মোল্লা সেই অনাদৃত অবহেলায় আবার সাধনা করতে লাগলেন স্বাধীনতা জয়ের নতুন সন্ধানে। কিন্তু হায়, দীর্ঘ বাইশ বৎসরের কঠিন যুদ্ধ, নিদারুণ কৃসাধনে তাঁর স্বাস্থ্য তখন ভেঙে গিয়েছে। শেষ পরাজয়ের এক বৎসর পর, যে ভগবানের নাম স্মরণ করে বাইশ বৎসর পূর্বে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিলেন তাঁরই নাম স্মরণ করে সেই-লোকে চলে গেলেন যেখানে খুব সম্ভব সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব নেই।
এই যে জিবুটি বন্দরে বসে বসে চোখের সামনে তাগড়া লম্বা জোয়ান সোমালিদের দেখছি, তারাও নাকি তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে।
বীরের কাহিনী থেকে আমরা উৎসাহ সঞ্চয় করব, তা না হলে আমি এ দুঃখের কাহিনী তুললুম কেন? তার কারণ বুঝিয়ে বলার পূর্বে একটি কথা আমি বেশ জোর দিয়ে বলতে চাই।
ফরাসিরা বড় খারাপ, ইংরেজ চোরের জাত এরকম কথার কোনও অর্থ হয় না। ভারতবর্ষে বিস্তর পকেটমার আছে, তাই বলে কেউ যদি গাল দেয় ভারতবাসীরা পকেটমার তা হলে অধর্মের কথা হয়। ইংরেজ জাত অত্যাচারী একথা বলার কোনও অর্থ হয় না।
তাই যখন অধর্ম অরাজকতা দেখি তখন সংযম বর্জন করে তদণ্ডেই অস্ত্রধারণ করা অনুচিত। বহু জাত বহু বার করে দেখেছে, কোনও ফল হয়নি; হিংসা আর রক্তপাত শুধু বেড়েই গিয়েছে।
তাই মহাত্মাজি অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। অহিংসা দিয়ে হিংসা জয় করতে হবে। এর চেয়ে মহৎ শিক্ষা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষ যদি তাই দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-সংগ্রাম, লুণ্ঠন-শোষণ রুদ্ধ করতে পারে তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সে সর্বসভ্য জাতি বলে গণ্য হবে।
এবং শেষ কথা– সবচেয়ে বড় কথা
আমাদের যেন রাজ্যলোভ না হয়। এদের অন্যায় আচরণ দেখে আমরা যেন সতর্ক হই। আমরা দুশো বৎসর পরাধীন ছিলুম। পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।
.
০৭.
পল জিগ্যেস করলে, একদৃষ্টে কী দেখছেন স্যর? আমি তো তেমন কিছু নয়নাভিরাম দেখতে পারছিনে।
বললুম, আমি কিঞ্চিৎ শার্লক হোমসগিরি করছি। ওই যে লোকটা যাচ্ছে দেখতে পারছ? সে ওই পাশের দোকান থেকে বেরিয়ে এল তো? দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ফ্রিজোর; তাই লোকটার ঘাড়ের দিকটা দেখে অনুমান করছিলুম জিবুটি বন্দরের নাপিতদের কোন পর্যায়ে ফেলি?
পার্সি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার ঠিক মনে আছে। আমি তো চুল কাটাবার কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। চলুন ঢুকে পড়ি।
আমি বললুম তা পার। তবে কি না, মনে হচ্ছে, এ দেশে কোদাল দিয়ে চুল কাটে।
পার্সি বললে, কোদাল দিয়েই কাটুক, আর কাস্তে দিয়েই কামাক, আমার তো গত্যন্তর নেই।
নাপিত ভায়া ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা জানেন না। আমি তাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলুম, পার্সির প্রয়োজনটা কী।
কিন্তু দোকানটা এতই ছোট যে, পল আর আমি সেখানে বসবার জায়গা পেলুম না। বারান্দাও নেই। পার্সিকে বললুম, তার চুল কাটা শেষ হলেই সে যেন বন্দরের চৌমাথার কাফেতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
চৌমাথায় একটি মাত্র কাফে। সবকটা দরজা খোলা বলে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, খদ্দের গিস গিস করছে। কিন্তু এইটুকু হাতের তেলো পরিমাণ বন্দর, এখানে মেলার গরুর হাট বসল কী করে?
ভিতরে গিয়ে দেখি, এ কী; এ যে আমাদের জাহাজেরই ডাইনিং রুম! খদ্দেরের সব-কজনই আমাদের অতিশয় সুপরিচিত সহযাত্রীর দল। এ বন্দর দেখা দশ মিনিটেই শেষ হয়ে যায় বলে, সবাই এসে জড়ো হয়েছেন ওই একটিমাত্র কাফেতেই। তাই কাফে গুলজার। এবং সবাই বসেছেন আপন আপন টেবিল নিয়ে। অর্থাৎ জাহাজের ডাইনিং রুমে যে চারজন কিংবা ছ জন বসেন এক টেবিল নিয়ে, ঠিক সেইরকম এখানেও বসেছেন আপন আপন গুষ্ঠী নিয়ে।
এক কোণে বসেছে গুটিকয়েক লোক, উদাস নয়নে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে। জাহাজে এদের কখনও দেখিনি। আন্দাজ করলুম, এরাই তবে জিবুটির বাসিন্দা। জরাজীর্ণ বেশভূষা।
কিন্তু এসব পরের কথা। কাফেতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে এ দেশের মাছি। চোখে পড়ে বাক্যটি শব্দার্ধেই বললুম, কারণ কাফেতে ঢোকার পূর্বেই একঝাক মাছি আমার চোখে থাবড়া মেরে গেল।
কাফের টেবিলের উপর মাছি বসেছে আল্পনা কেটে, বারের কাউন্টারে বসেছে ঝাঁকে ঝাকে, খদ্দেরের পিঠে, হ্যাটে– হেন স্থান নেই যেখানে মাছি বসতে ভয় পেয়েছে।
দু গেলাস নিধু-পানি টেবিলে আসামাত্রই তার উপরে, চুমুক দেবার জায়গায়, বসল গোটা আষ্টেক মাছি। পল হাত দিয়ে তাড়া দিতেই গোটা কয়েক পড়ে গেল শরবতের ভিতর। পল বললে, ওই য যা।
আমি বললুম, আরেকটা অর্ডার দিই?
সবিনয়ে বললে, না স্যর, আমার এমনিতেই ঘিন ঘিন করছে। আর পয়সা খরচা করে দরকার নেই।
তখন তাকিয়ে দেখি, অধিকাংশ খদ্দেরের গেলাসই পুরো ভর্তি।
ততক্ষণে ওয়েটার দুটি চামর দিয়ে গেছে। আমরাও চামর দুটি হাতে নিয়ে অন্য সব খদ্দেরদের সঙ্গে কোরাসে মাছি তাড়াতে শুরু করলুম।
সে এক অপরূপ দৃশ্য! জন পঞ্চাশেক খদ্দের যেন এক অদৃশ্য রাজাধিরাজের চতুর্দিকে জীবনমরণ পণ করে চামর দোলাচ্ছে। ডাইনে চামর, বাঁয়ে চামর, মাথার উপরে চামর, টেবিলের তলায় চামর। আর তারই তাড়ায় মাছিগুলো যূথভ্রষ্ট কিংবা ছন্নছাড়া হয়ে কখনও ঢোকে পলের নাকে, কখনও ঢোকে আমার মুখে। কথাবার্তা পর্যন্ত প্রায় বন্ধ। শুধু চামরের সাইসাই আর মাছির ভনৃভন! রুশ-জর্মনে লড়াই। মাত্র সেই চারটি খাস জিবুটি বাসিন্দে নিশ্চল নীরব। অনুমান করলুম, মাছি তাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, এবং মাছিদের সঙ্গে লড়নেওলা জাহাজযাত্রীর দলও তাদের গা-সওয়া। এরকম লড়াইও তারা নিত্যি নিত্যি দেখে।