- বইয়ের নামঃ টুকুনের অসুখ
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
টুকুনের অসুখ
এক
খরা, প্রচণ্ড খরা। কবে কোন বছরে একবার বৃষ্টি হয়েছিল এ অঞ্চলে, কবে কোন বছরে সবুজ শ্যামল মাঠ ছিল এ অঞ্চলে—মানুষেরা তা যেন ভুলে গেছে। গ্রাম মাঠ খা খা করছে। নদী—নালা সব হেজে মজে গেছে। শুকনো বাতাস আর মাঠে মাঠে শুধু ধুলো উড়ছে।
ফাল্গুন মাস, বৃষ্টি হচ্ছে না। মনে হয় কোনোদিন আর বৃষ্টি হবে না। মাঠে শুধু ধুলো উড়ছিল। গোরু—বাছুর নিয়ে দেশ ছেড়ে মানুষেরা সব চলে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের মতো। ধান—চাল নেই, মাঠে শস্য নেই। দু’সাল হল দুর্ভিক্ষের মতো চলছে।
গ্রামের পর গ্রাম মাঠের পর মাঠ সব জলবিহীন। নদী যেখানে গভীর ছিল সেখানে সামান্য মাটি খুঁড়ে গত সালেও জল পাওয়া যেত—এবার তাও নেই।
যা কিছু অবশিষ্ট মানুষ গ্রামে রয়েছে, নারী যুবক—যুবতী, ছেলে বুড়ো সকলে মাটি খুঁড়ছিল নদীর ভিতর। ভিতর থেকে যদি সামান্য পরিমাণ জল পাওয়া যায়। সামান্য জল পেলে ওরা সংরক্ষণ করে রাখবে। অন্তত আগামী বর্ষা পর্যন্ত ওরা সেই জল নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি সকলের আগে আগে কাজ করছিল। তার হাতে যেন গুপ্তধন আবিষ্কারের চাবিকাঠি। সে দাগ দিয়ে যাচ্ছিল লাঠি দিয়ে। বালির ওপর একটা করে গুপ্তচিহ্ন রেখে যাচ্ছে। আর প্রতিটি গুপ্তচিহ্ন প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাত দূরে, এঁকেবেঁকে গেছে অনেকটা সাপের মতো—কারণ কেউ জানে না নদী কোথায় অন্তঃসলিলা। এ নদী যদি মরে যায়, মানুষরা তবে সব মরে যাবে। ওদের হাতে সামান্য শস্য—দু’সাল আগের সামান্য শস্য—সঞ্চিত শস্য এখন প্রায় নিঃশেষ, তবু এই জল পেলে তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচবে, জল পেলে পাতা ঘাস এবং অন্য যা কিছু আছে এ অঞ্চলে, পাহাড়ে, ছোট পাহাড় অঞ্চলে এখনও যেসব লতাগুল্ম রয়েছে, তার শিকড়—বাকড় আছে, বনআলু রয়েছে, জল পেলে যে—কোনোভাবে সিদ্ধ করা যাবে, খাওয়া যাবে, খেলে পরে এ বর্ষাকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে।
এই মাটি, বাপ—পিতামহের মাটি। সোনার ফসল হত মাটিতে। সব ফসল হায় কোথায় এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটির হাতে লাঠি। সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারে ছোট ছোট পাহাড়। ঝরনার জল আর নামছে না। গাছে গাছে কোনো পাখির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই যেন মন্বন্তরের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে।
বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছেন, মাটিতে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন। একজন করে মানুষ কেউ চিহ্নের ওপর বসে পড়ছে মাটি খোঁড়ার জন্য। যেখানে জলের সন্ধান পাওয়া যাবে সেখানেই পরদিন জড়ো হবে সব অন্য মানুষেরা—সারাদিন খেটে জল বের করবে। নিজেরা জল ভরে রাখবে ঘড়াতে। জলের জন্য ওরা প্রায় মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ল।
বৃদ্ধ মানুষটিকে মোজেসের মতো মনে হচ্ছিল। লম্বা আলখাল্লার মতো জামা গায়, পায়ে নাগরি জুতা, মাথায় ফেটি বাঁধা। উঁচু লম্বা মানুষ, চুল ছোট করে ছাঁটা, শক্ত চোয়াল মানুষটার। রোদে, জলে অথবা খরার সময়ে মুখে শক্ত সব রেখা—যেন দেখলেই মনে হয় মানুষটা আজ হোক কাল হোক এ অঞ্চলে জল নিয়ে আসবে।
গেরস্থের বউরা, বিবিরা, যুবক—যুবতীরা ছোট—বড় সকলে লম্বা লাইন দিয়ে এঁকেবেঁকে জলের জন্য মাটি খুঁড়তে বসে গেছে। বৃদ্ধ যেখানে পাহাড়ের ঢালু জায়গাটা ছিল, সেখানে উঠে দাঁড়ালে, পেছনে প্রায় দু—তিন মাইল পর্যন্ত শুধু নদীর বালি চোখে পড়ে—খরার জন্য, গ্রীষ্মের জন্য বালি চিকচিক করছিল। নদীটাকে এখন মরা একটা সাপ মনে হয়। আবার মনে হয়—চিত হয়ে আছে অজগরটা। এক লম্বা অজগর—দু—তিন মাইল লম্বা, চার মাইল লম্বা, আরও কত লম্বা হবে কে জানে। বালিয়াড়ি, দিগন্তের দিকে ছুটে গেছে—যেন নদীটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কারু জানা নেই।
পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথাও সমতল মাঠ আবার পাহাড়, ছোট পাহাড়, কত রকমের লাল—নীল পাথর, পাহাড়ে কত রকমের গাছ—গাছালি, গুল্মলতা আর কত রকমের পাখি ছিল। সব পাখিরা উড়ে চলে গেছে। গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। গাছগুলো মৃতের মতো পাহাড়ময় দাঁড়িয়ে—সমতলভূমিতে সব কুঁড়েঘর, খড়ের চাল। ঝোপে—জঙ্গলে শুধু শুকনো পাতার খস খস শব্দ। ঘাস আর নেই। মাটির নীচে ঘাসের শেকড় মরে যাচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।
ঠিক সামনেই বালুবেলাতে এই অঞ্চলের ছোট ছেলেটি বসে মাটি খুঁড়ছিল। বৃদ্ধ দেখল ছোট ছেলেটি সকলের শেষে মাটি খুঁড়তে বসেছে। ওর গায়ে লম্বা ঝুলের জামা। জামাটি ওর নয়, সুদিনে কী দুর্দিনে ওর বাবা হয়তো তৈরি করেছিল। পার্বণের দিনে ওর মা—বাপ একবার মেলায় গিয়েছিল এবং পরে, এই মাস দুই পরে হবে, ওলাওঠায় বাপ—মা দু’জনই গেছে। তখনও সামান্য জল ছিল পাতকুয়াতে, সামান্য জল তুলে রাখা যেত। এখন এই সামান্য বালকের হাতে একটা খুরপি। পিঠের নীচে বাঁশের এক হাত লম্বা একটা চোঙ। ভিতরে কিছু যত্ন করে রেখে দিয়েছে মনে হয়। বালিমাটি খোঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই লম্বা একটা চোঙ থেকে ম্যাজিকের মতো ছোট একটা পাখি বের করে আনছিল এবং বোধ হয় শুকনো বটফল খাওয়াচ্ছিল। সে, এই বালক কাজে ফাঁকি দিচ্ছে দেখে পাহাড়ের ঢালু থেকে হেঁকে উঠল—হেই সুবল।
দূরে দূরে এই হাঁক ভেসে যাচ্ছিল। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল।
সুবল তাড়াতাড়ি পাখিটাকে বাঁশের চোঙের ভেতর ভরে মুখটা সামান্য একটা ছোট্ট কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল, তারপর আপন মনে এবং একনাগাড়ে সে মাটি খুঁড়তে থাকল। দলের লোকেরা মাটি খুঁড়ছে। ওদের কোচড়ে শুকনো চানা ছিল। ক্ষুধার জন্য ওরা শুকনো চানা চিবিয়ে খাচ্ছিল। শুকনো চানা গালে এবং দাঁতের ফাঁকে সাদা অথবা হলুদ রঙের ফেনা তুলছে। দেখলেই বোঝা যায় ওরা জলের বিনিময়ে নিজের রক্ত চুষে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। মানুষগুলোর মুখ, যুবতীর মুখ, বউ—বিবিদের মুখ, মিঞা—মাতব্বরদের মুখ যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, বৃদ্ধের জন্য ওরা এখনও গ্রাম ছেড়ে পালায়নি, যেন এক বৃদ্ধ সকলকে আটকে রেখেছে। সকলকে বলছে—কোথাও না কোথাও নদীর অন্তঃস্তলে জল আছে, আমাদের এই জল অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।
নদী অন্তঃসলিলা। বৃদ্ধ বড় একটা অর্জুন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবল, নদী অন্তঃসলিলা। নদী কোথাও না কোথাও এইসব লোকালয়ের জন্য জল সঞ্চয় করে রেখে দিয়েছে। কী এমন পাপ ছিল, কী এমন জঘন্য অপরাধ ছিল মানুষের, যার জন্য হায়, ঈশ্বর বাধ সাধলেন। বৃদ্ধ ঈশ্বর বিশ্বাসী। ঈশ্বর মঙ্গলময়। তিনি মানুষের দুঃখ অনন্তকাল ধরে সহ্য করেন না। তিনি নিশ্চয় সরল এবং গরিব এই মানুষগুলোর জন্য নদীর বালুগর্ভে জল সঞ্চয় করে রেখেছেন।
শুধু এখন প্রচেষ্টা। সমবেত প্রচেষ্টা। আজ প্রায় পনেরো দিন ধরে এই সমবেত প্রচেষ্টা—জলের জন্য সপ্তাহে যে মোষের গাড়ি তিনটি আসে, যারা জল আনতে বিশ ক্রোশ দূরে যায়—তাদেরও ক’দিন ধরে আর দেখা নেই। লোকগুলো জলের অভাবে মরে যাবে এবার।
শহর অনেক দূরে—শহরের দিকে যে গেছে সে আর ফেরেনি। ক্রমশ এক—দুই করে গ্রামের মানুষেরা সরে পড়ছে। বৃদ্ধের দু’চোখে জ্বালা এবং যন্ত্রণায় জ্বলছিল। মানুষগুলো বলে দিয়েছে আজই ওরা শেষ চেষ্টা করবে, জল না পেলে শহরের দিকে চলে যাবে। গ্রামে আর একজন মানুষও থাকবে না। মাঠ এবং নদী ভেঙে ওরা সকলে শহরের দিকে চলে যাবে।
দুপুর পর্যন্ত জল পাওয়া গেল না। বালিয়াড়ি তেতে উঠেছে। উত্তপ্ত এই বালিয়াড়িতে মানুষগুলো বসে থাকতে পারছিল না। ওরা বালি খুঁড়ে খুঁড়ে আট—দশ—বারো হাত পর্যন্ত গর্ত করে ফেলেছে, ভিতরে ঠান্ডা ভাব, অথচ জলের কোনো চিহ্ন নেই।
পাহাড়ের ওপারে রেললাইন। দুপুরের গাড়ি চলে যাচ্ছে। পাহাড় এবং মাঠ অথবা দিগন্তের ওপারে ওই রেলের হুইসল ওদের বুকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যেন। ওরা একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল—এই ট্রেনে উঠলে অনেক দূরে এক শহর আছে, বড় শহর, বড় ইটের সব বাড়ি, আকাশ ছুঁয়ে আছে সেই সব উঁচু বাড়ি, কলকারখানা এবং নদীর ওপরে বড় জাহাজ, নদীতে কত জল, জলের জন্য বালি খুঁড়ে মরতে হয় না, সুতরাং সেই শহরে চলে যাবার হাতছানি ওদের মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল।
বৃদ্ধ মানুষটি অর্জুনগাছের নীচে বসে দূরে, বহু দূরে যাদের এখান থেকে পিঁপড়ের মতো মনে হচ্ছিল—লম্বা বালিয়াড়ি, দিগন্তে ভেসে গেছে এই নদী, সোজা, কোথাও বেঁকে নদীর বালুবেলা সূর্যের উত্তাপে আগুনের মতো ঝলসে যাচ্ছিল। মানুষগুলোকে কালো কালো কীটপতঙ্গের মতো মনে হচ্ছে। যেন একটা বড় পিঁপড়ের সারি নদীর মোহনা খোঁজার জন্য নদীর ঢালুতে নেমে যাচ্ছে। পাহাড় উঁচু বলে এবং এখানে সামান্য ছায়া রয়েছে বলে, ঝোপজঙ্গলের শেষ সুষমাটুকু নষ্ট হয়নি। বৃদ্ধ কোথায় এবং কোনদিকে গেলে বনআলু প্রচুর সংগ্রহ করা যেতে পারে—অর্থাৎ এই মানুষ যিনি আপ্রাণ তার মানুষের বেঁচে থাকার এলাদ সংগ্রহের জন্য ভেবে চলেছেন।
কবে একবার এ—অঞ্চলে মহারানির মতো এক সম্রাজ্ঞী এসেছিল—খরা অঞ্চল তিনি দেখে গেছেন। বড় বড় পরিকল্পনা হচ্ছে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই—জল এ অঞ্চলে আজ হোক কাল হোক আসবে। মানুষগুলো সম্রাজ্ঞীর কথায় প্রাণের ভিতর জীবনধারণের আকুল ইচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে পালায়নি। ওরা দিনের পর দিন জলের জন্য অপেক্ষা করছে। জল আসবে। এই গ্রীষ্মের খরা রোদ আজ হোক কাল হোক মরে যাবে। ওরা সকলে একবার আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাল, কোনও দিগন্তে যদি সামান্য মেঘের আভাস চোখে পড়ে। কোথাও কোনও মেঘের আভাস নেই। খালি আকাশ। নীল হরিদ্রাভ বর্ণ, যা শুধু মাঠের ওপর এবং ঘাসের ওপর আগুন ছড়াচ্ছে।
ঘাস নেই, শুকিয়ে কবে ধুলোবালির সঙ্গে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে অন্য কোনও নদী অথবা মাঠের ছায়ার সঙ্গে যেন বাতাসে ভেসে চলে গেছে। মানুষগুলো এখন কোনও মেষপালকের মতো আজগুবি স্বপ্ন দেখছিল। কারণ দুপুরের রোদে, কবে একবার ওরা পেটপুরে তৃষ্ণার জলপান করেছিল মনে নেই—মানুষগুলো সব ঝিমিয়ে পড়ছে। ওদের হাত অসাড় হয়ে পড়ছে। চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মাথা ঘুরছে। ওরা উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিল না। কারণ সারাদিন মাটি খুঁড়ে ওরা জলের সন্ধান পেল না। ওরা ক্লান্ত। এবং প্রায় হতচেতন। ওরা প্রায় কিছুই ভাবতে পারছিল না। ওরা বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এবং এক আজগুবি স্বপ্ন সেই মেষপালকের মতো। হাতে বড় এক শক্ত লাঠি মেষপালকের—আগুন, লাঠি তুললে আগুন। জল, লাঠি তুলতে জল। অন্নবস্ত্র, লাঠি তুললে অন্নবস্ত্র। এমন এক মানুষ কী তাদের জন্য কোথাও অপেক্ষা করছে না! যে তাদের জন্য এই মাটিতে জল নিয়ে আসবে। অন্নবস্ত্র নিয়ে আসবে।
ঠিক তখনই অর্জুনগাছের নীচ থেকে বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, তোমরা সকলে উঠে এসো।
সেই শব্দে আবার পাহাড়ের সঙ্গে সমতল ভূমিতে এবং ঢালু বালিয়াড়িতে প্রতিধ্বনি তুলে নেমে গেল। মানুষগুলো কোনও স্বপ্নলব্ধ আদেশের মতো সেই উঁচু পাহাড়ের দিকে যেতে থাকল।
সেই বালকটি তার পাখিটাকে চোঙের ভিতর রেখে পিঠে ছোট্ট একটা হুক দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। তার সঙ্গে টিনের থালা—মগ ছিল একটা এবং সামান্য কাপড়জামা। কালো নোংরা পুঁটলিটা সে পিঠের বাঁ দিকে ঝুলিয়ে সকলের সঙ্গে উঠে যেতে লাগল পাহাড়ের দিকে।
বৃদ্ধ পাহাড়ের নীচে সামান্য এক সমতলভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুসন্ধান করে এই স্থানটুকু আবিষ্কার করেছে। কিছু গুল্মলতা দেখে সে বুঝে নিয়েছিল এই মাটির নীচে রসাল একরকমের শিকড় রয়েছে। সুতরাং খুঁড়ে খুঁড়ে এক পাহাড় রসাল শেকড় তুলে রেখেছে। তার শক্ত বাহু কাজ করার জন্য বড় বেশি পাথরের মতো কঠিন মনে হচ্ছিল।
বৃদ্ধ সকলকে প্রায় সমানভাবে ভাগ করে দিল। এবং বলল, চুষে খাও। তোমাদের তেষ্টা নিবারণ হবে।
মানুষগুলোর কাছে এই বৃদ্ধ মোজেসের মতো। এই দুর্দিনে এই একমাত্র মানুষ যে তাদের আশা দিয়ে বাঁচবার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। তিনি কেবল বলছেন, জল হবে। এবার বর্ষায় জল হবে। জল হলে নদীর সব জল আমরা নেমে যেতে দেব না। বাঁধ দিয়ে আমরা জল আটকে রেখে দেব। সুদিনে দুর্দিনে জল আমাদের কাজে আসবে।
বৃদ্ধ আরও বলছিল, এই মাটি সোনার ফসল দেবে। এই মাটি ছেড়ে কোনো শহরে চলে গেলে—ভিখারি বনে যাবি, এই মাটিতে জল হলে আমরা সকলে মিলে সোনার ফসল ফলাতে পারি। বৃদ্ধ এইটুকু বলে পিতামহের আমলের এক মন্বন্তরের গল্প শোনাল।
সুবল কান খাড়া করে রাখল। নানারকমের বীভৎস দৃশ্য চোখের ওপর ভাসছিল সুবলের। বৃদ্ধ পুরাতন এক মন্বন্তরের গল্প শুনিয়ে বলল, সংসারে এমন হয় মাঝে মাঝে। তাতে ভেঙে পড়লে চলে না। মানুষ, গোরু—বাছুর পথে—ঘাটে মরে পড়ে থাকে। ঘরের ভিতর মৃতের দুর্গন্ধ। মহামারী আসে। গ্রামের পর গ্রাম ক্রমশ খালি হয়ে যায়।
পাহাড়ে পাহাড়ে ধুলোর ঝড় উঠছে। ওরা দলবেঁধে হাঁটতে থাকল। ওরা জানত, এই সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেলে বড় এক পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। তারপর দু’ক্রোশের মতো হেঁটে গেলে রেললাইন, লাইনের ধারে লঙ্গরখানা খুলেছে সরকার, সেখানে পৌঁছুতে পারলে এক হাতা খিচুড়ি পাওয়া যাবে। এই সামান্য আহার সারা রাত্রির জন্য ওদের সামান্য শান্তি দেবে। তারপর ফের আগামীকাল নদীর ঢালুতে জলের সন্ধান চলবে। ক্রমশ এভাবে চলবে। কতদিন চলবে এভাবে ওদের জানা ছিল না। শুধু বৃদ্ধ আগে আগে হাঁটছে। হাতে লাঠি। সে মাঝে মাঝে হাতের লাঠি আকাশের দিকে তুলে দিচ্ছে, পথে—ঘাটে গোরু—বাছুর মরে পড়ে ছিল, পচা দুর্গন্ধ। কোনও গ্রামে ওরা মানুষের চিহ্ন দেখতে পেল না। কেবল দূরে ট্রেনের হুইসল শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে।
ওরা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় রেললাইনের ধারে পৌঁছাল। গ্রামটাকে উৎসবের মতো মনে হচ্ছিল। বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষেরা এসে বসে রয়েছে। বড় বড় অর্জুন গাছের নীচে খড়বিচালি বিছিয়ে বউ—বিবিরা শুয়ে আছে, খাবার হয়ে গেলে টিনের থালা এবং মগ নিয়ে সকলে লাইন দেবে। অবশ্য শিশুদের এবং বালক—বালিকাদের খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা খেলে খাবে বুড়ো—বুড়িরা এবং বউ—বিবিরা। তারপর যুবক এবং মরদ মানুষেরা।
উৎসবের মতো এই গ্রাম। ব্যাজ পরা একদল মানুষ। বড় বড় তাঁবু খাটানো হচ্ছে। ডে—লাইট জ্বলছে, কোনও পরিত্যক্ত ধনী গৃহস্থের বাগানবাড়ি হবে এটা। প্রায় দশ—বারোটা উনুনে লোহার বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি ফুটছে। ত্রিপাল গোল করে মাটির গর্তে খিচুড়ি রাখা হচ্ছে। বড় বড় কাঠের হাতা নিয়ে বড় বড় বালতি নিয়ে ব্যাজ পরা মানুষগুলো ছুটোছুটি করছে। কিছু লোক কোথায় গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, একদল স্বেচ্ছাসেবক সেদিকে ছুটল। ওরা লুকিয়ে খাবার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
বড় বড় মোষের গাড়িতে শহর থেকে জল এসেছে। বড় বড় মাটির জালা জল ভর্তি ছিল, এখন সেই জল নিঃশেষ। কেউ খিচুড়ি খাবার পর এক ফোঁটা জল খেতে পারছে না। মানুষগুলোর মুখে বিরক্তির ছাপ এবং উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে।
জল নেই, খাবার জল নেই। এই অঞ্চলে পাঁচ—সাত ক্রোশ এমনকি দশ ক্রোশ হবে জল নেই—খাবার জল নেই, পাতকুয়াতে কোথায় সামান্য জল একজন গেরস্থ মানুষ লুকিয়ে রেখেছিল—সেখানে খণ্ডযুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের। কারণ কে যেন বলছিল এই দুর্দিনে জল লুকিয়ে রাখতে নেই।
তখন তাঁবুতে তাঁবুতে সরকারের লোক সব ফিরে যাচ্ছিল। জলের কথা বললে ওরা না শুনি না শুনি করে পেতল—কাঁসা যা ছিল কিছু সামনে তা দিয়ে কান ঢেকে দিল। অর্থাৎ ওরা কিছু শুনতে চাইল না। উপরন্তু তাঁবু থেকে হ্যাট পরা মানুষটা বের হয়ে বলল, কাল থেকে লঙ্গরখানা বন্ধ। কতদিন বন্ধ থাকবে জানা নেই, গুদামখানায় চাল—ডালের মজুত শেষ। আবার কোথা থেকে গম আসছে, আসার যদি কথা থাকে তবে এখানে দু’—চারদিন রুটি মিলতে পারে আবার নাও মিলতে পারে। সরকারের লোকটি নিজের দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে তাঁবুর ভিতর ঢুকে গেল।
মানুষগুলো, কত মানুষ হবে—প্রায় হাজার মানুষ, ছেলে বউ—বিবি নিয়ে হাজারের ওপর হতে পারে, বিশেষ করে সুবল, যার বাঁশের ভেতর ময়না পাখির বাচ্চা, বাচ্চাটাকে সুবল একটা মরা গাছের নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কারণ পাখিরা পর্যন্ত ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, জলের অভাবে, শস্যের অভাবে এখন আর কোনও পাখি পর্যন্ত ডাকে না—সুবল সেই মরা গাছের ডালে একটা ভাঙা বাসা দেখেছিল। বোধ হয় পাখিটা বাসা থেকে পড়ে গেছে। পাখিটা জলের জন্য অথবা ক্ষুধায় দু’ঠোঁট ফাঁক করে দিচ্ছিল—সুবল পাখি নিয়ে ছুটে ছুটে ওর যে শেষ সামান্য সঞ্চিত জল ছোট কাচের শিশিতে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই জল থেকে প্রায় মধুর মতো একটু একটু করে জল দিতেই পাখির বাচ্চাটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। সুবল হাতে তালি বাজাল এবং এতবড় খরা চলেছে, মন্বন্তর এসে গেল দেশে—এই পাখি মিলে যাওয়ায় ওর ভয় যেন কেটে গেল। সেই সুবল যাকে দেখলে এখন ভিড়ের মধ্যে মনে হল বড় কাঙাল, সরল সহজ—গোবেচারা সুবল পিঠে বাঁশের ভেতরে পাখি নিয়ে এগিয়ে গেল। বলল, আমরা খেতে না পেলে মরে যাব।
তাঁবুর ভিতরে বোধ হয় কী নিয়ে হাসি—মশকরা হচ্ছিল। ওরা খুব জোরে হাসছে। ওরা সুবলের কথা শুনতে পায়নি। সুতরাং সুবল পেছনের দিকে তাকাতেই দেখল সেই বৃদ্ধ লাঠি উঁচু করে রেখেছে। যেন এই লাঠিতে মোজেসের প্রাণ আছে। লাঠি এখন ওদের সব আশা পূরণ করবে। সে লাঠি তুলে ওপরে কী নির্দেশ করতেই সকলে বুঝে নিল, ওদের এবার এ স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। ওরা বৃদ্ধের কথামতো পিছনে পিছনে চলতে থাকল। তাঁবুর চারপাশে পুলিশ ছিল কিছু… ওদের হাতে বন্দুক ছিল, গ্রামের মানুষেরা হিংস্র, ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠছে অথচ এই বন্দুক দেখলে তাদের প্রাণ শুকিয়ে যায়—ওরা অর্থাৎ এই—এই মানুষেরা, যারা হা—অন্নের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকছে, তাদের নীরবে অন্ধকারে নেমে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকল না।
অন্ধকারে বৃদ্ধ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি সুবল?
—জানি না কর্তা।
—আমরা কোথাও যাচ্ছি না। আমরা এই পাহাড়ের ওপর আগুন জ্বেলে দেব। সব পুড়িয়ে দেব। যখন মাটি এত নেমকহারাম, ঈশ্বর এত বেইমান—যখন বৃষ্টি হচ্ছে না, যখন ঘাসমাটি পুড়ে গেল, সব তখন আমরা আগুন জ্বেলে বাকি যা আছে সব পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাব শহরে।
কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন রুখে উঠল। বলল, আমরা জল খেতে চাই কর্তা। তুমি সারাদিন বালুর ভিতরে পুরে রেখেছিলে জল দেবে বলে, কিন্তু জল কই?
দলের ভিতর শিশুদের কান্না, জল খাব। ওদের সকলের ভয়ঙ্কর তেষ্টা। বৃদ্ধ নিজেও তেষ্টায় মরে যাচ্ছে। ভিতরে এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতা কাজ করছে। ক্ষণে ক্ষণে বুদ্ধি পালটায়। মনে হয় এই মাটি সোনার ফসল দেবে, আবার মনে হয় জল বুঝি এখানে আর কোনওদিন হবে না, মাটি আর সোনার ফসল দেবে না। সব শুকিয়ে যাবে তারপর একদিন এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নেবে।
তখন দূরের ট্রেনের হুইসল। বড় একটা ট্রেন বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে। কোথায় এক দিল্লি বলে শহর আছে, কোথায় এক কলকাতা বলে নগর আছে, সেখানে ট্রেনটা যাবে। দিল্লি থেকে কলকাতা। বৃদ্ধ এবার লাঠিটা শক্ত করে ধরে ফেলল। তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা এই লাইনের ওপর বসে যাও। শহর থেকে নগরে যাবার জন্য বড় ট্রেন আসছে। আজ আমরা ট্রেনটা থামিয়ে দেখব কী আছে, যদি ভিতরে জল থাকে, তবে আমরা জল নিয়ে চলে যাব। জলের জন্য অন্নের জন্য আমাদের এই দস্যুবৃত্তি। আমাদের কোনো পাপ হবে না।
সুবলের ভয় ছিল, ট্রেনটা হুড়মুড় করে এসে ওপরে উঠে যেতে পারে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, কর্তা, আমরা যে তবে সব মরে যাব।
—মরে যাবে কেন?
—ট্রেনটা আমাদের ওপর দিয়ে চলে যাবে।
—আরে না, ট্রেন মানুষের ওপর দিয়ে যায় না। এতগুলো লোক দেখলে ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে দেবে।
কর্তামানুষ এ বৃদ্ধ, এই অঞ্চলের পুরোহিত মানুষ, বিদ্যায় বুদ্ধিতে সকলের চেয়ে প্রবল সুতরাং সুবলের আর কোনও ভয় থাকল না। সে তার পাখি পিঠে রেখে দিল, সে তার ঝোলাঝুলি, বগলের নীচে ঝুলিয়ে রাখল। সুবল অন্ধকারে টিপে টিপে দেখল ঝোলাঝুলিতে ওর সংগ্রহ করা পোকামাকড়গুলো রয়েছে কিনা! কারণ সে খুব ভোরে উঠে পোকামাকড় সংগ্রহ করে রেখেছে পাখিটার জন্য। খুব ভোরে উঠে সে পাখিটাকে আকাশে ওড়াবার চেষ্টা করেছে। কারণ তখন প্রবল খরা থাকে না, ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকে, এবং খুব ভোরেই পাখিটা যেন সামান্য সতেজ থাকে। তারপর সূর্য ওঠার সঙ্গে পাখিটা গরমে ছটফট করতে থাকে। সুবলের মনে হয় সে পাখিটাকে আর বুঝি বাঁচাতে পারবে না। সে যখনই সামান্য অবসর পায় পাখিটাকে বাঁশের চোঙ থেকে তুলে এনে হাতের ওপর বসিয়ে রাখে। এবং নিজে সূর্যের দিকে পিঠ রেখে পাখিটাকে ছায়া দেয়। যদি ফুরফুরে হাওয়া থাকে তবে পাখিটাকে হাওয়া লাগাবার জন্য হাতের কবজিতে বসিয়ে সে আপন মনে শিস দিতে থাকে এবং গ্রাম্য কোনো সংগীত অথবা লোকগাথা সে কবিতার মতো উচ্চারণ করতে করতে, এই প্রবল খরা, মন্বন্তর আসছে, দুর্ভিক্ষ সারা দেশে, আবার ওলাওঠা মহামারীর আকারে দেখা দিচ্ছে, সুবল পাখিটাকে রক্ষা করার জন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন সে অন্য কোথাও পালাতে পারলে বাঁচে।
ভয়ঙ্কর অন্ধকার। এতগুলো মানুষ নিঃশব্দে হাঁটছে। পাতার শুধু খস খস শব্দ উঠছিল। ওরা প্রায় সকলেই বনবেড়ালের মতো চুপি চুপি রেললাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের কান্না মাঝে মাঝে বড় ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল।
শালগাছের জঙ্গল সামনে। জঙ্গল পার হলে রেললাইন। শালগাছগুলো প্রায় মৃতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে গাছের ডালপালাগুলোকে খুব ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। কোনও গ্রাম থেকে একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। মাঝে মাঝে শেয়ালের চিৎকার—আর এক ঝিল্লির ডাক, মনে হয় এই সংসারে জীবনধারণের আর কিছু থাকল না, কোনও আলো অথবা হাওয়া, সর্বত্র ভয়াবহ মৃতের গন্ধ শুধু।
বৃদ্ধ পুরোহিত রেললাইনে ওঠার আগে বললেন, বিবি—বউদের এবং শিশুদের আলাদা রেখে দাও। ওরা বড় কড়ুই গাছের নীচে বসে থাকুক।
বৃদ্ধ এবার যুবকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা হাতে সামান্য কাপড় নাও। ট্রেনের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাত ওপরে তুলে গাড়ি থামাবার নির্দেশ দেবে। বৃদ্ধ পুরোহিত এই সব বলে রেলের লাইনে কী নুয়ে যেন দেখল। তারপর সে সকলের আগে হাতে সেই লাঠি নিয়ে সামান্য সময় স্থির হয়ে দাঁড়াল। অপলক সে যেন কিছু দেখছে,—অন্ধকার, না এই জগৎসংসার, না পূর্বস্মৃতি তার কাজ করছিল। কী ছিল এই অঞ্চলে। বড় মাঠে সোনার ফসল ছিল, বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, গোয়ালে বড় বড় গোরু, মোষ ছিল, শীতের সময়ে রামায়ণ—গান ছিল আর গ্রীষ্মকালে ঢোলের বাজনা ছিল, রামাহই রামাহই গান ছিল। এখন সব নিঃশেষ। কেবল ভয়, যা কিছু সামান্য মানুষ আছে তারাও চলে যাবে সব বাড়ি ছেড়ে। ভয়, মহামারী, মন্বন্তর এসে গেল। সামান্য খয়রাতি সাহায্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে আর কী থাকল মানুষগুলোর, কীজন্য আর অপেক্ষা করা। এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে মানুষগুলো বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বৃদ্ধ পুরোহিত অন্ধকারের ভিতর কোনও আলোর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না।
ট্রেনটা বোধ হয় তখন নদী পার হচ্ছিল, কোনও বড় সেতু পার হচ্ছিল, অথবা বাঁকের মুখে কোনও পাহাড়ের ভিতর ট্রেনটা ঢুকে যাচ্ছে—সুতরাং গম গম, খুব দূর থেকে গম গম শব্দ, মনে হয় খুব দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ, যেন হাওয়ায় ভর করে শব্দটা কানের পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।
তারপর সেই আলো, ট্রেনের আলো, দূর থেকে ওরা ট্রেনের আলো দেখতে পেল। ট্রেনটা যত দ্রুত এগিয়ে আসছে তত ওদের বুক দুরু দুরু করছিল। তত ওরা মরিয়া হয়ে উঠছে। যেন ওরা কোনও দীর্ঘ মরুভূমি পার হবে এখন—সুতরাং সকলের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই, সকলের রক্তে এক অমানুষিক উত্তাপ সঞ্চিত হচ্ছে।
হাড়গোড় বের করা মানুষগুলোর দিকে এখন আর তাকাচ্ছে না। লাইনের ওপর যেন শত শত কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, স্নান না করার জন্য চুল শনের মতো হয়ে গেছে, গায়ে খড়ি ওঠা, পেটের ভিতর যন্ত্রণা, ক্ষুধার যন্ত্রণা। সামান্য লঙ্গরখানার দান এই সামান্য পথটুকু অতিক্রম করতেই হজম হয়ে গেছে।
ওরা সকলে আলোটা দেখে ভয় পাচ্ছে। ওরা এই ভয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কী করবে ভেবে পাছিল না। ওরা অন্ধকারে পরস্পর মুখের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ পুরোহিত পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে। দৈত্যের মতো ঝড়ের বেগে ট্রেনটা ছুটে আসছে, পাহাড়ের ওপর পড়লে রক্ষা থাকছে না। সব মানুষগুলোর রক্তে এই লাইন ভেসে যাবে, শকুনের আর্তনাদ শোনা যাবে দূরে—বৃদ্ধ ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ডেকে উঠল, জল চাই, আমরা জল চাই।
সঙ্গে সঙ্গে সুবল ওর পাখিটাকে বুকের কাছে এনে বলল, হ্যাঁ, আমরা জল চাই। যুবক—যুবতীরা বলল, জল চাই, জল চাই।
কড়ুই গাছের নীচে থেকে বউ—বিবিরা চিৎকার করে উঠল, জল চাই, জল চাই।
ভূতের ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ওই মানুষগুলো জল চাই, জল চাই বলে হরি নামের মতো মন্ত্র উচ্চারণ করছে। এই উচ্চারণ কেবল দীর্ঘ মাঠে শব বহনকারী মানুষের কান্নার মতো শোনাচ্ছে। বড় মাঠ সামনে, লাইনের পাশে বড় পাহাড়, শালগাছের মাথায় ভাঙা চাঁদের আবছা অন্ধকার, এতগুলো মানুষের ভয়াবহ কণ্ঠ চারপাশের পরিবেশকে খুব বিষণ্ণ করে তুলছে।
ট্রেনটা হুইসল দিচ্ছে, ড্রাইভার টের পেয়ে গেছে বুঝি। আবছা কী যেন দেখা যাচ্ছে লাইনের ওপর। প্রথম কুয়াশার মতো মনে হচ্ছে, তারপর মনে হচ্ছে মরীচিকার মতো হাজার সরলরেখা পুতুলনাচের দড়িতে ঝুলছে।
ড্রাইভার চোখ মুছে নিল। এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত নেই এবং এই অঞ্চলে মহামারী আরম্ভ হয়ে গেছে—ড্রাইভার ভালো করে দেখে নিল। কিছুদিন আগে ড্রাইভার দেখেছে দূরে মাঠে সব মৃত গোরু—বাছুর—মোষ, হাজার হবে প্রায়, লাইনের ধারে ধারে মরে আছে। মাঝে মাঝে সে মৃত মানুষের মুখও দেখেছে। লোকালয়ে আর কোনও লোক নেই, সকলে শহর গঞ্জে চা—বাগানে এবং দূরদেশে চলে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর দুর্দিন মানুষের।
আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা বাঁক নিলে ড্রাইভার টের পেল, শত শত কঙ্কাল যেন রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ভূতের মতো নৃত্য করছে। সে এবার প্রাণপণে রড চেপে ধরল, প্রাণপণে সে হুইসল বাজাতে থাকল। এরা সব মানুষের কঙ্কাল, চোখ—মুখ কোটরাগত, লাইন থেকে একটা প্রাণী সরছে না এবং ড্রাইভার ভূতের ভয়ে প্রথম ভাবল যদি ওরা যথার্থই মানুষের অভুক্ত আত্মা হয় তবে আর ট্রেন থামিয়ে কী হবে, বরং সে জোরে বের হয়ে যাবে, ট্রেন থামালে মৃত আত্মারা ওর ট্রেনটাকে এই নির্জন মাঠে আটকে দিতে পারে। সুতরাং ফের চাকা ঘুরিয়ে দিতে গেল—ফায়ারম্যান শক্ত হাতে বাধা দিল, বলল, না। ওগুলা ভূত নয় দাদা। ওগুলো মানুষ। সে ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনটা থামিয়ে দিল।
মানুষগুলো কোলাহল করতে থাকল, জল চাই, জল চাই। মানুষগুলো কামরায় উঠে গেল। বলল, জল চাই, জল চাই।
ভিতরের যাত্রীরা ভয় পেয়ে গেছে। সব কঙ্কালের মতো মানুষের চেহারা, ক্ষুধার্ত, চোখ কোটরাগত, হাত—পা শীর্ণ, ক্লান্ত এবং অবসন্ন। এই সব মানুষের শরীরে জীর্ণ—বাস, ময়লার জন্য দুর্গন্ধ, ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ, যাত্রীরা সকলে নাকে কাপড় দিচ্ছে। ভয়ে ওরা কথা বলতে পারছে না। যেন শয়তানের প্রতীক এইসব মানুষেরা। যাত্রীদের সুন্দর সুদৃশ্য কামরার প্রাচুর্য ওদের পৈশাচিক করে তুলেছে। ওরা প্রেতের মতো ভিতরে ঢুকে দু’হাত ওপরে তুলে জলের জন্য, জল চাই, বলে নামকীর্তনের মতো নাচতে থাকল।
যাত্রীদের মনে হল, ক্ষুধার্ত সব রাক্ষস অথবা ডাইনির মতো মানুষগুলো আকাশে বাতাসে দুঃখের খবর পাঠাচ্ছে, ওরা ভিতরে ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছিল। জল কোথায়, জলের জন্য ওরা ওদের মগ, থালা এবং চামড়ার ব্যাগ খুলে রেখেছে, অথচ জল কোথায়, বৃদ্ধ পুরোহিত শুধু জানতেন জল কোথায়, তিনি সকলকে দু’হাত তুলে শান্ত থাকতে বলেছেন, সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগ করে দিতে হবে। তিনি প্রতি কামরায় একজন করে যুবককে জলের কল দেখিয়ে দিলেন, কী করে খুলতে হবে বন্ধ করতে হবে দেখিয়ে দিলেন, প্রত্যেককে লাইন দিয়ে যেমন মানুষগুলো সরকারের লঙ্গরখানাতে লাইন দিয়ে খাদ্যবস্তু থালায় নিত, তেমন লাইন দিয়ে সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে বললেন।
সুবলের কামরায় খুব অল্প মানুষ। সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ এক বালিকা নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। এতবড় কামরা—রিজার্ভ প্রথম শ্রেণীর কামরা, মাত্র তিনজন মানুষ। রুগণ বালিকা মোমের মতো সাদা। সাদা চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাথায় আলো জ্বলছিল। খুব অনুজ্জ্বল আলো। ওরা সকলে ভয়ে কেমন চোখ—মুখ সাদা করে রেখেছে। বালিকাটি পর্যন্ত মুখ—নাক দেখে আঁৎকে উঠেছে। সুবলের পিছনে বড় বড় সব মানুষ। মানুষ বলে চেনা যায় না। যেন বড় এক রাজপুরী। সুন্দর সব বাদামি রঙের গাছ। গাছে হিরে—পান্নার ফুল। নীচে রাজকন্যা আঙুর খেতে খেতে কোনও রাজপুরের জন্য অন্যমনস্ক। অথবা এও হতে পারে রাজকন্যার জানা ছিল না, রাজ্যের কোথাও দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। জানা ছিল না, রাজ্যের রাজা বনের হরিণ অনুসন্ধানে মত্ত। রাজা, রাজ্যের খবর রাখছে না। হাজার হাজার গ্রামে মড়ক লেগেছে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল ফলছে না। অল্প বৃষ্টির জন্য মাটি ক্রমশ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। হায়, তখনও রাজা মনোরম রাজপ্রাসাদে নূতন অরণ্যের সৃষ্টি করছে। কারণ ওর প্রিয় হরিণটি এই বনের ভিতর হারিয়ে যাবে। সে সেই হরিণের জন্য শুধু ব্যস্ত থাকবে। রাজকার্যের জন্য বনের হরিণটি ওর বড় প্রিয়। মরীচিকার পেছনে ছোটার মতো রাজা শুধু ছুটছেন। তখন রাজকন্যা দেখতে পেল হাজার হাজার কঙ্কালপ্রায় মানুষ তাকে ঘিরে ফেলেছে, হাউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ—এই সব কথা বলছে।
সুবল হাতের ইশারা করলে সকলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুখী মানুষটি প্রথম খুব চেঁচামেচি করছিল, পুলিশের ভয় দেখাচ্ছিল। কিন্তু এতবড় নির্জন মাঠ, একদিকে দীর্ঘ পাহাড়, অন্যদিকে এক মরা নদী, নদীতে মানুষগুলো জলের জন্য দিন নেই, রাত নেই মাটি খুঁড়ে চলেছিল, অথচ জল নেই, জল নেই, হাহাকার জলের জন্য। সুতরাং সামান্য পুলিশের ভয় সুবল অথবা এইসব কঙ্কালপ্রায় মানুষদের এতটুকু বিচলিত করতে পারল না।
বরং মানুষগুলো, সুদৃশ্য এই কামরা, আসবাবপত্র দেখে কৌতুকবোধ করতে থাকল। ওরা সুবলকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে। অথবা সুবলকে অনুনয়ে বলছে, ওরা এই কামরার ক্ষতি করবে না। শুধু ঢুকে দেখবে, মোটা গদি, এবং আলোর কাছে হাত রেখে দেখবে—কেমন ভিতরে অনুভূতি জন্মায়। সুবল ওদের এক এক করে জল খেতে দিচ্ছে, আর এক এক জন কামরার ভিতর ঢুকে দেওয়ালে হাত রাখল, অথবা একটু আরাম করে গদিতে বসে শুয়ে কেমন লাগে দেখতে থাকল। বা বেশ তো, ওদের কেউ কেউ যেন চোখ বুজে আরামটুকু অনুভব করছে। বাংকের ওপর বসে, হাঁটু মুড়ে বসে শুধু চারিদিকের দৃশ্য,—জানালা দিয়ে শুধু অন্ধকার মাঠ, পেছনের করিডোরে মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে, কোলাহল করছে। গার্ডের লালবাতি, যেন মাঠ, মরা নদী অথবা শুকনো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে লালবাতি জ্বেলে বসে আছে।
কামরার ভিতর সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ বালিকা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে, ওরা ভয়ে কামরার এক পাশে, যেন ভয়ঙ্কর কোনও দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছে ওরা।
ড্রাইভার নীচে নেমে দেখল, পিপীলিকার মতো মানুষগুলো কামরায় কামরায়, ছাদের ওপরে উঠে হৈহুল্লোড় করছে। শিশুদের মতো চিৎকার, যেন এই ট্রেন ওদের কাছে খেলনার মতো অথবা যুদ্ধে প্রতিপক্ষের পরিত্যক্ত কামান, কামানের গোলাগুলি শেষ, গ্রামের দুষ্ট বালকবালিকারা কামানটা টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার যাত্রীদের পার হয়ে গার্ডের ঘরে গিয়ে দেখছে, ভয়ে গার্ডসাহেব লালবাতি জ্বেলে বসে রয়েছে।
এবার ড্রাইভার মরিয়া হয়ে বলল, এবার নীলবাতি জ্বালুন, ট্রেন ছেড়ে দিই, একটা মানুষও লাইনের ওপর আর নেই। শালা সকলকে নিয়ে এবার স্টেশনে নিয়ে ফেলি।
ড্রাইভারের চিৎকারে গার্ডসাহেব ভয়ে তিড়িংবিড়িং করতে থাকল। ঘুরেফিরে কেমন মাতালের মতো কিছুক্ষণ নেচে বেড়াল। ড্রাইভার বুঝল গার্ডসাহেব ভয়ে ভিরমি খেয়েছে। সে বলল, গার্ডসাহেব, বেশি দেরি করলে বয়লার থেকে জল ঢেলে নেবে। ট্রেন তবে আর চলবে না!
গার্ডসাহেব কী যেন ভাবলেন। এদের এত তেষ্টা?
—তেষ্টা, কী যে জল খাচ্ছে! কেবল জল খাচ্ছে।
—কেবল জল খাচ্ছে?
—কেবল জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। কেবল জল খাচ্ছে।
—অন্য কিছু না?
—না, কিছু না। কোনোদিকে আর ভ্রূক্ষেপ নেই। বড় সজ্জন।
—তবে এবার শালা সজ্জনদের চল শহরে নিয়ে তুলি। বলে তিনি বসে টুক করে লাল বাতিটাকে নীল করে দিলেন।
ড্রাইভার নামার সময় বলে এল, আপনি সাব হুইসল বাজাবেন না। আমি সেকেন্ডে এমন গতি বাড়িয়ে দেব না, শালা একটাকেও নামতে দেব না। বলে ড্রাইভার অন্ধকারের ভিতর নিচু হয়ে হাঁটতে থাকল। এবং দেখল ট্রেনের নীচে আবার কেউ বসে রয়েছে কিনা। সে কোনো মানুষ দেখতে পেল না। কেবল মনে হল নীচে ঠিক বড় একটা গাছের অন্ধকারে একজন আলখাল্লা পরা মানুষ দাঁড়িয়ে দুঃখী লোকদের যেন জলপান দেখছে।
ড্রাইভার বলল, শালা, তুমি লিডার আছে। তোমাকে ফেলে দেখ শালা, কেমন সব ফাঁক করে দিই। তুমি শালা এখানে পড়ে পড়ে এবার ঘাস খাও। মুরগি খাও। মুরগির নাম মনে হতেই ড্রাইভারের জিভে জল এসে গেল।
ওদের এত জলতেষ্টা যে, কোথায় ড্রাইভার, কোথায় ফায়ারম্যান দেখবার ফুরসত নেই। আর এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ট্রেনে উঠে পড়বে সেও, কেউ ভাবেনি।
বৃদ্ধ পুরোহিত ওদের জল খেতে দেখে, ওদের হইচই দেখে খুব খুশি। দীর্ঘদিন পর জল পান, তৃষ্ণার জল কতদিন পর পান করা গেল। তিনি নিজেও জল এনে গাছের নীচে পান করছেন। মনে হচ্ছিল পেটে আর জায়গা নেই, তবু মনে হচ্ছিল জলের আর এক নাম জীবন, এই জল এবং জীবনকে চেটে চেটে খাবার জন্য তিনি কিছুক্ষণ পর পরই গলায় জল ঢেলে দিচ্ছেন, এবং জল খাবার সময় যেন অন্ধকারে টের পেলেন, ট্রেনটা নড়ছে, ট্রেনটা সহসা এমন গতি বাড়িয়ে দিল যে, তিনি অনুমানই করতে পারলেন না কী করে চোখের পলকে এতগুলো লোক নিয়ে ট্রেনটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিনি চিৎকার করতে করতে ট্রেনটার পিছনে ছুট দিলেন। তিনি অন্ধকারেও দেখতে পেলেন সেইসব দুঃখী মানুষদের হাত—ওরা যেন বলছিল, দেখ দেখ, কেমন বেইমান এই ট্রেন, আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শুধু চিৎকার করছিলেন, তোরা সব নেমে পড়। তোদের নিয়ে ট্রেনটা চলে যাচ্ছে, তোরা লাফিয়ে পড়।
কিন্তু সুবল ট্রেনের ভেতর জানালাতে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দিয়েছিল। অন্ধকারে গাছপালা আবছা আবছা, সে কোনও মানুষকে কোনও বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখেনি। সে ভেবেছিল হয়তো দু—একজন পড়ে থাকল—আর সকলকে নিয়ে ট্রেনটা মোটামুটি শহরে পৌঁছে যাবে। কারণ এই মন্বন্তর মানুষের আত্মবিশ্বাস হরণ করে নিয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে কেউ লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেনি। সকলে যেন মোটামুটি ভিতরে ভিতরে খুশি।
ট্রেনটা ওদেরকে কোনও না কোনও শহরে পৌঁছে দেবে। অন্ন—জল এবং বস্ত্রের অভাব হবে না। একবার শুধু পৌঁছে যাওয়া। সেখানে পুলিশের ভয় সামান্য থাকবে। সুতরাং ওরা সকলেই প্রায় ভদ্রলোকের মতো কামরায় টিকিটবিহীন যাত্রীর মতো বসে থাকল। ওরা আর কিছু তছনছ করছে না। যাত্রীদের মনে সাহস ফিরে এসেছে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে বড় নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। শরীর শক্তিবিহীন। অনেকের ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম পাচ্ছিল।
সুবল প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর ঘরে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকল। সাদা মোমের মতো বালিকার মুখ। চোখ বড় বড়। সুবলকে বালিকাটি দেখছে। ঘরে অন্য যারা ছিল তারা জল খেয়ে চলে গেছে।
এই কামরায় অবশিষ্ট জলটুকু নিঃশেষ। প্রৌঢ় মানুষটি কী যেন বই পড়ছিলেন। তাকে এখন আর উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তিনি যেন ভেবে নিয়েছেন, এইসব দেহাতি মানুষেরা কোনও কিছু আর অনিষ্ট করবে না। ফাঁক বুঝে জলের জন্য ট্রেন আক্রমণ করতে এসে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে। এক ঢিলে দুই পাখি। রথও দেখা হল, কলাও বেচা হল। সুবলের মুখ দেখে তাই মনে হয়।
সুবল এখন ট্রেনে চড়ে কোথাও চলে যেতে পারছে ভেবে খুশি। অন্তত জলের জন্য আর মাঠ—ঘাট ঘুরে মরতে হবে না। সুবলের মুখ দেখলে তাই হয়। বালিকাটি অসুস্থ। সাদা মোমের মতো মুখে শুধু চোখ দুটোই অবশিষ্ট। চোয়ালে সামান্য মাংস। হাত—পা বড় শীর্ণ। শুধু মুখে সামান্য সতেজ ভাব। চোখ দুটো বড় টল টল করছিল। সুবলের আশ্চর্য লাগছে—এই মুখ, সুন্দর সতেজ মুখ রুগণ এবং পীড়িত। ভিতরে ভিতরে অসামান্য কষ্ট। শিয়রে বসে আছেন যিনি—বালিকাটির মা হবে নিশ্চয়ই। তিনি বুক পর্যন্ত সিল্কের চাদরটা মাঝে মাঝে টেনে দিচ্ছেন। যারা পরে তৃষ্ণার জল খেতে এসেছিল—অবশিষ্ট জল, এমনকি এই রুগণ বালিকার জন্য যে মাটির জারে অল্প জল ছিল, জলের স্বাদ পেয়ে সবটুকু জল খেয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছিল, বালিকার এখন তৃষ্ণা পেয়েছে। বালিকা তৃষ্ণায় জলের জন্য ঠোঁট চাটছে। শিয়রে মা বসে। তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, টুকুন জল খেতে চাইছে।
প্রৌঢ় মানুষটি উঠে বসলেন, তিনি দেখলেন জল কোথাও নেই। দরজার গোড়ায় সুবল বসে বসে ঝিমুচ্ছে। এখন আর স্টেশন না এলে জল পাওয়া যাবে না। কোনও বয়কে ডেকে অথবা খাবার ঘরে অনুসন্ধান করলে হয়। তিনি সুবলকে অতিক্রম করে বাইরে বের হতেই দেখলেন বারান্দায় সেইসব দেহাতি মানুষেরা ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছে। কোথাও এতটুকু স্থান নেই যে, তিনি পা ফেলে তাদের অতিক্রম করে যাবেন। এবং এইসব দেহাতি মানুষদের দেখেই মনে হয়, জল কোথাও আর অবশিষ্ট নেই। শুধু এনজিনে জল আছে এবং তিনি ঈশ্বরের নিকট কেমন অন্যমনস্কভাবে হাতজোড় করে ফেললেন। বললেন, ঈশ্বর, এই নির্জন মাঠে ট্রেন ফের থেমে পড়লে মেয়েটাকে আর জল দিতে পারব না। জল না পেলে বড় ছটফট করবে।
সুবল ঝিমুচ্ছিল। সহসা আর্তনাদে সুবলের ঘুম ভাবটা কেটে গেল। সুবল দেখল সেই সুন্দর সতেজ মুখ বালিকার, অথচ চিৎকার করছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব, কষ্ট আর সহ্য হয় না মা! কী যে এক ভীষণ রোগ মেয়ের, মা পর্যন্ত তার দুঃখে আর্তনাদ করছিলেন।
বড় শহরে যাচ্ছে মা—বাবা, মেয়েকে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। অথবা মনে হচ্ছিল এই মেয়ের জন্যই মা—বাবা প্রবাস ছেড়ে নিজের দেশে চলেছেন। অনেক ডাক্তার দেখানো হল। জলবায়ু পরিবর্তন করা হল। কত টোটকা, কবিরাজি কি—না করেছেন প্রৌঢ় মানুষটি হায়, মনের অসুখ মেয়ের, কেউ কিছু করতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে বালিকার শুধু জলতেষ্টা পায়।
ছেঁড়া জামা সুবলের গায়ে। সুবলের পরনে প্রায় নেংটির মতো একটু কাপড়। জামাটা হাঁটু পর্যন্ত সুবলের ফুলে—ফেঁপে ছিল। দেখলে মনে হবে, দুটো সুবলকে ভিতরে পুরে রাখা যায়।
সুবল উঠে দাঁড়াল এবং ওর মাথায় লম্বা টিকি দেখে মেয়েটি প্রথমে চিৎকার থামিয়ে দিল। সুবলের বড় বড় চুল, প্রায় চুলে মুখ ঢেকে যাচ্ছে, সুবলের শরীরে ঘাম এবং ময়লায় অথবা বলা যেতে পারে অপরিচ্ছন্নতার গন্ধ। সুবলকে দেখে মেয়েটি এবার ভয়ে যেন গুটিয়ে যাচ্ছে ফের। সে সন্তর্পণে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
সুবল বলল, মা, আমার একটু জল আছে। জলটা ওকে দিতে পারি মা। ওর খুব তেষ্টা পেয়েছে।
মা বললেন, তুমি জল দেবে কী বাছা! জল তোমার কোথায়?
সুবল বলল, এই যে! সে একটা বাঁশের চোঙ বের করে দেখাল।
—এই চোঙায় জল আছে মা। আমার একটি পাখি আছে মা! পাখির জন্য একটু জল নিয়েছি মা।
মা বললেন, না বাছা। জল তোমার বড় নোংরা।
সুবল কোনও কথা বলল না। সে তার পাখিটাকে পাশের পকেট থেকে তুলে এনে হাতের কবজিতে বসাল। নীচে ছোট ছোট পুঁটলি সুবলের। সংসার বলতে যা—কিছু সবই শেষদিকে সুবলের সঙ্গে সঙ্গে থাকত। কারণ ওদের কোনও ঠিক ছিল না কখন কোথায় ওরা থাকবে। বৃদ্ধ পুরোহিত মানুষটি তাদের সকলকে নিয়ে স্থানে স্থানে জলের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। বৃদ্ধের কথা মনে হতেই অন্য একটা চোঙে পাখিটাকে পুরে রাখল। পোকামাকড় যা—কিছু পাখিটার জন্য, পোঁটলা খুলে দেখল। পোঁটলা খুলতেই ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সেটা হাত থেকে খসে পড়ল, আর পোকামাকড়গুলো পর পর ছড়িয়ে পড়ল। বৃদ্ধের কথা মনে পড়েছে, কামরায় কামরায় খুঁজে দেখলে হয়, কোনও কামরায় তিনি হয়তো আছেন। কারণ সুবল ভেবেছে ভিড়ের সঙ্গে তিনি নিশ্চয় উঠে এসেছেন। কিন্তু পোকামাকড়গুলো ছড়াতেই যাত্রী তিনজন, বিশেষ করে রুগণ মেয়েটি হইচই বাধিয়ে দিল ভয়ে।
পোকামাকড়গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। আলোর ভিতর ওরা চোখে দেখতে পাচ্ছে না—বালিকার অথবা প্রৌঢ় ব্যক্তিটির পিঠে শরীরে মুখে বেয়ে বেয়ে উঠে যাচ্ছে। সুবল ভয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমনটা হবে জানা ছিল না। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে হাত থেকে পোঁটলা খসে পড়বে এবং ঘরময় কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে ভাবতে পারেনি সুবল।
ট্রেন বেগে চলছে, মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসল কানে বড় বেশি বাজছে! পাখিটা সুবলের মাথায় হাতে এবং ঘাড়ে উড়ে উড়ে বসছে। পাখিটাকে দেখে মেয়েটি ওর সব দুঃখ যেন ভুলে যাচ্ছে। এমনকি এই যে কীটপতঙ্গ মেঝের ওপর, দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। কী সুন্দর পাখি, সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো, গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা, নরম এবং কোমল পাখি। সুবলকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে পাখিটা, পাখিটার বয়স আর কত, পাখিটা উড়ে উড়ে দেয়ালের দিকে চলে যেতে থাকল এবং একটা একটা করে কীটপতঙ্গ ধরে এনে সুবলের জেবে ভরে দিতে থাকল।
সুবল দেখল, তার পোষা পাখিটা বড় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে। সে যেন ইচ্ছা করলে এই পাখি নিয়ে সকলকে এখন খেলা দেখাতে পারে।
সুতরাং এখন কামরায় চারজন। বিশেষ করে মা—বাবা এই পাখিয়ালা সুবলকে আর ঘৃণার চোখে দেখতে পারছে না। মেয়েটা এই যে এতক্ষণ কেবল ছটফট করছিল—আমার কিছু ভালো লাগছে না মা, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব মা, মা আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? এইসব দুঃখকর কথা আর বলছে না। একটা পাখি, সাধারণ পাখি আর এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পাখিয়ালা, ময়লা, বিশীর্ণ চেহারা, দেহাতি—কোনো আশা—আকাঙ্ক্ষা নেই, শুধু যেন এই পাখি বেঁচে থাক, পাখি থাকলেই সব থাকল, পাখির খেলা দেখিয়ে সে সকলকে বুঝি মুগ্ধ করতে চায়।
টুকুন বলল, এই পাখিয়ালা।
সুবল চোখ তুলে তাকাল।
—পাখিয়ালা, দ্যাখো এখানে একটা লম্বা গঙ্গাফড়িং।
পাখি কী দেখল, সুবল পাখিকে কী বলল বোঝা গেল না। পাখি উড়ে গিয়ে ফড়িংটাকে ঠোঁটে ঠেসে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টুকুন অতীব আনন্দে হাততালি দিতে থাকল। আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখে জল এসে গেল। যেন বলতে চাইল—পাখিয়ালা, তুমি জাদুকর, জাদু তোমার হাতের খেলনা। এই মেয়ে কতকাল তার হাসি ভুলে ছিল, কতকাল এই মেয়ে আমার হাততালি দেয় না, আনন্দ করে না। পাখিয়ালা, তুমি আমার এই মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছ, তুমি বুঝি জাদুকর!
এই করে এখন আর কোনও বেদনার চিহ্ন আঁকা নেই। কোনও জলতেষ্টা নেই।
টুকুন বলল, পাখিয়ালা, তুমি এই পাখি কোথায় পেলে?
—গাছের নীচে দিদিমণি।
—কী গাছ ছিল ওটা?
—একটা শিরিষ গাছ ছিল।
—পাখিটার বুঝি কেউ ছিল না?
—কেউ ছিল না। ওর মা—বাবা ওকে ফেলে রেখে চলে গেছে। কী খরা আমাদের দেশে! কী রোদ ছিল, কী দুঃখ। আমাদের লোকগুলো টুকুনদিদিমণি, তোমাকে কী বলব, আমাদের লোকগুলো সতেরো আঠারো দিন জল খেতে পায়নি।
বাবা বললেন, সুবল, তোমাদের কোনও সরকারি সাহায্য মেলেনি?
সুবল কী বলবে ভেবে পেল না, কিছুদিন কিছু লোক বড় বড় গাড়ি করে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে ফিরে গেছে, বড় বড় পরিকল্পনার কথা বলে গেছেন। ঐসব পরিকল্পনার কথা সুবল বোঝে না। বড় বড় নেতাগোছের মানুষ এসেছিল। দেশের জননী এসেছিলেন। তিনি খিচুড়ি মুখে দিয়ে কেমন খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে সকলকে, তার স্বাদ চেখে গেছে। কিন্তু মানুষের তেষ্টা দেখে যাননি।
হায়, সুবল যেন বলতে পারত, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো আর। গোরু—ভেড়া নিয়ে মানুষেরা চলে যাচ্ছে, মাটি ফেটে গেছে, শুকনো উত্তাপ, লু বইছে এবং গাছে মৃত ডাল শুধু, মাঝে মাঝে কোনও পাহাড়ের গায়ে দাবানল জ্বলতে দেখা গেছে। এক বুড়ো ঠাকুর সেই দাবানল দেখে বলেছে, দেশের পাপ, এত পাপ আর ধরণী সহ্য করবে না। পাপে দেশ ছেয়ে গেছে, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মরুভূমির মতো হাহাকার করছে গোটা দেশ। বুড়ো ঠাকুর এই বলতে বলতে একটা গাছের ডালে নিজের বস্ত্র বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল।
আর কী দেখেছিল! দেখেছিল সেই চৌবেজীর বউকে। বউটা এমন খরা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অভাব দেখে চৌবেজীর বউ অন্ন—বস্ত্রের সব আশা ত্যাগ করা যায় কিনা তার পরীক্ষা করত। সে অন্ন পেলে বলত, বিষ্ঠা খেতে নেই, জল পেলে বলত, বিষ, বিষ খেতে নেই। কাপড় পরতে দিলে বলত, আগুন, আগুন পরতে নেই। চৌবেজীর বউটা রাতে মাঠে নেমে উলঙ্গ হয়ে নাচত। ভয়ে বিস্ময়ে সকলে একদিন দেখেছে, চৌবেজীর বউ শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
সবই অভাবের জন্য এবং অন্নের জন্য। সারা গ্রামময় যখন ওলাওঠা, তখন মহাবীর মা শীতলার একটা মূর্তি বানিয়ে দিনরাত অশত্থ গাছটার নীচে বসে থাকত। মূর্তিটাকে সে সবসময় বগলের নীচে চেপে রাখত। যেন বগল থেকে ছেড়ে দিলে তার শরীরে মায়ের দয়া হবে। বগল থেকে ছেড়ে দিলেই মা শীতলা ওর ভিতরে ঢুকে ওলাওঠা বানিয়ে দেবে।
বস্তুত মহাবীর অভাবের জন্য, অন্নের জন্য, এবং এমন অনাবৃষ্টি আর আকাল দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে সেই খড়ের তৈরি মা শীতলাকে বগলে চেপে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকত। বিড় বিড় করে বকত। তারপর একদিন সকলে দেখল মহাবীর মাথায় পাগড়ি বেঁধে মা শীতলাকে বগল তলায় রেখে উত্তরের দিকে যাচ্ছে। লোকটা আর এ—অঞ্চলে ফিরে এল না। লোকটা অভাবের জন্য, খরার জন্য পাগল হয়ে গেল, নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
সুবল খুব নিবিষ্টমনে পোঁটলাটা বাঁধছে। এখন আর একটাও পোকামাকড় কামরার ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছে না। পাখিটা উড়ে উড়ে সব ক’টি পোকামাকড় ধরে দিয়েছে সুবলকে। তারপর বড় জেবের ভিতর ফুর ফুর করে উড়তে উড়তে ঢুকে গেছে।
ট্রেন চলছিল। বেগে চলছিল। জানালা খুলে সুবল দেখল সারা মাঠে শুধু অন্ধকার। মাঝে মাঝে কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে। বোধহয় দূরে কোথাও অন্য ট্রেন লাইন আছে। দূরে একটা ট্রেন বাঁক নিচ্ছে। ঠিক একটা আলোর মালা, সুবলের এই আলোর মালা দেখতে বড় ভালো লাগছিল।
ওর ঘুম পাচ্ছে, মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস মনে হচ্ছিল ভিতরে ঢুকছে—বোধহয় রাত শেষ হয়ে আসছে। এই শেষ রাতটুকুতে মনেই হয় না কোথাও কোনও অঞ্চল এখন জলাভাবে পুড়ে যেতে পারে। সুবলের চোখে ঘুম এসে গেল। জেবের ভিতর পাখিটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ল।
দুই
অতর্কিতে এই ট্রেনটার চলে যাওয়া—যেন নিমেষে এক বড় সংসার নিয়ে ট্রেনটা উধাও হয়ে গেল। পুরোহিত মানুষটি কী করবেন ভেবে পেলেন না। তিনি ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে থাকলেন। এত চেষ্টা সত্ত্বেও কোনও মানুষ অথবা পরিবারকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ভিন্ন ভিন্ন আশার কথা শোনাতেন, হা অন্নের জন্য, জলের জন্য এবং অনাবৃষ্টির জন্য যখন মন্বন্তর আসে তখন হাজার হাজার লোক মরে যায়, মহামারী দেখা দেয়, গোরু—বাছুর সব বিক্রি করে দিতে হয়, শুধু সামান্য কুঁড়েঘর পড়ে থাকে অবশিষ্ট—কিন্তু তারপর ঈশ্বর মঙ্গলময়, তারপর সব পাপের সংসার আগুনে পুড়ে গেলে ঘনবৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই নতুন গাছগাছালি, মাঠে সবুজ ঘাস দেখা দেয়, কোথা থেকে সব পাখি উড়ে আসে তখন। কোথা থেকে সব বন্যপ্রাণী নেমে আসে। এবং ধীরে ধীরে অঞ্চলটা তপোবনের মতো হয়ে যায়। তখন আর পাপ থাকে না, শুধু পুণ্য পড়ে থাকে, এই পুণ্যের জন্য আবার শতবর্ষ ধরে ফসল ফলাও, ঘরে উৎসব, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ। তারপর ফের পাপ, ফের হা অন্নের সম্মুখীন হওয়া।
বস্তুত এই বৃদ্ধ পুরোহিত ভোর হলেই আকাশ দেখতেন, তিনি প্রায় সব সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একটু মেঘ দেখলে চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠত। বুঝি আজই বৃষ্টি হবে। কিন্তু তারপর কোথায় বৃষ্টি, সামান্য মেঘটুকু ফুসমন্তরে আকাশের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত। তিনি তখন ফের অন্য একটুকরো মেঘের সন্ধানে পাহাড়ের টিলাতে উঠে যেতেন। যেন মৃত সব গাছাগাছালি, কুঁড়েঘর অথবা উত্তর—পশ্চিমের পাহাড় যাবতীয় মেঘকে তার দৃষ্টির আড়ালে রেখে দিয়েছে।
তিনি ভেবেছিলেন মানুষের অসীম দুঃখ—কষ্টের দিন শেষ হয়ে আসছে। এবার এ অঞ্চলে ঈশ্বরের করুণাধারা দ্রুত নেমে এসে মাঠ—ঘাট ভাসিয়ে দেবে। তিনি সেই আশায় পাহাড়ের টিলাতে দাঁড়িয়ে দিগন্তে সামান্য মেঘের অনুসন্ধান করতেন।
অথচ এক ট্রেন এসে এ অঞ্চলের সব লোকজন নিয়ে চলে গেল। শহরের দিকে ট্রেন চলে গেছে। জলের জন্য ট্রেন ধরতে আসা, আর সেই ট্রেনে চড়ে মানুষজনেরা সব চলে গেল।
পাহাড়ের উৎরাই ভেঙে উঠতে ভীষণ কষ্ট। পথ, অন্ধকারে স্পষ্ট নয়। চাঁদের ম্লান আলোটুকু নিভে গেছে। ইতস্তত কিছু কুঁড়েঘর ছোট ছোট পাহাড়ি—উপত্যকা—তিনি পাহাড়ি—উপত্যকায় নেমে গেলেন। পথের দুধারে শূন্য সব কুঁড়েঘর। একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। অন্ধকার এবং মৃত অরণ্য কেবল ভয়ের সঞ্চার করছে। তিনি চলতে চলতে কিছু কীটপতঙ্গের আওয়াজ পাচ্ছিলেন। ওরা সামান্য জীব মাত্র, এতবড় লোকালয় এখন একেবারে জনহীন।
তিনি হাঁটতে হাঁটতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কে বা কারা সারাক্ষণ পাহাড়ের নীচে দৌড়াচ্ছে মনে হল। যেন কোনও বন্য জন্তুর দল। ক্লপ ক্লপ শব্দ তুলে খুরে, অনবরত সমতল মাঠে ছুটছে। তিনি দ্রুত পাহাড়ের ঢালুতে নেমে এলেন, মনে হল ভোরের হাওয়া বইছে। মনে হল এবার পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। আর মনে হল শান্ত এক ভাব ধরণীর কোলে। এইসব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বসে পড়লেন। তাঁর ঘুম এসে গেল।
সুবল কীসের শব্দে জেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত জেবের ভিতর, পাখিটা পোষা এবং ভালোবাসার পাখিটা কী করছে দেখতে থাকল। চারিদিকে কোলাহল। ট্রেন বড় একটা স্টেশনে থেমে আছে। কেবল ফুঁসছে ট্রেনটা, সে জানালাতে মুখ রাখতেই দেখল, দেহাতি মানুষগুলো সারা রাস্তায় ট্রেন আটকে জল শুষে নিয়েছে, সেই মানুষগুলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। গোটা স্টেশনে একদল পুলিশ। দেখলে মনে হবে না ওদের এই মানুষগুলো সম্পর্কে কোনও কৌতূহল আছে। নির্বিকারভাবে যেন একদল বন্য মানুষকে ঘেরাও করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই পালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু হাতে বন্দুক, কিছু ফাঁকা আওয়াজ ওদের সন্ত্রস্ত করছিল।
সুবল এবার দ্রুত নেমে যাবার জন্য দরজা টানতেই দেখল দরজা খুলছে না। সে এবার কামরার ভিতরটা দেখল। এত কোলাহলের ভিতরও টুকুন এবং টুকুনের মা—বাবা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। সে ভেবে পেল না এখন কী করবে! সে পুলিশের ভয়ে, নিশ্চয়ই ওরা এসে দরজা খুলে ওকে ধরে নিয়ে যাবে, সে কী করবে ভেবে পেল না! নিশ্চয়ই ওরা এসে ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নামাবে। ওর ভয়ে কান্না পাচ্ছিল প্রায়।
ঠিক তখন টুকুন জেগে গেছে। এই সব শব্দে, টুকুন জেগে দেখল, সুবল দরজা খুলতে পারছে না। টুকুন বাবাকে দেখেছিল দরজা লক করে দিতে। সুতরাং সুবল দরজা খুলতে পারছে না। সে সুবলকে কিছু বলার জন্য উঠে বসতেই জানালায় দেখতে পেল একজন পুলিশ ওদের কামরার দিকে ছুটে আসছে। প্ল্যাটফরমে হইচই। মানুষের ছোটাছুটি, এবং কান্না। যারা জল চুরি করেছিল অথবা লুট করেছিল তাদের এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। টুকুন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ডাকল সুবল, সুবল। দরজা খুলবে না। দরজা খুললে ওরা ঢুকে পড়বে ঘরে।
সুবল বলল, আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে!
টুকুন বলল, তাড়াতাড়ি এদিকে এসো সুবল। বলে, সে বাংকের নীচে সুবলকে ঢুকিয়ে দিল। তারপর লম্বা চাদর দিয়ে পর্দার মতো একটা আড়াল সৃষ্টি করে সুবলকে অদৃশ্য করে দিল।
সুবল সব পোঁটলাগুলো শিয়রের দিকে রেখে দিল। জেবের ভিতর পাখিটা আছে, সুতরাং সুবল পাখিটাকে একটু আলগা করে রেখে দিল পাশে। পাখিটা এখন প্রায় জড় পদার্থের মতো যেন শীতে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে অথবা পাখিটার ঘুম পাচ্ছিল বোধহয়—খুব জড়সড়ো হয়ে সুবলের শিয়রে বসে রয়েছে। টুকুন তার বিছানার চাদরটা নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছে। টুকুন রুগণ এবং দুর্বল। টুকুন কোনওরকমে উঠে বসল এবং চাদর ঠিক মেঝের সঙ্গে মিলে আছে কিনা, সুবলের হাত পা এবং অন্য কোনও অংশ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য উঠে দাঁড়াল। টুকুন বড় দুর্বল, ক্ষীণকায়। সিল্কের দামি ফ্রক গায়ে ঢল ঢল করছে। শুধু সামান্য মুখে সতেজ সুন্দর চোখ কালো জলের মতো গভীর মনে হয়, বেদনার চিহ্ন এই চোখে। দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। টুকুন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাসটুকু পেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। সুতরাং টুকুন নিজে ধীরে ধীরে উঠে গেল এবং দরজা খুলে দিল—লম্বা এক পুলিশের মুখ, গোটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
টুকুন খুব আস্তে আস্তে বলল, কেউ নেই।
—কেউ তোমাদের কামরায় ঢুকে লুকিয়ে নেই তো?
—না।
—বড় জালাতন করছে এইসব দেহাতি মানুষগুলো।
টুকুন কোনও জবাব দিল না। কারণ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর এত দুর্বল যে, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে নীচে পড়ে যাবে। সে পুলিশের কথা প্রায় শুনতে পাচ্ছিল না। এটা প্রথম শ্রেণী, ওরা প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। পুলিশের গার্ড এসেছিল, স্টেশনমাস্টার এসেছিল, ওদের কামরাতে এইসব দেহাতি মানুষগুলো উপদ্রব করে গেছে কিনা, অথবা কোনও দুর্ঘটনার জন্য এই দেহাতি মানুষগুলো দায়ী কিনা অনুসন্ধানের চেষ্টায় আছে।
টুকুন এবার শক্ত গলায় বলল, এ ঘরে কেউ আসেনি গার্ডসাহেব। বলে, সে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বাংকে কোনোক্রমে ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আর অবাক টুকুন, কী বিস্ময় টুকুনের, আজ প্রথম কতদিন পর সে নিজে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে পেরেছে। সে কতদিন পর নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পেরেছে। সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মা—বাবা ঘুমুচ্ছেন। মা—বাবা দেখতে পেলেন না টুকুন নিজে উঠে বসেছে এবং নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। দরজা বন্ধ করেছে।
সে মা—বাবাকে ডাকেনি, কারণ মা—বাবা হয়তো ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে সব বলে দিতেন। হ্যাঁ, এসেছিল, সুবল এক পাখিয়ালা, সে পাখিয়ালা এসেছিল দলবল নিয়ে, সে তার দলবল নিয়ে এই ঘরের শেষ জলটুকু নিঃশেষ করে গেছে। মাকে হয়তো বোঝাতেই পারত না, সুবল এক পাখিয়ালা এসে টুকুন নামে এক রুগণ স্থবির বালিকার পায়ে শক্তি সঞ্চার করতে সাহায্য করেছে। টুকুন মাকে বাবাকে তার এই বিস্ময় দেখানোর জন্য ডাকল, মা, মা!
সে ডাকল, বাবা, বাবা!
ট্রেন চলছে। ভোর হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে আবার বড় মাঠ দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের তার দেখা যাচ্ছে। পাখিরা ভোরের আলোতে উড়ে যাচ্ছিল। এই মাঠ দেখলে এখন আর কোনও জলকষ্টের কথা মনে পড়ছে না। কিছুটা সবুজ আভা এখন দেখা যাচ্ছে। গ্রামে মানুষের চালাঘর, গোরুবাছুর এবং মাঠে সামান্য শস্য দেখা যাচ্ছিল। টুকুন খুব ধীরে ধীরে তখনও ডাকছে, মা, বাবা, দেখো দেখো। মা, বাবা, ওঠো ওঠো। দেখো তোমরা, তোমরা দেখো, টুকুন শুয়ে নিজের মায়ের ওপর কোমল হাত রাখল।
সুবল বাংকের নীচে চুপ মেরে শুয়ে আছে। এখন বের হলে যে কোনও আর ভয় নেই সে তা বুঝতে পারছে না। ওর ধারণা পুলিশ এখনও এই ট্রেনে দলবল নিয়ে ঘুরছে। সে এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটাকে পর্যন্ত হাতের ইশারাতে দুষ্টুমি করতে বারণ করে দিল। কারণ ভোর হয়ে গেছে বোধহয় আর খরা অঞ্চলের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে না। সে ট্রেনে শুয়ে শস্যের গন্ধ পেল। এই শস্যের গন্ধ পেয়ে পাখিটা কেমন শক্তি পাচ্ছে ভিতরে। ওর ফুর ফুর করে উড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে এত উত্তেজিত যে বাংকের নীচেই দু’বার ফুর ফুর করে উড়ে মাথায়—মুখে এসে সুবলের পাশে বসে পড়ল।
সুবল এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটার দুষ্টুমি ধরতে পেরে বাঁশের অন্য একটা চোঙ টেনে আনল সন্তর্পণে। তারপর পাখিটাকে চোঙের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। এবং মুখ বন্ধ করে বলল, বড় বজ্জাত পাজি তুই। বড় শহরে না গেলে তোমাকে আর ছেড়ে দিচ্ছি না।
টুকুন নিজের পায়ের ওপর চোখ রেখেছিল বিস্ময়ে! মা—বাবা উঠে গেছেন। টুকুন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আমি উঠে দরজা পর্যন্ত গেছি, দরজা খুলে দিয়েছি।
মা এত বিস্মিত যে কথা বলতে পারছিলেন না। বোধহয় টুকুন স্বপ্নের কথা বলছে।
—বাবা, পুলিশ এসেছিল।
বাবা টুকুনকে দেখতে থাকলেন। কথা বলতে পারছিলেন না।
—বাবা, সত্যি আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি। ওরা সুবলকে ধরতে এসেছিল। আমি বলেছি এখানে কেউ নেই।
বাবা এবার দরজার দিকে চোখ তুলে দেখলেন, দরজা তেমনি লক করা আছে। তিনি ভাবলেন টুকুন হয়তো কোনও স্বপ্ন দেখেছে। টুকুন স্বপ্ন দেখেছে কোনও মাঠ অথবা ওর প্রিয় লেবুতলায় সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীরের সমস্ত শিরা—উপশিরা শুকিয়ে আসছে। পায়ের কোথাও আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। কেমন ক্রমশ টুকুন স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোনও জায়গা নেই, বড় ডাক্তার নেই যেখানে তিনি টুকুনকে নিয়ে না গেছেন। হতাশা এখন সম্বল। মেয়েটা ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাবে তারপর সতেজ মুখে আর কোনও বিষণ্ণ ছবি ঝুলে থাকবে না। টুকুন মরে যাবে। বাবা তার এই স্বপ্নটুকু ভেঙে দিতে চাইলেন না।—বাঃ, বেশতো টুকুন, তুমি হেঁটে গিয়েছ, বাঃ, বেশতো। আমি তো বলেছি তুমি আজ হোক কাল হোক হাঁটতে পারবে। তুমি হেঁটে হেঁটে কোথাও না কোথাও চলে যেতে পারবে।
—বাবা, আমি হেঁটে হেঁটে এই বাংকে এসে শুয়ে পড়েছি। আমি সুবলকে পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছি, সব আমি বাবা নিজের হাতে করেছি। আমি পায়ে হেঁটে করেছি। বলে টুকুন ফের উঠে বাবাকে দেখাতে চাইল, আমি হাঁটতে পারি, মাকে দেখাতে চাইল, এই দেখ আমার পায়ে কেমন শক্তি, কিন্তু হায়, টুকুন শত চেষ্টা করেও পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারল না, অতীব আশার উত্তেজনা ওকে বড় অসহায় করে তুলছে। তবে কী সব ভোজবাজির মতো হয়ে গেল! টুকুন কত চেষ্টা করল। কতভাবে চেষ্টা করল। প্রাণে সকল আবেগ ঢেলে চেষ্টা করল, কিন্তু হায়, টুকুন কিছুতেই আর নিজের চেষ্টায় উঠে বসতে পারল না। টুকুন ভয়ঙ্কর হতাশায় ফের কেঁদে ফেলল, মা, আমার কিছু ভালো লাগে না, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, কোথাও আমি চলে যাব।
হায়, মেয়েটার দিকে এখন আর তাকানো যাচ্ছে না। সতেজ মুখে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। সাদা জামা, চোখের জলে ভিজে গেল। সারাজীবন ধরে কান্না। কী এক দুরারোগ্য ব্যাধি, কী এক অসীম হতাশা এই পরিবারকে ক্রমশ গ্রাস করছে। টুকুন ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। হাত—পা অচল হয়ে যাচ্ছে। ভিতরের শিরা—উপশিরা শুকিয়ে যাচ্ছে, রোগের কোনও কারণ নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
ট্রেন চলছিল। পাখি উড়ছিল আকাশে। লাইনের তারে কিছু শালিখ পাখি দেখতে পেল ওরা। কত গ্রাম—মাঠ ফেলে ট্রেন ছুটছে। জানালায় ছোট ছোট কুঁড়েঘর, বড় দিঘি, কালো জল, সবুজ মাঠ ভেসে উঠছিল। যত ট্রেন বড় শহরের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে তত লোকালয়, ইট—কাঠের বাড়ি, কারখানার চিমনি এবং লোহার পুল। সুবল বাংকের নীচে থেকে উঠে এলে দেখতে পেত সব। বোধহয় সুবল ফের ঘুমিয়ে পড়েছে বাংকের নীচে। সুবলকে ঘুমুতে দেখে পাখিটা চোখের ভিতর কিচমিচ করছিল। ছটফট করছিল ভিতরে। ফুর ফুর করে ওড়বার ইচ্ছা পাখির, পাখি কেন আর এখন চোঙের ভিতর থাকবে। দুষ্টু পাখি সুবলের কানের কাছে চোঙের ভেতর থেকে বের হবার জন্য কিচমিচ করে প্রায় কোলাহল জুড়ে দিল।
বোধহয় সুবল পুলিশের ভয়ে ঘাপটি মেরে আছে। নড়ছে না। পাখিটা চোঙের ভেতর থেকে ভাবছে সুবল ঘুমোচ্ছে। টুকুন ভাবছে সুবল ঘুমুচ্ছে। মা—বাবা এ—ঘরে সুবল আছে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কারণ এঁরা সুবলকে দেখতে পাচ্ছেন না। চাদরটা মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সুবলের হাত—পা—মুখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবটাই স্বপ্ন টুকুনের। সুবল, পাখিয়ালা সুবল চলে গেছে।
আর ঠিক তক্ষুনি সুবল চাদর ফাঁক করে কচ্ছপের মতো মুখ বার করে বলল, মা পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে নেই তো। মা, আমরা আর কতক্ষণ ট্রেনে? পুলিশ আমাকে ধরবে না তো! টুকুন শুয়ে শুয়ে বলল, তুমি কতদূর যাবে সুবল?
—আমি কলকাতা যাব দিদিমণি।
—সেখানে কে আছে সুবল?
—আপন বলতে কেউ নেই। বলে সুবল হামাগুড়ি দিয়ে চাদরটা সরিয়ে বের হয়ে এল। নোংরা জামাকাপড় বলে সে এক কোণায় মেঝের ওপর জবুথবু হয়ে বসল। সে দু’হাত জোড় করে বলল, মা, পাখিটা আমার বের হতে চাইছে। বের করব? পাখিটা একটু উড়তে চাইছে।
পাখিটা হেগে—মুতে দিতে পারে এই ভয়ে প্রৌঢ় মানুষটি কিঞ্চিৎ সংশয় প্রকাশ করছিলেন। নোংরা সুবলকে সহ্য করতে পারছিলেন না। যেখানে সুবল বসছে ঠিক সেখানেই নোংরা লাগাচ্ছে। কিন্তু টুকুন পাখির নাম শুনেই বলল, সুবল, তুমি এখন পাখি ছেড়ে দিলে মাঠে উড়ে যাবে?
—না দিদিমণি। পাখি আমার পোষা। পাখির মা নেই বাবা নেই, আমার মতো পাখির কেউ নেই। আমাকে ফেলে পাখি আর কোথাও যাবে না দিদিমণি।
—দেখি, কেমন যায় না!
—কেন দিদিমণি, তুমি দ্যাখোনি পাখিটা আমাকে কেমন সব পোকামাকড় ধরে দিয়েছে?
—তা দিয়েছে তোমার পাখি।
—তবে এই দ্যাখো। বলে চোঙের মুখ খুলে দিল সুবল। সেই পাখি সোনার ঠোঁটে কিচমিচ করে উঠল। পেটের দিকে সাদা রঙ, পাখা কালো আর ঘন সবুজ রঙ পাখির পায়ে। পাখিটা প্রায় নেচে নেচে বেড়াল সারা কামরায়। পাখিটা দেয়ালে উড়ে গিয়ে বসল, ওপরের বাংকে বসে উঁকি দিয়ে যেন গাছের ডালে বসে উঁকি দিচ্ছে তেমনি পাখিটা নীচে টুকুনকে দেখল। টুকুন পাখিটাকে দেখল, মাঠের ভিতর খোলা আকাশের নীচে এই পাখি কত সুন্দর দেখাত—সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা যাচ্ছে। যেন বলছে, দেখো দেখো খেলা দেখো, পাখি আমার খেলা দেখাবে, নাচবে, গাইবে, হাওয়ায় উড়বে, ষাঁড় গোরুর মতো, ভালুক অথবা বাঁদর নাচের মতো, সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা নগরীতে অন্নসংস্থানের জন্য যাচ্ছে।
পাখিটা জানালায় বসল, পাখিটা টুকুনের শিয়রে বসে লেজ নাড়ল। আর পাখিটাকে টুকুন সামান্য আপেলের টুকরো দিল খেতে। শিয়রে বসে টুকুনের হাত থেকে পাখিটা ফলের নরম অংশ ঠুকরে ঠুকরে খেল।
তখন সুবল বসেছিল নীচে। ওর পোঁটলার ভিতর লুকনো বটফল, একমুঠো ফল মুখে ফেলে দিয়ে চিবুতে থাকল। প্রায় যখন ফেনা উঠে গেছে মুখে তখন দলাটা কোঁৎ করে গিলে ফেলল সুবল। ফের একমুঠো, ফের ফেনা ওঠা পিষ্টক সে খেয়ে সামান্য পাখিটার জন্য রেখে দিল হাতে।
সুবলের এই নোংরা স্বভাব দেখে টুকুনের মা ঘৃণায় মুখ কোঁচকাল, ঘৃণায় একবার চেকারবাবুকে ডেকে বলবে কিনা ভাবল, এখন তো খরা অঞ্চল নেই, এখন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের ভয় কি! সুতরাং এবার প্রায় টুকুনের মা ধমক দিয়ে বলল, সামনের স্টেশনে তুমি বাপু নেমে যাবে।
সুবল বলল, তাই যাব মা। স্টেশনের কী নাম?
—স্টেশনের নাম ব্যান্ডেল।
—যাব মা। সেখান থেকে কলকাতা কতদূর মা?
অত কথা শুনতে ভালো লাগল না। কোথাকার কোনও এক মানুষ, উটকো মানুষ মা মা বলে একেবারে কামরাটাকে কদাকার করে তুলছে। সে বলল, মা, আমি তো আপনাদের কোনও অনিষ্ট করছি না।
টুকুন শুনছিল সব। সে দেখল সুবল ভয়ে কেমন চুপ মেরে গেছে। সুবল ওর সব সম্বল নিয়ে এসেছে বলে পোঁটলা খুলে দেখল, ছোট ছোট পোঁটলার কোনোটায় চন্দনের বীচি, কোনোটাতে পুঁতির মালা।
তার মা একবার মেলা থেকে একটা পুঁতির মালা কিনে দিয়েছিল আর রঙবেরঙের সব পাথর, সে সেইসব পাথর পাহাড়ের নুড়িপাথর থেকে সংগ্রহ করেছে। সে কিছুই ফেলে না। যা ভালো লাগে, যা কিছু ভালো লাগে—সবই সঞ্চয়ের সামিল এই ভেবে সব সে সঞ্চয়ের ঝুড়িতে জমা রেখে দিত। চন্দনের বীচি, কুঁচফল এবং ভিন্ন ভিন্ন পাথরের উজ্জ্বল রঙ টুকুনকে পুলকিত করছিল। টুকুন মাকে ভয় পায়, মা সুবলকে নেমে যেতে বলেছেন, টুকুনের কষ্ট হচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল টুকুনের, কারণ সুবলের কেউ নেই—কত আর বয়েস সুবলের, সে সময় পেলে পাখির খেলা দেখায়। অথবা কোনও কোনও সময় ঋষিপুত্রের মতো মনে হয় যেন সুবলকে, সবচেয়ে বড় আশ্চর্য, সুবলের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল। যেন এক দৈবশক্তি ভর করেছিল টুকুনের পায়ে। অথবা সুবল মন্ত্র—টন্ত্র পড়ে টুকুনকে হাঁটতে সাহায্য করেছে। এই সুবল চলে গেলে সে সত্যই পঙ্গু হয়ে যাবে। আর কোনওদিন সে হেঁটে গিয়ে জানালায় দাঁড়াতে পারবে না, কোনওদিন সে খোলা আকাশের নীচে আর দৌড়তে পারবে না।
তিন
তখন খোলা আকাশের নীচে একটা গাছ, কী গাছ হবে, চড়ুইগাছ অথবা অর্জুন গাছ হতে পারে। গাছে পাতা নেই, রোদ এসে মুখের ওপর পড়ছে, প্রথমে মনে হচ্ছিল কেউ অন্ধকার রাতে ওর সামনে আলো বহন করে এনেছে, সে সচকিত হয়ে চোখ খুলল, মাথার ওপর প্রখর রোদ, সামনে খোলা মাঠ, শুধু ধুধু করছে মাঠের রোদ। ঝিল্লির আঁকাবাঁকা রেখা দিগন্তে পাখির মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মরীচিকার মতো মনে হচ্ছিল। বৃদ্ধ পুরোহিত প্রথমে শরীরের আলখাল্লা খুলে ফেললেন। মরীচিকার মতো এই জলের চিহ্ন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, মাঠ পার হয়ে হয়তো আকাশের নীচে কোথাও কোনও মেঘের টুকরো উঠে আসছে, তিনি জলের সন্ধানে এই মরুভূমির মতো প্রান্তরে ছুটতে থাকলেন। তাঁর কোনও জ্ঞান ছিল না। তিনি প্রায় পাগলের মতো ছুটে চলেছেন, যদি কোথাও কোনও জলের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।
আর তিনি ঠিক নীচে এসে যেখানে গতকাল মানুষেরা নদীর ঢালুতে জল অনুসন্ধান করে গেছে, সেখানে থমকে দাঁড়ালেন। দক্ষিণ অঞ্চল থেকে একটি ছোট্ট পাহাড়ের শিরা বের হয়ে এসেছে। দু’দিকে পাহাড়ের উপত্যকা গিরিখাতের মতো সৃষ্টি করেছে। তারই নীচে ছোট পাতকোর মতো গর্ত। বালুর পাহাড় চারধারে। একের পর এক এই সব গর্ত গতকাল তাঁর দলের মানুষেরা করে গেছে। কোনও গর্তেই জল নেই তিনি তা জানতেন। শুধু দূরে দেখলেন তিনটি ছোট ছোট প্রাণী একটা গর্তের চারধারে কেবল ঘুরছে। এই খরা অঞ্চলে, জলের অভাবের জন্য যেখানে কোনও পাখপাখালি পর্যন্ত নেই, যেখানে কোনও কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না, সেখানে এমন তিনটি প্রাণী দেখে বিস্মিত হলেন।
তিনি যত এগুচ্ছিলেন তত এইসব ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে কেমন চঞ্চল দেখাচ্ছিল। কাছে গেলে বুঝতে পারলেন দুটো হরিণ শিশু জলের জন্য পাশের সংরক্ষিত বন থেকে এখানে ছুটে এসেছে। ওঁকে দেখে তারা ছুটে পালাল না! শুধু সামান্য লাফ দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল। তিনি গর্তের পাশে দাঁড়ালে আরও বিস্মিত হলেন—একটা বড় হরিণ গর্তের ভিতর পড়ে গেছে, হরিণটার হাঁটু পর্যন্ত জল, সে তার শিশুদের জল দেবার জন্য নীচে লাফিয়ে পড়েছে। আর উঠতে পারছে না। কেবল ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃদ্ধকে দেখে কেমন কঁকিয়ে কঁকিয়ে একটু শব্দ করল তারপর বৃদ্ধকে অপলক দেখতে থাকল।
তিনি এবার হরিণ শিশুদের অতিক্রম করে সেই গর্তে নেমে গেলেন। নীচে নেমে হরিণটাকে পাড়ে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর আলখাল্লাটা জলে ভেজালেন। হরিণী একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে। জলের পিপাসা ওদের এত বেশি যে, ওরা জল খাবার জন্য ঝুঁকে পড়ছিল গর্তে। প্রাণের মায়া ছিল না। বৃদ্ধ আলখাল্লা ভিজিয়ে জল তুলে আনলেন। একটু একটু করে তিনি সেই তিনটি শিশুকে আলখাল্লা চিপে জল খেতে দিলেন। ওরা জল খেল, লাফাল, তারপর হরিণীর সঙ্গে সেই বনের দিকে ছুটে যাবার জন্য পাহাড়ের কোলে উঠে গেল।
যতক্ষণ না ওরা তিনজন হারিয়ে গেল ততক্ষণ বৃদ্ধ সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এখন আর যেন কিছু করণীয় নেই। বালির নীচে চোরা স্রোত, এই স্রোতের সন্ধান যদি তিনি গতকাল পেতেন তবে বুঝি এইসব অঞ্চলের অন্তত কিছু কিছু মানুষকে শস্য এবং সুদিনের আশ্বাস দিয়ে ধরে রাখতে পারতেন। কিন্তু হায়, ওরা এখন সব বিবাগী। ওদের ছোট ছোট কুঁড়েঘর পড়ে আছে। পাহাড়ি উপত্যকাতে এই সময় অন্যান্য বছর যখন বর্ষার জলে মাটি ভিজতে থাকে তখন এক মেলা হয়, উৎসব হয়, উৎসবে তিনি প্রধান মানুষ। এই উৎসব শস্যের জন্য, সম্পদের জন্য, কতকাল থেকে পৈতৃক এই ব্যবসা তাঁর। সকলের বিশ্বাস এখন তিনিই একমাত্র মানুষ যার মন্ত্রের উচ্চারণে আর তেমন শক্তি নেই। হোমে তিনি যে বিল্বপত্র দান করেন এখন তা আর তেমন পবিত্র নয়—নিশ্চয় কোথাও না কোথাও তিনি তাঁর পবিত্র জীবন থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের দায়ভাগ তাঁর ওপর।
বৃদ্ধ পুরোহিতের নাম জনার্দন চক্রবর্তী। তিনি জলের ভিতর তাঁর মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। চোখে—মুখে অবসাদ, বড় বড় দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে, তিনি ক্রমশ কেমন বন্য জীবের মতো হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে বনমানুষের মতো মনে হচ্ছে। তিনি রোদের জন্য ওপরে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তিনি উলঙ্গ হলেন এবং হাঁটুজলে নেমে শরীরে মুখে জল ঢেলে দিলেন। সমস্ত ক্লান্তি এবং অবসাদ শরীরের ক্রমশ কেমন উবে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিন পর ঠান্ডা জলের এই স্নান তাঁকে সুখী এবং তাজা যুবকের মতো ফের সেই পুরানো মন্দিরে উঠে যেতে প্রেরণা দিচ্ছে। তাঁর সেই স্বপ্নের কথা মনে হল, জলের জন্য অনুসন্ধান, স্বপ্নে কে যেন বলল—অনুসন্ধান কর, কোথাও না কোথাও নদীর ঢালুতে চোরা স্রোত রয়েছে, তুমি তাই খুঁজে বের কর।
সে আবার চিৎকার করে উঠল, মা সুবচনী, তোর জয় হোক! কিন্তু মা তোর মনে কী এই ছিল? তোর মাটিতে মা ফসল ফলে না, তোর মাটিতে মা আর পালা—পার্বণ নেই, সব খা খা করছে, সব জনহীন প্রাণীহীন মা, আমি এখন এই জলে কী করব মা। তোর জলে তুই ডুবে মর। তুই ডাইনি। সকলের হাড়—মাংস খেয়ে তুই সুবচনি এখন ধেই ধেই করে নাচছিস।
জনার্দন পাড়ে উঠে আলখাল্লা এবং পরনের কাপড়টা কাঁধে ফেলে একবার চারিদিকে তাকালেন। কবে সব মানুষজনদের নিয়ে তিনি জলের সন্ধানে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে চলে এসেছিলেন, এখন যেন আর তা মনে পড়ছে না। ভালোবাসার মাটি সকলে ছেড়ে চলে গেলে কী আর থাকল। জনার্দন, এই মাটি ছেড়ে সকলে কোথাও চলে যাবে ভাবতেই জলের জন্যে হতাশ হয়ে মরছিল। পাড়ে উঠে দেখল—তাঁর আবাস অনেক দূর। এত দূর তিনি হেঁটে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে এই খরার রোদে। তিনি বালুর ওপর আর পা রাখতে পারছিলেন না, সূর্য যত ওপরে উঠে আসছে তত পায়ের নীচের উত্তাপ প্রখর মনে হচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি কোনও নিকটবর্তী গ্রামে উঠে যাবার জন্য প্রায় ছুটে চললেন। পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে এখন অন্তত সময়টা কাটিয়ে বেলা পড়ে এলে পর ছোট পাহাড়ে চলে যাবেন।
গ্রামের ভিতর ঢুকতেই জনার্দনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখন আর এখানে মানুষের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয় কদমফুল গাছটা মরে গেছে। পুকুরের মাটি ফেটে গেছে। সব কেমন জ্বলেপুড়ে খা খা করছিল। কোথা থেকে পচা দুর্গন্ধ আসছিল। জনার্দন ছোট একটা কুঁড়েঘর দেখে ভিতরে ঢুকে গেলেন। বস্তুত জনার্দন ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন দরজার পাশে একটা ছেঁড়া গামছা ঝুলছে এবং বাতাসে গামছাটা নড়ছিল। জনার্দন ভয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লেন। মনে মনে বললেন, মা সুবচনি, এত ভয় কেন প্রাণের জন্য। কীসের ভয় মা। আর তো কেউ নেই মা। আমি পুত্র—কন্যাবিহীন। শুধু এক অহঙ্কার ছিল মা। অহঙ্কার আমার এই উপবীতের। তিনি তাঁর উপবীতে হাত রাখলেন। পুরুষানুক্রমিক এই উপবীত, উপবীতের অহঙ্কার, কে যেন হেঁকে গেল মাঠে, ঠাকুরমশাই, মেয়ের বিয়ে কোন মাসে দেব, ঠাকুরমশাই মাথা চুলকে কী দেখলেন, তারপর বইয়ের পাতায় কী পড়লেন, শেষে বলে দিলেন, সাতাশে শ্রাবণ। সন্তানের কী নাম হবে, তিনি নাম বলে দিতেন, পুত্র হবে না কন্যা হবে, তিনি বলে দিতেন, কবে জমিতে ধান চাষ হবে—তিনি বলে দিতেন, কালবৈশাখীর ঝড় থেকে রক্ষার জন্য ভৈরব পূজা দিতেন। বৃষ্টি না হলে হোম করতেন। সময়ে অসময়ে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ত। জলে ভেসে যেত মাটি। লাঙল কাঁধে তুলে সুবচনির মন্দিরে চাষি মানুষেরা যেত, তিনি লাঙলের ফলাতে সুবচনির তেল সিঁদুর মেখে দিতেন, গৃহস্থগণ চাষ করে আপন ঘরে সম্বৎসর সোনার ফসল তুলত।
জনার্দন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলেন। ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ, ঘরের ভিতর একটা ছেঁড়া বালিশ—তিনি তার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। দিনের বেলাতে আর বের হওয়া যাবে না বোধ হয়, চারিদিকে লু বইছে। মাথায় মুখে কাপড় জড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। তিনি স্থির করলেন, দিনের বেলাতে সুবচনির মন্দিরে নিদ্রা যাবেন, রাতের বেলাতে উঠে খাদ্য অন্বেষণ এবং অন্যান্য কাজ, কী করে এই মাটিকে উর্বর করা যায়, কী করে ফের মন্ত্রের অমোঘ শক্তিতে বৃষ্টিপাত ঘটানো যায়, সে সবের চেষ্টা।
কারণ জনার্দন ঠাকুরের মন্ত্রের ওপর জনগণের বড় বিশ্বাস ছিল। এই অঞ্চলের দেবী সুবচনি, এই অঞ্চলের রক্ষার দায়িত্ব তাঁর। আর জনার্দন ঠাকুর পুরুষানুক্রমিক দেবীর সেবাইত। পুরুষানুক্রমিক বিশ্বাস, অঞ্চলের মানুষদের বিষয় সম্পর্কে জনার্দন ঠাকুর—প্রায় যেন ঈশ্বরের কাছের মানুষ। অশিক্ষিত গ্রাম্য এবং পূর্ণিয়া অথবা বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ এরা। কিছু পাহাড়ি আদিবাসী। কিছু বাঙালি। ভাষা, বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের। বড় গরিব মানুষগুলো। যা ফসল ফলত মাঠে, ওরা সোনার ফসল ভেবে নিত। এভাবে ওদের বছরের পর বছর কেটে গেছে। জলের কষ্ট ছিল, কিন্তু জলের অভাবে গোরু—বাছুর মরে যায়নি, অন্নের কষ্ট ছিল মানুষের—কিন্তু কেউ অনাহারে থাকে না। মা সুবচনি, বড় জাগ্রত, বড় লক্ষ্য তাঁর সন্তানের ওপর।
বিস্তীর্ণ পাহাড় আছে, শাল—শিমুলের গাছ আছে, বনে পাখি আছে, হরিণ আছে, আর কত রকমের মূল আছে গাছের যা তুলে ক্ষুধায় খেলে অন্নকষ্ট দূর হয়, শরীরে শক্তি সঞ্চার হয়। গৃহস্থের সোনার ফসল, গরিবের মুনিষ খেটে খাওয়া, কাজ না থাকলে, বনে—পাহাড়ে ঘুরে বেড়াও সকল অন্নকষ্ট দূর হয়ে যাবে। তেমন অঞ্চলে পর পর তিন বছর খরা গেল—সকলে দুঃস্বপ্ন দেখল—বুঝি এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নিচ্ছে।
সুতরাং মানুষেরা যাদের সহায়—সম্বল আছে তারা শহরে চলে গেল, মড়কে কিছু লোক সাফ হয়ে গেল আর বাকি যারা ছিল এতদিন তাদের জনার্দন ঠাকুর নানারকম আশ্বাস দিয়ে ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু হায়, কোথাকার এক ট্রেন এসে তাদেরও নিয়ে চলে গেল। জনার্দন দুঃখে হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তবু হায়, জনার্দন ঠাকুরের এই মাটির জন্য আশ্চর্য এক ভালোবাসা। এমন মাটি, ভালোবাসার মাটি, কোথাও যেন তাঁর নেই। তিনি এখানে রাজার মতো ছিলেন, মানুষের কাছে তিনি এখানে পিরের মতো। সেই মানুষেরা চলে গেছে। সেই সব ভালোবাসার মানুষেরা চলে গেছে। তিনি তাদের আর কিছুতেই বুঝি ফেরাতে পারবেন না। তাঁর বাপ—পিতামহের গল্প, দেবীর সব পৌরাণিক ইতিহাস, এবং যা চমকপ্রদ, ঈশ্বরপ্রাপ্তির প্রবাদ এই মাটির সঙ্গে মিশে আছে। কেউ আর স্মরণ করবে না, জনার্দন ঠাকুরের পরিবার দশ পুরুষ আগে পূর্ববাংলার কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে এখানে সুবচনি দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন এত লোকালয় ছিল না, দেবীর আশীর্বাদ পাবার লোভে মানুষেরা এই পাহাড়ের নীচে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর থেকে এই জনার্দন এবং তাঁর পরিবার পৌরাণিক ধর্ম বিশ্বাসের মত।
জনার্দন ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে ফের উপবীতে হাত রেখে বিড় বিড় করে কী যেন আওড়ালেন, যেন তিনি শপথ করছেন। কীসের শপথ স্পষ্ট বোঝা গেল না। তবু তাঁকে দেখলে মনে হল আমৃত্যু এই মাটির সঙ্গে তাঁর লড়াই। দেবীর সঙ্গে তাঁর লড়াই। ঊষর এই দেশকে উর্বর করে তোলার জন্য তাঁর সংগ্রামকে বড় স্বাস্থ্যকর মনে হবে। কিন্তু তাঁর মুখের ছবি, চোখের দৃঢ়তা এবং উপবীতের অহঙ্কার তাঁকে যেন বড় এক লম্বা দৈত্যের মতো বড় করে ফেলেছে! ভয়ঙ্কর খরা, বাইরের লু আর ঊষর প্রকৃতি তাঁকে নিরস্ত করতে পারল না।
শরীর—মন—প্রাণ শক্ত করার জন্য তিনি বিড়বিড় করে দেবী সুবচনির পাঁচালি পড়তে থাকলেন, সুবচনি মায় বাড়ি বাড়ি যায়, বাড়ি বাড়ি গেলে মায় আমার ধান্য—দূর্বা পায়। আরও কী বলার ইচ্ছা যেন। যেন বলার ইচ্ছা মা, তোর এত ছেলে আছে, আর তুই তোর মাটির ছেলেদের সব একসঙ্গে গ্রাস করে ফেললি! জনার্দন চিৎকার করে উঠলেন, সুবচনি মায়গ আমার বড় দয়াময়, ছেলে কোলে লইয়া ঘোরে পাড়াময়। জনার্দন আবছা অন্ধকারের ভিতর উঠে বসলেন, বললেন, তুই যদি দয়াময়ী হস মা, তবে তোর এই রাক্ষুসী মুখ দেখতে পাচ্ছি কেন?
তখন সারা মাঠ খা খা করছিল। চিতার মতো জ্বলছে গ্রাম—মাঠ গাছগাছালি। জনার্দন পরিত্যক্ত এক কুঁড়েঘরে বসে আছেন। তিনি ভিজা আলখাল্লাটা গায়ের ওপর রেখে দিয়েছিলেন, এখন সেই আলখাল্লা এবং কাপড় দুই—ই শুকিয়ে প্রায় শক্ত কাঠ।
তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বিশ—ত্রিশ ক্রোশ হেঁটে শহরের দিকে চলে যাবেন—কিন্তু যা খবর সেখানেও লোক নেই। লোক সব শহর—গঞ্জ ছেড়ে দিচ্ছে। সরকার থেকে যা সামান্য সাহায্য আসছে তাও বন্ধ। সরকার থেকে যে পাতকুয়া গ্রামের মাঠে কাটা হয়েছিল, তাতে জল নেই। সুতরাং জনার্দন ক্রমশ ভেঙে পড়ছেন। ওঁর প্রবল আবেগ, ঊষর জমি উর্বর করে তোলার আবেগ ক্রমশ মরে যাচ্ছিল। কারণ সর্বত্র এই হাহাকারের দৃশ্য—জনার্দন এবার পাগলের মতো দরজা খুলে দিলেন এবং তপ্ত মাঠের ওপর দিয়ে লু—এর ভিতর দিয়ে শ্মশানের মতো এক সাম্রাজ্য শুধু চারিদিকে—জনার্দন চোখ—মুখ বন্ধ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ছুটছেন।
চার
তখন ট্রেনটা ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে ছাড়ব ছাড়ব করছে। সুবল কামরা থেকে নেমে গিয়েছিল, নেমে গিয়ে দেখল বড় একটা চোঙ দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে যেন জল পড়ছে। এত জল! সে অবাক হয়ে তাকাল পশ্চিমের দিকে, সেখানেও বড় একটা চোঙ থেকে জল পড়ছে আকাশ থেকে। এত জল। সুবল দেখল নীচে ছোট ছোট টিপকল, কেবল জল আর জল। সে তাড়াতাড়ি পোঁটলাপুঁটলি রেখে জলে স্নান করে নিল। জল আর জল। চোখ—মুখে জল পড়তেই শরীরের সব অবসাদ কেটে গেল। যেন সমস্ত শরীরে ঈশ্বর তাঁর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ দিচ্ছেন। সে কলের নীচে শুয়ে বসে লাফিয়ে স্নান করল। ওঃ, কী ঠান্ডা জল! ওঃ কী আরাম!
কিন্তু একজন নীল উর্দিপরা লোক এসে হেঁকে উঠতেই সে ভয়ে ভয়ে কলের নীচ থেকে বের হয়ে গা—শরীর মুছে যখন প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছিল তখনও ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। জেবের ভিতর পাখিটা আছে কিনা দেখে নিল সুবল, তারপর ছুটে গিয়ে সেই কামরার জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁকল, টুকুন দিদিমণি, আমি স্নানটা সেরে নিলাম।
সুবলের মুখ কী সতেজ, আর কী এক গ্রাম্য সরলতা—আশ্চর্য সরল চোখ সুবলের। স্নান করার জন্য চুল থেকে এখনও টুপটাপ জলের ফোঁটা মুখে শরীরে পড়ছে। সেই লম্বা জামা গায়ে, পোঁটলাপুঁটলি কাঁধের দু’ধারে ঝোলানো—প্রায় তীর্থযাত্রীর মতো দেখতে। একটা শুকনো ডাল হাতে এবং বাঁশের চোঙটা পিঠের ডানদিকে ঝুলছিল।
টুকুন ওর সরল গ্রাম্য চোখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, সুবল, তুমি কলকাতায় গেলে আমাদের বাড়ি এসো।
—যাব দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা কোথায় সুবল?
—পাখিটা জেবের ভিতর বটফল খাচ্ছে দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা আর একবার উড়বে না?
—উড়বে না কেন? বলে সে হাত দিল পকেটে। তারপর পাখিটাকে কাঁধে বসিয়ে দিল। তারপর এই প্ল্যাটফর্মে পাখিটা সুবলের মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে জেবের ভিতর ঢুকে গেল।
টুকুন বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে গেলে আমি আবার পাখির খেলা দেখব। বলতেই ট্রেন—টা ছেড়ে দিল। সুবল গাড়িটার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গেল। সুবল, টুকুন দিদিমণিকে একটা চন্দনের বীচি, একটি পাথর এবং সেই দুর্মূল্য কুঁচফল দেবে ভেবেছিল, এত তাড়াতাড়ি ট্রেন ছেড়ে দেবে তার মনে হয়নি। সে পোঁটলা খুলে দিতে গিয়ে দেখল ট্রেনটা সামান্য চলছে। সে পোঁটলা থেকে চন্দনের বীচি একটি পাথর ও সেই দুর্মূল্য কুঁচফল বের করে গাড়ির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টুকুনের হাতে দিল। সে দাঁড়িয়ে থাকল। চারদিকে অপরিচিতি জন, পাখিটা জেবের ভিতর খুঁটে খুঁটে কেবল ছোলা খাচ্ছে, আর একটা ট্রেন এসে এই মাত্র থামল প্ল্যাটফর্মে। সব মানুষেরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামছে কিন্তু বড় নির্জন মনে হল জায়গাটা। যেন সেই পরিত্যক্ত মাঠ এবং পাহাড়ের মতো এই প্ল্যাটফর্মে শুধু হাহাকারের দৃশ্য। কোথাকার একটা ট্রেন তার প্রিয় দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল।
সুবলের দীর্ঘদিন পর আজ মা’র কথা মনে হল। মেলার কথা মনে হল। সুবচনি দেবীর মন্দিরে ফসল ঘরে এনে যে উৎসব হত তার কথা মনে হল—সে মেলায় বিদেশ থেকে কত লোক আসত, বাজিকর আসত, সাপের পেটে মানুষের মুখ, একটা মানুষের তিনটে মুখ, তিনটে মানুষের একটা মুখ, বড় বড় কাচের বৈয়াম, আর তার ভিতর কিম্ভূতকিমাকার সব মানুষ, অথবা মাঠের শেষ দিকে বড় তাঁবু, সার্কাসের খেলা, হাতি, বাঘ, সিংহ, একটা মেয়ে তারে ঝুলে খেলা দেখাত। একটা ট্রেন গাড়ি তার টুকুন দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল—এসব দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকল সুবলের। আর একটা ট্রেন এসে থেমেছে। ট্রেন চলে যাবে এবার। সুবল ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে বসে ওর পোঁটলাগুলো ফের বেঁধে নিল। তারপর যাকে সামনে পেল তাকেই শুধাল, এই ট্রেন কর্তা, কলকাতা যাবে না?
কে যেন বলল, যাবে।
সে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনে উঠে গেল। ট্রেনটা নীল রঙের। বড় হাতল ঝুলছে। সুবল বয়েস অনুযায়ী লম্বা এবং পায়ের পেশী পাহাড়ে ওঠানামার জন্য বড় শক্ত। সে এক পাশে ভিড়ের ভিতর একটা হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন আর মনে কোনও গ্লানি নেই। ট্রেনটা ওকে কলকাতা নিয়ে গেলে সে টুকুন দিদিমণির কাছে চলে যেতে পারবে।
আর এ—সময়ই সুবলের মনে হল ভীষণ ক্ষুধা পেটে। সে তার সঙ্গের শুকনো বটফল থেকে একটা দুটো করে মুখে পুরে দিতে থাকল। সে বটফল চিবুচ্ছে আর দু’পাশের বড় বড় কলকারখানা দেখে কেবল বিস্মিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও এক রাজার দেশে চলে এসেছে। যেন এখানে অন্নের অভাব নেই। অন্ন চাইলেই অন্ন। জলের অভাব নেই, জল চাইলেই জল। আর ভালোবাসার অভাব নেই, টুকুন দিদিমণি রাজ্যের সব ভালোবাসা তার জন্য সঞ্চয় করে রেখেছে। তার মনে হল, কলকাতায় পা দিলেই সে রাজা বনে যাবে।
সুবল দেখল তার গাড়ি আশ্চর্য এক নগরীর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সে চোখ মেলে যত দেখছে তত বিস্মিত হচ্ছে। বড় আশ্চর্য এক নগরী, চারিদিকে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি, সেই সুসনের রাজবাড়ির মতো, কবে একবার বাবা তাকে রাজবাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, কবে একবার সে ছোট বেলায় গল্পের বইয়ে রাজবাড়ির গল্প পড়েছিল, চারিদিকে বড় বড় অট্টালিকা, চারিদিকে বাঁধানো রাস্তা। বড় বড় দেবদারু গাছ, গাছে গাছে রুপোর পাতা, সোনার ফল, নীচে বনের ভিতর সোনার হরিণ—এ যেন সেই রাজার দেশ, লাইনের ওপর তার, আর আশ্চর্য এক লম্বা ঘরের ভিতর তার গাড়ি ঢুকে গেছে, নানারকমের নীল লাল রঙের বাতি, বেগুনি রঙের বাতি, কত হাজার হাজার লোক, সব রাজবাড়ির রাজপুত্রদের মতো ফিটফাট, কোথাও কোনও অপরিচ্ছন্নতা নেই, ঝক ঝক করছে সবকিছু।
অথচ কেউ দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত গল্প করছে না, সকলে নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। সকলে ব্যস্ত। সকলে যেন কোথাও কোনও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছে। অথবা কোথাও বড় এক রাজবাড়ি আছে, সকলে সেই রাজবাড়ির উদ্দেশে ছুটছে।
সুবল ভিড়ের ভিতর দেখল ডান পাশের লোহার গেটে চেকারবাবু কার সঙ্গে পয়সার হিসাব করছেন গোপনে, মনে হল, চেকারবাবুর হাতে কে পয়সা গুঁজে দিল। সুবল দাঁড়িয়ে থাকল। ওর কাছে পয়সা নেই, টিকিট নেই। এখন টুকুন দিদিমণি নেই যে ওকে গেট পার করে দেবে। এই লোহার দরজাটার কাছে এসেই সুবলের ভয়ে পা সরছিল না। সে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, ভিড় কমলে চেকারবাবুকে বলবে, বাবু আমার পয়সা নেই, আমার কিছু বটফল আছে, কিছু পাথর আছে আর আছে এক পাখি। আমি বাবু আমার পাখির খেলা দেখাতে পারি। বাবু পাখির খেলা দেখলে আপনি খুশি হবেন। খুশি হলে বাবু ওকে ছেড়ে দেবে এই ভেবে সুবল একটু পিছনের দিকে সরে তাকাতেই দেখল—ট্রেন, মেলা ট্রেন, কেবল ভোঁস ভোঁস করছে ট্রেন। মানুষ আর লটবহর চারিদিকে। লোহার রেলিং পার হলে ফলের দোকান। চারিদিকে এত প্রাচুর্য, এত সম্পদ, এত মানুষ, এত জল—সুবল ক্রমশ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ছে।
তখন চেকারবাবু ডাকলেন, এই ছোকরা, ওখানে কী হচ্ছে। টিকিট কোথায়?
—বাবু টিকিট নেই।
চেকারবাবু দেখলেন সুবলকে এবং চেহারা দেখে না হেসে পারলেন না। ভিখারির মতো জামাকাপড় গায়ে কতরকমের পোঁটলা ঝুলছে কাঁধে, হাতে লাঠি এবং পিঠে বাঁশের চোঙ। একেবারে বহুরূপী।
অন্য চেকারবাবু বললেন, ঠিক শালা খরা অঞ্চলের লোক। উপদ্রব বাড়ছে।
—কী করে হবে! ওরা তো দল বেঁধে আসছে। এ তো একা।
—দল ছুট। দেখে বুঝতে পারছ না?
সুবল দেখল বাবু দু’জন ওকে দেখে খুব হাসাহাসি করছে। সুবল যেন সাহস পেল এবার। কাছে গিয়ে বলল, বাবু আমাকে ছেড়ে দিন। আমার পয়সা নেই। এই দেখুন বলে সে তার জেব উলটে দেখাতে গেলে পাখিটা উড়ে এসে ওর মাথার ওপর বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে চেকারবাবু দু’জন বলল, শালা ভোজবাজি জানে। জেব উলটে পয়সা নেই দেখাতে গেল আর শালার জেব থেকে পাখি উড়ে এসে মাথায় বসল। পয়সার বদলে পাখি!
চেকারবাবু বললেন, খুব তো ভোজবাজি শিখেছ।
—না কর্তা। কোনও ভোজবাজি নেই। পাখি আমার পোষা। ও জেবের ভিতর থাকে। খুব নাছোড়বান্দা না হলে চোঙের ভিতর ভরে রাখি না। বলে সে পিঠ থেকে বাঁশের চোঙা এনে উলটে দেখাল। তারপর একটু হেসে খুব বিনীতভাবে বলল, যাব কর্তা? শুকনো বটফল ছিল পোঁটলাতে, কথা বলতে বলতে দুটো একটা বটফল মুখে পুরে দিচ্ছিল।
এখন যথার্থই যেন সুবলের কোনও ভয় ছিল না। কোনও ডর ছিল না। চেকারবাবুরা ওকে কোনও আর ভয়ও দেখাচ্ছে না, কেমন আলগা করে পথ ছেড়ে দিলেন। সুবল পাখির খেলা দেখানোর জন্য চেকারবাবু দু’জন বোধহয় খুশি। সে প্রায় চুপি চুপি বের হয়ে সোজা স্টেশনের কাউন্টার পর্যন্ত হেঁটে এল। প্রায় মুক্ত এখন সুবল। সে ঘুরে ফিরে এতবড় স্টেশন দেখতে থাকল। চারদিকের এই প্রাচুর্য ওকে জীবনযাপন সম্পর্কে আর কোনও ভয়ের উদ্রেক করতে পারল না। যখন এত প্রাচুর্য, এত জল আর এত সুখী মানুষের ভিড় তখন সামান্য এক সুবলের আহারের জন্য ভাবনা কী। সে প্রায় লাফিয়ে হাঁটতে থাকল, ঘুরতে থাকল এবং ছবির মতো, রাজারানির মতো আর নদীর জলের মতো পরিচ্ছন্ন এই স্টেশনের চারদিকটা দেখতে পেয়ে সে আনন্দে প্রায় শিস দিয়ে উঠল।
কোনও গ্রাম্য সংগীত ও শিসে বাজাচ্ছিল। আর ওর মুখের শিস শুনে পাখি পর্যন্ত আত্মহারা। পাখি এবং সুবল এমন একটা দেশে চলে এসেছে—এমন প্রাচুর্যের দেশ, ভাবল সে। বাইরে বের হতেই দেখল বড় বড় দোতলা সব বাসগাড়ি, ট্রামগাড়ি দৈত্যের মতো—সেই যেন আলাদীনের প্রদীপ, যা চাওয়া তাই পাওয়া যায়। আলাদীনের পোষা দৈত্যের মতো সব ট্রামগাড়ি, বাসগাড়ি সুবলের জন্য এবং ওর পাখির জন্য প্রতীক্ষা করছে। সুবল বলল, রোস। আমরা আসছি। কারণ ডানদিকে কিছুদূর হেঁটে গেলে জল, টিপকল থেকে কেবল জল পড়ছে।
সে জলের নীচে ফের ছুটে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিকে জল খাওয়াল, স্নান করাল। এবং শান্তশিষ্ট বালকের মতো সে তার ভিজা নেংটি কাপড়, জামা সব রেলিঙ—এ শুকোতে দিলে।
এখন নদীর জলের ওপর সব বড় জাহাজ ভাসছে, কোথাও আকাশের নীচে লম্বা ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়ি, ডানদিকে বড় একটা পুল, মাথায় সারি সারি সব পাখি বসে রয়েছে আর সব ঠেলাগাড়িতে আলু, ফুলকপি, শাকসবজি হরেক রকমের কত তরমুজ এবং ফল যাচ্ছে। সে অপলক দেখতে দেখতে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতের কথা ভাবল। তিনি সামান্য জলের জন্য কী না করেছেন। পাগলের মতো পাহাড়ের নীচে, সমতলভূমিতে, নদীর ঢালু অঞ্চলে এবং পাহাড়ের গিরিপথে জলের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। হায়, যদি মানুষরা কলকাতার এত প্রাচুর্যের কথা জানতে পারত। তা হলে বুঝি তিনি সব ফেলে, তাঁর সুবচনি মন্দিরে তেলসিঁদুর ধান—দূর্বা ফেলে এখানে চলে আসতেন।
ঠিক তক্ষুনি এক বৃদ্ধ যেন সেই জনার্দন চক্রবর্তী, সে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল—না, জনার্দন ঠাকুর নয়, অন্য মানুষ, তেমনি লম্বা জোয়ান মানুষ, মাথায় সাদা চুল, চোখ বড় বড়, পায়ে হরেক রকমের রঙবেরঙের কানি বাঁধা, হাতে পায়ে গলায়! ঠিক ফকির দরবেশের মতো মুখ—কেবল হেঁকে যাচ্ছে। কী হাঁকছিল বোঝা যাচ্ছে না—খুব সন্তর্পণে কান পাতলে ওর অস্পষ্ট কথা ধরা যাচ্ছে। সে দু’হাত ওপরে তুলে নাচছিল, গাইছিল এবং মাঝে মাঝে কলকাতা শহরকে যেন সে জরিপ করছে—একটা ফিতা ছিল হাতে, সে ফিতা দিয়ে কী যেন কেবল মাপছে মাঝে মাঝে। সুবল বুঝল মানুষটা তবে জনার্দন চক্রবর্তী নয়। সুবল রেলিং থেকে ওর জামাকাপড় তুলে নিল। তারপর এক অনির্দিষ্ট যাত্রা। এই শহর এতবড় শহর ঘুরে ঘুরে দেখা। কিছু আহারের ব্যবস্থা করতে হয়। সুবল আহার সংস্থানের নিমিত্ত চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকল।
তখন টুকুন হাসপাতালের এক ঘরে শুয়ে ছিল। জানালার পাশে টুকুনের বিছানা। স্প্রিং—এর খাট। মাথার দিকটা একটু ওপরের দিকে তোলা। টুকুন সামনের জানালা দিয়ে মাঠ দেখতে পাচ্ছিল। জানালার নীচে পথ, পথের ওপর এক ফুচকাওয়ালা ফুচকা বিক্রি করছে। বড় গরম চারিদিকে। বৃষ্টি নেই, টুকুন গরমে হাঁসফাঁস করছিল দুপুর থেকে।
এখন বিকেল সুতরাং এখন ফুচকাওয়ালা ফুচকা নিয়ে বের হয়েছে। এখন বিকেল সুতরাং মাঠে মাঠে খেলার দৃশ্য আর পার্কের ভিতরে ছোট বড় ছেলেমেয়ে সব খেলতে এসেছে। ওরা ঘাসের ওপর ছুটাছুটি করছিল।
টুকুন জানালা থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। একটা গাছে কিছু ফুল ফুটে আছে—কী ফুল হবে, বোধহয় নাগেশ্বর ফুল, ফুলের সৌরভ সব পার্কটা কেমন আমোদিত এবং বোধ হয় এই সব ফুলের সৌরভের জন্য নানারকমের পাখি উড়ে এসেছে, পাখিগুলো উড়ছিল, পাতা উড়ছিল, পাখিগুলো উড়ে উড়ে ডালে বসছে, ঠিক যেন সুবলের পাখি! সুবল, এক পাখিওয়ালা সুবল এই শহরে এসে নানা জাতের সব পাখি ছেড়ে দিয়েছে আকাশে।
কিন্তু রাস্তার অন্য দৃশ্য। রাস্তার ওপর বড় মিছিল। মিছিলের আগে একটা মানুষ লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে একদল মানুষ, ওদের হাতে নানা রঙের ফেস্টুন, ভিন্ন ভিন্ন লেখা, বাঁচার মতো খাদ্য দিতে হবে, চোরাকারবারি বন্ধ করতে হবে, অথবা যেন বলার ইচ্ছা সকলের, আমাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে সংসারে সব আগুন লাগিয়ে দেব।
অথবা টুকুন মাঝে মাঝে এমন সব দৃশ্য দেখতে পায় যা মনকে ব্যথিত করে। সামনে একটা—বোধ হয় ওটা শাল—শিমুল জাতীয় গাছ, গাছের নীচে প্রায় উলঙ্গ সব কাচ্চাবাচ্চা, প্রায় নগ্ন সব যুবক— যুবতী রাতে শুয়ে থাকে। ভোর হলেই ওরা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। আর টুকুনের চোখে ঘুম নেই বলে, শেষ রাতের দিকে কেবল মনে হয় ঘোড়ার গাড়িতে অথবা গোরুর গাড়িতে কারা যেন শহরে কেবল কীসব ভোজ্যদ্রব্য নিয়ে আসছে চুরি করে। অথবা মাঝে মাঝে রাত গভীরে শহরের সব অলিগলিতে কীসের যেন ফিসফিস শব্দ, ওরা যেন এক ষড়যন্ত্র করছে।
ভোর হলেই টুকুন দেখতে পায় এক ছোট্ট বালক কাঁধে মই নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে কেবল পোস্টার মেরে যাচ্ছে। ওর একদিন বলতে ইচ্ছা—এই পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে কী লেখা আছে?
হয়তো সেই পোস্টারয়ালা জবাব দেবে—কী করে বাঁচতে হয় তার কথা লেখা আছে।
আমার পায়ে শক্তি নেই, আমার শরীর ক্ষীণ হয়ে আসছে, আমি আর বাঁচব না বুঝি। পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে আমার বাঁচার কথা লেখা নেই? টুকুনের আরও যেন কীসব প্রশ্ন করার ইচ্ছা। শাল—শিমুলের নীচে যুবক—যুবতীরা কেন রাতে শুয়ে থাকে, অন্ধগলিতে রাতে কারা ফিসফিস করে কথা বলে, কত রকমের ভোজ্যদ্রব্য চুরি যাচ্ছে শহরে, গ্রামে, কেবল মানুষেরা আপন স্বার্থের জন্য সঞ্চয় করে যাচ্ছে, অন্যের জন্য ভাবনা নেই, এমন কেন হয়, টুকুনের ঘুম আসে না রাতে, কেবল দুঃস্বপ্ন।
মা—বাবা বিকালে আসেন, ওঁদের মুখ বড় করুণ, বাবা সারাদিন অফিস করেন, কত হাজার টাকা বাবা রোজগার করেন, বাবা টুকুনের কাছে বীরপুরুষের মতো, মা বাবাকে আদৌ সমীহ করেন না, মা কেমন গোমড়ামুখো অথবা টুকুনকে এই যে নানারকমের খেলনা কিনে দিয়ে যাচ্ছে—গোটা ঘর ভর্তি খেলনা, রাতে ওরা টুকুনের সঙ্গে কেবল কথা বলতে চায়, কিন্তু টুকুন সামান্য তাজা মুখ নিয়ে যখন কথা বলতে থাকে তখন বড় বেড়ালটা মিউ মিউ করে কাঁদে। টুকুনের রাগ হয়। তুমি কাঁদবে না, কাঁদলে তোমাকে বাছা জলে ফেলে দেব।
গোটা ঘর ভর্তি খেলনা। টুকুনের মাঝে মাঝে মনে হয় খেলনাগুলো সব নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। হাসি—মশকরা করছে। যেন টুকুনই এখন ওদের খেলনা হয়ে গেছে। কারণ টুকুন বিছানা ছেড়ে ওদের কাছে যেতে পারে না, হাঁটতে পারে না। দিনের বেলায় শুধু জানালা দিয়ে সামনের মাঠ দেখে, এবং মাঠ, গাছ, পাখি আর পথের বিচিত্র সব মানুষদের দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায়। ওর তখন সব ছেড়েছুড়ে ছুটতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু হায়, পায়ে একেবারে শক্তি পাচ্ছে না। হায়, সেই পাখিয়ালা যে টুকুনকে হাসিয়েছিল, যার জন্য টুকুন তালি বাজিয়েছিল এবং যে মানুষের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল, সেই মানুষের আর দেখা নেই।
টুকুনের বাঁ—দিকে বড় একটা পুতুল ছিল, টুকুন দেখল পুতুলটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সামান্য গোঁফের রেখা আছে পুতুলটার মুখে, পুতুলটার নামও আছে একটা, টুকুন চিৎকার করে উঠল, রাজা, এক থাপপর মারব। খুব হাসা হচ্ছে! সব খেলনাগুলো ভয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল।
টুকুন সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বালিশের নীচ থেকে চন্দনের বিচি, পাথর এবং কুঁচ ফল বের করে দেখাল রাজাকে এবং অন্যান্য পুতুলগুলিও ওর দিকে যেন চন্দনের বিচি, লাল—নীল পাথর, কুঁচ ফল দেখার জন্য এগিয়ে এল। টুকুন এবার বলল, বুঝলি রাজা আমি মিথ্যা বলি না। এই দেখ, সুবল আমাকে কত কিছু দিয়েছে। সুবলকে পুলিশ ধরতে এসেছিল, আমি নিজে পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে রাজা এবং কুদুমাসি বিড়াল সকলের হয়ে আদাব দিল টুকুনকে। তারপর টুকুন তাচ্ছিল্যভরে ওদের শোনাল, দেখিস সুবল এলে আমি তোদের হেঁটে দেখাব। সুবল জাদুকর, সে জাদুর পাখি রেখেছে কাঁধে। সে পাখি উড়িয়ে দিলেই আমি তোদের কাছে হেঁটে চলে যেতে পারব।
পাঁচ
সেই এক জাদুকরের জন্য জনার্দন চক্রবর্তীও ঘুরছে। একা নিঃসঙ্গ মাঠে জনার্দন চক্রবর্তী রাতের অন্ধকারে অথবা ভোররাতের দিকে ঘুরছে। খরা থেকে এই মাটিকে রক্ষা করার জন্য ঘুরছে। এক প্রচণ্ড অহমিকা জনার্দনের। সুবচনি দেবীর মন্দিরে মাথা কুটছে, মা জল দাও। জল দাও। মা, জলে তুমি মাটি ভাসিয়ে দাও। মা, তোমার সন্তানেরা সব দেশ ছেড়ে চলে গেল। কেউ আর ফিরে এল না, আমি মরে গেলে তোকে কে আর ফুল জল দেবে। কিন্তু নিষ্ঠুর সুবচনি দেবী, করালবদনি ডাইনি মুখ ব্যাদান করে আছে। লম্বা জিভে যেন জনার্দনকে ভেংচি কাটছে। শ্মশানের মতো মন্দিরের চারপাশে শুধু আগুনের মতো রোদ।
জনার্দন মাঝে মাঝে দেবীর কপালে হাত রাখত, কপাল ঘামছে কিনা দেখত, কপাল ঘামলে দেবী প্রসন্না হবেন।
সে দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য এক রাতে হাজার বিল্বপত্র সংগ্রহের জন্য বের হয়ে দেখল, গাছে কোনও বিল্বপত্র নেই। সে দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য জল তুলে আনল নদীর গর্ত থেকে কিন্তু এমন মরুভূমির মতো স্থান যা জলের রঙ ক্রমশ গাঢ় হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করল। দেবী হা হা করে হেসে উঠে যেন ভয় দেখালেন জনার্দনকে। জনার্দন খেপে গিয়ে বলল, বল—মাগি, কবে বৃষ্টি হবে, তোর কোনও মরদকে ধরে আনতে হবে বল, বলে সেই নগ্ন সন্ন্যাসী অথবা কাপালিকের মতো চেহারা যে জনার্দন মুখে বড় দাড়ি, নাসিকা লম্বা, আর কোটরাগত চোখ থেকে আগুন ঝরছে, সেই জনার্দন হা হা করে লাঠি তুলে তেড়ে গেল দেবীর কাছে এবং চিৎকার করে উঠল, জল, জল চাই, জল না হলে শালি তোর একদিন কী আমার একদিন। এই দ্যাখ, বলে সে বড় শক্ত বাঁশের লাঠি ঘরের কোণে তুলে রাখল, জল না হলে তোর মাথা দু’ভাগ করে দেব। তোর ছেইলা কোলে নিয়া বেড়ানোর শখ ভেঙে দেব।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। সুতরাং ভিতরে উত্তাপ কম। প্রায় সারাটা দিন এই মন্দিরে জনার্দন পড়ে থাকে। প্রায় সারাটা দিন জনার্দন দেবীর সঙ্গে বচসা করে, কথা বলে, মার্জনা ভিক্ষা করে, অথবা উপবীতের অহঙ্কার দেখায়। পাথরের দেয়াল বলে এবং জায়গাটা পাহাড়ের গুহার ভিতর বলে ওর চিৎকার অথবা মার্জনা ভিক্ষা কোনও কাকপক্ষী পর্যন্ত টের পায় না। কোনও লোক চলাচল আর নেই এ অঞ্চলে।
সে মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপরে উঠে দূরে ট্রেনের শব্দ শোনার চেষ্টা করে অথবা কখনও দেবীর গায়ের কাছে পড়ে থেকে মা মা বলে কাঁদতে থাকে—মা, সোনার দেশে ফসল ফলাবি না মা? কোন পাপে মাগো তোর মাটিতে আর ফসল ফলাবি না মা? কোন পাপে মাগো তোর মাটিতে আর ফসল ফলে না, বৃষ্টি হয় না।
দেবীর মুখ তেমনি নির্বিকার। ছেলের মুখ দেবীর স্তনের কাছে। কালো পাথরের মূর্তি। এক ফুটের মতো লম্বা। পায়ে কপালে এত সিঁদুর যে এখন আর মুখ এবং স্তনের প্রভেদ খুঁজে পাওয়া যায় না। নীচে বেদি। বেদিমূলে কিছু ধান—দূর্বা, শুকনো ধান—দূর্বা, শঙ্ক কোষাকুষি, ঢোল ঢাক, বড় কাসি আর বাঘের কী হরিণের চামড়া, ব্যবহারে সব লোম উঠে গেছে, সুতরাং বাঘ অথবা হরিণ না অন্য জীবজন্তুর চামড়ায় তৈরি এই আসন বোঝা যায় না। তেল—সিঁদুরের জন্য দেবীর মুখ সব সময়ই চক চক করছে।
জনার্দন তিক্ত হয়ে দেবীর মুখে দুটো বুড়ো আঙুল ঠেসে ধরল। বলল, খা, কাঁচকলা খা। বস্তুত জনার্দন পেটে খিধে থাকলে এমন করতে থাকে। কোনও খাদ্যদ্রব্য নেই। সে গত রাত্রে বনের ভিতর বন—আলুর মতো লতার সন্ধানে ছিল। সে কিছু খুঁজে পায়নি। লতার সন্ধান পেলে সে মাটি খুঁড়ে অনেক নীচ থেকে বড় থামের মতো আলু তুলে আনতে পারত।
সে সুতরাং সারাদিন উপোসী থেকে দেবীর ওপর তিক্ত হয়ে পড়েছে। নিজের উপবাসই দেবীর উপবাস। নিজের দুঃখই দেবীর দুঃখ।—কি আর খাবি মা। হয়তো কিছু বটফল সংগ্রহ করেছে জনার্দন, তাই মুখে ফেলে বলল খা মাগো, খা, এই খেয়ে পেট ভরে ফেল। কেমন লাগে মা খেতে! সে নিজে বটফল চিবিয়ে বলত, কেমন লাগে! ভালো লাগে! খা, ভালো লাগলে অমৃত বলে খেয়ে নে। সে কোৎ করে একটা ঢোঁক গিলত তারপর। তারপরে দেবীর মুখের দিকে ফ্যাকাসে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত কতক্ষণ, একসময়ে হা হা করে হেসে উঠত ফের।—কেমন লাগে, অন্ন নেই, জল নেই, মানুষ নেই, ফুল বেলপাতা, দূর্বা—ধান কিছু নেই, কেমন লাগে! ছেইলা কোলে লৈয়া বৈসা থাকতে কেমন লাগে। চেষ্টা নেই, সাধনার ধন মা না দিলে ফসল ফলে না। বলে জনার্দন দরজাটা ফাঁক করে দেখল, বেলা পড়ে গেছে। সূর্য পাহাড়ের অন্যমাথায় নেমে গেছে।
এবার তার ফের বের হবার পালা। এখন বের হলে সব ঘুরে, পাহাড়ময় ঘুরে মাঠময় ছুটে নদীর গর্ত থেকে ভোরের দিকে সামান্য জল নিয়ে ফের সুবচনির মন্দিরে উঠে আসা যাবে। জল তোলার আগে তেমনি সেই হরিণী তার দুই শিশু নিয়ে এসে বসে থাকতে পারে। জলের জন্য পারে সে বসে থাকত। জনার্দন উঠে আসার মুখে ওদের জল দেবে খেতে। জীবের জন্য মায়া। যেন জীব বলতে সামান্য এই হরিণ, তার দুই শিশু, ক্বচিৎ দুটো একটা পাখি উড়ে যেতে দেখা যায়।
জনার্দন আকাশের দিকে চোখ তুলে অনেকক্ষণ পাখির আকাশে ওড়া দেখে, কোথায় কোনও টুকরো মেঘ আকাশের কোলে ভেসে আসছে কিনা দেখে, আর হা—অন্নের জন্য দু’হাত তুলে যেন হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময়, একটি ম’ল জলে ডুবে রইল বাকি নয়, জনার্দন ডুবে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া ছেলের মতো মাঠময় পাহাড়ময় শুধু নদীর কোথায় জলসঞ্চয় করে রাখলে সম্বৎসর এই অঞ্চলে জলে ভরে থাকবে, তাই অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।
সুতরাং রাতের বেলায় জনার্দনকে চেনা যায় না। মানুষ বলে চেনা যায় না। এক দৈত্য আলখাল্লা পরে অথবা এক কাপালিক মাথায় পাগড়ি বেঁধে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জল, মাগো জল চাই। এমন এক অঞ্চল মা, জলের ব্যবস্থা থাকলে আর কোনোকালে এখানে দুর্ভিক্ষ হবে না, সময়ে জল চাই ফসলের গোড়ায়।
নদীর নীচে জমি, বাঁধ দিলে জল থাকে, এমন এক জায়গার সন্ধানে ছিল জনার্দন যেখানে অল্প আয়াসে বাঁধ দিলে সব জল বর্ষায় নেমে যাবে না, কিঞ্চিৎ জল থেকে গেলেই অঞ্চলের খরা নিভে যাবে। সেজন্য জনার্দন প্রায় পাগলের মতো পাহাড়ের ঢালুতে, এবং নদী উৎরাইয়ে রাতের অন্ধকারে অথবা যখন জ্যোৎস্না থাকত, চাঁদের মরা আলোতে জনহীন প্রান্তর ভীষণ মনে হত তখন জনার্দন দাগ কেটে আপন উদ্যম, সফল উদ্যম মিলিয়ে নদীর তটে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিত। বটফল, বন—আলু এবং ক্বচিৎ কোথাও মৃত পাখি অথবা জীব মিলে গেলে তার মাংস জনার্দনের খাদ্যবস্তু ছিল।
জনার্দন মাঠময় ঘুরে পাহাড়ময় ঘুরে সেই স্থান সেই সংযোগস্থলের সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল। সে রাত হলে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিত, নদী এখানে বড় সরু পথ কেটে নেমে গেছে। দু’ধারে পাহাড়, উঁচু মতো পাহাড়, জল নেমে গেলে পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো জল ধরে রাখবে, শুধু খাদে বড় কিছু পাথর ফেলে দিতে হবে, হাজার পাথর, লক্ষ পাথর। জনার্দন শিশু বয়সের কবিতা আওড়াত—উদ্যমবিহনে কিবা পুরে মনোরথ। শুধু উদ্যম চাই, সফল উদ্যম।
সে একটা পাথর টেনে আনত আর বলত উদ্যম চাই, উদ্যম। মা, মাগো, শক্তি দে। সে আবার পাহাড়ের মাথায় পাথর দোলাত, তারপর পাথরটা নীচে ফেলে দিত, মাগো উদ্যম চাই, উদ্যম। সে সারারাত এক করে ভোরের দিকে হরিণ শিশুদের জলের ব্যবস্থা করে, নিজের জন্য সামান্য জল তুলে সুবচনির মন্দিরে উঠে যেত। ওঠার সময় শুনত, মা—ও যেন বলছেন, উদ্যম চাই জনার্দন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি।
টুকুনের ঘরেও সেই এক কথা। ডাক্তারবাবু, নার্স, টুকুনের বাবা এবং মা বসেছিলেন। টুকুন এই সময়টাতে একটু হাত—পা মেলে বসার চেষ্টা করে। মা—বাবাকে দেখলে কেমন যেন মনটা নরম হয়। ডাক্তারবাবু ভালোবাসার হাত রাখেন টুকুনের মাথায়।
নার্স টুকুনের বেণী বেঁধে দেবার সময়ে নানারকমের পাখির গল্প করে থাকে। ফুলপরি, জলপরি, স্থলপরি, দেবস্থানে এক রকমের পরি থাকে, ভগবানের কছে অন্যরকমের পরি, আর ডাক্তারবাবু বলছিলেন, সব পাখির এক কথা টুকুন, উদ্যম চাই, বাঁচার উদ্যম। ডাক্তারবাবু টুকুনের বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েটার সব উদ্যম শেষ হয়ে গেছে যেন। বেঁচে থাকার স্পৃহা জন্মানো দরকার ওর ভেতরে। নতুবা একদিন শুকিয়ে মেয়েটা কাঠ হয়ে যাবে। কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।
সুতরাং এক বাঁচার উদ্যম এই সংসারকে নিয়ত গতিশীল করে রেখেছে। টুকুনের বাবা বললেন, মা, তোমার জন্য আমরা আর কী কী করতে পারি!
টুকুন বলল, বাবা, আমার জন্যে একটা ফুলপরি কিনে আনবে।
বাবা টুকুনকে ফুলপরি এনে দিয়েছিলেন।
টুকুন বলল, বাবা, আমাকে একটা খরগোস কিনে দেবে।
বাবা তাই কিনে দিলেন। আর এভাবেই টুকুনের ঘরটা খেলনায় ভরে গেল। কী নেই এখন টুকুনের ঘরে, জলপরি আছে, ফুলপরি আছে, রাজা আর কুদুমাসি বিড়াল এবং সেই এক বন্দুকধারী সিপাই। টুকুনের বাবা টুকুনের জন্য কোনও অভাব রাখেনি। যা চেয়েছে টুকুন, বাবা সব এনে দিয়েছেন। যেন এখন শুধু টুকুনের জন্য এক রাজপুত্র ধরে আনা বাকি। এনে দিলেই টুকুন এই ঘরের ভিতর স্বর্গরাজ্য তৈরি করে ফেলবে। কারণ টুকুন যেন কী করে জেনে ফেলেছিল—সে মরে যাবে। মরে গেলে মানুষ কী হয়। টুকুনের কী হবে অথবা মৃত্যুর পর টুকুন নিশ্চয় এমন এক স্বর্গীয়রাজ্যের ভিতর প্রবেশ করবে যেখানে তার এই জগৎ থাকবে আর কে থাকবে! সেই সুবল নিশ্চয়ই থাকবে, পাখিয়ালা সুবল, কাঁধে পাখি নিয়ে। বড় পাঁচিল থাকবে একটা, কারণ যারা নরকে যায় তাদের জন্য পাঁচিলের ওপাশে যমপুরী। যমপুরীতে ভূতপ্রেত থাকে। সুবল পাঁচিলের ধারে এসে উঁকি মারলে সে হাত ধরে তাকে তুলে নেবে। তখন বাবা—মা কিছু বলতে পারবে না। সুবল এলেই প্রায় যেন সবকিছু ওর হয়ে যায়। সে হেঁটে চলতে ফিরতে পারবে। সুবলের জন্য তার ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল।
টুকুন বলল, বাবা, সুবল বলেছিল কলকাতায় আসবে?
বাবা বললেন, কে সুবল?
—বা, তুমি দ্যাখোনি, ট্রেনে যখন ফিরছিলাম, সেই সুবল, পাখিয়ালা সুবল, আমাদের সঙ্গে আসছিল। মা ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিলেন!
টুকুনের বাবা এতক্ষণে মনে করতে পারল!
ডাক্তারবাবু বললেন, কী ব্যাপার সুরেশবাবু?
—আর বলবেন না। আমরা ফিরছিলাম সিমলা থেকে। ট্রেনটা যখন বাংলায় ঢুকছে, রাতের বেলা, কোথাকার সব কতগুলি লোক, কংকালসার চেহারা, আমাদের ট্রেনটাকে আটকে দিল। বলল, জল চাই, জল চাই। বোধহয় খবরটা পত্রিকায়ও পড়ে থাকবেন।
—হ্যাঁ, সেই খরার খবর! জল নেই নাকি দেশটাতে।
—ওরা ট্রেনে উঠে কল খুলে সব জল খেয়ে নিচ্ছিল।
—তারপর!
—তারপর আর কী! ড্রাইভার ভীষণ চালাক। লোকগুলো সব জল যখন চেটে চেটে খাচ্ছিল, সে মশাই জল খাওয়া দেখলে আপনি ভয় পেয়ে যেতেন, জল এভাবে খায় আমার জানা ছিল না, যেন অমৃত পান করছে অসুরেরা। জলের অপর নাম জীবন, সেদিন ট্রেনে প্রথম বুঝেছিলাম। ড্রাইভার দেখল জলের নেশায় পাগল, ড্রাইভার বুদ্ধি করে ট্রেন সহসা ছেড়ে দিল। ব্যস।
—সব নিয়ে রওনা হলেন?
—হ্যাঁ, প্রায় তাই। দলের মধ্যে সুবল ছিল। সুবল আমাদের কামরায় ছিল! ওর একটা পাখি ছিল সঙ্গে, কিছু কীটপতঙ্গ ছিল, শুকনো বটফল ছিল পুঁটলিতে, সে তার পোষমানা পাখি উড়িয়ে দিয়েছিল, পাখিটা উড়লে টুকুনকে আমরা হাততালি দিতে দেখেছিলাম।
ডাক্তারবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
—জানি না। ব্যান্ডেল স্টেশনে দেখি সে নেই।
টুকুন বলল, মা ওকে নামিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনারা দেখেছেন টুকুন হাততালি দিয়েছে।
—হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনে।
—তুমি সে কথাটা বলো। টুকুনের মা টুকুন যে স্বপ্ন দেখেছিল তার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
—হ্যাঁ, আর একটা কথা ডাক্তারবাবু, ট্রেনে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সুবল দরজার এককোণায় পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বসেছিল। অন্য স্টেশনে ট্রেন এলে পুলিশ তাড়া করেছিল লোকগুলিকে। সুবল আমাদের কামরায় আছে, টুকুন বলছিল সে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। এটা স্বপ্নের মতো ঘটনা, হয়তো টুকুন স্বপ্ন দেখছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ওর সে সময় বাসনা, তীব্র বাসনা, বাঁচার তীব্র বাসনা, জীবনের সুখ—সম্পদে কী কোথায় জীবনের তৃষ্ণা রয়েছে সামান্য সময়ের জন্য বোধহয় ভিতরে ওর সেই তৃষ্ণা জেগেছিল। এই তৃষ্ণা কী করে ফের জাগানো যায়। বেঁচে থাকার তৃষ্ণা, রক্তের ভিতরে তুফান, বুঝলেন সুরেশবাবু, সেই তুফানের কথাই বলছি, রক্তের ভিতরে তুফান তুলে দিতে হবে, ঢেউ, যাকে আমরা তরঙ্গ বলি, বেঁচে থাকার জন্য এই তরঙ্গ তুলে দিতে পারলে আবার টুকুনকে বাঁচাতে পারব। সুবল সেই পাখিয়ালা হয়তো সেই রক্তে সামান্য দোলা দিতে পেরেছিল। ডাক্তারবাবু প্রায় সব কথাই বিশেষ করে রুগি সম্পর্কে কথা বলে ইংরেজিতে বলেছিলেন। সুতরাং টুকুন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল, সে স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলল, মা, আমি জল খাব।
—সেই এক উদ্যমের কথাই বলছি ডাক্তারবাবু। কথাটা বলে ফের কেমন অন্যমনস্ক হলেন। এবং নিজেকেই নিজে বললেন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, সুরেশবাবু।
বিকাল মরে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন। সুরেশবাবু এবং টুকুনের মা চলে গেল। নার্স সামান্য দুধ গরম করার জন্য কিচেনের দিকে গেছে। বাইরে আলো জ্বলে উঠল। ঘরে হলুদ রঙের আলো, এখন। এই ঘরের চারপাশে সব পুতুল, জলপরি, স্থলপরি। আর কেউ থাকবে না এখন। সুতরাং পুতুল এবং এইসব পরিরা সন্ধ্যার পর টুকুনের সঙ্গে ঘর—সংসার আরম্ভ করে দেয়। টুকুন আপন মনে কথা বলে চলে, এই রাজ্যে তখন টুকুন রানি অথবা রাজকন্যার মতো। সব পরিদেব, সে জলপরি অথবা স্থলপরি হোক, সে রাজা অথবা কুদুমাসি বিড়ালই হোক টুকুনের কথায় উঠতে বসতে হবে। এদিক ওদিক হলে রক্ষা থাকবে না। পরদিন ভোরে নার্সকে বলবে, মাসি বেড়ালটাকে ঘরের বার করে দাও। সারারাত ওটা আমাকে ঘুমুতে দেয়নি, কেবল জ্বালাতন করেছে।
সুবল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, পাখি তুমি বড় জ্বালাতন করছ। উড়ে গেলে আসতে চাও না।
পাখিটা সুবলের মাথায় মুখে ঘুরতে থাকল। যেন পাখিটা সুবলের অভিমান ধরতে পেরেছে। অভিমান ভাঙানোর জন্য নানাভাবে সুবলকে খুশি করার চেষ্টা করছিল উড়ে উড়ে।
সুবলকে এখন দেখলে প্রায় চেনা যায় না। সে কী করে ইতিমধ্যে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে ফেলেছে। ওর বাঁ হাতে ছোট কাঠের বাক্স, বাক্সের ভিতর জুতোর ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের কালি, ব্রাস, ক্রিম এবং ছোট একটা তোয়ালে। ওর চুল আর বড় নেই, টিকি এখন আরও ছোট করে ছাঁটা। বড় লম্বা জামা আর শরীরে ঢল ঢল করছে না, সুবল প্যান্ট পরেছে একটা, গেঞ্জি গায়ে দিয়ে সমস্ত সকাল জুতা পালিশ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। সে গাছের নীচে শুয়েছিল। পাখিটা ঘাসের ওপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কিছু চানা কিনে নিজে খেয়েছে, পাখিটাকে খাইয়েছে।
পথের ওপাশে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি। সে ঘাসের উপর শুয়ে বড় সব বাড়ি দেখছিল। জানালায় কত সুন্দর মুখ, সুন্দর মুখ দেখলেই টুকুন দিদিমণির কথা মনে হয়। সে প্রথম ভেবেছিল। কলকাতা গেলেই টুকুনদিদিকে পাওয়া যাবে, সে সেই ডাবয়ালাকে অর্থাৎ সুবল কতদিন সেই ডাবয়ালার ডাব নৌকা থেকে তুলে এনেছে পারে, ডাবয়ালা খুশি হয়ে পয়সা দিয়েছে, তাকে একবার বলেছিল, তুমি জান ডাবয়ালা টুকুনদিদিমণি কোথায় থাকে? লোকটা রাস্তার নাম এবং নম্বর চাইতেই বুঝেছিল সুবল, টুকুনদিদিমণিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, এতবড় শহরে টুকুনদিদিমণি হারিয়ে গেল।
এতবড় শহর দেখে সুবলের বিস্ময়ের আর সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন জনার্দন চক্রবর্তী ওদের প্রিয় পুরোহিত, গ্রামের এবং অঞ্চলের বাঞ্ছিত পুরুষ যিনি প্রায় সব ধর্মের নিয়ামক তেমন কোনও অসীম এবং অপরিমেয় শক্তিশালী মানুষ, অথবা সে জাদুকর হতে পারে, পির পয়গম্বর হতে পারে যিনি এই শহরকে চালাচ্ছেন। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, প্রাসাদে—প্রাসাদে উর্দিপরা দারোয়ান, হাওয়াই গাড়ি, ট্রাম এবং স্রোতের মতো মানুষের মিছিল। সন্ধ্যা হলে রাস্তার সব আলো জ্বলে উঠছে। গাড়িগুলো মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার চলতে শুরু করেছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই। কেবল বড় বড় অট্টালিকা আর গম্বুজের মতো রহস্যজনক মিনার সুবলকে বড় বেশি আবেগধর্মী করে তুলেছে।
আর মনে হত এই শহরে টুকুনদিদিমণি আছে। এই শহরের কোথাও না কোথাও টুকুনদিদিমণি আছে। সুতরাং সুবল যখনই সময় পেত, পথ ধরে হেঁটে যেত, গাড়ি দেখলে এবং ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে চোখ তুলে তাকাত যদি টুকুনদিদিমণি হয়, যদি টুকুন তার জন্য কোনও জানালায় মুখ বার করে রাখে। সে ভোরের দিকে কাজ করত, সুবল একা মানুষ। কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধু—বান্ধবহীন সুবলের আয় থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় হলে সে বাসে উঠতে পারছে, সে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে।
সে কখনও এক জায়গায় বসছে না, প্রায় শহরটাই যখন মেলার মতো, প্রায় শহরটাই যখন উৎসবের মতো সেজে আছে এবং যেখানে বসা যায় সেখানেই দু’পয়সা সংগ্রহ হচ্ছে তখন এক জায়গায় বসে কী লাভ। এই ঘোরা, কাজের জন্য ঘোরা এবং টুকুনদিদিমণির জন্য ঘোরা সুবলের একটা বাই হয়ে গেল। শুধু দুপুর হলে সে গড়ের মাঠে চলে আসত। এসময় সুবলের প্রিয় পাখি আকাশে উড়তে চায়। পাখিটা না উড়লে ওর পা স্থবির হয়ে যাবে, পাখি স্থবির হয়ে যাবে ভেবেই সুবল ঠিক দুপুরে, যখন রোদে খা খা করছে সারা মাঠ, যখন দুর্গের উপর কবুতর ওড়ে এবং যখন প্রায় পাখিরা দুপুরের অবসাদে গাছের ডালে অথবা অন্য কোনও ছায়ায় চুপটি মেরে ঠোঁট পালকে গুঁজে পড়ে থাকে তখন সুবল আকাশে পাখিটাকে উড়িয়ে দেয়। পাখিটা উড়তে উড়তে কোথায় যেন চলে যায়। আর দেখা যায় না।
রোদের জন্য আকাশের দিকে বেশিক্ষণ চোখ তুলে তাকাতে পারে না সুবল। সে পাখিটার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। ওর এক হাতে বাক্সটা তখন খোলা, অন্য হাতের মুঠোয় সে রোদের ভিতর অনেকটা ঠিক আকবর বাদশার মতো হাতের মুঠোয় পাখি রাখার জন্য গর্বে আত্মহারা। অথবা পাখি উড়ে উড়ে যখন ক্লান্ত হয়, পাখি যখন সুবলের কাছে ফের ফিরে আসে এবং মুঠোয় বসে চারদিক তাকায় তখন সুবলের এক প্রশ্ন, টুকুনদিদিমণিকে পেলি?
পাখি পাখা ঝাপটাল, ফের উড়তে চাইল। সুবল বুঝল, না টুকুন দিদিমণিকে পাখিটা খুঁজে পায়নি। সুতরাং সে বলত, বেশ হয়েছে বাপু, এবার চলো চুপটি করে আমার কাঁধে বসে থাকবে। এখন আর রোদে রোদে তোমায় ঘুরতে হবে না।
এই পাখি যেন সব বোঝে। সুবলের দুঃখের দিনে এ পাখি ছিল, সুখের দিনেও এই পাখি। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কোথায় যে গেল।
পাখি বলল, কিচ কিচ। পাখি সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।
সুতরাং সুবলের এখন এক কাজ। টুকুনকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনও ঠিকানা নেই টুকুনের। এতবড় শহর তবু সুবল হার মানল না। সকালের দিকে দুজনের মতো রোজগার হয়ে গেলেই সুবল পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। জানালায় জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে, পার্কের ভিতর ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে টুকুনদিদিমণি যদি হয়, সে প্রায় পাগলের মতো এই শহরে টুকুনকে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে, পার্কে, বড় রাজপথ, গঙ্গার ধারে, এবং বড় বড় বাড়িতে উঠে যেত কাজ নিয়ে। সে কাজের ফাঁকে শুধু কীসের প্রত্যাশা করত যেন।
সুবল ওর পাখিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল অনুসন্ধানের জন্য। যখন ওর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যখন অবসাদে শরীর চলতে চাইত না, সুবল ওর পাখি ছেড়ে দিত, দেখ যদি তুই কোথাও টুকুনকে খুঁজে পাস। সুবল এক সরল বালক, পাখি এক অবলা জীব, শহরের মানুষেরা সুবলকে দেখলে এবং ওর পাখি দেখলে কৌতুক বোধ করত। সুতরাং সুবল পাখিটার জন্য একটা দাঁড় কিনে নিয়েছে। পাখিটা দাঁড়ে বসে থাকত। সুবল মাঝে মাঝে যখন হাতে কাজ থাকত না আর ঘুরে ঘুরে আর শরীরও যখন দিচ্ছে না, তখন বলত, পাখি তুই আগে ছিলি কার?
পাখি বলত, কী বলত—সরল না হলে বোঝা যায় না, পাখি বলত বুঝি রাজার!
সুবল, মনে মনে এবার বলত, এখন কার?
—এখন তোমার।
—হ্যাঁ তবে দেখ উড়ে, সেই দিদিমণি আমাদের কোথায়! তারপর পাখি উড়তে থাকত। দেওয়ালের পাশে, জানালায়, অথবা সদর পথে এক সোনার পাখি উড়ে যেত। পাখির সরল চোখ জানালায়, ঘরের ভেতর এবং রুগণ যুবক—যুবতী অথবা ছোট মেয়ে দেখলে শিয়রে বসে দেখত সেই টুকুন কিনা। সুবলের পাখি, ভালোবাসার পাখি হয়ে শহরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখি উড়ে উড়ে কত দৃশ্য দেখতে পেল, শহরে বড় লাল বাড়িতে কারা যেন জড়ো হয়েছে, রাস্তায় মানুষের কী ভিড়, আর পুলের উপরে সম্রাট সিজার যেন মিশর দেশ জয় করে ফিরছেন, এক অলৌকিক ঘটনার মতো, পাখি এসে দাঁড়ে বসে গেল এবং কিচ কিচ করে উঠল।
সুবল বলল, পেলি না।
পাখি কিচ কিচ করে উঠল।
—না পেলে আর কী করবি।
সুবল বলল, টেরিটিবাজার থেকে তোর জন্য কীটপতঙ্গ কিনে এনেছি। খা। বলে সুবল দাঁড়ের উপর ছোট পেতলের বাটিতে কীটপতঙ্গগুলো রেখে দিল।
আর তখনই মনে হল শহরের উপর দিয়ে দলে দলে লোক ছুটছে, ওদের কণ্ঠে চিৎকার, অন্ন চাই, বস্ত্র চাই। সুবলের মনে হচ্ছিল ওরা সব বলছে সকলে, শুধু বলছে না, উদ্যম চাই। আমরা কেমন যেন উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, একথা কেউ বলছে না।
সুবলের ইচ্ছা হল চিৎকার করতে, বলুন আপনারা উদ্যম চাই। উদ্যম। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ। পাঠশালায় জনার্দন ঠাকুর ওদের পড়াত, উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ।
সুবলের এই করে শহরটা প্রায় ঘোরা হয়ে গেল ক্রমশ। শহরের সর্বত্র সে এক উদ্যমবিহীন জীবন দেখতে পেল যেন। অফিসে, কাছারিতে, মাঠে ময়দানে এবং সব নেতা গোছের মানুষদের মুখেও সব কথার উল্লেখ আছে, শুধু উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, এ—কথা কেউ বলছে না। অফিসে কাছারিতে এবং বড় পার্কের ভিতর মানুষের কথাবার্তা থেকে এসব ধরতে পারত।
সকলের কথায় কী এক আক্রোশ যেন, কেউ সুখী নয়, এত বড় কলকাতা শহর দেখে সে যা ভেবেছিল, সুখের নগরী, দুঃখ নেই, অভাব নেই, জল, অন্ন—বস্ত্র সব কিছু আছে যখন, যখন আলোময় এই শহর, যখন বড় বড় হলঘরের মতো হোটেল ঘর, দেব—দেবীর মন্দির রয়েছে, মানুষের দুঃখ তখন থাকার কথা নয়।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে শুধু দুঃখই আছে, ফুটপাতে মানুষের দৈন্য, পাগলের প্রাদুর্ভাব বড় বেশি শহরে। এই দুঃখের নগরীতে সুবলের যেন আজকাল আর ভালো লাগছে না। ওর মনে হল সেই সব বরিষের দিন, মাঠে মাঠে ধান, গোয়ালে গোরু, সে গোরু নিয়ে মোষ নিয়ে বের হয়ে গেছে মাঠে, মাঠে মাঠে ফসলের দিনগুলি অথবা আদিগন্ত সবুজ মাঠ শুধু, সে দৌড়ে বেড়াত, মাঠের ভিতর কেবল কী যেন এক রহস্য। গ্রামের অন্য রাখাল বালকের সঙ্গে গুলি খেলা, কোনও বড় অর্জুন গাছের নীচে বসে থাকা, অথবা বুনো মানুষ হরিপদর মুখে—অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যাওয়া—হায় সেই দেশে কী করে এমন খরা এসে মরুভূমির মতো হয়ে গেল, সুবল চোখ বুজে বলল, মা সুবচনি জল দে। যদি জল হয়, যদি খাদ্য হয়, যদি মাঠে মাঠে ফের গোরু মোষ নিয়ে বের হওয়া যায়, কিন্তু কে খবর দেবে, কে বলবে দেশটাতে ফের বর্ষা নেমেছে, দেশটাতে আবার সোনার ফসল ফলবে—কার এমন উদ্যম আছে—ফের মাঠে সোনার ফসল ফলার, বরিষের দিনে জল কোথাও ধরে রাখে, অজন্মা অথবা খরা এলে সেই জলে মানুষ স্নানাহার করবে।
ছয়
পাখি উড়ছিল আকাশে, সুবল ঘুরছিল পথে পথে। টুকুন বসে রয়েছে নিজের জানালায়, আর জনার্দন মাঠ ভেঙে নেমে আসছে। নদীর চোরা স্রোতের ওপর বন থেকে হরিণী ওর দুই বাচ্ছা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন অপেক্ষা করছে।
জনার্দন খুব পা চালিয়ে হাঁটছিল। সারারাত পাহাড়ের উপর কাজ গেছে। পাহাড়ের মাথা থেকে বড় বড় পাথর ফেলে যোজকের মতো ফাঁকটুকু বন্ধ করে দিচ্ছে। পাগলের প্রায় কাজকর্ম। কী হবে, যদি এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়, যদি নদী জলে ভেসে যায়, এবং পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো স্থানটুকু জলে ভেসে যায়, তবে কার সাধ্য এই সামান্য আলগা পাথরে আটকে রাখে।
তবু এক বিশ্বাস, এই উপবীতের অহঙ্কার—এর এই কাজ উদ্যম এবং আত্মত্যাগ মন্ত্রের মতো শুভ দিনের জন্য প্রতীক্ষা করবে। জল হবে দেশে, ঘরে ঘরে মানুষজন ফিরে আসবে, সে এই জল নিয়ে চরণামৃত করবে মা সুবচনির, এবং মাঠে মাঠে তাই ছড়িয়ে দিয়ে হাঁকবে, শস্যশ্যামলা দেশে আমার সুবচনি মায়, ছেইলা কোলে লৈয়া বাড়ি বাড়ি যায়। দুর্ভিক্ষ এবং খরার দিনেও জনার্দন প্রায় একটা সুখের স্বপ্ন দেখে ফেলল।
সে দেখল যেন সেই পাহাড়ের ওপর বিরাট এক জলাশয় গড়ে উঠেছে। এক হ্রদ, চারপাশে কত গাছপালা, নীচে কত জীবজন্তু বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আরও নীচে সমতল মাঠ, কোঠা বাড়ি, ছোট ছোট নালার মতো খাল সমস্ত অঞ্চলটাকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। মানুষ তার প্রয়োজনমতো জল নিচ্ছে নালা থেকে এবং সময়ে শস্য হবে, জলের জন্য শস্য হবে, আর সারা গ্রামময়, অঞ্চলময় কোনও বিষাদ থাকছে না, শুধু গাছপালা পাখি, নদীতে জল, হ্রদে জল, মাঠের মাঝে যেসব খাল হ্রদ থেকে নেমে এসেছে সেখানে জল, আর জলে কত গাছ, মাঠে কত সোনার ফসল, সুবচনি দেবীর মন্দিরে মেলা বসেছে। দূর দেশ থেকে মানুষ এসেছে সওদা করতে, নটুয়া এসেছে গান গাইতে, কবি এসেছে কবিগান শোনাবে বলে। বাজিকর এসেছে জাদু দেখাবে বলে, ছোট—বড় শিশুরা যুবকেরা যুবতীরা মাথায় ফেটি বে�ধে ছুটছে মেলায়, যুবতীরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কাচের চুড়ি কিনছে দু পয়সায় আর মেলার প্রাঙ্গণে বড় নিশান উড়ছে—উদ্যমবিহনে কার পূরে মনোরথ।
জনার্দন বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে নীচে সেই সামান্য জলাশয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটছে এবং স্বপ্ন দেখছে। হরিণী আর তার দুই শিশুসন্তান প্রতীক্ষারত। জলের জন্য ওরা দূরের কোনও সংরক্ষিত বন থেকে নেমে আসে। ওরা জলপানের জন্য ভোর রাতের দিকে নেমে আসে এবং ভোরেই জল পান করে চলে যায়। সুতরাং জনার্দন পা চালিয়ে হাঁটছিল। ওর হাতে একটা ছোট পেতলের বালতি, ফেরার পথে সামান্য জল নিয়ে সুবচনির মন্দিরে উঠে যাবে।
ভোরে জলপান করানো তার কাজ, সে নেমে এসে কিছুক্ষণ ওদের তিনজনকে দেখল। হরিণী নির্ভয়ে জিভ বের করে নাক দিয়ে কিছু ঘাম চেটে নিল। হরিণী এতক্ষণ শুয়ে ছিল। জনার্দনকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। পাশে তার দুই শিশু হরিণ ঘোরাফেরা করছে। লাফাচ্ছে। ছুটে দূরে চলে যাচ্ছে। মুখ উঁচু করে কী দেখছে। ফের নেমে আসছে নীচে ঠিক মায়ের কাছে, আর পেটের নীচে এসে গুঁতো মারছে। সামান্য স্তন থেকে দুধ খাবার জন্য মুখ বাড়ালে, এখন নয় এখন নয় এমন ভাব হরিণীর চোখে। সে তার পিছনের দুপা দিয়ে ওদের সরিয়ে দিচ্ছে। তারপর সেই শিশু হরিণেরা মায়ের কাছে বিমুখ হয়ে জনার্দনের পায়ের কাছে দাঁড়াল। জনার্দন ওদের একজনকে তুলে নিল বুকে, অন্যজন মুখ উঁচু করে জনার্দনকে দেখতে থাকল।
—অভিমান। জনার্দন অন্য শিশু হরিণকে বাঁ হাতে তুলে এনে দুগালে দুজনের মুখ লেপ্টে দিল।—কিরে তোদের কি ভয় হয় না। জনার্দন বলল। তোদের মানুষকে এখন ভয় নেই। তোরা এতদূর থেকে চলে আসিস কষ্ট হয় না!
হরিণী তার দুই শিশুর সঙ্গে এই মানুষের ভালোবাসাটুকুতে খুব খুশি, সে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। এবার একেবারে শরীর ঘেঁসে দাঁড়াল। জনার্দন বলল, কতক্ষণ লাগে যেতে? বলে তার কোল থেকে তাদের নামিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর লাফানো ঝাপানো নয়। এবার জল খেয়ে সূর্য ভালো করে না উঠতে মানুষের এই অঞ্চল ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আমার অনেক কাজ আছে, ওদিকে মা আমার প্রত্যাশায় বসে থাকে, কেবল কী খাবে কী খাবে করে সারাদিন! জনার্দন তার কথা নালিশের মতো করে যেন ওদের শোনালো, তুই মেয়ে ছেলে খরা এনে দেশটাকে শ্মশান করে দিলি, এখন কেবল খাব খাব করলে চলবে কেন!
ভিতরে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা জনার্দনের। যখন খিদে পায়, যখন পেটের ভিতরটা সামান্য আহারের জন্য ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে তখন পাগলের মতো সুবচনি দেবীর উদ্দেশ্যে গাল পাড়তে থাকে।—খাবি খাবি। সব খেয়ে তোর শান্তি। আমাকেও খাবি। জনার্দন জল খেল। জল খেলে পেটের যন্ত্রণাটা সামান্য সময়ের জন্য কমে যায়।
মন্দিরে আর আহার বলতে কিছু নেই। আলুর লতা এখন পাহাড়ে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জল নিয়ে নদীর পারে সে উঠে এল। হরিণী তার তুই শিশু নিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ের ওপারে যে সংরক্ষিত বন রয়েছে তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
সে কিছুক্ষণ অপলক ওদের উঠে যাওয়া দেখল। ভিতরে ক্ষুধার কষ্ট, কোনও মৃত পাখি পর্যন্ত সে খুঁজে পেল না, না শুকনো বট ফল। সে ভাবল—দূরে যেসব কুঁড়েঘর রয়েছে, যা এখন শ্মশানপুরীর মতো খা খা করছে—সেখানে উঠে গেলে হয়। ঘরের ভিতরে যদি খুঁজে কিছু সংগ্রহ করতে পারে। যদি কেউ দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় রেখে মারা যায়। জনার্দন এবার মা মা বলে দ্রুত হাঁটতে থাকল। এই অঞ্চল লোকালয়বিহীন। সুতরাং এখন সে প্রায় নগ্ন। সে প্রায় বেঁহুশ। সে ওপরে উঠে যাচ্ছিল, আর বম বম করছিল। মা, তারা শ্মশানীকে বলছিল, তুই মা আর কত কষ্ট দিবি জীবকুলকে এসব বলছিল! মা তারা ব্রহ্মময়ী। ওর চলতে চলতে মনে হল, মা তারা ব্রহ্মময়ী তার সামনে ডাইনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জীর্ণ কুটিরের দিকে উঠে যেতে বলেছিল। সে বলল, পথ ছাড়। তুই ভেবেছিস ভয় দেখিয়ে আমাকেও দেশছাড়া করবি। তুই জানিস না জনার্দন কত অহঙ্কারী মা। মা তোর একদিন কী আমার একদিন। আমি মা দেখব তোর সন্তানকে তুই আর কত কাল নিরন্ন রাখবি। দেখব, দেখব, দেখব। জনার্দন দ্রুত হাঁটছিল আর তিনসত্য এই বলে গাল দিচ্ছিল, তুই মা করালবদনী, মুখ ব্যাদন করে আছিস, মুখের রক্ত মাটিতে উগলে পড়ছে তবু একবিন্দু জল দিবি না।
জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের বলল, বেশিদিন আর নেই। আমি মরে গেলে মনে করবি না, তোকে ওখানে বসিয়ে রাখব। তোকে বুঝলি সুবচনি, তোকে তোর ছেলেকে নিয়ে ঐ যে পাহাড় দেখছিস সেখানে নিয়ে যাব। পাথরের নীচে রেখে পাষাণের ভার চাপিয়ে দেব। তবু যদি তোর চোখে জল না আসে দুঃখে, তবে তোর মুখে মুতে দেব।
তখন সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছিল। পাখিটা দাঁড়ে বড় বেশি ছটফট করছে। বড় বেশি কিচমিচ করছে। পাখিটার তবে বুঝি জল তেষ্টা পেল। সে বাটিতে করে সামান্য জল দিল পাখিটাকে। কিন্তু পাখি জল খেল না। পাখা ঝাপটাতে থাকল। এবং পা দিয়ে বাটির জল উলটে চিঁ চিঁ করে কাঁদতে থাকল!
পাখিটাত এমন করে না কোনওদিন! সুবল ভাবল। সুবল অস্বস্তি বোধ করছে। পাখিটা ছটফট করলে ওর বড় কষ্ট হয়। সে ভালোভাবে জুতো পালিশে মন দিতে পারছিল না। সুতরাং লোকটা রেগে মেগে পয়সা না দিয়ে চলে গেল।
সুবল ভাবল, বাঁচা গেল। লোকটি পয়সা দেয়নি বাঁচা গেল। লোকটি চলে গেছে, সুতরাং সুবল এখন পাখিটার দিকে ভালোভাবে মন দিতে পারবে। সে ওর ক্রিমের কৌটার মুখ বন্ধ করে ব্রাস দিয়ে কাঠের বাক্সটাতে একটা বাড়ি মারল, তারপর ব্রাসটা নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই সাতসকালে তোর কী হল বাপু।
পাখিটা দাঁড় থেকে উঠে সুবলের হাতে ঠোকরাতে থাকল। সুবল কী ভেবে বলল, আমাকে ভালো লাগছে না। তবে যা, উড়ে যা। বলে সে পা থেকে শেকল খুলে দিল। আর শেকল খুলে দিতেই পাখিটা সামনের দেবদারু গাছ অতিক্রম করে সামনের ছোট মাঠ পার হয়ে একটা জানালায় গিয়ে বসল। আর সেখানে বসে সেই আগের মতো প্রাণপণে চিঁ চিঁ করতে থাকল।
সুবল কিছু একটা ঘটবে, ঘটেছে ভেবে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখল ঘরের ভিতর টুকুনদিদিমণি, সংজ্ঞাহীন, বড় বড় ডাক্তার, অনেক খেলনা চার ধারে। পাখিটা কিচ কিচ করছে বলে নার্স ছুটে এসে পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে চাইলে, সুবল বলল, আমাদের টুকুনদিদিমণি না? টুকুন টুকুনদিদিমণি, সে খেপা বালকের মতো ডাকতে থাকল, সে এত উত্তেজিত যে এইসব বড় বড় ডাক্তারদের আদৌ ভ্রুক্ষেপ করল না। সে জানালার ওপরে উঠে গেল। পাখিটা সুবলের উত্তেজনা যেন ধরতে পারছে, পাখিটা সুবলের চারপাশে এখন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সুবল ডাকছে, টুকুনদিদিমণি আমি এসে গেছি। আমি তোমাকে কত খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছি। এই দেখ টুকুনদিদিমণি সেই দুষ্টু পাখি, দেখ নীল লাল কুঁচ ফল।
একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল তুমি কে বাপু।
—আমি সুবল। সুবল আমি। আমরা ট্রেনে করে আসছিলাম…।
—অঃ তুমি সুবল। নার্সের মনে হল যেন সেই এক গল্প টুকুনের মা বাবা করে গেছে, এক সুবল, পাখিয়ালা সুবলকে দেখে টুকুনদিদিমণি হাতে তালি বাজিয়েছিল। সেই সুবল এসে গেছে। নার্স এবার ধীরে ধীরে বলল, টুকুনদিদিমণির খুব অসুখ। টুকুনদিদিমণি বাঁচবে না।
সুবল বলল, বাঁচবে না কেন?
—ওর ভয়ঙ্কর অসুখ।
—কী অসুখ।
—নার্স অসুখটার নাম করতে পারত। কিন্তু সাধারণ এক পাখিয়ালা সুবলকে এত ফিরিস্তি দিয়ে কী লাভ। সে বলল, তুমি অতসব বুঝবে না। তুমি যদি টুকুনদিদিমণিকে দেখতে চাও, ঘুরে সামনের দরজায় এসো।
—আমি ত এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি টুকুন দিদিমণিকে। দিদিমণি ঘুমুচ্ছে।
নার্স এবার বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছে।
—জাগলে একবার ডেকে দেবেন। আমি দেবদারু গাছটার নীচে রয়েছি। আমার কথা আছে অনেক। টুকুনদিদিমণি বলেছিল কলকাতায় এলে আমি যেন ওর সঙ্গে দেখা করি।
নার্স বলল, এখন যাও বাপু। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন। তুমি গিয়ে চুপচাপ দেবদারু গাছের নীচে বসে থাক।
—দিদিমণির বাবা মাকে দেখছি না?
—ওরা বিকেলে আসবে। তুমি যাও বাপু। কথা বল না। ডাক্তারবাবুরা বিরক্ত হচ্ছেন।
—তবে আমার পাখিটা এখানে থাকল।
—পাখি আবার কেন।
—দিদিমণি জাগলে সে আমাকে ডেকে দেবে।
—না বাপু পাখি টাখি রেখ না। তুমি তোমার পাখি নিয়ে চলে যাও। টুকুন জাগলে তোমায় ডেকে দেব।
—সত্যি ডেকে দেবে ত?
নার্স বিরক্তি প্রকাশ না করে আর থাকতে পারল না, যাও বলছি।
—যাচ্ছি। সে পাখিটাকে ডাকল, আয়।
পাখিটা নড়ল না। পাখিটা গরাদে বসে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সুবল বলল, এ এখন যাবে না। আমি যাচ্ছি। পাখিটা আপনাদের কোনও বিরক্ত করবে না!
—না নিয়ে যাও বলছি।
পাখিটা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, টুকুন চোখ খুলছে। পাখিটা এবারে ভিতরে ঢুকে ফুর ফুর করে উড়তে থাকল। টুকুন ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখল সেই পাখি—সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো—গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা! টুকুন মনে করতে পারছিল না এই পাখি সে প্রথম কোথায় দেখেছিল। সে পাখিটাকে কোথায় দেখেছে। কবে কখন! এই প্রিয় পাখি কার, কে এই পাখি নিয়ে এসেছিল তার কাছে। যেন স্বপ্নের মতো তার কাছে এক পাখি এসে গেছে, লাল রিবন বাঁধা পাখি! সে এই পাখি দেখে কত দীর্ঘদিন পর যেন মনে করতে পারল—এ পাখি সুবলের পাখি। সুবলকে ফেলে তার কাছে চলে এসেছে। পাখি দেখে টুকুন প্রথম জল খেতে চাইল, জল দিলে সে পাখিটাকে ধরার জন্য হাত তুলতে গিয়ে মনে হল শরীরের ভিতর কী যেন কেবল শির শির করছে। সে সামান্য হাসতে পারল, আরামদায়ক এক অনুভূতি! পাখি, সুবলের পাখি, পাখি যখন এসে গেছে তখন সুবলও এসে যাবে। সুবল, পাখিয়ালা সুবল এই সংসারে এলে আর কোনও দুঃখ থাকবে না। টুকুন সামান্য না হেসে যেন থাকতে পারল না।
বিকালের দিকে টুকুনের বাবা সুরেশবাবু এলেন। ওদের পারিবারিক ডাক্তার এলেন। এবং টুকুনের মা শিয়রে বসেছিল। নার্স, সকালের দিকে টুকুন সংজ্ঞাহীন হয়েছে আজও—খবরটা সুরেশবাবুকে দিতে গিয়ে সেই পাখিয়ালার গল্পও করে ফেলল।
সুরেশবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
নার্স দেবদারু গাছটার দিকে হাত তুলে বলল, ওর নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। সকালের দিকে এসেছিল। খুব বিরক্ত করছিল টুকুনকে। তাই তাড়িয়ে দিয়েছি।
—ওর পাখিটা এখনও আছে?
—পাখিটাকে নিয়েই ত সব ঝামেলা। ঘরের ভিতর ঢুকে কেবল ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে। আমার কথা শুনছে না, পাখিয়ালার কথা শুনছে না। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে আমি তখন ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম। সে পাখি নিয়ে দেবদারু গাছের নীচে বসে আছে।
নার্স ভুলে গেল পাখিটা যখন উড়ছিল তখন টুকুনের মুখে সামান্য সজীবতা লক্ষ্য করা গেছে। নার্স ভুলে গেল বলতে সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে টুকুন পাখির ডাক শুনে জেগে উঠেছে। আর ভুলে গেল বলতে পাখিয়ালা বিশ্বাস করছিল না, টুকুন বাঁচবে না।
মা টুকুনের কপালে হাত রাখল। টুকুনকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। খেলনাগুলো সব একদিকে জড়ো করা। নার্স বিকেলের দিকে চুল বেঁধে দিয়েছে। মুখে সামান্য পাউডার। মুখের এনিমিয়া ভাবটা এখন আর তত স্পষ্ট নয়। সকলের মুখই বিষণ্ণ। বিশেষ করে টুকুনের মা সারাক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, এখন আর আমাদের কিছু করণীয় নেই।
—না কিছু করণীয় নেই।
—সংক্ষেপে বুঝলেন সুরেশবাবু, ডাক্তারবাবু কেমন বিচলিতভাবে কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
—আপনি উদ্যমহীনতার কথা বলতে চাইছেন।
—হুঁ আমরা কেমন যে ক্রমশ উদ্যমবিহীন হয়ে পড়ছি সকলে।
—তিনি একটু থামলেন, তারপর টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। ওর ভিতরের কলকবজাগুলো ঠিকমতো প্রথম থেকেই কাজে লাগেনি।
সুরেশবাবু বললেন, কিন্তু আমার দিক থেকে ত’ কোনও ত্রুটি ছিল না ডাক্তারবাবু।
আর তখন কে যেন পথে পথে বনে বনে বলে গেল, কে যেন হেঁকে হেঁকে গেল, পথ দিয়ে মানুষ যায় দেখ, ঘোড়া যায় গাড়ি যায় দেখ, দুঃখ যায় সুখ যায় দেখ। দেখ দেখ মানুষ কত মানুষ, কত হিসাবের মানুষ পোস্টার মারছে দেয়ালে—খেতে পায় না, অনাহারে দুর্ভিক্ষে মানুষ সব গ্রামে মাঠে মরে থাকছে।
অথবা যেন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল শহরটা—জল চাই, অন্ন চাই। শুধু লেখা ছিল না উদ্যমবিহনে কিবা পূরে মনোরথ! সুরেশবাবু নিজের চোখে মেয়ের চোখ দেখছিলেন, এক দুরারোগ্য ব্যাধি এই মেয়ের! ঠিক যেন তার কলকারখানার মতো। আয় নেই, ব্যয় বাড়ছে, শ্রমিকেরা উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। টাকার দাম কমছে, জিনিসপত্র আকরা। এক রোগ তার কলকারখানাকে উৎখাতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তিনি সে ক্ষয় থেকে তাকে রক্ষা করতে পারছেন না…ঠিক যেন এই মেয়ে, যে ইচ্ছা করলেই বেঁচে উঠতে পারে ভিতরের উদ্যমহীন এক ক্ষতজাত রক্ত কিছুতেই তাকে সুস্থ হতে দিচ্ছে না।
সুরেশবাবু যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন, তোরা বল, বুকে হাত দিয়ে বল, যা এখন উৎপাদন করছিস, তোরা মনপ্রাণ দিলে তার দ্বিগুণ দিতে পারিস।
এক দৈত্য বোধহয় নিয়মের দৈত্য অথবা আদাইয়ের দৈত্য হু হু করে হেসে উঠল—স্যার আপনি কী জলে ডুবে স্বপ্ন দেখছেন। আমরা কী আর উৎপাদন বাড়াতে পারি!
সুরেশবাবু মেয়ের মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। ভিতরে মেয়ের সেই ক্ষতজাত রক্ত কেবল ভিতরে ঘুরে ঘুরে আমরণ পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য লড়াই। যেন এই মেয়ে তার নিজের ভিতরেই ক্ষয়কে ভালোবেসে পুষে রেখেছে। সে বলল, টুকুন তুমি ঐ দেখ পাখিয়ালা সুবল এসে গেছে। তুমি তখন হাতে তালি বাজিয়েছিলেন, এখন পারো না। ঐ দেখ সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। তাকে ডাকব?
টুকুন হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। যেন কোনও অমল আনন্দের খবর বয়ে আনার মতো মানুষ তার আর নেই।
সে শুধু বলল, বাবা জল খাব। জল।
সুরেশবাবু নার্সকে জল দিতে বলে বের হয়ে গেলেন। যে বাঁচতে চায় না, তাকে বাঁচিয়ে লাভ নেই। সুরেশবাবুর মুখে অবসাদের চিহ্ন। তিনি বড় বড় হাই তুলতে থাকলেন।
সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে ছিল। রাস্তায় আলো জ্বলছে। ফুটপাতে মানুষের ভিড়। কোথায় কী গণ্ডগোল হয়েছে, সহসা শহরের ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে। কিছু টেম্পো, লরি এবং রিকশা মানুষ বইছিল, রাস্তা ফাঁকা বলে সব ছোট ছোট ছেলের দল রাস্তার উপর বল খেলেছিল, ক্রিকেট খেলছিল এবং হাডুডু খেলছিল।
অথচ দেবদারু গাছটার নীচে বসেছিল সুবল, রাতে সে এই গাছের নীচে শুয়ে থাকবে। সঙ্গে ওর ছোট এক সতরঞ্চ আছে, অপরিচ্ছন্ন হলে সে সব গঙ্গার জলে ধুয়ে নেয়। আর ঐ গাছের নীচ থেকে টুকুন দিদিমণির জানালা স্পষ্ট। এখন মনে হচ্ছে দিদিমণির ঘরে কেউ নেই। ঘর ফাঁকা। শুধু সেই রাজা, কিছু পরি এবং বিড়াল, কুদুমাসির মুখ দেখা যাচ্ছিল। সে তার পাখির দিকে মুখ তুলে তাকাল। পাখিটা দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। সে এবার সব গোছগাছ করে কাঁধে ফেলে জানলার দিকে এগুতে থাকল, যখন কেউ নেই, জানলা দিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঘরে একটা নীল আলো জ্বলছে, তখন সুবল কিছুতেই দেবদারুর নীচে বসে থাকতে পারল না। কী এক অপরিসীম ভালোবাসা আছে টুকুনদিদিমণির, টুকুনদিদিমণি ছুটে গিয়েছিল দরজায়, দরজা খুলে বলেছিল, এখানে কেউ নেই, এ কামরায় কেউ ঢোকেনি। বলে পুলিশের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল—সেই থেকে মনে হয়েছে সুবলের এমন ভালোবাসার জন আর তার কেউ নেই। এমন আপনার জন তার আর পৃথিবীতে কেউ নেই। টুকুনদিদিমণিকে সে যেন ইচ্ছা করলে সব দিয়ে দিতে পারে। আর এই যে পাখি, যার মূল্য সুবলের কাছে প্রাণের চেয়েও অধিক, ইচ্ছা করলে সুবল টুকুনদিদিমণিকে খুশি করার জন্য সেই অমূল্য ধনও উড়িয়ে দিতে পারে। তার যা কিছু সম্বল, যা কিছু সঞ্চয় সব এই টুকুনদিদিমণিকে দিয়ে দিতে পারে। ঘর ফাঁকা দেখে সে কিছুতেই আর গাছের নীচে বসে থাকতে পারল না—জানালায় এসে কাঁধ থেকে ঝোলাঝুলি নামিয়ে ফিস ফিস করে ডাকল, টুকুনদিদিমণি আমি এসেছি।
জানলার দিকে মুখ ছিল টুকুনের। স্প্রিং—এর খাট, শিয়রের দিকটা একটু উঁচু করা। টুকুনদিদিমণির চোখ ঘোলাটে, যেন স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। প্রায় অন্ধের মতো—অথবা সংজ্ঞাহীনের মতো ঠিক যেন তার সেই খরা অঞ্চল, কোনওকালে বৃষ্টি পায় না আর ফসল ফলবে না, সোনার ফসল ঘরে তুলে কেউ আর উৎসবে পার্বণে আলো জ্বালবে না। সে ফিস ফিস করে ডাকল, দিদিমণি, দিদিমণি আমি সুবল চিনতে পারছ না? আমাকে তুমি চাদর দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলে, আমাকে তুমি পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে। আমি পাখিয়ালা সুবল।
—কে? সুবল!
—হ্যাঁ আমি সুবল। আমি তোমাকে কুঁচফল দিয়েছি।
—তুমি আমাকে রঙবেরঙের পাথর দিয়েছ সুবল।
—আমি তোমাকে চন্দনের বীচি দিয়েছি।
—আমার শিয়রে সব আছে।
—কৈ দেখি। সুবল দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। কিন্তু অবাক টুকুন তার হাত—পা নড়াতে পারল না।
সুবল বলল, কৈ দেখি। তোমার শিয়রের নীচে কোথায় রেখেছ দেখি।
টুকুন বলল, নার্স এলে বলব। নার্স শিয়রের নীচ থেকে চন্দনের বীচি বের করে দেখাবে।
—কেন তুমি পারো না!
—না সুবল। আমি পারি না। আমি হাঁটতে পারি না সুবল। কতদিন আমি হাঁটি না। কতদিন আমি মাঠে মাঠে হেঁটে বেড়াইনি। বলে দুঃখী এক মুখ নিয়ে সুবলের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর সামনের মাঠে যে আলো জ্বলছিল, সামনের পার্কের বেঞ্চগুলোতে যে মানুষগুলো বসেছিল তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, জানো সুবল কেউ বিশ্বাস করে না। আমি ট্রেনে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম, ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। বলে সে আঙুলে সমস্ত ফুলপরি, জলপরি, রাজা এবং অন্যান্য পুতুলদের উদ্দেশ্য করে দেখাল।
সুবল বলল, যা তুমি আবার হাঁটতে পারবে না কেন? তুমি ঠিক হাঁটতে পারো।
—আমি হাঁটতে পারি তাই না সুবল? আমি ট্রেনে হেঁটেছিলাম তাই না সুবল। বলে সে খুব উচ্ছ্বল হয়ে উঠল।
—তুমি এখন হাঁটতে পারো।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হল টুকুন খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। সে আর সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। কী যেন ভাবছে। সে সুবলকে বলতে চাইল, আমি আর হাঁটতে পারি না। তোমাকে ইচ্ছা হয় বারবার হেঁটে দেখাই। কিন্তু সুবল আমি সত্যি পারি না এখন। গায়ে শক্তি নেই। হাতে পায়ে স্থবির একভাব সব সময়।
টুকুনের চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল ফের। ভিতরে লজ্জাকর অনুভূতি। বড় মাঠ সামনে, আর এতসব ট্রাম বাস চোখের উপর দিয়ে ছুটছে, এতসব মানুষজন পথ পার হয়ে যাচ্ছে—ওদের দেখে টুকুনের ভিতর সব সময় অসহিষ্ণু ভাব। টুকুন ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল।
সুবল যেই দেখতে পেল, টুকুনদিদিমণির চোখ ফের ঘোলা হয়ে যাচ্ছে—সে বলল, টুকুনদিদিমণি, তুমি হাঁটতে পারো। তুমি হেঁটে হেঁটে ইচ্ছা করলে, অনেক দূরে চলে যেতে পারো।
আমি হাঁটতে পারি সুবল তুমি বলছ?
টুকুন এবার তার খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে রাজা এখন বুঝতে পারছিস, আমি হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। এই দেখ সুবল, পাখিয়ালা সুবল, সব দেখেছে। ওদের দেশে খরা বলে ও কলকাতায় চলে এসেছে। ওর সঙ্গে ট্রেনে কত কথা বলেছি। ওর পাখিকে আমি খেতে দিয়েছি। আমি তোদের মতো নেঙ্গু নইরে। তোদের মতো এক জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে থাকি না।
সুবল বলল, এই যে পাখি দেখছ, ওর কেউ ছিল না। একদিন ফিরে আসার সময় দেখি গাছের নীচে পড়ে ছটফট করছে। ওর মা বাবা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখে বুঝি পালিয়েছিল। পাখিটা নড়ে না, খায় না, পাখির চোখ ঘোলাটে। এই পাখি সকলে বলল মরে যাবে, আমি পাখিকে নিয়ে মাঠে চলে গেলাম, সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খুঁজে বের করলাম। অতল জলের স্বাদ মুখে দিলাম। নদীর জলে স্নান করালাম, সুবচনি দেবীর মন্দিরে গিয়ে মানত করলাম, মা আমার পাখিকে উড়িয়ে দে আকাশে, উড়িয়ে দে সব, পাখির চোখে নদীর জল লেগে পাথরের মতো কালো হয়ে গেল। সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খেয়ে পাখা গজালো, অতল জলের স্বাদ পেয়ে পাখি তাজা হল—কিন্তু হায় পাখি আমার আকাশে ওড়ে না, চলে না ফেরে না। পাখিকে নিয়ে কী কষ্ট! মাঠে নেমে পাখিকে বলতাম ঐ দেখ বড় মাঠ, ঐ দেখ বড় গাছ, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা! সে কী দৌড়ঝাঁপ গেছে। খরা চলছে গ্রামে মাঠে, মানুষ রোদে বের হতে চায় না, আমি পাখিকে শুধু বললাম, পাখি, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা। একদিন দুদিন গেল, মাস গেল, এবং মাঝে মাঝে আমরা নদীতে জলের সন্ধানে বের হতাম, পাহাড় চারপাশে, কত গাছপালা ফুল ফল পাখি ছিল, খরায় সব পুড়ে গিয়েছে। চারদিকে তাকালে কান্না পায়, জল খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে পাখিকে বলতাম—উড়ে যা। আপন প্রাণের আবেগে উড়ে যা। বলে সুবল নিজের পাখিকে বলল, উড়ে যা, তোর টুকুনদিদিমণি দেখুক—সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়তে থাকল ডিগবাজি খেতে থাকল—কোথাও উড়ে গিয়ে নিমেষে ফিরে এল, রাজার মাথায় বসেছে কিন্তু মলমূত্র ত্যাগ করলে মনে হল চোখের নীচে রাজার পিচুটি। রাজা যেন হাপুস নয়নে কাঁদছে।
তখন সুবল বলল, দেখ দিদিমণি দেখ, তোমার রাজার চোখে পিচুটি, রাজা কেমন মুখগোমড়া করে আছে। টুকুন ঘাড় ফিরিয়ে রাজাকে দেখতে পেয়েই হো হো করে হেসে উঠল।—ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে। পাখি তোমায় উচিত শাস্তি দিয়েছে। পাখিটার কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। পাখি আকাশে ওড়ার মতো ঘরের ভিতর দোল খেয়ে উড়ছে।
সুবল বলল, দিদিমণি ওর পাখায় কত রাজ্যের স্বপ্ন দেখো।
সুবল বলল, দিদিমণি পাখির পায়ে কত রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখো।
তারপর সুবল কেমন নেচে নেচে বলতে থাকল, আকাশ দেখো, সমুদ্র দেখো, দেখো দেখো মাঠ দেখো, পাহাড় দেখো, পাখিটা সেই দেখার মতো ঘরের ভিতর উড়তে থাকল, সমুদ্র দেখার মতো বাতাসের উপর ভাসতে থাকল, নদী দেখার মতো এঁকেবেঁকে সোজা উপরে নীচে উঠে গেল। টুকুন সব দেখছিল। জাদুকর তার পাখির খেলা দেখাচ্ছে। জাদুকর এই ঘরে পাখির খেলা দেখিয়ে সকল দুঃখ যেন দূর করে দিচ্ছে।
টুকুন মনপ্রাণ ঢেলে এই পাখির খেলা দেখতে থাকল। ভিতরে সেই শির শির ভাবটা কাজ করছে। ভিতরে, সেই প্রাণের ভিতরে শির শির ভাবটা কাজ করছে। যেন শরীরের সর্বত্র রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে। শরীরের ভিতরে কোথাও এক হীরামন পাখি এতদিন চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিল এই পাখির খেলা দেখতে পেয়ে সে—পাখি আকাশে ওড়ার জন্য ডানায় যেসব রাজ্যের ক্লান্তি জমে ছিল এতদিন, তাই উড়িয়ে দিল। প্রাণের ভেতরে এক পাখি আছে, ওড়ার পাখি, সেই পাখির আজ কতদিন পর যেন ওড়ার প্রত্যাশায় চোখে মুখে হাসির আনন্দ, হায় এই হাসির আনন্দ কোথাও শেষ পর্যন্ত থাকে না, মানুষেরা এই হাসির আনন্দ প্রাণের কখন যেন বড় হতে হতে হারিয়ে ফেলে।
টুকুন ধীরে ধীরে দেখল অনেকক্ষণ ওড়ার পর পাখিটা ক্লান্ত হয়ে সুবলের মাথায় গিয়ে বসেছে। রাত বাড়ছিল। সুবল ধীরে ধীরে জানালা থেকে নেমে ফের দেবদারু গাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। টুকুন জোরে চিৎকার করতে চাইল, সুবল তুমি আবার কাল এসো। আমি জানালায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এবং পিছনে দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল নার্স দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। টুকুন এতক্ষণে বুঝতে পারল নার্সের ভয়ে সুবল চুপি চুপি কিছু না বলে পাখি নিয়ে চলে গেছে।
সাত
জনার্দন বুঝতে পারল, আর রক্ষা নেই। মাটি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো উত্তাপে গাছপালা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কোথাও সামান্য রস সঞ্চিত নেই। এখন এই পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে শুধু মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করে বসে থাকা। জনার্দন মন্দিরের ভিতর পায়চারি করছিল। হাত—পা শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। চোখে আর প্রায় দৃষ্টি ছিল না। সে এখন আর পাহাড়ের ওপর উঠে পাথর নিক্ষেপ করতে পারছে না। সমস্ত উদ্যম নিঃশেষ হয়ে গেল।
দাবানলের মতো জ্বলে সূর্য অস্ত চলে গেল। জনার্দন অভ্যাসমতো বের হয়ে পড়ল। চোখের দৃষ্টি কমে আসছে বলে সে ধীরে ধীরে পরিচিত পথ ধরে পাহাড় থেকে নেমে সমতল পথ ধরে হাঁটতে থাকল। আজ প্রায় চারদিন হল জনার্দন শুধু জল খেয়ে আছে। জনার্দন আজও শেষবারের মতো বের হয়ে পড়ল। যদি কোনও আহার্য বস্তু সংগ্রহ করতে না পারে, যদি পাহাড়ময় এবং মাঠময় কোনও মৃত জীবজন্তু অথবা ঘাসপাতা সংগ্রহ করতে না পারে তবে মনে হচ্ছিল মৃত্যু অবধারিত। এই মৃত্যু ওকে গ্রাস করবে ক্রমশ। এখন আর পায়ে শক্তি নেই যে সে দূরের কোনও শহরে অথবা গঞ্জে চলে যাবে। ষাট সত্তর মাইল হেঁটে যাবার শক্তিটুকু জনার্দনের শেষ হয়ে গেছে। সে হাঁটছিল এবং মাঝে মাঝে আবেগে মা মা বলে ডেকে উঠছিল।
জনার্দনের হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সংসারে একরকমের তেষ্টা আছে যা কোনওকালে নিবারণ হয় না। একরকমের অভাব আছে যা কখনও দূর হয় না। আর একরকমের অহঙ্কার আছে যা কোনওকালে শেষ হয় না। জনার্দনের সেই অহঙ্কার। শস্যশ্যামলা এই দেশে প্রথম পিতৃপুরুষেরা আসেনি। পাহাড়ি অঞ্চল ছিল। সেখানে লোকালয় বিশেষ ছিল ন। নির্জন এক পাহাড় ঘেরা প্রান্তরে সামান্য ক’ঘর আদিবাসীর ভিতর তার কোনও পিতৃপুরুষ এসেছিল সুবচনি দেবীর ভার কাঁধে নিয়ে। সে এসেছিল বলে, দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে, এবং দিনমান এই মাঠের ভিতর উপুড় হয়ে পড়ে থেকে সব ঘাসবিচালি তুলে নিয়েছিল বলে বর্ষার শেষে কী ফসল, কী ফসল। এত ফসল হয় মাটিতে মানুষের জানা ছিল না। পাহাড়তলি অঞ্চল থেকে মানুষজন ফসলের লোভে চলে এসেছিল—আর যায়নি। তার পূর্বপুরুষ এক বন্ধ্যা মাটিকে উর্বরা ভূমি করে সংসারে প্রায় পির সেজে গেল। তারপর থেকেই বংশের ভিতর এক নিদারুণ অহঙ্কার। উৎসবে, পালাপার্বণে মানুষের সুখে দুঃখে সব সময় এই দেবীর সেবাইত প্রায় ঈশ্বরের সমতুল্য। জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মা মা—মা সুবচনি তুই নিষ্ঠুর হলে চলবে কেন—আমার অহঙ্কার মুছে দে মা। সামান্য বৃষ্টি দে মা। রাগ করে মা কার ঘরে বসে আছিস। বৃষ্টি দে মা, মাঠে ঘাসবিচালি গজাক। পাখি—পাখালি উড়ে আসুক মা। গাছে গাছে ফুল ফুটুক। ফল হোক মা গাছের শাখা—প্রশাখাতে। তোর লীলা মা আর কতকাল চলবে।
কিন্তু হায় কার কথা কে শোনে। শেয়াল ডাকছে না। কুকুরের আর্তনাদ নেই কোথাও। চারিদিকে বীভৎস জ্যোৎস্না! সাদা আলো মাঠময়। সেই মাঠের ভিতর বসে একসঙ্গে কারা যেন নিত্য কেঁদে চলেছে। জনার্দন একটু থমকে দাঁড়াল। কারা কাঁদছে! ঠিক যেখানে নদী সামান্য বাঁক নিয়েছে, যেখানে ক’ঘর মুন্ডা জাতীয় আদিবাসী ছিল, এবং যেখানে পেটের জ্বালায় ঘরের এক বউ ফাঁসি দিয়েছিল সেইসব মাঠে এবং গাছের ভিতর একদল মেয়ে যেন হাজার হবে, তার বেশিও হতে পারে বসে বসে কাঁদছে। জনার্দনের প্রায় পা চলছিল না। এমন বীভৎস দৃশ্য জনার্দন কোনওকালে যেন দেখেনি। হাজার ঘোড়া ছুটছে। ঘোড়ার পিঠে সব নারী—পুরুষের মুখ ঝুলছে। দেহ নেই। শুধু মুখ। তারপর একটা কালো ঘোড়া যেন ছুটে গেল, সেই ঘোড়ার পিঠে শুধু এক তরবারি। তারপর মনে হল সুবচনি দেবী মাঠের ভিতর ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। ছোট সুবচনি দেবী হাত পা বিশাল করে, স্তনে সন্তান ঝুলিয়ে ঠিক কোনও ভৈরবীর মতো দু হাত ওপরে তুলে জনার্দনের দিকে এগিয়ে আসছে। আর মনে হল হাজার হাজার কঙ্কাল সেই সুবচনি দেবীর চারপাশে আনন্দে নৃত্য করছিল। জনার্দন এবার বলল, মা আমার আর কোনও অহঙ্কার নেই মা। আমি ক্ষুধার জন্য অন্ধ হয়ে যাচ্ছি মা। মা আমার এই পিতৃপুরুষের দেশকে শ্মশান করে দিলি মা। আমি যে মা বড় ঘোরে পড়ে যাচ্ছি। জনার্দন হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল।
জনার্দন ধীরে ধীরে আরও নীচে নেমে এল। সে একনাগাড়ে হাঁটতে পারছিল না বলে কোথাও সামান্য সময় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। জলের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। খাদ্য অন্বেষণের জন্য সে নেমে যাচ্ছে। যেখানেই সে বসত—চারপাশে শুধু মৃত গাছের ডাল। হাওয়া দিলে মরমর শব্দ করে কিছু গাছপালা ভেঙে পড়ত। জনার্দনের ইচ্ছে যায় তখন, মৃত ডালে, গাছে গাছে এবং সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দিলে কেমন হয়। মা সুবচনিকে পুড়িয়ে মারলে কেমন হয়। ভাবতে ভাবতে জনার্দন হা হা করে হেসে উঠল।
আবার জনার্দনের হাঁটা। দক্ষিণের মণি পাহাড়ে উঠে গেলে হয়তো এখন কিছু কাঁটাজাতীয় গাছ মিলতে পারে। কম জল হলে ওরা বেশি গজায়। পাথরের ফাটল থেকে রস চুষে ওরা বড় হয়। কিন্তু শরীর দুর্বল, মণি পাহাড়ে উঠে যাবার সাধ্য যেন একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে জনার্দনের। সে হেঁটে হেঁটে শেষ যে পাহাড়ের মাথায় রোজ উঠে পাথর নিক্ষেপ করত তার নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। জ্যোৎস্না রাত বলে পাহাড়ের শেষ দিকের অংশটুকু একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। সে এবার সেই যোজকের নীচের অংশটুকুতে এসে দাঁড়াল। পাথরে পাথরে জায়গাটা খুব উঁচু হয়ে গেছে। এবার নদীতে জল এলে প্রায় হ্রদের মতো জায়গাটা ঘিরে জল ধরে রাখবে। সে জলের আশায় বৃষ্টির আশায় আকুল হতে থাকল। বৈশাখ চলে গেছে, জ্যৈষ্ঠ যাব যাব করছে। অথচ একবিন্দু বৃষ্টি নেই। এবারেও মা সুবচনি এ—অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে রাখবে। রাগে দুঃখে জনার্দন পাথরের ওপরই খামচাতে থাকল।
দুঃস্থ মানুষ জনার্দন অহোরাত্র খাদ্য অন্বেষণের পর ক্লান্ত হয়ে নদীর স্রোতের উঁচু অংশটাতে চুপচাপ বসেছিল। ভোর হতে আর দেরি নেই। হরিণী তার দুই শিশু সন্তান নিয়ে এবার নেমে আসবে। ওদের জলপান করানো হলে জনার্দন পেট পুরে জলপান করবে। তারপর, মন্দিরের ভিতর সারাদিন পড়ে থাকা ক্ষুধার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়া—হায় জনার্দন প্রায় এখন কিছুই ভাবতে পারছিল না। সামনে যেসব গঞ্জ ছিল সেও সুনসান। কোনও কোলাহল নেই, ক্রমশ এক অন্ধকার এই পাহাড়ঘেরা মাঠে নেমে এসে সব অঞ্চলটাকে ভূতপ্রেতের রাজত্ব করে দিল।
জনার্দন মনে মনে খেঁকিয়ে উঠল, না হয় না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল যে কোনও মই বেয়ে এবার প্রায় আকাশের কাছাকাছি উঠে যাবে, এবং আকাশটাকে মা সুবচনির খাঁড়া দিয়ে দুভাগ করে দেবে। দু ভাগ করে দিলেই ঝর ঝর করে জল নামবে। সে এই ক্লান্ত শরীরেও মই বেয়ে ওঠার মতো দু হাত তুলে দিল আকাশের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলতে চাইল, জল দে। আমি যদি তোর কাছে পাপ করে থাকি, আমার প্রাণের বিনিময়ে জল দে। বলে সে বালিয়াড়ির ওপর সটান শুয়ে পড়ল এবং হাত দুটো পিঠের উপর যেন দুটো হাত বাঁধা অবস্থায় ওকে বলি দেওয়া হচ্ছে এমন ভঙ্গি নিয়ে বালির উপর শুয়ে পড়ল।—এবার দে এক কোপ। ভ্যাঁ। জনার্দন বালির ওপর কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকল এবং ব্যা ব্যা করে ডাকতে থাকল। যথার্থই যেন ওকে সুবচনি দেবীর মন্দিরে পাঁঠার মতো বলি দেওয়া হচ্ছে এখন।
না এভাবে পড়ে থেকে লাভ নেই—জনার্দন উঠে পড়ল। নিশুতি রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মাঠ, গাছ, পাহাড় যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে তাকে হত্যা করবে বলে। জনার্দন উলঙ্গ ছিল বলে উপবীত ডানদিকের কোমরের কাছে ঢলঢল করছিল। মনে হচ্ছিল উপবীত ওর শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে উপবীতে হাত রেখে হাঁকল, কে আসবি আয়, কার কত হিম্মত আছে আয়, কত লড়বি এই ঠাকুরের সঙ্গে আয়—কারণ জনার্দনের মনে হচ্ছিল শুধু সুবচনি নয়, শুধু এই অঞ্চলের মানুষজন নয়, সকলেই যেন, যেন গাছ, ফুল, পাখি, পাহাড় সকলে মিলে ওর সঙ্গে তঞ্চকতা করছে। অথবা রসিকতা করছে—হায় জনার্দন তোদের ফসলের অহঙ্কার ভালোবাসার অহঙ্কার এবারে সব মুছে যাবে।
ঠিক তক্ষনি লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে আসছে হরিণী আর তার দুই শিশু। সোনার হরিণের মতো দেখাচ্ছিল প্রায়। ভোর রাতের জ্যোৎস্নায় ওদের চোখগুলো বড় উজ্জ্বল ছিল। বালিতে পায়ের দাগ পড়েছে। ওদের শরীর এত নরম এবং উজ্জ্বল যে জ্যোৎস্নায় মনে হচ্ছিল শরীর থেকে পিছলে যাচ্ছে। ওরা নেমে আসছিল এবং পিছনের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। জনার্দনের এখন আর মৃত্যুভয় থাকছে না। মাঠ এবং পাহাড়কে এখন দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে না। এখন যেন জনার্দন আর একা নয়। সে এবং এই তিন বন্যপ্রাণী মিলে চারজন। সে প্রায় সুবচনি দেবীর মন্দিরে যেমন একা একা কথা বলে দিন কাটায় অর্থাৎ সেই সুবচনির সঙ্গে কথা বলে, এবং সুবচনির হয়ে কথার উত্তর দেয় তেমনি এই নদীর খাতে হরিণদের সঙ্গে প্রায় একা একা কথা বলার স্বভাব।—তা হলে তোরা এলি। তোদের জন্য আমি কখন থেকে বসে রয়েছি। তোরা তো বাপু দ্রুত ছুটতে পারিস, কোথায় কোনও বনে দ্রুত ছুটে যাস কে জানে। আহারের কোনও অসুবিধা হচ্ছে নাত! জনার্দন ওদের সঙ্গে প্রায় সাধু ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করে দিল।
সে ওদের নাম রেখে দিয়েছে এতদিনে।
সে সবচেয়ে ছোটটাকে ডাকল—পলা এই পলা তুইত বাপু ভারী দুষ্টু। শিঙে মুখ ঘসে সুখ খাচ্ছিস। পলা পা দুটো হঠাৎ এবার পিঠের উপর রেখে প্রায় মাথার কাছে মুখ নিয়ে এল। ওর মাথার নীচে এবং গা চেটে দিচ্ছে। বোধহয় ঘাম ছিল শরীরে, এবং ঘাম শুকিয়ে নুনের গন্ধ ছিল শরীরে, পলা মনের সুখে জিভ দিয়ে পিঠ ঘাড় গলা চেটে দিতেই জনার্দন এক ধরনের সুখ পেল—অতীব সুখ, লোভের বশবর্তী সে সুখ আহারের সুখ, এমন সুখ বুঝি কতদিন সে পায়নি—সে ভিতরে আহারের এক সুখ আছে ভাবতেই মনে হল কোথায় যেন আগুন জ্বলছে, কাঠের আগুন, বন্য মানুষেরা সেই কাঠে মাংস পুড়িয়ে চিবুচ্ছে। ওর জিভ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়, জিভে জল এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে খপ করে পলাকে ধরে বুকের কাছে টেনে আনল, এবং ওদের জলপান করানোর কথা মনে থাকল না। আহারের লোভে, দীর্ঘদিনের অনাহার জনার্দনকে প্রায় পাগলের মতো করে ফেলছে। সে পলাকে নিয়ে এবার মন্দিরের দিকে দ্রুত ছোটার জন্য মাঠের দিকে উঠে যেতে থাকল।
সুবলের পাখিও দ্রুত আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে। দ্রুত যেন পাখি সকলকে হারিয়ে দেবে। দেখো হুই আকাশে উড়েছে। জানালার পাশে আর কেউ নেই এখন। সুবল এবং টুকুন।
ভোরবেলা, নার্স এখনও আসেনি ঘরে। সুবলের কেবল গমনের অপেক্ষা। ওর দেবদারু গাছের নীচে থেকে জানালা দিয়ে ঘর স্পষ্ট, নার্স না থাকলেই টুকুনদিদিমণির সঙ্গে কথা, কত কথা, রাজ্যের কথা, রাজারানিদের কথা, রাজা ঘোড়ায় চড়ে শিকারে যাচ্ছেন তার কথা—টগবগ করে ঘোড়া ছুটছে তার কথা—ঘোড়া ছুটছে, দিদিমণি—সেই ঘোড়া, কালো ঘোড়া ছুটছে। সামনে পাহাড়, পথ উঁচু টগবগ করে উঠে যাচ্ছে, থামছে না, ঘোড়ায় চড়ে যেন রাজা যুদ্ধে যাচ্ছেন। সুবল পায়ে ঠিক ঘোড়ার মতো তাল দিতে থাকল। বলল, দেখো আমার পাখি কালো ঘোড়ার মতো, বাজপক্ষী ঘোড়ার মতো রাজার দেশে চলে যেতে পারে। সে যে কত বড় রাজার দেশ! দেশে কোনও দুঃখ নেই, কত গাছ, কত ফুল ফল পাখি—রাজার দেশে মানুষের মুখে হাসি আর আনন্দ। সামনে সমুদ্র, রাজার দেশে হায় কোনও দুঃখ জাগে না। কোটাল পুত্র, রাজার পুত্র মাণিক্যের আলোতে দুখের জন্য জাগে। দিদিমণি দুঃখ না থাকলে কষ্ট না থাকলে প্রাণে, আপনি বাঁশি বাজে না।
টুকুনকে খুশি রাখার জন্য, সামান্য সুবল আবোল তাবোল যা মনে আসে যা মুখে আসে বলতে থাকে। টুকুনের সামান্য হাসি দেখার জন্য সে তার পাখি নিয়ে এসে জানলায় দাঁড়ায়। জানলায় দাঁড়ালে টুকুনের মনে হয় সুবল এসেছে পাখি নিয়ে। এই পাখির জন্য সে ট্রেনে হাততালি দিতে পারছিল, এই পাখির জন্যে সুবলের জন্য সে হেঁটে গিয়েছিল। ওর মনে হয় ওর আর আলস্য থাকার কথা নয়, আর দূরে থাকার কথা নয়। আকাশে পাখি উড়তে থাকলে—অথবা ঘোড়া ছুটছে টগবগ…তখন ঘোড়ার মতো শক্তি যেন পায়ে খেলা করতে থাকে। রাজার হাতে অসি, অসি খেলা হচ্ছে, সুবল দুহাত দিয়ে ছোট্ট একটা তালপাতার মতো বাঁশের বাঁট দিয়ে অসি বানিয়ে রাজার মতো খেলা দেখাচ্ছে। যেন এক রাজা যুদ্ধে যাবার আগে সেনাপতিদের অসির নিয়মকানুন বোঝাচ্ছে।
অথবা ওর হাতে কোনও কোনও দিন লাঠি থাকত। মেলার দিনে সকলে যেমন লাঠি খেলা দেখায়—দূর থেকে ছুটে এসে লাঠিতে মাথায় বাড়ি মারে অথবা এক দুই তিন, এক পা, দু পা, তিন পা সামনে গিয়ে ফের পিছনে—লাঠি ঠিক কোমরের সামনে রেখে ফের এক পা, দু পা এগিয়ে যাওয়া—দেখলে মনে হবে সুবল যেন পায়ের ওপর পাইকদের মতো নাচানাচি করছে। জানলা থেকে টুকুন ওর সব রকমের নাচন—কোঁদন দেখে হাসত। ওর পায়ে কী শক্তি কী শক্তি! পাখির পাখায় কী রাজ্যের স্বপ্ন। মনে হত টুকুনের সমস্ত শরীরে সহসা বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে।
তারপর সুবল যখন ক্লান্ত হত অথবা নার্স ঘরে ঢুকলে সে ভালোমানুষের বাচ্চার মতো দেবদারুর নীচে গিয়ে বসে বলত, এসে যান বাবু দেখে যান বাবু, জুতো সাফ করে যান—এবং বলত, দু আনা পয়সা দেবেন—সুবল বেশি চায়না, শুধু খেতে পরতে চায়। বলত, আর এই পাখি আছে, পাখির জন্য কিছু সঞ্চয় করে নিচ্ছি। সে মন দিয়ে জুতো সাফ করে। সে পাখিকে টেরিটি বাজার থেকে কিনে আনা কীটপতঙ্গ খাওয়াত। ওর সুখের পাখি শখের পাখির জন্য প্রায় সময় সে স্বপ্ন দেখত। স্বপ্নে টুকুনদিদিমণি খুব সুন্দর এক জরির টুপি মাথায় দিয়ে কনে বউ সেজে বসে আছে। সুবল লাঠি নিয়ে দু’পাশে নাচানাচি করছে। সুবল রাজার পাইক যেন। সুবল লাঠি নিয়ে কনে বউকে খেলা দেখাচ্ছে লাঠির। পরনে জরির কাপড়, মালকোঁচা মেরে সে কাপড় পরেছে। মাথায় পাগড়ি সুবলের। পাগড়িতে পালক আছে। সে রাজার মতো অথবা রাজপুত্রের মতো কোনও কোনও সময়, যেন ঘরে কনে বউ ফেলে হরিণ শিকারে যাচ্ছে আর সেই শিকারের গল্প ভোর হলে অথবা বিকাল হলে বলা চাই।
সে বলত—সে এক হরিণ টুকুনদিদিমণি। হরিণের বনে হরিণ আছে। রাজার সঙ্গে পাইক বরকন্দাজ আছে। বনে ঘন বন আছে। দু’চোখে বনের পথ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে সমতল মাঠ আছে, মাঠে ঘাস আছে। রাজার পিঠে তিরধনুক। একটি হরিণ জল খাচ্ছিল। মাঠের ভিতরে এত হরিণ অথচ একটা হরিণ জল খাচ্ছে। ছোট হরিণ—শুধু লাফায়, নাচে আর ঘাস খেতে শখ যায়, কিন্তু নরম ঘাস না হলে, কুয়াশায় ভেজা ঘাস না হলে হরিণ শিশু ঘাস খেতে পারে না।
রাজা ছুটছেন। বুঝলে দিদিমণি বনের ভিতর দিয়ে রাজা ছুটছেন। হরিণ ছুটছে। শিকার ধরার জন্য রাজা ছুটছে। কী বেগে ছুটছে! চারিদিকে পাহাড়, ওপরে মধ্যিখানে হ্রদের পারে হরিণী ছুটছে। কী বেগে কী তালে তালে পায়ের খুরে আগুন জ্বলছে। পাথরে ঘসা লেগে পায়ের খুর জ্বলছে। হরিণীর বাচ্চা একা একা পথে তখন মাঠের ওপাশে হ্রদের জলে মুখ দিয়ে বসে রয়েছে। মা বুঝি আসছেন।
—বুঝলে দিদিমণি বিপদ বুঝতে পেরেছিল হরিণের বাচ্চারা।
—সে মাকে দৌড়তে দেখে সেও দৌড়তে থাকল।
—রাজা ধরতে পারল সুবল?
—না! কী করে পারবে। হ্রদের পারে আসতেই রাজা দেখল পাথরের ঘসা খেয়ে ঘোড়ার পায়ে ফোসকা পড়েছে।
—ঘোড়ার পায়ে ফোসকা।
—বাপরে, আগুন জ্বলছিল পাথরে। হরিণের খুরে আগুন লেগেছিল।
—অঃ। টুকুন যেন আবার যথার্থই সবটা বুঝে ফেলেছে।
আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল টুকুন, সুবল চলে যাচ্ছে। বড় জ্বালাচ্ছে। নার্স চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু অবাক টুকুন খাটের উপর বসে রয়েছে। মুখে কোনও অবসাদের চিহ্ন নেই। সব কিছু কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সে ডায়াল করে বলল, সুরেশবাবু, সুরেশবাবু আছেন?
—কে।
—আমি সারদা বলছি।
সহসা এই ফোন সুরেশবাবুকে বিস্মিত করেছে। কোনও অঘটনের আশঙ্কা করলেন তিনি। তার বুক কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছে। নার্স সারদার গলা কাঁপছে বলতে—সে ঠিক স্পষ্ট বলতে পারছে না। দুঃসহ খবরের জন্য বুঝি ওর গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু একি বলছে! কী বললে! কী বলল!
—টুকুন খাটের উপর বসে দিব্যি সেই সুবল ছোঁড়াটার সঙ্গে কথা বলছিল।
—ঠিক ঠিক বলছ?
—ঠিক। আমি দরজা দিয়ে ঢুকতেই সুবল পালিয়ে গেল।
—ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছ?
—না।
—আগে তাকে খবর দেওয়া উচিত ছিল।
—এমন আনন্দের খবর আপনাকে আগে না দিয়ে তাকে দিই কী করে?
—শোন আমরা যাচ্ছি এখুনি। বলে ফোন ছেড়ে দিলেন সুরেশবাবু।
তারপর কিছুক্ষণের ভিতরেই ওরা সকলে এসে গেল। ডাক্তারবাবু এলেন। তিনি টুকুনকে দেখে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। টুকুন কিছু কুঁচফল এবং চন্দনের বীচি নিয়ে এখন বিছানার ওপর একা একা আপন মনে খেলা করছে, সে ভিড় প্রায় লক্ষ্যই করল না। রাজার গল্প, হরিণের গল্প, রাজপুত্রের গল্প অথবা এই যে এক পাখিয়ালা সুবল যার আপন প্রাণে নিরন্তর বেঁচে থাকার উদ্যম যে—কোনও এক খরা অঞ্চল থেকে চলে এসে এই শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে সেই সুবল, বালক সুবল রাজার মতো ওকে কেবল উৎসবের কথা বলে গেল। বেঁচে থাকার কথা বলে গেল। আপন প্রাণের তেজে উড়ে যাবার কথা বলে গেল। সে চন্দনের বীচি কুঁচফল এবং রঙবেরঙের পাথরগুলো দেখতে দেখতে কেমন নিবিষ্ট হয়ে পড়ল।
—টুকুন তোমার শরীর ভালো হয়ে যাচ্ছে! মা মাথায় হাত রেখে বললেন।
—টুকুন একবার মার দিকে তাকাল। কোনও কথা বলল না।
ডাক্তারবাবু বললেন, আমার হাত ধর টুকুন।
টুকুন ডাক্তারবাবুর হাত ধরল।
—এবারে উঠে দাঁড়াও।
—আমি পারব না ডাক্তারবাবু।
—সুবলের একটা পাখি আছে টুকুন।
—ওর পাখিটা ভারী দুষ্টু। ও রাজার মাথায়—বলে হো হো করে হেসে উঠল।
—তুমি দাঁড়াও। সুবল আজ আবার কখন আসবে।
—কখন আসে বলে না। ওদিকে একটা দেবদারু গাছ আছে, তার পাশে কোথায় যেন থাকে।
—তুমি দাঁড়াও। এইত উঠতে পারছ।
—আমি পারব না ডাক্তারবাবু।
—এইত হচ্ছে। আচ্ছা শোন তুমি সুবল এলে থাকতে বলবে, ওর সঙ্গে আমি কথা বলব। আচ্ছা শোন, ঠিক আছে, কাল আবার আমরা হাঁটার চেষ্টা করব।
ডাক্তারবাবু টুকুনকে বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন এবং নার্সকে ইশারা করতেই নার্স বারান্দায় বের হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু নার্সের পেছনে পেছনে বের হয়ে ফিস ফিস করে বললেন, সুবল কখন আসে।
—ঠিক থাকে না। আমি না থাকলেই চলে আসে। ও যেন কী করে টের পায় কখন আমি থাকি না।
—ঠিক আছে। ও আসবে। ও টুকুনের সঙ্গে কথা বলবে। তবে যেন একনাগাড়ে বেশিক্ষণ ও না থাকে। তোমার প্রতি সুবলের যে ভয়টা আছে সেটা সব সময় রাখবে।
—আমি ওকে বেশি আসতে দিই না।
—খুব বেশি না দিলেও তোমাকে মাঝে মাঝে কাজের অছিলায় বাইরে বেশি সময় থাকতে হবে। সুবল এসে কথা বললে ও প্রাণের ভেতর এক অশেষ আনন্দ পায়। এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হয়। আমরা সকলে যা পারিনি, সামান্য এক পাখিওয়ালা তাই করে দিয়ে গেল।
—তবে ওকে ভিতরে নিয়ে এলে হয় না?
—না। তা হয় না সারদা। ওর যদি মনে হয় সুবল এখানেই থাকবে, সুবলের আর যাবার জায়গা কোথাও নেই, তবে ওর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। কারণ এখন সুবল ওর কাছে জাদুকরের মতো। স্রেফ অলৌকিক জাদুকর। আসে যায়, কখনও হারিয়ে যায়। আবার আসে। প্রত্যাশা ওকে বড় এবং ভালো করে তুলবে। বলে ডাক্তারবাবু অন্যমনস্কভাবে কেবল তুড়ি মারতে থাকলেন।
সুরেশবাবু বাইরে এসে বললেন কেমন বিস্ময়ের ব্যাপার লাগছে সব!
সুরেশবাবুর স্ত্রী বললেন, ডাক্তারবাবু টুকুন সত্যি হাঁটতে পারবে?
—সব এখন পাখিয়ালা সুবলের উপর নির্ভর করছে।
—কেন কেন।
সুরেশবাবুর স্ত্রীর মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
—টুকুনের কাছে সুবল এখন আশ্চর্য এক জাদুকর। ওর পাখি, ওর কুঁচ ফল, চন্দনের বীচি, রঙবেরঙের পাথর আর সারদা যা বলল, কীসব আজগুবি গল্প বলে সে নাচতে থাকে কেবল। তার অর্ধেকটা বোঝা যায়, অধের্কটা বোঝা যায় না। রাজার গল্প, হরিণের গল্প, বন পাহাড়ের গল্প, এবং পাখির গল্প বলে সে কেবল ছোটার অভিনয় করে। তখন টুকুনের সুবলের পা দেখতে দেখতে বুঝি মনে হয়—হরিণের মতো সেও ছুটছে, মনে হয় ঘোড়ার মতো সেও ছুটছে, গল্পের সঙ্গে এই যে ছোটা, ছোটা আর ছোটা—প্রাণের ভিতর এই ছোটা, কেবল আবেগের জন্ম দেয়। রক্তে উত্তেজনা আসে। হাতে পায়ে সেই উত্তেজনায় রক্ত বইতে থাকে। টুকুনকে তখন খুব স্বাভাবিক দেখায়। এই ছোটার ভিতর সেই উদ্যমের কথাই বলা হচ্ছে সুরেশবাবু। আমরা এই উদ্যম হারিয়ে কেমন ক্রমশ টুকুনের মতো স্থবির হয়ে যাচ্ছি। বলে ডাক্তারবাবু কেমন হাঁসফাঁস করতে থাকলেন!—আমাদের জীবনে এখন সুবলের মতো এক পাখিয়ালা চাই। যে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে আমাদের এই কঠিন রোগ সারিয়ে তুলবে। বলে তিনি ফের অন্যমনস্কভাবে হাতে তুড়ি মারতে থাকলেন।
হাতে তুড়ি মারতে থাকলেন ডাক্তারবাবু, জনার্দন ছুটতে থাকল মাঠ দিয়ে। বুকে পলা। হরিণ শিশু পলা জনার্দনের বুকের ভিতর চুপটি করে আছে। কোনও ভয়ডর নেই। কান খাড়া করে দেখছে পেছনে ওর মা অপলা, বোন অচলা আসছে। ছুটে ছুটে আসছে না। কারণ জনার্দন ভাবছিল সে খুব দ্রুত ছুটছে, কিন্তু জনার্দনের মনে নেই বোধ হয়—ওর শরীর বড় ক্লিষ্ট, শরীরে কোনও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। চোখ মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। মনে হয় সব কিছু ঝাপসা। আবার কেমন সামান্য জল খেলে চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে।
জনার্দন ছুটছিল। কারণ সে অন্য দুই হরিণকে ভয় পাচ্ছিল। শুধু ফাঁকা মাঠ। বালি শুধু মাঠে। এখনও রোদ ওঠেনি বলে বালিতে কোনও উত্তাপ জমছে না। পাহাড়ের নীচটা ক্রমশ সাদা হয়ে উঠছে। অন্য পাশে চাঁদের মরা গোল সোনার বাটি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। দু—একটা শকুন উড়ে যাচ্ছিল কোথাও। কোনওদিকে এই শকুনেরা উড়ে যাচ্ছে অন্যদিন হলে জনার্দন একটু অপেক্ষা করে দেখত। কিন্তু আজ এই পলা তার বুকে। এই পলার চোখ ওকে ভয় দেখাচ্ছে—জনার্দন ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে ছুটছিল আর মাঝে মাঝে পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল। ওরা এখনও জনার্দনকে অনুসরণ করছে। ওরা অর্থাৎ দুই হরিণী। অচলা, অপলা। সে এবার নুয়ে একটা পাথর তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল। পাথরটা বেশি উঁচুতে উঠল না। কিছুদূরে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। হরিণীরা সেই পাথর নিক্ষেপের জন্য অল্প সময় থমকে দাঁড়াল। পাথরটা গড়িয়ে আসছে। জনার্দন ওদের ভয় দেখানোর জন্য থেমে থেমে পাথর ছুঁড়ে যাচ্ছিল। আর হাত তুলে—যা আমার সঙ্গে কেন! যা বলছি! ভয়ে কেমন টেঁসে যাচ্ছিল জনার্দন। জনার্দন পিছন ফিরে তাকালে ওরাও থেমে যেত। জনার্দন ছুটতে থাকলে ওরাও ছুটত। জনার্দন পাথর নিক্ষেপ করলে ওরা দু পা তুলে পাথর রোখার চেষ্টা করত। অথবা যেন পাথরটাকে গুঁতো মারতে আসছে তেমনি শিং বাগিয়ে ধরত।
পাহাড়ের ভিতর দূরে সুবচনির মন্দির দেখা যাচ্ছে। চারপাশে বনের মতো। পাতা নেই কোনও গাছে। ফলে গাছগুলো যেন মৃত। শুকনো এক ভাব—মনে হয় আগুন লাগলে দাবানল জ্বলবে। চারিদিকে তাকানো যাচ্ছে না। চারিদিকে মরুভূমির মতো হাহাকার। মাটি, মরুভূমি বুঝি গ্রাস করছে। জনার্দনের আর পা চলছিল না। সুবচনি দেবী কিছুতেই প্রসন্না হচ্ছেন না। তিনি প্রসন্ন হলে সংসারে আর দুঃখ কীসের! ঠিক তক্ষুনি পলা ওর বুকে ডেকে উঠল। ভয়ে ডেকে উঠল। জনার্দনের চোখে লোভ লালসা ভেসে বেড়াচ্ছে। জনার্দন থর থর করে কাঁপছিল। যত এগিয়ে যাচ্ছে, সুবচনি দেবীর মন্দিরের দিকে উঠে যাচ্ছে, ঠিক তত সে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। এবং মন্দিরের ভিতর ঢুকেই পিছন ফিরে তাকাল। দেখল ঠিক মন্দির সংলগ্ন একটা মৃত অর্জুন গাছের নীচে দুই হরিণী বসে রয়েছে। ওরা ওদের বাচ্চাকে ফিরিয়ে নিতে চায়।
জনার্দন আর অপেক্ষা করতে পারল না। সে ভয়ে ওদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। কারণ জনার্দনের ভয় ওর ক্ষীণ শরীর সামান্য আঘাতেই ভেঙে পড়বে। যদি হরিণী ওকে আক্রমণ করে তবে ওর পেট ফুঁড়ে যাবে। কিন্তু দরজা বন্ধ করতে মনে হল, ওর কোলের ওপর থেকে হরিণ শিশুটা লাফিয়ে নীচে পড়ে গেল আর মনে হল সে ক্রমশ যে দৃষ্টিহীনতায় ভুগছিল, এখন সেই দৃষ্টিহীনতা ওকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। সে অন্ধকার দেখল চারিদিকে। সে হরিণ শিশুকে ডাকল, পলা পলা। সে লোভের গলায় ডাকল। পলা, মুখে সেই নোনতা স্বাদ, বনে সেই আগুনের ছবি যেন, কোনও আদিম মানুষ বনের ভিতর হরিণের মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছে। পলা সুবচনি দেবীর পেছনে চলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। জনার্দনের চোখের ছবি দেখে বুঝতে পারছিল যেন মানুষটা ওকে এবার চিবিয়ে খাবে। ভয়ে পলা কোনও শব্দ পর্যন্ত করল না। একবার উঠে গিয়ে দরজার কাছে মাথা ঠুকল। বের হবার চেষ্টা করল।
জনার্দন—অন্ধ জনার্দন দরজায় শব্দ শুনে ছুটে গেল। কিন্তু কোথায়! অন্যদিকে বোধহয়। সে শব্দ শুনে এবার হরিণ শিশুকে ধরার জন্য ওৎ পেতে থাকল। এবং প্রায় অজগর সাপের মতো সে মেঝের ওপর শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হরিণের পায়ে জাপটে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু হায়! হরিণ শিশু লাফাচ্ছিল, নাচছিল—ওর এখন প্রায় খেলার মতো হয়ে গেল। চারিদিকে পাথরের দেয়াল। ঘুলঘুলি দিয়ে সামান্য বাতাস আসছে। জনার্দন দরজা বন্ধ করে রেখেছে। জনার্দন অন্ধ। সুবচনি দেবীর খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলছে। ফুল বেলপাতা শুকনো। যেখানেই পলা গিয়ে দাঁড়াক না কেন, মনে হয় ঐ দিকে। মনে হয় এখন পলা কাসর ঘণ্টার নীচে, মনে হয় পলা এখন ঢাক ঢোলের নীচে, মনে হয় পলা এখন সুবচনি দেবীর মাথার ওপর উঠে বসে আছে। অথবা মনে হয়, পলা ঘরময় হেগে মুতে বেড়াচ্ছে।
জনার্দন সারাদিন ধরে পলাকে ধরার চেষ্টা করল। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ওর রাগে দুঃখে চোখ মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সামান্য এক হরিণ শিশু ওকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা করছে। সে হুংকার দিয়ে উঠল। যেখানে খাঁড়াটা ঝুলছিল তার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর খাঁড়াটা দড়ি থেকে খুলে ছুটে গেল মায়ের পাশে—মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে। মা আমি না খেতে পেয়ে অন্ধ হয়ে গেছি। শরীরে শক্তি নেই মা। সে খাঁড়া নিজের মাথায় রেখে কেমন পাগলের মতো শুয়ে পড়ল মেঝের উপর। পলাকে পুড়িয়ে মাংস খাবার ক্ষমতা তার আর থাকল না।
কিন্তু হায়! সব পাগলের কাণ্ড। আত্মহত্যার মতো এই ঘটনা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জনার্দনের মনে হচ্ছিল সে মরে যাচ্ছে। খাঁড়ার ঘায়ে ঘাড়ের কিছুটা অংশ কেটে গেছে। ভোঁতা খাঁড়ার আঘাত ভালো করে লাগেনি। তবু ঘাড়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে শান ভেসে যাচ্ছিল। এবং মনে হল এবার জনার্দন সত্যি মরে যাবে। কিন্তু পলার কথা মনে হতেই মনে হল ঘরের ভিতর আবদ্ধ থেকে এক অবলা পশু শেষে মরে যাবে! সে কেঁদে উঠল, মা মাগো। আমাকে আর সামান্য শক্তি দে। আমি মা দরজাটা খুলে দি।
শান ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ওর জিভে সেই রক্তের স্বাদ নোনতা লাগল, সে তাড়াতাড়ি উপুড় হয়ে সেই রক্ত চাটতে থাকল। আহা আহা খাদ্যবস্তু। এমন খাদ্যবস্তু সে যেন কতকাল আহার করেনি। নিজের রক্ত পানে সে উল্লাসে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে পারল। সে অন্ধ হলেও রক্তটুকু সে চেটে চেটে খেয়ে ফেলল। খেয়ে ফেলতেই ওর মনে হল কতকাল পর আহার করেছে। সে কতকাল পর আহার করে উল্লাসে জয়ঢাক বাজাচ্ছে। জয়ঢাক, ঢাক ঢোল বাজাচ্ছে। সে বাজাচ্ছিল না অন্য কেউ বাজাচ্ছে।—কই রে পলা গেলি কই। সে উঠে দাঁড়াতে পারল, সে হেঁটে যেতে পারল। দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারল। টলতে টলতে সে দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেল। খিল খুলে দিয়ে বলল, যা অবলা হরিণ শিশু চলে যা। যদি কোনওকালে বৃষ্টি হয় তবে বলবি—এই সংসারে জনার্দন চক্রবর্তী বলে একটা লোক ছিল, সে তার সব ভালোবাসা দিয়ে, মন্ত্র দিয়ে এই দেশের প্রাণপ্রাচুর্যকে রক্ষা করতে চেয়েছিল—পারেনি।
একি! কীসের এত শব্দ! মনে হয় পৃথিবী দুলে উঠছে। মনে হয় পাহাড় টলছে। মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হয় ঝড়ে দেবীর মন্দির গাত্রে পাথর ছুটে আসছে। যেন এক প্রলয়। জনার্দন দু’হাত তুলে সেই উলঙ্গ রাত্রির ভিতর ডাকল, পলা, অপলা, অচলা কোথায় গেলি। ঝড়ে মরে যাবি। তোরা মরে গেলে এই অঞ্চলে আমার চেষ্টার সাক্ষী কেউ থাকল না। তোরা মন্দিরের ভিতর চলে আয়। এই ঝড়ে পড়লে তোরা মরে যাবি।
কিন্তু জনার্দন ওদের কোনও সাড়া পেল না। মনে হল অর্জুন গাছটা ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। মনে হল ভিতরে যত ফুল বেলপাতা ছিল সব উড়ে যাচ্ছে, মনে হল সেই হরিণ শিশুরা এখন লাফিয়ে চলছে। আর আর আর মনে হল—এটা কী হচ্ছে। বৃষ্টি। বৃষ্টি! মা, মা, বৃষ্টি হচ্ছে। মা মা, মাগো সুবচনি তোর এত কৃপা, তোর এত কৃপা। মা আমি যে আর কিছু ভাবতে পারছি না।
জনার্দন মন্দিরের ভিতর পর্বত প্রমাণ দৈত্যের মতো লুটিয়ে পড়ল।
আট
ডাক্তারবাবু ভিতরে ঢুকে বললেন, তুমি আজ বাড়ি যাবে টুকুন।
—সত্যি!
—সত্যি।
টুকুন বলল, আমি সত্যি বাড়ি যাব। ওর চারপাশে যা কিছু আছে—এই ভেবে একবার দেখল সব। তেমনি জানালা খোলা। মা—বাবা আসবেন। কখন আসবেন এই ভেবে টুকুন অধীর হয়ে উঠল। নার্সিং হোমের এদিকটায় একটা সবুজ মাঠ। এবং জানলা খুললেই চোখে পড়ে হাজার মানুষের মিছিল—এই কলকাতা শহর এত মানুষ কেন? কোথায় যায়—কী করে এরা, টুকুন ভেবে পায় না। কিন্তু টুকুন যেজন্য জানলায় বসে আছে এবং খোলা রেখেছে, নার্স এলে বলেছে, সুবল এসেছিল সিস্টার? সুবল কি আমার ঘুমের ভিতর ঘুরে গেছে?
সিস্টার বলল না।
—সে কেন এল না। আমি বাড়ি চলে যাব—সে না এলে কী করে আমি বাড়ি যাব?
সিস্টার বলল, তোমার মা—বাবা এসে নিয়ে যাবে।
—মা—বাবা তো সব সময়ই আসছে, ওরা আমাকে যখন খুশি নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সুবলকে যে আমার বলা হয়নি, আজ আমি চলে যাব। সে এখানে এলে আমার ঠিকানা পাবে কী করে?
—আমি দেব। তোমার বাড়ির ঠিকানায় চলে যাবে। তোমাদের কত বড় বাড়ি, চিনতে ওর অসুবিধা হবে না।
—সে তো বলেছে, টুকুনদিদিমণি, আমি কলকাতার পথ—ঘাট চিনি না। তুমি যখন বাড়ি যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ো।
—সে ঠিক চলে যাবে।
—কিন্তু মা কী ওকে নিতে চাইবে?
—নেবে না কেন? এত বড় একটা অসুখ তোমার সে সারিয়ে দিল। আমরা সবাই যা করতে পারিনি, কোথাকার এক পাখিয়ালা এসে সব করে দিল, ভাবা যায় না।
—কোথাকার বলতে নেই সিস্টার। সুবল খুব ভালো ছেলে। সে আমাকে চন্দনের বীচি, কুঁচফল দিয়েছিল।
—খুব ভালো। ঐ যা একটা পাখি রেখেছে বাঁশের চোঙে আর লম্বা আলখাল্লার মতো পোশাক। মনে হয় আমরা তিন চারজন ওর ভিতর ঢুকে যাব।
—সিস্টার আমি একটু জানালার দাঁড়িয়ে থাকতে চাই এখন।
—আমি ধরছি।
—না আমি নিজে হেঁটে যাব। সুবল যে কখন আসবে।
সুবল এলেই যেন টুকুনের সব হয়ে যায়। সে কখনও জানালা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না। সে ক’দিন আগে মাত্র উঠে বসতে পেরেছে। গতকাল তাকে ধরে ধরে হাঁটা শেখানো হচ্ছিল। বারবার হাঁটতে গিয়ে টুকুন পড়ে যাচ্ছিল। পারছিল না। নার্স এবং আয়া মিলে দু’পা হাঁটতে সাহায্য করেছে। একে ঠিক হাঁটা বলে না, কিছুটা সান্ত্বনা দেবার মতো ব্যাপারটা ছিল—তুমি হাঁটতে পার টুকুন, আর কী, এবারে তোমাকে আমরা অনেক দূরে নিয়ে যাব। কোনও বড় পাহাড়ে। সেখানে পাইন গাছ থাকবে, শীত থাকবে, বরফের পাহাড় জমবে। তুমি ফারের কোট গায়ে দিয়ে লম্বা সরু দুটো লাঠি হাতে নিয়ে দু’পায়ে স্কেটিং করবে। এ—পাহাড় থেকে সে—পাহাড়। এ—উপত্যকা থেকে সেই অন্য উপত্যকায়—অনেকটা পাখিয়ালা সুবলের মতো ভাষা, সুবল যে জানালায় এসে বলত, টুকুন দিদিমণি, দ্যাখো কেমন পাখি উড়ে যায়, দ্যাখো কেমন ঘোড়া ছোটে, দ্যাখো কেমন নিরিবিলি আকাশে মেঘেরা উড়ে বেড়ায়—তুমি টুকুনদিদিমণি, রাজার মেয়ের মতো ঘোড়ায় চড়ে স্ফটিক জলের নীচে রুপোর কৌটা খুঁজতে যাবে না? আমি তোমায় নিয়ে যাব। তখন টুকুন কেমন ছেলেমানুষের মতো বড় বড় চোখে তাকায়। হাতের ইশারাতে সুবল যা কিছু দেখায়—টুকুনের মনে হয় সব সত্যি। সে সব পারে। সে রাজার মেয়ের মতো রাজ্যের সব দুঃখী রাজপুত্রদের স্বয়ংবর সভা ডাকতে পারে সেই সুবল কেন যে এখনও এল না!
টুকুন বলল, কী সুন্দর দিন!
সিস্টার বলল, ভারী সুন্দর।
—সুবল আমাদের ট্রেনে উঠে এলে পুলিশ এসেছিল সিস্টার।
—পুলিশ।
—হ্যাঁ পুলিশ। ওরা তো জল খাবে বলে মাঝ—রাস্তায় ট্রেন আটকে দিয়েছিল।
—ও মা, কী বলে টুকুন।
—হ্যাঁ সত্যি সিস্টার। ওদের দেশে খুব খরা। জল নেই। লঙ্গরখানা বন্ধ। জলের অভাবে চাষবাস হয় না। গাছপালা পুড়ে গেছে। সারা মাঠ খাঁ খাঁ করছে।
—সত্যি?
—সত্যি সিস্টার। আমাদের ট্রেনটা থামিয়ে দিলে বাবা তো ভয়ে কাঠ। ওদের কী চেহারা! সুবলকে এখন দেখে চেনাই যায় না। ওর শরীরে মাংস ছিল না। লিকলিকে। কাঠির মতো হাত—পা। অথচ কী সুন্দর হাসিমুখ সুবলের, কী সুন্দর সরল চোখ!
সিস্টার বলল, গ্রামের মানুষদের এমনই মুখ চোখ হয় টুকুন।
টুকুন বলল, না দিদিমণি, হয় না। আমাদের কামরায় কেবল তো সুবল ওঠেনি, আরও অনেকে। ওদের দেখলে সিস্টার আপনিও ভয় পেতেন। আমি তো ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলাম, কিন্তু সুবল এসে শিয়রের কাছে দাঁড়াতেই আমার মনে হয়েছিল সিস্টার, একজন বালক সন্ন্যাসী এসে দাঁড়িয়েছে।
সিস্টার না বলে যেন পারল না, টুকুন তুমি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারছ দেখছি।
—সিস্টার আমি জানি না, কী করে এমন সুন্দর কথা বলতে শিখে গেছি। আগে মা বলত, আমি একটাও কথা বলতাম না। সব তাতেই আমি বিরক্ত হতাম। শুধু চুপচাপ শুয়ে থাকা ছিল আমার কাজ। আমি এখন কেমন উঠে বসতে পারি, হাঁটতে পারি।
সিস্টার জানেন—টুকুন ঠিক হাঁটতে জানে না। টুকুনের বয়স কত—এই বারো—চোদ্দো হবে, টুকুনের অসুখ কবে থেকে, সেই কবে থেকে যেন, সাল—তারিখ সবাই ভুলে গেছে—এত লম্বা অসুখ মানুষের কী করে হয়—কী যে লম্বা অসুখ, ঠিক ঘোড়দৌড়ের মাঠের মতো, রেসের মাঠে যেমন একটা ঘোড়া অনন্তকাল ছুটেও শেষ করতে পারে না, তেমনি মনে হয় টুকুন এক অনন্তকালের ঘরে অসুখের দরজায় বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এমন অনেকবার হয়েছে। সে বেশ ভালো হয়ে গেছে। হেসে খেলে বেড়িয়েছে—আবার কী করে যে একটা অসুখের ভিতর পড়ে যায়—সে জানে না কী করে সে রুগণ হয়ে যায়, ফ্যাকাশে হয়ে যায়, চোখের নীচটা ফুলে যায়। তখন শরীরের যাবতীয় কিছুতে কড়া পাহারা এবং এই করে কতকাল থেকে মা—বাবা বেশ একটা প্রতিযোগিতার ভিতর পড়ে গেল টুকুনের। প্রতিযোগিতা ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের।
টুকুন বলল, এখনও সুবল আসছে না।
—এসে যাবে।
—আমি জানলায় যাচ্ছি। বলে টুকুন নিজেই উঠে বসার চেষ্টা বলল। ওর হাত—পা লম্বা। গায়ে মাংস সামান্য লাগায় মুখটা বেশ ভরা দেখাচ্ছে। সব কিছুর ভিতর আছে কেবল ওর দুটো সুন্দর চোখ। মনে হয় আশ্চর্য নীল চোখ। চোখের মণিতে এখনও ছায়া দেখা যায়। কেউ এসে পাশে দাঁড়ালেই ছায়াটা নড়ে ওঠে। সিস্টার টুকুনকে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করতে চাইলে হাতটা ঠেলে দিল।—না সিস্টার, আপনি দেখুন আমি ঠিক ঠিক উঠে যাচ্ছি। আমার এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না। বলে সে অনায়াসে উঠে বসে, বলল, কেমন ঠিক আমি উঠতে পেরেছি।
টুকুনকে আজ সকালেই হলুদ রংয়ের একটা ফ্রক পরানো হয়েছে। নরম সিল্কের। রংটা ভারী উজ্জ্বল। লতাপাতা আঁকা ফ্রক। কোথাও দুটো প্রজাপতি মুখোমুখি বসে—এবং নানা রংয়ের ছবি ফ্রকে। ওর সেই খেলনাগুলোর মতো। এই বয়সেও টুকুন খেলার জগতে থাকতে ভালোবাসে। এই খেলনার জগতে সে কখনও রানি হতে ভালোবাসে, অথবা রাজকন্যা। ওর কুদুমাসি বেড়ালটা ভারী বজ্জাত। যখন টুকুন এমন ভাবে, তখন বেড়ালটার গোঁফ নড়ে ওঠে। টুকুনের তখন ইচ্ছে হয় আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে। সে পারে না। কারণ সে উঠতে পারে না, হাঁটতে পারে না। ক’দিন কোনও হুঁশ ছিল না। সুবল এসে খুঁজে পেতে ঠিক জানলায় আবিষ্কার করে ফেলে, আবার ওকে উৎসাহ দিল। বাঁচার উৎসাহ। কী এক জাদুকরের মতো সুবল হাত—পা নেড়ে কেবল নেচে নেচে গ্রাম্য সংগীত সুর করে বলে যেত।
এখনও সুবল আসছে না। সিস্টার অবাক—আজ এমন প্রতীক্ষা একজন মানুষের জন্য টুকুনের, যে এলেই বলবে তুমি যাবে আমাদের বাড়িতে। এই আমাদের ঠিকানা। দেখবে খুব বড় বাড়ি। সামনে বড় জলাশয়। চারপাশে অনেক দিনের পুরনো পাঁচিল। ভিতরে অজস্র গাছপালা। এবং জলাশয়ের পাশে সুন্দর এক অট্টালিকা। অট্টালিকার ছায়া যখন সেই জলাশয়ে ভাসতে থাকে তখন মনে হবে সুন্দর এক রাজকন্যার সন্ধানে কোনও রাজপ্রাসাদে ঢুকে গেছ।
সিস্টার অবাক, ভারী সুন্দর পা ফেলে ঠিক ওর মনে আছে, সে এমন পা ফেলে হেঁটে গেছে—সেই কবে, এখন ভারী স্বপ্নের মতো মনে হয়—সে একজন মানুষের উদ্দেশ্যে এমন পা ফেলে হেঁটে গেছে, বাড়িতে কীসব আলো জ্বালানো হয়েছিল সেদিন, সকাল থেকে শানাই বেজে চলেছে, সে সকাল থেকে হলুদ রংয়ের শাড়ি পরেছিল, এবং পায়ে পায়ে হাঁটা, প্রতীক্ষা, আশ্চর্য প্রতীক্ষা থাকে মানুষের। সে কখনও জানে না কীভাবে সেইসব প্রতীক্ষার দিনগুলি মরে যায়। এখন টুকুন জানলায় যেভাবে হেঁটে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে গুণে গুণে পা ফেলে, কেউ যেন দুপাশ থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যেমন তাকে কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, পীড়িতে বসিয়ে দেবার জন্য, লাল বেনারসি, চুমকি—বসানো ওড়না, মুখে কপালে ঘাম, পা গুণে গুণে হাঁটা, টুকুন ঠিক সেইভাবে জানলায় হেঁটে যাচ্ছে।
টুকুন বলল, সিস্টার আপনি বলেছিলেন আমি হাঁটতে পারি না।
—আমি দেখেছি টুকুন। তুমি ঠিক হাঁটতে পারো।
—আজ মা—বাবাকে বলবেন কিন্তু আমি জানালা পর্যন্ত হেঁটে গেছি।
—বলব।
—কী সুন্দর লাগে।
—আমি তোমাকে ধরে থাকব।
টুকুন জানলার গরাদে হাত রেখে বেশ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কষ্ট হচ্ছিল—কষ্ট হোক, পায়ে এভাবে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে, মেয়েটা একদিন ঠিক অশ্বের মতো হয়তো দৌড়ে যাবে। কত জায়গায় না গেছে। এই অসুখ নিরাময়ের জন্য মিঃ মজুমদার হিল্লি—দিল্লি কম করেননি। অথচ মেয়েটা সেই যে কী হয়ে থাকল, চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, আর ভালো হতে চাইল না। তারপর সেই খরার দেশের ওপর দিয়ে ট্রেন এসে গেলে, ট্রেন আটকে দিল মানুষেরা। ট্রেনের জল লুটে—পুটে খেয়ে নিল। খেয়ে নিয়ে কেউ নেমে গেল না। ওরা শহরে—গঞ্জে চলে যাবে বলে ট্রেনে বসে থাকল। তারপর অন্য স্টেশনে, পুলিশ। কড়া পাহারায় সব মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। টুকুন শুয়ে শুয়ে আশ্চর্য এক মানুষের গল্প করার সময় এমন বলেছে।
—জানেন সিস্টার, সুবলের একটা বাঁশের চোঙ ছিল। কত যে রাজ্যের কীটপতঙ্গ ওর পকেটে।
—ওসব দিয়ে ও কী করত?
—ওর পাখির জন্য ধরে এনেছিল।
—পাখিটার কী নাম?
—কী যে নাম জানি না।
—ট্রেনে উঠে তোমাদের কামরায় সরাসরি?
—আমি দেখলাম, ওরা এসেই বাথরুমে চলে গেল। জলের কল খুলে দিল। অঞ্জলি পেতে কেবল জল খেতে থাকল।
—তারপর?
—তারপর অবাক আমরা, কী করে সুবলের কোল থেকে সব পোকামাকড় উড়ে গেল। এবং সারাটা কামরা ভরে গেল।
—ও মা, তাই বুঝি?
—বাবা ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু যতসব ক্ষুধার্ত লোক একটু জলের জন্য যখন এমন করতে পারে তখন ভয়ে বাবা কিছু বললেন না। পোকাগুলো সারাটা কামরায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বসতে পারছি না। আমাদের মুখ—চোখ ঢেকে গেছে।
—সত্যি!
—সত্যি সিস্টার! কিন্তু সুবল নিমেষে সব সাফ করে দিল।
—কী করে?
—কিছু না। সে তার বাঁশের চোঙ থেকে বলল, যা পাখি উড়ে যা! পাখি উড়ে গেল। উড়তে থাকল। সব এক দুই করে খেতে থাকল। বড় বড় পোকামাকড় সব ধরে এনে সুবলের চোঙের ভিতর পুরে দিতে থাকল পাখিটা।
তারপর টুকুন অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না। সে চুপচাপ, চারপাশের মাঠ, রাস্তা, ট্রামগাড়ি, বাসগাড়ি দেখছিল। বেশ চলছে কলকাতা শহর। চলে যাচ্ছে, কেবল চলে যাচ্ছে। কেবল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালান কোঠাগুলি আর লাইটপোস্ট, ইলেকট্রিক তার এবং নিরবধি কালের এই আকাশ।
এমন দেখতে দেখতে সে তন্ময় হয়ে যায়। তখন মনেই হয় না, এই শহরের কোথাও সুবল বলে একজন বালকের নিবাস রয়েছে। যে এসেছিল তাদের সঙ্গে, যাকে মা ব্যান্ডেলে নামিয়ে দিল। যার কেউ নেই। মা নেই, বাবা নেই। সংসারে সুবল একা এক মানুষ। অথচ আশ্চর্য, তার কোনও ভয় নেই। মা—বাবা না থাকলে সংসারে কী যে ভয়। টুকুনের ভয়ে চোখ বুজে এল।
সে চোখ বুজেই বলল, জানেন সিস্টার, সুবলের কেউ নেই। মা নেই, বাবা নেই, কেউ না থাকলে কী কষ্ট না।
—খুব কষ্ট। এবার এসো তোমাকে শুইয়ে দিচ্ছি। এতক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে নেই।
—আমার কিন্তু কোনও কষ্ট হচ্ছে না।
—তা না হোক। তবু তোমার এখন শুয়ে থাকা উচিত।
সিস্টার জানে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ওর নেই। এবং যদি দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় তবে কেলেঙ্কারি। সে বলল, আমি জানলায় আছি, সুবলকে আসতে দেখলেই বলব সুবল আসছে।
—আপনি ঠিক চিনতে পারবেন না।
—আমি এত দেখলাম, কেন চিনতে পারব না!
—না। আমার মনে হয় আপনি ভুলে গেছেন। সে থাকে জানালার বাইরে। আপনি ভিতরে। আপনি তাকে কতটুকু দেখেছেন!
তা ঠিক। সিস্টার খুব একটা বেশি দ্যাখেনি। ছেলেটা এলেই কেমন বিরক্তিকর ঘটনা। সিস্টার দূরে অন্য কাজে মন দিত। কী যে এত কথা এমন একটা সুন্দর বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে—কোথাকার হাভাতে একটা ছোঁড়া, সে এলেই কেমন টুকুন হাতে পায়ে বল পায়। ডাক্তারবাবু বলে গেছেন, সে এলে তাকে যেন টুকুনের সঙ্গে কথা বলতে অ্যালাউ করা হয়—সুতরাং সিস্টার আর কী করে এবং এখন মনে হল, সুবলকে সে খুব একটা ভালো লক্ষ্য করেনি।
টুকুন এবার ধীরে ধীরে বলল, জানেন সিস্টার কেউ একা, এমন ভাবতে আমার কেন জানি ভারী কষ্ট হয়। আমার তখন কিছু ভালো লাগে না।
টুকুন একা—এটা ভাবতে ওর আরও কষ্ট। কখনো কেউ একা থাকলে—কেউ না থাকলে—টুকুনের মনে হয় সে যদি এমন একা হয়ে যায়। কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই। ওর দেখাশোনার মেয়ে শেফালি নেই—কী যে হবে তখন—ওর কী যে কষ্ট, ঠিক সুবলের মতো সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করবে না। একটা গাছের নীচে বসে থাকলে তার ভেউ ভেউ করে শুধু কান্না পাবে।
এ—জন্যেই ওর ভিতর সুবলের জন্য কেমন মায়া পড়ে গেছে। সে জানে ওর যা বয়েস—এ বয়সে অনেক কিছু হবার কথা। অথচ কী আশ্চর্য, তার শরীরে কোথাও সে সব লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। মা—বাবার কথাবার্তা অথবা ডাক্তারের কথাবার্তা থেকে সে ধরতে পারে—জননী হতে গেলে যা যা লাগে এই বয়সে তার কিছুই তার ভিতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। সে কেমন দুঃখী গলায় এবার বলল, সিস্টার আমাকে ধরুন। আমি পায়ে হেঁটে আর যেতে পারছি না।
মেয়ের এমনই রোগ। হতাশা বুকে। এখন মনে হয় মেয়ের বয়স ষোলোর মতো। ফ্রক কী খালি গায়ে রাখলেও কোনও ক্ষতি নেই। সে যেন ইচ্ছা করলে একটা সিল্কের গেঞ্জি পরে থাকতে পারে। পুরুষমানুষের মতো হেঁটে বেড়াতে পারে। এবং এ—ভাবেই মেয়ের অসুখ বেড়ে গেল। এখন মনে হয় বয়স আরও বেশি টুকুনের, হিসাব করলে ষোলো—সতেরো। ফ্রক গায়ে কচি বালিকা সেজে বসে আছে—এবং ইহজীবনে বুঝি টুকুন আর এ—বয়স পার হবে না। অথচ আশ্চর্য সুন্দর মুখ টুকুনের। মেয়েদের এমন সুন্দর মুখ হয়! আহা আশ্চর্য চোখের তারায় কী যে মায়া। সে সুবলের জন্য এখন বিছানায় শুয়ে কেমন প্রার্থনা করছে। ঈশ্বর, যাদের কেউ নেই, তুমি তাদের আছো। তুমি তাদের দ্যাখো।
সে শুয়ে আছে। পা দুটো সোজা। একটা সাদা চাদরে ঢাকা। এবং ফের মোমের মতো মুখ হয়ে গেছে। চোখ প্রায় স্থির। কেমন কষ্টদায়ক মুখের ছবি। তাকে কফিনের ভিতর রাজকন্যার মমির মতো লাগছে এবং এ—ভাবেই সিস্টার দেখে অভ্যস্ত। এই যে একটু সময় জানালায় গিয়ে দাঁড়াল সেটাই বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। টুকুনকে যারা দেখেছে, তাদের কাছে টুকুনের এমন ভঙ্গিতে শুয়ে থাকার ব্যাপারটাই বরং স্বাভাবিক, টুকুন যে জানালায় হেঁটে গিয়ে সেই সুবল নামক বালকের জন্য প্রতীক্ষা করছিল কে বলবে।
টুকুন বলল, জল খাব সিস্টার।
সিস্টার জল দিলে বলল, সে এলে আমায় কিন্তু ডেকে দিয়ো। আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে।
নয়
সুবল সকাল সকাল উঠেই ফুটপাথের কলে স্নান করে নিয়েছে। সে একটা ঘর এখনও পাচ্ছে না। সে যা আয় করছে, বাবুরা ওর ভাজা—ভুজি কিনে যা দেয়, তাতে ওর দু বেলা ছাতু খেয়ে বেশ চলে যাচ্ছে। আর পয়সা বাঁচে না যা দিয়ে সে একটা ঘর, খুপরি ঘর ভাড়া নিতে পারে। এখানে সে দু—একজন লোকের সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিচয় করে ফেলেছে, যেমন অজিত সাহা লোকটি তাকে অন্য ব্যবসা করতে বলছে—এই যেমন মটর কিনে সেদ্ধ করে রং মিশিয়ে মটরশুঁটির মতো বাজারে বিক্রি করা। সিনেমার শো ভাঙলে সে অনায়াসে এই সব বিক্রি করতে পারে।
সুবল বলেছিল, রং মেশাতে হবে কেন?
—রং না মেশালে শুকনো মটর মনে হবে, সবুজ মনে হবে না।
—রং তো লোকে খায় না!
—খায় না, খেতেও নেই। ওতে অক্সাইড থাকে, পেটে ঘা করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
—ওতে মানুষের ক্ষতি হয় অজিতদা।
—মানুষের ক্ষতি হলে তোর কী? তোর ক্ষতি না হলেই হল।
—তা হলে এটা তো ভালো না। মানুষের ক্ষতি হলে কিছু আমার ভালো লাগে না। তুমি অন্য ব্যবসার কথা বলো।
—তবে যা করছিস তাই কর। ফুটপাথে শুকিয়ে মর।
—আমি তো একা মানুষ, আমার তো চলে যাচ্ছে।
—তোর অসুখে—বিসুখে কোথায় থাকবি?
—গাছের নীচে।
—শালা তবে খরার দেশ থেকে চলে এলি কেন?
—ওখানে বর্ষা নামলে চলে যাব। এ—শহরে আমি থাকব না অজিতদা।
—কেন, ভালো লাগে না? তোকে একদিন সিনেমায় নিয়ে যাব। দেখবি তখন তোর এই শহরটার উপর মায়া পড়ে যাবে।
—তাই বুঝি?
—তবে আবার কী!
—আমার পাখিটা এখানে থাকতে চাইছে না।
—রাখ তোর পাখি। কোথাকার কী একটা রেখেছিস, ছেড়ে দে চলে যাক। সঙ্গে শুধু উটকো ঝামেলা রেখেছিস।
—ছেড়ে দিলে চলে গেলে মন্দ হত না। কিন্তু যায় না। আমাকে নিয়ে যাবে বলছে।
—শালা তোর পাখি তবে কথাও বলে!
—বলে তোমরা ঠিক বুঝতে পারো না। বলে সুবল হেসেছিল। তবু সুবল এই অজিত সাহার উপর রাগ করে না। বরং দু—একদিন কিছু কামাতে না পারলে অথবা পয়সা কম পড়লে সে তার কাছ থেকে ধার নেয়। দু—একদিন অজিত সাহা ওর বস্তিতে খুপরি ঘরে ডেকে দুটো ভালো—মন্দ খাইয়েছে। সুবল অনেকদিন ভাত খায়নি। সে টুকুনদিদিমণিকে বিকেলে দেখতে যায়। একদিন টুকুনদিদিমণির নার্স দেখে কেমন বিরক্ত হয়ে দশটা পয়সা ছুঁড়ে দিয়েছিল, যেন ভিক্ষে চাইছে সুবল, সুবল হেসে বলল, না মা—জননী, আমি ভিখারি নই। টুকুনদিদিমণি আমি ভিখারি! টুকুনদিদিমণি আমাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। আমার কেমন এই টুকুনদিদিমণির জন্য মায়া পড়ে গেছে।
সুবলের আর যাবার জায়গা কোথাও নেই, তবে ওর প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। কারণ এখন সুবল ওর কাছে জাদুকরের মতো। স্রেফ অলৌকিক জাদুকর। আসে যায়, কখনও হারিয়ে যায়। আবার আসে। প্রত্যাশা ওকে বড় এবং ভালো করে তুলবে। বলে ডাক্তারবাবু অন্যমনস্কভাবে কেবল হাতে তুড়ি মারছিলেন।
সুরেশবাবু বাইরে গিয়ে বলেছিলেন, কেমন বিস্ময়ের ব্যাপার লাগছে সব।
সুরেশবাবুর স্ত্রী বলেছিল, টুকুনের জীবনে স্বাভাবিকতা তবে আসবে ডাক্তারবাবু?
—সব এখন সেই পাখিয়ালার ওপর নির্ভর করছে।
পাখিয়ালার নাম শুনেই টুকুনের মা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। তাই বলে একটা রাস্তার ছেলে! অন্য কেউ হলে হয় না! কত সুন্দর সুপুরুষ সব তরুণ রয়েছে তাদের চারপাশে। টুকুনের মা আর কোনও কথা বলতে পারল না। ছেলেটা তন্ত্র—মন্ত্র জানে। কোথাকার ছেলে, খরা অঞ্চল থেকে উঠে এসে কী করে যে টুকুনকে ট্রেনে নিজের মতো করে ফেলল!
অথবা সেই সব দৃশ্য। টুকুনের মা এখনও যেন মনে করতে পারছে—টুকুন জেগে দেখেছিল, সুবল দরজা খুলতে পারছে না। টুকুন বাবাকে দেখেছিল দরজা লক করে দিতে। সুতরাং সুবল দরজা খুলতে পারছিল না। টুকুন সুবলকে কিছু বলার জন্য উঠে বসতেই জানালায় দেখতে পেল একজন পুলিশ ওদের কামরার দিকে ছুটে আসছে। প্ল্যাটফরমে হইচই। মানুষের ছুটোছুটি এবং কান্না। যারা জল চুরি করে খেয়েছিল অথবা লুট করেছিল, তাদের এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। টুকুন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ডেকেছিল, সুবল সুবল, দরজা খুলবে না। দরজা খুললে ওরা ঢুকে পড়বে ঘরে।
সুবল বলেছিল, আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে?
—তাড়াতাড়ি এদিকে এসো সুবল, বলে সে ব্যাংকের নীচে সুবলকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর লম্বা চাদর দিয়ে পর্দার মতো একটা আড়াল সৃষ্টি করে সুবলকে অদৃশ্য করে দিয়েছিল।
সুবল ট্রেনে তখন সব পোঁটলাগুলো শিয়রের দিকে রেখে দিয়েছিল। বাংকের ওপর টুকুন চুপচাপ শুয়ে। চাদরটা দিয়ে বাংকের নীচটা ঢেকে দিয়েছে। ওর ভিতর একটা ছেলে শুয়ে আছে পালিয়ে, কেউ টের পাচ্ছে না। টুকুনের মা—ও জানত না। টুকুন পরে সব বলেছিল।—জানো মা, আমি দরজা পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম।
সে—সব কথা তখন টুকুনের মা বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ সে তো কিছু দ্যাখেনি। পাশের বাংকে সে ঘুমাচ্ছিল। ফার্স্ট ক্লাস কামরা, রিজার্ভ।
জেবের ভিতর ছিল তখন পাখিটা। সুবল একটু আলগা হয়ে শুয়ে ছিল নীচে। পাছে পাখিটা চাপা পড়ে মরে না যায়। পাখিটা তখন জড়পদার্থের মতো, যেন শীতে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে, অথবা পাখিটার ঘুম পাচ্ছিল বোধহয়—খুব জড়সড়ো হয়ে জেবের একটা দিকে বসে আছে। তারপর মনে হয়েছিল সুবলের, ঘুম এসে গেলে পাখিটা জেবের ভিতর চেপটে যেতে পারে, সেজন্য সে শিয়রে রেখে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুম যাবার চেষ্টা করেছিল। পাখিটা শিয়রে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। নড়ছে না। যেন পাখিটারও ভয়, পুলিশ পাখিটাকে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি এদের দলে, সুতরাং নিস্তার নেই।
টুকুন রগণ এবং দুর্বল। টুকুন কোনোরকমে উঠে বসেছিল এবং চাদরটা ঠিক মেঝের সঙ্গে মিলে আছে কিনা দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। টুকুন ক্ষীণকায়, লম্বা। সিল্কের দামি ফ্রক গায়ে ঢল ঢল করছিল। শুধু সামান্য মুখে সতেজ সুন্দর চোখ কালো জলের মতো গভীর মনে হচ্ছিল। দরজায় তখন ঠক ঠক শব্দ। টুকুন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা শেষরাতে ঠান্ডা বাতাসটুকু পেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। সুতরাং টুকুন নিজে ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছিল এবং দরজা খুলে দিয়েছিল—লম্বা একটা পুলিশের মুখ গোটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
টুকুন খুব আস্তে আস্তে বলল, আমাদের কামরায় কেউ জল খেতে আসেনি।
—কেউ ভিতরে পালিয়ে নেই তো?
—না না, কেউ নেই। কেউ আসেনি। ট্রেন ওরা থামিয়ে দিলেই আমরা দরজা লক করে দিয়েছিলাম।
দশ
সিস্টারের ভয়ে সুবল ক’দিন হল নার্সিংহোমের দিকে পা বাড়ায়নি। এই শহরে একমাত্র টুকুন দিদিমণিই ওর জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকে। তাকে দেখালে খুব খুশি হয়। এবং কেন জানি এ—ভাবে সুবলের কাছে টুকুন খুব আপনজন হয়ে গেল।
অথচ ভয়, সিস্টার তাকে নানাভাবে ভর্ৎসনা করেছে। সেদিন সিস্টারের চোখে কী এক কঠিন বিরক্তি দেখে সে আর যেতে সাহস পায়নি। তা ছাড়া অজিতদা ওকে অন্য একটা সুন্দর ব্যবসার কথা শিখিয়ে দিয়েছে। সে বড়বাজার থেকে চিনাবাদাম কিনে আনছে। এবং ফুটপাথে সে উনুন জ্বালিয়ে বেশ ভাজাভুজি রেখে বিক্রি করছে। সে এখানে এসে একটা ব্যাপার দেখে খুশি। দেশে থাকতে কী না ওরা অসহায় ছিল। এমন একটা সুন্দর দেশ পর পর ছ’বছর খরাতে শস্যবিহীন দেশ হয়ে গেল। তবু অন্যান্য বছর সামান্য বৃষ্টিপাতের দরুন কিছু ফসল হয়েছিল—এবার যে কী হল! দেশ ছেড়ে মানুষ পালাল। সে আর থাকে কী করে! ওর ইচ্ছা ছিল টুকুনদিদিমণিদের সঙ্গেই চলে যাবে। দিদিমণির মা—টা যেন কেমন। ঠিক সিস্টার যেমন মুখ করে রেখেছিল, দিদিমণির মা—টার তেমনি রাগী রাগী ভাব। সে ভয়ে ব্যান্ডেলে নেমে গেল। তারপর এক আশ্চর্য বিকালে এতবড় জানালায় দিদিমণিকে আবিষ্কার করে অবাক।
কিন্তু এখন সে এমন একটা কাজ নিয়ে ফেলেছে যে সে যেতে পারছে না। ওর জুতো—পালিসের সব কিছু অজিতদার বাড়িতে আছে। অজিতদার বউয়ের খুব সিনেমা দেখার স্বভাব। সে সুবলকে নিয়ে যেতে চায়। অথচ তার এসব ভালো লাগে না। সে সময় পেলে বরং টুকুনদিদিমণির কাছে চলে যাবে।
টুকুনদিদিমণির কাছে গেলেই তাকে নানারকম গল্প বলতে হয়। সে আজ যাবে ঠিক করেছে। চার—পাঁচদিন হয়ে গেল দিদিমণিকে না দেখে কেমন সে কিছুটা দুঃখী সুবল বনে গেছে। সকাল সকাল কলের জল থেকে স্নান করেই মনে হয়েছে, দিদিমণির সঙ্গে দেখা না হলে কাজে উৎসাহ পাবে না। সে তাড়াতাড়ি কিছুটা ভাজাভুজি বিক্রি করে নেবে, তারপর বিকেলে হাতে সে কোনো কাজ রাখবে না। আগে ওর খুব একটা ঝামেলা ছিল না। যখন খুশি চলে যেতে পারত। এখন পারে না। সে আগে হাতে তার জুতোর বাক্সটা রেখে দিত। এখন তার সম্বল একটা উনুন, একটা চট, একটা চালুনি, একটা কাঠের ট্রে, একটা ভাঙা কড়াই, কিছু বালি, এতগুলো দিয়ে যে যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে পারে না।
সে আজ ভাবল, সব রেখে দেবে শেফালী বউদির কাছে। শেফালী বউদির রং কালো। কেবল গুন গুন করে হিন্দি গান গায়। সব সিনেমার গল্প এসে কাউকে না কাউকে বলা চাই। রাতের বেলায় সুবল গেলে তাকে বসিয়ে গল্প। এক কাপ চা খেতে দেয় তখন। কালো রংয়ের শেফালী বউদির খুব তাজা চোখ মুখ। এবং সবসময় পান খাবার স্বভাব। ছোট দুটো ঘর। তাই যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখে। কাগজের ফুল তৈরি করে নানা রংয়ে সাজিয়ে রাখার স্বভাব। এবং কারুকার্য করা ডিমের খোলা—কোনটা লাল রংয়ের, কোনটা হলুদ রংয়ের। পাশে একটা বড় পুকুর। জানালা খুললে পুকুরের জলে অনেককে নাইতে দেখা যায়। অজিতদা না থাকলে জানলা খুলে শেফালী বউদি কার জন্য মনে হয় জানলায় অপেক্ষা করে। সুবলের এটা কেন জানি ভালো লাগে না।
সুতরাং সুবল সব টুকিটাকি কাজ সেরে ফেলার সময় শেফালী বউদির কথা ভেবে কেমন সামান্য কষ্ট পেল। এই শহরে বড় একটা কষ্ট আছে সবার। যেমন অজিতদার, বউদির। ওদের কাছে যেন কিছু জিনিস খুব দুর্লভ। সেই দুর্লভ কিছু পাবার জন্য ওরা এমন করছে। ওর কাছে দুর্লভ বলতে টুকুনদিদিমণি। দিদিমণিকে দেখলেই ভিতরে সুবল প্রাণ পায়। সুবল দিদিমণির জন্য কী যে সুন্দর একটা খেলা শিখে ফেলেছে, আজ গেলে সেই খেলাটা দেখাতে পারলে খুব আনন্দ পাবে।
সে তার টুকিটাকি মালপত্র সব মাথায় করে এক সময় শেফালী বউদির ঘরের দিকে রওনা হল। সে যাবার সময় একটা সুন্দর সাজানো পান কিনে নিল। নিজে সে পান—টান কিছু খায় না। অজিতদা ওকে একদিন একটা বিড়ি দিয়েছিল খেতে। সে খেতে গিয়ে খক খক করে কেশেছে ভীষণ। সেই থেকে বিড়ি ব্যাপারটাকে ভীষণ ভয় পায় সে।
সে হাঁটছিল। তাকে খুব একটা দূরে হেঁটে যেতে হয় না। বড় রাস্তা থেকে কিছুদূর হেঁটে গেলেই গোলবাগান বস্তি। দুপাশে ছোট ছোট সব খুপড়ি ঘর, টিনের চাল। একটা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের ডিসপেন্সারি। তারপর একটা লোক দুটো লেদ মেসিনের দোকান নিয়ে সারাদিন কাজ চালিয়ে যায় এবং রোয়াকে চায়ের দোকান। একটা ছোট মুদি—দোকান, কলের জল পড়ছে এবং কলের পাড়ে ভীষণ ভিড়। সে এখানে এলেই সবাই ঝুঁকে পড়ে। সুবল তোর পাখিটা দেখি। দেখা না রে পাখিটা। কেউ কেউ একটা মাকড় ধরে এনে বলে, নে, এটা খাওয়া। সে জানে কোথায় কী বলতে হয়। সে মানুষকে আঘাত করতে জানে না। সে মিথ্যা কথাও বলতে জানে না, সে ইচ্ছা করলে বলতে পারে না, পাখিটা এখন আমার জেবে নেই। বললেই ওরা সরে যায়। কিন্তু বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। সে কোনোরকমে তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পার হয়ে যায় তখন। চৌকাঠে ঢুকে গেলে কেউ তখন আর বিরক্ত করতে আসে না।
শেফালী অসময়ে সুবলকে দেখে বলল, সুবল, এ—সব নিয়ে অসময়ে?
—একটু কাজ আছে বউদি।
শেফালী ওর মাথা থেকে এক এক করে টুকিটাকি জিনিস নামাতে নামাতে বলল, কোথায় যে রাখি!
—আজ রাখো, কাল সকালে নিয়ে যাব। তোমার জন্য একটা পান নিয়ে এসেছি।
—সুবল, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
সুবল অবাক। বউদি তাকে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে। তবু কেমন যেন গা—টা শির শির করে উঠল। এই শহরে এলে মানুষ বুঝি সব কিছু একটু তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে। সে বলল, তুমি পান খেতে ভালোবাসো। অজিতদা কোথায়?
শেফালী ঠোঁট উলটে বলল, জানি না।
—আজ আসেনি?
—না।
—কেন আসে না?
—একবার জিজ্ঞাসা কর না!
—না, খুব খারাপ বউদি। আমি ঠিক জিজ্ঞাসা করব। বলেই সুবল হেসে দিল।—তুমি ঠাট্টা করছ বউদি। দাদা ঠিক এসেছে।
—না রে! তোর সঙ্গে আমি মিথ্যা বলি না।
সুবলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, কোনও খবর নিয়েছ?
—ঠিক চলে আসবে। কোথায় খোঁজ করব বল? কোথায় যায় আমাকে বলে যায় না।
সুবল বুঝতে পারল, বউদি সত্যি কিছু জানে না। সে নিজেই একটা জলঢৌকি টেনে দিল। বসতে বসতে বলল একটু জল খাব।
শেফালী জল এনে দিলে বলল, কাল ক’টায় বের হয়েছে?
—রাতে।
—রাতে ক’টায়?
—বেশ রাত। যেন শেফালী ইচ্ছা করেই আর বেশি বলতে চাইছে না,—শেফালী সুবলকে মাঝে মাঝে রাজা বলে ডাকে। যদিও জানে রাজা খুব ভালো ছেলে। রাজার নতুন গোঁফ উঠছে বলে, খুব ভালো লাগে দেখতে। এই নতুন গোঁফ—ওঠা ছেলেদের খুব ভালো লাগে। রাজা আগে খুব নোংরা জামাকাপড় পরে থাকত। শেফালী ওকে কিছু কিছু ট্রেনিং দিয়ে বেশ এখন সাফসোফ রাখার ব্যবস্থা করেছে। আগে চুল ছিল বড় বড়। চুল কাটত না। ইদানীং চুল কাটছে। এবং বড় একটা শিখা ছিল মাথায়, সেটাও ছোট করে ফেলেছে। খুব খেয়াল না করলে বোঝা যায় না শিখাটা আছে মাথায়।
শেফালী বলল, সব ফেলে কোথায় যাচ্ছ?
—টুকুনদিদিমণির কাছে।
—তুমি যে বলেছিলে আর যাবে না? সিস্টার পছন্দ করে না।
সুবল বলল, আমার বউদি, আপনজন বলতে টুকুনদিদিমণি। ভেবেছিলাম যাব না। কিন্তু কাল থেকে মনটা টুকুনদিদিমণির জন্য কেমন করছে।
—কবে যেন গেছিলে?
—গত বুধবার।
—আর মাঝে যাওনি?
—না।
—টুকুন ঠিক জানলায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকবে?
—জানি না বউদি। ওর মা আমাকে দেখতে পারে না। ওদের অসুবিধা হবে বলে একটা বড় স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দিয়েছিল।
—ভীষণ খারাপ। বড়লোক হলে মানুষ ভালো হয় না। বড়লোকেরা খুব স্বার্থপর।
সুবল সে—সব কথায় গেল না। সে বলল, আসতে আসতে দেখলাম, একটা বড় গির্জার সামনে দুটো ছেলে ফুল বিক্রি করছে। বেশ ভালো কাজ।
—কেন, তুমি ফুল বিক্রি করবে নাকি?
—দাদা এলে জিজ্ঞাসা করব, কোথায় ফুল কিনতে পাওয়া যায়।
—এ কাজটা খুব ভালো হবে। তোমার খুব সুন্দর মুখ রাজা। তুমি যদি ফুল বিক্রি করো তবে লোকে অনেক ফুল কিনবে।
—সত্যি কিনবে?
—সত্যি। প্রথম দিনের একজন খদ্দের তুমি আমাকে পাবে।
—আমি তোমাকে এমনি দেব।
—তবে তোমার ব্যবসা হবে কী করে রাজা?
—একটা ফুল দিলে ব্যবসা নষ্ট হয় না। যখন চিনাবাদাম ভেজে বিক্রি করি, কেউ কেউ দুটো একটা এমনি খায়। খেয়ে পছন্দ হলে নেয়। তুমিও আমার তেমন।
—আমার একটা ফুলে কিছু হবে না রাজা। একটা ফুল দিয়ে মালা গাঁথা হয় না।
—কত ফুল লাগবে?
—একগুচ্ছ।
—তাই নেবে!
—না রাজা, এমনি নেব না।
—তাহলে কী করতে হবে?
—সে পরে বলব। বলেই শেফালী বলল, যাও, আপনজনের কাছে যাও।
সুবল এতক্ষণে মনে করতে পারল সে টুকুনদিদিমণিকে একমাত্র আপনজন বলেছে। সে বউদির ঠাট্টাটা ধরতে পেরে বলল, তোমার নিজের লোক। অজিতদা কত ভালো লোক।
—ভালো লোক না ছাই!
—তুমি কেবল বউদি অজিতদার নিন্দা কর। দাদা এলে বলে দেব।
—বলে দ্যাখ না যদি একটু রাগ করে। লোকটার রাগ অভিমান বলতেও কিছু নেই। যা খুশি করবে। মান—সম্মান বুঝবে না। অপমান বলতে কিছু নেই।
সুবল দেখল কথা অন্যদিকে যাচ্ছে। সে উঠে পড়ল। সে একটা বল নিয়েছে হাতে। শেফালীর ইচ্ছা সুবল আর একটু বসুক। এখন এই বিকেলটা শেফালীকে বড় একা একা কাটাতে হবে। এখানে এ ঘরের কেউ দেখতে পাচ্ছে না সুবলকে সামনে নিয়ে বসে রয়েছে। সুবল এলেই মনের ভিতর একটা অদ্ভুত রহস্য খেলা করে বেড়ায়। ওর নরম চুল এবং চোখ দেখলে যেন কোনও আর দুঃখ থাকে না। বেশ জড়িয়ে ধরে ছেলেটাকে চুমু খেতে ইচ্ছা হয়। এবং সুন্দর করে সাজানো পুতুলের মতো অথবা সে যে—সব সিনেমায় নানারকমের কল্প—কাহিনী দেখে তেমনি সব কল্প—কাহিনীর বাসিন্দা হতে ইচ্ছা হয়। সুবলকে না দেখলে তার এমন বুঝি হত না।
শেফালী বলল, পাখিটার খেলা আজ দেখালে না?
সুবল বুঝতে পারছিল, কিছু না কিছু বলে তাকে আটকে রাখছে। সে বলল, আজ আমার একটু তাড়া আছে। বলে সে বারান্দা থেকে নেমে চৌকাঠ পার হয়ে রাস্তায় নামল।
সুবলের বেশ ভালো লাগছিল হাঁটতে। সে সাফসোফ হয়ে যাচ্ছে। জামা পাজামা সব ধবধব করছে। সে কলের পাড়ে এসব গতকাল কেচে নিয়েছিল। পয়সা হলে সে আরও দুটো ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবি করে নেবে। একটা টিনের স্যুটকেস কেনার খুব বাসনা। একটা টিনের স্যুটকেস কিনে ফেলতে পারলেই সে সব কিছু অতি প্রয়োজনীয় যা আছে স্যুটকেসের ভিতর রেখে দেবে। আর কেন জানি মাঝে মাঝে টুকুনদিদিমণিকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আর মাঝে মাঝে আর একজন মানুষকে তার চিঠি লিখতে ইচ্ছা হয়। সেই যে কাপালিকের মতো মানুষ জনার্দন চক্রবর্তী। যিনি তাদের নিয়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন জল আবিষ্কারের। এবং তিনি পাহাড়ের ওপর কোনও ঋষি পুরুষের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে একটা লাঠি। নদী পাহাড় খাত ভেঙে উপত্যকার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। যদি নদীগর্ভে চোরা স্রোত থাকে, সেজন্য তিনি সব মানুষদের, যারা আর অবশিষ্ট ছিল, শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিল, তাদের নিয়ে শেষ চেষ্টা। দূরে দূরে সব এক একজন করে মানুষ ক্রমান্বয়ে দিনমান বালি খুঁড়ে চলছিল—জলের আশায় মানুষের এমন মুখ—চোখ হয় সুবল এখন চিন্তা করতেই পারে না।
সারাদিন কেটে গিয়েছিল, রাত নেমে এসেছিল, না, কোথাও জল নেই। মানুষটিই তাদের অনেকদূর হাঁটিয়ে, প্রায় ক্রোশ—দশেক হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল—এবং ট্রেন আটকে দিতে বলেছিল। জল লুটেপুটে খেতে বলেছিল। এখন মানুষটা কেমন কে জানে! চিঠি দিলে সেখানে আর কে যাবে। কে আর পৌঁছে দেবে।
মনের ভিতর মানুষটার মুখ—চোখ, আলখাল্লার মতো পোশাক, এবং দিনমানে সে হয়তো অন্নহীন হয়ে সুবচনি দেবীর মন্দিরে পড়ে আছে। এমন মানুষ সে কোথাও দেখেনি। এই একমাত্র মানুষ যার বিশ্বাস ছিল দেবী কখনও না কখনও সুপ্রসন্না হবেন। এবং কোনও পাপ মানুষকে এভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেই পাপের খণ্ডন কী কোনও এক অলৌকিক উপায়ে করতে চেয়েছিলেন। এবং মানুষেরও তেমন একটা বিশ্বাস ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোখের ওপর দেখেছেন দেবীর মহিমা কী ভাবে বার বার মিথ্যা প্রতিপন্ন হচ্ছে। সংসার আর সুজলা—সুফলা হচ্ছে না। সুবলের সেই মানুষটার জন্য মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। ওকে ফেলে চলে এসে সে যেন ঠিক কাজ করেনি। খুব স্বার্থপরের মতো ব্যাপারটা হয়ে গেছে।
সুবল দেখল সে ভাবছে বলে খুব একটা এগোতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে গেলে সে কেমন ঝিমিয়ে হাঁটে। সেই গির্জাটা পার হয়ে যাচ্ছে সে। গির্জায় বাঁশ বেঁধে রং করছে। গেটে একজন লোক বসে রয়েছে। ভিতরে বড় কারখানা। কাচের বাক্স করে নিয়েছে একটা লোক। তার ভিতরে বসে ফুল বিক্রি করছে। লোকটার কাজই সবচেয়ে ভালো। মানুষের শেষদিনে মানুষকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে।
অথবা সুবলের ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝে এমন সব গির্জায় কেবল রং করে বেড়ায়। অথবা মন্দিরে। মসজিদে, মসজিদে কারুকাজ করা যেসব পাথর আছে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। মানুষের সুখদুঃখ ব্যাপারটা সুবলকে খুব ভাবায়!
অথচ এর ভিতর টুকুনদিদিমণির মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। গাছের মাথায় সূর্যের আলো। এবং সব সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা পার্কে খেলা করে বেড়াচ্ছে। দোকানগুলোতে মানুষের ভিড়। কী পোশাক, কী সুন্দর সব মানুষ! কোনও অভাব—অনটন নেই। শেফালীবউদি খুব সুন্দর পোশাক পরে যখন সিনেমায় যায়, তখন ওর তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে। সব মানুষগুলোই সেজে—গুজে কেমন সুন্দর সুসজ্জিত হয়ে থাকে। এমন পরিপাটি পোশাক, মুখ—চোখ, সে তার গ্রামে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মানুষ এ—ভাবে সুখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি। খুশিমতো আলো জ্বেলে নেয়। জল তুলে নেয়, রাস্তা পার হয়ে যায়, হুস—হাস গাড়ি চলে যায়, বাজারে বাজারে প্রচুর শাকসবজি মাছ মাংস! ওর একবার মনে আছে গ্রামে মাংস হবে। গোবিন্দ বণিক একটা পাঁঠা কিনে এনেছিল। বাবা কী করে পাঁচসিকা পয়সা সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দুর্দিন এলে খরচ করবেন। কিন্তু বণিক সেই পাঁঠাটা কাটলে বাঁশতলায় কী ভিড়! বাবাও লোভে পড়ে পাঁচসিকার মাংস কলাপাতায় কিনে এসেছিলেন। সেবারই শেষ মাংস খাওয়া। তবে বাবা মাঝে মাঝে পাখি ধরে আনতেন। ওরা পাখির মাংস খেত। মা খুব পাখির মাংস খেতে ভালোবাসত বলে বাবা অনেকদিন খুব রাত থাকতে পাহাড়ে চলে যেতেন। বালিহাঁসের ডিম, ডিম না হয় হাঁস ধরে আনতেন।
সুবলের ধারণা ছিল পাখি ধরা খুব সহজ কাজ। কিন্তু বাবা প্রায়ই কিছু আনতে পারতেন না। মা রাগ করে কিছুই না খেয়ে থাকত। এমনিতে না খাওয়া ছিল তাদের অভ্যাস, আর একটু চাল— ডাল হলেই মা মাংস দিয়ে ভাত খেতে চাইত। বাবার ওপর রাগ করে মা—টা তার মরে গেল।
সুবলের এখন ধারণা হয় বাবা উদ্যমশীল ছিল না। যেমন সে—ও খুব নয়। কোনওরকমে দিন চলে গেলেই হল। কিন্তু এখানে এসে সে নানাভাবে দেখছে খুব সহজে দিন চলে গেলে জীবনের কোনও মানে থাকে না। চারপাশে এত প্রাচুর্যের ভিতর সে কতদিন আর ফুটপাথে দিন কাটাবে। ওর একটা ঘর না হলে চলছে না। সে ভাবল, বলবে টুকুনদিদিমণিকে, আমি আর গাছতলায় থাকব না। আমাকে একটা ঘর বানিয়ে নিতেই হবে।
সুবল রাস্তায় কত কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। শহর ধরে হাঁটলেই যেন এমন হয়। অথচ খারাপ দিনগুলোতে সে একটা ভাবনাই ভাবত, জল কোথায় পাবে? জল পেলে কখনও পাহাড়ে যা সব লতা মূল ছিল, যেমন পেস্তা আলোর গাছ, এবং তার মূল অথবা ফল কিছু সিদ্ধ করে খেলে কোনওরকমে তাদের দিন চলে যেত। জল যে কী দুর্লভ ছিল! এখন এই শহরে এটা ভাবতে পর্যন্ত হাসি পায়। জলের জন্য তারা প্রাচীনকালের মানুষদের মতো নদীগর্ভে এক এক করে মাইলের পর মাইল বালি তুলে মানুষ—সমান গর্ত করেও যখন দেখল নদীর চোরাস্রোতে পর্যন্ত জল নেই, তখন যার যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাওয়া যেন।
অথচ এখানে এসে আর জলের কথা মনে হয় না। সে চারপাশে দেখে নানা আকর্ষণ। সকাল হলে গাছে তেমন পাখি ডাকে না, অথচ আকাশ নীল, ট্রামলাইনের তার নীল সুতোর মতো অজানা রহস্য হয়ে যায়। কত দূরে এই সব ট্রামলাইন চলে গেছে সে জানে না। পয়সা হলে সে একদিন সারাদিন ট্রামে চড়ে ঘুরবে। শহরে বড় রাস্তায় কখনও কখনও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে হেঁটে যেত। আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। এবং দুটো একটা গাড়ি গেলে মনে হত এক বড় মাঠের ভিতর দিয়ে একা একা সে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ তার পাশে নেই। তাকে ঠিক পথ চিনে মাঠ পার হয়ে যেতে হবে।
এত সব ভাবতে ভাবতে সে দেখল এক সময় দূর থেকে টুকুনদিদিমণির জানলাটা দেখা যাচ্ছে। সে এবার প্রায় রাস্তা ধরে ছুটতে চাইল। কারণ সে দেখতে পাচ্ছে, ঠিক স্পষ্ট নয়, এখনও স্পষ্ট নয়, তবু মনে হচ্ছে জানলাটা বন্ধ। এখন শরৎকাল। আকাশে নানা বর্ণের মেঘের খেলা। কখনও বৃষ্টি, কখনও নির্মল আকাশ। অথচ এ—সময় জানালা বন্ধ। টুকুনদিদিমণি কখনও জানালা বন্ধ করে না। ওর মনে হল হয়তো ক’দিন ওকে আসতে না দেখে হতাশায় জানলা বন্ধ করে দিয়েছে।
ওর খুব খারাপ লাগছিল। সে কেন যে এল না, কেন যে সিস্টারের ওপর অভিমান করে এল না! যদি অন্য কিছু হয়, যদি টুকুনদিদিমণির ছোট পাখির মতো আত্মাটা উড়ে চলে যায়! এসব মনে হতেই কেমন ওর বালকের মতো বুকভরে কান্না উঠে আসতে চাইল। সে বলল, দিদিমণি, এবার থেকে ফের আগের মতো রোজ আসব। আমি এসেছি।
কিন্তু সে গিয়ে যা দেখল—সত্যি অবাক, জানলা বন্ধ। সেখানে কেউ আছে বলেও মনে হয় না।
সুবল পাগলের মতো জানলায় শব্দ করতে থাকল।
সহসা জানলা খুলে, প্রায় পাঁচ সাতটা মানুষ ওকে তেড়ে এল। সে ওদের কাউকে চেনে না। ওরা সবাই একসঙ্গে মুখ খিঁচিয়ে আছে।
তবু এরই ভিতর সে যা দেখল, একজন খুব মোটামতো মানুষ বিছানায় বসে আছে। ওর পাশে একটা নলের মতো কী যেন। মাঝে মাঝে দুটো সরু হলুদ রংয়ের নল সে টেনে নিয়ে দরকার হলে নাকে দিচ্ছে আবার খুলে রাখছে। মোটা গোঁফ লোকটার। সুবল ওদের তবু বলল, আমার টুকুন দিদিমণি এ—ঘরে ছিল। আমি ওকে দেখতে এসেছি।
লোকগুলো কোনও কথা বলল না। মুখের ওপর জানলা বন্ধ করে দিল।
এগার
এটা একটা বড় বাড়ি। খুব বড়। কলকাতার ওপর এতবড় বাড়ি সচরাচর দেখা যায় না। বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে। খুব ছিমছাম, পরিপাটি নরম ঘাসের চাদর বিছানো চারপাশে। সামনে একটা ছোট্ট পাহাড়। দু’দিকে দুটো পথ চলে গেছে। পাঁচিল লম্বা, দু’মানুষ—সমান উঁচু পাঁচিল বাড়িটার চারপাশে। পাঁচিলের পাশে সব ছোট ছোট আউটহাউস। এবং নানা বর্ণের করবীফুলের গাছ। গাছের নীচ দিয়ে হেঁটে গেলে বোঝাই যায় না এ—বাড়িতে কোনও দুঃখ জেগে আছে।
অথচ একটা মেয়ে, ছোট্ট জানলায় বসে রয়েছে। সে এখন জানলা আর বন্ধই করে না। সে আসবে। ঠিক আসবে। কারণ সুবল না এসে পারে না। ওর পাখিটা যখন সম্বল আছে, সে আজ হোক কাল হোক, জানলায় পাখিটাকে পাঠিয়ে দেবে। টুকুন আছে দোতলার দক্ষিণ দিকের বারান্দায়। নীচে মালীরা বড় একটা বাগান করছে। কত সব ফুলের সমারোহ এখন। শেফালীগাছে কত অজস্র ফুল। এবং সকাল হতেই গীতামাসি যখন জানলা খুলে দেয়, সে দেখতে পায় কত সব পাখি এসেছে গাছটায়। সে সুবলের পাখিটাকে তার ভিতর খোঁজার চেষ্টা করে। যদি ওদের সঙ্গে ছদ্মবেশে মিশে থাকে পাখিটা।
আর কী সুন্দর মনে হয় পৃথিবী। ওই যে সকাল হল, কিছুক্ষণ পরই রোদ এসে নামবে, এবং সামান্য শিশিরের টুপটাপ শব্দের মতো পাখিরা এসে বসেছে গাছগাছালির ভিতর—তার যে কী ভালো লাগছে!
এই দক্ষিণের বারান্দায় কাচের জানলা সব। ভিতরে টুকুনের মনোরঞ্জনের জন্য নানারকমের খেলনা। এখন এই ক’মাসেই বোঝা যায় টুকুনের বয়স আর খেলনার জগতে নেই। সে সুবলের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই শারীরিক কীসব অনুভূতি যেন তাকে ক্রমে গ্রাস করছে। সে এখন সুন্দর সুন্দর বই পড়তে ভালোবাসে। দি প্রিন্স অ্যান্ড দি পপার গল্পটি বড় ভালো লাগে। কখনও সে আতোয়ান দ্য স্যাঁত—একজুপেরির ল্য পতি প্র্যাঁস পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে যায়। সেই সাহারা মরুভূমির বুকে নায়ক, সে বিমান বিকল হয়ে যাওয়ায় ওখানে পড়ে গেছে, সাত—আট দিনের মতো মাত্র পানীয় জল আছে—আর আশ্চর্য সেই মানুষটা যখন একাকী, নিঃসঙ্গ মানুষের বসতি থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে এবং শুধু আকাশ সীমাহীন দেখা যাচ্ছে, কিছু নক্ষত্র, আর কাঁটাগাছ মরুভূমির, তখন কিনা সকাল হলে, সুন্দর এক ছোট্ট রাজপুত্রের কণ্ঠ সে শুনতে পায়—আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চার ছবি এঁকে দাও না!
টুকুন যেন সেই ছোট্ট রাজপুত্রের সঙ্গে সুবলের একটা আশ্চর্য মিল খুঁজে পায়। এখন অপেক্ষায় আছে, তার জন্য কেউ একটা সুন্দর ছবি এঁকে দেবে। টুকুন আজকাল বরং ঘর থেকে খেলনাগুলো সরিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। পরিবর্তে ওর ঘরে এখন আলমারি—ভর্তি বই। এবং সুন্দর সুন্দর সব ভালোবাসার কথা সেখানে লেখা আছে।
আবার টুকুন আজকাল নানারকম গ্রহ—নক্ষত্রের বই পড়তে ভালোবাসে। বিশাল সৌরমণ্ডলের কথা ভেবে সে কেমন মুহ্যমান হয়ে থাকে। সেখানে সামান্য টুকুন অথবা তার অসুখ, সে বড় হচ্ছে না, তার শরীরের সব লক্ষণগুলো কোথায় যেন আটকে আছে—এসব বড় তুচ্ছ। তখন তার কেন জানি বাবা—মা—র ওপর ভীষণ করুণা হয়। মা—বাবা কেন যে মুখ করুণ করে রাখে! মা কিছুতেই কেন যে সুবল এ—বাড়িতে আসুক চায় না! বাবার সঙ্গে ওই নিয়ে মা—র ভীষণ মন—কষাকষি! বাবা শেষ পর্যন্ত মা—র কথাতেই রাজি—তাই বলে একটা রাস্তার ছেলে কখনও টুকুনের সঙ্গী হতে পারে না। আমি বরং রণবীরকে বলব ওর ছেলে ইন্দ্রকে যেন পাঠিয়ে দেয় এখানে থাকবে। কী সুন্দর সুপুরুষ রণবীর। ওর ছেলে বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন কথার পর বাবা আর সিস্টারকে ঠিকানা দিতে পারেননি! সুবল এলে পাঠিয়ে দিতে বলেননি।
তবু টুকুনের ধারণা, সুবল আসবে। কারণ সে কেন জানি সুবলকে এ—গ্রহের বাসিন্দা বলে ভাবতেই পরে না। সেই ছোট রাজপুত্রের মতো তার বাড়ি অন্য কোনও গ্রহে হবে। সে কোনও অলৌকিক যানে চড়ে এখানে নেমে এসেছে। সুবল নিজের সঠিক ঠিকানা জানে না। তার গ্রহটা খুব ছোট। একটা বাড়ির মতো গ্রহটা। সে সেখানে এতদিন থাকত বোধহয়।
সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গল্পের মতো মনে হয় সত্যি এই সৌরজগতে কত তো গ্রহ আছে। সংখ্যায় তারা কত কেউ বলতে পারে না। কত সব ছোট্ট গ্রহ আছে যা দূরবিনে পর্যন্ত ধরা পড়ে না। অথবা কখনও কখনও বিন্দুর মতো ধরা পড়লে জ্যোতির্বিদরা সংখ্যা দিয়ে তার অবস্থান অথবা নাম প্রকাশ করে থাকে। বড়দের তবু নাম আছে একটা—পৃথিবী, বৃহস্পতি, মঙ্গল, শুক্র। কিন্তু ছোটদের জন্য কেউ নাম দেয় না। কোনও জ্যোতির্বিদ কোনও একটা গ্রহ আবিষ্কার করে বসলে একটা সংখ্যা দিয়ে দেন। গ্রহাণু ৩০৪০৮৩, একটা সংখ্যা দিয়ে হয়তো ঠিক নির্ণয় করা যায়। সেই রাজপুত্র তেমন একটা ছোট্ট গ্রহের বাসিন্দা। ছোট্ট রাজপুত্রের কথা ভাবলেই সুবলের আশ্চর্য সুন্দর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে।
সুতরাং সকাল হলেই টুকুন বুঝতে পারে—এই পৃথিবী কত সব ভারী মজার ব্যাপার নিয়ে বেঁচে আছে। এই পৃথিবীর মাটিতেই সাহারা মরুভূমিতে এক ছোট্ট রাজপুত্রের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়ে গেছিল। বড়রা এ—সব বিশ্বাস করবে না। যেমন বড়রা বিশ্বাস করবে না, ছোটরা যদি ছবি এঁকে দিয়ে বলে, এই ছবিতে একটা বাঘ এঁকেছি, বাঘের মুখে হরিণ—ওরা বলবে, ধ্যৎ, তা হয় নাকি, এটা তো রহমৎ মিঞার গোঁফ হয়ে গেল। তা হয় কী করে! এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করেও বড়দের বিশ্বাস করানো যাবে না—কখনও কখনও কোনও ছোট রাজপুত্র অন্য গ্রহাণু থেকে চলে আসতে পারে। টুকুন ভাবল, এসব কথা শুধু একজনকেই বলা যাবে—সে সুবল, সুবল শুনলে বলবে, হ্যাঁ দিদিমণি আমাদের ছিল একটা নদী, বড় নদী শুকিয়ে গেল—সে যেমন বলেছিল, দিদিমণি স্বপ্নে দেখেছি, আমরা চলে আসার পর জনার্দন চক্রবর্তী ফিরে গেছে নদীতে। যেখানে দিনমানে আমরা গর্ত করেছিলাম—সেখানে কী নির্মল জল। জলের ভিতর একটা হরিণ শিশু পড়ে গেছে।
সুবল যখন এমন বলে, তখন মনে হয় সব কিছু সত্যি হতে পারে। সে এলে গল্পটা বলা যাবে। বলা যাবে ছোট্ট রাজপুত্র বারবার একটা কথা কেবল বলেছিল, আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চা এঁকে দাও। মানুষটা কী করে তখন, সে বলেছিল, আমি ছবি আঁকতে জানি না।
ছোট্ট রাজপুত্রের এক কথা, দাও না আমাকে একটা ভেড়ার বাচ্চা এঁকে।
মানুষটা ভাবল ভারী বিড়ম্বনা। এমনিতে উড়োজাহাজটা বিকল হয়ে গেছে। সাত—আট দিনের মাত্র জল আছে এর মধ্যে, কিছু না করতে পারলে মরে যেতে হবে। তখন এমন ছোট্ট রাজপুত্র কী করে যে এখানে! সে বলল, ছোট রাজপুত্র আমি ছেলেবেলাতে একটা ছবি এঁকেছিলাম।
রাজপুত্র বলেছিল, তাই বুঝি?
—কিন্তু কী জান, আমি যা ভেবে আঁকলাম, তা সত্যি হল না।
—মানে?
—আমি একটা অজগরের মুখে হাতির ছবি এঁকেছিলাম।
—বাবা! বেশ তো!
—না, বেশ নয়?
—কেন নয়?
—কেউ বিশ্বাসই করল না ওটা অজগরের হাতি গেলার ছবি।
—ওরা কী বলল?
—ওরা বলল, ওটা একটা টুপি।
ছোট্ট রাজপুত্র হা হা করে হেসে উঠল। —বড়রা খুব অঙ্ক ভালোবাসে। অঙ্কের হিসাবে না মিললে ওরা বিশ্বাস করতে চায় না। যেমন দ্যাখো, বিশ্বাস করতে চায় না কেউ আমার বাড়ি একটা গ্রহাণুতে। কিন্তু লামারতিন নামে এক জ্যোতির্বিদ আবিষ্কার করেছিল—সেটা সতেরোশো বাইশের জানুয়ারির আটাশ তারিখ হবে, আমার গ্রহের নম্বর পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছিল…..
—কত?
ছোট্ট রাজপুত্র বলল, তিন আট সাত পাঁচ…ছোট রাজপুত্র বলতে থাকলে আর শেষ হয় না।
টুকুনের মনে হত সে নিজেই সাহারা মরুভূমিতে একটা ছোট্ট এরোপ্লেন নিয়ে নেমে গেছে এবং যা কিছু কথা সব তার সঙ্গে হচ্ছে।
এমন একটা সকালে যখন সে এসব ভাবছিল, এবং জানালা দিয়ে সুন্দর ফুলের সৌরভ ভেসে আসছিল, তখন ইন্দ্র এসে হাজির।
টুকুন বলল, ইন্দ্র, আজও সুবল এল না।
—আসবে।
—তুমি ওকে আমার ঠিকানাটা দিয়ে আসবে?
—ও কোথায় থাকে?
—তা জানি না। সে একটা দেবদারু গাছের নীচে শুয়ে থাকে জানি।
ইন্দ্র জানে টুকুনের এমনই কথা বলার ধরন। টুকুনকে আজ শাড়ি পরিয়েছে গীতামাসি। টুকুনকে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। কিন্তু টুকুনের ভিতর কোনও লজ্জা নেই। সে তার শাড়ির আঁচল বুক থেকে ফেলে দিয়েছে। ইন্দ্র যে পুরুষ সেটা মনেই হয় না টুকুনের চোখ দেখে। ইন্দ্র বেশি সময় সঙ্গ দিতে পারে না। সে সুন্দর করে সেজে আসে। সে যতটা পারে সরু প্যান্ট জামা পরে এবং ওর ভিতর কিছু কৃত্রিমতা থাকে বলে টুকুনের ভারী হাসি পায়। সে কিছুতেই টুকুনকে ছুঁতে চায় না। টুকুন সে এলে ঠিক বান্ধবীর মতো জড়িয়ে ধরতে চায়—আর ইন্দ্র তখন কেমন করে, টুকুন তো এখনও ভালো করে হাঁটতে পারে না। তখন সব কিছু তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। সে আর নড়তে পারে না খাট থেকে।
টুকুন ডাকল, ইন্দ্র কাছে এসো।
ইন্দ্র কাছে গেলে বলল, তুমি আমার হাত ধরো।
ইন্দ্র হাত ধরতে সঙ্কোচ করলে বলল, তুমি ইন্দ্র এমন কেন, সুবলকে যদি দেখতে, সে আমার জন্য সব করতে পারে। আমি ভালো হলে সুবলকে ঠিক নিয়ে আসব।
ইন্দ্র বলল, মাসিমা বলেছে আমরা আজ ‘চাঁদমামার সংসার’ দেখতে যাব।
—কোথায়?
—ছোটদের নাট্য—সংসদে।
—আমি যাব না।
—তুমি গেলে খুব আনন্দ পাবে টুকুন।
—আমার ভালো লাগে না।
মা এসে বললেন, খুব ভালো লাগবে। ইন্দ্র আর তুমি যাবে।
—আমার ভালো লাগে না মা। আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে, আমার এটা ভালো লাগে না।
—ডাক্তার বলেছে, তুমি ভালো হয়ে গেছ। এখন শুধু তোমাকে নিয়ে ইন্দ্র ঘুরে বেড়াবে।
ইন্দ্র বলল, আমি দেখেছি। খুব ভালো।
টুকুন বলল, ওসব বাচ্চাদের বই।
—না, সবাই দেখতে পারে। সবারই ভালো লাগবে।
—আমার এখন রোদ ভালো লাগে। বৃষ্টি অথবা ঝড়। আমার কখনও সূর্য ওঠা দেখতে ভালো লাগে। পাখিরা তখন আশ্চর্যভাবে উড়ে বেড়ায়। আমার কেন জানি মনে হয় সুবল তার দেশে চলে গেছে। সে রোদে বৃষ্টিতে অথবা ঝড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর যে তাকে লাগছে দেখতে! চোখ বুঝলে আমি সব টের পাই।
তবু ইন্দ্র বারবার চেষ্টা করল। এখন ইন্দ্রের কলেজ বন্ধ। সে এখানেই থাকবে। ইন্দ্রের জন্য নীচে একটা বড় ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ইন্দ্রর সকালে একবার বিকেলে একবার আসার কথা। সবই ডাক্তারের পরামর্শ মতো হচ্ছে। যখন পাখিয়ালা সুবলকে মিসেস মজুমদার মাঝে মাঝে আসতে দিতে একেবারেই রাজি হলেন না, তখন আর কী করা। তবু তাঁর ধারণা, জীবনের ভিতরে এই বয়সে যে উদ্দামতা দেখা যায়, ইন্দ্রের শরীর থেকে মেয়েটা তার গন্ধ পেলে হয়তো বাছবিচার না করা এক আশ্চর্য গন্ধে এই পৃথিবীর কোনও এক সকালে সে বড় হয়ে যাবে। এবং পৃথিবীময় তখন সে মনোরম সংগীত শুনতে পাবে—যা সে কোনওদিন টের পায়নি, এত ভালো, এভাবে পৃথিবী ক্রমে তার কাছে আরও বড় হয়ে যাবে। সে তখন ছুঁতে পাবে চারপাশটা।
ইন্দ্র বলল, তুমি না গেলে আমি যাচ্ছি না।
টুকুন বলল, আমাকে শাড়ি পড়লে বড় দেখায়?
—খুব বড়।
—মা—র মতো লাগে?
—মাসিমার মতো লাগবে কেন?
—বা রে, শাড়ি পরলে মাসিমার মতো না লাগলে তবে শাড়ি পরা কেন?
—তোমাকে টুকুনই লাগছে। যুবতী টুকুন।
—বাঃ, আমি যুবতী হব কী করে, বলেই সে কেমন হতাশ মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভীষণ অভিমান সুবলের ওপর। কী দরকার ছিল ট্রেনে দেখা হওয়ার! কী দরকার ছিল পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দেবার! আমি বেশ তো মরে যাচ্ছিলাম। মরে যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সবার আগে মানুষের সব দুঃখ বুঝতে না বুঝতে চলে যেতাম তবে। তুমি কেন যে আমার শরীরে আবার প্রাণের সাড়া এনে দিলে! দিলে তো একেবারে ভালো করে দিলে না কেন। কখনও কখনও এত ভালো লাগে সবকিছু—আবার কখনও কেমন হতাশা। আমার কী আছে বল? ইন্দ্র আমার কাছে আসে দায়ে পড়ে। ও তো আমাকে ভালোবাসে না। আমার কিছু নেই। আমি এখনও বাচ্চা মেয়ে হয়ে আছি। ওর কেন আকর্ষণ থাকবে বল?
এভাবে কত সব ভাবনা এসে মাঝে মাঝে টুকুনকে ভীষণ অভিমানী করে রাখে—পাখিটাকে পাঠিয়ে দিতে পারছ না? সে আমার কত খবর নিয়ে যেত। আমার কত গল্পের বই আছে। সেখানে কতরকমভাবে সব মানুষ সমস্ত সৌরজগতের খবর নিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তুমি তোমার পাখিটাকে পাঠিয়ে আমার খবরটুকু নিতে পারছ না!
টুকুন এখন দেখল ইন্দ্র আর নেই। এতবড় একটা সম্পত্তির ওপর ইন্দ্রের লোভটা সে কী করে যে টের পায়। ইন্দ্রের বাবা খুব খুশি। আগে এ বাড়িতে ওদের গলা সে কখনও শুনেছে মনে করতে পারে না এখন এ বাড়িতে ইন্দ্রকে নিয়ে আসায়—ওরা খুব আসে। বাবার মুখ দেখলে টের পায় টুকুন তিনি আর কাজে কোনও উৎসাহ পাচ্ছেন না। চারপাশ থেকে বাবাকে কারা যেন অক্টোপাশের মতো গিলে খাচ্ছে। কখনও কখনও এমন হয়ে যায় যে টুকুন ইন্দ্রকে একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু স্বভাবে টুকুন ভারী মধুর। সে রাগ করে কেন জানি কথা বলতে পারে না। রাগ করে কথা বলতে পারলে সে কবে ইন্দ্রকে তাড়িয়ে দিত।
টুকুন বুঝতে পারে এভাবে একজন তরুণ বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। সে যখন খুব বিনয় করে বলে, আমি আসি টুকুন, আবার পরে আসব—তখন টুকুনের ভারী হাসি পায়। কেন যে মিথ্যা অভিনয় করছে ইন্দ্র! ওর বলতে ইচ্ছা হয়, তোমাকে আর কখনও আসতে হবে না। তুমি আমার কাছে এসে কোনও উৎসাহ পাও না। উৎসাহ না পেলে কিছুই জমে ওঠে না। যদি সুবলকে দ্যাখো, দেখবে সে যে কোথাকার সব রাজ্যের ফুল ফল পাখির খবর নিয়ে আসছে।
সুতরাং ইন্দ্র চলে গেলে ঘর ফাঁকা। মা এসে কিছুক্ষণ পাশে বসে থেকে গেছে। গীতামাসি আসবে নানারকমের খাবার নিয়ে। সে একটা দুটো খাবে, বাকিটা খাবে না। তারপর ওর যা কাজ, জানালায় বসে মালিদের বাগানের কাজ দেখা। প্রতিটি গাছ ওর এত চেনা যে, এখন ইচ্ছা করলে সে যেন বলে দিতে পারে কোথায় ক’টা নূতন কুঁড়ি মেলেছে, কখন ফুল ফুটবে, ক’টা ফুল ক’টা গাছে ফুটে রয়েছে। ম্যাগনোলিয়া গাছে দুটো ফুল ফুটেছিল কাল। সাতটা কুড়ি। তিনটা ফুটবে ফুটবে ভাব। আগামীকাল তিনটা ফুল ফুটবে। আগে এইসব ভালো জাতের ফুল তুলে এনে ওর ঘরে নীল রংয়ের ভাসে সাজিয়ে রাখত গীতামাসি। কিন্তু সে বারণ করেছে, ফুলেরা গাছে থাকলে বেশি ভালো লাগে। ওরা যে কীভাবে ফোটে! কখনও কখনও রাত জেগে দেখতে ইচ্ছা হয়। সে এভাবে আজ পর্যন্ত একটা ফুলের কাছাকাছি যেতে পারল না। ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারল না। কান্নায় ওর গলা বুজে আসে তখন।
সুবল এলে বুঝি সত্যি সত্যি সে এবার ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারত। শরীরে তার নানারকমের ঘ্রাণ, সুন্দর সুন্দর সব ইচ্ছারা খেলা করে বেড়াত। সুবল এলে এইসব ইচ্ছা কেন যে জেগে যায়। এবং সে তখন যেন ইচ্ছা করলে ছুটতে পারে।
সে বলল, গীতামাসি আমাকে ছোট্ট রাজপুত্রের বইটা দাও তো।
টুকুন ‘বৈমানিকের ডায়রি’টা তুলে নিয়ে সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গল্পটা পড়তে থাকল।
বৈমানিক লিখেছে, প্রতিদিন আমি তার গ্রহ, সেখান থেকে তার যাত্রা তার ভ্রমণ বিষয়ে খানিকটা করে জেনেছিলাম। এভাবে তৃতীয় দিনে বাওবাব গাছের গল্পটা জেনেছিলাম।
সেটাও আমার সেই ভেড়ার ছবি আঁকার কল্যাণেই জানতে পেরেছি।
কারণ দেখেছিলাম, ওর মুখে ছোট্ট সংশয়ের রেখা। সে যেন কী ভাবছে। কী যে ভাবছে আমি জানি না। চারপাশে বিরাট সাহারা, আমার কাছে আর পাঁচ দিনের মাত্র জল আছে। এর ভিতর উড়োজাহাজটাকে মেরামত করে নিতে না পারলে, আমি আর ফিরতে পারব না। আমার ছোট্ট বন্ধুটির সঙ্গে সারা মাস কাল বোধহয় এই মরুভূমিতেই ঘুরে মরতে হবে। আমি বললাম, কিছু বলবে?
—অনেকক্ষণ থেকে ভাবছি কিছু বলব, কিন্তু—
—কিন্তু কী?
—তুমি যে—ভাবে কাজ করে যাচ্ছ—
—হ্যাঁ কাজ করছি। না হলে দেশে ফেরা যাবে না।
—কিন্তু তুমি ঠিক জানো তো ভেড়ারা গুল্ম খায়?
—হ্যাঁ খায়।
—যাক বাঁচা গেল। কী যে ভাবনা হচ্ছিল!
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সে এমন বলছে কেন! আবার ছোট্ট রাজপুত্রের ভারী গলায় প্রশ্ন—ওরা বাওবাব খায়?
আমি হেসেছিলাম। এমন একটা প্রাণ—সংশয়ের ভিতর আছি, আর সে কিনা এমন সব প্রশ্ন করছে—ভেবে অবাক, বললাম—বাওবাব তো গুল্মজাতীয় গাছ নয়। তুমি যদি একপাল হাতি নিয়ে যাও এবং তার ওপর তোমার ভেড়াটাকে চাপাও, তবু বাওবাবের পাতার নাগাল পাবে না।
—আঃ। ছোট্ট রাজপুত্রকে খুব যেন চিন্তিত দেখাল। তারপর খুব জোরে হেসে নিল, তুমি একটা কথা জানো না, সব গাছই বড় হবার আগে ছোট থাকে। ছোট্ট থেকে বড় হয়।
—তাহলে তুমি বাওবাবের চারাগাছের কথা বলছ?
ছোট্ট রাজপুত্র কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখল। আর একটা সংশয় যেন দানা বাঁধছে। প্রশ্ন করল, ভেড়া যদি গুল্ম খায় তাহলে বলতে হবে ফুলও খায়।
—ওরা যা পায় তাই খায়। আমাদের দেশে কথাই আছে, ছাগলে কী না খায়, পাগলে কিনা বলে!
—ছাগল ব্যাপারটা কী?
বুঝতে পারলাম ছোট্ট রাজপুত্র ছাগল ব্যাপারটা জানে না। আমি বললাম, সে এক রকমের ভেড়ার মতোই দেখতে জীব। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখে আবার সংশয় ফুটে উঠছে। সে কিছু আবার প্রশ্ন করবে বুঝতে পারলাম।
—আচ্ছা যে ফুলের কাঁটা আছে—
—যে ফুলের কাঁটা আছে ওরা তাও খেয়ে নেবে।
তখন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম বিমানের কাজে। একটা লোহার ডাণ্ডা ভিতরে ঢুকে গেছে! ওটাকে বের করতে না পারলে শান্তি নেই। জলও ক্রমে আমার কমে আসছে। খুব শঙ্কিত ছিলাম এজন্য। পাশে ছোট্ট রাজপুত্রের একের পর এক প্রশ্ন। আর আশ্চর্য, কোনও প্রশ্নের যতক্ষণ পর্যন্ত জবাব না পাবে—একনাগাড়ে সে তা জানতে চাইবে। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত। যা মনে আসছে তাই আবোল—তাবোল কিছু বলে সান্ত্বনা দেবার মতো বললাম, কাঁটা দিয়ে কিছু হয় না। ওগুলো আমার মনে হয় ফুলগুলির দুষ্টুমি।
ছোট্ট রাজপুত্র বলল, ও। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কেমন ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, তোমার কথা মানি না। যা মনে আসছে বলে যাচ্ছ। ফুলেরা দুর্বল আর সরল বলে কাঁটা না থাকলে চলে না। ও—ভাবে কাঁটা আছে বলেই কারও কারও কাছে ওরা ভয়ানক।
কোনও জবাব দিচ্ছিলাম না। এতবড় একটা মরুভূমির মতো জায়গায় ছোট্ট রাজপুত্র আমার সঙ্গী। সে যদি আমাকে ফেলে চলে যায়—ভাবতেই গা—টা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি ডাণ্ডাটা খোলার জন্য খুব জোরে হাতুড়ি মারলাম। একেবারে ওটাকে উপড়ে আনতে চাইছি।
ছোট্ট রাজপুত্র ফের বলল, তুমি কী ভাব ফুলেরা—
—না না, আমি কিছুই ভাবছি না। কেবল আবোল—তাবোল বকে যাচ্ছি। আমার মাথাটা ঠিক নেই। তা ছাড়া দেখছ না দরকারি কাজে ব্যস্ত।
ছোট্ট রাজপুত্র আমার দিকে ভারী বিস্ময়ের চোখে তাকাল। বলল দরকারি কাজ! সে কী জিনিস আবার?
আমি কিছু বললাম না। আমার কিছু ভালো লাগছিল না।
হাতের আঙুলে, হাতুড়িতে তেল—কালি মাখা। বেয়াড়া একটা যন্ত্রের ওপর ঝুঁকে আছি সেই কখন থেকে। ছোট্ট রাজপুত্র আমায় কেবল এখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এবং বুঝতে পারছিলাম ভীষণ রেগে যাচ্ছে। সে ফের বলল, তুমি বড়দের মতো কথা বলছ।
আমি কিছু বলছি না। এমন কী তাকাচ্ছিও না।
সে বলল, তুমি সব ভুলে গেছ, গুলিয়ে ফেলছ।
ছোট্ট রাজপুত্র এভাবে চটে যাচ্ছে। সে কোনও ছোট গ্রহাণু থেকে পাখিদের ডানার মতো একরকম কীসব লাগিয়ে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে এসে এমন একটা বেরসিক লোকের দেখা পাবে বোধহয় আশাই করতে পারেনি। ওর সোনালি চুলগুলি কী যে মাখনের মতো নরম, ওর চোখ কী যে নীল—সে আর যেন আমার এই অবহেলা মোটেই সহ্য করতে পারছে না।
সে এবার একনাগাড়ে বলে চলল, একটা গ্রহের কথা জানি আমি। সেখানে ঘন লাল রংয়ের একটা লোক থাকে। কখনও একটা ফুল শুঁকে দ্যাখেনি। সে কোনওদিন সাদা জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়ায়নি, আকাশের তারা দ্যাখেনি, কাউকে সে ভালোবাসেনি। সে একটা যোগ অঙ্ক ছাড়া কিছুই করেনি। সারাদিন তোমার মতো বলত, আমি ভারী ব্যস্ত মানুষ। আর অহঙ্কারে পা পড়ত না। একটু থেমে ছোট্ট রাজপুত্র দুহাতে বালি ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, সে কী একটা মানুষ! সে তো একটা ব্যাঙের ছাতা!
—একটা কী? হাতের সব কাজ ফেলে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
—একটা ব্যাঙের ছাতা। রাগে ছোট্ট রাজপুত্র একেবারে সাদা হয়ে গেছে। ওর সোনালি চুল ছোট পাখির বাসার মতো বাতাসে যে কাঁপছে।
সে ক্রমান্বয়ে রাগে দুঃখে বলে চলল, লাখ লাখ বছর ধরে ফুলেরা কাঁটা তৈরি করছে। আর লাখ লাখ বছর ধরে ভেড়ারাও ফুল খেয়ে যাচ্ছে। যে কাঁটা কারুর কোনও কাজে আসে না, ফুলেরা তাই বানাতে গিয়ে এত কষ্ট করে কেন, সেটা জানা কী দরকারি নয়? এই যে লড়াই ফুলের সঙ্গে ফুলের কাঁটার, ভেড়ার সঙ্গে ফুলের—সেটা একটা যোগ অঙ্কের চেয়ে বেশি দরকার নয় জানার।
আর কথা বলতে পারছিল না ছোট্ট রাজপুত্র। কোনওরকমে ধীরে ধীরে বলছিল—কেউ যদি একটা ফুলকে ভালোবাসে, যে ফুল লক্ষ লক্ষ তারার ভিতর তাদেরই একটি হয়ে ফুটে আছে, এবং তখন যদি একটা ভেড়া ফুল খেয়ে ফেলে—আর যদি আকাশের তারারা সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় ভয়ে, তখন কী সেটা আমাদের জীবনে বড় সমস্যা নয়?
এবং এভাবে ছোট্ট রাজপুত্র আর কথা বলতে পারছিল না। হঠাৎ কেন যে ফুঁপিয়ে ওঠে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। রাত নেমে এসেছিল। যন্ত্রপাতি ফেলে এবার উঠে দাঁড়ালাম। এই মরুভূমির রুক্ষতা, সীমাহীন বালুরাশি, তৃষ্ণা, মৃত্যুভয়—সবই কেমন তুচ্ছ বলে মনে হল। কেন জানি মনে হল আমার গ্রহ এই পৃথিবীতে এক ছোট্ট রাজপুত্র চলে এসেছে—যার নিয়মকানুন সব আলাদা, যাকে আমায় সান্ত্বনা দিতে হবে। ওকে হাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নিলাম। একটা ফুলের মালার মতো হাতের ওপর দোলাতে লাগলাম। তাকে সান্ত্বনা দিলাম, যে ফুল ভালোবাস তুমি, তার কোনো বিপদ হয়নি। তোমার ভেড়ার একটা মুখ—ঢাকা এঁকে দেব। আর তোমার ফুলের জন্য একটা বর্ম। আর ভেবে পেলাম না ওর হয়ে আমি আর কী বলব। বুঝতে পারছিলাম না তাকে কীভাবে আর শান্ত করব। কী করে তার মান পাব। চোখের জলের রাজ্যটি সত্যি বড় রহস্যময়।
টুকুন বুঝতে পারল না এভাবে বইটি পড়তে পড়তে সে—ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন। এ—ধরনের কান্না তার বুক বেয়ে কখনও উঠে আসেনি। সেই নির্বান্ধব ছেলেটি এখানে কোথায়! সে তার কাছে এলে যেন এখন বলতে পারত, আমরা এখানে থাকব না, সেই ছোট গ্রহাণুতে চলে যাব। তুমি আমি ছোট্ট রাজপুত্র একসঙ্গে থাকব। ওর ফুলকে পাহারা দেব।
এবং এভাবে টুকুন কখনও কখনও সন্ধ্যায় অথবা রাতে নিজের বিছানা থেকে বড় জানলা দিয়ে অন্ধকার আকাশ দেখতে থাকে। এবং সব উজ্জ্বল গ্রহ দেখতে দেখতে কোনও বিন্দুর মতো অনুজ্জ্বল কিছু দেখলেই মনে হয় বুঝি সেই গ্রহাণুতে ছোট্ট রাজপুত্র থাকে। সুবলকে নিয়ে সে যদি সেখানটায় যেতে পারত!
বার
সুবল সেদিন শেফালীবউদির কাছে ফিরে আসবে ভেবেছিল। সে গিয়ে যখন দেখল টুকুন দিদিমণি হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছে, তখন ওর আর কিছু ভালো লাগছিল না। কেউ তাকে আর কোনও খবরও দিল না। সে দুবার চেষ্টা করেছে সেই সিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে। কিছুতেই সুবলের সঙ্গে সিস্টার দেখা করতে চায়নি।
তবু যা হয়ে থাকে, মনের ভিতর এক অসীম বিষণ্ণতা। সে যখন তার গ্রাম মাঠ ফেলে চলে আসছিল, তখন কী ভীষণ মায়া তার গ্রাম মাঠের জন্য। সে বারবার বলেছে, আমি আবার ফিরে আসব মা সুবচনি। সুবচনি দেবী ওদের খুব জাগ্রত দেবতা। তার যতদূর মনে আছে, বাবা—মা ওর কী একটা অসুখে একবার সেই দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়েছিল। সে সেই পূজা দেখেছিল, না অন্য মানুষের মুখে শুনে শুনে সে তার বাবা—মার সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে রেখেছে, এখন আর মনে করতে পারে না।
সুবল জানত না এই শহরে এসে সে এক আশ্চর্য মায়ায় জড়িয়ে পড়বে। এতবড় শহরে কী করে যে টুকুনদিদিমণি তার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল! এখন নিজের ওপরেই তার রাগ হচ্ছে। সে যদি দেবদারু গাছটার নীচেই আস্তানা গেড়ে নিত! কিন্তু ওর কী যে হয়ে গেল, বেশি পয়সার লোভে সে অন্য ব্যবসা করতে গিয়েই মরেছে। সে সময় কম পেত। আগের মতো খুশিমতো দুজোড়া জুতো পালিশ করে গাছের নীচে ঘুমিয়ে যেতে পারত না। এখন কেন জানি ঘুমিয়ে পড়লেই মনে হয় কেউ তার সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাবে। তার এমন কিছু হয়েছে, যা চুরি যাবার ভয়। তার আর আগের মতো কোনও স্বাধীনতা নেই। সে বুঝতে পারে, এইসব শহরে এলেই মানুষের স্বাধীনতা চুরি যায়।
সে যখন শেফালীবউদির ওখানে ফিরল তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। সে ইচ্ছা করলে ফুটপাথে রাত কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু কেন জানি সে আজ খুব পরিষ্কার হয়ে গেছিল, এমনকি সঙ্গে সে পাখিটাকে নিয়ে যায়নি। তার হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, পাখিটাকে খাওয়ানো হয়নি। নানা কারণেই সে ফিরে না এসে পারেনি। আর এমন পরিচ্ছন্ন পোশাকে ফুটপাথে রাত কাটাতেও কেমন খারাপ লাগছিল।
শেফালী সুবলের মুখ দেখেই বুঝল, টুকুনের সঙ্গে সুবলের কিছু একটা হয়েছে।
সে বলল, মুখ গোমড়া কেন রাজা?
—তোমার কাছে থাকব বউদি আজ। দাদা এখনও ফেরেনি?
—না। একটু থেমে বলল, সিস্টার আবার বুঝি ধমক দিয়েছে?
সে জবাব দিল না কিছু। গলায় সুবলের মাফলার জড়ানো স্বভাব। সে তার গ্রামে দেখেছে, কেউ বাবুবনে গেলে গলায় একটা কমফর্টার জড়িয়ে রাখে। সে—ও আজ গলায় একটা কমফর্টার জড়িয়ে গিয়েছিল। সে সেটা একটা দড়িতে ঝুলিয়ে ঝুড়ির ভিতর থেকে পাখিটাকে বের করল। সে পাখিটার জন্য ইচ্ছা করলে একটা খাঁচা কিনতে পারে। কিন্তু খাঁচায় পাখি রাখার ইচ্ছা সুবলের হয় না। পাখি সেই যে কবে বাঁশের চোঙে আশ্রয় নিয়েছিল, আর সে অন্য আশ্রয়ে যেতে চায়নি। সে বলল, পাখি তোর টুকুনদিদিমণি চলে গেছে।
পাখি পাখা নাড়ল। যেন বলতে চাইল, কোথায়?
—জানি না।
শেফালীর ঘুম পাচ্ছিল। সুবল কিছু খাবে হয়তো। ওকে জল—নুন দিতে হবে। বাকিটা সুবল নিজের কাছে রাখে। ছোলার ছাতু, লংকা একটু চাটনি। সে একটা থালায় এসব রেখে শেফালীবউদিকে হয়তো বলবে এক গেলাস জল দাও তো বউদি, খেয়েনি।
কিন্তু আজ সে—সব কিছুই করল না সুবল। বরং পাখিটাকে খাওয়াল। তারপর পাখিটার সঙ্গে কী যেন ফিস ফিস করে বলল, এবং এক সময় মনে হল, ওর টুকুনদিদিমণিকে খুঁজতে যাওয়া দরকার। সে শেফালীবউদিকে বলল, একটু কষ্ট করতে হবে। আমার যা কিছু—এই যেমন কড়াই, চিনেবাদাম, ছোলা—মটর সব এখানে কিছুদিনের জন্য থাকল। কবে ফিরব ঠিক নেই। পাখিটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
—দেশে যাচ্ছ নাকি? অবাক চোখে তাকাল শেফালী।
—দেশে আমার কেউ নেই। আমাদের কেউ নেই। তবে স্বপ্ন দেখেছি একদিন জনার্দন চক্রবর্তী দেবীর মন্দিরের বাইরে একটা হরিণকে ধরার জন্য ছুটছে। কী যে স্বপ্ন! স্বপ্নটার কোনও মানে হয় না।
—কিন্তু এত রাতে? কিছু খেলে না। তুমি কী পাগল!
সুবল হাসল। সুবলের লম্বা পাজামা, লম্বা পাঞ্জাবি গেরুয়া রংয়ের এবং সন্ন্যাসীর মতো মুখ শেফালীকে কেমন কাতর করছে। সে বলল, খেলে না। টুকুনের কাছে গেলে—দেখা হল কিনা বললে না। সিস্টার কী বলল বললে না। কী হয়েছে তোমার?
—টুকুনদিদিমণি হাসপাতাল থেকে চলে গেছে।
—তাহলে দেখা হয়নি?
—না।
এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা ধরা পড়ছে সুবলের চোখে মুখে। অথবা দেখলে মনে হয় সুবল মনে মনে কিছু স্থির করে ফেলেছে। তাকে এখন শেফালী কিছুতেই আটকে রাখতে পারবে না। শেফালী তবু বলল, কিছু খেলে না!
—কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
—তুমি তো দেখছি শহরের মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছ।
সুবল চোখ তুলে তাকাল।
—তোমার তো এমন হওয়া উচিত না রাজা।
সুবল কিছু বলল না। সুবলের যেমন স্বভাব কথার ঠিক জবাব দিতে না পারলে একটু হেসে ফেলা, তেমনি সে হেসে দিল।
এই হাসিটুকু ভারী সুন্দর। এমনভাবে হাসলে বড় বেশি সরল মনে হয়। তখন ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয়। আদর করতে ইচ্ছা হয়। এত যে মনের ভিতর তার অশান্তি—কেমন নিমেষে উড়ে যায়। তার মানুষ ঘরে থাকে না। মানুষটা সংসার চালাবার নামে কোথায় থাকে, কোথায় যায় সে বলতে পারে না। এবং মদ্যপানে মানুষটা কখনও অমানুষ হয়ে গেলে শহরের সব দুঃখ একসঙ্গে ধরা যায়। তখন সুবলের মতো একজন সরল গ্রাম্য বালকের সঙ্গ পেতে বড় ভালো লাগে।
শেফালী বলল, তুমি রাজা আজ কোথাও যেতে পারবে না।
সুবল দেখল শেফালীবউদির চোখে ভীষণ মায়া। ভীষণ এক টান। এবং এই শহর, নির্বান্ধব শহরে সে কেন জানি আর না করতে পারে না।
শেফালী বলল, আমি কটা গরম রুটি সেঁকে দিচ্ছি। একটু আলুর তরকারি। বেশ খেতে ভালো লাগবে।
সুবল বলল, তুমি আমার জন্য এত রাতে এসব করবে?
—বাঃ করব না! তোমার দাদা এসে যদি জানতে পারে রাজা রাতে না খেয়ে বের হয়ে গেছে, তবে আমাকে আস্ত রাখবে!
সুবল বুঝতে পারে এই শহরের কোথাও নানা ভাবে নানা বর্ণের দুঃখ জেগে আছে। এই সংসারে এমন এক দুঃখ। অভাব—অনটনের সংসারে একটা মানুষ সবসময় কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে! কেমন একটা পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব অজিতদার। কোথায় যে এই মানুষের আস্তানা সে সঠিক জানে না। খুব কম সময় সে অজিতদাকে এখানে দেখেছে। এবং শেফালীবউদির চোখ দেখে মনে হয়েছে সে—ও সঠিক ঠিকানা অজিতদার জানে না। ওর মনে হল টুকুনদিদিমণির সঙ্গে অজিতদার সঠিক ঠিকানাটাও সে খুঁজে বের করবে। সে বলল, দাও তবে। আজ আর বের হচ্ছি না। যখন বললে, তখন আজ রাতটা এখানেই কাটানো যাক।
সুবল কেমন স্মার্ট গলায় এখন কথাবার্তা বলছে। সে দেখল বারান্দায় উনুনে বউদি আঁচ দিচ্ছে। এবং বউদিকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছুদিন থেকে দাদার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার অভাব হচ্ছে। অথবা বউদির এমন একটা জায়গা ভালো লাগছে না। কারণ বউদি খুব পরিপাটি এবং সেজেগুজে থাকতে ভালোবাসে।
অজিতদার খুব ইচ্ছা বউদির জন্য সে যাবতীয় কিছু করবে। এতসব অট্টালিকা এই শহরে, বউদির জন্য এমন একটা অট্টালিকা চাই। এবং যখন সে নানাভাবে চেষ্টা করেও কোনওরকমে একটু সুন্দরভাবে বাঁচবার মতো ব্যবস্থা করতে পারে না, তখন কেমন হীনমন্যতায় ভোগে। এবং এভাবে সংসারে অশান্তি নেমে এলে মনে হয় শেফালীবউদিকে অজিতদা কোথা থেকে যেন চুরি করে নিয়ে এসেছে। অনেক কিছুর প্রলোভনে শেফালীবউদি সবকিছু পিছনে ফেলে চলে এসেছিল। বউদি কতদিন কতভাবে তাকে নানারকম সব গল্প শুনিয়েছে। এবং আজকের এই রাতে খাওয়া একটা বেখাপ্পা ঘটনা। ওর সঙ্কোচ হচ্ছিল।
শেফালী বলল, বেশ গরম পড়েছে। চান করে নাও।
কলতলা খোলা। সেখানে সে পাজামা খুলে চান করতে পারে না। এবং শরীরে সব অস্পষ্ট জলের রেখা চারপাশে ভেসে উঠেছে। সে ছুঁলেই বুঝতে পারে নরম, খুব নরম ত্বকে বাবুইয়ের বাসার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ কীসব ভেসে উঠেছে। এবং এভাবে ওর এক লজ্জা নিবারণের কথা মনে হয়। সে বলল, বউদি আমি বরং রাস্তার কল থেকে স্নান করে আসি।
শেফালী বলল, এত রাতে রাস্তার কলে চান করলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।
পুলিশকে বড় ভয় সুবলের। সে বলল, আমি বরং হাত—মুখ ধুয়েনি।
শেফালী বলল, রাস্তায় গাছের নীচে শুয়ে থাকলে এত গরম লাগে না রাজা।
ঘরে শুলে ভীষণ গরম। চান না করে নিলে ঘুমোতে পারবে না।
—তাহলে আমি যখন চান করব, তুমি কিন্তু তাকাবে না।
—তাকালে কী হবে? শেফালী হেসে দিল।
সুবল বলল, আমি বড় হয়ে গেছি বউদি। বলেই সে কেমন ছেলেমানুষের মতো লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল।
—আমার বড় তোয়ালে—ওটা পরে নাও।
—তোমাদের অসুবিধা হবে না? অজিতদা খারাপ ভাবতে পারে।
সুবল আর কিছু না বলে বেশ বড় একটা তোয়ালে নিয়ে নিল। সংসারে অজিতদার যা কিছু রোজগার সব শৌখিনতার জন্য। সুবল এতসব সুন্দরভাবে ভাবতে পারে না। তবু যখন তোয়ালেতে এক মনোরম গন্ধ, সে তোয়ালেটা মুখে নিয়ে কেমন ঘ্রাণ নিতে থাকল। এমন রঙবেরঙের তোয়ালে নিশ্চয়ই বউদির। সে ঠিক টুকুনদিদিমণির মতো এক আশ্চর্য সুবাস পায় বউদির শরীরে। আর কেন জানি সুবলের মনে হয় এই শহরে, সে যতবার যতভাবে যুবতী মেয়েদের অথবা ফ্রকপরা মেয়েদের সান্নিধ্যে এসেছে, কেমন এক ফুলের সুবাস সবার গায়ে। সে ভাবল, সে যখন ফুল বিক্রি করবে তার শরীরেও এমন একটা মিষ্টি গন্ধ থাকবে।
শেফালীবউদির চটপট সব হয়ে যায়। সুবল গড়িমসি করছিল খুব। ওর তো এমনভাবে বাঁচার স্বভাব নয়। এ যেন আলাদা ব্যাপার। সে একটা আলাদা স্বাদ পাচ্ছে। খুব নিরিবিলি একটা ঘরে, বউদি, বউদির রান্না, ঝালের গন্ধ, এবং আলোর ভিতর বউদির কপালে ঘামের চিহ্ন কেমন এক আকর্ষণ তৈরি করছে। সে সুবল, সংসারের নিয়ম—কানুন সঠিক তার জানা নেই, সে জানে না, এভাবে কোনও যুবতী বালককে রেঁধে—বেড়ে খাওয়াতে পারে, সে ভারী এক রহস্যের স্বাদ পেয়ে যাচ্ছে, সে বলল, বউদি এখানে এলে আমার আর যেতে ইচ্ছা হয় না। অজিতদা যে কী করে তোমাকে ফেলে এতদিন নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে বুঝতে পারি না।
শেফালী বলল, তুমি থেকে যাও না রাজা।
—আমার যে বউদি টুকুনদিদিমণির কাছে যেতে হবে।
—কে যে এক টুকুনদিদিমণি তোমার।
—না, খুব ভালো। আমাকে দেখলেই দিদিমণির প্রাণে যেন জল আসে।
—তুমি ঐ ভেবেই সুখে থাক।
সুবল বলল, আমি যখন ফুল বিক্রি করব তখন একটা করে ফুলের গুচ্ছ দিদিমণিকে দিয়ে আসব।
—তুমি ওকে কোথায় পাবে?
—কেন, এই শহরে।
—সে কী খুব ছোট ব্যাপার?
—আমি যখন ফুল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করব তখন আমার ডাক শুনলে ঠিক দিদিমণি টের পাবে। জানালা খুলে দিলে আমাকে চিনতে পারবে।
আমি বলব, দিদিমণি তোমার ফুল।
শেফালী এই সরলতার জন্য কেমন মুগ্ধ হয়ে যায়। সে বলল, তুমি দাঁড়াও রাজা। ঝোলটা হয়ে গেলে তোমাকে জল পাম্প করে দেব।
শেফালী জল পাম্প করে কেমন ছেলেমানুষের মতো বলল, রাজা তুমি সাবান মাখ না কেন?
—সাবান কোথায় পাব?
—আমি তোমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছি। আমাকে তোমার দাদা পামঅলিভ কিনে দেয়।
—আমার গায়ে মেখে দিলে তোমার শরীরের মতো গন্ধটা হবে?
—হ্যাঁ। ঠিক আমার শরীরে তুমি স্নান করে এলে, যেমন গন্ধ পাও ঠিক তেমনি।
—তবে দাও। খুব সুন্দর গন্ধ শরীরে থাকলে আমার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগে।
—শেফালী ছুটে ছুটে কাজ করছিল। ওর যেন এটা একটা খেলা হয়ে গেছে। সুবলকে নিয়ে খেলা। সুবল কলের নীচে বসে আছে। সুবলের পিঠে শেফালী সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে। বড় নরম শরীর সুবলের। ওর ঘন চুল কী কালো। কপাল প্রায় যেন ঢাকা। লম্বা ভুরু। চোখ ভাসা, এবং পদ্মফুলের মতো জলের ওপর যেন গাছের ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে।
কী যে ভালো লাগছিল শেফালীর—এমনভাবে সাবান মাখিয়ে দিতে! ওর শরীরের ভিতর এক আশ্চর্য অহঙ্কার আছে, শেফালী কেমন পাগলের মতো ওর শরীর নিয়ে, ঠিক একটা ছোট্ট পাখির মতো ওর অহঙ্কার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুবল বলছে, বউদি ঠিক আছে, এবার বাকিটা আমি ঠিক পারব।
—না, তুমি পারবে না রাজা। তুমি কিছু জানো না।
—জানি, ঠিক জানি। দাও, দ্যাখো কী করে মাখতে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি এমন করছ, আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
কিন্তু শেফালী আজও আশা করেছিল, অজিত ফিরে আসবে, কিন্তু যা খবর পাঠিয়েছে ওর মানুষ দিয়ে, অজিত কবে আসবে ঠিক নেই, কবে আসতে পারবে সে বলতে পারবে না। কিছু টাকা পাঠিয়েছে। ভীষণ হতাশা ছিল মুখে। এই সুবল এখন সব আকাঙ্ক্ষার রাজ্যে নতুন বাতির মতো। —তোমার শরীরে রাজা কী ময়লা, বলেই সে বগল তুলে ঘষে দিতে দেখল, কালো মসৃণ ছোট সুন্দর সব চুলের গুচ্ছ—ঠিক কলমি ফুলের মতো রং। ঠিক কালো নয়, কিছুটা তামাটে রং। সুবলের কেমন কাতুকুতু লাগছিল। সে হো হো করে হাসতে থাকল।
শেফালী বলল, তুমি এমন বড় হয়ে গেছ আগে বলোনি কেন রাজা?
সুবল কোনও জবাব দিতে পারল না। একেবারে চুপ মেরে গেল। সত্যি ওর ভীষণ খারাপ লাগছিল। এবং ভয়ে ক্রমে গুটিয়ে যাচ্ছিল।
এভাবে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকার যে বাসনা মানুষের, মানুষ যার টানে বড় রকমের কঠিন কিছু করতে পারে না, এবং এভাবে সুবলের ব্যথিত মুখ দেখে শেফালী কেমন থমকে গেল। বলল, তুমি এমন দুঃখ পাবে জানতাম না।
সুবলের ভিতর এক পাপবোধ এভাবে জন্ম নিলে—এই শহরের গ্লানিকর সব ছবি তাকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। ওর মনে হল, সকাল হলেই সে ফুলের সন্ধানে চলে যাবে।
সঙ্গে থাকবে পাখিটা। যা সামান্য সম্বল আছে এই দিয়ে সে এই শহরের বড় রকমের পাপখণ্ডনের নিমিত্ত আবার রাস্তায় নেমে গেল। সেই যে এক দেশ, যে দেশে সে জন্মেছে, কী যে পাপ ছিল, টুকুনদিদিমণির এমন অসুখ!
সে নানাভাবে ফুলের সন্ধান করে বেড়াল। বই—পাড়ার কাছে খুব বড় ফুলের দোকান আছে। সেখানে সন্ধান নিয়ে সে জেনেছে, কিছুদূর ট্রেনে গেলে, একজন মানুষ আছে। মাঠে তার কেবল ফুলের চাষ। সে রজনিগন্ধার চাষ করতেই বেশি পছন্দ করে। ওর কেন জানি মনে হল, এই পৃথিবীতে একমাত্র সেই লোকটির সঙ্গেই তার এখন বন্ধুত্ব হতে পারে।
সুবল লোকটার সন্ধানে চলে গেল।
একটা নীল রঙের ট্রেনে চড়ে একটা সাদা রংয়ের স্টেশনে সে নেমে পড়ল। যে লোকটা নীলবাতি নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে তার কাছেই খবর পেল—লোকটি একটা ভাঙা কুটিরে থাকে। ওর সম্বল একটা লণ্ঠন। সে তার দুই বিঘা জমিতে নানারকমের ফুলের চাষ করে থাকে। বেলফুলের জন্য আছে কাঠা চারেক ভুঁই। রজনিগন্ধার জন্য আছে কাঠা দশেক। গাঁদাফুল এবং অন্য মরশুমি ফুলের চাষের জন্য সে রেখেছে বাকি জমিটা।
তার বাড়ি যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সে গেলেই একটা ফুলের গুচ্ছ এনে তুলে দেবে। সেখান থেকে তোমার খুশিমতো ফুল পছন্দ করে কিনে আনবে। গুচ্ছের ভিতর সে সব সময় তাজা এবং ভালো ফুলগুলো রাখে। ওর মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। ভীষণ কালো রং মানুষটার। সে একটা লুঙ্গি পরে। মাথায় তার একটা ফেজ টুপি। মানুষটা ধার্মিক। পাঁচ বেলা নামাজ। আর ফুল ফোটানো তার কাজ। পৃথিবীতে অন্য কাজ আছে বলে সে জানে না।
মানুষটার আবার ভীষণ বাতিক। সে যে জমি থেকে মৃতের জন্য ফুলের তোড়া তৈরি করে, সেই জমি থেকে কখনও ফুলশয্যার মালা গাঁথে না। সুবল লোকটির পরিচয় পেয়ে খুব খুশি। সুবল বলল, আমার খুব ইচ্ছা ফুলের চাষ করি তোমার মতো।
—ফুলের চাষ কোর না। দুঃখ পাবে।
সুবল বলল, দুঃখ মানুষের জন্য। মানুষটার কাছে এসে সুবল তার মতো ধার্মিক কথাবার্তা বলতে পেরে আনন্দ পাচ্ছে।
—তা হলে এই বয়সে সুখ—দুঃখ নিয়ে তোমার ভাবনা আছে?
—ভাবনা কী নিয়ে ঠিক জানি না বুড়োকর্তা। তবে এটুকু মনে হয়েছে, তুমি খুব আনন্দে আছো। তুমি শহরে যাও না?
—শহরে কোনওদিন যাইনি। আগে ফুলের চাষ করতাম নেশার জন্য। এখন এটা পেশা হয়ে গিয়ে ভালোই হয়েছে। শুনেছি আমার ফুলের খুব সুনাম বাজারে। মানুষেরা মরে গেলে শুনেছি আমার ফুল তাদের চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা ভাবতে খুব আনন্দ পাই।
—সুন্দর সুন্দর বউরা শুনেছি বিকেলে ছাদে ঘুরে বেড়ায়। তাদের খোঁপায় আমার এই সব বেলফুলের মালা জড়ানো থাকে! বুড়ো মানুষটি সুবলকে এমনও বলল।
সুবল বলল, তুমি আনন্দেই আছো। ফুল বিক্রি করাও খুব আনন্দের। আমার তো তেমন পয়সা নেই।
বুড়ো লোকটি বলল, আমার কাছে একদিনের ধারে পেতে পারো। তার বেশি নয়।
—কিন্তু আমার ঠিকানা নেই।
—ঠিকানা! মানুষটা ঠিকানার কথা বলতেই কেমন চোখ বড় বড় করে ফেলল। মানুষের কোনও আবার ঠিকানা থাকে নাকি?
—থাকে না? এই যে তোমার ঠিকানা, ফুলের মাঠ, একটা সবুজ কুটির এবং নদীর ধারে বড় রাস্তা।
লোকটি বলল, অঃ। এই ঠিকানার কোনও দাম নেই। আমি তোমার ঠিকানা চাই না। তুমি তো একদিনের জন্য ধার নেবে। বাকিটা তো আমার ওপর।
যাই হোক, সুবল লোকটির কাছে অনেক বেলফুল চাইল।
লোকটি বলল, এসো।
সুবল লোকটির সঙ্গে হাঁটতে থাকল।
বেলফুলের জমিতে এসে বলল, তুমি এই এই গাছ, বুড়ো এক দুই করে গাছের নম্বর বলে গেল, এগুলো তোমার। তুমি এসব গাছ থেকে ফুল নেবে। বলেই সে সুবলের মুখে কী দেখল। বলল, দাম অর্ধেক হয়ে যাবে। গাছের সেবা—যত্নের ভার নিলে, ফুলের দাম কমে যায়।
সুবল অর্ধেক দামেই ফুলের বন্দোবস্ত নিল।
সুবল খুব সকালে আসত। গাছে জল দিত। গাছগুলোর গোড়া খুঁচিয়ে দিত নিড়িকাচি দিয়ে। নদীতে স্নান করত। জোয়ারে জল থাকত খুব নদীতে। সে জল বয়ে আনত নদী থেকে। মাটিগুলো টেনে গেলে অথবা গোড়া শক্ত হয়ে গেলে, সুবলকে খুব চিন্তিত দেখাত। অথবা পোকা লাগলে সে কী করবে ভেবে পেত না। বুড়ো মানুষটা তখন নানারকমের শুকনো পাতা সংগ্রহ করত বন থেকে। শুকনো নিমপাতা অথবা কচুরিপানা। সব সে আগুন জ্বেলে একরকমের ছাই সংগ্রহ করত। ছাই ছড়িয়ে দিত গাছে গাছে পাতায় পাতায়।
আর সকাল হলেই সুবল দেখতে পেত ঝোড়ো হাওয়ায় পাতা থেকে সব ছাই উড়ে গেছে। পোকামাকড় সব মরে গাছের নীচে পড়ে গেছে। পাতাগুলো গাছের কেমন সবুজ হয়ে গেছে। আর কী আশ্চর্য সাদা রংয়ের ফুল—চারপাশে গন্ধে ভীষণ আকুল করছে। এমন একটা ফুলের মাঠে দাঁড়ালে কোথাও দুঃখ আছে বোঝা যায় না।
এই কুটিরের পাশেই সুবল আর একটা কুটিরে বানিয়ে নিয়েছে। সে নদী থেকে মাটি কেটে এনেছে। বুড়ো মানুষটা তাকে সাহায্য করেছে নানাভাবে। এতদিন একা থেকে বুড়ো মানুষটার একরকমের স্বভাব হয়ে গিয়েছিল—মানুষ কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। আর যেসব ফুলের দালালরা আসত, ভারী খারাপ লোক। নানাভাবে তাকে ঠকাত। একমাত্র সুবল এক মানুষ, কেমন সরল, এবং ঠকানো কাকে বলে জানে না। সে আসার পর তার চাষ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এবং সময়মতো আজকাল বর্ষা আসে। ভালো ভালো ফুল হয়। গোলাপগুলো কী যে বড় হয়ে ফুটছে। গোলাপ চাষের ভার এখন সুবলের উপর। ছেলেটা ভারী পয়া। যেন সুবল বললে সব তার নামেই লিখে দেবে।
এই লোকটিকে দেখে সুবলের কখনও কখনও জনার্দন চক্রবর্তীর কথা মনে হয়। খুব দাম্ভিক, কিছুতেই হার মানবে না প্রকৃতির কাছে। এই মানুষেরও একটা তেমন অহঙ্কার আছে। তার মতো ফুলের চাষ এ—তল্লাটে কেউ জানে না। সে ফুলের চাষ করে যা উদ্বৃত্ত হয়েছে, একটা মসজিদ বানিয়েছে। সে সেখানে মাঝে মাঝে গরিব মানুষের জন্য শিরনি দেয়। তার স্বভাব উলটো। একটা ইঁদারা করে দিয়েছে। সে এসবের ভিতরেই ধর্মকে খুঁজে বেড়ায়। এবং সুবল এখানে আসার পর সে একটু যেন হাতে সময় পেয়েছে। মাঝে মাঝে চারপাশে যখন তার অজস্র গোলাপ, তখন সে একটা বড় লম্বা মানুষ হয়ে যায়। ওকে একটা ফুলের বনে ফেরেস্তার মতো মনে হয়।
একদিন সকালে উঠে বুড়ো মানুষটা দেখল, সুবল ঘরের দাওয়ায় চুপচাপ বসে আছে। পাখিটা খুব ওকে জ্বালাচ্ছে। সে মাত্র নামাজ পড়ে এদিকে এসেছে সুবলকে বলতে, যেন সুবল গোলাপের দালালি করার লোকটা এলে ভাগিয়ে দেয়। এবার থেকে সব ফুল সে সুবলকে দিয়ে দেবে। গোরুর গাড়িতে সুন্দর করে স্তবকে স্তবকে কলাপাতায় মোড়া ফুলের গুচ্ছ। শেষ—রাত থেকে উঠে তুলে ফেলতে হয়। সকাল সকাল স্টেশনে ওগুলো চালান দিতে হয়। রোজ ফুল যায় না। একদিন অন্তর একদিন। কিন্তু সে এসে সুবলকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখবে ভাবতে পারেনি।
বুড়ো লোকটা কাছে গিয়ে বলল, তোর আজকাল ফিরতে এত রাত হয় কেন রে?
সুবল তাকাল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
বুড়ো মানুষটা এমন একটা মুখ মাঝে মাঝেই সুবলের দেখেছে। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে, ফুলের কুঁড়ি বেছে নিচ্ছে সুবল, সাতটা কথা বললে একটা কথার জবাব দিচ্ছে। বুড়ো লোকটা এবার কেমন খেপে গেল, বলল, সুবল ফুলের মাঠে কেউ দুঃখ নিয়ে বাঁচলে আমার ভালো লাগে না।
—দুঃখটা তুমি কর্তা কোথায় দেখলে?
—সকালে এমন মুখে বসে আছিস কেন?
—তুমি জানো না কর্তা, আমি কতদিন থেকে তাকে খুঁজছি।
বুড়ো লোকটা বুঝতে না পেরে বলল, সে সবাই খোঁজে, কেউ পায় না। আমিও তো তাকে খুঁজছি। পাচ্ছি কোথায়?
সুবল বলল, তুমি বুড়োকর্তা এমন কোনও মেয়ে দেখেছ, কেবল যার অসুখ? অসুখ ছাড়ে না। দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে পারে না। কেবল শুয়ে থাকে। মুখটা তার বেলফুলের মতো সাদা।
বুড়োকর্তা হা হা করে হেসে উঠল। বলল, মেয়েই দেখিনি জীবনে। তার আবার অসুখ, তার আবার ভালো থাকা! আর তাই নিয়ে তুই মুখ গোমড়া করে রেখেছিস!
সুবল বুড়োকর্তার দুঃখটা কোথায় ধরতে পারে। এমন একজন কুৎসিত মানুষকে, কেউ হয়তো ভালোবাসেনি। যখন ঘরে বিবি আনার বয়স ছিল, তার পয়সা ছিল না, তার মুখের চেহারাতে আছে নৃশংস এক ছবি। নিষ্ঠুর মুখচোখ দেখলে কেউ কাছে আসতে সাহস পায় না।
কেবল সুবল জানে—কী কোমল ধর্মপ্রাণ মানুষটি। সে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তাকে খুঁজে ঠিক বের করব। তার খুব অসুখ। আমাকে দেখলে ও খুব খুশি হয়।
অথবা তার যেমন ধারণা। সে গেলেই টুকুনদিদিমণি ভালো হয়ে যাবে। এমন এক সরল বিশ্বাস টুকুনের চোখ—মুখ দেখে তার গড়ে উঠেছে বুঝি। সে তো কখনও টেরই পায় না টুকুনদিদিমণি অসুস্থ। সে গেলে জানলা পর্যন্ত হেঁটে আসতে পারে। কত কথা। টুকুনকে নিয়ে সে কত কথা। টুকুনকে নিয়ে সে সারা বিকেলে শুধু গল্প আর গল্প। এবং এভাবেই মানুষের মনে অজান্তে এক অহঙ্কার গড়ে ওঠে। সে জনার্দন চক্রবর্তীর মতো রুক্ষ মাঠে বান ডাকাবার চেষ্টা করছে।
বুড়োকর্তা বলল, তুমি পাবে। তাঁকে ঠিক খুঁজে পাবে। ভালো মানুষেরা তাঁকে একদিন খুঁজে পায়।
সুবল বুঝতে পারল বুড়োকর্তা ঈশ্বরের কথা বলছেন। সে আর বুড়োকর্তাকে ঘাঁটাল না! ঈশ্বর—বিশ্বাসেরই মতোই ওর ধারণা, সে একদিন না একদিন টুকুনদিদিমণিকে ঠিক জানালায় আবিষ্কার করে ফেলবে।
তের
টুকুনকে নিয়ে সুরেশবাবু আবার একটা কষ্টের ভিতর পড়ে গেছেন। শুধু এখন শুয়ে থাকে আবার। মাঝে একটু ভালো হলে সুরেশবাবু টুকুনকে নিয়ে একটা স্পেস অডিসি দেখে এসেছেন। টুকুন স্পেস অডিসি দেখার পর কেমন সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে হাজার লক্ষ কোটি গ্রহ—নক্ষত্রের ভিতর দিয়ে যখন মহাযানটি ছুটছিল, তখন নিশ্চয়ই তার পাশে ছিল ছোট্ট রাজপুত্রের গ্রহাণু। অথবা সেই যে এক বাতিয়ালা ছিল এক ছোট গ্রহাণুতে তার কথাও মনে পড়ছে। তার গ্রহাণুর পাশ দিয়ে যাবার সময় মহাযানটি নিশ্চয়ই উঁকি মেরে দেখেছে, বাতিয়ালা সন্ধ্যা হলেই গ্যাসের একটা বাতি জ্বেলে দিচ্ছে।
সুরেশবাবুও মনে মনে সেই পাখিয়ালাকে খুঁজছেন। তাঁর দৈবে এখনও বিশ্বাস আছে। ডাক্তারবাবু পর্যন্ত মত দিয়েছিলেন। কেবল টুকুনের মার জন্য সিস্টারকে ঠিকানা দেওয়া গেল না। তিনি তিন— চারদিন আগে সিস্টারকে ফোন করেছিলেন পাখিয়ালা এসেছিল কিনা আর? সিস্টার বলে দিয়েছিল—না।
টুকুন এখন আর কিছু বলে না। সে ছোট্ট রাজপুত্রের বইটাই বারবার আজকাল পড়ছে। স্পেস অডিসি দেখার পর এই গ্রহ—নক্ষত্র—সৌরজগৎ অথবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ধারণা মনের ভিতর গড়ে উঠল—বেঁচে থাকা এই গ্রহে বড় অকিঞ্চিৎকর ঘটনা—অথবা টুকুনের মনে হয় সে কত অপ্রয়োজনীয় এই সৌরমণ্ডলের ভিতর। অন্তত ছোট রাজপুত্রের মতো বাঁচারও একটা মানে ছিল। তার ছিল তিনটে আগ্নেয়গিরি, ছ’টা পাহাড়, দুটো নদী, একটা হ্রদ, একটা সমুদ্র। সে আসার আগে সমুদ্রের ওপরটা বাওবারের পাতায় ঢেকে দিয়েছিল, সে গ্রহাণু থেকে বিদায় নেবার সময় আগ্নেয়গিরির মুখগুলো হাঁড়ি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। নদীর জল কলাপাতায় ঢাকা। এবং ক’টা বাওবাবের চারা ছিল, সব উপড়ে ফেলেছিল। কিন্তু পরিজ পাখিদের ডানায় ভর করে গ্রহাণু থেকে নেমে আসার সময় তার মনে হয়েছিল বাওবাবের চারা একটা বেঁচে থাকলে, ওর মূল শেকড় এত পাজি যে তার ছোট গ্রহটিকে ঝাঁঝরা করে দেবে।
টুকুন জানলা দিয়ে নানারকম ফুল ফুটতে দেখলেই রাজপুত্রের কথা মনে করতে পারে, সুবলের কথা মনে হয়। সে বিমর্ষ হয়ে যায়। খেতে তার ভালো লাগে না, ইন্দ্রকে আজকাল একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। মা এসে ইন্দ্রের সম্পর্কে সব গল্প করে যাচ্ছে। ইন্দ্র কলেজের পড়া শেষ হলেই সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাবে। এসব খবর অর্থহীন টুকুনের কাছে খুবই অর্থহীন। ওর এসব কথা শুনলে ভারী হাসি পায়। সে বলতে পারে, আমার কাছে এমন সব ইতিহাস লেখা আছে, যা তুমি আদৌ জানো না। কত যে অকিঞ্চিৎকর—এই বিদেশ যাওয়া। মা, তুমি ইন্দ্রকে আমার ঘরে আর পাঠাবে না। ওর মুখ পুতুলের মতো। সব সময় মুখটা একরকমের থাকে। সে একটা কথা শুধু জানে,—টুকুন আজ তোমার কেমন লাগছে? শরীর তোমার কেমন?
অন্য কথা জানে না বলে টুকুনের মনে হয় ইন্দ্র এই দুটো কথাই শুধু সারাজীবন ধরে মুখস্থ করেছে। অন্য কথা সে জানে না। তার আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরা কেউ বড় আসে না তার ঘরে। ওর অসুখটা যদি অন্য কারও শরীরে সংক্রামিত হয়—এই অসুখ—কী যে অসুখ—কেউ টের পায় না, একটা মেয়ে সবকিছুর ভিতর কেমন সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে বেঁচে আছে।
সকাল থেকেই আজ এই অঞ্চলে গণ্ডগোল চলেছে। গীতামাসি টুকুনকে এমন বলেছিল। পাঁচিল পার হলে ফুটপাথ। লাইটপোস্টটার নীচে দুটো মানুষের মাথা কারা কেটে রেখে গেছে। সকাল থেকে হইচই। পুলিশ। কোথায় পাশে গুলি চলছে। তিনজন ধরাশায়ী। বিকেলে একটা বড় মিছিল যাচ্ছিল, সেখানে বোমা।
বোমা মিছিল আর নানারকমের অসুখ নিয়ে বেঁচে আছে এতবড় শহরটা। যেমন একটা অসুখ এই শহরের, সব বড় বড় বাড়ি, প্রাসাদের মতো বাড়িগুলো রাতে ফাঁকা থাকে নীচে ফুটপাথে লোক শুয়ে থাকে—শীতে অথবা ঝড়বৃষ্টিতে কষ্ট পায়। টুকুন বুঝতে পারে না এমন কেন হয়। যখন বাড়িগুলো ফাঁকা, লোকজন কম, গরিব সব মানুষদের সেখানে আশ্রয় দিলে কী যে ভালো হয়। কিংবা কেউ খায়, কেউ খেয়ে হজম করতে পারে না, কেউ না—খেয়ে পেটের জ্বালায় ফুটপাথে পড়ে থাকে। অথবা কী যে ধনাঢ্য পরিবার, তার বাবা তাকে নিয়েও বেশ একটা খেলায় মেতে গেছে, কত বেশি সুখ সে টুকুনের জন্য এনে দিতে পারে এমন খেলা। টুকুনের ঘরটা হলঘরের মতো। নানাবর্ণের দেয়াল। ভিতরে চন্দনের মতো গন্ধ। এবং সব সময় কী যেন গীতামাসি স্প্রে করে দিয়ে যায়। বড় বাথরুম। শ্বেতপাথরের দেয়াল। বিখ্যাত সব চিত্রকরদের ছবি। একটা ছবি, বনের ভিতর একটা বাঘ। পিছনে শিকারি হাতির পিঠে। বাঘের সঙ্গে দুটো বাচ্চা।
আবার ওর খাটটা মেহগনি কাঠের। নানারকমের কারুকাজ করা খাটে সে একা শুয়ে থাকে। এতবড় খাট যে, সে একা শুয়ে থাকে, এ—পাশ ও—পাশ করে কতবার যে অন্য প্রান্তে যেতে চায়—কিন্তু পারে না। সে চুপচাপ কাত হয়ে শুয়ে থাকে, তার পায়ে গীতামাসি আলতা পরিয়ে দেয়। চুল বিনুনি করে বেঁধে দেয়। সে সিল্কের লাল—হলুদ ছোপের ফুল—ফল আঁকা কেমন লুঙ্গির মতো একটা পোশাক পরে। ফুল—হাতা সাদা রংয়ের জামা। চোখ কেমন নীল নীল—এবং বুকে সে কোনও ধুকপুক শব্দ শুনতে পাচ্ছে না ভালোবাসার জন্য। কেবল সেই নির্বান্ধব ছেলেটির জন্য ওর মায়া। সে এলে হয়তো উঠে বসতে পারত।
এবং চারপাশে নানারকমের গণ্ডগোল। গণ্ডগোলের শহরে গণ্ডগোল বাদে কী আর থাকবে! এই সন্ধ্যায় যখন একটা গ্রহাণুতে এক বাতিয়ালা গ্যাসের আলো জ্বেলে দিচ্ছে, তখন কিনা এই গ্রহের সব সৌন্দর্য হরণ করে নেবার জন্য মানুষ মানুষকে অকারণ মেরে ফেলছে। টুকুন জানালায় দাঁড়িয়ে তার দোতলার ঘর থেকে দেখতে পেল, রাস্তার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষ পাঁচিল টপকে ছুটে আসছে।
দারোয়ানদের ঘরগুলোর পাশে যেখানে লম্বা গ্যারেজ, তার পাশে একটা লোক টপকে এসে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। সে যেন রাস্তা থেকে প্রাণ বাঁচাতে এসে অন্য একটা ট্র্যাপে পড়ে গেল। পুলিশের লোকগুলো ছুটছে। যাকে পারছে তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পাঁচিল টপকে একটা লোক এ—বাড়িতে ঢুকে গেছে, পুলিশের নজর এড়ায়নি। পুলিশও বেশ গোঁফে তা মেরে লাফ মেরে পাঁচিলের এ—পাশে এসেই দেখছে ফাঁকা।
টুকুন চুপচাপ শুয়ে দেখছে আর মজা পাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে—সেই পালানো লোকটা একটা বনকরবীর ডালে বসে আছে। নানারকমের লতাপাতায় গাছটা ঢাকা। এবং টুকুন একেবারে অবাক, রক্তের ভিতর তার হাজার ঘোড়া সবেগে ছুটছে, ওর মুখ—চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, এবং সে কেমন অধীর হয়ে যাচ্ছে—সে তার ভিতর আশ্চর্য এক তাজা ভাব, অথবা মানুষের যা হয়ে থাকে, সময়ে সংসারের সব নিয়ম—কানুন সহসা পালটে যায়, বোঝানো যায় না এমন কেন হয়, টুকুন কেমন হয়ে যাচ্ছে, টুকুন উঠে বসল খাটে। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে কেউ নেই। সে পিছনের দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল। ঘোরানো সিঁড়ি বাগানে নেমে গেছে। মালিরা কেউ নেই। এবং সে এ—সময় পাগলের মতো ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে যাচ্ছে। সে কিছু দেখে ফেলেছে, সে যে নিজের ভিতর এখন নিজে নেই, অথবা তার এটাই নিজের, এতদিন সে একটা মেকি ভয়ে খাটে শুয়ে রয়েছে, এ—মুহূর্তে কোনটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। টুকুন পাগলের মতো ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছটা পার হয়ে গেল।
এখন যদি সুরেশবাবু দেখতে পেতেন—অথবা গীতামাসি কিংবা মা, কেউ এ—ঘটনা বিশ্বাসই করতে পারত না। ওদের চোখে এটা কোনও ভৌতিক ব্যাপার হয়ে যেত।
টুকুন এবার গোলাপের বন পার হয়ে গেল। সে দেখতে পাচ্ছে পুলিশটা চারদিকে তাকাচ্ছে।
টুকুন এবার বনকরবী গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। পুলিশটা তার দিকে আসছে।
এখন সন্ধ্যা। বাগানের নানারকমের ফ্লুরোসেন্ট বাতি। টুকুন পুলিশ আসার আগে ডাকল, সুবল।
সুবল এতক্ষণে লতাপাতার ফাঁকে দেখছে—দিদিমণি। সে প্রায় পাগলের মতো নেমে আসছে এবং লাফ দিয়ে ঝুপ করে টুকুনের পায়ের কাছে পড়ল।
—দিদিমণি তুমি!
—তাড়াতাড়ি এসো। বলে টুকুন আবার সুবলকে নিয়ে বাগানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুবলের হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ। ব্যাগে কিছু রজনিগন্ধা। তার গন্ধ এখন সুবলের গায়ে। সে এখানে যে ভয়ে ছুটে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। এভাবে একদিন টুকুনদিদিমণিকে আবিষ্কার করতে পারবে ভাবতে পারেনি। অনেকটা গল্পগাথার মতো। এমন সব মেলানো গল্প শেফালীবউদি তাকে বলত। সে এতটা কখনও আশা করেনি। আশা করেনি বলেই সে কেমন আরও গ্রাম্য সরল বালক হয়ে গেল। নিজের এই আনন্দ সে কিছুতেই হইচই করে প্রকাশ করতে পারছে না।
টুকুন ওকে যেভাবে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে—সে সেভাবে যাচ্ছে।
টুকুনকে দেখে সুবল বিশ্বাসই করতে পারছে না, এই টুকুনদিদিমণি। খুব বেশি একটা হেঁটে এলে জানালা পর্যন্ত আসতে পারত। সে এতটুকুই দেখেছে। এমনভাবে একেবারে স্বাভাবিকভাবে সে কোনওদিন টুকুনকে হাঁটতে দেখেনি। কী সহজ সরল ভাবে ওর হাত ধরে নানারকমের গাছের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টুকুনের পরনে কী সুন্দর পোশাক। কেমন সকালের গোলাপের মতো তাজা রং পোশাকের রংয়ে। এবং গোলাপের পাপড়ি মতো নরম পোশাক। প্রায় ফ্লুরোসেন্ট আলো যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
পুলিশটা এখন পাঁচিলের এদিকটায় একটা মানুষ খুঁজছে। পুলিশটার মনে হয়েছে, যারা বোমা ছুঁড়েছিল রাস্তায় তাদের একজন কেউ হবে কারণ লোকটার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে বোমা ছুঁড়ে মারা সহজ। প্লাস্টিকের ব্যাগ আছে বলেই পুলিশটা এখন ওৎ পেতে আছে। সুবল বাগানের ঝোপজঙ্গল থেকে বের হয়ে এলেই ধরবে। প্লাস্টিকের ব্যাগে যে রজনিগন্ধার গুচ্ছ থাকতে পারে—কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। পুলিশেরা ফুলের কথা বিশ্বাস করে না।
টুকুন বলল, সুবল তুমি এতদিন আসনি কেন?
সুবল বলল, টুকুনদিদিমণি, এটা রাজবাড়ি?
—যা, রাজবাড়ি হতে যাবে কেন? আমাদের বাড়ি।
—তোমাদের বাড়ি? এতবড় ফুলের বাগান! এত ফুল! টুকুনদিদিমণি, আমি রোজ ফুল তুলে নিয়ে যাব এখান থেকে। তার এসব দেখে এত আনন্দ হচ্ছে সে কী কথা বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবু কিছু বলতে হয় বলে যেন বলা, টুকুনদিদিমণি আমি তোমাকে রোজ ফুল বিক্রি করতে করতে খুঁজেছি। শেষদিকে কেমন ভেবেছিলাম তোমাকে আর খুঁজে পাব না। তুমি বাদে আমার তো এ শহরে আর কেউ নেই।
টুকুন বলল, সুবল তাড়াতাড়ি এসো।
সুবল বলল, এটা কী ফুল গাছ?
—তোমাকে পরে চেনাব। ঐ দ্যাখো পুলিশটা বাগানের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।
সুবল দেখল সত্যি। ওকে দেখে ফেলেছে।
টুকুন বুঝতে পারল পুলিশটার চোখে ওরা ধুলো দিতে পারবে না। কিংবা সুবলকে নিয়ে জানাজানি হলে মা আবার সুবলের এখানে আসা বন্ধ করে দেবেন। এটা বাড়ির দক্ষিণ দিক। মা—বাবা থাকেন পুবের মহলাতে। এই মহলে সে থাকে, আর ভিতরের দিকে থাকে গীতামাসি। ও—পাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে। কেউ ওর ঘরে উঠে আসতে হলেই সে টের পায় কেউ আসছে। কারণ কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হয়। সেই শব্দ এক দুই করে গুণে গুণে কী যে একটা স্বভাব হয়ে গেছে টুকুনের, কোন শব্দে কে আসে টের পায়। মা উঠে আসছেন, না বাবা, না গীতামাসি, না ডাক্তারবাবু না ইন্দ্র—সে সব টের পায়। পায়ের শব্দ কারও একরকমের হয় না।
সে এবার দাঁড়াল এবং এটা বোধহয় একটা রক্তকরবী গাছ। সে বাতির আলোতে ঠিক বুঝতে পারছে না। গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে সে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এবং পুলিশ হামাগুড়ি দিয়ে কিছু বনঝোপের মতো জায়গা পার হয়ে সামনে দাঁড়াতেই চোখ মেলে তাকাতে পারল না। একটা ফুলপরির মতো মেয়ে। যেন পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখের পলক ফেলতে পারছে না। কোনও দেবীমহিমা টহিমা হবে। সুবল ওপাশে একটা বড় পাথরের স্ট্যাচুর নীচে বসে রয়েছে। ওকে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশটার মনে হল সে কোথাও কিছু গোলমাল করে ফেলেছে। সে বোধহয় ছুটেই পালাত। কিন্তু সুন্দর গলায় যখন টুকুন বলছে, তুমি এখানে কী চাইছ? কাকে খুঁজছ?
—আমি কিছু খুঁজছি না মেমসাব।
টুকুন এমন কথাবার্তা আরও শুনেছে। সে অবাক হল না। বলল, কেউ নেই এখানে।
—কেউ আমার মনে হয় এই বাগানেই লুকিয়ে আছে।
—সে আমাদের সুবল। সে খুব ভালো ছেলে।
পুলিশ খুব বোকা মুখ করে রেখেছে। টুকুন বলল, সুবলের একটা পাখি আছে। সে এক আশ্চর্য পাখি। এমন পাখি আমি কোনওদিন দেখিনি।
পুলিশ বলল, তাই বুঝি?
টুকুন বলল, সে এসেছে এক খরার দেশ থেকে।
পুলিশ বলল তাই বুঝি?
টুকুন বলল, সে এখন শহরে ফুল বিক্রি করে।
এবং এটুকু বলার পর টুকুন সুবলকে ইশারায় ডাকল। সুবল স্ট্যাচুর ওপাশ থেকে খুব অপরাধী মুখে উঠে আসছে।
টুকুন বলল, এই আমাদের সুবল।
সুবল বলল, আমার নাম সুবল।
টুকুন বলল ওর একটা পাখি আছে। সুবলের দিকে তাকিয়ে বলল, সুবল তুমি পাখিটা আজ এনেছ?
—না দিদিমণি।
—কাল সুবল পাখিটা নিয়ে আসবে।
—আসব।
—আর এই দ্যাখো, বলে সুবলের প্লাস্টিকের ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। —দ্যাখো শুধু ফুল আছে। ফুল। সুবল এর ভিতরে ফুল নিয়ে আসে।
—ব্যাগের ভিতর আজকাল কেউ ফুল রাখে জানতাম না মেমসাব।
টুকুন বলল, ব্যাগের ভিতর অনেক কিছু রাখতে পারে। শুধু ফুল থাকবে কেন? সন্দেশ থাকতে পারে, বই থাকতে পারে।
—না, আজকাল মেমসাব শুধু ব্যাগের ভিতরে বোমা থাকে। আর আমাদেরও শালা এমন বজ্জাতি বুদ্ধি, ব্যাগ দেখলেই পিছন ধাওয়া করো, কী আছে না আছে দেখার দরকার।
টুকুন বলল, তবে তুমি যেতে পারো।
পুলিশ একটা সেলাম ঠুকে বলল, খুব বেঁচে গেছিস সুবল। মেমসাব দেবতা। তোকে বাঁচিয়ে দিল!
টুকুন বলল, এসব কেন বলছ?
—মেমসাব আমাকে তো কাউকে ধরে নিয়ে যেতেই হবে। সুবল না হলে সেটা সফল হতে পারে না।
—বিনা দোষে ধরে নিয়ে যাবে?
—আমাদের শুধু ধরার কাজ। বিচারের কাজ সরকারের।
—তার জন্য যাকে তাকে? টুকুনের আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না। এখন পুলিশটাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কিছুতেই যেন যেতে চাইছে না। সে বলল, বড় আজগুবি ব্যাপার। আমি যাচ্ছি।
পুলিশ আর দাঁড়াল না। সে সুবলের দিকে ভীষণ কটমট করে তাকাল। এটা কী করে আজগুবি হয় সে বুঝতে পারে না। না, এরা একটা আজগুবি দেশে বাস করছে, সংসারে কী ঘটছে ঠিক খবর রাখছে না? পুলিশ যাবার সময় বলল, মেমসাব যাচ্ছি। আমার খুব ভুল হয়ে গেছে।
ভুল হয়ে গেছে বলল, এজন্য যে সে জানে বড়লোকদের মেয়েরা এমন হয়ে থাকে। কোথাকার একটা ফুলয়ালার জন্য প্রাণে হাহাকার। এখন ওর সারা মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে কোথায় যে আর একটা লোক পাবে! একজনকে ধরে না নিয়ে গেলে বড়বাবু তাকে আস্ত রাখবে না। সে এখন কী যে করে! রাস্তায় তিনজন গেছে। অ্যাম্বুলেন্স এসে ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। যারা গণ্ডগোল করল তাদের পেছনে তাড়া করতে গিয়ে মরার দায়িত্ব নিতে পারছে না। তা ছাড়া এখন রাস্তায় একটাও লোক নেই। শুধু একটা কুষ্ঠরুগি আছে। তাকে নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু অসুখটা বড় খারাপ। একটা খারাপ অসুখের লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া ঠিক না।
এইসব নানারকম ভেবে যখন পাঁচিল টপকে পুলিশ রাস্তায় নেমে গেল তখন টুকুন কিছুটা যেন হালকা হল। সে বলল, সুবল এসো।
সে সুবলকে নিয়ে এবার নরম ঘাস মাড়িয়ে হাঁটছে। সামনে সেই ঘোরানো সিঁড়ি। টুকুন খুব তর তর করে উঠে যাচ্ছে। সুবল ওর পায়ের দিকে তাকাচ্ছে। কী সুন্দর আর সতেজ মনে হচ্ছে। পায়ে আলতা। সুবলের বারবার কেন জানি মনে হচ্ছে—নীলকমল—লালকমল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে। সেই সব রাজপুত্রেরা বুঝি এমন বাড়িতেই থাকত।
এমন একটা প্রাসাদের মতো বাড়ি এই শহরে আছে, অথবা এখনও থাকতে পারে—সে সব দেখতে দেখতে কেমন অবাক হয়ে যাচ্ছে। সে বলল টুকুন দিদিমণি আমি যাব কী করে?
—তোমাকে যেতে হবে না সুবল। তুমি এতবড় বাড়িতে থেকে গেলে কেউ টের পাবে না।
সুবল সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে এসেই দেখল সাদা রংয়ের কেমন মসৃণ মেঝে। একেবারে সাদা সবটা। দেয়াল, মেঝে, বারান্দা এমনকী পোশাক নানাবর্ণের যে আছে তাও অধিকাংশ সাদা রংয়ের।
সুবল বলল, আমার এ—ফুলগুলো তোমার পছন্দ হয় টুকুনদিদিমণি?
—খুব। বলে সে বুকের কাছে ফুলগুলো তুলে নেবার সময়ই মনে হল, সে তো বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। এখন এমন কী করে হচ্ছে? কী করে সে এটা করে ফেলল। ওর চোখ বুজে আসছে। সে বলল, সুবল, সুবল তুমি আমাকে ধরো। আমি পড়ে যাব।
সুবল দেখল আশ্চর্য মায়া চোখে মেয়ের। ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলছে দাঁড়াতে পারছে না। বুকের ওপর ফুলগুলো ধরা আছে। বুঝি পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে বলছে এবং সুবল শুনতে পাচ্ছে, সেই নিঃশব্দ এক ভাষা থেকে সুবল টের পাচ্ছে—টুকুন তাকে ফেলে আর কোথাও যেতে বারণ করছে। এবং টুকুন দিদিমণি যেন পড়ে যাচ্ছিল। সব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিজের অক্ষমতার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হাত—পায়ে আর শক্তি পাচ্ছে না টুকুন। কেমন স্থবির হয়ে যাচ্ছে।
সুবল ধীরে ধীরে টুকুন দিদিমণিকে শুইয়ে দিল। ফুলগুলি পাশে রেখে দিল। সে পায়ের কাছে বসে থাকল। চোখ মেলে না তাকালে সে এখান থেকে চলে যেতে পারে না।
চোদ্দ
তারপর একটা খেলা হয়ে গেল। সংসারে এমন খেলা কে কবে খেলেছে জানা নেই। সুবলকে নিয়ে টুকুন নূতন এক জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেছে।
সুবল, টুকুন চোখ মেলে তাকালে বলেছিল, টুকুন তুমি ভালো হয়ে গেছ। টুকুনকে খুব অবুঝ বালিকার মতো দেখাচ্ছে। সুবলের টুকুনকে আর দিদিমণি বলতে ইচ্ছা হয় না। কারণ টুকুনকে অসহায় এবং কাতর দেখাচ্ছিল। সে যা করেছে এতক্ষণ, সিঁড়ি ধরে যে নীচে নেমে গেছে, গোলাপ গাছগুলোর পাশ দিয়ে যে হেঁটে গেছে, সে কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস না করতে পারলে যা হয়, ভিতরের উদ্যম নষ্ট হয়ে যায়।
সে বলল, টুকুন তোমার কোনও অসুখ নেই। তুমি ভালো হয়ে গেছ।
—তুমি সুবল সত্যি বলছ?
—সত্যি টুকুন। তুমি উঠে বোস। আমি নেমে গেলে দরজা বন্ধ করে দেবে। সুবল এই বলে উঠে এসে রাস্তায় গণ্ডগোল কমেছে কি না, না আবার কারফিউ দিয়ে দিল—এসব জানার জন্য উদগ্রীব হলে টুকুন বলল, সুবল তুমি কোথায় থাকছ?
—অশ্বিনীনগর স্টেশনে নেমে যেতে হয়।
—এত দূরে চলে গেলে কেন?
—খুব দূর না তো। শিয়ালদা থেকে বিশ মিনিট লাগে।
—তবে তো খুব কাছে।
—খুব কাছে। শুয়ে শুয়ে তোমার কথা বলতে ভালো লাগে টুকুন?
—না।
—তবে উঠে বসছ না কেন? এই দ্যাখো বলে সে বলল, তুমি রেডিয়োটা চালিয়ে দাও না।
—কী হবে?
—কারফিউ দিলে বলে দেবে।
—কারফিউ হলে যাবে কী করে?
—কিন্তু যাওয়া দরকার। আমি না গেলে বুড়ো মানুষটা ভয়ানক ভাববে।
—বুড়ো মানুষটা তোমাকে বুঝি খুব ভালোবাসে?
—ভালোবাসে না ছাই! কেবল কাজ। কাজ করো। কাজ করলে লোকটা সবাইকে ভালোবাসে। কাল আমাদের বনে যাবার কথা আছে।
—কী করবে গিয়ে?
—সব শুকনো পাতা জড়ো করব। তারপর যখন সন্ধ্যা হবে, সেইসব শুকনো পাতায় আগুন দেব।
—কী মজা।
—খুব মজা! শীতের সময় আগুন দিলে বুড়ো লোকটা বলেছে জীবজন্তুরা পর্যন্ত সব চলে আসে।
—ওরা আসে কেন?
—আগুন পোহাতে। একটু থেমে সুবল বলল, তুমি রেডিয়োটা খুলে দাও, আচ্ছা টুকুন, কেউ আবার চলে আসবে না তো? কত বড় ঘর তোমার। কেউ চলে এলে কী হবে?
—কেউ এলে কী হবে সুবল?
—আমাকে আসতে দেবে না। তোমার মা আমাকে যদি পুলিশে দেয়!
টুকুনের মুখটা সত্যি শুকিয়ে গেল। সে এটা ভাবেনি। না বলে না কয়ে পাঁচিল টপকে সে চলে এসেছে, পুলিশে দিয়ে দিলে যা হোক ওদের একটা কাজ মিলে যাবে।
সুবল বলল, আমি আর আসব না। আমি এতটা ভাবিনি।
টুকুন বলল, আমার পাশের ঘরটায় গীতামাসি থাকে। বিকেলের খাবার দিয়ে সে নীচে নেমে যায়। উঠে এলে টের পাব সুবল। কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হবে।
—গীতামাসি তোমার দেখাশোনা করে?
—হ্যাঁ। ওকে, দ্যাখো, ঠিক হাত করে নিতে পারব।
—কিন্তু তোমার মাকে টুকুন?
টুকুন উঠে বসল। যেন একটা পরামর্শ না করলেই নয়। সে বলল, এদিকে এসো। সুবলকে নিয়ে ওর বাথরুমের দিকে চলে গেল। ওর দু—পাশে দুটো জলের কল। বড় বড় দুটো থাম। এবং কিছু জালালি কবুতর একসময় কার্নিশে ছাদের অলিন্দে বসবাস করত, তারা এখন কেউ নেই। টুকুনের অসুখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা নাকি উড়ে গেছে। সুবলকে এসব দেখাল টুকুন, বলল সুবল, মা এলে আমরা টের পাব। তোমার কোনও ভয় নেই। পায়ের শব্দ আমি টের পাই। কোনটা গীতামাসির, কোনটা ডাক্তারবাবুর। সব আমি জানি। ওরা এলে তোমাকে আমি ঠিক লুকিয়ে ফেলব। সে দোতলার অলিন্দে নিয়ে গেল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সুবলের কাছে এটা প্রায় রাজার দেশ। টুকুন এক রাজকন্যার মতো। সে যেন এক রাখাল বালক। তার কাছে আছে মৃতসঞ্জীবনী সুধা। সুধা রসে মেয়েটা এখন নির্ভাবনায় হাঁটছে। সুবলের আছে এক ভালোবাসার জাদুমন্ত্র, অথবা সুবলকে নিয়ে হেঁটে এই যে ঘরের পর ঘর, নানাবর্ণের ছবি, এবং সব বিচিত্রবর্ণের কারুকাজ করা খাট—পালঙ্ক পার হয়ে যাচ্ছে—এ যেন তার কাছে ভারী মজার। যেন হাজার হাজার দৈত্য আসবে সুবলকে তুলে নিতে। টুকুনের কাছে আছে দৈত্যের প্রাণ। কোথায় ওরা দাঁড়িয়ে পাখিটার পাখা পা এবং গলা ছিঁড়বে তার যেন একটা পরামর্শ চলেছে।
এসব হলেই মেয়ের মনে হয় না তার কোনও অসুখ আছে। এসব হলেই মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে অনেক সুখ। এক অপার অভাববোধ এই বালকের জন্য। সংসারে ছেলেটি যত অপাঙক্তেয়, তত টুকুনের কাছে সে মহার্ঘ। টুকুন আনন্দে, কারণ যখন প্রায় সব ঠিক হয়ে গেল তখন আনন্দে প্রায় ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। বলল সুবল তোমাকে এখানে আসার একটা সুন্দর রাস্তা দেখিয়ে দেব। তুমি ফুল বিক্রি করে রোজ এখানে আসবে। আমি কী সুন্দর ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প পড়ে রেখেছি। তুমি আসবে বলে বসেছিলাম। তুমি না এলে কাকে আর আমার গল্প শোনাব।
কাঠের সিঁড়ির মুখের দরজাটা টুকুন বন্ধ করে দিল। কী বড় বড় শার্সির নীল রংয়ের দরজা। টুকুন অনায়াসে টেনে টেনে বন্ধ করে দিচ্ছে। সুবল ওকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে সাহায্য করলে সে বলল, আমি পারব সুবল। বলে হাসল।
সুবল যেতে যেতে বলল, এটা কী?
—এটা পিয়ানো। বলেই টুকুন দুহাতে ঝম ঝম করে বাজাতে থাকল। কতদিন থেকে পিয়ানোটা কেউ বাজায় না। না, ইন্দ্র মাঝে দু’একদিন বাজিয়েছে। যখন টুকুন শুয়ে থাকে মা কখনও বাজান। লম্বা একটা খাতা পিয়ানোর ওপর। সুবল দেখল কেমন গোটা ঘরটা ঝম ঝম করে উঠছে। এবং ক’টা চড়াইপাখি ঝাড়—লণ্ঠনে বসেছিল, পিয়ানো বাজালে পাখিগুলো উড়ে উড়ে বাগানের ভিতর চলে গেল।
সুবল দেখছে—কী সুন্দর বাজাচ্ছে টুকুন। এমন একটা সুন্দর বাজনা পৃথিবীতে আছে তার যেন জানা ছিল না। চুলগুলো বব করা টুকুনের। বিনুনি বাঁধা নয়। হাতের আঙুলগুলো চাঁপা ফুলের মতো। পায়ে আলতা আছে বলে খুব সুন্দর লাগছে। এবং সে পাজামার মতো কোমল পোশাক পরে আছে, আর লম্বা, টুকুন প্রায় তার মতো লম্বা। সে বয়সানুপাতে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। সে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পেল। কারণ বড় বড় দুটো আয়না, পৃথিবীতে এতবড় আয়না দিয়ে কী হয় সে জানে না। গোটা ঘরের প্রতিবিম্ব এখন এই আয়নার ভিতর। সে তন্ময় হয়ে টুকুনদিদিমণির পিয়ানো বাজনা শুনছে।
আর তখন কাঠের সিঁড়ির মুখে কারা উঠে আসছে যেন। ওরা দুজনে এত বেশি গভীরে ডুবে আছে যে কেউ টের পায়নি, অথবা শুনতে পাচ্ছে না সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির সবাই ছুটে আসছে এদিকে। কারণ অসময়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে কেউ, সে কে।
আশ্চর্য এক মেলডি ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়িময়।
সুবলেরই প্রথম মনে হল দরজায় কারা আঘাত করছে। সে টুকুনকে ঠেলে দিয়ে বলল, টুকুন কারা দরজায় ধাক্কা মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো ব্যাপারটা হয়ে গেল। টুকুন বাজানো বন্ধ করে দিল। সুবল লুকিয়ে পড়ল টুকুনের খাটের নীচে। তারপর খুব সহাস্যে দরজা খুলে দিলে দেখল সবাই, টুকুন দরজা খুলে দিচ্ছে। ওরা হাসবে না কাঁদবে স্থির করতে পারছে না। মা বললে, টুকুন তুমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলে?
—হ্যাঁ মা।
—সত্যি?
—হ্যাঁ মা।
টুকুনের মা টুকুনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। সে বলল, তুমি আর একবার বাজাবে?
—এক্ষুনি?
—তোমার বাবা এলে তাকে বাজিয়ে শোনাও না। তিনি খুব আনন্দ পাবেন।
—বাবা আসুক।
—আমি জানি টুকুন ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে যাবে।
গীতামাসি বলল, কোথাকার একটা রাস্তার ছেলেকে ধরে আনতে যাচ্ছিলেন বড়বাবু।
মা বলল, আজকালকার ডাক্তারও হয়েছে তেমন। তারপর কী ভেবে বলল, একবার ইন্দ্রকে ডাকো না?
—সে তো নেই দিদিমণি?
—কোথায় গেল?
—সে তো এসময়ে ক্লাবে রোয়িং করতে যায়। ইন্দ্রকে খুশি রাখার জন্য মা—র যে কী করার ইচ্ছা। কারণ এখানে বসে থাকতে চায় না ইন্দ্র। আজ ইন্দ্র এলে খুব খুশি হবে।
টুকুন এখন চাইছে সবাই চলে যাক। কিন্তু সে যে কেন পিয়ানো বাজাতে গেল। সবাই এখন এটা গল্পগাথার মতো ব্যবহার করবে। ছুটে আসবে। এখন যেভাবে হোক সুবলকে বের করে দিতে হবে। ওর ভিতরে সুবলের জন্য একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে। এবং নানাভাবে সে চিন্তা করছে। কী করলে যে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সবাই এসে টুকুনকে দেখে যাচ্ছে। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে এখন আবার সাদা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল। কেবল সুবলের জন্য সে শুয়ে পড়তে পারছে না। খাটের নীচে একবার উঁকি দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ওদিকে কেউ গেলে পা দেখে ফেলবে। এবং এমন একটা ভয়াবহ সমস্যার মোকাবেলা সে জীবনে করেনি। এবং এইসব সমস্যা অথবা তাড়না তাকে এখন বড় বেশি স্বাভাবিক করে রেখেছে। সে বলল, মা আমার আবার ভালো লাগছে না কেন জানি। আমার ঘুম পাচ্ছে।
গীতামাসি, যারা সবাই চাকর এবং অন্যান্য সব পরিজন এসেছিল তাদের চলে যেতে বলল। গীতামাসির কাজ এখন কত বেড়ে গেছে এমন ভাব। সে বলল, দিদিমণি, টুকুন এবার ঠিক বড় হয়ে যাবে।
এ—ছাড়া টুকুনের মার কত সব দুশ্চিন্তা এবং মনের ভিতর সংশয় থেকেই যাচ্ছে। টুকুন এভাবে আরও দু’একবার খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। অবশ্য প্রতিবারই পাখিয়ালা সুবল ছিল কাছে। এবার সে নেই। কিন্তু এমন ম্যাজিকের মতো ব্যাপারটা ঘটবে আশা করতে পারেনি।
মা বলল, টুকুন আমি তোমার জন্য একজন পিয়ানোর শিক্ষক দেব।
টুকুন বলল, আমি শোব মা। আর বসে থাকতে পারছি না।
গীতামাসি টুকুনকে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিচ্ছেন।
মা বলল, এটা কী করছ গীতা?
গীতামাসি বলল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে।
খাটের নীচে যেই না শুনতে পেল সুবল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে, সে বোধহয় জোরজার করে উঠেই আসত—কেবল টুকুন চাদরটা একটু ফেলে দিয়ে ওকে একদিকে ভালো করে আড়াল করে দিচ্ছে।
টুকুন শুয়ে পড়লে মা বলল, তুমি যে বলেছিলে, বাবা এলে বাজাবে?
—কাল বাজাব মা। খুব দুর্বল লাগছে।
—তা ঠিক। একদিনে বেশি ভালো না। তুমি বরং একটু শুয়ে থাক। বাবা এলে আমরা আসব।
মা চলে গেলে গীতামাসি বলল, টুকুন এখন তোমার দুধ, আপেল, সন্দেশ খাবার সময়! বের করে দিচ্ছি।
—কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি মাসি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না।
দরজা ভেজানোর কথা উঠলেই মাসি উঠে পড়বে। কারণ বারবার এক কথা শুনতে ভালোও লাগে না। নিজের ঘরে গিয়ে বেশ পান—দোক্তা খেয়ে উত্তরের বারান্দায় চলে গেলে, নীচ থেকে যারা উঠে আসে তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করা যায়।
গীতামাসি বলল, কিন্তু এখন তো তোমার এসব খাবার সময়।
টুকুন বুঝতে পারল, না—খাইয়ে ছাড়াবে না। সে বলল, তুমি রেখে যাও, আমি ঠিক খেয়ে নেব।
—অন্যদিন আমার সামনে তুমি খাও। আজ কেন এমন বলছ?
—আজ তোমার সামনে খাব না। কিছুতেই খাব না।
টুকুনের জিদ উঠলে একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেজন্য ভয়ে ভয়ে গীতামাসি বাইরে বের হয়ে এলে সে নিজে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। ডাকল, সুবল বাইরে এসো। ওরা সবাই চলে গেছে।
সুবল বের হয়ে এলে টুকুন বলল, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
সুবল বলল, আমার ফুলের থলেটা দেখছি না।
—ওটা আমি ঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছি। তুমি যে কী বোকা না! ওটা দেখলেই ওরা বলত না, এই থলেটা কার, কী করে এমন একটা বিশ্রী থলে এখানে আসতে পারে। দরকার পড়লে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দিত।
সুবল শহরের অনেক ব্যাপার যেমন ঠিক বোঝে না, তেমনি ডিটেকটিভ কথাটাও বুঝতে পারলে না। সে বলল, ডিটেকটিভ কী টুকুন?
—ওরা চোর গুণ্ডা বদমাশ ধরে বেড়ায়। কেউ যদি খুন হয়, কে খুনটা করেছে তাকে খুঁজে বের করে।
—আমার সামান্য থলেটার জন্য এতবড় একটা ব্যাপার তবে ঘটে যেতে পারে?
—সুবল তুমি জানো না, এটা যে কী অসামান্য অপরাধ! আমার মা—র চোখ দেখতে সব টের পাই সুবল।
ওরা বাথরুমে ঢুকলেই সুবল বলল, জল দেখলেই চান করতে ইচ্ছা হয় টুকুন। বাঃ কী মজা! পাতাল থেকে ফোয়ারার মতো জল উঠে আসে, কী মজা প্রথম প্রথম ভাবতাম। খরা অঞ্চল থেকে আসার পর, দিনে কতবার যে রাস্তার কলে চান করতাম।
—তুমি চান করে নেবে?
—তোমার চানের ঘরটায় কী সুন্দর গন্ধ। মারবেল পাথরে কারুকাজ করা সব পাথরের দেয়াল—কী মসৃণ! সুবল দেয়ালের গায়ে হাত দিয়ে কী যেন দেখছে। ভীষণ মসৃণ। হাত পিছলে পিছলে যাচ্ছে। নানারকম গন্ধ সাবান। তেল। শ্যামপু সব। এসব সে ঠিক চেনে না, কী দিয়ে কী হয়, এবং মনে হয় সুবলের শরীরে ঘামের গন্ধ। টুকুন সুবলকে হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে নিয়ে এসেছিল। যা খাবার আছে সে সুবলকে খেতে দেবে। কিন্তু এখানে এসে সুবলের যে কী হয়ে গেল—সে চান না করে খাচ্ছে না। সে খুব পরিশ্রম করে—তার চোখে—মুখে আশ্চর্য দৃঢ়তা। টুকুন এসব দেখে ভাবল, চান করে নিলে তাকে আরও বেশি তাজা দেখাবে।
টুকুন বলল, সুবল তুমি চান করবে?
—মন্দ হয় না, টুকুন।
টুকুন শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে এভাবে জল পড়বে। বাথরুমের সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চান করে নাও। আমি দাঁড়াচ্ছি। সুবল বলল, টুকুন, আমি দরজা বন্ধ করে দেব।
টুকুন দরজা বন্ধ করার কারণ খুঁজে পেল না। সুবল তো তার কাছে ছোট্ট এক বালক বাদে আর কিছু না। সে তো সেই যেন দুই শিশু নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই। কেবল ওরা ছুটছে।
টুকুন বলল, আমাকে তোমার লজ্জা কী?
সুবল বুঝতে পারল টুকুনদিদিমণি এখনও স্বাভাবিক নয়। সে বাথরুমের দরজাটা খোলাই রাখল। সে একটা তোয়ালে পরে নিয়ে জামা পাজামা পাশের ব্রাকেটে ঝুলিয়ে রাখল।
টুকুন বেশ মনোরম চোখে দেখছে। সুবলের কী সুন্দর হাত। পুষ্ট বাহু। এবং পিঠের শক্ত কাঁধ খুব মজবুত। সে শাওয়ারের নীচে বসে গায়ে মাথায় সাবান মাখছে। বস্তুত সুবলেরও একটা অসুখ হয়ে গিয়েছিল—সে খরা অঞ্চল থেকে চলে এসে যখন কলকাতা নগরীতে এত প্রাচুর্য বিশেষ করে জলের—ভাবা যায় না—সে এখনও ফাঁক পেলে যেখানে সেখানে চান করে নেয়। শরীরে ওর কী যে গরম বেঁধেছে কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। সে এখানে এসেও এই লোভ সামলাতে পারেনি।
টুকুন বলল, আমি তোমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছি।
সুবল জানে, টুকুনের কোনও ইচ্ছাকে অবহেলা করতে নেই। টুকুন কত বড়, কত বড় বাড়ির মেয়ে, টুকুন যা বলবে তাকে এখন তাই করতে হবে। সে এভাবেই বুঝে ফেলেছে, এর ভিতর এক নতুন প্রাণের সাড়া দেখা দিচ্ছে। এখন কিছুতেই সেখানে ভাঁটার টান আনলে চলবে না। সে বলল, তুমি টুকুন পারবে?
—বা রে পারব না কেন?
—আমার বিশ্বাস হয় না টুকুন—সেই রাজার ঘোড়ায় চড়ে যাবার কথা মনে আছে? হরিণ ধরতে যাচ্ছে রাজা। হরিণ প্রাণের ভয়ে ছুটছে। রাজা, ঘোড়া পাহাড়ের ওপর দৌড় দিচ্ছে। পাথরে পাথরে ঘসা লেগে ঘোড়ার খুরে আগুন লেগে গেছে।
—সত্যি কী সুন্দর হরিণ না। টুকুন সুবলের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কী সুন্দর মজবুত সুবল। টুকুন বলল, আমিও চান করব। সে বলল, আমাকে সাবানটা দাও। সে একেবারে শিশুর মতো জলের নীচে খেলা করতে থাকল। সুবলও কখন এমন হয়ে গেছে। ওরা দুজনে গল্প করছিল—পাশের ওদিকটার যে দরজা বন্ধ আছে এবং কেউ আর একদিকটায় আসতে পারবে না ওরা জানে।
এবং এভাবে কী হয়ে যায়। সুবল স্নানের সময় শরীর থেকে সব জল শুষে নিতে গিয়ে দেখল, তোয়ালেটা কী করে কখন শরীর থেকে খসে পড়ে গেছে। সে তোয়ালে ব্যবহারের নিয়মকানুন ঠিক জানে না। আর টুকুন ওকে অপলক দেখছে। স্থির। চোখে বিস্ময়। সে টুকুনের এমন চেহারা দেখে একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেছে। দুজনেই দুদিকে, একটা ফ্রিজ শটের মতো। সুবলের যেন মুহূর্তের জন্য কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল।
পনের
সুবল চলে যাবার পর গোটা ব্যাপারটা টুকুনের মাথায় কেমন একটা অদ্ভুত নেশা ধরিয়ে দিল। সে ভিতরে ভিতরে ভীষণ একটা অভাবের কথা ধরতে পারছে। সে সংসারে খুব একা—পৃথিবীতে যে মৃত্যু এবং গ্রহাণুতে চলে যাওয়া বাদে অন্য কিছু আছে তার জানা ছিল না। সে এটা যে কী দেখে ফেলল। ওর চোখ বুজে আসছে। সুবল আবার কখন আসবে—শুধু প্রতীক্ষা।
ওর চোখে এখন কিছুটা স্বপ্নের মতো ঘটনাটা ঝুলে আছে। এক আশ্চর্য মহিমাময় শরীর সুবলের। এবং শরীরের সর্বত্র এক কঠিন অবয়ব, কী শক্ত, অথচ ভারী কোমল, লাবণ্যে ভরা, লম্বা সুবল, যার শিশুর মতো সরল মুখ এখন আরও সুন্দর মনে হচ্ছে। সে একটা পুরুষের শরীর, এবং শরীরের সবটা একসঙ্গে এভাবে কখনও দেখতে পায়নি।
ওর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বাবা এঘরে কিছুক্ষণ এসে বসে থেকে গেছেন। নানারকম প্রশ্ন করেছেন। বলেছেন, টুকুন তুমি আমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে না? ডাক্তারবাবু এসেছেন, তিনিও শুনতে চান।
টুকুন কেবল বলছিল, বাবা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। সে ইচ্ছে করেই হাই তুলছে। বলছে, আমাকে তোমরা আর কষ্ট দিয়ো না।
রাতে গীতামাসি একটা কম আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আলোটার রং কেমন তামাটে। এবং এই আলোটা না জ্বালালে, অন্যদিন টুকুনের ঘুম আসত না। আজ অন্যরকমের। সে গীতামাসিকে বলেছে—সবুজ আলোটা জ্বালিয়ে দেবে?
—সবুজ আলো জ্বাললে তুমি তো ঘুমোতে পারো না।
—তুমি দাও গীতামাসি। তামাটে রং আজ আমার ভালো লাগবে না।
টুকুন গীতামাসিকে আরও বলেছিল, এই দ্যাখো আমার বালিশের নীচে কিছু রজনিগন্ধা আছে। ওগুলো রুপোর ফুলদানিতে রেখে আমার মাথার কাছে রেখে যাও। আমার চারপাশে আরও কিছু রাখো, যাতে আমাকে আরও সুন্দর দেখায়। শেষপর্যন্ত ‘আমাকে সুন্দর দেখায়’ সে বলতে পারেনি। কেমন লজ্জা এসে গেছিল। তার এমন একটা অনুভূতি এতদিন কোথায় যে ছিল! ওর শির শির করছে শরীরটা। এবং চাদর দিয়ে গোটা শরীরটা ঢেকে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে। এটা যে কী হয়ে যাচ্ছে ভিতরে। ওর জল তেষ্টা পাচ্ছে। সে টিপয় থেকে হাতির দাঁতের মিনা—করা জলদানি তুলে জল খেল। তার হাত কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে। ভিতরে কীসের যেন ঝড়। যেন কোথাও বাদলা দিনে সে বৃষ্টি—ভিজে এক বড় মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে। ওর পায়ে সবুজ ঘাসের চিহ্ন। ওর চোখে—মুখে বৃষ্টির ছাট। পরনে সাদা সিল্ক লতাপাতা আঁকা নীল রংয়ের। পায়ে তেমনি আলতা। হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা, নখে নীল রংয়ের পালিশ। নখগুলো কিছুটা লম্বা, কিছুটা উজ্জ্বল, সে হাতের ওপর হাত রেখে নিজের সুন্দর হাত পা দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যাচ্ছে। সে আর টুকুন থাকছে না। সে কল্যাণী হয়ে যাচ্ছে। সে কল্যাণী মজুমদার হয়ে যাচ্ছে। সে তার ভালো নামটা অথবা বড় হয়ে যে নামটা ব্যবহার করার কথা, কতদিন পরে মনে করতে পারছে।
টুকুন পাশ ফিরে শুল। সেই গ্রহাণুর ছোট্ট রাজপুত্রের কথা কিছুতেই মনে আসছে না। অথবা সেই মরুভূমির কথা। মরুভূমিতে যদি সেই মানুষটা এখনও তার উড়োজাহাজটা ঠিক করে উঠতে না পারে—তার খুব কষ্ট। তার বাড়ি—ঘর, যদি তার স্ত্রী থাকে—খুব একটা কষ্টের ব্যাপার—সে এখন কেবল এসব মনে করতে পারছে।
ওর আঙুলে রক্তের তাজা একটা ভাব জেগে যাচ্ছে। সে এই শরীরে মনোরম এক স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে আছে।
সুবল আর তার কাছে এখন শুধু পাখিয়ালা নয়। সে একজন মানুষ। ওর শরীরে এক সুন্দর রাজপুত্রের বাস। সে টের পেয়েছে—এই শরীরে ঈশ্বর এমন কিছু দিয়েছেন যার সৌরভ মানুষকে বড় করে তোলে। মানুষ বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায়। তার কাছে এই অর্থটার মানে জানা ছিল না। সুবল আজ তাকে কী যে করে দিয়ে গেল।
সুবল, সুবল এক মানুষ, লম্বা, কালো চুখ, চোখ লম্বা, নাক সামান্য চাপা। ওর ঘাড় শক্ত। পিঠ চওড়া। বুকের পাশে দুভাগ এবং দুই হাতের নীচে সামান্য বনরাজি নীলা। সে যখন স্নান করছিল—সেইসব কারুকাজ করা সুন্দর সুদৃশ্য এক শরীরে কীযে সব আকর্ষণের খাঁজ রেখে দিয়েছে।
তার বাবা একটা তাজা সিংহের ছবি একবার তুলেছিল ক্যামেরাতে। ছবিটা তার দেখতে খুব ভালো লাগত। সেই তাজা সিংহের সঙ্গে সুবলের শরীরের কোথায় যেন একটা মিল আছে।
টুকুনের চুল, জামা, পাজামা ভিজা। টুকুনকে কোথাও মেয়ে মনে হয় না। শুধু মুখে মেয়ের মতো নরম এক ছবি। যা খুব কষ্টের আর দুঃখের মনে হচ্ছিল।
কোথাও ঘণ্টা বাজছে। রাত এখন বারোটা। কোথাও রেলগাড়ির শব্দ। না, সে নিজের ভিতরেই এক রেলগাড়ি চালিয়ে দিয়েছে। গাড়িটা তাকে নিয়ে ছুটছে। গাড়িতে সে এবং সুবল। সাদা জ্যোৎস্নায় তার সুবলের হাত ধরে বেড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার ইন্দ্রর কথা মনে হল। কাল ইন্দ্র এলে সে আর ঠিকমতো বুঝি কথা বলতে পারবে না।
গীতামাসি এসে বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি শোও।
—তুমি শুয়ে পড়োগে?
—বড়বাবু কী বললেন?
বাবা বললেন, টুকুন এবার তুমি সত্যি ভালো হয়ে গেছ।
ওরা কেউ বেশিক্ষণ ছিল না। এমন একটা উত্তেজনার ভিতর বেশি সময় টুকুনকে বিরক্ত করা ঠিক না। বাড়ি থেকে চারপাশে সব মানুষের কাছে খবর পৌঁছে যাচ্ছে টুকুন ভালো হয়ে উঠছে। টুকুন কতকাল পরে পিয়ানো বাজিয়েছে। টুকুনের রক্তকণিকারা আবার উদ্যমশীল হচ্ছে।
এইভাবে এই সংসারে কোথাও কখন কীভাবে যে খরা লেগে যায়। সেটা কখনও মানুষের শরীরে, প্রকৃতির ভিতর এবং কলকারখানায় হতে পারে। সুরেশবাবু জানেন, চারপাশে যে এত ঘেরাও লকআউট এবং শ্রমিকেরা নিজেদের দাবি সম্পর্কে সচেতন—অথচ কাজ হচ্ছে না, উদ্যমশীল না হলে যা হয়ে থাকে, একটা জাতি মরে যাচ্ছে।
তিনি বেশিক্ষণ ছিলেন না। মা—মাসিরা কী যে কলরব করে গেছে! গীতামাসি বলেছে, ওর শরীর খারাপ করবে। টুকুন এত ভিড় সহ্য করতে পারবে না। আবার কেউ কেউ ভাবছে টুকুনের তো এমন নাকি আরও দুবার তিনবার হয়েছে। সুতরাং খুব একটা আশা করা ভালো না।
গীতামাসি বলল, টুকুন না ঘুমালে শরীর আবার খারাপ করবে।
—আমার ঘুম আসছে না গীতামাসি। সে দেখল পায়ের হাঁটুর ওপরে ওর ফ্রক উঠে গেছে। সে তাড়াতাড়ি শরীর ঢেকে দিতে গেল। এই হাঁটু এই বয়সে বের হয়ে থাকা কেমন সঙ্কোচের। সে বলল, আমি শাড়ি পরব গীতামাসি।
—কাল থেকে পরবে।
—না। আমি এখন পরব।
জিদ ঠিক আছে। গীতামাসি মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। তবু কিছু বলার উপায় নেই। শাড়ি এলে টুকুন বলল, দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। তুমি যাও গীতামাসি। সে গীতামাসিকে যেন জোরজার করেই বের করে দিল। রেডিয়োটা খুলে দিল। ছায়াছবির গান হচ্ছে। সে প্রতিটি গানের সঙ্গে এখন গলা মেলাচ্ছে। সে ঘরেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার কোনও কষ্ট হচ্ছে না হাঁটতে। সে যে কী করে শরীরে এমন শক্তি পাচ্ছে! এবং কখনও কখনও যেন মনে হয় সে একটা হালকা পাখির মতো এখন এই গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতে পারে।
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখল। কতদিন পর সে আয়নার সামনে যেন দাঁড়াল। এতবড় আয়নায় সে কবে থেকে নিজের মুখ দেখতে ভুলে গেছিল। সহসা যেন মনে পড়ছে—মুখ না দেখলে, আয়নায় মুখ না দেখলে, কী করে বড় হয়ে যাচ্ছে বোঝা যাবে না।
সে দাঁড়িয়ে আয়নায় মুখ দেখল। ধীরে ধীরে সবুজ হালকা ফ্রকটা খুলে ফেলতে থাকল। শরীরে মাংস লাগতে চায় না। তবু সে বুকে হাত রাখল। ধীরে ধীরে হাত বুলাল। ওর কেন জানি কান্না পাচ্ছে। কেন জানি শরীরের ভিতর আশ্চর্য যে চেতনা নিয়ে বড় হবে স্বপ্ন দেখছে, সেখানে তার কিছু জন্ম নিচ্ছে না। যেন এখন থেকে সে প্রতিদিন এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেবল অপেক্ষা করা এবং স্মৃতি, কী যে স্মৃতি মানুষের—সুবল তার কাছে একটা প্রথম আদিম মানুষ, যে মানুষের আদিমতা নিয়ে সোজা সহজভাবে তাকিয়েছিল। এবং দৃশ্যটা ভাবতে কী যে ভালো লাগছে। সে যেন এমন একটা দৃশ্য ভেবে ভেবে সারারাত ভোর করে দেবে। হয়তো সকালে ফুল ফোটার মতো দেখবে, সে—ও শরীরের ভিতর ক্রমে ফুটে উঠছে। ওর ভীষণ ভালো লাগছে এভাবে ভাবতে!
এবং এসব ভাবনাই মেয়েকে এক সকালে সত্যি সত্যি বড় করে দিল। সে আয়নায় দাঁড়িয়ে এসব কী দেখছে। সে যে বড় হচ্ছে তার প্রমাণ শরীরে ভেসে উঠছে। কতকালের রাত জাগা, অথবা সুবল এলে ওকে নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে এই হলঘরের মতো ঘরে অথবা দক্ষিণের বারান্দায় এবং কথা আছে সে যখন গান গাইবে, অথবা পিয়ানো বাজাবে, কিংবা রেডিয়োর গানের সঙ্গে গলা মেলাবে—তখন এই ঘরে কেউ থাকবে না। সে ওর খুশিমতো সুবলকে নিয়ে এক আশ্চর্য সুন্দর জগৎ তৈরি করেছে—যা সে কোনওদিন ভুলে যেতে পারবে না। ইন্দ্র আসে ঠিক, তবু ইন্দ্র এলে সে কেমন উদাসীন হয়ে যায়। কারণ ইন্দ্রের স্বভাবটা কিছুটা কেন জানি আজকাল মেয়েলি মনে হচ্ছে। বরং এই সুবল যার কিছুটা সন্ন্যাসী তরুণের মতো মুখ, সে খুব সৎ এবং সব সময় নিজের মতো করে ভাবে—যে ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প শুনে হেসেছিল, বলেছিল—সে আর তার গ্রহাণুতে ফিরে যেতে পারবে না। পৃথিবীর গাছ পাখি ফুল ফল এমন সে আর পাবে কোথায়। কেউ এখানে এলে আর কোথাও যেতে চায় না। বড় মায়া আর ভালোবাসায় পৃথিবী মানুষকে আটকে রাখে। টুকুনের মনে হয়েছিল, সুবলই তার সেই ছোট্ট রাজপুত্র। তাকে বাদ দিয়ে কিছুতেই বাঁচতে পারে না। সুবল তার ছোট্ট গ্রহাণুতে আর ফিরে যেতে পারবে না।
ষোল
একটা বাওবাব গাছের বড় দরকার সুবলের, এমন মনে হলে—চারপাশে যা কিছু, যেমন একটা নদী আছে, নদীর পারে বন আছে আর এ পারে আছে ফুলের উপত্যকা, এর ভিতর বাওবাবের চারা লাগিয়ে দিলে বেশ একটা সুন্দর পৃথিবী সে গড়ে তুলতে পারত, এবং এমন উপত্যকায় একদিন ওর ভারী ইচ্ছা টুকুনকে নিয়ে আসবে। সে আর টুকুন। বুড়ো মানুষটা আজকাল আর ঘর থেকে বের হতে পারে না। সুবল তার জন্য সুন্দর টালির ঘর করে দিয়েছে। লাল টালি, মাটির দেয়াল, দেয়ালে নানারকমের কারুকাজ, ফুলফল, লতাপাতা সব ছবিতে আঁকা।
বুড়ো মানুষটা চলাফেরা তেমন আজকাল করতে পারে না বলে, সে তার জন্য আর বুড়ো মানুষটার জন্য রান্না করে। নামাজের সময় হলে সে মনে করিয়ে দেয়—এখন তোমার কর্তা জহোরের নামাজ। বুড়ো মানুষটা চোখে আজকাল ভালো দেখতে পায় না। কোথাকার কে সুবল এসে এখন এই ফুলের উপত্যকায় রাজা হয়ে গেল প্রায়। সে সুবলকে সব দিয়ে যাচ্ছে। কারণ বুড়ো মানুষটার তো কেউ নেই। সে সুবলকে সব দিয়ে যেতে পেরেছে বলে ভীষণ খুশি। এমনভাবে সে হালকা হতে পারবে কখনও ভাবতেই পারেনি। বড় চিন্তা ছিল তার, এমন সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা কাকে দিয়ে যাবে, ওর তো কেউ নেই। যারা আছে তারা সব ফুলের দালাল। কী লোভ বেটাদের। এসেই একটা বড় রকমের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলত—তা মিঞা, তুমি এমন একটা কাজ করলে কী করে!
—কী করে আবার, পরিশ্রম করে?
—শুধু পরিশ্রমে হয়?
—কেন হবে না?
—হয় না মিঞা।
তারপর সে থেমে একটু কী ভাবত, তারপর বলত, হ্যাঁ আর আছে অহঙ্কার। আমার হাতের অহঙ্কার। আল্লা আমার সঙ্গে আমার অহঙ্কারের জন্ম দিয়েছেন।
সে ঠিক ঠিক বুঝতে না পারলে বুড়ো মানুষটা বলত, আমি চাই আমার মতো এমন ফুলের চাষ কেউ আর করতে পারবে না। দিনমান খেটে, রাতে নদী থেকে জল এনে, রাতে কখনও বনে পাহাড়ের সব পাতা পুড়িয়ে এমন সব সার তৈরি করতাম—ভেবে অবাক হবে, সে সার না দিলে—ফুল কখনও এমন বড় হয় না। একটু থেমে সে ফুলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর বলত, আমি চাই না দুনিয়ায় আমার চেয়ে কেউ বেশি ফুলের চাষ ভালো জানুক।
সুবলের সঙ্গে সুখে দুঃখে ইমানদার মানুষটা এমন বলত।—আমার একটা লোভই আছে সুবল, কেবল জমি কিনে ফুলের চাষ বাড়িয়ে যাওয়া।
বুড়ো লোকটা আরও সব গল্প করত ওর সঙ্গে। সে ফিরে যখন বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে রাতের আহার তৈরি করত—তখন বুড়ো মানুষটার গল্প আরম্ভ হত। কারণ সে চোখে দেখতে পায় না বলে, রাজ্যের সব গল্প মনে করতে পারে। সুবলকে সে সব দিয়ে দেবার পরই কেমন আরও বেশি বুড়ো হয়ে গেল। সুবল যাদের নিয়ে চাষবাস বাড়াচ্ছে তাদের সন্ধ্যা হলেই ছুটি দিয়ে দেয় বলে, জায়গাটা কেমন আরও বেশি নির্জন হয়ে যায়। নদীতে কখনও নৌকার লগির শব্দ কানে আসে। বৈঠা মেরে কেউ হয়তো গান গেয়ে চলে যায়। আর সূর্যাস্ত হলে যখন হাত—পা ধোবার জল এনে দেয় টিউকল থেকে, বুড়ো মানুষটা কেমন আন্দাজে গল্প আরম্ভ করে দেয়। নীচে যেসব ঘাসের চটান আছে তার একপাশে সুবল রান্না আরম্ভ করে দেয়। সোজা রান্না। নদী থেকে মাছ আসে। বুড়ো মানুষটা চাপিলা মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। বিকেলে সেই মানুষটা এসে বেশ কয়েকটা বড় মাছ রেখে দিলে আন্দাজে হাত দিয়ে টের পায় মাছগুলো খেতে খুব ভালো লাগবে।
বুড়ো মানুষটার সামনে একটা হ্যারিকেন জ্বালা থাকে। মাদুরে সে বসে থাকে। পা দুটো তার ভাঁজ করা। মাথায় সাদা কাপড়ের টুপি। নানারকমের কারুকাজ টুপিতে। খুব সূক্ষ্ম সুতোর কাজ। সুবল ওর লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি রোজ ধুয়ে রাখে। খুব সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার শখ এই মানুষটার, যেমন সে ভাবে এই সরল পৃথিবীতে আল্লা অথবা ভগবান যেই হোক না সব কিছু রেখে দিয়েছেন মানুষের জন্য। মানুষ সেটা পরিশ্রম করে পাবে। ওর খুব ভাবতে কষ্ট হয়, সে কিছু এখন আর করতে পারে না। কাজ না করলে ঈশ্বর চিন্তা হয়। মাঝে মাঝে সে যখন এমন ভাবে তখন তার হাই ওঠে। সুবলের মাছের ঝোল টগবগ করে ফুটছে। সে সুন্দর কালোজিরে সম্ভারে বেগুন দিয়ে জিরে লংকার কেমন সব সুস্বাদু খাবার করে। অথবা সে যখন মাছ সাতলায় তার ঝাঁঝ নাকে লাগলে বেশ খিদেটা বেড়ে যায়। তখন আর বুড়ো মানুষটা বসে থাকতে পারে না। সে বারান্দা থেকে নেমে সুবলের কাছে চলে গেলে, মনে হয় বেশ একটা নির্জন পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে। অনেক দূরান্তে বন থেকে কিছু জীবজন্তুর ডাক, অথবা পাখপাখালির আওয়াজ এবং সে চুপ করে থাকলে পৃথিবীর যাবতীয় কীটপতঙ্গের আওয়াজ টের পায়। সে তখন চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছুটা যেন গল্প করে সময় পার করে দেওয়া অথবা গল্প করে খিদের কথা ভুলে থাকা। তাই ওর গল্পে এমন সব কথা থাকে—বুঝলি, আল্লা আমাদের খুব সরল।
সুবলের স্বভাব অন্য রকমের।—তুমি আবার কেন চাচা বাইরে এলে। ঠান্ডা না লাগালে বুঝি চলে না। সুবলের মাঝে মাঝে শখ হলে বুড়ো মানুষটাকে চাচা বলে ডাকে। এমন একটা ডাক খোঁজ সে চায়! সে ভালোবাসে সুবল তাকে চাচা বলে ডাকুক।
সে উনুনের পারে বসে কেমন কিছুটা তাপ নেবার মতো হাত বাড়িয়ে বলল, তোর উনুনের আঁচটা ভালো লাগছে। তারপর কেমন যেন সরল মানুষের মতো বলা, আমার খুব খিদে লেগেছে সুবল। তুই আমাকে খেতে দে। তোর কেবল কাজ আর কাজ।
—তুমি না বললে চাচা, আল্লা মানুষের জন্য পৃথিবীতে সব কিছু রেখে দিয়েছেন। পরিশ্রম করে তাকে সেটা পেতে হবে।
—খিদে লাগলে সব ভুলে যাই।
—আমি তো তোমার জন্য তাড়াতাড়ি করছি। সারাদিন পর দুটো খাবে—
—আমি কাঠ ঠেলে দিচ্ছি। তুই যা! কলাপাতা কেটে আন।
—রাতে কেউ গাছ থেকে পাতা কাটে!
—ওরা যে বলল, তুই কেটে রাখিসনি।
ওরা মানে যারা কাজ করে। কাজের শেষে ফিরে যাবার সময় বুড়ো মানুষটার কাছে এসে ওরা দাঁড়ায়। বলে, চাচা যাচ্ছি।
—যা। একটু থেমে বলে সুবল তোদের টাকাপয়সা দিয়েছে?
—দিয়েছে চাচা।
—আমাদের জন্য দু জোড়া কলাপাতা কেটে রেখে যাস। নিত্য এটা কেমন বলার স্বভাব মানুষটার।
ওরা বলল, সুবল বলেছে কেটে রাখবে। আমাদের কাজ সারতে সারতে একটু দেরি হয়ে গেল চাচা।
—ও কী করছে?
—আসছে। নলচিতা গাছের দুটো বেড়া কার গোরু ভেঙে দিয়ে গেছে। আজ সারাদিন আমরা ওটাই করলাম। ও ঘুরে ঘুরে দেখছে আরও কোথাও এমন হয়েছে কী না!
—আমাকে ও আজকাল কিছু বলে না।
—বললে তুমি কষ্ট পাবে।
—আমি কষ্ট পাব কেন?
—তোমার এমন সুন্দর বাগান কেউ নষ্ট করলে কষ্ট পাবে না?
—সে তো শুনছি খুব চাষবাস বাড়াচ্ছে।
—ওর জন্য আমাদের এখন আর শহরে যেতে হয় না চাচা। সুবল আমাদের শহরের চেয়ে বেশি পয়সা দিচ্ছি।
এমন বললেই বুড়ো মানুষের যা হয়—সেই ঈশ্বরপ্রীতির কথা, অর্থাৎ আল্লা আমাদের খুব সরল। তিনি পৃথিবীতে চান সরল এবং ভালো মানুষেরা বাঁচুক। তারপরই তিনি সেই মহামহিমের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখেন, যেন বুঝতে পারেন, আছেন, চারপাশেই আছেন তিনি। সব লতাপাতার ভিতর ফুলফলের ভিতর, এবং সব গ্রহনক্ষত্র আর সৌরলোক, যা কিছু আছে চারপাশে—তিনি আছেন। কোনও উপাস্য নেই তিনি ভিন্ন। তিনি রাজার রাজা। তিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ। যা কিছু আছে আকাশে, আর যা কিছু আছে পৃথিবীতে সব তাঁর। তিনি জানেন সব কিছু—সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তাঁর অন্তর্লোকের রহস্য। তিনিই জানেন একমাত্র কী আছে সামনে আর কী আছে পিছনে। তাঁর আসন আকাশ আর পৃথিবীর ওপরে বিস্তৃত আর এই দুইয়ের তিনি নিশিদিন রক্ষাকারী। তিনি তার জন্য এতটুকু ক্লান্ত বোধ করেন না। আর সেজন্য তিনি মহীয়ান, মহামহিম।
সুবল তখন এসে বলল, চাচা তুমি খাবে।
মানুষটার চোখমুখ কেমন উদাসীন দেখায় তখন। চুপচাপ বসে থাকে। খাবার কথা সে ভুলে যায়। তাকে যে খেয়ে নামাজ পড়তে হবে সে যেন তা আর মনে রাখতে পারে না। সেই থেকে, অর্থাৎ সেই যখন পরিশ্রমী মানুষেরা চলে গেল, এবং সে বসে থাকল একা মাদুরে—তারপর সুবলের ফুলের চাষবাস দেখে ফেরা, এবং এসব কেমন যেন তার উদাসীনতার ভিতর পার হয়ে গেছে। সে যে উত্তাপ নেবার জন্য উনুনের পাশে বসেছিল, সেও কিছুটা বোধহয় সেই অন্তর্যামীর ইচ্ছা, সে যে খিদে লেগেছে বলেছে, সেও বোধহয় তাঁর ইচ্ছা। এবং এই বুড়ো মানুষের যা স্বভাব খেতে খেতে কেমন আনমনে হয়ে বসে থাকা তাও।
সুবলেরও স্বভাব হয়ে গেছে, খাও চাচা। তোমার মাছ বেছে দিচ্ছি। এই বলে সে বেশ ডেলার উপর মাছ রেখে দিলে হাত টিপে টের পায় মানুষটা—সুবল বড় যত্নে সব কিছু করে যাচ্ছে।
সে তখন বলবে, সুবল তুই তোর ধর্ম মানিস?
—ঠিক বুঝি না চাচা। ধর্মের কথা মনে হলেই সেই জনার্দন চক্রবর্তীর কথা মনে হত। আর আমাদের ছিল সুবচনি দেবীর মন্দির। ওর ভীষণ বিশ্বাস ছিল, দেবীর ক্রোধে আমাদের দেশটায় খরা এসে গেল।
বুড়ো মানুষটা বলল, তোরা সবাই চলে এলি, সে থেকে গেল।
—ওর ছিল প্রচণ্ড অহঙ্কার। ও ছিল ঠিক তোমাদের মুসার মতো।
রাতে যখন ওরা শোয়, ঘরের দু—পাশে দুটো বাঁশের মাচান, মাচানে নকশি কাঁথার বিছানা, তার পাশে ফুল, বেলফুল, রজনিগন্ধা অথবা গন্ধরাজ ফুল এবং কখনও সব নীল অপরাজিতা, জবা ফুল, চামেলি, চাঁপা কত যে ফুল নিয়ে বেঁচে আছে এই উপত্যকা আর তার ভিতর আছে একটা লাল টালির ঘর, সেখানে সুবল আর চাচা শুয়ে যতক্ষণ ঘুম না আসে কেবল নানারকম গল্প করে যাওয়া। বুড়ো মানুষটা খুব বেশি মুসার গল্প বলতে ভালোবাসত। সেই থেকে সুবল একটা মানুষের সঙ্গে কেবল জনার্দন চক্রবর্তীর মিল পায়, তার নাম মুসা। মুসার মতো আত্মবিশ্বাস ছিল মানুষটার। কেবল লাঠিটা ছিল না হাতে। অথবা যে লাঠি ছিল, সেটা বুঝি ঈশ্বরপ্রদত্ত ছিল না। না হলে মুসা সেই যে তাঁর লোকদের জন্য জল চাইলেন, আর তখনই দৈববাণী, তোমার আসা (লাঠি) দিয়ে পাথরে মারো। সেই মুসা তার লাঠি দিয়ে পাথরের পর পাথর ছুঁয়ে গেল, আশ্চর্য, নীল পর্বতমালার নীচে, শুকনো মরুভূমিতে বারোটি জলের প্রস্রবণ। জল পান করো মনুষ্যগণ। আল্লাহ যে জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও আর পান করো! অন্যায়কারী হয়ে দেশে অপবিত্র আচরণ করো না।
যখন সেই উপত্যকায় সাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে থাকত, আর ফুলেরা ফুটতে থাকত, এবং সব ফুলেদের ফোটার ভিতর আশ্চর্য উল্লাস থাকত, বুড়ো মানুষটা শুয়ে শুয়ে তা টের পেত। সে বলত, সুবল আমাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবি। আমাকে একটু গোলাপের বাগানে নিয়ে যাবি। অথবা চামেলি গাছটার নীচে তুই আর আমি কিছুক্ষণ বসে থাকব।
ছেলেমানুষ সুবল। সারাদিন খাটাখাটনি করে তার ঘুম পায়। সে এখন সপ্তাহান্তে যায় বড় শহরে। টুকুন এখন কত বড় আর লম্বা হয়েছে। সে যায় সদর দরজা দিয়ে। টুকুন আরও সুন্দর করে সাজে তখন। এবং যে দিনটাতে সে শুনেছে ইন্দ্র আসে না। টুকুনের ভয় কেন যে ইন্দ্রকে নিয়ে। সেতো কোনও পাপ কাজ করেনি। টুকুনদিদিমণির মুখ চোখ, এবং যখন সেই পিয়ানোতে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে চোখ বুজে গান গায়, ওর ববকরা চুল ঘাড়ে রেশমের মতো উড়তে থাকে তখন সে কেমন এক আশ্চর্য সুষমা টের পায় টুকুনের শরীরে। ঈশ্বর টুকুনকে যেন এতদিন অপবিত্র করে রেখেছিল। টুকুনের শরীর দেখে অর্থাৎ টুকুনের সব কিছু মা হবার জন্য যখন উন্মুখ, টুকুনকে কী করে আর ঈশ্বর অপবিত্র রাখেন। পবিত্র মুখে সুবলের জন্য ভীষণ মায়া। সুবলও যখন আসে বেশ সুন্দর পোশাকে আসে। সে তার ঘাড়ে একটা রঙবেরঙের ব্যাগ রাখে। ব্যাগে থাকে যাবতীয় সব কেয়াফুল। সুবল এলেই সব মানুষেরা টের পায় সুন্দর সুগন্ধে গোটা বাড়িটা ম ম করছে। অথচ কেউ টের পায় না, একজন মানুষ গ্রাম থেকে চলে আসছে, সদর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে, এবং এ সময় টুকুন ঠিক থাকবে। অন্য দিকের দরজা ঠিক বন্ধ থাকবে—কিন্তু রোজ এখন এটা করতে পারে না। টুকুন ভালো হয়ে গেছে বলে তাকে ইন্দ্রের কাছে গাড়ি চালানো শিখতে হয়। ভালো হয়ে গেছে বলে আত্মীয়স্বজনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা তাকে ঘিরে থাকতে ভালোবাসে। অথচ সুবল টের পায়—বড় অস্বস্তি টুকুনের। সে যখন যা ভাবছে, একটা বাওবাব গাছের চারা পেলেই টুকুনদিদিমণিকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে। এবং এতসব ভাবনায় সে রাতে বড় ক্লান্ত থাকে। ওর ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু বুড়ো মানুষটা টের পেয়েছে ফুলেরা ফুটছে। সে সাদা জ্যোৎস্নায় বসে চুপি চুপি ফুলেদের ফুটতে দেখবে। এবং মনে হয় যে তখন মহামহিম আলাহর করুণা সব ফুলে ফুলে আশ্চর্যভাবে টের পায়। বুড়ো মানুষটা চুপচাপ তখন, কেবল গাছের নীচে বসে থাকতে ভালোবাসে।
সেও বসে থাকে চাচার সঙ্গে। সামনের জমিটা বেলফুলের। হেমন্তের শেষাশেষি এটা। শীতকাল আবার আসবে। এখন সাদা জ্যোৎস্নায় শীতটা ওদের বেশ লাগছিল। একটা পাতলা কাঁথা বুড়োর গায়ে দিয়েছে সুবল। এমন জবুথবু হয়ে বুড়ো মানুষটা এখন ফুলের সৌরভ নিচ্ছে।
এমন দেখলেই সুবলের বলতে ইচ্ছা হয়, চাচা তুমিতো অনেক জানো, এখানে কোথায় বাওবাব গাছ পাওয়া যায় বলতে পার?
অনেকক্ষণ পর বুড়ো মানুষটা সুবলের দিকে তাকায়।—কীরে আমাকে কিছু বলছিস!
—একটা বাওবাবের চারা না হলে যে চলছে না।
—এটা এখানে পাবি কোথায়? সেতো ছোট্ট রাজপুত্রের দেশের গাছ।
এমনি হয়, কারণ ওদের কথা কিছুই সংগোপনে থাকে না। সুবল যেসব গল্প টুকুনের কাছে শুনে আসত, সব এসে হুবহু বুড়ো মানুষটাকে বলত। ইদানীং তো সুবলের সন্ধ্যার পর কথা বলার আর কেউ থাকে না। কেবল বুড়ো মানুষটার সঙ্গে যত কথা। সে উনুনে মাটির হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধর সময় অথবা যখন ডাল সেদ্ধ হয় উনুনে এবং আগুনের তাপে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়—তখন নিবিষ্ট মনে যত রাজ্যের গল্প সে চাচার সঙ্গে জুড়ে দেয়।
—ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে যদি আগ্নেয়গিরি থাকে, যদি নদী থাকে, এবং সমুদ্র থাকে তবে আমাদের পৃথিবীতে একটা বাওবাব থাকবে না।
—তা বটে। বলে কেমন একটা হাই তুলল।
—তোমার ঘুম পাচ্ছে চাচা। এবারে ওঠো।
—তোর ঘরে শুয়ে থাকতে এখন ভালো লাগবে।
—খুব।
—তুই তবে মানুষ না।
—তা যা খুশি বলতে পারো।
কেমন আসমান, তারা, চাঁদ, আর দ্যাখ যেদিকে চোখ যায় তোর মনে হবে একটা ফুলের জগতে বসে আছিস। দূরের জ্যোৎস্নায় কেমন ফুলের সৌরভ ভেসে যাচ্ছে দ্যাখ।
বুড়োরা এমন ধরনের কথা বলেই থাকে। সুবল সেজন্য মনে কিছু করে না। কেবল মাঝে মাঝে কথায় সায় দিয়ে যায়। এবং কথা না থাকলে টুকুনের কথা ঘুরে ফিরে আসে।
—জানো চাচা, টুকুন দিদিমণি এখন গাড়ি চালাতে শিখছে।
—টুকুনের জন্য তোর খুব কষ্ট সুবল। কারও জন্য কোনও কষ্ট মনে মনে পুষে রাখবি না। তবে দুঃখ পাবি।
—তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বলে এমন কথা বলছ।
বুড়ো হলে মানুষ অনেক কিছু বুঝতে পারে সুবল।
সুবল এবার বলল আমার কোনও কষ্ট নেই। আমি গাঁ থেকে এসেছি। জলের জন্যে এসেছিলাম। এখন ফুল বেচে খাই! তুমি আছো, এমন একটা ফুলের উপত্যকা আছে আর কিছুদূর গেলে নদী, তার পাড়ে বন আছে, আমার দুঃখ কী চাচা।
—তোর কথা শুনলে আমি সব বুঝি। তোর কতটা কষ্ট আমি ধরতে পারি।
ওরা এভাবে কখনও সকাল করে দেয়। এবং যখন ফুলের দালালেরা আসে, সুবল ফুল তুলে দেয় তাদের। তারপর খুব তাড়াতাড়ি বুড়ো মানুষকে খাইয়ে এবং নামাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে সুবল চলে যায় নদীতে। সে নদীর পাড়ে সব ছেড়ে জলে নেমে যায়। তার এভাবে নদীর জলে সাঁতার কাটতে ভীষণ ভালো লাগে। ও—পাশে বন, বনে নানারকম গাছ, সে সব গাছের নাম জানে না, বুড়ো মানুষটা জানে। সে আগে মাঝে মাঝে বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে বনে আগুন জ্বালতে গেলে কখনও কখনও সে কিছু গাছের নাম জেনে নিয়েছে। বাকিগুলো জানা যায়নি। জানতে জানতে কখন বুড়ো মানুষটা চোখে কম দেখতে থাকল। তাকে আর রোজ নিয়ে সে নদীর ওপারে যেতে পারত না। তাকে একা একা বনের শুকনো পাতা ঘাস কুড়িয়ে আনতে হত সারের জন্য। এবং এই সার তৈরি করা সে বুড়োর কাছেই জেনেছে। তিনি বলেছেন, তোমায় এই দুনিয়াতে আল্লা সব দিয়ে দিয়েছেন, তুমি বাপু করে কম্মে খাও। এমন কিছু নেই যা সংসারে অবহেলার। গাছ তার অতিরিক্ত সব কিছু অর্থাৎ পাতা ডাল, সময় হলে পরিত্যাগ করে, তুমি তা থেকেই অমূল্য সব বস্তু নির্মাণ করে নিতে পারো। বুড়ো মানুষটা আল্লার কথায় এলেই কেমন সাধুভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে।
সুতরাং সাঁতার কাটতে কাটতে সে কখনও নদীর ওপারে ওঠে, বনে ঢুকে যায়। বনে কোনও মানুষের ছায়া থাকে না। বড় শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের পর ট্রেনে এলে, এবং একটা বড় মাঠ পার হয়ে গেলে এমন একটা নদী, এমন একটা ফুলের উপত্যকা, এমন একটা ছোট্ট বন, সবুজ লতাপাতা ঘাস নিয়ে ক্রমে ঈশ্বরের পৃথিবীতে বড় হচ্ছে টের পাওয়া যায় না।
সুবল বেশ হেঁটে যাচ্ছিল। একা এই বনের ভিতর একজন আদিম মানুষের মতো তার হেঁটে যেতে ভালো লাগছিল। সেই যে সে মুসার গল্প শুনেছে, সেই যে সে আদম ইভের গল্প শুনেছে, অর্থাৎ প্রাচীনকালে মানুষ বনে পাহাড়ে থাকত অথবা প্রথম মানুষ আদম—ইভের জ্ঞানবৃক্ষের ফল চুরি করে খাওয়া সব তার একসঙ্গে মনে পড়ছে। এবং মনে হয় সে বেশ ছিল, ভালো ছিল, যেন সে ট্রেনে চড়ে শহরে চলে এসেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেছে। কেমন তার উচ্চাশা, এবং আকাঙ্ক্ষা তাকে নিরন্তর ভিতরে ভিতরে খুব ছোট করে দিচ্ছে। এমন মনে হলেই চুপচাপ একটা গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টুকুনদিদিমণির কথা মনে হয়। দিদিমণির সেই রুগণ মুখ, বিবর্ণ ছবি চোখে ভেসে ওঠে—তারপর সে কী করে যে আশ্চর্য এক পাখির খেলা দেখিয়ে দিদিমণিকে নিরাময় করে তোলার সময় তার জানা ছিল না, এক আশ্চর্য জাদুকরের খেলায় সে দিদিমণির ভিতরে ভালোবাসা সঞ্চার করেছে। পৃথিবীতে বুড়ো মানুষটাই কেবলমাত্র তার কষ্টটা বুঝতে পারে। সে যে নিশিদিন ফুল ফুটিয়ে বেড়ায় কেউ জানে না দুঃখটা কোথায়। টুকুন দিদিমণির সঙ্গে এখন সে একা একা কথা বলতে পারে। সে সেজন্য এখন বনে ঢুকে গেলে দেখতে পায় যেন সে ছোট্ট রাজপুত্র হয়ে গেছে। একটা বাওবাবের নীচে সে আর টুকুনদিদিমণি দাঁড়িয়ে। বুড়ো মানুষটা যাচ্ছে হেঁটে! ফুলের সৌরভ তখন কেবল ভেসে আসছিল। বুড়ো মানুষটা তখন লাঠি তুলে যেন বলছে, সুবল তোর ঈশ্বর তোকে অহঙ্কার দিক, তুই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে শেখ। ঈশ্বরের পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম সবচেয়ে বেশি। তাকে হেলা ফেলা করতে নেই।
সতের
ইন্দ্র বলল, বেশ হাত দেখছি।
—বেশ বলছ?
—এমন একটা জ্যামের ভিতর থেকে বেশ কায়দা করে গাড়িটা বের করে দিলে।
—তাহলে আমি একা একা চালাতে পারব বলছ?
—সে তো কবে থেকে তুমি চালাতে পারো।
—তবে মা দিচ্ছে না কেন?
—মাসিমার ভীষণ ভয়।
টুকুনের বলতে ইচ্ছা হল ভয় না হাতি। মা একা ছেড়ে দিচ্ছেন না, পাশে সেই যে যুবক বড় হচ্ছে ফুলের উপত্যকায়, সেখানে সে না চলে যায়। মা টের পেলে বলেছিল একদিন, টুকুন এটা তোমাকে মানায় না।
টুকুন যেন বুঝতে পারছে না, এমনভাবে বলেছিল, কী মানায় না মা?
—তুমি তা ভালো করেই বোঝ।
টুকুনের মনে হল, সেটা সে আজও ঠিক বোঝে না। সে আসত পালিয়ে পালিয়ে। পাঁচিল টপকে আসত। তার এমন নিত্য আসার সময় একদিন ধরা পড়ে গেলে—বাড়িতে হইচই। মা, বাবা, সব মানুষেরা ওকে বলেছিল, ছিঃ ছিঃ টুকুন, তুমি কত বড় বংশের মেয়ে।
টুকুনের বলার ইচ্ছা হয়েছিল, সে এলে আমি মা আমার ভিতরে থাকি না। কী সুন্দর এক জগতের সে বাসিন্দা মা। সে তার ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যাবে মা, সেখানে গেলে মানুষের বুঝি কোনও দুঃখ থাকে না!
মা বলেছিল, আমাদের দিকটা একবার ভেবো।
সুবল কিছু বলছিল না। সে সত্যি অপরাধ করে ফেলেছে। তার উচিত হয়নি এভাবে। সে কিছুটা মাথা নীচু করে রেখেছিল। কেবল মজুমদার সাহেব পাইপ টানতে টানতে কেমন একটা মজা অনুভব করেছিলেন। এবং সে যে একেবারে ভীষণ কিছু করে ফেলেনি সেটা যেন মজুমদার সাহেব হ্যাঁ বা না—র ভিতর কিছুটা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি এমনভাবে কথা বলেছিলেন যে, দ্যাখো সুবল, তুমি এভাবে না এসে সদর দিয়ে এলেই পারো। তুমি তো সুবল ফুল বিক্রি করে খাও। তোমার তো মানুষের ভালো দেখাই স্বভাব। তুমি কেন তবে এভাবে আসবে।
সুবলও ভেবেছিল, তা ঠিক, এভাবে না এসে সে সদর দিয়েই আসবে। সে বলেছিল, আমি সদর দিয়েই তবে আসব।
টুকুনের মার চোখ মুখ ভীষণ খারাপ দেখাচ্ছে। কী নির্লজ্জ বেহায়া। দ্যাখো। মান অপমান বোধটুকুও নেই। টুকুনের মা কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবে এতদিন নচ্ছার ছোঁড়াটা এভাবে পালিয়ে এসে কীনা করেছে। সে বলল, তুমি আসবে না। এলে তোমাকে পুলিশে দেব।
টুকুন বলল, পুলিশে দেবে কেন মা? সে চোর না মিথ্যাবাদী।
—দেখছো মেয়ের সাহস। বলেই টুকুনের মা ভীষণ জেদি মেয়ের মতো দুপদাপ কিছুদূর গিয়েই আবার ফিরে এল। এবং মজুমদার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, সব তোমার আসকারাতে। তুমিই এজন্য দায়ী।
—রাগ করছ কেন? ব্যাপারটা একবার ভেবে দ্যাখো না।
—ভাববার কী আছে! তুমি বরং ভাবো। তোমাদের যা খুশি করবে। আমি কিচ্ছু বলব না। এতবড় বাড়ি, তুমি এতবড় মানুষ, তার মেয়ে এমন হলে মান সম্মান আমাদের থাকবে!
আর তখনই মজুমদার সাহেব দেখলেন, পার্লারে বেশ লোকজন জমে গেছে। সদর থেকে দারোয়ান হাজির। আমলা কর্মচারীরা হাজির। তিনি বললেন আপনারা যান। এবং এই যান বলতেই যান—একেবারের কথাতেই কেমন নাটকের কুশীলবের মতো যবনিকার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন মাত্র আছেন, তিনি টুকুনের মা, টুকুন আর সুবল। মজুমদার সাহেব বললেন, সুবল বোস। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের সুবলের চোখ দুটো ভারী সুন্দর।
টুকুন বলল, ওর মুখটাও ভারী সুন্দর। আর সুবল কী লম্বা, না বাবা।
সুবল এসব বুঝতে পারছে না। ওর চেহারার প্রশংসা হচ্ছে। সে সাদা পায়জামা পরছে। ঝোলা গেরুয়া পাঞ্জাবি। সে রঙবেরঙের ব্যাগ রেখেছে বগলে। ভিতরে নানা বর্ণের ফুল। এবং আশ্চর্য গন্ধের ফুল। এই ঘরে এমন ফুলের সৌরভ যে বেশিক্ষণ রাগ নিয়ে বসে থাকা যায় না। ফুলের সৌরভে মন প্রসন্ন হয়ে যায়। এবং সবারই মন যখন প্রসন্ন হয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির সবারই অর্থাৎ দাসীবাঁদিদের পর্যন্ত তখনও কিনা টুকুনের মা ভীষণ অপ্রসন্ন। সেই ছোঁড়া তিন চার বছর যেতে না যেতে কী হয়ে গেল। ট্রেনের সুবল আর এ সুবল একেবারে আলাদা মানুষ। আর বেশ জালটি পেতেছে। অসুখ ভালো করার নামে সেই যে ছারপোকার মতো লেগে থাকল আর যাবার নাম নেই। সে বলল, বাপু তুমি এখানে আসবে না। আমি সোজা কথার মানুষ, সোজা ভাবে বুঝি। টুকুন এখন বড় হয়েছে। সুবলও যে বড় হয়েছে। সুবলও যে বড় হয়েছে সেটা বলল না।—খুব খারাপ এভাবে আসা।
—আর আসব না। সুবল এমন বলে উঠতে চাইলে, মজুমদার সাহেব লক্ষ্য করলেন টুকুনের চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
তিনি কী বুঝতে পেরে বললেন, না না, তুমি আসবে বৈকি।
টুকুনের মুখ চোখ ফের এটুকু বলে লক্ষ্য করতেই বুঝলেন, যে রক্তশূন্যতা সহসা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এ কথার পর তা আবার কেমন স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি এবার বললেন, রোজ আসবে না। ওর তো এখন অনেক কাজ। পড়াশোনাটা আবার আরম্ভ করতে হচ্ছে। সকালে ইন্দ্র গাড়ি চালানো শেখায়। বুধবার সন্ধ্যায় টুকুন ক্লাবে সাঁতার শিখতে যায়। সোমবার রাতে গিটার বাজনা শিখছে। সুতরাং বুঝতেই পারছ খুব ব্যস্ত টুকুন। টুকুনের ভালো তো তুমি চাও। তুমি বরং এক কাজ করবে। রবিবার বিকেলে তুমি আসবে। টুকুন সেদিন ফ্রি থাকার চেষ্টা করবে। কী বলিস টুকুন!
এসব শুনে টুকুনের মা কী যে করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মানুষটা যে দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছে! কোথাকার কে একটা ছেলে—তাকে মুখের ওপর বলতে পারছে না, না তুমি আসবে না। কী অসহায় চোখ মুখ মানুষটার। টুকুনের মার এসব ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন গরম হয়ে যাচ্ছে। ওর নিজের হাত পা কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মেয়েটাকে এভাবে একটা অপোগণ্ড মানুষের সঙ্গে ছেড়ে দিচ্ছে! মান সম্ভ্রম বলে কিছু নেই আর কী আশ্চর্য মানুষটা সুবলের সঙ্গে কথা বলছে ঠিক সমকক্ষ মানুষের মতো।—তুমি সুবল এখন কী করছ? আহা ঢং! সে নিজের কাপড়ের আঁচল অস্থির হয়ে একবার আঙুলে জড়াচ্ছে আবার খুলছে। ওপরে সিলিংফ্যানটা পর্যন্ত তাকে ঠান্ডা করতে পারছে না। ঘড়িতে সাতটা বাজে। চারপাশে নানারকম আলো জ্বলছে। দেয়ালে সব বিচিত্র ছবি। নানা রঙের ছবি। কোথাও বাঘ হরিণের পেছনে ছুটছে। কোথাও শিকারি, টুপি খুলে গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছে, আবার কোনও ছবিতে সূর্যের রং চড়া। আর সূর্য ওঠার নাম নেই অথচ একদল রাজহাঁস জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। এবং ঝাড়লণ্ঠনে একটা চড়ুই পাখি, আলো—আঁধারের খেলায় এসময় বেশ মেতে গেছে। ঠিক নীচে জেরার মুখে সুবল।
এটা চড়াই পাখি না সুবলের পাখি রাতের বেলায় টের পাওয়া কঠিন। এবং কঠিন বলেই পাখিটা নিজের খুশিমতো কার্নিশে বসে বেশ ডেকে চলেছে। সে বুঝতে পারছিল বুঝি বেচারা টুকুনের মা বেশ বিপাকে পড়েছে। এই বিপাক থেকে রক্ষা পাবার কী যে উপায় স্থির করতে না পেরে খুব অস্থিরচিত্ত হয়ে গেছে।
এবং এভাবে টুকুনের সঙ্গে মাত্র রবিবার এক বিকেলে, একটা বিকেলই মাত্র সুবল থাকে তার সঙ্গে। সপ্তাহে এসময়টা টুকুনের খুব মনোরম। সে যেন এসময়টার জন্য সারাটা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে। আজ শনিবার ইন্দ্র ওকে রেড রোডে নিয়ে এসেছে। রেড রোডে ইন্দ্র গাড়ির স্টিয়ারিং টুকুনের হাতে দিয়ে বেশ চুপচাপ বসে আছে। টুকুন নানাভাবে বেশ অনায়াসে গাড়ি চালাতে পারছে বলে ইন্দ্রের ভাবনা কম। আর টুকুন সেই স্ল্যাকস এবং ঢোলা ফুলহাতা সার্ট অর্থাৎ ফুলফল আঁকা সিল্কের পাতলা পোশাক পরে বেশ অনায়াসে গাড়ি চালিয়ে মাঠের চারপাশে, কখনও গঙ্গার ধারে ধারে আবার এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসের পাশ দিয়ে এবং মেডিকেল কলেজ ঘুরে সোজা ফুলবাগান পার হয়ে ভি—আই—পি। তারপর আরও সোজা লেক টাউন, কেষ্টপুর এবং দমদম বিমান ঘাঁটি ডাইনে ফেলে কোনও গ্রামের ভিতর গাছের ছায়ায় সহসা গাড়ি থামিয়ে দিলে মনেই হয় না কিছুকাল আগেও এ—মেয়ের কথা ছিল মরে যাবে। আগামী শীতে অথবা বসন্তে মরে যাবে। সুবল এসে ঠিক এক জাদুকরের মতো তাকে কী করে যে ভালো করে তুলেছে?
এভাবে টুকুন আজ বিশ্বাসই করতে পারে না, তার একটা অসুখ ছিল। সে যে শুয়ে থাকত সব সময় এবং হেঁটে যেতে পারত না, এমনকি দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল, কিছুতেই সে তা বিশ্বাসই করতে পারে না। সে যেন এমনই ছিল। তার কথা ছিল অনেক দূর যাবার। ঠিক মানুষের খোঁজে সে আছে। ইন্দ্র চেষ্টা করছে ওর পাশে পাশে থাকার। কিন্তু ইন্দ্রকে সে এখনও তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। ইন্দ্রকে পাত্তা দিলে মা খুব খুশি হবে—অথচ সে কেন যে পারে না। বেশ এই যে গাছের নীচে সে এবং ইন্দ্র বসে আছে, ইন্দ্র ফ্লাস্ক থেকে টুকুনকে চা ঢেলে দিচ্ছে, সবটাই কেমন আলগা মানুষের মতো ব্যবহার। এবং চা ঢেলে দেবার সময় ইন্দ্র দেখল, কী সুন্দর আঙুল, চাঁপার ফুলের মতো ছুঁয়ে দিলেই কেমন মলিন হয়ে যাবে—আর বাহুতে কী লাবণ্য—এবং টুকুনকে এত বেশি ঐশ্বর্যময়ী মনে হয় যে, একটু ছুঁতে পেলেই—সব হয়ে যায়—সে এই ভেবে টুকুনের পাশে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে, টুকুন বলল, তুমি আমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবে?
—কোথায়?
এমন একটা জায়গা, যেখানে কেবল ফুল ফোটে।
—জায়গাটা কোথায় আমার চেনা নেই।
সুবল সেখানে থাকে।
—সেই ফুলয়ালা সুবল!
সেই ফুলয়ালা সুবল, কথাটা তার ভালো লাগে না। সুবল সম্পর্কে সে আরও কিছু বলতে পারত, কিন্তু ইন্দ্র এই নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা করবে। মাকে গিয়ে বলবে। সুবলকে নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা তার ভালো লাগে না। মার কাছে সুবল একটা শয়তানের মতো। সুবলকে কীভাবে জব্দ করা যায়, অথবা সুবল একটা উইচ, সে মন্ত্রের দ্বারা বশ করেছে টুকুনকে, এসব গ্রাম্য লোকেরা নানারকমের তুকতাক জানে, এমন এক সুন্দর রূপবতী কন্যা আর ধন—দৌলত দেখে টুকুনকে সুবল বশীকরণ করেছে, এসব মা সব সময় ভেবে থাকে। আত্মীয়স্বজনের কাছে মা এসব বলে না। কেবল ইন্দ্রের বাবা এলে মা সব বলে। কী যে করা এখন। কারণ মার ইচ্ছা কোনও শুভ দিনে ইন্দ্র এসে ওর হাত ধরুক এবং এই যে কলকাতা শহর, রাস্তাঘাট, অথবা মেম
রিয়েল—কখনও কখনও উটকামাণ্ড একটা বড় নীল উপত্যকায় ইন্দ্রের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, এসব হলেই মা ভাবে টুকুন নিরাময় হয়ে যাবে। টুকুনের একটা অসুখ ছেড়ে আর একটা অসুখ এবং এটা মার কাছে ভীষণ অসুখ। বরং মার ইচ্ছা টুকুন আবার শুয়ে থাকুক, সে আর উঠতে না পারলে কোনও কষ্টই যেন নেই তার, তবু যে পারিবারিক সম্ভ্রম বজায় থাকে। মেয়েটা যা করছে, কিছুতেই পারিবারিক সম্ভ্রম আর রাখা যাচ্ছে না। মার হতাশ মুখ দেখলে টুকুন তা টের পায়।
টুকুন দেখল, বেশ একটা জায়গা, এমন নিরিবিলি জায়গায় তার বসে থাকতে ভালো লাগে। কাল সুবল আসবে। সুবল বলেছে, একটা বাওবাবের চারা পেলেই লাগিয়ে দেবে তার উপত্যকায়। এবং গাছটা ডালপালা মেলে ধরলে টুকুনকে নিয়ে যাবে। টুকুনকে এসেই যা সব গল্প করে তার ভিতর থাকে, কেবল বুড়ো মানুষটা। নদীতে যে সে সাঁতার কাটে তাও বলে থাকে এবং কখনও তার কিছু ভালো না লাগলে নদীর ওপারে যে বন আছে, বনের ভিতর সে একা একা হেঁটে বেড়ায়—সে সব কথাও বলে।
অথবা টুকুনের ভারী সুন্দর লাগে যখন সুবল বলে, মাঠের ভিতর শীতের জ্যোৎস্নায় ভাত ডাল রান্না ও মাছের ঝোল রান্না। জ্যোৎস্নায় কলাপাতা বিছিয়ে ঘাসের ওপর বিছিয়ে খাওয়া ভারী মনোরম। এসব বললে, টুকুনের সেই ছোট্ট রাজপুত্রের মতোই মনে হয়, সুবল এমন একটা দেশের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে যেখানে তাকে আজ হোক কাল হোক চলে যেতেই হবে। সুবল কলাপাতা কেটে আনবে গাছ থেকে, সে ডাল ভাত রান্না করবে। রান্না করতে সে ঠিক জানে না। সুবল তাকে ঠিক শিখিয়ে নেবে। সে যা জানে না সুবলের কাছে জেনে নেবে। বিকেল হলে সে এবং সুবল যাবে নদীতে। কোনও মানুষজন না থাকলে নদীর অতলে ডুবে ডুবে লুকোচুরি খেলতে তার ভীষণ ভালো লাগবে।
ইন্দ্র দেখছে, টুকুন অনেকক্ষণ কিছু কথা বলছে না। কেমন চোখ বুজে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে।
ইন্দ্র বলল, কী ভাবছ টুকুন?
—ভাবছি, সুবল এখানে কোথায় বাওবাব পাবে?
—ইন্দ্র বলল, বাওবাব মানে?
—বা তুমি জানো না, বাওবাব এক রকমের গাছ, খুব পাতা, ওর শেকড় অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়।
—এমন গাছের নাম তো আমি জীবনে শুনিনি বাবা।
—টুকুন কেমন অবাক হল, বলল, বলছ কী, তুমি বাওবাব গাছের নাম জানো না! সে কী!
ইন্দ্র বলল, সুবল তোমার মাথাটি বেশ ভালো ভাবে খেয়েছে।
—তুমি ইন্দ্র যা জানো না, তা বলবে না।
—তবে কে এসব খবর দিচ্ছে তোমাকে।
—কে দেবে? বইয়ে এসব লেখা আছে।
—কোন বইয়ে?
টুকুন ওর সেই বইটার নাম করলে ইন্দ্র বলল, ওগুলো রূপকথা।
টুকুন বলল, মানুষের জীবনটাতো রূপকথার মতো। তাই না! এই যে সুবল কে কোথাকার মানুষ, এখন ফুলের গাছ কেবল লাগায়। কত রকমের সে ফুল নিয়ে আসে।
ইন্দ্র কেমন খেপে গেল এসব শুনে। মাসিমা ঠিকই বলছেন, তোমার একটা অসুখ সেরে আর একটা হয়েছে।
টুকুন লাফ দিয়ে উঠে বলল—সেটা কী?
—এই যে তুমি সব রূপকথা বিশ্বাস করছ।
—তোমরা বুঝি কর না?
—আমরা কী করি আবার?
—অনেক কিছু কর। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছে মা। ইন্দ্র এবার কেমন মিউ মিউ করে জবাব দিল, সেটার সঙ্গে রূপকথার কী মিল আছে?
—মায়ের কাছে এটা রূপকথার শামিল। মা তোমাকে নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখছে। অথচ জানো, মা জানে না, আমি বিয়ে—থা করছি না।
—সেটা তোমার ইচ্ছায় হবে বুঝি?
—কার ইচ্ছায় তবে?
—মাসিমা মেসোমশাইয়ের।
টুকুন উঠে দাঁড়াল। কী যেন খুঁজছে মতো। সে বলল কোথায় যে সুবল বাওবাব পাবে। নদীটা ওর ফুলের জমি ভেঙে নিচ্ছে। বাওবাবের চারা নদীর পাড়ে পাড়ে লাগিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হত। ওর শেকড় অনেক দূর চলে যায়। ছোট্ট গ্রহাণুর পক্ষে যা খুব খারাপ পৃথিবীর পক্ষে তা খুব দরকারি।
আঠার
রাত থাকতেই সুবলের ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। তখন আরও চার—পাঁচ জন লোক আসে। ওরা একসঙ্গে কাঁচি দিয়ে চারপাশ থেকে, যেসব ফুল ঠিকমতো ফুটে গেছে, আর বড় হবে না, সে—সব ফুল তুলে নেয়। প্রত্যেকের সঙ্গে বেতের ঝুড়ি থাকে। ফুলটা রেখে দেবার সময় খুব যত্নের দরকার হয়। রাস্তায় চার—পাঁচটা ছোট গাড়ি থাকে। গাড়িগুলো ছোট রেলগাড়ির মতো দেখতে। গাড়িতে বেশ নানাভাবে চৌকো মতো ঘর। এবং এক—একটা ঘরে ছোট ছোট ফুলের চুবড়ি সাজানো। কেবল রজনিগন্ধার ডাঁটগুলো সে আঁটি করে বেঁধে রাখে। মাঝে মাঝে ফুলের ওপর জল ছিটিয়ে দিতে পারে। সে অন্ধকারেই বুঝতে পারে কোথায় কে কী করছে। বেশ বড় এই ফুলের উপত্যকা। নদী ঢালুতে নেমে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে লাল ইঁটের দেয়াল এবং টালির ছাদের ঘরটা আশ্চর্য মায়াবি মনে হয়। সে অন্ধকারেও টের পায় জল তুলে আনছে সবুর মিঞা। সে ভারে জল আনছে। নিতাই তোলা ফুলে জল দিয়ে যাচ্ছে। কালু এখন তৈরি, যাবে স্টেশনে ফুল নিয়ে। সে অবশ্য ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়ে শহরে চলে যেতে পারে। কখনও কখনও দেরি হয়ে যায়, তখন অন্য জায়গা থেকে ফুল চলে আসে, ফুলের দাম ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। ভোর রাতে যে গাড়িটা যায় এবং যে গাড়িতে এ অঞ্চল থেকে ডাব, মুরগি, হাঁস ডিম যায় শহরে, সেই গাড়িতে সুবল তার সব ফুল তুলে দেয়। দালালদের ফুল দিলে সে ঠিক পড়তা করতে পারে না। মোটামুটি ফুলের কারবারে অনেক মানুষ জন খাটছে। এবং মাইল দুই গেলে, এক জনপদ গড়ে উঠেছে। ফুল সব মানুষদের—এ অঞ্চলের, এমনকি যারা শহরে গেছিল—তারা পর্যন্ত ফিরে এলে তাদের নিয়ে বেশ একটা ফুলের চাষবাস করে দিলে বুড়ো মানুষটা খুব খুশি।
সে বুড়ো মানুষটার জন্য একটা বড় কাঞ্চন গাছের নীচে বেদি বাঁধিয়ে দিয়েছে। দিনের নামাজ বুড়ো সেখানে করে নেয়। রাতেও সেখানে মানুষটা নামাজ পড়ে। এবং চারপাশে থাকে তখন সাদা কাঞ্চন ফুল। বিকেলে কোনও কোনও দিন গাড়িতে ফুল যায়। তখন সুবল বেশ সুন্দর একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, পায়ে সাদা কেডস এবং হাতে কিছু রজনিগন্ধা নিয়ে যখন গাড়ির মাথায় বসে থাকে, বুড়ো মানুষটার মনে হয়, সুবল যাচ্ছে ফুলের গাড়ি নিয়ে—সুবল না হলে এমন একটা ফুলের গাড়ি কে যে চালায়। যখন দু—পাশে মাঠ এবং ঘাস মাড়িয়ে গাড়ি যায়, সাদা কাঞ্চন গাছটার নীচে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ এক উজ্জ্বল রোদ খেলা করে বেড়ায়। নদী থেকে হাওয়া উঠে আসে। এবং সুন্দর এক জীবন। এভাবে যখন মানুষেরা টের পায় ফুলের জমিটা ওদের—কী আপ্রাণ উৎসাহ তাঁদের তখন পরিশ্রম করার।
কোনও কোনওদিন সে ফুল নিয়ে স্টেশন যায় না। দুপুরের খাবার অথবা রাতের খাবার এখন কালু তৈরি করে দেয়। সে যতটা সময় এসব করবে, ততটা সময়ই তার নষ্ট। সে চাষবাসের কথা তখন ভালো করে ভাবতে পারে না। সেজন্য সে যখন বিকেলে চুপচাপ ফুলের উপত্যকা ধরে হেঁটে যায় তখন চারপাশের সব কিছু কেমন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। সে এভাবে একটা নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছে। সবাই চায় তার নিজের একটা পৃথিবী থাক। সবাই চায় সেই পৃথিবীর সে রাজা হয়ে থাকবে। যেমন বুড়ো মানুষটা ফুলের চাষ সম্পর্কে প্রায় রাজার মতো, যেমন জনার্দন চক্রবর্তী তার বিশ্বাস সম্পর্কে প্রায় ঈশ্বরের শামিল—সুবল যেমন একসময় ভাবত, টুকুনদিদিমণি মরে যেতে পারে, এমন মেয়ে অসময়ে মরে গেলে ভীষণ কষ্টের।
এবং এভাবে সে যখন চারপাশে তাকায়—দেখতে পায় সব রাস্তার ধারে ধারে গন্ধরাজ ফুল। গ্রীষ্মকাল চলে যাচ্ছে। বর্ষা আসছে। ক’দিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছে। ফল ফুলের গাছগুলো ভীষণ তাজা। সে নতুন কলম করছে গোলাপের। গোলাপের ডাল কেটে সে মাথায় গোবর ঠেসে দিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে রেখেছে। সামান্য বৃষ্টি পেয়ে কাটা ডালগুলো কুঁড়ি মেলেছে। সে এসব দেখতে যায়। এদিকটায় রাস্তার দুপাশে সব বড় বড় গন্ধরাজ ফুলের গাছ। গাছের পাতা কী আশ্চর্য সবুজ। এবং চারপাশে গাছের সাদা ফুল। নীচে নুড়ি বিছানো পথ। বৃষ্টিতে এতটুকু কাদা হয় না। সবুজ ঘাস রাস্তার ওপর। এবং হেঁটে টের পাওয়া যায় বুড়ো মানুষটার টালির বাড়ি অথবা ওর ঘরটা এবং এই চাষবাস মিলে জায়গাটা যেন একটা পুরানো কুঠিবাড়ি হয়ে গেছে। কত সব আশ্চর্য কীটপতঙ্গ উড়ে এসে বাসা বেঁধেছে। কিছু সোনা পোকা পর্যন্ত সে এই ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছগুলোর চারপাশে আবিষ্কার করেছিল। এবং এখানে উড়ে এসেছে নানাবর্ণের পাখি। আর এসেছে ছোট্ট সব খরগোস, কাঠবিড়ালি। এখানে এসে যেই সবাই জেনে ফেলেছে—সুবলের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা খুব আনন্দের।
আর এভাবেই সুবল তার এই পৃথিবীতে ছোট রাজপুত্রের মতো বেঁচে থাকতে চায়। সে আর যায় না টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পায় তাকে নিয়ে ভীষণ একটা ঝড় উঠেছে টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পেয়েই গত দু রোববার একেবারে ডুব মেরেছে। এমনকি বড় শহরে ফুল নিয়ে গেলে পাছে তার লোভ হয় একবার টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা করার, সেজন্য সে নিজে আর শহরে যাচ্ছে না। স্টেশন পর্যন্ত গিয়েই ফিরে আসে। ফুলের সব বিক্রি বাট্টা, যারা কাজ করে তাদের ওপর। ওর যেন কেবল ইচ্ছা সে কত বড় ফুল আর কত বেশি ফুল চাষবাস করে তুলতে পারছে, এবং এভাবে সে সবার জন্য এবং নিজের জন্য অর্থাৎ এই যে ঈশ্বর পরিশ্রমী হতে বলছে, সে কতটা পরিশ্রমী হতে পারে তার যেন একটা প্রতিযোগিতা। বস্তুত সে চাইছিল কাজের ভিতর ডুবে গিয়ে টুকুনদিদিমণির কথা ভুলে যেতে।
সুতরাং বিকেল হলেই যখন তার লোকেরা গাছে গাছে জল দিয়ে যায়, যখন জমির আগাছা বেছে নবীন উঠে দাঁড়ায় এবং বুড়ো মানুষটার ছবি কাঞ্চন ফুলের গাছটার ছায়ায় ভেসে ওঠে—তখন সে গাছের পাতায় পাতায়, ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে জীবনের সৌরভ খুঁজে বেড়ায়। ভাবতে অবাক লাগে টুকুনদিদিমণির ওপর তার ভীষণ একটা লোভ আছে। ঠিক সেই অজিতদার স্ত্রীর মতো যেন। এবং এভাবে সে মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভেবে ফেলে। যত তার বয়স বাড়ছে, টুকুন দিদিমণির ওপর তত তার লোভ বাড়ছে। এবং এটা টের পেলেই সে আর এইসব ফুলেরা যে সৌরভ নিয়ে বেঁচে থাকে তা মনে করতে পারে না। এবং শেষটায় সে দিশেহারা হয়ে গেলে কঠিন অসুখের ভিতর যেন সেও পড়ে যায়। সে বলল, যেন নিজেকে শুনিয়ে বলল—আমি খুব খারাপ মানুষ টুকুনদিদিমণি। এতদিনে আমি এটা টের পেয়েছি।
আর তখনই সেই উপত্যকার ওপাশে যে একটা বড় রাস্তা চলে গেছে, মনে হল সেই রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থেমেছে। এখন বিকেল। সূর্যাস্তের সময় গাছপালার ভিতর দিয়ে রোদ লম্বা হয়ে পড়েছে। গাড়িটা নীল রঙের। ভীষণ ঝকঝকে। আর সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। ফলে সূর্য তার আশ্চর্য লাল রং নিয়ে এক্ষুনি গাছপালার ওপর ছড়িয়ে যাবে। এবং এমন একটা সৌন্দর্যের ভিতর হালকা সিল্কের পোশাক পরে যদি কেউ ফুলের উপত্যকায় নেমে আসে—যেখানে কেউ নেই, আছে সুবল, আর বুড়ো মানুষটা, তার যত রাজ্যের নানাবর্ণের ফুল, নদীর নির্মল জল। ওপারে বন। বনের গাছপালা ভীষণ নিবিড় তখন সুবল অপলক না তাকিয়ে থাকে কী করে! ক্রমে অনেকটা হেলে দুলে সে যেন চলে আসছে। সুবল দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে কিছুটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সে চোখ মুছে ভালো করে দেখছে সব। সে মুগা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। পায়ে তার ঘাসের চটি, এবং সে আজ ধুতি পরেছে। বিকেল হলেই স্নান করার স্বভাব সুবলের। সে বেশ পরিপূর্ণ সেজেগুজে যখন নদীর ঢালুতে একটু চুপচাপ বসে থাকবে ভাবছিল, যখন ফুলের গাড়িটা টংলি টংলি শব্দ তুলে মাঠের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তখন কিনা আশ্চর্য সুন্দর এক মেয়ে প্রায় যেন রাজকন্যার শামিল, পায়ের গোড়ালির ওপর সামান্য শাড়ি তুলে প্রায় যেন ধীরে ধীরে উড়ে আসছে।
সুবল কাছে এলেই বুঝতে পারল, টুকুনদিদিমণি।
সুবল এবার হাত তুলে গন্ধরাজের ডাল ফাঁক করে ডাকল টুকুনদিদিমণি।
টুকুন, চারপাশে তাকাল। সে সুবলকে দেখতে পাচ্ছে না। সুবল যে গন্ধরাজ ফুলের গাছগুলোর ভিতর চুপচাপ অদৃশ্য হয়ে আছে টুকুন টের পাচ্ছে না। সে চিৎকার করে বলল, সুবল তুমি কোথায়?
—আমি এখানে টুকুনদিদিমণি।
—আমি যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না সুবল।
—তুমি আমাকে দেখতে না পেলে হবে কেন। কাছে এসো। কাছে এলেই টের পাবে আমি ঠিক এখানে আছি।
কী ভীষণ প্রতীক্ষায় মগ্ন চোখ মুখ টুকুনের। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেবল ফুল আর ফুল। কত যে ফুল ফুটিয়ে রেখেছে সুবল। সুবল যে গন্ধরাজ গাছগুলোর পাশে পাশে হাঁটছে টুকুন টের পাবে কী করে। সে তো কেবল দেখছে, ফুল আর ফুল। আর দেখছে, বড় একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ। সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। নীচে পরিপাটি করে কিছু বিছানো। এবং বুড়ো মতো একজন মানুষ বসে আছে। বরফের মতো, সাদা দাড়ি, পরিপাটি সাদারঙ গায়ে লম্বা আলখাল্লা, পরনে খোপকাটা লুঙ্গি, মাথায় সাদা টুপি। হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মুখ কী প্রসন্ন। হাত সামনে রেখে সে আছে মাথা নীচু করে। চুল এত সাদা যে দূর থেকে একটা বড় কদমফুলের মতো লাগছে। আর আশ্চর্য মানুষটা ওর গলার স্বরে এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিষ্ট মনে বুঝি ঈশ্বর চিন্তা করছে। এমন ঈশ্বর চিন্তায় মানুষ কখনও এত মগ্ন থাকে সে যেন টুকুনের জানা ছিল না। সে বুঝতে পারল—এই সেই বুড়ো মানুষ। সুবল যার গল্প কতবার করেছে। বলেছে, টুকুন দিদিমণি আমার দেশটা তোমার রাজপুত্রের ছোট গ্রহাণুর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।
টুকুন দেখল, সত্যি এটা একটা আলাদা দেশ। যেন দুঃখ দৈন্য বলে এখানে কিছু নেই। কেবল ফুলের আশ্চর্য সৌরভ। এবং এই সৌরভের ভিতর বসে আছে এক বৃদ্ধ মানুষ। টুকুন মুখে আঙুল রেখে ইশারা করল অর্থাৎ যেন বলছে এটা ঠিক হবে না সুবল, মানুষটা প্রার্থনায় মগ্ন, তখন এসো তুমি আমি বসে ওকে চুপচাপ দেখি।
আর তখন সুবল এসে পাশে বসলে বেশ সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়। এক বুড়ো মানুষ বয়স যে কত, কে জানে তার সঠিক বয়স কী, সে নিজেও হয়তো জানে না, তার বয়স বলে কিছু আছে, এই পৃথিবীর যেন সে আদিমতম মানুষ, সুন্দর করে এই পৃথিবীর শেষ ঘ্রাণ শুষে নিচ্ছে। এখন তাকে দেখলে এমনই মনে হয়।
কিছু কাঞ্চন ফুলের পাপড়ি তখন ঝরে পড়ছিল ওদের ওপর। হাওয়ায় দুটো একটা পাপড়ি বেশ উড়ে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। কেমন একটা বাতাসের হিল্লোল। ক—দিন আগে বৃষ্টিপাতের দরুন দারুণ সবুজ আভা, এবং তার ভিতর অজস্র ফুলের সুবাস এসে যেন যথার্থ এক অন্য গ্রহাণু সৃষ্টি করছে।
আর তখন সেই মানুষ যদি চোখে দেখতে পেত তবে একটা ছবির মতো মেয়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। স্থির। নিশ্চল। এতটুকু নড়ছে না। সুবলকে পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না এবং বুড়ো মানুষটা এভাবে বুঝতে পারে তার কাছে সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গা, এই ফুলফলের উপত্যকা। যা কিছু সুখ, যা কিছু আকাঙ্ক্ষা সব সে এর ভিতর ঈশ্বরপ্রাপ্তির মতো টের পায়। সে কিছুটা অনুমানের ওপর বলল, তোরা।
—আমরা চাচা।
—এই তোর সেই মেয়েটা।
সুবল হাসল।—কোন মেয়েটা?
—যে মেয়েটা ভাবত, আর বাঁচবে না।
—হ্যাঁ চাচা সেই মেয়ে।
—এখন কী ভাবছে মেয়ে?
—আমি আপনাকে দেখছি। কিছু ভাবছি না।
টুকুন দুষ্টুমেয়ের মতো কথা বলল।
—আমাকে। আমি তো বুড়ো মানুষ।
সুবল বলল, চাচা কিন্তু দেখতে পায় না।
টুকুন বলল যাঃ।
—হ্যাঁ।
—তবে আমাদের যে বলল, তোরা!
—ওর আর একটা ইন্দ্রিয় তৈরি হয়েছে। সে টের পেয়ে যায়। তার এই নিজের হাতে তৈরি ফুলের উপত্যকাতে কে এল কে গেল। কোন গাছে কী ফুল ফুটেছে সে এই কাঞ্চন ফুল গাছটার নীচে বসে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে।
টুকুন বলল, আমার অসুখ, আমি বাঁচব না, আপনাকে এমন কে বলেছে?
বুড়ো মানুষটার যা স্বভাব, দাড়িতে হাত বোলানো এবং যেন এভাবে বলে যাওয়া—টুকুন সুবল তো কাজের ফাঁকে জল আনার সময়, অথবা সব আগাছা বেছে দেবার সময় কেবল একজনের কথাই বলে থাকে—সেতো তুমি। তোমার নাম টুকুনদিদিমণি। তুমি বিছানাতে একটা মমির মতো শুয়ে থাকতে। সুবলের মুখ দেখলে তখন বুঝতে পারতাম—সে নানাভাবে তোমাকে নিরাময়ের চেষ্টা করছে। ঠিক সে যেমন এই ফুলের উপত্যকায় এসে চারপাশে যা কিছু আছে, সব কিছু নিয়ে মগ্ন হয়ে গেল, তেমনি সে মগ্ন ছিল, তুমি কী কী করলে আনন্দ পাবে—সুবল কতভাবে যে তখন এই সব মাঠে বড় বড় নানা বর্ণের ফুল ফোটাবার চেষ্টা করেছে। সুবল তোমার জন্য সবচেয়ে দামি ফুলের গুচ্ছ নিয়ে যেত। এভাবে আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে তুমি একটা অসুখে ভুগছিলে। অসুখটা ছিল তোমার মনের। তোমার বড় বেশি ছিল বিশ্বাসের অভাব। তোমার সব আকাঙ্ক্ষা মরে যাচ্ছিল। সুবল আবার তোমাকে আকাঙ্ক্ষার জগতে ফিরিয়ে আনল—তার কাছে তুমি একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। কতদিন বলেছি তোর টুকুনদিদিমণিকে আসতে বলিস এখানে। দেখে যাক—পৃথিবীর আর একটা ছোট জায়গা আছে—যেখানে মানুষেরা কেবল ফুল ফোটায়। মানুষ তার নিজের স্বভাবেই সুন্দর পৃথিবী গড়তে ভালোবাসে।
টুকুন বলল, চাচা তুমি সত্যি দেখতে পাও না।
—যাঃ দেখতে পাব না কেন! এখন আমি সবচেয়ে ভালো দেখি। এতদিন যা আমার চোখের আয়ত্তে ছিল তাই দেখতাম। এখন তো আরও দূরের জিনিস এই ধর হাজার লক্ষ মাইল দূরে এই সৌরলোকের কিংবা মহাবিশ্বের কোথায় কী আছে সব যেন নিমেষে দেখে ফেলি। সুবল আমাকে যে ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প শুনিয়েছিল আমি এখন তার মতো এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে নিমেষে চলে যেতে পারি। কোনও কষ্ট হয় না। না দেখলে কী করে টের পেতাম তুমি আজ আমার বাগানে এসেছ।
এভাবে এক বুড়ো মানুষ তার ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে এখন সব কিছু দেখতে পায়। আগে সুবল ওর কোরান শরিফ পাঠের জন্য একটা ছোট্ট মতো কাঠের র্যাক করে দিয়েছিল। বিকেল হলেই বুড়ো মানুষটা কাঞ্চন ফুলের গাছটার নীচে গিয়ে বসত। চোখে ভারী কাচের চশমা লাগিয়ে সে নিবিষ্ট মনে পড়ে যেত সুর ধরে। তার সে নানারকম ব্যাখ্যা শোনাত সুবলকে। সুবল বসে বসে শুনত সব। একটু মনোযোগের অভাব দেখলেই ধমক লাগাত। ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ থাকবে না কেন? আল্লা ঈশ্বর তো আলাদা নন।
সুবল বলল, এখন সময় পাই না। এখন শুক্রবারে চাচার জন্য নীলপুর থেকে আসে আক্রম খাঁ। সে সারাটা দিন নামাজের ফাঁকে ফাঁকে চাচাকে কোরান পাঠ করে শোনায়।
টুকুন বলল, আর কীভাবে দিন কাটে তোমার?
—আমার এভাবেই দিন কেটে যায়।
সুবল কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। পাশে টুকুন হাঁটছে। ফুলের সৌরভের কাছে টুকুনদিদিমণির দামি প্রসাধন কেমন ফিকে হয়ে গেছে। সে বলল, এটা শ্বেতকরবী। বলে সে কটা ফুল হাতে তুলে নিলে টুকুন বলল, আমাকে দাও।
এবং টুকুন ফুল কটা নিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল। ববকাট চুলে আজ নকল চুল বেঁধে খোঁপা করেছে দিদিমণি। এবং খোঁপায় ফুল গুঁজে দিলে টুকুনদিদিমণিকে আর শহরের মেয়ে মনে হয় না, কেমন এক বনের দেবী হয়ে যায়। ওর বড় ইচ্ছা একদিন সে টুকুনদিদিমণিকে নিয়ে ও—পারের বনে যায়। এবং সারাদিন বনের ভিতর চুপচাপ বসে থাকা, অথবা গল্প, দিদিমণি আর কী কী নূতন বই পড়েছে, সুবল তো বই পড়তে পারে না, টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা হলেই নানারকম গল্প শোনার ইচ্ছা এবং টুকুনদিদিমণি কীযে সব সুন্দর সুন্দর পৃথিবীর খবর নিয়ে আসে। তার ইচ্ছা বনের দেবীকে ঠিক একদিন বনে নিয়ে যাবে। এবং বনের ভিতরে ছেড়ে দিয়ে সেই যে সে একজন কাঠুরের গল্প শুনেছিল, কাঠুরে রোজ কাঠ কাটতে যেত বনে, এবং দেখতে পেত এক ছোট্ট মেয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, সে মেয়েকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে যেত, ফলে তার কাঠ কাটা হত না, সে কাঠ না কেটেই চলে আসত এবং এভাবে সংসারে তার ভারী অভাব—অথচ সে দেখে বনের ভিতর রোজই মেয়েটা রাস্তা হারিয়ে ফেলে, এবং তাকে গ্রামের পথ ধরিয়ে দিতে হয়। কাঠুরিয়ার কাঠ কাটা হয় না। এবং এভাবে কাঠুরিয়া জানে না, এক বনের দেবী তাকে নিয়ে খেলা করছে। তারপর সে অভাবের তাড়নায় আর বাড়ি ফিরে না গেলে একটা ফুলের গাছ দেখিয়ে বলেছিল ছোট্ট মেয়েটা, একটা চাঁপা ফুল রোজ এ—বনে ফুটবে। সেটা তুই নিয়ে যাবি। সে কথামতো চাঁপা ফুল বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখেছিল—চাঁপা ফুল স্বর্ণ চাঁপা হয়ে গেছে। একটা ফুল বিক্রি করলে তার অনেক টাকা হয়ে যায়। সে রোজ বনে এসে সেই ফুলটা কখন ফুটবে সেজন্য বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে মনে হয়, এই বনের কোথায় যেন এক শ্রীহীন রূপ ফুটে উঠেছে। সেই মেয়েটি, যে তাকে নিয়ে খেলা করে বেড়াত তাকে না দেখতে পেলে বুঝি ভালো লাগে না, এই চাঁপা ফুল তুলে নিয়ে গিয়ে সে রোজ রোজ কী করবে। সেই মেয়েটা তাকে যে এভাবে বেল্লিক করে দেবে সে ভাবতেই পারে না। সে দেবীর দেখা পেয়েও পেল না। সে বলত, বনের দেবী তুমি আমার কাছে এমন ছোট্ট হয়ে থাকলে কেন। বনের দেবী তুমি আমাকে এমন লোভে ফেলে গেলে কেন। আমার যে এখন হাজার অভাব। বেশ ছিলাম মা জননী, কাঠ কাটা, কাটা কাঠ বেচে পয়সা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে আহার—তারপর সন্ধ্যা হলে আমার বউ পিঁদিম জ্বালাত। আমার সুখ ছিল, স্বস্তি ছিল। এখন মা জননী এত টাকা আমার, অথচ দ্যাখো বউটার মোটরগাড়ি না হলে চলে না। এবং সেই গল্প মনে হলে সুবলের মনে হয় টুকুনদিদিমণি বনের দেবী হবে ঠিক, কিন্তু ছোট মেয়ে সেজে তার লোভ বাড়াবে না। সে বলল, দিদিমণি ওপারে একটা সুন্দর বন আছে। যখন কিছু ভালো লাগে না, নদী সাঁতরে আমি ওপারে বনে উঠে যাই। চুপচাপ গাছের নীচে বসে থাকি।
এভাবে ওরা কথা বলতে বলতে অনেকদূর চলে এসেছে। সামনে সেই ছোট্ট নদী। যেমন ছোট্ট উপত্যকা নিয়ে সুবলের ফুলের চাষ তেমনি ছোট্ট নদী নিয়ে, ছোট্ট একটা বন নিয়ে সুবল বেশ আছে। আর কী নির্মল জল নদীতে। টুকুন নেমে বাবার সময় দুপাশের জমিতে দেখল অজস্র অপরাজিতা ফুটে আছে। নানারকম বাঁশের মাচান ছোট ছোট। সেখানে ফুলের লতা বেয়ে বড় হচ্ছে সজীব হচ্ছে। একেবারে সবুজ রঙ, ফুলের রঙ নীল, ভিতরটা শঙ্খের মতো সাদা। এবং টুকুনের ইচ্ছা হল এ—ফুলের একটা লম্বা মালা গাঁথে। ফুলের সৌরভ নেই কোনও। অথচ কী সুন্দর নরম ফুলের মালা। এমন মালা হাতে গলায় পরে সর্বত্র ঠিক নূপুরের মতো বেঁধে কেমন সেই যেন শকুন্তলার প্রায় তপোবনে তার ঘুরে বেড়ানো। টুকুন বলল, আমি নদীতে সাঁতার কাটব।
—অবেলায় সাঁতার কাটলে অসুখ হবে।
টুকুন বলল, আমি তুমি সাঁতার কেটে সুবল ওপারে উঠে যাব। বনের ভিতর হারিয়ে গিয়ে দেখব, কী কী গাছ আছে। তুমি গাছের নাম বলে যাবে, আমি গাছ চিনে রাখব। কত বড় হয়েছি, অথচ দ্যাখো কোনটা কী গাছ ঠিক চিনি না।
সুবল বলল, বনের ভিতর গেলে আমার কেবল ভয় হয় তুমি বনদেবী হয়ে যাবে।
—তা হলে কী হবে?
—তুমি আমাকে লোভে ফেলে দেবে।
—সে আবার কী।
—সে একটা লোভ। সোনার চাঁপাফুল। পেলে আর ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তখন অসুখটা বাড়ে।
টুকুন দেখেছে, সুবল চিরদিন এভাবেই কথা বলেছে। কথায় কেমন হেঁয়ালি থাকে, সে কখনও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অথচ মনে হয়, সুবল যা বলে তা সত্যি। সে বলল, সোনার চাঁপাফুলটা কী?
—সে একটা লোভ দিদিমণি।
—সেটা কী?
—সেটা এক কাঠুরিয়ার গল্প।
—কে বলেছে?
—আমাদের বুড়োকর্তা।
—তবে শুনতে হয়। বলে সে শাড়ি সামান্য তুলে নদীর জলে সামান্য নেমে গেল। বালির জন্য পা দেবে যাচ্ছে না। কী সুন্দর আলতা পড়েছে টুকুন দিদিমণি। জলের নীচে পায়ের পাতা মাছরাঙার মতো দেখাচ্ছে। সুবল এমন দেখলেই কেমন লোভে পড়ে যায়। ওর শরীর ফুলের সৌরভের মতো কাঁপে। সে টের পায় চোখ মুখ কেমন জ্বালা করছে। কিন্তু টুকুন দিদিমণিকে সে কেন জানি ছুঁতে ভয়। কীসব আশ্চর্য সুবাস শরীরে মেখে রাখে! কী নরম সিল্ক পরে থাকে, আর কী রঙবেরঙের লতাপাতা আঁকা পোশাক! সবটা এমন যে সে ভালো করে চোখ তুলে কখনও কখনও দেখতে ভয় পায়। এবং এমন হলেই সুবল বলে, বেশ ছিল কাঠুরিয়া। টুকুন একটু জল অঞ্জলিতে নিয়ে কী দেখে ফেলে দেবার সময় বলল, কী বেশ ছিল?
—এই তোমার বেশ ছিল। সে পরিশ্রমী মানুষ ছিল। কাঠ কাটত। কাঠ বিক্রি করত। কাঠ বিক্রির পয়সায় চাল ডাল এবং সবাই রাতে বেশ পেট ভরে খেত। তারপর কী ঘুম। কোনো হুঁশ থাকত না। তার কোনও রোগভোগ ছিল না।
টুকুন বলল, সে তবে সুখী লোক ছিল?
—খুব। সে নদী পার হত সাঁতরে। গায়ে তার অসুরের মতো শক্তি। সে তার পরিশ্রমের বিনিময়ে খাদ্য পোশাক এবং আশ্রয় পেত। একটু থেমে সে বনের দিকে চোখ তুলে কী খুঁজল। তারপর বলল, বুড়োকর্তা বলেছে, এটাই নাকি ঈশ্বরের বিধান। তার পবিত্র পুস্তকে বুঝি এমনই লেখা আছে। সে এখানে একটু সাধুভাষায় কথা বলার চেষ্টা করল। কাঠুরিয়া ঈশ্বরের নিয়ম থেকে সরে গেল। বনদেবী তাকে লোভে ফেলে নিরুদ্দেশে গেল।
টুকুন দেখল কেমন উদাসীন চোখে সুবল ওকে দেখছে।
—কী দেখছ সুবল?
—তোমাকে দেখছি টুকুনদিদিমণি। কাঠুরিয়া তারপর থেকে ফুলটার জন্য রাতে ঘুম যেতে পারত না।
—আমাকে দেখে সেটা তোমার মনে হল?
—তোমাকে দেখে কিনা জানি না, আজকাল আমার মাঝে মাঝেই এমন হয়।
—সেজন্য আমাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছ!
—ছেড়ে ঠিক দিইনি। যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তোমার মা এজন্য ভীষণ কষ্ট পায়। কেউ কষ্ট পেলেই আমার খারাপ লাগে। বলে সে বালির চরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। ওপারের বনের ছায়া ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ওদের দুজনের ছায়াও বেশ লম্বা হয়ে নদীর চর পার হয়ে যাচ্ছে। ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল। একজনের শরীরে শহরের সুগন্ধ। অন্য জন ফুলের সৌরভ শরীরে মেখে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই বলা, কাঠুরিয়ার তখন বড় ভয় হয়, সেই চাঁপাফুলটা কে না কে চুরি করে নিয়ে যায়!
—কার আবার দায় পড়েছে—কে জানে যে বনে সোনার চাঁপা ফুটে থাকে।
—জানতে কতক্ষণ। সে তো ততদিনে লোভে পড়ে গেছে। সে শহরে যায়—স্যাকরার দোকানে ফুলটা বিক্রি করে, ওরা লোক লাগাতে পারে—দ্যাখো তো রোজ মানুষটা ফুল পায় কোথায়? সেজন্য সে রোজ এক দোকানে চাঁপাফুল বিক্রি করে না, আজ শহরের উত্তরে গেলে, কাল দক্ষিণে। এভাবে সে চিন্তাভাবনায় বড় উদ্বিগ্ন থাকে। সে একদিন দেখতে পায় আয়নায়, সব চুল পেকে যাচ্ছে, মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। সে কেমন অল্প বয়সে বুড়ো মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আর যা হয় সে চাঁপা ফুলটা চুরি যাবে বলে, রাত না পোহাতে বনে চলে যায়। তারপর বনের পাতালতার ভিতর নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকে। চারপাশের পোকামাকড়েরা ওকে কামড়ায়। সে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে তো জানে না এভাবে লোভের কীটেরা তাকে দংশন করে ক্রমে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
সুবল এবার বালির চরে বসে পড়ল। এখন ওদের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে নেই। বরং ছায়াহীন এক মাঠ, দূরাগত পাখির ডাকের মতো তাদের কেমন নির্জন পৃথিবীতে যেন নিয়ে এসেছে। সুবলের যা হয়, এমন এক নিরিবিলি নির্জন পৃথিবীতে বসে থাকলেই বুঝি তার ভালো ভালো কথা বলতে ভালো লাগে। সেজন্য বোধহয় সাধুভাষায় কথা বলতে পারলে ভীষণ খুশি হয়। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কাঠুরিয়া দিন—রাতের বেশি সময়টাই বাড়ির বাইরে থাকত। সে যখন ফিরত শহর থেকে গাড়িতে, তাকে বড় ক্লান্ত দেখাত। ফিরে এসে দেখত, বউ তার রেলগাড়িতে চড়ে কোথায় গেছে। ছেলেরা বলত, মায়ের ফিরতে রাত হবে বলে গেছে বাবা।
টুকুন বলল, এভাবে সুখী মানুষটা পরিশ্রম ছেড়ে দিয়ে দুঃখী মানুষ হয়ে গেল।
এবং এভাবেই টুকুনের মনে হয় তার বাবাও ভীষণ কষ্টের ভিতর পড়ে গেছে। বাবার জীবনের সঙ্গে কাঠুরিয়া জীবনের কোথায় যেন সাদৃশ্য আছে। টুকুন বলল, জানো বাবার জন্য আমার ভারী কষ্ট লাগে। কাঠুরিয়ার মতো বাবাও আমার দুঃখী মানুষ। বাবাও আমার আরও কত গাড়ি, কত বাড়ি বানানো যায়—সেই আশায় একটা বড় রেলগাড়িতে চড়ে বসে আছে। কিছুতেই নামতে চাইছে না।
সুবল সহসা অন্য কথায় চলে এল। বলল, কোথায় যে একটা চারা পাই। ওটা পেলেই আমার এ—ফুলের উপত্যকা ভরে যাবে। আমার আর কিছু লাগবে না।
টুকুন বলল, আমিও গাছ খুঁজছি। বাবাও খুঁজছেন।
কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় গাছটা আসলে পৃথিবীতে নেই।
তারপর ওরা আর কোনও কথা বলল না। চুপচাপ বসে থেকে এই সব বন উপবনের নানারকম বর্ণাঢ্য শোভার ভিতর ডুবে গেল। ওরা শুনতে পাচ্ছে—কীটপতঙ্গেরা সব ডাকছে। পাখিরা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। খরগোসেরা দল বেঁধে শস্যদানা খাবার লোভে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। আরও কত কী—কী যে আশ্চর্য মহিমময় এই পৃথিবী। অথচ কখন সোনার চাঁপা ফুটবে, সেই আশায় একটা গিরগিটির মতো গাছের ডাল দেখছে কাঠুরিয়া। চারপাশে তার এতবড় পৃথিবী, আর এমন সুন্দর দিন গাছপালার ভিতর বর্ণাঢ্য সব শোভা নিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে জানতেও পারছে না। লোভ তাকে সব কিছু থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
টুকুনের আজ এখানে এসে কেন জানি মনে হল, মানুষেরা ক্রমে গিরগিটি হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর দিনগুলি তারা আর ঠিক ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। কাঠুরিয়ার মতো বনে—জঙ্গলে শুয়ে আছে, কখন সোনার চাঁপা ফুটবে গাছে, আর খপ করে তুলে নেবে। তারা কিছুতেই পরিশ্রমী হবে না। পরিশ্রমী না হলে সুন্দর দিনেরা মানুষের কাছ থেকে ক্রমে সরে যায়।
এই ফুলের জগতে সুবলকে দেখে কেবল টুকুন কেমন এখনও সাহস পায়। সুন্দর দিনগুলো ঠিক ঠিক কোথাও একসময় আবার এভাবে ফিরে আসে। এবং এভাবে মানুষের পৃথিবীতে আরও অনেকদিন বেঁচে থাকে।
উনিশ
তখন শহরে মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের স্লোগান—ঘেরাও চলছে, চলবে। স্লোগান, আমাদের দাবি মানতে হবে।
বড় বড় লাল শালুতে দাবির ঘোষণা। বেশ বড় বড় করে লেখা—বেতনের একটা নিম্নতম হার।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে চেয়ে এক ভিখারিনি, পাগলিনি—প্রায় ভীষণ হাসছিল। আর হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছিল—দু ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার বলল—স্যার, আর এগুনো ঠিক উচিত হবে না।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার খুব পুরানো লোক। এবং কী হবে না হবে সেটা তার মনে করিয়ে দেবার স্বভাব। সে বলল—মিছিল শেষ হলেই গাড়ি জ্যামে পড়ে যাবে।
মজুমদার সাহেব টুবাকো টানেন। পাইপে ধোঁয়া উঠছে না। তিনি বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে ফের কটা টান দিয়েও যখন দেখলেন ধোঁয়া উঠছে না, তখন কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ক্লাবে আজ একটা বড় রকমের লাইসেন্সের লেনদেনের ব্যাপার আছে। ট্যান্ডন সাব আসবেন। তাঁকে খুশি করার ব্যাপারও একটা আছে। মিস ললিতাকে সেজন্য তিনি ফোনে বলে রেখেছিলেন, আর রাস্তায় নেমে এমন একটা বিশ্রী ব্যাপারের ভিতর আটকে যাওয়া। তিনি কেমন বিরক্ত মুখে বললেন—দিন দিন এসব কী হচ্ছে বুঝি না।
ড্রাইভার বলল—স্যার বরং গাড়ি বাড়িতে নিয়ে যাই।
কোনো উপায় নেই বুঝতে পারলেন। কেবল তারা যাচ্ছে। আর চারপাশে গাড়ির হর্ন। এভাবে ক্রমে এই রাস্তা একটা গাড়ির পিঁজরাপোল হয়ে যাবে কিছুক্ষণের ভিতর। তিনি যে এখন কী করেন। তাঁর হাত—পা কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথবা এই সব মিছিলের মানুষদের ধরে শহরের বাইরে বের করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তিনি বললেন—দ্যাখো ব্যাক করতে পারো কিনা।
এবং তখনই পাগলিনি হেঁকে হেঁকে যাচ্ছে—দু—ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। হাতে তার লাঠি। লাঠির মাথায় পালক। পাগলিনিকে ভীষণ দাম্ভিক মনে হচ্ছে। মজুমদার সাহেব বললেন—দ্যাখো পাশ কাটাতে পারো কিনা।
তারপর ফিরে এসে ফোন। প্রোগ্রাম ক্যানসেল। ভিতর বাড়িতে এ—সময় কারও থাকার কথা না। টুকুনের যাবার কথা আছে একাডেমিতে। ইন্দ্রকে নিয়ে যাবে। এখন টুকুন ভীষণ ভালো গাড়ি চালাতে পারে। ওঁর ইচ্ছা হাতের সব কাজ হয়ে গেলে একবার গাড়িতে স্বামী স্ত্রী টুকুন সবাই কাশ্মীর যাবেন। খুব জমবে। টুকুনের মা নিশ্চয়ই দরিদ্র—বান্ধব ভাণ্ডারে চাঁদা আদায়ের জন্য মিঃ তরফদারের কাছে গেছে। সেখান থেকে ফিরতে ওর রাত হবার কথা।
অথচ এমন একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে মনটা খচ খচ করছিল। তবে তিনি ট্যান্ডন সাবকে জানেন ভীষণ লোভী মানুষ। আশ্চর্য সৎ টাকাপয়সার ব্যাপারে। এক পয়সা ঘুষ তিনি নেন না কথিত আছে। তবে যে দেবতা যাতে খুশি। ললিতা সম্পর্কে এমন একটা ছবি তৈরি করে রেখেছেন ট্যান্ডন সাবের মনে যে তাঁর আর সূর্যাস্ত না দেখে উপায় নেই। নদীর পারে খোলামেলা বাতাসের ভিতর একটা নিরিবিলি গাছের ছায়ায় ট্যান্ডন—সাব আর ললিতা। সব ব্যবস্থা মজুমদার সাহেব নিপুণভাবে করে রেখেছেন। অথচ এই সময়টায় কিনা মিছিলের লোকগুলি—কাজ না করে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে পয়সা কামাতে চায়! কী যে স্বভাব মানুষের এবং এটা বাঙালিদের ভিতর খুব বেশি এমন মনে হলে তাঁর কেন জানি মনে হয় আর এ বাঙালি জাতিটাকে বাঁচানো গেল না।
রামনাথ ব্যক্তিগত খানসামার কাজও করে, এ সময়ে সাহেবের ফাইফরমাশ খাটার সে মানুষ, মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়েছিল—কী যে আদেশ করবেন তিনি।
এবং রামনাথ ভাবতেই পারেনি, এমন অসময়ে সাহেব তার কুটিরে ফিরে আসতে পারেন! তার পোশাক—আসাক ভারী বিশ্রী—সে তাড়াতাড়ি প্যান্টের বোতাম আঁটতে ভুলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাটেনশান হয়ে। পাগড়ি তার ঠিক ছিল না। স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হতেই তার মনে হল কী যেন দেখছেন মজুমদার সাব।
সে একটু হকচকিয়ে কেমন বোকার মতো হেসে দিল।
তারপর যা হয়, তাঁর অঙ্গুলি সংকেতই যথেষ্ট। রামনাথ দেখল ওর প্যান্টের বোতাম আলগা। নীচে কিছু পরার স্বভাব নেই বলে এমনটা হয়। সে জানে আরও ক—বার তার এমন হয়েছে। এবং মজুমদার সাবের লাস্ট ওয়ার্নিং ছিল। রামনাথ এখন ভীষণ কুপোকাত। সে বলল—সাব আর হবে না।
মজুমদার সাহেব মনটা ভালো না। তিনি তাঁর এটাচড বাথরুমে এখন ঢুকে বেশ ঠান্ডা জলে স্নান করবেন। তাঁর বাঁধানো দাঁত এখন টেবিলে একটা মোমের বাটিতে ভেজানো থাকবে। এবং তখন কিনা রামনাথ হাতজোড় করে দাঁড়াল। সাহেব কেমন অবাক চোখে তাকালেন। এ—ব্যাপারে যে তিনি একটা লাস্ট ওয়ার্নিং ওকে দিয়ে রেখেছিলেন, বেমালুম ভুলে গেছেন। টুকুনের মা—র ফিরতে অনেক রাত হবে। মিছিল—টিছিলের ব্যাপার দেখিয়ে একটা বেশ অজুহাত তৈরির সুবিধা পেয়ে যাবে।
কারণ এই শহরে মিছিলের পরই জ্যাম আরম্ভ হয়। এবং জ্যাম ভাঙতে ভাঙতে রাত যে কত হয় কত হতে পারে কেউ যেন জানে না। এবং এভাবে টুকুনের মা যত রাত করেই ফিরুক মজুমদার সাহেব কিছু বলতে পারেন না। রাত তাঁরও হয়। তবে তিনি একটা ব্যাপারে খুবই ভালো মানুষ, টুকুনের মাকে খুব ভালোবাসেন। ললিতার মতো মেয়েরা ট্যান্ডন সাবদের মতো মানুষের ভোগে লাগে—মজুমদার সাব সেখানে সামান্য কৌশলী ব্যান্ড—মাস্টার মাত্র।
এবং এভাবে আজকের ব্যান্ড—মাস্টার মজুমদার সাহেব নিজে হয়ে যাচ্ছেন। বাথরুমে স্নান করার সময় তাঁর কথাটা মনে পড়ল। মাথায় শাওয়ারের জল। হাতে নানা রঙের পাথর সব—দামি, ভাগ্য ফেরানোর ব্যাপারে সেই যৌবনকাল থেকে পরে আসছেন। এখন দু—আঙুলে দশটা—ক্রমে বয়েস বাড়লে বিশটা হয়ে যাবে। বাথরুমের আলোটা সাদা মতো দেখাচ্ছে। পেটে চর্বি, এবং লোমশ শরীর থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে টুকুনের মা—র কাছে নিজেকে কেমন একটা বনমানুষ মনে হল। ভাবল, টুকুনের মা—র আসতে দেরি হওয়া স্বাভাবিক। মুখে চোখের ভয়ঙ্কর ঈর্ষা কেমন এক উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেলে আয়না থেকে চোখ তুলে নেন তিনি। খুব সুগন্ধযুক্ত সাবানের ফেনার ভিতর লম্বা টবে শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা জলে কী যে ভালো লাগে পাইপ টানতে। এবং অনেক টুকিটাকি কাজ তিনি এভাবে শুয়ে ঠান্ডা জলের ভিতর সেরে ফেলতে পারেন। রামনাথ তখন তাঁর অনেক কাছের মানুষ হয়ে যায়। দরজায় পাহারা—আভি কোই মাত ঢোকনা। সাব নাহানে মে গিয়া।
—রামনাথ।
রামনাথ বুঝল, বাবুর নকল দাঁত এবার তাকে দিয়ে আসতে হবে। অথচ কী যে বয়স। এমন সামান্য বয়সে দাঁত কেন পড়ে যায় সব সে ভাবতে পারে না। সব না এক পাটির কিছু অংশ সে জানে না। এমন একটা মোমের পাত্রে তা ঢাকা থাকে, এবং সে যখন ভিতরে দিয়ে আসে তখন সাহেবের মুখে এমন একটা ফুলো ভাব থাকে যে দেখলে মনে হবে তাঁর একটা দাঁতও পড়েনি এবং রামনাথ জানে না, মেমসাব আজও জানে কিনা, দাঁত নকল না আসল। কনফিডেনসিয়াল সব। সে এ—ঘরের টুঁ শব্দটি দরজার বাইরে বের হতে দেয় না। এখানে এই স্নানের সময়টুকু স্নানের ঘরে ঢুকলেই তাঁর বের হতে হতে দু—ঘণ্টা—রামনাথের মনে হয় ঠান্ডা জলে কীসব গন্ধদ্রব্য একটার পর একটা ঢেলে, তিনি আশ্চর্য এক নীল সমুদ্রের বাসিন্দা হয়ে যেতে চান। সে তখন যেই খোঁজ করুক না—সাব নাহানে মে হ্যায়। ব্যাস তার এক কথা। এমনকি তখন মেমসাব কেমন সন্তর্পণে চলাফেরা করেন। তিনি পর্যন্ত ঢুকে বলতে সাহস পান না, আমি দেখব, দাঁত আসল না নকল।
তারপর যা হয়ে থাকে…নকল দাঁতের শৌখিনতা মানুষের মনে সেই কবে থেকে যেন। সে জানে বোঝে নকল দাঁতেরা খুব উজ্জ্বল হয়। পুরানো দাঁত পরে থাকতে বুঝি ভালো লাগে না মানুষের। উজ্জ্বল দাঁত পরে, হাসিটুকু উজ্জ্বল রেখে, সব সময় মানুষ তার নিজের গোড়ালি উঁচু রাখতে চায়। এবং এর ভিতরই থেকে যায় অসুখটা। টুকুনের ছিল—কিন্তু মজুমদার সাব অথবা মেমসাহেবের কোনও অসুখ নেই কে বলবে। প্রাচুর্য অনায়াস হলে মানুষের নকল দাঁতের দরকার হয়। মজুমদার সাব এটা যে বোঝেন না তা নয়, খুব বোঝেন। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ—উদ্যমই সব। অথচ কোথায় যে মানুষেরা উদ্যম বিহনে ভুগে ভুগে অনায়াস প্রাচুর্যের লোভে কখনও মিছিলের ভিতর, কখনও কারখানার ভিতর, আবার কখনও বড় বাড়ির সদরের এক কঠিন অসুখ—আর, এভাবে একটা ঐতিহাসিক তত্ত্বের মতো ঘটনাটা আবিষ্কার করে কেমন তিনি উৎফুল্ল হলে, দরজার ও—পাশে ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠল।
তিনি রামনাথের গলা পাবেন আশা করে বসে আছেন—কে রে? তিনি রামনাথকে উদ্দেশ করে বাথরুম থেকে বললেন।
—সাব ইন্দ্র দাদাবাবু।
—ইন্দ্র দাদাবাবু।
—হ্যাঁ সাব।
—ছোঁড়াটা জ্যামে পড়ে গেল বুঝি!
—তা কিছু বলছে না।
—তবে কী বলছে?
—মেমসাবকে চাইছে।
—ধরো। আসছি।
তিনি একটা নীল রঙের তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে বেশ ছুটে এসে ফোনটা ধরলেন—হ্যালো কে?
—আমি ইন্দ্র বলছি মেসোমশাই!
—কী ব্যাপার!
—ব্যাপার খুব ভীষণ।
—রাস্তায় আটকা পড়েছ?
—রাস্তায় না, একাডেমিতে। পাশের একটা দোকান থেকে ফোন করছি।
—আটকা পড়েছ মানে?
—টুকুন আমাকে না বলে না কয়ে কখন বের হয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে।
—কোথায় গেছে?
—জানি না।
—কখন গেছে?
—অনেকক্ষণ।
—গেছে যখন, ঠিক ফিরে আসবে। মজুমদার সাব এইটুকু বলে ফোন ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ইন্দ্র আরও কিছু বলবে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন সে কিছু বলতে ইতস্তত করছে।
—টুকুন আমাকে বলল, একটু বোসো। আমি আসছি।
—আসছি যখন বলেছে, ঠিক চলে আসবে।
—সে বাড়ি ফিরে যায়নি তো?
—তোমাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে কী করে!
—কী জানি, ওর যা মেজাজ।
—কতক্ষণ হল গেছে?
—ঘণ্টা দুইয়ের ওপর হবে।
মজুমদার সাবের মুখ সামান্য সময়ের জন্য খুব উদ্বিগ্ন দেখাল তারপর ভাবলেন কোনও জ্যামে পড়ে গেছে। তিনি বললেন—আজ তোমাদের বের হওয়া উচিত হয়নি। কী করে যে ফিরবে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার তো যাবার কথা ছিল ওদিকে, কিন্তু কিছুতেই যেতে পারলাম না। রাত দশটার আগে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হয় না।
—এদিকে তো শুনছি মাঠে ভীষণ গণ্ডগোল। পুলিশ আর জনতার খুব মারধর হচ্ছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
—তোমার তো দোকানে থাকা উচিত হবে না এ—সময়। টুকুন ফিরে এসে তোমাকে না পেলে ভাববে।
—কিন্তু এমন হওয়া তো উচিত না। কেমন বেপরোয়া। হুঁশ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। সোজা রবীন্দ্রসদন পার হয়ে বাঁদিকে ঘুরে গেল।
—কোথায় যেতে পারে তোমার মনে হয়।
—কী করে বলব। তবে কদিন থেকে বলছিল ওর বাওবাব গাছের খুব একটা দরকার।
—বাওবাব গাছ! সে আবার কী!
—সে আমিও জানি না। সুবল একটা বাওবাবের চারা খুঁজছে।
—কত রকমের যে গাছ আছে পৃথিবীতে!
ইন্দ্র মনে মনে হাসল। মেয়ের মতো বাপেরও বুঝি একটা রোগ আছে। মেয়েটা কোথায় গেল, এতটুকু চিন্তা করছে না। সে এবার বলল—মাসিমা কোথায়?
—এ সময় তো তুমি জানো ও বাড়ি থাকে না। আমিই কেবল অসময়ে বাড়িতে। একটু থেমে বললেন—শোন, তুমি দেরি কোরো না। ও এসে তোমাকে জায়গামতো না দেখলে খুব চিন্তায় পড়ে যাবে।
ইন্দ্র এবার হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। সে বলল—ঠিক আছে, যাচ্ছি। সে মজুমদার সাবকে কিছু বলে চটাতে ভয় পায়। টুকুনের সায় নেই, মেসোমশাইরও সায় না থাকলে ওর হিসাব উলটে যাবে। সে ভয়ে বলতে পারল না টুকুন আমাকে এসে না দেখলে খুব খুশি হবে, সে এতটুকু ঘাবড়ে যাবে না। বললেই যেন সে ধরা পড়ে যাবে—সে খুব অক্ষম, টুকুনকে সে এতদিনেও হাত করতে পারেনি। এবং অন্য যুবকেরা তো বেশ গোড়ালি উঁচু করে দাঁড়িয়েই আছে—এক ফাঁকে এই সাম্রাজ্যের ভিতর কী করে লাফিয়ে পড়া যায়। টুকুনের এক মাস্টারমশাই পর্যন্ত—ছোঁড়া খুব দামি গাড়িতে আসে পড়াতে। মেসোমশাইর কাছে ওর খুব সুনাম! আশ্চর্য যে একজন পেটি শিক্ষক কীভাবেই বা আশা করে টুকুনের মতো মেয়েকে পাবার—তবে যে টুকুনের অসুখ। অসুখ না থাকলে এমনভাবে সে একটা পাখিয়ালার জন্য বাওবাবের চারা খুঁজে বেড়াচ্ছে!
হঠাৎ ইন্দ্রের খেয়াল হল, যা, মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে! সে হঠাৎ কী ভাবতে গিয়ে বলতে গিয়ে বলতে পারল না, আমি ঠিক জানি ও কোথায় গেছে! কিন্তু ওটা যে আর বলা হল না! মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে আবার ভাবল ডায়াল ঘুরিয়ে বলবে—কিন্তু তক্ষুনি মনে হল টুকুন যদি চলে আসে। সে সত্যি যদি ওকে না দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়! এমন ভাবতে ইন্দ্রের ভীষণ ভালো লাগে এবং ভালো লাগাটা সে কখনও সত্যি সত্যি মনে মনে মেনে নেয়। কী হবে সব জানিয়ে—মেয়েটার অসুখ বড় কঠিন অসুখ এক—যা সে নিত্যদিন দেখে দেখে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। কোথাকার এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পেটি শিক্ষক—যারা সহবত জানে না তারা পর্যন্ত টুকুনের কাছে খুব দামি মানুষ।
ইন্দ্র সুতরাং রাস্তা পার হয়ে যায়। সেই গাছটার নিচে গিয়ে বসে থাকে। এবং গাড়িগুলোর যাওয়া—আসার পথে সে কেবল ভাবে—এই বুঝি টুকুন এল। ক্রমে রাত বাড়ে এভাবে। ওর ভালো লাগে না। মাকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলবে ভাবল। মা জিজ্ঞাসা করবে—কী হল, তোকে তো টুকুন পৌঁছে দিয়ে যায়। আজ তোর এমন কথা কেন! সে কেন জানি তার মাকেও বলতে ভয় পায়—মা, টুকুনের অসুখে আমাকে জড়াচ্ছ কেন। মেয়েটা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারপরই মনে মনে ভীষণ রাগ, এবং এক কঠিন মুখ, এ—মুখ যে তার নিজের সে ঠিক তখন বুঝতে পারে না। কেমন নৃশংস মুখ হয়ে যায়। পেটি শিক্ষকের কথা সে ছেড়ে দিতে পারে, তার ওপর সে ভরসা রাখতে পারে; কিন্তু মনে হয় বারবার সে হেরে যাবে একজনের কাছে—তার নাম সুবল—এক পাখিয়ালা। ফুলের রাজ্য তৈরি করে সে এক স্বপ্নের দেশের মানুষ হয়ে গেছে টুকুনের কাছে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, টুকুনের স্বপ্নটাকে সে যে ভাবে পারে ভেঙে দেবে। এবং তার আজই ইচ্ছা হল, একবার গোপনে সে সুবলের দেশটা দেখে আসবে—কীসের আকর্ষণ, এমনভাবে তাকে ফেলে পালিয়ে যাবার কী এমন আকর্ষণ! তারপরই কেন জানি সে জোর করে হেসে ফেলে—কীযে সব আজেবাজে সে ভাবছে! টুকুন না বলে গাড়ি নিয়ে গেছে বলে অভিমানে যত সব বাজে সন্দেহ। হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। কোথাও জ্যাম—ট্যামে আটকে গেছে। তা ছাড়া যদি…..যদি….একটা অ্যাকসিডেন্ট! ওর কেমন ভয় ধরে গেল। এভাবে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। সব খুলে বলা দরকার। একটা ট্যাকসি—এই ট্যাকসি। এভাবে দুবার তিনবার ট্যাকসি ডেকে শেষবার পেয়ে গেলে—সোজা টুকুনদের বাড়িতে। সে এসেই বলল—টুকুন ফেরেনি মাসিমা?
মাসিমার মুখ ভীষণ ভার। জ্যামে তিনিও আটকে গিয়ে অসময়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। হাতের এতটা সময় কী কে করেন! মিঃ তরফদারের সঙ্গে তাঁর দেখা না হওয়ায় তাঁর খুব খারাপ লাগছে। এবং তখন যেন হাসতে হাসতে বলা—শুনছ, টুকুন ইন্দ্রকে গাছতলায় বসিয়ে গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে গেছে।
—ভালো করেছে।
মেজাজ ভালো না থাকার ব্যাপারটা মজুমদার সাব বেশ ধরতে পেরে মনে মনে হাসছিলেন।
এবং ঠিক পরে পরেই ইন্দ্র এসে যখন বলল—মাসিমা টুকুন ফেরেনি! কেমন হুঁশ ফেরার মতো তিনি ঘড়ি দেখলেন—মেয়েটার জন্য কেমন প্রাণ কেঁদে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার—তুমি কী। মজুমদার সাবকে ভীষণ গালাগাল—তুমি এতবড় নিষ্ঠুর। আমার একটা মাত্র মেয়ে তাও তুমি এমনভাবে চুপচাপ আছো।
—আরে ঠিক চলে আসবে। মনে হয় সুবলের কাছে গেছে।
—সেই পাখিয়ালাটা! ছিঃ ছিঃ। তুমি এখনও চুপচাপ বসে আছ? ইন্দ্র, তুমি পরিমলকে ধরো তো।
—আরে করছ কী! পুলিশ কমিশনার—টমিশনার আবার ডাকছ কেন? আমি তো আন্দাজে বললাম।
টুকুনের মা ঘড়ি দেখছে কেবল। নটা বেজে গেছে। সুবলের কাছে গেছে কী, যায়নি, কেউ তো ঠিক জানে না, হয়তো মীনাদের বাড়ি গেছে, মীনার কথা মনে হতেই জোনার কথাও মনে হল। যা খামখেয়ালি মেয়ে। টুকুনের মা সব ওর বান্ধবীদের এক এক করে যখন ফোন শেষ করে উঠবে তখন সবার চোখে অন্ধকার। এবার বোধ হয় পুলিশ কমিশনার—টমিশনার দরকার আছে। কিন্তু এতবড় বাড়ির একটা ব্যাপার, স্ক্যান্ডাল হতে কতক্ষণ—আরও কিছু সময় দেখা দরকার। হয়তো কিছুই হয়নি। পুলিশে ছুঁলেই আঠারো ঘা। সুতরাং ইন্দ্র, মজুমদার সাব, টুকুনের মা এবং মজুমদার সাবের পার্সোনেল সেক্রেটারি চুপচাপ কী করা যায় ভাবছিলেন—তখন মনে হল কেউ বলতে বলতে আসছে—টুকুনদিদিমণি আসছে।
ওরাও দেখল টুকুনদিদিমণি আসছে। ভীষণ সজীব। পেছনে ধীর পায়ে আসছে সুবল। কত লম্বা দেখাচ্ছে ওকে। খুব হাসিখুশি। বাড়ির ভিতর যে একটা ব্যাপার ঘটবে সুবল যেন বুঝতে পেরেছে। তবু সে এতটুকু আমল না দিয়ে বলল—টুকুনদিদিমণি একাই ফিরতে চেয়েছিল, এতটা রাস্তা একা আসবে—ঠিক সাহস পেলাম না।
মজুমদার সাব খুব সংযত গলায় বললেন—এভাবে টুকুন তোমার যাওয়া উচিত হয়নি। আমরা খুব ভাবছিলাম।
ইন্দ্র বলল—আর একটু হলেই পরিমল মামাকে ফোন করব ভেবেছিলাম।
টুকুনের মা বলল—তুমি আর বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না।
সুবল বলল—আমি যাচ্ছি টুকুনদিদিমণি।
মজুমদার সাব বললেন—না, বোস।
টুকুনের মা বলল—না, তুমি যাও সুবল। অনেক রাত হয়েছে।
সুবল বলল—সেই ভালো।
টুকুন বলল—একটু দেরি করে গেলে কিছু হবে না। এগারোটার লাস্ট ট্রেন পেয়ে যাবে। একটু কফি করে দাও মা।
মা যে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। মেয়েটা এত বেহায়া। ইন্দ্র বলল—এটাও একটা অসুখ।
টুকুন বলল—কী অসুখ!
—এই অসুখ!
মজুমদার সাব খুব বিব্রত বোধ করছেন। তিনি বললেন—তুমি আর এসো না সুবল। তোমাকে নিয়ে সংসারে খুব অশান্তি।
টুকুন ভাবল, সবাই তবে তোমরা শান্তিতে আছো! সুবল এলেই যত অশান্তি। ঠিক আছে। সে বলল—সুবল, আমি কাল যাব।
টুকুনের মা থ, মেয়ের এত সাহস! ছেলেটা তুকতাক করে একেবারে মাথাটা খেয়েছে। এবং সুবল যখন চলে গেল, তখন টুকুনের মা—র ভীষণ মাথা ধরেছে। কী যে হবে!
কবে একবার ওর বাবা একটা বেয়াড়া চাকরকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, এবং কুয়োতে ফেলে দিয়ে মাটি বুজিয়ে দিয়েছিলেন, কেন যে বাবা এমন করেছিলেন, সে জানত না। কেবল সে দেখেছে ঐ চাকরটার মৃত্যুর পর মা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব সময় জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এবং চোখ উদাস। এখন সে ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
বুঝতে পারে বাবা বেশি বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সে শেষ পক্ষের মেয়ে। বাবার সঙ্গে মা—র বয়সের তফাত কত যে বেশি ছিল, সে যেন সেটা এখনও অনুমান করতে পারে না। মা—র চোখ মুখ কী পবিত্র ছিল, মা বড় করে সিঁদুরের টিপ কপালে দিতেন। খুব মোটা করে আলতা পরতে ভালোবাসতেন, মা—র চোখে মুখে ছিল অসীম লাবণ্য। মা কখনও কঠিন কথা বলতে জানতেন না। ঝি—চাকরদের কাছে মা ছিলেন দেবীর মতো, অথচ বাবার সংশয় ভীষণ এবং এই সংশয় থেকে সংসারে ঝড় উঠেছিল।
এসব কথা মনে হলে মাথা ধরাটাও আরও বেড়ে যায়। টুকুনের জন্য তার এমন একটা কিছু মনে হয়েছে। এবং সে যেতে যেতে দেখল বড় বড় আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব পড়ছে। সে নিজের মুখের দিকে নিজেই তাকাতে পারছে না। ভীষণ কুৎসিত দেখাচ্ছে মুখ। সমাজে সে মুখ দেখাবে কী করে! মিঃ তরফদার এ—নিয়ে বেশ রসিকতা করবেন। কান গরম হয়ে যাবে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে আসবে। সে তার শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে দেখতে পেল—দেয়ালের সব বড় বড় ছবি ওর দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। অথবা সব ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। এবং ওর পিছনে ছুটে আসছে। আর ঘড়িতে তখন সাড়ে দশ। রেল স্টেশনে গাড়ি ছাড়ার শব্দ। কেমন বেহুঁশের মতো সে তার ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল। আর একটু বাদে এ—ঘরে সেই কাপুরুষ মানুষটা ঢুকবে। মুখে লাগানো তার নকল দাঁত। ওকে চেটেপুটে খাবার জন্য আসবে। সে এসে যাতে চেটেপুটে না খেতে পারে সেজন্য দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ দেখলে মানুষটা ফিরে যাবে এবং সারা রাত ছটফট করবে বিছানায়। ওর ঘুম আসবে না। সকাল হলে সে মানুষটার কাছে যা চাইবে ঠিক পেয়ে যাবে। সে জানে সারা দিন পর শরীর চেটেপুটে খেতে না দিলে মানুষটার কামনা—বাসনা মরে না। সে তার মেয়ে টুকুনকে সুস্থ করে তোলার জন্য আবার কী করা যায় ভেবে যা স্থির করল সে বড় নৃশংস। ভাবতেও ভয় হয়।
কুড়ি
আর তখন টুকুন দরজা—টরজা পার হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
প্রায় সে ছুটে ছুটে সিঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেছে। কী যে মহার্ঘ বস্তু তার শরীরে আছে—যা সুবলের কাছে গেলেই ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। নদীতে স্নানের দৃশ্য মনে হলে সে কেমন লজ্জায় গুটিয়ে আসে। ওর চোখ মুখ তখন বড় সুষমামণ্ডিত মনে হয়। তার কাছে সুবল এক আশ্চর্য মানুষ। সে এতক্ষণ সুবলের ফুলের উপত্যকায় জ্যোৎস্না রাতে চুপচাপ বসেছিল পাশাপাশি। ফুলেরা সব ওর শরীরের চারপাশে বাতাসে দুলেছে। আর সেই বুড়ো মানুষের সুর ধুয়ে পড়ে যাওয়া সব সুরা বাতাসে এক সুন্দর সজীবতা গড়ে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সুবল সেই সব সুরার অর্থ করে দিলে—মনে হত আশ্চর্য এই জীবন—সে আছে মানুষের পাশাপাশি—যার শরীরে আছে নানা বর্ণের ফুলের সৌরভ।
সে এভাবে এমন একটা মুগ্ধতার ভিতর আছে যা ভাবা যায় না। ঘরে ঢুকেই সে পিয়ানোর রিডে ঝম ঝম শব্দ তুলে হাত চালাতে থাকল। এবং আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে তুলতে চাইছে সেই সব শব্দের ভিতর। যেমন যেমন সে সারাটা বিকেল, সারাটা সন্ধ্যা এবং রাতের প্রথম দিকে সারা জ্যোৎস্নায় ঘোরাঘুরি করেছে সে ঠিক তেমনি রিডের ওপর হাত চালাতে থাকল।
প্রথমে সে গোটা রিডের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে দু’ হাতের আঙুল চালিয়ে গেল। যেন সে সুবলের কাছে যাবে বলে মোটরে যাচ্ছে ঝড়ের বেগে। তার রাস্তাটা ঠিক জানা নেই। রিডে যে জন্য মাঝে মাঝে টুকুনের হাত কাঁপছে। হাত কাঁপলেই মনে হয় ইতস্তত মোটরটা রাস্তা ভুল করে ফেলেছে। ভুল করেই ফের শুধরে নিচ্ছে—তখন আবার দু’হাতের সমস্ত আঙুল কোমল লতার মতো দুলে দুলে যেন সুতার বাঁধা সরু সরু সব পুতুলের হালকা পা রিডগুলোতে কখনও অল্প, কখনও বেশি নরম এবং কখনও ছোট ছোট অক্ষরে লিখে যাবার মতো তার মনের উদ্বিগ্ন ভাব এবং আকুতি ফুটিয়ে তুলতে চাইছে পিয়ানোতে।
এভাবে একটি মেয়ে এমন সব সুর তুলে ফেলছে এমন সব সুন্দর ঝংকার তুলছে পিয়ানোতে যে সমস্ত বাড়িটা যেন সুরের ঝংকারে ভাসছে। কখনও হালকা মেঘের ওপর—কখনও জলে গলে যাবার মতো, আবার মনে হয় স্থির হয়ে আছে বাড়িটা—সাদা জ্যোৎস্নায় সব কেমন করুণ হয়ে আছে।
ঘরে ঘরে আর কেউ ঘুমোচ্ছে না এখন। সুরের ইন্দ্রজালের ভিতর সবাই ডুবে যাচ্ছে। এমন ঝংকার যে—মনে হয় কোথাও দু’জন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে, কোথাও ওরা দুজন পাশাপাশি সাঁতার কাটছে নির্মল জলে। আবার মনে হচ্ছে বনের ভিতর দাপাদাপি। একজন আগে ছুটে যাচ্ছে আর একজন পিছনে! পাতা পড়ার শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। বনের মর্মর শোনা যাচ্ছে আবার শোঁ শোঁ ঝড়ের বেগে গাছের ডালপালা ভাঙার শব্দ! আর খুব কান পাতলে বোঝা যায় এখন টুকুন যে ঝংকার তুলছে রিডে, সবই নদীতে নেমে যাবার আগের দৃশ্য। প্রথমে দুজনে ধীর পায়ে জলে নামছে। খস খস শব্দ। শাড়ি হাঁটুর ওপর উঠে আসছে। তারপর ঝুপঝাপ—দু’জনে নেমে যাচ্ছে। জলে সাঁতার কাটছে। খুব লঘুপক্ষ হয়ে জলে ভেসে যাচ্ছে। এত আস্তে এখন পিয়ানোতে আঙুলগুলো নড়ছে টুকুনের যে মনে হয় আঙুলগুলো অবশ হয়ে গেছে। টুকুন চোখ বুজে বাজাচ্ছে। এবং সেই দৃশ্যের ভিতর জলের নীচে ডুব দেবার শব্দ, অথবা পা দুটো ঠিক মাছের মতো যে খেলছে জলের নীচে তার শব্দ, অথবা লুকোচুরি খেলার জন্য গভীর জলে ক্রমে ডুবে যাওয়া, ডুবতে ডুবতে গভীরে ডুবে যাওয়া আরও তলায় এবং শেষে কিছু জলের ওপর ফুটকুরি তোলার আওয়াজ—সবটাই এখন নিপুণভাবে টুকুন রিডের ওপর বিস্তার করার চেষ্টা করছে।
আর চার পাশে ওপরে নীচে যত কামরা আছে, যত মানুষ আছে এই প্রাসাদের মতো এক অবিশ্বাস্য সিমফনি একের পর এক বাজিয়ে যাচ্ছে। একটা বাজাচ্ছে—শেষ করছে বাজনা, মিনিটের মতো বিরতি, তারপর আবার, ঝমঝম শব্দ। যেন ভীষণ বেগে প্রপাতের জল নেমে আসছে। বাড়িটা জলের নীচে ডুবে যাচ্ছে। আর নিশ্বাস বন্ধ করে একের পর এক সবাই এসে এবার পার্লারে জড়ো হচ্ছে। পার্লারে সব আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। সবাই মুখোমুখি বসে। কেউ ওপরে যেতে পাচ্ছে না। কেমন এক মুগ্ধতায় সবাই বসে রয়েছে মুখোমুখি। ঝাড়—লণ্ঠনে সব আলো জ্বলছে। দেয়ালের পুরানো পেন্টিং পর্যন্ত সজীব দেখাচ্ছে।
এবং মেয়েটা বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই। সে তার ঘরে খুব অল্প আলো জ্বেলে রেখেছে। একটা মোম জ্বাললে যতটা হয় ঠিক ততটা। সে সেই সিল্কের শাড়িটাই পরে আছে। ওঁর কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়েছে। ওর চুল উড়ছিল পাখার হাওয়ায়। আর ও ভীষণ ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ক্রমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে এবার বাজিয়ে গেল—একদল পাখি উড়ে যাচ্ছে। মেষপালকেরা ঘরে ফিরছে। গোরু—বাছুরের ডাক ভেসে আসছে। বাতাসে নদীর জলে ঢেউ। কেউ যেন সেই জলে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে তার শব্দ। তারপর চুপচাপ বসে থাকলে যে এক নিরিবিলি ভাব থাকে তেমন এক ভাব। কত অনায়াসে যে মেয়েটা এমনভাবে সামান্য কটা রিডে আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে যাচ্ছে।
এবং সব শেষে ওরা শুনছে ক্রমে বাজনা দ্রুত লয়ে উঠতে উঠতে ঝম—ঝম শব্দ। বুঝি যুবক—যুবতী সাঁতরে নদী পার হচ্ছে। এবং নরম ঘাস মাড়িয়ে ছুটছে। তারপর বনের ভিতর আদম—ইভের মতো ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষে জ্ঞানবৃক্ষের ফল থেকে যা হয় এক আশ্চর্য মাদকতা, অথবা মুগ্ধতা এবং অপার বিস্ময়বোধ শরীর সম্পর্কে কী যে ভালো লাগে, ভালো লাগার যেন শেষ থাকে না—অন্তহীন ঈশ্বরের অপার ইচ্ছা শরীরে খেলে বেড়ালে কেমন আবেগে বলার ইচ্ছে—তুমি আমায় দ্যাখো, সবকিছু দ্যাখো, আমাকে তোমার ভিতর নিঃশেষ করে দাও। এই ভাবে সব কিছু নিঃশেষে হরণ করে নিলে মনে আছে টুকুন সুবলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। কত সহজে সে—সবও বাজিয়ে যাচ্ছে!
তারপর এক সময় টুকুন পাশের টুলটাতে বসে পড়ল। এবং পিয়ানোর রিডে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকল। তার এখন আর উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। দরজায় বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন। ডাকছেন, টুকুন। এটা কী হচ্ছে! এত রাতে তুমি এমনভাবে বাজালে আমাদের ভয় লাগে। তুমি দরজা খোল।
ইন্দ্রও বলছে, টুকুন দরজা খোল।
টুকুনের মা বলল, এক অসুখ সেরে অন্য অসুখে মেয়েটা ভুগছে। আমার কী যে হবে!
—কী হবে আবার! টুকুনের বাবা ধমক দিতে গিয়েও ইন্দ্রকে দেখে কিছু বলতে পারলেন না।
—কিছু হবে না বলছ! মানুষ এভাবে কখনও পিয়ানো বাজাতে পারে?
—পারে না?
—টুকুন কতটুকু বাজনা শিখেছে! যে এতেই সে এমন একটা আশ্চর্য লয় তান শিখে ফেলবে।
—এটা তো মনের ব্যাপার। তুমি সব তাতেই এত ভয় পাও কেন বুঝি না।
—না, ভয় পাব না, একটা ডাইন এসে আমার মেয়েটাকে কী করে ফেলল। বলে, দরজায় নিজের কপাল ঠুকতে থাকল।
টুকুন আর বসে থাকতে পারল না; দরজা খুলে বলল, তোমরা এখানে কেন? মার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তুমি কী করছ!
—না এখানে থাকব না। এটা কী বাড়ি না ভূতের বাসা!
—পিয়ানো বাজালে ভূতের বাসা হয়।
মজুমদার সাহেব বাধা দিলেন কথায়। টুকুন মা লক্ষ্মী। তুমি এবার খেয়ে শুয়ে পড়। বাজাতে ইচ্ছা হয় সকালে উঠে বাজিয়ো।
গীতামাসি বলল, আমি সব গরম করে রেখেছি।
টুকুন আর কথা বাড়াল না। বাথরুমে ঢুকে সে সব খুলে ফেলল। শরীর কেন যে এত পবিত্র লাগছে। কেন যে এত হালকা লাগছে। শরীরে যা কিছু মুক্তাবিন্দু সব সে ধীরে ধীরে সাবানের ফেনায় তুলে ফেলল। সুবল এভাবে একটা ফুলের উপত্যকায় কিংবদন্তির মানুষ হয়ে যাবে কখনও যেন টুকুন জানত না। ওর ফুলের গাড়িগুলোর টংলিং টংলিং শব্দ টুকুন এখনও যেন শুনতে পাচ্ছে। এবং ওর চুপচাপ থাকা, বড় লম্বা শরীর, কালো গভীর চোখ, ঢোলা পাঞ্জাবি সব কিছু আর সে ফুলের জগতে আছে বলেই ওর ভিতর এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যেন জেগে উঠেছে। সুবল বলেছে—যা কিছু এখানে দেখছ—আমার বলতে কিছু নেই। যারা কাজ করে তাদের। যা কিছু লাভ অলাভ তাদের। ওরা না থাকলে—এভাবে একটা ফুলের উপত্যকা গড়া যায় না।
টুকুন ভেবেছিল, এটা খুব সত্যি। এবং টুকুনের কাছে এটাই খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে সে এভাবে সবকিছু কবে বিশ্বাস করতে শিখল।
সুবল বলেছিল—এটা একটা আমার অহঙ্কার টুকুনদিদিমণি—মানুষের ভালোর জন্য কতটা দূরে যাওয়া যায় দেখা।
এ—কথাটাও টুকুনের খুব ভালো লেগেছিল। এবং মনে হয়েছিল—একটা বিরাট অসুখের শিকার তার মা—বাবা। কখনও সে মা—বাবাকে শান্তিতে বসবাস করতে দ্যাখেনি। ওর ইচ্ছা হয়েছিল বলতে, আমাদের বাড়িতে এমন একটা সুন্দর ফুলের উপত্যকা গড়তে পারো না। কিন্তু বলতে গিয়ে ও থেমে গেল। কারণ সে তার মায়ের ভয়ঙ্কর দুটো চোখ তখন সামনে ভাসতে দেখেছিল।
আর তখন টুকুনের মা এবং বাবা ইন্দ্রকে গাড়িবারান্দায় ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসছিল। মনে হল ঝি চাকর পাশে কেউ নেই। দু—পাশে ঘরগুলো ফাঁকা। ফরাসে যারা কাজ করে তারা বারান্দায়—মেমসাব ঢুকে গেলেই ওরা সব এদিককার আলো নিভিয়ে দেবে। কেবল বড় একটা আলো জ্বলবে গাড়িবারান্দায়। এবং নিয়নের আলো জ্বালিয়ে রাখা হবে লম্বা করিডোরে।
একটু ফাঁকা পেয়ে আর সবুর সইছে না, টুকুনের মা কঠিন গলায় ডাকল। —শোন।
মজুমদার সাব দাঁড়ালেন।
—কাল আমি ইন্দ্রের বাবাকে কথা দেব।
—কী কথা!
—আগামী আষাঢ়েই বিয়ে। আমি আর একদণ্ড নষ্ট করতে চাইছি না।
—সে তো ভালো কথা।
—কাল থেকে টুকুনের বাইরে বের হওয়া বারণ।
—আবার যদি পুরানো অসুখটা দেখা দেয়।
—সে অনেক ভালো।
—মন খারাপ থাকলে যা হয়, পুরনো দুঃখ ফের ফিরে আসতে পারে।
—এটা হলে আমি বেঁচে যাই।
—মা হয়ে তুমি এমন কথা বলছ!
—আমি আমার মান—সম্মানটা বুঝি। তুমি তোমার কারখানা কারখানা করে সেটা পর্যন্ত হারিয়েছ।
—আর কারখানা থাকছে না।
টুকুনের মার মুখে কেমন ব্যাজার হয়ে গেল।
—সত্যি আর থাকছে না। আমি লক—আউট করব ভাবছি। ওরা স্টে—ইন—স্ট্রাইক করছে। আমি লক—আউটের কথা ভাবছি। দরকার হলে ক্লোজার।
—কিন্তু এসব করলে তুমি খাবে কী, আমরা খাব কী!
—সে দেখা যাবে।
ওরা এভাবে কথা বলতে বলতে ওদের শোবার ঘরের দরজায় চলে এসেছে। দুটো ঘর আলাদা। ওরা এক ঘরে শোয় না। ভিতরের দিকে একটা দরজা আছে—যা ইচ্ছা করলে দুজনেই দুদিক থেকে খুলে ফেলতে পারে। মজুমদার সাব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, খুব ভাবনা হচ্ছে!
টুকুনের মা এখনও যুবতী—লম্বা, চুল কোমর পর্যন্ত এবং চোখে ভীষণ মায়া। আবার এই চোখ কখনও কখনও খুব খারাপ দেখায়। মনেই হয় না টুকুনের মার স্নেহ মমতা বলে পৃথিবীতে কিছু আছে। এবং যা হয়ে থাকে, দুঃখী মুখ করে রাখলে মায়াবী এক ছবি চারপাশে দেখা যায়। তিনি তাঁর স্ত্রীকে দরজাতেই বুকের কাছে টেনে নিলেন। তারপর যা হয় দরজা খোলার তর সয় না। ওরা পরস্পর সংলগ্ন হয়ে যায়। মজুমদার সাব নানাভাবে অভয় দেন—আমি তো আছি, আমার লাইসেন্স আছে। উদ্যম বিহনে পূরে কিবা মনোরথ। মাঝে মাঝে যেমন কবিতাটা আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন, তেমনি এটা আবৃত্তি করে স্ত্রীকে নরম বিছানায় কিছুক্ষণের জন্য উদাসীন করে রাখলেন।
এবং এই উদাসীনতার ফাঁকে শরীরের সব কিছুর ভিতর আছে এক অহমিকা, ঠিক ঠিক জায়গায় হাত দিলে তিনি তা ধরতে পারেন। এবং এভাবে তিনি বেশ কিছু সময় স্ত্রীর শরীরে পার্থিব সুখ—দুঃখ খুঁজে যখন ক্লান্ত, তখন মনে হল চারপাশে কেমন একটা দমবন্ধ ভাব। রামনাথ ওপাশের দরজায় বসে ঝিমোচ্ছে। তাকে ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়ে দেবার আগে বললেন, আমার ঘরের সব জানলাগুলো খুলে দে তো।
দরজা—জানালা খুলে দিলেও ভিতরের কষ্টটা যাচ্ছে না। তিনি টেবিল থেকে একটা গেলাস তুলে জল খেলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। লম্বা সিল্কের শ্লিপিং গাউনের ফাঁকে শরীরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। পেটে তিনি এই বয়সেও চর্বি জমতে দেননি। খুব মিতাহারি। এবং শরীরের প্রতি অধিক যত্নের দরুন নকল দাঁত থাকলেও তাঁকে এখনও যুবা লাগে। খুব যুবা। তিনি অনায়াসে নিজেকে কমবয়সি বলে চালিয়ে যেতে পারেন। যৌবন ধরে রাখার কী প্রাণাক্তকর ইচ্ছা। এবার তিনি প্রথম কেমন নিরালম্ব মানুষের মতো শুয়ে পড়লেন। তিনি ছোট বয়সের কথা ভাবলেন। তাঁর ছোট বয়সে মা তাঁকে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি থাকবেন। পড়াশোনা করবেন। এবং বড় দুঃখের দিন—অনেক দূরে ছিল স্কুল। গ্রাম, মাঠ, কিছু ফলের বাগান পার হয়ে যেতে হত। টিফিনের পয়সা থাকত না। রাস্তায় শীতে অথবা বসন্তে পড়ত খিরাইর জমি, তিনি এবং অন্য সব ছেলেরা মিলে খিরাই চুরি করে স্কুলের টিফিন, অথবা বর্ষার দিনে ছিল শালুক আর শাপলা, গ্রীষ্মে নানারকম ফলপাকুড়—যেমন আম, জাম, জামরুল—এভাবে একটা সময় কেটে গেছে তাঁর। এখন কেন জানি মনে হয় বড় আরামের দিন ছিল সেগুলো। আত্মীয়াটি খুব নিগ্রহ করত তাঁকে। সে—সব এখন তাঁর মনেই হয় না। বরং কী যেন একটা জাঁতাকলে পড়ে সব সময় ভীতু মানুষের মতো মুখ করে রাখার স্বভাব এখন। ভালোভাবে হাসতে পর্যন্ত ভুলে গেছেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় এ—থেকে নিষ্কৃতি পেতে। নিজেই একটা নিজের গোলকধাঁধা বানিয়ে এখন যে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সেই অভিমন্যুর মতো ভিতরে ঢোকার পথটা বুঝি কেবল জানা আছে। বাইরে বের হবার রাস্তা তাঁর জানা নেই।
তারপর গভীর রাতে ঘুম এলে তিনি একটা ভীষণ জড়বৎ মানুষের পৃথিবীতে কিছু অস্থির ছবি একের পর এক দেখে গেলেন। ছবিগুলো তাঁর চোখের ওপর লম্বা হাত—পা—ওয়ালা কঙ্কাল সদৃশ চেহারায় নাচছে। কেউ হয়তো হাত—পা বাড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচছে। এবং সুন্দর এক মেয়ের চেহারা, সে এসেছে তাদের ভিতর নাচবে বলে। কেমন বায়ুহীন, অন্নহীন জগতে সে এসেছে দেবীর মতো। তারপর কী যে মোহে সেই সব লম্বা হাত—পা—ওয়ালা মানুষের ভিতর সে মিশে গেলে দেখতে পেল, ওরও হাত—পা ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কেমন আগুনের ঝড়ো হাওয়ায় ওর সব মাংস খসে পড়ছে। এখানে এলে বুঝি কেউ সঠিক চেহারায় ফিরে যেতে পারবে না। সেও নাচছে কোমর দুলিয়ে, মাঝে মাঝে হাত এত বেশি লম্বা করে দিচ্ছে যে সে ইচ্ছা করলে আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র পেড়ে আনতে পারে। এবং আকাশের সবকটা নক্ষত্র হেলেদুলে যেন একটা খেলা, ওরা বেশ সুন্দর মেয়ে হয়ে যাচ্ছে কখনও। এবং অন্নহীন, বায়ুহীন পৃথিবীতে ওরা আকাশের সব গ্রহ—নক্ষত্র ফুলের মতো পেড়ে পৃথিবীকে শ্রীহীন করে দিচ্ছে। তিনি তাঁর স্ত্রীর মুখও সহসা এদের ভিতর দেখে ফেললেন।
স্ত্রীর মুখ দেখতে পেয়েই মনে হল স্বপ্নটা কুৎসিত। তিনি আরও সুন্দর স্বপ্ন পছন্দ করেন। তবে কীভাবে যে সেই সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায়! তাঁর ইচ্ছা হচ্ছিল—এই বাড়িটা আরও বড় হয়ে যাক। গেটে টুপি পরা দারোয়ান থাকুক। অনেক দাসদাসী, কর্মচারী। পঁচিশ—ত্রিশটা কারখানার মালিক তিনি হতে চান। আজ কলকাতা, কাল সান—ফ্রান্সিসকো এভাবে বিদেশিনীদের নিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টির নীচে বসে থাকা। অথবা চোখের ওপর কেন যে সেই একশো আটতলা বাড়িটা ভেসে উঠছে না। অথচ স্বপ্নের ভিতর তিনি দেখলেন একটা কাচের বোয়েম। বোয়েমটা এক দুই করে অনেক তলা। এত ছোট বোয়েমে এক তলা থাকে কী করে! স্বপ্নের ভিতর গুনতে সময় লাগে না। সেই বোয়েমে তিনি বুঝতে পারলেন একশো আটতলাই আছে। এবং হাজার, দু’হাজার তারও বেশি হবে ফ্ল্যাট। লক্ষের ওপর মানুষের চিড়িয়াখানা। বোয়েমটা একটা দণ্ডের ওপর বসানো। কেমন কেবল চোখের ওপর ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। আর যা দেখা গেল আশ্চর্য! পৃথিবীটা এই একটা বোয়েমের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। এবং তিনি দেখতে পেলেন সেখানে পঞ্চানন দাসের স্ত্রী সুমতির গলায় দড়ি। এটা বোধহয় আত্মহত্যা। তিনি যেহেতু পঞ্চাননকে ডেকে চাকরি দিয়েছিলেন, যদিও এখন পঞ্চানন ইউনিয়ন করে লিডার বনে গেছে, তবু চাকরির সুবাদে তাকে তুই—তুকারি করতে বাঁধে না।
—এটা তোর বউ?
—আজ্ঞে স্যার।
—আত্মহত্যা?
—আজ্ঞে…!
—কেন?
—ঠিক জানি না স্যার। দুপুরের শিফটে খেয়ে কারখানায় গেছি—বউ সুন্দর করে রেঁধেবেড়ে খাইছে। কারখানায় খবর পেলাম যে গলায় দড়ি দিয়েছে।
—নিশ্চয়ই বকেছিলি।
—না স্যার। ইদানীং আমি ওকে কিছু বলতাম না।
—আগে বলতিস।
—আগে কথায় কথায় মারধোর করেছি। অভাব—অনটনে মাথা ঠিক থাকত না। তবে আমাদের খুব মিল ছিল।
—এখন।
—এখন তো আপনার দয়ায় সে—সবের কিছু নেই।
—তবে স্টে—ইন—স্ট্রাইক করেছিস কেন?
—হুকুম স্যার।
—কার হুকুম?
—ইউনিয়নের।
—কত মাইনেতে ঢুকেছিলি?
—ত্রিশ টাকা।
—এখন কত?
—তিনশ’ টাকা।
—ক’ বছরে?
—ছ’ বছরে?
—প্রডাকসান কত বেড়েছে?
—কিছু না।
—কতটা করতে পারিস ইচ্ছা করলে?
—তা দ্বিগুণ। মন দিয়ে কাজ করলে আমরা স্যার কী না করতে পারি?
—মন দিতে কুণ্ঠা কেন?
—যখন হয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে।
—এভাবে বেশিদিন চলে না! আমি ক্লোজার করব।
—ক্লোজার?
—কিন্তু কী কথায় কী কথা এসে গেল। তোর বউটা আত্মহত্যা কেন করল!
—স্যার বলেছি তো জানি না।
—ঠিক জানিস। তিনি এক ধমক লাগালেন। স্বপ্নে বোধহয় তিনি জানেন, ধমক লাগালে পঞ্চানন তেড়ে আসবে না। অথবা ঘেরাও—র ভয় দেখাতে পারবে না। আর বাছাধন তো বেশ আটকে গেছে কাচের বোয়েমে। এখান থেকে বের হবার আর উপায় নেই।
তিনি বললেন, সব জানিস। পুলিশের ভয়ে এখন মুখে কুলুপ দিয়েছিস।
পঞ্চানন চুপ করে থাকল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। তারপর লাশ, পুলিশ নিয়ে গেলে মিনমিনে গলায় বলল, স্যার পয়সা হলে ফটিনস্টি করার বাসনা হয়।
—সেটা কার?
—বউর।
—তোর হয় না?
—হয়। তবে কাজ করে সময় পাই না। কারখানায় কাজ, ইউনিয়নের কাজ করে ফিরতে বেশ রাত হত। বাড়ি ফিরলে সুমতি খুব সতীসাধ্বী মুখ করে রাখত। মুখ দেখলে কেউ তাকে অবিশ্বাস করতে পারবে না। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, তলে তলে সে বেশ একজন নাটকের লোককে ভালোবেসে ফেলেছে। টের পেলে কত বললুম—তুই ভুল করছিস। তোর ছেলেপুলেদের কথা ভাব। তখন স্যার কী বলব, সুমতি কোনও জবাব দিত না। চুপচাপ সংসারের কাজ করে যেত। যেন আমি মিথ্যা মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলছি। সতীসাধ্বী বলে ওর কিছু আসে যায় না।
এবং যখন ফের আত্মহত্যার কথায় এল মজুমদার সাব, তখন পঞ্চানন দাঁত বের করে হেসে দিল। —হ্যাঁ স্যার, এমন একটা করে ফেলেছি। এবং এভাবেই সংসারে টাকাপয়সা বাড়তি ঝঞ্ঝাট বয়ে আসে। কে যেন এমন বলে যাচ্ছিল। পঞ্চাননের এটা সঠিক টাকা রোজগার নয়। সে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে প্রাপ্যের ঢের বেশি আদায় করেছে। সংসারে এখন এসব টাকায় একটা বাড়তি খরচা তৈরি হয়। এবং এভাবেই পাপ এসে সংসারে বাসা বাঁধে।
পঞ্চানন বলল, স্যার আমরা উদ্যমশীল হলে আমাদের এমন অবস্থা হত না।
খুব ভালো লাগল এমন কথা শুনতে। যাক লোকটার ক্রমে চৈতন্যোদয় হচ্ছে। এবং সেই যে লাঠির ওপর, অথবা মনুমেন্টের মতো একটা উঁচু লম্বা লাঠির ওপর বোয়েমটা ঘুরছে এবং নাটক হচ্ছে প্রতি ঘরে, নাটকের কুশীলবদের চাউনি প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছে—ওরা সবাই হাড়গোড় বের করা মানুষ, মজুমদার সাব এসব দেখে ঢোক গিললেন। মনে হল বুকে কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে অন্ধকারে দেখলেন, কেউ তাঁর ঘর থেকে সরে যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, জল।
তারপর যা হয় ডাকাডাকি, লোকজন উঠে এলে, সবারই মুখে এক কথা, কী করে এ—ঘরে কেউ ঢুকতে পারে। তিনি বলে চলেছেন, জানো আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে।
এভাবে স্বপ্নের ভিতর একটা ভীষণ অবিশ্বাস দানা বেঁধে যায় মানুষের মনে। মজুমদার সাবকে সকাল বেলাতে কেমন যেন খুব বিমর্ষ দেখাতে থাকল। তিনি আর রাতে ঘুমোতে পারেননি। স্ত্রীকে বলেছেন ডেকে, সে যেন তাঁর পাশে শোয়। পাশে শুলেও ভয়টা কিছুতেই গেল না। কেমন সারারাত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। লাইসেন্সের জন্য মনে খুব উৎকণ্ঠা ছিল। এবং কারখানার লক—আউটের ব্যাপারেও একটা ভয়াবহ টেনসান যাচ্ছে। এসব মিলে তিনি রাতের ঘটনার কার্যকারণ মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারলেন—হিসাব ঠিক মিলছে না। তাঁর ভয়টা ক্রমে আরও বেড়ে গেল। সকালে খবর এল, সত্যি গত রাতে গলায় দড়ি দিয়ে পঞ্চাননের বউ আত্মহত্যা করেছে।
এবং এমন খবরেই মজুমদার সাবের আবার কেমন দম বন্ধ হবার উপক্রম। তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। আবার মনে হচ্ছে গলায় শ্বাসকষ্ট। ঠিক রাতের মতো অবস্থা। ডাক্তার এসে বলল, আপনাকে এবার কেবল শুয়ে থাকতে হবে। বিছানা থেকে একদম উঠবেন না। নড়াচড়া একেবারে বারণ।
মজুমদার সাব বুঝতে পারলেন হার্টটা তাঁর একেবারে গেছে। তাঁর হার্টের যখন অসুখ, এবার সংসারে এত যেসব করছেন, কেন যে করছেন, বরং এখন টুকুনকে ডেকে বললে হয়, মা তুই পারবি না, তোর সেই ফুলের উপত্যকাতে নিয়ে যেতে। যেখানে মানুষেরা নিজের জন্য ভারী সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা তৈরি করছে। আমারও ইচ্ছা ছিল এমন। কিন্তু কীভাবে যে আমি একটা কাচের বোয়েমের ভেতরে বাস—করা মানুষ হয়ে গেলাম।
মজুমদার সাব বুঝতে পারছিলেন, ওপরে আবার কেউ নানারকম ঝংকার তুলে নানাভাবে আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে তুলছে। তাঁর ভীষণ ভালো লাগছিল শুনতে। মানুষেরা সব সময় সুন্দর সব সিমফনি গড়তে চায়। গড়ায় স্বপ্ন থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পারে না। কেন যে সে একটা অসুখে পড়ে যায়!
একুশ
সকালবেলা যখন এমন অবস্থা, যখন টুকুন বাবার পাশে বসে আছে এবং টুকুনের মা ভীষণ বিশ্বস্ত মুখে কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তখন মনেই হল না, সংসারে স্বামী স্ত্রীতে এতটুকু অবিশ্বাস আছে। বরং অসুখটা যেন দুজনকে সহসা বারমুখী থেকে ঘরমুখী করে দিল। এবং এমন একটা অসুখ নিয়ে মজুমদার সাবকে চিরদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, টুকুনের মা চিরদিন এবার নীরবে মানুষটাকে সেবাশুশ্রূষার সুযোগ পাবে। এত বছর গেছে, এমন একটা সুযোগ যেন তার এই প্রথম। ফলে সে খুব যত্ন নিয়ে দেখাশোনা করে যাচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যে দুজন নার্সের কথা উঠেছে, এবং ওদের নিয়োগের ব্যাপারে বাইরের ঘরে কথাবার্তা চলছে তখন টুকুনের মা ভাবছে—এসব নার্স—টার্স কী দরকার, সে নিজেই যখন আছে তখন অনর্থক, নিজের মানুষটাকে পরের হাতে ছেড়ে দেওয়া কেন! তারপরই মনে হল হাতের কাছে কাজের লোক থাকলে মন্দ হয় না। সুতরাং সকালবেলাতে যে একটা জরুরি কথা ছিল টুকুনকে বলার, সেটা বুঝি আর বলা হল না। ইন্দ্রের বাবাকেও যে বলার ছিল কিছু, এখন এই অসময়ে আর কী হবে বলে, বরং তিনি ভালো হয়ে উঠুন, তারপর সব করা যাবে।
কিন্তু মজুমদার সাব কথাটা ভোলেননি। তিনি দেখলেন খুব বিষণ্ণ মুখে বসে আছে টুকুন। সকালবেলাতে এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে। নাকে মুখে এসে চুল উড়ে পড়ছে। এবং রাতে একেবারে মেয়েটার ঘুম হয়নি বোঝা যাচ্ছে। চোখ ভীষণ ভিতরে ঢুকে গেছে। হয়তো টুকুন ওর মার চেঁচামেচি থেকে টের পেয়েছে, এবাড়ি থেকে তাকে আর একা বের হতে দেওয়া হবে না। এমনকি, গাড়িতে ড্রাইভার থাকবে। সে আর একা ইচ্ছামতো ঘুরতে পারবে না। মেয়েটার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় মজুমদার সাবের। অথচ কেন যে মেয়েটা এভাবে একটা ফুলের উপত্যকায় হেঁটে যাবার আকর্ষণে পড়ে গেল। চারপাশে টুকুনের কত সুন্দর সুন্দর ছেলেরা আছে, কত বড় বড় পার্টিতে তিনি মেয়েকে নিয়ে গেছেন অথচ, একেবারে উদাসীন টুকুন। কিছুতেই টুকুন তার বন্য স্বভাব ছাড়তে পারছে না।
মজুমদার সাব বললেন, তুমি এত চুপচাপ কেন টুকুন?
টুকুন বোকার মতো একগাল হেসে দিল। অর্থাৎ বাবাকে সে অভয় দিতে চাইল যেন, কোথায়? আমি তো বেশ হইচই করে আছি বাবা।
মজুমদার সাব এবার হেসে বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব টুকুন।
—তোমার কিছু হয়নি বাবা। ডাক্তারবাবু অনর্থক তোমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
ওমা, একি কথা! এ যে দেখছি টুকুন একেবারে সুবলের মতো কথা বলছে।
টুকুন ফের বলল, তুমি বাজে দুশ্চিন্তা ছেড়ে দাও, দেখবে ভালো হয়ে যাবে!
এখানে যেন টুকুন কোথায় প্রায় ডাক্তারসুলভ কথা বলে ফেলল। সেতো এ—বাড়ির মেয়ে। সে টের পায় সংসারের জন্য বাবাকে অনেক পাপ কাজ করতে হয়। এমন একটি স্ট্যাটাসের ভিতর বাবা উঠে এসেছেন যে তার জন্য তিনি সারাটা দিন কী না করছেন। বাবা কোথায় কীভাবে কী করছেন সে জানে না, কিন্তু বাবার মুখ দেখে সে টের পায়, উদ্বিগ্ন চোখেমুখে বাবার এক অতীব ভয়। সব সময় যেন তিনি জীবনে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। সবকিছু ঠিকঠাক রেখে যাবার জন্য বাবার এই সব পাপ কাজ, বাবাকে খুব সহসা প্রাণহীন করে দিল।
টুকুন বলল, বাবা তুমি একটু ভালো হয়ে ওঠো। ভালো হলে তোমাকে রোজ বিকেলে এক জায়গায় নিয়ে যাব। সেখানে গেলে তুমি নিরাময় হয়ে যাবে।
টুকুন ‘ভালো হয়ে উঠবে’ না বলে ‘নিরাময়’ কথাটা ব্যবহার করল। নিরাময় কথাটা বলতে তার কেন জানি এ—সময় ভালো লাগল।
অর্থাৎ একদিনেই টুকুনের আশ্চর্য বিশ্বাস জন্মে গেছে, মানুষ নিজেই পারে এই আশ্চর্য সুন্দর জগৎ তৈরি করতে—যেখানে মানুষ এতটুকু নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে না। সেখানে সবাই সবার জন্য ভাববে। এবং এমন একটা জগৎ এভাবে তৈরি হয়ে যাবে একদিন। অহেতুক ভয় থাকবে না। ভয় থেকে কোনও অসুখ জন্মাবে না। বাবার অসুখটা সে বুঝতে পেরেছে ভয় থেকে হয়েছে। সব সময় এক ভয়, যা কিছু আছে মানুষেরা লুটেপুটে নিয়ে যাবে।
আবার সে বলল, বাবা ওখানে গেলে সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে।
টুকুনের মার যেন এতক্ষণে মনে পড়ল কথাটা। সে বলল, টুকুন তুমি বড় হয়েছ। এখন আর একা কোথাও যাবে না! বাড়ি থেকে বের হবে না।
টুকুন বুঝতে পারল মা তাকে সেই ফুলের উপত্যকায় যেতে বারণ করছে। কিন্তু সেই ফুলের উপত্যকার কথা মনে হলেই কেমন তার চোখ বুজে আসে। সে যদি যায়, মা ভীষণ অশান্তি করবে। এবং এই অশান্তি বাবার পক্ষে আরও ক্ষতিকারক। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা না বললে আমি আর কোথাও যাব না।
সে বাবার জন্য এই সংসারে কোনও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় না।
এবার টুকুন উঠে ওপরে চলে গেল। সকালে মুখ ধুয়ে সে এক গেলাস ফলের রস খায়। ঘরে গিয়ে দেখল, গীতামাসি সব ঠিক করে রেখেছে। ফলের রস খেতে তার ভীষণ বিস্বাদ লাগল। সে এখন এ বাড়িতে প্রায় বন্দি জীবনযাপন করবে, কোথাও গেলেই মার ধারণা হবে, সেই ফুলের উপত্যকায় সে চলে গেছে!
এভাবে বাড়িতে সে কিছুদিন আটকা পড়ে গেল। হেমন্তের শেষাশেষি বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। কারখানা ক্লোজারের পর খুব বাড়াবাড়ি গেছিল ক’দিন, এখন বোধ হয় ওটা সামলে উঠেছেন। ইউনিয়নের তরফের লোক এসে দেখা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ডাক্তারের দোহাই পেড়ে ওঁর সেক্রেটারি তা ঠেকিয়ে রেখেছেন।
যেমন টুকুনকে নিয়ে বাবা—মা একদিন সব পাহাড়ি জায়গায় শরীর ভালো করবার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, তেমন টুকুন তার বাবাকে নিয়ে নানা জায়গায় ক’মাস থেকে এল। যেমন কিছুদিন ওরা ছিল নৈনিতালে। দেরাদুনেও গেছে। অর্থাৎ এভাবে যাবতীয় পাহাড়ি জায়গায় আশ্রয় নিয়েও যখন দেখেছে বাবার শরীরে সম্পূর্ণ নিরাময়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না তখন ফের ফিরে আসা।
মাঝে মাঝে টুকুন বাবার পায়ের কাছে বসে থাকত। বাবা বুঝতে পারতেন, টুকুন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে ফের। বাবার রুগণ মুখে টুকুন তা ধরতে পারলেই হেসে দিত। বলত, বাবা আমি কত যে চেষ্টা করছি, চুপচাপ আগের মতো শুয়ে থাকলে কেমন হয়, সেই আগের মতো নিঃসাড় পড়ে থাকতে গিয়ে দেখেছি একেবারেই ভালো লাগে না শুয়ে থাকতে। তোমাকে বলিনি বাবা, বললে কষ্ট পাবে, ভেবেছি, কম খেয়ে না খেয়ে শরীর দুর্বল করে ফেললেই আগের অসুখটা ফের আমাকে আশ্রয় করবে। কিন্তু বাবা তোমাকে কী বলব, একবেলা না খেলেই চোখে অন্ধকার দেখছি। তখন গীতামাসিই হেসে বাঁচে না।
একটু হেসে টুকুন আবার বলল, আমার আর অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া হবে না। এভাবে সারা মাস ঘরে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে আমার অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া ভালো ছিল বাবা। তোমরা আমাকে আর সেখানে যেতে দাও না।
মজুমদার সাব বুঝতে পারেন টুকুন মায়ের উপর অভিমান করে এমন একটা অসুখের ভিতর ফের ফিরে যেতে চাইছে। তিনি বললেন, তুমি ভারী বোকা মেয়ে। বিয়ে হলে দেখবি, এসব অভিমান আর থাকবে না।
টুকুন বলল, বাবা আমার বিয়ের জন্য তোমরা এত ভাবছ কেন। যাকে আমার পছন্দ নয়, তার সঙ্গে কেন তোমরা আমাকে জুড়ে দিতে চাইছ?
কেমন মনটা খারাপ হয়ে যায় এমন কথা শুনলে। কিন্তু মেয়ের জেদ। মজুমদার সাব চুপ করে থাকেন।
টুকুন বুঝতে পারে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বলল, ঠিক আছে তোমাদের যা ইচ্ছা তাই হবে।
মজুমদার সাব সেই বিকেলেই বললেন, তুই যে বলেছিলি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি। সেখানে গেলে আমি ভালো হয়ে যাব।
—তুমি যাবে বাবা?
—যাব। কিন্তু তোর মা যদি জানে!
—তবে তুমি জানো কোথায় নিয়ে যাব তোমাকে?
—জানব না!
—কী করে বুঝলে আমি তোমাকে আমাদের সেই ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যাব?
—পৃথিবীতে মা তুই তো একটা জায়গার কথাই ঠিক জানিস। টুকুন কেমন মাথা নীচু করে রাখল।
—একটু যা মিথ্যে কথা বলতে হবে।
—কী মিথ্যে!
—বলবি, আমাকে নিয়ে তুই হাওয়া খেতে যাচ্ছিস মাঠে।
—বলব।
—বলবি আমরা গ্রাম মাঠ দেখে বেড়াচ্ছি।
—বলব।
—বলবি গ্রাম মাঠের ভিতর দিয়ে গেলে নির্মল বাতাস বুক ভরে নেওয়া যায়।
—বলব বাবা।
—আর বলবি ডাক্তারের পরামর্শমতো সব হচ্ছে।
—বলব।
ডাক্তার এলে মজুমদার সাব ফিস ফিস করে বললেন, একভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না হে ডাক্তার। সকালে বিকেলে গাড়িতে ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়। এই যেমন ধরো, বেহালার ভিতর দিয়ে গিয়ে যদি ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়ি। অথবা ফুলবাগান হয়ে কাঁকুড়গাছি পার হয়ে সোজা সলট লেক, লেক টাউন পিছনে ফেলে এরোড্রাম পার হয়ে বারাসাতের রাস্তায় চলে যাই।
—খুব ভালো। ঘুরে বেড়ান না। এতে যদি মন ভালো থাকে ক্ষতির তো কিছু দেখছি না।
—তুমি একবার তোমার বউদিকে বুঝিয়ে বলো। ও তো বিছানা থেকে উঠতেই দিতে চায় না। ডাক্তার হেসে বলল, বলব।
—আমার টুকুন মা আছে, ভারী সুন্দর গাড়ি চালায়। কাজেই বুঝতে পারছ, আজে বাজে ড্রাইভিং হবে না।
ডাক্তার বলল, ঠিক আছে। আপনার এখন খিধে কেমন?
—কিছু না। এখন মনে হয় হাওয়া খেয়ে পেট যে ভরে প্রবাদটা একেবারে মিথ্যা না।
ডাক্তার কিছু ওষুধ পালটে দিল। টুকুনের মা এলে বলল, বউদি, দাদার একটু বেড়ানো দরকার। বাড়িতে বসে থাকলে মন মেজাজ দুই—ই খারাপ হবার কথা। টুকুন ওঁকে নিয়ে সকাল—বিকেল গ্রাম মাঠ দেখে এলে মনটা প্রফুল্ল থাকবে। দেখা গেছে অসুখ অনেক সময় এভাবে সেরে যায়।
টুকুনের মা বলল, আমার সঙ্গে থাকা দরকার। ঝি—চাকর দিয়ে কী সব হয়! টুকুন কী সব বোঝে!
মজুমদার সাব হেসে ফেললেন, তুমি সেই সেকেলে আছো। এখনকার মেয়েরা অনেক কম বয়সেই সব শিখে ফেলে। কী বলো হে ডাক্তার? টুকুন তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে। সে না পারলে আর কে পারবে।
এভাবেই ঠিক হয়ে যায় টুকুন যাবে। আর যাবে মজুমদার সাব। সঙ্গে থাকবে পুরানো চাকর রামনাথ। ইন্দ্র ঘ্যান ঘ্যান করছিল—সেও যাবে। কিন্তু মজুমদার সাব সব জানেন বলে বললেন, ইন্দ্র তোমাদের ক্লাব এবার সেমিফাইনালে উঠেছে। সবটা তোমার কৃতিত্ব। ফাইনালে ওঠা চাই। আমাদের সঙ্গে বিকেলে কাটিয়ে দিলে দেখবে—ওই পর্যন্ত। এবার যে শিল্ড ঘরে তোলা চাই।
মজুমদার সাব এভাবে বেশ ম্যানেজ করে এক বিকেলে বের হয়ে পড়লেন।
ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর করে তিনি গাড়ি—বারান্দায় এলেন। টুকুন এবং রামনাথ দুপাশে দাঁড়ালে তিনি ওদের কাঁধে ভর করে সিঁড়ি ভাঙলেন! দুপাশে সব বাড়ির এবং অফিসের কিছু আমলা কর্মচারী, ফরাসের লোক খাস খানসাম রামনাথ সবাই মিলে বড়কর্তা বিকেলে যে বের হচ্ছেন এবং মানুষটি অসুখে ভুগলে কী যেন একটা ভয়—এতবড় বাড়ির বৈভব আর থাকবে না, সামনে কৃত্রিম পাহাড়ের পাশে ছোট্ট হ্রদ, হ্রদে কিছু পাখপাখালি এমন শৌখিন বাড়ি এ—তল্লাটে হয় না অথচ এখন এমন বাড়িটা ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। দুবছরের ওপর কারখানা ক্লোজার, দুবছরের ওপর এভাবে সাব বাড়িতে শুয়ে আছেন, দুবছরের ওপর, কারখানার শ্রমিকেরা স্টেশনে স্টেশনে কৌটো ফুটো করে পয়সা মাগছে—এসব দৃশ্য সবার মনে পড়ে গেলে ভারী খারাপ লাগে।
গাড়িতে মজুমদার সাব সামনে বসেছেন। পাশে টুকুন। টুকুনের চুল শ্যাম্পু করা। ঘাড় পর্যন্ত চুল পরিপাটি বিছানো। মনে হয় দেবদেবীর চুলের মতো—কী কোমল আর মিহি, হাত দিলে যেন ছোঁয়া যায় অথবা চুল শ্যাম্পু করা থাকলে আকাশের মতো ভারী দেখায় মুখ। চুলের ভিতর আছে আশ্চর্য এক গন্ধ। টুকুন পরেছে হালকা চাঁপা রঙের শাড়ি। শাড়িতে লতাপাতা আঁকা এবং নানা রকমের বর্ণাঢ্য শোভা—এমন একটা শাড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এবং মজুমদার সাব বেশ লক্ষ্য করে বুঝেছেন, মেয়ের খুব পছন্দ আছে—কী রঙ ওকে মানায় সে যেন জানে। আশ্চর্য স্নিগ্ধ স্বভাবের মনে হচ্ছে টুকুনকে। এবং শাড়ির এমন রঙের সঙ্গে ও শরীরের কোমল আভা অথবা বলা যায় লাবণ্য একেবারে মিলেমিশে গেছে। হালকা প্রসাধন পর্যন্ত। ঠোঁটে যে সামান্য রঙ তাও এত স্বাভাবিক যে মানেই হয় না টুকুন ঠোঁটে রঙ লাগিয়েছে। বরং এটুকু না লাগালেই ওকে যেন এই পোশাকের ভিতর সামান্য শ্রীহীন করে রাখত।
আর এভাবে এক মেয়ে—বোধ হয় এটা হেমন্তকাল—বেশ গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। সে দোকান থেকে ফুল আনার সময় সুবলের কিছু খোঁজখবর রেখেছে। কারণ শহরের সব ফুলের দোকানগুলো বলে দিতে পারে সুবলের কথা, সুবলের ফুল একদিন এই শহরে না এলে সব অন্ধকার দ্যাখে, সেই সুবলের খোঁজখবর সব তার কাছে থাকবে সে আর বেশি কী—এবং এভাবে সেও তার খোঁজখবর সুবলকে দিয়ে গেছে। সুবলের ওইটুকুই লাভ। সে টুকুনদিদিমণির চিঠি অতি যত্নে রেখে দিয়েছে। সে তার জন্য তপোবনের মতো আলাদা একটা আশ্রম করে দিয়েছে। বুড়ো মানুষটা মারা গেছে গত শীতে।
কাঞ্চন ফুলের চারপাশে সবুজ ঘাসের কাঠা চারেকের মাঠ। সেখানে ঘাসের ছায়ায় কাঞ্চন সৌরভে বুড়ো মানুষটা আছে। তার কবর শান বাঁধানো। কাঞ্চন ফুল দিন—রাত পাঁপড়ি ফেলছে সেখানে। বিকেলে যখন হাতে কোনও কাজ থাকে না, সুবল সেই ঘাসের ভিতর কাঞ্চন গাছটার নীচে চুপচাপ বসে থাকে। এসব খবর টুকুনদিদিমণিকে সে তার লোক মারফত জানিয়েছে। সে চিঠি লিখতে আজকাল পারে। কিন্তু হাতের লেখা এত খারাপ যে দিদিমণিকে চিঠি লিখতে লজ্জা পায়। টুকুনদিদিমণির সঙ্গে কতদিন দেখা নেই—বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না, সে যেন বুঝতে পারে টুকুনদিদিমণি বারান্দায় অথবা রেলিং—এ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারলেই ওর ভীষণ কষ্ট হয়—সব ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা হয়—কী এক আকর্ষণ শরীরে তার—কিন্তু টুকুনদিদিমণির অপমান ওর কাছে আরও কষ্টকর। এখন তো সে আর আগের মতো পাঁচিল টপকে যেতে পারে না। সে কেমন যেন ক্রমে স্বভাবে শহরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলো শহরে ফুল নিয়ে যাচ্ছে—তাদের টংলিং টংলিং শব্দ কানে এলে চোখ বুঝে পৃথিবীর যাবতীয় সুষমা সে শুষে নিতে পারে। এবং টুকুনদিদিমণির আশ্চর্য ভালোবাসা সে তখন ভিতরে ভিতরে বড় বেশি অনুভব করতে পারে।
মজুমদার সাব বললেন, তোর সুবল বাওবাব গাছ দিয়ে কী করবে রে টুকুন?
টুকুন এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। বলল, বাওবাব গাছের কথা তুমি কী করে জানলে?
—সে জেনেছি।
—ওটাতো বাবা একটা গল্পের গাছ।
—মানে!
—মানে ছোট্ট রাজপুত্রের একটা দেশ আছে। সেটা একটা ছোটো গ্রহাণু। শিশুদের জন্য লেখা গল্প। সেখানে বাওবাব গাছের কথা আছে।
—তুই জানিস না, বাওবাব বলে সত্যিকারের গাছ আছে। জায়গায় জায়গায় নামটা পালটে যায়।
এখানে রাস্তাটা একটা বড় পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে বলে টুকুনকে খুব ধীরে ধীরে টার্ন নিতে হল। এখন হেমন্তকাল বলে বেশ শীত শীত ভাব। চারপাশে ধানের জমি। কাঁচা পাকা ধানের মাঠ। চাষিরা মাঠের আলে আলে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। কারণ বোঝাই যায়—ধান তোলার সময় হয়ে আসছে। খুব খুশি ওরা, ফসল ভালো, এবং এভাবে এই মাঠের সব জমি, চাষিদের মুখে আকাশের নীলিমা এবং কিছু পাখির কলরব টুকুনকে ভীষণভাবে আপ্লুত করছে। সে বাবার শেষ কথাটা ঠিক মন দিয়ে শুনতে পায়নি।
মজুমদার সাব ফের বলে যাচ্ছেন—আমি একটা বইয়ে পড়েছি, কেনিয়াতে কাণ্ডুরার জঙ্গলে এই গাছ আছে। ছবিতে যা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের দেশে বাবলা গাছের মতো। আমার মনে হয় সুবল সেজন্য বাওবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে।
—আমি ঠিক জানি না বাবা। সুবলকে জিজ্ঞাসা করে দেখব।
—তোর মনে আছে যখন প্রথম সুবল গাড়িতে উঠে এসেছিল?
—মনে আছে বাবা।
—খুব হাসি পেত দেখলে! ওর পাখিটার খবর কীরে?
—সে ওটা ছেড়ে দিয়েছে বাবা।
তারপর ওরা সেই ফুলের উপত্যকাতে ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিল। বড় রাস্তা। তারপরই উঁচুনীচু মাঠ, চন্দনের গাছ, এবং নানারকম লতাগুল্মের বন। বনের ভিতর দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে, একটু বন থেকে বের হলেই সামনে এক বিস্ময়কর দেশ। নানা জায়গায় নানা ফুল। ওরা দূর থেকেই ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। এতসব ফুলের গন্ধ মিলে, যেমন গোলাপ, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজ, চামেলি, চাঁপা, বেল ফুল এবং টগর, জুঁই—কত যে সব ফুল এবং ফুলের বাস।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন সুবল এখন একটা দেশের রাজা।
টুকুন বলল, না বাবা, সে রাজা নয়। সে বলে, সে এর কিছু নয়। যারা কাজ করে তারাই সব। এবং সে দেখেশুনে বেড়ায় বলে তার একটু থাকবার জায়গা ওরা দিয়েছে। ওই যে দূরে দেখছ, উঁচু জায়গায় আশ্রমের মতো ঘর, ওখানে সুবল থাকে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না, টংলিং টংলিং শব্দ, দেখতে পাচ্ছ না, তুমি দেখতে পাবে না, ওপাশের রাস্তা দিয়ে একটা ফুলের গাড়ি চলে যাচ্ছে। তোমার কষ্ট হচ্ছে নাতো হাঁটতে? আমি তোমাকে ধরব?
মজুমদার সাবের এই প্রথম মনে হল তাঁর শরীর ভালো নেই। এভাবে হেঁটে যাওয়া ঠিক না, কিন্তু আশ্চর্য তার কষ্ট হচ্ছে না, তিনি বেশ হেঁটে যেতে পারছেন।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন আমি বেশ হেঁটে যেতে পারছি রে।
—আমি তোমাকে ধরব!
—কী বললি!
—তুমি যদি পড়ে টড়ে যাও?
—সুবলটা কোথায়?
—এখন সূর্য অস্ত যাবার সময়। সে হয়তো যারা খাটে তাদের এখন আগামী কাজকর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওদের টাকাপয়সা, সে এখানে নতুন দেশ গড়েছে বাবা। মানুষের জন্য একটা ভালো আবাস তৈরি করেছে।
মজুমদার সাব হেঁটে যাচ্ছিলেন। যেন ভিতরে থাকে মানুষের এক দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছা, সেই শৈশব থেকে স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবার স্বপ্ন, সব তাঁর হয়েছে, অথচ কোথায় যেন তিনি মানুষের চিরটা কাল অনিষ্ট করে বেড়িয়েছেন। সুবলের মতো তার জীবনেও ছিল অসীম দুঃখদারিদ্র্য—তিনি তা জয় করতে গিয়ে এটা কী করে ফেলেছেন! বড় হতে যাওয়ার মানে কেমন বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। সুবলকে দেখে, সুবলের উপত্যকা দেখে তাঁর মনে হল, পৃথিবীতে এভাবে বড় হলে অনেক পাপ থেকে মানুষ বেঁচে যায়। তিনি কেমন এবার দ্রুত হাঁটতে থাকলেন। সেই কুটিরে ওঁর যাওয়া চাই। সেখানে গেলেই বুঝি তিনি আশ্চর্যভাবে ঠিক ঠিক নিরাময় হয়ে যাবেন।
বাইশ
এভাবেই এখানে প্রতিদিন সূর্য ডোবে। ও—পাশের বনের ভিতর মনে হয়, সূর্য হারিয়ে যায়। কখনও হলুদ রঙ নিয়ে, কখনও বেগুনি অথবা নীল নীলিমাতে আগুন ছড়িয়ে সূর্য রোজ ও—পাশের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। বনের পাখিরা ডাকে। নদীতে বড় বড় গাছের ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসে এবং এভাবে পৃথিবী ক্রমে অন্ধকার হয়ে ওঠে।
সুবল লোকজনের বিদায় করে নিজের আশ্রমের মতো ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। সে দেখতে পায় পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে, নদীর জলে অন্ধকার নেমে আসছে। এ সময় মনে হয় কেউ আসবে, ঠিক পালিয়ে চলে আসবে, সে তাকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারে না। এমন একটা আশ্চর্য ফুলের উপত্যকা আর কোথাও নেই সে জানে। আর তখনই মনে হয় দূরে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠেছে টুকুনদিদিমণি। এমন ফুলের উপত্যকা পেয়ে টুকুনদিদিমণি প্রায় যেন ভেসে ভেসে চলে আসছে। সে চোখ মুছে ফের উঠে দাঁড়াল। না, সে অলীক কিছু দেখছে না, ওর ভিতরটা কী যে করছে! টুকুন, হালকা বাদামি রঙের প্রায় ফুলের গাছগুলো মাড়িয়ে ছুটে আসছে। সঙ্গে কেউ আছে, বয়সি মানুষ, তিনিও যুবকের মতো হেঁটে আসছেন। সুবল বুঝতে পারছে না, টুকুনের সঙ্গে কে আসছে! তার বারান্দা ফুলের ডালপালায় ঢাকা। ওর ভিতর থেকেই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, টুকুনদিদিমণি, আমি এখানে।
এখন হেমন্তের সময়। হেমন্তে ফুলের চাষ তেমন জমে না। মানুষজন যারা আছে, খেটে খেটে হয়রান, পাম্পে জল তুলে আনছে, নদী থেকে জল এনে অসময়ে সে যা চাষাবাদ করছে ফুলের, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। দূরে দূরে সব সাদা কোঠাবাড়ি, ছবির মতো উজ্জ্বল এক ছোট্ট ছিমছাম শহর যেন। পাকা রাস্তা চলে গেছে উপত্যকার ভিতর দিয়ে। নানা জায়গায় সব জলের ফোয়ারা এবং অসময়ে সব ফুলেরা ফুটে আছে। শীতে সে মাইলের পর মাইল গোলাপের চাষ করে থাকে, কে কত বড় গোলাপ ফোটাতে পারে—সুবলের কাছে কে কত বড় মানুষ তার দ্বারা প্রমাণ হবে। আমি এক মানুষ, আমার আছে এক বড় অহঙ্কার, ফুলের মতো ফুল দ্যাখো কী করে চাষাবাদ করে গড়ে তুলেছি। সুবলের মনে হল তখন, টুকুনের কেউ এসেছে সঙ্গে। ওরা, চাঁপা ফুলের যেসব সারি সারি গাছ আছে তার নীচে দিয়ে হাঁটছে। মেহেদি পাতার গাছ চারপাশে সবুজ হয়ে থাকে বলে কীযে সুন্দর লাগে সুবল যখন হেঁটে যায়। লম্বা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, ঢোলা সাদা রঙের পাজামা আর ঘাসের চটি, সুবলকে তখন কেমন বনের দেবতা টেবতা মনে হয়!
সুবল কাঞ্চন গাছের নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দুটো একটা কাঞ্চন ফুল এখনও ফুটছে। সাদা পাঁপড়ি বুড়োমানুষটার সমাধিতে পড়ছে। আর চারপাশে কী সবুজ ঘাস, ঘাসে এখন সব সাদা ফুল, সব ফুলগুলোই যেন বলছে, আমরা বুড়োমানুষটার হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব। ফুলগুলো দেখলে সুবলের এমনই মনে হয়। সে আর সেখান থেকে বেরতে পারে না।
সুবল কাঞ্চনের ডাল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলতেই দেখল, ও আর কেউ নয়, টুকুনের বাবা। সে প্রথমেই অবাক, তারপর কেমন অস্বস্তি, তারপর মনে হল বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাওয়ার শামিল, বোধ হয় এক্ষুনি তিনি তাকে তাড়া করবেন, অথবা যেমন তিনি মানুষের সূর্য বগলদাবা করে পালাচ্ছিলেন, এখানে তিনি তেমন কিছু করে ফেলবেন। দূরে নদীর পাড়ে তার দামি গাড়িটা। ডিমের মতো ঘাসের ওপর ভেসে আছে গাড়িটা। সূর্যাস্ত, বনের ছায়া, নদীর জল, সব মিলে সাদা রঙের গাড়িটাকে অতিকায় রাজহাঁসের ডিম ছাড়া ভাবতে পারছে না সুবল। টুকুনের বাবাকে দেখে সে সত্যি ঘাবড়ে গেছে। সে আর পালাতে পর্যন্ত পারল না। ফুলের উপত্যকায় সে একজন বনবাসী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
অথচ তিনি কাছে এসে বললেন, বাওবাব গাছ এনেছি হে।
সুবল ভেবে পেল না এমন কথা কেন! বলল, বাওবাব গাছ!
—কেন টুকুন যে বলল, তোমার এমন সুন্দর ফুলের উপত্যকাতে একটা বাওবাব গাছ না থাকলে মানাচ্ছে না।
সুবল কেমন সহজ হয়ে গেল। ওর আর টুকুনের বাবাকে ভয় থাকল না। সে ভেবেছিল, আবার কী ঘটেছে, টুকুনকে নিয়ে কী অশান্তি দেখা দিয়েছে সংসারে যে, টুকুনের বাবা এখানে পর্যন্ত ছুটে এসেছেন! সে তো আর যায় না। টুকুনের মা ওর যাওয়া পছন্দ করেন না, এ—নিয়ে বড় অশান্তি গেছে, সে টুকুনকে যেহেতু টুকুনদিদিমণি ডাকে, সেজন্য তার কোনও অশান্তি ভালো লাগে না। সে দেখল তখন টুকুনও কেমন সহজ হয়ে গেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে বলছে, তুমি আমাকে বলতে না, একটা বাওবাব গাছ পেলে এই উপত্যকাতে লাগিয়ে দিতে।
—কিন্তু সে তো রূপকথার গাছ। ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে পাওয়া যায়।
টুকুনের বাবা বললেন, ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে যা পাওয়া যায়, এখানে তা থাকবে না সে কী করে হয়?
সুবল বলল, আজ্ঞে তা ঠিক। আমার খুব ইচ্ছা—পেলে লাগাই। তবে রূপকথার গাছ তো, পাওয়া যায় না। যা কিছু ভালো, এই ফুলগাছ, লতাপাতা সব এনে লাগাতে ইচ্ছা হয়। তবে গল্পের গাছ তো পাওয়া যায় না। টুকুনদিদিমণি জানে সব। ওটা একটা অন্য গ্রহের গল্প।
—এসো। বলে তিনি সুবলের আশ্রমের মতো ঘরটার দিকে হাঁটতে থাকলেন। হাঁটতে হাঁটতেই বললেন, সব গ্রহের গল্পই আমরা বানিয়েছি। ছোট্ট রাজপুত্রের গ্রহটাতে একজনের মতো থাকার জায়গা আছে।
—তা আছে।
—ওর একটা ভেড়ার বাচ্চা আছে।
—তাও আছে।
—ওর গ্রহের সমুদ্র শুকিয়ে যাবে ভয়ে পাতায় ঢেকে রাখে।
—তা রাখে। আসলে আমরা চাই যে গ্রহেই মানুষ থাকুক, ঈশ্বর তার থাকা খাওয়ার নিরাপত্তা রাখবেন। রাজপুত্রেরও তা ছিল।
সুবল ভেবে পাচ্ছে না এমন সুন্দর সুন্দর কথা টুকুনের বাবা কী করে বলছেন! সে তো জানে টুকুনের বাবার খুব অসুখ। স্ট্রাইক, লক—আউট, ক্লোজার নানারকমের হাঙ্গামায় মানুষটা হৃদরোগে ভুগছেন। অথচ এখানে একেবারে অন্য মানুষ। যদিও এই মানুষটা তার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি। টুকুনের জন্য ভীষণ মমতা তাঁর। টুকুন যা ভালোবাসে, তিনিও তা ভালোবাসেন। টুকুনের জন্য সুবল যখন ফুল নিয়ে যেত, দেয়াল টপকে, টুকুনের ঘরে পালিয়ে ফুল দিয়ে আসত, তখন সে জানত না ধরা পড়লে খুব সহজভাবে তিনি বলবেন, বড় বাড়িতে এভাবে আসতে নেই। সদর দিয়ে আসবে। টুকুনের তো সময় থাকে না। রোববারে আসবে। বিকেলে সে তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারবে। রোববারের বিকেলে টুকুনের কোনও কাজ থাকে না।
টুকুনের বাবা বললেন, এসে খুব ভালো লাগছে। এমন একটা ফুলের উপত্যকা কোথাও থাকতে পারে জানা ছিল না। আমি তো বেশ হেঁটে যাচ্ছি, হাত তুলে তিনি বললেন, ডাক্তারদের কথা আর শুনছি না। বেশ আছি হে। তা তুমি কেমন লাভ টাব কর!
—লাভ!
—এই ফুল বেচে। টুকুন বলল, তোমার নাকি লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয় মাসে! তারও বেশি। এত টাকার ফুল বিক্রি করে খুব লাভ হওয়ার কথা।
—লাভ টাব বলে তো কিছু নেই।
—তবে কী আছে?
—যা আছে তাকে আরও বাড়ানো।
—সেটা কার জন্য?
—যারা কাজ করে, যারা এখানে থাকে খায়…..
—তবে তুমি কে?
—আমিও কাজ করি।
—কিন্তু বুড়ো মানুষটা তোমাকে দানপত্র করেছে না?
—তা করেছে।
—তবে তুমি মালিক। তোমার এখানে লেবার আনরেস্ট নেই শুনেছি!
সুবল বুঝতে পারল বিষয়ী মানুষ, তিনি বিষয়—আশয় ছাড়া বোঝেন না। সে তাঁকে বলল, বসুন।
তিনি এমন বড় উপত্যকার বিচিত্র বর্ণের সব ফুল এবং মানুষেরা এখনও কেউ কেউ কাজ করছে দেখে কেমন অবাক। —এরা বুঝি ওভার—টাইম খাটছে।
সুবল বলল, না। কাজ বোধ হয় শেষ করে উঠতে পারেনি।
—তোমার ফুলের গাড়ি কখন যায়?
—ভোর রাতে।
—কতজন লোক এখানে কাজ করে?
—তা অনেক হবে। তার হিসাবটা……
—তুমি কী হে। কোনো হিসেবপত্র রাখো না।
—না, মানে কী জানেন সবাই কাজ করে না তো। সবাই….।
—ওরা কোথায় থাকে?
তিনি আবার বললেন, এ—পাশের ছোট্ট একটা ছিমছাম শহরের মতো চোখে পড়ল। ওখানে কারা থাকে?
—এরা থাকে।
—এসব তুমি ওদের করে দিয়েছে।
—আমি করিনি। ওরা নিজেরাই করে নিয়েছে।
—তা হলে তোমার এখানে সত্যি গোলমাল হয় না।
সুবল হেসে বলল, কীসের গোলমাল?
—এই বোনাস নিয়ে, ইনক্রিমেন্ট নিয়ে।
সুবল ভেবে অবাক হয়ে যায়, এসব কথা সে শোনেনি। যখন সবই ওদের, ওরা যৌথভাবে খেটে এমন একটা উপত্যকা বানিয়ে ফেলেছে, কেন যে ওরা গোলমাল করবে, বুঝতে পারে না।
টুকুনের বাবা বললেন, সুবল তোমাকে আর চেনা যায় না। টুকুন তোর মনে আছে আমরা ট্রেনে আসছিলাম, তখন বিহার পূর্ণিয়া অঞ্চলে কী খরা। নীল রঙের বেতের চেয়ারে বসে তিনি কথা বলছিলেন। একটা নীল রঙের লণ্ঠন কেউ জ্বেলে দিয়ে গেছে। তিনি ফের বললেন তোমার পাখিটার কথা খুব মনে হয়।
সে অনেকদিন আগের কথা। ওরা তিনজনই মনে করতে পারে—কোথায় কবে এক প্রচণ্ড খরায় সব জ্বলে যাচ্ছিল, একদল তৃষ্ণার্ত লোক ট্রেন আটকে জল লুট করেছিল, এবং সুবল সেও এসেছিল জল খেতে। জল খেতে এসে অবাক, এক মেয়ে কী সুন্দর, মোমের পুতুলের মতো বাংকে শুয়ে আছে, উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কেবল চেয়ে থাকে, আর কী সুন্দর মুখ তার, দেখতে দেখতে সুবল অবাক হয়ে যায়। জল পান করতে হবে, অথবা সে তার তেষ্টার কথা ভুলে, কেমন ভেবে পায় না, কোথাও এমন সুন্দর মোমের মতো নরম চোখ অথবা কুঁচফলের মতো নাক থাকতে পারে। সে মেয়েটিকে তার জেবের পাখির খেলা দেখিয়েছিল। সুবল, এক আশ্চর্য বালক, জাদুকরের শামিল তখন। টুকুনের বাবা দেখেছিলেন, টুকুন সুবলকে বাংকের নীচে লুকিয়ে রেখেছে, পুলিশ এলে বলছে না নেই, এ—কামরায় কেউ আসেননি। যে মেয়ের মরে যাবার কথা যার কঠিন অসুখ যে ক্রমে স্থবির হয়ে যাচ্ছে তার এমন স্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে তিনি চোখ বড় করে ফেলেছিলেন। অথচ টুকুনের মা—র কী যে স্বভাব, কোথাকার এক নচ্ছার ছেলে উঠে এসেছে, তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, চাল নেই, চুলো নেই, হয়তো মন্ত্র—টন্ত্রও জানে, মেয়েটাকে বশ করার তালে আছে, প্রায় জোরজার করে ব্যান্ডেলে গাড়ি এলে তিনি সুবলকে নামিয়ে দিয়েছিলেন।
অথচ সুবল মনে করতে পারে, এক হাসপাতালে আবার দেখা টুকুনের সঙ্গে। সে তার পাখিটাকে নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে ডাব কেটে বিক্রি করত। সে ভেবেছিল, তখন শহরে এটাই সবচেয়ে ভালো কাজ। সে প্রায় নিজের মতো করে একটা জলছত্রও দিয়েছিল। আরও অনেক কাজ, এবং কাজের ভিতরই সে ফের হাসপাতালের জানালায় আবিষ্কার করেছিল টুকুনদিদিমণিকে। সে তখন প্রাণপণ, সেই জানালায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নানারকম আশ্চর্য গল্প, রূপকথার গল্প, জাদুকরের দেশে মুণ্ডমালার গল্প বলে টুকুনদিদিমণিকে সাহস দিত। বেঁচে থাকতে বলত। কারণ সে বিশ্বাস করতে পারত না, পৃথিবীতে সুন্দর মেয়েরা কখনও মরে যায়।
সুবলের এমন প্রাণপণ খেলা দেখে টুকুনেরও ভারী ছুটতে ইচ্ছা হত। টুকুন এই যে এখন বসে আছে, সুবল বসে রয়েছে সামনে, বাবা পাশে, বাবা সন্দেশ দুধ খাচ্ছেন, সুবল চা খাচ্ছে, সে চা ডিম ভাজা খাচ্ছে, এরই ভিতর যেন এক আশ্চর্য সৌরভ সে পায় সুবলের শরীরে, সুবলের কথা মনে হলেই সেই সব পুরনো দিনের কথা মনে হয়—এবং সুবলই পৃথিবীতে একমাত্র বাওবাব গাছ খুঁজে আনতে পারে—তার বিশ্বাস হয়। সে ভাবতে থাকে, সুবল না থাকলে, সে বুঝতে পারত না, ছোট্ট রাজপুত্রের কোনও গ্রহাণু থাকতে পারে, আর সেখানে আগ্নেয়গিরির মুখ ঢেকে রাখার জন্য বাওবাব গাছের পাতা লাগে।
তারপর আরও কীসব দিন গেছে টুকুনের। সুবল একবার এল ফুল নিয়ে। সব দামি গোলাপ, তখন সুবলকে চেনা যেত না। সে পালিয়ে আসত, আর কী রোমাঞ্চ, সে এলেই মনে হত শরীরের যাবতীয় অসুখ কেমন সেরে গেছে! টুকুন তখন নাচতে পারত, সে জোরে পিয়ানোতে নানা বর্ণের স্বর তুলতে পারত। যেন কবিতার মতো এক ঘ্রাণ আছে সুবলের চোখে মুখে, সুবল এলেই শরীরের সব কষ্ট এক মায়াবী সৌরভে মুছে যেত। ঘরের সাদা অথবা হলুদ রঙের দেয়ালে টুকুন মাঝে মাঝে তখন বনের দেবী হয়ে যেত।
এবং এভাবে এক শাহেন—সাহ মানুষ, সব অহঙ্কার মুছে আজ এখানে চলে এসেছেন। সুবলের ভারী ভালো লাগছে। তিনি বললেন, তোমার বুড়ো মানুষটা কোথায় থাকত?
—এ ঘরেই।
—তোমাকে খুব ভালোবাসতেন তিনি?
টুকুন বলল, বাবাকে দেখাবে না! অর্থাৎ টুকুন বাবাকে সেই বুড়ো মানুষটার সমাধি দেখাতে চায়। কতদিন টুকুন পালিয়ে এসে সবুজ ঘাসে কাঞ্চনের ছায়ায় চুপচাপ বসে রয়েছে। কতদিন পালিয়ে এসে বেশ রাত করে ফিরেছে। টুকুনের মা শেষ দিকে নানাদিক ভেবে ওর বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরিবারের মান—সম্মানের কথা ভেবে, তা ছাড়া টুকুনের এটা পাগলামি ছাড়া কী, কোথাকার এক ফুলয়ালা, যার চাল নেই, চুলো নেই, শহরে এখন ফুল বিক্রি করে খায়, তেমন এক মানুষের সঙ্গে টুকুনের এসব ঘটনা বড় পীড়াদায়ক। তিনি টুকুনকে আর বের হতে দিতেন না।
আর বিকেলে কী মনে হয়েছিল টুকুনের বাবার, হঠাৎ এসব হতেই বুঝি ভিতরে একটা গোলমাল দেখা দেয়। যা এতদিন সত্য জেনেছেন, সব মনে হয় অহমিকার কথা। সেই ফুলওয়ালার কাছে যেতে মনে হয়, টুকুন নিশিদিন যায়, গল্প করতে ভালোবাসে। —বাবা, সুবল তো তোমার মতো ভাবে না, সে তো তোমার যম দুঃখ পায় না। এখানে তো মানুষেরা মানুষের মতো কাজ করছে। নদী থেকে জল আনছে। লতাপাতা থেকে সার বানাচ্ছে। চারপাশে নানারকম পাম্প সেট, যখন যেখানে জল দরকার চলে যাচ্ছে। কারও নালিশ নেই, কারও তেমন ব্যক্তিগত উচ্চাশা নেই, বেশ তো ওরা। সারা উপত্যকাময় কীসব সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে।
এবং এভাবেই তিনি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এখানে। স্ত্রী জানেন না। মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। যেন দেখতে চান, যথার্থই পৃথিবীতে কোনও ফুলের উপত্যকা গড়ে উঠতে পারে কী না। তিনি বললেন, চলো, কাঞ্চন গাছগুলোর নীচে গিয়ে বসি।
সুবল বুঝতে পারল, তিনি সেই বুড়ো মানুষটার সমাধির পাশে বসে থাকতে চান। সুবল যেতে যেতে বলল, বুড়ো মানুষটার একমাত্র অহঙ্কার ছিল, কেউ ওর মতো ফুলের চাষ জানে না। ফুলের দালাল ঠকিয়ে ফুল নিয়ে যেত, কিছু মনে করতেন না। কেবল বললেই হত, মিঞাসাব আপনার ফুলের মতো ফুল আর কার আছে। তিনি তার পরিশ্রমের পয়সা পেতেন না। একটু থেমে বলল, ফুলের দালালি করতে এসে এখানে থেকে গেলাম। কেমন বুড়োমানুষটার জন্য মায়া হল। এর কাজ করতে কষ্ট হলে কাজ করে দিতাম। বন থেকে পাতা এনে দিতাম। পাতা পুড়িয়ে তিনি জমির সার বানাতেন! তাঁর কাছে আশ্চর্য সব খবর জেনে নিলাম। তার ফুলের চাষ এত কেন ভালো, বনের কোন গাছ, কী পাতা কোন সময়ে পোড়ালে কোন ফুলের উপকারে আসে, পৃথিবীতে কেউ বোধ হয় ওঁর চেয়ে তা ভালো জানতেন না। তখন বুড়ো মানুষটার আমি বাদে আর কেউ ছিল না।
বাবা বললেন, সুবল তোমার অহঙ্কার হয় না? শহর থেকে কত মানুষজন এই ফুলের উপত্যকা দেখতে আসছে—এতবড় এক ফুলের উপত্যকা তুমি গড়ে তুলেছ এখানে। সব মানুষের জন্য রেখেছ সমান দায়িত্ব, বড় শহরে সকালে যায় সারি সারি ফুলের গাড়ি, তোমার মনে হয় না রাজার মতো বেঁচে আছ?
সে বলল, আজ্ঞে না। আমার তখন বুড়ো মানুষটার কথা মনে হয়।
—কী বলেন তিনি?
ওরা সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসে রয়েছে। টুকুন এখন নানা বর্ণের ফুলের ভিতর ঘুরে ফিরে কেমন মজা পেয়ে গেছে, সামান্য জ্যোৎস্নায় ছুটতে পর্যন্ত ইচ্ছা করছে। তখন সুবল বলছে বুড়োমানুষটার কথা। সে বলল, তিনি বলতেন, আল্লা খুব সরল। তিনি চান পৃথিবীতে সরল এবং ভালোমানুষরা সুখে থাকুক। তারপরই সুবল কেমন চুপ হয়ে যায়। একটু পরে থেমে থেমে সুবল বলল, তিনি বলতেন, সব লতাপাতার ভিতর, ফুলফলের ভিতর এবং সব গ্রহ—নক্ষত্র, অথবা এই যে সৌরলোক, যা কিছু আছে চারপাশে, সবার ভিতর তিনি আছেন। কোনো উপাস্য নেই তিনি ভিন্ন। তিনি রাজার রাজা। তিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ। যা কিছু আছে আকাশে আর যা আছে পৃথিবীতে—সব তাঁর। তিনি জানেন সবকিছু। সৃষ্টি—স্থিতি—প্রলয় তাঁর অন্তর্লোকের রহস্য। তিনি জানেন একমাত্র কী আছে সামনে আর কী আছে পেছনে। তাঁর আসন আকাশ আর পৃথিবীর ওপরে বিস্তৃত। আর এ—দুয়ের তিনি নিশিদিন রক্ষাকারী। তার জন্য তিনি ক্লান্ত বোধ করেন না।
সুবল কী দেখল এবার। সে দেখল টুকুন ঘাসের ভিতর কাঞ্চন ফুলের পাঁপড়ি সংগ্রহ করছে। কী সুন্দরভাবে উবু হয়ে বসেছে। কী মায়ায় ভরা মুখ! সে কিছুতেই বেশি আশা করতে পারে না। সে বলল বুড়োমানুষটার কথা মনে হলে নিজেকে কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না। এমন কথা শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে কিনা জানি না।
টুকুনের ভারী আশ্চর্য লাগে সেই সুবল, ফুটপাতে সে ঘুরে বেড়াত, যার কোনও ঠিকানা ছিল না, নিজের বলতে কিছু ছিল না, কী করে সেই মানুষ এমন সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা যা মাইলব্যাপী কী তারও বেশি হবে কতদূর গেছে সে ঠিক জানে না, কীভাবে গড়ে তুলেছে!
সুবল ফের বলল, তিনি প্রায়ই মুসার কথা বলতেন। বলতেন বারোটি প্রস্রবণের কথা। লোকদের জন্য তিনি জল চাইলেন। মরুভূমিতে কোথায় জল! অথচ দৈববাণী, মুসা তার লাঠি দিয়ে বারোটা পাথরে বাড়ি মারলেন। জল উপছে ঠান্ডা জলের প্রস্রবণ। মুসা বললেন, জল পান করো মনুষ্যগণ। আল্লাহ যে জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও আর পান করো। অন্যায়কারী হয়ে দেশে অপবিত্র আচরণ কোরো না।
সামান্য জ্যোৎস্নায় টুকুন বুঝতে পারল, বাবার মুখ কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। আসলে কী সুবল বাবাকে অন্যায়কারী ভাবছে। অন্যায়কারী ভেবে গল্পটা বলছে! বাবাও কী ভেবে ফেলেছেন তিনি অন্যায়কারী। সংসারের জন্য তিনি অনেক অন্যায় কাজ করে ফেলেছেন। রাতে এজন্য তিনি ঘুমোতে পারেন না। মনে হয় কেউ তাঁকে গলা টিপে মারতে আসছে।
তারপরই বাবার মুখ ফের কেমন সরল সহজ হয়ে যায়। তিনি বলতে থাকেন, তোমার এখন শুধু দেখছি একটি বাওবাব গাছ হলেই হয়ে যায়।
সুবল কেমন বোকার মতো বলে ফেলল, হয়ে যায়।
টুকুন হাসবে কী কাঁদবে বুঝতে পারছে না। কারণ সুবল বাবার কথা ঠিক ধরতে পারছে না।
আর এভাবেই জীবনের কোনও সুসময়ে কিছু ভালো কাজ করে ফেলতে ইচ্ছা হয়। টুকুন সুবলকে ভীষণ ভালোবাসে। টুকুনের জন্য পৃথিবীর সব দামি অথবা মহার্ঘ যুবকেরা অপেক্ষা করছে। অথচ টুকুন সেই শৈশব থেকে এই পাখিয়ালার প্রেমে পাগল। মানুষের স্বভাবে কীযে থাকে! বাড়ির সবাই যখন ভেবেছে সাময়িক খেয়াল, তখন বাবা বুঝতে পারেন, টুকুন এমন একজন সৎমানুষকেই সারাজীবন ধরে চেয়েছে। সে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারে না। তিনি তো দেখছেন যেসব যুবকেরা টুকুনের পাশে ঘোরাফেরা করে, এই যেমন ইন্দ্র, সে টুকুনকে না পেলে রুমপাকে বিয়ে করবে। ওতে ওর আসে যায় না। কিন্তু এই ফুলের উপত্যকাতে এসে বুঝতে পেরেছেন, সুবল পৃথিবীর চারপাশে নিরন্তর খুঁজে যাবে একটি বাওবাব গাছ, না পেলে সে একা হেঁটে যাবে। কারণ ওর চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায়, গল্পের গাছটা ওর খুব দরকার। গল্পের গাছটা এই উপত্যকাতে না লাগাতে পারলে ওর ভারী দুঃখ থেকে যাবে। সারাদিন পরিশ্রমের পর মানুষের এমন একটি গাছের ছায়ার দরকার। আজীবন তিনিও তা চেয়েছেন। সঠিক গাছের ছায়া পেলে হয়তো তিনি এমন অন্যায়কারী হয়ে যেতেন না।
এবং এভাবেই টুকুন এখন প্রায় সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, সুবলের পাশে হাঁটতে পারলে পৃথিবীতে সে আর কিছু চায় না এবং ভেবে ফেলেছে, সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গ্রহাণুর মতো এটা সুবলের গ্রহাণু। এখানে মানুষের কোনও কষ্ট নেই, এখানে মানুষেরা খেটে খায়, পরিশ্রমের বিনিময়ে বাঁচে। সুবলকে খুব বড় মনে হয় তখন। আর রাগ হলে ভাবে ভীষণ অহঙ্কারী।
বাবা বললেন, বুঝলে হে সুবল, দেখেশুনে মনে হল, খুবই দরকার বাওবাব গাছের।
সুবল বোকার মতো যেই বললে, খুবই দরকার, তখন টুকুন ফিস ফিস করে বলল, এই কী যা—তা বলছ।
তিনি গাড়ির কাছে গিয়ে বললেন, বাড়িতে আছে। বড় হচ্ছে। যখন সময় হবে নিয়ে আসবে। বুঝতে পারছি, গাছটা না হলে তোমার এমন সুন্দর ফুলের উপত্যকা সত্যি শ্রী—হীন হয়ে থাকবে। মনে হয় তোমার এই উপত্যকাতে বাওবাব গাছ লাগিয়ে দিতে পারলেই আমার ঘুম আসবে। আমি ভালো হয়ে যাব।