- বইয়ের নামঃ টুনি মেম
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আন্তন চেখফের ‘বিয়ের প্রস্তাব’
অনুবাদকের টিপ্পনী
আন্তন চেখফের রচনায় রাশার যে যুগের বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আমাদের জমিদারি যুগের প্রচুর মিল দেখতে পাই। সেই কারণেই বোধহয় আমাদের শরৎচন্দ্র প্রচুর রাশান উপন্যাস, ছোটগল্প অতিশয় মনোযোগ সহকারে পড়েছিলেন। শরৎচন্দ্র অসাধারণ শিল্পী, তাই তার পরিণত বয়সের লেখাতে অন্যের প্রভাব খুঁজতে যাওয়া নিষ্ফল। তবে যদি কোনও সাহিত্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে থাকে তবে সেটা রুশ সাহিত্য। তাঁর দত্তার সঙ্গে এ-নাটিকার কোনও মিল নেই, কিন্তু দুটিতেই আছে একই জমিদারির আবহাওয়া।
চেখফ যে যুগের বর্ণনা দিয়েছেন সে সময় একই লোককে ভিন্ন ভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ডাকত। যেমন এই নাটিকার নায়িকার নাম নাতালিয়া স্তেপানভনা চুবুকফ। অতি অল্প পরিচয়ে লোক তাকে ডাকবে মিস চুবুকফ বলে। যাদের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, তারা ডাকবে নাতালিয়া স্তেপানভনা (স্তেপানভনা = স্তেপানের মেয়ে)। যাদের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় তারা ডাকবে শুধু নাতালিয়া, এবং যারা নিতান্ত আপনজন তারা ডাকবে নাতাশা। এখনও বোধহয় এই রীতিই প্রচলিত আছে, তবে যে স্থলে মিস চুবুকফ বলা হত আজ বোধহয় সেখানে কমরেড চুবুকফ যা চুবুকভা বলা হয়।
পাত্র-পাত্রীগণ :
স্তেপান স্তেপানভি চুবুকফ জমিদার।
নাতালিয়া (ডাকনাম নাতাশা) স্তেপানভনা চুবুকফ ওই জমিদারের কন্যা; বয়স ২৫।
ইভান ভাসিলিয়েভ লমফ– চুবুকফের প্রতিবেশী জমিদার, স্বাস্থ্যবান হৃষ্ট-পুষ্ট লোক, কিন্তু সমস্তক্ষণ ভাবেন তিনি বড্ডই অসুস্থ (হাইপোক্রাডিআক)।
ঘটনা চুবুকফের জমিদারিতে।
চুবুকফের ড্রইংরুম। চুবুকফ এবং লম; ইভনিং ড্রেস এবং সাদা দস্তানা পরে লমফের প্রবেশ
চুবুকফ : লিমফের দিকে এগিয়ে গিয়ে] এস, এস, বন্ধুবর। এ যে একেবারে অপ্রত্যাশিত, ইভান ভাসিলিয়েভি। কিন্তু বড় আনন্দ হল, বড়ই আনন্দ হল হ্যান্ডশেক। সত্যি একেবারে তাক লাগিয়ে দিলে, ভায়া। কী রকম আছ?
লমফ : ধন্যবাদ। আর আপনি কী রকম আছেন?
চুবুকফ : মোটামুটি আমাদের ভালোই যাচ্ছে, বাছা– তোমাদের প্রার্থনা আর-যা-সব-কী-সব তো রয়েছে। বস, বস। জানো, এরকম করে পুরনো দিনের প্রতিবেশীকে তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়? বড় খারাপ, বড়ই খারাপ। কিন্তু বল দিকিনি, এতসব ধড়াচুড়ো পরে কেন। পুরোপাক্কা ফুল ডিনার ড্রেস, হাতে দস্তানা আর-যা-সব-কী-সব? কারও সঙ্গে পোশাকি দেখা করতে যাচ্ছ নাকি, না অন্য কিছু ভায়া?
লমফ : আজ্ঞে না, শুধু আপনাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।
চুবু : তবে ফুল ডিনার ড্রেস কেন, ভায়া। মনে হচ্ছে তুমি যেন নববর্ষে পোশাকি মোলাকাত করতে এসেছ!
লমফ। : ব্যাপারটা হচ্ছে (চুবুকফের হাত ধরে)… আমি কি না, আমি এসেছি আপনার কাছ থেকে একটা অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে, স্যার শুধু আশা করছি আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছ থেকে এর আগেও আমি সাহস করে কয়েকবার সাহায্য চেয়েছি এবং আপনিও, সবসময়েই, বলতে কী… কিন্তু মাফ করুন, আমার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে… আমি একটুখানি জল খাই। [জলপান]
চুবু : নেপথ্যে টাকা ধার চাইতে এসেছে নিশ্চয়ই। দেব না। [লমফকে] কী হয়েছে, বল না ভায়া।
লমফ : দেখুন স্যার, … কিন্তু মাফ করুন, স্যার…. আমার সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে .. দেখতেই পাচ্ছেন… মানে কী না, আপনি একমাত্র লোক যিনি আমায় সাহায্য করতে পারেন, যদিও সত্যি বলতে কী, আমি এ যাবৎ আপনার জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যার জন্য আপনার কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারি, সত্যি, আমার সে হক্ক আদপেই নেই…
চুবু : কী বিপদ! অত সুতো ছাড়ছ কেন ভায়া। বলেই ফেল না, কী হয়েছে বল।
লমফ : বলছি, বলছি, এখখুনি বলছি… ব্যাপারটা হচ্ছে এই, আমি আপনার মেয়ে। নাতালিয়া স্তেপানভনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
চুবু : (সোল্লাসে) ইভান ভাসিয়েলিভিচ! প্রাণের বন্ধু আমার! ফের বল তো, কী বললে। আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাইনি।
লমফ : অতিশয় সবিনয় নিবেদন জানাচ্ছি ..
চুবু : [বাধা দিয়ে সোনার চাঁদ ছেলে! আমি যে কী খুশি হয়েছি আর-যা-সব-কী সব। নিশ্চয় নিশ্চয় আর-যা-সব-কী-সব। লিমকে আলিঙ্গন ও চুম্বন] ঠিক এই জিনিসটিই আমি বহুকাল ধরে চাইছিলুম [একফোঁটা চোখের জল তোমাকে আমি চিরকালই আপন ছেলের মতো স্নেহ করেছি। ভগবান তোমাদের হৃদয়ে একে অন্যের জন্য প্রেম দিন, তোমাদের মনের মিল হোক, আর-যা-সব-কী সব। সত্যি বলতে কী, আমি সব সময়েই চেয়েছিলুম… কিন্তু আমি এখানে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছি কী? আমাকে কেউ যেন আনন্দের ডাঙশ মেরেছে আমার মাথায় কিছু আসছে না। আহা, আমার সমস্ত হৃদয় ঢেলে– আমি গিয়ে নাতাশাকে ডাকছি, আর-যা-সব-কী-সব—
লমফ : স্যার, উনি কী বলবেন আপনার মনে হয়? তিনি সম্মতি দেবেন, আশা করতে পারি?
চুবু : কী বললে? নাতাশা যদি রাজি না-ও হতে পারে! অবাক করলে! আর তোমার চেহারাটাও চমৎকার নয়? ধরো বাজি, ও তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর-যা-সব-কী-সব। আমি এখুনি তাকে বলছি গে।
[নিষ্ক্রমণ]
লমফ : [একা] আমার শীত-শীত করছে… আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, যেন পরীক্ষার হলে যাচ্ছি। আসল কথা হচ্ছে, মন স্থির করা। বেশিদিন ধরে শুধু যদি ভাবতেই থাকো, এর সঙ্গে ওর সঙ্গে শুধু আলোচনা করো, গড়িমসি গড়িমসি করতে থাকো, আর কোনও এক আদর্শ রমণীর জন্য, কিংবা খাঁটি সত্য প্রেমের জন্য পথ চেয়ে থাকে, তবে তোমার কখনও বিয়েই হবে না। উঁহুহুহু… কী শীত করছে আমার! নাতালিয়া স্তেপানভৃনা সংসার চালায় চমৎকার, লেখাপড়ি করেছে আর দেখতেও খারাপ নয়… এর বেশি আমার কীই-বা চাই? কিন্তু আমি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। মাথাটা তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। [জলপান] কিন্তু আমার আইবুড়ো হয়ে থাকা চলবে না। পয়লা কথা, আমার বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় : আমাকে মেপেজুকে ছকে কাটা জীবন চালাতে হবে… আমার বুকের ব্যামো রয়েছে, ভিতরটা সর্বক্ষণ ধড়ফড়… আমি কত সহজেই রেগে কাঁই হয়ে যাই আর কত সহজেই উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যাই… এই তো, এই এখৃখুনি আমার ঠোঁট কাঁপছে আর ডান চোখের পাতাটা নাচছে… কিন্তু সবচেয়ে বিপদ হল আমার ঘুম নিয়ে। বিছানায় যেই শুয়েছি আর চোখদুটো জুড়ে আসছে অমনি কী যেন কী একটা আমার বাঁ পাশটায় ছোরা মারে। এক্কেবারে ছোরা মারার মতো। আর সেটা সরাসরি আমার কাঁধের ভিতর দিয়ে গিয়ে মাথা অবধি পৌঁছে যায়। আমি খ্যাপার মতো লাফ দিয়ে উঠি, খানিকটা পায়চারি করি, ফের শুয়ে পড়ি… কিন্তু যেই না আবার ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল আর অমনি আবার পাশের দিকটায় সেই ছোরার ঘা– আর ওই একই ব্যাপার নিদেন কুড়িটি বার…