মফঃস্বলে বদলি হওয়ার পর, বিক্রমের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার অবকাশ মেলেনি। অভিজিৎও, শর্বরীকে নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত থাকায়, আমাকে স্মরণ করেনি। আমি নিজেও তখন বনানীকে খোলাখুলি প্রেম নিবেদনে কৃতকার্য হতে পারিনি। ‘বলি বলি করি-বলিতে না-পারি’ এই ধরনের মানসিক দ্বন্দ্বে হাবুডুবু খাচ্ছি। ভদ্রসম্মত চাকরি একটা জুটলেও, সেটি ছিল সম্পূর্ণ অস্থায়ী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে, বনানীর মুখোমুখি বসে চীনেবাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে রোজই মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঝপ করে বলেই ফেলি, ঘর বাঁধলে কেমন হয়? কিন্তু হিম্মতে কুলোচ্ছে না। কয়েক মাস কেটেই গেল, বিক্রম, শর্বরী অভিজিৎ কারো খবর পাই না।
আচমকা এক সন্ধ্যায় বিক্রম ‘জরুরি কথা আছে’ইও বলে, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেল। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছি, বিক্রম বলছে না কিছুই। আমিও তাড়া মারছি। একটা ট্যাক্সি ডেকে ওঠাল। আমরা আকাশবাণী ভবন ছাড়িয়ে, খানিক এগিয়ে, ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পদচারণা পর, গঙ্গার ধারে বসা গেল। সিগারেটের পর সিগারেট ধ্বংস করে, পরোক্ষে আমাকে দূষিত বিষিত করে, মিনিট পাঁচেক অস্ফুট বাক্যালাপের প্রয়াসের পর, মিনিট দুয়েক বিরতি। অবশেষে, নিষ্কম্প সুস্পষ্ট অথচ অনুচ্চস্বরে, বিক্রম ঘোষণা করল, শর্বরীর অনুমতিক্রমে সে ডিভোর্স চায়।
আমি কী বলব, বা আদৌ কিছু বলা উচিত হবে কি না, বুঝে উঠতেই পারলাম। এরপর সে প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কিত একটি সারগর্ভ নাতিদীর্ঘ ভাষণ সমাপনান্তে, যে উপসংহারে উপনীত হল, তা হল এইরকম : শর্বরীকে সে ভালবাসে। কিন্তু বর্তমানে শর্বরী, বিক্রমের মধ্যে ভালবাসা বা সুখ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন, যার চোখের চাওয়ার শর্বরীর মনে দোলা লাগে, সে হল অভিজিৎ। শর্বরীর হৃদয়ের নিভৃতিতে বর্তমানে যে ঠাই নিয়েছে, সে হল অভিজিৎ।
বিক্রম মনে করেছিল, তার জীবনের প্রতিটি দিন শর্বরীর নিচ্ছিদ্র ভালবাসায় উদ্বেল হয়ে উঠবে। প্রতিটি রাত্রি মধুর হতে মধুরতর হবে শর্বরীর সুখ-সান্নিধ্যে। প্রতিটি আকাক্ষিত মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে উঠবে, দ্বৈত কামনায়। প্রতিটি দুঃখের ক্ষণ গরীয়ান হয়ে উঠবে, মিলিত অপাতে। বিক্রমের এবম্বিধ প্রেম-পরিণয়-পরিক্রমার রাবীন্দ্রিক বৃিত্রি পর, আমার বক্তব্য বাহুল্যই ছিল, তবু, একেবারে নীরব থাকলে, বিক্রম মনে করতে পারে, আমার উদাসীন এবং তার সমস্যায় অংশ নিতে অনাগ্রাহী।
তাই প্রকৃত শুভানুধ্যায়ী হিসাবে প্রশ্ন রাখলাম, শর্বরীর সঙ্গে কথা বলব? কখনই নয়, সার্টেনলি নট।
পরিবার-পরিকল্পনার যুগে, সন্তান-সন্ততির ঝুট-থামেলা না থাকায়, বিবাহবিচ্ছেদে কোনওরকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হল না। অতএব বছর দেড়েকের মাথায়, আইনের পথ অনুসরণ করে, উভয়ের সম্মতি ও সমর্থনে বিক্রমের বিদায় পর্ব মসৃণ ও সরলপথে সঙঘটিত হল। রঙ্গমঞে অভিজিতের প্রবেশ পূর্বক শর্বরীর দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হল রেজিস্ট্রি অফিসে।
এখন, বিক্রম তার কর্মস্থলে। শর্বরী-বিক্রমের পুরান ফ্ল্যাটে, নতুন সংসার পাতল অভিজিৎ। আমরা ক’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সাধারণ বুদ্ধিতে ধরেই নিয়েছিলাম পিতৃমাতৃহীন বাধাবন্ধ হারা বিক্রম বুঝি বা আর কলকাতামুখো হবে না। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। সুখী ও জয়ী অভিজিৎ মহান ঔদার্যে বিক্রমকে সপ্তাহান্তিক অবকাশযাপনের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল। এবং বিষম বিস্ময়ের বিষয়, বিক্রম আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কুণ্ঠিত হল না। আমরাও সকৌতুক সিদ্ধান্তে এলাম, বেতাল পঞ্চবিংশতি কাহিনী অনুসরণে, বিক্রম ও অভিজিতের মধ্যে কে মহত্তর তারই মহড়া চলছে।
এরমধ্যে আমার ও বনানীর বিয়েতে শর্বরী-অভিজিৎ-বিক্রম তিনজনে জোটবেঁধে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে। আর, শরৎ-সমগ্র উপহার দিয়েছে, একসঙ্গে তিনজনের নাম লিখে। পূর্বরাগ অধ্যায়ে, আমার ও বনানীর সান্ধবিহার বাঁধা ছিল। এখন, আর তার প্রয়োজন বোধ করি না। বনানী স্কুলে পড়াচ্ছে, সেই আগে বাড়ি ফেরে। আমার অফিস ছুটি ছটায়। শনিবার পুরো বন্ধ। কোনও সন্ধ্যাতেই আর যৌথ বিহারের সময় হয় না। শনি রবি আলসেমি আসে। টিভিতে সিনেমা দেখি।
সে শনিবার ছিল ‘শ্যামলী’—উত্তম-কাবেরী। আমরা দুজনেই একাগ্র। উত্তমকুমার তো কানীর প্রাণপ্রতিম এবং দীর্ঘাঙ্গিনী সুঠাম সুডৌল কাবেরীকে আমি বিভিন্ন কোণ থেকে মনে মনে মেপেজুপে নিচ্ছিলাম। উত্তমকুমারের একটি আকর্ষণীয় ফোটো বুকে জড়িয়ে কাবেরী বসু অবিরাম অশ্রুপাত করছে। আমি তখন বিমোহিত হয়ে কাবেরীর মূক অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেই, বনানীর মন্তব্য করে উঠল উত্তম কুমারের অমন অনবদ্য একখানি ছবি বুকে নিয়ে, যে কোনও মেয়েই আবেগে অশ্রুমতি হবে, কষ্ট করে চোখে জল আনার অভিনয় করতে হয় না। দু’জনে হেসে উঠতেই ডোরবেল বাজল।
খুলেই দেখি। ত্রিমূর্তি শর্বরী-অভিজিৎ ও বিক্রম প্রেমের ত্রিকোণমিত্রি এমন চলমান বিজ্ঞাপনে, আমি ও বনানী সসংকোচ হাস্যে সকুণ্ঠ অভ্যর্থনা জানালাম। বনানীর কথা জানি না, আমার তো বিক্রমের ওপরই রাগ হল। এ আবার কেমনতর আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা। শর্বরীকে ছাড়তেই যদি পারবি না, তবে বিবাহ-বিচ্ছেদের ভড়ং–এর কি দরকার?