রায় শুধালেন, কী রে, কী হয়েছে? প্রেমে পড়েছিস?’
গোলাম মৌলা বড় লাজুক ছেলে। বয়স সতের হয় কি না হয়, বাপ কট্টর খেলাফতি, ছেলেকে কী দেশে কী বিলেতে ইংরেজের আওতায় আসতে দেবেন না বলে সেই অল্পবয়সেই বার্লিন পাঠিয়েছেন। সুয্যিমামা না থাকলে সে বহুকাল আগেই বার্লিন ছেড়ে পালাত। কথা কয় কম, আর বড়দের ফাইফরমাস করে দেয় অনুরোধ বা আদেশ করার আগেই।
বলল, আমার ল্যান্ডলেডি আর তার মেয়েতে কী ঝগড়াটাই না লেগেছে যদি দেখতেন! মা নাচে যাচ্ছে, কিছুতেই মেয়েকে নিয়ে যাবে না। মেয়ে বলছে যাবেই।
রায় জিজ্ঞেস করলেন, মায়ের বয়স কত রে?
চল্লিশ হয়নি বোধ হয়।
‘মেয়ের?’
‘আঠারো হবে।
রায় বললেন, তাই বল! এতে তোর এত বেকুব বনার কী আছে রে? মা-মেয়ে যদি একসঙ্গে নাচে যায় তবে মায়ের বয়স ভাড়াতে অসুবিধা হবে না?
মৌলা বলল, কী ঘেন্না! মেয়েটাও দেমাক করে বলছিল, সে থাকলে নাকি মায়ের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। আমি ভাবলুম, রাগের মাথায় বলছে, কিন্তু কী ঘেন্না। মায়ে-মেয়ে এই নিয়ে লড়াই! মৌলার বিহ্বলতা কেটে গিয়েছে, আর তার জায়গায় দেখা দিয়েছে তেতো-তেতো ভাব।
আজ্ঞা তর্কাতর্কির বিষয় পেয়ে যেন রথের নারকোলের উপর লাফিয়ে পড়ল। একদল বলে বাচ্চার জন্য মায়ের ভালোবাসা অনুন্নত সমাজেই পাওয়া যায় বেশি, অন্য দল বলে ভারতের একান্ন-পরিবার সভ্যতার পরাকাষ্ঠা, আর একান্ন-পরিবার খাড়া আছে মা-জননীদের দয়ামায়ার উপর। লেডি কিলার সরকারকে জনরা বলত Schuerzenjaeger অর্থাৎ এপ্রন-শিকারী’, কাজেই সে যে মা-মেয়ে সকলের পক্ষ নিয়ে লড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী, আর গোঁসাই বিশ্বাস করেন যে, আমাদের মা যশোদার কাছে মা-মেরির মাদারূপ নিতান্ত পানসে।
রায় তর্কে যোগ দেননি। কথা কাটাকাটি কমলে পরে বললেন, ‘অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? হবে হবে, কলকাতা-বোম্বাই সর্বত্রই আস্তে আস্তে মায়ে-মেয়ে রেষারেষি আরম্ভ হবে।
তখন চাচা চোখ মেললেন। বললেন, ‘সে কি হে রায়সায়েব! তুমিও একথা বললে? তার চেয়ে কথাটা পাল্টে দিয়ে বলল না কেন, জর্মনিতেও একদিন আর এলড়াই থাকবে না। এখনকার অবস্থা তো আর স্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগ ল্যান্ডলেডিই বিধবা, আর যাদের বয়স ষোলর উপরে, তারাই বা বর জোটাবে কোত্থেকে? আরো বহুদিন ধরে চলবে কুরুক্ষেত্রের শত বিধবার রোদন। ১৪-১৮টা কুরুক্ষেত্রের চেয়ে কম কোন হিসেবে?’
গোঁসাই বললেন, কিন্তু—
চাচা বললেন, তবে শোনন।
কর্নেল ডুটেন্হফারের বাড়ি ছাড়ার বৎসরখানেক পরে হঠাৎ আমাকে টাকাপয়সা বাবদে বিপদগ্রস্ত হতে হয়। তখনকার দিনে বার্লিনে পয়সা কামানো আজকের চেয়েও অনেক বেশি শক্ত ছিল। মনে মনে যখন ভাবছি ধন্নাটা কোন চাকরী নিয়ে শুরু করব, অর্থাৎ ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটুটে অনুবাদকের, খবরের কাগজে কলামনিস্টের, না ইংরিজি ভাষার প্রাইভেট ট্যুটরের, এমন সময়ে ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্রাভেলের সঙ্গে দেখা। আমি একটা অত্যন্ত নচ্ছার রেস্তোরাঁ থেকে বেরুচ্ছি, তিনি তার মেসেডেজ হাঁকিয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ক্লাইনার ইডিয়োট, ক্যুনিস্ট হয়ে গিয়েছ নাকি, এরকম প্রলেতারিয়া রেস্তোরাঁয় লবাব-পুত্তুর কী ভেবে?
‘তোমরা জানো, আমাকে ক্লাইনার ইডিয়োট’ অর্থাৎ হাবাগঙ্গারাম’ বলার অধিকার ক্লারার আছে।
আড্ডা ঘাড় নাড়িয়ে যা জানাতে চাইল তার অনুবাদ এককথায়—বিলক্ষণ।
চাচা বললেন, ততদিনে আমার জান শেখা হয়ে গিয়েছে। উত্তর দিলুম ডাকসাইটে কবিতায়–
কাইনেন্ ট্র্যোপ্ফ্ষেন্ ইন্ বেষার মেয়ার,
উন্ট্ ডেয়ার বয়টেল্ শ্লাপ্ উন্ট্ লেয়ার।।
গেলাসেতে নেই এক ফোঁটা মাল আর।
ট্যাঁক ফাঁকা মাঠ, বেবাক পরিষ্কার।।
ক্লারা বললেন, ‘পয়সা যদি কামাতে চাও তবে তার বন্দোবস্ত আমি করে দিতে পারি আমার পরিচিত এক ‘হঠাৎ-নবাবের’ ছেলের যক্ষ্মা হয়েছে। একজন সঙ্গীর দরকার। খাওয়া-থাকা তো পাবেই, মাইনেও দেবে ভালো। ওরা থাকে রাইনল্যান্ডে। বার্লিনের তুলনায় গরমে সাহারা।
আমি রাজি হলুম। দু’দিন বাদ টেলিফোনে চাকরি হয়ে গেল। হানোফার হয়ে কলন পৌঁছলুম।
মৌলা শুধাল, যেখান থেকে ‘ও দ্য কলন’ আসে?
হ্যাঁ, কিন্তু দাম এখানে যা, কলনেও তা। তারপর কলনে গাড়ি বদল করে বন্ন্, বন্ন্ থেকে গোডেসবের্গ। রাইন নদীর পারে। স্টেশনের চেহারাটা দেখেই জানটা তর হয়ে গেল। ভারি ঘরোয়া ঘরোয়া ভাব। ছোট্ট শহরখানির সঙ্গে জড়িয়ে মুড়িয়ে এক হয়ে আছে। গাছপালায় ভর্তি-বার্লিনের তুলনায় সোঁদরবন।
‘হঠাৎ-নবাব’ই বটে। না হলে জর্মনির আপন খাসা মের্ৎসেডেজ থাকতে রোল্স কিনবে কেন? ড্রাইভার ব্যাটাও উর্দি পরেছে মানওয়ারি জাহাজের এ্যাডমিরালের।
কিন্তু কর্তা-গিন্নীকে দেখে বড় ভালো লাগল। ‘হঠাৎ-নবাব’ হোক আর যাই হোক, আমাকে এগিয়ে নেবার জন্য দেখি দেউড়ির কাছে লনে বসে আছেন। খাতির-যত্নটা যা করলেন, আমি যেন কাইজারের বড় ব্যাটা। দু’জনাই ইয়া লাশকর্তা বিয়ার খেয়ে খেয়ে, গিন্নী হুইপট ক্রীম গিলে গিলে। কর্তার মাথায় বিপর্যয় টাক আর গিন্নীর পা দুখানা ফাইলেরিয়ায় ফুলে গিয়ে আগাগোড়া কোলবালিশের মতো একাকার। দু’জনেই কথায় কথায় মুচকি হাসেন—ছোট্ট মুখ দুখানা তখন চতুর্দিকে গাদা গাদা মাংসের সঙ্গে যেন হাতাহাতি করে কোনো গতিকে আত্মপ্রকাশ করে, এবং সে এতই কম যে তার ভিতর দিয়ে দাঁতের দর্শন মেলে না।।