃতি সর্বগ্রাসী।
বাড়িটার সামনের দিকটায় কবেকার মেরামতের কিছু ছাপ। পেছনদিকটা প্রকৃতি গিলে খাচ্ছে। কার্নিশে গাছ। দেয়ালে হিংস্র শেকড়-বাকড়। তারপর জঙ্গল হয়ে ওঠা লনের দিকে তাকাতেই অস্বস্তি জাগল। প্রতিটি গাছ যেন ভীষণ জৈব। ক্রুর চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখছে।
অক্টোবরের শ্যামলা চারদিকে। সেই শ্যামলতাকে কেন যেন নির্দয় দেখাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে পেছনে কোনও আততায়ীর পায়ের শব্দ এবং মুখ ঘোরাতেই সে অশরীরী!
–স্যার!
জেভিয়ার এসে ডাকলেন।
হঠাৎ ডাকে চমকে উঠেছিলাম। জেভিয়ার বললেন, লাঞ্চ রেডি।
তারপর একটু হাসলেন, এনিথিং রং স্যার?
–না তো।
–আপনাকে তখন বলেছিলুম, লোনসিনেস কখনও অসহ্য হয়ে ওঠে। টেক ইট ইজি, স্যার।
–আচ্ছা মিঃ জেভিয়ার, এ বাড়িটার নাম মুনভিলা কেন?
জেভিয়ার আঙুল তুলে নিচের দিকটা দেখালেন, জাস্ট লুক অ্যান্ড ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড! ওই ছোট্ট নদীটা, স্যার! কী দেখছেন, বলুন!
–চন্দ্রকলার মতো। দা ক্রিসেন্ট মুন!
ঠিক তা-ই। জেভিয়ার বিনীতভাবে বললেন, যদি দয়া করে লাঞ্চ খেয়ে নেন, ভালো হয়। আমাকে একবার বেরুতে হবে কিছুক্ষণের জন্য।…
রান্নাটা বিলিতি ধাঁচের হলেও মন্দ নয়। খিদেও পেয়েছিল। জেভিয়ার চলে গেলে সেকেলে উঁচু খাটের ওপর শুয়ে পড়লুম। ট্রেনজার্নিতে যথেষ্ট ক্লান্ত। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। দরজা ভেজানো ছিল। সেটা কাঁচ শব্দে খুলে যাওয়ার জন্যই হয়তো ঘুমটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাকিয়ে রইলুম। বাইরে নরম বিকেল।
বাতাসের চাপেই কি দরজা খুলে গেছে? হুহু করে বাতাস ঢুকছে ঘরে।
তারপরই তীব্র সেন্টের আভাস পেলুম। ট্রেনে দেখা পর্ণার সেই সৌরভ! ঝটপট উঠে বসে বললুম,–পর্ণা নাকি?
বললুম নয়, মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। অথচ একই সুগন্ধ। ঝাঝালো, তীক্ষ্ণ। চটিতে পা গলিয়ে এবার নিজের ইচ্ছায় ডাকলুম, পর্ণা! পর্ণা! কারণ সে নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও এসে গেছে। খেয়ালি বা ছিটগ্রস্থ মেয়ে, তাই আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।
একধারে বাথরুম, অন্য দুদিকে দরজাবন্ধ আরও ঘর। পর্ণা কি বাথরুমে এসে ঢুকেছে? বাথরুমের দরজা ভেজানো। একটু ইতস্তত করে দরজায় চাপ দিলুম। খুলে গেল। কিন্তু কেউ নেই।
অথচ ঘরভরা দুর্দান্ত সৌরভ। আর ক্রমশ, এতক্ষণে সেই সৌরভ মেয়েদের চুলের ঘ্রাণের মতো আকর্ষণ করছে। চাপা আর আকুল কণ্ঠস্বরে আবার ডাকলুম, –পর্ণা! পর্ণা! সহসা সুগন্ধটা মিলিয়ে গেল। লজ্জিত বোধ করলুম। ছি-ছি! এ কী রূপান্তর আমার মধ্যে! সমস্ত ভব্যতাকে এই জীর্ণ পুরোনো বাড়িটাই কি ঘষে তুলে ফেলতে চাইছে আমার চেতনা থেকে? প্রকৃতি কি মানুষকে নিছক জৈব করে ফেলে?
বেরিয়ে গেলুম। হাল্কা গোলাপি রোদ্দুরের গায়ে নীলাভ ধূসরতার মতো কী এক রং। হয়তো এখনই কুয়াশা ঘনিয়ে আসছে। ঢেকে দিতে চাইছে ক্রুর ও ভয়াল বৃক্ষলতাকে।
তাদের জৈবতাকে বিষাদের আড়ালে সরিয়ে ফেলতে চাইছে। বিষাদ কথাটাই মনে এল। কারণ ততক্ষণে টের পেয়েছি, বাড়িটার জীবনে অনেক স্মৃতি আছে। তাই নস্টালজিয়ার বিষাদ আছে। গেটের দিকে এগিয়ে এলুম। ঢালু ঘাসে ঢাকা জমি নিচের নদীটিতে গিয়ে মিশেছে। তীব্র স্রোতের চাপা বিষণ্ণ শব্দ কানে এল। তারপর বাঁ-দিকে কিছুটা দূরে একটা গাছের তলায় আবিষ্কার করলুম পর্ণাকে! সে জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেঁচিয়ে ডাকলুম,–পর্ণা।
পর্ণা মুখ তুলে তাকাল। কোমল রোদ্দুরে তার সুন্দর দাঁতগুলি ঝিকমিক করে উঠল। গেট খুলে ঢালু সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে, আশ্চর্য, পর্ণা হঠাৎ গাছপালার আড়ালে উধাও হয়ে গেল! থমকে দাঁড়িয়ে গেলুম। তাহলে মেয়েটি সত্যি সাইকিক রুগি।
নিচে রাস্তার বাঁকে জেভিয়ারের টুপি দেখা গেল। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চড়াই ভাঙছেন। কাছাকাছি এসে বললেন,–গুড ইভনিং স্যার! এবং পুনশ্চ আগের মতো, এনিথিং রং?
আস্তে বললুম,-না।
চলুন। লনে চেয়ার পেতে দিচ্ছি, বসবেন বরং। সরি স্যার! ভালো চায়ের খোঁজে বেরিয়েছিলুম। হোপলেস! কেকরাডি ইজ গোয়িং টু ডাই ডে বাই ডে। নাথিং গুড এনিহোয়্যার। অল ফুল অফ দা এভিল! জেভিয়ার সকৌতুকে হাসছিলেন। তারপর আমি নিচে নদীর ধারে সেই গাছটার দিকে বারবার ঘুরে তাকাচ্ছি লক্ষ করে বললেন,–ওখানে শ্মশান। আর ওই যে ছোট্ট টিলাটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা খ্রিস্টিয়ান সিমেট্রি। আশা করি, আমাদের চার্চের ঐশও দেখতে পাচ্ছেন। ওই যে গাছপালার ফাঁকে।
পর্ণার কথা জিগ্যেস করতে গিয়ে পারলুম না। পর্ণা নিষেধ করেছিল বলেও না। গেটে ঢোকার মুখে আবার পিছু ফিরতেই নিচের দিকে ঝোঁপের আড়ালে পর্ণাকে দেখলুম। ঠোঠে আঙুল। ইশারায় জেভিয়ারকে দেখিয়ে হাত নেড়েছিল। তারপর আবার উধাও …
কিছুক্ষণ পরে লনে বসে চা খাচ্ছি। জেভিয়ার এসে কুণ্ঠিত মুখে বললেন, আমি দুঃখিত স্যার! আপনার ডিনার রেডি, রেখে যাচ্ছি। আপনাকে রাত্রে সঙ্গ দিতে পারছি না। আপনাকে একা থাকতে হবে। ও নো-নো! ডোন্ট ওরি, স্যার। আসলে আমার স্ত্রী অনেকদিন থেকে অসুস্থ। তাকে দেখাশুনোর লোক নেই।
–না না। আমি একা থাকতে পারব! আপনি ভাববেন না।
জেভিয়ার একটু হাসলেন,-খুব পুরোনো বাড়ি। পুরোটা মেরামত হয়নি। প্লাস্টার খসে পড়ার শব্দ শুনলে ভয় পাবেন না। পেছনকার ঘরগুলিকে ছুঁচো চামচিকেরা দখল করে ফেলেছে। রাত্রে ওরা উৎপাত করতে পারে। আর একটা কথা, কেউ ডাকলে যেন দরজা খুলবেন না।
–চোর-ডাকাত আছে নাকি?
–সে আর কোথায় নেই? তবে…এনিওয়ে, বাইরে যা কিছু ঘটুক, যেন দরজা খুলে বেরুবেন না।
–আচ্ছা মিঃ জেভিয়ার, জংলি জানোয়ার আছে নাকি ওইসব জঙ্গলে?
শেয়াল আছে। জেভিয়ার শিশুর মতো হাসলেন, অবশ্য ওই যে নদীর ওপারে টিলা, ওখানে নাকি একটা শম্বর আছে। রাত্রে ডাক শোনা যায়। আমি কিন্তু শুনিনি স্যার!
জেভিয়ার চলে গেলেন কিচেনের দিকে। দিনশেষের ধূসরতা ঘনিয়েছে। লনের ডানদিকে বিধ্বস্ত ফোয়ারা ঘিরে প্রকাণ্ড গুল্মলতা। আবছা একটা মূর্তি ভেসে উঠল সেখানে। পর্ণা! সঙ্গে সঙ্গে চাপাস্বরে ডাকলুম,–পর্ণা! পর্ণা! জেভিয়ার বুড়োর যেন জন্তুর কান। কিচেন থেকে সাড়া দিলেন, জাস্ট আ মিনিট স্যার। পর্ণা মুছে গেল অমনি।…
জেভিয়ার সাইকেলে চেপে চলে যাওয়ার পর পর্ণার প্রতীক্ষায় ছটফট করছিলুম। বারান্দায় বসে বারবার টর্চের আলো ফেলছিলুম। ভাবছিলুম, এবার ওকে দেখে প্রকৃতিকন্যা বলে সম্ভাষণ করব। তারপর মনে হল, সন্ধ্যার পর আর কি ওকে বাড়ি থেকে বুেরতে দেবে, অথবা বসতি থেকে দূরে এই মুনভিলায় রাতের দিকে কেনই বা সে আসবে? আমি তার প্রেমে পড়তেই পারি, সে কেন পড়তে যাবে?
নদীর ওধারে টিলার মাথায় কতক্ষণ পরে চাঁদ উঠল। কুয়াশা তার জ্যোৎস্নাকে নিষ্প্রভ করে দিল। নিচের দিকে একদল শেয়াল ডাকাডাকি করে সহসা থেমে গেল। একটা পেঁচা কাওকাঁও শব্দ করতে করতে মুনভিলার ওপর দিয়ে চলে গেল। ক্রমে টের পেলুম জীবজগতে সাড়া পড়ে গেছে। পোকামাকড় ডাকছে। কখনও মাথার ভেতর, কখনও পারিপার্শ্বিকে আশ্চর্য প্রাকৃতিক সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা। আর কোনও মৌন নেই, শুধু শব্দ। ধ্বনিময়তা। বৃক্ষলতা থেকে শিশির পড়ার শব্দগুলিও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু নির্জনতা বড় অসহ্য। পর্ণা যদি আসত।
আটটা বাজলে কিচেনে হ্যারিকেনের আলোয় ডিনার খেয়ে নিলুম। খাদ্যের ব্যাপারেও জেভিয়ার ব্রিটিশ ঐতিহ্যের পক্ষপাতী। তবে আমি একেবারে ভে্তো বাঙালি। কাল বরং ওঁকে বলব, ডাল-ভাত আর একটুকরো মাছই আমার জন্য যথেষ্ট।
কিচেন বন্ধ করে তালা এঁটে হ্যারিকেন হাতে আমার ঘরে ফিরলুম। সিগারেট টানতে-টানতে আবার পর্ণার প্রতীক্ষা! কোথাও রাতপাখি ডাকতে থাকল। দরজা বন্ধ করে হ্যারিকেনের দম কমিয়ে খাটের তলায় রেখে শুয়ে পড়লুম। জানালাগুলি খোলা রইল। বন্ধ করলে স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু বদ্ধ ঘরে শুতে পারি না। একটা পোডো বাড়িতে একা রাত কাটানো এই প্রথম। খালি গা ছমছম আর অস্বস্তি। অথচ পর্ণার কথা ভাবতেই কেন যেন মনে হচ্ছে, আমি একা নই।
মশার উপদ্রব। তাই মশারি আছে। চিত হয়ে শুয়ে যতবার অন্য কিছু ভাবতে যাচ্ছি, পর্ণা মনে এসে দাঁড়াচ্ছে। প্রকৃতিকন্যার লাবণ্য, আর সেই ঝাঝালো সৌরভ স্মৃতি যা সমস্ত জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে।
কতক্ষণ পরে কোথাও কোনও ঘরের ভেতর চাপা শব্দে চমকে উঠলুম। শব্দটা ধস্তাধস্তি কিম্বা শ্বাসপ্রশ্বাসের। জেভিয়ার বলেছিলেন, যেন না বেরোই। কিন্তু শব্দটা বাড়ছে। টেবিলচেয়ার পড়ে যাওয়া, কাঁচ ভাঙা, শ্বাসপ্রশ্বাসটার বাম্প্রয় হয়ে ওঠে। তারপর গোঙানি, ঘড়ঘড়। কী ঘটছে? হুড়মুড় করে উঠে বসলুম। ঘড়ঘড় শব্দটা মৃদু হয়ে আসছে।
আর চুপ করে থাকা অসম্ভব। চরম ধরনের আতঙ্ক মরিয়া করে তোলে খুব ভিতু মানুষকেও। তাছাড়া হঠাৎ মনে হল পর্ণা এসেছিল এবং তাকে অনুসরণ করে কোনও দুবৃর্ত ওর ওপর ঝাঁপ দিয়েছে। হিংস্র গর্জনের ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলুম, কে? কে?
তারপর টর্চ হাতে মশারি ঠেলে বেরিয়ে পড়লুম। ঘরের কোণায় একটা মরচে ধরা বল্লম দেখেছিলুম। বল্লমটা হাতে নিয়ে সেই শব্দটা কোন ঘরে থেকে আসছে জানতে কান পাতলুম। পেছনদিকের ঘর থেকে শব্দটা আসছে মনে হল। প্রচণ্ড জোরে লাথি মারলুম দরজায়। কপাটে মচমচ করে উঠল। দমাদ্দম লাথির পর একটা কপাট মড়মড় করে একপাশে ঝুলে গেল। ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো ফেলেই আমার মাথা ঘুরে গেল। রক্ত হিম হয়ে পড়ল। দম আটকে গেল।
পর্ণাই! পুরোনো আসবাবপত্রের স্তূপে হেলান দেওয়ার ভঙ্গিতে দুপাশে হাত ছড়িয়ে আছে। শ্বাসনালি ফাঁক। চাপচাপ রক্ত।
চিৎকার করতে গিয়ে দেখি, গলা থেকে স্বর বেরুচ্ছে না। তারপর সেই ঘরে সৌরভ সহসা ঝাঁপিয়ে এলে ধাতস্থ হলুম। হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরের দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় গেলুম। এখনই জেভিয়ারের কাছে যাওয়া দরকার।
কিন্তু তার বাড়ি তো চিনি না।
বস্তি এলাকায় বাজারে এখনও লোক থাকা সম্ভব। বারান্দা থেকে নামছি, তখনও শরীর পাষাণভার। পা টলছে। গলা শুকনো। এখন চারদিকের কুয়াশা ঝলমলে জ্যোৎস্নায় ফাই। কালোকালো বৃক্ষলতা আবার ভয়াল জৈব হয়ে উঠেছে। নিচের নদীর জলে জ্যোৎস্না, নদীটাও হিংস্র নিষ্ঠুর হাসছে। গেটের কাছে সহসা আবছা এক মূর্তি। পর্ণার আততায়ীই বা! মরিয়া হয়ে বম তুলে এগিয়ে গেলুম। পারিপার্শ্বিক নিষ্ঠুর হিস্রেতা মুহূর্তে আমাকে ভর করেছিল।
কিন্তু তার ওপর টর্চের আলো পড়তেই থমকে দাঁড়ালুম। ভুল দেখছি না তো? পর্ণা! এ তো পর্ণাই।
সে হাত তুলে চোখ আড়াল করে চাপাস্বরে বলে উঠল, আঃ আলো নেভান।
তাহলে শ্বাসনালি কাটা রক্তাক্ত কার শরীর দেখে এলুম? নিশ্চয় অন্য কাউকে দেখেছি। পর্ণা এগিয়ে এসে তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাসময় কণ্ঠস্বরে আবার বলল,–এমন করে কোথায় যাচ্ছেন?
–পর্ণা! তুমি পর্ণা তাহলে…
–তাহলে? তাহলে কী? হঠাৎ থেমে গেলেন যে?
–ওই ঘরে একটা ডেডবডি। জাস্ট নাও মার্ডার্ড! অবিকল তোমার মতো একটা মেয়ে।
অবিকল আমার মতো! –পর্ণার কণ্ঠস্বরে চিড় খেল। সে তো আমিই।
–পর্ণা! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এ হেঁয়ালির অর্থ কী?
পর্ণা আরও এগিয়ে এল। সেই তীব্র সৌরভ আবার। কিন্তু এই জ্যোৎস্নায় সৌরভের সঙ্গে আরও কী মিশে আছে। সুঘ্রাণটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। হিংস্রতর হচ্ছে। সে শ্বাসপ্রশ্বাসময় কণ্ঠস্বরে বলল, আপনা মাসে হরিণা বৈরী। তুমি চর্যাপদ পড়োনি?
-–পর্ণা! দোহাই তোমার, বুঝিয়ে দাও এর অর্থ কী?
–আমাকে কেউ ভালোবাসেনি। সবাই ভালবাসত আমার এই শরীরটাকে। তাই এখন এই শরীরটাই সাজিয়েগুছিয়ে সেন্ট মেখে ঘুরে বেড়াই। অথচ আমি চেয়েছিলুম, আমার আত্মাকে কেউ ভালোবাসুক।
–পর্ণা! পর্ণা তুমি…
চুপ! এখন আমি তোমার কাছে একটু ভালোবাসা চাইতে এসেছি। দেবে তুমি? –বলে সে আরও কাছে এগিয়ে এল। তারপর আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুহাতে জড়িয়ে ধরল আমাকে। কিন্তু কী অসহ্য হিম তার শরীর! নিষ্ঠুর হিম আর কামনায় হিংস্র শরীরের চাপে আমার দম আটকে গেল। প্রচণ্ড আতঙ্কে মাথা ঘুরে উঠল। মনে হল, অতল শূন্যে তলিয়ে যাচ্ছি।…..
স্যার-স্যার!–শুনে চোখ খুলে দেখি, জেভিয়ার আমার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে একটুকরো গরম পশমি কাপড়। আমার পায়ের তলায় সেঁক দিতে দিতে বললেন,-মর্নিংয়ে এসে দেখি আপনি লনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। হোয়াট হ্যাপেন্ড?
মিঃ জেভিয়ার! অতিকষ্টে বললুম, পর্ণা কে?
জেভিয়ার চমকে উঠে বললেন,–ও মাই গড। তারপর দ্রুত বুকে ক্রুশ আঁকলেন। একটু পরে আস্তে বললেন, শি ওয়াজ আ স্কুল টিচার। এই ফ্যামিলিরই মেয়ে। মুনভিলায় মায়ের সঙ্গে থাকত। হঠাৎ একরাত্রে খুন হয়ে যায়। সরি স্যার, শি ওয়াজ জাস্ট আ নটি লাভগার্ল! ওকে! ডোন্ট ওরি! আর আপনাকে এখানে থাকতে হবে না। আমি বরং অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।…
জ্যোৎস্নারাতে আপদ-বিপদ
ছোটমামার সঙ্গে পাশের গ্রামে যাত্রা শুনতে গিয়েছিলুম। যাত্রার আসর যখন হোভাঙল তখন অনেক রাত। ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছিল। ছোটমামা বললেন, এত রাতে আর বাস পাওয়া যাবে না। আয়, বরং হাঁটাপথে শর্টকাট করি।
পিচের রাস্তা থেকে ছোটমামার পিছন পিছন মাঠে নেমে বললুম,–পথ কোথায় ছোটমামা? আপনি যে হাঁটাপথ বলছেন?
ছোটমামা সবে গুনগুন করে কী গান ধরেছিলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন,–দিলি তো মুডটা নষ্ট করে! হাঁটাপথ বুঝিসনে? যেখান দিয়ে তুই হাঁটবি, সেটাই হাঁটাপথ। চুপচাপ চলে আয়।
নির্জন মাঠে হু হু করে বাতাস বইছে। এদিকে-ওদিকে দু-একটা গাছ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শনশন শব্দে ডালপালা দুলছে। ছোটমামার গানের মুডটা ফিরে এসেছে। এবার গলা ছেড়ে গান ধরেছেন। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সুরটা চেনা ঠেকছিল। ছোটমামা তাহলে যাত্রার আসরে শোনা বিবেকের গানই গাইছেন। একটু পরে আমরা একটা দিঘির পাড়ে পৌঁছলুম! অনেকগুলো তালগাছ সেখানে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাতাগুলো অদ্ভুত শব্দে নড়ছে। হঠাৎ কে ধমক দিয়ে বলে উঠল, কী হে ছোকরা, আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলে?
কেমন খ্যানখেনে গলার স্বর। ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, অদ্ভুত তো! ঘর ছেড়ে দিঘির পাড়ে ঘুমোতে এসেছ। কে হে তুমি?
–আবার তুমি বলা হচ্ছে? ভারি বেয়াদপ ছোকরা দেখছি।
ছোটমামা একটু ভড়কে গিয়ে বললেন, আপনি কোথায় ঘুমোচ্ছেন?
–তালগাছের ডগায়।
এতক্ষণে টের পেলুম, সামনে একটা তালগাছের মাথা থেকে কেউ কথা বলছে। ছোটমামা হাসতে-হাসতে বললেন, তালগাছের ডগা কি ঘুমোনোর জায়গা? ঘুম পেলে বাড়ি গিয়ে ঘুমোন।
–এটাই তো আমার বাড়ি।
–তার মানে?
–মানে আবার কী? যাও, বিরক্ত কোরো না। আবার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
বিকট হাই তোলার শব্দ শোনা গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ছোটমামা গোঁ ধরে বললেন,-এর একটা এসপার-ওসপার না করে যাব না। তালগাছের ডগায় কেউ ঘুমোতে আসে বলে তো শুনিনি। গাছের তলায় অবশ্যি অনেক মানুষকে ঘুমোতে দেখেছি। ও মশাই, শুনছেন?
–জ্বালাতন! শোনো হে ছোকরা, এখনই কেটে না পড়লে বিপদ হবে বলে দিচ্ছি।
ছোটমামার হাত ধরে টেনে বললুম,–আমার বড্ড ভয় করছে। চলুন ছোটমামা।
ছোটমামা রেগে গিয়ে বললেন,–তুই বড্ড ভিতু ছেলে দেখছি। ব্যাপারটা তোর গোলমেলে মনে হচ্ছে না? তালগাছের ডগায় কেউ ঘুমোতে আসে! লোকটা নিশ্চয় চোর। পুলিশের ভয়ে ওখানে লুকিয়ে আছে।
এবার ওপর থেকে হুঙ্কার শোনা গেল, কী বললে! কী বললে? আমি চোর? আমি পুলিশের দারোগা বংকুবিহারী ধাড়া। আমাকে চোর বলা হচ্ছে? রোসো, দেখাচ্ছি মজা।
তালগাছের ডগায় পাতাগুলো প্রচণ্ড নড়তে লাগল। এবার ছোটমামা হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। চাপাস্বরে বললেন, দরকার হলে দৌডুতে হবে। রেডি হয়ে থাক।
দৌড়নোর দরকার হল না। বংকুবিহারী পাড়ার কোনও সাড়া পাওয়া গেল না আর। কিছুটা চলার পর ছোটমামা বললেন,-ব্যাপারটা বড় রহস্যজনক। বুঝলি পুঁটু? আমার ধারণা, দারোগাবাবু কোনও চোরকে ধরার জন্যে ওখানে লুকিয়ে আছেন।
ছোটমামার কথা শেষ হওয়ামাত্র কে চাপাস্বরে বলে উঠল,–কোথায় লুকিয়ে আছেন দারোগাবাবু?
চমকে উঠে দেখি, সামনে একটু তফাতে কেউ সদ্য উঠে দাঁড়াল। জ্যোৎস্নায় চেহারাটা আবছা কালো। ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,–কে, কে?
–আজ্ঞে আমি।
–আমি মানে কী? তোমার নাম?
–নাম শুনে কী হবে? দারোগাবাবু কোথায় লুকিয়ে আছেন বলুন।
ছোটমামা কিছু বলার আগে আমি বলে দিলুম,–দিঘির পাড়ে একটা তালগাছের ডগায়।
অমনি ছায়া কালো লোকটা বলে উঠল, ওরে বাবা! আমি তো ওখানেই ঘুমোতে যাচ্ছিলুম। সর্বনাশ!
বলেই সে উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা হেসে ফেললেন,–এই লোকটাই চোর। বুঝলি তো পুঁটু? একে ধরার জন্যই দারোগাবাবু ওখানে ওত পেতেছেন।
বললুম,–কিন্তু উনি তো ঘুমোচ্ছেন বললেন! নিজের বাড়িও বললেন!
–ধুর বোকা! পুলিশের কথা ওইরকমই। আসল কথাটা বললে চলে? চোর সাবধান হয়ে যাবে না?
–কিন্তু শেষপর্যন্ত চোর সাবধান হয়ে গেল তো!
ছোটমামা গুম হয়ে বললেন, আমার কী দোষ? চোর যে এখানে লুকিয়ে আছে, জানতুম নাকি?
আবার দুজনে হাঁটতে থাকলুম। ছোটমামার গানের মুডটা চলে গেছে মনে হচ্ছিল। চুপচাপ হাঁটছেন আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। বরাবর দেখেছি, ছোটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে বেরোলে বড্ড গোলমেলে কাণ্ড হয়। আমার গা ছমছম করছিল। ছোটমামাকে এদিক-ওদিক তাকাতে এবং কখনও হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে কান ধরে কিছু শুনতে দেখছিলুম। তারপর বললেন,–শোন পুটু! কথাটা মনে আছে তো? দরকার হলে দৌড়নোর জন্য রেডি থাকতে হবে।
ভয়ে ভয়ে বললুম, আবার দৌড়তে হবে কেন ছোটমামা?
–কিছু বলা যায় না! সামনে কালোমতো যে গাছটা দেখছিস, ওটা জটাবাবার থান। একবার এমনি রাত্তিরে জটাবাবার পাল্লায় পড়েছিলুম। ওঃ! সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড।
আরও ভয় পেয়ে বললুম,-তাহলে ওখান দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ছোটমামা।
ছোটমামা পা বাড়িয়ে বললেন, আয় না দেখি কী হয়। সেবার আমি একা ছিলুম। এবার দুজনে আছি। জটাবাবা আমাদের ঘাঁটাতে সাহস পাবে না!
–জটাবাবা কে ছোটমামা?
–একটা বুড়োমতো লোক। মাথায় প্রচুর জটা।
–সে ওখানে কী করে?
–বললুম না ওখানে ওর থান আছে? দিনের বেলা লোকেরা এসে ওখানে মানত করে। ঢাকঢোল বাজিয়ে জটাবাবার পুজোও দেয়। তবে দিনের বেলা জটাবাবা কাকেও দেখা দেয় না।
–দিনের বেলা জটাবাবা কোথায় থাকে?
ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, চুপচাপ আয় তো, জটাবাবা শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি।
গাছটা প্রকাণ্ড। তলায় ঘন ছায়া। বাতাসে ডালপালা কেমন অদ্ভুত শব্দ করছিল। ছোটমামা আবার একটুখানি দাঁড়িয়ে গাছটাকে দেখে নিলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, রেডি স্টেডি, গো-ও।
ছোটমামার পিছন পিছন গাছটার তলায় যেই গেছি, আমার মাথায় কী একটা ঠেকল। চমকে উঠে হাত তুলে দেখি, একটা পা। বারণ ভুলে চেঁচিয়ে উঠলুম, ছোটমামা! ছোটমামা!
–ধ্যাত্তেরি! চ্যাঁচিচ্ছিস কেন? বললুম চুপচাপ চলে আয়।
–একটা পা বড় ঠান্ডা, ছোটমামা!
–চলে আয় না হতভাগা!
আমাকে যেতে দিচ্ছে না যে?—কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললুম। বরফের মতো ঠান্ডা একটা পা আমার গলা আঁকড়ে ধরে আছে। দু-হাতে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলুম। দম আটকে যাচ্ছিল।
ছোটমামা কাছে এসে বললেন, কই, কোথায় পা?
–আমার গলায়।
ছোটমামা সেই ঠান্ডা ঝুলন্ত পা ধরে টানাটানি শুরু করলেন। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। খুব জোরে পায়ে চিমটি কেটে দিলুম। অমনি পা টা গলা থেকে সড়ে গেল আর কে ওপর থেকে আর্তনাদ করে উঠল, উচ্ছ। গেছি, গেছি! কী বিষ্টু ছেলে রে বাবা!
আমিও সাহস পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম,–ছোটমামা! টানুন! দুজনে টেনে নামাই জটাবাবাকে।
ছোটমামাও ততক্ষণে সাহসী হয়ে উঠেছেন। দুজনে ঠান্ডা পা ধরে টানতে থাকলুম। জটাবাবা ঠ্যাং ঝুলিয়ে ডালে বসে থাকার বিপদ টের পেল এতক্ষণে। কাকুতিমিনতি করে বলতে থাকল,–ঘাট হয়েছে বাবারা! ছেড়ে দে! উঁহুহুহ, বড্ড ব্যথা করছে রে!
ছোটমামা পা ছেড়ে দিলেন। আমিও ছেড়ে দিলাম। তারপর ছোটমামা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, কী জটাবাবা! সেবার তো আমাকে একা পেয়ে খুব ভয় দেখিয়েছিলে? এবার আর ভয় পাচ্ছি না। কই নেমে এসো। দেখি তোমার কত বুজরুকি?
গাছের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না পড়েছে। ওপরের ডালে জটাবাবাকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। পায়ে হাত বুলিয়ে আহা-উঁহু করছে। মাথার প্রকাণ্ড জটা পুঁটুলির মতো দেখাচ্ছে। ছোটমামার চ্যালেঞ্জ শুনে কোনও জবাব দিল না! চিমটিটা খুব জোর হয়ে গেছে–তাহলে।
বললুম,–আমার ঘুম পাচ্ছে। চলুন ছোটমামা!
ছোটমামা বীরদর্পে হাঁটতে থাকলেন। বললেন,–তোর বুদ্ধি আছে পুঁটু! খুব জব্দ হয়ে গেছে জটাবাবা।
–জটাবাবার পা অত ঠান্ডা কেন ছোটমামা?
–ঠান্ডা হবে না? জটাবাবাকে তুই জ্যান্ত মানুষ ভেবেছিস নাকি?
চমকে উঠে বললুম, জ্যান্ত মানুষ নয়? তা হলে কী?
ছোটমামা চাপাস্বরে বললেন, বাড়ি ফিরে বলবখন। রাত-বিরেতে নিরিবিলি জায়গায় ওসব কথা বলতে নেই।
এবার ছোটমামার মনে সাহস জেগেছে। তাই যাত্রদলের বিবেকের সেই গানটা গাইতে শুরু করলেন। কিছুটা চলার পর হঠাৎ গান থামিয়ে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। বুঝলি পুঁটু?
–কী ভুল ছোটমামা?
ডান দিকে আঙুল তুলে ছোটমামা বললেন, ভুল করে কঙ্কালিতলায় ঝিলের ধারে এসে পড়েছি। এখানে কোথায় একটা শ্মশান আছে যেন। বড় বিপদে পড়া গেল দেখছি।
একটু ভেবে নিয়ে ঝিলের ধারে ধারে হাঁটতে শুরু করলেন। ঝিলের জল জ্যোৎস্নায় ঝিকমিক করছে। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কিছুটা চলার পর কারা কথা বলছে শোনা গেল। ছোটমামা বললেন,–মনে হচ্ছে, জেলেরা ঝিলে মাছ ধরতে এসেছে। আয় তো! ওদের কাছে রাস্তাটা জেনে নিই।
ঝোঁপঝাড়ের পর একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে একটা ঝুপসিকালো গাছ। তার তলায় কারা বসে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছে! কিন্তু যেই আমরা সেখানে গেছি, লোকগুলো, ওরে বাবা! এরা আবার কারাবলে চ্যাঁচিমেচি করে দৌড়ে উধাও হয়ে গেল।
ছোটমামা বললেন,-যা বাব্বা! আমাদের দেখে ওরা ভয় পেল কেন? আমরা মানুষ না ভূ-ভূত?
গাছটার তলায় গিয়ে দেখি, কে খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে। ছোটমামা চাপাস্বরে বললেন,–সর্বনাশ! এখানেই তো তাহলে কঙ্কালিতলার শ্মশান। ওরা একটা মড়া পোড়াতে এসেছিল।
মড়াটা দেখে গা ছমছম করছিল। গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মুখটা একপাশে কাত হয়ে আছে। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছোটমামা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে পা বাড়িয়েছেন, সেই সময় খাঁটিয়া থেকে মড়াটা বলে উঠল,–চিতা সাজানো হয়েছে?
ছোটমামা বললেন, ওরে বাবা। এ যে দেখছি জ্যান্ত মড়া! পালিয়ে আয় পুঁটু!
মড়াটা তড়াক করে উঠে বসে বলল,–পালিয়ে যাবেন না, পালিয়ে যাবেন! একা থাকতে আমার বড্ড ভয় করবে।
পুঁটু! রেডি স্টেডি গো! বলে ছোটমামা দৌড়তে শুরু করলেন।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছোটমামার পিছনে ছুটতে থাকলুম। কিন্তু বড় বিচ্ছিরি ঝোঁপঝাড়। কোথাও চষা খেতের মাটি গাদা হয়ে আছে! তার ওপর দৌড়নো কঠিন। বারতিনেক আছাড় খেলুম। ছোটমামা একবার থেমে পিছনে তাকিয়ে বললেন, সর্বনাশ! মড়াটা ছুটে আসছে যে!
মড়াটার আর্তনাদ শুনতে পেলুম, দাদা! আমাকে ফেলে যাবেন না!
আবার আমাদের দৌড়নো শুরু হল। এবার এসে পৌঁছলুম গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ির কাছে! ছোটমামা বললেন, আবার ভুল হয়ে গেছে রে পুঁটু! অন্য একটা গ্রামে চলে এসেছি মনে হচ্ছে। আয় তো এদের ডাকি!
কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর দরজা খুলে কে একজন বলল, কাকে চাই?
ছোটমামা বললেন,–দেখুন, আমরা বড় বিপদে পড়েছি। তাই…
–বিপদটা কী আগে শুনি?
–কঙ্কালিতলার শ্মশানের ওখানে একটা মড়া ছিল। হঠাৎ সে…
লোকটা ঝটপট বলল,–থাকারই কথা। আমাদের ছোটকর্তার মড়া। তা এখনও চিতেয় ওঠেননি বুঝি?
ছোটমামা চাপাস্বরে বললেন, আমাদের ফলো করে আসছিলেন ভদ্রলোক। বলছিলেন শ্মশানে ওঁর একা থাকতে বড্ড ভয় করবে।
–মলোচ্ছাই! আমাদের লোকগুলো কোথায় গেল? তারা ছিল না?
–ছিল তো! হঠাৎ ওখানে দেখে ওরা কেন যে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল!
লোকটা খি-খি করে হেসে বলল,–তা ভয় পাওয়ারই কথা। রাতবিরেতে কাকেও চেনা কঠিন। এই তো আপনাদের দেখেও আমি দিব্যি ভয় পাচ্ছি।
ছোটমামা জোরে হাত নেড়ে বললেন,–আমরা মানুষ! মানুষ! আমাদের ভয় পাবেন কেন?
–কিছু বলা যায় না মশাই! দিনকাল যা পড়েছে। কে জানে কে কোন রূপ ধরে ঘোরে।
ছোটমামা তার দিকে এক পা এগিয়ে বললেন, আপনি আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখুন। আমরা মানুষ। এই ছেলেটা আমার ভাগ্নে। আমি ওর মামা। আমরা যাত্রা দেখে বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তা ভুল করে এই অবস্থা। এই নিন, আমার হাতটা ঠান্ডা না গরম দেখুন। আমরা ভূত হলে হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা হবে।
ছোটমামা হাত বাড়িয়ে আর এক পা এগোতেই লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, হাত সরান! হাত সরান। ওরে বাবা! হাত বাড়িয়ে ঘাড়টি ধরে মটকাবার মতলব? বড়কর্তা? বড়কা! একবার আসুন তো!
হেঁড়ে গলায় বাড়ির ভেতর থেকে কেউ বলল, কী হল রে ভূতু?
লোকটা বলল,-কারা এসে গণ্ডগোল বাধাচ্ছে।
–দরজা বন্ধ করে দে।
আমাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ছোটমামা বললেন,–কোনও মানে হয়?
বললুম, চলুন ছোটমামা! অন্য কোনও বাড়ির লোক ডেকে জিগ্যেস করে নিই।
দুজনে হাঁটতে থাকলুম। আশেপাশের আর কোনও বাড়ি নেই। ঝোঁপজঙ্গলে আর উঁচু-নিচু সব গাছ বাতাসে দুলছে। একটু পরে আর একটা বাড়ি দেখতে পেলুম। ছোটমামার ডাকাডাকিতে বাড়ির ভেতর থেকে কে ঘুমজড়ানো গলার সাড়া দিল, কী হয়েছে?
ছোটমামা বললেন, দয়া করে একটু বাইরে আসবেন?
–না বাইরে যাওয়ার সময় নেই। আমি ঘুমুচ্ছি।
ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,–কোথায় ঘুমুচ্ছেন? এই তো দিব্যি কথা বলছেন।
–ঘুমুতে-ঘুমুতে কথা বলা আমার অভ্যাস।
–কী অদ্ভুত! আচ্ছা, ঠিক আছে। ঘুমুতে-ঘুমুতে বলুন, আমরা কনকপুর যাব কোন রাস্তায়?
–কনকপুর? সে আবার কোথায়?
–কনকপুর চেনেন না? বাসরাস্তার ধারে অত বড় গ্রাম।
–বাসরাস্তার ধারে তো কত বড়-বড় গ্রাম আছে।
ছোটমামা হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,–ভারি বিপদে পড়া গেল দেখছি। আচ্ছা, এ গ্রামের নাম কী?
জবাব এল তেমনি ঘুমজড়ানো গলায়, নাম একটা ছিল যেন। মনে পড়ছে না।
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন, আপনি দেখছি ভারি অদ্ভুত লোক। নাম ছিল মানে কী!
এবার জোরালো নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল। ছোটমামা খুব রেগে গেছেন। দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে শুরু করলেন। কপাট ভেঙে পড়ল মড়মড় করে। আমার ভয় করছিল ছোটমামার কাণ্ড দেখে। পাশের বাড়ির লোকেরা জেগে গিয়ে হইচই বাধায় যদি? রাতদুপুরে কারও বাড়ির দরজা ভেঙে ঢোকা কি ঠিক হচ্ছে?
কিন্তু ছোটমামা একেবারে মরিয়া। ভেতরে পা বাড়িয়ে বললেন,–আয় পুঁটু! লোকটাকে ঘুম থেকে জাগানো দরকার। ঘুমের ঘোরে মাথামুণ্ডু কী সব বলছে।
ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলুম, একটা লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার নাক ডাকছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমুতে পারে মানুষ? উঠোনে সাদা হয়ে জ্যোৎস্না পড়েছে। লোকটার নাক থেকে ঘড়র-ঘড়র শব্দ হচ্ছে। ছোটমামা তার গায়ে ধাক্কা দিয়েই পিছিয়ে এলেন। বললুম, কী হল ছোটমামা?
ছোটমামা চাপাস্বরে বললেন, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না, পুঁটু। লোকটার গা বরফের মতো ঠান্ডা!
আঁতকে উঠে বললুম,–চলে আসুন ছোটমামা!
ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন,–পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে রে। বরং এক কাজ করি আয়। ওই বারান্দায় দুজনে শুয়ে পড়ি। ভোরবেলা নিশ্চয় মানুষজনের দেখা পাব। তখন জিগ্যেস করে নেব।
উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে একজন ঘুমন্ত লোক, যার গা নাকি বরফের মতো ঠান্ডা এবং এই বাড়িটাও তার। এখানে ঘুমননা কি ঠিক হবে? কিন্তু ছোটমামা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বারান্দায়। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমারও খুব ঘুম পাচ্ছিল। শুয়ে পড়লুম শানবাঁধানো বারান্দায়। দুজনেই ক্লান্ত।
তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি।
ঘুম ভাঙল ছোটমামার ডাকাডাকিতে। চোখ খুলে উঠে বসলুম। তারপর খুব অবাক হয়ে গেলুম। এ কোথায় শুয়েছিলুম আমরা? ভোরের আলোয় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা বটগাছের তলায় শুকনো ন্যাড়া মাটিতে মামা-ভাগ্নে খুব ঘুমিয়েছি। কোথাও ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। শুধু জঙ্গল।
ছোটমামা বললেন,–হাঁ করে কী দেখছিস? রাতবিরেতে বেরুলে একটু গণ্ডগোল হয়েই থাকে। চল, বাড়ি ফিরি।
হাঁটতে-হাঁটতে বললুম,–রাস্তা চিনতে পারবেন তো ছোটমামা?
ছোটমামা করুণ হেসে বললেন,–দিনের বেলা আর ভুল হবে না। আমরা কোথায় চলে এসেছিলুম জানিস? কঙ্কালিতলার জঙ্গলে। প্রবলেম হল। রাতবিরেতে কিছু চেনা যায় না। চেনা জায়গাও অচেনা হয়ে যায়।
ঝড়ে-জলে-অন্ধকারে
সেবার ঝাঁপুইহাটি গ্রামে ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি C হয়েছিলুম। উদ্যোক্তা তরুণ সংঘ নামক ক্লাবের ছেলেগুলি খুব ভদ্র। তাই তাদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারিনি। কথামতো তারা গাড়ি এনেছিল। কলকাতা থেকে গাড়িতে চেপে ঝাঁপুইহাটি পৌঁছতে ঘণ্টা তিনেক লেগেছিল। সভা শুরু হওয়ার কথা পাঁচটায়। ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলুম।
গ্রামটি বনেদি, তা গাছপালার ফাঁকে অনেক পুরোনো একতলা-দোতলা বাড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। নতুন পাকা বাড়িও কম নেই। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন যেখানে করা হয়েছে, সেটা গ্রামের শেষ দিকটায় একটা ছোট্ট খেলার মাঠ। মাঠের একপ্রান্তে পুরোনো একটা মন্দির। অন্যপ্রান্তে একটা বিশাল বট গাছ। গ্রামের উৎসব পালা পার্বণ উপলক্ষে এখানে মেলাও বসে। ক্লাবের ছেলেরা আমাকে একথা জানিয়েছিল।
সুন্দর রঙিন প্যান্ডেল। সেখানে টেবিল-চেয়ার পাতা ছিল। পেছনে রবীন্দ্রনাথের একটা বড় ছবি। মাইকে এক যুবক ঘন-ঘন ঘোষণা করছিল,–মাইক টেস্টিং! হ্যালো! ওয়ান…টু…থ্রি! প্যান্ডেলের সামনে নিচে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা তুমুল চ্যাঁচিমেচি করছিল। তাদের পেছনে নানা বয়সি লোকের ভিড় জমেছিল। আমাকে প্যান্ডেলের পেছন দিকে চেয়ারে বসিয়ে একটি ছেলে কাচুমাচু মুখে বলেছিল,–চা খান স্যার! একটু দেরি হবে। আমাদের এলাকার জননেতা সবার প্রিয় পন্টুদা এলেই সভা শুরু করব।
একটু পরে মাইক্রোফোনে হিন্দি ফিল্মের গান শুরু হয়ে গেল। আমি তো অবাক। এ কী করছে এরা? অনুষ্ঠানের সভাপতি স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বললেন,–দেখছেন কাজ?
বলে তিনি ব্যস্তভাবে একটি ছেলেকে ডাকলেন।–ও অশোক! রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এ কী গান বাজছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে বলল।
অশোক ছুটে গেল মাইকওয়ালার কাছে। তারপর ফিরে এসে বলল, মাইকম্যানের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের টেপ নেই স্যার।
হেডমাস্টারমশাই বললেন,–তাহলে থামাতে বলো! ছ্যা-হ্যা! রবীন্দ্রনাথবে অপমান করা হচ্ছে যে!
অশোক আবার ছুটে গেল। নবীন সংঘের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে এল। বলল,–স্যার! মাইক বাজানো বন্ধ করলে লোক জমবে না। একটু ওয়েট করুন স্যার! এক্ষুনি পন্টুদা এসে গেলেই ওসব বন্ধ হয়ে যাবে।
অবশ্য মাঝে-মাঝে গান থামিয়ে এক যুবক ঘোষণা করছিল,–বন্ধুগণ! আজ আমাদের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে উপস্থিত হয়েছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হেরম্বকুমার ইয়ে, মানে–
একটি ছেলে খাপ্পা হয়ে তাকে চাপা গলায় বলে দিল, হেরম্বকুমার ঘাঁটি।
মাইকে কথাটা শোনা গেল। কিন্তু কী আর করা যাবে? আমার নাম হেমন্তকুমার হাটি। আঁপুইহাটিতে এসে হয়ে গেলুম কি না হেরম্বকুমার ঘাঁটি! যাই হোক, আবার হিন্দি গানের গর্জনে সব চাপা পড়ে গেল। কতক্ষণ পরে আলো জ্বলে উঠল প্যান্ডেলে এবং পেছনদিকের তেরপলে ঘেরা জায়গাতে। ঘড়ি দেখলুম। ছটা বেজে গেছে।
ছটা পনেরো মিনিটে হঠাং মাইক্রোফোনের গান থেমে গেল। সেই যুবকটি ঘোষণা করল,-বন্ধুগণ! আমাদের এরিয়ার বিশিষ্ট জননেতা শ্রীপণ–পণ-পঞ্চানন ঢোল মহাশয় আমাদের সবার প্রিয় নেতা পন্টুদা এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছেন। এখনই সভা শুরু হবে। মাননীয় প্রধান অতিথি সুসাহিত্যিক হেরম্বকুমার ঘাঁ-ঘা– ঘাঁটি মহাশয় এবং এই সভার সভাপতি হেডমাস্টার মহাশয় শ্রীঅহিভূষণ চ-চ-চট্টো সরি–চক্রবর্তীকে প্যান্ডেলে আসার জন্য অনুরোধ করছি।
যাই হোক, প্যান্ডেলে তো গিয়ে বসলুম। প্রথমে আমন্ত্রিত অতিথিবর্গকে মাল্যদান ঘোষণা করলে যুবকটিকে সরিয়ে আরেক যুবক ঘোঘাষণা করল, সবার আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে মাল্যদান করবেন আমাদের সবার প্রিয় পন্টুদা!
পন্টুদা বেঁটে মোটাসোটা মানুষ। গায়ে হাতকাটা ফতুয়া, পরনে ধুতি। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মাল্যদান করেই মাইকের সামনে চলে এলেন। করজোড়ে নমস্কার করে বললেন, বন্ধুগণ! তরুণ সংঘের প্রিয় তরুণদল! প্রধান অতিথি সাহিত্যিক মহাশয়! সভাপতি মহাশয়! এখনই বাবুগঞ্জের একটি অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হবে। তাই দুঃখের সঙ্গে বিদায় নেওয়ার আগে বিশেষ করে তরুণ সংঘের তরুণ দলের উদ্দেশে দুটো কথা বলে নিই। তোমরা তরুণ! তোমরা জাতির ভবিষ্যৎ! তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তোমাদের জন্য লিখেছেন,
‘ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণীতল অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল!’
সর্বনাশ! এ যে রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়। এই কবিতা বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত মার্চ সঙ্গীত। কেউ এঁকে বাধা দিচ্ছে না কেন?
হেডমাস্টারমশাই আমার দিকে তাকালেন। আমি তার দিকে তাকালাম। তারপর হেডমাস্টারমশাই ফিসফিস করে বললেন,–ওঁকে থামাও। ওঁকে থামাও।
কার সাধ্য পন্টুদাকে থামায়? বেঁটে মানুষ। একহাত মুঠো করে ওপরে তুলে গর্জন করে কবিতা বলছেন, বিশ্বকবি তোমাদের আরও বলেছেন–
‘…নব-নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান
আমরা দানিব নতুন প্রাণ…’
হ্যাঁ। আমাদের অজ্ঞাতসারে পন্টুদাকে থামানোর আয়োজন চলছিল। বিশ্বকবির জন্মজয়ন্তীতে এই উল্টোপুরাণ সে বরদাস্ত করবে কেন?
আচম্বিতে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। পরক্ষণে কড়কড়-কড়াৎ করে কানে তালা ধরানো মেঘ ডাকল। তারপরই প্যান্ডেল মচমচ করে উঠল। আবার বিদ্যুতের ঝিলিক। আবার মেঘ গর্জন। তারপর সব আলো নিভে গেল। কারা চেঁচিয়ে উঠল, পটুদাকে টর্চ দেখাও! টর্চ দেখাও!
তাঁকে কারা টর্চের আলো জ্বেলে ধরাধরি করে প্যান্ডেল থেকে নামাচ্ছে দেখলুম। ততক্ষণে এসে পড়েছে সে। তার নাম কিনা কালবোশেখি। প্যান্ডেলের তেরপল আর কাপড়ের সাজ নৌকোর পালের মতো উড়তে থাকল। প্যান্ডেলের বাঁশগুলো মচমচ শব্দে আর্তনাদ করতে লাগল। ওদিকে ছোট ছেলেমেয়েদের চিৎকার, কান্না, বয়স্কদের হট্টগোল–সব মিলিয়ে সে এক বিভীষিকা!
প্যান্ডেল ভেঙে পড়ার ভয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছিলুম। সভাপতি হেডমাস্টারমশাইয়ের আর্তনাদ শুনতে পেলুম, অশোক ও অশোক! আমি চাপা পড়ব যে!–
তারপর নিরাপদ দূরত্বে যেই পৌঁছেছি, শুরু হয়ে গেল চড়বড় শব্দে বৃষ্টি। কালবোশেখির ঝড়ের সঙ্গে জোরালো বৃষ্টি এসে প্রলয়কাণ্ড বাধাল।
মাথা বাঁচাতে বিদ্যুতের ঝিলিকে বটগাছটাকে দেখামাত্র ছুটে গেলুম। কিন্তু মুহুর্মুহু মেঘের হাঁকডাক, বিদ্যুতের ছটা আর বৃষ্টির দাপটে সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে ভরসা পেলুম না। বটগাছটার ডাল ভেঙে পড়তে পারে। বাজ পড়তেও পারে বটগাছের মাথায়। প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় খুঁজছিলুম।
সেই সময় গাছপালার ফাঁকে একটা একতলা বাড়ি বিদ্যুতই দেখিয়ে দিল। ভিজতে ভিজতে এবং ঝড়ের দাপটে কুঁজো হয়ে সেই বাড়ির দিকে ছুটে চললুম।
বাড়িটার সামনে বারান্দা আছে। কিন্তু বৃষ্টির বাঁকা তিরে সেখানে বিদ্ধ হচ্ছি। হঠাৎ দেখলুম, বারান্দার একপাশে একটা খোলা দরজা। মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়লুম ঘরে। অমনি কেউ খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল,-কে? কে?
বললুম, আজ্ঞে আমি।
–আমি কে? আমি কি মানুষের নাম হয় নাকি?
–আমার নাম হেমন্তকুমার হাটি।
–হাটি? এ পদবি তো আমাদের ঝাঁপুইহাটিতে নেই কারও। বাড়ি কোথায়?
–কলকাতা!
–অ্যাঁ? কলকাতার নোক এখানে কেন?
–আজ্ঞে, আমি এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এসেছিলুম। আমি একজন লেখক।
–লেখক? কী লেখেন?
অন্ধকারে কে কথা বলছে, তাকে দেখছে পাচ্ছি না। বিরক্ত হয়ে বললুম, গল্প লিখি।
–কীসের গল্প লেখেন, শুনি?
–ভূতের গল্প–
–কী? কী? ভূতের গল্প লেখেন?
একটু হকচকিয়ে গেলুম খ্যানখেনে বিদঘুঁটে গলার ধমকে। বললুম,–চোরের গল্পও লিখি।
–কী? কী? চোরের গল্পও লেখেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। মানেসব রকমের গল্পই লিখি।
খ্যাঁক খ্যাঁক করে অদ্ভুত হাসল লোকটা। এই বাড়ির কর্তাই হবে নিশ্চয়। সে কয়েকবার হেসে বলল, তা হেরম্ববাবু
–আজ্ঞে, আমার নাম হেমন্ত।
–এই হল! মাইকে তো অ্যানাউন্স করছিল হেরম্বকুমার–কী যেন? ঘাঁটি! যাকগে। তা ঘাঁটিবাবু, আপনি ভূতের গল্প লেখেন। চোরের গল্প লেখেন। কী করে লেখেন? কখনও ভূত দেখেছেন?
–আজ্ঞে না। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। কল্পনা করে লিখি। যেমন ধরুন চোরের গল্প। আমি নিজে কখনও চুরি করিনি। তবু কল্পনার জোরে চোরের গল্প লিখি।
এই সময় বাইরে থেকে কেউ ঘরে ঢুকল। বিদ্যুতের ঝিলিকে এক নিমেষে আবছা একটা লোককে দেখতে পেলুম মাত্র। সে বলল, খুড়োমশাই! কার সঙ্গে গল্প করছেন?
–কে রে? পাঁচু নাকি? কোথায় ছিলিস এই ঝড়-বাদলায়।
পাচু বলল, শ্মশানতলায় মড়াপোড়ানো দেখছিলুম খুড়োমশাই! ঝড়বৃষ্টিতে লোকগুলো বেচারা আধপোড়া মড়াটাকে ফেলে পালিয়ে গেল। মড়াটা আমাকে দেখতে পেয়ে কাকুতিমিনতি করতে লাগল। একটু কাছে থাকো না দাদা! কথায় বলে, একা
বোকা!
খুড়োমশাই সেই খ্যাক খ্যাক হেসে বলল,–তা তুই তাকে ফেলে চলে এলি যে?
–না, না। পালিয়ে আসা যায়? আধপোড়া মড়া। চিতার কাঠ ভিজে গিয়েছিল? তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছিলুম। হাঁটতে পারে না। ওই সে আসছে এতক্ষণে।
কথাবার্তা শুনে ততক্ষণে প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার বৃষ্টিভেজা শরীর অবশ হয়ে গেছে। এরা কারা? তাছাড়া এখনই যে-কোনও সময়ে শ্মশানের চিতা থেকে আধপোেড়া একটা মড়া এসে পড়বে! আমি দেয়াল ঘেঁষে একটু-একটু করে দরজার দিকে সরে যাচ্ছিলুম।
পাঁচু বলল,–এই লোকটা কে খুড়োমশাই?
খুডোমশাই বলল, কলকাতার এক লেখক। বলে কিনা ভূতের গল্প লেখে। চোরের গল্প লেখে। হেরম্ববাবু! এই দেখুন একজন চোর। এর নাম পাঁচু-চোর। খুব বিখ্যাত চোর ছিল পাঁচু।
বললুম,–ছিল মানে?
–ও পাঁচু! এই বুদ্ধি নিয়ে লেখক হয়েছে। কালজ্ঞান নেই। ছিল যে অতীত কাল, তাও বোঝে না! ছ্যাঁ-ছ্যাঁ!
বাইরে কেউ বলে উঠল, আরে কী আশ্চর্য! বন্ধুড়ো যে! লোকটা তো আমাকে বলল না এই বাড়িতে তুমি আছো?
–কে রে? কিনু নাকি? আয়, আয়। এই পাঁচু! তুই কিনুকে চিনতে পারিসনি? গাধা কোথাকার!
পাঁচু রাগ করে বলল, খুড়োমশাইয়ের সব ভালো। শুধু এই এক দোষ। গাধা বলা! এইজন্য কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে।
দরজা দিয়ে কিনু ঘরে ঢুকে পড়ল। সে বলল,–পাচু আমাকে চিনতে পারবে কী করে? আমিই বা পাঁচুকে চিনতে পারব কী করে? দশ বছর আগে কালুডিহির ঘোঁতনবাবুর ঘরে একসঙ্গে সিঁদ কেটে ছিলুম। তারপর আর দেখাসাক্ষাৎ নেই। ছিলে কোথায় হে পাঁচু?
আমার নাকে এবার সত্যি মড়াপোড়া কটু গন্ধ লাগল। আমি দরজা দিয়ে পালানোর তালে আছি। কিন্তু আধপোড়া কিনুর মড়া যদি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে?
খুড়োমশাই এই সময় আবার এ্যাক-এ্যাক করে বিদঘুঁটে হেসে বললেন, কী হেরম্ববাবু? লেখক হয়েছেন। ভূতের গল্প লেখেন। চোরের গল্প লেখেন। স্বচক্ষে কখনও ভূত আর চোর–মানে চোর আর ভূত একসঙ্গে দেখেছেন?
বললুম,–মনে হচ্ছে, এবার দেখলুম।
কিনু বলে উঠল, কী সর্বনাশ! বন্ধুখুড়ো করেছ কী? ঘরে লেখক ঢুকিয়ে বসে আছো? তুমি ছিলে তল্লাটের কুঁদে দারোগাবাবু! তোমার দাপটে চোরে-ভূতে আর ভূতে-চোরে একঘাটে জল খেত। ঘরে লেখক ঢোকালে সব ফাস করে লিখে দেবে
যে! লিখবে, পুলিশের দারোগা ছিল যে, সে কিনা চোরে-ভূতে আর ভূতে-চোরে এক করে আড্ডা দিচ্ছে।
বললুম,–বঙ্কুবাবু! আপনিও তাহলে অতীত কালে?
খুড়োমশাই সগর্জনে বললেন, আমার নাম বন্ধুবিহারী ধাড়া। আমাকে নিয়ে গল্প লিখলে দুহাতে হাতকড়ি পরাব। সাবধান!
–আজ্ঞে না লিখব না। তবে একটা কথা বুঝতে পারছি না। ওরা দুজনে অতীতকাল। আর আপনিও অতীতকাল। কিন্তু ওরা সিঁদেল চোর। আর আপনি পুলিশের দারোগা। এই চোর-পুলিশ একত্র হয় কী করে, একটু বুঝিয়ে দেবেন? তাছাড়া চোরের খুড়োই বা পুলিশ হয় কী করে?
পাঁচু আর কিনু হি হি হি হি করে হেসে উঠল। বকুখুড়োও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, ওহে লেখক! এটুকুও বোঝো না! তবে এই গানটা শোনো। বলে তিনি বিদঘুঁটে গলায় গান গেয়ে উঠলেন–
–হরি, ওহে দয়াময়!
এ ভব সংসারে চক্ষু মুদিলে
সবই একাকার হয়।।
পাঁচু অরা কিনু ধুয়া ধরল, হরি, ওহে দয়াময়।
এইবার পালানোর সুসময়। তিনজনে মিলে গান ধরেছে অন্ধকারে। আমি সেই সুযোগে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলুম। একটু দূরে টর্চের আলো জ্বলল। তখনও বৃষ্টি ঝরছে। তবে বাতাস কমেছে। ভিজে জবুথবু হয়ে সেই আলো লক্ষ করে ছুটে গেলুম। আমার ওপর টর্চের আলো পড়তেই কেউ বলে উঠল,–এই তো প্রধান অতিথি।
আরেক জন এগিয়ে এসে বলল, আরে! এ কী অবস্থা হয়েছে আপনার? ছিলেন কোথায়?
কাঁপতে কাঁপতে বললুম,–ওই একতলা বাড়িতে।
–কী সর্বনাশ! ওটা তো পোড়োবাড়ি। ওই বাড়িতে নাকি বন্ধুবিহারী ধাড়া নামে পুলিশের এক দারোগা থাকতেন। রিটায়ার করে মারা যান। তাই ওর ছেলেমেয়েরা এখন কলকাতায় আছে। কোনও ইয়ে-টিয়ে দেখেননি তো? মানে ভূ-ভূ
ঝটপট বললুম, না, না। বড্ড শীত করছে।
তারা ছাতার আড়ালে আমাকে নিয়ে চলল, মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, আর কখনও কোথাও কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে যাব না। রবীন্দ্রনাথের নামে নজরুল, দারোগা আর চোরের নামে ভূ-ভূ–
নাহ। কথাটা বলতে নেই। চেপে যাওয়াই ভালো।…
ডনের ভূত
সেদিন সকালে চোখ বুজে একটা রোমাঞ্চকর গল্পের প্লট ভাবছি এবং টেবিলে কাগজ-কলমও তৈরি, হঠাৎ পিঠে চিমটি কাটল কেউ। উঃ বলে আর্তনাদ করে পিছনে ঘুরে দেখি, ডন দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ধূর্ত এবং ক্রুর হাসির ছাপ। খাপ্পা হয়ে বললুম, হতভাগা ছেলে! দিলি তো মুডটা নষ্ট করে?
ডন আমার ভাগনে। মহা ধড়িবাজ বিচ্ছু ছেলে! তার মাথায় একটা কিছু খেয়াল চাপলেই হল। তাই নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে।
তা লাগুক আপত্তি নেই। কিন্তু প্রতিটি খেয়ালের সঙ্গে আমাকেও যে জড়াবে, এটাই হল সমস্যা। ওইরকম নিঃশব্দ হাসিটি হেসে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললুম,–বুঝেছি। টাকা চাই। কিন্তু এবার কী কিনবি? রামুর গাধা, না সোঁদরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার?
ডন ফিক করে হেসে অমায়িক ভদ্রলোক হল। বলল, না মামা! ভূত কিনব।
অবাক হয়ে বললুম, ভূত কিনবি? কোথায় পাবি ভূত? কে বেচবে?
ডন কাছে ঘেঁষে এল। টেবিলের কলমটা খপ করে তুলে নিয়ে বলল,–মোটে তিন টাকা দাম, মামা! যদি এক্ষুনি তিনটে টাকা না দাও, কী হবে বুঝতে পারছ?
বিপদ ঘনিয়েছে দেখে ঝটপট বললুম,–বুঝেছি, বুঝেছি। লক্ষ্মী ছেলের মতো আগে আমার কথার জবাব দে। ঠিক-ঠিক জবাব হলে তিনটে টাকাই পাবি।
–শিগগির বলে মামা! দেরি হলে গোগো ভূতটা কিনে ফেলবে।
–ভূত কার কাছে কিনবি?
–মোনাদার কাছে।
–মোনাদা মানে সেই মোনা-বুজরুক? মোনা ভূত কোথায় পেল?
–ঝিলের ধারে বাঁশের জঙ্গলে ফঁদ পেতে ধরেছে।
–তুই দেখে এলি?
–হুঁ। শিশির ভেতর ভরে রেখেছে। –মোনাদা বলল,–শিশির দাম পঞ্চাশ পয়সা আর ভূতটার দাম দু-টাকা পঞ্চাশ পয়সা। ইজ ইকোয়্যাল টু তিন টাকা।
হাসতে-হাসতে বললাম, বাঃ! অ্যাদ্দিনে অঙ্কে তোর মাথা খুলেছে দেখছি। তো ভূতটা দেখতে কী রকম?
ডন চটে গেল। –ভূত কি চোখে দেখা যায়? কই শিগগির টাকা দাও।–বলে সে কলমটা টেবিলে ঠোকার ভঙ্গি করল।
দামি কলম। তাই বেগতিক দেখে তিনটে টাকা দিলুম। টাকা পেয়ে কলমটা রেখে ডন গুলতির বেগে উধাও হয়ে গেল।
গল্পের মুডটা চটে গেল। মনে-মনে মোনার মুন্ডুপাত করতে থাকলুম। মোনা থাকে ঝিলের ধারে পুরোনো শিবমন্দিরের কাছে।
মোনার মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে একফালি গেরুয়া কাপড়, কপালে লাল তিলক আঁকা। সে নাকি তন্ত্রসাধনা করে। কারও কিছু চুরি গেলে মোনা নাকি মন্ত্রের জোরে চোর ধরিয়ে দেয়। অসুখ-বিসুখের চিকিৎসাও করে। তবে কথাটা হল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কাজেই যারা ওকে বিশ্বাস করে, তারা বলে মোনা-ওঝা এবং যারা করে না, তারা বলে মোনা বুজরুক। তবে লোকটাকে যত ভয়ঙ্কর দেখাক, ওপর পার্টির দুটো দাঁত নেই বলে যখনই হাসে, তাকে ভালোমানুষ মনে হয়। কিন্তু মোনা বুজরুক ডনকে ঠকাবে এবং ডন একটা ছোট ছেলে। এতেই মোনার ওপর খাপ্পা হয়েছিলুম। বড়রা বোকামি করে ঠকে। ছোটদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকানো ভারি অন্যায়। ভাবলুম, মোনাকে গিয়ে খুব বকে দিয়ে আসি।
কিন্তু ডন তক্ষুনি ফিরে এল। তার হাতে একটা ছোট্ট শিশি। শিশিটা দেখিয়ে সে খুশিখুশি মনে বলল,-গোগো টাকা নিয়ে গিছল মামা! মোনাদা ওকে দিল না। বলল, আগে আমি কিনব বলেছিলুম, তাই আমাকেই সে বেচবে।
সে টেবিলে শিশিটা রাখল। শিশিটার ভেতর কিছু নেই। বললাম,–হ্যাঁরে, এর ভেতর যে ভূত আছে, কী করে বুঝলি?
ডন বলল, আছে মামা! মোনাদা বলল, সন্ধ্যা হলেই দেখতে পাওয়া যাবে।
–ঠিক আছে। তা এই যে তুই ভূত পুষবি, ভূতকে কিছু খেতে দিতে হবে?
–হবে বইকী। ভূতেরা দুধ আর মাছ খায়। তাই খাওয়াব।
–কিন্তু খাওয়াতে গেলে যদি ভূতটা পালিয়ে যায়?
মোনাদা বলল, আবার ফাঁদ পেতে ধরে দেবে।
–ডন চাপা গলায় বলল, আমি একটু দুধ নিয়ে আসি মামা! তুমি যেন ছিপি খুলল না।
ডন দুধ আনতে গেল। আমি সেই সুযোগে শিশির ছিপি খুলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না। ছিপিটা খুলতেই বোটকা গন্ধ টের পেলুম। তারপর দেখি, জানলা গলিয়ে একটা বেড়াল লাফ দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
ব্যাপারটা এমন আকস্মিক যে, চমকে উঠেছিলুম। কালো বেড়াল তো এঘরে দেখিনি। বাড়িতেও কোনও কালো বেড়াল নেই। ওটা এল কোত্থেকে? কখন এ ঘরে ঢুকল? ছিপি খোলার পরই বা জানালা গলিয়ে পালাল কেন?
হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম একেবারে। সেই সময় ডনের আবির্ভাব হল। তার হাতে দুধের বাটি। সে দেখতে পেল আমি ছিপি খুলেছি। অমনি চিকুর ছাড়ল,–মামা! মামা! ছিপি খুললে কেন? তারপরই তার চোখ গেল জানালার ওধারে পাঁচিলের দিকে। পাঁচিলে কালো বেড়ালটা বসে কেমন জুলজুলে চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে।
ডন দুধের বাটি রেখে আমার হাত থেকে শিশি আর ছিপি ছিনিয়ে নিয়ে বেরুল। পাঁচিলের কাছে যেতেই বেড়ালটা লাফ দিয়ে ওধারে নামল। ডনকেও বেরিয়েও যেতে দেখলুম।
এবার জানি কী কী ঘটবে। আমার কাগজ ছিঁড়ে কুচিকুচি হবে। কলমটা গুঁড়ো হয়ে যাবে। আমিও প্রচুর চিমটি খাব। ডনের নখ যা ধারালো!
কাগজকমল সামলে রেখে আমিও পালানো ভূতটা ধরার ছল করে বেরিয়ে গেলুম। রাস্তার দাঁড়িয়ে ডন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সে কিছু বলার আগেই বললুম,–চল! আবার মোনা বুজরুকের কাছে যাই। সে কাঁদ পেতে পালিয়ে যাওয়া ভূতটাকে ধরুক। টাকা যা লাগে, দেব।
ডন কঁদো কাঁদো মুখে এগোল! খেলার মাঠ পেরিয়ে ঝিল। ঝিলের ধারে শিবমন্দিরের ওখানে ঘন জঙ্গল। সেখানে পৌঁছে ডাকলুম,–মোনা আছে নাকি! ও মোনা!
সাড়া এল জঙ্গলের দিক থেকে,–কে ডাকে গো?
মোনার গলার স্বর কেমন অদ্ভুতুড়ে। বললুম,–শিগগির একবার এসো তো এদিকে। একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে।
জঙ্গলের ভেতর থেকে মোনার জবাব এল। আমিও এক কেলেঙ্কারিতে পড়েছি। জায়গা ছেড়ে নড়ি কী করে?
অগত্যা মন্দিরের পেছনে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকলুম। বললুম,–তুমি আছোটা কোথায়?
–শ্যাওড়া গাছের ভেতরে।
শ্যাওড়া গাছটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলুম, মোনা গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে ডালপালার ভেতরে। আমাদের দেখে সে ফিক করে হাসল। ওপর পাটির দুটো দাঁত নেই। তাই তার হাসিটা বেশ অমায়িক দেখাল। বললুম,–ওখানে বসে তুমি কী করছ মোনা?
মোনা বলল,–ফাঁদে একটা পেতনি পড়েছে। শিশিতে ঢোকাতে পারছি না। বলেই সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,–এই যা! পালিয়ে গেল।
সে শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এল। হাতে একই সাইজের একটা শিশি। হাসি চেপে বললুম, ফঁদ থেকে পেতনি পালিয়ে গেল। আর ডনের শিশি থেকে ভূতটা পালিয়ে গেছে। শিগগির একটা জোগাড় করো।
মোনা বলে উঠল,–এঃ হে হে হে! সর্বনাশ! সর্বনাশ! খোকাবাবুকে অমন পইপই করে বলেছিলুম, সাবধান!
ডন কঁদো কাঁদো মুখে বলল,–মামা শিশির ছিপি খুলেছিল।
মোনা বলল,-ছোটবাবু! কাজটা ঠিক করেননি। খোকাবাবুকে যে ভূতটা বেচেছিলুম, সে খুব ঘোডড়ল ভূত। সে কে জানেন! পাঁচু। সেই পাঁচু-চোর।
পাঁচু নামে একটা চোর ছিল আমার ছেলেবেলায়। পাকা সিঁদেলচোর। কত বাঘা বাঘা দাবোগাবাবুকে সে নাকাল করে ছাড়ত। বুড়ো হয়ে সে মারা পড়েছিল অসুখ-বিসুখে। যাই হোক ডনের সামনে মোনার সঙ্গে ভূত নিয়ে তর্ক করা ঠিক নয়। বললুম,–যাই হোক, পাঁচুকে আবার ফাঁদ পেতে ধরে দাও।
ডন বলল,–মোনাদা! পাঁচু কালো বেড়াল সেজে পালিয়ে গেছে।
ভনের ভূত
কালো বেড়াল? –মোনা ভুরু কুঁচকে বলল,-। তাহলে তো বড় কেলেঙ্কারি হল। ঠিক আছে, দেখছি। ইঁদুর ধরে ফাঁদে আটকাতে হবে ওকে। এখন ইঁদুর পাই কোথা দেখি। কই, খোকাবাবু। শিশিটা দাও।
শিশিটা নিয়ে সে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল। গেল তো গেলই। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। একসময় হঠাৎ াও শব্দ শুনে দেখি, ঝোঁপের ভেতর থেকে সেই কালো বেড়ালটা মুখ বের করছে। দেখামাত্র ডন তাকে তাড়া করে গেল। তারপর আর তাকে দেখতে পেলুম না। কিছুক্ষণ তাকে ডাকাডাকি করে মন্দিরের পেছনে বটতলায় গিয়ে বসে পড়লুম।
সেই সময় দেখলুম, একটু দূরে বাঁশবনের ভেতর গুঁড়ি মেরে মোনা বাঘের মতো চুপিচুপি হাঁটছে। তারপর সে লাফ দিয়ে যেন কিছু ধরল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল,-এবার? এবার বাছাধন যাবে কোথায়? খোকাবাবু! ছোটবাবু! চলে আসুন।
সাড়া দিয়ে বললুম,–এই যে এখানে আছি।
মোনা আমাকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত শব্দে হাসতে-হাসতে চলে এল। ছিপি আঁটা শিশিটা আমাকে দিয়ে বলল,-এবার কিন্তু সাবধান। তা থোকাবাবু কোথায় গেল?
বললুম, কালো বেড়ালটা দেখতে পেয়ে ছুটে গেছে। তুমি খুঁজে দেখো তো ওকে।
মোনা বলল, সর্বনাশ! আপনি খোকাবাবুকে যেতে দিলেন? পেতনিটার পাল্লায় পড়লে বিপদ হবে যে!
সে হন্তদন্ত হয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। একটু পরে সে ডনকে নিয়ে ফিরে এল। বলল, আর একটু হলেই পেতনি খোকাবাবুকে ধরে ফেলত। পেতনিদের স্বভাব জানেন তো? ছেলেপুলে দেখলেই কুড়মুড় করে মুন্ডু চিবিয়ে খায়। আপনারা শিগগির চলে যান। আর একটা কথা, পাঁচুকে তেরাত্তির উপোস করিয়ে রাখবেন।
ডন এসেই আমার হাত থেকে শিশিটা ছিনিয়ে নিল।… ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু তা হল না।
রাত্তিরে ডন আমার কাছে শোয়! শিশিটা বালিশের পাশে রেখে সে ঘুমোচ্ছিল। আমি ঘুমুতে পারছিলুম না। সেই বেড়ালটার কথা ভাবছিলুম। আরও ভাবছিলুম পাঁচু চোরের কথা। পাঁচুকে একটু-একটু মনে পড়ে! লম্বা সিঁড়িঙে চেহারার লোক ছিল সে। মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কেউ যাতে চুল ধরে তাকে বেকায়দায় না ফেলে, সেইজন্য ওইরকম করে চুল ছাঁটত। শুনেছি, দুদে দারোগা বন্ধুবিহারী ধাড়া তাকে শায়েস্তা করেছিলেন। কিন্তু কথাটা হল, পাঁচু মরে কালো বেড়াল সেজে বেড়ায় কেন?
হুঁ, ওই যে কথায় বলে-স্বভাব যায় না মলে। মরার পরেও পাঁচু বেড়াল সেজে দুধ-মাছ-মাংস চুরি করে বেড়াচ্ছে না তো? তবে তার আগে দেখা দরকার, সত্যি ডনের শিশি থেকে কালো বেড়াল বেরোয় কি না। রাত্তিরটা ছিল জ্যোৎস্নার। জানলার বাইরে ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় চুপিচুপি বালিশের পাশ থেকে শিশিটা নিয়ে ছিপি খুলে দিলুম।
অমনি দেখলুম, ফের একটা কালো বেড়াল জানালা গলিয়ে পালিয়ে গেল। এবার আমার শরীর শিউরে উঠল। তক্ষুণি ছিপি এঁটে শিশিটা যথাস্থানে রেখে জানালায় উঁকি দিলুম। বেড়ালটা পাঁচিলে বসে নীল জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তক্ষুণি জানলা থেকে সরে এসে শুয়ে পড়লুম। নাহ! সত্যি তাহলে ভূত আছে।
সকালে উঠে শুনি, রান্নাঘরে চোর ঢুকেছিল। সকালের চায়ের দুধ রাখা ছিল। এক ফোঁটা নেই। নটার আগে গয়লা দুধ দিতে আসে না। জামাইবাবু–ডনের বাবা খুব বকাবকি করলেন দিদিকে। দিদি নাকি রান্নাঘরের দরজা-জানালা আটকাতে ভুলে গিয়েছিল। শুধু দুধ নয়, ফ্রিজ থেকে মাছ-মাংস সব নিপাত্ত হয়ে গেছে।
ডন ছোটছেলে। সে এ নিয়ে মাথা ঘামাল না। কারণ শিশির ভেতর বন্দি পাঁচুকে তেরাত্তির উপোস রাখতে হবে। কাজেই সে ছিপি খোলেনি। সে তো জানে না, আমি ছিপি খুলে এই কেলেঙ্কারিটি বাধিয়েছি। ডন ভেবেছে পাঁচু শিশির ভেতর রয়ে গেছে।
চুপিচুপি মোনার ডেরায় চলে গেলুম।
মোনা আজ তার ডেরাতে বসে চোখ বুজে তপজপ করছিল। ডেরা মানে মন্দিরের লাগোয়া একটা পুরোনো জরাজীর্ণ একতলা ঘর। জপ শেষ হলে সে চোখ খুলে আমাকে দেখে বলল,-পাঁচু পালায়নি তো ছোটবাবু?
হ্যাঁ। পালিয়েছে। আসলে আমারই বোকামি। মোনা, ডন এখনও জানে না আমি ফের ছিপি খুলেছিলুম।–বলে যা ঘটেছে, তার মোটামুটি একটা বিবরণ দিলুম।
মোনা গুম হয়ে গেল। একটু পরে বলল, ঠিক আছে। তিনটে টাকা ছাড়ুন ছোটবাবু। আমি পেতনিটাকে শিশিতে ভরেছি। আপনি বরং এই শিশিটা আপনার ভাগনেবাবাজির শিশির সঙ্গে পাল্টে ফেলুন। খালি শিশিটা আমাকে ফেরত দিন। আর হ্যাঁ, পেত্নি কিন্তু দুধ-মাছ-মাংস খায় না। একটু শুকনো গোবর আর হাড়গোড় এর খাদ্য।
তিনটে টাকা গচ্চা গেল। কী আর করা যাবে? বাড়ি ফিরে এক সুযোগে ডনের শিশিটা নিয়ে এই শিশিটা রেখে দিলুম ডনের পড়ার টেবিলে। ডন তখন স্কুলে।
মোনাকে খালি শিশিটা ফেরত দিয়ে এলুম। মোন আমাকে সাবধান করে দিল।
সে-রাত্তিরে আবার আমার মনে হল, সত্যি এই শিশির ভেতর পেতনি আছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার। ডন যথারীতি বালিশের পাশে শিশি রেখে ঘুমোচ্ছিল। শিশিটা চুপিচুপি তুলে নিয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁকে রেখে ছিপি খুলে দিলাম।
তারপর যা দেখলুম, ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল।
জ্যোৎস্নায় একটা সাদা কাপড়পরা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
সাহস করে টর্চ বের করলুম। টর্চ জ্বালাতেই মূর্তিটা আর দেখতে পেলুম না। চুপিচুপি দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, সাদা মূর্তিটা বাগানের একটা আম গাছে উঠে গেল। একটু পরে আম গাছের ডগায় তাকে দেখা গেল। সেখান থেকে উঁচু একটা বাজপড়া ন্যাড়া তাল গাছের মাথায় গিয়ে বসল। তারপর পাচার ডাক শুনলুম ক্রাঁও। ক্রাঁও!
টর্চের আলো ফেললুম। কিন্তু কিছু দেখতে পেলুম না। আমার চোখের ভুল নয় তো? টর্চ নেভালে সাদা কাপড়পরা পেতনিকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আলো জ্বালিয়ে পাচ্ছি না। ব্যাপারটা ভালোভাবে পরীক্ষা করা দরকার।
বাজপড়া তালগাছটার কাছে গিয়ে ফের টর্চ জ্বাললুম। কিন্তু জুলল না। সুইচ বিগড়ে গেল নাকি? টর্চ নাড়া দিয়ে এবং ব্যাটারি বের করে আবার ঢুকিয়ে অনেক চেষ্টা করলুম, টর্চ আর জুলল না। পেতনিটা বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে।
একটু পরে শুনি, গুনগুন করে মেয়েলিগলায় গান গাইছে সে।
‘এমন চাঁদের আলো
মরি যদি সে-ও ভালো
সে-মরণ স্বরগ সমান।‘
এবার আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হল না। চুপিচুপি ঘরের দিকে পা বাড়ালুম তারপর এক কাণ্ড ঘটল। ভীষণ ঠান্ডা কী একটা জিনিস আমার মাথার পেছনে চাটি মারল। মাথা যেন বরফ হয়ে গেল।
তারপর ঘরের দিকে যত এগোচ্ছি, বারবার তত চঁটি খাচ্ছি। টলতে-টলতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলুম। শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল মাথায় পেছনদিকে কী একটা আটকে যাচ্ছে। আঁতকে উঠে হাত দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিলুম। পেতনির হাত ভেবে সেটা মুঠোয় ধরে ঘরের আলো জ্বেলে দিলুম।
কী কাণ্ড! একটা চামচিকে।
চামচিকেটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এটা না হয় চামচিকে। সাদা কাপড়পড়া মূর্তিটা তো পেত্নি।
নাকি পেতনিটাই চামচিকেটাকে হুকুম দিয়েছে আমার মাথায় চাটি মারতে?
কে জানে বাবা! আর ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। ডন খালি শিশিতে পাঁচুর ভূত আছে ভেবে কিছুদিন শান্ত থাকবে। খামখেয়ালি ছেলে। তারপর এসব ভুলে যাবে। কাজেই আর এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।…..
যা ভেবেছিলুম হলও তাই। পরদিন বিকেলে ডন এসে আমার পিঠে চিমটি কাটল। বললুম,–আবার কী চাই?
ডন গম্ভীরমুখে বলল,-পাঁচুর ভূতটা গোগোকে বেচে দিলুম।
–ভালো করেছিস।
–মামা, দুটো টাকা দাও।
–আবার কী কিনবি?
ডন ফিক করে হেসে বলল,–ঘুড়ি প্লাস লাটাই প্লাস সুতো। তোমার দুই প্লাস গোগোর তিন। ইজ ইকোয়াল টু পাঁচ।
দুটো টাকা দিলুম। বললুম,–হ্যাঁ ঘুড়ি কেনো। সেটা ভালো। কিন্তু আর যেন ভূত কিনতে যেও না।
ডন গুলতির বেগে উধাও হয়ে গেল।…
ডাকিনীতলার বুড়ো যখ
আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বাগান, তারপর ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের মধ্যিখানে ছিল একটা বটগাছ। গাঁয়ের লোক বলত ডাকিনীতলা।
ডাকিনীতলা, তার মানে ওই ধূধু তেপান্তরের একলা দাঁড়ানো বটগাছটার দিকে দুপুরবেলা তাকিয়ে থাকতুম যদি ডাকিনীটাকে দেখতে পাওয়া যায়। রোদ্দুর চনমন করত মাঠে। জন নেই, মানুষ নেই। খাঁ-খাঁ চারদিক। কথায় বলে, ঠিকঠাক দুকুর বেলা, ভূতপেরেতে মারে ঢেলা। দুপুরবেলায় ভূতপ্রেত-ডাকিনীরা পাড়াগাঁয়ের গাছগুলিতে ওঁৎ পেতে থাকে কিনা। একলা-দোকলা গাছতলায় যেই