- বইয়ের নামঃ টুনি মেম
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আন্তন চেখফের ‘বিয়ের প্রস্তাব’
অনুবাদকের টিপ্পনী
আন্তন চেখফের রচনায় রাশার যে যুগের বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আমাদের জমিদারি যুগের প্রচুর মিল দেখতে পাই। সেই কারণেই বোধহয় আমাদের শরৎচন্দ্র প্রচুর রাশান উপন্যাস, ছোটগল্প অতিশয় মনোযোগ সহকারে পড়েছিলেন। শরৎচন্দ্র অসাধারণ শিল্পী, তাই তার পরিণত বয়সের লেখাতে অন্যের প্রভাব খুঁজতে যাওয়া নিষ্ফল। তবে যদি কোনও সাহিত্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে থাকে তবে সেটা রুশ সাহিত্য। তাঁর দত্তার সঙ্গে এ-নাটিকার কোনও মিল নেই, কিন্তু দুটিতেই আছে একই জমিদারির আবহাওয়া।
চেখফ যে যুগের বর্ণনা দিয়েছেন সে সময় একই লোককে ভিন্ন ভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ডাকত। যেমন এই নাটিকার নায়িকার নাম নাতালিয়া স্তেপানভনা চুবুকফ। অতি অল্প পরিচয়ে লোক তাকে ডাকবে মিস চুবুকফ বলে। যাদের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, তারা ডাকবে নাতালিয়া স্তেপানভনা (স্তেপানভনা = স্তেপানের মেয়ে)। যাদের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় তারা ডাকবে শুধু নাতালিয়া, এবং যারা নিতান্ত আপনজন তারা ডাকবে নাতাশা। এখনও বোধহয় এই রীতিই প্রচলিত আছে, তবে যে স্থলে মিস চুবুকফ বলা হত আজ বোধহয় সেখানে কমরেড চুবুকফ যা চুবুকভা বলা হয়।
পাত্র-পাত্রীগণ :
স্তেপান স্তেপানভি চুবুকফ জমিদার।
নাতালিয়া (ডাকনাম নাতাশা) স্তেপানভনা চুবুকফ ওই জমিদারের কন্যা; বয়স ২৫।
ইভান ভাসিলিয়েভ লমফ– চুবুকফের প্রতিবেশী জমিদার, স্বাস্থ্যবান হৃষ্ট-পুষ্ট লোক, কিন্তু সমস্তক্ষণ ভাবেন তিনি বড্ডই অসুস্থ (হাইপোক্রাডিআক)।
ঘটনা চুবুকফের জমিদারিতে।
চুবুকফের ড্রইংরুম। চুবুকফ এবং লম; ইভনিং ড্রেস এবং সাদা দস্তানা পরে লমফের প্রবেশ
চুবুকফ : লিমফের দিকে এগিয়ে গিয়ে] এস, এস, বন্ধুবর। এ যে একেবারে অপ্রত্যাশিত, ইভান ভাসিলিয়েভি। কিন্তু বড় আনন্দ হল, বড়ই আনন্দ হল হ্যান্ডশেক। সত্যি একেবারে তাক লাগিয়ে দিলে, ভায়া। কী রকম আছ?
লমফ : ধন্যবাদ। আর আপনি কী রকম আছেন?
চুবুকফ : মোটামুটি আমাদের ভালোই যাচ্ছে, বাছা– তোমাদের প্রার্থনা আর-যা-সব-কী-সব তো রয়েছে। বস, বস। জানো, এরকম করে পুরনো দিনের প্রতিবেশীকে তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়? বড় খারাপ, বড়ই খারাপ। কিন্তু বল দিকিনি, এতসব ধড়াচুড়ো পরে কেন। পুরোপাক্কা ফুল ডিনার ড্রেস, হাতে দস্তানা আর-যা-সব-কী-সব? কারও সঙ্গে পোশাকি দেখা করতে যাচ্ছ নাকি, না অন্য কিছু ভায়া?
লমফ : আজ্ঞে না, শুধু আপনাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।
চুবু : তবে ফুল ডিনার ড্রেস কেন, ভায়া। মনে হচ্ছে তুমি যেন নববর্ষে পোশাকি মোলাকাত করতে এসেছ!
লমফ। : ব্যাপারটা হচ্ছে (চুবুকফের হাত ধরে)… আমি কি না, আমি এসেছি আপনার কাছ থেকে একটা অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে, স্যার শুধু আশা করছি আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছ থেকে এর আগেও আমি সাহস করে কয়েকবার সাহায্য চেয়েছি এবং আপনিও, সবসময়েই, বলতে কী… কিন্তু মাফ করুন, আমার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে… আমি একটুখানি জল খাই। [জলপান]
চুবু : নেপথ্যে টাকা ধার চাইতে এসেছে নিশ্চয়ই। দেব না। [লমফকে] কী হয়েছে, বল না ভায়া।
লমফ : দেখুন স্যার, … কিন্তু মাফ করুন, স্যার…. আমার সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে .. দেখতেই পাচ্ছেন… মানে কী না, আপনি একমাত্র লোক যিনি আমায় সাহায্য করতে পারেন, যদিও সত্যি বলতে কী, আমি এ যাবৎ আপনার জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যার জন্য আপনার কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারি, সত্যি, আমার সে হক্ক আদপেই নেই…
চুবু : কী বিপদ! অত সুতো ছাড়ছ কেন ভায়া। বলেই ফেল না, কী হয়েছে বল।
লমফ : বলছি, বলছি, এখখুনি বলছি… ব্যাপারটা হচ্ছে এই, আমি আপনার মেয়ে। নাতালিয়া স্তেপানভনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
চুবু : (সোল্লাসে) ইভান ভাসিয়েলিভিচ! প্রাণের বন্ধু আমার! ফের বল তো, কী বললে। আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাইনি।
লমফ : অতিশয় সবিনয় নিবেদন জানাচ্ছি ..
চুবু : [বাধা দিয়ে সোনার চাঁদ ছেলে! আমি যে কী খুশি হয়েছি আর-যা-সব-কী সব। নিশ্চয় নিশ্চয় আর-যা-সব-কী-সব। লিমকে আলিঙ্গন ও চুম্বন] ঠিক এই জিনিসটিই আমি বহুকাল ধরে চাইছিলুম [একফোঁটা চোখের জল তোমাকে আমি চিরকালই আপন ছেলের মতো স্নেহ করেছি। ভগবান তোমাদের হৃদয়ে একে অন্যের জন্য প্রেম দিন, তোমাদের মনের মিল হোক, আর-যা-সব-কী সব। সত্যি বলতে কী, আমি সব সময়েই চেয়েছিলুম… কিন্তু আমি এখানে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছি কী? আমাকে কেউ যেন আনন্দের ডাঙশ মেরেছে আমার মাথায় কিছু আসছে না। আহা, আমার সমস্ত হৃদয় ঢেলে– আমি গিয়ে নাতাশাকে ডাকছি, আর-যা-সব-কী-সব—
লমফ : স্যার, উনি কী বলবেন আপনার মনে হয়? তিনি সম্মতি দেবেন, আশা করতে পারি?
চুবু : কী বললে? নাতাশা যদি রাজি না-ও হতে পারে! অবাক করলে! আর তোমার চেহারাটাও চমৎকার নয়? ধরো বাজি, ও তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর-যা-সব-কী-সব। আমি এখুনি তাকে বলছি গে।
[নিষ্ক্রমণ]
লমফ : [একা] আমার শীত-শীত করছে… আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, যেন পরীক্ষার হলে যাচ্ছি। আসল কথা হচ্ছে, মন স্থির করা। বেশিদিন ধরে শুধু যদি ভাবতেই থাকো, এর সঙ্গে ওর সঙ্গে শুধু আলোচনা করো, গড়িমসি গড়িমসি করতে থাকো, আর কোনও এক আদর্শ রমণীর জন্য, কিংবা খাঁটি সত্য প্রেমের জন্য পথ চেয়ে থাকে, তবে তোমার কখনও বিয়েই হবে না। উঁহুহুহু… কী শীত করছে আমার! নাতালিয়া স্তেপানভৃনা সংসার চালায় চমৎকার, লেখাপড়ি করেছে আর দেখতেও খারাপ নয়… এর বেশি আমার কীই-বা চাই? কিন্তু আমি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। মাথাটা তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। [জলপান] কিন্তু আমার আইবুড়ো হয়ে থাকা চলবে না। পয়লা কথা, আমার বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় : আমাকে মেপেজুকে ছকে কাটা জীবন চালাতে হবে… আমার বুকের ব্যামো রয়েছে, ভিতরটা সর্বক্ষণ ধড়ফড়… আমি কত সহজেই রেগে কাঁই হয়ে যাই আর কত সহজেই উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যাই… এই তো, এই এখৃখুনি আমার ঠোঁট কাঁপছে আর ডান চোখের পাতাটা নাচছে… কিন্তু সবচেয়ে বিপদ হল আমার ঘুম নিয়ে। বিছানায় যেই শুয়েছি আর চোখদুটো জুড়ে আসছে অমনি কী যেন কী একটা আমার বাঁ পাশটায় ছোরা মারে। এক্কেবারে ছোরা মারার মতো। আর সেটা সরাসরি আমার কাঁধের ভিতর দিয়ে গিয়ে মাথা অবধি পৌঁছে যায়। আমি খ্যাপার মতো লাফ দিয়ে উঠি, খানিকটা পায়চারি করি, ফের শুয়ে পড়ি… কিন্তু যেই না আবার ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল আর অমনি আবার পাশের দিকটায় সেই ছোরার ঘা– আর ওই একই ব্যাপার নিদেন কুড়িটি বার…
[নাতালিয়ার প্রবেশ]
নাতালিয়া : ও, আপনি! অথচ বাবা বললেন : যাও, খদ্দের মাল নিতে এসেছে। কী রকম আছেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ?
লমফ : আপনি কী রকম, নাতালিয়া স্তেপানভনা?
নাতালিয়া : কিছু মনে করবেন না, আমার এপ্রন পরা রয়েছে, ভদ্রদুরুস্ত জামা-কাপড় পরিনি বলে। আমরা মটরশুটির খোসা ছাড়াচ্ছিলুম রোদ্দুরে শুকোবার জন্যে। এতদিন আমার সঙ্গে যে বড় দেখা করতে আসেননি? বসুন না …. দু জনেই বসলেন দুপুরবেলা এখানে খাবেন?
লমফ : না। অনেক ধন্যবাদ। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
নাতালিয়া : সিগরেট খাবেন না? এই তো দেশলাই… আজকের দিনটা চমৎকার, কিন্তু কাল এমনি জোর বৃষ্টি হল যে মজুররা সমস্তদিন কিছুই করতে পারল না। জানেন, আমরা কাল ক-গাদা খড় তুলতে পেরেছি? বিশাস করবেন না, আমি সব খড় কাটিয়ে নিয়েছিলুম, আর এখন তো আমার প্রায় দুঃখ হচ্ছে ভয় হচ্ছে, সব খড় পচে না যায়। হয়তো অপেক্ষা করলে ভালো হত। কিন্তু এসব কী? আমার মনে হচ্ছে আপনি ধরাচুড়ো পরেছেন। এ তো নতুন দেখলুম। আপনি কি বনাচ কিংবা অন্য কিছু একটায় যাচ্ছেন? হ্যাঁ, কী বলছিলুম, আপনি বদলে গেছেন– ভালো দেখাচ্ছে আগের চেয়ে!… কিন্তু, সত্যি, আপনি ধড়াচুড়ো পরেছেন কেন? লমফ : [উত্তেজিত হয়ে ব্যাপারটা কী জানেন, নাতালিয়া স্তেপান… আসলে কী জানেন, আমি মনস্থির করেছি, আপনাকে… মন দিয়ে শুনুন … আপনি নিশ্চয়ই আশ্চর্য হবেন, হয়তো-বা রাগ করবেন, কিন্তু আমি… [নেপথ্যে) আমি শীতে জমে গেলুম।
নাতালিয়া; কী বলুন তো! [একটু থেমে] বলুন।
লমফ : সংক্ষেপেই বলি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, শ্রীমতী নাতালিয়া স্তেপানভনা, যে, আমি বহুকাল ধরে আপনাদের পরিবারের সান্নিধ্য পেয়ে কৃতকৃতার্থ হয়েছি– ছেলেবয়েস থেকে, সত্যি বলতে কি। আমার যে পিসিমার কাছ থেকে তিনি গত হলে পর তার জমিদারি পেয়েছি, তিনি আর পিসেমশাই দু জনাই আপনার পিতা এবং স্বর্গত মাতাকে গভীর সম্মানের চক্ষে দেখতেন। লমফ আর চুবুকফ পরিবারের বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, এমনকি ঘনিষ্ঠতাও ছিল, বলা চলে। তা ছাড়া, আপনি জানেন, আমার জমিদারি আপনাদের জমিদারির একেবারে গা-ঘেঁষে। আপনার হয়তো মনে পড়বে আমার ভলোভি মাঠ আপনাদের বার্চবনের লাগাও।
নাতালিয়া : মাফ করবেন, কিন্তু এখানে আমাকে বাধ্য হয়ে আপনার কথা কাটতে হল। আপনি যে বলেছেন, আমার ভলোভি মাঠ… কিন্তু ওটা কি সত্যি আপনার?
লমফ : হ্যাঁ, আমার…
নাতালিয়া : তাই নাকি! এর পর আর কী চেয়ে বসবেন! ভলোভি মাঠ আমাদের, আপনার নয়।
লমফ : না। ওটা আমার, নাতালিয়া স্তেপান। নাতালিয়া : এটা আমার কাছে নতুন খবর বলে ঠেকছে। ওটা আপনার হল কী করে? লমফ : তার মানে? আমি তো সেই ভলোভি মাঠের কথা বলছি, যেটা আপনাদের বার্চবন এবং পোড়া-বনের মাঝখানটায়…
নাতালিয়া : হ্যাঁ, সেইটের কথাই তো হচ্ছে.. ওটা আমাদের।
লমফ : না, আপনি ভুল করেছেন নাতালিয়া স্তেপানভনা, ওটা আমার।
নাতালিয়া : পাগলামি ছাড়ুন ইভান ভাসিলিয়েভি। ওটা ক-দিন ধরে আপনাদের হয়েছে?
লমফ : ক-দিন ধরে মানে? যতদিন ধরে আমার মনে পড়ে– ওটা তো চিরকালই আমাদের।
নাতালিয়া : আমাকে মাফ করতে হচ্ছে, আমি একমত হতে পারছিনে।
লমফ : কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলেই দলিলপত্রে জিনিসটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। একথা অবশ্যি সত্য যে ভলোভি মাঠের স্বত্ব নিয়ে একসময় মতবিরোধ হয়েছিল কিন্তু এখন তো কুল্লে দুনিয়া জানে, ওটা আমার। তা নিয়ে তর্কাতর্কি করার এখন আর কোনও প্রয়োজন নেই। আপনাকে জিনিসটা বুঝিয়ে বলছি আমার পিসির ঠাকুরমা আপনার প্রপিতামহের রায়তদের ওই মাঠটা বিনা খাজনায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভোগ করতে দেন; তার বদলে ওরা তার ইটের পাঁজা পোড়াবার ব্যবস্থা করে দেয়। আপনার প্রপিতামহের চাষারা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ওটা লাখেরাজ ভোগ করে করে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে মনে করে ওটার স্বত্ব ওদেরই। কিন্তু দাস-প্রথা উঠে যাওয়ার পর যখন নতুন বন্দোবস্ত হল….
নাতালিয়া : কিন্তু আপনি যা বলছেন সেটা আদপেই ওরকম ধারা নয়। আমার পিতামহ এবং প্রপিতামহ জানতেন যে তাদের জমিদারির হদ্দ পোড়া-বন অবধি কাজেই ভলোভি মাঠ আমাদের সম্পত্তির ভিতর পড়ল বইকি। তা হলে সেটা নিয়ে খামখা তর্ক করছেন কেন? আমি সত্যি আপনার কথার মাথা-মুণ্ডু বুঝতে পারছিনে। হক কথা বলতে কী, আমার বিরক্তি বোধ হচ্ছে।
লমফ : আপনাকে আমি দলিল-দস্তাবেজ দেখাব নাতালিয়া স্তেপানভনা।
নাতালিয়া : না। আমার মনে হচ্ছে, আপনি মস্করা করছেন কিংবা আমাকে চটিয়ে মজা দেখছেন… বাস্তবিক, এটা একটা তাজ্জব ব্যাপার। জমিটা প্রায় তিনশো বছর ধরে আমাদের স্বত্বে, আর আজ হঠাৎ একজন বলে উঠল, ওটা আমাদের নয়। মাফ করবেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমি আমার আপন কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না… অবশ্য আমি ওই জমিটার কোনও মূল্যই দিইনে। কত আর হবে– পনেরো একরটাক, তিনশো রুবলের বেশি ওর দাম হবে না, কিন্তু ওটা নিয়ে এই নাহক অবিচার আমার পিত্তি চটিয়ে দেয়। আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমি অন্যায়-অবিচার বরদাস্ত করতে পারিনে।
লমফ : আপনাকে মিনতি করছি, আমার সব কথা শুনুন। আপনার প্রপিতামহের চাষারা আমার পিসির ঠাকুরমার ইট পোড়াবার ব্যবস্থা করে দেয়– একথা আমি পূর্বেই আপনাকে নিবেদন করেছি। আমার পিসির ঠাকুরমা তার বদলে ওদের অনুগ্রহ দেখাতে গিয়ে…
নাতালিয়া : ঠাকুদ্দা, ঠাকুমা, পিসি… আমার মাথায় ওসব কিছুই ঢুকছে না। মাঠটা আমাদের, ব্যস!
লমফ : ওটা আমার।
নাতালিয়া : ওটা আমাদের। আপনি ঝাড়া দু দিন ধরে তর্ক করুন, যদি সাধ যায় পনেরোটা ধড়াচুড়ো সর্বাঙ্গে চড়ান, কিন্তু তবু ওটা আমাদেরই, আমাদেরই, আমাদেরই।… আপনার জিনিস আমি চাইনে, কিন্তু যে জিনিস আমার সেটা আমি হারাতে চাইনে… আপনার যা ইচ্ছে তাই ভাবতে পারেন।
লমফ : ও মাঠ আমি চাইনে, নাতালিয়া স্তেপানভুনা, কিন্তু এটা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের কথা। আপনি যদি চান তবে এটা আমি আপনাকে উপহার দিতে পারি।
নাতালিয়া : কিন্তু ওটা যদি বিলিয়ে দিতে হয় তো সে হক্ক তো আমার কারণ ওটা তো আমার জিনিস। আপনাকে খোলাখুলি বলছি, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমার কাছে সব-কিছু বড়ই আজগুবি মনে হচ্ছে। এতদিন অবধি আমরা আপনাকে ভালো প্রতিবেশী বলেই মনে করেছি, আমাদের বন্ধুরূপেই আপনাকে গণ্য করেছি। গেল বছরে আমরা আপনাকে আমাদের গম-মাড়াইয়ের কলটা দিলুম; ফলে আমাদের আপন গম তুলতে তুলতে নভেম্বর হয়ে গেল। আর এখন আপনি আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার আরম্ভ করলেন যেন আমরা রাস্তার বেদে। আমাকে উপহার দিচ্ছেন আমার নিজের জমি। কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এটা কি প্রতিবেশীর আচরণ? আমি বলব, এটা রীতিমতো বেয়াদবি যদি শুনতেই চান…।
লফম : আপনি বলতে চান, আমি তছরুপ করি! আমি কখনও অন্যের জিনিস চুরি করিনি, ম্যাডাম, আর কেউ এ কথা বললে আমি কিছুতেই সেটা বরদাস্ত করব না… দ্রুতগতিতে জগের কাছে গমন ও জলপান] ভলোভি মাঠ আমার!
নাতালিয়া : কচু। ওটা আমাদের।
লমফ : ওটা আমার।
নাতালিয়া : ডাহা মিথ্যে। আপনাকে আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি। আজই আমি আমার লোকজনকে ওই মাঠে ঘাস কাটতে পাঠাচ্ছি।
লমফ : কী বললেন?
নাতালিয়া : আমার লোকজন আজই ওখানে কাজ করবে।
লমফ : আমি ওদের লাথি মেরে খেদিয়ে দেব।
নাতালিয়া : আপনার সে মুরোদ নেই।
লমফ : [বুক আঁকড়ে ধরে] ভলোভি মাঠ আমার! এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছেন না? আমার!
নাতালিয়া : দয়া করে চাঁচাবেন না। আপন বাড়িতে বসে চাঁচাতে চাঁচাতে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাক, কিন্তু এখানে বাড়াবাড়ি করবেন না।
লমফ : আমার বুকের ভিতর যদি ওরকম মারাত্মক ব্যথা আর ধড়ফড়ানি না থাকত, ম্যাডাম, আমার রগদুটো যদি দপদপ না করত, আমি তা হলে আপনার সঙ্গে অন্যভাবে কথা বলতুম। [চিৎকার করে) ভলোভি মাঠ আমার!
নাতালিয়া : আমাদের।
লমফ : আমার!
নাতালিয়া : আমাদের!
লমফ : আমার!
[চুবুকফের প্রবেশ]
চুবুকফ : ব্যাপার কী? তোমরা চ্যাঁচাচ্ছ কেন?
নাতালিয়া : বাবা, তুমি এই ভদ্রলোককে একটু বুঝিয়ে বল না, ভলোভি মাঠটা কার ওঁর, না আমাদের!
চুবু: [লমফকে] মাঠটা আমাদের, বাবা।
লমফ : মাফ করবেন, স্যার; ওটা আপনাদের হল কী করে? আপনি অন্তত হক্কের বিচার করবেন। আমার পিসির ঠাকুরমা আপনার ঠাকুরদার চাষাদের জমিটা কিছুদিনের জন্য লাখেরাজ ভোগ করতে দেন। চাষারা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সেটা ভোগ করে। ফলে আস্তে আস্তে ওদের বিশ্বাস হয়ে যায় ওটা ওদেরই। কিন্তু পরে যখন নতুন বন্দোবস্ত হল…। কিছু মনে করো না, বাবা… তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, ওই জমিটার স্বত্ব আর-যা-সব-কী-সব নিয়ে ঝামেলা ছিল বলেই চাষারা তোমার ঠাকুরমাকে কোনও খাজনা দেয়নি, আর-যা-সব-কী-সব… আর এখন গাঁয়ের কুকুরটা পর্যন্ত জানে যে ওটা আমাদের হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। তুমি নিশ্চয়ই জরিপের ম্যাপগুলো দেখনি।
লমফ : কিন্তু আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেখাব, জমিটা আমার।
চুবু : সে, বাছা, তুমি পারবে না।
লমফ : নিশ্চয় পারব।
চুবু : কিন্তু চ্যাঁচাচ্ছ কেন, লক্ষ্মীটি। চাঁচালেই কি কোনও জিনিস প্রমাণ হয়? তোমার যা হক্কের মাল তা আমি চাইনে, কিন্তু যে জিনিস আমার সেটা ছাড়বার বাসনা আমার কণামাত্র নেই। ছাড়ব কেন? অবশ্য আখেরে যদি তাই দাঁড়ায়, অর্থাৎ তুমি যদি ওই জমি নিয়ে ঝগড়া-কাজিয়া আরম্ভ করতে চাও, আর যা-সব-কী-সব, তা হলে আমি বরঞ্চ আমার চাষাদের ওই জমিটা বিলিয়ে দেব, কিন্তু তোমাকে না। এই হল পাকা কথা। লমফ : আমি তো বুঝতে পারলুম না। পরের সম্পত্তি বিলিয়ে দেবার কী হক্ক আপনার?
চুবু : আমার কী হক আছে, না আছে সেটা স্থির করার ভার দয়া করে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আর শোনো, ছোকরা, আমি এরকম ধরনের কথা বলা আর–সব-কী-সব শুনতে অভ্যস্ত নই… আমার বয়স তোমার ডবল, তবু তোমায় অনুরোধ করছি ওরকম মাথা গরম করে, আর-যা-সব-কী-সব ওরকম ধারা আমার সঙ্গে কথা কয়ো না…।
লমফ : না। আপনারা ভেবেছেন আমি একটা আস্ত গাড়ল আর আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন। আমার জমি বলছেন আপনাদের আর তার পর আশা করছেন আমি সুবোধ ছেলেটির মতো শান্ত কণ্ঠে আর পাঁচজনের মতো কথাবার্তা বলব। ভালো প্রতিবেশী এ-রকম কথা বলে না, স্তেপান স্তেপানভিচ মশাই! আপনি প্রতিবেশী নন, আপনি পরের জমির বেদখলকারী।
চুবু : মানে? কী বললে?
নাতালিয়া : বাবা, এখখুনি মজুরদের মাঠে ঘাস কাটতে পাঠাও।
চুবু : (লমফকে] আপনি আমাকে কী বলছিলেন, স্যার?
নাতালিয়া : ভলোভি মাঠ আমাদের আর ওটা আমি ছাড়ব না, ছাড়ব না, ছাড়ব না।
লমফ : সে আমরা দেখে নেব। আমি আদালতে সপ্রমাণ করে ছাড়ব ও মাঠ আমার।
চুবু : আদালতে? আপনি আদালতে যান না, স্যার, আর-যা-সব-কী-সব। যান না, যান। আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনি–এতদিন ধরে শুধু অপেক্ষা করেছিলেন আদালতে যাবার জন্য, একটা মোকা পাওয়ার আর-যা-সব-কী-সব। তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা– ওই তো তোমাদের স্বভাব। তোমাদের পরিবারের সব ক-জনাই মামলাবাজিতে ওস্তাদ! সব কটা।
লমফ : দয়া করে আমার পরিবারের লোককে অপমান করবেন না। লমগুষ্টির সবাই সন্তান। আপনার কাকার মতো তহবিল তছরুপের দায়ে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
চুবু : লমফ পরিবারের সব কটা বদ্ধ পাগল!
নাতালিয়া : সব কটা সাকুল্যে!
চুবু : তোমার ঠাকুরদা ছিলেন পাঁড় মাতাল, আর তোমার ছোট মাসি নাতাসিয়া মিহাইলভনা–-হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদম খাঁটি কথা… এক রাজ-মিস্ত্রির সঙ্গে পালিয়ে যায়, আর-যা-সব-কী-সব।
লমফ : আর আপনার মা ছিলেন কুঁজো। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে আমার বুকের সেই বেদনাটা চিলিক মারছে… সব রক্ত আমার মাথায় উঠে গেছে… হে ভগবান, জল, জল!
চুবু : তোমার বাবা ছিলেন জুয়াড়ি আর পেটুকের হদ্দ!
নাতালিয়া : তোমার পিসি ছিলেন একটি সাক্ষাৎ নারদ গাঁ উজাড় করলে ওঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার!
লমফ : আমার বাঁ পা-টা অবশ হয়ে গিয়েছে… আর আপনার পেটে জিলিপির প্যাঁচ… ওঃ, আমার বুকটা গেল… আর সবাই জানে, নির্বাচনের আগে আপনি.. আমার চোখের সামনে বিজলি খেলে যাচ্ছে.. আমার টুপিটা গেল কোথায়?
নাতালিয়া : এসব ছোটলোকমি! ধাপ্পাবাজি। নোংরামির চূড়ান্ত।
চুবু : আর তুমি কুচুটে, ভণ্ড, ছোটলোক। হ্যাঁ, তা-ই।
লমফ : হ্যাটটা পেয়েছি…ও আমার বুকের ভিতরটা… কোন দিক দিয়ে বেরুব? দরজাটা কোথায়? ওহ্, আমি আর বাঁচব না… আমার পা যে আর নড়ছে না। (দরজা পর্যন্ত গমন)।
চুবু : লেমকে পিছন থেকে চেঁচিয়ে আমার বাড়িতে আর কখনও পা ফেলবে না।
নাতালিয়া : আদালতে যান। আমরাও দেখে নেব!
[টেলতে টলতে লমফের প্রস্থান]
চুবু : জাহান্নামে যাক। উত্তেজনার সঙ্গে পায়চারি)।
নাতালিয়া : এ রকম একটা ছোটলোক দেখেছ কখনও? এর পরও লোকে বলে প্রতিবেশীর ওপর ভরসা রাখতে!
চুবু : আস্ত একটা সঙ! বদমাইশ!
নাতালিয়া : পিচেশ! অন্যের জমি বেদখল করে উল্টো দেয় গালাগাল?
চুবু: সৃষ্টিছাড়া ব্যাটা চক্ষুশূল জানো, ব্যাটার বেয়াদপি কতখানি? এখানে এসেছিল প্রস্তাব পাড়তে, আর-যা-সব-কী-সব! বিশ্বাস হয় তোমার প্রস্তাব করতে?
নাতালিয়া : কিসের প্রস্তাব?
চুবু : হ্যাঁ, ভাবো দিকিনি, এসেছিল তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে।
নাতালিয়া : বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে? আমাকে আগে বললে না কেন?
চুবু : তাই তো ধড়াচুড়ো পরে এসেছিল! বাঁদর! খাটাশ!
নাতালিয়া : আমাকে বিয়ে করতে? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে? ও! [চেয়ারে পতন শুঙরে শুঙরে] ওকে ডেকে নিয়ে এস। ওকে ডেকে নিয়ে এস। ও!–ডেকে নিয়ে এস।
চুবু : কাকে ডেকে নিয়ে আসব?
নাতালিয়া : শিগগির করো, জলদি যাও। আমি যে ভিরমি যাব। ওকে ডেকে নিয়ে এস। [ছন্নের মতো আর্তরব]
চুবু : কী বলছ! কী চাও তুমি? দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে] এ কী অভিসম্পাত! আমি বন্দুকের গুলিতে মরব। আমি নিজের হাতে ফাঁস পরব। সবাই মিলে আমার সর্বনাশ করেছে।
নাতালিয়া : আমি মরে যাচ্ছি। ওকে ডেকে নিয়ে এস।
চুবু : বাপস! যাচ্ছি, যাচ্ছি। ওরকম হাউমাউ করো না। [ধাবমান]
নাতালিয়া : [একা, গুঙরে গুঙরে] আমরা কী করে বসেছি! ওগো, ওকে ডেকে নিয়ে এস, ফিরিয়ে নিয়ে এস।
চুবু : (দ্রুতপদে প্রত্যাবর্তন) এখুনি আসছে ও আর-যা-সব-কী-সব। জাহান্নামে যাক ব্যাটা। আখ! তুমি ওর সঙ্গে নিজে কথা বল; আমার দ্বারা হবে না, পষ্ট বলে দিলুম।
নাতালিয়া : (গুঙরে গুঙরে] ওকে ডেকে নিয়ে এস!
চুবু : [চিৎকার করে] ও আসছে, আসছে, তোমায় বলছি তো। হে ভগবান, আইবুড়ো মেয়ের বাপ হওয়া কী গব্বযন্তনা! আমি আমার গলায় দা বসাব। হ্যাঁ, আলবৎ। আমি আমার গলাটা কেটে ফেলব। আমরা লোকটাকে গালাগাল দিয়েছি, অপমান করেছি, লাথি মেরে বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিয়েছি– আর এসবের মূলে তুমি– তুমিই করেছ এসব।
নাতালিয়া : না, তুমি।
চুবু : ও! এখন সব দোষ আমার! আর কী শুনতে হবে তার পর? [চুবুকফের প্রস্থান
[লমফের প্রবেশ]
লমফ : [অবসন্না] আমার বুক ভীষণ ধড়ফড় করছে… আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছে… বাঁ পাশটায় অসহ্য যন্ত্রণা…
নাতালিয়া : আমাদের মাফ করুন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ, আমরা ঝোঁকের মাথায়,.. আমার এখন মনে পড়ছে, ভলোভি মাঠ সত্যিই আপনার।
লমফ : আমার বুকটায় যেন হাতুড়ি পিটোচ্ছে.. মাঠটা আমার… আমার দুটো চোখ করকর করছে…
নাতালিয়া : হ্যাঁ, মাঠটা আপনার, আপনারই… বসুন (উভয়েরই উপবেশন] আমাদেরই ভুল হয়েছিল।
লমফ : আমার কাছে এটা ন্যায়-অন্যায়ের কথা… জমিটার আমি কোনও মূল্য দিইনে, কিন্তু ন্যায়ের মূল্য আমি দিই…
নাতালিয়া : সত্যিই তো ন্যায়-অন্যায় বোধের কথা… ওসব বাদ দিন… অন্য কথা পাড়ুন।
লমফ : বিশেষত আমার কাছে যখন প্রমাণ রয়েছে। আমার পিসিমার ঠাকুরমা আপনার বাবার ঠাকুরদার চাষাদের…।
নাতালিয়া : হয়েছে, হয়েছে, ওসব কথা তো হয়ে গিয়েছে… (স্বগত) কী করে আরম্ভ করব, বুঝতে পারছিনে… লেমফকে) আপনি কি শিগগিরই শিকারে বেরুচ্ছেন?
লমফ : ভাবছি, নবান্নের পরই বন-মোরগ শিকারে বেরুব… মনে পড়ল; আপনি কি শুনেছেন, আমার কী মন্দ কপাল…আমার ট্রাইয়ার বেচারি– আপনি তো ওকে চেনেন– ওর পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছে।
নাতালিয়া : আহা বেচারা! কী করে হল?
লমফ : আমি ঠিক জানিনে… বোধহয় পায়ের থাবা মচকে গিয়েছে, কিংবা হয়তো অন্য কুকুর তাকে কামড়ে দিয়েছে… দীর্ঘনিশ্বাস] আমার সবচেয়ে ভালো কুকুর, টাকার কথা না হয় বাদই দিলুম। জানেন, মিরনফকে একশো পঁচিশ রুবল দিয়ে ওকে কিনি।
নাতালিয়া : বড্ড বেশি দিয়েছিলেন, ইভান ভাসিলিয়েভিচ।
লমফ : আমার তো মনে হয়, সস্তাতেই পেয়েছি। ওর মতো কুকুর হয় না।
নাতালিয়া : বাবা তার ফ্লাইয়ারের জন্য পঁচাশি রুবল দিয়েছিলেন। আর ফ্লাইয়ার আপনার ট্রাইয়ারের চেয়ে ঢের ঢের ভালো।
লমফ : ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে ভালো? কী যে বলছেন! (হাস্য] ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে ভালো! নাতালিয়া : নিশ্চয়ই ভালো। অবশ্য স্বীকার করছি, ফ্লাইয়ার বাচ্চা এখনও পুরো বয়েস হয়নি কিন্তু যেমন বুদ্ধি তেমনি আর সবদিক দিয়ে। ভলচানিয়েৎস্কিরও এমন একটা কুকুর নেই।
লমফ : মাফ করতে হল, নাতালিয়া স্তেপানভুনা, কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ও থ্যাবড়া-মুখো, আর থ্যাবড়া-মুখো কুকুর কখনও ভালো করে কামড়ে ধরতে পারে না।
নাতালিয়া : থ্যাবড়া-মুখো? এই প্রথম শুনলুম।
লমফ : আপনাকে পাকা কথা বলছি, ওর নিচের চোয়াল উপরের চোয়ালের চেয়ে ছোট।
নাতালিয়া : বটে? আপনি মেপে দেখেছেন নাকি?
লমফ : হ্যাঁ। শিকার তাড়া করতে অবশ্য সে ভালো, কিন্তু কামড়ে ধরার বেলা ওটাকে দিয়ে বিশেষ কিছু হবে না।
নাতালিয়া : প্রথমত, আমাদের ফ্লাইয়ার খানদানি কুকুর। হার্নেস আর চিজল ওর বাপ-মা। আর আপনার ট্রাইয়ারের গায়ে এমনই পাঁচ-মেশালি রঙ যে বলাই যায় না, ওটা কোন জাতের কুকুর। বিশ্রী চেহারা, বুড়ো-হাবড়া হয়ে গিয়েছে…।
লমফ : ও বুড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু ওর বদলে আমি আপনাদের পাঁচটা ফ্লাইয়ারও নেব না… স্বপ্নেও না। ট্রাইয়ার যাকে বলে সত্যিকার কুকুর, আর ফ্লাইয়ার… কিন্তু এ নিয়ে তর্ক করাটাই বেকুবি… আপনাদের ফ্লাইয়ারের মতো কুকুর প্রত্যেক শিকারিরই গণ্ডায় গণ্ডায় আছে। ওর জন্য পঁচিশ রুবল দিলেও বড্ড বেশি দেওয়া হয়।
নাতালিয়া : সব কথার প্রতিবাদ করার শয়তান আজ আপনার ঘাড়ে চেপেছে, ইভান ভাসিলিয়েভিচ। প্রথম আরম্ভ করলেন ভলোভি মাঠের ওপর খামকা হক বসিয়ে, আর এখন বলছেন, ট্রাইয়ার ফ্লাইয়ারের চেয়ে সরেস। কেউ কিছু বিশ্বাস করে না বললে আমার ভারি বিরক্তি বোধ হয়। যা বলেন, যা কন, আপনি খুব ভালো করেই জানেন, ফ্লাইয়ার আপনার কী যে ওর নাম ওই বোকা ট্রাইয়ারের চেয়ে শতগুণে ভালো। তা হলে খামকা উল্টোটা বলছেন কেন?
লমফ : আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, নাতালিয়া স্তেপানা, আপনি ভাবছেন আমি কানা কিংবা আহাম্মুখ। আপনি কি কিছুতেই বুঝবেন না যে আপনাদের ফ্লাইয়ার থ্যাবড়া-মুখো?
নাতালিয়া : মিথ্যে কথা।
লমফ : ওটা থ্যাবড়া-মুখো।
নাতালিয়া : [চিৎকার করে] মিথ্যে কথা!…
লমফ : আপনি চ্যাঁচাচ্ছেন কেন, ম্যাডাম?
নাতালিয়া : আপনি আবোল-তাবোল বকছেন কেন? পিত্তি একেবারে চটে যায়। ট্রাইয়ারকে গুলি করে মারার সময় হয়ে গিয়েছে আর আপনি ওটাকে ফ্লাইয়ারের সঙ্গে তুলনা করছেন!
লমফ : মাফ করবেন, আমি আর এ আলোচনা করতে পারব না। আমার বুক ধড়ফড় করছে।
নাতালিয়া : আমি লক্ষ করেছি, যে শিকার সম্বন্ধে যত কম বোঝে সে-ই শিকার নিয়ে তর্কাতর্কি করে বেশি।
লমফ : মাদাম, দয়া করে চুপ করুন… আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।… [চিৎকার করে) চুপ করুন।
নাতালিয়া : আমি চুপ করব না, যতক্ষণ না আপনি স্বীকার করছেন, ফ্লাইয়ার ট্রাইয়ারের চেয়ে শতগুণে সরেস।
লমফ : শতগুণে নিরেস। ওর এতদিনে মরে যাওয়া উচিত ছিল– ওই আপনাদের ফ্লাইয়ারের কথা বলছি। ওহ, আমার মাথাটা… আমার চোখ দুটো… আমার কাঁধটা…
নাতালিয়া : আর আপনাদের ওই হাবা ট্রাইয়ারটা আমাকে তার মৃত্যু-কামনা করতে হবে না; ওটা তো আধমরা হয়েই আছে।
লমফ : (কেঁদে কেঁদে] চুপ করুন। আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। নাতালিয়া; আমি চুপ করব না।
[ চুবুকফের প্রবেশ]
চুবু : এখন আবার কী?
নাতালিয়া : আচ্ছা বাবা, তুমি খোলাখুলি বল তো, ধর্ম সাক্ষী করে বল তো কোনটা সরেস আমাদের ফ্লাইয়ার, না ওঁর ট্রাইয়ার?
লমফ : স্তেপান স্তেপানভি, স্যার, আপনার পায়ে পড়ছি, মাত্র একটি কথা আমাদের বলুন, ফ্লাইয়ার থ্যাবড়া-মুখো, কিংবা থ্যাবড়া-মুখো নয়? হ্যাঁ কি না?
চুবু : হলেই-বা? যেন তাতে কিছু এসে-যায়! যাই বল, যাই কও, ওর মতো কুকুর তামাম জেলাতেও একটা নেই, আর-যা-সব-কী-সব।
লমফ : কিন্তু আমার ট্রাইয়ার ওর চেয়ে সরেস। নয় কি? ধর্ম সাক্ষী করে বলুন।
চুবু : ওরকম মাথা গরম করো না, বাছা আমার… বুঝিয়ে বলছি আমি… তোমার ট্রাইয়ারের বিস্তর সদগুণ আছে, কেউ অস্বীকার করবে না– জাতে ভালো, পাগুলো জোরদার, গড়ন চমৎকার আর-যা-সব-কী-সব। কিন্তু হক্ কথা যদি শুনতে চাও, বাছা, তবে বলি ওর দুটো মারাত্মক খুঁত আছে– সে বুড়ো হয়ে গিয়েছে আর তার প্যাঁচা-নাক।
লমফ : মাফ করবেন, আমার বুক ধড়ফড় করছে … কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী সেইটে দেখা যাক… আপনার হয়তো স্মরণ থাকতে পারে, আমরা যখন মারুসৃকিনের মাঠে শিকার করতে গিয়েছিলুম, আমার ট্রাইয়ার কাউন্টের স্পটারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে সমানে ছুটেছিল, আর আপনাদের ফ্লাইয়ার নিদেনপক্ষে পাকি আধটি মাইল পিছনে পড়ে ছিল।
চুবু : কাউন্টের শিকারি তাকে চাবুক মেরেছিল বলে সে পিছিয়ে পড়ে।
লমফ : সেইটেই তার প্রাপ্য। আর সবকটা কুকুর খেঁকশিয়ালকে তাড়া লাগাচ্ছিল আর ট্রাইয়ার জ্বালাতন করতে লাগল ভেড়াগুলোকে।
চুবু : বাজে কথা। শোনো বাছা, আমি বড় সহজে চটে যাই, তাই তোমায় অনুরোধ করছি, এ আলোচনাটা থাক। লোকটা ফ্লাইয়ারকে চাবুক মেরেছিল, কারণ মানুষের স্বভাব অন্যের কুকুরের প্রতি হিংসুটে হওয়া… হ্যাঁ, পরের কুকুরকে কেউ দু চক্ষে দেখতে পারে না। আর আপনিও, স্যার, ওর ব্যত্যয় নন। হ্যাঁ, যেই দেখলে আর কারও কুকুর তোমার ট্রাইয়ারের চেয়ে সরেস, ব্যস, অমনি জুড়ে দিলে কিছু একটা… আর-যা-সব-কী-সব… দেখলে, আমার সব মনে থাকে।
লমফ : আমারও।
চুবু : [ভেংচিয়ে] আমারও!
লমফ : বুক ধড়ফড় করছে… আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছে… আমি কিছুই…
নাতালিয়া : [ভেংচিয়ে বুক ধড়ফড় করছে! কী রকম শিকারি মশাই, আপনি? আপনার উচিত শিকারে না গিয়ে আগুনের পাশে শুয়ে শুয়ে আরশুলা মারা। বুক ধড়ফড় করছে, হুঁঃ।
চুবু : হ্যাঁ, হক কথা বলতে কী, শিকার-টিকারে বেরোনো আসলেই তোমার কম নয়। বুকের ধড়ফড়ানি আর-যা-সব-কী-সব দিয়ে ঘোড়ার পিঠে ঝাঁকুনি খাওয়ার চেয়ে তোমার পক্ষে বাড়িতে বসে থাকাই ভালো। অবশ্য তুমি যদি সত্যিই শিকার করতে যেতে তা হলে কোনও কথা ছিল না, কিন্তু তুমি তো যাও নিছক তর্কাতর্কি করার জন্য, আর অন্য পাঁচজনের কুকুরগুলোর সামনে পড়ে তাদের বাধা দেবার জন্য আর-যা-সব-কী-সব… আমি বড্ড সহজেই চটে যাই, কাজেই এ আলোচনা বন্ধ করাই ভালো। তুমি আদপেই শিকারি নও, ব্যস।
লমফ : আর আপনি আপনি বুঝি শিকারি? আপনি তো যান কাউন্টকে নিছক তেল মালিশ করার জন্য, আর পাঁচজনের বিরুদ্ধে ঘোটালা পাকাবার জন্য… ওহ! আমার বুকের ব্যথাটা! আসলে আপনি কুচুটে।
চুবু : কী? আমি–কুচুটে? [চিৎকার করে চুপ করো।
লমফ : কুচুটে।
চুবু : ভেড়ে, বখা ছোকরা!
লমফ : বুড়ো-হাবড়া! ভণ্ড!
চুবু : চুপ করো, না হলে আমি একটা নোংরা বন্দুক দিয়ে তোমাকে তিতির মারার মতো গুলি করে মারব। ফকিকার কোথাকার!
লমফ : দুনিয়াসুদ্ধ জানে– ওহ, ফের আমার হার্টটা! আপনাকে আপনার স্ত্রী ঠ্যাঙাতো! … আমার পা-টা… আমার মাথাটা!…চোখের সামনে বিদ্যুৎ খেলছে… আমি পড়ে যাব… আমি পড়ে যাচ্ছি ..
চুবু : আর যে মাগী তোমার বাড়ি চালায় সে তোমাকে চেপে রেখেছে বুড়ো আঙুলের তলায়।
লমফ। : ও, ও, ও! আমার হার্টটা ফেটে গিয়েছে। আমার কাঁধটা যে আর নেই… আমার কাঁধটা কোথায়?… আমি মরলুম। আিরাম-চেয়ারে পতন) ডাক্তার! (মূৰ্ছা।)
চুবু : ভেড়ে! বকা! ফক্কিকার! আমি জোর পাচ্ছিনে। (জলপান) ভিরমি যাচ্ছি নাকি।
নাতালিয়া : শিকারি, হুঁ! ঘোড়ার উপর কী রকম বসতে হয়, তাই জানেন না আপনি! [পিতাকে] বাবা, কী হল ওর? বাবা! দেখ বাবা, (চিৎকার করে) ইভান ভাসিলিয়েভি! ইনি মরে গেছেন।
চুবু : আমি মূৰ্ছা যাচ্ছি … আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! বাতাস, আমাকে বাতাস দাও!
নাতালিয়া : ইনি মারা গেছেন। লিমফের আস্তিন ধরে টানাটানি] ইভান ভাসিলিয়েভিচ! ইভান ভাসিলিয়েভিচ! আমরা কী করে বসলুম! ইনি মারা গেছেন। (আর্ম চেয়ারে পতন ডাক্তার! ডাক্তার! [ছন্নের মতো কখনও ফোঁপানো, কখনও হাসি]
চুবু : ব্যাপার কী? কী হয়েছে? তুমি কী চাও?
নাতালিয়া : [গোঙরাতে গোঙরাতে মারা গেছেন… উনি মারা গেছেন।
চুবু : কে মারা গেছে? লিমফের দিকে তাকিয়ে সত্যি ও মারা গেছে। হে ভগবান, জল, জল! ডাক্তার! লিমফের ঠোঁটের কাছে একগ্লাস জল ধরে] জল খাও! না, ও জল খাচ্ছে না… তা হলে মারাই গেছে, আর-যা-সব-কী-সব… হায়, হায়, আমার কী পোড়া কপাল! আমি আমার মগজের ভিতর দিয়ে গুলি চালিয়ে দিলুম না কেন? এর অনেক আগেই আমার গলাটা কেটে ফেললুম না কেন? আমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাকে একখানা ছোরা দাও। বন্দুক দাও। (লমফ একটু নড়ল মনে হচ্ছে, সেরে উঠছে… একটু জল খাও তো, বাছা! হ্যাঁ, ঠিক…।
লমফ : আমার চোখের সামনে বিদ্যুৎ খেলছে… কুয়াশা না কি… আমি কোথায়!
চুবু : তুমি যত শিগগির পার বিয়ে করে ফেল আর জাহান্নামে যাও… ও রাজি আছে দু জনের হাত মিলিয়ে দিয়ে] ও রাজি আছে, আর-যা-সব-কী-সব, আমি তোমাদের আশীর্বাদ– আর-যা-সব– করছি। শুধু আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।
লমফ : এ্যা? কী? [দাঁড়িয়ে উঠে] কে?
চুবু : ও রাজি আছে। আবার কী হল? চুমো খাও… আর জাহান্নামে যাও।
নাতালিয়া : [গোঙরাতে গোঙরাতে] উনি বেঁচে আছেন… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি রাজি…
চুবু : এসো, চুমো খাও, একজন আরেকজনকে। লমফ : এ্যা, কাকে? নাতালিয়াকে চুম্বন] আমার কী আনন্দ! মাফ করবেন, ব্যাপারটা কী? ওহ্! হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি… আমার হার্ট… বিদ্যুৎ.. আমি কী সুখী, নাতালিয়া স্তেপানভনা… নাতালিয়ার হস্তচুম্বন আমার পা-টা যে অবশ হয়ে গেল…।
নাতালিয়া : আমি… আমিও বড় সুখী…।
চুবু : ওহ! পিঠের থেকে কী বোঝাটাই না নামল! আহ!
নাতালিয়া : কিন্তু… যাই বল, তোমাকে এখন স্বীকার করতেই হবে, ট্রাইয়ার ফ্লাইয়ারের মতো অত ভালো না।
লমফ : সে ভালো।
নাতালিয়া : সে খারাপ।
চুবু : এই লাও! পারিবারিক সুখ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। শ্যাম্পেন নিয়ে আয়।
লমফ : সে সরেস! নাতালিয়া : ওটা নিরেস, নিরেস, নিরেস!
চুবু : [চিৎকার করে দু জনার গলা চাপবার চেষ্টাতে) শ্যাম্পেন! শ্যাম্পেন। নিয়ে আয়!
যবনিকা
উলটা-রথ
অবতরণিকা
কত না কসরত, কত না তকলিফ বরদাস্ত করে কত চেষ্টা দিলুম, দেশে নাম কেনবার জন্য, আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পিছন পানে তাকিয়ে দেখি সব বরবাদ, সব ভণ্ডুল। পরের কথা বাদ দিন, নিতান্ত আত্মজনও আমার লেখা বই পড়ে না। গিন্নিকে–না, সে কথা থাক, তাঁর সঙ্গে ঘর করতে হয়, ওঁয়াকে চটিয়ে লাভ নেই। অথচ আমার জীবনে মাত্র একটি শখ ছিল, সাহিত্যিক হওয়ার। আপনাদের মনের বেদনা কী বলব– তবে হ্যাঁ, আপনারাই হয়তো বুঝবেন, কারণ সিনেমায় দেখেছি, নায়িকা যখন হা নাথ, হা প্রাণেশ্বর, তুমি কোথায় গেলে? বলে হন্যে-পারা স্ক্রিনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি টাটুঘোড়ার মতো ছুটোছুটি লাগান তখন আপনারা হাপুস-হুঁপুস করে অবর্ষণ করেন (যে কারণে আমি হলের ভিতরেও রেনকোট খুলিনে), তাই আপনারা বুঝবেন।
যখন দেখি প্রখ্যাত সাহিত্যিক উচ্চাসনে বসে আছেন, তাঁর গলায় মালার পর মালা পরানো হচ্ছে, খাপসুরৎ মেয়েরা তার অটোগ্রাফের জন্য হদ্দমুদ্দ হচ্ছে, তার জন্য ঘন ঘন বরফজল শরবত আসছে, সভা শেষে হয়তো আরও অনেক কিছু আসবে তখন আমার কলিজার ভিতর যেন ইঁদুর কুরকুর করে খেতে থাকে, আমার বুকের উপর যেন কেউ পুকুর খুঁড়তে আরম্ভ করে। সজল নয়নে বাড়ি ফিরি। পাছে গিন্নি অট্টহাস্য করে ওঠেন তাই দোরে খিল দিয়ে বইয়ের আলমারির সামনে এসে দাঁড়াই– তাকিয়ে থাকি আপন মনে আমার, বিশেষ করে আমার নিজের পয়সায় মরক্কো লেদারে বাঁধানো সোনার জলে আমার নাম ছাপানো আমার বইয়ের দিকে।
আমার মাত্র একজন বন্ধু– এ সংসারে। কিন্তু আর কিছু বলার পূর্বে আগেভাগেই বলে নিই, ইনিও আমার বই পড়েননি। তিনি এসে আমায় একদিন শুধোলেন, ব্রাদার, আমিয়িলের জুনাল পড়েছ?
সে আবার কী বস্তু? বই-ই হবে। না? তা সে কি আমার বই পড়েছে যে আমি তার বই পড়ব?
আহা চটো কেন? জল্লাদ যখন কারও গলা কাটে তখন তার মানে কি এই যে, সে লোকটা আগে জল্লাদের গলা কেটেছিল? অভিমান ছাড়ো। আমার কথা শোনো। এই আমিয়েল সায়েব প্রফেসর ছিলেন। তার বাড়া আর কিছু না। যশ প্রতিপত্তি তার কিছুই হয়নি। নিঃসঙ্গ জীবনে নির্জনে তিনি লিখলেন তাঁর জুনাল।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, জুনাল-জুনাল করছ কেন? উচ্চারণ হবে জার্নেল। উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি বড্ডই পিটপিটে।
বন্ধু বললেন, কী উৎপাত! ওটার উচ্চারণ ফরাসিতে জুর্নাল। এসেছে ডায়ার্নাল থেকে, সেটা এসেছে লাতিন দিয়েস থেকে–যেটা সংস্কৃতে দিবস। ফরাসিতে তাই দিন দিন প্রতি দিন নিয়ে যখন কোনও কথা ওঠে তখন ওই জুর্নাল শব্দ ব্যবহার হয়। তাই দৈনিক কাগজ জুর্নাল, আবার প্রতিদিনের ঘটনা লিখে রাখলে সেটাও জুর্নাল অর্থাৎ ডাইরি। ফার্সিতে দিনকে বলে রোজ, তাই প্রতিদিনের ঘটনার নাম যেখানে লেখা থাকে সেটা রোজনামচা। আবার
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হয়েছে, হয়েছে।
সেই আমিয়েল লিখলেন তাঁর জুনাল। মৃত্যুর পর সে-বই বেরোতে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বসত শহর জিনিভাতে হয়ে গেলেন লেখক হিসেবে প্রখ্যাত। বছর কয়েকের ভিতর তামাম ইউরোপে। ইস্তেক তোমাদের রবি ঠাকুর সে বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাই বলি কি না, তুমি একখানা জুনাল লেখো।
আমি শুধালুম, তুমি পড়বে?
বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। ছাতাখানা বগলে চেপে বললেন, চললুম, ভাই। শুনলুম পাড়ার লাইব্রেরিতে পাঁচকড়ি দের কয়েকখানা অপ্রকাশিত উপন্যাস এসেছে। পড়তে হবে।
ভালোই করলেন। না হলে হাতাহাতি হয়ে যেত।
কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, তার সেই মোস্ট সাজেশনের পর থেকে এই জুর্নালের চিন্তাটা কিছুতেই আমি আমার মগজ থেকে তাড়াতে পারছিনে। যে-রকম অনেক সময় অতিশয় রদ্দি একটা গানের সুর মানুষকে দিবারাত্তির হন্ট করে। এমনকি ঘুম থেকে উঠে মনে হয় ঘুমুতে ঘুমুতেও ওইসঙ্গে গুনগুন করেছি।
কিন্তু জুনাল লিখতে যাওয়ার মধ্যে একটা মস্ত অসুবিধে রয়েছে আমার। সংস্কৃতে শ্লোক আছে :
শীতেহতীতে বসনমশনং বাসরান্তে নিশান্তে
ক্রীড়ারম্ভং কুবলয়দৃশং যৌবনান্তে বিবাহম।
শীতকাল গেলে শীত-বস্ত্র পরিধান।
আহার গ্রহণ যবে দিন অবসান
রাত্রিকাল শেষ হলে প্রেম আলিঙ্গন!
বিবাহ করিতে সাধ যাইলে যৌবন!
—(কবিভূষণ পূর্ণচন্দ্র)
একশো বছর বয়সে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে অন্তৰ্জলি অবস্থায় সাততলা ইমারত বানাবার জন্য কেউ টেন্ডার ডাকে না।
জুর্নাল লেখা আরম্ভ করতে হয় যৌবনে। তা হলে বহু বছর ধরে সেটা লেখা যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে পর পাঠক তার থেকে লেখকের জীবনক্রম-বিকাশ, তার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব পড়ে পরিতৃপ্ত হয়।
আজ যদি আমি জুনাল লিখতে আরম্ভ করি তবে আর লিখতে পাব কটা দিন? তাই কবি বলেছেন, এ যে যৌবনান্তে বিবাহ!
তা হলে উপায় কী?
তখন হঠাৎ একটি গল্প মনে পড়ে গেল।
এক বেকার গেছে সায়েবাড়িতে। কাচুমাচু হয়ে নিবেদন করল, সায়েব, আপনার এখানে যে কী ভয়ে ভয়ে এসেছি, কী আর বলব! এক পা এগিয়েছি কি তিন পা পেছিয়েছি! সায়েব বলল, ইউ গাগা, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? বেকারটি আদৌ গাগা অর্থাৎ যে বদ্ধ পাগল শুধু গাগা করে গোঙরায় ছিল না। বরঞ্চ বলব হাজির-জবাব– অর্থাৎ সব জবাবই তার ঠোঁটে হাজির। বলল, হক কথা কয়েছেন, হুজুর। আমিও তাই মুখ করলুম আপন বাড়ির দিকে। এক পা এগোই তিন পা পেছোই। করে করে এই হেথা হুজুরের বাঙলোয় এসে পৌঁছে গেলুম।
তাই যখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, জুর্নাল লেখার মতো দীর্ঘদিনের ম্যাদ যমরাজ আমায় দেবেন না তখন ওই কেরানির মতো পিছন ফিরলে কী রকম হয়? অর্থাৎ বিগত দিনের জুর্নাল? সেই-বা কী করে হয়? পোস্ট-ডেটেড চেক হয়, কিন্তু প্রি-ডেটেড দলিল করার নামই তো জাল। আজ আমি তো আর লিখতে পারিনে :
‘জন্মাষ্টমী ১৩১১ আজ আমার জন্ম হল। মা তখন তার বাপের বাড়িতে। হায়, আমাকে দেখবার কেউ ছিল না। কী হতভাগ্য আমি!’
পুলিশে ধরবে না তো!
বিবেচনা করি আপনারা ক্লাসিকস পড়েছেন– ঋগবেদ, মেঘনাদ, হ-য-ব-র-ল ইত্যাদি। শেষোক্তখানাতে এক বুড়ো ত্রিশ না চল্লিশ হতে না হতেই বয়েসটা ঘুরিয়ে দিত। তখন তার বয়স যেন কমতির ফটকাবাজারে যাকে বলে মন্দি বা বেয়ার দিকে। তখন তার বয়স হত ত্রিশ, উনত্রিশ, আটাশ করে করে আট হয়ে গেলে ফের বাড়তি বা তেজীর দিকে চালিয়ে দিয়ে নয়, দশ, এগারো করে বয়েস বাড়াত।
কিন্তু এ কৌশল রপ্ত করার জন্য মুষ্টিযোগটা শিখি কার কাছ থেকে? হ-য-ব-র-ল সৃষ্টিকর্তা ওপারে যাবার সময় তাঁর ব্যাটা বাবাজি সত্যজিৎকে কি এটা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন? তাতেই-বা কী? বাবাজি তো তারও আগে ওঁরই কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন, গেছোদাদা হওয়ার পন্থাটি–আমি যদি তার সন্ধানে যাই মতিহারি তখন তিনি ছিকেষ্টপুর। আমি ফিলাডেলফিয়ায় তো তিনি ভেরমন্টে। উঁহু, হল না।
ইরানের কবি অন্য মুষ্টিযোগ বাতলেছেন– তার বৃদ্ধ বয়সে :
আজ এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই।
জোয়ান হইব; এ জীবন তবে গোড়া হতে দোহরাই ॥
শবি আগর আজ লবে ইয়ার বোসে এ তলবম
জওয়ান শওম জসেরো জিন্দেগি দু বারা কুনম্ ॥
পাড়ার ছোঁড়ারা ঢিল ছুড়বে।
আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ তা হলে কী বলেন?
শিশু হবার ভরসা আবার
জাগুক আমার প্রাণে,
লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে,
ভবিষ্যতের মুখোশখানা
খসাব একটানে,
দেখব তারেই বর্তমানের কালে।
তার পর তিনি কী করবেন?
জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা
তৈরী হবে আমার খেলা—
সর্বনাশ! এই বৃদ্ধ বয়সে যদি সক্কলের সামনে তাই করি তবে ডা. ঘোষ আমাকে রাঁচি পৌঁছিয়ে দেবেন।
মোদ্দা কথায় তা হলে ফিরে যাই। আমাকে খামাখা মেলা বকর বকর করাবেন না। অবশ্য আমার মা বলতেন, আমার দোষ নেই। আমাকে টিকা দেবার সময় ডাক্তার ছুরি আনেনি বলে একটা গ্রামোফোনের নিড়ল দিয়ে টিকা দিয়েছিল।
তা হলে একটা মাস চিন্তা করতে দিন। সামনে হোলি। গায়ে রঙ মাখাব। মনেও।
স্লিস্টলার অর্থ নিম উকিল। উকিলের কাছে যাবার পূর্বে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেটি হয়তো পূর্বেও কোনও-কোথাও উল্লেখ করেছি। তাই সেটি আবার বলছি। কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যা সে পূর্বেও একাধিকবার শুনেছে–নয়া কথা তার ভালো লাগে না। তাই দেখুন– এটাও আমি আরেকবার বলেছি– একই প্লট নিয়ে ক-গণ্ডা ফিলিম নিত্যি নিত্যি বেরুচ্ছে তার হিসাব রাখেন?
ঘটনাটি সংক্ষেপে এই :
নরক আর স্বর্গের মধ্যিখানে মাত্র একটি পাঁচিলের ব্যবধান। নরক চালায় শয়তান, আর স্বর্গ চালান সিন্ট পিটার। পাদ্রিসায়েবের মুখে শোনা, তাঁরই হাতে থাকে স্বর্গদ্বারের সোনার চাবি।
পাঁচিলটি ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে দেখে পিটার একদিন শয়তানকে ডেকে বললেন, দেয়ালটা এজমালি। তাই এটার মেরামতি আমি করব এক বছর, তুমি করবে আর বছর। আসলে তোমারই করা উচিত প্রতি বছর। কারণ তোমার দিকে সুবো-শাম জ্বলছে আগুনের পেল্লাই পেল্লাই চুলোতারই চোটে দেয়াল হচ্ছে জখম। আর আমার দিকে সর্বক্ষণ বয় মন্দমধুর মলয় বাতাস। দেয়াল বিলকুল জখম হয় না।
বিস্তর তর্কাতর্কির পর স্থির হল, ইনি এ বছর আর উনি আর বছর দেয়াল মেরামত করবেন। শেষটায় বিদায় নেবার সময় শয়তান ঘাড় চুলকে বলল, দাদা, কিছু যদি মনে না কর, তবে এ বছরটায় তুমিই মেরামতিটা করাও। একটু অভাবে আছি।
পিটার মাই ডিয়ার লোক। রাজি হয়ে গেলেন।
তার পর এক বছর যায়, দু বছর যায়, পাঁচ বছর যায়, দেয়াল পড়ো-পড়ো–শয়তানের সন্ধান নেই। পিটার রেজেস্ট্রি করে চিঠি লিখলেন। ফেরত এল। উপরে লেখা, মালিক না পাইয়া ফেরত। পিটার তখন একাধিকবার শয়তানের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেন। ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ বামাকন্ঠ বেরুল– কত্তা বাড়ি নেই। পিটার বাড়ির সামনে লটকাইয়া শমন জারি করলেন। কোনও ফায়দা ওতরাল না।
এমন সময় পিটারের বরাতজোরে হঠাৎ শয়তানের সঙ্গে রাস্তায় মোলাকাত। শয়তান অবশ্য তড়িঘড়ি পাশের গলিতে গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এঞ্জেলদের ডানা থাকে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পার্ফেক্ট ল্যান্ডিং করে দাঁড়ালেন তার সামনে। খপ করে হাত ধরে বললেন, বড় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছ দেয়াল মেরামতির কী হবে?
শয়তান গাইগুই টালবাহানা আরম্ভ করল। পিটার চেপে ধরলেন, পাকা কথা দিয়ে যাও।
তখন শয়তান শেষ কথা বলল, কিছু মনে কর না ভাই, কিন্তু আমি আমার উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও পাকা কথা দিতে পারব না।
নিরাশ হয়ে পিটার শয়তানের হাত ছেড়ে দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাড়ি ফেরার মুখ করে বললেন, ওইখানেই তো তোর জোর। সবকটা নিয়ে বসে আছিস। আমার যে একটাও নেই।
আমার উকিল অবশ্য নরকে যাবেন না। তিনি বলেন, নরক নেই, স্বর্গ আছে।
আমি বললুম, সে কী কথা! লোক হয় দুটোতেই বিশ্বাস করে, নয় একটাতেও না।
উকিল বললেন, ওইখানেই তো ভুল। তোমরা দর্শনের কিছুই জান না। বুঝিয়ে বলছি। স্বর্গ জিনিসটের কল্পনা আমি করতে পারি। খাসা জায়গা, না গরম না ঠাণ্ডা। তোমাদের পরশুরামই তো বলেছেন, ঝোপে-ঝাপে চপ কাটলেট ঝুলছে। পাড়ো আর খাও, খাও আর পাড়। হুরী-পরীদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ কর, কেউ কিছু বলবে না। অতএব স্বর্গ আছে। কিন্তু এই পৃথিবীর চেয়ে বেদনাময় জায়গা আমি কল্পনাই করতে পারিনে। অতএব সেটা নেই। যে জিনিস আমি কল্পনাই করতে পারিনে সেটা থাকবে কী করে?
যুক্তিটা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করতে গিয়ে মুনিঋষিরা যেসব যুক্তি দেন তার চেয়ে অবশ্য বেশি ঘোলাটে নয়। কিন্তু সে-কথা থাক। ওটা নিয়ে আমার শিরঃপীড়া নয়। কথায় বলে, বিপদে পড়লে শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়–আমার উকিলটি নরকে না গেলেও শয়তান তার বাঁ হাতের তেলোতে জল রেখে তাতে ডুবে আত্মহত্যা করবে না। বরঞ্চ একটা উকিলকে যদি কোনওগতিকে স্বর্গরাজ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে তা হলেই তো চিত্তির। ক্লাইভ তো আর গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না! এক ক্লাইভে যা করল, তার ধকল আমরা এখনও কাটাচ্ছি। দ্যাখ তো না দ্যাখ, সেন্ট পিটারের পেটের ভাত চাল হয়ে যাবে, তন্দুরি মুর্গি ডানা গজিয়ে পেটের ভিতর ফুড়ুৎ ফুড়ৎ করতে থাকবে।
আমার শিরঃপীড়া :- আমি যদি প্রি-ডেটেড চেক সই করি, অর্থাৎ শুঁটকিকে তাজা মাছ বলে পাচার করি, অর্থাৎ প্রাচীন দিনের ডায়ারি নবীন বলে চালাই তবে কি আমি ভেজালের ভিটকিলিমিতে ধরা পড়ব না?
উকিল পরম পরিতোষ সহকারে বলল, কিছু ভয় নেই। তবে যা লিখবে তার ন আনার বেশি যেন সত্য কথা না হয়। মিথ্যে লিখতে হবে নিদেন সাত আনা। নতুন আইন।
আমার মিথ্যে বলতে কণামাত্র আপত্তি নেই। লেখক মাত্রই মিথ্যেবাদী। এবং মিথ্যেবাদীকেও সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গুণীরা বলেছেন, যে লোক দুর্ভাগ্যক্রমে লেখক হওয়ার সুযোগ পেল না, হতাশ-প্রেমিকের মতো হতাশ-লেখক। তবু অবাক হয়ে বললুম, সে কী কথা?
উকিল বলল, ক্যারেট কারে কয় জানো? ২৪ ক্যারেটে খাঁটি সোনা হয়। এখন আইন হয়েছে, চৌদ্দ ক্যারেটের বেশি সোনা দিয়ে গয়না গড়ানো চলবে না। বাকি দশ ক্যারেটের বদলে দিতে হবে খাদ।
আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি স্যাকরা যে আমাকে এ-আইন শোনাচ্ছেন!
উকিল আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকাল। যেন আমি ফিয়ারলেস নাদিরা বা কাননবালার চেয়েও খাপসুরত। নিজের চেহারার প্রতি ভক্তি বেড়ে গেল।
বলল– এবারে অতিশয় শান্তকণ্ঠে সোনা ভারতবাসীর চোখের মণি, জিগরের টুকরো, কলিজার খুন। তাই দিয়ে যখন আরম্ভ হয়েছে, তখন সর্বত্রই এটা ছড়াবে। যাও, আর মেলা বকর বকর কর না। আর শোনো, তোমার মাথায় যা মগজ তা দিয়ে পুঁটিমাছেরও একটা টোপ হবে না। তুমি নির্ভয়ে লেখো। কেউ পড়বে না। তুমিও পড়বে না– অর্থাৎ ধরা পড়বে না।
আঁতে ফের লাগল। তবে খুব বেশি না। আমার আঁতে গণ্ডারের চামড়ার লাইনিং।
তা সে যাকগে। আইন বাঁচিয়ে লিখব।
***
আমার শক্র চতুর্দিকে। বরঞ্চ আমাকে অজাতশত্রু না বলে অজাতমিত্র বলা যেতে পারে। তারা যে আমার কী বদনাম করে বেড়াচ্ছে তার লেখাজোখা নেই। না, ভুল বললুম। পাড়ার ছোঁড়াদের কাছে আছে। তৃষ্ণার্ত ছাত্রদের বিয়ারদার সমিতিতে চাঁদা দিইনি বলে তারা সেগুলো জিগির বা স্লোগানরূপে ব্যবহার করে। মহরমের হায় হাসান, হায় হোসেন রোদনরব এর তুলনায় অট্টহাস্য।
তারই একটা– আমি নাকি অতিশয় সুপুরুষ। আপনারা অবশ্য একথা শুনে সরল চিত্তে শুধোবেন, এটা আবার কুৎসা হল কী প্রকারে?
ওই তো! ছোঁড়াদের পেটে কী এলেম তা তো আপনারা জানেন না। সূক্ষ্ম তালেবরদের দুষ্টবুদ্ধি। বেদে নাকি আছে, স নে বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুক্ত–তার এক অর্থ নাকি, দেবতা শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত করুন– এক করুন। অশুভ বুদ্ধি যে আরও কত বেশি সংযুক্ত করে, ঋষি সেটা জানতেন না। কারণ আমাদের বঁড়শে ব্যালার বুদু খানসামা লেনের ছোঁড়াদের ঐক্য তিনি দেখেননি।
তা হলে আরও বুঝিয়ে বলি! রবীন্দ্রনাথের লেখাতে আছে, এক হাড়কিপ্টেকে শিক্ষা দেবার জন্য পাড়ার ছোঁড়ারা কাগজে মিথ্যে মিথ্যে ছাপিয়ে দেয়, তিনি নাকি অমুক চ্যারিটি ফান্ডে বিস্তর টাকা খয়রাত করেছেন। আর যাবে কোথা? চ্যারিটি না করে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়ির সামনে চ্যারিটি ম্যাচের ভিড়।
হুবহু ওই একই মতলব।
তখন স্থির করলুম, একটা ফটো তুলে এই উল্টো-রথের সঙ্গে ছাপিয়ে দেব। শুনলুম, কালীঘাটের কাছে ফটো ফ্ল্যাশের নাকি বাসটিং বিজিনেস ফেটে পড়ার উপক্রম। গিয়ে দেখলুম, কথাটা খাঁটি, ছাব্বিশ ক্যারেট খাঁটি। আমার ছবি তুলতে গিয়ে তাদের তিনখানা লেন্স বার্সট করল। আমার শ্যাটারি সৌন্দর্য সইতে না পেরে।
সেই নব্বই বছরের থুরথুরে ফারসি বুড়ির কাছে বাজ পড়াতে তিনি ভিরমি যান। হুঁশ ফিরে এসে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, বাজের কী দোষ? আমি যে বড্ড বেশি অ্যাট্রাকটিভ।
ফটো হল না। অইল পেন্টিং-ওলা বলেন, কালো হলেও চলত, তা সে যত মিশই হোক না। কিন্তু এ যে, বাবা, খাজা রঙ। কালো কালির উপর পিলা মসনে। তার উপর কলাইয়ের ডালের পিছলপারা, না-সবুজ না-নীল না-কিচ্ছ। আমার প্যালেট লাটে।
.
সেই থেকে ভাবছি কী করি?
তা হলে আবার একটা মাস ভাবতে দিন।
কিন্তু তাতেই-বা কী? দশ ঘণ্টা বাতি জ্বালিয়ে রাখার পর সেটা নিভিয়ে দিলে ঘরে যে অন্ধকার, এক মিনিট জ্বালিয়ে রাখার পর নিভিয়ে দিলেও সেই অন্ধকার।
এক মাস চিন্তা করলেই-বা কী, আর এক মিনিট চিন্তা করলেই-বা কী?
এক ঝাণ্ডা
বহু শক্তিকামী জন, দেশ যখন স্বাধীন, তখন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন না। কারণ সে সময় রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা মুনির নানা মত, নানা পাণ্ডার নানা দল। এসব ঝামেলার ভিতর ঢুকতে হলে প্রথমত দরকার গণ্ডারের মতো চামড়া, দ্বিতীয়ত বিপক্ষকে নির্মমভাবে হানবার মতো ক্ষমতা, তৃতীয়ত দেশের নেতা হওয়ার মতো এলেম এবং তাগদ আমার আছে এই দম্ভ। যাদের এসব নেই, তারা হয়তো আপন গণ্ডির লোককে তাদের মতামত জানান, বড়জোর কাগজে লিখে সেগুলো প্রকাশ করেন, কিন্তু দৈনন্দিন রাজনীতি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলেন।
কিন্তু এমন সময়ও আসে, যখন তারা এক ঝাণ্ডার নিচে এসে দাঁড়ান। সে দিন এসেছে।
পরাধীন জাতের একমাত্র রাজনীতি স্বাধীনতা-সগ্রামে যোগদান করা। স্বাধীন জাতি আক্রান্ত হলে তার একমাত্র রাজনীতি আক্রমণকারীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। সে বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত সে দেশের অন্য কোনও রাজনীতি থাকতে পারে না। বিধানসভা, রাজ্যসভা, ট্রেড ইউনিয়ন, এমনকি পাড়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানে তখন বিরুদ্ধ পক্ষ বলে কিছু থাকতে পারে না। দেশের লোক যাকে নেতা বলে মেনে নিয়েছে তাকে তখন প্রশ্নজালে উদ্ব্যস্ত না করা, কিংবা গুরুগম্ভীর মাতব্বরি-ভর্তি উপদেশ দিয়ে তার একাগ্র মনকে অযথা চঞ্চল না করা। যদি সে নেতার প্রতি দেশের আস্থা চলে যায়, তবে তাকে তাড়াবার জন্য গোপনে দল পাকাতে হয় না। দেশের সর্বসাধারণ তখন চিৎকার করে ওঠে ও সে সময় তাঁকে সরে দাঁড়াতে হয়। ১৯৪০-এ চেম্বারলেন যেরকম মানে মানে সরে দাঁড়ালেন।
এটা শুধু সম্ভব, যেখানে গণতন্ত্র আছে। ডিটেটরদের স্বৈরতন্ত্রে এ ব্যবস্থা নেই। সেখানে গেস্তাপো, ওপণ্ড বহস্তে জনসাধারণের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রাখে– যতদিন পারে। তার পর একদিন মুসলিনিকে মরতে হয় গুলি খেয়ে এবং মাথা নিচের দিকে করে ঝুলতে হয় ল্যাম্পপোস্ট থেকে, হিটলারকে মরতে হয় আত্মহত্যা করে।
রবীন্দ্রনাথ একস্থলে বলেছেন, আমি যে আমার ভগবানে বিশ্বাস করি তার কারণ তাঁকে অবিশ্বাস করার স্বাধীনতা তিনি আমাকে দিয়েছেন–ঠিক ঠিক কথাগুলো আমার মনে নেই বলৈ পাঠক অপরাধ নেবেন না।
আমি যে পণ্ডিতজির নেতৃত্বে বিশ্বাস করি, তার কারণ তাঁকে অবিশ্বাস করার অধিকার তিনি আমাকে দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন বলেই সে স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন বলেই আপনাকে, আমাকে, আর পাঁচজনকে বিশ্বাস করেছেন আমরা যে-রকম তাকে বিশ্বাস করেছি। আমাদের একান্ত প্রার্থনা, আমরা যেন তার সে বিশ্বাস-ভঙ্গ না করি। শত্রু দেশ থেকে বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরই ভাষায় বলি, আরাম হারাম হ্যায়!
আমার দুঃখের অবধি নেই, শেষ পর্যন্ত চীনদেশ আমাদের আক্রমণ করল! প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে জাপান যখন চীন আক্রমণ করে, তখন ভারতবাসীমাত্রেই মর্মাহত হয়েছিল। সদয় পাঠক এস্থলে আমাকে একটি ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ করতে অনুমতি দিন। আমি তখন জর্মনিতে পড়াশুনা করি। সে সময় আমাকে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে চীন-জাপানের কথা ওঠে! আমি বলেছিলুম, এই যে অর্বাচীন জাপান সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে তার পিতামহ চীনের বুকে বসে তার দাড়ি ছিঁড়ছে, এর চেয়ে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে। পরদিন দুই বয়স্ক চীনা ভদ্রলোক আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত– এঁরা দুজনেই আপন দেশের অধ্যাপক। জর্মনি এসেছিলেন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক জন আমার দু হাত চেপে ধরে বললেন, জাপান শক্তিশালী জাতি। অক্ষম চীনের প্রতি দরদ দেখিয়ে তার বিরাগভাজন হতে যাবে কে? আপনি কাল সন্ধ্যায় যা বলেছেন, সে শুধু ভারতবাসীই বলতে পারে। অন্য জনের চোখ দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে জল বেরিয়ে এসেছে। আমি জানতুম, চীনা ভদ্রসন্তান অত্যন্ত সংযমী হয়, সহজে আপন অনুভূতি প্রকাশ করে না, কিন্তু এখানে এ কী করুণ দৃশ্য! আর আমি পেলুম নিদারুণ লজ্জা। আমি পরাধীন দেশের জীবনমৃত অর্ধ-মনুষ্য। আমার কী হক্ক এসব বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করবার!
আজ জানতে ইচ্ছে করে, এই দুই অধ্যাপক এখনও বেঁচে আছেন কি না! থাকলে তারা কী ভাবছেন!
কিন্তু এসব কথা বলার প্রয়োজন কী? ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের যে কত যুগের হার্দিক সম্পর্ক, সে তো স্কুলের পড়ুয়া জানে। শুধু এ দেশ নয়, চীন দেশেও। কারণ চীন দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আছে; আজ যদি চীনের টুথব্রাশ-মুসটাশহীন নয়া হিটলাররা সে ঐতিহ্য অস্বীকার করে বর্বর অভিযানই কাম্য মনে করেন, তবে যেসব সভ্য-ভূমিতে এখনও ঐতিহ্য সংস্কৃতির মর্যাদা আছে, তারা চীনের এই অর্বাচীন আচরণ দেখে স্তম্ভিত হবে। অবশ্য এ আচরণ সম্পূর্ণ নতুন নয়। রুশ দেশ যখন প্রথম কম্যুনিজম ধর্ম গ্রহণ করে তখন সে দেশও তার গগল, পুশকিন, তুর্গেনিয়েভ, চেখফকে বুর্জুয়া, শোষক, প্রগতিপরিপন্থী বলে দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল, কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই দেখতে পেল, কূপমণ্ডুক হয়ে থাকতে চাইলে অন্য কথা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়– মানবসভ্যতার যে চিরন্তন দেয়ালী উৎসব চলছে, তাতে যদি রুশ তার ঐতিহ্যের প্রদীপ নিভিয়ে বসে থাকে তবে সে অন্ধকার কোণ থেকে কেউ তাকে টেনে বের করবে না। তাই আজ আবার রুশ দেশ বিনাবিচারে তার সাহিত্যিকদের পুস্তক ছাপে– সেগুলোতে সে যুগের অনাগত কম্যুনিজমের জয়ধ্বনি থাক আর না-ই থাক।
তাই যখন কম্যুনিজম গ্রহণ করার পর চীন বলল, পৃথিবীতে হাজার রকমের ফুল ফুটুক–তখন আমরা মনে করেছিলুম, অপরের প্রতি সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য স্মরণ করেই চীন একথা বলেছে, কিয়ৎকালের জন্যে রুশ আপন ঐতিহ্য অস্বীকার করে যে মূর্খতা দেখিয়েছিল, তার থেকে সে শিক্ষালাভ করেছে, এবং এখন লাওৎসে কনফুস এবং বৌদ্ধ-ঐতিহ্যের সঙ্গে কম্যুনিজম মিশে গিয়ে এক অভিনব সমাজব্যবস্থা, ধন-বণ্টন পদ্ধতি দেখা দেবে। তার সঙ্গে আমাদের মনের মিল হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু সে এক্সপেরিমেন্ট যে বিশ্বজনের কৌতূহল আকর্ষণ করবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই হাজার রকমের ফুল ফুটুক যে নিতান্ত মুখের কথা, সেটা তিন দিনেই ধরা পড়ে গেল। আমরাই যে শুধু ধরতে পেরেছি তাই নয়, চীনা আক্রমণের পরের দিনই এক সুইস কাগজে একটি ব্যঙ্গচিত্র বেরোয়। ছবিতে জনমানবহীন বিরাট বিস্তীর্ণ এক বরফে ঢাকা মাঠে মাত্র একটি ফুল ফুটেছে। তার নিচে লেখা ভারতবর্ষ। তারই পাশে দাঁড়িয়ে চু এন লাই। পাশে যে সখা দাঁড়িয়ে, তাকে বলছেন, এ ফুলটি আমি তুলে নেব।
অত সহজ নয়।
একদিন জাপান তার উত্তমর্ণ চীনকে আক্রমণ করেছিল। আজ চীন তার উত্তমর্ণ ভারতকে আক্রমণ করেছে।
চীন দেশ কখনও কোনও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেনি। লাওৎসেকনফুৎস যে জীবনদর্শন প্রচার করেছেন, তাতে আছে কী করে সাধু, সৎ জীবনযাপন করা যায়, কিন্তু ইহলোক-পরলোকে মানুষের চরম কাম্য কি এই পঞ্চভূত পঞ্চেন্দ্রিয়াশ্রিত মরদেহ চৈতন্যের ঊর্ধ্বলোকে কী আছে,
কী করে সেখানে তথাগত হওয়া যায়, এ সম্বন্ধে তাঁরা কোনও চিন্তা করেননি।
অথচ বুদ্ধের বাণী যখন মৃদু কাকলি রবে চীন দেশে পৌঁছল, তখন থেকেই বহু চীনা এদেশে এসেছেন। ইৎসিং, ফা-হিয়েন, য়ুয়ান চাঙ, আরও সামান্য কয়েকটি নাম আমরা সকলেই জানি, কিন্তু এঁরা ছাড়া এসেছেন আরও বহু বহু চীনা শ্ৰমণ। বিশেষ করে য়ুয়ান চাঙের ভ্রমণ-কাহিনী পড়লে আজও মনে হয় যেন পরশু দিনের লেখা! বৌদ্ধ শ্রমণ যেমন যেমন ভারতের নিকটবর্তী হতে লাগলেন, তখন তাঁর হৃদয়মনে কী উত্তেজনা, ভারতবর্ষে পৌঁছে তার প্রতিটি তীর্থ দর্শন করে তিনি কী রকম রোমাঞ্চ কলেবর। কামরূপের রাজা যখন তাঁকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গিয়ে পূর্বদিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ওই আপনার মাতৃভূমি, পঁচিশ মাইল হয় কি না হয়, তখন বৃদ্ধ শ্ৰমণ চিন্তা করেছিলেন, কত না বিপদের সম্মুখীন হয়ে, কত না ঘোরালো পথে তাকে তথাগতের জন্মভূমিতে আসতে হয়েছে।
ভারতের রাজা হর্ষবর্ধন তাঁকে সসম্মানে সখারূপে গ্রহণ করেছিলেন।
আজ যদি চীন সে সখ্য ভুলতে চায়, ভুলুক।
ভারতও তার রুদ্র রূপ দেখাতে জানে।
জয় হিন্দ।
এক পুরুষ
০১.
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিক।
বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। আজকের দিনের যুদ্ধে যাকে ইংরেজিতে বলে মপিং অপ, যেন স্পঞ্জ দিয়ে মেঝের এখান-ওখান থেকে জল শুষে নেওয়া– তাই চলেছে। আজ এখানে ধরা পড়ল জন দশেক সেপাই, কাল ওখানে জন বিশেক। কাছাকাছি কামান থাকলে পত্র-পাঠ বিদ্রোহীগুলোকে তাদের মুখের সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা ফাঁসি। গাছে গাছে লাশ ঝুলছে, যেন বাবুইপাখির বাসা।
পাঁচশো দু-আসপা (দ্বি-অশ্বা) অর্থাৎ এক হাজার ঘোড়া রাখার অধিকারী বা মনসবদার গুল বাহাদুর খান বর্ধমানের কাছে এসে মনস্থির করলেন, এখন আর সোজা শাহি সরকারি রাস্তায় চলা নিরাপদ নয়। তিনি অবশ্য আপদ কাটাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেননি। তিনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন গদর (মিউটিনি) শেষ হয়ে গিয়েছে তারা হেরে গিয়েছেন। তিনি কেন, তার সেপাইরা আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তিনি নিজে নিরাশ হওয়ার বহু পূর্বেই। সলা-পরামর্শ করার জন্য তিন রাত্রি পূর্বে যে জলসা বসেছিল তাতে তারা অনুমতি চায়, অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে গরিবশুরবো, ফকির-ফুকরো সেজে যূথভঙ্গ হয়ে যে যার আপন শহরের দিকে রওনা হবে। এলাহাবাদ, কনৌজ, ফররুখাবাদ, লক্ষ্ণৌ, মলিহাবাদ, মিরাট– যার যেখানে ঘর।
গুল বাহাদুর খান বলেছিলেন, সেটা আত্মহত্যার শামিল। পথে ধরা পড়বে, আর না পড়লেও বাড়িতে পৌঁছানোর পর নিশ্চয়ই। তাঁর মনের কোণে, হয়তো তার অজান্তে, অবশ্য গোপন আশা ছিল বেঁচে থাকবার। সুদ্ধমাত্র বেঁচে থাকবার জন্য নয়, তার বয়স বেশি হয়নি, হয়তো আবার নতুন গদর করার সুযোগ তিনি এ জীবনে পাবেন। কিন্তু যখন দেখলেন, সেপাইদের শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে আজকের দিনের ভাষায় যাকে বলে মরাল টুটে গিয়েছে তখন তিনি তাদের প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শেষরাত্রে আধোঘুমে অনুভব করলেন, সেপাইরা একে একে তার পায়ে চুমো খেয়ে বিদায় নিল তিনি আগের দিন মাগরিবের নামাজের পর অনুরোধ করেছিলেন, বিদায় নেওয়া-নেওয়ির থেকে তাঁকে যেন রেহাই দেওয়া হয়।
শুনলেন, সেপাইরা চাপা গলায় একে অন্যকে শুধোচ্ছে, কাজটা কি ঠিক হল, বাড়ি পৌঁছানোর আশা কতখানি, সেখানে পৌঁছেই-বা কিস্মতে আছে কী, এ রকম সর তাজ (মাথার মুকুট) সর্দার পাব কোথায়?
গুল বাহাদুর খানের কিন্তু কোনও চিত্তবৈকল্য হয়নি। তাঁর কাছে এরা সব নিমিত্ত মাত্র। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাঁর প্রাণের একমাত্র গভীর ক্ষুধা– জাহান্নামি শয়তান ইংরেজকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে শাহানশাহ বাদশা সরকার-ই-আলা বাহাদুর শাহের প্রাচীন মুঘলবংশগত শাশৌকৎ তখৃৎদৌলৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। আজ যদি এই সেপাইদের দিল দেউলে হয়ে গিয়ে থাকে তো গেছে। এরা তো আর কিছু কাপুরুষ নয়। কিন্তু এরা কাকের মতো একবারই বাচ্চা দিতে জানে। একবার তারা চেষ্টা দিয়েছিল। সফল হতে পারেনি। দু-বার চেষ্টা দেওয়া তো এদের কর্ম নয়। তাই নিয়ে আফসোস্ করে কী ফায়দা। খুদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন, আল্লার যদি মেহেরবানি হয় তবে আবার নয়া সেপাই জুটবে, নয়া গদর দামামা পিটিয়ে জেগে উঠবে– তার আশা তিনিই করতে পারেন, এরা করবে কী করে?
গদর আরম্ভ হয়েছিল এলোপাতাড়ি কিন্তু পরে দিল্লিতে লালকেল্লার তসবিখানাতে যে মন্ত্রণাসভা বসেছিল সেখানে স্থির হয়, গুল বাহাদুরকে পাঠানো হবে বাঙলা দেশে। সেখানকার বাগদিরা এককালে ছিল বাদশাহের সেপাহি। ইংরেজ তাদের বিশ্বাস করত না বলে ইংরেজ ফৌজে তাদের স্থান হয়নি। শুধু তাই নয়, ইংরেজ তাদের অন্য কোনওরকম কাজ তো দিলই না, উল্টো হুকুম করল তারা যদি আপন জমি নিজে চাষ না করে তবে সে জমি কোম্পানি বাজেয়াপ্ত করবে। বাগদিদের আত্মসম্মানে লাগে জোর ঘা। যে তলোয়ার দিয়ে সে দুশমনের কলিজা দু টুকরো করে দেয়, তাই দিয়ে সে খুঁড়বে মাটি! তার চেয়ে সে তলোয়ার আপন গলায় বসিয়ে দিলেই হয়, কিংবা মওকা পেলে দুশমনের গলায়–
গুল বাহাদুরকে বাঙলা দেশে পাঠানো হয়, এই বাগদি ডোমদের জমায়েত করে এক ঝাণ্ডার নিচে খাড়া করবার জন্য।
আফসোস্, আফসোস্! হাজার আফসোস্! একটু, আর একটু আগে আরম্ভ করলেই তো– গুল বাহাদুর নিজের মনেই বললেন, থাক্ সে আফসোস্। এখন বর্তমানের চিন্তা করা যাক্।
বাগদিদের সাহায্যেই তিনি জোগাড় করলেন ধুতি নামাবলী। তিনি এখন বৃন্দাবনের বৈষ্ণব। বাঙলা জানেন না, জানেন হিন্দি। আসলে সেটাও ঠিক জানেন না। তিনি ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে বলেছেন দিল্লির উর্দু, মকতবে শিখেছেন ফারসি, আর বলতে পারতেন দিল্লির আশপাশের হিন্দির অপভ্রংশ হরিয়ান। কিন্তু তাই নিয়ে অত্যধিক শিরঃপীড়ায় কাতর হবার কোনও প্রয়োজন নেই। এই রাঢ় দেশে কে ফারাক করতে যাবে, দিল্লির হরিয়ানা থেকে বৃন্দাবনের ব্রজভাষা।
দাড়িগোঁফ কামাতে গিয়ে একটুখানি খটকা বেধেছিল, এক লহমার তরে! তার পর, মনে মনে কান্নার হাসি হেসে বলেছিলেন, তা কামাবো বইকি, নিশ্চয়ই কামাবো। লড়াই হেরেছি, তলওয়ার ফেলে দিয়েছি, পালাচ্ছি মেয়েছেলের মতো– এখন তো আমাকে মেয়েমানুষ সাজেই মানায় ভালো।
শেষটায় হঠাৎ অট্টকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ইয়াল্লা, আমি কী গুনা করেছিলাম যে এ সাজা দিলে?
ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্টও মৃত্যুর পূর্বে চিৎকার করে বলেছিলেন, হে প্রভু, তুমি আমাকে বর্জন করলে কেন?
বাগদিরা তাঁর হাহাকার হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল। তেঁতুলতলায় শুইয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সান্ত্বনা দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।
দুপুররাতে চাঁদের আলো মুখে পড়াতে ঘুম ভাঙল। দেখলেন, ঘুমিয়েও ঘুমোননি। ঘুমন্ত মগজও তাঁর জাগ্রত অবস্থার শেষ হাহাকারের খেই ধরে মাথা চাপড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সান্ত্বনাও খুঁজে পেয়েছে। কী সান্ত্বনা? গুল বাহাদুর, এ কি তোমার ফাটা কিস্মাৎ, না তোমার বাপ-ঠাকুর্দার ভাঙা কপাল? মনে নেই, দেওয়ান-ই খাসের যেখানে লেখা–
অগর ফিরদৌস বররূয়ে জমিন অস্ত
ওয়া হমিন অস্ত হমিন অস্ত হমিন অস্ত।
ভূস্বর্গ যেখানে খুশি বলো, মোর মন জানে।
এখানে, এখানে দেখো তারে, এই এখানে।
তারই সামনে নাদির কর্তৃক হৃতসর্বস্ব, লাঞ্ছিত, পদদলিত বাদশা মুহম্মদ শাহ কপালে করাঘাত করে কেঁদে উঠেছিলেন,
শামাতে আমাল-ই-মা সুরুতে নাদির গিরিফৎ।
কপাল ভেঙেছে, আমারই কর্মফল
নাদির মূর্তিতে দেখা দিল।
তখন কি তোমার পিতামহ তার নুন-নিমকের মালিক শাহিনশার সে দুর্দৈব দাঁড়িয়ে দেখেননি? বাদশার খাস আমির সর-বুলন্দখান, হাজার দু-আম্পা মনসবের মালিক। তোমার পিতামহ তখন কী করতে পেরেছিলেন? আলবত্তা, হ্যাঁ, হাবেলিতে ফিরে এলে তাঁর জননী তাঁকে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেল, আর তলওয়ারখানা শাহিনশাকে ফেরত দিয়ে এসো।
তার পর দীন-দুনিয়ার মালিক আকবর-ই-সানী (দ্বিতীয় আকবর) যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাতের বাদশার কাছে দরখাস্ত পেশ করলেন তাঁর তনখাহ্ বাড়িয়ে দেবার জন্য মেথর যে-রকম জমাদারের কাছে তখা বাড়াবার জন্য আরজি পেশ করে–তখন সে বেইজ্জতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তোমার বাপ। শোনোনি যে বাঙালিন বাবু* [*রাজা রামমোহন রায়] সে দরখাস্ত নিয়ে বিলায়েত গিয়েছিলেন তিনি পর্যন্ত নাকি তার জবান, ঢঙ আর শৈলী দেখে শরম বোধ করেছিলেন।
তাই বলি, তুমি এত বুক চাপড়াচ্ছ কেন?
তাদের তুলনায় তোমার মনসবই (পদমর্যাদা) বা কী, বাদশাহ তোমাকে চেনেনই-বা কতটুকু? নানাসায়েব, লছমীবাঈ এঁরা সব গায়েব হয়েছেন, আর তুমি তাঁতি এখন ফারসি পড়বে। হয়েছে, হয়েছে, বেহ হয়েছে। গিদড়ের গর্দানে লোম গজালেই সে শের-বাবর হয় না!
আল্লাহ জানেন, এসব তত্ত্বকথা চিন্তা করে গুল বাহাদুর খান কতখানি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনেও তার আচার-ব্যবহার থেকে অনুমান করা যেত না, তিনি তাঁর কপালের গর্দিশ কতখানি বরদাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বড় রাস্তা থেকে নেমে ডান দিকে মোড় নিয়ে, ফের বাঁ দিকে পুরো পাক খেয়ে তিনি পেরোলেন অজয় নদ। উঁচু পাড়ি বেয়ে উঠেই দেখলেন, সমুখে দিকদিগন্ত প্রসারিত খরদাহে দগ্ধ সবিতার অগ্নি-দৃষ্টিতে অভিশপ্ত চিতানল– ভস্মীভূত প্রান্তর।
অবাঙালির তো কথাই নেই, এ দেশের আপন সন্তানও এই তেপান্তরি মাঠের সামনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে। এর নাম বাঙলা রেখেছে কোন কাষ্ঠরসিক।
কিন্তু গুল বাহাদুর শিউরে ওঠেননি; তাঁর জীবন কেটেছে দিল্লি-আগ্রার চারদিকের খাকছার দেশ দেখে দেখে। সেরেফ উনিশ-বিশের ফারাক।
তাবৎ তেপান্তরের ওপারেও লোকালয় থাকে। সাহারার মতো মরুভূমি পেরিয়েও বেদুইন যখন ওপারে ডেরা পাততে পারে তখন এই তেপান্তরের পরেও নিশ্চয়ই বসতি আছে। কিন্তু সেখানে থাকে কি সর্বহারা লক্ষ্মীছাড়ারাই! যাদের প্রাণ ছাড়া আর কিছু দেবার নেই শুধু তারাই তো পারে এ রকম ডাক-ডাকিনীর মাঠে পা ফেলতে!
ভালোই। ভালোই হল। এই তেপান্তরই তাঁর ও ইংরেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইবে অচল অভেদ্য দুর্গবৎ। সেই হতভাগাদের সঙ্গেও তাঁর বনবে ভালো, hail fellow wellmet, এক বাথানের গরু।
গুল বাহাদুর বললেন, শুকর, আলহামদুলিল্লা।
মাঠে ফেললেন পা।
.
০২.
সংসারের অধিকাংশ লোক না গোলাম না বাদশাহ। বাদবাকির কেউ সরদার কেউ চেলা। ওদের কেউ কেউ জন্মায় হুকুম দেবার জন্য, আর কেউ কেউ সে হুকুম তামিল করার জন্য। ভাগ্যচক্রে অবশ্য কখনও হুকুম-দেনেওলাও জন্মায় হুকুম-লেনেওলা হয়ে। তখনও কিন্তু তার গোত্র বুঝতে অসুবিধে হয় না। সে তখন বাদশাহ হয়ে জন্মালে উজিরের হুকুমমতো ওঠ-বস করে, উজির হলে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকে কোটালের দিকে তার আদেশ কী। আবার উল্টোটাও হয় ঠিক ওই রকমই। সে পাইক হয়ে জন্ম নিয়েও ফৌজদারকে হামেহাল বাৎলে দেয় তার কর্তব্য কোন্ পথে।
দুঁদে জমিদারের জেল হলে সে তিন দিনের মধ্যেই চোর-ডাকাত নিয়ে কয়েদিখানায় দল খাড়া করে, সপ্তাহের মধ্যেই জেল সুপারিনৃটেডেন্ট তার কথায় হাঁচে, তার হুকুমে কাশে। মওকা পাওয়া মাত্রই উপরওলাকে জানায়, অমুক কয়েদির কন্ডাক্ট ভেরি ভেরি গুড; অ্যামনেস্টির সময় একে অনায়াসে খালাস দেওয়া যেতে পারে। জমিদার বেরিয়ে গেলেই সে তখন খালাসি পায়।
গুল বাহাদুরের জন্ম হয়েছিল হুকুম দেবার জন্য। নামাবলী গায়ে দিয়েই আসুন আর রাইডিং বুট পরেই আসুন, ডোমের দল তাকে চট করে চিনে ফেলল। পিঠে থাবড়া খেয়েই ঘোড়া চিনতে পারে ভালো সোওয়ার কে?
তেপান্তরের মাঠের প্রত্যন্ত প্রদেশে, গ্রাম যেখানে শুরু, সেখানে এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলেন গুল বাহাদুর। চালের ভিতর দিয়ে আসমান দেখা যায়। রাতে আকাশের তারা তার দিকে মিটমিটিয়ে তাকায়, দিনে কাঠবিড়ালি। ঘরের কোণের গর্ত থেকে একটা সাপ মাথা তুলে তার দিকে জুল জুল করে তাকিয়েছিল। গুল বাহাদুর বলেছিলেন, তশরিফ নিকালিয়ে, আত্মপ্রকাশ করতে আজ্ঞা হোক। গদরের সময় তিনি নিমকহারামি দেখেছেন প্রচুর। সাপ তো তাঁর নুননিমক খায়নি যে তাকে কামড়াতে যাবে।
ডোমরা তার ঘর মেরামত না করে দিলে গুল বাহাদুর কদাচ এই গর্ত বন্ধ করতেন না।
চিকনকালা গ্রামে আসার পরদিন গুল বাহাদুর গিয়েছিলেন গ্রামের ভিতর একটা রোদ মারতে দিল্লির চাঁদনীচৌকে যাওয়ার মতো। এক জায়গায় দেখেন ভিড়। তিনি ভিতরে যাওয়ার উপক্রম করতেই ডোমরা তড়িঘড়ি পথ করে দিল। একটা ছেলে গাছ থেকে পড়ে পা মচকিয়েছে। তার মা হাউমাউ করে আসমান ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে জমিনের উপর ফেলছে।
গুল বাহাদুর বরিশাল গান ফাটিয়ে বললেন, চোপ!
মার কথা দূরে থাক সুবে ডোমিস্থান সে হুঙ্কারে কে কার ঘাড়ে পড়বে ঠিক নেই। এই যে খুদাতালার এত বড় দুনিয়া, তার আধেকখানাই তো ওই তেপান্তরি মাঠ, সেখানেও যেন তারা পালাবার পথ পাচ্ছে না। হুঙ্কার তারা বিস্তর শুনেছে, নামাবলীও বিস্তর দেখেছে, কিন্তু নামাবলীর তলা থেকে এ রকম অট্টরব! নিরীহ গোপীযন্ত্র থেকে গদরের কামান ফাটে নাকি!
চোপ বলে গুল বাহাদুরের হাত গোঁফের দিকে উঠেছিল। তখন মনে পড়ল তিনি গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন।
গুল বাহাদুর ছেলেটার পায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।
কে এক ওলন্দাজ না অন্য জাতের অর্টিন্ট বলেছেন, যারা এচিং কিংবা অন্য কোনও প্রিন্টিঙের কাজ করে তাদের হাতের তেলো হবে রাজকুমারীর মতো কোমল, পেশি হবে কামারের মতো কট্টর। প্লেট থেকে ফালতো রঙ তোলার সময় রাজকুমারীর মখমলি তেলো দিয়ে আলতো আলতো করে তুলবে রঙ, আর প্রিন্ট করার সময় দেবে কামারে পেশির জোরে মোক্ষম দাবাওট!
গুল বাহাদুর তাঁর মোলায়েম তেলো দিয়ে ছোঁড়াটার গোড়ালি বুলোতে বুলোতে হঠাৎ পা-টা পাকড়ে ধরে কামারের পেশি দিয়ে দিলেন হ্যাঁচকা ঝাঁকুনি। ছেলেটা আঁৎকে উঠে রব ছাড়ল, কক্!
তিনি বললেন, ঠিক্ হৈ, বেটা, আরাম হো-জায়েগা। ফির বন্দর জৈসা কুদেগা।
এতক্ষণ ছেলেটার পা-টা উরু থেকে কাঠের মতো শক্ত হয়ে উপর-নিচ করছিল না, এবারে গুল বাহাদুর সেটাকে কজা-ওলা বাক্সের ডালার মতো উপর-নিচু করলেন। তার পর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিন দন সোলাকে রাখবে।
রাখবে শব্দটা বর্ধমান অঞ্চলে তাঁর বাঙলা শেখার প্রচেষ্টার ফল। ডোমরা বুঝল। সোলাকেও বুঝল– শুইয়ে, তিন তো সোজা তিন কিন্তু দ-টা কী চি?
গুল বাহাদুরকে গদরের সময় জাত-বেজাতের সেপাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা কইতে হয়েছিল। তিনি তাই শিখে গিয়েছিলেন, বিদেশি কোনও শব্দ না বুঝতে পারলে তাকে শোনাতে হয় এই শব্দের সম্ভব-অসম্ভব যাবতীয় প্রতিশব্দ। যেমন ইনসান বললে যদি না বোঝে তবে বলতে হবে আদমি, তার পর মানস লোগ বেটা বাচ্চা ইত্যাদি। একটা না একটা বুঝে যাবেই।
গুল বাহাদুর বললেন, তিন্ দন, তিন্ শাম, তিন্ রোজ।
এক ডোম চিৎকার করে বলল, বুঝেছি গো, বুঝেছি। তিন দিন, তে রাত্তির।
জীবনের দীর্ঘতম অংশ চিকনকালা গ্রামে কাটিয়ে গুল বাহাদুর বীরভূমি ডোমি ভাষা শিখেছিলেন কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত তার হিন্দুস্থানি হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বর থেকে তিনি নিষ্কৃতি পাননি। তার দিন শোনাতো দন, কিতাব কতব, হিন্দু হন্দু, বিলকুল বলকল –বাগদিদের কানে।
অঙ্গরখার দাম (চাপকানের নিম্নাঞ্চল) ওঠাতে গিয়ে গোঁফে তা দিতে যাবার মতো তার খেয়াল হল, তিনি ধুতি-উত্তরীয়ধারী।
সেদিন সন্ধ্যায় তিনি আঙ্গিনায় পলাশতলায় চ্যাটাইয়ের উপর শুয়ে। আসমানে দেখেছেন মিজান (দাড়িপাল্লা, মধ্যিখানে তিনটে তারা কাটার মতো, দু দিকে ভার আমাদের কালপুরুষ)। তখন খেয়াল গেল, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, সবই আগের থেকে উদয় হয়েছেন। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, মিজান, অকরব, কওস, সঙ্কুলা, জদি, দলে, হুৎ–!
দিল্লিতেও তিনি ছাতের উপরই থাকতেন বেশিরভাগ।
ঠাকুরদা শখ করে বানিয়েছিলেন যমুনার উপর একখানি চক-মেলানো বাড়ি। বাড়িখানি ছোট কিন্তু উচ্চতায় সে বাড়ি ও-পাড়ার সব বাড়ি ছাড়িয়ে উঠেছিল। আজকের দিনের ভাষায় একেই বলে বাড়ি হাঁকানো। বৃদ্ধ বয়সেও ঠাকুরদার চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে যায়নি। নাতিকে কোলে বসিয়ে বলতেন, ওই দেখো, ওই দেখো, ওই দূরে, যমুনার ওপারে শাহদারা, গজিয়াবাদ, নাতি দেখত ওপারে শুকনো মাঠ খাঁ খাঁ করছে, আর তার মাঝে মাঝে ঝোঁপ-ঝাড়। কুত্ত্বউদ্দীন আইবেক থেকে আরম্ভ করে বাবুর, হুমায়ুন, রফীউদ্দৌলা মুহম্মদ শাহ– সবাই গিয়েছেন ওপারে হরিণ শিকার করতে। বুড়ো বাদশাহের হরিণ-শিকারের বয়স গেছে–তিনি এখন লাল কেল্লার ছাতের উপর থেকে ওড়ান ঘুড়ি। শাহজাদারা এখনও যান, তিনিও বহুবার গিয়েছেন।
বাহাদুর শাহ ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। অবশ্য সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি জওক ও গালিবের তুলনায় তাঁর রচনা নিম্নাঙ্গের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কবিতায় এমন একটা সরল সহৃদয়তার গুঞ্জন থাকত যেটা কারও কান এড়িয়ে যেত না। এবং তার মধ্যে ছিল এমন একটা সদ্গুণ যেটা জওক কিংবা গালিব কারওরই ছিল না। জওক-গালিবের মধ্যে হামেশাই হত লড়াই। তৎসত্ত্বেও একে অন্যের প্রশংসা করতেও তারা কুণ্ঠিত হতেন না। শোনা যায় শ্রেষ্ঠতর কবি গালিব নাকি এক মুশায়েরাতে (কবি সম্মেলনে) জওকের কোনও কবিতার দু ছত্র শুনে তাঁকে সর্বসমক্ষে বার বার কুর্নিশ করতে করতে বলেছিলেন, আপনার এ দুটি ছত্র আমাকে বখশিশ দিন; আমি তার বদলে আমার সমস্ত কাব্য আপনাকে দিয়ে দেব। কিন্তু এদের বাক্যের চিকন কাজ বাদশাহ বাহাদুর শাহ যতখানি অনুভব করতে পারতেন, এরা একে অন্যের ততখানি পারতেন না। বাহাদুর শাহ ছিলেন সে যুগের– সে যুগের কেন, তাবৎ উর্দু যুগের সবসে বঢ়িয়া সমজদার।
গদর আমলের ইংরেজরা তাঁর কাব্যপ্রেমকে নিয়ে কত যে ব্যঙ্গ-পি ঠাট্টামস্করা করেছে তার অন্ত নেই। তাদের রাজদরবারেও পোইট লরিয়েট নামক একটি প্রাণী পোষা হয়। তাদের কুরান-পুরাণে আছে, গ্রেট ন্যাশনাল অকেশনে তিনি টপ্পা-ফপ্লাভি লিখতে পারেন, ওইসব অকেশনে দর্জি-ওস্তাদরা যে রকম রাজা-রানির পাতলুন-বুসাৰ্জ বানায়, কিংবা বলতে পারেন হটেন্টটদের রাজদরবারে পালপরবে যে রকম পোষা বাদর দু চক্কর নাচভি লেচে ল্যায়।
আসলে তাদের রাজারা দেবসেনাপতি, অসুরমর্দন, রুদ্ৰাত্মজ কার্তিকের বংশ-অবতংস। তাঁরা তীব্রতম চিৎকারে আকাশ বাতাস সসাগরা পৃথিবী (যে রাজত্বে সূর্য অস্তমিত হন না) প্রকম্পিত করে শিকার করেন খ্যাকশ্যালী। দি লর্ড বি থ্যান্ট– তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান আছে।
তাবৎ ইংরেজই অগা, ও-কথা বলা বোধহয় অন্যায় হবে। কারণ পরবর্তী যুগের এক ইংরেজই দুঃখ করে বলেছেন, যেসব গাড়লরা গদরের সময় ভারতবর্ষ শাসন করত তাদের সামনে শেলি কিংবা কিটস এলে যে সম্মান বা অসম্মান পেতেন কবি বাহাদুর শাহ সেই গবেটদের কাছে সেই মূল্যই পেয়েছেন। এবং সেসব সম্বন্ধীরা এই মামুলি খবরটুকুও জানত না যে, তাদের দুই নম্বরের মাথার মণি ওয়ারেন হেস্টিংসও কবিতা লিখতেন, এবং ইংরেজ লেখক জোর গলায় বলেছেন, সে কবিতা বাহাদুর শাহের কাব্যের তুলনায় অতিশয় নিকৃষ্ট এবং ওঁচা।
গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, গদর শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে নওরোজের রাতে যে মুশায়েরা বসেছিল তাতে সভাপতির আসন নিয়েছিলেন বাদশা সালাম বাহাদুর শাহ। সেই শেষ মুশায়েরা।
থাক্ থাক, কী হবে ভেবে?
ভাববই না কেন? আমার অতীতকে আমি আঁকড়ে ধরে থাকব না, আর ভবিষ্যৎকেও আমি আলিঙ্গন করতে ভয় পাব না।
রাজত্ব বধূরে যেই করে আলিঙ্গন
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন।
কী ভয় তাতে? আমার রথ চলবে এগিয়ে, রথের পতাকা পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে কাপবে অতীতের স্মরণে। তাই বলে কি আমার এগিয়ে চলা বন্ধ হবে?
বরঞ্চ বলব, নবজন্ম লাভ, অবশ্য আমি জাতিস্মর।
এই তো সেই আকাশ। এ আকাশ আর দিল্লির আকাশে তো কণামাত্র তফাৎ নেই। এ আকাশ তো আমার। হেসে মনে পড়ল ফিরদৌসির একটি দোঁহা। সম্পত্তির ভাগাভাগির সময় একজন অন্য বখরাদারকে বলল
আজ ফর্শ-ই-খানা তা ব লব-ই বাম্ আজ আন্-ই-মন্
আজ বাম্-ই-খানা তা ব সুরইয়া আল্ আন্-ই-তো।
মেঝের থেকে ছাতটুকু তাই নিলেম কুল্লে আমি
ছাতের থেকে আকাশ তোমার সেইটে তো ভাই দামি।
প্রথম যখন দোঁহাটি পড়েছিলেন তখন তার মনে হয়েছিল এ কী কাষ্ঠ রসিকতা! আজ হৃদয়ঙ্গম হল, এ শ্লেষ নয়, বিদ্রূপ নয়– ছাত থেকে আকাশই মূল্যবান সেখানেই মুক্তি, সেখানেই নির্বাণ।
ওই তো আকাশের তারা। তাঁর পেয়ারা ঘোড়ার জিনের সামনের উঁচু দিকটা ঠিক এই রকমই পেতলের স্টাড দিয়ে তারার মতো সাজানো ছিল। এ তো কিছু অজানা সম্পদ নয়। দার্শনিক গজ্জালিও তার সৌভাগ্য স্পর্শমণি (কিমিয়া সাদৎ) গ্রন্থে বলেছেন, আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দেখো, আর আপন অন্তরের দিকে তাকাও বুঝতে পারবে সৃষ্টির মাহাত্ম্য।
দুই-ই অলঙ্ঘ্য নিয়ম অনুসারে চলে। শুধু হৃদয়ের আইন বোঝা কঠিন। স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে ভাবি, স্বেচ্ছায় করছি- তারারাও হয়তো তাই ভাবে।
তরল অন্ধকার। এ অন্ধকার বুকের উপর দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে। এর চেয়ে অনেক বেশি মসীকৃষ্ণ দেখাচ্ছে পলাশের ডালগুলো। তারা আঁকাবাঁকা শাখা দিয়ে অন্ধকারের গায়ে এঁকেছে বিচিত্র আলিম্পন। গাছের শক্ত ডাল, অশরীরী অন্ধকার, দূরদূরান্তের তারার দেয়ালি– সবাই একসঙ্গে মিলে গিয়ে পেলব মধুর স্পর্শ দিয়ে শান্তি এনে দিচ্ছে গুল বাহাদুরের দগ্ধ ভালে। এইটুকু তার চোখের মণিতে ধরা দিয়েছে সে সন্ধ্যার অনন্ত আকাশ থেকে পলাশের ডগাটুকু পর্যন্ত। যমুনার পারে প্রাসাদের উপরে এরা তাকে যেমন করে সোহাগ জানাত ঠিক তেমনি তারা এসে ধরা দিল ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শায়িত ফকির গুল বাহাদুরের কাছে।
কৃতজ্ঞ গুল বাহাদুর তার দীর্ঘ দুই হাত তাদের দীর্ঘতম প্রসারণে উচ্চ বিস্তার করে আসমানের দিকে তুলে মোনাজাত করলেন,
তোমার আমার মাঝখানে, বিভু, নাই কোনও বাধা আর
তোমার আশিস বহিয়া আনিল তরল অন্ধকার।
.
০৩.
আরব্য রজনীর গল্পে আছে কোথায় যেন দমস্কস্ না বাগদাদ শহরে, এক ঝুড়ি আণ্ডা সামনে নিয়ে বসে অন-ন শার স্বপ্ন দেখছিল। হুবহু স্বপ্ন না, দিবা-স্বপ্ন। ওই ডিমগুলোই তার সাকুল্য সম্পত্তি। এক ডিম বিক্রি করে মুনাফা দিয়ে সে কিনবে আরও ডিম। তারই লাভে পুষবে মুরগি। তারই লাভে সে যাবে হিন্দুস্থান, সদাগরি করতে। তারই লাভে সে হয়ে যাবে শেষটায় শহরের সবচেয়ে মাতব্বর আমির। তখন প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আলা– যেচে-সেধে তাঁর মেয়েকে দেবেন তার সঙ্গে বিয়ে। তার পর আরও অনেক কিছু হবে। হয়ে হয়ে একদিন এই এমনি খামোখা তার রাগ হয়েছে বেগম সায়েবার ওপরে। তিনি অনেক সাধাসাধি করেছেন তার মান ভাঙাবার জন্য। অন-নশ শার মানিনী শ্রীরাধার মতো অচল অটল। বরঞ্চ হঠাৎ আরও বেশি ক্ষেপে গিয়ে মারলেন বেগম সায়েবাকে এক লাথ। হায়রে, হায়! এতক্ষণ ছিল সুদ্ধমাত্র খেয়ালের পোলাও খাওয়া, দিবা-স্বপ্ন এখন অন্-নশ শার মেরে দিয়েছে সত্যিকার লাথি। সেটা পড়ল সামনে-রাখা ডিমের ঝুড়ির উপর। কুল্লে আণ্ডা ভেঙে ঠাণ্ডা।
এ গল্প কখনও ফ্রক পরে ইংলন্ডে, কখনও দাড়ি রেখে আফগানিস্তানে সর্বত্রই প্রচলিত আছে। এবং সর্বযুগেই সর্বদেশের প্র্যাকটিকেল পাণ্ডারা বেচারি অনু-নশ শারকে নিয়ে কতই না ব্যঙ্গোক্তি করেছেন। সে-ও লজ্জায় রা-টি কাড়ে না।
কিন্তু এ কথাটা কেউ ভেবে দেখে না যে, এ সংসারে অহরহই প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে যারা বৃহত্তর ভুবনে চলে যেতে জানে তাদের সবাই অন্-নশ শার– ওই শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। যারা আপন নাকের ডগার বাইরে তাকাতে জানে না তারাই দৈনন্দিন দৈন্যে শেষদিন পর্যন্ত নাকানি-চুবানি খায়। দিবাস্বপ্ন আলবৎ দেখতে হয় কিন্তু শেষ লাথিটুকু বাদ দিয়ে। গুল বাহাদুর ঠেকে শিখেছেন। গদরের আণ্ডা বিক্রি হওয়ার পূর্বেই তারা স্বাধীনতার উজির-কুমারীকে লাথি মেরে বসিয়েছিলেন। তিনি সাবধান হয়ে গিয়েছেন। এখন আর কুঁড়েঘরে বসে বালাখানা-রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন নয়, গদরের খেয়ালি পোলাও নয়। এখন দেখতে হবে নাকের ডগা ছাড়িয়ে ত্রিশ গজ দূরের স্বপ্ন মাত্র সাংসারিক সচ্ছলতার স্বপ্ন।
তাঁর প্রথম আণ্ডা এল অযাচিত, অপ্রত্যাশিতভাবে।
ডোমেরা এসে সভয়ে তাঁকে নিবেদন জানাল, শিবু মোড়ল যায় যায়। মরার আগে বাবাজির চরণধূলি চায়।
গুল বাহাদুর পড়লেন বিপদে। ওপারে যাওয়ার সময় মুসলমান যেসব তওবা-তিল্লা করে থাকে অনেক হিন্দুদের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা জৈনদের পর্যসনের মতো সেগুলো তিনি কোনওমতে সামলে নিতে পারেন, কিন্তু হিন্দুধর্মের তিনি জানেনই-বা কতটুকু? তার আমলে দিল্লির হিন্দুরা তো শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতি-সভ্যতায় পুরো-পাক্কা মুসলমান বনে গিয়েছে। তারা পরে চোৎ চুড়িদার পাজামা, লম্বা শেরওয়ানি, মাথায় দুকল্পি কিস্তি টুপি আর মুশাইরায় হাঁটু গেড়ে বসে বয়েৎ আওড়ায়– মক্কা-মদিনার মালিক, ইয়া আল্লা, আমাকে ডেকে নাও নবীর নূর হজরত মুহম্মদের পদপ্রান্তে।
বরন্দাবন (বৃন্দাবন)-কে কুন্জ গলিয়ামে (কুঞ্জ গলিতে) কিসজি (শ্রীকৃষ্ণ) কভি কভি বাসরী (বাশরী) বৃজাওৎ (বাজান), এই তো হিন্দুধর্ম বাবদে তাঁর এলেম! ওইটুকু জ্ঞানের ন্যাজ তিনি শিবু মোড়লের হাতে তুলে দিয়ে তাকে নির্ভয়ে বৈতরণীতে নাবতে ভরসা দেবেন কী প্রকারে?
ধরা পড়ার ভয় আছে, অথচ না গিয়েও উপায় নেই। গুল বাহাদুর মনে মনে বললেন, চুলোয় যাক গে। এ রকম ভয়ে ভয়ে কাটাব আর কতদিন! মৃত্যু যে অহরহ মানুষের চুলের ঝুঁটি পাকড়ে ধরে আছে সেটা স্মরণ করে কটা লোক? কিংবা বলা যায়, গুল বাহাদুর ভাবলেন, গায়ে শু মেখে বসে থাকলেই কি আর যম ছেড়ে দেবে?
শিবু মোড়লের ইঙ্গিতে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল–মায় তার ছ বচ্ছরের ছেলেটাও। অবাক ইশারায় গুল বাহাদুরকে তক্তপোশের একদম কাছে ডেকে নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার ছেলেটাকে তুমি মানুষ করো। সব তোমাকেই দিলুম।
গুল বাহাদুর ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছেন। ছেলেটার ভার কাঁধে তুলতে তার কণামাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে আসলে মুসলমান।
মোড়ল বলল, আমার অনেক শক্র; ছেলেটাকে মেরে ফেলবে।
দুশ্চিন্তার ভিতরও গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, হজরত মুহম্মদের পূর্বেও আরবরা ছিল বর্বর। তারাও নির্ভয়ে অনাথকে মেরে ফেলে তার টাকাকড়ি উট তাম্বু কেড়ে নিত। তাই হজরতের নবধর্ম স্থাপনার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল অনাথের রক্ষা। মনে পড়ল, স্বয়ং আল্লা হজরতকে মধ্যদিনের আলোর দোহাই, নিশির দোহাই, ওরে বলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তিনিও অনাথরূপেই জন্ম নিয়েছিলেন,
অসহায় যবে আসিলি জগতে তিনি দিয়েছেন ঠাঁই,
তৃষ্ণা ও ক্ষুধা আছিল যা সব মুছায়ে দেছেন তাই।
পথ ভুলেছিলি, তিনিই সুপথ দেখায়ে দেছেন তোরে
সে-কৃপার কথা স্মরণ রাখি। অসহায় শিশু, ওরে,
দলিনে কভু। ভিখারি-আতুর বিমুখ যেন না হয়।
তাঁর করুণার বারতা যেন রে ঘোষিস জগৎময়।
এ তো আল্লার হুকুম, রসুলের আদেশ। মানা-না-মানার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তোমার ঘাড় মানবে।
কিন্তু তিনি যে মুসলমান। ডোম হোক আর মেথরই হোক, মোড়লের ছাবালের মুখে তিনি জল তুলে দেবেন কী প্রকারে? গুল বাহাদুর চুপ।
শিবু তার লাল ঘোলাটে চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকাল কিছুক্ষণ। তার পর ধীরে ধীরে বলল, গোসাই, তুমি গোসাই নও, সে কথা আমি জানি। তুমি কী, তা-ও আমি জানি। কিন্তু আর কেউ জানে না। জানার দরকারও নেই।
কী করে জানলে? এ প্রশ্ন গুল বাহাদুর শুধালেন না। তিনি পল্টনের লোক; বললেন, আমি মুসলমান, জানো?
শিবুর শুকনো মুখ খুশিতে তামাটে হয়ে উঠল। গুল বাহাদুরের হাতখানা আপন হাড্ডিসার দু হাতে তুলে নিয়ে বলল, বাঁচালে, গোসাঁই, তরালে আমাকে। তার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মুসলমানেরই এক দর্গায় মানত করে মা পেয়েছিল আমাকে। আমি পেয়েছি আনন্দীকে। পীর সৈয়দ মরতুজার ভৈরবীর নাম ছিল আনন্দী।
মুসলমান পীরের দরগায় যে হিন্দু বন্ধ্যা সন্তানের আশায় যায়, এ দৃশ্য গুল বাহাদুর বহুবার দেখেছেন দিল্লিতে নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার দরগায় কিন্তু পীরের আবার ভৈরবী হয় কী করে, আর ভৈরবীই-বা কী চিজ, আনন্দী শব্দটাও হিন্দু হিন্দু শোনায়, এসব গুল বাহাদুর কিছুই বুঝতে পারলেন না। কে জানে মুসলমান ধর্ম বাঙলা দেশে এসে কী রূপ নিয়েছে।
বাচ্চাকা ভালা বোলনা-চোলনা, বহুড়ীকা ভালা চুপ–বাচ্চার ভালো বকবকানো, কনের ভালো চুপ ভালো সেপাইও বহুড়ীর মতো চুপ করে শুনে যায়, গুল বাহাদুর চুপ করে শুনে যেতে লাগলেন।
মোড়লের দম ক্রমেই ফুরিয়ে আসছিল। তাই আশকথা-পাশকথা সম্পূর্ণ বর্জন করে শুধু তার ইচ্ছাগুলো বলে যাচ্ছিল, বিষয়-আশয় বোঝবার বয়স হলেই তাকে মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরে পাঠিয়ে দিয়ো। সেখানে তার জমিজমা এখানকার চেয়ে ঢের বেশি।
গুল বাহাদুর পুরনো কথায় ফিরে গিয়ে শুধালেন, তোমার ছেলে আমার সঙ্গে থাকলে মুসলমান হয়ে যাবে না।?
মোড়ল বলল, না। আমরা জাতে ডোম। মুসলমানের হাতে খেলেও আমাদের জাত যায় না, আমরা মুসলমানও হইনে। থাক্ অতশত কথা। তুমি নিজেই জেনে যাবে। শোনো, আর যা করতে হয় করো, ছেলেটাকে কিন্তু লেখাপড়া শিখিয়ো না, ওকে ভদ্রলোক বানিয়ো না।
সে কী!
না, ভদ্রলোক বানিয়ো না। আর শোনো, জলের কলসির তলায় মাটির নিচে কিছু টাকা আছে। তোমাকে দিলুম।
গুল বাহাদুরের আবার মনে পড়ল, হজরত তার যৌবন আরম্ভ করেছিলেন, এক বিধবার ব্যবসায়ের কর্মচারীরূপে। বললেন, টাকা ব্যবসাতে খাটাব। তোমার ছেলে পাবে মুনাফার আট আনা।
মোড়ল বলল, যা খুশি কর, কিন্তু লগ্নির ব্যবসা কর না।
গুল বাহাদুরের মুখ লাল হয়ে উঠল। ভদ্র মুসলমান সুদের ব্যবসা করে না।
মোড়ল বলল, আর শোন, খুশ বিরামপুরের ঘোষালদের মেজবাবুর সঙ্গে আলাপ কর। তোমারই মতো। কিন্তু সাবধানে। আর শোন, তোমারই মতো আরেকজন আশ্রয় নিয়েছে বর্ধমানের কাছে, দামোদরের ওপারে–
এবারে গুল বাহাদুর আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তবু উত্তেজনা চেপে রেখেই তাড়াতাড়ি শুধালেন, কোন গ্রামে?
মোড়ল তখন হঠাৎ চলে গিয়েছে ওপারে, যেখানে খুব সম্ভব গ্রামও নেই, শহরও নেই।
গুল বাহাদুর দু হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মোড়লের চোখ দুটি বন্ধ করে দিলেন। মনে মনে আবৃত্তি করলেন,
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আল্লার কাছ থেকে এসেছি, আর তার কাছে ফিরে যাব। কাফেরের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কট্টর-মোল্লা কট্টর উল্লাসভরে এ মন্ত্র উচ্চারণ না করে বলে ওঠে ভিন্ন মন্ত্র–
ফি নারি জাহান্নামা।
একমাত্র ইংরেজদের মৃত্যুসংবাদ শুনলে গুল বাহাদুর দ্বিতীয় মন্ত্রটি একশোবার আবৃত্তি করতেন। আল্লার একশো নাম– মানুষ তার নিরানব্বই জানে– সেই নিরানব্বই নামের উদ্দেশে নিরানব্বই বার আর শয়তানের উদ্দেশে একবার।
দাহ-কর্ম শ্রাদ্ধ, তা-ও আবার ডোমের, এসব কোনওকিছুই গুল বাহাদুর জানতেন না, জানবার চেষ্টাও করলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখলেন। তবে তাঁর গম্ভীর আঁটসাট মূর্তি আনন্দীর হাত ধরে না দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ঝগড়াঝাটি হতে পারত। মোড়লের মরে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে যে ভিড় জমেছিল তার দিকে একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, শাহ্-ইন-শাহ্ বাহাদুর শার দরবারে যদি দৈবপাকে চিকনকালা গ্রামের মাতব্বরদের কুর্নিশ জানাবার অনুমতি লাভ হত তবে তাতে দুই নম্বর হত কে? পয়লা নম্বর তো চলে গিয়েছেন, দুই নম্বর হতেন ঝিঙে সরদার। ভিড়ের মধ্যে ঝিঙের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ভারি গলায় হুকুম দিলেন, ইধর আও।
ঝিঙে ভয়ে ভয়ে, লোকলজ্জায় কিছুটা বুক ফুলিয়ে, এগিয়ে এল– ভিড় রাস্তা করে দিল। ঝিঙের সঙ্গে শিবুর সদ্ভাব ছিল না।
গুল বাহাদুর বললেন, সব-কিছু চালাও।
ঝিঙে গলে গেল। তার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না, শিবু গত হলেই সে হবে গাঁয়ের মোড়ল। মধ্যিখানে বাদ সাধল এই লক্ষ্মীছাড়া বাবাজি। শিবু নিশ্চয়ই মরার সময় এ-ব্যাটাকে বিষিয়ে গেছে। তা হলে এটা হল কী করে? থাক্ এখন, পরে জানা যাবে।
ঝিঙে ডবল উৎসাহে সবকিছু সামলাল। বেশিরভাগ ব্যবস্থা শিবু মরার আগেই করে গিয়েছিল।
শ্মশান থেকে ফিরে এসে ঝিঙে সরদার শিবু মোড়লের দাওয়ায় গুল বাহাদুরের কাছে এসে বসল। গাঁয়ের দু-চারজন তাদের কথার্বাতা শোনবার জন্য এগিয়ে এলে ঝিঙে দিল তাদের জোর ধমক। তারা গুল বাহাদুরের দিকে আপিল-নয়নে তাকাল কিন্তু তার কোনও ভাব-পরিবর্তন না দেখে আস্তে আস্তে সরে পড়ল।
তখন তিনি অতি শান্তকণ্ঠে, ধীরে ধীরে বললেন, মোড়ল, ধমক না দিয়েই যেখানে কাজ চলে সেখানে ধমকের কী দরকার! কিন্তু সে তুমি বোঝো। আমি বলবার কে? আমি তো এদের চিনিনে। এদের কী করে সামলাতে হয় তার খবর রাখো তুমি।
মোড়ল সম্বোধনে ঝিঙে একেবারে পানি হয়ে গেল– জল তো হয়ে গিয়েছিল আগেই। হাতজোড় করে বলল, দেবতা, অপরাধ হয়েছে। কিন্তু ওদের থাকতে বললে না কেন?
গুল বাহাদুর প্রথমেই লক্ষ করলেন ঝিঙে তোতলা। তোতলাকে মোড়ল বানানো কি ঠিক? তখন মনে পড়ল, একাধিক পয়গম্বরও ছিলেন তোতলা।
ঝিঙের কথার উত্তরে বললেন, তুমি মুরুব্বি, একটা হুকুম দিয়েছ। আমি উল্টো কথা বললে তোমার মুখ থাকত কি?
ঝিঙে কিন্তু শিবুর মতো বিচক্ষণ লোক নয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধাল, শিবু তোমাকে বলে যায়নি আমাকে মোড়ল না করতে?
গুল বাহাদুর বললেন, না।
শিবুর মতো বিচক্ষণ নয় ঝিঙে, কিন্তু সে শিবুর চেয়ে অনেক বেশি ঘড়েল।
ভাবখানা করল, ওহ! শিবু যদি বলত তবে তুমি আমায় ডাকতে না।
গুল বাহাদুর বললেন, শোন সরদার, শিবু সব কথা বলে যাবার ফুরসত পায়নি। পেলেও যে তোমার কথা বলত, তা-ও তো জানিনে। আর ওর বলাতে না-বলাতে কিছু আসে-যায় না। সে গেছে, এখন গাঁ চালাব আমরা। ওর ইচ্ছে বড়, না, গাঁ-চালানো বড়? ও যদি বলে যেত, আনন্দী গা চালাবে, তা হলে তোমরা কি সেটা মানতে?
গুল বাহাদুরের মনে পড়ল হজরত মুহম্মদও ইহলোক ত্যাগ করার সময় মুসলমানদের জন্য কোনও খলিফা নিয়োগ করে যাননি। গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, তবে কি অনুন্নত সম্প্রদায়ে এই ব্যবস্থাই বেশি কার্যকরী? তবে কি বংশগত রাজ্যাধিকার পরবর্তী যুগের সৃষ্টি? তার পর মনে পড়ল, ঐতিহাসিক ইবনে খলদুন তার পৃথিবীর ইতিহাসে এই নিয়ে কী যেন এক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ভাবলেন, দেখতে হবে। তার পর মনে পড়ল, এখানে তো বইপত্র কিছুই নেই। যাক্ গে এসব কথা।
ঝিঙেকে বললেন, কানাবুড়ি বাতাসীকে বল সে এ ভিটেয় থাকবে। ঝিঙে অবাক। বাতাসীর মতো অথর্ব অচল ঝগড়াটে সাড়ে ষোল আনা অন্ধ এ তল্লাটে দুটি নেই। তার গলাবাজির চোটে পুঁদে মোড়ল শিবুও তার তল্লাট মাড়াত না।
ঝিঙে গুল বাহাদুরের মতলব আদপেই বুঝতে পারেনি। তিনি জানতেন, শিবুর যে কিছু লুকানো টাকা আছে সেটা সকলের অজানা না-ও হতে পারে। রাত্রে ভিটে খোঁড়ার জন্য চোর আসতে পারে। বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে না আসতে বুড়ি চিৎকার করে করে পাঁচখানা গাঁয়ের লোক জড়ো করে ফেলবে। অন্ধের শ্রবণশক্তি চক্ষুম্মানের চেয়ে বেশি। দিল্লির জামি মসজিদের দেউড়িতে এক অন্ধ শুধু গলা শুনে হাজার লোকের জুতো সামলায়। মাদ্রাসার ছোঁড়াদের কেউ মজা দেখবার জন্য অন্যের গলা নকল করলে অন্ধ দু-জোড়া জুতো বাড়িয়ে দিয়ে বলত, এই নাও তোমার জোড়া, আর এই নাও যার নকল করছিলে। লোকে বলত, আগ্রাতে শুকনো পাতা ঝরে পড়লে এ অন্ধ দিল্লির চাঁদনি চৌকে বসে শুনতে পায়। বাতাসী অতখানি কেরানি হয়তো দেখাতে পারবে না, কিন্তু দুটি বেগুন বাঁচাবার জন্য যে বেটি সমস্ত রাত দাওয়ায় বসে কাটায় তার চেয়ে ভালো পাহারাওলা পাওয়া যাবে কোথায়? এখন কয়েক রাত তো পাড়াপ্রতিবেশীরা কান খাড়া রেখে ঘুমুবে শিবুর ভিটেতে খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ হচ্ছে কি না শোনবার জন্যে। কয়েকটা রাত যাক, তার পর তিনি সুবিধেমতো তার ব্যবস্থা করবেন।
কিছুক্ষণের ভিতরই শোনা গেল পাড়ার শেষপ্রান্ত থেকে বাতাসীর চিৎকার। চিকনকালা গ্রামটাকে সে বেতারকেন্দ্র বানিয়ে বিশ্বভুবনকে জানাচ্ছে, শিবু গেছে বেশ হয়েছে, আগে গেলেও কেউ মানা করত না, বাতাসী তো নয়ই, কিন্তু এ কী গেরো, সে কেন সামলাতে যাবে শিবুর গোয়াল-খামার, ওই দিকধিড়িঙে মিনসে বাবাজিটা আছে কী করতে, তাকেই তো শিবু ঘটিবাটি চুলো-হাঁড়ি সব-কিছু দিয়ে গিয়েছে, মরে যাই, আর লোক পেল না, কোথাকার হাড়হাভাতে শতেক খোয়ারি- আরও কত কী!
গলার শব্দ কিন্তু এগিয়ে আসছে শিবুর বাড়ির দিকেই।
মোগল শাসনেও চার্জ দেওয়া-নেওয়া নামক মস্করাটা চলত। গুল বাহাদুর সে-মস্করাটা বাতাসীর সঙ্গে করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাঁর ঘাড়েও তো মাথা মাত্র একটা। সেটা তো চায় ইংরেজ। বুড়িকে দিয়ে চলবে কেন?
আনন্দীকে হাতে ধরে নিয়ে বললেন, চলো।
যেতে যেতে আনন্দী বলল, দাদু, বাবা আমাকে বলেছিল, বাতাসী পিসিকে বাড়ি নিয়ে আসতে। সে তো বলছে, আসবে না।
গুল বাহাদুর ভারি খুশি হলেন। প্রথমত শিবু যে আহাম্মুখ ছিল না, তার শেষ প্রমাণ পাওয়া গেল বলে এবং তার চেয়েও বড় কথা, ছ বছরের আনন্দীর বুঝ-সমঝ আছে দেখে। বাপকা ব্যাটা না হলেও তার ঘোড়া তো নিশ্চয়ই। জোর গলায় হেসে বললেন, কুছ পরোয়া নহি, দাদু, ও বেটি সব-কুছ সম্হালেগি, তার পর বললেন, সমহালেগা। মনে মনে বললেন, দচ্ছাই ভাষা, স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গে ফারাক নেই। তার পর বললেন, সেই তো ভালো। এরা তো আর দিল্লি দরবারে মুশায়েরা করতে যাবে না যে ভাষাতে পয়ষট্টি রকমের বয়নাক্কার প্রয়োজন। ওই করেই তো আমাদের সব গেল। তার পর মনে পড়ল, কই, তাই-বা কেন? মাহমুদ বাদশাহ তো তাঁর সভাপণ্ডিত ফিরদৌসির সঙ্গে বয়েৎ-বাজি করতেন। তাঁর রাজত্ব তো যায়নি। বাহাদুর শা গালিবের সঙ্গে করলেই-বা কী দোষ! ফারসির কথাতে তখন মনে পড়ল, সে ভাষাতেও তো পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গের তফাৎ নেই। বিরক্ত হয়ে তখন বললেন, কী আশ্চর্য! চলছি ডোমবস্তির মধ্যিখান দিয়ে, আর স্বপ্ন দেখছি গজনির। অন্-নশূ শারও এর চেয়ে ভালো। আমাকে এখন দেখতে হবে, ছেলেটার পেটে ক্রিমি।
গুল বাহাদুর পড়েছেন এ বাবদে বিপদে। ক্রিমির নুসখা (প্রেসক্রিপশন) তিনি দু মিনিটেই লিখে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা লিখতে পারেন উর্দু কিংবা ফারসিতে। এবং তার জন্য যেতে হবে ইউনানি দাওয়াখানায়, হেকিমের কাছে। এ তল্লাটে তো এসব জিনিস থাকার কথা নয়। আর বোষ্টম বাবাজি লিখবেন ফারসি নুসখা! যদিও গুল বাহাদুর জানতেন, বৃন্দাবন অঞ্চলের বাবাজিরা ফারসিতে ইউনানি নুসখা বিলক্ষণ লিখতে জানেন।
গুল বাহাদুরের ভুল নয়। চৈতন্যদেব ইসলামি শাস্ত্রের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি একাধিকবার ইসলামি শাস্ত্র দিয়েই মোল্লাদের কাছে প্রমাণ করেন যে তার প্রচলিত ধর্ম ইসলামের মৌলিক সিদ্ধান্তের সম্মতি পায়।
আনন্দী বলল, দাদু, ওই দেখ হলদে পলাশ।
ততক্ষণে তারা গ্রামের বাইরে চলে এসেছেন। আর একটু দূরেই গুল বাহাদুরের রাজপ্রাসাদ।
দূরদূরান্তে চলে গেছে লাল খোয়াই। বাঁ দিকের উঁচু ডাঙা ভেঙে ভেঙে চলেছে খোয়াইয়ের অগ্রগতি। গুল বাহাদুরের আপন দেশ দোয়াবে প্রকৃতির হাত থেকে মানুষ অহরহ অনুর্বর জমি সওগাত পাচ্ছে চাষের জন্য, আর এখানে খোয়াইয়ের খাই আধা-বাঁজা আধা-ফসলের জমির উপর। খোয়াইটা চলে গিয়েছে কতদূরে প্রকাণ্ড একটা লাল সাপের মতো এঁকে-বেঁকে। মাঝে মাঝে ডাঙার ফালিটুকরো এসে যেন সাপের খানিকটে গতিরোধ করছে। ফের যেন অজগরের গ্রাসটা আরও বড় হয়ে আরও দূরে এগিয়ে গিয়েছে।
সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিটুকুও যেন এ খোয়াই শুষে নিতে জানে। খোয়াইয়ের শুরু থেকে সূর্যাস্তের মোকাম পর্যন্ত গাছপালার কোনও বালাই নেই। পাতার আড়াল থেকে বিকেলের আলোটুকু এখানে এসে কোনও কালো কেশে পড়ে না। সাঁওতালিনীরাও সন্ধের পরে ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না।
কিন্তু মাধুর্য আছে– সে মাধুর্য রুদ্রের।
কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) যে বর্ণনা কুরান শরীফে আছে সেটিও রুদ্র-মধুর, আশ্চর্য! আল্লাতালা মানুষের মনে ভয় জাগাবার জন্য কিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন কুরানে, কিন্তু তার প্রকাশ দিয়েছেন কাব্যরসের মারফতে। কেন? সোজা কথা। ঐতিহাসিক যখন লড়াইয়ের খবর লিপিবদ্ধ করে কত হাজার লোক মরল তার বর্ণনা দেয়, তাতে তো মানুষ ভয় পায় না। কারণ তাতে কাব্যরস নেই। ভয় অনুভূতি-বিশেষ। সেটা জাগাতে হলে কাব্যরসের প্রয়োজন। ইতিহাসের শুকনো ফিরিস্তি থেকে মন করে জ্ঞানসঞ্চয়, তাতে ভয়সঞ্চার হয় না।
এই রুদ্র-রসই এখন গুল বাহাদুরের জন্য প্রশস্ত।
ভাগ্যিস, তাঁকে পূর্ব-বাঙলার ঘনশ্যাম, কচিসবুজ, শিউলিভরা, শিশিরভেজা, পানাঢাকা বেতেসাজা পূর্ব-বাঙলার আশ্রয় নিতে হয়নি।
গাঁয়ের শেষ গাছ পেরিয়ে এসে তার খেয়াল গেল আনন্দী যেন কী একটা বলেছে। শুধালেন, কী বললে, দাদু?
পিছনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওই যে, হলদে পলাশ!
পলাশ হলদে হতে পারে, বেগুনি হতে পারে, সবুজও হতে পারে, এই হল গুল বাহাদুরের ধারণা। কিন্তু তাঁর মনে তবু ধোকা লাগল। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে আসবার সময় দু-চারটে ফুলগাছ তারা পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু আনন্দী কিছু বলেনি। এখনই-বা বলছে কেন? এ গাছটার তেমন তো কিছু জৌলুসও নয়। মাত্র গোটা পাঁচ গুচ্ছ ফুল ফুটেছে। গাছটাও বেঁটে। যেন থাবড়া মেরে চেপটে দেওয়া। এর তুলনায় গাঁয়ের ভিতরকার শিমুলে তো ডালে ডালে ফুল ছিল অনেক বেশি। বললেন, পলাশ– উয়ো তো ফুল। হলদে পিলা। তো ক্যা হল?।
আনন্দী কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে বলল, সব পলাশ লাল, এটা হলদে। বলে সে আঙুল দিয়ে গাঁয়ের ভিতরকার উঁচু উঁচু গাছের লাল পলাশ দেখিয়ে দিল।
এতক্ষণে বীরভূমের বৃক্ষ-বৃত্তান্ত বাবদে আকাট অগা গুল বাহাদুরের খেয়াল হল, তাই তো, আর সব পলাশ লাল, এটা হলদে।
উদ্ভিদতত্ত্বে এই তাঁর প্রথম পাঠ। আনন্দীর কাছে। বললেন, চলো দুটি ফুল পেড়েই নিই।
ছ বছরের ছেলে আনন্দীর উল্লাসের অন্ত নেই। বাপ যদিও বলেছিল, বাবাজিকে ডরাসনি তবু তার মন থেকে ওঁর সম্বন্ধে ভয় কাটেনি। একে তো গম্ভীর লোক, তার ওপর ওই যে দুশমনের মতো বদমেজাজি ঝিঙেও যার পায়ের কাছে বসে ভয়ে কাঁচুমাচু তার সঙ্গে সাহস করে কথা কওয়া যায় কী প্রকারে। তবে তার শিশুবুদ্ধি শিশুযুক্তিতে একটা ভরসা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল। সেটা কী? বাবাজিও বাতাসী বুড়িকে ডরায়। দ্বিতীয় ভরসা পেল এখন। যখন বলল, চল, দুটো ফুল পাড়ি। তার বাপ তাকে ভালোবাসত। তার সম্বন্ধে আনন্দীর কোনও ভয় ছিল না, কিন্তু তাকেও ফুল কুড়োতে বললে ঘাড় বাঁকিয়ে বলত, যা যা, খেলা করগে যা।
ফুল পাড়তে পাড়তে গুল বাহাদুরের মনে পড়ল, গুল অর্থাৎ ফুল আর প্রাচীন ফারসিতে অগ অর্থ জল গোলাপ আর জোলাব একই শব্দ। আরবি ভাষায় গ আর প নেই বলে আরবিতে গোলাপ লেখা হয় জোলাব। বিরেচক অর্থে। ছেলেটাকে তাই খাওয়ালেই হবে। কিন্তু এই অজ জায়গায় গোলাপ পাওয়া যাবে কি?
আনন্দীকে শুধালে বহুদূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বোঝাল ওখানে পাওয়া যায়। কিন্তু যেভাবে ইশারা করল তাতে সে দূরের গ্রাম হতে পারে, বেহেশতের গুল-ই-স্তান, ফুলের বাগানও হতে পারে।
.
০৪.
এতক্ষণে গুল বাহাদুর আসলে ভাবনা নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত পেলেন। ছেলেটা নিশ্চিন্ত চেহারায় ঘুমুচ্ছে দেখে তিনি ফিরে গেলেন সকালবেলাকার ঠেলে রাখা সমস্যাগুলোতে।
শিবু মোড়ল বুঝতে পেরেছে তিনি বৈরাগী নন, তিনি যে মুসলমান সেটা জানত না। কিন্তু আর কেউ বুঝতে পেরেছে কি? আর ওই ঘোষালই-বা কে? সেই বর্ধমানের ওপারের লোকটাই-বা ওখানে এল কোথা থেকে? তাকেই-বা খুঁজে পাওয়া যায় কী করে?
অনেক চিন্তা করেও তিনি কোনও হদিস পেলেন না। এমনকি ঘোষাল পদবি যে ডোমের হয় না, ওটা ব্রাহ্মণের পদবি এবং অতএব কাছেপিঠে ব্রাহ্মণ পরিবার আছে, অর্থাৎ শিক্ষা-সভ্যতার পত্তনও আছে, এইটুকু পর্যন্ত গুল বাহাদুর বিচার করে ধরতে পারলেন না।
তবে শিবু যখন বলেছে সাবধান, তখন তার অর্থ তাড়াহুড়ো করলে বিপদের সম্ভাবনা। আর এখন তো বর্ধমান যাওয়ার কোনও কথাই ওঠে না। এ দেশের আচার-ব্যবহার এ ক মাসে শিখেছেন কতটুকুই-বা? ডোমদের ভালো করে চিনে নিতে পারলে পরে ডোম সেজে চলাফেরা করা যাবে। তার আগে শিখতে হবে ওদের ভাষা। এ-যাবৎ তাতেও তো খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
আর এই ডোমদের নিয়ে তিনি করবেন নতুন গদর। দেশ কী, রাজা কারে কয়, ইংরেজ যে শয়তান ভিন্ন অন্য কোনও প্রাণী নয়– এসব খবর তো এরা কিছুই রাখে না। পেটের ধান্দায় এদের কাটে সুবো-শাম। খুব যে তারা শান্ত এ কথা বলা চলে না, কিন্তু জীবন-মরণ পণ করে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে যাবার মতো ধাতু কি এদের শরীরে আছে?
কিন্তু থাকবেই না কেন? গজনির মাহমুদ, ঘোরের মুহম্মদের আমলে গ্রামাঞ্চলের পাঠানরা কি এদের চেয়ে বেশি সঙ্গিন জঙ্গিলাট ছিল? কিংবা বাবুরের আমলে ফরগনা বদখশানের আশপাশের গামড়িয়ারা? কিংবা হাতের কাছের মারাঠারা? একবার কী একটা সামান্য গুজব রটাতে এই দিল্লিবিজয়ী বীরের দল দিল্লি থেকে যেন পালাবার পথ পায়নি। ঐতিহাসিক খাফি খান ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, তখন দিল্লির এক বুড়ি নাকি একাই তিনজন মারাঠাকে নিরস্ত্র করেছিল। ঐতিহাসিক খুশ হাল চন্দও বলেছেন, তারা নাকি তখন হাতিয়ার-তলোয়ার ফেলে দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো মাগো, ওমা বলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। কিন্তু এসব কাহিনীর বিশ্বাস করা যায় কতটুকু? দিল্লি একদিন এদের হাতে খেয়েছিল মার। সেই বেইজ্জতি ঢাকবার জন্য পরবর্তী যুগে হয়তো তিলকে তাল বানিয়েছে।
তা বানাক, আর না-ই বানাক, এরাই তো একদিন সাহস করে আবদালির মুকাবেলা করেছিল। অবশ্য লড়াইয়ের আগের রাত্রে মারাঠা সেনাপতি ভাবসাহেব আপন রোজনামচায় লিখেছিলেন, আমাদের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছে। কাল অবশ্য-মৃত্যুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমরা মারাঠারা তো কখনও সম্মুখযুদ্ধ লড়িনি; আমাদের রণকৌশল, শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করে তার যথাসম্ভব ক্ষতি করে পালিয়ে যাওয়া বার বার। সর্বশেষে তার সর্বস্ব লুঠ করা।
এ সব-কিছু ভাবসাহেব সত্যই লিখেছিলেন কি না, সে কথা গুল বাহাদুর জানতেন না। তবে এ কথা জানতেন, মারাঠারা সম্মুখসংগ্রাম সবসময়ই এড়িয়ে চলে।
কিন্তু একথাও অতি অবশ্য ঠিক, ভাবসাহেব অবশ্য-মৃত্যু জেনেও আবদালির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধই লড়েছিলেন। কেন লড়েছিলেন? পেশওয়ার হুকুমে। তাঁর প্রতি আনুগত্য বশ্যতার দরুন। তাঁর নুন-নেমক খেয়েছি। সে নুনের শেষ কড়ি শোধ না করে দেশের লোকের সামনে মুখ বের করব কী করে? কিন্তু দিল্লির বাদশার প্রতি বাঙালি ডোমের কী আনুগত্য, কী বশ্যতা?
তবে কি এদের তাতাতে হবে বাবুর কিংবা মাহমুদের মতো লুঠতরাজের লোভ দেখিয়ে? তার সরল অর্থ দিল্লির বাদশাহর খেদমত করতে গিয়ে তারা করবে দিল্লি লুঠ! এ তো চমৎকার ব্যবস্থা!
তখন বড় দুঃখে তার মনে পড়ল, গদরের সিপাহিরাও বেপরোয়াভাবে যত্রতত্র লুঠতরাজ করেছে। যাদের জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম লড়েছে, লুঠ করেছে তাদেরই। কী মূল্য সে স্বাধীনতার।
গুল বাহাদুরের মাথা গরম হয়ে উঠল। সুরাহির জল ঢেলে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবলেন, যারা গদর ইনকিলাব করে তারা অতশত ভাবনা-চিন্তা করে না। তিমুর- নাদির বিজয়-অভিযান আরম্ভ করার পূর্বে বু আলী সিনা কিংবা আবু রুশদের দর্শন আর তর্কশাস্ত্রের কেতাব-পুঁথি নিয়ে বিদ্রি যামিনী যাপন করেন না।
ইংরেজ এ দেশের দুশমন, এ দেশের বাদশার দুশমন। তাকে খেদাতে হবে। কীভাবে তাড়াতে হবে তার জন্য মোল্লা-মৌলবির কাছ থেকে ফতোয়া আনবার প্রয়োজন নেই। তা হলে পাড়ার পদী পিসির কাছেও যেতে হয়। তিনি ইতু ঘেঁচুর পুজো-পাটা করে দিন-ক্ষ্যাণ বাৎলে দেবেন– তবে হবে অভিযান শুরু! তওবা, তওবা!! শয়তানের খুন পিনেওলা তলোয়ারকে পয়মন্ত করতে হবে চড়ুইপাখির ন্যাজের পালক দিয়ে!
কিন্তু একটা জিনিস সর্বক্ষণ গুল বাহাদুরের মনে পীড়া দিচ্ছিল। এই যে ছদ্মবেশ পরে আত্মগোপন করে থাকাটা, এভাবে কাপুরুষের মতো কতদিন প্রাণ বাঁচিয়ে থাকতে হবে? দেশ স্বাধীন করার জন্য একটা বড় আদর্শ সামনে ধরেছি বলে এই নীচ আচরণ সর্বক্ষণ হজম করে চলতে হবে? ডোমকে তাতানোর জন্য লুঠতরাজের লোভ কেউ দেখালে সেটা না হয় বরদাস্ত করে নিলুম কিন্তু নিজে একটা নীচ আচরণ করব–এ চেঁকি ঢোঁক গিলে হজম করি কী করে? তা-ও একদিন নয়, দু দিন নয়–কত বছর ধরে কে জানে?
চুলোয় যাক্ গে অত ভয়। চুলোয় যাক গে শিবুর হুশিয়ারির পরামর্শ। আমি বেরুব ঘোষালের সন্ধানে।
কিন্তু ইতিমধ্যে একটা কাজে ডুব না মারলে চিন্তা করে করে পাগল হয়ে যাব যে।
কাজও এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ল তার ঘাড়ে।
শিবুর খেতখামার ছিল সামান্যই কিন্তু গুল বাহাদুরের পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট। সেসব সামলাতে গিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন এক নতুন ভুবনে। এটা ধরলে ওটা হাতছাড়া হয়ে যায়, ছাগল দুটোকে সামলাতে গাইটা নাপাত্তা হয়ে যায়। মরাইয়ের ইঁদুর মারতে হলে বেড়াল পুষতে হয়, বেড়ালকে পেট ভরে খেতে দিলে সে আবার ইঁদুর মারার প্রয়োজন বোধ করে না। পচা গোবরের গন্ধে মাথা তাজ্জিম তাজ্জিম করে, অথচ সে গোবরের বরবাদ হবে তা-ও প্রাণ সইতে পারে না।
ইতিমধ্যে ঝিঙে এসে খবর দিল একপাল সাঁওতাল কোশখানেক দূর নদীপারে আস্তানা গেড়েছে। ওদের দিয়ে একটা নতুন আবাদ করানো যায় কি না।
গুল বাহাদুর লম্ফ দিয়ে উঠলেন। এ একটা কাজের মতো কাজ বটে। এ বিষয়ে তাঁর কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতাও আছে। ভাওলপুর না পাটিয়ালা কোথা থেকে একপাল মেয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পালমে, যেখানে বাবুর শাহের পাথরের তৈরি সরাই– তারই পিছনে। তারই চাচা দানিশমন্দ খান তাদের দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটা সুন্দর আবাদ। চাচার সঙ্গে থেকে থেকে তিনি তখন শিখেছিলেন অনেক কিছু। আজ দেখা যাবে চাচাকা ভাতিজা সে এলেমের কিছুটা স্মরণ রেখেছে কি না।
কিঞ্চিৎ অর্থের প্রয়োজন। শিবুর কলসির তলায় পাওয়া গিয়েছে, শ-আড়াই টাকা। এত টাকা শিবু পেল কোথায়? তবে কি গুপ্তি ডাকাতি করত? তা আসুক সে টাকা জাহান্নাম থেকে। ওই দিয়ে আবাদ আরম্ভ করা যাবে অক্লেশে। তার পর বরাত। আল্লা ভরসা।
প্রথম দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গুল বাহাদুর আনন্দীকে সেলাম করে বললেন, হুজুর, আজ থেকে আপনি জমিদার। আপনাকে সমঝে চলতে হবে।
জমিদার হওয়ার রৌদ্ররস আনন্দী জানে না কিন্তু সে চালাক ছেলে। গুল বাহাদুরের মেজাজ আজ খুশ দেখে সে কোলের কাছে ঘেঁষে এসে বলল, দাদু, আমাকে কেঁদুলীর মেলায় নিয়ে যাবে?
গুল বাহাদুরের প্রাণ-যমুনায় তখন আনন্দের উজানতরঙ্গ লেগেছে। আনন্দী তখন শয়তানের জন্মভূমি বিলেত যেতে চাইলেও তিনি তখন ঘিনপিত বাদ দিয়ে সেখানে তাকে নিয়ে যেতেন। শুধালেন, সে কোথায়?
বলল, অনেক দূরে। ওই হোথা অজয় দিয়ে।
.
শীতের শেষে অজয়ের পারে কেঁদুলীর মেলা। বাঙলা দেশের হাজার হাজার বাউল সেখানে জমায়েত হয়ে তিন রাত ধরে আউল-বাউল-কেত্তন গান গায়। কেনা-কাটাও হয় প্রচুর।
সেখানে গুল বাহাদুরের আরেক অভিজ্ঞতা।
এই যে হাজার হাজার ষণ্ডামার্কা লোক দিনরাত্তির ধেই ধেই করে নৃত্য করছে খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমুচ্ছে, কোনও কিছু করছে কম্মাচ্ছে না, সমাজের তোয়াক্কা করে না, ধর্মের নামে অকাতরে গরিব-দুঃখীদের অনে ভাগ বসাচ্ছে, দরকারে অদরকারে একে অন্যে কামড়াকামড়ি পর্যন্ত করছে– এ তামাশা তৈরি করল কোন মহাজন? কার আদেশে এরা এসব করে, কার হুকুমে গৃহী এদের সব-কিছু জোগায়? এর কী অর্থ, কী মূল্য?
অথচ গুল বাহাদুরের চট করে মনে পড়া উচিত ছিল যে, মুসলমান পীর দরবেশরাও ঠিক এই কর্মই করে থাকে, তারই হীরের টুকরো দিল্লি শহরে– নিজামউদ্দীনের দরগায়, মেহেরৌলীর কুত্ত্বসাহেব, নাসিরউদ্দীন চিরাগ-দিল্লির আস্তানায়। সেখানেও তো বাউণ্ডুলে খোদার খাসিরা ঠিক এদেরই মতো ধেই ধেই করে নৃত্য করে। যিশুখ্রিস্টের ভাষায়, তারাও সুতো কাটে না, মেহন্নতও করে না। এবং তাই শুধু নয়, এখানকার এই বাউলদের ভিতর আছে মুসলমানও।
ছেলেবেলা থেকে আপন ধর্মে যেসব জিনিস গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, সেগুলো একটু ভিন্ন বেশে দেখা দিলেই মানুষ চমকে ওঠে। তার পর হুঁশ হয়, দুটোই হুবহু এক বস্তু। এ-ও যা, ও-ও তা। কালীঘাটের পাঁঠা কাটাতে আর ঈদগার পাশে গরু জবায়ে তফাৎ কী? গুরুকে মাথায় তুলে তাকে অবতার বলা, আর পীরের পায়ে চুমো খেয়ে তাকে আল্লার নূর বলে আত্মতৃপ্তি পাওয়া একই, একই, সম্পূর্ণ একই জিনিস।
গুল বাহাদুরের মনে যখন এ চৈতন্যের উদয় হয় তখন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাজ্জব মুলুক হিন্দুস্তান। এই এদের আমরা যুগ যুগ ধরে শিরতাজ, মাথার মুকুট করে পরে আসছি আর এদের মনের কোণে কণামাত্র উদ্বেগ নেই এদেশের লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে। এদের কাছে আমরা সব মায়াবদ্ধ জীব (ফানি দুনিয়ার ক্রিমি), আমরা মরলেই কী, বাঁচলেই কী! ইয়া আল্লা মেহেরবান। তোমার কেরামতি বুঝে ওঠা ভার। এ সংসার থেকে মুক্তি পাওয়াই যদি মানব-জীবনের চরম আদর্শ হয় তবে এ সংসারে তুমি তাকে পাঠালে কেন?
.
হঠাৎ খেয়াল গেল, আনন্দী বাউলদের অনুকরণে ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো কোমরে বেঁধে এক হাত উপরের দিকে তুলে অদৃশ্য একতারা ধরে নাচছে। দিলেন এক ধমক। শিবুর কথামতো একে ভদ্রলোক না হয় না-ই বানালুম, কিন্তু একে কখনও বৈরাগী হতে দেব না।
কী রে আনন্দী, কী রকম আছিস?
গলা শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখেন–বাঙালি বাবু। লম্বা লিকলিকে চেহারা, গৌরবর্ণ, সরু বাঁকা নাক, বাদামি–প্রায় নীলরঙের দুটি হাসি-হাসি চোখ, উপরের ঠোঁটটি চাপা–নিচেরটি ডপকী হুঁড়িদের মতো একটু পুরুষ্টু এবং রস-ভরভর, পানের লাল না এমনিতেই লাল ঠিক বোঝা গেল না, একমাথা কোঁকড়া বাবরি চুল কিন্তু একেবারে রুক্ষ শুষ্ক, পরনে কটকি জুতো, ধুতি, মেরজাই আর কাঁধের উপর বীরভূমি কেটের চাদর।
বললেন, এই যে বাবাজি, ঝিঙের মুখে তোমার কথা শুনলুম।
গুল বাহাদুর অচেনার আগমনে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, বসুন। মনে মনে ভাবলেন, ঝিঙের মুখে? তবে কি শিবু কিছু বলেনি!
গদরের সেপাইদের মধ্যে একে অন্যকে পরিচয় দেবার জন্য গোপন সংকেত ছিল হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে শরীরের কোনও এক জায়গায় কেমন যেন আনমনে আস্তে আস্তে চক্কর কেটে যাওয়া– তারা যে গোল চাপাটি দিয়ে খবর পাঠাত তারই অনুকরণে। গুল বাহাদুর মাটিতে বসে তার আপন হাঁটুর উপর যেন বেখেয়ালে চক্কর আঁকতে লাগলেন।
বাবুটি চমকে উঠে আপনি হাঁটুতে একটা চক্কর একেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চল।
দু-জনা নদীপাড়ের বটগাছতলায় বসলেন।
পূর্ণিমা রাত্রি। সামনে, উঁচু পাড়ির অনেক নিচে অজয়ের ক্ষীণধারা। তার গতিবেগ প্রায় নেই। যেন মরা অজগর সাপ শুয়ে আছে। চাঁদের আলোতে তার আঁশ যেন চিচিক্ করছে। দু-একটি মেয়েছেলে সেই আঁশ যেন আঁজলা আঁজলা করে মাথায় মাখছে। তাদের কালো চুল থেকে ছোট ছোট ঝরনা চিক্ চিক্ করে পড়ছে। জলের ওপারে বিরাট বালুচরের আরম্ভ। তার পর কাশের ঝোঁপ, নিচু পাড়, যাত্রীদের আস্তানা সবকিছু চাঁদের আলোতে স্নান কুয়াশার হিমিকার গ্লানিতে মিশে গিয়েছে। মেলার কোলাহলকে শান্ত নদীর নৈস্তব্ধ্য এখানে গ্রাস করে ফেলেছে।
গুল বাহাদুর বললেন, জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ।
জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ। জিন্দাবাদ কুমার সিং।
কুমার সিং?
.
০৫.
অনেকক্ষণ ধরে দু-জনাই চুপ। একে অন্যের সঙ্গে এই তাঁদের প্রথম পরিচয়, কিন্তু বাহাদুর শাহ আর কুমার সিং যেন তাদের হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে দিলেন, যেন কত দিনকার পরিচয়। দীর্ঘ বিরহের পর মিলন হলে মানুষ যেমন একে অন্যের নিঃশব্দ সঙ্গসুখ প্রথমটায় শুষে নেয়, এদের বেলা তাই হল।
একবার কথা আরম্ভ হলে সে সুখ যেন ক্ষীণ হয়ে আসে।
গুল বাহাদুর বললেন, সব খতম!
সব খতম। কিন্তু আবার সব শুরু।
দু-জনায় আবার চুপ।
গুল বাহাদুর বললেন, আমি দিল্লি থেকে এসেছি। আমার নাম—
থাক। নামের প্রয়োজন হলে পরে শুধিয়ে নেব। আমি ঘোষাল।
গুল বাহাদুর বললেন, বুঝেছি।
আশ্চর্য হয়ে ঘোষাল শুধাল, কী করে?
শিবু বলেছিল। আমার কথা আপনাকে বলেনি?
না। বোধহয় সময় পায়নি।
গুল বাহাদুর আফসোস করে মনে মনে ভাবলেন, এরকম একটা বিচক্ষণ লোক চলে গেল। বেঁচে থাকে শুধু গাধা-খচ্চরগুলো।
ঘোষাল বললেন, শোন, আমার কথা সব বলি।
এবার ঘোষাল অতি বিশুদ্ধ উর্দুতে আপন বক্তব্য আরম্ভ করলেন।
আমি ছেলেবেলায় পালিয়ে যাই বেহারে। সেখানে অনেক জায়গায় কাজকর্ম করি– এমনকি ইংরেজের সঙ্গেও। শিউরে উঠ না। পরে বুঝবে। ওদের সঙ্গে কাজ না করলে আমি কখনও এরকম গভীরভাবে বুঝতে পারতুম না, এরা কী বজ্জাৎ, কী ধড়িবাজ। কিন্তু সেকথা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার দরকার এখন নেই। তুমি ফারসিতে যেসব বই পড়েছ, আমিও পড়েছি সেগুলোই। আমরা ব্রাহ্মণ কিন্তু আমাদের বংশে বহুকাল ধরে চলে আসছে ফারসির চর্চা। কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েলুম ইতিহাস চর্চার ফলে নয়। আমার পূর্বপুরুষরা পাঠানদের হয়ে মোগলের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন পূর্ব-বাঙলায়। হেরে গিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেন, বীরভূমে। জাহাঙ্গীর, শাজাহান, ঔরঙ্গজেব ব্যস্– মাত্র এই তিন বাদশাহর আমলে বাঙলা পরাধীন ছিল, অর্থাৎ দিল্লির হুকুমমাফিক চলেছে। তার পর আমরা আবার সরকারি কাজ করেছি। তার পর এল ইংরেজ। পলাশী থেকে এই একশো বছর আবার আমরা বাড়ি থেকে বেরোইনি।
গুল বাহাদুর অনেক কিছুই জানতেন না। এই ন মাস ধরে তিনি চিনেছেন শুধু ডোম আর সাঁওতালদের। এদেশেও ব্রাহ্মণ আছে, এ কথা তিনি মোটামুটি জানতেন। কিন্তু তারা যে গদরে লড়ে এ খবর তার জানা ছিল না। দিল্লির ব্রাহ্মণেরা পরে চুড়িদার পাজামা, লম্বা শেরওয়ানি, আর মাথায় কিস্তিটুপি। তারা করে পুরুতের কাজ। বিয়ে-শাদিতে এসে মন্ত্রফ পড়ায়– তা-ও সে-মন্ত্র কাগজে লিখে আনে ফারসি হরফে। তারা আবার লড়াই করে কী করে? লড়াই তো করে রাজপুতরা, মারাঠারা, ক্ষত্রিয়রা। তা সে যাক গে। তাঁর মনে তখন লেগেছে আর এক ধোকা। শুধালেন, তোমরা কি শুধু বাঙলার স্বাধীনতা চাও? বাহাদুর শাহকে শাহ-ইন-শাহ বলে মানো না?
ঘোষাল বললেন, ওই তো আরম্ভ হয়ে গেল, হিন্দুস্থানবাসীদের ঝগড়া-কাজিয়া। এসব কথা পরে হবে। উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ না, আমাদের ভিতর মিল বেশি, অমিল কম। যদি খুশি হও, তবে না হয় মেনেই নিলুম তোমার বাহাদুর শাহকে। কুমার সিংকে তো মেনেছিলুম। তোমাকেও মানছি। সবাইকে মেনে নেব– দরকার হলে এবং হবেও। তুমি কি মনে কর, আমরা জিতলে সেই পুরনো মোগলাই রাজত্ব আসবে– বাহাদুর শাহকে বাদশা করতে পারলেও? না বাবাজি, দেশের হাওয়া বদলাচ্ছে। বাবুর বাদশাহর মতো রাজত্ব বাহাদুর কখনও করেননি, আর কখনও কেউ পারবে না।
গুল বাহাদুর শুধালেন, আপনারা হেরে গেলেন কেন?
ঘোষাল হাতজোড় করে বললেন, ওই একটি প্রশ্ন শুধিয়ো না। এর উত্তর দিতে গেলে আবার নতুন করে সেই মর্মন্তুদ পীড়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয়, যা ভুলতে পারা একটা জীবনের কর্ম নয়। কোন কোন ভুল না করলে আমরা জিতে যেতুম সে প্রশ্নও তুলো না। আমি নিশ্চয়ই জানি, সে ভুলগুলো না করলে পরে অন্য ভুল করতুম। না বাবাজি, গলদের মূল উৎস কোথায় ছিল তখনও বুঝতে পারিনি, এখনও পারিনি। আমরা এখানে পাথরচাপা দিয়েছি তো ওদিক দিয়ে জল বেরিয়েছে, সেখানে পাথরচাপা দিয়েছি তো অন্য দিক দিয়ে বেরিয়েছে। সর্বাঙ্গে ঘা, মলমফ লাগাই কোথায়?
এখন তবে কর্তব্য কী?
ঘোষাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, বিলকুল কোনও ধারণা নেই। এখনও মনে মনে জমা-খরচ মিলাচ্ছি। তুমি এসেছ, ভালোই হয়েছে। দিল্লি ফিরে যাচ্ছ না তো?
প্রশ্নটা যেন নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে জিগ্যেস করা হল। ঘোষালই জানতেন এর উত্তর। গুল বাহাদুরও কোনওকিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
ঘোষাল বললেন, ছদ্মবেশটা মন্দ ধরনি। বাঙলাটাও খুব যে মন্দ শিখছ তা-ও নয় কিন্তু ডাহা ডোম-ডুমে। এই বেলা ওটাতে লেখা-পড়াও আরম্ভ করে দাও। নিজেই করে নিতে পারবে। কোনও ভাবনা নেই। ওতে সাহিত্য বলে কোনও বালাই নেই। আশ্চর্য, সাতশো না আটশো বছর ধরে বাঙলাতে বই লেখা আরম্ভ হয়েছে অথচ একগণ্ডা কবি বেরোয়নি যাদের ইরানি কবিদের সামনে দাঁড় করানো যায়। ফারসিতে তিনশো বছর যেতে-না-যেতেই ফিরদৌসি, হাফিজ, সাদি, রুমি, আত্তার, নিজামি, আরও কত কে?
গুল বাহাদুর মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললেন, বাঙালিরা হয়তো মনে করে, তাদের কবি হাফিজ-সাদির চেয়ে বড়।
ঘোষাল তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, তা করতে পারে। সাঁওতালরা হয়তো মনে করে, তাদের তীর-ধনুক নিয়ে বন্দুক-কামানের সঙ্গে লড়া যায়।
তুলনাটার ঢপ দেখে গুল বাহাদুর একটু হাসলেন।
ঘোষাল বললেন, হাসলে? তা হাস। আমারও বলার বিশেষ হক্ক নেই। আমিও তেমন কোনও চর্চাও করিনি। কিন্তু জানো, সাতশো বছর বাঙলা চর্চা করার পর তারা গদ্য লিখতে আরম্ভ করেছে এই মাত্র সেদিন। পঞ্চাশ বছরও হয়নি। ওই যে রাজা রামমোহন রায়
গুল বাহাদুর চমকে উঠে বললেন, কে?
রাজা রামমোহন রায়। চেন না কি?
গুল বাহাদুর বললেন, হ্যাঁ, আমার পিতার কাছে শুনেছি, বাদশাহ দুসরা আকবরের চিঠি নিয়ে তিনি বিলেত গিয়েছিলেন। আমি তো শুনেছি, উনি জানতেন অতি উত্তম ফারসি এবং আরবি।
ঘোষাল বললেন, তা তিনি জানতেন। এদেশের মুসলমান পণ্ডিতরা তাঁকে নাম দিয়েছেন জবরদস্ত মৌলবি। তার পর একটু অবজ্ঞার সুরে বললেন, লোকটা মৌলবিই বটে। ধর্ম সম্বন্ধে বই লেখে। ফারসিতে একটা লিখেছে। আমার কাছে বোধহয় এখনও আছে। কিন্তু ধর্মে আমার রুচি নেই। তাতে কিছু এসে-যায় না। কিন্তু তাজ্জব কি বাৎ, লোকটা দেশের সবাইকে ইংরেজি শেখাতে চায়।
সে কী?
আশ্চর্য! আরবি-ফারসির রস চেখেছে, শুনেছি ইবরানি সুরয়ানি ইস্তেক (হিব্রু, সিরিয়া) জানে– তার পর এই রুচি! ইংরেজ ব্যাটারা তো পায়খানা ফিরে জল পর্যন্ত থাক্ গে। জানো বাবাজি, এক ব্যাটা ইংরেজের সঙ্গে আমাকে একদিন নিতান্ত বাধ্য হয়ে হাত-নাড়ানাড়ি করতে হয়েছিল। হাতে যেন এখনও গন্ধ লেগে আছে। বেসন দিয়ে কত মেজেছি, ঝামা দিয়ে তার চেয়েও বেশি ঘসেছি।
বলে ডান হাতখানা অতি সন্তর্পণে নাকের ইঞ্চি তিনেক সামনে ধরে দু বার কে বলে উঠলেন, তৌবা তৌবা! এখনও গন্ধ বেরুচ্ছে।
গুল বাহাদুর সহানুভূতির সুরে বললেন, আমিও পাচ্ছি। তা ওই অপকর্ম করতে গেলেন কেন?
সাধে? ওই করে তো সম্বন্ধীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আর পাঁচজনের চোখের আড়াল করলুম। ঘোষাল চুপ করে গেলেন।
গুল বাহাদুর শোধালেন, তার পর?
ঘোষাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উদাস সুরে বললেন, তার পর কে কোথায় যায় সে তো আল্লাই জানেন। কেউ যায় বেহেস্তে, কেউ যায় দোজখে, কেউ যায় বৈকুণ্ঠে, কেউ যায় কৈলাসে।
সে আবার কোথায়?
বাবাজি, ধরা পড়ে যাবে। বৈকুণ্ঠটা কোথায় সেটা অন্তত তোমার জানা উচিত। বাবাজিরা মরে গেলে বৈকুণ্ঠে যায়– নামাবলীর কার্পেট পেতে তারই উপরে বসে। আরব্য রজনীতে যেরকম আছে। কিন্তু থাক ওসব। ধর্মে আমার রুচি নেই– তোমাকে তো বলেছি।
অনেকক্ষণ পর গুল বাহাদুর শুধালেন, ইংরেজ মেরেছেন; ইংরেজ আপনাকে তালাশ করছে না?
তা করছে, কিন্তু আমি ইংরেজ মারলুম কখন?
গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে বললেন, এই যে বললেন।
তাজ্জব বাৎ শোনালে! অমি বেটাকে নিয়ে গেলুম যেখানে তার বরাতে লেখা ছিল যাবার। তার পর আমাদের সেপাইরা তাদের কাজ করল। আমি কি জল্লাদ?
আপনি তবে কী করতেন?
আমি? আমার কাজ ছিল তাপ্পা, রিপুকর্ম। আজ বন্দুক নেই, জোগাড় কর। কাল বারুদ নেই, ঠ্যালা সামলাও। পরশু খোরাক নেই, আমার নাভিশ্বাস। আরও কত কী? লুঠের মাল বখরা করা, গায়ের লোককে মিথ্যে দিব্যি-দিলাশা দিয়ে তাতানো, চিঠি জাল করা
সে আবার কী?
ইংরেজের গুপ্তচর আমাদের সেপাইদের ভিতর জাল চিঠি পাচার করল, যেন সে চিঠি কুমার সিং ইংরেজকে লিখেছেন আত্মসমর্পণ করে, অবশ্য তার ধনপ্রাণ যেন রক্ষা হয় এই শর্তে। আমি তখন পাল্টা চিঠি জাল করাতুম, ইংরেজ আত্মসমর্পণ করেছে এই মর্মে। সেটা চালিয়ে দিতুম আমাদের সেপাইদের ভিতর। কিন্তু ইংরেজ সেপাইদের ভিতর ভিতর এরকম জালিয়াতি আমরা করতে পারিনি। অতখানি বাঢ়িয়া ইংরেজি লেখা জাল করনেওলা আমাদের ভিতর কেউ ছিল না।
গুল বাহাদুর বললেন, তাই বোধহয় রাজা রামমোহন আমাদের ইংরেজি শেখাতে চান।
ঘোষাল গোসসাভরে বললেন, কচু হবে ইংরেজি শিখে। যেন ইংরেজি চিঠি জাল করতে পারলেই আমরা গদর জিতে যেতুম। যেন কাঠবিড়ালির ধুলো না হলে থাক্ গে– ওসব কেচ্ছা তুমি জান না।
চাঁদ অনেকখানি ঢলে পড়েছে। বাউলদের গীতও ঝিমিয়ে এসেছে।
নদীর জলের রুপোলি ঝিকিমিকি লোপ পেয়েছে, কিংবা সরে গিয়েছে। ওপার থেকে পাড়ি দিয়ে একটা দমকা হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস দু-জনার ভিতর দিয়ে চলে গেল। কিংবা হয়তো গদরেরই দীর্ঘশ্বাস, হায় হায় আফসোস্।
গুল বাহাদুর বললেন, যাক্। তবু ভালো। আমি তো শুনেছিলুম, কুমার সিং সত্যি আত্মসমর্পণ করে ইংরেজকে চিঠি লিখেছিলেন। সেগুলো তা হলে জাল!
ঘোষাল হেসে বললেন, সবকটা জাল হতে যাবে কেন? কিছু সত্যিও ছিল।
গুল বাহাদুর আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী?
নিশ্চয়। যখন দেখলুম, ইংরেজ চিঠি চালাচ্ছেই, তখন আমরাও ইংরেজকে দু-চারখানা লিখে পাঠালুম। নানারকম ভুল খবর দিয়ে। নিছক ধাপ্পা মারার জন্য। ঝাসিও তাই করেছিলেন।
কিন্তু এতে করে যে পরে দেশের লোকের মনে ভুল ধারণা হল, কুমার সিং সত্যি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে ভুল ধারণা সরাবে কে?
দেখ বাবাজি, গদর জিতলে এ ভুল ধারণা থাকত না। আর হারলে তো গাল খাবই। তখন কাজ ছিল লড়াই জেতা। তার জন্য যা প্রয়োজন তাই করেছি। হেরে গিয়েছি সেইটে হল সবচেয়ে বড় গাল। তার ওপর এ-বদনাম তো বোঝার উপর শাকের আঁটি। এবং তার চেয়েও বড় কথা, পকড়ে তলওয়ার দামনকো সম্হালে কোঈ? তলোয়ার নিয়ে হামলা করার সময় রক্তের ছিটে পড়ার ভয়ে কেউ তো কুর্তার অঞ্চল সামলায় না– অর্থাৎ একবার মনস্থির করবার পর ছোটখাটো চিন্তা করতে নেই।
গুল বাহাদুর বললেন, সে তো বিলকুল ঠিক। কিন্তু, ইংরেজ আপনার সন্ধান পাবে কি না, সে-ও কি ওই পর্যায়ের?
ঘোষাল বললেন, প্রায় তাই। কিন্তু আসলে কী জানো, বাবাজি, বেঁচে থাকার ওপর আমি খুব বেশি দাম দিইনে। এই গদরে চলে গেল মানুষগুলো, আর বেঁচে রইল যারা, তাদের আমি দোষ দিইনে, কিন্তু তাদের নিয়ে আমি করব কী? ঝড়ে মোটা আমগুলো ঝরে পড়ে সে তো জানা কথা। আমি নিজে অত্যন্ত সামান্য প্রাণী কিন্তু ওই মহাজনদের সম্পর্কে এসে আমি কয়েক দিনের জন্য কী যে হয়ে গিয়েছিলুম তোমাকে বোঝাই কী প্রকারে? আমি যেন রোগা-পটকা হাড্ডিসার গঙ্গাযাত্রায় জ্যান্ত মড়া হয়ে যাচ্ছিলুম উদ্ধারণপুরের ঘাটে। আমার ঘাড়ে এসে করল ভর এক উড়োনচণ্ডী দানো। আমি উঠলুম লম্ফ দিয়ে, মড়ার খাঁটিয়া ছেড়ে, আর তার পর সে কী তিড়িংবিড়িং ভূতের নৃত্য করলুম কদিন। তখন আমি সব জানি, সব পারি। ওই আনন্দী ছেঁড়াটা তখন যদি আমাকে আব্দার করত, দাদু বেহেস্ত থেকে এনে দাও না আমাকে খুদাতালার কুর্সিখানা, আমি তা হলে একগাল হেসে বলতুম, রঃ। উঁড়া! এনে দিচ্ছি, এ আর এমন কী চাইলি? তার পর দিতুম এক আকাশ-ছোঁয়া লক্ষ। স্বপ্নে যেরকম মানুষ মিন-পাখনায় পায়ের কড়ে আঙ্গুলে অল্প একটু ভর দিলেই হুশ করে উড়ে গিয়ে ঠুকে যায় তার মাথা চাঁদের বুড়ির চরকাতে।
জানো বাবাজি, এ যেন স্বপ্নের মাঝে সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা পেরিয়ে আল্লার পায়ের কাছে ফেরেশতা বনে যাওয়া। আর আমার চতুর্দিকে কুমার সিং আর তার সঙ্গী-সাথী। কী সব বাঘ, কী সব সিংহ। আমরা যেন সবাই, অন্ধ-প্রদীপ। আপন আপন সেজে পলতের মতো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিলুম। এল কুমার সিংয়ের দীপ্ত দীক্ষা। তার আলো আমাদের এক-একজনকে স্পর্শ করে, আর আমরা প্রদীপশিখার মতো জ্বলে উঠি। আবার আমাদের শিখা জ্বালিয়ে দেয় অন্য প্রদীপ। তাই বলছিলুম, এ তো দীপ্ত-দীক্ষা— এ তো স্পর্শদীক্ষা নয়, সে তো সামান্য জিনিস। পরশপাথরের স্পর্শ লেগে লোহা হয় সোনা, কিন্তু সে সোনা তার পরশ দিয়ে অন্য লোহাকে সোনা করতে পারে না, তাই তার নাম স্পর্শ-দীক্ষা, তার মূল্য আর কী?
সে কী দেয়ালি জালিয়েছিলুম আমরা।
আর আজ, অন্ধকার, অন্ধকার– সব অন্ধকার।
হঠাৎ বলা-নেই, কওয়া নেই, ঘোষাল দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁটুতে মাথা খুঁজে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
গুল বাহাদুর স্তম্ভিত। বয়স্ক লোক, বিশেষ করে ঘোষালের মতো কট্টর গদর-প্রাণ লোক যে এরকম বে-এক্তেয়ার হয়ে যেতে পারে, তিনি তার জন্য তৈরি ছিলেন না। গুল বাহাদুর তখনও জানতেন না, বাঙালি কতখানি দরদী, ভাবালু, অনুভূতিপ্রবণ।
তিনি চুপ।
ঠিক যে রকম হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন সেই রকমই হঠাৎ মাথা তুলে হেসে বললেন, কিন্তু আমাকে ধরিয়ে দেবে সেই ইংরেজেরই ভূত। বলে ডান হাতখানা নাকের কাছে এনে বার দুই কে বললেন, তৌবা, তৌবা, এখনও গন্ধ বেরুচ্ছে।
পূর্বের মতো গুল বাহাদুর মমতামাখা সুরে বললেন, আমিও পাচ্ছি।
ঘোষাল উৎসাহিত হয়ে বললেন, তবেই বোঝ ঠ্যালা। ওই ইংরেজ ব্যাটার ভূত এসে ভর করেছে আমার পাঁচ আঙুলে। তারই বোটকা গন্ধ ডেকে আনবে আর পাঁচটা ইংরেজকে, ধরিয়ে দেবে আমাকে। না হলে কে জানবে বীরভূমের ঘোষাল আরা জেলার মহব্বত খান! ভূতই শুধু সব-কিছু জানতে পারে।
গুল বাহাদুর বললেন, ইংরেজ মাত্রই জ্যান্ত ভূত। মরে গিয়ে তার আর হের-ফের হয় না।
ঘোষাল একেবারে ছেলেমানুষের মতো আরও যেন উৎসাহ পেয়ে বললেন, যা বলেছ গোসাই। হিন্দু মরে গিয়ে হয় ভূত, মুসলমান মরে গিয়ে হয় মামদো। কথায় কয়, ভূতের। ওপর মামদোবাজি। অর্থাৎ হিন্দুর ওপর মুসলমানের কেরানি। কিন্তু মামদোর ওপর অন্য ভূত কই? সেরকম কোনও প্রবাদ তো এখনও হল না। তা হলে বাহাদুর শা-র ওপর শেষ পর্যন্ত উপর-চাল মারতে পারবে না তো ইংরেজ। বাবাজি, তোমারই জিৎ। জিন্দাবাদ বাহাদুর শাহ।
গুল বাহাদুর বললেন, তুমি যে বলেছিলে বাঙলাতে কিছুই নেই। কিন্তু ভূতের ওপর মামদোবাজি তত খাসা প্রবাদ।
ঘোষাল গম্ভীর হয়ে বললেন, একেবারে কিছু নেই সে-কথা বলবে কে? একটা জিনিস আছে সেটি মহা মোক্ষম। বাঙলার কেত্তন। হরিবোল, হরিবোল বলে নাচন-কুদন নয়। পদকীর্তন। ওর মতো জিনিস হয় না। ঝাড়া পাঁচশো বছর ধরে হাজার হাজার বাঙালি তার প্রেমের গীত আপন গলায় গায়নি– গেয়েছে রাধার গলা দিয়ে, কিংবা কৃষ্ণের বাঁশির ভিতর দিয়ে। ফারসিতে প্রেমের গান গাওয়া হয়েছে লায়লী-মজনু, শীরীন-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখার ভিতর দিয়ে দেখতেই পাচ্ছ, বিস্তর বখরাদার, ভাগের মা গঙ্গা পায় না, প্রেমটা তেমন জমজমাট ভরভরাট হয়নি। তাই কীর্তনে পাবে ঠাসবুনোট। তার গোড়াপত্তন হয় এইখানেই, এই কেঁদুলীতেই– তবে সংস্কৃতে। জয়দেবের গীতগোবিন্দে। আমি শুনেছি। বিশেষ ভালো লেগেছে, বলতে পারব না। বড় কথার ঝলমলানি। আমি সংস্কৃত বুঝিও না। কিন্তু বাঙলায় পেয়েছে ওই বস্তুই তার আসল খোলতাই। হ্যাঁ, মনে পড়ল, মুসলমান কীর্তনীয়াও বিস্তর আছে। তারই একজন আমাদেরই পাশের সৈয়দ মরতুজা।
গুল বাহাদুর এ নামটি ভালো করে মনে রেখেছিলেন, শিবু মরার সময় তাকে বলে গিয়েছিল বলে। বললেন, এর নাম শুনেছি শিবুর কাছে। তারই কে যেন কী– আনন্দী তাঁর নাম, তার মেহেরবানিতে পেয়েছিল বলে শিবুর ছেলের নাম আনন্দী।
ঘোষাল বললেন, তাই বল। আনন্দ নাম হয়, কিন্তু ডোমপাড়াতে আনন্দী নামের হদিস আমি এতক্ষণ পাইনি। তা সে-কথা পরে হবে। এখন শোন, এই কেত্তন গান বোষ্টমদের জান-প্রাণ। আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে প্রায়ই হয়। তুমি এলে কেউ কিছু ভাববেই তো না, উল্টো তোমার গোসাইগিরি আরও ফলাও হয়ে ফুটে উঠবে।
গুল বাহাদুর একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, আমি তো ওসবের কিছুই জানিনে।
জানবে আবার কী? বসে বসে মাথা নাড়বে, আর মাঝে মাঝে আহা-হা করে উঠবে। তোমাকে তো আর গাইতে হবে না। মুসলমানদের কাওয়ালিতে যখন হিন্দু হমূদ্ ও নাৎ (আল্লা রসুলের প্রশস্তি) শুনতে যায়, তখন তারা সে গীতে পো ধরে নাকি? বেন্দাবনের বাবাজি বসে আছেন, ওই তো ব্যস্। আর হজরত মুহম্মদই তো বলেছেন, মূখের উপাসনা অপেক্ষা গুণীর নিদ্রা শ্রেয়ঃ। কেত্তন চলে অনেক রাত অবধি। ভালো কেত্তনীয়া হলে তো কথাই নেই- ভোর অবধি। কথাবার্তা তখন হবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঘোষাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আর কীই-বা আছে কথাবার্তা বলার।
এ রকম নৈরাশ্য গুল বাহাদুরের সয় না। বললেন, অত কাতর হয়ো না বাবুজি। আল্লার ওপর একটু বিশ্বাস রাখতে শেখ।
ঘোষাল হেসে বললেন, আমি তো বিশ্বাস রাখি গোসাই, কিন্তু আল্লা যে আমাকে বিশ্বাস করলেন না। গদরের মেওয়া তো আমার কোঁচড়ে ফেললেন না। আচ্ছা এখন তবে আসি।
গুল বাহাদুর ফার্সিতে চাপান বললেন,
দুঃখ করো না, হারানো ইউসুফ
কিনানে আবার আসিবে ফিরে।
ঘোষাল ওতর হাঁকলেন,
দলিত শুষ্ক এ মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তা হাসিবে ধীরে ॥
কেঁদুলী থেকে ডুবসাঁতারে চিকনকালা গায়ে পৌঁছানো যায়। সন্ধ্যার সময় গরুর গাড়িতে উঠে দোলানি-ঝাঁকুনির ভিতর নিদ্রা– সকালবেলা চিকনকালা। সন্ধ্যার সময় চাঁদ থাকবে পায়ের দিকে, ঘুম ভাঙলে দেখবে, তিনিও ডুবসাঁতার মেরে চিকনকালা গাঁ পেরিয়ে পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু।
গুল বাহাদুর ভেবেছিলেন, সন্ধ্যার সময় রওনা দেবেন, কিন্তু ঘোষালের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যখন রওনা হলেন তখন রাত প্রায় কাবার। দিনের বেলা গরমে গরু দুটোর কষ্ট হবে, কিন্তু গাড়োয়ান গণি মিয়া বলল, বরঞ্চ দুপুরে গরমটা গাছতলায় কাটানো যাবে, কিন্তু এখানে থাকা নয়, ওলা বিবির দয়া হয়েছে, অর্থাৎ কলেরা আরম্ভ হয়েছে।
ওলা বিবি! সে আবার কী! গণি মিয়া পণ্ডিত নয়, তাই ঘোষালের মতো এককথায় সবকিছু বলে দিতে পারল না। অনেক সওয়াল করার পর বেরুল, শেতলা-মনসার মতো ইনি ওলাওঠার দেবী কিংবা বিবি। কিন্তু আর সব দেবী যখন হিন্দুর মৌরশি পাট্টা, তখন ইনিই-বা মুসলমানী হয়ে বিবি খেতাব নিলেন কেন?
গুল বাহাদুর জানতেন না, বাঙলা দেশ তাজ্জব দেশ! ভাগ্যিস তিনি তখনও দখিন বাঙলায় যাননি। সেখানে তা হলে আলাপ-পরিচয় হত জলের দেবতা বদর পীরের সঙ্গে, বড়মো ওরফে বাঘের দেবতা গাজী পীরের সঙ্গে।
এই ঘোষালের সঙ্গেই আলাপ করে তিনি যত না শিখলেন তথ্য, তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন। যথা,
এ দেশের খানদানিরাও কিছু কিছু তা হলে গদরে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন, সে কি শুধু বাঙলা দেশের বাইরে? দেশের ভিতর অন্য খানদানিদের মতিগতি তা হলে কী? তারা যদি ইংরেজকে এদেশ থেকে খেদাতে না চায় তবে তো কোনওকিছু করা অসম্ভব, কারণ তারা যদি নেতৃত্ব না নেয় তবে ডোম-চাড়ালেরা কি আপন হিম্মতে নয়া গদরের তাজা ঝাণ্ডা উঁচু করতে পারবে? তারপরের প্রশ্ন, এই খানদানি অর্থাৎ বামুন এবং চাড়ালদের ভিতর কি অন্য কোনও সম্প্রদায় নেই? দিল্লিতে যে রকম ব্রাহ্মণ আর বেনের মাঝখানে আছে ক্ষত্রিয়রা? দিল্লির ব্রাহ্মণ আর এখানকার ঘোষাল ব্রাহ্মণেই-বা মিল কোথায়? দিল্লির বামুনরা তো করে স্রেফ পুরুতগিরি, এ বামুন তো একদম আগখুর অর্থাৎ আগুন-গিলনেওলা। কিন্তু মারাঠি ব্রাহ্মণ পেশওয়ারাও তো পুরুতগিরি করে না। তবে কি তারা হাতিয়ার নেয়, না শুধু আড়ালে বসে কল-কাঠি নাড়ে?
আনন্দীর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে গুল বাহাদুর ভাবলেন, এসব জাত-বেজাত আর তাদের ফ্যাচাঙ-ফেউ শিখতেই তো যাবে একটা আস্ত জীবন। তা আর কী করা যায়, অন্য কোনও পন্থা যখন আর নেই। আরব্য উপন্যাসের জিনও তো বোতলের ভিতর বন্ধ হয়ে কাটিয়েছিল তিনশো না চারশো বছর। পরমাত্মার কৃপায় তবু তো তিনি মুক্ত অন্তত বোতলের জিন্নির তুলনায়।
দূরের শালবনের ফাঁকে কে যেন ছোট্ট একটি আগুন জ্বালিয়েছে। না, সূর্যঠাকুর ঘুম ভেঙে চোখ কচলে কচলে লাল করে ফেলেছেন। আকাশে চাঁদের আলো কখন মিলল, সূর্যের আলো দেখা দিল তিনি লক্ষই করেননি। পূর্ব থেকে একটুখানি ঠাণ্ডা বাতাস এগিয়ে চলেছে পশ্চিমপানে দেবতার পায়ে পেন্নাম করতে। কিন্তু এ দেবতা বড়ই জাগ্রত বদমেজাজি পীর। ভক্তকে অভ্যর্থনা জানান ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে। পুব-বাঙলা থেকে বেরিয়ে আসা এই তীর্থযাত্রী পূরবিয়া হাওয়াকে তিনি আদর করে গায়ে মাখেন না, উল্টো ছেড়ে দেন পচছিমিয়া গরম বাতাস। আল্লাওয়ার্দী খানের আমলের মারাঠা দস্যুর মতো তারা পশ্চিম দিগন্ত থেকে আসে ঝড়ের মতো হু হু করে, ঘোড়ার খুরে বালি পাথর শুকনো পাতার হাজারো দ জাগিয়ে দিয়ে। একেবারে আকাশজোড়া নিরন্ধ্র, তমসাঘন, সূর্যাচ্ছাদিত একচ্ছত্রাধিপত্য।
দানিশপুর গাঁ ডাইনে রেখে চিকনকালা যেতে হয়। সে গাঁয়ের বাইরে আসতে-না-আসতেই গাড়ির উপর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল চৌষট্টি পবন মারাঠাদের চৌষট্টি হাজার হর্সপাওয়ার নিয়ে।
সামাল সামাল বলতে-না-বলতেই, গরু, গাড়োয়ান, গুল বাহাদুর খান কারও কোনও খবরদারি হুশিয়ারির তোয়াক্কা না করে গাড়ি ঢুকল দানিশপুর গাঁয়ের ভিতর। তার পর বাঁ দিকে চক্কর খেয়ে শিমুল পলাশ মহুয়ার আড়ালে এক আঙ্গিনায় গিয়ে ছিটকে ফেলে দিল আনন্দী, গুল বাহাদুর, গণি মিয়া মায় দুটো গরুকে একে অন্যের ঘাড়ে। মায়ের সুপুতুর যে রকম বস্তা বস্তা চাল ডাল নুন চিনি আঙ্গিনায় আছাড় মেরে হুঙ্কার দিয়ে কয়, দেখ মা, তোমার জন্যে কী এনেছি। কোথায় লাগে এর কাছে পঞ্চ-পাণ্ডবের দ্রৌপদীকে বাড়ি এনে মাতা কুন্তীকে আনন্দসংবাদ জানানো!
চতুর্দিকে আকাশ-বাতাসে তখন লাল ধুলো-বালির ভূতের নৃত্য। ঝড়টা এমনি অসময়ে এবং অতর্কিতে এসে আক্রমণ করেছে যে ধূর্ত বায়সকুল পর্যন্ত আশ্রয় নেবার ফুরসত পায়নি। সেই ঝড়ের তীব্র সিটির শব্দের ভিতরও ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে তাদের তীক্ষ্ণ মরণাহত আৰ্তরব।
গুল বাহাদুর সবকিছু ভুলে উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, শাবাস, শাবাস! একেই বলে আক্রমণ; একেই বলে হামলা। বিলকুল বে-খবর এসে বে-এক্তেয়ার করে দিল দুশমনকে।
গুরুদুটো গাড়ি থেকে খালাস করে আনন্দীকে কোলে করে আঙ্গিনায় অন্য প্রান্তরে কুঁড়েঘরের দাওয়াতে উঠতেই গুল বাহাদুরের চোখে পড়ল আরেক ঝড়। ঝড়েরই বেগে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিনায় এল এক রমণী। শাড়ির এক অংশ কোমরে বাঁধা, দীর্ঘতর অংশ সোজা উঠে গেছে আকাশের শূন্যে, মাথার চুলও উঠেছে আকাশের দিকে তালগাছের সক্কলের উঁচু পাতাটার মতো ঢপ নিয়ে। তার বগলে একটি ছোট্ট ছাগলের বাচ্চা। এই লালচে অন্ধকারের ভিতরও গুল বাহাদুরের নজরে পড়ল ছাগলবাচ্চাটার দুটো ভয়ার্ত চোখ। আর, আর তার পাশে, একে অন্য থেকে বেশ দূরে আরও দুটি লাল-কালো চোখ। মেয়েটি আসমান থেকে শাড়ি নামিয়ে বুক ঢাকার চেষ্টা না করে সোজা উঠল ঘরের দাওয়ায়। ঝটাৎ করে শিকলি খুলে ঘরের ভিতর ঢুকে এক লহমার তরে দরজা ফাঁক করে ধরল। এহেন প্রলয়নৃত্যের ওক্তে আপ যাইয়ে, আপ বৈঠিয়ে বলে কে? পেছন থেকে গণির বেধড়ক ধাক্কা খেয়ে গুল বাহাদুর পড়লেন মেয়েটার উপর। সে চোট না সামলাতে পেরে পড়ে যাচ্ছে দেখে তাকে জাবড়ে ধরলেন দু হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে। মেয়েটা আ মর মিনষে ওই ধরনের কী যেন একটা বলল। ইতিমধ্যে গণি মিয়া কোনও গতিকে দরজাতে হুড়কো দিয়ে ফেলেছে।
ভিতরে ঘোরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু চালের সঙ্গে যেখানে মাটির দেয়াল লেগেছে তারই ফাঁক দিয়ে কেমন যেন একটা লাল আভা দেখা যাচ্ছে গায়ে আগুন লাগলে রাতের বেলা অন্ধকার ঘরে যে রকম বাইরের আগুনের আভাস পাওয়া যায়, বিদ্যুৎ ঝলমল করে উঠলে সক্কলের মুখের উপর সোনালি আবীর মাখিয়ে দেয়।
একটা মোড়া ঠেলে দিয়ে রমণী বলল, বস গোসাঁই। গণি এক কোণে চ্যাটাইয়ের উপর বসেছে। আনন্দী গুল বাহাদুরের হাঁটু জড়িয়ে ধরে ভীত নয়নে এ-দিক ওদিক তাকাচ্ছে।
গুল বাহাদুর দিল্লি শহরে বিস্তর খাপসুরৎ রমণী দেখেছেন। খাঁটি তুর্কি মেয়ের ড্যাবডেবে চোখ, খানদানি পাঠান মেয়ের ধনুকের মতো জোড়া ভুরু, নিকষ্যি কুলীন ইরানি তম্বঙ্গীর দোলায়িত দেহসৌষ্ঠব, এমনকি প্রায় অমিশ্র আর্যকন্যা ব্রাহ্মণকুমারীর সরল বুদ্ধিদীপ্তশান্তসৌন্দর্য তিনি বহুবার দেখেছেন, কিন্তু আজ যে রমণী তাঁর সামনে আধা আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তার লাবণ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সৌন্দর্য ছ শো বছরের মিশ্রণের সওগাত। এর গায়ের রঙ এদেশের কচি বাঁশপাতার সবুজ দিয়ে আরম্ভ, তাতে মিশে গিয়েছে পাঠান-মোগলের কিঞ্চিৎ তাঁবা-হলুদের রঙ। চুল ইরানিদের মতো কালো হয়ে গিয়ে যেন নীলের ঝিলিক পড়েছে। কিন্তু তার আসল সৌন্দর্য তার আঁটসাঁট গড়নে সাঁওতাল মেয়ে দেখে যেমন মনে হয় এর দেহ তৈরি হয়েছে গয়ার কালো পাথর দিয়ে। পেটে-পিঠে কোনও জায়গায় একচিমটি ফালতো চর্বি নেই। আলগোছে কোমরে জড়ানো এর শাড়ির আঁচল কোমরটিকে যা ক্ষীণ করে দিয়েছে দিল্লির তৰঙ্গী তার ইজের-বন্ধ কষে বাঁধলেও এ ক্ষীণ কটি পেত না।
প্রথম তরুণ বয়সে গুল বাহাদুর যখন সবে বুঝতে আরম্ভ করেছেন যুবতীর দেহে কী রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে, তখন তাঁর এক ইয়ার তাঁকে একখানা চিত্রিত ইউসুফ-জোলেখার বই দিয়েছিল। পাতার পর পাতা উল্টে সে বইয়ে তিনি দেখেছিলেন শিল্পী কীভাবে প্রতি পাতায় জোলেখার সৌন্দর্য ধীরে ধীরে উদঘাটন করেছেন। প্রতি ছত্র, প্রতি রঙ তাঁর অঙ্গে অঙ্গে তখন কী অপূর্ব শিহরণ এনে দিয়েছিল। রোমাঞ্চ কলেবরে কাটিয়েছিলেন অর্ধেক যামিনী।
আজ ঠিক সেইরকম বিদ্যুতের প্রতি ঝলক যেন মেয়েটির সৌন্দর্য পাতার পর পাতা খুলে তাঁর মুগ্ধ আঁখির সামনে তুলে ধরছিল। আর চতুর্দিকে তখন ঝঞ্ঝাবাত্যার প্রলয়নৰ্তন। তারই মাঝখানে এই কমলিনীর ক্ষণে ক্ষণে আত্মবিকাশের মন্দমধুর প্রস্ফুরণ।
কিন্তু আজ আর প্রথমতারুণ্যের সেই রোমাঞ্চ শিহরণ গুল বাহাদুরের দেহে-মনে হিল্লোলিত হল না। আজ এই সৌন্দর্যের পটপরিবর্তন তিনি গভীর তৃপ্তির সঙ্গে গ্রহণ করলেন–শান্ত মনে সমাহিত চিত্তে।
বিদ্যুতালোকে গুল বাহাদুরের চোখে চোখ পড়তে রমণী শুধাল, কী দেখছ, গোসই?
অতিশয় অনাবশ্যক প্রশ্ন। কণ্ঠে লজ্জা দেবার কিংবা পাওয়ারও কোনও রেশ নেই। এমন সময় আকাশ থেকে কক্কড় করে নামল শুকনো দেশের ভরাট অকাল বৃষ্টি। গুল বাহাদুরকে কোনও উত্তর দিতে হল না।
মেয়েটি মাটিতে বসে দু হাতে হাঁটু জড়িয়ে গুল বাহাদুরের মুখের দিকে আবার তাকাল। চিবুক যে জোড় হাঁটুর উপর রাখবে তার যেন উপায় নেই। মাঝখানে সুবিপুল মৃন্ময় মর্ম-বিগ্রহ যুগল।
হঠাৎ রমণী দু বাহু তুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে গুল বাহাদুরকে শুধাল, গোসাই, তোমার বয়স কত?
যেন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন। কিন্তু উত্তর না দিয়ে পাল্টে শুধালেন, কোন বয়স?
রমণী হেসে উঠল। বলল, সে আবার কী? বয়স আবার কত রকমের হয়?
গুল বাহাদুর বললেন, অনেক রকমের হয়। আমার বয়স তেইশ। গদরের নৈরাশ্য এই নাতিদীর্ঘ তেইশকে যেন কত দীর্ঘ তেইশে সম্প্রসারিত করে দিয়েছে।
এবারে রমণী খল খল করে হেসে উঠল। ইয়া আল্লা, ইয়া রসুল, তোমার বয়স তেইশ! আমার-ই তো এক কুড়ি হয়!
গুল বাহাদুর চমকে উঠলেন। এ মেয়ে কি মুসলমান? শুধালেন, তোমার নাম কী?
হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, তোমার যেমন অনেক রকমের বয়স, আমার তেমনি অনেক নাম। লোকে বলে মিছার মা।
সে আবার কী?
বুঝলে না? আমি সাচ্চা মা নই, তাই আমি মিছার মা।
বৃষ্টি নেমেছে দেখে গণি মিয়া গাড়ি-গরুর খবর নিতে বাইরে যাচ্ছিল। এতক্ষণ সে কোনওকিছুতে কান দেয়নি। এবারে একটুখানি দাঁড়িয়ে গুল বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে যা-তা বলছে, বাবাজি। ওর নাম আসলে মিঠার মা।
মিঠার মা গণির দিকে তাকিয়ে রাগত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁরে গণ্যা, আমি যা-তা বলি? আমি মিছার মা না তো কী? আল্লার কিরে কেটে ক তো?
গণি বাইরে যেতে যেতে বলল, তা তুই নিকে করে বাচ্চা বিয়োলেই পারিস। গুল বাহাদুরকে বলল, আসলে ওর নাম মোতী।
গুল বাহাদুর ভাবলেন, এ-নাম যে দিয়েছে সে আর যাই হোক, মিছের বাপ নয়– সত্যি নামই দিয়েছে। কিন্তু এর জাত কী তার হদিস গুল বাহাদুর তখনও পেলেন না।
কিন্তু এক মুহূর্তেই পাওয়া গেল। তা-ও অনায়াসে।
আনন্দী বলল, দাদু, জল খাব।
মোতী শুনতে পেয়েছে। ভাবখানা যেন শুনতে পায়নি।
গুল বাহাদুর বললেন, মোতী, একে একটু পানি খেতে দাও।
মোতীর মুখ শুকিয়ে গেল। একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, আমি যে মুসলমান।
গুল বাহাদুর বললেন, তুমি পানি দাও।
মোতী চীনেমাটির বাটিতে করে আনন্দীকে জল দিল। সঙ্গে দুটি বাতাসা। গুল বাহাদুরের কাছে এসে এ তো তোমার ছেলে নয়, ঠাকুর। কার ছেলের জাত মারছ?
এই জাত মারামারিতে গুল বাহাদুর একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। বললেন, শিবু মোড়লের ছেলে। ও জাত–
আনন্দের চোটে আনন্দীকে জড়িয়ে ধরে মোতী বলল, কোজ্জাব মা, তুই শিবুর ব্যাটা। তাই ক। কী খাবি বল।
মোতী ভারি খুশি। অচেনাজন চেনা লোককে যখন চেনে তখন আর সে অচেনা নয়। আসলে তা-ও নয়– চেনা-অচেনার পার্থক্য মোতী কখনও করেনি। মোতী খুশি হয়েছে, কথা কইবার মতো দু-জনারই একজন চেনা লোক পাওয়া গেল বলে। গুল বাহাদুরকে বলল, ওর কথা আর তুলো না, গোসাই, ওর মতো হতচ্ছাড়া হাড়হাভাতে এ মুলুকে দুটো ছিল না। ক বছরের কথা? আমার সোয়ামী রেখেছে রোজা, জষ্ঠি মাসের গরমে। ইফতারের জন্য আমি করেছি শরবত। র র, থাম্ থাম্ বলতে না বলতে শিবু মেরে দিল-বেবাক ঘটি। ওর আবার জাত। ওর জাত মারে কে?
তার পর গুল বাহাদুরের প্রায় গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করল, যেন কতই না লুকানো কথা, ওর জাত ছিল সোনা বাঁধানো। একঘটি তেঁতুলের শরবত ঢাললে তার জেল্লাই বাড়ে বই কমে না। আর আসলে ছিল, আমারই মতো বদ্ধ পাগল। জানো, আমার বিয়ের দিনে একজালা তাড়ি খেয়ে এসে জুড়ে দিল কান্না। আমার বাবা নাকি তাকে বলেছিল আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেবে। সবাই হেসে গড়াগড়ি। শেষটায় আমার মামা বলল, তা মোড়ল, বিয়ে করবে তো তোমার পাটরানিকে খবর দাও, তিনি এসে বাদীবরণ করে নিয়ে যাবেন। যেই না শোনা অমনি শিবু জল। নেশা কেটে পানি হয়ে গেল। শিবুর বউ ছিল এ তল্লাটের খাণ্ডার। মারমুখী বঁটিদা। তার পর শিবু গলায় ঢোল ঝুলিয়ে শুরু করল নাচতে। পাঁচখানা গায়ের লোককে সেদিন যা হাসিয়েছিল। বিয়ের পর আকছারই আসত আমাদের বাড়িতে। কই গো নাগর বলে আমার সোয়ামীর হাত থেকে হুঁকো কেড়ে নিয়ে একদমে দিত ছিলিম ফাটিয়ে। আসলে ও খেত বড়তামাক।
গুল বাহাদুরের দুঃখ আরও বেড়ে গেল। এরকম একটা গুণরাজ খান চলে গেল। আর কেউ যেতে পারল না?
মোতী আরও গলা নামিয়ে বলল, কিন্তু জানো ঠাকুর, আমার সোয়ামী চলে যাওয়ার পর একদিনও এ বাড়িতে আসেনি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। একদিন বাঁধের কাছে ধরা পড়ে গেল। তখন আমায় মনের কথা বলল। ওরা দু-জনে নাকি কোম্পানির সঙ্গে লড়তে যাবার মতলব করেছিল। তার পর শিবু কোথায় উধাও হয়ে গেল। ফিরে এসে বেশিদিন বাঁচল না। কিন্তু ওসব কথা আর কেউ জানে না।
বাইরে আসমান-ফাটা বরষাত নেমেছে, হাওয়ার মাতামাতি বন্ধ হয়ে গিয়ে চাল দিয়ে জলের ধারা ঝালরের মতো ঝুলে পড়ছে। গণি মিয়া দাওয়ায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। বাইরে জলের ধারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মিঠার মা তার বড় বড় ডাগর চোখে শুকনো চোখে।
হঠাৎ হেসে উঠে বলল, লোকে যে আমায় পাগলী বলে, ভুল বলে না। তুমি পায়ের ধুলো দিয়েছ এ বাড়িতে, আর আমি একবার জিগ্যাসাবাদও করছিনে, তোমার সেবার কী হবে?
গুল বাহাদুর তাড়াতাড়ি বললেন, তার জন্যে তুমি চিন্তে কর না, মিঠের মা। গাড়িতে চিড়ে-মুড়ি আছে। না হয় তুমিও কিছু দেবে।
অবাক হয়ে মোতী শুধাল, তুমি জাত মানো না? একটুখানি ভেবে নিয়ে গুল বাহাদুর বললেন, আমার ধর্মে জাত মানামানি বারণ।
মোতী প্রথম একটু অবাক হয়ে তাকাল। তার পর বলল, বুঝেছি। খুব যারা উঁচুতে উঠে যায়, তারা বোধকরি ওসব আর মানে না। আমার বাপের বাড়ির পাশের গায়ে বামুনরা থাকত। ভয়ঙ্কর জাত-বামুন। আমার বাবা বলত, তাদের কেউ কেউ নাকি জাত মানত না। বাবার হাতে তামাক খেত।
গুল বাহাদুরের জানবার ইচ্ছে হল, এই ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা মোতী কোন চোখে দেখে। শুধালেন, এ জিনিসটে কি ভালো?
মোতী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কী জানি ভালো, না মন্দ। যার যেমন খুশি। আমাদের পীর সাহেবও তাঁর বিবির হাতে ছাড়া খান না। ভালোই করেন নিশ্চয়। তিনি যা জায়গা-বেজায়গায় নিত্যি নিত্যি আড়াই কুড়ি দাওয়াত পান, ওসবের সিকিটাক খেলেও দেখতে হত না। ওই হোথায় বাসা বাঁধতে হত। সেখানে আবার বাবুর্চিখানা নেই। বলে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল।
গুল বাহাদুর বুঝতে না পেরে বললেন, কোথায়?
ডান হাতে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে বাঁ হাতে খোলা দরজা দিয়ে কোথায় যেন দেখিয়ে দিল। গুল বাহাদুর তবু বুঝলেন না।
গোরস্তান গো, গোরস্তান। ওই যেখানে মিছার বাপও ঘুমুচ্ছে।
গুল বাহাদুর মরমী, দরদী লোক নন অন্তত এই তাঁর বিশ্বাস। তবু শুকনো মুখে বললেন, কেন তুমি এ দুঃখের কথা বার বার তুলছ মিঠার মা?
মোতী যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। দু হাত জুড়ে বললে, মাফ কর গোসাই, কিন্তু দুঃখের কথা বলল কে? ও তো ওখানে বেশ আরামে ঘুমুচ্ছে। আর যাবার সময় ও তো ভারি হাসিমুখে গিয়েছে। চোখ বুজল, কিন্তু মুখের হাসিটুকু মিলাল না। জিগ্যেস কর না, এই গাঁয়ের পাঁচজনকে, যারা তাকে গোসল করাল, কাফন পরাল।
থাক।
হ্যাঁ, থাক্। দাঁড়াও, আনন্দীর গায়ে একটা কাঁথাচাপা দিয়ে আসি।
তার পর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ।
গুল বাহাদুর মাঝে মাঝে খোলা দরজা দিয়ে দেখছিলেন, জল ধরার কোনও চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে কি না। মোতী লক্ষ করে বলল, সে আশা ছেড়ে দাও আজ। জল ধরলেও বেরুতে পারবে না। এ গাঁ ও গা-র মাঝখানে যে খোয়াই তার ভিতর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জল যা তোড়ে বয় তাতে হাতি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর কত শো দ। একবার একটাতে মজে গেলে বিনা মেহন্নতে বেরিয়ে যাবে এক ঝটকায় ওই দূরের অজয়ে, তবে জানটা আর সঙ্গে যাবে না। না, থাক। ওসব কথা তুমি ভালোবাস না। আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়। সামলে-সুমলে কথা বলতে হয়।
গুল বাহাদুর বললেন, তুমি তো কিছু খেলে না।
আমি তো দিনের বেলা খাইনে।
সে কী? তামাম বছর রোজা রাখ নাকি?
ওই দুই ঈদের ছটা দিন বাদ দিয়ে। তবু দেখ তো গতরখানা।
ছাড়পত্র পাওয়ার পূর্বেও গুল বাহাদুর অনেকবার সীমা লঙ্ন করেছেন, তবু নতুন করে গতরখানা দেখে খুশিই হলেন। কোনও প্রকারের সহানুভূতি জানাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। বললেন, কার ওজন কতখানি তাই মাপবার জন্য ভগবান দাঁড়িপাল্লা নিয়ে স্বর্গে বসে থাকেন না।
মোতী বলল, হক কথা। কিন্তু আমাদের একটা মুর্শিদীয়া গীত আছে ওই নিয়ে। শুনবে? বলেই গুন গুন করে ধরল– মিষ্টি গলায় কিন্তু কেমন যেন কান্না ভর-র সুরে
দীপ নাই শলিতা নাই,
জ্বলে শখের বাতি
কইয়ো গিয়া মুরশীদের ঠাই।
জ্বলে দিবা জ্বলে রাতি
কইয়ো গিয়া ও ভাই—
ঘুরে ফিরে, এখানে ধরে, ওখানে ছেড়ে, আবার নতুন করে ধরে মোত অনেকক্ষণ ধরে গানটি গাইল। সমস্ত প্রাণ দিয়ে। ঝরঝর বারিধারা যে রকম সহজ পথে আকাশ থেকে নেমে আসে, এর গানও হৃদয়ের উৎস থেকে নেমে এসে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। রসকষহীন গণি মিয়া পর্যন্ত সরে এসে চৌকাঠের কাছে বসেছে।
গুল বাহাদুর গানের পুরো অর্থ বুঝতে পারলেন না, কিন্তু রস পেতে খুব যে অসুবিধে হল তা নয়। বাচ্চারা যেরকম গল্প শোনার সময় ভাষার দৈন্য কল্পনা দিয়ে পুষিয়ে নিয়ে পুরো রসই পায়, নতুন ভাষা শেখার সময় বয়স্ক লোকও তাই করতে পারে, যদি সে ইতিমধ্যে কল্পনাশক্তি হারিয়ে না ফেলে থাকে। জ্বলে শখের বাতি বলার সময় মোতীর দেহ যেন আরও সুন্দর হয়ে দেখা দিচ্ছিল, আর দীপ নাই শলিতা নাই গাইবার সময় মোতীর চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, গুল বাহাদুরও সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন।
তবু বললেন, বুঝিয়ে বল।
এতে আবার বোঝাবার কী আছে। গুরুকে খবর পাঠাচ্ছি, মহব্বত দরদের তেল শলতে নেই ভিতরে, তবু দেহের বাতি জ্বলছে। তা আবার খামোখা দিনের বেলাও জ্বলে। তাই তো তোমাকে বলছিলুম, গতরটার পানে চেয়ে দেখ।
গুল বাহাদুর মনে মনে বললেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা, অত্মোৎসর্গ করার তেল শলতে তৈরি করেই আমরা জ্বালিয়েছিলুম গদরের প্রদীপ। সে মিথ্যা মায়া, ফানি।
কিন্তু মোতীর এই সুন্দর দেহ। এর ভিতরে সুন্দর হিয়ার প্রদীপ নেই- অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব।
বললেন, মোতী, সবই ভগবানের দান। তাচ্ছিল্য করতে নেই। রোজা ভালো জিনিস, কিন্তু তারও বাড়াবাড়ি করতে নেই। মীরাবাঈয়ের ভজন তুমি শুনেছ,
নিত্য নাহিলে হরি যদি মিলে
জল-জন্তু আছে ঢের
কামিনী ত্যাজিলে হরি যদি মিলে
তবে হরি খোঁজাদের।
মোতী গদগদ কণ্ঠে বলল, এ তো ভারি মধুর, গোসই। আমি কখনও শুনিনি।
যমুনার পারে রাজপুতানার এক বৈরাগী মীরার ভজন গাইত। গুল বাহাদুর আনমনে তার গান শুনেছেন, মাঝে-মধ্যে, কিন্তু সে গান যে তার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে, তা তিনি নিজেই জানতেন না। ভক্তিরস, ভাবালুতা গুল বাহাদুর কখনও খুব নেকনজরে দেখেননি। বাড়াবাড়ির ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ তবে চলি, মিঠার মা। খোয়াইয়ের জলটা আমার দেখবার ইচ্ছে আছে। গণি আর আনন্দী রইল। কাল সকালে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিয়ো।
মোতী বাধা দিল না। গোঁয়ারদের নিয়ে তার জীবনের কেটেছে অনেকখানি তার বাপ-ভাইরা ছিল এক একটি পুঁদে গোঁয়ার।
শিমুলতলায় এসে শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আচ্ছা গোসই, একটা কথার উত্তর দেবে? এই গণির স্বভাব-চরিত্র কী তা তুমি জানো না। সে আমার বাড়িতে থাকলে তোমার কোনও আপত্তি নেই। সে আমাকে নিয়ে যা খুশি করুক। কিন্তু তুমি থাকলেই আসমান মাথার উপর ভেঙে পড়ে। কেন বল তো? ছোটজাতে ছোটজাতে যা খুশি করুক– নয় কি?
সত্যি বলতে কী, গুল বাহাদুর পরিস্থিতিটা এভাবে চিন্তা করে দেখেননি। কিন্তু মোতীর কথাগুলো এমনি সোজাসুজি তার কানের ভিতর দিয়ে মগজের উপর ঠনঠন হাতুড়ি পিটিয়ে দিল যে তাঁকে চিন্তা করে কথাগুলো বুঝতে হল না। প্রথমটায় থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, তোমায় সত্যি বলছি, আমাকে বিশ্বাস কর, আমি অতখানি চিন্তা করে এ ব্যবস্থা করিনি। বোধহয়, এ ব্যবস্থা আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর তুমি যে কারণটা দেখালে সেটাও হয়তো ঠিক, কিন্তু আমাকে যদি জিগ্যেস কর তবে বলব, আমি ভদ্রলোক-সাধারণ লোক সকলের সঙ্গেই মিশেছি এবং এ বাবদে আমি গণি মিয়াদের ঢের ঢের বেশি বিশ্বাস করি। এদের হ্যাংলামো অনেক কম। গরিবের সুন্দরী মেয়েকে মোকায় পেলে দ্রলোক-এর মাথায় বদ-খেয়াল চাপবেই। ভদ্রলোকের মেয়ে হলেও তাই তবে সেখানে একটু লাইয়ের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তাই দেখ, ভদ্রলোকের মেয়েকেও আমরা চাকর-বাকরের হেফাজতিতে রাখা পছন্দ করি। আর
থামলে কেন? বল। কঠিন গলা একটু মোলায়েম হয়েছে বলে মনে হল।
আর গণি ভালো-মন্দ কিছু একটা করতে গেলে তাকে যে রকম ঠাস করে তুমি চড় মারতে পারবে, আমাকে কি–
ধমক দিয়ে বলল, থাক থাক্। কে কাকে চড় মারত কে জানে। বিকেলবেলার বৃষ্টিশেষের কনে-দেখার আলো সবটুকু মুখে মেখে এতক্ষণ-গোপন-রাখা তার সবচেয়ে মিষ্টি গলায় বলল, তবে এসো ঠাকুর।
***
জলের তোড় গুল বাহাদুর অতি উত্তমরূপেই দেখলেন। বাদশাহ মুহম্মদ তুগলুক যে রকম দিল্লির জাহানপানা শহরে সাততলা মঞ্চের উপরে বসে তার হাজার হাজার সৈন্যস্রোত বয়ে যেতে দেখতেন অর্থাৎ একটা উঁচু ঢিবির উপর বসে জলের তোড়, স্রোতের দু উঁচু উঁচু টিবির উপর রাগী ঢেউয়ের ছোবল তাবৎ বস্তুই দেখলেন এবং তার চেয়েও উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করলেন, মোতীর– মিছার মার কথা গল্প নয়। এর যেখানে হাঁটুজল সেখানেও দাঁড়ায় কার সাধ্য?
সন্ধের সময় আবার বৃষ্টি নামল। ষোড়শীর রাত কিন্তু মেঘে মেঘে সব অন্ধকার। সমস্ত রাতটা কাটাতে হল ঢিবির উপর।
অভিসম্পাত দিতে দিতে বললেন, মহাজনগণ বলেছেন, মেয়েদের বুদ্ধিতে চলো না। হক কথা। কিন্তু না চললে কী হয় তা-ও বেশ টেরটি পেলুম। ওদের কথা শুনলে বিপদ, না শুনলে আরও বিপদ। এ জাতটাই বজ্জাৎ!
.
০৬.
কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে পান্ডোরা খুলে ফেলল কৌটাটি, আর অমনি তার থেকে পিল পিল করে বেরুতে লাগল দুঃখ, দৈন্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আরও কত কী– আর তারই চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ল ভুবনময়। পান্ডোরা ভয়ে ভয়ে যখন ভিরমি যাব যাব করছে তখন সর্বশেষে বেরুল– আশা। তারই জোরে মানুষ সব দুঃখদৈন্য সয়। আত্মহত্যার দৃঢ় দড়িতে নিজেকে না ঝুলিয়ে দিয়ে ঝুলতে থাকে সেই আশার ক্ষীণ সুতোটিতে।
সুলেমান যখন তার স্বাধিকার-প্রমত্ত জিকে শাস্তি দিয়ে বোতলে পুরে সমুদ্রে ফেলে দেন তখন তাকে পান্ডোরার শেষ দৌলতটি নিতে বাধা দেননি। সেই তার চরম করুণা। জিনি যদি বোতলের ভিতর বন্দিদশার প্রথম প্রহরেই জানতে পেত তাকে ক-শো বছর ধরে বোতলের ভিতর প্রহর নয়– শতাব্দী গুনতে হবে, সে নিশ্চয়ই থ্রম্বসিসে মারা যেত।
গুল বাহাদুর যদি চিকনকালাতে আশ্রয় নেবার দিন জানতে পেতেন, তাঁকে ক-যুগ ওখানে কাটাতে হবে, তা হলে তিনি নামাবলীতে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তেন। পাভোরার যে ক্ষীণ আশাটি নিয়ে তিনি নামাবলী গায়ে দিয়েছিলেন, সেটি ওরই মতো এত জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছে যে, ওটিকে আর পরা চলে না।
কিন্তু
কেশের আড়ালে জৈছে
পর্বত লুকাইয়া রৈছে।
ঠিক তেমনি তার দিন-আনি-দিন-খাই-এর আড়ালে আশা-নিরাশা সবকিছুই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বলে সেটা দিব্যি যেন ক্লোরফর্ম কিংবা আফিঙের কাজ করে যাচ্ছিল। পরম ধার্মিকজনও যখন দিনযামিনী এটা-সেটার চিন্তায় মশগুল থেকে শেষের দিনের কথা সম্বন্ধে অচেতন হয়ে যেতে পারে, তখন সামান্য প্রাণী গুল বাহাদুর যে পলাশতলায় খাঁটিয়ার উপর শুয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেবেন তার আর বিচিত্র কী?
কালটাও ছিল ধীরমন্থর। কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে তোড়জোড় করতেই লেগে যেত তিন মাস। বিয়ের আলাপ পাকাপাকি করতে নিদেন তিন বছর। এমনকি মরার সময় গঙ্গাযাত্রায় বেরিয়ে সেখানে দিনসাতেক না কাটালে মুরুব্বিরা রীতিমতো বেজার হতেন। অত তাড়া কিসের রে বাপু? দু-পাঁচ দিন হরিনাম শুনবি, চন্দন বেটে ধীরেসুস্থে সর্বাঙ্গে হরিনাম ছাপা হবে, ইষ্টিকুটুম খবর পেয়ে ঘরসংসার গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখা করতে আসবে, শুনতে পাবি কবে যাবি, ক দিন আর আছিস তাই নিয়ে চাপা গলায় আলোচনা হচ্ছে, বাজি ধরা হচ্ছে; তা না, চললি হুট করে যেন ডাক পড়ার পূর্বেই হাড়-হাবাতে আপন হাতে আসন পেতে বসে গেল যজ্ঞির দাওয়াতে। কিংবা যেন বাসরঘরে পাঁচজনের সামনে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে ফেললি কনে-বউয়ের ঘোমটাখানি। কিংবা তারও বেশি।
হিসাব কর দিকিনি গুল বাহাদুর, শান্ত মনে– শুদ্ধ-বুদ্ধ চিত্তে। ক বছর হল? দশ, বিশ, ত্রিশ? পিছনের দিকে না সামনের দিকে? তুমি বসে, আর তারা সামনে দিয়ে চলে গেল, না তুমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছ, না তাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছ? না তুমি কাজের মাঝখানে এমনি যোগসাধনায় তুরীয় ভাব অবলম্বন করেছিলে যে কাল, না কাল কেন, হেন স্বয়ং মহাকালই ধূর্জটির জটার ভিতর প্রথম উর্বশীর মতো বেশ খানিকটা নেচে কুঁদে, তার পর গঙ্গার মতন এদিক-ওদিক পথ না পেয়ে বিষ্ণুর মতন উত্তম ডানলোপিলোর বিছানাতে অনন্ত শয়নে নেতিয়ে পড়েছেন?
কে জানে কী হয়? যেখানে বছরে একদিনও স্মরণ করতে হয় না আজ কোন তারিখ, সেখানে একটা বছরই এক দিন। আর যেখানে দিনে বত্রিশবার স্মরণ করতে হয় আজ অমুক তারিখ, সেখানে একটা দিনই এক বছর। কে জানে সময় কোন্ দিক দিয়ে যায়? দশ, বিশ, ত্রিশ বছর।
এই মোতীর সঙ্গেই আবার দেখা হতে লেগে গেল দেড় মাস।
সকাল থেকেই পুবের আকাশে মেঘ জমে উঠেছে সাঁওতাল দেশের সাঁওতালি মেয়ের গায়ের রঙ মেখে। মেঘের পর মেঘ জমেই উঠছে। যেন আকাশের ভরা গেলাসে পর্জন্য এক-এক ফোঁটা করে জল ঢালছেন আর দেখছেন, এইবারে উছলে পড়ল কি না। ক্ষণে ক্ষণে কালো মেঘের উপর দিয়ে খেলে যাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলমলানি। যেন ওই সাঁওতালনীরই শ্যামবদনে টগরফুলের সফেদ হাসি। কিংবা যদি ইন্দ্রপুরীতেই ফিরে যাই তবে মনে হবে, মেঘের কালো টানার উপর উর্বশী বিদ্যুতের রুপোর পোড়েন টানছেন, বাসররাতের কাঁচুলির কিংখাপ বুনতে। নাহ্! এসব তুলনাই অতি কাঁচা। মোক্ষম তুলনাটির চড় বিশ্বসাহিত্যের গালের উপর মেরে দিয়ে গিয়েছেন রাজা শূদ্রক। বিদ্যুৎ যেন শ্যামাস্তু নীলকণ্ঠের গলা জড়িয়ে গৌরীর শুভ্রধবল বাহুলতা।
গৌরী ভুজলতা যত্র বিদ্যুল্লেখেব রাজতে হায় রে শূদ্রক! একটু টেনে-সামলে উপমাগুলো ছাড়লে কেন হে পৃথ্বীরাজ, কাব্যম্রাট? এ যুগের মধ্যমজনকেও যে একদিন রসসৃষ্টি করে নিষ্ক সঞ্চয় করতে হবে সেটা কি তিনি খেয়ালই করলেন না? রাজা হলেই কি এরকম দান করতে হয়? তাই দেশের রাজা হাতিম তাই অন্ন-দান করে হয়েছিলেন অন্নরাজ, কিন্তু তিনিও তো বীচির ধান খাইয়ে ভবিষ্যত্বংশীয়দের নিরন্ন করে যাননি। উপমার বেলা শূদ্রক শেষে নবান্নের বীচিও যে খতম করে গেলেন।
তা যাক। কিন্তু দয়াদাক্ষিণ্য, স্নেহ-প্রেম, বিশেষ করে আসঙ্গলি– এ জগৎ থেকে এখনও লোপ পায়নি।
গুল বাহাদুর দেখলেন, তেপান্তরি মাঠ যেখানে ফালি হয়ে বাঁ দিকে ঢুকেছে, তারই অপর প্রান্তে, মেঘের আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে একটা উঁচু ঢিবির উপর ক্ষণিকের তরে দাঁড়াল। মাঠ-ঘাট জনহীন। বৃষ্টি নামি-নামছি, নামি-নামছি করছে। এ অবেলায় লোকটার আহামুখি দেখে গুল বাহাদুর ভুরু কোঁচকালেন।
আধ আলো-অন্ধকারে বেলা কতখানি গড়িয়েছে ঠাহর হচ্ছে না। ঘরে ঢুকে গুল বাহাদুর আনন্দীকে শুধালেন, কী খাবে আনন্দী? দিল্লিতে তুই তু শব্দটা প্রায় উঠে গিয়েছে।
আনন্দীর আটপৌরে পোশকি একই মেনু। বলল, খিচুড়ি আর আলুর দম। ওই একটিমাত্র রান্না যার সঙ্গে দিল্লির রান্নার কিঞ্চিৎ ঐক্যসখ্য আছে– গরমমশলার কৃপাতে– অবশ্য আনন্দীর অজান্তে। গুল বাহাদুর সাজসরঞ্জামের চতুরঙ্গ বাহিনী তোড়জোড় করে জোগাড় করতে লাগলেন। আনন্দী কখনও মায়ের আদর পায়নি। পাওয়ার মধ্যে পেয়েছে বাপের ধাতানি। সে-ও এটা-সেটা যোগান দিতে লাগল।
বৃষ্টি নামবার আগে আরও কিছুটা জল এনে রাখলে ভালো হয় ভেবে গুল বাহাদুর ঘর থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। দাওয়ার এক প্রান্তে খুঁটিতে হেলান দিয়ে মোতী বসে।
তুমি!
নিরুত্তর।
কখন এসেছ? ডাকলে না কেন?
দেয়ালের থেকে চোখ না ফিরিয়েই বললে, তুমি আমাকে ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে চলে গেলে কেন?
গুল বাহাদুর হেসে বললেন, তাজ্জব কি বাৎ! অতদূর থেকে আমি তোমাকে চিনব কী করে? আমি ভাবলুম,–
দত্যি, দানো, মামদো! তোমাদের কাছে সব মুসলমানই মামদো, না?
গুল বাহাদুর বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, এ কী জ্বালা! হিন্দু নই, তবু হিন্দু অপরাধের হিস্যে আমাতেও অর্শায়?
গম্ভীর মুখে বললেন, তোমাকে আমি বলিনি, আমার ধর্মে জাত-মানামানি বারণ। চল ভিতরে, ওই দেখ বৃষ্টি আসছে।
এবারে মারাঠা সৈন্যের অতর্কিতে আক্রমণ নয়। দূরদিগন্ত থেকে হেলে-দুলে বিলম্বিত তালে এগিয়ে আসছে আকাশ-জোড়া পাতাল-ছোঁয়া শ্যামসুন্দর মেঘ-বৃষ্টি। এই রকম অগণিত করীযূথ সমাবৃত গাঙ্গেয় চমূ অগ্রসর হচ্ছে শুনেই আলেক্ষান্দর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমীচীন গণনা করেছিলেন।
এবারে মোতী খিলখিল করে হেসে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। যেন পেটের ভিতর হামানদিস্তে দিয়ে কেউ পাথর কুটছে। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে দুলে দুলে ফুলে ফুলে কাঁপন। গায়ের বসন যেন সে কাঁপন সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে চায়। কার যেন বিরহ-বেদনায় কনকবলয়-ভ্রংশ, অর্থাৎ বাজুবন্দ খোল খোল যাউত হয়েছিল, আজ হাসির হররায় এ রমণীর বসনাঞ্চলপ্রান্ত বিস্রস্ত। এবং স্মরণ রাখা কর্তব্য, গ্রামাঞ্চলে অঞ্চল প্রায়শ উপকণ্ঠিত থাকে না।
চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ঠাকুর, তুমি মস্করা-ফিস্কিরি এক্কেবারে বুঝতে পার না। ওদিকে কথা কও পাকা পাকা। তুমি একটি আস্ত মেড়া। তার পর গম্ভীর হয়ে বলল, আল্লা করুন, তুমি ওই রকম মেড়াই থাকো। আল্লার স্মরণে ডান-বাহু উঁচুতে তুলে আঁচল দিয়ে ঘোমটা টানল। আজান শুনলে বাঙালি মুসলমান মেয়ে যে-রকম করে থাকে।
ওদিকে তখন বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটা গুল বাহাদুরের ধুলো-ভরা আঙ্গিনায় হরিটের বাতাসা ছড়াতে আরম্ভ করেছে।
গুল বাহাদুর নিজের অপ্রতিভ ভাব কাটাবার জন্য গলা একটু শক্ত করে বললেন, ভিতরে চলো।
মিঠার মা মিশ্রির মিঠা। শক্ত। বললে, জোর করে টেনে নিয়ে যাবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে হাত দুখানি এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। এবং তারি সঙ্গে সঙ্গে উঠি-উঠি ভাব। টান দিলেই সুড়সুড় করে ভিতরে চলে যাবে।
গুল বাহাদুর দ্বিধায় পড়লেন। কী আর করেন? সুরটি যতদূর পারেন মমতাময় করে বললেন, মেহেরবানি কর। মেহেরবানি কথাটার আমেজ উর্দু এবং বাঙলাতে এক নয়। সেকথা না জেনেও আশা করলেন, মুসলমানের মেয়ে সুরটি ধরতে পারবে।
মোতী গুনগুন করে গান ধরে ভিতরে গেল। বুঝল গুল বাহাদুরের হার হয়েছে, কিন্তু এ লোকটা নিজে যখন বুঝতে পারেনি যে তার হার হয়েছে, তখন সে জেতাতে কী আনন্দ? আর হেরে যাওয়ার দুঃখের ছাপ যদি তার মুখের ওপর পড়ত তা হলেই কি মোতী আনন্দ পেত?
এবারে গুল বাহাদুরকে শুনিয়ে একটু উঁচু গলায় গাইল–
ও মুর্শিদ তোমার লগে নাই তো অভিমান
আইলে আও, যাইলে যাও, ঠেলে মারো টান
ও মুর্শিদ নাই তো অভিমান।
বাচ্চারে যে ঠ্যালা মারলে কান্দ্যা পড়ে মায়ের কোলে
যতো মারো বাচ্যা উঠে তত পরাণখান।
ও গুরু নাই তো অভিমান।
তুলাধুনা করা, মৌলা, ফেলাও না ফের জান।
করো না খান খান।
জানুক না জাহান।
মস্তান ফকিরে কয় হেন আমার মনে লয়
শুরুর মনে হৈল ভয়, পায়ে দিল স্থান।
ও মুর্শিদ গেল অভিমান।
এবারে শুল বাহাদুরের গীতটি বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না। কিন্তু খটকা লাগল অভিমান শব্দটি নিয়ে।
মোতী বলল, এতে আবার মুশকিল কোথায়? এই মনে কর আনন্দী যদি তোমার ওপর রাগ করে খিচুড়ি আলুর দম না খেয়ে শুতে যায় তবে সে তোমার ওপর অভিমান করল।
গুল বাহাদুর বললেন, সে তো হল রাগ।
মোতী বলল, তা নয়। যদি সে তখন তোমার ভাতে ছাই মিশিয়ে দেয় তবে হবে রাগ।
এবারে গুল বাহাদুর অনেকখানি বুঝতে পেরে বললেন, ওহ, তাই তুমি আমার ওপর অভিমান করে বাইরে বসে ছিলে?
মোতী উত্তর দিল না।
গুল বাহাদুর শুধালেন, এ গীত তুমি কাকে শোনালে?
মোতী নির্ভয়ে উত্তর দিল, তোমাকে, মুর্শিদকে, আর কাকে?
তোমার মুর্শিদ কে?
মোতী হেসে উঠল। বলল, আজ দেখি, তুমি অনেক কথাই শুধাচ্ছ। কেন, হিংসে হচ্ছে নাকি? হ্যাঁ, আছে একজন। কিন্তু সে বড় বুড়ো। সব রসকষ শুকিয়ে গিয়েছে। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।
গুল বাহাদুর বললেন, ছিঃ, গুরুকে নিয়ে কি এ ধরনের মস্করা করতে আছে?
মোতী বলল, মস্করা কিসের? এই তো আমার সব। আমার জান ভরে দেবে মহব্বত দিয়ে সে তো সব গীতেই আছে। আর আমার শরীরটা? সে বুঝি কিছু নয়? শুরু আমার সব আশা পূর্ণ করবে না?
গুল বাহাদুর নিরাশ হয়ে বললেন, তুমি সবসময় কেমন যেন হেঁয়ালিতে কথা কও। তোমার আশা যদি পাপে ভরা হয় তবে সেটাও গুরু পূর্ণ করবেন নাকি?
মোতী চিন্তা না করেই বলল, নিজেই জানিনে কী চাই। কখনও ইচ্ছে করে মা হয়ে ছেলে কোলে নিতে, কখনও-বা স্বামী পেতে ইচ্ছে করে, আর কখনও মনে হয় দুই, এসব দিয়ে কী হবে? তার চেয়ে একটি নাগর পেলে হয়। ওই যে-রকম তোমাদের রাধা ঠাকুরাণী কেষ্ট-মুরারিকে পেয়েছিলেন। রসের সায়রে সুবো-শাম ডুবে থাকব। আমার শরীর ওর শরীরে মিশে যাবে।
গুল বাহাদুর হাসিমুখে বললেন, যাক, বাঁচালে। মনের কেষ্টকে দিলের হরি বানিয়ে পড়ে থাকো। কোনও বদনাম হবে না।
অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মোতী বলল, ছোঃ! বদনাম! ডবকী ব্লাড়ি। নিকে করিনে। একলা পড়ে আছি। আমার বদনাম তো লেগেই আছে। নাগর নিলে তার আর বাড়বে কী? মড়ার গোরের উপর এক মণও মাটি শ মণও মাটি। আমি তাকে সাজ-সকাল কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসব– হাটে যাবার পথের পাশে।
গুল বাহাদুর ভাবলেন, মেয়েটা বদ্ধ পাগল। তার পর ভাবলেন, কিন্তু এরকম সাদা যার দিল তার আর ভাবনা কী? এর ভিতর-বাহির দুই-ই সাফ। বললেন, এসব খেয়ালি পোলাও খেয়ে তুমি খুব সুখ পাও, না? কিন্তু যত্রতত্র বলে বেড়িয়ো না।
মোতী সেদিকে খেয়াল না দিয়ে শুধাল, তোমার সম্বন্ধে বেবাক বাৎ আমার শুনতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বাবাজিদের তো ঘর-গেরস্তির কথা শুধানো বারণ। তবে যদি অভয় দাও তবে একটি কথা শুধাই।
গুল বাহাদুর হেসে বললেন, নির্ভয়ে জিগ্যেস কর। আমার কিচ্ছুটি লুকোবার নেই। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল গোঁফে চাড়া দেবার। কিন্তু গোঁফ তো আর নেই।
তোমার বিয়ে-শাদি হয়নি?
না।
কারোতে মজোনি?
না। তবে লক্ষ্ণৌ থেকে একবার একটি বাঈজি এসেছিল। যেমন নাচতে পারত, তেমনি গান জানত, তেমনি ছিল চেহারাটি। তাকে বড় ভালো লেগেছিল।
তার পর কী হল?
কিছুই হল না। আমি অন্য কাজে জড়িয়ে পড়লুম। তার পর এখানে চলে এলুম।
ও। কোনও কেলেঙ্কারি করে ভেক নাওনি?
বোষ্টমদের প্রতি গুল বাহাদুরের কোনও অহেতুক প্রেম ছিল না, কিন্তু তারা কেলেঙ্কারি করলেই শুধু ভেক নেয়, এ ইঙ্গিতটা তার ভালো লাগল না।
বললেন, কুল্লে বোষ্টমরা পাষণ্ড?
অত রাগো কেন? আমাদের মুসলমান পীরসায়েবদের দেখনি? তারা যে তাদের চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে রাখেন?
সে আবার কী?
ওই, আমার মতো গোটা দশেক খাপসুরৎ ডবকী হুঁড়ির মধ্যিখানে বসে ভাবখানা করেন, হেরো, হেরো, আগুন আমারে ছোঁয় না।
তার পর?
তার পর আবার কী, তার পর বিস্তর ঘি গলে যায়।
গুল বাহাদুর খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আচ্ছা, তুমি অতশত বলছ-কইছ, শুনছ শোনাচ্ছ কেন বল তো? আসলে তোমার মতলবটা কী খুলে বল তো?
মোতী গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছিল। বলল, মতলব কিছুই নয় গোঁসাই। আমি ভেবেছিলুম, তুমি নষ্টামি করে বেরিয়ে এসেছ। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তোমার সঙ্গে নষ্টামি করে আমি নষ্ট হব। এই আমার শরীর, এই আমার দিল। ওগুলো যখন কোনও কাজেই লাগল না, তখন না হয় ভেঙেই দেখি, কী হয়। তা আর হল না। তুমি বড় সরল, বড় সাদা। তোমার সঙ্গে বনলো না।
গুল বাহাদুর আপত্তি জানিয়ে বললেন, এটা মিথ্যে কথা। তোমার সবই ভালো। আমি অনেক দেখেছি, আমি ঠিক ঠিক বলতে পারি। অবশ্য আমার সঙ্গে বনলো কি না সে অন্য কথা।
মোতী আপত্তি জানিয়ে বলল, আমার যদি সবই ভালো তবে তাই হোক ঠাকুর। এবাবে তোমাকে শেষ প্রশ্ন শুধাই। তোমার সংসারে মন বসল না কেন, সেইটে আমায় বল।
গুল বাহাদুর বললেন, সংসারে আমার রত্তিভর অরুচি হয়নি, মোতী। আসলে আমি শিবুর মতো গদরের সেপাই। তোমার স্বামীর যা হওয়ার কথা ছিল। লড়াইয়ে হেরে গা-ঢাকা দিয়েছি। ভেক নিয়েছি যাতে করে দুশমন চিনতে না পারে– আমি মুসলমান।
***
লেখকের নিবেদন :
এখানেই ‘এক পুরুষ’ শেষ।
বইখানা ‘তিন পুরুষ’-এ সমাপ্ত করার বাসনা ছিল; কিন্তু আমার গুরুই যখন ‘তিন পুরুষ’ লিখতে গিয়ে এক পুরুষে সমাপ্ত করে সেটিকে ‘যোগাযোগ’ নাম দিলেন তখন যাঁর কৃপায় ‘মূক বাচাল হয়’ তাঁরই কৃপায় এস্থলে ‘বাচাল মূক’ হল।
ঘাটে যেও না বেউলো
আমার উল্টা-রথ তৈরি হচ্ছে। নিশ্চিন্ত থাকুন। পাকা লোক লাগিয়েছি। খাস মার্কিন। ওরা গ্রেতা গার্বো থেকে আরম্ভ করে ডিউক অব উইনজার আলকাপোনি থেকে শুরু করে আর্চবিশপ অব নটিংহাম সক্কলেরই কোরা কাপড় ধুয়ে কেচে মলমল করে তুলতে জানে। ওটা বেরোলে আর কেউ জীবনস্মৃতি পড়বে না।
ইতোমধ্যে ইতোমধ্যে কেন– বহুদিন ধরেই আমি বহু লোকের কাছ থেকে বহু পাণ্ডুলিপি পেয়েছি। প্রেরকদের কেউ কেউ চান আমি যেন তাবৎ বস্তু পড়ে সেটি মেরামত করে দিই। কেউ কেউ অল্পতেই সন্তুষ্ট। বলেন, আমার মতামত জানাতে। আর কেউ-বা সরাসরি শুধান, সার্থক-সাহিত্য কী প্রকারে সৃষ্টি করতে হয়?
উপদেশ-নির্দেশ দিয়ে, রিপুকম-মেরামতি করে যদি লেখক গড়া যেত তা হলে এই যে শান্তিনিকেতন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রায় চল্লিশ বছর ওইসব কর্ম লেখক এবং শিক্ষক উভয়রূপেই করে গেলেন, এখান থেকে বেরিয়েছেন ক-টি সার্থক সাহিত্যিক? আমি তো একমাত্র প্রমথনাথ বিশীর নাম জানি। পক্ষান্তরে শরৎ চাটুয্যে তো কারও কাছ থেকে একরত্তি সাহায্য পাননি। তার মতো সার্থক লেখক ক-জন? উত্তরে সবাই বলবেন, উনি একসেপশন– ব্যত্যয়। আমি বলব, সার্থক সাহিত্যিক হওয়া মানেই ব্যত্যয়।
কিন্তু তৎপূর্বে প্রশ্ন, আপনি সাহিত্যিক হতে চান কেন?
টাকা রোজগার করতে হয় না, তা এদেশে হয় না।
অনুসন্ধান করে দেখুন, এই বাঙলা দেশে ক-জন লোক একমাত্র কলমের জোরে মোটামুটি সচ্ছল অবস্থায় আছেন। অধিকাংশই কোনও না-কোনও ধান্দায় নিযুক্ত থেকে মাসের শেষে পাকা মাইনে পান। লেখার আমদানি ঘুষের মতো। কখন আসে কত আসে তার ওপর কণামাত্র নির্ভর করা যায় না। ঘুষের টাকা থাকেও না।
অর্থাৎ কপালজোরে হয়তো মাসতিনেক আপনি প্রায় পাঁচশো টাকা করে মাসে কামালেন–এর বেশি এদেশে আশা করবেন না কিন্তু তার ওপর নির্ভর করা চলবে না। পাঠকের মতিগতি কোন দিন কোন দিকে মোড় নেবে তার কোনও স্থিরতা নেই। আপনাকে তবু লিখে যেতে হবে, নতুন বই তৈরি করতে হবে, ওই দিয়ে যদি ভাটার টান ঠেকাতে পারেন। ইতোমধ্যে আপনার পুঁজি ফুরিয়ে এসেছে, অর্থাৎ যে অভিজ্ঞতার মূলধন নিয়ে লেখার ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন সেটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন কী করে? বয়েস হয়ে গিয়েছে বন্ধ প্রেমের হাট। লোটাকম্বল নিয়ে ঘোরাঘুরিও করতে পারেন না কোমরে বাত।
এই অভিজ্ঞতা-সঞ্চয়ের ব্যাপারে আরেকটা জিনিস মনে পড়ল– সে বড় মজার। ইয়োরোপে যে কোনও চিত্রকরের বাড়িতে নিত্যনতুন রমণী মডেল হয়ে আসছে। তারা বিবসনা হয়ে পোজ দেয়। কেউ কিছু বলে না। ওটা নাকি ওদের দরকার। চিত্রকরদের সবাই যে ভীষ্মদেব, শুকদেব ঠাকুর নন সে কথাও সবাই জানে। বস্তুত কোনও চিত্রকর যদি একটুখানি শুকদেবীয় হন তবে তার তাবৎ জীবনীকার সেটা চিৎকার করে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে দিয়ে আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দেন। বাদবাকিদের কেউ গালমন্দ করে না। ওই যে বললুম, ওটা নাকি ওদের দরকার।
এদেশে গুরুমহারাজদের এ অধিকার আছে। ভৈরবী, নর্মসখীরূপে এঁরা গুরুমহারাজদের সাধন-সঙ্গিনী হন। এ প্রথা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত।
কিন্তু যদি ইয়োরোপের পাদ্রিসাহেব ভৈরবী ধরেন তবে তাকে তিন দিনও সমাজে টিকতে হবে না। এদেশের গেরস্তপাড়ায় কোনও আর্টিস্টকে মডেলসহ বাস করতে দেবে না।
আমি কোনও ব্যবস্থার নিন্দা বা প্রশংসা করছিনে। সাহিত্যিক হিসেবে সে অধিকার আমার নেই। এর বিচার করবে সমাজ। সমাজ গুরু চায়, চিত্রকর চায়, সাহিত্যিক চায়। সমাজই স্থির করবে, কার কোটাতে অধিকার। সমাজ ভুলও করে। সোক্রোতেসকে বিষ, খ্রিস্টকে ক্রুশ দেয়।
এটা কিছু নতুন কথা নয়। সামান্য একটি আলাদা উদাহরণ দিই। বৈজ্ঞানিকদের সাধ্যি নেই জাহাজ জাহাজ টাকা জোগাড় করে এটম বম বানাবার। মার্কিন সমাজের সর্বপ্রধান মুখপাত্র রোজোভেল্ট দেশের টাকা বৈজ্ঞানিকদের পায়ে ঢেলে দিয়ে বললেন, ওটা আমার চাই। বৈজ্ঞানিকরা তৈরি করে দিলেন। ওটা জাপানে ফেলা হবে কি না, সেটা স্থির করলেন ট্রমান বৈজ্ঞানিকদের হাতে সে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত করার ভার দেওয়া হয়নি। তাদের মতামত চাওয়া হয়েছিল মাত্র। এবং শুনলে আশ্চর্য হবেন, বৈজ্ঞানিকদের অধিকাংশই বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন।
দার্শনিকদের বেলাও তাই। কেউ হয়তো প্রামাণিক বই লিখে প্রমাণ করলেন, ঈশ্বর নেই। কিন্তু তার সাধ্য কী সে বই স্কুলে স্কুলে কলেজে কলেজে পড়ান! সেটা স্থির করবে সমাজ। কিংবা মনে করুন, বুদ্ধদেব বলেছেন ঈশ্বর নেই। সেটা সিংহল, বর্মার স্কুলে পড়ানো হয়। এদেশে পড়াতে গেলে সমাজ আপত্তি করবে।
কিংবা এই ফিল্মের কথাই নিন। প্রডুসার ডিরেক্টর দর্শক তো স্থির করেন না, কোন্ ফিল্ম দেখানো চলবে আর কোনটা চলবে না। স্থির করে সমাজ সেন্সর বোর্ডের মারফতে। কিন্তু সে আলোচনা উপস্থিত মুলতবি থাক। আপনি কেন সাহিত্যিক হতে চান, সেই কথায় ফিরে যাই।
তা হলে কি আপনি সাহিত্য সৃষ্টি করে খ্যাতি-প্রতিপত্তি সঞ্চয় করতে চান?
প্রতিপত্তি হবে না। সে-কথা গোড়া থেকেই বলে রাখি।
আমি সামান্য লেখক। দেশে-বিদেশে বইখানা প্রাইজ পেয়েছে। আমি তাই নিয়ে গর্ব করছিনে, ঈশ্বর আমার সাক্ষী। নিতান্ত এই প্রতিপত্তির কথা উঠল বলে সে কথাটা বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। আমার বন্ধুবান্ধব এবং আপনাদের মতো সহৃদয় পাঠক কেউ কেউ বলেন, কাবুলে তো ছিলে মাত্র দু বছর। তবু বইখানা মন্দ হয়নি। জর্মনিতে তো ছিলে অনেক বেশি। সে দেশ সম্বন্ধে ওইরকম একখানা বই লেখ না কেন? আমি ভাবলুম, প্রস্তাবটা খুব মন্দ নয়। মোটামুটি একটা খসড়াও তৈরি করলুম। কিন্তু বিপদ হল হিটলারকে নিয়ে। বিপদ হল ১৯৩৯-৪৪-এর যুদ্ধ নিয়ে। আমি ১৯৩৮-এর পর সেখানে আর যাইনি। আর আজ হিটলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাদ দিয়ে জর্মনি সম্বন্ধে লেখা, এ যেন মুরারজি দেশাইকে বাদ দিয়ে চৌদ্দ ক্যারেট গোল্ডের কথা লেখা।
তাই মনে করলুম, আরেকবার না হয় হয়েই আসি। কুড়ি বছরের বেশি হতে চলল, বিদেশ যাইনি। হার্টও ট্রাবল দিচ্ছে। জর্মন ডাক্তাররা যদি কিছু একটা ভালো ব্যবস্থা করে দেয়। পাবলিশারদের বললুম কিছু টাকা আগাম দিতে। যাদের অনুরোধ করলুম তাঁরা সোল্লাসে টাকা পাঠালেন– এঁরা সজ্জন।
এবারে ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বিদেশি মুদ্রার পালা।
উত্তর এল, ফেলেট ননা– তিন না চার লাইনে, ঠিক মনে নেই।
কোথায় রইল প্রতিপত্তি? কোথায় রইল খ্যাতির মূল্য? আমি যেতে চাইছিলুম নিজের টাকায় সরকারের টাকায় নয়। বলুন তো, ক-জন বাঙালি লেখক নিজের টাকায় (অবশ্য সেই আগাম টাকা নেওয়ার ফলে নির্ভর করতে হবে আমার চাকরির মাইনের ওপর) বিদেশ যেতে পারে? যে পারল সে-ও সুযোগ পেল না।
পাঠক ভাববেন না, আমি কর্তৃপক্ষকে দোষ দিচ্ছি। মোটেই না। তারা তো আমার দুশমন নন। তাঁরা যা ন্যায্য মনে করেছেন তাই করেছেন।
আমি বলতে চাই, কোথায় রইল লেখকের প্রতিপত্তি! আমি চেয়েছিলুম, কুলে দু হাজার টাকার বিদেশি মুদ্রা। আমার প্রতিপত্তির মূল্য তা হলে দু হাজার টাকাও নয়। অবশ্য এতে আমার দুঃখিত হওয়া অত্যন্ত অনুচিত। স্বয়ং যিশুখ্রিস্টকে ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর শিষ্য জুডা ত্রিশটি মুদ্রার বিনিময়ে!
ঈষৎ অবান্তর হলেও বলি, তবু আমি গিয়েছিলুম। জানেন তো, নেড়ের গো। পকেটে ছিল পঞ্চাশ না ষাটটি জর্মন মুদ্রা। সেখানে চলল কী করে? ওহ! সেখানে আমার কিঞ্চিৎ প্রতিপত্তি আছে। তবে কি জর্মনরা খুব বাঙলা বই পড়ে? মোটেই না। তবে আমার প্রতিপত্তি অন্য বাবদে এবং সেটা এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর। ধরে নিন, আমি সার্কাসের দড়ির উপর নাচতে পারিনা, সেটা বিশ্বাস হল না, আমার কোমরে বাত বলে?– তা হলে ধরুন, আমি হত্তনের পঞ্জাকে হত্তনের গোলাম বানাতে পারি।
এই তো গেল প্রতিপত্তির কথা। এবারে খ্যাতি। আমার খ্যাতি অত্যল্প, তাই আমার কথা তুলব না। আমার ইয়ার পাহাড়ী সান্যালের (ওহ! বলতে গর্বে বুকটা কী রকম ফুলে উঠেছে!) খ্যাতি সম্বন্ধে তো আপনাদের কোনও সন্দেহ নেই। তাকে গিয়ে শুধান, সে কী আরামে আছে। অত্যন্ত গোবেচারী লোক– অন্তত আমার যদুর জানা– দুটি পয়সা কামিয়ে, কোনও ভালো হোটেলে ইয়ার বক্সিসহ একটুখানি মুর্গি-কারি খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে–তার পানের ঝাঁপিটি দেখেছেন তো বাড়ি যাবে। শুধান গিয়ে তাকে, হোটেলে বসামাত্রই আকছারই তার কী অবস্থা হয়।
অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ, গুষ্টির পিগ্রিাফ কী চায় না লোকে তার কাছ থেকে! গোড়ায় আমি জানতুম না। আমার এক ভাগ্নের জন্য চাইলুম অটোগ্রাফ। সে যা করুণ নয়নে তাকাল– ভাবখানা এ টু ব্রুটি!–যে আমার দয়া হল। তাড়াতাড়ি বললুম, না, না, থাক।
বেশ কিছুদিন তাকে দেখিনি। তার কারণ অবশ্য, আমার নিবাস মফস্বলে। শহরে গিয়েছি। রেস্ত কম। তাই বসেছি তন্দুরি মুর্গির হোটেলে একলা-একলা। মুর্গিটা খেয়ে প্রায় শেষ করেছি এমন সময় গলকম্বল মানমুনিয়া দাড়ি সমেত সমুখে দাঁড়ালেন এক মহারাজ। আমার মুখে বোধহয় কিঞ্চিৎ বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। লোকটাও রস্টিক, হোটেলে এত টেবিল খালি থাকতে আমার সামনের চেয়ারখানায় ধপ করে বসে পড়বেন কেন?
শুধাল, কেমন আছ ভাই?
আরে! এ যে পাহাড়ী। দাড়ি-ফাড়ি নিয়ে এদ্দিন বাদে খাঁটি পাহাড়ী বনল। বললুম, খুলে কও।
কাতর কণ্ঠে বললে, আর কী উপায়, বল!
আমি দরদী গলায় বললুম, বড় পাওনাদার লেগেছে বুঝি?
পাহাড়ী খাসা উর্দু বলে। সে-ও বলে বেড়ায়, আমি ভালো উর্দু বলতে পারি। এই করে আমার নিজের জন্য বেশ একটা সুনাম কিনে ফেলেছি।
পাহাড়ী বললে, তওবা, তওবা। ওয়াস্তা ফিরুল্লা। পাওনাদার হলেও না হয় বুঝতুম। আর সে কি আমার নেই? এন্তের। কিন্তু তারা ভদ্রলোক। খাবার সময় উৎপাত করে না।
বুঝলুম, মামেলা ঝামেলাময়। বললুম, তা তুমি এক কাজ কর না কেন? এডমায়ারারদের কেউ ধরলে বল না কেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, মিলটা ধরেছেন ঠিকই। তবে আমি পাহাড়ী সান্যাল নই, আমি তার ছোট ভাই, আমার নাম জংলী সান্যাল। দাড়িটাই অবশ্য জংগলীর ইন্সপিরিন জুটিয়েছিল।
ঠাণ্ডি সাঁস লেকর অর্থাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে– পাহাড়ী ফরাসিতে বলল, সা না ভা পা, শের– না, ডিয়ার সে হয় না।
আমি বললুম, কেন? তুমি কি আডোনিসের মতো খাবসুরত?
তেড়ে বলল, কামাল কিয়া, ইয়ার। নামে কী আপত্তি? তা নয়। একবার তাই করেছিলম। ফল কী হল, শোনো। এই হোটেলেই, যা, এই হোটেলেই একদিন বসে আছি, একলা। এমন সময় কে এক অচেনা লোক এসে শুধাল, আপনি কি পাহাড়ী সান্যাল? আমিও তোমারই মতো– গ্রেট মেন থিঙ্ক এলাইক– একগাল হেসে বললুম, আজ্ঞে, মিলটা ধরেছেন ঠিকই, তবে আমি পাহাড়ী সান্যাল নই, আমি তার ছোট ভাই। লোকটা খানিকক্ষণ ইতিউতি করে বলল, কী করি বলুন তো! ম্যানেজারবাবু আমাকে তার কাছে পাঠালেন তিনশো টাকা দিয়ে যেতে। তাঁকে পাই কোথায়? তার পর আমি তাকে যতই বোঝাই
আমিই পাহাড়ী সান্যাল, সে আর মানতে চায় না।
আমি ভেবে বললুম, তা তো বটেই। আমিই সে অবস্থায় মানতুম না। সোত্সাহে বলল, ইয়ে। তার পর আরও ঠাণ্ডি সঁস লেকর বলল, ভাই, সে টাকাটা আর কখনও পাইনি। ম্যানেজার লোকটা ছিল ভালো। অন্তত আমার টাকাটা শোধ করে লাটে উঠতে চেয়েছিল– আমি কি আর জানি! পরদিন সেখানে গিয়ে দেখি সব ফর্সা।
হ্যাঁ! একটা কথা বলতে ভুলে গেলুম। আমার মুর্গির বিলটা পাহাড়ীই দিয়েছিল। কিন্তু এটা বলে কি পাহাড়ীর দুশমনি করলুম না? এ যাবৎ তো লোকে শুধু অটোগ্রাফ চাইত, এখন যদি
আরেকটি কথা। আমাদের এত দোস্তি কেন? সে আমার বই পড়ে না, আমি তার অভিনয় দেখি না। একেবারে খাঁটি হল না কথাটা। আমি বড়দিদি দেখেছি– সে বোধহয় দেশে-বিদেশের পাঁচ পাতা পড়েছে।
পাঠক সর্বশেষে অবশ্য শুধাবেন, আমি এত বাখানিয়া আপনাদের সাহিত্যিক হতে বারণ করছি কেন। তার কারণ সোজা। আমার বিশ্বাস একমাত্র জিনিয়াসরাই আমার লেখা পড়ে। অর্থাৎ আপনারা। বাজারে নামলে আমার রুটি মারা যাবে বলে।
আচ্ছা, আমার কথা ছাড়ন। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র কী বলেছেন
অস্য দন্ধোদরস্যার্থে কিং কিং ন ক্রিয়তে ময়া।
বানরীমিব বাগদেবীং নয়ামি গৃহে গৃহে ॥
ওরে পোড়া পেট, কত না কিছুই করি আমি তোর তরে।
বাদরীর মতো সরস্বতীরে নাচাচ্ছি ঘরে ঘরে —
(লেখকের অনুবাদ)
পেটের জন্যই হোক, আর খ্যাতির জন্যই হোক, সরস্বতাঁকে বানরের মতো নাচাবেন না। আপনারা বলবেন, এটা তো বড় সিরিয়াস কথা হয়ে গেল। সে-ই তো চেষ্টা করছি গত চৌদ্দ বছর ধরে। সিরিয়াস কথা হেসে হেসে বলার।
কিন্তু পারলুম কই? এখন আবার বৃদ্ধ বয়সে ধাতই-বা যায় কী করে?
উম্র সারি তো কটি ইশকে বুতা মে, মোমিন!
আখেরি ওয়ক্ত সেঁ ক্যা খাক মুসলমা হোংগে?
সমস্ত জীবন তো কাটালে মিথ্যা প্রতিমার প্রেমে,
হে মোমিন!
এই শেষ সময়ে আর কি ছাই মুসলমান হব?
বরঞ্চ লেখা বন্ধ করাই ভালো। উৎসও শুকিয়ে এসেছে।
ওয়ার এম
রাজা প্রজাগণকে কহিলেন,
দেখ, আমার রাজ্যে শত্রুভয় উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু ইহা ফলিত(১) বংশের(২) ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইবে। শত্রুগণ আত্মবিনাশের নিমিত্তই আমার রাজ্যে আক্রমণ করিতে অভিলাষ করিতেছে। এক্ষণে এই ঘোরতর ভয়াবহ আপদ সমুপস্থিত হওয়াতে আমি তোমাদিগকে পরিত্রাণাৰ্থ অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। উপস্থিত ভয় নিরাকৃত হইলে তোমাদিগকে পুনরায় প্রদান করিব।(৩) আর শত্রুগণ যদি বলপূর্বক তোমাদের ধন গ্রহণ করে, তাহা হইলে তোমরা কদাচ উহা পুনঃপ্রাপ্ত হইবে না। বিশেষত অরাতিগণ রাজ্য আক্রমণ করিলে তোমাদের পুত্রকলত্রাদিও বিনষ্ট হইবে। তাহা হইলে তোমাদের অর্থ আর কে ভোগ করিবে! তোমরা আমার পুত্রের ন্যায়, আমি তোমাদের সমৃদ্ধি দর্শনে যারপরনাই পরিতুষ্ট হইয়া এই আপকালে রাজ্যরক্ষার্থে তোমাদিগের নিকট অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। তোমরা যথাশক্তি ধন উৎপাদনপূর্বক(৪) রাজ্যের উপদ্রব নিবারণ কর। বিপদকালে ধনকে প্রিয় বোধ করা অত্যন্ত অকর্তব্য।
রাজ্যপালন সম্পর্কে যুধিষ্ঠির কর্তৃক ভীষ্মকে প্রশ্ন করায় ভীষ্মের উত্তর। মহাভারত, শান্তিপর্ব, সপ্তাশীতিতম অধ্যায়। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে তৃতীয় খণ্ড, ৪৫০ পৃ.।
যুদ্ধ কাম্য নয়। একথা সত্য, যুদ্ধের সময় অনেকেই আপন শৌর্য, বীরত্ব দেখিয়ে আপন জাতকে গৌরবান্বিত করেন, কিন্তু শেষ বিচারে দেখা যায়, যুদ্ধে অমঙ্গলের অংশই বেশি।
তাই যখন কোনও জাতিকে বাধ্য হয়ে সংগ্রামে নামতে হয় আজ আমরা যে রকম নেমেছি– তখন তাকে খুব ভালো করে, অতিশয় সুস্থ মস্তিষ্কে আবেগ-উচ্ছ্বাসরহিত হৃদয়ে চিন্তা করে নিতে হয়, তার উদ্দেশ্য কী? সে কী চায়? একে বলা হয় ওয়ার এম্।
তার খানিকটা নির্ভর করে বিপক্ষের মতলবটা কী, সে কী চায় তার ওপর।
চীন প্রাচ্যদেশের জনবলে বলীয়ান মহারাষ্ট্র। কিন্তু জন থাকলেই ধন হয় না। চীন গরিব দেশ। তাই গত দশ-বারো বছর ধরে সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কী করে সে আপন ধনদৌলত বাড়াতে পারে। প্রধানত রুশের সাহায্যে।
ইতোমধ্যে এই নয়া কম্যুনিস্ট জাত অর্থাৎ চীন– খানদানি কম্যুনিস্ট জাত অর্থাৎ রুশকেও খানদানিত্বে এক কাঠি ছাড়িয়ে যেতে চাইল। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে আকছারই হয়েছে। পূর্ববাংলায় মুসলমানরা বলে, নয়া মুসলমান গরু খাওয়ার যম হয়। অর্থাৎ শুশানের চাড়াল যদি হঠাৎ দৈবযোগে পৈতে পেয়ে যায় তবে তার বাড়িতে যা সন্ধ্যা-আহ্নিকের ঘটা লাগে তা দেখে জাত ব্রাহ্মণ পরিত্রাহি রব ছাড়ে। চীন বেশ কড়া গলায় রাশাকে বলল, তুমি যেভাবে মার্কিনিংরেজের সঙ্গে দহরম-মহরম করছ সেটা মার্ক-লেনিনবাদের বিশ্ব-কম্যুনিজম আশু আনয়ন করার বিপক্ষে যায়। তুমি শান্তি চাইছ; এ করে এখনকার মতো শান্তি পাচ্ছ বটে, কিন্তু চিরন্তন শান্তি আসবে একমাত্র বিশ্বক্যুনিজমের ফলরূপে। তার জন্য দরকার আপন ধর্মে অর্থাৎ ক্যুনিজমে বিশ্বাস। তার অর্থ শান্তির মারফতে ইহসংসারে কোনও প্রকারের প্রগতি হয় না। সর্ব প্রগতি যুদ্ধের মাধ্যমে। অতএব মার্কিনিংরেজ যেখানে বলবে শান্তি চাই, তুমি সঙ্গে সঙ্গে বলবে যুদ্ধ চাই। এই করে আসবে বিশ্ব-কম্যুনিজম।
রুশ বলল, হক কথা। কিন্তু মার্কস-লেনিনের আমলে অ্যাটম বম্ ছিল না। এখন যদি যুদ্ধ চালাই তবে আখেরে যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড ছারখার হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে কে?
এখানে এসে চীন কিছু বলে না। কারণ চীন জানে, রুশ ইংল্যান্ড আমেরিকার জনসংখ্যা ৯৯ পার্সেন্ট মরে গেলেও তার আপন দেশে থাকবে লক্ষ লক্ষ লোক। কারণ তার জনসংখ্যা সক্কলের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। তারাই তখন পৃথিবীর রাজত্ব করবে।
এটা কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। ১৯৩৮-এ ইংরেজ-ফরাসি চেয়েছিল হিটলারে-স্তালিনে লড়াই লাগিয়ে দুই ব্যাটাই মরে; তারা পরমানন্দে বিশ্ব-সংসারটা চষে বেড়াবেন।
কট্টর কম্যুনিস্ট বিশ্বাস করে যে, যারা কমুনিজমে বিশ্বাস করে না তারা সবাই এক গোয়ালের গরু। তার কাছে মার্কিন যা ভারতবাসীও। ইংরেজিতে কথায় কথায় বলে, যে আমার সপক্ষে নয় সে আমার শত্রু–নিরপেক্ষ বলে কোনও জিনিস নেই। কাজেই আমরা যে ভারতীয়েরা চীনের শত্রু-মিত্র কিছুই নই, আমরাও তার শত্রু- আমাদের একমাত্র অপরাধ আমরা কম্যুনিস্ট নই– অথচ ধর্ম জানেন, আমরা কম্যুনিস্টদের প্রতি যতখানি সহনশীল, চেকোশ্লোভাকিয়া কিংবা পোল্যান্ড অতখানি হবে না। যদি আজ পূর্ণ স্বাধীনতা পায় তবে কম্যুনিস্টদের ঠেঙিয়ে ঠাণ্ডা করে দেবে। এই যে পশ্চিম জর্মনি গণতান্ত্রিক দেশ, সে-ও কমুনিস্টদের বরদাস্ত করে না।
খ্রশ্চভ এ তত্ত্বটি ভালো করেই জানেন। তাই তিনি ভারতকে শত্রুর চোখে দেখেন না। তাঁর বিশ্বাস, তিনি এবং অন্য কম্যুনিস্টরা যদি আমাদের দিকে চোখ রাঙায় আক্রমণ দূরে থাক তবে আমরা পুরো পাক্কা ক্যাপিটালিস্ট হয়ে গিয়ে মার্কিনকে আমাদের দেশে বিমানঘাঁটি বানাতে দেব, এবং শেষ হিসেবের দিন তার হয়ে রুশের বিরুদ্ধে লড়ব।
চীন যখন রাশাকে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করতে পারল না, এবং শুধু তাই নয়, রুশ যখন চীনের বাড়াবাড়ি বরদাস্ত না করতে পেরে তার সর্ব সাহায্য বন্ধ করে দিল–শুনতে পাই রাশানরা চীন ত্যাগ করার ফলে তাদের তৈরি কারখানাগুলো চালকের অভাবে খা খা করছে তখন চীন বলল, এটার একটা ইপার-উস্পার করতে হবে। আমি ভারত আক্রমণ করে দেখি রুশ তখন কী করে? সে তো আর কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনিস্ট রাষ্ট্র– অর্থাৎ ভারতকে সাহায্য করতে পারবে না!
এইটে চীনের গৌণ ওয়ার এম– যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
মুখ্য ওয়ার এম তবে কী?
পোল্যান্ড-রুশের বিরুদ্ধে হিটলারের ওয়ার এ ছিল, (১) ওদের সৈন্যবাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করা, (২) ওদের নেতৃস্থানীয় কমিসারদের নিধন করা– তারা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুক আর না-ই করুক, অর্থাৎ কোলব্লাডেড মার্ডার। (৩) তাদের রাজত্বে জর্মনদের বসতি স্থাপনা করে তাদের দিয়ে দাসের কাজ করানো।
রুশভেল্ট ঠিক অতখানি চাননি। তবে তিনিও জর্মনদের কাছ থেকে শর্তহীন আত্মসমর্পণ চেয়েছিলেন আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার। অর্থাৎ তিনি নাৎসি গুণ্ডা ও জর্মন জনসাধারণের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখেননি। চার্চিল এটা পছন্দ করেননি তিনি চেয়েছিলেন নাৎসি রাষ্ট্রের পতন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা– এই ছিল তার ওয়ার এম্।
চীন আমাদের সমূলে ধ্বংস করে এ দেশে চীনা চাষাভূষোর বসত করতে চায়নি কিন্তু চীনের অন্যতম ওয়ার এ ছিল এদেশে কম্যুনিস্ট রাজ বসানো। চীন আশা করেছিল সে ভারতে হামলা দেওয়া মাত্রই এদেশের কম্যুনিস্টরা দেশের জনসাধারণকে তাতিয়ে কমুনিস্ট রাষ্ট্র বসাতে পারবে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, সেটা হল না। এমনকি অনেক খাঁটি কম্যুনিস্ট, চীনের এ আচরণে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছেন এবং অনেকেই পণ্ডিতজির ঝাণ্ডার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন আর খ্রশ্চভপন্থীরা তো রীতিমতো উন্মা প্রকাশ করেছেন।
স্মরণ রাখা উচিত, চীনাদের এ ওয়ার এম উপস্থিত মুলতবি থাকলেও সেটাকে সে কখনও বর্জন করবে না। আমাদের তার জন্য হুশিয়ার হয়ে থাকতে হবে–হয়তো-বা বহু বছর ধরে।
আমাদের মনে হয় চীন চায় আমাদের পঙ্গু করে রাখতে। প্রাচ্য দেশের দুই বিরাট ভূখণ্ড চীন এবং ভারত। ভারত কম্যুনিস্ট না হলেও দেশের ধনদৌলত বাড়াতে চেয়েছে, আর চীন কম্যুনিজমের মাধ্যমে। এবং চীন যে বিশেষ সফল হয়নি এ কথা বিশ্বসুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছি সে-ও জানা কথা। আখেরে তা হলে আমরাই প্রাচ্য দেশগুলোর নেতৃস্থানীয় হব। চীনের কর্তারা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেন না।
তাই তাঁদের মতলব আমরা যেন আমাদের ধনদৌলত বাড়ানো বন্ধ করে বন্দুক-কামানের দিকে মন দিই। তাই নিয়ে চীনের কোনও আশঙ্কা নেই, কারণ চীন বিলক্ষণ জানে, আমাদের বন্দুক-কামান যতই বাড়ুক না কেন, আমরা কখনও চীন আক্রমণ করব না। মাঝের থেকে বন্ধ্যা বন্দুক-কামানের সেবা করে আমাদের ধনদৌলত বৃদ্ধি ক্ষান্ত হবে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের বন্দুক-কামান বাড়াতে হবে।
কিন্তু আমাদের ওয়ার এ চীনার বিনাশ-সাধন নয়। আমাদের ওয়ার এম্ অত্যন্ত লিমিটেড সঙ্কটকালে আক্রমণকারীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। এবং ভবিষ্যতে যেন সে দম্ভভরে পুনরায় আক্রমণ করার সাহস না পায়, তার জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে বন্দুক-কামান বানাতে হবে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গরিব-দুঃখীর মুখে অন্ন তুলে দেবার জন্য আমাদের ধনদৌলতও বাড়াতে হবে।
তাই বলছিলুম, রাধব এবং চুলও বাঁধব।
———-
১. ২. ফলবান্ বংশের–বাঁশের ফল হইলে বাঁশ মরিয়া যায়। অনুবাদকের টীকা। কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ। বসুমতী।
৩. আজকের দিনের উয়োর-বনড, ডিফেন্স সার্টিফিকেট।
৪. ধন উৎপাদনের একমাত্র পন্থা, প্রোডাকশন্ বাড়ানো। অর্থাৎ ইন্ডাসট্রিয়াল ও এগ্রিকালচরল তৈজসপত্র বাড়ানো। না হলে শুধুমাত্র ধনে সর্ব সমস্যার সমাধান হয় না। কথিত আছে, বর্বর মঙ্গলরা যখন প্রবল প্রতাপশালী আব্বাসী খলিফার রাজধানী বাগদাদ দখল করে খলিফাঁকেও বন্দি করতে সক্ষম হল, তখন মঙ্গল সেনাধ্যক্ষ খলিফাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। ভোজনের জন্য খলিফার সামনে রাখলেন থালা থালা সোনা-জহরত। নিজের সামনে রাখলেন উত্তম উত্তম আহারাদি। খেতে খেতে খলিফাঁকে শুধালেন, হুজুর, খাচ্ছেন না কেন? হুজুর চুপ করে রইলেন। পুনরায় সেই প্রশ্ন। পুনরায় নো রিপ্লাই। তৃতীয় বারে নিরুপায় হয়ে খলিফা বললেন, এগুলো তো খাবার জিনিস নয়। মঙ্গল বললেন, সে কী হুজুর, আপনার রাজত্ব জয় করবার পর আপনার ধনাগার বোঝাই পেলুম এইসব সোনা-জহর। ভাবলুম এগুলো বুঝি আপনি খান। অন্য কোনও কাজে লাগাননি তাই।
অর্থাৎ, শুধু ধন দিয়ে সবকিছু হয় না।
তা হলে ধনী লোকের বাড়িতে ডাকাতি হত না।
হিটলার কী আদর্শ নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন সেটা জানবার আমাদের প্রয়োজন নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ দেউলে রাষ্ট্রকে তিনি কী করে জোরদার করলেন সেটা জানা উচিত। তিনিও বলেছিলেন, আমার ব্যাংকে সোনা-জহর নেই। বয়ে গেল। আমি চাই জোয়ান মেয়েম। যারা উৎপাদন করতে পারে। আপন বাহুবলে। আমি রাজা, তখন সেগুলো কিনব। তাই ভীষ্মদেব ধন উৎপাদনের আদেশ দিয়েছিলেন।
কবিরাজ চেখফ
উত্তম গুরুর সদুপদেশ পেলেই যদি সার্থক লেখক সৃষ্টি হতেন তবে ইহ-সংসারে আমাদের আর কোনও দুর্ভাবনা থাকত না। কারণ আমার বিশ্বাস, এতাবৎ বহুতর গুরু অপ্রচুর পুস্তকে নানাবিধ সদুপদেশ দিয়ে গিয়েছেন, এবং সদুপদেশ-তিয়াষী তরুণ সাহিত্যযশাভিলাষীরও অনটন এই বঙ্গদেশে নেই।
আমি সার্থক সাহিত্যিক নই, তবে কিছুটা লোকায়ত (জনপ্রিয় বললে বড় বেশি দম্ভভাষণ হয়ে যায়) বটি। ট্রেনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তিনি সোল্লাসে বলেছিলেন, আপনার লেখা পড়লেই পাঁচকড়ি দের কথা আমার মনে আসে।
আমি সাতিশয় শ্লাঘা অনুভব করেছিলুম। আমি জানি আপনারা পাঁচজন পাঁচকড়িকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। যদিও শুধোই, বুকে হাত দিয়ে উত্তর দিন তো, পনেরো বছর বয়সে পাঁচকড়ি পড়ে আপনার পঞ্চেন্দ্রিয়াস্তম্ভন হয়নি? আপনার চৈতন্যকে এরকম সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ একাগ্ৰমনা করতে পেরেছেন ক-জন লেখক এবং স্বয়ং গীতা বলেন, চৈতন্যকে সর্বপ্রথম নিষ্কম্প প্রদীপশিখার ন্যায় একাগ্র করে তবে ধ্যানলোকে প্রবেশ করবে। স্বয়ং পতঞ্জলিও বলেন, ধ্যানের বিষয়বস্তু অবান্তর। তা সে যাক্। আসল কথা সে বয়সে পাঁচকড়ি আপনাকে এমনি একাগ্ৰমনা করে দিয়েছিলেন যে, আপনি তখন দেশকালপাত্র ভুলে গিয়েছিলেন। এবং এটা যে আর্টের অন্যতম লক্ষণ সেটি সর্বজনবিদিত। তা হলে আজ আপনি পাঁচকড়ির নামে নাক সেঁটকান কেন? পাঁচকড়ি পড়ার পূর্বে সাত বছর বয়েসে আপনি রূপকথা পড়েছিলেন, আজ পড়েন না, কিন্তু তাই বলে তো আপনি ওর পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসেন না, কেন?
টলস্টয় বলেন, যে বই সর্বযুগে সর্ববয়সের লোক পড়ে আনন্দ পায় সেই বই-ই উত্তম বই। সেরকম বই ইহসংসারে অতিশয় বিরল। টলস্টয় মহাভারতের নাম করেছেন। আমরা সম্পূর্ণ একমত। (তিনি তাঁর নিজের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তির নিন্দা করেছেন। আমরা একমত নই)।
অতি অল্প লেখককেই টলস্টয় আর্টিস্ট বা সৃষ্টিকর্তারূপে স্বীকার করেছেন। চেখফ তাদেরই একজন* [*টলস্টয় চেখকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যে, একদিন টলস্টয়ের বাড়ি ইয়াসানা পলিয়ানাতে যখন তিনি আর গোর্কি বসে গল্প করছেন তখন চেখ বাগানের অন্য প্রান্ত দিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে টলস্টয় গোর্কিকে বলেন, জানো গোর্কি, চেখফ যদি মেয়েছেলে হত তবে আমি ওকে বিয়ে না করে থাকতে পারতুম না। যারা বর্তমান লেখকের অত্যধিক বাগাড়ম্বর অপছন্দ করেন, তারা বাকি প্রবন্ধ না পড়ে সোজা চেখফের দুলালী গল্পের অনুবাদে চলে যাবেন।] তাকে তিনি বলেছেন, রিয়েল আর্টিস্ট;- পাঠক সেটি পরে সবিস্তর শুনতে পাবেন।
চেখফের দিকে তাকিয়ে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই।
প্রথম ছবি দেখি, রুশের এক গগ্রামে ঘরের ছেলে চেখফ গাঁয়ের পাঁচজন মাতব্বরের চালচলন কথাবার্তার ভঙ্গির অনুকরণ করে বাড়ির পাঁচজনকে হাসাচ্ছে। আবার সঙ্গে সঙ্গে সে ক্লাসের সর্দার পড়ুয়াও বটে।
তার পরের ছবি দেখি মস্কোতে। গরিব পরিবারে। একটা ছোট্ট ঘরে মা কচুঘেঁচু রাধছেন, বাবা অর্থাভাবের কথা চিন্তা করে আপন মনে গজগজ করছেন, ভাইবোনেরা কিচিরমিচির করছে, আর মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র চেখ– বয়স উনিশ– তারই এককোণে, হট্টগোল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, খস্ খস্ করে পাতার পর পাতা ফার্স লিখে যাচ্ছেন। তিনি জানেন, খুব ভালো করেই জানেন, রসিকতাগুলো কাঁচা, কিন্তু তার চেয়েও ভালো করেই জানেন, খবরের কাগজের গ্রাহক রামাশামা এ ধরনের রসিকতাই পছন্দ করে, সম্পাদকমশাইও সেই মালই চান। লেখা শেষ হল। রান্না তখনও শেষ হয়নি। চেখক ছোট ভাইকে বললেন, লেখাটা নিয়ে যা তো অমুক পত্রিকার আপিসে। দু-পাঁচ টাকা যদি দেয় তবে কিন্তু কাবাব-টাবাব কিনে আনিস। কচুঘেঁচু গেলার সুবিধে হবে।
এর পাঁচ বছর পর চেখফ মেডিকেল কলেজ পাস করলেন।
কিন্তু ভালো করে প্র্যাকটিস করা চেখফের আর হয়ে উঠল না। ইতিমধ্যে রুশদেশ জেনে গিয়েছে, চেখফের সার্জিকাল ছুরির চেয়ে তার কলমের ধার বেশি। তবু সরকার তাঁকে পাঠালেন সাখেলিন দ্বীপের কয়েদিদের সম্বন্ধে মেডিকেল তদন্ত করতে। সে রিপোর্ট তিনি এমনই বুক-ফাটানো জোরালো ভাষায় লিখেছিলেন যে, তারই ফলে সরকার কয়েদিদের জন্য বহু সুব্যবস্থা অবলম্বন করলেন। এ রিপোর্টখানা আমি কিছুতেই সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আমার বড় বাসনা ছিল দেখবার, সাহিত্যিক যখন মেডিকেল রিপোর্ট লেখে তখন তার কলমফ কীভাবে চালায়? সংযত করে? যাতে করে লোকে না ভাবে সাহিত্যিক তার হৃদয়-উচ্ছ্বাস দিয়ে তথ্যের দীনতা ঢাকতে চেয়েছে– কেসে পয়েন্ট না থাকলে উকিল যে-রকম গরম লেকচার ঝাড়ে আর টেবিল থাবড়ায়। কিংবা তার জোরদার কলমফ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে? কিংবা উভয়ের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণে? রবীন্দ্রনাথ যখন সভ্যতার সংকট লিখেছিলেন তখন তার লেখনে কতখানি রাষ্ট্রদর্শন আর কতখানি কবির তীব্র হৃদয়-বেদনার পরিপূর্ণ প্রকাশ!
তার পর একবার লেগে যায় রুশ দেশে জোর কলেরা। সেই এক বছর চেখফ ডাক্তারি করেন প্রাণপণ। ব্যস।
খাস পশ্চিমের লোক বয়েস হওয়ার পর বিয়ে-শাদি করে কস্মিনকালেও বাপ-মায়ের সঙ্গে বসবাস করে না। ভিন্ন সংসার পাতে। রুশদেশ বোধহয় কিছুটা প্রাচ্যের আমেজ ধরে।
কিছুটা প্রতিষ্ঠা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই চেখফ গ্রামাঞ্চলে কিঞ্চিৎ জমিজমা ও ছোট্ট একটি বসতবাড়ি কিনলেন। বাপ-মায়ের সঙ্গে সেখানে ছ-টি বছর চেখফ বড় আনন্দে কাটালেন। চেখফের সমগোত্রীয় আরেকজন অতিশয় দরদী লেখক, আলফঁস দোদেও ঠিক ওইরকমই মোটামুটি ওই সময়েই অসুরের মতো খেটে পয়সা রোজগার করে গরিব বাপ-মাকে গ্রাম থেকে এনে প্যারিসে আরামে রেখেছিলেন। জীবনের এই ছ-টি বছর চেখফের বড় শান্তি আর আনন্দের মধ্যে কাটে। এর পরই দেখা দিল তার শরীরে ক্ষয়রোগের চিহ্ন এবং বাকি জীবনের অধিকাংশ তাঁকে কাটাতে হয় ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যনিবাসে, সমুদ্রপারে। চেখফের বয়স তখন একচল্লিশ। তার ক্ষয়রোগের কথা জেনেশুনেও তারই নাট্যের অসাধারণ সুন্দরী এক অভিনেত্রী তাকে বিয়ে করেন। তিন বছর পর খ্যাতির মধ্যগগনে চেখ-ভাস্কর অস্ত গেল। দাম্পত্য জীবনে সুখ বলতে তার স্ত্রী পেয়েছিলেন স্বামীকে সেবা করার আনন্দ। অভিনেত্রীদের চরিত্র সম্বন্ধে নানা লোকে নানা কথা কয়। তাই বলে নেওয়া ভালো, চেখফের স্ত্রী বিধবা হওয়ার পর বাকি জীবন নির্জনে অতিবাহিত করেন। মডার্ন গল্প-উপন্যাসের পাঠক-পাঠিকারা বোধহয় তাজ্জব মানবেন। চেখফের বিধবা তখন যুবতী। রুশে বিধবাবিবাহ নিন্দনীয় তো নয়ই, যুবতী বিধবা পুনরায় বিয়ে না করলে তাকে আহাম্মুখ আখ্যা দেওয়া হয়। মা হওয়ার গৌরব থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করলেন। তিনি ত্যাগ ও প্রেমের নিষ্ঠায় বিশ্বাস করতেন। এ কথাটা বলতে হল চেখফ-চরিত্র বোঝাবার জন্য। তিনি নিশ্চয়ই এমনই গভীর প্রেম দিয়ে তার স্ত্রীর জীবন উদ্দীপ্ত করে দিয়েছিলেন যে, সেই দীপ্ত দীক্ষায় প্রজ্বলিত তাঁর প্রেম-প্রদীপ চেখফের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নির্বাপিত হল না। তারই অনির্বাণ বহ্নিতে তার ভবিষ্যতের পথ আলোকিত হয়ে রইল।
চেখফের জীবন সংক্ষিপ্ত ও আদৌ ঘটনাবহুল নহে। যে কটি ছবি আমাদের চোখের সামনে আসে সেগুলোই মধুর। শুধু শেষের চিত্রটি বড় করুণ। রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে আজীবন বিলাসে লালিতা এই যে অসাধারণ গুণবতী রমণী তাঁর স্বামীর প্রাণরক্ষার জন্য কন্টিনেন্টের খ্যাতনামা স্বাস্থ্যনিবাস থেকে স্বাস্থ্যনিবাস, এক ধন্বন্তরী থেকে অন্য ধন্বন্তরীর পদপ্রান্তে পাগলিনীর মতো ছুটোছুটি করলেন, আপন হৃদয়াবেগ শান্ত মুখের আড়ালে লুকিয়ে রেখে, কত না বিন্দ্ৰি যামিনী স্বামীর শয্যাপাশে কাটালেন, অসীম ধৈর্যে মিশ্রিত অক্ষয় সেবায় ক্ষয়রোগীর প্রতিটি পীড়িত মুহূর্তের যন্ত্রণাভার লাঘব করলেন– এ ছবিটি একাধিক রুশ লেখক এঁকেছেন।
টলস্টয়ের বৃদ্ধ বয়সে চেখফের তিরোধান তার বুকে বড় বেজেছিল– চেখফকে তিনি কতখানি স্নেহ করতেন সে-কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। গোর্কি তখন লেখেন চেখফ সম্বন্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। ইয়াসানা পলিয়ানাতে এই ত্রিমূর্তির আলাপ-আলোচনা, হৃদ্যতার আদান-প্রদান সম্বন্ধে অত্যন্ত মনোরম একাধিক প্রবন্ধ রুশ ভাষায় বেরিয়েছে। চেখ স্বয়ং তার নোটবুকে কিছু কিছু লিখে গিয়েছেন। টলস্টয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অকৃত্রিম। অবশ্য সে শ্রদ্ধা তাকে মোহাচ্ছন্ন করতে পারেনি। মাত্র অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি টলস্টয়ের নীতিমূলক (স্টোরি উইথ এ মরাল) গল্পের অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু রিয়েল আর্টিস্ট (টলস্টয়ের ভাষায়) তো বেশিদিন অন্যের পথে চলতে পারে না- তা সে-পথ যতই শান-বাঁধানো প্রশস্ত হোক না কেন।
গোর্কি তাঁর নাট্যরচনায় চেখফের অনুকরণ করেছেন। এস্থলে পাঠক-পাঠিকার স্মরণার্থে উল্লেখ করি–
টলস্টয় : জন্ম ১৮২৮ মৃত্যু ১৯১০
চেখফ : ১৮৬০ ১৯০৪
গোর্কি : ১৮৬৮ ১৯৩৬
চেখফ আমাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন যে, তাঁর সম্বন্ধে আমি এক যুগ ধরে লিখে যেতে পারি। তাঁর প্রতিটি গল্পের টীকা লিখতে লিখতেই আমার বাকি জীবন কেটে যাবে। অথচ এই প্রবন্ধ শেষ করতে হবে, এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এটি লিখছি সেটি ভুললেও চলবে না।
পূর্বেই বলেছি, বঙ্গসাহিত্যে আমি যশস্বী লেখক নই, কিন্তু পপুলার বটি। সেই কারণেই বোধহয়, আমি কিছু অনুরোধ পেয়েছি, পত্র-লেখকদের জানাতে, কোন কোন্ লেখক পড়লে তারা লাভবান হবেন। বিদায় নেবার প্রাক্কালে নিবেদন, ছোটগল্প দিয়েই সাহিত্যিক জীবন আরম্ভ করা প্রশস্ত এবং সম্মুখে চেখফের ফটোগ্রাফ টাঙিয়ে নিয়ে। এমনকি যারা পরবর্তীকালে উপন্যাস লিখবেন তারাও চেখফ চেখে, শুঁকে, সর্বাঙ্গে মেখে উপকৃত হবেন। এ প্রবন্ধটি তাদেরই উদ্দেশে লেখা।
কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, রুশ সাহিত্যে চেখফের অনুকরণ করেছেন অনেকেই, কিন্তু টলস্টয়-ঘরানা, ডস্টয়েফস্কি-ঘরানার মতো চেখফ-ঘরানা কখনও নির্মিত হয়নি। তার কারণ চেখফকে অনুকরণ করা অসম্ভব।
তবে সে উপদেশ দিচ্ছি কেন?
কারণ অসম্ভবের চেষ্টা করলেই সম্ভবটা হাতে আসে, সম্ভব হয়।
***
চেখফের আছে কী?
অদ্ভুত সহানুভূতি। সমবেদনা। সহানুভূতি সমবেদনা বললে কমই বলা হয়। মপাসাঁর বুল দ্য সুইফ (চর্বির গোলা, এ বল অব্ ফ্যাট) যখন ঘোড়াগাড়িতে ফিরে অঝোরে কাঁদছে তখন মপাসাঁও সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছেন কিন্তু চেখক যখন তাঁর কোচম্যানের দুঃখের কাহিনী বলেন তখন মনে হয় তিনি স্বয়ংই যেন সেই কোচম্যান।
গল্পটির প্লট এতই সরল যে কয়েক ছত্রে বলা যায়। এক ছ্যাকড়াগাড়ির কোচম্যান শহরে গাড়ি খাটায়, একমাত্র ছেলে থাকে গ্রামে। হঠাৎ খবর পেল তার সে জোয়ান ছেলে মারা গিয়েছে। বুড়োর তিন কুলে কেউ নেই যাকে সে তার দুঃখের কাহিনী বলে। পেটের ধান্দায় বেরোতে হয়েছে গাড়ি নিয়ে। উঠেছে এক সোয়ারি। বুড়ো কোচম্যান আস্তে আস্তে আলাপচারী জমিয়ে যখন তার পুত্রশোকের কাহিনী বলতে যাবে, তখন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সোয়ারি ঘুমিয়ে পড়েছে। থামতে হল। তার পর উঠলেন এক জেনারেল। জলদি চল, জলদি চল আর ধমকের চোটে সে তার কাহিনী আরম্ভ করেও শেষ করতে পারল না। তার পর উঠল জনাতিনেক ছাত্র। তাদের হৈ-হল্লার মাঝখানে বুড়ো কোনও পাত্তাই পেল না। তার পর উঠলেন আর এক ভদ্রলোক ভারি দরদী। তাকে যখন দুঃখের কাহিনী বলতে বলতে পুত্রের মৃত্যুসংবাদটা দেবে ঠিক তখনই তিনি বলে উঠলেন, থ্যাঙ্ক গড়। ওই আমার বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। বলা হল না। রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে। বুড়ো বাড়ি ফিরল। ঘোড়াটাকে দানা দিয়ে ডলাই-মলাই করতে করতে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল, তোকে কি আর আমি ভালো করে ডলাই-মলাই করতে পারি, বাছা। বুড়ো হাড়ে আর কি আমার তাগত আছে? থাকত আমার ছেলে! তাকে তো তুই চিনিসনে। হ্যাঁ, তার ছিল গায়ে জোর। হ্যাঁ, সত্যি বলছি। সে যদি থাকত আজ, তবে বুঝিয়ে দিত ডলাই-মলাই কারে কয়। ঘোড়াটা আপন খেয়ালে গরুগরু করে নাক দিয়ে শব্দ ছাড়ল। কেমন যেন দরদভরা– অন্তত বুড়োর তাই মনে হল।
তখন– তখন বুড়ো ঘোড়াটাকে তার শোকের কাহিনী বলে দিল।৮ [*গল্পটির প্লট আমার ঠিক ঠিক মনে নেই, তবে হরেদরে এই।]
যতবার গল্পটি পড়ি চোখে জল ভরে আসে– এখন আরও বেশি, কারণ আমার বয়স ওই কোচম্যানেরই কাছাকাছি… আর মনে হয়, কে বলে চেখফ ডাক্তার ছিলেন, কে বলে তিনি রূপসী অভিনেত্রী বিয়ে করেছিলেন, কে বলে তিনি টলস্টয়ের বন্ধু? তিনি নিশ্চয় ছিলেন। ওই কোচম্যান।
অনুকরণ করুন এই গল্পটির। কিংবা আরম্ভ করুন অন্যভাবে।
যেমন মনে করুন আপনার প্রিয়া সর্বাংশে আপনার চেয়ে গুণবান একটি লিভার পেয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন তার সঙ্গে। আপনি ঘন ঘন উদ্ভ্রান্ত প্রেমে পড়ে হৃদয়বেদনায় মালিশ করছেন, কিন্তু কোনও ফায়দা ওত্রাচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ল আপনার এক্স-বান্ধবীর এক বান্ধবী আছেন এবং তার সঙ্গে পরিচিত আরেক ভদ্রলোকও আপনার বন্ধু। আপনি ভাবলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে আমার দুঃখের কাহিনী কই। দুজনেই বড় দরদী। দুজনাই আপনার আপসাআপসি সাতিশয় মনোযোগ সহকারে শুনলেন। কিন্তু হায়, শেষটায় দেখলেন, ওদের দুজনারই পাকা রায়, আপনাকে কলার খোসাটির মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে আপনার প্রিয়া অতিশয় বিচক্ষণার কর্ম করেছেন।
এটা আপনি ব্যঙ্গ করে লিখতে পারেন, হাস্যরসে ভর্তি করে লিখতে পারেন, দু-ঘটি চোখের জল ফেলে করুণ রসে ঢেলে বানিয়ে লিখতে পারেন, যৌনবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ দিয়েও লিখতে পারেন কিন্তু আপনি চেখ হবেন তখনই যখন পাঠক পড়ে মনে করবে এটি একান্ত আপনারই অভিজ্ঞতা। অথচ আপনার এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা আদপেই হয়নি, আমার কাছে প্লটটি শুনে, এবং চেখফের কোচম্যানের গল্পটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন মাত্র।
এবারে টেকনিকাল দিক।
এখানে এসে সর্ব আলঙ্কারিকের ওয়াটারলু।
রস কী, এস্থলে কথাসাহিত্যে কী সে বস্তু যা আমার মনে কলারসের সঞ্চার করে– সেখানে যদি-বা কোনও গতিকে সংজ্ঞাবদ্ধ বর্ণনা করা যায়, তবু করা যায় না রস কোন উপাদানে, কোন প্রক্রিয়ায়!
কাজেই আমি সামান্য দুটি নির্দেশ দেব।
প্রথম বাকসংযম। সে বলে বিস্তর মিছা যে বলে বিস্তর–বলেছেন ভারতচন্দ্র। এ-স্থলে সে রচে নীরস রস যে বলে বিস্তর।
এখানে চীনা চিত্রকরদের কথা স্মরণে আনবেন। পাঁচটি আঁচড়ে আঁকা বাঁশের মগডালে একটি পাতা– আপনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন পাতাটি ফর ফর করছে। তিনটি আঁচড়ে আঁকা একটি উড়ন্ত হাঁস। আপনি দেখতে পেলেন যেন নীলাকাশে শরতের সাদা মেঘ ভালো করে তাকানোই যায় না, চোখ ঝলসে দেয়।
তার অর্থ উড়ন্ত হাঁস আঁকার সময় চিত্রকর সম্পূর্ণ হাঁস আঁকেন না। ঠিক কোন কোন জায়গায় বিন্দু ও বক্ররেখা (পইন্ট কার্ভ) দিলে পাঠকের মন নিজেই বাকিটা এঁকে নেবে, পাঠকের চোখ নিজেই বাকিটা দেখে নেবে ঠিক সেই সেই জায়গায় চিত্রকর তুলি ছুঁইয়েছেন।
চেখফও ঠিক তাই করতেন। কয়েকটি পইন্ট ও কার্ভ- শব্দের মারফতে– এমনই ভাবে এঁকে দিয়েছেন যে সম্পূর্ণ ছবিটি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। শুধু তাই নয়, এমনই সূক্ষ্ম দানালা ফিলমে তোলা ফটোগ্রাফ যে, যার যেমন কল্পনার লেন্স্ সে তেমনি বিরাট আকারে সেটিকে এনলার্জ করতে পারে। কোচম্যান চেষ্টা করেছিল তিন না চার টাইপের সোয়ারির কাছে তার হৃদয়বেদনা প্রকাশ করার; আপনি দেখতে পাবেন সে তাবৎ মস্কো শহরের লক্ষ লক্ষ নরনারীর হৃদয়দুয়ারে শির হেনে হেনে হতাশ হচ্ছে। আর সেই দরদী ঘোড়ার গার শব্দ যে শুধু শুনতে পাবেন তাই নয়, শুনতে পাবেন সে যেন বহু আবেগ থেকেই কোচম্যানকে বলছে, কেন তুমি আজেবাজে লোকের কাছে এসব দুঃখের কথা বলতে যাও? কে বুঝবে তোমার হৃদয়-বেদনা? সবাই আপন স্বার্থ নিয়ে মগ্ন। বল আমাকে। হাল্কা হবে। তার পর হয়তো আপন মনে বলছে, জানি তো সবই। কিন্তু হায় করি কী? এ যে ভগবানের মার।
গুণীরা বলেন সর্বনিম্নে জড়জগৎ, তার পর তৃণজগৎ, তার পর পশুজগৎ– সর্বোচ্চে মানুষ। চেখফের গল্পটি পড়ার পর মত পালটাতে হয়।
এস্থলেই ক্ষান্ত হোক আমার অক্ষম লেখনীর ক্ষীণ প্রচেষ্টা।
এইবার পড়ুন চেখফের একটি গল্পের বাঙলা অনুবাদ। অনুবাদটি করেছেন আমারই অনুরোধে, আমার সখা মৌলানা খাফী খান। যদৃষ্টং এবং প্রিয়াঙ্গীর লেখক।
খৈয়ামের নবীন ইরানি সংস্করণ
গিয়াস্-উদ্-দীন আবুল ফহ্ ওমর ইবন্ ইব্রাহিম অল খৈয়াম প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে সুপরিচিত। তাকে নিয়ে ইরানের ভিতরে-বাইরে সর্বত্র আজও পূর্ণোদ্যমে নানাপ্রকারে গবেষণা চলছে। এবং অত্যধিক গবেষণার মন্থনে যে বিষ ওঠে, তা-ও দেখা দিয়েছে। কোনও কোনও জর্মন গবেষক বলেন, খৈয়াম নামক জনৈক বৈজ্ঞানিক ছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সে খৈয়াম কোনও কবিতা রচনা করেননি। জনৈক রুশ গবেষক বলেন, কিন্তু খৈয়ামের ঠিক পরবর্তী যুগের ইতিহাসে যে এই বাক্যটি পাচ্ছি– তিনি খুরাসানের কবিদের অন্যতম– এটার অর্থ কী? তাই বোধহয় জনৈক ভারতীয় পণ্ডিত– তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না– মাত্র নয়টি রুবাইয়াৎ(১) (চতুষ্পদী) ওমরের বলে নিঃসন্দেহে স্বীকার করেছেন। অথচ পার্টিশনের পূর্বেও কলকাতার তালতলায় যে বটতলা সংস্করণ খৈয়ামের রুবাইয়াৎ পাওয়া যেত তাতে থাকত প্রায় বারশোটি।(২) তবে অতিশয় এক-নজর ফেললেও ধরা পড়ে, এর শত শত রুবাইয়াৎ ইরানের একাধিক কবির কাব্যসঙ্কলনে বিশেষত হাফিজের ওদেরই নামে চলেছে। কোনও কোনও রুবাঈ (রুবাইয়াতের একবচন) তো পাওয়া যায় দু-তিন-চার কিংবা ততোধিক কবির কাব্যে। এক জর্মন পণ্ডিত তাই এক বিরাট নিঘন্টু (কনকরডেন্স, ক্ৰসূরেফরেন্স সম্বলিত কার্ড ইনডেক্স যা খুশি বলুন) নির্মাণ করেছেন। খৈয়ামের নামে প্রচলিত প্রত্যেকটি রুবাঈ কোন কোন কবির কাব্যে আছে তারই পরিপূর্ণ ফিরিস্তি। টাইমটেবিলের মতো কলামের পর কলাম গেঁথে গেঁথে পাতার পর পাতা।
আমাদের মতো সাধারণ পাঠক ভীত হয়ে সে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করে।
কিন্তু আমাদের দলটি নিতান্ত ছোট নয়। এমনকি, আশ্চর্যের বিষয়, খুদ খৈয়ামের দেশে ইরানেও আমাদের মতো বিস্তর নিরীহ পাঠক আছেন, যারা কোন রুবাঈটি খাঁটি আর কোনটা মেকি তাই নিয়ে কালক্ষেপ করতে চান না।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ফিটজেরাল্ড যে কটি রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন তার কতগুলো ওমরের নয়। তৎসত্ত্বেও ইরানে তারই ওপর নির্ভর একটি খৈয়াম সংস্করণ বেরিয়েছে।
কিন্তু এই সংস্করণের আরও বৈশিষ্ট্য আছে।
এদেশে ফরাসি-জর্মন শেখার প্রতি অনেকের উৎসাহ দেখা দিয়েছে। খৈয়ামের এই ইরানি সংস্করণে আছে : ১. ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ, ২. সেই অনুবাদের যতটা কাছাকাছি পাওয়া যায় তারই ফারসি মূল (ফিটজেরাল্ড অনেক সময় ভাবানুবাদ করেছেন বলে বলা কঠিন, ঠিক কোন ফারসি রুবাঈটি অনুবাদ করেছেন, আবার এমনও দেখা যায়, একাধিক রুবাইয়াৎ থেকে তিন-চারটি ছত্র জোগাড় করে ইংরেজি একটি কোয়াট্রেন সৃষ্টি করেছেন), ৩. ফরাসি অনুবাদ– কখনও মূল ফারসির অনুবাদ অর্থাৎ ফিটজেরাল্ড যে স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদক তা নেননি, আর কখনও-বা ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি থেকে ফরাসি অনুবাদ, ৪. জর্মন অনুবাদ– একাধিক জর্মন অনুবাদ থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে, এবং ফিটজেরান্ডের অনুকরণ এরা প্রায়ই করেননি, ৫. আরবি অনুবাদ সরাসরি ফারসি থেকে, তবে অনেক স্থলেই স্বাধীন। অনুবাদ করেছেন এক আরব কবি যদিও তিনি জাতে ইরানি।
এছাড়া সংকলনে কয়েকটি মূল্যবান অবতরণিকাও একাধিক ভাষায় সংযোজিত হয়েছে। বিখ্যাত জর্মন ফারসিবিদ রোজেন, ফিটজেরাল্ড, আরব পণ্ডিত আদিব অলতুগা, ইরানি পণ্ডিত হিদায়ৎ ও সঈদ নফিসি (ইনি কয়েক বছর ভারতে বাস করে গেছেন) এঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পড়ে খৈয়ামপ্রেমী পাঠক মাত্রই মুগ্ধ হবেন। অবশ্য ফিটজেরান্ডের অবতরণিকা পড়া হয় পুরাতত্ত্ব হিসেবে।
আমরা যখন ফরাসি বা জর্মন কোনও নতুন ভাষা শিখতে যাই তখন আমাদের হাতে দেওয়া হয় যে পাঠ্যপুস্তক তাতে থাকে ঘরের আসবাবপত্রের নাম, পিতা-মাতা-ভ্রাতার প্রতিশব্দ, স্টেশন, টিকিট, প্ল্যাটফর্ম, খাদ্যাদি, বাগানের সাজসরঞ্জামের যাবতীয় জিনিসপত্র এদের নাম, লিঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে বয়স্ক পড়ুয়ারা এবং আমরা সচরাচর একটু বয়েস হওয়ার পরেই এসব ভাষা আরম্ভ করি– পায় অল্পই মনের খোরাক। লাগে একঘেয়ে– শিখে যাই গতানুগতিকভাবে। আমি জানি একেবারে গোড়ার থেকে মন এবং হৃদয়েরই খাদ্য দেওয়া যায় না কিন্তু কিছুটা শেখার পরেই তো মৃন্ময় বিষয়বস্তু থেকে চিন্ময়ে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। বয়স্কদের জন্য এরকম পাঠ্যপুস্তক বিদেশে আমি দু-একখানা দেখেছি। এস্থলে আমার মূল বক্তব্য এই, আট বছরের বাঙালি ছেলে ফরাসি শিখতে চাইলে তার পাঠ্যপুস্তক হবে একরকম, আঠারো বছরের কিশোর শিখতে চাইলে হবে অন্যরকম।
যাদের কিছুটা ফরাসি বা জর্মন, অথবা উভয়েরই কিছুটা শেখা হয়ে গিয়েছে আর খৈয়ামে আসক্তি থাকলে তো কথাই নেই তারা এই সংকলনটি পড়ে আনন্দ তো পাবেনই, ভাষা-শিক্ষার কাজও অনেকখানি দ্রুত এগিয়ে যাবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা ওমরের সবচেয়ে পরিচিত চতুষ্পদীটি নিচ্ছি …
ফারসিতে আছে–
গর দস্ত দহদ জ মগজে গন্দুমে নানি
ওজু মৈ দোমনি জ গুসফন্দি রানি
ও আনগে মন ও তো নিশসস্তে দর ওয়রানি
এয়েশি বুদ ওয়া আন নৃহদ-হর সুলতানি
Here with a Loaf of Bread beneath the Bough
A Flask of wine, a Book of Verse and Thou
Beside me singing in the Wilderness
And Wilderness is Paradise enow.
Pour celui qui possede un morceau de bon pain
Un gigot de mouton. un grand flacon de vin.
Vivre avec une belle au milieu des ruines,
Vaut mieux qu dun Empire etre le souverain
Wein, Brot, ein gutes Buch der Lieder :
Liess ich damit selbst unter Truemmern mich nieder,
Den Menschen fern, bei Dir allein,
Wuerdich gluecklicher als ein koenig sein. (৩)
মূল ফারসিতে আছে :
হাতে (দস্ত) যদি থাকে
গমের মগজের (মগ) রুটি (নান)
দুই মনী (দো মনী) মদ ও
ভেড়ার একখানা ঠ্যাঙ (রান),
তোমাতে আমাতে যেখানে বসেছি
সেটি যদি ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণও হয়
(তবুও) আনন্দ (আয়েস) যা হবে
সে সুলতানের রাজত্বের (হদ) চেয়েও বেশি।
ইংরেজিতে দেখা যাচ্ছে, ভেড়ার ঠ্যাঙ বাদ পড়েছে (বোধহয় অনুবাদক এটাকে বড় গদ্যময় মনে করেছেন), কবিতার বই যোগ করা হয়েছে, প্রিয়ার সঙ্গীতও বাড়ানো হয়েছে; সুলতানের রাজত্বের বদলে স্বর্গপুরী। কিন্তু একটা জিনিস আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। প্রথম ছত্রে আছে, বিনিৎ দ্য বাও– পরে আবার সেটাই উইলডারনিস হয় কী করে? সত্যেন দত্ত বুদ্ধিমানের মতো বিজন ব্যবহার করেছেন, উইলডারনিস ও বনচ্ছায়া দুই-ই বিজন। কান্তি ঘোষ উইলডারনিস বর্জন করে দ্বন্দ্বমুক্ত হয়েছেন।)।
ফরাসিতে আছে ভালো রুটি, ভেড়ার ঠ্যাঙ ও তবে মদের পাত্রকে গ্র (grand ফরাসিতে বিরাট অর্থে) বলা হয়েছে, দু মনী বাদ পড়েছে এবং ফারসিতে যেখানে সুদ্ধ তুমি আছে, সেটা ফরাসিতে সুন্দরী তরুণী (belle) হয়ে গিয়েছে। অনুবাদ মোটামুটি আক্ষরিক।
জর্মনে মদ (Wein), রুটি (Brot) আর কবিতার বই (Buch)। দুম্বা বাদ পড়েছে, তবে বাও নেই– আছে ফারসির সরল অনুবাদ ভগ্নাবশেষ মধ্যে (Truemmerm)।
ইরানি চিত্রকর চতুষ্পদীটি বর্ণে অলংকৃত (ইলট্রেট) করার সময় যুবক-যুবতীকে বসিয়েছেন ভাঙাচোরার মাঝখানে বিধ্বস্ত প্রাসাদের অবশিষ্ট একটি দেউড়ির কাছে। দূরের পটভূমিতে আবৃছা-আবৃছা দেখা যাচ্ছে, সপারিষদ সুলতান বসেছেন সিংহাসনে, সম্মুখে গায়িকা– কিন্তু সমস্তটাই যেন কোনও প্রেতলোকের আবহাওয়াতে ভাসছে।
চিত্রকর ফিটসজেরাল্ডের প্রভাবে পড়েছেন– কিঞ্চিৎ। যুবক-যুবতীর সম্মুখে দুম্বার ঠ্যাঙ আছে, মদের পাত্রও আছে, তবে সেটা বিরাট নয়, দু মনী তো নয়ই এবং সেটি ইটালিয়ান পদ্ধতিতে খড় দিয়ে প্যাচানো–ইরানে সে রেওয়াজ আছে বলে জানতুম না–কিন্তু যুবকের হাতে দিয়েছেন একখানি পুস্তিকা– ফিটজেরান্ডের ফিরিস্তিমাফিক–তবে তরুণী সে মাফিক গান গাইছেন না। পায়ের কাছে আমাদের খোয়াই-ডাঙার বুনো ফুল। তেরঙা ছবি, রেজিস্ট্রেশন খারাপ।
আমাদের কৈশোর-যৌবনে বহু তরুণ-তরুণী ফিটজেরাল্ডের ওমর প্রায় কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। সে রেওয়াজ এ যুগেও হয়তো সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। যেটুকু স্মরণে রয়েছে তারই ওপর নির্ভর করে ফরাসি-জর্মন অনুবাদ পড়লে ভাষাশিক্ষা দ্রুততর হবে, পাঠক আনন্দও পাবেন। হয়তো-বা তারই ফলে আমরা আরেকখানা খৈয়ামের বাঙলা অনুবাদ পাব।
পুস্তকে পঁচাত্তরটি চতুষ্পদীর জন্য পঁচাত্তরখানা তিনরঙা ছবি তো আছেই, তার ওপর এদিক-ওদিক সর্বত্র ছড়িয়ে আছে কারুকার্য, আবছা তুলিতে আঁকা নানা প্রকারের অর্ধসুপ্ত চৈতন্যের স্বল্প প্রকাশ– কাব্য পড়ে চিত্রকরের প্রতিক্রিয়ার রূপ। ছবিগুলো রবি বর্মা স্টাইলে আঁকা– তবে তার চেয়ে ঢের কাঁচা। একটি ব্যাপারে কিন্তু সর্বচিন্তাশীল দর্শকই সন্তুষ্ট হবেন– জামাকাপড়, বাড়িঘর, গাছপালা, আসবাবপত্র প্রায় সবই খাঁটি ইরানি। অবশ্য বিদেশি প্রভাব কিছুটা যে পড়েনি তা নয়, তবে সে সামান্য। বিদেশি বিশেষ করে ইয়োরোপীয় চিত্রকর– যেরকম নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর করে কিম্ভূত বদখৎ হাঁসজারু তৈরি করেন, তিনি তার থেকে স্বভাবতই মুক্ত। এবং তাঁর ছবিতে যে এক নতুন পরীক্ষার প্রচেষ্টা রয়েছে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই চিত্রকর ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে উপক্রমণিকায় লিখেছেন :
At the end, I hope the Patrons of art find this gift amusing and this could be an Ideal Ideas (sic) for the young artists, and the old and experience (sic) artists could forgive some of the scenes which lacking the Proper Techniques (sic). I wish they call them to my attention, Ill be most greatful (sic) …Akbar Tajvidi.
এ পুস্তক সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু মনোরম আলোচনা করা যেত, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল, এটির সঙ্গে শুধু আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।(৪)
The quatrains of Abolfath Ghiat-e-Din Ebrahim KHAYYAM of Nishabur, Published by Tahir Iran Co, Kashani Bros Teheran, Lalezar Istanbul Sq.
———–
১. তাপসী রাবেয়া নাম এদেশে অজানা নয়। তার অর্থ চতুর্থ কন্যা। রুবাইয়াৎ, রাবেয়া ইত্যাদি শব্দ আরবি, আরবাৎ অর্থাৎ চার থেকে এসেছে।
২. ইরানে ১৪০১ পর্যন্ত পাওয়া যায়। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ খৈয়ামের মৃত্যুর প্রায় ৮৮ বছর পরে লিখিত এক পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় ২৫১টি– এটি এখন অক্সফোর্ডে।
৩. বাঙলায় :
বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি পাই যদি একখানি,
পাই যদি এক পাত্র মদিরা আর যদি তুমি রানি,
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া গাহো গো মধুর গান
বিজন হইবে স্বর্গ আমার তৃপ্তি লভিবে প্রাণ ॥
—সত্যেন দত্ত
সে নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়া
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙি মোর পাশেতে গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর
সেই তো সখী স্বর্গ আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।
—কান্তি ঘোষ
৪. খৈয়াম ও নজরুল ইসলাম কৃত তার অনুবাদ নিয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি।
জাতীয় সংহতি
মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়।
এই যে ফারসি নামক ভাষা এটি সাতশো বছর ধরে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল। যদিও পাঠান ও মোগল কারওরই মাতৃভাষা ফারসি ছিল না। শেষ বাদশা বাহাদুর শা বাদশার অন্তঃপুরেও তুর্কি বলা হত। যদিও রাজদরবারে ফারসি চলত, কিন্তু কবিসম্মেলনে প্রধানত উর্দু।
ইংরেজও প্রথম একশো বছর এ দেশে ফারসি দিয়েই কাজ চালায়। ১৮৪০-এর কাছাকাছি একদিন তারা ফারসি নাকচ করে দিয়ে ইংরেজি চালাল। যে হিন্দু কায়স্থরা একদা অত্যুত্তম ফারসি শিখে পদস্থ রাজকর্মচারী হতেন, তারা ৫০/৬০ বছরের ভিতর ফারসি বেবাক ভুলে গিয়ে ইংরেজির মাধ্যমে রাজকর্ম চালিয়ে যেতে লাগলেন। অনেকের মুখে শুনি, কলকাতা হাইকোর্টে নাকি এখনও তাদের প্রাধান্য অতুলনীয়। বাদবাকি ভারতবর্ষে এখন ক-জন লোক ফারসি জানেন সেটা বের করতে হলে দিনের বেলাও লণ্ঠন নিয়ে বেরুতে হয়। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই কথা হচ্ছে। অবশ্য এই দুই সম্প্রদায়েরই যারা উর্দুর শক্ত গোড়াপত্তন করতে চান তারা ফারসি শেখেন– বাঙালি যেমন আপন বাঙলাকে জোরদার করতে হলে সংস্কৃত শেখে।
যে ফারসি প্রায় সাতশো বছর ধরে ভারতবর্ষে দাবড়ে বেড়াল, হাজার বছর ধরে তুর্কিস্তান থেকে তাইগ্রিস নদ অবধি রাজত্ব করল (লাতিনের মতোই ফারসিকে সে যুগের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বলা যেতে পারে) সেই ফারসিই পঞ্চাশ বছরের ভিতর ভারতবর্ষে লোপ পেল!
ইংরেজি মাত্র একশো বছর রাজত্ব করেছে। তার লোপ পেতে কত দিন লাগবে?
শ্রদ্ধেয়া বিজয়লক্ষ্মী সেদিন বলেছেন, ইংরেজি আমাদের লিগেসি, ওটা আমরা ছাড়ব কেন? তাঁর পুণ্যশ্লোক স্বর্গীয় পিতা মোতিলাল ফারসিকে তার লিগেসি মনে করতেন। ইংরেজ আমলে একদা দিল্লির বিধানসভায় দুই ইংরেজ একে অন্যকে প্রচুর অহেতুক প্রশংসা করলে পর মোতিলালজি বললেন, ফারসিতে একটি সুন্দর প্রবাদ আছে : মন্ তোরা হাজী মীগোই, তো মরা কাজী বগো! অর্থাৎ আমি তোমাকে হাজী বলে সম্বোধন করব, আর তুমি আমাকে কাজী বলে সম্বোধন কর– অথচ ইনিও মক্কাতে গিয়ে হজ করেননি, উনিও কাজী বা ম্যাজিস্ট্রেট নন। সেই ফারসি ভাষার লিগেসি গেছে, ইংরেজির কবে যাবে?
পাঠক ভাববেন না, আমি ইংরেজি তাড়াবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। আদপেই না। নিজের স্বার্থেই আমি চাই, ইংরেজি থাকুক এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায়, মশাই হিন্দির গাড়ি আতি হৈ, জাহাজ জাতা হৈ লিঙ্গ মুখস্থ করে করে হিন্দি যাদের মাতৃভাষা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাব! যে কটা দিন বেঁচে থাকব, ইংরেজি ভাঙিয়েই খাব। সে কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, আমি-আপনি চাইলে না চাইলেও ইংরেজির ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।
.
আরেকটি উদাহরণ নিন। এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ ওকিবহাল নই– যা শুনেছি তাই বলছি। ইংল্যান্ডে নাকি নরমান বিজয়ের ফলে ফরাসি রাষ্ট্রভাষা হয়ে যায়, এবং তামাম ইংল্যান্ডের লোক নাকি পড়িমড়ি হয়ে ফরাসি শেখে। কবি চসারের সামনে নাকি সমস্যার উদয় হয়, তিনি ফরাসি না ইংরেজিতে কাব্য রচনা করবেন? (ভাগ্যিস ইংরেজিতে করেছিলেন, কারণ ফরাসি লিখে কোনও ইংরেজ যশ অর্জন করেছেন বলে শুনিনি; এদেশে যেমন আটশো বছর ফারসি চর্চার পর এক আমির খুসরৌই কিছুটা নাম করতে পেরেছেন তা-ও তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফারসি।)
নরমান বিজয় খতম হওয়ার পরও ইংরেজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তার ফরাসি লিগেসি যেন মকুব না হয়ে যায়। কোটি কোটি পৌন্ড খর্চা করে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে ফরাসি শিখিয়েছে, কাচ্চা-বাচ্চার জন্য ফরাসি গভর্নেস রেখেছে, ছুটিছাটা পেলেই প্যারিসপনে ধাওয়া করেছে। আর তার ভাষার ভাই মার্কিনও ফরাসি মত্ততায় কিছুমাত্র কম নয়। শুনেছি, মার্কিনি ইংরেজিতে নাকি প্রবাদ আছে, সাধু মার্কিনেরই মৃত্যুর পর প্যারিসপ্রাপ্তি হয়– সেই তার স্বর্গপুরী, মুসলমানের বেহেশত, হিন্দুর কৈলাস-বৈকুণ্ঠ-প্রাপ্তির মতো।
ফরাসি শেখানোর বাজে খর্চা যারা কমাতে চান তারা নাকি হালে হাতে-কলমে সপ্রমাণ করেছেন যে, লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে শিক্ষিত ইংরেজকে ফরাসিতে প্রশ্ন শুধালে শতেকে গোটেক ফরাসিতে উত্তর দিতে পারে, কি না পারে।
শুনেছি ব্রিজ দিয়ে নাকি ফ্রান্স-ইংল্যান্ডে যোগ করে দেওয়া হবে। হায় রে কপাল! যখন ভাষার সেতু ছিল, তখন লোহার সেতু ছিল না; এখন লোহার সেতু হচ্ছে তো ভাষার সেতু নেই!
আরেকটি উদাহরণ দিই। খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হবার পর খ্রিস্টভক্তগণের বাসনা হল, খ্রিস্টধর্মের কল্যাণে সমস্ত ইয়োরোপে যে এক নবীন ঐক্য দেখা দিয়েছে সেটা যেন লোপ না পায়। তাই তারা আপ্রাণ লাতিন আঁকড়ে ধরে রইলেন। পাছে সেই ঐক্য লোপ পায়, তাই, দেশজ অনুন্নত ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ পর্যন্ত করতে দেওয়া হত না (মুসলমানরাও বহুকাল কোরানের ফারসি কিংবা উর্দু, বাঙলা অনুবাদ করতে দিতে চাননি, ওই একই কারণে)। লুথারের অন্যতম প্রধান সংস্কার ছিল জর্মন ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রচার। ফলে শেষ পর্যন্ত ফরাসি লাতিনের স্থানটি কেড়ে নিল এই সেদিন পর্যন্ত জর্মনভাষী ফিড্ররিক দি গ্রেট ফরাসি কবি ভলতেয়ারকে নিমন্ত্রণ করে তার অতি-কাঁচা ফরাসি কবিতা মেরামত করিয়ে নিতেন এবং সর্বশেষে ইয়োরোপের সর্বভাষা আপন আপন দেশে মাথা খাড়া করে দাঁড়াল। ইস্তেক ডেনিশ, ফিনিশ পর্যন্ত। লাতিন-ফরাসি সংহতি গেল। অনেক পর্যটকের মুখে শুনতে পাবেন– সে আসন এখন ইংরেজি নিচ্ছে। শুনে হাসি পায়। হোটেলবয়রা কিছুটা ইংরেজি বলতে পারে বইকি, যেমন মাদুরার হোটেলবয়ও কিঞ্চিৎ হিন্দুস্থানি কপচায়, কিন্তু প্যারিস কিংবা ভিয়েনার রাস্তায় ওইসব দেশবাসীর সঙ্গে ইংরেজিতে দু দণ্ড রসালাপ করবার চেষ্টা দিন না, দেখুন না ফলটা কী হয়।
আমি যদি বলি, সমস্ত ইয়োরোপে যতখানি ইংরেজি বলা হয়, তার তুলনায় ভারত-পাকে বেশি হিন্দুস্থানি বলা হয়, তবে ভুল বলা হবে না অবশ্য বই পড়ার কথা হচ্ছে না, সেটা নির্ভর করে জনসাধারণে শিক্ষার বিস্তৃতির ওপর।
অর্থাৎ ইংরেজি ও লাতিন সংহতি এনে দিতে পারবে না।
কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ আরব-আফ্রিকা ভূখণ্ডে। ইরাক থেকে আরম্ভ করে সিরিয়া, লেবানন, মিশর, তুনিস, আলজেরিয়া, মরক্কো, এদিকে কুয়েইত, বাহরেন, মক্কা-মদিনা, ইয়েমেন, জর্ডন, সর্বত্রই আরবি প্রচলিত। লেবানন বাদ দিলে এদের প্রতিটি রাষ্ট্রে চৌদ্দ আনা পরিমাণ লোক মুসলমান এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু বেরবের কপ্টিক ও নিগ্রো রক্ত বাদ দিলে সকলের ধমনীতেই প্রায় আভেজাল সেমিতি রক্ত।
কিন্তু কোথায় সেই আরব সংহতি?
প্রাচীন দিনের কাহিনীতে ফিরে যাব না। এই আপনার-আমার চোখের সামনেই দেখতে পেলুম, ইরাক সে সংহতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, কুয়েইত জাতভাই কাসেমের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বিধর্মী (কারও কারও মতে কাফের) ইংরেজকে দাওয়াত করে খানা খাওয়াল, এবং পরশু না তরশু দিন সিরিয়াও নাসেরের মিশরিদের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। এমনকি সিরিয়ার মসজিদে মসজিদে নাকি মোল্লারা নাসেরকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন, নাসের নাস্তিক, টিটোর সঙ্গে কোলাকুলি করে, তারই আশকারায় মিশরের টেলিভিশন অশ্লীল ছবি, অর্ধনগ্না রমণী দেখায়।
এক ধর্ম, এক রক্ত, এক ভাষা। এক ভাষা, বিশেষ করে বললুম, কারণ সিরিয়া, ইরাক, মিশরের কথ্য ভাষাতে প্রচুর পার্থক্য থাকলেও ওসব জায়গায় কোনও উপভাষা সৃষ্টি হয়নি– সেই এক হাজার বছরের পুরনো ক্লাসিকাল আরবিই সর্বত্র চলে। তবু আর মিলন হয়ে উঠছে না।
***
কাজেই সংহতির সন্ধানে অন্যত্র যেতে হবে। গুজরাতি, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, সবাই মিলে হিন্দি কপচালেই যে রাতারাতি আমাদের জাতীয় সংহতি গড়ে উঠবে, এ দুরাশা যেন না করি।
রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী বলেই বলছি তা নয়, আমার মনে হয়, তিনিই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার চিন্তা করেছেন।
টুনি মেম
বেশি দিনের কথা নয়, হালের। পড়িমড়ি হয়ে শেয়ালদায় আসাম লিঙ্কে উঠেছি। বোলপুরে নাবব। কামরা ফাঁকা। এককোণে গলকম্বল মানমুনিয়া দাড়িওয়ালা একটি সুদর্শন ভদ্রলোক মাত্র। তিনি আমার দিকে আড়নয়নে তাকান, আম্মো।
একসঙ্গেই একে অন্যকে চিনতে পারলুম।
আমি বললুম, খান না রে?
সে হাকল, মিতু না রে?
যুগপৎ উল্লম্ফন, ঘন ঘন আলিঙ্গন। পাঠশালে পাশাপাশি বসতুম। তার পর এই তিরিশটি বছর পরে দেখা। প্রথম উচ্ছ্বাস সমাপ্ত হলে জিগ্যেস করলুম, তুই এ রকম বদখদ দড়ি-দাঁড়া রেখেছিস কেন?
খানটা ওই পাঠশালার যুগেও ছিল হাড়ে টক শয়তান। প্রশ্ন শুধালে ইহুদিদের মতো পাল্টা প্রশ্ন জিগ্যেস করে, উত্তরটা এড়িয়ে যায়। শুধাল, দাঁড়া কারে কয়?
হাঁড়ি বড় সাইজের হলে হাঁড়া হয়, গাড়ি গাড়া। দাড়ি হিন্দি-উর্দুতে স্ত্রীলিঙ্গ!–কিন্তু দাঁড়া পুংলিঙ্গ। তোরটা দাড়ি নয়, দাঁড়া।
অবশ্য অস্বীকার করিনে, তাকে দেখাচ্ছিল গত শতাব্দীর ফরাসি খানদানিদের মতো। খানের রঙ প্যাটপেটে ফর্সা। গায়ে প্রচুর পাঁঠার রক্ত। শুধালুম, তা তোর পাকিস্তান ছেড়ে এই না-পাক দেশে এসেছিস কী করতে?
আজমিরের খাজা মুঈন-উদ-দীন চিশতির কাছে মানত করেছিলুম, বাবার আশীর্বাদে আল্লা যদি আমাকে এসৃপি-তে প্রোমোশন করেন তবে বাবার দরগা দর্শনে যাব, ভালো-মন্দ যা আছে তাই দিয়ে শিরনি চড়াব। সেই সেরে ফিরছি। এই নে প্রসাদি-গোলাপের পাপড়ি।
আমি মাথায় ছুঁয়ে বললুম, ও! তুই বুঝি পুলিশে ঢুকেছিলি?
বলল, হ্যাঁ, সাব-ইন্সপেকটর হয়ে।
আশ্চর্য হয়ে শুধালুম, বলিস কী রে? আর এরই মধ্যে এসপি।
প্রসাদির পাপড়ি মাথায় ঠেকিয়ে বলল, খাজা মুঈন-উদ-দীন চিশতির দোওয়া আর হিন্দুদের কৃপায়!
হিন্দুদের কৃপায়!
হ্যাঁ ভাই, তেনাদেরই কেরপায়। তেনারা যদি পূর্ব বাঙলার পুলিশের ডাঙর ডাঙর নোকরি ছেড়ে ঝেঁটিয়ে পশ্চিম বাঙলা আর আসামে না চলে যেতেন তা হলে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় প্রমোশন পেতুম কী করে? তারা থাকলে হয়তো অবিচার করে আমাকে দু একটা না-হক প্রোমোশন দিত, কিন্তু একদম দিনকে রাত, রাতকে দিন তো করা যায় না। আর তুই তো বিশ্বাস করবিনে– তুই চিরকালই সন্দেহপিচাশ, যে কটি হিন্দু রয়ে গেল তারা গণ্ডায় গণ্ডায় না হোক জোড়ায় জোড়ায় প্রোমোশন পেয়েছে। জানিস, মণ্ডল সিভিল সার্জন হয়েছে?
আমি ভিরমি যাই আর কি। গাড়ল ফোঁড়াটি পর্যন্ত কাটতে জানত না।
খান বলল, সব তো শুনলি। তোর বইও আমি দু চারখানা পড়েছি। আচ্ছা বল তো, এসব বানিয়ে বানিয়ে লিখিস, না কিছু কিছু দেখা-শোনার জিনিস, অভিজ্ঞতার বস্তু?
কিছুটা বানিয়ে, কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকে।
তাজ্জব! অমি তো ভাই বিস্তর খুন-খারাবি দেখলুম। এক-একটা এমন যে, আস্ত একখানা উপন্যাস হয়। কিন্তু তারই রিপোর্ট লিখতে গেলে আমার তালুর জল আর নিবের কালি শুকিয়ে যায়। কী করে যে তুই লিখিস।
আমি বললুম, আমাকেও যদি সুদ্ধমাত্র ফ্যাক্টের ভিতর নিজেকে সীমাবদ্ধ করে লিখতে হত তা হলে আমার রিপোর্টটা হত তোর চেয়েও ওঁচা। কল্পনা এসে উৎপাত করত। তা সেকথা যা গো আমার দিনকাল বড্ডই খারাপ যাচ্ছে প্লটের অপর্যাপ্ত অনটন। সম্পাদক মিঞা আবার গল্পই চান, ইলসট্রেট করবেন। বল না একটা।
দাড়ির ভিতর দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, কোনটা বলি, কেসগুলো তো মাথার ভিতর আবজাব করছে। আচ্ছা দাঁড়া, ভেবে নিই।
এমন সময় সিগনেল অভাবে ট্রেন খামোকা মাঝপথে দাঁড়াল। খান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, এরা কী জাত রে?
তাকিয়ে দেখি, মিশকালো সাঁওতাল মেয়ে তার ওপর মেখেছে প্রচুর তেল। শাড়ির উপর বেঁধেছে গামছা, উত্তমাঙ্গে চোলিফোলি কিছু নেই, নিটোল দেহ, সুডোল ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষেরটা বোঝা গেল পরিষ্কার, কারণ, হাতদুটি যতদূর সম্ভব উঁচু করে পলাশ ফুল পাড়বার চেষ্টা করছিল খোঁপায় গুজবে বলে। হলদে পলাশ। এ অঞ্চলে লালের তুলনায় ঢের কম। কী জানি, মেয়েটা হয়তো ভেবেছে, লাল-কালোর চাইতে হলদে-কালোর কন্ট্রাস্টে খোলতাই বেশি।
বললম, সাঁওতাল। হ্যাঁ, আমাদের দেশে অতদুর ওরা পৌঁছয়নি। কিংবা হয়তো ছিল এককালে। কাল যে-রকম হিন্দু পুব বাঙলা ছেড়ে চলে এল, এরা হয়তো পরশু।
খান দেখি, আমার কথায় বিশেষ কান দিচ্ছে না। আপন মনে কী যেন ভাবছে। ওস্তাদ গাওয়াইয়া যে-রকম গান শুরু করার পূর্বে হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। তখন বিরক্ত করতে নেই।
গাড়ি ছাড়ল। একটু কাছে এসে বলল, ওই কালো মেয়ে আরেকটি মেয়ের কথা আমার স্মরণে এনে দিল। তার রঙ ছিল এর চেয়েও কালো। কিন্তু সে কী কালো! সব রঙের অভাবে নাকি কালো হয়! হ্যাঁ তাই; কোনও রঙই সাহস করে তার শরীর চড়াও করতে পারেনি। আমি তাকে দেখেছিলুম তার শারীরিক মানসিক চরম দুরবস্থায়। তবু চোখ ফেরাতে পারিনি। হিন্দুরা কেন যে কালী কালী করে তখন বুঝতে পেরেছিলুম।
গাড়ি বর্ধমানে এসে থামল। বর্ধমানে আমি গত সাত বছর ধরে অর্ডার দিয়ে কখনও কেলনারের কাছ থেকে চা-আণ্ডা পাইনি। কাজেই ফর সেফটিস সেক প্রথমেই ভাঁড়ের চা কিনে রাখলুম। বিস্তর ছুটোছুটি করে কিছু-কিঞ্চিতের জোগাড় হল। স্থির করলুম, বোলপুরে খানকে একটা পুরা পাক্কা খানা তুলে দেব। সেখানকার গোসাই আমাকে নেকনজরে দেখে।
গাড়ি ছাড়তে খান বলল, আমি তখন আব্রুগড়ে। এসৃআই– আমরা বাঙলায় লিখি এছাই। রোজ থানায় বসে ভাবি, ইয়া আল্লা, চাকরির এ দুস্তর দরিয়া পেরিয়ে কবে গিয়ে এমন মোকামে পৌঁছব যেখানে হরহামেশা পয়সাটা-আধলাটার হিসাব না করতে হয়। ঘুষ খেতে তখনও শিখিনি–
আমি শুধালুম, এখন শিখেছিস? তা—
বললে, হ্যাঁ, তবে সে অন্য ধরনের। পরে তোকে বুঝিয়ে বলব।
আব্রুগড় বড় মনোরম জায়গা। অনেকটা শিলঙের মতো উঁচু-নিচুতে ভর্তি, টিলাটালার টক্কর। কোন্ এক সায়েব নাকি মালয় না, কোথা থেকে কৃষ্ণচূড়া এনে এখানে পুঁতে দেয়। এখন শহরটা আগাপাশতলা তাই দিয়ে ভর্তি। শহরটা এমনিতেই সবুজ, তার ওপর এল গোলমোরের কালো সবুজ আর তার মাঝখানে ফুটে ওঠে বাড়িগুলোর পোড়া লালের টাইলের ছাদ।
চতুর্দিকে অজস্র চা-বাগান আর তেলের খনি। সায়েব-সুবো, বেহারি-মারওয়াড়িতে শহরটা গিসগিস করছে। আর খাস আসামিদের তো কথাই নেই তারা বড়, বড় সরল। আব্রুগড়ের বটতলাতে চার আনা দিয়ে মিথ্যে সাক্ষী পাওয়া যেত না। আমাদের দেশে আকছারই যা যায়। এখন কী অবস্থা তা অবশ্য জানিনে।
বড়কর্তা বলেছিলেন, কিছু একটা জবরদস্ত নতুন না করতে পারলে কুইক প্রোমোশন হয় না। জবরদস্ত নতুন করবটাই-বা কী? এখানে খুন-খারাবি হয় অত্যল্প। উঠোনই নেই তো আমি নাচি কী করে!
তাই থানায় বসে বসে পুরনো দিনের খাতাপত্র দেখি, ফাইল পড়ি। সেইটেই একদিন লেগে গেল কাজে। পরে বলছি।
আমার চেনা এক রাজমিস্ত্রি আমায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে একদিন বলল, মোল্লাবাজারের পিছনে উঁচু টিলার উপর যে খালি বাঙলো আছে তার বাবুর্চিখানার ভিত মেরামত করতে গিয়ে সে একটা লাশ আবিষ্কার করেছে– ঠিক লাশ নয়, কঙ্কালই বলা যেতে পারে– পচা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো।
রক্তের সন্ধান পেয়ে বললুম, তুমি ওখানে যাও। হঠাৎ যেন আবিষ্কার করেছ এই ভাব করে আমাকে খবর পাঠাও।
তা না হলে পরে প্রমাণ করতে হবে, ওটা সত্যই সেখানে ছিল, বাইরের থেকে এনে কেউ চাপায়নি।
জিনিসটা যে খারাবি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাবুর্চিখানার নিচে কম্বলৈ জড়ানো পোঁতা কঙ্কাল! এখানে কস্মিনকালেও কোনও গোরস্তান ছিল না–টিলার ঢালুর দিকে কতটুকু জায়গা যে, ওখানে মানুষ গোরস্তান বানাতে যাবে। তা হলে এটা নিশ্চয়ই খুনের ব্যাপার। শুধু খারাবি নয়, খুন-খারাবি।
আমি বললুম, সাক্ষাৎ শার্লক হোমস।
শুধলে, সে আবার কে?
আমি প্রথমটায় হকচকিয়ে পরে সামলে নিয়ে বললুম, তুমি এগোও; আমি আর রসভঙ্গ করব না।
বলল, প্রথম রক্তের সন্ধান পেয়ে আমি যেন হন্যে হয়ে উঠলুম। সমস্ত রাত ঘুম হল না। মাথার ভিতর ঘুরছে, কত রকম নর-হত্যার ছবি, যেন স্বয়ং পাঁচকড়ি দে সেগুলো এঁকে যাচ্ছেন, আর দীনেন্দ্রকুমার রায় আপন হাতে রঙ গুলে দিচ্ছেন। বেবাক লালে লাল।
আমি বললুম, রসভঙ্গ করতে হল। অপরাধ নিসনি। হোমস্ হল বিলিতি অরিন্দম।
খান বলল, তাই বল। কিন্তু তুই ভাবিসনে, তোকে একটা রগরগে খুনের কাহিনী শোনাতে যাচ্ছি মাত্র। এতে আছে বড় দুঃখের কথা। বড় বিষাদ বেদনা। স্বর্গ আমি দেখিনি, কিন্তু স্বর্গচ্যুত হতভাগ্য একজনকে আমি দেখেছি। সে দৃশ্য আর কারও দেখবার দরকার নেই।
কী বলছিলুম? হ্যাঁ। ভোর হতে-না-হতেই আমি থানায় এসে উপস্থিত। কিন্তু মূর্খের মতো আমি রাজমিস্ত্রিকে বলে রাখিনি, সে কখন আসবে। সে যদি এসে ফিরে যায়; কিংবা কেসটা হাতছাড়া হয়ে যায়!
আজ হাসি পায়। রাতদুপুরে এখন যদি জমাদার এসে খবর দেয়, পদ্মার চরে ডাকাতিতে পাঁচটা চরুয়া আর তিনটে ডাকাত মারা গিয়েছে, আমি তা হলে পাশবালিশ জাবড়ে ধরে বলি, যা-যা, দি করিসনি!
রাজমিস্ত্রি হেলেদুলে বেলা প্রায় বারোটায় এলেন আমাকে আষ্ট ঘণ্টা দগ্ধানোর পর।
যেন সদ্য এইমাত্র ফার্স্ট ইনফর্মেশন পেয়েছি, এরকমধারা মুখের ভাব করে দুটি কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে অকুস্থলের দিকে রওনা দিলুম। গিয়ে দেখি অত্যন্ত কুস্থান, অর্থাৎ অকুস্থানই বটে।
আমি বললুম, ওই মলো। অকুস্থান হয়েছে আরবি, ওয়াকেয়া, অর্থাৎ ঘটনা আর স্থান নিয়ে।
খান বলল, থাক্ থাক্, আর বিদ্যে ফলাতে হবে না। অকুস্থলের হালটা ভালো করে শোন।
তিন বছর ধরে বাঙলোটায় বসতি ছিল না বলে বাবুর্চিখানার দোর-জানালা চুরি গিয়েছে, ঘরটা পড়ো-পড়ো। কে এক নতুন সাহেব আসবে বলে ওটার ভিত মেরামত করতে গিয়ে বেরিয়েছে একটা কঙ্কাল, পচা কম্বলে জড়ানো। মাথার চুল ছাড়া আর সব পচে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমি নয়া শিকারির মতো সন্তর্পণে এগোলুম বলে খুলির ভিতর মাটির মধ্যে পেয়ে গেলুম একটা বুলেট– তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি, খুলির পিছনের দিকে একটা ওই সাইজের গর্ত।
আব্রুগড়ে গণ্ডায় গণ্ডায় স্পেশ্যালিস্ট নেই যে, আমায় তদ্দণ্ডেই বাৎলে দেবে, ব্যাপারটা কী, অন্তত এই যে কঙ্কাল, এর লাশটা কবে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল। শহরের অ্যাসিস্টেন্ট সার্জন আমাদেরই জেলার ধীরেন সেন! তাঁকে ধরে এনে শুধালুম। বললেন, অন্তত তিন বছর। বিচক্ষণ লোক। রায়টা দিলেন কঙ্কাল উপেক্ষা করে, কম্বলটা উত্তমরূপে পরখ করে।
তা হলে প্রশ্ন, তিন বছর পূর্বে ওই বাঙলোয় থাকত কে– যার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল?
খবর পাওয়া গেল, আইরিশম্যান পেট্রিক ও’হারা সাহেব। সে এখন কোথায়? জেলে। কেন? সে-কথা জেনে কি পুলি-পিঠের নেজ গজাবে?
আমার মন ক্ষণে এদিকে ধায়, ক্ষণে ওদিকে ধায়। বন্ধ ঘরে আগুন লাগলে মানুষ যেমন মতিচ্ছন্ন হয়ে ক্ষণে এ-দরজায়, ক্ষণে ও-জানালায় ধাক্কা দেয়– কোনও একটাও ভালো করে একাগ্রমনে খোলবার চেষ্টা করে না– আমার হল তাই। কোনও একটা ক্লু পাঁচ মিনিটের তরেও ঠিকমতো ফলোআপ করতে পারিনে।
এখন জ্ঞানগম্যি হয়েছে ঢের। এখন বুদ্ধি হয়েছে বলে বুঝেছি যে, এসব রহস্য সমাধান বুদ্ধির কর্ম নয়। রুটিনের ঘানিতে সবকিছু ফেলে দিতে হয়। তেল বেরিয়ে আসবেই আসবে, সমস্যা সমাধান হবেই হবে।
যে-কাজ আজ পাঁচ মিনিটে করতে পারি, তখন লেগেছিল এক হপ্তা। ততদিনে প্রশ্নগুলো মোটামুটি সামনে খাড়া করে নিয়েছি :
(১) লোকটা কে?
(২) এটা খুন তো?
(৩) কে খুন করল?
(৪) কার বন্দুকের গুলি?
কঙ্কাল থেকে মানুষ শনাক্ত অসম্ভব না হলেও বড়ই কঠিন। তন্ন তন্ন করেও আঙটি-টাঙটি, বাঁধানো দাঁত, ডেন্টিস্টের কোনও প্রকারের কেরানি কিছুই পাওয়া গেল না। ব্লাঙ্কো!
আমি তো এ শহরে এসেছি মাত্র কয়েক মাস হল, কিন্তু পুরনো বাসিন্দাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানে, কিন্তু অহমিয়ারা সরল হলেও এ-তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানে যে, পুলিশের ঝামেলাতে খোদার খামোখা জড়িয়ে পড়তে নেই। ব্লাঙ্কো!
ইতিমধ্যে রিপোর্ট পৌঁছল, খুলির ভিতর যে বুলেট পাওয়া গিয়েছিল, সেই বুলেটই খুলির ফুটোটার জন্য দায়ী।
অমি বাঁকা হাসি হেসে বললুম, মারাত্মক আবিষ্কার। এ তো কানাও বলতে পারে। আর ওই দেখ, তোর কৃষ্ণসুন্দরী আর একপাল সাঁওতালি। ওদের বসতির দিকে এগোচ্ছি এখন।
গাড়ি তখন খানা জংশনে লুপ লাইনে ঢুকবে বলে ধীরে ধীরে চলছিল।
খান অনেকক্ষণ ধরে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, নাহ্, টুনি মেমের পায়ের নখের কণাও এরা হতে পারে না।
আমার অভিমান হল। সাঁওতালি আমাদের প্রতিবেশী মেয়ে।
লক্ষ না করেই খান বলল, বুলেটে যে খুলি ফুটো করেছে, সে তো তুই বুঝিস, আমিও বুঝি, কিন্তু আদালত কি বুঝবে? তারা প্রমাণ চায়। উঁঃ, আদালত তো আদালত! অডিটের বেলা জান না কী হয়? পেনশন্ নেবার জন্য তুমি সার্টিফিকেট দাখিল করলে যে, তুমি এপ্রিল মাসে জীবিত আছ। অডিট শুধাল, কিন্তু মার্চ মাসের সার্টিফিকেট কই? আপনি যে মার্চ মাসে জীবিত ছিলেন, তার প্রমাণ কী? না হলে যে মার্চ মাসের পেনশনটা পাবেন না।
আমি বললুম, সেটা কিন্তু ঠিক। দিল্লির যাদুঘরে কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বিদেশি ভিজিটরকে ছোট্ট একটি শিশুর খুলি দেখিয়ে বললেন, ইটি শঙ্করাচার্যের খুলি। ভিজিটর অবাক হয়ে শুধাল, তার খুলি এত ছোট ছিল? মন্ত্রী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এটা তার শিশু বয়সের খুলি। দুটো কিংবা ছটা খুলি যখন হতে পারে, তখন দু-টো কিংবা ছটা জীবন হবে না কেন? তা হলে একটা মার্চ মাসে গ্যাপ পড়াটাই-বা বিচিত্র কী?
ওসব কথা থাক; তার পর কী হল বল্।
তখন অনুসন্ধান করতে লাগলুম খুনটা হয়েছে ও’হারা সাহেব এই বাঙলোয় থাকাকালীন, না তার পরে কেউ খুন করে লোকটাকে নির্জন পোড়োবাড়িতে পুঁতে গেছে?
ও’হারা জেলে। দীর্ঘ মেয়াদে।
থানার পুরনো ফাইল কাগজপত্র ঘেঁটে যা আবিষ্কার করলুম, সে-ও বিচিত্র। সাহেব ছটা ইংরেজ পরিবারকে চকোলেটের ভিতর বিষ ঠেসে তাই খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল। প্রমাণের অভাব হয়নি। আব্ৰুগড় থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরের এক ছোট্ট ডাকঘর থেকে ও’হারা পাঠিয়েছিল ছটি রেজেস্ট্রি পার্শেল ছ জন ইংরেজের নামে পোস্টমাস্টার সেই মর্মে সাক্ষী দিয়েছিল।
এদের দুজন থাকত অব্রুগড়ে, বাকিরা কাছেপিঠের চা-বাগানে। একইসঙ্গে একই জিনিস খেয়ে সবাই মরমর হয়েছিল বলে সিভিল সার্জন বুদ্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে যে, চকোলেটের মধ্যে গড়বড় সড়বড় আছে। তাই তারা সে যাত্রা রক্ষা পায়। কেউ মরেনি।
কিন্তু ছ-টা কেন, একটা পরিবার একটা পরিবারই-বা কেন একজন লোককে খুন করার চেষ্টা করলেও দীর্ঘমেয়াদের জন্য শ্রীঘর। ও’হারা আলিপুরে।
ইতিমধ্যে বীরভূমের খোয়াইডাঙা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। খান বলল, এদের সঙ্গে আমাদের সবুজ সিলেটের কোনও মিল নেই বটে কিন্তু তবু এর রুক্ষ শুষ্ক একটা কঠোর সৌন্দর্য আছে। তার পর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলুম। মনে পড়েছে। হঠাৎ আমার মাথায় এক নতুন বুদ্ধির উদয় হল। ও’হারা যখন আইরিশম্যান তখন তার বন্দুক থাকাটা অসম্ভব নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলুম, ছিল। আমি জানতুম কারও দীর্ঘমেয়াদের জেল হলে তার বন্দুক সরকারি তোষাখানায় জমা দেওয়া হয়। সেটা সেখানে পাওয়া গেল। বিশেষজ্ঞেরা বললেন, খুলির মাথায় যে বুলেট পাওয়া গেছে, সেটা নিঃসন্দেহে ওই বন্দুক থেকেই ছোঁড়া হয়েছে।
যাক। এতক্ষণে এক কদম এগোলুম কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যে লোকটা খুন হয়েছে সে কে?
কলকাতায় যখন কলেজে পড়তুম তখন আমাদের হোস্টেলে রামানন্দ চাটুয্যে একবার জর্নালিজম সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে আসেন। মেলা কথা কওয়ার পর তিনি শেষ করেন এই বলে যে, যে কোনও জ্ঞান, যে কোনও খবর, তার মূল্য যত সামান্যই হোক না কেন, কোনও না কোনও দিন জর্নালিজমের কাজে সেটা লেগে যেতে পারে।
পুলিশের কাজেও দেখলুম তাই। সেই যে আমি অবসর সময়ে থানায় বসে পুরনো ফাইলের কাসুন্দি ঘাটতুম তাই লেগে গেল কাজে।
থানায় থানায় একখানা খাতাতে লেখা থাকে কে কবে নিরুদ্দেশ হল– অবশ্য যদি আত্মীয়স্বজন খবর দেয়। বিরাট দেশ ভারতবর্ষ– কত লোক কত রকমে কঞ্জুর হয়ে যায়, কে-বা রাখে তার খবর। তবু মনে পড়ল তিন বছর আগে এক বিহারি মজুর নিখোঁজ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কঙ্কালটা জড়ানো ছিল একটা চেক্ কম্বলে, এ ডিজাইনটা বিহারিদের ভিতর খুবই পপুলার।
যে পাড়াতে সে থাকত সেখানে জোর অনুসন্ধান চালালুম। অবশ্য ছদ্মবেশে। চায়ের দোকানে আশ-কথা পাশ-কথা কওয়ার পর একে একে তাকে শুধাই, সেই বিহারি রামভজনের কী হল?
যা খবর পাওয়া গেল সেটা আমাকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে দিল। তার নির্যাস–
রামভজনের বউ টুনি মেম—
আমি আশ্চর্য হয়ে বাধা দিয়ে বললুম, বিহারি মজুরের বউ মেম হয় কী করে?
খান বলল, সেই কথাই তো হচ্ছে। টুনি ও’হারা সাহেবের বাঙলোয় কাজ করত। পরে সায়েবের রক্ষিতা হয়ে যায়। তাই বিহারিরা তার নাম দেয় টুনি মেম।
রামভজন নাকি একদিন তার দেশের ভাই-বেরাদরকে বলে, সে দেশে চলে যাচ্ছে যা জমিয়েছে তাই দিয়ে খেত-খামার করবে। হয়তো তারও বাড়া আরেকটা কারণ ছিল। সামনাসামনি না হোক, আড়ালে-আবডালে অনেকেই টুনি মেমকে নিয়ে মস্করা-ফিস্কিরি করত। অতি অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে রামভজনকে বাদ দিয়ে নয়।
এবং শেষ খবর, টুনি মেম আর তার স্বামীকে স্টেশনে নিয়ে যাবার সময় নাকি ওদের দু জনকে ও’হারার বাঙলোর গেটের সামনে দেখা যায়।
আমি শুধালুম, তার পর? কৌতূহল তখন আমার মাথায় রীতিমতো চাড়া দিয়ে উঠেছে।
আমাকে হতাশ করে খান বলল, ব্লাঙ্কো। মাস তিনেক পর যখন রামভজনের পরিচিত নতুন মজুররা আব্রুগড়ে এল–ওরা কিস্তিতে কিস্তিতে আসছে-যাচ্ছে হামেশাই- তখন তারা বলল, রামভজন আদপেই দেশে পৌঁছয়নি। আব্রুগড়ের কেউ বলল, টুনি মেমের বেহায়াপনায় তিতি-বিরক্ত হয়ে সন্ন্যাস নিয়েছে, কেউ বলল দার্জিলিং না কোথায় যেন চা-বাগানে কাজ নিয়েছে।
আর টুনি মেম?
সে তখন ও’হারার রক্ষিতা। কিন্তু রক্ষিতা বললে হয়তো ও’হারা ও টুনি মেম দুইজনারই প্রতি অবিচার করা হয়। ও’হারা টুনি মেমকে রেখেছিল রানির সম্মান দিয়ে আর টুনি মেম ও’হারাকে ভালোবেসেছিল লায়লী যে-রকম মজনূনকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু এ-সব আমি পরে জানতে পেরেছিলুম।
আমি তখন মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটার একটা আবছা আবছা ছবি এঁকে ফেলেছি।
টুনি মেম স্বামীকে স্টেশনে নিয়ে যাবার পথে ও’হারার বাঙলোয় নিয়ে যায়। শীতকাল ছিল বলে রামভজন তার সেই চেক কম্বলখানা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। তার পর যে কোনও কারণেই হোক ও’হারা তাকে গুলি করে মেরে বাবুর্চিখানার ভিতের নিচে পুঁতে ফেলে। যে লোক ছটা পরিবারকে খুনের চেষ্টা করতে পারে তার পক্ষে এটা ধুলো-খেলা।
চায়ের দোকানে তদন্ত শেষ হলে পর একদিন থানা থেকে সরকারিরূপে চায়ের দোকানে যে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিফহাল ছিল তাকে ডেকে পাঠালুম। সে বলল কসম খেয়ে, কোনওকিছু তার পক্ষে বলা অসম্ভব তবে রামভজনের ওইরকম একখানা চেক কম্বল ছিল।
তা হলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল এই, ও’হারা যদি রামভজনকে খুন করে থাকে তবে তার একমাত্র সাক্ষী টুনি মেম।
টুনি মেম কোথায়?
খবর পেলুম ও’হারার জেল হওয়ার পর টুনি মেম বড় দুরবস্থায় পড়ে। শেষটায় কোনও পথ না পেয়ে ও’হারা সায়েবের বাবুর্চির সঙ্গে উধাও হয়ে যায়।
এইবার সত্যি আমার সামনে যেন পাথরের পাঁচিল খাড়া হল। বহু অনুসন্ধান করেও কিছুমাত্র হদিস পেলুম না, খানসামা আর টুনি মেম গেল কোথায়।
তখন মনে মনে চিন্তা করলুম, সাহেবদের এই যে বাবুর্চি ক্লাসের লোক, এরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের বাড়িতে চাকরি পায় না। পুডিং-পাডিং রোস্টো-মোস্টো দুনিয়ার যত সব অখাদ্য এরা রাধে, শুয়ার গোরুর ঘাট এরা যেসব বানায় সেগুলো দূর থেকে দেখেই শেষবিচারের দিন স্মরণ করিয়ে দেয়– খায় কোন বঙ্গসন্তানের সাধ্যি! অতএব এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ও’হারার বাবুর্চি নিশ্চয়ই অন্য কোনও সায়েবের চাকরি নিয়েছে।
তোকে পূর্বেই বলেছি, আব্রুগড়ের চতুর্দিকে মাইলের পর মাইলজুড়ে চা-বাগান আব-জাব করছে। আমি প্রতি উইক-এন্ডে আজ এটা কাল সেটায় তদন্ত করতে লাগলুম। পরনে খানসামা-বাবুর্চির পোশাক। সবাইকে শুধাই, বাবুর্চির চাকরি কোথাও খালি আছে কি না। আরও শুধাই, আমার এক ভাই নাম ভাঁড়িয়ে এক কুলি রমণীর সঙ্গে বসবাস করছে আসল কারণ অবশ্য আমি ও’হারার খানসামাটার নাম আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি– আমাদের মা তার জন্য বড় কান্নাকাটি করছে, তার খবর কেউ জানে কি না?
বাগানের পর বাগান ব্লাঙ্কো ড্র করেই যাচ্ছি আর আমার রোখও সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে।
শেষটায় আল্লার কুদরত, পয়গম্বরের মেহেরবানি, আর মুর্শিদের দোয়ার তেরস্পর্শ ঘটে গেল।
এক চা-বাগিচার কম্পাউন্ডার শুধু যে খবরটা দিল তাই নয়, বাঁকা হাসি হেসে বলল, ও! টুনি মেম। দেখে এসো গে তোমার বউদি কী সুখেই না আছেন।
আমি মেলা তর্কাতর্কি না করে ধাওয়া করলুম ম্যানেজার সায়েবের বাঙলোর দিকে। সেখানে গিয়ে শুনি, বাবুর্চি পরশু দিন থেকে উধাও, তার বউ কুলিলাইনের একটা কুঁড়েঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।
পড়ি পড়ি এই পড়ি, ত্রিভঙ্গ মুরারি-গোছ অতিশয় জরাজীর্ণ একখানা ছন-বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘর। ঝপের তৈরি দরজাখানা পাশের মাটিতে পচছে।
ভিতরের দৃশ্য আরও মারাত্মক। সঁতসেঁতে নয়, রীতিমতো ভেজা মাটির ভিত। হেথায় গর্ত, হোথায় গর্ত। আল্লার মালুম গর্তে সাপ না ইঁদুর আছে। এক কোণে একটা ভাঙা উনুন। কবে যে তাতে শেষ রান্না হয়েছিল ছাই দেখে অনুমান করতে পারলুম না। তারই পাশে একটা সানকি গড়াগড়ি দিচ্ছে। দু-একটা ভাত শুকিয়ে কাঠ হয়ে তলানিতে গড়াচ্ছে। তারই পাশে মলমূত্র। নোংরা দুর্গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে।
দেয়ালে হেলান দিয়ে একটি হাডিড়সার বছর তিনেকের ছেলে চোখ বন্ধ করে ধুকছে। ছেলেটিকে কিন্তু তবুও যে কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল সেটা আমার চোখ এড়ায়নি। কেউ না বললেও আমি চট করে বলে দিতে পারতুম ইটি ও’হারার সন্তান। শুনেছি স্বর্গের দেবশিশুরা অমর, কিন্তু এই মরলোকে এসে যদি তাদের কাউকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হত তবে বোধহয় তার চেহারা এরকমই দেখাত।
আমি যে গলাখাকরি দিয়ে ঘরে ঢুকলুম সে একবারের তরে চোখও খুলল না। সে শক্তিটুকুও তার গেছে।
অল্পক্ষণের জন্য নীরব থেকে খান বলল, বহু বছর পুলিশে কাজ করে করে আমি এখন সঙ্গ-দিল– পাষাণহৃদয়। তখন সবে পুলিশে ঢুকেছি– আমি ওদিক থেকে চোখ ফেরালুম।
সে আরও নিদারুণ দৃশ্য। একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা তার মায়ের সায়া ধরে টানাটানি করছে। তারও সর্বাঙ্গে অনাহারের কঠিন ছাপ। ভালো করে কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না। আর সে কী বীভৎস গোঙরানো থেকে থেকে হঠাৎ অনাহারের দুর্বলতা যেন তার গলা চেপে ধরে আর কক্ করে গোঙরানো বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার নীরবতা আরও বীভৎস।
চ্যাটাইয়ের উপরে শুয়ে টুনি মেম। পরনে মাত্র একটি সায়া– শত-ছিন্ন, বুক ঢেকে একখানা গামছা জরাজীর্ণ। হাত দু-খানা বুকের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে–কী জানি জীবন-মরণ-অনশন কিসের চিন্তা করছে।
স্পষ্ট দেখতে পেলুম, আসন্নপ্রসবা।
ক্ষণতরে পুলিশের কর্তব্য ভুলে গিয়ে আমার ভিতরকার মানুষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছিল। আমি সবলে তার কণ্ঠরোধ করে পুলিশের কর্তব্যে মন দিলুম। অর্থাৎ এ-রমণী যেন টের না পায় আমি পুলিশ। ও’হারার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে এসেছি।
তাই খানসামার ভাইয়ের পার্ট প্লে করে চিৎকার-চেঁচামেচি আরম্ভ করলুম, কোথায় গেল লক্ষ্মীছাড়াটা আপন বউকে ফেলে?
খান আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস মিতু, এত দুঃখের ভিতরেও মেয়েটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ছিল। কারণটা বুঝতে পেরেছিস? জানিস তো, আমরা সিলেটিরা যদি কুলি-রমণী গ্রহণ করি তবে সে হয় রক্ষিতা, কিংবা লোকে বলে খানকি-নটীর বেলেল্লাপনা, কুলি-রমণীকে স্ত্রীর সম্মান সে-ও দেয় না, আর পাঁচজনের তো কথাই নেই। তাই এত দুঃখের ভিতরও বিবাহিত স্ত্রীর সম্মান পেয়ে তার চোখেমুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছিল।
আমি ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছি, কোথায় গেলেন আমার পরানের ভাই? আচ্ছা আমার খবর নিসনে, নিসনি, কিন্তু হতভাগার মা যে কেঁদে কেঁদে দেশটা ভাসিয়ে দিল তার পর্যন্ত তোয়াক্কা করল না! এদিকে আবার বউ-বাচ্চা পোষবার ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।
আমার চেঁচামেচি শুনে কুঁড়েঘরের সামনে একপাল কুলি মেয়েম জমায়েত হয়ে গিয়েছে। আমি দোরে দাঁড়িয়ে বললুম, তোমাদের মধ্যে কেউ রাজি আছ, এদের জন্যে রান্নাবান্না করে দিতে, ঘর সাফসুতরো করতে, আর বেচারি বউটার সেবা-টেবা করতে? এখুনি তাকে পাঁচ টাকা দিচ্ছি। মাসের শেষে ফের পুরো মাইনে পাবে। আর এই আরও দু টাকা হাঁড়িকুড়ি চাল-ডালের জন্য।
সবাই চেঁচিয়ে বলল, মুন্নি, মুন্নি!
মুন্নি এগিয়ে এল। পুরনো ময়লা ছেঁড়া শাড়ি পরা। পরে জানতে পারলুম, এই গরিব বিধবা একমাত্র মুন্নিই যতখানি পারে টুনি মেমদের দেখভাল করেছে। সে-ও নিঃসম্বল, কীই-বা করতে পেরেছে! কিন্তু জানিস মিতু, দুর্দিনে দুটি দরদের কথাই বলে ক-টা লোক!
আর জানি, সেই মুনি আমাকে মৃদুকণ্ঠে কী বলল? বলল, আমাকে মাইনে দিতে হবে না সাহেব। ওদের জন্যে যা রান্না করব তার থেকে দু মুঠো আমাকে খেতে দিলেই হবে।
এর পরও যে খুদাতালায় বিশ্বাস করে না তাকে চড় মারতে ইচ্ছে করে।
মুন্নিকে বললুম, এই নাও আট আনা। তাড়াতাড়ি গিয়ে মুড়ি-মুড়কি যা পাও নিয়ে এসো।
চায়ের কথা বললুম না। ওই একটিমাত্র জিনিস চা-বাগানে ফ্রি। বিস্তর কুলি বিন দুধ-চিনি সুদ্ধমাত্র চায়ের লিকার খেয়ে খিদে মারে।
পাঁচজন সাধারণ মানুষের স্বভাব, কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে এসে সাহায্য না করার, কিন্তু তখন যদি এরই একজন বুকে হিম্মত বেঁধে সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন অনেকেই তার পিছনে এসে দাঁড়ায়।
একজন ইতিমধ্যে বসবার জন্য আমাকে একটা মোড়া এনে দিয়েছে। আমি বললুম, আমি একটা চারপাই কিনতে চাই। বেচবে?
চারপাই বলতে-না-বলতে এসে গেল। ভিজে ভিত থেকে উদ্ধার পেয়েও কিন্তু টনি মেমের মুখের ভাব বদলাল না।
তোকে বলেছি– হার্ড-বয়েল্ড পুলিশম্যান আমি তখনও হইনি, এমনকি অতিশয় সফ্ট-বয়েল্ডও না, তাই এই পুলিশের ভণ্ডামি করতে আমার বাধো বাধো।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, এইবারে তুই আরম্ভ করলি সত্যি সত্যি মিথ্যে ভণ্ডামি। ভুলে গেছিস নাকি, স্কুলে আসবার সময় কাঁধে করে মা-হারা একটা কাঠবেড়ালিকে সঙ্গে নিয়ে আসতিস? মাস্টারমশাই সেটার জন্য চোটপাট করাতে গ স্কুল ছেড়ে নবাবি তালবের উপরে রাজার স্কুলে ট্রেনসফার নিলি?
খান যেন আদৌ শুনতে পায়নি। বলল, আসন্নপ্রসবা রমণী পুরুষের চিত্তহারিণী হয় না। কিন্তু তোকে কী বলব, মিতু, ওরকম সুন্দরী মেয়ে আমি জীবনে কখনও দেখিনি।
অনাদর, অবহেলা এবং সর্বোপরি অনাহার তাকে ম্লান করে দিয়েছে সত্য কিন্তু খাঁটি সোনার উপরকার ময়লা কতক্ষণ থাকবে! একে দু-দিন খেতে দিলে, দুটি মিষ্টি কথা বললে এ তো চোখের সামনে কদমগাছের মতো বেড়ে উঠবে, সর্বাঙ্গে সৌন্দর্যের ফুল ফোঁটাবে। এই তো এখুনি যখন মুড়ি এল আর ছেলেটি এই প্রথমবার প্রসন্ন নয়নে তার দিকে তাকাল, তখন তার মায়ের সৌন্দর্য যেন সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল।
গয়ার কালো পাথরে কোঁদা মূর্তিটি যেন টুনি মেম। হিন্দুদের যে সুন্দর সুন্দর কালো পাথরের মূর্তি আছে সেগুলো সুন্দর আমি জানি, কিন্তু কালো বলে আমার মন কখনও সাড়া দেয়নি। টুনি মেমকে দেখে বুঝলুম, মরা কালো পাথর জ্যান্ত টুনির রঙের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কী মারই না খেয়েছে!
আমি তো তেমন ফর্সা নই, আমিই মজেছিলুম টুনির রঙ দেখে। আর ও’হারা তো আইরিশম্যান। সে যে পাগল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! গৌরী শ্রীরাধা কেন কৃষ্ণে লীন হয়েছিলেন, টুনি মেমকে দেখে বুঝতে পারলুম। তা সে যাক গে, তোকে আর কী বোঝাব? দেখাবার হলে দেখাতাম। ওই একটি মেয়ে এ-রঙ নিয়ে জন্মেছিল। তার আগেও না, পরেও না।
ইতিমধ্যে মুন্নি খিচুড়ি চড়িয়েছে। ঘরটা পরিষ্কার করা হয়েছে। একটা টেমি টিম টিম করে জ্বলছে। আমি কিছুক্ষণের জন্য বিদায় নিলুম।
বাগানের ছোটবাবু মুসলমান। তাঁকে সার্টিফিকেট দেখাবার ছল করে আমার পুলিশের পরিচয় দিলুম। খাওয়া-দাওয়া করলুম কিন্তু তাঁর বাবুর্চির সঙ্গে, পাছে কোনও সন্দেহের উদ্রেক হয়।
রাত নটার সময় টুনি মেমের ঘরে ফিরে দেখি মুন্নি তাকে আরও চারটি খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। আমাকে বলল, কদিন ধরে কিছুই জোটেনি, সাহেব; আজ হঠাৎ খাবেই-বা কী করে! তবু বলছি, পেটের বাচ্চার জন্য দুটি খেতে।
টুনির পরনে শাড়ি। সেদিকে তাকাতে মুন্নি বলল, আট আনা পয়সা দিয়ে মুদির দোকান থেকে ছাড়িয়ে এনেছি।
আমি বললুম, খুব ভালো করেছ।
মুন্নি আপন কথাখানা নিয়ে এসেছে। সেটা চেটাইয়ের উপর পেতে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে শুয়ে পড়ল।
আমি মোড়াটা চারপাইয়ের পাশে এনে বসলুম। টুনি সেই আগের মতো শুয়ে আছে। হাত দু-খানা বুকের উপর।
আমি উঠি উঠি করছি, এমন সময় টুনি চোখ বন্ধ রেখেই কোনওপ্রকারের ভূমিকা না নিয়ে বলল, আপনি সবকিছু জানতে চান না?
আমি হকচকিয়ে উঠলাম। কিন্তু তার পরের কথাতেই আশ্বস্ত হলুম। বলল, কী করে এ অবস্থায় পৌঁছলুম!
খান বলল, উত্তেজনা-ঔৎসুক্যে আমি তখন অর্ধমৃত। না, না, না, তোমার এখন শরীর দুর্বল, তুমি ওই ধরনের কিছু একটা বলা-না-বলার মতো কী যেন একটা অর্ধপ্রকাশ করেছিলুম।
টুনি বলল, আমি আপনাদের ভাষায় কুলি। আপনারা আমাদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না, অথচ জানেন, আমি একদিন রাজরানির সম্মান পেয়েছিলুম।
খান বলল, বিশ্বাস করবি নে মিতু, ঠিক এইরকম ধরনের মার্জিত ভাষায় কথা বলেছিল। আমি তো অবাক।
আমি বললুম, আম্মো।
খান বলল, সেটা পরে পরিষ্কার হল। তোকে সব বলছি, টুনি মেম যা বলেছিল।
বলল, অনেক অপমান নির্যাতন সয়েছি। হেন অপমান নেই যা আমায় সইতে হয়নি মুখ বুজে। নতুন অপমান আর কী হতে পারে? তাই মনে হচ্ছে আমার যাবার সময় বুঝি ঘনিয়ে এল।।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে পড়েছে। মুন্নির নাক অল্প অল্প ডাকছে। টিমেটা বাতাসে এদিক-ওদিক নাচছে।
টুনি বলল, ও’হারা সায়েবের বোন এসেছিল বিলেত থেকে এ দেশের হাতি-গণ্ডার দেখবে বলে। তারই আয়া হয়ে আমি ও-বাড়িতে ঢুকি। মেম চলে যাওয়ার পরও তিনি আমায় ছাড়লেন না।
আপনি মুরুব্বি, আপনাকে সব কথা বলতে আমার বাধছে। তবু যে বলছি, তার কারণ আপনি এসেছেন আমার ত্রাণকর্তা, আমার বন্ধুরূপে। আপনাকে না বলব তো বলব কাকে? আর এ যেন আমার বুকের উপর বোঝা হয়ে চেপে বসে আছে। এ-বোঝা না নামিয়ে তো আমার নিষ্কৃতি নেই। আপনি শুনুন।।
আমাদের প্রণয় হয়েছিল। আমি স্বীকার করছি, স্বামী বর্তমান থাকতে পরপুরুষের দিকে তাকানোই পাপ, প্রণয় সে তো মহাপাপ। তার জন্য যে সাজা পরমাত্মা আমায় দেবেন তার জন্য আমি তৈরি।
কিন্তু ভাবো দিকিনি ভাই সায়েব, আমি কুলি-কামিন। আমি কালো, কিন্তু প্রতিবেশিনীরা বলত, আমার সর্বাঙ্গ নাকি চুম্বক, পুরুষকে টানে। টানত নিশ্চয়ই বিশেষ করে ছোঁড়ারা যখন হ্যাংলার মতো আমার দিকে তাকাত তখনই সেটা বুঝতে পারতুম। কিন্তু ওরা কী চায়, সেটা আমি আরও ভালো করেই বুঝতে পারতুম। আমাকে রক্ষিতা করে রাখবার সাহসও এদের ছিল না। যাক, এসব কথা আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই।
তখন যদি কেউ আমাকে রানির সম্মান দেয় তখন সে প্রলোভন জয় করা কি সহজ পরীক্ষা? সায়েব আমাকে প্রথম দিন থেকেই ইংরেজি পড়াতে শুরু করল, বলল, তোমাকে আমি আমার মনের মতো করে গড়ে তুলব। ভালোবাসলে মানুষ কী না করতে পারে। কিংবা হয়তো পূর্বজন্মে আমি কোনও পাঠশালা-মক্তবের আঙ্গিনা ঝাঁট দিয়ে সেবা করেছিলাম বলে এ জন্মে তারই পুণ্যের ফলে আমার লেখা-পড়া যে গতিতে এগিয়ে চলল সেটা দেখে স্বয়ং সায়েবই অবাক।
এতক্ষণ পরে টুনি মেম আমার চোখের দিকে তাকাল। বোধহয় দেখে নিল এসব সূক্ষ্ম জিনিস বোঝবার স্পর্শকাতরতা আমার কতখানি আছে। আফটার অল, সে তো আমাকে জানে খানসামার ভাই খানসামা হিসেবে!
আমার চোখে কী দেখল কে জানে। আজও আমার কাছে রহস্য। কিন্তু বলে যেতে লাগল ঠিক সেইভাবেই।
বলল, বিদ্যাবুদ্ধি কতখানি হয়েছিল বলতে পারিনে, কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা কুলি-মজুররা যে ভালোবাসি, একে অন্যের প্রতি আমাদের যে টান হয়, সেটাকে আমি নিন্দা করছিনে, কিন্তু সায়েবের পাশে বসে প্রেমের ভালো ভালো গান আর কবিতা পড়ে পড়ে আমি এক নতুনভাবে তাকে ভালোবাসতে লাগলুম, আর সে যে আমাকে কত দিক দিয়ে কতখানি ভালোবাসে সেটাও দিনের পর দিন আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগল।
টুনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে থামাই। কিন্তু সে তখন আপন মনে যেন কথা বলছে। আবার কখনও-বা সংবিতে ফিরে চোখ-দুটি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে আপন কথা বলে যায়।
সায়েবের মতো এ রকম মানুষ আমি আর দেখিনি। সামান্য কয়েক ঘণ্টা দিনে কাজ করত চা-গাছের সার নিয়ে, আর তার জন্য পেত কাড়ি কাড়ি টাকা। আর খরচ করত বেহুশের মতো। আমি কিছু বললে হেসে উত্তর দিত, যত খুশি যে যখন কামাতে পারে তখন যত খুশি খরচ করবে না কেন?
এই তো আমার স্বামীকে দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল
খান বলল, আমি তখন উত্তেজনার চরমে। এইবারে জানতে পারব, সেই টাকা নিয়ে টুনি মেমের স্বামী দেশে ফিরে গিয়ে খেতখামারের প্ল্যান করছিল কি না? সে টাকা পেয়েছিল কি? না ও’হারা ডবল ক্রসিং করেছিল! রামভজন গুলি খেল কী করে, কেন, কার হাতে? কিন্তু হঠাৎ কেন জানি নে, টুনি মেম কথার মোড় ফিরিয়ে নিল। আমি শুধু লক্ষ করলুম, টুনির মুখ কেমন যেন ঈষৎ বিকৃত হয়ে গেল। পাছে সে সন্দেহ করে বসে, আমি কী মতলব নিয়ে এসেছি, তাই আমিও এই ব্যাপারটার ওপর চাপ দিলুম না। মনকে সান্তনা দিলুম, এতখানি যখন বলেছে, পরে মোকা পেলে বাকিটুকু পাম্প করে নেব।
কারণ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, টুনি মেম তো সাধারণ কুলি-কামিন নয়ই, সে অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে ভীষণ শক্ত মেয়ে। খুদাদা (বিধিদত্ত) চরিত্রবল তার নিশ্চয়ই ছিল, তার ওপর এত বেশি তুফান-ঝড়, এত বেশি বিচিত্র ভাগ্যবিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে মার খেয়ে খেয়ে আজ এই স্যাঁতসেঁতে কুঁড়েঘরে এসে পৌঁছেছে যে, এখন সে নির্ভয়– তার আর যাবে কী, তার আর হারাবার মতো কী আছে যে সে তারই ভয়ে আপন গোপন কথা ফাঁস করবে? সে যদি নিজের থেকে কিছু না বলে তবে আমার চতুর্দশ পুরুষের সাধ্য নেই যে, আঁকশি দিয়ে তার পেটের কথা বার করি। এই একফোঁটা দুবলাপাতলা মেয়ে, পুলিশের এক ফুয়ে সে কঁহা কঁহা মুলুকে উড়ে যাবে, কিন্তু আমি এ তত্ত্বটাও জানি যে সে ভাঙবে না, তার দার্চ অবিশ্বাস্য।
টুনি মেম বলল, কিন্তু সায়েব ছিল পাগল। আমি ভেবে-চিন্তেই বলছি, সায়েব ছিল পাগল। দুটো জিনিসে যে তার পাগলামি কত বিকট রূপ ধারণ করতে পারত সে যারা দেখেছে তারাই বলতে পারবে।
তারই স্মরণে টুনি মেম যেন আঁতকে উঠল। বলল, বেশ ভালোমানুষের মতো দিব্যি দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, আমাকে আদর-সোহাগ করার অন্ত নেই, সারা সকালটা হয়তো কাটাল ক্যাটালগ দেখে দেখে বিলেত থেকে আমার জন্য কী সব আনাবে বলে, তার পর হঠাৎ আরম্ভ হয়ে গেল একটানা মদ খাওয়া। চলল দিনের পর দিন। কাজকর্ম তো বন্ধ বটেই, নাওয়া-খাওয়ারও খোঁজ নেই। একটুখানি সুস্থাবস্থায় পেয়ে যদি বললুম, দুটি মুখে দাও, তবে সে কাতর স্বরে হয় বলত, নেশা কেটে যাবে, নয় বলত, মুখ দিয়ে কিছুই নামবে না! ঘুম আর মদ, মদ আর ঘুম। আমার জাতভাইরা এদেশে এসে মদ খেতে শেখে। তাদের কেউ কেউ খায়ও প্রচুর। ও জিনিস আমার সম্পূর্ণ অজানা নয়, কিন্তু ওরকম বেহদ মদ কাউকে আমি খেতে দেখিনি, শুনিনি। সে তখন মানুষ নয়, পশুও নয়, যেন কিছুই নয়।
আমি তার পা জড়িয়ে ধরে বলেছি কতবার তুমি যদি ওই মদটা না খেতে তবে আমি নির্ভয়ে বলতে পারতুম, আমার মতো সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই। সুস্থ অবস্থায় থাকলে সে-ও আমার পা জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করত, আর কখনও খাবে না। কী লজ্জা! যাকে আমি মাথার মণি করে রেখেছি সে দেবে হাত আমার পায়ে! অবশ্য এ কথাও ঠিক, আস্তে আস্তে তার এই মদের বান কমতির দিকে চলল। আমার আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু আমার কপালে এত সুখ সইবে কেন?
খান দম নিয়ে বলল, দেখ মিতু, এর পর বহুকাল চা অঞ্চলে কাজ করার ফলে বিস্তর সায়েবকে প্রচুর কালো মেয়ে নিতে দেখেছি এবং ছেড়ে যেতেও দেখেছি, কাচ্চা-বাচ্চা থাকলে তাদের মিশনারির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা আমাকেও মাঝে মাঝে করতে হয়েছে এসব ওদের ডালভাত। কিন্তু টুনি মেম স্বতন্ত্র।
আমি বললুম, সে আর তোকে বলতে হবে না। তার পর কী হল, তাই বল। বোলপুর আর বেশি দূর নয়।
খান বলল, টুনির কাহিনীও শেষ হতে চলল। শোন্। টুনি বলল, আমার দ্বিতীয় দুঃখ ছিল, সায়েবের অসম্ভব রাগ। ওই মদেরই মতো। বেশ দিন কাটছে, হাসিখুশির মানুষ সায়েব। হঠাৎ কোনও আরদালি বা বেয়ারা একটা কিছু বলল, আর সায়েব রেগে পাগলের মতো তাকে বন্দুক হাতে নিয়ে করল তাড়া। আমি কতবার যে ছুটে গিয়ে তার পায়ে জড়িয়ে ধরে তাকে ঠেকিয়েছি তার হিসাব নেই। তবু বুঝতুম, যদি মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় এ-রকম ধারা করত। তা নয়। সম্পূর্ণ সুস্থাবস্থায়। আমার নিজের কোনও ভয় ছিল না, কারণ আমার ওপর সে একবার মাত্র রেগে গিয়ে পরে এমনই লজ্জা পেয়েছিল যে, আমার মনে আর কোনও সন্দেহ ছিল না যে সে আর আমার ওপর রাগবে না। কিন্তু চাকরবাকরকে নিয়ে হত মুশকিল। আমার স্বামীকে
খান থামল। আমি তেড়ে বললুম, ওই রাগের মাথায় খুন করেছিল না কি?
খান বলল, ভাই এবারেও আমাকে প্রলোভন সংবরণ করতে হল। ঠিক যখন আমার মনে হল, এবারে টুনি আসল কথায় আসবে ঠিক তখন সে আবার তার কথার মোড় ঘোরালো। আমি নাচার। আবার মনকে সান্ত্বনা দিলুম, এই নিয়ে দু-বার হল; তিনবারের বার নিশ্চয়ই বলবে। কিন্তু টুনি পাড়ল অন্য কথা। বলল, ওই রাগই আমার সর্বনাশ করল। তার পর আমাকে শুধাল আমি এদেশে অনেক দিন ধরে আছি কি না? আমি বললুম, না, ভাইয়ের সন্ধানে হালে এসেছি। তখন টুনি বলল, তা হলে জানতে, যা সবাই জানে। ওই নিয়ে মোকদ্দমা হয়েছিল।
সায়েব ক্লাবে বড় একটা যেত না। একদিন ফিরে এল চিৎকার করতে করতে বদ্ধ মাতালের মতো, অথচ মদ খায়নি। পাগলের মতো শুধু চেঁচাচ্ছে, আমাকে অপমান, এত বড় সাহস! আমাকে অপমান, এত বড় সাহস। আমি দেখাচ্ছি, আমি কী করতে পারি? আমি কাউকে ছাড়ব না। আমি দেখাচ্ছি, আমি কী করতে পারি। আমি চেষ্টা করেছিলুম সায়েবকে ঠাণ্ডা করতে কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারলুম না। টাকা নিয়ে মোটরে করে ফের বেরিয়ে গেল।
ত্রিসংসারে আমার কেউ নেই। তাই নিয়ে আমি কখনও দুঃখ করিনি। আমার সায়েবকে পেয়েই আমি খুশি ছিলুম, আমি সুখী ছিলুম, কিন্তু রাত যখন ঘনিয়ে এল আর সায়েব ফিরল না তখন যে আমি কী করি, কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলুম না। এর পূর্বে সায়েব আমাকে কখনও একা ফেলে যায়নি। একা থাকতে আমার ভয় করে না। কিন্তু সে রাত্রে কেমন যেন এক অজানা ভয় এসে আমাকে অসাড় করে দিল। সে রাত্রিটা আমার কী করে কেটেছিল আজ আর বলতে পারব না।
পর দিন সায়েব সন্ধের দিকে ফিরে এল। আমি তাকে হাতে ধরে নিয়ে যেতে চাইলুম বাথরুমের দিকে। সে কিন্তু আমাকে দু হাতে শূন্যে তুলে নিয়ে বসাল উঁচু একটা চেয়ারের উপর। নিচে আমার পায়ের কাছে ছোট্ট একটি মোড়ার উপর বসে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে আমার দিকে। সায়েব এভাবে প্রায়ই আমাকে বসাত, আর একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার বড় লজ্জা করত। আমি কে, আমি কী?
ভাই সায়েব, তুমি কিছু মনে কর না, আমাকে সব কথা বলতে দাও।
ঠিক তার চারদিন পর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল।
কুকুর-বেড়ালকেও মানুষ এরকম লাথি মেরে বাড়ি থেকে খেদায় না। আমি সায়েবের রক্ষিতা, আমার তো কোনও হক্ক নেই। পুলিশ বাড়ি তালাবন্ধ করে সিলমোহর মেরে চলে গেল। আমি একবস্ত্রে বাঙলোর বারান্দা থেকে বাগানের বকুলতলায় এসে বসে রইলুম। সেখানে সায়েব আমার জন্য একটা সিমেন্টের বেদি বানিয়েছিল।
যে চাকর-নফর সেদিন সকালবেলা পর্যন্ত আমার পা চেটেছে, তারাই এখন আমাকে লাথিঝাটা মারল। চাকরি গেছে যাক কিন্তু ওই কুলি মেমটাকে যতখানি পারি অত্যাচার-অপমান করে তার দাদ তুলে নিয়ে যাই।
আমি একটি কথাও বলিনি।
মোকদ্দমাতে সব কথা বেরুল। সবাই জানে। সেই যেদিন সায়েব ক্লাবে গিয়েছিল সেদিন ক্লাবের কয়েকজন মুরুব্বি তাকে নাকি আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, অনেক চা-বাগিচার ইংরেজ ছোকরা দিশি মেয়ে রাখে কিন্তু আমার সায়েব আমাকে নিয়ে খোলাখুলি যে মাতামাতি করছে সেটা ইংরেজসমাজের পক্ষে বড়ই কেলেঙ্কারির ব্যাপার।
আমি জানতুম, আমার সায়েব এ-সব চা-বাগিচার সায়েবদের ঘেন্না করত। কতবার তাকে বলতে শুনেছি, যেসব নেটিভদের উপর সায়েবরা ডাণ্ডা মেরে বেড়ায়, তারা শিক্ষাদীক্ষার কোনও সুযোগই পায়নি, তাই তারা আজ মজুর, আর ওই সায়েবরা আপন দেশে সব সুযোগ পেয়েও নিতান্ত অপদার্থ হতভাগা বলে কিছুই করে উঠতে পারেনি। আপন দেশে মজুরের কাজ করতে হলে যেটুকু ধাতুর প্রয়োজন সেটুকুও এসব লক্ষ্মীছাড়াদের নেই বলে তারা এদেশে এসে নেটিভদের উপর দাবড়ে বেড়ায়।
তোমাকে বলেছি, ভাইয়া, আমার সায়েব অপমানিত বোধ করলে রেগে একেবারে পাগলের মতো হয়ে যেত। সে নাকি তখন যে কটা সায়েবকে হাতের কাছে পেয়েছে তাদের গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়েছে আর চিৎকার করে একই কথা বার বার বলেছে, আমি তোমাদের মতো ভণ্ড ছোটলোক নই। আমি যাকে নিয়েছি তাকে আমি আমার স্ত্রীর সম্মান দিয়েই রেখেছি। এখানে বলে রাখি, ভাই সায়েব, এরা সবাই জানত কথাটা সত্যি। আব্রুগড়ের পাদ্রি সায়েব আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়তে নারাজ জেনে সায়েব ঠিক করেছিল, কলকাতায় আমাদের বিয়ে হবে।
খান অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, তিনবারের বারও ঘোড়া জল খেল না। কারণ আমি তখন থাকতে না পেরে টুনিকে শুধালুম, তার স্বামী সম্বন্ধে যখন কোনও খবর নেই তখন তাদের বিয়ে হত কী করে? অবশ্য আমি ভাবখানা করেছিলুম যেন ওটা অমনি একটা কথার কথা, যেন নিছক একাডেমিক প্রশ্ন। আজও বুঝতে পারিনি টুনি মেম আমাকে সন্দেহ করেছিল কি না। টুনি শুধু বলল, সায়েব নাকি তাকে বলেছিল, সে কলকাতার উকিলদের কাছ থেকে তাদের সম্মতি আনিয়েছে, তবে সেটা নাকি খুব পরিষ্কার নয়। চুলোয় যাক গে সে-সব কথা, আমার ইচ্ছে শুধু জানবার তার স্বামীর নিখোঁজ হওয়া সম্বন্ধে সে কী জানে কিন্তু সেই যে ও’হারার বদমেজাজির কথা বলার সময় সে তার স্বামীর কথার আভাস দিয়েছিল, এবারে সেটুকুও না।
আমি বললুম, ওই কথাটুকু আমিও তো জানতে চাই।
খান বলল, টুনি জল খেয়ে নিয়ে খেই তুলে বলল, সায়েবকে ক্লাববাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। সেদিন বাড়ি ফিরে সায়েব আমাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিল– সে তো বলেছি তার পর মোকদ্দমায় বেরুল সায়েব পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরের একটা ছোট্ট পোস্টআপিসে গিয়ে যে ছ জন সায়েব তার গায়ে হাত তুলেছিল তাদের নামে ছ প্যাকেট বিষ-মাখানো চকলেট বিজ্ঞাপন হিসেবে পাঠায়। আচ্ছা, বল তো ভাইয়া, আমি যে বলেছিলুম সায়েবের মাথায় ছিট ছিল সেটা কি ভুল বলেছি? এটা কি ধরা পড়ত না? পাঁচটি পরিবারের লোক যদি একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ে আর সায়েবলোগের ব্যাপার সঙ্গে সঙ্গে সিভিল সার্জনকে ডাকা হয় তবে কি তার মূল ধরা পড়বে না? পার্সেলের উপর যে পোস্টআপিস থেকে সেগুলো এসেছিল তার খেই ধরে পুলিশ দু দিনের ভিতর ধরে ফেলল যে সে-ই পার্সেলগুলো পাঠিয়েছিল। পোস্টমাস্টার আদালতে তাকে শনাক্ত করল।
খান মন্তব্য করে বলল, টুনি মেমের নরম আর শক্ত দুটো দিকই দেখতে পেলুম তার পরের কথাতে। বলল, মানুষ মারা পাপ, আর ভাবো দিকিনি ওইসব পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট কাচ্চাবাচ্চাগুলো। আবার পাঠিয়েছিল একটি ছোট ডাকঘর থেকে। ধরা পড়তে কতক্ষণ। কিন্তু একথাও তোমাকে বলছি, ভাইয়া, আমি ঘুণাক্ষরেও সায়েবের এই দুর্বুদ্ধির কথা অনুমান করতে পারলে তার সামনে গলায় দড়ি দিতুম।
আদালতে সায়েব একটি কথাও বলেনি।
শুধু শহরময় ছড়িয়ে পড়ল, সায়েব নাকি হাজতে যাবার সময় তার উকিলকে বলেছিল, সে তার স্ত্রীর ন্যায্য সম্মান রাখবার চেষ্টা করেছে মাত্র। একথা শুনে শহরের লোক কী বলেছিল জানিনে, কিন্তু ওই আমি আমার শেষ সম্মান পেলুম।
সেই সম্মানের উঁচু আসন থেকে আরম্ভ হল আমার পতন।
আমি তখন যাই কোথায়? দেশের-দশের চোখে আমি সায়েবের রক্ষিতা। রক্ষিতাকে রক্ষা করনেওলা যখন আর কেউ নেই তখন সে যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নয়, মরার জায়গা একটা আছে। বেশ্যাপাড়া। কিংবা মরতে পারি ফাঁস দিয়ে। কিন্তু
টুনি মেম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু তখন সায়েবের বাচ্চা আমার পেটে। তার প্রাণ নিই কী করে?
খান বলল, এর পর টুনি মেম কী করে ধাপের পর ধাপ নামতে নামতে সেই জাহান্নামের রদ্দি কুঁড়েঘরে এসে পৌঁছল তার বর্ণনা দেয়নি। তুই সেটা যে রকম খুশি কল্পনা করে নিতে পারিস।
আমি বললুম, আমি স্যাডিস্ট নই। আমি বীভৎস রসে আনন্দ পাইনে। তার পর কী হল তুই বলে যা।
খান বলল, টুনি সে রাত্রে আর কিছু বলেনি। তার ক্লান্তি দেখে আমিও আর খোঁচাখুঁচি করিনি।
ওদিকে আমার বসের সঙ্গে কথা ছিল, টুনিকে আবিষ্কার করতে পারলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেলিগ্রাম করে জানাই। অতি অনিচ্ছায় পরের দিন তাঁকে কোড টেলিগ্রাম করে জানালুম। গেলুম স্টেশনে তাকে রিসিভ করতে।
সন্ধ্যাবেলা তিনি নামলেন পুলিশের ইউনিফর্ম পরে। আমি অবাক হয়ে বললুম, স্যার, করেছেন কী? টুনি বড় শক্ত মেয়ে। পুলিশকে সে একটি কথাও বলবে না। এমনকি আপনি চাকর-নফরের বেশ পরলেও ধরে ফেলতে পারে।
খেলুম উৎকট ধমক। বললেন, রেখে দাও ওসব জ্যাঠামো। এই ঘোষাল-বান্দা ঘড়েল ঘড়েল খুনিদের পেটের নাড়ির কিমি বের করেছে একশো সাতান্ন বার, আর আজ তুমি এলে শোনাতে, কী করে একফোঁটা ঘুড়ির ঠোঁটের কথা বের করতে হয়। চল, তোমাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি তাকে বহুৎ বোঝাবার চেষ্টা করলুম। খেলুম গণ্ডা তিনেক ধাতানি। কীই-বা করি আমি? তিনি উঁদে অফিসার। পাঠান আসামিকে তিনি খুন কবুল করাতে পেরেছেন বলে তার খুশ-নাম ছিল– পাঠানকে বেঈমান বলে অপমান করলে রেগেমেগে সব-কিছু ফাঁস করে দেয়, এই অজানিত প্যাঁচটি জানতেন বলে। আমি চুপ করে গেলুম।
গট গট করে মিলিটারি বুটে পাড়া সচকিত করে তিনি ঢুকলেন টুনি মেমের কুঁড়েঘরে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তার পর, মশাই, আরম্ভ হল পুঁদে পুলিশের যত রকম কায়দা-কেতা ফন্দি-ফিকির সন্ধি-সুড়ুক তার নির্মম প্রয়োগ। দুনিয়ার ভয়-প্রলোভন, মৃদু ইঙ্গিত, কটু সম্ভাষণ সব-কুচ চালালেন ঘড়েল পুলিশ-কর্তা।
কিন্তু সেই যে পুলিশ দেখে টুনি মেম মুখ বন্ধ করেছিল, সে মুখ আর সে খুলল না। ঝাড়া ছ-টি ঘণ্টা পুলিশ সাহেব তার শেষ চেষ্টা দিয়ে ঘেমে নেয়ে বেরুলেন সেই কুঁড়েঘর থেকে ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে। টুনি মেম একটা হা-না পর্যন্ত বলেনি।
আমার লজ্জাটুকু পর্যন্ত পুলিশ-কর্তা রাখলেন না। আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলুম তিনি যেন প্রকাশ না করেন যে, আমার কাছ থেকে সবকিছু জানতে পেরে তিনি তার সন্ধান পেয়েছেন। আমি যে খানসামার ভাই সেই খানসামার ভাই-ই থেকে যাই। কিন্তু টুনি মেমের নীরবতার পাঁচিলে মাথা ঠুকে ঠুকে পুলিশ-কর্তা ঘায়েল হয়ে গিয়ে সে কথাটাও প্রকাশ করে দিলেন। এমনকি তিনি আমাকে ভিতরে ডেকে পাঠালেন। যেতে হল– বস যে।
টুনি একবার আমার দিকে এক লহমার তরে তাকিয়েছিল।
কী বলব, মিতুয়া, সে দৃষ্টিতে ঘৃণা তাচ্ছিল্য কী ছিল, কিছুই বলতে পারব না। শুধু মনে হয়েছিল রহস্যময় সে দৃষ্টি।
খান বলল, তার পরদিন প্রসবের সময় টুনি মেম এই দুঃখের সংসার ত্যাগ করল।
এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। আমি অবাক হয়ে বললুম, সে কী!
হুঁ।
আমি শুধালুম, তা হলে ওই যে লোকটা খুন হয়েছিল তার কোনও হিল্যে হল না?
খান অনেকক্ষণ কোনও উত্তরই দিল না। শেষটায় বলল, সে যাক গে। এর পরও আমি বহু রহস্যের সমাধান করতে পারিনি– সে নিয়ে আমার শোক নেই। আমি শুধু এখনও টুনি মেমের শেষ চাউনির কথা ভাবি। সে চাউনিতে কী ছিল?
দুর্দশার চরমে বাচ্চাদুটো যখন ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে তখন আমি এসে তাদের চোখের জল মুছে দিলুম, টুনি তখন নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তাকে তার সর্ব দেহমন নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিল– তিনি যে তার ডুবুডুবু ভাঙা নৌকোখানিকে পাড়ে এনে ভিড়ালেন। আমাকে সে দেখেছিল তারই দূতরূপে, তাঁরই ফিরিশতারূপে। তার পর হঠাৎ দেখে, আমি দেবদূত নই, আমি শয়তান। তার দুর্দিনে যেসব চাকর-বাকর তাকে লাঞ্ছিত-অপমানিত করেছিল আমি তাদের চেয়েও অধম। আমার মতলব ছিল তার বাচ্চাদুটোকে খাইয়ে-দাইয়ে তাকে খুশি করে, তার জীবনের চরমধন তার স্বামীকে ঝোলাবার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করা।
.
এর পর আর কোনও কথা হয়নি। গাড়ি বোলপুরে এসে থামল।
চেল্লাচেল্লিতে ম্যানেজার গোসাঁই স্বয়ং এসে খানকে ডবল খানা দিল। গাড়ি যখন চলতে আরম্ভ করেছে তখন আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল টুনি মেমের বাচ্চাদুটোর কথা। চেঁচিয়ে খানকে শুধালুম, ওদের কী হল? খান শুনতে পেল না। হাসিমুখে শুধু হাত নাড়ল।
ঢেউ ওঠে পড়ে কাঁদার সম্মুখে ঘন আঁধার
খাচ্ছে, দাচ্ছে, বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কখনও হতাশ হয়, কখনও-বা খুশি, বউ বাপের বাড়ি গেল তো মুখে ব্যাজার ভাব, এমন সময়ে চ্যারিটি ম্যাচের একখানা টিকিট ফোকটে পাওয়াতে সে বেদনা না-পাত্তা ঘুচে গেল– এই নিয়ে আমরা পাঁচজন আছি। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এই আমরাই পৃথিবীতে ম্যাজরিটি। আমাদের বেদনা সামান্য, সেটা ঘুচতেও বেশিক্ষণ লাগে না।
অথচ মুনিঋষি পীর-প্যাকম্বর বলেন, তোমরা অমৃতের সন্তান, অমৃতের সন্ধান কর। একফোঁটা একটি মেয়েও নাকি বিস্তর ধনদৌলত পাবার পর বলেছিল, যা দিয়ে আমি অমৃত হব না, তাতে আমার কী প্রয়োজন!
চাকরি বজায় রাখার জন্য আমাকে সমস্ত জীবন ধরে দুনিয়ার তাবৎ ধর্মের, (বেশি না, আল্লার দয়ায় মাত্র সাতটি) বিস্তর বই পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, এই আমরা সাধারণ পাঁচজন তো অমৃত না পেয়েও দিব্যি বেঁচে আছি, ওর পিছনে ছুটোছুটি করার আমাদের কী প্রয়োজন। আর বাঙলা কথা বলতে কি, আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত মত, তখন ওই অমৃতটা আমাদের ঘাড়ে চাপানোই অন্যায়। অন্তত একটি মহাপুরুষ– আমাদের মতে– এ খাতায় একটি মুক্তো জমা রেখে গেছেন; তিনি বলেছেন, শুয়োরের সামনে মুক্তো ছড়িয়ো না। তাই সই। গালাগালটা বরদাস্ত করে নিলুম। আর, মহাপুরুষ একথাটা বলার সময় ক্ষণেকের তরে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ছিলেন তো? তাতেই হয়ে যাবে। মোক্ষ নামক অমৃত বলে কোনও পদার্থ যদি থাকে তবে ওই একটি চাউনিতেই সকলং হস্ততলং। অবশ্য সে অমৃতের জন্য কোনও অসম্ভব ভবিষ্যতে যদি আমার প্রাণ আদৌ কাঁদে!
রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ এরা দেখতে মানুষের মতো বটে, কিন্তু আসলে এঁরা মানুষ নন। নইলে বলুন দেখি, তুমি কবি, দু পয়সা তোমার আছে, পদ্মায় বোটে ভাসতে তুমি ভালোবাসো, কী দরকার তোমার স্কুল করার আর তার খাই মেটাবার জন্যে বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দিল্লি, বোম্বাই চষার? কিংবা বিবেকানন্দ। অসাধারণ জিনিয়াস। পঁচিশ হতে না হতেই প্রাচীন অর্বাচীন দিশি-বিদেশি সর্বশাস্ত্র নখদর্পণে! কী দরকার ছিল সেই সুদূর আমেরিকায় গিয়ে শেকস্পিয়ারের ভাষায়– টু টেক্ আর্মস্ এগেন্স এ সি অব ট্রাবলস?(১) কী দরকার ছিল অরবিন্দের নির্জনে ধ্যানে ধ্যানান্তরে উধ্ব হতে ঊর্ধ্বতর লোকে ব্রহ্মের কাছ থেকে অমৃতবারি আহরণ করে নিম্নে, তারও নিম্নে এসে এই ভস্মীভূত ভারতসন্তানকে পুনর্জীবিত করার?
এঁদের কথা বাদ দিলুম। এরা আমাদের মতন নন।
কিন্তু– এখানেই একটা বিরাট কিন্তু।
এই যে আমরা রামাশ্যামা, আমাদের ভিতর বিবেক-রবি নেই, কিন্তু তাই বলে আমাদের সক্কলেরই কি ওঁদের চেয়ে স্পর্শকাতরতা কম? ওঁদের মতো কীর্তি আমরা রেখে যাই না, তাই বলে বেদনাবোধ কি আমাদের সক্কলেরই ওঁদের চেয়ে কম? বরঞ্চ বলব, বিধি-প্রসাদাৎ, কিংবা আপন সাধনবলে তারা চিত্তজয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে বেদনাবোধ তাদের ভেঙে ফেলতে পারেনি। কিন্তু আমাদের কেউ কেউ যে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। যেন জীবন্ত অবস্থায়ই হঠাৎ তাদের জীবন-প্রদীপ নিভে যায় আর চোখের সামনে সে যেন শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। যেন বিরাট নবাববাড়ি আধঘণ্টার ভিতর চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল। আমরা যে কটি অকর্মণ্য গাছ তার চতুর্দিকে ছিলুম– যাবার সময় আমাদের ঝলসে দিয়ে গেল।
হয়তো ঠিক অতখানি না। আমার এক অতি দূরসম্পর্কের ভাগ্নে ছিল। ডিগডিগে লম্বা পাতলা, কাঁচা সোনার বর্ণ, ভারি লাজুক। বিধবা মায়ের এক ছেলে। তাঁর মানা না শুনে পড়াশুনো করতে এসেছে শহরে। সে গাঁয়ের আর কোনও ছেলে কখনও বাইরে যায়নি। এর বোধহয় উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ছিল। ছেলেটি কিন্তু তোতলা। হয়তো সেই কারণেই বেশি লাজুক।
এক মাসও যায়নি। ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুল দেখতে। তাকে শুধিয়েছেন একটা প্রশ্ন। উত্তরটা সে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু একে তো তোতলা, তার ওপর উত্তর জানে বলেই হয়ে গেছে বেজায় নার্ভাস্। তোৎ তোৎ করে আরম্ভ করতে না করতেই ইন্সপেক্টর তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ফেলে চলে গেলেন এগিয়ে।
ব্যাপারটা হয়েছিল বেলা তিনটেয়।
রাত সাতটায় পাওয়া গেল তার লাশ! গাছ থেকে ঝুলছে।
ভাবুন তো, স্কুল থেকে ফিরে যাবার পথে, তার মায়ের স্নেহের আঁচল থেকে দূরে, সেই আপন নির্জন কক্ষে ঘণ্টা তিনেক তার মনের ভিতর কী ঝড় বয়ে গিয়েছিল? অপমানের কালনাগিনীর বিষ যখন তার মস্তিষ্কের স্নায়ুর পর স্নায়ু জর্জর করে করে শেষ স্নায়ু কালো বিষেই রূপান্তরিত করেছে তখনই তো সে দড়িগাছা হাতে তুলে নেয়। সে তখন সহ্য-অসহ্যের সীমার বাইরে চলে গিয়েছে। আচ্ছা, সে কি তখন তার বিধবা মায়ের কথা একবারও ভাবেনি? কিন্তু দয়াময়, আমাকে মাফ কর, আমি বিচারকের আসনে বসবার কে?
অতি গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের মৌলিক কায়েত, আমার প্রতিবেশী হাতে যেন স্বর্গ পেল যখন তার সাদামাটা মেয়েকে বিয়ে করল এক মহাবংশের ঘোষ– বিনা পণে। ছেলেটি গরিব এই যা দোষ কিন্তু ভারি বিনয়ী আর বড়ই কর্মঠ। প্রেসের কাজ জানে। আমরা হিন্দু-মুসলমান। সবাই শতহস্ত তুলে তাকে আশীর্বাদ করেছিলুম।
বিয়ের কিছুদিন পরে কী জানি কী করে ধরে নিয়ে এল এক পার্টনার। খুলল ছোট্ট একখানা প্রেস। হ্যান্ডবিল বিয়ে-শ্রাদ্ধের চিঠি ছাপায়, কখনও-বা মুন্সেফি আদালতের ফর্ম ছাপাবারও অর্ডার পায়। জল নেই, ঝড় নেই, দুই দুপুরই বরাবর, সর্বত্রই তাকে দেখা যায় প্রফের বোন্দা বগলে। হেসে বলে, এই হয়ে এল। অর্থাৎ শিগগিরই ব্যবসাটা পাকা ভিতে দড় হয়ে দাঁড়াবে। একটু যাকে দরদি ভাবত তাকে বলত, মাকে নিয়ে আসছি। গরিব মা গায়ে থাকে। হয়তো-বা গতর খাঁটিয়ে দু মুঠো অন্ন জোটায়।
দশ বছর পরে দেশে ফিরেছি। বাড়ি পৌঁছবার পূর্বেই রাস্তায় সেই ছোকরা– না, এখন, বুড়োই বলতে হবে, অকালে দেখি উল্টো দিক থেকে আসছে, পরনে মাত্র শতচ্ছিন্ন গামছা। বগলে ঘেঁড়া খবরের কাগজের বোন্দা। ছন্নের মতো চেহারা। আমার কাছ থেকে সিগারেট চাইল। আমি তো হতভম্ব। তার স্ত্রী আমার ছোট-বোনের ক্লাসফ্রেন্ড। আমি তার মুরুব্বি। সিগারেট দিলুম। সেটা ধরিয়ে আমার দেশলাইটা ফেলে দিল নর্দমায়। একগাল হেসে বলল, মাকে নিয়ে আসছি। মনটা বিকল হয়ে গেল। দশ বছর পর আমার শহর এই দিয়ে আমায় ঘরে তুলছে?
বোন বলল, প্রেস যখন রীতিমতো পয়সা কামাতে আরম্ভ করেছে তখন তার পার্টনার তাকে দিল ফাঁকি। একটা আদালত পর্যন্ত লড়েছিল। তার পর পয়সা কোথায়? পাগল হয়ে গেছে।
তবু এখনও তার মাকে শহরে এনে পাকা বাড়িতে তুলছে। মা কবে ভূত হয়ে গিয়েছে। গাঁয়ের আর পাঁচটা বিধবা যে-রকম দুঃখ-দুশ্চিন্তায় মরে।
আর মাধবী? আমার বোন শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে সে তাকে দেখতে আসে। আমি তখন মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বৈঠকখানায় আশ্রয় নিই।
আর যে আত্মহত্যা করল না, পাগলও হল না, তার অবস্থা যে আরও খারাপ।
সরকার আমাকে অনর্থক একটা টেলিফোন দিয়েছিল। তবে সেটা কাজে লাগত তেতলার একটি মেয়ের। আমরা যৌবনে যে সুযোগ পেলুম না তা যদি ওই মেয়েটি পেয়ে থাকে তবে, আহা, ভোগ করুক না সে আনন্দ– তার ইয়ংম্যান প্রায়ই তাকে ফোন করে।
তার পর হঠাৎ মাসাধিক কাল কোনও ফোন নেই। ভাবলুম, আমি যখন আপিসে তখন বোধহয় ফোন করে। তার পর একদিন বাথরুমের দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা আর আমার চাকরের ভীত কণ্ঠস্বর। তাড়াতাড়ি খুলে দেখি, তেতলার মেয়েটি মেঝেতে পড়ে ভিরমি গেছে– পাশে টেলিফোনের রিসিভার।
সন্ধ্যাবেলা আমার লোকটা বলল, ভিরমি কাটাতে বেশিক্ষণ লাগেনি, তবে কিছু খেলেই সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যাচ্ছে।
আমার ঘরে এসে টেলিফোন করত বলে আমি ইচ্ছে করেই কোনও কৌতূহল দেখাইনি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও খবরটা কানে এসে পৌঁছল। এসব ব্যাপার পাড়াতে জানাজানি হয়ে যায়। মেয়েটির পরিবারের ডাক্তারও আমার ভালো করে চেনা। ইংরেজিতে বললেন, He walked out on her to another girl!
কেমন যেন চোখের সামনে দেখতে পেলুম, ওই ভিরমি-যাওয়া মেয়েটার উপর পা দিয়ে যেন সেই ছেলেটা পার হয়ে আরেকটা মেয়ের হাত ধরে চলে গেল। Walk on তো তাই মানে হয় না?
আজ আর মনে নেই- কতদিন ধরে মেয়েটা কিছু খেলেই বমি করত।
দু বছর তাকে দেখিনি। তার পর একদিন সিঁড়িতে দেখা। আগেকার মতোই সেই সাজগোজ করেছে। মনে হল চীনে ফানুস দেখছি, কিন্তু প্রদীপটি নিভে গেছে।
ওই বেদনাই তো সবচেয়ে বড় বেদনা।
মা যখন বাচ্চাকে মারে তখন সে বার বার ওই মায়ের কোলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আশ্রয়ের জন্য যেখান থেকে আঘাত আসছে সেখানেই। আশ্চর্য, কিন্তু আশ্চর্য হবার কীই-বা আছে, কারণ মারুক আর যাই করুক, অজানার মাঝেও অবুঝ জানে সে তার মা-ই। কিন্তু যখন দয়িত walk out on her, তখন বেচারি আশ্রয় খুঁজবে কোথায়? সে দয়িত তো এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক, সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা। এতদিন ধরে তার সামান্যতম বেদনা যখনই কোনও জায়গা থেকে এসেছে–বাপ মা সমাজ যেখান থেকেই হোক– তখনই ছুটে গিয়ে বলেছে তার দয়িতকে। ওই বলা-টুকুতেই পেয়েছে গভীর সান্ত্বনা। আর আজ? আজ তার সেই শেষ নির্ভর গেল। বরঞ্চ পাষাণ-প্রাচীরের উপর বল ছুড়লেও সেটা ফিরে আসে। কথা বললেও প্রতিধ্বনি আসে। কিন্তু এখন শূন্যে, মহাশূন্যে সব বিলীন।… (অবশ্য মডার্নরা বলবেন, ওসব রোমান্টিক প্রেম আজ আর নেই। আজ এক মাস যেতে না যেতেই সবাই অন্য লাভার পেয়ে যায়। তাই হোক, আমি তাই কামনা করি। আমার সর্বান্তঃকরণের আশীর্বাদ তাদের ওপর।)।
ধর্মের সমুখে উপস্থিত হলুম এই তিনটি মাত্র দৃষ্টান্ত নিয়ে। কেউ বলেন, এসব মায়া। তুমিও নেই, আমিও নেই, এই পৃথিবীও নেই, তথাপি কেন শোকাতুর হও। কেউ বলেন, লীলা। ঈশ্বরে সর্বস্ব সমর্পণ কর। সান্ত্বনা পাবে। কেউ বলেন, মনই সর্ব দুঃখের উৎপত্তিস্থল। সেই চিত্তের বৃত্তি নিরোধ কর। তাতেই শান্তি। আরও অনেক মত আছে।
আমি নতমস্তকে সব কটাই মেনে নিচ্ছি। মা-ঠাকুরমারা এসবে বিশ্বাস করতেন, কিংবা আরও ভালো হয় যদি বলি, ধর্ম তখন সজীব ছিল, সে তখন সে-বিশ্বাস জাগাতে পারত তাই তারা শান্তি পেয়েছেন।
কিন্তু ধর্ম কেন আমার সেই ভাগ্নেকে চিত্তবল দিল না আত্মহত্যা না করার জন্য, প্রেসের পাগলকে রুখল না সেই দারুণ দুর্দৈব থেকে, প্রতিবেশীর মেয়েকে দিল না শক্তি সইবার ফের স্বাভাবিক সুস্থ সবল হওয়ার? শুধু তাদেরই দোষ? ধর্মের আত্মশক্তি কমে যায়নি কি? কিংবা দোষ উভয়ের?
কম্যুনিজম তাই বুঝি। সে বলে রাষ্ট্রই সব। তোমার ব্যক্তিগত শোক কিছুই না। তুমি বেশি গম ফলাও, বেশি কামান বানাও রাষ্ট্ররক্ষার জন্য। সব ভুলে যাবে। কম্যুনিস্টরা এ ধর্মে বিশ্বাস করেন কি না তা জানিনে কিন্তু এ কথা জানি, রাষ্ট্র এ বিশ্বাস তাদের হৃদয়-মনে দৃঢ় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। অন্য ধর্মেরা করে?
***
আমরা কয়েকজন মিলে চা খাচ্ছিলুম। নানারকম দুঃখ-সুখের কথা হচ্ছিল। আমাদের মধ্যে একজন অল্পবয়সী বড়ই স্পর্শকাতর ডাক্তার। হঠাৎ বলল, জানেন, আলী সাহেব, আমাদের হাসপাতালে একটি চার বছরের ছেলে বড় ভুগে খানিকটা সেরে বাড়ি গিয়েছিল, আজ আবার ফিরে এসেছে। ও সারবে না। আমি যখন ইনজেকশন তৈরি করছিলুম তখন আমার গা ঘেঁষে যেন করুণা জাগাবার জন্য বলল, দাত্তার, দিয়ো না, বন্দো লাগে।
হে ধর্মরাজগণ, এ শিশুকে কী দিয়ে কে বোঝাবে?
দুপুররাতে যখন তার ঘুম ভেঙে যায়, ইনজেকশনের ভয়ে শিউরে উঠে চেয়ে দেখে, এই বিশাল পুরীতে কেউ নেই, তার কেউ নেই- তখন?
হয়তো-বা বিজ্ঞান পারবে। বিজ্ঞান একদিন তাকে সারিয়ে দেবে। না পারলেও হয়তো তাকে কোনও প্রদোষ-ন্দ্রিায় (আমি এসব জিনিস জানি না, তবে twilight sleep না কী যেন একটা আছে এবং আশা, সেটা আরও উন্নতি করবে) ঘুম পাড়িয়ে দেবে। হাসপাতালে গিয়ে দেখব, সে ঘুমিয়ে আছে, পুতুলটি বুকে চেপে ঘুমিয়ে আছে, নন্দনকাননের অপ্সরীদের আদর পেয়ে তার মুখে মিঠে হাসি।
জয় বিজ্ঞানের!
কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে তো জীবনের কোনও comprehensive philosophy নেই, যা ভাগ্নেকে রাখবে, প্রতিবেশীর মেয়েকে নর্মাল করে তুলবে।
হে ধর্মরাজগণ, বিজ্ঞানের সঙ্গে একটা ব্যবস্থা করে, তাকে আশীর্বাদ দিয়ে এবং আপন আত্মশক্তি দৃঢ়তর করে আমাদের বাঁচাও।
আমি জানি, আমার জীবনে সে দিন আমি দেখে যেতে পারব না।
এই নির্জন প্রান্তরে এ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থেকে থেকে নিশির ডাকের মতো শুনতে পাব, দাত্তার, দিয়ো না, বন্দো লাগে, দেখতে পাব সেই প্রদীপহীন চীনা ফানুস ॥
———–
১. ইদানীং রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ নিয়ে তুলনাত্মক আলোচনা হচ্ছে। অন্য কেউ দেখিয়ে না দিয়ে থাকলে আমি একটি মিল দেখাই। দুজনেই প্রথমেই আমেরিকা গিয়েছিলেন ভারত-সেবার জন্য অর্থ আনতে। দুজনাই নিরাশ হয়েছিলেন।
তলস্তয়
কবিগুরু, তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই। রবীন্দ্রজীবনের সপ্ততি বছর পূর্ণ হলে শরৎচন্দ্র এ কথাটি বলেছিলেন। সমস্ত বাঙলা দেশ তখন জয়ধ্বনি করে এই বিস্ময়ে আপন বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
কবিগুরু তলস্তয়ের(১) মৃত্যু-সংবাদ যখন রুশ সাহিত্যের তখনকার দিনের শরৎচন্দ্র গর্কির কাছে পৌঁছল, তখন তিনি তাঁর শোকলিপি শেষ করার সময় লিখেছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে যে আমি ঈশ্বর বিশ্বাস করিনে– মনে মনে বলেছিলুম, এই লোকটি ঈশ্বরের মতো (গড লাইক)।
প্রতি ধর্মেই একটি প্রশ্ন বার বার উঠেছে। ভগবান যখন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনা করতে চান, তখন তা করেন কোন পদ্ধতিতে? ভারতীয় আর্যরা উত্তরে বলেছেন, স্বয়ং ভগবান তখন মানুষের মূর্তি ধরে অবতাররূপে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধ এবং মহাবীর হয়তো নিজেরা এই মতবাদকে স্বীকৃতি দিতেন না, কিন্তু বহু বৌদ্ধ এবং জৈন ওঁদের পূজা করেন অবতাররূপে এবং হিন্দুরাও বুদ্ধকে অবতারের আসনে বসাতে কুণ্ঠিত হননি।
সেমিতি জগতে বিশ্বাস, ভগবান তখন মানুষের মধ্যে একজনকে বেছে নিয়ে তাঁকে তাঁর প্রফেট, পয়গম্বর, রসুল, প্রেরিত পুরুষ নাম দিয়ে নবধর্ম প্রচার করতে আদেশ দেন। ইহুদি এবং মুসলমানদের বিশ্বাস, এঁরা কখনও কখনও অলৌকিক দৈবশক্তির আধার হন, কখনও হন না।
খ্রিস্টের আসন মাঝখানে। তিনি কখনও-বা ঈশ্বরের পুত্ররূপে, কখনও ঈশ্বররূপে, কখনও-বা সুদ্ধমাত্র প্রেরিত পুরুষ রূপে অর্ঘ্য পেয়ে থাকেন। ইসলাম তাকে অলৌকিক শক্তিধারী (মুআজিজা বা মিরাকল করার অধিকারী) পয়গম্বররূপে স্বীকার করে। খ্রিস্ট যে অবতাররূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তার পিছনে হয়তো প্রাচীন ভারতীয় আর্যধর্মের প্রভাব আছে।
এ তথ্য প্রমাণ করা সহজ নয়, কিন্তু হিটাইটদের আমল থেকেই পূর্ব ভূমধ্যসাগর তটাঞ্চলে আর্যপ্রভাব বিস্তৃত ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ভারতবর্ষে যে দুজন অবতার সর্বজননমস্য, তাঁরা শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ।
রামচন্দ্র রাবণকে শাসন করে দুস্কৃতির বিনাশ করেন ও পুণ্যাত্মা জনের মনে সাহস বাড়িয়ে দেন। এবং এই সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অস্ত্রধারণ করতে বিমুখ হননি। পরবর্তী যুগে বোধ করি প্রশ্ন উঠেছিল যে, সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রাণনাশ কি নিতান্তই অপরিহার্য? এ যুগে তাই দেখতে পাই মাইকেল যখন সীতাকে দিয়ে রামের বর্ণনা করাচ্ছেন তখন বলছেন, মৃগয়া করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীবননাশে সতত বিরত।
কৃষ্ণ অবতীর্ণ হবার পূর্বে হয়তো প্রশ্নটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্য বা আদর্শ (এন্ড) মহান হলেই কি যা খুশি সে পন্থা (মিন্স) অবলম্বন করা যায়? মহাভারতে তাই কি শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্রধারণ করছেন না, কিন্তু অবশ্য অর্জুনকে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন?
এর পর বুদ্ধদেব। তিনি সর্ব অবস্থাতেই জীবননাশ করতে মানা করেছেন। কিন্তু রামকে যে-রকম এক রাষ্ট্রের অধিপতিরূপে অন্য রাষ্ট্রের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কৃষ্ণকে যে-রকম অধর্মচারী রাষ্ট্ররাজ দুর্যোধনের মোকাবেলা করতে হয়েছিল, বুদ্ধদেবকে সেরকম কোনও রাষ্ট্রের বৈরভাবের বিরুদ্ধে সম্মুখীন হতে হয়নি। সমাজের ভিতর ব্যক্তিগত জীবনে প্রাণনাশ না করেও প্রাণধারণ করা অসম্ভব নয়, কিন্তু যদি বর্বর প্রতিবেশী রাষ্ট্র এসে লুণ্ঠন, নরহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত হয়, তবে কি আক্রান্ত নৃপতি ক্ষমা ও মৈত্রী নীতি অবলম্বন করে নিষ্ক্রিয় তুষ্ণীম্ভাব দ্বারা রাজধর্ম প্রতিপালন করবেন?
বুদ্ধদেবের পর খ্রিস্ট যখন সে যুগের অধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র গঠন প্রেম ও মৈত্রী দ্বারা পরিবর্তিত করতে চাইলেন, তখন দ্বন্দ্ব বাধল সে রাষ্ট্রের স্তদ্বয় ধনপতি ও ধর্মাধিকারীদের সঙ্গে। তিনি অস্ত্র ধারণ করতে অসম্মত হন। ক্রুশের উপর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। (পাঠক কিন্তু ভাববেন না, তাই বলে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে বাধা পড়ে গেল– বস্তুত খ্রিস্টান মাত্রেরই বিশ্বাস প্রভু যিশু কুশে জীবন দেওয়াতেই তার বাণী জনগণের সম্মুখে জাজ্বল্যমান হল, তাঁর জীবনদানের ফলেই আমরা জীবনলাভ করলুম, কিন্তু এ প্রস্তাবনা আমাদের বর্তমান আলোচনায় অবান্তর।)
এর পর ওই সেমিতি জগতেই হজরত মুহম্মদ। মক্কাতে যতদিন ছিলেন, ততদিন তিনি অস্ত্রধারণ করেননি। মক্কার রাষ্ট্রপতিরা যখন তাকে মেরে ফেলা সাব্যস্ত করলেন, তখন তিনি মদিনার নাগরিকদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে তাদের দলপতি হবেন তারা অস্ত্রধারণে পরাঙ্খুখ ছিল না।(২)
আপন ধর্মকে উচ্চতর আসনে বসানোর জন্য কোনও কোনও অমুসলমান ধর্মযাজক হজরত মুহম্মদকে রক্তলোলুপ উৎপীড়করূপে অঙ্কিত করেছেন (যেন অন্যের পিতার নিন্দাবাদ না করে আপন জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায় না) কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে লুণ্ঠনকারী বর্বর নামে মুসলমানরা তুর্ক অভিযানকারীরা (এস্থলে ফিরোজ, আকবরের কথা হচ্ছে না)। বার্নার্ড শ মুহম্মদ-চরিত মন দিয়ে পড়েছিলেন বলে তাঁর কাল্পনিক কথোপকথনে এ সম্বন্ধে একটি মন্তব্য করেছেন। মুহম্মদকে দিয়ে বলাচ্ছেন, I have suffered & sinned all my life through an infirmity of spirit which renders me incapable of slaying.(৩)
বস্তুত নানাদিক দিয়ে দেখতে গেলে হজরত মুহম্মদ শ্রীরাম এবং শ্রীকৃষ্ণের মাঝখানে আসন নেন (এঁরা গীতা ও কুরান দিয়ে গিয়েছেন) এবং মোদ্দা কথা এই দাঁড়ায় যে, রাষ্ট্র যখন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল, তখন তিনি যুদ্ধ করতে পরাজুখ না হয়ে শর সংহরণে প্রস্তুত রইলেন। মহাপুরুষ মুহম্মদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পূর্ণতম বিকাশ দেখতে পাই বিরুদ্ধাচরণকারীর সমুখে সন্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করার সময়।
এর পর তেরশো বছর ধরে কেউ আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তাবের উত্থাপন করেনি। পাণ্ডা পুরোহিতদের টীকা-টিপ্পনীর ভিতর খ্রিস্টের বাণী নানা বিকৃত রূপ ধারণ করল– পাদ্রি সায়েবরা প্রতি যুদ্ধে পরমোসাহে বন্দুক কামান মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা পূত-পবিত্র করে যুদ্ধে পাঠালেন।
এ যুগে তলস্তয়ই পুনরায় খ্রিস্টকে আবিষ্কার করলেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে সমাজে তথা সাহিত্যে(৪) সম্পূর্ণতম খ্যাতি অর্জন করার পর তিনি করলেন। উনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ইউরোপীয় সভ্যতা-বৈদগ্ধের মূলে কুঠারাঘাত। তার অর্থনীতি, সাহিত্য, সমাজ এবং বিশেষ করে ধর্ম– এগুলোর পিছনে যে কত বড় ভণ্ডামি লুকানো রয়েছে, সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি যে দার্চ, মেধা ও কঠোর সত্যনিষ্ঠা দেখালেন, তার সামান্যতম বর্ণনা দেওয়াও আমার পক্ষে অসম্ভব। ওয়র এন্ড পিস তিনি লিখেছিলেন হীরার কলমফ নিয়ে সোনার কালি দিয়ে– আর তাঁর জীবনের এই চরম উপলব্ধি তিনি লিখলেন দধীচির অস্ত্র-নির্মিত দমশ কি তলওয়ার দিয়ে আপন বুকের রক্ত মাখিয়ে।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অস্ত্রধারণ মহাপাপ তার এ বাণী দুখবর সম্প্রদায় মেনে নিয়েছিল এবং বহু দুখবরণ করার পর তলস্তয়েরই সাহায্যে নির্বাসন স্বীকার করে মাতৃভূমি ত্যাগ করে। শেষ পরীক্ষা সেখানে হয়নি।
রুশ রাষ্ট্র তলস্তয়কে কখনও সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান করেনি বলে বলা অসম্ভব, তাঁকে শেষ পর্যন্ত ক্রুশবরণ করতে হত কি না। তবে একথাও ঠিক, আপন আদর্শের চরম মূল্য দেবার জন্য তিনি আত্মজন পরিত্যাগ করে পথপ্রান্তের অবহেলায় প্রাণত্যাগ করেন।
তলস্তয়-কাহিনী এখানেই হয়তো শেষ, কিন্তু সেই চিরন্তন কাহিনী আরও এগিয়ে গিয়েছে এবং কখনও শেষ হবে কি না জানিনে।
গাঁধীকে বহু অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তলস্তয়। তিনি এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম, যিনি বিদেশি পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সংগ্রাম করে জয়লাভ করেন।
এবার এটম বোমা তৈরি হচ্ছে।
———–
১. লেয়ো নিকোলায়েভিচ তলস্তয়। জন্ম–ইয়ানায়া পলিয়ানা (তুলা) ৯.৯.১৮২৮; মৃত্যু আস্তাপভো (তামবভ) ২০.১১.১৯১০।
২. বার্নার্ড শ খ্রিস্ট-মুহম্মদের এক কাল্পনিক কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর অতুলনীয় ভঙ্গিতে।
৩. Who is to be the judge of our fitness to live? said Christ. The highest authorities, the imperial governors, and the high priests find that I am unfit to live; Perhaps they are right. Precisely the same conclusion was reached concerning myself, said Muhammad. I had to run away and hide until I had convinced a sufficient number of athletic young men, that their elders were mistaken about me : that, in fact, the boot was on the other leg. Bernard Shaw, The Black Girl in Search of God, P. 57.
৪. যারা নোবেল প্রাইজের নাম শুনলেই চৈতন্য হারান তাদের বলে দেওয়া ভালো যে, ওই প্রাইজ যদিও ১৯০১ খ্রি. থেকে দেওয়া আরম্ভ হয়, ও তলস্তয় ১৯১০-এ গত হন, তিনি এটি পাননি।
দশের মুখ খুদার তবল
ইংরেজ খায় জব্বর একখানা ব্রেকফাস্ট! শুধু তাই নয়, অনেক ইংরেজ ঘুম থেকে উঠে বেড-টির সঙ্গে খায় একটি কলা কিংবা আপেল এবং একখানা বিস্কুট।
তার পর ব্রেকফাস্ট। দীর্ঘ সে ভোজন; আমি সংক্ষেপে সারি। যদি সে ইংরেজ ঈষৎ মার্কিন-ঘেঁষা হয়, তবে সে আরম্ভ করবে গ্রেপ ফুট দিয়ে। তার পর খাবে পরিজ কিংবা কর্নফ্লেক, মেশাবে এক জগ দুধের সঙ্গে, কেউ কেউ আবার তার সঙ্গে দেবে চাকতি-চাকতি কলা এবং চিনি। ইতোমধ্যে আরম্ভ হয়ে যাবে তবলা বাদ্য, অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে টোস্ট-মাখন খাওয়া। শেষ সময় পর্যন্ত এই তবলা বাদ্য বন্ধ হবে না। তার পর ভোজনরসিক খাবেন কিপারস (মাছ) ভাজা– অনেকটা লোনা ইলিশের ফালির মতো— তার পর খাবেন এ্যাব্বড়া এ্যাব্বড়া দুটো আণ্ডা ফ্রাই (আকারে এ-দেশি চারটে ডিমের সাইজ) তৎসহযোগে বেকন আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, টোস্ট-মাখনের তবলা কখনও বন্ধ হবে না এবং এর পর টেনে আনবে মার্মলেডের বোতল। খাবে নিদেন আরও খানচারেক টোস্ট ওই মার্মলেডসহ। এবং চা কিংবা কফি তো আছেই। বাস!
ফরাসি-জর্মন ব্রেকফাস্টে খায় যৎসামান্য রুটি মাখন আর কফি। খানদানি ফরাসি মাখনও খায় না বলে, ফরাসি রুটির যে আপন উত্তম সোয়াদ আছে সেটা মাখনের স্পর্শে বরবাদ হয়ে যায়।
লাঞ্চের বেলা ইংরেজ খায় যৎকিঞ্চিৎ। ফরাসি-জর্মন করে গুরুভোজন।
রাত্রিবেলা ইংরেজ করে শুরুভোজন। জর্মন খায় অত্যল্প। রুটির সঙ্গে সসিজ, কিংবা চিজ এবং ফিকে পানসে চা। যাসব খাবে সাকুল্যে মালই ঠাণ্ডা, শুধু চা-টাই গরম।
এবারে গিয়ে দেখি হইহই রইরই কাণ্ড ডিনারের বেলায়ও। অবশ্য সবকিছুই ঠাণ্ডা খাওয়ার ঐতিহ্য সে এখনও ছাড়েনি।
এবারে দেখি পাঁচ রকমের সসিজ, তিন রকমের চিজ এবং টুবের খাদ্যের ছড়াছড়ি। আমরা যেরকম টুব থেকে টুথপেস্ট বের করি, এরা তেমনি বের করতে থাকে কোনও টুব থেকে মাস্টার্ড, কোনওটা থেকে টমাটো সস, কোনওটা থেকে মাছের পেস্ট। শুনেছি, দেখিনি, মাংসের পেস্টভর্তি টুবও হয়। কোনও জিনিসের অভাব নেই। দামের পরোয়া করো না, যত পার খাও।
রাস্তায়ও দেখি, আগে যে রাস্তায় ছিল একখানা খাদ্যদ্রব্যের দোকান (লেবেনস মিটেল গেশেফট-কলোনিয়াল ভারেন) এখন সেখানে চারখানা। কারও বাড়িতে যাওয়া মাত্রই সে কোনও কথা না বলেই বের করে উত্তম রাইন মজেল (হক রেনিশ) তাজা বিয়ার ইস্তেক স্কচ হুইস্কি, মার্কিন সিগারেট।
বড় আনন্দ হল এসব দেখে খাক না বেচারীরা প্রাণভরে। এই সে সেভন ডেজ ওয়ান্ডার তিন দিনের ভেল্কিবাজি– এ যে কখন বিনা নোটিসে বন্ধ হয়ে যাবে কে জানে। অতএব খাও-দাও ফুর্তি কর। হেসে নাও, দু দিন বই তো নয়।
এ তত্ত্বটি জর্মনরাও বিলক্ষণ জানে।
হামবুর্গে আমি যে পাড়ায় থাকতুম সেটা শহরতলীতে। অন্যত্র যেমন এখানেও পাড়ার পাবটি ওই অঞ্চলের সামাজিক কেন্দ্রভূমি। দেশের লোকে কী ভাবে, কী বলে, পাবে না গিয়ে জানার উপায় নেই। গুণীজ্ঞানীরা কী ভাবেন, সেটা জানা যায় অনায়াসে–বই, খবরের কাগজ পড়ে। কিন্তু পাবের গাহকরা গুণী-জ্ঞানী নয়; তারা বই লেখে না, লেকচার ঝাড়ে না। অথচ এরাই দেশের মেরুদণ্ড।
এখানে কায়দামাফিক একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় না। পাশের লোকটির সঙ্গে গালগল্প জুড়ে দিলুম।
বললুম, যুদ্ধের পর ঠিক এই যে প্রথম এলুম তা নয়। বছর দুই পূর্বে এসেছিলুম মাত্র দু দিনের তরে। কোনও একটা পাবে যাবার ফুরসত পর্যন্ত হয়নি। এবারে তার শোধ নেব।
শুধাল, কীরকম লাগছে পরিবর্তনটা?
আমি বললুম, অবিশ্বাস্য! এত ধন-দৌলত যে কোনও জাতের হতে পারে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
লোকটি হেসে বলল, তা তোমরাও তো এককালে খুব ধনী ছিলে। সেদিন আমি খবরের কাগজে একটা ব্যঙ্গ-চিত্র দেখেছিলুম। তোমাদের তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে এক মার্কিন ট্যুরিস্ট তার স্ত্রীকে বলছে, ফ্যাসি! এসব জিনিস তারা এমেরিকান এড় ছাড়াই তৈরি করেছিল।
আমি বললুম, রাজরাজড়া ধনী ছিলেন নিশ্চয়ই আজ যে-রকম সউদি আরব, কুয়েত, বাহরেনে শেখরা জলের মতো টাকা ওড়ায়– কিন্তু আর পাঁচজনের সচ্ছলতা কীরকম ছিল অতখানি আমি জানিনে।
আমাদের কথায় বাধা পড়ল। দেখি এক বৃদ্ধ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে বিয়ারের গেলাস, পরনে মোটামুটি ভালো স্যুটই, তবে ফিটফাট বলা চলে না। ফিসফিস করে যেভাবে কথা আরম্ভ করল তাতে মনে হল, এখনও বুঝি নাৎসি যুগের গেস্তাপো গোয়েন্দার বিভীষিকা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। নাহ্, আমারই ভুল। হামবুর্গে যখন বেধড়ক বোমা ফেলে তখন কী জানি কী করে তার গলার সুর বদলে যায়। এ তত্ত্বটা জানা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার ফিসফিসানিতে বলা কথাগুলো কেমন যেন উচাটন মন্ত্রে উচ্চারিত নিদারুণ ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হচ্ছিল।
ডান হাত তুলে ধরে গেলাস দিয়ে জানালার দিকে নির্দেশ করে শুধাল, কী দেখছ?
আমি বললুম, এন্তের মোটরগাড়ি।
আবার সেই ফিসফিস। বলল, এদের কজন সত্যি সত্যি মোটর পুষতে পারে জানো? শতেকে গোটেক। তোমার দেশের কথা বলছিলে না, রাজরাজড়ারা ধনী ছিল, বাদবাকিদের কথা বলতে পারছ না। এখানেও তাই। এই যে মোটর দাবড়ে বেড়াচ্ছেন বাবুরা, এঁদের ক-জন মোটরের পুরো দাম শোধ করেছেন কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু আমি জানি, সব ইস্টমেন্টের ব্যাপার। জি লেবেন য়ুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে– দে আর লিভিং বিঅন্ড দেয়ার মিনস্– আনে সিকি, ওড়ায় টাকা।
আমি বললুম, সেকথা বললে চলবে কেন? কট্টর অবজেকটিভ বিচারেও বলা যায়, তোমাদের ধনদৌলত বিস্তর বেড়েছে।
বুড়ো অসহিষ্ণু হয়ে বলল, কে বলেছে ধনদৌলত বাড়েনি। বেড়েছে নিশ্চয়ই। আলবৎ বেড়েছে। কিন্তু প্রথম কথা, যা বেড়েছে তার তুলনায় খরচ করছে অনেক বেশি। এবং দ্বিতীয় কথা, এ ধনদৌলতের পাকা ভিত নেই। ১৯১২-১৯১৪-এ আমাদের যে ধনদৌলত ছিল তার ছিল পাকা বুনিয়াদ।
আমি বললুম, তাতেই-বা কী ফায়দা হল? ইনফ্লেশন এসে সে পাকা বুনিয়াদও তো ঝুরঝুরে করে দিয়ে চলে গেল।
বুড়ো শুধু মাথা নাড়ে আর বার বার বলে, জি লেবেন যুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে, জি লেবেন য়ুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে– কামায় সিকি, ওড়ায় টাকা।
বুড়ো আমাদের ছেড়ে বারের দিকে এগোলো খালি গেলাস পূর্ণ করার জন্য।
আমি যার সঙ্গে প্রথম কথা আরম্ভ করেছিলুম, সে এতক্ষণ হা-না কিছুই বলেনি। এবারে নিজের গেলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়োর কথা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তবে তুমি যে এই ইনফ্লেশনের কথা তুললে না, সেইটেই হচ্ছে আসল ভয়। ইনফ্লেশনের বন্যা এসে একদিন সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়, তারই ভয়ে সবাই টাকা খরচ করছে দু হাতে। এমনকি যে কড়ি এখনও কামানো হয়নি সেটাও ওড়াচ্ছে।
আমি বললুম, যে কড়ি এখনও কামানো হয়নি, সেটা ওড়াবে কী করে? তার পর বললুম, ওহ! বুঝেছি! ধার করে?
বলল, ঠিক ধার করে নয়। কারণ ধার করলে সে পয়সা একদিন না একদিন ফেরত দিতে হয় না দিলে পাওনাদার বাড়ি ক্রোক করে। কিন্তু ইনস্টমেন্টের কেনা জিনিসে সে ভয়ও নেই। বড়জোর যে জিনিসটা কিনেছে সেটা ফেরত নিয়ে যাবে।
ইতোমধ্যেই সেই ফিসফিস-গলা বুড়ো ফিরে এসেছে। বলল, টাকা ধার পর্যন্ত নেওয়া যায়। আমি রোক্কা টাকার কথা বলছি, ইনস্টমেন্টের কথা হচ্ছে না। টাকা শোধ না দিলে যদি ক্রোক করতে আসে, তবে লাটে তুলবে কী? বাড়ির তাবৎ জিনিসই তো ইন্সটলমেন্টে কেনা। সেগুলো তো ক্রোক করা যায় না।
আমি বুড়োকে বললুম, আপনি সব-কিছু বড্ড বেশি কালো চশমার ভিতর দিয়ে দেখছেন।
বুড়ো বলল, আমি কি একা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী আডেনাওয়ারও তো ওই পরশু দিন দেশের লোককে সাবধান করে দিয়েছেন, এ সুদিন বেশিদিন থাকবে না। হুশিয়ার, সাবধান! পড়োনি কাগজে?
আমি বললুম, অতশত বুঝিনে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সবাই খাসা ফুর্তিতে আছে। ওইটেই হল বড় কথা। তার পর যার সঙ্গে প্রথম কথা বলতে আরম্ভ করেছিলুম, তাকে শুধালুম, তোমাদের শহরের মধ্যিখানে যে হাজারখানেক সেকেন্ডহ্যান্ড কার ফর সেল দেখলুম, সেগুলো কি ইনস্টলমেন্টে কেনা ছিল, আর কিস্তি খেলাপ করেছে বলে বাজেয়াপ্ত হয়ে ওইখানে গিয়ে পৌঁছেছে?
বলল, নিশ্চয়ই তার একটা বড় অংশ। বুড়ো আবার মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, তোমাকে বলিনি, জি লেবেন যুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে! কামায় সিকি, ওড়ায় টাকা!
***
সুবুদ্ধিমান পাঠককে সাবধান করে দিচ্ছি, আমি অর্থনীতি জানিনে, এসব মতামতের কতখানি ধাপে টেকে, বলতে পারব না। আমি যা শুনেছি, সেইটেই রিপোর্ট করলুম। এবং আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এসব পাবে শুমৃপেটার, কেইনস, শাট আসেন না। আসে যেদো-মেদো। কিন্তু ভুললে চলবে না, কথায় বলে, দশের মুখ খুদার তবল।
দুলালী
ওলেঙ্কা অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসেসর প্লেইয়ান্নিকভের মেয়ে। সে ভাবনায় ডুবে বসেছিল উঠোনের সামনে ছোট্ট বারান্দাটিতে।
গরম, মাছিগুলো আঠার মতো লেগে আছে, বিরক্ত করছে। একটু বাদেই যে সন্ধে হবে সেকথা ভাবতে ভালোই লাগছে। পুব দিক থেকে ঘন কালো মেঘ এসে জমা হচ্ছে, সেইসঙ্গে থেকে থেকে ভিজে হাওয়ার আমেজ আসছে।
উঠোনের মধ্যিখানে আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কুকি। লোকটি থিয়েটারের ম্যানেজার, প্রতিদিন সন্ধেবেলায় এক বাগানে একটি আনন্দমেলার আসর জমায় নাম তিভলি প্রমোদ উদ্যান। থাকে ওলেঙ্কাদের বাড়ির একপাশে ভাড়া নিয়ে।
ককিন হতাশ হয়ে বলল, আবার! আবার এল বষ্টি। রোজ বৃষ্টি, রোজ, যেন আমাকে নাকাল করার জন্যেই নামে। গলায় দড়ি দিই না কেন? সর্বস্ব গেল। দিন দিন লোকসান আর লোকসান।
দু হাত জুড়ে ওলেঙ্কার দিকে ফিরে কুকি আবার বলতে লাগল, এই তো জীবন আমাদের, ওগা সেইয়ন। দু চোখ ফেটে জল আসে। খেটে মরি, যতদূর সাধ্য চেষ্টা করি, সারারাত জেগে ভাবি কী করে জিনিসটাকে উঁচুদরের করে তোলা যায়। হয় কী? এদিকে দেখ, লোকগুলোকে আহাম্মুখ, বর্বর।
আমি ওদের দেখাই সেরার সেরা ছোট ছোট অপেরা, কথা-ছাড়া শুধু ভঙ্গি দিয়ে বোঝানো নাটক, অপূর্ব অপূর্ব ভ্যারাইটি আর্টিস্ট। কিন্তু ওরা কি ও জিনিস চায়? বোঝে তার মর্ম? ওরা শুধু চায় হৈ-হুল্লোড়! ওদের দেখাতে হয় রদ্দি চিজ।
আবার ইদিকে দেখ আবহাওয়াখানা। প্রায় প্রতি সন্ধেয় বৃষ্টি। ১০ মে থেকে শুরু হল, চলছে রোজ, গোটা মে-জুন মাসটাই। দর্শকের দেখা নেই, অথচ বাগান-ভাড়াটা? সেটি ঠিক ধরে দিতে হয়। আর গাইয়ে-বাজিয়েদের মাইনেটা?
পরদিন সন্ধের দিকে আবার দেখা দিল মেঘ। হি হি করে হেসে উঠল কুকি। বলল, এসো, এসো বৃষ্টি। দাও ভাসিয়ে আমার প্রমোদ উদ্যান। সব ডোবাও, তার পর আমাকেও ডোবাও। আমার ইহলোক-পরলোক দুই-ই মজুক। মামলা করুক আমার আর্টিস্টরা আমার নামে, পাঠাক জেলে– সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে ফাঁসিকাঠে! হাহা হাহাঃ।
তার পরদিন আবার ওই।
ওলেঙ্কা চিন্তিত মুখে, নীরবে কুকিনের কথাগুলো শুনত। মাঝে মাঝে তার চোখে জল এসে পড়ত। এত উতলা হয়ে উঠত তার মন কুকিনের দুর্ভাগ্যে যে শেষ অবধি সে ওর প্রেমেই পড়ে গেল।
কুকিন মানুষটি বেঁটে, রোগা। মুখখানা ফ্যাকাসে। চুল আঁচড়ে রগের উপর টেনে নামানো। সরু গলায় কথা কয়, মুখ একপাশে বেঁকিয়ে। চেহারায় চিরকেলে নৈরাশ্যের ছাপ। তবু সে ওলেঙ্কার মনে গভীর এবং অকৃত্রিম একটি ভাব জাগিয়ে তুলল।
ওলেঙ্কা সর্বদাই কারও না কারও প্রেমে অভিভূত হয়ে থাকত। প্রথমে ছিল বাবা। এখন তিনি রুগণ; অন্ধকার একখানা ঘরে সারাদিন আরামকেদারায় বসে তার দিন কাটে। শ্বাসকষ্টে কাতর।
তার পর সে ভালোবাসল তার এক খুড়িমাকে। তিনি থাকতেন ব্রিয়াস্কে, দু বছরে একবার করে আসতেন। তার আগে, যখন সে স্কুলে পড়ত, তখন তার প্রেমপাত্রী ছিল তার ফরাসি শিক্ষিকা।
ওলেঙ্কা মেয়েটি শান্ত, সহৃদয় বড় ভালো স্বভাবের। চোখ দুটি ভীরু, নিরীহ। নিটোল স্বাস্থ্য। তার টলটলে, লালচে গাল দুখানি, ধপধপে সাদা নরম তুলতুলে ঘাড়ের উপর ছোট্ট কালো তিলটি, আর সরল স্নিগ্ধ যে হাসিটি ফুটে উঠত তার মুখে খুশির কোনও কথা শুনলেই, তা দেখে ছেলেরা ভাবত মন্দ নয় তো মেয়েটি। বেশ হাসতও। আর মেয়েরা তার সঙ্গে কথা কইতে কইতে হঠাৎ তার হাতখানি ধরে বলে উঠত, কথার মধ্যিখানে, আনন্দের উচ্ছ্বাসে ও দুলালী!
জন্ম থেকে যে বাড়িতে ওলেঙ্কার বাস, তার বাবার উইল অনুযায়ী সেটি তারই প্রাপ্য। বাড়িখানা ছিল শহরের একটু বাইরের দিকে, জিপসি রোডের উপর। প্রমোদ উদ্যান তিভলি থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে যখন সন্ধেবেলায় বা রাত্রে, বাজনা বাজত, বাজি ফুটত, ওলেঙ্কার মনে হত যেন যুদ্ধ বেধেছে কুকিনের সঙ্গে তার নিয়তির। কুকি লড়ছে, তার প্রধান শত্রু নিঃসাড় দর্শকগুলোর সঙ্গে। অমনি ওলেঙ্কার মন গলে যেত। ঘুমোতে ইচ্ছে করত না। ভোররাত্রে কুকি যখন বাড়ি ফিরত, তখন ওলেঙ্কা তার শোবারঘরের জানালায় আস্তে আস্তে টোকা দিত, আর পরদার ফাঁক দিয়ে শুধু তার মুখখানা আর কাঁধের একটুখানি দেখিয়ে তার দিকে চেয়ে হাসত, নরম হাসি।
কুকি বিয়ের প্রস্তাব করল, বিয়ে হয়ে গেল। তার পর দেখল, বেশ ভালো করে, ওলেঙ্কার ঘাড়খানি আর তার সুন্দর মোটাসোটা কাঁধ দুটি। দেখে বলে উঠল, দুলালী!
কুকিন খুশি হল, তবে তার বিয়ের দিন এবং রাত্রেও বৃষ্টি হল, তাই মুখের নিরাশ ভাবটা বদলাল না।
দু জনের বনে গেল বেশ। ওলেঙ্কা টিকিট বিক্রির দিকটা দেখত, হিসাব রাখত, মাইনে-পত্তর দিত। তার ছলাকলাবর্জিত হাসিটিতে কখনও টিকিটঘর, কখনও খাবার দোকানটি, কখনও রঙ্গমঞ্চের দুটি পাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
বন্ধুদের সে বলতে আরম্ভ করল, পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার মধ্যে সর্বপ্রধান সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং উল্লেখযোগ্য বস্তু হল নাট্যশালা–প্রকৃত আমোদ একমাত্র এরই মধ্য দিয়ে পাওয়া যেতে পারে। এর দ্বারাই মানুষ হয়ে উঠতে পারে দ্র এবং মানবতাবোধসম্পন্ন।
কিন্তু লোকে কি তা বোঝে? বলত ওলেঙ্কা। ওরা চায় হৈ-হুল্লোড়। কাল আমরা দেখালাম উল্টোপাল্টা ফাউস্ট বক্সগুলোর প্রায় সব কটিই খালি রইল। কিন্তু যদি ভানিচকা আর আমি দেখাতাম ওঁচা একটা কিছু, দেখতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত রঙ্গালয়। কাল ভানিকা আর আমি দেখাচ্ছি নরকে অর্ফেউস্ নিশ্চয়ই এসো কিন্তু।
কুকি থিয়েটার সম্বন্ধে, অভিনেতাদের সম্বন্ধে যাই বলত ওলেঙ্কা তারই পুনরাবৃত্তি করত। কুকিনের মতোই সে-ও দর্শকদের অজ্ঞতা এবং রসবোধের অভাবকে ঘৃণা করত। মহড়ায় আসত ওলেঙ্কা, অভিনেতাদের ভুল শোধরাত– বাজিয়েদের গতিবিধির দিকে চোখ রাখত। খবরের কাগজে যদি খারাপ কিছু মন্তব্য করা হত তবে সে কেঁদে ফেলত, যেত সম্পাদকের কাছে, কৈফিয়ৎ চাইত।
অভিনেতারা তাকে ভালোবাসত, ডাকত ভানিচকা আর আমি, দুলালী বলে। ওলেঙ্কার ওদের জন্য কষ্ট হত, মাঝে মাঝে টাকা ধার দিত অল্প-স্বল্প, ঠকালে গোপনে চোখ মুছত, স্বামীর কাছে নালিশ করত না।
শীতের মৌসুমেও ওদের গেল ভালোই। মিউনিসিপ্যালিটির থিয়েটারখানা ওরা ভাড়া নিল, নিয়ে অল্পদিনের মেয়াদে ভাড়া দিল উক্রাইন-দেশি একটা দলকে, এক জাদুকরকে, স্থানীয় একটি নাটুকে সঙ্কে।
ওলেঙ্কা হয়ে উঠল আরও গোলগাল, মুখে ফুটল কায়েম একটা খুশির জৌলুস, কুকিন হয়ে গেল আরও রোগা, মুখ হল আরও হলুদে। ভয়ানক লোকসানের বুলি তার মুখে লেগেই রইল, যদিও শীতের বাজারে ব্যবসা তার মোটেই খারাপ চলেনি।
কুকি রাত্রে কাশে। ওলেঙ্কা ফলের রসের সঙ্গে ফুল মেড়ে তাকে খাওয়ায়, বুকে তেলমালিশ করে, নিজের নরম নরম শালগুলো দিয়ে তার গা ঢাকে।
বলে, কী মিষ্টি তুমি মণি। চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, অন্তর থেকেই, আমার সুন্দর, আমার বুকের ধন।
শীতের শেষে কুকিন গেল মস্কো, নতুন একটা দল নিয়ে আসতে। ওলেঙ্কা কুকিবিহনে ঘুমোতে পারে না। সারারাত জানালার ধারে বসে তারার দিকে চেয়ে থাকে। ঘরে মোরগ না থাকলে মুরগি যেমন সারারাত অস্বস্তিতে কাটায়, জেগে থাকে; ওলেঙ্কারও তেমনি হয়।
মস্কোয় কুকি আটকা পড়ে গেল। চিঠি দিল ও-মাসে ইস্টারের আগেই সে ফিরবে। তিভলির কাজকর্ম বুঝিয়ে লিখল।
যে সময় কুকিনের ফেরার কথা সেই সময়েই একদিন, দিনটা সোমবার, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, হঠাৎ দরজায় অলুক্ষণে রকমের একখানা ঘা পড়ল। সে কী আওয়াজ! যেন কেউ ঢাক পিটছে। দড়াম দড়াম দমাদ্দাম। রাধুনী মেয়েটা ঘুম-চোখে খালি পায়ে থৈ থৈ জল ভেঙে ছুটল বেড়ার দরজা খুলতে।
দরজার ওধার থেকে হেঁড়েগলায় কে বলল, দরজাটা খোলো তো, তোমার নামে তার এসেছে।
ওলেঙ্কা আগেও পেয়েছে টেলিগ্রাম তার স্বামীর কাছ থেকে, কিন্তু এবারে কেমন যেন সে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। থর থর কাঁপা হাতে টেলিগ্রাম খুলে সে পড়ল :
ইভান পেত্রোভিচ আজ হঠাৎ মারা গেল আগরা নির্দেশ সাপেক্ষ মঙ্গলবার শেষকৃত্য।
ঠিক এই ছিল টেলিগ্রামে, শেষকৃত্য আর অবোধ্য কথাটা আগরা। টেলিগ্রামে সই নাটুকে দলের বড়কর্তার।
ওলেঙ্কা কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমার মণি, ভানিকা, মণি আমার, প্রিয়তম। কেন দেখা হল আমাদের? কেন তোমায় জানলাম, ভালোবাসলাম? তুমি তো ছেড়ে গেলে আমাকে, এখন তোমার দুঃখিনী ওলেঙ্কা কার পানে চাইবে?
মঙ্গলবার কুকিনকে ভাগানকোভো গোরস্তানে কবর দেওয়া হল। ওলেঙ্কা বাড়ি ফিরে এল বুধবার, এসেই বিছানায় আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল, এমন চেঁচিয়ে যে রাস্তা আর আশেপাশের বাড়ির উঠোন থেকে সে কান্না শোনা গেল।
পাড়াপড়শিরা ক্রুশের চিহ্ন এঁকে বুকে মাথায় কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল আর বলল, বেচারি দুলালী, ওল্গা সেমূইয়ান। আহা, দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে বাছার।
তিন মাস বাদে একদিন গির্জা থেকে ফিরছে ওলেঙ্কা। শোকে-দুঃখে জর্জর। ঘটনাচক্রে বাবাকায়ে কাঠগোলার গোমস্তা ভাসিলি আন্দ্রেয়ি পুস্তভালভ, সে-ও ফিরছিল গির্জা থেকে, তারই সঙ্গে হেঁটে এল। পুস্তভালভের মাথায় কেতাদুরস্ত সাদা টুপি, পরনে সাদা ওয়েস্টকোট তার উপর ঝুলছে সোনার ঘড়ি-চেন। লোকটিকে দেখে মনে হয় না ব্যবসায়ী, দেখায় জমিদারের মতো।
সে বলল গম্ভীর সুরে, যা কিছু ঘটে ওলগা সেমইয়নভনা, সেসব ঘটে তারই আদেশে। স্বরে সমবেদনার রেশ। প্রিয়জনদের কেউ যদি চলে যায়, তবে তার কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছা। বুক বেঁধে মাথা নত করে তা আমাদের মেনে নিতে হবে।
ওলেঙ্কাকে বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে পুস্তভালভ বিদায় নিল। ওলেঙ্কা সারাদিন ধরে শুনল তার গম্ভীর গলার আওয়াজ। চোখ যখন জুড়ে এল, স্বপ্নে দেখল তার কালো দাড়ি। বড় ভালো লাগল তাকে ওলেঙ্কার।
পুস্তভালভের মনে বোধহয় ওলেঙ্কা একটা দাগ ধরিয়ে দিল, কারণ দু দিন না যেতেই একটি আধবয়সী মহিলা, যাকে ওলেঙ্কা প্রায় চেনেই না, এল তার সঙ্গে কফি খেতে, আর খেতে বসেই পুস্তভালভের গল্প জুড়ে দিল। বলল, অতি চমৎকার শক্তপোক্ত লোকটি, বিয়ের বয়সী যে কোনও মেয়ে ওকে বিয়ে করে সুখী হবে। তিন দিন বাদে পুস্তভালভ নিজেই এল। রইল বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হবে, কথা বলল অল্পই, কিন্তু ওলেঙ্কা তার প্রেমে পড়ে গেল– এতদূর যে সারারাত তার ঘুম হল না, জ্বরের মতো জ্বালায় জ্বলল, এবং সকাল হতে সেই আধবয়সী মহিলাকে ডেকে পাঠাল। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি বিয়েও হয়ে গেল।
বিয়ের পর দু জনের বনিবনা খুব ভালো হল। নিয়মিত পুস্তভালভ কাঠগোলায় বসত দুপুরের খাওয়া অবধি, তার পর যেত কাজে বেরিয়ে, ওলেঙ্কা এসে বসত তার জায়গায়, আপিসে বসে সন্ধে অবধি বিল তৈরি করত, আর অর্ডারমাফিক মাল চালান দিত।
খদ্দেরদের এবং পরিচিত লোকদের ওলেঙ্কা শোনাত কাঠের দর ফি বচ্ছর শতকরা কুড়ি টাকা হিসাবে বাড়ে। আগে আমরা কাঠ নিতাম এখান থেকেই, কিন্তু এখন ভাসিকাকে প্রতি বছর যেতে হয় মগিলেভ অঞ্চলে, কাঠের বন্দোবস্ত করতে। আর ভাড়া কী! তাজ্জব হয়ে গালে হাত দিয়ে ওলেঙ্কা বলত, কী খরচা গাড়িভাড়ার!
তার মনে হত সে কাঠের ব্যবসায় আছে যুগ যুগ ধরে; কাঠ জীবনের সর্বপ্রধান এবং সার বস্তু। গার্ডার, কড়ি, বরগা, তক্তা, বাটাম, বাক্সের কাঠ, ল্যাথ, পিস্, স্ল্যাব কথাগুলো তার কাছে বড় আদরের মনে হত, শুনে মন-কেমন করত। রাত্রে সে স্বপ্ন দেখত পাহাড়প্রমাণ বোর্ড আর তক্তা, অসংখ্য গাড়িভর্তি কাঠের গুঁড়ি সার বেঁধে কোন্ দূর দেশে যাত্রা করেছে, ৮ ইঞ্চি চওড়া ২৮ ফুট লম্বা কড়িকাঠের একটা দল খাড়া দাঁড়িয়ে ধেয়ে চলেছে কাঠগোলার দিকে, কড়িতে কড়িতে, গার্ডারে স্ল্যাবে ঠোকাঠুকি হচ্ছে, শুকনো কাঠে কাঠে খটাখটির ভোতা আওয়াজ হচ্ছে, সবাই পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠছে, এর ওর ঘাড়ে চেপে স্কুপের মতো জমা হচ্ছে ..
ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে ওঠে ওলেঙ্কা। পুস্তভালভ আদর করে বলে, ওলেঙ্কা, কী হল দুলালী? মাথায় কাঁধে বুকে ক্রুশচিহ্ন ছোঁয়াও।
যে ধারণাই তার স্বামীর হত ওলেঙ্কারও তাই হত। পুস্তভালভ যেই বলত ঘরে বড় গরম, অথবা ব্যবসায়ে মন্দা পড়েছে, ওলেঙ্কারও মনে হত তাই। আমোদ-প্রমোদ পুস্তভালভের ভালো লাগত না, ছুটির দিন কাটাত বাড়ি বসে। ওলেঙ্কাও তাই করত।
বন্ধুবান্ধবেরা বলত, তুমি সবটা সময় কাটাও বাড়িতে বা আপিসে। থিয়েটারে সার্কাসে যাওয়াও তো উচিত।
মুরুব্বিয়ানার সুরে ওলেঙ্কা বলে, ভাসিচুকা আর আমি থিয়েটারের ধার মাড়াই না। আমরা খাঁটিয়ে লোক, ওসব ছ্যাবলামির দিকে আমাদের মন নেই। কী হয় ওসব থিয়েটার দিয়ে?
প্রতি শনিবার সন্ধ্যাবেলায় আর ছুটির দিনের সকাল সকাল তারা গির্জায় যেত, পাশাপাশি হেঁটে ফিরত, দু জনেরই মুখে ফুটে থাকত উপাসনার আবেগ। দু জনেরই অঙ্গে লেগে থাকত মনোরম সুবাস। ওলেঙ্কার রেশমি পোশাক থেকে বেরোত একটা খুশি-খুশি খখস্ শব্দ।
বাড়িতে তাদের খাদ্য ছিল চা, মিষ্টি রুটি, আর রকম রকম জ্যাম। তার পর কিমার পাই। রোজ দুপুরবেলা তাদের বাড়ির সামনের উঠোনে, গেটের বাইরে, রাস্তায়, সুরুয়ার ভুরভুরে গন্ধ ছড়াত, ভেড়ার বা হাঁসের ঝলসানো মাংসের কিংবা উপবাসের দিনে মাছের। যে-ই যেত ওবাড়ির পাশ দিয়ে, তারই খিদে পেয়ে যেত।
আপিসে, সামোভারে চায়ের জল সর্বদাই চড়ানো থাকত– খদ্দের এলে দেওয়া হত চায়ের সঙ্গে কড়াপাকের পিঠে।
সপ্তাহে একদিন করে তারা যেত স্নানাগারে, ফিরত একসঙ্গে টকটকে রাঙাবরণ হয়ে।
ওলেঙ্কা বলত বন্ধুদের, সত্যি ঈশ্বরের কৃপায় আমরা সবদিক থেকে বেশ ভালোই আছি। যেমন সুখে-স্বচ্ছন্দে আছি ভাসিচকা আর আমি, তেমনি যদি সবাই থাকত তত বেশ হত।
পুস্তভালভ যখন কাঠ কিনতে মগিলেভে যেত, ওলেঙ্কার ভীষণ মন-কেমন করত। সারারাত সে জেগে কাটাত, কাদত।
মাঝে মাঝে স্মিরনিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। স্মিরনিন ছিল সৈন্যদলের পশু-চিকিৎসক। সে ওলেঙ্কাদেরই বাড়ির একপাশটা ভাড়া নিয়ে থাকত। তার অল্প বয়স। সে এসে গল্প-সল্প করত, তাস খেলত, ওলেঙ্কার মনটা ভুলে থাকত।
স্মিরনিননের নানা কথার মধ্যে ওলেঙ্কার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত তার ঘরের খবর। স্মিরনিন বিবাহিত, আর একটি ছেলে আছে। তবে স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকে গেছে, কারণ পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম। বউকে সে দু চক্ষে দেখতে পারে না, তবু মাস মাস টাকা পাঠায় চল্লিশ রুল, তার ছেলের খোরপোশ বাবদ। এসব শুনে ওলেঙ্কা মাথা নাড়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর জন্য বড় দুঃখ হয় তার মনে।
যাবার সময় ওলেঙ্কা স্মিরনিনকে মোমবাতি হাতে করে সিঁড়ি অবধি পৌঁছে দেয়। বলে, ভগবান করুন, তোমার যেন কোনও বিপদ-আপদ না হয়। তুমি যে রইলে এতটা সময় আমার সঙ্গে, তার জন্য ধন্যবাদ। স্বর্গের রানি মেরি তোমাকে অটুট স্বাস্থ্যে রাখুন।
তার স্বামীর যেমন চারদিকে বিবেচনা করে গম্ভীরভাবে কথা কইবার ধরন, ওলেঙ্কা তারই অনুকরণ করে। ডাক্তার সিঁড়ির নিচেকার দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে, তখন ওলেঙ্কা তাকে ডেকে ফেরায়, আর বলে, দেখ ভাদিমির প্লাতোনি, স্ত্রীর সঙ্গে তোমার মিটমাট করে ফেলাই উচিত; তাকে ক্ষমা কর, ছেলের মুখ চেয়ে। ছেলেটি হয়তো সবই বোঝে।
পুস্তভালভ যখন ফিরে এল, ওলেঙ্কা তাকে ঘোড়ার ডাক্তারের দুঃখময় জীবনের সমস্ত কাহিনী শোনাল গলা খাটো করে। স্বামী-স্ত্রী দু জনেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, মাথা নাড়ল। দু জনেই বলাবলি করতে লাগল ছেলেটির বিষয়ে। বলল, নিশ্চয়ই ছেলেটির বাবার জন্য মন-কেমন করে। তার পর দু জনেরই মনে যেন কেমন করে এল একই কথা। তারা দাঁড়াল এসে গৃহ-বিগ্রহের সামনে। প্রার্থনা করল মাটি অবধি নুয়ে, ভগবান যেন তাদের সন্তান দেন।
এমনিভাবে পুস্তভালভ পরিবার ছ-টি বছর কাটাল, পরম শান্তিতে, বিনা আড়ম্বরে, ভালোবেসে, পরস্পরের সঙ্গে মিল সম্পূর্ণ বজায় রেখে। তার পর একদিন, শীতকালে ভাসিলি আন্দ্রেয়ি আপিসে বসে গরম চা খাওয়ার পর মাথায় টুপি না এঁটে বেরিয়ে গেল কিছু কাঠ চালান দিতে। তার ঠাণ্ডা লেগে গেল, অসুখ করল। সবচেয়ে বড় বড় ডাক্তার তার চিকিৎসা করলেন, কিন্তু রোগ কিছুতেই সারল না। চার মাস ভোগের পর পুস্তভালভ মারা গেল। ওলেঙ্কা আবার বিধবা হল।
স্বামীর গোর দিয়ে ওলেঙ্কা কুঁপিয়ে কান্না শুরু করল, কার কাছে যাব আমি, ওগো তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব আমি অভাগী দুঃখিনী? ওগো তোমরা সবাই আমাকে দেখসে।
কালো শোকবস্ত্র পরে ওলেঙ্কা চলাফেরা করে। মাথায় টুপি নেই, হাতে দস্তানা পরে না। চোখের জলের ধারার নকশায় তৈরি সাদা ঝালর অঙ্গে ধরে। বাইরে বেরোয় কদাচিৎ যদিও-বা যায় কোথাও তো সে গির্জায় কিংবা স্বামীর কবর দেখতে। বাড়িতে বাস করে যেন সন্ন্যাসিনী।
ছ-টি মাস কেটে যাবার পর সে বিধবার বেশ ছাড়ল। তার ঘরের জানালার খড়খড়ি উঠতে আরম্ভ করল। কখনও-সখনও তাকে বাজারের পথেও দেখা যেতে লাগল, সকালের দিকে রাঁধুনীর সঙ্গে। কী যে সে করে, বাড়িতে কী করে তার দিন কাটে তা নিশ্চয় করে কেউ জানল না, তবে আন্দাজ একটা করে গেল। দেখা যেত, ওলেঙ্কা বাগানে বসে চা খাচ্ছে ঘোড়ার ডাক্তারটির সঙ্গে, ডাক্তার ওলেঙ্কাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে। এসব দেখে লোকে অনুমান একটা করে নিত।
আরও একটা ঘটনা ঘটল। ডাকঘরে ওলেঙ্কার একটি চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হল। তাকে সে বলল, আমাদের এই শহরে গরু-ঘোড়ার কী হয় না হয় দেখবার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, তাই এত ব্যামো। প্রায়ই শোনা যায় দুধ খেয়ে মানুষের অসুখ করে, গরু-ঘোড়ার ছোঁয়াচ লেগে এটা হয়, সেটা হয়। গৃহপালিত পশুর স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে, যেমন মানুষের জন্য, ঠিক তেমনি নজর রাখা উচিত।
পশুর ডাক্তারটির মনে যা ধারণা ওলেঙ্কার বক্তব্যও তাই। সকল বিষয়েই ডাক্তারের যা মত তারও আজকাল সেই মত। স্পষ্টই দেখা গেল, কোনও একটা আকর্ষণ বিনা ওলেঙ্কার একটি বছরও কাটে না। আর, এবারে সে নতুন করে খুঁজে পেয়েছে আনন্দ, একেবারে তার নিজের বাড়িরই একপাশে।
মেয়েটি আর কেউ হলে তার নিন্দে হত, কিন্তু ওলেঙ্কার সম্বন্ধে কেউ কুকথা ভাবতে পারত না– সবটাই তার এত সহজ স্বাভাবিক। কি ডাক্তার কি সে– কেউই খুলে বলেনি যে আগে তাদের মধ্যে যে সম্পর্কটা ছিল তা বদলেছে। বরং ওটা ওরা ঢেকে রাখতেই চেষ্টা করত, কিন্তু পারত না, কারণ ওলেঙ্কার কথা গোপন রাখার ক্ষমতা ছিল না।
যখন ডাক্তারের সহকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসত, ওলেঙ্কা তাদের চা ঢেলে দিতে দিতে বা যাবার সময় তুলত জীবজন্তুর মড়কের কথা। কিংবা বলত পশুদের কোনও ব্যায়রাম অথবা সরকারি কসাইখানার বিষয়। ডাক্তার বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ত। বন্ধুরা চলে যেতেই সে ওলেঙ্কার হাত চেপে ধরে ফোঁস করে উঠত, বার বার তোমাকে মানা করেছি, যা তুমি বোঝ না তা নিয়ে কথা না বলতে। আমরা পশু-চিকিৎসকেরা যখন আলাপ-আলোচনা করি, দয়া করে তুমি তার মধ্যে এসে পড়ো না। সত্যি ভারি রাগ হয়।
ওলেঙ্কা স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকাত, চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করত, তা হলে কী বিষয়ে কথা বলব, ভলকা? তার পর জলভরা চোখে সে ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরত, ডাক্তারকে দিব্যি দিত রাগ না করতে। তার পর দু জনেরই খোশমেজাজ ফিরে আসত।
এ আনন্দ বেশিদিন রইল না। ডাক্তার তার সৈন্যদলের সঙ্গে কোথায় গেল, একেবারের মতো। গোটা দলটাই বদলি হয়ে গেল দূরদেশে হয়তো-বা সাইবেরিয়াতেই। ওলেঙ্কা একা পড়ে গেল।
এবারে সে একেবারেই একলা পড়ে গেল। তার বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন; তার সেই আরামকেদারাটা পড়ে আছে চিলেকোঠার গুদোমে। ধুলোয় ভর্তি, একটা পায়া ভাঙা। ওলেঙ্কা রোগা হয়ে গেল, তার চেহারায়ও আর সে শ্ৰী রইল না। রাস্তায় দেখা হলে আর তার দিকে কেউ আগের মতো চাইত না, হাসত না। বোঝা গেল তার জীবনের সবচেয়ে ভালো দিনগুলো চলে গেল। সেদিন রইল পিছনে পড়ে, এখন যে জীবন শুরু হল তা আলাদা, অনিশ্চিত, তার কথা ভাবতেও বুক কেঁপে ওঠে।
সন্ধেবেলায় বারান্দায় বসে ওলেঙ্কা শুনত তিতোলিতে বাজনা বাজছে, বাজি ফুটছে, কিন্তু তা শুনে তার কোনও কথাই মনে হত না। ফাঁকা উঠোনটার দিকে সে নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে থাকত, কোনও কথা ভাবত না, চাইত না কিছুই। দিন ফুরিয়ে গেলে ওলেঙ্কা শুয়ে পড়ত, স্বপ্নে দেখত ফাঁকা উঠোনটা। খাওয়া-দাওয়া করত, যেন অনিচ্ছায়।
সবচেয়ে বড় আর বিশ্রী ব্যাপার হল যে, তার আর কোনওরকম মতামত রইল না। চোখে পড়ত নানা জিনিস, বুঝত কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিন্তু কোনওকিছু সম্বন্ধেই একটা মতামত তার মনে গড়ে উঠত না। কী নিয়ে কথা বলা যায় তা-ও সে বুঝত না।
কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার মতামত না থাকা! ধরো, দেখছ একটি বোতল অথবা বৃষ্টি, কিংবা দেখছ চাষি চলেছে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে, কিন্তু বোতল, বৃষ্টি বা চাষি কী নিমিত্ত, কী তাদের তাৎপর্য কিছুই বলতে পারছ না, হাজার রুপিয়া কবুল করলেও নয়।
যখন তার কুকিন ছিল অথবা পুস্তভালভ কিংবা পরে তার কাছে থাকত পশুর ডাক্তারটি– তখন ওলেঙ্কা সবকিছুই বুঝিয়ে দিতে পারত, চাও তারই সম্বন্ধে একটা মত দিতে পারত। কিন্তু এখন তার মনটা ফাঁকা উঠোনটার মতো। বড় কষ্টমাখা, বড় বিস্বাদ এ জীবন।
শহরটা একটু করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। খোলামেলা রাস্তা জিপৃসি রোড় হয়ে উঠল শহুরে সড়ক। যেখানে ছিল তিভোলির বাগানগুলো আর কাঠের গোলা, সেখানে বাড়ির সারির ফাঁকে ফাঁকে গলিখুঁজি গজিয়ে উঠল। কী তাড়াতাড়ি কেটে যায় সময়।
ওলেঙ্কার বাড়িটা শ্রীহীন হয়ে পড়ল। ছাতে মরচে ধরল, কুঁড়েঘর একপাশে ঝুলে পড়ল, সারা উঠোনটা ভরে গেল লম্বা ঘাস আর বিছুটির ঝোপে। ওলেঙ্কার নিজেরও বয়স হল, চেহারায় সে লাবণ্য আর রইল না।
গ্রীষ্মকালে সে বসত বারান্দাটায়, মন শূন্য, নিরানন্দ, বিরস। শীতে সে বসত জানালার ধারে, তাকিয়ে থাকত বরফের দিকে। কখনও বসন্তের বাতাসে অথবা হাওয়ায় ভেসে আসা গির্জার ঘন্টাধ্বনিতে স্মৃতির বন্যা জেগে উঠত, তখন তার মন গলে যেত, চোখে জল ভরে আসত কিন্তু তা-ও মুহূর্ত-স্থায়ী, সেটা চলে গেলেই আবার ফিরে আসত সেই শূন্যতা, জীবনের উদ্দেশ্যের সেই অনিশ্চয়তা।
কালো বেড়ালের বাচ্চা ব্ৰিস্কা তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াত, ঘড়র ঘড়র শব্দ করত, কিন্তু ওসব বেড়ালি আদরে ওলেঙ্কার মন সাড়া দিত না। ওর কি ওইটুকুরই দরকার? সে চাইত এমন ভালোবাসা যা তার সমস্ত আত্মা, তার মনকে দখল করবে, মনে জন্ম দেবে ধারণার, জীবনে আনবে গতিমুখ, পড়ন্ত বয়সের রক্তে এনে দেবে উষ্ণতা।
কালো বেড়ালবাচ্চাটাকে ওলেঙ্কা তার কোল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলত, যা এখন থেকে, যাহ্। এখানে কী তোর? এখানে কিছু নেই।
এমনিভাবে চলত দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কোনও মত নেই, অমত নেই, আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই। রাধুনী মাত্রা যা বলত ওলেঙ্কা তাই মেনে নিত।
একদিন– জুলাই মাস, গরম পড়েছে, সন্ধের দিকে, গরুগুলো যখন ঘরে ফিরছে সারা উঠোনে ধুলো উড়িয়ে সেই সময় কে যেন আচমকা দরজায় ঘা দিল। ওলেঙ্কা নিজেই গেল ফটক খুলতে, খুলে যা দেখল তাতে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল– দরজায় দাঁড়িয়ে পশুর ডাক্তার স্মিরনিন। তার চুলে পাক ধরেছে, পরনে বেসামরিক পোশাক।
এক মুহূর্তে ওলেঙ্কার সব কথা মনে পড়ে গেল। সে নিজেকে সামলাতে পারল না, কেঁদে ফেলল। একটি কথাও না বলে সে স্মিরনিননের বুকে তার মাথা রাখল। এত ওলোট-পালট হয়ে গেল তার মন যে, কখন যে স্মিরনিনকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সে তার সঙ্গে চা খেতে লাগল তা সে বুঝতেই পারল না।
আনন্দে সে কেঁপে উঠল, মুখে কথা ফুটল, ওগো ম্লাদিমির প্লাতনি, কী জন্যে এলে এখানে?
স্মিরনিন বলল, আমি এসেছি এখানে থাকব বলে। সৈনিকের চাকরি আমার শেষ হয়েছে। এবারে এখানেই বসবাস করে নিজে রোজগার করবার চেষ্টা দেখব। তা ছাড়া ছেলেটিও বড় হল, তাকে উচ্চশিক্ষা দিতে হবে। আর জানো, স্ত্রীর সঙ্গে মিটমাট করে ফেলেছি।
ওলেঙ্কা বলল, কোথায় সে?
হোটেলে, আমার ছেলের সঙ্গে। আমি বেরিয়েছি একটা আস্তানা খুঁজতে। ভাড়া নেব।
সে কি কথা গো! আমার বাড়িটা নাও। ভাড়া। একটি পয়সা ভাড়া নেব না। এলেঙ্কার মন আবার চঞ্চল হয়ে উঠল, সে কাঁদতে শুরু করল। বলল, তোমরা এখানে থাকো। আমার পক্ষে বাড়ির একটা ধারই যথেষ্ট। ওহ কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার!
পরদিনই তারা ছাতে দু-এক পোঁচ রঙ আর দেয়ালে চুনকাম করতে লেগে গেল। ওলেঙ্কা কোমরে হাত দিয়ে উঠোনটার চারদিক ঘুরে কাজের খবরদারি করতে লাগল। সেই পুরনো দিনের হাসি আবার তার মুখে ফুটে উঠল। মনে হল যেন লম্বা একটানা ঘুমের পর তার শরীর তাজা হয়ে প্রাণ ফুটে উঠেছে।
পশুর ডাক্তারের স্ত্রী এল। রোগা মেয়েটি, সাদাসিদে, ছোট করে ছাটা চুল, মুখে একটা খামখেয়ালি ভাব। সঙ্গে তার ছোট ছেলেটি, সাশা, বয়স প্রায় দশ, কিন্তু সে আন্দাজে মাথায় খাটো। ফুলো ফুলো গালে টোল, উজ্জ্বল নীল চোখ। উঠোনে ঢুকেই সে বেড়ালটার পিছনে ছুটতে আরম্ভ করল, সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল খিলখিল হাসি খুশি মনের ফুর্তির।
ছেলেটি জিগ্যেস করল, মাসি, এটা কি তোমার বেড়াল? ওর যখন বাচ্চা হবে, আমাকে দিও। মা ইঁদুর দেখে ভয়ানক ভয় পায়।
ছেলেটির সঙ্গে ওলেঙ্কার গল্প শুরু হল। চা খাওয়াল সে ছেলেটিকে। হঠাৎ তার বুকটা ভরে উঠল। মধুর একটা ভারে তার বুক কনকন করতে লাগল ছোট্ট ছেলেটি যেন তার নিজের।
সন্ধেবেলায় সে যখন খাবারঘরে তার পড়া তৈরি করতে বসল, এলেঙ্কা তার দিকে চেয়ে রইল। মন মুখ তার স্নেহমমতায় ভরে উঠল। সে বলতে লাগল, নিচু গলায়, আমার দুলাল, আমার মানিক, কত বুদ্ধি তোমার–কী সুন্দর দেখতে তুমি।
ছেলেটি জোরে জোরে পড়তে লাগল, বই দেখে, দ্বীপ একটি ভূখণ্ড, সম্পূর্ণরূপে জলবেষ্টিত।
ওলেঙ্কা পুনরাবৃত্তি করল, দ্বীপ একটি ভূখণ্ড।
বহুদিনের ফাঁকা মন থেকে একটি কথা না বলে সে আজ এই প্রথম একটি মত প্রকাশ করল যাতে তার বিশ্বাস আছে।
এইবারে তার নিজস্ব মতামত গড়ে উঠতে আরম্ভ করল। রাত্রে খাবার সময় সে সাশার বাবা-মাকে শোনাতে লাগল যে, হাইস্কুলে ছেলেপিলেদের যা পড়ানো হয় তা কী রকম শক্ত। অবশ্য শুধু কারিগরির কাজ শেখানোর চেয়ে উচ্চশিক্ষা ভালো, কারণ তার দ্বারা সমস্ত পথই খুলে যায়– চাও তুমি ডাক্তার হতে পার … ইঞ্জিনিয়ার হতে পার…
সাশা হাইস্কুলেই যেতে শুরু করল। তার মা খারকভে তার বোনের বাড়ি গেল, গিয়ে আর ফিরল না। বাবা তার পশুর পাল দেখতে বেরোত, কখনও কখনও একনাগাড়ে বাইরে থাকত। ওলেঙ্কার মনে হত সবাই সাশাকে ছেড়ে চলে গেল, কেউ তাকে চায় না, না খেয়ে ছেলেটি মরে যাচ্ছে। ওকে সে সরিয়ে আনল নিজের পাশটিতে ছোট একটি কামরায়। সেখানেই তার থাকবার বন্দোবস্ত করে দিল।
ছ মাস হয়ে গেল। সাশা থাকে তার পাশেই। রোজ সকালে ওলেঙ্কা যায় সাশার ঘরে। সাশা তখনও শুয়ে, গালের তলায় হাতটি রেখে গভীর ঘুমে অচেতন, নিশ্বাস নিঃশব্দে উঠছে-পড়ছে। ওলেঙ্কার মনে কষ্ট হয় সাশার ঘুম ভাঙাতে। তবু বলে, আস্তে আস্তে, সাশেনকা, উঠে পড়ো সোনা। স্কুলে যাবার সময় হল।
সাশা ওঠে, পোশাক পরে প্রার্থনা সেরে খেতে বসে। খায় তিন গ্লাস চা, দুটো বড় কড়া কেক। মাখন-মাখানো আধখানা ছোট রুটি। ঘুম তখনও তার পুরোপুরি কাটেনি, তাই মেজাজটি তখনও ধাতস্থ হয়নি।
এলেঙ্কা বলে, সাশেনকা, গল্পটা তোমার কিন্তু ভালো তৈরি হয়নি।
এমনভাবে চেয়ে থাকে সে তার দিকে, যেন ছেলেকে সে বিদায় দিচ্ছে দূর যাত্রার পথে।
তোমার জন্য আমি ভেবে মরি। প্রাণপণ চেষ্টা করো সোনামণি, ভালো করে পড়াশুনা করো। মন দিয়ে মাস্টারদের কথা শুনো।
সাশা বলে, আহ, আমাকে ছেড়ে দাও দিকি।
তার পর হেঁটে রওনা হয় স্কুলে।
ছোট মূর্তিটি পথে চলেছে, মাথায় মস্ত একটা টুপি, কাঁধে একটা ঝুলি। ওলেঙ্কা নিঃশব্দে পিছু পিছু যায়। ডাকে, সাশেনকা– আ।
সাশা যেই পিছন ফিরে তাকায় এলেঙ্কা তার হাতে গুঁজে দেয় একটি খেজুর বা কারামেলের একটি টুকরো।
স্কুলের গলি এসে পড়ে। সাশেনকার বিশ্রী লাগে, লম্বা মোটাসোটা একটি মহিলা তার পিছু পিছু আসছেন, দেখে তার লজ্জা করে। পিছন ফিরে সে বলে, মাসি, বাড়ি ফিরে যাও। এখন আমি একা যেতে পারব।
ওলেঙ্কা থামে, কিন্তু তার চোখ সরে না। স্কুলে ঢোকার পথটিতে ছেলে পৌঁছে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সে তার দিকে তাকিয়েই থাকে। আহ, কী ভালোই বাসে সে ছেলেটিকে। মায়ার ফাঁদে সে আগেও পড়েছে, কিন্তু কেউই তাকে এমন করে বাঁধতে পারেনি। আজ তার মায়ের মন জেগে ওঠে যত আনন্দে, যেমন করে তার আত্মাটাকে একেবারে বিলিয়ে দিয়েছে, তেমন কখনও হয়নি আগে। এই ছোট্ট ছেলেটি তার নিজের নয়, তবু তার গালের টোলটি, মাথার টুপিটার জন্য সে তার জীবন দিতে পারে, আনন্দে, মমতায়, জলভরা চোখে। কেন? কেন তা কে বলতে পারে?
সাশাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ওলেঙ্কা শান্ত মনে বাড়ি ফিরে যায়। মনভরা তার তৃপ্তি, প্রশান্তি, ভালোবাসা। গেল ছ মাসে বয়স যেন তার কমে গেছে, মুখে উজ্জ্বল আনন্দ। লোকে তাকে দেখে খুশি হয়, বলে, সুপ্রভাত গো ওলগা সেমইয়নভুনা, দুলালী, কেমন আছ দুলালী?
সে বলে, স্কুলে আজকাল এত শক্ত পড়া দেয়। বাজারে ঘুরে কেনাকাটার ফাঁকে ফাঁকে সে বলতে থাকে, ঠাট্টা নয়। কাল প্রথম ঘণ্টায় ওকে পড়া দিয়েছে একটা গল্প মুখস্ত, লাতিন থেকে একটা তরজমা আর একটি সমস্যাপূরণ। ওইটুকু একটা ছেলের পক্ষে এটা বড্ড বাড়াবাড়ি, বাস্তবিকই।
তার পর সে আরম্ভ করে মাস্টারদের কথা, পড়ার কথা, পাঠ্যবইগুলোর কথা– সাশা যা বলে ঠিক তাই বলে।
তিনটের সময় ওরা একসঙ্গে খায়। সন্ধেবেলায়, মাস্টাররা যে বাড়ির পড়া দেন তা ওরা পড়ে একসঙ্গে, একই সঙ্গে কাঁদে। সাশাকে বিছানায় শুইয়ে ওলেঙ্কা প্রার্থনায় আর ক্রুশচিহ্ন আঁকায় অনেকক্ষণ লাগিয়ে দেয়। তার পর সে নিজে শুতে যায় আর স্বপ্ন দেখে সেই দূর, অস্পষ্ট ভবিষ্যতের, যখন সাশার পড়া শেষ হয়েছে, সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার– তার মস্ত একটা বাড়ি, ঘোড়াগাড়ি। বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে… এই কথাই ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। পাশে কালো বেড়ালটা শুয়ে আওয়াজ করে…ঘড়র… ঘড়র।
হঠাৎ দরজায় জোরে ঘা পড়ে। ওলেঙ্কার ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। আধ মিনিট বাদে আবার ঘা।
ওলগার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। সে ভাবে, খারক থেকে এসেছে তার। সাশার মা তাকে চেয়ে পাঠিয়েছে। হা ভগবান!
সমস্ত আশাভরসা তার উবে যায়, মাথা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, মনে হয়, তার মতো অভাগিনী জগতে আর কেউ নেই।
কিন্তু আরও এক মুহূর্ত কেটে যাবার পর সে কার যেন গলা শুনতে পায়; কিছু নয়, পশুর ডাক্তার ক্লাব থেকে ঘরে ফিরল।
ওলেঙ্কা মনে মনে বলে, যাক। ধন্য ভগবান! ক্রমে ক্রমে তার বুকের ওপর থেকে ভারটা সরে যায়। আশ্বস্ত হয়ে সে ফিরে যায় বিছানায়, আর সাশার কথা ভাবে। পাশের ঘরে ঘুমোয় সাশা আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে ঘুমের ঘোরে, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! এই, ওকি, মারামারি নয়!
***
গল্পটি চেখফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। কেউ কেউ বলেন, দি বেস্ট শর্ট স্টোরি অব চেখফ। আবার কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীর সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ গল্প।
কেন?
তারই টীকা করেছেন স্বয়ং টলস্টয়। এ-রকম একটা ঘটনা এই বাঙলা দেশেই ঘটেছিল। প্রভাত মুখুয্যে একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন। তার মূলে বক্তব্য ছিল, হিন্দুর নীচ জাতির একটি ছেলে অপমানিত বোধ করে খ্রিস্টান হবে বলে মনস্থির করল। তখন দেখে, খ্রিস্টানদের ভিতরও জাতিভেদ রয়েছে। নেটিভ খ্রিস্টানদের জন্য আলাদা ক্লাব, এমনকি ধর্মমন্দির– চার্চ সে-ও আলাদা, এবং সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, মৃত্যুর পরও জাতিভেদ যায় না : গোরার জন্য ভিন্ন। গোরস্তান, নেটিভের ভিন্ন গোরস্তান। গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ, সে যুগের ঋষিপ্রধান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটি সমালোচনা লেখেন– ডাঙায় বাঘ জলে কুমির। হিন্দুর বর্ণাশ্রম সমস্যা নিয়ে এরকম প্রামাণিক প্রবন্ধ এর পূর্বে বা পরে কখনও লিখিত হয়নি। হরিজন আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার বহু বহু পূর্বে।
টলস্টয়ের টীকা পড়ে পাঠক বুঝবেন, আমরা, সাধারণ-পাঠক, কত সহজেই গল্পটির মূল বক্তব্য মিস করে যেতে পারি। অনবদ্য এই টীকাটি।
টীকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর চেখফ সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানান তাঁর গল্পটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন টীকাটি পড়েন এবং প্রকাশকদের অনুরোধ করেন, তারা যেন সবসময়ই গল্পটির সঙ্গে টীকাটিও ছাপেন। এটিও অনুবাদ করেছেন সখা খাফী খান।
দুলালীর সমালোচনা
টলস্তয়
বাইলের গণনাপুস্তকে একটি গল্প আছে। তার অর্থ অতি গভীর। গল্পটিতে বলা হয়েছে, ইরাএলিরা যখন মোআবের রাজ্যসীমায় এসে উপস্থিত হল, মোআবীয়দের রাজা বালাক তখন নবী বালআমকে ডেকে পাঠালেন ইসরাএলিদের অভিসম্পাত দেবার জন্য; কাজটি সেরে দিলে বালা বালআমকে বহু পুরস্কার দেবেন। তার লোভে বালআম বালাকের কাছে গেলেন এবং তাকে নিয়ে উঠলেন পর্বতে। সেখানে একটি বেদি তৈরি করা হল, গোবৎস ও মেষ উৎসর্গ করা হল অভিশাপের উদ্যোগে। বালা রইল অভিশাপের প্রতীক্ষায়, কিন্তু বালআম ইসরাএলের লোকদের অভিসম্পাত না দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করলেন।
২৩ পরিচ্ছেদ ১১ চরণ : বালা বালআমকে কহিল, তুমি আমার প্রতি এই কী করিলা? আমার শত্রুগণকে শাপ দিতে তোমাকে আনিলাম, কিন্তু দেখ, তুমি তাহাদিগকে সর্বতোভাবে আশীর্বাদ করিলা।
তাহাতে সে উত্তর করিল, পরমেশ্বর আমার মুখে যে কথা দেন, সাবধান হইয়া তাহাই কহা কি আমার উচিত নহে।
১৩। পরে বালাক কহিল, আমি মিনতি করি, অন্যস্থানে আমার সহিত আসিয়া সেখানে থাকিয়া আমার নিমিত্ত তাহাদিগকে শাপ দেও।
কিন্তু আবার শাপ না দিয়ে বালআম আশীর্বাদ করলেন। তৃতীয় বারেও তাই।
২৫ পরিচ্ছেদ ১০ম চরণ : তখন বালআমের প্রতি বালাকের ক্রোধ প্রজ্বলিত হইল, সে আপনা হস্তে হস্তের আঘাত করিল এবং … বালআমকে কহিল, শত্রুগণকে শাপ দিতে আমি তোমাকে আনিলাম, কিন্তু দেখ, তুমি তিনবার সর্বতোভাবে তাহাদের আশীর্বাদ করিলা।
১১। অতএব তুমি এখন স্বস্থানে পলায়ন কর; আমি তোমাকে অতিশয় সম্মানিত করিব ভাবিয়াছিলাম কিন্তু দেখ পরমেশ্বর তোমায় সম্মান পাইতে নিবৃত্ত করিলেন।
তখন বালআম পুরস্কার লাভ না করেই প্রস্থান করলেন, কারণ তিনি বালাকের শত্রুদের অভিসম্পাতের পরিবর্তে দিলেন আশীর্বাদ।
বালআমের যা হয়েছিল প্রকৃত কবি ও রসস্রষ্টাদের প্রায়ই তা হয়। বালাকের পুরস্কার জনপ্রিয়তার লোভে কিংবা ভ্রান্ত ধারণার বশে কবি দেখে না যে তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে দেবদূত, গাধাও যাকে দেখতে পায়*। [*বালাকের আমন্ত্রণে বালআম যখন যাত্রা শুরু করে তখন তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল য়িহুহের দূত। বালআম তাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু যে গাধার পিঠে চড়ে সে আসছিল সে পেয়েছিল দেখতে– অনুবাদক।] চায় সে অভিশাপ দিতে, কিন্তু অহহ! সে দেয় আশীর্বাণী।
ঠিক তাই হল খাঁটি কবি এবং রসস্রষ্টা চেখফের মনোহর এই দুলালী গল্পটি লেখবার বেলায়।
লেখক নিশ্চিত চেয়েছিলেন কৃপার পাত্রী এই জীবটিকে উপহাস করতে। হৃদয় দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করেছিলেন দুলালীকে যে প্রথমে কুকিনের দুশ্চিন্তার বোঝা কাঁধে তুলে নেয়, তার পর কাঠ কেনা-বেচার বিষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার পর পশুর ডাক্তারের আওতায় এসে গরু-মহিষের ব্যায়োকেই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার বলে ঠিক করে, আর শেষে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ব্যাকরণের প্রশ্ন এবং মস্ত টুপি পরা ছোট্ট বাচ্চাটির ভালোমন্দ নিয়ে।
কুকিন পদবিটি উদ্ভট, তার অসুখ, যে টেলিগ্রামে তার মারা যাবার খবর জানানো হল তা-ও উদ্ভট, কাঠের ব্যাপারি আর খানদানি ঠাট পশুর ডাক্তার, এমনকি ছোট্ট ছেলেটি, সবাই, সবই উদ্ভট, কিন্তু দুলালী, তার অন্তর, যাকেই সে ভালোবাসে তারই মধ্যে তার সমস্ত সত্তার। নিবেদন– এ উদ্ভট নয়, অনির্বচনীয় পবিত্র।
আমার বিশ্বাস, দুলালী গল্পটি লেখার সময়ে লেখকের হৃদয়ের নয়– মনে ছিল একটি অস্পষ্ট মূর্তি, নব্য নারীর, স্বয়ং পুরুষের সমকক্ষ, মানসিক উৎকর্ষসম্পন্ন, শিক্ষিতা, সমাজহিতব্রতে স্বয়ং-নিযুক্ত দক্ষতায় পুরুষের তুল্য কিংবা আরও সুদক্ষ, নারীসমস্যা কথাটা যে তুলেছে এবং তোলে।
দুলালী লিখে লেখক দেখাতে চেয়েছিলেন মেয়েদের কী হওয়া উচিত নয়। জনমত বালা-চেখফকে বলেছিল, দুর্বল, একান্ত অনুগত, অনুন্নত, পুরুষসেবায় নিয়োজিত স্ত্রীদের অভিশাপ দাও। চেখফ পর্বতে উঠলেন, বেদির উপর গোবৎস এবং মেষ রেখে দেওয়া হল, কিন্তু যখন তাঁর মুখ খুলল, তখন, যাদের শাপ দিতে এসেছিলেন তাদের তিনি শোনালেন আশীর্বচন।
অনবদ্য স্বচ্ছ পরিহাসের রসে লেখা অপরূপ এই গল্পটি : তবু, এর কোনও কোনও অংশ পড়তে গিয়ে আমি অন্তত আমার চোখের জল সামলাতে পারিনি। মন ভিজেছে– কুকি, যা কিছু নিয়ে কুকি মেতে থাকে, কাঠ-ব্যবসায়ী, পশুর ডাক্তার এসবের প্রতি দুলালীর একান্ত অনুরাগ ও অভিনিবেশের বিবরণ পড়ে; আরও বেশি যখন সে একা, আর তার ভালোবাসার কেউ নেই– তখন তার যে যন্ত্রণা, তার বিবরণ, আর সবার শেষে, নারীর মাতৃত্বের যে অনুভূতি তার নিজের জীবনে সে পায়নি তার সমস্ত শক্তি এবং অপরিসীম প্রেম যখন সে নিয়োগ করে ভবিষ্যতের মানব মস্তবড় টুপি-পরা স্কুলের ছেলেটির মধ্যে, তার বিবরণ পড়ে।
লেখক মেয়েটিকে ভালোবাসলেন উদ্ভট এক কুকিনকে, নগণ্য এক কাঠ ব্যবসায়ীকে, কাঠখোট্টা এক পশুর ডাক্তারকে, কিন্তু প্রেমের পাত্র একটা কুকিনই হোক আর একটি স্পিনোজা পাস্কাল বা শিলারই হোক, প্রেমাস্পদ ঘন ঘন বদলাক– যেমন দুলালীর বেলায় অথবা চিরকাল একই থাক, প্রেম তাতে কিছু কম পবিত্র হয় না।
কিছুদিন আগে আমি নোভোয়ে ভ্রেমূইয়া কাগজে নারী সম্বন্ধে চমৎকার একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। প্রবন্ধটিতে লেখক নারীদের সম্বন্ধে অতি চতুর এবং বড় গভীর একটি মতবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, মেয়েরা আমাদের দেখাতে চেষ্টা করছে যে যা কিছু আমরা পুরুষেরা পারি, তারাও পারে। এ নিয়ে আমার বিবাদ নয়; আমরা মানতে রাজি যে, পুরুষেরা যা পারে মেয়েরাও তার সবই পারে, হয়তো পুরুষের চেয়ে ভালোই পারে। কিন্তু মুশকিল এই যে, মেয়েরা যা পারে পুরুষদের কীর্তি তার ধারেকাছেও যেতে পারে না।
ঠিক, কথাটি যে সত্য তাতে সন্দেহ নেই। এবং এটি যে শুধু শিশুর জন্মদান, লালন-পালন ও বাল্যশিক্ষার ক্ষেত্রেই সত্য তাই নয়। পুরুষ সেই সর্বাধিক উন্নত শ্রেষ্ঠ কার্যটি সাধন করতে পারে না যার দ্বারা মানুষ ঈশ্বরের নিকটতম সন্নিধানে আসতে পারে– এই কীর্তি প্রেম, প্রেমাস্পদে একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ। এটি শ্রেষ্ঠ নারী পেরেছে, পারে এবং পারবে– অতি উত্তমভাবে এবং সহজ স্বাভাবিক উপায়ে। কী হত এই জগতের যদি মেয়েদের এই ক্ষমতাটি না থাকত এবং যদি এর প্রয়োগ তারা না করত।
মেয়ে ডাক্তার, টেলিগ্রাফের কেরানি, নারী-বৈজ্ঞানিক, মেয়ে-উকিল, লেখিকা– এ সব না থাকলেও আমাদের চলত, কিন্তু যারা মানুষের মধ্যে যা সর্বোত্তম তাকে ভালোবাসে এবং সেইটিকে অগোচরে তার মধ্যে সঞ্চালিত, উদ্বুদ্ধ করে তার সহায় হয়, সেই মা, সহায়িকা, সান্ত্বনাদাত্রী– তারা না থাকলে জীবনটা বিপরীত একটা ব্যবহার হয়ে উঠত। যিশুখ্রিস্টের কাছে কোনও মগদলিনি আসত না, সাধু ফ্রান্সিসের সঙ্গে ক্লারা থাকত না, ডিসেম্বরের বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের পত্নীরা সাইবেরিয়ায় যেত না, দুখবরদের স্ত্রীরা যে তাদের স্বামীদের সত্যের জন্য আত্মদানের পথ থেকে না সরিয়ে দিয়ে বরং সেই পথেই তাদের প্রবৃত্ত করেছিল, তা-ও হত না। থাকত না সেই হাজার হাজার অজানা মেয়েরা নারীকুলশ্রেষ্ঠা এরা– অজ্ঞাতেরা চিরকালই যা হয়– যারা সান্তনা দেয় মদ্যপ, দুর্বল, উচ্ছল জনকে, প্রেমস্নিগ্ধ সান্ত্বনার প্রয়োজন যাদের সবার চেয়ে বেশি। এ প্রেম যাতেই প্রযুক্ত হোক, কুকিনে বা খ্রিস্টে, এইটেই নারীর প্রধান, মহীয়সী, অনন্যলভ্যা শক্তি।
কী প্রচণ্ড বোঝার ভুল, এইসব তথাকথিত নারীসমস্যা– যার কবলে পড়েছে শুধু মেয়ে নয়, পুরুষদেরও বেশিরভাগ। অর্বাচীন যে কোনও ধারণার কবলে এরা পড়বেই।
মেয়েদের মন চায় নিজেদের উন্নতি। এর চেয়ে ন্যায় যুক্তিসঙ্গত কথা আর কী হতে পারে?
কিন্তু স্বভাবগুণে মেয়েদের কাজ পুরুষদের কাজ থেকে ভিন্ন। অতএব মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের আদর্শ এবং পুরুষদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের আদর্শ এক হতে পারে না। মেনে নেওয়া যাক যে, মেয়েদের আদর্শ কী তা আমরা জানি না। যাই হোক সেটা, এটা নিশ্চিত যে সেটা পুরুষের চরম উল্কর্ষের আদর্শ নয়। অথচ, নারীজাতির পথকণ্টক এক শৌখিন নারী আন্দোলনের সমস্ত উদ্ভট কার্যকলাপের লক্ষ্য হচ্ছে ওই পুরুষালি আদর্শে পৌঁছানো।
আমার মনে হয়, এই ভুল বোঝার প্রভাব চেখফের ওপর পড়েছিল দুলালী লেখার সময়।
বালআমের মতো তিনি চেয়েছিলেন অভিশাপ দিতে, কিন্তু কাব্যদেবতা তাঁকে নিষেধ করলেন, আদেশ দিলেন আশীর্বাদ করতে। আশীর্বাদই তিনি করলেন এবং অজ্ঞাতে এমন অপূর্ব প্রভামণ্ডিত করলেন এই মাধুরীময়ী প্রাণীটিকে যে সে চিরকালের মতো একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইল– যে নিজে আনন্দ চায় এবং নিয়তি যাকেই তার সান্নিধ্যে আনে তাকেই আনন্দ দিতে চায়, এমন একটি নারী যে কী হতে পারে তার।
গল্পটি যে এত অপরূপ তার কারণ, এই পরিণতি পূর্বকল্পিত নয়।
.
আমি বাইসিকেল চালাতে শিখেছিলাম একটা হলঘরে। সেটা এত বড় যে তার মধ্যে একটি সৈন্যবাহিনী কুচকাওয়াজ করতে পারে। অপর প্রান্তে একটি মহিলা শিখছিলেন বাইসিকেল চড়া। আমি ভাবলাম, হুশিয়ার থাকব, ওঁর ওপর চোখ রাখলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে ক্রমেই আমি ওঁর দিকে এগিয়ে পড়তে লাগলাম। উনি বিপদ দেখে তাড়াতাড়ি পিছু হটতে আরম্ভ করলেন। তবু আমি গিয়ে পড়লাম ওঁর ঘাড়ের উপর, ধাক্কা মেরে বাইসিকেল থেকে তাকে ফেলে দিলাম অর্থাৎ যা চেয়েছিলাম তার উল্টোটাই করে বসলাম শুধু এই কারণে যে, আমার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল মহিলাটির ওপর।
চেখফেরও তাই হল, বিপরীত মুখে। উনি চেয়েছিলেন দুলালীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে, কিন্তু তাঁর কবির দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ থাকায় তিনি দিলেন তাকে তুলে।
.
এই টীকাটি পড়ার পর আর কার কী বলবার থাকে?
[চেখফ বলেছিলেন, এর চেয়ে বড় সম্মান আমি আমার জীবনে আর কী আশা করতে পারি?]।
সত্যেন্দ্রনাথ যখন একদিন দেখলেন, কবিগুরু তার একটি বাঙলা কবিতা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন (অর্থাৎ নিজের সৃজনীকর্ম মুলতবি রেখে) তখন তার হৃদয়ে কী শ্লাঘার উদয় হয়েছিল, তার কি কল্পনাও আমরা করতে পারি।
ধন্য দুলালীর প্রেম। তা সে যাকেই বাসুক না, যতবারই বাসুক না কেন। রমণীর এই প্রেমই তো জগৎকে শ্যামল করে রেখেছে।
কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয়। সহৃদয় পাঠক আমার দম্ভ ক্ষমা করবেন।
দুলালী যখন ভানিচকাকে ভালোবাসছে তখন যদি হঠাৎ ভাসিলিকে দেখে তার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে হৃদয়হীনার মতো হৃদয় খান খান করে তার প্রেমকে পদদলিত করে (ইংরেজিতে যাকে বলে তাকে জি করে) ভাসিলিকে বরণ করত তখনও দুলালীর সে-প্রেম ধন্য?
ঠাকুর-দেবতার কার্যকলাপ আমাদের সমালোচনার বাইরে। এই যে কেষ্ট-ঠাকুর রাধাকে জিট করে মথুরা গিয়ে একাধিক প্রণয় এবং শুধু তাই নয়, রাধার কানের কাছে ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে করলেন, সেগুলোও ধন্য? অথচ আমাদের হৃদয় তো পড়ে রইল শ্রীরাধার রাঙা পায়ে। শত শত বছর ধরে এই বাঙলা দেশে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিরা আপন আপন বিরহবেদনা আপন আপন পদদলিত প্রেমের নিবিড়তম পীড়া তুলে দিলেন রাধার মুখে। তাই দিয়ে মাথুর আর সেই জিনিসই পদাবলীর হৃদয়খণ্ড, –মেরুদণ্ড যে নামেই তাকে ডাকা যাক। পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা আমি পাইনিঃ শত শত বছর ধরে হাজার হাজার কবি (এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়, তার ভিতর নাকি প্রায় শ-তিনেক বিধর্মী মুসলমান কবি। ভাবলে আশ্চর্য বোধ হয়, এই অভাগিনী জিলটেড রাধার প্রেমে কী যাদুমন্ত্র লুকানো ছিল যে, শত শত বিধর্মী কবিকেও তার সামনে নতমস্তক হতে হল!) আপন আপন হৃদয়বেদনা– যার মূল্য বিশ্বাসঘাতক, প্রেমগ্ন নিরতিশয় স্বার্থপর, নীচ দয়িত দিল না– নিজের মুখে প্রকাশ না করে সর্ব বৈভব নত নমস্কারে রেখে দিল পাগলিনী শ্রীরাধার অধরোষ্ঠে। তার হয়তো একমাত্র কারণ, উপনিষদ বলেছেন, তাকে ত্যাগ করে ভোগ করবে। শ্রীরাধা প্রেম দিয়ে আনন্দ পেতে চাননি, মাতৃত্বের বিগলিত মধুরিমা, যশোদার মতো বিশ্বজয়ী পুত্রের গৌরবও তিনি কামনা করেননি। তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে ভোগ করলেন। এ ভোগ দুলালীর ভোগ নয়। এ শচীপতি ইন্দ্রের ভোগ নয়, এ শ্মশানবাসী নীলকণ্ঠের বৈরাগ্য। কিন্তু আশ্চর্য, রবীন্দ্র-সৃষ্টিতে পদদলিত প্রেমের উদাহরণ নেই। যার জন্য তাঁর বিরহবেদনা তাঁর শত শত গানে প্রকাশ পেয়েছে তিনিও কবিকে ভালোবাসেন তার প্রেমের বেদনাতে কবির মূল্য আছে- শুধু তিনি চলে গেছেন দূরে। রবিপ্রেম কখনও লাঞ্ছিত হয়নি। সে অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না।
কিন্তু এ তো একটা দিক। আমার মূল প্রশ্ন এখনও পাঠকের কাছে রইল, অতি ঘরোয়া ভাষায় শুধাই, এই যে আমাদের সোসাইটি লেডি, আজ মুখুয্যেকে জিট করে কাল সেনকে, পরশু সেনকে জিটু করে ঘোষকে– তাঁর প্রত্যেক প্রেমের জয়ধ্বনি গাইবেন টলস্টয়?
সর্বশেষে পুনরায় বিস্ময় মানি চেখফের এই গল্পটির সামনে। বিস্ময় মানি টলস্টয়ের টীকার সম্মুখে। আমাদের মতো জড় পাষাণ-হৃদয়কে বিগলিত করে বইয়ে দিল শত শত প্রশ্নধারায়।
৩ জুলাই, ১৯৬৩
[আন্তন চেখফ : The Darling and other short stories, রুশ কনস্ট্যান্স গার্নেটের তরজমা, London, Chatto & Windus, 1918]
দ্য গল
০১.
একপাল কাকের মধ্যিখানে ডাণ্ডা ছুঁড়ে মারলে যা হয়, কয়েকদিন পূর্বে ইউরোপোমেরিকায় তাই হয়ে গেল। বারোয়ারি বাজার, বারোর হাট, যুক্তহট্ট– যা খুশি বলুন– তারই দিকে তাগ করে জেনারেল শার্ল দ্য গল্ ইংরেজকে জল-চল করার বিরুদ্ধে যে ডাণ্ডাখানি হালে ছুড়লেন, তারই ফলে ইউরোপোমেরিকায় তো কা-কা রব উঠেছেই, এদেশেও কা-কা রব ছাড়িয়ে উঠছে স্বস্তির প্রশ্বাস। এ অধম অর্থনীতির খবর রাখে যতখানি নিতান্ত না রাখলেই নয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও সবিনয়ে বলব, যত দিন যাচ্ছে ততই অর্থবিদ পানডিট-দের প্রতি ভক্তি আমার কমছে।(১) মূল বক্তব্য থেকে সরে যাচ্ছি, তবু এই সুবাদে নিবেদন, এদেশের কর্তারা যে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলেন, ব্রিট বারোর বাজারে ঢুকে পড়লে ভারতীয় মাল অনায়াসে ব্রিটেনে ঢুকতে পারবে না, আমার হৃদয় সে ভয়ে কম্পিত নয়। বস্তুত আমি কাফেরের মতো বলব, এই বিলিতি তথাকথিত সুখ-সুবিধেই আমাদের সর্বনাশ করছে। দুনিয়ার সর্বত্র আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজের মাল চালাবার চেষ্টা করছিনে। আমাদের লক্ষ্মীছাড়া ক্যাপিটালিস্টরা ইংরেজের হাতে সর্বস্ব সঁপে দিয়ে লক্ষ্মীলাভ করছেন। কিন্তু ওঁদেরই-বা দোষ দিই কেন? স্বামীজির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বার বার এ নির্জন প্রান্তরে আমি চিন্তা করছিলুম, তার সবকিছুই তো অল্পস্বল্প বুঝি, তাঁর রাজযোগ আমার নিত্যপথপ্রদর্শক, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় কথা, বড় কাজ কী ছিল? যে সিদ্ধান্তে পৌঁছলুম সেটি জড়ত্বনাশ। চিন্তায়, অনুভূতিতে এবং কর্মে আমরা জড় হয়ে গিয়েছি। বিশেষ করে কর্মে। গীতায় আছে, কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নেই। আমরা গীতার ওপর আরেক কাঠি সরেস হয়ে গেলুম। বললুম, কর্মেও আমাদের অধিকার নেই।
এতকাল উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারও হুস(২) ছিল না। জগতে যারা হুশিয়ার(৩) এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিত্তও করে না। শিরোমণি-চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, বেহুশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি, হুশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।
সুপ্তি তবু ভালো। তার থেকে জাগৃতি আছে। কিন্তু জড়ত্বের কোনও ম্যাদ নেই।
এই জড়ত্বেরই অন্য শব্দ ক্লৈব্য।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ।
পণ্ডিতজিও তাই উদ্বিগ্ন হয়ে বার বার বলছেন– আমরা যেন কমপ্লেসেসের স্রোতে গা ঢেলে না দিই– ক্ষণতরে চীন এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে বলে। কমপ্লেস জড়ত্বেরই ভদ্র নাম।
আমাদের ছাত্রেরা গাইডবুক মুখস্থ করে পাস করে, আমরা–অধ্যাপকেরা ত্রিশ বছর পূর্বে কলেজে যা শিখেছিলুম তাই পড়িয়ে কর্তব্য সমাধান করি, আমাদের ধার্মিকজন কোনও এক গুরুতে আত্মসমর্পণ করে ধর্মজীবন পালন হল বলে আশ্বস্ত হন, যে-বই লিখে আমাদের সাহিত্যিক বিখ্যাত হন তিনি বার বার সেইটেরই পুনরাবৃত্তি করেন, আমাদের ফিল্ম-পরিচালকেরা একই প্লট সাতান্নবার দেখান, এবং যে ব্যবসায়ীদের কথা নিয়ে এ অনুচ্ছেদ আরম্ভ করেছিলুম– একই বাজারে বছরের পর বছর মাল পাঠিয়ে পরমানন্দে শয্যায় গা এলিয়ে দেন। নব নব সঙ্কটের অভিযানে পদক্ষেপ করার জন্য যে বিধিদত্ত প্রাণশক্তি আমাদের রয়েছে সেটা জড়ত্বের বলীকে আচ্ছাদিত।
আমাদের জীর্ণ আবেশ সুকঠোর ঘাতে কাটাবার জন্য স্বামীজি এনেছিলেন জড়ত্বনাশা মৃত্যুঞ্জয় আশা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বামীজির উদ্দাম অফুরন্ত স্বতশ্চল প্রাণশক্তি দেখে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ভয় পেয়ে বললেন, এ আমি কী গড়লুম! তাই সে ভুল শোধরাবার জন্য তাকে তাড়াতাড়ি নিজের কাছে টেনে নিলেন। শঙ্করাচার্যকে যে-রকম টেনে নিয়েছিলেন, চৈতন্যকে যে-রকম।
***
আশা করি কেউ ভাববেন না দ্য গলকে আমি চৈতন্য-স্বামীজির পর্যায়ে তুলছি : কিংবা আমি দ্য গলে মালা পরাবার জন্য উল্কণ্ঠিত হয়ে উঠেছি। স্বল্পবিস্তর নিবেদন করি।
ইংরেজের যে-রকম রাজকীয় সেন্ডহার্স্ট সামরিক বিদ্যালয়, ফরাসির তেমনি স্যাঁ সির। দ্য গল সেখানে শিক্ষালাভ করেন। ছাব্বিশ বছর বয়সে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি জর্মনদের কাছে বন্দি হন। এই সময় বন্দি অবস্থায় তিনি জর্মন ভাষা শিখে নেন। হালে তিনি জর্মনগণ কর্তৃক নিমন্ত্রিত হয়ে ওই দেশ ভ্রমণের সময় একাধিক শহরে জর্মন ভাষায় বক্তৃতা দেন। ইতিপূর্বে ফ্রান্সের কোনও রাষ্ট্রপতি জৰ্মনিতে যাননি– নেপোলিয়নের কথা বাদ দিন, তিনি গিয়েছিলেন বিজেতারূপে তার ওপর ইনি বলেছেন তাদেরই মাতৃভাষা, জর্মনরাতর। তাদের হর্ষধ্বনি বেতারে শুনেছি।
কিন্তু পুরনো কথায় ফিরে যাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে তিন ফরাসি বীর দেশের সম্মান পেতেন। ফক, জফর এবং পেতা। প্রথম দুজন মারা যাবার পর পেতাই ফ্রান্সের রক্ষণ বিভাগে সর্বদায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার বিশ্বাস ছিল, উত্তম অস্ত্রশস্ত্র সুসজ্জিত প্রকার নির্মাণই ফ্রান্স সংরক্ষণের জন্য প্রশস্ততম– ফলে কোটি টাকা খরচা করে তৈরি হল মাজিনো লাইন–বহুশত বছর পূর্বে চীনারা যে রকম দেওয়াল গড়েছিল।
দ্য গল ছিলেন পেতাঁর সহকর্মী। কিন্তু পদে পদে তিনি পেতাঁর সঙ্গে দ্বিমত। তিনি বার বার বলেছেন, এ রকম পাঁচিল তুলে জড়ভরতের মতো পিছনে বসে থাকলে আত্মরক্ষা হয় না। পেত তাঁর কথায় কান দেননি।
তার পর যখন ১৯৪০-এ ফ্রান্স নির্মমভাবে পরাজিত হল তখন সবাই বুঝল প্রাচীন যুগের দেওয়াল বাঁধার জড়ত্ব সত্য সংরক্ষণ নয়।
এইখানেই দ্য গলের মাহাত্ম্য!
.
০২.
ফরাসি বিদ্রোহ শেষ হলে পর এক ফরাসি নাগরিক জনৈক নামজাদা জঁদরেলকে শুধায়, মসিয়ো ল্য জেনারেল, এই যুগান্তকারী বিদ্রোহে আপনার কত্ৰিবিউসিয়ে– অবদান–কী ছিল? মসিয়ো ল্য জেনারেল গোঁফ মোচড়াতে মোচড়াতে সপ্রতিভ মৃদু হাস্য হেসে বলেছিলেন, পৈতৃক প্রাণটি বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি।
বাস্তবিকই তখন ঘড়ি ঘড়ি কর্ণধার বদল, এবং এক এক কর্ণধার প্রাক্তন অন্য কর্ণধারের কর্ণকর্তন করেই সন্তুষ্ট নন, কানের সঙ্গে মাথাও চান।(৫) হালে ইরাকে যা।
১৯১৮ এবং ১৯৪০-এর মাঝখানের সময়টাতে একই ধুন্ধুমার। তবে মাথা কাটাকাটি আর হত না। শুধু মন্ত্রিসভার পতন নিয়েই উভয় পক্ষ সন্তষ্ট হতেন। এবং এসব পতন সর্বক্ষণ লেগে থাকত বলে ১৯৩৮-এ এক ফরাসি কাফেতে চুকুশ চুকুশ করতে করতে বলেছিল, এই প্যারিসেই অন্তত হাজারখানেক প্রাক্তন মন্ত্রী আছেন। একটু কান পাতলেই শুনতে পাবে, পাশের টেবিলে কেউ বলেছে, কৎ জেতে ল্য মিনিন্ত্র –আমি যখন মন্ত্রী ছিলুম ইত্যাদি। তার পর সেই ফরাসি আমাকে সাবধান করে দেয়, আমি যেন বেশিদিন ফ্রান্সে না থাকি; বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ হয়তো একদিন ক্যাক করে পাকড়ে নিয়ে মন্ত্রী বানিয়ে দেবে। তার উপদেশ আমি পুরোপুরি নিইনি। তবে কাফেতে বসে প্রায়ই অজানা জনকে বলতুম, কৎ জেতে ল্য মিনিত্ত্ব– আমি যখন মন্ত্রী ছিলুম ইত্যাদি। আশ্চর্য! কারও চোখে অবিশ্বাসের আমেজ দেখিনি। ফরাসি কলোনি আলজেরিয়া থেকে কালা আদমি ভি মসিয়য়া ল্য মিনিসত্র হতে আপত্তি কী?
তা সে কথা থাক।
আসল কথা হচ্ছে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন, ইতালিয়ানে বিস্তর বই বেরোয়, ইয়োরোপের ভবিষ্যৎ কী তাই নিয়ে। এতদিন পর আমার আর ঠিক মনে নেই, তবে বোধহয় মাদাম তাবুই লিখিত একখানা বই বাজারে বেশ নাম কেনে।
ইংরেজি অনুবাদে তার নাম ছিল, পেরফিডিয়াস আলবিয়েন অর আঁতাকর্দিয়াল? বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ কিংবা তার সঙ্গে দোস্তি?
বৈঠে মেরেছি সমস্ত রাত; ভোরবেলা দেখি, বাড়ির ঘাটেই নৌকা বাঁধা। ব্যাপার কী? যে-দড়িতে নৌকা বাঁধা ছিল সেটা খুলিনি।
এ-ও তাই। দ্য গল আবার ফিরে এসেছেন যেখানে মাদাম তাবুই আপন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এই লক্ষ্মীছাড়া ইংরেজকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে পাকাপাকি কোনও দোস্তি করা যায় কি না? পূর্বেই বলেছি, দুই যুদ্ধের মাঝখানে ফ্রান্সে এতই ঘন ঘন মন্ত্রিসভার পরিবর্তন হত যে, ভেবেচিন্তে ইংরেজের সঙ্গে কোনও একটা চুক্তি– আঁতাত করা, কিংবা আরও মনস্থির করে না-করা, কোনওটাই করা যেত না। মাদাম তাবুইয়ের বিশ্লেষণ– যতদূর মনে পড়ছে- একটু অন্য ধরনের ছিল। তিনি বলেছিলেন, উভয় দেশেরই দুর্ভাগ্য যে, আমরা কোনও পাকাপাকি সমঝওতায় আসতে পারছি না। তার কারণ, আমাদের এখানে যখন গরমপন্থীরা (কনজারভেটিভ) মন্ত্রিসভা গড়ছেন, তখন বিলেতে নরমপন্থীরা (লিবারেল অথবা লেবার), এবং আমরা যখন নরম তখন ওরা গরম।
তা সে যে-কোনও কারণেই হোক, দুই যুদ্ধের মাঝখানে কোথায় না ফরাসি-ইংরেজ একজোট হয়ে বিশ্বশান্তির জন্য লিগ অব নেশনস হোক কিংবা অন্যত্রই হোক, পাকা বুনিয়াদ গড়ে তুলবে, না আরম্ভ হল দু-জনাতে খ্যাচা-খেউ। এর উদাহরণ তো মাদাম তাবুই প্রচুর দিয়েছেন। তাঁর বই বেরোনোর পরের শেষ উদাহরণ আমরা দিই। হের হিটলার যখন সগর্বে সদম্ভে রাইনল্যান্ডকে সমরসজ্জায় সাজাতে আরম্ভ করলেন তখন ফ্রান্স আর্তকণ্ঠে সেদিকে ইংরেজের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভের্সাইয়ের চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিল, জর্মন এ কর্মটি করতে পারবে না, এবং সে চুক্তির বরাত ফরাসি-ইংরেজ দু জনের ওপর ছিল। ইংরেজ সে আৰ্তরব শুনে সাড়া তো দিলই না, উল্টো দেখা গেল, সে গোপনে গোপনে হিটলারের সঙ্গে একটা নৌচুক্তি করে বসে আছে। ইংরেজের দৃষ্টিভঙ্গি এস্থলে বোঝা কঠিন নয়– তা আপনারা সেটাকে বিশ্বাসঘাতকতা পারফিডি বলুন আর না-ই বলুন। তার শক্তি জলে। হিটলার যদি তাকে কথা দেয়, সে সেখানে লড়ালড়ি করবে না, তবে চুলোয় যাক রাইনল্যান্ডের সমরসজ্জা।
তার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এল। ফ্রান্স গেল। ব্রিটেন যায়-যায়। প্রথমবারের মতো এবারও মুশকিল-আসান মার্কিন সবাইকে বাঁচাল।
কোথায় না এখন এ-দুজাত শিখবে একজোটে কাজ করতে, যাতে করে ফের না। একটা লড়াই লাগে, উল্টো দ্য গল্ লেগে গেলেন ইংরেজকে বাদ দিয়ে ইয়োররাপের ওপর সর্দারি করতে!
দ্য গলের বিশ্বাস, ইংরেজ তার সর্বস্ব বেচে দিয়েছে মার্কিনের কাছে। তাই মার্কিন ইংরেজের কাঁধে ভর করে ইয়োরোপে নেবে সেখানে সর্দারি করতে চায়। পক্ষান্তরে ফ্রান্স, লা ফ্রাস, তুজুর লা ফ্ৰাস। বাঙলা কথায়, সভ্যতা-ঐতিহ্য-বৈদগ্ধ্যের মক্কামদিনা ট্রুস। ইয়োরোপ তথা তাবৎ দুনিয়ার কেউ যদি সর্দারি করার হক্ক ধরে তবে সে ফ্রস।
তাই তিনি করতে চাইলেন জর্মনির সঙ্গে দোস্তি। তা তিনি করুন। খুব ভালো কথা। দোস্তি ভালো জিনিস।
তার পর তিনি হাত বাড়ালেন খুফের দিকে। সে-ও ভালো কথা। আমরা অন্তত আমি– রাশার শত্রু নই।
ইংরেজ চাইল, চতুর্দিকে এতসব দেদার দোস্তি হচ্ছে, সেই-বা বাদ যায় কেন? বারোয়ারি বাজারে সেই-বা ঢুকবে না কেন?
দ্য গল মারলেন ইংরেজের গালে চড়।
এখন কী হবে?
আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, ফ্রান্স যে সর্দারি করতে চাইছে তার মতো কোমরে জোর তার নেই। জর্মনির সঙ্গে তার দোস্তিও বেশিদিন টিকবে না। কারণ জর্মনি চায়, পূর্ব-পশ্চিম জর্মনির সম্মিলন। রাশা তার প্রতিবন্ধক। দ্য গলকে একদিন তার বোঝাপড়া করতে হবে। তখন হয় জর্মনি না হয় রাশাকে হারাতে হবে! তখন কোথায় রইল ইয়োরোপের ওপর সর্দারি?
———–
১. হিটলার এঁদের নিয়ে বড় মস্করা করতেন। তিনি বলেছেন, আমি যখন দেশের ভার কাঁধে নিয়ে বেকার-সমস্যা সমাধান করার জন্য কাজ আরম্ভ করলুম তখন দাড়িওলা অর্থবিদ অধ্যাপকরা ভল্যুম ভলমফ কেতাব লিখে সপ্রমাণ করলেন, দেশের সর্বনাশ হবে। যখন সমাধান করে ফেললুম, তখন ফের ভল্যুম ভল্যুম কেতাব বেরোলো যাদের মূল বক্তব্য, বলেছিলুম, তখনই বলেছিলুম, এই সমস্যার এই সমাধানই বটে। কেইনস, শাখট, শুমপেটার কজন?
২. ৩. ৪. বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলি ষড়বিংশ খঞ্জে ১৩১ পৃ. থেকে আমি উদ্ধৃত করছি। কেউ বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ স, সঙ্গে সঙ্গে হুশিয়ার এবং বেহুশ লিখলেন কেন? খনে স খনে শ? স্পষ্টত একই মূল থেকে তিনটি শব্দ তো এসেছে।
৫. ম্যাট্রিকের বাঙলা পরীক্ষায় একটি ছেলে লিখেছেন,
নৃপতি বিম্বিসার
নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা
পদ নাক কান তার
ধর্ম
প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, আজকের দিনে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় কে, ওটার কীই-বা প্রয়োজন? প্রশ্নটির ভিতরে অনেকখানি সত্য লুকানো আছে।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম তাঁর রাজত্ব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন। রাজপুত্রকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। একদা গঙ্গাস্নান পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হত বলে সেটি ধর্মের আদেশরূপে মেনে নেওয়া হত, কিংবা বলা যায়, ধর্মের আদেশ বলে সেটি পুণ্য বলে বিবেচিত হত। এখন সেটা ডাক্তারই স্ট্রংলি রেকমেন্ড করেন, এবং অধুনা বিজ্ঞানও নাকি সপ্রমাণ করেছে, গঙ্গাজলে কতকগুলি বিশেষ গুণ আছে যেগুলো অন্য জলে নেই। ধর্ম এখানে বৈদ্যের হাতে এ পুণ্যকর্ম করার আদেশ ছেড়ে দিয়েছেন, কিংবা বলা যায়, বৈদ্য সেটা কেড়ে নিয়েছে। আর কিছুটা কেড়ে নিয়েছে নিসিপ্যালিটি কোনও কোনও দেশে মুনিসিপ্যালিটিই ফরমান জারি করে, বাড়ি বানাবার সময় প্রতি কখানা ঘরপিছু একটি বাথরুম রাখতেই হবে। না হলে প্ল্যান মঞ্জুর হবে না। আহারাদিতেও তাই। ডাক্তারই বলে দেয় কোনটা খাবে, কোনটা খাবে না– অর্থাৎ কোনটাতে পুণ্য আর কোনটাতে পাপ। এবং আকছারই তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে অনুশাসন দেন। যেমন খেতে বলেন চিকেনস্যুপ–হিন্দুধর্মে, অন্তত বাঙলা দেশের হিন্দুধর্মে সেটা পাপ।
দান করা মহাপুণ্য। ধর্মের সনাতন আদেশ। কিন্তু আজকের দিনে আপনি-আমি এ অনুশাসন মেনে চলি আর না-ই চলি, সরকার কান পকড়কে তার ইনকাম এবং অন্যান্য বহুবিধ ট্যাক্স তুলে নেবেই নেবে এবং সভ্যদেশে তার অধিকাংশই ব্যয় হয় দীন-দরিদ্রের জন্য। (আজ যে মুরারজিভাই দিবারাত্র অস্তি নাস্তি ন জানাতি দেহি দেহি পুনঃপুনঃ করছেন তাতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু তিনি যদি সে পয়সা দু হাতে খরচা করে যুদ্ধের জন্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাড়ান– সঙ্গে সঙ্গে বেকার-সমস্যা অনেকখানি ঘুচবে, বেকার-সমস্যা ঘুচল বলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে তিনি যদি কষি করেন, তবেই হবে আমাদের চরম বিপদ কিন্তু এটা অর্থনীতির একটা উকট সমস্যা এবং হিটলারই সর্বপ্রথম এর সমাধান করেন দু হাতে পয়সা খরচ করে; পক্ষান্তরে অন্যান্য দেশের প্রাচীনপন্থী অর্থমন্ত্রীরা তখন দেশের দুরবস্থা দেখে আকুল হয়ে, পাছে ভবিষ্যতে আরও কোনও নতুন বিপদে পড়তে হয় সেই ভয়ে সরকারের খরচা প্রাণপণ কমিয়ে রিজার্ভ ফান্ড নামক দানবের ভুড়ি মোটার চেয়ে মোটা করতে থাকেন। তাদের দেখাদেখি ব্যাংকার সাহুকাররাও ক্রেডিট দেওয়া বন্ধ করে কিংবা কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও কমতে থাকে এবং সৃষ্ট হয় দুষ্টচক্র ভিশাস্ সারকল। সরকার ব্যাংকার টাকা দেয় না বলে দেশের উৎপাদন শক্তি বাড়ে না, আর দেশের উৎপাদন শক্তি বাড়ে না বলে সরকার খাজনা ট্যাক্সো পায় আরও কম এবং তারস্বরে চিৎকার করে, আরও ছাঁটাই কর, আরও ছাঁটাই কর।)* [*এরকম ক্রাইসিসের সময় আরও একটা মজার ব্যাপার ঘটে। ওই সময় বড় বড় প্রাচীন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যখন ব্যাংকের কাছে আরও ক্রেডিট চায় তখন ব্যাংক ভাবে, এদের বিস্তর টাকা দিয়েছি আর কত দেব? এতকালের বড় ব্যবসা নিশ্চয়ই টিকে যাবে। ব্যাংকার তখন ছোট ব্যবসাকে টাকা দেয়, পাছে তারা দেউলে হয়ে যায় এবং ব্যাংকের আগের দেওয়া সব টাকা মারা যায়। ফলে বিপদ কাটার পর দেখা যায় অনেক প্রাচীন, খানদানি ব্যবসা দেউলে হয়ে গিয়েছে, আর ছোট ব্যবসাগুলো টিকে গেছে। অবশ্য এর একটা নৈসর্গিক– অতএব দুর্বোধ্য কারণও থাকতে পারে। মহামারীতে বাড়ির রোগা-পটকাটাই যে মরে এমন কোনও কথা নয়। অনেক সময় তাগড়াটাই মরে। হয়তো মা রোগা-পটকাটারই যত্ন বেশি করেছিল বলে! ব্যাংকার বড় ব্যবসাকে যেরকম যত্ন না করে করেছিল ছোটটার!]
এই পরিস্থিতি হতে পারে বলেই ধর্ম প্রাচীন দিনে তার একটা ব্যবস্থা করেছিল।
দোল-দুর্গোৎসবে দান। এতে মহাপুণ্য।
বহুকাল পূর্বে আমি বাচ্চাদের মাসিকে একটি অনুপম প্রবন্ধ পড়ি। অসাধারণ এক পণ্ডিত সেই প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমা নির্মাণ থেকে আরম্ভ করে জমিদারকে অন্ন, বস্ত্র, ছত্র, তৈজসাদি, পাদুকা, খটু, অলঙ্কার দুনিয়ার কুল্লে জিনিস দান করতে হত। এতে করে চাষা, জোলা, ছাতাবানানেওলা, কাঁসারি, কামার, মুচি, মিস্ত্রি বস্তৃত গ্রামের যাবতীয় কুটিরশিল্প এক ধাক্কায় বহু-বিস্তর বিক্রি করে রীতিমতো সচ্ছল হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, কাঁসারি দু পয়সা পেত বলে সে ছাতা কিনত, ছাতাওয়ালার চার পয়সা হল বলে সে শাখা কিনত–ইত্যাদি ইত্যাদি, আদ ইনফিনিতুম। এবারে আর নষ্টচক্র বা ভিশাস সারক্ল নয়– এখন যাকে বলে স্পায়ারেল মুভমেন্ট— চক্রাকারে স্বর্গ-বাগে!
তার পর লেখক দুঃখ করেছিলেন, আজ যদি-বা জমিদার পুণ্য সঞ্চয়ার্থে পূর্ববর্ণিত সর্বদানই যথারীতি করেন তবু মূল উদ্দেশ্য সফল হয় না। বস্ত্র এসেছে বিলেত থেকে (তখনকার দিনে দিশি কাপড় অল্পই পাওয়া যেত), ছত্র রেলি ব্রাদার্সের, বাসনকোসন অ্যালুমিনিয়মের এবং অন্যান্য আর সব জিনিসের পনেরো আনা এসেছে হয় বিদেশ থেকে, নয় দেশেরই বড় বড় শহর থেকে (শাখা জাতীয় মাত্র দু-একটি জিনিস আপন গ্রামের কিংবা গ্রামের বাইরের কুটিরশিল্প থেকে)। মোদ্দা মারাত্মক কথা– জমিদারের গ্রাম এবং কিংবা আর পাঁচখানা গ্রাম নিয়ে যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাগোষ্ঠী (ইউনিট) সে কোনও সাহায্যই পেল না। আখেরে দেখা যাবে কোনও কুটিরশিল্পই ফায়দাদার হল না, হল শিল্পপতিরা দিশি এবং বিদেশি।
এবং লাওৎসে বলেছেন- অবশ্য বর্তমান চীনা সরকার সেটা মানে না–যখনই দেখতে পাবে বড় শহরে বড় বড় ইমারত তখনই বুঝতে হবে, এগুলো গ্রামকে শুষে রক্তসঞ্চয় করেছে। পতন অনিবার্য।
ধর্ম এখন পুণ্যের দোহাই দিয়ে দানের কথা জমিদারের সামনে তোলে না– আর জমিদারকে সে পাবেই-বা কোথায়? হয়তো তিনি শহরে থাকেন কিংবা সরকারের নতুন নীতির ফলে লোপ পেয়েছেন। তা সে যাই হোক, এ কথা তো ভুললে চলবে না, দান মাত্রই দান, পেরসে, পুণ্য নয়। গ্রাম পোড়াবার জন্য কেউ যদি দেশলাই চায় তবে আমি তো তাকে দেশলাই দান করে পুণ্যসঞ্চয় করিনে!
শিল্পের উন্নতির জন্য অর্থব্যয় করলেই যে দান হত তা নয়। জামি মসজিদ নির্মাণ করে শাহ-জাহান নিশ্চয়ই পুণ্যসঞ্চয় করেছিলেন, কিন্তু তাজ বানাতে– অর্থাৎ খাসপেয়ারা বেগম সাহেবার জন্য গোর বানাতে– কোনও পুণ্য আছে বলে ইসলাম ফতোয়া দেয় না। তাই বোধহয় পাশে মসজিদ বানিয়ে দিয়ে একটুখানি পুণ্যের ছোঁয়াচ লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু যে রাজা-বাদশা-জমিদার এসব পুণ্যকর্ম করতেন তাই নয়। বছর কুড়ি পূর্বে আমি মোটর-বাসে করে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে পাগলা গ্রামের কাছে এসে দেখি এক বিরাট মসজিদ। ড্রাইভার বলল, এক জেলে হাওর-বিলের ইজারা নিয়ে বিস্তর পয়সা জমানোর পর এ মসজিদ গড়িয়েছে*। [*ঈষৎ অবান্তর হলেও এই নিয়ে একটি সমস্যার কথা তুলি। রোজার মাসে অসুস্থ ছিল বলে একজন লোক উপবাস করতে পারেনি। এখন ঈদ পরবের পর সে রোজা রাখতে যাবে, এমন সময় সে মসজিদ (কিংবা কুয়ো, কিংবা পান্থশালা– এ সবকে সবীল-আল্লা ঐশ মার্গ, যে পথ আল্লার দিকে নিয়ে যায় বলা হয়) বানাতে চাইল। তখন প্রশ্ন, সে উপবাস করা মুলতবি রেখে মসজিদ বানাবে কি না? ভারতের মুসলমান যে মানবধর্মশাস্ত্র মানেন তাঁর মতে, রোজা পরে রাখবে। এ অনুশাসন যিনি দিয়েছেন তিনি আসলে ইরানি।]
এই বীরভূমে যে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছে তার পরোক্ষ কারণে কিছুটা পুণ্য কিছুটা স্বার্থ আছে। মহর্ষিদেব এখানে আশ্রম গড়ার সময় সর্বপ্রথম জলের চিন্তা করেছিলেন। কুয়ো তো খোঁড়াবেন, সে তো পাকা কথা, কিন্তু যদি সেটা শুকিয়ে যায়? শান্তিনিকেতনের অতি কাছে ভুবনডাঙা। রাইপুরের জমিদারবাবু ভুবনমোহন সিংহ সেখানে তাঁদের মাটি খনন করে নিচু জমির উপরে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা একটি উঁচু বাঁধ (দিঘি) পূর্বেই তৈরি করে দিয়েছিলেন। (মতান্তরে এটি রাইপুরের ঘোষালদের– এরা সিংহ পরিবারের পুরোহিত– ব্রহ্মত্র ছিল।) এই পুণ্য-স্বার্থে মেশানো বাঁধের ওপর ভরসা রেখে মহর্ষিদেব এখানে আশ্রম গড়েন।* [*অঘোর চট্টোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন আশ্রম, পৃ. ৯ ও পরবর্তী।]
এখন আর কেউ বাঁধের জন্য ধর্মের দোহাই দেয় না। এখন অন্য পন্থা। গত নির্বাচনের সময় এই বীরভূমেরই একটি গ্রাম তিনজন প্রার্থীকে বলে– সরকারের সাহায্যে বা অন্য যে কোনও পন্থায় যে প্রার্থী তাদের গ্রামে ছটি টিউবওয়েল করে দেবে তাকে তারা একজোটে দেবে ভোট!
ভাবি, কোন শ্রাদ্ধের না, কোন বাঁধের জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ধর্ম তারই সঙ্গে ভেসে যায়।
ধর্ম ও কম্যুনিজম
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশে প্রলেতারিয়ারাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক মহতী সভার অনুষ্ঠান হয়। সভার আলোচ্য বিষয়বস্তু কিংবা কর্মসূচি– এজেন্ডাও বলতে পারেন– ছিল মাত্র একটি। ভগবান আছেন কি নেই? বিস্তর তর্কাতর্কির পর স্থির হল, জনমত নেওয়া হোক, প্লেবিসিট করো।
আজকের দিনের ভাষায় আমরা যাকে বলি বিপুল ভোটাধিক্যে ভগবানের পরাজয় হল। বিপুল কেন, ভগবান অতিকষ্টে পেলেন শতকরা মাত্র একটি ভোট। ভগবান থাকলেও বোঝা গেল তাঁর পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট অতিশয় রদ্দি, তাঁর মাথুর সত্যসত্যই মথুরা চলে গিয়েছেন; জিপ, মাইক ইত্যাদির সুব্যবস্থা তার ছিল না : তার টাউটরা উভয় পক্ষের পয়সা খেয়ে শেষটায় ভোট দিয়েছে গণ্ডার আণ্ডা ফেলে দুশমন কাফিরদের সঙ্গে। তবুও হয়তো তিনি আরও দু-চারখানা বেশি ভোট পেতেন, যদি পোলিং বুথের একটু দূরে সামান্য কামুক্লাজ করে কিঞ্চিৎ ধান্যেশ্বরী গমরাজ ভদকার ব্যবস্থা রাখতেন। এসব কোনও তরিবত না করে আজকের দিনে ভোটের আশা!! তার ডিপজিটও মারা যায়। সে নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনও মে নেই। কারণ তার ম্যানিফেস্টোতে ছিল তিনি ধর্মাচারীগণকে মৃত্যুর পর স্বর্গরাজ্যে নে অর্থাৎ পোস্ট-ডেটেড চেক অন এ নন-একজিটিং ব্যাংক তবে এস্থলে নিছক সত্যের আমাদের স্বীকার করতেই হবে : গডের দুশমনরাই যে শুধু এই জিগির তুলেছিল তা নয়, কম-সে-কম পঁচিশ বছর আগে প্রাতঃস্মরণীয় আস্তিক স্বামী বিবেকানন্দ নিউইয়র্কে ব শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখেছিলেন, ‘অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখবেন–ইহা আমি বিশ্বাস করি না।’
তা সে যাই হোক, ভগবান দশচক্রে ভূত হয়ে রুশ থেকে বিদায় নিলেন।
উন্মাদ, উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ! পড় আস্তিকেরা অবশ্য বলবেন, ভোট দিয়ে ভগবানের অস্তিত্ব অথবা তদ্বিপরীত প্রমাণ করার চেষ্টা বাতুলতা। এ সেই পুরনো লোকসঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেয়,
ফুলের বনে কে ঢুকেছে
সোনার জহুরি
নিকষে ঘষলে কমল
আ মরি আ মরি ॥
আত্মার উপলব্ধির চরম কাম্য ঈশ্বর। তিন কোটি গাধা-গরু-খচ্চর একজোট হয়ে ম্যাঁ, ম্যাঁ, না, না করলেই কি তিনি লোপ পেয়ে যাবেন!
আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে রুশের এই সশস্ত্র সংগ্রাম পছন্দ করি। সংগ্রামে পরাজিত, এমনকি নিহত হলে আপাতদৃষ্টিতে ধার্মিকজনের পরাজয় হয় বটে, কিন্তু তাতে করে ধর্ম লোপ পান না। তাই যখনই হিন্দুরা তারস্বরে চিৎকার করেন, ধর্ম গেল, ধর্ম গেল, কিংবা মুসলমানরা জিগির তোলেন ইসলাম ইন ডেনজার, তখন অধমের নিবেদন, পৃথিবীর তাবৎ হিন্দু লোপ পেলেও হিন্দুধর্মের এতটুকু সত্য বিনষ্ট হবে না, তাবৎ মুসলমান মারা গেলেও শব্দার্থে লুপ্ত হবেন না। ‘ইসলামে’র শব্দার্থ, ‘সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করা।’ শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে সর্বধর্ম ত্যাগ করে তাঁরই শরণ নিতে আদেশ করছেন, তখন ওই অর্থেই করেছেন। সর্বধর্ম বলতে আজকের দিনে আমরা বুঝি different ideals, different values। আমাদের ভুল বিশ্বাস, ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ বুঝিবা একে অন্যকে contradict করে ও সবাই সত্য। তা নয়। সত্য এক। সত্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। তাই বিদ্যাপতির ভাষায় কৃষ্ণলাভ করে শ্রীরাধা বললেন, দশদিশ ভেল নিরদ্বন্দ্ব।
তাই সত্য নিরূপণার্থে দ্বন্দ্বের প্রয়োজন হয়তো হয়। কিন্তু অবহেলা ভয়ঙ্কর জিনিস।
আমার মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, রোমকরা যদি প্রথম খ্রিস্টানদের অত্যাচার না করে অবহেলা করত, মক্কাবাসীগণ যদি মহাপুরুষ ও তাঁর সঙ্গীদের নির্যাতন না করত, তা হলে কী হত?
ঊনবিংশ শতাব্দীর স্কুল-কলেজে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মকে অবহেলা করা হল। গোড়ার দিকে যখন খ্রিস্টানরা হিন্দুধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন বস্তুত হিন্দুধর্মের পুনর্জীবন লাভ হয়। ওই চ্যালেঞ্জের ফলে হিন্দুদের ভিতর আরম্ভ হল আত্মজিজ্ঞাসা– যে সতীদাহ, বহুবিবাহ, অবরোধ-প্রথা নিয়ে হিন্দু শত শত বছর ধরে আপন মনে কোনও চিন্তাই করেননি, তাই নিয়ে আরম্ভ হল তীব্র আলোড়ন আন্দোলন। আজকের দিনের ছেলে-ছোকরারা যে রকম রাজনীতি, সাহিত্য ও ফুটবল নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করে, ঠিক সেইরকম প্রায় একশো বছর ধরে চলল ধর্ম এবং সমাজ নিয়ে আলোচনা। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, সমাজে যেসব অনাচার প্রচলিত আছে, এর পিছনে ধর্মের সম্মতি নেই। তাই নিয়ে চলল কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর আলোচনা, প্রচুর আন্দোলন।
পক্ষান্তরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়–যেখানে দেশের সর্বোৎকৃষ্ট হৃদয় এবং মন একত্র হয়, সেখানে যদি ধর্ম অবহেলিত হয়, সেখানে যদি ধর্ম নিয়ে তর্ক আলোচনা না হয়, তা হলে শহরের গলিতে গলিতে এবং গ্রামে গ্রামে পুরুত-মোল্লারা পেয়ে যান প্রায় অবারিত রাজত্ব–উর্দুতে বলে, তখন তাদের ‘দোনো হাত ঘি মে ঔর গর্দান ডেগ্মে’–ডেগচির ভিতর মাথা ঢুকিয়ে তারা তখন পোলাও খায়। ধর্মের নামে তখন সমাজে জমে ওঠে কুসংস্কারের স্তূপ। বিবেকহীন রাজনৈতিকরা নেয় তার চরম সুযোগ। বারোয়ারি পূজার নাম করে তহবিল তছরুপাৎ, মা-দুর্গা চেহারা নেন ফিল্ম স্টারের কিংবা পূজাকমিটি-সেক্রেটারির লেটেস্ট গার্ল ফ্রেন্ডের। আমার চোখের সামনে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে নামলেন এক মহিলা। পেটকাটা ব্লাউজ, শাড়িখানা যেন রবারের তৈরি, সর্বাঙ্গে সেঁটে আছে– তাকাতে লজ্জা করে, লিপস্টিক-রুজের কথা বাদ দিন– কী আপদ, আপনারা জানেন, আমি কোন টাইপ মিন করছি–ইনি বাড়ির মহিলাদের নিয়ে মিলাদ শরীফ পরব করতে এসেছেন! পরে বন্ধুর স্ত্রীর কাছে শুনলাম, দোয়াদরুদ পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা টানার যে প্রয়োজন, সেটা নাকি ওই মহিলা করে উঠতে পারছিলেন না, শাড়ি ছোট, বার বার খসে পড়ছিল, বার বার হাত ওঠাচ্ছিলেন বেয়াড়া ঘোমটা দুরস্ত করতে। শেষটায় নাকি সক্কলের দৃষ্টি পড়ে রইল মোল্লানীর হাত-কসরৎ দেখার দিকে।
শুনেছি রুশের সংবিধানে নাকি আছে, ধর্মনিরপেক্ষ কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার অধিকার সর্ব কম্যুনিস্টের আছে। ফলে ওই সময়কার একখানা রুশভাষায় লিখিত ইংরেজি শিক্ষার দ্বিতীয় সোপানের পাঠ্যপুস্তকে নিম্নলিখিত কথোপকথন :
প্রথম ছাত্র : ঈশ্বর নেই।
দ্বিতীয় ছাত্র : ওটা একটা বুর্জোয়া কুসংস্কার– ভূতেরই মতো। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কাবুলে থাকাকালীন সিয়েশকফ নামক একটি পরিবার বাপ, মা, ছেলে– তিনজনাই আমার কাছে ইংরেজি পড়ত। যখন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ওই জায়গাটি এল, তখন সিয়েশকফ একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, এটা থাক। ব্যাপারটা ১৯২৭ সালের। তখনও কম্যুনিস্ট রেভলুশন হার্ডবইলড এগ হয়নি। জোয়ানদের সকলেই ইকনের সামনে বিড়বিড় করে বড় হয়েছে। আমি বললাম, থাকবে কেন? আমি তো বৌদ্ধধর্মের বই পড়ি, সেখানেও ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হয়।
তার পরে ১৯৪১-৪২ সালে রুশ যখন হিটলারের হামলায় যায়-যায়, তখন স্তালিন খুলে দিলেন বেবাক চার্চ, বিস্তর মঠ, নিমন্ত্রণ করলেন মিত্র ইংল্যান্ডের ডাঙর পাদ্রিকে। আবার গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা উঠল, হে ঈশ্বর, হোলি রাশাকে (হোলি?– তওবা, তওবা) বাঁচাও।
সেই অরণ্যের মতো জনসমাগম, ধর্মোচ্ছ্বাস দেখে স্তালিন খুশি হয়েছিলেন, না পাড় কম্যুনিস্টের যা হওয়া উচিত– ব্যাজার হয়েছিলেন, জানিনে। হয়তো-বা বিষাদে হরিষ, কিংবা হরিষে বিষাদ। কে জানে!
আমার মনে হয়, ১৭ থেকে ৪১ পর্যন্ত যদি ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করে তাকে অবহেলা করা হত, তবে বোধহয় ঠিক এতটা হত না।
ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা
শুধু এ দেশে নয়, সব দেশেই ধর্ম তার তালুক-মুলুক হারায় যখন তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়। আসলে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা তার প্রকৃত পরিচয় বাতলায় না। ধর্মনিরপেক্ষ আমরা সেকুলার শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ হিসেবে নিয়েছি, এবং সেই সেকুলার শব্দের অন্য অর্থ প্রোফেন- হিরেটিক্যালও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ সেকুলার শিক্ষাপদ্ধতি ধৰ্মবৈরী, এমনকি ধর্মাঘ্নও হতে পারে।
কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যায়তন ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে না। করলে বরঞ্চ ভালো হত। ধর্ম তা হলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো-বা জিতে যেত। কিন্তু সে সুযোগ ধর্ম পায় না–তার জয়াশা অতি অত্যল্প হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, সে ধর্মকে তাচ্ছিল্য করে, অবহেলা করে, এমনকি তার অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করে না। তার ভাবখানা অনেকটা এই : ধর্ম বাদ দিয়ে শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুই হয়, ছাত্রেরা পরীক্ষা পাসের পর যদি কাজকর্ম করে দু-পয়সা কামাতে পারে তবে ধর্ম অপ্রয়োজনীয় অবান্তর।
এক ইয়োরোপীয় বৈজ্ঞানিক যখন আঁক কষে ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দিলেন সৌরজগৎটা কীভাবে চলে তখন কে এক ধার্মিকজন শুধাল, কিন্তু তোমার সিস্টেমে তো ভগবান নেই।–উত্তরে বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন, ওঁকে বাদ দিয়েই যখন সিস্টেমটা নিটোল ত্রুটিহীন, তখন তাকে লাগাবার কী প্রয়োজন? কিন্তু ওই বৈজ্ঞানিকটি ব্যক্তিগত জীবনে কিঞ্চিৎ ধর্মভীরু ছিলেন বলে আস্তে আস্তে যোগ করলেন, কিন্তু দরকার হলে তাকে টেনে আনতাম বইকি। সে দরকার অদ্যাবধি হয়নি। সেকুলার শিক্ষাপদ্ধতি ধর্মের সেই কাল্পনিক প্রয়োজনীয়তাটুকু স্বীকার করে না।
বেদের বড় বড় দেবতা ইন্দ্র-বরুণ, এরা যে লোপ পেলেন তার কারণ এ নয় যে, কোনও বিশেষ যুগে এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে ধর্ম-সংস্কারকগণ জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আসলে মানুষ আস্তে আস্তে দেখতে পেল, প্রকৃতি তার নিয়ম অনুযায়ী চলেছে। বৃষ্টি-বর্ষণ, ফসল উৎপাদন, গোধনবৃদ্ধি ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজন এঁদের না ডেকেও সমাধান হয়। তবে বিশ্বাসীজনের কথা স্বতন্ত্র। দীর্ঘদিনব্যাপী অনাবৃষ্টি হলে এখনও তারা হোমযজ্ঞাদি করে থাকেন, বিশ্বাসী মুসলমান এখনও মোকদ্দমা জেতার জন্য মৌলা আলীর দর্গায় গিয়ে ধর্না দেয়*।[দক্ষিণ মিশরে ক্রমাগত কয়েক বৎসর বৃষ্টি না হওয়াতে একবার বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়। শহরের কাজি (চিফ জাস্টিস) সে নামাজের ইমাম (প্রধান) হবেন। ইনি ছিলেন মারাত্মক ঘুষখোর। নামাজে যাবার পথে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। কাজি যখন আল্লাকে শুকরিয়া (ধন্যবাদ) জানাবার জন্য মিম্বরে (পুলপিটে) উঠলেন তখনই, সঙ্গে সঙ্গে, বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। টীকাকার বলছেন, টিটকারির ভয়ে কাজি মসজিদের পিছনের দরজা দিয়ে পালালেন।] ভলটেয়ারকে কে যেন শুধিয়েছিল, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মারা যায় কি না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, অবশ্যই যায়। তবে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক খাইয়ে দিলে সন্দেহের আর কোনও অবকাশই থাকে না।
তা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ইন্দ্র-বরুণ চলে যাওয়ার পরে কালী-হনুমান এলেন কী করে? কুরান হদীসে যখন স্পষ্ট লেখা রয়েছে, আল্লা, মানুষকে তার ন্যায্য হক্কাহ (হ+ন+হ, অ+হক) ইনসাফের সঙ্গে বিতরণ করেন, মধ্যস্থতা করার জন্য উকিল ধরে কোনও লাভ নেই, তখন মানুষ নৌকা ছাড়ার পূর্বে বদরপীর কিংবা পুত্রলাভের জন্য সোনা গাজীর শরণাপন্ন হয় কেন?
উত্তরে পণ্ডিতেরা বলেন, অনার্যদের স্বধর্মে আকর্ষণ করার জন্য আর্যরা অনার্যদের অনেক দেবদেবীকে আপন ধর্মে স্থান করে দেন। অনার্যরা অনুন্নত। তারা ওইসব দেবীর সহায়তায় তখনও বিশ্বাস করে। যারা করে করুক, ক্ষতিটা কী? বদর পীর মৌলাআলীর বেলাও তাই। এবং সবচেয়ে মোক্ষম যুক্তি–পুরুত-মোল্লাদেরও তো খেয়ে বাঁচতে হবে। পরমে ব্রহ্মণি যোজিত চিত্তঃ তো আর পূজাপাটা করেন না, আল্লাকে যে-সাধক নূর বা জ্যোতিরূপে অনুভব করে আপন ক্ষীণ জ্যোতি-শিখা তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন–কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃসমুদ্রেই তিনি তো আর মোল্লা ডেকে শিরনি চড়ান না। তাই ঘেঁটু-মনসা মৌলাআলী সোনা গাজীর দরকার। সত্যপীর তো আরও শহর-পসন্দ, জনপদবল্লভ–উভয় ধর্মেরই বিশ্বাসীজনকে পাওয়া যায়। মোল্লা-পুরুত দুজনারই সুবিধা।
সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে এস্থলে আরেকটি প্রশ্ন তুলি। তবে কি আজ আর বেদাধ্যয়নের কোনও প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। ঋষি কবিরূপে বেদে যে মধুর এবং ওজস্বিনী ভাষায় তার উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন সেটি বড়ই মূল্যবান। বুদ্ধি দিয়ে যেটা বুঝেছি সেইটে কবিমনীষীর প্রসাদাৎ তখন হৃদয় দিয়ে অনুভব করে সম্যক অনুপ্রাণিত হই। অনুভূতির হৃদয়াবেগ তখন ধ্যানলোকে অগ্রসর হওয়ার শক্তি সঞ্চারিত করে।
এরই তুলনায়– যদিও এর চেয়ে অনেক নিম্নস্তরের একটি উদাহরণ দিই। তিক্ত অভিজ্ঞতার পর বুদ্ধি দিয়ে বুঝলুম, দুরাশা করে শুধু বঞ্চিত হতে হয়। তখন যদি কেউ এসে আবৃত্তি করে–
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনে।
তখন কেমন যেন সেই নিরাশার মাঝখানেও অনেকখানি সান্তুনা লাভ করি।
ফ্রান্স যখন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য দৃঢ়সংকল্প, তখন মাসে ইয়েজ গীতি কী অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণাই না তাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেছিল।
অনেকখানি দাগা খাওয়ার পর যখন মাইকেল আশার ছলনার কথা ভাবছেন তখন যদি কুরান শরীফের উষস্ সুরা পড়তেন তবে কি অনেকখানি সান্ত্বনা পেতেন না?
৯৩ অধ্যায়
ঊষস্
(অদ-দুহা)
মক্কায় অবতীর্ণা
(একাদশ পঙক্তি)
আল্লার নামে আরম্ভ–
তিনি করুণাময়, দয়ালু
ঊষালগনের আলোর দোহাই,
নিশির দোহাই ওরে,
প্রভু তোরে ছেড়ে যাননি কখনো
ঘৃণা না করেন তোরে।
অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো
রয়েছে ভবিষ্যৎ
একদিন তুই হবি খুশি লভি
তাঁর কৃপা সুমহৎ।
অসহায় যবে আসিলি জগতে
তিনি দিয়েছেন ঠাঁই
তৃষ্ণা ও ক্ষুধা দুঃখ যা ছিল
মুছায়ে দেছেন তাই।
পথ ভুলেছিলি তিনিই সুপথ।
দেখায়ে দেছেন তোরে।
সে কৃপার কথা স্মরণ রাখিস।
অসহায় জন, ওরে–
–দলিস নে কভু। ভিখারি-আতুর
বিমুখ যেন না হয়।
তাঁর করুণার বারতা যেন রে
ঘোষিস জগন্ময় ॥
—সত্যেন দত্তের অনুবাদ
সত্যেন দত্তের অনুবাদে আরম্ভ, মধ্য দিনের আলোর দোহাই নিশির দোহাই ওরে। অথচ আরবিতে অদ-দুহা অর্থ উষা। ইংরেজি অনুবাদের সর্বত্রই আর্লি আওয়ার অব দি মর্নিং। হয়তো সত্যেন দত্ত ভেবেছিলেন আরবের মধ্যাহ্নসূর্য অতুলনীয়। আল্লা যদি কোনও নৈসর্গিক বস্তুকে সাক্ষী ধরে দোহাই দেন, তবে তিনি মধ্যাহ্ন-সূর্যকেই নেবেন। আমাদের মনে হয় ঊষা নেওয়া হয়েছিল এই অর্থে যে, রাত্রির অন্ধকার যতই সৃচিভেদ্য এবং নৈরাশ্যজনক হোক না কেন, ঊষার আলো প্রভাসিত হবেই হবে। আল্লা এস্থলে বলেছেন, সেটা যে রকম সত্য, আমার বাক্যও তেমনি ধ্রুব।
যারা কুরান শরীফকে মেটাফরিকালি ও সিম্বলিকালি (অর্থাৎ দ্বিতীয় পক্ষে) রূপকে ব্যাখ্যা করেন (যেমন পরবর্তী ওমর খৈয়ামের মদকে ভগবৎপ্রেম অর্থে ধরেন, কিংবা ভারতচন্দ্র চৌরপঞ্চাশিকা কালী-পক্ষেও অনুবাদ করেছেন। তাঁরা বলেন এখানে প্রভাতসূর্য (ঊষস্, অ-দুহা) হজরত মুহম্মদের (দ) প্রেরিত-পুরুষরূপে আগমনের সূচনা করেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান কিন্তু কুরান শরীফকে এ রকম রূপক অর্থে নেন না।
নব-হিটলার
আত্তিলা, চেঙ্গিস, নাদির যখন রক্তের বন্যায় পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়েছেন তখন অসহায় মানবসন্তান কাতরকণ্ঠে রুদ্রকে স্মরণ করে তার দক্ষিণ মুখের কামনা করেছে, কিংবা হয়তো ভগবানকে অভিসম্পাত দিয়েছে। কিন্তু সাহস করে এ আশা করতে পারেনি, ভবিষ্যতের আত্তিলা-নাদিরকে ঠেকানো যায় কী প্রকারে?
আজ কিন্তু মানুষের চিন্তা, এমন কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে করে আবার যেন আরেকটা হিটলার দেখা না দিতে পারে? কারণ এই সুসভ্য বিংশ শতাব্দীতে হিটলার যে রক্তপাত করে গেলেন, তার সামনে খুব সম্ভব চেঙ্গিস-নাদির হার মানেন। তাই আমি যে হিটলার নিয়ে আলোচনা করি সেটা কিছু একাডেমিক ইনট্রেসট নয়– অর্থাৎ অমাবস্যার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্বডিম্বের অনুসন্ধান, সমস্যাটা শত লক্ষ নিরীহ মানুষের জীবনমরণ নিয়ে!
হিটলারকে আমি যে বিশেষ করে বেছে নিয়েছি তার দুটি কারণ আছে। প্রথমত তিনি এমন সব কীর্তিকর্ম করে গেছেন যা আত্তিলা-চেঙ্গিসের পক্ষে সম্ভব হয়নি। (সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বোধহয় রুদ্রের নবমাবতার হিটলারের পর দশমাবতার চীনের গোকুলে বাড়ছেন নেফার সংবাদ থেকে আমার এই অনুমানটি হয়েছে। এখানে সামান্য একটি উদাহরণ দিই। পাঠকদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি–অপরাধ নেবেন না–এটা অন্ধের অশ্বডিম্বের অনুসন্ধান* [*আমার শব্দগুলো ঠিক মনে নেই তবে শোপেনহাওয়ার দর্শনচর্চার বর্ণনা দিতে গিয়ে বোধহয় মোটামুটি এই বলেছেন : The search of a blind man in a dark night for a black cat, which is not there.] নয়। চেঙ্গিস-নাদির যখন কোনও শহর দখল করে পাইকারি কচুকাটার হুকুম দিতেন তখন দেখা যেত তাদের সৈন্যরা তলোয়ার দিয়ে যুবা-বৃদ্ধ-শিশুর গলা কেটে কেটে শেষটায় হয়রান হয়ে গিয়ে ক্ষান্ত দিত, শুধু তাই নয়, যুদ্ধের উত্তেজনাহীন আপন-জীবনমরণ-সমস্যাবিহীন এরকম একটানা কচুকাটা কেটে কেটে তাদের এক অদ্ভুত মানসিক অবসাদ দেখা যেত, যার ফলে নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু–পিপাসারও তো একটা সীমা আছে–বর্বরও নিস্তেজ হয়ে যেত। এ তত্ত্বটি বুঝতে হিটলারের বেশি সময় লাগেনি। হিটলার, হিমলার, হাইড্রিষ… আইষম্যান গোড়ার থেকে লক্ষ করলেন যদিও বাছাই বাছাই ব্ল্যাক-কোট পল্টনের পর-পীড়ন-উল্লাসী (স্যাডিস্ট)-দের ওপর ভার দেওয়া হয়েছিল বালবৃদ্ধবনিতা ইহুদিদের গুলি করে মারার– তারাও শেষ পর্যন্ত মানসিক অবসাদের স্নায়বিক জটিলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন হিটলার-হিমলার বের করলেন এক নয়া কল– যে কল চেঙ্গিস-নাদিরের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না, কারণ সে যুগের বিজ্ঞান তার বাল্যাবস্থায়। বিরাট একখানা অ্যারটাইট ঘরে ইহুদিদের ঢুকিয়ে দিয়ে ছাতের উপর থেকে ভেন্টিলেটারপনা ছিদ্র দিয়ে ছোট্ট একটি বিষে-ঠাসা গ্যাস ফেলে দেওয়া হত–দশ মিনিটেই ঘরের সব-কুছ বিলকুল ঠাণ্ডা। এতে করে যে গ্যাসের টিনটা ফেলল তার কোনও মারাত্মক স্নায়বিক ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।
হালে আইষম্যান সম্বন্ধে একখানা বাঙলা বই পড়েছিলুম। তাতে লেখক বলেছেন, পাঁচ লক্ষ ইহুদির প্রাণহরণের জন্য হিটলার সম্প্রদায় দায়ী। পাঁচ লাখ নয়, হবে পঞ্চাশ লাখ। ফাইভ মিলিয়ন পাঁচ লাখ নয়। হয়তো লেখক আশ্চর্য হয়ে ভেবেছেন, পঞ্চাশ লাখ কী করে হয়– এত অসংখ্য লোক মেরে ফেলা অসম্ভব পাঁচ লাখই হবে। আমরাও আশ্চর্য হই। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। একাধিক সহানুভূতিশীল এবং একাধিক নিরপেক্ষ জন বহু। গবেষণার পর যেসব গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তার থেকে দেখা যায়, আমেরিকার প্রকাশিত হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ আটাত্তর হাজার, প্যারিসের হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ ত্রিশ হাজার, লন্ডনের হিসাবে চল্লিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। অন্য আরেক হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ সাতানব্বই হাজার। নাৎসিরা যেসব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলতে পারেনি সেগুলো নরনবর্গের মকদ্দমায় মিত্রপক্ষ পেশ করেন। সেগুলো থেকে অনায়াসে চল্লিশ লক্ষের হিসাব পৌঁছনো যায় (আত্মহত্যা, অনাচার ও অকালরোগে যারা মরেছে তাদের হিসাব এতে বা অন্যান্য হিসাবে ধরা হয়নি)।
তাই আমি হিটলারকেই বেছে নিয়েছি। আমাদের সম্মুখে প্রশ্ন– এই বিরাট নরমেধ যজ্ঞ কি আবার অনুষ্ঠিত হতে পারে? কিংবা বিরাটতম?– এটম বমে যখন হাত বাড়ন্ত নয়? সে সম্ভাবনা যদি থাকে তবে আগেভাগে সময় থাকতে এমন কোনও এক কিংবা একাধিক ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে কি গ্রহণ করা যায়?
চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি, আরেক হিটলার খাড়া হয়ে উঠেছেন। এবং ইনি হিটলারেরও বাড়া। হিটলার মেরেছেন প্রধানত ইহুদিদের এবং শেষের দিকে যুদ্ধে পরাজয়ের বিভীষিকার সম্মুখীন হয়ে হন্যে হয়ে গিয়ে জর্মন জাতকে–১৩/১৪ বছরের বালকরাও বাদ যায়নি– পাঠিয়েছেন রণক্ষেত্রে, জয়ের আশা যখন সমূলে নির্মূল হয়ে গিয়েছে তখনও। আর এক চৈনিক নব-হিটলার গোড়ার থেকেই পাঠাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ চীনা যুবককে লস অব ম্যানপাওয়ারের কোনও চিন্তা-বিবেচনা না করে। আমাদের অফিসাররাই বলেছেন, ওরা নেমে আসে একেবারে পিঁপড়ের মতো। আফটার অল্ হাউ মেনি আর ইউ গোয়িং টু কিল, হাউ মেনি ক্যান ইউ কি! আমি শুনেছি কোরিয়াতেও চীনেরা এইভাবে নেমে এসেছিল। শুনেছি প্রথম সারির হাতে বন্দুক থাকে, দ্বিতীয় সারির হাতে তা-ও না। শত্রুপক্ষ প্রথম সারিকে কচুকাটা (মো ডাউন– আমি শব্দার্থে কচুকাটা বলছি, কারণ এদের ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়েছে, শুধু বন্দুক দিয়ে মেশিনগানের মোকাবেলা করতে, তাতে করে সামান্য একটা ঘাঁটি দখল করতে কত হাজার আপন সৈন্য অযথা মারা গেল বিলকুল তার কোনও পরওয়া না করে) করে ফেললে দ্বিতীয় সারি সেইসব বন্দুক তুলে নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কচুকাটা হয়। কোরিয়াতে নাকি একটা সুরক্ষিত ঘাঁটি থেকে শ-তিনেক মার্কিন সেপাই- এখানেও মেশিনগান বনাম রাইফেল– চীনাদের কচুকাটা করতে করতে শেষটায় তাদের প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে চললে কমান্ডার আদেশ দেন, ঘটি ত্যাগ করে পিছনে হটে যেতে। অর্থাৎ যেখানে লস্ অব ম্যানপাওয়ার সম্বন্ধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যুযুধান নব-হিটলার অগ্রসর হতে চান সেখানে তাঁর উপস্থিত জয় হবে, কিন্তু আখেরে সমূলস্তু বিনশ্যতি–কিন্তু অগণিত আপনজন ও বিস্তর পরজনকে মৃত্যু, অনাহার, মহামারীর কবলে তুলে ধরে ও বহু বহু গৃহে শোকের ঝঞ্ঝা বইয়ে দিয়ে।
হিটলারের একাধিক সেনানায়ক শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর বলেন, যেদিন আমি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করলুম, লস অব জর্মন ম্যানপাওয়ার হিটলার আর হিসাবে নেন না, সেদিন থেকেই আমি আত্মসমর্পণের চিন্তা আরম্ভ করি। স্তালিনগ্রাদে পাউলুস তাই করেছিলেন– যদিও হিটলারের কড়া হুকুম ছিল কচুকাটা হয়ে মরার। স্পেব কলকারখানা, পুল ধ্বংস করতে নারাজ হয়েছিলেন ও মোডেলের মতো একাধিক সেনানায়ক আত্মহত্যা বরণ করেন।
মৃত্যুর আটাশ দিন পূর্বে হিটলার কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। চীন যে একদিন মারমূর্তি ধারণ করবে সেটা তিনি জানতেন। তবে ভারতবর্ষ আক্রমণ করবে এ তত্ত্বটা তার জানা ছিল না। তিনি বলেছিলেন– From the point of view of both justice and history they (Batst) will have exactly the same arguments, or lack of arguments to support their invasion of the American continent as had the Europeans in the sixteenth century. Their vast and undernourished masses will confer on them the sole right that history recognizes the right of starving people to assuage their hunger provided always that their claim is well-backed by force.
হিটলারের এই শেষ ভবিষ্যদ্বাণী। এর পর তিনি কিছু বলে থাকলে সেটা আমাদের কাছে পৌঁছয়নি।
হিটলারের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত নই। তিনি মনে করেছিলেন, রুশ এবং মার্কিনে লড়াই লাগবে। ফলে আমেরিকা ছারখার হবে। তখন চীনারা সে দেশ দখল করবে। সেই দখল করার ভিতর অন্যায় বা অধর্ম কিছু নেই। কারণ ইতিহাস মাত্র একটি সত্য স্বীকার করে– ক্ষুধিত পঙ্গপালের মতো যে জনসমাজ কাতর সে যত্রতত্র বেদখলি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করার হক ধরে।
অর্থাৎ হিটলারের মতে ইতিহাস ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে না। আমরা করি। শাস্ত্রে আছে–
অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো দ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি।
অধর্ম দ্বারা বুদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া যায়, মঙ্গল দেখা যায়, শত্রু (সপত্ন = প্রতিদ্বন্দ্বী, সপত্নী এরই স্ত্রীলিঙ্গ এবং বাঙলায় চলিত) পরাজিত হয়, কিন্তু সমূলে বিনাশ পেতে হয়।
এই তত্ত্বকথাটি অভিজ্ঞতাপ্রসূত– আ পস্তেরিয়োরি এবং অভিজ্ঞতা থেকে নীতিসূত্র বের করা ইতিহাসের কর্ম, অথবা ইতিহাসের দর্শন (ফিলজফি অব হিস্ট্রি) এটি করে।
হিটলার ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি এমনকি রুশের বহুলাংশ জয় করতে ন্দ্র, মঙ্গল দেখেছিলেন, সপত্নগণকে পরাভূত করেছিলেন, কিন্তু বিনাশ যখন এল তখন সেটা সর্বস্ব সমূলে উৎপাটন করল।
এর আরেকটি গৌণ অর্থ আছে। আমরা যে ছোটখাটো পাপ-অবিচার করে থাকি তার জন্য এই পৃথিবীতেই অল্পস্বল্প সাজা পাই– কারণ আমরা হিটলার কিংবা লাই সায়েবের মতো ডাঙর প্রাণী নই। আমাদের বিনাশ সমূলে হয় না। কিন্তু ওদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা।
ভারতবর্ষের ইতিহাস আদ্যন্ত গৌরবময় না-ও হতে পারে, কিন্তু আমরা ক্ষুধার তাড়নায় বা অন্য কোনও কারণেই স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে পররাজ্য আক্রমণ করিনি।
বড় হিটলার, ছোট হিটলারের ডরাবার কারণ নেই।
কিন্তু বারুদ শুকনো রাখতে হবে।
নানাপ্রশ্ন
যতই বয়স বাড়ছে, কোথায় না মনের ভিতর যেসব প্রশ্ন জাগে তার সংখ্যা কমবে, উল্টো তার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এই তো কয়েকদিন পূর্বে বাঙলায় লেখা কয়েকখানি মুসলমানি কেতাব বা পুঁথি হাতে পড়ল। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্য। বিষয়বস্তু ফারসি, যদিও নায়ক-নায়িকা কোনও কোনও মূল কাব্যে আরবদেশের– ফারসির মাধ্যমে বাঙলা দেশে এসে পৌঁছেছেন। সঙ্গে এনেছেন ইরানি মেজাজ। সেটা মধুর,– আরবি কাব্যের মূল সুর দার্চ।
বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়, যেসব কবি বাঙলায় এসব কাব্য স্বাধীন অনুবাদ করেছেন এঁদের অনেকেই উত্তম ফারসি জানতেন। কেউ কেউ ভালো আরবি ও সংস্কৃত জানতেন, এবং প্রায় সকলেই তখনকার দিনের প্রচলিত বাঙলা কাব্যের ভাষা জানতেন। ছন্দও হয় পয়ার নয় ত্রিপদী। এমনকি কবিদের একজন পয়ার লিখতে লিখতে এমনই আনন্দে নিমগ্ন হয়ে গেছেন। যে, একঘেয়েমি কাটাবার জন্য যে মাঝে মাঝে ত্রিপদী ভি আমদানি করতে হয় সে বাৎ বেবাক ভুলে গেছেন এবং কাব্য সমাপ্তির পর যখন কানে জল গেল তখন কুছ কুছু ত্রিপদী-ভি* [*ইনি অবশ্য অনেক পরের কবি।– সুকুমার সেন, ইসলামি বাংলা সাহিত্য, পৃ. ১১০, ১১১ পশ্য।]-বগৃহার দিয়ে কবিধর্মের ইমান দুরস্ত রাখলেন।
তাই প্রশ্ন, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে যারা বাঙলা কাব্যে বিদেশি সুর আনলেন, তারা উত্তম ফারসি এবং আরবি শব্দ বাঙলাতে আমদানি করলেন না কেন?
দর্শনের অনুশাসনে, যে প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে তোমার কণামাত্র ধারণা নেই, যে উত্তর কোন দিক দিয়ে আসতে পারে না আসতে পারে সে সম্বন্ধে তুমি কণামাত্র কল্পনা করতে পার না, সে প্রশ্ন প্রশ্নই নয়, সে প্রশ্ন বাতিল, ইনভ্যালিড। তাই আমার মনে যে কাল্পনিক উত্তর এসেছে সে দুটির ইঙ্গিত দিই।
প্রবন্ধান্তরে বলেছি, বাঙলা দেশ চিরকালই বিদ্রোহী। এ দেশ মুসলমান আগমনের পর থেকে সুভাষ বসু পর্যন্ত একমাত্র জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেবের আমলে কেন্দ্রের অর্থাৎ দিল্লি-আগ্রার হুকুম তামিল করেছে। বস্তৃত পাঠান-মোগল প্রায় সব বাদশাকেই এ দেশে আসতে হয়েছে বিদ্রোহ দমন করতে আমরা অবশ্য বলব, আমাদের স্বাধীনতা হরণ করতে। বিশেষত বাঙলার স্বাধীন পাঠান রাজাদের আমলের তো কথাই নেই। তখন বাঙলা দেশ চীনের সঙ্গে রাজদূত বিনিময় করছে, প্রতিবেশী জৌনপুরি রাজাদের সঙ্গে কখনও লড়াই করছে, কখনও আশ্রয় দিচ্ছে, এবং জনশ্রুতি যে, বাঙলা দেশে স্বাধীন রাজা ইরানের কবি হাফিজকে বিস্তর সওগাত পাঠিয়ে দাওয়াত করেছেন এদেশে। অবশ্য নৌপথে।
এখানেই হয়তো রহস্যদ্বারের গুপ্ত কুঞ্চিকা।
স্থলপথে ইরান যাবার কথাই ওঠে না। মাঝখানে জৌনপুর, দিল্লি, লাহোর, কান্দাহার, হিরাত কত না স্বাধীন রাজত্ব! একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে হরবকৎ। নিরীহ কবি, চিত্রকর, গায়কের তো কথাই ওঠে না, ইরান-তুরানের ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধারা পর্যন্ত মেরে কেটে হয়তো দিল্লি অবধি দু-একজন এসে পৌঁছেছে, দিল্লি দূর অস্তৃ বরঞ্চ দিল্লি নজ্বদিক্ মিশওদ (দিল্লি কাছে এল), কিন্তু বাঙলা দূর অস্তৃ শুধুই নয় দূরান্তর অন্ত।
এদিকে বাঙলার স্বাধীন সুলতানদের মাতৃভাষা ফারসি নয়, ফারসি তাদের কোর্ট লেনগুইজ মাত্র এমনকি স্টেট লেনগুইজও নয়– যত দিন যাচ্ছে ততই তারা সে ভাষা ভুলে যাচ্ছেন, ওদিকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে বিদেশাগত নতুন কবি নতুন লেখক সে ভাণ্ডারের মাল নিয়ে আসছেন না, রাজদরবারেই যখন ফারসি দিনের পর দিন শুকিয়ে আসছে তখন জনসাধারণে সে ভাষা প্রচলিত ও প্রসারিত হবে কী করে?
দু-চারজন পণ্ডিতদের কথা সবসময়ই আলাদা। রামমোহন হিব্রু জানতেন, হরিনাথ দে না জানি কটা বিদেশি ভাষা সেসব দেশে না গিয়ে এমনকি সেসব ভাষার পণ্ডিতদের সংস্পর্শে না এসেও শিখতে পেরেছিলেন। অবশ্য স্বাধীন বাঙলায় তার চেয়ে অনেক বেশি আলিম-ফাজিল ছিলেন কিন্তু এদের প্রায় সকলেরই ছিল কাফিরদের ভাষা বাঙলার প্রতি গভীর অশ্রদ্ধা (ওই যুগের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদেরও বাঙলার প্রতি বিশেষ কোনও শ্রদ্ধা ছিল না)। এঁরা বাঙলায় কাব্য এমনকি ধর্মালোচনা করতেও কড়া বারণ করতেন। কিন্তু যেখানে স্টেটের খানিকটা উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ওটাকে কিছুটা উপেক্ষা করা যায়। তাই দৌলত কাজী, আলাওল, সৈয়দ সুলতান ইত্যাদি কবিদের আবির্ভাব*। [সৈয়দরা নিজেদের মহাপুরুষ মুহম্মদের বংশধর বলে দাবি করেন। মুসলমান ধর্মে যদিও সৈয়দদের বিশেষ কোনও সম্মান দেখাবার নির্দেশ নেই তবু কার্যত এঁরা অনেকটা ব্রাহ্মণদের সম্মান পান। তার কারণ অবশ্য অংশত এই যে, এদের ভিতরই ইসলামি শাস্ত্রচর্চার প্রচলন ছিল বেশি। এবং ঠিক যেরকম ব্রাহ্মণরাই শাস্ত্র বানায়, এবং শাস্ত্র ভাঙে তারাই রামমোহন বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করুন– ঠিক সেই রকম ধর্ম, সমাজসংস্কার, সাহিত্য-সৃষ্টিতেও সৈয়দের ভাঙা-গড়ার সাহস বেশি। হিন্দুর বৈষ্ণব পদাবলি রচনায় যে মুসলমান কবি সম্মানের সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন তাঁর নাম সৈয়দ মোর্তুজা।] পূর্বেই বলেছি এঁরা ফারসি জানতেন উত্তম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটিও বিলক্ষণ অবগত ছিলেন যে তাদের পাঠকমণ্ডলী, কি মুসলমান কি হিন্দু কেউই বিদেশি আরবি-ফারসির সঙ্গে সুপরিচিত নন। কাজেই আসল উদ্দেশ্য সমাধান হবে না আদপেই।
(এর সঙ্গে আজকের দিনের একটি তুলনা দিতে পারি। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে দেখি, কোনও পশ্চিমবঙ্গবাসী ঢাকার কোনও উটকো খবরের কাগজ থেকে আরবি-ফারসি মিশ্রিত বাঙলা উদ্ধৃত করে আতাঁরব ছাড়ছেন, এত বেশি আরবি-ফারসি শব্দ যদি ঢাকার লেখকরা ব্যবহার করেন তবে এক নতুন ভাষার উদ্ভব হবে এবং বঙ্কিম-রবির বাঙলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। এঁরা যদি অনুগ্রহ করে ঢাকার নিত্যকার খবরের কাগজ পড়েন, লেখকদের সাহিত্য রচনা পড়েন তবে দেখতে পাবেন ঢাকা সেই বাঙলাই লিখেছেন কলকাতা যে বাঙলা লেখে–দু-চারটি আব্বা, আম্মা, ফজরের নামাজের কথা হচ্ছে না, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি আরবি-ফারসি শব্দ আলাল হুতোমে আছে এবং তার কারণ দৌলত কাজী, আলাওলের বেলায় যা হয়েছিল তা-ই। ঢাকার উত্তম ফারসি জাননেওয়ালা লেখকও বোঝেন যে তিনি ফারসি জানলে কী, তাঁর পাঠকের অধিকাংশই যে ফারসি জানেন না। এস্থলে অবশ্য মডার্ন কবিদের মতো যারা মনে করেন, যত দুর্বোধ্য লেখা যায় ততই সুবোধ পাঠক প্রশংসা করবে বেশি, তাঁদের কথা হচ্ছে না।)।
আকবরের আমলেই প্রথম অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হয়। কিন্তু তার আগে আমার আরেকটি প্রশ্ন আছে।
ইংরেজি শব্দ যখন প্রথম বাঙলাতে ঢুকতে আরম্ভ করে তখন লেখা হয়েছিল লভ, কালেজ ইত্যাদি; আজ আমরা লিখি লাভ কলেজ। আজ আবার দেখতে পাই, স্যুটিং শুটিং, হাসপাতাল, হাসপাতাল একই শব্দ দুই বা তিন রকম লেখা হচ্ছে। তার ওপর জুটেছে এসে আরেক আপদ। ছেলে-ছোকরারা ফরাসি, জর্মন, ভাষাতে ওকিব-হাল হয়ে উঠেছে, পারি পারী এমনকি দু-আঁসলা প্যারি পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে, প্যাসনে, পশনে আরও কত কী?
দৌলত কাজী ইত্যাদি লেখকগণ মাত্রাধিক আরবি-ফারসি শব্দ বে-এক্তেয়ারভাবে গ্রহণ করেননি সত্য কিন্তু কিছু পরিমাণে তো করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন তারা আমাদেরই মতো এলোপাতাড়ি যার যা খুশি করেছিলেন, না কতকগুলো সুস্পষ্ট আইন বেঁধে নিয়ে সেগুলো যতদূর সম্ভব মানাবার চেষ্টা করেছিলেন?
যেমন মনে করুন এ যুগের মরমিয়া কবি হাসন রাজা গাইলেন–
মম আঁখি হৈতে পয়দা আসমান জমিন,
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানী দিন।
এখানে দিন-কে যদি বাঙলা দিবস অর্থে নেওয়া হয় তবে ছত্রটির কোনও ব্যাখ্যা করা যায় না। আসলে শব্দটি আরবি দীন অর্থাৎ ধর্ম! অর্থ দাঁড়াল আমার কানে এসে মুসলমানি ধর্মের খবর পৌঁছিল বলে সে ধর্ম তার অস্তিত্ব পেল, যেরকম আমি যখন আঁখি মেলে চাইলুম তখনই দ্যুলোক ভূলোকের সৃষ্টি হল। কট্টর আদর্শবাদীর (আইডিয়ালিস্ট স্কুল) মতো হাসান রাজা বলেছেন, ত্রিলোকের চিন্ময় মৃন্ময় জগৎ তাদের অস্তিত্বের জন্য আমার চিত্ত ও পঞ্চেন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করছে। আমি না থাকলে এসবের অস্তিত্ব নেই।
পুনরায় বলেছেন–
আমা হইতে আসমান জমিন, আমা হইতে সব
আমা হইতে ত্রিজগৎ, আমা হইতে রব।
এখানে রব আওয়াজ এই অর্থে নিলে সদর্থ হয় না। আরবি রব শব্দের অর্থ ভগবান। হাসন রাজা বলতে চান, আমার চৈতন্য যদি ভগবানের অস্তিত্বের কল্পনা না করত তবে তার স্বয়ম্ভু অস্তিত্বই হত না।
.
০২.
টকির কল্যাণে আমরা একটা জিনিস সম্বন্ধে সচেতন হয়েছি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। টকি আসার পূর্বে আমরা ভাবতুম, আমরা রকে বসে বেহারি মুটের সঙ্গে যে উচ্চারণে হিন্দি কথা বলি, সেইটেই অতি বিশুদ্ধ হিন্দি উচ্চারণ, এবং ক্লাসে মাস্টারমশাই যে ইংরেজি উচ্চারণে টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েন সেই উচ্চারণই অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে চালু।
পৃথিবীর সর্ব আর্য ভাষা এমনকি সেমিতি ভাষাতেও একটি ধ্বনি কথায় কথায় আসে, কিন্তু বাঙলায় (এবং ওড়িয়া, আসামিতে) নেই। ইংরেজিতে the-র ই উচ্চারণ; ফরাসিতে le-র e; জর্মনের gegeben-এর তৃতীয় e উচ্চারণ; আরবি, ফারসি, হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিতে কলমফ শব্দে ক এবং ল-এর মধ্যে ল এবং ম-এর মধ্যে যে উচ্চারণ আছে, সেটি বাঙলাতে নেই।
সোজা কথায় হিন্দির আমি বা আমরা বলতে যে হম শব্দটি আছে তার হ এবং ম-এর মাঝখানে যে ধ্বনিটি আছে সেটা আমাদের কেউ শুনেছেন অ এবং তাই লিখেছেন হ এবং অধিকাংশই শুনেছেন আ এবং তাই লিখেছেন হাম। এ যুগে সচেতন হয়ে আমাদের অনেকেই লিখতে আরম্ভ করেছেন হ্যম। (উপস্থিত আমরা এই ধ্বনিটির নাম দিলুম অস্পষ্ট স্বর)।
দৌলত কাজী, আলাওলের সামনে সর্বপ্রথম এই অস্পষ্ট ধ্বনি নিয়েই এল সমস্যা। কলমফ জবরদস্ত, মক্কা, মদিনা ধরনের অসংখ্য আরবি-ফারসি শব্দে আছে এই অস্পষ্ট ধ্বনিটি: এটাকে প্রকাশ করেন কোন চিহ্ন দিয়ে? কলম, না কালাম, না কল্যম (আজকে পূর্বোল্লিখিত হ্যম-এর মতো)?
আলাওলরা অনেকেই সংস্কৃত জানতেন, এবং এটিও জানতেন যে সংস্কৃতে এ ধ্বনিটি আছে বটে, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ করে অ রূপে। যেমন সংস্কৃতে কমল শব্দের ক এবং ম-এর মাঝখানে আছে সেই অস্পষ্ট স্বর, কিন্তু বাঙালি সেই অস্পষ্ট ধ্বনির পরিবর্তে কমল উচ্চারণ করে অ দিয়ে, অর্থাৎ বাঙলা শব্দ ঘর উচ্চারণ করতে যে অ উচ্চারণ করি সেই অ দিয়ে।
তাই তাঁরা মনে মনে আন্দেশা করলেন, সংস্কৃতের কমল এবং আরবি-ফারসির কলমে যখন একই উচ্চারণ এবং এই ধ্বনি প্রকাশের সময় বাঙলায় কোনও পরিবর্তন না করাই ভালো। অবশ্য তারা কলমফ না লিখে কালাম লিখতে পারতেন (আজকে যে রকম কেউ কেউ হদিস না লিখে হাদিস লেখেন, বরকৎ না লিখে বারাক লেখেন) কিন্তু তা হলে বিপদ হত যে, দীর্ঘ আ-কার-যুক্ত কালাম নামক যে ভিন্ন শব্দ আছে সেটার অর্থ বাণী– (আবুল কালাম আজাদ-এর অর্থ বাণীর পিতা, যিনি স্বাধীন) সেটাতে এবং লেখনীতে (অর্থাৎ কলম-এ) যে পার্থক্য আছে সেটা আর লেখাতে দেখানো যেত না।
অবশ্য তাঁরা কালাম (কলমের জন্য, এবং কালাম বাণীর জন্য) লিখতে পারতেন কিন্তু সেটা করতে গেলে অন্যান্য নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয় এবং সে দীর্ঘ আলোচনার জন্য এ স্থলে স্থানাভাব।
এই আইন তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু বাঙালি কীভাবে অ এবং আ উচ্চারণের ভিতর পার্থক্য করে সে সম্বন্ধেও বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন বলে একটি ব্যত্যয় তারা করে দিয়েছিলেন। আরবি-ফারসি শব্দের আদ্যক্ষরে আলিফ, আয়েন, বা হে থাকলে সেখানে আ ব্যবহার করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তাই অল্লা অহমদ না লিখে লিখেছেন আল্লা, আহমদ; অব্দুলের বদলে আব্দুল এবং হমিদের হসেনের পরিবর্তে হামিদ হাসেন।
দ্বিতীয় সমস্যা ছিল দীর্ঘ-হ্রস্ব নিয়ে। সংস্কৃত দিন এবং দীন উচ্চারণে, কুল এবং কূল উচ্চারণে আমরা কোনও পার্থক্য করি না, এমনকি সংস্কৃত পড়ার সময়ও না। তাই তাঁরা স্থির করলেন যে, বাঙলাতে আরবি-ফারসি শব্দ লেখার সময় তারা সব শব্দই হ্রস্ববর্ণ দিয়ে লিখবেন। কাজেই আরবি ধর্ম অর্থে দীন শব্দ যদিও দীর্ঘ উচ্চারণে আছে তবু তারা বাঙলাতে দিন-ই লিখলেন, এবং ঠিক সেইমতো নূর রসূল না লিখে নুর রসুল লিখলেন।
তৃতীয় সমস্যা, সংস্কৃতে শ, ষ, স-এর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ। আমরা বাঙলাতে তিনটিকেই এক উচ্চারণ শ অর্থাৎ sh-এর মতো করে থাকি। শুধু সংযুক্তের বেলা এবং অন্যান্য কোনও কোনও স্থলে ইংরেজি s-এর উচ্চারণ, অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃত স-এর উচ্চারণ করে থাকি। মস্তক, পুস্তক, আস্তে, শ্রাবণ, প্রশ্ন ইত্যাদিতে আমরা শ উচ্চারণ না করে স, অর্থাৎ sh না করে s করে থাকি। আরবি-ফারসিতে আছে চার রকমের ওই ধরনের উচ্চারণ। মুসলমান আদি-লেখকেরা বাঙলা উচ্চারণপদ্ধতি মেনে নিয়ে একটি স দিয়েই সব কারবার চালাবার চেষ্টা করেছেন। তবে পুব বাঙলায় ছ অক্ষর স-এর মতো উচ্চারিত হয় বলে মাঝে মাঝে (পরবর্তী যুগে এবং আধুনিককালে আকছারই) ছ এসে স-এর স্থান নিয়েছে।
এ আলোচনার সর্বশেষে কিন্তু নির্ভয়ে একটি কথা বলা যেতে পারে। মুসলমান আদি-লেখকেরা বাঙলা উচ্চারণকে পরিপূর্ণ সম্মান দিয়ে তারই রীতিনীতি মেনে নিয়েছিলেন। উদ্ভট বিদকুটে বানান লিখে নতুন নতুন ধ্বনি আমদানির বন্ধ্যাগমন করেননি। আরবি-ফারসি শব্দের বাঙলা বানানে প্রথম ভূতের নৃত্য আরম্ভ হল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ১৯৩৬ সালে বাঙলা বানান নিয়ন্ত্রণ ও সরল করতে চাইলেন। কিন্তু সে আলোচনা অতিশয় দীর্ঘ হয়ে পড়বে, আমার জ্ঞানও অতিশয় সীমাবদ্ধ এবং তদুপরি আমার বিলক্ষণ জানা আছে, এ আলোচনায় অধিকাংশ পাঠকেরই কোনও উৎসাহ নেই। তবু যে আমি করছি, তার কারণ, বাঙলা বানানের অরাজকতার মাঝখানে একথাও সত্য যে বাঙলার একাধিক তরুণ নানা ভাষার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে নানা শব্দ ও ধ্বনির প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। তাঁরা যদি এসব বিষয়ে গবেষণা করেন তবে আমার নানা প্রশ্নের কিছুটা উত্তর আমি হয়তো পাব।
এটা অবশ্য একেবারে সম্পূর্ণ নতুন নয়। গত শতাব্দীর শেষের দিকে বানানের অরাজকতা দূর করার জন্য সাহিত্য-পরিষদ(?) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে(?) অনুরোধ করেন, তিনি ওই সম্বন্ধে নির্দেশ দেন। আমার যতদূর জানা আছে, তিনি সে কার্য শেষ করে উঠতে পারেননি। আমার এ মন্তব্যে ভুল থাকতে পারে, কারণ সমস্ত জিনিসটা আমার আবছা-আবছা মনে আছে।
শেষ প্রশ্ন :
বাঙলা বাক্যগঠন, পদবিন্যাস অর্থাৎ সিনটেক এল কার অনুকরণে?
ফারসিতে বলি, চুন (যখন) পাদশা (বাদশা) মরা (আমাকে) দীদ (দেখলেন) উনহা (উনি) গুফত (বললেন) তু (তুই) কুজা (কোথায়) মীরওয়ী (যাচ্ছি)?
হুবহু একই সিনটেকস?
ফারসি থেকে?
এবং সবশেষে প্রশ্ন :
আমরা যে গোটা গোটা বাঙলা লেখার সময় এবং সাইন-বোর্ডে বাঙলা অক্ষরের কোনও জায়গায় মোটা কোনও জায়গায় সরু করি সেটা এল কোথা থেকে? ফারসি লেখার কলমফ (আমাদের প্রাচীন লেখনী বা লোহার স্টিলো না–) ব্যবহার করেছিলুম বলে?
প্রিন্স গ্রাবিয়েলে দা’ন্নুনদজিয়ো
গ্রিকের উত্তরাধিকারী লাতিন। লাতিন তার অনুপ্রেরণা, প্রাণরস, কলাসৃষ্টির আদর্শ ও তাকে মৃন্ময় করার পদ্ধতি সবকিছুই নিয়েছে গ্রিক থেকে। বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যও সংস্কৃতের এতখানি পদাঙ্ক অনুগমন করেনি। বরঞ্চ বলব উর্দুর সঙ্গে ফারসির যে সম্পর্ক, লাতিনের সঙ্গে গ্রিকের তাই। অহমিয়ারা যদি রাগ না করেন তবে বলব, বাঙলা ও অহমিয়ার মধ্যে ওই সম্পর্কই বিদ্যমান, যদিও বাঙলার মৃত্যু হওয়ার পর অহমিয়া তার উত্তরাধিকারী হয়নি বাঙলা তার উৎকর্ষের এক বিশেষ চরম স্তরে পৌঁছনোর পর অহমিয়া তার রস-সৃষ্টিতে বাঙলা সাহিত্যকে তার আদর্শরূপে ধরে নেয় (এখানে বুরুঞ্জী বা দলিলদস্তাবেজের গদ্যের কথা হচ্ছে না)।
বহুশত বছর ধরে লাতিন পাশ্চাত্যভূমির সর্ব চিন্তা সর্ব অনুভূতির মাধ্যম ছিল। এমনকি লাতিনের উত্তরাধিকারী ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষা পূর্ণ সমৃদ্ধি পাওয়ার পরও এমনকি এত শতাব্দীতেও, ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা, যখনই চেয়েছেন যে তাবৎ ইয়োরোপ তাঁদের রচনার ফললাভ করুক তখনই তারা আপন আপন মাতৃভাষা– জর্মন, ফরাসি ইত্যাদি না লিখে লিখেছেন লাতিনে। ইবন খলদুনের (ইনি মার্কসের বহু পূর্বে ইতিহাসের অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন) আরবি পুস্তকের অনুবাদক মাতৃভাষা ব্যবহার না করে খলদুনের মোকদ্দমা– প্রলেগমেনন অনুবাদ করেছেন লাতিনে। এ শতাব্দীতেও জলালউদ্দীন রুমির ফারসি থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করার সময় ইংরেজ তথাকথিত অশ্লীল অংশগুলো অনুবাদ করেছেন লাতিনে উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্কের হাতে এ বই পড়লে তারা যেন বুঝতে না পারে।
খাস লাতিনের জন্মভূমি ও লীলাস্থল যদিও ইতালিতে এবং ইতালীয় সাহিত্যের অতি শৈশবাবস্থায়ই দান্তের মতো অতুলনীয় মহাকবির আবির্ভাব, তবু কার্যত দেখা গেল লাতিনের অন্য উত্তরাধিকারী ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য যেন তাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, ইতালীয়রা তখন শুধু সাহিত্য নয়, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারুশিল্পেও আপন সৃজনীশক্তির বিকাশ করছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্যারিস ক্রমে ইয়োরোপের কলাকারদের মক্কা হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময় রুশের তুর্গেনিয়েফ, জর্মনির হাইনে, পোল্যান্ডের সঁপা, এমনকি ইতালির রসসিনি– এঁরা সকলেই প্যারিসে বসবাস করতেন।
এর পরই ফরাসিতে যাকে বলা হয় ফাঁ দ্য সিয়েক শতাব্দীর সূর্যাস্ত।
দানুনদজিয়ো খ্যাতিলাভ করেন ওই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে–কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকাররূপে এবং কর্মযোগী–ফিউমের রাজারূপে তিনি খ্যাতির চূড়ান্তে ওঠেন ১৯১৯-এ, অর্থাৎ আমাদের শতাব্দীতে। আরবি ভাষায় এঁদের বলা হয় জু অল করনেন–দুই শতাব্দীর অধিপতি।
বহু রাগরঙ্গে রঞ্জিত বৈচিত্র্যপূর্ণ এর জীবন। স্কুলে থাকাকালীন তিনি তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করে রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে রোমে এসে ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য তিন ক্ষেত্রেই তিনি অতুলনীয় বলে স্বীকৃত হলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পদাতিক, নৌবাহিনী ও বিমানবহরে সর্বত্রই সমান খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে বিমান পরিচালনায়। আজ যেটাকে স্ট্যান্ট ফ্লাইং বলা হয়, তার প্রধান পথপ্রদর্শক দানুনদজিয়ো। অমর খ্যাতির জন্য তাঁর এমনই অদম্য প্রলোভন ছিল যে, তার জন্য তিনি সর্বদাই প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার পর মিত্রশক্তি যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিউমে বন্দরকে ইতালি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেন, তখন কবি দানুনদজিয়ো তার রুদ্রতম রূপ ধারণ করলেন। ফিউমে বন্দর দখল করে তিনি সেখানে এক রাজ্য স্থাপন করে নিজেকে অধিপতি রূপে ঘোষণা করলেন। কবি, সৈনিক, নেতা তিন রূপেই তিনি স্বপ্রকাশ হলেন। মাত্র ১৫ মাস তিনি সেখানে রাজত্ব করেছিলেন বটে, কিন্তু ইতালির লোক আজও তাকে ফিউমের বীর, জাতির গর্বরূপে স্বীকার করে।
প্রেমের জগতেও দানুনদজিয়ো অভূতপূর্ব কীর্তি রেখে গেছেন। লোকে বলে, তিনি নাকি একসঙ্গে পাঁচটি রমণীর সঙ্গে প্রেম করতে পারতেন। একসঙ্গে পাঁচসেট প্রেমপত্র লিখেছেন (কু-লোকে বলে, সেক্রেটারিকে ডিটেট করতেন এবং প্রত্যেক সেটই একেবারে অরিজিনল, অন্যান্য সেট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস লে ভেজিনি দেল্লে রক্কে গিরিকুমারীত্রয়-এ। সেখানে উপন্যাসের নায়ক কিছুতেই মনস্থির করতে পারলেন না, তিন নায়িকা, আনাতোলিয়া, ভিয়েলান্তে, মাসসিমিল্লা, কাকে তিনি বরণ করবেন। এ উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, তার পক্ষে একই সময়ে এই তিনজনকে তিন ধরনের প্রেমপত্র লেখা মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ এই তিন বোনের চরিত্র তিনি এমনই অদ্ভুত কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন, দৃঢ় রেখায় অঙ্কন করেছেন যে, প্রত্যেকটি চরিত্র আপন মহিমায় স্বপ্রকাশ। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তিন ধরনের প্রেমপত্র লেখা চারুশিল্পী দানুনদজিয়োর পক্ষে অসম্ভব তো নয়ই, খুবই সহজ বলতে হবে।
দানুনদজিয়ো চরিত্র বুঝতে ভারতবাসীর খুব অসুবিধা হয় না। কিছুদিন পূর্বেও আমরা পরাধীন ছিলুম। আমরা যদি হটেনটট বা বন্টুর মতো ঐতিহ্য-সভ্যতা-সংস্কৃতিহীন জাত হতুম, তা হলে আমাদের অপমানবোধের বেদনা এতখানি নির্মম হত না। ফ্যা দ্য সিয়েলে ইতালি স্বাধীন বটে, কিন্তু সে তখন তার গৌরবময় নেতার আসন ছেড়ে দিয়েছে ফ্রান্স, জর্মনি, ইংল্যান্ডকে। এমনকি যে অন্নবস্ত্র সমস্যা তাকে তখনও (এখনও) কাতর করে রেখেছে সেটাকে ঐতিহ্যহীন সুইটজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে ততদিনে সমাধান করে ফেলেছে। জাত্যাভিমানী স্পর্শকাতর ইতালীয় মাত্রই যখন দেখত প্রতি বছর হাজার হাজার ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন তার প্রাচীন কীর্তিকলা দেখবার জন্য রোম নেপলস্ ভেনিস পরিক্রমা করে, গ্যেটে-বায়রন কেউই বাদ যান না(১) এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখে ছিন্নবস্ত্র, নগ্নপদ আপন ইতালীয় ভ্রাতা, এদের কাছে ভিক্ষা চাইছে, তখন ঐতিহ্যচেতন ইতালিয়ার মরমে মরাটা কি হৃদয়ঙ্গম করাটা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন? দানুনদজিয়ো তার দেশকে ভালোবাসতেন শুধু তার পূর্ব গৌরব, প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্যই নয়, তার সদাজাগ্রত পঞ্চেন্দ্রিয় অহরহ তাকে সচেতন রাখত দেশের অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে। ভেনিস দেখে বহু দেশের বহু কবি আপন মাতৃভাষায় তার প্রশস্তি গেয়েছেন, কিন্তু দানুনদজিয়োর উপন্যাস ইল ফুয়োকো অগ্নিশিখা, ফ্লেম অব লাইফে– তাঁর যে বর্ণনা এবং দরদবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, সে জিনিস ইতালীয় সাহিত্যে অতুলনীয় তো বটেই, অন্য সাহিত্যেও আছে কি না সন্দেহ অন্তত আমার চোখে পড়েনি।
ইয়োরোপে রেনেসাঁস যারা আনয়ন করেন, তাঁদের শেষ প্রতিভূ দানুদৃজিয়ো, মাঝখানে কত শত বছরের ব্যবধান, তবু তাঁর লেখা পড়ে মনে হয় এবং যারা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তারা বলেছেন, তার কথাবার্তা শুনে মনে হত– তিনি কী স্বচ্ছন্দে রেনেসাস সৃষ্টিকর্তা অতিমানবদের মধ্যে বিচরণ করেছেন। ওদিকে তিনি নিজেও মনে করতেন যে, তিনি প্রাচীন গ্রিক ক্লাসিসের পরবর্তী পুরুষমাত্র। একটি ফোয়ারার বর্ণনা দিতে গিয়ে দানুদৃজিয়ো সে ফোয়ারার পাথরে খোদাই কতকগুলো লাতিন প্রবাদ তুলে দিয়েছেন। লাতিন অনেকখানি পড়া না থাকলে এরকম একটি অনবদ্য সঙ্কলন অসম্ভব।
কর ত্বরা, ওগো
তোল ফুলগুলো
ভরা মধু গন্ধে।
পলাতকা ঐ
মুহূর্তগুলির
পরা নীবিবন্ধে ॥
PRAECIPITATE MORAS,
VOLUCRES CINGATIS,
UT HOBAS NECTITE FORMOSAS, MOLLIA SEATA, ROSAS
Hasten, hasten! Weave garland of fair roses to girdle the passing hours.
সেই ফোয়ারার জল নিচের আধারে জমেছে; সে বলছে :–
জীবন সলিল
পান করিবে কি?
এ যে বড় মধুভরা–
আঁখিজলে করো
লবণসিক্ত
তবে হবে তৃষা-হরা ॥
FLETE HIC OPTANTES NIMIS ESS ACQUA DULCIS AMANTES SAL SUS, UT APTA VEHAM, TEMPERE HUMOR EAM.
Weep here, ye lovers who come to slake your thirst. Too sweet is the water. Season it with the salt of your tears.
গ্রিক এবং লাতিন থেকে তিনি নিয়েছিলেন তার ভাষার অলঙ্কার। আজ যদি বাংলাতে কেউ পদে পদে কালিদাস-শূদ্রকের মতো উপমা ব্যবহার করতে পারেন এবং সে তুলনাগুলো হয় এ যুগের বাতাবরণেই– কারণ দানুদৃজিয়ো ক্লাসিসে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও নিশ্বাস নিতেন বর্তমান যুগের আবহাওয়া থেকে তা হলে তার সঙ্গে দানুনদজিয়োর তুলনা করা যাবে। এ যুগের লেখকদের মধ্যে প্রধানত নিৎশে, শোপেনহাওয়ার, দস্তেয়ফস্কি এবং সুরকারদের মধ্যে ভাগনার তার ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তাই একদিক দিয়ে দেখতে গেলে অতিমানব, সুপারম্যান বা ঝুবারমেনশের যে ধারণা ফিষটে দিয়ে আরম্ভ হয় এবং কার্লাইল, মাজিনি হয়ে নিৎশেতে পৌঁছয়– যার সাহায্যকারী ছিলেন ট্রাইশকে, কিপলিং, হাউস্টন, চেম্বারলেন এবং বেৰ্গসো– দানুনদজিয়ো এদেরই একজন। এরা সকলেই যে সুপারম্যান চেয়েছেন তা নয়। কেউ কেউ চেয়েছেন সুপাররেস শ্রেষ্ঠ জাতি, যেমন হিটলার চেয়েছিলেন হেরেন-ফলক প্রভুর জাত– কেউ কেউ চেয়েছেন সুপারস্টেট।
রাসল বলেন, তবু ফিষটে, কার্লাইল, মাদৃজিনিতে মুখের মিষ্টি কথায় কিছুটা নীতির দোহাই আছে, কিন্তু নিৎশেতে এসে তা-ও নেই।(২) সেখানে উলঙ্গ রুদ্ররূপে সুপারম্যানের আপন শক্তিসঞ্চয়ই সর্বপ্রধান কর্তব্য, স্বধর্ম। হিটলারের গ্যাস চেম্বার তারই এক কদম পরে।
আমার মনে হয়, দানুনদজিয়ো এসব কউরের সমধর্মী নন। তাঁর ভিতরকার আর্টিস্টই বোধহয় তাঁকে সে বর্বরতা, নৃশংসতা থেকে বাঁচিয়েছে। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে রসিক প্রতি মুহূর্তে পঞ্চভূতকে নিঃশেষে শোষণ করেছে, যার রচনার প্রতিটি ছত্রে প্রতিটি শব্দে রূপরসগন্ধস্পর্শ ধ্বনির সমাবেশ, তুলনাব্যঞ্জনা মধুরতম সামঞ্জস্য যার অব্ৰণ-নিটোল সুডৌল নির্মাণপদ্ধতিতে সে সৃষ্টিকর্তাকে কোনও বিশেষ পর্যায়ে ফেলা যায় না।
দানুনদজিয়োর সৃষ্টিতে আমি যদি কোনও ক্রটি লক্ষ করে থাকি তবে সেটা মাধুর্যের অতিরিক্ততায় কাদম্বরীতে যেরকম।(৩)
————
১. এবং এ যুগে–
ইটালিয়া
কহিলাম, ওগো রানি,
কত কবি এল চরণে তোমার উপহার দিল আনি।
এসেছি শুনিয়া তাই,
ঊষার দুয়ারে পাখির মতন গান গেয়ে চলে যাই।
—রবীন্দ্রনাথ, পূরবী।
পক্ষান্তরে ইতালীয় কবি ফিলিকাজা গেয়েছেন–
ইতালি, ইতালি! এত রূপ তুমি
কেন ধরেছিলে হায়!
অনন্ত ক্লেশ লেখা ও-ললাটে
নিরাশার কালিমায়।
—সত্যেন দত্তের অনুবাদ
(Italia, Italia, o tu cui feo la sorte)
২. বাট্রান্ড রাসল- দি এনসেস্ট্রি অব ফ্যাসিজম। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস দেবপ্রিয় বিধিদত্ত সকলের সেরা জাতের ধারণা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইহুদিরাই সৃষ্টি করে। সে ধারণার দলিলে বাইবেল ভর্তি। খ্রিস্ট তার প্রতিবাদ করেন।
৩. প্রিন্স গ্রাবিয়েলে দানুদৃজিয়ো–১২ মার্চ, ১৮৬৩১ মার্চ, ১৯৩৮।
বিষের বিষ
আগা আহমদের প্রাণ অতিষ্ঠ। একফোঁটা মেয়ে তার বউ মালিকা খানমটা, ফুঁ দিলে উড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু সেই যে সাতসকাল ভোরবেলা থেকে ক্যাট-ক্যাট আরম্ভ করে তার থেকে আগা আহমদের নিষ্কৃতি নেই। মিনষে, হাড়-হাভাতে, ড্যাকরা– হেন গাল নেই যেটা আগা আহমদকে দিনে নিদেন পঞ্চাশবার শুনতে হয় না। আর গয়নাগাটি নিয়ে গঞ্জনা– সে তো নিত্যিকার রুটি-পনির। এবং সেই সামান্য রুটি-পনিরটুকুও যদি ভালো করে আগা আহমদের সামনে ধরত তবুও নাহয় সে সবকিছু চাঁদপানা মুখ করে সয়ে নিত, কিন্তু সে রুটিও অধিকাংশ দিন পোড়া, এবং পনিরের উপরে যে মনে পড়েছে সেটা চেঁচে দেবার গরজও বিবিজানের নেই। আগা আহমদ দিনমজুর; খিদে পায় বড্ডই।
ব্যাপারটা চরমে পৌঁছল বিয়ের বিশ বছর পর একদিন যখন আগা আহমদ কী একটা খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল, মালিকা খানম নিজের খাবার জন্য লুকিয়ে রেখেছে মুরমুরে রুটি, ভেজা-ভেজা কাবাব, টনটনে সেদ্ধ ডিম এবং তেল-তেলে আচার!
সে রাত্রে আগা আহমদ খেল না। বউ ঝঙ্কার দিয়ে বলল, ও আমার বাব-পুতুর রে– রুটি-পনির ওয়ার রোচে না। কোথায় পাব আমি কাবাব আণ্ডা আমার আগাঁজানের জন্যে–
সেই কাবাব আণ্ডা! যা বউ নিজে খেয়েছে!
স্থির করল ওকে খুন করবে। নতুন করে তালাক দিয়ে লাভ নেই। অন্তত একশো বার দেওয়া হয়ে গিয়েছে। মালিকা খানম মুখ বেঁকিয়ে আপন কাজে চলে যায়। ওরা থাকে বনের পাশে পাড়া-প্রতিবেশীও কেউ নেই যে মালিকা খানমকে এসে বলবে, তোমার স্বামী যখন তোমাকে তালাক দিয়েছে তখন তার পর ওর সঙ্গে সহবাস ব্যভিচার। আর থাকলেই-বা কী হত? কেউ কি আর সাহস করে আসত? আগা আহমদের মনে পড়ল গত পনেরো বছরের মধ্যে কেউ তাদের বাড়িতে আসেনি।
শুয়ে শুয়ে সমস্ত রাত ধরে আগা আহমদ প্ল্যান করল, খুন করা যায় কী প্রকারে।
সকালবেলা বনে গিয়ে খুঁড়ল গভীর একটা গর্ত। তার উপর কঞ্চি কাঠ ফেলে উপরটা সাজিয়ে দিল লতাপাতা দিয়ে।
বিকেলের ঝেকে বউকে বলল, গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু বেড়াতে যাবে?
বউ তো খলখল করে হাসল চোচা দশটি মিনিট। তার পর চেঁচিয়ে উঠল, কোজ্জাবো মা–মিনষের পেরাণে আবার সোয়াগ জেগেছে!
আগা আহমদ নাছোড়বান্দা। বহু মেহনত করে গা-গতর পানি করে গর্তটা তৈরি করেছে।
বউ রাজি হল। বেড়াতে নিয়ে গেল বনে। কৌশলে বউকে স্টিয়ার করে করে গর্তের কাছে নিয়ে গিয়ে দিল এক মোক্ষম ধাক্কা। তার পর ফের বাঁশ-কঞ্চি লতাপাতা সহযোগে গর্তটি উত্তমরূপে ঢেকে দিয়ে আগা আহমদ তার পীর-মুরশিদকে শুকরিয়া জানাতে জানাতে বাড়ি ফিরল।
রান্না করতে গিয়ে বাড়িতে অনেক কিছুই আবিষ্কৃত হল। হালুয়া, মোরব্বা, তিন রকমের আচার, ইস্তেক উত্তম হরিণের মাংসের শুঁটকি। পরমানন্দে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের আগা রান্নাবান্না সেরে আহারাদি সমাপন করল। ক্যাটক্যাটানি না শুনে না শুনে আজ তার চোখে নিদ্রা আসবে– এ কথাটা যতবার ভাবে ততই তার চিত্তাকাশে পুলকের হিল্লোল জেগে ওঠে।
পরদিন কিন্তু আগা আহমদের শান্ত মনের এককোণে কালো মেঘ দেখা দিল। হাজার হোক– তার বউ তো বটে। তাকে ওরকম মেরে ফেলাটা–? বিয়ের সময় হজরত মুহম্মদের নামে সে কি শপথ নেয়নি যে তাকে আজীবন রক্ষণাবেক্ষণ করবে? কিন্তু ওদিকে আবার সেই দুশমনটাকে ফের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে তো মন চায় না।
এ অবস্থায় আর পাঁচজন যা করে আগা আহমদও তাই করল। যাক গে ছাই, গিয়ে দেখেই আসি না, বেটী গর্তের ভিতর আছে কী রকম। সেই দেখে মনস্থির করা যাবে।
গর্তের মুখের পাতা সরাতেই ভিতর থেকে পরিত্রাহি চিৎকার! আল্লার ওয়াস্তে, রসুলের ওয়াস্তে আমাকে বাঁচাও। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ তো মালিকা খানমের গলা নয়। আরও পাতা সরিয়ে ভালো করে তাকিয়ে আগা আহমদ দেখে— বাপ রে বাপ, এ্যাব্বড়া কালো-নাগ, কুলোপানা-চক্কর গোখরো সাপ! সে তখনও চেঁচাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও, আমি তোমাকে হাজার টাকা দেব, লক্ষ টাকা দেব, আমি গুপ্তধনের সন্ধান জানি, আমি তোমাকে রাজা করে দেব।
সম্বিতে ফিরে আগা আহমদের হাসিও পেল। সাপকে বলল, তা তুমি তো কত লোকের প্রাণ নির্ভয়ে হরণ কর– নিজের প্রাণটা দিতে এত ভয় কিসের?
ঘেন্নার সঙ্গে সাপ বলল, ধাত্তর তোর প্রাণ! প্রাণ বাঁচাতে কে কাকে সাধছে! আমাকে বাঁচাও এই দুশমন শয়তানের হাত থেকে। এই রমণীর হাত থেকে। তার পর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, মা গো মা, সমস্ত রাত কী ক্যাট-ক্যাট, কী বকাটাই না দিয়েছে। আমি ড্যাকরা, আমি মদ্দা মিনষে হয়ে একটা অবলা হ্যাঁ, অবলাই বটে-নারীকে কোনও সাহায্য করছিনে, গর্ত থেকে বেরোবার কোনও পথ খুঁজছিনে, আমি একটা অপদার্থ, ষাঁড়ের গোবর। আমি–
আগা আহমদ বলল, তা ওকে একটা ছোবল দিয়ে খতম করে দিলে না কেন?
চিল-চ্যাঁচানি ছেড়ে সাপ বলল, আমি ছোবল মারব ওকে! ওর গায়ে যা বিষ তা দিয়ে সাত লক্ষ কালনাগিনী তৈরি হতে পারে। ছোবল মারলে সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়তুম না? সারাত কোন্ ওঝা? ওসব পাগলামি রাখো। আমাকে তুমি গর্ত থেকে তোলো। তোমাকে অনেক ধনদৌলত দেব। পশুপক্ষী সাপ-বিচ্ছর বাদশা সুলেমানের কসম।
রূপকথা নয়, সত্য ঘটনা বলে দেখা গেল মালিকা খানমেরও অনেকখানি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে– এক রাত্রি সর্পের সঙ্গে সহবাস করার ফলে। কারণ এতক্ষণ ধরে একটিবারও স্বামীকে কোনও কড়া কথা বলেনি। এটা একটা রেকর্ড, কারণ ফুলশয্যার রাত্রেও নাকি সে মাত্র তিনটি মিনিট চুপ করে থেকেই ক্যাটক্যাটানি আরম্ভ করে দিয়েছিল।
মালিকা খানম মাথা নিচু করে বলল, ওরা গুপ্তধনের সন্ধান জানে।
আমাদের আগা আহমদের টাকার লোভ ছিল মারাত্মক। সাপকে সুলেমানের তিন কসম খাইয়ে গর্ত থেকে তুলে নিল। বউকেও তুলতে হল– সে-ও শুধরে গেছে জানিয়ে অনেক করে কসম কেটেছিল।
সাপ বলল, গুপ্তধন আছে উত্তর মেরুতে বহু দূরের পথ। তার চেয়ে অনেক সহজ পথ তোমাকে বাতলে দিচ্ছি। শহর-কোতয়ালের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরব আমি। কেউ আমাকে ছাড়াবার জন্য কাছে আসতে গেলেই মেয়েকে মারতে যাব ছোবল। তুমি আসামাত্রই আমি সুড়সুড় করে সরে পড়ব- তোমাকে দেবে বিস্তর এনাম, এন্তার ধন-দৌলত। কিন্তু খবরদার, ওই একবার। অতি লোভ করতে যেয়ো না।
ভূতের মুখে রাম নাম?
সাপের দ্বারা ভালো কাম?
শহরে এমনই তুলকালাম কাণ্ড যে তিন দিন যেতে-না-যেতে সেই বনের প্রান্তে আগা আহমদের কানে পর্যন্ত এসে পৌঁছল কোতয়াল-নন্দিনীর জীবন-মরণ সমস্যার কথা। তিন দিন ধরে তিনি অচৈতন্য। গলা জড়িয়ে কাল-নাগ ফোঁস ফোঁস করছে। কোতয়াল লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। তবু সাপুড়েরাও নাকি কাছে ঘেঁষছে না, বলছে উনি মা-মনসার বাপ।
প্রথমটা তো আগা আহমদকে কেউ পাত্তাই দেয় না। আরে, ওঝা-বদ্যি হদ্দ হল এখন ফারসি পড়ে আগা! কী বা বেশ, কী বা ছিরি!
কোতয়ালের কানে কিন্তু খবর গেল,
বন থেকে এসেছে ওঝা
পেটে এলেম বোঝ বোঝ।
ছবি-চেহারা দেখে তিনিও বিশেষ ভরসা পেলেন না। কিন্তু তখন তিনি শুশান-চিকিৎসার জন্য তৈরি– সে চিকিৎসা ডোমই করুক, চাঁড়ালও সই।
তার পর যা হওয়ার কথা ছিল তাই হল। ওঝা আগা আহমদ ঘরে ঢোকামাত্রই সেই কাল-নাগ কোথা দিয়ে যে বেরিয়ে গেল কেউ টেরটি পর্যন্ত পেল না। কোতয়াল-নন্দিনী উঠে বসেছেন, তাঁর মুখে হাসি ফুটেছে। ভীষণ-দৰ্শন কোতয়াল সাহেবের চেহারা প্রসন্ন বদান্যতায় মোলায়েম হয়ে গিয়েছে। আগাকে লক্ষ টাকা তো দিলেনই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে করে দিলেন তাঁর বাড়ির পাশের বনের ফরেস্ট অফিসার। এইবার আগা দু বেলা প্রাণভরে বাচ্চা হরিণের মাংস খেতে পারবে।
আগা সুখে আছে। সোনাদানা পরে মালিকা খানমও অন্য ভুবনে চরছেন– ক্যাটক্যাট করে কে? তা ছাড়া এখন তার বিস্তর দাসীবাদী। ওদের তম্বি-তম্বা করতে করতেই দিন কেটে যায়। কর্তাও বৈঠকখানায় ইয়ার-বক্সি নিয়ে।
ও মা! এক মাস যেতে না যেতে খবর রটল, উজির সাহেবের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরেছে একটা সাপ। কোন্ সাপ?– সেই সাপটাই হবে, আর কোনটা?
এবারে দশ লাখ টাকার এনাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাইক-বরকন্দাজ, পেয়াদা-নফর ছুটেছে আগা আহমদের বাড়ির দিকে,
হাতের কাছে ওঝা,
সহজ হল খোঁজা।
কিন্তু আগা আহমদের বিলক্ষণ স্মরণে ছিল, কাল-নাগ খবরদার করে দিয়েছে অতি লোভ ভালো না, সাপ সরাতে একবারের বেশি না যায়। সে যতই অমত জানায়, ইয়ার-বক্সি ততই বলে, হুজুরের কী কপাল! বাপ-মার আশীর্বাদ না থাকলে এমন ধারা কখনও হয়!
আগাকে জোর করে পাল্কিতে তুলে দেওয়া হল।
এবারে সাপ জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার খাই বড় বেড়েছেনা? তোমাকে না পই পই করে বারণ করেছিলুম, একবারের বেশি আসবে না। তবু যে এসেছ? তা সে যাকগে– তুমি আমার উপকার করেছ বলে তোমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিলুম। কিন্তু এই শেষবার। আর যদি আস, তবে তোমাকে মারব ছোবল। তিন সত্যি।
দশ লাখ টাকা এবং তার সঙ্গে পাঁচশো ঘোড়ার মনসব পেয়েও নওয়াব আগা আহমদের দিল-জান সাহারার মতো শুকিয়ে গিয়েছে। মুখ দিয়ে জল নামে না, পেটে রুটি সয় না। কাল-নাগ আবার কখন কোথায় কী করে বসে আর সে ছোবল খেয়ে মরে! স্থির করল, ভিন দেশে পালাবে।
ঠিক সেই দিনই স্বয়ং কোতয়াল সাহেব এসে উপস্থিত। বিস্তর আদর-আপ্যায়ন, হস্তচুম্বন-কালিঙ্গন। কোতয়াল সাহেব গদগদ কণ্ঠে বললেন, ভাই নওয়াব সাহেব, তোমার কী কপাল! তামাম দেশের চোখের মণি, দিলের রোশনি, রাজকুমারীর প্রাণ উদ্ধার করে তুমি হয়ে যাবে দেশের মাথার মুকুট। চলো শিগগির! সেই হারামজাদা কাল-নাগ এবার জড়িয়ে ধরেছে শাহজাদীর গলা।
নওয়াব আগা আহমদ জড়িয়ে ধরল কোতয়ালের পা। হাউহাউ করে কেঁদে নিবেদন করল সে কোন্ ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে পড়েছে।
কোতয়ালদের হৃদয় মাখন দিয়ে গড়া থাকে না। ব্যাপারটা বুঝে নিতেই শহরদারোগাকে হুকুম দিলেন, চিড়িয়া বন্ধ করো পিঞ্জরামে।
পালকিতে নওয়াব আগা আহমদ। দু পাশের লোক তার জয়ধ্বনি জিন্দাবাদ করছে। এক ঝরোকা থেকে কোতয়াল-নন্দিনী, অন্য ঝরোকা থেকে উজিরজাদী তাঞ্জামের উপর পুষ্পমাল্য বর্ষণ করলেন।
আগা আহমদ মুদ্রিত নয়নে মুর্শিদমৌলার নাম আর ইষ্টমন্ত্র জপছে।
স্বয়ং বাদশা তাকে হাতে ধরে রাজকুমারীর দোরের কাছে নিয়ে এলেন।
আগা আহমদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
কাল-নাগ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, আবার এসেছিস, হতভাগা? এবার আর আমার কথার নড়চড় হবে না। তোর দুই চোখে দুই ছোবল মেরে ঢেলে দেব আমার কুল্লে বিষ।
আগা আহমদ অতি বিনীত কণ্ঠে বলল, আমি টাকার লোভে আসিনি। তুমি আমাকে অগুনতি দৌলত দিয়েছ। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, তাই তোমার একটা উপকার করতে এলুম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, শুনলুম তুমি এখানে। ওদিকে সকালবেলা বিবি মালিকা খানম আমাকে বলেছিলেন তিনি রাজকন্যাকে সেলাম করতে আসছেন। বোধহয় এক্ষুণি এসে পড়বেন। তুমি তো ওঁকে চেনো,- হেঁ, হেঁ- তাই ভাবলুম, তোমাকে খবরটা দিয়ে উপকারটাই না কেন করি। তুমি আমার
বাপ রে, মা রে চিৎকার শোনা গেল। কোন্ দিক দিয়ে যে কাল-নাগ অদৃশ্য হল আগা আহমদ পর্যন্ত বুঝতে পারল না।
এর পর আগা আহমদ শান্তিতেই জীবনযাপন করেছিল। গল্পটি নানা দেশে, নানা ছলে, নানা রূপে প্রচলিত আছে। আমি শুনেছিলুম এক ইরানি সদাগরের কাছ থেকে, সরাইয়ের চারপাইতে শুয়ে শুয়ে।
কাহিনী শেষ করে সদাগর শুধোলেন, গল্পটার মরাল কী, বলো তো?
আমি বললুম, সে তো সোজা। রমণী যে কীরকম খাণ্ডারনী হতে পারে তারই উদাহরণ। এ দুনিয়ার নানা ঋষি নানা মুনি তো এই কীর্তনই গেয়ে গেছেন।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সদাগর বললেন, তা তো বটেই। কিন্তু জান, ইরানি গল্পে অনেক সময় দুটো করে মরাল থাকে। এই যে-রকম হাতির দু জোড়া দাঁত থাকে। একটা দেখাবার, একটা চিবোবার। দেখাবার মরাল-টা তুমি ঠিকই দেখেছ। অন্য মরাল-টা গভীর –খল যদি বাধ্য হয়ে, কিংবা যে-কোনও কারণেই হোক তোমার উপকার করে, তবে সে উপকার কদাচ গ্রহণ করবে না। কারণ খল তার পরই চেষ্টায় লেগে যাবে, তোমাকে ধনেপ্রাণে বিনাশ করবার জন্য, যাতে করে তুমি সেই উপকারটি উপভোগ না করতে পার।
অবশ্য তোমার বাড়িতে যদি মালিকা খানমের মতো বিষ থাকে অন্য কথা।
কিন্তু প্রশ্ন, ক জনের আছে ও-রকম বউ?
ভারতীয় সংহতি
ভারতীয় সংহতি তবে কোথায়?
এস্থলে নিবেদন করে রাখি যে, আমার ধারণার সঙ্গে অল্প লোকেরই ধারণা মিলবে ও যাদের সঙ্গে মিলবে তারা এবং আমি এ দুরাশা পোষণ করি না যে, বিংশ শতাব্দীর লোক আজ অথবা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বক্তব্য কান দিয়ে শুনবে।
বেদ-উপনিষদ নমস্য কিন্তু সমস্ত ভারতবর্ষেই এসবের চর্চা অতি কম। এমনকি পণ্ডিতদের মুখে শুনেছি, গীতা পর্যন্ত এদেশে উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে বিশেষ প্রচলিত ছিল না।
আপনি ভারতবর্ষের যে কোনও গ্রামে যান না কেন, তা সে মালাবারে আসামে পাঞ্জাবেই হোক– সেখানকার লোকনাট্য চারণ গানে সর্বত্রই মহাভারত-রামায়ণ বিরাজিত। জনপদবাসীর রসাস্বাদনের প্রধান উৎস রামায়ণ-মহাভারত। আমি একবার মালাবারের গ্রাম্য কথাকলি দেখতে এবং শুনতে গিয়ে তিন মিনিটেই বুঝে যাই, হনুমান সভাজনকে সালঙ্কার বর্ণনা করছেন, তিনি কী করে লঙ্কায় উপস্থিত হলেন, নগর পরিদর্শন করলেন, লঙ্কার কদলীবনে কী প্রকারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটালেন, অবশেষে রাবণের অনুচর তাঁর পুচ্ছটিতে অগ্নিসংযোগ করলে তিনি কী প্রকারে গৃহ থেকে গৃহান্তরে লফপ্রদান করে নগরীতে ব্যাপকভাবে বহ্নি প্রজ্বলিত করলেন। মালায়ালমফ ভাষার এক বর্ণ না জেনেও আমি স্বচ্ছন্দে গল্পটি উপভোগ করলুম।
ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে যারাই পরিভ্রমণ করেছেন তারাই জানেন, রামায়ণ-মহাভারত ভারতীয় জীবনের কতখানি গভীর অতলে প্রবেশ করেছে।
এবং এই নাট্যনৃত্য উপভোগ করে শুধু হিন্দু না, মুসলমানও। কারণ ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভাষা এক। বাঙ্গলার মুসলমানের মাতৃভাষা যেমন বাঙলা, গুজরাতি মুসলমানের মাতৃভাষাও গুজরাতি। লক্ষ্ণৌয়ের মুসলমানের মাতৃভাষা যেমন উর্দু, হিন্দুরও তাই এখন অবশ্য হিন্দি ক্রমে ক্রমে উর্দুর জায়গা দখল করে নিচ্ছে। মাতৃভাষায় আমোদ-আহ্লাদ করাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা শুনেছি দেশবিভাগের পরও হর হর মহাদেব ফিল্ম ঢাকাতে সে বক্স আপিস ভরলে তাতে সিনেমার মালিকগণ বিস্মিত হন।
কিন্তু অমিলও আছে।
ধর্মজগতে হিন্দু ভীষ্ম-কর্ণকে আদর্শ বলে ধরে নেয়, মুসলমান নেয় না। গোব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করবার কোনও কারণও মুসলমানের নেই। অবশ্য আউল-বাউল মুর্শিদীয়া মিস্টিকগণের গানে কিছুটা রামায়ণ-প্রীতি পাওয়া যায়, কিন্তু ভারতীয় মুসলমান ব্যাপকভাবে সেটা গ্রহণ করেনি।
***
রামায়ণ-মহাভারতের উৎস থেকে সঞ্জীবনী-সুধা আহরণ করে হিন্দু সংহতি পুনর্জীবিত করা যায় অবশ্য যদি সাহিত্যিক, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতাদের এ পন্থায় আস্থা থাকে এবং সে কর্মে নিজেদের নিয়োগ করেন, বিনোবাজি যেরকম করেছেন, কিন্তু যদি ভারতীয় সংহতির কথা তোলা যায় তবে সমস্যাটা কঠিন হয়, কারণ ভারতবর্ষে মুসলমান খ্রিস্টান পার্শি গারো নাগা আদিবাসীও আছেন। জৈনদের কথা তুলছিনে, কারণ একমাত্র উপাসনা পদ্ধতি বাদ দিলে তারা সর্বার্থে হিন্দু।
সর্বপ্রথম প্রশ্ন, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য কোন জায়গায়? রসের ক্ষেত্রে যে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ সেকথা পূর্বেই নিবেদন করেছি।
এখন যা বলতে যাচ্ছি, সেটি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে।
ছেলেবেলা থেকেই আরব দেশাগত দু-একটি আরব মুসলিমের জীবনযাত্রা ও চিন্তাপদ্ধতির সঙ্গে আমার পরিচয়। পরবর্তী যুগে আরব দেশে থাকবার আমার সুযোগ হয়েছিল।
এদের ধর্মবিশ্বাস সরল। এরা বিশ্বাস করেন, আল্লাতালা এই বিশ্ব মানুষের আনন্দের জন্য সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু পাছে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত লাগে তাই তিনি ধর্মের সৃষ্টি করেছেন। সেই ধর্মে কতকগুলি বস্তু ও আচরণ আল্লা বেআইনি বলে হুকুম দিয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, আল্লাতালা হুকুম দিয়েছেন, তুমি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পার, যদি সকলকে সমান সম্মান সমান প্রেমের চোখে দেখতে পার। না পারলে তোমার পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা অন্যায়!
আরব ভূমি তথা অন্যান্য মুসলিম ভূখণ্ডে তাই যদি কেউ বৃদ্ধ বয়সেও পুনরায় ভার্যা গ্রহণ করে তবে তাই নিয়ে লোকনিন্দা হয় না। সমাজ ভাবে, সে একাধিক স্ত্রীকে সমান চোখে দেখতে পারবে কি না, সে দায়িত্ব তার স্কন্ধে।
কিন্তু ভারতবর্ষের মুসলমান অর্থাগম হলেই দ্বিতীয় দারা গ্রহণ করে না। তার ভিতরে কেমন যেন একটা ত্যাগের আদর্শ আছে। তার বক্তব্য, আল্লাতালা আমাকে এটা-সেটা অনেক কিছুই উপভোগ করতে দিয়েছেন সত্য কিন্তু আমি চেষ্টা করে দেখি না, আমার এগুলো না হলে চলে কি না?
একথা বলা আমার আদৌ উদ্দেশ্য নয় যে, কোরানে ত্যাগের আদর্শ নেই। বিস্তর আছে। বস্তুত জাকাত (বাধ্যতামূলক দান-খয়রাত) ইসলাম সৌধের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এবং নিতান্ত দীন-দুঃখী ছাড়া সকলকেই কিছুটা দান করতে হয়। তদুপরি সুফি এবং সাধুসন্ত সম্প্রদায় তো চূড়ান্ত ত্যাগের আদর্শই বরণ করে নেন। উপস্থিত এদের কথা হচ্ছে না। আমার বক্তব্য ভারতীয় মুসলিম যতখানি ত্যাগের আদর্শ বরণ করেছে সে শুধু ধনদৌলতের বেলায়ই নয়, আমোদ-আহ্লাদ পারিতোষ-আনন্দের আভ্যন্তরীণ জগতেও অন্যান্য মুসলিম ততখানি করেনি।
এই ত্যাগের মন্ত্র ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে প্রচলিত।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা– অর্থাৎ তাকে ত্যাগের দ্বারা ভোগ করতে হবে।
***
এস্থলে ঈষৎ অবান্তর হলেও ত্যাগ সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিৎ নিবেদন আছে।
যার কিছু নেই, উপার্জন করার কোনও ক্ষমতা নেই, তার মুখে ত্যাগ ত্যাগ শোভা পায় না। বিশেষত এই বিংশ শতাব্দীতে। যখন অক্ষম জন সর্বদায়িত্ব এড়িয়ে ত্যাগের অছিলা ধরে সোশ্যাল সার্ভিসের নাম করে আশা করেন, সমাজ তাঁকে পুষবে, এবং ভালোভাবেই পুষবে, কারণ তিনি সর্বস্ব (!) ত্যাগ করেছেন, তখন আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে (এরই অন্য উদাহরণ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন– শক্তিহীনের ক্ষমা ক্ষমা নয়)। সোজা কথা বিড়লা-টাটার দৌলত তাঁরাই ত্যাগ করতে পারেন, আমি পারিনে, কারণ ও দৌলত আমার নয়।
ওদিকে আবার উপনিষদ বলেছেন, মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধন! অন্যের ধনের ওপর লোভ করো না।
অর্থাৎ চাষা, মজুর, সাহিত্যিক, মাস্টার আপন আপন পরিশ্রম দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে পারে, অন্যের ধনের প্রতি লোভ না করেও।
সেই ধন অর্জন করে ত্যাগের মাধ্যমে তাকে উপভোগ করতে হবে।
এই আদর্শ হিন্দু-মুসলমান দুয়েরই আছে, এবং বহু যুগ ধরে জীবনে উপলব্ধি করেছে বলে এই দৃঢ়ভূমির উপর জাতীয় ঐক্য গঠিত হতে পারে। তা হলে আর কোনও দ্বন্দ্ব থাকবে না।
শুধু তাই নয়, তা হলে ভারতবর্ষ যে শুধু শক্তিশালী রাষ্ট্র বলেই গণ্য হবে তা নয়, সে ভদ্রতম সম্ভ্রান্ততম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃত হবে।
ভাষা
আমার আর একটি প্রশ্ন আছে :
এই যে লাকসমবার্গের মতো ক্ষুদে রাষ্ট্র কিংবা জনবিরল ফিনল্যান্ড, কিংবা ওই ধরনের ছোট-বড় নানারকমের রাষ্ট্র রয়েছে, কোনখানে দেশটা সে দেশের ভাষায় না চালিয়ে অন্য কোনও বিজাতীয় ভাষায় চালানো হচ্ছে?
সুইজারল্যান্ডের লোক তিন অঞ্চলের তিন ভাষায় কথা বলে। জর্মন, ফরাসি এবং ইতালীয়। রোমানুশ ভাষায় এত কম লোক কথা বলে যে সেটার কথা না হয় না-ই তুললুম। এদের সকলের পক্ষে দিশিই হোক আর বিদেশিই হোক– কাজ চালাতে যে বিস্তর সুবিধা হত সে বিষয়ে কী সন্দেহ? কত পয়সা খরচ করে তিন-তিনটে ভাষায় সরকারি-বেসরকারি বিস্তর জিনিস ছাপাতে হয়, তিন ভাষায় লোকে বক্তৃতা দেয় বলে পার্লামেন্টের কাজ দ্রুতগতিতে এগোয় না, এক অঞ্চলের জিনিস অন্য অঞ্চলে বেচতে হলে তার জন্য আলাদা বিজ্ঞাপন, আলাদা এজেন্ট রাখতে হয়, এবং আরও কত যে ঝামেলা তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওরা হাসিমুখে সবকিছুই মেনে নিয়েছে।
তার কারণ মাত্র একটি, এবং সে কারণ পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযোজ্য।
মাতৃভাষা ছাড়া আর অন্য কোনও ভাষায় কাজ চালানো যায় না।
অবশ্য আজ যদি বাঙলা দেশ চালানোর জন্য একজন রাজা, তার জন্য পঁচিশ মনসবদার এবং একটি পুরুষ্টু সৈন্যদল থাকলেই যথেষ্ট হত তা হলে ইংরেজি-হিন্দি যে কোনও ভাষা দিয়েই অল্পায়াসেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যেত। যেমন ধরুন একটা চা-বাগানের ইংরেজ ম্যানেজার, গুটিকয়েক কেরানিতে ইংরেজির মারফতে দিব্যি কাজ চালিয়ে নেয়। কিন্তু আজ পৃথিবী অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, আজ বাঙলা দেশের গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে গিয়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যেক গ্রামবাসীর যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি কতকগুলি হক্ক এবং দাবিও আছে। এরা প্রত্যেকেই যে শহরে এসে মন্ত্রী হতে চায় তা নয়, কিন্তু আস্তে আস্তে এদের মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, গা-গতর খাটানোর পর যদি দু মুঠো না খেতে পায় তবে রাষ্ট্র অবিচার করছে।
গণতন্ত্রের সামনে এই-ই বড় পরীক্ষা।
এবং আমি এর ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চাই।
গ্রামবাসীর সক্রিয়, সতেজ এবং দরদী সহযোগিতা না পেলে বাঙলার কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন, নেতারা, সমাজপতিরা এদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবেন কোন ভাষার মাধ্যমে? ইংরেজির কথা পূর্বেই আলোচনা করেছি; এইবার হিন্দিতে আসি।
প্রথমেই একটা সাফাই গেয়ে নিই। আমি হিন্দি-প্রেমী এবং ওই ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। হিন্দি বাংলার বুকের উপর চেপে বসে একদিন হিন্দি ইমপিরিয়ালিজম কায়েম করবে এ দুর্ভাবনা আমার মনের কোণেও আসে না। বস্তুত স্বরাজ লাভের পর কলকাতা তথা বাঙলা দেশে হিন্দি প্রচারের যেটুকু ব্যবস্থা হয়েছে তাতে আমি আদৌ সন্তুষ্ট নই– এর চেয়ে ঢের ব্যাপকতর চেষ্টার প্রয়োজন হবে কিন্তু সে কথা পরে হবে, উপস্থিত ফের গ্রামে ফিরে যাই।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালে পাঠশালে হিন্দি শেখাতে হলে যে কতখানি রেস্তোর প্রয়োজন হবে সেটা একবার শিক্ষামন্ত্রীকে জিগ্যেস করে দেখুন। এ নিয়ে দীর্ঘ বাগাড়ম্বর করতে চাইনে– জিনিসটা এতই সরল এবং স্বতঃসিদ্ধ।
দ্বিতীয়ত, যে দেশের লাখের মধ্যে একজন গ্রামবাসীও আপন প্রদেশের বাইরে যায় না, তার পক্ষে ভিন্ন ভাষা শেখার প্রয়োজন নেই।
সবসুদ্ধ মিলিয়ে দেখা গেল, নেতারা তা হলে এদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করবেন বাঙলার মারফতেই।
কিন্তু নেতারা যদি পরিপুষ্ট হন হিন্দি চর্চা করে, তা হলে ইংরেজ আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে–তাঁরা জানতেন ইংরেজি, শ্রোতারা জানত বাঙলা, দুজনার চিন্তাজগৎ, অনুভূতি ক্ষেত্র ভিন্ন। শেষটায় নেতারা যে অতিকষ্টে বাঙলা শিখে কাজ চালালেন, সে তো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।
ওদিকে ভারতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতি তো চাই। এই যে প্রদেশে প্রদেশে দ্বন্দ্ব, একই প্রদেশের ভিতর সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর অবিচার, এ তো ক্রমাগতই বেড়ে চলছে, এর বিরুদ্ধে তো কিছু-একটা করা চাই।
এর সরল সহজ রাস্তা নেই।
ভাষা এক না করেও সংহতি হয় যেমন সুইজারল্যান্ডে, বেলজিয়ামে আছে এবং ভাষ্য এক হলেও সংহতি না হতে পারে যেমন নাসের, কাসেম, মক্কার বাদশা, কুয়েতের শেখ সক্কলেরই ভাষা আরবি কিন্তু এদের ভিতর দ্বন্দ্ব-কলহের অন্ত নেই। এই যে এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সংযুক্ত আরবরাষ্ট্র (UAR) করা হল তার সূতিকাগৃহ তো শুশানশয্যায় পরিণত হতে চলল।
মহাআজিকে এক ইংরেজ সাংবাদিক শুধিয়েছিল, তোমরা আপসে এত লড়ো কেন? মহাত্মাজি বলেন, ইংরেজ লড়ায় বলে। ফের প্রশ্ন– ইংরেজ লড়তে চাইলেই তোমরা লড়ো কেন? উত্তর হল, আমরা মূর্খ বলে!
সেই হল মুখ্য কথা! আমরা মূর্খ।
এখন তো আর ইংরেজ নেই, কেউ ওস্কাচ্ছে না, আমরা তবু লড়ে মরছি!
তা হলে প্রশ্ন– এই মূর্খতা ঘুচাই কী করে?
বিদ্যাদান করে, ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত করে, রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য সম্বন্ধে তাকে সচেতন করে।
এইখানেই অধীনের সবিনয় নিবেদন– সেটি মাতৃভাষার মারফতেই করতে হবে, অন্য কোনও পন্থা নেই, নেই, নেই।
ভ্যাকিউয়াম
কবি এবং বৈজ্ঞানিকে প্রায়ই বিরোধ উপস্থিত সেকথা আমরা জানি। কবি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, অহে-হে! কী সুন্দর সূর্যোদয়। বৈজ্ঞানিক গম্ভীর কণ্ঠে টিপ্পনী কাটলেন, হস্তীমূর্খ। সূর্যের আবার উদয়-অস্ত কী? পৃথিবীটা ঘুরে যাওয়াতে মনে হল সূর্যোদয় হয়েছে।
কিন্তু কোনও কোনও স্থলে উভয়েই একমত পোষণ করেন।
কবি গাইছেন,
কে বলে সহজ, ফাঁকা যাহা তারে
সহজ কাঁধেতে সওয়া
জীবন যতই ফাঁকা হয়ে যায়
ততই কঠিন বওয়া ॥
বৈজ্ঞানিকও উচ্চকণ্ঠে বলেন, প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে
নেচার এবরজ ভ্যাকিউয়াম।
ধর্মের উচ্ছেদ যারাই কামনা করেন তারাই এ তত্ত্বটি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। প্রাচীন যুগের চার্বাকপন্থী বা তার পরবর্তী যুগের মক্কার কাফিরদের কথা হচ্ছে না। এ যুগের কথা বললেই এ যুগের লোক সাড়া দেয়। এ যুগে ধর্মের প্রধান শত্রু টোটেলিটেরিয়ান স্টেট, একচ্ছত্র রাষ্ট্র জগদ্দল রাষ্ট্র বললে জিনিসটা আরও পরিষ্কার হয়। তা সে রাষ্ট্র ফাঁসিস্টই হোক আর কমুনিস্টই হোক।
হিটলার বা স্তালিনের ভাবখানা অনেকটা এই : কী! আমার রাষ্ট্রে আমি ভিন্ন অন্য কার মুরদ যে আমার কথার ওপর কথা কইতে যাবে? আপন রাষ্ট্রের প্রতি, ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি অবশ্য আখেরে সেটাও আমি দখল করব– তোমার আচরণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কলা-দর্শনে তোমার আদর্শ ঠিক করে দেব আমি। এ যেন বাইবেল বর্ণিত যেহোভার তীব্র তীক্ষ্ণ আদেশ, আমা ভিন্ন তোর অন্য কোনও উপাস্য দেবতা থাকবে না।
এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ উঠল সেটা প্রধানত ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠান থেকে। শিল্পী-দার্শনিকের সেরকম কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। আর বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক পণ্ডিতেরা জীবনদর্শন চিন্তা করেন কমই। গবেষণার ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা পেলেই তারা সন্তুষ্ট। আইন-আদালত নিয়ে যাদের কারবার তারা গোড়ার দিকে কিছুটা আপত্তি জানান বটে, কিন্তু দেশের ডিক্টেটর একবার জোর করে, ভয় দেখিয়ে, যে করেই হোক– যদি আইন পাস করিয়ে নিতে পারেন যে তিনিই সর্ব আইনের মূলাধার, তা হলে এদের আর আইনত কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। মিলিটারির বেলায়ও হুবহু তাই। ডিক্টেটর যখন দেশের সর্বোচ্চ সামরিক উর্দি পরে তার সেনাবাহিনীর সামনে এসে দাঁড়ান তখনই সেনানায়করা শপথ নেন যে, তাঁর কোনও আদেশ তারা ভঙ্গ করবেন না। সকলেই জানেন, হিটলারকে নিধন করার জন্য বড় বড় সেনাপতিরা যখন ষড়যন্ত্র আরম্ভ করেন তখন তাঁদের প্রধান অন্তরায় ছিল এই শপথ।
শেষ পর্যন্ত যখন অকথ্য অত্যাচার, নি