সুদক্ষিণা পর্দাগুলো ভালো করে টেনে দিচ্ছে। বিকালে আলতা পরেছে।
কনকেন্দু জানে এমন তার মাসখানেক কী দু-মাস। কনকেন্দু তখন রাজার মতো। নিজেকে যাত্রার সখা সাজতে হয় না। সে নিজে থেকে কিছু না বললেও দেখা যায় এ সময়টায় সুদক্ষিণার মধ্যে প্রবল বাতাস যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। কনকে ইচ্ছে করলে বলতে পারে, শরীর ভালো নেই। যেমন, ভাটার সময়। সুদক্ষিণা প্রায় এমন কথা বলেই এড়িয়ে যায়। ভাটার সময়টাও মাস দু-মাসে। একবার তো মাস চার পাঁচ। তখন সে কিছুতেই সুদক্ষিণার শরীরে হাত দিতে পারে না। তখন অভিমান এবং যতরকমের ভালোবাসাবাসির কথা। কিন্তু সুদক্ষিণার এক কথা, পেটের নীচটায় ব্যথা।
ডাক্তার দেখালে হত না।
না, আর না। যা সব ডাক্তার-হাত দিতে পারলেই বাঁচে। আর ও-মুখো হচ্ছি। এমনিতেই সেরে যাবে। ঠিক যায়ও সেরে। জোয়ার এলে রক্তকোশে কোনো কীট বাসা বাঁধলে তার আর নিস্তার নেই বুঝি। দু-পার ভাঙার মতো, নতুন দ্বীপ সৃষ্টি করার মতো, অথবা সবুজ বনভূমি—যা কিছুই হোক না, সুদক্ষিণা তখন সহজেই নিজে থেকে আরোগ্য লাভে উন্মুখ হয়ে ওঠে। অবেলায় সে খোঁপা বাঁধে। উচ্ছল হয়ে পড়ে অতি সহজে। এসব দেখলেই কনকেন্দু টের পায়, নদীর দু-পাড় আবার ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। তখন সেও কেমন সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে আসতে বড়ো বেশি আকর্ষণ বোধ করে। দু-চার দিন, তারপর একজন পুরুষ মানুষের যা হয়, ক্লান্তিকর। কারণ তার শরীরে যে রক্ত প্রবাহ সেখানে বোধ হয় অত শুক্রকীটের জন্ম হয় না। অথবা রোজ রোজ সরবরাহ করা একটা বড়ো রকমের শারীরিক দায় হয়ে ওঠে।
সুতরাং কনকেন্দুর কেন জানি ইচ্ছে হল, আজ সে সুদক্ষিণার ডাকে সাড়া দেবে না। সুইট সিকসটিন, কিংবা টুয়েনটিও বলবে না। তোমার ইচ্ছে সব আমি পূরণ করে যাব, আমার উষ্ণতার দাম দেবে না। দীর্ঘকাল এটা চলতে পারে না। সে এ ভাববার সময়ই দেখল, সুদক্ষিণা নিজেই দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।
এই বাড়িতে সিঁড়িতে ওঠার মুখে দোতালায় কলাপসিবল গেট আছে। মাত্র তারা পাঁচজন মানুষ। মা তাদের ঘরে কখনোই আসে না। তাদের ঘরটায় মাত্র দুজন আসে। পাপু আর ঝুমকি। তার ঘরটায় আছে বড়ো ড্রেসিং টেবিলের আয়না। সুদক্ষিণা চায় না তার এই ঘরে কেউ এসে বসুক। সে যত নিজের আত্মীয় কিংবা মা-মাসি হোক। কনকেন্দু বুঝে উঠতে পারে না সুদক্ষিণার এত জেদ কেন। পাপু ঝুমকি বাদে কেউ তার ঘরে ঢুকলেই রাগ করে। এই ঘরটায় কী আছে? একটা লকার, বড়ো একটা ড্রেসিং টেবিল এবং তার চেয়েও বড়ো বেলজিয়াম কাচের আয়না। ঘরের যে, কোনো জায়গায় দাঁড়ালেই আয়নাটা প্রতিবিম্ব ভাসিয়ে রাখে। আসলে কী সুদক্ষিণা জানে এই দর্পণে তার এবং কনকেন্দুর নগ্ন শরীরের নানারকম ভঙ্গিতে ডজন ডজন অ্যালবাম রাখা আছে। আত্মীয়-অনাত্মীয় যে কেউ আসুক বড়ো আয়নাটা দেখলেই টের পায়, অথবা খুলে দেখতে পারে নরনারীর মধ্যে বীজ বপনের ক্ষেত্রটি কত সরস।
অবশ্য কনকে সুদক্ষিণার এই গোপন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেনি। প্রশ্ন করে জানতে চায়নি, এই বেডরুমে কেউ ঢুকলে সে এত রাগ করে কেন। ছোটো শ্যালক এলে একদিন কনকে তাকে নিয়ে এসে এই ঘরে বসিয়েছিল। সেই নিয়ে সুদক্ষিণার কী মুখ ভার। বলেছিল, তোমার বড়ো বুদ্ধিসুদ্ধির অভাব। আর কোনোদিন কাউকে এ-ঘরে এনে বসাবে না।
কী বলছ! সানু তোমার ছোটো ভাই।
সে যাই হোক। বসাবে না বলেছি। শুধু এইটুকু মনে রেখো।
এসব সহস্যের সে কিনারা করতে পারত না। বলত, বসালে কী হয়।
কী হবে আবার। তুমি বুঝবে না, তোমাকে বোঝাতে পারব না।
সেই জন্যই তো বুঝিয়ে বলার দরকার।
বারে, ঘরে ঢুকলে টের পাবে না।
কী টের পাবে।
তোমার মুণ্ড। তারপর খিল খিল করে হেসে দিয়েছিল। বড়ো আয়নাটায় দুজনের প্রতিবিম্ব ভাসছে। চোখ ছিল সুদক্ষিণার সে-দিকে। দেখ তোমার হাত!
হাতে কী আছে!
কী লোম হাতে।
তাতে কী হয়েছে।
আয়নায় বড়ো বেশি প্রকট।
প্রকট কথাটাই সুদক্ষিণা বলেছিল। কেমন সাধু বাংলায় কথাটা বলে যেন বোঝাতে চেয়েছিল, আয়নাটা বড়ো নির্লজ্জ। কোনো কিছু গোপন করতে জানে না।
অ এই! কনকে বুঝতে পেরে বলল, সত্যি এটা মনে হবার কথা। শচীন বিশ্বাসের বাড়িতে এক রবিবার তারা দুজনই আমন্ত্রিত হয়েছিল। আলাদা বসার ঘর তাদের নেই। শচীন তাকে এবং সুদক্ষিণাকে টেনে নিয়ে একেবারে নিজেদের বেডরুমে বসিয়েছিল। সুদক্ষিণা দেখেছিল তেমনি ওদের ঘরে একটা বড়ো আয়না। মুচকি হাসছিল। শচীনের বৌ বলে উঠেছিল, না ভাই তুমি কেন মুচকি হাসলে বলতে হবে। এমন করে ধরেছিল যে সুদক্ষিণার চোখ মুখ কেমন সব গোপন করতে গিয়ে লাল হয়ে গেছিল।
বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, কী হয়েছিল বলতো? শচীনের বৌ তোমাকে এমন করে জানতে চাইল কেন?
বোঝ না!
কী বুঝব!
দেখলে না শচীন ঠাকুরপো উঠে চলে গেল। ঘরে লোকে এত বড়ো একটা আয়না কেন রাখে সবাই বোঝে। মা-বাবারা তো বোঝে সব। সঙ্গে আর কিছু না দিন আসবাব পত্রের মধ্যে এই একখানা বড়ো আয়না দরকার।
বা, সাজগোজ করতে হলে মেয়েদের তো বড়ো আয়নার দরকার হতেই পারে।
বেডরুমে তাই বলে থাকবে কেন?
কোথায় থাকবে! সাজগোজ তো সবাই বেডরুমেই করে থাকে। কার কটা আলাদা ঘর আছে। এটা অজুহাত। আসল উদ্দেশ্য অন্য।