- বইয়ের নামঃ দু-হারা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অদৃষ্টের রঙ্গরস
আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাবৎ ভারতবর্ষে লেগে গেল ধুন্ধুমার। বাদশাহ হবেন কে?
এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিই যে, আর্য এবং একাধিক আর্যেতর জাতির মধ্যে প্রথা– রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিনা বাধায় সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তুর্কমানিস্তানের মোগলদের ভিতর এরকম কোনও ঐতিহ্য ছিল না। তাদের ছিল জোর যার মুলুক তার। আরবদের ভিতর গোড়ার দিকে এই একই প্রবাদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট (খলিফা) নিযুক্ত হতেন, তবে জোরের বদলে সেখানে ছিল চরিত্রের, শৌর্যবীর্যের, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই বলা হত, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হবেন খলিফা হন-না তিনি হাবশি (নিগ্রো)। এবং সেটাও ঠিক করা হত গণভোট দিয়ে।
তাই মোগল রাজা মারা যাওয়া মাত্রই, কিংবা তিনি অথর্ব অসমর্থ হয়ে পড়লেই লেগে যেত রাজপুত্রদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ। কোনও কোনও সময় রাজার নাতিরাও এবং অন্য বাজে লোকও এই লড়াইয়ের লটারিতে নেবে যেতেন। অবশ্য রাজরক্ত না থাকলে তার সম্রাট হবার সম্ভাবনা থাকত না। পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ফররুখসিয়ারের রাজত্বের শেষের দিক থেকে মুহম্মদ শাহ বাদশা রঙিলার সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত সিন্ধু দেশের সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিল্লিতে সিংহাসনের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। রাজার পর রাজাকে তাঁদের হাতে পুতুলের মতো নাচতে হয়েছে। কিন্তু খ্যাতি, শক্তি, অর্থবলের মধ্যাহ্নগগনে থাকাকালীনও তাঁদের কারও তখৃৎ-ই-তাউসে বসবার দুঃসাহস হয়নি। সৈয়দ পয়গম্বরের বংশধর– তিনি সম্মান পাবেন। মসজিদে, মক্তবে, মাদ্রাসায়– রাজসভায় কবিরূপে, ঐতিহাসিকরূপে সমাজে গুরুরূপে, কিন্তু মোগল রাজবংশের রক্ত তাঁদের ধমনীতে ছিল না বলে দিল্লির হিন্দু-মুসলমান তাঁদের বাদশাহ-সালামতরূপে কিছুতেই এঁদের স্বীকার করত না। ঠিক ওই একই কারণে মারাঠা ও ইংরেজ দিল্লির সিংহাসনে বসতে চায়নি। সিপাহি বিদ্রোহ চূর্ণবিচূর্ণ না করা পর্যন্ত ইংরেজ স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ভারতের অধীশ্বরী বলে ঘোষণা করার সাহস পায়নি। এবং সেটাও করেছিল অতিশয় সভয়ে।
রাজা ও সার্বভৌম আমিরের মৃত্যুর পর যুবরাজদের ভিতর ভ্রাতৃযুদ্ধের মারফতে কে সবচেয়ে শক্তিশালী সেটা বের করা তুর্কমানিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশে প্রবল বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে না। কিন্তু ভারতের (এবং অনেক সময় কাবুল কান্দাহার গজনির ওপরও দিল্লির আধিপত্য থাকত) মতো বিরাট দেশে এ প্রকারের যুদ্ধ বিকট অরাজকতা ও দীর্ঘকালব্যাপী অশান্তির সৃষ্টি করত। লোকক্ষয়, অর্থক্ষয় তো হতই,–অনেক সময় একই ভূখণ্ডের উপর ক্রমাগত অভিযান ও পাল্টা অভিযান হওয়ার ফলে সেখানে চাষবাস হত না, ফলে পরের বৎসর দুর্ভিক্ষ হত। সাধারণজনের বাড়িঘরদোর তো নষ্ট হতই, কলাসৃষ্টির উত্তম উত্তম নিদর্শনও লোপ পেত। এইসব যুদ্ধবিগ্রহের ফলেই ইউরোপের তুলনায় এদেশে বেঁচে আছে অতি অল্প রাজপ্রাসাদ। কোনও কোনও স্থলে পলায়মান সৈন্য পথপ্রান্তের প্রতিটি ইদারাতে বিষ ফেলে যেত। ফলে বৎসরের পর বত্সর ধরে পার্শ্ববর্তী জনপদবাসীর একমাত্র জলের সন্ধান অব্যবহার্য হয়ে থাকত।
এই দলাদলি মারামারি থেকে, কি দিল্লি-আগ্রার মতো বৃহৎ নগর, কি সুদূর সুবের (প্রভিন) ছোট শহর, আমির-ওমরাহ, সিপাহসালার, ফৌজদার প্রায় কেউ নিষ্কৃতি পেতেন না। কারণ এঁদের প্রায় প্রত্যেকেই আহ্বান, আদেশ, অনুনয়-ভরা চিঠি পেতেন প্রত্যেক যুযুধান, রাজপুত্রের কাছ থেকে আমাকে অর্থবল সৈন্যবলসহ এসে সাহায্য কর। তখন প্রত্যেক আমিরের সামনে জীবনমরণ সমস্যা দাঁড়াত আখেরে জিতবে কোন ঘোড়াটা, ব্যাক্ করি কোনটাকে? অতিশয় বিচক্ষণ কূটনৈতিকরাও রং হর্স ব্যা করে আপন, এবং কোনও কোনও স্থলে সপরিবার, প্রাণ দিয়ে ভুলের খেসারতি দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকবার উপায় ছিল না। মোগল রাজপুত্র মাত্রই ইংরেজি প্রবাদটাতে বিশ্বাস করতেন, ওয়ান হু ইজ নট উইদ্ মি ইজ এগেস্ট মি, যে আমার সঙ্গে নয়, সে আমার বিপক্ষে।
নির্ঝঞ্ঝাটে প্রতিষ্ঠিত বাদশাদের তো কথাই নেই, অতিশয় টলটলায়মান সিংহাসনে বসে দুদিনের রাজাও সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন সেপাই-শান্ত্রি, ফাঁসুড়ের দল– তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের উভয় চক্ষু অন্ধ করে দেবার জন্য যেন তারা চিরতরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সিংহাসন লাভের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা না করতে পারে। শান্তিকামী, ধর্মাচরণে আজীবন নিযুক্ত, সিংহাসনে আরোহণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক জনেরও নিষ্কৃতি ছিল না। নিষ্কৃতি ছিল একমাত্র পন্থায়– আত্মীয়-স্বজন দশ-দেশ ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। তবে সেটাও করতে হত আগেভাগে পরিপূর্ণ শান্তির সময়। একবার ধুন্ধুমার লেগে যাওয়া মাত্রই তামাম দেশে এসে যেত এমনই অশান্তি, লুটতরাজ যে তখন আর বন্দরে গিয়ে জাহাজ ধরার উপায় থাকত না। এমনকি পরিপূর্ণ শান্তির সময়ও আগেভাগে শেষরক্ষা বাবদে কসম খাওয়া যেত না– মক্কাতে নির্বাসিত বাইরাম খান নাকি পথমধ্যে গুজরাতে আকবরের গুপ্তচর দ্বারা নিহত হন।