- বইয়ের নামঃ টুকুনের অসুখ
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
টুকুনের অসুখ
এক
খরা, প্রচণ্ড খরা। কবে কোন বছরে একবার বৃষ্টি হয়েছিল এ অঞ্চলে, কবে কোন বছরে সবুজ শ্যামল মাঠ ছিল এ অঞ্চলে—মানুষেরা তা যেন ভুলে গেছে। গ্রাম মাঠ খা খা করছে। নদী—নালা সব হেজে মজে গেছে। শুকনো বাতাস আর মাঠে মাঠে শুধু ধুলো উড়ছে।
ফাল্গুন মাস, বৃষ্টি হচ্ছে না। মনে হয় কোনোদিন আর বৃষ্টি হবে না। মাঠে শুধু ধুলো উড়ছিল। গোরু—বাছুর নিয়ে দেশ ছেড়ে মানুষেরা সব চলে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের মতো। ধান—চাল নেই, মাঠে শস্য নেই। দু’সাল হল দুর্ভিক্ষের মতো চলছে।
গ্রামের পর গ্রাম মাঠের পর মাঠ সব জলবিহীন। নদী যেখানে গভীর ছিল সেখানে সামান্য মাটি খুঁড়ে গত সালেও জল পাওয়া যেত—এবার তাও নেই।
যা কিছু অবশিষ্ট মানুষ গ্রামে রয়েছে, নারী যুবক—যুবতী, ছেলে বুড়ো সকলে মাটি খুঁড়ছিল নদীর ভিতর। ভিতর থেকে যদি সামান্য পরিমাণ জল পাওয়া যায়। সামান্য জল পেলে ওরা সংরক্ষণ করে রাখবে। অন্তত আগামী বর্ষা পর্যন্ত ওরা সেই জল নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি সকলের আগে আগে কাজ করছিল। তার হাতে যেন গুপ্তধন আবিষ্কারের চাবিকাঠি। সে দাগ দিয়ে যাচ্ছিল লাঠি দিয়ে। বালির ওপর একটা করে গুপ্তচিহ্ন রেখে যাচ্ছে। আর প্রতিটি গুপ্তচিহ্ন প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাত দূরে, এঁকেবেঁকে গেছে অনেকটা সাপের মতো—কারণ কেউ জানে না নদী কোথায় অন্তঃসলিলা। এ নদী যদি মরে যায়, মানুষরা তবে সব মরে যাবে। ওদের হাতে সামান্য শস্য—দু’সাল আগের সামান্য শস্য—সঞ্চিত শস্য এখন প্রায় নিঃশেষ, তবু এই জল পেলে তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচবে, জল পেলে পাতা ঘাস এবং অন্য যা কিছু আছে এ অঞ্চলে, পাহাড়ে, ছোট পাহাড় অঞ্চলে এখনও যেসব লতাগুল্ম রয়েছে, তার শিকড়—বাকড় আছে, বনআলু রয়েছে, জল পেলে যে—কোনোভাবে সিদ্ধ করা যাবে, খাওয়া যাবে, খেলে পরে এ বর্ষাকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে।
এই মাটি, বাপ—পিতামহের মাটি। সোনার ফসল হত মাটিতে। সব ফসল হায় কোথায় এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটির হাতে লাঠি। সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারে ছোট ছোট পাহাড়। ঝরনার জল আর নামছে না। গাছে গাছে কোনো পাখির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই যেন মন্বন্তরের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে।
বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছেন, মাটিতে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন। একজন করে মানুষ কেউ চিহ্নের ওপর বসে পড়ছে মাটি খোঁড়ার জন্য। যেখানে জলের সন্ধান পাওয়া যাবে সেখানেই পরদিন জড়ো হবে সব অন্য মানুষেরা—সারাদিন খেটে জল বের করবে। নিজেরা জল ভরে রাখবে ঘড়াতে। জলের জন্য ওরা প্রায় মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ল।
বৃদ্ধ মানুষটিকে মোজেসের মতো মনে হচ্ছিল। লম্বা আলখাল্লার মতো জামা গায়, পায়ে নাগরি জুতা, মাথায় ফেটি বাঁধা। উঁচু লম্বা মানুষ, চুল ছোট করে ছাঁটা, শক্ত চোয়াল মানুষটার। রোদে, জলে অথবা খরার সময়ে মুখে শক্ত সব রেখা—যেন দেখলেই মনে হয় মানুষটা আজ হোক কাল হোক এ অঞ্চলে জল নিয়ে আসবে।
গেরস্থের বউরা, বিবিরা, যুবক—যুবতীরা ছোট—বড় সকলে লম্বা লাইন দিয়ে এঁকেবেঁকে জলের জন্য মাটি খুঁড়তে বসে গেছে। বৃদ্ধ যেখানে পাহাড়ের ঢালু জায়গাটা ছিল, সেখানে উঠে দাঁড়ালে, পেছনে প্রায় দু—তিন মাইল পর্যন্ত শুধু নদীর বালি চোখে পড়ে—খরার জন্য, গ্রীষ্মের জন্য বালি চিকচিক করছিল। নদীটাকে এখন মরা একটা সাপ মনে হয়। আবার মনে হয়—চিত হয়ে আছে অজগরটা। এক লম্বা অজগর—দু—তিন মাইল লম্বা, চার মাইল লম্বা, আরও কত লম্বা হবে কে জানে। বালিয়াড়ি, দিগন্তের দিকে ছুটে গেছে—যেন নদীটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কারু জানা নেই।
পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথাও সমতল মাঠ আবার পাহাড়, ছোট পাহাড়, কত রকমের লাল—নীল পাথর, পাহাড়ে কত রকমের গাছ—গাছালি, গুল্মলতা আর কত রকমের পাখি ছিল। সব পাখিরা উড়ে চলে গেছে। গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। গাছগুলো মৃতের মতো পাহাড়ময় দাঁড়িয়ে—সমতলভূমিতে সব কুঁড়েঘর, খড়ের চাল। ঝোপে—জঙ্গলে শুধু শুকনো পাতার খস খস শব্দ। ঘাস আর নেই। মাটির নীচে ঘাসের শেকড় মরে যাচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।
ঠিক সামনেই বালুবেলাতে এই অঞ্চলের ছোট ছেলেটি বসে মাটি খুঁড়ছিল। বৃদ্ধ দেখল ছোট ছেলেটি সকলের শেষে মাটি খুঁড়তে বসেছে। ওর গায়ে লম্বা ঝুলের জামা। জামাটি ওর নয়, সুদিনে কী দুর্দিনে ওর বাবা হয়তো তৈরি করেছিল। পার্বণের দিনে ওর মা—বাপ একবার মেলায় গিয়েছিল এবং পরে, এই মাস দুই পরে হবে, ওলাওঠায় বাপ—মা দু’জনই গেছে। তখনও সামান্য জল ছিল পাতকুয়াতে, সামান্য জল তুলে রাখা যেত। এখন এই সামান্য বালকের হাতে একটা খুরপি। পিঠের নীচে বাঁশের এক হাত লম্বা একটা চোঙ। ভিতরে কিছু যত্ন করে রেখে দিয়েছে মনে হয়। বালিমাটি খোঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই লম্বা একটা চোঙ থেকে ম্যাজিকের মতো ছোট একটা পাখি বের করে আনছিল এবং বোধ হয় শুকনো বটফল খাওয়াচ্ছিল। সে, এই বালক কাজে ফাঁকি দিচ্ছে দেখে পাহাড়ের ঢালু থেকে হেঁকে উঠল—হেই সুবল।