এক সময় পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুরও উঠে গেলেন। লীলাবতী ঈশাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। সাদা কাপড়ে ইশার শরীরও ঢেকে দেওয়া হল। আমি ঈশার শিয়রেই বসে আছি। কখন যে দেখি পাশে কেউ নেই। ঝড়ে সাদা কাপড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কে বলবে, ঈশার সব শেষ, সে তো ঘুমিয়ে আছে, ফ্রক গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঈশার সেই মধুমালা কোথায় গেল? ডাকলে সেই প্রাণের সাড়া পাওয়া যাবে না। কিংবা সাপটে ধরলে। কেউ তো নেই। সব আশ্রমের বিশাল প্রাঙ্গণে, নদীর পাড়ে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত।
প্রাণের সাড়া যদি পাই। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম নির্জন বারান্দায়। উষ্ণতা সষ্টি হোক, সে ভিতরে জেগে উঠক। তারপর আরও নানা চেষ্টা, না, সাড়া নেই। আমি তার মুখের উপর ঝুঁকে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার দু-ফোঁটা অশ্রুবিন্দু তার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিতেই সে যেন জেগে গেল। সে চোখ মেলে তাকাল। সে এক আশ্চর্য বিস্ময় ভরা চোখে আমাকে দেখছে।
উচ্ছেদ
এ যেন গত জন্মের কথা। একটা কাজের জন্য তখন হন্যে হয়ে ঘুরছি। তখন মুকুল আমার আশাভরসা। যখনই বিপন্ন বোধ করেছি তার কাছে ছুটেছি। সেও চেষ্টা করছে। আমরা তখন এক কলেজে পড়ি, একসঙ্গে ঘুরি, দু-জনেরই দুটো ভাঙা সাইকেল সম্বল। মুকুল থাকে শহরে, আমি কলোনিতে। জঙ্গল সাফ করে মাটির ঘরবাড়ি, ভাইবোন মেলা, তখন আমরা ছিন্নমূল। মুকুলের দাদা পি ডব্লিউ ডি-র কোয়ার্টারে থাকেন, আফিসের ডেসপাঁচ ক্লার্ক তিনি। যদি কোনো কাজের সুযোগ করে দেন, যে কোনো কাজ, মুকুলের জামাইবাবু স্কুল ইনসপেক্টর, মুকুলের দিদিকে ছোড়দি ডাকি—সকলেরই এককথা আরে হয়ে যাবে, আমরা তো আছি। জামাইবাবু একদিন ডেকে বললেন, সারকুলার এলেই তুমি অ্যাপ্লাই করবে।
কাজের জন্য চেনাজানা যত মানুষজন আছে, তাদের কাছে যাই-মুকুল আমার সঙ্গে থাকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। বাড়িতে অর্ধাহার অনাহার, কী যে করি, নিরুপায় বাবার একটাই কথা—বিলু, কেউ কিছু বলল!
কিছু বলল মানে, আমার চাকরির কথা জানতে চান। বাবার দিকে তখন তাকানো যায় না, ক্লিষ্ট এবং উদাস মুখখানি আমি তার এখনও ভুলতে পারি না।
কলেজে যেতে হয় যাই, বেতন দিতে পারি না বলে যে কোনো সময় নাম কাটা যাবে, বাড়িতে থাকলে পিতাপুত্রের একটাই কাজ, জঙ্গল সাফ করা, এবং গাছপালা লাগানো একদিন সকালে মুকুলই খবর দিল, হাতিনগর প্রাইমারি স্কুলে স্পেশাল ক্যাডার শিক্ষকের পদে আমার কাজ হয়েছে—আশি টাকা মাইনে—আশি টাকাই বাবার হাতে তুলে দিই এবং এ-ভাবেই জীবন শুরু, সে দিন আনন্দে চেনাজানা মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দিতে বেশ রাত হয়ে গেছিল ফিরতে। দু-বেলা আহারের বন্দোবস্ত হয়ে গেলে মানুষের আর কী লাগে! মুকুল না থাকলে বোধহয় আমার জীবনসংগ্রামই শুরু হত না। ভাঙা সাইকেলটার কথাও মনে হয়, বিকেল হলেই সাইকেলে পাকা সড়ক ধরে কত দূরে যে উধাও হয়ে যেতাম। তখন শুধু স্বপ্ন, স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছি—আরও বন্ধুবান্ধব জুটে গেল, আমরা সবাই মিলে একটা কাগজও বের করলাম, রায়বাহাদুরের নাতনি মৃন্ময়ীও জুটে গেল।
আড্ডায় যা হয়, কথা শেষ হতে চায় না। রাত বাড়ে। আকাশে নক্ষত্র ফুটে থাকে। গাছপালা অন্ধকারে কেমন নিথর। সোজা পাকা সড়ক চলে গেছে লালাবাগের দিকে। রেলগুমটি পার হলে দু-দিকে দুটো সড়ক। কারবালা দিয়ে গেলে বাড়ির রাস্তা সংক্ষিপ্ত হয়। খুবই বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে কবরখানা পার হয়ে রাস্তাটা আমাদের বাড়ির দিকে চলে গেছে। দিনের আলোয় সাহস পেলেও, রাতে ওই রাস্তা ধরে একা বাড়ি ফিরতে ভয় হয়। বাদশাহি সড়ক ধরেও যাওয়া যায়, তবে অসুবিধা, পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, ঢুকলেই সিপাই হল্ট বলে চিৎকার করবেই। তখন বলতে হয়, আমি পিলুর দাদা। ব্যস, ওই যে কথা, পিলুর দাদা, এতেই হয়ে যায়। পিলুর খ্যাতি সর্বত্র। পিলু-ধিলুরা তখন বড়ো হয়ে উঠছে।
তারপরই ট্রেনিং ক্যাম্পের আর্মারি। আমারি পার হলে মাঠ। মাঠে কাঁটাতারের বেড়া। মাঠে নামলেই আমাদের পাড়াটা চোখে পড়ে। বেড়ার গেট পার হলে দেখতে পাই লম্ফ জ্বলছে, ঘরে ঘরে। অন্ধকার রাতে এগোনো যে কত কঠিন— গাছপালার ছায়ায় নিজেকে পর্যন্ত দেখা যায় না—তবু পথটা এত চেনা যে যেন জন্মজন্মান্তরের রাস্তা, কখনোই ভুল হতে পারে না— কারণ বাড়ি ঢুকলেই যে বাবা মা ভাই বোনেরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, বুঝি। কুকুর বিড়াল কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ি এজন্য অনবরত ক্রিং ক্রিং বেল বাজাই– যারা দূরে কাছে আছ, সরে যাও। বাবা-মা এমনকী পিলু দূর থেকেই টের পার তার কলেজে পড়া দাদাটি ফিরছে। আমাদের ফেলে আসা দেশ, কিংবা জন্মভূমির জন্য কারও আর তেমন কোনো মায়া মমতা নেই। যেন এ-দেশে চলে এসে আত্মরক্ষা করা গেছে। মান মর্যাদা আর নষ্ট হবার ভয় নেই। মনেই হয় না আমরা ছিন্নমূল। বরং এই যেন আমাদের দ্বিতীয় জন্মভূমি। সুযোগ এবং সময় পেলেই, ছোট্ট জন্মভূমিতে বাবা, আমি শুধু গাছ লাগাই, আম জাম জামরুল কাঁঠাল লিচু এবং একটি বাতাবি লেবুর গাছও লাগানো হয়ে গেছে। গাছের সঙ্গে মানুষের যে কত নাড়ির টান বাবাকে দেখলে বুঝি। বাড়ির গাছপালার ভিতর দিয়ে সাইকেলে চেপে উধাও হওয়ার আনন্দও আলাদা। আর কী করে যে এই বাড়িঘরের সঙ্গে বাবার মতো আমিও এক গভীর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। তারপর যা হয় মুখ বাড়ে, মানুষ বাড়ে, দায়িত্ব বাড়ে—বাবার সংসার, আমার নিজের সংসার, কত দায়িত্ব, বোনেদের বিয়ে, ভাইয়েরা কেউ পড়াশোনায় মন দিতে পারল না, পিলু মিলিটারিতে চলে গেল, বিয়ে করে যাবার সংসার থেকে আলাদাও হয়ে গেল, ধিলুর মোড়ের মাথায় দোকান। দোকান জমে উঠতেই সেও ভিন্ন হয়ে গেল। ধিলুর বউয়ের অভিযোগ আমি যে বাবার মাসোহারা পাঠাই, তাতে সব খরচ নির্বাহ হয় না।