- বইয়ের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত গল্পসংগ্রহ
অনাবৃতা
জতুর আজও ঘুম ভেঙে গেল। কোথাও থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ—কেউ কাঁদছে। মাথার দিকের জানালা খোলা। গন্ধরাজ লেবুর পাতা ডাল হাওয়ায় দুলছে। তার কেমন ভয় করছিল।
পাশের খাটে মা শুয়ে আছেন।
মা বোধহয় ঠিকই টের পান।
কী হল জতু? ঘুমিয়ে পড়। ও কিছু না।
কেমন ভূতুড়ে মনে হয়, মা কি বোঝেন, জতু ঠিক টের পেয়ে গেছে মধ্য রাতে কেউ কাঁদে। মা কি চান না, জতু জেগে থাক, বিছানায় উঠে বসুক, ভয়ের কী আছে, দুপুর রাতে কেউ কান্নাকাটি করলে কী করা! তোর না ঘুমানোর কী আছে বুঝি না। মা এমন ভাবতেই পারেন।
জতু তার মায়ের সঙ্গে পুবের ঘরে থাকে। বাবা প্রবাস থেকে এলে এই ঘরে থাকেন। জেঠিমা কাকিমাদের আলাদা ঘর। উঠোনের চার ভিটিতে চারটি আটচালা। দক্ষিণের ঘরে আত্মীয়-কুটুম এলে থাকেন। মাষ্টারমশাই আর নিমাইদা রাতে আত্মীয়-কুটুম না এলে ও ঘরটায় থাকে। উত্তরের ঘরে ঠাকুরমা ঠাকুরদা, বিশাল বাড়িতে এদিক ওদিক মেলা শরিক, গোয়ালবাড়ি, রান্নাবাড়ি-অন্দরে পুকুরও আছে একটা। বড়ো একটা তেঁতুলগাছ আছে ঘাটে। বৃষ্টি হলে ঘরবাড়ির জল গাছটার শেকড়বাকড় পার হয়ে পুকুরে গিয়ে নামে। কতকাল থেকে বর্ষায় এই জল নামছে জতু ঠিক জানে না। গাছটার শেকড়বাকড় আলগা, বর্ষার মাটি ধুয়ে নিলে শেকড়বাকড় আলগা হবারই কথা। এত বড়ো গাছ, আর তার কুমিরের মতে শেকড়বাকড় এলোমেলোভাবে জড়িয়ে আছে বলে, সকালে ঘাটে গেলে জতুর দাঁড়িয়ে থাকতে কিংবা বসে থাকতে অসুবিধা হয় না। গাছের শিকড়বাকড়ে উঠে বসে থাকে। বউটি জলে নামে, সে দেখে। জলে ডুব দেয় সে দেখে। সে না বললে বউটি জল থেকেও উঠে আসতে পারে না।
কেন যে মা সকালেই তাকে ডেকে দেন, ও জতু ওঠ। কমলবউ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। ওঠ বাবা। সঙ্গে যা। তুই না গেলে পুকুরে ডুব দিয়েও শান্তি পাবে না।
জতুর উঠতে ইচ্ছে হয় না। মাঝরাতের চাপা কান্নার তার মগজ গরম হরে থাকে। শীতল হতে সময় নেয়। ভোররাতের দিকেই প্রগাঢ় ঘুম চোখে। মা ডাকাডাকি করলে, চোখ মেলতে তার কিছুতেই ইচ্ছে হয় না।
সে এক রাতে ঘুম থেকে উঠে বসেছিল।
কেউ কাঁদছে ফুঁপিয়ে।
সে বলেছিল, মা তুমি কিছু শুনতে পাও না।
কী শুনতে পাব?
বারে, শুনতে পাচ্ছ না?
মা কেমন অস্বস্তিতে পড়ে যান। খাট থেকে নেমে মাথার জানলা বন্ধ করে দেন। মাথার জানলা বন্ধ করে দিলে হাওয়া ঢোকে না। গরমে খুব কষ্ট হয় জতুর। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলে। মা যে কেন জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। তবে জানলা বন্ধ করে দিলে চাপা কান্নার আওয়াজ থাকে না। অবশ্য গাছে একটা প্যাঁচা ডাকছিল। রান্নাবাড়ির দিকটায় প্যাঁচাটা থাকে। জামগাছের মাথায় এক জোড়া প্যাঁচা কবে থেকেই আছে।
আরও শব্দমালা সে শুনতে পায়। কীটপতঙ্গের আওয়াজ তো আছেই। রাতে পাখিরা বিল থেকে উড়ে যায়—তার পাখার শব্দ এবং ভরা বর্ষার সময় বলে চারপাশের জলমগ্ন জায়গায় শাপলা শালুকের সবুজ পাতায় টিট্রিভ পাখিদের বিচরণ—তার কলরবও কানে আসে। বাড়ির দক্ষিণে সদর পুকুর, চারপাশে চালতাগাছের ছায়া। দুটো খেজুরগাছ এবং ছোটো বিশাল শিমূল গাছও আছে। বাড়ির পিছনে মোত্রাঘাসের জঙ্গল। ডাহুক পাখিরাও গভীর রাতে মারামারি শুরু করে দিলে কোলাহল ওঠে। বর্ষায় জলে জঙ্গলে দেশটা ভেসে থাকে।
মা বললেন, তুই শুয়ে পড় জতু। বসে থাকলি কেন? গরম লাগছে। জানলাটা খুলে দি। তুমি জানলা বন্ধ করলে কেন?
জতু তুই বড়ো জ্বালাস!
জতু মার জন্য অপেক্ষা না করে, নিজেই জানলাটা খুলে দিল। কান্না আর শোনা যাচ্ছে না। পাশের বাড়িটা যতীন দাসের। দেখতে কদাকার মানুষটি কুশঘাটে শাড়ি বিক্রি করতে যায়। ঘরে দুটো তাঁত, দুজন তাঁতি, সকাল বিকাল চরকার ববিনে সুতো পরানো হয়, তানা। হয়, মাকুর খটাখট শব্দে কান পাতা যায় না। কমলবউ নিজেও তাঁত বুনতে পারে। মিষ্টি সুন্দর মতো বউটাকে যতীন দাস গেল বছর বিয়ে করে এনেছে। আগের পক্ষের বউটি আত্মহত্যা করায় যতীন দাসের বিয়ে না করেও উপায় ছিল না।
নে শুয়ে পড় জতু।
জতু জানে শুয়ে পড়লেই তার ঘুম আসবে না। ঘুম এলেও মা-ই আবার তাকে জাগিয়ে দেবেন ওঠ জতু। যা উঠোনে কমলবউ দাঁড়িয়ে আছে।
এত সকালে সে না উঠলে কমলবউ উঠোন থেকে নড়বে না। মাকে জ্বালাবে। পাড়াপড়শিরা জেগে যাবার আগে পুকুরঘাটে তার সঙ্গে যেতে হবে।
রোজ কাঁহাতক ভালো লাগে। তার উঠতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু বউটি যে তার প্রায় সমবয়সি, সমবয়সি না হোক, কিছু বড়ো হলেও ক্ষতি নেই। জতু ক্লাস এইটে পড়ে। তার দাদারা কলেজে পড়ে। তিন ক্রোশ সাইকেল চালিয়ে দাদারা কলেজ যায়। দত্তদের বাড়ি বললে এ-অঞ্চলে সবাই এক ডাকে চেনে। তার জ্যাঠামশাই ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। বাড়ির বাইরে একটা নীল রঙের ডাকবাক্সও আছে।
তাছাড়া বাড়িটা তাদের খুবই ছিমছাম। দক্ষিণের ঘর পার হলেই বাইরের উঠোন, বিকেলে সেও দাদাদের সঙ্গে নেট টানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে। জ্যাঠামশাই ঘোড়ায় চড়ে তখন রোগীর বাড়ি থেকে ফেরেন। জ্যাঠামশায়ের ডিসপেনসারি ঘরের মেঝে শান বাঁধানো। বড়ো বড়ো বয়েম। উদখল আরও বড়ো। নিমাইদা এ-বাড়িতে এসেছে কবিরাজি শিখতে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় বন্যার জলের মতো রিফুজিতে ভেসে যাচ্ছে দেশটা। কমলবউ রিফুজি মেয়ে সে জানে। ভালো নাম কমললতা। নাকে নথ করিয়ে দিয়েই যতীন দাস তাকে বাড়িতে তুলে এনেছে।
একদিন রাতে জতুর কী হল সে জানে না। চুপি চুপি দরজা খুলে বের হয়ে দেখল, বাগানের দিকটায় কেউ জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে মানুষ বাইরে থাকলে চোর ডাকাত ভাবাই যায়। কিন্তু সে দেখল, লোকটা বাগানের গাছ থেকে ফুল তুলছে। ঠিক নিমাইদা, নিমাইদা এত রাতে বাগানে ঢুকে কী ফুল তুলছে সে জানে না। তবে জ্যোৎস্নায় নিমাইদা গাছ লতা পাতা ফুল ভালো চেনে, সে এটা জানে।
বাড়িতে কবিরাজি ওষুধে লাগে। এমন অনেক গুল্মলতাই ঠাকুরদার আমল থেকে বড়ো হয়ে উঠেছে। বাড়ির এই বাগানটায় একটি দারুচিনি এবং এলাচের গাছও আছে। তেজপাতার লতাও আপন মহিমায় নিজের মতো একটি কয়েদবেল। গাছ জড়িয়ে বেঁচে আছে।
নিমাইদাকে রাতে উঠতে হয়, কারণ রাত থাকতেই কাজকাম শুরু হয়ে যায়। গাছ থেকে পাতা, ফুল এবং শেকড়বাকড় তুলে পুকুরঘাটে ধুয়ে তারপর শান বাঁধানো বারান্দায় ছড়িয়ে রাখতে হয়। জ্যেঠামশাইয়ের নির্দেশ মতোই সে কাজ করে থাকে। রাত থাকতে তুলে না নিতে পারলে, জীবনদায়ী ওষুধ বোধ হয় তৈরি করা যায় না। শেকড়বাকড়ে, পাতায় এবং ফুলে সকালের রোদ না খাওয়ালে চলে না।
তারপরই মনে হল সে উঠোনে নেমে এসেছিল, সেই এক কুহকে। চাপা কান্নার উৎস খুঁজতে বের হয়েছে, তার মনে পড়ে গেল। তবে নিমাইদা বাগানে ঘোরাঘুরি করায় বুঝতে অসুবিধা থাকল না, রাত আর বেশি নেই। রাতে চাপা কান্না শুনলে কার না অস্বস্তি হয়।
তার মতো সবারই অস্বস্তি হতে পারে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। অথবা কারও কোনও কৌতূহলও নেই। কিংবা সে এবং তার মা ছাড়া রাতের এই অস্বস্তি এত বেশি বোধ হয় কেউ টের পায় না। কারণ যতীন দাসের ঘরটি ডেফল গাছটা পার হয়ে গেলেই। বড়ো সংলগ্ন ঘর। ঘরে যতীন দাস আর কমললতা রাতে শোয়। তারপর আরও ঘর আছে যতীন দাসের। তাঁত, তানা সুতোর ডাঁই ঘরগুলোতে। দক্ষিণের দিকে সুপারি বাগান, পিছনের দিকে বেতের জঙ্গল এবং একটা বিশাল গাবগাছ। তারপরই বুক সমান বর্ষার জল—যত দূর চোখ যায়।
শেষ রাতের জ্যোৎস্নায় জতু এত গাছপালা এবং ঘরবাড়ির মধ্যে হেঁটে বেড়ালে শুনতে পায় ঠাকুরদা কাশছেন। আর কোনও আওয়াজ নেই। নিমাইদা বাগান থেকে ঝুড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। সদর পুকুরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। যতীন দাসের লেবুর ঝোপে জোনাকি ওড়াওড়ি করছে। কিন্তু কোনও চাপা কান্নার আওয়াজ নেই।
সে হয়তো ভুল শোনে।
সে আবার সতর্ক পায়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঠোকে এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। খাটে উঠে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে শোয় না। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। কান খাড়া করে রাখে। তার ঘুম আসে না।
সকালে সে আজ নিজেই উঠে পড়ল। দরজা খুলে দেখল কমললতা দাঁড়িয়ে আছে। একটা ডুরে শাড়ি পরনে। হাতে পেতলের একটা ঘটি। তাকে বের হতে দেখেই অন্দরের পুকুরের দিকে হাঁটা দিল কমল। অলগাভাবে হাঁটছে যেন সে এখন যেখানে পা বাখবে সবই অসুবিধে হয়ে যাবে। কমল তাকে ছুঁয়ে দিলেও জতুর যেন জাত যাবে।
জতু জানে তার কাজটা কী। বউটি পুকুরের জলে ডুব দেবে। গভীর জলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠবে। বলবে, জতু আমার কিছু ভেসে ছিল না তো। ঠিক ডুবে গেছি তো।
কিছু তো ভেসে থাকে। যেমন শাড়ির আঁচল, অথবা চুল, এত ঘন লম্বা চুল খোঁপা না ডুবে গেলে হয় না। আবার ডুব।
জতু আগে বেশ মজা পেত এই নিয়ে।
না ডোবেনি।
কী ডোবেনি।
তোমার ঘোমটা।
কমলবউ ঘোমটা খুলে শাড়িটা দুহাতে জড়িয়ে ডুব দিলে, কিছুই ভেসে থাকে না। একেবারে যতটা পারা যায় নীচে কাঁকড়ার মতো বিচরণ করতে থাকে। চোখ লাল, এতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকাও কঠিন। কিছু ভেসে থাকার আতঙ্কে জলের নীচ থেকে উঠেই আসতে চায় না।
জতু না বললে, কমল জল থেকেও উঠে আসত না।
এই এক খেলা যে জতুকে ক্রমে আকৃষ্ট করে তুলেছে। বউটি জলে নেমে যায়, শাড়ি ভিজতে থাকে, কোমর জলে নেমে শাড়ি দু-হাতে বুকে জড়িয়ে রাখে, তারপর খোঁপা খুলে চুল ছড়িয়ে দেয়। খোঁপা বাঁধা থাকলে, জলে সব চুল ভেজে না, রাতে অশুচি হয়ে থাকে শরীর। জলের নীচে ডুব দিলে কমল, পুণ্যতীর্থ গয়া গঙ্গা আছে টের পায়। না হল না চুলের ডগা ডোবেনি।
কমল পড়ে যায় মহাবিভ্রাটে। তার কেবল মনে হয় বারবার ডুব দিয়েও সে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধুয়ে সাফ করতে পারেনি।
আবার ডুব?
কীরে জতু কী হল!
আঁচল ভেসে আছে।
কমল নিজের মধ্যে বোধ হয় থাকে না। সে তার সায়া শাড়ি খুলে সব বুকের মধ্যে জড়িয়ে ডুব দেয়। সেমিজটিও খুলে ফেলে। কীভাবে যে শাড়ি সায়াতে বাতাস ঢুকে থাকে এবং ডুব দিলেও শাড়িসায়া ভেসে ওঠে জলে। জতু কমলকে শুধু দেখে।
কখনও মনে হয় মাছের মতো পাখনা মেলে দিয়েছে জলে। অন্দরের পুকুর, তায় বর্ষাকাল, জল টলমল হয়ে আছে, জলের নীচে নুড়ি পাথর পর্যন্ত স্পষ্ট। স্ফটিক জলে কমল নেমে গেলে সবই দেখতে পায়। সুন্দর শরীর এবং স্তন, সবই অবাধে কমল জলের নীচে নগ্ন সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে।
জতু হাঁটছে।
কমল হাঁটছে।
ঘুম থেকে কেউ ওঠেনি। কিছুটা অন্ধকার মতো হয়ে আছে—সূর্য উঠলেই এই অন্ধকার কেটে যাবে। কমল তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটছে। ইঁদারা পার হয়ে, বাড়ির পাঁচিল বাঁশঝাড় পার হয়ে কমল পিছন ফিরে তাকাল।
এই আয়।
যাচ্ছি তো।
কমল ঘাটে এসেই এক কাণ্ড করে বসল আজ। চারপাশে সতর্ক নজর তার। পুকুরের পাড়ে সব আম জাম নারকেল গাছ। তারপর বিশাল জলাভূমি যতদূর চোখ যায়। অন্দরের পুকুরে পুরুষমানুষদের আসার নিয়ম নেই। জতু পুরুষমানুষ কি না সন্দেহ আছে এখনও। ক্লাস এইটে পড়লে পুরুষমানুষ হওয়া যায় না। অন্দর সদর সব সমান তার কাছে। কমল এটা ভালো করে জানে বলেই সেজমামিকে বলে জতুকে সহজেই বিছানা থেকে তুলে আনতে পারে। জলের নীচে ডুবে গেছে কি ডোবেনি কেউ বলে না দিলে তার জলে ডুবে তৃপ্তি হয় না।
জতু দেখছে, আবার থুতু ফেলছে কমল।
সে ডাকে, কমলবউ।
আমাকে কিছু বলবি।
কমলবউ তুমি এত থুতু ছিটাও কেন?
কমলবউ বলল, শরীর। শরীর কী আগে বুঝতে শেখ। শরীরে যে বিষ আছে। জতু দেখেছে, কমলবউ সারাক্ষণ থুতু ফেলে। উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিত করে থুতু ফেলার অভ্যাস। হাঁটার সময়ও। মুখে এত থুতু জমে কী করে। সকালে পুকুরে ডুব দিতে যাবার আগে এটা তার হয়। জতু কিছুটা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে কমলের দিকে। শরীরে এত বিষ, কেন হয়, বিষের কি মা বাপ নেই, কিংবা ঘৃণা কখনও মানুষের মধ্যে জেগে গেলে থুতু জমে উঠতে পারে মুখে। জতু অবশ্য থুতু মাড়িয়ে হাঁটে না। হাঁটার নিয়ম নেই। কমল ঠিক মনে রাখতে পারে কোথায় কখন সে থুতু ছড়িয়েছে। পুকুর থেকে পবিত্র হয়ে ফেরার সময় ঘটির জল ছিটিয়ে বসুন্ধরাকেও পবিত্র করে নেয়। সে দেখেছে, ঠিক যেখানে কমল আসার রাস্তায় থুতু ছিটিয়েছে—ঠিক সেসব জায়গায় জল ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। থুতুতে পা পড়ে গেলে কমল বোঝে। এই এত আতঙ্ক থেকে জতু, কমল যে রাস্তায় হাঁটে, তার থেকে কিছুটা আলগা হয়ে হাঁটে।
মা একদিন জতুকে কেন যে বলেছিল, তোমার এখানে কী? যাও।
কমলবউ বসে আছে মেঝেতে। ঠাকুমা মা জ্যেঠিমা সবাই ঘাটে বসে আছেন। কমলবউ পিঠের শাড়ি সরিয়ে ওঁদের কী দেখাচ্ছিল।
সে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিল ঠিক, তবে কাছাকাছি এবং জানলার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আমাকে মারে।
ঠাকুমা বললেন, মারবে না, সোহাগ করবে। তুই কম যাস না। পুরুষমানুষ সারাদিন খাটাখাটনি করে, তার আর আছেটা কী! গোয়ার্তুমি করলে চলে।
আমার যে ইচ্ছে করে না ঠাইনদি।
মেয়েমানুষের আবার ইচ্ছে কী! তোর মুখে খেতা পুড়ি।
মা বলেছিলেন, তাই বলে মারধর করবে!
করবে না। মাথা না পাতলে সে বেচারাই বা যায় কোথায়?
জতুর কষ্ট সেই থেকে। যতীন দাদা মানুষ তো খারাপ না। তবে বেঁটে, বেঢপ, দেখতে আবলুস কাঠের মতো রং। চোখ দুটো চামড়ার ভাঁজে দেখা যায় কী যায় না। ব্যাঙের মতো নাকটা সায়া মুখ জুড়ে বসে আছে। কানে বড়ো বড়ো লোম, নাকের ভিতরে থেকে লম্বা গোঁফ এবং বিসদৃশ্য এই চেহারা কমলবউয়ের খারাপ লাগতেই পারে।
শেষে জ্যাঠামশায়ের কানেও কথাটা উঠেছিল।
সেদিন জ্যাঠামশাই সবে রোগীর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। জনার্দন কাকা তাঁর ঘোড়া নিয়ে আস্তাবলে বেঁধে দিচ্ছে। তিনি স্নানটান সেরে বৈঠখখানায় বসে নিমাইদাকে ডেকে কী একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছেন। বাসলেহর ওষুধের দরকার। বর্ষাকাল, সর্দিজ্বরের প্রকোপ বেড়েছে, ওষুধটি না হলে চলে না। তখনই বাবা গিয়ে নালিশ দিলেন, আর তো ও ঘরে থাকা যাচ্ছে না।
কেন রে?
যতীন বউটাকে রাতে মারে।
মারে কেন?
সে আমি কী করে জানব।
তারপর কেন যে তিনি কী বলেছিলেন, কারণ না থাকলে কেউ মারে!
একবার জিজ্ঞেস করুন ডেকে।
জ্যাঠামশাই হেসে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি বোঝ না, কেন মারধর করে? যতীন তো আর অমানুষ নয়। মাথায় তার রক্ত উঠে যায় কেন? তুমি হলে কী করতে।
বাবা আর কোনও কথা না বলে যেন পালাতে পারলে বাঁচেন।
জতু ঠিক বোঝে না সব কিছু। তবু সে জানে সারারাত কমলবউকে যতীন দাদা ঠ্যাঙায়। এমন সুন্দর মেয়েটা, বালিকা স্বভাবের, তার মুখে থুতু উঠলে যে কিছু না কিছু গর্হিত কাজ হয়ে থাকে বুঝতে তার কষ্ট হয় না। কমলবউ ডাকলেই সে সাড়া না দিয়ে পারে না।
এমনকী জলে ডুবিয়ে, বার বার ডুবিয়ে, না হল না, আবার ডুব দাও, হল না, ভেসে উঠলে কেন, পায়ের পাতা ভেসেছিল, না হল না, তোমার হাতের আঙুল জলের ওপয়ে থাকলে হবে কেন, নিশ্বাস বন্ধ করে, একেবারে তলিয়ে যেতে পার না, তোমার শরীরে শাড়ি আলগা হয়ে জলে ভেসে থাকে কেন, এভাবে অজস্র ডুব আর ডুব, বালিকা বউটির বয়সি স্বামীর তাড়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য ডুব দিতে দিতে হাত পা অবশ হয়ে আসে। ঠোঁট সাদা হয়ে যায়। ঠান্ডায় থরথর করে কখনও কাঁপে।
জতুর কষ্ট হয়। মিছে কথাও বলতে পারে না। পাপ হবে। তাকে দিব্যি দিয়েছে, জতু, আমি ঠিক ডুবে না গেলে, কখনও বলবি না, ডুবে গেছি। বলবি না, আর জলে ডুব দিয়ে কাজ নেই। বললে, তোর পাপ হবে। মিছে কথা বললে, পাপ হয় জানিস!
জতু আজ আলগাভাবেই তেঁতুলগাছের শেকড়ে বসে পড়ল। কতক্ষণে জল থেকে উঠে আসবে কে জানে!
কিন্তু আজ এটা কী করল কমলবউ।
সে তাকাতে পারছে না।
কমলবউ আঁচল শরীর থেকে নামিয়ে দিল।
সেমিজ টেনে খুলে ফেলল শরীর থেকে। তারপর সায়ার ফসকা গেরো টেনে দিতেই, থর থর করে পড়ে গেল পায়ের কাছে। কমল বউ পা দিয়ে সায়াটা তুলে জলে ছুড়ে দিল। শাড়ি ব্লাউজ পা দিয়ে ঠেলে দিল জলে।
কোনও হুঁশ নেই কমলবউয়ের। হাঁসের মতো ঘাটলা থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডুব দিল। কী একটা ঘোরের মধ্যে আছে যেন।
ডাকল, জতু ধর।
সে চোখ মেলে দেখছে, কমলবউ বুক জলে দাঁড়িয়ে সব সায়া শাড়ি সেমিজ ভালো করে জলে ডুবিয়ে ঢেউ দিচ্ছে জলে।
ধর, বসে আছিস কেন!
জলের নীচে মাছরাঙা পাখি হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এক অতীব আশ্চর্য শিহরণ খেলে গেল জতুর শরীরে।
কী, বসে আছিস কেন। এগুলো তুলে রাখ। জলে ভালো করে ডুবিয়ে দিয়েছি। এবং এমনভাবে জলের মধ্যে কমল ঢেউ খেলিয়ে ভাসিয়ে দিল কাপড় জামা যেন এ শাড়ি সেমিজের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
জতু অগত্যা কী করে। লাফ দিয়ে শেকড় থেকে নেমে ভেজা সায়া শাড়ি তুলে রাখল ঘাটলায়।
জতু দ্যাখ, আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি কি না।
কমলবউ ডুব দিল। জলের নাচে তার নগ্ন ফর্সা শরীর সাপের মতো কিলবিল করে এগিয়ে যাচ্ছে।
কমলবউ ডুব সাঁতারে-চিৎ সাঁতারে বড় পটু। তার হাত পা পিঠ দেখা যাচ্ছে। জলে ডুব দিচ্ছে, ভেসে উঠছে। সাঁতার কেটে মাঝপুকুরে চলে যাচ্ছে।
মাঝপুকুর থেকেই চিৎকার করছে, জতু আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি তো! হ্যাংলার মতো জতু চিৎকার করে উঠল, তুমি কোথায়?
ঠিক টের পেয়েছে কমলবউ, জতু ভয় পেয়ে গেছে।
আমি এখানে। বলে কচুরিপানার ভেতর থেকে ভুস করে ভেসে উঠল কমলবউ। কমলবউ তুমি মাঝপুকুরে চলে যাচ্ছ কেন! আর যেও না। ওদিকে বড়ো বড়ো কচুরিপানা, শ্যাওলা, আটকে গেলে ডুবে যাবে। দূরে নদীর জল, জোয়ার, সেখানে পড়ে গেলে ভেসে যাবে।
কমলবউ, ফের কচুরিপানার ভিতর থেকেই হাত তুলে বলল, আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি তো?
তুমি ফিরে এসো কমলবউ। আর যেয়ো না।
কমলবউয়ের আর সাড়া পাওয়া গেল না। কচুরিপানার ভিতর থেকে, হাতও তুলে দিল। কোমর সমান উঁচু কচুরিপানা পার হয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সম্ভব হলেও পুকুরের শ্যাওলা-দামে কিংবা লতাগুলো আটকে যাবে। জলে ডুবে মরে যাবে। লাশ হয়ে ভেসে উঠবে। জতু যে কী করে! জতুর কান্না পাচ্ছিল।
পুকুরের ওপাড়ে যাবে তারও উপায় নেই। জল আর জল, গভীর জল—সামনে যত দূর চোখ যায় জলাভূমি নদী আর তার জলরাশি বেগে নেমে যাচ্ছে। ঘাটলায় শাড়ি সায়া সেমিজ পড়ে আছে—জতু কাউকে ডাকতেও পারছে না। কেবল মাঝে মাঝে চিৎকার করছে, কমলবউ আমার ভালো লাগছে না।
আমি চলে যাচ্ছি। পড়ে থাকল তোমার জামাকাপড়। কী আরম্ভ করলে!
জলের উপর দিয়ে দুটো ফড়িং উড়ে গেল। নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ উঠল। কিন্তু কমলবউ হাত তুলে, কিংবা ডুব সাঁতারে পায়ের কাছে এসে ভেসে উঠল না।
জতু ছুটছে। জতু চিৎকার করছে কমলবউ জলে ডুবে গেছে। যতীন দাস পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে এল। মা জ্যেঠিরা সবাই। খবর ছড়িয়ে পড়লে পুকুর পাড়ে ভিড় বেড়ে গেল। কিন্তু এই জলা জায়গায় খুঁজে দেখাও অসম্ভব। কোথায় পড়ে আছে কে জানে! জলে নেমে গেল কেউ কেউ। কচুরিপানা টেনে তুলে দেখা হল, লগায় খুঁচিয়ে কিংবা জলে ডুবে যতটা পারা যায় তাও দেখা গেল।
মাস্টারমশাই শুধু বললেন, নিমাইকে দেখছি না। সে কোথায়? সে কি বাসলেহর খোঁজে শহরে গেছে?
না হয় জলা জায়গায়, লাশ হলে ভেসে উঠবে। কাকপক্ষী তাড়া করবে। শকুনের ওড়াওড়ি শুরু হবে। জলে ডুবে গেলে ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠবেই। না, কিছুই হল না। কেউ বলল, জলে ডুবেছে না ছাই, ভেগেছে। খোঁজো নিমাইকে। কোথায় গেল নিমাই, খোঁজো তাকে। থানা-পুলিশেও বাদ গেল না। জতুকে ডেকেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ভেগে যাবে তো সায়া শাড়ি ফেলে যাবে কেন? লাজলজ্জা আছে না। জতুর এক কথা, আমি জানি না, আমি কিছু জানি না।
জ্যাঠামশাই বললেন, তোর সামনেই সায়া সেমিজ খুলে ফেলল। তুই পুরুষমানুষ না! কমল তো আচ্ছা বেহায়া মেয়ে দেখছি।
জতু দেখল, মা ক্ষোভে ফুঁসছে ঘরের মধ্যে। সে তার মাকে এতটা রেগে যেতে কখনও দেখেনি। কদিন থেকে মা খেতে বসেও খেতে পারেনি। বমি উঠে আসছে। জ্যাঠামশাইর মুখের উপর মা কথা বলে না, আজ কেন যে এত রেগে গেল।
শহর থেকে নিমাইদা আর ফেরেনি। শহরে খোঁজাখুজি হয়েছে, সেখানেও সে নেই। যতীন দাস ভেজা সায়া শাড়ি তুলে নিয়ে গেছে। রোদে শুকিয়ে জায়গারটা জায়গায় রেখে দিয়েছে! জলা জায়গার স্বভাবই এরকম, কিছুদিন উত্তেজনা–তারপর সব থিতিয়ে যায়। যতীন দাস ফের নতুন একটি বউ ঘরে তুলে এনেছে। ভুরিভোজের আয়োজন যথেষ্ট। যে খেয়েছে সেই বলেছে, বউটি বড়ো সুন্দর হে যতীন। নজর আছে তোমার!
অন্নপূর্ণা
প্রণাম করো। তোমার দিদিশাশুড়ি। ভিড় থেকে আত্মীয়-পরিজনের কে কথাটা বললেন চাঁপা বুঝতে পারল না। প্রায় অন্ধকার ঘরে তিনি শুয়ে আছেন। ঘরে ওষুধের গন্ধ। ডেটলের গন্ধ কিংবা ফিনাইলের গন্ধ, ঠিক কীসের গন্ধ সে বুঝতে পারছে না। সারা রাস্তায় ট্রেনের ধকল গেছে, বিয়ের পাট চুকতে হোমের কাজ শেষ করতে প্রায় রাত কাবার। সারারাত ঘুমোয়নি। সকালেও বান্ধবীরা ছেড়ে যায়নি, ঠাট্টাতামাশায় তাকে উদব্যস্ত করে রেখেছিল। ট্রেনে সামান্য ঝিমুনি, ঘুম বলতে এইটুকু।
শেষে এই বাড়ি।
বাবা বলছেন, এখন থেকে আমরা আর তোমার কেউ না। বাবাজীবনের হাত ধরে বলেছেন, দ্যাখো বাবা ভুলত্রুটি হলে শুধরে নিও। বেয়াইকে বলেছেন, আমার ঘর খালি হয়ে গেল, আপনার ঘর ভরে গেল। আপনি ভাগ্যবান।
এমন সব নানা কথাই মনে পড়েছিল তার। শেষ পর্যন্ত প্রায় অন্ধকার ঘরে কারা তাকে যে নিয়ে এল! পাশে রূপক আছে এই রক্ষা। সে এখনও কাউকেই নিজের মনে করতে পারছে না। অপরিচিত মানুষজন যে যা বলছে করে যাচ্ছে।
রূপক বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। প্রণাম করো। আমার ঠাকুরমা। বৃদ্ধা উঠে বসার চেষ্টা করছেন। তারপর কেমন মিনমিনে গলায় বললেন, কাপড়টা পরতে দে বাবা। বোধহয় এতই কাহিল, সারাদিন এই ঘরটা থেকে নড়তে পারেন না। অস্থিচর্ম সার এই বৃদ্ধাকে প্রণাম করার সময় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। চোখ কোটর গত। চুল শণের মতে, নাতবউকে একজোড়া বালা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। রূপকের সম্পর্কে এক পিসি বালাজোড়া পরিয়ে দিল। সে তো কিছু বলতে পারছে না। বুড়ি ঠাকুমার দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে। বুকের হাড়-পাঁজর দেখা যায়, কতক্ষণে বের হয়ে আসবে।
এই বাড়িতে তাকে থাকতে হবে। তিনি যদি ঘরের বার না হতে পারেন অস্বস্তি কম হবে। যদি বের হতে পারে, সারাদিন প্রায় যেন, তবে চামড়া দিয়ে ঢাকা একটা কঙ্কাল তার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবে। কেমন আতঙ্ক ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছিল।
রাতে রূপক বুকে টেনে নিলে বলল, তোমার ঠাকুমার কী অসুখ?
অসুখ হবে কেন। বয়সের ভার।
চলাফেরা করতে পারেন?
পারেন। তবে বিছানা থেকে একা নামতে পারেন না। ধরতে হয়। দেয়াল ধরে হাঁটেন। বিছানায় পড়ে থাকলে বেডসোর হতে পারে। বাবাকে যমের মতো ভয় পান। সকালে বাবা ধরে নিয়ে যান, বারান্দার ইজিচেয়ারে বসিয়ে দেন। যেখানে বসিয়ে দেবেন, আর নড়বেন না।
চাঁপা বলল, জান আমার না ভয় করে।
কীসের ভয়।
কী ভয় বুঝতে পারছি না।
সে বলতে পারছে না, বাথরুম কিংবা কোনো কাজে একা পড়ে গেলে, তিনি যদি হেঁটে এসে সামনে দাঁড়ান, তার সাহস নেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকার।
বাড়িটাতে অবশ্য লোকজন কম না। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ জা এবং তাদের ছেলেমেয়ে, দুই মেয়ের জামাই, বাড়িটায় অনেকগুলি ঘর, ঘরের মতোই মানুষজনেরা গিজগিজ করছে। ছোটো দুই দেওর ঠাকুমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়েছে। বুড়ি রসিকতায় বেশ তুখোড়, কি লা কোমরে জোর আছে তো। দেখিস মিনসের চাপে তুবড়ে যাস না।
অশ্লীল কথাবার্তা। সে তো একমাত্র মেয়ে, বাবা রেলে কাজ করেন। কত দেশ তারা দেখেছে, ঘুরেছে। মা বাবা আর সে। স্কুলের বাসে ফিরেছে। কোয়ার্টারের লনে ব্যাডমিন্টন খেলেছে। সাদা ফ্রক গায়, পায়ে কেডস। তারপর তার নিজের টেবিল, জটায়ুদা এক গ্লাস দুধ নিয়ে হাজির—দুধ দেখলেই তার মাথা গরম, কত সাধ্যসাধনা, এবং সে কখনো কোনো বুড়ো মানুষ বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দেখেনি। এমন অস্থিচর্মসার তো নয়ই। তার দাদুমণি ঠাকুমা, দিদিমা দাদু বেড়াতে এসেছেন, কিন্তু কী সবল আর হাসিখুশি! মানুষের মুখ তোবড়ানো টিনের মতো হয়, আর দেখলে ভিতরটা এত ঠাণ্ডা মেরে যায় রূপকের ঠাকুমাকে না দেখলে বিশ্বাসও করতে পারত না। কী বিকট চোখ মুখ। ঠোঁট দুটো সাদা। ঠোঁটের কশে ঘা। দাদমণি মারা গেলে বাবা একা গেলেন। ঠাকুমার এখন-তখন, বাবা সবাইকে নিয়ে দেশের বাড়িতে গেলেন। সেও কাটোয়া ইস্টিশনে নেমে ছোটো লাইনে, তারপর কিছুটা গোরুর গাড়ি এবং হাঁটা পথে। সে যে খুব বিরক্ত বাবা ফিরে এসে ভালোই টের পেয়েছিলেন। তবে বাবার জ্ঞাতিগুষ্টির কেউ বুঝতে পারেনি, গাঁয়ের বাড়িতে চাঁপার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ময়লা, নোংরা জামাকাপড়, হাঁটুর ওপর ধুতি, গালে দু-পাঁচদিনের বাসি দাড়ি, দরকচা মারা সব মানুষজন, আলাদা বাথরুম নেই, আলো নেই, পাখা নেই—সে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
এই বাড়িটায় সব আছে। একতলা বাড়ি, বিশাল ডাইনিং স্পেস। ছেলেদের আলাদা ঘর। শেষদিকের দুটো ঘরে রূপকের বাবা মা থাকেন। সে রূপকের বাবাকে এখনও বাবা বলে ডাকতে পারছে না। তবে রূপকের মাকে মা ডাকতে সংকোচ হচ্ছে না তার। সে সারাদিনই মা মা করছে। বাড়িটার সব এত সুন্দর, কেবল বিকট ভূতুড়ে বুড়িটা বাড়িটাকে হত কুৎসিত করে রেখেছে। একদম বেমানান।
বউভাত হয়ে যাবার পর বাড়ি খালি হয়ে গেল।
চাঁপা এখনও কাজে হাত দেয়নি। মা বলছেন, তোমরাই তো করবে। আমার তো বয়স হয়ে গেল। আর পেরেও উঠি না। কাজের লোকের হাতে রান্না কেউ খেতে চায় না। তৃপ্তি পায় না। নিজের মানুষদের জন্য রান্নাবান্নায় আনন্দ আছে চাঁপা। আনন্দটা খুঁজে নিতে হয়। যতদিন পারব, করব। তারপর তোমরা ছাড়া কে করবে।
চাঁপা দরজার পাশে হেলান দিয়ে সব শোনে।
নাও। তোমার ঠাকুমার ঘরে চা দিয়ে এস। ব্যস শরীরে জ্বর এসে যায়। বুড়ি কীভাবে পড়ে আছে কে জানে। ঘরটায় ঢুকতেই তার ভয় হয়। সারা গা চুলকায়। মরামাস ওঠে। হাঁটুতে দগদগে ঘা। মলম লাগানো বলে ঘা আরও কুৎসিত দেখায়। ঘরে ঢুকলে পচা গন্ধও পায়। পা দুটো অস্বাভাবিক ফোলা। যেন টিপে দিলে পুঁজরক্ত বের হয়ে আসবে। মাথার চুল কাগে বগে ঠুকরে নিয়েছে।
মা, ঠাকুমা সকালে চা খায় বুঝি?
খায় পেলে। বুড়ো মানুষ, মাথাও ঠিক নেই। সবাই খেলে তাঁকে দিতে হয়। খান না-খান দেখি না। খুশি থাকলে খাবেন, অখুশি থাকলে কিছুতেই খাওয়ানো যাবে না। তোমাকে দেখে খুব আহ্লাদ হয়েছে। গুনগুন করে গান গাইছিলেন। তোমার বাবাকে ডেকে বললেন, নতুন বউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলো।
মা।
কী!
আমার বাথরুম পেয়েছে।
ঠিক আছে যাও। আমি দিয়ে আসছি।
বউমা তুমি! নাতবউ কোথায়।
ও বাথরুমে গেছে।
আমার নাতবউ কী সুন্দর! ঘর আলো করে রেখেছে। ও কাছে থাকলে বড়ো আনন্দ হয়।
চাঁপা বাথরুমে ঢুকে অক অক করে বমি করল। কেন ওক উঠে এল বুঝতে পারছে না। তারপর মুখ মুছে আয়নায় মুখ দেখল। বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে। সে যে সত্যি ঘর আলো করে আছে আয়নায় নিজেকে দেখলে আরও বেশি টের পায়। ভুরু প্লাক করা। চোখে আইল্যাশ। সকালে ঘর থেকে বের হবার সময়, একেবারে পরিপাটি হয়ে বের হয়েছে। ঘরে ঘরে অ্যাটাচড বাথ। রূপক ঘরে নেই। ঘরে ঢোকার আগে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাড়িটা এত সুন্দর, আর এই বৃদ্ধা বাড়িটাতে কেন যে আছে! না থাকলে কি ক্ষতি ছিল! বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকলেও যেন এক কদর্য অনুভূতি সারা বাড়িটায় ছড়িয়ে রেখেছে।
তোমাকে ডাকলাম, সাড়া পেলাম না। কোথায় ছিলে।
মা, আমি শুনতে পাইনি। ঘরেই ছিলাম।
আতঙ্ক আবার সেই অন্ধকারে মৃতপ্রায় এক রমণীর কাছে তাকে গিয়ে না দাঁড়াতে হয়। মা বললেন, ভয় কীসের। যা কিছু দেখছ সবই তাঁর দয়ায়। তিনি ছিলেন বলে এই সংসার। তোমার বাবারা চার ভাই দু-বোন। কেউ ফেলনা নয়। তিনি তো গাছের মতো আছেন। কত সকালে ফুল ফুটেছে, ফল হয়েছে তারপর হাওয়ায় বীজ উড়ে গেছে কখন, তিনি নিজেও জানেন না। বীজ এখন গাছ হয়ে গেছে। নতুন গাছে নতুন ফুল। ফল। সব কিছু। তাঁকে ভয় পাবার কি আছে। তিনি তো ন্যাড়া গাছ।
শাশুড়িমা ঠিক ধরে ফেলেছেন। সে ঘরটায় যেতে অস্বস্তি বোধ করছে।
বরং নিজের মতো বউমা কাজ খুঁজে নেয়। ঘরে ঢুকে টেবিল চেয়ার, ঝাড়ন দিয়ে পরিষ্কার করে। গ্রিলের ময়লা ন্যাকড়ায় মুছে দেয়। এক দণ্ড যেন তার বসে থাকার উপায় নেই। আসলে তিনি কখন কী বেশে থাকবেন তাও বলা যায় না। সর্বাঙ্গ খালি। কেবল কোমরের নীচে কোনোরকমে কাপড়টুকু গুঁজে রাখেন। গায়ে কিছু রাখতে পারেন না। বুক শুকিয়ে স্তন দুটি জরুলের মতো হয়ে গেছে। চামড়া কুঁচকে অসাড় হয়ে গেছে। মানুষকে তো আর মেরে ফেলা যায় না যতদিন আছে। সেবা শুশ্রুষা করে যেতেই হবে।
চাঁপা সারাক্ষণ এ-ঘর ও-ঘর করে। শুধু ওই ঘরটায় দিকে তাকাতে পারে না। খেতে বসলেও অস্বস্তি। কখন না বের হয়ে এসে পাশে দাঁড়ান-মাথায় হাত রেখে নাতবউকে আদর করেন। পারতপক্ষে সে একা খেতে বসে না। খাওয়া তো নয় গেলা। তারপর নিজের ঘরে সারা দুপুর দরজা বন্ধ করে থাকা। রূপকের মোটরবাইকের শব্দ পেলেই সে উঠে বসে। জানালা খুলে মুচকি হাসে। ধড়ে তার প্রাণসঞ্চার হয়।
ওই ঘরটা এড়িয়ে চলার বিষয় ধীরে ধীরে সবার নজরে পড়ে গেছে। চাঁপা অপরাধী মুখে সবার সঙ্গে কথা বলে। শ্বশুরমশাই ঘরে তখন শাসাচ্ছেন, কাপড় খুলে ফেলছ কেন? চল বারান্দায় বসবে।
শরীরে কী আর কাপড়ের দরকার আছে বাবা। কাপড় যে রাখতে পারি না। এখন থাক সময় হলে না হয় কাপড় দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিস।
বাবা বোধহয় জোর করে শায়া পরিয়ে দিচ্ছে।
বুড়ির চিলচিৎকার, আরে অধম্মের বেটা, আমাকে তুই মেরে ফেলতে চাস। শরীরে কিছু না থাকলে কী হয়!
চাঁপা জানে বাবা নিজেই বুড়ির কাপড় শায়াতে গুঁজে, সারা শরীর কাপড়ে ঢেকে, ধরে ধরে বারান্দায় এনে বসিয়ে রাখবেন। যতক্ষণ পারা যায়, ঝিম মেরে বসে থাকেন আর বিড়বিড় করে বকেন। শাপশাপান্ত করেন কি না সে জানে না। কারণ বুড়ি যেদিকটায়, সে তার বিপরীত দিকে। চোখে পড়ে যাবে ভেবে সে এখন সোজা তাকিয়ে হাঁটে না।
দেখলে বমি উঠে আসে। মানুষ তো না কঙ্কাল। রাতের বেলা ঘরে একলা ঢুকতেও ভয়। রূপক কিছুক্ষণ তার ঠাম্মার ঘরে বসে মজা করে। অন্য দুই দেওর মন্টু ও রন্টুও ঠাম্মাকে নিয়ে রঙ্গেরসে মেতে যায়। তার তখন রাগ হয়। ঘেন্নাপিত্তি নেই।
রূপক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জড়িয়ে ধরতে গেলেই এক কথা—না। আমার কিছু ভালো লাগছে না। হাত পা ভালো করে ধুয়ে এসো। তারপর চোখের জলে ভাসায়। বাপের বাড়ি দিয়ে আসতে বলে। এত আতঙ্ক আর অস্বস্তি নিয়ে সে এই সংসারে আর লেপটে থাকতে রাজি না। বুড়ির শেষ খবর পেলে সে আবার ফিরে আসবে। তবে মুখে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাবার জন্য বায়না ধরে ঠিক, কিন্তু সবাই বুঝিয়ে বললে, নিজেকে কেন জানি বোকা লাগে। রূপককে ছেড়ে থাকতেও তার এখন কষ্ট। কী যে করে।
সারাদিন আজ সে ওদিকে মাড়ায়নি। সে আজ বেশ খুশি। জানালায় তার মুখ যে যায় সেই বলে ধীরাজবাবুর পুত্রবধূ লক্ষ্মী প্রতিমা। কী সুন্দর। চোখ আছে ভদ্রলোকের। সে তখন আয়নায়, সে তখন বাথরুমে, নিজেকে দেখতে দেখতে কেমন অভিভূত হয়ে পড়ে। পুষ্ট স্তন, উরুমূলে বিজলি বাতির প্রভা, কালো মেঘের মতো চুলের ঢেউ, আর শরীরে আশ্চর্য সুষমা। বড়ো হতে হতে টের পেয়েছে, শরীরে একটা ফোসকা পড়লেও কষ্ট।
দামি লোশন, এবং বাজারের সব বিজ্ঞাপনের ছবির মতো তার বাড়িটায় উড়ে বেড়াতে ভালো লাগে। কেবল ওই ঘরটার দিকে চোখ গেলেই হিম হয়ে যায় শরীর।
সাঁঝবেলার আগেই ছাদ থেকে সে সবার জামা প্যান্ট শাড়ি শায়া নামিয়ে আনে। রবিবার বলে রূপক বিছানায় আটকে রেখেছিল, সারা দুপুর বিকেল সে শরীরের সর্বস্ব দিয়ে রূপকের সঙ্গে মেতেছিল—তারপর বাথরুম এবং আয়না, পাতায় আইল্যাশ, চোখের নীচে নীলাভ রঙের পালকের স্পর্শ সেরে যখন বের হয়ে এল একেবারে অপ্সরা।
ও বউমা ছাদ থেকে জামাকাপড় নামিয়েছ? এ-কাজটা এখন সে বাড়ির করে থাকে। জিভ কেটে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল। আশ্চর্য আকাশ মাথার ওপর, নীল নক্ষত্র আকাশে ভাসমান, বসন্তের শীতল হাওয়া—তার ছাদ থেকে নেমে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর তখনই মনে হল, এই বাড়ির এক কোণে জ্যান্ত এক নরকঙ্কালের বাস। সঙ্গে সঙ্গে ভয়। ছুটে তার থেকে সব টেনে পড়িমরি করে নেমে আসতেই সে দেখল চাতালের অন্ধকারে কিছু নড়াচড়া করছে। সে কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। তব নামতে হবে। সিঁড়ির পাশে কেউ-কে সে। অন্ধকারে দেখল, বুড়ি খুট খুট করে ট্রাঙ্কের ভিতর চাতালের নীচে কী খুঁজছে।
শরীর তার হিম হয়ে গেল। বেহুশ। কোনোরকমে দেয়াল ধরে বসে পড়ল। তারপর গোঙানি।
এই ঘটনার পর পরই বউমাকে ধীরাজবাবু বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যা হয়—বর্ষা নামতেই বাড়ি ফাঁকা করে তিনিও চলে গেলেন। শরীর তাঁর সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হল।
খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন, চাঁপা এবং তার বাবা মা ভাই বোন সবাই এল। সবারই কৌতূহল, সিঁড়ির চাতালের নীচে কী দেখে ভিরমি খেয়েছিল বউমা!
ঠাকুমা চাতালের নীচে কী খুঁজছিল।
কী করে হয়! মাকে ধরে না নিয়ে গেলে কখনো যেতে পারেন না।
আমি যে দেখলাম বাবা।
ধীরাজবাবু বললেন, ওখানে আছে তো কটা ভাঙা ট্রাঙ্ক। মা ফেলে আসতে চাননি দেশের বাড়ি থেকে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
সিঁড়ির চাতালের নীচটা পরিষ্কার করতে গিয়ে চাঁপা সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাঠের বাক্স পেয়ে গেল একদিন। সে গোপনে ঘরে নিয়ে বাক্সটা খুলল। কিছুই নেই। সাদা ন্যাকড়ায় জড়ানো একটা খাম। খুব যত্নের সঙ্গে রাখা। খামে আশ্চর্য সুন্দর এক টুকটুকে নতুন বউয়ের ফোটো।
সে ছুটে গেল বারান্দায়।
ধীরাজবাবু চা খাচ্ছিলেন।
কী ব্যাপার! হাঁপাচ্ছ কেন!
দেখুন দেখুন। কী সুন্দর না দেখতে নতুন বউটি! ছবিটি দেখে ধীরাজবাবু বললেন, আমার মার ফোটো। যেই বাড়িতে আসত, বলত, হ্যাঁ অন্নপূর্ণাই বটে। কী সুন্দর চোখ মুখ। ছবিটা মা কিছুতেই হাতছাড়া করত না। কোথায় পেলে! আমরা কিছু বললে, বলতেন, কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না। মা বোধহয় সেদিন সিঁড়ির চাতালের নীচে ছবিটা খুঁজতে গেছিলেন। নিজের ছবির সঙ্গে মানুষের শেষ ছবির তফাত কত খুঁজে দেখছিলেন বোধহয়।
অবলম্বন
ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
টুকু ধরফর করে উঠে বসল তক্তপোষে। কখন মেঘ করেছে আকাশে টের পায়নি। দাবদাহ চলছে। চৈত্র গেল, বৈশাখের মাঝামাঝি, এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। গরমে দিনরাত হাসফাঁস, লু বইছে। দরজা জানালা খোলা রাখার উপায় নেই। গরম বাতাসে গারে জ্বলুনি, প্যাঁচপেচে ঘাম। আর এ-সময় ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে ভাবা যায় না।
টুকু দৌড়ে তক্তপোষ থেকে বারান্দায়, তারপর উঠোনে। তারে মেলা সায়া শাড়ি, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় টেনে আবার ঘরে। হাওয়া দিচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া। টুকুর শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ায়।
তাপরই মনে হল, দুদুমণি কোথায়। ঘর খালি। কুকুরটা বারান্দায় শুয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে বলেই হয়তো লেজ নাড়তে নাড়তে উঠোনে নেমে গেল। দুদুমণি বাড়ি থাকলে, কুকুরটা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না। সে থাকলেও। কেউ একজন না থাকলে বাড়িতে কুকুরটাও থাকে না। কুকুরটাও বাড়িতে! দুদুমণি গেল কোথায়।
সে গেলে কুকুরটা পেছনে ল্যাকপ্যাক করে হাঁটে।
দুদুমণি গেলে কুকুরটা পেছনে ল্যাকপ্যাক করে হাঁটে।
সেই কুকুর বাড়িতেই আছে। কুকুরটাই তাদের এখন পাহারাদার। দুদুমণি একা রোদে কোথায় বের হয়ে গেল।
আমগাছতলায় থাকতে পারে। ঝড় উঠবে আশঙ্কায় যদি বুড়ি গাছতলায় ছুটে যায়। আম, জাম, জামরুলের গাছ বাড়িটার চার পাশে। কাঁঠাল গাছও আছে। লেবু সফেদা গাছ, যে দিনের যে ফল দাদু নিজ হাতে লাগিয়ে গেছেন। একটা আম চুরি গেলে দুদুমণির চোপার শেষ থাকে না।
টুকু রেগে গেলে, বুড়ি মরতে গেছে ভাবে। ঝড়ে আম পড়বেই। লোকজন সব তাঁদের তাও তার জানা। ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে থাকারও স্বভাব আছে পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের। দুপুরে বিকেলে কোথা থেকে যে পঙ্গপালের মতো তারা উড়ে আসে বোঝা দায়। দুদুমণি লাঠি হাতে তাড়া করবে। পারে। একদিকে তাড়া করলে অন্যদিকের বোপ থেকে উঠে আসে তারা। না পারলে চেঁচামেচি, ওরে টুকু সব সাফ করে দিল। না পারলে, ওরে নধর সব শেষ করে দিল। কে বেশি বিশ্বাসী তখন বোঝা ভার। সে না নধর। আর নধরও হয়েছে তেমনি, কোথা থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসবে। ছুটে যাবে, ঘেউ ঘেউ করবে। মুহূর্তে গাছপালা সাফ।
আজ তেমন কিছু হলে নধর নিশ্চিন্তে বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারত না। দুদুমণি গাছতলায় থাকলে সেও গাছতলায়। ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে মুহূর্তে ঘর বাড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল। আকাশে মেঘের ওড়াউড়ি। ঝড়ও উঠে গেল। অথচ দুদুমণির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
সে দরজা পার হয়ে উত্তরের বারান্দায় গেল। না দুদুমণি নেই।
বারান্দায় ছোট্ট চালাঘর, টালির ছাউনি, মাটির মেঝে, উনুনে কাঠপাতায়, রান্না, দুদুমণির খাওয়া খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে—একবেলা আহার, সহজে পাত থেকে উঠতে চায় না। যদি খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে, রাগ হলে টুকুর এমনই সব মনে হয়।
সে বারান্দা থেকে অগত্যা নেমে গেল।
বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজতেও আরাম লাগছে। কিন্তু দুদুমণি গেল কোথায়। তাকে না বলে কোথাও যায় না। অবশ্য যায় না বললে ভুল হবে, এই নগেনের বাড়ি থেকে আসছি বলে, কোথায় কার বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে বলা মুশকিল। এক বাড়ি থেকে আরও দশ বাড়ি ঘুরে বেশ বেলা করেই হয়তো ফিরে এল। তারপর দশরকমের কৈফিয়ত দিয়ে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খাওয়া।
খেতে খেতে গ্লাস নামিয়ে বলা, আমি তো বসে থাকি না দিদি, কাকে দিয়ে কী উদ্ধার হয়, তাই সমরেশের বাড়ি হয়ে এলাম…
টুকু বিরক্ত হলে না বলে পারে না, দয়া করে থামবে বিরজাসুন্দরী। বকর বকর ভালো লাগছে না। কখন রাঁধবে, কখন খাবে। আমি রাঁধলে মুখে রোচে না।
হয়ে যাবে। তুই চান করে দু-বালতি জল তুলে রাখ। পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এলাম বলে।
সে রেগে গেলে দুদুমণি আর দুদুমণি থাকে না, বিরজাসুন্দরী হয়ে যায়।
রাগ হয় না! জোরে হাঁটতে পারে না, কানে শোনে না, চোখে দেখে না ভাল, কোথায় গিয়ে মরে পড়ে থাকবে—এই এক দুশ্চিন্তা তার। রাগ জল হতে অবশ্য সময় লাগে না—কেমন অপরাধী বালিকার মতো তখন কথাবার্তা বিরজাসুন্দরীর।
আমার কী দোষ। নগেনের বউ যে খবরটা দিল।
আবার খবর।
তা দিলে কী করব। ওদেরই বা দোষ কী, ওরা তো জানে তোর জন্য আমার মাথা খারাপ। রাতে ঘুম নাই।
টুকু বুঝতে পারে তখন, হয়ে গেল, সেই এক প্যাচাল সাতকাহন করে বলা, কাকে না ধরেছে তার খবর দেওয়া, কেউ তো মাথা পাতছে না, রাগ করলে হয়।
এই খবরের কথা শুনলেই টুকুর মাথা গরম। আবার মরতে গেছিলো তোমাকে কতবার বলেছি, আমার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার এক পেট চলে যাবে।
তোর এক পেট, তুই মেয়েমানুষ না। সোমত্ত মেয়ের কখনো এক পেট থাকে। টুকু জানে বিরজাসুন্দরীর মুখে এমনিতেই আগল নেই। সোমত্ত মেয়ের এক পেট মানতেই রাজি না। বিয়ে না হলে মেয়েমানুষ হয়ে কাজ কী।
তুই কি পুরুষমানুষ, তোর এক পেট হবে!
পেট কথাটা কানে বড়ো লাগে। এমন কতরকমের কথা হয়—সে পছন্দ করছে না, বিরজাসুন্দরী হন্যে হয়ে ঘুরুক। তার অপমানের দিকটাও বিরজসুন্দরী বোঝে না। সকালেই কথা কাটাকাটি হয়েছে-মালা-তাবিজের কথাও উঠেছে, কবজ ধারণ করলে, পাত্রপক্ষ আর ফিরে যাবে না। কোথায় কার কাছে খবর পেয়েছে, কিংবা পালন কাকার পরামর্শেও বিরজসুন্দরী যে মাথা মুড়িয়ে আসেনি কে বলবে।
গন্ধর্ব কবচ সোজা কথা না! বিরজাসুন্দরী বিড়বিড় করে নিজেই প্যাচাল শুরু করে দিয়েছিল।
টুকুর আর সহ্য হয়নি।
তাগা তাবিজ পরতে হয় তুমি পরবে। আমার পেছনে লাগবে না বলে দিলাম। তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে বসে থাক। দেখতে হয় তোমাকে দেখুক।
তোকে কিছু বলেছি। এতো চোপা।
তবে কাকে বলছ?
নধরকে বলছি। একটা কুকুর সেও বোঝে আমার কষ্ট, তুই বুঝবি কী, তোর কি কোনো ভাবনা আছে! খাস আর ঘুমাস।
টুকু বুঝেছিল, দুদুমণিকে বুঝিয়ে লাভ নেই। যা ভাববে শেষ পর্যন্ত তা করবে। স ক্কাল বেলায় কোনো তিক্ততাই সুখের হয় না। বড়োমাসিও বুঝিয়েছে তাকে, মা আমার কী করবে বল। তোকে কার কাছে রেখে যাবে, এই ভাবনাতে ঘুম নেই চোখে। মার এক কথা, আমি চোখ বুজলে টুকুর কী হবে!
টুকু যে বোঝে না এ-সব তো নয়। ঠিকই বোঝে। পছন্দ হলেও দাবিদাওয়া নিয়ে আটকে যায়। তার হয়ে এই খরচের বহর কেউ নিতে রাজি না। পাসটাস করা ছেলের খাঁইও কম না। সরকারি চাকুরের তো মেলা দাম। তার একটা দুটো পাস থাকলেও না হয় কথা ছিল, তার তো কিছুই নেই। মায়ের মুখ মনে পড়ে না, বাবারও সে দোষ দেয় না, একা মানুষ, সংসার সামলাবে কে? বাবা তার নিজের সংসার, স্ত্রী বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই জেরবার। বছরে দু-বছরে তাকে দেখতে এক আধবার চলেও আসে। এই আসাও যে কত গোপনে, সে তার বাবার মুখ দেখলেই টের পায়।
বাবা এলে চোরের মতো বসে থাকে বারান্দায়। বাবা কথা কম বলে—তখন দুদুমণির মুখের কামাই নেই। বাবাকে দেখলে আরও খেপে যায়। সোমত্ত মেয়ে আর কালসাপ সমান, তুমি না তার বাপ, রাতে ঘুমাও কী করে বুঝি না। ভাত হজম হয় কী করে বুঝি না।
টুকু তখন ভারি বিড়ম্বনায় পড়ে যায়।
দুদুমণি তুমি থাকবে?
বিরজাসুন্দরী থামবার পাত্র, আগুনে ঘি পড়ে যাবার মতো ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠবে।
থামব। চিতায় উঠে থামব। আলগা সোহাগ দেখাতে কে বলে! কীসের টানে আসে! কর্তব্য অকর্তব্য বলে কথা। আমি হলে মুখ দেখাতে পারতাম না। এ কেমন বাপ, দায় আদায় বোঝে না।
সে না পেরে, বাবাকে সান্তনা দেয়, তুমি কিছু বাবা মনে কর না। দদমণির মাথাটা গেছে। এই নাও গামছা, পুকুরে ডুব দিয়ে এস। দুপুরে খেয়ে যাবে।
বাবা বাধ্য ছেলের মতো উঠে যায়। পুকুর থেকে ডুব দিয়েও আসে। মেয়ের টানে যে আসে বোঝাও যায়। খেতে বসলে, সে পাখার হাওয়াও করে। সে তার সুন্দর কারুকাজ করা আসন পেতে দেয়। ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে জল, দুদুমণি চোপা করে ঠিক, তবে জামাই আদরে যে খেতেও দেয় তাও সে বোঝে।
কুমড়োফুলের বড়া করেছি। আর দুটো নাও।
বাবা কুমড়োফুলের বড়া খেতে ভালোবাসে। গন্ধরাজ লেবু খেতে ভালোবাসে। দুদুমণির এতটুকু কার্পণ্য নেই। জামাইটির কথা ভেবে যে তিনি এক দণ্ড আগে তেতে উঠেছিলেন, যা খুশি মুখে আসে বলে গেছেন, খাওয়ার পাত দেখে মনেই হবে না।
একটু আমের আচার দে তোর বাবাকে।
আর একটুকরো মাছ দে।
মুড়িঘন্ট কেমন হয়েছে?
পায়েসটুকু খাও। তাও যে আস, এই আমার অনেক। সম্পর্ক তো চেষ্টা করলেও মুছে ফেলা যায় না। আমি আর ক-দিন, চেষ্টা তো কম করছি না।
বাবা কোনো কথারই জবাব দেবে না। অপরাধ বোধ সে বোঝে। খোঁড়া মেয়েটার দুর্ভাগ্য তাও বোঝে। চুপচাপ খেয়ে উঠে বাবা আবার বারান্দায় জলচৌকিতে গিয়ে বসলে, দুদুমণিই বলবে, টুকু বিছানাটা করে দে। একটু গড়াগড়ি দাও। বেলা পড়লে রওনা দেবে।
ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি এল, ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি চলেও গেল।
গাছের নীচে ভাঙা ডালপালা, আমের কুশির ছড়াছড়ি—আম ডাঁসা হতে সময় লাগে, হনুমানের উৎপাতে কিছু রাখাও যায় না। মানুষের উৎপাত তো আছেই। গাছে আম ডাঁসা হতে থাকলেই বিরজাসুন্দরী চঞ্চল হয়ে পড়ে। দিবানিদ্রাও যায় না। হাতে লাঠি নিয়ে ঠুকঠুক করে গাছতলায় গিয়ে বসে।
যদি গাছতলায় বসে থাকে। টুকু দরজায় শেকল তুলে দিল।
ঝড় বৃষ্টির মধ্যে গাছতলায় বসে থাকবে। হয় কী করে। তবে বিরজাসুন্দরীর অসাধ্য কর্ম কিছু নেই। ঝড়ে গাছ থেকে আম পড়তেই পারে, ঝড় বৃষ্টিতে ছুটে যেতেও দ্বিধা করবে না। যদি বাগানে ঢুকে বসে থাকে, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ঠিক। ঝুড়িতে আম তুলেও রাখতে পারে। খোঁজাখুঁজির তো শেষ নেই। ঝোপ জঙ্গলে দু একটা থেকে যদি যায়, ভিজে গিয়েও হাতড়াতে পারে। সহজে গাছতলা থেকে আসার পাত্র যে নয় ভেবেই টুকু ডাকল, দুদুমণি তুমি কোথায়। অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে শরীর খারাপ হবে বোঝো।
কোনো সাড়া নেই।
গাছগুলি সব পর পর দাঁড়িয়ে আছে। টুকু মাথায় সামান্য আঁচল টেনে, উঠোন পার হয়ে কাঁঠাল গাছটার নীচে এসে দাঁড়াল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, গরমের এই বৃষ্টিতে বসুন্ধরা ঠান্ডা। গাছপাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। দু-তিন বিঘে জমি জুড়ে বাঁশঝাড়, ফলের গাছগাছালি, হলুদের জমি সবই ঠান্ডা মেরে গেছে। কিন্তু গাছতলায় দদমণি নেই। ভাঙা ডালপালার ছড়াছড়ি। ঝড়টা জোর হয়েছে ঘুমের মধ্যে টের পায়নি। কিংবা তার মনে হয় সে জেগেই ছিল, সে তো বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে সায়া সেমিজ শাড়ি তুলে নিয়ে ঘরে রেখেছে, ঝড় প্রবল হলে সে টের পেত। কিংবা ঝড় শুকনো ডালপালা খসিয়ে উড়ে গেছে, তারপর ঝুপঝাপ বৃষ্টির শুরু। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় মনোরম শব্দ শুনেই হয়তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।
গাছতলায় দুদুমণি নেই। বাঁশঝাড়ের দিকেও গেল, বাড়িটার সঙ্গে বিরজাসুন্দরীর এতো ভাব যে কখন কোথায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে বলা যায় না। অবলম্বন বলতে, সে আর এই বাড়ির গাছপালা। পাতা থেকে শুকনো ডাল সবই বড় দরকারি—সবই জড় করে রাখা স্বভাব। কোথায় কী জড় করছে কে জানে। পুকুরপাড়ের দিকটায় যদি থাকে। নারকেল গাছগুলি দুদুমণির চিরশত্রু। কচিকাচা ডাবও গাছে রাখা যায় না। কে যে কখন সব চুরি করে নিয়ে যায়। এই গাছগুলি নিয়ে বিরজাসুন্দরী ঝড় ফাঁপড়ে আছে।
না নেই। সব ফেলে, না বলে না করে উধাও।
কী যে করে!
ফের বারান্দায় উঠে দরজায় শেকল খুলে টুকু ভিতরে ঢুকল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে অবাক। বিরজাসুন্দরীর সাদা পাথরের রেকাবিতে ভাত, কালো পাথরের বাটিতে ডাল, ভাজাভুজি যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। কিছু মুখে দেয়নি।
টুকুর বুকটা ছাঁত করে উঠল।
না খেয়ে বের হয়ে গেছে!
কোথায় যেতে পারে? তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল—ঠিক আবার কোনো ধান্দাবাজের পাল্লায় পড়ে গেছে। ঘটক সেজে সবাই উপকার করতে আসে।
তা ঠাইনদি, পাত্র বড়োই সুপাত্র। আপনার টুকুকে একবার দেখতে চায়। বলেন তো পাত্রের বাবা মাকে আসতে বলি।
তখন বুড়ির যে কী হয়! সাপের পাঁচ পা দেখে। এরা যে টাকা হাতড়াবার তালে থাকে কিছুতেই বিরজাসুন্দরীকে বোঝানো যাবে না। গাড়ি ভাড়ার নাম করে পালান কাকাই কতবার টাকা নিয়ে গেল। ঠিকমতো দুধ জোটে না, কৃপন স্বভাবের বিরজাসুন্দরী ফোকলা দাঁতে হাসিটি জুড়ে দিয়ে বলবে, যার কেউ নেই, তার ভগমান আছে, তোরা আমার ভগমান।
এখন যে আর এক ভগমানের পাল্লায় পড়ে গেছে টুকুর বুঝতে অসুবিধা হয়। না।
গন্ধর্ব কবচ। সকালেই একবার বিড়বিড় করে বকেছে, হাতে গলায় যেখানেই হোক তিথি নক্ষত্র দেখে ধারণ করতে হবে। আজই সেই তিথি নক্ষত্রের সময় যদি উপস্থিত হয়, কে জানে তারই টানে বের হয়ে গেল কি না।
যা খুশি করুক।
কিন্তু টুকু যাই বলুক, তারই হয়েছে জ্বালা। বড়োমামা মাসেহারা পাঠিয়ে খালাস। মাসের এক তারিখও পার হয় না, রাস্তায় গিয়ে বসে থাকবে। পিওন সুবলসখা যদি সাইকেলে যায়। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে বলবে, খোকার টাকা হয়েছে?
রোজ রোজ কে আর জবাব দেয়, জবাব না দিলেই মাথা গরম বিরজাসুন্দরীর। —তোর বাপের টাকা, বাপ ঠাকুরদার চোদ্দোগুষ্টির উদ্ধার। তারপর টুকুকে ভিজা গলায় বলবে, যা না পোস্টঅফিসে, সাইকেলে যেতে কতক্ষণ। দীনুকে বলবি মাসের আট তারিখ, মানি অর্ডারের নাম গন্ধ নেই।
তখনই বিরাম মাঝির বাউন্ডুলে ছেলে শরদিন্দুকে দেখে টুকু অবাক। টুকু বারান্দা থেকে মুখ বার করে দেখল, শরদিন্দুই। সবাই বলে খ্যাপা। সে ভাবে বাউন্ডুলে। লোকে খ্যাপা বললে তার রাগ হয়। লোকের কী দোষ, বাপই বলে বেড়ায়, মাথা খারাপ, ছেড়া ফাটা জামা কাপড় পড়ে বেড়ায়, আমার কীসের অভাব! মাথার দোষ না হলে কেউ এ-ভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। নিখোঁজ ছিল কতদিন। মাঝে মাঝেই নিখোঁজ হয়ে যায়। আগে থানা পুলিশ, ঘুরাঘুরি শেষ ছিল না। এখন সব হয়ে গেছে। দুদুমণি খোঁজ খবর নিতে গেলে এক বাক্যে সারা—পুত্র আমার পর্যটনে বের হয়েছে ঠাইনদি। পর্যটন ফেরে বাড়ি ফিরবে।
এবারে পর্যটন সেরে ফিরে এলে বিয়ে দিয়ে দাও। ঘর বাড়িতে শেকড় না গজালে থাকবে কেন! মন উড়উড়। তোমারও তো এই বয়েসটা ছিল, বোঝো না কষ্টটা কীসের।
সব বুঝি ঠাইনদি। তবে দেবেটা কে। একখানা কলসি সঙ্গে দিলে সুবিধে হয়। পুত্র আমার মূত্রের সমান ঠাইনদি। কিছু আর ভাবি না। যা আছে কপালে হবে।
এ-কথা বলতে নাই। দশটা না পাঁচটা, এক ব্যাটা তোমার। মুখে আগুন দিতেও লাগবে। কবিরাজ দেখাচ্ছিলে না।
ও নিজেই ধন্বন্তরী, বলে কিনা, সব উজাড় হয়ে গেছে, কিছু নেই, ধাপ্পা, লোক ঠকানো ব্যাবসা। আনারসের ডিগ চিবিয়ে খাচ্ছে—সঞ্জিবনী সুধা পান করছে ভাবে। ঘরে ক-দিন মানুষ থাকে—ঘর তার ভালো লাগে না। মা জননী চোখের জল ফেললে এক কথা, জগজ্জননী বৃহৎ ব্যাপার। মহাবিশ্ব নিয়ে তার কারবার ঠাইনদি। লেখাপড়াই ব্যাটার কাল বুঝলেন ঠাইনদি। আপনার বউমারে কত বুঝিয়েছি, দ্যাখো আমি মুদির ব্যাটা, নম নম করে আতপ চাউল ছিটাতে জানলেই হয়, বেশি বিদ্যার দরকার নাই। শুনল না, শহরে পাঠাল দিগগজ করতে, নে এবারে বোঝ–মাথায় কাকের বাসা নিয়ে হাজির। যখন তখন ডিম পাড়ছে আর এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে। সাধ্য কী আটকায়।
দুদুমণির কার সঙ্গে কী কথা হয় বাড়ি ফিরে বলা চাই। শরাটা আবার পাগল হয়ে গেছে টুকি। বাড়ি থেকে পালিয়েছে—বিরাম বাজারে যাবার সময় বলে গেল, টুকুর কাছে যদি যায়, খবর দিতেন। সে তো কবেকার কথা। মাসখানেক হয়ে গেল। শরা দেশান্তরী হয়েছিল, ফিরে এসেছে তবে।
এদিকেই আসছে। বাড়ি ঢোকার রাস্তা থেকেই চিৎকার করছে, জয় টুকুদির। কতদিন তোমাকে দেখি না টুকুদি। থাকতে পারলাম না। ভাবলাম যাই দেখি, টুকুদির হাতের যশ দেখি। ওই যে তুমি কাঁথায় চন্দ্র সূর্য নামিয়ে আনবে বলেছিল, সেই বল কাল। চন্দ্র সূর্য নামাতে পারলে!
টুকুর সূচিশিল্পে যশ আছে। সুচসুতোর মধ্যে প্রাণের রস সঞ্চার না করতে পারলে এমন ছবি নাকি ফুটে ওঠে না। দু-দুবার তার হাতের কাজ প্রদর্শনীতে প্রাইজ পেয়েছে। নকশি কাঁথার বাজার আছে এমনও শুনেছে সে। কাঁথার ফুল ফল গাছের ছায়া আকাশ এবং চন্দ্র সূর্য নিয়ে পড়ে আছে শরার কথাতেই। কত খবর রাখে, তা ঘোরাঘুরি করলে খবর না রেখেই বা উপায় কী!
শরাই কলেজ একজিবিশনে প্রায় জোরদার করেই দুটো তার হাতের কাজ নিয়ে যায়। শরা জোরজার না করলে হত না। শরা এক সকালে এসে ডেকেছিল, টুকুদি আছ?
কে?
আমি শরা টুকুদি।
তুমি কোথার? ঘরের ভিতর টুকু ঝাঁট দিচ্ছিল। সে ঝাঁটা হাতে নিয়ে উঁকি দিলে বলেছিল, ও বাবা হাতে ঝাঁটা, ঝাঁটাপেটা করবে! কী দোষ করেছি!
তোর আজ কলেজ নেই।
কলেজেই যাচ্ছি। কলেজ কম্পাউন্ডে মেলা বসবে। বই-এর মেলা—সঙ্গে হস্তশিল্প। ভাবলাম টুকুদির কাছ থেকে দুটো হস্তশিল্প নিয়ে যাই—চোখ ধাঁধিয়ে দেই।
হয়েছে থাক। বোস।
সাইকেল থেকে নামাল না পর্যন্ত।
কই দেখি।
পাগলামি করবি না।
আচ্ছা তুমি কী টুকুদি! আমি তোমার সঙ্গে মিছে কথা বলতে পারি! ঘরে পড়ে থাকলে কে মর্ম বোঝে। দেখই না দিয়ে।
না কিছু হয়নি। তুই যা।
কেন ওই যে দুটা ময়ূর উড়ে যাচ্ছে, ওটা দাও। আর পাহাড় ঝরনা নদী আছে যেটায় ওটা দাও।
বোকার মতো কথা বলবি না তো! বাড়ি বসে থাকি, কিছু নিয়ে থাকতে হয়। দুদুমণির মতো তোরও দেখছি আমার সবকিছুতেই যশ খুঁজে পাস।
যশ না থাকলে কে কার প্রশংসা করে! দাও তো। আমার সময় নেই। মেলা কাজ। আমরা আর্টসের ছাত্ররা স্টল নিয়েছি আলাদা। ওখানে বাঁধিয়ে রাখব। লোকে আমার টুকুদির কাজ দেখে ভিড়মি খাবে—কী আনন্দ। দেরি কর না টুকুদি। ঝাঁটা ফেলে শিল্পটুকু দাও তোমার।
এরপর আর পারে!
নে নিয়ে যা। হারবি না কিন্তু। হারালে দুদুমণির চোপার চোটে ভূত পালাবে বলে দিলাম। যা মুখ!
বড়ো ছেলেমানুষী স্বভাব শরদিন্দুর। বয়সে তার বয়সিও না, বড়ই হবে, অথচ সেই ছেলেবেলা থেকেই টুকুদি টুকুদি করে। আর সে বামুনের নাতিন বলে হেয় জ্ঞান করার স্বভাব আছে তার। মাঝির বেটা কলেজে পড়ে এটাও হেয় জ্ঞানের কারণ হতে পারে। অথবা কিছুই হয়তো নয়, অভ্যাস, কেউ যদি দিদি দিদি করে আনন্দ পায় সে বাধা দেবার কে?
শরার এখন সাইকেলখানা কোথায় টুকু জানে না। এমন সুন্দর ছেলেটার মাথা খারাপ ভাবতেও খারাপ লাগে। না ভেবেও উপায় নেই, কলেজ কবেই ছেড়ে দিয়েছে। বই পড়ে, তবে ভারী ভারী বই। এই সব বইই নাকি তার মগজে ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার এক কথা, টুকুদি, এই মহাবিশ্বটি বড়ো আজব কারখানা। ভাবলে মাথা ঘোরায়। কত আজগুবি কথাও যে শরা বলে।
উঠোনে দাঁড়িয়েই শরা এদিক ওদিক চুপি দিল। কেউ নেই। গেল কোথায়! সে ফের ডাকল, গেলে কোথায় টুকুদি, তোমার জয় দিলাম। মুখখানাও দেখলাম বারান্দায়, তারপর কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছ।
সে সাড়া দিল না।
দুদুমণি না খেয়ে না বলে কোথায় চলে গেছে, খারাপ লাগে না! সে যে গলার কাঁটা দুদুমণির তাও বোঝে। তাই বলে গন্ধর্ব কবচ, হয়! মানুষের বিবেক সাফ না থাকলে কিছু হয় না। বিবেক সাফ থাকলে কি শেষে শরা হয়ে যেতে হয়।
টুকুদি তোমার আবার জয় দিচ্ছি। একবার বের হও না। কতদিন পর এলাম, একবার ঝলমলে দেবী মুখখানা দেখি। আরে বাবা, গাছে তোমাদের কত আম। ওই গাছটা কথা বলতে পারে। গাছে রাশি রাশি আম ঝুলছে, কাঠবিড়ালি উঁকি দিয়ে আছে। কাক শালিখ উড়ে আসছে—তাজ্জব ব্যাপার, আর গ্রহপুঞ্জ ঘুরছে টুকুদি। একটা ফলের মতো ঝুলে আছে, ঘুরছে ঘুরছে। ছবিটা ভারি মজার না টুকুদি। চন্দ্রসূর্য নামল?
না বের হলে রক্ষা নেই। সারাক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়েই বকবক করবে।
বের হয়ে টুকু বলল, কবে ফিরলি? মন ভালো নেই, বকবক করিস না, বাড়ি যা।
চন্দ্র সূর্য নামল!
কাঁথার নকশাতে চন্দ্র সূর্য চায়—গাছপালা, ফল ফুল পাখি চায় শরা। খোঁজ নিতে এসেছে, কাঁথাখানায় কাজ শেষ, না বাকি আছে। সে দেখতে চায়। মন কেমন নরম হয়ে গেল টুকুর বলল, বোস।
বলে টুকু একখানা জলচৌকি এগিয়ে দিল।
ঠাইনদিকে দেখছি না।
কোথায় গ্যাছে। মুখে কিছু দিল না, ঘুম থেকে উঠে দেখি নেই। চা খাবি।
দাও। লিকার দেবে। দুধ দেবে না।
কোথায় ছিলি এতদিন।
কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা সব ঘুরে এলাম। পৃথিবীটা একটা মস্ত ব্যাপার, অতি ক্ষুদ্র অণু তবে এমনিতে কিছু বোঝা যায় না। ব্রহ্মাণ্ড বোঝ? ব্রহ্মাণ্ড রোজ লক্ষ কোটি আন্ডা দিচ্ছে জানো। কুম্ভীচক্রে ঘুরছে। কত লক্ষ কোটি বিশ্ব নিয়ে মহাবিশ্ব ভাবলে মাথা খারাপ।
মাথা খারাপের আর কাজ নেই। বাড়ি যা।
চা খাই। কতদিন পর এলাম। তোমার কাছে বসতে ইচ্ছে করছে। তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন।
টুকু খড়কুটো জ্বেলে আলগা উনুনে চা করল, দু-কাপ চা, এক কাপ শরাকে দিতে গেল বারান্দায়। শরা নেই।
এই গেলি কোথায়!
এই এখানে দিদি। আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে সাড়া দিচ্ছে।
চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
শরার এই এক দোষ। বাড়িটার এলে যেতে চায় না। গাছপালার ছায়ায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। এতটা জমি ফুলের বাগান বাঁশঝাড় নিয়ে বাড়িঘর কম মানুষেরই আছে। জমি কেউ রাখছে না—বেশি দরদামে জমি বেচে দিচ্ছে। বড়োমামা বাপের জমি বেচে দিতে রাজি না। চলে যখন যাচ্ছে, জমি ভাগ করে কী হবে। ছোটোমামা মেজমামা গাইগুই করলে কী হবে, তাঁর এক কথা। মা বেঁচে থাকতে জমি ভাগ হবে না। জমি বন্টননামা না হলে যা হয়, পড়ে আছে— দুদুমণির রাজত্বে কেউ বড়োমামার ভয়ে হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না। এতে বিরজাসুন্দরীর তেজ আরও বাড়ছে।
না খেয়ে কোথায় বের হয়ে গেলেন!
শরা এখন না এলেই যেন ভালো ছিল। মিল খোলা থাকলে বেলার আন্দাজ মাথায় থাকে। বন্ধ বলে মিলের ভোঁ বাজে না। হাতঘড়িটা তপনকাকার দোকানে পড়ে আছে। খুবই স্লো যাচ্ছে ঘড়ি। কটা বাজে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় বেশ ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল। সাইকেল বের করে একবার বড়ো মাসিকে খবরটা দেওয়া দরকার। বাড়ি খালি রেখেই তাকে যেতে হয়। নধর অবশ্য বারান্দায় শুয়ে থাকবে। বলে গেলেই হল, আমি আসছি। বিরজাসুন্দরী কোথায় না খেয়ে বের হয়ে গেল, মাসিকে খবরটা দিতে হয়। সারমেয়টি খুবই অনুগত—কী করে যে সব বোঝে! বের হবে ঠিক করছিল, শরা এসে হাজির। কী করে যায়।
টুকুদি তোমার বিয়ের কিছু হল! শরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে কথাটা বলে ফেলল। শুরা সবই জানে, বিরজাসুন্দরী তাকে নিয়ে আতান্তরে আছে, তাও জানে, মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা প্রতিবেশীরাও কেন যে করে ফেলে। আগে চেঁচামেচি করা, বিয়ের কথা বললে গা জ্বলে যাবারই কথা। তাকে নিয়ে সবাই মজা করছে ভাৰত, শরাও বলত, শরার কথায় রাগ করতে পারত না। শরাকে খুব ব্যাকুল দেখাত। সামান্য খুঁত আছে শরীরে। তাই বলে কী মেয়েদের বিয়ে হয় না!
চা-এর কাপ নামিয়ে কী ভেবে টুকু থামল। খুব গরম চা। খেতে তার খারাপ লাগে। তাড়াতাড়ি থাকলে প্লেটে ঢেলে খায়। এখন তাড়াহুড়ো নেই, কতদিন পর শরা এসেছে। তার ভালোই লাগছিল। দেশ বিদেশ ঘুরে এলে দাড়ি গজিয়ে যায়। প্যান্ট সার্ট নোংরা হয়ে যায়। ছেড়া তালিমারা প্যান্ট পরেও চলে আসে। বোধহয় সে এখন বাড়িতেই আছে। চুল শ্যাম্পু করেছে। গোঁফ রেখেছে। মুখে চোখে সরল বালকের মতো মনে হয় দেখলে। টুকু যা বলবে তাই বিশ্বাস করবে।
তুমি হাসলে যে টুকুদি।
হাসব না। আমার কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। তুই খবরই রাখিস না। তুই এতো বোকা।
বিয়ে।
হ্যাঁ বিয়ে।
কার সঙ্গে।
গাছের সঙ্গে।
গাছের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা কী ভালো টুকুদি।
ভালো মন্দ বুঝি না। তুই আর কোনোদিন বলবি না, টুকুদি তোমার বিয়ের কী হল! কী ঠিক তো!
শরা কী ভাবল কে জানে। সে উঠে পড়ল। গাছের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে ক্ষুন্ন হয়েছে, অন্তত টুকু শরার মুখ দেখে এমনই ভাবল।
আমি যাই। নীলুমাসির খবর কি! আসে?
আসে।
সুধাদি চলে গেছে?
সুধাদি প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারনি। কোনো খবরই রাখিস না। সুধার বর তাকে ফেলে চলে গেছে।
সুধাদিকে বল, আমি ফিরে এসেছি। কোথাও আর এখন যাচ্ছি না। তোমার নকশিকাঁথায় চন্দ্র সূর্য নামলে আসব।
বোস। এখন যাবি না। একবারে নরেন সাধুর কাছে ঘুরে আয়। মনে হয় বিরজাসুন্দরী সেখানে গিয়ে বসে আছে। আমার সাইকেলটা নিয়ে চলে যা। না গেলে মাসিকে খবর দিতে হবে। বিরজাসুন্দরী ধনুরাঙা পণ, কিছুতেই ঘরের খুঁটি করে রাখবে না। আমাকে তাড়াবে।
কোথায় তাড়াবে।
কী জানি। যা, বসে থাকিস না।
বড়ো অনুগত শরা। সে সাইকেল বের করে বিরজাসুন্দরীর খোঁজে বের হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে নধরও সাইকেলের পেছনে ছুটতে থাকলে, শরা ডাকল, টুকুদি দ্যাখ তোমার নধর আমার পিছু নিয়েছে। ঘেউ ঘেউ করছে। তোমার সাইকেল ধরেছি বলে রাগ করছে।
টুকু ডাকল, নধর এদিকে আর। শরা সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না। এক্ষুনি ফিরে আসবে। আয় বলছি।
নধর এক লাফে বারান্দায় উঠে পায়ের তলায় শুয়ে লেজ নাড়তে থাকলে টুকুর চোখে জল এসে গেল।
দুদুমণি না খেয়ে কোথায় বের হয়ে গেল।
বড়মামা লিখেছে, টুকু কিছু করুক। এত দাবিদাওয়া—দেবে কোত্থেকে। আমার ঘাড়েও তো তিন তিনটি মেয়ে।
কিছু করুক। কী করবে বুঝতে পারছে না। সকালে কটা বাচ্চা বাড়িতে এসে পড়ে যায়। অজ আম ইট-অ পড়ায়। ক খ লিখতে শেখায়নামতা পড়ায়। মাত্র পাঁচ টাকা করে পায়। এতে তার ত্রিশ টাকা উপার্জন হয়। তারপর আর কি করা যায়—সে সাইকেলে মাসির বাড়ি যাবার সময়, অথবা শহরে যদি যায়, চারপাশের লোকজন দেখে—কেউ বসে নেই। সে কোনোদিন ভাবে বড়ো রাস্তায় মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান দিলে কেমন হয়। বিরজাসুন্দরীকে কথাটা বলতেই, কী চোপাচায়ের দোকান দিবি! কী বললি, তুই, মজুমদারের নাতনি চা-এর দোকান দিয়েছে! মান সম্মান তুই বুঝবি না। তোর মামারা জানতে পারলে আগুন জ্বলে যাবে। তাদের বাড়ির মেয়ে চায়ের দোকান দিয়েছে রাস্তায়! শেষে তুই আরও কি দোকান খুলে বসবি কে জানে।
আরও কী দোকান খুলে বসবি কথাটাতে কত কুৎসিত ইঙ্গিত দুদুমণি বোঝে না। চায়ের দোকান, এই যেমন, তার যা সামান্য টাকা আছে, টালির চাল, বাঁশের বেড়া, দুটো টুল, একটা কেটলি, কিছু গ্লাস আর একটা বড়ো মাটির হাঁড়ি, গামলা–হয়ে যাবে মনে হয়েছিল। একটা স্বপ্ন। তার কাঁথাখানার কাজ শেষ হলে আরও কিছু পয়সা আসবে। শরাই মাধববাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। শহরে হস্তশিল্পের একটি দোকান আছে তার। ভালো দামই দেবে। তবে বড়ো সময় লাগে, দিনরাত স্বপ্ন না দেখলে নকশি কাঁথার চন্দ্র সূর্য নামে না। করে যে শেষ হবে, কবে যে নামবে, কখনো জ্যোৎস্না রাতে উঠোনে নকশিকাঁথাখান মাদুরে বিছিয়ে বসে থাকে।
বাড়ি থেকে বিশেষ বেরও হতে পারে না। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে বলে মানুষের নজর বড়ো বিপাকে ফেলে দেয়। সে হেঁটে গেলে—এতো কী দেখার আছে বোঝে না। হাঁটাহাঁটি যেটুকু পাড়ার মধ্যে। পাড়া থেকে বের হলে সাইকেল, পরিচিত কেউ ডাকলে, সে মাটিতে এক পা রেখে সাইকেলে বসেই কথা বলে। কত উড়ো কথা কানে আসে, অপরিচিত যুবকদের চোখ তাঁর খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যে আনন্দ খোঁজে। সেটা যে কী সে ভালোই বোঝে।
মাসির বাড়িতে বড়ো আয়নায় তার খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যে কোনো যৌনতার ছবি থাকে কিনা সে সুযোগ পেলেই খুঁজে দেখে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে। তার পেছনটা বড়ো বেশি দোল খায়। এমনিতে সে স্থূলকায় নয়, শরীরের গড়ন খুবই তার মজবুত। ঈশ্বর তাকে লাবণ্য এবং সুষমা দুইই দিয়েছেন। খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য পেছনটা তার একটু বেশি ওঠানামা করে। মানুষের লুব্ধ দৃষ্টি তার দিকে এতো কেন তাও বোঝে।
দোকানের কথাতে বিরজাসুন্দরীর একদিন কী চোপা! চায়ের নেশা না ছাই, তোর নেশাতেই দোকানে ভিড় বাড়বে। এটা বিরজাসুন্দরী দশভাতারির মতো ভাবে। নাতনি দশভাতারি হলে বিরজাসুন্দরীর মরণ। গলার ফাঁস।
বিরজাসুন্দরী কেন, মামাদেরও চটাতে সে সাহস পায় না। তার সমবয়সিরা কেউ বসে নেই। সবাই স্বামীর ঘর করছে। তারা বেড়াতে এসে খোঁজখবরও নেয়। কোলে কাঁখে বাচ্চা থাকে। স্বামীর এলেম কত কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে এসে দেখিয়ে যায়।
বিরজাসুন্দরী মনে মনে তখন খুবই অপ্রসন্ন। আমার টুকুর বিয়ে হচ্ছে না, তোরা শরীর খালি করে মরদ নিয়ে পড়ে আছিস, টুকুর কি আমার শরীর নাই।
তারও খারাপ যে লাগে না তা নয়। তার তো একজন পুরুষ সত্যি দরকার। সে কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে। তার শরীর এতো মজবুত, যে রোগ বালাই পর্যন্ত নেই। শরীরে রোগ ভোগ থাকলেও কিছু নিয়ে সে থাকতে পারত। কত রাতে যে তার ঘুম হয় না। এ-পাশ ওপাশ করে। উঠে জল খায়। বিরজাসুন্দরী ঠিক টের পায়।
সে রাতে উঠলেই টের পায় বিরজাসুন্দরী জেগে আছে।
বাইরে যাবি।
না।
উঠলি যে।
জল খাব।
দুগগা দুগগা।
জল খাওয়ার সঙ্গে দুগগা দুগগা বলার কি আছে টুকু বোঝে না। পরে ভেবে দেখেছে, দুদুমণি টের পায়—এই জলতেষ্টা কেন। এতো রাতেও টুকু না ঘুমিয়ে থাকে কেন। জল তেষ্টা পায় কেন!
সকালে উঠেই টুকু দেখতে পায়, দুদুমণি পাটভাঙা সাদা থান পরে, নামাবলি গায়ে দিয়ে কোথায় বের হচ্ছেন।
কী হল, সাত সকালে কোথায় যাচ্ছ।
যাচ্ছি মরতে।
কোথায় কার কাছে মরতে যাচ্ছ বলে যাবে না।
না, বলে যাব না।
বলে গেলে, দেখবে এসে আমিও বাড়ি নেই।
বুড়ি জব্দ।
হরতুকির কৌটাটা আবার রাখলাম কোথায়। টুকুদিদি, খুঁজে দে না। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি। কোথাও বের হলেই তুই এতো ফোঁস করিস কেন। আমিতো চেষ্টা করছি।
না আর চেষ্টা করতে হবে না। বের হবে না। তোমার জন্য মুখ দেখাতে পারি না। কী রে তোর দুদুমণি সকালে উঠেই কোথায় বের হল। যা গরম পড়েছে—কী রোদ, ছাতা মাথায় কোথায় যাবে! তোর দুদুমণির গোরু খোঁজা চলছে, কবে যে শেষ হবে।
এটা যে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ, দুদুমণি কিছুতেই বোঝে না। দুদুমণি শুনতে পেলে বলবে, তা মা যা বলেছ, গোরু খোঁজাই সার, পাচ্ছি না। এসব কথা শুনলে তার সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
সুধার বাবা যে যেতে বলল!
বলুকগে।
বিরজাসুন্দরী অগত্যা সেদিন বারান্দায় বসে পড়েছিল। কিছুটা সান্ত্বনা দেবার মতো যেন বলা, আরে বিবাহ কী সহজ কথা, সাত মন ঘি না পুড়লে পাকা কথা হয় না। বিধির নির্বন্ধ, তাই বলে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না, কপালের নাম গোপাল তাও বুঝি—যখন হবার ঠিকই হবে, তবে মন যে মানে না।
তুমি যাবে না সোজা বলে দিলাম। অনেক বিভ্রাট বাধিয়েছ, লোক হাসিয়েছ। সুধার বাবা উদ্ধার না করলেও চলবে।
লোক হাসালাম! কবে?
হাসালে না, যাকে রাস্তার দ্যাখ তার কাছেই বলবে, তোরা আমার ভগবান। কাকে না বলেছ, পালান কাকা, অধীর কর্মকার, মানিক দাস কে না সুযোগ বুঝে তোমার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। আমাকে তুমি কী ভাব। যাবে না বলে দিলাম—এক কথা।
আমার অন্য কাজ আছে। তোর জন্য ভাবতে আমার বয়েই গেছে।
কী কাজ বল, আমি করে দিচ্ছি। কাকে খবর দিতে হবে বল, ডেকে নিয়ে আসছি। তুমি আমার পাত্রের খোঁজে এক পা বাড়ি থেকে বাড়িয়েছ তো, আমার মরা মুখ দেখবে।
তখনই বুড়ির কী কান্না। তুই কী বললি টুকু, মরা মুখ, তোর মা নেই, আমার কেউ নেই, থাকলে তুই এতো বড়ো কথা বলতে পারতিস। তাপরই ঘরে ঢুকে গায়ের নামাবলি তক্তাপোষে ফেলে দিয়ে একেবারে নিরাসক্ত গলায় কথাবার্তা, আমার কী, এতো যার মান, তাকে বিয়েটা করবে কে! দু-দিন বাদে ফেরত দিয়ে যাবে।
সেই থেকে অনেকদিন চুপচাপই ছিল। কোথাও বের হত না। আজ কী হল কে জানে, আবার বের হয়ে পড়েছে।
কুকুরটার দিকে টুকুর চোখ গেল।
বেইমান।
দু-জনে ঠিক শলাপরামর্শ করেই বের হয়েছে। না হলে, নিশ্চিন্তে নধর বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারে।
এই কোথায় গেছে দুদুমণি?
লেজ নাড়ছে। একবার চোখ তুলে তাকে দেখল। আবার মুখ গুঁজে দিল পেটের দিকে।
তোমার আরাম বের করছি।
বলেই টুকু তাড়া লাগাল কুকুরটাকে। কুকুরটা লাফ মেরে উঠোনে নেমে গেল।
বের হ। যেদিকে চোখ যায় চলে যা। দুদুমণি গেছে, তুইও যা। থেকে কী হবে!
তখনই শরা সাইকেল চালিয়ে সোজা উঠোনে ঢুকে গেল।
গেছে?
নরেন সাধুর কাছে গেছে।
শরা সাইকেল থেকে লাফিয়ে নামল। তারপর বলল, এক গ্লাস জল দাও টুকুদিদি। নরেন সাধুর থানে মচ্ছব। ঠাইনদি পর্যন্ত খাটছে।
টুকুর মাথা গরম হয়ে গেল। দণ্ডি খাটছে এই বয়সে। বুড়ি মরবে। কুলো মাথায় রোদে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন মন্দির প্রদক্ষিণ করা সোজা! মানত করেছে বুড়ি। মানত না করলে সাধুর পাল্লায় পড়ে গেছে। সর্বস্ব যাবে। খায়ওনি। নরেন সাধু তুমি মানুষ! ঠাকুরের নামে দুদুমণিকে দণ্ডি খাটাচ্ছ, তোমার পাপ হবে না। গন্ধর্ব কবচ পেতে হলে দণ্ডি খাটতে হয়, বললেই হয়েছে! বিরজাসুন্দরী না খেয়ে, তাকে লুকিয়ে তবে সেই গন্ধর্ব কবচ আনতে গেল। দুদুমণি তাকে নিয়ে কত অসহায় এটি ভাবতে গিয়ে তার দু-চোখ ভিজে গেল। যে যা বলছে, করে যাচ্ছে।
টুকুদি, নরেন সাধু জানোয়ার।
টুকু কী করবে বুঝে পাচ্ছে না। সে ভিতরে কেমন অস্থির হয়ে পড়ছে। সেখানে তার ছুটে যাবারও ক্ষমতা নেই। সাধুর থানে শনি মঙ্গলবারে পাঁঠা পড়ে। তিথি নক্ষত্র বুঝে লোকে হত্যে দেয়। যার যা মনস্কামনা পূর্ণ হয়। বাজার পার হয়ে রাজবাড়ির রাশতলায় এখন সাধুর আশ্রম। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় লম্বা টিকি, টিকিতে জবাফুল বাঁধা। জরা ব্যাধি মৃত্যুর হাত থেকে মানুষ রেহাই পেতে চাইলে থানে যেতেই হয়। মানত করতে হয়।
সাধুর চেলা কালীপদই একদিন বারান্দায় বসে বলে গেছে, ঠাইনদি, সব গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানে হয়। টুকুর কুষ্ঠিটা দেবেন, বিচার করে দেখব।
কালীপদ আচার্য বামুন। গ্রহরাজ বলতে কথা। গাছের পাকা পেপে থেকে, কাঁঠালের দিনে কাঁঠাল, আমের দিনে আম সবই সে পায়। দাদু বেঁচে থাকতেও দেখেছে, কালীপদ এলে, ফল–মূল তার হাতে তুলে দিয়ে দাদু তৃপ্তি পেতেন। গ্রহরাজ সন্তুষ্ট থাকলে বাড়ির অমঙ্গল হয় না। কুষ্ঠি ঠিকুজিও সেই করে দেয়। বাড়িতে তার আগমন সব সময়ই শুভ সময়ের কথা বলে। তাকে নিয়ে আতান্তরে পড়ে গেছে বিরজাসুন্দরী সে ভালই জানে। সেই বলে গেছে বোধহয়, সাধুর কাছে যাবেন, বিধান মতো তাঁর কাজ করে দেখুন—ফল হাতে নাতে পাবেন।
ইদানীং টুকু দেখেছে, দুদুমণি, সূর্যস্তব পাঠ করছেন। সকালে উঠে সূর্যপ্রণাম। শেষে এই দণ্ডি খাটা। সে খেপে যাবে শুনলে—ভেবেই হয়তো লুকিয়ে চলে গেছে।
কী শরা।
একবার বড়ো মাসিকে খবরটা দিতে হয়।
এই শরা চলত আমার সঙ্গে।
কোথায় যাবে?
বড়োমাসিকে খবরটা দিই। দুদুমণির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
নীলুমাসিকে এখন পাবে? স্কুল আছে না। স্কুল থেকে কি ফিরেছে।
সে বলল, কটা বাজে।
ঘড়িতে সময় দেখে বলল শরা, চারটা বেজে গেছে।
আকাশ মেঘলা বলে কটা বাজে বুঝতে পারছিল না টুকু। মাসি বাড়িতে এখনও ফেরেনি। মেসো ফিরতে পারে। মেশোর স্কুল বাড়ির কাছেই। খুব টিউশানি করে, এখন গরমের ছুটি বলে তাও নেই। মেসো বাড়ি থাকতেই পারে। তবে ক্লাবে গিয়ে বসে থাকলে মুশকিল। বোনটাও বাড়ি থাকলে এক্ষুনি চলে যেতে পারত। কলেজ হোস্টেলে থাকে বলে বাড়ি খালি পড়েই থাকে। কেউ না থাকলে, যা হয়, তালা দিয়ে যায় মাসি। মেসোর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, তবে তার যে একদণ্ড আর এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এক্ষুনি ঘরের দরজায় শেকল তুলে তালা দিয়ে বের হয়ে পড়তে পারলে বাঁচে। ক্রোশখানেক রাস্তা সাইকেলে যেতে দশ বিশ মিনিট—কিন্তু গিয়ে যদি দেখে কেউ নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
মেসোদের দিকটাই পাকা রাস্তা, টাইম কলের জল, কারেন্ট সব আছে। পাকা বাড়ি একতলা। ছাদের সিঁড়ি করবে বলে ইট বালি সিমেন্ট তুলে রেখেছে। গরমের ছুটিতে সিঁড়িটা করে ফেলবে। বারান্দায় গ্রিল। উঠোনে ঢুকে ভিতরের বারান্দায় দিকটায় যাওয়া যায়। মেসো মাসি কেউ না ফিরলেও তার অসুবিধা হয় না। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢোকালেই সদর দরজার চাবি।
মাসিই বলেছে, আমরা না থাকলেও অসুবিধা নেই। কোথায় চাবিটা থাকে দেখিয়ে দিয়েছে। দুদুমণির কত খবর থাকে, এবেলা ওবেলা তাকে মাসির বাড়ি যেতেই হয়। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেই সবার চোখ তার ওপর। টুকু এসেছে আবার। ঠিক বিরজাসুন্দরী মেয়ের কাছে খবর পাঠিয়েছে, টুকুর পাত্রের একটি খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিবেশীরা জানালা খুলে তাকে দেখলেই টুকুর গা জ্বালা হয়। আজকাল সে চোরের মতো সবার আড়ালে মাসির বাড়ি ঢুকে যায়—সাঁজ লাগলে চুপিচুপি বের হয়ে আসে। সিঁড়ির মালমশলাতে উঠোন ভরতি—সে শত চেষ্টা করলেও চাবিটার নাগাল পাবে না। সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু আজ সে মরিয়া।
এই শরা চল আমার সঙ্গে।
টুকু ঘরে ঢুকে শাড়ি সায়া পাল্টে নিল। মুখে সামান্য প্রসাধন করল। তারপর দরজা টেনে শেকল তুলে তালা লাগিয়ে দিল।
তকে বের হতে দেখে নধর কোথা থেকে হাজির।
সঙ্গে যাবে।
কারও যেতে হবে না। মনে মনে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে গজ গজ করছে টুকু। তাছাড়া খালি বাড়ি রেখে সে যেতেও পারে না। শরাকে পাঠাতে পারত, খবর দিয়ে আয়, দুদুমণি নরেন সাধুর থানে গণ্ডি খাটছে। খবর পেলে মাসি নিজেও ছুটে আসতে পারে। মাসকাবারি রিকশাওয়ালাকে খবর দিলেই হল, রিকশায় চড়ে মেসো না হয় মাসি চলে আসতে পারে। কিন্তু সে একটা কিছু করতে চায়। শরাকে দিয়ে খবর পাঠালে আর দশদিনের মতোই তার প্রতিবাদের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। মাসি এসে বলতেই পারে, মা কী করবে! দাদারা মাথা পাতছে না— বড়দা লিখবে, আমার সময় কোথায়, টাকা পয়সা যা লাগে জানাবে। তোর মেসোই বা কী করবে। তারই বা সময় কোথায়। কত সম্বন্ধ এল, দানবের মতো দাবি দাওয়া সব। কে মেটাবে অত খাই।
এ-সব কথা শুনলে টুকুর যে মাথা হেঁট হয়ে যায় কেউ বোঝে না। কোনো কথাই আর তার শুনতে ভালো লাগে না।
টুকু বলল, এই শরা চল। তোর নীলুমাসিকে খবরটা দিতে হবে। আমরা সাইকেলে যাব আর আসব।
সাইকেলে! আমার তো সাইকেল নেই।
তোর সাইকেল না থাকলেও চলবে। তুই না হয় আমি রডে বসব।
তোমার নিন্দামন্দ হবে টুকুদি।
হোক। আমার আর নিন্দামন্দের বাকি আছে কি। মাসিকে খবরটা দিই। নাতনির জন্য বুড়ি নরেন সাধুর থানে দণ্ডি খাটছে। বুড়ি মরবে। আমি কেন মরার ভাগী হতে যাব।
শরাকে খুবই বিচলিত দেখাচ্ছে। টুকুদি রডে বসবে না সে বসবে বুঝতে পারছে না। যেই বসুক লোকেরা চোখ টাটাবে।
টুকুদি আমাকে না নিয়ে গেলে হয় না।
না হয় না।
এই অবেলায় বের হবে? আমাকে নিয়ে বের হলে যে লোকে তোমারও মাথাটি খারাপ ভাববে। তোমার নিন্দামন্দ হবে। লোকে কুকথা বলবে।
তুই যাবি, না বকবক করবি।
শরা আর কী করে। টুকুদির চুলের গন্ধ পাবে রডে বসলে। এই লোভেই যেন সে সাইকেলে চেপে বসল। টুকু রডে বসে বলল, বড়ো সড়কের দিকে চল।
ওদিকটায় তো ফাঁকা। ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। মাসির বাড়ি যাবে না!
টুকু খেপে যাচ্ছে।
তুই কি আমার গার্জিয়ান। নাম।
শরা ভয়ে ভয়ে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল। রাস্তায় লোকজন তাকে দেখছে। কাউকে সে গ্রাহ্য করছে না।
চৌধুরীমামা আড়তে যাচ্ছেন, তাকে দেখেই বলল, টুকু না?
টুকু বলল, বড়ো সড়কে যাচ্ছি।
শরা ঘাবড়ে গেল। টুকুদির মামারা জানতে পারলে তাকে লাঠিপেটা করতে পারে। এতো বড়ো আস্পর্ধা, টুকুকে সাইকেলের রডে বসিয়ে কলোনি ঘোরা হচ্ছে। এত সাহস হয় কী করে। অথচ টুকুদির কথা সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে হতাশ গলায় বলল, টুকুদি বাড়ি চল। মাথা গরম কর না। আমি না হয় মাসিকে খবরটা দিয়ে আসছি।
টুকু সাইকেলে চেপে শুধু বলল, রডে বোস। কোনো কথা না। দশ ভাতারের খোঁজে যাচ্ছি। এক ভাতার নিয়ে আমার পেট ভরবে না। বুঝতে চেষ্টা কর।
মেজাজ টুকুদির খুবই অপ্রসন্ন। এতেক খারাপ কথা টুকুদি কখনো বলে না। কী সুন্দর স্বভাব টুকুদির। আর সেই কিনা বলছে, দশ ভাতারের খোঁজে যাচ্ছি। তার যেন এ-বড়ো অচেনা টুকুদি। দুদুমণি দণ্ডি খাটতে না গেলেই পারত। এমন সুন্দর মেয়ের বর জুটছে না, খোঁড়া বলে কী তার কোনো মূল্য নেই। দুদুমণি বাজিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র, টুকুদির পাত্র জুটছে না। টুকুদি যে বলল, গাছের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। সবকিছুই বড়ো রহস্যজনক ঠেকছে।
টুকু কলোনির ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। টুকুকে সবাই চেনে—কুমুদ মজুমদারের নাতনি, পা খোঁড়া মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না। স্কুলের মাঠ পার হয়ে তেলিপাড়ায় আসতেই শরা বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও, মাসিকে খবরটা দিয়ে আসছি।
না। কোনো খবর দিতে হবে না।
টুকু সোজা বড়ো সড়কের দিকে উঠে গেল। তারপর সাইকেল থেকে নেমে কিছুটা ঘোরের মধ্যে যেন হেঁটে গেল।
শরা সাইকেল নিয়ে টুকুদিকে অনুসরণ করছে।
একবার না পেরে বলল, তোমার কী হয়েছে টুকুদি।
এই যে ছোটো জায়গাটা দেখছিস, দাদু আমার নামে দিয়ে গেছে। এখানটায় কিছু একটা করতে হবে। এই একটা চা-এর দোকান টোকান। বাস স্ট্যান্ড, সারের গুদাম, সরকারি কোয়ার্টার কত কিছু হচ্ছে। রাস্তার ধারে তুই আমি মিলে কিছু একটা করতে চাই। এক ভাতারের হাত থেকে তো বাঁচি! দশ ভারি হয়ে বেঁচে থাকাও অনেক গৌরবের। চা-এর নেশার চেয়ে আমার নেশা নাকি মানুষের বেশি! দেখি না দোকান করে। জলে ডুবে যাচ্ছি। তুই না হয় আমার খড়কুটো হয়েই থাক। কি পারবি? রাজি। টুকু প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকল।
তোমার কোন কথাটা আমি রাখিনি টুকুদি। কিন্তু তোমার গাছটা রাগ করবে না?
গাছ! টুকু হা হা করে হাসল।–তুই রাজি কি না বল।
বললে যে গাছের সঙ্গে তোমার বে হয়ে গেছে।
বোকা কোথাকার। গাছ কখনো রাগ করে। না সে রাগ করতে জানে। তুই রাজি আছিস কি না বল। তুই রাজি থাকলে গাছটা মাটিতে লেগে যাবে মনে হয়।
তখন সারা আকাশ ম্লান অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে সহসা রূপালি বন্যায় ভেসে গেল। আবিষ্কারের মতো মনে হল—গাছটা লেগে যাবে। জীবনে সামান্য সূর্যালোক। এইটুকুই টুকুর আজ বড় বেশি দরকার। জমিটায় সে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। জমিটা তার নিজের, নিজস্ব। চা-এর দোকান, মানুষজন, ভিড় এবং ব্যস্ততা —এক টুকরো স্বপ্ন। শুরা না এলে এই স্বপ্নটুকু যেন খুঁজে পেত না।
টুকুদি ওঠো। দুটো একটা তারা ফুটছে। চল মাসির বাড়ি হয়ে যাই।
তুই বোস আমার পাশে। আমার কোথাও আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ঘাস থেকে দুটো একটা ফুল তুলে খোপায় গুঁজে দিতে থাকল টুকু।
অ্যালবাম
আমাদের কিছুই আর ভালো লাগছিল না। জাহাজ কবে দেশে ফিরবে জানি না। মাসের পর মাস দরিয়ার ভাসছি। বন্দরে মাল নামাচ্ছি। মাল তুলছি। জাহাজঘাটায় তবু দিন কেটে যায়। জাহাজে নানা কিসিমের কিনারার মানুষ উঠে আসে। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। কেউ আসে—সস্তায় টোবাকো নিয়ে। কেউ সেকেন্ড হ্যান্ড। মার্কেট থেকে কেনা কোট-প্যান্ট জ্যাকেট—কিংবা গাউন। তারপর বিকেলে ছুটি হলে ঘুরে বেড়াও। কার্নিভালে যাও। সস্তায় মদ গেলা যায় সি-ম্যান মিশানগুলিতে। ফলে দিন কেটে যায়। সবচেয়ে খারাপ লাগে জাহাজ সমুদ্রে ভেসে গেলে। যতদূর চোখ যায় শুধু নীল জলরাশি।
সেই কবে কলকাতা থেকে জাহাজে সাইন করে উঠেছি—আর দেশে ফেরার নাম নেই।
ব্যাংক লাইনের জাহাজ এরকমেরই। মাতামুণ্ডু ঠিক নেই। জাহাজ কোথায় যাবে, কবে ছাড়বে, কোন বন্দরে কতদিন লেগে যাবে এবং কবে জাহাজ আবার কোথায় যাচ্ছে দুদিন আগেও জাহাজিরা জানতে পারে না। জাহাজ ছাড়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে বোর্ডে নোটিশ ঝুলত—কোথায় জাহাজ যাবে, আমরা খবর পেতাম।
ইদানীং বুড়ো ডেকসারেঙ ছাড়া সবাই বেশ মনমরা। ইঞ্জিন সারেঙও বেশ আছেন। যেন সদ্য দেখছেন—আরে বোঝে না কেন—কত দেশ, কত মানুষ সারা দনিয়া চষে বেড়াচ্ছ, সোজা কথা যত লম্বা সফর তত লম্বা বোটখানা। নামার সময় এককাড়ি টাকা পাবা সোজা কথা। তা ঠিক—যত, লম্বা সফর তত বেশি টাকা—শেষের দিকে দেড়-দু’গুণ টাকা কোম্পানিকে গচ্চা দিতে হয়। তবু ব্যাং লাইনের জাহাজে একবার বের হলে কবে দেশে ফেরা যাবে কেউ বলতে পারে না। সারেঙের এক কথা, কোম্পানির মর্জি। বিনি মাগনায় তো কাজ করছ না। তবে এত মুখ গোমড়া কেন বুঝি না। জাহাজে ওঠার সময় মনে ছিল না! সাইন কে করতে।
সারেঙসাবও যে মিথ্যা চোটপাট করছেন না বুঝি। আমাদের মাথা গরম, জাহাজ যাচ্ছে, মাটি টানার কাজে। ব্রিটিশ ফসফেট কোম্পানির সঙ্গে নাকি চুক্তি সারা। অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে ফসফেট এনে ফেলতে হবে। নিউ ক্যাসেল, সিডনি, জিলঙ—এমন সব বন্দরের নামও শুনেছিলাম। জাহাজ অকল্যান্ডের জাহাজঘাটায় ভিড়ে আছে। খবরটা এনেছে কোয়ার্টার মাস্টার হাপিজুর। সে-ই পিছিয়ে এসে বলল, হয়ে গেলা ন-দশ মাস কাবার।
তার মানে আরও ন-দশ মাস! সারেঙসাব খবরটা পেয়ে খুশিই দেখলাম। দু আড়াই বছর—মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়—শুধু জল আর নীল আকাশ, ঝড় সাইক্লোন। কখনো গভীর বৃষ্টিপাত অথবা জ্যোৎস্নারাতে গভীর সমুদ্রে আমাদের ডেকে বসে থাকা। ঘুম আসে না।
সবচেয়ে খারাপ লাগছে বেচারা সতীশের কথা ভেবে। সবে বিয়ে করে ব্যাটা জাহাজে এসে উঠেছে। কলকাতার ঘাটে সে সাইন করার পরও রাতে জাহাজে থাকত না। তা নতুন শাদি, সারেঙসাবের কোমলমতিতে টুটাফাটা দাগ থাকতে পারে—তিনি বলতেন, যা। সকাল সকাল চলে আসিছ। কেউ যেন টের না পায়। জাহাজ ছাড়ার আগে সে একদিন বউয়ের রান্নার হাত কত মিষ্টি, পরখ করবার জন্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেছিল। ভারি সুন্দর মিষ্টি দেখতে লাজুক। সতীশের মা-বাবাও খুব খুশি আমরা যাওয়ায়। রবিবার বলে সারাদিন সতীশের বাড়িতে চুটিয়ে আড্ডা, তাস খেলা, এবং প্রায় সোরগোলের মধ্যে তার বউকে দেখেছিলাম—চুপিচুপি সতীশকে ফাঁক পেলেই ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। ফিরে এল মসকরা—কি দিল!
কি দেবে আবার!
শালো, তুমি কি করে এলে বল!
আরে না, তোরা কখন খেতে বসবি জানতে চাইল।
ফের মিছে কথা!
সতীশ বেচারা হেসে ফেলত।
বল কি করেছিস! বউটাকে একদণ্ড বিশ্রাম দিচ্ছিস না!
জাহাজ মাটি টানার কাজ নিয়েছে শুনে সেই সতীশ খুবই ভেঙে পড়ছ। খুব হিসেবি সতীশ।
বউ-এর জন্য টাকা বাঁচাচ্ছো। বন্দরে নেমে কেনাকাটা যা-কিছু বউকে খুশি করার জন্য। বন্দরে যে-কদিন থাকা হয়, রোজ বউকে একটা চিঠি। সাঁজবেলায় সবাই যখন শহরে ঘুরতে বের হয়, সে তখন ব্যাংকে শুয়ে বউকে চিঠি লেখে। কখনো লুকিয়ে বউ-এর ছবি দেখে। লুকিয়ে না দেখে উপায়ও নেই। কারো সামনে পড়ে গেলে, ফটোটা নিয়ে টাটানি শুরু হয়। এটা সতীশ একদম পছন্দ করে না। তার একটা যে গোপন পৃথিবী আছে, সেটা যেন খোলামেলা হয়ে যায়। সে জাহাজে উঠে তার বউ-এর ছবিগুলি না দেখালেই ভালো করত। বিয়ের সময় তার যত ছবি তোলা হয়েছিল, তার সব কপি সঙ্গে এনেছে। সে না দেখালে অবশ্য আমরা জানতেও পারতাম না। সমুদ্র সফরে এই ছবিগুলি তার সঙ্গে আছে। বন্দর এলেই সে ছবিগুলি দেখার সুযোগ পায়। এক ফোকসালে আমরা। চারটা ব্যাংকে চার বাঙালিবাবু। সতীশ, নিমাই, অপরেশ আর আমি। সমুদ্রে নানা কাজ থাকে। সকালে একসঙ্গে উঠতে হয়। ডেকে জল মারতে হয়। তারপর চা চাপাটি খেতে হয়। তারপর কশপের ঘরে খেতে হয়। স্টোর রুম থেকে যে-যার মতো দড়িদড়া বের করে নেয়। তক্তা বের করে নেয়। কারও রঙের কাজ, কারো চিপিংয়ের কাজ। কেউ ফোকসালে অবশ্য তখন কাজে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যেতে পারে। তবে ডেকরেঙের সতর্ক নজর। তারপর দুপুরে ভাত-ডাল-সবজি, গোস্ত। আবার কাজা। পাঁচটা না বাজলে কাজ থেকে ছুটি হয় না। তখনও ফোকসালে লোজন থাকে। সে যে গোপনে বউ-এর ছবি দেখবে, তারও উপায় নেই। একমাত্র ফুরসত মেলে জাহাজ ঘাটে ভিড়লে। সবাই বন্দরে নেমে গেলে ফোকসাল ফাঁকা।
এ-সময়টাতেই তার সুযোগ। সে জাহাজঘাটায় এক-দু-দিন বন্দরে যে নামে না, তা নয়। তবে তার কাছে বন্দরের সুন্দরী যুবতীদের আকর্ষণের চেয়ে বউ-এর ফটো দেখার আকর্ষণ অনেক বেশি। সে এই করে পনেরো-যোলো মাস জাহাজে কাটিয়ে দিয়েছে। কখনো বৌকে চিঠি লিখে, কখনো তার বউ-এর চিঠি পড়ে, ছবি দেখে তার সময় কেটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে হাই তুলত। রাতে এপাশ-ওপাশ করত। ঘুমোতে পারত না। উঠে জল খেত। ঘুম ভেঙে গেলে একদিন টের পেয়েছিলাম, সতীশ ফোকসালে নেই। গেল কোথায়? বাথরুমে যেতে পারে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। কনকনে শীত। আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছি। জাহাজ যাচ্ছে ফিজিতে। সেখান থেকে মাটি কাটার কাজ শুরু হবে। ফিজি থেকে প্রায় দেড়-দু হাজার মাইল আরও ওপরে অজস্র ফসফেটের দ্বীপ আছে। সেইসব দ্বীপ থেকে সফেট বোঝাই করে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে খালাস করতে হবে। কনকনে শীতে ফোকসালের বাইরে কোথায় গেলা। বাথরুমে যেতে গেলে সিঁড়ি ভাঙতে হয়। যদি গিয়ে থাকে, ফিরে আসবে। কিছুটা মানসিক অবসাদে ভুগছে সতীশ, টের পাচ্ছিলাম। জাহাজে এটা মারাত্মক রোগ। আমরা সতীশকে সাহস দিতাম। বলতাম, দেখতে দেখতে কেটে যাবে কটা মাস। এত ভেঙে পড়ছিস কেন! সে কথা বলত না। সিগারেট টানত ঘনঘন। মাঝে মাঝে পোর্টহোলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখত।
সেই সতীশ না নেমে এলে ভয়ের। কম্বল মুড়ি দিয়ে আর তো শুয়ে থাকা যায় না। আবার কাউকে ডাকাও যায় না। হয়তো দেখা যাবে সতীশ গ্যালিতে কনকনে ঠান্ডা থেকে শরীর গরম করার জন্য চা বানাচ্ছে। কিংবা রেলিঙে দাঁড়িয়ে, নিশীথে সমুদ্র দেখতে দেখতে দেশের কথা ভাবছে। ঘুম না হলে আমরাও ডেকে উঠে গেছি কতদিন। ফল্কার ওপর মাদুর পেতে শুয়ে থেকেছি। মাস্তুলের আলো দুলছে। জাহাজ দুলছে। মনে হচ্ছে আকাশ কখনো ঝপাত করে মুখের সামনে নেমে এসেছে। আবার ঝপাত করে উঁচুতে উঠে গেছে। এটা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। গরমের সময় প্রায় জাহাজিরাই ফোকসাল থেকে উঠে আসে। উপরে সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া। বেশ আরাম বোধ করা যায়। কিন্তু এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় উপরে উঠে গেলে হাত-পা টাল মেরে যায়। সারা গায়ে কনকনে শীতের সূচ বিধতে থাকো কখন গেল, কোথায় গেলা! আর তো শুয়ে থাকা যায় না। কম্বল গায়েই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলাম। গ্যালির দরজা বন্ধ। মেসরুমের দরজা বন্ধ। ব্রিজে সেকেন্ড অফিসার আর কোয়ার্টার মাস্টার। কাচের ঘর বলে, বুঝতে কষ্ট হয় না—কোয়ার্টার মাস্টার হুইলে হাত রেখে দূরের সমুদ্র দেখছেন। সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে পায়চারি করছেন। এখন সেকেন্ড অফিসারের ডিউটি মানে, রাত একটার ওয়াচ চলছে। গেল কোথায়! ইঞ্জিন রুমে! সেখানে তার কী কাজ থাকতে পায়ে! বাথরুম খালি, গ্যালি বন্ধ, মেসরুমের দরজাও বন্ধ। ডেক, ফলকা, এলিওয়ে সব খালি—এই নিশীথে জেগে থাকার কথা একমাত্র ইঞ্জিন রুমে যারা ডিউটি দেয়।
খুবই ফাঁপরে পড়ে গেলাম।
কোথায় আর যেতে পারে এই ঠান্ডায়। ঝড়ো হাওয়ায় সমুদ্র বেশ ক্ষেপে উঠেছে। আকাশে মেঘ নেই, তবু বরফঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া। কম্বল উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
তারপরই মনে হল, মেসরুম তো বন্ধ থাকায় কথা নয়। দরজা কে বন্ধ করল! রাতের পরিদাররা তো ওয়াচ শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে মেসরুমে বসে সিগারেট খায়। দরজা খোলা থাকারই কথা। সারা জাহাজ ঘুরে যখন কোথাও পাওয়া গেল না, ছুটে এলাম, যদি মেসরুমে দরজা বন্ধ করে কিছু করে বসে। দরজা দেখি ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকলাম, কে ভিতরে? সাড়া নেই।
অগত্যা পোর্টহোল দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি সতীশ তাস সাজাবার মতো ফটোগুলি সাজিয়ে বসে আছে। প্রায় বেঘোরে পড়ে গেছে ছবিগুলি দেখতে দেখতে–এক তরুণীর স্তন নাভি অধর আরও গভীর অভ্যন্তর ভেসে বেড়াচ্ছে বোধহয় সতীশের …..
ডাকলাম, এই, কি হচ্ছে, হ্যাঁ। বসে বসে কী করছিস। এই তোমার কাজা! হ্যাঁ বউকে দেখছ সবার গোপনে বউকে দেখছ। আমরা তোমার বউকে খেয়ে ফেলব।
সতীশ কেমন চমকে গেল। সে ভাবতেই পারেনি, গ্যালির উলটোদিকের পোর্টহোলে কেউ এতে উঁকি মারতে পারে। এত উপরে উঠে … পোর্টহোলে কেউ মুখ গলাবে—কার এত দায়-সমুদ্রের ঝড় উড়িয়ে নিলে রক্ষা করবে কে? আমাকে
এতটা বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া যেন তার ঠিক হয়নি। সে দু-হাতে তাড়াতাড়ি সাপটে ফটোগুলি তুলে ফেলল। তারপর দৌড়ে এসে পোর্টহোলের কাছে দাঁড়াল। চোখেমুখে প্রচণ্ড ক্লেশ ফুটে উঠেছে। ভয়ে সচকিত গলায় বলল, নাম, নেমে যা লক্ষ্মী ভাইটি। ঝড়ে উড়েফুড়ে গেলে কেলেঙ্কারি।
দরজা খোল।
খুলছি। তুই নাম। তোর ভয়ডর নেই।
জীবনের মায়া নেই!
দরজা খোল।
খুলছি।
পোর্টহোল থেকে নামছি না দেখে সে যেন অগত্যা দরজা খুলে দিল। একলাফে নেমে এল দরজায়।
কী করছিলি!
সে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল—হিস।
তারপর বাইরে বের হয়ে বলল, কাউকে বলিস না। কেমন অপরাধীর গলা। নিজের বৌ-এর ফটো লুকিয়ে দেখা কী এমন অপরাধ বুঝলাম না। সে এই ফটো দেখে সারা সফর কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ কি! কিন্তু যা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, তা জাহাজে থাকলে, সবাইকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। সে হাসে না। কথা বলে না। কাজে কোনো জুস পায় না। খেতে পারে না ভালো করে। অনিদ্রা। এগুলো জাহাজির ভালো লক্ষণ নয়।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সতীশ বড়ো কাতর গলায় বলল, কাউকে বলিস না।
খেপে গেলাম। বোধহয় চিৎকার করেই উঠতাম। এত রাতে তবে আর একটা নাটক হয়ে যাবে পাশাপাশি কোন পালে যারা থাকে, তারা দরজা খুলে ছুটে আসতে পারে। নানা প্রশ্ন করতে পারে। কারণ দীর্ঘ সফরে জাহাজিদের মাথা ঠিক থাকে না, সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়, কেউ উন্মাদ হয়ে যায়—ঠিকঠাক আর দেশে ফেরা হয়ে উঠে না। সতীশকে নিয়ে অনেকের মনেই এ-ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে। হয় আমাকে, নয় অপরেশকে সারেঙ ডেকে সতীশের খোঁজখবর নেয়। দেশ থেকে ওর চিঠি এল কিনা, চিঠিতে কোনো খারাপ খবর আছে কিনা—সতীশ দিন-দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমরাও বলছি, না তো, দেশ থেকে তো চিঠিপত্র ঠিকই আসছে। বউ-এর জন্য লম্বা সিল্কের নাইটি কিনেছে বলতে পারতাম। কিন্তু সারেঙসাব বুড়ো মানুষ—তাকে এমন খবর দিলে যেন সতীশকে ছোটো করা হবে। ওর বৌয়ের মর্যাদা রক্ষা হবে না। কিছু না অশালীন ইঙ্গিত থেকে যায় এমন খবরে! কাজেই চুপ করে যেতাম। কিন্তু ফোকসালে ঢুকে দেখি অপরেশ, নিমাই বসে আছে। ওরা হয়তো আমাদের খুঁজতে উপরে উঠে যাবে ভাবছিল। আমাদের দেখেই বলল, কি রে, কোথায় গেছিলি এত রাতে! কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলে সন্দেহ বাড়ে। আমাকে নিয়ে তাদের ভয় নেই। কারণ তারা জানে, আমি কিছুটা খোলামেলা স্বভাবের। আমার খুব-একটা শুচিবাই না থাকলেও কোনো নারীসংসর্গে যেতে যে রাজি না তারা জানে। তারা নিজেরাও বন্দরে নারীসংসর্গ করে না। কারণ দুরারোগ্য ব্যাধির ভয় কার না থাকে। ডালভাত খাওয়া বাঙালি যেমন হয়ে থাকে—বরং আমাদের উপাস্য দেবী বলতে কিছু নারীর উলঙ্গ অ্যালবাম। যা দেখলে মানসিক অবসাদ থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। জাহাজের একঘেয়ে খাওয়া, একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা, একঘেয়ে ঝড়-সাইক্লোন, নীল আকাশ, এবং নক্ষত্রমালা—সবই বড়ো তিক্ততার সৃষ্টি করে। সেখানে বন্দরে কোনো নারীর হাতছানি অবহেলা করা খুব কঠিন। সতীশের শুচিবাই তাকে কিছুটা আলগা করে রেখেছে আমাদের কাছ থেকে। নারী সম্পর্কে সে কোনো অশ্লীল কথা পর্যন্ত বলে না। আমাদের প্রিয় অ্যালবাম থেকে তাকে কত চেষ্টা করেছি নরনারীর সংসর্গের ছবি দেখাতে। ওটা ছুঁলেও যেন পাপ। দেখলে নরকবাস। অথচ আমরা জানি, আমাদের শুচিবাই কম। আমরা এইসব ছবি নিয়ে হেসেখেলে মজা করতে পারি। এতে বোধহয় থাকে কঠিন সব উপসর্গ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়। আমরা সহজেই তারপর জাহাজ ঘাটে ভিড়লে শিস দিয়ে নেমে যেতে পারি—সুন্দরী যুবতীকে ফুল উপহার দিতে পারি—কার্নিভালে ঢুকে যে-কোনো যুবতীর সঙ্গে রঙ্গরসে মজে যেতে পারি—শুধু সহবাস ছাড়া আমাদের যেন আর কিছুতেই আপত্তি নেই। আমরা এজন্যও বাকি ন-দশ মাস জাহাজে থাকব ভেবে ভেঙে পড়ছি না।
অপরেশ যে বেশ খেপে আছে, বোঝাই গেল।
সে উঠে গিয়ে ফোকসালের দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করলে বাইরে থেকে ভেতরের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
অপরেশ ব্যাং-কে বসে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর তাকাল সতীশের দিকে। সতীশ তার ব্যাংকে এসে শুয়ে পড়েছে। কম্বলের ভিতর খামে সব ফটো, সেগুলি বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলেছে। আমি লক্ষ করছি-অপরেশ ফুঁসছে।
অপরেশ গজগজ করছে, শালা মরবে। শালার মগজে বীর্য উঠে মরবে। বেটার কোনো ওয়ে-আউটই নেই। জাহাজে কেন মরতে এলি। বিছানায় কোনো দাগ লাগে না! সব বউ-এর জন্য জমা করে রাখছিস! জমা করলে থাকে, থাকলে পাগলের মতো উঠে যাস। কী হাড়কাঁপানো শীত! তার মধ্যে লুকিয়ে বউ-এর ফটো দেখতে উঠে গেলি!
ঠিক ধরে ফেলেছে অপরেশ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথা থেকে ধরে আনলি!
বললাম, মেসরুম থেকে।
একসঙ্গে থাকলে, আর এতদিন এক ফোকসালে থাকলে মায়া-দয়া জন্মাতেই পারে। চিন্তা হতেই পারে। তাছাড়া সতীশের সুন্দরী বউকে আমরাও দেখেছি একদণ্ড কাছছাড়া হয় না। কিন্তু এটা যে কতবড় বিপজ্জনক খেলা একজন জাহাজির পক্ষে, ভেবেই অপরেশ ক্ষুব্ধ।
সে সোজা উঠে এল।—এই ওঠ। বলে সতীশের হাত ধরে টানাটানি করতে থাকল।
নিমাই বলল, ছাড়ো তো অপরেশদা। এত রাতে আর ঝুটঝামেলা ভাল্লাগে না।
আর ও তো মরবে।
মরবে কেন!
শোন, এমন অনেক দেখেছি! জানিস, মাথায় বীর্য উঠে গেলে পাগল হয়ে যায়। দিওয়ানা হয়ে যায়।
যা, কী যে আবোলতাবোল বকছ না?
এই উঠবি, না শুয়ে থাকবি। তোর সতীপনা বের করছি। এই নিমাই বের কর তো। ঘাড় ধরে দেখাব।
সতীশ কম্বলের নীচ থেকে হাতজোড় করল, দাদা ক্ষমা কর। আমি পারব না।
পারতে হবে। ওঠ বলছি। অনেক সতীপনা সহ্য করেছি। এখন মেসরুমে শালা, পরে সমুদ্রের তলায় যাবি—তোর তো নিরিবিলি জায়গা চাই। তুই সব করতে পারিস।
সতীশ মটকা মেরে পড়ে আছে।
অপরেশের মাথা গরম হয়ে গেছে। সে এমন একটা কাজ করে বসবে বুঝতে পারিনি। এক ঝটকায় বালিশের তলা থেকে ফটোভরতি খামটা তুলে নিল।
আর নিতেই ছুটে গেল সতীশ।
সব ফেলে দেব।
অপরেশ জেটির উপরে উঠে পোর্টহোলের কাচ খুলতে লাগল।
ওর মুখে এক কথা, আগে দ্যাখ, না দেখলে ফেলে দেব।
নিমাইকে বলল, আরে বের কর আমাদের অ্যালবাম। যেটাকেই দেখা, সব এক। তার বউ-এরটা আলাদা নয় বুঝোক। ওষুধ প্রয়োগ না-হলে বাঁচবে না। ব্যাটা সাধুপুরুষ। বউ ছাড়া কিছু বোঝে না। আট-দশ মাস সফর-করা অপরেশ আমাদের চেয়ে অভিজ্ঞ। সে বলতেই পারে। জাহাজের অসুখ সম্পর্কেও সে বেশি খবর রাখে। সতীশ অপরেশের হাত ধরে টানাটানি করছে। অপরেশ হাতটা পোর্টহোলের বাইরে রেখে দিয়েছে। ছেড়ে দিলেই সমুদ্রের নীল জলে প্রপেলারের চাকায় তছনছ হয়ে গভীর জলের অন্ধকারে ভেসে যাবে।
সতীশের কাতর অনুনয়, দোহাই অপরেশদা। পায়ে পড়ি।
দ্যাখ তবে। এই নিমাই ওর সামনে অ্যালবামটা মেলে ধর। ব্যাটা দেখুক লজ্জা ভাঙুক।
নিমাই দেখল, অ্যালবাম খুলে দিলেও সতীশ তাকাচ্ছে না।
অপরেশের হুঙ্কার, ঠিক আছে, নে এবার ঠিক ফেলে দিচ্ছি। দেখি তারপর কী। থাকে তোর। বউ মগজে সেঁটে আছে।
ফেলবে না দাদা। প্লিজ, পায়ে পড়ছি।
তাকা। দ্যাখ। দিল তোর সাফ হয়ে যাবে।
ঠিক যেন ধর্মগ্রন্থ খুলে রেখেছে নিমাই। সতীশ বলল, কী নোংরা ছবি!
দেখ না! নোংরা হোক। তবু দেখ। আমাদের ধর্মগ্রন্থ এটা, বুঝিস! পাঠ কর। ভালো করে দ্যাখ। জীবনেরও ধর্মগ্রন্থ।
সতীশ দেখছে।
দ্যাখ।
সতীশ দেখছে নিমাই অ্যালবামের পাতা উল্টে যাচ্ছে।
সতীশের আর খেয়াল নেই।
এই তবে সব! সতীশ কেমন দেখতে দেখতে নেশায় পড়ে গেল।
অপরেশ বলল, যা, ব্যাং-কে বসে দেখ। সতীশ ব্যাং-কে বসে দেখতে থাকল। কী মজা লাগছে। নারে! মহাকাব্যের উৎপত্তিস্থলটা দ্যাখ বাবা ভালো করে।
সতীশ তাকাচ্ছে না। নিবিষ্টমনে দেখছে। ইস, কী নোংরা। কেউ এভাবে ছবি তুলতে পারে। এদের লাজলজ্জা নেই দাদা! কী কুৎসিত। বমি পাচ্ছে।
শালা বমি পাচ্ছে তোমার। মারব এক থাপ্পড়। যা এবার বালিশের নীচে রেখে শুয়ে পড়। অনেক জ্বালিয়েছ। আর না। বউ-এর ফটোগুলো আমার কাছে থাকল। দরকার পড়লে চেয়ে নেবে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত দরকার পড়েনি।
অপরেশই কলকাতার ঘাটে ফটোগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, বউকে বলবি, আর-একদিন নেমন্তন্ন করে যেন খাওয়ায়। আমরা তো খারাপ। কে কত ভালো জানা আছে! পাগল হসনি রক্ষে। এবারে অ্যালবামটা ফেরত দে।
পাচ্ছি না।
মিছে কথা বলছিস!
ধরা পড়ে গিয়ে সতীশ বলল, এটা থাক দাদা আমার কাছে। তুমি না-হয় আর একটা কিনে নিও।
আজব বাতি
দেবনাথ ডেক ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। প্রবল ঝোড়ো হাওয়া সমুদ্রে। টলতে টলতে সে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কেন জানি, এ সময় ফের লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে হল। ফোকসালে সে ইচ্ছে করলে সিগারেট ধরাতে পারত। কিন্তু সবাই যা করছে। বন্ধু, প্রেমা, রাজু সবাই যেন টের পেয়ে গেছে ব্যাটা কিছু লুকাচ্ছে। এমনকি তাকে গোপনে অনুসরণ পর্যন্ত করতে পারে! সে টুইন-ডেকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, না, কেউ এদিকটায় আসছে না। ডেক-টিণ্ডাল তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বোট-ডেকে জল মারছে। তার কাজ গ্যাঙওয়ের পেছনটাতে। হাতে রঙের টব। চিপিং করার হাতুড়ি পকেটে। সে রং করতে যাচ্ছে। সকালে চা-চাপাটি খেয়ে একটা সিগারেট মৌজ করে খেতে কার না ইচ্ছে হয়। কিন্তু ফোকসালে প্রেমা রাজুর উপদ্রবে সে লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা পর্যন্ত ধরাতে পারল না। রোজ এক উপদ্রব।
আরে দেখি দেখি! কবে কিনলি?
সঙ্গে সঙ্গে সে লাইটার ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে।
দেখি না! কত দিয়ে কিনলি?
দেবনাথ রা কাড়ে না। তাড়াতাড়ি উঠে সিঁড়ি ধরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে যেন বাঁচে। ওরা ধাওয়া করে। সেও ডেক ধরে দৌড়ায় এবং একসময় জোরজার করে চেপে ধরলে দেবনাথ হাত তুলে দেয়।—দ্যাখ, দ্যাখ না। নেই।
কোথায় রেখেছিস?
ফোকসালে।
আসলে এভাবেই লাইটারটা নিয়ে ওদের চারজনের মধ্যে বেশ একটা রহস্যময়তা গড়ে উঠেছে। লাইটারটা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। পোর্ট অফ সালফার থেকে জাহাজ ছাড়ার পরই ওরা পেছনে লেগেছে। সে কিছুতেই লাইটারটা হাতছাড়া করতে চায় না। ওরাও দেখবেই। ছাড়বে না।
এই দে না, সিগারেট ধরিয়ে নি।
না।
শালা তোমার লাইটারে কী আছে? আমরা খেয়ে ফেলব? তুই কী রে! আমাদের কাপ-ডিশ ধরে দেখিস ব্যাটা, কী করি! প্রেমা, লকারে চাবি দিয়ে রাখবি তো। জাহাজে উঠে এসেছে—নিজের কাপ-ডিশ পর্যন্ত আনেনি! ব্যাটা হাড়কেপ্পন!
দেবনাথ চুপচাপ থাকে। তা সে সামান্য কিপ্টে স্বভাবের। তার মতো মানুষের পক্ষে কোনো শৌখিন জিনিস কেনা সম্ভব রাজু প্রেমা ভাবতেই পারে না। পলকে সিগারেট ধরিয়েই নিভিয়ে দেয়। তখনই ওরা দেখে ফেলে, বস্তুটি সত্যি শৌখিন। আকারে একটু বড়োকাচের আবরণ, এক পাশে সোনালি জলের দাগ, কিছু সবুজ লতাপাতার চিত্রমালা কাচের গায়ে। এইটুকু দেখেই বুঝেছে, দেবনাথ তবে টাকা খরচ করতে শিখেছে। প্রথম দিকে জাহাজে ওঠে, সে বন্দর এলে নামতই না। নতুন জাহাজিও নয়। এই নিয়ে পাঁচ সফর। সিটি লাইনেই তার পর পর তিন সফর হয়ে গেল। ডারবান, কেপটাউন, স্যান্টিস–কোথাও সে নামেনি। বুনোসাইরিসে এক বিকেলে নেমে সস্তায় কিছু আপেল কিনে এনেছিল— এই যা। তারপর পোর্ট অফ জামাইকাতে মাঝে মাঝে দল বেঁধে নেমে গেছে। কিন্তু কোনো সওদা করেনি।
দেবনাথ পকেট থেকে লাইটার বের করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, না। কেউ অনুসরণ করছে না। মেজ মালোম দু-নম্বর ফল্কায় দাঁড়িয়ে বড়ো মালোমের সঙ্গে কথা বলছেন। জাহাজ যাচ্ছে হাইতি দ্বীপে। সেখান থেকে সোজা বিশ-বাইশ দিনের যাত্রা। রসদ নেবার জন্য জাহাজটা দ্বীপে কয়েক ঘণ্টা থামবে। সাত আট মাস হল ওরা সফরে বের হয়েছে–একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা কাঁহাতক ভালো লাগে।
দেবনাথ জাহাজে উঠলেই বাড়িঘরের কথা ভেবে বিষণ্ণ থাকে। কিনারায় কাজ পেলে সে কিছুতেই জাহাজে মরতে আসত না—এমন সে কতবার আক্ষেপ করেছে। সেই দেবনাথ বেশ হাসিখুশি। শিস দিয়ে একদিন হিন্দি গানের কলিও ভাঁজছিল দেখে রাজু এমনকি সারেঙ পর্যন্ত অবাক। আরে দেবনাথ শিস দিচ্ছে।
সত্যি শিস দিচ্ছিল দেবনাথ!
লাইটারটা জ্বালাবার আগে দেবনাথ আশ্চর্য এক উত্তেজনা বোধ করে। সে হাত দিয়ে বার বার দেখে পকেট আছে তো—এই এক ভয় নিরন্তর। কেউ না মেরে দেয়। মেরে দিলে নির্ঘাত সে পাগল হয়ে যাবে। সামান্য একটা লাইটারের প্রেমে পড়ে যেতে পারে কেউ, এই প্রথম দেবনাথ টের পেল। সে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালাতে গিয়ে দেখল বারবার নিভে যাচ্ছে। ঝাপটা হাওয়া নিভিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এবং অসীম অনন্ত আকাশ ছাড়া তাকে দেখবার কেউ নেই। সে আড়ালে-আবডালে কাজ করতে ভালোবাসে। আসলে কেউ জানেই না লাইটারটা জ্বালিয়ে সে অপলক দেখে কিছু। লাইটারের কাচের মধ্যে তার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যায়। কেমন এক ঘোর তৈরি হয়। সে জাহাজের কাজকর্মের ব্যস্ততার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়।
এই যে দেবনাথ! বসে কেন?
না স্যার, মানে…। সে তাড়াতাড়ি লাইটার নিভিয়ে মাস্তুলে রং লাগাতে শুরু করে। ধরা পড়তে পড়তে কতদিন বেঁচে গেছে। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ফোকসাল, কিন্তু একদণ্ড খালি থাকে না। যখন-তখন যে-সে ঢুকে যায়।
আরে তুমি লাইটার জ্বালিয়ে কী দেখছ!
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে। তাড়াতাড়ি লাইটার নিভিয়ে দিয়ে হেসে ফেলে।
না দেখছিলাম?
কী দেখছিলে?
সে কী দেখছিল বললে জাহাজে মারামারি পর্যন্ত শুরু হয়ে যেতে পারে। বলা যায় না, খুনটুনও।
সে বলে, না, কিছু না।
দেবনাথ সবসময় সতর্ক থাকে। ঘুমাবার আগে লাইটারটা কোথাও লুকিয়ে রাখে। নিজস্ব লকার থাকে না। দুজনের জন্য একটা লকার বরাদ্দ। কাজেই চাবি দিয়ে যে নিশ্চিত থাকবে তার উপায় নেই। লকারের ডুপ্লিকেট চাবি রাজুর কাছে। সে পেলেই ওটা মেরে দেবে। এবং যদি টের পায়, কোনো অলৌকিক ছবি লাইটার জ্বাললে দেখা যায় তবে তো কথাই নেই।
লাইটারটা কেনার পর থেকেই তার বিচিত্র শখ জন্মেছে। সে নীল রঙের টাই পরে সাদা প্যান্ট সাদা শার্ট গায়ে দিয়ে বোট-ডেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাজের সময় ছাড়া কোনো জাহাজি এদিকটায় বড়ো আসে না। বোট–ডেকের মাথায় কাপ্তানের কেবিন। ব্রিজে উঠে যাবার সিঁড়ি। পাশে চার্টরুম। বোট-ডেকের পাশে কিছুটা আড়াল আছে। দুটো বোটের মধ্যবর্তী জায়গা ফাঁকা। আফটার-পিক কিংবা ব্রিজ থেকে জায়গাটা দেখা যায় না। কেবল ওয়াচ বদলের সময় ফায়ারম্যানরা উঠতে নামতে দেখতে পায়, দেবনাথ চুপচাপ বোট-ডেকে বসে আছে।
আরে এখানে!
এই এমনি। সে আবার কিছু লুকিয়ে ফেলে।
সে তার বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় সব পাল্টে ফেলেছে। ফোকসাল আর কেবিনের তফাত আকাশপাতাল। ফোকসালে চারটে বাঙ্ক। ম্যাট্রেস। কোম্পানি থেকে দুটো নীল প্যান্ট, নীল শার্ট, একটা গরম কালো রঙের সোয়েটার পায় জাহাজিরা। সেও পেয়েছে। বাড়তি জামা প্যান্ট যতটা দরকার—এই যেমন সে কার্ডিফের সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে একটা কোট কিনেছিল প্রথম সফরে শীতের দেশে এখনও সেই কোটই সম্বল। সে আর কিছু কেনাকাটা করেছে বলে কেউ জানে না। কারণ একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় বের হলেই মন খারাপ হয়ে যায়। মা বাবা ভাই বোন ফেলে সমুদ্রে ঘুরতে তার ভালো লাগে না।
বিচিত্র শখ। এজন্য যে, সাদা চাদর সাদা ওয়াড় যেমন কেবিনে ধোপদুরস্ত, ছিমছাম পাতা থাকে সব কিছু, তেমনি তার, বিছানায় সাদা চাদর বালিশের সাদা ওয়াড়—স্টুয়ার্ডের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। এমনকি বন্দরে এলে মেসরুম মেট ফুলও রাখে ফ্লাওয়ার ভাসে-স্টুয়ার্ডের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তার বাঙ্ক, বিছানা অফিসারদের মতো করে নিয়েছে। সে দামি গন্ধ সাবান মাখে। গায়ে বিদেশি আতর দেয় আজকাল।
স্বাভাবিক কারণেই একজন সামান্য জাহাজির এই ধরনের শৌখিন জীবনযাপন বিচিত্র শখের পর্যায়ে পড়ে। জাহাজিরা অফিসারদের মতো কে কবে শোখিন হয়!
হাইতিতি দ্বীপ থেকে জাহাজ যাচ্ছে অকল্যান্ডে। এ সময় দরিয়ায় ঝড়-ঝাপটা লেগে থাকে বলে ডেকে বের হওয়া যায় না। বলতে গেলে মাত্র পাঁচ-সাতদিন সমুদ্র শান্ত ছিল। তখন দেখা যেত দেবনাথ একা একা বোট-ডেকের দিকে উঠে যাচ্ছে। ডেক-জাহাজিদের পাঁচটার পর ছুটি। জাহাজের স্টাবোর্ড-সাইডে থাকে ডেক-জাহাজিরা। সুখানিরাও থাকে। তিন সুখানি এক ফোকসালে। পাশের ফোকসালে থাকে ডেক-টিল্ডাল আর ডেক-কর্মীরা। সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে দুদিকের ফোকসালে থাকে এনজিন-সারেঙ আর ডেক-সারেঙ। স্টাবোর্ড-সাইডের জাহাজিদের রাতে পালা করে দুজনকে অবশ্য ওয়াচ দিতে হয়। ফরোয়ার্ড-পিকে ডিউটি থাকে। অন্ধকারে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে টনটন করে ঘণ্টা বাজাতে হয়।
দেবনাথের আদ্ভুত আগ্রহ রাতে ফরোয়ার্ড-পিকে ওয়াচ দেওয়ার। সাধারণত এই ওয়াচ ডেক-জাহাজিরা পছন্দ করে না। পুরো চার ঘণ্টা একটানা দাঁড়িয়ে দূরের সমুদ্রে লক্ষ রাখা খুবই কঠিন কাজ। এ-কাজে উৎসাহ কেন এত দেবনাথের কেউ বুঝতে পারছে না। যেন সে যদি রোজ এই ওয়াচের কাজটা পায় বর্তে যায়। এটাও রাজু, প্রেমাকে হতবাক করে দিয়েছে। কোথায় সারাদিন খাটুনির পর পড়ে ঘুমাবে, না তিনি চললেন ফরোয়ার্ড-পিকে ওয়াচ দিতে।
তারা আরও আশ্চর্য হল, অকল্যান্ড বন্দরে তাকে থ্রি-পিস-স্যুট করাতে দেখে। আরে শালা যে জাহাজের সব টাকা খতম করে যাবে বলে ঠিক করেছে। অবশ্য ইচ্ছে করলেই এটা হয় না। জাহাজিরা সমুদ্রের মাইনের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তুলতে পারে। তবে বেশি পারে না। কিন্তু দেবনাথের টাকায় কুলোচ্ছে না বলে সে ফালতু কিছু কাজ স্টুয়ার্ডের করে দেয়। সে হিসাবপত্র রাখতে ওস্তাদ। কিছু টিপসও নিয়েছে স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে। যেমন পানামা থেকে কম্বল কিনে নিতে পারলে বেশি দামে বিক্রি করা যায়। ঘড়ি কিনে নিলেও বেশি দাম পাওয়া যায়। সে রেডিও পর্যন্ত কিনে নিয়েছিল বিক্রি করবে বলে। তবে দাম পায়নি বলে বিক্রি করেনি। সে এখন অবসর পেলেই রেডিওতে বিদেশি সংগীত শুনতে শুনতে কেমন মজে যায়।
একটা সামান্য লাইটার তাকে এমনকি প্রেমে ফেলে দিল বুঝতে পারছে না তারা!
শালা ফুটানি করতে গিয়ে ধনে জনে যাবে এবার। এবং সত্যি সে একদিন রাজুকে বলল, এই, দু-ডলার ধার দিবি।
রাজু বলল, আর কি কেনার থাকল বাবা! তুমি তো ফোকসালে থাক না মনে হয়। কেবিনে থাক, ফুল কিনে আনছ কেন গুচ্ছের! ফুলের ভাস! দরিয়ায় সব শালা উলটে পড়ে ভাঙবে।
দেবনাথ রা কারে না।
এরপর তারা ভাবল, দেখা যাক ব্যাপারটা কী!
জাহাজ আবার সমুদ্রে। যাবে তাসমানিয়ায়। দেবনাথ আবার ওয়াচ দেবার জন্য রাত বারোটায় ফরোয়ার্ড-পিকের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল সব। তারা তিনজনেই জেগে ছিল। কেন এত আগ্রহ। এমন একটা একঘেয়ে কাজের। পালা করে দেবার নিয়ম। ডেক সারেঙকে ভজিয়ে সে এখন একাই রাতের ওয়াচ দেয়।
ওরা ডেকে উঠে দেখল, দেবনাথ কানের কাছে রেডিও নিয়ে শুনছে। থামছে। আবার হাঁটছে। সে গেলে ওয়াচের পরীদার চলে আসবে। সে একটু বেশি আগে যাচ্ছে। রাত এগারোটা না বাজতেই দেখলাম ওয়াচ দিতে যাচ্ছে আচ্ছা লোক মাইরি! পারলে যেন দুটো ওয়াচ তাকে একা দিলে সে আরও বেশি খুশি হতে পারে। লাইটারটা আর তারা দেখেইনি। ওটাও কি বিক্রি করে দিল! কী জানি কীসে যে মজে যায় কখন মানুষ বোঝা কঠিন। লাইটারটা আর তারা দেখতে পায় না। সে সিগারেট খাওয়াও কি ছেড়ে দিল শেষ পর্যন্ত।
সমুদ্রে জ্যোৎস্নার আলাদা একটা রূপ আছে। অন্ধকারেরও। আকাশে বেশ বড়ো গোল চাঁদ। ঢেউ নেই বলে স্থির দেখাচ্ছে। ঢেউ থাকলে জাহাজ টলত। চাঁদও মাতলামি শুরু করে দিত আকাশে। তবে মজা, জাহাজ যেদিকে যায়, চাঁদও সেদিকে ভেসে চলে। যেন দুই সঙ্গী নির্জন সমুদ্রে এবং এই নীরবতা কখনও মানুষকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিতে পারে। বিশেষ করে মধ্যরাতে সমুদ্র আরও নিথর। এনজিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসে না। মাঝে মাঝে ওয়াটার ককের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা যায়। নতুন রং হলে রং বার্নিশের গন্ধ। মাস্তুলে আলো জ্বালা থাকে। ডেকে, টুইন ডেকে এবং আফটার-পিকে আলো জ্বালা থাকে। অস্পষ্ট আলো অন্ধকার সারা জাহাজ ডেকে ভেসে বেড়ায়। শুধু ব্রিজে জেগে থাকে সুখানি, সেকেন্ড মেট, এনজিন রুমে ফায়ার ম্যান, টিণ্ডাল। খুব দূরবর্তী মনে হয় তখন ডাঙার জীবন। যেন অনন্তকাল জাহাজটা সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে বলেই বের হয়ে পড়েছে। সামনে পেছনে, আকাশ-নক্ষত্র এবং প্রপেলারের জল ভাঙা শব্দ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না।
এমন জ্যোৎস্নারাতেই রাজু, বন্ধু, প্রেমা খুব সতর্ক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। এনজিন থেকে ওয়াচের লোকজন উঠে এলে ঘাবড়ে যেতে পারে। গ্যালি থেকে চা করে নিয়ে যাবার জন্য উঠে আসতেই পারে। অথবা তেষ্টা পেলে জল। দেখলে বলবে, কে? কে?
কারণ জাহাজে এই মধ্যরাতে ডেকে বেড়াবার কারও কথা নয়। তাছাড়া সব জাহাজেই নানারকম ভৌতিক কাণ্ডকারখানা ঘটে থাকে এমন বিশ্বাস থাকে জাহাজিদের। কারণ জাহাজের দীর্ঘ সমুদ্র সফর কখন কাকে যে অবসাদগ্রস্ত করে তুলবে বলা কঠিন। অবসাদ থেকে আত্মহত্যা—আরও নানা কারণে এসব ভৌতিক ঘটনা প্রাচীন নাবিকেরা এত বেশি বিশ্বাস করে থাকে যে, তারা যেন নিজের চোখে দেখেছে এবং এভাবেই পল্লবিত হয়ে যায় সব খবর। জাহাজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রটে যায়, বরফ-ঘরে মাঝে মাঝে প্রায় বড়ো আস্ত ছাল-ছাড়ানো গোরু ভেড়ার ভিড়ে কোনো নারীর লাশ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। স্টুয়ার্ড রসদ আনবার জন্য বরফ-ঘরে কখনও একা ঢোকে না। সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে হয়। আলো নিভে গেলে রাস্তা খুঁজে উপরে ওঠাই দুঃসাধ্য।
সুতরাং এই দুই ছায়ামূর্তি প্রায় আড়ালে উঠে যাচ্ছে ফরোয়ার্ড-পিকে। টুইন ডেকে উঠেই মাস্তুলের পাশে আড়াল করে দাঁড়াল তারা। এলিওয়ে ঘরে যেতে পারে না। অভিসাররা ওদিকটায় থাকে। এলিওয়েতে কার্পেট পাতা। বেশ উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ওদিক ধরে গেলে ওদের দেখে ফেলতে পারে কেউ। পরদিন সকালে সারেঙ-এর কাছে নালিশ উঠতে পারে—ওরা এত রাত্রে ডেকে কী করছিল? জাহাজে চোরাইমাল কে কীভাবে নিয়ে যায় বলা যায় না। এসব ভয়ও আছে তাদের। ফরোয়ার্ড-ডেকে এসে ওরা আরও সতর্ক হয়ে গেল। কারণ ব্রিজে সেকেন্ড মেট ওয়াচ দিচ্ছে। দেখে ফেলতে পারে। স্টাবোর্ড-সাইড ধরে গেলে দেখতে পাবে সে। যে কোনও কারণেই হোক ওদিকটায় অন্ধকার না থাকলেও নিজেদের আড়াল করার মতো যথেষ্ট সুযোগ আছে।
রাজু ফিসফিস করে বলল, আরে দেবনাথ কোথায়!
সত্যি তো, দেবনাথ ফরোয়ার্ড-পিকে নেই। নোঙর ফেলবার আই-হোলের পাশে তার দাঁড়িয়ে ওয়াচ দেবার কথা।
কিন্তু চার নম্বর ফল্কা পার হতেই ওরা টের পেল, দুটো উইন্ডসহোলের মাঝখানে দেবনাথ। ওরা আরও আশ্চর্য—দেখল সামনের উইন্ডসহোলের মুখটা সে উলটো মুখে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বাতাসের ঠিক বিপরীত দিকে। আর উইন্ডসহোলের মুখের ভিতর ঝুঁকে কী দেখছে।
কেমন আলো জ্বলছে, আলো নিভছে উইন্ডসহোলের মুখে। আলো জ্বললে আবছা মতো মুখটা ভেসে উঠছে, আলো নিভে গেলে মুখ অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
বেটা কী দেখছে ঝুঁকে!
ওরা হামাগুড়ি দিতে থাকল। কারণ এখন উঠে দাঁড়ালেই ব্রিজ থেকে সেকেন্ড মেট তাদের দেখে ফেলবে। নোঙর-ফেলার উইনচ ম্যাসিনের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেতেই টের পেল, আসলে দেবনাথ ঘোরে পড়ে গেছে। ঘোরে পড়ে না গেলে এমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য কেউ হয় না তারা এত কাছে, একবার রাজুর খুকখুক করে কাশি—এইরে ধরা পড়ে গেল। তোরা! বলতেই পারে। কিন্তু হুশ নেই। ওরা পেছন থেকে ঝুঁকে দাঁড়াল সন্তর্পণে আর দেখল, দেবনাথ তার অলৌকিক লাইটার জ্বালিয়ে বার বার মজা পাচ্ছে। তারা লাইটারটা দেখতে পাচ্ছে না। কারণ গোটা উইন্ডসহোলের মুখ ওর মাথা আড়াল করে রেখেছে। ডান হাতটা বাতাস থেকে লাইটারের আগুন বাঁচাবার জন্য উইন্ডসহোলের ভেতরে ঢোকানো।
ওরা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, দেবনাথ টের পাচ্ছে না। এমনকি নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও খেয়াল করছে না। না করারই কথা। জাহাজ জল ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কলকল ছলছল শব্দ আরও গভীর হতে পারে।
ওরা তিনজনই এই রহস্যকে ছুঁতে চায়।
কী আছে লাইটারে!
বার বার জ্বলছে, আবার নিভিয়ে দিচ্ছে।
যেন এক বালক খেলাচ্ছলে কাজটা করছে।
ওরা দেখছে, লাইটার জ্বললে ওর মুখ অধীর হয়ে উঠছে। মুখের সবটা দেখা যাচ্ছে না। আংশিক। ওতেও বুঝতে পারে, কিংবা মাস্তুলের আলোয় ওর মুখের অধীরতা কিংবা শরীরে আশ্চর্য ধবনি খেলা করে বেড়াচ্ছে টের পাওয়া যায়। ওদের ছায়ামূর্তি তাকে ঘিরে রেখেছে। উইন্ডসহোলের থেকে মুখ এবং হাত বের করে আনলেই জাপটে ধরবে। যা পাগল, ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে যদি উইন্ডসহোলের ভেতর ফেলে দেয়, তবে আজকের মতো আর লাইটারের রহস্য ধরা যাবে না। ফল্কার কাঠ না খোলা পর্যন্ত দেখা কঠিন। গুড়ো সালফার বোঝাই। উইন্ডসহোলে গলিয়ে দিলে হাজার হাজার টন ফসফেটের ভিতর থেকে লাইটারটা খুঁজে বার করাও শক্ত। কারণ তারা ধরে নিয়েছে, দেবনাথ অপ্রকৃতিস্থ। না হলে এমন আচরণ জাহাজে ভাবা যায় না। বাড়ির জন্য যে এত বিষণ্ণ হয়ে থাকত, সে-ই লাইটারটা কেনার পর আশ্চর্যরকম ভাবে পালটে গেল। শৌখিন, কেতাদুরস্ত নাবিক।
আর এ সময়ই দেখল, দেবনাথ মুখ বের করে এনে লাইটারটা ঝাঁকাচ্ছে। আসলে বোধ হয় আর জ্বলছিল না। তেল উঠে আসার পথে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছ। সঙ্গে সঙ্গে শিকারি ঈগলের মতো রাজু লাইটারটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আর প্রেমা ওকে ঝাপটে ধরে রেখেছে। কারণ তারা জানে, সেও দৌড়োবে রাজুর পেছনে।
জায়গাটার একটা বিশেষ সুবিধা আছে। পাঁচ-সাতটা উইন্ডসহোলের মুখ উপরে উঠে সাপের ফণার মতো মুখ বাঁকিয়ে রেখেছে।
প্রেমা চিৎকার করতে পারছে না। দেবনাথ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে।
হইহল্লা হলে ব্রিজ থেকে সেকেন্ড মেট ছুটে আসবে। এমনকি জাহাজের সাইরেনও বেজে উঠতে পারে। ধড়ফড় করে সবাই জেগে যাবে। মধ্যরাতে সাইরেন কেন।
ফলে দেবনাথ হল্লা জুড়ে দিতে পারছে না।
কিন্তু এ কি, রাজু লাইটারটা জ্বেলে কী দেখছে। যেন তারও হুঁশ নেই।
প্রেমা দেবনাথকে ছেড়ে ছুটে গেল—এই, কী দেখছিস? রাজু ছুটতে থাকল। সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
আরে এ তো ভারি বিপজ্জনক খেলা! মধ্যরাতে স্তব্ধ আকাশের নীচে কজন নাবিকের মধ্যে মহামারি কাণ্ড। কে বিশ্বাস করবে! রাজুর হাত থেকে লাইটারটা কেড়ে নিল প্রেমা।
সেও হতবাক। কেমন ঘোরে পড়ে যাচ্ছে।
জ্বাললে এক নগ্ন সুন্দরী নাচে। নিবিয়ে দিলে নগ্ন সুন্দরী অদৃশ্য হয়ে যায়। আগুন বাতাসে কাঁপলে নাচের বাহার একরকম, বাতাস না থাকলে সেই নগ্ন নারী সোজা মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীরের সব ভাঁজ এত স্পষ্ট যে-কোনো মানুষ মুহূর্তে কামুক হয়ে উঠতে পারে। আসলে কাচের ভিতর কোনও মজা আছে অথবা আগুনের প্রতিবিম্ব কোনও মায়াবি নারীর শরীর নিয়ে ভেতরে ঘোরাফেরা করে। এখন এই আজব বাতিটা কে যে কজা করবে। এবং যখন ডেক জুড়ে এভাবে মারামারি হাতাহাতি চলছিল, তখনই ছিটকে কোথায় পড়ে গেল লাইটারটা। কাচ ভেঙে গেল।
দেবনাথ এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে হাউ হাউ করে কেঁদে দিল। সে চিৎকার করে উঠল, কেন, কেন তোরা আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলি! আমি তোদের কী ক্ষতি করেছি? বল বল! বলে ছুটে গিয়ে সে একটা রড তুলে এনে রাজুকে খুন করতে গেলে প্রেমা ধরে ফেলল।
দেবনাথ সত্যি কেমন হয়ে গেল! সে কারও সঙ্গে আর কথা বলত না। চুপচাপ একা মধ্যরাতে ডেকে ঘুরে বেড়াত। পকেটে ভাঙা লাইটার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কথা বলে নিজের সঙ্গে। তারপর এক রাতে সে আর ডেক থেকে ফিরে এল না। অজানা সমুদ্রে সে হারিয়ে গেল।
আত্মরতি
এই যাবি টুম্পা।
কোথায়?
মিডনাইট ফ্যাশন শোতে।
ওরে বাপস, এত রাতে।
তোদের ফ্ল্যাট থেকে বেশি দূর না, হেঁটেই যাওয়া যাবে। তুই আমি পালিয়ে যাবি!
মরতে চাস নাকি।
এখন তো আমাদের মরারই বয়স রে। গেলে দেখা যাবে রবি বর্মার শরীরী নারী, রবি বর্মার বর্ণময় রোমান্টিকতা, রবি বর্মার ইশারাবাহী যৌনতা। সকালের কাগজটা দেখিসনি—শাড়ির ফ্যাশান শো-শাড়ির রং, শরীরের ওপর তার ইঙ্গিতময় বিন্যাস, খসে পড়া আঁচল উদ্ভিন্ন লাবণ্যের হঠাৎ প্রকাশ–শাড়ির ভিতর থেকে ফুটে ওঠে শরীরের উদ্ভাস—সত্যসুন্দর শাড়িতে ধরা দিয়েছেন ইবকল রবি বর্মা। কাগজেই লিখেছে রে। খবরটা পড়ার পর আমার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে রে।
যাও মরো গে। সামনে আর দু-মাসও সময় নেই পরীক্ষার—তোকে এখন মিডনাইট ফ্যাশন শোতে পেয়েছে রুবি।
আচ্ছা টুম্পা তোর ইচ্ছে হয় না হালকা শাড়ির ভিতর নিজের শরীর ভাসিয়ে রাখতে? এ শাড়ি শরীর ঢেকেও পৌঁছে দেয় শরীরের বার্তা। এ শাড়ি দর্পিত করে শরীরের ইচ্ছা। এ শাড়ি আবরণ নয়—মধ্যরাতে এ-শাড়িই নারী শরীরের উদ্বোধন, আমি কাগজ থেকেই তোকে পড়ে শোনাচ্ছি রে—আহা কী সুখ, নারীর শরীরকে উত্তীর্ণ করবে উৎসবে। ভারতের টপ মডেলরা হাঁটবেন উৎসবের কোহলসিক্ত ক্ষীণ সরণিতে-রজনী উদ্দীপ্ত আঁচল কখনো উড়বে, খুলবে, খসবে। আলোর মোহময় উদ্ভাসে কখনো চমকে উঠবে অন্তর্বাসের মৃদুভাস উচ্চারণ। শুনছিস তো, কাগজে লিখেছে। কাগজ থেকে পড়ে শোনাচ্ছি। কি রে যাবি! চল না বাবা।
থাম তো রুবি। বাড়িতে টিভি দেখিস না?
কি রে কথা বলছিস না কেন। ফোনটা এত ঘ্যাস ঘ্যাস করছে কেন?
টিভিতে দেখা আর শোতে দেখা এক কথা বল—রবিবারের পাতাটা খুলে দ্যাখ, বিনোদিনী রাধা উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। মাথা খারাপ করে দেয়। আমি একটা অ্যাড আঁকছি। পুরুষ মানুষের।
আমি কি বিনোদিনী রাধার চেয়ে দেখতে খারাপ।
কে বলেছে খারাপ। তুই আরও সুন্দর টুম্পা। ভেসে যাওয়া হালকা মসলিনে তোকে জড়িয়ে দিলে তোর নগ্ন শরীরও আশ্চর্য এক শিল্পির আঁকা ছবি হয়ে যাবে।
তুই অসম্ভব নগ্ন থাকতে ভালোবাসিস রুবি। অলকদাকে বল না এঁকে দেবে তোর ন্যুড। বিনোদিনী রাধার চেয়েও তোকে সুন্দর দেখাবে। সকাল বেলায় তোর এত খারাপ খারাপ কথা বলতে ভালো লাগে।
মারব টুম্পা। একদম বাজে কথা বলবে না। অলকদা তোমার আমার মতো বসে নেই। রেবাদির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে।
তাতে কি হল। অলকদাকে তো তুই ভালোবাসিস। অলকদার ছবির এগজিবিশানে কী ন্যাকামিটাই না করলি।
কী মিছে কথা। তুই কী রে! অলকদা রেবাদি উটিতে বেড়াতে গেছে। অলকদাকে রেবাদি ছাড়া ভাবাই যায় না। অলকদাকে দিয়ে নুড আঁকাতে যাব কেন! ও কি আমাকে আর ভালোবাসে। ভালো না বাসলে নগ্ন হওয়া যায় বল।
রাখ তো বাজে কথা, স কালবেলায় তোর মাথায় কি ঢুকেছে বল তো রুবি। এত আজেবাজে বকছিস। আমার জেরক্সগুলি করিয়েছিস?
তুই কবে আসবি? আজই আয় না। কগজে বিনোদিনী রাধা, আমি তুই, ওফ যা জমবে না! জানিস আমার ছোটোকাকা এসেছেন। তুই তো চিনিস।
আমি কাউকে চিনি না—চেনার দরকারও নেই। টি কে-র নোটগুলো তোর কাছে আছে?
সব আছে টুম্পা। তোকে কতদিন দেখি না রে। আয় না, দু-জনে দুপুরে খেয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমাব। আসবি। হালকা মসলিনে আমরা বিনোদিনী রাধা হয়ে যাব। কুয়াশায় ভেসে যাব।
আসলে রুবি এবং টুম্পার এখন উড়ে বেড়াবার বয়স বলা যেতে পারে, আবার উড়ে বেড়াবার বয়স নাও বলা যেতে পারে। নিজেরা নিজেদের নিয়ে অদ্ভুত মজা করতে তারা ভালোবাসে। কিছুটা উচ্চবিত্ত পরিবারের বলা যায়, তবে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধও তাদের কম না। দুজনের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব এবং অদ্ভুত সব ইচ্ছের কথা অনায়াসে তারা একজন আর একজনকে বলতে পারে।
এমনকী স্বপ্ন দেখলেও এবং স্বপ্নটা যদি শরীর নিয়ে হয় এই যেমন, টুম্পা প্রায়ই স্বপ্ন দেখে সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। একজন পুরুষ সঙ্গীও সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত এবং বড়ো বড়ো ঢেউ-শরীর হালকা, সায়া শাড়ি ব্লাউজ গায়ে না থাকলে শরীর তো হালকা হবেই এবং সে দেখতে পায় একটা দ্বীপ, দ্বীপে পুরুষটি তাকে পাঁজাকোলে করে হেঁটে যাচ্ছে, তারপর বালিয়াড়ি সে এবং পুরুষটির মধ্যে যদি কোনো রমণের ছবি থাকে তাও রুবিকে টুম্পা অকপটে বলে যাবে–টুম্পার একটাই কষ্ট, পুরুষটির মুখ সে চিনতে পায় না। এই আত্মপ্রকাশের মধ্যে কোনো অশিষ্টতা আছে তারা মনে করে না।
সক্কাল বেলায় এত ফাজিল কথা বলতে পারিস! তুই কী রে রুবি। হালকা মসলিন পাব কোথায়। সুতরাং এ-সব ফাজিল কথা ছেড়ে আসল কথায় আসা যাক।–আসলে মেয়েরা যেমন হয় আয় কি।
গল্পটা বর্ষাকাল দিয়ে শুরু করলেই বোধ হয় ভালো হয়। এই আকাশ ঝকঝকে তকতকে, এই মেঘ বৃষ্টি, বর্ষার আকাশের মতোই দুই বন্ধুর প্রীতি এবং সৌন্দর্য, কেমন এক অমায়িক রূপও অনুধাবন করা যায়— ওদের কোনো অলকাও নেই রেবাদিও নেই। সব বানানো, রুবি নূডও আঁকে না, আসলে সে ছবিই আঁকে না তবু তারা দুজনেই সুযোগ পেলে একসঙ্গে বের হয়, রবিঠাকুরের জন্মদিনে শুচিশুদ্ধ হয়ে জোড়াসাঁকো যায়, কিংবা বাংলা আকাদেমিতে কবিতা পাঠের আসরেও শ্রোতার ভূমিকা পালন করে, কোনো কবি সুপুরুষ হলে দুই বন্ধুতে ঠাট্টাতামাসা করতেও ভালোবাসে—দারুণ কবিতা, গালে রেশমের মতো দাড়ি–আজকে কবিকে আমি রেহাই দিচ্ছি না। সঙ্গে সঙ্গে রুবিও বলবে, আমিও না। যা হয় হবে।
এ মা, তুই কী রে! আমার পছন্দের জিনিস তুই চুরি করবি। আমি তাকে রেহাই দিলে তোর কি সুবিধা হয়! ঠিক আছে আমি দেখি আর কাউকে পাই কি না। একমাত্র বিনোদিনী রাধার আশ্চর্য সুন্দর চিত্রশিল্পটি ছাড়া এ-গল্পের আয় কোনো সারবত্তা নেই।
আসলে রুবির এ-সবও ফাজিল কথা—অথবা বলা যায় কথার কথা, মেট্রোতে ভালো বই থাকলে তারা একসঙ্গে দেখে, এমনকী বেড়াতে যদি যায় কেউ কারও বাড়িতে নিজের নিজের ঘরে টিভি চালিয়ে ইংরেজি অর্ধ-উলঙ্গ বই তারা দেখে, তবে কেউ দরজায় নক করলেই উঠে যায় এবং চ্যানেল পাল্টে ডিসকভারিতে এসে যায়, আসলে পড়াশোনার চাপ যথেষ্ট, তাই একটু সময় নিয়ে খেলা—আসলে গল্পটা কেন যে শুরুই করতে পারছি না-বুঝছি না, এমন দু-জন অকপট মেয়েকে যদি কোনোদিন কোনো পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রতটে দেখে ফেলা যায়—তবে তাদের কথা কীভাবে যে প্রকাশ করা যায়, এই সব ভেবেই যখন কলমের ডগায় দুই সুন্দরী ভেসে যায় তখন তাদের খারাপ ভাবতে আমার একদমই ভালো লাগে না—গল্পটা যদি এ-ভাবে শুরু করি–
আহা কী বৃষ্টি!
বর্ষার বৃষ্টি এই আসে এই যায়। রুবি এমন সুন্দর একটি চিত্রশিল্প নিয়ে অপেক্ষা করছে সে একা বাড়িতে থাকে কী করে! বের হবার সময় টুম্পার মনেই হয়নি শেষে সারাদিনই তাকে বৃষ্টি তাড়া করবে।
বর্ষার বৃষ্টি এই আসে এই যায়।
বাড়ি থেকে বের হবার সময় টুম্পার এমনই মনে হয়েছিল। রবিবারের পাতায় বিনোদিনী রাধার হালকা অনাবৃত ভেসে যাওয়ার ছবিটা সেও দেখেছে—তবে একা, কেন যে সে রুবির অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। দু-জনে একসঙ্গে বসে দেখার মজাই আলাদা।
সে বৃষ্টি মাথায় বের হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি কিংবা নরম রোদ অথবা বিকেলের ঘোর অন্ধকারে ছাতা মাথায় মেয়েদের এমনিতেই বড়ো রহস্যময়ী মনে হয়। যেন ঘাস ফুল পাখির মতো তারা ঝড়ের বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হবার সময়ও টুম্পার মনে হয়েছিল বর্ষার বৃষ্টি এই আসে এই যায়। রাস্তায় বের হলেই বৃষ্টি উধাও হয়ে যাবে। কারণ মেঘ পাতলা। সূর্য মেঘের ফাঁকে দু-একবার যে উঁকি মারেনি তাও নয়। কেন যে মনে হয়েছিল, এবারে রোদ উঠবে— গানের স্কুল হয়ে রুবির বাড়ি যাবে। রুবি কী এক গোপন সৌন্দর্য তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছে, সে গেলে দু-জনে বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে সেই দৃশ্য এবং মগ্নতা দু জনে নিবিষ্ট হয়ে খুঁজে বেড়াবে। কাগজে বিনোদিনী রাধার ন্যুড ছবিটা রুবি তার আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছে। রুবির এক কথা, একা দেখতে ভালো লাগে না, তুই এলে দারুণ মজা হবে। নাভির ঠিক নীচটায় হালকা সোনালি রঙের গভীরে হিজিবিজি কি সব দাগ। স্পষ্ট নয়, আভাসে বিস্তীর্ণ মাঠের মতো ছবিটা শাড়ির হালকা আরামবোধে জড়িয়ে আছে। তুই আসবি তো!
এত আশা নিয়ে বসে আছে রুবি, বৃষ্টি বাদলা যাই হোক, আর বসে থাকা যায় না। বর্ষার সৌন্দর্যই আলাদা। গভীর এক মন্ত্রমুগ্ধ দৃশ্যকাব্যের মধ্যে যেন ঢুকে যাওয়া—সে রাস্তায় নেমে বুঝল, বৃষ্টিটা আজ ভোগাবে।
রুবির দাদা সুযোগ পেলেই আড়ালে তাকে দেখে। সেও দেখে। চোখে পড়ে গেলে দু-জনেই কেন যে চোখ নামিয়ে নেয়। আর ভাবে এই তোমার দাদাগিরি! রুবির একটুকু দেরি হলে ধমকাও, কোথায় গেছিলি! এত দেরি। কোথায় যায়, যেতে চায়, বোঝ না।
রুবিকে নিয়ে তোমার এত দুশ্চিন্তা। কী যে ভাব, তাও যদি সে কোনো তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরত। আমরা তো পুরুষ বন্ধু খুঁজছি–সিনেমা নাটকে কবিতাপাঠে কোথায় না। দুর্গোৎসবের মণ্ডপে মণ্ডপে শুধু ওই একজনের আশায়। সে যে আমার সঙ্গ নিয়েছে। যখনই একা নির্জনে বসে থাকি, সেও এসে যায়। তাকে ছাড়া একদণ্ড সময় কাটে না, ভেবেই টুম্পা কেমন ব্যঙ্গ করে ঠোঁট উলটাল। ভিড়ের বাসে কেউ না আবার দেখে ফেলে—সে নিজের মনেই হাসছে, এত কী আশ্চর্য গোপন অভিসার তোর কাগজের পাতায় রুবি। কী আবিষ্কারের জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছিস রুবি।
বাড়িতে টুম্পার এমনিতেই আজকাল কেন যে মন টেকে না। কেমন একঘেয়েমি, ছুতোয় নাতায় সে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়তে চায়। আর বের হলেই কেমন এক হাঁফ ধরা জীবন থেকে যেন তার মুক্তি মেলে।
মাকে বাবাকে মিছে কথা বলতেও আটকায় না—এই যাচ্ছি, ছোটোকাকার বাসায়।
মাঝে মাঝেই সে যেমন রুবির বাড়িতে যায়—ছোটোকাকার বাড়িতেও যায়। কোথাও তার আকর্ষণ না থাকলে সে যায় না।
ছোটোকাকার বাড়িতে সে কেন যায় বোঝে। সেখানে তার একজন মামা আছেন। পদার্থবিজ্ঞানের জাঁদরেল ছাত্র। গবেষণা না কি মুণ্ডু ঘরে বসে সারাদিন দরজা বন্ধ করে চালিয়ে যাচ্ছে। দরজা খুললেই দেখতে পায় এক গাদা বই-এর মধ্যে ডুবে আছেন। তাকে দেখলেই বালকের মতো খুশি হয়ে ওঠেন তিনি। তবু সম্পর্কে মামা বলেই গম্ভীর চালে কথাবার্তা বলেন— তার পরীক্ষার প্রিপারেশান নিয়েই কথাবার্তা বেশি, সে গেলে গবেষণার চেয়ে এই দূর সম্পর্কের আত্মীয়াটির প্রতি যে ক্রমশই বেশি আগ্রহ বোধ করছেন, টের পায় টুম্পা। যতই নির্দোষ আলোচনা হোক, টুম্পা তার শাড়ি সামলাতেই ব্যস্ত থাকে।
বাসটা যাচ্ছে।
বাসের ভিড়ও বাড়ছে।
ঠোঁটে তার আবার মজার হাসি ফুটে উঠছে। একবার পরীক্ষায় বসলে হত। আজ পর্যন্ত একজন পুরুষ মানুষকেও বাজিয়ে দেখা হল না। এই শারীরিক পরীক্ষা আর কি। কেউ বাসায় নেই। সে গিয়ে যদি কোনোদিন একা আবিষ্কার করে ফেলে মামাকে, তখন তাঁর আচরণ কেমন হয় এমন কোনো পরীক্ষায় যদি মানুষটাকে ফেলে দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলে মানুষটার ভালোমানুষের জারিজুরি নিমেষে হাওয়া করে দিতে পারে।
সে যায় সেই কারণে।
মগজে তাঁর এই সব ছবিই বেশি ভাসে। এই সব অলস ভাবনায় সে তাড়িত হয় বলেই ঘরে তার মন টেকে না। রুবির কাছে যাওয়া এই গোপন অভিসারেও মজা কম না। কাগজের একটা নড় ছবি কী আছে—বাথরুমে সে যখন নিজেকে আবিষ্কারে মত্ত থাকে তখনও শরীরে সে যে কী খুঁজে বেড়ায় বোঝে না। এত রহস্যময় শরীর নিয়ে সে যে কী করে।
তার তো বয়স বেশি না। এই কিছুদিন হল ফ্রক ছেড়েছে। ম্যাকসি পরত। বাড়িতে কোনো পুরুষ আত্মীয় এলে ম্যাকসি পরে ঘুরে বেড়ানো বাবা-মার পছন্দ না। সে শাড়ি না পরলে বাবা গুম মেরে যেতেন। তার দিকে তাকাতেনই না। তারপর কিছুদিন সালোয়ার কামিজ-তারপর শাড়ি পরতেই সে কেমন হালকা হয়ে গেল। হালকা হয়ে গেল ঠিকই, তবে চলাফেরায় অস্বস্তি। বাসে ট্রামে সালোলায়ার কামিজে খুব সুবিধে। তবে তাকে নাকি শাড়িতেই বেশি সুন্দর দেখায়।
বাসটা চলছে।
বাসটা থামছে।
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি তেমনই পড়ছে।
কন্ডাকটার হাঁকছে, পরেশনাথের গেট।
একজন যুবক ওর পেছন দিয়ে তাকে ঠেলে বের হয়ে গেল। সে রড ধরে আছে। ঠিক যেখানে হাতে ছুঁয়ে দেখা দরকার দেখে গেছে। সে শত চেষ্টা করেও কোমর বাঁকিয়েও রক্ষা পায়নি।
সে খুবই গম্ভীর হয়ে গেল। এ কী অসভ্যতা। তখন কেন জানি সমগ্র পুরুষজাতিটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করে। তার রাগ হয়, ক্রোধ বাড়ে–চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাস পড়তেই বুঝল, আবার কেউ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাধের উপর দিয়ে হাত বাড়াবার চেষ্টা করছে। তা ভিড়ের বাস, ঝাঁকুনিতে পড়েটড়ে গেলে হাত পা ভাঙতেই পারে।
মেয়েদের সিটের পাশে সে দাঁড়িয়ে আছে—একটা সিটও খালি নেই।
তার পেছনে যে আবার একজন কোনো পুরুষ—পুরুষ কি নারী, সে শরীরের ঘ্রাণ থেকেই তা টের পায়। তা দাঁড়িয়ে থাকুক, অসভ্যতা করলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়। রড না ধরে থাকলে টুম্পার আরও বেশি বিপদের সম্ভাবনা।
অবশ্য পেছনে দাঁড়ানো পুরুষটি তার যে চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে এটা সে ভালোই বোঝে।
এতে টুম্পার অবশ্য আপত্তি নেই।
তবে ভিড়ের চাপে একেবারে পেছন থেকে ঠেসে ধরলে সে খুবই বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে। সুযোগ বুঝে কিছু করে ফেললেই তার মাথায় রক্ত উঠে যাবে। পুরুষজাতটাকেই বেহায়া নির্লজ্জ মনে হবে।
মাথা গরম করেও লাভ হয় না। হাসিঠাট্টা বিদ্রুপ তখন সারা বাসে। পুরুষ নারী তখন সব সমান—কেউ প্রতিবাদ করে না। বরং যেন মজা পায়।
এ-সব কারণে বাসে উঠলেই ধরে নিতে হয়, সুযোগ বুঝে যাত্রীদের রুচিমতো সে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে।
তবে সে দেখেছে সবাই সমান হয় না।
সে এখনও বুঝতে পারছে না, লোকটার সত্যিই আর কোথাও রড ধরায় জায়গা আছে কি নেই। ঘুরে দাঁড়াবারও তার ক্ষমতা নেই। সে ঘামছে। তার সব অবয়বে ঘাম চ্যাটচ্যাট করছে। এবং শরীরের কোনা-খামচিতেও ঘাম জমে বিশ্রী গন্ধ উঠেছে কি না কে জানে!
কাজেই পেছনের লোকটা মধ্যবয়সী না যুবা, না প্রৌঢ় সে কিছুই বুঝতে পারছে। ঘাড় ঘোড়াবারও জায়গা নেই। বাসটা বাদুড়ঝোলা হয়ে ছুটছে।
সে দেখেছে, মধ্যবয়সীরাই বেশি ইতর হয় এবং যুবকরা যতটা পারে গা বাঁচিয়ে চলে। তবে সবাই না।
টুম্পা বুঝতে পারে বয়সটারই দোষ। শরীর যেন ক-বছরে বাতাসে ফুলেফেঁপে উঠেছে।
সে বাসায় ফিরে বাথরুমে ঢুকলে এটা বেসি টের পায়। বাথরুমে নিজেকে খোলামেলা দেখার সময় টের পায় শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো আর বাঁধ মানতে চাইছে না। কাগজে বিনোদিনী রাধার ছবিটা কী কোনো উষ্ণতার ছবি হালকা ফিনফিনে কোনো কুয়াশায় জড়ানো। সবই অস্পষ্ট দেখা যায়, স্তন, গ্রীবা এবং নাভিমূল। নাভিমূলের দিকটাই শিল্পী আবছা রহস্যময়তায় ঢেকে দিয়েছে। ছবিটায় যে যথেষ্ট যৌনতা বিদ্যমান—এবং সে ছবিটা ইচ্ছা করলে বাড়িতেও দেখতে পারত, কারণ বাড়িতেও সেই কাগজই রাখা হয়, তবে বাবাই প্রথম কাগজটা পড়েন বলে, শেষ পর্যন্ত কাগজটা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না—তিনি বোধ হয় চান না, টুম্পার নগ্ন ছবি দেখে মতিভ্রম হোক—কাগজগুলো যে কী করছে। পরিবারে সব বয়সের মানুষই থাকে, সবার চোখে এমন একটা উলঙ্গ ছবি খুবই দৃষ্টিকটু—অথচ সবাই চুপিচুপি ছবিটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। রুবির বাড়িতে অবশ্য এতটা নজরদারি নেই—রুবি বড়ো হয়েছে, সে সবই বোঝে। কেবল তার বাবা-মাই মনে করে টুম্পা কিছুই বোঝে না। ভিড়ের বাসেও তার খিলখিল করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হল।
তার বাবাটা যে কী! ন্যাকা ভাবতে পারত, শত হলেও তার বাবা, বাবাকে আর যাই ভাবা যাক ন্যাকা ভাবতে পারে না। ন্যাকা ভাবলে বাবাকে খাটো করা হয়। লুকিয়ে শেষ পর্যন্ত কাগজের সেই নির্দিষ্ট পাতাটি সে দেখেছে। বাবা পাতাটা লুকিয়ে রেখেও রেহাই পায়নি। তবে সে বিনোদিনী রাধার ছবিতে নিজেকেই আবিষ্কার করেছে। কী এমন রহস্য থেকে গেল যে রুবি ফোন করে তাকে যেতে বলেছে। দু-জনে দরজা বন্ধ করে ছবিটা দেখার এত প্রলোভনই বা কেন রুবির। বাথরুমের বড়ো আয়নায় বলতে গেলে রোজই সে নিজেকে দেখতে পায়—কেবল শরীরে তখন থাকে না কোনো মসলিনের ওড়াউড়ি। এমন নরম হালকা মসলিন শরীরে উড়িয়ে দিয়েই ছবিটায় মধ্যে শিল্পী ঝিনুকের তলপেটের মতো উষ্ণতা সৃষ্টি করেছে।
সে তো যতটা রুচিসম্মত পোশাক পরা দরকার তাই পরে। এজন্য সে পাতলা ব্লাউজ পরে না। ব্লাউজের নীচে তার অন্তর্বাস ফুটে বের হলে লজ্জা পায়—কখনো তার নিজের বৈভব হাটেঘাটে ফিরি করার স্বভাব নয়। তবু কেন যে মনের মধ্যে কোনো প্রিয় যুবকের মুখ ভেসে উঠলেই বড়ো বেশি কাতর হয়ে পড়ে।
পেছনের লোকটার চাপ ক্রমশ ভারী হচ্ছে। রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মুখ না ঘুরিয়েই সে বলল, একটু সরে দাঁড়ান।
সে তার পাছা সরিয়ে নেবারও চেষ্টা করছে। লোকটা কী উজবুক!
আর একটু সরে দাঁড়াতে বলায় মহিলাদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি চলছে। টুম্পা মহিলাদেরও তখন কেন জানি নষ্ট চরিত্রের মনে না করে পারে না। এই সামান্য কথায় মুখ টিপে হাসার কি যে হল—সিটে বসে যেতে পারলে পরের সুবিধে
অসুবিধার কথা কেউ আর ভাবে না। তারপর কেন যে মনে হল সরে দাঁড়ানোর কথা তার উচ্চারণ করা ঠিক হয়নি। সরে দাঁড়াবেটা কোথায়! বাসে একটা সুচ রাখার পর্যন্ত বুঝি জায়গা নেই।
রড ছেড়ে দিলে লোকটা হয়তো পড়েও যেতে পারে। আবার নাও পড়তে পারে। রড না ধরলেও এত বেশি ঠেস দেওয়া আছে যে লোকটা ঝাঁকুনিতে অনড়ও থাকতে পারে।
ভিড়ের বাসে এই এক জ্বালা।
হাতের ব্যাগটি অবশ্য তার বড়ো সম্বল। স্পর্শকাতর জায়গাগুলি দরকারে আড়াল করার জন্য ব্যাগ থাকলে খুবই সুবিধা। দরকারে হাতের খাতাটি বুকের মধ্যে চেপে রাখে। দরকারে কাঁধের ব্যগটি পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। বাবা কাকা মামা মেসো সবার ক্ষেত্রেই আগ্রহটা যে একরকমের সে বোঝে। দোষও দিতে পারে না। মানুষ তো! এমন ভিড়ের বাসে মেয়ে পুরুষ সবাই একসঙ্গে এত গাদাগাদি সহ্য হবে কেন!
সে যতটা পারল পাছা ঘুরিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।
শ্যামবাজারের মোড়ে এসে ভিড়টা পাতলা হল। তবে এখান থেকে বাসটা টপাটপ আরও কিছু যাত্রী তুলে নিল। সিথির মোড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বোধ হয় তার রেহাই নেই। সিঁথির মোড়ে গেলে বাসটা প্রকৃতই হালকা হয়ে যাবে সে জানে। এর আগে স্টপে বেস্টপে গাড়ি দাঁড়াবে, প্যাসেঞ্জার তুলবে। না উঠলে ড্রাইভার গড়িমসি করবে বাস চালাতে। গালিগালাজ ওদের গা সওয়া। পাত্তাই দিতে চায় না।
কী যে রাগ হয়।
সর্বত্র এক ধরনের নির্লজ্জ আচরণের সে শিকার।
কাকে দোষ দেবে।
সে পেছন ফিরে আর না তাকিয়ে পারল না। লোকটার অর্ধেক শরীর মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখা তার পক্ষেও শোভন হবে না।
‘একটু সরে দাঁড়ান’ বলতেই বাসের সবার কাছে সে লোকটিকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে। বেশি কিছু বলে লোকটিকে আর অপ্রস্তুতের মুখে ফেলতে চায় না। হয়তো লোকটির বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াবার জায়গা ছিল না।
প্যাঁচপ্যাচে গরমে সে অনবরত ঘামছে আর মুখ ঘাড় গলা রুমালে মুছে নিচ্ছে।
আর তখনই সামনের স্টপে মোটকা মতো মহিলাটি প্রায় দু-জনের মতো জায়গা ফাঁকা করে নেমে গেল। টুম্পা টুক করে বসে পড়ল।
সে চোখ তুলে তাকাল।
আরে রুবির ছোটোকাকা যে। ছিঃ ছিঃ কী না মনে করল।
সে তো রুবির ছোটোকাকাকে চেনে।
রুবিদের বাড়ি রথতলায়। রুবির জন্মদিনে সে তার ছোটোকাকাকে দেখেছে। লাজুক প্রকৃতির মানুষ। এমনকী রুবি তাকে তার ছোটোকাকার ঘরে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেও তিনি তাকে চোখ তুলে দেখেননি।
রুবিই বলেছিল কাকা তার মিলিটারির ডাক্তার। শর্ট কমিশনে ছিলেন, পারমানেন্ট কমিশনে যেতে রাজি হননি। চাকরিটা বোধ হয় তার পছন্দ হয়নি। এখন ভাবছেন, এখানেই চেম্বার খুলবেন। কত বয়স মানুষটার!
আর এক বার দেখবে নাকি চোখ তুলে।
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। কমও হতে পারে। আবার বেশিও হতে পারে।
সে তো বাইশ।
ইস কী যে সব ভাবছে। তার নিজের মধ্যেই এক অদ্ভুত দ্বৈত সত্তা পুরুষের জন্য ক্রিয়া করতে থাকে। বয়সের ফারাক নিয়ে মাথা ঘামাতে কেমন সংকোচ বোধ করছে। একদণ্ড আগে কত কুৎসিত চিন্তা মানুষটি সম্পর্কে। একদণ্ড পরে রুবির কাকাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে। দশাসই চেহারা, দীর্ঘকায়, পুরুষের মতো পুরুষ।
তার দিকে তিনি সেদিন ফিরেও তাকাননি।
এই আমার বন্ধু টুম্পা।
অ। হাত জোড় করে নমস্কার। সে দেখতে কেমন একবার যদি চোখ তুলে তাকাতেন। এত অহংকার।
অপমানের শোধ তুললে কেমন হয়!
সহসাই সে কেন যে বলে ফেলল— আপনি বসুন, জায়গা হয়ে যাবে।
না, ঠিক আছে।
টুম্পা সরে বসে জায়গা করে দিতে চাইছে—কিন্তু তিনি রাজি না।
এসে তো গেছি।
তার বলার ইচ্ছে হল, এসে গেলে কি বসা যায় না। একটুক্ষণ, এই একটুক্ষণেই বড়ো মাধুর্য সৃষ্টি হয় জীবনে, সেটা কি বোঝেন!
মহিলাদের সিটে বসলে কখন না আবার উঠে পড়তে হয় এমন লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা ভেবেই হয়তো তিনি তার অনুরোধ রক্ষা করলেন না। সামনের দুটো স্টপের পর তারা দুজনেই নেমে গেল।
টুম্পা তো জানে রুবির কাকা কোথায় যাবেন। কিন্তু তিনি কি জানেন, সে কোথায় যাচ্ছে! শেষে না পেরে বলল, আমি রুবির বন্ধু। আপনি রুবির ছোটেকাকা না!
তাই নাকি, তাই নাকি!
যেন সে একটা বাচ্চা, বড় আদুরে গলায় তাই নাকি তাই নাকি বলতে বলতে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
রুবি দৌড়ে এসে কাকার ঘরে উঁকি দিয়ে বলল টুম্পাকে কোথায় পেলে?
ওর নাম বুঝি টুম্পা, কোনো আগ্রহ নেই। বাইশ বছরে যুবতীর পক্ষে এটা যে কত বড়ো অসম্মানের অথবা বড়ো অপমানও বলা যায়, টুম্পা রুবির ঘরে বসে সব শুনে ক্ষোভে জ্বলছিল।
রুবি ঘরে ঢুকে বলল, কি রে টুম্পা, তোর মুখ গোমড়া কেন রে!
কী করে বুঝবে ভিতরে কত জ্বালা তৈরি হয়—এত অবহেলা একটু আলাপ পর্যন্ত না। এত বড়ো মহাপুরুষ তুমি, আসলে সে যে এই মানুষটার খোঁজেই এসেছে—আমার ছোটোকাকা বাড়ি এসেছে শুনেই সে কেন যে ক-দিন থেকে অস্থির ছিল। কোনোও অজুহাতে একবার ঘুরে এলে হয়, বিনোদিনী রাধার ছবি দেখা একটা অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়, দু-জনে একসঙ্গে বসে দেখার মজা, কত আর মজা, এ তো বারবার নিজের শরীরকেই দেখা— বিনোদিনী রাধার প্রায় উলঙ্গ শরীর যতই মসলিনে জড়িয়ে জ্যোৎস্নায় ভেসে থাক— সে তো বোঝে এ-শরীর তারই—সব নারীর।
রুবি দু-কাপ চা নিয়ে বসল তার পাশে—
সেন্টার টেবিলে চা রেখে বলল, এক্ষুনি দেখবি না পরে।
টুম্পা কিছু বলছে না।
কি রে, হলটা কি!
সে বলল, আমি উঠব রুবি।
তোর শরীর খারাপ!
জানি না।
জানিস, ছোটোকাকা না লুকিয়ে ছবিটা সকালে বারবারই উলটেপালটে দেখেছে। কারও চোখে না পড়ুক, আমি ঠিক টের পেয়েছি।
টুম্পা আরও কেন যে অস্থির হয়ে উঠল।
এই চল।
কোথায়!
আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিবি।
এই তো এলি! চল ছোটোকাকার ঘরে। কথা বলবি।
তোর ছোটোকাকা কি মহাপুরুষ!
মহাপুরুষ হতে যাবেন কেন। তোর কথা খুব বলে। এবারে ফিরেই বলেছে, তোর বন্ধুর খবর কি রে, ও আর আসে না।
কেমন এক আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় তার শরীর মন ভিজে গেল। নিজের ভিতরেই সে গলে যাচ্ছে—বিনোদিনী রাধার ছবিতে কি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ভিতরে সে সত্যি উষ্ণ হয়ে উঠছে।
তবু কি যে হয়, বের হবার মুখে টুম্পা দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, যাচ্ছি। আমি বুঝে কিছু বলিনি।
তোমার দোষ হবে কেন। ভিড়ের বাসে সত্যি তো তোমার কষ্ট হচ্ছিল। আমারও উপায় ছিল না। একবার ভাবলাম নেমে পড়ি, ভিড় ঠেলে নামাও যে কঠিন।
টুম্পা বলল, যাই।
তিনি তাকে এই প্রথম দু-চোখ মেলে দেখলেন। আশ্চর্য রোমান্টিক চোখ। পৃথিবীর তাবৎ সুধারসে যেন তিনি উপচে পড়ছেন। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। তিনি যে তার অন্তর্বাস ভেদ করে সব দেখে ফেলছেন বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
বাড়ি ফিরে টুম্পা আরও অস্থির হয়ে পড়ল—কেন যে মনে হচ্ছে, তিনি এখনও বোধ হয় লুকিয়ে সেই নগ্ন ছবিতে ডুবে আছেন। শিল্পীর আঁকা সেই মুগ্ধতায় ডুবে যাওয়া ছাড়া তাঁর বোধহয় উপায়ও নেই। মানুষ তো শরীর নিয়েই বাঁচে। মানুষটার কথা যত ভাবছে তত উতলা হয়ে উঠছে।
সে ভালো করে খেতে পারল না পর্যন্ত।
বাবা ফিরে এসে দেখলেন সে শুয়ে পড়েছে। সে শুনতে পাচ্ছে। টুম্পার কি শরীর খারাপ? কি জানি! মা-র কথাবার্তায় অবজ্ঞার সুর।
দরজা বন্ধ করে না শুলে বাবা হয়তো ঘরে ঢুকে কপালে হাত দিতেন। অসময়ে শুয়ে পড়লে বাবা যে ঘাবড়ে যান কেন এত, সে বোঝে না।
তার বড়োই অসময়।
আবার সুসময়ও। কেন যে সব ভেসে যাচ্ছে।
কিন্তু কেউ তো জানে না, সে একেবারে অবিন্যস্ত হয়ে শুয়ে আছে। সে ক্রমশ অতলে ডুবে যাচ্ছিল। হাতড়ে হাতড়ে নিজেকে খুঁজছে, নিজের মধ্যে।
আত্মসম্মান
সঞ্চারী বাস থেকে নেমে গেল। এই স্টপেই সে নামে। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে কাউকে যেন খুঁজছে। শরঙ্কাল, এবং আকাশ নীল অর্থাৎ শরৎকালে যেমনটা হয়ে থাকে। ভ্যাপসা গরম আবার রাতের দিকে ঠান্ডা বাতাসের আমেজ। নাকে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাসের ভিড়ে সে কাহিল। তখনই কে যেন বলল, পলার দোকানের দিকে গেল। ওখানে গেলে পাবেন। ওদিকটায় থাকতে পারে।
এই স্টপে পর পর কিছু চা-এর দোকান, ওষুধের দোকান, এমনকী চাউমিন, এগরোলের দোকানও আছে। বড়ো রাস্তা থেকে গাড়ি চলাচলের মতো পাকারাস্তা তার বাড়ির দিকে চলে গেছে। বাসস্টপ থেকে সে হেঁটেই বাড়ি ফেরে। মার স্কুল থেকে এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। বাবার ফিরতে রাত হয়। বাবার ছোটাছুটিরও শেষ নেই। হুট করে দিল্লি, বোম্বাই, হায়দরাবাদ কখন যে কোথায় চলে যান, ইউনিয়নের নেতা হলে যা হয়। পেকমিশনের বিরুদ্ধে লড়ালড়ি শেষ। সব দাবিই সরকার মেনে নিয়েছে। লড়াই সার্থক। বাবা আজকাল খুবই প্রসন্নচিত্তে বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন। সে বাড়ি ফিরলে কারও আর চিন্তা থাকে না। বাসস্টপে নামলে, সেও ভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে।
যা হয়, শৈশব থেকে সে বড়ো হয়েছে এই এলাকায়। মোড়ের সব দোকানিরাই বাবার দৌলতে তাকে ভালোই চেনে। সে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী খুঁজছে তারা তাও বুঝতে পারে।
পলার দোকান সামনের খাটাল পার হয়ে দুটো কাঠের গোলাও পার হতে হয়। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পলার দোকান দেখা যায়। ইতস্তত রাস্তার কুকুর যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়—পলার দোকানের সামনেও কুকুরের ঘোরাঘুরি আছে। তবে তামাটে রঙের কোনো খোঁড়া কুকুর সেখানে নেই। বাসের চাকায় চাপা পড়ে কুকুরটার অর্ধেকটা পা উড়ে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। পায়ে ঘা, শুয়ে থাকলে নীল রঙের মাছির উপদ্রব, কেড়ে কুড়ে খাবার আর ক্ষমতাই নেই। ভালো করে হাঁটতে পারে না, দৌড়তে পারে না, তাকে দেখলেই কুঁই কুঁই করতে থাকে।
কেউ দিলে খায়, না দিলে গাছতলায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে।
সে কলেজ থেকে ফেলার সময় কুকুরটাকে একটা পাউরুটি খেতে দেয়। কলেজে বাবার সময় টিফিন ক্যারিয়ারের সব খাবারটাই খাইয়ে যায়। কোথায় যে ডুব মারল। আর তখনই কুঁই কুঁই আওয়াজ। পেছনে ফিরে দেখল গাছের গুড়ির আড়ালে মুখ বার করে তাকে দেখছে। তুই এখানে! বলেই কাছে ছুটে গেল। পাটা ফুলে গেছে, শরীর বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে, নড়তে পারছে না। কাল পরশু অথবা তারও পরে, একদিন সে ঠিক দেখতে পাবে কুকুরটা রাস্তায় মরে পড়ে আছে। তার ভিতরে খুবই কষ্ট হচ্ছিল—সে একটা পাউরুটি কিনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখের কাছে এগিয়ে দিল। লোকজন তামাশা দেখতেই ব্যস্ত। তার রাগ হচ্ছিল খুব।
অবশ্য সে জানে রাগ করে লাভও নেই। যেমন কেউ বলছিল, তোর এত নরম মন ভালো না রে সঞ্চারী। কেউ বলছিল, রাস্তার কুকুর রাস্তায় মরে পড়ে থাকে, তুই তাকে বাঁচিয়ে রাখবি সাধ্য কী! এরা কেউ কেউ পাড়ার দাদা কাকা, কেউ সমবয়সী, যেমন ‘কেউ বলেই ফেলল, তোর সঙ্গে বাড়িতেই নিয়ে যা। তুই একা থাকিস, মাসিমা খুশিই হবেন।
সে কারও কথার জবাব দিল না। রুটি খাওয়া হয়ে গেলে, সে বটুয়া খুলে কী দেখল। তারপর রাস্তার নেমে গেল। গাছপালা এখনও কিছু আছে, এই রাস্তার কিছু হাইরাইজ বিল্ডিংও উঠে গেছে। পাশের মাঠে গোলপোস্টের কাঠে দুটো কাক বসে আছে, পুকুর থেকে বণিকদের রাজহাঁসগুলি উঠে এসেছে। গলা তুলে রাজনন্দিনীর মতো হাঁটছে। তার মন কঠিন না নরম সে ঠিক বোঝে না, কুকুরটা খেতে পাবে না, না খেয়ে মরে যাবে ভাবতেই তার ভিতরে কিছু একটা তড়িৎ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছিল, বোধবুদ্ধি এর নাম হতে পারে, অথবা মায়া, সে যাই হোক, কিছু একটা করা দরকার। মনে হতেই টিফিন বাক্সটা উপুড় করে দিয়েছিল কুকুরের মুখের সামনে। সেই থেকে চলছে।
তার সালোয়ার কামিজ আশ্চর্য রকমের সবুজ। সে লম্বা এবং তার অনায়াস বিচরণে কিছুটা মুগ্ধতা থেকে যায়। ফেরার সময় সবাই টের পায় সে ফিরছে। শ্যামলা রঙের মেয়ে সে, চোখ মুখে লাবণ্য থাকলেও সে যে দেখতে খুব ভালো না, এটা সে বোঝে। রাস্তায় সে চোখ নামিয়েই হাঁটে। কারও চোখে চোখ পড়ে গেলে তার অস্বস্তি হয়। সে ঠিক সময়ে না ফিরলে মা তার বড়ো উৎকণ্ঠায় থাকে। বার বার রাস্তায় চোখ-সঞ্চারী যদি ফেরে।
সে দূর থেকেই দেখল, গেটের মুখে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে কি কেউ নেই। মা স্কুল থেকে না ফিরলে কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া থাকে। তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, কেউ না থাকলেও অসুবিধা হয় না। লোকটা গতকালও ঠিক এভাবে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল। সে না বলে পারেনি, কাল আসবেন। বাড়িতে কেউ নেই। মা স্কুলে গেছে, ফেরেনি। বাবার ফিরতে রাত হয়।
এই একটা দোষ আছে তার। কেউ নেই’ কথাটাই যথেষ্ট। মা বাড়ি কখন ফেরে, কি ফেরে না, বাবার ফিরতে রাত হয়, কেন যে বলতে গেল! সে সোজাসুজি বলে দিলেই পারত, আপনার এত আধুনিক ফিল্টার আমাদের লাগবে না। মণিপিসি রেখেছে বলে আমাদেরও রাখতে হবে তার কী মানে আছে!
কিন্তু সোজা কথা সোজা ভাষায় বলতে তার যে আটকায়। এখন ফিরে গিয়ে লোকটার সঙ্গে আবার বক বক করতে হবে। মা বাড়ি থাকলে ঠিক জানালায় দেখা যেত। কিংবা গেট খুলে নোকটা ভিতরে ঢুকে যেত। গেটে তালা দেওয়া, লোকটাই বা যায় কোথায়। মণিপিসিরও খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, বাড়ির ঠিকানা, গেরস্থের নাম-সহ লোকটাকে এখানে পার্সেল করে দিয়েছে। কাল মা-বাবা কেউ বাড়ি ছিল
বলে ফিরে গেছে, আজ ফের হাজির। সহজে এরা ছাড়বার পাত্র না। ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকার স্বভাব।
তার মন নিতান্তই ব্যাজার হয়ে গেল। কেন যে মণিপিসি পাঠাল!
আপনার পিসিমা যে বলল, অবশ্যই যাবেন। চিনি বউদিকে বলবেন, আমি রেখেছি। তারপর হাতের লম্বা বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আপনার মারও খুব ইচ্ছে কেনার। যা দিনকাল, জল খেয়ে পেটের অসুখ লেগেই থাকে। পেট ভুটভাট কত কিছু…।
ইস লোকটা কত খারাপ কথা কত সহজে বলে দিতে পারে। পেট ভুটভাট মানে তার পেটে ভুটভট শব্দ হচ্ছে-জলে নানারকম জীবাণুও এ-বাড়ির জল খাওয়ার অনুপযোগী—সে তো কোনো অসুবিধা ভোগ করে না। মা-বাবাও না। একবার অবশ্য তার জন্ডিস হয়েছিল। সে তো শুনেছে, কোনো কিছুতেই ভাইরাস আটকানো যায় না। অকারণ এই কেনাকাটা তার খুব একটা পছন্দও না। তবু লোকটা দাঁড়িয়ে থাকলে কী করা। কিছুতেই যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তবু যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, তবু যাবে না। রাস্তার ধারে বাড়ি বলে এই এক উটকো ঝামেলা। কেউ না কেউ অনবরত দরজায় টোকা মেরে যাচ্ছে— চাই বেডকভার, চাই ভাঙা ছাতা সারানো, চাই বাঁশমতি চাল, চাই শুটকি মাছ। তারপরও আছে, কাগজ আছে মা, কাগজ। ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে ভিতরে বসতেও বলতে পারে না। সে একা, কাজের মাসি কাজ করে চলে গেছে। পাশের বাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে কেউ কেউ লক্ষও করছিল। সেই লোকটা আবার আজ।
পূজার মরসুম শুরু হয়ে গেছে।
কেনাকাটা থাকে অনেক। স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় হাতিবাগানে একবার টু মারবেই মা। বেশি কেনাকাটা থাকলে দেরি হতেই পারে। বাসে যা ভিড়! ব্যাগ ভরতি শাড়ি সায়া ব্লাউজ, এটা তোর মণিপিসির, এটা তোর সেজপিসির জন্য কিনলাম, আত্মীয়স্বজনদের এই মৌকায় যতটা পারা যায় ফুটানি দেখানো।
আসলে ‘ফুটানি দ্যাখানো’ খুবই রেগে আছে বলে ভাবছে। সেও কম দিতে থুতে পছন্দ করে না। রমাদার জন্য কিনলে না মা। বরং সেই সুযোগ বুঝে কার কেনা হয়নি মনে করিয়ে দেয়। তারপর বাড়ি বাড়ি যাওয়ার মধ্যেও কম আনন্দ থাকে না। তার যে মেলা মাসিপিসি। কাকিমা জেঠিমা। বড়োমামা মেজমামা, রনোদি, মা’র বোনঝি বোনপোও কম নেই। সুতরাং পূজার মরসুমে স্কুল সেরে কেনাকাটা যতটা পারে এগিয়ে রাখে মা। কখনো বাড়ি থাকলে সেও যায়। সেও কাকাকাকিমাদের জামাকাপড় পছন্দ করে কেনে। না গেলেও মা বাড়ি ঢুকেই চেঁচাতে শুরু করবে, সঞ্চারী কোথায় রে! এই দ্যাখ তো, কী রকম হল, তোর দুদুমণির শাড়ি।
চারপাশে তার এত আছে, তবু এই অবেলায় কেন যে মনে হল তার কিছুই নেই। রাস্তার কুকুরের মতোই সে এই সংসারে পড়ে আছে। দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে আরও একলা হয়ে গেল।
কী আছে তার!
সেকেন্ড ক্লাস অনার্স। ফিজিক্স। মনে হলেই যেন কেউ গায়ে তার চিমটি কেটে দেয়। তার ভিতরে জ্বালা ধরে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
হবে না। এত কম নম্বরে হয় না। যাদবপুর, সিট নেই।
বিশ্বভারতী—মাত্র দুটো সিট।
ভাগলপুর যেতে পারে। বাবা রাজি না।
মার এক কথা, তোকে বলছি না, কমপিউটার কোর্সটা সেরে ফেল।
সে লেগে গেল।
তারপর সে কী কবে!
তারপর সে অগত্যা বিটি পড়ছে। লেসন নোট, প্র্যাক্টিস টিচিং, রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেসারি, মায় গান্ধি রবীন্দ্রনাথ কিছুই বাদ নেই। চাকরি! শুধু ইন্টারভিউ, বেশি দূর গড়ালে ভাইবা। ব্যাস হয়ে গেল।
তারপর আর খবর নেই। সে রাস্তার কুকুরটার মতোই খোঁড়া, পর্যদস্তু। পারলে বাড়িঘর সব গুড়িয়ে দিতে চায়। সেকেন্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বলে একদিন অকারণ চেঁচাতে থাকলে মা ছুটে তার ঘরে ঢুকে গেছে।
তোর কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি মা। কিছুই হয়নি!
চেঁচাচ্ছিলি কেন!
জানি না। তুমি যাও মা, প্লিজ আমার ঘর থেকে এখন যাও। সে দরদর করে ঘামছিল।
আর তার জেঠুও আছেন। এসেই এক খবর, সঞ্চারী দুই কইবে!
ওমা জেঠুমণি! কখন এলে।
তোর কী খবর?
কোনো খবর নেই।
আর বাবাও আছেন, বড়দা নরেনবাবুরা আর কোনো খবর দিল!
জেঠুমণি কেমন মুখ ফ্যাকাসে করে হাসবেন। সে কাছে থাকলে সত্যি কথাটা বলবেন না। তবে আড়াল থেকে সে ঠিকই টের পায়, পছন্দ না।-তোকে তাপস এত করে বলেছিলাম, বিয়ে দিয়ে দে। লাবণ্য আছে, রেজাল্টও খারাপ না, এটাই সঞ্চারীর বিয়ের সময়।
মেয়ে রাজি না হলে কী করব বলুন।
এখন মেয়ে ধুয়ে জল খাও। চাকরি করবে, চাকরির বাজার কী বুজিস না। সবই তো বুঝি দাদা। চেষ্টা করছি, এম এস-সি পাস করে যদি কোথাও কিছু জোটাতে পারে। কত আশা ছিল। হল কোথায়। দিনদিন রোগা আর খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। আমার সুপারিশে চাকরি হলে, বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে–ভয় দেখায়।
জেঠু হা হা করে হেসে উঠেছিলেন, পাগল! পাগল! বিয়ের বাজারেও চল সঞ্চারী। তার কিছুই নেই, কেন নেই এই একটা প্রশ্ন। বিয়ে থা দিলেই কি সব ল্যাঠা চুকে যেত! কেন এত কষ্ট করে পড়া! রাত জেগে, স্কুল কলেজের ভাল ছাত্রী হবার বাসনা। কোনো স্বপ্ন। সে যে কী, সে নিজেও ভালো বোঝে না। বিয়ে তো শুধু শরীরের কথাই বলে, মন বুঝবে না! লাবণ্য মানে তো শরীরের চটক, এবং বাথরুমে সে তখন দেখেছে নিজেকে বার বার–তারও যে ইচ্ছে হয় না বললে মিছে কথা বলা হবে। খুবই ইচ্ছে হয়। খুব, খুব। এক আদিগন্ত পৃথিবীর মাঝে কোনো সুনিপুণ কারিগর তার শরীরের রন্ধে রন্ধে খুঁজে বেড়াবে, কোথায় গচ্ছিত আছে তার ভালোবাসা। শরীরে শরীর মিশে যাবে। ভালোবাসাও।
লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
আচ্ছা বেহায়া মানুষ তো। বাড়িতে যখন কেউ নেই, চলে গেলেই হয়।
লোকটা যে তার কথাতেই এসেছে তাও সে জানে। তার ঠিক বলাও উচিত হয়নি, কাল সন্ধ্যার দিকে আসুন, মা থাকতে পারে।
থাকবেই সে বলেনি। চৌকোনো মতো একটা কাগজের লম্বা বাক্স কালও সঙ্গে ছিল, আজও আছে। এটাই সে ফিরি করে বেড়ায়। কোম্পানির মাল, কিছুতেই হাত ছাড়া করতে রাজি না। ওজনও যথেষ্ট। প্যান্টশার্ট পরা ফিটফাট যুবক। গলার নেকটাইটা নীল রঙের কেন সে জানে না। নীল রংটা তার পছন্দ না। চুল ব্যাকব্রাশ করা। জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় সে সব লক্ষ করেছে। একবার যখন এসেছে না গছিয়ে ছাড়বে না।
সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। এই রাস্তা দিয়েই ঢুকবে। তার এখন ঘরে ঢুকে বাথরুমে না গেলেই নয়। ঘামে সারা শরীর চ্যাট চ্যাট করছে। সামনে দেখতে পেলেই ঠিক বলবে, গুড ইভনিং আজ আবার এলাম। আপনি বলেছিলেন, সন্ধ্যার সময় আপনার মাকে পাওয়া যাবে।
ধুত্তোরি গুড ইভনিং, একটুও পাত্তা দেবে না। সে চেনে না এমন ভান করবে। রাস্তায় কত লোকই তো দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার লোকের খোঁজখবর নিতে তার বয়েই গেছে।
সে হেঁটে গেল লোকটার পাশ দিয়ে।
এই যে, দিদি এসে গেছেন, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িতে কেউ নেই, আপনার মা কি আজও দেরি করে ফিরবেন!
জানি না। বলতে পারত। কিন্তু এই হয়েছে মুশকিল। সে বলতে পারে না। আশ্চর্য রকমের শীতল ব্যবহার করলেও চলে, তাও সে পারে না।
সে গেট খুলে, কোলাপসিবল টেনে ভিতরে ঢুকে গেল। বসার ঘরের দরজা খুলল না, তবে সব জানালা খুলে দিল। লোকটা গেটের মুখে ঢুকে বলল, আসতে ভেতরে।
সে যে কী বলে! যত রাগ এখন মা আর মণিপিসির ওপর। মণিপিসিরও খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, নিজে একটা নিয়েছে, সঙ্গে একটা লেজুড় ধরিয়ে দিয়েছে। কী যে খারাপ লাগছে। অচেনা একজন যুবক, বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে অপেক্ষা করলে তার যে বড়ো অস্বস্তি হয়। দিনকাল ভালো না। খবরের কাগজ খুললে সে বুঝতে পারে কতরকমের রাহাজানি ছিনতাই ধর্ষণের ঘটনা যে ঘটে থাকে। সে ইচ্ছে করলেই একজন অপরিচিত যুবককে বলতে পারে না, আসতে পারেন, আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তারপরই কেন যে মনে হল লোকটা নির্বোধ, আসতে পারি’ বলা তার উচিত হয়নি। একা একটা মেয়ে বাড়িতে, আসতে পারি’ বললে কী বোঝায়, তাও কি জানে না! অবশ্য এতসব ভাবনার মধ্যে দরজা খুলে একটা টিনের চেয়ার বাইরে বের করে দিয়ে বলল, বসুন। মা এক্ষুনি চলে আসবে। তারপর সে দরজা বন্ধ করে দিল। সে যথেষ্ট ভদ্রতা করেছে। একজন অচেনা, অজ্ঞাতকুলশীল পুরুষের সঙ্গে এর চেয়ে বেশি ভদ্রতা বজায় রাখা যায় না। বসার ঘরে এনে বসানোও যায় না। পরদা টেনে দিলেই আব্রু ঠিক থাকবে কেন, সে বাথরুমে যাবে, যে কোনো কারণেই হোক বসার ঘর থেকে বাথরুমের জলের শব্দ শোনা যায়। জোরে পাখা চালিয়ে দিলে অবশ্য হাওয়া আর জলের শব্দ মাখামাখি হয়ে যায়। বাথরুমে কী হচ্ছে বোঝা যায় না।
সে বাথরুমে ঢুকে গেল। শরীর থেকে সব খুলে ফেলে শাওয়ার খুলে দিল। কী আরাম! সারা শরীরে সাবান, মুখ উঁচু করে জলের নিম্নগামী ধারার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে কেমন মুহ্যমান এক জগৎ, এবং সারা দিনের ক্লান্তি অবসন্নতা ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সে সহজেই সতেজ হয়ে উঠতে পারছে।
তখনই ডোর বেল বেজে উঠল। মা বোধ হয় এল!
দরজা খুলে দিলে, মা মেয়েতে ইশারায় বাক্য বিনিময় হয়ে গেল। সেই লোকটা!
ঈষৎ ব্যাখ্যা করে সঞ্চারী সব তার মাকে বলতেই, কৃষ্ণ লাফিয়ে উঠল। ও তাই, আচ্ছা। দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, আপনি ভাই ভিতরে এসে বসুন। মণি পাঠিয়েছে, কাল এসে ফিরে গেছেন, পুজোর বাজার!
সোফায় ঢাউস ব্যাগটা তুলে নিয়ে কথাটা বলল কৃষ্ণ।
বসুন। মণির বাড়িতে কবে লাগালেন! মণিকে বলেছিলাম।
বসার ঘরটা একটু বেশি মাত্রাতেই বড়ো। একদিকে সোফাসেট, কোনায় টিভি, বাঁদিকে লম্বা বই-এর র্যাক, পাশে পর পর দুটো বড় কোম্পানির ক্যালেন্ডার এবং দেয়ালে লাঠি হাতে সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে চার্লি চ্যাপলিন। ঘরের আর একদিকে একজনের শোওয়ার মতো তক্তপোষ। দামি বেডকভারে ঢাকা একটা পাশবালিশের সাদা রঙের ঢাকনায় রেশমি সুতোর কিছু নকশা। ঘরের তুলনায় জানালাগুলি ছোটো, নেট দেওয়া নীল রঙের নাইলেন, মশার উৎপাত আছে।
সঞ্চারী এখন খুবই হালকা। মা এসে গেছে। তার আর কোনো কর্তব্য নেই। সে নিজের ঘরে ঢুকে আয়নায় দাঁড়াল। চুলে কাঁকুই চালাল। কাঁধের আধ-শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে সামান্য প্রসাধন করল। গোল করে কপালে সুন্দর সবুজ রঙের একটা টিপ পরল। তারপর উরুর কাছটায় ভিজে মনে হওয়ায় লম্বা ফ্রক তুলে বাঁপাটা খাটে রেখে ভিজে জায়গা মুছে দিতেই, মায়ের কণ্ঠস্বর কী রে এসে কিছু খেয়েছিস। শুভদা কিছু করে রেখে গেছে।
কী জানি, দেখিনি।
খেয়েছিস?
না। বাথরুমে মা-র যে বেশি সময় লাগে না, সঞ্চারী ভালোই জানে। তার প্রসাধনের ফাঁকে মা-র সব কাজ সারা। চাও বসিয়ে দিয়েছে। পাউরুটি স্যাঁকা, স্যালাড় কেটে রাখা, ডিমের ওমলেট সবই তৈরি। মা এত কাজের, কে বলবে ভিড়ের বাস ঠেঙিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাবাও বোধহয় এসে যাবেন। তা ছাড়া পে কমিশনের লড়ালড়িও আর নেই। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর লড়াকু নেতা এখন নিশ্চিন্ত। পুজোর সময়, আত্মীয়স্বজনদের ভিড় থাকেই। কেউ না কেউ রাতে আসে। বাবা বাড়ি না থাকলে তারা যেন হই হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারে না। মামারা তো ভগ্নিপতিটির নামে পাগল। এই হই হুল্লোড়, কখনো তার ভালো লাগে, কখনো লাগে না। আসলে সবাই কাজে কামে ব্যস্ত, অফিস আর ইনক্রিমেন্ট পদোন্নতির কথাও থাকে, এই একটা জগৎ, কোম্পানির কথা, রেলের কথা, এবং বাজারদর, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কোথায় কে পূজার ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছে, কোন কোম্পানির হলিডে হোম, কী সুযোগ-সুবিধা বিস্তারিত তার বর্ণনা। তারাও যায়, বাবার রেলের এ-সি পাস, তাদেরও। সে তো গত পুজোয় দেরাদুন থেকে দিল্লি ফেরার পথে পুরো ছশো টাকা শুধু কোল্ড ড্রিংকসের পিছনেই উজাড় করে দিয়েছিল। আসলে কিছুটা রাগ ক্ষোভ, তার কিছুই হচ্ছে না, সবাই দারুণ সুখী, মা
বাবা দিদি, সবার আর্থিক সঙ্গতি প্রবল, প্রিভিলেজজ ক্লাস। সে সেবারে বাবার কাছ থেকে ছশো টাকা নিয়ে বাবাকেই ফতুর করে দিতে চেয়েছিল। সবাই মিলে তাকে ডিক্লাসড করে রেখেছে—সে ছাড়বে কেন?
তার কত স্বপ্ন, এম এস-সি, থিসিস, স্লেট নেট—সবই ভোকাট্টা। পার্ট টুর প্র্যাক্টিক্যাল তাকে ডুবিয়েছে। পার্ট ওয়ানে এখন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, মা তো খুশি হয়ে বাড়িতে বিশাল গেট টুগেদারে মত্ত হয়ে গেছিল। মা তার কলিগদের, বাবা তার অফিসের বন্ধুদের, আত্মীয়স্বজনরা তো আছেনই, তারপর…তারপর কী!
না, সে আর ভাবতে পারে না। প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার আগেই অসুস্থ। ছোঁয়াচে রোগ, সারা শরীরে গুটিপোকার মতো জল নিয়ে ফোসকা, কী ব্যথা, আর জ্বর, জ্বরে তারপর বিছানায় শয্যাশায়ী, প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষার সময় আলাদা সিটে আলাদা ব্যবস্থা। সে অচ্ছুত হয়ে গেল। অদ্ভুত জীবনের শুরু। কোথাও ঢোকার জায়গা নেই। তার জন্য সর্বত্র নো এনট্রি।
আবার ডোর বেল বাজল।
এই সঞ্চারী, দ্যাখ তোর বাবা বোধহয় এল।
সঞ্চারী বসার ঘরে ঢুকে দরজা খুলে দিল। বাড়িটায় যেই আসে, সামনের বারান্দায় উঠে বেল টিপে দেয়। পেছনে সিঁড়ির পাশের দরজাটা এ-জন্য প্রায় খোলাই হয় না। পেছনের দরজায় এসে ডাকলে, তাকে বসার ঘরে ঢুকতে হয় না। লোকটা দারুণ ভালো মানুষের মুখ নিয়ে বসে আছে। তার দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। অবশ্য সে জানে লোকটা সবই তার দেখছে, এমনকী তার শরীরের সব ভাঁজগুলো পর্যন্ত। পুরুষ তো নারী-শরীরের অন্তর্যামী। তাদের কাছে কিছুই আড়াল করা যায় না। দামি পোশাকে শরীর ঢেকে রাখার চেষ্টা খুবই হাস্যকর, এটা সে ভালোই টের পায়। আলোর মতো তাপও অদৃশ্য এবং তরঙ্গগামী। উৎস থেকে তরঙ্গের আকারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চারিত হয়। যে-ভাবে তাকে আড়ালে দেখছিল!
সঞ্চারী-ই…।
কেউ যেন দূরে ডাকে।
কে ডাকে! সে বালিকা বয়স থেকেই এই ডাক শুনতে পায়। সে জানা গায়ে দেয়, প্যান্টি খুলে ফেলে, মোজা পরে, পারে জুতো গলায়, এবং সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকলে, এই অধীর অচেনা কণ্ঠস্বরে সে বিচলিত বোধ করে। কেউ তাকে ডাকে, বড়ো হতে বলে। সে মাঝে মাঝে বড়ো হবার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে—এবং কিছু আভাস শরীরে ফুটে উঠতে থাকলে, সে বোঝে এরই নাম বড়ো হওয়া। প্রকৃতির অমোঘ ইচ্ছে শরীরে কারুকার্য তৈরি করছে। প্রকৃতির কূট কামড়ে সে এখন বিছানায় শুয়ে প্রায়ই সেই রহস্যময় পুরুষকে খুঁজে বেড়ায়।
বাবাও ঢুকে বললেন, ও এসে গেছেন, বসুন।
তারপর পরদা তুলে ডাইনিং স্পেসে হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে দিলে মা বলল, চা দেব! হাত মুখ ধুয়ে নাও।
আচ্ছা এরা কী! লোকটার সঙ্গে কেউ আর কথা বলছে না। নেওয়া হবে কি না তাও বোধহয় ঠিক নেই। সঞ্চারী খুবই অস্বস্তি বোধ করছে।
মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কথা বলো।
তুমি বলো না।
কত দাম বলছে!
ওতো বাজার দর—কত বলার কী আছে। সাতে পাঁচ হাজার।
লোকটিকে এক কাপ চাও দেওয়া যায়। অন্তত বসার ঘরে চুপচাপ বসে না থেকে চা খেতে পারে। তার নিজেরই গায়ে কেমন জ্বালা ধরে যাচ্ছে। ভিতরে বসে তারা চা জলখাবার খাচ্ছে, লোকটিকে বসিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।
সে না বলে পারল না, তোমরা ওর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নাও। কতক্ষণ বসে।
থাকবে।
বলছি, দাঁড়া। একটু জিরোতে দে। বলেই বাবা ঘর থেকে পরদা তুলে বললেন, এই যে ভাই, বড়ো সকাল সকাল এসে গেছেন। মণিদি তো জানে আমার ফিরতে রাত হয়। ছুটির দিনে আসতে পারতেন। একটু দেরি হবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। কোথায় থাকেন?
হাওড়ায়। ওরে বাব্বা, সে তো অনেক দূর।
আজ্ঞে, তবে অসুবিধা হবে না। ও নিয়ে ভাববেন না। পরদার ফাঁক দিয়ে সঞ্চারীও দেখল, কেমন কুঁজো হয়ে বসে আছে লোকটি। লোকটি না ভেবে যুবক ভাবা যেতে পারে। তারই বয়সী, কিংবা কিছু বড়ো হতে পারে, সরু গোঁফ, কালো, বেশ কালো রঙের মুখে এত কালো গোঁফ মানায় না। বড় বেমানান। সে কেন যে ফিক করে হেসে দিল।
বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, এবং কথাবার্তায় বড়োই বিগলিত ভাব। সেলসম্যানশিপ। ব্যবহারে যদি ভজে না যায়, তবে কপালে দুঃখ থাকতে পারে। একটু বেশি মাত্রাতেই আজ্ঞে আমি করছে। ভদ্রলোকের কপালে আজ বেশ দুঃখ আছে। তার বাবাটিকে তো জানে না। সব কিছু বাজিয়ে নেবার স্বভাব। এত বৈষয়িক যে জীবনেও ঠকতে রাজি না।
বাবা পরদা ফেলে দিলে, কালো মানুষ, কালো গোঁফ নিমেষে অদৃশ্য।
সঞ্চারীর কেন জানি চা খেতে ভালো লাগছে না। সে চা ঠেলে দিয়ে উঠে। পড়ল। খাবার কিছুটা খেল, কিছুটা পড়ে থাকল।
বাবা বললেন, কী হল, উঠে পড়লি।
তোমরা খাও। আমার খেতে ভালো লাগছে না।
শরীর খারাপ!
না।
জানি না।
সঞ্চারী চায়ের কাপ বেসিনে রেখে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কেমন অভব্য মনে হচ্ছে। সব ঠিকঠাক থাকলে বোধহয় এমন হয়। অন্যের মান অপমান বুঝতে চায় না। দুদিন ধরে ঘুরছে, সে জিনিস গছাতে এসেছে, এটাই তার কাজ।
হাওড়ায় বাড়ি, বাসে কী ভিড় সে নিজেই টের পায়। না এটা ঠিক না। মা কার, কার পূজার বাজার এখনও বাকি, বাবাকে সেই ফিরিস্তি দিচ্ছে। বাবা মার এমন আচরণ সে পছন্দ করে না। এত চেষ্টা করছে, একটা তার চাকরি হল না! সে বেকার। এই জ্বালা থেকেই বোধহয় ভদ্রলোকের ওপর সে একটু বেশিমাত্রায় সহৃদয় হয়ে পড়ছে।
এটাই তার দোষ।
বেকার না থাকলে, খোঁড়া কুকুরটার জন্য বোধহয় এত মায়া হত না। জীবকুলের সর্বত্রই ছড়ানো-ছিটানো হেয়জ্ঞান বিরাজ করছে। তাদের এই বয়সটাকে কেউ বুঝতেই চায় না। মেয়ে যখন, বিয়ে দিলেই রেহাই। বিয়ে, তারপর এক পুরুষ এবং পুরুষের বিছানা, তার জাতকের জন্য প্রস্তুত থাকা, তাকে বড়ো করা, মেয়েমানুষের আবার কী চাই। জানালার পরদা ঠিক আছে কি না, সতর্ক থাকলেই হল।
মানছি না, মানব না। সে কেমন স্লোগান দিতে যাচ্ছিল। তোমাদের টাকা, তোমাদের বাড়ি, আমি কেন অনুগ্রহ নিতে যাব। তারপরই মনে হল, না মাথাটাই তার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার আজকের প্র্যাক্টিস টিচিংও ভালো হয়নি। বি টিতেও সেকেন্ড ক্লাস। স্যারেদের উমেদারি সে একদম করতে পারে না। সবাইকে চতুর এবং সুযোগসন্ধানী মনে হয়।
তখনই সবার ঘর থেকে বাবা ডাকলেন, সঞ্চারী শুনে যা। জিনিসটা একবার দেখবি না। তোরই পাল্লায় পড়ে কিনছি। তোর বন্ধুদের বাড়িতে অনেকের আছে, আমাদের থাকবে না, হয় কী করে। তোর মাও চাইছেন, তাঁর বন্ধুদের বাড়িতেও অনেকের নাকি আছে। জল এখন পরিত না করে খাওয়া ঠিক না।
পরিশ্রুত কথাটাতে সঞ্চারীর মুখ বেঁকে গেল। পরিশ্রুত না ফুটানি, সবার আছে। সবার আছে বলতে কারা! সবার কখাটা কত ব্যাপক বুঝবে না। সবার থাকে না, কিছু লোকের থাকে। বাবা-মা সেই কিছু লোকের মধ্যে। তাকে ডাকছে।
সে বলল, আমার আবার দেখার কী আছে! তোমরা কিনবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।
বারে, একবারই তো কেনা হবে। দেখে নিবি না।
তোমরা দ্যাখো।
তখনই দরজায় মা পরদা ফাঁক করে বলল, আয় না। লোকটা কতক্ষণ বসে থাকবে।
সঞ্চারী এর পর আর নিজের ঘরে বসে থাকতে পারল না। তার পছন্দ না হলে সে কিনবে না, এমনও কথা নেই। তবে এই নিয়ে জল ঘোলা হোক সে চায় না। তার জন্য লোকটার দেরি হোক সে চায় না।
বাবার গলা পাওয়া গেল।
এত দেরি কেন রে।
সে শাড়ি পরছে। এবং মুখ আয়নায় দেখছে। পাফে সামান্য পাউডার মুখে ঘসে দিল। চুল দু-একটা এলোমেলো হয়ে কপালে উড়ছে। সে বের হয়ে বেশ পরিপাটি করে লোকটার পাশে না বসে বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে যুবকের মুখ প্রত্যাশায় গাঢ় হয়ে গেল। সঞ্চারীর নজর এড়াল না। বড়ো সবিনয়ে বাক্স খুলতে গেলে সঞ্চারী বলল, খুলতে হবে না। ও আর দেখার কী আছে। আপনাদের কোম্পানির খুবই সুনাম।
আবার ডোর বেল।
দ্যাখ তো কে এল! বাবা তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন।
মা বলল, চেক দেব কিন্তু।
তা দিন। চেকই নিয়ে থাকি। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক।
তাই দেবার নিয়ম। সে এবার বাক্স থেকে পরিশ্রুত জলের মেশিন এবং তার লটবহর টেনে বের করতে থাকল।
ও মা জেঠুমণি।
জেঠুমণি টুকতেই বাবা বেশ চঞ্চল হয়ে উঠল। কোথায় বসায়! ঘরে এ দিকের পাখাটা চলছে। ও দিকের পাখা চালিয়ে বলল, বড়োদা এখানটায় বসুন।
সঞ্চারী দেখল জেঠুমণি মেশিনের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরালেন কুঁজো হয়ে বসে থাকা যুবকটির দিকে তারপর মা এবং বাবা, শেষে দেয়ালের ছবি, এবং ছাদের পাখাও বাদ দিল না।
বললেন, তোমারও দেখছি খপ্পরে পড়ে গেছ।
আসলে উক্তিটি বউমার প্রতি না বাবা, না তারা সবাই সঞ্চারী বুঝতে পারছে। জেঠুমণির এই কথাটাই যে সব কেঁচিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। সঞ্চারী এটাও বোঝে। এবারে জেঠুমণি পাখার নীচে শশাফায় বসতে বসতে বললেন, কতদিনে পাকড়ালে হে ছোকড়া। ঠিক জায়গাতেই এসে গেছ।
না স্যার, পাকড়াব কেন। এটা তো ফ্যামিলির পক্ষে খুবই জরুরি।
বাজে কথা। বছর খানেক আগে আমার বাড়িতেও গছিয়ে দিয়ে গেছে। কোনো কাজ হয় না। সাধারণ ফিল্টারেই কাজ চলে। যাই বল এতে ভাইরাস কিছুতেই আটকায় না।
বাবাও গোঁ ধরলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বাড়ির সবাই চাইছে, আমার তো একদম ইচ্ছে ছিল না।
সঞ্চারী এবার আর পারল না।
একদম মিছে কথা বলবে না বাবা। সবাই চাইছে মানে। আমি কখনো বলেছি কিনতে।
বলিসনি, তবে কেউ কিছু কিনলেই বাড়িতে এসে কে সাতকাহন করে বলে, বল।
আমি বলি না। তোমাদের পছন্দ হলে কিনবে, না হয় কিনবে না। আমাকে এর মধ্যে জড়াবে না বলে দিলাম।
জেঠুমণি বললেন, আরে রাগ করছিস কেন। সঞ্চারী দেখল, মা গুম হয়ে বসে আছে। একটা কথাও বলছে না।
জেঠুমণি কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললেন, কেনার যখন ইচ্ছে হয়েছে কিনে ফেল। কত টাকাই তো জলে যায়।
যুবকটি এতক্ষণ হাবলার মতো তাকিয়ে ছিল, এবারে সে বলল, দেখুন স্যার একটা কথা বলব, কিছু যদি মনে করেন। আমাদের মালে লাইফ লং সার্ভিস, আমার কোম্পানির মাল হলে ঠিকানা দেবেন, আমি নিজে মিস্ত্রি নিয়ে এসে ঠিক করে দেব।
ও সবাই বলে, কল দিলে পাত্তাই পাওয়া যায় না। ছ মাসও গেল না। বড়ো বড়ো কথা সবাই বলে—সকাল নটা থেকে শুরু—আসছে, যাচ্ছ। দরজায় বেল বাজছেই। কাঁহাতক দরজা খোলা যায়। আমরা স্যার বিজনেস ম্যানেজমেন্ট থেকে এসেছি, কী সাবান ব্যবহার করেন, কেন করেন, এই সবের ডাটা সংগ্রহে এসেছি। শেষে যা দাঁড়ায় ঝুলি থেকে বিড়াল, একটা শ্যাম্পেল মাল রাখুন, দাম দিতে হবে না। এই তো ভাই তোমাদের চেহারা। দুপুরে ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না। বেচু পার্টিরা অতিষ্ঠ করে মারছে। এক তলায় থাকার এই একটা বিড়ম্বনা।
সঞ্চারীর খুবই খারাপ লাগছে। মা-র দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কি কিনবে?
কেন কিনব না!
বাবা বললেন, সেই, কেন কিনব না। ভাইরাস থাকে থাকুক।
যুবকটি বলল, ব্যবহার না করলে বুঝতে পারবেন না, কত দরকারি জিনিস।
ভাইরাস মরে না কে বলেছে! কত উন্নতি হচ্ছে সবকিছুতে। ভিতরে আলট্রা ভায়োলেট রে দিয়ে ভাইরাস মেরে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাজারের আর দশটা মালের সঙ্গে স্যার গুলিয়ে ফেলবেন না।
জেঠু বললেন, দ্যাখো ভাই আমি তো কিনছি না, কিনবে এঁরা।
সঞ্চারী দেখল, মা যেন কিছু বলতে চাইছে।
বলল না কী বলতে চাও।
লাইফ লং সারভিস বলছেন? যুবকটির দিকে মা তাকিয়ে থাকল।
হ্যাঁ মাসিমা।
কিন্তু কমপ্লেন আছে। আমার বন্ধুরা আপনার কোম্পানির মালের খুবই সুখ্যাতি করেছে। তবে একটাই মুশকিল, মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়। কল দিলে কেউ তখন আসতে চায় না।
কল চার্জ দিলে আসবে না কেন মাসিমা? সঞ্চারী নিজেও কেমন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
আমি উঠছি মা।
সঞ্চারীর কেন যে মনে হচ্ছে, যুবকটি বাড়িতে ঢুকে চোরের দায়ে ধরা পড়েছে যেন। সে বিরক্ত গলায় বলল, আপনার কী নাম!
অমিত সেন।
আপনারা কেন আসেন বুঝি না। কী দরকার আসার। কী দরকার এত খোশামোদ করার। দু-দিন ধরে ঘুরছেন।
যুবকটি অবলীলায় বলল, দরকারে দু-দিন কেন বছরের পর বছর ঘুরতে পারি। আমাদের এটাই তো কাজ।
তা হলে ঘুরুন। সঞ্চারী আর একটাও কথা বলল না। রাগে ফুঁসছে। সে ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর যা হল, মা বাবাকে দুষছে। বাবা মাকে দুষছে। কার অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কাটা হবে, সেটা এই মুহূর্তে দিলেও দু-দিন বাদে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। তাতেও রাজি। বাবার কথা, এক সঙ্গে এত টাকা দেওয়া ঠিক না। বরং ইনস্টলমেন্টে কেনা ভালো।
ইনস্টলমেন্টে কিনলে লাইফ লং সার্ভিসের গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না, যুবকটি ক্যাটালগ খুলে তাও দেখাল।
পরদার ফাঁক দিয়ে সঞ্চারী দেখতে পেল, যুবকটির মুখ ক্রমে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
বাবার কথা, চেক দিলে, মেশিনটা রেখে যেতে হবে। এবং দেয়ালে জুড়ে দিতে হবে। তারপর ব্যাংকে চেক জমা যাবে। কে ঘুরবে ভাই তোমাদের পেছনে।
যুবকটি বলল, ঠিক আছে পরশু দেবেন চেক। পরশু আসব। বলে সে বেশ ভারী জিনিসটি হাতে ঝোলাতে গেলে, জেঠুমণি বলল, এটা রেখে যান। এতটা রাস্তা আবার টেনে নিয়ে যাবেন। কষ্ট হবে। বাসের যা অবস্থা।
না, নিয়ম নেই। পেমেন্ট এগেনস্ট ডেলিভারি। তারপর জেঠুমণির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আমাদেরও বাবা-মা আছেন। আমাদেরও পুজো পার্বণ সবই আছে। ভাইবোনেরা দাদার আশায় থাকে। ফিরতে ফিরতে কত রাত হবে জানি। সল্ট লেকের ডিপোতে মাল জমা দিয়ে, কত রাতে কোন বাসে যাব তাও ঠিক জানি না। আমি না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির সবাই জেগে থাকবে।
সঞ্চারী আর পারল না নিজেকে দমন করতে। সে বসার ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বলতে থাকল, কেন আপনারা আসেন, এঁদের আপনি চেনেন না। এরা সব পেয়ে গেছে। কেউ দরজায় এসে দাঁড়ালে এদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
বাবা অবাক চোখে সঞ্চারীকে দেখছে। সঞ্চারী এত ক্ষিপ্ত হয়ে কখনো কথা বলে না।
আরে তোর এত রাগের কী হল! তুই খেপে যাচ্ছিস কেন। আমরা কতটা কী করতে পারি।
কতটা পারো, জানি না বাবা, যতটুকু পারি তাও আমরা করি না। সিঁড়ি ধরে নামার সময় সঞ্চারী বারান্দার আলো জালিয়ে দিয়ে বলল, অমিতবাবু, সাবধানে নামবেন। সিঁড়ির এ-জায়গাটায় অন্ধকার আছে। একটা গর্তও আছে। পড়ে-উড়ে পা খোঁড়া হলে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। কে দেখবে তখন।
লোকটি পেছন ফিরে তাকাল। সঞ্চারী কেন যে মুখ ফিরিয়ে নিল। ধরা পড়ার ভয়ে, না অন্য কিছু।
ঈশা
মাথায় কোনো গল্প আসছে না। কী করি? আর তখনই তিনি এসে সামনে দাঁড়ান। অর্থাৎ নিরাময়দার কথা মনে হয়, ঈশার কথা মনে হয়। তারা সশরীরে যেন হাজির।
তাদের তো সশরীরে হাজির হবার কথা না। সেই কবে পুব-বাংলার এক জলা জায়গায় তাদের সঙ্গে আমার দেখা—দেখা বলা হয়তো ঠিক হবে না। কারণ তাদের শ্যেন নজর এড়িয়ে কোনো কুকাজ করাই আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিরাময়দাকে বাড়ির কাজের লোকও বলা যায়, আবার অভিভাবকও বলা যায়। আমাদের শৈশবে নিরাময়দা যে কত সম্ভব-অসম্ভবের গল্প বলে মনমেজাজ ভালো করে দিতেন এবং তার কথা ভাবলেই মগজে নানা গল্প তৈরি হয়। তাকে নিয়ে গল্পও লিখেছি, তবে ঈশার গল্প শেষ হয় না। বাড়িতে ঈশার আসার কথা থাকলেই আমি বড়ো অস্থির হয়ে পড়ি।
যেমন একবার নিরাময়দাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না। তিনি ঢাইন মাছ শিকারে নদীতে যাবেন। আমরাও যাব। আমরা বলতে বড়দা, মেজদা আর ছোটদা। যে সে নদী না। মেঘনা নদী—বিশাল বিপুল জলরাশি নিয়ে সে কোথায় যে ছুটছে! বর্ষায় নদীর দু-পার দেখা যায় না। আর তার তরঙ্গমালার কী বাহার!
সেই তরঙ্গমালায় পড়ে গেলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। তবু কেন যে দেখার বাহার, বাহার অর্থাৎ জীবনের বাহার—স্টিমার, গাদাবোট, একমাল্লা, দোমাল্লা নৌকা, খাসি নৌকাও মেলা, পাল তুলে দিয়ে কোথায় যে তারা যায়।
গয়না নৌকাও থাকে। কলের গান বাজে-নদী তুমি কোথায় যাওরে। বর্ষায় আত্মীয়জনেরা আসেন। শহর থেকে দূর গ্রাম থেকে, পঁচিশ-তিরিশ ক্রোশ কোনো ব্যাপারই নয়। বড়ো পিসি ছোট পিসি, মামা-মামিরাও আসেন। আর আসে বড়ো পিসির মেয়ে ঈশা। সে আমাদেরই বয়সি।
নদীর পারে আমরা বড়ো হয়েছি।
ঠিক নদীর পারে বলা যাবে না। নদী থেকে এক ক্রোশ দূরে।
আমাদের গ্রামের মাঠ পার হলেই খোপেরবাগ, তারপর আর একখানা মাঠ, সেই মাঠে পড়লেই সংসারদি, তারপরই দামোদরদির মাঠ। সেখানে নদীর পাড়ে ডাঙার মতো জায়গায় শ্মশান এবং বটগাছ—যে সে বটগাছ নয়। বিশাল অশ্বখ গাছ বলাই ভালো—তার নীচে জটাজুটধারী এক মহাক্ষেপা পাগল, গৌরবর্ণ, কপালে সিঁদুর, বম বম ভোলানাথ ত্রিশূল হাতে নিয়ে বসে আছেন—নিশুতি রাতে শবদাহ হলে তার কষুকণ্ঠে চিৎকার জয় মা জগদম্বা, কারণ গাছের নীচে একটি মন্দিরে তিনি বসবাস করেন। সকালে জগদম্বার অন্নভোগ হয়। ভৈরবী লীলাবতী শুদ্ধ বস্ত্রে খিচুড়ি পায়েস লাবড়ার ভোগ দেন—এবং নিরাময়দার মুখেই সব শোনা —আমাদের অবশ্য সেখানে যাওয়া হয়নি। ঢাইন শিকার উপলক্ষে যদি সেই আশ্রম দেখার সৌভাগ্য হয়।
বাড়ির ছোটোকর্তার মেজাজ খারাপ। সকাল থেকে নিরাময়দাকে শাসাচ্ছেন, কাজকাম ফেলে চললি নদীতে। বড়দির আসার কথা–পূজার ছুটি পড়লেই তারা রওনা হবেন।
তারা মানে ঈশাও সঙ্গে থাকে। শহরের মেয়ে ঈশা। চঞ্চল, কৌতূহলী এবং বন্যপ্রকৃতির। আর আমাদের মধ্যে ঈশা এলে আশ্চর্য এক প্রাণের সাড়া পড়ে যায়। আমরা তিন জনই পানাস হাইস্কুলের উঁচু ক্লাশের ছাত্র। তাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে বিচিত্র সব মান-অভিমানের পালাও জমে ওঠে।
তখন তাঁর এককথা, কী করি কন কর্তা! মাছের নেশা যার আছে সে জানে। শ্রাবণ-ভাদ্রি নদীর উজানে ঢাইন মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে। মাছেরা এই ‘জো’ আগামী পূর্ণিমা পর্যন্ত থাকবে। নদীর অতলে তেনারা উঠে আসছেন।
ছোটোকর্তার শাসানি থামছে না।—কাজকাম সেরে যাবি। খবরদার, অচল ভোলা উমা কেউ যেন আবার নৌকায় গিয়ে বসে না থাকে! ওদের সঙ্গে নিবি না। জ্বরজ্বালা হলে কে দেখবে। পড়ার ক্ষতি, একবারে তো একটাও পাশ করতে পারে না।
বড়দা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হয়ে গেল। ছোটোকাকা খেপে আছে।
আমরা পশ্চিমের ঘরে পড়ছি, কাকার হম্বিতম্বিও কানে আসছে। পূজার ছুটি পড়ে গেলেই ঈশা স্টিমারে না হয় নৌকায় চলে আসবে।
তখনও নিরাময়দার বিনয়ের শেষ নাই।– আজ্ঞে কর্তা আমি কী পাগল। জল এখন নামছে। বিল খাল থেকে সব জল নদীতে নামছে। পোকামাকড় সব জলে ভেসে যাচ্ছে। মাছেরা গন্ধ পায়, ঢাইন মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসছে। বড়ো বড়ো হা করে গিলছে সব। পাতালপুরীতে রাজসূয়যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে জানেন!
কাকা পুকুরে ডুব দিতে যাচ্ছেন। তাঁর সন্ধ্যা-আহ্নিক আছে, ঠাকুর পূজা আছে। কোথায় কোন যজমান বাড়িতে বিবাহ আছে। সকাল থেকেই তিনি ব্যস্ত। কাকিমা জেঠিমারা হেঁসেলে ব্যস্ত। ঠাকুমার ঘরে ঠাকুরমা পূজার বাসনকোসন বের করে দিচ্ছেন। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত—অথচ আমাদের স্কুল ছুটি, সারাটা দিন কী যে করি! নিরাময়দা ঢাইন শিকারে গেলে কথা দিয়েছিল আমাদের নিয়ে যাবেন। শুধু তাকে দু-কৌটা আরশোলা ধরে দিতে হবে। এখন তিনি কাকার কাছে কী ভালোমানুষ! মেজদা ক্ষোভে ফুঁসছে। বইখাতা ছুড়ে ফেলে একেবারে উঠোনে নেমে গেল। মেজদা যে গোয়ারগোবিন্দ বাড়ির সবাই জানে। নিরাময়দাও জানে।
নিরাময়দা তুমি আমাদের নিয়ে যাবে না?
তিনি তখন টোনসুতোয় গাবের কষ খাওয়াচ্ছেন। ঘাটের গাবগাছে সুতোর একমাথা গিঁট দিয়ে বাঁধা। অন্য প্রান্ত বাড়ির উঠোনের অড়হড় গাছের ডালে বেঁধে মৌজ করছেন। বঁড়শির গিঁট টেনে দেখছেন। চার-পাঁচটা বোয়ালে বঁড়শি দশির বাজার থেকে কিনে এনে তাদের দেখিয়েছেন। বঁড়শির কী তেজ! একবার গিলে ফেললে মাছের আর রক্ষে থাকবে না।
তুমি আমাদের নিয়ে যাবে কিনা বলো। কথার খেলাপ করবে না!
কোথায়!
আরে অদ্ভুত কথা বলছে তো!
বললে যে আরশোলা দু-কৌটা ধরে দিলে আমাদের মাছ শিকারে নিয়ে যাবে!
ছোটোকর্তা রাজি না। তোরা ছেলেমানুষ, মাছ ধরার ধকল সহ্য হবে না। পড়াশোনার ক্ষতি। পাশ না করলে খাবি কী!
তোমার কথা মতো আমরা দু-কৌটা আরশোলা ধরে দিলাম–
তোরা গেলে আমার কত সুবিধা। তারাপদ সকাল সকাল চলে আসবে বলেছে। সেই নদীর উজানে নৌকা তুলে নিয়ে যাবে। তারা পারবি না।
বড়দা বলল, আমরা পারব। নৌকায় আমরা স্কুলে যাই। সেও তো কত লম্বা রাস্তা। আমরা পারব না কেন?
ঠিক আছে। তোরা পারবি। তোরা বড়ো হয়ে গেছিস। ছোটোকর্তাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। যা তো নৌকার পাটতনে সব সরঞ্জাম তুলে ফেল—চানটান করে নে। যদি পারি তোর পিসিকে ঈশাদিকে ফেরার সময় ঘাটে তুলে নেব।
মেজদা বলল, কাকা খেপে আছে। পিসির পাত্তা নেই। শহর থেকে শাড়ি, সায়া, জামাকাপড় নিয়ে আসে পিসি পিসেমশাই। আর ঈশাদি একাই একশো। পিসি পিসেমশাইর জন্য বাড়ির সবাই অপেক্ষা করে থাকে। তাদের পাত্তা নেই। খেপে তো থাকবেনই। পূজার জামাকাপড় বলে কথা! তাকে তুমি রাজি করাতে পারবে না। ফিরে এলে আমাদের সব কটাকে পেটাবে।
ঠিক আছে। আমি তো আছি। কর্তা ছাড়া আর কি কেউ বাড়িতে থাকে না! ঠাইনদিকে বললেই হবে।
ঠাইনদি অর্থাৎ আমাদের ঠাকুরমা। তিনি রাজি হলে কারও কিছু করার নেই। এই মাছ ধরা এক দুঃসাহসিক অভিযান। কোষা নৌকার পাটাতনে বসে থাকা, ঝড়বৃষ্টি আছে এবং ধাপে ধাপে নদীর জল পাগল হয়ে থাকে। মাছ পাগল হয়ে থাকে। বর্ষায় ঢাইন মাছের গর্ভসঞ্চার হয়। কারে খায় কারে রাখে ঠিক থাকে না। এই সময় এক একটা ঢাইন মাছ হাঙরের মতো বিশাল আকারের হয়। রুপোলি মাছ, মুখ কুঁচলো এবং টকটকে গভীর লাল, মাছ যদি বঁড়শিতে লেগে যায়, তাকে কবজা করতেই রাত কাবার হয়ে যেতে পারে। শিকারে গেলেই হয় না, তিথিনক্ষত্র দেখে বের হতে হয়। নিরাময়দা সব কাজই সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন। কোষা নৌকার গলুইতে বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ দিয়েছেন, বিশকরম বলে শুধু রওনা হয়ে যাওয়া।
নদীতে যাচ্ছি শুনে বাড়িতেও শোরগোল পড়ে গেল। মা জেঠিমারাও তেতে আছেন। নিরাময় তুই কী পাগল! এই ভাদ্রমাসের গরমে—রোদে ঝড়বৃষ্টিতে রওনা হলি!
আমার কী দোষ! ঠাইনদি যে কইল, নিয়া যা, নদীতে সবাই মাছ ধরতে যায়, আমার নাতিরা কী দোষ করল। পূজার ছুটি পড়ে গেছে—ঈশা এলে ওদের মজা কত বোঝ না!
আর কথা নাই। কথা বললেই সাতকাহন, নিরাময়দা শুধু বললেন, দেরি হইলে চিন্তা কইরেন না। মনে করবেন বঁড়শিতে মাছ আটকাইছে।
ঠাকুরমা বলল, আশ্রমে গিয়া ট্যাবারে কবি বিনোদিনী দিদি পাঠাইছে। সে তো শুনেছি দৈব লাভ করেছে। আমার তিন নাতির মাথায় যেন দেবী জগদম্বার আশীর্বাদী ফুল দেয়। দৈব বলেই জন্ম-মৃত্যু। কার জীবন কে যে নেয়। এত আতুপাতু ভালো না। নাতিরা বড়ো হচ্ছে, কত কিছু বুঝতে শিখেছে, তাদের বাধা দিতে নেই।
বেলা পড়তেই রওনা হওয়া গেল।
এই সময় জলে টান ধরে। চার পাশ এত দিন বর্ষায় মাঠঘাট নদীনালা সব ডুবে ছিল। নৌকা বাইতে বিশেষ কষ্ট ছিল না। জলে টান ধরায় নৌকায় লগি মারতে কষ্ট। নিরাময়দা সাহসী মানুষ, ভূতপ্রেতে বিশ্বাস আছে—তবে তিনি মনে করেন ভূতপ্রেত মানুষের কোনো অনিষ্ট করে না। মানুষই মানুষের অনিষ্ট করে, আবার উপকারও করে। নিরাময়দার এক কথা, আরে পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর যার সহায় তার ভয় কীসের।
আসলে ঠাকুমার ট্যাবা এখন শ্মশানে সিদ্ধি লাভ করে যে পুণ্ডরীকাক্ষ হয়ে গেছেন সেকথা আমাদের জানা ছিল না। মেজদাই বলল, বড়ো খটকা লাগছে।
কীসের খটকা।
ট্যাবা বলল কেন ঠাকুমা। ট্যাবা নাম হয় নাকি?
আরে আরে ঠাকুর তো ঠাকুমার দেশের লোক। ট্যাবা যে শেষে পুণ্ডরীকাক্ষ হয়ে যাবেন তিনিও জানতেন না। ঠাকুর তোদের নাকি একবার দেখতে চেয়েছিলেন। বিনোদিনী দিদির নাতিরা কত বড়ো হয়েছে দেখার খুব সাধ। এবারে মাছ শিকারও হবে, ঠাকুরের মনোবাঞ্ছাও পূরণ হবে। বুঝলি কিছু। বললাম, আমার মন ভালো না, ঈশা যে কবে আসবে! কেমন পাগল পাগল লাগছে। ঠাইনদি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ঠাকুরের আশ্রমে রাত যাপন করব শুনেই ঠাইনদি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। —আশ্রমে কোনো বিপদ-আপদ থাকে না জানিস। তা ছাড়া ভৈরবী ঠাকরুন দেখবি তোদের কত আদরযত্ন করে খাওয়ায়। ঠাকুর আবার নদীরও দেবতা—তার প্রিয়জনদের অনিষ্ট হয় এমন কোনো কাজই করতে নদী সাহস পাবে না।
ঈশা এলে আমরা যে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, ঈশার পূজার ছুটি হয়তো পড়েনি, গ্রীষ্মের ছুটিতে আসতে পারে না, অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। বর্ষায় নৌকা এলে ঘাটে লাগে—বড়োই সোহাগি মেয়ে ঈশা। আমি ঈশার কথাই ভাবছিলাম। কী সুন্দর মেয়ে, ফ্রক গায়ে দেয়। আমরা লম্বায় এখনো সমান সমান। সে এলেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাপবে। সে কত লম্বা হয়েছে।
আমাদের কোষানৌকা তখন পদ্ম আর শাপলা শালুকের বিলে ঢুকে গেছে। নদীতে সূর্য ডুবছে। এই বিল পার হলেই সংসারদির পুল। তারপরই সেই ডাঙা দেখা যাবে। বড়দা হালে বসে আছে। মেজদা আর নিরাময়দা বৈঠা মেরে পদ্মবন পার হয়ে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে আছি পাটাতনে—চারপাশে জলাভূমি আর অজস্র পাখির কলরব। তারা এতক্ষণ বিলের জলে ওড়াউড়ি করছিল। পোকামাকড় এবং মাছ ভেসে উঠলে, যেমন কিছু চিল এবং তার সঙ্গে দু-চারটি ঈগল পাখিও আছে, বিলের জল থেকে একটা ঈগল বিশাল ডানা মেলে জল থেকে ঝুপ করে তুলে নিয়েছে অতিকায় একটা মাছ এবং উড়ছে। জলা জায়গা বলে কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। দূরের আশ্রমে দেখা যাচ্ছে, সব বড়ো বড়ো বৃক্ষ, এই তাজ্জব করা জায়গায় এসে কেমন একটা আশ্চর্য মোহ তৈরি হয়। পুণ্ডরীকাক্ষ কথাটার অর্থ কী জানতে ইচ্ছে হয়।
নিরাময়দা বললেন, আর বেশি দূর না। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই আশ্রমের ডাঙ্গা পেয়ে যাব। কী রে ভোলা, পাটাতনে বসে যে একেবারে ভাবলু বনে গেলি!
আমি যে ঈশার কথা ভাবছিলাম নিরাময়দা হয়তো টের পেয়ে গেছেন। আমি সোজা হয়ে বসলাম।
বল। মনে হয় কোনো সংশয়ে ভুগছিস?
বললাম, না মানে—
আরে মানে মানে করিস না। সব তাঁরই কৃপা।
কৃপা কেন।
তিনি তো ধরণীর তাবৎ সুখ-দূঃখের অধিকারী।
আচ্ছা কাকা, পুণ্ডরীকাক্ষ কাকে বলে?
বিষ্ণু অবতার।
এত খবর তুমি দাও, এত বড়ো একজন দেবতা নদীর পারে আশ্রম বানিয়ে বসে আছে বলোনি তো। আমার কথাবার্তায় ঈশাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে গেলাম।
তোরা ছেলেমানুষ, কেবল স্কুল আর বিদ্যাশিক্ষা আর বছর বছর ফেলমারা। তার বাইরেও এক বড়ো জগৎ বিদ্যমান—সোজা হয়ে বোস। সব ঠিকঠাক আছে, কপালে সব লেখা থাকে। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিন অবতার বুঝলি, আমাদের ঠাকুর বিষ্ণুর অংশ। আশ্রমে ঢুকে প্রথমেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। সব বিপদ কেটে যাবে। আশীর্বাদে তাঁর পরীক্ষায় ভালো ফল করবি। তোদের চড়চড়ে কপালে বিদ্যুৎ রেখা ভেসে উঠবে। তিনি মঙ্গলময়। যত বড়ো মাছই শিকার করি না কেন, তিনি আছেন সর্বত্র। তিনিই আমাদের হয়ে মাছটাকে দেখবি কবজা করে ফেলবেন। মাছ শিকারে আমাদের কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।
ঢাইন মাছ ধরার উত্তেজনা তো আছেই, তার উপর ঈশা, আমি ঈশাই ডাকতাম–তুই তুকারিও চলত, তবে ঈশা আমার চেয়ে কিছু বড়ো। ঠাকুমা জেঠিমা সবারই এক অভিযোগ, তুই কীরে, তুই নাম ধরে ডাকছিস? ঈশাদি ডাকতে পারিস না। ঈশাদি বলত, নারে, তুই আমার নাম ধরেই ডাকবি। দিদিফিদি আমার ভালো লাগে না।
নিরাময়দা বললেন, তোর পিসির পাত্তা নেই, তোর ঈশাদিও আসছে না, কী ব্যাপার!
আসলে আমাদের সবারই আগ্রহ আছে ঈশার সম্পর্কে। পূজার ছুটিতে পিসেমশাই সবার জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসেন। আজকাল ঈশাই নাকি সব পছন্দ করে কেনে। আমার ওপর বাড়ির সবাই একটু বেশি সদয়। কারণ পরিবারে আমি পিতৃমাতৃহীন। জেঠিমা কাকিমার আদরেই বড়ো হয়েছি। ঈশা এলে সে আমাকে ছাড়া কোথাও এক পা নড়বে না। আমার পিসেমশাইয়ের ঢাকা শহরের বাংলা বাজারে বিশাল গারমেন্টের দোকান। ঈশা তার বাবা-মায়ের সবেধন নীলমণি। তার আবদার কারও কাছে হেলাফেলার নয়। আর আমি যে বড়ো হয়ে গেছি, বছর দুই আগে ঈশাই বুঝিয়ে দিয়েছিল। সে আমাকে ছাড়াবাড়িতে সাপটে ধেরে টকাস করে চুমু খেয়েছিল।
ঈশা সম্পর্কে নিরাময়দার আসল আগ্রহ, পূজার জামাকাপড় তিনি তার হাত থেকেই পেয়ে থাকেন। ঈশার পছন্দের তিনি খুব প্রশংসা করে থাকেন। ঈশাদির রুচি আছে এমনও বলেন। আর ঈশা যে রহস্যময়ী নারী হয়ে যাচ্ছে গতবারের পুজোয় তা ভালোই টের পেয়েছি। এই করে কেন যে মেয়েটার জন্য আমার এত টান—এবং কখনো মনে হয় আর কেউ না থাকুক ঈশা আছে। সে আরও কিছু চায় আমার কাছে। ঈশার কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
আসলে তরুপিসি ঠাকুমার পালিতা কন্যা। ঠাকুমার কোনো কন্যাসন্তান না থাকায় তরুপিসি এ-বাড়িতে আশ্রয় পান। এবং আমার বাবা-কাকারাই তরুপিসির বিয়েও দেন। এই তো সকালে ঠাকুমাই বললেন, পরের মেয়ে এত করে, তোমরা বউমারা কি তার জন্য এতটুকু ভাব! তারা আসছে না কেন, খোঁজখবর নিতে হয়। না!
বড়ো জেঠি বলল, আপনার ছেলে তো জানে। ডেকে জিজ্ঞেস করুন না।
হ্যাঁরে উপেন শুরু কবে আসবে। পূজার ছুটি পড়ে গেছে। ওদের কারও শরীর খারাপ হয়নি তো!
না না। ভালোই আছে। ঈশার পূজার ছুটি একটু দেরিতেই হয়। জান না!
আমাদের ছাড়াবাড়িটা প্রকৃতই নিঝুম। আট-দশ বিঘার ছাড়াবাড়িতে নানা ফলের গাছ। আম, আতা, লিচু, কাঁঠাল কী নেই! সফেদা গাছও আছে। খালের ধারে কিছু জঙ্গলও আছে আর আছে বড়ো বড়ো শিমুল, নিম, রসুনগোটার গাছ। কত রকমের যে গাছ! সুপারি গাছও মেলা। ঈশার বড়ো প্রিয় এই ছাড়াবাড়ি। বর্ষায় জলে ডুবে যায় জায়গাটা। ঈশার খুব সাঁতার শেখার শখ। সে আমাকে নিয়ে কিছু ভাবলেই তলব–
এই ছোড়দা চল। ছোটো ভাইবোনেরা ছোড়দা ডাকে। ঈশাও ডাকে—এটা তার আবদার।
কোথায়!
ছাড়াবাড়িতে। আমাকে সাঁতার শেখাবি।
ধেড়ে মেয়ে, আমি পারব না।
ওমা। ধেড়ে মেয়ে বলায় কী রাগ। ফুঁসে উঠেছে।
আমাকে তুই ধেড়ে মেয়ে বললি! ধেড়ে মেয়ে হলেই বা কি! ধেড়ে মেয়েরা কী সাঁতার শিখতে পারে না!
তা পারবে না কেন? আমি পারব না। বড়দাকে বল।
শোন ছোড়দা, আমাকে তোয়াজ করতে হলেও সে আমাকে ছোড়দা ডাকত।
বড়দাকে দিয়ে হবে না। সে কিছু জানে না। কিছু বোঝে না। কারও কালি আমার সহ্য হয় না। বড়দার এটা আছে।
জান বড়দা আমার চেয়েও সাঁতারে বেশি পটু।
কিন্তু ঈশা নাছোড়বান্দা, সে অগত্যা তার মাকে ডেকে বলল, দ্যাখ মা ছোড়দা আমাকে সাঁতার শেখাবে না বলছে।
আরে যা না। তোকে ছাড়া তো কোথাও নড়ে না। সাঁতার শেখাতে তোর আপত্তি কেন!
আপত্তি কেন, কী যে বলি। টুকুস করে চুমু খায়, বলে সাপটে ধর, ধর, আরও জোরে, আমাকে পিষে মেরে ফেলতে পারিস না। হস্তপদ নিয়ে গজ হয়ে গেছিস। কিছু কি তুই বুঝিস না। কিছু কি তোর নেই!
মেয়েটা এত ভালো, অথচ মাঝে মাঝে কী যে হয়। বাড়ির ভালো-মন্দ খাবার সে রান্নাবাড়ি থেকে তুলে এনে ঠাকুরঘরের পেছনে খাওয়ায়। বলে সব স্বার্থপর ছোড়দা। কেউ তোর কথা ভাবে না। বলতে বলতে সহসা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। সে গতবারে একটি ঝরনা কলম দিয়ে বলেছে, আমার জন্য মন খারাপ হলে চিঠি লিখবি কীরে লিখবি তো। আমার কত রকমের ইচ্ছা হয় জানিস। ভাবলে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে। চল ছোড়দা। তারপর ফিস ফিস করে বলবে, আমি কিছু করব না। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে। ছাড়াবাড়িটি সাঁতার শেখার পক্ষে প্রকৃষ্ট জায়গা। বর্ষাকালে কোমর জল থাকে। ডুবে যাবার আশঙ্কা থাকে না। ভাদ্র মাসে পুকুরে এক লগি জল, হাত ফসকে গেলে ডুবে যেতেই পারে। তার কথা ভেবেই শেষে রাজি হওয়া।
কিন্তু মুশকিল সাঁতার শিখতে গিয়ে তার বায়না—এই ছোড়দা আমার হিসি পেয়েছে।
নাম জলে। কেউ দেখতে পাবে না।
ভয় করে। তুই নাম।
কোষা নৌকায় ছাড়াবাড়িতে যেতে হয়। নৌকা থেকে অগত্যা জলে লাফিয়ে নামতে হয়। কীসের সাঁতার শেখা। সে জলে নেমে হুটোপুটি শুরু করে দেয়। আর আমার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। তবু কেন যে এক সময় তার কোমর ধরে বুকজলে দাঁড়িয়ে থাকি। আর তার যে কী হয়, সে আমার হাত ঠেলে আরও নীচে নামাতে গিয়ে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে। তারপর কিছুটা বেহুঁশের মতোই বলে, আমি ডুবে যাব। তুই আমাকে জড়িয়ে ধর। আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।
সে যেহেতু আমার জন্য এত করে, আমিও তার উত্তেজনা লাঘবের জন্য কিছুটা সাহায্য করি। এটাই ছিল ঈশার সাঁতার শেখার প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে সে সাঁতারও শিখে যায়। এবং বুঝতে পারি আমরা সত্যি বড়ো হয়ে গেছি। ঈশা আর আমার দিকে বাড়িতে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। কথা বলতে পারে না। চোখের এই ভাষায় বড় হওয়ার কথা থাকে, তাও বুঝি। শরীরে ইচ্ছে অনিচ্ছে নানাভাবে বিচ্ছুরিত হতে থাকে। পূজার ছুটি হলেই তার আসার অপেক্ষা করি। এবারেও প্রায় তাই। দূরে দূরে সব জলময় মাঠ। কোনো ছই দেওয়া নৌকা দেখলেই ছুটে যাই। সময় কাটে না।
নিরাময়দা ঢাইন মাছ শিকারে নিয়ে না এলে এক ছন্নছাড়া মানুষের মতো বাড়ির ঘাটলায় চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
সামান্য বড়ো হয়ে ওঠার মুখেই সে যে কী গন্ধ পেয়ে গেল আমার শরীরে। আমি হাটে যাব নিরাময়দা সঙ্গে—সেও আমার সঙ্গ নেবে।
খেলার মাঠেও তাই।
সুপুরি গাছে ওঠারও সাধ তার। প্রায়ই বলবে, তুই সঙ্গে থাকলেই আমার কেন যে এত হিসি পায়! প্যান্টিটা ধর। আমি সুপুরি গাছে উঠব। সুপুরি গাছে চড়া শিখব। সুপুরি গাছে সহজে ওঠা যায় না। কিছুটা উঠলেই হড়হড় করে পড়ে যেতে হয়। প্রকৃতই তার প্যান্ট ভিজা ভিজা থাকে।
কত ছবি হয়ে আছে সেই সব দৃশ্য কিংবা দুই বালক-বালিকা, পুজার সময় প্রকৃতির মধ্যে বড়ো হয়ে উঠছে—এক অষ্টমী পূজায় ঈশাকে কুমারী পূজাও করা হয়। এমন বন্য স্বভাবের মেয়ে যদি দুর্গা মণ্ডপে কুমারী সেজে বসে থাকে, তার পূজাআর্চা হয়, বড়ো বড়ো পদ্মফুলের সিংহাসনে এক দেবীকন্যা, কে বলবে তার মধ্যে পাক খাচ্ছে প্রকৃতির নানা কূটকামড়, পূজা আসলেই আমার এখনো মন খারাপ হয়ে যায়।
নিরাময়দা বলল, এসে গেছি।
আমাদের কোষা নৌকা খুব একটা বড়ো নয়। চারজন আমরা, নৌকা বড়ো হলে নদীর উজানে উঠে যাওয়া খুব কষ্টসাধ্য—নৌকা যত ছোটো হয়, ততই জলে নৌকা ভাসিয়ে নিতে সুবিধে। শত হলেও মাছে-মানুষে লড়াই কপালে থাকলে দু-মনি, আড়াই-মনি ওজনের মাছও লেগে যেতে পারে। পরিণামে নৌকাডুবি হয়। নদীর তরঙ্গে ভেসে কিংবা পাতালে অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে। ঠিক হয়ে আছে, রাতে আশ্রমে আহার এবং ঠাকুরের ফুল বেলপাতার আশীর্বাদ, এবং ঠাকুমার সেই ট্যাবা, যিনি এখন নিরাময়দার পুণ্ডরীকাক্ষ অর্থাৎ বিষ্ণুর অবতার, তার অনুমতি নিয়ে ভোররাতে ভাটার মুখে জয় মা জগদম্বা বলে নদীর বুকে বড়শি ছুঁড়ে দিয়ে বসে থাকা। গভীর জলে বড়শিতে আরশোলা গেঁথে, সেই কোন গভীরজলে ছুঁড়ে দেওয়া।
তারপর গভীর জলের নীচে বড়শি আরশোলার টোপ নিয়ে অপেক্ষা করবে, এবং শয়ে শয়ে নৌকায় এই মাছ শিকার এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর ঘটনা। মাছে মানষে লড়ালডি, মাছ আটকে গেলে মাছে-মানষে খণ্ডযুদ্ধ। প্রবল সেই রোমাঞ্চ শরীরে শিহরণ খেলে যাবার মতো—ঈশার সেই সাঁতার শেখা কিংবা সুপুরি গাছ বেয়ে ওঠার মতো আশ্চর্য এক স্তব্ধতার অনুভূতি–
তখনই দেখলাম নদীর উত্তর-পশ্চিম কোণে এক প্রগাঢ় খণ্ডমেঘ উঠে আসছে। বর্ষাকালে প্রবল ঝড় হয়েই থাকে। বহু জনপদ ঝড়ের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নিরাময়দা নৌকা থেকে নেমে যাবার সময় বলল ঠাকুরের কৃপায় মেঘ কেটে যাবে।
আমরাও লাফিয়ে নামলাম। দূরে আশ্রমের হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশাল এলাকার এই ডাঙা জায়গা খ্যাপা নদীর কোনো রোষই প্রত্যাঘাত করতে পারে না। অজস্র বৃক্ষ, এবং এক খণ্ড অরণ্যও বলা চলে, দূরে সেই মহাশ্মশানে আজ কোনো চিতার আগুন দেখা গেল না, ঠাকুর পুণ্ডরীকাক্ষ মন্দিরের গর্ভগৃহে জপতপে বসেছেন, নিরাময়দা কেমন প্রমাদ গুনলেন—আশ্রমের হরি ব্রহ্মচারী দেখাশোনা করছে সব। তিনিই মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন।
আশ্রমবাসীর সংখ্যা যথেষ্ট। নানারূপে তাঁরা আছেন। ছোটো ব্রহ্মচারী, বড়ো ব্রহ্মচারীরা নানা কাজে ব্যস্ত। তাদের একজন হরিঠাকুর কী ভেবে বললেন, চলুন অতিথি ভবনে বসবেন। জপ তপ সারতে ঠাকুরের দেরি হবে। ভবনটি বিশাল, মাঘ সংক্রান্তিতে এখানে মেলা হয়। তখন দূর দূর অঞ্চল থেকে এমনকী ঢাকা শহরের গণ্যমান্য পুণ্যার্থীরা এসেও ওঠেন। জাগ্রত দেবী। তাকে অবহেলা করা যায় না। কোনো পাটের আড়তদার ভবনটি জগদম্বার নামে তৈরি করে দিয়েছেন। সারা অঞ্চল জুড়ে ঠাকুরের মেলা শিষ্য। মন্দির, অশ্বত্থাগাছ, অতিথি ভবন, আর নদীর বিশাল ঘাটলা তো আছেই। এই সব দেখে আমরা হতবাক, কলাপাতায় তখনই কিছু প্রসাদ চলে এল। প্রসাদ শেষ হতে না হতেই, ঠাকুর স্বয়ং হাজির।
আমার নাতিরা কই?
একেবারে নিকট আত্মীয়ের মতো সাদাসিধে সরল কথাবার্তা।
তারপর বললেন, দিদির নাতিরা আমারও নাতি। দেখি। আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন।
জটাজুটধারী এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটিকে কেন যে আর ভয় থাকল না। খবর পেয়ে লীলাবতী ভৈরবিও হাজির। কই দেখি অচল ভোলা উমারে।
যেন কত কাল আমাদের দেখার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন। শেষে যে বিনোদিনী দিদি রাজি হয়েছেন, কারণ লীলাবতী বংশের কলঙ্ক, এমনও শুনেছি সামাজিক বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে বিধবা লীলাবতী এক কাপড়ে ট্যাবা ভট্টাচার্যের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায় বংশের মুখে কালি পড়ে এবং সেই থেকে বিনোদিনীর পরিবার এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন পারতপক্ষে এই আশ্রমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। লীলাবতী মরে গেছে এমনই চাউর হয়ে গেছিল।
সে যাইহোক, বলতে গেলে অনেক কথা হয়।
তিনি অর্থাৎ পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর বললেন, নদীতে তো ভাই তোমাদের যাওয়া হবে। উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে অতিকায় কালো মেঘে নদী আবৃত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী ঝড়ে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। বহু প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। নদী শান্ত না হলে তোমাদের ছাড়া যাবে না।
শত হলেও নিরাময়দার পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর বাকসিদ্ধ পুরুষ। তার কথাই শেষ কথা।
নিরাময়দা ঠাকুরের পাশে হাত জোড় করে বসে আছেন। শুধু ওঠার মুখে নিরাময়দা বললেন, যে আজ্ঞে বাবাঠাকুর। আর তখনই বাবাঠাকুর খুবই যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললেন, ঈশা নারানগঞ্জের স্টিমারে রওনা হয়েছে অথচ স্টিমারের কোনো পাত্তা নেই। ঝড় কি নদীর মুখে শুরু হয়ে গেল।
তখনই বিদ্যুৎ চমকাল। কোথাও বাজ পড়ল, আর প্রলয় শুরু হয়ে গেল যেন। মহাপ্রলয় কাকে বলে। নদীর জল আশ্রমের ঘাটাল পার হয়ে অতিথিভবনের সিঁড়িতে ঢুকে গেল। এবং নদীর তরঙ্গমালায় নানাপ্রকারের বিদ্যুৎলতা সাপের ফণা তোলার মতো ভেসে যেতে লাগল। নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর শোঁ শোঁ আওয়াজ। জানালা-দরজা বন্ধ। চারপাশে অন্ধকার নিস্তব্ধতা। ঈশা স্টিমারে রওনা হয়েছে–আমার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল ঈশার কথা ভেবে।
নিজের ভিতর নিজেই ছটফট করছি।
আমার পিসেমশায় হয়তো আশ্রমে খবর পাঠিয়েছেন, তাঁরা স্টিমারে রওনা দিয়েছেন, কারণ পূজার ছুটিতে কিংবা ঈশা যদি অন্য কোনো ছুটিছাটায়, অথবা বাড়ির কোনো উৎসবে, কারুর বিয়ে, অন্নপ্রাশন, বাস্তুপূজা এবং নানাবিধ পূজা সহযোগে উৎসব লেগেই থাকে। পিসেমশাই আসতে না পারলে পিসিমা ঈশাকে নিয়ে চলে আসবেনই, সঙ্গে বিশ্বস্ত কোনো কর্মচারী এবং আশ্রমের ঘাটে স্টিমার নোঙর ফেললে মন্দির দর্শন, ঠাকুরের পায়ে প্রণিপাত এবং রাত্রিবাস করে ফের সকালের নৌকোয় রওনা হওয়া।
ঈশার বন্য স্বভাবের কথা মনে পড়ছে।
মেয়েটা বলত, তুমি আমার ভালো না বাসলে একদিন দেখবে আমি মরে যাব।
কেন মরবি? মরা কি এত সহজ?
ঠাকুর তো বলেছে, আমার মৃত্যু জলে ডুবে।
আজেবাজে কথা একদম বলবি না।
বলেছে বলছি।
কেন বলল। তুই কী করেছিলি! তুই তো সাঁতার জানিস?
সে দিনও মেঘনায় সাঁতার কাটছিলাম। বাবার কী মানত ছিল! দুদিন তিনি আশ্রমে ছিলেন। পাঁঠাবলি হবে শুনে, আমার রাগ, পাঁঠাবলি কেন?
ঠাকুর খুবই কুপিত।
শোনো ঈশা, সবই মা জগদম্বার ইচ্ছা। তিনি যা চান দিতে হয়। গোলমাল করে পূজার বিঘ্ন ঘটিও না।
কে শোনে কার কথা।
ছাগ শিশুটির আত্মরক্ষার্থে কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বৈশাখ মাস, নদীতে হাঁটু জল। নদীর ওপারের চরে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। জল থেকে উঠে আসার সময় কুপিত হয়ে বললেন, নদীর জলেই তোমার মরণ ঈশা। মা জগদম্বার ইচ্ছার বিরোধী তুমি। তোমার জন্য আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। মুখ থেকে কথাটা কী করে যে ফসকে বের হয়ে গেল।
আমি বলেছিলাম, কচু হবে দেখিস!
তারপরও কিছু করণীয় থাকে।
এবং বাকসিদ্ধ মানুষের এই এক বিড়ম্বনা। কুপিত অবস্থায় একরকম, মন শান্ত হলে অন্যরকম। অনুশোচনায় মাথা থারাপ হয়ে যায় ঠাকুরের। সবই অমোঘ ঈশ্বরবিশ্বাস হেতু। তিনি জানেন তাঁর কথা মিথ্যে হয় না। তিনি দিনের পর দিন অনশনে থাকলেন। মা জগদম্বাকে তুষ্ট করার জন্য হোমের আয়োজন, সারা দিন উপবাস থেকে সেই হোমে অপাবৃত অবস্থায় মন্ত্র উচ্চারণ করালেন ঈশাকে দিয়ে, অঘোরমন্ত্রে দীক্ষিত করালেন, বাক্যদোষ খণ্ডনে শাস্ত্রমতে যা যা করণীয়, কিছুই বাদ দিলেন না।
ঈশা-ই তাকে সব খুলে বলেছে।
ছোড়া কাউকে বোলো না। বললে মন্ত্রশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
তখনই ঝড়ঝাপটা আর বজ্রপাতের মধ্যে নদীর মাঝখানে স্টিমার চরায় ঠেকে গেছে। আশ্রমের পাশেই হাট, এবং মাছ ধরতে আসা সব নৌকাই ডাঙায় তুলে দিয়ে সবাই এসে আশ্রয় নিচ্ছে আশ্রমে, আর তখনই স্টিমার থেকে বার বার আর্তনাদের মতো ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। ভয়ঙ্কর বিপদসূচক বার্তা পাঠাচ্ছে। কেউ স্থির থাকতে পারছে না। ঠাকুর শুধু বললেন, প্রলয়কালে এমনই হয়ে থাকে।
তারপর তিনি, আরও যারা ঝড়ের আতঙ্ক থেকে আত্মরক্ষার্থে আশ্রমের ঘাটে উঠে এসেছিল তারা—নিরাময়দা তো আছেনই, টর্চ হাতে আশ্রম থেকে নেমে গেলেন। জীবন বাজি রেখে আমরাও নেমে গেলাম। আর চারপাশে টর্চ জ্বেলে খুঁজতে থাকলাম, কোনো জলে ডোবা মানুষ যদি নদীর পাড়ে পড়ে থাকে।
নদীর পাড় অনতিক্রম্য। এখানে সেখানে সব গাছপালা পড়ে আছে। ডাল পাতা সব বেগে ধেয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর কেবল মা জগদম্বার নাম নিচ্ছেন। তুমিই অগতির গতি। স্টিমারের আলো নিভে গেছে, অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না, নদীর কোন চরায় স্টিমারটা আটকে গেল। বিদ্যুৎ চমকালে বোঝা যাচ্ছে, যাত্রীরা প্রাণ হাতে তরঙ্গসঙ্কুল নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে। আর তখনই নিরাময়দা এবং আর কেউ কেউ, এমনকী আমরাও আশ্রমে উঠে এসে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। আমার মাথা খারাপ অবস্থা—ডাকছি ঈশা, ঈশা, আমরা নদীতে আছি, তুই কি স্টিমারে? ঈশা, ঈশা। নিরাময়দার চিৎকার থাম থাম। ওই দ্যাখ ভেসে যাচ্ছে, আমরা এক এক করে তুলছি, আর আশ্রমে এনে শুইয়ে দিচ্ছি। জীবিত, মৃত কেউ বাদ যাচ্ছে না। এতগুলি নৌকা একসঙ্গে উদ্ধার কার্যে নামলে যা হয়, ঈশার কথা কেউ আর মনে রাখে না।
ঝড়ের প্রকোপ কমে আসছে।
কিছু মানুষজন সাঁতরে পাড়ে উঠে আসছে।
বৈদ্যেরবাজার থেকে থানার দারোগাবাবু সব সেপাইদের নিয়ে ত্রাণের কাজে নেমে পড়েছেন। বড় টর্চের আলোয় নদীতে জলে ডোবা মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা। আর আমি পাগলের মতো এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়ছি। আর ডাকছি, ঈশা। ঈশা। তুই কোথায়! আর নানা প্রশ্ন, পিসিমা, পিসেমশাই এল না কেন? একা চলে এলি! তোর সঙ্গে আর কে আছে?
নিরাময়দা সারেঙকে হুইলঘরে পেয়ে গেছেন। ডেকছাদে তাঁরও ছোটাছুটি কম না। জনে জনে লাইফবেল্ট লাইফ বয়া দেওয়া, শিশু, নারীকে আগে বোটে পার করে দেওয়া, তাঁর লস্করদের নিয়ে তিনি এখানে সেখানে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। নিরাময়দার গলা পাওয়া যাচ্ছে।
সারেঙসাব ঈশাদির আসার কথা, সে কোথায়?
সারেঙসাব আর্তগলায় বললেন, ঈশাদি কথা শুনল না। চরায় ধাক্কা খেয়ে স্টিমার দু-টুকরো। কে কোথায় ডুবেছে, কী ভেসেছে—জানি না। নদীর কঠিন তরঙ্গ দফে দফে ডেকছাদ সাফ করে নিয়ে গেছে। তরঙ্গ উঠে আসার ফাঁকে ছোটাছুটি করছি, ঈশাদির সঙ্গে গগন এসেছে।
গগন পিসেমশায়েরই বিশ্বস্ত কর্মচারী, প্রৌঢ় মানুষ।
কোথায় গেল!
ঝড়ের মধ্যেই খ্যাপা নদীতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঈশাকে সারেঙসাব চিনতেই পারেন। কেবিনের যাত্রী ঈশা। ডেকছাদে মাত্র তিনটে কেবিন। সব কেবিনগুলোর দরজাই ফাঁক হয়ে আছে। আর কড় কড় শব্দ উঠছে। সব কেবিনগুলিতেই উঁকি দিলাম, সব ফাঁকা।
সারেঙসাব ছুটে এসে বললেন, ঈশাদি আমার বলল, আমি সাঁতার জানি। এই তরঙ্গসঙ্কুল নদীকে সে ভয় পায় না। সামনের আশ্রমে ঠিক সে উঠে যেতে পারবে।
হায় কপাল, তালগাছ প্রমাণ সব ঢেউ, ঈশা তো জানে না তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে কারও কথা শোনার বান্দা যে না আমিও বড়ো হতে হতে কতবার টের পেয়েছি। ছোটোদাদু আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই ফোকলা দাঁতে হাসতেন।—এই দুপুরের রোদে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। তোর মাকে ডাকছি ঈশা।
ডাকো না। সঙ্গে ছোড়দা আছে।
ভিতরে প্রাণসৃষ্টির মধুমালা কুব কুব করে ডাকছে যে, কে আর আটকায় দিদি তোকে।
ইশা তাকায় আমার দিকে।
আমিও। তারপরই ঈশা ছুটে আমার সঙ্গে উঠে যেত ছাড়াবাড়িতে। ছোটোদাদু বলতেন, প্রাণসৃষ্টির পুঁথির পাতাটি খুলে গেছে, কী মজা!
এই সব কথাই মনে হচ্ছিল। ভিতরে হায় হায় করছিলাম। আমি ডাকছি, ঈশা, ঈশা। ঈশাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ঈশার নানা উপদ্রব আমার কাছে এখন জীবনের মাধুর্য। আমি তখন আর এক খ্যাপা। তরঙ্গ উঠে আসছে নদীর। নৌকার চেয়ে এই তরঙ্গমলায় ভেসে যাওয়া সহজ।
সব তরঙ্গই নদীর কিনারে আছড়ে পড়ছে।
আর আশ্রমে উঠেই শুনলাম, কিছু জলে ডোবা মানুষকে তুলে আনা হয়েছে। কেউ মৃত কেউ অর্ধমৃত। সমস্ত আশ্রম জুড়ে মানুষের কান্না এবং কোলাহল। সব ডে-লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈশাকেও পাওয়া গেছে। নিরাময়দা বললেন, ঈশাকে মন্দিরের বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথায় তুলে হরি ব্রহ্মচারী তাঁকে ঘোরালেন। কিছুটা জল উগলে দিল। তারপর নিস্তেজ। ঠাকুর পুণ্ডরীকাক্ষ তার নাড়ি ধরে বসে আছেন। আর কালীস্তোত্র জপ করছেন। তোরা গিয়ে ঈশার পাশে বোস। আমার দিকে তাকিয়ে নিরাময়দা সতর্ক করে দিলেন, পাগলামি করিস না। সব ভবিতব্য। ঈশার শিয়রে শান্ত হয়ে বোস। আমি বাড়ি যাচ্ছি খবর দিতে।
এক সময় পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুরও উঠে গেলেন। লীলাবতী ঈশাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। সাদা কাপড়ে ইশার শরীরও ঢেকে দেওয়া হল। আমি ঈশার শিয়রেই বসে আছি। কখন যে দেখি পাশে কেউ নেই। ঝড়ে সাদা কাপড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কে বলবে, ঈশার সব শেষ, সে তো ঘুমিয়ে আছে, ফ্রক গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঈশার সেই মধুমালা কোথায় গেল? ডাকলে সেই প্রাণের সাড়া পাওয়া যাবে না। কিংবা সাপটে ধরলে। কেউ তো নেই। সব আশ্রমের বিশাল প্রাঙ্গণে, নদীর পাড়ে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত।
প্রাণের সাড়া যদি পাই। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম নির্জন বারান্দায়। উষ্ণতা সষ্টি হোক, সে ভিতরে জেগে উঠক। তারপর আরও নানা চেষ্টা, না, সাড়া নেই। আমি তার মুখের উপর ঝুঁকে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার দু-ফোঁটা অশ্রুবিন্দু তার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিতেই সে যেন জেগে গেল। সে চোখ মেলে তাকাল। সে এক আশ্চর্য বিস্ময় ভরা চোখে আমাকে দেখছে।
উচ্ছেদ
এ যেন গত জন্মের কথা। একটা কাজের জন্য তখন হন্যে হয়ে ঘুরছি। তখন মুকুল আমার আশাভরসা। যখনই বিপন্ন বোধ করেছি তার কাছে ছুটেছি। সেও চেষ্টা করছে। আমরা তখন এক কলেজে পড়ি, একসঙ্গে ঘুরি, দু-জনেরই দুটো ভাঙা সাইকেল সম্বল। মুকুল থাকে শহরে, আমি কলোনিতে। জঙ্গল সাফ করে মাটির ঘরবাড়ি, ভাইবোন মেলা, তখন আমরা ছিন্নমূল। মুকুলের দাদা পি ডব্লিউ ডি-র কোয়ার্টারে থাকেন, আফিসের ডেসপাঁচ ক্লার্ক তিনি। যদি কোনো কাজের সুযোগ করে দেন, যে কোনো কাজ, মুকুলের জামাইবাবু স্কুল ইনসপেক্টর, মুকুলের দিদিকে ছোড়দি ডাকি—সকলেরই এককথা আরে হয়ে যাবে, আমরা তো আছি। জামাইবাবু একদিন ডেকে বললেন, সারকুলার এলেই তুমি অ্যাপ্লাই করবে।
কাজের জন্য চেনাজানা যত মানুষজন আছে, তাদের কাছে যাই-মুকুল আমার সঙ্গে থাকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। বাড়িতে অর্ধাহার অনাহার, কী যে করি, নিরুপায় বাবার একটাই কথা—বিলু, কেউ কিছু বলল!
কিছু বলল মানে, আমার চাকরির কথা জানতে চান। বাবার দিকে তখন তাকানো যায় না, ক্লিষ্ট এবং উদাস মুখখানি আমি তার এখনও ভুলতে পারি না।
কলেজে যেতে হয় যাই, বেতন দিতে পারি না বলে যে কোনো সময় নাম কাটা যাবে, বাড়িতে থাকলে পিতাপুত্রের একটাই কাজ, জঙ্গল সাফ করা, এবং গাছপালা লাগানো একদিন সকালে মুকুলই খবর দিল, হাতিনগর প্রাইমারি স্কুলে স্পেশাল ক্যাডার শিক্ষকের পদে আমার কাজ হয়েছে—আশি টাকা মাইনে—আশি টাকাই বাবার হাতে তুলে দিই এবং এ-ভাবেই জীবন শুরু, সে দিন আনন্দে চেনাজানা মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দিতে বেশ রাত হয়ে গেছিল ফিরতে। দু-বেলা আহারের বন্দোবস্ত হয়ে গেলে মানুষের আর কী লাগে! মুকুল না থাকলে বোধহয় আমার জীবনসংগ্রামই শুরু হত না। ভাঙা সাইকেলটার কথাও মনে হয়, বিকেল হলেই সাইকেলে পাকা সড়ক ধরে কত দূরে যে উধাও হয়ে যেতাম। তখন শুধু স্বপ্ন, স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছি—আরও বন্ধুবান্ধব জুটে গেল, আমরা সবাই মিলে একটা কাগজও বের করলাম, রায়বাহাদুরের নাতনি মৃন্ময়ীও জুটে গেল।
আড্ডায় যা হয়, কথা শেষ হতে চায় না। রাত বাড়ে। আকাশে নক্ষত্র ফুটে থাকে। গাছপালা অন্ধকারে কেমন নিথর। সোজা পাকা সড়ক চলে গেছে লালাবাগের দিকে। রেলগুমটি পার হলে দু-দিকে দুটো সড়ক। কারবালা দিয়ে গেলে বাড়ির রাস্তা সংক্ষিপ্ত হয়। খুবই বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে কবরখানা পার হয়ে রাস্তাটা আমাদের বাড়ির দিকে চলে গেছে। দিনের আলোয় সাহস পেলেও, রাতে ওই রাস্তা ধরে একা বাড়ি ফিরতে ভয় হয়। বাদশাহি সড়ক ধরেও যাওয়া যায়, তবে অসুবিধা, পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, ঢুকলেই সিপাই হল্ট বলে চিৎকার করবেই। তখন বলতে হয়, আমি পিলুর দাদা। ব্যস, ওই যে কথা, পিলুর দাদা, এতেই হয়ে যায়। পিলুর খ্যাতি সর্বত্র। পিলু-ধিলুরা তখন বড়ো হয়ে উঠছে।
তারপরই ট্রেনিং ক্যাম্পের আর্মারি। আমারি পার হলে মাঠ। মাঠে কাঁটাতারের বেড়া। মাঠে নামলেই আমাদের পাড়াটা চোখে পড়ে। বেড়ার গেট পার হলে দেখতে পাই লম্ফ জ্বলছে, ঘরে ঘরে। অন্ধকার রাতে এগোনো যে কত কঠিন— গাছপালার ছায়ায় নিজেকে পর্যন্ত দেখা যায় না—তবু পথটা এত চেনা যে যেন জন্মজন্মান্তরের রাস্তা, কখনোই ভুল হতে পারে না— কারণ বাড়ি ঢুকলেই যে বাবা মা ভাই বোনেরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, বুঝি। কুকুর বিড়াল কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ি এজন্য অনবরত ক্রিং ক্রিং বেল বাজাই– যারা দূরে কাছে আছ, সরে যাও। বাবা-মা এমনকী পিলু দূর থেকেই টের পার তার কলেজে পড়া দাদাটি ফিরছে। আমাদের ফেলে আসা দেশ, কিংবা জন্মভূমির জন্য কারও আর তেমন কোনো মায়া মমতা নেই। যেন এ-দেশে চলে এসে আত্মরক্ষা করা গেছে। মান মর্যাদা আর নষ্ট হবার ভয় নেই। মনেই হয় না আমরা ছিন্নমূল। বরং এই যেন আমাদের দ্বিতীয় জন্মভূমি। সুযোগ এবং সময় পেলেই, ছোট্ট জন্মভূমিতে বাবা, আমি শুধু গাছ লাগাই, আম জাম জামরুল কাঁঠাল লিচু এবং একটি বাতাবি লেবুর গাছও লাগানো হয়ে গেছে। গাছের সঙ্গে মানুষের যে কত নাড়ির টান বাবাকে দেখলে বুঝি। বাড়ির গাছপালার ভিতর দিয়ে সাইকেলে চেপে উধাও হওয়ার আনন্দও আলাদা। আর কী করে যে এই বাড়িঘরের সঙ্গে বাবার মতো আমিও এক গভীর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। তারপর যা হয় মুখ বাড়ে, মানুষ বাড়ে, দায়িত্ব বাড়ে—বাবার সংসার, আমার নিজের সংসার, কত দায়িত্ব, বোনেদের বিয়ে, ভাইয়েরা কেউ পড়াশোনায় মন দিতে পারল না, পিলু মিলিটারিতে চলে গেল, বিয়ে করে যাবার সংসার থেকে আলাদাও হয়ে গেল, ধিলুর মোড়ের মাথায় দোকান। দোকান জমে উঠতেই সেও ভিন্ন হয়ে গেল। ধিলুর বউয়ের অভিযোগ আমি যে বাবার মাসোহারা পাঠাই, তাতে সব খরচ নির্বাহ হয় না।
২.
বাড়িটা আর বাড়ি থাকল না। দাদা দেশভাগের আগেই রেলে কাজ নিয়ে সুদুরে হারিয়ে গেল, সেখানে সে ঘরবাড়িও বানিয়েছে। বছরে দু-বছরে আসে এই পর্যন্ত।
তার কথায় বুঝি তারও অভাবের অন্ত নেই, পর পর সন্তান ধারণ করে বউদিও জেরবার, এবং একবার বাড়ি গিয়ে জানতে পারি সে তার বড়ো মেয়েটিকে বাড়িতেই রেখে গেছে।
বাবা বললেন, কী আর করা!
বাবা যে খুব অদৃষ্টবাদী এবং ধর্মভীরু মানুষ। জীবন একভাবে না একভাবে চলে যায়। এত ভেবে কী হবে!
তত দিনে আমারও কলকাতায় থাকার একটা আস্তানা হয়েছে। কিন্তু মা বাবা ভাই বোনের টানে, এবং সেই গাছপালা—যা প্রায় তিন বিঘা জুড়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল, তারা প্রায় বলতে গেলে মহাবৃক্ষ হয়ে উঠেছে—ডালপালা মেলে দিয়েছে —বড়োঘর, রান্নাঘর, ঠাকুরঘরও হয়ে গেছে এবং শহর জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে, প্রায়ই মা বাবার কাছে ছুটে যাই। মাটির আটচালা ঘরটির একটি তক্তপোশে বাবার বিছানা হয়, আমারও হয়, পাশের তক্তপোশে আমার মা এবং ভাইঝি শোয়, আমায় ছেলেরা কিংবা স্ত্রী গেলেও কোনো রকমে সেই ঘরটাতেই থাকি। ধিলু বাড়ির সামনের দিকটায় মাটির ঘর তুলে সে তার আলাদা সংসার করে নিয়েছে। বাড়ি গেলে বাবাই একবার বললেন, ধিলুর দোকান ধারদেনায় বসে গেছে। তুই যদি পারিস মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাস।
মা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাঁরও এক কথা। তুই না দেখলে, কে দেখবে। এমন অবস্থা ধিলুর, দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। তুই যা টাকা পাঠাস আমাদেরই হয় না, তার উপর ধিলুর বাড়তি মুখের অন্ন জোটানো তো বাবার পক্ষে সম্ভব! ধিলুকে কত বললাম, তোকে চিঠি লিখতে, সে কিছুতেই রাজি না। বড়ো বিবেচক, দাদা কত দিক সামলাবে। বরং তোমরা বললে দাদা গুরুত্ব দেবে।
কী আর বলি, দেখি বলে চুপ করে গেলাম। সেই কবে কলেজের চাকরি নিয়ে প্রথম বাড়ি ছেড়ে কাটোয়ায় যাই। তখন থেকেই ধিলু আমার কাছে। সে স্কুলে যায়, আমার স্ত্রী শিক্ষয়িত্ৰী একটা স্কুলের। সে-ই সকালে কাজের ফাঁকে ধিলুকে পড়ায়। কিন্তু তার পড়ায় মন বসে না। সুযোগ পেলেই, পড়া ছেড়ে উঠে যায়, স্টেশনে গিয়ে বসে থাকে—বাড়ির জন্য মন খারাপ হলেই, তাকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। স্কুল কামাই হয়। স্কুলে না গেলে পড়ায় যে ক্ষতি হয়, কিছুতেই সে তা বোঝে না।
এক সকালে বাবার চিঠি নিয়ে বোনও হাজির। আমার কাছে না থাকলে সে পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না। তার বউদি স্কুলে পড়ায়। এই ভরসাতেই বাবা ভেবেছেন, বউমা সাহায্য করলে বিনি ঠিক পাশ করে যাবে।
পাশ আর করে!
পড়তে বসে, তবে মন অন্যমনস্ক। পড়া ছাড়া আর সব কাজই তার প্রিয়। ধিলুর সঙ্গে বিনি একদণ্ড বনে না। অথচ বাড়ি গেলে দুই ভাইবোনেই বউদিটি যে তার ভালো না, কারণ দাদাকে গ্লাস ভরতি দুধ দেয়, তাদের গ্লাস ভরতি দুধ দেয় না, বউদির খুবই দেড় নজরে স্বভাব, এই সব অভিযোগে মা ক্ষিপ্ত হন, তাঁর এক কথা, তুই পেটে ধরেছিস, না আমি ধরেছি। তোর উপার্জনে খায়, না আমার পুত্রের উপার্জনে খায়। এই সব নিন্দামন্দ কানে উঠতেও দেরি হয় না। স্ত্রী মাঝে মাঝে এই নিয়ে কান্নাকাটিও করতেন। সে যাইহোক, কাটোয়া থেকে সরকারি কলেজে চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসার আগে জেলা বোর্ডের বড়োবাবু ধ্রুবকে ধরে আমার স্ত্রী একটি মাদার টিচার ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে দেয় বিনিকে। আর কলকাতার স্কুলে ধিলুকে যে ভর্তি করানো কঠিন, বরং তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। সেখানে কলোনির হাইস্কুলে যদি ভর্তি করে দেওয়া যায়।
আমি নিজেই বাড়ি গেলাম।
বাবা।
বলো। আমি তো কলকাতা চলে যাচ্ছি। আপনার বউমার ডেপুটেশনে কাজ, সেও চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে। কলকাতার স্কুলে ভর্তি করানো খুব টাফ ব্যাপার। ওকে কলোনির হাইস্কুলে ভর্তি করে দিন। বাড়ি থেকে পড়ুক। আর একটা তো বছর দেখি তারপর কী করা যায়।
আর, একটা বছর!
বাবার চিঠি নিয়ে ধিলু আমার বাসায় হাজির।
বাবা লিখেছেন, ধিলু আর পড়তে চায় না। সে তোমার কাছে চলে যাচ্ছে। যে কোনো একটা কাজ তাকে তুমি জুটিয়ে দিও। কী করি! বাধ্য হয়ে আমার এক ছাত্রের বাবাকে ধরে ধিলুকে কারাখানায় ঢুকিয়ে দিই। এই সব স্মৃতি আমাকে বিষণ্ণ করে দেয়। ধিলুর শেষে এই পরিণতি! বড় দুশ্চিন্তা আমার। তার মারামারির স্বভাব প্রকট, মাথা গরম, একবার স্কুলেও সে তার এক সহপাঠীর মাথা ফাটিয়ে দিয়ে বাড়িতে পালিয়েছিল। স্ত্রী শিক্ষয়িত্রী, আমি কলেজে পড়াই, কাটোয়ায় আমাদের বিশেষ পরিচিতির দরুনই বিষয়টি বেশি দূর গড়ায়নি। কারখানায়ও সে মারপিট করে চাকরিটা শেষ পর্যন্ত খুইয়েছে।
তখন সে আমার বাসায় থেকে কারখানায় কাজ করত। ধিলু কাজ পেয়েছে শুনেই, মা এক সকালে হাজির আমার কলকাতায় বাসায়।
আমি যে জন্যে এলাম— মা বললেন।
বিশেষ জরুরি কাজেই এসেছেন মা। স্ত্রী নীরা মাকে ভালোই জানে। সে ভয়ে ভয়ে প্রণাম সেরে বলল, আপনি হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন মা। আপনার ছেলে আসুক। আমার দুই পুত্র তাদের ঠাম্মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। তারাও জানে ঠাম্মা তাদের মাকে পছন্দ করে না। মা বাবাকে অন্য গ্রহে
তুলে আনায় ঠাম্মার যে ক্ষোভ আছে তাও তারা বোঝে
শোনো বউমা, ধিলু কোথায়?
কাজে গেছে। কারাখানায় ওর শিফট ডিউটি।
বিলু!
আপনার ছেলে বাজারে গেছে। আসছে।
আমি বসব না বউমা। মরনির ছেলের বিয়ে, বিয়ে বলে কথা, না এসেও পারা যায় না। সংসার ফেলে আসা সোজা কথা না, এলাম প্রাণের দায়ে–
আমি দরজা খুলে ঢুকতেই কানে এল কথাটা—বাজারের থলে নামিয়ে বসার ঘরে ঢুকে প্রণাম সেরে বললাম, প্রাণের দায়! প্রাণের দায় কেন মা!
হ্যাঁরে বাবা। তোর পলতার মরনিমামির ছেলে জনার্দনের বিয়ে। যখন এতটা দূরে এলামই, তোকে, নাতি দুটোকে না দেখে যাই কী করে। প্রাণ কাঁদে।
কে তোমাকে দিয়ে গেল!
নরহরি।
অর্থাৎ আমার মেলোমশাই, বললাম, তিনি এলেন না।
আসে কী করে! বিয়ে বলে কথা, এদিকটার আত্মীয়স্বজনদের বিয়ের চিঠি দিয়ে আসবে। তার সঙ্গেই ফিরব।
প্রাণের দায়টা কী তোমার! এসেই যাওয়ার কী হল।
তুই কি বাবা মানুষ আছিস!
বুঝলাম হয়ে গেল। সবটাই নীরা উপলক্ষ।
নিজের ভাই বলে কথা! সে থাকে তোর কাছে, তার কাছ থেকে, কোন মুখে খোরাকির টাকা নিস—
ও তো কোনো টাকা দেয় না মা!
দেবে কোত্থেকে, কটা টাকা মাইনে, তোকে দিলে ওর বউকে কী পাঠাবে! ওর বউয়ের যা চোপা, ঠেস দিয়ে কথা—নিজের ভাই, থাকে খায় সে জন্য কেউ টাকা নেয়! কী মুখ বউটার! তোকেও ঠেস দিয়ে কথা বলে। একজনের নামের চোটে গগন ফাটে, আর তারই ভাই উবু হয়ে ঘাস কাটে। আরে তোর এ-কথা সাজে, বিপদে আপদে সেই তো দেখে!
বললাম, মা ধিলু আমাকে কানাকড়িও দেয় না। খোরাকির টাকার কথা আসে কী করে!
কী জানি বাবা তোরাই জানিস।
বছর দশেক ছিল ধিলু আমার বাসায়। তারপর ফের বাড়িতে। কোম্পানির প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং সঞ্চিত টাকা নিয়ে গিয়ে ফের মোরের মাথায় দোকান, এবং বাড়ি ছেড়ে সে যে থাকতে পারেনি—কাজে কামাই করারও স্বভাব ছিল তার। বাড়ি গেলে আর ফিরতে চাইত না। কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার এটাও বোধহয় একটা কারণ। ধিলুকে নিয়ে আমার শুধু দুশ্চিন্তা বাড়ে।
৩.
সে বারে বাড়ি গিয়ে দেখি, ধিলুর ঘরটা ফাঁকা।
বাবা বুঝতে পেরে বললেন, তাড়িয়েছি। অত্যাচারের শেষ নেই। সে আমার ত্যাজ্যপুত্র।
কী বলছেন!
তোমার ভাইঝিকে ধিলুর বউ চর মেরেছে। ধিলু বারান্দার টালি টেনে ছুঁড়ে ফেলেছে উঠোনে। তোমাকে জানাইনি। পিলু ছুটে না এলে ধিলুর বউ তোমার ভাইঝিকে মেরেই ফেলত। চুল ধরে টানতে টানতে উঠোনে আছড়ে ফেলেছে। মানিক ছুটে এসে লাঠি নিয়ে তাড়া না করলে আমাদেরও মেরেই ফেলত। বাড়িটা দিন দিন শেষে কী হয়ে উঠল।
আমার মা জেদি, একগুঁয়ে। বুঝি দোষ সবটাই ধিলুর বউয়ের নয়। ভাইঝিও রগচটা। সে যাহোক, বললাম ওরা কোথায়।
দীনবন্ধুর বাড়িতে বাসা ভাড়া করে আছে। এটা খারাপ দেখায় বাবা। বাড়ি ঘর থাকতে বাসা ভাড়া করবে শত হলেও সে আপনার পুত্র।
পুত্র না মূত্র। তুমি যা পাঠাও ওই সম্বল আমার। একটা পয়সা দেয়! দিতে পারে, দেবে না। কুপুত্র থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আর প্রতারণা, তোমাকে সাতকাহন করে যে অভাবের কথা লেখে সব বানানো। সুদের ব্যবসা করছে সে।
কথায় কথা বাড়ে। মা বললেন, থাকবি তো! রুমির একটা সম্বন্ধের কথা হচ্ছে। সবই ঠিক, কেবল বলেছি তুই না এলে কিছু হবে না। তুই না দেখলে কিছু হবে না। দেনা পাওনা নিয়ে সেই কথা বলবে।
আমি বললাম, দাদা কী বলছে! দাদা দেখুক।
বাবা বললেন, সে দেখবে না। তার দায় নেই জানিয়ে গেছে। আমার কাছে
বড়ো হয়েছে, আমার দায়। তার নিত্য অভাব, জানিয়েছে, বিয়ে দেবে কোত্থেকে। ঘাড়ের উপর তার আরও তিনটি মেয়ে দাদার দোষও দেওয়া যায় না। পুত্র দুটির তার অপুষ্টি কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, বুদ্ধি-বিবেচনার খুব অভাব। কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধীও বলা যায়। রেলের চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মীর পক্ষে এতগুলো মানুষের ভরণপোষণই কঠিন।
মা বললেন, কীরে কদিন থাকবি তো! গলায় বিষধর সর্প নিয়ে ঘুরছি। তুই ছাড়া কে উদ্ধার করবে—তুই দেখে যা। দাবিদাওয়া বলতে নগদ পঞ্চাশ হাজার চায়, আর কিছু চায় না। আর বিয়ের খরচ।
আমি কী যে বলি! নগদ দেওয়া যে অপরাধ, যে দেয় সেও অপরাধী। তারপর এত টাকা পাব কোথায়! সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে মা। মা ফের বললেন, সাদুল্লা আমগাছটা বিক্রি করলে হাজার তিনেক টাকা পাওয়া যাবে। যদি বলিস, গাছটা না হয় বিক্রি করে দিবি। বিয়ের খরচ মিটে যাবে।
বাবা খেপে গেলেন, শোনো ঠাকরুণ, গাছ আমার প্রাণ। গাছগুলোর দিকে তোমাদের নজর পড়েছে দেখছি। এত বড়ো বড়ো গাছ বাড়ির চারপাশে তোমার সহ্য হচ্ছে না!
বিকেলে আমার বোন বিনিও হাজির। তার বিয়ে কলোনিতেই হয়েছে। সে কলোনির প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারিও করে। সপ্তাহে দু-সপ্তাহে একবার মাকে রুমিকে দেখে যায়-রুমিকে সে মেয়ের মতোই ভালোবাসে। কারণ মাকে যখন দাদা রেখে যান তারই উৎসাহ ছিল বেশি। আমি রাজি ছিলাম না।
ভগ্নিপতিও কিছুক্ষণ পরেই হাজির। কথাবার্তায় খুবই ভদ্র এই ভগ্নিপতি, প্রণাম সেরে বলল, কবে এলেন দাদা। ছেলেটিকে আমার পছন্দ। বাজারে স্টেনলেস স্টিলের বাসনকোসনের দোকান আছে। দোকানটা সে বড়ো করতে চায়। এই জন্যই নগদ টাকা তার দরকার।
কী যে বলি! তবু বললাম, সবাই মিলে দিলে ত হয়েই যায়। তবে এত টাকা!
আর কার দেবার সামর্থ্য আছে বলুন! থাকলেও মুখ শুকিয়ে রাখার স্বভাব। কার কাছে চাইবেন বলুন। ইচ্ছা হল বলি বিনিও দিতে পারে। তুমিও পার। সবাই মিলে দিলে আমার ভার লাঘব হয়। গাছও কাটতে হয় না। যাই হোক বিয়ে আর হয়নি। ছেলের কী খুঁত পাওয়া গেছে।
রাতের দিকে বারান্দায় বসে আছি। বাড়ি এলে যে আমরা পরমায়ু বাড়ে—এত সব গাছপালার মধ্যে বসে থাকার আনন্দই আলাদা।-দেখি অন্ধকারে উঠোন অতিক্রম করে কে বারান্দায় উঠে আসছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া। ধিলু! তার ছেলে দুটি এবং মেয়েটিও হাজির। ওরা প্রণাম করে বলল, জেঠু তুমি কিন্তু আমাদের বাসায় যাবে। মা রাতে তোমাকে খেতে বলেছে।
সবারই কুশল নিতে হয়।
তুই কোন ক্লাশে পড়িস মেঘা?
ক্লাশ ফোরে পড়ি।
সিধু তুই?
আমি পড়ি না জেঠু।
তখনই মা বললেন, ও তো ব্যবসা করবে বলছে। একটা সাইকেল না হলে চলছে না। আমাকে ধরেছে, ঠাম্মা তুমি জেঠুকে বলো, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেয়।
ধিলু বাঁশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। সে যে ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে বুঝি, তার এই ক্রোধ যে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় তাও বুঝি— বারান্দার এক কোনায় হারিকেনটা রাখা, তার আলোতে সবার মুখই আবছা দেখা যায়, রুমি ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, কাকা সবারই চা হচ্ছে, আপনাকে দেয়?
দে। ধিলুকে বললাম, তুই এত অমানুষ ধিলু, বারান্দার টালি সব ভেঙে ফেললি, তোর স্ত্রী রুমিকে ধরে মারধর করল ছেলেটার পড়া বন্ধ করে দিলি, এই সে দিন হল, ব্যবসার ও কী বোঝে!
সহসা ধিলু আগুনের মতো জ্বলে উঠল। আমি অমানুষ—তোরা সব মানুষ। তুই আমাকে টাকা পাঠাতিস, মা-র সহ্য হল না। বউদিকে লাগাল। তুই টাকা বন্ধ করে দিলি।
তোর দোকান তো ভালোই চলছে।
মিছে কথা। ঈর্ষা, এই দোকান থেকে কী হয় বুঝিস না, ধার দেনায় ডুবে গেছি। বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়, এখন সব রুমি, তুই জানিস দাদা, দিদি মা মিলে তোর টাকা থেকে রুমিকে পাসবই করে দিয়েছে। তোকে চাপ দিয়ে, তুই খাস না-খাস বছরের পর বছর টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে নিচ্ছে, দিদিই দেখবি রুমির বিয়ে দেবে না। ওর মেয়েকে কে পাহারা দেবে, সকাল হলেই রুমি দিদির বাড়ি চলে যায়—তার মেয়ের দেখাশোনা করে, বাড়িতে কতক্ষণ থাকে!
এসব কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না, বললাম ঠিক আছে, বাবাকে বললাম, আপনি সামনের দিকে ওকে দুকাঠা জমি দিন, ধিলু বাড়ি করে থাকুক। বাড়ির ছেলে পাড়াতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে, দেখতেও খারাপ লাগে।
বাবা আর কী করেন? বাড়ির দায়-অদায় সব যে সামলায় তার কথা ফেলাও যায় না, তিনি বললেন, আমার উঠোনে সে থাকতে পারবে না। জায়গার তো অভাব নেই, রাস্তার দিকে জায়গা দে।
সেই মতো ধিলু জমিটার এক কোনায় বাড়িঘর করে আছে। বছরে দু-চারবার কখনো আরও বেশি বাড়ি যাওয়াই আমার স্বভাব। মাটির টানে হতে পারে, মা বাবা ভাই বোনের টানে হতে পারে, গেলেই কেমন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। অথবা সেই গাছপালা বৃক্ষ, কারণ কখনো যে বাড়িটাকে তপোবনের মতো মনে হয়, শহরের কোলাহল থেকে এই সব বৃক্ষসমূহের নির্জনতায় ঢুকে গেলে তৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে। বাবার লাগানো গাছ, আমার লাগানো গাছ পঁচিশ-ত্রিশ বছরে যে-সব মহাবৃক্ষ হয়ে গেল, তার নীচে চেয়ার পেতে দিলে গাছের সঙ্গে আমার কথা হয়।
বাবাও সারা দিন এ-গাছ সে-গাছের গোড়া খুঁড়ে মাটি আলগা করে দেন, এতে গাছের প্রাণশক্তি বাড়ে। সারা দিন বাবাও গাছের সঙ্গে কথা বলেন।
সে যাহোক, সে বারে বাড়ি গিয়ে টের পাই, প্রকৃতই বাবার অনেক বয়েস হয়ে গেছে। বাবা বারান্দায় জলচকিতে বসে আছেন। বর্ষাকাল, বাবার শরীর কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
আমার জরুরি কাজ, পরদিনই ফিরতে হবে। পিলুকে ডেকে পাঠালাম। সে কয়েকটা জমি পার হয়ে আলাদা জমি কিনে পাকা বাড়ি করে আছে।
বাবার শরীর কিন্তু ভালো না পিলু।
সে তো জানি দাদা, আমি একা কী করব?
কালু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা, না হয় কল দে। বাবার রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। ধিলুকে ডেকে বললাম, বাবার কিন্তু শরীর ভালো না।
ধিলুর সোজা কথা, আমার পক্ষে সম্ভব না কিছু করা। অগত্যা আর কী করা, নিজেই ছোটাছুটি করে বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করে আসার সময় বিনিকে খবরটা দিয়ে এলাম। সাত দিনের মাথায় বিনির টেলিগ্রাম। আমাদের বাবা আর নেই।
৪.
নামের চোটে গগন ফাটে এমন সব কথা এমনিতেই পাড়াগাঁয়ে চাউর হতে সময় লাগে না। মান এবং বংশের মর্যাদা রক্ষার্থে, সব ভাইরাই বসল। দাদাও বাড়িতে চলে এসেছেন।
বললাম, দাদা, বাবার শেষ কাজ। আমরা সবাই তঁরা আত্মার সদগতির অংশীদার। তোমরা কে কী দিতে পারবে, বললে ভালো হয়।
দাদার দিকে তাকালাম, আমি ভাই হাজার টাকার বেশি দিতে পারব না।
পিলু—
দাদা আমার অবস্থা তো বুঝিস?
ধিলু—
আমরা ক্ষমতা কোথায়! মাঝে মাঝে কিছু দিস বলে এখনো দুবেলা খেতে পাই।
অগত্যা ভগ্নীপতিকে ডেকে পাঠালাম। এবং পুরোহিত ডেকে ফর্দ তৈরি হল।
আমাদের আত্মীয়স্বজন মেলা। জেঠা কাকারাও আছেন, বংশটি বড়ো, কারণ বাবা জেঠারা পাঁচ ভাই-দুই বোনও আছে, তা ছাড়া কলোনির কাজে কর্মে যারা আমাদের নিমন্ত্রণ করে তাদেরও বলা দরকার। এ ছাড়া পিলু ধিলুর শ্বশুরবাড়ির মানুষজন, কাজেই তালিকাটিতে নামের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। বাবার কাজে কোনো কার্পণ্য থাকুক আমি চাই না। বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ সহ দান-ধ্যানেরও ব্যবস্থা থাকল। বলতে গেলে ঘটা করেই কাজ সারা হল।
মৎস্যমুখ হয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে কলকাতার ফিরব। বড়ো পুত্রের বারো ক্লাসের রেজাল্ট বের হবে পরদিনই বড়ো মাটির ঘরটায় তক্তপোশে বসে আছি। মা কেমন ব্যাজার মুখ করে বলল, আমাকে আলাদা ক-টা টাকা দিয়ে যাস বাবা। স্টোভ না কিনলে আমার রান্না হবে কীসে। মন আমার আরও খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির টানে বাড়ি ফিরব ঠিক, তবে বারন্দার চেয়ারে বাবা বসে তামাক খাচ্ছেন, এই দৃশ্যটি আর চোখে পড়বে না। কেন যে চোখে জল এসে গেল। বড় বিষণ্ণ হয়ে গেলাম—বাইরে বের হয়ে অবাক, গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। কেমন চার–পাশ এবং গাছপালা সহ সমস্ত প্রাণীজগৎ যেন স্তব্ধ হয়ে আছে।
আসলে আমি বিষণ্ণতার শিকার এবং কোথাও যেন প্রাণের লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছি না।
পিলুকে ডেকে পাঠালাম।
ধিলুকেও।
শোনো, আমার মা থাকল, রুমি থাকল। এদের তোমরা দেখো। অযথা ঝগড়া করবে না। অসুবিধে হলে আমাকে জানাবে। এই যে গাছপালা বাবা লাগিয়ে গেছেন, এখন সব মহাবৃক্ষ, আম, জাম নারকেল গাছ কী নেই। নারকেল গাছ দুটো এই সে দিন বাবা লাগালেন। পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে বাবা এই গাছগুলির সঙ্গেই কথা বলেছেন, তোমাদের আচরণে তিনি তোমাদের প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, মা চোপা করলে, বাবার এককথা, এই যে গাছ লাগিয়ে গেলাম—এরাই তোমাকে দেখবে। পুত্র না মূত্র বলে তিনি আমাদের অবজ্ঞাও করতেন। যাহোক, তোমরা গাছের কিছু ধরবে না। জমিজমা যেটুকু আছে, সবই মা ভোগ করবেন।
যেহেতু ধিলু পিলুর সুবিধা-অসুবিধায় আমি আছি, তারা সুবোধ বালকের মতো বলল, তুই যা বলবি তাই হবে।
ধিলু বলল, জমি ভাগ হবে না?
না। মা যদ্দিন আছেন, এ-বাড়ির, মাসির বাড়ির কোনো জমিই ভাগ হবে না। মা যত দিন বেঁচে আছেন, তাঁর ইচ্ছে মতো জমি ভোগ করবেন। ফলপাকুড় যা তিনি তোমাদের হাতে ধরে দেবেন তাই নেবে।
তুই যা বলবি, তাই হবে।
সেই এক কথা–একেবারে একান্ত বশংবদ। ঘাড় তুলতে বললে তুলবে, ঘাড় নামাতে বললে নামাবে।
মাকে নিয়ে মুশকিল হচ্ছে, তিনি কারও ওপর প্রীত থাকলে, দু-হাত উজার করে তাকে সব দিয়ে দিতেন। রুমি আর ধিলুর বউ দুজনেরই আচরণ সাপ আর নেউলের মতো। গাছের আম জাম জামরুল, প্রতিবেশীদের ডেকে দেবেন, কিন্তু ধিলুর বউকে দেবেন না। তার ছেলেমেয়েরা গাছতলায় ঘুরে বেড়ালেও রক্ষা থাকত না।—গাছতলায় ক্যারে।
অবশ্য আমার মা কখন কার পক্ষ নেবে বলাও মুশকিল মা কীভাবে যে কার অনুগত হয়ে যান তাও বোঝা যায় না। ধিলু এক সকালে কলকাতার বাসায় এসে হাজির। মা তাকে চিঠি লিখে দিয়েছেন, আমাকে দিতে। চিঠিতে দেখি গাছ বিক্রির কথা আছে। ধিলুব খুব অভাব। আতপ চাল রাখার অজুহাতে পুলিশ তার দোকান সিজ করে দিয়েছে। তার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। থানা, পুলিশ, আদালত, সামলাতে অনেক টাকার দরকার।
লাইসেন্স না থাকলে দোকানে চাল রাখা যায় না। ধিলুর দোকান থেকে প্রায় আট কুইন্টাল চাল পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। দোকানও বন্ধ করে দিয়ে গেছে, এখন বাড়ির বাবার লাগানো গাছই একমাত্র তাকে রক্ষা করতে পারে। গাছই ভরসা।
মামলা কত দিন চলবে উকিলও বলতে পারল না পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা বুঝি, এই খরচ চালানো আমার পক্ষেও কঠিন, বললাম, তোরা যা ভালো বুঝিস করবি।
গাছ কাটা শুরু হয়ে গেল। আমারও ধিলুর জন্য দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। আমিই বা কতকাল টানব।
ধিলু দুটো বিশাল আমগাছ বিক্রি করে আপাতত শান্ত আছে। মাঝে মাঝে সে আমার বাসায় এসে বাড়ির খবর জানিয়ে যায়, হেমন্ত উকিলের ফিজ বাবদ টাকাও নিয়ে যায়—আর আমার এত অনুগত যে সে তার লেবুগাছ থেকে কিছু কাগজি লেবু নিয়ে এলেই নীরা খুশি, বাড়ির গাছের লেবু, এতেই নীরা ধন্য।
ধিলু এলেই এক কথা, জানিস দাদা মা কাঁঠাল গাছ দুটো বিক্রি করে দিয়েছে, দিদির পরামর্শে এ সব করে মা, সব টাকা রুমির নামে পাশবুকে রাখছে। আমার মেয়েটাও বড়ো হচ্ছে—আমি যাব কার কাছে! এভাবে কখনো মা, কখনো ধিলু, কখনো পিলু, আপদে বিপদে গাছই যে ভরসা—গাছ কাটতে অনুমতি না দিলে দায়টা যে আমার ঘাড়ে চাপবে বুঝি। নীরাও বোঝে, ওর এক কথা, যা খুশি করুক।
তবে যা খুশি করলেই তো হয় না। বাড়ি যাই, বাবার ঘরটায় থাকি, গাছপালা কাটা হয়ে গেলে কী যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় কেউ বোঝেই না। অজুহাতেরও শেষ নেই। ধিলু বড়ো রাস্তার ধারে বাড়ির সামনের দিকটার আছে—সে নতুন করে গাছ লাগাচ্ছে সামনের দিকটায়। মা বলল, তুই ধিলুকে গাছ লাগাতে দিস না। আমিও বুঝি, জমি দখলের চেষ্টা, বাধ্য হয়ে বললাম, জমি বন্টন নামা হয়নি, গাছ লাগাচ্ছিস তুই!
ধিলুর একেবারে দরাজ প্রাণ, জমি খালি আছে, লাগিয়ে দিচ্ছি। বন্টননামা হলে যার যার জায়গা সেই পাবে। গাছ তো কাটলে বাধা দিতে যাবে না।
অকাট্য যুক্তি। আমার বাবাও গাছ লাগাতে ভালোবাসতেন। ধিলুও গাছ লাগাতে ভালোবাসে। আমি শুধু বললাম, তুই লাগাচ্ছিস ভালো। পরে এই নিয়ে যেন ঝামেলা না হয়।
না না। তুই যা বলবি তাই হবে।
মামলা করতে গিয়েই আদালতের উকিল মুহুরিদের সঙ্গে চেনা জানা হয়ে গেল ধিলুর। সে আদালত চত্বরে ফলের কারবারিও হয়ে গেল। যে দিনের যে ফল। গরমে ডাব, শীতে আঙুর, আপেল বেদানা নেসপাতিও বিক্রি করে। আম, লিচু, কাঁঠালের সময়, লিচু বিক্রি করে, আম বিক্রি করে। বাড়ির গাছের একটা ফল থাকে না। মা শাপ-শাপান্ত করে, তোর সর্বনাশ হবে রে, তুই নির্বংশ হয়ে যাবি। রাতে আমার গাছ কে ফাঁকা করে দেয় বুঝি না! মা গেলেই নালিশ দেবে, তুই অরে কিছু বলবি না। আসলে ধিলু পিলু আমার পায়ে পায়ে বড়ো হয়েছে, ধিলুর অভাব সে দূর না করতে পারলে আমার সাধ্য কী দূর করি! ছ্যাঁচড়ামি করে যে পেট ভরে না, কলকাতার বাসায় এলে তাও টের পাই। চোখ মুখ শুকনো, যেমন সত্যি চোরের মতো চেহারা হয়ে গেছে—বাসায় ঢুকেই নীচের ঘরের খাটে লম্বা হয়ে যাবে, কথা বলবে না, স্নান করতে যাবে না, জোর করে যেন তাকে স্নানে পাঠানো হয়, খেতে বসানো হয়, রান্নার মেয়েটা পিছু লেগে থাকে। বাড়িতে যে তার স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি হয়, ঠিক মতো টাকা না পাঠালে আমাকে আত্মহত্যারও হুমকি দেয়। ধিলু আমার বাড়িতে এসে যদি কিছু করে বসে, এই এক আতঙ্কও কাজ করে। স্ত্রীর স্কুল, আমার অফিস, বউমাদেরও কলেজ না হয় হাসপাতলে ডিউটি, কাজের লোকরাই সব দেখে, রান্নার মেয়ে প্রভারই দায়—সে বার বার তাগাদা দেবে, যান কাকা, স্নানে যান, খাবেন কখন, খেতে বসুন, এবং সে খায় আবার শুয়ে থাকে, বাড়ি ফিরলে দেখি নীচের ঘরের খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আমি জানি যে অভিপ্রায়ে এসেছে, তা না মেটা পর্যন্ত স্বাভাবিক হবে না।
কীরে কী খবর?
আর খবর! মেঘার কোনও খোঁজ নাই। মেঘা তার বড়ো পুত্র।
বলিস কী!
কী যে করি! ওর মাসির বাড়ি যাব, যদি সেখানে যায়। এবং আরও নানা অছিলায় আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে যখন টাকাটি তার হস্তগত হয়, তখন আর তাকে দেখে কে! দ্রুত স্নান টান সেরে, তখন তার খাবারও সময় থাকে না, রাস্তায় খেয়ে নেবে বলে, এবং বের হয়।
মায়ের মৃত্যুর জন্যও ধিলু দায়ী এমন মনে হয় আজকাল। লিচু গাছটায় এত লিচু হয়, যে দূর থেকে মনে হয় এক থোকা মেরুন রঙের ফুল হয়ে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। লিচু চুরি যাবে বলে, রাতে মা ঘুমায় না, বার বার উঠে গিয়ে গাছটার নীচে দাঁড়ায়। হাতে লণ্ঠন, লণ্ঠন তুলে দেখারও চেষ্টা করে। হনুমানেরও উৎপাত আছে, তবে মা আসল হনুমানের চেয়ে ধিলুকেই ভয় পায় বেশি। দুপুরে পর্যন্ত ঘুমায় না, গাছতলায় বসে থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাস, বৃষ্টি নেই হাওয়া আগুনের মতো গরম এবং যেন লু বয়, যত কষ্টই হোক মা লিচুগাছ পাহারা দেবেই। এবং এই করে গাছতলা থেকে বারান্দায় উঠে চেঁচায়, এক গ্লাস জল দে রুমি। বলে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে, রুমি জল নিয়ে এসে দেখে ঠাম্মা, কাত হয়ে পড়ে আছে। কোনো হুস নেই মার। তাঁর আর হুস ফিরেও আসেনি। মা বোধহয় বুঝেছিলেন, যে কটা টাকা পাওয়া যায় লিচু বিক্রি করে, রুমির পাশ-বুকে রেখে দেবেন। মা যে আমার রুমি-অন্ত প্রাণ। রুমির বিয়ে না হোক, তার নামে ব্যাঙ্কে অনেক টাকা জমা রাখার স্বপ্ন দেখতেন মা। সেই স্বপ্নও আমার মা-র শেষ হয়ে গেল।
তারপর যা হয় বাড়িটা আবার আত্মীয়স্বজনে ভরে যায়।
মাটির আটচালা ঘরটির তক্তপোশে শুয়ে কত কথা যে ভাবি, এই মা, আর আমরা তার এই পুত্র। কষ্ট হয়—মায়ের কাজ-কামও ঘটা করে করতে হয়, কারণ তিনি যে বিলুঠাকুরণের মা।
আটচালা টিনের ঘরটাতে গেলেই থাকি। একবার গিয়ে দেখি বড়ো তক্তপোশটা নেই।
ধিলু বলল, বড়ো তক্তপোশটা দুই ভাই ভাগ করে কেটে তাদের ঘরে তুলে নিয়ে গেছে।
কী আর বলি! তবে ছোটো তক্তপোশটা আছে। গেলে সেখানেই শুই। সে ঘরেই থাকি চাল ডাল তেল নুন এক মাসের মতো ধিলুকে কিনে দিই। সকালে ভালমন্দ বাজারও করি। দুবেলা ধিলুর বউই রান্না করে খাওয়ায়। বাড়িতে গাছ বলতে আর বিশেষ কিছু নেই, শুধু জঙ্গল, নারকেল গাছ দুটো শুধু আছে।
নিরানব্বই সালের বন্যায় আমার প্রিয় সেই টিনের আধচালা ঘরটির খুব ক্ষতি হয়। ধিলুর ঘরটিরই বেশি ক্ষতি হবার কথা। নীচু জমিতে তার ঘর। অথচ ধিলুর ফোন পেলাম, সে জানাল, মাটির দেয়াল ফেটে একটা দিক ধসে গেছে। বড়োই ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম, ঘরটি মেরামত না হলে বাড়িতে গিয়ে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। বাবা-মা এবং আমরা থেকেছি, সব ভাইবোনেরা এই ঘরটায় বড়ো হয়েছি। এই ঘরেই বাবার মৃত্যু হয়েছে, মাও গত হয়েছেন এই ঘরে। এ তো ঘর নয়, আমার পরমায়ুর প্রাসাদ—ইট গেঁথে পাকা করারও সুযোগ নেই কারণ মাটির ঘরের সৌন্দর্য পাকা বাড়িতে থাকে না। বাবা কিংবা মায়ের কারও ইচ্ছাই ছিল না ঘরটি পাকা হোক।
এই ঘরের মেরামত উপলক্ষেও ধিলু যথেষ্ট টাকাপয়সা নিয়ে গেছে। আশায় আছি, ঘরটি থাকার উপযুক্ত হয়ে ধিলু ফোন করে জানাবে। বাড়ির পাশেই এস টি ডি বুথ থেকে আজকাল সবাই ফোন করে থাকে। আমার বোন বিনি জানাল, দাদা তুই আর টাকা দিস না। তুইও ফতুর হয়ে যাবি।
সত্যি তো দু-তিন মাস হয়ে গেল, নিজের চোখেই একবার দেখে আসা যাক। গিয়ে দেখি ঘরটা আছে। তবে দেয়াল মেরামত হয়নি। ছোট্ট তক্তপোশটাও হাওয়া।
বললাম, মেঝেতেই থাকা যাবে। তোর দুই ছেলে তো এ ঘরে থাকে বলেছিলি।
ধিলুর মুখ করুণ।
ধিলুর বড়ো পুত্র মেঘা বলল, তুমি থাকবে। এই সে দিন একটা এত্ত বড়ো মোটা চিতি ফুলগাছটা থেকে লাফিয়ে পড়ল টিনের চালে। ভয়ে আর আমরা ঘরটায় শুই না।
ধিলু বলল, ঘরে বাড়ির সেই বাস্তু সাপটা আশ্রয় নিয়ে আছে। রাত-বিরেতে পা পড়লে–
পিলু এসে বলল, দাদা, তুই আমার বাড়ি চল। এ ঘরে থাকা ঠিক হবে না। মেঝেতে শুবি কী করে!
ঘরে ঢুকে দেখলাম, দেয়ালের দুরবস্থা। টিনের চাল একদিকে কাত হয়ে আছে।
ঘরটায় আমি থাকলে দখল-স্বত্ব থাকত। ধিলু ঠিক পরিকল্পনামাফিক আমাকে উৎখাত করছে। সব বুঝি। কিন্তু ধিলুকে দেখে আমার কষ্টই হল, সেই লুঙ্গি-পরা বাসি দাঁড়ি গালে।
ধিলু বলল দাদা তুই আমার বারান্দায় থাক। কোনো অসুবিধা হবে না। আমার বাড়িতে লাইট এসেছে। তোর অসুবিধা হবে না। ধিলুর বউ মেয়ে খুব আদর যত্নের মধ্যেই রাখল। খেতে বসলে বউমা বলল, আপনার ভাইঝির বিয়ের কী করবেন। আপনি মাথা না পাতলে আমাদের সাধ্য আছে বিয়ে দিই। নগদই আঠারো হাজার টাকা চায়— তারপর দানসামগ্রী। তা ছাড়া ধিলু বাইরে ডেকে বলল, দাদা বংশের মান সম্মান আর থাকবে না। তোর ভাইঝি এস টি ডি-র ছোকরাটার সঙ্গে পালাবার ধান্দা করছে। আমাকে রক্ষা কর দাদা।
মনে মনে ভাবলাম, এরা আমাকে কী পেয়েছে। আমি পাগল, না ভাইদের উপসারী একজন দানব। আমারও তো সংসার আছে। যদিও আমার পুত্ররা কৃতী তবু কেন যে মনে হল কোনো ছলনা আমাকে গ্রাস করছে।
ন্যাড়া আর বেলতলায় যায়!
বিনি আমাকে ফোনে জানাল, খবরদার দাদা, টাকা দিবি না। তার আগে জমি বন্টননামা করে নে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে, ধিলু তোদের কিন্তু জমির দখল দেবে না। বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।
পরদিনই চলে এলাম। আসার আগে সারা বাড়ির কোথায় কী গাছ ছিল মনে করার চেষ্টা করলাম। এক জীবনে একটা বাড়ি ছারখার হয়ে যেতে পারে, আমাদের সেই টিনের আটচালা ঘরটি না দেখলে অনুমান করাই কঠিন। রাস্তায় রিকশায় তুলে দেবার সময়ে ধিলু বলল, দাদা তুই পঁচিশ হাজার টাকা দিলেই হবে। আর তোর কাছে আমি কোনো দিন টাকা চাইব না।
কোনো কথা না বলে রওনা হয়ে রাতের দিকে বাড়ি ফিরে এলাম। অবাক, এসে দেখি ধিল আমার আগেই কীভাবে বাসায় পৌঁছে গেছে। সে আমার ছোটো পুত্রকে রাজি করিয়েও ফেলেছে। আর ছোটো পুত্রের কথা কখনোই আমি অগ্রাহ্য করি না। তবু কোথায় যেন এক প্রতারকের পাল্লায় পড়ে গেছি এমন মনে হল আমার।
মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই, পিলুকে ধিলু শাসিয়ে গেছে, যে বাড়ি ঢুকবে দখল নিতে লাশ ফেলে দেব। আমাকেও সে ফোনে একই হুমকি দিয়েছে।
জমির দর বাড়ছে। ত্রিশ হাজার টাকা কাঠা। তিন বিঘা জমির দু-বিঘে তার, আর এক বিঘে আমরা ইচ্ছে করলে পাঁচ ভাইবোন নিতে পারি। সেই পিতার প্রকৃত অধিকারী তার দাবি। সবাই উড়ে গেছে, সেই একমাত্র এই বাড়িতে বসবাস করছে। তা ছাড়া জমি, আমার বাবার অনুমতি দখল, বলতে গেলে খাস জমি—সে, তার দুই পুত্র এবং কন্যা মিলে পাঁচ কাঠা করে কুড়ি কাঠা জমির আইনত উত্তরাধিকারী—তারা এখানে বাড়ি করে আছে। কে হঠায়!
ছোটো পুত্র শুধু বলল, একবার দেশ থেকে উচ্ছেদ, দ্বিতীয়বার পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ। ভালোই হল।
সারা জীবন দাদার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার চেয়ে এ যে এক আশ্চর্য মুক্তি, আমার তা কে বোঝে!
উষ্ণতার ঐশ্বর্য
প্রকাশকরাও কম বড়ো মাপের মানুষ নয়—
শ্রাবণীর এমন বলায় নরেন্দু কিছুক্ষণ পুঁদ হয়ে বসে ছিল। শ্রাবণী মাসে-দুমাসে অন্তত এক-দু-বার তার দোকানে ঢুঁ মারবেই।
বই-এর খোঁজে আসে নতুন পুরোন। আজকাল প্রবন্ধ, সমালোচনা লেখার লেখকই মেলে না। উপন্যাসের কালান্তর বইটি খুঁজতে এসেই প্রথম তার আলাপ নবেন্দুর সঙ্গে।
শ্রাবণী বইটির পৃষ্ঠা উলটে দেখার সময় বলেছিল, আপনাদের এ-রকম আর কী বই আছে?
নবেন্দু তাদের একটি পুস্তক-তালিকা দিয়ে বলেছিল, দেখুন আপনার পছন্দমতো আর কোনও বই পান কি না।
শ্রাবণী প্রবন্ধের তালিকাটি দেখে তাজ্জব। এত বই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটোগল্পের উপর সমালোচনার বইটি দেখতে চাইলে বলেছিল, ওটা নেই। আউট অব প্রিন্ট।
আউট অব প্রিন্ট!
আজ্ঞে। ছাপতে গেছে।
তা হলে আবার এলে পাব।
তা বলতে পারি না।
মানে!
মানে ওই একটাই। কালই যদি আসেন পাবেন না। দেরি হবে ছাপতে। কাজেই আবার।
এলেই পাবেন, কথা দিতে পারছি না সেটা কবে কত দিন পরে আসছেন। জানতে পারলে ভালো হয়।
এই সব কথার মধ্যে কিছুটা কৌতুক লুকিয়ে থাকায় শ্রাবণী হেসেছিল।
হাসছেন যে!
শ্রাবণী বলেছিল, আপনার রসবোধ আছে।
সাধারণত কাউন্টার পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি থাকে না। শ্রাবণী কাউন্টারে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে যেন কিছুটা মজা ছুড়ে দিয়েছিল।
দেখুন না যদি কোনও স্পয়েলড কপিটপি থাকে।
স্পয়েলড কপি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভিতরে এসে খুঁজে নিন। প্রসন্ন দেশে গেছে—তিনি বলতে পারতেন। থাকলেও আমার পক্ষে খুঁজে বের করা কঠিন। কাল আসুন না।
কাল হবে না।
কেন? কোনও অসুবিধা আছে?
আমি তো পাঁচটার ট্রেন ধরব। ওটাই আমার লাস্ট ট্রেন।
কী ভেবে নবেন্দু বলেছিল, ভিতরে এসে বসুন। সুধীর আসুক। দেখি। পাঁচটা বাজতে অনেক দেরি। কাছেই স্টেশন। ট্রেন ধরতে অসুবিধা হবে না।
নবেন্দু ফের বলল, কোথায় থাকেন?
থাকি তো দূরে, মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে কলেজ স্ট্রিটে ঢুঁ মারতে না পারলে পেটের ভাত হজম হয় না।
সুধীর দোকানে ঢুকে দেখেছিল, ছিমছাম লম্বা এবং ভারি সুন্দর একজন যুবতী ভিতরের দিকের চেয়ারে বসে কী একটা বই উলটে পালটে দেখছে।
কোথায় ছিলি এতক্ষণ! একবার বের হলে ফিরতে চাস না।
সুধীর কাঁচুমাচু গলায় বলল, ধীরেনবাবু যে বললেন, বসতে হবে। উপন্যাস সংকলনের কভারের কিছু কাজ বাকি। বসে, করিয়ে নিয়ে এলাম।
উদ্ধার করেছিস। যা চা নিয়ে আয়। আপনি কিছু খাবেন? পাঁচটায় ট্রেন, কখন পৌছবেন? আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসুক।
প্রকাশকরাও কম বড়ো মাপের মানুষ নয় মেয়েটির এমন মন্তব্যে সে কিছুটা সত্যি বিগলিত।
ঘুরে ফিরে একই রকমের ভাঙা। প্র
কাশকরা ঠগ জোচ্চর, বেশি বই ছাপে, গাড়ি-বাড়ি করে, লেখকরা খেতে পায়। প্রাপ্য রয়েলটি ফাঁকি দেবার নানা ধান্দা—কি শ্রাবণীর কাছে প্রকাশকরাও বড়ো মাপের মানুষ রেকর্ডের মতো কানে বাজছিল তার।
প্রকাশকরা অবশ্য সবাই সাধু নয়, শ্রাবণীর জানা উচিত। অসাধু প্রকাশকেরও অভাব নেই। তবে সবাই অসাধু এটাও বলা যায় না। নরেন্দুও এমন ভাবল।
লেখকের দুঃসময়ে প্রকাশকই ভরসা। বিপদে-আপদে ছোটাছুটি যতটা পারা যায়—লেখককে ভারমুক্ত করার ঘটনাও বিরল নয়। কত প্রকাশকের ভালো বই প্রকাশের নেশা হয়ে যায়। পেশার চেয়ে নেশা প্রবল হলে যা হয়, কেউ আবার সর্বস্বান্তও হয়—বই-এর বাজার সব সময়ই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে—বিশেষ করে গল্পউপন্যাসের ক্ষেত্রে বাজার ধরে গেলে পয়সা, সে আর কটা বই!
তার বাবা তো নানা দিক ভেবেই তাঁর দোকান চালু রাখার জন্য গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে স্কুল-বইও করতেন। এতে খুব একটা মার নেই। ঠিকমতো বই ধরাতে পারলে দুটো পয়সাও হয়। তবে ভালো গল্প-উপন্যাসের বই না থাকলে প্রকাশক জাতে ওঠে না, তার বাবা এটা ভালোই বুঝেছিলেন—আর অপরিসীম ধৈর্য লেখককে খুশি রাখা, কাগজ আনা থেকে বাইন্ডার কাকে না খুশি রাখতে হয়! এক-একটা বই ছেপে বের হবার পর সে দেখেছে, বাবা কী নিশ্চিন্ত। বই-এর প্রোডাকশান-মলাটের ছবি থেকে ব্লক, সর্বত্র তাঁর সতর্ক নজর।
বাবার মাথায় বই ছাড়া কিছু থাকত না।
দোকানে এসে বসতে পারলেই তাঁর মুক্তি। এই ব্যবসাটি বাবা প্রায় পুত্রস্নেহে যেন লালন-পালন করছেন। অসুখে-বিসুখেও বাড়িতে বসে থাকার লোক ছিলেন না তিনি। এই নিয়ে তার মায়ের সঙ্গে তিক্ততাও সৃষ্টি হত।
আরে, এই শরীর নিয়ে তুমি দোকানে যাবে।
কী হয়েছে আমার।
কী হবে আবার! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, বলছ কী হয়েছে তোমার।
এমন এক-আধটুক সবারই শরীর খারাপ হয়। দোকানে বসলে দশটা লোকের সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে, বই-এর কাস্টমারদের সঙ্গে কথা বলারও আনন্দ আছে জানো। সমস্ত জীবন প্রাণ নিয়ে আট বাই দশ ফুটের ঘরটি যে আমার অস্তিত্ব। দোকানে ঢুকলেই আমার শরীর হালকা, মন হালকা, তুমি ঠিক বুঝবে না।
অগত্যা যাবেই।
নবেন্দু তখন কলেজে পড়ে।
যা তোর বাবার সঙ্গে। এই শরীর নিয়ে একা যাওয়া ঠিক হবে না। আরে না না, আমি একাই যেতে পারব। নবেন্দু তুই আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে যা। শ্রাবণীর কথায় মনে হল সত্যি তো, প্রকাশকরাও কম বড়ো মাপের মানুষ না, শ্রাবণী যেন বাবার সম্পর্কে তার চোখ খুলে দিয়েছে।
শ্রাবণী এলে বই নিয়েই বেশি আলোচনা হত। মোহিতলাল মজুমদারের সব বই-ই আছে দেখছি। একসঙ্গে কিনতে পারব না। সারের বইও করেছেন।
সার মানে।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
হ্যাঁ আছে, তাঁর কিছু বই আমরা করেছি।
তিনি এখানে আসেন!
এ পাড়ায় এলে ঢুঁ মেরে যান।
আরও সব প্রিয় লেখকও এখানে আসে শুনে, যদি দেখা হয়ে যায় এই আশাতেই শ্রাবণী বইপাড়ায় এলে এই দোকানে ঢুঁ না মেরে যাবে না।
একদিন নবেন্দু না বলে পারেনি, আপনার এত প্রবন্ধের বই কেনার আগ্রহ কেন বলুন তো! সমালোচনার বইও কেনেন দেখছি। কত প্রিয় কবির দেখা হবে ভেবে এখানে ফাঁক পেলেই আসেন। গল্পের বইও তো আমাদের কম নেই, কখনও গল্প-উপন্যাস কিনতে দেখলাম না। আপনি কী থিসিস নিয়ে ব্যস্ত আছেন। থিসিস যারা করেন, তাদের দু-একজনের সঙ্গে তার আলাপ আছে বলেই এই ধারণা। তারা শুধু প্রবন্ধের বই কেনে।
ওই আর কী। প্রাবণীর অভ্যাস সব বই দেখেটেখে মাত্র একটি দুটি বই কিনবে। ঘরের সংলগ্ন পেছনের ঘরটায় শ্রাবণী আজকাল এলে নিজেই ঢুকে যায়। ঘরটা নিরিবিলি। সুদেববাবু প্রুফের বাণ্ডিল জড়ো করে বসে থাকেন। সে তার পছন্দমতো বই নিয়ে কিছুটা পড়ে—কারণ তার পাঁচটায় ট্রেন বলে ছাত্রীদের বই কেনার পর অথবা নিজের দরকারি বই সংগ্রহ করার পর নবেন্দুর দোকানে এসে বসে। মাঝে মাঝে কথা হয়।
এবং কিছুটা যেন নবেন্দুর উপর সে নির্ভর করতে শিখেছে।
দেখুন তো এই বইটা পেলাম না। যদি পান।
আপনি বসুন, দেখছি।
এ-ভাবে নবেন্দুর সঙ্গে পরিচয়।
ট্রেনে কত দূরে যান?
বহরমপুর।
সেখানে বাড়ি?
তা বাড়িই বলতে পারেন। কলেজে দিদির কোয়ার্টারে থাকি।
বহরমপুর গার্লস কলেজ।
ওই আর কী।
কলেজের মণিদাকে চেনেন?
শ্রাবণী কিছুটা যেন চমকে গেল। মুখেচোখে তার কেমন একটা অপরাধবোধ জেগে যাওয়ায় মাথা নীচু করে ফেলল। নবেন্দু কাজ করে আর কথা বলে।
বই দেখুন ঠিক আছে কিনা। পাঁচ খণ্ড অবিরাম জলস্রোত, তিনটে দুঃখিনী মা, দুটো সোনার মহিমা—এবং রসিদ কেটে টাকা গুনে নেবার সময়ই তার যত কথা।
শ্রাবণীর সঙ্গে কথা বলতে তার ভালোই লাগে।
আপনি কি কলেজে পড়ান?
বাংলা পড়াই।
আজকাল তো স্লেট না নেট কীসব পরীক্ষা দিতে হয়।
শ্রাবণী ঘড়ি দেখছিল।
আরে সময় হয়নি। সুধীরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
এবং শ্রাবণী বোঝে নবেন্দু তার সুবিধা-অসুবিধা খুব বোঝে।
সুধীর শুধু টিকিটই কেটে দেয় না, ট্রেন এলে সিটে বসে থেকে শ্রাবণীদির জন্য প্রায় সিট রিজার্ভ করে রাখে। শ্রাবণীদি দীর্ঘাঙ্গী বলে প্ল্যাটফরমে সহজেই তাকে আবিষ্কার করা যায়। সে জানালা দিয়ে মুখ গলিয়ে চেঁচাবে, শ্রাবণীদি, এদিকে, এদিকে। এই যে আমি, সে জানালার বাইরে হাত গলিয়ে চেঁচায়।
কথায় কথায় নানা কথা হত। অবশ্য নবেন্দুর আদ্ভুত স্বভাব। সে কখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। ওই প্রথম দিনই যা চোখ তুলে বলেছিল, কী বই বললেন? মেয়েদের দিকে তাকালে কি কোনও অপরাধবোধ কাজ করে? কিংবা মেয়েদের সম্পর্কে খুবই লাজুক-শ্রাবণী মনে মনে না হেসে পারে না। সে তো নবেন্দুর নাড়ি-নক্ষত্রের সব খবরই রাখে।
হাটেবাজারে।
এটা আমাদের বই নয়।
চিরকুট দিলেও নবেন্দু তাকাত।
ও আপনি!
সে কাউন্টারের কাঠ তুলে তাকে ঢুকতে বলত।
ওই একবারই, তারপর সে কখনও দেখে না, নবেন্দু তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। কাজের ভিড়ে বেশি কথাও হয় না।
নবেন্দু কি মেয়েদের পছন্দ করে না! স্ত্রী মণিকা তাকে ছেড়ে যাওয়ায় কি সে
মেয়েদের ঘৃণা করে!
নবেন্দু খুবই চাপা স্বভাবের মানুষ। খুব বেশি দিলখোলা নয়। সেটুকু কাজ তার বাইরে কোনও কথাই হত না। তবু দেখেছে, দেয়ালের ফটোটি খুঁটিয়ে দেখলে নবেন্দু বোধহয় খুশি হত। একজন প্রৌঢ় মতো মানুষ, কেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখমুখ–
আপনার বাবা।
আজ্ঞে।
পরিচয়ের প্রথম দিকে এসব কথা হত।
আপনার বাবা খুব রাশভারি মানুষ ছিলেন!
মোটেও না। দিলখোলা মানুষ সব সময়।
মানুষজন নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। বিপদে আপদে তিনি সবার বেলাতেই আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, কোথায় কার কাছে গেলে কাজ উদ্ধার করা যাবে দরকারে হাসপাতাল পর্যন্ত ভর্তি করে দিতেন।
তার পরই থেমে বলত, বাবার মাথায় অবশ্য বই ছাড়া কিছু থাকত না। দোকানেও বই, বাড়িতেও থলে ভর্তি প্রুফ। এক দণ্ড বসে থাকতেন না।
শ্রাবণী বোঝে নবেন্দু তার বাবা মানুষটির জীবন সম্পর্কে ভারি অহংকারী।
সে দেখেছে, বাবার কথা উঠলেই নবেন্দু তার নিজের কাজের কথাও ভুলে যেত। এত বড় প্রকাশনের মালিক, অথচ এক সময় তার বাবাকে বই ফিরি করতে হত—সেই ফেরিওয়ালা এই বইপাড়ায় জাতে উঠতে কত না পরিশ্রম করেছেন। আসলে অপরিসীম ধৈর্য-প্রুফরিডারদের হাতেই তিনি সব ছেড়ে দিতেন না। প্রিন্ট অর্ডারের আগে নিজে খুঁটিয়ে পড়তেন—কোথায় না আবার ছাড় যায়। বানান নিয়েও ঝামেলা কম না—এক-একজন লেখক এক-এক রকম বানান পছন্দ করেন। সে তার বাবার উদয়াস্ত পরিশ্রম দেখে ভেবেছিল, আর যেই আসুক সে অন্তত বই-এর লাইনে আসছে না। কলেজে কাজটাজ নিয়ে, অথবা অন্য কোনও ব্যবসায় নেমে যাবে।
হল কই।
বাবা বলতেন পরের গোলামি নাই করলে। বই-এর ব্যবসায় সৃষ্টির আনন্দ আছে।
নবেন্দু দোকানে বসত, তবে কোনও আকর্ষণ বোধ করত না। কী আছে। দিনরাত তাগাদা। এখানে যাও, ওর সঙ্গে কথা বলো। অমুক লেখক রাজি হয়েছেন বই দেবেন। যাও তার কাছে। সে তখন এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগত। সবার কাছে জো-হুজুর হয়ে থাকা কাঁহাতক ভালো লাগে। লেখকরা কেউ কেউ এমনও বলত, হবে না। তোমরা বই ভালো চালাতে পারো না। ঠিকঠাক হিসাব পাচ্ছি কোথায়।
সে এসে ক্ষোভে দুঃখে বলত, আমাকে আর পাঠাবেন না। আপনি ইচ্ছে হয় যান। ঠিকঠাক হিসাব দিয়ে আসুন গে।
বাবা বালকের মতো হেসে ফেলতেন।–আরে কান ভাঙানোর লোকের তো অভাব নেই। তাঁরা বলতেই পারেন। উপন্যাস গল্প লেখা কি চাট্টিখানি কথা। তুই পারবি, না আমি পারব। প্রতিভা না থাকলে হয় না। এরা হলেন দেবী সরস্বতীর বরপুত্র। ওদের গালাগাল খেলেও পুণ্য হয়, বোঝে।
শ্রাবণী এই আসা যাওয়ায় কত কিছু যে জেনেছে। যত জেনেছে তত দিব্যেন্দু এবং তার পরিবারের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে। আজকাল মাঝে মাঝে কাজ না থাকলেও এই বইপাড়ায় চলে আসে। কোনও পারিবারিক উৎসবে অনুষ্ঠানে কাছাকাছি, এই যেমন বেলেঘাটা কিংবা সোদপুর, কখনও টিটাগড় এলে কোনও কোনও অজুহাতে নবেন্দুর দোকানে ঢুকে যেত। কলেজ লাইব্রেরির জন্য বাজারে ভালো বই বের হলে সংগ্রহ করত। কখনও বই কেনে, আবার কেনেও —দরকারে চিঠি লিখলেই নবেন্দু কারও হাতে বই পাঠিয়ে দেয়। বই কিনতে যারা দোকানে আসে তাদের বলে দিলেই হল, এই অজিত শোনো। তারপর অজিতকে বই-এর প্যাকেটটি এগিয়ে দিলেই হল, অজিত বুঝে নেয়, লালদিঘির পারে মেয়েদের কলেজের শ্রাবণীদির প্যাকেট। শ্রাবণীদিও আদ্ভুত, কী করে যে জানাজানি হয়ে গেছে, তাকে দিলেই কমিশনে বই আনিয়ে দিতে পারে। স্কুল বইয়ের বেলায় সে মাঝে মাঝে নবেন্দর হয়ে নানা স্কুলে চিঠিও লিখে দেয়, আট দশ বছর হয়ে গেল সে কলেজে পড়াচ্ছে, তার ছাত্রীরা শহরের স্কুলে কিংবা গাঁয়ের স্কুলে অনেকেই শিক্ষয়িত্রীর কাজ পেয়ে গেছে, নবেন্দুর লোক তার কাছে গেলেই বোঝে সিজনের সময়, নিশ্চয় নবেন্দুর হয়ে চিঠি লিখে দিতে হবে—স্কুলে বইটি যদি পাঠ্য করা যায়।
তা ছাড়া নবেন্দুর কিছু গল্প-উপন্যাস হটকেক–নবেন্দু বলে এগুলি আমার সোনার খনি। বাবার দূরদৃষ্টিতে সব হয়েছে।
আমাদের দুটো উপন্যাসের যে চাহিদা হয়েছে, এবং নানা পত্রপত্রিকায় বই দুটোর সম্পর্কে লেখালেখি বলুন, লেখকের পুরস্কৃত হওয়া—সবই মণিদার কল্যাণে। মণিদা বাবার হিতৈষী। অথচ মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। মণিদার কথা উঠলেই শ্রাবণী কেমন অতল জলে ডুবে যায়। কতকাল পর একজন পুরুষমানুষকে তার ভালো লাগছে—সেই মানুষটা যদি জেনে যায় সব। যদি সে ধরা পড়ে যায়।
তবু আজ অনেক সাহস সঞ্চয় করে শ্রাবণী বলল, উনি তো শহরে থাকেন না। পার্টির কাজে গাঁয়েগঞ্জেও ঘুরে বেড়ান শুনেছি। তিনি কি এখানে আসেন?
আদ্ভুত মানুষ, আমরা আশা করতাম তিনি আসবেন— কি আর আসেননি। শুধু একবার বাবাকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, পাণ্ডুলিপি তিনি পাঠিয়ে দেবেন। লেখক নিজেই যাবেন।
এবং লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে গেলে বলতে গেলে চোখ বুজেই বাবা প্রেসে দিয়েছিলেন ছাপাতে। বাবা পরে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলেন জানি, তবে তার উত্তর পাওয়ায় আগেই—
উত্তর আর আসেনি?
না।
আপনি মণিদাকে চেনেন?
শ্রাবণী চা খাচ্ছিল। কোনও জবাব দিল না।
হঠাৎ নবেন্দু কেন যে বলল, এবারের বুক সিজনে ভাবছি ও দিকটা আমি নিজেই একবার ঘুরে আসব। পুরনো এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে হয় না–কিছু পারিবারিক বিপর্যয়ে প্রকাশনার কাজ থিতিয়ে এসেছিল। এখন আপনাদের সবার সহযোগিতায় মনে হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঠিক চালিয়ে যাওয়াই আমার বড়ো কাজ।
মন বসেছে।
বসে তো উপায় নেই। বাবা আমার জন্য ভেবে ভেবেই মরে গেলেন।
কী বলছেন।
ঠিকই বলছি।
তার পরই নবেন্দু কেমন সতর্ক হয়ে গেল। পারিবারিক বিপর্যয় কথাটা বলা ঠিক হয়নি। শ্রাবণী এলে তারও ভালো লাগে। বাড়িতে মা এবং মাসি মামারা বারবার বলেছে, একবার বাড়িতে আসতে বল না। আত্মীয়তা তৈরি করতে হয়। মানুষের সম্পর্ক কী হযে একমাত্র মানুষই ঠিক করতে পারে। একজনকে দিয়ে সবাইকে বিচার করিস না।
অতটা দুঃসাহস তার নেই নবেন্দু ভালোই জানে। বরং শ্রাবণীর আর কে কে আছে, আজকাল মেয়েদের বোঝা মুশকিল, বিবাহিত বা কুমারী। কারণ অনেক আধুনিকাই শাখা-সিঁদুর নারী স্বাধীনতার নামে বিসর্জন দিয়েছেন।
শ্রাবণী না এলে নবেন্দু টেরই পেত না, একজন প্রকাশকও লেখকের প্রতিটি হরফের প্রতি সতর্ক নজর রাখে। লেখকরা লেখক হয় প্রকাশকের পরিশ্রমের গুণে। শ্রাবণী কী টের পেয়েছিল এই থরে থরে সাজানো বই-এর ঘ্রাণ তার বাবা না থাকলে সে বুঝতে পারত না। কতটা গভীর মনঃসংযোগ থাকলে, এটা হয়, টের পেয়েই হয়তো তার বাবাকে এত বড়ো কথা—প্রকাশকেরাও কম বড়ো মাপের মানুষ ভাবেন কী করে। প্রকাশনার কাজ যথেষ্ট গৌরবের। বাবার বই-এর দোকান নিয়ে এতটা অবহেলা দেখানো আপনার উচিত হয়নি। আর কণিকা বইয়ের মর্মই বুঝল না। এটা কোনও ব্যবসা!
আসলে সেই থেকেই কি নবেন্দুর এত টান জন্মে গেল প্রকাশনার প্রতি। শ্রাবণী এলে যেন বুঝতে পারে, তার বাবার মতোই সে এই প্রকাশনের শ্রীবৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ খাটছে।
সেই থেকেই তার কি শ্রাবণীর প্রতিও টান জন্মে গেল।
সে তো নিজে গিয়ে বইতে শ্রাবণীর প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ নিয়েছে।
সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই চিঠিও দিয়েছিল।
শ্রাবণী আপনার অনুরোধ রক্ষা করা গেছে। সুযোগসুবিধা মতো বইগুলি নিয়ে যাবেন। রেফারেন্স সংক্রান্ত বই দুটো বাজারে পাওয়া যায়নি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আশা করি বই দুটো সংগ্রহ করতে পারব। আশা করি একা একা দিনগুলি বই আর ফুল নিয়ে বেশ কেটে যাবে। আপনি যে বলেছিলেন বই আর ফুলের মতো এত পবিত্র আর কিছু হয় না।
তার পর লিখে ভাবল, না এসব লেখা ঠিক না। সম্পর্কের জোর চাই। এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যে সে সম্পর্কের জোরের ওপর কোনও দাবি করতে পারে।
কোনো সম্পর্কই ছিল না।
এতদিন পরও কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে সে তেমন কিছু ভাবতে পারত না। কি চিঠি লিখতে গিয়ে বুঝল, সম্পর্কের জোর না থাকলে এত বড়ো কথা অনায়াসে চিঠিতে লিখতে পারত না। জীবনের অন্তরালে কখন যে কীভাবে নতুন জীবন তৈরি হয় সে জানেই না।
সে যাই হোক নবেন্দু শেষ পর্যন্ত শেষ লাইন দুটো কেটে দিল। তার দুর্বলতা ধরা পড়ে গেলে সে খাটো হয়ে যাবে।
তারপর মনে হয়েছিল, কাটাকুটিও সংশয়ের উদ্রেক করতে পারে। নবেন্দু কী লিখল—আবার কেটে দিল—কেন কেটে দিল–কৌতূহল হতে পারে এবং লেখা উদ্ধারের প্রাণান্তকর চেষ্টায় এক সময় যদি ভেবে ফেলে—লোকটা সুবিধের নয়। বাজে লোক।
ফের নতুন করে চিঠিটা লিখেছিল।
সাদামাঠা চিঠি। কোনও কাটাকুটি নেই।
তারপরই মনে হয়েছিল সে তো খারাপ কিছু লেখেনি।
বোকার মতো কাটতে গেল কেন!
একা একা দিনগুলি বই আর ফুল নিয়ে বেশ কেটে যাবে। কবিতার মতো শুনতে। ভালোবাসলে কবিতা আসে। তবে চিঠিতে একজন পরিচিত নারীকে কবিত্ব প্রকাশ করলে সে অন্য রকম ভাবতেই পারে।
শেষে ভেবেছিল, সম্পর্কের জোর না থাকলে দোষের হতে কতক্ষণ!
ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসিও ফুটে উঠতে পারে।
চিঠিতে আবার কবিত্ব ফলানো হয়েছে। না, কেটে দিয়ে সে ঠিকই করেছে। তাকে কেউ উজবুক ভেবে মনে মনে মজা পাক সে তা চায় না।
শ্রাবণী চিঠির উত্তরে লিখেছিল, অনেক ধন্যবাদ। কষ্ট করে লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করার জন্যও ধন্যবাদ। আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল। তবে নিজে যেতে পারছি না। অফিসের সন্ধ্যাদি যাবে। ছুটিতে দেশে গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আগরপাড়ার দিকে থাকে। তাকে একটা হাতচিঠি দিয়ে দেব। বিশ্বাসী এবং নির্ভরযোগ্য।
চিঠি পেয়ে নবেন্দু খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল। চিঠিতে যেন বিন্দুমাত্র আকুলতার ছাপ নেই।
চিঠি পেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসবে এমন মনে হয়েছিল। লেখকদের সম্পর্কে শ্রাবণীর দুর্বলতা যে যথেষ্ট, তাদের অটোগ্রাফ পেলে সে যে বর্তে যায়, অথচ বইগুলি সম্পর্কে তার এখন যেন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ছুটিতে সন্ধ্যাদি যাবে, তার হাতে দিলেও হবে। কিছুটা অপমানজনকও মনে হল।
শ্রাবণী চিঠি পেলেই চলে আসবে এমন ভেবে নিজের ড্রয়ারে যত্ন করে বই কটা রেখে দিয়েছিল। মেলা বই-এর মধ্যে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তারপর মনে হল কাউন্টারে কিংবা ড্রয়ারে যেখানেই প্যাকেট থাকুক গোলমাল হবার কথা না, তার লোকজন এতটা কেউ নির্বোধ নয়। শ্রাবণীর বেলায় এতটা ত্রাস কেন মনে চেপে বসেছিল এতক্ষণে যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ত্রাস ছিল শ্রাবণীর এই দুর্মূল্য বইগুলি না আবার হারিয়ে যায়।
শ্রাবণী না আবার রাস্তা হারায়।
শ্রাবণী না আবার তাকে ভুল বোঝে। তার এত বেশি আগ্রহ শ্রাবণীর কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে।
সে যে কী করে।
বাজার খারাপ, কাউন্টারে ভিড় কম।
সে সুধীরকে ডেকে বলল, এই অসীমবাবুকে ও-ঘর থেকে ডেকে আন।
অসীমবাবুকে ও-ঘর থেকে ডেকে আন।
অসীমবাবু এলে নবেন্দু বলল, আমি কাল পরশু আসছি না।
কেন! শরীর খারাপ?
শরীর ঠিকই আছে।
তবে!
আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। বলতে পারত–কি তার পক্ষে একজন কর্মচারীর কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা ঠিক না। শ্রাবণী মাঝে মাঝে এসে তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, শ্রাবণী যদি তার জীবনের বিপর্যয়ের কথা জেনে ফেলে তবে তাকে অ্যাভয়েড করতেই পারে। কেমন সরল সুন্দর এক যুবতীর আকর্ষণে সে বোধহয় ফের আবার এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেল।
তুচ্ছ কারণে শ্রাবণী তার—বই-এর দোকানে ঢুকে নানা আবদার করত।
সে চেষ্টা করেছে সব আবদার রক্ষা করার—শ্রাবণীকে দেখে কেমন এক মর্যাদাবোধে দিন দিন আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল—
চাপা স্বভাবের বলেই মুখ ফুটে কিছুই প্রকাশ করতে পারত না। সে নিজে সঙ্গে যেত, স্টেশনে দাঁড়িয়ে গল্পও করেছে। কোনও রেস্তোরায় দুজনে সামনাসামনি বসে অকারণে কত কথা বলেছে, শ্রাবণীর স্বভাব জোরে হাসার, আবার দেখেছে, কথা বলার সময় তাকে সামান্য ঠেলে দিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে।
একদিন না বলে পারেনি, শ্রাবণী, তোমার ফোন নেই?
শ্রাবণী মুচকি হেসেছে।
কারণ শ্রাবণী জানে, এইটুকুই যথেষ্ট, কোয়ার্টারে ফোন আছে, কখনও সে ফোনে কথা বলেনি—ফোনে কথা বললেই যেন শ্রাবণী ধরা পড়ে যাবে।
কারণ শ্রাবণী জানে পুরুষমানুষের আপাত এই মিষ্টি ব্যবহার বিয়ের পর কত রুক্ষ হতে পারে এবং এক অপ্রিয় কর্কশ জীবন তৈরি হয়ে যায়, তারপর পুরুষমানুষের নানা বিকৃত যৌনতারও সাক্ষী সে। মণিকে সে চিনতে পারেনি। মণিদা তাদের পরিবারের বন্ধু, মকরিও সে মণিদার অনুগ্রহে পেয়েছে—এবং সেই মানুষটিই ক্ৰমে এক দৈত্য হয়ে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে উড়িয়ে দিয়ে উপগত হয়েছে।
আমার লাগছে।
আমি পারছি না। ছাড়ো।
তখনই সংশয় এবং মণি জোরজারই শুধু করেনি, বিকৃত কামনায় তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করতেও চেয়েছে। ফোনের নম্বর সে দেয়নি। কারও ফোন এলে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরবেই। ইচ্ছে করেই গোপন করে গেছে। কারণ কোয়ার্টারে মা-বাৰা-দিদি আর প্রাণের চেয়ে অধিক এক অস্তিত্ব নিরন্তর তার এক উৎকণ্ঠার বিষয় ছিল।
মণিদাকে নবেন্দু চেনে, তার কাছে যদি সব খবর পেয়ে যায়—আরে কী করছ, আবার ভুল করবে। এত ঠান্ডা বরফ যে তাকে উষ্ণ করে তোলাই কঠিন।
বিয়ের মাধুর্য রক্ষা করতেও যৌনতার শিল্পবোধ না থাকলে হয় না, মণি তা বুঝতই না।
যাই হোক সে আর নবেন্দুর কাছে যেতে চায় না। আসলে সে যে ভালোবাসার কাঙাল। তার শরীরকে ব্যবহার করবে, অথচ, ভালোবাসবে না! এ তো ফুল ফোঁটার মতো, মনোরম কুয়াশায় ফুল তার পাপড়ি মেলে, সেই কুয়াশায় রহস্যটি যে পুরুষ বুঝতে চায় না, শুধু স্ত্রীর অধিকারে শরীর ব্যবহার করতে চায়, তার প্রতি যে ঘৃণা জন্মায়-নিপীড়িত মনে হয় নিজেকে, একটাই জীবন, তখন মনে হয় এই রাহুগ্রাস থেকে আত্মরক্ষা না করতে পারলে তার জীবন অর্থহীন। মণি কাছে এলেই সে তার মুখে দুর্গন্ধ পেত।
এত সব চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়ে সন্ধ্যাকে একটি চিঠি লিখেছিল। সে জানে নবেন্দু এতে অপমানিত বোধ করবে। কারণ সে তো জানে, প্রতিদিনই কোনও না অতর্কিত মুহূর্তে কোনও সুন্দর মুখ দেখার প্রত্যাশায় নবেন্দু বসে থাকে। সে যদি না যায় তখন ব্যাজার মুখ। এই যে নবেন্দুর মহাবিশ্ব তার কাছে এক অশরীরী চৈতন্য হয়ে বিরাজ করছে, মুহূর্তে দেখামাত্র সব ম্লান অন্ধকার দূর হয়ে যায়। সে যায়, মাসে ছ-মাসে যায়, তবে নবেন্দুর কাছে এই যাওয়া আবির্ভাবের সামিল।
সেও তো কম ছলনার আশ্রয় নেয়নি।
সে তো বলতেই পারত, আপনার সব খবরই আমি রাখি। আপনার মণিদা আমাকে সব বলেছে, কথায় কথায় এত প্রশংসা করলে কার না রাগ হয় বলুন তো। বারবার এক প্রশ্নে আহত। এতই যদি গুণবান—তবে জীবনে তার এত বড়ো বিপর্যয় নেমে আসে কেন!
আসলে ওর বাবা মহেশবাবুরই ভুল, গুরুদেব বলেছেন এক কথায় রাজযোটক। মেয়েটি যে মানসিক অসুস্থতার শিকার বিয়ের পর মহেশবাবু হাড়ে হাড়ে টের পেলেন, তারপর যা হয়, শত হলেও গুরু বাক্য—সুতরাং বছর দুই চেষ্টা করেছেন পুত্রের দাম্পত্যজীবন রক্ষা পাক। কথায় কথায় ভয় দেখাত, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।
চিকিৎসা করাতে পারত।
কণিকার বাবা রাজি না। কণিকা মানে নবেন্দুর স্ত্রী—তার বাবা বধূ-নির্যাতনের অভিযোগ তুললেন, আদালতে গেলেন। স্বেচ্ছায় ডির্ভোস নেওয়ালেন, তারপর পূর্ব প্রণয়ীর সঙ্গে বিয়ে দিতেও বাধ্য হলেন।
মহেশবাবু খোঁজখবর নিলেন না পাত্রীর?
ওই তো গুরুবাক্য। গুরুর আশীর্বাদে তার এত জয়ময়, তাঁর পক্ষে সম্ভব গুরুবাক্য লঙঘন করা!
ইস এভাবে একটা জীবন নষ্ট হয়ে গেল।
মহেশবাবু সেই যে বিছানা নিলেন—
থাক আর বলতে হবে না।
সেই মণিদা, অর্থাৎ মণিমোহনেরই বা কী পরিণতি। নবেন্দুর কষ্টের কথা ভাবলেই তার শরীরে জ্বর আসত। শরীর গরম হয়ে উঠত। আর মণিমোহন কাছে এলে শীতল হয়ে যেত শরীর। নবেন্দু সুন্দর, সুপুরুষ, দীর্ঘকায়, পাত্র হিসেবে দুর্লভ। অথচ দ্যাখো কী দুর্ভাগ্য এক পুত্রবধূর পাল্লায় পড়ে গোটা সংসারটা তছনছ হরে গেল মহেশবাবুর। নারী হল গিয়ে পুরুষের মুক্তি।
সেই মুক্তির স্বাদ মণিমোহনের কাছ থেকে এভাবে সম্ভোগ করবে শ্রাবণী জীবনেও চিন্তা করেনি। আসলে এক অন্তর্গত খেলা, একজন অদৃশ্য যুবক অদৃশ্য বলে বলা যায় সেই কবে মণিমোহন কোনও বইমেলা কিংবা জেলার বইমেলায় তাকে নিয়ে গেলে বলত চলো আলাপ করবে। সে যায়নি। ভিড়ের মধ্যে নবেন্দুকে দেখেছে— সত্যি বেচারা। মুখ দেখলেই ওর ভিতরের কষ্ট সহজেই বোঝা যেত। যৌনতার স্বাদ পাওয়া একজন পুরুষের পক্ষে নারী বিহনে থাকা যে কত কঠিন দূরাগত কোনও মিউজিকের মতো সেই কষ্টের মুখ তাকে সর্বদা অনুসরণ করত। পাগল পাগল লাগত।
এ ভাবেই সে কলকাতায় এলে একবার সেই দোকানটি আবিষ্কার করে ফেলেছিল। দোকানের মালিককেও-সুপুরুষটিকেও।
সে ছলনার আশ্রয় নিল।
উপায় ছিল না, মণিমোহন তার জীবন থেকে কিছুতেই নিশ্চিহ্ন হবে না। কারণ মণিমোহন তার পুত্রের দাবি করেনি, একটি শিশুঁকে বড়ো করতে গেলে সুবিধা অসুবিধা অনেক। সে কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের। আর শ্রাবণীরও ইচ্ছা নয়, সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাক। শিশুটি তার যে প্রাণের চেয়ে অধিক। সে শুধু ডিভোর্সি নয়, সে জননীও। জননী হলে যে সমাজে ব্রাত্য হতে হয়। অথচ শরীর মানে না। তার পাগল পাগল লাগত। এবং নবেন্দুকে সে নানা ভাবেই ছলনা করেছে। কী নবেন্দু ভালোবাসার জন্য পাগল। তার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত, তারও নবেন্দুকে নিয়ে কম স্বপ্ন তৈরি হয়নি।
এইসব দোলাচলে সে যখন কাহিল, তখনই পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির সিন্ধান্ত নেয়, নবেন্দু যদি ছুটে আসে তার কাছে, এবং এত দিন যে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে, তা নিমেষে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে শ্রাবণীর প্রকৃত সচিত্র পরিচয়টি তুলে ধরতে চায়।
আমি শ্রাবণী।
আমার প্রাক্তন স্বামী মণিমোহন দাস।
আমি জননী। এই আমার খোকা, তাকে এবারে নার্সারিতে ভর্তি করাতে হবে। ছেলের প্রিপারেশানে ব্যস্ত আছি। ভালো স্কুলে ভর্তি করানো যায় কি না দেখছি। ফর্ম পূরণে তার বাবার নাম না দিয়ে উপায় নেই। এসব কারণে যাওয়া হচ্ছে না। সন্ধ্যাদিকে পাঠাচ্ছি। কত কিছু চিন্তা করে যে সন্ধ্যাদিকে পাঠাচ্ছে—মানুষটাকে অন্ধকারে রেখে এই লুকোচুরি তার আর সহ্য হচ্ছে না।
সন্ধ্যাদি রাতে হাজির। সকালের ট্রেন ধরবে। সন্ধ্যাদিকে তার ছাপানো কার্ডটি দিয়ে বলল, এটি দেবে বাবুকে। আর কিছু বলতে হবে না। তিনি বই-এর একটি প্যাকেট দেবেন। ওটা নিয়ে সোজা আবার ট্রেন ধরবে। কোনও প্রশ্ন করলে বলবে, আমার শরীর ভালো না। ফোনে যোগাযোগ করতে বলবে।
তুমি তো শ্রাবণীদি ফোনেই বলে দিতে পারো।
কী বলব?
তোমার শরীর ভালো না।
তিনি জানেনই না আমার বাড়িতে ফোন আছে। কার্ডটা কি যত্ন করে নেবে।
আসলে এত বেশি হ য ব র ল হয়ে যাবে জীবন, শ্রাবণী ভাবতেই পারেনি। যতই দুজনের মধ্যে টান তৈরি হোক, যতই নবেন্দুর কথা ভাবলে পাগল পাগল লাগুক, এত সব ছলনা শ্রাবণী এখন নিজেই সহ্য করতে পারছে না। কেন যে মরতে দোকানে ঢুঁ মেরেছিল।
শ্রাবণী তুমি এলে না। সন্ধ্যাদিকে পাঠালে। কত আশা করেছিলাম তুমি আসবে। মাকে তোমার কথা বলেছি।
এত দিনে! কী বললেন।
খুব খুশি। মা দিদি সত্যি খুব খুশি। কবে আসবে?
দেখি।
একটি কথা বলব শ্রাবণী। তোমার কার্ড দেখে বুঝতে পারলাম, ফোনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। অথচ ফোন সম্পর্কে তুমি নীরব থাকতে। ফোন নম্বর চাইলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে। কেন? আমাদের দুজনেরই যথেষ্ট বয়েস হয়েছে।
শ্রাবণী চুপ করে আছে।
কী হল, কথা বলছ না।
ভাবছি। জানো তো সব স্বামী-স্ত্রীই চায় বিয়ের পর স্বপ্নের রেলগাড়িতে উঠে যেতে। এক সময় স্বপ্নটাই থাকে। রেলগাড়ি থাকে না, কখন যে এক তুষার-ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। তাই আমার স্বপ্নের রেলগাড়িতে উঠতে ভয় লাগছে। আমারই দোষ, তোমার মণিদাকে ভালোবাসতে পারিনি। কাছে এলেই শরীর শীতল হয়ে যেত। তবু মানুষটি শরীরে দাগ রেখে গেছে। জননদাগ—চিতায় না উঠলে দাগ মিলবে না। ইমনের স্বভাব দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরা-কে আপনি? মা, দাদুমণির ফোন। মা বড়ো মাসির ফোন। আপনি ফোনে কথা বললে ধরা পড়ে যেতাম। আমি ডিভোর্সি, নবেন্দুবাবু।
আমি সব জানি শ্রাবণী। তুমি আসছ না শুনে কেমন ঘাবড়ে গেলাম। পাগলের মতো কিছু করে ফেললাম, আমাদের গোরাবাজারের এজেন্টকে তোমার খবর নিতে বললাম। সাত-আট বছর ধরে একা। ন্যাড়া বেলতলায় যেতে আর রাজি না
বলে মা-র সঙ্গে কথা বন্ধ। সংসার ঘরবাড়ি সব অর্থহীন। অন্ধকার। মাকে সব কথা বলেছি। রাজি। বাড়িটায় আবার আলো জ্বলবে।
নবেন্দুবাবু, আমি একটা খারাপ মেয়ে—
কী বাজে বকছ বলো তো? তোমার স্বপ্নের রেলগাড়িতে আগে উঠে বসি, কত দূর যাওয়া যায় দেখি। যেতে যেতে ঠিক হবে খারাপ না ভালো। ভালো না লাগলে সামনের কোনও স্টেশনে নেমে গেলেই হবে। আমি নিজেও কম খারাপ না। কণিকা আমাদের গোটা পরিবারের মাশয় কলঙ্ক চাপিয়ে চলে গেছে। আজ রাতের ট্রেনেই তোমার কাছে যাচ্ছি।
এবং জ্যোৎস্নায় রেলগাড়িই ছুটছে। নবেন্দু জানালায় বসে আছে। আকাশ নক্ষত্র এবং শস্যক্ষেত্র পার হয়ে গাড়িটা ছুটছে।
এক লণ্ঠনওয়ালার গল্প
সেদিন আমার সহকর্মী এসেই বললেন, কী, আপনার সেই পাখিরা কোথায়?
আমার বাড়িতে তার পাখি দেখতেই আসা। কারণ সহকর্মী এবং বন্ধু মানুষটি প্রায়ই আক্ষেপ করতেন, বোঝালেন, ছেলেবেলায় কত রকমের পাখি দেখেছি। আজকাল আর বুঝি তারা নেই। বসন্ত বউড়ি পাখি দেখেছেন? আমাদের বাগানে তারা উড়ে বেড়াত।
পাখি নিয়ে যখন তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়, তখন আমি সবে এ অঞ্চলে বাড়ি করছি। ফাঁকা জায়গা। গাছপালা বা জঙ্গল সবই আছে। ফাঁকা মাঠ আছে। পুকুর বাগান সব। বাড়ি করার সময় যেসব পাখি ছিল, ক-বছর পরে তাদের আর দেখা গেল না। তবু পাশের জঙ্গলে একজোড়া ডাহুক পাখি থাকত বলে, রাতে তাদের কলরব শুনতে পেতাম। ক-দিন থেকে তাদেরও আর সাড়া পাওয়া যায় না।
বন্ধুটি এলেন ঠিক, তবে তখন পাখিরা আর নেই, বনজঙ্গল নেই, মাঠ নেই, গাছপালা নেই—কেবল ইটের জঙ্গল বাদে এখন আর কিছু চোখে পড়ে না।
পাখি নিয়ে অফিসে কথা উঠলেই, সহকর্মীটির এককথা, ঠিক চলে যাব একদিন। একরাত থাকব আপনার বাড়িতে।
কথাবার্তা শুনলে মনে হবে—আমি যেন কোনো সুদূর রেল স্টেশন পার হয়ে এক নির্জন জায়গার বাসিন্দা। আমার বাড়ি তাঁর বাড়ি থেকে বাসে ঘন্টাখানেক লাগে না। কলকাতা শহর বাড়ছে। আগে দক্ষিণে বাড়ত, এখন সল্টলেক ধরে উত্তরের দিকটাতে বাড়ছে। দশ-বারো বছরের মধ্যে ফাঁকা ধানের মাঠ সব ঘরবাড়িতে ভরে গেছে। আসব আসব করে তাঁর এতদিন আসা হয়নি। কবি মানুষ হলে যা হয়। শেষে যখন হাজির তখন তাঁকে আমার আর কাক-শালিক বাদে কোনো পাখি দেখাবার উপায় নেই। তাঁকে বললাম, ওরা সব চলে গেছে।
কবিবন্ধুটির প্রশ্ন, কোথায় যায় বলেন তো!
আমরা দোতলার ব্যালকনিতে বসেছিলাম। বললাম, কোথায় যায় বলতে পারব না, নিশ্চয়ই যেখানে বনজঙ্গল আছে তারা সেখানেই যায়।
কবিবন্ধুটির আবার প্রশ্ন, বনজঙ্গল কি আর থাকবে। যেভাবে মানুষ বাড়ছে। এভাবেই বন্ধুটির কথা বলার অভ্যাস। একটু ফাঁকা জায়গা বনজঙ্গল পাখি প্রজাপতি দেখলে তাঁর আনন্দ হবারই কথা। শোভাবাজারের দিকে অত্যন্ত এক সরু গলির অন্ধকারের একতলা বাসা থেকে বের হলেই তাঁর বোধহয় পাখি প্রজাপতি দেখার শখ হয়। অবশেষে সেই দেখতেই আসা। আমরা মুখোমুখি বসে। বললাম, এই যে পাশের ডোবাটা দেখছেন, এখানে এই কদিন আগেও একজোড়া ডাহুক পাকি দেখেছি। আপনি আগে এলে দেখতে পেতেন। ক-দিন থেকে দেখছি তারাও নেই।
বন্ধুটি বললেন, যখন দেখা হল না, তখন পাখি নিয়েই গল্প হোক। আপনি কী কী পাখি দেখেছেন?
বুঝতে পারছি আমরা আজ বেশ মুডে আছি। ছুটির দিন। রাতে থাকবেন বন্ধুটি। খাবেন। সারা বিকেল, সন্ধে এমনকী গভীর রাত পর্যন্ত চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে। সংসারী মানুষের পক্ষে এগুলো খুব দরকার। হাঁপিয়ে উঠতে হয় না বুঝি। সময় করে তাই কবিবন্ধুটি আজ আমার এখানে চলে এসেছেন। একটাই শর্ত, পাখি ছাড়া আমরা আর অন্য কোনো গল্প করব না।
বন্ধুটি বললেন, আমি লায়ার পাখির নাম শুনেছি। দেখিনি।
আমি একজন পাখি বিশেষজ্ঞ বলে তিনি মনে করেন। আমার লেখাতে তিনি অনেক পাখির নাম জেনেছেন। বোধহয় লায়ার পাখিরও। এককালে জাহাজে কাজ করতাম বলে পৃথিবীটা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বললাম, ও-পাখি অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। জিলঙে দেখেছি।
তাঁর স্বাভাবিক প্রশ্ন, জিলঙ কোথায়?
বললাম মেলবোর্ন থেকে শ-দুই মাইল পশ্চিমে। খুবই ছোটো বন্দর। ওখান থেকে গম রপ্তানি হয়। আমরা গম নিতেই গেছিলাম। লায়ার পাখি আকারে বেশ বড়ো। চওড়া পালক। পাখা মেলে দিলে লায়ারের মতো দেখতে লাগে।
-লায়ারটা কী?
-ওটা একটা বিলেতি বাদ্যযন্ত্রের নাম। গায়ের রং মেটে। গলার দিকটা লাল। লেজের দিকটা সাপের ফণার মতো। খুব লাজুক পাখি। দেখলে বড়ো মায়া হয়। ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার স্বভাব।
এভাবে আরও অনেক পাখির কথা উঠল। সদা সোহাগি, শা’ বুলবুলি, নীল কটকটিয়া, ভীমরাজ, ওরিওল, রেন, বেনেবৌ, ভাট শালিক, গাং-শালিক, মুনিয়া, দোয়েল, বুলবুলি, ছাতার পাখি, টিয়া, হাড়িচাঁচা কত আর বলব।
স্ত্রী চা ডালমুট রেখে গেল। দুজন সোফায় গা এলিয়ে বসে। পাখির কথা উঠতেই আমরা দুজনেই আমাদের শৈশব কালে চলে গেলাম। দুজনেরই শৈশব ওপার বাংলায় কেটেছে। জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, সেখানে। দেশভাগ না হলে আমাদের দুজনের দেখা হবারই কথা ছিল না। দেশের নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে দুজনকেই।
বন্ধুটির আপশোস, বললেন, ইস্টিকুটুম পাখি এখানে এসে দেখেছেন?
বললাম, বাড়িঘর করার সময় এ-অঞ্চলে অনেক পাখি ছিল। ইস্টিকুটুম আমার ছাদের কার্নিশেই একবার উড়ে এসে বসেছিল। ছেলেরা এসে বলল, বাবা দেখো
এসে, দুটো সুন্দর পাখি আমাদের ছাদে এসে উড়ে বসেছে। উপরে উঠে দেখলাম। বললাম, এরা হল ইষ্টিকুটুম। দেশের বাড়িতে এরা ডাকলেই মা জেঠিমারা বলতেন, কুটুম আসবে। বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে বললাম, জানেন, সত্যি দু একদিনের মধ্যে কুটুম চলে আসত বাড়িতে। একবার তিনুকাকা এলেন, ঠাকুমা বললেন, ইস্টিকুটুম ডেকে গেছে বাড়িতে, তুই আসবি জানতাম।
বন্ধুটির প্রশ্ন, পাখিদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা?
আমি বললাম অনেক। ধরুন, আমার বাড়িটা যদি আরও বড়ো হত, গাছপালা লাগাতে পারতাম, তবে কিছু পাখি এসে থাকতে চাইত। আমার বাবা জানেন, দেশ থেকে এসে বিঘে পাঁচেকের মতো জমি কিনে কোনোরকমে থাকবার মতো টালির ঘর করলেন। ঠাকুরঘর বানালেন। রান্নাঘর। কাঠা চারেকের মধ্যে সব। বাকি জায়গাটায় কত রকমের যে ফলের গাছ লাগালেন! আবাদ করার জন্য কোনো জমি রাখলেন না। মা গজ গজ করত, গাছ তোমাকে খাওয়াবে।
বাবা হাসতেন। মা আরও রেগে যেত। বলত, জমি চাষ-আবাদ করলে সংসারের অভাব মিটত। বাবা হয়তো স্নান করে ফিরছেন কালীর পুকুর থেকে—দেখি বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। একঝাঁক পাখি উড়ে আসছে। বাবা বলতেন, কেন আসছে জানো? ওরা বুঝেছে। এই গাছপালায় তাদের আমি বসার জায়গা করে দিয়েছি। বাসা বানাবার জায়গা করে দিয়েছি। ফল-পাকুড় হবে, তোমরা খাবে, ওরা খাবে না—সে হয়!
চায়ে চুমুক দিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। বন্ধুটি বললেন, কী ভাবছেন?
ভাবছি গাছপালা, পাখপাখালি না থাকলে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ে না। কত রকমের পাখি এসে উড়ে বসত। বাবা বলতেন, চেনো!
আমরা জানি, বাবা পাখিদের নাম বলবেন। বাবাই আমাকে কোনটা কী পাখি, তার স্বভাব চরিত্র, কোথায় বাসা বানায়, ক-টা করে ডিম পাড়ে সব বলতেন। আমরা ভাইবোনেরা ভারি কৌতূহল নিয়ে শুনতাম। ফল-পাকুড়ের সময় পাখির উপদ্রব বেড়ে যেত। মা গজগজ করত। দ্যাখ গাছে টিয়ার ঝাঁক বসেছে। সব কামরাঙ্গা সাফ করে দিচ্ছে।
বাবা ইশারায় আমাদের বারণ করতেন। তখন মা নিজেই কোটা নিয়ে ছুটত। পাখিদের তাড়াত। বাবা হাসতেন।
মা রেগে গিয়ে বলত, হাসছ কেন?
হাসছি এমনি। তু
মি এমনি হাসার মানুষ! কেন হাসলে বল!
বাবা ঠাকুরঘরে হয়তো যাচ্ছেন। গৃহদেবতার পূজার সময় হয়ে গেছে। ঘরে ঢোকার আগে বলতেন, ওরা জানে বাড়ির মালিক তাদের পছন্দ করে। তুমি যখন দিবানিদ্রা যাবে ওরা তখন আসবে। আমি বলে দিয়েছি, সময় বুঝে আয়। যখন তখন এলে চলে! দেখছিস না বাড়ির মাঠান রাগ করে!
কবিবন্ধুটি বিস্ময়ে বললেন, ওরা আসত।
ঠিক আসত! মা দিবানিদ্রা গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসত। বাবা বলতেন, পাখি প্রজাপতি, গোরুবাছুর অর্থাৎ তিনি প্রাণীকুলের কথাই বলতে চাইতেন—না থাকলে মানায় না। জানেন, যদি টাকা থাকত, আর দু-চার কাঠা জমি রাখতে পারতাম—বাবার মতো আমার বাড়িতেও গাছপালা লাগিয়ে দিতাম। গাছপালা লাগানোর মধ্যেও বড় একটা আনন্দ আছে। বাড়িতে গাছপালা না থাকলে, পাখি প্রজাপতি উড়ে না এলে বাড়ির জন্য মায়াও বাড়ে না।
বন্ধুটি কী ভেবে ডাকলেন, বউঠান আর এক রাউণ্ড চা। আমরা এখানে জমে গেছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, তাহলে কি আমাদের দেশবাড়ির জন্য যে নস্টালজিয়া, তা এই গাছপালা, পাখি প্রজাপতির জন্য?
বললাম, তার বিস্ময় সে প্রকৃতির মধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছে। এঁদো গলিতে যে জন্মায়, বড়ো হয়ে তার কিছু থাকে না। শহরের ঘরবাড়ির জন্য মানুষের এ কারণে টান কম।
কবিবন্ধুটি বললেন, আমাদের কিন্তু আজ কথা ছিল পাখি ছাড়া অন্য কোনো কথা হবে না। পাখি দেখাবেন বলে এনেছেন। দেখছি জায়গাটা যা হয়ে গেছে, তাতে কাক-শকুনের উপদ্রব বাড়তে পারে। আসল পাখি সব উধাও।
স্ত্রী চা রেখে গেল। একটা সিগারেট ধরালাম। ছুটির দিন, প্রসন্ন মেজাজ। বন্ধুটির কথায় রাগ করা গেল না। আসলে সেই কবে বলেছিলাম, যখন সবে বাড়িঘর বানাতে শুরু করি তখন। বন্ধুটি প্রায়ই বলতেন, জায়গাটা কেমন? গাছপালা মাঠ আছে? বিশাল আকাশ দেখতে পান? নির্জন নিরিবিলি? পাখি প্রজাপতি আসে?
আমি বলেছিলাম, আসে।
তাহলে তো একদিন বেড়াতে যেতে হয়।
আসুন না।
বললাম, আসব আসব করে দশটা বছর পার করে দিলেন। কলকাতার আশেপাশে কোনো ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকবে না। একটু ফাঁকা জায়গায় থাকব বলে, এখানে বাড়িটা করি। দেখছেন তো জায়গাটা কী হয়ে গেল! ওই যে সামনের ঘরবাড়ি দেখছেন, সেখানে সব ধানের জমি ছিল। ওই যে ও-পাশের রাস্তা দেখছেন, সেখানে গেলে এক বুড়ো লণ্ঠনওয়ালাকে দেখা যেত। সে দূর দূর গাঁয়ে যেত সকালে, ফিরত সন্ধ্যা হলে। লণ্ঠনবাতি নিজে বানাত। গাঁয়ে গাঁয়ে বিক্রি করত। আমার সঙ্গে লোকটির খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। বলেছিল, হুজুর, আপনি এমন পাণ্ডববর্জিত এলাকায় বাড়ি করলেন।
ওকে বলেছিলাম, একদম হুজুর হুজুর নয়। তুমি আমার সঙ্গী। এ জায়গা ছেড়ে তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছা হয়?
না মরে গেলেও যেতে পারব না।
কেন না!
সে বলতে পারব না। গাছপালা পাখি এই ফসলের মাঠ নিয়ে বেঁচে আছি বাবু। কোথাও ভালো লাগবে না। আমার সঙ্গে তার বিচিত্র সব গল্প হত। সে কোথায় লণ্ঠনবাতি বিক্রি করতে যায়, রাস্তায় যেতে যেতে কার দাওয়ায় বসে, কোথায় একটা ছোট্ট মশলাপাতির দোকান আছে, সেখানে বিড়ি পর্যন্ত পাওয়া যায়। এসব খবরই দিত। এই যে পাশের খাল দেখছেন, সারা বর্ষাকাল ধরে খড়ের নৌকা যেতে দেখেছি। এসব দেখাব বলেই আসতে বলেছিলাম।
বন্ধুটি বললেন, দুর্ভাগ্য। আপনার পাখি প্রজাপতি দেখা হল না। খড়ের নৌকাও দেখা গেল না। সেই লণ্ঠনওয়ালার কাছে চলুন না। সন্ধেটি বেশ কাটবে।
সে তো আর এখানে নেই। জমিটুকু বেচে দিয়ে আরও ভেতরে চলে গেছে। সে নাকি অনেক দূরে। ভালোই আছে সেখানে। বাসে যাওয়া যায়। বাস থেকে নেমে মাইলখানেক হাঁটতে হয়। জমির খুব ভালো দাম পেয়ে গেল, আমায় এসে বলল, বুঝলেন, থাকা যাবে না। আপনি এসেই জায়গাটার বারোটা বাজালেন।
অবাক আমি! সে বলল, তাই। আপনার দেখাদেখি সব ভদ্দরলোকেরা আসতে শুরু করে দিলেন। জমির দর বেড়ে গেল। এত টাকা একসঙ্গে জীবনেও দেখিনি বাবু।
বন্ধুটি বললেন, আসলে আমরা তাকে উৎখাত করেছি।
তাই বলতে পারেন।
সে যাকগে।
আমি বললাম, না যাকগে নয়। শুধু তাকে উৎখাত করিনি, তার স্বপ্নের পৃথিবী থেকে বনবাসে পাঠিয়েছি।
বন্ধুটি হেসে বললেন, সে সেখানেও নিজের মতো স্বপ্নের পৃথিবী বানিয়ে নেবে। ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
সে হয়? সে রোজ গাঁয়ে গাঁয়ে গেছে, সে সারাজীবন তার নিজের মানুষের সঙ্গে বড়ো হয়েছে, গাছপালা মাঠ সবই তার অস্তিত্ব, সে টাকার বিনিময়ে সব হারিয়ে চলে গেছে। একজন লণ্ঠনওয়ালা এখন হয়তো কোথাও একটা চা-বিড়ির দোকান করেছে। কিন্তু বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, গাঁয়ের কোনো সুন্দরী বউয়ের ডাক, এই লণ্ঠনওয়ালা তোমার কুপির দাম কত গো, একটা দিয়ে যাও না! বউটির সঙ্গে কুপির দর নিয়ে কষাকষি, একটু বসে জিরিয়ে নেওয়া, কিংবা সংসারের দুটো সুখ-দুঃখের কথা, এসব সে আর পাবে কোথায়? তার বাড়িতে ছিল দুটো নারকেলগাছ, একটা আমগাছ, লেবু করমচা, সবই সে লাগিয়েছিল। এরা তার জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। সে তাদের ভুলবে কী করে! টাকার লোভে একজন লণ্ঠনওয়ালা সব বেচে দিয়ে চলে গেল।
ঠিক এসময় বন্ধুটি স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমাদের কিন্তু আজ শুধু পাখির গল্প। লণ্ঠনওয়ালার জন্য দুঃখ করলে পাখিরা সব উড়ে যাবে।
হামি হাসলাম।
আসলে বাড়িটা করার সময় এই নির্জন মাঠে এতসব বিচিত্র পাখি দেখেছি যে, অফিসে গিয়ে সবার কাছে গল্প না-করে পারিনি। কারণ গাঁয়ে জন্মালে মানুষের বোধহয় এই হয়। শহর মানুষের অনেক মমতা নষ্ট করে দেয়। প্রকৃতির উদার আকাশ, বিশাল ধানের মাঠ, দিগন্তে কোনো বড় লাইটপোস্টের ছবি এবং নীল সমুদ্রের মতো রাশি রাশি মেঘ যখন বাড়ির মাথার উপর দিয়ে ভেসে যেত তখন আমার শৈশব এসে জানালায় উঁকি মারত। আমি স্থির থাকতে পারতাম না। অফিসে জায়গাটা নিয়ে খুব গল্প করতাম।
বন্ধুটি বলল, কোনো কোনো জাতের পাখি খুব হিংস্র হয় শুনেছি। এদের জন্য তো মায়া হবার কথা না।
বললাম, হিংস্র বলছেন কেন! বাঁচার তাগিদে সব। তবে একটা পাখির গল্প বলি শুনুন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা মাইলখানেক রাস্তা হাঁটতে হলেই গেল। বাস স্ট্রাইক হলে, মাথায় হাত। চার-পাঁচ মাইল হেঁটে গেলেই বাড়ি, অথচ মুখ দেখলে মনে হবে কত বড়ো সর্বনাস হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরা বুঝি হবে না।
আর আমরা রোজ চার মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুল করেছি। গাঁয়ের পনেরো যোলোজন ছাত্র একসঙ্গে বের হতাম। ফিরতাম একসঙ্গে। সারাটা রাস্তা আমাদের কাছে কতরকমের কৌতূহল নিয়ে জেগে থাকত। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে হাঁটছি পথে কারও আমবাগান, লিচুবাগান, পেয়ারার গাছ, কুলের গাছ, কোথায় কী গাছ সব আমাদের জানা, কোথায় কোন গাছে কখন কী ফল হবে সব জানা। কেউ ফল, গোলাপজাম, ঢেউয়া কতরকমের গাছই ছিল আমাদের জীবনের সঙ্গী। চুরি করতাম, ছুটতাম, খেত থেকে ক্ষিরাই চুরি করে খেতাম। গ্রাম মাঠ বিল পার হয়ে এক আশ্চর্য তীর্থযাত্রা ছিল প্রতিদিন।
বন্ধুটি আজ যেন আমার নস্টালজিয়াকে আক্রমণ করতেই এসেছেন। তিনি বললেন, এতে পাখির গল্প কোথায়?
দাঁড়ান বলছি। বলে উঠে বাথরুমের দিকে গেলাম। আসলে সাঁজ লেগে আসছে। রাতে বন্ধুটি খাবে। ঘরে কী আছে না আছে খবর রাখি না। একবার অন্তত জানা দরকার, রাতে কী হচ্ছে। স্ত্রীকে নীচে সিঁড়ির মুখে পেয়ে গেলাম। বললাম, গৌরাঙ্গবাবু কিন্তু আজ রাতটা এখানে কাটাবেন। রাতে খাবেন।
স্ত্রীর এক কথা, তোমাকে ভাবতে হবে না। বাড়িতে বাজার, কেনাকাটা স্ত্রীই করেন। এমনকী রান্নাবান্নাও করা হয়ে আছে বোধহয়। শুধু গ্যাস জ্বেলে গরম করে নেওয়া। কাজেই ফের উঠে এসে বললাম, জামাকাপড় ছাড়ন। পাখির গল্পটা না হয় রাতে খেতে বসে শুনবেন।
বন্ধুটির এককথা, খাওয়ার সময় কোনো হিংস্র পাখির গল্প বললে, গল্পটা জমতে পারে, খাওয়াটা জমবে না।
আমি জানি, গৌরাঙ্গবাবু ভোজনরসিক। খেতে ভালোবাসেন। কোনো এক কবি সম্মেলনে গিয়ে তিনি কুড়িটা ডিমই খেয়েছিলেন, সেসব গল্প কানে এসেছে। এক ফাঁকে স্ত্রীকে বললাম, ইনিই সেই কুড়িটা ডিম।
ইনিই সেই কুড়িটা ডিম শুনে স্ত্রী কেমন সামান্য ঘাবড়ে গেল। তারপর কী ভাবল কে জানে, বলল, কুড়িটার জায়গায় ত্রিশটা—এর বেশি তো লাগবে না। আমি আনিয়ে রাখছি।
তুমি কী রাতে।
সব আছে। তোমার তো মনে থাকে না। সেদিন সকালে বললে না, রোববারে আমার এক সহকর্মী আসতে পারেন। থাকতে পারেন। খেতে পারেন। খেতে খুব ভালোবাসেন।
ভুলেই গেছি। আমি উপরে উঠে এলাম। গৌরাঙ্গবাবু ব্যালকনিতে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই বললেন চলুন ছাদে যাওয়া যাক। আমরা ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। অনেক দূরের।
ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে। কিন্তু গাছপালা কম। বলতে গেলে সামনের দিকটায় একসময় বনভূমি ছিল। এখন আর তার চিহ্ন নেই। বাড়ির পেছনটায় কয়েকটা গাছ লাগিয়েছি। গাছগুলো বড়ো হচ্ছে। সবই ফুলের, শেফালি, কামিনী এবং স্থলপদ্মের গাছ।
গৌরাঙ্গবাবু ঝুঁকে দেখলেন। বললেন, এগুলি বুঝি আপনার সান্ত্বনা? বললাম, বলতে পারেন। গৌরাঙ্গবাবু বললেন, চলুন ওই গাছগুলোর নীচে গিয়ে বসি। নীচে নেমে এলাম। বেশ ঘন অন্ধকার। বললাম, আলো জ্বেলে দি। ঘাসের উপর চেয়ার পেতে দিয়ে গেল কাজের লোকটা। প্রায় অন্ধকারে বসে গৌরাঙ্গবাবু বললেন, এখানে মনে হয় আপনার হিংস্র পাখির গল্পটা জমবে।
বললাম, দেখুন পাখিটা অতিকায়।
কী পাখি?
কী পাখি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলাম। তারপর কী ভেবে যে বললাম, সাপটা আরও অতিকায়।
তার মানে। পাখি সাপ!
আসলে আমাদের সমাজজীবনে শুধু এই পাখি এবং সাপের খেলা চলছে।
বুঝলাম না।
আমি কাউকে দোষ দিই না। নিজেকে শুধরে নিলাম।
গৌরাঙ্গবাবু খুবই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন—সোজাসুজি বলুন না।
তখন চৈত্র মাস। স্কুল থেকে ফিরছি। জমি উরাট। গ্রাম থেকে নামলেই ফসলের মাঠ, পরে গোপের বাগ বলে একটা গাঁ। গাঁ ছাড়ালেই বিশাল বিলের জায়গা। ওটা পার হয়ে গেলে খংশারদির পুল। পুল পার হয়ে গেলে পোদ্দারদের প্রাসাদের মতো বাড়ি, বাগান, তারপর গঞ্জের মতো জায়গায় আমাদের স্কুল। এতটা রাস্তা আমাদের রোজ হাঁটতে হয়। যাবার পথে, ফেরার পথে কখনো মনে হয়নি স্কুলটা আমাদের খুব দূর।
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, পাখি গেল কোথায়?
আসছে, এবারেই আসবে। বললাম না, চৈত্র মাস। সারা মাঠে চাষ-আবাদ নেই বললেই চলে।
নীচু জমিতে ক্ষিরাইর চাষ। ক্ষিরাই, বাঙ্গি, তরমুজ ফলে আছে। জানেন তো, বড়ো তরমুজের নীচে খড় দিতে হয়। উপরেও দিতে হয়। যাতে চোখ না লাগে সেজন্য খড় দিয়ে তরমুজ ঢেকেও রাখা হয়। কিন্তু আমাদের চোখকে ফাঁকি দেয় কে! একটা আস্ত বড়ো তরমুজ চুরি করে গাছতলায় বসে খেয়ে, তার ছালবাকল আবার সেখানেই রেখে আসার মধ্যে, আমাদের একটা মজা ছিল। মজা করতে গিয়েই তাড়াটা খেয়েছিলাম।
কে তাড়া করল? জমির মালিক?
ধুস! একটা শাদা খরিস।
খরিস?
সে না দেখলে তার বিশাল ফণা কত বড়ো হতে পারে বিশ্বাস করতে পারবেন। হাত দুই দূরে ফণা তুলে আমার মুখের সামনে দুলছে। আমি চোখ খুলে আছি। সারা অঙ্গ অবশ। দূরে পালাচ্ছে সবাই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যেন বলছে, কি, আর চুরি করবে?
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, যান মশাই, ও সময় এসব কথা মনে হয়। মস্তিষ্কের ঘিলু তো গলে যাবার কথা!
জানি না, এটাই আমার মনে হয়েছিল, বাস্তু সাপটাপ নাকি এমন করে! শুধু বিড় বিড় করে বলছি, দোহাই আস্তিক মুনি। জানি একটু নড়লেই আমার মাথায় ছোবল বসাবে। নড়ছি না আর তখনই কী না…
কী তখন?
দেখলাম কোত্থেকে একটা বিশাল পাখি উড়ে এল! একটা বাজপাখি। এসেই গলার কাছে সাপটে ধরতেই আমি ছুটে পালাব ভাবলাম। কিন্তু এ কি! সাপটা বিশাল লেজ দিয়ে পাখিটার পা পাখা সব জড়িয়ে ধরেছে। খণ্ডযুদ্ধ। আমার সব বন্ধুদের ডাকছি। দেখছি কেউ নেই। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি বাজপাখির হিংস্র চোখ জ্বলছে। সাপের হিংস্র চোখ জ্বলছে। পাখিটা কিছুতেই গলার কাছে লেজ আনতে দিচ্ছে না। গলা বাঁকিয়ে ফণায় মাথায় ঠুকরে সাপের মগজ থেকে ঘিলু তুলে নিতেই বিশাল সেই দানব এলিয়ে পড়ল। এযারে পাখিটার শরীর থেকে সব প্যাঁচ
খুলে গেল। পাখিটা সাপটাকে নিয়ে অনায়াসে উড়ে যাচ্ছে। এমন ভয়ংকর দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য জীবনে অনুভব করিনি! বিশাল আকাশের নীচে অবলীলায় উড়ে যাচ্ছে।
গল্পটা শোনার পর গৌরাঙ্গবাবু বললেন, আদিমকাল থেকেই এটা চলছে। সবলেরা বেঁচে থাকে। দুর্বলেরা চলে যায়।
আমি শুধু বললাম, এজন্য লণ্ঠনওয়ালার খোঁজে আর আমি যাইনি। সে যখন
বাড়ি জমি বিক্রি করে দেখা করতে এসেছিল, আমি তার সঙ্গে দেখাও করিনি। কারণ সব নষ্টের মূলে আমি। ওর উৎখাত হওয়ার মূলে আমি। আমার স্ত্রীকে বলে গেছিল একসঙ্গে এত টাকা নাকি সে জীবনেও দেখেনি।
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, আপনি না এলেও তাকে উৎখাত হতে হত। পৃথিবীতে সবসময় একজন আর একজনকে তাড়া করছে।
এক হাত গণ্ডারের ছবি
চার্চের ঠিক সামনে এক পাগল। সে হাঁকছিল, ‘দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্র। ওর হাতে লাঠি এবং লাঠিতে পাখির পালক বাঁধা। মাথায় লাল রুমাল। দূরে বেরন। হোটেলের পর্দা উড়ছে। পাগল চার্চের সদর দরজা থেকে বেরন হোটেলের দরজা পর্যন্ত ছুটে আসছিল বার বার আর ডিগবাজি খাচ্ছিল। সে কোনো যানবাহন। দেখছিল না, সে এক পাগলিনির জন্য যেন প্রতীক্ষা করছিল কারণ পাগলিনি অন্য পারে ঠিক পেচ্ছাবখানার পাশে এবং কিছুদূর হেঁটে গেলে অনেক কাপড়ের দোকান, ছায়া স্টোরস অথবা হরলালকা আর গ্রীষ্মের দিন বলে প্রখর উত্তাপে পাগলিনী নগ্ন এবং বধির, পাগলিনি পথের উপর বসে পড়ল।
ঠিক তখন চার্চের দরজার সামনে শববাহী শকট। সোনালি ঝালরের কাজ করা কালো কফিনে মৃত পুরুষ এবং কত ফুল। শোকের পোশাক পরা যুবক যুবতীরা, বৃদ্ধেরা সদর দরজা ধরে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। সকাল হচ্ছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। বড়ো বড়ো গাছের মাথায় সূর্য অকারণ কিরণ দিচ্ছে। তখন পাগল হাঁক দিয়ে সকলকে যেন ডেকে বলছিল, কে আসবি আয়, সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়। অথবা নানারকমের অশ্লীল আলাপ, যা শোনা যায় না, যার জন্য পথে হাঁটা দায়। তখন পথ ধরে কোটিপতি পুরুষের স্ত্রী দামি গাড়িতে নিউ মার্কেট যাচ্ছে। পথে দেবদারুগাছ এবং গাছের ছায়া পাগলিনির মুখে। পাগল ঊর্ধবাহু হয়ে পাখির পালক ওড়াচ্ছে আকাশে। পাগলিনি বসেছিল, আর উঠছে না। এইসব দৃশ্য এ অঞ্চলে হামেশাই ঘটছে, পুলিশের প্রহরা এবং তীর্যক সব দৃষ্টির জন্য যানবাহন থেমে থাকছে না। বড় নোংরা এই অঞ্চল। দেয়ালে দেয়ালে বিচিত্র সব নগ্ন দৃশ্য চিত্রতারকাদের এবং রাজাবাজার পর্যন্ত অকারণ অশ্লীলতা। হামেশাই পথে ঘাটে নগ্ন যুবতীরা পাগলিনি প্রায় শুয়ে থাকছে। সব অসহ্য।
এবং মনে হয় এরা সকলে রাতে ফুটপাথে নিশিযাপন করেছিল। এখন এরা নিজেদের ছেড়া কাঁথার সঞ্চয় ছেড়ে রোজগারের জন্য বের হয়ে পড়বে। পাগল তার সঞ্চয় সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিল। কিছুই ফেলা যায় না। সে নারকেলের মালা এবং সিগারেটের বাক্স দিয়ে মালা গেঁথে গলায় পয়েছিল। পিঠে পুরাতন জামার নীচে পচা ঘায়ের গন্ধ। সে শুধু এখন হাসছিল। পথে লোকের ভিড় বাড়ছে, ট্রাম বাসের ভিড় বাড়ছে। মানুষের মিছিল সারা দিনমান চলবে। পাগল হেসে হেসে সকলকে উদ্দেশ করে বলছিল, দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। সে এখন অন্য কোনো সংলাপ আর খুঁজে পাচ্ছিল না।
গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপ এবং ছায়াবিহীন এই পথ। ফুটপাথে অথবা গাড়ি বারান্দায় যারা রাত যাপন করছে, যারা ঠিকানাবিহীন, যাদের সব তৈজসপত্র ঘেঁড়া, নোংরা এবং প্রাচীনকাল থেকে সব সংরক্ষণ করছে নগরীর সেইসব প্রাচীন রক্ষীরা এখন অন্নের জন্য ফেরেববাজের মতো ঘোরাফেরা করছে। ছেঁড়া সব তৈজসপত্রের ভিতর এক অতিকায় বৃদ্ধ, মুখে দাড়ি শণপাটের মতো এবং সাদা মিহি চুল আর অবয়বে রবীন্দ্রনাথের মতো যে, কপালে হাত রেখে গ্রীষ্মের সূর্যকে দেখার চেষ্টা করছে।
অন্য ফুটপাথে পাগল ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আছে। ওর এই পাগলকে যেন কতকাল থেকে চেনা। বড়ো স্বার্থপর-বৃদ্ধ এই ইচ্ছাকৃত পাগলামির জন্য একদিন রাতে তখন নগরীর সকল মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন হাসপাতালের বড়ো আলোটা পর্যন্ত নিভে গিয়েছিল, রাজবাড়ির সদর বন্ধ হচ্ছে এবং যখন শেষ ট্রাম চলে গেল, যানবাহন বলতে পথে কোনো কপর্দক পড়ে নেই….সব নিঃশেষ, শুধু কুকুরের মাঝে মাঝে আর্ত চিৎকার তখন পাগল ওই পাগলিনির পাশে শুয়ে নোংরা তৈজসপত্রের ভিতর থেকে ছোটো ছোটো উচ্ছিষ্ট হাড় (আমজাদিয়া অথবা বেরন হোটেল থেকে সংগ্রহ করা) দুজনে চুষছিল, রাতের দ্বিপ্রহরে ওদের উদরে মাংসের রস যাচ্ছে, ওরা সারা দিনমান পাগলামির জন্য ফের প্রস্তুত হতে পারছে–বৃদ্ধ হাঁ করে দেখতে দেখতে বলেছিল, এই সরে বোস, এটা পাগলামির জায়গা নয়। ঘুমোতে দে। রাজ্যের সব নোংরা এনে জড় করেছিস?
পাগল কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। কথাটা বোধগম্য হয়নি। কিন্তু পাগলিনি সুলভ রমণীর মতো কাছে এসে বলল, ‘তোর বাপের জায়গা! ঠিক ভালো মানুষের মতো, ঠিক সুলভ রমণীর মতো এবং দিনের জন্য অভিনয়টুকু তখন আর ধরা পড়ছে না, পাগলিনি গলাটা খাটো করে বলল, তোর মুখে চুনকালি পড়বে।
পাশে তেরো বছরের সুমি চিৎকার শুনে উঠে বসেছিল। রাতে পিতামহের হাত ধরে ফুটপাথের অন্য প্রান্তে চলে গিয়েছিল। ওরা পাগলিনির ঝোলাঝুলির ভিতর পচা গন্ধ পাচ্ছিল কারণ এই ঝোলাঝুলি বরফ ঘরের মতো—সবই দুর্দিনের জন্য সংরক্ষণ করা এবং কত রকমের সব উচ্ছিষ্ট খাবার। পাগলিনি চিৎ হয়ে শুয়েছিল। মাংসের হাড় অনবরত চোষার জন্য গালের দুধারে ঘায়ের মতো সাদা দাগ। শরীরে দীর্ঘদিনের ময়লার পলেস্তারা মুখের অবয়বকে নষ্ট করে দিয়েছে। চেনা যাচ্ছিল না ওরা জন্মসূত্রে কোনো গ্রাম্য গৃহস্থের ঔরসজাত না অন্য কোনোভাবে অথবা কোনো অলৌকিক ঘটনার নিমিত্ত এই ফুটপাথ সংলগ্ন ডাকবাক্সের মতো পাতলা অস্থায়ী প্লাইউডের বাড়িতে বসবাস করছে।
পাশের বাড়িটা চারতলা এবং নীচে ফুটপাতের উপর ছাদের মতো গাড়িবারান্দা। সামনে হাসপাতাল এবং রাজবাড়ি, সদর দরজার উপর একটা এক হাত লম্বা গণ্ডারের ছবি ঝুলছে। সময়ে অসময়ে বৃদ্ধ ছবিটার নীচে কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে পড়ার সময় ‘নাট্যকার এই শব্দটি ভয়ংকরভাবে কষ্ট দিতে থাকে। আর হাসপাতালের বাড়িটা দীর্ঘদিন খালি পড়েছিল, শুধু কাক উড়ত ছাদে এবং পাঁচিলের পাশের পেয়ারা গাছটাতে একজোড়া ঘুঘু পাখি আশ্রয় নিয়েছিল। ইদানীং চনকাম হবার সময় মোষের মতো এক ইতর ছোকরা কিছু চুনগোলা জল ছাদ থেকে নালির ফুটোর উপর ফেলে দিয়েছিল। সেই মোষটা হালফিলে সকল খবর নিয়ে গেছে এবং চেটেপুটে রেখে গেছে সুমিকে। চুনগোলা জলের জন্য ঘুঘু পাখিরা উড়ে চলে গেল। তারপর একদিন যেন মনে হল ফের এম্বুলেন্স আসতে শুরু করেছে, ফের এই বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল এবং ট্রাম ডিপোতে ফের ঘন্টি বাজছে।
আর এই বাড়িটার জন্যই ভোরের দিকে সূর্যের উত্তাপ ছাদের নীচে যেন পৌঁছাতে পারে না অথবা লম্বা হয়ে যখন সর্য হাসপাতালের মত মানষের ঘর অতিক্রম করে পেয়ারাগাছের মাথায় এসে পৌঁছোয় তখন ছাদের ছায়া বৃদ্ধ ফকিরচাঁদকে রক্ষা করতে থাকে। এই জন্যই অভ্যাসের মতো এই স্থান বসবাসের উপযোগী। সুমি পাশে নেই, কোথাও আহারের জন্য অন্নসংস্থান করতে গেছে। সে নিজে একটা শতচ্ছিন্ন চাদর ফুটপাথে বিছিয়ে তার পাশে কিছু গোটা অক্ষরে, তার জীবনের বিগত ইতিহাস, পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা হেঁট করে ধিকৃত জীবন এবং গ্লানিকর জীবনের জন্য করুণা ভিক্ষা করছিল।
গ্রীষ্মের উত্তাপ প্রচণ্ড। দীর্ঘদিন থেকে অনাবৃষ্টি। সব কিছু রোদের উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। পথের গলা পিচে করপোরেশনের গাড়ি বালি ছিটিয়ে গেছে। তখন পাগল পিচগলা পথে, মাথায় দুপুরের রোদ, লাঠিতে পাখির পালক বাঁধা—হাঁটছে। ইতস্তত সব ডাস্টবিনের জংশন এবং সেখানে হয়তো সুমি পোড়া কয়লা, কাগজ অথবা লোহার টুকরো খুঁজছে। ফকিরচাঁদ উঠে এক মগ চা সংগ্রহ করল। রাতের আহারের জন্য খড়কুটো অথবা পাতলা কাঠ সংগ্রহ করতে হয়-ফকিরচাঁদ আকাশ দেখল, আকাশ থেকে গনগনে আঁচ ঝরে পড়ছে, সে এই রোদে বের হতে সাহস করল না। সে হাত বাড়াল রোদে—যথার্থই হাত পুড়ে যাচ্ছে যেন, শুধু রাজবাড়ির সদর দেউড়িতে এক হাত গণ্ডারের ছবিটা এই রোদে চিক চিক করছিল।
বৃদ্ধ ফকিরচাঁদ এবার পা দিয়ে নিজের সুন্দর হস্তাক্ষর মুছে দিল। পাঁচিল সংলগ্ন ওর ছোটো প্লাইউডের সংসার—বসবাসের উপযোগী নয়, শুধু তৈজসপত্র রাখার জন্য পাতলা প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে সব ঢাকা। ফকিরচাঁদ সব টেনে বের করল মেটে হাঁড়ি পাতিল, ছেড়া কাঁথা, ভাঙা জলের কুঁজো সবই সুমির সংগ্রহ করা, মেয়েটার সারাদিন ঘুরে ঘুরে ওই এক সংগ্রহের বাতিক এবং সুমিই একদা শেয়ালদা স্টেশন থেকে এই বাড়ি সংলগ্ন গাড়িবারান্দা আবিষ্কার করে ফকিরচাঁদের হাত ধরে চলে এসেছিল। সেই থেকে অবস্থান এবং সেই থেকে দিনগত পাপক্ষয়। সে এ-সময় ভালো করে চারদিকটা দেখল। মগের চা কিছু খেয়ে কিছু রেখে দিল, পাশে পাগল পাগলিনির আস্তানা। দুজনই সারাপথে অভিনয়ের জন্য বের হয়ে গেছে। দুজনই হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার রাতের জন্য সংগ্রহ করছে।
প্রখর উত্তাপের জন্য পথ জনবিরল। দোতলায় মসজিদ এবং সেখানে মোল্লার আজান। ফকিরচাঁদ এবার চিৎকার করে ডাকল—সু…..উ…….মি। ফকিরচাঁদ কপালে হাত রেখে দেখল ট্রামডিপোর সামনে ডাস্টবিন এবং সেখানে সুমি উপুড় হয়ে কী খুঁছছে। সে কোথাও আজ বের হল না ভিক্ষার জন্য, ফকিরচাঁদ মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ক্ষোভে দুঃখে ফের বড়ো বড়ো সুন্দর হস্তাক্ষরে ফকিরচাঁদ ফুটপাথ ভরিয়ে তুলল। সামনের বড়ো বড়ো বাড়িগুলোর দরজা জানালা বন্ধ। ট্রাম ফাঁকা এবং বাসযাত্রী উত্তাপের জন্য কম। সে সুন্দর হস্তাক্ষরের উপর থুথু ফেলল তারপর রাগে দুঃখে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। সুমি আসছে না, ওর গলার আওয়াজ প্রখর নয়, সুতরাং সুমি ফকিরচাঁদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। ফকিরচাঁদ নিজেকে বড়ো অসহায় ভাবল—এই দুর্দিনে সে যেন আরও স্থবির হয়ে যাচ্ছে, চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলছে, ক্রমশ জীবন থেকে সোনার আপেলের স্বপ্ন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এত বেলা হল, এখনো পেট নিরন্ন, সামনের হোটেলটাতে এখন গিয়ে দাঁড়ালে সমি নিশ্চয়ই কিছ পেত, কারণ শেষ খদ্দের ওদের চলে যাচ্ছে। ফকিরচাঁদ অভিমানে নিজেই উঠে যাবার জন্য দাঁড়াতে গিয়ে প্রথম পড়ে গেল, পরে হেঁটে হেঁটে রেস্তোরাঁর সামনে যখন উপাসনার ভঙ্গিতে মাথা হেঁট করে দাঁড়াল, যখন করুণাই একমাত্র জীবনধারণের সম্বল এবং আর কিছু করণীয় নেই এই ভাব—তখন সে দেখল সব সোনা রুপোর পাহাড় আকাশে। আকাশ গুড়গুড় করে উঠল, মেঘে মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আর বাতাস পড়ে গেল, দরজা জানালা খুলে গেল এবং বৃষ্টির জন্য সর্বত্র কোলাহল উঠছে।
আর তখনই চার্চের দরজাতে শববাহী শকট মাঠের মসৃণ ঘাস পার হয়ে অন্য এক ইচ্ছার জগতে উঠে যাচ্ছে। ফুটপাথ ধরে অজস্র যাত্রী—গুনে শেষ করা যায় না, ফকিরচাঁদ অন্তত সময়ের প্রহরী হিসাবে গুনে শেষ করতে পারছে না। বাসস্ট্যান্ডে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা পর্যন্ত কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করল, কারণ দীর্ঘ সময় এই অনাবৃষ্টি……ফলে এই নগরীর দূরতম প্রান্ত আর দূরের মাঠ ঘাট সবই ক্লিষ্ট সকলে জানালা খুলে বৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকল। ফকিরচাঁদ একটু বৃষ্টিতে ভেজার জন্য পথে গিয়ে বসল। আজ অফিস পাড়ায় এই বৃষ্টি উৎসবের মতো। সকলে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য মাঠে এবং ফুলের ভেতর ছুটোছুটি করছিল। এবং পাগল যে শুধু হাঁকছিল, ‘দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর’, যে শুধু হাঁকছিল, কে আসবি আয়, সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়’—সে এখন কিছু না হেঁকে শান্ত নিরীহ বালকের মতো অথবা কোনো কৈশোর জীবনের স্মৃতিকে স্মরণ করে আকাশে মেঘের খেলা দেখছিল। আর পাগলের পাখির পালক তখন লাঠি থেকে উড়ে গেল—পাগল পালকের জন্য ঝড়ের সঙ্গে ছুটছে।
পাগলিনি নিভৃতে ট্রামডিপোর বাইরে লোহার পাইপের ভিতর শুয়ে বৃষ্টির খেলা দেখছিল। সে নখে দাঁত খুটছে। পাগলকে ছুটতে দেখে খপ করে পাগলের পা চেপে ধরল, এবং বলল, ‘দ্যাখ কেমন বৃষ্টি আসছে।’
‘হায় আমার পাখি উড়ে গেল, বৃষ্টি দেখে পাখি উড়ে গেল…’ পাগল হাউহাউ করে কাঁদছে।
দীর্ঘদিনের উত্তাপ, অনাবৃষ্টি বৃষ্টির জলে ভেসে গেল। পাগল বৃষ্টি দেখে পালকের কথা ভুলে গেছে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টির জল ওদের শরীরে মুখে পড়ল। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছিল। সুমি ওর ক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে কোনো রকমে দৌড়ে ফকিরচাঁদের কাছে চলে এল। বৃষ্টির ফোঁটা হিরের কুচির মতো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। পথের যাত্রীরা যে যার মতো গাড়িবারান্দায়, বাসস্টপের শেডে এবং দোকানে দোকানে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য ঢুকে গেল—ওরা সকলেই যেন প্রাচীন কাল থেকে কোনো বিস্তীর্ণ কবরভূমি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত—ওরা সবুজ শস্যকণা এই বৃষ্টির জলে এখন ভাসতে দেখল।
পরদিন ভোরে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো হরফে কলকাতায় বছরের প্রথম বর্ষণ’ এই শীর্ষকে প্রবন্ধ এবং ঠিক প্রথম পাতার উপরে বড়ো এক ছবি, আর যুবতী নারী জলের ফোঁটা মুখে চন্দনের মতো মেখে নিচ্ছে। অথবা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ছবি, দুর্গের বুরুজে জালালি কবুতর উড়ছে।
বৃষ্টি সারারাত ধরে হয়েছে। কখনও টিপটিপ কখনও ঘোর বর্ষণ এবং জোরে হাওয়া বইছিল। ভোরের দিকে যখন কর্পোরেশনের গাড়ি গলা জলে নেমে ম্যানহোল খুলে দিচ্ছিল, যখন ট্রাম-বাস বন্ধ, যখন বৃষ্টির জন্য ছাতার পাখিরা কলকাতার মাঠ পার হয়ে গঙ্গার পাড়ে, অথবা হুগলি নদীর পাড়ে পাড়ে সব চটকলের বাবুরা বাগানে ফুলের চারা পুঁতে দিচ্ছিল তখন বৃদ্ধ ফকিরচাঁদ কলকাতার বুক জল থেকে আকাশ দেখল। পাশে সুমি। সে পেটের নীচে হাত দিয়ে রেখেছে-ভয়, নীচে যে সন্তান জন্মলাভ করছে, ঠাণ্ডায় ওর কষ্ট না হয়।
পাতলা প্লাইউডের ঘর এখন জলের তলায়। মরা ইঁদুর ভেসে যাচ্ছিল জলে। জানালায় যুবক যুবতীরে মুখ-ওরা বৃষ্টির জলে হাত রেখে বড়ো বড়ো হাই তুলছিল। কিছু টানা-রিকশা চলছে, ট্রাম-রাস্তার উপরে যেখানে জল কম, যেখানে একটা মরা কুকুর পড়ে আছে, টানা-রিকশাগুলো সেই সব পথ ধরে প্রায় হিক্কা ভোলার মতো এগুচ্ছে। এই বর্ষায় পিচের পথ সব ভগ্নপ্রায়, মাঝে মাঝে ভয়ানক ক্ষতের মতো দাগ, সুতরাং রিকশা চলতে গিয়ে ভয়ংকর টাল খাচ্ছে। বর্ষার জলে পথ ভেসে গেছে বলে সুখী লোকেরা কাগজের সব নৌকা জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। সুমি এবং বৃদ্ধ ফকিরচাঁদ সারারাত জলে ভিজে ভিজে শীতে কাঁপছিল। অন্য ডাঙার সন্ধানে যাওয়ার জন্য ওরা জলে নেড়ি কুকুরের মতো সাঁতরাচ্ছিল। ওরা আর পারছে না। গভীর রাতে যখন বর্ষণ ঘন ছিল, যখন কেউ জেগে নেই, যখন পথের সব আলো মৃত জোনাকির মতো আলো দিচ্ছে…সুমি অসীম সাহস বুকে নিয়ে ডাঙা জমির জন্য সর্বত্র বিচরণ করতে করতে সামনের চার্চ এবং রাজাবাজারের ডিপোতে অথবা জলের পাইপগুলো অতিক্রম করে অন্য কোথাও…সুমি পরিচিত সব স্থান খুঁজে এসেছে, ডাঙা জমির কোথাও একটু সে ছাদ খুঁজে পায়নি।
ওরা জল ভেঙে ওপারে এসে উঠতেই দেখল বৃষ্টি ধরে আসছে। আকাশের গুমোট অন্ধকারটা নেই এবং কিছু হালকা মেঘ দেখা যাচ্ছে। এ-সময়ে সেই পাগল পুরোপুরি নগ্ন। ভিজে জামাকাপড়। গায়ে রাখতে সাহস করছে না। সুমি পাঁচিলের সামনে শরীর আড়াল করে কাপড় চিপে নিল এবং ফকিরচাঁদের কাপড় চিপে দিল। ফকিরচাঁদ শীতে ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাগলিনি জলের পাইপের ভেতর শুয়ে থেকে শুকনো হাড় চুষে চুষে শীতের কষ্ট থেকে রেহাই পাচ্ছে। ওর সব বসনভূষণ পাইপের ভিতর যত্ন করে রাখা। কিছু কাগজ সংগ্রহ করে মুণ্ডমালার মতো কোমরের ধারে ধারণ করে যেন কত কষ্টে লজ্জা নিবারণ করছিল। আকাশে হালকা মেঘ দেখে এবং আর বৃষ্টি হবে না ভেবে ঠিক টাকি হাউসের সামনে বাঁ হাত কোমরে অথবা সামনে….তেরে কেটে ধিন এইসব বোলে পাগল হামেশাই নাচছে—কলকাতা বৃষ্টির জলে ডুবে গেল, আমার পাখি উড়ে গেল বাতাসে। পাগল এইসব গান গাইছিল।
সুমি পাগলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং একটু ঠেলে দিয়ে বলল, এই তুই ফের নেংটো হয়েছিস! তুই ভারি অসভ্য। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল, ফকিরচাঁদ পাঁচিলের গোড়ায় বসে রয়েছে। সে হাসতে পারছে না। থেকে থেকে কাশি উঠছে এবং চোখ ক্রমশ ঘোলা দেখাচ্ছিল। আকাশের মেঘ হালকা, হয়তো আর বৃষ্টি হবে না। ফের ট্রাম বাস চলতে শুরু করবে অথবা এইসব সারি সারি ট্রাম বাস উটের মতো মুখ তুলে ‘দীর্ঘ উ টি আছে ঝুলে’ বলে সারাদিন মুখ থুবড়ে থেমে থাকবে। ফকিরচাঁদ শীত তাড়াবার জন্য কাতরভাবে শৈশবের ‘অ’য় অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে, ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে—যা বৃষ্টি শালা কোনো ইঁদুরের ছানাকে আর বেঁচে থাকতে হচ্ছে না। সে দেয়ালে এসময় কী লেখার চেষ্টা করল কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতা ঘন বলে কোনো লেখা ফুটে উঠল না।
ফকিরচাঁদ রোদের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকল। ফুটপাথ থেকে জল নেমে যাচ্ছে। ট্রাম বাস ফের চলতে শুরু করেছে এবং দুপুরের দিকে আকাশ যথার্থই পরিষ্কার—মনে হচ্ছে বৃষ্টি আর হবে না, যেন শরৎকালীন হাওয়া দিচ্ছে। বৃদ্ধ এ সময় সুমিকে পাশে নিয়ে বসল। রোদ উঠবে ভেবে সে সুমিকে জীবনের কিছু সুখদুঃখের গল্প শোনাল। ভিজে কাপড় শরীরে থেকে থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার জল কমে গেছে-বৃদ্ধ এবার উঠে দাঁড়াল এবং এক মগ চা এনে পরস্পর ভাগ করে খেল। বৃষ্টি আর আসছে না, বৃদ্ধ অনেকদিন আগের কোনো গ্রাম্য সঙ্গীত মিনমিনে গলায় গাইছে। তার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির ভিতর থেকে একটা ভাঙা এনামেলের থালা বের করে রেস্তোরাঁ অথবা কোনো হোটেলের উদবৃত্ত এবং উচ্ছিষ্ট অন্নের জন্য বের হয়ে গেল। জীবনটা এভাবেই কেটে যাচ্ছে-জীবনটা রাজবাড়ির সদরে ঝুলানো এক হাত গণ্ডারের ছবির মতো—মাথা সবসময় উঁচিয়েই আছে।
কিন্তু কীসে কী হল বলা গেল না। সমাজের সব ধূর্ত শেয়ালদের মতো আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল। ফের বৃষ্টি-বর্ষাকাল এসে গেল। বৃষ্টি ঘন নয় অথচ অবিরাম। ফকিরচাঁদের বসবাসের স্থানটুকু ভিজে গেছে। পাগল-পাগলিনিকে আর এ-অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে না। ফকিরচাঁদ উচ্ছিষ্ট অন্ন খেতে খেতে হাঁ করে থাকল— কারণ আকাশের অবস্থা নিদারুণ, আজ সারাদিন বৃষ্টি হবে…উত্তাপের জন্য ওর ফের কান্না পাচ্ছিল।
সুমি পাঁচিলের পাশে ফকিরচাঁদকে টেনে তুলল। এই শেষ শুকনো ডাঙা। ওর ভিতরে ভিতরে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছিল। তলপেট কুঁকড়ে যাচ্ছে এবং ভেঙে যাচ্ছে। সুমি নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেল এবং যে-কোনোভাবে ফকিরচাঁদের শরীরে উত্তাপ সঞ্চয় হোক এই চাইল। ফকিরচাঁদ শীতের কথা ভেবে মড়া কান্নায় ভেঙে পড়ছে। ফকিরচাঁদ খেতে পারছে না—কত দীর্ঘদিন থেকে যেন বৃষ্টি আর থামবে না—শীতে শীতে বছর কেটে যাবে। ফকিরচাঁদ বলল, সুমি আমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চল।
কোথায় যাব রে! আমার শরীর দিচ্ছে না রে! তেরো বছরের সুমি তলপেটের দু-পাশে দু-হাত রেখে কথাগুলো বলল।
ফকিরচাঁদ পুনরাবৃত্তি করল, আমাকে কোথাও নিয়ে চল রে সুমি।
সুমি এনামেলের থালা থেকে বাসি রুটি এবং ডাল খাচ্ছিল। ভিজে জবজবে কাপড়। ভিতর থেকে ওর-ও শীত উপরে উঠে আসছে। এবং মনে হচ্ছে জরায়ুর ভিতর যেন কেউ গাঁইতি মেরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। সুমি নিজের এই কষ্টের জন্য রুটি মুখে দিতে পারছে না এখন এবং ফকিরচাঁদের কথার জবাব দিতে পারছে না।
বাস ট্রাম যাবার সময় কাদা জল উঠে আসছে ফুটপাথে। ফুটপাথ কর্দমময়। ফকিরচাঁদের এখন উঠে দাঁড়াবার পর্যন্ত শক্তি নেই। সে ক্রমশ স্থবির হয়ে পড়ছে। এখন সর্বত্র যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা এবং কাকগুলো বিজলির তারে বসে বসে ভিজছে। থেকে থেকে ট্রাম বাস চলছে এবং ছাতা মাথায় যারা যাচ্ছিল তারা ছাতার জলে আরও ভয়াবহ করে তুলছে ফুটপাথ—সুতরাং ফকিরচাঁদ কিছু বলতে পারছে না, ফকিরচাঁদ বৃদ্ধ, সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল হাতের, পণ্ডিত ছিল ফকিরচাঁদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পণ্ডিত, তারপর ফকিরচাঁদ পত্র এবং পরিবারের সকলকে হারিয়ে দীর্ঘসূত্রতার জন্য ফুটপাথের ফকিরচাঁদ হয়ে গেল। ফকিরচাঁদের সংগ্রহ করা শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি এবং আবরণ এখন কর্দময়। সে শীতে ফের কাঁপতে থাকল এবং ফের কথা বলতে গিয়ে দেখল দাঁতমুখ শক্ত, শরীর শক্ত এবং অসমর্থ। সে যেন কোনোরকমে নিজের হাতটা সুমির দিকে বাড়িয়ে ধরল।
এখন দিন নিঃশেষের দিকে। সুমি একটু শুকনো আশ্রয়ের জন্য গোমাংসের দোকান অতিক্রম করে রাজাবাজারের পুল পর্যন্ত হেঁটে গেছে। সর্বত্র মানুষের ভিড় এবং এতটুকু আশ্রয় সুমির জন্য কোথাও পড়ে নেই। সকল ফুটপাথবাসী অথবা বাসিনীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। সকলেই মাথার উপর ভাঙা ছাদ পেলে খুশি আর সর্বত্র ওলাওঠার মতো মড়কের শামিল পথঘাট। সুতরাং সুমি ফিরে এসে হতাশায় ফকিরচাঁদকে কিছু বলতে পারল না। সে ফকিরচাঁদের পাশে চুপচাপ বসে পড়ল। ঠাণ্ডা লাগার জন্য শীতে এখন সে কাঁপছে।
ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট সর্বত্রগামী। বৃদ্ধের চুল দাড়ি ভিজে গেছে। রাস্তার আলো বৃদ্ধ ফকিরচাঁদের মুখে, দাড়িতে বিন্দু বিন্দু জল মুক্তোর অক্ষরের মতো—যেন লেখা, আমার নাম ফকিরচাঁদ শর্মা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পণ্ডিত, নিবাস যশোহর-ফকিরচাঁদ উদাস চোখে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে এসব ভাবছিল। চোখ ঘোলা ঘোলা ওর, সুমি এই বৃষ্টিতে বসেই এনামেলের থালা থেকে ঠাণ্ডা অড়হরের ডাল এবং রুটি ফকিরচাঁদের মুখে দিতে গেল। সে মুখে খাবার তুলতে পারছে না। ঠাণ্ডায় মুখ শক্ত। সে শুধু উত্তাপের জন্য হাত দুটো সুমির হাঁটুর নীচে মসৃণ ত্বকের ভিতর গুঁজে দিতে চাইল।
সুমি বলল, ‘দাদু তুই ইতর হয়েছিস?’ বলে হাতটা তুলে দিতেই দেখল, ফকিরচাঁদের চোখ যেন ঘোলা ঘোলা-ফকিরচাঁদ যেন মরে যাচ্ছে।
সে চিৎকার করে উঠল ‘দাদু! দাদু! ফকিরচাঁদ ঈষৎ চোখ মেলে ফের চোখ বুজতে চাইল। সুমি তাড়াতাড়ি একটু আশ্রয়ের জন্য হোক অথবা ভীতির জন্য তোক উঠে পড়ল। বৃষ্টি মাথায় একটু আশ্রয়ের জন্য দোকানে দোকানে এবং ফুটপাতের সর্বত্র এমনকী গলিঘুজির সন্ধানে সে ছুটে ছুটে বেড়াল। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। ফুটপাথে ফের জল উঠতে আরম্ভ করেছে। আর অধিক রাতে সুমি যখন ফিরল, যখন ফের তলপেটে ঈশ্বর কামড়ে ধরছে, শরীরটা নুয়ে পড়ছিল, জলের জন্য ভিতরে ভিতরে ঈশ্বর মোচড় দিচ্ছে এবং ট্রাম বাস চলছে না, ইতস্তত দূরে দূরে কিছু ট্যাক্সি কচ্ছপের মতো ভেসে আছে এবং হোটেল রেস্তরাঁর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেউ বৃষ্টিতে ভিজে জেগে থাকবার জন্য বসে নেই—সুমির তখন ক্লিষ্ট চেহারা বড়ো করুণ দেখাচ্ছিল। সামনে অপরিচিত অন্ধকার, চার্চের সামনে হেমলক গাছ লোহার রেলিং টপকে গেলে ছোটো ঘর এবং সেখানে কাঠের কফিন মাচানের মতো করে রাখা। হেমলক গাছের বড়ো বড়ো পাতার ভিতর জলের শব্দ আর সামনে সব কবরভূমি—চার্চের ভিতর কোনো আলো জ্বলছে না…সুমি নিঃশব্দে লোহার রেলিং টপকে কফিনের ভিতর শুয়ে সন্তান প্রসবের কথা ভাবতেই ফকিরচাঁদের কথা মনে হল—আবার এই পথ এবং জলের শব্দ, সুমি ফুটপাথের জল ভেঙে ফকিরচাঁদকে আনার জন্য ধীরে ধীরে রাজবাড়ির সদর দরজার ঝোলানো এক হাত গণ্ডারের ছবির নীচে দাঁড়াল। ওর অদ্ভুত এক কান্না উঠে আসছে ভিতর থেকে। জন্মের পর এই বৃদ্ধকে সে দেখেছে আর সেই মোষের মতো পুরুষটা যাকে সে তার ভালোবাসা দিতে চেয়েছিল, যে চুন গোলা জল ফেলে ঘুঘু পাখিদের উড়িয়ে দিয়েছে…..সদর দরজায় এক হাত গণ্ডারের ছবির নীচে দাঁড়িয়ে সুমি কাঁদতে থাকল। বৃষ্টির ঘন ফোঁটা, গাছগাছালির অস্পষ্ট ছায়া অথবা সাপ বাঘের ডাকের মতো ব্যাঙের ডাক আর নগরীর দুর্ভেদ্য স্বার্থপরতা সুমির দুঃখকে অসহনীয় করে তুলছে। সুমির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এমনকী পাগলেরাও এই বৃষ্টিতে বের হচ্ছে না, পুলিশ কোথাও পাহারায় নেই। সুমি এত বড়ো শহরের ভিতর এখন একা এবং একমাত্র সন্তান যে মুখ বের করবার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তখনই সুমি দেখতে পাচ্ছে পাগল জলের ভিতর হেঁকে হেঁকে যাচ্ছে ‘দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর’। পিছনে পাগলিনি। আজ এই রাতে দুজনের হাতেই লাঠি। লাঠির মাথায় পাখির পালক উড়ছে।
সুমি ফকিরচাঁদের হাত ধরে কফিনের ভিতর ঢুকে প্রসব করার জন্য কাঠের দোকানগুলো অতিক্রম করে গেল। ফকিরচাঁদ দেখল ওদের কাপড়জামা জলে ভিজে সপসপ করছে। শীত সেজন্য ভয়ংকর। ওরা দুজনে প্রথম জামাকাপড় ছেড়ে ফেলল—এখন ফকিরচাঁদই সব করছে। সুমি অতীব দুঃখে এবং বেদনায় একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছিল। ওদের শরীরে কোনো আবরণ ছিল না। মাচানের নীচে সুমি ঢুকে যেতে চাইল। কিন্তু কফিনের ভিতরে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। কে! কে!’ ফকিরচাঁদ চিৎকার করে যুবকের মতো রুখে দাঁড়াল।
কফিনের ডালা খুলে মুখ বের করতেই বুঝল সেই পাগল, পাগলিনি। ওরা আশ্রয়ের জন্য এখানে এসে উঠেছে।
ফকিরচাঁদ বলল, তোরা সকলে মিলে সুমিকে ধর। সুমির বাচ্চা হবে।
ফকিরচাঁদ এবং পাগল হেমলক গাছটার নীচে বসে থাকল। পাগলিনি মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে সুমিকে কোলে তুলে চুমু খেল একটা। তারপর কফিনের ভিতর সন্তানের জন্ম হলে পাগলিনি গ্রাম্য প্রথায় তিনবার উলু দিল। সেই শব্দের ঝংকারে মনে হচ্ছিল সমুদ্র কোথাও না কোথাও আপন পথে অগ্রসর হচ্ছে, মনে হচ্ছিল— এই সংসার হাতির অথবা গণ্ডারের ছবির ভিতর কখনো-কখনো লুকিয়ে থাকে। শুধু কোনো সৎ যুবকের সংগ্রাম প্রয়োজন। পাগল হেমলক গাছের নীচে শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠল—’কে আসবি আয়, সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়। ফকিরচাঁদ ধূসর অন্ধকারের ভিতর সুন্দর হস্তাক্ষরে শিশুর নতুন নামকরণ করে অদৃশ্য এক জগতের উদ্দেশে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
[দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর’ এবং ‘সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়’ কবি বিমল চক্রবর্তীর কবিতা থেকে সংগৃহীত
এখন ফোঁটার সময়
কোনো কোনো দিন কাকে যে কীভাবে মুখর করে তোলে। চারপাশে মনে হয়। ব্যাপ্ত জীবন-আকাশ গভীর নীল, পৃথিবীর অদূরে শুকতারা জ্বলে। দখিনের হাওয়া বয়—মনের মধ্যে কারা কেবল কথা কয়ে যায়—জীবনের চারপাশে অপার এক সৌন্দর্য খেলা করতে থাকে। এরই নাম বোধ হয় জীবনের সুষম্য—কখনো অতর্কিতে সে আসে। আবার গভীর এক রহস্য লোকে সে হারিয়ে যায়।
আজ জানালা খুলতেই পূর্বার এমনটি মনে হল। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। বাগানে বড়ো বড়ো ডালিয়া, ক্রিসেন্থিমাম সব ফুটে আছে। শিশির ভেজা। সকাল সকাল তার আজ ঘুম ভেঙে গেছে। এত সকালে তার ওঠার অভ্যাস নেই। মা গায়ের লেপ সরিয়ে না দিলে সে উঠতেই চায় না। সকাল থেকে বাবা ডেকে যান, মা ডেকে যায়, আরে ওঠ। কত ঘুমাবি।
মা বলবে, ঘুম না ছাই। লেপে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে। পড়ার ভয়ে উঠছে না।
বাবা বলবেন, উঠে পড়। শুনছিস তো কী বলছে তোর মা।
আসলে পূর্বা জানে বাবা বিশ্বাসই করেন না, সে পড়ার ভয়ে না ওঠার মেয়ে। বাবা কি টের পান, ভোরে জেগে জেগে সে একটা স্বপ্ন দেখে। বাবা না হলে বেসিন থেকে হয়ত মুখ ধুয়ে আসার সময় চোখে পড়ে গেলে মিষ্টি করে হাসেন কেন!
তার ভাবতে লজ্জা লাগছিল।
বাবা এ-সব জানবেন কী করে!
মা জানতে পারে। মার কাছে তার এখনকার পৃথিবীটা পুরোনো পৃথিবী।
কিন্তু বাবা!
সে কেমন তাড়াতাড়ি গা ঢেকে ফেলল। চাদর মুড়ি দিয়ে অলস চোখে বাগানের ফুল ফোঁটা দেখছিল।
সে ভাবল, ফুল ফোটে।
সে ভাবল, তার এখন ফোঁটার বয়স।
সে জানালায় দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকে সূর্য ওঠা দেখল। কত সব পাখি উড়ে যাচ্ছে দূরের আকাশে। সবাই বের হয়ে পড়েছে। সে টের পায় সুদূরের সব সৌন্দর্য এখন তার সারা গায়ে শীত হয়ে জড়িয়ে আছে। সে ভিতরে ভিতরে আজ ভারি শীত অনুভব করল।
বাবা সকাল আটটায় বের হয়ে যান।
বাবা বোধহয় বাথরুমে। ঘড়িতে সে দেখল সত্যি বেলা হয়ে গেছে। সাতটা বাজে। শীতের সকালে সাতটা খুব বেলা নয়। তবু বাড়িতে সকালের দিকে খুব তাড়াহুড়ো থাকে। বাবা বের না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এটা চলে। সে দরজা ভেজিয়ে দেয়, দরজা বন্ধ করে শুতে তার কেমন এখনো ভয় লাগে। বাড়িতে সে মা বাবা, আর দুজন কাজের লোক। ওরা রান্নাঘরের ওদিকটার থাকে। সবার আগে ঘুম ভাঙে মার। মারই কাজ সবাইকে ডেকেডুকে তোলা। করিডোরে হাঁটাহাঁটির শব্দ হলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। মার ডাকাডাকিতেও ঘুম ভাঙে। তাদের দিকটার কোলাপসিবল গেট। রাতে শোবার সময় মা সেটা বন্ধ করে দেয়। কারণ বাবা-মা কেউ বোধ হয় কাজের লোক দুজনকে বিশ্বাস করে না। মেয়ে বড়ো হয়ে উঠছে, না চোর বাটপাড়ের ভয় কোনটা, সে বোঝে না। সুদামদা নিরীহ গোবেচারা মানুষ, আর নন্দ তো বুড়ো হয়ে গেছে। কতকাল হল আছে!
আজ নিনি মাসিরা আসবে। শীতের সময় নিনি মাসি, মেলোমশাই, অরূপদা এখানে একবার বেড়াতে আসেন। ফুল ফোঁটা দেখার সময় এ-কথাটা মনে হতেই ভেতরে সে কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন চাঞ্চল্য সে কেন জানি কোনোদিন অনুভব করেনি! তার হাই উঠছিল।
আসলে বড়ো হবার সময় কত অকারণে মনের মধ্যে নিশিদিন কি যেন এক রপকথার জগৎ ভেসে থাকে। অরূপদার ভারি ফাজিল স্বভাব। মাথায় গাঁট্টা মেয়ে কথা বলবে। বছর খানেকের বড়ো। তবু যেন তার কত খবরদারি।-এই পূর্বা, আবার জানালায় মুখ বাড়াচ্ছিস!
গাড়িতে যাবার সময় বাবা মেসো সামনে। সে মাসি অরূপদা আর মা পেছনে। সব সময় সে জানলার পাশে বসতে ভালোবাসে। অরূপদা তার সঙ্গে। সে দশ ক্লাশে উঠেছে। এবার। অরূপদার দশ ক্লাস শেষ। অথচ খবরদারিতে একেবারে বাবা মেসোর মতো!
আবার!
পূর্বা জানালার কাচ নামিয়ে মুখ বাড়িয়ে চারপাশের বাড়িঘর গাছপালা দেখতে ভালোবাসে। হু হু করে হাওয়া বয়। চুল ওড়ে, যেন এক ড্যাং ড্যাং বাজনা শুরু হয় ভিতরে। আর তখনই অরূপদার শাসনের গলা, ইস আবার!
চার পাশে তখন রা রা করে যেন বাজনা বাজতে থাকে আবার মিউজিক–ক্যান ইউ হিয়ার দ্য ড্রামস ফারনানডেজ। ওর তখন চোখ বুজে আসে। আবার কানে ভাসতে থাকে সেই অলৌকিক জগতের বাজনা-কিংবা সংগীত-সিনস মেনি ইয়ারস আই হ্যাভেন্ট সিন ইউ লাইং ফোল্ডিং ইউর হ্যাণ্ডস। অথবা নিল ডায়মন্ডের সেই সব সঙ্গীতমালা, ইউ আর দ্য সান, আই অ্যাম দ্য মুন, ইউ আর দ্য ওয়ার্ডস, আই অ্যাম দ্য টিউন। প্লে মি।
আসলে বাবা কী বুঝতে পারেন, এই খেলা তার জীবনে শুরু হয়ে গেছে। নতুবা আয়নায় এবার মুখ দেখে কেন! বাথরুমে ঢুকলে বের হতে ইচ্ছে হয় না। আয়নায় সে কত ভাবে যে নিজেকে এই বছর দুইয়ের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছে। সারা শরীর দেখার মধ্যে আশ্চর্য এক মজা পায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে আয়নার সামনে ভালোবাসে। বাবা কি টের পেয়ে গেছেন কেউ তার জীবনে সকালের সব পবিত্রতা নিয়ে জেগে উঠছে। ঠিক সূর্যের মতো। যেন লালা আভা, দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত্র, কীটপতঙ্গের আওয়াজ, ঝাঁকে ঝাঁকে নিরন্তর পাখিদের ওড়াউড়ি কোন এক সুদূরের জগতে নিয়ে চলে যায় বাবা কি সকালে মুখ দেখলেই এ-সব টের পান। এবারে সরস্বতী পূজার সময় বাবা না হলে তার জন্য হলুদ পাড়ের সাদা জমিনের শাড়ি কিনে আনলেন কেন! বললেন কেন, পূর্বা তুমি এই শাড়িটা পরে অঞ্জলি দেবে!
তখনই মার গলা পেল।
— কীরে এয়ারপোর্টে যাবি নাকি!
পূর্বার মনে হল মাসিদের আনার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ি যাবে। সব বারই সে মা-বাবার সঙ্গে যায়। নিনি মাসি মার বোন নয়। ছেলেবেলায় একসঙ্গে মানুষ, মার তো আর কেউ নেই। তার একটা মামা পর্যন্ত নেই। নিনি মাসিকেও দেখে বোঝা যাবে না, কথায়-বার্তায় এমনকী ব্যবহারে, নিজের বোনের চেয়েও বেশি। বোম্বেতে গেলে ওদের মাসি ছাড়তেই চায় না। যেমন কলকাতায় এসে মাও ছাড়তে চায় না নিনি মাসিকে। কটা দিন বাবার চেম্বার, নাসিংহোম সব কেমন ঢিলেঢালা। কখনও দীঘা, কখনো মুর্শিদাবাদ, আবার কখনো পিকনিক করতে চিড়িয়াখানায়। নানা রকম প্রোগ্রামে দিনগুলি ঠাসা থাকে।
কেন জানি সে বলল, আমি যাব না মা। তোমরা যাও।
মার কথা বলার সময় নেই। বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে বলে গেল পূর্বা যাচ্ছে না। শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই।
শরীর ভালো নেই বললেই বাবা সব বোঝেন। তখন আর কেউ তাকে পীড়াপীড়ি করতে সাহস পায় না।
এই শরীর ভালো না থাকার মধ্যেও সে দেখেছে বাবা মজা পান। সে যে গিয়ে বলবে, ধূস, তোমরা যে কী না, আমার শরীর ভালো নেই কে বলল! এমনি যেতে ইচ্ছে করছে না। দু-বছরে সে কত বড় হয়ে গেছে বাবা-মা বুঝবে কী করে। এই তো সেবারে অরূপদারা এল, তার ঘরে অরূপদা সব কিছু নিয়ে টানাটানি করত। তার ছবির খাতা, অ্যালবাম, ক্যাসেট, রেকর্ডপ্লেয়ার যা কিছু সবই হাঁটকাত। এটা না, ওটা। কী কেবল ‘আবা’র রেকর্ড দিচ্ছিস। বনি-এমে’র রেকর্ড দে না শুনি। সেই গানটা বাই দ্য বিভারস অব ব্যাবিলন, অথবা সেই রেকর্ডটা, নেভার চেঞ্জ লাভার এট মিড-নাইট। কেন যে এ গানটা এত ভালোবাসত অরূপদা। না দিলে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিত। অরূপদা রেকর্ডটা বাজাবেই। সে কিছুতেই দেবে না— কী বিশ্রী গান! না ওটা না। এটা শোন, আবার সেই রেকর্ড দিলে, অরূপদা সুইচ অফ করে দিত। এটা তোর খুব ভালো গান, না! ইউ আর দ্য ওয়ার্ডস, আই অ্যাম দ্য টিউন! এই একটাই বুঝেছিস!
হ্যাঁ বুঝেছি। যাও। ভাল লাগে না শুনবে না। তোমাকে কে শুনতে বলেছে! জোর করে পূর্বা সুইচ টিপে দিলে অরূপদা ফের ওটা আল্পা করে দেবেই। সে যতবার দেবে ততবার। তখন দুজনেরই গলা সপ্তমে। মাসি দেখ অরূপদা আমার সঙ্গে কী করছে!
ডাইনিং টেবিলে দুই বন্ধুতে ছেলেবেলার গল্পে মশগুল–মাঝে মাঝেই পূর্বার ঘর থেকে হাঁক আসছে—ওরা দু’জনেই চিক্কার করে ওঠে এখন, আবার শুরু হলো শম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধ।
আমাকে মারছে।
এই অরূপ মারছিস কেন?
না মা, মারছি না। মিছে কথা বলছে। তারপর আরম্ভ হতো দু-জনের মধ্যে রেকর্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি-ধস্তাধস্তি।
সে কিছুতেই রেকর্ডটা বাজাতে চাইত না। গানটার মধ্যে কি যেন এক নগ্ন নির্জনতা লুকিয়ে আছে। অরূপদাটা যে কী! কিছু বোঝে না! ছেলেমানুষির চুড়ান্ত। পাশের ডাইনিং স্পেসে মা–মাসি, ঘরে সে আর অরূপদা—এমন একটা গান বাজছে শুনলে মা-মাসি কী না মনে করবে। নেভার চেঞ্জ লাভার এট মিড-নাইট। এই মিড-নাইট কথাটাই কেন জানি আজকাল তাকে ভারি হন্ট করে। কতদিন ঘুম আসে না। ছটফট করে। কখনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। দুবছরে সে বুঝেছে, কেন অরূপদা গানটা এত ভালোবাসে। মধ্যরাতে মানুষের ভিতর এক আশ্চর্য নির্জনতা জেগে ওঠে। বোধ হয় এই বয়সে এটা বেশি হয়। মনে হয় সে এবং কেউ কোনো নদীর ধারে, কিংবা গভীর বনের অভ্যন্তরে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সব সবুজ বৃক্ষ, লাল নীল ফুল ফুটে আছে চারপাশে–আবার খড়ের বন, বন পার হলে নদীর চরা—বালিয়াড়ি, দু-পা বালির ভিতর ঢুকিয়ে নদীর জলকল্লোল শুনতে পায়। শরীর তখন তার অবশ হয়ে আসে। অথবা স্বপ্নে সে এমন সব কিছু দেখে ফেলে যা ঘুম ভাঙলে মনে হয় কি যে একটা অসভ্যতা সে করে ফেলেছে। বাবা কি তার চোখ দেখলে, রাতের স্বপ্নের কথাও টের পান। তখন সে কেন জানি বাবার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে না। আশ্চর্য এক অপরাধবোধে সে বাবাকে দেখলেই মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
বাবা দরজার পাশে এসে বললেন, তুমি তবে যাচ্ছ না।
তোমরা যাও। আমার যেতে ভালো লাগছে না।
বাবা এরপর আর কোনো প্রশ্ন করবেন না সে জানে। মায়ের মতো বলবে না, তোমার কি শরীর খারাপ! জ্বরজ্বালা না হলে বাবা তার শরীর খারাপ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে না। শরীর খারাপ কথাটা একজন নারীর পক্ষে কত দূরের খবর যে বয়ে আনে বাবা বুঝবে কী করে! যদিও ভারি অস্বস্তি হয় তার তখন। কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়—অথবা র্যাক থেকে গল্পের বই নিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে ইচ্ছে হয়—কেমন এক আলস্য সারা শরীরে জড়িয়ে থাকে তখন। আজ তার সে সবের কিছুই হয়নি। বরং সে আজ একটু বেশি ছিমছাম। এক হপ্তাও হয়নি, সময়টা পার হয়ে গেছে। দু-তিন হপ্তার জন্য নিশ্চিত। সে ইচ্ছে করলে সহজেই বের হয়ে পড়তে পারে।
কিন্তু কেন যে সে বলল, যাবে না, মাথায় কিছুতেই আসছে না। তার খুবই ইচ্ছে করছে, বলে, সে যাবে। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বাধা তাকে আটকে রাখছে। কেন এই সংকোচ সে ঠিক বুঝতেও পারছে না। দু-বছরে সে কতটা যে বদলে গেল! আগে সে এতটা ভাবতই না। সবার আগে গিয়ে সেজেগুঁজে বসে থাকত। ফ্রক গায়, বব করা চুল, সাদা মোজা, আর হালকা প্রসাধন মুখে। মেসো গাড়িতে ওঠার সময় তার দিকে তাকিয়ে বলত, ব্লমিং মাই গার্ল। এবারে কী বলত! অরূপদা প্রথম দিকে কেমন একটা আলগাভাব দেখাত। যেন চেনেই না। তারপর দিন যেতে না যেতেই অসুরের মতো উপদ্রব শুরু করে দিত। কোথায় কোনো সিনেমায় কোন নায়ক কীভাবে হাঁটাচলা করে, কিংবা কথা বলে সব নকল করে দেখাত। তারপর মজা করার জন্য বলত, মার দেঙ্গা। কেইসে তুম হো! আর তখনই তার রাগ বাড়ত। একদম হিন্দি বলবে না। তোমার এমন কথা শুনলে আমার বন্ধুরা হাসবে। আসলে পূর্ব বাংলা মিডিয়ামে পড়ে। ইংরেজিটা ভালো আসে না। অরূপদার সব কথাই হয় ইংরেজি না হয় হিন্দিতে। সে বলে দিয়েছে, আড়ি। এ কীরে বাবা, বাংলা বলতে পার না।
পারি। ঘোড়া হোড়া।
আবার ইয়ার্কি হচ্ছে!
আচ্ছা বাবা বাংলাই বলব। তোর এত রাগ কেন বুঝি না!
রাগ আবার কী! ও-ভাবে কথা বললে, কাছের মানুষ তোমরা মনেই হয় না।
কত সহজে সে বলতে পেরেছে অরূপদাকে, কাছের মানুষ! অরূপদার সেই থেকে কেমন একটা অধিকার জন্মে গেছে। মতো তার ঘরে এসে এটা ওটা ধরে টানাটানি করত। তুই আজকাল খুব হালকা নভেল পড়ছিস দেখছি। তারপর হেডলি চেজ থেকে আরম্ভ করে হ্যারল্ড রবিনস, আরভিং ওয়ালেস, এমনকী আরও আধুনিক লেখকদের নাম করে বলত, পড়বি। একটা বই দিয়েছিল অরূপদা, দু পাতা পড়েই শরীর কেমন গোলাচ্ছিল। মেয়েদের এ-সব কথা এ-ভাবে লেখা যায়। নোংরা! তুমি এ-সব পড়ো। ছি!
পড়তে বারণ করছিস!
একদম পড়বে না।
কেন পড়লে কী হয়!
নষ্ট হয়ে যায়।
নষ্ট হওয়াটা কী মজার তুই বুঝিস না।
আমি বুঝি। বুঝিস! আরে ব্বাস, মাই গড, তুই এত বুঝিস জানতামই না।
এবারে তবে জেনে রাখ।
কথাগুলো বলতে হয় বলে বলা। সে এত কিছু ভেবে বলেনি। শুধু বলেছিল, এসব বই পড়লে তুমি নষ্ট হয়ে গেছ ভাবব।
বাবা মাও তো পড়ে।
যা!
সত্যি বলছি।
পূর্বা কেমন অবাক হয়ে যায়। মানুষের কাছে এটা তো এক মুগ্ধ জীবনের প্রকাশ। ভারি গোপন। সবাইকে জানিয়ে দিলে এর সব স্নিগ্ধতা যেন নষ্ট হয়ে যায়। গভীর গোপন এই সৌন্দর্যকে নিয়ে চটকালে ফুলটা বিবর্ণ হয়ে যাবে না! এমনই ভাবে পূর্বা। অরূপদা ভালোবাসে বলেই ‘আবা’র বনি-এমের রেকর্ড কিনে এনেছিল—এই কী বাজাচ্ছিস, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। কী গান রে বাবা। চল তোকে আবা’র রেকর্ড কিনে দিচ্ছি। আশ্চর্য মিউজিক। রেকর্ডগুলো এনে বাজাবার সময়, আঙুলে তুড়ি মেরে কেমন গলা মিলিয়ে গাইত। পূর্বার মনে হত অরূপদা বড়ো কম বয়সে অনেক বেশি জেনে গেছে। মাঝে মাঝে রাগ হলে বলত, হঁচড়ে পক্ক।
সেই অরূপদারা আসছে।
গাড়ি বের হয়ে যাবার শব্দ পেল পূর্বা।
পূর্বা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিলে হয়।
নন্দ বলল, দিদিমণি চা।
সে চা না খেয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। সেই বড়ো আয়না। সে ছোটোবেলা থেকেই আয়নাটা দেখে আসছে। মাথা সমান একটা উঁচ আয়না দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা আগে বুঝত না, বাথরুমে এত বড়ো একটা আয়নার কী দরকার! যত বড়ো হচ্ছে তত বুঝতে পারছে আয়না আছে বলেই সে নিজের সব কিছু এত খোলামেলা দেখতে পায়। আগে সে বাথরুমে ফ্রক প্যান্টি খুলতে পর্যন্ত লজ্জা পেত। সে খুলত না। বাবাকে মনে হত, বুদ্ধির চেঁকি। আর জায়গা পেলে না! এত বড়ো আয়না এখানে! এখন বুঝতে পারে আয়নার রহস্য! আয়নাটা না থাকলে বাথরুমের আসল সৌন্দর্যটা নষ্ট হয়ে যেত। বাথরুমে ঢুকলেই আয়নায় সে তার নারী মহিমা টের পায়।
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ নিজেকে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখল। আশ্চর্য, আয়নার অদুরে কেউ দাঁড়িয়ে হাসছে। এই ফাজিল ছেলে, ওখানে কেন। মারব। সরে যাও বলছি। ছিঃ তুমি কী! যাওনা। নানা। ও-ভাবে না। আমি ওভাবে ভালোবাসি না।—পাশ থেকে? না না আমি মরে যাব। ও-ভাবে না! তুমি কী বোকা। এই পাগলের মতো কী করছ! আঃ।
সে কতক্ষণ আয়নার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না। কখনো চড়াই উত্রাই পার হয়ে গেছে কারো হাত ধরে, কখনো কোনো নির্জন দ্বীপে সে আর অরূপদা। একটা বোটে করে চলে গেছে। এক উলঙ্গ পৃথিবীর বাসিন্দা দুজনে। সবুজ প্রান্তর পার হয়ে ছুটে গেছে প্রজাপতি ধরতে। আবার কখনো সমুদ্রের তরঙ্গমালায় ভেসে যেতে যেতে চিৎকার করে উঠেছে, আমি ডুবে যাচ্ছি কেন। আমাকে কে তলিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের গভীরতা খুঁজে পাচ্ছি না অরূপদা! আর তখন অরূপদার ক্ষীণ গলা শুনতে পাচ্ছে, গভীরতার খবর আমি রাখি। আমি আছি বলেই তোমার এই গভীরতার সন্ধান দিতে পারব। আমরা আছি বলেই তোমার এই রহস্যময় গভীরতা পৃথিবীতে জন্মের ইশারা ডেকে আনে।
নন্দ ডাকছে তখন, ও দিদিমণি, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
তার হুঁশ ফেরে।
সে বের হয়ে এল শাড়ি পরে।
নন্দ বলল, কী সুন্দর লাগছে দিদিমণি! সরস্বতী ঠাকরুণ একেবারে।
এই মারব।
তুমি একেবারে দুগগা ঠাকুর হয়ে গেছ দিদিমণি!
মারব বলছি।
আসলে পূর্বার মনে হচ্ছিল দুগগা ঠাকরুণ না ছাই। বাথরুমে কত রকমের অসভ্য চিন্তা করেছে। ওটা ভালো না। নিজেকে বড়ো ছোটো মনে হয়। অথচ না ভেবেও কেন যে থাকতে পারে না। অসভ্যতা ভেবেও সে স্থির থাকতে পারে না। ভাবতে ভাবতে কখন অবশ হয়ে আসে শরীর। পিচ্ছিল এক নদীপথে ভাসমান নক্ষত্রমালার স্বপ্ন দেখতে দেখতে তার ঘুম চলে আসে। নন্দ তা বুঝবে কী করে! সে খুব সাহসী না। সে এখনও দরজা ভেজিয়ে শোয়। বন্ধ করে শুতে ভয় পায়।
আর তখনই সিঁড়িতে হৈ-চৈ করে উঠে আসছে কারা। অরূপদার গলা পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেই দেখতে পাবে তাকে। তাড়াতাড়ি নিজেকে কেমন লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। কেন যে সোজাসুজি ছুটে গিয়ে বলতে পারছে না—অরূপ-দা, কি মজা, তোমরা এসে গেছো! এবারে তোমাকে নিয়ে কাকুলিয়া পার হয়ে চলে যাব। কাঁচা রাস্তা, তারপর আর গাড়ি চলে না। আমরা হেঁটে যাব। গ্রামটা কী সুন্দর! সব গরিব মানুষের বাস। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। বাবা তার পড়ার খরচ চালান। বড়ো হোস্টেলে থাকে। বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে নিয়ে যান। এবার আমি তোমার সেখানে নিয়ে যাব। ওর বাবা মা কী ভালো। সামনে পুকুর, তেঁতুল গাছ কী প্রকাণ্ড, তার ছায়া কী গভীর আর কী ঠাণ্ডা! তেঁতুল গাছের নীচে আমরা দুজনে চুপচাপ বসে থাকব।
আর তখনই গলা পাওয়া গেল, এই পূর্বা তুই কোথায়।
সে আয়নায় নিজের মুখ দেখে চুলে সামান্য চিরুনি চালিয়ে বের হয়ে বলল, তালে এসে গেলে!
আমরা ভাবলুম, তোর আবার কোনো অসুখ-বিসুখ নাকি!
তুই গেলি না!
পূর্বা কিছু বলল না।
অরূপদাকে কিছু না বললেও আসে যায় না। নিজেই অজস্র কথা বলে যাবে। কে কী কথার জবাব দিল তোয়াক্কা করে না। দু-বছরে মানুষ সত্যি দ্রুত বদল হয়ে যায়। অরূপদা আরও লম্বা হয়েছে। ঢ্যাঙা, লম্বু। চুল ব্যাকব্রাস করা। নরম নীলাভ দাড়ি গালে অল্প অল্প। প্রায় নবীন সন্ন্যাসী গেরুয়া পরলে। পূর্বা ঠিক চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
আবার অরূপদার কথা, এই আর। তোকে মা ডাকছে বাবা খোঁজাখুঁজি করছেন।
পূর্বা জানে ওরা এখন বসার ঘরে। বসার ঘরটা করিডোরের শেষ প্রান্তে। সিঁড়ির মুখেই। মা ওদের জলখাবার করার জন্য ব্যস্ত। বাবা বসে শহরের যানজট নিয়ে কথা বলছেন। বাবার এক কথা, যে ভাবে পপুলেশন বাড়ছে, বামফ্রন্ট কেন, কোনো সরকারেরই ক্ষমতা নেই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
প্রায় যেন অরূপদাই তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। সে যেতেই মেসো বলল, দেন মাই ফেয়ার লেডি, কেমন আছ!
পূর্বা হেসে বলল, ভালো।
— পড়াশোনা কি রকম চলছে?
— ভালো। আসলে পূর্বা এর চেয়ে বেশি জবাব দিতে পারছে না। এবারে মাই ব্লমিং গার্ল না বলে, মাই ফেয়ার লেডি বলছে। সে কেমন নিজের মধ্যে অতর্কিতে ড্রাম পেটানোর শব্দ শুনতে পায়। সে বড় হয়ে গেছে। শাড়ি পরলে বড়ো দেখায়। আর বোধ হয় ঠিক ফ্রক গায় সে আর তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। আসলে মেয়েরা শাড়ি পরলে অনেক বড়ো হয়ে যায়। সে প্রায় ছুটেই বের হয়ে গেল। বলল, আসছি।
আসলে জীবনের এই মাধুর্য কেউ জানে না কখন জেগে ওঠে। রান্নাঘরে এসে সে এটা-ওটা মাকে এগিয়ে দিচ্ছে।
মা অবাক!—কী রে তুই। তোকে এ-সব কে করতে বলল! যা ওদের সঙ্গে গল্প করগে। ওরা কী ভাববে!
অরূপ রান্নাঘরে ঢুকে বলল, আন্টি তোমার মেয়ে পালিয়ে এল কেন?
কী জানি! জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, কেন পালিয়ে এল।
আমার ইচ্ছে। বলে সে আবার মাকে কাজে সাহায্য করতে গেলে তার মা কেমন বিরূপ হয়ে উঠল।—সব ভাঙবে। ইস তোমাকে কে বলেছে! কবে ঢুকেছ। মেসোকে গিয়ে বল হাত মুখ ধুয়ে নিতে। ওদের ঘরগুলো দেখ ঠিক আছে কি না!
পূর্বা ঘর হয়ে এল। মা বুঝতেই পারছে না, সবার কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। অরূপদার চোখ কি রকমের বন্য, মেসোর চোখে অপার প্রশান্তি, মাসির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো যেন বলা, যাক তবে বড়ো হয়ে গেলি! অরূপদার বন্য চোখ দেখলে সে কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। অরূপদার ঘরটায় সব ঠিক আছে কি না–পার্ট করা সাদা চাদর বের করল, বালিশের ওয়াড় পাল্টে দিল, সামান্য ঝুল ছিল কোণায়, নিজেই তা পরিষ্কার করার সময় দেখল অরূপদা হাজির। তাকে অরূপদা এক দণ্ড কোথাও একা থাকতে দিচ্ছে না।
এই।
বল!
এখানে এ-সব কী হচ্ছে!
কী করব।
চল না সেই রেকর্ডটা বাজাই।
কোনটা?
কিস মি, কিস মি।
না।
কেন না।
বললাম তো না।
অরূপ বলল, দেন লেট মি কিস ইয়ু বলে হাত ধরে টানতেই পূর্বা কেমন ক্ষেপে গেল, ছোটোলোক! ইতর!
অরূপ কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। সে মাথা নীচু করে বসে থাকল। পূর্ব ছুটে বের হয়ে গেছে।
পূর্বা নিজের ঘরে এসে কেমন হাঁপাতে থাকল। সে বলতে চায়নি। সে এত ছোটো নয়, তবু কেন যে এমন কুৎসিত ভাবে অরূপদাকে অপমান করল! কী তার হয়েছে! সে তো চায় কোনো কাশবনের গভীরে অরূপদাকে নিয়ে প্রবেশ করতে সে তো চায়, আকাশের নীচে একজন মানুষই তার সর্বস্ব কেড়ে নিক— তবু কেন, সে এ-ভাবে মানুষটার খোলামেলা স্বভাবে আঘাত দিতে গেল। নিজের মধ্যে এত সব বৈপরীত্য কাজ করে কেন! কেন! সে প্রায় বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বালিশে মুখ চাপা দিল। এমন সুন্দর মানুষটাকে অপমান করে এসে বিষের জ্বালায় নিজেই জ্বলছে।
সে-দিনই রাতে প্রথম পূর্বা তার দরজার ছিটকিনি আটকে ঘুমাতে গেল। জীবনে আর একটা নতুন ভয় এবার তার সামনে হাজির। সবাই জেনে গেছে এই বয়সেই বালিকারা নারী হয়ে যায়। আর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে শুনতে পেল সুদুরে সেই মিউজিক বাজছে, আই অ্যাম দ্য সান, ইউ আর দ্য মুন, আই অ্যাম দ্য ওয়ার্ডস, ইউ আর দ্য টিউন। মিউজিক শুনতে শুনতে নারীমহিমায় চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল পূর্বা।– প্লে মি।
কপালি
কপালি থেকে গেল।
কপালির বাপ কালীপদ বলেছিল, বাবু ভালোমানুষ। থাক। মন টিকে গেলে থাকবি। মন খারাপ হলে বাবু চিঠি দেবে, তখন না হয় নিয়ে যাব। থেকে দ্যাখ। পেটভরে খেতে পাবি। জামাকাপড়ের অভাব রাখবে না। তা ছাড়া দেশের মানুষ। অচেনা নয়।
এর আগেও দেশের মানুষের বাড়িতে কপালি যে কাজ না করেছে তা নয়। তবে তার মন টেকে না। দুদিন যেতে না যেতেই বাড়ির জন্য মন খারাপ। বাড়ি বলতে খালপাড়-ভাইবোনগুলির জন্য মন পোড়ে। ভিটেমাটি বলতে কাঠা দু-এক জমি, সরকারের খাস থেকে পাওয়া। ছিল বিগেখানেক–কমতে কমতে কাঠা দু কাঠায় ঠেকেছে। খড়ের চাল, মাটির দেয়াল আর যেদিকে চোখ যায় বনজঙ্গল গাছপালা। খালের জল নদীতে গিয়ে পড়ে। নদী থেকে সমুদ্রে।
নদীর পাড়ে দৌড়ে গেলেই হুহু করে হাওয়া উঠে আসে। কপালি ফাঁক পেলেই দৌড়ে বনজঙ্গল পার হয়ে নদীর ধারে চলে যায়–ও-পার দেখা যায় না, নদীর ঢেউ, ভটভটির শব্দ, নীল খোলামেলা আকাশের নীচে সন্ধ্যা তারা কিংবা দূরের বটগাছ, বটগাছের নীচে সাধুবাবার আশ্রম—মেলার সময় কী ভিড়, কী ভিড়!
তার মধ্যে আছে এক প্রকৃতির সুষমা।
বাপ কালীপদ এটা জানে, বোঝে। বনজঙ্গল পার হলেই নদী, ঘরের পাশে খাল, আদিগন্ত মাঠ সামনে—ফসলের দিনে সবুজ গন্ধে বাড়িটা ডুবে থাকে।
বৃষ্টির দিনে কাঠকুটো পাঁজাকোলে করে নিয়ে আসে। ভিজা কাঠে ধোঁয়া। বারান্দায় ভুখা ভাইবোনগুলির জন্য কপালি একদণ্ড বসে থাকে না। মা নেই—সে নামেই বাপ। বাপের কাজ তো কিছুই করতে পারে না। রায়মশায়দের বড়ো শরিকের ছোটোবাবুর পুত্র শহরে থাকে। বিদ্যার জাহাজ। তবে সংসারে শান্তি নেই। রোগভোগে বাবুর পরিবার জেরবার। সে দায়ে, অদায়ে ছোটোবাবুর কাছে যায়। তিনিই বলেছিলেন, বৌমা ছেলেপুলে নিয়ে পারে না। বিশ্বাসী লোকজনের খোঁজ পাসতো জানাবি।
বাবুতো জানে না, কপালি বড়ো হয়ে গেছে। বাবুতো জানে না, কপালি দু-দুবার শহরে কাজ করতে গিয়ে টিকতে পারেনি। একাই একবার চলে এসেছিল। রাস্তাখান তো সোজা না। শ্যামবাজার থেকে বাস। বাসে বারাসাত। আবার বাস। বাসে মহেশখালি। মহেশখালি থেকে ভটভটিতে পা কা দু-ঘণ্টা। তারপর ঘাট থেকে নেমে টানা এক ক্রোশ পথ। সকালে বের হলে গাঁয়ে পৌঁছাতে সাঁজ লেগে যায়। বড়োই দুর্গম অঞ্চল। শাকপাতা, বন আলু, খালে বিলে মাছ আর নদী ধরে যায় হাঁড়ি পাতিলের নৌকা। কপালির নেশা—ওই হাঁড়ি পাতিলের নৌকা দেখা। ঘাটে যদি ভিড়ে যায়—টাকা পাঁচসিকেয় সে যা পারে কিনে আনে। শহরে টাকা ওড়ে কালীপদ জানে। সে নিজেও শহরে গিয়ে সুখ পায় না। কপালি চলে এলে কোনো ধন্দ থাকে না। বনজঙ্গলের নেশা। সহজে কাটবার নয়। বাবুরা বুঝিয়েও রাখতে পারেনি। সে কান্নাকাটি করলে রাখেই বা কী করে? দেশগাঁয়ের লোক পেলে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না।
তা কালীপদ বলেছিল, বিশ্বাসীজন তো ঘরেই আছে বাবু। সে কারো কাঠকুটোও সরায় না। তবে ওই এক বদভ্যাস বাবু।
কী বদভ্যাস! কে সে!
আমার কপালি। গতরে খাঁটি। মেয়েটা ঘর সামলায়। দু দু-বার শহরে পাঠালাম। মন টিকল না।
বদভ্যাসটি কী বললে না!
নেশা বাবু।
কীসের নেশা!
বনজঙ্গলের। নদীর পাড়ের। খোলা আকাশের।
নেশা বলছ কেন?
তা ছাড়া কী বাবু। ওইতো সেবারে কপালি শহর থেকে চলে এসে ভয়ে বাড়ি ঢোকেনি। পাছে মন্দ কথা বলি। বড়ো খাটতি পারে। বললাম, চলে এলি!
বাবুরা মন্দ স্বভাবে!
কী বলে!
কিছু বলে না।
ভালো নয়। কিছু না বললে চলবে কেন! শহর তো ভালো জায়গা নয়। কপালির মন্দ কিছু করেনি তো!
না বাবু। মন্দ কিছু করলে বলতনি! তার নাকি পেয়ারা গাছটা ছাগলে না হয় গোরুতে খাবে এই আতঙ্ক।
কপালি পেয়ারা গাছ লাগিয়েছে?
শুধু কী পেয়ারা গাছ! বাড়ি থাকলে, আনাচে-কানাচে নিজের মাটিটুকু সাফ করে লঙ্কা গাছ, কুমড়ো গাছ, ফুলের গাছ যা পায় লাগায়। গাছের যত্নআত্তি জানে। এটাও নেশা।
তা কপালির বদভ্যাস বলছিস কেন?
ওইতো বলছি বাবু, তার মন পুড়লে চলবে! পেট পুড়লে মন কি ঠিক থাকতে পারে! আগে তো পেট বাবু, পরে তো মন—কী বলেন, ঠিক বলিনি!
সবই ঠিক। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারিস। হোকন অফিস যাবে না বৌ সামলাবে, বাচ্চা সামলাবে বুঝতে পারছি না। ঠিকা কাজের লোক আছে। তার মাকে ফের চিঠিতে লিখছে, দেশ থেকে যদি কেউ যায়।
চেনাশোনা ছাড়া বাড়িতে কাউকে রাখাও যায় না। দিনকাল বড়ো খারাপ। ঝি চাকর গলায় ছুরি বসায়—খবরের কাগজ দেখে তো ঘিলু ঠাণ্ডা মেরে যায়। কাকে যে পাঠাই।
কপালিরে দিয়ে আসব বাবু?
থাকবে?
সেই। থাকবে কি না কথা দিতে পারব না। কন্যে লকলক করে বাড়ছে বাবু। কুমড়ো গাছের মতো—এ-বেলা দেখলেন একরকম, ও-বেলা অন্যরকম। আমার কপালি কাজ করলে ক-টা কাচা পয়সা হয়। তা কন্যে মাথা পাতছে না। শহরের কথা তুললেই মন খারাপ, মেজাজ খারাপ-খাঁচার মধ্যে বন্দি। আমি কী টিয়া না ময়না। খাঁচায় পুরে দিয়ে আসতে চাও!
কথা তো মিছে না। কপালির দোষ নেই। তবে খোকন বেশ বড়ো জায়গা নিয়ে বাড়ি করেছে। আমি জমিটা কিনে রেখেছিলাম—কোনো রকমে বাড়িটা করেছি। তোর গিন্নিমা গিয়েও সুখ পায় না।
কলকাতায় আমারও মন টেকে না। কেন টেকে না বলতো?
সেইতো কথা বাবু। কপালির দোষ দিই না। আমার ভাগ্য। বাপের স্বভাব পেয়েছে। শহরে যেতে পারলাম কৈ বাবু? কেত্তনের গলাখানা আমারে খেয়েছে। তা খোলে চাপড় মেরে যখন গাই, ও রাই নিশি যে পোহায়—শহরে কে বোঝে তার মর্ম বলেন।
নিশি যে পোহায়।
খুবই দামি কথা। ছোটোবাবু ঝিম মেরে থাকেন। কথা বলেন না। শুধু মাথা ঝাঁকান—নিশি যে পোহায়।
তা কপালিরতো নিশি পোহাবার সময় নয়। নিশি সবে শুরু। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী। ওরে একদিন নিয়ে আয়, দেখি।
কালীপদ এক ক্রোশ হেঁটে কপালিকে দেখাতে নিয়ে গেছিল। বাবুর সম্রম আছে এ-তল্লাটে। লোকে এক নামে গড় হয়।
সেও কপালিকে গড় হতে বলেছিল।
দিব্যি কোঠাবাড়ি—সামনে গন্ধরাজ ফুলের বাহার। কপালি এক ফাঁকে কখন যে গাছের কাছে চলে গেছে। ফুল তুলছে। খোপায় গুঁজেছে। তারপর বাবুর পায়ে গড় হলেই বলেছেন, কপালি তুই ফুল হয়ে ফুটে থাকতে চাস ভালো। টিয়াপাখির মতো উড়ে বেড়াতে চাস ভালো—বয়েসটাতো ভালো না। তা কালীপদ শাড়ি কিনে দিও। বলে দুখানা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ঘুরে দেখে আসতে পারিস। মন টিকলে থাকবি, না টিকলে কী করা! বাচ্চাদুটোকে দেখাশোনা করবি, পারবি না!
কপালি একবার বাপের দিকে তাকায় অন্য বার বাবুর দিকে তাকায়। কিছু বলে না। যা বলবে বাবা, যা করবে বাবু। সে তো সব বুঝতে পারে না।
তা কালীপদ নিয়ে যাও। মেরে তোমার মাথা পাতবে মনে হয়। খাঁচায় বন্দি থাকবে না। বাড়িটায় ঝোপজঙ্গলও গজিয়েছে। বর্ষাকাল বোঝইতো। সাফ না করলে ঘাস, ঝোপজঙ্গলে ভরে যায়। বনজঙ্গলেরতো নিশি পোহাবার বালাই নেই। আপনিই বড়ো হয়, আর আপনিতেই মজে যায়। শীত এলে বুঝি। ফাগুনের বাতাসেই পাতা ঝরতে থাকে। কীরে কপালি বুঝলি কিছু?
ফিক করে হেসে দিয়েছিল কপালি। বাপের পেছনে গিয়ে মুখ লুকিয়েছিল। কোনো কথা বলেনি।
দুদিন পরে ফের গিয়েছিল কালীপদ। গড় হয়েছিল।
কী খবর।
মেয়েতো মাথা পেতেছে বাবু।
বলিস কী?
ওই যে বলেছেন, ঝোপজঙ্গল আছে—কী বুঝল কে জানে—বলল, কবে যাব বাবা। তুমি দিয়ে এস।
তারপর টাকাপয়সার রফা। কপালি টাকাপয়সার মধ্যে থাকে না। টাকাপয়সা সে বোঝেও না। ভাই-বোনগুলি খেতে পাবে—উদোম হয়ে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করবে না-দিদি যাবে শহরে—তা পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে—কবে আসে দিদি—এলেই দৌড়। দিদির কোমর জড়িয়ে চিৎকার—আমার দিদি। দিদি এসেছে।
কপালির এই সুখটাও কম না। এই ভাবনাটাও বড়ো মধুর।
তা কপালিকে নিয়ে রওনা হবার সময় কালীপদ বার বার বুঝিয়েছে, ভেবে দ্যাখ, আমার মুখ পোড়াস না। বাড়িঘর দেখে পছন্দ হলে থাকবি, নয়তো সঙ্গে নিয়ে ফিরে আনব। বাবু নতুন শাড়ি দিয়েছে। শাড়ি পরতে শিখে গেলি। বেইমানি করলে, মুখ থাকবে না।
সে শহরে ঢুকে দেখল, তারাবাতির মতো রাস্তায় আলো জ্বলছে। লোকজন, হট্টগোল পার হয়ে ঠিকানা খুঁজে বাড়িখানা বের করতেই হিমসিম খেয়ে গেল।
নতুন বাড়িঘর উঠছে। এদিক ওদিক ফাঁকা জমিরও অভাব নেই। গাছপালাও চোখে পড়ছে। ডোবা কচুরিপানায় ভরতি, ইট সুরকির রাস্তা—তারের লাইন চলে গেছে মাথার উপর দিয়ে। গাঁয়ের আসটে গন্ধটা যে মরে যায়নি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই কপালি টের পেল।
গেট সামনে।
ঝুঁকে, কী লেখা দেখল কালীপদ। নিকু’ ভবন। ছোটোবাবুর নামে বাড়ির নাম। সান বাঁধানো রাস্তা গেট থেকে। কালীপদ গেট খুলতেই ভিতরে আলো জ্বলে উঠেছিল!
কে? কে?
আমি খোকনবাবু। আপনার বাবা পাঠিয়েছে।
দরজা খুলে বলেছিল, ভিতরে এস। তারপর খোকনবাবু পত্রখানা পাঠ করে বলেছিল, তোমার মেয়ে।
আজ্ঞে বাবু।
খোকনবাবুর স্ত্রীও হাজির।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বাবা পাঠিয়েছে।
স্ত্রীটি যে কমজোরি দেখে টের পেয়েছে কালীপদ। কপালি গা ঢেকে একপাশে অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।
চিঠির বয়ানটি খুব মধুর ঠেকেনি। বাবা লিখেছেন, সুজাপুরের লোক এরা। বাবা কীর্তন গাইয়ে। মেয়ে ফুল-বিলাসী। দ্যাখো রেখে, যদি টিকে যায় ভালো। না টিকলে চিঠি দেবে—কালীপদ গিয়ে নিয়ে আসবে।
কীরে থাকতে পারবিতো?
ঘাড় বাকিয়ে দিয়েছিল কপালি।
কালীপদ দুগগা নাম জপ করছে। বললেই হল, আমি যাব বাবা।
কোথায় যাবি।
তোমার সঙ্গে চলে যাব।
যাক ঘাড় কাত করেছে। থাকতে পারবে বলছে। তবু সারারাত কালীপদ ঘুমোতে পারেনি। খাওয়াটাও পেটের কসি আলগা করে—মুগের ডাল, বেগুনভাজা, ইলিশ মাছের ঝাল, চাটনি। শেষ পাতে গিন্নিমা দুটো মিষ্টি দিয়েছে। বাচ্চা-দুটি যে জমজ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। দেখতে একরকম। একটা গেলে, আর একটাকে খুঁজে আনলেও চলে।
সকালে উঠে কালীপদ কপালিকে বিছানায় দেখতে পায়নি। বাইরের ঘরে তাদের থাকতে দিয়েছে। ফুল ফল আঁকা রংচঙে মেজে। মাদুর দুখানা, বালিশ দুখানা। বড়ো বড়ো জানালা খোলা। বাবু পাখা চালিয়ে দিলে বলেছিল, না বাবু, পাখার হাওয়া সহ্য হয় না। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে। মাথা ধরে।
তা এই গরমে!
গরমকালে, গরম থাকবে না! সে হয় বাবু!
বৃষ্টি বাদলার দিনে বৃষ্টি না হলে গরমের প্রকোপ বাড়ে। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। তবু কালীপদ পাখা চালাতে রাজি হয়নি।
কপালিও বেঘোরে ঘুমিয়েছে।
সকালে উঠেই দেখেছে, কপালি বিছানায় নেই। গেল কোথায়। তা তার একটু বেলা হয়ে গেছে, উঠতে।
আকাশ ফর্সা। রোদ উঠে গেছে। এত বেলা অবধি কপালি বিছানায় থাকতে পারে না। অন্ধকার থাকতেই কপালির ঘুম ভেঙে যায়। তার হাঁস মুরগি আছে। মুরগির ডিম হয়। কপালি ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বানায়। বড়ো করে। সংসারে শতেক কাজ।
সে দেখল দরজা খোলা।
সদরও খোলা।
বাবুরা কেউ ওঠেনি। বাবুদের বেলা করে ঘুম ভাঙে। কিন্তু কপালি গেল কোথায়।
সদর ধরে বাইরে বের হয়ে এল। ভিতরের দিকের দরজা বন্ধ। কপালি কি হাওয়া হয়ে গেল। তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। আর তখনই দেখল বাড়িটা মেলা জায়গা জুড়ে। অথচ গাছপালা কিছু নেই। ফাঁকা জমিন—ঘাস বড়ো বড়ো। চারপাশে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গেটে তালা মারা। পাঁচিল টপকে কপালি পালাতে পারবে বলে মনে হয় না। সে আর্ত গলায় ডেকেই উঠত, বাবুগো আমার সর্বনাস হয়েছে।
কিন্তু তখনই দেখল, পাঁচিলের এক কোণায় কপালি ঝোপজঙ্গলে উঁকি দিয়ে আছে।
অ কপালি! তুই এখানে। তোরে খুঁজছি।
বাবা দেখবে এস।
কালীপদ ছুটে গিয়েছিল।
কলমি লতায় ফুল এয়েছে। কপালি ফুল দেখে কী খুশি!
পাঁচিলের কোণের দিকে সামান্য জলা জায়গা। শাড়ি তুলে কপালি কলমিলতার শাক তুলছে।
বাবু বের হয়ে বলছেন, আরে তোমরা এখানে?
কপালি কেমন লজ্জা পেল। সে পা ঢেকে সরে দাঁড়াল।
কপালির কাণ্ড দ্যাখেন বাবু! শাকপাতা তুলছে। আর কপালির এই দোষ, একদণ্ড স্থির হয়ে বসতে জানে না। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানায় নেই। বিদেশ জায়গা—ডর লাগে না বলেন! তা জায়গা তো অনেক। গাছ নাই একটা বাবু। কপালির ওই আর এক দোষ। ফাঁকা জমিন সহ্য হয় না। ওর দোষগুণ ক্ষমা করে নিলে, কপালি আমার সন্ধ্যাতারা।
তা সন্ধ্যাতারাই বটে।
কপালি কই রে!
যাই দাদাবাবু।
কলপাড়ে কী করছিস! ডাকলে সাড়া দিস না। বৌদিমণির ঘরে চা দিলি না।
কপালি দৌড়ায়।
কলপাড়টা কী হয়ে আছে! বর্ষাকাল-ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামে। ঝম ঝম করে আকাশ মেঘলা হয়ে যায়—ঘোর অন্ধকারে কপালি জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর কেন যে তার মনে হয়, জমি পরিষ্কার করে দুটো কুমড়োর চারা পুঁতে দিলে হয়। তার চোখ, বাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরে। সে দেখেছে এটো কাঁটা ফেলার জায়গায়, দুটো কুমড়োর চারা বর্ষার জলে লক লক করছে। সে ফাঁক খুঁজছিল— দাদাবাবু অফিস, অরুণ বরুণ মার সঙ্গে দিবানিদ্রা দিচ্ছে।
এই সুযোগ।
সে চুপি চুপি খুরপি হাতে বের হয়ে এসেছে। দাদাবাবু এত সকাল সকাল বাড়ি আসবেন বুঝতে পারেনি। সদরে ঢুকে গেলে কলপাড় থেকে বোঝায় উপায় থাকে না। সে কলপাড়ে কী করছে ভাবতেই পারে। জিভ কেটে সে দৌড়াল। বৌদিমণি দরজা খুলে দিয়েছে। খুবই অনায্য কাজ। সে আঁচলে হাত মুছে এক লাফে রান্নাঘরে ঢুকে বাসন সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দাদাবাবু বুঝুক, সে রান্নাঘরেই আছে।
বৌদিমণি বুঝুক, সে চা-এর জল গরম করছে।
দাদাবাবু রান্নাঘরে উঁকি দিতেই বলল, চা করে দিয়ে আসছি দাদাবাবু।
কোথায় থাকিস। কলপাড়ে গলা পেলাম। না, ঘরেই ছিলাম।
সে না ধরা পড়ে যায়। নতুন জায়গা, তবে সে বোঝে, বৌদিমণি বড়ো আয়েসি। সে খুবই কাজের। কারণ শহরে যে টাইমে জল আসে তাও সে জানে। গ্যাস বন্ধ করতে জানে, খুলতে জানে। বৌদিমণি খুবই অবাক–তুই এত শিখলি কবে?
বৌদিমণি, তোমাদের টাইমের জল নেই।
আসবে। কেন!
শহরে তো টাইমের জল থাকে।
আসলে বৌদিমণি টের পাক, সে শহরের অনেক খবরই রাখে। টাইমে জল আসে তারও খবর জানা। বৌদিমণিকে অবাক করে দিতে পারলে ভারি মজা। কুমড়োর চারা পুঁতে দিয়েছে। মাটিতে লেগে গেলেই ডগা মেলতে শুরু করবে। এটা তার আর এক আনন্দ।
সে বাজার করেও আনে।
লোকজনের সঙ্গে মিশতে শিখে গেছে।
ও মাসি, আমাকে দুটো লঙ্কার চারা দেবে।
কী করবি।
যারে কত জমি আমাদের। গাছ হলে লঙ্কা হয় তাও বুঝি জান না?
গাছ হলে লঙ্কা হয় খবরটা কপালি ছাড়া কেউ যেন বোঝে না।
দাদাবাবুর এক অভিযোগ, তুই ঘরে থাকতেই চাস না। থাকবে কি! খোলামেলা আকাশ যে তার প্রিয়। ঘরের মধ্যে কাহাতক বন্দি হয়ে থাকা যায়। বাড়ির ফাঁকা জায়গাটুকু না থাকলে তার যে কী হত।
এই কপালি।
আজ্ঞে যাই বৌদিমণি।
এত বেলা হল, চান করিসনি, খাসনি! কী করছিস?
রিনা দরজায় চুপি দিলে দেখতে পায়-কপালি কি লাগাচ্ছে।
কী আবার কার কাছ থেকে আনলি! তোর কি মাথা খারাপ আছে!
এই হয়ে গেল। যাচ্ছি।
ক-টা বাজে খেয়াল করেছিস?
তা অনেক বেলা। তারতো জমির আগাছা দেখতে ভালো লাগে না। সে যে নিজের মেলা জমি পেয়ে গেছে তারতো মনেই হয় না, সে এ-বাড়ির কেউ না। কুমড়ো গাছ, লঙ্কা গাছ,
ক-টা বেগুনের চারা পর্যন্ত পুঁতে দিয়েছে। কে যে মাথার দিব্যি দিয়েছে সে তাও জানে না, তবে দাদাবাবু একদিন খুবই প্রশংসা করেছে। তার হাতের গুণ আছে। কুমড়ো ফুল ভাজা খেতে খেতে দাদাবাবু এমন বলেছিল। তারপর বড়ো বড়ো কুমড়ো ধরল, গাছে লঙ্কা হল—দাদাবাবু দেখে আর অবাক হয়ে যায়।
সে কোত্থেকে দোপাটি ফুলের চারা এনেছে। কিছু রজনীগন্ধার মূল। এবং এক বছরেই সে বাড়িটায় পেঁপে গাছ, লেবুর গাছ এবং সঙ্গে দুটো আমগাছের চারা পর্যন্ত পুঁতে দিয়েছে। এত ফাঁকা জমিন—শুধু আগাছা থাকবে, হয়!
হঠাৎ বিকালে সেই কপালি উধাও। গেল কোথায়! না বলেতো কোথাও যায় না। বড় রাস্তা, বাজার ওদিকে, হানাপাড়া পর্যন্ত চেনে—তার বেশি না।
রিনা, কপালি নেই!
রিনা টেবিল পরিষ্কার করছিল।
কিছু বললে?
কপালিকে কোথাও পাঠিয়েছ?
নাতো! দুধ আনতে যায়নি তো। দ্যাখোতো রান্নাঘরে দুধের পাত্র আছে কি না?
দাদাবাবুর মাথা গরম। কপালির গায়ে কি শহরের জল লেগে গেল! সে যদি পালায়। তা কপালির মিষ্টি মুখখানি উঠতি ছোকরাদের টানতেই পারে। সকাল থেকে তো কাজের শেষ থাকে না।
এই কপালি যা, দোকান থেকে দাদাবাবুর ব্লেড নিয়ে আয়।
এই কপালি যা, রেশন তুলে আনগে।
এই কপালি যা, গ্যাসের লোকটাকে খবর দিয়ে আয় সিলিণ্ডার খালি।
কত লোককে সে এখন চেনে।
তুই কাদের বাড়িতে কাজ করিস রেবললেই কপালি ক্ষেপে যায়।
আমি কোথায় কাজ করি তা দিয়ে তোমার কী দরকার?
সে বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে একবার একটা কাগজি লেবুর কলম কিনে এনেছিল। লোকটা তাকে চেনে। খোকনবাবুর কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ে কাগজি লেবুর কলম দিয়ে কী করবে! মনে তার সংশয় হতেই পারে।
কোথায় লাগাবি!
কেন আমাদের বাড়িতে।
লোকটা হেসেছিল।
কপালির যে তখন কী রাগ হয় না। সে গজ গজ করছিল, আমার গাছ কোথায় লাগাব তাতে তোমার কি গো। জায়গা না থাকলে গাছ কেউ কেনে! গাছ না থাকলে বাড়ি হয়!
জানো দাদাবাবু লোকটা ভালো না।
কোন লোকটা!
ওই যে গাছের চারা নিয়ে বসে থাকে।
আবার গাছ কিনলি!
এই এতটুকুন গাছ। বেশি দাম না।
দাদাবাবু কিছু আর আজকাল বলেন না। বাড়িটাকে কপালি খুশিমতো বাগান বানিয়ে ফেলছে। আত্মীয় স্বজনরা এলে সে তার কিচেন গার্ডেন ঘুরিয়ে দেখায়। এতদিন বাড়ির পেছনের দিকটা ঝোপ–জঙ্গলে অন্ধকার হয়ে থাকত। এখন সেখানে একটা আগাছা গজাতে দেয় না কপালি। কপালির গাছ লাগার এত নেশা যে চান খাওয়ার কথাও মনে রাখতে পারে না। আবদার করলে সে নিজেও গাছের কলম কেনার জন্য আলাদা পয়সা দেয়। কপালিকে আর মনেই হয় না, সে এ-বাড়ির কেউ না। শহরে থেকে রং ফর্সা হয়ে গেছে। রিনাও পছন্দ করে, বকাঝকাও করে। পূজার সময় কপালির পছন্দ মতো সায়া শাড়ি কিনে দিয়েছে। নিজের শাড়ি একটু পুরোনো হলেই কপালিকে দিয়ে দেয়। কী খুশি মেয়েটা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখতেও পছন্দ করে। গোপনে কাজটা সারে। একদিন তার চোখে পড়ে যেতেই বুকের কাছে মাথা নীচু করে হাওয়া।
কিন্তু গেল কোথায়?
কার কাছেই বা খবর নেবে! উঠতি বয়েস। ফুলের মতো ফুটে উঠছিল সবে। কী যে করে!
কপালি অদায়িত্বশীলও নয়। যদি কোনো উটকো লোকের পাল্লায় পড়ে যায়।
সাজ লেগে গেল। সামনে কপালির ফুলের বাগান। টগর দোপাটি যুঁই মালতী কী ফুল নেই। সদর দরজায় রিনা দাঁড়িয়ে।
দুশ্চিন্তায় মুখ ভার। মেয়েটা শেষে না বলে-কয়ে পালাল!
রিনা দেখল তার মানুষটি ফিরে আসছে। একা।
কোনো খোঁজ পেলে! কেউ দেখেছে।
না। কেউ দেখেনি।
তবু একবার ভালো করে ঘরগুলি দেখা দরকার। বাড়িতে ঘরও অনেক। বাবার ইচ্ছে ছিল ফ্ল্যাট বাড়ি করার। দুটো করে হাজার স্কোয়ার ফিটের মতো ফ্ল্যাট। তার বাবা শেষে কেন যে মত বদলালেন। বাড়িতে থাকবে তো নিজের বাড়িতে থাকবে। বাইরের লোক বাড়িতে থাকা ঠিক না। ফ্ল্যাট বাড়িগুলি নিরাপদ নয়। কার বাড়িতে কোন অছিলায় কী লোক ঢুকে যাবে—কিছু বলাও যাবে না। পরে আর বাড়ির কাজে বাবা হাতই দিলেন না। দেশের জমিজমা বেচে দিয়ে শহরে চলে আসবেন এমনও ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না।
তোমার মা থাকতে রাজি না। বাবার এক কথা।
তোমার বাবাও শহরে এসে সুখ পায় না। বাবার এক কথা।
আসলে গাঁয়ে থাকলে এক রকমের স্বভাব, শহরে থাকলে এক রকমের।
ওদিকের ঘরগুলি খোলাও থাকে। বন্ধও থাকে। লম্বা করিডোর—দু-পাশে দুটো ফ্ল্যাট–এখন সবটাই তার ভোগ দখলে।
কোনো ঘরে যদি ঘাপটি মেরে থাকে। আকাম কুকাম করলে বুঝতে পারে কপালি, দাদা এসে চোটপাট করবে। দাদাবাবু বকতে পারে। তখন পালিয়ে থাকার স্বভাব। অন্ধকারও পছন্দ। শ্যামলা রং ধরেছে ইদানীং। বিয়ের বয়স ফুটে উঠলে যা হয়। লাবণ্য যেন উপচে পড়ছে। কারো নজর পড়বে না হয়! আর কপালি যদি মাথা পাতে।
দরজা খুলে সব ঘরগুলিই দেখা গেল।
ঘুমালে অঘোরে ঘুমায় কপালি। দিশা থাকে না। সাঁজ লাগলেও সাড়া পাওয়া যায় না। মরার মতো ঘুম। মাদুর পেতে শুতে তর সয় না। পড়লো তো মরল।
না কোনো ঘরে নেই। ছাদেও নেই। বাথরুম খুলে দেখল। তারপর অগত্যা দেশেই খবর পাঠাতে হয়। থানা পুলিশ করতেও ভয়। কালীপদকে আগে খবর দেওয়া দরকার। সঙ্গে বাবাকেও। বাবা ঠিক কথাই বলেছেন, মন খারাপ হলে পালাতে পারে। যদি দেশেই চলে যায়।
সাত পাঁচ ভাবছিল তারা। আর তখনই রিনা বলল, দেখতো গেটের অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
গেট বন্ধ করে দিয়ে এসেছিল সে। বেশি রাতে গেট খোলা রাখতেও সাহস পায় না।
কে? ওখানে কে?
সাড়া নেই।
সে ছুটে গিয়ে দেখল, অন্ধকারে কপালি দাঁড়িয়ে আছে।
আর মাথা ঠিক রাখা যায়?
কোথায় গেছিলে! ভিতরে আয়। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন!
কপালি মাথা তুলছিল না। দাদাবাবু চোটপাট করলে সে এমনিতেই ঘাবড়ে যায়। আজ যে কপালে দুর্ভোগ আছে ফেরার মুখেই টের পেয়েছিল।
দাদাবাবু, বৌদিমণি কাউকে না বলে বের হয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। মিনসেটা এত পাজি জানবে কী করে।
কী বললি কপালি?
আমার গন্ধরাজ ফুলের কলম কী হল?
দেব!
তবে দিচ্ছ না কেন। ঘোরাচ্ছ। বা
ড়িতে কলম করেছি। হলে বলব।
কবে হবে?
সময় হলে বলব। তখন কিন্তু না করতে পারবি না।
বারে না করব কেন?
বাড়ি যেতে হবে। যা
ব। বাড়ি কতদূর!
এই হানাপাড়া পার হয়ে।
গেট বন্ধ করার সময় দাদাবাবু তার দিকে তাকিয়ে অবাক!
এঁকি ছিরি তোর। চোখ বসে গেছে কেন! এত আতঙ্ক কীসের। হাতে ওটা কী! শাড়ি সায়া ব্লাউজ সামলাতে পারেনি। দেখেই দাদাবাবু বোধহয় টের পেয়ে গেছে। সে ফুঁপিয়ে উঠল। কাঁদছে।
কী হল!
রিনাও ছুটে এসেছে। গেটে এই তামাসা তার পছন্দ না। বলা নেই কওয়া নেই হাওয়া। রাত করে ফিরে আসা! চোখে আবার জল গড়াচ্ছে! ঢং। হাতে ছোট্ট টব। কী ফুল, কী গাছের কলম কিছুই বুঝছে না রিনা। সব গেলেও কপালি টবটা আর গাছটা অক্ষত রাখতে পেরেছে–একেবারে ভেঙে পড়ছে না। এতে আরও ক্ষেপে গেল রিনা।
ভিতরে যা।
কপালি বাড়ি ঢুকে বারান্দায় টবটা আলতোভাবে নামিয়ে রাখল।
তারপর জেরা শুরু।
জেরার মুখে কপালি বলল, আমার কী দোষ, লোকটা তো বলল, বাড়িতে গেলে দেবে!
কোন লোকটা!
ওই যে গাছফাছ বিক্রি করে।
ধন’য়। ও বলল, আর তার বাড়ি গেলি!
আমার কী দোষ! ওতো ঘোরাচ্ছিল। বাড়ি যেতে বলল। লোকটার খারাপ মতলব বুঝব কী করে? টবটা দেখিয়ে বলল, ঘরে আয়। দামদর হবে! কত এনেছিস! বলেই হাত ধরে টানতে থাকল। আমিও ছাড়িনি। হাত কামড়ে টব নিয়ে পালিয়েছি।
টবটা ছুঁড়ে মারতে পারলি না মুখে! দেখাচ্ছি মজা!
টবটা ছুঁড়ে মারলে ভেঙে যেত না! গাছটা কী তবে বাঁচত!
বৌদিমণি কিংবা দাদাবাবু কেন যে আর একটা কথা বলতে পারল না। মাথা নীচু করে ভিতরের দিকে চলে গেল! নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও গাছটা অক্ষত আছে ভেবেই কপালি খুশি।
কপালি বেশ চেঁচিয়ে বলল, বৌদিমণি গাছটা কিন্তু গেটের সামনে লাগাব।
দেখবে ফুল ফুটলে বাড়িটা গন্ধে ম ম করবে। কী মজা হবে না বৌদিমণি।
কপালি সব ভুলে গেছে। টবটা কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছে না।
ও বৌদিমণি, টবটা বারান্দায় রাখলাম।
অবশ্য ভিতর থেকে কোনো সাড়া নেই।
সে আবার চেঁচিয়ে বলল, গাছ না হলে বাড়ি হয়।
এবারেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
কপালি সত্যি সন্ধ্যাতারা। তারার সঙ্গে কে কথা বলে!
কাকচরিত্র
বড়োই বিপাকে পড়েছি হে। ঘিলুতে লোকটার এই একটা কথাই পাক খাচ্ছে। তাও মনে মনে। কী বিপাক, কীসের বিপাক কেউ জানে না। মাসখানেক ধরে এই একটা কথাই পাক খায়। ছনের চালে কাক এসে বসে থাকে হুস করলে উড়ে যায়, কিন্তু এই বিপাক উড়ে যায় না। আবাদে আখাম্বা ষাঁড় দৌড়ায়, হাতে লাঠি নিয়ে তাড়া করলে, সেও দৌড়ায়। পাখ পাখালি গমের জমিতে উড়ে এলে হাঁ হাঁ করে তেড়ে যায়, পোকামাকড়ের বড়ো উপদ্রব। তার এক কথা। বিষম বিপাকে পড়েছি হে।
এই বিপাক মাসখানেক দৌড় করাচ্ছে তাকে। তা তুই আবাগির বেটি বুঝলি না, তোর বাপ মুখ দেখায় কী করে! শিরে বজ্জাঘাত। এখন আমি তাকে পাই কোথা!
হা শুনছ বাবা!
কে?
আমি তোমার খুড়ামশায়।
কিছু করেন।
আরে দেবীর খোঁজ জান!
ও তো নলহাটির কাছে কোথায় থাকে?
তারে যে একখান খবর পাঠাতে হয়।
তারপরই চুপ, খবর কেন! কীসের খবর!
মাখন কুণ্ডু দেবী ঠাকুরের খবর জানতে চায় কেন! খবর পাঠাতে চায় কেন!
পাড়া প্রতিবেশীরা কেমন চুপ মেরে গেছে। সৃষ্টিছাড়া কাজ হয়ে গেল যে, উঠোনের মাঝখানে অপকৰ্ম্মটা সেরে গেল। ধূপ ধুনোর তো খামতি নেই। সকাল থেকে তার কাজ, জমিতে যে দিনে যা লাগে সবকিছুর জন্য ছোটাছুটি। গোরুর দুধ ঘরে—তা অভাব অনটন আছে, ছানি মানি ধানি তিন কন্যে, বড়ো পুত্র কাঁচরাপাড়ায় কলে কাজ করে, হপ্তার ছুটিতে এলে যেতে চায় নালাগোয়া ঘরটায়। উঠতি যুবকেরা তখন ভিড় বাড়ায়—কীসের গরমে সে বোঝে। শরীরে গরম ধরলে এটা হয়।
মানুষটা সব বুঝেও চুপচাপ ছিল। ছানি মানি ধানি তিনজনাই সোমত্ত, গায়ে গরম ধরে গেছে। পুরুষ মানুষ বড়ো সংক্রামক ব্যাধি, এলেই গায়ে তাপ বাড়ে। তা বাড়ছিল, বেশ কথা। বাড়তে বাড়তে আগুন লেগে যাবে, মুখপুড়ী রাক্ষুসী তোর এ কথাটা মনে এল না। পেটের মধ্যে, আগুন গিলে বসে আছিস, কে নেভায়।
সহসা তার আর্তনাদ, কার কাম ক দিকি, মুণ্ডু ছিঁড়ে আনি!
ছানি মুখ থুবড়ে বসে পড়েছিল সেদিন। বমি, গা গোলায়, তা তুই কুমারী মেয়ে, আমিতো বসে নেই-বয়স হলে গোরু বাছুরের মতো পাল খাওয়াতে হয়, মনুষ্য সমাজে বাস, শাঁখা, সিঁদুর লাগে, আর লাগে হলুদ বাটা, আম্র পল্লব—সামিয়ানা টানাতে হয়, তার নীচে আগুনের কুণ্ডু, হোম দু-হাতের মিলন, তারপর যদৃচ্ছ আচরণ, যেমন খুশি পা তুলে নামিয়ে, উপুড় করে কিংবা উটের মতো মুখটি তুলে হাঁটো, কিছু বলার নেই—মাথা উঁচু করে হাঁটতে কষ্ট হয় না। পেটে আগুন থাকলেও জ্বলে না।
কার কাম? বল! বল পোড়াকপালী সর্বনাশী, দা খানা কোথায়, না বলিস তো দা দিয়ে গলাখানা কেটে ফেলব।
ছানি কী বলবে। ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। ধানি মানি বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে।–ও বাবা কী কচ্ছ, ও বাবা তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? বাবা বাবা!
মাখন কুণ্ডু তেড়ে যাচ্ছে আর বলছে, তার আগে আমি কেন গলায় দড়ি দিলাম না। তোদের মা থাকলে সে সব সামলাত! আমি কার কাছে যাই, কী করি! আবার হুংকার, বলবি না, কে করল। কোন পাষণ্ডের কাজ। আমার এমন সুন্দর কন্যেটাকে নষ্ট করে দিল।
ছানি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। কিছু বলে না! খাচ্ছে না! দুপুরে দরজা বন্ধ করতেই গোলমাল, ও বাবা শিগগির, এস। ক্ষোভে দুঃখে মাখন নিজের জমির আলে মুখ গামছায় ঢেকে শুয়েছিল। খায়নি স্নান করেনি, কোনোদিকে বের হয়ে যাবে ভাবছিল—তুই হলিগে ধরিত্রী। আবাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে বুঝি। তা পাত্রপক্ষের এত জুলুম আমি অভাবী মানুষ সামলাই কী করে!
কী হল!
শিগগির এস। দিদি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।
আতঙ্ক। সে মাথার গামছাখান হাতে নিয়ে ছুটেছিল। সুখো মিঞা রাস্তায়। গোরুর গাড়ি নিয়ে শহরে যাচ্ছে-তার সামনে পড়ে গিয়ে মানি ধানি জমির মধ্যে নেবে গেল।-বড়োভাই ছুইট্টে গ্যাল! কী ব্যাপার!
ধানি শাড়ির আঁচলে গা ঢাকছিল। বাবা দৌড়াচ্ছে। কথা কবার সময় নাই। ছুটতে ছুটতেই বলল, শকুন উড়তাছে সুখা ভাই।
কোনখানে?
বাড়ির মাথায়।
আসলে এই শকুনের ওড়াউড়ি তারা বড়ো হতে না হতেই টের পায়। চোখ দেখলে টের পায়। দিদি এখন পেটে আগুনের আঙরা নিয়ে বসে আছে, পেটে আগুনের আঙরা এবং এসব মনে হলেই ধানি মানির মনে হয়, সব শকুন। সব ক-টা শকুন। দেবীদা, অমর, গোপাল ছান সব। ওরা কী টের পেয়ে গেল। দাদাটাও মাসখানেক বাড়ি আসছে না। কী যে করে। শাড়ির আঁচল সামলে তালগাছটার নীচে আসতেই কেমন আতঙ্ক-পা অসাড়। তবু টেনে টেনে যখন উঠোনে হাজির, দেখল দিদি আবার অক অক করে বমি করছে।
ধানির মনে হল, বমি পেয়েছে বলে রক্ষা, দরজা খুলে বমি করতে বের হয়েছে। না হলে সর্বনাশ।
মানি ফুঁপিয়ে কাঁদল দিদিকে জড়িয়ে। আর ঠেলাঠেলি, তুই কেন দিদি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলি,—এই দিদিরে, তুই কেন, কেন! দরজা বন্ধ করলে মাথাকুটে মরব বলে দিচ্ছি। বাবাতো একরামের নানির কাছে যাবে। সব সাফ হয়ে যাবে দেখবি! ভালো হয়ে যাবি। আসলে এতটা কথা মানি বলতে জানে না। টের পেয়ে সেও গুম মেরে গেছিল। ধানির ফিসফিস কথাবার্তা—দেবীদা ছাড়া কেউ না। আসুক ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব।
তা হতেই পারে। মিলে যাত্রা দেখতে গেলে, দিদি একা বাড়ি ছিল। পূজার দিনে শহরে ঠাকুর দেখতে গেলে দিদি একা বাড়ি ছিল। ফাঁক ফোঁকরে ইঁদুর বাদুড় ঘরে ঢুকে গেছে। দিদি কিছু বলছে না, বাবা গুম মেরে গেছে—মাঝেমাঝে একখানই কথা, বিষম বিপাকে পড়েছি হে।
তা সংসারে কন্যের বাপ হওয়াটা বড়ো দায় হে। এই একখান কথাও ত্রিভুবনে লংকা কাণ্ড-কন্যের জমিতে বীজ ফেলে তুই উধাও হলি। হারামির বাচ্চা। দেখি নাগাল পাই কী না।
গোপনে গোপনে সাফ করার চেষ্টা, এক সকালে মাখন দুটো শেকড় এনে দিল ধানিকে। বলল, পাঁচ ক্রোশ হেঁটে গেছি হেঁটে এসেছি। নির্ঘাৎ পাতের কথা বলে দিয়েছে।
ধানি বলল, শুধু বেটে খাওয়ালেই হবে।
সঙ্গে নিরসিন্দার পাতার রস।
আর কী।
আর ত কিছু বলেনি।
সব গোপনে গোপনে, বাড়িগুলি ফাঁকা ফাঁকা বলে রক্ষা, প্রথম থেকেই গোপন রাখা গেছিল, কিন্তু শেষে আর পারা যায়নি।
এই দিদি রসটা খেয়ে নে।
ছানি পাশ ফিরে দেখছিল ধানিকে। হাতে কাচের গেলাস নীল রঙের রস। ছানির চোখ সাদা ধূসর, মুখ শুকনো, গলা টিপে আত্মহত্যার চেষ্টা করার সময় মনে হয়েছে, পেটে তার আবাদ, সে মরে গেলে আবাদ নষ্ট। পারেনি।
এই দিদি ওঠ না।
ছানি শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে রেখেছে।
দিদি।
বাইরে বসে আছে মাখন কুণ্ডু।–নচ্ছার, কুলটা মেয়ে, বংশের মুখে কালি দিলি! তুই মরে যা। মরে যা। সবই মনে মনে—ত্রিসংসারে তার আর কে আছে? এই তিনটে কন্যে, কিছু হাঁস কবুতর, গোয়াল গোরু বাছুর, জমিজমা–চাষা মানুষের যা হয় লেপ্টে থাকার স্বভাব, এই তিন কন্যে নিয়ে সে লেপ্টে ছিল।—ছানিরে তুই একী সর্বনাশ করলি রে!
দিদি ওঠ। খা। বাবা চিল্লোচ্ছে।
সহসা ছানি উঠে বসল, গ্লাসটা কেড়ে নিল ধানির হাত থেকে। তরপর উঠোনে ছুঁড়ে মারল। শেষে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল। মাখন কুণ্ডু ভাবল, উঠে গিয়ে মেয়ের চুল ধরে টেনে আনে। আছড়ে-পিছড়ে পেট থেকে পিছলে বের করে আনে এক কুলাঙ্গার ইতরটাকে। হাতের কাছে না পেয়ে দাঁত নিশপিশ করছে। যেন বেটা ভূত হয়ে উবে গেল। তারপরই মনে মনে এক কথা, বিষম বিপাকে পড়েছি হে!
মাথায় চড়াৎ করে দেবী ঠাকুর এ-ভাবে হেগে দিয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি। বামুনের বেটা তুই, আমার কন্যের এত বড়ো সর্বনাশ করলি! তা পঞ্চায়েতে গেলে হয়।
কে বলল পাশ থেকে, তুই পাগল মাখন!
আপনি কে গুরুঠাকুর?
আমি কে দেখতে পাও না!
অ আপনি আমার মাথার ঘিলু। তা বলেন, কী করব। খুঁ
জে দেখ পাও কি না।
মাখন খুঁজে দেখতে বের হয়ে গেল। সেই যে বের হয়ে গেল আর ফিরল না।
তারপর দিন যায়।
ছানি এক রাতে দেখে দেবী ঠাকুর হাজির।
ছানি বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে!
দেবী ঠাকুর বলল, এখান থেকে চলে যেতে হবে।
কেন?
সবই গোপনে! রাতের গভীরে ঢোকা। ধানি ভেবেছিল, বাবা ফিরে এসেছে, দরজা খুলে দেখে বাবা না, দেবীদা।
ধানি প্রায় চাপা আর্তনাদ করে উঠেছিল, দিদি, দেবীদা!
ছানির পৃষ্ট শরীর দুর্ভাবনা দুশ্চিন্তায় কিছুটা রোগা হয়ে গেছে। তবু স্তন বেশ পুষ্টই আছে। এবং দেখামাত্র লোভ এবং সংক্রামক ব্যাধির মতো শরীর অবশ হতে থাকলে দেবী ঠাকুর শিয়রে বসে পড়ল।
ধানি বলল, বাবা তোমায় খুঁজতে গেছে। মাস হয়ে গেল ফিরে আসছে না। বলে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।
ছানি পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘরে লণ্ঠন জ্বালা। কথা বলছে না।
ধানি বলল, এই দেবীদা দিদি না কেমন হয়ে গেছে।
কারো সঙ্গে রা করে না।
দেবীর চারপাশে সতর্ক নজর। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, তোরা যা। আমি দেখছি কথা কয় কি না।
ধানি মানি ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বেশি রাতে পাশের বাড়ির পিসি এসে শোয়। আজ বারণ করে দিতে হয়। দাদা এসেছে। তোমার শুতে হবে না পিসি।
ঘর থেকে দু-বোন বের হয়ে গেলেই ছানি বলেছিল, তুমি আসবে জানতাম।
সেই জানাজানি দুজনে রাতে ফের এক প্রস্থ ভালো করে হয়ে গেল। শরীরে গরম ধরলে আর সব অচল পয়সা। গরম মরে গেলে ছানি বাপের জন্য সে রাতে চোখের জল ফেলল। বাবা আর ফিরবে না আমার এমন বলে ভ্যাক করে ধানির মতো কিছুক্ষণ কেঁদেও নিল। দেবী ঠাকুর বুঝল প্রবোধ দিল। রাত থাকতে বের হয়ে পড়তে হবে। কাকপক্ষী টের যেন না পায়।
পরদিন সকালে দুই বোন উঠে দেখল, ঘর ফাঁকা। দরজায় শেকল তোলা।
বাপ গেল, দিদিও গেল।
শকুন উড়ছে।
শকুনের চোখ বড়ো তীক্ষ্ণ। সে শুধু উপরে উড়ে—গন্ধ শুঁকে বেড়ায়।
দুই বোন গলা জড়াজড়ি করে কাঁদল। প্রতিবেশীরা বলল, তোর দাদাকে খবর দে।
দাদা আর আসবে না।
তা না আসতেই পারে। ছোঁড়ারই বা কী দোষ। বোনের এত বড়ো কলঙ্ক মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছে। বাপ নিখোঁজ। বোনটাও।
কোথায় গেল।
দু-বোন বলল, জানি না।
তবে জানে না বললে মিছে কথা বলা হবে।
নলহাটির ডাকবাংলোয় দেবী ঠাকুর কাজ পেয়েছে। চাপরাশির কাজ। দিদিকে নিয়ে সেখানেই তবে তুলেছে। কেবল রাতে বলেছিল, আমি যে নলহাটিতে আছি বলিস না।
দেবী ঠাকুরের বাবার মুদি দোকান বাজারে। পুত্রের প্রতি কোনোদিনই আবেগ বোধ করেনি। নষ্ট মেয়েছেলে তিনটের পেছনে দু-হাতে টাকা উড়িয়েছে। দোকান ফেল মারতে বসেছিল-সময়মতো রশি টেনে ধরেছে বলে রক্ষা। সেই থেকে দেবী ঠাকুর পলাতক।
বাড়ি জমিজমা চাষ আবাদ হাঁস কবুতর দুই বোন সামলায়। দুটো পেট। ধানি শাড়ি পরে। মানি ফ্রক। গাছপালার মতো শরীরে ডালপালা মেলছে। মুখে লাবণ্য, শাড়ি পরলে সুন্দরী ধানি, আলতা পরে মেলায় যায়। মানি ঘর ঝাঁট দেয়—দুধ দুইয়ে দিয়ে যায় নরহরি, আবাদ দেখে সুখো মিঞা-পুরুষ মানুষ এ-কামে সে কামে বাড়িতে আসেই। নরহরি দুধ দুইয়ে নড়তে চায় না।—এক কাপ চা হবে নি ধানি?
হবে না! বস না। কী কাজকর্ম ফেলে এয়েছ?
আর বলিস না, বসার কী সময় আছে, টেনে এক কোরোশ রাস্তা যেতে হবে।
নরহরি একা মানুষ বিধবা পিসি নিয়ে সংসার। আচার্য বামুন। কাকচরিত্র জানে। গলায় তুলসির মালা। দুধ দুয়ে ফের বসে, এক গেলাস দুধ পায়। বাকি দুধ রোজ। দু-বোনের কপালে দুধ বড়ো জোটে না।
নরহরিই বলেছিল, মাখনদা গেছে নৈঋত কোণে। বুঝলে অগস্ত্য যাত্রা। ওই যাত্রায় বের হলে ফেরা যায় না।
মানি ফ্রক গুটিয়ে বসলে মাখনের মতো সাদা উরু দেখা যায়। বসেও। এই একটা লোভ আছে—তা বয়স একটু বেশি তার। ধানি শাড়ি পরে আলতা পায়ে দিলে দেবী জগদ্ধাত্রী। সে শুধু তাকিয়ে থাকে তখন। বলে তোমার বাবা বুঝলে ধানি একজন পুণ্যবান মানুষ। তা তিনি এখন সাধু সন্নেসী হয়ে গেছেন।
তুমি দেখতে পাও। ধানি ভাবল, কাকচরিত জানে, বলতেই পারে।
চোখ বুঝলে, কে কোথায় আছে টের পাই।
আমার দিদি কী করছে।
ও একখান বারান্দা বুঝলে লম্বা। সামনে মাঠ। চারপাশে গাছপালা। ফুলের গাছ। সূর্যমুখী, গেঁদা, দোপাটি, বেলফুল। নানা গাছ। তোমার দিদির বাচ্চাটা বসে আছে। দিদি তোমার বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছে।
কোথায় আছে বলতে পার? কোনদিকে?
এই তোমার উত্তর-পশ্চিম কোণে। কী ঠিক না?
কী ঠিক না কথায় সায় দিতে পারে না মানি। দেবীদা নলহাটির কোথায় কোন ডাকবাংলোর চাপরাশি এটুকু শুধু জানে। নলহাটি কতদূর জানে না। কোনদিকে জানে না।
কী করে যেতে হয় জানে না। খবর নেবে কাকে দিয়ে—এমনও মনে হয়। সংসারে দিদিটার কথা উঠলে নিজেরাও ছোটো হয়ে যায়। শুধু গুম মেরে থাকা। বাবার জন্য ধানি মানি আর অপেক্ষায় থাকে না। সুখো মিঞার এককথা, বড়া ভাইর মাথায় আল্লার গজব নেমে এয়েছে। পথের টানে বের হয়ে গেল।
তারা এই পথের টানটা কী জানে না। থানা পুলিশে খবর দেবার লোক নেই। শুধু কেউ পথে ঘাটে দেখা হলে এক প্রশ্ন, কী রে দিদি ফিরল? তোর বাবা।
ধানির আজকাল মনে হয়, এ-সব বলে শুধু লোক তামাসা দেখছে। নরহরিদাকে ধানি না পেরে একদিন বলল, মুখে পোকা পড়বে।
কার মুখে। কী হল?
আবার কার। আমরা নষ্ট মেয়ে বলে।
তা বলবে। গার্জিয়ান না থাকলে বলে। এত করে বললাম, পিসিরে নিয়ে এসে তুলি, আমি থাকি, সুখো মিঞা বরগা করে, চাষ আবাদ করলে দেখবি কত ফলে। আমি একাই একশো। গার্জিয়ান না থাকলে শকুন ওড়ে।
কথাটা মন্দ মনে হয়নি ধানির।
শকুন উড়ছে। টাউনে ভালোবাসা ছবি চলছে। ধানি গেছিল শোভাদির সঙ্গে। শোভাদির বর ভালো মানুষ বুঝেই গেছিল। শোভাদিকে রিকশায় তুলে দিয়ে তার সঙ্গে হেঁটে ফিরেছিল। এক রিকশায় চারজন ধরবে না, শোভাদি তার জা। দুটো রিকশা একসঙ্গে—কত টাকা, ধানির কট কট করছিল—সে বলেছিল হেঁটেই মেরে দেব। তা সাঁজ লেগে যাবে, লাগুক। শোভাদির বর বলেছিল সে না হয় আমি যাচ্ছি সঙ্গে। রিকশায় ওরা চলে গেলে বর মানুষটি বলল, টাউনে এলে, চা খাবে না?
দেরী হয়ে যাবে। মানিটা একা।
আরে আবার কবে আসব।
লোভ তারও শরীরে আছে। কেমন যেন ঝিম ধরা জীবনে, একটু নেশা, রাত হয়ে গেছিল ফিরতে। রেলগুমটি পার হয়ে পঞ্চানন তলার রাস্তায় বলল, চল কারবালা দিয়ে সোজা মেরে দি তা রাস্তা সংক্ষেপ হয়, ঝোপজঙ্গল আছে, সেই ঝোপজঙ্গলে ঢুকতেই হাত ধরে টানাটানি। গার্জিয়ান নেই বলেই এত সাহস।
মাথার উপরে শকুন উড়ছে।
ধানি বলল, সেই ভালো। পিসিকে, এনে তোল। পাশের ঘরটায় থাকলে শকুন সব ভেগে যাবে।
ভেগে গেল ঠিক—তবে নরহরি ছেড়ে দেবার পাত্র না। জমিজমার লোভে এক রাতে ধানির হাত ধরে বলল, দেখলি তো। কী ফসল তোদের ঘরে তুলে দিয়েছি। নরহরিকে ঘাঁটাতে কে সাহস করে।
ধানি জানে, লোকটার কাগচরিত্র জানা। সে কী বুঝে ফেলেছে বছরখানেক যেতে না যেতেই টান ধরে গেছে। গলায় তুলসীর মালা শুধু বদল করে ক-জন বোষ্টম বোষ্টমীকে খাওয়ালেই কাজ সারা।
ধানির গলায় তুলসীয় মালা উঠে গেল।
মানি এখন একা শোয়। কী ছিল, কী হয়ে গেল। জমিজমা নতুন সেটেলমেন্টে নরহরি নিজের নামে করিয়ে নিল। যে মালিক সে নেই, ক্যাম্প অফিসে গিয়ে এদিক ওদিক পয়সা দিয়ে অধিকটা দিদির নামে, বাকিটা তার নামে লিখিয়ে বলল, আমি কারো বাড়াতে নজর দিই না। কারো পয়সা ছুঁই না। মাখন কুণ্ডুর নাতি ভোগ করবে জমি। বংশ রক্ষা না হোক, কন্যের পক্ষে বংশধর জমি ভোগ করবে। মাখন কাকার কত কষ্টের উপার্জন। একটা পয়সা হাত থেকে খসত না। দিন নেই রাত নেই খেটে খেটে মানুষটা কম রেখে যায়নি। তা শকুনে খাবে, হয় নরহরির যে কাগচরিত্র জানা, মানি সেটা বুঝেছিল, দিদি একটা পুত্রসন্তান প্রসব করতেই। লোকটার তেলের কাছে মানি কাৎ। সে যেন ইচ্ছে করলে সত্যি বলতে পারে, তার বাপ আছে না মরে গেছে বলতে পারে। কুণ্ডু মশাইর নাতি হবে নরহরি আগেই গাওনা গেয়েছে।
মানি এক সকালে উঠে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। বাজারে যাবে নরহরি। ছেলেটা তার কাঁধ থেকে নামছে না। সকাল বেলা, বেশ রোদ উঠেছে, শীতও জাঁকিয়ে পড়েছে। আর এ-সময় মানি গোমড়া মুখে বসে আছে দেখতেই বলল, আরে আমিতো আছি শকুন উড়ে দেখুক না।
মানি বলল, একটা কথা রাখবে নরহরিদা!
এই সক্কালে তোর আবার কী কথা।
না বলছিলাম, তোমার তো কাগচরিত্র জানা, বল না, বাবা এখন কোথায় আছে?
নরহরি ট্যারচা চোখে দেখল মানিকে। ডুরে শাড়ি পরে উঠোনের কোনায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে। সে যে বড়ো রসিকজন। এমন একটা গানের কলি গলায় ভেসে উঠল। বলল, বলব। তবে বসতে হবে। হুট করে সব বলা যায় না। রাতে জায়গা পবিত্র করে রাখবি–বসব।
এই পবিত্র করে রাখবি কথাটাতে মানির মনে শিহরণ খেলে গেল। সে পবিত্র করেই রেখেছিল।
সকালে ধানি বলল, রাতে টের পেলে?
মানি বলল, কী জানি? জানি না।
ধানি বলল, একা ঘরে উনি কাগচরিত্র নিয়ে বসেছিলেন। ছেলেটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম—আমার আর জাগা হল না। সকালে উঠে দেখি তুই নিজেই কখন উঠে ঘরদোর লেপতে শুরু করেছিস। কী বলল?
মানির এককথা, কী জানি! তোমার সোয়ামি বোষ্টম মানুষ, তারে আমি ঠিক বুঝি না! জিগাও না কী কয় দ্যাখ।
লোকটা সকালেই গোরু বাছুর নিয়ে মাঠে বের হয়ে গেছে। ফিরলে বলল, বাবার খবর পেলে। কালতো বসলে।
বাবার খবরে আর কাজ কী? মানি আর বাবার খবর জানতে চায় না। ধানি বলল, তাহলে বাবা আমার নেই? কাল পবিত্র জায়গায় বসে কী টের পেলে বল!
বললাম মানিকে, তোর বাবা পথের টানে পড়ে গেছে। ফিরছে না।
আর কী বললে?
বললাম, তোর বাবা সবার ঠিকানায় গেছে।
এখানে এসেছিল?
ঘুরে গেছে।
গাঁয়ে এসে বাড়ি না ঢুকে চলে গেল।
নরহরি হাসল। বসে আছে বারান্দায়। আসন পেতে। কোলে মাখন কুণ্ডর নাতি। বংশধর। কন্যের পক্ষের। বলল, নাতির মুখ দেখে গেছে।
বুবলার মুখ দেখে গেল?
হাঁ, হাঁ। দেখল। রাস্তায় নিয়ে গেছিল মানি কোলে করে। লোকটা বলল নলহাটির রাস্তা চেন।
নলহাটি?
আরে হ্যাঁ। ওই রাস্তার খোঁজে গিয়ে দেখল, সবাই যে যার মতো বেঁচে আছে। সে কে? এই ভাবটা উদয় হতেই বিবাগী। সবারেই এককথা কয়।
কী কথা!
রাস্তাটা কোনদিকে। নলহাটির রাস্তার খোঁজ আর পায়নি।
তবে যে বললে, সব দেখে গেল?
এখন মাথায় অন্য পোকা। কারা এরা?
বষ্টুম মানুষের কথায় রহস্য—ধানি পাশে বসে শুনছে।
এই ধর না, বড়ো পুত্র কাঁচরাপাড়ায় বাড়ি করে বৌ নিয়ে সুখেই আছে। ছানি বছর না ঘুরতেই পেটে আর একখান। বাপের কথা কে মনে রেখেছে বল। মানি এতদিন অবুঝ ছিল। বলে হাই তুলল একটা। জমিজমা পেলে, ফনী ধরের বেটা রাজি। সেটাই শুধালাম মানিকে। মানি রাজি।
কিন্তু বাবা গেল কোথায়? কী দেখলে পবিত্র জায়গায় বসে?
কেমন গম্ভীর গলা নরহরির। চুল কোঁকড়ানো চোখ জবাফুলের মতো লাল— রাত্রি জাগরণ গেছে হতেই পারে-কালো ধুমসো চেহারার মধ্যবয়সী মানুষ। কাগচরিত্র আর ঝোলা ছিল সম্বল। মানুষ ঠকিয়ে, করকোষ্ঠি বিচার করে পয়সা সেই পয়সা থেকে বৌ, জমি, বংশধর ওই পর্যন্ত সে বোঝে। শরীর তার এমন খেলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তার জন্য জমিজমা, গাই বাছুর, হাঁস কবুতর ছানি ধানি মানি লাগে—আর রহস্য এক ঘরে উদয়, অন্যঘর ফাঁকা।—তোদের বাপের শেষে অন্য রহস্য। দেখল, সবাই ত ভালোই আছে। সে না থাকলে সংসার অচল এই বিশ্বাসটা গেল মরে। সে বাড়তি মানুষ। নলহাটির খোঁজে যেতে যেতে পথের টানে ঘাটে-অঘাটে কুখাদ্য খেয়ে মরে পড়ে থাকল বালির চরায়। শকুনে চোখ উপড়ে খেল। শেষে থানা পুলিশ, মর্গ—এই আর কী? মানুষের জীবন। জীবনের আর একখানা কাগচরিত্র। সব গরমে হয় বুঝলি না। গরম মরে গেলে কিছু থাকে না। তখন বালির চরায় মরা লাশ।
তারপর একেবারে চুপ নরহরি। চোখ বুজে আছে। আসন পিড়ি। সোজা, লম্বমান দেহ, যেন ইচ্ছে করলেই শরীর থেকে জ্যোতি বের করতে পারে। বহু দূর থেকে কথা বলার মতো সতর্ক বাণী–শকুন উড়ছে।
আবার সতর্ক বাণী, বুঝলি ধানি মানি, নলহাটি যাবার রাস্তা কেউ কেউ খুঁজে পায় কেউ পায় না। খুঁজতে গেলেই আউল বাউল হয়ে যেতে হয়। মরে যেতে হয়। শকুনে তার চোখ উপড়ে খায়।
কাঠপিঁপড়ে
বিশ্বরূপ আজ মোট উনিশটি কাঠপিঁপড়ে নিধন করে …ধরের দরজার দিকে এগোল। খুব খুশি। ওদিক থেকে আবার একটা তেড়ে আসছে। পাঁচিল থেকে নেমে সেফটি ট্যাঙ্কের দিকে এগোচ্ছে। আর এগোতে দেওয়া যায় না। পালাবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। পালাচ্ছে না। সারবন্দি যারা যাচ্ছিল—তারা নেই। জানবে কি করে বিশ্বরূপের মেজাজ গরম। এত উৎপাত কাঠপিঁপড়ের! শেষ করে দাও।
চটাস। চটি দিয়ে পিঁপড়ের দফা রফা। চেপ্টে গেছে। সারা বাড়িটার এখানে সেখানে সে সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়ে। এত মারছে, তবু শেষ হচ্ছে না। এদের চলার রাস্তা পাঁচিল ধরে, তারপর সেফটি ট্যাঙ্ক, তারপর সিঁড়ির দরজা। সামনের বারান্দায়ও ঢুকে যাবার ফন্দি। বাসা বানাবার তালে আছে। দরজা জানালার ফাঁকফোকড় খুঁজছে। কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না বিশ্বরূপ। এত বিষ হুলে, যে একবার তার বড়ো নাতনির পাছায় হুল ফুটিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় কাতর —চুন লাগিয়ে দেওয়ার পর পাছাখানা কিছুদিন টিবি হয়েছিল। বিষ বেদনায়ও কষ্ট পেয়েছে।
আসলে পাঁচিলের পাশের আমগাছটা ছিল এদের আস্তানা। গাছের খোঁদলে বাসা। গাছ থেকে খাবারের খোঁজে হয়তো বাড়ির দেওয়ালে, পাঁচিলে, বারান্দায় এমনকী দোতলার জানালার কাঠে ঘোরাঘুরির মজা পেয়ে গেল। হয়তো তার এ নিয়ে মাথা ব্যথাও থাকত না।
মুশকিল বাঁধাল, প্রথম বড়ো নাতনির পাছায় হুল ফুটিয়ে। তারপর একদিন বিশ্বরূপ নিজেও আক্রান্ত হল।
চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিল, হঠাৎ দংশন ঊরুর নীচে। প্রচণ্ড জ্বালা। সঙ্গে সঙ্গে সে ওটির নিধন পর্ব সেরে চুন হলুদের ব্যবস্থা। এবং পর পর বাড়ির সবাই যখন কোনো-না-কোনোভাবে আক্রান্ত হতে থাকল, বড়ো পুত্রবধূর অভিযোগ গাছটা থাকলে, কাঠপিঁপড়ে কামড়াবেই। যত রাজ্যের পোকা-মাকড়ের উপদ্রব গাছটায়। শত হলেও গাছটা বিশ্বরূপ নিজে লাগিয়েছে। তার মায়া হবার যথার্থ কারণ আছে।
ছোটো ছেলেরও ইচ্ছে গাছটা কেটে ফেলা হোক। কাঠপিঁপড়ের উপদ্রব থেকে তবে বাঁচা যাবে। বিশ্বরূপ একদিন কি ভেবে নিজেই গাছটায় উঠে গেল। … তারপর নেমে এল ফুলে ঢোল হয়ে। জ্বালা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে চিৎকার করে ডাকল, পূর্ণ আছিস। কর্তার ডাকে, আজ্ঞে বলে হাজির। গাছে পূর্ণকেও উঠতে বলতে পারত। তবে বাড়ির সবাই যখন গাছটা কেটে ফেলার ব্যাপারে সমর্থন জানাচ্ছে, তখন পূর্ণ গাছে উঠেই—ওরে বাবা গেলুমরে মলুমরে বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিতে পারে। সবার সমর্থনের বিরুদ্ধে সে যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। কাঠপিঁপড়েতে গাছটা ছেয়ে আছে কর্তা, সে বলতেই পারে। সত্য মিথ্যা যাচাই করতে গেলে তার না উঠে উপায় কি! গাছটা যেন সবাইকে কামড়াচ্ছে।
একটা গাছও রাখা গেল না। চার কাঠা জমি নিয়ে বাড়ি। ফল ফুলের গাছ না থাকলে বাসস্থান হয়, তবে নিজের ঘরবাড়ি মনে হয় না। গাছ না লাগালে বাড়ির জন্য মায়াও জন্মায় না। সেই ভেবে একটা আম গাছ, একটা শেফালি গাছ, পেয়ারা গাছ দুটি এবং একটি কামিনী ফুলের গাছ সে লাগিয়েছিল। গিন্নিরও মেজাজ প্রসন্ন। গাছগুলো বড়ো হতে থাকলে গিন্নি একদিন অত্যন্ত আদরের গলায় বলেছিল, এখন তোমার বাড়িটাকে বাড়ি মনে হচ্ছে। বাড়িতে শুধু পুত্র-কন্যারাই বড়ো হযে, গাছ বড়ো হবে না হয়!
গিন্নি নেই। তিনি গত হয়েছেন চার পাঁচ সাল আগে। পেয়ারা গাছদুটো সে নিজেই কেটে ফেলেছে। পাশের প্রাথমিক স্কুলের হনুমানগুলির জ্বালায় দুপুরের ঘুম মাটি। সারা দুপুর গাছে উৎপাত, দাও কেটে, বাঁচি। বছর খানেক আগে শিউলি গাছটাও কেটে ফেলতে হল। বর্ষাকালে এত শুয়োপোকার উপদ্রব যে, ঘরের মেঝেতে, দেয়ালে তারা উঠে আসতে থাকল। জামা-প্যান্টের ভিতরও খুঁজে পাওয়া যেতে থাকল। জ্বালা যন্ত্রণা, চাকা চাকা দাগ। কী আর করা! দাও কেটে। ছিল আমগাছটা।
সে নিজে উঠে যায়। ফুলে ঢোল হয়ে নামল, তখন আর সংশয় থাকার কথা। দিল কেটে। কাঠপিঁপড়ের ঘাঁটিটি অন্তত তছনছ করে দেওয়া গেল।
এখন গাছের কাঠপিঁপড়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটে। সারা বাড়িটায় বোধহয় ছড়িয়ে পড়ার তালে আছে।
ছোটোছেলে জানাল, ছোটোবৌমা মাস দুই পরেই চলে আসছে নবজাতককে নিয়ে। তার একমাত্র বংশধর। নীচের তলায় থাকুক আর উপরের তলাতেই থাকুক কাঁথা কাপড়ের সঙ্গে অগোচরে দুটো-একটা কাঠপিঁপড়ে বিছানায় উঠে আসবে না বলা যায় না। কামড়ালে কি যে হবে! আর যদি কানের ভিতর ঢুকে যায়, শিশু সে বুঝবে কি করে দাদুর আমগাছের পিঁপড়ে তার কানে ঢুকে গেছে, আর যদি কানের পর্দায় হুল ফুটিয়ে দেয়, তবেই হয়েছে। যেন বিষধর সর্প তার সামনে ফণা তুলে আছে। আতঙ্ক।
সুতরাং গাছটি কেটে ফেলা ছাড়া তার উপায়ও থাকল না। গাছ না থাকলে তারাও থাকবে না। অন্য কোথাও ডেরা বানিয়ে নেবে।
গাছ কাটল ঠিক, ফল হল বিপরীত। সারা বাড়ির দেয়ালে পাঁচিলে, দরজায় পিলপিল করে ধেয়ে আসছে। কাঠপিঁপড়ে কি শেষ পর্যন্ত তাদের বাড়িছাড়া করে ছাড়বে!
প্রথমে গ্যামাকসিন।
যে যাই বলে। বেগন স্প্রে করুন। কেরোসিন তেল ঢেলে দিন চলার রাস্তায়। গ্যামাকসিন ছড়িয়ে দিন। বেগন স্প্রে করল। গ্যামাকসিন দিল। কেরোসিন তেল ছড়িয়ে দিল, কিছুটা উৎপাত কমল বটে, তবে রেহাই পাওয়া গেল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে গেল ফের উৎপাত। তারপর দেখা গেল, কোনো কিছুতেই আর কাজ হচ্ছে না।
অল প্রুফ কাঠপিঁপড়ে।
অনায়াসে তারা গ্যামাকসিনের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। ঘরে ঢোকে। মেঝেতেও দু-একটা চোখে পড়ে। বারান্দার দেয়ালে। যে যা বলছে, সবই করে দেখেছে। কিছুই ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
অগত্যা নিধনযজ্ঞও।
রোজ অবসর পেলেই, একটা চটি হাতে উঠে আসে। প্রথম বারান্দা দিয়ে শুরু। বারান্দার দেওয়ালে তিনটে কাঠপিঁপড়ে হাঁটছে। চটি দিয়ে চটাস। একটা পড়ে গেল। হাত-পা গুড়িয়ে গেল। পেট চেপ্টে গেল। আরও একটা চটাস। পড়ল ঠিক তবে মরল না। মরবে মরবে ভাব। রান্নাঘরে নেই। পাঁচিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পিলপিল করে আসছে। সে মারছে আর আসছে। মারছে। আবার আসছে। এক সময়ে মনে হল পাঁচিল ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বারান্দায় ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে, অবাক হয়ে দেখছে, আবার ঠিক তিনটে কাঠপিঁপড়ে। মরা কাঠপিঁপড়েগুলো পিঠে নিয়ে উঠে যাচ্ছে।
ঠিক মরা বলা যায় না। হাত-পা নড়ছে। সে চেপ্টে দিয়েছিল, বেলুনের মতো বাতাসে আবার ফলে উঠছে যেন। কাঠপিঁপড়ের জান এক কঠিন। কচ্ছপের। চেয়েও বেশি। পাঁচিলের দিকটায় গিয়ে দেখতে হয়। আবার কোথা থেকে আধমরাগুলো পিঠে তুলে কাঠপিঁপড়েরা হেঁটে যাচ্ছে। তবে সে হেঁটে যাবার সুযোগ দিচ্ছে না। জোড়ায় জোড়ায় নিধন হচ্ছে এবারে।
মাসখানেক ধরে এই করে যাচ্ছে। কিন্তু একটা পিঁপড়েরও খোঁটা ওলটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। মরে যায় আবার দুদিন গেলেই বেঁচে ওঠে।
সে কাঠপিঁপড়ের গতিবিধিও লক্ষ রাখছে। আসলে সে এক সকালে একই জায়গায় বসে কাঠপিঁপড়ে নিধনে মত্ত হল। মারছে। মরছে। আবার কোথা থেকে মৃত কাঠপিঁপড়েদের খোঁজে পিলপিল করে তারা চলে আসছে। কি করে খবর পেয়ে যায়—সে বোঝে না। সাঙ্কেতিক বার্তা পাঠাতে পারে বোধহয়। সারা বাড়ি ঘোরারও দরকার নেই, তবে এক জায়গায় বসে ক্রমাগত মেরে গেলেই হয়।
চটাস শব্দ শুনলেই বাড়ির সবাই বুঝে ফেলে বাবা এখন পিঁপড়ে নিধনযজ্ঞে মেতে গেছেন। পূর্ণ বলবে, কর্তার শুরু হয়ে গেল। মাথায় তার কেমন একটা জেদ চেপে গেল।
একসময় দেখল, সে নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে গেছে। ফকির আমজাদ মাঝে মাঝে ভিক্ষে করতে আসে। বাবুর সঙ্গে তার সুখ-দুঃখের গল্পও হয়। আগে এলে দেখতে পেত, বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে তিনি কি পাঠ করছেন, এখন এলে দেখে পাঁচিলের পাশে গোঁজ হয়ে বসে আছেন। কিছু বললেই, হাত তুলে ইশারা, ভিক্ষে দিয়ে চলে যাও। কথা না। এত মনোযোগ দিয়ে কি করেন।
সে না পেরে একদিন পাঁচিলে উঁকি দিয়ে দেখেছিল, বাবুর একহাতে চটি, এক পায়ে চটি। একটা চটি হাতে, একটা চটি পায়ে কেন! সে ভড়কে গিয়ে বলেছিল, বাবুর কি মাথা ঠিক আছে।
বিশ্বরূপ তাকাল। করিম ভিক্ষে, ধর্মের নামে বড়ো বড়ো কথা, আমার মাথা ঠিক নেই, তোমার আছে! সে জবাব দিল না।
বাবু রেগে গেছেন কথাটাতে। হেন অযৌক্তিক কথা বলা ঠিক হয়নি। সে খুব বিব্রত বোধ করে বলল, বাবু কী খুঁজছেন?
বিষধর সাপ।
কোথায়!
এই যে বলে কাগজে কুড়নো ডাইকরা মৃত পিঁপড়ে দেখাল। বলল, শালাদের পুড়িয়ে মারছি। আমার সঙ্গে চালাকি।
ফকির আমজাদ বলল, বাবু ভাবলে বিষধর সর্প—না ভাবলে জীব। সে যার মধ্যে বিচরণ করে। আপনি আমি তার কি ক্ষতি করতে পারি!
কামড়
না নেই।
কোথাও নেই।
মহীতোষ এ সময় নিজের ঘরে বসে থাকে। তার নিজস্ব কাজকর্মে ডুবে থাকে। চা দিতে এসে সুর দেখল ঘর খালি। বাথরুমে যদি যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা না খেয়ে তিনি প্রায় নড়েন না। বাথরুমে যাবেন কেন! কিংবা ছোটোবাবুর ঘরে। ছোটোবাবুর ঘরটা খালি থাকলে তিনি সকালে কখনও কখনও সে ঘরে যান। দোতলার একপাশে ঘরটা। পাশে বারান্দা। কদিনের জন্য ছোটোবাবু এসেছিলেন, সকালে উঠেই ছোটোবাবুর ঘরে গিয়ে ডাকতেন, ওঠ। কত বেলা হল। আসলে যেন ছোটোবাবুর জন্যই মহীতোষ উপরে উঠে যান। কথা বলার মতো ওই একজনই আছেন—দেরি করে উঠলে তিনি কেমন ফাঁপরে পড়ে যেতেন।
ছোটোবাবু কালই গেছে। যাবার সময় বাবাকে বার বার বলে গেছে, তুমি আর এসব নিয়ে ভেব না। ওদের ভালোমন্দ ওরা বুঝবে। নির্বিকার থাক। তোমার তো অনেক কাজ। নিজের কাজে ডুবে যাও।
সিঁড়ি ধরে নামছেন। সুর জানে কে নামছেন। বছর খানেক হয়ে গেল, সে এ বাড়িতে আছে। কার পায়ের শব্দ কী রকম সে জানে। বৌমা নামছেন—তার নামার শব্দ একরকমের, বড়ো দাদাবাবুর পায়ের শব্দ একরকমের। ওপরে মাসিমা থাকেন। সকালে স্কুল, পাঁচটায় বের হয়ে যান।
এখন এবাড়িতে বৌমা সিঁড়ি ধরে নামছেন। বাসি সায়া-শাড়ি-চাদর, ভিজালে এক বালতি। ঠিকা কাজের মেয়েটা চুপি চুপি বাবুর কাজ থেকে মাইনে গোপনে দ্বিগুণ করে নিয়েছে। মাসিমা জানলে অশান্তি করবে ভেবেই চুপি চুপি তাঁকে গোপন অনেক কাজ করতে হয়—যেন যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ সুর ভেবে পায় না, এত বেলা করে কেউ ঘুম থেকে উঠতে পারে! তার খারাপ লাগে। শত হলেও বাড়ির বউ!
বৌমা বাবু নেই!
নেই তো আমি কী করব?
না, কোথায় গেল! তিনি সকালে চায়ের জন্য নিজের ঘরে বসে থাকেন।
দেখ ওপরে আছে কী না?
না ওপরে নেই।
সুর কিছুটা ফাঁপরে পড়ে গেল। মানুষটা কোথায় গেল? সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। তিনি তো সকালের চা না খেয়ে ঘর থেকে কোথাও যান না। ছোটোবাবুর ঘর দেখল, ফাঁকা। বারান্দার ইজিচেয়ারে যদি বসে থাকেন না নেই। মাসিমা স্কুলে, কোথাও যাবার কথা থাকলে রাতেই সুরকে বলে দেন, উনি সকাল সকাল বের হবেন। তাও বলে যাননি। এত সকালে তো কোথাও যাবার কথা না। বুধ-শনি বাজারে যান। আজ তো বুধও নয় শনিও নয়।
সুর একতলা-দোতলা সব জায়গায় খুঁজল। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নীচে নেমে চায়ের কাপ, প্লেট দিয়ে ঢেকে দিল। বছর খানেক থেকেই বুঝেছে, এ বাড়িতে একটা চাপা অশান্তি আছে। মহীতোষ যেন পুত্রবধূর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। মাসিমাও কথা কম বলেন। সারা সংসারে দাপাদাপি শুধু বৌমার। এই সে বাড়ি, তার ঘর, তার আসবাবপত্র সব কিছুই যেন বড়ো বেশি খোলামেলা। বৌমার আত্মীয়স্বজনরা এলে সমারোহ বেড়ে যায়। সুর দেখেছে, বাবুর আত্মীয় স্বজন এলে বৌমা পছন্দ করেন না। কিন্তু বৌমাটি বুদ্ধিমতী, বুদ্ধিমতী না ধূর্ত সে ঠিক বোঝে না। যতক্ষণ বাবুর আত্মীয়স্বজন থাকে খায়, তাদের নিয়ে সাধ আহ্লাদের শেষ নেই। চলে গেলেই মেজাজ গরম।
বাবুর আত্মীয় স্বজনরা যে খুবই গরিব তারা এলে সে তা টের পায়। বাবুকে দেখেছে, একে ওকে লুকিয়ে টাকা দিতে। যেন কেউ না জানে। মাসিমাও পছন্দ যে খুব করেন বাবুর আত্মীয়স্বজনকে মনে হয় না। মাসিমার এক কথা কত টাকা দিলে?ণ্ঠ বাবুর সোজা এক কথা, দিইনি।
সব চেয়ে বোধহয় বাবু কষ্ট পান ছোটো ভাই মনতোষের জন্য। বাবুর সঙ্গে চেহারার কোনও মিল নেই। এলে কেমন চোরের মতো চলাফেরা। যেন বাড়িটায় ঢোকা তার মতো মানুষের পক্ষে শোভা পায় না। বাবু বাড়ি এলে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। সারাক্ষণ বড়দার পাশে বসে থাকবেন। মুখ কাঁচুমাচু করে কথা বলেন— কী বলেন, কান পেতে শোনার কারও আগ্রহ না থাকলেও বৌমাটির আগ্রহ খুব। সে দেখেছে, দরজার আড়ালে দাদা ভাই কী বলাবলি করছে দাঁড়িয়ে শোনার আগ্রহ খুব। তারপরই মুখ কালো করে দুপদাপ সিঁড়ি ভাঙা। এবং নিজের পাঁচ বছরের পুত্রটিকে অকারণ পেটানো—কী হচ্ছে! একদম পড়ায় মন নেই। কে খাওয়াবে? তিনি তো দানছত্র খুলে বসে আছেন।
মাসিমারও একই অভিযোগ–দানছত্র।
বাবু শুধু শোনেন। ক্ষোভে মুখ লাল হয়ে যায়। সংসারে অপচয় দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। তখন নিজের উপরই কেমন এক তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে।
কী খাবে না?
না। শরীর ভালো নেই।
কাল একটা চিঠি নিয়ে বসেছিলেন। বোধহয় বাবুর অফিসের ঠিকানায় চিঠিটা এসেছে। বাবুর মা লিখতে পারেন, ছোটোভাই লিখতে পারে—যেই লিখুক বাবু চিঠিটা বার বার পড়ছিলেন।
কী লেখা আছে কে জানে!
সুর সামান্য লেখাপড়া জানে, ইচ্ছে করলে সে গোপনে চিঠিটা পড়তে পারত। কিন্তু বাবু কেন যে বাড়ির চিঠি এলে সতর্ক হয়ে যান সে বোঝে না। হয়তো জানাজানি হয়ে গেলে মাসিমার অশান্তি বাড়বে, পুত্রবধূরও নির্যাতন শুরু হয়ে যাবে পুত্রের উপর। বাবুর বড়ো পুত্রটি তো গোবেচারা—সেও কেমন অকলে পড়ে যায় মাঝে মাঝে যখন লাভা উৎক্ষেপণ শুরু হয়, সুর বোঝে, কী নিয়ে অশান্তি। বড়ো দাদাবাবুর এক কথা বাবার টাকা যা খুশি করবেন। তাঁর তো দায় শেষ। তিনি যদি টাকা দেন আমরা বলার কে? তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলবেন, তুমি কি কিছুর অভাব বোধ করছ? এত টাকা কী করো!
সর-এর এটাই প্রশ্ন। বড়ো দাদাবাবুর সরকারি চাকরি। মাস গেলে গুচ্ছের টাকা, মাসিমার মাস গেলে মাইনে, বাবু দু-হাতে রোজগার করেন এখনও। ছোটো দাদাবাবুও কম যায় না। অথচ সংসারে বাবুকে দেখলে তার কষ্ট হয়।
সুর কাল দেখেছিল, চিঠিটা পড়তে পড়তে কেমন অনামনস্ক হয়ে গেছেন। ফোন বাজছে, সেটা যে উঠে গিয়ে ধরা দরকার, তাও যেন খেয়াল নেই। বড়ো দাদাবাবু নীচে নেমে ফোন ধরলেন। বাবা, তোমার ফোন।
কে ফোন করছে?
কী জানি! নাম পার্থ বলছে। কাগজ থেকে।
বাবু উঠে গিয়ে ফোন ধরে বললেন, পার্থ? শোনো ভাই–আজ থাক। না, আজ না। বলেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেন।
যেন তিনি ভিতরে ভিতরে খুবই ভেঙে পড়ছেন। বৌমা পাশের ডাইনিং স্পেসে মোটামুটি যুদ্ধ করছে পুত্রটিকে নিয়ে। কিছুই খাবে না। বৌমাও না খাইয়ে ছাড়বে না।
পাঁচ বছরের শিশু পুত্রের জেদ দেখে সুর মাঝে মাঝে ভাবে—গোল্লায় কেন যায় এই শিশুর জীবন প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বুঝতে শিখে গেছে তার জেদের কাছে সবাই কাৎ। সকাল থেকেই একচোট শুরু হয় খাওয়া নিয়ে। স্কুলের বাস না আসা পর্যন্ত তা চলে।
খাও বলছি। খাচ্ছ না কেন! না খেলে বাঁচবে কী করে? দু-পিস পাউরুটি, ডিমের পোঁচ, সন্দেশ। খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
মহীতোষ রোজই দৃশ্যটা দেখেন। কিছু বলেন না। মুখ তাঁর গম্ভীর। তিনি বেসিনে মুখ ধোয়ার সময় চোখে জলের ঝাপটা দেন কেন এত সুর বোঝে না।
কাল সকালে চিঠিটা পড়ার সময় কেমন থমথম করছিল মুখ।
শিশুটির মা, পেট ভরবে কী করে, বাঁচবে কী করে বলে উঠে যান। ফ্রিজ থেকে কলা, আম, লিচু, আঙুর সাজিয়ে দেন শিশুটিকে। তাও কেমন আধখ্যাঁচড়া করে খায়। ভাত, মাছ ভাজা, মাখন দিয়ে আর এক প্রস্থ চেষ্টা। কিছু খায় কিছু ফেলে।
মহীতোষ একদিন ক্ষোভে দুঃখে বলেছিলেন, বৌমা খিদে পেলে ঠিকই খাবে। জোর করতে যেও না।
খিদে পেলে ঠিকই খাবে কেন বলছেন মহীতোষ— বৌমাই বোঝে। অর্থাৎ এটা বাড়াবাড়ি। মহীতোষ যেন আভাসে তা জানিয়ে দেন।
সুর চিঠিটা খুঁজল। বৌদি ছেলেকে বাসে তুলে দিতে গেছে। বড়ো দাদাবাবু অফিসে বের হয়ে গেছেন। মহীতোষ কোথায় কেউ জানে না। কারও দায় নেই জানার। লোকটা মরল কী বাঁচল—এক মাসিমা ফিরে এলে ত্রাসের মধ্যে পড়ে যাবে। যদি তিনি সত্যি নিখোঁজ হয়ে যান!
সুর দেখল, চিঠিটা দেরাজের মধ্যেই আছে। বাবুর ছোটো ভাইয়ের চিঠি। সে চেনে মনতোষদা লিখেছে, দাদা আগুনের হলকা বইছে। সব জতুগৃহ। কাজ কৰ্ম্ম নাই। তুমি যে টাকা পাঠাও ওতে চালের দাম হয় না। পাঁচটি মুখ, আগুনে পুড়ে মরছি। সারাদিন খাটলে বারোটা টাকা। যদি এ-মাসে কিছু বেশি টাকা দাও ভালো মাঠঘাট আংড়া, কাজ নাই। কোনোদিন হয়, কোনদিন হয় না।
হঠাৎ মনে হল সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।
তাড়াতাড়ি চিঠিটা রেখে দিয়ে দরজায় উঁকি দিতেই দেখল মহীতোষ নেমে আসছেন। সারা শরীরে ঘাম। মুখ পুড়ে গেছে। ছাই রঙের হয়ে গেছে।
আপনার চা, ঠান্ডা হয়ে গেছে। খোঁজলাম। কোথায় ছিলেন।
ছাদে।
ছাদে। সুর অবাক হয়ে গেল। বৈশাখের দাবদাহে সব পুড়ছে। বৃষ্টি নেই। গাঁয়েগঞ্জে আকাল। তেষ্টার জল নেই-নদী খুঁড়ে বালি তুলে দুক্রোশ দূর থেকে জল নিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘড়ায়—সে কাগজে এমন ছবি দেখেছে। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে সুর টানা দু-তিন ঘণ্টা হাতে সময় পায়। তার আলাদা ঘর আছে সেখানে সে তখন কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। তার কোনও অসুবিধা না হয়, সবার এটা যেন দায়িত্ব। সে জানে বাড়ির চাকাটা সচল রাখার দায় তার। সে বেগড়বাই করলেই সব যাবে। তাকে তুষ্ট করার চেষ্টা সবার।
যেন সুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে আটকে রাখা। তার দেশে ঝুপড়ি মতো ঘরে মা আছেন। দুই লায়েক ব্যাটা আছে। সেখানেও জলের আকাল, ভাতের আকাল-চাষ আবাদ না থাকলে গাছের মরা ডাল। মট করে যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে।
এই রোদে ছাদে! অসুখে পড়ে যাবেন।
মহীতোষ জানে, কাজের মেয়েটি একটু বেশি বাচাল। সে নিজেকে বাড়ির একজন ভাবে। তার দাপট আছে। যে গোরু দুধ দেয় তার লাথি খেতে কষ্ট হয় না। মহীতোষকে এত প্রশ্ন করার স্বভাব সেই সাহসেই।
ছাদে কী করছিলেন?
দাঁড়িয়েছিলাম।
দাঁড়িয়ে থাকলেন! রোদে কেউ এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকে? তাও খালি পায়ে। ছাদে কী তাপ। পা রাখা যায় না।
মহীতোষ কোনও কথারই জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে একটা চিঠি লিখল মনতোষকে। মনি অর্ডার ফর্ম তার দেরাজে থাকে— সে এ-মাসে টাকা বেশি করে পাঠাল। মাকেও টাকা পাঠায়—এই দায় তার এখনও আছে। ঝুমির বিয়ে পাকা, শুধু সে ঘাড় পাতলেই হয়ে যায়। পাত্রপক্ষ পনেরো হাজার টাকা নগদ চেয়েছে। মুদি দোকান আছে। চায় ভাই। বিধবা মা, শহরের কাছে টালির বাড়ি।
মহীতোষ ইদানীং কিছু কিছু ব্যাপারে ফেঁসে গেছে। তার আয়কর বাবদ বড়ো অঙ্কের টাকা সরকারের ঘরে জমা দিতে হযে। পাঁচ সাত বছর তার চাকরি আছে। কোম্পানির অবস্থা খারাপ—গো স্লো, ইউনিয়নের হুমকি ধর্মঘটের। কোটি টাকার উপর বাকি প্রভিডেন্ট ফান্ড-এল আই সি, ই এস আই বাবদ। ধারদেনা, কোম্পানির লোন ব্যাঙ্কের কাছে তার ঋণ শোধ দিতে মালিক পক্ষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তার বাইরে সে কিছু টাকা আয় করে থাকে—বই বিক্রি হয় তার বেশ ভালো। স্কুলের বই। এখন বাজারে টেক্কা দেবার মতো তার বই-এর সমকক্ষ আরও বই বের হয়ে গেছে। স্কুলগুলি নানাভাবে উৎকোচপ্রিয় হয়ে গেছে। বই ধরাবার জন্য সবাই হন্যে হয়ে ঘুরছে। সঙ্গে টাকার থলে, হয় টিভি নয় গোদরেজের লকার—কিছু একটা উপহার হিসাবে দিলে, দু-পাঁচটা বই প্রকাশকের লেগে যায়। মহীতোষ আর আগের মতো টাকা উপার্জন করতে পারে না। সে এইসব নানা ঝামেলায় ত্রস্ত হয়ে পড়ছে।
মহীতোষ আজ সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, রোদের তাপ কত প্রখর হতে পারে। একজন মানুষ এই কড়া রোদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
এটা তার এখন এক ধরনের মজা।
যেমন একদিন সবাই দুপুরে ঘুমিয়ে আছে। সে ছাদে খালি পায়ে দাঁড়িয়েছিল। সে ফ্রিজের ঠান্ডা জল খায় না। সে শুধু ডাল দিয়ে ভাত মেখে খায়। সকালে মুড়ি চিবোয়। আগে তার সকালের খাবার ছিল চার পিস টোস্ট, ডিমের পোচ, দুটো মিষ্টি এবং একটি মর্তমান কলা।
এক দুপুরে সে স্ত্রীর কাছেও ধরা পড়ে গেল!
ওমা কী সর্বনাশ! তুমি রোদে দাঁড়িয়ে আছ! কী হয়েছে! কেন দাঁড়িয়ে আছ! তোমার মাথা ঠিক নেই। আমাকে আর কত জ্বালাবে। নামো বলছি।
মহীতোষ নেমে এসে বলল, আমি বাড়ি যায়।
যাও যেখানে খুশি যাও। এই গরমে তুমি বাড়ি যাবে! আলো নেই, পাখা নেই। মাটির ঘর, জানালা নেই। অসুখ বিসুখ হলে কে দেখবে?
কাউকে দেখতে হবে না। এবং পরদিন সকালে সে সত্যি এক জামা কাপড়ে বের হয়ে গেল–কাউকে কিছু না বলে!
সুর দেখল, ঘরে তিনি নেই। তবে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কী যে মজা পান—না মাথায় গোলমাল, কে জানে—সে ছাদে গিয়ে দেখল, নেই।
নেই। নেই।
ঝুমি সকালে উঠে দেখল গাছতলায় কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এত সকালে ঝুমি ঘুম থেকে ওঠে না। এবারের সমন্দ ভেঙে যাওয়ায় ঠাকুমা খুবই ভেঙে পড়েছে। চোপা করেছে, শাপ-শাপান্ত করেছে বৌদের। ঝুমি বিরক্ত হয়ে বলেছে, ঠাম্মা চুপ করবে কি না বল!
কাকাকে চিঠি লিখতে বলেছিল, মহীতোষকে বাড়ি আসতে বল। সে নিজে গিয়ে যদি একবার চেষ্টা করে।
ঝুমির এক কথা, আমি পারব না। কাকাকে দেখছি তোমরা সবাই মিলে মেরে ফেলবে। কাকা এসে কী করবে! আমি তোমার গলার কাঁটা। যাব যেদিকে চোখ যায় বের হয়ে।
ঝুমির বয়েস হয়ে গেছে। দেখতে খারাপ না। কাকা তো বলবেন ঝুমি আমাদের প্রতিমার মতো দেখতে। রংটা শুধু চাপা। কাকা নিজে চেষ্টা করতে পারতেন, কাকিমার ভয়ে চুপ। কী নিয়ে অশান্তি শুরু হবে সে জানে। কাকিমার এক কথা, মানুষটাকে সবাই মিলে মেরে ফেলবে। ঝুমি বোঝে কাকিমার অভিযোগ খুব মিছে নয়। বাড়ির আর সবাই বাবা এবং অন্য কাকারা তার কথা খুব ভাবে বলে মনে হয় না। বাবা তো বলেই দিয়েছে, আমি রিটায়ার করেছি। পেনশনের টাকায় চলে না। ঝুমির নীচে আরও পাঁচ বোন। তারা সবাই বাবার কাছেই থাকে। কেবল সে থাকে ঠাকুমার কাছে।
আগে সংসারটা এমন ছিল না। দাদু বেঁচে থাকতে বাড়ির চারপাশে যেন আশ্চর্য সমারোহ ছিল। কাকা টাকা পাঠাতেন, দাদু আড়তে কাজ করতেন জমিজমা চাষ-আবাদ মিলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। গৃহ-দেবতার পূজার আয়োজন তাকেই করতে হত। ফুল তোলা থেকে, ঠাকুরের বাসন-কোসন মাজা সব। বড়ো পিসির টিউসিনি করে টাকা উপার্জন। ছোটো কাকার পাটের দালালি, তাতেও দু-পয়সা-এই করে সংসারে কোনো টান ছিল না। দাদু মরে যেতেই সংসারটা কেমন আলগা হয়ে গেল। সেজ কাকা, ছোটো কাকা ভিন্ন হয়ে গেল। ঠাকুমার খবর নেয়, তবে টাকাপয়সা দিয়ে কেউ সাহায্য করে না। কাকা দাদুর কাজ হয়ে যাবার পর ভাইদের ডেকে বলেছিলেন, মার জীবিতাবস্থায় বাবার সামান্য জমি-জমা, গাছপালা বাগান যা আছে তিনিই ভোগ করবেন। তোমরা হাত দেবে না।
ছোটো কাকাকে দু-দুবার দোকান করে দিল—ফেল। এখন তো দোকান বন্ধ। ছোটো কাকার জন্যও তার কষ্ট হয়। তবে কাকিমাটি যা একখানা, এত মুখ করে আর এমন সব লাগানি ভাঙ্গানি চলে যে কষ্টটা কেন যেন মাঝে মাঝে বুক খালি করে উবে যায়। তখন তারও রাগ, বোঝে এবার ঠাকুমাকে তড়পে এসেছিলে, গাছ বিক্রি করতে দেবে না বলেছিলে, বোঝো এবার।
গাছ বিক্রি করলেই মনতোষ মা-র উপর ক্ষেপে যেত। তার এক অভিযোগ, দাদা ফল খেতে বলেছে, গাছ বিক্রি করতে বলেনি। তুমি গাছ বিক্রি করে কী কর বুঝি না। ঝুমির নামে ব্যাঙ্কে টাকা রাখছ। দাদাকে মিছে কথা বলে বেশি টাকা আনাচ্ছ। দাদাকে দাঁড়াও সব লিখব।
ঝুমি তখন আর সহ্য করতে পারে না। মাটির ঘর। টিনের চাল। চারপাশে টালির বারান্দা। বাঁশের খুঁটি। নড়বড়ে হয়ে যায়! কী দিনকাল! কাকা দুজনের ভরণপোষণের বাবদ যা দেয় তাতে চলে না। ঠাকুমা গাছ বিক্রি করে, বাঁশ বিক্রি করে বাড়তি কাজগুলি সেরে নেয়। তুই পেটের ছেলে! সহ্য হয় না!
সামনের দিকে মনতোষ তার ঘর তুলে আছে। একখানাই মাটির ঘর। সামনে সঙ্গের বারান্দা, পেছনে বাঁশের খুঁটি দিয়ে গোয়াল। গোরুটা অভাবে পড়ে বিক্রি করে দিয়েছে। মনি অর্ডার এলে মনতোষের দৌড়ে যাওয়ার স্বভাব। দাদা তার নামে যদি মাসোহারা পাঠায়।
এই একটা আশায় সে বসে থাকে। মাঝে মাঝে আসে। আবার কোনো মাসে আসে না। চিঠি আসে। আগামী মাসে পাঠাবার প্রতিশ্রুতি থাকে। মনতোষ বোঝে, দাদার কাছে আবার না গেলে চলবে না। পাঁচ-পাঁচটা মুখ। পুত্র সন্তান দুটি তার স্কুলে পড়ে। ঠিক পড়ে না, বলতে গেলে টিফিনে পাউরুটি পাওয়া যায়। দু-ভাই মিলে পাউরুটি নিয়ে এলেও কিছুটা যেন পেটের দায় মেটে।
তার এক কথা, ও নলিনী, দাদা মাকে কত পাঠাল?
যা পাঠায়।
তুমি মনে রাখতে পার।
তা পারব না। এ-মাসে বেশি দেয়নি।
বেশি দিলেই মনতোষ গড় গড় করবে।–মা নাতিনকে আর দুটো হিন্দি সিনেমা বেশি দেখাতে পারবে। নিজের থান না কিনে ঠিক নাতনিকে শাড়ি কিনে দেবে। আমরা তো সব কলাগাছ ফুড়ে হয়েছি। একবার দ্যাখে, তারপরই লাঠি নিয়ে তাড়া, এই তারক আবার যদি ওদিকে যাস ঠ্যাং ভেঙে দেব। ধীরু তোর ছাল চামড়া তুলে নেব। বুড়ি তোদের কেউ হয় না। আমার কেউ হয় না। তারপরই লাফিয়ে গাছে উঠে যায়। ডাল কাটতে থাকে।
মনতোষের কেমন মাথা ঠিক থাকে না। অভাব অনটনে মনতোষ মাঝে মাঝে আগুন জ্বালিয়ে দিতে চায়।
সেই মনতোষ মাকে বলে গতকাল সারা উঠোন কুপিয়েছে। হাতে কাজ নেই। ইটের ভাটায় কাজ নেই। আর সে পারবে কেন! কোমরে ব্যথা। এদিকে ঘরে এক মুষ্টি আটা পর্যন্ত নেই। সে যে কী করে! তখনই বুঝি ফন্দিটা কাজ করেছিল মাথায়।
সে ডালিম গাছটার কাছে নীচু হয়ে বসে কী দেখল।
আজকাল সে কিছু তুকতাক শিখেছে, তার গুরু নাদুঠাকুর। নাদুঠাকুরকে–ও মানে। এই যে এবারেও সমন্দ ভেঙে গেল, কোন গুণের প্রভাবে। কিন্তু সেটা কীভাবে চাল দেবে সারারাত ভেবেছে। জল পড়া, চাল পড়া কত রকমের তুকতাক আছে। মা-র বোকনা হাফিজ। কে নিল।
ঝুমি তখন কলকাতায় কাকার কাছে। পাশের কুমোরদের মেয়ে পাতিকে শুতে বলে গেছে রাতে। তা পাতি আরও কয়েকবার থেকেছে। ঝুমির জন্য পাত্রপক্ষের খবর এলেই দিনক্ষণ মাসখানেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মাস দেড়মাস ঝুমি কাকার কলকাতার বাড়িতে থেকে এলেই শহুরে মেয়ে। লাবণ্য জমে যায় শরীরে। রং খুলে যায়। বাধা জায়গায় থাকলে যা হয়। কলকাতায় জলের গুণটা টের পেতেই মা বছরে এক দু-বার ঝুমিকে মহীতোষের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সাওয়ারের জল, গন্ধ সাবান, স্যাম্পু কত কিছুর ব্যবস্থা স্নানের ঘরে। পাত্রপক্ষ দেখে পছন্দ করে ঠিক। তারপরই পাকা কথা দেবার সময় হলে আর কোনো খবর দেয় না। কে যে কানে তুলে দেয়, যা খোলতাই দ্যাখলেন দু-দিনের। তবে কি পাত্রপক্ষ টের পায় কলকাতার জল হজম না হলে বোঝা যাবে না। হজম হতে বেশি সময়ও বোধ হয় লাগে না। পাঁচ দশদিন যেতে না যেতেই কেমন শরীর চিমসে মেরে যায়। গাল বসে যায়। চামড়া পুড়ে যায়।—গাঁইয়া চেহারা, কে নেবে। স্কুল ফাইনালটা পাস করলেও হত। কিছুতেই মই বেয়ে উপরে উঠতে পারল না ঝুমি। বার বার হড়কে পড়ে গেল।
সেই ঝুমির বিবাহ এবারে পাকা।
বয়স নিয়ে পাত্রপক্ষের সঙ্গে মিছে কথা বলতে হয়। এবারের পাত্রটির খবর নিয়ে এসেছিল বড়োপিসি। বড়োপিসি ভাইঝিকে ছোটোবেলা মানুষ করেছে। পায়ে পায়ে ঘুরেছে। এখন পিসিরও সংসার হয়েছে। ছেলেরা বড়ো হয়ে গেছে। বড়োটা এবার ইস্কুল ফাইনাল দেবে।
আসলে ঝুমি বোঝে সে এখন তিনজনের গলায় কাঁটা হয়ে ফুটে আছে। একনম্বর ঠাকুমা, দু-নম্বর বড়োপিসি, তিন কলকাতার কাকা। লোকজন বাড়ি এলে মহীতোষের নাম আর করে না। বলে কলকাতার ছেলে চিঠিপত্র দেয় তো! ঝুমিকে বলে তোর কলকাতার কাকা পূজায় কী দিল!
সবই গোপনে করতে হয়। লাগানি-ভাঙানি হচ্ছে দেখে ঝুমিকে এবার পিসির শহরের বাড়িতে দেখানো হয়েছে। সবে দু-দিন হল কলকাতা থেকে এসে ঝুমি শুধু পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। পিসির এক কথা, তোকে কে বলেছে, কলকাতায় যেতে। ঝুমি কাজ ছাড়া থাকতে পারেনা। আর স্বভাব টিভি দেখা। পিসির বাড়িতে আছে, কলকাতার কাকার বাড়িতেও আছে। টিভির বিজ্ঞাপনের মতো জীবন যে নয়, সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
ঠাকুমার এক কথা, কম সমন্দ এল! ঝুমির বয়সি পাড়ার সব মেয়ে কবেই সাফ হয়ে গেছে। কপাল মন্দ না হলে হয়!
এত গোপন, এবং পাত্রপক্ষের সব দাবি মেনে নিয়েছে কলকাতার পুত্র তাঁকে ঠিক আপৎকালে রক্ষা করবে।
কলকাতায় এই বুড়ো বয়সে ছোটাছুটি।
মহীতোষও ভেবেছিল, এবারে তবে হয়ে গেল। বলেছে—যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তারপর কী না চিঠি না পাত্রপক্ষ পাকা কথা দিতে আসেনি। হাত থেকে এবারেও ডিম ফসকে চড়াৎ করে ভেঙে গেল।
মনতোষ মনে মনে খুশিখুশির কারণ এই বাড়ি, বাগান, গাছপালা সব সাফ করে দিচ্ছে মা। দাদাকে ইনিয়ে বিনিয়ে লিখছে—আর দাদাটিও মাতৃআজ্ঞা শিরোধার্য—বোঝে না, ঝুমি ছাড়া তার আর কারও প্রতি কোনো টান নেই। অন্য নাতি নাতিনরা কী সব জলে ভেসে এসেছে! একটা ফল পাকুড় পর্যন্ত ধরতে দেয় না। বলে কি না, ঠাকুমা দেখ ধীরু আবার গাছতলায় ঘুর ঘুর করছে। ঠাকুমা দেখ ছোটোকাকা আম পাড়ছে। আর তখন চোপা ঠাকুমার—নির্বংশ হবি, ধনেজনে যাবি। মরবি। গোলাম তুই আমার গাছে না বলে কয়ে উঠলি, ডাক শিবতোষকে। শিবতোষ, আলাদা বাড়ি করেছে—তার অভিযোগ, মনতোষ মানুষ নেই। অমানুষ হয়ে গেছে। বৌটা দজ্জাল। সে মাকে এক ধমকে তাড়িয়ে দেবে। বলবে, আমি কিছু জানি না, যাও।
শিবতোষ তেড়ে যাবে!
কেন, এখন কেন! কার জন্য বাড়ি ছাড়লাম। তোমার ছোটোপুত্র—আহা বোঝো ছোটোপুত্র, সে তেড়ে এসেছিল কেন। গলা টিপে ধরেছিল কেন—বল! আমাকে উৎখাত করে ছাড়লে। তোমরা সবাই। মেজদার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছি। আমাকে এখন লাগে কেন। ছেলেদের বলে দিয়েছি, আম খেতে হয় সাবর্ণদের বাগানে ঘুরবি-মরতেও বাড়ির আমবাগানে ঢুকবি না।
সুতরাং বুড়ো বয়সে মরণ!
মনতোষ জানে, এবারে একটা মোক্ষম সুযোগ এসে গেল তবে। সে ডালিম তলায় বসে ঘরে কী কথা হয় শুনছিল।
কী বলে!
ঝুমির গলা।
–ঠাকমা টোকা তুলতে গেছ তো আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। ঠাকমার কেমন চোখ বিবর্ণ হয়ে যায়। দুটো কচুর লতি তুলে এনেছিল সকালে। মেজাজ খারাপ বলে দুপুরে সেদ্ধভাত খেয়েছে। কচুর লতির উপর জল ছিটিয়ে চালে রেখে দেবে। ঘরবাড়ি গরমে জতুগৃহ–ঘরে টেকাই যায় না। মনে হয় আগুন, হলকা বইছে। আর তখনই কিনা বড়ো পিসি বলল, টোকা পোতা আছে কে বলল।
–ঝুমি ঠোঁট উলটে চোখ ট্যারচা করে দিল।
বড়োপিসি বুঝল মনা মানে মনতোষের পরামর্শ। কিন্তু নাদুঠাকুরের তুকতাকে তারও বিশ্বাস আছে। মনার সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা হয় তার। তবে আপদকাল বলে কথা। মনা বাড়ির সবটা গ্রাস করবার তালে আছে। মাঝে মাঝে সে বলতেও ছাড়ে না, বাড়িতে কি আর লক্ষ্মী আছে। গাছের ডালে সব শকুন বসে আছে—বুড়ি মরলে উড়ে এসে জুড়ে বসবে। দাদাকে সব না লিখে জানাচ্ছি তো, মুনিষ খাটছিস, দ্যাখ তোর আরও কত অধঃপতন হয়। ঠাকুর বাড়ির নাম ডোবালি। চুরি চামারি পর্যন্ত করতে শুরু করেছিস। মা-র নালিশ থেকেই দু-তিন সাল হল বুঝেছে কে নেবে—নেয় তোমার গুণধর ছোটোপুত্র। আচার্য বলেছিল না, ঠাউরকর্তা আপনেরে ছোটো পোলায় খাওয়াইব। খাওয়াচ্ছে না! গাছে নারকেল থাকে না— লিচু সাফ, আম, কাঁঠাল কিছু রাখতে পারছ!
কিন্তু আপদকাল বলে কথা। বড়োপিসি ঘরে বসেই ডাকল, মনা, মনারে!
উঠোনের সামনে রাস্তার ধারে মনার ঘর। মনা তো আর ঘরে নেই। সে ডালিমতলায় বসে। ঝুপড়ি আছে। শরীর আলগা করে বসেছিল। দিদির ডাকে, সে তাড়াতাড়ি নুয়ে গুড়ি মেরে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
আবার ডাকছে, মনা বাড়ি আছিস।
সাঁজ বেলা। ঘরে লম্প জ্বেলে দিয়েছে তারকের মা। সে দেখল, তিনটে মুখেই প্রত্যাশা-বাবা রাতে কিছু আনবে। সারাদিন এ-বাগানে সে-বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছে। এঁচড় চুরি করেছিল—জঙ্গলে রেখে এসেছে। কাল সকালে বাজারে যাবে না শহরে যাবে ঠিক করতে পারছিল না। যদি ধরা পড়ে যায়। এসব সাত পাঁচ ভাবনা মাথায়—দিদি ডাকছে, ডাকুক। মজা। কারণ সে জানে দিদি এল বলে। উঠোনে আমার মুততেও আসবে না। বোঝো এখন।
মনা আছিস!
লুঙ্গিটা উপরে তুলে বাঁধল মনতোষ। গায়ে হাড় ছাড়া কিছু নেই। পেট তালপাতার পাখার মতো ঠান্ডা মেরে পড়ে আছে। লুঙ্গি খুলে যায় বার বার।
কী হল! ডাকছি। সাড়া দিচ্ছিস না।
সে উঠোনে বের হয়ে বলল, বল।
বাড়িতে নাকি টোকা পোঁতা আছে!
নাদুঠাকুর তো তাই বলল।
কে পুঁতেছে।
কে জানে!
শরিকি ঝগড়া যেমন হয়ে থাকে। টোকা যদি মনা নিজেই পুঁতে রাখে। অভাবে বুদ্ধিনাশ। পুঁতে রাখতেই পারে। ঝুমিরও হয়েছে, বাড়ি বাগান বাঁশঝাড়ে কেউ ঢুকলেই তাড়া। ঠাকুমার কাছে নালিশ। ঠাকুমার চোপার চোটে ভূত ভাগে। টোকা নিয়েও চেষ্টা করেছে দিনমান আমার আবাগী নাতিনের উপর তোদের কেন এত নজর রে ড্যাকরার বাচ্চা। ওলাওঠা হয়ে মরবি। কিন্তু পরে বুঝেছে বিধান মেনে না চললে ঝুমির উদ্ধার হবে না। বিকালেই খবর পাঠিয়েছে, বড়োমেয়েকে। শিবতোষ শুনে বলেছে, রাখ তোমার টোকা! টোকায় কী আছে!
মনা যে বলল, কালো ছাগলের নাদি আছে, ধনেশ পাখির পালক আছে। কুমারী মেয়ের রজস্বলার তেলকানি আছে। টোকা তুলতে না পারলে ঝুমির গতি করা যাবে না।
শিবতোষও তুকতাক বিশ্বাস করে। ওই তো গ্রীষের বৌটা জলে ভার হয়ে গেল। নাদু ঠাকুরের টোটকায় আরোগ্য লাভ করেছে। কী ভেবে বলেছিল, যা ভালো বোঝো করো।
তার নিজেরও কাচ্চাবাচ্চা আছে। কে কোথা থেকে তুক তাক করবে, গুণ করবে—যা দিনকাল, চালের কেজি পাঁচ টাকা। রেশনের চাল খাওয়া যারে না। সকালে উঠে গোরু সেবা, দুধ দোহানো—বাজারে দুধ বিক্রি, রোজের দুধ দিয়ে আসা, তারপর বগলে গামছা ফেলে ডোবার তলানি জলে ডুব—শেষে পড়িমরি করে আহার এবং সাইকেলে সরকারি অফিস। ফেরে পাঁচটায়। চারপাশে বনজঙ্গল, সাপখোপ, ইঁদুর বাদুর কত কিছুর উপদ্রব-বাড়তি উপদ্রবের ভয়েই সে বলেছিল, টোকা যখন পোঁতা আছে কিছু আর করার নেই। টোকা পুঁতে রাখলে তো সমন্দ ভেঙে যাবেই।
টোকাখান তুলতেই হয়।
তা মনা টোকা কোনখানে পোঁতা আছে জানস!
কী করে কই। বলল ত নৈঋত কোণে বড়ো চাঁপা গাছের নীচের দিক থেকে মাটি কোপাতে শুরু করতে হবে। না পেলে মরণ। কার কিছু করার নেই! পেলেও মরণ। আর একখান টোকা মন্ত্র তন্ত্র তালপত্র ভূর্জপত্র আরও কী সব মোক্ষম চালান দেবে, বাঙ্গ-বাক্স করে টোকা পোঁতা বের হয়ে যাবে। গলগল করে রক্ত ওগলাবে। তা ম্যাও লাগে। ম্যাও নিয়ে কথা।
কত ম্যাও লাগব।
মনা মাথা ঝাঁকায়। আর বলে মায়রে কও, আমার পুত্ররা গাছতলায় গেলে আগুন জ্বলে তেনার নাতিন এখন বয়স পার করে দিয়ে কুড়িতে বুড়ি। আর তুই দেড় কুড়ি বয়স-বিয়ার আর দরকারটা কী।
মনা ভালো হবে না। তুই আবার ঝুমিকে নিয়ে পড়লি। ঘর শত্রু বিভীষণ।
সবাই দিচ্ছি। তুমি নও! নাও আমি জানি না কত লাগব। নাদু ঠাকুরের কাছে যাও। তার মর্জি।
নাদু ঠাকুরের কাছে গিয়ে বড়ো পিসি শুনল, কোনো এক আমবাগানের বাবু ধরে নিয়ে গেছে। খুবই গুপ্ত কথা। বাবু নাকি কোনো পরস্ত্রীর জন্য পাগল। হিল্লে করতে গেছে। সারা সকাল এই করে গেল, নাদু ঠাকুর, ফিরল না। বড়ো পিসির মুখ ভার। এক কথা তার এই কী ফ্যাসাদে ফেলালিরে মা। তর নিজের ভাইঝি— তুই কইতে পারস না!
কইতে পারি।
তবে ক।
একশো এক টাকা টোকা তুলতে একশো এক টাকা পালটি টোকা পুঁততে। টোকা তুলে দিলেই হবেখন! পালটি মারতে হবে না। নাহলে, আবার টোকা যদি পোঁতে ফের একশো এক টাকা। পুঁতলেই একশো এক টাকা!
ঝুমি দেখল ছোটো কাকার উঠোনে পিসি কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছে।
টাকা দিব কে?
ক্যান দাদা। মায় লিখলেই হয়ে যাবে। টোকা পুঁততে তুলতে পুঁততে।
মনা!
মনতোষ এবার ঠাণ্ডা মাথায় বলল, দশটা টাকা দে দিদি। পুত্ররা কিছু খায় নাই। দাদা টাকা পাঠায় নাই। দে। দাদার টাকা এলে দিয়ে দেব। দে দিদি। কাল সকালে উঠে টোকা তুলে দিলে বাকি টাকা দিতে বলবি মাকে।
বড়োপিসি আর কী করে। অতিকষ্টে দশটাকার নোট বের করে বলে, টোকা খুঁজে না পেলে, ফেরত দিবি।
তা দেব না! আমি মাগনা কারো কাছে কিছু চাই না।
সেই টাকার চাল ডাল নুন— খিচুড়ি মহোৎসব। সকালে মনতোষ, একজন যোগলদার সঙ্গে নিয়ে কোপাতে থাকল। সারা উঠোন কুপিয়ে ফালা ফালা করে দিল। কোথায় টোকা পোঁতা আছে! সে গড় গড় করছিল। নাদু ঠাকুর তুমি তো জায়গাসোন দেখিয়ে গেলে পারতা। তা টৌকা-তো মেলে না। সারা উঠোনে মনা হম্বিতম্বি করে বেড়ায়। অদৃশ্য হবে। এত বড়ো বেশি ওজনদার গুণিন-পাশের বাড়ির দিকে চোখ মট মট করে তাকায়। নারানের দিদির বাড়ি ওটা। একা বিধবা মানুষ, তিন পুতের মাথা খেয়ে দিব্যি যাত্রা দেখতে যায় মিলের গেটে। তারই কাজ। অন্তত নাদু ঠাকুর এমনই বলেছে।
মনতোষ আসল রহস্য ভাঙছে না। টোকা তোলার নামে সে এক এলাহি ব্যাপার শুরু করে দিতেই ঝুমির মাথা খারাপ। তার মাথা কুটতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছোটোকাকার বুজরুকি—এবং সত্যি যখন টোকাখানা দিনের শেষে তুলে আনল, তখন পাড়াপড়শির ছোটাছুটি—পাওয়া গেছে। ডালিম গাছের নীচে কে পুঁতে রেখেছিল। পাওয়া গেছে।
পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে, টোকা পুঁতে রেখেছিল কে? ডালিম তলায় চুপিসারে কে কাজ সেরে গেছে—কবে কখন, ওই মাল আসে—তা বলতে পারছে না। সবাই হামলে পড়ছে টোকাখান উপুড় হয়ে দেখার জন্য—মানা মানে মনতোষের এক রা না—টোকা তার মতো থাকুক—সে কলাপাতায় মুড়ে টোকাখান দিব্যি মাথায় নিয়ে নাচানাচি করছিল। ঠাকমা বারান্দার ছোটো পুত্রের নাচ দেখছে, টাকা, বাকি টাকা গস্ত করতে পারলেই সে টোকাখান গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে আসবে। বাকির কারবার সে করে না।
সবাই বলল, কী আছে।
মনা বলল, কী নেই। কী না লাগে বশীকরণ করতে যারা মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাদের কাছে বলি, টোকার ভেতরে আছে মধু, প্যাঁচার কান, প্যাঁচার চোখ, প্যাঁচার মাংস। চটক পাখির চোখ, সাপের খোলস।
আছে কাকজংঘা।
আমার টাকা কই। লাফ মনার।
লোকের ভিড়। ঝুমি চোরের মতো ঘরের কোণায় বসে। পাত্রপক্ষ এবারেও উধাও। ঝুমির কান ঝা ঝা করছে। হঠাৎ সে বের হয়ে চিল্কার করতে থাকল, ঠাম্মা টাকা দিলে আমার মরা মুখ দেখবে। ঝুমির বিশ্বাস কাকার ছলচাতুরি সব, ঠাকুমার কাছ থেকে টাকা হাতাবার ধান্দা।
মনা বলছে, রাক্ষসী তন্ত্রের বিধান। না মানলে চোখ অন্ধকার। সে টোকা মাথায় নিয়ে নাচছে। নেচে বেড়াচ্ছে। টাকা, বাকি টাকা চাই।
মাঝে মাঝে শুধু হাঁকছে, টাকা কই।
তার লুঙ্গি খসে যাবার উপক্রম। সে কোনোরকমে এক হাতে লুঙ্গি সামলাচ্ছে আর জয় রাক্ষসীতন্ত্র। তর তন্ত্রে তরে যামু।
আসারনাম মনা ঠাকুর। নাদু ঠাকুর গুরুকাকা।
তারপরই হাঁকছে—বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে বশীভূত করার জন্য চাই কিংবা চিরদাসত্বে বন্দি করার জন্যও বিধান আছে। আমার ভাইঝিরে পছন্দ না। দ্যাখ
ব্যাটারা কী হয়!
তারপরই হাঁক, টাকা কই! বড়োপিসি আর না পেরে বলল, মা টাকা দাও শিগগির। তোমার পোলা এখন নাদু ঠাকুর।
কী বিধান ঠাকুর?
বিধান আছে, বামনহাটি, বচ, পিপুল পায়রার বিষ্ঠা সৈন্ধব লবণ, প্রিয় তণ্ডুল, খঞ্জন পাখির মাংস শোল মাছের চোখ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে যৌনাঙ্গে লেপন। বাস। কাম ফতো! পাত্র বল, স্বামী বল পরস্ত্রী বল সব শ্রীচরণের দাস। টোকাখান এবারে কী করমু কন!
তাড়াতাড়ি ঠাকুমা অর্থাৎ মোক্ষদা বুড়ি গুনে গুনে টাকা দিয়ে বলল, তুই আমার শ্রাদ্ধের অধিকারী বাপ। পেটের বাড়িতে আর টান নাই, শুকাইয়া গ্যাছে। গঙ্গায় যা, আমার শেষ আদ্যাশ্রাদ্ধের কাম সাইরা আয়।
লাফাতে লাফাতে মনা চলে গেল। সঙ্গে এক পাল কাচ্চা বাচ্চ গঙ্গাযাত্রা শুরু। কপালে রক্ত চন্দন লেপে, মনা রওনা হয়ে গেল।
তারপর ফিরে এল মনা বড়ো সাত্ত্বিক হয়ে। এসে ঘরে কাচা ধুতি পরল। এতদিনের ক্ষোভ জ্বালা ঝুমির উপর যেন নেওয়া গেল। প্রতিশোধ যারে কয়। গাছের ফল-পাকুড় খা এবার। লাগানি ভাঙ্গানিতে কী হয় দ্যাখ! এর বিয়া হইব। দাদার টাকার দাম নাই। পুত্রগণ আমার উপবাসে থাকে, হাত ওঠে না। ঘরে ঢুকলে দূর দূর ছাই ছাই। এই ধীরু আবার এয়েছিস! আবার! ঠাকুমা খাবে না!
আর এক গরাস দিদি।
হাঁ-মুখ করে মোক্ষদা বুড়ির পাশে বসলে না দিয়ে পারা যায়! তুই ঝুমি নাতনি, পিণ্ডদানের কোনো অধিকার আছে তোর। কেবল পালন করে বুকের মধ্যে দুঃখ জমা হয়ে আছে। আমি ছোটোপুত্র—সারাদিন মায় আমারে শাপ-শাপান্ত করে—কয়, মর। নির্বংশ হয়ে যাবি। আমার কাঁঠাল কে নেয়! আমার গাছে আম থাকে না। তুই জোর করে দু-খানা গাছ বিক্রি কইরা দিলি! বাপের দোহাই মানলি না। দাদার চিঠি পড়ে উলঙ্গ হয়ে নাচলি—এই করবে। আসুক মহী না বলেছি তো আমার নামে কুত্তা পুষিস।
মনা এবার মোক্ষদা বুড়ির বারান্দায় এসে বসল। ঝুমির ইচ্ছা হচ্ছে এক কোপে গলাখান কেটে দেয়। ইতর। তার জীবন নিয়ে মজা করছে সবাই। কে বলেছে, পাত্র খুঁজে বেড়াতে। কেউ নেই। বাপ থেকেও নেই। মাও না। অপমান লজ্জায় ঘৃণায় ঝুমি কী করবে বুঝতে পারছে না। তখনই সে দেখল, ঠাকুমা দরজা ধরে বারান্দার দিকে এগোচ্ছে। চোখে কম দ্যাখে। হাতে লাঠি না থাকলে চলাফেরা করতে পারে না-কে যেন ডাকল।
আমি মা। তোমার ছোটো পুত্র। মনা। চোখে দেখতে পাওনা, তবু বাঁইচা থাকতে চাও। নাতনির ঠাই না করতে পারলে মরতে পারবা না কও। মাঝে মাঝে বাবায় রাতে আইসা শিয়রে বইসা ডাকে—তোমার এক কথা, স্বগগ সুখ! স্বগগ সুখ ভোগ কর একলা একলা, ঝুমিরে বিয়া না দিয়া যাইতে পারমু না।
তুই আমারে ডাকলি মনা।
হ মা। বস।
শোন আর একবার চেষ্টা কর। বলে মনতোষ একটা বিড়ি ধরাল।
আমি রোহিণী নক্ষত্রে বটগাছের পরগাছা নিয়ে আসব। বুঝলে। কী বললাম! সে বিড়িটা ফুক ফুক করে টানছে।
বটগাছ বললি!
বটগাছ না, বটগাছের পরগাছা।
কী হবে!
হবে। সব হবে। রোহিণী নক্ষত্রে বটগাছের পরগাছা নিয়ে হাতে রাখলে রাজা থেকে শুরু করে, দুষ্টা স্ত্রী, লম্পট স্বামী, প্রভু, পতি, পশুপাখি পর্যন্ত বশীভূত থাকে। এই একটা উপায় মাথায় খেলছে। আর ভূর্জপত্রে ষড়যন্ত্র এঁকে একটি করোটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। ওটি এবার পুঁতে দেব। তুমি খোঁজ কর পাত্রের।
দিদি, দিদি। মনতোষ জানে দিদি ঘরের ভিতরেই আছে।
ভিতরে ঝুমির বড়পিসি মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আজই ভেবেছে, দাদাকে সব জানিয়ে চিঠি লিখবে! কী আরম্ভ করেছে মনা। তুই কিছু বলবি না দাদা! এভাবে ঝুমিকে নিয়ে কেলেঙ্কারি করলি। টাকা নিলি! মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না!
দিদি হঠাৎ বের হয়ে চিৎকার করে বলল, তোর মুখ দেখলেও পাপ। তারপর হন হন করে হেঁটে গেল। বড়ো রাস্তায় রিকশা ধরে শহরে চলে যাবে, না হয় বাসে।
মনা বলল, যা বাব্বা। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। এত অধর্ম সইবে! কলিকাল।
আর তখনই দুজন পুলিশ আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে কাকে খুঁজছে। পুলিশের সঙ্গে পঞ্চায়েত মেম্বার প্রবোধ দাস। প্রবোধ দাসই ডাকল, মনা ঠাকুর আছ!
পুলিশ দেখলে মনতোষের আজকাল বুক গলা শুকিয়ে যায়। উঠে চম্পট দেবে ভাবল,
কিন্তু সঙ্গে প্রবোধ দাস–নিশ্চয়ই অন্য কোনও কার্যকারণ আছে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, দাদা আপনি!
থানা থেকে এসেছেন। তোমার কলকাতার দাদা দু-দিন হল নিখোঁজ। কাগজে দ্যাখনি!
না তো!
আর কাগজ! মনে হল চড়াৎ করে মাথায় কাগে হেগে দিল—দাদা নিখোঁজ! তার মানে দাদা কোথায়! দাদার সংসারে অশান্তি চোখের উপর দেখে এসেছে। দাদা নিজেই বাড়িতে তস্করের মতো হাঁটাহাঁটি করত। সন্ত্রাস। সন্ত্রাসে পড়ে দাদা চোখে মুখে বোধহয় আর পথ দেখতে পায়নি। বৌদিও সারা জীবন ঘোড়ার মতো ছুটিয়েছে। মনে হল এক নারী অশ্বপৃষ্ঠে বসে কেবল চাবুক মারছে।
সে সহসা চিৎকার করে উঠল! আরে তোরা কে কোথায়? মা মা। ওগো শুনছ সরলা। দাদা নিখোঁজ।
আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বজ্রপাত যেন। মনতোষ তন্ত্রমন্ত্র ভুলে গেল। মাসোহারা বন্ধ। কী করবে! সে দেখল, মা লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কোপানো উঠোনের উপর দিয়ে ছুটে আসতে গিয়ে পড়ে গেল। ঝুমি কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শিবতোষ খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।
পুলিশ বিশেষ কিছু বলতে পারল না। যদি এখানে চলে আসে–তারবার্তায় খবর।
পুলিশ আর কী খবর নেবে বুঝল না।
তখনই ঝুমি গাছতলায় ছুটে এসে বসে পড়ল। বলল, কাল সকালে, ফর্সা হয়নি, দেখি কে আমগাছটার নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এত সকালে কাকা কী করে আসবে! চোখের ভুল—পরে দেখি সত্যি নেই।
মোক্ষন্দা ছুটে এসে বিলাপ শুরু করে দিল, বাবারে—কার কাছে রেখে গেলিরে! আমার কী হবে। আমাকে কে দেখবে— ঝুমির বিয়ে কে দেবেরে বাবা!
শিবতোষ বলল, কবে থেকে নিখোঁজ?
ওরা কাগজ বের করে সব দেখল। বলল, দু-দিন হল। সকালে বাড়ির কাজের মেয়ে দেখে তিনি নেই। অফিসের কোনও কাজেও বাইরে যায়নি। কেউ কিছু জানে না।
শিবতোষ মাকে এক ধমক লাগাল।
থামবে! কী আরম্ভ করলে তোমরা!
সব চুপ।
বাড়িটার চারপাশে গাছপালা জঙ্গল, বাঁশঝাড়–দাদা এলে কী আর জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াবে। হয় কখনও! ঝুমি দেখেছে। তবে দাদা বেঁচে নেই। শেষবারের মতো তার প্রিয় ঘরবাড়ি দেখার জন্য বিদেহী আত্মা স্বরূপ ধারণ করে দাঁড়িয়েছিল। দাদার কোনো অর্থাভাব নেই, কিন্তু অশান্তির চোটে ইদানীং খুবই কম। কথা বলতেন। বছর তিনেক হল বাড়িমুখো হয়নি। বাড়িতে মাটির ঘরে কষ্ট। মা তালপাতার পাখায় হাওয়া করলে বলত, না, না আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বলত, বাড়িতে এলে আমার পরমায়ু বাড়ে। সেই দাদা নিখোঁজ।
দাদাকে বৌদি কিছুতেই বাড়ি আসতে দিত না। শিবতোষের চোখ ফেটে জল বের হয়ে এল। ভাই বোন-অন্ত প্রাণ। সেই দাদা বৌদিকে বাড়ি যাবে বললেই ক্ষেপে যেত। অশান্তি করত। ওটা বাড়ি না জঙ্গল। গরমে মরে যাবে না। শীতের দিনে বলত, ঠান্ডা লাগিয়ে অসুখ বিসুখ বাধালে আমি জানি না। কে করে? আসবে কেউ-কেউ এসে সেবা করবে? টাকা ছাড়াতো তারা কিছু বোঝে না। সব ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্ত পুরুষ। দাদা বৌদির কথায় অতিষ্ট হয়ে উঠলে বলত বুঝছ না, আমি সেখানে ভাই বোনদের সঙ্গে বড়ো হয়েছি। আমাদের কী দিন গেছে! গাছপালা মাঠ আমার কত প্রিয় বোঝ না। আমার শেকড় উপড়ে ফেলছ কেন?
তখন মহীতোষ হাঁটছে। গালে বাসি দাড়ি। পাজামা পাঞ্জাবি ময়লা। সে দু-রাত কিছু খায়নি। নিজেকে এই কষ্ট দেওয়ার মধ্যে সে যেন কোনো আনন্দ পাচ্ছে। নিজের সঙ্গে কথা বলছে— কী মহী কোথায় যাবে বলে রওনা হয়েছিলে-জঙ্গলে রাত কাটাতে মন্দ লাগে না! সাপ, খোপের আতঙ্কে তোমার বৌ তো গাঁয়ের বাড়িতে আসতেই দিত না। কবজা করে ফেলল। বাড়িতে কী দেখলে! কার জন্য দৌড় শুরু করেছিলে।
এখানটায় চুপচাপ বসা যাক কী বল!
মহীতোষ দেখল সড়ক থেকে অনেক দূরে একটা কবরখানায় সে হেঁটে যাচ্ছে। ভাঙা পাঁচিল, মিনার মসজিদ, একটা লম্বা শান কবরের উপর। আহা কী আরাম, সে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল। ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই। দাহ ভিতরে ছিল— এই গভীর বনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে তার মনে হল, ভালোই আছে। তার ঘুম পাচ্ছিল।
সে শুয়ে আছে।
অদ্ভুত সব দৃশ্য ভেসে উঠছে।
সে বড়ো হবার মুখে বড়ো অভাবের সময়। মনতোষকে কোলে নিয়ে সে ঘুরছে। মাঠে নেমে গেছে-মনে মনে পরীক্ষার পড়া ঝালিয়ে নিচ্ছে। মনতোষ তার পুত্রবৎ বয়সে। সেই মনতোষ এখন মনা ঠাকুর হয়ে গেছে। বারান্দায় খেতে বসলে মনতোষ তার পাশে বসত। সে খাইয়ে না দিলে মনতোষ খেত না। ওর দুই পুত্রের কথাও মনে হল। নাতির কথা মনে হল, সন্দেশ কলা পাউরুটি ডিমের পোচ দিয়ে শুরু আঙুর দিয়ে শেষ। খেতে চায় না। খাবার নিয়ে পুত্রবধূর অশান্তির ছবিও ভেসে উঠল। কত রকমের বাহানা।
দুই উলঙ্গ শিশু।
বাড়িতে গেছে। ধীরুর তখন বছর তিনেক বয়স।
সে বাড়ি গেলেই ধীরু তারক সামনে। কত কথা।
যেমন বলত, জান জেঠু আমি রসগোল্লা খাই।
সে বলত, আর কী খাও!
পাউরুটি খাই। ইস্কুলে জান পাউরুটি দেয়। তারপর আবার বলেছিল, আমি রসগোল্লা খাই।
আর কী খাও?
আমি ভাত খাই ডাল খাই পাউরুট খাই। রসগোল্লা খাই।
আসলে যেন বড়োলোক জেঠুকে খবর দেওয়া সে রসগোল্লা খায় না এমন কেউ বললে মিছে কথা হবে।
মহীতোষ এক হাঁড়ি রসগোল্লা আনিয়ে ভেবেছিল, ভাইপো ভাইঝিদের পেট ভরে রসগোল্লা খাওয়াবে।
ধীরুকে বলেছিল সে।
ধীরু সব সময় দু-হাত পেছনে রেখে দাঁড়ায়। পেট শ্রীঘটের মতো। অপুষ্টিজনিত এই শরীর। সে বোঝে। কিন্তু যা কিছু করে গোপনে–এমনকী একবার খবর পেয়ে তার চাবি সিজ করে ফেলল। সে অশান্তিকে বড়ো ডরায়।
ধীরু এক হাতে রসগোল্লা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
মহীতোষ ভেবেছিল, একটা করে খাবে, একটা করে দেবে। আশ্চর্য ধীরু কিছুতেই হাতের রসগোল্লা খেল না।
মহীতোষের মধ্যেও ছেলেমানুষি প্রবল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, খা আবার দেব।
ধীরু ডান হাত পেতে বলেছিল, দাও।
আরে ওটা খা, খেলে তো দেব।
ধীরু কিছুতেই জেঠুকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সবাইকে দিল, টপাটপ খাচ্ছে। কিন্তু ধীরুকে আর একটা না দিলে হাতেরটা খাবে না। সত্যি খেল না। রসগোল্লার হাঁড়ি শেষ। পাঁচ-সাতজন ভাইপো ভাইঝি—কতক্ষণ লাগে। ধীরু ওই রসগোল্লাটি নিয়ে, গাছের ছায়ায় ঘুরে বেড়ালো। চিমটি কেটে মুখে দিচ্ছে। ফুরিয়ে গেলে তো আর পাবে না। ঘণ্টাখানেক পরেও মহীতোষ দেখেছিল, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে চিমটি কেটে রসগোল্লার স্বাদ নিচ্ছে ধীরু। মহীতোষ কত বড়ো অমানুষ সেদিনই টের পেয়েছিল। সে তার স্ত্রী এবং পুত্রদের স্বার্থে—নিজের পৃথিবী থেকে কখন যে অজ্ঞাতবাসে চলে গেছে সেদিনই টের পেয়েছিল।
মহীতোষ বুঝতে পারছে জীবনে বেঁচে থাকার সব রহস্যই তার মুছে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে বয়সের তাড়না শুরু হয়ে গেছে জীবনে। সবাই যে যার মতো আত্মসর্বস্ব, স্বার্থপর।
কিছুই আর তার ভালো লাগে না।
কোনও ঋতুই আর তার জন্য নতুন খবর বয়ে আনে না।
সে নদীর পাড়ের মানুষ। একা একা হেঁটে যাচ্ছে।
আকাশে মেঘ, কখনও বজ্রপাত অথবা নীল আকাশ এবং নক্ষত্রমালা—কিছুই চমক সৃষ্টি করে না আর। যেন এভাবেই মানুষের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়, শেষ হয়। সব। তবু শৈশব এক রকমের, যৌবন এক রকমের। প্রৌঢ় বয়সে সে বোঝে ভারি একা। নদীর পাড়ের মানুষ হয়ে যায়। ঘরে মন টেকে না, কেবল বের হয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। কেমন ঘোরের মধ্যেই সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
তবে কোথায় সে যাবে জানে না।
সবকিছু অর্থহীন, জীবন এবং বেঁচে থাকা। মৃত্যুর অধিক বেঁচে থাকা আহাম্মকের প্রলাপ।
এই সব তাড়নায় যখন সে পাগল, তখনই চকিতে মনে হয় কে তাকে খণ্ড খণ্ডভাবে রেখে এসেছে নদীর চরায়, কাশফুলের মাঠে, গয়না নৌকার পাটাতনে। কিংবা দূরে মামার বাড়ি যাবার পথে কোনো বুড়ো নিমের ছায়ায়।
তার চোখ জলে ভেসে যায়।
আর তখনই মনে হল দূরে হল্লা।
সে শানের উপর উঠে বসল। এদিকটায় তবে কোনো গ্রাম আছে। সে হেঁটে যেতে থাকল। ঘাস বনজঙ্গল মাড়িয়ে সে যাচ্ছে। সে যে মহীতোষ, সে যে কৃতী মানুষ, সে যে কলকাতায় তার ভোগের সর্বস্ব ফেলে চলে এসেছে দেখলে মনেই হবে না। সামনে পুকুর, পরে রেল লাইন, দূরে কোনো স্কুলবাড়ি। আরও দূরে স্টেশনে সিগনাল। সে হেঁটে গিয়ে দেখল পুকুর পাড়ে তারই মতো একটা লোক শুয়ে আছে। খবর পেয়ে মানুষজন ছুটে আসছে। স্টেশনের কাছাকাছি এলাকা, দূরে ধুধু মাঠ ছাড়া সামনে আর কিছু চোখে পড়ে না। সে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গাঁয়ের কিছু মানুষ লোকটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যেতে চাইছে। কেন বুঝছে না। আর তখনই দেখল, হাতে একটা বিশাল কাঁকড়া থাবা বসিয়ে দিয়েছে। আঙুলের দু-পাশে সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছে কাঁকড়ার বিশাল ঠ্যাং। গোরু চরাতে এসে পুকুরের তলানিতে শামুক গুগলি খুঁজতে গিয়ে এই মরণ।
আঙুল থেকে চুইয়ে রক্ত পড়ছে।
এই মাধা, কী বলছে ব্যাটা। কাঁকড়াটা মার।
মাধা বলছে, না লাগবে।
মাধা বলছে, ওয় থাক, আমমো থাকি।
কাঁকড়ার কামড় হজম করছে মাধা। ভিড়ের মধ্যে মহীতোষকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। স্টেশনে নানা কিসিমের বেওয়ারিশ লোক ঘুরে বেড়ায়। মহীতোষ তাদের একজন হয়ে গেছে।
ইস কী কষ্ট।
হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কাউকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। কাঁকড়ার কামড়!
মাধা কেবল বলছে, ওয় থাক, আমমো থাকি। মেঘ না ডাকলে কামড় ছাড়বে না। মহীতোষ ভাবল, ওয় থাক, আমিও থাকি, ভারী সার কথা বলছে তো লোকটা!
কাঁকড়াটা মেরে ফেললেই হয়!
বা বাবু। বড়ো কামড়। মরে গেলে শেষ কামড় বসাবে। হাড় ফুটো করে দেবে। মহীতোষ এ-দৃশ্য দেখেনি। জানে না, তাহলে কাঁকড়ার কামড় মেঘ গুড়গুড় না করলে খোলে না। সে কেমন আহাম্মকের মতো দেখল শুধু।
কে একজন বলল। শালো ব্যাটা কাঁকড়ার গহ্বরে হাত! বোঝ। ধরতে জানিস না!
মাধার এক কথা, না ধরবে না। কাছে আসবে না। আর যেই না পাঁজাকোলে করে তাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা—তখনই দৌড়। মাঠের উপর দিয়ে দৌড়োচ্ছে। আগুনের হলকা রোদে। খরায় জ্বলছে সব। মাঠ ঊষর হয়ে আছে। ফাটল বড়ো বড়ো মাটির পিঠে। কুমিরের চামড়ার মতো উঁচুনীচু জমির উপর দিয়ে ছুটছে। মেঘ না ডাকলে আঙুল থেকে কাঁকড়া খুলে পড়বে না। মরে গেলে কাঁকড়ার ঠ্যাং এর সাঁড়াশি-দাঁত হাড় ফুটো করে বসে যাবে। সেই ত্রাসে মাধা ছুটছে।
মহীতোষ দেখল, গামছা, জ্যালজ্যালে গামছা পরনে একজন মানুষ হাতে কাঁকড়া ঝুলিয়ে চড়া রোদের ভেতর দিয়ে ছুটছে। দিগন্তের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কোনোও গাছতলায় শুয়ে থাকবে আবার। মেঘবৃষ্টির জন্য এই নিরন্তর অপেক্ষা বুঝি সব মানুষের।
মহীতোষ বুঝল লোকটা আসলে সে নিজে।
তারও এখন দরকার কোনো গাছের ছায়ায় চুপচাপ বসে থাকা। কিংবা শুয়ে থাকা। গাছের ছায়ার জন্য সে হেঁটে যেতে থাকল। সঙ্গে একটা বেহালা থাকলে বড়ো ভালো হত। সুমার মাঠে কেন যে তার ইচ্ছে হল বেহালা বাজাতে বাজতে চলে যায়।
তার এই ইচ্ছের কথা ভেবে সে আর মুহূর্ত মাত্র দেরি করল না। লোকটা যেদিকে গেছে সেদিকটায় ধাওয়া করল। পারল না। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আর উঠল না।
মাঠচরার দল ঝড়বৃষ্টি ভেঙে বাড়ি ফেরার পথে দেখল, একজন মানুষ সুমার মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।
বাজ পড়ে মারা যেতে পারে।
গাঁয়ে তারা খবরটা পৌঁছে দিল শুধু।
কাল-ভুজঙ্গ
নিশি ফিসফিস করে ডাকল, সোনামণি, অ সোনামণি।
সোনামণি কোনো উত্তর করল না। মানুষটা বারান্দায় বসে সোনামণিকে ডাকছে। সোনামণি উঠনে কচু সেদ্ধ করছে। দু’মেয়ে সোনামণির। অঙ্গি বঙ্গি দুই ছানাপোনা উনুনের ধারে কচু সেদ্ধ হবার আশায় বসে রয়েছে। উদোম গায়ে বসে। আছে। আর অভাব সোনামণির নিত্যদিনের। সারা অঞ্চল জুড়ে খরা আর খরা। বর্ষা নেই। বৃষ্টি হচ্ছে না। বৃষ্টির আশায় মানুষটা বারান্দায় বসে আকাশ দেখছিল। বর্ষা এলেই ফসল ফলবে। ঝোপে-জঙ্গলে শাকপাতা গজাবে। অন্ন নেই পেটে, মানুষের অন্ন না থাকলে মাথা ঠিক থাকে না। সুতরাং নিশির ডাকে সোনামণি বিরক্ত হচ্ছিল।
‘কিছু বুলছিলম রে সোনামণি’, খর গলায় ফের ডেকে উঠল নিশি।
তবু সোনামণি জবাব দিল না। মানুষটা খাবার লোভে অমন করছে।
আমি কি তুর কেউ না রে সোনামণি? এবার সোনামণি খেপে গেল। তু আমার ভাতার নিশি। রাগলে সোনামণির কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। মরদকে ভাতার, আসলে ভাতার অথবা গালাগাল-মরে না কেন, যম কি নেই, হা ঈশ্বর, তুর মুখে আগুন—এ সব বলে সোনামণি কেমন সুখ পায়। সুখ পায়। সুখ পেলে তখন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে কটুবাক্য বর্ষণ। বারান্দা থেকে অল্প জ্যোৎস্নায় নিশি টের পেল—সোনামণি এবার হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে কটুবাক্য বর্ষণ করবে। ভয়ে নিশির গলা প্রায় কাঠ হয়ে গেল। সে ভয়ে ভয়ে বলল, রাগ করিস না সোনামণি। তুকে একটা কথা বুললে রাগ করে লিবি না তো!
‘মরণ’—সোনামণি মুখের ওপর ঝামটা মারল একটা। মাঠে এখন আগুন জ্বলছে, পেটে আগুন—মানুষটার চোখে আগুন। সোনামণি এই প্রখর খরার দিনে নিশির চোখে আসঙ্গলিপ্সা দেখে ভয় পেয়ে গেল।
মরণ বুলছিস সোনামণি। মরণ বুলতে লাই রে। মরণ বুললে স্বামীর ঘরে আগুন লাগে। ঢোল বাজায় যে মানুষ, যে মানুষ বাড়ি বাড়ি পূজা-পার্বণে ঢোল বাজায়, কাঁসি বাজায় তারে মরণ বুলতে নাই। তারপর বারান্দা থেকে সন্তর্পণে নেমে খোলা মাঠের দিকে মুখ করে বলল, তুই সোনামণি নিশির সঙ্গে মাঠে যাবি। বড়ো মাঠ। মাঠের দক্ষিণ সামুতে সরকারি খামার। খামারে বাবুরা বীজের ধান্য বুনেছে। সোনামণি রে সোনামণি, কী ধান্য, কী ধান্য! বলে নিশি একটা ঢোঁক গিলল। নিশি, যে ঢোল বাজায় পূজা-পার্বণে, যে কাঁসি বাজায় পূজা-পার্বণে, মুচিরাম হিদে যার বাপ ছিল, পাঁচ কাঠার জমির ওপরে যার ঘর ছিল, যার এখন কিছুই নেই—সব বন্ধক নিয়েছে ভালোমানুষের ছা শশী। শশী এখন বাবু, বাবু শশী খামারে এখন দারোয়ানের কাজ করছে।
সোনামণি বলত–নাগর আমার!
সেই নাগরের বিয়েতে, কন্যার অন্নপ্রাশনে ঢোল বাজিয়েছে নিশি। পাপ মুছে পুণ্য তুলে দিয়ে এসেছে, আর ধান্যদূর্বা ঢোলের উপরে-নিশি কত মঙ্গলকামনা করেছে শশীর। সেই শশীবাবু দু-গণ্ডা টাকায় জমি বন্ধক রেখে সোনামণি সহ নিশিকে বিবাগী করে দিল।
নিশির দুই মেয়ে, অঙ্গি বঙ্গি। ওরাও পূজা-পার্বণে নিশি ঢোল বাজাতে গেলে ছোটো গামছা পরে সঙ্গে সঙ্গে যায়। বাপের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি কাঁসি বাজায়। কিন্তু, খরা প্রবল খরা। এখন আর কে কার পাপ মুছে পুণ্য নেয়। তাই অঙ্গি বঙ্গি, দুই মেরে কচু সেদ্ধ পাতে তুলে খুব তারিয়ে খাচ্ছে।
বোধহয় দুই মেয়ের তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া দেখেই নিশি আগুন হয়ে উঠেছিল। পেটে আগুন, পিঠে আগুন, সারা মাঠময় শুধু আগুন ছড়িয়ে আছে— ক্ষুধার আগুন। নিশি ক্রমশ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল—’অ সোনামণি, শুনতে পেছিস।
দুই মেয়ের খাওয়া দেখে সহ্য হচ্ছে না মানুষটার। সোনামণিও আগুন হয়ে আছে ভিতরে ভিতরে। সে দাঁত শক্ত করে বলল, শুনতে পেছিস নাগর।
সব শুনতে পেয়েছে, তবে সে এবার গলে গলে পড়ল। অরে সোনামণি, অ সুমি, তবে দে, দুটা খেয়ে লিলে শান্তি পাই।
‘হা আমার মানুষ রে! বলে সোনামণি কপালে করাঘাত করল। প্রায় বিলাপের মতো সুর ধরে বলতে থাকল, হায় ছানাপোনা পাখ-পাখালির হয়, গাছের পাতা মাছের মাথা হেথা-হোথা যা মিলে লিয়ে আসে, ছানা-পোনার কষ্টে পাখ-পাখালির ঘুম থাকে না চোখে—আর তু এক মনুষ্যের ছানা, মেরে দু’টা খেয়ে লিচ্ছে তর সহ্য হচ্ছে না!
অরে সোনামণি, অরে সুমি, তুই এমন করে রেতের বেলা বিলাপ করিস না। বিলাপ করলে মাঠে-ময়দানে মড়ক লেখেছে ভেবে সকলে ছুটে আসবে। আমি এক মানুষ, ঢুলি মানুষ, আমার দুই মেয়ে অঙ্গি বঙ্গি, ঢুলি মানুষের অমঙ্গল বইতে নাই। নিশির ইচ্ছা হল, ঘরে ঢুকে ক্ষিধের জ্বালায় ঢোলটা কাঁধে নিয়ে মাঠে নেমে যায়। মেয়ে দুটো কচু সেদ্ধ খাচ্ছে। সোনামণি কাঠের হাতা নিয়ে বসে রয়েছে, ওরা পাতেরটুকু শেষ করে ফেললেই বাকিটুকু ঢেলে দেবে। নিশির ঢোল নিয়ে ছুটতে ইচ্ছা হল মাঠে, তারপর ঢোলের উপর বোল তুলে, ছররা ছুটিয়ে, মাঠে ময়দানে আগুন ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হল। ক্ষুধার আতঙ্কে সোনামণির গলা টিপে ধরতে ইচ্ছা হল।
বড়ো দুঃসময়। না আছে পূজা, না আছে পার্বণ। দেশের লোক আকালে আকালে গেল। কী করবে, কাকে দোষ দেবে, সে ভেবে পেল না। তা ছাড়া মনে হল, রেগে গিয়ে লাভ নেই। বরং ঠান্ডা মাথায় পেটে হাত রেখে বসা যাক। উঠনের ওপর চুপচাপ বসে থাকলে সোনামণির দয়া হতে পারে। সে সোনামণিকে সেজন্য আর বিরক্ত করল না। উঠনের উপর সে হাঁটু গেড়ে বসে থাকল। মনে হল শশীর কথা। শশীর জমির কথা। সরকারি খামারে বীজের জন্য ধান ছড়িয়ে রেখেছে শশী। ধানের কথা মনে পড়তেই নিশির সবটুকু জ্বালা মুহূর্তে উবে গেল। সে এবার গিয়ে হাত পেতে দাঁড়াল সোনামণির কাছে। দে, একটু দে। পেটের জ্বালা নিবারণ করি। দে, দোহাই তুর বাপের সোনামণি, দে একটু দে, পেটের জ্বালা নিবারণ করি। দিলে তুর আয়ু বাড়বে সোনামণি। পুণ্য হবে তুর। সতীলক্ষ্মী হয়ে মরবি। তারপর খুব কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, যাবি তু, যদি যাস তবে সোনার ধান্য তুলে লিব। শশী কাদামাটিতে বীজের ধান্য ছড়িয়েছে। যাবি তু! তু আর আমি দু-পাখিতে সারা রাত ঠুকরে ঠুকরে ধান্য তুলে লেব। সোনামণিকে বড় তাজা মনে হচ্ছে এখন। স্বপ্নে দেখছে যেন। নিশি এবার সুযোগ বুঝে বলে ফেলল, দে সোনামণি, দে একটু খাই। খেয়ে পেটের জ্বালা নিবারণ করি। সঙ্গে সঙ্গে সোনামণি কেমন রেগে গেল। শক্ত হয়ে বসে থাকল। সারা দিনমানে এই কচু সেদ্ধ সম্বল। সে নিশিকে আড়াল দেবার জন্য হাঁড়িটা পেছনের দিকে টেনে নিল।
বড়ো দুঃসময়। বড়ো বেহায়া নিশি। সে ঘুরে গিয়ে সামনে বসল। তারপর সেই আগের মতো হাত বিছিয়ে বলল, আমি ঢুলি মানুষ সোনামণি, আমারে তু ছোটো করে লিচ্ছিস। তু আর আমাতে এত ভালোবাসা, তু আমারে ছোটো করলে ধম্মে সইবে না।
তখন অঙ্গি ডাকল, বাপ। বঙ্গি ডাকল, বাপ।
তখন সোনামণি টিনের ভাঙা থালায় অবশিষ্ট কচু সেদ্ধ দু-ভাগ করে নিশির পাশে খেতে বসে গলে। ‘লে খা। ইবারে কী বুলবি বুল।
সোনার ধান্য আছে গ মাঠে। নিশি কচু সেদ্ধ মুখে আলগা করে দেবার সময় কথাটা বলল। এমন করে বলল, যেন স্বপ্নে দেখা গুপ্তধনের খবর দিচ্ছে।
কোথায়?
‘শশীর খামারে। নিশি দুলে দুলে এত বড়ো খবরটা ভালো করে এবার শোনাল সোনামণিকে।
অঙ্গি বলল, আমি যাব বাপ!
বঙ্গি বলল, আমি যাব বাপ।
দেখলি ত!
সোনামণি ঢকঢক করে জল খেল। তারপর এনামেলের তোবড়ানো ঘটিটা পাশে রেখে বলল, গেলে কী অধম্মটা হবে শুনি।
ধরা পড়ে যাব।
চুপি চুপি যাব। কেউ টেরটি পাবে না। ওরা খুঁটে খুঁটে ধান তুলে লিবে।
অঙ্গি বঙ্গি দুই মেয়ে। সুদিনে দুর্দিনে এই দুই মেয়ে। সুদিনে ফসল কাটা হলে মেয়ে দুটো মাঠময় ঘুরে বেড়ায়। কোন মাঠের কোন সামুতে ইঁদুরে গর্ত করে ধান চুরি করে নিয়েছে তার খবর বয়ে আনে ঘরে। তখন নিশি আর ঢোল কাঁধে লয় না। মাথায় ফেটি কাঁধে কোদাল। নিশুতি রাতে দুই মেয়ে সঙ্গ দেয়। সরু হাতে অঙ্গি বঙ্গি দুই মেয়ে গর্তের ভেতর থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ধান তুলে আনে অথবা ওরা পাহারা দেয়। মাঠময় চোখ সজাগ করে রাখে-বাপ কে যেন আসে! সাপ, ওটা কী? বাপ কোদালে যেন কী লেগে আছে—অক্ত লেগে আছে। অক্ত বাপ, কীসের অক্ত হঁদুরের! তখন হেই হেই করে নিশির চিৎকার, না রে না, ইঁদুর-বাদুড় কিছু নয়, মা বসুন্ধরার কন্যা মামনসার বাহন ভুজঙ্গ। কালো রঙের ভূজঙ্গ চিকচিক করছে, আর মাথাটা দোলাচ্ছে। কিন্তু সেবারে কী হল বাপ। কোদাল মেরে মেরে হয়রান নিশি, মাটির তলায় কোন সুদূরে ইঁদুরে ধান টেনে নামিয়েছে টেরটি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও ধানের গুচ্ছ নেই একটা। হায় হায়, পরিশ্রম বৃথাই গেল। রাগে দুঃখে গান ভেসে এল নিশির গলায়, সময়ে ওটা সুখের গান ছিল—হায় মা, কে কার তবে চুরি করে হে মা ঈশ্বরী। কিন্তু নেই, ধান গর্তের ভিতর কোথাও নেই—প্রায় মাঠ চষে ফেলেছে নিশি, নিশুতি রাতে অঙ্গি বঙ্গির ভয় ধরে গিয়েছিল, তখন নিশির নজর হক করে থেমে গেল। গর্তের মুখে আলিসান ভুজঙ্গ। কালো রঙের ভুজঙ্গ। কোদাল মারলে সামান্য লেজটুকু কাটা যাবে। গোটা শরীর গর্তের ভিতরে। হায় তবে সব যাবে। ভিতরে সোনার ধান্য আছে গ মা জননী। তবে ইবারে কী করি। বলে এক হ্যাঁচকা টান লেজ ধরে। হাত বিশেক দূরে আলিসান ভুজঙ্গটা উঁইয়ে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর যায় কোথায়। নিশি দেখল, ভুজঙ্গটা ওকে তেড়ে আসছে। ঠিক মনে হল সোনামণির মতো তেড়ে আসছে। নাকে নথ ছিল সোনামণির, বালির চরে সোনামণি হক করে কাকে কামড়ে দিয়েছিল—বুঝি শশীকে, বুঝি নিশিকে এখন কামড়ায়, নিশি ছুটতে থাকল, ঘুরতে থাকল। নিশি এঁকেবেঁকে চলতে থাকল। আর হাঁকতে থাকল—অঙ্গি বঙ্গি ধান তুলে লে। আমি ভুজঙ্গরে ডাঙায় তুলে আড়াল করে লিচ্ছি। নিশি আলের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে ছুটতে থাকল।
অঙ্গি বঙ্গি নাছোড়বান্দা। ওরা যাবেই। মৃগয়াতে বাপ বাবে, সঙ্গে মা সোনামণি যাবে—ওরা যাবে না কেমন করে হয়।
সুতরাং অঙ্গি গেলে, বঙ্গি গেল। সঙ্গে মা সোনামণি এক কাপড়ে মাঠে নেমে গেল। কিছু আর সম্বল নেই সোনামণির। এক কাপড়ে, এক আঁচলে ওকে সব সংগ্রহ করে আনতে হয়। নিশি কাঁধে গামছা ফেলে, কোমরে নেংটি এঁটে সকলের আগে আগে চলল। আর গান ধরল, সুখের গান। কে কার তরে চুরি করে হে মা ঈশ্বরী।
গহন মাঠ। দূরে লণ্ঠন নিয়ে শশী খামারে উঠে যাচ্ছে। সে মাঠের ভিতর একটা ভাঙা টিন বেঁধে রেখেছে। টিনটা থেকে থেকে বেজে উঠেছিল। একটা দড়ি, লম্বা দড়ি মাথার উপর দিয়ে টিনটা বাজায়। নদী থেকে, বিল থেকে পাখ-পাখালি উড়ে আসার সম্ভাবনা। বীজধান বুনে শশীর চোখে ঘুম নেই। যখন দেশে আকাল, যখন দেশে শস্য মিলছে না—হঁদুরে-বাদুড়ে শস্য খেয়ে নিতে কতক্ষণ। শশী খামারে বসে এখন শুধু টিন বাজাবে। নিযুতি রাতে শব্দটা বড়ো ভূতুড়ে মনে হয়—মনে হয়, কেউ যেন মাঠময় আকালের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। পাখপাখালিরা আকালের ভয়ে আর নদী বিল থেকে উঠতে সাহস পায় না।
ওরা তখন তারকাঁটার বেড়াটা পার হচ্ছিল। ঠিক তখনই টিনটা বেজে উঠল। ঝরঝর করে বেজে উঠল। মাথার ওপর দড়িটা অনেক দূরে টেলিগ্রাফের তারের মতো চলে গেছে। শশী খামারে বসে দড়ি টানছে। নিশি পায়ের ওপর ভর করে দেখাল—’ওই যে হোথা, উঁইয়ে সোনার ধান্য।
অঙ্গি বলল, কোথা রে বাপ?
বঙ্গি বলল, কুনঠিতে?
নিশি বলল, হুই যে, দেখতে পেছিস না!
ওরা পা টিপে টিপে হাঁটছিল। শশীর দড়ি ওদের মাথার ওপর। বীজধানের জমিতে বাঁশের খুঁটি। খুঁটির মাথায় ভাঙা টিনটা ঝুলছে। জ্যোৎস্না ছিল সামান্য। কোথাও একটা পাখি ডেকে ডেকে তেপান্তরে হারিয়ে যাচ্ছে। সোনামণির বড় ভয় করছিল। শশীর ভয়। দড়ি ধরে শশী বসে আছে। ভয়ে সোনামণির বুকটা শুকিয়ে উঠছে। নিশি ফিসফিস করে ডাকল, কোনো কথা লয় সোনামণি। কথা বললে শশী টের পাবে। ধরা পড়লে জেল হাজতবাস। গেরস্থের ঘরে চুরি লয়, সরকারি ধান্য, বীজধান্য, ধান্য থেকে হেথা হোথা সব পুণ্য উঠবে।
অঙ্গি ডাকল—বাপ।
বঙ্গি ডাকল, বাপ।
আর সঙ্গে সঙ্গে ওরা চারজনই আলের ওপর উপুড় হয়ে গেল। টিনটা ঝরঝর করে বাজছে। আকালের ঘণ্টা বাজাচ্ছে শশী। ঘণ্টাটা ক্রমাগত বেজে চলেছে। শশী কি টের পেল-পাখ-পাখালি উড়ে এসে বসেছে। আকালের ঘণ্টাও পরানে ডর ধরাচ্ছে না! যেন শশী শরীরে সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে দড়ি টানছিল। যেন প্রাণপণ ঘণ্টাধবনি করছিল। ভয়ংকর শব্দটা গ্রাম মাঠ পার হয়ে বিলের দিকে নেমে যাচ্ছে। তখন কে যেন কেবল বলছিল, হুই হোথা নিশি রে, সোনার ধান্য পড়ে আছে রে! ওরা হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিল। শুধু একটু যেতে পারলেই হয়। ওরা প্রাণপণ হামাগুড়ি দিতে থাকল, গোসাপের মতো ওরা এগোচ্ছিল। শুকনো জমি, উত্তাপে সব ঘাস জ্বলে পুড়ে গেছে। ওদের হাঁটু থেকে, কনুই থেকে রক্ত ঝরছিল। ওদের হুশ ছিল না, ওরা বীজ ধানের জমি নাগাল পাবার জন্য অধীর এবং জীবনের সুঁই নাগাল পেয়ে নিশি আনন্দে প্রায় কিছুক্ষণ জমিতে হাত রেখে মড়ার মতো পড়ে থাকল।
সোনামণি ডেকে উঠল, মানুষটা কতকাল অন্নের মুখ দেখেনি, কতকাল ওরা অন্নভোজন করেনি, সোনামণি ভয়ে ডেকে উঠল, হেই। মাথার চুল ধরে টানল। হেই, কী হয়েছে তুর! সোনামণির ভয়, নিশি দুবলা নিশি এত দূর আসতে গিয়ে ফুসফুসটা জখম করে ফেলেছে। ফুস করে হাওয়া বের হয়ে গেলে আর কী থাকল।
নিশি। অঃ নিশি। সোনামণি ফের ডেকে উঠল।
নিশি এবার চোখ মেলে তাকাল এবং খপ করে হাতটা ধরে ফেলল সোনামণির। তারপর ভুইয়ের ভিতর, কাদা জমির ভিতর নেমে গেল। ওরা প্রায় চারটা পাখির মতো খুঁটে খুঁটে যেন ধান খেতে থাকল। খুঁটে খুঁটে খুব সন্তর্পণে–আলগোছে হাত বাড়িয়ে তুলে আনল ধান। একটা ধান, দুটো ধান, একসঙ্গে পাঁচটা সাতটা ধান তুলতে পারছে না। পাঁচটা সাতটা ধান তুলতে গেলে এক মুঠো কাদা উঠে আসছে। জ্যোৎস্না প্রায় মরে আসছিল। ওরা ধানের চেয়ে কাদা তুলে ফেলছিল বেশি। শশী খামারে বসে দড়ি টানছে তো টানছেই। এক মুহূর্তের জন্য থামছে না। থামলেই ওরা চারটা পাখি ভুইয়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। হাতে পায়ে কাদা, শরীরে কাদা-সর্ব অঙ্গে কাদা লেগে আছে। চোখ মুখ দেখলে এখন কে নিশি কে সোনামণি, আর কে অঙ্গি বঙ্গি বোঝা দায়।
ঠিক পাখির মতো ওরা এক পা দু-পা করে এগুচ্ছিল। কাদার ভিতর হামাগুড়ি দিচ্ছিল। ধান খুঁটে যে যার গামছায় রাখছে। সোনামণি ধান তুলে আঁচলে রাখছে। ধানের সঙ্গে কাদা আর জমি থেকে জল শুযে আঁচলটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। ধান সামান্য, কাদা জলে গামছা ভরে গেল নিশির। সে কী করবে ভেবে পেল না। ধীরে ধীরে সোনামণির কাছে বুদ্ধির জন্য উঠে গেল। কাছে গিয়ে দেখল সোনামণি গোসাপের মতো কাদা হাটকাচ্ছে। শরীরে কোনো বাস রাখেনি। সোনামণি অঙ্গ ছোলা মুরগির মতো। গোটা শরীরটা ভুইয়ে বিছিয়ে রেখেছে। সে তাড়াতাড়ি ধান তুলে নিচ্ছে। কারণ শশীকে বড়ো ভয় সোনামণির। শশী বড়ো চেনা মানুষ কঠিন মানুষ। মনে হতেই দাঁত শক্ত হয়ে গেল সোনামণির। কাপড় হাঁটুর ওপর তুলে কটুবাক্য বর্ষণ করতে ইচ্ছা হল। বেইমান শশী, নেমকহারাম শশী। লজ্জা শরম মানুষটার দিন দিন উবে যাচ্ছে। পয়সা হাতে আসতেই শশী তবলা ডুগি কিনে বোলানের একট দল করে ফেলল। ওস্তাদ শশী সোনামণিকে তাড়ি খাবার লোভ দেখাল। সোনামণির সোনার ধান্য চুরির লোভে নিশি বাড়ি না থাকলে শশীর ঘুরঘুর করা বেড়ে যেত। শশী—তুমি গোলাম হে শশী। সোনামণির চোখে আগুন জ্বলছিল, জিভ ভয়ে শুকিয়ে আসছিল, আর সেই এক সিংহের খেলা দেখানো চোখ সোনামণির। সামান্য দূরে অঙ্গি বঙ্গি। সেচের জল বীজের ধান, সেই ধান তুলে এদিকেই এগিয়ে আসছে অঙ্গি বঙ্গি। আর সেই মানুষ নিশি, কুঁড়ে মানুষ বসে বসে সোনামণির তামাশা দেখছে। সোনামণি খ্যাঁক করে উঠল।
নিশি আমতা আমতা করে বলল, গামছাটা ভরে গেল সোনামণি। ধান লেবটা কীসে।
হা রে আমার মরদ। সোনামণি ফের দুঃখে দাঁত শক্ত করে ফেলল। এখন বচসার সময় না। নাচন-কোদনের সময় নয়। এখন শুধু ধান তুলে নেবার সময় নিশিকে বসে থাকতে দেখে আগুনের মতো ওর শরীর জ্বলে উঠছিল। সে কী ভাবল, কী দেখল নিশির, তারপর সহসা নিশির নেংটিটা হ্যাঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। ঠিক যেন এক ভুজঙ্গ এখন ভূঁইয়ের মাঝে পড়ে আছে চিত হয়ে।
নিশি বলল, হ্যা ল সোনামণি, হ্যা ল সুমি, আমি নিশি, আমি ঢোল বাজাই পুজা-পার্বণে, আমারে তুই উলঙ্গ করে দিলি!
মরদের কথা শুন! সোনামণি ধান রেখে শাড়িতে মুখ তুলে কথা বলল। ‘আমার সাধু রে। সুমি ফের