- বইয়ের নামঃ তুলনাহীনা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
তুলনাহীনা – ১ম খণ্ড
০১.
লে, চ, ঝপ করে আরেকটা গিলে ফেল।
না, দাদা। আমার আর সইছে না।
ওই তো তোদের দোষ। হুইস্কি, হুইস্কি আর হুইস্কি। স্কচ্ হুইস্কি। ভগবানের যেন খেয়ে-দেয়ে অন্য কোনও কর্ম ছিল না। তার কুল্লে রস ঢেলে দিলেন ওই ধেঋেড়ে পাহাড়ে স্কটল্যান্ডের খাজাদের মধ্যিখানে। আরে ব্যাটা ওইটেই যদি দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল হত তবে ওই খেয়ে ওদেশের লোকগুলো দুনিয়ার সেরা সেরা কেষ্টবিষ্ট হল না কেন? বাবুরা তো এখনও ইংরেজের গোলাম। ওদিকে দেখ, ফরাসিদের। শুনিনদের জাত। খায় দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা মাল-বর্দো, বর্গন্ডি, শ্যাম্পেন। নাচে, গানে, প্রেমে–
কীর্তি বাধা দিয়ে বলল, বাঁচালে, সুদিনদা, তুমি তো জানো, আমি হপ্তা দু তিন ধরে—
একটি জান্-খুশ, দিল-তরুর পরীতে মজেছিস। তা বেশ, তা বেশ, তা বেশ। অতি উত্তম প্রস্তাব। তবে কি না আস্ত একটা আসুপ্ত ভলকানো। তা বেশ, তা বেশ!
এই আমাদেরই গানে গন্ধের চেয়ে গণগন্ধে ভরা কলকাতারই একটি অতি বিখ্যাত বার-এর সুমুখে দুটো দেড় গজি স্টেনলেস্ চোঙার লাল মুণ্ডর উপর বসে দুই ইয়ার পঞ্চ মকারের শ্রেষ্ঠতম যে মটি সর্ব বার-এ খুশবায়ে ম ম করেন তারই সেবা করতে মধ্যমণি তৃতীয় ম-এর আলোচনা-চরে নৌকো ভিড়িয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে দুজনাই ক্ষণতরে বার-এর গর্ভদেশের প্রতি প্রীতিপ্ৰসন্ন নড় করলেন। কারণ বার-এর বারাঙ্গনা কও আর বরাঙ্গনাই কও, বা-মেড় শ্রীমতি বেয়াত্রিচে ইতোমধ্যে লক্ষ করেছেন, দুনো ইয়ারের গেলাস তলানিতে এসে ঠেকেছে এবং সেটা যে তিনি অবশ্যই লক্ষ করেছেন তারই স্বীকৃতিস্বরূপ মোলায়েম মৃদুহাস্য মুখে মাখলেন। হেস্টিংস্ হার্ডিঞ্জের লীলাভূমি মহানগরীর মহা-বারু-এর মহারানির এতখানি দূরদৃষ্টি ও পরাভাবকাতরতা অবশ্যই আছে যে, এই খানদানি বার-এ কোনও মেহমানকে কোনও কিছু নিজের থেকে চাইতে হয় না–তা সে আই সে মিস্ বলে তাঁকে ডাক দিয়ে কিংবা শূন্য গেলাসের উপর ঠুংঠাং করে জলতরঙ্গ বাজিয়ে; এমনকি উচ্চ মঞ্চাসনের সামান্যতম উসখুস দ্বারা আপন অস্বস্তিটা প্রকাশ করে কোনও মেহমানকে কস্মিনকালেও সিন্নোরিনা বেয়াত্রিচের নেকনজর আকর্ষণ করতে হয়নি। সে-পরিস্থিতি, সে-ইনকিলাব ঘটবার বহুপূর্বেই বেয়াত্রিচে নিঃসন্দেহে আত্মহত্যা করবেন। সে আত্মনাশ জাপানি হারাকিরি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংভূ।… কবে, কবে সেই ফিMো পেলিত্তি, তার পূর্বেকার স্পেনসার-এর আমলে এদেশে এসেছিলেন বেয়াত্রিচে গোষ্ঠীর প্রথম মহিলা। বসন্তসেনাশ্রেণিয়া মনোরঞ্জনী, চিত্তহরিণী এ পরিবার-বংশানুক্রমে।
এখনও আমাদের এই সমসাময়িক বেয়াত্রিচে বিপদে-আপদে উৎসবে-ব্যসনে সুদিনদা এবং তার পঁচো ইয়ারের সম্মানরক্ষার্থে তাদের পার্টির মক্ষিরানির রূপে সেখানে ত্রিযামা যামিনী যাপন করে আসেন। তাঁর এখন বয়ঃসন্ধিকাল, অবশ্য কিঞ্চিৎ ভিন্নার্থে; তিনি যৌবন আর ভরা যৌবনের মাঝখানে। আমাদের ইতিহাসে তিনি পরিপূর্ণ স্টার না হলেও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুল্লেখার মতো বার বার আমাদের সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে যাবেন।… তাই এই বেলাই তাঁর সম্বন্ধে কিছুটা বলে নিতে হল।
আবার দেব? কিংবা ইয়েস্ প্লিজ? বাঁধা গতে বেয়াত্রিচে ফ্যালনা বার-মেডের মতো খদ্দেরদের সম্মুখীন হন না। সামান্যতম মৃদুহাস্য দিয়ে জানালেন, এই যে? অর্থাৎ জানি। কী চাই, কখন চাই, জানি। আসছে।
দুই ইয়ারও মানানসই স্মিতহাস্য না-বলা থ্যাঙ্কু জানালেন।
ছিঁড়ে যাওয়া রসালাপের রিপকর্মটি করতে করতে কীর্তিনাশ চৌধুরী ঈষৎ অভিমানের সুরে বলল, সুদিনা, তুমি মাইরি আমার চেয়ে আর ক-বছরের সিনিয়র? আমাকে যা বলতে চাও সোজাসুজি কইলেই পারো। আস্ত একটা ভলকানো কথাটার মানে কী? মিস্ শিপ্রা ভোরের শিশির-ভেজা শিউলিটি নন সে তো তুমি জানো আমার চেয়েও বেশি। আর পাঁচজনের তুলনায় তুমি তাকে কতখানি বেশি জানো কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারির পর– মানে, ইয়ে, কতদিক দিয়ে সেটা অবশ্য আমার অজানা, কিন্তু অশ্রাব্য হবে না, ভরসা আছে। তুমিই তো, বাপু, আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তাঁর সঙ্গে।
সুদিন চৌধুরী : অপরাধ করেছিলুম কি? চুপ করে রইলি যে? এবং এই চুপ করে থাকাটাই সদুত্তর। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে গভীরতম সত্য লুকনো আছে। এই যে তোদের পোয়েট রবিবাবু গেয়েছে,
দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে
কী জানি কী মহা লগনে
কেন বাপু, শুভ লগনে বললে অপরাধটা কী হত? অ। তা হলে তেনার অরিজিনালিটি থাকত কোথায়? তাই না? যেদো-মেদো, এস্তেক মুসলমানদের গাইয়া পোয়েট বসিরুদ্দি মৃদম খা তক শুভ লগনটা অ্যামন জাবড়ে ধরে আছে যে ঠাকুরবাড়ির তেতলার কবি, রাজপুত্ত্বর দ্বারকানাথের নাতি, আগাপাশতলা একটা নয়া ধর্মের ভগীরথ দেবেনঠাকুরের নন্দন নোবেল ঘোড়ার রেসে পয়লা নম্বরি সওয়ার তিনি ওই হাজাপচা শুভ লগনটা এস্তেমাল করেন কী প্রকারে? না? কিন্তু তা নয়। এ উত্তরটা অতি রদ্দি মার্কা প্রোলেতারিয়ার যা-তা উত্তর। আসলে ওই যে যেতে যেতে পথে দেখাটা হয়ে গিয়েছিল তার ফলে হল প্রেম– পূর্বরাগ, অনুরাগ, চুম্বন, আলিঙ্গন-এটসেটরা-গয়রহ ইত্যাদি, কিন্তু সে-সব থাক্। ওসবের কথা তুললে কফি হৌসের তরুণরা তেড়ে আসে। প্রেমের এসব বস্তাপচা প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি এখন যাদুঘরের মাল মুজিয়াম পিস। হক্ কথা। কিন্তু দাদা, তার সঙ্গে সঙ্গে যে-বিরহ, হু করে বিবিজান তোমাকে ঠাঠা রোদ্দুরের ব্লদেভুতে ছিবড়েটার মতো ফেলে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন লেকচারারটার সঙ্গে সিনেমায় আরও কত কী, সেগুলো কি শুভ লগনে দেখা হওয়ার সিমটম মোটেই না। মিলনের চুম্বন = শুভ-লগন + রাঁদেভুতে কর্ণমর্দন = অশুভ লগন। একুনে, মহালগন।