- বইয়ের নামঃ অজ্ঞাত রচনা
- লেখকের নামঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
অন্তর্যামী
ভীমচাঁদ নিজের বাঁ হাতের উপর সজোরে ডান হাত চাপড়াইয়া তাহার ষোড়শী স্ত্রীর কাছে আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘মানুষের মুখের পানে চেয়ে যদি তার মনের কথাই না জানতে পারলুম ত এ দুটো চোখ বৃথাই রাখি! ওগো আমাকে ফাঁকি দেওয়া সোজা কাজ নয় !’
তাহার স্ত্রী বিনোদিনী, রাগ করিয়া বলিল, ‘ওই অহঙ্কারেই তুমি মাটি হয়ে গেলে! বরং, আমি ত বলি তোমাকে ঠকানোর চেয়ে সোজা কাজ আর এ পৃথিবীতে নেই।’
ভীমচাঁদ মহা অবজ্ঞাভরে হাসিয়া বলিল, ‘ভুল, ভুল, মস্ত ভুল! আমাকে দেখতে বোকার মত, কিন্তু, আসলে তা নয়! আমি একবার যাকে চেয়ে দেখব, তার পেটের কথা টেনে আনব, সে তুমি নিশ্চয় জেনে রেখো।’
‘রেখেচি’ বলিয়া বিনোদিনী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া শেষে উদাসভাবে বলিল, ‘আর পারলেই ভাল। তা ছাড়া আমার কি! তুমি স্বামী, খাওয়াবে পরাবে—যা ভাল বুঝবে কোরবে। কিন্তু, এই কথা আমিও বলে রাখলুম, তোমার নতুন মা তোমাকে ফাঁকি যদি না দেন ত আমাকে কুকুর বলে ডেকো।’
ভীমচাঁদ এক মুহূর্ত তাহার স্ত্রীর প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিল, ‘আচ্ছা’ আজই আমি তা জেনে আসচি। নতুন মা’র কি মতলব এক্ষণি ফিরে এসে যদি না বলতে পারি ত, আমার নাম ভীমচন্দ্রই নয়।’ বলিয়া সে বাটীর বাহির হইয়া গেল।
এইখানে একটু গোড়ার কথা বলিয়া রাখি। ভীমের পিতা শিবদাসবাবু সঙ্গতিপন্ন লোক। তাহার স্ত্রী, ছয় বৎসরের শিশু ভীমকে রাখিয়া স্বর্গারোহন করিলে, শিবদাস পত্নীশোক আর সহ্য করিতে না পারিয়া সেই মাসের শেষেই স্বগ্রামস্থা এক দরিদ্র বিধবার বয়স্থা কন্যা সুখদাকে বিবাহ করিলেন এবং মাতা ও কন্যা উভয়কেই নিজের সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত করিলেন। অতঃপর নিরতিশয় দুরন্ত ও অবাধ্য ভীমকে সংসারে রাখা একপ্রকার অসম্ভব হইয়া পড়িল। তাহার মাতুল সংবাদ পাইয়া ভীমকে লইয়া গেলেন, মানুষ করিলেন এবং যথা সময়ে বিবাহ দিয়া পাটের কাজে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।
তাহার পর বহু বৎসর গত হইয়াছে। বৎসর তিনেক পূর্বে ভীমচাঁদ পত্নী বিনোদিনীকে লইয়া বাটী ফিরিয়া আসে। কিন্তু , এবারেও এক পরিবারে বসবাস করার সুবিধা হইল না। বিনোদিনীর সহিত সুখদা ও তাহার মাতার, এবং ভীমের সহিত সুখদার তিন পুত্রের বনিবনাও না হওয়ায় বৃদ্ধ পিতা শিবদাস স্পষ্ট কথা বলিতে বাধ্য হইলেন। ভীম আলাদা বাসা ভাড়া করিল। তখনও সে বেশি কিছু উপার্জন করিতে পারিত না, তাই, একটু দুঃখে-কষ্টেই দিন কাটিতেছিল। আমি এই সময়ের ইতিহাসটাই বলিতে বসিয়াছি।
মাস-খানেক হইল শিবদাস সাংঘাতিক পীড়ায় শয্যাগত হইয়াছেন, তাঁহার জীবনের আশা নাই। ভীম, নিজের কাজকর্ম ফেলিয়া দিবারাত্রি পিতার সেবায় নিযুক্ত রহিয়াছে, শুধু সকালবেলায় ঘণ্টা-খানেকের জন্য নিজের বাসায় ফিরিয়া আসিয়া এ দিকের বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করিয়া যাইতেছে। জনশ্রুতি উঠিল, শিবদাস ভীমের অসাক্ষাতে এক উইল করিয়াছেন, তাহাতে জ্যেষ্ঠপুত্র ভীমের অংশে শূন্য পড়িয়াছে। এই দুঃসংবাদ বিনোদিনী লোকের মুখে শনিতে পাইয়া আজ সকালে স্বামীকে জানাইয়া দিল, এবং তাহারাই উত্তরে অন্তর্যামী ভীমচন্দ্র হাত চাপড়াইয়া আস্ফালন করিয়া কহিল, এমন একটা কাজ তাহার অসাক্ষাতে ঘটিলেও, সে তাহার বিমাতার মুখের দিকে চাহিবামাত্রই বিদিত হইত, কোনমতেই তাহার অগোচর থাকিত না।
ভীম দ্রুতপদে এ বাটীতে আসিয়া এঘর-ওঘর করিয়া সোজা রান্নাঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বিমাতা সুখদা তখন মৃতকল্প স্বামীর জন্য পথ্য প্রস্তুত করিতেছিলেন, ভীম ডাকিয়া বলিল, ‘মা শোন।’ সুখদা শ্রান্ত ক্লান্ত চোখ তুলিয়া চাহিলেন। ভীম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, ‘বাবা উইল করেচেন নাকি?’ সুখদা একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চিঁচিঁ করিয়া কহিলেন, ‘কি করে জানব বাবা, কি তিনি করেচেন? আমি ত দুঃখে কষ্টেই মারা যাচ্চি—আমার যা হচ্চে তা ভগবানই জানেন।’ ভীম একটুখানি নরম হইয়া বলিল, ‘শুনলুম তোমার মতলবেই উইল হয়েচে, আর তাতে আমার নামগন্ধও নেই।’ সুখদা চোখে আঁচল দিয়া অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলিলেন, ‘লোকে ত বলবেই। আমি তোমার সৎমা বৈ ত নই—বেশ ত, বাবা, তিনি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁকেই জিজ্ঞেসা কর না কেন?
ভীমের বুকের ভিতর হইতে সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গেল। বিমাতার কান্না ও কণ্ঠস্বরে আর তাহার লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, এ-সব মিথ্যা রটনা। সে তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘আমি বিশ্বাস করিনি, মা, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি কোন কথা কাউকে জিজ্ঞেস কত্তে চাইনে—এ সমস্ত মিথ্যে।’ বলিয়া সে বাহিরে চালিয়া গেল। পিতার ঘরে গিয়া আজ মরণাপন্ন পিতৃমুখের দিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মমতার সহিত চাহিয়া রহিল, তাঁহার নাড়ী দেখিয়া, পায়ে হাত বুলাইয়া দিল, একটু গরম দুধ পান করাইয়া দিল। এখন, সব কাজেই তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। বছর-তিনেক পূর্বে যেদিন পিতার স্পষ্ট কথায় সে স্ত্রীকে লইয়া গৃহত্যাগ করিয়া আলাদা বাসা করিয়াছিল, সেদিন পিতার উপর তাহার অত্যন্ত অভিমান হইয়াছিল। সেই অভিমানের জন্য এখন সে মনে মনে ক্ষমা ভিক্ষা করিল এবং মুখ ফিরাইয়া চোখের জল মুছিল। কিন্তু, এখানেও সে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিল না। স্ত্রীকে এই সুসংবাদটা না দেওয়া পর্যন্ত সে ত কিছুতেই সুস্থির হইতে পারে না। ঘরের বাহিরে আসিয়া চটি-জুতা পায়ে দিয়া ভীম চটপট শব্দে বাসার দিকে রওনা হইয়া পড়িল। বিনোদিনী তখন রাঁধিতেছিল, ভীম কবাটের সুমুখে দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল—’ওগো, শুনচ?’
বিনোদিনী চোখ তুলিয়া কহিল, ‘আবার কি?’
ভীম একগাল হাসিয়া ফেলিয়া বলিল—’মিথ্যে মিথ্যে, সব মিথ্যে।’
‘কি মিথ্যে?’
‘এই তোমার উইল করার কথা। বললুম তোমাকে, একি হতে পারে? সারাদিন আমি ও বাড়িতে আছি, আমাকে ফাঁকি দেবে কে? আমি জানতে পারলুম না, আর জানলে যত পাড়ার লোকে?’
বিনোদিনী স্বামীর কথা বিশ্বাস করিল না, প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কি জেনে এলে তাই বল না?’ ভীম তেমনি আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘মিথ্যে তাই জেনে এলুম। একটা সম্ভব-অসম্ভব আছে ত! এ কি হতে পারে আমাকে ফাঁকি আর আমি জানলুম না!’ বিনোদিনী নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। ভীম বলিতে লাগিল, ‘গিয়েই বললুম, ‘মা শোনো’—তিনি মুখ তুলতেই আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে রইলুম। ওগো, এটা আমার ঈশ্বরদত্ত শক্তি—যে কোন মানুষ হোক না, তার চোখ দেখে আমি মনের কথা ছাপার অক্ষরের মত পড়ে ফেলতে পারি। পড়েও ফেললুম।’ বিনোদিনী একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বেশ করেচ। আমি বলি বুঝি, সত্যই কিছু জেনে এসেচ।’
ভীম ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া জবাব দিল, ‘আবার সত্যি কি হবে শুনি? উইল হল, আমি জানলুম না, মা জানলেন না আর জানলে এখানে বসে তুমি? মা আমার কেঁদে ফেলে বললেন, বাবা, আমি সৎমা বলেই—আবার কি চাও তুমি?’ বিনোদিনী আর তর্ক করিল না। সে স্বামীকেও চিনিত, তাঁর বিমাতাটিকেও চিনিত। আর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘হলেই ভাল। আচ্ছা, যাও তুমি স্নান করে এসো, আমার রান্না হয়ে গেছে।’
ভীম, স্ত্রীর ভাব দেখিয়া বুঝিল, সে কিছুই বিশ্বাস করে নাই। তাই ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, ‘আমার কথায় তোমার বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় পরের কথায়। আচ্ছা, তখন টের পাবে—কিন্তু, আমি ত এখানে খেতে পারব না—আমাকে এখনি ফিরে যেতে হবে ‘ বলিয়া ভীমচাঁদ যেমন করিয়া আসিয়াছিল, তেমনি করিয়া চটি-জুতার পটাপট শব্দ করিয়া বাহির হইয়া গেল।
পিতৃশ্রাদ্ধ ভীমচাঁদ মহা আড়ম্বরে সম্পন্ন করিল। সদ্য বিধবা সুখদা কাঁদিয়া কাটিয়া জানাইলেন, লোহার সিন্দুকে কিছু নাই। ভীমচাঁদ জ্যেষ্টপুত্র, সুতরাং সমস্ত কর্তব্য তাহারই, সে স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিয়া, এবং এক পাটের মহাজনের নিকট খত লিখিয়া দু’ হাজার টাকা কর্জ করিয়া সমস্ত ব্যয়ভার নিজেই বহন করিল। শ্রাদ্ধ-শেষে রেজেস্ট্রি-করা উইল বাহির হইল, উকিল সর্বসমক্ষে পড়িয়া শুনাইলেন। তাহাতে শিবদাসবাবু, দ্বিতীয় পক্ষের তিনটি ছেলেকেই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি তিন সমান ভাগে দিয়া গিয়াছেন, ভীমের ভাগ্যে এক কানাকড়িও নাই। ভীম শুষ্ক মুখে অধোবদনে বসিয়া রহিল।…
একটি অসমাপ্ত গল্প
আচ্ছা, জ্যাঠামশাই?
কেন মা? বলিয়া গোবিন্দ মুখুয্যে ভাগবত হইতে মুখ তুলিয়া পরম স্নেহে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রীর দিকে চাহিলেন।
সুরমার দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল। হাত দিয়া একগোছা কালো চুল মুখের উপর হইতে পিঠের দিকে সরাইয়া দিয়া মহা অভিমান ভরে অভিযোগ করিল,—আচ্ছা, সাহেবরা যদি এতই পারে তবে কেন তারা দাঁড়কাকগুলো সব মেরে ফেলে না? বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
গোবিন্দ ব্যাপার বুঝিয়া সুরমাকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিলেন। বাটীর ভিতরে তাঁহার স্ত্রী দুরারোগ্য পীড়ায় শয্যাগত,—মরণাপন্ন। এবং এইমাত্র চিলের ছাদে বসিয়া একটা দাঁড়কাক অতি কর্কশ কণ্ঠে খাখা করিয়া চীৎকার করিতেছিল।
সেটাকে তাড়াইয়া দিয়া সুরমা অত্যন্ত বিরক্ত ও ভীত হইয়া জ্যাঠামশায়ের কাছে জানিতে আসিয়াছিল—কি জন্য সরকার বাহাদুর এত ক্ষমতাশালী হইয়াও এই ভীষণ অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিতেছেন না।
খানিক পরে গোবিন্দ একটুখানি শুষ্ক মলিন হাসি হাসিয়া বলিলেন, সাহেবদের কথা ত জানিনে মা, কিন্তু দাঁড়কাকের অপরাধটা কি শুনি?
সুরমা তখন চোখের জল মুছিয়া ফিসফিস করিয়া অনেক নালিশ করিল। কহিল, ইহারাই যমরাজের গুপ্তচর, এবং তাহার অকাট্য প্রমাণ এই যে, দাঁড়কাক হইয়াও ইহাদের গলা ময়ূরের মত চিকচিক করে। ছাদে কিংবা নিকটবর্তী কোন বৃক্ষশাখায় বসিয়া আয়-আয়-খাখা করিয়া ইহারা বাটীতে যমদূত ডাকিয়া আনে। বউদিদি বলিয়াছেন, কাহারও ছাদে বসিয়া ডাকিলে আর রক্ষা নাই,—সে বাটীর কেহ-না-কেহ নিশ্চিত মরে। বলিতে বলিতে সুরমা সহসা জ্যাঠামশায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার বাপ-মা নাই, কবে মরিয়াছেন জানেও না। জ্যাঠাইমাই মানুষ করিয়াছেন। সেই স্নেহময়ী আজ সুদীর্ঘ ছয় মাস কাল রোগশয্যায় পড়িয়া। আজ তাঁহারই মরণ কামনা করিয়া ওই ঘৃণিত পক্ষীটা যখন বারংবার ডাকিয়া গিয়াছে, তখন কি উপায়ে কেমন করিয়া তাঁহাকে আর মৃত্যুর অনিবার্য কবল হইতে রক্ষা করা যাইবে! উপায় না পাইয়া যখন সে বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতে লাগিল, তখন এই উপায়বিহীনাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া আর এক নিরুপায়ের চোখ দিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।
রাত্রে আহার করিতে বসিয়া গোবিন্দ বধূকে ডাকিয়া মৃদু অনুযোগের স্বরে বলিলেন, ছি মা, ও মেয়েটার জ্যাঠাইমা-অন্ত প্রাণ, তাকে কি এমন করে ব্যাকুল করে দিতে আছে?
এই বধূটি অত্যন্ত মুখরা। এখন শ্বশুরের সুমুখে কিছু বলিল না বটে, কিন্তু তিনি আঁচাইতে বসিয়া স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন, বধূ অস্ফুট ক্রুদ্ধ বিড় বিড় করিতেছে—ইস কচি খুকি কিনা, তাই ভয় দেখিয়ে ব্যাকুল করে দিয়েচি! এগারো-বারো বছরের মেয়ে হল, ও নিজেই ত সব জানে! আজকাল রাত্তির হলে বাড়িসুদ্ধ লোকের ভয়ে গা ছমছম করে, বজ্জাত মেয়ে আবার তাই কিনা লাগিয়ে এসেচে।
গোবিন্দ বসিয়া সমস্তটা শুনিলেন, কিন্তু একটি কথাও না কহিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন।
তাহার পর হইতে সুরমা না খাইয়া, না শুইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া মাথা খুঁড়িয়া কি কাণ্ডই না করিয়া বেড়াইল। কিন্তু, মরণের দিনটিতে এমনি আশ্চর্য শান্ত হইয়া গেল যে, পাড়ার লোকেরা পর্যন্ত বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। মা-কে দেখিতে দুই মেয়ে এবং জামাইরা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সকলের সুমুখে তিনি সুরমাকে স্বামীর হাতে-হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন, এটি আমার সকলের ছোট সন্তান। এর যেন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অযত্ন না হয়। আর আমার গায়ের সমস্ত গহনা একে দিয়ে গেলুম।
তাঁহার অনেক টাকার অনেক রকমের অলঙ্কার ছিল—সুতরাং পুত্রবধূ এবং মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইল।
বহুদিন হইতে ভুগিয়া ভুগিয়া তিনি একটু একটু করিয়া মরিতে ছিলেন, সেই জন্য শেষ সময়টিতেও জ্ঞান ছিল, সুরমাকে বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া কানে কানে বলিলেন, সুরো, তোর বুড়ো জ্যাঠামশাইকে দেখিস মা,—তুই ছাড়া ওঁর আর কেউ রইল না। ওঁকে তোর ভরসায় রেখেই আমি নির্ভাবনায় যাচ্ছি।
মেয়েরা এই কানে কানে কথাটা শুনিতে না পাইয়া মনে মনে আরও ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া অনুমান করিল, তিনি নিশ্চয়ই গোপনে তাঁহার সঞ্চিত টাকাকড়ির সন্ধান বলিয়া দিয়া গেলেন।
জ্যাঠাইমা পরলোকে চলিয়া গেলেন। শুধু সেই দিনটি মাত্র সুরমা হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়া রহিল। কেমন করিয়া সেদিন সে রাত্রি কাটিল, তাহা সে ঠাহর পাইল না। কিন্তু পরদিন আপনা-আপনিই সুস্থির সুদৃঢ় হইয়া উঠিয়া বসিল। তাহার চোখে-মুখে বিহ্বলতার লেশমাত্র রহিল না। প্রচণ্ড ভূমিকম্প যেমন মুহূর্তের আলোড়নে সমুদ্রতলদেশকে পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া যায়, জ্যাঠাইমার মৃত্যু তেমনি এই একটি দিনের নিদারুণ ধাক্কায় বালিকা সুরমাকে একেবারে প্রবীণতার সীমায় পৌঁছাইয়া দিয়া দু-দিনের আড়ালে পড়িয়া গেল।
শোকাচ্ছন্ন গোবিন্দ মুখুয্যে ঘাড় গুঁজিয়া বাহিরের ঘরে বসিয়া ছিলেন, সুরমা নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া তাঁহার কেশবিরল মাথাটিতে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে প্রশ্ন করিল, জ্যাঠামশাই?
কেন মা?
জ্যাঠাইমা এতক্ষণ আমার মায়ের সঙ্গে বসে কত গল্প কচ্চেন না?
গোবিন্দ হঠাৎ প্রশ্নটা বুঝিতে না পারিয়া মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।
সুরমা কহিল, জ্যাঠাইমা বলতেন, সবাই স্বর্গে গেলে আবার দেখা হয়। আচ্ছা, আমার ত মাকে মনে পড়ে না, আমি কেমন করে চিনে নেব?
গোবিন্দ আগ্রহভরে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ সুরমা, তোর জ্যাঠাইমা বুঝি এই সব বলতেন? আচ্ছা, তোদের দুজনের কি কি কথা হত আমাকে সব খুলে বল ত মা।
তখন সুরমা একটি একটি করিয়া স্মরণ করিয়া বলিতে লাগিল। তিনি সুদীর্ঘ রোগশয্যায় শুইয়া জীবনের আশা ত্যাগ করিয়া কতদিন কত উপলক্ষে কত কথাই না এই মেয়েটিকে বলিয়াছিলেন। মরণের পর সুস্থ সবল দেহের কথা, পুনরায় দেখা-সাক্ষাতের কথা।
হাঁরে সুরো?
কেশব লাহিড়ী মাইনার ইস্কুলের হেডমাস্টার, বেতন ত্রিশ টাকা। এই গ্রামখানিতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদরওয়ালা, বড় চাকুরে, জমিদার প্রভৃতি অনেক বড়লোকের বাস, তথাপি লাহিড়ীমশায়ের ন্যায় সম্মানিত ব্যক্তি বোধ করি আর কেহই ছিলেন না। এ সম্মান তাঁহার নিজের অর্জিত এবং একেবারে নিজস্ব। সেই জন্যই মনে হয় ছোট, বড়, ইতর, ভদ্র সবাই মান্য করিয়া চলিত।
আজ রবিবার, স্কুল ছিল না। অপরাহ্ণবেলায় তিনি বাহিরের উঠানে চাঁপাতলায় একখানি চৌকি পাতিয়া নিবিষ্টচিত্তে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পাঠ করিতেছিলেন। চোখের কোণ বাহিয়া জল ঝরিয়া পড়িয়াছিল, তাহাই মুছিবার জন্য ক্ষণকালের নিমিত্ত চশমাখানি নামাইয়া ধরিয়া চোখ মুছিতেছিলেন, হঠাৎ পিছন হইতে ডাক আসিল, ‘জ্যাঠামশাই?’
‘কেন মা?’
কমলা তাঁহার বড় আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী, বয়স দশ বৎসর। কাছে আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘আচ্ছা, জ্যাঠামশাই, সাহেবরা ত এত পারে, তবে কেন দাঁড়কাকগুলোকে সব মেরে ফেলে না?’ কমলার অদ্ভুত প্রশ্নে কেশব হাসিলেন। বলিলেন, ‘সে খবর ত জানিনে মা। কিন্তু দাঁড়কাকগুলোর অপরাধ?’
কমলা অতিশয় গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘বাঃ,—ওরা যে যমের বাহন, জ্যাঠামশাই। চিলেরা ছাতে বসে ডেকে ডেকে বাড়ি চিনিয়ে দেয়, তাই ত যমের দূত চিনতে পারে। নইলে কেউ ত মরত না, সবাই কেমন মজা করে বেঁচে থাকত, না জ্যাঠামশাই?’
কেশব হাসিতে লাগিলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ খবরটি কে তোমাকে দিলে মা?’
‘বউদি। সত্যি, না?’
কেশব মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ তোমার বউদির কথা হয়ত সত্যি নয় মা।’
কমলা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, ‘সত্যি নয়?’ পরক্ষণেই একগোছা চুল কপালের একাংশ হইতে সরাইয়া দিয়া বার-দুই গ্রীবা আন্দোলিত করিয়া বলিল, ‘না জ্যাঠামশাই, সত্যি। নইলে ওরা ত দাঁড়কাক, তবে কেন ওদের ময়ূরের মত গলা চিকচিক করে?’
কেশব প্রথমে উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন, তারপর যথাসাধ্য গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু মা, তোমার কালো পায়রাগুলোরও ত গলা চিকচিক করে।’
কমলা বলিল, ‘তা করলেই বা। তারা যে পায়রা, লক্ষ্মীর বাহন, আর এরা যে দাঁড়কাক।’
কেশব ক্ষণকাল হাসিমুখে নিরুত্তর থাকিয়া বলিলেন, ‘তবুও, আমার বিশ্বাস হয় না মা।’
কমলা ক্ষুণ্ণ হইল। মুখখানি অপ্রসন্ন করিয়া সেইখানে হাঁটু গড়িয়া বসিয়া জ্যাঠামশায়ের জানুর উপর হাতের ভর দিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কেন বিশ্বাস হয় না তোমার?’
কেশব বলিলেন, ‘আরো অনেক পাখির গলা চিকচিক করে মা, সেইজন্যই হয় না।’
কমলা কিছুক্ষণ স্থির হইয়া চিন্তা করিয়া অবিশ্বাসের স্বরে বলিল, ‘তা করুক জ্যাঠামশাই, কিন্তু, তারা ডাকবার সময় অমন ন্যাজ নিচু করে না—এরা ন্যাজ নিচু করে।’
কেশব বলিলেন, ‘ফিঙে পাখিও ন্যাজ নিচু করে।’
‘করে? কিন্তু, তাও যদি করে, তারা ত ছাতে বসে বাড়ি চিনিয়ে দেয় না। আর তারা ডাকলে ভয় করে না, কিন্তু এরা ডাকলে যে ভয় করে! আচ্ছা, তোমার করে না?
কেশব এ অকাট্য যুক্তি আর খণ্ডন করিতে পারিলেন না। ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘করে বৈ কি মা, আমারও ভয় করে।’
কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমার বড্ড করে। আচ্ছা, জ্যাঠাইমা আমার ভাল হয়ে উঠচেন না কেন? একটা দাঁড়কাক কালও ডেকেচে। আজও একবার সকালে ডেকেচে—তাই, বৌদি বলছিলেন’—বলিয়াই সে সহসা থামিয়া গেল। এতক্ষণে কেশব বুঝিলেন, কেন কমলা দাঁড়কাকের বিরুদ্ধে নালিশ করিতে আসিয়াছে। তাঁহার স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রায় এক বৎসর হইতে পীড়িত হইয়া আছেন, কিছুতেই আরোগ্য হইতে পারিতেছিলেন না। বরং মাস-খানেক হইতে আরও যেন বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাল সমস্ত দিন শয্যাত্যাগ করিতেও পারেন নাই। ছয় বৎসর পূর্বে সিদ্ধেশ্বরীর ছোটছেলের মৃত্যু হয়। তখন হইতেই তাঁহার দেহ ধীরে ধীরে ভাঙ্গিতেছিল। এই পাঁচ বৎসর ভাল-মন্দে কোনমতে কাটাইয়া গত বৎসর হইতে রীতিমত পীড়িত হইয়া পড়িয়া ছিলেন। কেশব যথাসাধ্য চিকিৎসার ত্রুটি করেন নাই, কিন্তু ফল হয় নাই। তাই ইদানীং তাঁহার আশঙ্কা হইতেছিল, বুঝিবা, সত্যই তাঁহার পরকালের ডাক পড়িয়াছে। এখন কমলার কথায় তাঁহার চোখ-দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। কমলা তাহা লক্ষ্য করিয়াই তাঁহার জানুদ্বয়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। কেশব জামার হাতায় চোখ মুছিয়া ফেলিয়া ভারী গলায় আস্তে আস্তে বলিলেন,—‘কাঁদিস নে মা, ভাল হয়ে যাবে।’
কমলা মুখ না তুলিয়াই প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘তবে, কেন ওরা অমন করে বলে?’
‘কে কি বলে মা?’
কমলা তেমনি করিয়াই জবাব দিল, ‘মা আর বৌদি। তারা ফিসফিস করে কি বলছিল—আমি যেতেই চুপ করলে, আমাকে শুনতে দিলে না।’
কোরেল
এক
লন্ডন নগরের পঞ্চাশৎ মাইল উত্তরে কোরেল নামে একটি গ্রামে ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতীরস্থ দুইখানি অট্টালিকা গ্রামের শোভা শতগুণে বর্ধিত করিয়া রাখিয়াছিল। উভয়ের সৌন্দর্যে একটা সাদৃশ্য থাকিলেও একটি অপরটি অপেক্ষা এত বৃহৎ জমকাল এবং মূল্যবান যে, দেখিলে বোধ হয় যেন কোন রাজা তাঁহার যৌবনের প্রথমাবস্থায় একটি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তাহার পর যত দিন গড়াইয়া পড়িতে লাগিল, সুখসম্পদ পরিব্যাপ্ত আত্মসুখ যেদিন মরণের ছায়াটা সম্মুখে ঈষৎ হেলাইয়া ধরিয়াছিল, সেই দিন হইতে বোধ হয় অপরটির নির্মাণকর্ম আরম্ভ করাইয়াছিলেন। তাহাই যৌবনে এবং বার্ধক্যে যেরূপ প্রভেদ, এই দুইটি অট্টালিকার মধ্যেও সেইরূপ একটা প্রভেদ লক্ষিত হইত। একটি তাঁহার বিলাসভবন, রাজসভা, অপরটা তাঁহার শান্তিনিকেতন, কুঞ্জকানন। একটিতে কত মর্মরপ্রস্তর, কারুকার্যশোভিত কত ঝরনা, রঞ্জিত পত্রপুষ্পগঠিত কুঞ্জবন,তাহার পর তোষাখানা, অশ্বশালা, পশ্বালয় গ্রামের মত চতুর্দিকে ঘেরিয়া আছে, আর ভিতরে কত আসবাব! কত টেবিল, চেয়ার, পিয়ানো প্রভৃতি বহুমূল্য কার্পেটের উপর দাঁড়াইয়া আছে- ভিত্তিসংলগ্ন বৃহৎ মুকুরে সে শোভা সহস্রবার প্রতিফলিত হইয়াছে,তাহার উপর কত রকমের চিত্র, নানাবিধ ঝাড়-লণ্ঠন দেয়ালগিরির মধ্য দিয়া স্ব স্ব সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু অপরটিতে অত কিছু নাই। বাইরে শুধু শ্যামল তৃণদল, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুষ্পতরু, লতাবিতান, একঝাড় পিয়ার বৃক্ষ, একদল আঙ্গুরের কুঞ্জবন মধ্যে দুই একটি বসিবার বেঞ্চ; নদীর ধারে দুই ঝাড় বংশবাটিকা, তন্মধ্যে এই ক্ষুদ্র অট্টালিকাখানি
নদীতীর হইতে ঈষৎ দেখা যায় মাত্র!
দুইজন প্রাচীন সৈনিক এই দুই ভবনের অধিকারী। একজনের নাম ক্যাপ্টান নোল; অপরের নাম কর্নেল হ্যারিংটন। যুদ্ধকর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া দুই বন্ধু নির্জনে এই দুটি অট্টালিকা সামর্থ্য অনুসারে ক্রয় করিয়া বাস করিতেছিলেন। Captain Noll- এরও একটি মাত্র কন্যা-নাম মেরি; Colonel Herrington-এরও একটি মাত্র পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার নাম লিওপোল্ড-জননী আদর করিয়া লিও বলিয়া ডাকিতেন।
একদিন লিওর জননী পুত্রকে শিয়রে বসাইয়া মেরিকে আশীর্বাদ করিয়া স্বামীর কর নিজ করে গ্রহণ করিয়া বসন্তপ্রভাতে সূর্যোদয়ের সহিত হাসিমুখে চিরদিনের মত প্রস্থান করিলেন। লিওর তখন দশ বর্ষ মাত্র বয়ঃক্রম;—খুব কাঁদিতে লাগিল। মেরির জননী আসিয়া তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন, মুখ চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘ভয় কি বাবা, আমি চিরদিন তোমার মা হইয়া থাকিব।’ সপ্তবর্ষীয়া বালিকা মেরি লিওর হাতে ধরিয়া বলিল, ‘লিও কাঁদিও না—চুপ কর।’ লিও চুপ করিল।
স্ত্রীবিয়োগের পর কর্নেল হ্যারিংটন জুয়াক্রীড়ায় নিতান্ত মনঃসংযোগ করিলেন। সঞ্চিত অর্থ যত সঙ্কুচিত হইয়া আসিতে লাগিল, প্রবাসী পুত্রমুখ স্মরণ করিয়া তত অধিক উৎসাহের সহিত নষ্ট ধন পুনঃপ্রাপ্তির আশায় জুয়াক্রীড়া করিতে লাগিলেন। ক্রমে সমস্ত নিঃশেষ হইয়া আসিল, ক্রীড়ার মত্ততায় তিনি আত্মবিস্মৃত হইয়া বন্ধু নোলের নিকট বাটী বন্ধক রাখিয়া ঋণ গ্রহণ করিলেন! তাহাও শেষ হইল—দারুণ নিরাশায় তাঁহার উন্মত্ততা আসিল, একদিন রাত্রে খাইবার সংস্থান পর্যন্ত নাই—আর সহ্য হইল না—বন্দুকে গুলি ভরিয়া আত্মহত্যা করিলেন। পুত্র লিও তখন লন্ডনে বিদ্যাভ্যাস করিতেছিল—সংবাদ পাইয়া বাটী আসিল। মেরির জননী তখন জীবিত নাই। ক্যাপ্টান নোল মৌখিক সান্ত্বনা মাত্র করিলেন। সপ্তদশ বর্ষীয় লিও অকূলসমুদ্র দেখিয়া যখন ছটফট করিতেছিল, নিরতিশয় মমতায় করুণ অশ্রুভারাক্রান্ত চক্ষু দুটি লিওর মুখের পানে রাখিয়া তাহার হাত ধরিয়া মেরি কহিল, ‘লিও ভয় করিও না—তোমার মেরি এখনও মরে নাই।’
এ কথার অর্থ সবাই বুঝে,—লিও অন্তরে আশীর্বাদ করিয়া মৃদু কম্পিত-কণ্ঠে বলিল, ‘তাই হউক—জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন।’
কিন্তু সেবার দুইজনেরই বড় দুর্বৎসর পড়িয়াছিল,—অধিক দিন না যাইতেই ক্যাপ্টান নোল জ্বরবিকারে প্রাণত্যাগ করিলেন। পিতৃ-মাতৃহীন মেরি লিওর বুকে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘লিও শুধু তুমি রহিলে—বিপদে-সম্পদে আমাকে রক্ষা করিও।’
লিও চক্ষু-দুটি মুছাইয়া দিয়া বলিল, ‘করিব।’
‘প্রতিজ্ঞা কর কখন পরিত্যাগ করিবে না।’
‘প্রতিজ্ঞা করিলাম।’
মেরি মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘তবে আর কাঁদিব না;—আমার সব আছে।’
দুই
লিও একখানি পুস্তক লিখিয়াছিল। লন্ডন নগরে তাহার একজন বন্ধু ছিলেন। সমালোচনার জন্য হস্তলিখিত পুস্তকখানি তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দেয়। কিছুদিন পরে এইরূপ উত্তর আসিল, ‘বন্ধু, তোমার গৌরবে আমি গৌরবান্বিত হইয়াছি। তোমার লিখিত পুস্তকখানি একজন পুস্তক-প্রকাশকের নিকট কতকটা বাধ্য হইয়া বিক্রয় করিয়াছি। পাঁচ শত পাউন্ড পাঠাইলাম—রাগ করিও না, ভবিষ্যৎ উন্নতির বোধ হয় ইহাই সোপান।’
এ কথা শুনিয়া মেরির চক্ষে জল আসিল,—আনন্দে সে লিওর মুখচুম্বন করিয়া বলিল, ‘লিও জগতে তুমি সর্বপ্রধান কবি হইবে।’
লিও হাসিয়া উঠিল, ‘আর কিছু না হউক মেরি, পিতার ঋণ বোধ হয় পরিশোধ করিতে পারিব।’
মেরি আজকাল স্বয়ং উত্তমর্ণ, তাই এ কথার বড় লজ্জা পাইত। রাগ করিয়া বলিল, ‘এ কথা পুনর্বার বলিলে তোমার কাছে আমি আর আসিব না।’
লিও হাসিল, মনে মনে কহিল, ‘তোমার পিতার নিকট আমার পিতা ঋণী; আমরা দুজনে তাঁহাদের সন্তান, তাই আমি জীবিত থাকিলে এ ঋণ তোমার নিকট পরিশোধ করিবই।’
লিওর আজকাল বড় পরিশ্রম বাড়িয়াছে। নূতন পুস্তক লিখিতেছিল, আজ সমস্ত দিন মুখ তুলিয়া চাহে নাই। মেরি প্রত্যহ যেমন আসিত, আজিও তেমনি আসিয়াছিল। লিওর শয়নকক্ষ, পাঠাগার, বসিবার ঘর প্রভৃতি স্বহস্তে সাজাইয়া গুছাইয়া দিতেছিল। দাসদাসী সত্ত্বেও এ কাজটি মেরি নিজে করিয়া যাইত।
সম্মুখে একখানা দর্পণ ছিল, লিওর প্রতিবিম্ব তাহার উপর প্রতিফলিত হইয়াছিল। মেরি বহুক্ষণ ধরিয়া তাহা দেখিয়া বলিল, ‘লিও তুমি স্ত্রীলোক হইলে এতদিন ইংলন্ডের রানী হইতে।’
লিও হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন?’
‘অত রূপ দেখিয়া রাজা তোমাকে বিবাহ করিয়া সিংহাসনে লইয়া যাইতেন। তোমার মত কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশরাশি আমি আর্ট গ্যালারিতে কোন রাণীর দেখি নাই; এমন শুভ্র কোমল মুখশ্রী কোন্ সম্রাজ্ঞীর ছিল? গোলাপ পুষ্পের মত এমন কোমল মধুময় দেহশোভা স্বর্গে ভিনসেরও ছিল বলিয়া মনে হয় না।’
লিও খুব হাসিয়া উঠিল। কলেজে অধ্যয়নকালেও এমন কথা অনেকে কহিয়াছিল; বোধ হয় তাহাই মনে পড়িয়াছিল। হাসিয়া কহিল,’রূপ যদি চুরি করা যাইত তা হইলে তুমি বোধ হয় এ রূপ চুরি করিয়া আমাকে ফাঁকি দিয়া এতদিনে ইংলন্ডের রানী হইয়া যাইতে।’
মেরি মনে মনে অপ্রতিভ হইয়া সলজ্জ হাসিয়া বলিল, ‘তুমি স্ত্রীলোকের মত দুর্বল, তাহাদের মত কোমল, তাহাদের মতই সুন্দর-তোমার রূপের সীমা নাই।’
এত রূপের নিকট মেরি আপনাকে বড় ক্ষুদ্র বিবেচনা করিত।
তিন
কোরেল গ্রামে প্রতি বৎসর অতি সমারোহের সহিত ঘোড়দৌড় হইত। আজি সেই উপলক্ষে প্রান্তস্থিত মাঠে বহু জনসমাগম হইয়াছিল।
মেরি ধীরে ধীরে লিওর পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। লিও তখনও অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পুস্তক লিখিতেছিল, তাই দেখিতে পাইল না। মেরি কহিল, ‘আমি আসিয়াছি, ফিরিয়া দেখ।’
লিও ফিরিয়া দেখিয়া কহিল, ‘ইস—এত সাজিয়াছ কেন?’
মেরিও হাসিয়া ফেলিল; কহিল, ‘সাজিয়াছি কেন শুনিবে?’
‘বল।’
আজ ঘোড়দৌড় হইবে। যে জয়ী হইবে, সে আজ আমাকেই ফুলের মালা দিবে।’
তবে ত তোমার আজ বড় সম্মান! তাই এত সাজসজ্জা!’
মেরি প্রীতি-প্রফুল্ল নেত্রে কিছুক্ষণ লিওর মুখপানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর পরম স্নেহে দুই হস্তে তাহার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া মুখের কাছে মুখ রাখিয়া বলিল, ‘শুধু তাই নয়। তুমি আমার কাছে থাকিবে। তোমার পাশে দাঁড়াইয়া পাছে নিতান্ত কুৎসিত দেখিতে হই, সেই ভয়ে এত সাজিয়াছি,—মণিমুক্তায় রূপ বাড়ে ত?’
সম্মুখস্থিত মুকুরে দুটি মুখ ততক্ষণ দুটি পরিস্ফুট গোলাপ ফুলের মত ফুটিয়া উঠিয়াছিল, লিও তাহা দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ দেখ।’
মেরি অতৃপ্ত নয়নে কিছুক্ষণ ঐ দুটি ছবির পানে চাহিয়া রহিল। তাহার বোধ হইল সেও বড় সুন্দরী। আজ তাহার প্রথম মনে হইল সৌন্দর্যের আশ্রয়ে দাঁড়াইলে কুৎসিত দেখিতে হয় না, বরং যাহা সৎ তাহাকে জড়াইয়া থাকিলে দোষটুকুও চাপা পড়িয়া যায়।আবেশে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মেরি ধীরে ধীরে কহিল, ‘আমি যেন চাঁদের কলঙ্ক—তবু আমার কত শোভা!’
মেরি শিহরিয়া উঠিল।লিও তাহা অনুভব করিল, তাই তাহার মুখখানি আরও কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘চাহিয়া দেখ,—তুমি আমার কলঙ্ক নহ—তুমি আমার শোভা! তুমি চাঁদের পূর্ণবিকশিত, উজ্জ্বল কৌমুদী!’
চক্ষু চাহিতে মেরির কিন্তু সাহস হইল না। কতক্ষণ হয়ত এইভাবে কাটিত, কিন্তু এই সময় অদূরস্থিত গির্জার ঘড়িতে ঢং করিয়া একটা বাজিল। মেরি চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, ‘সময় হইয়াছে—চল!’
‘আমার যাওয়া একেবারে অসম্ভব।’
‘কেন?’
‘এই পুস্তক পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ করিয়া পাঠাইব বলিয়া চুক্তি করিয়াছি,—চুক্তিভঙ্গ হইলে বড় লজ্জায় পড়িব।’
মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘তা বলিয়া আমি তোমাকে প্রাণপাত করিয়া পরিশ্রম করিতে কিছুতেই দিব না।’
লিওর মুখে ম্লান ছায়া পড়িল; পিতৃঋণ স্মরণ করিয়া বলিল, ‘আমার অদৃষ্ট! কি করিব মেরি, পরিশ্রম করিতেই হইবে।’
মেরি তাহার মনের কথা বুঝিল, তাই আরো রাগ হইল। বলিল, ‘তোমার পুস্তক আমাকে বিক্রয় করিও—আমি দ্বিগুন মূল্য দিব।’
লিওর তাহাতে সন্দেহ ছিল না; হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু কি করিবে?’
মেরি নিজ গলদেশের বহুমূল্য মুক্তামালা দেখাইয়া বলিল, ‘এই মালা ছিন্ন করিয়া ফেলিব,—যতগুলি মুক্তা, যে কয়খানি হীরক আছে সবগুলি দিয়া পুস্তকখানি বাঁধাইয়া সোনার কৌটায় করিয়া মাথার শিয়রে তুলিয়া রাখিব,—তারপর—তারপর—’
লিও বলিল, ‘তারপর কি?’
মেরি সলজ্জ হাস্যে রক্তিমাভ মুখখানি ঈষৎ নত করিয়া বলিল, ‘তারপর যেদিন রাত্রে খুব বড় চাঁদ উঠিবে, আর তাহার কিরণগুলি তোমার নিদ্রিত মুখের উপর খেলা করিতে থাকিবে, সেই দিন—’
‘সেই দিন কি?’
‘সেই দিন খুব উচ্চকণ্ঠে পাপিয়া ডাকিতে থাকিবে, তোমার কিন্তু কিছুতেই ঘুম ভাঙ্গিবে না, আমি তখন তোমার কানের কাছে বসিয়া’—মেরি হাসিয়া ফেলিল।
লিও বলিল,—’আমার কানের কাছে বসিয়া পুস্তকটিতে যতগুলি কথা আছে, সবগুলি পড়িয়া ফেলিবে, না?’
মেরি মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘হুঁ।’
‘আমি তাহা হইলে জাগিয়া এমনি করিয়া তোমার মুখচুম্বন করিব।’
তাহার পর দুইজনেই হাসিয়া উঠিল।
ঘড়িতে দেড়টা বাজিয়াছে—লিও তাহা দেখিয়া বলিল, ‘ঢের হইয়াছে—এইবার যাও—।’
মেরি জাঁকিয়া বসিল; বলিল, ‘আমার শরীর খারাপ হইয়াছে—আজ যাইব না।’
‘তা কি হয়? কথা দিয়াছ, না যাইলে চলিবে কেন? কত লোক তোমার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।’
মেরি নিতান্ত অবাধ্যের মত কহিল, ‘চুক্তিভঙ্গ হইলে তোমার মত আমার বিশেষ লজ্জাবোধ হয় না—আমি যাইব না।’
‘ছিঃ—যাও।অবাধ্য হইও না।’
‘তবে তুমিও চল।’
‘ক্ষমতায় থাকিলে নিশ্চয় যাইতাম।’
‘ক্ষমতায় আছে—চল।’
‘ক্ষমতায় নাই—যাওয়া অসম্ভব।’
মেরি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,’তবে আমি আর এখানে আসিব না।’
লিও হাসিয়া বলিল, ‘আমি জানি তুমি নিশ্চয় আসিবে।’
মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘আমি না আসিলে তোমার হয়ত খাইবার অযত্ন হইবে। পোড়াপ্রাণে যে এটা সহ্য করতে পারি না, না হইলে নিশ্চয় দুই-এক দিন চুপ করিয়া ঘরের কোণে বসিয়া থাকিতাম।’
‘এ ক্ষমতাটুকু যদি নাই, তবে রাগ করিলে চলিবে কেন?’
কথাটার সত্যতা সম্বন্ধে মেরির অণুমাত্র সন্দেহ ছিল না, তাই ক্ষুণ্ণ অন্তঃকরণে গাড়িতে বসিয়া ভাবিল—সে ছেলেবেলার পড়িয়াছিল যে, উদরের উপর নাকি একদিন হাত-পাগুলা বড় চটিয়া গিয়াছিল—কিন্তু ফল বিশেষ তৃপ্তিজনক হয় নাই।
মেরি তাই রাগ করিতে পারিল না।
চার
দুইটার কিছু পূর্বে যখন মেরির প্রকাণ্ড জুড়ি গাড়ি প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইল তখন সমবেত জনমণ্ডলী বিপুল কলরবে কোলাহল করিয়া উঠিল। সে সুন্দরী, সে যুবতী, সে অবিবাহিতা, এবং বিপুল ধনের অধিকারিণী; মানবের যৌবনরাজ্যে তাহার স্থান অতি উচ্চে; এখানেও বহু মানের আসনটি তাহারই জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সে আজ পুষ্পমাল্য বিতরণ করিবে। তাহার পরে যে তাহার শিরে জয়মাল্যটি প্রথম পরাইতে পারিবে জগতে সেই ভাগ্যবানের অদৃষ্ট আজ হিংসা করিবার একমাত্র বস্তু। সওয়ারগণ রক্তবর্ণ পোশাকে সজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে উৎসাহের বেগ ও চাঞ্চল্য কষ্টে সংযম করিয়া অপেক্ষা করিতেছিল। দেখিলে বোধ হয় তাহারা যেন পর্বতও ভেদ করিতে সক্ষম,—মেরি উপস্থিত হইয়াছে, নির্দিষ্ট সময়ও আসিল,—পিস্তলের শব্দে সকলেই ব্যগ্র হইয়া দেখিল অশ্বশ্রেণী প্রাণপণে ছুটিয়া চলিয়াছে। তাহার পর মেরির নিকট আসিয়া তাহারা অশ্ব সংযম করিল, নিমেষের মধ্যে এক একটি পুষ্পমাল্য হাতে লইয়া আবার ঘোড়া দৌড়াইয়া দিল।—মরিবার সময়টুকু পর্যন্ত তাহাদের নাই। প্রাণ তাহাদের নিকট আজি নিতান্ত তুচ্ছ—শুধু এক কথা মনে জাগিতেছে, কে সর্বপ্রথমে মেরির হস্তে মালা ফিরাইয়া দিতে পারিবে। প্রতি অঙ্গচালনায় শুধু ঐ এক ভাব;—মৃত্যু কিংবা সম্মান! মেরি মনে করিল, সে-ই আজি তাহাদিগের একমাত্র লক্ষ্য। শুধু তাহার নিকট অগ্রে আসিবার জন্য তাহারা প্রাণ দিতে পারে। বালিকাসুলভ আনন্দে এবং যৌবনের চাপল্যে তাহার বুকখানি ঈষৎ ফুলিয়া উঠিল।
ঘোড়া ছুটিয়াছে, সকলেই ব্যগ্রতার সহিত অপেক্ষা করিয়া আছে। কেহ কহিল, ডেভিড প্রথম হইবে; কেহ কহিল, চার্লস আগু হইয়াছে। বিদ্যুতের মত তাহারা অভীষ্ট স্থানে আসিতেছে। ঐ ডেভিড পিছাইয়া পড়িল, চার্লস অগ্রে আসিয়াছে—কেহ কহিল, এখনও কিছু বুঝিতে পারা যায় না; কিন্তু তাহা মুহূর্তমাত্র—পরক্ষণেই স্পষ্ট দেখা গেল, ডেভিড প্রভৃতি পিছাইয়া পড়িয়াছে। চার্লস বিদ্যুতের মত ছুটিতেছে—তাহার পর অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই সে সর্বপ্রথম পুষ্পমাল্য মেরির পদতলে নিক্ষেপ করিল। খুব কোলাহল হইল, অসংখ্য করতালিশব্দ বহু দূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইল। চার্লস প্রথম হইয়াছে, মেরি সসম্মানে তাহার হস্ত গ্রহণ করিল।
তাহার পর দ্বিতীয় রেস হইবে;—সওয়ারগণ স্ব স্ব অশ্বে স্থান গ্রহণ করিল। পিস্তলের শব্দে সকলেই কশাঘাত করিয়া অশ্ব ছুটাইয়া দিল—মেরির নিকট হইতে মাল্যগ্রহণ করিবার জন্য সকলেই ছুটিয়া আসিল, সেবার কিন্তু অসাবধানতাবশতঃ চার্লস নীচে পড়িয়া গেল, পশ্চাতের অশ্ব তাহার পদদ্বয়ের উপর দিয়া প্রবল বেগে ছুটিয়া গেল—যাহারা নিকটে থাকিয়া তাহা দেখিল, তাহারা সকলেই চিৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু চিৎকার শব্দ থামিবার পূর্বেই চার্লস লম্ফ দিয়া পুনর্বার অশ্বারূঢ় হইল। পদদ্বয়ে দারুণ আঘাত পাইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাতে সে ভ্রূক্ষেপও করিল না। অপরাপর অনেকেই চার্লসের জন্য শঙ্কিত হইল; দারুণ আঘাতবশতঃ যদি অশ্বপৃষ্ঠে স্থান না রাখিতে পারে! অজ্ঞাতসারে মেরিও এ সন্দেহ এবং শঙ্কা হৃদয়ে স্থানদান করিল,—প্রথম কারণ তাহার হৃদয় স্বভাবতঃ কোমল, পরদুঃখে শীঘ্রই আর্দ্র হইয়া যায়, দ্বিতীয় কারণটি তাহার বংশগত।বালিকাকাল হইতে সে বীরত্বের বড় পক্ষপাতী, তাহার পিতা-পিতামহ প্রভৃতি সকলেই যুদ্ধব্যবসায়ী ছিলেন। এ সকল গল্প সে বাল্যকালে পিতার নিকট শুনিতে পাইত; অশ্বচালনা যুদ্ধের একটি অংশ,—ইহাতে কত দৃঢ়তা, সাহস এবং সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। যাহা যুদ্ধের অংশ, তাহাই গৌরবের সামগ্রী। সম্মানের নিকট যুদ্ধ-ব্যবসায়ীরা প্রাণকেও নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করে, আজ শুধু সম্মানলাভের জন্যই চার্লস এ আঘাত তুচ্ছ জ্ঞান করিয়াছে—হয়ত বা সে প্রাণ হারাইবে। মেরি শিহরিয়া উঠিল। এইমাত্র যাহার হস্তগ্রহণ করিয়া সম্মানিত করিয়াছে, সে হয়ত প্রাণত্যাগ করিবে; এরূপ চিন্তা হৃদয়-প্রফুল্লকারী নহে, তাই অত্যন্ত আগ্রহ এবং ভীতির সহিত মেরি দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল; চার্লসের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করিল। তাহার পর বড় কোলাহল হইতে লাগিল; দূরবীন লাগাইয়া অনেকেই দেখিল চার্লস পুনর্বার অগ্রে আসিতেছে; কিন্তু ইতিমধ্যে মেরি মনে মনে আপনাকে এই অল্প সময়ের মধ্যেই চার্লসের সহিত এরূপ জড়িত করিয়া লইয়াছিল যে, তাহার এই দুঃসাহসিক কার্যের জন্য আপনাকে নিতান্ত গৌরবান্বিত এবং শ্লাঘ্য বলিয়া বোধ করিল। বাস্তবিক সেবারেও চার্লস জয়ী হইল,—আনন্দে মেরির সহসা বাক্য নিঃসৃত হইল না, পরে নিজের গলদেশ হইতে ঘড়ি ও চেন খুলিয়া লইয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিয়া কহিল, ‘তুমি এ গ্রামের রত্ন, তোমার মত সাহসী যুবা আর কেহ নাই।’ চার্লস স্মিতমুখে এ প্রশংসা গ্রহণ করিল।
সে রাত্রে মেরি সকলকেই নিমন্ত্রিত করিল, সন্ধ্যার পর তাহার বাটীতে খুব সমারোহে ভোজন ব্যাপার সমাধা হইতে চলিল; আহারে বসিয়া মেরি চার্লসের পার্শ্বে উপবেশন করিয়া, মৃদুকণ্ঠে কহিল, ‘তোমার জন্য বড় ভয় পাইয়াছিলাম।’
চার্লস ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘কেন?’
‘বড় কঠিন আঘাত লাগিয়াছিল,—তুমি ভিন্ন আর কেহ বোধ হয় অশ্বপৃষ্ঠে স্থান রাখিতে পারিত না।’
চার্লস বিনয়নম্রকণ্ঠে কহিল, ‘আমার আঘাত আরোগ্য হইয়াছে; আমার জন্য তুমি দুঃখিত হইয়াছিলে, এমন সৌভাগ্য পূর্বে কখন হয় নাই—এত আনন্দও কখনও অনুভব করি নাই—। তোমার করুণা পাইবার জন্য আমি একটা পা কাটিয়া দিতে পারিতাম; আঘাত ত তুচ্ছ কথা!’
সে রাত্রে অনেক শেরি, শ্যাম্পেনের শূন্যগর্ভ বোতল ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল; গভীর রাত্রি পর্যন্ত আপনার পাঠাগারের জানালায় বসিয়া দুঃখিত অন্তঃকরণে লিওপোল্ড বিকৃত জড়িত কণ্ঠের গীতধ্বনি শ্রবণ করিল; পিয়ানোর শব্দ ঝমঝম করিয়া আকাশে উঠিল; কর্কশ কণ্ঠের সহিত মধুর কণ্ঠও কয়েকবার মিশ্রিত হইল। জানালা বন্ধ করিয়া লিও শয্যাশ্রয় করিল,—আজ হৃদয়ে একটু যাতনা বোধ হইতেছিল।
পাঁচ
পরদিন মেরি লিওকে বলিল, ‘কাল আমাদের বাটীতে কেমন উৎসব হইয়া গেল, তোমার সময় ছিল না বলিয়া তোমাকে ডাকি নাই।’
লিও হস্তস্থিত কলম দোয়াতের উপর রাখিয়া দিয়া কহিল, ‘ভালই করিয়াছিলে—কিন্তু আমারও কাল রাত্রে কিছুই কাজ হয় নাই, কিছু ক্ষতি হইয়াছে।’
মেরি মুখপানে চাহিয়া বলিল, ‘কেন কাজ হয় নাই?’
লিও কলম তুলিয়া লইল, পুস্তকে মনঃসংযোগ করিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘সে কথা তুলিয়া কাজ নাই, আমি বলিতে পারিব না।’
এরূপ কথা জীবনে মেরি এই প্রথম শুনিল। বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘কেন?’
‘তা জানি না; বোধ হয় মন কিছু নীচ হইয়া পড়িয়াছে।’
তাহার পর মেরি অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল, অনেক কথা মনে মনে তোলাপাড়া করিল কিন্তু লিও আর মুখ তুলিল না, কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিল না।
মেরি যাইবার সময় বলিল, ‘যাইতেছি।’
‘যাও।’
যাইবার সময় তাহার বোধ হইল যেন সে লিওর মনের কথা কতক বুঝিতে পারিয়াছে, কিন্তু প্রতিপন্ন করিবার উপায় নাই—শুধু অনুমান করা যায় মাত্র। যাহা হউক, ক্ষুদ্র পথটুকু সে বড় অন্যমনস্কভাবে অতিক্রম করিল। বাটীর ভিতের প্রবেশ করিবার সময় ভৃত্য একখানা টিকিট হাতে করিয়া কহিল, চার্লস বসিবার কক্ষে অপেক্ষা করিতেছেন।
মেরি ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ‘কেন?’
‘তাহা জিজ্ঞাসা করি নাই,—জিজ্ঞাসা করিয়া আসিব কি?’
মেরি একটু ভাবিয়া বলিল, ‘থাক, আমি নিজেই যাইতেছি।’
চার্লসের বিশেষ কিছুই কাজ ছিল না। সে শুধু গত নিশির আমোদ-উৎসবের জন্য ধন্যবাদ দিতে আসিয়াছিল। মেরি কক্ষে প্রবেশ করিলে সে অতিশয় ভদ্রতার সহিত অভিবাদন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মেরি হাত ধরিয়া অতিথিকে বসাইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিল,—কারণ পূর্বেই বলিয়াছি কিন্তু কথায় কথায় তাহা একটু অন্যরকমে দাঁড়াইতে চলিল।
মেরির কত ঐশ্বর্য, কত বিষয়-আশয়, কত মান-সম্ভ্রম! এই ত হইল প্রথম; তাহার পর মেরি কত উচ্চবংশীয়া, তাহার পিতা কত বড় বীর এবং সজ্জন ছিলেন—রাজদ্বারে তাঁহার যে পরিমাণ সম্ভ্রম ছিল সে পরিমাণের সম্ভ্রম অর্জন করিতে বিশেষ বুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, রাজনৈতিক জ্ঞান প্রভৃতির প্রয়োজন, মেরির পিতা Captain নোলের তাহা কিছুমাত্র কম ছিল না; এক কথায় আজকাল সেরূপ আর মিলে না। কিন্তু শেষের কথাগুলি আরও উচ্চ অঙ্গের, মেরির তাহার খুব ভাল লাগিতেছিল;—সেটা অন্য কিছু নয়, শুধু তাহার নিজের রূপ এবং যৌবনের ব্যাখ্যা এবং পক্ষপাত সমালোচনা। পুরুষের মুখে এ কথাগুলা স্ত্রীলোকের সর্বাপেক্ষা তৃপ্তিকর বোধ হয়, এ কথার কাছে আর কিছুই নয়। তাই কতক্ষণ দুইজনে নির্জন কক্ষে গল্প করিয়া অতিবাহিত করিল তাহা মেরি বুঝিতে পারিল না। ঘড়িতে যখন দুইটা বাজিল তখন চার্লস বিদায় হইল এবং যাইবার সময় সেই দিন সান্ধ্যভোজনের নিমন্ত্রণও লইয়া গেল।
সে চলিয়া গেলে, এই রূপ এবং ঐশ্বর্যের কাহিনীর তরঙ্গগুলা যখন অল্পে অল্পে শান্ত হইয়া আসিতে লাগিল, এবং তাহার প্রতিধ্বনিগুলা মেরির মস্তিষ্কের ভিতর ঠোকাঠুকি করিয়া ক্রমশঃ হীনবল হইয়া ধীরে ধীরে শূন্যে মিলাইয়া যাইতে লাগিল এবং যে অবশিষ্ট স্পন্দনটুকু নাচিয়া বেড়াইতেছিল, তাহাও যখন অন্য আর একটি অসীম সৌন্দর্যের পার্শ্বে কাতরভাবে ছুটিয়া পলাইবার প্রয়াস করিতে লাগিল, তখন তাহার বোধ হইল এই ঝোঁকের উপর আকস্মিক নিমন্ত্রণকার্যটা তেমন যুক্তিসঙ্গত হয় নাই। সন্ধ্যার পর সে আসিবে, দুইজনে একত্র আহার করিতে হইবে, হয়ত বা আর কেহই থাকিবে না, কত গল্প কত কথা বলিবার ও শুনিবার উপায় থাকিবে, কিন্তু মেরির তাহাতে আর তেমন মন উঠিল না। যদি আর কেহ জানিতে পারে? যদি তাহার ক্লেশ বোধ হয়? চঞ্চল হস্তে মেরি এক খণ্ড কাগজ লইয়া লিখিল, ‘তুমি সন্ধ্যার পর আসিও না; আমার শরীর মন্দ বোধ হইতেছে।’ কিন্তু এ পত্র চার্লসের নিকট পাঠাইতে লজ্জা বোধ হইল। অনেক চিন্তা করিয়া মেরি অবশেষে এইরূপ লিখিল, ‘যখন আসিবে তখন আর তিন-চারিজন বন্ধুকে আনিও। আনিতে পারিলে নিতান্ত সন্তুষ্ট এবং সুখী হইব।’ ভৃত্য পত্র লইয়া চলিয়া গেল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে রাত্রে চার্লস আরও দুই-তিনজন বন্ধুকে সঙ্গে আনিল। আহারাদি শেষ করিয়া সকলেই একবাক্যে মেরিকে গান গাহিবার জন্য ধরিয়া বসিল। ইচ্ছা না থাকিলেও অতিথির অনুরোধ রাখিতে হইল; পিয়ানো-এ ঝঙ্কার দিয়া মেরির সুকণ্ঠ দুই-তিনটি সপ্তকের মধ্যে খেলা করিয়া ছুটিতে লাগিল, উৎসাহ ও আনন্দে চার্লস প্রভৃতি কয়েকবার উচ্চ শব্দ করিয়া উঠিল, কেহ বা আবেগের সহিত দুই-এক পদ সঙ্গে সঙ্গে গাহিয়া ফেলিল। ক্রমশঃ শেরি, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি ও রামের শূন্যগর্ভ বোতলগুলির সংখ্যা যত বৃদ্ধি হইয়া চলিল, উৎসাহ, আবেগ, উচ্চস্বর ততই পরিপূর্ণভাবে নৈশ আকাশে ঠেলিয়া ফুঁড়িয়া উঠিতে লাগিল। জানালার ভিতর দিয়া এ শব্দ লিওর পাঠাগারে যে একদম প্রবেশ করে নাই তাহা নহে, কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক আজ লিও জানালাগুলা একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। শব্দ-সাড়াগুলা সেখানে তেমন গোলযোগ করিতে পারিতেছিল না।
এদিকে গাহিতে গাহিতে মেরির কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিতেছে, পার্শ্বেও চার্লস কিংবা আর কেহ শেরির গ্লাস লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ক্রমাগত শেরি গ্লাসের মুখচুম্বন করিয়া মেরির গলাটা নিতান্ত সরস এবং মস্তিষ্ক অত্যন্ত সজীব হইয়া উঠিল। উৎসাহের সহিত গভীর রাত্রি পর্যন্ত পিয়ানোর ঝঙ্কার উঠিতে লাগিল।
শেষ হইলে, শয্যায় শয়ন করিয়া সেদিনের মত আজ আর নিদ্রা আসিল না; মেরি অনেক কথা ভাবিল। পুরুষের দল তাহার বড় প্রশংসা করিয়াছে—কেমন করিয়া তাহার শুভ্র পুষ্পকোরকতুল্য অঙ্গুলি কি-বোর্ডের উপর বিদ্যুৎ গতিতে ছুটিয়া যাইতেছিল এবং অঙ্গুলি সংলগ্ন বৃহৎ হীরক-অঙ্গুরীয় মধ্যে মধ্যে ঝকঝক করিয়া এক শোভা দশগুণ করিয়াছিল; কিন্তু সহসা মনে পড়িল হয়ত আর একজনের আরও শুভ্র, আরও সুন্দর, কিন্তু ক্লান্ত এবং অবসন্ন অঙ্গুলি দুইটি এখনও নিঃশব্দে কাগজের উপর দিয়া ধীরে ধীরে লিখিয়া চলিয়াছে। সে হয়ত সমস্ত শুনিয়াছে, হয়ত বা ক্লেশ অনুভব করিয়াছে, কিন্তু প্রতিবিধানের উপায় কৈ? মধু থাকিলে মৌমাছি আসিবেই, ধন থাকিলে তাহার চতুষ্পার্শ্বে লোকসমূহ জড় হইবেই, নূতন সম্বন্ধের বন্ধন যৌবনের অঙ্গ জড়াইয়া উঠিবার স্বতঃ প্রয়াস করিবেই—ইচ্ছা থাকিলেও এ বাঁধন নিজ হস্তে খুলিয়া ফেলা যায় না। মেরি কাতরভাবে উদ্ধারের কামনা এবং প্রার্থনা করিতে করিতে সে রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন সে লিওর কাছে গিয়া বসিল, লিও লিখিতেছে, কৈ একবারও চাহিয়া দেখিল না। অনেকক্ষণ ধরিয়া মেরি কথা খুঁজিয়া পাইল না—তারপর সাহসে ভর করিয়া বলিল, ‘তোমার আর কত বাকি আছে?’
‘অনেক।’
‘আজ দু-তিনদিন ধরিয়া কি লিখিলে? আমাকে শুনাইবে না?’
এই সময়ে অনবধানতাবশতঃ কলমের মুখে অনেকখানি কালি উঠিয়াছিল; টপ করিয়া একটা বড় রকমের ফোঁটা শুভ্র কাগজের উপর পতিত হইল। লিও খাতাখানা ঈষৎ সরাইয়া কলমের মুখটা মুছিতে মুছিতে বলিল, ‘মেরি, তোমার মুখ দিয়া বড় তীব্র সুরার গন্ধ বাহির হইতেছে; এ গন্ধ আমার সহ্য হয় না—সরিয়া বস। অত কাছে বসিয়া থাকিলে আমার সমস্ত ভুল হইয়া যাইবে।’
একদণ্ডে মেরির চক্ষু দুটি চকচক করিয়া উঠিল; বলিল, ‘আমি তীব্র সুরা পান করি নাই।’
‘হইতে পারে। কিন্তু আমার নিকট ও গন্ধ বড় উগ্র বোধ হইতেছে। তুমি হয় সরিয়া বস, না হয় গৃহে যাও।’
মেরি উঠিয়া দাঁড়াইল। সে চিরকাল আদর ও যত্নের মধ্যে লালিত পালিত। এরূপ তাচ্ছিল্যের কথা শুনা তাহার অভ্যাস নহে। বড় অপমান বোধ হইল। তাহার সমস্ত হৃদয় আত্মাভিমানে পরিপূর্ণ, তাই এ ক্ষুদ্র যুবার কোমল অথচ রীতিমত দৃঢ় ও নির্ভীক সত্য কথা তাহার সমস্ত শরীরে অকস্মাৎ খর বিষের জ্বালা জ্বালাইয়া দিল। দাঁড়াইবার সময় সে ভাবিয়াছিল, খুব দুটো চড়া কথা শুনাইয়া দিবে; মিথ্যাবাদী, অকৃতজ্ঞ প্রভৃতি শব্দগুলা আরোপ করিয়া, তাহার বুকে ছুরির মত বিদ্ধ করিয়া দিবে—তারপর যথারীতি খুব একচোট কলহ করিয়া চিরদিনের মত বিচ্ছেদ করিয়া চলিয়া যাইবে, কিন্তু দাঁড়াইয়া উঠিয়া তাহার শব্দশাস্ত্রের অভিধানটা একেবারে কোথায় হারাইয়া গেল। ভ্রূ কুঞ্চিত করিল, চক্ষু বিস্ফারিত করিল, দন্তে অধর দংশন করিল কিন্তু কথা বাহির হইল না।
সম্মুখের দর্পণে সে চিত্র লিও দেখিতে পাইল। কাছে আসিয়া মেরির উন্নত গ্রীবার এক পার্শ্বে হাত রাখিয়া বলিল, ‘অপমান বোধ হইয়াছে?’
মেরির আত্মাভিমান এবার কথা খুঁজিয়া পাইল। তীব্রকণ্ঠে কহিল, ‘তুমি নীচ এবং ঈর্ষাপরবশ, তাই অপমান করিলে!’
লিও ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। কহিল, ‘মেরি, জগতের মধ্যে ঐ দুটি কথা আমার সহ্য হয় না। অমন কথা আর মুখে আনিও না। তুমি অধঃপথে যাইতেছ, তাই সাবধান করিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু তাহার পরিবর্তে ওরূপ মর্মান্তিক কথা শুনিবার বাসনা রাখি না।’
মেরি আরও ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, ‘অধঃপথে কি করিয়া গেলাম?’
‘আমার তাই মনে হয়। ভদ্রঘরের স্ত্রীলোক, বিশেষত তুমি একান্তে অত রাত্রি পর্যন্ত যে আমোদ-প্রমোদ করিবে আমার সেটা ভাল বোধ হয় না। লোকেই বা কি বলিবে?’
আবার লোকের কথা! মেরি অস্থির হইয়া উঠিল। কহিল, ‘লোকে কিছুই মনে করে না। তুমি দরিদ্র কিন্তু আমার ধন ঐশ্বর্য আছে, তোমার মত অনবরত পরিশ্রম করিয়া আমার খাদ্য সংগ্রহ করিতে হইবে না, তোমার মত নির্জন গৃহে বসিয়া জনসমাজের নিকট অপরিচিত থাকিলেই বরং লোকে মন্দ বলিবে।’ তাহার পর একটু বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল, ‘লিও, আপনার ভাগ্য দিয়া আমার ভাগ্য গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিও না—পিতা আমার জন্য অভিশাপ এবং মর্মপীড়া রাখিয়া যান নাই—যাহা সুখের,যাহা বাঞ্ছিত, সমস্তই যথেষ্ট দিয়া গিয়াছেন। যাহার এত আছে তাহার পক্ষে দু-দশজন বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করিয়া আমোদ-প্রমোদ করিলে কেহই দুষে না।’
এত কথা মেরি কহিতে জানে, লিও তাহা জানিত না; এত স্নেহ, এত করুণা যে এত তীব্র বিষ ঢালিয়া তাহার সমস্ত চৈতন্য ওলটপালট করিয়া দিতে পারে, সে ধারণা লিও করিতে পারে নাই—তাই নিতান্ত নির্জীব অবসন্নভাবে বসিয়া পড়িল। কোন উত্তর বা কোনরূপ প্রতিবাদ খুঁজিয়া পাইল না। রাগের মাথায় মেরি চলিয়া গেল, তাহা সে দেখিল কিন্তু ফিরাইতে পারিল না, ইচ্ছাও বড় বেশি ছিল না, কিন্তু দুটো কথা বলিতে পারিলে বোধ হয় ভাল হইত।
আপনার কক্ষে পৌঁছিয়া মেরি, একখণ্ড রুমালে মুখ আবৃত করিয়া একটা সোফার উপর বসিয়া পড়িল—সমস্ত শরীরে অগ্নির উত্তাপ বাহির হইতেছে।
এই সময় একজন ভৃত্য আসিয়া কহিল, চার্লস অপেক্ষা করিতেছেন।
মেরি মুখ তুলিয়া তাহার পানে তীব্র কটাক্ষ করিয়া কর্কশ-কণ্ঠে কহিল, ‘তাড়াইয়া দাও।’
ভৃত্য অবাক হইয়া গেল। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া চলিয়া গেল। চার্লসের নিকটে গিয়া কহিল, ‘শরীর খারাপ, এখন দেখা হইবে না।’
চার্লস উৎকণ্ঠিতভাবে নানারূপ প্রশ্ন করিল। কখন শরীর খারাপ হইয়াছে, কেমন করিয়া হইল, কতক্ষণে সারিবে—ইত্যাদি অনেক কথা এক নিঃশ্বাসে কহিয়া গেল। উত্তর পাইল না। সদ্য তিরস্কৃত হইয়া ভৃত্য মহাশয় কিছু চটিয়াছিলেন; কিন্তু তিরস্কার যে তাহাকে করা হয় নাই, সে কথা সে বুঝিল না। বলিল, ‘আমি অত জানি না।’
হতাশ হইয়া চার্লস একটা ফুলের তোড়া তাহার হাতে দিয়া বলিল, ‘আমার নাম করিয়া এইটা দিও।’
ভৃত্য পার্শ্বের টেবিলে তাহা রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘তিনি নীচে আসিলে দিব।’
ছয়
প্রায় এক মাস অতীত হইল কেহই কাহারো সহিত সাক্ষাৎ করিল না। মেরি মনে করে যে, তাহার বাল্যসখাটি তাহার শরীরের ও মনের চতুষ্পার্শ্বে যে মমতার আবরণে ঢাকিয়া দিয়াছিল,তাহা অল্পে অল্পে সে কাটিয়া ফেলিয়াছে; আর তাহার উপর কোন স্নেহ নাই, মায়া নাই—এক বিন্দু সম্বন্ধ পর্যন্ত নাই। এই এক মাসের মধ্যে সে এই কথাগুলি নিশিদিন ধরিয়া মনে মনে তোলাপাড়া আলোচনা করিয়া দেখিয়াছে। কিন্তু যত অধিক সে এ বিষয় আলোচনা করিয়াছে, তত বেশি সে আপনাকে প্রতারিত করিয়াছে। নিজের হৃদয়ের তলায় সে এক দিনও প্রবেশ করে নাই, করিলে দেখিতে পাইত যে, সেখানে শুধু লিও আর নিজে অষ্টপ্রহর মুখোমুখি করিয়া বসিয়া আছে। প্রেমালাপ করিতেছে না—কলহ করিতেছে। উঠিতে বসিতে সে সর্বদাই চিন্তা করে, কি করিলে এ কলহটা আরও পাকাইয়া তুলিতে পারা যায়, কিরূপ নিত্য নব উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলে লিওর বিরক্তি আরও একটু সজীব করিয়া তুলিতে পারা যায়। কিরূপ আচার-ব্যবহার আরম্ভ করিলে তাহাকে আরও একটু ম্রিয়মাণ করা যাইতে পারে। ইতিমধ্যে আরও দুই-একবার ভোজন উৎসবাদি সমাধা হইয়াছে, ব্যয়বাহুল্য এবং আয়োজনাদির পারিপাট্য দেখিয়া গ্রামের লোক কত সুখ্যাতি করিয়াছে, কিন্তু তাহাতে তাহার মন নাই। মানস-চক্ষে সে শুধু দেখিতে চাহে, এ-সকল কাহিনী শুনিয়া লিওর মুখ কিরূপ বিশুষ্ক এবং পাণ্ডুবর্ণ হইয়াছে, কর্ণে শুনিতে চাহে, লিও কিরূপ ফুলিয়া ফুলিয়া হৃদয়ের যন্ত্রণায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিতেছে। এত অর্থব্যয় বুঝি তাহা হইলে সার্থক হয়। অর্থব্যয়ের কারণ ঐ লিও এবং উদ্দেশ্য তাহার যাতনা বৃদ্ধি করা;—কিন্তু সফলতার কথা কেহ বলে না। এ কথা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করা যায় না— কিন্তু এমন কি কেহ নাই, এমন কি কোন সর্বদর্শী অন্তর্যামী পদার্থ নাই, যাহা এ কথা বলিয়া যাইতে পারে? মেরি অন্যমনস্কভাবে এই সব ভাবে। কিন্তু যখন মনে হয়, লিও তাহার পুষ্পের মত শুভ্র শান্ত দেহটি লইয়া হৃদয়ের মধ্যে জগতের শক্তি এক করিয়া পর্বতের মত দৃঢ় হইয়া আছে, এত সমারোহ, হট্টগোল তাহার হৃদয়ের দ্বারে আঘাত খাইয়া ঠিকরিয়া পড়িতেছে, ভিতরে একটিবারও প্রবেশ করিতে পারিতেছে না; হয়ত বা সে-হৃদয়ে জ্বালার পরিবর্তে অবহেলা ও ঘৃণার স্থান হইয়াছে, তখন মেরির সমস্ত শিরা, অস্থি, মজ্জা—যাহা কিছু আছে সমস্ত এক সাথে ঝমঝম করিয়া সুরে-বেসুরে নিতান্ত একটা অবসন্ন হতাশ ছবি চক্ষের উপর দাঁড় করাইয়া দেয়।
উৎসবরাত্রে যখন সকলে ব্যস্তভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, বাটীময় সাড়াশব্দে পূর্ণিত, শিখরে শিখরে উৎসবের সহস্র দীপ দৈত্যরাজার প্রমোদভবনের মত শোভা পাইতেছে—হয়ত সে সময়ে মেরি একটু নির্জনে বসিয়া একটা অপরূপ বিষাদচিত্র মনে মনে আঁকিতেছে। ভাবিতেছে, লিও হয়ত এতক্ষণে তাহার নৈশ কার্য শেষ করিয়া শীতল বায়ুর জন্য একটিবার মাত্র জানালা খুলিয়াছে; উৎসবের দীপামালা চক্ষে পড়িয়াছে—কিন্তু নিমেষের জন্য! নিতান্ত অবজ্ঞাভরে জানালা রুদ্ধ করিয়া পরক্ষণেই সে নিতান্ত নিশ্চিত- মনে আপনার স্নিগ্ধ শয্যাতলটি আশ্রয় করিয়া শুইয়া আছে,—নিদ্রাদেবী পদ্মহস্তে তাহার পদ্মের মত দুটি চক্ষের উপর হাত বুলাইয়া তাহাকে নিদ্রিত করিতেছেন। মেরি ছটফট করিয়া উঠিয়া পড়িল,—ভাবিল, সে নিজে? নিজের কথা নিজেই বুঝে না—মনে হয়, এত উৎসব-সমারোহ মিথ্যা পণ্ডশ্রম মাত্র! লিওর গ্রাহ্যের মধ্যেও আসে না।
জ্বালার উপর জ্বালা, মেরি ধনবতী কিন্তু লিও দরিদ্র, তাহার সহায়-সম্পদ আছে, লিওর কিছুই নাই, জনসাধারণ তাহাকে কত খাতির-যত্ন করে, লিওকে কেহ চিনে না, তবুও সে এত উচ্চে বসিয়া আছে যে, মেরি তাহার যথাসর্বস্ব ব্যয় করিয়াও তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারিতেছে না। তাহার রূপ যৌবন ঐশ্বর্যের পদতলে কতলোক নিত্য আসিয়া মাথা নত করিতেছে, স্বেচ্ছায় অযাচিত আপনাকে বিক্রয় করিবার জন্য তাহার পানে ঈষৎ সঙ্কেতের অপেক্ষামাত্র করিয়া দীন নয়নে চাহিয়া বসিয়া আছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র দারিদ্র্যপীড়িত, পরিশ্রমক্লিষ্ট, অসহায় অলৌকিক জীবটি একবার ফিরিয়াও দেখে না। সে ধরিতে চাহে না, ধরা দিতেও চাহে না। রাগের মাথায় মেরি আকাশের গায়ে থুথু ফেলিত। লিওর স্থান বড় উচ্চে, সেখানে এ-সব পৌঁছিত না, শুধু মেরির মুখে-চোখেই তাহা ফিরিয়া আসিত। দ্বিগুণ জ্বালায় সে আপনি জ্বলিয়া মরিত।
সাত
নিজের জন্মতিথি উপলক্ষে বাটীতে আজ মহোৎসবের বিপুল আয়োজন হইতেছে, প্রতি বৎসরই ইহা হইত, কিন্তু এবার জাঁকজমক কিছু বেশি। সমস্ত বাটীময় ফল, ফুল ও রংদার পাতায় সাজান হইতেছে, সহস্র দীপ নানাবর্ণ বিচিত্র কাচপাত্রের ভিতরে সজ্জিত হইয়া শুধু রাত্রির জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। গ্রামের সমস্ত সম্ভ্রান্ত স্ত্রী-পুরুষগণ নিমন্ত্রিত হইয়াছেন; এই সময় লন্ডন নগরে কে একজন প্রসিদ্ধ জাদুকর আসিয়াছিল, বহু অর্থ ব্যয় করিয়া সে-রাত্রের জন্য তাহাকে নিযুক্ত করা হইয়াছে।
বাজিকরের বাজি দেখিবার জন্য সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই আনেকে ধীরে ধীরে জমা হইতেছে। যাহার শরীর অসুস্থ সেও রীতিমত গরম কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া সন্ধ্যার মধ্যেই উপযুক্ত স্থান দখল করিয়া বসিয়াছে। কথা ছিল সাতটার গাড়িতে বাজিকর আসিবে এবং অর্ধ ঘণ্টার মধ্যেই তাহার বিদ্যা হস্তকৌশল ইত্যাদি পরিদর্শন করাইবে; তাহার পর দশটার সময় ভোজনাদি হইবে। সাড়ে-সাতটার জন্য সকলেই উৎসুক হইয়া ছিল, কিন্তু সাতটার সময় একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটিল। বাজিকরের পরিবর্তে একখানা টেলিগ্রাফ আসিয়া উপস্থিত হইল। ‘জাদুকর হঠাৎ বড় পীড়িত হইয়াছে—আসিতে পারিবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে মেরির মাথাটা ঘুরিয়া গেল। এখন উপায়? দক্ষিণ হস্তে চার্লসের হস্তে কাগজখানা দিয়া বলিল, ‘যাহা হয় কর। কেহ আমার কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিও, সহসা পীড়িত হইয়া শয্যা আশ্রয় করিয়াছি।’
টেলিগ্রাফ পড়িয়া চার্লসও বিষম অভিভূত হইল; সেও কহিল, ‘উপায়? সাতটা হইতে দশটা পর্যন্ত কাটে কিরূপে?’
আপাততঃ এ কথা চাপা রহিল। ক্রমশঃ লোকে হল্ পূর্ণ হইয়া গেল। আগ্রহ এবং উৎকণ্ঠা সকলের মুখে; ক্রমে যত সময় যাইতে লাগিল, তত সকলে ব্যস্ত হইতে লাগিল। যাহারা কিছু অসুস্থ ছিল, তাহারা গৃহে প্রত্যাগমনের উপায় খুঁজিতে লাগিল। সর্বত্রই একটা অস্ফুট চাপা কলরব হইতে লাগিল, ভাবগতিক দেখিয়া মেরির নিজের কেশ উৎপাটন করিবার ইচ্ছা হইল। ক্রমশঃ কথাটা জানাজানি হইল—তখন হতাশ হইয়া কেহ বা সংগীতের কথা উত্থাপন করিল, কোন বৃদ্ধ বা তাহার সঙ্গিনীকে হুইস্ট টেবিলের দিকে টানিয়া লইয়া গেল, কোন যুবক তাহার বন্ধুর হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে বিলিয়ার্ড হলের দিকে চলিল,—এইরূপে সাতটা হইতে দশটা পর্যন্ত কেমন করিয়া কাটান যাইতে পারে তাহা সবাই ভাবিতে বসিল। সকলকে অন্য কোন উপায়ে নিযুক্ত রাখিবার কোনরূপ আয়োজন করিয়া রাখা হয় নাই বলিয়া মেরি মৃদুকণ্ঠে চার্লসকে অনুযোগ করিল, কিন্তু উপায় কেহই উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হইল না।
আপাদমস্তক আলস্টরে আবৃত করিয়া আজ লিওপোল্ড আসিয়াছিল, হলের এক কোণে একটা সোফায় বসিয়া নিকটস্থ একজন যুবতীর সহিত বাক্যালাপ করিতেছিল। জিজ্ঞাসা করিল, ‘জাদুকর আসিল না কেন?’
যুবতী কহিল, ‘তাহার সহসা পীড়া হইয়াছে।’
‘তাহা হইলে?’
‘তাহা হইলে আর কি? দশটা পর্যন্ত যাহার যাহা খুশি করুক। মেরির অবস্থা বড় শোচনীয় হইয়াছে—সে অতিশয় লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে।’
লিও একটু ভাবিয়া বলিল, ‘আমি গাহিতে জানি। বোধ হয় নিতান্ত মন্দ শুনাইবে না,—কি বল?’
রমণীটি অতিশয় সংগীতপ্রিয়। সে একেবারে লিওর হাত ধরিয়া পিয়ানোর নিকট টানিয়া আনিয়া বসাইয়া দিল। স্বহস্তে ডালা খুলিয়া দিয়া বলিল, ‘বাজাও।’
পিয়ানো ডাকিয়া উঠিল—’ঝম ঝম ঝম!’
অনেকেই এখনো এদিকে চাহে নাই, পিয়ানোর শব্দে তাহারা ফিরিয়া চাহিল। ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে তখন মর্তের পিয়ানো স্বর্গের সংগীত বলিতেছিল। যাহারা বুঝিত, তাহারা বুঝিল এরূপ অলৌকিক ক্ষিপ্রহস্ত, এরূপ পারদর্শী অসামান্য শিক্ষিত অঙ্গুলি বোধ হয় ইতিপূর্বে কখনও এ পিয়ানো স্পর্শ করে নাই। পার্শ্বের কামরায় যাহারা তাস লইয়া বসিয়াছিল তাহারা ক্রীড়া স্থগিত করিল; বিলিয়ার্ড হলের দিকে যাহারা পদচালনা করিয়াছিল, তাহারা আপাততঃ দাঁড়াইয়া পড়িল। সকলেই পরস্পরের মুখ চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘কে?’
কেহই লিওকে ভাল করিয়া দেখে নাই, তাই কেহই চিনিতে পারিল না। যে চিনিত সে কথা কহিল না। তাহার পর, পিয়ানো যাহা অস্ফুট বলিতেছিল, কণ্ঠ তাহা স্পষ্টতম করিল। সে কণ্ঠের তুলনা হয় না। অশীতিপর বৃদ্ধও মনে করিল, তাহার জীবনে এরূপ কণ্ঠস্বর শুনে নাই। ধর্মপরায়ণা বৃদ্ধা মনে করিল জগতের শেষ দিনটিতে বুঝি দেবতাগণ এইরূপ সংগীত করিবেন। লহরে লহরে সে স্বর কক্ষ ভরিয়া আকাশে উঠিতে লাগিল; ঘূর্ণবায়ু যেমন রাস্তার ধূলা, কুটা, তৃণ, কঙ্কর সমস্তই একসাথে ঘুরাইয়া লইয়া আকাশে উঠে, এ স্বরও তেমনি বালক, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ প্রভৃতি সকলের মন একসাথে উপরে উড়াইয়া চলিল। এরূপ মুগ্ধ করিতে জাদুকর বোধ হয় পারিত না। নিস্পন্দ নীরব—কাহারো মুখে কথা নাই, অনেকের শরীরে চৈতন্যের লক্ষণটুকু পর্যন্ত নাই। ঠিক কোন্ সময়ে গীতটি শেষ হইল, অনেকেই তাহা বুঝিতে পারিল না, তাহার পর পিয়ানো যখন ঝম ঝম ঝম করিয়া তাহার শেষ ঝঙ্কারটুকু মুগ্ধ আকাশের তরঙ্গশ্রেণীর শেষ গতিটুকু বিতরণ করিয়া স্তব্ধ হইল, তখন সেই আহূত জনমণ্ডলী নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খলভাবে একেবারে পিয়ানোর চতুষ্পার্শ্বে ঘিরিয়া দাঁড়াইল, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে?’ কেহ উত্তর দিতে পারিল না।
লিও নিজের মুখ নিচু করিয়া রাখিয়াছিল। আবার পিয়ানো ঝম ঝম করিয়া উঠিল, নিমেষে মুগ্ধ, বিস্মিত জনমণ্ডলী সরিয়া গেল,—যে যেখানে পাইল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পড়িল, শুনিল নির্জীব পিয়ানো সজীব হইয়া কত কি কথা বলিয়া যাইতেছে, পুনর্বার কণ্ঠস্বর তাহা স্পষ্টতর করিয়া দিল। লিও বিরহের গান গাহিতেছিল;—কোন্ সুদূর সমুদ্রকূলে বসিয়া পরিত্যক্ত রাজকন্যা তাহার প্রণয়ীর জন্য সমুদ্রকে ডাকিয়া বলিতেছে, ‘ওগো সমুদ্র আমার স্বামীকে ফিরাইয়া দাও;—ফিরাইয়া দাও;—কোন্ অতলগর্ভে তাহাকে নিমজ্জিত করিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছে; হায়, দয়া করিয়া ফিরাইয়া দাও, না হইলে আমাকেও তোমার একটি তরঙ্গ পাঠাইয়া টানিয়া লও। এ দুঃসহ জীবনের ভার আর বহিতে পারি না।’ গানের ভাবটা এইরূপ। শ্রোতৃবর্গের মধ্যে কাহার কিভাবে কাটিতেছিল তাহা পূর্বে বলিয়াছি, কিন্তু মেরির কথা বলি নাই। সে এতক্ষণ একটা কোচের বাজুতে মাথা রাখিয়া আকুলভাবে কাঁদিতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল—বুঝি তাহার সমস্ত হৃদয়খানা সঙ্গীত হইয়া কাঁদিয়া ফিরিতেছে;—সমুদ্র কি, তাহা সে জানে না, শুধু আকুল মর্মভেদী ক্রন্দনে দয়া ভিক্ষা চাহিতেছে—সে আমার হারাইয়া গিয়াছে—ওগো, ফিরাইয়া দাও!—ফিরাইয়া দাও!
প্রবল জ্বরে যেমন রোগীর কিছুতেই পিপাসার শান্তি হয় না, তেমনি এই নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গের সংগীতের তৃষ্ণা কিছুতেই শান্ত হইতেছে না। একটির পর একটি করিয়া কতগুলি সংগীত হইল!
দশটা বাজিয়া গিয়াছে, আহারের সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায় দেখিয়া লিও পিয়ানোর ডালা বন্ধ করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; তখন সকলে চিনিল, লিও! মেরি যখন চিনিতে পারিল, তখন সে টলিতে টলিতে একটা কক্ষে প্রবেশ করিয়া শুইয়া পড়িল। ক্ষণকালের জন্য তাহার চৈতন্য রহিল না। সে শুধু ক্ষণকালের জন্য। তাহার পর মেরি উঠিয়া বসিল, আপনাকে সামলাইয়া লইয়া ভোজনকক্ষে উপস্থিত হইল; চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিল সকলে একত্রিত হইয়াছে কিন্তু লিও নাই। সেই কথাই সকলে বলাবলি করিতেছিল, মেরি আসিবামাত্র সকলেই এ প্রশ্ন করিল;—মেরি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘জানি না।’ সকলকে জিজ্ঞাসা করা হইল, কেহই জানে না। অবশেষে দ্বারবান সংবাদ দিল—লিও চলিয়া গিয়াছে।
কেহই কারণ বুঝিল না, কিন্তু কথাটা সকলের মনেই খট করিয়া বাজিল। লজ্জায় ও অভিমানে মেরি দন্তে ওষ্ঠ চাপিয়া রক্তাক্ত করিল।
সে অনিমন্ত্রিত অযাচিত আসিয়াছিল। মেরির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতি বৎসরই আসিত, আজও তাহাই আসিয়াছিল; নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করে নাই। আজিকার দিনে না আসিলে এত আনন্দ কতকটা নিরানন্দে পরিণত হইত। মেরির মান বজায় রাখিয়া সকলকে নিরতিশয় সুখী করিয়া নিঃশব্দে সরিয়া পড়িয়াছে। দুটো ধন্যবাদ, দুটো কৃতজ্ঞতার কথা, কিছুরই অবকাশ দেয় নাই; নীরবে গৃহকর্ত্রীকে সহস্র অপরাধী করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাই মেরি গুপ্ত অবমাননায় ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।
সংগীতশাস্ত্রের প্রথম অক্ষরের সহিতও যে লিওর পরিচয় আছে—এতদিনের ঘনিষ্ঠ আলাপেও মেরি তাহা জানিতে পারে নাই, তাই তাহার কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিল না। যখন চিনিল তখন তাহার চৈতন্য লুপ্ত হইয়া আসিতেছিল,—তাহার পর এই নীরব প্রচ্ছন্ন অবমাননা । যাতনার তাড়নায় সে-রাত্রের জন্য মেরি চক্ষু মুদ্রিত করিতে পারিল না।
আট
আরও তিন দিন নিঃশব্দে অতিবাহিত হইয়া গেল। এইবার, এতদিন পরে লিওর চক্ষে খুব বড় দু’ ফোঁটা জল আসিয়া পড়িল। আজ মাসাধিক কাল হইল মেরি অল্পে অল্পে সরিয়া দাঁড়াইয়াছে, সামর্থ্যানুযায়ী অবহেলা তাচ্ছিল্য করিতে ত্রুটি করে নাই কিন্তু এত দিন পরে অবমাননা করিয়াছে। সে যে আত্মসম্মান তুচ্ছ করিয়া অনাহূত অতিথি হইতে গিয়াছিল এবং তাহার পরিবর্তে অবজ্ঞার মৌন জ্বালাটুকু লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে, এইটাই তাহাকে অধিক বিচলিত করিয়া ফেলিয়াছে। তিন দিন অতিবাহিত হইল, সে একবার আসিল না, একবার ডাকিল না, আর চোখের জলের অপরাধ কি? কিন্তু শুধু কি তাই? লিওর অন্তরের ভিতর হইতে একটা ধিক্কার উঠিয়াছে। পরে দুঃখ দিলে চোখে জল আসে, কিন্তু সেজন্য আপনাকে কেহ ধিক্কার দেয় না, বরং নিজেকে একটু উচ্চ স্থানে দাঁড় করাইয়া একটু সান্ত্বনা পাইবার চেষ্টা করে। অদৃষ্টকে দোষ দিয়া কর্মফলের নিন্দা করিয়া, পরের মন্দ চরিত্রকে গালি পাড়িয়া অনেকটা শান্ত হওয়া যায়; কিন্তু যাহার আপনাকে আপনি ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হয়—তাহার দুঃখ রাখিবার স্থান নাই, তাহার সান্ত্বনা এ জগতে আছে কিনা বলিতে পারি না। লিওর একফোঁটা অশ্রু মেরির জন্য পড়িয়াছিল, কিন্তু শেষ ফোঁটাটি যখন চক্ষু ছাপাইয়া গণ্ড বাহিয়া বক্ষে আসিয়া পড়িল, তখন তাহার হৃদয়ের প্রতি গ্রন্থিগুলি শিথিল হইয়া যাইবার মত হইল। এ অশ্রু তাহার নিজের জন্য পড়িয়াছে।—সকলের এমন দুর্ভাগ্য ঘটে না, ঘটিলেও হয়ত বুঝিতে পারে না, কিন্তু যদি কখন কেহ বুঝিতে পারে, তাহা হইলে সে লিওর মত নিশ্চয়ই যুক্তকরে ঊর্ধ্বমুখে কহে, ‘ভগবান, এমন অশ্রুপাত কাহাকেও করাইও না।’
এক মাস হইতে লিওর অন্তরে সুখ নাই, কিন্তু সম্মান ছিল, আত্মগৌরব তাহাকে পর্বতের মত অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ সে প্রথম দেখিয়াছে যে, তাহারই আত্মগৌরব তাহাকে প্রতারিত করিয়াছে, আত্মা বিদ্রোহী হইয়াছে, মন বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। মেরিকে সে ভালবাসিত, কারণ মেরিও তাহাকে ভালবাসিত; এটা বেশ কথা; তার পর সে রাগ করিল, কথা না শুনিয়া অবাধ্য হইয়া পড়িল, আর তাহার ভালবাসা নাই—লিও মনে স্থির করিল সেও আর বাসিবে না, তবে একটা পদার্থকে এতদিন পরে বিনাশ করিতে হইলে ক্লেশ বোধ হয়, লিওরও ক্লেশ বোধ হইয়াছিল, কিন্তু সে যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করিল যে, স্ত্রীচরিত্র সহজে বুঝা যায় না, মেরিকেও সে এজন্য বুঝিতে না পারিয়া ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল, যাহা হউক এখন সংশোধন করিলেই হইবে।
সে আপনাকে শোধরাইয়া লইল, তবে মধ্যে মধ্যে দুঃখ হয়, মধ্যে মধ্যে হাসিও পায়, এমন হইয়াই থাকে, এজন্য কোন ক্ষতি নাই। সে আপনাকে সংযত করিয়া, জগতের যাবতীয় দুর্ভাবনা, দুঃখ, ক্লেশ দূর করিয়া দিয়া, পরম আনন্দে সমস্ত অন্তরাত্মা এই পুস্তকখানির উপর ন্যস্ত করিয়া হৃষ্টচিত্তে ‘ইভা’র চরিত্র গড়িতেছিল। লিখিয়া শেষ করিতে পারিতেছিল না—গুণের কথা লিখিতে বুঝি স্বর্গও ফুরাইয়া যাইবে, রূপের মাধুরী বর্ণনা করিতে বুঝি স্বয়ং সজীব প্রকৃতিদেবীকে টানিয়া আনিয়া ইভার চতুর্দিকে জড়াইয়া দিতে হইবে; তাহার হৃদয়ের প্রবৃত্তিগুলি আঁকিবার আনন্দে লিওর আহার-নিদ্রা ত্যাগ হইয়াছিল, এই এক মাস ধরিয়া দারুণ পরিশ্রমেও এক তিল ক্লান্তি বোধ করে নাই, তথাপি এ চিত্র শেষ হইতেছে না, মনে হয় যদি অব্যক্ত অজানিত দুটো কথা কেহ বলিয়া দিতে পারিত,—সে দেবী-হৃদয়ের গোটা দুই গুপ্ত কথা কিছুতেই বুদ্ধিতে আসিতেছিল না, তাহা যদি পরিষ্কৃত হইত তাহা হইলে, এ স্বর্গচিত্র কোন স্বর্গীয় দেবীর হস্তে পরমানন্দে সমর্পণ করিয়া লিও তাহার এ জীবনের সমস্ত বাসনা, সমস্ত আশা কাগজ কলম যাহা কিছু আছে সমস্তই উৎসর্গ করিয়া নিতান্ত নিশ্চিত মনে বাকি জীবনটা চুপ করিয়া বসিয়া কাটাইয়া দিতে পারিত। আজ প্রাতঃকাল হইতে লিও এই লিখিত চিত্রখানি ভাল করিয়া দেখিতেছিল; সহসা মনে হইল, লোকটিকে যেন সে কোথায় দেখিয়াছে, যেন এ দেবী-প্রতিমার সহিত কখন কোন স্বপ্নরাজ্যে দেখাশুনা হইয়াছিল, একটু বোধ হয় পরিচয় হইয়াছিল, কিন্তু সে আর নাই, দেখাশুনা হইলে হয়ত বা চিনিতে পারা যায় কিন্তু মুখখানি মনে পড়িতেছে না। প্রাতঃকাল হইতেই সে এ কথা ভাবিতেছিল।
এখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, বাগান ফুলের গন্ধে ভরিয়া উঠিয়াছে—লিও তাহার মধ্যে বসিয়া। দুই ফোঁটা অশ্রুর শেষ বিন্দুটি এখনও গণ্ড ছাড়ায় নাই—বুকের উপর হয়ত এইবারে পড়িবে। লিও ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, ‘ভগবান! এত পরিশ্রম করিয়া কি শেষে মেরির চিত্র অঙ্কিত করিয়াছি? দিবানিশির এই গভীর একান্ত চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা, আনন্দ, আশা, ভরসা কি সব মেরির পদতলে লুটাইয়া দিয়াছি? কি করিতে কি করিয়াছি, ভগবান! লাঞ্ছিত, উৎপীড়িত, অবমানিত—আমাকে কি শেষে মেরির চিরদাস করিয়া দিয়াছ? হৃদয়, মন, চিন্তাশক্তি, কল্পনা—সমস্ত অযাচিত তাহাকে দিয়া আমি কি শূন্যগর্ভ জড় পুতুলের মত হইয়াছি? সে চাহে না, আমি চাই। সে পদদলিত করিয়া চলিয়া যায়, আমি ধূলার মত পদতল জড়াইয়া আছি।’ ছুটিয়া আসিয়া লিও গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।
নয়
এক সপ্তাহও অতিবাহিত হয় নাই, মেরি চার্লসকে হঠাৎ বলিল, ‘তুমি আমার একটা উপকার করিতে পারিবে?’ আজ মেরির চক্ষু দুটা কতকটা উন্মাদের মত চকচক করিতেছে।
চার্লস কহিল, ‘কি রকম উপকার?’
মেরি একটু থামিয়া বলিল, ‘তবে শোন, তোমাকে বুঝাইয়া বলি;—আমার বুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট, অতি ক্ষুদ্র কাঁটা ফুটিয়াছে। বাহির হইতে দেখা যায় না, বড় ভিতরে প্রবেশ করিয়া সর্বদা খচখচ করিতেছে—এক বিন্দুও সুখ পাই না; তুমি তুলিয়া দিতে পারিবে?’
চার্লস ভাবিল কি রকম! বলিল, ‘কেমন করিয়া কবে ফুটিল?’
মেরি মুখ টিপিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘তাও শুনিবে? শোন, কিন্তু বোধ হয় বুঝিতে পারিবে না। ছেলেবেলায় একটা গোলাপ ফুল লইয়া খেলা করিতাম, তাতে একটা কাঁটা ছিল—দেখিতে পাই নাই। তার পর মনে কোনদিন বুঝি ঘুমের ঘোরে বুকে চাপিয়া ধরিয়াছিলাম—কাঁটাটি ফুটিয়া গিয়াছে। ফুল শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে—এখন কাঁটাটি বাহির করিয়া ফেলিতে চাই, —তুমি পারিবে?’
চার্লস কিছুই বুঝিল না। মন-রাখাগোছ কহিল, ‘বোধ হয় পারিব; কিন্তু কাঁটা খুব ছোট ত?’
‘হ্যাঁ, খুব ছোট কিন্তু সাবধান, অনেকখানি বুকের রক্ত-মাংস না কাটিলে আর বাহির হইবে না। হয়ত বা প্রাণে বাঁচিব না—সাবধানে তুলিবে ত?
চার্লস ভয় পাইল। কহিল, ‘তবে ডাক্তার ডাকাও।’
মেরি হাসিল। বলিল, ‘ডাক্তার ডাকিতে লজ্জা বোধ হইবে—বুকের মাঝে কিনা—তাই!’
চার্লস চিন্তা করিয়া কহিল, ‘আমি বোধ হয় পারিব না।’
মেরি ভ্রূকুঞ্চিত করিল—’যদি পারিবে না, তবে মনে মনে লুকাইয়া আমাকে কামনা কর কেন?’
চার্লস শুকাইয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিল ঘরে অপর কেহ নাই; একটু সাহস হইল, বলিল—’তোমাকে দেবতাও কামনা করেন—আমি ত সামান্য মনুষ্যমাত্র!’
মেরি অন্যমনস্কভাবে কহিল, ‘কিন্তু একজন আমাকে কামনা করে না। সে বোধ হয় দেবতারও উচ্চে।’ তাহার পর তাহার অন্য ভাবোদয় হইল। অমনি কঠিন কটাক্ষে চার্লসের পানে চাহিয়া বলিল, ‘দেখ, সে কাঁটাটি যদি একবার হাতে পাই, তা হলে এমনি করিয়া পদাঘাত করি—একফোঁটা কাঁটা নিমেষে পরমাণু হইয়া যায়, কিন্তু হাতে পাই না,—বুকের ভিতর লুকাইয়া বসিয়া আছে!’
চার্লস বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। মনে হইতেছে—বুঝি ঠিক কাঁটার কথা নহে, কিন্তু ভাল পরিষ্কারও হইতেছে না। সাতপাঁচ ভাবিয়া কহিল,’ডাক্তার দেখাইলে হানি কি?’
মেরি প্রথমে হাসিয়া ফেলিল কিন্তু পরক্ষণেই মলিন হইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমার যেমন পোড়া কপাল, তাই তোমাদের সঙ্গে কথা বলি—সোনার পাত্র ছাড়িয়া আমি মাটির পাত্র লইয়াছি। তৃপ্তি হইবে কেন?’
চার্লসের রাগ হইল কিন্তু ভয়ে ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।
মেরি তাহা দেখিয়া মনে মনে হাসিল, মনে মনে কহিল, ‘এরা আমাকে কত ভয় করে।’
সেদিন সমস্ত দুপুরবেলা সে ঘরের কোণে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। রাত্রে শয্যার উপর জাগিয়া পড়িয়া রহিল। প্রভাতে কোচমানকে ডাকাইয়া বলিল, ‘গাড়ি সাজাও—মিঃ বাথের বাড়ি যাইব।’
মিঃ বাথ ক্যাপ্টান নোলের এটর্নি। মেরি দ্বারে গাড়ি দাঁড় করাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। বৃদ্ধ বাথ একরাশি কাগজপত্র টেবিলে রাখিয়া কাজ করিতেছিল। মেরিকে সহসা অফিসে দেখিয়া অভিবাদন করিয়া উপবেশন করাইয়া বলিল, ‘এত সকালে?’
‘কাজ আছে। কর্নেল হ্যারিংটন আমার পিতার নিকট কত টাকা কর্জ লইয়াছিল?’
মিঃ বাথ খাতাপত্র দেখিয়া হিসাব করিয়া বলিল, ‘আট হাজার পাউন্ড।’
‘বেশ! সুদে-আসলে আজ পর্যন্ত তাহা কত হয়, শীঘ্র হিসাব করিয়া দাও।’
সে হিসাব করিয়া বলিল, ‘আজ পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার দুই শত পাউন্ড হয়।’
মেরি দন্তে দন্ত টিপিয়া বলিল, ‘খুব ভাল, জোঁক যেমন রক্ত শুষিয়া লয়, তেমনি করিয়া হিসাব করিয়াছ ত?’
বৃদ্ধ ভয় পাইল—বলিল, ‘হাঁ, সেই মত!’
‘আজ হইতে সাত দিনের মধ্যে আমার এই টাকা চাই—বুঝিলে?’
বৃদ্ধ অবাক হইয়া গেল। ‘এ কি কথা? সাত দিনের মধ্যে এত টাকা কে দিবে?’
মেরি চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল, ‘তাহার পুত্র দিবে। না পারে—তাহার বাটী ঘর দ্বার সমস্ত বিক্রি করিয়া লইব।’
বৃদ্ধ ভাবিল, ভিতরে কিছু ঘটিয়াছে; তথাপি বলিল, ‘এই সেদিন পুস্তক বিক্রয় করিয়া আমার নিকট দু’ হাজার পাউন্ড জমা দিয়া গিয়াছে। আর তাহার কিছু নাই। সেদিন বলিয়াছিল যে, সম্ভবতঃ আর দুই-তিন বৎসরের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করিবে। কিন্তু এত তাড়াহুড়া করিলে তাহার বাটী বিক্রয় ভিন্ন অন্য উপায় নাই।’
মেরি আগ্রহের সহিত বলিল, ‘বাটী বিক্রয় হইবে?’
‘বোধ হয়।’
‘হয় হউক—উত্তম কথা। আমার টাকা চাই। সাত দিনের মধ্যে—না হয় নালিশ করিও।’
বৃদ্ধ অনেক দেখিয়াছে কিন্তু এমনটি দেখে নাই। বলিল, ‘এত অল্প বয়সে তাহাকে পথের ভিখারী করিবে? কাহাকে দেশত্যাগী করা উচিত কি?’
মেরি চক্ষু রাঙ্গাইল। ‘টাকা তোমার নয়, আমার। আমি তাহাকে পদতলে টানিয়া লইতে চাই।’
শেষ কথাটা বৃদ্ধ ভাল শুনিতে পাইল না, বলিল, ‘কি করিতে চাও?’
‘কিছু না। শুধু টাকা চাই। আজ নোটিশ দাও—ঠিক সাত দিনের দিন।’
দশ
নোটিশ পাইয়া লিওপোল্ডের সমস্ত সংসার অন্ধকার বোধ হইল। সমস্ত রাত্রি চিন্তা করিয়াও সে কূল দেখিতে পাইল না।
প্রাতঃকালে, মেরি আপনার কক্ষে বসিয়া রক্তবর্ণ চক্ষু নত করিয়া কি ভাবিতেছিল, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া কহিল, ‘নীচে লিও দাঁড়াইয়া আছে।’
মেরি মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কে?’
‘লিও।’
‘দূর করিয়া দাও।’ ভৃত্য ভাবিল মন্দ নয়। সে চলিয়া যাইতেছিল—মেরি তাহাকে ডাকিয়া কহিল—’দাঁড়াও, দূর করিয়া দিও না। সে বড় অভিমানী—অপমান সহিতে পারে না—মিষ্টি কথায় যাইতে বলিও। বলিও, আমি বাড়ি নাই,—দেখিয়ো কিছুতে যেন সে মনে ক্লেশ না পায়, কিছুতে যেন সে বুঝিতে না পারে আমি ইচ্ছাপূর্বক দেখা করিলাম না। বুঝিলে?’
ভৃত্য ঘাড় নাড়িল। সে লিওকে খুব চিনিত;—বাটীর সকলেই চিরকাল তাহাকে সম্মান করিয়াছে; মেরি আজ্ঞা করিলেও কেহ তাহাকে অপমান করিতে পারিত না। সে নীচে চলিয়া গেল।
নিঃশব্দ পদক্ষেপে মেরি ভৃত্যের পশ্চাতে নামিয়া আসিল। ঈষৎ উন্মোচিত দ্বারের অন্তরাল হইতে দেখিল, লিও দাঁড়াইয়া আছে। মুখ বড় শীর্ণ, যেন কিছু পীড়িত। ভৃত্য কহিল ‘তিনি বাটী নাই।’
‘কোথায় গিয়াছেন?’
ভৃত্য বুদ্ধি করিয়া বলিল, ‘কাল রাত্রে লন্ডন গিয়াছেন।’
‘কবে আসিবেন?’
‘জানি না। বোধ হয় কাল।’
নিকটস্থ একটা চেয়ারের উপর লিও বসিয়া পড়িল। শরীর নিতান্ত পরিশ্রান্ত বোধ হইতেছিল।
ভৃত্য তাহা অনুমান করিয়া বলিল, ‘বসুন। আপনাকে বড় ক্লান্ত বোধ হইতেছে। এক গ্লাস বিয়ার আনিয়া দিব কি?’
লিও বলিল, ‘না।’
ভৃত্য ছাড়িল না। বলিল, ‘শরীর অসুস্থ বোধ হইতেছে। বিয়ারে উপকার হইবে।’
লিও অল্প হাসিয়া ধন্যবাদ দিয়া কহিল, ‘আমার দুই দিন হইতে জ্বর হইয়াছে, দুই দিন উপবাসী আছি—তাই এমন বোধ হইতেছে।’
এই সময় কবাট-জোড়াটা খুব দুলিয়া শব্দ করিয়া উঠিল। লিও চাহিয়া দেখিল—’ও কি!’
ভৃত্যও চাহিল—’বোধ হয় বাতাস।’
মেরি পা টিপিয়া দ্রুতপদে পলাইয়া গেল।
এই গ্রামে টমাস হগ বলিয়া একজন মহাজন বাস করিত। লিওপোল্ড বরাবর তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাকিয়া বলিল, ‘হগ, আমার বাটী বিক্রয় হইবে তুমি কিনিবে?’
হগ বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘বাটী বিক্রয় করিবে? কেন?’
‘সে কথা না শুনিলে কিনিবে না?’
‘নিশ্চয় নয়। কিন্তু কত টাকায় বিক্রয় করিবে?’
‘তের হাজার পাউন্ড পাইলেই বিক্রয় করিব।’
‘এত টাকা? কি প্রয়োজন?’
‘বলিতেছি। পিতা Captain Noll-এর নিকট আট হাজার পাউন্ড লইয়া বাটী বন্ধক রাখিয়াছিলেন। সুদে-আসলে তাহা প্রায় চৌদ্দ হাজার হইয়াছে। দুই হাজার পাউন্ড পরিশোধ করিয়াছি—আর বারো হাজার বাকি আছে। তাহাই পরিশোধ করিতে চাই।’
Thomas Hogg মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। ‘উঃ—তাঁহারা দুজনে বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তবুও এত সুদ! আমারাও যে এত লই না!’
লিও উত্তর দিল না। বলিল,’কিনিবে?’
‘কিনিতে পারি, কিন্তু অত টাকা দিতে পারি না। বারো হাজারের বেশি কিছুতেই নয়।’
লিও চিন্তা করিয়া বলিল,’আমার অনেক আসবাব আছে—তা’ ছাড়া এক ঘর পুস্তকও আছে—সমস্ত লইয়াও কি তের হাজার দেওয়া যায় না?
হগ কহিল,’যায়। কিন্তু বাটী বন্ধক আছে—তুমি যে টাকা পরিশোধ করিবে, তাহার প্রমাণ কি?’
লিও হাসিল। ‘আমাদের বংশে কেহ চুরি করে নাই—আমিও চোর নহি। তোমার বিশ্বাস না হয়, আমার সহিত এস, বন্ড তোমার হাতে দিব।’
হগ বিশ্বাস করিল। সমস্ত টাকা গুনিয়া দিয়া বলিল,’কাল রেজেস্ট্রি করিয়া দিও—কিন্তু এক কথা বলি, যদি কখন তোমার টাকা সংগ্রহ হয় আমার নিকট আসিও, তোমার বাটী তোমাকেই ফিরাইয়া দিব।’
সে রাত্রে লিওর পুরাতন ভৃত্য দুইটি বড় বেশি রকম কাঁদিতে লাগিল। আকস্মিক এরূপ সংবাদে তাহাদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। প্রত্যেকে ছয় মাসের করিয়া অধিক বেতন পুরস্কার পাইয়াছে, তথাপি কাঁদিতে ছাড়িল না। আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি গুছাইয়া বাঁধা হইল, বাকি যাহা রহিল, হগের লোক তাহা বুঝিয়া লইল। কাল সপ্তদিন পূর্ণ হইবে, পিতৃঋণ পরিশোধ করিয়া লিও কাল জন্মের মত কোরেল গ্রাম ছাড়িয়া যাইবে, চিরপুরাতন ভৃত্যেরা তাই কাঁদিয়া শেষ করিতে পারিতেছে না। লিও তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিতেছে—যদি বাঁচিয়া থাকি দুই বৎসরের মধ্যে আবার আমার কাছে আসিতে পাইবে। লিওকে তাহারা বাল্যকাল হইতে সত্যবাদী বলিয়া বিশ্বাস করিত—সেইজন্য কতক শান্ত হইয়াছে।
লিও ভাবিতেছে—জনক-জননীর মুখ, মেরি, তাহার জননী, পুস্তকের রাশি, ফুলের বাগান, তাহার চির সহচর ঐ ক্ষুদ্র পাঠাগার—আর ভাবিতেছে মেরি তাহাকে গৃহত্যাগী করিয়াছে।
দুশ্চিন্তা ও নানা কারণে সে রাত্রে তাহার প্রবল জ্বর বোধ হইল। সমস্ত রাত্রি একরূপ অচৈতন্য অবস্থায় কাটিল—দ্বিপ্রহরের পর জ্বরত্যাগ হইল, কিন্তু শরীর নিতান্ত দুর্বল। সামান্য জিনিসপত্র যাহা সাথে লইয়াছিল তাহা স্টেশনে পাঠাইয়া দিয়া নোটের তাড়া হাতে লইয়া মেরির গৃহে উপস্থিত হইল।
মেরি উপরে বসিয়া ছিল, ভৃত্য সংবাদ দিল, ‘লিও টাকা লইয়া আসিয়াছে।’ মেরি Bond লইয়া নীচে নামিয়া আসিল। কিন্তু টাকার কথায় সে আদৌ বিশ্বাস করে নাই, এবং এজন্য আপনাকেও প্রস্তুত করে নাই। সমস্ত দিন ধরিয়া সে এইরূপ একটা কল্পনা করিতেছিল, সে ভাবিতেছিল আজ তাহার চিরবাঞ্ছিত ধরা দিবে, আজ তাহার উচ্ছৃঙ্খল অতৃপ্তি পদতলে লুটাইয়া পড়িবে। তখন সে কি করিবে, কেমন করিয়া আপনার গাম্ভীর্য বজায় রাখিয়া সে সময়ের প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু মাথায় পাতিয়া লইবে, তাহাই স্থির করিয়াছিল। ঋণ পরিশোধ করিয়া লিও যে তাহাকে জন্মের মত পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারে, এ দুরদৃষ্টের এক বিন্দুও তাহার মনে উদয় হয় নাই। লিও তাহার বশ্যতা স্বীকার করিবে, কেননা সবাই করিয়াছে। এতদিন যে করিতেছিল না সে কেবল তাহার মূর্খতার ফল।
মেরি উপায়সিদ্ধির জাল বুনিতেছিল, কিন্তু এতদিন তাহা পারিয়া উঠে নাই,—এক দিক বুনিতে অন্য দিকের সুতা ছিঁড়িয়া যাইতেছিল। কিন্তু এতদিনে দুই দিকে বেশ শক্ত করিয়া বাঁধিয়া চমৎকার জাল তৈয়ার হইয়াছে, এবার শিকার ধরা পড়িবেই।
কতকটা হৃষ্টচিত্তে মেরি নামিয়া আসিল। বসিবার কক্ষে লিও দাঁড়াইয়াছিল। আসিয়াই দেখিল তাহার হাতে একতাড়া নোট রহিয়াছে, মেরি কাঠের মত হইয়া গেল। লিও হাসিয়া হস্তগ্রহণ করিল। মেরি মুখ অবনত করিল। মনে হইল হাত বুঝি বড় উষ্ণ, আর এ হাসি বুঝি উপহার দিবার জন্য কাহারো নিকট চাহিয়া আনিয়াছে।
লিও কহিল,’টাকা নাও। আজ সাত দিনের শেষ দিন।’
মেরি হাত পাতিল। লিও একে একে নোটের তাড়া গুনিয়া দিয়া বলিল, ‘হইয়াছে?’
মেরি পূর্বের মত মাথা নাড়িয়া Bond ফিরাইয়া দিল। একমুহূর্তে তাহার সমুদয় কৌশল, আশা, ভরসা সমস্ত ফাটিয়া গিয়াছে—ভিতরের হৃৎপিণ্ডও ফাটিবার উপক্রম করিতেছে; শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করিয়া এ সময়ে সে প্রাণপণে সচেতন রহিল; এ সময়ে অচেতন হইলে চলিবে না।
লিও কহিল, ‘আজ বোধ হয় এই শেষ। শেষ সময়ে তোমাকে দুটো কথা বলিতে চাই, শুনিবে কি?’
মেরি মাথা নাড়িয়া বলিল,’শুনিব।’
‘তবে এ কথাটি রাখিও। কাহাকেও সৎ দেখিয়া শীঘ্র বিবাহ করিও; তোমার অর্থ আছে—অর্থের জন্য ভাবিও না; শুধু সৎ এবং উচ্চ দেখিয়া কাহাকে বিবাহ করিয়া সুখী হইয়ো;—এরূপ ধনসম্পত্তি লইয়া অরক্ষিতা অবস্থায় বেশি দিন থাকিয়ো না।’
মেরি একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়া লিওর মুখপানে চাহিয়া অবনত হইল।
লিও কহিল, ‘আর একটি কথা!’ এই সময়ে দুজনেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল। ‘আর একটি কথা,—মনে রাখিও, লজ্জা যেমন স্ত্রীলোকের ভূষণ, অভিমানও তাই; কিন্তু বাড়াবাড়ি করিলে বড় কুফল ঘটে।’
এ কথা তাহাকে শিখাইতে হইবে না। জগতের মাঝে এ সত্য আজ মেরি অপেক্ষা বোধ হয় কেহই অধিক বুঝে না।
তারপর পাঁচটা বাজিল, ঘাড়ির পানে চাহিয়া লিও বলিল, ‘তবে যাই—আমার সময় হইয়াছে।’
চলিয়া যায় দেখিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বহু ক্লেশে মেরি কহিল,—’একটি কথা বলিয়া যাও—’
লিও ফিরিয়া আসিয়া কহিল, ‘কি কথা?’
‘এত টাকা কোথায় পাইলে?’
লিও মৃদু হাসিল। ‘এ কথা কেন জিজ্ঞাসা কর? আমার কোন্ কথা তুমি জান না?’
‘কি জানি? অমন গান গাহিতে জান তাহা কি কখন বলিয়াছিলে?’
লিও এবার যথার্থই হাসিয়া ফেলিল—‘কৈ, তুমি ত কখন জিজ্ঞাসা কর নাই? জিজ্ঞাসা করিলে কত গান শুনাইয়া দিতে পারিতাম, এতদিনে হয়ত তুমিও আমার মত শিখিতে পারিতে।’
মেরি কহিল, ‘সে কথা নয়, টাকা কোথায় পাইলে বল?’
‘কোথায় আর পাইব? পিতা যাহা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার কার্যে তাহাই ব্যয় করিলাম। বাড়ি, ঘর, ফুলবাগান, আমার একরাশি পুস্তক—যাহা কিছু ছিল প্রায় সমস্তই বিক্রয় করিয়া তাঁহার ঋণ পরিশোধ করিয়াছি।’
মেরি কঠিন দৃষ্টিতে মুখপানে চাহিয়া বলিল—‘বেচিয়াছ?’
‘সব।’
‘থাকিবে কোথায়? খাইবে কি?’
‘আপাততঃ লন্ডনে যাইতেছি—সেখানে কোন কার্য খুঁজিয়া লইব। আশা আছে সমস্ত দিন উপবাস করিতে হইবে না।’
‘লন্ডনে কোথায় থাকিবে?’
‘দিন কতক বোধ হয় হসপিটালে থাকিব, তাহার পর যাহা হয় করিব।’
‘সেখানে কেন?’
‘সেখানে কিছু দিন কাটাইতে হইবে বলিয়া অনুমান করিতেছি। আজ চার দিন হইতে জ্বর হইয়াছে, কিছুতেই সারিতেছে না,—সদ্য লন্ডনে গিয়া যে ভাল থাকব এ আশাও করি না, টাকাকড়িও সঙ্গে অধিক নাই,—সে অবস্থায় কোথায় আর যাইব বল?’
মেরি শিহরিয়া উঠিল। ‘অ্যাঁ—আজ চার দিনের জ্বর সারে নাই?’
‘কৈ আর সারিয়াছে।’
এক দণ্ডে মেরির সমস্ত মুখের ভাব পরিবর্তন হইয়া গেল। কাতরতা, বিষাদ, নিরাশা, লজ্জা, অভিমান সে-মুখে আর কিছুই রহিল না। শুধু বিশ্বব্যাপী প্রবল স্নেহ ও দিগন্তবিস্তৃত বিপুল শঙ্কা! প্রথমে সে হাত দিয়া লিওর কপোল স্পর্শ করিয়া শরীরের উত্তাপ দেখিল,—ভাল বুঝিতে পারিল না। তাহার পর দুই হস্তে লিওর মুখ নিচু করিয়া নিজের কপোল তাহার কপোলে সংলগ্ন করিয়া উত্তাপের স্তর অনুভব করিল; তাহার পর বিনা বাক্যব্যয়ে হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। দৃপ্ত চক্ষে অমানুষিক আভা।
লিও সভয়ে বলিল, ‘কোথা যাও?’
‘যেখানে ইচ্ছা; কোন কথা জিজ্ঞাসা করিও না।’
লিও ভাবিল, এ কি!
মেরি বরাবর তাহাকে টানিয়া লইয়া একেবারে উপরে উঠিল, তাহার পর আপনার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। অট্টালিকার মধ্যে এই কক্ষটিই সর্বাপেক্ষা সুন্দর এবং সজ্জিত। এক পার্শ্বে একটা প্রকাণ্ড দুর্মূল্য পালঙ্ক সজ্জিত ছিল, মেরি তাহার উপর লিওকে টানিয়া লইয়া বসাইয়া দিল। বালিশগুলি একত্র করিয়া বলিল, ‘চুপ করিয়া এখানে শুইয়া থাক—।’
চক্ষু ও মুখের ভাব দেখিয়া লিও পূর্বেই কিছু ভীত হইয়াছিল, এবার নিতান্ত ভয়ের সহিত বলিল—‘আমাকে যে আজ যাইতে হইবে। সময় উত্তীর্ণ হইতেছে।’
মেরি সে কথা শুনিতে পাইল বলিয়া বোধ হয় না। আপনার মনে একটা বহুমূল্য উষ্ণ শাল আনিয়া তাহার বক্ষ পর্যন্ত ঢাকিয়া দিয়া বলিল—‘লিও, এ সময়ে আমার সহিত কলহ করিলে চলিবে না। তুমি মনে করিয়াছ, ঋণ পরিশোধ করিয়াছ? কিছুই কর নাই!—আজ নয়, ভাল হও, তাহার পর এ কথা বুঝাইয়া দিব। তোমার যখন শরীর অসুস্থ তখন ও শরীরে আমারই সর্বময় অধিকার, আবার যখন ভাল হইবে তখন যাহা ইচ্ছা করিও—’
লিও স্তম্ভিত হইয়া গেল। এ কি কথা! ক্লিষ্ট শরীর মন্ত্রমুগ্ধবৎ ঢলিয়া আসিতেছিল, অর্ধমুদ্রিত চক্ষে লিও জোর করিয়া কহিল, ‘ছাড়িয়া দাও—আমি লন্ডনে যাইব।’
মেরি তাহার মুখের উপর মুখ রাখিয়া বলিল, ‘লন্ডনের কথা ছাড়িয়া দাও,—আমাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া শয্যার নীচে নামিলে, আমি এই ছাদ হইতে নীচে লাফাইয়া পড়িব। আমার মন এখন পাগলের মত হইয়া আছে,—অবাধ্য হইলেই প্রাণ বিসর্জন দিব।’
লিও ধীরে ধীরে বলিল, ‘তবে আর কি করিয়া যাইব।’ তাহার পর পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
এগার
পনর দিনের মধ্যে লিওর রীতিমত সংজ্ঞা হইল না; পনর দিন মেরি তাহার শয্যা ত্যাগ করিল না।
ডাক্তার বলিল, ‘মেরি, অত পরিশ্রম করিলে তুমিও পীড়িত হইয়া পড়িবে।’
মেরি ম্লান হাসিয়া উত্তর দিল, ‘ডাক্তার মহাশয়, এ সময়ে আমি পীড়ার ভয় করি না। এ স্থান ত্যাগ করিলেই আমার পীড়া হইবে।’
ডাক্তার বলিল, ‘আমি ধাত্রী আনাইয়া দিতেছি—দুইজনে পালা করিয়া শুশ্রূষা কর।’
মেরি মুখখানি আরও মলিন করিয়া বলিল, ‘তাহা হইবে না। এ সময়ে আমার কাহাকেও বিশ্বাস হয় না। গোলাপ ফুল বাসী হইয়াছে, রৌদ্রের তাপে বড় নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে—এতটুকু আঘাতেই হয়ত ঝরিয়া যাইবে,—তখন তুমি কি তাহাকে ফিরাইয়া দিতে পারিবে?’
নিরুত্তরে ডাক্তার চলিয়া গেল।
রোগ বেশি নহে, তথাপি লন্ডন হইতে তিন-চারজন ডাক্তার মেরির বাটীতে এই পনর দিন ধরিয়া বসিয়া আছে। একদিন তাহারা বলিল, ‘অনর্থক আর কেন আমাদিগকে ধরিয়া রাখিয়াছ—রোগ সারিয়া গিয়াছে।’
মেরি তাহাদের হাত ধরিয়া কাতর-কণ্ঠে কহিল, ‘ওগো, তোমরা আমার লিওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করিয়া আমার হাতে দিয়া—আমার সর্বস্ব লইয়া যাও—মানা করিব না কিন্তু এখন যাইও না—।’
তিন সপ্তাহ পরে লিওপোল্ড উঠিয়া বসিল। ডাক্তার এবং ঔষধের উপদ্রব আর নাই—। মেরি জানালা খুলিয়া দিল—আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল,—জ্যোৎস্না ঘরে আসিয়া পড়িল—মেরি চাঁদের পানে চাহিয়া সহসা লিওর বুকের উপর আসিয়া পড়িল। নিঃশব্দে অনেকক্ষণ বুকের উপরে অশ্রুসিক্ত করিল, তাহার পর চাঁদের পানে চাহিয়া বলিল, ‘ঐ দেখ, এখনও চাঁদের ভিতর কলঙ্ক বসিয়া আছে,—তোমারও কলঙ্ক তোমার বুকের উপর স্থান পাতিয়া বসিয়াছে,—তাড়াইবে কি করিয়া?’
লিওর চক্ষেও জল আসিল; সংবরণ করিয়া কহিল, ‘কলঙ্কই হউক, শোভাই হউক—বুকের উপর বড় দৃঢ় বসিয়াছে—পরিত্যাগ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’
তাহার পর একদিন বসন্ত প্রভাতে কোরেল গ্রামের গির্জায় বড় ধুমধামের সহিত ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সমস্ত গ্রামবাসী বড় জাঁকজমকের সহিত প্রফুল্ল মনে সেই দিকপানে ছুটিয়া চলিয়াছে—।
সেখানে কি হইতেছে তোমরা কেহ জিজ্ঞাসা করিবে কি?
দু’টি আবেদন
এক
ভারতের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি-আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসই ছিল এতাবৎ একমাত্র রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইহার শক্তি ছিল ক্ষুদ্র, উদ্যম ছিল অকিঞ্চিৎকর, পরিসর ছিল সঙ্কীর্ণ, এবং জীবন ছিল নৈরাশ্যপীড়িত, দেশের যৌবনশক্তি না যতদিন ইহাতে যোগ দিয়াছিল। ইহা যে অত্যুক্তি নয় একটু চিন্তা করিয়া দেখিলেই তাহা দেখা যাইবে।
কংগ্রেসকে শক্তিশালী করিয়াছে দেশের যৌবন, তথাপি সেই কংগ্রেসের কাটা-ছাঁটা, ধরা-বাঁধা মুষ্টিভিক্ষায় যৌবনের ক্ষুধা মিটিল না; তাই যুব-সমিতির সৃষ্টি। এই তো সেদিনের কথা,—জন্মের তারিখ গণনায় ইহার হিসাব মিলিবে না, কিন্তু যে মুহূর্তে সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিয়াছে তাহার বাধা নাই, বিনাশ নাই, সে অপরাজেয় এবং তাহার ‘পরেই এ দুর্ভাগা দেশের সব চেয়ে বড় দাবী, সেই দিন হইতেই এই সমিতির বিস্তৃতির আর বিরাম নাই। সঙ্ঘ-শক্তির অপরিমেয় বিকাশে আজ এই প্রতিষ্ঠান অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।
স্বদেশের মুক্তি-সংগ্রামে বাঙ্গলার স্থান যে কোথায় এ কথা নিজে বাঙ্গালী হইয়া উচ্চারণ করিলে আমার অবিনয়ের অপরাধ স্পর্শিবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশের মাঝখানে হাওড়া জেলার নাম সসম্ভ্রমে উল্লেখ করিতে আর কোন সঙ্কোচ নাই। ইহার বিগত ইতিহাস যাঁহারা জানেন তাঁহারাই এ কথার সত্যতা বুঝিবেন।
অন্যান্য স্থানের ন্যায় হাওড়ার যুব-সমিতির সম্মিলনও আসন্নপ্রায়। ইহার অনেক কাজ রহিয়াছে। তাই সর্বসাধারণের কাছে, বিশেষ করিয়া দেশের তরুণসম্প্রদায়ের কাছে আমার একান্ত নিবেদন, তাঁহারা যেন একযোগে এই সম্মিলনীকে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করিতে অবহেলা না করেন। আপনাদের পক্ষ হইতে আমি বঙ্গদেশের সকল জেলার সকল কর্মীকেই আমন্ত্রণ করিব এবং নিঃসন্দেহে জানি আমার আহ্বান তাঁহারা কেহই উপেক্ষা করিতে পারিবেন না।
যৌবনে নিজের আর আমার দাবী-দাওয়া নাই, সামর্থ্যও নিঃশেষিতপ্রায়, তথাপি ইহার উদ্বোধনের ভার যুবকেরা স্নেহবশতঃ আমার হস্তেই ন্যস্ত করিয়াছেন। যথাশক্তি কর্তব্য সমাপন করিব প্রতিশ্রুত হইয়াছি।
এখানে এই ব্যাপারে আর একটা কথা সকলকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করিতেছি। যুব-সমিতির সম্মিলনের আয়োজনের প্রারম্ভেই জন-কয়েক বিশিষ্ট কর্মী-যুবক ব্যক্তিগত মতবিরোধের জন্য বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছেন। প্রথমে, উভয় পক্ষই আমাকে মীমাংসা করিয়া দিতে আহ্বান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক পক্ষের আহ্বানে বোধ করি আন্তরিকতা ছিল না।
আমার প্রতি অশ্রদ্ধাবশতঃ আমার নির্ধারণ তাঁহারা গ্রহণ করিতে পারিলেন না, ‘কর্মী-সম্মিলনী’ নাম দিয়া তাঁহারা স্বতন্ত্র আয়োজনে ব্যাপৃত।
এইভাবে যুব-শক্তি খণ্ডিত বিক্ষিপ্ত হওয়া যত বড় বেদনার বস্তুই হোক, যাহা হইল না তাহা লইয়া ক্ষোভ করা নিষ্ফল। বোধ করি, ইহাই এ দেশের সনাতন-রীতি। যাই হোক, তাঁহাদের অধিকাংশই আমার সুপরিচিত, কর্মনৈপুণ্যে, নিষ্ঠায়, দেশের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অনুরাগে তাঁহারা কাহারও অপেক্ষা ন্যূন নহেন। সেও দেশেরই কাজ, দেশের মুক্তি তাঁহাদেরও সাধনার সামগ্রী। প্রার্থনা করি, সে অনুষ্ঠানও যেন জয়যুক্ত হয়, ইতি—৪ঠা শ্রাবণ ১৩৩৬।—(বঙ্গবাণী, ২৪ জুলাই ১৯২৯)
দুই
রূপনারায়ণ নদীর ধারে পানিত্রাসে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে ঘাটাল স্টীম নেভিগেশান কোম্পানীর স্টীমার ও লঞ্চ চলে। কোলাঘাট হইতে ঘাটাল পর্যন্ত ইহাদের গতায়াত। হোরমিলার কোম্পানীও এই লাইনে তাহাদের স্টীমার চালায়। গত ছয় বৎসর কাল এই দুইটি কোম্পানীর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি। হোরমিলার কোম্পানীর স্টীমার বড়, অথচ কম জলে চলিতে পারে; সুতরাং সারা বৎসর তাহাদের চলায় বাধা হয় না। এ ছাড়া তাহাদের অর্থের অভাব নাই; ফলে ভাড়া কমাইয়া যাত্রীদের সিগারেট উপহার দিয়া, একতলা ও দোতলার ভাড়া সমান করিয়া এবং অধিকসংখ্যক স্টীমার দিয়া তাহারা দেশী কোম্পানীর পক্ষে প্রতিযোগিতা কঠোর ও নিদারুণ করিয়া তুলিয়াছে। দেশী কোম্পানীর স্টীমার ছোট, জল ভাঙ্গে বেশী, সেইজন্য সারা বৎসর সকল সময় চলিতে পারে না। তথাপি, এতপ্রকার অসুবিধাসত্ত্বেও দেশী কোম্পানীর স্টীমারে লোক যথেষ্ট হয়। ইহার একটা বড় কারণ এই যে, যাত্রিগণের অধিকাংশই এই স্বদেশী ‘ঘাটাল কোম্পানীর’ অংশীদার এবং প্রায় সমস্ত দেশের লোকই এখন দেশী কোম্পানীকে নানাভাবে সাহায্য করিতে চায়। এই-সকল কারণে এবং ঘাটাল কোম্পানীর ডিরেক্টারদের কর্মপটুতা, সততা ও নিঃস্বার্থতার জন্য এই ধনী, বিদেশী ও শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বীর সহিত লড়াই করিয়া, প্রতি বৎসর ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াও দেশী কোম্পানীটি এখনও টিকিয়া আছে।
এই দেশী কোম্পানীটিকে এই অসম প্রতিযোগিতার হাত হইতে রক্ষা করিয়া বাঁচাইয়া তোলা দেশের লোকের একান্ত কর্তব্য। বহুদিন হইতে ইহার সকল দিক দেখিয়া ও চিন্তা করিয়া বুঝিয়াছি যে, যাতায়াতের যথেষ্ট ও নিয়মিত সুবিধা করিয়া দিতে পারিলেই যাত্রীরা দেশের বর্তমান অবস্থায় বিদেশী কোম্পানীকে ছাড়িয়া দেশী কোম্পানীরই পৃষ্ঠপোষকতা করিবে। ইহার জন্য প্রয়োজন হোরমিলার কোম্পানীর ‘শীতলা’র মত একখানি বড় স্টীমার।
ইতিপূর্বে ঘাটালের বিশিষ্ট উকীল, মোক্তার, ডাক্তার, মহাজন প্রভৃতি কোম্পানীর পরিচালকগণ নিজেদের এবং এগার শত যাত্রীর মধ্যে ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা তুলিয়া দুইটি ছোট স্টীমার ও একটি মোটর লঞ্চ ক্রয় করিয়া আজ ছয় বৎসর এই লড়াই চালাইতেছেন। তাহার উপর বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা-বিপর্যয়ে ঘাটালের জনসাধারণের যে অবস্থা হইয়াছে, তাহাতে সেখান হইতে আরও বেশীসংখ্যক অংশীদার পাওয়ার আশা করা বর্তমানে শুধু অন্যায় নহে, নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতা। সেইজন্য আমি আজ এই আবেদন লইয়া দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে।
কোম্পানীটি এবং কোম্পানীর ক্রিয়াকলাপ ঘাটালের স্থানীয় ব্যাপার হইলেও, সমস্যাটি স্থানীয় নহে, সর্বজনীন। দেশী কোম্পানী বনাম বিদেশী কোম্পানী ইহাই হইল আসল সমস্যা। একটি দেশী বাঙ্গালী কোম্পানীকে বাঁচাইয়া তুলিয়া লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত করা বাঙ্গালীর শুধুই কর্তব্য নয়, গৌরবের বিষয়। আশা করি, এই স্বাদেশিকতার ক্ষেত্র হইতে সমস্যাটিকে দেখিয়া দেশের শিক্ষিত জনসাধারণ ও ধনিগণ এই কোম্পানীকে স্বেচ্ছায় ও সানন্দে সাহায্যদানে অগ্রসর হইবেন। শুধু সাহায্য ভিক্ষা দিয়া নয়,—ব্যবসায়ে অংশীদার হইয়া যে সাহায্য দেওয়া যায় তাহাই আমরা চাই। অথচ, এ কথা প্রকাশ করা প্রয়োজন যে, এই অসম প্রতিযোগিতায় হয়ত অনেকদিন পর্যন্তই দেশী স্টীমার কোম্পানী লাভবান হইতে সমর্থ হইবে না। তথাপি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, একটি বড় স্টীমার ক্রয় করিতে পারিলেই এই দেশী ‘ঘাটাল কোম্পানী’ অচিরভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামুক্ত হইয়া একটি লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হইতে পারিবে।
এই কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ আমার সবিশেষ পরিচিত। তাঁহাদের সহিত ভালরূপ মিশিয়া দেখিয়াছি যে, তাঁহারা প্রত্যেকেই এই কোম্পানীর কাজকে জাতীয় কাজ মনে করিয়া একান্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সহিত বিনা-পারিশ্রমিকে ইহার কর্ম পরিচালনা করিতেছেন। এরূপ অবস্থায়, প্রতিযোগিতা প্রতিরোধ করিবার মত সাহায্য ও সুবিধা পাইবামাত্রই এই দেশী কোম্পানী সুদৃঢ় ভিত্তির উপর নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হইবে।
সর্বাপেক্ষা আশা ও আনন্দের কথা এই যে, ইহার ম্যানেজার শ্রীযুক্ত বিপিনচন্দ্র ভট্টাচার্য শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী গ্রাজুয়েট নন—কলকব্জা সম্বন্ধে তাঁহার হাতেকলমে শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতাও প্রচুর পরিমাণে আছে। তিনি নিজ হাতে স্টীমার চালানো শিক্ষা করিয়া পোর্ট আফিসে সারেঙের পরীক্ষায় পাশ করিয়াছেন এবং গত পাঁচ বৎসর ধরিয়া স্টীমারের যাবতীয় কলকব্জা কোনো ডকে না দিয়াও গবর্নমেণ্ট সারভেয়ারের অনুমোদনে নিজেই মেরামত করিয়া চালাইতেছেন। কলকবজা-ঘটিত ব্যক্তিগত জ্ঞানের অভাবে বহু স্থানে এইরূপ কোম্পানীর যে ক্ষতি হয়, বর্তমান ক্ষেত্রে তাহার আশঙ্কা নাই। প্রয়োজনীয় মূলধন পাইলে এরূপ সুদক্ষ ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে এই কোম্পানীর ক্রমোন্নতি অবশ্যম্ভাবী। আশা করি, দেশের কল্যাণকামী জনগণের নিকট আমার এই আবেদন ব্যর্থ হইবে না।—(বঙ্গবাণী, ২৩ শে মার্চ ১৯৩১)
দুটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ
এক
দেশকে স্বাধীন করার প্রয়াস ‘ন্যারো ন্যাশনালিজম্’ ও নয়; ‘চাঊভিনিজম্’ ও নয়; বিশ্বমানবের হিতের জন্যই নিজের দেশ। যে দেশে জন্মেছি, মানুষ হয়েছি, সে দেশকে পরা-অধীনতার নিদারুণ অভিশাপ থেকে মুক্ত কোরব।
আদর্শের উল্লেখ যখন কোরব তখনই বৃহৎ আদর্শ, কল্যাণের আদর্শ গৌরবের আদর্শের কথাই স্মরণ কোরব। কেবল মহামানবতার আদর্শ গ্রহণ কর, তাকে ভারতের আদর্শ, এশিয়ার আদর্শ, হিন্দুর আদর্শ—এদিক দিয়ে কিছুতেই বিচার কোরব না। কারণ সেই ত ক্ষুদ্র মনের সঙ্কীর্ণ হীন আদর্শ; কোনমতেই সর্বজনীন মুক্ত আদর্শ নয়।
ত্যাগ কিসের? ভোগ করবে কে? কিসের জন্য জীবনের সর্বস্ব পরিত্যাগব্রতী হব? যারা বৃহত্তর স্বার্থের জন্য সামান্য বিশিষ্ট স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবে না—শুধু তাদের জন্য? এ যেমন আত্ম-বিড়ম্বিত কৃপণের ধন সঞ্চয়ের মত, আমি না খেয়ে না পরে না দিয়ে খেটে খেটে মরি, আমার নন্দদুলাল ছেলেটা যেন সমস্ত নিষ্ফল জীবনটা নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে পারে—এরই জন্য?
হে ভারত, তুমি কি শিখায়েছ না, ধর্মযুদ্ধে পদে পদে ক্ষমিতে অরিরে! তাই ভারতের আজ এত বড় দুর্দশা। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় ঈশ্বর-বিশ্বাসী জগতে কেউ আছেন বলে আমার মনে হয় না। এই পরম ভাগবত কবির সহস্র পলিটিক্যাল যুক্তি-তর্ক ভগবানের রুদ্ধদ্বারে এসে আছাড় খেয়ে পড়ে। তাঁর একান্ত বিশ্বাস বিধাতার কল্যাণহস্তই সব কিছু করে চলেছে, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা কি তা আমরা জানিনে, তাঁর ইচ্ছার দোহাই পলিটিক্স-এ আসা কোন কারণেই আমার ভালো মনে হয় না।
প্রাচীনকালের দর্শনের বড় বড় যুক্তি-তর্ক যেমন বেদের বাণীর দরজায় এসে নিজেদের পথ হারিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হোতো।
বড় বড় ঈশ্বর-বিশ্বাসী ভক্তের দলই এ যাবৎ দেশের পলিটিকস্ নিয়ে নাড়াচাড়া করচে। যাঁদের হওয়া উচিত ছিল সন্ন্যাসী, তাঁরা হলেন পলিটিশিয়ান। তাই ভারত পলিটিক্সে এত বড় দুর্গত।
দুই
সংসারে যাহার যথার্থ মর্মটি উদঘাটন করা যত দুরূহ, মিথ্যায় বিড়ম্বিত করিয়া তোলা তাহাকে তত সহজসাধ্য।
সুবিস্তীর্ণ বারিধির কূল-কিনারা মানুষের চোখের উপর থাকিতে পায় না বলিয়াই উপরের মেঘ ও আকাশ এমন করিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহাকে সব দিকে মিথ্যায় সীমাবদ্ধ করিয়া ফেলিবার সুযোগ পায়।
ভগবান ব্যাপারটির প্রতি চাহিয়া দেখ। ইহার সত্য তত্ত্বটি আবিষ্কার করা নাকি একান্ত কঠিন, তাই কুতত্ত্বে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলা এত সহজ। অজ্ঞানী-জ্ঞানী, বোকা-বুদ্ধিমান সকলেরই যেন বলিবার বিষয় ইহাতে কিছু-না-কিছু থাকেই। আবার সবচেয়ে কৌতুক এই যে, ইহাতে জ্ঞানীর চেয়ে অজ্ঞানীর, বুদ্ধিমানের চেয়ে বোকার হাতটাই বেশি খেলে। ইহাদের নৈপুণ্যই যেন সকলের উপর ফেনাইয়া উঠিতে থাকে। কিন্তু, তাই বলিয়া অকৌতুকও বড় কম নাই। কারণ, ফেনা জিনিসটি চিরস্থায়ী হইয়া রহে না। সুতরাং আনাড়ীর সুবিধাটা শুধুই ততক্ষণ, যতক্ষণ এই ফেনাটা বাঁচিয়া থাকে; যতক্ষণ ভাসমান বুদ্বুদপুঞ্জে আসল বস্তুটি আবৃত করিয়া রাখার উপায় থাকে। এই বুদ্বুদ সমষ্টি কোন গতিকে মরিয়া গেলে আর রক্ষা নাই। তখন অসত্যের যে চেহারা বাহির হইয়া পড়ে তাহা অতি কদর্য, অতি ভয়ানক। এ ছাড়াও একটা নিদারুণ অসুবিধা এই যে, এই সকল অগাধ, অতি বৃহৎ ব্যাপারের সাঁচ্চা ও ঝুটার হিসাব ঠিক এই অনুপাতেই গণনা করা হয়। সুতরাং সে অঙ্কফলে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকেই। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। রাঙ কিনিতে গিয়া ঠকিয়া সীসা কিনিয়া আনিলে ক্ষতি হয়ত হয়, কিন্তু ভরাডুবি হয় না, কিন্তু হীরা কিনিতে গিয়া ঠকিয়া আসিলে যে বস্তুটা ঘরে আসে সেটা কাঁচ মাত্র। একেবারে ফেলিয়া দিতে হয়। সাহিত্যও ঠিক তাই। অপরিসীম ব্যাপার, অগাধ ব্যাপ্তি। সুতরাং ইহারও সাঁচ্চায়-ঝুটায় আকাশ পাতাল প্রভেদ। অথচ, উপরোক্ত কারণে কাহাকেই হাত খেলাইতে নিষেধ করিবার জো নাই। মানুষ যাই আপনাকে বুঝিয়া ফেলে সে অতি-বুদ্ধিমান, যেহেতু, সাংসারিক ছোট বিষয়ে, অর্থাৎ যাহার উভয় তট মানব-চক্ষুর অন্তর্গত, যাহা সুনির্দিষ্ট, যাহাতে হাত দিবামাত্রই পৃথিবীর নির্বোধ লোকগুলোর সহিত অনধিকারচর্চা বাবদে খ্যাচাখিচি বাধে, বেরসিক লোকগুলা তাহাদের অকেজো জগতের বৃহত্তম তোরণের বহির্দেশে অসম্ভ্রমে বিদায় করিয়া দেয়, অমনি বাহিরে আসিয়াই বুদ্ধিমান টের পায় এ জীবনের লক্ষ্য কি! লক্ষ্য সাহিত্য সৃষ্টি করা। শুদ্ধমাত্র এই জন্যই তাঁহার ধরাধামে আগমন। অতএব, আর কালবিলম্ব না করিয়া, অমূল্য সময় অপব্যয় না করিয়া এক পা ছোটগল্প ও আর এক পা খণ্ডকবিতার মাথায় গিয়া হৈহৈ শব্দে কর্তব্যপথে আগুয়ান হইয়া পড়ে।
এ পথের সুবিধা-অসুবিধার কথাটা পূর্বেই বলিয়াছি, সুতরাং পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নাই। কিন্তু, ফলাফলের কথাটা, অর্থাৎ সেই হীরক ও কাঁচখণ্ডর উপমাটা আর একবার স্মরণ করাইয়া দিয়া আসল কথাটা বলিয়া যাই।
কিন্তু, পূর্বাহ্ণেই একটা অবান্তর কথার আবশ্যক। আজকাল কোন একটা মাসিকপত্র খুলিলেই চোখে পড়ে ছাপার অক্ষরগুলোকে প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করে হইয়াছে। একভাগ ছন্দোবদ্ধ ব্যাপার, অর্থাৎ—পদ্য [যাঁহারা লেখেন তাঁহাদের ভাষায় ‘কবিতা’!] আর এক ভাগ—যাহাতে ছন্দের বালাই নাই—অর্থাৎ কিনা গদ্য! পদ্যের আলোচনা পরেই হইবে, আগে গদ্যের কথাটাই বলি। এই গদ্য দুই শ্রেণীর। মাসিকের সম্পাদকেরা বলেন, ‘কথাসাহিত্য’ ও ‘গবেষণামূলক প্রবন্ধ’! এই ‘কথাসাহিত্য’ আবার তিন প্রকার। প্রথম ছোটগল্প, দ্বিতীয় ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য উপন্যাস’ এবং তৃতীয়—যাহাকে সাহিত্যিকেরা কহেন—‘বিদেশের রত্নরাজি আহরণপূর্বক ভাষাজননীর শ্রীপদপঙ্কজে উপহার।’ উপহার! উপহারের দাম কষিতে গেলে লোকে আমাকে ইতর বলিবে, সুতরাং সেটা থাক। বাকী রহিল ছোটগল্প ও ক্রমশঃ প্রকাশ্য উপন্যাস। কিন্তু, ইহাই বিশেষ করিয়া নাকি এ প্রবন্ধের আলোচ্য বস্তু, তাই শেষে বলিব।
গবেষণামূলক প্রবন্ধ! ইহাতে সাধারণতঃ কি বুঝায়, এ প্রশ্ন আর কোন দেশের লোক করিয়া বসিলে নিশ্চয়ই বিপদে পড়িতাম এবং খুব সম্ভব জবাব দিতেও পারিতাম না, কিন্তু, বাঙ্গালা মুলুকের লোকের কাছে ভয় পাইবার কিছুমাত্র হেতু দেখি না। কারণ, এ মুলুকের গবেষণার ধারা আমি বিদিত আছি। ইহা মাত্র দুই প্রকার এবং গবেষণাকারীরা দুই দল হইয়া বিরাজ করেন। এ দলের একজন যাই ‘পদ্যপ্রচারিণী’তে গবেষণা করেন, ‘বিক্রমপুর পরগণার স্বর্ণভৃগু গ্রামের তিন্তিড়ী বৃক্ষমূলে যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহাই ভোজরাজের তাম্রশাসন এবং ইহাই বাঙ্গালার ইতিহাসের প্রকৃত উপাদান।’ ‘গদ্যপ্রচারিণী’তে ও-দলের আর একজন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেন—‘কখনই না। কারণ, এই প্রমাণ—ওই প্রমাণ—সেই প্রমাণের বলে স্পষ্ট জানা যাইতেছে, ওটা ভোজরাজের তাম্রশাসন হইতেই পারে না, ওইটাই তাম্ররাজের ভোজশাসন, যাহা নবম ধর্মপালদেব পঞ্চম বিক্রমপালদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া উজ্জয়িনীর তটে—উৎকীর্ণ করিয়া তাম্রলিপ্ত নগরে প্রোথিত করিয়াছিলেন, অতএব ইহাই বাঙ্গালার আসল ইতিহাস।’
দ্বিতীয় প্রকার হইতেছে, প্রাচীন কবিদিগের কাল নিরূপণ করা। একজন বলিতেছেন, কবি কালিদাসের প্রকটকাল ৫৬৮ শকে, আর একজন সংশয় প্রকাশ করিয়া জবাব দিতেছেন—শ্রদ্ধেয় লেখকের গণনায় ঈষৎ ভুল হইয়াছে। কারণ, অনঙ্গদেবের প্রপিতামহ তখন মগধের সিংহাসন অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। সুতরাং এক পুরুষে যদি ২৫ বৎসর ধরা যায়, তাহা হইলে কালিদাসের জন্মকাল ১১৯৩ সংবতের পূর্বে ঘটিতেই পারে না।
এখানে হতভাগ্য পাঠক-পাঠিকার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আত্মরক্ষা অতি শ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং এ অধিকার সকলেরই আছে। কাজেই, পাঠকবেচারা যদি প্রাণের দায়ে গবেষণার হাত ছিনাইয়া কথাসাহিত্যের ভিতরে গিয়া ঢোকে তাহাকে নিন্দা করা চলে না। অবশ্য, এই যাওয়াটাকে ইংরাজি ভাষায় ‘ফ্রাইং প্যান টু দি ফায়ার’ বলিয়া পরিহাস করা চলে কিনা, ঠিক জানি না, কিন্তু আর কোন নিরাপদ স্থানের সংবাদও ত তাহাকে বলিয়া দিতে পারিলাম না।
এ হেন যে ‘গবেষণামূলক’ তাহা যে কি বস্তু আশা করি সাধারণকে তাহা বুঝাইতে পারিয়াছি। অন্ততঃ আমি ত শপথ করিতে পারি, বাঙ্গালা গবেষণাময় প্রবন্ধে ইহার অধিক কিছু এখনও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই। কেহ হইয়া থাকিলে দয়া করিয়া লিখিয়া জানাইবেন, আজীবন কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিব।
এইবার ‘কথাসাহিত্যের’ কথা। দুনিয়ায় গান গাহিতে পারে না এমন লোক বিরল, কথাসাহিত্য সৃষ্টি করিতে পারে না এমন হতভাগা ত নাই-ই। কারণ, কথার ত অন্ত নাই। থাকিলে, আজ পর্যন্ত এত মানুষ এত কথা লিখিয়া ফেলিয়াছে, কোন্ যুগে ইহার শেষ হইয়া যাইত। সে ত হইবার নয়। যাহার আদি অন্ত নাই তাহার অতীতও নাই ভবিষ্যৎও নাই। যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহাও গত নয়, যাহা ঘটে নাই তাহাও অনাগত নয়। সৃষ্টি করার পক্ষে ইহাই ইহার প্রচণ্ড সুবিধা। মানুষের অদৃষ্ট ত দেখা যায় না, সে কি করিবে না করিবে, কি হইবে না হইবে, কোথায় জীবনের কূল-কিনারা সে ত কাহারও ঠাহর করিবার জো নাই, তাই নবীন সাহিত্যস্রষ্টা যখন দিকচক্রবালে আঙুল তুলিয়া জোর করিয়া বলেন, ওর বেশি নাই, তখনও চুপ করিয়া থাকিতে হয়, এবং ভাবুক কবি যখন অপার আকাশে মুখ তুলিয়া মানবসৃষ্টির অগোচর বহু বহু দূরে ইঙ্গিত করিয়া হৃদয়ে অসীমতার আভাস জাগাইয়া দেন তখনও নির্বাক স্তব্ধ হইয়া থাকিতে হয়। হয় বটে, কিন্তু চুপ করিয়া যাওয়া এবং স্তব্ধ হইয়া থাকা এক বস্তু নয়। তাহাই বলিতেছি…।
দেশসেবা
দেশসেবা কথার কথা নয় দেশসেবা মানবের শ্রেষ্ঠ সাধনা। স্বার্থ-গন্ধ থাকবে না, নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, প্রাণের ভয় পর্যন্ত থাকবে না, এক দিকে দেশসেবক নিজে, আর দিকে তার দেশ, মাঝে আর কিছু থাকবে না। যশ, অর্থ, দুঃখ, পাপ, পুণ্য, ভাল, মন্দ সব যে দেশের জন্য বলি দিতে পারবে, দেশসেবা তার দ্বারাই হবে।
রাষ্ট্রীয় সাধনাতে নারীকেও নাবতে হবে—দেশের স্বাধীনতার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত সাধনা চাই, তা নইলে কিছু হবে না। আমি জানি ছেলেরা আর মেয়েরা যদি এক সঙ্গে কাজে নামে, তাহলে দেশের লোক নানারকম কুৎসা রটাবেই—তা রটাক। নিন্দুক তার কাজ করবেই, কিন্তু তাই বলে কি আমরা কাজ বন্ধ রাখবো? দেশের জন্য যে সুনামের প্রতিষ্ঠা ত্যাগ করতে পারবে না, তার আবার ত্যাগ কোথায়?
দেশের স্বাধীনতা কেউ চায় না—সবাই চায় নাম প্রতিষ্ঠা, বড় বড় বচন ঝেড়ে নেতা হতে—সত্যিকার ক’টা লোক পরাধীনতার জ্বালা অনুভব করে? দেশের কি দেখে আশান্বিত হব? আমার দেশের ছেলেরা ম্যালেরিয়ায় ভুগে মরবে, তবু দেশের জন্য মহিমময় মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। দেশের জন্য লাঞ্ছনা সওয়া, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া সে কি সোজা সৌভাগ্য? দেশ উঠবে কি করে? দেশের জন্য কি কেউ প্রাণ দিতে চায়? দেশের জন্য কি কেউ ত্যাগ স্বীকার করতে চায়? আবার যেদিন দেশে নগরে স্বার্থত্যাগী সন্তান জন্মাবে, সত্যিকার দেশের কাজ সেই দিন সম্ভব হবে।
‘নারীর মূল্য’র ভূমিকা
১৩২০ সালের ‘যমুনা’ মাসিকপত্রে ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকরূপে যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন আমরা এগুলি গ্রন্থাকারে ছাপিবার অনুমতি লাভ করি।
কি মনে করিয়া যে শরৎবাবু তখন আত্মগোপন করিয়া শ্রীমতী অনিলা দেবীর ছদ্মনাম গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে তিনিই জানেন। তবে, তাঁহার ইচ্ছা ছিল এমনি আরও কয়েকটি ‘মূল্য’ লিখিয়া ‘দ্বাদশ মূল্য’ নাম দিয়া পরে যখন গ্রন্থ ছাপা হইবে, তখন তাহা নিজের নামেই বাহির করিবেন। তারপরে, এই দীর্ঘ দশ বৎসর কাটিয়া গেল, না লিখিলেন তিনি আর কোন ‘মূল্য’, না হইতে পাইল ‘দ্বাদশ মূল্য’ ছাপা। আমরা গিয়া বলি, মশায়, আপনার দ্বাদশ ‘মূল্য’ আপনারই থাক, পারেন ত আগামী জন্মে লিখিবেন, কিন্তু যে ‘মূল্য’ আপাততঃ হাতে পাইয়াছি, তাহার সদ্ব্যবহার করি,—তিনি বলেন, না হে, থাক, এ আর বই করিয়া কাজ নাই। কিন্তু কারণ কিছুই বলেন না। এমনি করিয়াই দিন কাটিতেছিল। অথচ, তাঁহার মতের পরিবর্তন হইয়াছে তাহাও নয়,—আমাদের শুধু মনে হয়, তখনকার কালে নারীরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কথা কহিতে শিখে নাই বলিয়াই এ কাজ তিনি করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন কাগজে কাগজে ইঁহাদের দাবী-দাওয়ার প্রাবল্য ও পরাক্রান্ত নিবন্ধাদি দর্শন করিয়া এই বৃদ্ধ গ্রন্থকার ভয় পাইয়া গেছেন। তবে, এ কেবল আমাদের অনুমান, সত্য নাও হইতে পারে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, এ বই ছাপাইবার তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইহা প্রকাশ করিয়া ভাল করিয়াছি, কি মন্দ করিয়াছি, তাহা পাঠক বলিতে পারেন, আমাদের ত মনে হয় মন্দ করি নাই। কিন্তু ইহার যত কিছু দায়িত্ব সে আমাদেরই।
বামুনের মেয়ে’র নাট্যরুপ
প্রথম অঙ্ক
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
দুদিন পরে পথ্যি কোরেই আজ আবার কেন সেলাই নিয়ে বসলি মা? একটু শুগে না।
সেলাই-এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়াই কহিল, দুপুরবেলা আমি ঘুমোতে পারিনে মা। তা ছাড়া সন্ধ্যা ভারী তাগাদা করে পাঠিয়েছে, আজ এটা শেষ করে দিতেই হবে। কাল সকালেই হাট কিনা।
এই সব বিক্রি করে তবে বুঝি তোমাদের মেয়ে-ইস্কুলের খরচ চলে? কেন সন্ধ্যার বাপের ত টাকার অভাব নেই? তার দাদা অরুণও ত শুনতে পাই অনেক টাকার মানুষ। সেও কি বোনের শখের ইস্কুলের খরচটা দিতে পারে না?
পারবে না কেন মা? কিন্তু আমরা কারো কাছে সাহায্য চাইনে। নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাই। সন্ধ্যা বলে, মেয়েরা আরও একটু ভালো সেলাই শিখলে, আমাদের ইস্কুলেরও ভাবনা থাকবে না। তাদের নিজেদেরও অভাব ঘুচবে। এমন কি যদি দরকার হয়, ভবিষ্যতে তারা শুধু সেলাই করেই আপনাদের খরচ আপনারা চালাতে পারবে। একি সোজা কাজ মা?
হাটে যাবে কেন মা,—দোকানদার বাড়িতে এসে দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। আর তাই যদি বল, এ সব ভদ্রঘরের মেয়েরি ত বেশি দরকার। ছোটলোকদের মেয়েরা অনেক কাজ করতে পারে, যা আমরা পারিনে। শশীর মায়ের যে কত কষ্ট যাচ্ছিল মা! রোজ দুবেলা ভাত পর্যন্ত জুটত না। ভিক্ষে করে ত আর দুঃখ ঘোচে না, তাই সন্ধ্যা তাদের দু’বোনকেই ডেকে নিয়ে যায়। এই তিন মাসের মধ্যেই তাদের কত উপকার হয়েছে জানো মা? গেল মাসে দু’ বোনে শুধু রুমাল বেচেই পেয়েছে ১৪ টাকা।
আচ্ছা, আমার কাছে যে শশীর মা কালী-পূজোর দিন চার আনা পয়সা ধার নিয়েছিল, কৈ সে ত দিলে না।
নিরুপমা হাসিয়া বলিল, তাও ভোলো নি মা? আচ্ছা, আমি তোমার পয়সা আদায় করে দেব। তখন তাদের বড় কষ্ট ছিল। কিন্তু এখন ঐ চার আনা আট আনা পয়সা তারাই ধার দিতে পারে। বলিয়া সে পুনরায় কাজে মন দিল।
জগদ্ধাত্রী খুশী হইয়া কহিলেন, আহা, তা হোক। লোকের ভাল হলেই ভাল। এত ফন্দিও জানে ঐ সন্ধ্যা মেয়েটি। মাগী বড় কষ্টেই পড়েছিল, তা নিস্ মা চেয়ে পয়সা-ক’টা মনে করে। আহা খুলচিস কেন সেলাইটা? ফুলটি ত বেশ হচ্ছিল!
না মা,—কথা কইতে কইতে ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু কখ্খনো ভুল হয় না দেখেচি সন্ধ্যার।
কথা কইচে, শেখাচ্চে, পড়াচ্চে,—আবার নিজেও কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু একটা ফোঁড় কখনো উলটো পড়ে না! তার হাতের কাজ যদি দেখ মা ত অবাক হয়ে যাবে।
জগদ্ধাত্রী বিশেষ খুশি হইলেন না! নিজের মেয়ের চেয়ে পরের মেয়ের অধিক গুণপনার কথা বোধ করি তাঁহার তেমন ভাল লাগিল না। অবহেলার ভাবে বলিলেন—হবে না কেন বাছা! আমাদের হিঁদুর ঘরের মেয়েরা ত আর মেম রেখে সেলাই শিখতে যায় না! শিখলে ওদের মতই হতো। ছোঁয়াছুঁয়ি করে ওদের নাইতেও হয় না, কাপড়টাও ছাড়তে হয় না। মা গো মা! হাজার হোক বাঙালী ঘরের মেয়ে ত! কি করে যে সেই কাপড়-চোপড়ে ওদের মুখে ভাত ওঠে, আমি তাই শুধু ভাবি। বলিতে বলিতেই তিনি ঘৃণায় যেন কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন।
নিরুপমা নীরবে কাজ করিতে লাগিল,—কথা কহিল না।
জগদ্ধাত্রী একটু স্থির থাকিয়া কহিলেন, তোর বাপের সেই হাতকাটা জামাটা একটু ছিঁড়ে গেছে—নিয়ে আসব সেরে দিতে পারবি?
নিরুপমা মুখ না তুলিয়াই বলিল, পারবো বৈ কি মা, নিয়ে এসো।
জগদ্ধাত্রী জামা আনিতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ এই অসময়ে অরুণকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। অরুণের হাতে একখানা কাগজের মোড়ক ছিল। সে মুহূর্তকাল থামিয়া কহিল, খুড়ীমা, ভাল ত সব? বলিতে বলিতেই তাহার দৃষ্টি কর্ম-নিরত নিরুপমার উপরে গিয়া পড়ল।
জগদ্ধাত্রী অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন, ভাল আর তেমন কৈ বাছা! আমার—
কিন্তু কথাটা শেষ হইতে পাইল না কারণ, দাঁড়াইয়া শুনিবার ধৈর্য অরুণের ছিল না। সে সোজা অগ্রসর হইয়া গিয়া নিরুপমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, এই নাও তোমার কার্পেটের প্যাটার্ন। সন্ধ্যা বললে, কলকাতায় যাচ্ছো দাদা, অমনি নিরুপমার জন্যে আমার মত একটা কিনে এনো। তা খুঁজে খুঁজে আর কোথাও পাইনে, শেষে একটা সাহেবের দোকান থেকে জোগাড় করেচি।
নিরুপমা হাত বাড়াইয়া মোড়কটি গ্রহণ করিয়া কৃত্রিম ভর্ৎসনার স্বরে কহিল, কেন তুমি এই রোদের মধ্যে এত কষ্ট করতে গেলে? এ প্যাটার্ন আমার না হয় নাই হতো। ইস্টিশান থকে সোজা আসচ বুঝি? এখনো বাড়ি যাওনি? নাওয়া খাওয়া হয়নি?
না। এক গেলাস জল দাও দিকি। ভয়ানক তেষ্টা পেয়েচে।
জগদ্ধাত্রী এতক্ষণ অদূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন। বিরক্তির স্বরে কহিলেন—ঝিকে ডেকে জল দিতে বল নিরু। হাত থেকে ওটা নিলি—মন ভুলে আবার যেন তুই খাবার জলের কলসি-টলসি ছুঁয়ে ফেলিস নে বাছা! বলিয়া ঘরে চলিয়া গেলেন। উভয়েই উভয়ের প্রতি ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মত চাহিয়া থাকিয়া, অরুণ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, থাক থাক আর জলে কাজ নেই,—আমি বাড়ি গিয়েই খাবো অখন।
নিরুপমা উঠিয়া গিয়া মুখের পানটা একধারে ফেলিয়া দিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, কেন তুমি আমাকে কষ্ট দিতে এ বাড়িতে কোন কিছু চাও? একদিন মা তোমাকে মাটির ভাঁড়ে জল খেতে দিয়েছিলেন, তোমার মনে নেই?
অরুণ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, না, আমার মনে ছিল না। কিন্তু হলোই বা মাটির ভাঁড় তাতে কি তেষ্টা ভাঙ্গে না?
জানিনে তোমার ভাঙ্গে কি না। কিন্তু আমার যে—বলিতে বলিতেই সে অকস্মাৎ ঘাড় ফিরাইয়া আর এক দিকে চাহিয়া চুপ করিল।
অরুণ হাসিল। কহিল, কিন্তু তুমিও ত মুখের পান ফেলে দিলে নিরু। শুধু খুড়ীমার দোষ দিলে হবে কেন? ওটা ত তিনি বলেন নি! একটা ছাগল কি একটা বেড়াল ছুঁয়ে ফেললে ত তুমি এ কাজ করতে না। আমার নিরাশ্রয় ব্রাহ্ম বোনটিকে আশ্রয় দিয়ে কি আমি তার চেয়েও ছোট হয়ে গেছি?
নিরুপমা অন্য দিকে চাহিয়া থাকিয়াই জবাব দিল—কিন্তু ছোট-বড় স্থির করবার ভার ত তোমরা আমাদের ওপর দাওনি। যে ঘৃণা করি বলে এখন নালিশ করচ, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ মন্দ বলে ঘৃণায় তাঁরাই চলে গিয়েছিলেন, আমরা যাইনি। আজ এ অভিযোগ ত তোমাদের মুখে সাজে না অরুণদা!
অরুণ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তাহলে আমাদের ঘৃণা করবার তোমাদের অধিকার আছে বল?
যদি থাকে ত সে তোমাদেরই দান।
তাহলে খুড়ীমার আচরণে রাগ করবার অধিকার ত তোমারও নেই।
নিরুপমা অকস্মাৎ তাহার আরক্ত সজল চোখ-দুটি অরুণের মুখের প্রতি তুলিয়া বলিল, আমার মায়ের ওপর আমার কি অধিকার সে আমি বুঝবো। কিন্তু তুমি কি ক্ষিদে-তেষ্টা চেপে এই দুপুরবেলা আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে দাঁড়ালে নাকি? বাড়ি যাও।
যাচ্চি। হাঁ নিরু, আমাকে ছুঁতে কি তোমার ঘৃণা হয়?
হাঁ হয়। তুমি বাড়ি যাও না।
যাচ্চি।
আচ্ছা, খুব একটা নোংরা জিনিস, যেমন—
হাঁ, হাঁ, ঠিক তেমনি। ঠিক তেমনি। তোমার পায়ে পড়ি অরুণদা, বাড়ি যাও—ক্ষিদে-তেষ্টায় তোমার গলা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
তা যাক। বলিয়া অরুণ ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিল, আমি নিজে থেকে কোন দিন সমাজও ত্যাগ করিনি, অন্য ধর্মও গ্রহণ করিনি। শুধু আমার খুড়ীমাকে মায়ের মত এবং অনাথ বোনটিকে বোনের মতই আশ্রয় দিয়েচি। কেবল এই অপরাধেই যে তোমাদের চোখে এত ছোট হয়ে যেতে পারি, এ কথা কখনো ভাবিনি নিরুপমা। আমিও না, সন্ধ্যাও না। বরঞ্চ গ্রামের মধ্যে তোমরাই শুধু আমাদের ভালবাস, এই আমরা দু-ভাইবোনে ভাবতুম। এতদিন উল্টো বুঝে না জানি তোমার প্রতি আমরা কত উৎপাতই করেচি।
সত্যি নাকি? কৈ কিরকম উৎপাত একটা শুনি?
অরুণ নিজেও একটুখানি শুষ্কভাবে হাসিয়া কহিল, জেনে করিনি বলে মনে নেই নিরু। নইলে মনেও থাকত, বলতেও নিশ্চয় পারতুম।
তাহলে মনে করে এসে তখন ঝগড়া করো। এখন বাড়ি যাও। বেলা আর নেই—মুখে একটু জলটল দাও গে।
হাঁ, যাই! আমাকে মাপ করো ভাই, আর আমি তোমাদের বাড়িতে উপদ্রব করতে আসব না। বলিয়া অরুণ ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।
সে চলিয়া গেলেও নিরুপমা পাষাণমূর্তির মত অপলকচক্ষে সেই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
জগদ্ধাত্রী ঘর হইতে বাহির হইয়া কহিলেন, অরুণ চলে গেল?
নিরুপমা ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল—হাঁ।
কিসে জল খেলে?
জলের বদলে যে জিনিস তুমি দিয়ে গেলে মা, তেষ্টা ঘোচবার পক্ষে সেই কি যথেষ্ট নয়?
মা মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া শান্ত তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিলেন, বটে! আচ্ছা, একটা কথা তোকে জিজ্ঞেস করি বাছা, ওদের সম্বন্ধে কিছু বললেই তুই এমন বিঁধে বিঁধে কথা কোস কেন বল ত। ওর একটি কথা দেখচি তোর সামনে—
বাহির হইতে ডাক আসিল, বলি জগদ্ধাত্রী আছিস গো? এবং সঙ্গে সঙ্গেই একটি প্রবীণ ব্যক্তি—
বারোয়ারি উপন্যাস
একুশ
অরুণের মুখে শাশুড়ীর ওই দুর্দান্ত অসুখের কথা শুনে কমলার দু’চক্ষু ছলছল করে এল। এবং বিশেষ করে সে যখন জানালে যে, জামাইবাবু নিরুদ্দেশ, হয়ত বা তিনি এখন হিমালয়ের কোন গুহার মধ্যে তপস্যায় নিযুক্ত, এবং তাঁকে একটা সংবাদ দেওয়া পর্যন্ত সম্ভবপর নয়, তখন সেই দুটি চোখ দিয়ে বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ধারা বেয়ে নেমে এল।
হঠাৎ কি কারণে যে সতীশ সংসার ত্যাগ করে চলে গেল, এ কথা মনে মনে সবাই বুঝলে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলে না।
অরুণ বললে, শুধু কি এই? ডাক্তারের কাছে শুনে এলুম, দুর্নামের ভয়ে পাড়ার কেউ শুশ্রূষা পর্যন্ত করতে রাজী নয়। একেই ত ওদের গ্রামে মানুষের চেয়ে জানোয়ারই বেশি, তার ওপর যদি এই উৎপাত হয় ত বুড়ী বেঘোরেই মারা যাবে।
কমলা আঁচলে চোখ মুছে অশ্রুরূদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, হাঁ অরুণ, মা কি তবে একলাই পড়ে আছেন? মুখে একফোঁটা জল দেবারও কি কেউ নেই?
অরুণ বললে, অবস্থা ত তাই বটে,—আমাকে ত একরকম দোর ভেঙ্গেই বাড়ি ঢুকতে হয়েছিল। তবে আজ রাতটার মত একটা বন্দোবস্ত করে এসেচি, ডাক্তারবাবু তাঁর হিন্দুস্থানী দাসীটাকে পাঠিয়ে দেবেন ভরসা দিয়েছেন ।
যাক বাঁচা গেল! বলে, হরেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, রাতটা ত কাটুক;—ভোর পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে। আমরা তাইতে বেরিয়ে পড়লে সকাল নাগাদ কমলাকে পৌঁছে দিতে পারবো।
ক্ষিতীশ এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ কোরেই ছিল, মুখ তুলে বললে, কমলাকে নিয়ে যাবে? হঠাৎ ওঁকে নিয়ে গিয়ে কি সুবিধে হবে হরেন?
বাঃ—সুবিধে হবে না? সতীশ যখন নেই, তখন শাশুড়ীর সমস্ত দায়িত্ব ত এখন ওরই। তাছাড়া দেখবে কে? শুনলে ত গ্রামের মেয়েরা দুর্নামের ভয়ে বুড়ীর কাছে ঘেঁষতে পর্যন্ত রাজী নয়। কে সেবা করে বল ত?
ক্ষিতীশ লোকটি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিও নয়, আগাগোড়া ভেবে-চিন্তে হুঁশিয়ার হয়ে কাজ করাও তার স্বভাব নয়, কিন্তু ভিতরের একটা গোপন বেদনা কিছুদিন থেকে ওই দিকের দৃষ্টিকে তার অত্যন্ত প্রখর কোরে তুলেছিল, সে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললে, কথাটা ঠিক সত্যি নয় হরেন। আমার মনে হয়, তাঁর অসুখের খবর পাড়ার মেয়েরা জানেন না। কারণ, আমার নিজের বাড়িও ত পল্লীগ্রামে, সেখানে বাপের বাড়ি থেকে বৌ হারিয়ে গেলে, শাশুড়ীর জাত যেতে আমি আজও দেখিনি, এবং এই দোষে পাড়ার মেয়েরা পীড়িতের সেবা করেন না, এত বড় কলঙ্কও তাঁদের দেওয়া চলে না হরেন।
অভিযোগটা হরেনের নিজের গায়েও বিঁধল। সে লজ্জিত মুখে জবাব দিলে, বেশ ত ক্ষিতীশ, সেবা না হয় তাঁরা করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে এত বড় একটা টাইফয়েড রোগের সেবাও তাঁরা নিয়মিত কোরে যাবেন, এত বড় বোঝাও ত তাঁদের উপর চাপানো যায় না, ভাই।
ক্ষিতীশ বললে, ওটা যে টাইফয়েড তাও নিশ্চয় বলা যায় না। অন্ততঃ একটা দিনের জ্বরকে অত বড় একটা নামের ঘটা দিয়ে না ডাকাই ভাল হরেন।
হরেন চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলে, তাহলে কি করা যায় বল?
এতক্ষণ পর্যন্ত অরুণ বড়দের কথায় কথা কয়নি, চুপ কোরেই শুনছিল, এবার বলে উঠলো, দিদির শাশুড়ী সকাল থেকে জ্বরে বেহুঁশ, এই আমি শুনে এসেছি, কিন্তু জ্বরটা যে কেবল আজই হয়েছে তাও ত জানিনে। হয়ত বা ক’দিন থেকে—
ক্ষিতীশ কথাটা তার শেষ করতেও দিলে না, কানেও নিলে না, বললে, তা ছাড়া একটা বড় কথা আছে হরেন। তাঁর সামান্য জ্বর হয় ত দু-চার দিনেই সেরে যাবে, কিন্তু মাঝখানে সহসা কমলাকে নিয়ে গেলে পল্লীগ্রামে কত বড় একটা সামাজিক বিপ্লবের সৃষ্টি হতে পারে, ভেবে দেখ দিকি? সতীশের মা জ্বরের ঘোরে হয়ত বলেছেন যে তিনি কমলার কলঙ্ক বিশ্বাস করেন না, কিন্তু—
কিন্তুটা ওইখানেই থেমে গেল। অরুণের মত ক্ষিতীশের নিজের বক্তব্যটাও শেষ হতে পেল না। কমলা এতদূর পর্যন্ত নীরবে শুনছিল, হঠাৎ তার কান্না যেন একেবারে সহস্রধারে ফেটে পড়ল। অশ্রু-বিকৃত কন্ঠে সে বলে উঠলো, কিন্তু, কি ক্ষিতীশদা? আমাকে কি তোমরা এইখানেই বেঁধে রাখতে চাও? আমার শাশুড়ীর ব্যামো, তিনি কাছে নেই, আমি না গেলে কে যাবে বল ত?
ক্ষিতীশ হতবুদ্ধি হয়ে বলতে গেল, তা বটে, কিন্তু ভেবে দেখলে
কমলা তেমনি কাঁদতে কাঁদতে বললে, ভেবে কি দেখতে চাও, শুনি? কেবল ভেবে ভেবেই ত আজ আমার এই দশা করেছ। হরেনের মুখের দিকে চোখ তুলে বললে, আমি দোষ করিনি,আমার ভালর জন্যে যদি তোমরা অত ফন্দি-ফিকির না করে সোজা আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে ত আজ হয়ত আমার ভালই হতো; তোমাদেরও আমার জন্যে এমন ভেবে সারা হতে হতো না। আমি আর তোমাদের সাহায্য চাইনে, কেবল অরুণকে সঙ্গে নিয়ে কাল ভোরেই চলে যাবো । আমার ভাগ্যে যা আছে, তা হোক, তোমরা আর আমার ভালর চেষ্টা কোরো না ।
ক্ষিতীশ এবং হরেন দুজনেই চমকে গেল । কমলাকে এমন জোরে কথা বলতে কেউ কখনো শোনেনি । ভাল-মন্দ সম্বন্ধে তার নিজের ব্যক্তিগত যে কোন মতামত আছে, আপনার দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া, এবং তার সংশোধনের সমস্ত ভার অপরের উপর নির্ভর করা ভিন্ন সেও যে আবার মনে মনে কিছু চিন্তা করে, এ কথা তারা দুজনেই যেন একপ্রকার ভুলে গিয়েছিল ।
হরেনের মুখে সহসা কোন উত্তর যোগাল না, এবং ক্ষিতীশ বিস্ময়ে দুই চক্ষু বিস্ফারিত কোরে চেয়ে রইল । কিন্তু এ কথা বুঝতে আর তাদের বাকী রইলো না যে, তাদের উভয়ের সম্মিলিত দুশ্চিন্তাকেও বহুদূরে অতিক্রম করে আর একজনের উদ্বেগ কোথায় এগিয়ে গেছে।
কমলা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলে বললে, তোমরা মনে কোরো না ক্ষিতীশদা, তোমাদের দয়া আমি কোনদিন ভুলতে পারবো, কিন্তু আজ তোমাদের হাত জোড় করে জানাচ্ছি ভাই,—বলতে বলতেই তার দু’ চোখ বেয়ে ঝরঝর করে আবার জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু এবার সে-জল সে মোছবার চেষ্টাও করলে না, হাত-দুটি জোড় করে বলতে লাগল—আমার জন্যে তোমরা যে কত দুঃখ পেলে, সে আমি জানি, আর ভগবানই জানেন, কিন্তু আর একটা দিনও না। আজ থেকে আমার দুর্ভাগ্যের সমস্ত ভারই আমি নিজের মাথায় তুলে নিলুম। ক্ষিতীশদা, একদিন যেমন আমাকে তুমি পথ থেকে এনে বাঁচিয়েছিলে, আজ তেমনি আমাকে কেবল এই আশীর্বাদ তুমি কর, এর থেকেও একটা যেন কোথাও কূল পাই,—আর না তোমাদের দুঃখ দিতে ফিরে আসি!
ক্ষিতীশ চোখ ফিরিয়ে বোধ হয় তার চোখের জলটাই গোপন করলে, কিন্তু হরেন বললে, আমরা দুজনে সেই আশীর্বাদই তোকে করি কমলা, আমি বলচি এ বিপদ একদিন তোর কেটে যাবেই, কিন্তু কাল সকালে আমিও কেন তোর সঙ্গে যাইনে?
কমলা ঘাড় নেড়ে জানালে, না।
হরেন উত্তেজনার সঙ্গে বলে উঠলো, না কেন কমলা? আমি যদি তোর সত্যিকারের দাদা হতুম, তাহলে ত তুই না বলতে পারতিস নে।
তার শেষ কথাটায় এত দুঃখেও কমলার মুখখানি লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেল, সে অধোমুখে তেমনি নীরবে মাথা নেড়ে বললে—না।
তার এই লজ্জাটা হরেনের অগোচর রইল না। কিন্তু পরস্পরের নাম নিয়ে এই যে একটা লজ্জাকর অপবাদ, একে সে যে বিন্দুমাত্র স্বীকার করে না, এই কথাটাই সদর্পে জানাবার জন্যে হরেন তীব্রকন্ঠে বলে ফেললে, তুই কি ভাবিস কমলা আমি মিথ্যে দুর্নামকে ভয় করি? বাবার অন্যায় শাসন গ্রাহ্য করি? আমি যাবো তোর সঙ্গে, দেখি গ্রামের কে আমার মুখের সামনে তোকে কিছু বলতে পারে। তার জবাব আমি দিতে পারবো, কিন্তু ছেলেমানুষ অরুণ পারবে না।
কমলা সজল চোখ দুটি তার মুখের পানে তুলে বললে, অরুণ পারবে না সত্যি, কিন্তু তোমারও পেরে কাজ নেই হরেনদা। আমার বোঝা আমাকে বইতে দাও, আর আমার সমস্যাকে তোমরা জটিল করে তুলো না।
হরেন বললে, গ্রামের লোকগুলোকে একবার ভেবে দেখ কমলা, সেখানে একাকী তোর অদৃষ্টে কি যে না ঘটতে পারে, সে ত আমি ভেবেও পাইনে!
কমলা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। সে আর কথা কাটাকাটি না করে শুধু উপরের দিকে মুখ তুলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বললে—তিনিই জানেন। এই বলে সে হাত দুটি মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে কাকে যেন প্রণাম করেই দ্রুতপদে উঠে অন্য ঘরে চলে গেল।
কয়েক মুহূর্ত কারো মুখ দিয়েই কোন কথা বার হল না, সবাই যেন নিস্পন্দ হয়ে বসে রইল। খানিক পরে অরুণ বললে—আমি কিন্তু একটা সুবিধে করে এসেছি হরেনদা। জামাইবাবুর মাকে বলে এসেছি, দিদি হারিয়ে যাবার পরে অসুখ থেকে সেরে উঠে পর্যন্ত বরাবর আমার কাছেই আছেন। ঠিক করিনি ক্ষিতীশদা? অবশ্য তোমাদের নামও করেছি বটে।
হরেন বললে, দূর পাগলা! তুই ছেলেমানুষ, কলকাতায় কমলা তোর কাছে আছে, এ কথা কেউ কখনো বিশ্বাস করে? কি বল হে ক্ষিতীশ?
ক্ষিতীশ হঠাৎ চমকে উঠে বললে, হুঁ। বলেই লজ্জিত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে একটুখানি হেসে বললে, আমার ভারী ঘুম পাচ্চে হরেন, আমি চললুম।—বলে ঠিক যেন টলতে টলতে তার নিজের ঘরে চলে গেল।
নিজের বাড়িতে তাদের কোন খেয়াল না করে ক্ষিতীশ শুতে গেল, এটা তার স্বভাবের এমনি বিরুদ্ধ যে হরেন ও অরুণের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কিন্তু যথার্থই আজ ক্ষিতীশের এদিকে দৃষ্টি দেবার সাধ্যই ছিল না। বহুক্ষণ থেকেই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, এত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক অর্ধেক বোধ হয় তার কানেই যায়নি। সেখানে কেবল একটা কথাই বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, সমস্ত প্রকাশ হয়ে গেছে, সমস্ত প্রকাশ হয়ে গেছে! তার মনের নিভৃত গুহায় যত কিছু আশা সঞ্চিত হয়ে উঠছিল, কমলার কাছে সমস্ত ধরা পড়ে গেছে, তার কোথাও কিছু আর লুকোনো নেই! তাই সে আজ ভয়ে ভীত হরিণীর মত ছুটে পালাতে চায়। আজ তার সকল যত্ন, সকল সেবা, সকল পরিশ্রম একেবারে ব্যর্থ, একেবারে নিরর্থক।
বাইশ
ক্ষিতীশদা!
কে?
আমি কমলা, একবারটি দোর খোল।
ক্ষিতীশ শশব্যস্তে দোর খুলে বাইরে এসে দেখলে, সুমুখে দাঁড়িয়ে কমলা। রাত্রির ঘোর তখনও কাটেনি, তখনো আকাশে দু’-চারটে বড় বড় তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কেবল পূবের দিকটা একটু স্বচ্ছ হয়েছে মাত্র। বারান্দার এককোণে যে লন্ঠনটা মিটমিট করে জ্বলছিল, তারই সামান্য আলোতে ক্ষিতীশ চক্ষের নিমেষে সমস্ত ব্যাপারটা দেখে নিলে।
কমলার গায়ে আগাগোড়া একটা হলদে রঙের র্যাপার জড়ানো, এবং তারই অদূরে দাঁড়িয়ে অরুণ। তার ডোরা-কাটা কোটের ওপর কোমরে বাঁধা একটা আধ-ময়লা চাদর। বাঁ হাতে তার পৈতের সময়কার লাল রঙের ছাতাটি এবং ডান বগলে একটি ছোট্ট পুঁটুলি।
কেবল এতটুকুই ক্ষিতীশ দেখতে পেল। কিন্তু কমলা যখন গড় হয়ে প্রণাম করে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ক্ষিতীশদা আমি চললুম, তখন আলোর অভাবেই হোক, বা চোখের দোষেই হোক, তার মুখের কিছুই আর ক্ষিতীশের চোখে পড়ল না। তার মনে হল, অকস্মাৎ একমুহূর্তে যেন সন্মুখে, পাশে, ওপরে, নীচে সমস্তটাই একেবারে মসীকৃষ্ণ হয়ে গেছে।
—আমাদের সময় হয়েছে, আমি যাচ্ছি ক্ষিতীশদা।
—যাচ্ছো? আচ্ছা—
—আমি কোথাকার কে, তবু কত কষ্টই না এতদিন ধরে তোমাকে দিলাম, এই বলে কমলা
র্যাপারের কোণে চোখ মুছলে।
প্রত্যুত্তরে ক্ষিতীশ শুধু জবাব দিলে, কষ্ট? কৈ, নাঃ—
—কিন্তু তোমার প্রাণবাঁচানো যেন নিষ্ফল না হয়, যাবার সময় আমাকে এইটুকু আশীর্বাদ কেবল তুমি কর ক্ষিতীশদা—এই বলে কমলা ঘন ঘন চোখ মুছতে লাগল।
ক্ষিতীশ কোন উত্তরই খুঁজে পেলে না। কিন্তু খানিক পরে হঠাৎ বলে উঠল, আশীর্বাদ? নিশ্চয়! নিশ্চয়! তা করব বৈ কি। হাঁ অরুণ, মোটরটা বলে দেওয়া হয়েছে?
অরুণ মাথা নেড়ে জবাব দিলে, হাঁ। হরেনদা ত নীচে তাতেই বসে আছেন! তিনি ইস্টিশান পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবেন। আপনি যাবেন না?
আমি? না ভাই, আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই—
কমলা দূর থেকে আর একবার নিঃশব্দে নমস্কার কোরে আস্তে আস্তে নীচে চলে গেল। অরুণ কাছে এসে বললে, আমিও চললুম ক্ষিতীশদা,—এই বলে সে দিদির মত প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্ষিতীশ সহসা সজোরে তার হাত দুটো ধরে হিড়হিড় করে টেনে তার ঘরের মধ্যে এনে ফেলে বললে, অরুণ, তোমরা সত্যি সত্যি চললে ভাই?
অরুণ অবাক হয়ে তার পানে চেয়ে রইল, প্রশ্নটা যেন সে বুঝতেই পারলে না।
ক্ষিতীশ পুনরায় বললে, কে জানে আর হয়ত আমাদের দেখাই হবে না,—আমিও আজ দুপুরের গাড়িতে পশ্চিমে চললুম ভাই।
অরুণ এ কথারও কোন জবাব দিতে পারলে না, কিন্তু বালক হলেও সে এটুকু বুঝতে পারল যে, ক্ষিতীশদার কণ্ঠস্বর কান্নার জলে যেন একেবারে মাখামাখি হয়ে গেছে।
ক্ষিতীশ প্রত্যুত্তরে আশা না করেই বললে, তুমি ছেলেমানুষ, তোমার ওপর যে কত বড় ভার পড়ল এ হয়তো তুমি জানোও না, কিন্তু ভগবানের কাছে আমি কায়মনে প্রার্থনা করি, তোমাদের আজকের যাত্রাটা যেন তিনি সকল প্রকারে নির্বিঘ্ন কোরে দেন।
এই বলে সে তার বালিশের তলা থেকে একখানা খাম বার করে অরুণের হাতে গুঁজে দিতে গেল। অরুণ হাতটা সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এ কি ক্ষিতীশদা?
সামান্য গোটা-কয়েক টাকা আছে অরুণ।
কিন্তু ভাড়ার টাকা ত আমার কাছে আছে ক্ষিতীশদা।
তা থাক। তবু ছোট ভাইদের যাবার সময় কিছু হাতে দিতে হয়। এই বোলে সে অরুণের কোঁচার খুঁটটা টেনে নিয়ে তাতে বাঁধতে বাঁধতে বললে, তোমার ত কেউ বড় ভাই নেই অরুণ, তাই জানো না, নইলে তিনিও এমনি করেই বেঁধে দিতেন, দাদার স্নেহের উপহার বলে নিতে কিছু লজ্জা কোরো না ভাই! তোমার দিদি কখনো যদি জানতে পেরে জিজ্জাসা করেন, তাঁকেও এই কথাটাই বোলো।—এই বলে সে সেটা যথাস্থানে পুনরায় গুঁজে দিয়ে হাত ধরে তাকে বাইরে এনে বললে, আর সময় নেই অরুণ, তুমি যাও ভাই, সাড়ে-চারটে বেজে গেছে। ওঁরা বোধ করি বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন—এই বলে সে একরকম তাকে জোর করে বিদায় কোরে দিলে।
অরুণ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলে, আপনি কতদিন পশ্চিমে থাকবেন ক্ষিতীশদা?
সে কথা আজ কি কোরে বলব ভাই?
মিনিট-খানেক পরে অরুণ গিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বোসলো, তখন তাকে একাকী দেখে কমলা কোন প্রশ্নই করলে না, কিন্তু হরেন জিজ্ঞাসা করলে, ক্ষিতীশ এলো না অরুণ—
তার জবাবটা ক্ষিতীশ নিজেই দিলে। সে উপরের বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বললে, শরীরটা আমার ভাল নেই হরেন, আর ঠাণ্ডা লাগাবো না।
হরেন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললে, ভাল নেই? তাহলে হিমে আর দাঁড়িয়ো না ক্ষিতীশ, ঘরে যাও, আমি এদের পৌঁছে দিয়ে এসে তোমাকে জানাবো।
মোটর ছেড়ে দিলে। হরেনের উপদেশ তার কানে গেল কিনা কে জানে, কিন্তু গাড়ি যখন বহুক্ষণ তার চোখের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখনও সে তেমনি সেই দিকে চেয়ে তেমনি স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল।
স্টেশনে পৌঁছে, টিকিট কিনে দু’জনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে হরেন কমলার কাছে গিয়ে একটুখানি লজ্জার সঙ্গে বললে, আমার উপস্থিত ঠিকানা যদিচ আমি নিজেই জানিনে, তবুও আমাকে খবর দেবার যদি আবশ্যক হয় ত কেয়ার অফ্—
অরুণ পকেট থেকে তাড়াতাড়ি এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল বার করে বললে, থামো থামো হরেনদা, ঠিকানাটা তোমার লিখে নিই। তাছাড়া শুনলুম, ক্ষিতীশদাও আজ দুপুরের ট্রেনে পশ্চিমে চলে যাচ্ছেন। এটা ছাই মনে হোলো না যে তাঁর ঠিকানাটা জিজ্ঞেসা কোরে রাখি।
সংবাদ শুনে কমলা মনে মনে আশ্চর্য হলো, কিন্তু কিছুই প্রকাশ করলে না। কিন্তু হরেন উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো, বলিস কি অরুণ! তাহলে ত আমাকে এখুনি ফিরে গিয়ে তাকে থামাতে হয়!
কমলা মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলে, কেন হরেনদা?
অরুণ বললে, কেন কি, বাঃ—
হরেন বললে, সেখানে কত কি ঘটতে পারে কে বলতে পারে? অন্যায় হলে আমি ত যাবই, এমন কি ক্ষিতীশকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে যেতে ছাড়বো না! তুই কি আমাকে ভীরু মনে করিস?
কমলা ঘাড় নেড়ে বললে, না, তা করিনে। কিন্তু তোমাদের কারও সেখানে আমার জন্যে যাবার দরকার হবে না।
হরেন ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললে, হবে না? নাই হোক, কিন্তু আজও কি তুই আমাদের পাড়াগাঁয়ের লোকগুলোকে চিনিস নি কমলা?
কমলা এ প্রশ্নের ঠিক জবাব দিলে না, বললে, আমি কিছুতে ভেবে পাইনে হরেনদা, এতদিন কি করে আমার সমস্ত বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, আর কেমন করেই বা এতদিন নিজের কাজের ভার তোমাদের পরের ওপর নির্ভর করে থাকতে পেরেছিলুম। ভুল যা করেচি তার সীমা নেই, কিন্তু তোমাদের সাক্ষী দিতে ডেকে পাঠাবো এত বড় ভুল বোধ হয় আমিও আর কোরবো না।—এই বলে সে ছোটভাইয়ের হাত থেকে কাগজের টুকরোখানি নিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলে।
হরেন মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত হয়ে বললে, কিন্তু কমলা, নির্দোষীকেও কি সাক্ষী দিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমান করতে হয় না?
কমলা একটুখানি ম্লান হেসে বললে, সে আদালতে হয়, কিন্তু আমার বিষয়ের ভার যাঁর হাতে তুলে দিয়েচি হরেনদা, তাঁকে সাক্ষী যোগাতে হয় না, তিনি আপনিই সব জানেন।
এই বোলে সে উদ্গত অশ্রু গোপন করতে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলে।
গার্ডসাহেব সবুজ নিশান নেড়ে দিলেন, ড্রাইভার বাঁশী বাজিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলে। এই সময়টুকুর মধ্যে হরেন যেন একটা ধাক্কা সামলে নিলে। সে সঙ্গে সঙ্গে দু’পা এগিয়ে এসেও কমলার মুখ আর দেখতে পেলে না, কিন্তু তাকেই উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললে, তাই যেন হয় বোন, আমি কায়মনে প্রার্থনা করি তিনিই যেন আমাদের বিচারের ভার গ্রহণ করেন।
কমলা এ কথার কোন উত্তর দিল না, দেবার ছিলই বা কি! কিন্তু গাড়ি কতকটা পথ চলে গেলে সে কেবলমাত্র একটিবার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলে হরেন এখনও সোজা তাদের দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পথের মধ্যে অরুণ অনেক কথাই বকে যেতে লাগল। তার নিজের প্রতি ভারী একটা ভরসা ছিল। সেই যে দুর্গামণি তাকে বলেছিলেন, তিনি গুজবটা বিশ্বাস করেন নি, এবং সেও তাকে জানিয়ে এসেছে, কলকাতায় দিদি তার কাছেই আছেন, এতেই তার সাহস ছিল, দুর্ঘটনাটাকে সে অনেকখানিই সহজ করে দিয়েছে। এই ভাবের সান্ত্বনাই সে থেকে থেকে দিদিকে দিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু দিদি যেমন নিঃশব্দে ছিল, তেমনি নীরবেই বসে রইল। হরেনের সেই কথাটা সে ভোলেনি যে অরুণের এই কথাটা সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না! কিন্তু এজন্য মনের মধ্যে তার বিশেষ কোন চাঞ্চল্যও ছিল না। বস্তুতঃ যা সত্য নয়, সে যদি লোকে অবিশ্বাসই করে ত দোষ দেবার কাকে কি আছে! কিন্তু যথার্থ যে-চিন্তা তার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জাঁতার মত চেপে বসছিল, সে তার শাশুড়ীর কথা। তিনি বলেছিলেন বটে, তাঁর বধূর কলঙ্ক তিনি বিশ্বাস করেন না, কিন্তু এই বিশ্বাস কি তাঁর শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে? কোথাও কি কোন অন্তরায় কোন বিঘ্ন ঘটবে না? সে জানতো, ঘটবে। পল্লীগ্রামে মানুষ হয়েই সে এত বড় হয়েছে, তাদের সে চেনে,—কিন্তু এ সংকল্পও তার মনে মনে একান্ত দৃঢ় ছিল, অনেক ভুল, অনেক ভ্রান্তিই হয়ে গেছে, কিন্তু আর সে তার নিজের এবং স্বামীর মধ্যে তৃতীয় মধ্যস্থ মানবে না। এ সম্বন্ধ যদি ভেঙ্গেও যায় ত যাক্, কিন্তু জগদীশ্বর ভিন্ন দুজনের মাঝখানে অন্য বিচারক সে কখনো স্বীকার করবে না।
বেলতলী স্টেশনে যথাসময়েই ট্রেন এসে পৌঁছল, কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি যোগাড় করা সহজ হোলো না। অনেক চেষ্টায় অনেক দুঃখে অরুণ যখন একটা সংগ্রহ করে নিয়ে এল, তখন বেলা হয়েছে, এবং পল্লীপথের পাকা দুই ক্রোশ উত্তীর্ণ হয়ে অশ্বযান যখন জগদীশপুরের সতীশ বাগচীর বাটীর সুমুখে উপস্থিত হল তখন বেলা বারোটা।
দুর্গামণি গোটা-তিনেক ময়লা ওয়াড়হীন তুলো-বার-করা বালিশ জড়ো করে ঠেস দিয়ে বসে এক বাটি গরম দুধ পান করছিলেন, এবং অদূরে মেঝেয় বসে পাড়ার একটি বিধবা মেয়ে কুলোয় খৈয়ের ধান বাচছিল। দুর্গামণির জ্বর তখনও একটু ছিল বটে, কিন্তু টাইফয়েডের কোন লক্ষণই নয়। তিনি অরুণকে দেখে খুশী হয়ে বললেন, কে অরুণ এসেছো বাবা? এসো বোসো। দোরগোড়ায় ও কে গা?
দিদি এসেছেন—
দিদি? কে বউমা?
পরক্ষণেই কমলা ঘরে ঢুকে গলায় আঁচল দিয়ে ভূমিতলে গড় হয়ে প্রণাম করতেই দুর্গামণি শশব্যস্ত হয়ে উঠ্লেন। দুধের বাটিটা মুখ থেকে নামিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন—থাক থাক, বউমা, আর পায়ের ধূলো নিতে হবে না। সারাদিন পরে দুধ ফোঁটাটুকু মুখে তুলেচি, এটুকু আর ছুঁয়ে দিয়ো না।
যে মেয়েটি খৈ বাচছিল সে স্পর্শ বাঁচিয়ে কুলোসমেত দু’হাত সামনে এগিয়ে গেল। কমলা নির্বাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু অরুণ যেন একেবারে অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলে উঠে বলে ফেল্লে—মিথ্যেবাদী! কেন তবে কাল তুমি বললে, ও-সব গুজবে তুমি বিশ্বাস করো না! কেন বললে—
শোন কথা! কবে আবার বললুম বিশ্বেস করিনে? আর জ্বরের ধমকে যদি কিছু বলেই থাকি ত সে কি আমার ধর্তব্যি, বাছা!
অরুণ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললে, তা হলে ত আমি কখখনো দিদিকে আনতুম না। দুর্গামণি দুধের বাটিটি সরিয়ে একটু নিরাপদ স্থানে রেখে বললেন, তা বেশ ত বাছা, অমন মারমুখী হোচ্চো কেন? সাণ্ডেল মশাই আসুন, রায় বট্ঠাকুরকে খবর দি,—ততক্ষণ ঘরে সবই আছে, পটলের মা বের কোরে দিক্—দোরের উনুনটায় বোক্নোয় করে ডাল-চাল দুটো ফুটিয়ে তোমাকেও দুটো দিক্, নিজেও দুটো খাক।
অরুণ চতুর্গুণ জ্বলে উঠে বললে, কি! আমরা তোমার বাড়ি ভিক্ষে নিতে এসেচি । এত বড় কথা বল তুমি! আচ্ছা, টের পাবে! এই বোলে সে কমলার হাতখানা চেপে ধরে বললে, চল দিদি, আমরা যাই,—এখনো আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—এক মিনিটও এর মুখ দেখতে চাইনে।
কমলা ধীরে ধীরে নিজের হাতখানি মুক্ত করে নিয়ে বললে, চল, যাচ্চি ভাই। তারপরে মাথার আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে শাশুড়ীর মুখের পানে চেয়ে শান্ত সহজ কণ্ঠে বললে, মা আমি চললুম, কিন্তু আমিও এ বাড়ির বউ, তোমারি মত এও আমার শ্বশুরের ভিটে। কিন্তু এমন অপরাধ আজও করিনি যাতে এ বাড়িতে আমাকে দোরের উনুনে রেঁধে খেতে হয়।
শাশুড়ী বললেন—তা কি জানি বাছা!
কমলার মলিন চোখের দৃষ্টি হঠাৎ শিখার মত দীপ্ত হয়ে উঠল—বোধ হয় কি যেন সে বলতেই চাইলে, কিন্তু সে অবসর আর পেলে না। অরুণ বজ্রমুষ্টিতে হাত ধরে জোর করে তাকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
বিচার
এক
রাঠোন রাজকুমারী যমুনাবাই ছেলেবেলায় তাহার পিতার ক্রোড়ে বসিয়া বলিত—‘বাবা, তুমি সিংহাসনে বসিয়া বিচার কর না কেন?’ অজয় সিংহ কন্যার শির চুম্বন করিয়া বলিতেন—‘মা, তোমার বুড়ো বাবার বড় ভুল হয়, তাই সে আর বিচার করে না—সিংহাসনে বসিয়া শুধু ক্ষমা করিতে ভালবাসে। তুমি যখন ঐ স্বর্ণ সিংহাসনে বসিবে, তখন কি করিবে যমুনা?’
যমুনা বলিত—‘আমি নিজে বিচার করিব। অপক্ষপাত বিচার করিয়া যে দোষী তাহাকে নিশ্চয় শাস্তি দিব। দোষ করিলে আমি কাহাকেও ক্ষমা করিব না।’
বৃদ্ধ রাজা হাসিতেন। বলিতেন—‘মা, ক্ষমা কেহ করে না—ক্ষমা হৃদয় হইতে আপনি বাহির হইয়া দোষীর দোষটুকুকে এমন স্নেহের সহিত কোলে লইয়া বসে যে রাজাও সে মুখ দেখিয়া নিজের চোখের জল সামলাইতে পারে না। ক্ষমা আপনি ক্ষমা করে। ভুল প্রমাদের সংসারে এ স্বর্গীয় প্রবৃত্তি মানুষের হৃদয়ের একটি ছোট নির্জন প্রান্তে বসিয়া থাকে, প্রয়োজন হইলে সে শতমুখী অমৃত প্রস্রবিণীর মত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়ে; কেহই তাহার গতিরোধ করিতে পারে না। আমিও সে গতিরোধ করিতে পারি না—তাই লোকে বলে—বৃদ্ধ অজয় সিংহ শুধু ক্ষমা করিতেই আছে।’
‘আমি কিন্তু নিজেই বিচার করিব—মিছামিছি কখন ক্ষমা করিব না।’
‘যদি কখন আমার বয়স পাও’—বৃদ্ধ রাজা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘যদি কখন তেমনটি ঘটে, তখন দেখিতে পাইবে রাজা হইয়া রাজসিংহাসনে বসিয়া বিচার করার মত ঘৃণার কাজ আর নাই—যখন দেখিতে পাইবে একটি মাত্র কথার জন্য হৃদয়ের সমস্ত রক্ত ছুটিয়া গিয়া ব্যাকুলভাবে দোষীর পদতল ধৌত করিয়া দিবার জন্য তুমুল তুফান তুলিয়াছে, তখন তোমার এই বৃদ্ধ পিতার কথা মনে করিবে ত?’
যমুনার চক্ষে জল আসিল, বলিল—‘সে কি বাবা?’
বৃদ্ধ রাজা মলিনমুখে হাসিয়া কহিলেন—’যখন যৌবনকাল ছিল তখন সিংহাসনে বসিয়া বিচার করিতাম; এখন আর সে ক্ষমতা নাই। এখন দেখিতেছি, এ বিশ্বে শুধু একজন বিচারকর্তা আছেন; তিনি পাপ-পুণ্যের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই বলিতে পারেন—কে দোষী, কে নির্দোষ। আমরা মাত্র শুধু বিচারের ভান করি আর অবিচার করি।
দুই
রাজরাজেশ্বরী যমুনাবাই স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়া মাথার হেমমুকুট ধীরে ধীরে কম্পিত করিয়া বলিলেন—’রাঠোন রাজ্যে মহোৎসবের আয়োজন কর মন্ত্রি, সাত দিনের মধ্যে নগরে যেন কোন দুঃখের চিহ্ন না দেখা যায়। যে দরিদ্র তাহাকে অর্থ দাও। যাহার যাহাতে প্রয়োজন তাহাই দেওয়া হউক, সকলে যেন সুখে ও সন্তোষের সহিত থাকে। যাহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিবে না তাহাকে তাড়াইয়া দাও—রাজাজ্ঞায় দুঃখী দুর্ভাগার স্থান নগরের বহির্দেশে হইয়াছে। দুর্জয় সিংহ!’
‘মহারানি!’
‘এতদিনে তুমি তোমার পদের গৌরব রক্ষা করিয়াছে। রাঠোন রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। এই তোমার পুরস্কার।’ যমুনাবাই নিজ গলদেশ হইতে বহুমূল্য মুক্তার মালা লইয়া তাঁহার হস্তে দিলেন। দুর্জয় সিংহ নতজানু হইয়া বহু সম্মানে সে পুরস্কার মস্তকে গ্রহণ করিলেন। ‘মহারানীর জয় হোক।’
মহারানী কহিলেন, ‘দুর্জয় সিংহ, এই সভামধ্যে বর্ণনা কর কেমন করিয়া সেই কণ্টককে টানিয়া বাহির করিয়াছে, কেমন করিয়া সেই অধম পাপিষ্ঠ চেত্তা রাজপুত্রকে বন্দী করিয়া সমগ্র রাঠোন রাজ্যের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছ।’
নতশিরে অভিবাদন করিয়া দুর্জয় সিংহ কহিলেন, ‘চেত্তা রাজপুত্রের মত অসমসাহসী, মহাকৌশলী, সমরবিশারদ দুর্মদ যোদ্ধা রাজপুতের মধ্যে নাই।’
(সভামধ্যে) সাধু! সাধু!
যমুনাবাই ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, ‘বীরের কাহিনী বীরের মুখেই শোভা পায়—কিন্তু—’
দু—’না মহারানী, ইহাতে কিন্তু নাই, বীর মাত্রেই রাজপুত মাত্রেই এ কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিবে। আজ দুই বৎসর হইতে চেত্তারাজের সহিত সমর বাধিয়াছে; বলুন দেখি কবে কে চেত্তারাজের গতিরোধ করিতে পারিয়াছে? বিদ্যুতের শিখা যেমন পর্বত ভেদ করিয়া স্বচ্ছন্দে চলিয়া যায়, ভরত সিংহও সেইরূপ এই রাঠোন রাজ্য ভেদ করিয়া কতবার চলিয়া গিয়াছে, কখন কি বাধা পাইয়াছে? কিন্তু এই যে তাহাকে মহারানীর পদতলে আনিতে পারিয়াছি ইহা আমার বীরত্বের ফল নহে, ইহা স্বর্গীয় মহারাজার পুণ্যে এবং মহারানীর সৌভাগ্যবলে।’
‘সাধু! সাধু!’
যমুনাবাই বলিলেন, ‘এরূপ হীনতা রাঠোন সেনাপতির মুখে বিদ্রূপের মত বোধ হয়, যাহা হউক কেমন করিয়া তাহাকে বন্দী করিলে?’
‘মহারানি! বলিতে লজ্জা হয়—দুই সহস্র সৈন্য লইয়া একশত রাজপুতকে ঘিরিয়া ফেলি। কিন্তু তাহা মহারানীর আদেশ।’
যমুনাবাই হাসিয়া বলিলেন—’ভাল আমিই আদেশ দিয়াছিলাম, যেমন করিয়া পার ভরত সিংহকে বন্দী করিতেই হইবে।’
‘ভরত সিংহ একশত মাত্র অনুচর লইয়া বিশাখা পাহাড়ে শিকার করিতে গিয়াছিল, সংবাদ পাইয়া আমি চতুর্দিকে বেষ্ঠন করিয়া একশত জন রাজপুতকেই বন্দী করিয়াছি—তাহারা কেহ যুদ্ধ করে নাই।’
‘কেন?’
‘চেত্তারাজের কুলপ্রথা যে, মৃগয়ার দিন নরহত্যা করে না।’
মন্ত্রী কহিলেন, ‘এখন তাহাদিগের উপর কি শাস্তিবিধান করিবেন?’
যমুনা বলিলেন, ‘ভরত সিংহ বিদ্রোহী, তাহার বিচার পরে হইবে। আর একশত জন রাজপুত সৈন্যের কর্ণচ্ছেদ করিয়া তাড়াইয়া দাও।’
সভাসুদ্ধ সকলে শিহরিয়া উঠিল, ‘মহারানি! এই কি রাজাজ্ঞা?’
তিন
যমুনা কহিল, ‘ভাই মলিনা, ভরত সিংহকে বড় দেখিতে ইচ্ছা করে, সে নাকি বড় যোদ্ধা, বড় সাহসী বীরপুরুষ।’
মলিনার মুখের উপর কাল ছায়া পড়িল, বলিল, ‘বাবা বলেন, তাহার তুল্য যোদ্ধা রাজপুতের মধ্যে নাই, শত হস্তের মধ্যে কোন মৃগই তাহার বর্শার ফলা ছাড়াইয়া যাইতে পারে না, বাহুর এত বলের কথা কোথাও শুনিয়াছ কি?’
যমুনা বলিল, ‘আহা যদি প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা না দিতাম।’
মলিনা আগ্রহের সহিত কহিল, ‘সেই ভাল, প্রাণদণ্ডাজ্ঞা মার্জনা করিয়া দাও।’
যমুনা মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘মহারানীর আজ্ঞার প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’
মলিনা বলিল,—’মহারানী হইয়া কেন এমন করিলে?’
‘সে রাজ্যের শত্রু—মহারানীর শত্রু, সিংহাসন তাহার প্রাণ লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে—আমি নিজে তত হই নাই। সে কথা যাউক, কিন্তু একবার তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করে। পর্বতের মত ভীম শরীর, গালপাট্টা দাড়ি, হস্তপদগুলা লৌহের মত—চক্ষু দুটি সাদা রক্তবর্ণ—কেমন মলিনা, একবার দেখিতে সাধ হয় না?’
‘হয় বৈ কি! বলে দাও এইখানে প্রাসাদের নীচে তাহাকে দাঁড় করাক, আমরা গবাক্ষ দিয়া দেখিব।’
‘ছিঃ, বীরপুরুষের কি অপমান করিতে আছে? ইহাতে তাহার বড় ক্লেশ হইবে—আজ সন্ধ্যার সময় আমরা পুরুষের বেশে কারাগারে গিয়া দেখিয়া আসিব।’
সন্ধ্যার পর তাহারা দুইটি কিশোর রাজপুত সাজিয়া দ্বারপালের নিকট রানীর অনুজ্ঞাপত্র দেখাইয়া প্রবেশ করিল। ঘরে ঘরে কত শৃঙ্খলাবদ্ধ রাজপুত বন্দী বসিয়া আছে দেখিতে পাইল। দাড়ি গোঁফ, গালপাট্টা, লোহার মত শরীর এমন কতজন কাতরমুখে সময় কাটাইতেছে দেখা গেল, কিন্তু কাহাকেও ভরত সিংহের মত বোধ হইল না।
দুইজনের মধ্যে কেহ বলিল, ‘ওই।’ কেহ বলিল, ‘দূর, একি রাজপুত্রের মত দেখিতে?’ দুইজনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল একটা কক্ষে প্রহরীর সংখ্যা কিছু অধিক, জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ ঘরে কে আছে?’
প্রহরী বলিল—’রাজকুমার ভরত সিংহ।’
‘যাইতে দিবে?’
প্রহরী মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না।’
তাহারা অনুজ্ঞাপত্র দেখাইয়া কহিল, ‘মহারানীর আদেশে আমরা সর্বস্থান যাইবার অধিকার পাইয়াছি।’
প্রহরী সসম্মানে পথ ছাড়িয়া দিল।
তাহারা ভিতরে প্রবেশ করিয়া অবাক হইয়া গেল। এই রাজপুত্র! পরিষ্কার শয্যার উপর একজন ক্ষীণকায় শুভ্র ক্ষুদ্র দেহ লইয়া ঘুমাইয়া আছে। মলিনা কহিল, ‘এই রাজপুত্র!’ যমুনা বলিল, ‘এই ভরত সিংহ, এই দেহে এত শক্তি?’ মলিনা বলিল, ‘এতো আমাদের সমবয়সী।’ যমুনা প্রতিবাদ করিল, ‘না আমাদের চেয়ে বড়। আমার দাদা স্বর্গে গিয়াছেন, তিনি বাঁচিয়া থাকিলে এত বড় হইতেন।’
মলিনা ডাকিল, ‘রাজপুত্র।’
রাজপুত্র ফিরিয়া দেখিল। সে শুধু চক্ষু মুদিয়া ছিল। কহিল, ‘কে তোমরা?’
‘আমরা আপনাকে দেখিতে আসিয়াছি। আমরা রাজার আত্মীয়।’
যমুনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘পীড়া কিছু উপশম হইয়াছে কি?’
‘না, বড় ক্লেশ পাইতেছি। বস।’
তাহারা কাছে বসিল।
মলিনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘রাজপুত্র এখানে কোনরূপ অসুবিধা বোধ করিতেছেন?’
‘না, দুর্জয় সিংহ যথেষ্ট যত্ন করিতেছেন।’
সে রাত্রে ফিরিয়া যাইবার সময় মলিনা, যমুনার হাত ধরিয়া বলিল, ‘সখি, অভিমন্যু বধ করিবে?’
চার
যমুনা ভরত সিংহের হাত আপনার হাতে লইয়া বলিল, ‘রাজপুত্র, এই ক্ষীণ বাহুতে এত শক্তি, আমার ত বিশ্বাস হয় না।’
রাজপুত্র হাসিয়া কহিল, ‘লোকে বেশী বাড়াইয়া বলে।’
যমুনা জিজ্ঞাসা কহিল—’এই বালক বয়সের মধ্যে এত বড় যোদ্ধা কি করিয়া হইলেন?’
‘আমি যুদ্ধের চেয়ে সেতার বাজাইতে, চারণদের গান শুনিতে ভালবাসি। পিতৃ আজ্ঞায় যুদ্ধ করি।’
‘আর আমাদের ধর্ম বলিয়া যুদ্ধ করি, না?’
‘না, সমর (পুরুষবেশে যমুনার ইহাই নাম), মানুষ মারাটা ধর্ম বলিয়া মনে হয় না। তবে সকলই করিতে হয়।’
সমর সিংহ কহিল, ‘তোমার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, শুনিয়াছ?’
উ। শুনিয়াছি।
স। মরিতে তোমার ভয় হয় না?
উ। হয়, আমার মরিতে সাধ নাই।
সমর সিংহ কঠিন স্বরে কহিল, ‘তুমি রাজপুত। রাজপুত মরিতে ভয় পাইলে তাহার নরকে স্থান হয়, তুমি তবে কাপুরুষ?’
ভরত সিংহ কহিল, ‘তা বৈ কি!’ এবং কিঞ্চিৎ হাসিল।
‘তবে তোমাকে সকলে সাহসীর অগ্রণী বলে কেন?’
‘সকলেই কি সত্য বলে? তাহারা বোধ হয়—মিছা কথা কহে।’
‘মরিবার পূর্বে তোমার কি কিছু কামনা নাই?’
‘কত কামনা আছে। কিন্তু তাহাতে কাজ কি?’
‘মহারানীকে বলিয়া আমি তাহা পূর্ণ করাইয়া দিতে পারি।’
‘তাহা পার না। আপাততঃ আমার মাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, তুমি দেখাইতে পার?’
যমুনা ভাবিয়া কহিল, ‘তোমার রানীমাতা এখানে আসিবেন কেন?’
‘তাই ত।’ রাজপুত্র পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া চক্ষু মুদিয়া রহিল।
পাঁচ
তার পরদিন সমর সিংহ রাজপুত্রকে ধরিয়া বসিল, ‘কাল তোমাদের বিচার, তুমি রানীর নিকট প্রাণভিক্ষা চাহিয়ো।’
রাজপুত্র হাসিয়া উঠিল, ‘তাই ত ভাই, ওরূপ ব্যবসা যে কখন করি নাই।’
—নাই করিলে, এখন প্রাণের জন্য সব করিতে হয়।
রাজপুত্র কথা কহিল না।
—বল, কাল ক্ষমা চাহিবে?
—বোধহয় পারিব না।
সমর সিংহ শিহরিয়া উঠিল, ‘তাহলে যে প্রাণ যাইবে।’
‘কি করিব ভাই! অন্য উপায় যে আর দেখিতেছি না।’
সমর সিংহ খুব কাছে আসিয়া বসিল। বলিল, ‘তোমার জননীর মুখ স্মরণ কর। তুমি তাঁহার একমাত্র পুত্র, তোমার মৃত্যুতে তাঁহারাও মরিবেন।’
পূর্বদিনের মত ভরত সিংহ পুনরায় পাশ ফিরিয়া শুইলেন। সমর সিংহ বসিয়া রহিল। রাত্রি বাড়িয়া যাইতেছে। প্রহরী বলিল, ‘এইবার যাইতে হইবে।’
সমর সিংহ ডাকিল—রাজপুত্র!
—কি ভাই!
—এই চারি-পাঁচদিন তোমার কত শুশ্রূষা করিয়াছি, অন্ততঃ আমার জন্য তুমি বাঁচিবার চেষ্টা কর।
‘আহা তোমার জন্য বড় দুঃখ হয়; কেন ভাই আমার এত করিতেছ?’
সমর সিংহ মুখ ফিরাইয়া কহিল—‘সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়ো না। বল তুমি বাঁচিবে?’
রাজপুত্র হাসিল। বলিল, ‘সে ত ভাই, তোমাদের রানীর হাত।’
সমর সিংহ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, ‘ভাই, তুমি একবার ক্ষমা চাহিলেই তিনি ক্ষমা করিবেন।’
‘আর যদি না চাই?’
সমর সিংহ মলিন হইয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘সে যে প্রাণের চেয়েও গর্ব ভালবাসে, তাই বড় ভয় হয়।’
প্রাতঃকালে মলিনা বলিল, ‘মহারানি! এস সাজাইয়া দিই। আজ যে রাজপুত্রের বিচার!’
মহারানী বড় বিরক্ত হইলেন। রক্ত-পদ্মের মত চক্ষু দুইটি ফিরাইয়া বলিলেন, ‘মহারানি মহারানি সর্বদা করিস কেন? যমুনা বলিতে পারিস না?’
সে বিস্মিত হইয়া ভাবিল, মহারানী বলিলে যে মুক্তার হার খুলিয়া দিতে পারে, সে আজ এমন করে কেন?
যমুনা বলিল, ‘আমি বিচার করিব না।’
‘তা কি হয়?’
—খুব হয়! বাবার সময় কি রাজত্ব চলিত না?
ছয়
বিচার সভা! স্বর্ণখচিত হীরক-মণিমুক্তাশোভিত, বিচিত্র পট্টবস্ত্রাবৃত স্বর্ণসিংহাসনে যমুনাবাই রাজরাজেশ্বরী বেশে বসিয়া আছে। মন্ত্রী, সভাপণ্ডিত, সভাসদ্, প্রভৃতি সারি দিয়া বসিয়া আছে। অসংখ্য প্রহরী রক্তবর্ণ সজ্জায় সুশোভিত হইয়া শান্তিরক্ষা করিতেছে।
‘জয় মহারানীর জয়! জয় মহারানীর জয়!’
শৃঙ্খলের ঝম ঝম শব্দ শ্রুত হইল। সকলেই চাহিয়া দেখিল, শৃঙ্খলাবদ্ধ শত শত বন্দী যোদ্ধার মধ্যে ভরত সিংহ দাঁড়াইয়া আছে।
কে একজন পার্শ্ব হইতে মৃদুস্বরে কহিল, ‘রাজপুত্র ক্ষমা চাহিও।’ পরিচিত স্বর।
রাজপুত্র চাহিয়া দেখিল, কিন্তু গোলমালের ভিতর সে লুকাইয়া পড়িল।
মহারানীর গলা কাঁপিয়া উঠিল, ‘রাজপুত্র।’
রাজপুত্র চাহিয়া দেখিল।
—কিছু কামনা আছে?
—কিছু না।
—তোমার আজ প্রাণদণ্ড হইবে।
রাজপুত্র কথা কহিল না, মনে হইল সমর সিংহ কোথায়!
—রাজপুত্র কিছু ভিক্ষা আছে?
রাজপুত্র মুখ তুলিল না। নত দৃষ্টিতে হাসিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল—না।
—কিছু না?
—না।
—তোমার মা—তোমার মনে কোন সাধ নাই?
—না।
মহারানী আদেশ করিলেন—রাজপুত্রকে বধ্যভূমিতে লইয়া যাও।
বিপ্রদাস-এর পরিত্যক্ত এক পৃষ্ঠা
মুখুয্যেমশাই, আমি সঙ্গে যাবো।
বিপ্রদাস সবিস্ময়ে কহিল, কোথায়? বলরামপুরে?
বন্দনা বলিল, নিয়ে যান ত রাজী আছি। কিন্তু এখন সে যাওয়ার কথা বলচি নে, বলচি দক্ষিণেশ্বরে যাবার, সাধুজীকে দেখবার ভারী ইচ্ছে হচ্ছে,—আর যদি আপত্তি না করেন ত মা-কালীকেও দর্শন করে আসবো।
কিন্তু তুমি ত এ-সব বিশ্বাস করো না।
না, করিনে, কিন্তু তাই বলে দেখবার ইচ্ছে হবে না কেন? সংসারে সবাই কি সব বিশ্বাস করে, তা বলে কি তারা চোখ বুজে থাকে?
বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, তবে চলো। কিন্তু এঁরা ফিরে এলে তাঁদের দেখবে কে? তুমি আমি দুজনেই চলে গেলে ত ঠিক হবে না।
বন্দনা বলিল, ঠিক হবে মুখুয্যেমশাই, কোন চিন্তা নেই, অন্নদাকে বলে সমস্ত বন্দোবস্ত করে আমি এখুনি আসচি। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।
মিনিট-কয়েক পরে উভয়ে গাড়িতে বসিয়া বন্দনা বলিল, আমি শুনেচি আপনি ভারী পণ্ডিত। এদেশ-ওদেশ দু’দেশের সমস্ত বিদ্যেই আপনার আয়ত্ত। অত বড় লাইব্রেরির প্রত্যেক বইটি আপনার মুখস্ত।
এ সংবাদ দিলে কে? দিদি?
না, আপনার ছোটভাই দ্বিজবাবু।
এটা ওর একটা বাতিক। না বলে বোধ হয় স্বস্তি পায় না। বন্দনা এ লইয়া তর্ক করিল না। কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া প্রশ্ন করিল, মুখুয্যেমশাই, সাধু-সন্ন্যাসী আপনি বিশ্বাস করেন? বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, বিশ্বাস না করবার হেতুটা কি? ওরা যে সংসারে রয়েছে এতো সর্বদাই চোখে পড়ে।
বন্দনা বলিল, সে আমারও পড়ে। আমি মানুষগুলোর কথা বলিনি! জিজ্ঞাসা করচি ওরা যা বলে তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?
ওরা কি বলে?
কি বলে তার আমি কি জানি? আমি কি তাদের জিজ্ঞাসা করেচি নাকি?
বন্দনা মনে মনে বুঝিল প্রশ্নটা বোকার মতো হইয়া গেছে। একটু মৌন থাকিয়া কহিল, সেই কথাই ত জানতে চাইচি, আপনিই বলুন না ওরা কি বলে। বলুন না কিসের জন্যে ওদের দেখতে যাচ্ছেন।
ভালমন্দ
অবিনাশ ঘোষাল আরও বছর-কয়েক চাকরি করতে পারতেন কিন্তু তা সম্ভব হোলো না। খবর এলো এবারেও তাঁকে ডিঙিয়ে কে একজন জুনিয়ার মুনসেফ সব-জজ হয়ে গেল। অন্যান্য বারের মতো এবারেও অবিনাশ নীরব হয়ে রইলেন, শুধু প্রভেদ রইলো এই যে, এবারে তিনি ডাক্তারের সার্টিফিকেট সমেত অবসর গ্রহণের আবেদন যথাস্থানে পৌঁছে দিলেন। আবেদন মঞ্জুর হবেই এ সম্বন্ধে তাঁর সন্দেহ ছিল না।
অবিনাশ সুজন, সুবিচারক, কাজের ক্ষিপ্রতায় সকলেই খুশী, ভদ্র আচরণের প্রশংসা সবাই করে, তবু এই দুর্গতি! এর পিছনে যে গোপন ইতিহাসটুকু আছে কম লোকেই তা জানে। সেটা বলি। তাঁর চাকরির গোড়ার দিকে, একবার এক ছোকরা ইংরেজ আই. সি. এস. জেলার জজ হয়ে আসেন অফিস ইন্সপেকসনে। সামান্য ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে প্রথমে ঘটলো মতভেদ, পরে পরিণত হলো সেটা বিষম বিবাদে। ফিরে গিয়ে জজসাহেব নিরন্তর ব্যাপৃত রইলেন তাঁর কাজের ছিদ্রান্বেষণে, কিন্তু ছিদ্র পাওয়া সহজ ছিল না। জজসাহেবের মন তাতে কিছুমাত্র প্রসন্ন হলো না। রায় কেটেও দেখলেন হাইকোর্টে সেটা টেঁকে না—নিজেকেই অপ্রতিভ হতে হয় বেশী। বদলির সময় হয়েছিল, অবিনাশ চলে গেলেন অন্য জেলায়, কিন্তু দেখা করে গেলেন না। শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রচলিত রীতিতে তাঁর দারুণ ত্রুটি ঘটলো। তারপরে কত বছর কেটে গেল, ব্যাপারটা অবিনাশ ভুলেছিলেন কিন্তু তিনি ভোলেন নি। তারই প্রমাণ এলো কিছুকাল পূর্বে। সেই ছোকরা জজ হয়ে এসেছেন এখন হাইকোর্টে, মুনসেফ প্রভৃতির দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে। অবিনাশ সিনিয়র লোক, কাজে সুনাম যথেষ্ট, উন্নতির পথ সম্পূর্ণ বাধাহীন, হঠাৎ দেখা গেল তাঁকে ডিঙিয়ে নীচের লোক হয়ে গেল সব-জজ। আবার এখানেই শেষ নয়, পরে পরে আরও তিনজন তাঁকে এমনি অতিক্রম করে উপরে উঠে গেল। যাঁরা জানেন না তাঁরা বলবেন, এ কি কখনো হয়? এ যে গবর্নমেন্টের চাকরি! তায় আবার এত বড় চাকরি! এ কি কাজীর আমল! কিন্তু অভিজ্ঞ যাঁরা তাঁরা বলবেন, হয়। এবং আরও বেশী কিছু হয়। সুতরাং, অবিনাশ মনে মনে বুঝলেন এর থেকে আর উদ্ধার নেই। আত্মসম্মান ও চাকরি দু’নৌকোয় পা দিয়ে পাড়ি দেওয়া যায় না—যে-কোন একটা বেছে নিতে হয়। সেইটেই এবার তিনি বেছে নিলেন।
বাসায় অবিনাশের ভার্যা আলোকলতা, আই. এ. ফেল-করা পুত্র হিমাংশু এবং কন্যা শাশ্বতী। ঝি-চাকরের সংখ্যা অফুরন্ত বললেও অতিশয়োক্তি হয় না—এত বেশি।
সেদিন অবিনাশ আদালত থেকে ফিরলেন হাসিমুখে। যথারীতি বেশভূষা ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে জলযোগে বসে বললেন, যাক, এতদিনে মুক্তি পাওয়া গেল ছোটবৌ। সরকারীভাবে খবর এলেও হাইকোর্টের এক বন্ধুর কাছ থেকে আজ টেলিগ্রাম পেলাম আমার জেলখানার মিয়াদ ফুরলো বলে। অধিক বিলম্ব হবে না। বিলম্ব যে হবে না তা নিজেই জানতাম।
আলোকলতা অনতিদূরে একটা চেয়ারে বসে সেলাই করছিলেন, এবং কন্যা শাশ্বতী পিতার পাশে বসে তাঁকে বাতাস করছিল, শুনে দুজনেই চমকে উঠলেন।
স্ত্রী প্রশ্ন করলেন, এ কথার মানেটা কি?
অবিনাশ বললেন, শুনেছ বোধ হয় কে একজন গোবিন্দপদবাবু এবারেও আমাকে ডিঙিয়ে মাস-ছয়েকের জন্যে সব-জজ হয়ে গেলেন। হগসাহেব হাইকোর্টে আসা পর্যন্ত বছর-তিনেক ধরে এই ব্যাপারই চলচে—একটা কথাও বলিনি। ভেবেছিলাম ওদের অন্যায়টা একদিন ওরা নিজেরাই বুঝবে, কিন্তু দেখলাম সে হবার নয়। অন্ততঃ ও লোকটি থাকতে নয়। অবিচার এতদিন সয়েছিলাম, কিন্তু আর সইলে মনুষ্যত্ব যাবে।
কাল বিকেলেই সদরআলার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে এমনি ধরনের একটি কথা আলোকলতা আভাসে-ইঙ্গিতে শুনে এসেছিলেন কিন্তু অর্থ তার বুঝতে পারেন নি। এখনো পারলেন না, শুধু বললেন, তদবির-তাগাদা না করলে আজকালকার দিনে কোন্ কাজটা হয়? মনুষ্যত্ব যাতে না যায় তার কি করেছ শুনি?
অবিনাশ বললেন, তদবির-তাগাদা পারিনে, কিন্তু যেটা পারি সেটা করেছি বৈ কি।
আলোকলতা স্বামীর মুখের পানে চেয়ে এখনও তাৎপর্য ধরতে পারলেন না, কিন্তু ভয় পেলেন। বললেন, সেটা কি শুনি না? কি করেছ বলো না?
অবিনাশ বললেন, সেটা হচ্ছে কাজে ইস্তফা দেওয়া—তা দিয়েছি।
আলোকের হাত থেকে সেলাইটা মাটিতে পড়ে গেল। বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থেকে বললেন, বলো কি গো? এতগুলো লোককে না খেতে দিয়ে উপোস করিয়ে মারবার সঙ্কল্প করেছ? কাজ ছাড়ো দিকি—আমি তোমার দিব্যি করে বলচি সেই দিনই গলায় দড়ি দিয়ে মরবো।
অবিনাশ স্থির হয়ে রইলেন, জবাব দিলেন না।
দরখাস্ত যদি দিয়ে থাকো, কালই উইথড্র করবে বলো?
না।
না কেন? মনের দুঃখে ঝোঁকের মাথায় কত লোকেই ত কত কি করে ফেলে, তার কি প্রতিকার নেই?
অবিনাশ আস্তে আস্তে বললেন, ঝোঁকের মাথায় ত আমি করিনি ছোটবৌ। যা করেছি ভেবে-চিন্তেই করেছি।
উইথড্র করবে না?
না।
আমার মরণটাই তাহলে তুমি ইচ্ছে করো?
তুমি ত জানো ছোটবৌ সে ইচ্ছে করিনে। তবু স্ত্রী হয়ে যদি স্বামীর মর্যাদা এমন করে নষ্ট করে দাও যে মানুষের কাছে আর মুখ তুলে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে—
কথাটা অবিনাশের মুখে বেধে গেল—শেষ হলো না। আলোকলতা বললেন, কি তাহলে—বলো?
উত্তরে একটা কঠোর কথা তাঁর মুখে এসেছিল, কিন্তু এবারেও বলা হোলো না। বাধা পড়লো কন্যার পক্ষ থেকে। এতক্ষণ সে নিঃশব্দেই সমস্ত শুনছিল, কিন্তু আর থাকতে পারলে না। বললে, না বাবা, এ সময়ে মার ভেবে দেখবার শক্তি নেই, তাঁকে কোন জবাব তুমি দিতে পারবে না।
মা মেয়ের স্পর্ধায় প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন, পরক্ষণে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, শাশ্বতী, যা এখান থেকে, উঠে যা বলচি।
মেয়ে বললে, যদি উঠে যেতে হয়, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো মা। তোমার কাছে ফেলে রেখে যাবো না।
কি বললি?
বললাম, তোমার কাছে ওঁকে একলা রেখে আমি যাবো না। কিছুতেই যাবো না। চলো বাবা, আমরা নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি গে। সন্ধ্যের পরে আমি নিজে তোমার খাবার তৈরী করে দেবো—এখন থাক গে খাওয়া। ওঠো বাবা, চলো। এই বলে সে তাঁর হাত ধরে একেবারে দাঁড় করিয়ে দিলে।
ওরা সত্যি চলে যায় দেখে আলোক নিজেকে একটু সামালে নিয়ে বললেন, একটু দাঁড়াও। সত্যিই কি একবারও ভাবোনি, চাকরি ছেড়ে দিলে তোমার বাড়ির এতগুলি প্রাণী খাবে কি!
অবিনাশ উত্তর দিতে গেলেন, কিন্তু এবারেও বাধা এলো মেয়ের দিক থেকে। সে বললে, খাবার জন্যে কি সত্যিই তোমার ভয় হয়েছে মা? কিন্তু হবার ত কথা নয়। চাকরি ছাড়লেও বাবা পেনশন পাবেন—সে তিন শ’ টাকার কম হবে না। পাশের বাড়ির সঞ্জীববাবু ষাট টাকা মাইনে পান, খেতে তাঁর ন-দশ জন। কতদিন দেখে এসেছি, খাওয়া তাঁদের আমাদের চেয়ে মন্দ নয়। তাঁদের চলে যাচ্চে, আর আমাদের তিন-চারজনের খাওয়া-পরা চলবে না!
মায়ের আর ধৈর্য রইলো না, একটা বিশ্রী কটূক্তি করে চেঁচিয়ে উঠলেন—যা দূর হ আমার সুমুখ থেকে। তোর নিজের সংসার হলে গিন্নীপনা করিস, কিন্তু আমার সংসারে কথা কইলে বাড়ি থেকে বার করে দেবো।
মেয়ে একটু হেসে বললে, বেশ ত মা, তাই দাও। বাবার হাত ধরে আমি চলে যাই, তুমি আর দাদা বাবার সমস্ত পেনশন নিয়ে যা ইচ্ছে করো, আমরা কেউ কথা কব না। আমি যে-কোন মেয়ে ইস্কুলে চাকরি করে আমার বুড়ো বাপকে খাওয়াতে পারবো।
মা আর কথা কইলেন না, দেখতে দেখতে তাঁর দু’ চোখ উপচে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়লো।
মেয়ে বাপের হাতে একটু চাপ দিয়ে বললে, বাবা, চলো না যাই। সন্ধ্যে হয়ে যাবে।
অবিনাশ পা বাড়াতেই আলোকলতা আঁচলে চোখ মুছে ধরা-গলায় বললেন, আর একটু দাঁড়াও। তোমার এ কি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা? এর নড়চড় কি নেই?
অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বললেন, না। সে হবার জো নেই।
দেখো, আমি তোমার স্ত্রী, তোমার সুখ-দুঃখের ভাগী—
অবিনাশ বাধা দিলেন, বললেন, তা যদি সত্যি হয় ত আমার সুখের ভাগ এতদিন পেয়েছ, এবার আমার দুঃখের ভাগ নাও।
আলোক বললেন, রাজি আছি কিন্তু সমস্ত মান-ইজ্জত বজায় রেখে এতগুলো টাকায় চলে না, এই সামান্য ক’টা পেনশনের টাকায় চালাবো কি করে?
অবিনাশ বললেন, মান-ইজ্জত বলতে যদি বড়মানুষি বুঝে থাকো ত চলবে না আমি স্বীকার করি। নইলে সঞ্জীববাবুরও চলে।
কিন্তু তোমার মেয়ে? উনিশ-কুড়ি বছরের হলো, তার বিয়ে দেবে কি করে?
মেয়ের সমস্যার সমাধান করতে শাশ্বতী বললে, মা, আমার বিয়ের জন্যে তুমি ভেবো না। যদি নিতান্তই ভাবতে চাও ত বরঞ্চ ভেবো সঞ্জীববাবু কি করে তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
উত্তর শুনে মায়ের আর একবার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। সজল চক্ষু দৃপ্ত হলো, ধরা-গলা মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে কণ্ঠস্বর গেল উচুঁ পর্দায় চড়ে। বললেন, শাশ্বতী, পোড়ারমুখী, আমার সুমুখ থেকে এখনো তুই দূর হয়ে গেলি নে কেন? যা যা বলছি।
যাচ্চি মা। চলো না বাবা।
পাশের ঘরে হিমাংশু কবিতা রচনায় রত ছিল। আই. এ. পরীক্ষার তৃতীয় উদ্যমের এখনো কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। তার কবিতা ‘বাতায়ন’ পত্রিকায় ছাপা হয়, আর কোন কাগজওয়ালা নেয় না। ‘বাতায়ন’-সম্পাদক উৎসাহ দিয়ে চিঠি লেখেন, “হিমাংশুবাবু, আপনার কবিতাটি চমৎকার হয়েছে। আগামীবারে আর একটা পাঠাবেন—একটু ছোট করে। এবং ঐ সঙ্গে শাশ্বতী দেবীর একটি রচনা অতি অবশ্য পাঠাবেন। “ জানিনে, ‘বাতায়ন’-সম্পাদক সত্যি বলেন, না ঠাট্টা করেন। কিংবা তাঁর আর কোন উদ্দেশ্য আছে। শাশ্বতী দেখে হাসে—বলে, দাদা, এ চিঠি বন্ধু-মহলে আর দেখিয়ে বেড়িও না।
কেন বলতো?
না, এমনিই বলচি। নিজের প্রশংসা নিজের হাতে প্রচার করে বেড়ানো কি ভালো?
কবিতা পাঠানোর আগে সে বোনকে পড়ানোর ছলে ভুল-চুকগুলো সব শুধরে নেয়। সংশোধনের মাত্রা কিছু বেশি হয়ে পড়লে লজ্জিত হয়ে বলে, তোর মত আমি ত আর বাবার কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্য, সাহিত্য পড়িনি, আমার দোষ কি? কিন্তু জানিস শাশ্বতী, আসলে এ কিছুই নয়। দশ টাকা মাইনে দিয়ে একটা পণ্ডিত রাখলেই কাজ চলে যায়। কিন্তু কবিতার সত্যিকার প্রাণ হলো কল্পনায়, আইডিয়ায়, তার প্রকাশ-ভঙ্গিতে। সেখানে তোর কলাপ মুগ্ধবোধের বাপের সাধ্যি নেই যে দাঁত ফোটায়।
সে সত্যি দাদা।
হিমাংশুর কলমের ডগায় একটি চমৎকার মিল এসে পড়েছিল, কিন্তু মায়ের তীব্রকণ্ঠ হঠাৎ সমস্ত ছত্রভঙ্গ করে দিলে। কলম রেখে পাশের দোর ঠেলে সে এ ঘরে ঢুকতেই মা চেঁচিয়ে উঠলেন, জানিস হিমাংশু, আমাদের কি সর্বনাশ হলো? উনি চাকরি ছেড়ে দিলেন,—নইলে মনুষ্যত্ব চলে যাচ্ছিল। কেন? কেননা কোথাকার কে একজন ওঁর বদলে সব-জজ হয়েছে, উনি নিজে হতে পারেন নি। আমি স্পষ্ট বলচি, এ হিংসে ছাড়া আর কিছু নয়। নিছক হিংসে!
হিমাংশু চোখ কপালে তুলে বললে, তুমি বলো কি মা! চাকরি ছেড়ে দিলেন? হোয়াট্ নন্সেন্স!
অবিনাশের মুখ পাংশু হয়ে গেল, তিনি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে স্থির হয়ে রইলেন। আসন্ন সন্ধ্যার ম্লান ছায়ায় তাঁর সমস্ত চেহারাটা যেন কি একপ্রকার অদ্ভুত দেখালো।
শাশ্বতী পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠলো—উঃ—জগতে ধৃষ্টতার কি সীমা নেই বাবা! তুমি চলো এখান থেকে, নইলে আমি মাথা খুঁড়ে মরবো। বলে, অর্ধ-সচেতন বাপকে সে জোর করে টেনে নিয়ে বাড়ি থেকে বার হয়ে গেল।
মাতৃভাষা এবং সাহিত্য
গোড়াতেই বলিয়া রাখা ভাল, এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে আমি যে সাহিত্যের সকল দিক ও বিভাগ লইয়া প্রকাণ্ড একটা কাণ্ড বাধাইয়া দিতে পারিব, আমার এমন কোন মহৎ উদ্দেশ্য বা ভরসা নাই। তবে মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের সাধারণ ধর্ম এবং প্রকৃতি এই ক্ষুদ্র স্থানে যতটা সম্ভব, আলোচনা করিবার চেষ্টা করিব মাত্র। আমার উদ্দেশ্য বৃহৎ নহে; অতএব যিনি বৃহৎ একটা আশা লইয়া আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ পড়িতে বসিবেন। তাঁহার আশার তৃপ্তি সাধন করিতে আমি একান্ত অপারগ।
একটা কথা আমার অত্যন্ত দুঃখের সহিত মনে পড়িতেছে, আমার জীবনের আমি এমন দুই-একটা কৃতবিদ্য বাঙালীকে ঘনিষ্ঠভাবে জানিয়াছি, যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষাগুলাই কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হইয়াও মাতৃভাষা জানা এবং না-জানার মধ্যে কোন পার্থক্যই দেখিতে পাইতেন না। তাঁহারা সব-কটাই পাস করিয়াছেন এবং সরকারী চাকরিতে হাজার টাকা বেতন পাইতেছেন। অর্থাৎ যে-সব অদ্ভুত কাণ্ড করিতে পারিলে বাঙালী সমাজে মানুষ প্রাতঃস্মরণীয় হয়, তাঁহারা সেই-সব করিয়াছেন। অথচ, বাঙ্গালায় একখানা চিঠি পর্যন্ত লিখিতে পারিতেন না। অবশ্য, না শিখিলে কিছুই পারা যায় না—ইহাতেও অত দুঃখের কথা নাই, কিন্তু বড় দুঃখের কথা এই যে, তাঁহারা নিজেদের এই অক্ষমতাটা বন্ধু-বান্ধবের কাছে আহ্লাদ করিয়া বলিতে ভালবাসিতেন। লজ্জার পরিবর্তে শ্লাঘাবোধ করিতেন অর্থাৎ ভাবটা এই যে, এত ইংরাজি শিখিয়াছি যে, বাঙ্গালায় একখানা চিঠি লিখিবার বিদ্যাটুকু পর্যন্ত আয়ত্ত করিবার সময় পাই নাই। জানি না, এ-রকম হাজার টাকার বাঙালী আরো কত আছেন, কিন্তু এটা যদি তাঁহারা জানিতেন যে, মাতৃভাষা না শিখিয়াও ঐ অতটা পর্যন্তই পারা যায়, কিন্তু তার ঊর্ধ্বে যাওয়া যায় না, ঐ চলা-বলা-খাওয়া-টাকা রোজগার পর্যন্তই হয়, আর হয় না; যথার্থ বড় কাজ, যা করিলে মানুষ অমর হয়, যাঁর মৃত্যুতে দেশে হাহাকার উঠে, তেমন বড় কর্মী কিছুতেই হওয়া যায় না, তাহা হইলে নিজেদের ঐ অক্ষমতার পরিচয় দিবার সময় অমন করিয়া হাসিয়া আকুল হইতে পারিতেন না।
তাই আজ আমি এই কথাটাই আপনাদিগকে বিশেষ করিয়া স্মরণ করাইতে চাই, যে, যথার্থ স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তার সাক্ষাৎ মাতৃভাষা ভিন্ন ঘটে না, যথার্থ বড় চিন্তার ফল সংগ্রহ করিবার পথ মাতৃগৃহদ্বারের ভিতর দিয়াই, বাঙ্গালী যখন বাঙ্গালী, সে যখন সাহেব নয়, তখন, বিলাতি ভাষার মস্তবড় ফাটকের সম্মুখে যুগযুগান্তর দাঁড়াইয়াও কোনদিনই সে পথের সন্ধান পাইবে না।
এ কথা শুধু ইতিহাসের দিক দিয়াই সত্য নহে, মনোবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের দিক দিয়াও সত্য।
কেন যে আজ পর্যন্ত জগতে, মানুষ যত-কিছু বড় চিন্তা করিয়া গিয়াছেন সে সমস্তই মাতৃভাষায়, বৈষয়িক উন্নতির অবনতির ফলে এক-একটা ভাষা সাময়িক প্রাধান্য এবং ব্যাপকতা লাভ করা সত্ত্বেও এবং সেই ভাষা সর্বতোভাবে আয়ত্তাধীন থাকা সত্ত্বেও কেন যে চিন্তাশীল ভাবুকেরা নামের লোভ ত্যাগ করিয়া নিজেদের অমূল্য চিন্তারাশি মাতৃভাষাতেই লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, কেন মাতৃভাষা ভিন্ন অপরের ভাষায় বড় চিন্তার অধিকার জন্মায় না, এই সত্যটা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতে গেলে, প্রথমতঃ ভাষাবিজ্ঞানের দুটো মূল কথা মনে করিয়া লওয়া উচিত।
ব্রহ্মাণ্ডে আছে কি? আছে আমার চৈতন্য এবং তদ্বিষয়ীভূত যাবতীয় পদার্থ। অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যজগৎ। উভয়ে কি সম্বন্ধ এবং সে সম্বন্ধ সত্য কিংবা অলীক, সে আলাদা কথা। কিন্তু এই যে পরিচয় গ্রহণ, একের উপরে অপরের কার্য, ইহাই মানবের ভাব এবং চিন্তা। এবং এই পদার্থ নিশ্চয়ই মানবের চিন্তার বিষয়। এমনি করিয়াই সমস্ত স্থূল বিশ্ব একে একে মানবের ভাব-রাজ্যের আয়ত্ত হইয়া পড়ে। ঘর-বাড়ি, সমাজ, দেশ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ এক-একটি চিন্তার জন্মদান করিয়া ইহারাই মানব-চিত্তে এক-একটি ভাব উৎপন্ন করে। অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগৎ উভয়েই বিচিত্র তথ্য ও ঘটনায় ভরিয়া উঠে। উভয় জগতের এইসব তথ্য ও ঘটনা ছাড়া মানুষ ভাবিতেই পারে না। অর্থাৎ ইহাদের দ্বারাই মানবচিত্ত আন্দোলিত হইয়া ইহাতেই পরিপূর্ণ হইয়া যায়। এক কথায় ইহারা ভাব ও ধারণার কারণও বটে, ইহারা তাহার বিষয়ও বটে।
এইবার মনের মধ্যে পদার্থের পরীক্ষা হইতে থকে। ভাব ও চিন্তার কাছে তাহাদের প্রকৃতি ও স্বরূপ ধরা পড়ে, ধর্ম ও গুণের হিসাবে নানা লক্ষণবিশিষ্ট হইয়া বাহ্যজগৎ এইবার ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট হইতে থাকে।
মানবের ভাব ও চিন্তাই যাবতীয় পদার্থে গুণের আরোপ করে। সে কি, আর একটার সহিত তাহার কি প্রভেদ স্থির করিয়া দেয়। তারপর পদার্থের সহিত পদার্থের তুলনা করিয়া সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া লক্ষণ নির্ণয় করিয়া ধর্মবিশিষ্ট করিয়া আমরা তাহাদের ধারণা-কার্য সম্পূর্ণ করি।
বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সময়ের মানব-চিন্তা-প্রণালী পর্যালোচনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায়, এই চিন্তা-প্রণালী কয়েকটা সাধারণ নিয়মের অন্তর্গত। একই নিয়মে মানবের চিন্তারাশি পরিপক্ক ও সম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।
যেমন বাহ্যজগতে দেখা যায়, কোন দুটি বস্তু একই সময়ে একই স্থান অধিকার করিতে পারে না অন্তর্জগতেও ঠিক তাই। সেখানেও কোন দুটি বস্তু এক সঙ্গেই চিত্ত অধিকার করিতে পারে না। সেই জন্যই আমরা কোনমতেই এক সঙ্গে একই আয়াসে দুটি বস্তুর পরিচয়-লাভ কিংবা একটি বস্তুর দুটি গুণনির্ণয় করিতে পারি না। আমরা বিষয় ভাগ করিয়া একটি একটি করিয়া লক্ষণ স্থির করি। অর্থাৎ চিন্তার কার্য ক্রমশঃ নিষ্পন্ন হয়। অন্তর্জগতে মন যেমন দুটি বস্তু বা দুটি গুণ এক সঙ্গে গ্রাহ্য করে না, বাহ্যজগতে পদার্থও তেমনি তাহার সব-কটা গুণই একই সময়ে মানব-চিত্তের কাছে প্রকাশ করে না। যুবতী রমণীর রূপ শিশুচিত্তের কাছে ধরা দেয় না। সে রূপের মূল্য উপলব্ধি করিবার জন্য শিশুচিত্তকে একটা নির্দিষ্ট বয়সের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়।
এই জন্য ভাবের ক্রমিক বিকাশ, বয়োবৃদ্ধি ও ধারণা-শক্তির বিকাশের উপর নির্ভর করে। এবং তাহার উপর ভাব ও চিন্তার সংখ্যাবৃদ্ধি হয়।
কিন্তু চিন্তা-পদ্ধতির সর্বাপেক্ষা সাধারণ নিয়ম এই যে, পুরাতন ভাব ও ধারণার ভিত্তি অবলম্বন না করিয়া প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত চিন্তাস্রোতে গা ভাসান না দিয়া মানব-চিত্ত কোনমতেই নতুন ধারণা বা নূতন ভাব আয়ত্ত করিতে পারে না। জ্ঞাত ও সুনির্দিষ্ট পদার্থ নিয়ে অতীত দিনে যেভাবে চিত্তকে নাড়া দিয়া তাহার গুণ ও ধর্মের কাহিনী জানাইয়া দিয়া গিয়াছে, অর্থাৎ তাহার সম্বন্ধে মনের মধ্যে যে জ্ঞান জন্মিয়া রহিয়াছে, সেই জ্ঞানের সহিত তুলনা না করিয়া, তাহাদিগকে ব্যবহার না করিয়া কোনমতেই মানুষ পদার্থের নূতন লক্ষণ ও ধর্মের পরিচয় পাইতে পারে না।
যেমন করিয়া এবং যে-যে উপায়ে শিশুচিত্তে প্রথম চৈতন্যের বিকাশ ঘটিয়াছিল জানিয়া এবং না জানিয়া যে-সকল পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া সেই তরুণ চিত্ত, ভাব, চিন্তা ও ধারণায় অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, যে-সমস্ত জল, হাওয়া ও আলোক পাইয়া তাহার জ্ঞানের অঙ্কুর পল্লবিত হইয়া আজ শাখা-প্রশাখায় বড় হইয়াছে, সে জল, হাওয়া, আলোককে বাদ দিয়া আর একটা অভিনব প্রণালীতে মানবচিত্ত কোনমতেই নূতন জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। অর্থাৎ যেমন করিয়া সে মাতৃক্রোড়ে বসিয়া চিন্তা করিতে শিখিয়াছিল মরিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে সে-পথ ছাড়িয়া যাইতে পারে না—পুরাতন জ্ঞানকে অস্বীকার করিয়া পুরাতন পদ্ধতি ত্যাগ করিয়া কাহারোই নূতন জ্ঞান, নূতন চিন্তা জন্মে না।
আরো একটা কথা। ভাব ও চিন্তা যেমন ভাষার জন্মদান করে, ভাষাও তেমনি চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত, সুসম্বন্ধ ও শৃঙ্খলিত করে। ভাষা ভিন্ন ভাবা যায় না। একটুখানি অনুধাবন করিলেই দেখিতে পাওয়া যায়, যে-কোন একটা ভাষা মনে মনে আবৃত্তি করিয়াই চিন্তা করে—যেখানে ভাষা নাই, সেখানে চিন্তাও নাই।
আবার এইমাত্র বলিয়াছি, পুরাতন নিয়মকে উপেক্ষা করিয়া, পুরাতনের উপর পা না ফেলিয়া নূতনে যাওয়া যায় না—আবার ভাষা ছাড়া সুসম্বন্ধ চিন্তাও হয় না—তাহা হইলে এই দাঁড়ায় বাঙ্গালী বাংলা ছাড়া চিন্তা করিতে পারে না, ইংরাজ ইংরাজি ছাড়া ভাবিতে পারে না। তাহার পক্ষে মাতৃভাষা ভিন্ন যথার্থ চিন্তা যেমন অসম্ভব, বাঙ্গালীর পক্ষেও তেমনি। তা তিনি যত বড় ইংরাজি-জানা মানুষই হউন। বাংলা ভাষা ছাড়া স্বাধীন, মৌলিক বড় চিন্তা কোনমতেই সম্ভব হইবে না।
এ-সব বিজ্ঞানের প্রমাণিত তথ্য। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। চলে শুধু গায়ের জোরে, আর কিছুতে না।
যে ভাষায় প্রথম মা বলিতে শিখিয়াছি, যে ভাষা দিয়া প্রথম এটা ওটা সেটা চিনিয়াছি, যে ভাষায় প্রথমে ‘কেন’ প্রশ্ন করিতে শিখিয়াছি, সেই ভাষার সাহায্য ভিন্ন ভাবুক, চিন্তাশীল কর্মী হইবার আশা করা আর পাগলামি করা এক। তাই যে কথা পূর্বে বলিয়াছি তাহারি পুনরাবৃত্তি করিয়া বলিতেছি, পরভাষায় যত বড় দখলই থাক, তাহাতে ঐ চলা-বলা-খাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা, টাকা রোজগার পর্যন্তই হয়, এর বেশি হয় না, হইতে পারে না।
তারপরে সাহিত্য। আমার মনে হয়, সর্বত্র এবং সকল সময়েই ভাষা ও সাহিত্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত। যেন পদার্থ ও তাহার ছায়া। অবশ্য প্রমাণ করিতে পারি না যে, পশুদের ভাষা আছে বলিয়া সাহিত্যও আছে। যাঁহারা ‘নাই’ বলেন, তাঁহাদের অস্বীকার খণ্ডন করিবার যুক্তি আমার নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে, ভাষা আছে কিন্তু সাহিত্য নাই।
ভাষা-বিজ্ঞানবিদেরা বলেন, মানবের কোন্ অবস্থায় তাহার প্রথম সাহিত্য-সৃষ্টি তাহা বলিবার জো নাই, খুব সম্ভব, যেদিন হইতে তাহার ভাষা, সেই দিন হইতে তাহার সাহিত্য। যেদিন হইতে সে তাহার হত দলপতির বীরত্ব-কাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, যেদিন হইতে প্রণয়ীর মন পাইবার অভিপ্রায়ে সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছিল, সেই দিন হইতেই তাহার সাহিত্য।
তাই যদি হয়, কে জোর করিয়া বলিতে পারে পশু-পক্ষীর ভাষা আছে অথচ সাহিত্য নাই? আমি নিজে অনেক রকমের পাখি পুষিয়াছি, অনেক বার দেখিয়াছি তাহারা প্রয়োজনের বেশি কথা কহে, গান গাহে। সে কথা, সে গান আর একটা পাখি মন দিয়া শুনে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে, উভয়েই এমন করিয়া তৃপ্তির আস্বাদ উপভোগ করে, যাহা ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির অতিরিক্ত আর কিছু। তখন, কেমন করিয়া নিঃসংশয়ে বলিতে পারি ইহাদের ভাষা আছে, গান আছে কিন্তু সাহিত্য নাই? কথাটা হয়ত হাসির উদ্রেক করিতে পারে, পশু-পক্ষীর সাহিত্য! কিন্তু সেদিন পর্যন্ত কে ভাবিতে পারিয়াছিল গাছপালা সুখদুঃখ অনুভব করে? শুধু তাই নয়, সেটা প্রকাশও করে। তেমনি হয়ত, আমার কল্পনাটাও একদিন প্রমাণ হইয়া যাইতেও পারে।
যাক ও কথা। আমার বলিবার বিষয় শুধু এই যে, ভাষা থাকিলেই সাহিত্য থাকা সম্ভব; তা সে যাহারই হোক এবং যেখানেই হোক। অনুভূতির পরিণতি যেমন ভাব ও চিন্তা, ভাষার পরিণতিও তেমনি সাহিত্য। ভাব প্রকাশ করিবার উপায় যেমন ভাষা, চিন্তা প্রকাশ করিবার উপায়ও তেমনি সাহিত্য। জাতির সাহিত্যই শুধু জানাইয়া দিতে সক্ষম সে জাতির চিন্তাধারা কোন্ দিকে কোথায় এবং কতদূরে গিয়া পৌঁছিয়াছে। দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, এমন কি যুদ্ধবিদ্যার জ্ঞান ও চিন্তাও দেশের সাহিত্যই প্রকাশ করে।
একবার বলিয়াছি, ভাষা ছাড়া চিন্তা করা যায় না। তাই জগতে যাঁহারা চিন্তাশীল বলিয়া খ্যাত,তা সে চিন্তার যে-কোন দিকই হউক, মাতৃভাষায় দেশের সাহিত্যে তাঁহারা ব্যুৎপন্ন এ কথা বোধ করি অসংশয়ে বলা যায়।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের প্রতি চোখ ফিরাইলে এই সত্য অতি সহজেই সপ্রমাণ হয়। তাঁহারা দর্শন বা বিজ্ঞান লইয়াই থাকেন, লোকে তাঁহাদের চিন্তার ঐ দিকটার পরিচয় পায়, কিন্তু, দৈবাৎ কোন প্রকাশ পাইলে, বৈজ্ঞানিকের অসাধারণ সাহিত্য-ব্যুৎপত্তি দেখিয়া লোকে বিস্ময়ে অবাক হইয়া যায়। বিলাতের হক্সলি, টিন্ডল, লজ, ওয়ালেশ, হেল্ম হোজ, হেকেল প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকেরা খুব বড় সাহিত্যিক। আমাদের জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্রও কোন খ্যাত সাহিত্যিক অপেক্ষা ছোট নহেন।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় কিছুই থাকে না, যদি এই কথাটা মনে রাখা যায়। সাহিত্যকে বাদ দিয়া যাঁহারা বিজ্ঞান আলোচনা করেন, তাঁহারা বিজ্ঞানবিৎ হইলেও হইতে পারেন, কিন্তু বাহিরের সংসার তাঁহাদের পরিচয় পায় না। কারণ, ভাষা সাহিত্যকে অবহেলা করার সঙ্গে সঙ্গেই, স্বাধীন চিন্তাশক্তিও অন্তর্ধান করে।
এইবার সাহিত্যের দ্বিতীয় অংশের কথা আপনাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিব। কিন্তু তাহার পূর্বে এতক্ষণ যাহা বলিলাম তাহা কি? তাহা শুধু এই যে, মাতৃভাষা শিক্ষার যথেষ্ট আবশ্যকতা আছে। পরের ভাষায় সংসারের সাধারণ মামুলি কর্তব্যই করা যায়, কিন্তু বড় কাজ, বড় কর্তব্যের পথ মায়ের উঠানের উপর দিয়াই—তাহার আর কোন পথ নাই। ইতিহাস ও বিজ্ঞান এই সত্যই প্রচার করে।
কিন্তু সাহিত্য বলিতে সাধারণত কাব্য ও উপন্যাসই বুঝায়। সে যে নিছক কাল্পনিক বস্তু। একশ্রেণীর কাজের লোক আছেন, তাঁহাদের বিশ্বাস যাহা কল্পনা তাহাই মিথ্যা এবং মিথ্যা কোন দিন কাজে লাগিতে পারে না। সেটা পড়িয়া নিশ্চয়ই জানিয়া রাখা উচিত, বিলাতের রাজা অত নম্বরের হেনরীর কতগুলি ভার্যা ছিল এবং অমুক অমুক সালে, তাহাদের অমুক অমুক কারণে, অমুক অমুক দশা ঘটিয়াছিল। কারণ, কথাগুলি সত্য কথা এবং দশাগুলি সত্যই ঘটিয়াছিল। কিন্তু, কি হইবে জানিয়া বিষবৃক্ষের নগেন্দ্রনাথের ভার্যা সূর্যমুখীর কি দশা ঘটিয়াছিল এবং কেন ঘটিয়াছিল? তাহা ত সত্যই ঘটে নাই—লেখক বানাইয়া বলিয়াছেন মাত্র। বানানো কথা পড়িয়া বড় জোর সময়টাই কাটিতে পারে। কিন্তু, আর কোন্ কাজ হইবে? তাঁহাদের মতে যাহা ঘটিয়াছে তাহাই সত্য, কিন্তু যাহা হয়ত ঘটিলে ঘটিতে পারিত কিন্তু ঘটে নাই, তাহা মিথ্যা। কিন্তু বস্তুতঃ তাই কি? এইখানে কবির অমর উক্তি উদ্ধৃত করি—
ঘটে যা তা সব সত্য নয়, কবি তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
বস্তুতঃ ইহাই সত্য এবং বড়রকমের সত্য। ইংরাজেরা যাহাকে ‘এ হায়ার কাইন্ড অফ ট্রুথ’ বলেন, ইহা তাহাই। সীতাদেবী যথার্থই শ্রীরামচন্দ্রকে অতখানি ভাল বাসিয়াছিলেন কিনা, ঠিক অমনি পতিগতপ্রাণা ছিলেন কিনা, যথার্থই রাজপ্রাসাদ, রাজভোগ ত্যাগ করিয়া বনে-জঙ্গলে স্বামীকে অনুসরণ করিয়াছিলেন কিনা, কিংবা ঐতিহাসিক প্রমাণে তাঁহাদের বাস্তব সত্তা কিছু ছিল কিনা, ইহাও তত বড় সত্য নয়, যত বড় সত্য কবির মনোভূমিতে জন্মিয়া রামায়ণের শ্লোকের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
জানকী দেবী হউন, মানবী হউন, সত্য হউন, রূপক হউন, যাহা ইচ্ছা হউন; অত গভীর পতিপ্রেম তাঁহাতে সম্ভব-অসম্ভব যাহাই হউক, কিছুমাত্র আসে যায় না; যখন, ঐ গভীর দাম্পত্য-প্রেমের ছবি কবির হৃদয়ে সত্য বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারিয়াছে এবং যুগ-যুগান্তর নর-নারীকে আদর্শ দাম্পত্য প্রেমে দীক্ষা দিয়া আসিয়াছে, ইহাই সত্য। সত্যকার অযোধ্যা সত্যকার রাম-সীতা অপেক্ষা সহস্র সহস্র গুণে সত্য। অযোধ্যা হয়ত একটি রাম, একটি সীতাতে সত্য, কিন্তু কবির কল্পনায় যে রাম-সীতা জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, হয়ত তাহা আজ পর্যন্ত কোটি কোটি রাম-সীতাতে সত্য হইয়াছে।
সেদিন স্নেহলতার আত্মবিসর্জনকাহিনী সংবাদপত্রে পড়িয়াই মনে হইয়াছিল ঠিক এমনি করুণ, এমনি স্বার্থত্যাগের চিত্র কিছুদিন পূর্বে গল্প-সাহিত্যে পড়িয়াছিলাম। সে মেয়েটিও দরিদ্র পিতাকে দুঃখ-কষ্ট হইতে অব্যাহতি দিবার জন্যই আত্মবিসর্জন করিয়াছিল। তাহারও বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইতেছিল এবং পাত্র পাওয়া যাইতেছিল না।
সংবাদপত্রের কাহিনী ঐ একটি স্নেহলতাতেই সত্য, কিন্তু কবির কল্পনায় যে মেয়েটি আত্মহত্যা করিয়াছিল, তাহা হয়ত শত-সহস্রে সত্য।
স্নেহলতা শিক্ষিতা ছিলেন, কে জানে তিনি এই কাহিনী পড়িয়াছিলেন কি না, এবং স্বার্থত্যাগ-মন্ত্র ইহাতেই পাইয়াছিলেন কি না!
আমার বিশ্বাস কিন্তু এই। আমার নিশ্চয় মনে হয়, তিনি লেখাপড়া না জানিলে, সাহিত্যচর্চা না করিয়া থাকিলে কিছুতেই এ শক্তি, এ বল নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইতেন না। কবির কল্পনা এমনি করিয়াই সত্য হয়, কবির কল্পনা এমনি করিয়াই কাজ করে।
দেশের কল্পনায় দেশের সাহিত্য, দেশের ইতিহাস বড় হউক, জীবন্ত হউক, সত্য হউক, সুন্দর হউক, এই প্রার্থনাই আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করিতেছি। প্রত্যেক সুসন্তান অকপটে মাতৃভাষার সেবা করুন, এইটুকু মাত্র ভিক্ষা আপনাদের কাছে সবিনয়ে করিতেছি। কিন্তু কি করিলে সাহিত্য ঠিক অমনটি হইবে, সে পরামর্শ দিবার স্পর্ধা আমার নাই। শুধু এইটুকু মাত্র বলিতে পারি, যাহা সত্য বলিয়া মনে হইবে, অন্তরের সহিত যাহাকে সুন্দর বলিয়া বুঝিবেন, নিজের সাধ্যমত সেই পথ ধরিয়াই চলিবেন—তার পরে ফল ভবিষ্যতের হাতে।
যাঁহারা বড় সাহিত্যিক, বড় সমালোচক তাঁহারা পরামর্শ দিতেছেন, উপদেশ দিতেছেন ইংরাজি ভাব, ইংরাজি ভঙ্গী ত্যাগ করিয়া খাঁটি স্বদেশী হইতে; আমি নিজেও একজন অতি ক্ষুদ্র নগণ্য সাহিত্যসেবক, কিন্তু দুঃখের সহিত স্বীকার করিতেছি, তাঁহাদের পরামর্শ, তাঁহাদের উপদেশ যে ঠিক কি, তাহা এখন পর্যন্ত বুঝি নাই।
কে কোথায় হ্রস্ব-ই-কার স্থানে ঈ দিয়াছেন, কে কোথায় ‘অ’-কারের পরিবর্তে ‘ও’-কার ব্যবহার করিয়া ভয়ানক অন্যায় করিয়াছেন, কে কোথায় কোন্ বিধবা বঙ্গনারীকে দিয়া এক মুমূর্ষু হতভাগ্য পরপুরুষের মুখে জল দিয়া সাহিত্যে বিষম কুরুচি টানিয়া আনিয়াছেন, এই-সব লইয়া সাহিত্যক্ষেত্রে মহা তোলপাড় হইতেছে, কেন হইতেছে, যথার্থ কি তাহাতে দোষ, কি হইলে ঠিকটি হইত, এ-সব খুঁটিনাটি আয়ত্ত করিয়া তাহাতে মতামত দিবার ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি কিছুই আমার নাই।
কোন সাহিত্য-সেবককেই আমি উপদেশ দিতে পারি না, এই কর কিংবা এই করা উচিত।
শুধু এইটুকু বলি, হৃদয়ের মধ্যে এই সত্য জাগাইয়া রাখিয়া সাহিত্যসেবা করুন, যেন আপনার সেবা মাতৃভাষার দ্বার দিয়া স্বদেশবাসীকে কল্যাণের পথে লইয়া যায়। তখন কি উচিত, কি উচিত নয়, তাহা দেশের হৃদয় ও প্রাণই বলিয়া দিবে।
শেষের পরিচয় – এর অপ্রকাশিত অংশ
‘শেষের পরিচয়’ – এর অপ্রকাশিত অংশ
ষোল
সারদাকে অপমান করিয়া তাহার ঘর হইতে ফিরিয়া রাখাল বাসায় আসিল। দাসী তখনো বাড়ি যায় নাই, কুকারে রান্নার সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত করিয়া তখনো সে অপেক্ষা করিতেছিল। রাখাল বলিল, আজ খাবো না নানী, ক্ষিদে নেই। রান্নার দরকার হবে না।
ঝি রাগ করিয়া বলিল, সে হবে না বাবু। আলিস্যি করে রাঁধবে না, না খেয়ে উপোস করে শুয়ে থাকবে, সে আমি কিছুতেই সইবো না। দিন দিন দেহটা কি রকম হয়ে যাচ্ছে একবার চেয়ে দেখো দেকি। এই বলিয়া সে একটা ছোট আরশি আনিয়া সুমুখে ধরিতেছিল। রাখাল সলজ্জ হাস্যে হাত দিয়া সরাইয়া দিয়া বলিল, বুড়ো হয়ে তোমার চোখের দৃষ্টি খারাপ হয়ে যাচ্চে,—আমি ত ভালই আছি।
না, তুমি ভাল নেই দাদাবাবু, আমার মাথা খাও, আগের মতো খাওয়া-দাওয়ায় আবার দৃষ্টি দাও। না হয় আমাকে ছুটি দাও, দেখতেও আসবো না, বলতেও যাবো না।
রাগের ওপর আমাকে ত্যাগ করবে নানী? তুমি ছাড়া আমার ত সংসারে কেউ নেই। এই বলিয়া সে জোর করিয়া হাসিয়া কুকারে খাবার চড়াইয়া দিল। ক্ষুধার প্রয়োজনে নয় এই পুরাতন দাসীটিকে কেবল খুশি করার জন্যই।
রাখাল মুখে যাই বলুক, মনে মনে বুঝিতে পারে পূর্বের মতো সে আর নাই। কিসে যেন তাহার মুখের লাবণ্য প্রতিদিন ম্লান করিয়া আনিতেছে। আনন্দের পাত্রে ঠিক কোনখানে যে চিড় খাইয়াছে ধরিতে পারে না; কিন্তু সঞ্চয় ধীরে ধীরে কমিতেছে টের পায়।
উৎসবে যোগদানের নিমন্ত্রণ, বেগার খাটার আবেদন, কর্তব্য পালনের আহ্বান আজও তেমনি আসিয়া পৌঁছে, যায় না, করে না তাও নয়, তিরস্কারের দাবী যাহাদের কর্তব্য অবহেলার অপরাধে তিরস্কার তেমনি করে, ভর্ৎসনার উত্তরে আজও রাখাল তেমনি সবিনয়ে ক্ষমা করে, ভিক্ষা করে, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়া তেমনি উৎসাহে কাজে নামে, তবু যেন কেমন করিয়া এই কথাটা প্রকাশ পায় সে-রাখাল ও এ-রাখাল ঠিক এক মানুষই নয়। কাজ করার হঠাৎ কোন ফাঁকে তাহার মনের ঔদাসীন্য এমনি ধরা পড়ে যে সে অপ্রতিভ হইয়া যায়,—উত্তর দিতে পারে না। এতদিন এইভাবেই তাহার কাল কাটিতেছিল। মনের তলদেশ কি দিয়া কেমন করিয়া ধীরে ধীরে আচ্ছাদিত হইতেছিল, যাচাই করিয়া, জেরা করিয়া দেখে নাই, আজ সারদার সঙ্গে কলহ, কথা কাটাকাটির ফলে ভিতরের পঙ্ক উপরে উঠিয়া হঠাৎ সমস্ত স্থানটা এমনি ঘুলাইয়া কলুষিত করিয়া দিল যে, সে নিজেই একেবারে অবাক হইয়া গেল। নতুন-মার বাড়ি হইতে চলিয়া আসার সময়ে তাহার মনের মধ্যে এই ছিল যে, সারদার অশিষ্ট দুর্বিনয়ের জবাব সে নিঃশব্দে উপেক্ষায় দূরে রাখিয়া দিবে, কোন সম্বন্ধই আর রাখিবে না। কিন্তু নিজের বাড়িতে ফিরিয়া সংকল্প স্থির করিতে পারিল না। মন তিক্তকণ্ঠে বারবার বলিতে লাগিল, সারদার আচরণ ক্ষমার অযোগ্য, যাহা বলিয়াছে সে শুধু কৃতঘ্নতাই নয়, নিরতিশয় অপমানকর। অথচ এই উত্তেজনা তাহার কানে কানে কে দিতে লাগিল রাখাল ভাবিয়া দেখিল না, বিচার করিল না সারদা কি বলিয়াছে, কেন বলিয়াছে এবং কেমন করিয়া অপমান করিয়াছে। কৃতঘ্নতা তাহার কোন্খানে। প্রতিহিংসার আগুন এক নিমেষে যেন তাহাকে পাগল করিয়া দিল।
চুল্লীর উপর কুকার চড়ানো রহিল, গায়ের চাদরটা আলনা হইতে টানিয়া লইয়া সে ঘরে তালা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
এ বাড়িতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন পাশাপাশি ঠাঁই করিয়া দিয়া তারক ও বিমলবাবুকে সারদা খাইতে দিয়াছে। অনতিদূরে বসিয়া সবিতা এবং একধারে দাঁড়াইয়া সারদা। তাহার প্রতি চোখ পড়িল সকলের আগে সবিতার, তিনি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, রাজু যে, ব্যাপার কি? তাঁহার মুখ সংশয়ে পাংশু হইয়া গেল।
এইমাত্র সে গিয়াছে, এখনি ফিরিয়া আসার হেতু নাই, অকারণে আসা-যাওয়া তাহার প্রকৃতিও নয়—ভয় হইল স্বামী ও মেয়ের জন্য, হয়ত ইতিমধ্যে কি-একটা খবর আসিয়াছে। এবং তাহাই জানাইতে সে আসিয়াছে। বলিলেন, বাড়িতে সবাই ভালো আছে রাজু? রেণু, তার বাবা?
আমি কি করে জানবো নতুন-মা?
সবিতা ধীরে ধীরে বলিলেন, একা তুমিই ত তাঁদের খবর রাখো বাবা।
আগে রাখতাম যখন তাঁরা এখানে ছিলেন। নানা কাজে এখন আর বড় সময় পাইনে।
সকলেই মৌন হইয়া রহিলেন, এ কথায় অভিযোগ করিবার কিছু নাই, কিন্তু আঘাত যেখানে লাগিবার সেখানে লাগিল।
শ্রীকান্ত’র পরিত্যক্ত অংশ
‘আরে যাঃ—এই ত বটে! মনে মনে প্রায় হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলাম, বুঝি বা ইহজন্মে হাতের লেখা আর ছাপার অক্ষরে দেখা ঘটিল না!
না, তা কেন? এই যে বেশ পথের সন্ধান মিলিয়াছে। আমি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিখিব। এ বুদ্ধি এতদিন আমার ছিল কোথায়? দেখি, সবাই লেখে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত—মেয়ে পুরুষ ইহার আর অন্ত নাই, সমাপ্তি নাই। যে-কোন একখানা মাসিকপত্র খুলিলেই চোখে পড়ে—আছে রে, আছে আছে। ঐ যে! কে গিয়াছে কাশী, কে গিয়াছে খুলনা, কে গিয়াছে সিমলা-পাহাড়—অমনি ভ্রমণ-কাহিনী। যে পাহাড়ে পর্বতে উঠিয়াছে, তাহার ত কথা নাই। আর যে জল-জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাকে ঠেকাইয়া রাখা ত একেবারে অসাধ্য!
কিন্তু এ খেয়াল আমার হইল কেন? সে কৈফিয়ত ত আগেই দিয়াছি—তা ছাড়া আরও একটা কারণ ঘটিয়াছিল।
সেদিন সন্ধ্যার পর ভুল করিয়া বার-দুই আফিং খাইয়া ফেলার দরুন রাত্রে ঠিক সেই অমৃত-মধুর নিদ্রাটুকু আসিতেছিল না। যদিচ বহুদিন হইতেই এই বস্তুটা সেবন করিতেছি, কিন্তু এমনি হতভাগ্য আমি যে, কিছুতে আফিংখোর হইয়া আর উঠিতে পারিলাম না। বলিতেও লজ্জায় ঘাড় হেঁট হইয়া যায় যে, সুদীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সামান্যমাত্র ভরিখানেকের একটু বেশি পেটে গেলেও কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করি। আজও বিছানায় পড়িয়া এ-পাশ ও-পাশ করিতেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়িল একখানা বাঙলা মাসিকপত্র চোখের সামনে মেলিয়া ধরি না কেন? যে-কোন প্রবন্ধ—ঘুমের এমন মহৌষধ ত আর নাই! তাই করিলাম। কখন ঔষধ ধরিল মনে নাই—কারণ, মনে থাকিবার জো নাই! আফিংখোরের নিদ্রা। ইহা যে অব্যক্ত, অতুলনীয়, অনির্বচনীয় ব্যাপার! ইনি যে কখন কেমন করিয়া ভক্ত-চক্ষু-পল্লবে আবির্ভূতা হন এবং কখন কি করিয়া অন্তর্হিতা হন, সে তত্ত্ব কে কবে পাইয়াছে?
আমার যিনি গুরু, যাঁর পদরেণুর যোগ্যতাও আমার নাই—তিনি ত আর আমাদের মত ফাঁকি নন; তাঁর শ্রীমুখে শুনিয়াছি, বেদ ইঁহাকে অজ্ঞেয় পরম বস্তু বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। পাতঞ্জলের নিগূঢ়-মর্মের সন্ধান যাঁহারা পাইয়াছেন, তাঁহারা বিদিত আছেন যে, এই চতুষ্পাদ যোগশাস্ত্রের আগাগোড়ায় ইঁহার বাহক বলিয়া আমাদিগকে মহাযোগী আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। বস্তুতঃ, আমরা জীবন্মুক্ত! কারণ, সেই পরমানন্দের আস্বাদ উপভোগ করিয়া আমরা চিরদিনের মত ধন্য হইয়া গিয়াছি। অহোরাত্র ইহাতে লীন থাকিয়া, আমরা বিধাতা-পুরুষের ন্যায় জাগিয়া ঘুমাই এবং ঘুমাইয়া জাগি। কাজকর্মের নশ্বরতা সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা নড়াচড়াকে অত্যন্ত ঘৃণা করি। আমরা শর্করা-দুগ্ধ-ঘৃতাদি সাত্ত্বিক ভোজ্য ভালবাসি এবং চেঁচামেচি, গোলমাল, হাঙ্গামা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করিয়া চলি; এবং সেই পরম পুরুষের পদে সমস্ত চিত্ত মগ্ন করিয়া দিয়া যোগনেত্র ও স্তব্ধ হইয়া যখন আমরা মাথা ঝুঁকাইয়া ঝুঁকাইয়া তাঁহাকেই বার বার প্রণাম করিতে থাকি, বিশ্বাসবিহীন মূঢ় লোকেরা আমাদের সেই ভক্তি-নম্র নমস্কারকে ‘ঝিমানো’ বলিয়া অশ্রদ্ধা ও উপহাস করিয়া শুধু নিজেদের নিদারুণ অজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং পরলোকে কৈলাসে যাইতে পারে না।
এই হতভাগ্যদিগকে আমরা অতিশয় কৃপার চক্ষে দেখি, এবং যে ব্যক্তি আফিং ভোজন করে না, তাহার বাঁচিয়া থাকাটাকে নিছক বিড়ম্বনা বলিয়া মনে করি। যাক ইহাদের কথা। অকস্মাৎ সজাগ হইয়া দেখিলাম, হাতের ‘ভারতবর্ষ’ বুকের উপর আড় হইয়া পড়িয়া আছে, এবং বুকের ভিতরে তাহারই উত্তর হইতে দক্ষিণ এবং পূর্ব হইতে পশ্চিম, সমগ্র ভূখণ্ডটাই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। না হইবেই বা কেন? হেন স্থান ত এই সীমাটুকুর মধ্যে নাই, যেখানে বাল্য ও যৌবনে এই চরণ-জোড়াটি মাড়াইয়া বেড়ায় নাই।
সেটা ছেলেবেলার কথা; অর্থাৎ যখন এমন সুসিদ্ধ, সুপক্ক হইয়া উঠিতে পারি নাই—শুধু চেষ্টা করিতেছি মাত্র। সেই তরুণ-দিনে একজামিন ফেল করার দরুন একবার, এবং লুকাইয়া গাঁজা খাওয়ার তুচ্ছ অপরাধে কানমলা খাইয়া আর একবার, এই মায়ামোহময় অনিত্য সংসার ত্যাগ করিয়া বাবাজী হইয়া গিয়াছিলাম। তারপরে পাহাড় জঙ্গল—সে অনেক কথা—কিন্তু, সে-সব এখন থাক। আবার বাহিরেও অনেকদূর পর্যন্ত গতিবিধি ছিল। অভ্যাসের দোষে আজ সমুদ্রটাকেও ডোবার মত দেখি। কিন্তু, এ-সব কথাতেও এখন কাজ নাই। ছেলেবেলার এই যে ছোট্ট একটু ভ্রমণ-কাহিনী বলিতে বসিয়াছি, ইহা ছাপা হয় ত, সে-সকল ইতিহাস পরেও একদিন হইতে পারিবে।
ছেলেবেলা হইতে ‘ভবঘুরে’ হইয়াই ত বুড়া হইলাম। আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের মুখেই শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ ‘ছি-ছি’ র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়াছিল, বহু কালান্তরে বসিয়া প্রয়োজনবোধে আজ সেই – সব স্মৃত ও বিস্মৃত কাহিনীর মালা গাঁথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে, এই ‘ছি-ছি’টা যত বড় করিয়া সবাই দেখিয়াছে, হয়ত ঠিক তত বড়ই ছিল না। মনে হইতেছে, হয়ত ভগবান যাহাকে তাঁহার বিচিত্র সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেন, তাহাকে ভাল ছেলে হইয়া একজামিন পাস করিবার সুবিধাও দেন না; গাড়ি-পালকি চড়িয়া বহু লোক-লশকর সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিয়া তাহাকে ‘কাহিনী’ নাম দিয়া ছাপাইবার অভিরুচিও দেন না। বুদ্ধি হয়ত ভগবান তাহাদের কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না। তাই প্রবৃত্তি তাহাদের এমনি অসঙ্গত খাপছাড়া এবং দেখিবার বস্তু ও তৃষ্ণাটা স্বভাবতঃই এতই বেয়াড়া হইয়া উঠে যে, তাহার বর্ণনা করিতে গেলে সুধী ব্যক্তিরা বোধ করি হাসিয়াই খুন হইবেন। তারপরে সেই মন্দ ছেলেটি যে কেমন করিয়া অনাদরে অবহেলায় মন্দের আকর্ষণে মন্দ হইয়া, ধাক্কা খাইয়া, অজ্ঞাতসারে অবশেষে একদিন অপযশের ঝুলি কাঁধে ফেলিয়া কোথায় সরিয়া পড়ে—সুদীর্ঘদিন আর তাহার কোন উদ্দেশই পাওয়া যায় না।
কিন্তু এ কি করিতেছি! কাঁদুনি গাহিতে বসিয়া গেলাম কিরূপে? ‘ভ্রমণ-কাহিনী’ যদি বা কেহ শোনে—এ-সকল শুনিবেই বা কে, আর ইহার সমাপ্তি হইবেই বা কোথায়?
অতএব এ-সকলও থাক। যাহা বলিতে বসিয়াছি, তাহাই বলি। কিন্তু বলিলেই ত বলা হয় না, ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা আর। যাহার পা-দুটো আছে, সে-ই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত-দুটো থাকিলেই ত আর লেখা যায় না। সে যে ভারী শক্ত। তাছাড়া মস্ত মুশকিল হইয়াছে আমার এই যে, ভগবান আমার মধ্যে কল্পনা-কবিত্বের বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পোড়া চোখ দিয়া আমি যা কিছু দেখি, ঠিক তাহাই দেখি। গাছকে ঠিক গাছই দেখি—পাহাড়-পর্বতকে পাহাড়-পর্বতই দেখি। জলের দিকে চাহিয়া, জলকে জল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। আকাশে মেঘের পানে চোখ তুলিয়া রাখিয়া ঘাড়ে ব্যথা করিয়া ফেলিয়াছি, কিন্তু যে মেঘ সেই মেঘ। কাহারো নিবিড় এলোকেশের রাশি চুলোয় যাক—একগাছি চুলের সন্ধানও কোনদিন তাহার মধ্যে খুঁজিয়া পাই নাই। চাঁদের পানে চাহিয়া চোখ ঠিকরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু কাহারো মুখটুকু ত কখনো নজরে পড়ে নাই!
এমন করিয়া ভগবান যখন বিড়ম্বিত করিয়াছেন, তখন আমি আর কি উপায় করিব? তাই পূর্বেই বলিয়াছি—নিরুপায় হইয়া হালটা ত প্রায় ছাড়িয়াই দিয়াছিলাম! হঠাৎ সেদিন বড় একটা ফন্দি মাথায় ঢুকিয়াছে! আচ্ছা, এক কাজ করি না কেন? বড় বড় লোকের ভ্রমণ-কাহিনীগুলো পড়িয়া লই না কেন? অতএব আর দ্বিধা নয়—ইহাই স্থির। তখন হইতে ইহাই উলটিয়া-পালটিয়া অধ্যয়ন করিয়া করিয়া, আজ আমার এমনি সাহস বাড়িয়া গিয়াছে যে সত্য সত্যই লিখিতে বসিয়া গিয়াছি। শুধু তাই নয়, আমার নিশ্চয় মনে হইতেছে, কাহিনী লিখিবার গুপ্ত ‘এলেম’টায় লায়েক হইয়া পড়িয়াছি!
কিন্তু এ কি নিদারুণ ব্যবধান! বড়লোক এবং দুঃখীকে ভগবান কি আলাদা করিয়াই গড়িয়াছেন! উভয়ের বেড়াইয়া-বেড়ানোর মধ্যেও কি আকাশ-পাতাল পার্থক্য!
বড়লোক ক্রমাগত বলিতেছেন—‘আমি! আমি! আমি! ওগো তোমরা দেশের হতভাগা পাঁচজন চোখ চাহিয়া ইহার প্রতি অক্ষরটি পড়, হাঁ করিয়া আমার প্রতি শব্দটি শোন—আমি বিদেশে গিয়াছিলাম।’
কিন্তু সে যেন হইল। তাঁহাদের কাজ না হয় তাঁহারা ভবিষ্যতে ভাল করিয়াই করিলেন।
কিন্তু আমার দুঃখ তাহাতে ত ঘুচিবে না। বড়লোক ত নই। আমার অহংটা কোনদিনই ত তেমন করিয়া হাত-পা ঝাড়া দিয়া বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে নাই। আমি হাজার চেষ্টা করিয়াও অতটা সাহস করিয়া ‘আমি’ ‘আমি’ করিতে পারিব কিনা, সে ভরসা ত কোনমতেই পাঠকবর্গকে দিতে পারিতেছি না।
আবার ইহাই কি সব? ইহার চেয়েও বড় বাধা এই দেখি যে, বিনা রঙে, অর্থাৎ শুধু ‘লাইট’ এবং ‘শেড’ দিয়া আঁকিতে ত শিখি নাই। নিছক কালি দিয়া ছবি আঁকিতে জানা, এই সব ‘ভ্রমণ-কাহিনী’ বিবৃত করার পক্ষে যে একেবারে অত্যাবশ্যক।
অতএব পাঠকবর্গের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, শ্রীকান্তের কাছে আপনারা সে প্রত্যাশা রাখিবেন না। এ ত ভ্রমণ নয়, এ এক দুর্ভাগার ঘুরে বেড়ানো মাত্র! সঙ্গে থাকার ক্লেশ আছে। সঙ্গে গেলে, গতি ও স্থিতির জন্য ‘ফার্স্ট ক্লাস সেলুন’ ও ‘শ্লিপিং কার’ দিতে পারিব না, আহারের জন্য ডিনার যোগাড় করিতেও পারিব না। তবে চাহিলে এক-আধবিন্দু সর্বশ্রান্তিহরা কালাচাঁদ দিতে পারিব বটে। এ ভরসা দিতেছি। তাও কিন্তু একটু-আধটু এক-আধবার।
ভাল কথা। কি করিয়া ‘ভবঘুরে’ হইয়া পড়িলাম, সে কথা বলিতে গেলে, প্রভাত-জীবনে এ নেশায় কে মাতাইয়া দিয়াছিল, তাহার একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তাহার নাম ইন্দ্রনাথ।
৫৭তম জন্মদিনে প্রতিভাষণ
৩১এ ভাদ্র—আমার জন্মদিনের আশীর্বাদ-গ্রহণের আহ্বান আমার স্বদেশের আপনজনদের কাছ থেকে প্রতি বৎসরই আসে, আমি শ্রদ্ধানত শিরে এসে দাঁড়াই; অঞ্জলি ভরে আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ি যাই,—সে আমার সারা-বছরের পাথেয়। আবার আসে ৩১এ
ভাদ্র ফিরে, আবার আসে আমার ডাক, আবার এসে আপনাদের কাছে দাঁড়াই। এমনি করে এ-জীবনের অপরাহ্ন সায়াহ্ন এগিয়ে এলো।
এই ৩১ এ ভাদ্র বছরে বছরে ফিরে আসবে, কিন্তু একদিন আমি আর আসবো না। সেদিন এ কথা কারো বা ব্যথার সঙ্গে মনে পড়বে, কারো বা নানা কাজের ভিড়ে স্মরণ হবে না। এই-ই হয়, এমনি করেই জগৎ চলে।
কেবল প্রার্থনা করি, সেদিনও যেন এমনিধারা স্নেহের আয়োজন থেকে যায়; আজকের দিনে যাঁরা তরুণ, বাণীর মন্দিরে যাঁরা নবীন সেবক, তাঁরা যেন এমনি সভাতলে দাঁড়িয়ে আপনাদের দক্ষিণহস্তের এমনি অকুণ্ঠিত দানে হৃদয় পূর্ণ করে নিয়ে গৃহে যেতে পারেন।
আমার অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য-সেবার পুরস্কার দেশের কাছে আমি অনেক দিক দিয়ে অনেক পেলাম—আমার প্রাপ্যেরও অনেক বেশী ।
আজকের দিনে আমার সবচেয়ে মনে পড়ে এর কতটুকুতে আমার আপন দাবী, আর কত বড় এর ঋণ। ঋণ কি শুধু আমার পূর্ববর্তী পূজনীয় সাহিত্যাচার্যগণের কাছেই? সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছু, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষে যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই,—এদের কাছেও কি ঋণ আমার কম? এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে। তাদের প্রতি কত দেখেচি অবিচার, কত দেখেচি কুবিচার, কত দেখেচি নির্বিচারের দুঃসহ সুবিচার। তাই আমার কারবার শুধু এদেরই নিয়ে। সংসারে সৌন্দর্যে সম্পদে ভরা বসন্ত আসে জানি; আনে সঙ্গে তার কোকিলের গান, আনে প্রস্ফুটিত মল্লিকা-মালতী-জাতি-যূথি, আনে গন্ধ-ব্যাকুল দক্ষিণা পবন; কিন্তু যে আবেষ্টনে দৃষ্টি আমার আবদ্ধ রয়ে গেল, তার ভিতরে ওরা দেখা দিলে না। ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ আমার ঘটলো না। সে দারিদ্র্য আমার লেখার মধ্যে চাইলেই চোখে পড়ে। কিন্তু অন্তরে যাকে পাইনি, শ্রুতিমধুর শব্দরাশির অর্থহীন মালা গেঁথে তাকেই পেয়েচি বলে প্রকাশ করবার ধৃষ্টতাও আমি করিনি। এমনি আরও অনেক কিছুই—এ জীবনে যাঁদের তত্ত্ব খুঁজে মেলেনি, স্পর্ধিত অবিনয়ে মর্যাদা তাঁদের ক্ষুণ্ণ করার অপরাধও আমার নেই। তাই সাহিত্য-সাধনার বিষয়বস্তু ও বক্তব্য আমার বিস্তৃত ও ব্যাপক নয়, তারা সংকীর্ণ স্বল্প-পরিসরবদ্ধ। তবুও এইটুকুও দাবী করি, অসত্যে অনুরঞ্জিত করে তাদের আজও আমি সত্যভ্রষ্ট করিনি।
আমার বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। প্রতি সাহিত্য-সাধকের অন্তরেই পাশাপাশি বাস করে দু’জনে; তার একজন হলো লেখক, সে করে সৃষ্টি, আর অন্যজন হলো তার সমালোচক, সে করে বিচার। অল্পবয়সে লেখক থাকে প্রবল পক্ষ,—অপরকে সে মানতে চায় না। একজন পদে পদে যতই হাত চেপে ধরতে চায়, কানে কানে বলতে থাকে,—পাগলের মতো লিখে যাচ্ছো কি, থামো একটুখানি,—প্রবল পক্ষ ততই সবলে হাত-দুটো তার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চালিয়ে যায় তার নিরঙ্কুশ রচনা। বলে, আজ ত আমার থামবার দিন নয়,—আজ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের গতিবেগে ছুটে চলার দিন। সেদিন খাতার পাতায় পুঁজি হয় বেশী, স্পর্ধা হয়ে ওঠে অভ্রভেদী। সেদিন ভিত থাকে কাঁচা, কল্পনা হয় অসংযত উদ্দাম; মোটা গলায় চেঁচিয়ে বলাটাকেই সেদিন যুক্তি বলে ভ্রম হয়। সেদিন বইয়ে-পড়া ভালো-লাগা চরিত্রের পরিস্ফীত বিকৃতিকেই সদম্ভে প্রকাশ করাকে মনে হয় যেন নিজেরই অনবদ্য মৌলিক সৃষ্টি।
হয়ত, সাহিত্য-সাধনায় এইটিই হচ্ছে স্বাভাবিক বিধি; কিন্তু উত্তরকালে এর জন্যই যে লজ্জা রাখার ঠাঁই মেলে না, এ-ও বোধ করি এর এমনিই অপরিহার্য অঙ্গ। আমার প্রথম যৌবনের কত রচনাকেই না এই পর্যায়ে ফেলা যায়।
কিন্তু ভাগ্য ভাল, ভুল আমার আপনার কাছেই ধরা পড়ে। আমি সভয়ে নীরব হয়ে যাই। তারপরে দীর্ঘদিন নিঃশব্দে কাটে। কেমন করে কাটে, সে বিবরণ অবান্তর। কিন্তু বাণীর মন্দির-দ্বারে আবার যখন ফিরিয়ে এনে আত্মীয়-বন্ধুরা দাঁড় করিয়ে দিলেন, তখন যৌবন গেছে শেষ হয়ে, ঝড় এসেচে থেমে, তখন জানতে বাকী নেই সংসারে সংঘটিত ঘটনাই কেবল সাহিত্যে সত্য নয়, এবং সত্য বলেই তা সাহিত্যের উপাদানও নয়। ওরা শুধু ভিত্তি এবং ভিত্তি বলেই থাকে মাটির নীচে সঙ্গোপনে—থাকে অন্তরালে।
তখন আমার আপন বিচারক বসেচে তার সুনির্দিষ্ট আসনে; আমার যে-আমি লেখক, সে নিয়েচে তার শাসন মেনে। এদের বিবাদের হয়েচে অবসান।
এমনি দিনে একজন মনীষীকে সকৃতজ্ঞ-চিত্তে স্মরণ করি; তিনি স্বর্গীয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন আমাদের ছেলেবেলায় ইস্কুলের শিক্ষক। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল এই নগরেরই এক পথের ধারে। ডেকে বললেন, শরৎ, তোমার লেখা আমি পড়িনি, কিন্তু লোকে বলে সেগুলো ভালই হচ্ছে। একদিন তোমাদের আমি পড়িয়েচি। আমার আদেশ রইল—যা সত্যই জানো না, তা কখনো লিখো না। যাকে উপলব্ধি করোনি, সত্যানুভূতিতে যাকে আপন করে পাওনি, তাকে ঘটা করে ভাষার আড়ম্বরে ঢেকে পাঠক ঠকিয়ে বড় হতে চেয়ো না। কেন না এ ফাঁকি কেউ-না-কেউ একদিন ধরবেই, তখন লজ্জার অবধি থাকবে না। আপন সীমানা লঙ্ঘন করাই আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করা। এ ভুল যে করে না, তার আর যে দুর্গতিই হোক, তাকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় না। অর্থাৎ, বোধ হয় তিনি এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন যে, পেটের দায়ে যদি-বা কখনও ধার করো, ধার করে কখনও বাবুয়ানি করো না।
সেদিন তাঁকে জানিয়েছিলাম, তাই হবে।
আমার সাহিত্য-সাধনা তাই চিরদিন স্বল্পপরিধিবিশিষ্ট। হয়ত, এ আমার ত্রুটি, হয়ত এ-ই আমার সম্পদ, আপনাদের স্নেহ ও প্রীতি পাবার সত্য অধিকার। হয়ত আপনাদের মনের কোণে এই কথাটা আছে—এর শক্তি কম, তা হোক, কিন্তু এ কখনও অনেক জানার ভান করে আমাদের অকারণ প্রতারণা করেনি।
এমনি একটা জন্মদিন উপলক্ষে বলেছিলাম চিরজীবী হবার আশা করিনে, কারণ সংসারে অনেক-কিছুর মতো মানব-মনেরও পরিবর্তন আছে; সুতরাং, আজ যা বড়, আর একদিন তা-ই যদি তুচ্ছ হয়ে যায় তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেদিন আমার সাহিত্যসাধনার বৃহত্তর অংশও যদি অনাগতর অবহেলায় ডুবে যায়, আমি ক্ষোভ করব না। শুধু মনে এই আশা রেখে যাবো, অনেক-কিছু বাদ দিয়েও যদি সত্য কোথাও থাকে সেটুকু আমার থাকবে। সে আমার ক্ষয় পাবে না। ধনীর অজস্র ঐশ্বর্য নাই-বা হলো, বাগ্দেবীর অর্ঘ্যসম্ভারে ঐ স্বল্প সঞ্চয়টুকু রেখে যাবার জন্যই আমার আজীবন সাধনা। দিনের শেষে এই আনন্দ মনে নিয়ে খুশী হয়ে বিদায় নেবো, ভেবে যাবো আমি ধন্য, জীবন আমার বৃথায় যায়নি।
উপসংহারে একটা প্রচলিত রীতি হচ্ছে, শুভানুধ্যায়ী প্রীতিভাজন বন্ধুজনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানো। কিন্তু এ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। তাই শুধু জানাই আপনাদের কাছে সত্যই বড় কৃতজ্ঞ।