যেতে যেতে আনন্দী বলল, দাদু, বাবা আমাকে বলেছিল, বাতাসী পিসিকে বাড়ি নিয়ে আসতে। সে তো বলছে, আসবে না।
গুল বাহাদুর ভারি খুশি হলেন। প্রথমত শিবু যে আহাম্মুখ ছিল না, তার শেষ প্রমাণ পাওয়া গেল বলে এবং তার চেয়েও বড় কথা, ছ বছরের আনন্দীর বুঝ-সমঝ আছে দেখে। বাপকা ব্যাটা না হলেও তার ঘোড়া তো নিশ্চয়ই। জোর গলায় হেসে বললেন, কুছ পরোয়া নহি, দাদু, ও বেটি সব-কুছ সম্হালেগি, তার পর বললেন, সমহালেগা। মনে মনে বললেন, দচ্ছাই ভাষা, স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গে ফারাক নেই। তার পর বললেন, সেই তো ভালো। এরা তো আর দিল্লি দরবারে মুশায়েরা করতে যাবে না যে ভাষাতে পয়ষট্টি রকমের বয়নাক্কার প্রয়োজন। ওই করেই তো আমাদের সব গেল। তার পর মনে পড়ল, কই, তাই-বা কেন? মাহমুদ বাদশাহ তো তাঁর সভাপণ্ডিত ফিরদৌসির সঙ্গে বয়েৎ-বাজি করতেন। তাঁর রাজত্ব তো যায়নি। বাহাদুর শা গালিবের সঙ্গে করলেই-বা কী দোষ! ফারসির কথাতে তখন মনে পড়ল, সে ভাষাতেও তো পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গের তফাৎ নেই। বিরক্ত হয়ে তখন বললেন, কী আশ্চর্য! চলছি ডোমবস্তির মধ্যিখান দিয়ে, আর স্বপ্ন দেখছি গজনির। অন্-নশূ শারও এর চেয়ে ভালো। আমাকে এখন দেখতে হবে, ছেলেটার পেটে ক্রিমি।
গুল বাহাদুর পড়েছেন এ বাবদে বিপদে। ক্রিমির নুসখা (প্রেসক্রিপশন) তিনি দু মিনিটেই লিখে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা লিখতে পারেন উর্দু কিংবা ফারসিতে। এবং তার জন্য যেতে হবে ইউনানি দাওয়াখানায়, হেকিমের কাছে। এ তল্লাটে তো এসব জিনিস থাকার কথা নয়। আর বোষ্টম বাবাজি লিখবেন ফারসি নুসখা! যদিও গুল বাহাদুর জানতেন, বৃন্দাবন অঞ্চলের বাবাজিরা ফারসিতে ইউনানি নুসখা বিলক্ষণ লিখতে জানেন।
গুল বাহাদুরের ভুল নয়। চৈতন্যদেব ইসলামি শাস্ত্রের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি একাধিকবার ইসলামি শাস্ত্র দিয়েই মোল্লাদের কাছে প্রমাণ করেন যে তার প্রচলিত ধর্ম ইসলামের মৌলিক সিদ্ধান্তের সম্মতি পায়।
আনন্দী বলল, দাদু, ওই দেখ হলদে পলাশ।
ততক্ষণে তারা গ্রামের বাইরে চলে এসেছেন। আর একটু দূরেই গুল বাহাদুরের রাজপ্রাসাদ।
দূরদূরান্তে চলে গেছে লাল খোয়াই। বাঁ দিকের উঁচু ডাঙা ভেঙে ভেঙে চলেছে খোয়াইয়ের অগ্রগতি। গুল বাহাদুরের আপন দেশ দোয়াবে প্রকৃতির হাত থেকে মানুষ অহরহ অনুর্বর জমি সওগাত পাচ্ছে চাষের জন্য, আর এখানে খোয়াইয়ের খাই আধা-বাঁজা আধা-ফসলের জমির উপর। খোয়াইটা চলে গিয়েছে কতদূরে প্রকাণ্ড একটা লাল সাপের মতো এঁকে-বেঁকে। মাঝে মাঝে ডাঙার ফালিটুকরো এসে যেন সাপের খানিকটে গতিরোধ করছে। ফের যেন অজগরের গ্রাসটা আরও বড় হয়ে আরও দূরে এগিয়ে গিয়েছে।
সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিটুকুও যেন এ খোয়াই শুষে নিতে জানে। খোয়াইয়ের শুরু থেকে সূর্যাস্তের মোকাম পর্যন্ত গাছপালার কোনও বালাই নেই। পাতার আড়াল থেকে বিকেলের আলোটুকু এখানে এসে কোনও কালো কেশে পড়ে না। সাঁওতালিনীরাও সন্ধের পরে ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না।
কিন্তু মাধুর্য আছে– সে মাধুর্য রুদ্রের।
কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) যে বর্ণনা কুরান শরীফে আছে সেটিও রুদ্র-মধুর, আশ্চর্য! আল্লাতালা মানুষের মনে ভয় জাগাবার জন্য কিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন কুরানে, কিন্তু তার প্রকাশ দিয়েছেন কাব্যরসের মারফতে। কেন? সোজা কথা। ঐতিহাসিক যখন লড়াইয়ের খবর লিপিবদ্ধ করে কত হাজার লোক মরল তার বর্ণনা দেয়, তাতে তো মানুষ ভয় পায় না। কারণ তাতে কাব্যরস নেই। ভয় অনুভূতি-বিশেষ। সেটা জাগাতে হলে কাব্যরসের প্রয়োজন। ইতিহাসের শুকনো ফিরিস্তি থেকে মন করে জ্ঞানসঞ্চয়, তাতে ভয়সঞ্চার হয় না।
এই রুদ্র-রসই এখন গুল বাহাদুরের জন্য প্রশস্ত।
ভাগ্যিস, তাঁকে পূর্ব-বাঙলার ঘনশ্যাম, কচিসবুজ, শিউলিভরা, শিশিরভেজা, পানাঢাকা বেতেসাজা পূর্ব-বাঙলার আশ্রয় নিতে হয়নি।
গাঁয়ের শেষ গাছ পেরিয়ে এসে তার খেয়াল গেল আনন্দী যেন কী একটা বলেছে। শুধালেন, কী বললে, দাদু?
পিছনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওই যে, হলদে পলাশ!
পলাশ হলদে হতে পারে, বেগুনি হতে পারে, সবুজও হতে পারে, এই হল গুল বাহাদুরের ধারণা। কিন্তু তাঁর মনে তবু ধোকা লাগল। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে আসবার সময় দু-চারটে ফুলগাছ তারা পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু আনন্দী কিছু বলেনি। এখনই-বা বলছে কেন? এ গাছটার তেমন তো কিছু জৌলুসও নয়। মাত্র গোটা পাঁচ গুচ্ছ ফুল ফুটেছে। গাছটাও বেঁটে। যেন থাবড়া মেরে চেপটে দেওয়া। এর তুলনায় গাঁয়ের ভিতরকার শিমুলে তো ডালে ডালে ফুল ছিল অনেক বেশি। বললেন, পলাশ– উয়ো তো ফুল। হলদে পিলা। তো ক্যা হল?।
আনন্দী কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে বলল, সব পলাশ লাল, এটা হলদে। বলে সে আঙুল দিয়ে গাঁয়ের ভিতরকার উঁচু উঁচু গাছের লাল পলাশ দেখিয়ে দিল।
এতক্ষণে বীরভূমের বৃক্ষ-বৃত্তান্ত বাবদে আকাট অগা গুল বাহাদুরের খেয়াল হল, তাই তো, আর সব পলাশ লাল, এটা হলদে।
উদ্ভিদতত্ত্বে এই তাঁর প্রথম পাঠ। আনন্দীর কাছে। বললেন, চলো দুটি ফুল পেড়েই নিই।
ছ বছরের ছেলে আনন্দীর উল্লাসের অন্ত নেই। বাপ যদিও বলেছিল, বাবাজিকে ডরাসনি তবু তার মন থেকে ওঁর সম্বন্ধে ভয় কাটেনি। একে তো গম্ভীর লোক, তার ওপর ওই যে দুশমনের মতো বদমেজাজি ঝিঙেও যার পায়ের কাছে বসে ভয়ে কাঁচুমাচু তার সঙ্গে সাহস করে কথা কওয়া যায় কী প্রকারে। তবে তার শিশুবুদ্ধি শিশুযুক্তিতে একটা ভরসা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল। সেটা কী? বাবাজিও বাতাসী বুড়িকে ডরায়। দ্বিতীয় ভরসা পেল এখন। যখন বলল, চল, দুটো ফুল পাড়ি। তার বাপ তাকে ভালোবাসত। তার সম্বন্ধে আনন্দীর কোনও ভয় ছিল না, কিন্তু তাকেও ফুল কুড়োতে বললে ঘাড় বাঁকিয়ে বলত, যা যা, খেলা করগে যা।