এ গল্প বানানোর ভিতর কারও কোনও কেরানি নেই।
.
এইরকম দুনিয়ার যত রকমের হাস্যরসের উপাদান থাকতে পারে, তারই একটি সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন জর্মনির এক উত্তম সাহিত্যিক। পূর্বেই বলেছি, সাধারণত এরকম সংকলন করে থাকেন আপনার-আমার মতো সাধারণ জন, তাই সঙ্কলনগুলো অসাধারণ হয় না। এটা অবশ্য একটা paradox. পূর্বে যখন বলেছি, পৃথিবীর বেশিরভাগ চুটকিলাই নির্মাণ করে সাধারণ জন, তখন তার সংকলন করবে সাধারণ জন– এ তো বাঙলা কথা। কিন্তু এইখানেই প্যারাডস্। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মধু তার নিজ মূল্য নাহি জানে। এক ইরানি কবিও বলেছেন, যে-শুক্তি মুক্তার জন্ম দিয়েছে আপন প্রাণরস দিয়ে, সে শুক্তিকে তো মুক্তার মূল্য বিচারের সময় ডাকা হয় না– ডাকা হয় জহুরিকে। কিংবা বলতে পারি, নেপোলিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনী যে তার জননীই লিখবেন, এমন কোনও কথা নয়।
বর্তমান পুস্তকের নাম, আ বে সে ডেস লাখেনসা, হাসির অ-আ ক-খ (এক্স ওয়াই জেড– যদি কখনও বেরোয়, তবে দেশের পাঠককে জানাব।) লেখকের নাম জিগিসমুন্ট ফন্ রাডেকি। ল্যাভিয়ার রাজধানী রিগা শহরে এঁর জন্ম ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। পড়াশুনা করেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে, পরে এঞ্জিনিয়ারিং পাস করে জর্মনিতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টা কাটান তুর্কিস্তানে এঞ্জিনিয়াররূপেই। সাহিত্য-রস কিন্তু বরাবর ছিল। ওদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিনে আসার পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অভিনেতা চিত্রকর এবং সাহিত্যিকরূপে। উত্তম ইংরেজি জানেন। জি.কে. চেস্টারটনের ইনি পরম ভক্ত এবং হিলের বেলকের উক্তৃষ্ট জর্মন অনুবাদ তিনি করেছেন– যদিও জর্মনিতে অনুবাদকরূপে তার সর্বোত্তম খ্যাতি রুশ ঔপন্যাসিক গগলের বই জর্মনে তর্জমা করার ফলে।
এঁর জীবনীকার বলেন, রাডেকির বীণায় প্রচুর কোমল এবং অতিকোমল। তার প্রতিটি ধ্বনিতে তত্ত্ব-দার্শনিকের ক্ষীণ মধুর স্মিতহাস্য।
জর্মন, ফরাসি, রুশ, ইংরেজি তথা ইয়োরোপীয় ক্লাসিস নখাগ্রদর্পণে এবং বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন বলে বহু বছর ধরে সঞ্চিত এঁর সঙ্কলন হাসির অ-আ, ক-খ সত্যিই যেন হাস্যরসের কনসার্ট। ব্যালাকত্তাল থেকে আরম্ভ করে ডুগডুগি পিয়ানো কোনও যন্ত্রই বাদ যায়নি।
পাঠক হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। ভাবখানা, দু-একটা গল্পই শোনাও না। তার থেকেই তো এঁর পরিচয় পাওয়া যাবে। সেখানেই তো মুশকিল। আমার বিশ্বাস গোটা সংকলনটি আপনি যদি পড়েন, তবে আপনি খুশি হবেন, যে কোনও লোক খুশি হবে। কিন্তু আমি যেগুলো বাছাই করে দেব, সেগুলো আপনার পছন্দ না-ও হতে পারে। আপনার সংকলন আমার পছন্দ না-ও হতে পারে। সংকলনের সংকলন বিপদসঙ্কুল। তবু চেষ্টা দিতে ক্ষতি নেই এবং গুণীরা যখন অরুন্ধতী ন্যায়ের অর্থাৎ চেনা জিনিস থেকে অচেনা জিনিসে যাবে বলে উপদেশ দিয়েছেন তখন আপনার-আমার পরিচিত শার্লক হোমস দিয়েই বিসমিল্লা করি :
মরুভূমিতে শার্লক হোমস্ (অবশ্য আমার জানামতে হোমস্ কখনও কোনও মরুভূমিতে যাননি বর্তমান লেখক)। ১৯১৭ সালের হেমন্তকাল। কয়েক মাস ধরে এক ইংরেজ রেজিমেন্ট প্যালেস্টাইনের দুরন্ত গরমে মরুভূমিতে থানা গেড়েছে। মদ্যাদি তো প্রায় নেই-ই, জলও কম, আর খাবার সময় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেই এক কর্নড় বিফ! শেষটায় এমন হল যে, শব্দটা শুনলেই জোয়ানদের বমি আসে।
এলেন এক সন্ধ্যায় এক নতুন অফিসার। রান্নাঘরে ঢুকে তদারক তদন্ত করছেন, যাকে বলে ইন্সপেকশন-কলেন, চাখলেন এবং সর্বশেষে অতিশয় বিজ্ঞের মতো অভিমত প্রকাশ করে বললেন, হুম… আজ ডিনারে তা হলে কর্নড় বিফ!
জোয়ানদের সবাই চুপ–কেউ একটি রা-ও কাড়ল না। উঁচ পড়লেও শোনা যায়। শেষটায় এক কোণ থেকে কোন এক ককনির ব্যঙ্গের গলা শোনা গেল, আ মরি! ওয়াটসন!
একটু সূক্ষ্ম রসিকতা। এ যেন এ কথা বলার জন্যে তো ভূতের দরকার হয় না হুজুর। আস্ত না হলেও ওয়াটসন যে একটি হাফ-গবেট ছিলেন, সেটা হোমসৃপিয়াসীদের জানা। এটি প্রধানত তাঁদের জন্যই। আসছে বারে নিবেদন করব হরেকরকম্বা। পূর্বোক্ত আইনস্টাইন-গৃহিণীর গল্পটি রাডেকির সংকলন থেকেই নেওয়া।
.
০২.
জিগিসমুন্ট ফন রাডেকি তার হাস্যরস সংকলনের পুস্তিকায় একটি ক্ষুদ্র অবতরণিকা দিয়েছেন। সে অবতরণিকায় আর পাঁচজন মোকা-বেমোকা-উদাসীন জর্মনের মতো তিনি পাণ্ডিত্য ফলাতে যাননি। জর্মনদের যে পাণ্ডিত্য ফলাবার ব্যামোটা আছে সে বিষয়ে স্বয়ং জর্মনরাই সচেতন। ভিন্ন ভিন্ন জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা যেরকম হক্ক না-হক্ক গল্প বানাই– মারোয়াড়িদের পয়সার লোভ, পূর্ববঙ্গবাসীদের খামোখা চটে যাওয়া নিয়ে ইয়োরোপীয়রাও সেরকম করে থাকে। গ্যোরিঙ যখন নরনবের্গ মোকদ্দমার জন্য সেখানকার হাজতে, তখন তিনি মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডা. কেলিকে নিম্নের চুটকিলাটি বলেন :
একজন ইংরেজ– একটা আস্ত ইডিয়ট। দুজন ইংরেজ একত্র হলে সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্লাবের পত্তন। তিনজন হলে নতুন এক সাম্রাজ্য জয়।
একজন ইতালিয়ান– উত্তম গাইয়ে। দুজন হলে ডুয়েট। তিনজন হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন। (এটা যে কী রকম খাঁটি কথা সেটা গত বিশ্বযুদ্ধে বার বার সপ্রমাণ হয়েছে।)
একজন জর্মন, পণ্ডিত। দুজন জর্মন একটা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে বসবে। তিনজন হলে যুদ্ধ ঘোষণা।