- বইয়ের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
গোঘ্ন
চারু মাস্টারের বেহালা শুনে দোলাই বড় কেঁদেছিল। দোলাই ছিল নরম মনের ছেলে। বলেছিল, আপনার যন্তরে কী জানি কী যাদু আছে, কলজে টাটায়। হেই মাস্টেরবাবু, আপনার বিটির বিভায় যত কুমড়ো লাগবে, হামি দিবো। যত কলাই লাগবে, তাও দিবো।
চারু মাস্টারের বিটির ফাগুন মাসে বিভা। দোলাই তার আগেই গাবতলার গোরে ঘুমোতে গেছে। নীচে ধু ধু পদ্মার জল ছুঁয়ে শেষ মাঘের হাওয়া এখন চারু মাস্টারের বেহালার সুরে বাজে। তাই শুনে ভাই হারাইয়ের মনে টান বেজেছিল। ফাগুন মাসে মাস্টোরের বিটির বিভা। যত কুমড়ো লাগে দেবে বলেছিল দোলাই। যত কলাই লাগে, তাও দিতে চেয়েছিল।
উঠোনের কোণায় বসে শালপাতায় ভাত খেতে খেতে হারাই ভাইয়ের কথা বলে। চারু মাস্টার মোড়ায় বসে গায়ে রোদ নেন। যে বিটির বিভা হবে, সে খঞ্জনীর মতো মিঠে স্বরে বলে—ও চাচা, লজ্জা কোরো না। পেট পুরে খাও।
বাঁ হাতের আঙুলে নাক ঝেড়ে পাছায় মোছে হারাই। মাথা নেড়ে বলে—খাছি মা, খুব খাছি। বড় মিঠা আপনারঘে রাঢ়দাশের ভাত।
ফাগুন মাসে বিভা। ভাঁড়ার ঘরে দু বস্তা কলাই, কুড়িটে বড় বড় কুমড়ো—ভিতরটা নাকি লাল বিরিং! এই সুখে আদী মেয়েটা খিলখিল করে হাসে।–ও চাচা! তোমাদের দেশের ভাত বুঝি তেতো?
হারাইও হাসে—দানাগুলান মোটা, বিটি রে! বাবাকে পুছো, হামারঘে দ্যাশে রাঢ়ী চালের ভাত খায় শুধু আমির-বড়লোকে। পুছো মাস্টেরবাবুকে, বিটি রে!
চারু মাস্টার চোখ বুজে ঝিমোচ্ছেন। তাঁর মেয়ে অবাক হয়ে বলে—তোমরা কী খাও চাচা?
–ইয়া মোটা মাসকলাই আটার লাহারি। ছাতু ভুজা। গেঁহু উঠলে দুটা মাস সুখ আম কাঁঠালের সঙ্গে গেঁহুর আটার চাপড়ি। বলে হারাই ফের নাকের ডগা মোছে। ভাত মাখো পরম নিষ্ঠায় সে মুখে তোলে, সাবধানে।
মেয়ে মুখে দুঃখ রেখে বলে-ভাত খাও না তোমরা, চাচা?
—অল্পস্বল্প খাই। আউষের ভাতা সেও মাসে আর ক’দিন? হারাই উজ্জ্বল মুখে পাঁচিল ঘেঁষে রাখা ধানের তিনটে বস্তার দিকে তাকায় একবার ফের বলে—বিটি রে! তুমারঘে দ্যাশের ধান লিতেই তো ফি বছর কষ্ট করে আসি। হামারঘে কষ্ট, জানোয়ারেরও কষ্ট। বাঁওয়ালি বলদটার হালগতিক খারাপ।
তার উজ্জ্বল মুখে দ্রুত ছায়া নামে। ভাঙা পাঁচিলের ও-পাশে নিমতলায় গাড়ি রেখেছে। বলদ দুটো দু চাকায় বাঁধা। চারু মাস্টার কিছু খড় দিয়েছেন তাদেরও কপাল হারাইয়ের কপালে বাঁধা। হারাই যখন আমন ধানের সুন্দর ভাত খাচ্ছে, তারাও কত সুখে নাড়া খড় চিবুচ্ছে। তবে বাঁয়েরটা রাত থেকে কেমন ঝিমন্ত। নাড়ির লক্ষণ গোলমেলে। পাকা রাস্তা থেকে এই গাঁয়ে ঢুকতে পা টেনে হাঁটছিল আর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছিল।
চোখ বুজে রেখে চারু মাস্টার বলে—এ গাঁয়ে গোবদ্যি নেই। একঘর বেদে ছিল, মরে হেজে গেছে। হারাই, তুমি সানকিভাঙার কাছে গাড়ি রেখো রেখে পিরিমল হাড়িকে ডেকে এনো। আমার নাম কোরো, কম পয়সায় কাজ হবে।
কান করে কথাটা শোনে হারাই। তারপর বলে—জী হ্যাঁ।
—জী হ্যাঁ না, অবশ্যি করে দেখিয়ে নিও। চারু মাস্টার এবার চোখ খোলেন। মোটাসোটা মানুষ। পিঠে কাঁচা-পাকা লোম। পুরু গোঁফা লুঙির ভেতর হাত ঢুকিয়ে জাং চুলকে বলেন, ফের —তোমরা বাঘড়ে গাড়োয়ানরা বড় আলসে মাইরি! দোলাইকে গতবার বললুম, দোলাই, পথেই ততা ইকরোল পড়বো ভুতু কোবরেজের কাছ হয়ে যাস দোলাই বললে যাবা পরে ভুন্দার সঙ্গে দেখা হল গিয়ে কাঁদির বাজারে জিগ্যেস করলাম। বললেন, না তো! তেমন কেউ যায় নি তো!
ভুতু কোবরেজের কাছে গেলে দোলাই মরত না, এ বিশ্বাস হারাইকে অস্থির করে। বাকি ভাতগুলো কোন রকমে গিলে সে এঁটো কুড়োতে থাকে। তারপর শালপাতাটা সাবধানে বাইরে নিয়ে যায়। রাস্তার ধারে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়। ও পাশে ছোট্ট পুকুর ঘাটে লোক আছে দেখে সে আঘাটায় নামে।
এটা হিঁদুর গাঁ। ছোঁয়াছুঁয়ির হালহদিস সবই জানে হারাই, সে দেশচরা মানুষ। এ গাঁয়ে মোছলমান থাকলে সে চারু মাস্টারের বাড়ি ভাত খেত না। তার কপালে নমাজ পড়ার ঘেঁটো ফতুয়ার পকেটে তালপাখার শিরে তৈরি একটা গোল টুপি আছে। পথেই সময় হলে গাড়ি বেঁধে রেখে সে নমাজ পড়তে ভোলে না। ছোট ভাই দোলাই প্রথম তার সঙ্গে এসে খুব ভড়কে গিয়েছিল। হেঁদুর বাড়ি খাবা? ও বড়ভাই, হেঁদুর বাড়ি খাবা? হেঁদুর বাড়ি খাবা? খালি ওই কথা। চোখ রাঙিয়ে হারাই ধমক দিয়েছিল—জান বাঁচানো ফরজ (অবশ্যপালনীয়) কাম, জানিস গে ছোকড়া? খালি বকর বকর! মুখে কুলুপ দেদিনি!
পরে যত বয়েস হল দোলাই পাকলা বড় শৌখিন ছেলে ছিল সো। চারু মাস্টারের গাঁয়ে আসার জন্যে প্রতি মাঘে আনচান করত মাঘে ঈশানদেবের চত্বরে শিবচতুর্দশীর মেলা শুরু। গাঁয়ের যাত্রা দল পালা গায়। চারু মাস্টার বেহালা বাজায়। তাঁর বেহালার সুরে কী যাদু, কলজে বড় টাটায়। চোখে ঘোর লাগো আর সামিয়ানার তলায় শব্দহাবা মানুষজন ঘিরে কী এক চিরকালের দুঃখস্রোত বয়ে যায়। মাস্টের গে, হেই মাস্টের! এ বড় যাদুর খেলা। নিশুতি রাতে নির্জন দূরগামী সড়কে ক্লান্ত পা-টেনে-চলা বলদের বোবা অবোলা চোখের কোণায় যেন চারু মাস্টারের বেহালার ছড়-টানা রেখা আর আতেলা ধুরির চারদিক ঘুরে ঘুরে কালের চাকার মতো এই গাড়ির দুই চাকায় সেই করুণ সুর নিরন্তর বাজে। মাঠ পারের গাঁয়ে হঠাৎ ঘুম ভাঙা মানুষজনের কানে ছড়িয়ে যায় হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো চাকা-গড়ানো গুরুগুরু গভীর গম্ভীর দূরের ধ্বনিপুঞ্জের সঙ্গে কোঁ কোঁ বেহালার সুর। মাস্টের গে, হেই মাস্টের! তুবি বড় যাদুকর এই বয়েসেই কী দুঃখু চিনিয়ে দিয়েছিলে পদ্মার কোলের এক আপনভোলা ছেলেকে। তাই নিয়েই সে গোরে ঘুমুতে গেল। …