পাছে পল ভুল বোঝে তাই তাড়াতাড়ি বললুম, কিন্তু এই চারটি লোক বসে আছে, ঠিক এরাই যে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারার সেকথা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে হওয়ার সম্ভাবনা আছে– ওইটুকু যা কথা।
ইতোমধ্যে মুখে একটা মাছি ঢুকে যাওয়াতে বিষম খেয়ে কাশতে আরম্ভ করলুম। শান্ত হলে পর পল শুধাল, এদের কথা শুনে এদের প্রতি করুণা হওয়া উচিত, না অন্য কোনও প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে।
আমি অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললুম, আমার কী মনে হয় জানো? কেউ যখন করুণার সন্ধান করে তখনই প্রশ্ন জাগে, এ লোকটা করুণার পাত্র কি না? কিন্তু এরা তো কারও তোয়াক্কা করে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এরা আশা রাখে, স্বপ্ন দেখে, রাস্তার মোড় ঘুরতেই নদীর বাঁক নিতেই সামনে পাবে পরীস্থান, যেখানে গাছের পাতা রুপোর, ফল সোনার, যেখানে শিশিরের ফোঁটাতে হাত দিলেই তারা হীরের দানা হয়ে যায়, যেখানে
আরেকটুখানি কবিত্ব করার বাসনা হয়েছিল কিন্তু ইতোমধ্যে পার্সি মাছি তাড়াতে তাড়াতে এসে উপস্থিত। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখল ও-দ্য কলনের এক ঢাউস বোতল। মুখে হাসি, দুনিয়ার সবচাইতে ডাকসাইটে ও-দ্য-কলন– খাস কলন শহরের তৈরি কলনের জল– Eau de Cologne! 4711 মার্কা!
পার্সি বললে, দাঁও মেরেছি স্যর! বলুন তো এর দাম বোম্বাই কিংবা লন্ডনে কত?
আমি বললুম, শিলিং বারো-চোদ্দ হবে।
লঙ্কা জয় এবং সীতাকে উদ্ধার করেও বোধহয় রামচন্দ্রজি এতখানি পরিতৃপ্তির হাসি হাসেননি। তবু হনুমান কী করেছিলেন তার খানিকটে আভাস পেলুম, পার্সির বুক চাপড়ানো দেখে।
তিন শিলিং স্যর, তিন শিলিং! সবে মাত্র, কুললে, জ, তিন শিলিং! নট, এ পেনি মোর, নট ইভন, এ রেড ফার্দিং মোর।
এমন সময় দেখি, কাফের আরেক কোণ থেকে সেই আবুল-আসফিয়া-কী কী যেন-সিদ্দিকি সাহেব তাঁর সেই লম্বা কোট আর ঝোলা পাতলুন পরে আমাদের দিকে আসছেন। ইনি আমাদের সেই বন্ধু যিনি সবাইকে লাইমজুস, চকলেট খাওয়ান–কিন্তু যার। কসি কথা কওয়াতে।
আমরা উঠে তাকে অভ্যর্থনা জানালুম।
তিনি বসেই বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তাররা যেরকম একসরের প্লেট দেখে সেইরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।
পার্সি পুনরায় মৃদু হাস্য করে বললেন, একদম খাঁটি জিনিস।
আবুল আসফিয়া মুখ বন্ধ রেখেই নাক দিয়ে বললেন, হুঁ।
তার পর অনেকক্ষণ পরে অতি অনিচ্ছায় মুখ খুলে শুধালেন, এটা কার জন্য কিনলে?
পার্সি বললে, পিসিমার জন্য।
আবুল আসফিয়া বললেন, বোতলটার ছিপি না খুললে বিলেতে নামবার সময় তোমাকে প্রচুর কাস্টমসের ট্যাক্স দিতে হবে। এমনকি এ জাহাজে ওঠার সময়ও তবে সে আমি ঠিক জানিনে।
পার্সি আমার দিকে তাকাল।
আমি বললুম, ছিপি খোলা থাকলে ওটা তোমার আপন ব্যবহারের জিনিস হয়ে গেল, তাই ট্যাক্স দিতে হয় না।
অনেকক্ষণ পর আবুল আসফিয়া বললেন, যখন খুলতেই হবে তখন এই বেলা খুলে ফেলাই ভালো।
আমরা সবাই পার্সিও–বললুম, সেই ভালো।
ওয়েটার একটা কর্ক স্ক্রু নিয়ে এল। আবুল আসফিয়া পরিপাটি হাতে বোতল খুলে প্রথম কর্কটার ভিতরের দিকে ঝুঁকলেন, তার পর বোতলের জিনিস।
একটু ভেবে নিয়ে আমাদের শোকালেন।
কোনও গন্ধ নেই!
যেন জল-প্লেন, নির্জলা জল!
পার্সি তো একেবারে হতভম্ব। অনেকক্ষণ পর সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু ছিপি, সিল সবই তো ঠিক?
আবুল আসফিয়া বললেন, এসব হোট বন্দরে পুলিশের কড়াকড়ি নেই বলে নানা রকমের লোক অনেক অজানা প্রক্রিয়ায় আসল জিনিস সরিয়ে নিয়ে মেকি কিংবা প্লেন জল চালায়।
আমি পলকে কানে কানে বললুম, হয়তো আমাদেরই একজন অ্যাডভেঞ্চারার।
পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি, খাস জিবুটি-বাসিন্দারা দরদভরা আঁখিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুমান করতে বেগ পেতে হল না, এরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
পার্সিও খানিকটে বুঝতে পেরেছে। বললে, যাত্রীরা বোকা কি না, তাই এ শয়তানিটা তাদের ওপরই করা যায়। আর প্রতি জাহাজেই আসে এক জাহাজ
পল বাধা দিয়ে বললে, পার্সি!
পার্সি চটে উঠে বললে, ওহ্, আর উনিই যেন এক মহা! কন্-ফু-ৎস!
জাহাজে ফেরার সময়, আবুল আসফিয়াকে একবার একা পেয়ে শুধালুম, ছোঁড়াটাকে বড় নিরাশ করলেন।
বললেন, উপায় কী? না হলে প্রতি বন্দরে মার খেত যে!
.
০৮.
গুণীরা বলেন, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে কথা বলবে।
জিবুটি ত্যাগ করার সময় পার্সি বন্দরের দিকে তাকিয়ে বললে, লক্ষ্মীছাড়া জায়গাটা। ও-দ্য কলনের খেদটা তখনও তার মন থেকে যায়নি। তাই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই কথাটা বলল।
ঘন্টাখানেকের ভিতর উঠল ঝড়। তেমন কিছু মারাত্মক নয় কিন্তু সি সিকনেস দিয়ে মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। পার্সিই প্রথম বিছানা নিল। বমি করতে করতে তার মুখ তখন শর্ষে ফুলের রঙ ধরেছে। ভাঙা গালদুটো দেখে মনে হয় সত্তর বছরের বুড়ো।
আমি নিজে যে খুব সুস্থ অনুভব করেছিলুম তা নয়। তবু পার্সিকে বললুম, তবে যে, বস, জিবুটি বন্দরকে কটুকাটব্য করছিলে? এখন ওই লক্ষ্মীছাড়া বন্দরেই পা দিতে পারলে যে দু মিনিটেই চাঙা হয়ে উঠতে। মাটিকে তাচ্ছিল্য করতে নেই– অন্তত যতক্ষণ মাটির থেকে দূরে আছ– তা সে জলের তলাতে সাবমেরিনেই হোক, উপরে জাহাজেই হোক, কিংবা তারও উপরে বাতাসে ভর করে অ্যারোপ্লেনেই হোক। তা সে যাক গে। এখন বুঝতে পারলে গুণীরা কেন বলেছেন, অগ্র-পশ্চাৎ ইত্যাদি?