কেন্দ্র কবুতর
ছিটকে গিয়ে পড়লম ঘরের কোনায় রাখা শৌখিন টেবিলটার ওপর। মট করে ভেঙে গেল ওটার পায়া। টেবিলের ওপর থেকে কাচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল। আবার যখন ভালো করে তাকালাম, তখন আমার জিভের ডগায় নোনতা স্বাদটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রায় ছফুট লম্বা লোকটি পায়ে-পায়ে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, আমার কাছে রিভলভারও আছে।
এ-কথা বলার কোনওই প্রয়োজন ছিল না। কারণ ওর একটা ঘুষিতেই আমি সরষেফুল দেখছিলাম। কোনওরকমে বললাম, কী কী চাই তোমার? যদিও মনে-মনে ভালোই বুঝতে পারছিলাম যে ও কী চায়।
লোকটি বলল, পাণ্ডুলিপিটা।
ওই ব্যথার মধ্যেও আমার চোখে বোধহয় একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল। সেটা দেখে লোকটি বলল, আমার দলের চিহ্ন– বলে একটা কাগজ ওর জামার বুকপকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিল।
কাগজটার মধ্যে লাল রঙ দিয়ে তোলা একটা হাতের পাঞ্জার ছাপ। ওটা দেখছিলাম, লোকটির কথায় আমার চমক ভাঙলঃ আমি লালপাঞ্জা দলের কমরেড।
আমি হেসে বললাম, এটা খুব উঁচুদরের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, ঠিক ধরতে পারছি না। তবে মনে হয়, ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রতীরে সূর্যোদয়ের ছবি, তাই না?
উত্তরে একটা বুটসুদ্ধ ভারি পা দড়াম করে এসে পড়ল আমার চোয়ালে ও পাণ্ডুলিপিটা বের করে দাও।
মনে-মনে রাগ হলেও আমি নিরুপায়। বললাম, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে, বলে ওর পেছনে আঙুল নিয়ে দেখালাম। লোকটি ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল।
ব্যস, ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল আমার কাছে। একটুও দেরি না করে টেবিলের ভাঙা পায়াটা তুলে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়ে দিলাম ওর চোয়ালে। ফট করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে-সঙ্গে অতবড় দেহটা সটান পড়ে গেল মেঝেতে।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। লোকটি ঢুকল কোথা দিয়ে! ভালো করে দেখেশুনেও কোনও দরজা খোলা দেখলাম না। তবে কি জানলা দিয়ে ঢুকেছে! এই ভেবে এগিয়ে গেলাম জানলার কাছে।
দূরে হোটেলের কার পার্কের সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই উধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে একটা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে দিল। এও কি লালপাঞ্জার কমরেড নাকি? রহস্যের জট ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে দেখছি!
প্রথম থেকে ভাবতে লাগলাম ঘটনাগুলো।
ঘটনার শুরু সেইদিন থেকে, যেদিন অশোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় কলকাতায়–একরকম হঠাৎই বলতে হবে।
নিত্তনৈমিত্তিক একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি পাওয়ার আশায় সন্ধের সময় গিয়েছিলাম ময়দানে। ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই দেখা হয়েছিল অশোকের সঙ্গে। অশোক বোস–আমার স্কুলের বন্ধু ছিল ও।
আরে, কাঞ্চন না!
চন্ডাশোক নিশ্চয়ই! আমিও কম অবাক হয়নি।
হ্যাঁ। তা কী করছিস এখন?
এই দেশভ্রমণ বলতে পারিস হালকা সুরে জবাব দিয়েছিলাম।
আচ্ছা, কাঞ্চন, আমার একটা কাজ করে দিবি?
একটু আশ্চর্য হয়ে বলি, কী কাজ?
খুবই সামান্য একটা ম্যানাস্ক্রিপ্ট একজন প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
তা সেটা আমাকে করতে বলছিস কেন? জানতে চাইলাম আমি।
দ্যাখ, তোকে খুলেই বলি, বলল অশোক, তুই নিশ্চয়ই সিরাজনগর স্টেটের নাম শুনেছিস?
হ্যাঁ–শুনেছি। না শুনলেও বললাম আমি।
সেই সিরাজনগরের রাজা ছিলেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়। তিনি সিনেমার এক হিরোইনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল সুলক্ষণা সেন। পরে সিরাজনগরের বিপ্লবীরা বিপ্লবের সময় রাজা-রানীকে খুন করে। শোনা যায় এর পেছনে নাকি লালপাঞ্জা নামে একটা দলের হাত ছিল। রানী সুলক্ষণা অভিনেত্রী ছিলেন বলে তার ওপর বিপ্লবীদের রাগ বোধহয় বেশি ছিল। তাকে ওরা এমনভাবে পিটিয়ে মেরেছিল যে, রাজবাড়ির সিঁড়ির ওপর শুধু এক তাল মাংসপিণ্ড পড়ে ছিল। এরপর শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের প্রথম পক্ষের ছেলে অতলান্ত রায় রাজা হন। রানী সুলক্ষণার ব্যাপারটা তিনি জানতেন না। রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার সময় রানীর মৃত্যুর খবর পান তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর গুপ্তঘাতকের ভয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে শোনা যায় যে, তিনি নাকি নেপালে এক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কিছুদিন পর অবস্থা শান্ত হলে রণজিৎ সেন রাজ্যের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠায় তিনি অর্থ সাহায্যের জন্যে দু-একটি প্রদেশের কাছে গোপনে আবেদন জানান।
কিন্তু এর মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা আসছে কোত্থেকে? এতক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে উঠি আমি।
আসছে–আসছে। একটু ধৈর্য ধরে শোন, বলে অশোক আবার শুরু করল, তুই নিশ্চয়ই সুরেন্দ্র পালিতের নাম শুনেছিস? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও বলে চলল, সুরেন্দ্র পালিত ছিলেন সিরাজনগরের রাজা শুদ্ধসত্ত্বর মুখ্য প্রতিনিধি। এই দিনসাতেক হল তিনি মারা গেছেন। এই পালিতসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একটু বিচিত্রভাবে। সে আজ প্রায় বছরদুয়েক আগের কথা। সিরাজনগরে আমি গিয়েছিলাম অফিসের কাজে–সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে। একদিন রাতে একটা অন্ধকার গলিতে দেখি দুটো লোক একজন বৃদ্ধ লোকের ওপর চড়াও হয়েছে। রাস্তায় আর লোকজন ছিল না। আমি ছুটে গিয়ে ওদের ওপর পড়ি। তারপর আমার সেই পুরোনো অভিজ্ঞতা সামান্য পরিমাণে অবোধ শিশুদুটোকে দান করলাম। বলে প্রাক্তন জেলা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন অশোক হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখাল। আমরা একসঙ্গেই বক্সিং শিখতাম।
বললাম, তারপর?
তারপর আর কী, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, আপনি কি জানেন, আপনি আজ কার জীবনরক্ষা করলেন? আমি বললাম, না–আমি এখানে নতুন এসেছি। তিনি বললেন, আমার নাম সুরেন্দ্র পালিত।…চমকে উঠলাম আমি। কারণ ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে কানাঘুষোয় অনেক কথাই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম সুরেন্দ্র পালিতই নাকি রাজা শুদ্ধসত্ত্বের পেছনে বসে সবকিছুর কলকাঠি নাড়তেন। যাকগে, তিনি বললেন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ–আমার মনে থাকবে। এরপর তিনি আমার নাম-ঠিকানা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
এতদিন পর হঠাৎ সেদিন–এই দিনদশেক আগে তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খবরের কাগজেই দেখেছিলাম, তিনি কলকাতায় আছেন। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন ভীষণরকম অসুস্থ। আমাকে দেখে বললেন, মিস্টার বোস, আপনার ওপর আমি খুব বড় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই। সিরাজনগরের রাজনীতির সমস্তরকম খেলারই সাক্ষী ছিলাম আমি। প্রচুর গুপ্তকথাও জানতে পেরেছিলাম। আমি আজ আমার স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আপনি দিল্লি যাবেন। সেখানে এক পাবলিশার্স আছে– মেহেতা অ্যান্ড সন্স। তাদের হাতে আপনি এই পাণ্ডুলিপিটা সামনের মাসের মধ্যে তুলে দিলে তারা আপনাকে পনেরো হাজার টাকা দেবে। এইরকমই কথা আছে। আপনি না করবেন না, মিস্টার বোস। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা শোধ দেওয়ার এই আমার শেষ সুযোগ। আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। কথা দিন আপনি।
আমি কথা দিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে একটা মোটা পাণ্ডুলিপি দেন। আমি সেটা নিয়ে আমার কাছে রাখি। কিন্তু তারপর থেকে একদম সময় করে উঠতে পারছি না। এর ওপর পরশুদিনই অফিসের কাজে একবার রাজস্থান যেতে হবে। এখন তুই এই কাজের ভারটা নিতে পারিস। পনেরোর মধ্যে পাঁচ হাজার তুই নিস, আর আমাকে বাকিটা দিয়ে দিস–রাজি? অশোক হাসিমুখে তাকাল আমার দিকে।
অশোকের কথাগুলোর মধ্যে কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাই সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম বললাম, আপত্তির কী আছে! কিন্তু রণজিৎ সেন এখন কোথায়, দিল্লিতে?
ঠিকই ধরেছিস, বলল অশোক, সেখানে কুমার রণজিৎ কয়েকজন বিরাট বিজনেস ম্যাগনেটের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন, রাজ্যের অর্থসঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্যে। কয়েকজন বিজনেসম্যান সিরাজনগরে তেলের কোম্পানি খোলার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই ব্যাপারেই রফা করে একটা চুক্তি হবে আর কী। ও চাই তেল, আর এ চায় টাকা। বলে অশোক হাসল।
আচ্ছা, অশোক, রণজিৎ সেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের ঠিক কীরকম রিলেটিভ হন?
কুমার রণজিৎ শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের শ্যালক। ওহ্-হো, আর-একটা কথা তোকে বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, কাঞ্চন। আমার কাছে কতকগুলো চিঠি আছে। আশ্চর্যভাবেই পেয়েছিলাম ওগুলো। একবার একজন নেপালিকে আমি খুব রিস্ক নিয়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতায় সে একটা চিঠির বান্ডিল আমাকে দিয়েছিল।
হেসে বাধা দিলাম আমি : মাইরি, একটা বই লেখ তুই, যাহাদের আমি প্রাণরক্ষা করিয়াছি।
শোনই না আগে! লোকটি আমাকে যা বলল, তা হল যে, ওই চিঠিগুলো সে একটি লোকের কাছ থেকে পায়। লোকটির পকেটে সে নাকি একটা লালপাঞ্জার ছাপওয়ালা কাগজ দেখতে পায়। লোকটি গুরুতর অসুস্থ ছিল। সে মারা যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল ভীষণ দামি চিঠি এগুলো। তাই সে কৃতজ্ঞতায় এগুলো আমাকে দিচ্ছে। যা হোক, পরে আমি এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করি যে, পাণ্ডুলিপির হাতের লেখা আর চিঠির হাতের লেখা একেবারে এক। তবে কি সুরেন্দ্র পালিতই চিঠিগুলো লিখেছেন? কিন্তু চিঠির নীচে সই আছে দিল্লির কোনও এক মিসেস সুচরিতা চৌধুরির। অনেকগুলো চিঠি–আমি আর পড়ে দেখিনি। ওগুলোও তুই নিয়ে আমাকে রেহাই দিস। আর পারলে ওই সুচরিতা চৌধুরীকে চিঠিগুলো ফেরত দিয়ে দিস।
এরপর আমি অশোকের সঙ্গে গিয়ে পাণ্ডুলিপি আর চিঠি নিয়ে অশোকেরই বুক করা এয়ার টিকেটে দিল্লি রওনা হই। তা এই অতি সামান্য কাজের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা বা মন্দ কী? কিন্তু তখন কি জানতাম, কী সাঙ্ঘাতিক বিপদ হায়েনার মতো হাঁ করে বসে রয়েছে আমারই জন্যে– দিল্লিতেই!
.
ঘরের জানলা দিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল সুচরিতা চৌধুরী। এ-জীবন আর ভালো লাগছে না। ওর মনে পড়ছিল সিরাজনগরের দিনগুলোর কথা। সেখানে সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিল অমিত-অমিত চৌধুরী। ওর কথা মনে পড়লে মাঝে-মাঝে এই পোড়া মনটা বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। হয়তো একথা সত্যি যে, অমিত সুচরিতাকে ভালোবাসেনি– যন্ত্র হিসেবেই দেখেছে চিরকাল। অথচ কী যে হয়েছিল ওই আঠেরো বছর বয়েসটায়! সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে অমিতকেই হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়েছিল ও। বিয়ের পর স্বামীর জন্য সবরকম কাজই করেছে। উঃ–সেই বিপ্লবের রক্তাক্ত দিনগুলো, যেদিন শেষবারের মতো আর্তনাদ করে উঠেছিল অমিত। ওর মনে পড়ল লালপাঞ্জা দলের কথা। আজ পর্যন্ত ও সে-দলের কাউকেই দেখেনি। তবে একটা কাগজ দেখেছিল অমিতের কাছে তাতে একটা পাঞ্জার ছাপ ছিল লাল রঙের। সেটা নিশ্চিত বিপদের ইশারা বয়ে এনেছিল।
অমিতের মৃত্যুর পর যখন ও সিরাজনগর ছেড়ে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য দিল্লির দিকে পা বাড়িয়েছিল, সেইসময় ওকে রণজিৎ সেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অমিত চৌধুরীর একনিষ্ঠ সাহায্যের প্রতিদান দিতে তিনি যে অক্ষম সে কথাই জানিয়েছিলেন। বারবার করে। সুচরিতা লজ্জা পেয়েছিল। এর পরই ও দিল্লিতে চলে আসে। টাকার অভাব ওর ছিল না–এখনও নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।
এই প্রসঙ্গেই ওর মনে পড়ল সুরেন্দ্র পালিতের কথা। তার স্মৃতিকথা লেখার ব্যাপারটা। ম্যানাস্ক্রিপ্টের কথা। হেন ব্যাপার বোধহয় ছিল না, যা সুরেন্দ্র পালিত না জানতেন। এখন যদি ম্যানাস্ক্রিপ্টটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়, তা হলে! তা হলে যে সর্বনাশ হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কুমার রণজিৎ একেবারে অথৈ জলে পড়বেন, অথৈ জলে পড়বে লালপাঞ্জা দলের কমরেডরাও। আর হ্যাঁ, আর অসুবিধেয় পড়বে সমর বর্মন। তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধেয় পড়বে সিরাজনগর।
সমর বর্মনকে নিজের লাইনে শিল্পী বলা যেতে পারে। লোকটার সঙ্গে সুচরিতার সামনাসামনি পরিচয় নেই, কিন্তু তার সম্বন্ধে এত কথা শুনেছে যে, তার চরিত্র সুচরিতার কাছে একটুও অচেনা নয়। লোকটা বহুবার প্রমাণ করেছে চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা। এরকম নিখুঁত টাইপের হীরে চোর ও ব্ল্যাকমেলার কেউ বোধহয় কোনওদিন দেখেনি। সুরেন্দ্র পালিত বহুবার সমর বর্মনকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পর সফলও হয়েছিলেন। সমর বর্মন জেলে গিয়েছিল তিন বছরের জন্য।
কিন্তু এখন? হ্যাঁ, এর মধ্যে তার মেয়াদ সম্পূর্ণ হয়ে সে বোধহয় ছাড়া পেয়ে গেছে। এই বর্মন লোকটা ছদ্মবেশ নিতে এত ওস্তাদ যে, ধারণার বাইরে। এককথায়, সমর বর্মন তার লাইনে সম্রাট। সে যখন সুরেন্দ্র পালিতের হাতে ধরা পড়েছিল তখন সুরেন্দ্র পালিত নিশ্চয়ই তাঁর স্মৃতিকথায় বর্মন সম্পর্কে অনেক কথাই লিখে গিয়েছেন, যা পুলিশ জানতে পারলে বর্মন মুশকিলে পড়বে।
সিরাজনগর যে মুশকিলে পড়বে তারও কারণ আছে। কারণ, কুমার রণজিতের আর্থিক অনটনের কথা বাইরের কেউই বিশেষ জানেন না। জানলে কুমার রণজিৎ সারা ভারতের কাছে ছোট হয়ে যাবেন। কিন্তু সুরেন্দ্র পালিত যদি এই সব ব্যাপারে খোলসা করে লিখে গিয়ে থাকেন ওই পাণ্ডুলিপিতে? নাঃ, পরের ব্যাপার আর ভাবতে পারছে না সুচরিতা। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সত্যিই সাঙ্ঘাতিক।
আবার অমিতের কথা মনে পড়ল সুচরিতার। ভালোবাসা কথাটার প্রকৃত সংজ্ঞা সুচরিতা জানে না। অনেকেই এখন ওকে পাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুচরিতা তাতে হেসেছে। যদিও অত্যন্ত স্বাভাবিক এই ব্যাপারটা। কারণ ওর তিরিশ বছরের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, কটাক্ষ, চেহারা ইত্যাদিকে অবহেলা করা কোনও পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এখনও কোনও-কোনও বিজ্ঞাপনের কাজে সুচরিতা নিজের অমূল্য সময় খরচ করে। নাম করা সিনেমার কাগজেও ওর ছবি মাঝে-মাঝে ছাপা হয়। তবু একটা কিছুর অভাব যেন ও বুঝতে পারে।
এমন সময় ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। চটপট উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সুচরিতা। দরজায় মৃদু হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ সান্যাল। ছিপছিপে চেহারার যুবক। চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। বয়স সুচরিতার চেয়ে কমই। আটাশ কি উনতিরিশ। তবু ছেলেটা ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চায়। সত্যি, কী বিচিত্র!
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তরুণ বলল, সুচরিতা, একটা জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। মানেকজি পাঠিয়েছেন আমাকে বুঝতেই তো পারছ।
দরজা বন্ধ করে সুচরিতা এসে চেয়ারে বসল। বলল, কী জরুরি খবর, শুনি?
মানেকজি আমাকে আজ সকালে বললেন, তোমাকে ফোন করে একটা খবর দিতে। আমি ফট করে বলে দিলাম ফোন খারাপ আছে, যাতে তোমার সঙ্গে অন্তত দেখাটা হয়। তখন তিনি আমাকে পাঠালেন কুরিয়ার হিসেবে।
তরুণ সান্যাল মানেকজিপ্রসাদজি ফার্মের পার্টনার মানেকজির প্রাইভেট সেক্রেটারি। সারাদিনে বেচারা একদম ছুটি পায় না, খালি ডিক্টেশন আর টাইপ।
রাবিশ বিরক্ত গলায় বলল তরুণ, আমার আর ভালো লাগছে না, সুচরিতা।
কেন, বেশ তো আছ। যাকগে, জরুরি কথাটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়? মুচকি হেসে জানতে চাইল সুচরিতা। ও জানে তরুণ সান্যাল বোকা নয়।
তা, মোটামুটি জানি বইকী। ইতস্তত করে বলল তরুণ, তুমি বরং মানেকজির কাছ থেকেই শুনে নিয়ো।
তরুণ! ঈষৎ ভৎর্সনা, কটাক্ষ, চোখের ইশারা-ব্যস ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল তরুণের পক্ষে। গড়গড় করে বিগলিতকণ্ঠে বলতে শুরু করল তরুণ, সুচরিতা, ব্যাপারটা সিরাজনগরের সঙ্গে, সুরেন্দ্র পালিতের সঙ্গে কানেক্টেড। অশোক বোস নামে এক ভদ্রলোক দিল্লি আসছেন আগামীকাল। সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা তার কাছেই আছে। তিনি সেটা এখানকার কোনও এক পাবলিশার্সের কাছে পৌঁছে দেবেন। তুমি তো বুঝতেই পারছ–ওই পাণ্ডুলিপি এখন ছেপে বেরোলে সর্বনাশ হবে। সেইজন্যেই মানেকজি আর প্রসাদজি খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। তোমার মনে আছে, গত বছর মিস্টার পালিত একবার কবুতর-এ এসেছিলেন, কিছু গোপন ব্যাপার আলোচনা করার জন্যে?
হ্যাঁ মনে আছে। উত্তর দিল সুচরিতা।
কবুতর! প্রসাদজির বাগানবাড়ি। শহরতলিতে বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি এই কবুতর। মাঝে মাঝে গোপন মিটিং থাকলে প্রসাদজি ওই কবুতরকেই ব্যবহার করেন। এবারও সেই তেলের ব্যাপারটা, টাকার ব্যাপারটা, আলোচনার জন্য একটা ঘরোয়া মিটিং ডাকা হয়েছে ওই কবুতরে।
এবারের মিটিংয়ের আলোচনার বিষয় কিন্তু অন্য। কুমার রণজিতও আসছেন। মানেকজি তোমাকেও ওই মিটিং-এ থাকতে বলেছেন। আর…।
তরুণকে ইতস্তত করতে দেখে সুচরিতা হাসল, বলল, শ্রীঅশোক বোসও আশা করি ওই মিটিং-এ আসছেন!
না, এখনও বোধহয় তাঁকে বলা হয়নি। আগামীকাল তিনি এসে হোটেল কন্টিনেন্টালে উঠছেন। তারপর নিশ্চয়ই বলা হবে।
ও, এবার বুঝেছি, ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে সুচরিতা বলল, তা হলে কবুতরে গিয়ে আমাকে ওই ভদ্রলোককে কবজা করতে হবে, যাতে তিনি আমার ছলাকলায় মুগ্ধ হয়ে ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট পাবলিশার্সের কাছে না দেন!
বুঝতেই তো পারছ, সুচরিতা। এতে তোমারও স্বার্থ আছে। তুমি কি চাও যে, ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট ছেপে বেরোক?
দ্যাখো তরুন, সত্যি কথা বলতে গেলে আমি তা চাই না। কিন্তু তা বলে মনের দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠতে পারল না সুচরিতা, বলল, যাকগে, আমি সোজাসুজি মানেকজিকেই আমার মত জানাব।
আচ্ছা, সুচরিতা, একটা কাজ করলে হয় না?
কী? অবাক হয়ে তরুণের মুখের দিকে তাকাল সুচরিতা। পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে তরুণ বোধহয় নতুন কিছু বলবে।
চলো না, আমরা দুজন একটু বেড়িয়ে আসি। মানেকজিকে গিয়ে বললেই হবে যে, আমি এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
না, তরুণ, আমার ঠিক মুড নেই। তা ছাড়া সময় কোথায়!
হুঁ, সময় তোমার আর কোনওদিনই হবে না। কবে তোমার মত পালটাবে বলতে পারো, সুচরিতা!
আচ্ছা, তরুণ, গতকাল সঁদনী চকের কাছে তোমাকে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখলাম…ওই মেয়েটি কে?
মুহূর্তের মধ্যে তরুণ স্যানালের মুখের রং পালটে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, ও কিছু নয়। তুমি কি জানো না সুচরিতা, ভালো আমি তোমাকেই বাসি!
মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ ধরনের লোকদের দেখলে ওর রাগ হয়। এইজন্যই আজকাল ওর আর কিছুই ভালো লাগছে না। চারপাশে সব স্তাবকের দল স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিনরাত প্রশংসা করে চলেছে। উঃ! মুখে বলল, তরুণ, তুমি এখন যাও। আমাকে একটুখানি একা থাকতে দাও–।
তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল ও।
তরুণ সান্যাল হতাশভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
সুচরিতা শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল অমিতের কথা। সুরেন্দ্র পালিতের পাণ্ডুলিপি যদি ছাপা হয় তবে কি ও বিপদে পড়বে? অথবা অমিত চৌধুরীর চরিত্রে দাগ পড়বে? না, কিচ্ছু ভাবতে পারছে
সুচরিতা। এ ছাড়াও কানাঘুষোয় ও আঁচ পেয়েছে যে, সমর বর্মন নাকি ওইদিনের মিটিংয়ে হাজির থাকছে। কারণ? কারণটা ঠিক পুরোপুরি জানে না সুচরিতা। তবে শুনেছিল যে, গত বছরের মিটিংয়ে সুরেন্দ্র পালিত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন। রানী সুলক্ষণার গলায় যে হীরের নেকলেস ছিল, সেটা কোনওরকমে সরিয়ে সুরেন্দ্র পালিত এতদূরে এসে এই কবুতরেই লুকিয়ে রেখেছিলেন–ওই মিটিংয়ের দিনই। অথচ সেই নেকলেস চুরির দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন সমর বর্মনের ঘাড়ে। সত্যিই সাংঘাতিক কূটবুদ্ধির লোক ছিলেন এই সুরেন্দ্র পালিত।
সুরেন্দ্র পালিত চলে যাওয়ার কিছুদিন পর কবুতরের মালি লাইব্রেরি-ঘরে একজন লোকের মৃতদেহ পায়। মৃত লোকটির পকেটে লালপাঞ্জা দলের প্রতীকচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে হীরের নেকলেসটার কথা সবাই জানে। আগামী মিটিংয়ে বর্মন যদি কারও ছদ্মবেশে আসে– তবে? নাঃ–এই অশোক বোস নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার। এবং কালই।
.
লোকটির অচেতন দেহটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছিলাম, এমন সময় ঘরে ঢুকল ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম হোটেল কন্টিনেন্টালের বেয়ারা। ও-ই আমার ঘর অ্যাটেন্ড করে। ও ঘরে ঢুকে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল, বলল, স্যার–এ কী কাণ্ড!
আমি কেটে যাওয়া ঠোঁটের কোনাটা রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলাম, বললাম, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। আমি আর-একটু হলেই একে জানলা দিয়ে ফেলে দিতাম। একে নিয়ে গিয়ে হোটেলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
ইব্রাহিম চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে লোকটির উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটিকে চিত করে দিল। আমি আয়নায় দেখছিলাম কতখানি আহত হয়েছি। হঠাৎ আয়নাতেই লক্ষ করলাম, ইব্রাহিম লোকটিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে। কে জানে! হয়তো আমার দেখার ভুল।
একটু পরেই লোকটিকে কোথায় যেন রেখে ইব্রাহিম আমার ঘরে ফিরে এল। এসে ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করল। ঘর সাফসুতরো হয়ে গেলে ওকে পাঁচটা টাকা দিলাম। ও চলে গেল।
হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধে ছটা। দারুণ কৌতূহল হচ্ছে ওই পাণ্ডুলিপি আর চিঠিগুলো নিয়ে। আজ পড়ব, কাল পড়ব, করেও সময় করে উঠতে পারিনি। এখন হাতমুখ ধুয়ে দরজা বন্ধ করে সুটকেশ খুললাম। দুটো প্যাকেটই বের করলাম।
প্রথমে চিঠির বান্ডিলটা ধরলাম। দু-একটা চিঠি উলটেপালটে দেখলাম। নিছকই প্রেমপত্র। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা। লেখিকা মিসেস সুচরিতা চৌধুরী। আর চিঠির ওপরে কোনও নাম উল্লেখ করে সম্বোধন নেই। শুধু মাই ডিয়ার দিয়ে শুরু। তবে একটা বিশেষ চিঠির মধ্যে একটা বাড়ির নামের উল্লেখ করা হয়েছে। কবুতর থেকে চিঠিটা লেখা হয়েছে। আর চিঠির ওপরে দিল্লি শব্দটি লেখা আছে। তার মানে দিল্লিরই কবুতর নামের কোনও বাড়ি থেকে চিঠিটা লেখা। কেউ কি এই চিঠিগুলো নিয়ে সুচরিতা চৌধুরিকে ব্ল্যাকমেল করছিল? সেইজন্যেই কি এগুলো দামি বলেছিল নেপালীটি? যাকগে, যার চিঠি তার দেখা যদি পাই তবে এ-ভার থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। বলা যায় না, ভদ্রমহিলা হয়তো আতঙ্কে পাগল হয়ে নিশিদিন কোনও ব্ল্যাকমেলারের অপেক্ষা করছেন।
চিঠিগুলো রেখে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে পড়লাম।
প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলাম।
সাধারণ ধরনের স্মৃতিকথা। সিরাজনগর সম্বন্ধে নানা তথ্য লেখা। পড়তে-পড়তে এক জায়গায় সমর বর্মনের কথা পেলাম। পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে, মানুষ ছদ্মবেশ নিয়ে সর্বাঙ্গে পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু কানের পরিবর্তন করা অসম্ভব…। তার মানে সমর বর্মনের কানে কি কোনও বিশেষত্ব আছে? নাকি এটা নিছক কল্পনা?
পাণ্ডুলিপিটা প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পর শেষ করলাম। এমন সময় ঘরের দরজায় নক করার শব্দ শোনা গেল। পাণ্ডুলিপি আর চিঠির বান্ডিলটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।
দেখি ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে। ওর হাতের ট্রেতে সাজানো ডিনার।
ও ট্রে-টা এনে টেবিলের ওপর রাখল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, ওর চোখের দৃষ্টি ড্রেসিং টেবিলের ওপর।
আমার দেখার ভুল?
ও খাবার রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তা হলে কি তা হলে কি…।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অবশ্য তার আগে চিঠির বান্ডিলটা সুটকেসে বন্ধ করে রাখলাম। আর পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
অনেক রাতে ঘরের ভেতরে কারও চলাফেরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সামান্য চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি ঘরের জানলাটা নেই। শুনতে অবাক লাগলেও ঠিক তাই। জানলার জায়গাটা জমাট অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ সেই জমাট অন্ধকারটা নড়ে উঠল। জানলাটা আবার দেখা গেল।
ছায়ামূর্তিটা ক্রমশ ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগোতে লাগল। আমি চুপিচুপি উঠে গিয়ে একলাফে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলাম। যে-লোকটি হতভম্ব হয়ে চমকে ফিরে তাকাল, তার হাতে একটা ছুরি ঝিকিয়ে উঠল। লোকটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ইব্রাহিম!
আমাকে আলো জ্বালতে দেখেই ও তীরবেগে আমার দিকে ছুটে এল। আমার চোখ ছিল ওর হাতের দিকে। নিমেষের মধ্যে দু-হাতে ওর ডানহাতের কবজি চেপে ধরলাম। দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। আমার আঁকুনিতে ইব্রাহিমের হাতের ছুরি পড়ে গেল মাটিতে। তারপর কেন জানি না ও হঠাৎই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়োল জানলার দিকে। এবং মুহূর্তের মধ্যেই জানলা পথে সটকে পড়ল।
ইব্রাহিমের পিছু নিয়ে লাভ নেই জেনে সে-চেষ্টা আর করলাম না। এগিয়ে এসে ছুরিটা তুলে নিলাম। সাধারণ ছুরি একটা, কিন্তু বাঁটের ওপর একটা হাতের পাঞ্জা খোদাই করে আঁকা। এখানেও লালপাঞ্জা! ইব্রাহিমও লালপাঞ্জা দলের কমরেড? তাই হয়তো গত বিকেলের অচেতন লোকটিকে দেখে ও একটু অবাক হয়েছিল।
তাড়াতাড়ি গিয়ে সুটকেসটা খুললাম। সর্বনাশ! চিঠির বান্ডিলটা অদৃশ্য হয়েছে। তবু ভালো যে, পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে শুয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার আলো নিভিয়ে জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই রাতে চেঁচামেচি করেও কোনও ফল হবে না। কারণ, ইব্রাহিম নিশ্চয়ই আর কন্টিনেন্টালের চত্বরে বসে নেই!
.
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠেই প্রথমে গেলাম ম্যানেজারের ঘরে।
আমাকে দেখেই তিনি বললেন, মিস্টার বোস, (অশোকের নামেই হোটেলে ঘর বুক করেছিলাম আমি। শুনলাম আপনার ঘরে নাকি গত রাতে চোর এসেছিল!
আমি বললাম, না তো! ইব্রাহিম কী একটা জরুরি খবর দিতে ভুলে গিয়েছিল বলে রাত দুটোর সময় খবরটা দিতে একবার এসেছিল।
কী খবর? কী খবর? ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ম্যানেজার।
ইব্রাহিমের শাদির নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। যাওয়ার সময় ও তাড়াতাড়িতে ওর ছুরিটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। আপনি কাইন্ডলি ওকে এটা দিয়ে দেবেন। বলে পাশপকেট থেকে ইব্রাহিমের অস্ত্রটা বের করে ম্যানেজারসাহেবকে দিলাম।
এটা যে সত্যি-সত্যিই একটা ছুরি দেখছি! আঁতকে উঠলেন ম্যানেজার।
না, দাঁত খোঁচানোর কাঠি মনে-মনে বললাম আমি, মুখে বললাম, ইব্রাহিম আশা করি হোটেলে আর নেই।
না, পালিয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গেই জানালেন তিনি।
চুরি অবশ্য তেমন কিছু যায়নি। তবু খবরটা দিয়ে রাখা ভালো, বললাম আমি, এক বান্ডিল চিঠি নিয়ে গেছে ইব্রাহিম। বোধহয় কোনও নামকরা লোকের নিজের হাতে লেখা এক অমূল্য পাণ্ডুলিপি মনে করেছে ওটাকে। বিবিকে শাদিতে উপহার দেবে হয়তো। চেয়ার ঠেলে উঠলাম আমি।
এমন সময় ম্যানেজার আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বোস, আপনি কি আমাদের হোটেলে আর থাকবেন?
তার মানে! যেতে গিয়েও ঘুরে তাকালাম আমি।
না, এরকম একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল…।
ওঃ– হেসে ফেললাম আমি : আপনিশুদ্ধ সবকটা বেয়ারাও যদি আমার ঘরে চুরি করতে ঢোকেন, তবু আমি এ-হোটেল ছাড়ছি না, আন্ডারস্ট্যান্ড?
ম্যানেজারকে উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
ওপরে ঘরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ করেছি, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো–
স্যার, ডেস্ক ক্লার্কের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
কী নাম? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
মিস্টার…। মিনিটখানেক নীরবতার পর আবার গলা শোনা গেল, স্যার, আমি ভদ্রলোকের কার্ড আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোন নামিয়ে রাখার একটু পরেই দরজায় নক করার শব্দ পেলাম। দরজা খুলতেই একজন বেয়ারা একটা কার্ড দিল আমার হাতে। তাতে লেখাঃ
শ্রীনরসিংহ দত্তরায় সেন চৌধুরী
বার-অ্যাট-ল
ডেক্স ক্লার্কের নীরবতার কারণ এখন বুঝতে পারলাম না। যা হোক, মনে-মনে নরসিংহবাবুর বাবাকে ছেলের নামকরণের জন্যে কয়েক হাজার ধন্যবাদ জানিয়ে বেয়ারাটিকে বললাম, বাবুকে ডেকে দাও–আমি দেখা করব।
একটু পরেই ঘরে যিনি প্রবেশ করলেন তাঁকে এক কথায় জলহস্তীর ছানা বলা যায়। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আসুন, আসুন
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে-বসতে তিনি বললেন, আমার নাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাধা দিলাম আমিঃ প্লিজ, আর বলার প্রয়োজন নেই। কার্ড পড়েই মাথা ঘুরছে। তার ওপর আবার বললে হয়তো হার্টফেল করব।
ভদ্রলোক একটু হাসলেন, বললেন, যদি ভুল না আমার হয়ে থাকে, তবে বোধহয় অশোক বোস আপনিই?
আমি মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ।
লয়ালিস্টদের তরফ থেকে আমি আসছি। শুনেছি আপনার কাছে সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার ম্যানাস্ক্রিপ্টটা আছে।
ঠিকই শুনেছেন। জানালাম আমি। ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম।
চাই না আমরা যে, পাণ্ডুলিপিটা ছাপা এখন হোক। কুমার রণজিতও চাইবেন না সেটা। আপনি আশা করি রাখবেন কথা আমাদের এবং প্রকাশ এখন পাণ্ডুলিপিটা করবেন না।
মোটেই না–মোটেই না। বরং আজকালের মধ্যেই আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের হাতে পাণ্ডুলিপিটা তুলে দিচ্ছি। নির্বিকারভাবে জানালাম আমি।
করতে এটা পারেন না আপনি। এতে বিপদ অনেক হবে।
আমি কথা দিয়েছি।
আপনি তা হলে শুনবেন না অনুরোধ আমাদের? এই শেষ কথা আপনার তা হলে?
আমি নিরুপায়–।
বেশ, উঠে দাঁড়ালেন শ্রীনরসিংহ : জানি অন্য আমরা উপায়। আমরা এটা ছাপানোর ব্যাপারটা করবই যেভাবে হোক বন্ধ। নমস্কার।
শ্রীনরসিংহ থপথপ করে বিদায় নিলেন।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অন্য উপায় মানে! ইব্রাহিমের মতোই কাউকে তিনি ব্যবহার করবেন নাকি!
প্রায় ঘণ্টাখানেক ডুবে রইলাম নানান চিন্তায়।
হঠাৎই সমস্ত চিন্তা ছিন্নভিন্ন করে ফোন বেজে উঠল।
চিন্তিত হলাম। এ আবার কে ফোন করল! এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো।
মিস্টার অশোক বোস?
আপনি?
মেহেতা অ্যান্ড সন্সের শ্রী জগদীশকিশোর মেহেতা।
ও কী ব্যাপার? ভীষণ অবাক হলাম আমি।
মিস্টার বোস, ম্যানাস্ক্রিপ্টটা কি আপনি আজ দেবেন?
হ্যাঁ, আমি একটু পরে গিয়ে দিয়ে আসব। ভাবলাম ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়াই ভালো।
পাগল হয়েছেন আপনি! আমি ডেফিনিটলি বলতে পারি ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে আপনি কোনওদিনই আমাদের অফিসে সুস্থ অবস্থায় পৌঁছোতে পারবেন না।
তা হলে?
আমি বরং গজানন শিকদার নামে আমার এক অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে পাঠাচ্ছি। আপনি ম্যানাস্ক্রিপ্টটার মতো একটা নকল প্যাকেট তৈরি করে হোটেলের কাস্টডিতে জমা দিন। তা হলে সবার নজর ওইদিকেই থাকবে। আর বাই দ্যাট টাইম পনেরো হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে আমি গজানন শিকদারকে আপনার ওখানে পাঠাচ্ছি। আপনি ওর হাতে সুরেন্দ্র পালিতের ম্যানাস্ক্রিপ্টটা দিয়ে দেবেন। আচ্ছা, রাখছি।
প্রায় আধঘণ্টা পর একজন ভদ্রলোক এলেন। বললেন, আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের গজানন শিকদার। বলে একটা পনেরো হাজার টাকার চেক পকেট থেকে বের করলেন।
আমি ইতিমধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। চেকটা নিয়ে পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে তুলে দিলাম। বললাম, মিস্টার শিকদার, সাবধানে যাবেন। আমার কিন্তু আর কোনও দায়িত্ব নেই।
মৃদু হেসে গজানন শিকদার চলে গেলেন।
তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই একটা বয় এসে একটা কার্ড আর চিঠি দিয়ে গেল। অবাক হয়ে সেটা নিলাম, দেখি তাতে লেখা?
শ্রী অশোক বোস সমীপেষু,
মহাশয়, আগামী রবিবার কবুতরে যে-পার্টি দেওয়া হচ্ছে তাতে আপনাকে সম্মানিত অতিথি হতে অনুরোধ করছি। বয়টির কাছে আপনার উত্তর দিলে বাধিত হব। ইতি–
সঙ্গের কার্ডে মানেকজিপ্রসাদজির ফার্মের নাম ও কবুতরের ঠিকানা ছিল। বয়টিকে ডেকে ওগুলো ফেরত দিয়ে বললাম, দুঃখিত, তোমার মালিককে বোলো, আমি বিশেষ কারণে পার্টিতে যেতে পারছি না।
বয়টি চিঠি ও কার্ড নিয়ে চলে গেল।
আমি এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সব কাজ শেষ। এখন শুধু জানতে হবে কে ওই সুচরিতা চৌধুরী। নামটার মধ্যেই যেন কেমন এক প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ আমার চোখ গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপর খোলা অবস্থায় রাখা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনের দিকে। এখনও পর্যন্ত নেড়েচেড়ে দেখিনি। হাওয়ায় ম্যাগাজিনটার কতকগুলো পাতা উলটে গেছে। সেখানে একজন মহিলার ফটো দেখা যাচ্ছে। নীচে লেখা : শ্ৰীমতী সুচরিতা চৌধুরী, মোতিবাগ।
লাফিয়ে উঠলাম আমি। ইস, যদি এঁরই হয়ে থাকে চিঠিগুলো! নাঃ, এক্ষুনি ওঁকে একবার সাবধান করে দিতে হবে। নয়তো বলা যায় না, চিঠিগুলো নিয়ে কেউ হয়তো মিসেস চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করবে। ভদ্রমহিলা তা হলে এখানে বেশ পরিচিত দেখছি!
ভাবলাম শহর দেখতে বেরোব। উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় পালটাতে লাগলাম। মনে-মনে নিজের পিঠ চাপড়ে বললাম, এখন শ্রীযুক্ত অশোক বোস মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবেন এবং তার পরিবর্তে মঞ্চে আবির্ভূত হবেন একমেবাদ্বিতীয়ম, আদি ও অকৃত্রিম, শ্ৰীযুক্ত কাঞ্চন মৈত্র!
.
সুচরিতা প্রসাধন সেরে বেরোতে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য, তরুণের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে শ্ৰীযুক্ত বোসের সঙ্গে দেখা করা। কী জানি কেমন দেখতে হবে ভদ্রলোককে! তিনি কি জানেন যে, সঙ্গে অ্যাটমবোমার মতো একটি ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে তিনি ঘুরছেন! বোধহয় না।
বেরোনোর আগে কাজের লোককে ডেকে সুচরিতা বলল, যতীন, আমি একটু বেরোচ্ছি।
কিন্তু দরজা খুলে বেরোতে যেতেই ধাক্কা লাগল একজন লোকের সঙ্গে। লোকটি বোধহয় ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল।
মাপ করবেন, লোকটি বলল, আপনিই কি মিসেস সুচরিতা চৌধুরী?
হ্যাঁ। সুচরিতার ভ্রূ-কুঞ্চিত হল। কী চায় লোকটি? একে তো ও চেনে বলে মনে হচ্ছে না।
লোকটি ওর দিকে চেয়ে হাসল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করে বলল, আপনার সঙ্গে একটু ব্যাবসার ব্যাপারে গোপন কথা আছে।
গোপন কথা! খুবই অবাক হল সুচরিতা।
প্লিজ, দয়া করে দরজাটা ছাড়ুন, ম্যাডাম। এখানে দাঁড়িয়ে তো আর কথা হতে পারে না! বলল লোকটি।
ইতস্তত করে সুচরিতা বলল, আচ্ছা–আসুন, ভেতরে আসুন।
ভেতরে গিয়ে বসল দুজনে।
বিচিত্রভাবে হাসল লোকটি ও আমার কাছে কতকগুলো কাগজ আছে। বলল সে।
কাগজ! আবার অবাক হল সুচরিতা।
লেখা কাগজ।
কী বলতে চাইছেন?
আপনার লেখা কাগজ।
আমার লেখা?
কাউকে আপনার লেখা চিঠির কাগজ।
আমার লেখা চিঠি! দেখি!
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সুচরিতা চৌধুরীর হাতে দিল লোকটি ও অনেকগুলো চিঠির একটি।
চিঠি দেখে মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ-চিঠি ও কোনওদিনই লেখেনি। ওর হাতের লেখাও নয় এগুলো। শুধু লেখিকার নামের জায়গায় ওর নাম লেখা আছে।
কিন্তু কী উদ্দেশ্য এই লোকটির? ব্ল্যাকমেলিং? নাকি অন্য কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে?
মনে-মনে নিশ্চিত কিছু একটা ভেবে নিয়ে সুচরিতা বলল, এগুলো আপনি কেমন করে পেলেন?
দেখুন, আমার এখন খুব অভাব চলছে। তাই হাজার পঁচিশেক টাকার ব্যবস্থা যদি করেন… সব চিঠিগুলোর জন্যে। অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল লোকটি।
মনে-মনে অতি দ্রুত চিন্তা করল সুচরিতা। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। ভাবল, দেখিই না কী মতলব।
সুচরিতা বলল, দেখুন, আপাতত আমার কাছে তো এত টাকা নেই। এই চিঠিটার জন্যে আমি শদুয়েক টাকা দিচ্ছি। আগামীকাল রাতে আপনি আসুন, তখন বাকি চিঠিগুলোর ব্যাপারে কথা বলা যাবে।
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে লোকটির হাতে দিল ও। চিঠিটা রেখে লোকটি চলে গেল।
চিঠিটা পড়ল সুচরিতা। নিছক একটা প্রেমপত্র। কী কারণে কে কাকে লিখেছিল তা বুঝতে পারল না। চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে উঠে গিয়ে ফোন করল তরুণের অফিসে। সেখান থেকে। অশোক বোসের হোটেলের নাম জেনে সেই হোটেলে ফোন করল।
হ্যালো, হোটেল কন্টিনেন্টাল?
হ্যাঁ–কাকে চান?
অশোক বোসকে।
কাইন্ডলি একমিনিট অপেক্ষা করুন, লাইন দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে কারও কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে কথা বলছেন?
আমি কি অশোক বোসের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে বলছেন?
মিসেস সুচরিতা চৌধুরী।
ওদিকের কণ্ঠস্বর চমকে উঠল মনে হলঃ মিসেস চৌধুরী!
হ্যাঁ। আপনার কাছেই তো নটোরিয়াস ম্যানাস্ক্রিপ্টটা রয়েছে, না?
কাছাকাছি গিয়েছিলেন। আছে নয়, ছিল।
তার মানে! তার মানে আপনি?
ঠিকই ধরেছেন। ওটা এখন মেহেতা অ্যান্ড সন্সের কাছে। আজ সকালেই ওটা ওদের হাতে তুলে দিয়েছি।
ওঃ– সুচরিতা যেন আশাহত হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রিসিভার নামিয়ে রাখল।
ওপারের কণ্ঠস্বর তখনও বলছিল, কিন্তু মিসেস চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার–।
সুরেন্দ্র পালিত, কুমার রণজিৎ, মৃত কুমার অতলান্ত রায়, মানেকজি, প্রসাদজি, তরুণ, অমিত এবং অশোক বোস–সবাই যেন সুচরিতার চারপাশে এসে ছায়ার মতো ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। সবাই হাত বাড়িয়ে ওর থেকে যেন কিছু চাইছেন।
চকিতে সুচরিতার মনে পড়ল ব্ল্যাকমেলারটির কথা। আবার আগামীকাল! চোখ বুজল সুচরিতা।
.
পরদিন রাত দশটার সময় ক্লাব থেকে ফিরল সুচরিতা। একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে আজ। কিন্তু সদর দরজা হাট করে খোলা কেন! দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকল। যতীনকে কোথাও দেখতে পেল না। কোথায় যেতে পারে! হঠাৎই লক্ষ করল, একটুকরো কাগজ মেঝেতে হাওয়ায় উড়ছে। কৌতূহলে কুড়িয়ে নিল ওটা। এ যে একটা চিঠি! তাতে লেখাঃ
যতীন,
শিগগিরই চাঁদনি চকের বাজারের কাছে চলে আয়। অনেক জিনিসপত্র কিনে ফেলেছি।
–দিদিমণি।
অবিশ্বাস্য। কোনও চিঠি ও যতীনকে পাঠায়নি। অবশ্য একথা ঠিক যে, ক্লাবের ফোন খারাপ থাকলে মাঝে-মাঝে এ ধরনের চিঠি ও ক্লাব থেকে পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু ক্লাবের ফোন তো ঠিকই আছে!
অর্থাৎ, সব জেনেশুনেই এই চিঠিটা কাউকে দিয়ে পাঠানো হয়েছে।
পায়ে-পায়ে শোবার ঘরে এসে সুচরিতার বিস্ময় আতঙ্কে পালটে গেল। শোওয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একজন চেনা লোক। একটা সুদৃশ্য ছুরি তার হৃৎপিন্ডকে এফেঁড়-ওফেঁড় করে দিয়েছে। লোকটি এই হিসেবে চেনা যে, তাকে আগের দিনই সুচরিতা দেখেছে। এ সেই ব্ল্যাকমেলার।
তার মানে টাকার জন্য সে আজ সময়মতোই এসেছিল। কিন্তু কে মারল ওকে?
হতভম্ব অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুচরিতা। আজই ওকে কবুতরে যেতে হবে। ও মিটিং এ যাবে, কারণ অশোক বোসের ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু এ কী ঝামেলা? এরপর পুলিশ আসবে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ব্ল্যাকমেলিংয়ের কথা বেরিয়ে পড়বে। ও যে শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানোর জন্যই দুশো টাকা দিয়েছে তারা তা শুনবে না। তার মানে নিঃসন্দেহে ওঁকে কিছুদিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মিটিং-এ যাওয়া যাবে না। কিন্তু কারা ওকে এভাবে রহস্যের জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
এই মুহূর্তে কারও সাহায্য খুব দরকার এই ভেবে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল সুচরিতা। তখনই দেখল একজন সুপুরুষ যুবক ওর বাড়ির নেমপ্লেটের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
হাতে যেন চাঁদ পেল সুচরিতা। কিন্তু ওকে দেখামাত্রই লোকটি বলে উঠল, মিসেস চৌধুরী, তাই না?
আপনি আমাকে চিনলেন কেমন করে?
একটা সিনেমা-ম্যাগাজিনের একটা ছেঁড়া পাতা তুলে ধরল লোকটি : আমার নাম কাঞ্চন মৈত্র।
দেখুন, ইতস্তত করে শুরু করল সুচরিতা, মানে, আমার ঘরে একজন লোক মরে পড়ে আছে–মানে, তাকে কেউ খুন করেছে। আপনি যদি পুলিশে…মানে…।
তার বেশি আর বলতে হল না। কোথায় বডি? বলে তৎপর হয়ে উঠল কাঞ্চন। সুচরিতা জবাব দেওয়ার আগেই ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল সে।
সুচরিতার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। তাই বোধহয় প্রথম দেখাতেই একজন অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলেছে। কিন্তু…।
কোনও উপায় না দেখে সদর দরজা বন্ধ করে কাঞ্চনকে অনুসরণ করে শোবার ঘরে এল সুচরিতা।
ঘরের অবস্থা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল কাঞ্চন। তার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের শব্দ বেরিয়ে এল। তারপর নিজেকে সামলে বলল, বাড়িতে আর কে-কে আছে?
আপাতত কেউ নেই, তবে একজন কাজের লোক আছে–এখন বাইরে গেছে।
সে এলে দূরের একটা দোকান-টোকানে পাঠিয়ে দেবেন। ততক্ষণে আমি দেখি কদুর কী করতে পারি। বলে চটপট কাজে লেগে গেল সে।
তাকে সাহায্য করতে নিজেও হাত লাগাল সুচরিতা।
প্রায় একঘণ্টা পর বাইরের দরজায় কারও নক করার শব্দ শোনা গেল।
ওই বোধহয় যতীন এসেছে, বলে কাঞ্চনের দিকে একটা ইশারা করে বলল, প্লিজ কোনও শব্দ করবেন না। আমি এখুনি আবার ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সুচরিতা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ইতিমধ্যে লাশটাকে একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে রাখা হয়ে গেছে। তখনই হঠাৎ ছোরার হাতলটার দিকে চোখ গেল কাঞ্চনের। সে কি ভুল দেখছে নাকি? এই তো! এই তো লেখা রয়েছে পরিষ্কারভাবেঃ সুচরিতা চৌধুরী।
সর্বনাশ! তা হলে তো ছুরিটার আলাদা একটা ব্যবস্থা করতে হয়! চটপট হাতে রুমাল জড়িয়ে এক হ্যাঁচকায় ছুরিটাকে বের করে নিল কাঞ্চল। রক্ত এতক্ষণে জমাট বেঁধে আসায় বিশেষ অসুবিধেয় পড়তে হল না।
এই সময় আবার ঘরে এসে ঢুকল সুচরিতা। ওকে দেখেই কাঞ্চন বলল, দেখুন তো, কিছুটা ব্রাউন পেপার আনতে পারেন কি না। এই ছোরাটাকে মুড়ে একটা প্যাকেটমতো করতে হবে।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সুচরিতা।
ট্রাঙ্কের ডালাটা বন্ধ করতে গিয়েই দ্বিতীয় বিস্ময়। একচিলতে কাগজ উঁকি মারছে ইব্রাহিমের পকেট থেকে।
হ্যাঁ, এ-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই নেই? মৃত লোকটি হোটেল কন্টিনেন্টালের সেই রহস্যময় বেয়ারা ইব্রাহিম।
নীচু হয়ে চিরকুটটাকে বের করে নিল কাঞ্চন। তাতে লেখাঃ কবুতর, রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ
কাগজটা পকেটে গুঁজল সে।
কিছুক্ষণ পরই ব্রাউন পেপার হাতে ঘরে ঢুকল সুচরিতা।
সব কাজ সেরে তৈরি হয়ে কাঞ্চন বলল, মিসেস চৌধুরী, আপনি ঘরটাকে আর-একবার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখুন। আমি আপনার গাড়িটা নিয়ে এগুলোর ব্যবস্থা করতে রওনা হচ্ছি। গাড়িটা হয়তো কাল আপনাকে ফেরত দিয়ে যাব। আশা করি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন।
সুচরিতা এমনভাবে হাসল যার অর্থ, বিশ্বাস না করে উপায় কী!
ওরা দুজনে মিলে ট্রাঙ্কটাকে বাইরে এনে গাড়ির ডিকিতে রাখল। কাঞ্চন গাড়ি ছেড়ে দিল। যাওয়ার আগে সুচরিতার দিকে আশ্বাসের একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গেল।
সুচরিতা ভাবছিল। মিটিং আগামীকাল। কিন্তু আজ রাত থেকেই সকলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কবুতরে। ওরও আজ রাতেই যাওয়ার কথা।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল সুচরিতা। যতীন ফিরে এলেই ও বেরোবে। লক্ষ্য কবুতর।
মিটিং-এ ওর থাকাটা কি বিপজ্জনক? তাই কি এই রহস্যময় জঘন্য খুনের খেলা? কিন্তু কারা, কেন, মিটিংয়ে ওর হাজিরা চায় না? সেটাই–সেটাই এখন জানতে চায় সুচরিতা।
.
কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত খুনই হল ইব্রাহিম! কার দলের হয়ে কাজ করছিল ও লাল পাঞ্জা কি? হতে পারে। হয়তো তাদের কথার অবাধ্য হয়েই সুচরিতা চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল ইব্রাহিম। তাই হয়তো লালপাঞ্জার এই নিষ্ঠুর শাস্তি।
কিন্তু চিঠিগুলো গেল কোথায়? সুচরিতা চৌধুরী বাড়িতে ঢোকার আগে কি কেউ ঢুকেছিল ওঁর বাড়িতে? গাড়ি চালাতে চালাতে এই সব কথা মনে পড়ছিল। অথচ একইসঙ্গে আর-এক চিন্তা। সেটা হল, এই লাশটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লুকিয়ে ফেলতেই হবে–যাতে এটা খুঁজে বের করতে অন্তত দু-তিনদিন সময় লাগে।
হঠাৎই একটা কথা মনে এল। সুচরিতা চৌধুরীকে এই খুনের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ওঁর বাড়িকেই খুনের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হল! ছুরির বাঁটেও ওঁরই নাম লেখা! অর্থাৎ, কেউ-কেউ কবুতরে সুচরিতা চৌধুরীর উপস্থিতি চান না। কারণ? সুচরিতা মিটিংয়ে হাজির হলে কি কোনও বিপদের সম্ভাবনা আছে? কেন? কার?
চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। স্টিয়ারিং ধরে সোজা হয়ে বসলাম। শহরতলিতে চলে এসেছি বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন রাস্তার ধারে একটা গাছের কাছে গাড়ি থামালাম। ক্যারিয়ার খুলে ট্রাঙ্কটাকে বের করে রাস্তার ধারের নদৰ্মার দিকে গড়িয়ে দিলাম। দু চারবার উলটে-পালটে ট্রাঙ্কটা নদৰ্মার মধ্যে গিয়ে পড়ল। এইবার ব্রাউন পেপারে মোড়া ছুরিটাকে পকেট থেকে বের করে চিন্তা করতে লাগলাম, কোথায় লুকোনো যায় এটাকে।
হঠাৎই একটা মতলব মাথায় আসাতে হেসে উঠলাম। তারপরই ছুরিটাকে পকেটে রেখে চটপট গাছে উঠে পড়লাম। দুটো ডালের খাঁজে সাবধানে গেঁথে দিলাম ওটা। গাছে উঠে খোঁজার কথা পুলিশের নিশ্চয়ই মাথায় আসবে না।
গাছ থেকে নেমে হাতঘড়ির দিকে নজর দিলাম। পৌনে বারোটা। ফিরে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠে গাড়ি ছাড়তেই মনে পড়ল সেই কাগজটার কথা। ইব্রাহিমের পকেট থেকে পাওয়া চিরকুটটার কথা। কবুতর, রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ। কবুতরে রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশে কি কিছু ঘটবে নাকি? কবুতরের ঠিকানাটা ভাগ্যিস মনে রয়েছে এখনও। অতএব ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম কবুতরের উদ্দেশে। যে করেই হোক, বারোটা পঁয়তাল্লিশের আগেই কবুতরে আমার পৌঁছোনো চাই-ই চাই! আরও জোরে চাপ দিলাম অ্যাকসিলারেটরে।
শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হলাম কবুতরে। হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত বারোটা চুয়াল্লিশ। আর এক মিনিট বাকি।
গাড়ি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রসাদজির বাগানবাড়ি কবুতর। কবুতর নাম সত্যিই সার্থক হয়েছে। গোটা বাড়িটা ধপধপে সাদা। যেন কোনও রাজহংসী ডানা মেলে রয়েছে উড়ে যাওয়ার জন্যে।
কবুতরের সদর গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। বাড়িটার কোনও ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে না। নিঝুম নিস্তব্ধ। সুরকি ঢালা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কিছুটা যেতেই এক বিকট শব্দ ভেসে এল বাড়ির ভেতর থেকে।
গুড়ুম।
নিশ্চয়ই গুলির শব্দ!
শব্দটা একতলার কোনও ঘর থেকেই এল বলে মনে হল। পরমুহূর্তেই দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আমি তীরবেগে ছুটলাম শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। কে জানে, পরমুহূর্তে আমি কী দেখতে চলেছি!
দৌড়ে গিয়ে উঠোন পার হয়ে একতলার একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলাম। ঘরের সবকটা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোই ভেতর থেকে আটকানো। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। জানলার শার্সিগুলো ধরে টানাটানি করলাম। নাঃ, ভেতর থেকেই বন্ধ।
হঠাৎই আমি একটু ভয় পেলাম। এইরকম অবস্থায় কেউ যদি আমাকে আবিষ্কার করে, তবে! একথা মনে হতেই আবার ছুটলাম গাড়ি লক্ষ্য করে। গাড়িতে পৌঁছে আর-একবার ঘুরে তাকালাম কবুতরের দিকে। সেই আলোটা এখন নিভে গেছে। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলাম।
গাড়ি চালাতে চালাতে আবার মনে হল ইব্রাহিমের পকেটে পাওয়া সেই চিরকূটটার কথা। ইব্রাহিমের এখানে আসার কথা ছিল। আর তার বদলে এসেছি আমি। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। কিন্তু সুচরিতা? সুচরিতা যদি কবুতরে পৌঁছে থাকে, তবে ও গেল কোথায়! গুলির আওয়াজে কি কারওরই ঘুম (একজন বাদে, যার ঘরে আলো দেখা যাচ্ছিল) ভাঙল না!
যাই হোক, আমি আবার আসব এই কবুতরে মিটিংয়ে যোগ দিতে। নোবডি ক্যান স্টপ মি ফ্রম কামিং হিয়ার। আপনা থেকেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
.
পরদিন ভোরবেলা খবরের কাগজে খবরটা দেখে চমকে উঠলাম। কবুতরে আমার প্রায় চোখের সামনে গতকাল রাতে যিনি নিহত হয়েছেন, তিনি সিরাজনগরের বর্তমান প্রধান কুমার রণজিৎ সেন।
তা হলে মিটিং-এ এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে খুন করে কার লাভ? কেউ কি চেয়েছিল যে, কুমার রণজিৎ মিটিংয়ের আলোচনায় যোগ না দেন। কিন্তু কেন?
এ কী জটিল রহস্যের মুখোমুখি হলাম! রহস্যময় পাণ্ডুলিপি। ইব্রাহিমের মৃত্যু। সুচরিতা চৌধুরির নাম ধার করে লেখা প্রেমপত্র। সুচরিতা চৌধুরীকে মিটিংয়ে যেতে বাধা দেওয়া। কুমার রণজিতের মৃত্যু। লালপাঞ্জা–উঃ, কে জানে এর পরের অধ্যায় কী!
যা হোক, কবুতরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলাম। অসুবিধে হবে না। কারণ, সুচরিতা চৌধুরীর গাড়িটা সঙ্গে রয়েছে। মিনিটদশেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে গাড়িতে করে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য– কবুতর। কে জানে, হয়তো আরও কী রহস্য সেখানে আমার জন্যে ওত পেতে রয়েছে।
কবুতরে পৌঁছেই প্রথম যেটা চোখে পড়ল তা হল সারা বাড়ি জুড়ে একটা থমথমে ভাব। গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে সুরকি ঢালা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির কাছে পৌঁছোতেই কবুতরের একতলার বাঁদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল সুচরিতা চৌধুরী। গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়িতে কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে!
কিছুক্ষণ বোধহয় হাঁ করে চেয়েছিলাম ওর দিকে। চমক ভাঙতেই জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু সুচরিতার চোখের তারায় আশঙ্কার ছায়া কেঁপে উঠল। হরিণী-গতিতে ও এগিয়ে এল আমার কাছে। অস্ফুটভাবে বলল, আপনি এখানে। আপনার-আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
একটু অবাক হলেও সে-ভাবটা মুখে প্রকাশ করলাম না। কবুতরের বাইরে এসে দুজনে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি ছেড়ে দিলাম। লক্ষ্য, উদ্দেশ্যবিহীন।
কিছুদূর যাওয়ার পর আড়চোখে তাকালাম সুচরিতার দিকে। ওর চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি দেখে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ভয় নেই। ইব্রাহিমকে খুঁজে বের করতে পুলিশের অন্তত দিনদুয়েক লাগবে।
তারপর ওকে শুরু থেকে আমার কাহিনি শোনালাম–সব বললাম। শেষে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু সুচরিতা, এদিকের খবর কী?
একথা বলেই হৃৎপিণ্ডে এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। চোখ, মুখ, কান লাল হয়ে উঠল সর্বনাশ! ওকে নাম ধরে ডেকে ফেলেছি!
কিন্তু এ কী! সুচরিতা মাথা নীচু করে ছিল। আমার দিকে চোখ তুলে এক চিলতে হাসল। আমি সাহস করে বাঁ হাতটা ওর হাতের ওপর রাখলাম। বুঝলাম আমরা দুজনেই দুজনকে জানতে চাই।
এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম, সুচরিতা, আমরা একটা কিছু করতে পারি না?
কী? আনন্দে, কৌতূহলে ওর মুখ ঝলমল করছিল।
না, মানে, এই যে সব রহস্য–সেগুলো সম্ভ করার চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?
তা হলে তো দারুণ হবে। ছোট্ট মেয়ের মতো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুচরিতা।
আমি ওকে গতরাতের সব কথা খুলে বললাম। ও চোখ বড় বড় করে শুনল।
আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, দোতলার বাঁদিক থেকে তিন নম্বর জানলাটা কার ঘরের?
ওই ঘরেই কি আলো জ্বলতে দেখেছিলে তুমি?
মনে তো হয় তাই।
কিন্তু, তা হলে তো ঠিক মিলছে না। একটু চিন্তিতভাবেই জানাল সুচরিতা।
কেন? কেন?
ওই ঘরটায় মানেকজির এক দূরসম্পর্কের বোন থাকেন। তিনি তো বেশ কয়েকদিন হল আছেন। ওঁকে ঠিক এ-ব্যাপারে…।
মাঝপথে বাধা দিলাম আমি, বললাম, সূত্র যখন পাওয়া গেছে, তা যতই সামান্য হোক, তাই ধরেই এগোব আমরা। আমি ওই ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিচ্ছি। ওঁর নাম কী?
নয়না কল্যাণী।
এবার তবে কবুতরে ফেরা যাক। বললাম আমি, কিন্তু আমার সঙ্গে কী অনেক কথা আছে। বলছিলে যেন? হঠাৎই মনে পড়ায় প্রশ্ন করলাম।
কুমার রণজিৎ গতকাল রাতে রিভলভারের গুলিতে মারা গেছেন।
কাগজে পড়েছি। তুমি তাকে দেখেছ নাকি?
না। তবে সিরাজনগরে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।
সঙ্গে-সঙ্গে একটা সম্ভাবনা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আমার মানসচক্ষে ধরা পড়ল। চকিতে ব্রেক কষে দাঁড় করালাম গাড়িটাকে। ব্যাক করে ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়ার বেগে আবার গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম।
এ কী! কী হল? ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল সুচরিতা।
এখন আর কোনও প্রশ্ন নয়। এই মুহূর্তে আমাদের কবুতরে পৌঁছানো দরকার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি, তোমার কবুতরে পৌঁছোনো বন্ধ করার চেষ্টা যারা করছিল তাদের উদ্দেশ্য আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি।
তার মানে! কৌতূহলের ঝাপটায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে সুচরিতা।
এই কুমার রণজিৎ সম্ভবত তোমার পরিচিত কুমার রণজিৎ নন।
সুচরিতার মুখ থেকে শুধু একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। আমি বলে চললাম, যে এখানে কুমার রণজিৎ পরিচয়ে এসেছে, সে জানে যে, তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল হবে। তাই কবুতরে তুমি যাতে না আসতে পারো সেই ব্যবস্থা করেছিল। হয়তো সমর বর্মনই এখানে কুমারের ছদ্মবেশে এসে শত্রুপক্ষের হাতে মারা গেছে।
কিন্তু সমর বর্মন এখানে আসবে কেন?
সুরেন্দ্র পালিত রানী সুলক্ষণার হীরের নেকলেস কবুতরেই লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তার ম্যানাস্ক্রিপ্টেই এরকম হিন্টস ছিল। বর্মন সেই খবর পেয়ে হয়তো…।
কবুতরের বাইরে গাড়ি থামিয়ে সুচরিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললাম। উত্তেজনায় তখন আমার আর মাথার ঠিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে ওকে জিগ্যেস করলাম, পুলিশ কি এখনও কবুতরে রয়েছে?
কোনওরকমে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল সুচরিতা।
কবুতরের একতলার দরজা দিয়ে দুজনে ঢুকলাম। ডানদিকেই লাইব্রেরি। সেই ঘরের দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা দিলাম দুজনে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই চমকে উঠলাম।
কাঞ্চনবাবু, প্লিজ, একটিবার পেছন ফিরে তাকান। একটিবার দেখুন শিগগিরই। ওই দেখুন, কালো পোশাক পরা একটি নোক আপনার রেখে যাওয়া গাড়ির পেছনের সিটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল। গাড়ির দরজা বন্ধ করে একটু হাসল। ওই দেখুন, সে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দুরের বনানীতে। লোকটি কে বলুন তো! লোকটাকে যে আপনি চেনেন না সে কথা হলফ করে বলতে পারি। প্লিজ, আমার কথা এখনও শুনুন। কবুতরে কেন এলেন। ওই লোকটি প্রথম থেকেই পেছনের সিটের নীচে লুকিয়ে ছিল। কী সাঙ্ঘাতিক কান্ড বলুন তো!
আপনাকে তো প্রথমেই বলেছিলাম, প্লিজ কবুতরে আসবেন না।
লাইব্রেরিতে পা দিয়েই আমি চমকে উঠলাম। পুলিশের লোকজন ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাইব্রেরির র্যাকে সাজানো থরেথরে বই। মাঝখানে রাখা টেবিলটার নীচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাকে। যে-লোকটি শূন্য দৃষ্টি মেলে চিৎ হয়ে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে সে আমার বিশেষ পরিচিত। মেহেতা অ্যান্ড সন্সের কর্মচারী, গজানন শিকদার।
সুচরিতা আমার কানে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, ইনিই কুমার রণজিৎ। আমি শিয়োর।
তা হলে কুমার রণজিৎই মারা গেছেন! শেষ পর্যন্ত কুমার রণজিৎ নিজেই গিয়ে ভঁওতা দিয়ে আমার কাছ থেকে সুরেন্দ্র পালিতের ম্যানাস্ক্রিপ্টটা হাতিয়েছিলেন! বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই যে, কুমার নিজেই গজানন শিকদারের পরিচয় নিয়ে আমার কাছে গিয়েছিলেন। তার মানে মেহেতা অ্যান্ড সন্স থেকে যে-ফোন এসেছিল, সেটা ভঁওতা দিয়ে কুমার রণজিতই করেছিলেন।
যাকগে, ওই ম্যানাস্ক্রিপ্টটার জন্যে হা-হুঁতাশ করে কোনও লাভ নেই। সুচরিতার গা টিপে ফিসফিস করে বললাম, সু, চলো আমরা যাই।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরোতে যেতেই একটা হাত আমার কাঁধের ওপর এসে পড়ল।
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। চোখে পড়ল কাঠে খোদাই করা ভাবলেশহীন একটা বলিষ্ঠ চেহারা। একটু মৃদু হাসি ঠোঁটের রেখায় টেনে তিনি বললেন, মিস্টার…প্লিজ টেক ইওর সিট, বলে লাইব্রেরি-ঘরের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
আমি সুচরিতার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই তিনি বললেন, আ অ্যাম নোন টু এভরিবডি বাই দ্য নেম ক্রসওয়ার্ড। যদিও আমার নাম ওয়াডি ক্রসবি।
কাঞ্চন মৈত্র–। বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করলাম, বলুন, আমি আপনাদের কী কাজে লাগতে পারি? ইন্সপেক্টরকে বাঙালি ক্রিশ্চান বলে মনে হল।
আমি এখানকার থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর, মুখ খুললেন ক্রসওয়ার্ড, কুমার রণজিতের মিস্টিরিয়াস ডেথের ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করার ভার আমার ওপর পড়েছে। আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। আর তা ছাড়া আপনি ঘরে ঢুকেই কুমারের ডেডবডিটা দেখে যেভাবে চোখ কপালে তুললেন…। কথা অসম্পূর্ণ রেখে চোখ নাচালেন ক্রসওয়ার্ড।
এরপর মুখ না খুলে চুপ করে থাকা হবে স্রেফ বোকামি। তাই একটুও সময় নষ্ট না করে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি সুচরিতার বন্ধু। ওয়েল উইশার বলতে পারেন। কুমারের মারা যাওয়ার খবর আমি কাগজেই পড়েছি, কিন্তু তাঁর ডেডবডি দেখে আমার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে…।
তারপর প্রথম থেকে শুরু করে সব খুলে জানালাম তাঁকে। অবশ্য ইব্রাহিমের ব্যাপারটা বাদ। দিলাম।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ইন্সপেক্টর। তারপর বললেন, মিস্টার মৈত্র, এবার কাজের কথায় আসা যাক। কাল রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেছে। কবুতরের সবাইকেই আমরা প্রশ্ন করেছি, কেউ কিছু বলতে পারেননি। তাই আমরা কবুতরের চারিদিকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, একজন লোককে একটা গাড়ি চালিয়ে বারোটা সোয়া বারোটা নাগাদ কবুতরের দিকে যেতে দেখা গেছে। আপনাকে দেখে আমিও কম অবাক হইনি। কারণ, আপনার সঙ্গে সেই অপরিচিত লোকটির ডেসক্রিপশন প্রায় মিলে যাচ্ছে…।
কী…। ইন্সপেক্টরকে বাধা দিয়ে বলতে গেলাম আমি। কিন্তু ক্রসওয়ার্ড বাধা দেওয়ায় আমার চাইতেও বেশি এক্সপার্ট। তিনি চটপট বলতে শুরু করলেন, সেটাই সব নয়। আমরা কবুতরের সুরকি ঢালা পথে একসারি জুতোর ছাপ পেয়েছি। ছাপগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেশি এবং তাদের ডেস্থ দেখে আমরা আন্দাজ করছি যে, গত রাতে যেই এসে থাকুক না কেন, সে দৌড়েছিল। কবুতরের প্রত্যেকের জুতোর ছাপ আমরা নিয়েছি। আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন ক্রসওয়ার্ড, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। কারও সঙ্গে সেই ছাপ মেলেনি। এখন আপনার জুতোর সঙ্গে যদি এই ছাপটা না মেলে তবে আমাদের আরও ভালো করে প্রোব করে দেখতে হবে…। একটু থেমে দম নিলেন ক্রসওয়ার্ড।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, লুক হিয়ার, ইন্সপেক্টর। শুধু-শুধু আপনাদের পরিশ্রম আর খরচ বাড়িয়ে লাভ নেই। আমিই সেই রাতের আগন্তুক। আমিই এসেছিলাম কবুতরে।
ইন্সপেক্টর অবাক-টবাক কিছুই হলেন না। অল্প-অল্প হাসতে লাগলেন।
অত্যন্ত বিরক্ত হলেও বিরক্তি চেপে বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, ইফ ইউ ওয়ান্ট মাই কো অপ দেন প্লিজ স্টপ লাফিং। তারপর কাল রাতে যা-যা হয়েছিল সব খুলে বললাম।
ইব্রাহিমের পকেট থেকে পাওয়া সেই চিরকুটটার কথা চেপে গিয়ে বললাম, আমি সন্দেহ করেছিলাম যে, কবুতরে একটা কিছু ঘটতে চলেছে। তাই শখের গোয়েন্দাগিরির নেশাতেই কবুতরের ওপর লক্ষ রাখতে গত রাতে এসেছিলাম।
জানি না আমার ব্যাখ্যাটা কতটা জোরদার হল। কিন্তু ইন্সপেক্টরের মুখ দেখে মনে হল তিনি আমার কথা মোটামুটি বিশ্বাস করেছেন।
হঠাৎই মুখ তুলে বললেন তিনি, মিস্টার মৈত্র, একটা প্রশ্ন করব–ভালো করে ভেবে উত্তর দিন।
আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম তার দিকে।
আপনি কি শিয়োর যে, জানলাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?
হ্যাঁ, দৃঢ়স্বরে জবাব দিলাম আমি, আমি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা টানাটানি করেছিলাম। কিন্তু নড়াতেই পারিনি। বলতে বলতে আমি লাইব্রেরির তিনটে জানলার মধ্যে বাঁদিকেরটা দেখিয়ে বললাম, ওই তো, ওই জানলাটা।
কিন্তু এইখানেই একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, কাঞ্চনবাবু। আজ যখন আমরা এই ঘরে আসি তখন শুধু একটা জানলা খোলা ছিল এবং ওই জানলাটাই।
আশ্চর্য, বললাম আমি, তা হলে নিশ্চয়ই যে খুন করেছে, সে এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে, খুনি বাইরের লোক। জানলা দিয়ে এসে খুন করে আবার জানলা দিয়েই চলে গেছে।
ঠিকই ধরেছেন আপনি, বললেন ইন্সপেক্টর, কিন্তু জানলায় আপনার ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। তবে আপনার হাতের ছাপগুলো আপনার কথামতো শুধু বাইরের দিকেই ছিল।
আমি চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসলাম, বললাম, মার্ডার ওয়েপনটা পেয়েছেন?
নাঃ, জানালেন ইন্সপেক্টর, সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমার লোকেরা রিভলভারটা বের করতে পারেনি। তবে আশা করি দিনকয়েকের মধ্যেই খুঁজে পাব। আচ্ছা, নমস্কার–আপনি এখন যেতে পারেন। পরে যদি দরকার হয় আপনার সঙ্গে কথা বলবখন।
কোনওরকমে নমস্কার জানিয়ে শ্লথ পায়ে দরজার দিকে এগোলাম।
সুচরিতা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। আমার পেছন-পেছন সেও বেরিয়ে এল বাইরে।
বাইরে এসে আমি বললাম, সুচরিতা, কবুতরে যারা রয়েছেন তাদের নামের একটা লিস্ট আমাকে দাও।
সুচরিতা বলল, মানেকজি, প্রসাদজি, তরুণ সান্যাল–মানেকজির সেক্রেটারি। শ্রীনরসিংহ চৌধুরী আর কিরণ শর্মা। এঁরা হলেন লয়ালিস্টদের তরফের। কিরণ শর্মা কুমার রণজিৎকে ফাইনান্স করতে রাজি ছিলেন। নয়না কল্যাণী এবং সর্বেশ্বর রায়–তেলের ব্যাপারটায় এঁর স্বার্থ ছিল। এঁরা ছাড়া কুমারের একজন নেপালি চাকর আর কবুতরের কাজের লোকজন।
আমার মনে নামগুলো গেঁথে গেল। বললাম, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়া শুরু করব এবার। প্রথম কাণ্ড হলেন নয়না কল্যাণী।
আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। গজানন শিকদার আর কুমার রণজিৎ এক ও অভিন্ন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও কথাটা সত্যি!
কাঞ্চনবাবু, এই যে,…আপনি কিন্তু একজনকে বিশেষভাবে বাদ দিয়ে গেছেন। সুচরিতাদেবীকে আপনি ভালোবাসেন–তাই ওঁকে বাদ দেওয়ার যুক্তি থাকতে পারে– চাকরবাকরদের মোটিভ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এসব মানলাম। কিন্তু ওই লোকটিকে আপনি বাদ দিলেন কী বলে? আরে, ওই লোকটা, যে কালো পোশাক পরে গাড়ির সিটরে নীচে লুকিয়ে আপনাদের কথা শুনছিল। দেখুন না, ওই দেখুন– সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে কবুতরের সদর গেটের কাছে। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। হাতে সিগারেট। দেখুন না, কাঞ্চনবাবু, প্লিজ এদিকে তাকান না একবার!
কবুতর থেকে শপাঁচেক গজ দূরে গাছ-গাছড়ার একটা জঙ্গলের মতো রয়েছে। বনই বলা যেতে পারে সেটাকে। এবড়ো-খেবড়ো জমি। বড়-বড় বট, অশথ, দেবদারু ইত্যাদি গাছ জায়গাটাকে ছেয়ে ফেলেছে। সেইখানে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি আর সুচরিতা।
আমি এখন কবুতরের অতিথি। আমিই যে অশোক বোস নাম নিয়ে ভাগ্যচক্রে পাণ্ডুলিপির জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম সেটা প্রসাদজিকে খুলে বলেছি। এখন ব্যাপারগুলোর একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কবুতরেই থাকব আমি।
বিকেলের সোনা-রোদ যেন অনেক কষ্ট করে লুকোচুরি খেলে গাছের আড়াল দিয়ে এসে পড়েছে আমাদের গায়ে। মাঝে-মাঝে ঠান্ডা হাওয়ায় একটা আদর টের পাচ্ছিলাম। পাশাপাশি হেঁটে যেতে কী ভালো যে লাগছিল! মনে হচ্ছিল, যদি এই পথ আর না ফুরোয়…।
হাতে হাত ধরে ঝরাপাতার পথ মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে-যেতে তাকালাম সুচরিতার দিকে। সুচরিতাও আমারই দিকে চেয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই ফিক করে হেসে ফেলল। আমি একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললাম, সুচরিতা, সত্যিই আমি কোনওদিন ভাবিনি যে, এমনিভাবে তোমার সঙ্গে– সুচরিতার চোখে কপট রাগ দেখে চটপট বলে ফেললাম, তোমার সঙ্গে ভাগ্য এমন চাতুরী করবে। সত্যি, কী বিপদেই না জড়িয়ে পড়েছ!
থাক, আর কথার জাল পাততে হবে না, হেসে বলল সুচরিতা, এবার কাজের কথায় আসা যাক।
হ্যাঁ, গলার স্বর গম্ভীর করে শুরু করলাম, নয়না কল্যাণী সম্পর্কে তুমি কী জানেনা, তাই খুলে বলো।
কিছুই না। ওঁকে আমি চোখে দেখিনি কোনওদিন, ঠোঁট বেঁকিয়ে জবাব দিল ও, শুনেছি গতবছর পর্যন্ত নাকি সাইরেন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন। তারপর মানেকজি ওঁকে কবুতরে ডেকে পাঠান। মানেকজির ইচ্ছে, নয়না কল্যাণী তাঁর সঙ্গেই রাজনীতি নিয়ে থাকুক।
তিনি কবুতরে কতদিন হল এসেছেন?
গতকাল সকালে। কিন্তু ওঁকে তুমি সন্দেহ করছ কেন?
না। সন্দেহ আমি প্রত্যেককেই করছি। কিন্তু ভাবছি যে, রণজিৎ সেনকে খুন করে নয়না কল্যাণীর কী লাভ? হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, সু, চলো ফেরা যাক।
ঘুরে দাঁড়াতেই আমার চোখ পড়ল একজন ছায়া-ছায়া মানুষের দিকে। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে দেখেই সে দৌড়োতে শুরু করল। দিনের আলোয় উজ্জ্বল আকাশের পটভূমিতেও তাকে চেনা গেল না। তবু আমি ছুটলাম।
সুচরিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে আমাকে অনুসরণ করে আসতে লাগল।
দৌড়োতে-দৌড়োতে বনের বাইরে চলে এলাম। কিন্তু কই, কেউ তো কোথাও নেই! হতাশ হয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বললাম, সুচরিতা, এই লোকটা কোন দলের, সমর বর্মন, না লালপাঞ্জা?
উত্তরে ঠোঁট উলটে হাসল সুচরিতা।
দুজনে আবার কবুতরে ফিরে এলাম। বাড়িতে ঢুকতে যেতেই একটা ব্যাপার দেখে চমকে উঠলাম। বাঁদিক থেকে তৃতীয়? নাঃ, এ তো চার নম্বর জানলাটা দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে আরও দু-চার পা এদিক-ওদিক সরলেই তিনটে জানলা থেকে চারটে হয়ে যাচ্ছে। কারণ, দ্বিতীয় সারির ঘরগুলোর একটা জানলা প্রথম সারির ঘরগুলোর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। যাকগে, কুছ পরোয়া নেই।
সুচরিতার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, সু, ওই জানলাটা কার ঘরের?
কেন বলো তো! ওটা কিরণ শর্মার।
কিরণ শর্মার? ঈষৎ ভাঁজ পড়ল আমার কপালে, তা হলে, আমার লিস্টে দ্বিতীয় ব্যক্তি শ্ৰীযুক্ত কিরণ শর্মা। দৃঢ়স্বরে বললাম আমি।
আবার পা বাড়ালাম কবুতর লক্ষ্য করে।
ভেতরে গিয়ে দেখা হল মানেকজির সঙ্গে। তিনি ক্রসওয়ার্ডের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, আসুন, আসুন–
আমি মৃদু হেসে তার পাশে গিয়ে বসলাম। সুচরিতাও আমার পাশে বসল।
মিস্টার মৈত্র, আমাকে লক্ষ্য করে বললেন মানেকজি, আপনার জন্যে দোতলার যে-ঘরটা ঠিক করে দিয়েছি, সেটা আপনার পছন্দ হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ধন্যবাদ।
এইবার ক্রসওয়ার্ডের দিকে ফিরলেন মানেকজি। বললেন, ওয়াডি, এ তো ভীষণ বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। মানেকজির স্বচ্ছন্দ বাংলা শুনে অবাকই হলাম।
কুমার রণজিৎ এখানে সাঙ্ঘাতিক জরুরি একটা কনফারেন্সে এসেছিলেন, মানেকজি বলে চললেন, মিটিং তো হলই না, তার ওপর এই স্ক্যান্ডালাস ব্যাপার। কে, কেন, কুমার রণজিৎকে খুন করল আমি ভেবেই পাচ্ছি না, ক্রসবি। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে, মুখে একবার বুলিয়ে নিলেন মানেকজি।
দেখুন, আমি চেষ্টায় কোনওই ফাঁক রাখব না। আমতা-আমতা করে বললেন ক্রসওয়ার্ড, কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারছি না যে, আপনারা গুলির শব্দ পেলেন না কেন? অথচ মিস্টার মৈত্র বারোটা পঁয়তাল্লিশের সময় গুলির শব্দ পেয়েছেন।
একটা সম্ভাবনার কথা মনে হওয়ায় আমি বললাম, ইন্সপেক্টর, হয়তো মার্ডারার কোনও কেমিক্যাল দিয়ে রাতে সবাইকে ড্রাগ করেছিল।
হতে পারে, বললেন ক্রসওয়ার্ড, আমি এবার বাড়ির সবাইকে ডেকে একটা রিকোয়েস্ট করতে চাই। তা হল, কেউ যেন আপাতত, অন্তত দিনসাতেকের জন্যে, কবুতর ছেড়ে কোথাও না যান।
ঠিক আছে, আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি কথাটা। মনে হয় কেউ এতে অরাজি হবেন না। বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মানেকজি। বললেন, ওয়াডি, যেমন করে হোক এই পলিটিক্যাল স্ক্যান্ডালের শেষ চাই আমি। কারণ, ভুরু তুলে তাকালেন মানেকজি ও ..এর সঙ্গে আমার আর প্রসাদজির মানসম্মান জড়িয়ে আছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মানেকজি।
মানেকজি চলে যাওয়ার পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি আজ কবুতর ছেড়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি, কাল বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব।
ক্রসওয়ার্ড হাসলেন : যাবেন যান। কিন্তু মাইন্ড ওয়ান থিং–আমাদের যেন বডি ওয়ারেন্ট বের করতে না হয়।
উত্তরে আমি স্যালুট করার ভঙ্গি করে সুচরিতার হাত ধরে বললাম, এসো, সুচরিতা।
বাইরে এসে বললাম, সু, আমি এখন সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে যাব। নয়না কল্যাণী সম্পর্কে খোঁজ নিতে। কাল আবার দেখা হবে। তুমি কিরণ শর্মার ওপর নজর রেখ। আমার জন্যে ভেব না। আর হ্যাঁ–তোমার গাড়িটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আর দেরি না করে সুচরিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি চড়ে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য, সাইরেন ইন্টারন্যাশনাল।
গাড়িতে যেতে-যেতে ভাবছিলাম। আলোটা জ্বলেছিল কার ঘরে? কিরণ শর্মা না নয়না কল্যাণী? কী করছিলেন তিনি ওই সময়? গুলির শব্দ শুনে কি ঘুম ভেঙেছিল ওঁর? কিন্তু আর কারও ঘুম ভাঙল না কেন? আর নয়না কল্যাণীর যদি কোনও গোপন ব্যাপার থাকে, তবে আমি নিশ্চিত যে, সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে শুনব নয়না কল্যাণী নামে কেউই ওখানে কাজ করত না। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
.
শেষ পর্যন্ত সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে।
রিসেপশনের ঘুমে ঢুলে পড়া হ্যাংলা মেয়েটিকে বললাম, ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
একটু পরেই একটি লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল ম্যানেজারের ঘরে। ঘরের দরজায় লেখা প্রাইভেট।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
চেয়ারে বসে একজন প্রৌঢ়। মাথাজোড়া টাক। পাইপ টানছেন। তাকে বললাম, আমি নয়না নামে একটি মেয়ের খোঁজ জানতে এসেছি। সে আপনার হোটেলে কাজ করত।
হ্যাঁ, রিসেন্টলি ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। কোথায় ওর এক কীরকম ভাই না কে থাকে, তার কাছে যাবে বলছিল।
জবাব শুনে একেবারেই দমে গেলাম আমি। এরকমটা ঠিক আশা করিনি। তা হলে কি কিরণ শর্মা…?
থ্যাংক ইউ, ম্যানেজারসাহেব, বলে নড় করে বেরিয়ে এলাম আমি। তার মানে নয়না কল্যাণী মানেকজির সত্যিকারের রিলেটিভ!
হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট করলাম। সুচরিতাকে সব খুলে বলতে হবে। একবার ভালো করে আলোচনা করা দরকার। ঘড়ি দেখলাম, রাত তিনটে।
কবুতরে পৌঁছেই দেখি সুচরিতা গেটের বাইরে উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরোতেই দৌড়ে এল ও। বলল, কাঞ্চন, সর্বনাশ হয়েছে! বলে ও আমাকে হাত ধরে নিরিবিলি গাছ-গাছালির দিকটায় টেনে নিয়ে চলল। ভোরের হালকা আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীতে।
কিছুদূর গিয়ে আমি বললাম, কী হয়েছে?
হাঁফাতে-হাঁফাতে বলতে শুরু করল সুচরিতা, ইব্রাহিমকে খুঁজে পেয়েছে ওরা!
তাই নাকি? মুখে একথা বললেও মনে-মনে রেলগাড়ি ছুটিয়ে চিন্তা করছিলাম, এরপর কী করা উচিত।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর ক্রসবি খোঁজ করেছিলেন যে, তুমি এসেছ কি না, বলে চলল সুচরিতা, আর কিরণ শর্মাকে দেখলাম লাইব্রেরি-ঘরের বইপত্তর ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখছেন। আমি ঢুকতেই মৃদু কাষ্ঠহাসি হেসে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল সুচরিতা, বলল, ওহ্ হো, আমি তো জিগ্যেস করতেই ভুলে গেছি। ওদিকের খবর কী?
বিষণ্ণ হাসি হেসে বললাম, শিকে ছেড়েনি। একদম বাজে খবর। নয়না কল্যাণী সত্যি কথাই বলেছেন, সাইরেনেই কাজ করতেন উনি। এখন আমার মনে হচ্ছে যে, সে-রাতে আলো বোধহয় কিরণ শর্মার ঘরে জ্বলছিল। কথা বলতে বলতেই একটা দেবদারু গাছের দিকে চোখ গেল আমার। তখনই দেখলাম গাছের গুঁড়ির ওদিক থেকে কারও জামার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সেই লোকটা।
পা টিপে টিপে এগোলাম। সুচরিতা কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি মুখে আঙুল তুলে ওকে ইশারায় জানালাম চুপ করে থাকতে। তারপর গিয়ে আচমকা গাছের ওপিঠে হাজির হলাম।
গাছের আড়ালে যে লোকটি নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়েছিল, সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হাসবার চেষ্টা করল।
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, ঠান্ডা স্বরে বললাম আমি, দয়া করে নিজের পরিচয়টা যদি দেন…।
আমি–আমি এখানে নতুন এসেছি, কর্কশ স্বরে থেমে-থেমে সে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না কোন দিকে পড়বে বাড়িটা…।
আমি সুচরিতার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম। তারপর লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আসুন আমার সঙ্গে। কোথায় বাড়ি আপনার?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল লোকটি। তারপর বলল, ওই দিকটায়– বলে একটা দিক দেখাল সে।
আমি তার এই এলোমেলো কথায় ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম। হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ লোকটি থ্যাংক ইউ অ্যান্ড গুড বাই বলে হনহন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠিক তখনই আমার মাথায় এল ব্যাপারটা। এই লোকটাই সেই লোকটা নয় তো! নিশ্চয়ই, কোনও সন্দেহই নেই! লোকটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম। চোখে সবুজ সানগ্লাস, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সরু গোঁফ, কপালে বলিরেখা।
চিন্তার জাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে আবার হাঁটতে শুরু করলাম, কবুতরের দিকে।
সুচরিতাকে বললাম, সু, আজ রাতে আমি বোধহয় কবুতরে থাকতে পারব না।
কেন, কেন? অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠল সুচরিতা।
আমি হাসলাম। সুচরিতা এতই চঞ্চল হয়ে উঠল যে, হাসি চাপতে পারলাম না।
কেন, আবার হাসির কী হল? অবাক হয়ে বলল সুচরিতা।
কিছু না। আমি একবার হোটেল কন্টিনেন্টালে যাব। খোঁজ নেব যে, ইব্রাহিমের সঙ্গে কেউ ওখানে দেখা করতে যেত কি না…।
ও, তা বেশ তো। গম্ভীর গলায় বলল সুচরিতা।
প্লিজ সু, বোঝার চেষ্টা করো। কোনও ভয় নেই। আজ রাতে আর কোনও বিপজ্জনক ঘটনা ঘটবে না–তুমি শুধু-শুধু চিন্তা করছ। তা ছাড়া ইব্রাহিমের ব্যাপারটার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার।
একটু থেমে সুচরিতা বলল, কাল কখন ফিরবে?
সকালেই। জোর দিয়ে বললাম আমি।
কবুতরের বাইরের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। সুচরিতা কবুতরের বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, তাই আমিই লক্ষ করলাম ব্যাপারটা।
দেখলাম, কিরণ শর্মা উত্তেজিতভাবে ক্রসওয়ার্ডকে কী যেন বোঝাচ্ছেন, আর ক্রসওয়ার্ড চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ছেন।
একটু পরে ক্রসওয়ার্ড একাই এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে, বললেন, মিস্টার মৈত্র, আমি আপনার সঙ্গে একটু গোপনে আলোচনা করতে চাই।
সঙ্গে-সঙ্গে সুচরিতার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল।
আমি ওর দিকে ফিরে হেসে অভয় দিলাম, বললাম, কোনও ভয় নেই, সু, তুমি যাও।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে গেল ও।
মিস্টার মৈত্র, ক্রসওয়ার্ডের কাঠ-খোদাই মুখে কোনও অভিব্যক্তি লক্ষ করা গেল না, আমরা একটা ডেডবডি পেয়েছি। তার পরিচয়ও আমরা জেনেছি। হোটেল কন্টিনেন্টালের বেয়ারা ছিল সে। হোটেলের ম্যানেজারও আমাদের আপনার সেই চিঠি চুরি করার কথা বলেছে। সবই ঠিক আছে, শুধু একটা ব্যাপারে একটু খটকা দেখা দিয়েছে। যেখানে বডিটা পাওয়া গেছে, সেখানকার জনাদুয়েক লোক বলেছে যে, সে-রাতে তারা নাকি ভারি অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিল। ওরা ড্রিঙ্ক করে ফিরছিল বলে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি…ভেবেছে দেখার ভুল। অর্থপূর্ণভাবে কথা শেষ করলেন ইন্সপেক্টর।
কী, কী দেখেছিল ওরা? আমি জানতে চাইলাম।
আপনাকে একটা গাছ থেকে নামতে দেখেছিল। আমি ওদের আপনার ফটো দেখাতেই ওরা আইডেন্টিফাই করেছে। এরপর সেই গাছে উঠে আমরা এটা পেয়েছি। বলে পকেট থেকে ব্রাউন পেপারে মোড়া ছুরিটা বের করলেন তিনি।
এরপর চুপ করে থাকার মানে হয় না। তাই সব খুলে বললাম ওঁকে। মৃতদেহ গুম করার কারণটাও খুলে বললাম। জানি না তিনি বিশ্বাস করলেন কি না। আমার বলা শেষ হলে ক্রসওয়ার্ড শুধু মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলেন, হু–।
তারপর একটু থেমে দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমি বললাম, ইন্সপেক্টর, আমাকে আজ রাতে একটা জায়গায় যেতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসব।
যাবেন যান, কিন্তু একটা কথা জেনে রাখুন, দিল্লি পুলিশের ডিকশনারিতে ইমপসিব বলে কোনও শব্দ নেই– বলে হনহন করে এগিয়ে গেলেন ক্রসওয়ার্ড।
ওঁর দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, তুমি যদি জানতে, আমি কে, তবে–।
কাঞ্চনবাবু, সুচরিতা চৌধুরী কিন্তু কবুতরে থেকে গেলেন। আপনি তো যাওয়ার আগে বললেন, আজ রাতে কবুতরে আর কিছু হবে না। কিন্তু শুনুন– হা আজ রাতেই একটা ব্যাপার হবে। সম্ভবত মাঝরাতে– সুচরিতাদেবী বিপদে পড়তে পারেন। তবু আপনি যাবেন? থেকে গেলে পারতেন কিন্তু। যাকগে, নিয়তিকে তো আর কেউ রুখতে পারে না! ভীষণ কান্ড হবে একটা সত্যি বলছি সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা হবে!
এ রহস্যের শেষ কোথায়? নিজের ঘরে শুয়ে-শুয়ে এ কথা ভাবছিল সুচরিতা। রাত প্রায় দেড়টা। আশ্চর্য! কুমার রণজিৎ খুন হওয়ার রাতে গুলির শব্দ কেউ শুনল না কেন! তবে কি রাতে ওরা যে-ড্রিঙ্কস নিয়েছিল তাতেই কোনও স্লিপিং ড্রাগ মেশানো ছিল। কিন্তু কে মেশাল! হঠাৎ…।
ঠিক সেই মুহূর্তে সুচরিতার কোষে-কোষে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। পায়ের শব্দ না! অন্ধকারেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ও। কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে ঠাহর করতে পারল না। তাড়াতাড়ি পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে করিডরে বেরিয়ে এল। করিডর নিঝুম নিস্তব্ধ। কেউ কোথাও নেই।
আবার শব্দ হল একটা। নিশ্চয়ই নীচের লাইব্রেরি-ঘরে। কেউ তা হলে আছে নাকি ওখানে?
পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়াল সুচরিতা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। এগিয়ে এসে চাবির ফুটোয় চোখ রাখল। এ কী!
লাইব্রেরি-ঘরের গভীর অন্ধকারে শুধু একটা টর্চলাইটের আলো ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন সরে দাঁড়ানোয় চাবির ফুটো দিয়ে আর কিছু দেখা গেল না।
তবে কি লাইব্রেরি-ঘরে চোর ঢুকেছে? কিন্তু ওর পক্ষে তো একা কিছু করা সম্ভব নয়। চিন্তা করে দেখা গেল সাহায্য করার মতো একজনই আছে কবুতরে। সে তরুণ সান্যাল।
অতএব সিঁড়ি দিয়ে উঠে তরুণের ঘরের কাছে এসে দরজায় টোকা দিল সুচরিতা।
তরুণ–।
একটু পরে ঘুম চোখে এসে দরজা খুলল তরুণ সান্যাল। চেঁচিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল। ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে সুচরিতা বলে উঠল, শ স্। চুপ! নীচের লাইব্রেরিতে মনে হয় চোর ঢুকেছে।
কী! চোর! তরুণের ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি।
আস্তে, ফিসফিস করে বলল সুচরিতা, তুমি রেডি হয়ে নাও–আমরা দুজনে ঢুকব ও-ঘরে।
দাঁড়াও। বলে ঘরের কোনা থেকে একপাটি লোহার নাল লাগানো জুতো তুলে নিল তরুণ। বলল, চলো, এই জুতোর এক ঘা খেলে চোরবাবাজিকে আর উঠে দাঁড়াতে হবে না।
নিঃসাড়ে চুপিচুপি ওরা দুজনে এসে দাঁড়াল লাইব্রেরির সামনে।
ভেতরে কজন আছে? ফিসফিস করে জিগ্যেস করল তরুণ।
কে জানে! বোধহয় দু-তিনজন! অবহেলাভরে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল সুচরিতা।
আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তুমি ভেতরে ঢুকে আলোর সুইচটা অন করে দেবে। বলে জুতোটাকে বাগিয়ে ধরে এক ঝটকায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তরুণ।
ভেতরে টর্চের আলো তখনও দেওয়ালের গায়ে ঘুরছিল। দরজা খোলার শব্দে টর্চধারী লোকটি সচকিত হওয়ার আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তরুণ। ওদের দুজনের ঝাঁপটিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুচরিতা–ওই অন্ধকারেই। ঠিক ওই সময়ই কে যেন মনে হল ওর পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। আর কিছু ভাববার আগেই তরুণের চিৎকার ভেসে এল : সুচরিতা, আলোটা জ্বালাও শিগগিরই
সুচরিতা সুইচের দিকে পা বাড়াতেই দেখা গেল একটি ছায়ামূর্তি এক ছুটে লাইব্রেরির খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে লাফিয়ে সুরকি ঢালা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাল।
এই দেখে আর আলো না জ্বালিয়ে লোকটির পিছন পিছন ধাওয়া করে বাইরে বেরিয়ে এল সুচরিতা।
দৌড়ে যখন ও কবুতরের গেটে পৌঁছেছে, ঠিক সেই সময় ওর সঙ্গে একজনের ধাক্কা লাগল।
লোকটি পালিয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল কারও।
চোখ তুলে তাকাল সুচরিতা। ওর সামনে টেরিন-টি-শার্ট আর ফুলপ্যান্ট পরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি শ্রীকিরণ শর্মা।
দারুণ অবাক হয়ে গেল সুচরিতা। এই রাতেও টিপটপ ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছেন শর্মাসাহেব!
লোকটি পালিয়েছে, মিসেস চৌধুরী, আর ফলো করে লাভ নেই। দ্বিতীয়বার বললেন তিনি।
ও–।
একটা কথা ভাবছিল সুচরিতা। সত্যি যদি তাই হয়! হয়তো অসম্ভব কল্পনা, কিন্তু অসম্ভবও তো সময়ে-সময়ে সম্ভব হয়।
চলুন, শর্মাসাব, কবুতরে ফিরে যাওয়া যাক, বলে দুজনে ফিরে চলল কবুতরের দিকে।
বাড়ির সবাই তখন লাইব্রেরি-ঘরে এসে ভিড় করেছেন–একমাত্র নয়না কল্যাণী ছাড়া। ওঁর নাকি অনিদ্রা রোগ আছে। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়লেও ঘুম নাকি ওঁর ভাঙে না–মানেকজি জানালেন।
তরুণের কপালে একদিকটায় ছড়ে গেছে। সবাইয়ের ননস্টপ প্রশ্নের উত্তরে সবই খুলে বলল ওরা। কিন্তু কারা, কেন এসেছিল, কিছুই জানা গেল না।
অবসন্ন মনে নিজের ঘরে ফিরে চলল সুচরিতা। লোকটা ঘরের দেওয়ালে আলো ফেলে কী দেখছিল? ইস, কাঞ্চন থাকলে কত ভালো হত!
কবুতরের রহস্য কি এখনও শেষ হয়নি? কে জানে, এরপর কবুতরে কোন অধ্যায় অভিনীত হবে!
.
পরদিন সকালেই ফিরে এলাম আমি। আমাকে দেখেই প্রথমে সুচরিতার মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। ছুটে এগিয়ে এল আমার কাছে। ওর চোখে আতঙ্ক-বিহ্বল দৃষ্টি।
আমি ওকে আশ্বাস দেওয়ার জন্যে কাছে টেনে নিলাম। ওর কানে কানে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, কী হয়েছে, সু, কী হয়েছে?
আমার ভয় করছে ভীষণ ভয় করছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিল সুচরিতা।
আরে ভয় কী– থেমে-থেমে বললাম আমি, আমি থাকতে তোমার গায়ে যে হাত দেবে তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব। কী হয়েছে?
শেষ দিকে আমার গলা পালটাতে দেখে ও একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর ধীরে-ধীরে বলল সব। কীভাবে রাতে চোর ঢুকেছিল লাইব্রেরিতে, তারপর তাড়া করতে গিয়ে কিরণ শর্মার সঙ্গে ধাক্কা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। তারপর বললাম, সু, তোমার পাশ দিয়ে অন্ধকারেই যে কেউ বেরিয়ে গিয়েছিল এ-ব্যাপারে তুমি কি শিয়োর?
তাই তো মনে হয়েছিল আমার…।
হুঁ–। তার মানে বাইরের কারও সঙ্গে ভেতরের কেউ হাত মিলিয়েছে। একটু চিন্তা করে বললাম আমি।
তক্ষুনি সুচরিতা এমন একটা কথা বলল যে, আমি সাঙ্ঘাতিকভাবে চমকে উঠলাম। ও বলল, বাইরের লোক হওয়ার কী দরকার? ভেতরের দুজন হলেও বা আপত্তি কিসের! যদি কিরণ শর্মাই সেই বাইরের লোক হয়?
কিন্তু, এ কী করে সম্ভব!
তুমি না একটা আস্ত বোকা! তোমাকে বললাম না, কিরণ শর্মা একদম ড্রেন্ড-আপ হয়ে ছিলেন। মনে করো কিরণ শর্মা জানলা দিয়ে লাফিয়ে দৌড়লেন। আমি তাড়া করলাম। ধরতে পারলাম না, কিন্তু একটু পরেই তো কবুতরে ওঁর অ্যাবসেন্স ধরা পড়বে, তখন! তাই দৌড়ে কবুতরের গেট পার হয়েই তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। বললেন যে, লোকটি পালিয়েছে। খুশি-খুশি মুখে চুপ করল সুচরিতা।
জিনিয়াস! সু, তুমি একটা জিনিয়াস। উচ্ছ্বাসে বললাম আমি। কিন্তু পরমুহূর্তেই গলার স্বর খাদে নামিয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তোমার পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে কে বেরিয়ে গিয়েছিল?
কী জানি, আমি বুঝতে পারিনি। তবে কী যেন একটা মনে করেও করতে পারছি না…।
কী? কী কথা? আমি জানতে চাইলাম।
ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়তো পরে মনে পড়বে।
এইবার আমি মনে-মনে একটা প্ল্যান ছকে ফেললাম। প্রশ্ন করলাম সুকে, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় যে, যারা এসেছিল, তারা তাদের কাজ গুছিয়ে নিতে পেরেছে?
উঁহু– সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল সুচরিতা।
তার মানে আবার তারা আসবে–দৃঢ়স্বরে বললাম আমি, হয় আজ রাতে, নয়তো কাল রাতে, নয় আগামী আর কোনও রাতে। তা হলে শুরু হোক আজ রাত থেকেই।
কী শুরু হবে? চোখ নামিয়ে প্রশ্ন করল সুচরিতা।
যাকগে…পরেই শুনবে–দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর। হ্যাঁ, ভালো কথা–তরুণ সান্যাল কবুতরে আজ থাকছে তো?
হ্যাঁ। কিন্তু ইব্রাহিমের ব্যাপারটার কী হল?
কিস্যু না। যে-অন্ধকারে ছিলাম এখনও সেই অন্ধকারে। ইব্রাহিমের সঙ্গে তেমন কেউ গোপনে দেখা করতে আসত না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুকের পাঁজর থেকে : চলো, ভেতরে যাওয়া যাক। বলে দুজনে কবুতরে ঢুকলাম।
সেখানেই দেখা হল ইন্সপেক্টর ক্রসবির সঙ্গে। আমাকে দেখে হাসলেন, বললেন, শুনেছেন তো, গত রাতে কবুতরে চোর এসেছিল!
হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।
এতক্ষণ প্রসাদজিকে লক্ষ করিনি। তিনি ইন্সপেক্টরের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, মিস্টার মৈত্র, আপনার সব কথাই আমি শুনেছি। আশা করি কবুতরে থাকতে আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।
না, না,বাধা দিয়ে বলে উঠলাম আমি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
প্রসাদজি চলে গেলেন।
ইন্সপেক্টর আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কাঞ্চনবাবু, গতরাতে আপনি কবুতর ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি সব খুলে বললাম। কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হলেন না বলেই মনে হল।
তিনি কি আমাকেই রাতের আগন্তুক বলে সন্দেহ করছেন নাকি? যাক গে, আমি আর সুচরিতা কোনও কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম।
দুপরের খাওয়া-দাওয়ার পর তরুণ আর সুচরিতার সঙ্গে গোপনে আলোচনা করলাম। ঠিক হল, সুচরিতা একটা আলমারির পেছনে লুকিয়ে থাকবে, ঘরে কেউ ঢুকলেই আলো জ্বেলে দেবে। আর আমি থাকব টেবিলের পেছনে। সব শেষে তরুণ থাকবে দরজায় কাছে–যাতে দরজা দিয়ে কেউ পালাতে না পারে। রাত বারোটা থেকে আমরা অপেক্ষা শুরু করব ঠিক করলাম। আমরা ছাড়া আর কেউ যেন কিছু জানতে না পারে, এ-কথা বারবার করে বলে চলে এলাম নিজের ঘরে। সটান গিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
.
রাত বারোটা বেজে এক মিনিট। অজ্ঞান কবুতরে জেগে আছি শুধু আমরা তিনজন আমি, তরুণ আর সুচরিতা।
পা টিপে টিপে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম আমরা। ঘরে জমাট অন্ধকার। আমরা যার-যার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তরুণ সঙ্গে এনেছে একপাটি নাল লাগানো জুতো। আমার পাঁচ আঙুলে আটকানো একটা নাল ডাস্টার। সারা ঘর অন্ধকার। শুধু তিনটে কাচের জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ভেতরে।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম আমি। আজ হয়তো আমাদের প্রতীক্ষা নিষ্ফল হবে। তবু আশা–। বাঁ হাতের রেডিয়াম ডায়ালে চোখ নামালাম। পৌনে একটা। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল।
এইভাবে কতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। হঠাৎই যেন সুরকি-ঢালা পথে কারও সতর্ক পায়ের শব্দ আমার কানে এল। শরীরের সবকটা স্নায়ু যেন নিঃশব্দ চিৎকারে গলা ফাটিয়ে বলতে লাগল, এসেছে। সে এসেছে!
একটু পরেই একটি ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল জানলায়। দম বন্ধ করে চরম মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। ধীরে-ধীরে জানলা টপকে ঘরের মধ্যে নেমে দাঁড়াল সে। একবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর এক পা এগোতেই আমি কাঁপয়ে পড়লাম তার ওপর।
পরমুহূর্তেই ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল সুচরিতা। তরুণ এগিয়ে এসে কলার ধরে এক হ্যাঁচকায় তুলে দাঁড় করাল লোকটিকে।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম আমি। একী! এ যে সেই রহস্যময় কালো পোশাক পরা লোকটি।
এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, স্যার, নিজের বাড়ি খুঁজতে এসে আপনাকে যে এত বিপদে পড়তে হবে তা বোধহয় ভাবেননি!
লোকটি গম্ভীর মুখে তাকাল আমার দিকে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরিতে প্রায় সবাই এসে হাজির হয়েছেন। শ্রী নরসিংহ আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, মিস্টার বোস, হচ্ছে এসব ব্যাপার কী? মাঝরাত্রে যত সব বিড়ম্বনা।
আমি হাসলাম, ওঁকে নকল করে বললাম, বোস নয়, মৈত্র। দেখুন না নিজেই হয়েছে কী। সর্বেশ্বর রায় নামধারী ভদ্রলোক চোরের মতো দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন নৈশ আগন্তুকের দিকে।
সকলের দিকে একপলক দেখে জামাকাপড় ঝেড়ে মুখ খুললেন আমাদের নৈশ অতিথি। আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাদের সবাইকে জানাই যে, আমার নাম কিষাণ আপ্তে– দ্যাট ইজ, এজেন্ট জেড। সি.বি.আই. থেকে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
একথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল সবাইয়ের মুখ দিয়ে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মিস্টার আপ্তে বলে চললেন, আমি এখানে এসেছি সমর বর্মনকে গ্রেপ্তার করার জন্যে। নামটা আপনাদের সকলের কাছেই বোধহয় পরিচিত। আমি দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, কবুতরে যে কজন হাজির আছেন, তাদের মধ্যে একজন অবশ্যই সমর বর্মন। বর্মনের ছদ্মবেশ ধরার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। সে আমার ছদ্মবেশ ধরে হাজির হয়েও আপনাদের ধোঁকা দিতে পারে। এই আশ্চর্য চোর এবং ব্ল্যাকমেলারটিকে ধরা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এখন যেহেতু সে কবুতরে আছে, তাই আমাদের কাজ একটু সহজ হয়ে পড়েছে।
সমর বর্মন কবুতরে এসেছে সম্ভবত হীরের নেকলেসের জন্যে। গতবছর সিরাজনগরের মন্ত্রী সুরেন্দ্র পালিত একটা মিটিং-এ কবুতরে এসেছিলেন। আমরা খবর পেয়েছি যে, তিনি একটা দামি নেকলেস এখানে লুকিয়ে রেখে যান। সেটার খবর বর্মন জেলে বসেই পায়। আমরা আন্দাজ করেছিলাম যে, ওটা হাতানোর জন্যে সে, কবুতরে আসবেই। তাই এতদিন আমি ছদ্ম পরিচয়ে কবুতরের আশেপাশে ঘুরেছি বলে আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর সুচরিতার দিকে ফিরে বললেন, ম্যাডাম, গত রাতেও আমি এসেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল এই লাইব্রেরিতে লুকিয়ে রাখা হীরের নেকলেসটা উদ্ধার করা। আমি চাইনি যে, সবাই এই ব্যাপারটা জানুক। যা হোক, আগামীকাল আমি ইন্সপেক্টর ক্রসবির সঙ্গে দেখা করছি। এবার আমি বর্মনকে ধরবই। সে আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না। তার চোখ জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
সর্বেশ্বর রায় বললেন, মিস্টার আপ্তে, আমি আগামীকাল কবুতর ছেড়ে যেতে চাই। তা না হলে আমার প্রায় পঞ্চাশহাজার টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে।
সেটা আপনি ক্রসবিকেই বলবেন–। জানালেন এজেন্ট জেড।
প্রসাদজি মিস্টার আপ্তের জন্যে ওপরে একটা ঘরের ব্যবস্থা করলেন। সবাই লাইব্রেরি ছেড়ে পা বাড়ালেন নিজের নিজের ঘরের দিকে।
সুচরিতাকে নিয়ে ওপরে ওঠার সময় শুধু শুনলাম, শ্রীনরসিংহ নিজের মনেই বলছেন, খুবই ঘটছে আশ্চর্য এখানে ব্যাপার।
.
পরদিন সকালে উঠে চুল আঁচড়াতে যেতেই সাঙ্ঘাতিক অবাক হলাম আমি। আয়না দিয়েই চোখে পড়ল বান্ডিলটা। তারপর তাকালাম টেবিলের ওপর। এই তো! এই তো সেই চিঠির বান্ডিলটা। সুচরিতা চৌধুরীর নাম লেখা সেই চুরি যাওয়া চিঠিগুলো!
হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে এল। সুরেন্দ্র পালিতের লেখা পাণ্ডুলিপির হাতের লেখা আর এই চিঠিগুলোর হাতের লেখা একই। তার মানে এই চিঠির লেখক শ্রীযুক্ত পালিতই। হয়তো এই চিঠিগুলোতে কোনও গোপন ইঙ্গিত আছে। এই যে, কবুতর থেকে লেখা চিঠিটা। এটা আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও, হয়তো এর সাহায্যেই পালিতসাহেব লুকোনো নেকলেসের সন্ধানটা জানাতে চেয়েছেন।
এক দৌড়ে নীচে নেমে গিয়ে কিষাণ আপ্তেকে সবকিছু খুলে বলে আমার সন্দেহের কথা জানালাম।
তিনি প্রসাদজির সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, মিস্টার মৈত্র, আপনি যা বলেছেন তা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমি এক্ষুনি থানায় যাচ্ছি। এখানকার সাইফার রিডারকে অনুরোধ করব এগুলো ডিসাইফার করার জন্যে। বলেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে চিঠিগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি প্রসাদজির সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। বললাম, আচ্ছা প্রসাদজি, আপনার বাড়িতে কোনও গুপ্তপথ আছে কি?
না তো। জানালেন প্রসাদজি।
কোনওকালেই ছিল না? গভীর আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম আমি।
উত্তরে প্রসাদজি জানালেন যে, অনেক আগে একটা সুড়ঙ্গপথ ছিল ওই লাইব্রেরিতেই। কিন্তু পরে সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
আমি আর প্রসাদজি উঠে রওনা হলাম লাইব্রেরির দিকে। মাঝপথেই দেখা হল সুচরিতার সঙ্গে। ওকে সব কথা বললাম। শুনে অবাক হয়ে গেল ও। আমরা তিনজনে গিয়ে হাজির হলাম লাইব্রেরিতে।
প্রসাদজি এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে। ছবিটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে দেওয়ালের সেই অংশে একটু চাপ দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা আলমারির পাশ থেকে দেওয়ালের কিছুটা অংশ নিঃশব্দে সরে গেল। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অতি সাধারণ একটা সুড়ঙ্গপথ। দেখে অনেক পুরোনো বলেই মনে হয়। প্রায় কুড়ি গজ যাওয়ার পর দেখা গেল পথ সম্পূর্ণ বন্ধ। সুড়ঙ্গের দেওয়াল অত্যন্ত জীর্ণ হওয়ায় ইটের গা থেকে চুন-বালি সব খসে-খসে পড়ছে।
মিনিটদশেক পর আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। প্রসাদজি বললেন, মৈত্রসাব, কিছু ব্যাপারই আমার মাথায় ঢুকছে না। কোত্থেকে কী সব হচ্ছে–
এমন সময় লাইব্রেরির দরজায় হাজির হলেন এজেন্ট জেড। তার মুখ খুশিতে ভরপুর।
আমাদের দেখেই বললেন, সব জেনেছি আমি। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, মিস্টার মৈত্র, কবুতরের নাম লেখা চিঠিটাই আসল। সেটা ডিকোড করা গেছে। এই দেখুন– বলে একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম। তাতে লেখা–
আট বাঁ–সাতটা ইট-পাশে তিনটে কাগজ।
গজ উপরে
—-সুরেন্দ্র
এ তো জলের মতো স্পষ্ট! বলে উঠলাম আমি, তার মানে সুড়ঙ্গপথ ধরে আট গজ গিয়ে বাঁ দিকের দেওয়ালে দেখতে হবে। মেঝে থেকে সাতটা ইট ওপরে গিয়ে তিনটে ইট পাশে– ব্যস, তা হলেই পাওয়া যাবে।
আমিও ঠিক তাই ভেবেছি। বললেন কিষাণ আপ্তে, চলুন, আর দেরি করে লাভ কী!
শুরু করা যাক।
প্রসাদজি একটা মাপার ফিতে নিয়ে এলেন। মাপজোখ করে কাজ শুরু করলাম আমরা চারজন। সাতটা ইট ওপরে আর তিনটে হঁট পাশে যেতেই একটা আলগা ইট চোখে পড়ল। পকেট থেকে ছোট্ট ছুরি বের করে ইটটাকে বের করে নিলাম।
অন্ধকার একটা খুপরি। আনন্দে উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে গেল যেন। কিষাণ আপ্তে চটপট হাত ঢুকিয়ে দিলেন খুপরির ভেতরে।
একটু পরেই হাত বের করে নিলেন। তার হাতে একটা কাগজ।
তাহলে কি কেউ আমাদের আগেই এ-জায়গার সন্ধান পেয়েছে! উঁচু গলায় বললাম আমি।
মনে তো হয় না। জানালেন এজেন্ট জেড। কাগজটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। কী আশ্চর্য! তাতে শুধু দেখা যাচ্ছেঃ
গ গ গ গ গ
গ গ গ গ গ
দেখে ভীষণ অবাক হলাম আমি। এরকম তিক্ত রসিকতার অর্থ কী?
কিষাণ আপ্তেকে লক্ষ করে বললাম, মিস্টার আপ্তে, আপনি কি এর অর্থ বুঝতে পারছেন?
উঁহু মাথা কঁকালেন এজেন্ট জেড।
প্রসাদজি বললেন, মিস্টার মৈত্র, চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রসাদজি গুপ্তপথটা বন্ধ করে দিয়ে ছবিটাকে আবার যথাস্থানে টাঙিয়ে রাখলেন।
এমন সময় লাইব্রেরিতে এসে ঢুকলেন কিরণ শর্মা ও ক্রসওয়ার্ড। কিষাণ আপ্তের হাতে চিরকুটটা দেখে এক লাফে এসে দাঁড়ালেন সামনে, বললেন, দেখি, দেখি। বলে আর দেওয়ার অপেক্ষা রাখলেন না। একরকম ছিনিয়েই নিলেন ওটা।
জেড বাধা দিলেন না।
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম কিরণ শর্মার মুখের দিকে। হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, একটা খুশির ঝিলিক লহমার জন্যে ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। তারপর অপেক্ষাকৃত গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলেন, ভারি অন্যায়। এরকম রসিকতা করা ভারি অন্যায়।
ক্রসওয়ার্ডও দেখলেন কাগজটা। কিন্তু কিছু বুঝলেন বলে মনে হল না।
এসবই সমর বর্মনের কারসাজি, দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন জেড? তাকে একবার হাতের মুঠোয় যদি পাই…।
আমি যাচ্ছি–একটু কাজ আছে। বলে সঙ্গে-সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শর্মা। আমরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার চলার পথের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমি, মিস্টার আপ্তে, এই কিরণ শর্মা যদি কুমার রণজিৎকে খুন করে থাকেন, তা হলে আমি বিন্দুমাত্রও আশ্চর্য হব না।
দুজন অফিসিয়াল হাঁ করে চেয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। সুচরিতা আপনমনেই নখ খুঁটতে থাকল।
.
ওপরে উঠে প্রথম ঘরটায় উঁকি মেরে দেখি শ্রীসর্বেশ্বর রায় গোছগাছ শুরু করে দিয়েছেন। আমি পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখি একজন চাকরগোছের লোক বসে রয়েছে। আমি তাকে দেখে অবাক হলাম। এ যে কুমার রণজিতের নেপালি চাকরটা!
আমাকে দেখেই লোকটি হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, বাবু, আমার সাহেবকে যে খুন করেছে তাকে আমি শেষ করব। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে নিন–আমি আপনার কেনা হয়ে থাকব। বলতে-বলতে লোকটি কোমর থেকে হঠাৎই একটা বাঁকানো ছোরা বের করল। ওর মুখ জিঘাংসায় বিকৃত হয়ে উঠল।
আমি ভাবলাম, লোকটি আমাকেই খুনি ভাবছে না তো! হয়তো আমার বিশ্বাসভাজন হয়ে তারপর আমাকেই খুন করতে চায়।
মুখে বললাম, ঠিক আছে। তোমার কোনও চিন্তা নেই। পুলিশ কুমারের হত্যাকারীকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাবেই।
জানি না, সে আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করল। কিন্তু ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার যে-কোনও কাজে দরকার হলেই আমাকে বলবেন। আপনার জন্যে জান হাসিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আমি হাঁফ ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর এসে দাঁড়ালাম জানলায় কাছে। এই জানলা দিয়ে কবুতরের পেছনদিকটা চোখে পড়ে। ও কী! কিরণ শর্মা না? পেছনদিকের গোলাপ বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ব্যাপার কী জানার জন্যে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আমি রওনা দিলাম বাগানের উদ্দেশে।
বাগানে গিয়ে হাজির হতেই সেখান থেকে দ্রুতপায়ে প্রস্থান করলেন শ্রীশর্মা। ফিরে আসতে যাব, হঠাৎই দেখি কিষাণ আপ্তে দৌড়ে আসছেন আমার দিকে।
আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে, মিস্টার আপ্তে?
হাঁফাতে-হাঁফাতে জবাব দিলেন তিনি, পেয়েছি! এতদিন পরে পাওয়া গেছে রিভলভারটা। চলুন, দেখবেন চলুন।
আমি আর কোনও কথা না বলে দ্রুত তাঁর সঙ্গে রওনা হলাম।
কিছুক্ষণ পরে দুজনে এসে হাজির হলাম কবুতরের গেটের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীনরসিংহ, সর্বেশ্বর রায়, ক্রসওয়ার্ড, আর সুচরিতা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মানেকজি ও প্রসাজি হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। আর পেছনে ও কে! তরুণী কথাটা যাকে হুবহু মানায় সেইরকম একজন। নয়না কল্যাণী! নাঃ, রূপ আছে মেয়েটার! চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে লিপস্টিক। ঢল নামা চুলে মুখের অর্ধেকটাই প্রায় ঢাকা।
প্রথমে ভালো করে দেখলাম। সর্বেশ্বর রায়ের সুটকেশটা তার পায়ের কাছে ভোলা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তার মধ্যে উঁকি মারছে একটা সুদৃশ্য কালো অটোমেটিক। সর্বেশ্বর রায় চেঁচাচ্ছিলেন, আমি তো বলেছি, আমি জানি না। আমার ব্যাগে কেউ যদি রিভলবার লুকিয়ে রাখে, তবে আমি কী করতে পারি?
কিষাণ আপ্তে বললেন, ঠিক আছে মিস্টার রায়, আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান। আমরা পরে এ-ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করব।
বেশ রাগ-রাগ ভাব দেখিয়েই চলে গেলেন সর্বেশ্বর রায়।
ক্রসওয়ার্ড সুটকেশ থেকে রিভলবারটি বের করে নিয়েছিলেন। সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, হু, এটাই কাজে লাগানো হয়েছিল বলে মনে হয়। আপনার কী মনে হয়, মিস্টার আপ্তে?
পয়েন্ট থ্রি এইট বলেই মনে হচ্ছে। ভালো করে সেটাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন জেড।
আচ্ছা, আপনারা এবার যার-যার ঘরে ফিরে যান– ক্রসওয়ার্ড হাতে তালি দিয়ে বললেন, এখানে দয়া করে আর ভিড় করবেন না।
মানেকজি, প্রসাদজি আর আমি ছাড়া সবাই চলে গেলেন। নয়না কল্যাণী চলে যাওয়ার আগে মানেকজির সঙ্গে চাপা গলায় কীসব কথা বলে গেলেন।
মানেকজি অস্থিরতাকে আর চাপতে পারছিলেন না। বলে উঠলেন, ক্রসবি, কী সব ফ্যানটাস্টিক ব্যাপার হচ্ছে এখানে? সর্বেশ্বর রায় আমার পরিচিত। তুমি শিগগিরই এর একটা হেস্তনেস্ত করো। ফানি!
মানেকজি ও প্রসাদজি চলে গেলেন।
আমি এবার ক্রসওয়ার্ডকে বললাম, ইন্সপেক্টর, দেখুন, রিভলভারটায় কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পান কি না।
আশা খুবই কম, বললেন এজেন্ট জেড। তারপর চিন্তিত মনে তিনজনই ফিরে এলাম কবুতরে।
একটু পরে ছুটতে ছুটতে আমার ঘরে এল সুচরিতা। বলল, কাঞ্চন, মনে পড়েছে। মনে পড়েছে।
কী? কী মনে পড়েছে? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
সেই রাতে কেউ আমাকে পাশ কাটিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ-ব্যাপারে আমি শিয়োর। দৃঢ়স্বরে বলল সুচরিতা।
কেন! কী হয়েছে?
আমি একটা গন্ধ পেয়েছিলাম, বলল সুচরিতা, কিসের গন্ধ তা ঠিক বলতে পারব না, কিন্তু আজ আবার আমি গন্ধটা পেয়েছি। আজ, একটু আগে, সবাই যখন গেটের কাছে ভিড় করেছিল তখন!
তার মানে সে-রাতে কেউ একজন লাইব্রেরিতে লুকিয়ে ছিল। মিস্টার আপ্তে তা জানতে পারেননি। অথচ আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, ঘরে দু-চারজন লোক ছিল।
আমার কথা শেষ হতে-না-হতেই ঘরের দরজায় দেখা গেল সেই চাকরটিকে। কুণ্ঠিতস্বরে সে বলল, যদি এটা একবার দেখেন– বলে আমার দিকে একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে ধরল।
উঠে গিয়ে আমি সেটা হাতে নিলাম। তাতে একটা ঠিকানা লেখা।
আমি চোখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে তাকালাম ওর দিকে। ও জবাব দিল, ওই দাড়িওয়ালাবাবুর পকেট থেকে পড়েছিল এটা।
দাড়িওয়ালাবাবু মানে কিষাণ আপ্তে। কিন্তু এর অর্থ কী! জেড কি এই লোকটাকে পরীক্ষা করার জন্যে পকেট থেকে কাগজটা ইচ্ছে করেই ফেলেছেন? যাকগে, একবার শেষ চেষ্টা করব এই সূত্র ধরে। কিষাণ আপ্তের সঙ্গে কথা বলে এই ঠিকানায় একবার যাব। জানি কোনও লাভ হবে না, তবু– এই আশা নিয়ে সুচরিতাকে বসতে বলে জেড-এর সঙ্গে দেখা করার জন্যে উঠলাম।
নীচের ঘরে এসে তাঁকে দেখলাম। বসে-বসে মানেকজির সঙ্গে কথা বলছেন। আমি গিয়ে তাঁকে একপাশে ডাকলাম, বললাম, মিস্টার আপ্তে, আপনার পকেট থেকে কি এই কাগজটা পড়ে গিয়েছিল?
না তো! সবিস্ময়ে বললেন তিনি, কোথায় পেলেন এটা?
আমি তাকে সব খুলে বললাম।
সব শুনে তিনি বললেন, ওই চাকরটা নিশ্চয়ই কারও হয়ে কাজ করছে। দেখি, ব্যাটার মতলব কী!
আমি আর দেরি না করে কবুতরের বাইরে এসে ক্রসওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি একটা সামান্য সূত্র পেয়েছি। সেটা নিয়েই একবার শেষ চেষ্টা করতে চাই বলে তাকে সব বললাম, ঠিকানাটাও দেখালাম। শেষে যাওয়ার সময় বললাম, আপনি কাইন্ডলি লক্ষ রাখবেন যে, কেউই যেন কবুতর ছেড়ে কোথাও না যান।
কবুতর ছেড়ে যাওয়ার সময় একবার পেছনদিকটায় উঁকি দিয়ে গেলাম। দেখলাম, কিরণ শর্মা তখনও গোলাপের বাগানে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন। আমাকে দেখেই সাঁৎ করে সরে গেলেন।
আমি মনে-মনে একটু হেসে কবুতর ছেড়ে রওনা দিলাম। হতাশা আমার মন ছেয়ে ফেলেছিল।
.
পোড়ো বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকানাটা মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। এই বাড়িটাই তো? ভাঙা নেমপ্লেট থেকে যতটুকু উদ্ধার করা গেল, তা খুবই সামান্য। তবু ঠিকানাটা মেলাতে অসুবিধে হল । বনজঙ্গলে ভরতি এই ভাঙা পোড়ো বাড়িতে আর যেই থাক, মানুষ বাস করে বলে মনে হল না।
পা টিপেটিপে ঢুকলাম বাড়ির চত্বরে। বেলা পড়ে এসেছিল। জায়গাটা ছায়া পড়ে অন্ধকার অন্ধকার হয়ে রয়েছে। ধীরে-ধীরে বাড়ির পেছনদিকে গিয়ে পৌঁছোলাম। ঝোপঝাড়ে ভরতি পেছনদিকটা। তারই মধ্যে কিছুক্ষণ লুকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে নীচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, সেখানে জনাসাতেক লোক বসে আছে। ঘরের দেওয়ালে একটা লাল পাঞ্জার ছাপ। এখানেও লাল পাঞ্জা!
লোকগুলোর আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, ওদের নেতা বা ওই ধরনের কেউ এখনও আসেননি। জানলা ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই একজন লোককে হেঁটে যেতে দেখলাম। তার পেছনদিকটা দেখে খুব চেনা মনে হল। কিন্তু কে, তা কিছুতেই ধরতে পারলাম না। আমি তো ক্রসওয়ার্ডকে বারণ করে দিয়ে এসেছিলাম যে, কবুতর ছেড়ে কেউ যেন বেরোতে না পারে!
হঠাৎ মাথার ওপরের একটা জানলা থেকে ভেসে আসা গোঙানির শব্দ আমার কানে এল। সঙ্গে-সঙ্গে পুরোনো জীর্ণ পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। সবসময়ই ভয় হতে লাগল, পাইপটা যদি ভেঙে পড়ে, কিংবা কেউ যদি দেখে ফ্যালে!
শেষ পর্যন্ত জানলার কার্নিশে পৌঁছে জানলা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘরে আবছা আবছা চোখে পড়ল একটি লোককে। ঘরের এক কোনায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
কী করব ভাবছি–এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। আর আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে, তিনি কিরণ শর্মা।
আমি তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠলাম, তা হলে শেষ পর্যন্ত আপনিই নাটের গুরু?
কোনও জবাব না দিয়ে আমার দিকে ছপা এগিয়ে এলেন তিনি। তারপরই পকেট থেকে একটা গাঢ় নীলচে রঙের রিভলভার বের করে উঁচিয়ে ধরলেন আমার দিকে, তার মুখ ব্যঙ্গের হাসিতে বিকৃত হয়ে গেল…।
.
রাতে যখন কাঞ্চন ফিরল না, তখন খুবই মুষড়ে পড়ল সুচরিতা। কোত্থেকে কী হয়ে গেল। তাদের মধ্যেই একজন সমর বর্মন! কী সাঙ্ঘাতিক! তবে কাঞ্চন নিশ্চয়ই নয়। সত্যিই, কাঞ্চন ছেলেটা এমন দুরন্ত প্রকৃতিরদারুণ ছেলে। ওকে ছাড়া সুচরিতা নিজেকে ইদানিং ভাবতে পারে না। ও আসার পর থেকেই সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে আছে সুচরিতা।
ঠিক এমন সময় ঠক করে একটা আওয়াজ হল কাচের শার্সিতে। চকিতে জানলার দিকে ছুটে গেল সুচরিতা। জানলা খুলল–। নীচের সুরকি ঢালা পথে কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুচরিতা মুখ বাড়াতেই আর একটা সাদা রঙের কী ছিটকে এল ঘরের ভেতরে। নীচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল ও। কাগজে মোড়া একটা পাথর। কাগজটা খুলল..একী! এ যে কাঞ্চনের চিঠি। চিঠিতে লেখাঃ
সু,
ভীষণ বিপদ, শিগগির কবুতর ছেড়ে আমার লোকের সঙ্গে চলে এসো। অনেক কথা বলার আছে। আর, এদিকে কী হয়েছে জানো? কিরণ শর্মা হলেন…।
কাঞ্চন।
আর দেরি করল না সুচরিতা। চটপট তৈরি হয়ে নেমে এল নীচে। দেখল, লোকটি ওর পরিচিত। ওই লোকটিই কুমার রণজিতের চাকর ছিল।
সুচরিতা নেমে আসতেই সে চাপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চলুন, বাবু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
ওরা দুজন দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল।
সুচরিতা ভাবছিল–তা হলে কাঞ্চনের ধারণাই সত্যি হল। কিরণ শর্মাই আসল লোক।
কবুতরের বাইরে সুচরিতার গাড়ি ছাড়াও আর একটা কালো রঙের স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়েছিল। চাকরটার নির্দেশে সুচরিতা গিয়ে বসল সেই গাড়ির পিছনের সিটে। চাকরটা ওর পাশে এসে বসল।
ড্রাইভারের সিটে যে বসেছিল সে গাড়ি ছেড়ে দিল। লোকটির মুখ সুচরিতার চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু পাশ থেকে দেখে ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না।
হঠাৎই পিছনদিকে মুখ ফেরাল লোকটি।
সঙ্গে-সঙ্গে খুশির বন্যায় ছলকে উঠল সুচরিতার আনন্দ ও কাঞ্চন, তুমি!
কাঞ্চন কোনও জবাব না দিয়ে হু-হু করে গাড়ি ছোটাতে লাগল।
এ কী! কাঞ্চন, কী হয়েছে তোমার? কথা বলছ না কেন? ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করল সুচরিতা।
কাঞ্চন এবারও কোনও জবাব দিল না। গাড়ি ছুটতে লাগল ঝড়ের গতিতে।
সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে পড়ল সুচরিতা। খামচে ধরল কাঞ্চনের জামা। তারপর হিস্টিরিয়া রুগির মতো চেঁচিয়ে উঠল, কাঞ্চন, কী ব্যাপার? কথা বলছ না?
সুচরিতা, তুমি ভয় পেলে? গম্ভীর স্বরে জবাব এল।
গাড়ি তখন ঝড়ের বেগে উল্কার মতো ধেয়ে চলেছে অজানার দিকে..।
.
শেষ দৃশ্য! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এতক্ষণ ঘটে যাওয়া কবুতর নাটকের এটাই শেষ দৃশ্য।
কবুতরের লাইব্রেরি-ঘর। সেখানে আজ প্রায় সবাই হাজির হয়েছেন। মানেকজি, প্রসাদজি, সর্বেশ্বর রায়, নরসিংহ চৌধুরী, কিষাণ আপ্তে, ক্রসওয়ার্ড, তরুণ সান্যাল। ঘরে অনুপস্থিত কিরণ শর্মা, কাঞ্চন মৈত্র, সুচরিতা চৌধুরী এবং বরাবরের মতোই নয়না কল্যাণী তিনি সম্ভবত মরফিনে আচ্ছন্ন।
জেন্টমেন, আজ সব রহস্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার। সমর বর্মনকে আমি খুঁজে পেয়েছি। কিষাণ বলছিলেন, আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে, সেই দুর্ধর্ষ তস্কর সমর বর্মন আর কেউ নয়–শ্রীকাঞ্চন মৈত্র!
ঘরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হতবাক দৃষ্টি মেলে সবাই তাকিয়ে রয়েছেন কিষাণ আপ্তের দিকে। তিনি তখনও বলে চলেছেন, মিস্টার ক্রসবির সঙ্গে আলোচনা করে আমি সবই জানতে পারি। ভেবে দেখুন কাঞ্চন মৈত্রের কথা। এই দিল্লিতে আসার আগে ইনি কী করতেন? কোথায় ছিলেন? ..কিছুই আমরা জানি না। চিঠিগুলো হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটা দেখুন কী হাস্যকর। আসলে চিঠিগুলো উনি ডিকোড করতে পারছিলেন না। তাই যেমন করে তোক ওগুলোকে আবিষ্কার করলেন–তাও আবার নিজের ড্রেসিং টেবিলেই যাতে আমাদের দিয়ে ওগুলো ডিকোড করিয়ে নেওয়া যায়। কুমার রণজিতের মৃত্যুর ব্যাপারে তাঁর কথাগুলো ভেবে দেখুন। তিনি আসলে পৌনে একটায় হাজির হতে চেয়েছিলেন কবুতরে। হয়তো লাইব্রেরিটা খুঁজে দেখার ইচ্ছে ছিল। কোনও শব্দ-টব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কুমার রণজিৎ। লাইব্রেরিতে গেলেন–সমর বর্মনকে চিনে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গুলি করলেন শ্রীমৈত্র। তারপর আমাদের কাছে একটা বানানো গল্প ছেড়ে দিলেন। সুচরিতা চৌধুরীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকেও দলে টানলেন। মনে রাখবেন, বেশিরভাগ ঘটনাই কাঞ্চনবাবুর নিজের স্টেটমেন্ট। লাল পাঞ্জা নামে আদৌ যে কোনও গ্যাং আছে। তা আমি বিশ্বাস করি না। এরপর মিস্টার মৈত্র রিভলবারটা শ্রীরায়ের সুটকেশে পাচার করে দিলেন। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে আমরা একটা খুপরি দেখতে পাই। তাতে কিছু না পাওয়ায় শ্রীমৈত্র অত্যন্ত ডিসহার্টেন্ড হয়েছিলেন।
কিন্তু সমর বর্মন সম্বন্ধে আমি যতদূর শুনেছি, সে কখনও মানুষ খুন করেনি, দ্বিধাগ্রস্তভাবে জানালেন ক্রসওয়ার্ড।
ঠিক কথা। কিন্তু তখনকার অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখুন আপনারা। আমি গোপনে তাকে অনুসরণ করে অনেককিছুই জানতে পারি–।
কিন্তু তিনি এখন কোথায়? সর্বেশ্বর রায় প্রশ্ন করলেন।
যেখানেই থাকুন না কেন, আমাদের লোক তাকে খুঁজে বের করবেই। দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন ক্রসওয়ার্ড।
ঠিক এই সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন কিরণ শর্মা, কাঞ্চন মৈত্র ও সুচরিতা চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে ক্রসওয়ার্ড এগিয়ে গেলেন কাঞ্চনের দিকে।
.
হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে একবার তাকালাম সকলের দিকে। বিষণ্ণ হাসি হেসে সুচরিতার দিকে চেয়ে বললাম, সু, তুমিও কি এসব বিশ্বাস করো?
বিশ্বাস না করতে পারলেই খুশি হতাম… সুচরিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
আমি মিস্টার মৈত্রকে পরীক্ষা করার জন্যে তার অনুচরের–নেপালী চাকরটা, যে কুমারের সঙ্গে এখানে এসেছিল সামনে ইচ্ছে করেই বাজে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ ফেলে দিই। পরে দেখলাম, কাঞ্চনবাবু আমাকে ওটা দেখিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেন। কিন্তু এর মধ্যে আশ্চর্য কী জানেন! ওই কাগজটা আমি পেয়েছিলাম কাঞ্চনবাবুর ঘর থেকেই ব্যঙ্গের হাসি হেসে থামলেন কিষাণ আপ্তে।
দাঁতে দাঁত চেপে আগুনঝরা দৃষ্টি মেলে আমি এগিয়ে গেলাম ক্রসওয়ার্ডের দিকে। বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, প্লিজ, ফর হেভেন্স সেক–এই হাতকড়াটা কিছুক্ষণের জন্য খুলে দিন।
কী ভেবে ক্রসওয়ার্ড আমার অনুরোধ রাখলেন। আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলাম কিষাণ আপ্তের দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, মিস্টার জেড, আমার নামে কেউ মিথ্যে কথা বললে আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। সুরেন্দ্র পালিত তার স্মৃতিকথায় একটা কথা ঠিকই লিখেছিলেন–তা হল– বলে আমি জেডের কানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, মানুষ নিজের কান কখনও চেঞ্জ করতে পারে না। পরের মুহূর্তেই এক বিরাশি সিক্কার চড় মেরে তাঁকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বললাম, এটা আপনার মিথ্যে কথা বলার শাস্তি। ক্রসওয়ার্ডের দিকে ফিরে বললাম, ব্যস্ত হবেন না, ইন্সপেক্টর–এই হল আপনাদের ভাষায় দুর্ধর্ষ সমর বর্মন!
অসম্ভব! বলে উঠলেন ক্রসওয়ার্ড।
আমি উত্তরে মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম মেঝেতে পড়ে থাকা আপ্তের দিকে। একটানে তুলে ফেললাম তার পরচুলা আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সানগ্লাসটা খুলে নিতেও ছাড়লাম না।
কিরণ শর্মা এক ফাঁকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তিনি এসে ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে এক ভদ্রলোক, তার চোখে সবুজ রঙের সানগ্লাস, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
অবাক এ কী কান্ড সব! বললেন নরসিংহ চৌধুরী।
হ্যাঁ, বললেন কিরণ শর্মা, ইনিই হলেন আসল কিষাণ আপ্তে বা এজেন্ট জেড। যাকে আমরা–মানে, আমি আর কাঞ্চনবাবু, একটা পোড়ো বাড়িতে বন্দি অবস্থায় পেয়েছি।
কিন্তু আপনি! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন সর্বেশ্বর রায়।
অধমের নাম, অরুণ চৌধুরী ফ্রম ক্যালকাটা। পেশায় শার্লক হোমস–মানে, ডিটেকটিভ।
আপনিই! বিস্ময়াপন্ন স্বর বেরিয়ে এল অনেকের গলা দিয়ে।
হ্যাঁ, আমিই। আমি কাঞ্চনবাবুকে সব খুলে বলেছি–উনিই আপনাদের সব বুঝিয়ে বলবেন। আমি কোনওদিন এরকম জটিল রহস্যের মুখোমুখি হইনি।
ক্রসওয়ার্ড এগিয়ে গিয়ে ভূলুণ্ঠিত বর্মনকে দাঁড় করিয়ে হাতকড়া এঁটে দিলেন। বললেন, কিন্তু, মিস্টার চৌধুরী, কুমার রণজিৎকে খুন করল কে? সমর বর্মন?
না। বললাম আমি, সে কথায় পরে আসছি। প্রথম থেকেই বলা যাক সব। শ্রীনরসিংহ যেদিন হোটেলে গিয়ে আমার সঙ্গে পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমি বুঝিনি অন্য উপায় বলতে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন। পরে আমি ফোন পাই মেহেতা অ্যান্ড সন্স থেকে। তারা একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ পাঠাচ্ছে পাণ্ডুলিপিটার জন্যে। সন্দেহ হওয়ায়, সঙ্গে-সঙ্গে আমি ফোন করি মেহেতা অ্যান্ড সন্সে। কিন্তু তারা আমাকে জানায় যে, তারা কোনও ফোনই করেনি। আমি তখন আসল পাণ্ডুলিপিটা হোটেল কন্টিনেন্টালের ভলটে রেখে নকল একটা প্যাকেট গজানন শিকদারের হাতে তুলে দিই।
এখনও তা হলে পাণ্ডুলিপিটা আপনার কাছেই আছে? প্রশ্ন করলেন মানেকজি।
হা-হোটেলের ভলটে। সে যাক, এর পরের ব্যাপার আরও ঘোরালো। চিঠিগুলো আমার কাছে থেকে চুরি করেছিল ইব্রাহিম। সে লাল পাঞ্জার হয়ে কাজ করছিল। পরে বোধহয় বেলাইনে চলার জন্যে সে মার্ডার হয়। তখন মার্ডারারকুমারের হত্যাকারী তাদের নির্দেশ দেয় সুচরিতাকে ফাঁসানোর জন্যে। কারণ? কারণ নিশ্চয়ই একটা ছিল।
আমি পুলিশী ঝামেলা এড়ানোর জন্যে ইব্রাহিমের বডি নিয়ে কী করেছি তা আপনারা জানেন। এদিকে ইব্রাহিমের কাছ থেকে চিঠিগুলো চলে যায় হত্যাকারীর হাতে। কিন্তু এর আগে একটা চিরকুটে সে ইব্রাহিমকে তার সঙ্গে কবুতরে দেখা করতে বলেছিল। সম্ভবত সে নেকলেসটা পাচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইব্রাহিম মারা যাওয়ায় এবং চিরকুটের ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ায় ওটা আমার হাতে পড়ে। আমি সেই রাতে কবুতরে আসি এবং কী ঘটেছিল তা আবার বলার বোধহয় দরকার নেই। হত্যাকারী যখন নেকলেসটা লাইব্রেরিতে খুঁজছিল তখন কুমার আচমকাই সেখানে এসে হাজির হন এবং তাকে চিনতে পারেন। সঙ্গে-সঙ্গে হত্যাকারী তাকে গুলি করে। এই নেকলেস নিয়ে এর আগেও একজন অজ্ঞাতপরিচয় লোক খুন হয়েছিল–এই কবুতরেই।
সমর বর্মনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল হত্যাকারী। এবং প্রথম রাতে যখন বর্মন (আপ্তের পরিচয়ে) লাইব্রেরিতে ঢোকে তখন তার সঙ্গে মার্ডারার ছিল। সে সুচরিতার পাশ কাটিয়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে যায়। সুচরিতাকে অরুণ চৌধুরী ইচ্ছে করেই আটকেছিলেন। কারণ, তখনও তিনি জানতেন যে, আসল এজেন্ট জেডই গোপনে তদন্ত করছেন। পরে তিনি বর্মনের ছদ্মবেশটা ধরে ফেলেন শুধু তার কানের জন্যে। আপনারা আসল জেডকে দেখুন–তাঁর কানের লতিটা গালের সঙ্গে লাগানো নয়। অথচ সমর বর্মনের কান লক্ষ করুন কানের লতিটা গালের সঙ্গে লাগানো। সুরেন্দ্র পালিত এই কথাই লিখেছিলেন তাঁর পাণ্ডুলিপিতে।
কিন্তু, কুমারের হত্যাকারী কে? প্রশ্ন করলেন প্রসাদজি।
রানী সুলক্ষণা সেন। কুমার রণজিৎ সেনের বোন অথবা শ্ৰীমতী নয়না কল্যাণী।
অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
মানেকজি কোনওরকমে বললেন, ইমপসিবল!
আমি ওঁর দিকে ফিরে হেসে বললাম, উনি আপনার দূরসম্পর্কের বোন। কিন্তু এখানে আসার আগে কি আপনি ওঁকে কখনও চোখে দেখেছেন?
মানেকজি হতভম্ব হয়ে মাথা নাড়লেন, বললেন, না।
ঠিক তখনই লাফিয়ে উঠল সুচরিতা, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, কাঞ্চন,–সেই রাতে আমি ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পেয়েছিলাম–আর নয়না কল্যাণীর গা থেকে কাল ওইরকম গন্ধ পেয়েছি তখন আমার ঠিক মনে পড়েনি।
প্রসাদজি, মনে করে দেখুন যখন গুপ্তপথে আমরা ঢুকেছিলাম, তখন বর্মনের অতিআগ্রহের কথা–। নয়না কল্যাণী নিজেই চেষ্টা করেছিলেন চিঠিগুলো ডিকোড করতে। কিন্তু না পেরে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে-কথা আপনারা নকল জেডের কাছ থেকে শুনেছেন। কুমারের মৃত্যুর রাতে নয়না কল্যাণীর ঘরেই আলো জ্বলেছিল।
কিন্তু আসল নয়না কল্যাণী গেলেন কোথায়? প্রশ্ন করলেন শ্রীসর্বেশ্বর রায়।
তিনি কবুতরে আসার পথে বদল হয়েছেন। আসল নয়নার বদলে এসেছেন সুলক্ষণা সেন। সুলক্ষণা সেনকে আমি দেখিনি। আমি তখন নেপালে ছিলাম, কিন্তু সুচরিতা তাঁকে দেখেছিল। তাই, ও যদি চিনে ফ্যালে…তাই ওকে কবুতরে আসা থেকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
সুলক্ষণা সেন কি বিপ্লবের সময় মারা যাননি? মানেকজি প্রশ্ন করলেন।
না, কারণ তার মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি। আমি এটা সন্দেহ করেছিলাম। সুলক্ষণা সেন অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি তার দাসীর ছদ্মবেশে পালিয়ে বাঁচলেন, আর তার দাসী মারা পড়ে বিপ্লবীদের আগুনে।
এবার একটা কথা বলি–তা হল ঠিকানা লেখা চিরকুটটার কথা। ওটা সমরের পকেট থেকেই পড়েছিল–ওর অজান্তে। আমি ইন্সপেক্টরকে বলেছিলাম কেউ যেন কবুতর ছেড়ে না যায়। তাই বর্মন বেরোতে পারেনি। কিন্তু অরুণ চৌধুরীর পরিচয় ক্রসওয়ার্ড জানতেন। তাই তাকে যেতে দিয়েছিলেন। মিস্টার চৌধুরীও প্রথমে আমাকেই সন্দেহ করেছিলেন।
সুলক্ষণাকে যদি সুচরিতা চিনে ফেলত তবে ওর বিপদ হত, তাই আমি চিঠি দিয়ে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। আমি একটু অভিনয় করাতে ও দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি সুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আপনার আসল পরিচয়টা সবাইকে এবার বলুন, ইয়োর মেজেস্টি। অরুণ চৌধুরী বললেন।
তার মানে! আটটি কণ্ঠস্বর একসঙ্গে বলে উঠল।
আমিই শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের ছেলে–অতলান্ত রায়। আমিই রটিয়ে দিয়েছিলাম যে, অতলান্ত রায় নেপালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
কিন্তু, কুমার, নেকলেসটা কোথায় গেল? মানেকজি প্রশ্ন করলেন।
গোলাপ বাগানের নীচে। সারি-সারি গোলাপের ইঙ্গিতই ছিল ওই সাঙ্কেতিক চিঠিতে। বললেন অরুণ চৌধুরী।
তোমার পরিচয় আমাকে আগে বলোনি কেন? অনুযোগের সুরে বলল সুচরিতা।
তা হলে আমি অ্যারেস্টেড হতাম। কারণ রণজিতের পর আমিই ছিলাম সিরাজনগরের অধিপতি। হেসে জবাব দিলাম আমি।
রিভলভারটা আমার সুটকেশে তা হলে নয়নাই রেখে দিয়েছিল? সর্বেশ্বর রায় জানতে চাইলেন।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি।
চলুন, এবার মিসেস সেনের খোঁজ নেওয়া যাক। ক্রসওয়ার্ড বললেন।
তাই তো! কারওরই খেয়াল ছিল না কথাটা। সবাই মিলে দৌড়ে গেলাম ওপরে।
গিয়ে দেখলাম নিজের ঘরে নিপ্রাণ দেহে পড়ে আছেন নয়না কল্যাণী।
আত্মহত্যা করেছেন। বললেন কিষাণ আপ্তে।
সম্ভবত মরফিনের সাহায্যে। জানালাম আমি।
.
এরপর হীরের নেকলেসটা খুঁজে পাওয়া গেল গোলাপ বাগান খুঁড়ে। আবার শান্ত হল কবুতর। সুচরিতার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পরদিন কাগজে দেখি একটি বিজ্ঞাপন।
কবুতর বিক্রি হচ্ছে। উৎসুক ক্রেতারা খোঁজ নিন।
–মানেকজি প্রসাদজি লিমিটেড কোং
যার হাতেই তুমি যাও, তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে কবুতর।
সুচরিতার বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
চুনি-হীরা
ঘরটা মাপে বিশাল। এ-প্রান্তে দাঁড়িয়ে ও-প্রান্তের মানুষকে বোধহয় ঝাপসা দেখায়। কারণ, ঘরের দূরতম কোণে প্রকাণ্ড এক সেক্রেটারিয়্যাট টেবিল সামনে রেখে যে-মানুষটি বসে আছেন তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া জোয়ান লোকটা কর্কশ গলায় বলল, এগিয়ে যান। উনিই মিস্টার মিত্র।
আমি চোখ ফিরিয়ে লম্বা-চওড়া সঙ্গীর দিকে তাকালাম। নাক থ্যাবড়া, চৌকো চোয়াল, কুতকুতে চোখ। গায়ের রং মাঝারি, তবে শুধু ওইটুকুই মাঝারি। বাকি সব কিছুই মাঝারির চেয়ে বাড়াবাড়ি রকমের। যেমন হাতের পেশি, তেমনি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ। হিন্দি ছবির ফর্মুলামাফিক শেষদিকে এর সঙ্গে আমার মোকাবিলা হওয়া উচিত। আর তাই যদি হয়, তা হলে এখন থেকেই বিষ্টু ঘোষের আখড়ায় গিয়ে আমার ব্যায়াম শুরু করা দরকার।
আসুন, আসুন, মিস্টার শিকদার–।
ঘরের দূরপ্রান্তের সেক্রেটারিয়্যাট টেবিলের পিছন থেকে আপ্যায়নবাণী ভেসে এল অনেকটা দৈববাণীর মতোই। মাখনের মতো মোলায়েম স্বর এবং সুর। কিন্তু পরক্ষণেই রুক্ষ আদেশ শোনা গেল, খুদে, তুই নজরকে ডেকে দে। তারপর দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবি। দেখবি কেউ যেন আমাদের কথাবার্তায় বাগড়া না দেয়। এবারে গলার স্বর ও সুর শজারুর পিঠের মতো মসৃণ।
আমি খুদের দিকে তাকালাম। এই জিনিস যদি খুদে হয় তা হলে দামড়া কী জিনিস তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
আসুন, মিস্টার শিকদার। আবার মাখনে ফিরে গেছেন মিত্র সাহেব। পিছনে টুকিটাকি শব্দ পেয়ে বুঝলাম, খুদে চলে গেছে। ঘরে শুধু আমরা দুজন।
টেবিলের এপাশে মিত্ৰসাহেবের মুখোমুখি বসলাম।
কলকাতার নামি মেটাল মার্চেন্ট শরদিন্দু মিত্র। কলকাতার ওপরতলার মানুষরা ওঁকে উঁদে ব্যবসায়ী বলে চেনেন। আর নীচুতলার মানুষরা চেনে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। সেই কারণেই খুদেকে চিনে নিতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে যে অন্তত গোটাদুয়েক খুন রয়েছে তা রীতিমতো হলফ করে বলা যায়।
সেক্রেটারিয়্যাট টেবিলটা ভারি অদ্ভুত। কুচকুচে কালো কাঠের ওপরে চকচকে পালিশ। এবং তার মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিমূর্ত আকারের একটা স্টেইনলেস স্টিলের পাত বসানো। হঠাৎ দেখলে আয়না বলে ভুল হতে পারে। তারই ওপরে নানান সরঞ্জাম–একজন নামজাদা ব্যবসায়ীর টেবিলে যা যা থাকে। তবে একটা তফাত রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বস্তুর সঙ্গেই কোনও না কোনও ধাতু জড়িত। যেমন প্রতিটি কলমে সোনালি পাতের পটি। অ্যাশট্রে কারুকাজ করা তামার তৈরি। কলমদানিটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। পিনকুশন অ্যালুমিনিয়াম আধারে বসানো। ডেট ক্যালেন্ডারও একই ধাতুর তৈরি। এইরকম সবকিছু।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করে দেয় টেবিলে রাখা পেপারওয়েটগুলো। দু-ইঞ্চি ব্যাসের ঝকঝকে কতকগুলো বল। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। সেগুলো দিয়ে নানান কাগজপত্র চাপা দেওয়া রয়েছে। না, এজন্য আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি, বলমার্কা পেপারওয়েটগুলো টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ছে না বলে। কারণ, সিলিং ফ্যানের তীব্র বাতাসে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া কাগজগুলো উড়তে চাইছে। ফলে বলগুলো ডাইনে-বাঁয়ে দুলছে, কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ছে না।
অবাক হয়েছেন, মিস্টার শিকদার?
মুখ তুলে তাকালাম। মিত্রসাহেবের কথায় সূক্ষ্ম একটা অবাঙালি টান লক্ষ করলাম। আরও লক্ষ করলাম, তার কপালে ছোট্ট চন্দনের টিপ। গায়ের রং কালো হওয়া সত্ত্বেও আগে চোখে পড়েনি।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মিত্রসাহেব বললেন, ছোটবেলা থেকেই মেটালের শখ, তাই মেটাল মার্চেন্ট হয়ে সমস্ত শখ মেটাচ্ছি। তা আপনি ওই পেপারওয়েটগুলো দেখে অবাক হয়েছেন…অবাক হবারই কথা। সবাই অবাক হয়। আমি ছাড়া ইন্ডিয়াতে এরকম পেপারওয়েট আর কেউ তৈরি করতে পারে না। ওই বলগুলোর ভেতরে খানিকটা কাঁপা জায়গা আছে। ফঁপা জায়গাটা ওপরদিক ঘেঁষে হওয়ায় বলের নীচটা ভারী হয়ে গেছে, তাই জায়গা ছেড়ে ওগুলো নড়ে না। সেই যে বাচ্চাদের একরকম খেলার পুতুল আছে দেখেননি! যেদিকেই শুইয়ে দিন সবসময় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেপারওয়েটগুলো অনেকটা সেইরকম–।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
মিত্ৰসাহেব ইঙ্গিতটা বুঝলেন। হাসলেন। ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি চোখে পড়ল। আরও চোখে পড়ল ওপরের পাটির শ্ব-দন্ত দুটো রুপোলি। হাসি শেষ হলে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান, মিস্টার শিকদার। পেপারওয়েটের ওপরে বক্তৃতা শোনানোর জন্যে আপনাকে ডাকিনি। আপনাকে ডেকেছি হীরাকে খুঁজে দেবার জন্যে–।
হীরা?
হ্যাঁ, হীরা–আমার মেয়ে। একমাত্র মেয়ে।
রহস্য এতক্ষণে পরিষ্কার হল।
শরদিন্দু মিত্র আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিষধর ঝুমঝুমি সাপের মতো ঠান্ডা স্থির নজর। ধবধবে পাঞ্জাবির ওপরে বেরিয়ে থাকা কষ্টিপাথরে খোদাই করা কালো মুখ বেমানান লাগছে। মাথায় হালকা হয়ে আসা কাঁচা-পাকা চুল তেল জবজবে করে পিছন দিকে টেনে আঁচড়ানো। সাদা পাঞ্জাবির হাতার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা দুটো হাতের পাঁচ-পাঁচ দশটা কালো আঙুল সাপের মতো হিলহিল করে নড়ছে। তাল ঠুকছে টেবিলের ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের পাতের ওপরে। আঙুলে চড়ানো একাধিক সোনা ও প্লাটিনামের আংটি।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিত্রসাহেব আবার বললেন, হীরাকে আমার চাই– কালকের মধ্যেই।
গতকাল রাত দশটা নাগাদ টেলিফোন পেয়েছিলাম। যে ফোন করেছিল নাম বলেনি। তবে এটুকু বলেছে, শরদিন্দু মিত্র আমার সঙ্গে দেখা করতে চান–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ কাজটা ভীষণ জরুরি। তারপরই একটা ঠিকানা শুনিয়ে দিয়ে লাইন কেটে গেছে। জরুরি কাজটা যে কী তা আর জানা যায়নি। এখন জানা গেল।
আমার টেলিফোন নাম্বার সরকারি বইতে থাকে না। তবে যারা আমার সাহায্য চায় তারা ঠিক খোঁজখবর করে অভিজ্ঞ লোকজনের সূত্র ধরে আমার টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেলে। আমাকে খোঁজ করার কারণ, এমন অনেক কাজ আমি করে দিই যা আইনসঙ্গত পথে গেলে চারগুণ সময় ও আটগুণ খরচ লেগে যাবে। সেদিক থেকে আমি হলাম ডিউটি ফ্রি শপ। আমি আইনমাফিক কাজ করি বেআইনি পথে। আইনমাফিক পথে বেআইনি কাজ করি না। নীচু মহলে কেউ-কেউ আমাকে প্রাইভেট আই বলে ডাকে। অবশ্য তাদের অনেকের মতে আমি বড় বেশি প্রাইভেট।
শরদিন্দু মিত্র এমন একজন লোক যার কখনও প্রাইভেট আই দরকার হয় না। বরং দরকার হলে প্রাইভেট আই ব্যাঙ্কে প্রচুর প্রাইভেট আই তিনি জমা দিতে পারেন। সুতরাং টেলিফোনের খবরটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল। তবে খুশিও কিছুটা হয়েছিলাম। কারণ, এই প্রথম শরদিন্দু মিত্রের সঙ্গে অমিতাভ শিকদারের দেখা হবে। তাই দেরি না করে আজ সকালেই চলে এসেছি।
মিত্ৰসাহেব এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো চাইছেন আমি কিছু বলি। তাই সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রশ্নটাই করলাম। আপনার মতো একজন মেটাল মার্চেন্ট থাকতে হীরাকে খুঁজে দিতে আমার মতো সামান্য মানুষের ডাক পড়ল?
শরদিন্দু মিত্র হাসলেন : শিকদারবাবু, অনেক রকম মেটালের কারবার আমি করি– তারপর দাঁতের পাটি বের করে একটা রূপোলি দাঁতে সশব্দে টোকা মারলেন। বললেন, প্লাটিনাম। পাশে ঝুঁকে পড়ে একটা ড্রয়ার খুলে কী একটা বের করলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুঁড়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষ হল। একটি ঋজু ফলার কুৎসিত ধারালো ছুরি। আবার ঝুঁকে পড়লেন। সোজা হলেন। টেবিলে সংঘর্ষের শব্দ। গাঢ় নীল রঙের একটা পিস্তল। বললেন, এসবও মেটাল–।
আমার কথায় মেটাল মার্চেন্ট-এর বাঁকা ইঙ্গিত বুঝতে ভুল করেননি মিত্রসাহেব।
মিস্টার শিকদার, কাজটা সামান্য বলেই আপনার মতো সামান্য লোককে তলব করেছি। আঙুলে তুড়ি বাজালেন শরদিন্দু মিত্র, হীরাকে আমি এখুনি তুলে আনতে পারি। কিন্তু আমি চাই
চুনিকে ওর চোখের সামনে কোতল করা হোক। খুদে, নজর, বা আর কাউকে পাঠালে চুনির মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেইজন্যেই আপনার সাহায্য চাইছি। সবরকম খবরাখবর আপনাকে আমি দিয়ে দেব। আপনি শুধু হীরাকে ফেরত নিয়ে আসুন। ওকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে চুনির কী হল না হল তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে হীরার চোখের সামনে কিছু না হলেই হল। একটা গভীর শ্বাস পড়ল, বাচ্চা মেয়ে তো! তা ছাড়া ছোটবেলায় চুনির কোলেপিঠে করেই মানুষ হয়েছে।
ঘটনাগুলো আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। এ-পর্যন্ত শরদিন্দু মিত্রের কথাবার্তা শুনে যা অনুমান হয় তাতে হীরা একটি বাচ্চা মেয়ে এবং চুনি মিত্ৰসাহেবের বাড়ির চাকর। কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই তা নয়। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঘটনা ঘটেছে কাল বিকেলে–মিত্রসাহেব বলে চললেন, নজর মহম্মদ আপনাকে সমস্ত খবর-টবর দিয়ে দেবে। কোনওরকম অসুবিধে হলে ওকে বলবেন, ও-ই ব্যবস্থা করবে। বুঝতেই তো পারছেন, আমাকে বিজনেস নিয়ে সবসময় নাজেহাল হতে হয়, কত দিকে আর মাথা দেব।
পিছনের দরজার দিক থেকে শব্দ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। খুদের সঙ্গে ছিপছিপে চেহারার একটি লোক এসেছে। ধারালো নাক-মুখ-চোখ। নিখুঁত পরিপাটি চাপদাড়ি। পরনে ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি। ওরা দুজন কাছে এগিয়ে আসছে।
ওই তো নজর এসে গেছে। শরদিন্দু মিত্র স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। তারপর আরামি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। তার ধবধবে চওড়া পাড় শৌখিন ধুতি চোখে পড়ল। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বললেন তিনি, শিকদারবাবু, পুলিশে আপনার তো চেনাজানা আছে। আশাকরি এ-ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অযথা পুলিশি ঝাটে জড়াব না। তা ছাড়া আপনাকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ তো আমি করাচ্ছি না। শুধু আমার মেয়েকে ফেরত চাইছি। পুলিশের হাতে দায়িত্ব দিতে চাইনি একটাই কারণে। ওদের গদাইলশকরী তদন্তে চুনিকে হয়তো সাজা দেওয়া যাবে, কিন্তু হীরাকে হয়তো আর কোনওদিনই দেখতে পাব না। আপনার সম্পর্কে অনেক জানি, অনেক শুনেছি। তাই ভরসাও করি অনেক। শরদিন্দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও হাত বাড়ালাম। পাঁচটা শীতল কালসাপ আমার হাত জড়িয়ে ধরল। রুদ্ধস্বর কানে এল, হেল্প মি, শিকদার। হেল্প আ পুওর ড্যাড!
নজর ও খুদে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ করলাম, নজরের চোখ কটা। কটা নয়, বরং বলা যায় ভীষণ ফ্যাকাশে। হঠাৎ দেখলে চোখের মণি ঠাহর হয় না। চোখের সাদা অংশের সঙ্গে রং মিলিয়ে যেন গা-ঢাকা দিয়েছে।
শরদিন্দু মিত্র বসে পড়লেন। টেবিলের বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা ড্রয়ার খুললেন। সামান্য খোঁজাখুঁজির পর একটা প্লাস্টিক কভার ফাইল বের করলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিলেন সেটা।
এগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে একটু ইতস্তত ভাব ছিল। ফাইলটা নিয়ে প্লাস্টিকের মলাট ওলটাতেই বোধহয় তার কারণটা বোঝা গেল। ফাইলের সব লেখাই ইংরেজিতে টাইপ করা। সেই ইংরেজি পড়ে তার সঠিক অর্থ বুঝে নেওয়ার ব্যাপারটা আমার বিদ্যেয় কুলোবে কি না সেটাই বোধহয় মিত্রসাহেবকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল।
সুতরাং শরদিন্দু মিত্রের দুশ্চিন্তা দূর করতে হেসে বললাম, চিন্তা করবেন না, মিস্টার মিত্র। বাঙালির লেখা ভুল ইংরেজি আমি মোটামুটি বুঝতে পারি। ওটা না বুঝলে আপনাদের মতো রইস ক্লায়েন্ট জুটবে কোথা থেকে?
শরদিন্দু মিত্র বেশ চেষ্টা করেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। কিন্তু খুদের বুদ্ধি কম। বোধহয় বিদ্যেও। তাই ফস করে ধমকের সুরে বলে বসল, বসের সঙ্গে মুখ সামলে কথা বলবেন।
আমি শব্দ করে ফাইলটা বন্ধ করে খুদের দিকে তাকালাম। দাঁত বের করে হেসে বললাম, মিস্টার মিত্র, প্রভুভক্তির জন্যে এটার মাইনে এ-মাস থেকে পাঁচসিকে করে বাড়িয়ে দেবেন।
খুদে ওর মোটা বুদ্ধিতেও ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। তেড়ে আসার ভঙ্গিতে এক পা এগিয়ে এল আমার দিকে। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, আর একটা ফালতু আওয়াজ যদি বেরোয়।
আমি খুদের ঘামের গন্ধ পাচ্ছিলাম। নিশ্বাসের শব্দও। সুতরাং এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলাম ওর বাঁ গালে।
ঘরে বাজ পড়ার শব্দ হল যেন। খুদের তামাটে গাল লাল হয়ে গেল। ও ধাক্কাটা সামলে নিয়েই হাত চালাতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে আমি বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে শরদিন্দু মিত্রের টেবিল থেকে ইস্পাতের ছুরিটা তুলে নিয়েছি এবং তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছি। পিস্তলটা নিইনি, কারণ ওটাতে গুলি ভরা আছে কি না আমার জানা নেই।
খুদে যেন নেতাজির হুকুমে ফ্রিজ শট হয়ে গেল। আমার জীবনে এরকম বহু ফ্রিজ শট আমি দেখেছি। না দেখলে বয়েসটা চল্লিশ পর্যন্ত আর গড়াত না। সেই কোনকালেই নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যেত।
আমার ছুরি ধরে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে শরদিন্দু মিত্রের কালো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল পলকের জন্যে। বুঝলাম, মিত্তিরমশাই জাতসাপ দেখলে চিনতে পারেন। চেনেন তার ফণা তোলার ঢঙ।
শুধুমাত্র নজর মহম্মদ নির্বিকার। যেন কটা চোখে অপলকে তাকিয়ে কাশ্মীরের সিনারি দেখছে।
খুদে! শরদিন্দু মিত্র গর্জে উঠলেন ভয়ংকর সুরে।
খুদের টানটান শরীরটা সঙ্গে সঙ্গে ঢিলেঢালা হয়ে গেল। আহত গালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে পিছিয়ে দাঁড়াল। তারপর আচমকাই ওর বাবার লেখা বর্ণপরিচয় থেকে শেখা খিস্তির ফুলঝুরির কয়েকটা ফুলকি উপহার দিল। লক্ষ করলাম, রাগে ওর মুখচোখ থমথম করছে এখনও।
আমি ছুরি ছুঁড়ে দিলাম টেবিলের ওপরে। বললাম, মিস্টার মিত্র, আপনার কথা বলা কুকুরকে একটু পিঠ চাপড়ে দিন। ভীষণ খেপে গেছে।
খুদে। আবার ডেকে উঠলেন শরদিন্দু। বুঝতে পারছিলাম, খুদের আচরণ ওঁর ভদ্রতার পোশাক টেনেহিঁচড়ে খুলে দিতে চাইছে।
তুই দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। মুখ দিয়ে যেন কোনও আওয়াজ না বেরোয়। শিকদারবাবু আমাদের গেস্ট–মেহমান। সেটা খেয়াল থাকে যেন।
লেজ গুটিয়ে চলে গেল খুদে। যাওয়ার সময় গজগজ করছিল আর মাথা নাড়ছিল।
নজর মহম্মদ দুটো হাত সামনে জড়ো করে রেখেছে। আঙুলে আঙুলে পাচানো। চোখ আধবোজা। মুখ শান্ত। মাথার চুল দু-এক গাছা কপালে।
নজর! শরদিন্দু গলার স্বর আবার মোলায়েম করে ফেলেছেন? মিস্টার শিকদারকে পাশের ঘরে নিয়ে যাও। নিরিবিলিতে বসে গোটা ব্যাপারটা ওঁকে বুঝিয়ে দাও। যেন কোনও গোলমাল হয়।
জি মিত্ৰসাব। বলে অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে আবার সোজা হল নজর। আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, চলিয়ে শিকদারসাব, আপসমে বাত করতে হয়।
অতএব ফাইলটি বগলদাবা করে নজরকে অনুসরণ করলাম।
মিত্ৰসাহেব পিছন থেকে বললেন, উইশ ইউ বেস্ট অব লাক–।
আমি মুখ না ফিরিয়ে বাঁ হাতটা ওপরে তুলে ওঁর শুভেচ্ছা গ্রহণ করলাম। খুদেকে থাপ্পড় কষিয়ে আমার ডান হাতটা জ্বালা-জ্বালা করছিল। সুতরাং দরজা পার হয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে ফেললাম, তোমার গাল এত খসখসে কেন গো? গালে কিরিম-টিরিম মালিশ করো না–।
খুদের মুখ থেকে একটা চাপা গরগর শব্দ শোনা গেল।
নজর পিছনে তাকিয়ে বলল, শিকদারবাবু, আমাদের সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজ হয়ে গেলে ঢের দিল্লাগি করা যাবে, কী বলেন!
আমি মনে-মনে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ বলতে শুরু করলাম। রাগ কমানোর এ এক অব্যর্থ ওষুধ। ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছি। এখন শেখানোর কেউ নেই। বাবা-মা দুজনেই বহুবছর ধরে দেওয়ালে ফটো হয়ে ঝুলছে। আমি বছরে দুটো মালা কিনি, ফটোয় লাগাই। আর সেই দিন দুটোয় কোনও খারাপ কাজ করি না। কাউকে দুঃখ দিই না। শুধু নিজে দুঃখ পাই। অন্ধকার নিঃঝুম ঘরে কোলের ওপরে চাঁদের আলো নিয়ে জানলার ধারে বসে থাকি। টেপরেকর্ডারের ক্যাসেটে নীচুস্বরে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান বাজতে থাকে, বুকে বিঁধতে থাকে তীব্রভাবে ও প্রথমত আমি তোমাকে চাই। দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই। তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই। শেষপর্যন্ত তোমাকে চাই…।
কিন্তু কাকে চাই আমি নিজেই জানি না।
.
ছিমছামভাবে সাজানো একটা বসবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঘরের সর্বত্র রুচি ও পয়সার ছাপ। ভেলভেট মোড়া নরম যে-সোফায় বসলাম তার মধ্যেও কোমল বিলাসী আমন্ত্রণ।
বিশাল ঘরের তিন দেওয়ালে তিনটে পেইন্টিং। আর চতুর্থ দেওয়ালে সুন্দর ওয়াল ক্যাবিনেট। তার পাল্লা কাচের। তাই তাকে সাজানো কারণবারির বোতলগুলো চোখে পড়ছে। তার নীচে একপাশে ফ্রিজ।
দেখেশুনে মনে হয় এটা বোধহয় শরদিন্দু মিত্রের গোপন ব্যবসায়িক কথাবার্তার আপ্যায়নকক্ষ। যেমন এখন আমি আর নজর মহম্মদ ব্যবসায়িক আলোচনা করতে বসেছি।
আমি আর নজর মুখোমুখি বসে। মাঝের টেবিলে পড়ে আছে প্লাস্টিক কভার ফাইলটা। তার পাশেই কারুকাজ করা এক কাচের ফুলদানিতে রজনীগন্ধাগুচ্ছ।
আমি ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎই নজরের কথায় চমক ভাঙল।
শিকদারসাব, এই হল হীরা।
আমি চোখ ফিরিয়ে তাকালাম।
ফাইলের কোনও আনাচকানাচ থেকে পোস্টকার্ড মাপের একটা রঙিন ফটোগ্রাফ বের করে ফেলেছে নজর।
ছবির মেয়েটাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত সুন্দরও কাউকে দেখতে হয়! টানা-টানা নিষ্পাপ চোখ। ধনুকের মতো ভুরু। তার মাঝে সবুজ এক চিলতে টিপ। তার নীচ থেকেই কোমল রেখায় নেমে গেছে নাক। নাকের বাঁ দিকে হীরের নাকছাবি। তারপর স্ফুরিত আমন্ত্রণী ঠোঁট এবং মানানসই চিবুক।
ফটোটা গলার খানিক নীচেই শেষ হয়েছে। কিন্তু কোনও পুরুষকে প্রতিবন্ধী করে দেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। যেমন, আমি এখন বোবা হয়ে গেছি।
আমি বললাম, ফটোটা আমার লাগবে।
নজর হাসল। এই প্রথম ওর শান্তশিষ্ট ভদ্রতার মুখোশ সামান্য সরে গেল যেন। ও বলল, শুধু ফটো কেন, ইচ্ছে করলে এই গোটা ফাইলটাই আপনি নিতে পারেন।
হীরার ফটোটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে আমি বললাম, এবারে গোটা গল্পটা আমাকে বলুন। তার পরে ফাইল দেখছি–
নজর বলতে শুরু করল, চুনিবাবু, মানে চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মেটাল কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার। আজ প্রায় পনেরো বছর ধরে চাকরি করছে। কোম্পানি তখন ছোট ছিল। ডান হাতটা শূন্যে নেড়ে ঘরটাকে দেখিয়ে নজর বলল, এসব ঠাটবাট কিছুই ছিল
আমার চোখ গেল কারণবারিক্যাবিনেটের দিকে। বললাম, নজরসাব, ওগুলো কি শুধু চোখে দেখার জন্যে, না চেখে দেখার জন্যে।
নজর মহম্মদ তৎক্ষণাৎ গুস্তাখি মাফ বলে উঠে পড়েছে সোফা ছেড়ে, এবং এগিয়ে গেছে কাবিনেটের দিকে। সেখান থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আমাকে, আপনার পসন্দ কী আছে বলুন?
আমি ঠোঁট উলটে কাঁধ কঁকালাম। যার অর্থ যা তোক কিছু একটা হলেই চলবে। মদ আর অস্ত্রের ব্যাপারে আমার খুব একটা বাছবিচার নেই।
এরপর সুন্দর কাচের গ্লাসে বরফ ডোবানো মদিরা নিয়ে বসে পড়েছি আমি আর নজর মহম্মদ মুখোমুখি।
নজরের কাছ থেকে গল্পটা যা জানা গেল তা সংক্ষেপে এই
চুনিবাবু হীরাকে ছোটবেলা থেকে দেখছে। আর কোম্পানির প্রায় শুরু থেকেই মিত্ৰসাহেবের ডান হাত হয়ে কাজ করে গেছে। শরদিন্দু মিত্রের বিপদে-আপদে চুনি ব্যানার্জি যা করেছে তা ভোলার নয়। মিত্ৰসাহেবও ওকে খুব স্নেহ করেন–অন্তত করতেন, হীরাকে নিয়ে ভেগে পড়ার আগে। হীরা মিত্রসাহেবের চোখের মণি। তাঁর মেটাল বিজনেসের রাজত্ব আর রাজকন্যা কার হাতে তুলে দেবেন তা ঠিক না করলেও, সেই ভাগ্যবান যে চুনি বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, সেটা বোধহয় তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন। তাই যখন টের পেলেন চুনির সঙ্গে হীরার আশনাই চলছে, তখন বিরক্ত হয়েছিলেন, রেগেও গিয়েছিলেন। তারপর একদিন নজর আর খুদের সামনে চুনিকে একা ডেকে শাসিয়েছিলেন। শরদিন্দু মিত্রের শাসানিকে ভয় পায় না এমন লোক খুব বেশি নেই। চুনি ভয় পেয়েছিল। কিন্তু হীরাকে না পাওয়ার ভয়টা ছিল আরও বেশি। তাই কেঁদেকেটে বলেছিল, আপনার ব্যবসা চাই না, একটা ফুটো পয়সাও চাই না, শুধু হীরাকে চাই। ওকে আমি, আমি…।
শরদিন্দু মিত্র চুনির অনুনয়ে কান দেননি। শক্ত গলায় বলেছিলেন, চুনি, তোমাকে আমি পছন্দ করি। তোমার উপকার আমি ভুলিনি, কখনও ভুলি না। তাই এখনও তুমি দেখতে পাচ্ছ, সূর্য উঠছে, পাখি ডাকছে, চঁদ উঠছে। নইলে এসব কিছু দেখতে পেতে না। আর তোমাকে কোম্পানি থেকে এক্ষুণি তাড়িয়ে দিতেও চাইছি না।
কিন্তু এত সাবধান করা সত্ত্বেও কাজ হয়নি। লায়লা-মজনু, শিরি-ফরহা, হীরা-রাঞ্জার বেলাতেও কোনওরকম হুঁশিয়ারিতে কোনও কাজ হয়নি। তাই গতকাল সকাল থেকে হীরা– মিত্রসাহেবের কলিজা হীরালোপাট। সেই সঙ্গে চুনিবাবুও। ব্যস, দুয়ে দুয়ে চার।
ঘরের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি পাঁচ কান করতে চান না শরদিন্দু মিত্র। আর চুনিকে খতমও করতে চান না–অন্তত হীরার চোখের সামনে। তাই পুলিশে যাননি। নজর, খুদে, বা ওদের মতো কাউকেও দায়িত্ব দেননি। ডেকেছেন অমিতাভ শিকদারকে। যে-লোকটা রোজ চারটে রিভলভার আর সাতটা স্টিলেটো দিয়ে ব্রেকফাস্ট খায়।
নজর মহম্মদের গল্পটায় কোথায় যেন একটা গোলমাল ছিল। কী একটা যেন ঠিকঠাক খাপ খাচ্ছে না, মিলছে না মোটেই। ব্যাপারটা তখনকার মতো মগজ থেকে সরিয়ে রেখে ফাইলের দিকে মনোযোগ দিলাম।
চুনিবাবুকে আমি দোষ দিই না। হীরার জন্যে যে-কোনও মোকাবিলায় নেমে পড়া যায়। জান কবুল সেই লড়াইতে নেমে কখনও খেয়াল হয় না, জান তো একটাই।
ফাইল থেকে একটার পর একটা কাগজ নিয়ে নজর আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। চুনির একটা ফটোও দেখাল আমাকে।
চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়েস চল্লিশের ওপারে। তবে দেখে বছর পাঁচ-সাত কম বলেই মনে হয়। ফরসা চেহারা। চোখে রিমলেস-চশমা। চোয়াল শক্ত। খাড়া নাক। চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। ডান গালে চোখে পড়ার মতো একটা তিল।
আশ্চর্য! এই লোকটা ওর আধা বয়েসের একটা ছুকরির জন্যে দিওয়ানা হয়ে গেল! অবশ্য হীরার ছবি দেখলে বোঝা যায় যে-কোনও বয়েসের পুরুষই ওর জন্যে দিওয়ানা হয়ে যেতে পারে।
সব দেখা-টেখা যখন শেষ হল তখন আমি জিগ্যেস করলাম, আমি কোথা থেকে ওদের তুলে নিয়ে আসব?
নজর মহম্মদ বলল, হোটেল রিভারভিউ, ডায়মন্ডহারবার। ওরা ওখানে ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। রুম নম্বর দুশো তিন।
আমি অবাক চোখে নজরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক ঢোকে গ্লাসের বাকি মদটা শেষ করে দিয়ে বললাম, নজরসাব এই কাজের জন্যে আমাকে ডেকেছেন! আবার পয়সাও দেবেন। সত্যি, বিশ্বাস হচ্ছে না–।
নজর ওপর দিকে চোখ তুলে হাত নেড়ে বলল, খুদা যব দেতা হ্যায়, ছপ্পড় ফাড় কর দেতা হ্যায়। খুদা মেহেরবান, তো ঢুহা পহেলবান।
আমি কোনও জবাব না দিয়ে হীরা আর চুনির ফটো দুটো তুলে নিলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবার মিত্রসাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করব।
অতএব নজর আবার আমাকে নিয়ে চলল শরদিন্দু মিত্রের ঘরে।
ঘরের দরজার মুখে খুদে এখনও দাঁড়িয়ে। দাঁত খুটছে। আমাকে চোখ টেরিয়ে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।
শরদিন্দু মিত্র টেলিফোনে কথা বলছিলেন কার সঙ্গে। টেবিলের ওপরে একটা ফাইল খোলা। আমাকে দেখে সপ্রশ্নে তাকালেন নজরের দিকে। নজর তার হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে বলল, শিকদারবাবু সিরফ ফটো দুটো নিয়েছেন।
শরদিন্দু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বসতে বললেন চোখের ইশারায়।
আমি বসলাম। টেলিফোনে কথা শুরু হল আবার। শরদিন্দুর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি এবং নজর। উনি ফোনে বলছিলেন, না, না, ব্যাপারটা নিয়ে আমি অকারণে পাঁচকান করতে চাই না। শুধু চাই হীরা আর চুনি মঙ্গলমতো ফিরে আসুক। আমি ওদের দুজনকেই ভালোবাসি, স্নেহ করি। আমি ওদের আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছি। কে জানে, কবে ফিরবে ওরা… একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তার একটু পরেই ফোন রেখে দিলেন শরদিন্দু।
আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে বললেন, সব বুঝে নিয়েছেন, মিস্টার শিকদার?
আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ। তারপর হীরা আর চুনির ফটো দুটো ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, এগুলোর পেছনে সই করে তারিখ দিয়ে দিন।
শরদিন্দু হীরার ফটোটা গভীর আবেগমাখা চোখে দেখছিলেন। প্রায় চমকে উঠে বললেন, কেন, সই করব কেন?
আমি হাসলাম। অনেক বুদ্ধিমান মানুষও অনেক সময় ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করে। ওঁকে বললাম, আপনার সই-ই হচ্ছে হীরা আর চুনির কাছে আমার আইডেন্টিফিকেশান। আমি বেপরোয়া কাজ করি বটে, তবে বুরবাক নই।
ওঁর কালো মুখ কি বেগুনি হল একটু? স্বচ্ছন্দে হোক। শুধু বেগুনি কেন, শরদিন্দু ইচ্ছে করলে বেগুনি থেকে শুরু করে বর্ণালীর বাকি রংগুলোও পরপর ফুটিয়ে তুলতে পারেন ওঁর মুখে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
হঠাৎই গম্ভীর ভাবটা পালটে ফেললেন শরদিন্দু। হাসলেন। ওঁর প্লাটিনামের দাঁত দেখা গেল। বললেন, মিস্টার শিকদার, মনে হচ্ছে লোক চিনতে আমি ভুল করিনি। হীরাকে আমার চাই। ওকে ছেড়ে আমি একটা মুহূর্তও থাকতে পারছি না।
তারপর খসখস করে সই করে দিলেন। ফটো দুটো এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
এবার টেবিলের বাঁ দিকের ড্রয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়লেন শরদিন্দু। একটু পরেই একশো টাকার নোটের একটা বান্ডিল আলতো করে ছুঁড়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। দশহাজার। বললেন, এটা আপনার পারিশ্রমিক নয়, মিস্টার শিকদার, স্রেফ রাহাখরচ। পারিশ্রমিক আপনাকে দেব হীরাকে হাতে পাওয়ার পর। শরদিন্দু মিত্রের কথার নড়চড় হয় না।
আমি ফটো দুটো নিলাম, টাকার বান্ডিলটাও। পকেটে রাখলাম।
আপনার যদি গাড়ির দরকার হয় বলুন, নজর সব ব্যবস্থা করে দেবে–
আমি বললাম, দরকার নেই। আমার একটা ছোট প্রিমিয়ার পদ্মিনী আছে। আপনাদের মতো ক্লায়েন্টদের সহযোগিতায় কেনা। ওটা দিয়েই কাজ চলে যাবে। একটু থেমে আবার বললাম, সত্যিই কি হীরাকে আপনার কালকের মধ্যেই চাই?
কেন, পারবেন না? ভুরু কুঁচকে গেল শরদিন্দুর।
হয়তো পারব, তবুও একটা দিন বেশি চাইছি।
বেশ। এখন সবই আপনার হাতে–। একটু থেমে আরও বললেন, নজর আপনাকে দুটো আনলিস্টেড ফোন নাম্বার দিয়ে দেবে। কোনও জরুরি খবর থাকলে ওই নাম্বারে ফোন করতে পারেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ালাম।
শরদিন্দু পিছন থেকে ডাকলেন, মিস্টার শিকদার–।
আমি থমকে দাঁড়ালাম। ঘুরে তাকালাম।
শরদিন্দু বললেন, মেটাল মার্চেন্ট হিসেবে আর কোনও সাহায্য করতে পারি?
যথারীতি মেটাল শব্দটার ওপরে জোর দিয়েছেন শরদিন্দু।
আমি হাসলাম। পুরোনো কথাটাই বললাম, ধন্যবাদ, তার দরকার হবে না। আমি রোজ একডজন আর্মস দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাই।
বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। সঙ্গে নজর মহম্মদ। এবং দরজার কাছে আবার সেই খুদে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁত খুঁটছে। দাঁত ছাড়া বোধহয় খোঁটার মতো আর কিছু ওর নেই।
রাস্তায় বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি তখন আনলিস্টেড কোনও নাম্বার দুটো নজর মহম্মদ আমাকে দিল। ডান হাত আদাবের ভঙ্গিতে দুবার নেড়ে বলল, ফির মিলেঙ্গে, শুকরিয়া।
আমিও ওকে পালটা অভিবাদন জানিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। চারপাশে যানবাহনের কোলাহলে বোঝা যায় বেলা বেড়েছে। রাস্তায় লোকজনও প্রচুর। যে যার কাজে ব্যস্ত।
গাড়ি চালিয়ে কিছুটা এগোতেই হীরার মুখটা মনে পড়ল। অপরূপ ওই মেয়েটা এখন কী করছে, কেমন অবস্থায় আছে? আর তখনই লক্ষ করলাম, একটা সাদা মারুতি আমার গাড়ির প্রায় ছায়া হয়ে গেছে।
আমার হাসি পেল। এরকম টিকটিকির লেজ হেঁটে ফেলতে আমার বেশ মজা লাগে।
.
ডায়মন্ডহারবার রোডে মিনিট পঁয়তাল্লিশ গাড়ি চালানোর পর তাকালাম রিয়ারভিউ মিরারের দিকে। টিকটিকির লেজ ছেটে ফেলতে রিয়ারভিউ মিরারের উপকারিতার কোনও জবাব নেই।
বর্ষা চলছে। তাই রাস্তার দুপাশে প্রকৃতি সবুজ জামা-প্যান্ট পরে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে টুকরো দু-একটা দোকানপাট অথবা ছন্নছাড়া কঁচা-পাকা বাড়ি।
চায়ের তেষ্টা পাচ্ছিল। তাই রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানের কাছে গাড়ি দাঁড় করালাম। গাড়ি থেকে নেমে বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চায়ের কথা বললাম।
কানটা মাপে বড়সড় হলেও নিতান্ত ঝোঁপড়ি। মালিকের বয়েস দেখে মনে হয় ছশো নিরেনব্বই বছর। চলাফেরার সময় যে কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠকাঠক শব্দ করে যখন-তখন খসে পড়তে পারে। তারই হুকুমে এক ছোকরা এক গ্লাস চা দিয়ে গেল আমাকে।
চায়ে প্রথম চুমুক দিতেই পায়ের কাছে একটা ছায়া দেখতে পেলাম। কে যেন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো প্যান্ট পরা একজোড়া পা। পায়ে স্নিকার।
আকাশ মেঘলা। একটু আগে পথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পেয়েছিলাম, যদিও এখন নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবছা ছায়াটা আলাদা করে চিনতে পারলাম আমি। চায়ের গ্লাস থেকে মুখ না তুলে, ছায়ার মালিকের দিকে না তাকিয়ে আমি আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম, কে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।
চায়ের দোকানে দ্বিতীয় খদ্দের বলে কেউ নেই। তবে সামনের পাকা রাস্তায় কদাচিৎ লোকজন চলাফেরা করছে, কয়েকটা গাড়িও ছুটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে।
প্রায় দশ সেকেন্ড কেটে গেল চুপচাপ। তারপর একটা ভরাট গলা বলে উঠল, মিস্টার শিকদার, কোথায় যাচ্ছেন? হোটেল রিভারভিউ?
আমার দেখা ছায়ার কণ্ঠস্বর। এ-গলা আমি আগে কখনও শুনিনি।
গ্লাসের চা মোটামুটি গরম। সুতরাং প্রথম ধাপ হিসেবে সেটা এই কালো প্যান্টের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া যায়। তারপর শরীরের দুর্বলতম জায়গা লক্ষ্য করে কষিয়ে বুটের এক লাথি। ব্যস, ততক্ষণে মক্কেল ভার্টিকাল অবস্থা থেকে হরাইজন্টাল অবস্থায় পৌঁছে যাবে। সুতরাং তারপর ওর শরীরের ওপরে ফ্রি স্টাইল চালানো যেতে পারে।
মানুষ যা ভাবে সবসময় তা করে না। আমিও করলাম না। একবার মনে হল, এটা সেই সাদা মারুতির কেউ নয়তো! তা ছাড়া লোকটা আমার নাম জানল কেমন করে? শরদিন্দু মিত্র কি একে পাঠিয়েছে আমার ওপরে নজর রাখার জন্যে?
অবশেষে মুখ তুলে তাকালাম।
বছর তিরিশের এক যুবক। কিন্তু মাথায় চুল বিরল। চোখ ছোট। তামাটে গালে ছোট মাপের একটা পুরোনো ক্ষতের দাগ। পরনে চেকশার্ট। তাতে লাল আর সবুজ ডোরা।
যুবক হাসছিল। আমি কিছু বলার আগেই বসে পড়ল আমার পাশে। বলল, মিস্টার শিকদার, হীরার খোঁজে আপনি না গেলেই ভালো হয়।
ছেলেটি বোধহয় আমার স্থানীয় অভিভাবক। আমার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবছে। চমৎকার!
আমি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখলাম ভিজে মাটিতে। মুখের ভাব যথাসম্ভব মোলায়েম রেখে জিগ্যেস করলাম, আপনি কে? মিত্তিরের চামচে?
যুবকের মুখ শক্ত হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনিও তো এখন তাই।
আমি নড়েচড়ে বসলাম। এরকম মোকাবিলায় মজা আছে। অমিতাভ শিকদার মোকাবিলায় মজা পায়।
যা বলার চটপট বলে ফেলুন। আমাকে এক্ষুনি রওনা দিতে হবে।
ছেলেটা এবার সিরিয়াস মুখ করে বলল, হীরাকে নিয়ে চলে গিয়ে চুনিদা কোনও অন্যায় করেনি। ওদের মোহাব্বত আছে। শরদিন্দু মিত্তির মোহাব্বতের কী বুঝবে! ও শালা তো বউকে পুড়িয়ে মেরেছিল– ছেলেটার মুখ ঘেন্নায় কুঁচকে গেল।
এই মুহূর্তে শরদিন্দু মিত্রের জীবনী জানার কোনও আগ্রহ নেই আমার। সুতরাং কোনও মন্তব্য না করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ছেলেটা হাতের ঝাপটায় বাতাস কাটার ভঙ্গি করে বলল, আপনি যদি ফিরে না যান তা হলে চুনিদা আপনাকে ছেড়ে দেবে না। চুনিদা বহুত খতরনাক লোক। আপনি এসব ফ্যামিলির ঝামেলায় নাক গলাবেন না। ছেলেটা আঙুলে তুড়ি বাজাল দুবার। বলল, মিত্তিরের ওখানে আমাদের লোক আছে। সব খবরই আমরা পাই। সুতরাং সময় থাকতে থাকতে হাপিস হয়ে যান। ন-দো গিয়ারা। ফুটটুস…।
আমি হঠাৎই হাসতে শুরু করলাম। গলা ফাটানো হাসি।
হাসি দেখে চুনি ব্যানার্জির চামচে এবং আমার লোকাল গার্জেন কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আর চায়ের দোকানের মালিক চমকে নড়েচড়ে বসল। ওর হাড়ে হাড়ে খটাখট শব্দ হল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঢোলা জিসের প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালাম। হাতটা যখন মুঠো করে বের করে নিয়ে এলাম তখন তার সঙ্গে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন মিলিটারি অ্যান্ড পুলিশ মডেলের দুটো রিভলভার বেরিয়ে এল। মাত্র দুইঞ্চি ব্যারেলের এই হ্যান্ডগান ০.৩৮ স্পেশাল কার্ট্রিজ ফায়ার করতে পারে। বন্দুকবাজের সঙ্গে মোকাবিলায় এই খুদে রিভলভার ভীষণ কাজের। এর এক-একটার ওজন মাত্র পাঁচশো গ্রাম। আধুনিক ধাতুবিজ্ঞান এই রিভলভারকে একইসঙ্গে মাপে ছোট এবং ক্ষমতাশালী করে তুলতে পেরেছে।
ছেলেটার মুখের রক্ত পলকে মঙ্গলগ্রহে চলে গেল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। আর বাঁ গালের একটা পেশি কেঁপে উঠতে লাগল বারবার।
রিভলভার দুটো আমি বেঞ্চির ওপরেই রাখলাম। তারপর হাসতে হাসতেই প্যান্টের অন্য পকেটে হাত ঢোকালাম।
ছেলেটা এবার স্পষ্ট কেঁপে উঠল থরথর করে। বলল, মিস্টার শিকদার, আমি– আমি–।
আমি হেসে বললাম, আমি রোজ রিভলভার চেটে দেখি, চুষে দেখি, কামড়ে দেখি, চুমু খেয়ে দেখি–।
বলে একটা রিভলভার তুলে নিয়ে চুমু খেলাম। মিষ্টি শব্দ হল। ওকে বললাম, তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। যা, মাঠে গিয়ে হা-ডু-ডু খেল।
ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে দৌড়ে পালাল। আমি ওকে দেখলাম কিছুক্ষণ।
আমার খবর ছেলেটা পেল কেমন করে? কে খবর দিল ওকে? আর চুনি ব্যানার্জি কি সত্যিই ভয়ংকর লোক? কতটা ভয়ংকর? শরদিন্দুর সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবে সে?
আর হীরা! অষ্টাদশী ওই অপরূপ সুন্দরী কি সত্যিই ভালোবাসে চুনিকে? নাকি জটিল কোনও সমীকরণ লুকিয়ে রয়েছে এর আড়ালে?
রিভলভারগুলো আবার পকেটে রাখলাম।
শরদিন্দু মিত্র ছেলেখেলা করার জন্যে আমাকে ডাকেননি। এখন ছেলেখেলার সময় নয়। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে।
চায়ের দোকানির দিকে চোখ পড়তেই দেখি বৃদ্ধ দু-হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে বসে। বোধহয় ঠিক করেছে, একটু আগের দেখা অশ্লীল দৃশ্য জীবনে আর দেখবে না। অবশ্য এর জীবন বলতে আর কয়েকটা দিনও বাকি আছে কি না কে জানে!
চায়ের পয়সা মেটালাম একটা দু-টাকার নোট দিয়ে। বাচ্চা ছেলেটা কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছিল। ছুটে এসে টাকাটা নিল। ওকে জিগ্যেস করলাম টাক মাথা ছেলেটাকে চেনে কি না। কালো বাচ্চাটা মাথা নাড়ল। না, কোনওদিন দ্যাখেনি।
গাড়িতে উঠে স্পিড বাড়ালাম। নাঃ, নাটক মনে হয় জমে উঠেছে। জানি না সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে।
.
ডায়মন্ডহারবারের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে বুঝলাম, আমার জন্যে একটা লাশ অপেক্ষা করছিল। এবং সেই লাশের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হল রীতিমতো নাটকীয়ভাবে।
লাল রঙের মারুতি ওমনিটা ছুটে আসছিল আমাকে লক্ষ করে। আর ছুটে আসার পথে বিপজ্জনকভাবে টলছিল এপাশ ওপাশ।
এক লহমার জন্যে আমার মনে হয়েছিল কোনও সেন্ট পারসেন্ট মাতাল বেলা সাড়ে বারোটায় এই ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানো প্র্যাকটিস করছে। কিন্তু গাড়িটা আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতেই–অথবা বলা যেতে পারে, আমি কোনওরকমে ওটাকে পাশ কাটিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়েছি, আর একইসঙ্গে আমার গাড়ির চাকা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ তুলে পিচের রাস্তা ছেড়ে পাশের কাদামাটিতে গভীর ছাপ ফেলে টাল খেয়ে আবার উঠে এসেছে রাস্তায়। তবুও যা দেখার তা ওইটুকু সময়ের মধ্যেই দেখে নিয়েছি।
ওমনি গাড়িটা চালাচ্ছে একজন মাঝবয়েসি লোক। মাথায় কঁচাপাকা চুল। জামায় লাল রঙের ছোপ। আর গাড়ির পেছনের কাঁচে কয়েকটা ফুটো, সেগুলোকে ঘিরে মাকড়সার জালের মতো চিড় খাওয়া হিজিবিজি।
আর গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কী ভেবে গাড়ি থামিয়ে দিলাম একেবারে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লাল ওমনিটা দেখতে লাগলাম।
ফঁকা রাস্তায় এলোমেলোভাবে ছুটে মিলিয়ে যেতে-যেতে গাড়িটার ড্রাইভার বোধহয় মত পালটাল। কারণ গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে সোজা মুখ থুবড়ে পড়ল পাশের নালায়। সেখানকার ঝোঁপঝাড় আগাছার মধ্যে গাড়িটার শতকরা সত্তরভাগই ঢাকা পড়ে গেল।
না, আর দেরি নয়। আমার একটা স্বভাব হচ্ছে সব সময় পরের ব্যাপারে নাক গলানো। এই স্বভাবটা বোধহয় জন্মগত কিংবা জন্মের আগে থেকেই। আর সেইজন্যেই নাকটাও কি একটু বেশি চোখা?
অতএব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইউ বাঁক নিয়ে পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলাম ওমনির দিকে। অনুভূমিক রেখার সঙ্গে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে গোঁত্তা খেয়ে থমকে রয়েছে গাড়িটা। গাছপালা আগাছা সরিয়ে চলে গেলাম ড্রাইভারের দরজার কাছে। দরজা খুলতেই লোকটা হেলে পড়ল আমার দিকে। আমি চট করে একহাতে ওর দেহটা ঠেলে ধরলাম। নইলে আমার জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যেত।
একটু আগে জামায় লাল ছোপ নজরে পড়েছিল। এখন দেখলাম বেচারা একেবারে হোলি খেলে উঠেছে। লাল রঙের হোলি। বোধহয় অন্য কোনও রং দোকানে ছিল না।
গাড়ির পেছনের কাছে অন্তত চারটে ফুটো আমার নজরে পড়ল। আর লোকটার পিঠে দুটো, পেটের কাছে একটা। অভিজ্ঞতা বলছে, যে দুটো গুলি ওর গায়ে বিঁধেছে তার মধ্যে অন্তত একটা ওর দেহকে এফেঁড়-ওফেঁড় করে দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছি, ভারতের জনসংখ্যা এক কমে গেছে এবং বাকি জনগনের মাথাপিছু জমি ও খাদ্য অনেকটা করে বেড়ে গেছে। কিন্তু আমার রাষ্ট্র-উন্নয়নের চিন্তা ধাক্কা খেল একটা অস্ফুট আর্তনাদে।
আর্তনাদটা বেরিয়ে এসেছে লালুর–মানে, ওই লালজামার মুখ থেকেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার কৌতূহল একশো তেরো গুণ বেড়ে গেল। খরচা খাতায় ফেলা লোকটাকে মনে মনে ঝট করে জমার খাতায় ফেলে ঝুঁকে পড়লাম ওর মুখের কাছে। অনেকটা চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনার নাম কী? কী করে এরকম হল?
লালুর ঢলে পড়া মাথা নড়ল সামান্য। ক্লান্ত ঠোঁট ফাঁক হল। বলল, ডাক্তার…হসপিটাল.. আমাকে বাঁচান…।
আমি ওর নাড়ি দেখলাম, নাঃ যা ভেবেছি তাই। ওর এখন ডাক্তার বা হাসপাতালের কোনও প্রয়োজন নেই। শুধু ডোমের প্রয়োজন–পোস্ট মর্টেমের জন্যে।
সুতরাং চিৎকার করে আবার একই প্রশ্ন করলাম। তখন মাথা তোলার চেষ্টা করে বিড়বিড় করে লোকটা বলল, মিত্র..শরদিন্দু মিত্র…।
তারপরই ওর মাথাটা আঁকুনি খেয়ে ঢলে পড়ল।
শরদিন্দু মিত্র? এটা নিশ্চয়ই আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর নয়। তা হলে কি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?
লোকটার নাড়ি দেখলাম আবার। নেই। মুনিয়া উড়ে গেছে দুনিয়া ছেড়ে। মনে-মনে একবার বলো হরি, হরিবোল– বলে মৃতদেহটা ঠেলে দিলাম গাড়ির ভেতরে। ওটা সিটের ওপরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তখন কী ভেবে খুব সাবধানে লোকটার পকেট হাতড়ালাম। কিছু টাকা-পয়সা আর কাগজপত্র পাওয়া গেল। টাকা মাটি, মাটি টাকা। অতএব কাগজপত্রের ওপরেই নজর বুলিয়ে নিলাম। দু-একটা ক্যাশমেমো আর মিত্রসাহেবের একটা ভিজিটিং কার্ড। কার্ডটা দুমড়ে গেছে। কার্ডের পেছনদিকে দুটো ফোন নাম্বার লেখা। দেখে চিনতে পারলাম। নজর মহম্মদ আমাকে এই দুটো ফোন নাম্বারই দিয়েছিল। অবাক হলাম। অমিতাভ শিকদারের মতো আরও কজনকে একই কাজে লাগিয়েছেন শরদিন্দু মিত্র? নাকি আমার বোঝার ভুল? হতে পারে এই লোকটা হয়তো শরদিন্দু মিত্রের পরিচিত ব্যাবসার সূত্রে চেনা। সে যাই হোক, কার্ডটা আমি পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। আর তারপরই একটা ক্যাশমেমো আমার নজর টানল। রেস্তরাঁয় খাওয়ার ক্যাশমেমো। ব্লু গার্ডেন রেস্তোরাঁ। কেয়ার অফ হোটেল রিভারভিউ, ডায়মন্ডহারবার। ক্যাশমেমোতে আজকেরই তারিখ। সুতরাং ক্যাশমেমোটাও পকেটে চালান করে দিলাম। তারপর গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে উঠে এলাম রাস্তায়। পুলিশে একটা খবর দিতে হবে।
রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কোনও ভরসা পেলাম না। সুতরাং ঠিক করলাম, হোটেল রিভারভিউ থেকেই ফোন করা যাবে থানায়। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আমি চাকরি করেছিলাম কলকাতা পুলিশে। সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি প্রায় সাড়ে আট বছর। কিন্তু মাথা থেকে পুলিশি কর্তব্যবোধটা এখনও একেবারে মুছে ফেলতে পারিনি।
অতএব গাড়িতে স্টার্ট দিলাম আবার। তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সোজা হোটেল রিভারভিউ। হীরাকে খুঁজে আনার সামান্য কাজে এত জটিলতা লুকিয়ে থাকবে একথা কে ভাবতে পেরেছিল!
.
হোটেল রিভারভিউতে রিভার আর ভিউ দুই-ই আছে। ডান দিকে হুগলি নদী। বর্ষায় জল থইথই। সেদিক থেকে ভেসে আসছে জোলো বাতাস। নদীর পাড়ে, কিছুটা দূরে-দূরে, কয়েকটা গাছ। বাতাসে দুলছে। তার সামনে খানিকটা খোলা মাঠ-ঘাসে ছাওয়া। সেখানে কয়েকজন মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
বাঁদিকে উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা হোটেল এলাকা। তারই মাঝে বিশাল লোহার দরজা। দরজার দুপাশে আধুনিক স্থাপত্যের কারুকাজে হোটেলের নাম লেখা। সঙ্গে বাতিস্তম্ভ।
দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মোরাম বিছানো পথ। আর তার খানিকটা দূরেই চারতলা হোটেল বিল্ডিং। সেখানেও আধুনিক ছাঁদ। চেহারাতেই বোঝা যায়, এ-হোটেল আমজনতার জন্যে নয়।
দরজার কাছে গাড়ি নিয়ে যেতেই উর্দি পরা দারোয়ান দরজা খুলে স্যালুট ঠুকল। গোঁফওয়ালা গোবেচারা লোকটার হাতে একটা দশ টাকার নোট তুলে দিয়ে জিগ্যেস করলাম, একটু আগে একটা লাল রঙের মারুতি ওমনি এখান থেকে বেরিয়েছে কি না।
লোকটা ইতস্তত করছিল। হয়তো জরুকে জিগ্যেস না করে ও কারও কথার জবাব দেয় না। আমি আর-একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম। ভারতীয় টাকার ঘন-ঘন অবমূল্যায়নে দশ টাকার এখন তেমন একটা দাম নেই–অন্তত লুব্রিকেশানের কাজে। তবে বিশ টাকায় কাজ হল। লোকটা জরুর আদেশের অপেক্ষা না করেই বলল, হ্যাঁ, একটা লাল মারুতি ওমনি গাড়ি সে বেরোতে দেখেছে। তবে ওইটুকুই, তার বেশি কিছু জানে না।
আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। গাড়ি চালিয়ে মোরামের ওপর দিয়ে কচর-মচর শব্দ করতে করতে সোজা হোটেল বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে গেলাম।
হোটেলের পেছনদিকে বিরাট খোলা জায়গা। সেখানেই কার পার্ক। কিন্তু এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কোনও অ্যাটেনড্যান্টকে চোখে পড়ল না। কার পার্কে গাড়ি রেখে এসে প্রকাণ্ড কাচের দরজা ঠেলে হোটেলের অভ্যর্থনাকক্ষে ঢুকলাম। এবং ঢুকেই চমকে গেলাম।
হোটেলের প্রতিটি সাজসজ্জায় বিলাসিতার ছাপ। পাঁচতারা হোটেলে এক-আধবার যে ঢুকিনি তা নয়। তবে এর তারার সংখ্যা পাঁচের অনেক বেশি মনে হয়।
প্রকাণ্ড রিসেপশান হলের মেঝেতে নরম কার্পেট। একপাশে অনেকগুলো সোফা। তার পাশে পাশে ছোট-ছোট টবে ছায়াতরু। একটু দূরে রঙিন টিভি। হলের ডানদিকের শেষ প্রান্তে কাচের দেওয়াল। দেওয়ালের ওপাশে সাঁতার-দিঘি। সেখানে কলির কেষ্ট আর গোপিনীর দল জলকেলি করছে। গা-থেকে-জল-ঝরে-পড়া দু-একজন সুন্দরীকে দেখে বেশ ভালো লাগল। লক্ষ করলাম, সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ার ভান করে তিনজন ভদ্দরলোক সুন্দরীদের বেশ খুঁটিয়ে দেখছে।
ইচ্ছে থাকলেও ওসব দেখার খুব বেশি সময় আমার হাতে নেই। সুতরাং এগিয়ে গেলাম রিসেপশান ক্লার্ক দুজনের কাছে। গাড়ি থেকে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ব্রিফকেসটা নিয়ে এসেছি। ওটা কার্পেটের ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাথার মধ্যে ঘুরছে রুম নম্বর টু-জিরো-থ্রি।
ক্লার্ক দুজন যেন উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু। একজন বেশ গাঁট্টাগোট্টা, অন্যজন রোগা। একজন ফরসা, অন্যজন কালো। একজনের চশমা, তো আর একজনের চশমা নেই। তবে দুজনেরই পরনে ছাইরঙা টেরিকটনের টিপটপ পোশাক। তার ওপরে হোটেল রিভারভিউর মনোগ্রাম এবং সারি সারি পেতলের বোতাম।
রিসেপশান কাউন্টারটা তিমির মতো লম্বা। আর তামা, পেতল, কাঠের তৈরি। যেখানে যেটা ব্যবহার করা উচিত, তাই ব্যবহার করা হয়েছে। সবটাই ঝকঝকে তকতকে।
আমাকে দেখেই গাঁট্টাগোট্টা এগিয়ে এল। মুখে ফুটিয়ে তুলল যান্ত্রিক হাসি। আমি ওকে বললাম যে, সেকেন্ড ফ্লোরে, মানে বাংলায় তিনতলায়, একটা ঘর চাই। সিঙ্গল বা ডবল, যে কোনও একটা হলেই চলবে।
লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। ঘরের নম্বর লেখা খোপগুলো দেখল। কোনও কোনও খোপে পেতলের বিশাল টিকিট লাগানো চাবি ঝুলছে। আমি আগেই লক্ষ করেছি, দুশো তিন নম্বর খোপে চাবি নেই, আর দুশো সাত নম্বর খোপে চাবি ঝুলছে। ঘরটা খালি হতে পারে, আবার এমনও হতে পারে, দুশো সাতের বোর্ডার চাবি কাউন্টারে জমা দিয়ে হুগলির হাওয়া খেতে বাইরে গেছে।
লোকটা এবার খাতা খুলল। কী সব দেখেটেখে বলল, দুশো সাত নম্বর খালি আছে। সিঙ্গল বেড। ভাড়া নশো পঞ্চাশ টাকা–।
বোধহয় শেষ কথাটা বলল আমার চেহারা ও পোশাক দেখে। আমি পকেট থেকে টাকা বেরে করে গুনে উনিশশো টাকা দিলাম ওর হাতে। বললাম, দু-দিনের ভাড়া। পরে দরকার হলে দু-একদিন বেশি থাকব।
লোকটা টাকা নিয়ে রোগা সঙ্গীকে ডেকে বলল কাগজপত্র তৈরি করতে। তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন উর্দিপরা বেয়ারার একজনকে ইশারায় কাছে ডাকল। দুশো সাত নম্বরের চাবিটা তাকে দিয়ে বলতে যাচ্ছিল কী কী করতে হবে, আমি হেসে বাধা দিলাম। বললাম, আমি নিজেই পারব। তারপর চাবিটা নিয়ে পকেটে ঢোকালাম। বেয়ারাটা ব্যাজার মুখে চলে গেল। সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। আমি সামনের খোলা খাতায় নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লেখার কাজ শেষ করলাম।
এবার আসল কাজ। গাঁট্টাগোট্টা লোকটাকে ইশারায় কাছে ডাকলাম। ও কৌতূহলী মুখে পালিশ করা কাউন্টারের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আমার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করল। জিগ্যেস করলাম, টেলিফোন করা যাবে একটা?
নিশ্চয়ই, স্যার– বলে কাউন্টারের ভেতরের তাক থেকে একটা নীল রঙের হালকা আধুনিক টেলিফোন বের করে কাউন্টারের ওপরে রাখল।
লোকাল থানার ফোন নাম্বার জানা নেই। অতএব লালবাজারে ফোন করে খুনের খবরটা দিলাম। নিজের পরিচয় জানালাম না। বললাম, লাশ গাড়িতে শুয়ে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
টেলিফোন শেষ করে গাঁট্টাগোট্টাকে ধন্যবাদ দিলাম। তারপর পকেট থেকে একটা আইডেনটিটি কার্ড বের করে পলকে ওর নাকের ডগায় খুলে ধরেই বন্ধ করে দিলাম। একইসঙ্গে জিগ্যেস করলাম, দুশোতিন নম্বরে কোন বোর্ডার আছে?
লোকটা বারকয়েক ঢোঁক গিলে খাতা উলটেপালটে দেখল। তারপর বলল, চুনিলাল ব্যানার্জি, স্যার। কাল থেকে এসে উঠেছে।
লক্ষ করলাম, লোকটার গলার স্বর কাঁপছে। একটা আইডেনটিটি কার্ডেই এই অবস্থা! তাও যদি কার্ডটা জেনুইন হত! এই রামছাগলটা ধরতে পারেনি যে, ওটা আমারই তৈরি। একটা আইডেনটিটি কার্ড বাজার থেকে কিনে তার ওপরে আমার পাসপোর্ট ফটো সেঁটে দিয়েছি। আর তার পাশে আমার নাম, বাবার নাম, জন্মতারিখ, সই ইত্যাদি যেমন থাকা উচিত ঠিক তেমনটি রয়েছে। আর সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটা হল রাবার স্ট্যাম্প। আমাদের দেশের জনগণের রাবার স্ট্যাম্পে অগাধ বিশ্বাস। সুতরাং সেরকম জাতের একটা পুরোনো রাবার স্ট্যাম্প নিয়ে তার ধ্যাবড়া ছাপ ছেপে দিয়েছি আইডেনটিটি কার্ডের ওপরে। স্ট্যাম্পের মাঝখানে তিন সিংহের মূর্তির ছাপও আছে। নিছকই ভেঁতা আউটলাইন–শুধু সিংহ তিনটের আদলটুকুই বোঝা যায়। তবে রামছাগলকে বশ করতে এটুকুই যথেষ্ট আসল সিংহের কোনও দরকার নেই। সুতরাং কার্ডটা নিশ্চিন্তে পকেটে চালান করে দিলাম।
এবার ওকে পরের প্রশ্নগুলো করলাম।
চুনি ব্যানার্জির সঙ্গে আর কেউ এসে উঠেছে? কোনও মেয়ে?
না, স্যার,
আমার ভুরু কুঁচকে গেল। হীরার খোঁজেই এসেছি। অতএব পকেট থেকে হীরার ফটো বের করে ওকে দেখালাম। হীরাকে কেউ একবার দেখলেই যথেষ্ট, কোনওদিন ভুলবে না। জিগ্যেস করলাম, চুনিবাবুর সঙ্গে এই মেয়েটি ছিল না?
হীরার ছবি দেখে লোকটার চশমা কেঁপে উঠল নাকের ডগায়। চোখজোড়া জুলজুল করে খাইখাই ভঙ্গিতে বলে উঠল, না, স্যার, মিসেস রায় তো তার স্বামীর সঙ্গে এসে উঠেছেন। এই তো, দুশো আঠেরো নম্বর রুমে। বলে খাতার পাতার দিকে আঙুল দেখাল সে।
তার মানে? চুনি ব্যানার্জি একা উঠেছে? আর হীরা মিসেস রায় নাম নিয়ে উঠেছে তার স্বামীর সঙ্গে? উঁহু..ওরে মন, পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন–।
সুতরাং নোলা ঝরা লোকটাকে আরও এক ডিগ্রি কাহিল করতে বললাম, স্বামী আবার কী! সব বোগাস–।
সত্যি স্যার, তাই?
আমি এক চোখ ছোট করে বললাম, তবে ওর রেটটা বড় হাই। আসলে দেখতে সুন্দর তো–।
কত রেট স্যার, কত? এরকম একজন বিউটি কুইন– লোকটার ডান হাতটা নড়ছিল। বোধহয় নজরের আড়ালে পকেটের খুচরো পয়সা গুনছিল।
আমি পাথরের মতো মুখ করে বললাম, দশ হাজার। পার নাইট।
টগবগে বেলুন চুপসে গেল পলকে। একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুখটাও ব্যাজার হয়ে গেল।
আমি এবার লাল মারুতির প্রসঙ্গে এলাম। জিগ্যেস করলাম, আধঘণ্টাটাক আগে লাল রঙের মারুতি ওনি নিয়ে কোনও কাস্টমার এখানে এসেছিল? ব্লু গার্ডেন রেস্তোরাঁয় বসেছিল খেতে…।
লোকটা হাসল। বলল, সেটা ঠিক বলতে পারব না, স্যার। তবে আমাদের রেস্তোরাঁটা দোতলায়। ওখানে মাইকেল আছে। ও তখন স্টেজে গাইছিল। ও সব লোককে ঠিকঠাক মনে রাখতে পারে। ওকে একটিবার জিগ্যেস করে দেখুন।
আমি হেসে ধন্যবাদ জানালাম। পকেট থেকে লুব্রিকেশান ফি হিসেবে একটা একশো টাকার নোট বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিলাম।
এর আবার কী দরকার ছিল, স্যার– বলতে-বলতে টাকাটা ও নিল। যতক্ষণ পর্যন্ত পরের টাকা খরচ করছি ততক্ষণ দয়ালু হতে কোনও বাধা নেই। তবে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। আপনমনেই বিড়বিড় করে কী যেন হিসেব কষছে। বোধহয় ভাবছে, বাকি নহাজার নশো টাকা কোত্থেকে জোগাড় করা যায়। আজ রাতে হীরাকে যে ও স্বপ্নে দেখবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গরিব তো স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে।
দোতলার সিঁড়ির পাশেই অটোমেটিক এলিভেটর। এলিভেটরে তিনতলায় উঠতে উঠতে ঠিক করলাম, আগে স্নান, তারপর খাওয়া–অবশ্যই ব্লু গার্ডেনে বসে আয়েস করে। তারপর মাইকেল। কিন্তু ওর পদবিটা কী হতে পারে? জ্যাকসন, না মধুসূদন দত্ত?
.
ব্লু গার্ডেনে। নামের মধ্যে যেমন একটা মিষ্টি সুর ও ছবি রয়েছে, চেহারাতেও তাই। বিশাল খোলা-হাওয়া রেস্তরাঁ। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের মতোই এই নীল উদ্যান। হোটেলের সদর দরজার দিকে মুখ করে তৈরি হওয়ার ফলে এখানে বসেই নদী দেখা যায়, টের পাওয়া যায় ছন্নছাড়া বাতাস। রোদ অথবা বৃষ্টি আড়াল করতে মাথার ওপরে উঁচু-নীচু পিরামিডের ঢঙে তৈরি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। রেস্তোরাঁর শতকরা সত্তর ভাগ খোলা হাওয়ায়, আর বাকি তিরিশ ভাগ অন্দরে। সেই অংশে নাচ-গানের ডায়াস, বার কাউন্টার এবং কিচেন। আর খোলা অংশে টেবিল চেয়ার সাজানো।
রেস্তোরাঁয় ভিড় মাঝারি রকমের। একে বর্ষাকাল, তার ওপরে বেলা প্রায় দুটো। তাই হয়তো খদ্দের বেশি নেই তা ছাড়া এই রেস্তোরাঁয় আকাশছোঁয়া দামও একটা কারণ হতে পারে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম আয়েস করেই। খালি পেটে কখনও রিভলভার চালানো যায় না।
বেয়ারাকে বিল মেটাতেই একটা ক্যাশমেমো হাতে পেলাম। চেহারায় ঠিক লালুর ক্যাশমেমোর মতো। বেয়ারাটাকে ডেকে লালুর ক্যাশমেমোটা দেখিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। লোকটা কিছুই ঠিকমতো বলতে পারল না। তখন ওকে বললাম, তোমার নাম নিশ্চয়ই মাইকেল নয়?
বেয়ারাটা আমতা-আমতা করে বলল, না, স্যার। মাইকেল গান গায়, গিটার বাজায়। একটু আগেই ওর গান শেষ হয়েছে। আবার সন্ধেবেলা ওর শো শুরু হবে। আঙুল তুলে দূরের কোণের ডায়াসটাকে দেখিয়ে বলল, ওই স্টেজে।
মাইকেল এখন কোথায়? পকেট থেকে কার্ডটা বের করে বেয়ারাটাকে দেখলাম। ছোট্ট করে উচ্চারণ করলাম, লালবাজার।
লোকটা মুখ তালশাঁসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নাঃ, আজ দেখছি শুধু রামছাগলদের দিন।
লোকটা রীতিমতো কাঁপা গলায় বলল, মিউজিক রুমে, স্যার।
আমার ভুরু কুঁচকে গেল। জিগ্যেস করলাম, সেটা আবার কোথায়?
ওই যে, স্টেজের পাশের দরজাটা।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। লুব্রিকেশান ফি হিসেবে দশ টাকা বের করলাম। লোকটাকে অনেক কষ্টে টাকাটা নিতে রাজি করালাম। টাকাটা বকশিশ হিসেবে দিয়ে কী ভেবে জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কী?
ক্ষুদিরাম, স্যার।
বাঃ! মাইকেল, তারপর ক্ষুদিরাম! আজ কি স্বাধীনতা দিবস না প্রজাতন্ত্র দিবস? কে জানে, নীচের ওই গাঁট্টাগোট্টা চশমাওয়ালার নাম রামমোহন অথবা প্রফুল্ল কি না!
ভেলভেট মোড়া সুদৃশ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এবার অপারেশান মাইকেল।
কতকগুলো ব্যাপার আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। শরদিন্দু মিত্রের কাজের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর কেউ আমাকে সাদা মারুতি নিয়ে ফলো করছিল। তারপর চুনি ব্যানার্জির লোক আমাকে শাসিয়েছে। আর সবশেষে লাল মারুতি ভ্যান নিয়ে লালুর অপঘাতে মৃত্যু।
লালু কী করতে এসেছিল রিভারভিউতে? এল, ব্লু গার্ডেনে খেল-দেল, তারপর একজোড়া গুলি খেয়ে মরে গেল। যে গুলি ছুঁড়েছে সে নিশ্চয়ই গাড়ির বাইরে থেকে, পিছন থেকে, ফায়ার করেছে। আর তখন গাড়িটা হয়তো ছুটন্ত অবস্থায় ছিল। নইলে চারটে গুলির মধ্যে দুটো গায়ে লাগবে কেন? যারা রিভলভার চালায় তাদের টিপ কি এতই ভেঁতা হয়!
হঠাৎই আমার থিয়োরিতে একটা বড় গলদ চোখে পড়ল। না, লালু যখন গুলি খায় তখন সে মোটেই ড্রাইভ করছিল না। কারণ সিটে বসা অবস্থায় সিটের গদি ফুটো না করে কোনও গুলি ওর বুকে বা পিঠে বিধতে পারে না। সামনের সিটের গদিতে সেরকম কোনও ফুটো আমার নজরে পড়েনি। সুতরাং গুলি খাওয়ার পর লালু কোনওরকমে গাড়িতে উঠে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। তখন আরও চারবার কেউ গুলি ছুঁড়েছে ওর গাড়ি লক্ষ্য করে।
গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে এখানেই, এই হোটেলে–এতে আর কোনও সন্দেহ নেই। তা হলে গুলির আওয়াজ কি কেউ শোনেনি? নাকি রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো ছিল?
এইসব উলটোপালটা ভাবতে-ভাবতেই মিউজিক রুমে গিয়ে ঢুকলাম। সঙ্গে-সঙ্গে হুইস্কির গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল।
ঘরটা ঝিমঝিম অন্ধকার। তারই মধ্যে টুং-টাং করে বাজছে গিটারের সুর। ঘরের একপাশে যন্ত্রসংগীতের নানা যন্ত্রপাতি জ্যাজ, কঙ্গো, পারকাসন, ম্যারাকাস, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন, আর বড় মাপের ইয়ামাহা ইলেকট্রনিক অরগ্যান। সেগুলো থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালা মোটাসোটা একটা লোক তামাটে শরীরটাকে সামান্য ঝুঁকিয়ে স্প্যানিশ গিটার বাজাচ্ছে। তার কাছে বসে আছে একটি রোগা চেহারায় ছোকরা।
আমি গিটারওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হুইস্কির গন্ধ গায়ে মেখে জিগ্যেস করলাম, মাইকেল?
দাড়িওয়ালার গিটার বাজতেই থাকল। তারই মধ্যে সুর করে ছড়া কেটে বলল, কী চাই, বলে ফেল ভাই– হুইস্কির গন্ধ আবার ঝাপটা মারল নাকে।
আমি জিগ্যেস করলাম, ঘণ্টাখানেক আগে ব্লু গার্ডেনে বসে খেয়ে গেছে একটা লোক। তারপর এই হোটেলেই গুলি খেয়ে রাস্তায় গিয়ে মরেছে। রেস্তোরাঁর তখন আপনার শো চলছিল। লোকটার চেহারার বর্ণনা দিলে চিনতে পারবেন?
রোগা ছেলেটা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। এত স্বাভাবিক গলায় কখনও কাউকে খুনের ঘটনা বোধহয় বলতে শোনেনি।
মাইকেল গিটার বাজাতে বাজাতেই হাসিমুখে সঙ্গীর দিকে তাকাল। বলল, ভয় পেলি, তরুণ? তোর অবস্থা বড় করুণ।
তরুণ তখন ভয়ার্ত মুখে যাই-যাই করছে।
মাইকেল এবার আমাকে জিগ্যেস করল, ভাই, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার কী নাম?
গিটার বাজছিল। একবারের জন্যেও থামেনি।
আমি দাঁত বের করে হেসে ছড়া কেটে বললাম, ভালো নাম অমিতাভ শিকদার, ডাকনাম পুলিশ। বলতে পারেন, বুলেট খাওয়া লোকটার হদিস?
ওদের দুজনেরই মুখের ছবি পালটে গেল। গিটারের তারের ওপরে থমকে গেল মাইকেলের আঙুল। কুতকুতে চোখ দ্রুত নড়াচড়া করতে লাগল এদিক-ওদিক। আর তরুণের অবস্থা এখন সত্যিই করুণ।
মাইকেলকে এবার লালুর চেহারার বর্ণনা দিলাম। ও চুপ করে শুনল। তারপর গিটারটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। বলল, আবছা মনে পড়ছে। ডায়াসের খুব কাছেই বসেছিল। বারবার ঘড়ি দেখছিল। তারপর একসময় ঘড়ি দেখেই জলদি খাওয়া শেষ করে ঝট করে উঠে পড়েছিল। তাড়াহুড়ো করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেছে। একটু থেমে আবার বলল, এইজন্যেই লোকটাকে মনে আছে। তবে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে বলতে পারব না।
মাইকেলের মুখ দেখে মনে হল সত্যি কথাই বলছে।
নাঃ, লালুর গল্প তা হলে এখানেই শেষ! হোটেলের ম্যানেজারকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই না, কারণ, তাতে শোরগোল হবে। আমার কাজ হীরাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, ব্যস।
মাইকেলকে আলগা গোছের ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। ও তখন আবার গিটার বাগিয়ে ঝংকার তুলতে শুরু করেছে। মাথা ঝুঁকিয়ে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করে বলল, অলওয়েজ ওয়েলকাম, মাইকেল ডিসুজা আমার নাম।
আমি হাসলাম, বললাম, দরকার পড়লেই আসব আবার, এখন সময় হল যাওয়ার–।
রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে বেরোনোর সময় মনে হল, ছোটবেলা থেকে রিভলভার চর্চা না করে যদি কবিতা চর্চা করতাম তা হলে বড় ভালো হত। আজ আমাকে এভাবে লালুর খোঁজ করে বেড়াতে হত না।
শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিল। দুশো সাত নম্বরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম আরামের বিছানায়। সন্ধেবেলা কারপার্কের অ্যাটেনড্যান্টকে লাল ওনির ব্যাপারে জিগ্যেস করা যাবে। আর হীরা যখন হাতের নাগালে রয়েছে তখন রাতের অন্ধকারে ওকে নিয়ে উড়ে যেতে অসুবিধে কী?
শুধু একটা ব্যাপার মনের মধ্যে খচখচ করছিল। লালু মারা যাওয়ার আগে শরদিন্দু মিত্রের নাম বলে গেল কেন?
.
হোটেল রিভারভিউর যে-কোনও ভিউই চমৎকার। অন্তত সূর্য ডুবে যাওয়ার মুখে কার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আমার তাই মনে হল।
সবুজ ঘাসের কিনারায় ঝুলন্ত শিকলের চেন। তারপরই মেটাল রোড এবং কার পার্ক। হোটেলের চৌহদ্দির পাঁচিল প্রায় দেড়মানুষ উঁচু। সুতরাং নদী বা সূর্যাস্ত কোনওটাই সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। তবে লালচে আকাশ পরোক্ষভাবে সূর্যের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছিল। আর হু-হু বাতাসের গায়ে নদীর নাম লেখা ছিল।
কার পার্কের কাছে চৌহদ্দির দেওয়াল ঘেঁষে হাফ ডজন পাম গাছ। তার মাথায়, পাতার ফাঁকে, পাখির বাসা ও সংসারী পাখি। ঘাসের ওপরে দাঁড়িয়ে ওদের নির্লজ্জ দাম্পত্য কলহ শোনা যাচ্ছে।
আমি অ্যাটেনড্যান্টের সঙ্গে কথা বলছিলাম। নেহাতই বিশ-বাইশের ছোকরা। নাম শিবনাথ। কালো মুখ পুরোনো বসন্তের দাগ। সামনের কয়েকটা দাঁত উঁচু। পরনে খাকি পোশাক।
একটু আগেই লুব্রিকেশান ফি জমা দিয়েছি তিরিশ টাকা। তারপরই লালুর গাড়ির খবর এবং বুলেটের ব্যাপারটা জানতে পেরেছি।
লালু দৌড়ে এসে ওর গাড়িতে উঠছিল। সেই সময়ে ওর পিঠে গুলি লাগে। না, গুলির শব্দ শুনতে পায়নি শিবনাথ। তবে হঠাৎই লালুর পিঠে সাদা জামার ওপরে লাল রং ফুটে উঠতে দেখে চমকে উঠেছে।
সময় তখন কটা হবে? এই বারোটা সাড়ে বারোটা। কার পার্কে শিবনাথ একাই ছিল। ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, মেটাল রোডের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল লালু। তারপর শিবনাথকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। টলতে টলতে উঠে পড়েছে গাড়িতে। গাড়িটা চলতে শুরু করামাত্রই আবার গুলি। কাচের ওপরে গুলির শব্দ–বেশ কয়েকবার। তখন শিবনাথ আন্দাজে ওপর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। তখনই একটা লোককে দেখতে পেয়েছে ও।
আমি মনোযোগ দিয়ে শিবনাথের কথা শুনছিলাম। আর একইসঙ্গে চারপাশে নজর রাখছিলাম। কারণ, খনা বলে গেছেন, ন বিশ্বাসন্তি আপনং ছায়া। যার অর্থ, নিজের ছায়াকেও কখনও বিশ্বাস কোরো না।
শিবনাথ হোটেলের তিনতলার জানলায় একজন লোককে দেখতে পায়। না, তাকে ঠিক চিনতে পারেনি। তবে ওই ঘরটায়।
আঙুল তুলে ঘরটা দেখাল শিবনাথ। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার বুকের ভেতরে একটা হাতি ব্যালে নেচে উঠল। কারণ, ঘরের নম্বরটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছি। দুশো তিন। চুনি ব্যানার্জির ঘর!
শিবনাথ আর কিছু বলতে পারেনি। না, এই দুর্ঘটনার কথা কাউকে জানায়নি সে।
তখন ওকে আইডেনটিটি কার্ডটা দেখিয়ে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, ওর কোনও ভয় নেই। পুলিশ ওকে বিরক্ত করবে না।
শিবনাথ তিরিশ টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি করতে লাগল। আমি হেসে বললাম, পুলিশ যেমন সবসময় সার্ভিস চার্জ নেয়, তেমনি মাঝে-মাঝে সার্ভিস চার্জ দেয়। এটা অনেকটা সেইরকম–
শিবনাথের কাছ থেকে সোজা ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে রাখলাম। বিছানায় ওপরে। কম্বিনেশান লক ঘোরাতেই ব্রিফকেস খুলে গেল। ভেতরে কাগজপত্র, কলম, টুকিটাকি জিনিস। এ ছাড়া ছোট একটা ডাম্বেল। মাঝের হাতলটা কাঠের। তাতে আঙুলের মুঠোর মাপে খাঁজ কাটা। আর দু-মাথায় দুটো ইস্পাতের বল–বড়জোর দু-সেন্টিমিটার ব্যাসের। ডাম্বেলটা মুঠো করে ধরলে হাতলটা দেখা যায় না, শুধু বল দুটো মুঠোর দু-পাশে উঁকি মেরে থাকে।
ডাম্বেলটা প্যান্টের পকেটে ঢোকালাম। তারপর ব্রিফকেস থেকে তুলে নিলাম চার ইঞ্চি মাপের একটা সাইলেন্সার টিউব। টিউবের গায়ে নানা রঙের স্টিকার লাগানো। যাতে দেখে বোঝা ণা যায় এটার আসল কাজ কী। একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভারে ওটা প্যাঁচ দিয়ে লাগিয়ে নিলাম। তারপর প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।
অন্য স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটায় হাত দিলাম না। তার বদলে ব্রিফকেস থেকে বের করে নিলাম নল কাটা একটা শটগান। তার বাঁট বলে কিছু নেই। একটা তেকোনা ইস্পাতের ফ্রেম নিয়ে শটগানের সঙ্গে এঁটে দিতেই একটা খাটো বাঁট তৈরি হল। একবার দেখে নিলাম গুলিভরা আছে কিনা। তারপর ওটা শিরদাঁড়ার কাছে প্যান্টের ভেতরে আধাআধি গুঁজে নিলাম। ঢোলা জামাটা টেনে দিলাম ওপর দিয়ে।
ব্রিফকেস বন্ধ করে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম শটগানটা দৃষ্টিকটুভাবে উঁচু হয়ে থেকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কি না। এ-শটগানের বিজ্ঞাপনের দরকার নেই। একবার ফায়ার করলেই শতকরা দুশো ভাগ কাজ দেয়।
ঘর ছেড়ে যখন বেরোলাম তখন আমি দুনিয়া ছাড়ার জন্যে তৈরি। কিন্তু তার আগে দুশো তিন নম্বর ঘরের রহস্য আমি ভেদ করতে চাই। সেই সঙ্গে লালুর মৃত্যুরহস্য।
করিডরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট। সুতরাং পায়ের শব্দের কোনও ব্যাপার নেই। আর লোকজন কাউকেই চোখে পড়ল না। একবার শুধু একজন বেয়ারাকে দেখলাম। হাতে ট্রে। ট্রে-র ওপরে বোতল ও গ্লাস। আমি বেয়ারাটাকে পাশ কাটিয়ে গেলাম। এবং দুশো তিন নম্বরের দরজাটাও পেরিয়ে গেলাম।
যখন দেখলাম পথ পরিষ্কার তখন দুশো তিনের সামনে এসে নক করলাম ব্যস্তভাবে।
কিছুক্ষণ কোনও উত্তর নেই। তখন আমি কলিংবেলের বোতাম টিপলাম। তারপর আবার নক করলাম।
এবার কেউ ভরাট গলায় প্রশ্ন করল, কে?
ভাবার সময় নেই। অতএব যা মুখে এল বলে দিলাম, দরজা খুলুন, মিস্টার ব্যানার্জি। আমি রিভারভিউর ম্যানেজার।
তারাওয়ালা হোটেলের ম্যানেজাররা নিশ্চয়ই বেয়ারাদের মতো বোর্ডারদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজ হল। দরজা সামান্য ফাঁক হল। একটা ভয়ার্ত চোখ দেখা গেল সেই ফাঁকে। চুনি ব্যানার্জির চোখ।
আমি দরজায় সপাটে এক লাথি মারলাম। আর একইসঙ্গে পকেট থেকে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা বের করে বাগিয়ে ধরলাম। তারপর ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। ছিটকিনিও এঁটে দিলাম।
মেঝেতে পড়ে যাওয়া চুনি তখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। রিমলেস চশমা চোখ থেকে সরে গিয়ে কাত হয়ে নাকের কাছে আটকে রয়েছে। ব্যাকব্রাশ চুলের পরিপাটি ভাব নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ডান গালের তিলটা রয়েছে জায়গা মতোইনড়ে যায়নি।
নল কাটা শটগানটার জন্যে পিঠের কাছটায় খচখচ করছিল, কিন্তু সেটা ভ্রূক্ষেপ না করে আমি দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়েই রইলাম। দু-হাতে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের বাঁট চেপে ধরেছি। সাইলেন্সারের নল সরাসরি চুনির কপাল দেখছে।
শক্ত গলায় চুনিকে বললাম, উঠে দাঁড়ান–।
চশমা ঠিক করে সাইলেন্সরের নলের দিকে স্থির নজর রেখে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল চুনিলাল। তারপর অপমানে আহত গলায় বলল, হাত দুটোও কি মাথার ওপরে তুলতে হবে?
আমি হাসলাম ও কোনও দরকার নেই। হাত তুলুন আর না-ই তুলুন, আমার টিপ ফসকাবে না।
চুনিলাল মাথার চুল ঠিক করল, প্যান্ট-শার্ট ঝাড়ল। তারপর খানিকটা শান্ত গলায় বলল, কবে থেকে হোটেল রিভারভিউর ম্যানেজার হয়েছেন?
আপনার ঘরের দরজায় নক করার দু-সেকেন্ড আগে থেকে।
ও– হাত নাড়াল চুনি, বলল, নিন, আর দেরি করছেন কেন? কাজ শেষ করুন।
কাজ? কী কাজ? একটু অবাক লাগল আমার। চুনির কাছে গিয়ে শরীর হাতড়ে দেখলাম ও নিরস্ত্র। তখন রিভলভার পকেটে রাখলাম। ওকে জিগ্যেস করলাম, ঘরে আর কে আছে?
চুনির নজর কেঁপে গেল একতিল। কিন্তু আমি সেটা লক্ষ করলাম। সুতরাং ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম ভেতরের ঘরের দিকে।
ভেতরের ঘর বললাম বটে, কিন্তু ঘর আসলে একটাই। একটা ভারী পরদা সেটাকে বসবার ঘর ও শোবার ঘরে ভাগ করেছে। সবুজ পরদাটা অনেকখানি টানা ছিল। কিন্তু পরদার ডানদিকে দরজার মতো সামান্য ফাঁক রয়েছে।
আমি সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরের ঘরে যাইনি। চুনিলালের কেঁপে যাওয়া নজর আমাকে সাবধান করে দিয়েছে এক লহমা আগেই। অতএব এক ঝটকায় মেঝে পর্যন্ত লেপটে থাকা পরদার
বাঁ দিকের কোণ দিয়ে ঢুকে পড়েছি ভেতরের ঘরে–চুনির শোবার ঘরে।
চায়ের দোকানের সেই শিক্ষানবিস ছোকরা মাস্তানের কথা মনে পড়ল : চুনিদা বহুত খতরনাক লোক…।
কথাটা যে একেবারে মিথ্যে নয় সেটা এখন বোঝা গেল। কারণ, শোবার ঘরে একটা লোক উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। না, বিছানায় নয়, খাটের নীচে, ঘরের মেঝেতে। তবে মেঝেতে
কার্পেট থাকার জন্যে শুয়ে থাকতে বোধহয় তেমন কষ্ট হচ্ছে না।
লোকটা পরদার শেষপ্রান্তের দরজার দিকে সজাগ চোখে তাকিয়ে বাঘের বাচ্চার মতো ওত পেতে ছিল। বোধহয় আমারই জন্যে। ওর হাতে অস্ত্রশস্ত্র কী আছে ভালো দেখার মতো সময় এবং মনের অবস্থা আমার ছিল না। তা ছাড়া শটগানটা অনেকক্ষণ ধরে পিঠের কাছে খচখচ করছিল। তাই পরদা তুলে ঢোকার সময়েই ওটা হাতে বের করে নিয়েছি এবং ওই হুমড়ি খাওয়া অবস্থাতেই ওর মাথার দিকে তাক করে ট্রিগারে আঙুল শক্ত করে ফেলেছি।
আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই বাঘের বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। শটগানের নিশানা নির্ভুল লক্ষ্যে স্থির।
লোকটা নিশ্চয়ই পেশাদার পুরোনো পাপী। কারণ নলকাটা শটগান দেখেই চিনতে পারল। বুঝতে পারল, যদি আমি ওর কপাল তাক করে ফায়ার করি তা হলে মুন্ডুটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে খবরের কাগজে হারানো-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। সুতরাং নিমেষের মধ্যে ওত পেতে থাকা বাঘের বাচ্চাটা শুয়োরের বাচ্চা হয়ে গেল। মুখ ফ্যাকাশে। চোখে ভয়।
আমি নোংরা গলায় বললাম, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে মাথা নীচু কর–।
লোকটা দণ্ডিকাটার মতো সামনে দু-হাত বাড়িয়ে মুখ নীচু করে শুয়ে পড়ল।
চুনি ব্যানার্জি ইতস্তত পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। আমি ওকে বললাম, আপনার বডিগার্ডকে খাটের তলা থেকে টেনে বের করুন–।
খাটের তলায় উঁকি মেরে দেখলাম। নাঃ, ওই একজনই, আর কেউ নেই।
চুনিলাল ওর চ্যালাকে টেনে বের করল খাটের তলা থেকে। লোকটার গায়ে আঁটোসাঁটো গেঞ্জি, তার ওপরে লেখা লাভ, পাশে হৃদয়ের ছবি। আর ওর পায়ে ডেনিমের প্যান্ট–প্যান্টের পকেট উঁচু হয়ে রয়েছে।
চুনিলাল বারবার আমাকে দেখছিল, এবং অর্থপূর্ণ চোখে তাকাচ্ছিল ওর চ্যালার দিকে। চ্যালা এপাশ-ওপাশ ঘাড় নাড়ল–অর্থাৎ, না। আমার মনে হল, চুনিলাল আমার হাতের নলকাটা শটগানের গুরুত্ব বোঝেনি। চ্যালা বুঝেছে। তাই গুরুকে বোঝাতে চাইছে।
আমি চ্যালাকে বললাম, জামা-প্যান্ট খোল–জলদি।
দু-জোড়া চোখ অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কথা শুনল চ্যালা। আমার দিকে সাবধানী চোখ রেখে গেঞ্জি-প্যান্ট খুলে ফেলল। লোকটার পাকানো পেটানো চেহারা। মাথার চুল কদমছাঁট। এখন ওকে ভি.আই.পি. জাঙিয়ার বিজ্ঞাপনের মতো দেখাচ্ছে।
চুনিলাল ব্যানার্জি বোধহয় ধীরে-ধীরে সামলে উঠছিল। ঠান্ডা গলায় জিগ্যেস করল আমাকে, আপনি কে? কী চান এখানে?
আমি কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম। তারপর বললাম, শুনলে খারাপ লাগবে, কিন্তু আমার কোনও উপায় নেই। আমি হীরাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি–একটু থেমে আবার বললাম, তা ছাড়া এই ঘর থেকে আজ সকালে গুলি চলেছে। একটা লোকের পিঠে গুলি লেগেছে। লোকটা উন্ডেড অবস্থায় লাল রঙের মারুতি ভ্যানে চড়ে রিভারভিউ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর রাস্তায় মারা যায়।
কথা বলতে বলতে আমি চুনির চ্যালা উলঙ্গনাথনকে পাশ কাটিয়ে জানলার কাছে এগিয়ে গেছি। উঁকি মেরে দেখেছি নীচের কার পার্কের দিকে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে শিবনাথ। এই জানলা দিয়ে গুলি চালানোটা নেহাত অসম্ভব নয়।
বোধহয় দু-তিন সেকেন্ড অমনোযোগী হয়েছিলাম। এবং সেই অন্যমনস্কতার সুযোগে উলঙ্গ নাথন আমার শটগান লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ওকে আমি গুলি করতেই পারতাম। কিন্তু শটগানে নয়েজ পলিউশান হয়। দশটা লোক ছুটে আসতে পারে এই ঘরে। তারপর, সন্দেহ নেই, আমার কাজ পণ্ড হবে।
উলঙ্গনাথনকে দেখে যতই মাথামোটা মনে হোক, ও বোধহয় মনে-মনে ঠিক এই হিসেবটাই কষেছিল।
শটগানটা আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল বিছানায়। আর একইসঙ্গে আমি উলঙ্গ নাথনের শরীরের একমাত্র পোশাক ঢাকা অঙ্গ লক্ষ করে তীব্র লাথি চালিয়ে দিয়েছি।
লাথি যে জোরেই লেগেছে সেটা যন্ত্রণার শব্দ শুনে এবং আমার ডান পায়ের ব্যথা অনুভব করে বোঝা গেল, কিন্তু লোকটা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে যায়নি। শুধু সামান্য কাবু হয়ে সামনে হাত চেপে ঝুঁকে পড়েছিল। আমি আর অপেক্ষা করিনি। পকেট থেকে মিনি ডাম্বেল বের করে শক্ত মুঠোয় ধরেছি, এবং পরক্ষণেই বাতাসে এক সুদীর্ঘ বৃত্তচাপ রচনা করে ইস্পাতের বল মারাত্মকভাবে আঘাত করল উলঙ্গনাথনের শক্ত বুকে।
হাড় ভাঙার শব্দ হল বোধহয়। উলঙ্গনাথন হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল কার্পেটের ওপরে। আমি ডাম্বেল ফেলে দিলাম হাত থেকে। খালি হাতের লড়াইয়ের বিখ্যাত বই কিল অর গেট কিড় এর পঞ্চাশ পৃষ্ঠার নির্দেশ অনুযায়ী দু-হাতে প্রচণ্ড চাপড় মারলাম উলঙ্গনাথনের দুকানের ওপরে। বেশ জোরে শব্দ হল। জানি, এই শব্দ উলঙ্গনাথনের কানে বাজ পড়ার শব্দের মতো শুনিয়েছে। এবং ওর দু কানের পরদা নিশ্চয়ই ফেটে গেছে।
উলঙ্গনাথনের চোখ উলটে গেল। ও চিৎ হয়ে পড়ে গেল কাপেৰ্টের ওপরে। ওর তামাটে বুকের মাঝখানে একটা জায়গা কালচে-নীল হয়ে ফুলে উঠেছে।
চুনি ব্যানার্জি ভয়ার্ত চোখে নিথর হয়ে পড়ে থাকা উলঙ্গনাথনকে দেখছিল। আমি ডাম্বেলটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখলাম। শটগানটা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম চুনির কাছে। উলঙ্গনাথনকে দেখিয়ে বললাম, এটাকে কোত্থেকে জোগাড় করেছেন? যদি গ্যারান্টি পিরিয়ডের মধ্যে থাকে তা হলে সেখানে জমা দিয়ে রিপেয়ার করিয়ে নেবেন।
আমার কথা চুনির মাথায় কতটা ঢুকল কে জানে। ও বড়-বড় চোখে ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছিল। বোধহয় ভাবছিল, একটু আগের দেখা ঘটনাগুলো স্বপ্ন, না সত্যি।
আমি আর দেরি করলাম না। চুনির কলার চেপে ধরে শটগানটা ওর মুখের কাছে নিয়ে এলাম। দাঁতে দাঁত চেপে জিগ্যেস করলাম, কে গুলি চালিয়েছে এ-ঘর থেকে?
চুনি ব্যানার্জি হাঁপাতে লাগল। ওর গলা বন্ধ হয়ে এল। কোনওরকমে বলল, সুরিন্দার গুলি করেছে।
কে সুরিন্দার?
মেঝেতে পড়ে থাকা উলঙ্গনাথনকে দেখাল চুনিলাল : ও গুলি করেছে।
আমি জিগ্যেস করলাম, মেশিনটা কোথায়?
ওর প্যান্টের পকেটে আছে।
আমি মেঝেতে পড়ে থাকা প্যান্টটার দিকে তাকালাম। ওর পকেটে বড়জোর একটা রিভলভার থাকা সম্ভব। ওই রিভলভার দিয়ে তিনতলা থেকে লক্ষ্যভেদ করা অসম্ভব। তা ছাড়া রিভলভার থেকে ছোঁড়া গুলি কখনও ওই দূরত্বে লালুর দেহ এফেঁড়-ওফেঁড় করতে পারত না।
আমি চুনিলালকে দেখলাম এক পলক। ওর ঘোট ছটফট করছে। ঠোঁট কাঁপছে। কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।
চিন্তা করে দেখলাম, নলকাটা শটগানটা যদি ওর মুখের ভেতরে গুঁজে দিয়ে ফায়ার করি তা হলে শব্দ তেমন জোরে শোনা যাবে না।
সে-কথাই বললাম চুনিকে। ও কী একটা বলতে গিয়ে ঠোঁট ফাঁক করল। সঙ্গে-সঙ্গে শটগানটা আমি ওর দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিলাম। একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরিয়ে এল চুনির মুখ থেকে। চোখ আবার মাপে বড় হয়ে গেল।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, শব্দ কম হবে বটে তবে এই ঘরের দামি কার্পেটটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, গুলিটা যখন আপনার মাথার পেছন দিয়ে বেরোবে তখন মাথার ঘিলু টিলু, রক্ত, হাড়ের কুচি, সবই ছিটকে বেরোবে তার সঙ্গে। কিন্তু কী করব, উপায় নেই– তারপর হাসি থামিয়ে ধমকের সুরে বললাম, শিগগির বলুন, মেশিনটা কোথায় রিভলভার দিয়ে সুরিন্দার ও কাজ করেনি।
আমি কথা বলতে-বলতে চুনিলালের ফরসা গালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। তখন টের পেয়েছি ওর গালের পেশি কাঁপছে। সেটা স্বাভাবিক। আমি মোটেই অবাক হইনি। কিন্তু অবাক হলাম ওর তিলটা লেপটে গালে মাখামাখি হয়ে গেছে দেখে। নকল তিল!
আমি স্থির চোখে চুনিলাল ব্যানার্জিকে দেখতে লাগলাম। এখন বুঝতে পারছি, চায়ের দোকানের সেই উঠতি রংবাজ নেহাত মিথ্যে বলেনি। চুনি ব্যানার্জি সত্যিই বহুত খতরনাক লোক।
আমি শটগানটা টেনে বের করে নিলাম ওর মুখ থেকে। টানের হ্যাঁচকায় একটা দাঁত পড়ে গেল মেঝেতে। কিছুটা রক্তও বেরোল।
আমি আবার জিগ্যেস করলাম, মেশিনটা কোথায়?
আগে মেশিন, পরে তিল।
নকল চুনি আঙুল তুলে বিছানাটা দেখাল।
আমি সুরিন্দারের বুকের ওপরে পা দিয়ে ওর দেহ ডিঙিয়ে গেলাম। তারপর একটানে উলটে দিলাম বিছানায় তোশক। সঙ্গে-সঙ্গে দেখতে পেলাম মেশিনটা। থ্রি-নট-থ্রি উইনচেস্টার, টেলিস্কোপ লাগানো। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের খতম করার জন্যে এই ধরনের দূরপাল্লার মেশিন ব্যবহার করা হয়।
মেশিনটা বাঁ-হাতে তুলে নিলাম। ফিরে গেলাম নকল তিলের কাছে। সুরিন্দারকে লাথি কষানোর পর থেকে ডান পা-টা একটু টনটন করছে।
নকল চুনি এখন ভয়ে কাঁপছে। কাঁপারই কথা। আমার ডান হাতে শটগান, বাঁ-হাতে থ্রি নট থ্রি, পকেটে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, আর সেই মারাত্মক ডাম্বেল। এসব দেখে এবং জেনে ভয় পাওয়ারই কথা। তা ছাড়া সামনেই পড়ে রয়েছে সুরিন্দারের ড্যামেজড বডি।
তোর নাম কী?
আমার প্রশ্ন করার ভঙ্গিই লোকটাকে জানিয়ে দিল এ-প্রশ্ন দ্বিতীয়বার আমি করব না।
ও চটপট বলল, রমেন হালদার।
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, আমার হাতে সময় বেশি নেই। গোটা গল্পটা তাড়াতাড়ি বল। কথা শেষ করার সময় শটগানটা খানিকটা ওপরে তুললাম।
রমেন আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুলে আঁতকে উঠল। বলল, বলছি, সব বলছি–মুখটা ধুয়ে আসি।
বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে এল রমেন। তারপর একরকম টলতে-টলতে বিছানার ওপরে গিয়ে বসে পড়ল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছুঁড়ে দিল একপাশে। মাথার চুলে দু-বার হাত চালিয়ে বলল, আপনি কে জানি না। তবে মনে হচ্ছে চুনিদা আপনার সঙ্গে এঁটে উঠবে না। আমি চুনিদার কথা মতো এই মেকাপ নিয়ে কাল থেকে এই ঘরে এসে উঠেছি। আর সুরিন্দার বলে এই লোকটা সবসময় আমার সঙ্গে রয়েছে। চুনিদা বলছিল, আমার ওপরে অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু কী করব! দশ হাজার টাকা দিয়েছে আমাকে। মাথা ঝাঁকাল রমেন। তারপর বলল, বিশ্বাস করুন, কাল থেকেই ভয়ে-ভয়ে আছি–।
মারুতি গাড়ির লোকটাকে সুরিন্দার খতম করল কেন?
বলছি, বলছি। একটু দম নিল রমেন : আজ সকালে আমরা ব্রেকফাস্ট খেতে ব্লু গার্ডেনে গিয়েছিলাম। চুনিদা বলেছিল মাঝে-মাঝে ঘরের বাইরে বেরোতে, লোকজনকে দেখা দিতে যাতে সবাই আমাকেই আসল চুনিলাল ব্যানার্জি ভাবে। তো ব্রেকফাস্ট সেরে চলে আসছি–তখন কটা হবে? বড়জোর সাড়ে নটা কি দশটা হঠাৎই মাইকেল ডিসুজা নামে দাড়িওয়ালা একটা লোক সুরিন্দারকে ডেকে নিয়ে কী যেন বলল। তখন সুরিন্দার আমাকে এসে বলল, একটা লেজুড় লেগেছে। ওটাকে খতম করতে হবে। সুরিন্দারকে আমি চিনি না–আগে কখনও দেখিনি। তো আমি ঘরে ফিরে এলাম, কিন্তু সুরিন্দার কীসব খোঁজখবর করতে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রমেনবাবু কেস খারাপ। ওই ফেউটা আপনার মেকাপের ব্যাপারটা কী করে যেন জানতে পেরে গেছে। ও এখন ফিরে গিয়ে মিত্তিরসাহেবকে খবর দিলেই মুসিবত।
আবার দম নিতে থামল রমেন। ওর ভয়ার্ত চোখ-মুখ বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। এসব ছাপোষা লুড়োখেলা লোককে কেন যে এই খুন-খুন খেলার মধ্যে টেনে আনা কে জানে!
হালদার আবার বলতে শুরু করল, ব্যস, তারপর থেকেই এই জানলায় রাইফেল তাক করে বসে রইল সুরিন্দার। অনেকক্ষণ পর চারবার ফায়ার করল শুনলাম। আমার তখন মাথা ঝিমঝিম করছিল। সুরিন্দার হাসি মুখে আমার কাছে এসে বলল, পাখির গায়ে গুলি লেগেছে। কিন্তু কী করে যে শালা ওই হালতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল কে জানে! চুনিবাবুকে খুশখরিটা জানিয়ে দিন।
রমেন হালদার এখন রীতিমতো কঁপছে। মানুষ খুন করাটা কোনওদিনই ওর সিলেবাসের মধ্যে ছিল না।
আমি প্রশ্ন করলাম, চুনি ব্যানার্জিকে কী করে খবর দেন আপনি?
টেলিফোনে।
কোথায় ফোন করেন?
আমার ঘরের উলটোদিকের দুশো আঠেরো নম্বর ঘরে। চুনিদা ওই ঘরেই আছে কাল থেকে। ভাঙা দাঁতের জায়গাটায় জিভ বুলিয়ে নিল রমেন।
আমার হাসি পেয়ে গেল। কী চমৎকার ব্যবস্থা! শরদিন্দু মিত্র বোধহয় এরকম হিসেবের কথা ভাবেননি। কিন্তু এখন আমার সত্যিকারের চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। রিসেপশানের খবর অনুযায়ী দুশো আঠেরো নম্বর ঘরেই রয়েছে হীরা, আর তার সঙ্গে হীরার মাশুক চুনি।
আমার গলা খুসখুস করছিল। একটু ভেজাতে পারলে ভালো হত। সে-কথাই বললাম রমেনকে। ও মাথা নাড়ল–ঘরে স্টক নেই।
থ্রি-নট-থ্রি-টা এতক্ষণ ধরে ঝুলিয়ে রেখে বাঁ-হাতটা টনটন করছিল। ওটা রেখে দিলাম তোশকের নীচে। বিছানাটা আবার ঠিকঠাক করে দিলাম। রমেনকে বললাম সবুজ পরদাটা ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিতে। ও চটপট কথা শুনল। এরকম প্রভুভক্ত লাখে একটা পাওয়া যায়।
চুনি ব্যানার্জিকে ফোন করে এ-ঘরে ডেকে নিয়ে এলে কেমন হয়? এবং স্বাভাবিকভাবেই ফোনটা করতে পারে রমেন হালদার। অতএব রমেনকে বললাম ফোন করতে।
ঘরের উত্তরদিকের দেওয়াল ঘেঁষে টেলিফোন। রমেন রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাল। ইন্টারকম লাইনের ব্যবস্থা। সুতরাং তিনটে সংখ্যা ঘোরালেই কাজ হয়।
আমি টেলিফোনের কাছে এগিয়ে যেতে চাইলাম। কারণ সম্ভব হলে দু-প্রান্তের কথাই আমি শুনতে চাই। কিন্তু আমার অগ্রগতিতে বাধা দিল সুরিন্দার। ওর পড়ে থাকা নিথর দেহটাকে এতক্ষণ কোনও আমল দিইনি আমি। না দিয়ে যে ভুল করেছি সেটা এখন বুঝলাম।
সুরিন্দার পেশাদার। হয়তো ও চোখ খুলেছে কয়েক মিনিট আগেই, এবং বেশ খুঁটিয়ে আমাকে এবং আমার হাতে ধরা অস্ত্রশস্ত্রকে লক্ষ্য করেছে। তাই প্রথম হ্যাঁচকাটা মারল আমার ডান পা ধরে। আর প্রায় একইসঙ্গে আমার হাতের শটগান ধরে টান মারল।
সুরিন্দার জানে না আমিও পেশাদার। ও যে পাঠশালায় পড়েছে সেখানে পড়াশোনা করলে আমি নির্ঘাত ডবল প্রমোশন পেতাম। সুতরাং ওর হ্যাঁচকা টানে টাল খেয়ে পড়ে যেতে-যেতেই শটগানের ট্রিগারে আঙুলের চাপ দিলাম। কারণ নয়েজ পলিউশানের চেয়ে প্রাণের দাম বেশি।
গুলির শব্দ হল। তবে আওয়াজটা যত জোরে শোনাবে ভেবেছিলাম ততটা শোনাল না। সুরিন্দার শটগান ধরে টান মেরেছিল। তবে ও ভাবেনি ওই বেটাল অবস্থাতেও আমি ফায়ার করতে পারব।
না, গুলি সুরিন্দারের গায়ে লাগেনি। গুলি গিয়ে বিঁধেছে কার্পেটে। তবে গুলি ছোঁড়ার পরক্ষণেই শটগানের নল চেপে ধরেছিল সুরিন্দার। তাই ওর হাত পুড়ে গেছে। ও যতটা ক্ষিপ্রভাবে আমাকে আক্রমণ করেছিল তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ফিরিয়ে নিল ছ্যাকা খাওয়া হাতটা।
আমি পড়ে গিয়েছিলাম মেঝেতে। শটগানও ছিটকে গেছে হাত থেকে। কিন্তু সুরিন্দারের ছ্যাকা খাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে বাড়তি দু-তিন সেকেন্ড সময় দিয়েছে। তাই-ই যথেষ্ট। কোনওরকম চিন্তাভাবনা না করেই পা চালালাম। বোধহয় সুরিন্দারের মাথায় লাগল। কিন্তু ও দমল না। স্বাস্থ্যবান শরীরটাকে বেঁকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায় কোণে। ও জানে, তোশক ওলটালেই দূরপাল্লার মেশিনটা ওখান থেকে পাওয়া যাবে।
মেশিনটা সুরিন্দার পেল। কিন্তু ততক্ষণে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন আমি পকেট থেকে বের করে ফেলেছি, এবং নিশানা নির্ভুল করার ব্যাপারে কোনওরকম চেষ্টা না করেই ট্রিগার টিপেছি।
গুলি সুরিন্দারের উরুতে লাগল। ও কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। যন্ত্রণার দু-একটা টুকরো চিৎকার বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে।
এবার আমি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় পেলাম। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পকেটে ঢুকিয়ে একটু দূরে পড়ে থাকা শটগানটা তুলে নিলাম। মনের ভেতরে একটা ঠান্ডা রাগ কাজ করছিল। এই সুরিন্দার নামের শুয়োরের বাচ্চাটাকে কোথা থেকে তুলোধোনা শুরু করব? মাথা থেকে, না পা থেকে?
আমি সুরিন্দারের কাছে এগিয়ে গেলাম। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, রমেন ফোনে কথা বলা শেষ করে ফোন নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
ফ্রিজ! আমি চেঁচিয়ে হুকুম দিলাম। আমার শটগান রমেনের বুক দেখছে।
রমেন থেমে গেল মাঝপথে। ভয়ে কেঁপে যাওয়া গলায় বলল, প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন। চুনিদা আসছে এ-ঘরে। প্লিজ…।
আমি সুরিন্দারের বুকে এক লাথি কলাম। অমিতাভ শিকদারের সঙ্গে যারাই মোকাবিলা করে তারা জীবনভর সে কথা ইয়াদ রাখে। ওঁক শব্দ করল সুরিন্দার। আঘাত সামলাতে চিৎ হয়ে গেল। ওর উরু থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
আমি সুরিন্দারের বহু যত্নে বানানো পেশি ও হাড় দেখছিলাম। কী অযত্নেই না আমি এখন এগুলো চুরমার করব! সাপের বাচ্চাকে মাথা না থেতলানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।
সুতরাং শটগানটাকে উলটো করে বাগিয়ে ধরে সুরিন্দারের পাঁজরের মোক্ষম জায়গায় বসিয়ে দিলাম। সুন্দর শব্দ হল–পাকাটি ভাঙার মতো। সুরিন্দার চেঁচাল প্রাণপণে। আর একইসঙ্গে টুং টাং শব্দে কলিংবেল বেজে উঠল।
আমার চোখেমুখে বোধহয় খুন চেপে গিয়েছিল। কারণ রমেন ছুটে এসে আমাকে একরকম জড়িয়ে ধরল। বলল, চুনিদা এসে গেছে। ওকে এবার ছেড়ে দিন, প্লিজ।
আমি এক ধাক্কায় রমেনকে দরজার দিকে ঠেলে দিলাম। তারপর শটগান বাগিয়ে ধরে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। জীবনমরণের খেলা আমাকে একধরনের বিকৃত আনন্দ দেয়। স্পষ্ট টের পাচ্ছি, আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু মাথা বরফের মতো ঠান্ডা।
রমেন প্রথমে দরজা সামান্য ফাঁক করল। তারপর দরজা খুলে দিয়েই একপাশে সরে দাঁড়াল। আসল চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঘরে ঢুকেই দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। ভুরু কুঁচকে চারপাশটা দেখল। পরিস্থিতি আঁচ করল বোধহয়। তারপর রীতিমতো শান্ত গলায় বলল, রমেন, সুরিন্দারকে ফার্স্ট এইড দাও। কোনওরকমে ম্যানেজ করো। আমি এখন আর বাড়তি ঝামেলা চাই না।
চুনি ব্যানার্জির কথায় ব্যক্তিত্বের ছাপ টের পেলাম। এই লোকের পক্ষেই মিত্র সাহেবের ডানহাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু সুরিন্দারের এখন হয়তো লাস্ট এইড প্রয়োজন।
চুনিলালের চোখে রিমলেস চশমা নেই। মাথার চুলও ব্যাকব্রাশ করা নয় সামান্য এলোমেলো। বোধহয় আলতো ছদ্মবেশ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফটোর চেহারার সঙ্গে মিলছে পুরোপুরি।
আমার দিকে, আমার হাতের দিকে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় চুনি বলল, মিস্টার শিকদার, আমার ঘরে চলুন–সেখানে বসে আমরা নিরিবিলি কথা বলতে পারি।
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে চুনিলাল বলল, কোনও প্রশ্ন নয়–অন্তত এখানে। আমি চাই আমাদের কথাবার্তা নিরিবিলিতে হোক। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তা হলে শটগানটা কি লুকিয়ে ফেলবেন? আমার চোখে বোধহয় দ্বিধা ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করেই চুনি আরও বলল, না, ভয় নেই। আমাকে আপনি সুরিন্দারের মতো মূর্খ ভাববেন না। আপনার নাম যারা জানে তারা অন্তত বোকার মতো ঝুঁকি নেবে না।
আমি এতক্ষণে হাসতে পারলাম। নিজের কোম্পানির জন্য জুতসই ডেপুটি ম্যানেজার বাছতে কোনও ভুল করেননি শরদিন্দু মিত্র। সুতরাং শটগানটা জায়গা মতো গুঁজে নিয়ে চুনি ব্যানার্জির কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, চলুন, নিরিবিলিতে বসে কথা বলা যাক।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম হাসল চুনি। আমার হাতে হাত মেলাল।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। এক্ষুনি ভেজানো দরকার। শুকনো গলায় বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। আশা করি দুশো আঠেরো নম্বর ঘরটা মরুভূমি নয়।
দুশো তিন নম্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে কোনওরকম শোরগোল বা ভিড় নজরে পড়ল । না, গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। তা ছাড়া ব্লু গার্ডেনে মাইকেলের সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তার জম্পেশ ধুমধাম এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। সেই আওয়াজে আমার তৈরি নয়েজ পলিউশান দিব্যি চাপা পড়ে গেছে। দূষণ দিয়েই দূষণকে ঢাকতে হয়।
চাবি ঘুরিয়ে দুশো আঠেরো নম্বর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে চুনি প্রশ্ন করল, শরদিন্দু মিত্র আপনাকে পাঠিয়েছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ। একটু চুপ করে থেকে যোগ করলাম, হীরাকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। আর আপনিও আমার সঙ্গে গেলে ভালো হয়। মিত্র সাহেব আপনাদের দুজনকে আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
অবাক চোখে আমার দিকে ফিরে তাকাল চুনি। বলল, তাই? তারপর করিডরে দাঁড়িয়েই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একটা মেয়ে বীভৎস সেজেগুজে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হাসির শব্দে চোখ ফিরিয়ে দেখল আমাদের দিকে।
আমি বিব্রতভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা আমাকে লক্ষ্য করে বাঁকা হেসে। চোখ মারল।
নাঃ, হোটেল রিভারভিউর জবাব নেই!
.
চুনি ব্যানার্জির কাছ থেকে গোটা গল্পটা শুনলাম।
দুশো আঠেরোর সঙ্গে দুশো তিনের একমাত্র মাপ ছাড়া সাজসজ্জায় আর কোনও তফাত নেই। ভেড়ার লোমের মতো হালকা বাদামি কার্পেটে মেঝে ঢাকা। ঘরে তিনরকম আলো। তার মধ্যে নৈশবাতির চেহারাটা টেডি বিয়ারের মতো। আসবাবপত্র সবই অভিজাত। সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল, তার মাথায় প্রসাধন বাতি। চওড়া আধুনিক খাট, তার ওপরে পরিপাটি বিছানা। বিছানার চাদর, দেওয়ালের ডিসটেম্পার ও কার্পেট–এই তিনের রঙে মানানসই মিল।
ঘরে একটিমাত্র ছোট মাপের ফ্লুওরেসেন্ট বাতি জ্বলছিল। সেই কারণেই একটা নিষ্প্রভ ভাব ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। তারই মধ্যে নীচু লয়ে শোনা যাচ্ছে চ্যানেল মিউজিক।
দুটো সোফায় মুখোমুখি বসলাম আমরা। সামনে ছোট টেবিল। টেবিলে গ্লাস। গ্লাসে হুইস্কি। সেই হুইস্কি সঞ্জীবনী ঝরনা হয়ে আমার মরুভূমি-গলা বেয়ে নামছে। কেমন যেন এক স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে বসে আমি চুনি ব্যানার্জির কথা শুনছিলাম।
ঘরে হীরা নেই। সেটা আমাকে অবাক করেছে। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিনি। সময়মতো করা যাবে।
চুনি ব্যানার্জি পানীয় নেয়নি। তার বদলে সিগারেট ধরিয়েছে। বোধহয় মাথা ঠিক রাখতে চায়–অন্তত এরকম বিপদের সময়ে।
মিস্টার শিকদার, আপনি হয়তো আমার গল্পের অনেকটাই জানেন– চুনিলাল বলতে শুরু করল।
আমি হীরাকে তখনও খুঁজে চলেছি। নাক টানছি বাতাসে যদি খুঁজে পাই পারফিউম পাউডার কিংবা শ্যাম্পুর গন্ধ।
আমি লোকটা খুব সুবিধের নই– ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চুনিলাল বলল, তবে আপনার মতো অতটা এলেমদার নয়। হীরাকে আমি ভালোবাসি। অনেকদিন ধরেই ভালোবাসি। তাই শেষ পর্যন্ত গতকাল ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি মিত্রভিলা থেকে। বিশ্বাস করুন, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। শরদিন্দু মিত্রকে আপনি কতটা চেনেন জানি না, কিন্তু আমি চিনি।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল চুনি। সিগারেটটা টেবিলের অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে শার্টের পকেট থেকে চশমা বের করে নাকের ওপরে বসাল। হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। ওর চেহারাটা এবার নজর মহম্মদের দেওয়া ফটোগ্রাফের মতো হয়ে গেল।
বলুন, আমি শুনছি কান দিয়ে গেলাসে চুমুক দিচ্ছি না।
চুনিলাল হাসল। দুঃখের হাসি। বলল, মিত্রসাহেব তো কান দিয়ে দেখেন–রাজাদের মতো। তাই আমার সঙ্গে হীরার প্রেম মেনে নিতে পারেননি। ওঁর কানে কেউ খবর পৌঁছে দিয়েছে, আমি নাকি খুব বাজে টাইপের লোক। মাতাল, অপদার্থ, দীর্ঘশ্বাস ফেলল চুনি। ঘরের সিলিংয়ের দিকে বারদুয়েক তাকিয়ে পায়চারি করতে করতে বলল, সে যাই হোক, হীরাকে নিয়ে আমি পালিয়ে এসেছি, বিয়েও করে ফেলেছি। ও এখন আমার। ওকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। যদি আপনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান তা হলে আমাকেও সঙ্গে নিতে হবে, মিস্টার শিকদার। আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারব না।
আমার ঠোঁটে বোধহয় সামান্য বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে চুনি বলল, জানি, আমার বয়েসটার কথা ভেবে আপনার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আপনার জানা উচিত, ভালোবাসার সঙ্গে বয়েসের কোনও সম্পর্ক নেই।
আমি কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বলা হয়ে উঠল না আর।
কারণ বাথরুমের ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। প্রথমেই একটা বিলিতি সুগন্ধী আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। আর তারপরই হীরার সৌন্দর্য ধাক্কা মারল রীতিমতো।
এরকম এক সুন্দরীকে দেখার জন্যে সাতজন্ম সাগরতীরে বসে অপেক্ষা করা যায়। নজর মহম্মদের দেওয়া ছবিটা যেন লজ্জায় নতজানু হয়ে গেল আমার চোখের সামনে। যেন বলতে লাগল, আমি তো কেবলই ছবি, তুমি তো জীবন–।
চুনিলাল ইশারায় আমার দিকে দেখিয়ে বলল, হীরা, ইনিই অমিতাভ শিকদার। এঁর কথাই তোমাকে বলেছিলাম।
আমার হাতের গ্লাস থেমে গিয়েছিল শূন্যে। এবার সচেতন হয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপরে। দেখতে লাগলাম হীরাকে।
পরনে বেগুনি-সাদা নকশাকাটা সালোয়ার কামিজ। মাথায় সাদা তোয়ালে জড়ানো। নাকে নাকছাবি জ্বলছে। সেইসঙ্গে গভীর দু-চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। হয়তো কাগজের বিয়ে হয়ে গেছে।
জোড়হাতে নমস্কার করে ঘাড় কাত করে দেখল আমাকে। বুকের ভেতরে একটা তরুণ বুলবুলি উড়ে গেল আমার। সুদীর্ঘ একযুগ ধরে মরে হিম হয়ে যাওয়া পাখিটা কী করে আচমকা বেঁচে উঠল কে জানে!
এক মিনিটের মধ্যেই চুলের পরিচর্যা সেরে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল হীরা। চুনি ওকে সোফায় বসতে বলল। তারপর আমাকে লক্ষ করে বলল, ওর কাছে লুকোনোর কিছু নেই। ওর সামনেই সব বলছি। আগেই আপনাকে বলেছি, আমি লোক খুব সুবিধের নই। ঢিল ছুড়লে তার বদলে পাটকেল মারতে জানি। তাই হীরাকে নিয়ে মিত্রভিলা ছাড়ার আগে থেকেই আমি লোকজন ঠিক করে রেখেছিলাম। তা ছাড়া মিত্র সাহেবের অনেক গোপন খবরও আমার কানে আসে। সেরকম লোক আছে–যাকে বলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।
মিস্টার শিকদার, আপনার খবরটাও লোক মারফতই পেয়েছি। আর তখনই একটু ভয় পেলাম। কারণ, আপনার সম্পর্কে কিছু-কিছু আমি জানি। হীরার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ও অবশ্য কিছু জানে না।
আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটা অদ্ভুত মিষ্টি গলায় বলে উঠল, কেন, আপনি কি ডেঞ্জারাস লোক?
প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছে। বোধহয় জীবনে এই প্রথম আমার জিভ আড়ষ্ট হল, নজর হয়ে গেল বিব্রত। কোনওরকমে বলাম, এসব বাজে কথায় কান দিতে নেই।
চুনি বলল, আমার কিছু চ্যালাচামুণ্ডা আছে। তাদের নিয়ে শরদিন্দু মিত্রকে আমি এতদিন কম সাহায্য করিনি। এখন সাহায্যের দরকার হল আমারই। রমেন হালদারের সঙ্গে আমার চেহারা কিছুটা মেলে। ও লম্বা-চওড়ায় আমারই মতো। তাই ওকে আমার মতো করে সাজিয়ে তুলে দিলাম দুশো তিন নম্বর ঘরে। সঙ্গে সুরিন্দার–বন্দুকবাজ সুরিন্দার। আমি জানতাম কেউ না কেউ আসবে আমাকে খতম করতে। এসেছিল। জনার্দন সামন্ত। ওকে রেস্তোরাঁয় দেখামাত্রই আমি চিনতে পেরেছি। তা ছাড়া মাইকেল ডিসুজারু গার্ডেনে গান গায়…।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, ছড়া কেটে পায় সুখ, দাড়িগোঁফ এক-মুখ–।
চুনি হাসল। বলল, পরিচয় হয়েছে তা হলে? ওই মাইকেল হল সুরিন্দারের পুরোনো চেনা লোক। মাইকেলের কাছ থেকেও সুরিন্দার জানতে পারে জনার্দন সামন্ত আমার খোঁজখবর করছে। তখন ও জনার্দনকে খতম করার ব্যবস্থা নেয়–।
লাল মারুতির লালুর নাম তা হলে জনার্দন সামন্ত।
জনার্দন হল শরদিন্দু মিত্রের পুরোনো ভাড়াটে গুণ্ডা। অনেকবার ওর নাম শুনেছি। যাই হোক, তারপর আমরা আপনার খবর পাই–যে আপনি রিভারভিউতে এসে উঠেছেন। এরপর তো সবই জানেন–।
আমি গ্লাসের তরলটুকু এক ঢোকে গলায় ঢেলে দিলাম। বললাম, চুনিবাবু, আমরা রীতিমতো ভাগ্যবান যে, এ-পর্যন্ত মাত্র একটাই লাশ পড়েছে–শুধু জনার্দন সামন্ত খরচ হয়েছে। আর সুরিন্দার খরচ হয়েছে আধাআধি। এ-ব্যাপারে আর বডি পড়ুক তা আমি চাই না। আপনি টেলিফোন করে মিত্র সাহেবের সঙ্গে মিটমাট করে নিন। তা হলে আমিও একটা অস্বস্তির হাত থেকে বেঁচে যাই। তখন আমি অন্য ক্লায়েন্ট খুঁজব।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এইবার কথা বলল হীরা।
মিস্টার শিকদার, আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু ও কিছুতেই আমার কথা শুনছে না। আমি বলেছি, বাপি আমাদের ভালো চায়। আমরা ফিরে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে কথা কে শোনে।
চুনি অধৈর্যভাবে একটা শব্দ করল।
আমি বললাম, কথাটা বোধহয় ঠিক, চুনিবাবু। কারণ, আবার বলছি, আমি নিজের কানে শুনেছি, মিত্র সাহেব আপনাদের আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন। উনি টেলিফোনে কাকে যেন বলছিলেন।
চুনিলালের চোখ কপালে উঠল। ভুরুর ওপরে ভাঁজ পড়ল। বলল, সত্যি? আসলে আমি একটা এমন ব্যাপার জেনেছি যেটা কাউকে বলতে পারছি না।
কী ব্যাপার? হীরা আকুল হয়ে জানতে চাইল। সুন্দর চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।
তোমাকেও বলা যাবে না। গম্ভীরভাবে জবাব দিল চুনি। তারপর বউকে সাফাই দেবার সুরে বলল, কিছু মনে কোরো না। সময় হলেই সব বলব।
এবারে লাখ টাকার প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল চুনিলাল ও মিস্টার শিকদার, এখন সবকিছুই আপনার হাতে। বলুন, এখন কী করবেন?
আমার মনে এক অদ্ভুত তোলপাড় চলছিল। কী করব এখন আমি?
এমন সময় দরজায় নক করল কেউ। তারপর কলিংবেল টিপল।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল চুনিলাল। বলল, কে এল? এখন তো কারও আসার কথা নয়!
আমি শটগানটা ঝটিতি বের করে নিলাম। দৌড়ে গিয়ে দরজার পাশে পজিশন নিলাম। চুনিলালও পকেটে হাত ঢোকাল। হীরাকে ইশারা করল বাথরুমে গিয়ে ঢুকতে। তারপর এগিয়ে গেল দরজার কাছে। চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, কে? কী চাই?
দরজার ওপিঠ থেকে উত্তর এল? আমি, খুদে–।
আমার মাথার ভেতরে যুক্তি-বুদ্ধির একটা ঘুড়ি লাট খেতে শুরু করল। খুদে? এখানে?
চুনিলাল হাসল। আমার দিকে ফিরে বলল, বলেছিলাম না, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! খুদেই আমাকে সব খবর দেয়। ও মিত্র সাহেবের লোক।
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, জানি।
দরজা খুলে দিল চুনি। এবং খুদে ঢুকে পড়ল ঘরে। চাপা গলায় বলল, খবর আছে, চুনিবাবু–বলেই আমার দিকে তাকাল। ওর চোখের নজর দেখেই বোঝা গেল, সকালের থাপ্পড়টা ও ভোলেনি। না ভোলাটাই স্বাভাবিক। আমার শিক্ষা কেউ সহজে ভোলে না।
শটগানটা আমি লুকিয়ে ফেললাম আবার। লক্ষ করলাম, খুদের চোখ ঘরটাকে জরিপ করছে। বোধহয় হীরাকে খুঁজছে।
নজর মহম্মদের কাছ থেকে হীরা ও চুনির গল্প শোনার সময় আমার কেমন যেন খটকা লেগেছিল। এখন চুনিলালের কথা শুনে আর খুদেকে এখানে দেখে সেই খটকা আরও জোরদার হল।
খুদে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ওকে বসতে বলে চুনি আমার কাছে সরে এল। বলল চাপা গলায়, মিস্টার শিকদার, এখন আপনি ভরসা। আমি জানি মিত্র সাহেব এখন আমার ওপরে যেভাবে খুশি যেমন খুশি আক্রমণ চালাবেন। হীরার জন্যে উনি ভাবেন, আমার জন্যে না। আপনি একটু পরে আবার আসবেন। কথা আছে।
আমি বললাম, আপনি কথা বলে নিন। আমি দুশো সাত নম্বরে আমার ঘরে আছি। কথা শেষ হয়ে গেলেই আমাকে একটা ফোন করে দেবেন–।
একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। হীরার কথাটা কানে ভাসছিল : কেন, আপনি কি ডেঞ্জারাস লোক?
এ-প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই জানি না।
.
টেলিফোন এল মিনিট কুড়ি পরেই। এবং ফোনটা করল হীরা।
চ্যানেল মিউজিক চালিয়ে বিছানায় শুয়ে আয়েস করছিলাম। টেলিফোন ধরার পরই হাত পা কাঁপতে লাগল অদ্ভুতভাবে। কারণ হীরা কথা বলছে অস্বাভাবিক সুরে। একটা ভেজা চড়ুই শীতের রাতে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
শিগগির আসুন! শিগগির—প্লিজ–।
এই কণ্ঠস্বর যখন ডাকে তখন হিমালয় থেকে কোনও হঠযোগীও ছুটে আসে। সুতরাং আমিও যে হঠকারী হয়ে ছুটে যাব সে আর বেশি কী!
চোখের পলকে তৈরি হয়ে দুশো আঠেরো নম্বরের দরজায় পৌঁছে দেখি দরজা বন্ধ। কলিংবেল টেপামাত্রই দরজা খুলে দিল হীরা। ওর কান্না-ভেজা ভয়ার্ত মুখ আমাকে বিপন্ন করে তুলল। ভয় পাওয়া মুখও এত মিষ্টি।
ঘরে ঢুকেই পায়ের ধাক্কায় দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর একইসঙ্গে চোখে পড়ল ঘরের বাঁ দিকের কোণে চুনি আর খুদে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছে। চুনি হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে কার্পেটের ওপরে। আর ওর পিঠের দু-দিকে পা রেখে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে খুদে। খুদের দু-হাতে নীল রঙের নাইলনের দড়ি। দড়ির লাগামটা চুনিলালের গলায় লাগিয়ে খুদে টানছে। চুনির চোখ মুখ টকটকে লাল। মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হাতে আর সময় নেই।
ওই অবস্থাতেও খুদে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু ওর দড়ির টান এতটুকুও শিথিল হল না।
লক্ষ করলাম, হীরার কপালের একটা পাশ ফুলে উঠেছে। সেখানে রক্তের দাগও রয়েছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কোনওরকমে বলল, ওকে বাঁচান! প্লিজ!
আমার মাথার মধ্যে অঙ্ক কষার কাজ চলছিল। খুদের ভূমিকাটা আমার মাথার মধ্যে ঠিক পরিষ্কার হচ্ছিল না। ও কার হয়ে কাজ করছে? ওর একটু আগের বেপরোয়া হাসি বলে দিচ্ছে। আমরা একই লোকের হয়ে কাজ করছি। সে লোকটির নাম শরদিন্দু মিত্র। কিন্তু মিত্র সাহেবের কথার সঙ্গে যে এই মুহূর্তের গল্পটা মিলছে না। চুনিকে যদি খতম করারই দরকার ছিল তা হলে আমাকে ডাকা হয়েছে কেন?
হীরা এবার হাউহাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে। বলল, অমিতদা, অমিতদা, ওকে বাঁচান–।
আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে গেল।
ঘরের নরম আলো, হালকা চ্যানেল মিউজিক আর সামনের ওই বীভৎস ঘোড়া-ঘোড়া খেলা আমার বুকের ভেতরে ঝড় তুলেছিল। সেই ঝড়ে যখন বনের গাছপালা উথালপাথাল কাঁপছে তখনই মেয়েটার ওই দাদা ডাক তাতে দাবানল জ্বেলে দিয়েছে।
কে দাদা? কার দাদা? আমার জীবনে কেউ নেই। মা-বাবা-ভাই-বোন–কেউ নেই! সব শালা ফটো হয়ে দেওয়ালে ঝুলছে। আর আমি একা–এক জিন্দা লাশ, মরার চেষ্টা করছি।
অমিতদা!
শয়তান সর্বনাশী মেয়েটা আবার ডাকছে ওই নামে।
অমিতদা!
চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার। কিন্তু ওই অবস্থাতেই স্লো মোশনে শটগানটা বের করে খুদের দিকে তাক করলাম। মাংস চিবিয়ে বলার মতো করে বললাম, ছেড়ে দে।
আমার চোখে-মুখে খুদে কী দেখল কে জানে, ছেড়ে দিল চুনিকে। চুনি ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। আর হীরা ছুটে গিয়ে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর শরীরের ওপরে।
খুদে অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। তারপর হাসিমুখে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। জিগ্যেস করল, কী হল, বস, খেপে গেলে কেন?
কোনও জবাব না দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে শটগানটা ঘুরিয়ে বসিয়ে দিলাম খুদের নাকের ওপরে। শব্দ হল। ওর ভারী দেহটা যেন পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। কিন্তু আমি থামলাম না। কানে বাজছে বহুযুগ ধরে না-শোনা অলৌকিক ডাক অমিতদা! সুতরাং দ্বিতীয় আঘাতটা করলাম ওর মাথায়।
কিন্তু খুদে সেটা রুখে দিল। ওর গায়ের জোর আমি টের পেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আবার হাসল। অথচ ওর নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বলল, এসব কী উলটোপালটা কাজ করছ, বস্? মিত্তিরসাহেব রাগ করবেন।
আমিও হাসলাম। শটগানটা হাত থেকে ফেলে দিলাম মেঝেতে।
আমি জানতাম, এরপর খুদে কী করবে। ও শটগানটা তুলে নেবে মেঝে থেকে। তারপর দাবার চাল উলটে দেবে। ওর মোটা বুদ্ধি ওকে অন্তত এই শিক্ষাই দিয়েছে। আর ও ভুলে গেছে রোজ এক ডজন আর্স দিয়ে আমি ব্রেকফাস্ট খাই।
সুতরাং খুদে যখন শটগানটা কুড়িয়ে নিচ্ছে তখনই আমি পকেট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা বের করে ওর কাঁধে এবং কোমরে গুলি করলাম।
খুদের বেলা আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি। ওর প্রতিবন্ধী জীবনের জন্যে অমিতাভ শিকদারের সমবেদনা রইল।
খুদে যখন টলে পড়ছে তখনই ওকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছি আমি। আর তৎপর হাতে শটগানটা তুলে নিয়েছি। আমার দু-হাতের দুটো মেশিন খুদের বাকি সাহস কেড়ে নিল। খুদে চেঁচায়নি। জানে, চেঁচালে ওরও বিপদ। তাই ও শুধু গোঙাতে লাগল আর বলতে লাগল, তুমি বাঁচবে না, বস্…।
কোন্ শালা বাঁচতে চায়?আমি ওর মুখে থুতু ছিটিয়ে দিলাম। ঘড়ি দেখলাম। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রিভারভিউ আমাদের কাছে আর কতক্ষণ নিরাপদ কে জানে!
শটগান ও রিভলভার যথাস্থানে রেখে ছুটে গেলাম হীরা আর চুনির কাছে। চুনির চোখ উলটে গেছে। নাইলন দড়িটা কেটে বসে গেছে গলায়। ওর বিবর্ণ ঠোঁট নড়ছে। কী যেন বলতে চাইছে বিড়বিড় করে।
হীরা কাঁদছিল অঝোরে। বারবার বলছিল, অমিতদা, ওকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন– জলদি!
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, হাসপাতাল এখন কিছু করতে পারবে না। চুনিলাল এখন পাতালের পথে।
হীরাকে সরিয়ে দিয়ে আমি ঝুঁকে পড়লাম চুনির মুখের কাছে। ও কী বলছে শুনতে চাইলাম।
চুনির ফুলে ওঠা ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বুঝতে পারলাম ওর কথাগুলো : শরদিন্দু মিত্র কাউকে…ছাড়বে না। আমরা সবাই দাবার খুঁটি…সবাই। খুদে এরকমভাবে আমাকে ঠকাবে বুঝতে পারিনি। মিস্টার শিকদার…।
আমি আরও ঝুঁকে পড়লাম চুনির ওপরে।
…হীরাকে দেখবেন…ওকে যেন কেউ কিছু না করে…হীরা…হীরা…।
আমি সরে এলাম। হীরাকে ঠেলে দিলাম ওর স্বামীর দিকে। শেষ কথাগুলো অন্তত ও শুনুক। শেষ কথায় ওরই একমাত্র অধিকার।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে এলাম দরজার কাছে। মন বলে উঠল, সময় নেই। হীরাকে নিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।
খুদের নড়াচড়া থেমে গেছে। তবে খেল খতম ভাবার কোনও কারণ নেই। ওর ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কার্পেটে। হোটেল রিভারভিউর দুটো দামি কার্পেট নষ্ট হল। সুরিন্দার আর খুদে যদি দুশো তিন আর দুশো আঠেরো নম্বরে শহিদ হয় তা হলে এই দুটো ঘর হয়তো বাতিলের খাতায় জমা পড়বে। আর এই হোটেলের নামটা রিভারভিউ থেকে হয়তো মার্ডারভিউ হয়ে যাবে।
হীরার কান্না থামেনি। হঠাৎই কান্নার রেশ জোরালো হয়ে উঠতেই বুঝলাম সব শেষ, এবার এক মিনিট নীরবতা পালন করা দরকার। আমি আর চুনিলাল সেটা করলাম বটে কিন্তু হীরা অবাধ্য হল। ওকে ডেকে বললাম, হীরা, জলদি! আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।
ও উঠতে চাইছিল না। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে টেনে তুললাম। তারপর বিছানার তোশক সরিয়ে চ্যানেল মিউজিকের সুইচগুলো খুঁজে পেলাম। মিউজিকের ভলিয়ুম বাড়িয়ে দিলাম। স্বর্গীয় কিশোরকুমার গাইছিলেন? হমে তুমসে প্যার কিতনা ইয়ে তুম নহি জানতে, মগর জি নহি সকতে তুমহারে বিনা–।
বিছানার চাদরটা তুলে নিয়ে চুনিলালের মৃতদেহ ঢেকে দিলাম। ওঁ শান্তি।
তারপর হীরাকে ডাকলাম, চলে এসো–।
এখন সামনে কোন বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে!
হোটেলের করিডরে কোনও ঝামেলা টের পেলাম না। হীরাকে বলেছি মুখে ওড়না জড়িয়ে নিতে। ও একটুও তর্ক না করে সাদা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায়। বেশ বউ-বউ লাগছে। আমার ব্রিফকেস পড়ে আছে বিছানার ওপরে। যদি আজকের রাতটা জানে বেঁচে যাই তা হলে কাল ওটা দরকার হবে। আর যদি কপাল খারাপ হয়, তা হলে ব্রিফকেস স্মৃতি হয়ে যাবে।
সতর্কভাবে পা ফেলে নীচে নেমে এলাম। ইচ্ছে করেই এলিভেটর ব্যবহার করিনি। ওই ছোট্ট জায়গায় আমার কেমন অস্বস্তি হয়।
অবশেষে একতলায় হোটেলের লাউঞ্জ। আমি হীরার অনুমতি নিয়ে ওকে সামান্য কাছে টেনে নিয়েছি। লোকে বোধহয় আমাদের নতুন বর-বউ ভাবছে। ভাবুক। যতক্ষণ শ্বাস পড়ছে ততক্ষণ এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত নয়। কে জানে জনার্দন সামন্ত কিংবা সুরিন্দারের মতো কেউ কোথাও ওত পেতে আছে কি না!
কার পার্কের কাছে এসে কাউকে দেখতে পেলাম না। উঁহু, ভুল হল। বরং বলা উচিত, সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলাম না। সারি-সারি গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। কয়েকটা গাড়িতে ড্রাইভাররা স্টিয়ারিং-এ মাথা ঝুঁকিয়ে ঝিমোচ্ছে। শিবনাথ অনেকটা দূরে, হোটেলের সীমানাপ্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে একটা লোকের সঙ্গে গল্প করছে।
আমি হীরাকে নিয়ে উঠে পড়লাম আমার গাড়িতে। শটগান ও স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন বের করে সিটের ওপর রাখলাম। ইঞ্জিন চালু করে এক ঝটকায় গাড়িটা বের করে নিয়ে কাঁচাচ আওয়াজ তুলে দ্রুত বাঁক নিয়েই গতি বাড়িয়ে দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে লক্ষ করলাম, শিবনাথের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত লোকটা দৌড়ে গিয়ে উঠল একটা কালো অ্যামবাসাডর। ও, আমার ধারণা তা হলে ভুল হয়নি। আর একজন জনার্দন সামন্ত তৈরিই ছিল! আমি বাঁ হাতের শক্ত মুঠোয় শটগানের বাঁটটা চেপে ধরলাম। এই বন্দুকটা সকাল থেকে ভুখা দিন কাটাচ্ছে। আর নয়, সময় এসে গেছে। এখন থেকে ভুখ হরতাল বন্ধ।
গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে। সামনের রাস্তা গড়িয়ে ছুটে আসছে চাকার তলায় আত্মহত্যা করছে। আমি দুরন্ত গতিতে পৌঁছে গেলাম হোটেলের সিংদরজায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা ভালোমন্দ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার গাড়ি পিছলে বেরিয়ে পড়েছে বাইরের রাস্তায়।
আর তখনই প্রথম গুলির শব্দ শোনা গেল। বোধহয় পিছনের অ্যামবাসাডর থেকে কেউ গুলি ছুঁড়েছে।
হোটেলের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে কয়েকটা বড় বড় গাছ। হোটেলের লনে লাগানো হ্যালোজেন বাতির আলো সেই গাছের ওপরে পড়েছে। গুলির শব্দে পাখিরা চঞ্চল হয়ে গাছের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে এলোমেলো উড়ে বেড়াতে লাগল। হীরা ওর হাত রাখল আমার হাতের ওপরে। স্পষ্ট টের পেলাম, মেয়েটার কোমল হাত কাঁপছে।
এরপর শুরু হল দুরন্ত ছুট। রাতের হুগলি নদী থেকে ছুটে আসা পাগল বাতাস আমাদের শান্ত করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু হীরার ফেঁপানো কান্না তাতে থামছিল কই?
চোখের সামনে অন্ধকার নির্জন পিচের রাস্তা। কখনও কখনও ছুটে আসা হেডলাইটের আলো। সেই আলোয় হীরার মুখ দেখা যাচ্ছে : কান্নার জলছবি। আর আমার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দুপাশের ঝোপেঝাড়ে গাছে চকিতের জন্যে যেন ঝলসে উঠছে ফ্ল্যাশ বা।
টায়ারের বাঁক নেওয়ার শব্দ আহত হায়েনার কান্না। আর ইঞ্জিন চিতাবাঘের গর্জন। তারই মধ্যে আবার শব্দ তুলল ফায়ারিং-এর শব্দ। অ্যামবাসাডর গাড়ির অনুসরণকারী অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
অ্যাকসিলারেটরে আমার পা চেপে বসেছিল, কিন্তু তাতেও আশ মিটছে না কিছুতেই । আরও অনেক কিছু আমাকে দলে পিষে নিকেশ করতে হবে। যুদ্ধের দামামায় আঘাত পড়েছে। কেউ ঘা দিয়েছে প্রাণপণে বুকের ভেতরে ও অমিতদা! এক সদ্যবিধবার সিঁথির সিঁদুর কেন মুছে গেল আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে!
রিয়ারভিউ মিরারে অ্যামবাসাডরের একজোড়া চোখ জ্বলছে। দূরত্ব কমে আসছে ধীরে ধীরে। এখন গুলি চালালে আমাদের গায়ে বিধবে কি না জানি না, তবে গাড়ির বডিতে বা কাঁচে লাগতেই পারে।
হীরা কান্না ভাঙা গলায় জিগ্যেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি, অমিতাদা?
কী জবাব দেব এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে! শর্ত অনুযায়ী এখন ওকে নিয়ে যেতে হবে ওর শোকে মুহ্যমান বাবার কাছে। নিতে হবে আমার পারিশ্রমিক। তারপর জানতে হবে জটিল অঙ্কের উত্তর।
আবার গুলির শব্দ। গাড়ির পেছন ও সামনের দুটো কাঁচই ফুটো হয়ে গেল। হীরা চিৎকার করে মাথা নীচু করল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে স্টিয়ারিং এদিক-ওদিক করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে পথ চলতে লাগলাম।
কিন্তু একটু পরেই সরু পিচের রাস্তায় গাড়িটা পাশাপাশি এসে গেল। দুটো গাড়ি এলোপাতাড়ি চলতে-চলতে ধাক্কা খেল গায়ে-গায়ে। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ হল।
হীরা চিৎকার করে উঠল। বসে পড়ল সিটের নীচের অংশে।
আর আমি বাঁ হাতে স্টিয়ারিং ধরে শটগানটা ডান হাতে উঁচিয়ে ধরলাম।
ওই এলোমেলো চলার মধ্যেই দেখতে পেলাম অ্যামবাসাডরের স্টিয়ারিং-এ একটা কালো ছায়া। আর তার পাশেই আর একজন। তার হাতে লম্বা লাঠির মতো কী যেন একটা রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হল না, ওটা প্রকৃতপক্ষে রাইফেলের নল। লোকটা আমাদের গাড়ির দিকেই তাক করার চেষ্টা করছে।
ব্যাপারটা আমার অবাক লাগল। এরা নিশ্চয়ই চুনিলালের দল নয়, শরদিন্দু মিত্রের দল। তাই যদি হয় তা হলে এরা কাকে খতম করতে চাইছে? আমাকে, না হীরাকে? নাকি দুজনকেই? আর কেনই বা খতম করতে চাইছে? কোথাও কি কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে? নাকি চুনিলালের কথাটাই ঠিক? শরদিন্দু মিত্র কাউকে ছাড়বে না। আমরা সবাই দাবার খুঁটি। আর মিত্র সাহেব দাবা খেলছেন।
কিন্তু মিত্র সাহেব কি জানেন, এখন ওঁর সঙ্গে দাবা খেলছে শয়তানের বাচ্চা অমিতাভ শিকদার?
এতগুলো ভাবনা পলকে খেলে গেল মনের মধ্যে। আর সেই পলকের মধ্যেই চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে শটগান ফায়ার করলাম। নিশানায় কোনও গোলমাল ছিল না। তাই রাইফেলওয়ালা ঠিকঠাক করে নল তাক করার আগেই ওর মাথা কিংবা বলা যায় মাথার অবশিষ্ট অংশ ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপরে।
অ্যামবাসাডর গাড়িটা পিছলে এগিয়ে যেতে চাইল সামনে। আমি দরজা বন্ধ করে অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়িয়েছি। দুটো গাড়িতে ধাক্কা লাগল আবার। এবারের ধাক্কাটা বেশ জোরেই। চাকার বিপর্যন্ত শব্দ, হীরার চিৎকার, ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ সব মিলিয়ে শব্দের এক ডামাডোল। ঠিক তখনই উলটো দিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা আমি দেখতে পেলাম।
সরু রাস্তায় বিশেষ জায়গা ছিল না। অতি কষ্টে আমি গাড়িটাকে বাঁ দিকে কাদার ওপরে নিয়ে গেলাম। জায়গাটা অন্ধকার ঢালু নালার মতো। রাস্তার কোনও বাতি জুলছিল না? হয় খারাপ, নয় তো লোডশেডিং। তাই আন্দাজটা জুতসই না হওয়ায় গাড়িটা টাল খেয়ে গেল।
অ্যামবাসাডরটা আমার সামনে চলে গিয়েছিল। তাই বাঁ দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করার আগেই ট্রাকের সঙ্গে ওটার ধাক্কা লাগল।
মুখোমুখি ধাক্কা নয়। ধাক্কাটা লেগেছে ডানদিকে, হেডলাইটের কাছে। ফলে ছুটন্ত ট্রাকটা নিজেকে সামলে নিয়ে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে। আর অ্যামবাসাডর গাড়িটা লাটুর মতো ঘুরপাক খেয়ে গেল খানিকটা। তারপর প্রায় উলটোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আর দেরি নয়। শটগানে নতুন টোটা ভরে নিয়ে কাত হয়ে থাকা গাড়ি থেকে পড়লাম আমি। হীরাকে বললাম, জায়গা ছেড়ে একদম নড়বে না। তারপর এক ছুটে কালো অ্যামবাসাডরের কাছে।
স্টিয়ারিং-এ বসে থাকা লোকটা বোধহয় মাথায় সামান্য চোট পেয়ে থাকবে। কারণ, মাথায় হাত বোলাচ্ছে। আমি দরজা খোলার জন্যে হাতলে টান দিলাম, কিন্তু খুলল না। ট্রাকের ধাক্কায় ডানদিকের ফেন্ডার তুবড়ে গেছে, দরজাও সামান্য আহত। তাই পাল্লাটা এঁটে বসে গেছে।
আমার হাতে সময় নেই। ফলে শটগান কোমরে গুঁজে হেড হোল্ড প্রয়োগ করলাম। ওর চিবুকের তলায় একটা হাত, আর মাথার পিছনে অন্য হাত। সামান্য মোচড় দিয়ে টান মারতে শুরু করলাম। লোকটা আমার হাত খামচে ধরল। আঁকড়া-আঁকড়ি করতে লাগল। ওর নখ আমার হাতের নুনছাল তুলে দিচ্ছে। বেচারা জানে না, হাতের মোচড় সামান্য বাড়ালেই ও নিচ থেকে সোজা আকাশে চলে যাবে। তাই সেটা একটু জানান দিলাম। ব্যস, ওর সব লড়াই থেমে গেল। ও মাখনের মতো বেরিয়ে এল জানলা দিয়ে।
লোকটাকে আমি পেড়ে ফেললাম রাস্তায়। কোমর থেকে শটগানটা বের করে তার হাতল দিয়ে সারেগামা বাজিয়ে দিলাম ওর মাথায়। তারপর ওকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলাম আমার গাড়ির কাছে।
আতঙ্ক আর উত্তেজনায় হীরা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ওকে বললাম পেছনের দরজা খুলতে। তারপর দুজনে মিলে লোকটাকে তুলে দিলাম পেছনের সিটে। হীরাকে ওর পাশে বসিয়ে শটগানটা ওকে দিলাম। বললাম, ঘড়ি দেখে দশমিনিট অন্তর-অন্তর লোকটার মাথায় শটগানের হাতল দিয়ে মারতে। তা হলে আমি নিশ্চিন্তে বাকি পথ গাড়ি চালাতে পারব।
হীরা জীবনে কখনও একাজ করেনি। সুন্দরীদের এ-কাজ মানায় না। কিন্তু উপায় নেই। এখন শটগানের ট্যাবলেট ছাড়া আর কোনও ওষুধ আমাদের হাতে নেই।
হীরা ভয়েভয়ে বলল, যদি মরে যায়?
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম, দশমিনিট হতে আর দু-মিনিট বাকি আছে।
সামনের সিট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা তুলে নিলাম। একছুটে চলে গেলাম অ্যামবাসাডরের কাছে। নীচু হয়ে পেট্রল ট্যাঙ্ক লক্ষ করে ফায়ার করলাম পরপর দুবার। সঙ্গে-সঙ্গে আগুন জ্বলে গেল।
গাড়িতে ফিরে এসে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে হীরার দিকে তাকিয়ে দেখি আগুনের আলোয় ওর সুন্দর মুখে এক মায়াময় আভা। কিন্তু চোখে ওর প্রতিজ্ঞা।
রাতের বাতাস কেটে হু-হু করে ছুটে চলল আমার গাড়ি। আজ রাতে হীরা আর ওই অজ্ঞান অথবা মৃত লোকটা আমার বাড়িতেই থাকবে। আমি ওদের পাহারা দেব সারারাত। সারারাত বাজবে নীচু স্বরের গান : প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই…।
আমি আবার দেখলাম হীরাকে।
অমিতদা!
শুধু ফটোয় ঘেরা আমার জীবন। হীরা, তুই যেন ফটো হয়ে যাস না। তোকে আমি কিছুতেই ফটো হয়ে যেতে দেব না।
.
ঘরটা মাপে বিশাল। এ-প্রান্তে দাঁড়িয়ে ও-প্রান্তের মানুষকে বোধহয় ঝাপসা দেখায়। কারণ, ঘরের দূরতম কোণে প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়্যাট টেবিল সামনে রেখে যে-মানুষটি বসে আছেন তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে তাকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না : শরদিন্দু মিত্র।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নজর মহম্মদ। পরনে সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি। চুল দাড়ি অভিজাত নবাবের মতো পরিপাটি।
শরদিন্দু হাসলেন। সেই সাপের মতো হাসি। ঠান্ডা হাসি। উনি বোধহয় অন্য কোনওভাবে হাসতে পারেন না। ওঁর প্লাটিনামের দাঁত দেখা গেল।
আসুন, মিস্টার শিকদার। হীরা কোথায়, আমার হীরা? উতলা সাপ তার বাচ্চার জন্যে আকুলভাবে প্রশ্ন করছে। মুখে কাল্পনিক বেদনার ছাপ।
হীরা আছে। একটু থেমে আবার বললাম, আমার কাছে আছে।
হীরার কথা মনে পড়ল আমার।
গতকাল রাতে আমরা কেউই ঘুমোতে পারিনি। একটা অচেনা অচেতন আহত মানুষকে সামনে রেখে দিশেহারার মতো বসে থেকেছি আমরা। তারপর হীরা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি কোনও কথা বলিনি। শুধু উঠে গিয়ে টেপরেকর্ডারের সুইচ অন করে দিয়েছি। নিভিয়ে দিয়েছি ঘরের আলো। আর জ্বেলে দিয়েছি অল্প পাওয়ারের রাতের বাতি।
তারপর ফটোগুলোর নীচে জ্বেলে দিয়েছি সুগন্ধী ধূপ। শুরু হয়েছে রাতের পূজা। আমি জানি, আধো-আঁধারেও মা-বাবা-ভাই-বোন আমাকে, হীরাকে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ভালোবাসছে। ওরা জানে কার ভালোবাসা দরকার।
টেপরেকর্ডারে গান শুরু হয়ে গিয়েছিল । একে একে সব তারা, জেনো নিভে যাবে। একলা আকাশটুকু শুধু পড়ে রবে। তোমার আমার কথা কেউ শুনবে না, আমাদের ফেলে রেখে সব চলে যাবে…।
এই গানটা মায়ের বড় প্রিয় ছিল।
হীরা গান শুনতে-শুনতে কান্না থামাল। ডেকে উঠল, অমিতদা!
আমি চোখ মুছলাম। বললাম, কী?
আমার একটুও ভাল্লাগছে না–।
আমারও না…। কিন্তু তবুও যে বেঁচে থাকতে হয়। আমি যদি বেঁচে না থাকতাম, তা হলে তোমার সঙ্গে দেখা হত না। তুমি যদি বেঁচে থাকে তা হলে তেমন কারও সঙ্গে হয়তো তোমার দেখা হবে। কে বলতে পারে।
হীরা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আমার স্বামীর শেষ কথাগুলো বড় কষ্টের।
আমি সব শুনলাম। সত্যি বড় কষ্টের সেই কথাগুলো। বড় বেদনার।
হীরার কথা ভাবতে-ভাবতেই আমি মিত্র সাহেবের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম অবহেলায়।
নজর মহম্মদ আমার পিছনে পিছনে এগিয়ে এসেছে। এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে খুব কাছাকাছি। মিত্ৰসাহেবের কাছ থেকে মাইনে নিলেও ও যেন এখন আমারই দেহরক্ষী।
আমি জিগ্যেস করলাম, খুদে কোথায়?
শরদিন্দু মিত্র উত্তর দিতে কোনও সময় নিলেন না। বললেন, বোধহয় শরীর খারাপ, তাই আসেনি।
আমি হাসলাম। বললাম, আপনি অন্তর্যামী, মিস্টার মিত্র। কাঁধে আর কোমরে গুলি খেয়ে খুদে কাল রাত থেকে হোটেল রিভারভিউর দুশো আঠেরো নম্বর ঘরে পড়ে আছে।
মিত্র সাহেবের মুখে সংশয়ের ছাপ পড়ল। বুঝতে পারছিলেন না আমি সত্যি বলছি, না গপ্পো বলছি। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলাম, নজর মহম্মদের হাত চলে গেছে পাজামার পকেটে। তাই ওর দিকে ফিরে বললাম, নজরসাব, আমার ধারণা ছিল খুদের চেয়ে আপনার মাথায় বুদ্ধি বেশি আছে। আপনার ওই পকেট থেকে কী বেরোতে পারে? বড়জোর একটা ছুরি কি পিস্তল–।
নজর! কী হচ্ছে? ধমক দিলেন শরদিন্দু, আমি মিস্টার শিকদারের সঙ্গে কথা বলছি।
নজর মহম্মদ হাসল। পকেট থেকে সেন্ট মাখানো রুমাল বের করল একটা। বলল, রুমাল, সাব। সিরফ রুমাল।
শরদিন্দু আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন, খুদের ব্যাপারটা কি সত্যি?
আমি বললাম, গল্পটা গোড়া থেকে আপনাকে বলি। তা হলে আপনার বুঝতে সুবিধে হবে। আপনি হীরাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমাকে ভাড়া করেছিলেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অমিতাভ শিকদারকে ভাড়া করা যায়, কিন্তু কেনা যায় না। কাল সকালে আপনার কাছ থেকে বেরোনোর পর একটা সাদা মারুতি আমার পিছু নেয়…।
এইভাবে প্রায় গোটা গল্পটা শুনিয়ে দিলাম শরদিন্দু মিত্রকে। উনি দুহাতে মাথা ঢেকে যেন ভেঙে পড়লেন।
গল্প শেষ করে আমি বললাম, হীরা আমার কাছে আছে। আপনার পাঠানো কালো অ্যামবাসাডরের ড্রাইভারকে পাহারা দিচ্ছে। সে বেচারা এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে, তাই ওর নামটা আপনাকে বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।
চুনি–চুনি মারা গেছে। খুদে ওকে খুন করেছে! ভাঙা গলায় আর্তনাদ করলেন শরদিন্দু ও কিন্তু কেন? কেন ও একাজ করল?
আমি আর থাকতে পারলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলাম কয়েকবার। হেসে বললাম, উত্তমকুমারের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা এখনও খালি আছে, মিস্টার মিত্র। আপনাকে পেলে বাংলা ফিল্মের বড় উপকার হত।
শরদিন্দু সোজা হয়ে বসলেন। কালো কপালে চন্দনের টিপ কাঁপছে। মুখের চেহারা এখন একেবারে অন্যরকম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।
আমি চেয়ার সরিয়ে নজর মহম্মদকে পাশ কাটিয়ে খানিকটা দূরে সরে এলাম। কিন্তু চোখের সতর্ক দৃষ্টি সবসময়েই শরদিন্দু মিত্র এবং নজর মহম্মদের দিকে।
কিছুটা সময় নিয়ে বললাম, আপনার ছকটা ছিল এইরকম। হীরা ও চুনিকে খতম করা, তারপর সেই খুনের দায়টা আমার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া। কারণ, আমি এককালের পুলিশের লোক হলেও এখন তাদের খুব পছন্দের লোক নই। আসলে আপনি ভাবতেই পারেননি এতগুলো ধাক্কা সামলে আমি হীরাকে সহি-সলামত ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আপনি জনার্দন সামন্তকে লাগিয়েছিলেন। সাদা মারুতি লাগিয়েছেন। কালো অ্যামবাসাডরে দুজনকে পাঠিয়েছেন। আর সবার সেরা, খুদেকে ডাবল এজেন্ট তৈরি করে পাঠিয়েছেন চুনি ব্যানার্জিকে বোকা বানানোর জন্যে। চুনি বেচারা ভেবেছে, খুদে ওর হয়ে স্পাইয়ের কাজ করছে। আসলে ব্যাপারটা ছিল ঠিক উলটো। আমি একটু থেমে কাঁধ কঁকালাম ও আপনার আর কী দোষ! আপনি কী করে জানবেন, অমিতাভ শিকদার সহজে খতম হয় না! এই খতমের খেলায় আমি পুরোনো পাপী। তাই আমি বেঁচে ফিরে এসেছি, হীরা বেঁচে ফিরে এসেছে। আপনার পোষা কোনও জনার্দন বা মধুসূদন আমাদের ছুঁতে পারেনি–।
হীরা–আমার মেয়ে হীরাকে আমি মারতে চাইব? একথা আপনি বিশ্বাস করেন, মিস্টার শিকদার!
হ্যাঁ, করি। কারণ হীরা যে আপনার মেয়ে নয়!
শঙ্খচূড় যেন ছোবল বসাল শরদিন্দুর কপালে। মুখ ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেল চোখের পলকে। আর নজর মহম্মদের হাত ঝলসে উঠল শূন্যে।
নজর মহম্মদ আমাকে চেনে না, তাই বোকার মতো এ কাজ করতে গেল। আমি শরীরটাকে আধ পাক ঘুরিয়ে ভয়ংকর এক লাথি কলাম ওর শূন্যে তোলা হাতের বগলের নীচে। ওর ছিপছিপে দেহটা টাল খেয়ে পড়ল শরদিন্দুর টেবিলে। লিকলিকে ছুরিটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল মেঝেতে। আমি ঝটিতি নজরের কাছে চলে গেলাম। বাঁ হাতে চেপে ধরলাম ওর চুলের মুঠি। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ও ডান হাতটা চালিয়ে দিল আমার পাঁজরে।
একটা ধাক্কা আর জ্বালা আমাকে শেষ করে দিল যেন। নজর কোথা থেকে একটা দ্বিতীয় ছুরি বের করে বিধিয়ে দিয়েছে আমার পাঁজরে।
ক্ষণিকের জন্যে আমার দেহ স্থির হল। আর তার পরই টেবিল থেকে ইস্পাতের পেপারওয়েট তুলে নিয়ে আমি নৃশংস আক্রোশে বসিয়ে দিয়েছি নজরের রগের ওপরে–একবার, দুবার।
নজর মহম্মদের শরীর অবশ হয়ে গেল। আমি কোনওরকমে ওর চিবুকের নীচে হাত দিয়ে ওর মাথা মুচড়ে দিলাম। একটা শব্দ হল। কী ভাঙল কে জানে! নজর মহম্মদ এবার টেবিল থেকে পড়ে গেল নীচে। বোধহয় আল্লার প্রিয় হয়ে গেল।
না, শরদিন্দু মিত্র এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেননি। যখনই দেখেছেন লড়াইয়ে পাল্লা আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখনই হয়তো কোনও কোনো বিপদ সংকেত বাজিয়ে দিয়েছেন। আর দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে হাজির হয়ে গেছে দুজন সাকরেদ।
ওই দশ সেকেন্ড আমিও বসে থাকিনি। কোমর থেকে নলকাটা শটগানটা বের করে আহত শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেছি শরদিন্দুর কাছে। ওঁর চর্বিঝোলা গলকম্বলে শটগান চেপে ধরে বলেছি পুলিশে টেলিফোন করতে।
ডায়াল করুন–ওয়ান জিরো জিরো!
আমার রক্তে ভেজা শরীর আর যন্ত্রণায় ভাঙাচোরা মুখ দেখে প্রতিবাদের বিশেষ ভরসা পাননি শরদিন্দু। ডায়াল করেছেন। তারপর আমারই কথামতো নিজের ডেরার ঠিকানা দিয়ে পুলিশকে আসতে বলেছেন।
শরদিন্দু ফোন রেখে দেবার পর খেয়াল করেছি, ওঁর সাকরেদ দুজন দরজার কাছে ফ্রিজ শট হয়ে আছে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত ওদের ফ্রিজ শট হয়েই থাকতে হবে।
হীরা আপনার মেয়ে নয়। আমি নীচু গলায় বললাম শরদিন্দুকে। আমার শরীরের বাঁ দিকটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। জানি, ছুরিটা টেনে বের করে নিলে যন্ত্রণা কমবে। কিন্তু তারপর যে-রক্তস্রোত শুরু হবে তাকে রুখবে কে!
আপনি হীরার সম্পর্কের কাকা। ছোটবেলায় হীরা অনাথ হয়। আপনি ওকে মানুষ করেন। আপনাকে ও বাবা বলে জানে। এই ব্যাবসা, কারখানা, মিত্রভিলা–কোনও সম্পত্তিই আপনার নয়। সব ছিল আপনার দাদার। কিন্তু তাঁর উইল ছিল। তাতে বলা ছিল, হীরা সাবালিকা হলে বা বিয়ে করলে সবকিছু ওর হয়ে যাবে। আপনার তখন কিছুই থাকবে না। হীরা এসব খবর কিছুই জানত না। এসব খবর জানতে পেরেছিল চুনি ব্যানার্জি। মারা যাবার আগে ও হীরাকে তার কিছু কিছু বলে গেছে। বলে গেছে সেইসব কাগজপত্রের হদিস।
একটু থেমে দম নিয়ে আমি বললাম, সারা জীবনে আপনি কম খারাপ কাজ করেননি। এমনকি নিজের বউকেও পুড়িয়ে মেরেছেন। আর কাল মারতে চেয়েছেন ফুলের মতো একটা মেয়েকে–যে আপনাকে গত ষোলো-সতেরো বছর ধরে বাপি বলে ডেকেছে। আমার বাড়িতে বসে হীরা এখন কাঁদছে। ওর যে আর কেউ নেই–মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই।
না, আমি আছি! হীরার ডাক মনে পড়ে গেল : অমিতদা!
আমার জীবনে সবই ফটো আর ফুলের মালা। কিন্তু হীরা ফটো হয়ে যাক আমি চাই না।
ঠিক তখনই গুলির শব্দ পেলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, তাই ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলাম না কে গুলি করল। তবে কোমরের কাছে একটা ধাক্কা টের পেলাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটোর মধ্যে একজনের হাতে কী যেন একটা রয়েছে।
আমার ডান হাতের জোর কমে আসছিল। এরপর আর শটগানের ট্রিগার টিপতে পারব কি না কে জানে!
সুতরাং ট্রিগার টিপে দিলাম। বিশ্রী শব্দ হল। রক্তে আমার ডান হাতের মুঠো ভিজে গেল। আমার সামনের চেয়ারটায় একটা সাপ বসে আছে, কিন্তু তার ফণা নেই, প্লাটিনামের বিষদাঁতও আর নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে।
হীরার আর কোনও ভয় নেই।
সুমনের গান কানে বাজছে : প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই…কিন্তু কাকে চাই এখনও জানি না। মৃত্যুর চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে!
শুধু একটাই তৃপ্তি–আমার মতো অন্ধকার ঘরে বসে চাঁদের আলো কোলে নিয়ে হীরাকে কখনও এ-গান শুনতে হবে না।
পায়ের শব্দ নেই
বিদিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজের সাজগোজ দেখে নিচ্ছিল। আয়না মিথ্যে কথা বলে না। তাই সামনের মেয়েটাকে রীতিমতো সুন্দরী বলে মনে হচ্ছিল বিদিশার। বিধাতাপুরুষ যখন রোজকার দমবন্ধ করা কাজের রুটিন থেকে ছুটি নিয়ে স্বর্গীয় কোনও জায়গায় আলস্যে অবসর যাপন করছিলেন, তখন বেশ ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে বিদিশাকে তৈরি করেছেন তিনি।
নিটোল ফরসা মুখ, স্পষ্ট ভুরু, মায়াজড়ানো টানা-টানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট, হাসলে এক গালে টোল পড়ে। ওর মুখের দিকে একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া কঠিন! কত পুরুষ যে ওর সঙ্গে নানান ছলছুতোয় আলাপ জমাতে চায়।
বিদিশার গাঢ় নীল শাড়িতে সূক্ষ্ম জরির কাজ। গত বছর পুজোর সময় মা কিনে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউস থেকে। বিদিশাও সঙ্গে গিয়েছিল। এত দামি শাড়ি কিনতে ওর মন চায়নি। কিন্তু মা জোর করে কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোর সাজগোজের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি–।
ছাব্বিশ বছর বয়েসে কি কারও সাজগোজের বয়েস ফুরিয়ে যায়? কিন্তু বিদিশার ভেতরে সবসময়েই একটা অস্থির ঝড় মাথা খুঁড়ে মরতে থাকে।
মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে তেরছা চোখে আয়নার দিকে তাকাল বিদিশা। কোঁকড়া কালো চুলের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে চাইছে পিঠে। চুলের গোড়ায় সাদা সিল্কের সৌন্দর্য বন্ধনী। চুলের ঢঙ বিদিশার পছন্দ হল। আর ঠিক তখনই ওর চোখ গেল বাঁ গালে কানের কাছাকাছি জায়গায়। ইঞ্চিদুয়েক লম্বা একটা কাটা দাগ। রণজয়ের ভালোবাসার চিহ্ন। সেই রাতটার কথা বিদিশা এখনও ভুলতে পারেনি। যেমন ভুলতে পারেনি আরও অনেক দিনরাতের কথা।
সাজগোজ পরখের পালা শেষ করে বিদিশা কবজি উলটে ঘড়ি দেখল ও সওয়া নটা। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে না বেরোতে পারলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে। সল্ট লেকের সি. এ. পি. ক্যাম্প থেকে পার্ক স্ট্রিট–সব মিলিয়ে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো লাগবেই।
আয়নার পাশে দাঁড় করানো একটা সোফায় বিদিশার লম্বা স্ট্র্যাপ দেওয়া হাতব্যাগটা পড়ে ছিল। তার পাশেই বাপ্পার স্কুলের পোশাক। বাপ্পা এখন স্নান করতে বাথরুমে ঢুকেছে। ও দশটায় স্কুলে বেরোয়।
বিদিশা ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরোতে যাবে, মা বসবার ঘরের দরজা থেকে ডাকলেন, মানু, তোর ফোন।
বিদিশা ভুরু কুঁচকে ডাইনিং হলের দিকে এগোল। কে ফোন করল এই অসময়ে?
সবুজ রঙের রিসিভার টেবিলে কাত করে নামানো। সেটা তুলে নিয়ে বিদিশা ছোট্ট করে বলল, হ্যালো–।
মানু, কেমন আছ?
ও-প্রান্তের গলা শোনামাত্রই বিদিশার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। রণজয়।
কেমন আছ, মানু? রণজয় আবার জিগ্যেস করল।
গলা শুকিয়ে কাঠ। অতি কষ্টে জিভে সাড় এনে বিদিশা বলল, ভালো–
বিদিশা রণজয়কে ছেড়ে চলে এসেছে প্রায় নমাস। প্রথম ছমাস রণজয় ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করেনি। তারপর একদিন ফোন করে বাপির সঙ্গে কথা বলে, মায়ের কথা বলে। তবে সে-সব কথাবার্তাই ছিল লিগাল সেপারেশনের ব্যাপার নিয়ে।
তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, মানু। রণজয় বলল।
দম বন্ধ করে বিদিশা জিগ্যেস করল, কী কথা?
আমি একেবারে বদলে গেছি। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারছি না। রাতগুলো আমাকে হাঁ করে গিলতে আসে। শেষ দিকে রণজয়ের গলা ধরে এল।
বিদিশার ভেতরে একটা কষ্ট সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ও চোয়াল শক্ত করে সেটাকে চেপে সাধারণ গলায় বলল, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি পরে ফোন কোরো।
বিদিশা, প্লিজ। আমার কথাটা শোনো একবার–।
সরি, রণজয়। সত্যি ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।
রিসিভার নামিয়ে রাখল বিদিশা।
মা তখনও বসবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। বিদিশা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মা পিছন থেকে জিগ্যেস করলেন, রণজয় কী বলল?
বিদিশা দায়সারাভাবে জবাব দিল, তেমন কিছু না।
তুই একটু ভেবে দ্যাখ না, যদি…।
বিদিশা ঘুরে তাকাল মায়ের দিকে। মায়ের দু-চোখে অনুনয়, প্রত্যাশা। মা এখনও ভাবে, রণজয়ের সঙ্গে ওর বিয়েটা জোড়া দেওয়া সম্ভব। দু-বছরে ওদের সম্পর্কে এমন কোনও ফাটল ধরতে পারে না যা সারিয়ে নেওয়া যায় না।
কিন্তু বিদিশা কেমন করে মাকে বলবে, মা, ওই লোকটার সঙ্গে দুটো বছর আমি ঘর করেছি, তুমি করোনি। ওর ভেতরে এমন কতকগুলো গোলমাল আছে যা কখনও ঠিক হবে না। তুমি কি আমার বাঁ-গালের কাটা দাগটার কথা ভুলে গেলে!
বিদিশা ছোট্ট করে বলল, আমি বেরোচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হলে চিন্তা কোরো না। দুপুরে খাওয়ার আগে বাবাকে মনে করে ডাইজিনটা দু-চামচ খাইয়ে দিয়ো।
ও যখন দরজা খুলে বেরোচ্ছে তখন পিছন থেকে শোনা গেল বাপ্পার চিৎকার, দিদি, আমার জন্যে আজ একটা ক্যাডবেরি নিয়ে আসবি।
আচ্ছা, নিয়ে আসব।
বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে সদর দরজা টেনে দিল বিদিশা। পালিশ করা ভারী কাঠের দরজা ক্লিক শব্দ করে অটোমেটিক লক হয়ে গেল।
ছোট্ট মোজেইক করা বারান্দায় শেষে দু-ধাপ সিঁড়ি। তারপর খানিকটা জায়গা জুড়ে শান বাঁধানো চাতাল। তার প্রান্তে, পাঁচিলের কিনারা ঘেঁষে, লম্বা মাটির ফালিতে সবুজের বাগান। রিটায়ার করার পর বাবাকে এই নেশায় পেয়েছে। সবসময় এই গাছ নিয়ে পড়ে আছেন। একা-একা কথা বলেন গাছের সঙ্গে। আপনমনে মাথা নাড়েন, বিড়বিড় করেন।
বাবা সারাটা জীবন কলকাতা করপোরেশনে ঘুষ না নিয়ে চাকরি করেছেন। ওদের নিয়ে পাইকপাড়া অঞ্চলে কী কষ্ট করেই না থাকতেন! বিদিশা শুনেছে, বিয়ের আগে মা রমলা গালর্স হাই স্কুলে অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন বাবার কথায়। কিন্তু পড়ানোর অভ্যেস ছাড়তে বাবা মানা করেননি। তাই বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পড়াতেন মা।
সল্ট লেকের জমি লটারি হওয়ার সময় সেই কোন যুগে বাবা একটুকরো জমি পেয়েছিলেন। তারপর, প্রায় পঁচিশ বছর পর, সেখানে এই ছোট্ট একতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। বাবা-মায়ের তিলতিল কষ্ট দিয়ে গড়ে তোলা এই বাড়ি।
তাই বিদিশার আবদার ছিল, বাবা-মায়ের নামেই হোক বাড়ির নাম। অনেক লড়াইয়ের পর জিতেছিল ও।
সদরের গ্রিলের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বিদিশা দেখতে পেল, শোওয়ার ঘরের লাগোয়া গ্রিল-ঘেরা বারান্দায় বসে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। লম্বা তামাটে কাঠামো। মুখে বয়েসের ভজ, চোখে হাই-পাওয়ার চশমা। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় মানুষটা ঘুম থেকে ওঠে, আর রাতে শুয়ে পড়ে নটার মধ্যে। আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ।
বিদিশা ডেকে বলল, বাবা, আমি বেরোচ্ছি।
মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজের আড়াল সরিয়ে তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলেন। সে-হাসির অর্থ বোধহয়, আমার জোয়াল টানার পালা শেষ, এবার তোর পালা।
লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল বিদিশা। একবার পিছন ফিরে দেখল। সদর দরজায় এক পাশে পাথরের ফলকে লেখা বাড়ির নাম : অরুণা-সুধাময়। ছোট্ট সাদা বাড়িটা যেন বাড়ির মানুষগুলোর মতোই সাদাসিধে। এরকম সাদাসিধে জীবনই চেয়েছিল বিদিশা। কিন্তু ওর বিয়েটা গোলমাল হয়ে গিয়ে সবকিছুই কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
অথচ বিয়ের আগে ও পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছিল রণজয়ের সঙ্গে।
ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক বিয়েবাড়িতে। আঠারো বছর বয়েসেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল কল্পিতা বিদিশার স্কুলের বন্ধু। বরযাত্রীরা এসেছিল দুর্গাপুর থেকে। সবাই মিলে বেশ হইহুল্লোড় করছিল। তারই মধ্যে রণজয়কে লক্ষ করেছিল বিদিশা। ফরসা রোগা চেহারা। মুখে কেমন যেন মেয়েলি ভাব। চোখে চশমা। চোখ দুটো বেশ গভীর আর মিষ্টি।
হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল রণজয়। মাঝে-মাঝে নতুন বউকে তাক করে শাটার টিপছিল।
বরযাত্রী দু-চারজন যুবক বিদিশার সঙ্গে গল্প জুড়েছিল। দুর্গাপুর যে কত ভালো জায়গা সে কথা সবিস্তারে বলছিল। বিদিশা সেই বয়েসেই বেশ বুঝে গিয়েছিল ওকে ঘিরে পুরুষদের কিছু সমস্যা হয়। তাই ও সতর্কভাবে সৌজন্য বজায় রেখে টুকটাক কথা বলছিল।
হঠাৎই তাদের একজন বিদিশাকে বলল, ম্যাডাম, আমাদের সঙ্গে একটা ছবি তুলুন।
সঙ্গে-সঙ্গে আর একজন : এই রনো, আমাদের দিকে তাক করে কটা ফিলিম খরচ করো, বস্।
রণজয় ইতস্তত করে জবাব দিয়েছিল, উনি এখনও ফটো তোলার পারমিশান দেননি।
তখন কে একজন বলে উঠল, রনোটা বড্ড বেরসিক। সবসময় নীতিশিক্ষা ফলায়।
আগের জন্মে ও পাদরি ছিল।
উঁহু, বেচারা নারীজাতিকে শ্রদ্ধা করে।
বিদিশা অস্বস্তি পাচ্ছিল। অথচ রণজয় বেশ স্মার্টভাবে ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল, আজেবাজে কথায় কান দেবেন না। শুধু বলুন, ফটো তুলতে আপনার আপত্তি নেই তো?
বিদিশা বলেছিল, তুলুন–।
রণজয় নরম গলায় আলতো করে বলল, একটা সবার সঙ্গে..আর একটা একা।
ফটো তোলার পর রণজয় বিদিশার ঠিকানা চেয়েছিল। বলেছিল, ফটোর প্রিন্ট ডাকে পাঠিয়ে দেবে। কয়েক সেকেন্ড দোটানার পর ঠিকানা দিয়েছিল বিদিশা।
এমন সময় কনেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ছাদনাতলায়। রণজয় ফটো তোলা নিয়ে কীসব কথা বলছিল গুনগুন করে। আবার মাঝে-মাঝে হঠাৎই চুপ করে যাচ্ছিল। দেখে কেমন যেন অসহায় বলে মনে হচ্ছিল।
একটু পরে ভিড়ের মধ্যে কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছিল রণজয়।
দিন পনেরো পর বিদিশার নামে একটা খাম এসেছিল পাইকপাড়ার বাড়িতে। দুটো ফটোর দু কপি করে পোস্টকার্ড মাপের প্রিন্ট। সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা : খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের জন্যে কোনও প্রিন্ট রাখিনি। বিশ্বাস করুন। ফটো কেমন লাগল এক লাইন লিখে জানাবেন?
সামান্য নির্দোষ চিঠি। কিন্তু তারই মধ্যে আঠারো বছরের বিদিশা কী যেন খুঁজে পেয়েছিল। এ যেন এক আঁজলা জলে ডুবে মরার গভীরতা।
এক লাইন নয়, বিদিশা এক পৃষ্ঠা লিখে জানিয়েছিল, ফটো কেমন লেগেছে।
নিতান্ত নির্দোষ চিঠি। কিন্তু তারপর থেকে একইরকম নির্দোষ চিঠি আসতে লাগল, যেতে লাগল।
দিন-মাস কাটতে লাগল। আর, অত্যন্ত ধীরে নির্দোষ চিঠিগুলোতে ভালোবাসার দোষ ঢুকতে লাগল।
রণজয় সি. এন. জ্যাকসন কোম্পানির সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার। বি. ই. কলেজ থেকে ইলেকট্রনিক্সে ডিগ্রি নিয়ে বছর আড়াই হল চাকরিতে ঢুকেছে। কোম্পানির হেড অফিস কলকাতার, কিন্তু ফ্যাক্টরি দুর্গাপুর। মাসের মধ্যে অন্তত দুবার কলকাতার আসে রণজয়। তখন বিদিশার সঙ্গে দেখা করতে ওর অসুবিধে নেই।
বিদিশা ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বেথুন কলেজে ভরতি হয়েছিল।
রণজয় ওর সঙ্গে কলেজে এসে দেখা করতে লাগল। একবার দেখা হওয়ার পর চোদ্দো দিন ধরে অপেক্ষা করত বিদিশা। তখন ওর মনে হত, হেদুয়া পার্কের গাছের পাতাগুলো কী সাংঘাতিক সবুজ, ওপরের আকাশটা কী বিপজ্জনক নীল, আর হেদুয়ার জল কী ভীষণ স্বচ্ছ!
জীবনকে আগে কখনও এত রূপসী মনে হয়নি বিদিশার। একটা রোগা ফরসা মুখচোরা চশমা পরা মিষ্টি ছেলে ওর জীবনটাকেই যেন পালটে দিল।
এখন পিছন ফিরে তাকালে বিদিশার মনে হয়, রণজয়ের মধ্যে ছোটখাটো কয়েকটা অস্বাভাবিক ব্যাপার তখন থেকেই দেখা গিয়েছিল। আজ যত স্পষ্টভাবে তার অর্থ বোঝা যায় তখন তা বোঝা যায়নি।
পার্ক স্ট্রিটের বাস স্টপে নেমে ডানদিকের ফুটপাথ ধরে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটছিল বিদিশা। অফিসে দেরি হয়ে যাবে এই ভয়ে বারদুয়েক হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎই পিছন থেকে, ঠিক ঘাড়ের কাছে, কে যেন বলে উঠল, আগে গেলে বাঘে খায়–।
চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল বিদিশা। ওরই অফিসের সহকর্মী বোসদা-সুধীর বোস। অভিজ্ঞ ড্রাফটসম্যান। মাথায় টাক–শুধু কানের কাছটায় খানিকটা করে চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পানের রসে ঠোঁট লাল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন।
বিদিশা অপ্রস্তুত হেসে বলল, দেরি হয়ে যাবে, তাই তাড়াতাড়ি হাঁটছি।
সুধীর বোস পান চিবোতে-চিবোতে জড়ানো গলায় বললেন, আমার কথাটার ইনার মিনিং আছে, মা জননী।
বিদিশা অপ্রতিভ হয়ে আশেপাশে তাকাল। কেউ শুনতে পায়নি তো! বোসদার কথাবার্তাই এইরকম। বিদিশা জানে এখানে বাঘ বলতে ওদের সেকশনের ম্যানেজার প্রশান্তলাল চক্রবর্তী। ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, আর সেইজন্যেই বোধহয় মহিলা-আসক্তি অত্যন্ত প্রবল। কারণ, লোকে বলে, একটা ইন্দ্রিয় কমজোরি হলে অন্য কোনও ক্ষমতা শক্তিশালী হয়ে লোকসান পুষিয়ে দেয়।
বিদিশা স্টেনোগ্রাফারের চাকরি করে। প্রশান্ত চক্রবর্তী নানা ছুতোয় ওকে ডেকে ডিকটেশন দেন। সারাদিনই নির্লজ্জ চোখে ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রথম-প্রথম বিদিশার খুব খারাপ লাগত, কিন্তু ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ও বুঝতে পেরেছে, মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে এ-অসুবিধেটা থাকবেই। ছমাসের চাকরি বিদিশাকে ছবছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে দিয়েছে। যেমন রণজয়ের সঙ্গে দু-বছরের সংসারটাকে ওর সবসময় দুশো বছর বলে মনে হয়।
সকালের এই সময়টা পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে অসংখ্য অফিসযাত্রী দ্রুত-পায়ে হেঁটে যায়। আর রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে একের পর এক গাড়ি। এই অঞ্চলটার আপাদমস্তক এখন গতি। মাথার ওপরে শ্রাবণের মেঘলা আকাশ যেন অলস ঘুমচোখে এই গতি দেখছে।
বোসদা বিদিশার পাশাপাশি পা ফেলতে-ফেলতে বললেন, ফাঁকা অফিসে আগে-আগে যেয়ো না। প্রশান্ত চক্রবর্তী ওত পেতে বসে আছে।
বিদিশা হেসে বলল, যাঃ, কী যে বলেন! আমাদের চক্রবর্তীসাহেব অতটা ডেঞ্জারাস নন। যাট পেরোনো রোগা-ভোগা মানুষ, দাঁত-টাত নেই, কামড়াবে কেমন করে!
মাড়ি তো আছে! সুযোগ পেলে ওই মাড়ি দিয়েই কিড়মিড় করবে।
বোসদার কথায় বিদিশা জোরে হেসে ফেলল।
প্রথম-প্রথম এসব পুরুষালি রসিকতায় অস্বস্তি পেত বিদিশা। কিন্তু পরে এই ব্যাপারটাকে ও মানিয়ে নিতে পেরেছে। তা ছাড়া ওর অফিস কলিগরা বেশিরভাগই ভীষণ ভালো। একে অপরের সুখে-দুঃখে অংশ নেয়। কারও সম্পর্কে অহেতুক কোনও কৌতূহল নেই।
বিদিশা যখন অফিস বিল্ডিং-এ ঢুকল তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ও আর বোসদা গ্রাউন্ড ফ্লোরের লিফটের কাছে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। দু-চারটে চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছিল বিদিশার। ও সৌজন্যের হাসি হাসল।
আশেপাশের নানান কথাবার্তা কানে আসছিল। কেউ অফিসের সমস্যার কথা বলছে, কেউ বলছে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সমস্যার কথা, কেউ বা পরিবারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির কারণ বিশ্লেষণ করছে।
বিদিশার মাথায় রণজয়ের ভাবনাটা আবার ফিরে এল।
আজ মঙ্গলবার। রণজয় বিদিশাকে বাড়িতে ফোন করতে শুরু করেছে রবিবার থেকে। এ পর্যন্ত মোট চারবার ফোন করেছে ও। আর চারবারই একইরকম কথাবার্তা বলেছে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না ইত্যাদি।
কথাগুলো শুনে বিদিশার কষ্ট হয়। প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে পড়ে, মনে পড়ে ফটো তোলার কথা। আবার অন্য অনেক ঘটনাও মনে পড়ে। দুঃস্বপ্নের স্মৃতির ভারে স্বপ্নের স্মৃতি চাপা পড়ে যায়।
বিদিশার মন বলছে, আজ রাতে ও আবার ফোন করবে। আবার একই কথা বলবে।
ছতলার অফিসের ফ্লোরে পৌঁছে যেন অন্য জগতে ঢুকে পড়ল বিদিশা। নিজের চেয়ার টেবিলে গুছিয়ে বসল। পোস্টাল ফ্যানটা চালিয়ে দিল ফুল স্পিডে। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে নিল। হালকা পারফিউমের গন্ধ টের পেল। আর তখনই দেখল শেখর সেন ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।
শেখর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বয়েস বত্রিশ-তেত্রিশ। লম্বা শক্তিশালী কাঠামো। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। চোখে চশমা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা।
একসময়ে ট্র্যাকে দৌড়োনোই ছিল শেখরের ধ্যানজ্ঞান। একশো মিটারে ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল। এখন রোজ ভোরবেলা দেশবন্ধু পার্কে দৌড়োয়।
ম্যাডাম, নিন, এই বইটা পড়ে দেখুন– একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বিদিশার দিকে এগিয়ে দিল শেখর, এই বইটা বিদেশে প্রচুর বিক্রি হয়েছে।
বিদিশা বইটা হাতে নিয়ে দেখল। স্টিভ সোয়ানসন নামে একজন সিরিয়াল কিলারের আত্মজীবনী। নাম : মাই লাইফ উইথ নাইফ।
শেখর বইয়ের পোকা। অফিসে কোনও না কোনও বই ওর সঙ্গে থাকবেই। আজ এটা নিয়ে এসেছে। হয়তো আজই বাসে বইটা পড়ে শেষ করেছে। তাই বিদিশাকে পড়তে দিচ্ছে।
শেখর প্রায়ই বই পড়তে দেয় বিদিশাকে। ইংরেজি গল্প-উপন্যাস নিয়ে ফাঁক পেলেই আলোচনা-তর্ক জুড়ে দেয়। আর নিজের দৌড়োনোর দিনগুলোর গল্প করে।
বিদিশা ঠোঁট কুঁচকে বলল, না, না, এসব খুন-জখমের বই আমার ভালো লাগে না।
শেখর বলল, এই সোয়ানসন লোকটা স্যাডিস্ট সাইকোপ্যাথও বলা যায়। মহিলাদের খুন করেই ও আনন্দ পেত। ওর মাথার গণ্ডগোল আছে বলেই ইলেকট্রিক চেয়ার হয়নি। আমেরিকায় যাবজ্জীবন জেল খাটছে।
ওরে বাবা আঁতকে উঠল বিদিশা, এসব বই কেন পড়েন আপনি?
বিদিশার টেবিলে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে পড়ল শেখর। বলল, আপনাকে সত্যি কথাটাই বলি। রোমাঞ্চকর থ্রিলিং ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে। যখন ট্র্যাকে দৌড়োতাম তখন খুব থ্রিলিং লাগত। এখন তো জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গেছে।
শেষদিকে মুখটা এমন ব্যাজার করল যে বিদিশা হেসে ফেলল।
হঠাৎই কোথা থেকে ম্যানেজার পি. এল. চক্রবর্তী এসে শেখরের পাশ দিয়ে উঁকি মারল ও বিদিশা, জলদি এসো। অনেকগুলো ইমপরট্যান্ট চিঠি ডিকটেট করার আছে।
বিদিশা চক্রবর্তীসাহেবের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, এখুনি যাচ্ছি।
শেখর হেসে বলল, আপনিও একটা এরকম বই লিখে ফেলুন ম্যাডাম। বইটার নাম দেবেন মাই লাইফ উইথ পি. এল. চক্রবর্তী।
বিদিশা শর্টহ্যান্ড খাতা আর পেন্সিল বের করে নিল ড্রয়ার থেকে। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
শেখর বলল, লাঞ্চের সময় দেখা হচ্ছে।
বিদিশা ঘাড় নেড়ে মোজাইক করা মেঝেতে পা ফেলে এগিয়ে চলল প্রশান্ত চক্রবর্তীর টেবিলের দিকে।
এর মধ্যেই যে যার কাজে মন দিয়েছে। চায়ের গাড়ি ঢুকে পড়েছে ফ্লোরে। টেবিলে-টেবিলে চা পৌঁছে দিচ্ছে টি-বয়। ছেলেটা বিদিশাকে জিগ্যেস করল ম্যাডাম, আপনার চা কোথায় দেব?
বিদিশা ইশারায় ম্যানেজারের এক্সিকিউটিভ টেবিল দেখিয়ে দিল।
ঠিক তখনই ওদের বেয়ারা বনজারা এসে দাঁড়াল ওর কাছে। বলল, ম্যাডাম, আপনার ফোন। আঙুল তুলে একটা এক্সটেনশন লাইন দেখাল বনজারা।
বিদিশা এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরল।
হ্যালো।
মানু, কেমন আছ?
বিদিশার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইল। ওর অফিসের ফোন নম্বর কী করে পেল রণজয়!
মানু, কথা বলছ না কেন? আকুল গলায় জানতে চাইল রণজয়, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। একটিবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বিদিশা…মানু…প্লিজ, একবার আমাকে কথা বলার চান্স দাও।
এটা অফিস। এখানে এভাবে ফোন করাটা ভালো দেখায় না– ঠান্ডা গলায় বলল বিদিশা।
কী বলছ, মানু! আমি তোমাকে ফোন করলে কে কী মনে করবে! আফটার অল আমি তোমার স্বামী।
বিদিশা একটা ধাক্কা খেল। রণজয় ওর প্রাক্তন স্বামী নয়–আইনের হিসেব অনুযায়ী বর্তমান স্বামী। ওর মাথার ভেতরটা কেমন যেন করছিল। কী বলবে এখন রণজয়কে?
অফিসের ফোন নম্বর তুমি কোথায় পেলে? বরফের গলায় জানতে চাইল বিদিশা।
ও-প্রান্তে পাগলের মতো হেসে উঠল বিদিশার স্বামী। হাসতেই লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর সহজ গলায় জবাব দিল, তোমাকে আমি প্রায়ই ফলো করি, তুমি টের পাও না। অফিসের আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে হইহুল্লোড় ফুর্তি করতে করতে আমার কথা তুমি একেবারে ভুলেই গেছ। তোমাকে আমি দূর থেকে রোজ দেখি আর নতুন করে ভালোবাসায় পাগল হয়ে যাই।
অফিসের অপারেটর লাইন ট্যাপ করে যান্ত্রিকভাবে মন্তব্য করল, প্লিজ মেক ইট কুইক, ম্যাম। সো মেনি ইনকামিং কল্স আর ওয়েটিং।
বিদিশার ভয় করছিল। যে-দুঃস্বপ্নটা মুছে গেছে বলে মাসতিনেক ধরে ও নিশ্চিন্ত ছিল। সেই দুঃস্বপ্নটা আবার কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে।
ও ছোট্ট মেয়ের মতো জেদি গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। প্লিজ, গেট লস্ট ফ্রম মাই লাইফ। কথার শেষে কেঁদে ফেলল বিদিশা।
জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল রণজয় : ছিঃ মানু, শুধু-শুধু কাঁদতে নেই। আজ সন্ধেবেলা তোমার সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলব। তখন বুঝবে, একা-একা আমি কী কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এখন রেখে দিই? টা-টা। আই লাভ য়ু, লাভ।
লাইন কেটে গেল।
অসাড় হাতে রিসিভার নামিয়ে রেখে কোমর থেকে রঙিন রুমাল বের করল বিদিশা। প্রাণপণে। কান্না চেপে চোখ মুছল।
ইন্টারকম টেলিফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে। বিদিশার বুকের ভেতরেও পাগলা ঘণ্টি বাজছে। সত্যিই কি আজ সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে দেখা করবে রণজয়? কোথায় দেখা করবে?
যেন অন্য কারও পায়ে ভর দিয়ে চক্রবর্তীসাহেবের টেবিলের দিকে এগোল বিদিশা। লক্ষ করল, নিজের সিট থেকে শেখর উদ্বিগ্ন চোখে ওকে দেখছে। আরও দু-একজন কলিগের চোখে কৌতূহল। এখন কী করবে ও?
কী ব্যাপার, বিদিশা, তোমাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? প্রশান্তলাল চক্রবর্তীর গলায় দরদ উথলে উঠছে? আবার চা দিতে বলি? তোমার চা এতক্ষণে ঠান্ডা জল হয়ে গেছে।
বিদিশা কোনওরকমে বলল, না, চা খাব না। তারপর শর্টহ্যান্ড খাতা আর পেনসিল নিয়ে ডিকটেশন নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসল।
অফিসের দেওয়ালে বড় বড় কাচের জানলা। জানলার বাইরের ভিজে মেঘলা আকাশ মন খারাপ করে দিচ্ছে। হঠাৎই একটা বিদ্যুৎ-রেখা চোখে পড়ল বিদিশার। বিদ্যুতের ঝিলিক দেখলেই ওর সেই ভয়ংকর রাতটার কথা মনে পড়ে যায়। চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে একটা অচেনা রণজয় হঠাৎই উঁকি মেরেছিল সেই রাতে।
সেদিনটাও ছিল আজকের মতোই মেঘলা। ঘন-ঘন বৃষ্টি পড়ছিল আকাশ ভেঙে। আর সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আলপনা।
রণজয় বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে হয়ে বাড়ি ফিরল। তখন রাত কত হবে? বড় জোর নটা। সকালে বেরোনোর সময় ও বলেই গিয়েছিল ফিরতে একটু দেরি হবে। তবে দেরি বলতে বিদিশা ভেবেছিল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। কারণ রোজ ও ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরে।
ওর হেড অফিস বালিগঞ্জে। বছরদুয়েক হল রণজয় হেড অফিসেই আছে। এখানে নতুন একটা রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট উইং ভোলা হয়েছে–ও-ই সেটার গ্রুপলিডার। কোনও কোনও দিন অফিসের কাজে আটকে গেলে ও ফোন করে দেয় বাড়িতে।
বাড়িতে শুধু বিদিশা আর রণজয়ের মা। ছোট দোতলা বাড়ির একতলায় মা থাকেন, দোতলায় রণজয়-বিদিশা। ঠিকে কাজের বউ দু-বেলা কাজ করে যায়।
কলিং বেলের ঘণ্টা শুনে বিদিশাই খুলে দিয়েছিল সদর দরজা।
ভিজে সপসপে রণজয় দরজায় দাঁড়িয়ে। রাস্তার মলিন আলো তেরছাভাবে এসে পড়েছে। ওর ভিজে পোশাকে।
আজ ছাতা না নিয়ে ভীষণ ভুল করেছি। রণজয় হেসে বলল।
সদর দরজা বন্ধ করে ওর পিছন পিছন শোয়ার ঘরে এসেছিল বিদিশা। রণজয় অফিস থেকে অন্তত একটা ফোন করতে পারত বিদিশাকে। সারাটা সন্ধে ঘরে বন্দি হয়ে কারই বা টিভি দেখতে ভালো লাগে!
ফিরতে এত দেরি হল?
বিদিশা প্রশ্নটা নির্দোষভাবেই করেছিল, কৈফিয়ত চাওয়ার জন্য নয়।
রণজয় ওর দিকে পিছন ফিরে ভিজে জামা ছাড়ছিল গা থেকে। পলকে ঘুরে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিল বিদিশার গালে। বিদিশা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে।
কৈফিয়ত দেওয়া আমি পছন্দ করি না। কঠিন গলায় মন্তব্য করেছিল রণজয়।
বিদিশা হঠাৎই যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। গালে হয়তো ব্যথা পেয়ে থাকবে, কিন্তু সেই ব্যথাটা ও টের পাচ্ছিল না। ভালোবাসার পুরুষ রণজয়ের আচরণ ওকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
বাইরে মেঘ ডাকছিল। কিন্তু বিদিশার মনে হচ্ছিল মেঘ ডাকছে ওর বুকের ভেতরে। মেঝেতে আধশোয়া অবস্থায় ওর শরীর কাঁপছিল থরথর করে।
ভিজে জামাটা মেঝেতে একপাশে ফেলে দিয়ে রণজয় এগিয়ে এল বিদিশার কাছে।
বিদিশা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ওর ঠোঁটের কোণ জ্বালা করছিল। বোধহয় কেটে গেছে।
রণজয় ওকে সাবধানে তুলে বসাল বিছানায়। বিদিশা তখন মাথা নীচু করে কাঁদছে। ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছে।
কেঁদো না, মানু, কেঁদো না– ওকে আদর করে বোঝাতে চাইছিল রণজয়, অন্যায় করেছ, তার শান্তি পেয়েছব্যস, মিটে গেছে।
মিটে গেছে! চোখ মুছে অচেনা রণজয়কে দেখতে চাইল বিদিশা। কিন্তু ততক্ষণে চেনা রণজয় আবার ফিরে এসেছে। দু-চোখে ভালোবাসা। আর দু-হাতে আদর করছে বিদিশাকে। বিদিশা কাঠ হয়ে বসেছিল।
কিন্তু রণজয়ের আদর বাড়তেই লাগল।
ওর ভিজে প্যান্ট থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল মেঝেতে। গায়ের ভিজে গেঞ্জিটা একটানে খুলে ফেলল রণজয়। পরক্ষণে প্যান্ট ইত্যাদিও।
বিদিশা প্রথম ধাক্কাটা তখনও সামলে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় ধাক্কাটাও পারল না।
রণজয় খ্যাপা ষাঁড়ের মতো হিংস্রভাবে আদর করতে লাগল ওকে। জামাকাপড় লন্ডভন্ড হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বিছানাও।
ঘরের টিউব লাইট নির্লজ্জভাবে জ্বলছে। জ্বলছে বিদিশার শরীরটাও। বাইরে মেঘের ডাক যেন রণজয়ের গর্জন। তীব্র এক জ্বালায় ওর শরীরটা বিদিশাকে আঁকড়ে মরিয়া হয়ে ছটফট করছে।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বিদিশার ভেতরেও।
একসময় মেঘের গর্জন, বৃষ্টি–দুই-ই কমে এল। অসাড় মন নিয়ে বিদিশা এলোমেলোভাবে পড়ে রইল বিছানায়। শুধু ওর ক্লান্ত দুটো চোখ রণজয়কে দেখতে লাগল। এই মানুষটাকে ও ভালোবেসে সাতমাস আগে বিয়ে করেছিল!
রণজয় একটা পাজামা আর গেঞ্জি পরে নিয়ে পাখার বাতাসে চুল শুকোচ্ছিল। মাথার চুলে আঙুল চালাতে-চালাতে ও নির্লিপ্ত গলায় বলল, খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।
বিদিশা সেই রাতেই মনে-মনে টের পেয়েছিল ওর বিয়েটা মরে গেছে।
কিন্তু তার পরেও সতেরোটা মাস ওকে সেই লাশটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। অবশ্য তারপর আর পারেনি।
থ্যাংক য়ু, বিদিশা। তুমি টেবিলে গিয়ে একটু রেস্ট নাও। এই চিঠিগুলো সেকেন্ড হাফে টাইপ করে দিলেও চলবে।
বিদিশা চমকে উঠে খেয়াল করল প্রশান্ত চক্রবর্তী ওর সঙ্গে কথা বলছেন। বিদিশা ওর হাতের শর্টহ্যান্ড খাতার দিকে দেখল। দেখে অবাক হয়ে গেল। পুরোনো কথা ভাবতে-ভাবতেও কী করে যেন যান্ত্রিকভাবে ও ডিকটেশন নিয়ে ফেলেছে।
স্যার, আমি আসছি বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিদিশা।
প্রশান্ত চক্রবর্তী কথাটা বোধহয় শুনতে পাননি, কারণ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ওর দিকে। কানে খাটো বলে সবসময় ওঁর সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। এখন বিদিশার চেঁচাতে ভালো লাগছিল না।
যদি দরকার হয় বোলো। ছুটির পর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। তোমাকে ভীষণ আপসেট দেখাচ্ছে।
বিদিশা কোনও জবাব না দিয়ে ফিরে গেল নিজের সিটে।
ওদের সেকশনে তিনটে এক্সটেনশন লাইন আছে। তিনটে টেলিফোনের দিকেই ভয়ে-ভয়ে দেখছিল বিদিশা। এই বুঝি একটা ফোন বেজে উঠল, আর কেউ ফিসফিসে গলায় বলে উঠল, মানু, কেমন আছ?
টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল বিদিশা। শরীরটা কেমন লাগছে। সেই সঙ্গে ঝিমুনি ভাব। রণজয় বলেছে, আজ সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলবে। কখন দেখা করবে? দেখা। করে কী বলবে?
অফিস ছুটির সময় যতই কাছে এগিয়ে আসছিল, বিদিশার ভয় ততই বাড়ছিল। রণজয়ের কথা কাকে বলবে ও? শেখরকে? বোসদাকে? নাকি চক্রবর্তীসাহেবকে?
অফিসে কেউ জানে না বিদিশার বিয়ে হয়েছে। কপালে বা সিঁথিতে কোনওরকম সিঁদুরের ছোঁয়া নেই। নামও বিদিশা রায়–সুধাময় রায় ও অরুণা রায়ের মেয়ে। এখন যদি ও হঠাৎ করে কাউকে বলে ওর একটা স্বামী আছে, তাহলে কেমন শোনাবে ব্যাপারটা?
সারাটা দিন এরকম তোলপাড় মন নিয়ে কেটে গেল বিদিশার। বিকেলে হঠাৎই একসময় ওর খেয়াল হল অফিস ছুটি হয়ে গেছে।
ছুটির পর ওরা বেশ কয়েকজন দল বেঁধে পার্ক স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত যায়। তারপর কেউ পাতাল রেল, কেউ বাস কিংবা মিনিবাস, আর কেউবা চার্টার্ড বাসের যাত্রী হয়ে যে যার দিকে চলে যায়।
বিদিশার সঙ্গে শেখর আর বোসদা প্রায় রোজই বেরোন। আজ ওঁরা দুজন ছাড়াও রয়েছে। জুনিয়ার ড্রাফটসম্যান অশোক চন্দ্র, রিসেপশনিস্ট দেবলীনা পাল, টাইপিস্ট অতনু সরখেল আর অ্যাকাউন্টস-এর সুতপা দাস।
সুতপাদি আর দেবলীনা ক্যামাক স্ট্রিটে কীসব কেনাকাটা করবে বলে চলে গেল। অতনু সরখেল রোজই ধর্মতলা পর্যন্ত হেঁটে যায়, তারপর সেখান থেকে হাওড়ার বাস ধরে। তাই ও রাস্তা পার হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দিকে চলে গেল।
শেখর থাকে টালিগঞ্জে। পাতাল রেলে যাতায়াত করে। বোসদা, থাকেন শোভাবাজারে। তিনিও পাতালযাত্রী। অশোক চন্দ্রর বাড়ি রাজাবাজারের কাছে। ও পার্ক স্ট্রিটের মোড় থেকে বাস ধরে।
বিদিশা ভাবছিল, কার সঙ্গে কত বেশিক্ষণ ও থাকতে পারে। রণজয় ওকে প্রায়ই ফলো করে, বিদিশা টের পায় না। এখনও কি ফলো করছে না কি? ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ কয়েকবার পিছনে তাকাল বিদিশা। কিন্তু অফিস ছুটির ভিড়, গাড়ির ব্যস্ততার মধ্যে ফরসা রোগা চেহারার কোনও মানুষকে খুঁজে পেল না।
শেখর বলল, কী ব্যাপার, ম্যাডামকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।
বিদিশা ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ, একটু ঝামেলা হয়েছে। পরে বলব।
বোসদা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, এ কী ধরনের পারশিয়ালিটি, মা জননী? সেনসাহেবকে বলবেন, আর আমি বাদ! আমি কি বুড়ো বলে এজ বারে আটকে গেলাম?
ওরা তিনজনই হেসে উঠল।
তখন অশোক বলল, ঠিক বলেছেন, বোসদা, আমি ছোট বলে এজ বারে আটকে গেছি।
এইরকম হাসি-ঠাট্টা করতে করতে ওরা পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে গেল।
তখন বিদিশা আচমকা বলে উঠল, বোসদা, আমি আপনার সঙ্গে মেট্রোতে যাব। শোভাবাজারে নেমে অটো ধরব।
শেখর একটু অবাক হয়ে গেল। কারণ বিদিশা সাধারণত বাসে যায়। কিন্তু কিছু বলল না।
বোসদা শেখরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললেন, সেন মহাশয়, আমাকে তুমি যতটা বুড়ো ভাব ঠিক ততটা বুড়ো আমি নই।
উত্তরে শেখর হাসল।
ওরা তিনজনে কথা বলতে বলতে মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। তখনও বিদিশা পিছন ফিরে শেষবারের মতো রণজয়কে খুঁজল।
.
সল্ট লেকের সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে যখন নামল, তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথায় দিল বিদিশা।
চৌরাস্তার আইল্যান্ডটা জালের বিশাল ঘেরাটোপে ঢাকা। একসময়ে এটা পাখির খাঁচা ছিল। এখন পাখি নেই–শুধু শূন্য খাঁচা পড়ে আছে।
খাঁচাটাকে বাঁ-দিকে রেখে রাস্তা পার হল বিদিশা। বাস স্টপে মাত্র তিন-চারজন মানুষ। প্রত্যেকেরই মাথায় ছাতা। রাস্তার আলোয় ছাতার ভিজে কাপড় চিকচিক করছে।
বিদিশা ঘড়ি দেখল। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। অফিস ছটায় ছুটি হলেও দু-একদিন এমনই
দেরি হয়ে যায়। উলটোডাঙার রেল ব্রিজের নীচটায় জ্যাম থাকে। আজও তাই।
সি.এ.পি. ক্যাম্প স্টপেজে বিদিশা একাই নেমেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা নিরাকার আতঙ্ক বাসা বেঁধে রয়েছে ওর মনে। তাই ভিজে রাস্তায় চটপট পা ফেলে হাঁটা দিল।
ওর বাড়ি সি.ই. ব্লকে। সুইমিং পুলের মোড় ছাড়িয়ে প্রায় আর এক চৌরাস্তার মোড়ের কাছাকাছি। সেখানেও একটা পাখির খাঁচা আছে।
সারাদিন মেঘলা আর বৃষ্টি। তাই রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। কখনও কখনও একটা-দুটো বাস ছুটে যাচ্ছে। সেই শব্দ মিলিয়ে গেলেই এলাকাটা চুপচাপ।
রাস্তায় কয়েকটা নেড়ি কুকুর বৃষ্টির মধ্যেই ঝগড়া করছে। পরদা ঢাকা একটা সাইকেল রিকশা সুইমিং পুলের দিকে চলে গেল। সামনে যতদূর নজর চলে, কোনও মানুষজন নেই। এমনকী সাইকেল রিকশা স্ট্যান্ডেও কোনও রিকশা দাঁড়িয়ে নেই।
বিদিশা পিছন ফিরে একবার দেখল। না, সন্দেহজনক কাউকে নজরে পড়ছে না। রণজয় কি তাহলে মিথ্যে ভয় দেখাল! কিন্তু ভয় দেখানোর প্রশ্ন উঠছে কেন? একজন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চায়। এর মধ্যে ভয়ের কী আছে! ভয়ের কিছু থাকত না, যদি না বিদিশা রণজয় সম্পর্কে কিছু কথা জেনে ফেলত। যে রাতে ও কথাগুলো জানতে পেরেছিল সেই রাতেই রণজয় ওর বাঁ গালে ভালোবাসায় স্থায়ী চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল।
সুইমিং পুলের মোড়টা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগোতেই বিদিশার নিজেকে আরও একা মনে হল। রাস্তার কোনও আলো জ্বলছে না। তবুও সামনের আইল্যান্ডের প্রকাণ্ড খাঁচাটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগোলেই ডান দিকের সরু গলিটা পেয়ে যাবে বিদিশা। তারপর এক মিনিটেই পৌঁছে যাবে বাড়ির দরজায়।
উলটোদিকের রাস্তায় সি. এফ. ব্লকের বাড়িগুলোর ধার ঘেঁষে একটা মারুতি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির ছাদে আলো পড়ে বৃষ্টির জল চিকচিক করছে। কিন্তু গাড়ির রং ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না।
রণজয়ের গাড়ি নেই। অন্তত বিদিশা যখন ওকে ছেড়ে চলে আসে, তখন ছিল না। বিদিশার বুক ঠেলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। ওই তো, কাঠগোলাপ গাছটা এসে গেছে। তার পাশ দিয়েই সরু গলিটা চলে গেছে। গলির শেষে পিচের রাস্তা। রাস্তার শেষে বিদিশাদের বাড়ি।
আজকের দিনটা কোনওরকমে তাহলে কাটল। ভাবল বিদিশা।
আর ঠিক তখনই মারুতি গাড়িটার তীব্র হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বলে উঠল। বিকট গর্জন করে পাগলের মতো বাঁক নিয়ে গাড়িটা ছুটে এল বিদিশার দিকে।
আপ আর ডাউন লেন–দু-রাস্তার মাঝে সরু একফালি ঘাসে ঢাকা জমি। জমিটা রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। আড়াআড়ি আসতে গিয়ে দ্রুতগতির গাড়িটা উঁচু জমিতে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠল। তার পরেই বিশ্রী গর্জন করে ঠিকরে এল বিদিশাকে লক্ষ করে।
বিদিশা চিৎকার করতে গিয়ে টের পেল ওর গলা দিয়ে কোনওরকমে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো ওকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হ্যালোজেন বাতির আলোয় বৃষ্টির ঝিরঝিরে ফোঁটাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ও একপাশে সরে যেতে গিয়ে হোর্চট খেল। টাল খেয়ে নিজেকে সামলে নিতে পারলেও ছাতাটা পড়ে গেল হাত থেকে।
গাড়িটা ওর ঠিক পাশ দিয়ে খ্যাপা জন্তুর মতো ছুটে গেল। তারপর বিশ্রী শব্দ তুলে ব্রেক কষে একটা ঝটকা দিয়ে থামল।
পরক্ষণেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ইউ টার্ন নিল গাড়িটা। বিদিশা তখন বৃষ্টিভেজা পিচের রাস্তা ধরে পাগলের মতো ছুটছে।
গাড়িটা এবারে ধেয়ে এল আরও জোরে। বিদিশার গায়ে মরণের বাতাস ছুঁইয়ে ওর ঠিক গাঁ ঘেঁষে ঠিকরে গেল সামনে। কিছুটা গিয়ে আচমকা ব্রেক কষল। তারপর গর্জন তুলে বাঁক নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বিদিশার মুখোমুখি। আবার পাগল করা গতিতে ছুটে এল ওর দিকে।
বেড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলা করে, বৃষ্টিভেজা কালো রাতে গাড়িটা বিদিশাকে নিয়ে ঠিক সেরকম খেলতে লাগল। ইঞ্জিনের গর্জন, হেডলাইটের তীব্র আলো, চাকার শব্দ মেয়েটাকে দিশেহারা করে দিচ্ছিল। এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করতে করতে ও ধাক্কা খেল কাঠগোলাপ গাছটার গুঁড়িতে। পলকের জন্য শরীরটা একটা ভয়ংকর ঝাঁকুনি খেল। তার পরই ও পড়ে গেল মাটিতে।
গাড়িটা ওকে লক্ষ করে ছুটে আসছিল। ওকে পড়ে যেতে দেখেই গাড়িটা থামল। হেডলাইটের উজ্জ্বল চোখ বিদিশার দিকে স্থির।
বিদিশা কেমন অসাড় হয়ে গেলেও চেতনা হারায়নি। ও তাকিয়ে ছিল মারুতি গাড়িটার দিকে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোয় স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু বৃষ্টির ফোঁটা ঝিরঝির করে পড়ছে।
গাড়ি থেকে কেউ নামল। কারণ দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ হল। তারপর হেডলাইটের আড়াল করে একটা রোগা শরীর অলস পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগল বিদিশার দিকে।
বিদিশা চিৎকার করতে চাইছিল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছিল না। ওর চোখ সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল এগিয়ে আসা কালো ছায়াটার দিকে।
এক সময় মানুষটার তীব্র ছায়া এসে পড়ল বিদিশার গায়ে। আর তখনই আলতো গলায় সে বলে উঠল, মানু, কেমন আছ?
বিদিশার শীত শীত করে উঠল। ওর শাড়ি বৃষ্টিতে ভেজা সপসপে। কাঁধের ব্যাগ কোথায় ছিটকে পড়েছে। গলার কাছে একটা পাথরের বল আটকে রয়েছে কিছুতেই ওকে চিৎকার করতে দিচ্ছে না। শুধু চাপা আঁক-আঁক শব্দ বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে। ওর চেতনার জগৎ ঘিরে রয়েছে চোখ ধাঁধানো হেডলাইটের আলো, একটা লিকলিকে কালো ছায়া, আর শ্বাস রোধ করা এক আতঙ্ক।
ওর ফরসা মুখের সৌন্দর্য কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। আতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়া মুখ দেখে ওকে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না। জল কাদা মাখা ওর অসহায় শরীরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। বিদিশার সেদিকে কোনও খেয়াল নেই।
অশরীরী ছায়াটা চেনা গলায় আবার কথা বলল, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, মানু। তোমাকে ছেড়ে আমি ভীষণ কষ্টে আছি। এতদিন একষ্ট টের পাইনি, কিন্তু এখন টের পাচ্ছি। তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। আমার ফাঁকা জায়গাটা ভরে দাও। নইলে আমি মরে যাব..বিশ্বাস করো। তুমি আমার বাড়িতে উঁহু, আমার বাড়িতে নয়, তোমার বাড়িতে ফিরে এসো, তোমাকে অনেক কথা বলব। আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারো না, মানু। মানুষের কি ভুল হয় না! অনুতাপে অনুতাপে আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখো–।
লোকটা শেষ দিকে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বিদিশার আরও কাছে এগিয়ে এল। যখনই সে বিদিশার ওপরে ঝুঁকে পড়তে গেল, তখনই যেন গলার স্বর খুঁজে পেল ও।
কান ফাটানো এক মর্মান্তিক আর্তনাদ করে উঠল বিদিশা। হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া কোণঠাসা পশু যেভাবে চিৎকার করে, অনেকটা সেইরকম। বৃষ্টি ভেজা রাতে সে-চিৎকারের প্রতিধ্বনিও যেন শুনতে পেল ও। আর একইসঙ্গে শুনতে পেল ছুটে-আসা কয়েকটা পায়ের শব্দ।
রাস্তার ধারের কয়েকটা বাড়ির দরজা-জানলা খুলতে শুরু করেছে। হেডলাইটের আলো পেরিয়ে চৌকো আলোর খোপগুলো আবছাভাবে দেখতে পেল বিদিশা। ওর গলার ভেতরটা জ্বালা করছিল। সেই অবস্থাতেও ও আরও দুবার চিৎকার করে উঠল।
বিদিশা দেখতে পেল, ছায়ামূর্তিটা কয়েক মুহূর্ত দোনামনা করে এদিক-ওদিক পা বাড়াল। তারপর এক ছুটে গাড়িতে গিয়ে উঠল। জোরালো শব্দে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির দরজা। তারপর তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মতো বেপরোয়া বাঁক নিয়ে ছিটকে গাড়িটা গেল দূরে। যাওয়ার সময় রাস্তার কাছ ঘেঁষে রাখা একটা ইটের পাঁজায় গাড়ির বাঁ দিকের হেডলাইটটা ধাক্কা খেল। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙল, আলো নিভে গেল। চাকায় কাঁচকাঁচ শব্দ তুলে আঁকাবাঁকা পথে ছুট লাগাল গাড়িটা। মিশে গেল রাতের আঁধারে।
বিদিশা বোধহয় কয়েকমিনিটের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ হঠাৎই ও দেখতে পেল, ও দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দু-পাশ থেকে ধরে রয়েছে দুজন পথচারী। একজন কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে ওর ছাতা আর ব্যাগ। আর একজন ওকে জিগ্যেস করছে, কী হয়েছে, দিদি?
লোকগুলোকে এক পলক দেখল বিদিশা। দুজনকে দেখে রাজমিস্ত্রি বা রিকশাওয়ালা বলে মনে হয়। তারাই আজ বিদিশাকে বাঁচিয়েছে।
বিদিশা থরথর করে কাঁপছিল। কোনওরকমে ও বলল, আমি বাড়ি যাব।
কোথায় বাড়ি বলুন, আমরা এগিয়ে দিয়ে আসছি– একজন বলল।
গাড়িটা কি আপনাকে ধাক্কা মেরে পালাল? আর একজন বলল।
বিদিশা মাথা নেড়ে জানাল, না। তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে বাড়ির দিকে এগোল। দুজন মানুষ ওর পাশে-পাশে পা ফেলে ওকে এগিয়ে দিয়ে গেল অরুণা-সুধাময় পর্যন্ত।
কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললেন অরুণা। বিদিশার মুখ-চোখ-পোশাক দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে রে?
বিদিশা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, আগে এক গ্লাস জল দাও।
অরুণা আর কোনও কথা না বলে ব্যস্ত পায়ে জল আনতে চলে গেলেন।
বিদিশা ক্লান্ত পায়ে ওর ঘরে এল। হাতব্যাগ আলনায় ঝুলিয়ে ছাতাটা খুলে মেলে দিল পাখার হাওয়ায়। ভিজে কাপড়ে একটু-একটু শীত করছিল। আর একইসঙ্গে বিদিশা বুঝতে পারছিল, ওকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটা রণজয়ের মাথায় যখন একবার ঢুকেছে, তখন সহজে ও ছাড়বে না। রণজয়কে বিদিশা যেভাবে চেনে, আর কেউ সেভাবে চেনে না। ওর অনেক ব্যাপার কাউকে খুলে বলেনি বিদিশা–বলতে পারেনি।
মা জল নিয়ে এলেন।
এক ঢোঁকে গ্লাসটা খালি করে দিল ও। তারপর একটা বড় শ্বাস ছাড়ল।
অরুণা আবার জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে বললি না তো!
রণজয়ের ব্যাপার। ও আবার আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছে।
অরুণার ভুরু কুঁচকে গেল। কিন্তু বিদিশা আর কোনও কথা না বলে শুকনো জামাকাপড় নিয়ে চলে গেল বাথরুমের দিকে। অরুণা জানেন, নিজে থেকে না বললে কোনও কথা বের করা যাবে না এই মেয়ের মুখ থেকে।
বারান্দার লাগোয়া ঘরে টিভি চলছে। বাবা টিভি দেখছেন। গাছপালা, টিভি আর খবরের কাগজ–এই নিয়ে বেশ আছেন। তবে ছোটবেলা থেকেই বিদিশা আর বাপ্পাকে শিখিয়েছেন; যদি বাঁচতেই হয়, মাথা উঁচু করে বাঁচবে।
বাথরুমে ঢোকার সময় বিদিশা বাপ্পার গলা শুনতে পেল। ওর ছোট্ট ঘরে মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছে। পড়া শেষ করেই ও ছুটে আসবে বিদিশার কাছে। ক্যাডবেরির খোঁজ করবে। আজ নানান দুশ্চিন্তায় ওর ক্যাডবেরির ব্যাপারটা ভুলেই গেছে বিদিশা।
মা-বাবা আর ছোট ভাইকে নিয়ে কী সুন্দরভাবেই না জীবন কাটাচ্ছিল বিদিশা! কোথা থেকে এক দুঃস্বপ্নের মতো এসে হাজির হল রণজয়। মাসতিনেক আগেও লিগাল সেপারেশন আর ডিভোর্সের ব্যাপারে দিব্যি রাজি ছিল। এখন হঠাৎ মাথা বিগড়ে গেছে।
আর কেউ না জানুক, অন্তত বিদিশা তো জানে, হঠাৎ হঠাৎ মাথা বিগড়ে যাওয়াটাই রণজয়ের অসুখ। তার ওপরে রয়েছে ওর অস্বাভাবিক বড় মাপের অপ্রতিসম করোটির ব্যাপারটা। ওর মাথার খুলিকে নাক বরাবর লম্বালম্বি ভাগ করলে দুটো ভাগ মোটেই সমান পাওয়া যায় না। বাঁ-দিকের ভাগটা ডান দিকের তুলনায় অনেক বড়। ডাক্তারি মতে এটা খুব বিপজ্জনক হতে পারে।
বাথরুমে গা ধুয়ে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে রণজয়ের কথা ভাবছিল বিদিশা। ও মিথ্যে বলেনি। ও নিয়মিত অনুসরণ করছে বিদিশাকে–সে অফিস-পাড়াতেই হোক বা সল্ট লেকেই হোক। ফোন করে ফলো করে রণজয় তো ওকে পাগল করে দেবে।
আচ্ছা, শেখরকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? প্রশ্নটা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করল বিদিশা। তারপর ঠিক করল, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শেখরকে ফোন করবে। রাতে ও পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারতে বেরোয়। শেখরই বলেছে। বাড়ি ফেরে সাড়ে দশটা নাগাদ। তারপর নতুন কোনও পেপারব্যাক নিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। অবশেষে বই পড়তে-পড়তে ঘুম।
বেশ আছে মানুষটা! ওকে হিংসে করতে ইচ্ছে হল বিদিশার। কী চমৎকার দুশ্চিন্তহীন সুখী জীবন! রণজয়কে নিয়ে একইরকমই একটা জীবন চেয়েছিল বিদিশা। অথচ সব কীরকম গোলমাল হয়ে গেল।
সেই ভয়ংকর রাতের পর থেকে রণজয়ের অস্বাভাবিক এলোমেলো আচরণ আরও বেশি করে নজরে পড়েছিল। ও খুব সাবধানে কথা বলত রণজয়ের সঙ্গে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও রেহাই পায়নি। রণজয়ের মা ওকে রেহাই পেতে দেননি।
বিয়ের পর সেই মেঘ-বৃষ্টির রাতে প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল বিদিশা। সারাটা রাত ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু নিজের অদৃষ্ট ছাড়া আর কাকে ও দায়ী করবে? ও-ই তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রণজয়কে।
পরদিন রণজয় অফিসে বেরিয়ে গেলে ও দুপুরের দিকে মাকে ফোন করেছিল।
মা, মানু বলছি।
হাঁ, বল, কী খবর? অরুণা সহজ গলায় কথা বলেছেন।
আমি খুব..খুব..ঝামেলায়… চোখে জল এসে গেছে বিদিশার। গলা ধরে গিয়ে কথা আটকে গেছে মাঝপথে।
কী হয়েছে, মানু? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন অরুণা ও কাঁদছিস কেন? রণজয় কিছু বলেছে?
ন-না। একটু চুপ করে থেকে বিদিশা বলেছে, আমি তোমাদের কাছে গিয়ে কদিন থাকব, মা–
মন খারাপ লাগলে তুই আজই চলে আয়। তুই এলে বাপ্পাও খুশি হবে, আমাদেরও ভালো লাগবে।
বিদিশা ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে-মনে ঠিক করেছিল। সেদিনই চলে যাবে সল্ট লেকের বাড়িতে।
রণজয় অফিস থেকে সাড়ে ছটা নাগাদ ফিরে এল। হাত-মুখ ধুয়ে ওর কাছে এসে দু গাল চেপে ধরল দু-হাতে। কয়েকটা আদরের চুমু খেয়ে বলল, চলো, তোমাকে সল্ট লেকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তবে চারদিনের বেশি থেকো না। আমি এখানে বের হয়ে যাব।
বিদিশা হতবাক হয়ে গেল। রণজয় কি মন পড়ে নিতে জানে? ও কী করে জানল যে, বিদিশা সল্ট লেকে যাবে বলে মন ঠিক করেছে! কিন্তু গতকাল রাতের কথা ভেবে কোনও প্রশ্ন করল না বিদিশা। কিন্তু মনের ভেতরে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল।
বেশ মনে পড়ে, ওকে ভালোবেসে অত্যন্ত যত্ন করে সল্ট লেকে পৌঁছে দিয়েছিল রণজয়।
বাপ্পার জন্য একটা ক্যাডবেরি চকোলেট কিনে নিয়ে গিয়েছিল। হেসে-হেসে কথা বলেছিল মা-বাবার সঙ্গে।
বিদিশা অবাক হয়ে দেখেছিল চেনা রণজয়কে। তাই শেষ পর্যন্ত মাকে কোনও কথা বলতে পারেনি ও। ভেবেছে, গতকাল রাতের ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।
সল্ট লেকের রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে রণজয় ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে।
তারপর বেশ কয়েকটা দিন স্বাভাবিকভাবে কেটে গেছে। অচেনা মানুষটা মাথা চাড়া দেয়নি চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক হয়ে লক্ষ করত বিদিশা। সারাদিন অফিসে কাটালেও রণজয় ওর অনেক কথা টের পেয়ে যেত।
অনেকদিন ধরেই একটা সন্দেহের কাটা বিঁধছিল বিদিশার মনে। সন্দেহটা ঠিক কি না সেটা যাচাই করতে একদিন ও মাকে ফোন করল। তারপর কথায় কথায় বাপ্পার লেখাপড়ার কথা জিগ্যেস করল। বিদিশা জানে বাপ্পার পড়াশোনার কথা জিগ্যেস করলে মা সাতকাহন জবাব দেয়। তাই মাকে প্রশ্নটা করেই ও রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছে টেবিলে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে নেমে এসেছে একতলায়।
রণজয়ের মায়ের ঘরে সন্তর্পণে উঁকি মেরে বিদিশা দেখল, ও যা ভেবেছে তাই।
এ বাড়িতে টেলিফোনের প্যারালাল লাইন আছে। একটা দোতলায় বিদিশাদের শোয়ার ঘরে, আর একটা রণজয়ের মা তরুবালার ঘরে।
সেই বিধবা ভদ্রমহিলা এখন টেলিফোনের রিসিভার কানে চেপে ধরে একমনে আড়ি পেতেছেন। প্রয়োজন মনে করলে তিনি পরে ফোন করবেন ছেলের অফিসে, গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো ঢেলে দেবেন ওর কানে।
প্যারালাল লাইনে খুব সহজেই আড়ি পাতা যায়। একটা টেলিফোনে কেউ ফোন করলে অন্য টেলিফোনটায় টিকটিক শব্দ হয়।
বিদিশার সামান্য নড়াচাড়া তরুবালা বোধহয় টের পেয়েছিলেন। কারণ চকিতে চোখ ফেরালেন দরজার দিকে। রিসিভার তখনও কানে ধরা।
না, বিদিশাকে দেখে রণজয়ের মা বিশেষ বিচলিত হননি। সবসময় হুকুম করতে অভ্যস্ত এই মহিলা সহজে হার মানেন না। বিয়ের পরেও রণজয়কে ছোট ছেলের মতো নির্দেশ দিয়ে থাকেন। বিদিশার সামনেও এই ধরনের হুকুম করতে তার বাধে না।
রণজয় এমনিতে যতই দাপট দেখাক না কেন, মা তরুবালার কাছে সে বাধ্য শিশু। তরুবালার শরীরে শক্ত বাঁধুনি, মনেও তাই। চোখের দৃষ্টি তীব্র–যেন গভীরতা মাপার যন্ত্র। যে সব শাড়ি জামাকাপড় পরেন তাতে সাদার ভাগ কম। তবে সিঁথি শূন্য।
কিছু বলবে, বিদিশা? অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় জিগ্যেস করলেন তরুবালা। প্যারালাল টেলিফোন লাইনে অকারণে রিসিভার কেন চেপে ধরে আছেন তার কৈফিয়ত ছেলের বউকে দেওয়ার কোনও চিহ্ন নেই।
বিদিশা হেরে গেল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত না, কিছু না বলে ফিরে এসেছিল দরজা থেকে। চলে আসার আগে তরুবালার কৌতুকের স্মিত হাসি নজরে পড়েছিল ওর।
দোতলায় এসে বিদিশা যখন আবার ফোনে কথা বলল তখন অরুণা মেয়েকে নানান প্রশ্ন আর বকাবকি শুরু করলেন। মেয়ে কোনও জবাব দিল না। ওর ক্রমশ নিজেকে বন্দি বলে মনে হচ্ছিল। টেলিফোন রেখে দিয়ে বিছানায় খোলা জানলার কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছিল ও। তখন পাশের বাড়ির প্লাস্টার চটে যাওয়া ফাটল-ধরা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা কচি অশ্বত্থ গাছ ওকে দেখছিল। দুপুরের নির্জন পরিবেশ ট্রামের চাকার ঘরঘর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল বিদিশা। লোহার-লোহার ঘর্ষণ। সেই আঘাতের যন্ত্রণা ও টের পাচ্ছিল। ট্রামটা যেন ওর বুকের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল।
বাথরুমের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল। বিদিশা চমকে উঠে প্রায় ভয়ের গলায় বলে উঠল, কে?
তোর জন্যে চা করেছি–জুড়িয়ে যাচ্ছে। মায়ের গলা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল বিদিশা। রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে চায়ের কাপ নিল। তারপর ডাইনিং হলের টেলিফোনটার কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শেখর সেনের নম্বর ডায়াল করল ও।
বিদিশাদের বাড়িতেও ফোনের প্যারালাল লাইন। একটা ডাইনিং হলে, আর একটা মা-বাবার শোয়ার ঘরে। কিন্তু টেলিফোনে আড়িপাতার অভ্যেস নিয়ে ওরা মানুষ হয়নি।
হ্যালো, শেখর সেন আছেন? ও-প্রান্তের মহিলা কণ্ঠের হ্যালো শোনামাত্রই প্রশ্নটা করল বিদিশা। গলা শুনে ওর মনে হল বোধহয় শেখরের বউদি ফোন ধরেছেন।
ধরুন। দিচ্ছি।
একটু পরেই চেনা গলার হ্যালো শুনতে পেল বিদিশা।
আমি বিদিশা বলছি।
আরে বলুন, আপনার জন্য কী শিভারি দেখাতে পারি। হাসিখুশি গলায় বলল শেখর।
না, না, বড়সড় কোনও শিভারি দেখাতে হবে না। শুধু কাল অফিসে আধঘণ্টা আগে আসতে হবে–পারবেন?
না পারার কী আছে! কিন্তু কেসটা কী বলুন, তো, ম্যাডাম?
কাল বলব। মন-টন বেশ শক্ত করে আসবেন। নিজের অজান্তেই হাসি-ঠাট্টার মেজাজটা ফিরে পাচ্ছিল বিদিশা। মারুতি গাড়ির ঘটনাটা যেন মুছে গেছে ওর মন থেকে।
কেন, মন শক্ত করব কেন? আমার আপনার ক্লোজ ইয়ের মাঝখানে কোনও উটকো থার্ড পার্টি এসে গেছে নাকি? হেসে জিগ্যেস করল শেখর।
বিদিশাও পালটা ঠাট্টা করে জবাব দিল, সে তো বরাবরই আছে। আমাদের বোসদা। তা ছাড়া ফোর্থ পার্টিকেও তো আপনি চেনেন–মহান মহামান্য প্রশান্তলাল চক্রবর্তী।
ও-প্রান্তে জোর গলায় হেসে উঠল শেখর ও এতগুলো পার্টিকে আমি কেমন করে ঠেকাই বলুন তো, ম্যাডাম?
না, শেখর, সিরিয়াসলি বলছি। কাল আপনাকে অনেকগুলো জরুরি কথা বলব। একটু ইতস্তত করে বিদিশা আরও বলল, কিন্তু ভয় হচ্ছে, আপনি আমার জন্যে না বিপদে জড়িয়ে পড়েন…।
বিদিশার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বলে উঠল, শেখর, বিপদ! মানে থ্রিল? আপনি তো জানেন, থ্রিলিং ব্যাপার আমার দারুণ লাগে। ঠিক ট্র্যাকে দৌড়োনোর মতো। কিন্তু এমনই কপাল, লাইফটা কেমন একঘেয়ে হয়ে গেছে। যাক, তবু আপনি একটু খ্রিলের ব্যবস্থা করেছেন। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
কাল তা হলে আধঘণ্টা আগে আসছেন তো?
অতি অবশ্যই।
টেলিফোন সেরে নিয়ে চা শেষ করল বিদিশা। তারপর ক্লান্তভাবে শোয়ার ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। যদি ঘুম এসে যায় আসুক। মা ডেকে খাইয়ে দেবেন।
চোখে ঘুম নেমে আসার সময় বিদিশা রণজয়ের মারুতি গাড়িটা দেখতে পেল। তীব্র হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বেলে খ্যাপা চিতাবাঘের মতো ভয়ংকর গতিতে ওকে লক্ষ করে ছুটে আসছে।
.
মঙ্গলবার গভীর রাতের দিকে মেঘের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বিদিশার। তারপর আর ভালো করে ঘুম আসেনি। তখন থেকেই অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই বৃষ্টি থেমেছে ভোর ছটায়। শ্রাবণে-শ্রাবণে ভেজা ভিজে কাকের ডাকে বিদিশা বুঝতে পেরেছে গাঢ় মেঘের আড়ালে ভোর হয়েছে।
বিছানা ছেড়ে ওঠা থেকে অফিসে বেরোনোর আগে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থেকেছে বিদিশা। এই বুঝি টেলিফোনটা বেজে উঠল। কাল রাতের ভয়ানক পাগলটা এই বুঝি শুরু করল নতুন পাগলামি!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও ফোন আসেনি।
অফিসে যাওয়ার সময় দিব্যি সহজভাবে অকুস্থলটা পেরিয়ে গেল বিদিশা। গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে হচ্ছিল যেন নিছকই কোনও স্বপ্ন। শুধু কাঠগোলাপ গাছটা থেকে খানিকটা দূরে ইটের পাঁজার সামনে ভাঙা কাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে রয়েছে। সেই চকচকে কাচের টুকরোগুলো বিদিশার স্বপ্নকে সত্যি করে দিচ্ছিল।
ঠিক আটাশ মিনিট আগে অফিসে ঢুকল বিদিশা। দেখল, শেখর নিজের চেয়ার-টেবিলে হাজির।
ওকে দেখে হাসল শেখর। বিদিশাও হাসতে পারল। সত্যি, অফিসটা ওকে বাঁচিয়ে রাখার কোরামিন জোগায়।
বনজারা সাদা ইউনিফর্ম পরে অফিস ফ্লোরে পায়চারি করছিল। বিদিশাকে দেখে সুপ্রভাত জানাল। ওর ডিউটি অফিস-টাইমের একঘণ্টা আগে থেকে। ও অফিস ঝাড়পোঁছের তদারকি করে। দরজা-জানলা ঠিকঠাকমতো খুলে দেয়। ফাইলপত্র আলমারি থেকে বের করে টেবিলে-টেবিলে সাজিয়ে দেয়।
শেখরকে ডেকে নিয়ে নিজের সিটের কাছে চলে গেল বিদিশা। সেখানে গুছিয়ে বসল দুজনে। সামনের টেবিলে টাইপ মেশিন, পাশে শর্টহ্যান্ডের খাতা আর পেনসিল।
বড় কাচের জানলা দিয়ে মেঘলা আলো এসে পড়েছে বিদিশার মুখে। ওকে বড় বিষণ্ণ অথচ সুন্দর লাগছিল।
শেখর, আপনারা কেউই জানেন না…আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বিদিশা এমনভাবে কথাটা বলল, যেন খবরের কাগজের খবর পড়ে শোনাচ্ছে।
শেখর বিদিশার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর কথাটা শোনার পর ভোলা জানলার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ ধরে মেঘলা আকাশ দেখল। তারপর মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে টেবিলের ল্যামিনেটেড প্লাস্টিকের ডিজাইন দেখল কিছুক্ষণ। এক সময় মুখ তুলে তাকাল বিদিশার দিকেঃ তারপর? বলুন– আমি শুনছি।
বিদিশা বলতে শুরু করলসংক্ষেপে যেটুকু বলা যায় শেখরকে।
রণজয়কে ছেড়ে আসার পর তিনটে মাস এক অদ্ভূত যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছিল বিদিশার। ওর মনের ভেতরে চেনা আর অচেনা রণজয়কে নিয়ে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছিল। হাজারবার জিগ্যেস করা সত্ত্বেও মাকে ও সব কথা খুলে বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, ওর সঙ্গে আর থাকা যায় না, মা, কিছুতেই থাকা যায় না।
সেই ভয়ংকর রাতটার কথা মাকে বলেনি বিদিশা। কিন্তু মা যখন গালের কাটা দাগটা দেখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, এ কী! কী করে কাটল?
বিদিশা কান্না চেপে বলেছিল, রণজয়…।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণা আর কোনও কথা জিগ্যেস করতে পারেননি।
ওর জীবনে চরম ঘটনাটা ঘটেছিল নভেম্বরের শেষ দিকে। শীত তখন চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে।
রণজয় ফোন করেছিল, ওর হেড অফিসে প্রোডাকশন মিটিং না কী যেন আছে। তাই ফিরতে রাত হবে। বিদিশা ছোট্ট করে হুঁ বলেছিল।
তারপর যথারীতি সংসারের কাজ নিয়ে ডুবে গিয়েছিল। সন্ধের মুখে একবার মাকে ফোন করেছিল। বুঝতে পেরেছিল, তরুবালা আড়ি পেতেছিল। তবুও সাধারণ কয়েকটা কথাবার্তা বলেছিল মায়ের সঙ্গে।
রান্নাবান্না ইত্যাদির কাজ সেরে টিভি দেখতে বসেছিল বিদিশা। শুনতে পাচ্ছিল, নীচে তরুবালা টেপ রেকর্ডারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট শুনছেন। রণজয়ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালোবাসে।
তরুবালা এমব্রয়ডারি কাজ খুব ভালো পারেন। তার হাতের কয়েকটা কাজ বাঁধানো রয়েছে একতলা-দোতলার ঘরের দেওয়ালে। রণজয়ও অল্পস্বল্প এমব্রয়ডারির কাজ জানে। মায়ের হাতের কাজে প্রশংসায় ও সবসময় পঞ্চমুখ।
বিদিশা বুঝেছে, রণজয়ের ভেতরের অনেকটাই দখল করে রয়েছেন তরুবালা।
প্রথম-প্রথম বিদিশা নিজের মতামত স্পষ্ট করে জানাত। দরকার হলে তর্কও জুড়ে দিতে স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু ওকে থাপ্পর মারার সেই অস্বাভাবিক ঘটনার পর ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে একমত হওয়ার জন্য সবসময় প্রাণপণ চেষ্টা করত।
টিভি প্রোগ্রামটা ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল বিদিশার। তাই টিভি অফ করে ও চলে এসেছিল দোতলার ছোট্ট ঝুলবারান্দায়। নীচের গলিতে সন্ধেবেলার ব্যস্ততা। গলির মোড়ে তেলেভাজার দোকানে ভিড়। বড় রাস্তা দিয়ে হুসহুস করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল বিদিশা। ও ঘরে ফিরে এল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎই সাজতে শুরু করল।
তখনই ও লক্ষ করল, ড্রেসিং টেবিলে ধুলোর আস্তরণ।
সাজগোজ সংক্ষেপ করে ড্রেসিং টেবিলের ধুলো ঝাড়তে লেগে গেল বিদিশা। তারপরই ঘরটার অগোছালো অবস্থা চোখে পড়ল ওর। কোণের টেবিলে কয়েকটা ম্যাগাজিন ছড়ানো তার পাশে রণজয়ের এলোমেলো বইপত্র আর ফাইল। বিছানার চাদর অনেকদিন পালটানো হয়নি। পিলো কভারগুলোও বদলানো দরকার। আলনার জামাকাপড়গুলোও কীরকম বিচ্ছিরিভাবে অগোছালো হয়ে রয়েছে।
সুতরাং বিদিশা কাজে নেমে পড়ল।
সব কাজ শেষ করে ও যখন রণজয়ের ফাইলপত্রগুলো সাজিয়ে নিয়ে দেওয়ালের তাকে রাখতে যাচ্ছে তখনই ছোট মাপের মেডিকেল ফাইলটা নজরে পড়ল ওর।
বিদিশা প্রথম ভেবেছিল, ওটা বোধহয় রণজয়ের বাবার মেডিকেল ফাইল। এ-ফাইল এখানে কেন? তিনি মারা গেছেন প্রায় চার বছর। গ্যাসট্রিক, ডায়াবিটিস ইত্যাদি নানান রোগে ভুগতেন ভদ্রলোক। তরুবালার ঘরের দেওয়ালে তার ফটো আছে।
কিন্তু ফাইলের মলাট ওলটাতেই অবাক হয়ে গেল বিদিশা। প্রথম পৃষ্ঠাতেই পাওয়া গেল রোগীর নামঃ রণজয় সরকার।
কী অসুখ হয়েছে রণজয়ের?
ফাইলটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল বিদিশা। মেডিক্যাল রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের মতো একের পর এক ওলটাতে লাগল। বেশিরভাগটাই বুঝতে পারল না। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার জেনে ওর বেশ খটকা লাগল।
রণজয়ের মাথার খুলি সুষম নয়। লম্বালম্বি দুভাগ করলে বাঁ-দিকের অংশটা বেশ বড়। ওর মধ্যে আবেগের জটিলতা রয়েছে। ডাক্তারি ভাষায় লেখা যেসব টুকরো-টুকরো শব্দ বিদিশার নজর কাড়ল সেগুলো হল? মনস্ট্রাস প্যাথোলজিক্যাল ইনটেনসিফিকেশন অফ অ্যাবারেটেড সেনসুয়ালিটি, সাইকোপ্যাথিক স্টেট একসি, সাইকোনিউরোটিক টেন্ডেনসিস, অ্যালার্মিং ডিজঅর্ডার ইন দ্য ফ্রন্ট্রাল লোব অফ দ্য ব্রেইন।
এ কোন অসুখে ভুগছে রণজয়!
বিদিশা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। রণজয়ের মাথার ঠিক নেই, মনেরও ঠিক নেই!
এতদিন যেসব অদ্ভুত আচরণ বিদিশা লক্ষ করেছে, তার আসল কারণ তা হলে এই! এই কারণেই চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে হঠাৎ-হঠাৎ অসুস্থ মনের অচেনা রণজয় বেরিয়ে আসে।
ভাবতে-ভাবতে সময় বয়ে যাচ্ছিল। কোনওদিকেই খেয়াল ছিল না বিদিশার। ও রণজয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন থেকে আজ পর্যন্ত সাতটা বছরের কথা ভাবছিল। ওদের গল্পটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, আর এখন কীরকম অস্বাভাবিক বাঁক নিয়ে জটিল পথে এগিয়ে চলেছে।
নীচের সদরে কলিংবেলের শব্দ নিশ্চয়ই হয়ে থাকবে। বিদিশা সে শব্দ শুনতে পায়নি। তরুবালা নিশ্চয়ই দরজা খুলে দিয়েছেন। তাই চেনা পায়ের শব্দ উঠে এসেছে ওপরে। কিন্তু অন্যমনস্ক বিদিশা সেই শব্দটাও শুনতে পায়নি।
ব্যাপারটা ও টের পেল যখন রণজয় একেবারে ঘরে এসে ঢুকল।
এ কী! আমার কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছ কেন? বিরক্ত রণজয়ের ভুরু কুঁচকে গেছে। বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে মুখে। টিউব লাইটের আলোয় মুখটা কেমন ফ্যাকাসে রক্তহীন দেখাচ্ছে।
হাতের ব্রিফকেস নামিয়ে রাখল মেঝেতে। দুটো লম্বা পা ফেলে চলে এল বিদিশার কাছে। বাঁ-হাতে নিষ্ঠুরভাবে চেপে ধরল ওর চুলের গোছা। এক হ্যাঁচকায় ওকে চিতপাত করে দিল বিছানায়।
ততক্ষণে অচেনা রণজয় বেরিয়ে এসেছে চেনা রণজয়ের মুখোশের আড়াল থেকে। ওর দু-চোখ পাগলের চোখ হয়ে গেছে। সেই চোখজোড়া এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে মরিয়া হয়ে কী যেন খুঁজছে।
বিদিশার হাত থেকে খসে পড়ে গেছে গোপন মেডিকেল ফাইল। একটা আধো-আধো চিৎকার বোধহয় বেরিয়ে এসে থাকবে ওর ঠোঁট চিরে। এখন ওর চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
রণজয় দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি।
বিদিশার মাথা তখনও কাজ করছিল। ও বুঝল, তরুবালার কাছে অচেনা রণজয় অচেনা নয়।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কোনওদিনও তোমার…।
ডান হাতের এক ঘুসি এসে পড়ল বিদিশার মুখের ওপরে।
ঠোঁট কেটে গিয়ে জিভে নোনতা স্বাদ পেল ও। রণজয়ের বাঁ হাত তখনও ওর চুলের মুঠি ধরে রেখেছে। আর অদ্ভুত এক জান্তব শক্তিতে বিদিশাকে কাবু করে রেখেছে।
রণজয়ের পাগল চোখ অবশেষে খুঁজে পেল দরকারি জিনিসটা। বিদিশা লক্ষ করল, রণজয় অবশেষে তাকিয়েছে রান্নাঘরের দরজার দিকে।
চোখের পলকে এক নৃশংস হঁচকা টানে বিদিশাকে মেঝেতে পেড়ে ফেলল রণজয়। তারপর পাগলের মতো ছুটে গেল রান্নাঘরে। দু-এক সেকেন্ড পরেই ও যখন ফিরে এল, তখন ওর হাতে ধরা রয়েছে দশ ইঞ্চি লম্বা ফলার একটা চকচকে কিচেন নাইফ। তার ধারালো দিকটা করাতের মতো দাঁত কাটা।
ঝুঁকে পড়ে আবার বিদিশার চুলের মুঠি চেপে ধরল রণজয়। এক হ্যাঁচকা টানে ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে ছুরি চেপে ধরল ওর বাঁ গালে কানের খুব কাছে।
ফাকিং বিচ! দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল বিদিশার উন্মাদ স্বামী। তারপরই অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিল।
ওই নোংরা কথাগুলো বলতে-বলতে ছুরিতে টান মারল ওর ডান হাত।
বিদিশা এবার চিৎকার করে উঠতে পারল।
চিৎকারটা যখন মাঝপথে তখনই ওর টুটি চেপে ধরল রণজয়ের জঙ্গি ডান হাত।
বিদিশার দম আটকে গেল। চোখ বড়-বড় করে ও নিপ্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রণজয়ের বিকৃত মুখের দিকে। ওর চোখে পড়ল করাতের দাঁতওয়ালা ছুরির ফলাটা। চকচকে ফলায় সামান্য রক্ত লেগে আছে।
বিদিশা এইবার ছটফট করতে শুরু করল। কে-ই বা সহজে মরতে চায়। রণজয়ের মুখ ওর মুখের ওপরে অনেকটা নেমে এসেছে। লম্বা-লম্বা চুল ঝরে পড়েছে রণজয়ের কপালে চোখে। ওর দাঁত বেরিয়ে আছে হিংস্রভাবে। ঠোঁটে লালা। চেনা রণজয়ের মুখোশটা একেবারে সরে গেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট-এর মন্তব্য মনে পড়ল বিদিশার : মনস্ট্রাস প্যাথোলজিক্যাল ইনটেনসিফিকেশন অফ অ্যাবারেটেড সেনসুয়ালিটি। এবং ওই মন্তব্যের অর্থ বোধহয় এই মুহূর্তে পুরোপুরি বুঝতে পারল ও।
আচমকা ওকে ছেড়ে দিল রণজয়। ছুরিটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগল। তারপর মেডিকেল ফাইলটা তুলে নিল বিছানার কাছ থেকে। ওটা নিজের ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রেখে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ও। চোখ বুজে নিজের কপালে মাথায় হাত বোলাতে লাগল।
বিদিশা কাশতে কাশতে উঠে বসছে বিছানার। গলায় ভীষণ ব্যথা। বাঁ-গালে অসম্ভব জ্বালা করছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গলায়, কাঁধে, বুকে। তীব্র কান্না উঠে আসতে চাইছিল গলা দিয়ে, কিন্তু বিদিশা কাঁদতে পারছিল না। ওর চোখের সামনে একটা অশরীরী ছায়া উল্লাসে তাণ্ডব নৃত্য করছিল, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল বারবার।
কিছুক্ষণ পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রণজয়। বিদিশার কাছে এসে পিঠে হাত রাখল। ক্লান্ত স্বরে বলল, মানু, আমি এক্সট্রিমলি সরি। ব্যাপারটা ভুলে যাও– একটু চুপ করে থেকে তারপর ও আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে খাওয়াও তো।
বিদিশার অবাক হওয়ার ক্ষমতা বোধহয় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই ও অবাক হল না। স্বামীর হুকুম তামিল করতে চলল। তারই ফাঁকে ও আঁচল চেপে ধরেছিল বাঁ-গালে, কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। তখন রান্নাঘরে গিয়ে একমুঠো চিনি চেপে ধরেছে ক্ষতস্থানে। মাথা ঝিমঝিম করলেও বিদিশা কাঠের তাক ধরে নিজেকে সামলে রেখেছিল–টলে পড়ে যায়নি।
তারপর দুটো ঘণ্টা যে কী ভয়ংকর জ্বালা-যন্ত্রণায় কেটেছে তা বিদিশা আজও ভুলতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে রাতের আঁধারে ও ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তখনই কোনও একটা দুর্বল মুহূর্তে ও ঠিক করেছিল, আর নয়। এই বন্দি জীবন আর নয়। সব জ্বালা-যন্ত্রণায় দাঁড়ি টানতে হবে।
অন্ধকারে বিছানা থেকে নেমে এসেছিল বিদিশা। আন্দাজে ভর করে টলতে টলতে চলে গিয়েছিল ওষুধের তাকের কাছে। হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজে পেয়েছিল নির্দিষ্ট ওষুধের পাতাগুলো। টেনটেক্স ফোর্ট। চ্যাপটা গোল রুপোলি রঙের ট্যাবলেট। রোজ রাতে রণজয় একটা করে এই ট্যাবলেট খায়। এই ট্যাবলেট খেলে যৌন উত্তেজনা বাড়ে। রণজয়ের এই ট্যাবলেট কেন দরকার হয় তা বিদিশা জানে না। কিন্তু বিয়ের পরে রণজয়ই ওকে খুলে বলেছিল এই রুপোলি ট্যাবলেটের রহস্য। দশটা ট্যাবলেটের একটা পাতার দাম তেরো টাকা মতো।
যে কটা ট্যাবলেট পেল সবকটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল বিদিশা। আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে মুঠোয় ধরা ট্যাবলেটগুলো অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিল ও। পাতা ছিঁড়ে ট্যাবলেটগুলো যখন ও হাতের চেটোয় ঢালল তখন মনে হচ্ছিল ও বিশ-পঁচিশটা ক্যাডবেরি জেম্স খাচ্ছে। শুধু এগুলোর রং লাল-নীল নয়, রুপোলি।
বাথরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে ভেউভেউ করে কেঁদেছিল বিদিশা। মা, বাবা, বাপ্পার কথা মনে পড়ছিল। ওদের আর দেখতে পাবে না বিদিশা। কিন্তু একটু পরেই যে-ঘটনা ঘটবে তার জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাকে দায়ী করবে ও। রণজয়ের সঙ্গে এই জীবন ও নিজেই বেছে নিয়েছিল। আজ এই মৃত্যু ও নিজেই বেছে নিচ্ছে।
কল থেকে মগে করে জল নিয়ে মুখে ঢালল ও। তারপর একে-একে সবকটা ট্যাবলেট ঢেলে দিল মুখে। বারবার জল খেল।
ট্যাবলেটগুলো খাওয়া শেষ করে বাথরুমের ভেজা মেঝেতে বসে পড়ল বিদিশা। পেটটা ভার লাগছে। গাল জ্বালা করছে। মাথা টং হয়ে আছে।
হঠাৎই বিদিশা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল বাচ্চা মেয়ের মতো। তারই মধ্যে ও টের পাচ্ছিল, বুকের ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে। আর মাথার ঝিমঝিম ভাবটা যেন বাড়ছে।
খুব আবছাভাবে বিদিশা টের পেরেছিল বাথরুমের বন্ধ দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। সত্যি, না ওর মনের ভুল? এর পর আর কিছুই ওর মনে নেই।
.
দেড়দিন পর বিদিশার জ্ঞান ফিয়েছিল সুকিয়া স্ট্রিটের সিটি নার্সিং হোম-এ। চোখ খুলতেই ও মা-বাবা আর রণজয়কে দেখতে পেয়েছিল। মুহূর্তে বিদিশার চোখে জল এসে গিয়েছিল। অশরীরী ছায়াটা তার নাচ থামিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।
নার্সিং হোমের চিকিৎসা আর যত্নে আটদিনেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল বিদিশা। মা-বাবাকে বলে ও চলে এসেছিল সল্ট লেকে। অরুণা-সুধাময় তখনকার মতো রণজয়কে বুঝিয়েছিলেন, মানসিক আঘাতটা সামলে উঠলেই ও মানিকতলায় চলে যাবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আয় হয়নি। বিদিশা প্রচণ্ড একরোখা জেদ ধরেছিল, সল্ট লেক ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। অরুণার সঙ্গে এ নিয়ে বেশ মন কষাকষি হয়েছিল। কিন্তু বিদিশা সরাসরি সুধাময়কে একদিন প্রশ্ন করেছিল, বাপি, তোমার হাতে বেড়ে ওঠা রক্তকরবী গাছটাকে কেউ যদি রোজ টেনে মুচড়ে ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তুমি কী করবে?
সুধাময় কেঁদে ফেলেছিলেন এ কথায়। তার লম্বা কাঠামো নুয়ে পড়েছিল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, আমি সারাজীবন বহু কষ্ট করেছি, মানু। কখনও ঘুষ নিইনি, কখনও ঘুষ দিইনি। আর তোকে আমি বলব ঘুষ দিয়ে ভালোবাসা আদায় করতে! অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা মানেই তো ঘুষ দেওয়া! তুই আমাদের চোখের সামনে থাকবি। এ বাড়িতে তোর অধিকার কিছু কম নয়।
বাবাকে টপ করে একটু চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল বিদিশার। কিন্তু কী করবে! এখন তো আর ও সেই ছোট্টটি নেই।
সেইদিন থেকে সল্ট লেকে অভয়ারণ্য খুঁজে পেয়েছিল বিদিশা।
বেশ মনে পড়ে, রণজয় দু-চারবার যাতায়াত করেছিল ওদের বাড়িতে। ওকে দেখতে এসেছিল। ওর সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেছিল। মানিকতলায় ফিরে যাওয়ার জন্যে অনুরোধও করেছিল।
কিন্তু বিদিশা টলে যায়নি। রণজয়ের সঙ্গে ওর ভালোবাসার স্মৃতিগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে চাপা দিয়েছিল বিপজ্জনক মারাত্মক সব স্মৃতি। করাতের দাঁতওয়ালা লম্বা ছুরিটা ও সবসময় চোখের সামনে দেখতে পেত।
এর পর রণজয় প্রায় মাসছয়েক চুপচাপ হয়ে যায়। কোনও যোগাযোগ করেনি, কোনও চিঠি দেয়নি, একটা টেলিফোনও করেনি।
তারপর হঠাত্ একদিন ও ফোন করেছে সুধাময়কে। ফোন করে লিগাল সেপারেশন চেয়েছে। একই ব্যাপারে অরুণাকেও ফোন করেছে রণজয়। কথাবার্তা ঢিমে তেতালায় হলেও এগিয়েছে। সেসব শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বিদিশা। আর অরুণা মাঝে-মাঝেই জেদী মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছেন ধর্মের কথা।
বিদিশা ধর্মের কথা শোনেনি। শোনার মতো মনের অবস্থা ওর ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ও সামলে নিতে পেরেছিল। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শর্টহ্যান্ড আর টাইপ শিখতে শুরু করেছিল। কয়েক বছর আগে বিভিন্ন পরীক্ষার ফাঁকে-ফাঁকে শর্টহ্যান্ড-টাইপ নিয়ে ও বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। এখন তীব্র প্রয়োজনে সেই পুরোনো চর্চাটাকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরল।
সুধাময়ের যোগাযোগ আর চেষ্টায় ইন নামের এই ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্সি ফার্মে স্টেনোগ্রাফার কাম-টাইপিস্টের চাকরি পেয়েছে বিদিশা। আর একইসঙ্গে ওর জীবনের ছবিটা একটু একটু করে বদলে গেছে। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জীবন আবার স্মিত হেসে তাকিয়েছে ওর দিকে।
এখন, ওর সেই নতুন বাঁচার জায়গায় বসে, শেখরকে নিজের কথা বলছিল বিদিশা।
রণজয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্কের সব কথা অরুণা কিংবা সুধাময়কে খুলে বলেনি বিদিশা। তাই শেখরকেও বলল অনেক রেখে-ঢেকে রণজয়ের অস্বাভাবিক মনের কথা বলল, বলল ওর বাঁ-গালের কাটা দাগের ইতিহাস, আর আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টার কথা।
সব কথা বলতে বলতে বিদিশার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সেটা লক্ষ করে শেখর বলল, ম্যাডাম, এখন চোখের জল ফেলার সময় নয়–চোখের জল মুছে নেওয়ার সময়।
বিদিশা চোখ মুখে নিল রুমালে। তারপর গতকাল রাতের ঘটনা বলল।
রণজয় আমাকে ছাড়বে না, শেখর। যেভাবেই হোক, ওর মাথায় এখন ঢুকেছে আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। ও যখন-তখন যা খুশি করে ফেলতে পারে।
অফিসে লোকজন আসতে শুরু করেছে। ম্যানেজার পি. এল. চক্রবর্তী একবার এসে বিদিশাকে গুড মর্নিং বলে গেছেন। চায়ের ট্রলি এসে গেছে ফ্লোরে।
দেবলীনা হঠাৎ এসে দাঁড়াল বিদিশার টেবিলের কাছে। বলল, কাল দারুণ দুটো চুড়িদার কিনেছি। ভীষণ ব্রাইট রং। লাঞ্চের সময় এসো, দেখাব।
দেবলীনার ছিপছিপে ফরসা চেহারা। চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। ছাই রঙের ওপরে সাদা কালোয় কাজ করা একটা চুড়িদারে ওকে বেশ মানিয়েছে। বিদিশাকে ও প্রায়ই শাড়ি ছেড়ে চুড়িদার পরতে বলে। তা হলে নাকি বিদিশাকে আরও সুন্দর দেখাবে।
এই প্রস্তাবের কথা জানতে পেরে বোসদা পান চিবোতে-চিবোতে বলেছিলেন, না, মা জননী, তুমি চুড়িদার পোরো না। তাহলে আমার আর চরিত্র বলে কিছু থাকবে না। এমনিতেই শাড়ি পরে তোমাকে যা ফ্যান্টা লাগে! আমি তো সবাইকে স্পষ্ট করেই বলি? আমি তোমাকে দেখতেই রোজ অফিসে আসি। হাসলেন বোসদা? তা হলেই বোঝে। এর ওপর তুমি যদি চুড়িদার ধরো তাহলে আমাদের মতো বুড়োগুলো কী ধরবে।
বোসদা, প্লিজ… কপট অস্বস্তিতে বলে উঠেছে বিদিশা : ঠোঁটে কুলুপ লাগান।
ঠোঁট থেকে পানের রস মুছে নিয়ে সুধীর বোস মজা করে বলেছিলেন, আমার তো যত রস ঠোঁটেই, মা জননী! সেখানে কী করে গোদরেজের তালা লাগাই!
দেবলীনা রিসেপশন কাউন্টারের দিকে চলে যেতে না যেতেই চায়ের কাপ হাতে বোসদা এসে হাজির। হাসি হাসি মুখ। টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বোঝা যায়, এই মাত্র অফিসে ঢুকেছেন।
আপনাদের কাছে এগোনো যাবে? না কি কালকের মতো এজ বার আছে?
না, না। আসুন, চেয়ার টেনে নিয়ে বসুন– হাসিমুখে বোসদাকে আমন্ত্রণ জানাল বিদিশা।
বোসদা চোখ সামান্য কুঁচকে বিদিশাকে লক্ষ করেছিলেন। হঠাৎই সিরিয়াসভাবে মন্তব্য করলেন, মা জননী, তোমার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছি। সকাল-সকাল মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল।
এমন সময় সিনিয়ার ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সৌমেন পাল বোসদাকে এসে ডাকলেন, মিস্টার বোস, একটু আসবেন? আজই একটা আরজেন্ট ড্রয়িং পাঠানোর আছে। আপনার সঙ্গে একটু ডিসকাস করতে হবে।
পরে কথা বলব। ছোটভাই, তুমি দ্যাখো, ম্যাডামের প্রবলেম সলভ করতে পারো কি না– বলে বোসদা চায়ের কাপ হাতেই চলে গেলেন।
শেখর বলল, বলুন, ম্যাডাম, আমার থেকে আপনি কী হেল্প চান?
বিদিশা দিশেহারাভাবে বলল, সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
থানায় ডায়েরি করতে চান?
না, না– চকিতে মাথা নাড়ল বিদিশা, ওতে অনেক জল ঘোলা হবে, স্ক্যান্ডাল হবে।
তা হলে আপনি কী করতে চান?
বিদিশা চিন্তিত গলায় বলল, সেটাই বুঝতে পারছি না। রণজয় সবসময় আমাকে ফলো করছে। সেটা শোনার পর থেকেই আমার ভয় করছে।
এমন সময় বনজারা এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল বিদিশাকে। শেখর দেখল, সাধারণ একটা ইনল্যান্ড লেটার।
এখন তা হলে যাই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শেখর, পরে এ-নিয়ে কথা বলব।
বিদিশা ঘাড় নেড়ে চিঠিটা দেখতে শুরু করল। শেখর রওনা হল নিজের সিটের দিকে।
চিঠিটা কে পাঠিয়েছে তা ওপরে লেখা নেই। তবে হাতের লেখাটা বেশ চেনা!
ইনল্যান্ড লেটারটা খুলে ফেলল বিদিশা। তিন পৃষ্ঠা জোড়া বিশাল চিঠি। চিঠির শেষে রণজয়ের নাম লেখা রয়েছে।
বিদিশা ওর খুব চেনা বাংলা হরফগুলোর ওপরে চোখ বোলাতে শুরু করল।
রণজয়ের লেখা প্রেমজর্জর চিঠি। অনেক ভালোবাসা, অনেক দুঃখ-কষ্টের কথা বলা আছে। চিঠিতে। নির্লিপ্তিভাবে চিঠিটা পড়ল বিদিশা। ওর রক্তে নতুন কোনও স্রোত তৈরি হল না।
চিঠির শেষ দিকে রণজয় লিখেছে?
…তোমার সন্তান এখনও আমাকে বাবা বলে ডাকতে চায়। আর আমি তোমাকে বউ বলে ডাকতে চাই, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে চাই। এখনও সময় আছে ফিরে এসো। তা না হলে ফল খুব খারাপ হবে। অ্যাকোয়া রিজিয়া-র নাম শুনেছ? না, সুলতানা রিজিয়ার কোনও আত্মীয় নন ইনি। গাঢ় নাইট্রিক অ্যাসিড আর হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি এক মারাত্মক অ্যাসিড। সোনাও গলিয়ে দিতে পারে অতি সহজে। এই অ্যাসিড ভরা বা তোমার মুখে ছুঁড়ে মারলে তোমার ওই সোনার মতো রঙের কী হাল হবে বুঝতে পারছ?
তাই তোমার পায়ে ধরে বলছি, মানু, ফিরে এসো। আমাকে খারাপ হয়ে যেতে দিয়ো না, লক্ষ্মীটি।
বিদিশার চিঠি ধরা হাত তিরতির করে কাঁপতে লাগল। চিঠিটা কোনওরকমে ড্রয়ারে রেখে দিয়ে ও টেবিলে মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কী করবে এখন ও? কী করা যায়?
জটিল দুশ্চিন্তার মধ্যে অফিসের সময়টা ধীরে-ধীরে কাটতে লাগল। তারই মধ্যে শেখর অন্তত বারতিনেক বলেছে, ম্যাডাম, আমাকে কী করতে হবে বলবেন কিন্তু।
লাঞ্চের পর শেখরের সিটের কাছে বসে ওর সঙ্গে গল্প করছিল বিদিশা। কথা বলতে বলতে ও ভাবছিল, শেখরকে ওর বিপজ্জনক জীবনের সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে কি না।
শেখর ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করল। বিদিশার দিকে বইটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই বইটা পড়ে দেখুন। একটা সাইকোপ্যাথের কাণ্ডকারখানা। ভীষণ থ্রিলিং।
বিদিশা পেপারব্যাকটা হাতে নিয়ে দেখল। বইটার নাম ইয়র্কশায়ার রিপার। ব্যাক কভার পড়ে বুঝল, ছুরি দিয়ে একের পর এক মহিলা খুনের ঘটনা।
আবার সিরিয়াল কিলার? আপনার কি টেস্ট বলে কিছু নেই। বিদিশা বইটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল।
শেখর হেসে জবাব দিল, টিভিতে যেসব বাংলা সিরিয়াল হয় তার চেয়ে সিরিয়াল কিলার ফার বেটার। তাছাড়া, রণজয়বাবুর কেসটাও বোধহয় অনেকটা এই টাইপের। সত্যি, আপনার লাইফটা কী থ্রিলিং!
বিদিশা অবাক হয়ে শেখরকে দেখল ও আমি দিনরাত দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে গেলাম, আর আপনি বলছেন আমার লাইফটা কী থ্রিলিং! আপনি হেল্প করবেন বলছিলেন…আপনি পারবেন আমার এই থ্রিল ট্যাক্স করতে? আমি থ্রিল চাই না–আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই।
শেখর বিদিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, আমি ট্যাক্স করলে আপনার ওই মিস্টার হাজব্যান্ড হুউশ করে হাওয়া হয়ে যাবে। আমি ট্র্যাকে দৌড়োনো স্পোর্টসম্যান। এটা অফিস
তাইনা হলে আপনাকে এখনই বাইসেপ ট্রাইসেপ দেখিয়ে দিতাম।
আমি কিন্তু ইয়ারকি করছি না, সিরিয়াসলি বলছি।
আমিও সিরিয়াসলি বলছি। আজ আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
সত্যি! বিদিশা শেখরের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
সত্যি! আশ্বাসের হাসি হাসল শেখর। সত্যিকারের সহকর্মীর হাসি।
বিদিশাও হাসল–নির্ভর করতে পারার হাসি।
আর তখনই অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বোসদা এগিয়ে এলেন শেখরের টেবিলের কাছে। যথারীতি পানের রসে ঠোঁট লাল।
জড়ানো গলায় বোসদা বললেন, সেনভায়াকে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?
শেখর হেসে বলল, এত ফরমালিটির কী আছে? বলুন—
বোসদা সামান্য ঝুঁকে পড়লেন শেখরের মুখের কাছে ও বলতে পারো সেনভায়া, সেনসেক্স মানে কী?
শেখর বোসদার অশ্লীল ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। ওটা সেনসিটিভ ইনডেক্স না কী যেন–ঠিক জানি না।
তাই বলো। সেনসেক্স ওয়ার্ডটা শুনে আমি ভাবতাম শুধু বুঝি বদ্যিদেরই সেক্স আছে, আর কারও নেই. চলে যাওয়ার আগে বোসদা বিদিশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, কিছু মনে করলে না তো, মা জননী। সেনভায়া বড় ভালো ছেলে…তবে মাঝে-মাঝে নুন দিয়ে লুচি খায়…।
বোসদা চলে যেতে বিদিশা শেখরের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, নুন দিয়ে লুচি খাওয়ার মানে?
ও কিচ্ছু নয়, বোসদার বাজে ইয়ারকি। শুনুন, আমি তা হলে আজ থেকে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
বিদিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। এই মুহূর্ত থেকেই ও যেন অনেকটা ভরসা পাচ্ছে।
শেখরের কাছ থেকে উঠে চলে যাওয়ার আগে বিদিশা বলল, একটু আগে রণজয়ের একটা চিঠি পেয়েছি–অফিসের ঠিকানায়। পরে আপনাকে দেখাব। আমার মুখে অ্যাসিড বা ছুঁড়ে মারার হুমকি দিয়েছে।
শেখর শুধু বলল, ওসবে পাত্তা দেবেন না–আমি আছি।
বিদিশা নিজের টেবিলে ফিরে আসছিল, অশোক চন্দ্র ওকে ডাকল, ম্যাডাম, আপনার ফোন।
বিদিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ডানদিকের দেওয়ালের কাছে অশোক টেলিফোনের রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদিশা ওর কাছে গিয়ে ফোন ধরল।
হ্যালো।
কেমন আছ, মানু? রণজয়।
রাগে জ্বলে উঠল বিদিশা : তোমাকে বলেছি না যে অফিসে এভাবে ফোন করবে না। তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই, কোনও সম্পর্ক নেই। আমি…।
ও-প্রান্তে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রণজয়। ধরা গলায় বলল, আমার কষ্টটা তুমি কেন বুঝতে চাও না বলো, তো! আমি যে একা-একা শেষ হয়ে গেলাম।
বিদিশা বাঁকা সুরে বলল, একা কেন? তোমার মা তো রয়েছে।
রণজয় কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, সেইজন্যেই তো কষ্ট আরও বেশি। দেখা হলে তোমাকে সব বলব। কাল রাতে তো সে কথাই বলতে চেয়েছিলাম, তুমি হঠাৎ অকারণে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলে। আজ তোমার সময় হবে? অফিস ছুটির পর দেখা করতে পারবে?
বিদিশার কৌতূহল হচ্ছিল। তাই ও দ্বিধায় পড়ে গেল। তরুবালার সঙ্গে কী হয়েছে রণজয়ের? ঝগড়াঝাটি? কী নিয়ে? বিদিশার চলে যাওয়া নিয়ে?
ও-প্রান্ত থেকে রণজয় অধৈর্য হয়ে উঠল, মানু, একটিবার আমার সঙ্গে দেখা করো। তুমি পাশে না থাকলে আমি কেমন করে সেরে উঠব? কেমন করে আবার ভালোবাসব তোমাকে?
বিদিশা ঠিক করল, রণজয়ের সঙ্গে দেখা করবে–তবে শেখর সঙ্গে থাকবে। শেখর সঙ্গে থাকলে ও ওই ভয়ংকর মানুষটার সঙ্গে দেখা করার জোর পাবে।
ঠিক আছে। কোথায় দেখা করবে বলো– বিদিশা ঠান্ডা গলায় বলল।
মানু, মানু, আই লাভ য়ু, লাভ– উত্তেজনায় রণজয়ের গলা কাঁপছে ও সি. এ. পি. ক্যাম্প বাস স্টপে আমি সাতটার সময় তোমার জন্যে ওয়েট করব। তুমি আসবে তো?
আসব– বিদিশা ইচ্ছে করেই শেখরের কথা বলল না। রণজয়কে ও একটা মানসিক ধাক্কা দিতে চায়।
আমি…আমি তোমাকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছি…অফিসের ঠিকানায়…।
জানি। একটা আজ পেয়েছি।
চিঠির খারাপ কথাগুলো ধোরো না, মানু। ওগুলো রাগের মাথায় লিখেছি।
বিদিশা কোনও জবাব দিল না।
রণজয় আবার কথা বলল চাপা গলায়, মানু, চিঠি পড়ে তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না। তোমার সঙ্গে দেখা হলে সব বুঝিয়ে বলব।
ঠিক আছে। এখন তা হলে রাখছি। সন্ধে সাতটায়, সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে।
টেলিফোন রেখে দিয়ে শেখরের টেবিলের কাছে গেল বিদিশা। অচেনা একজন ভিজিটর ওর টেবিলে বসে টেকনিক্যাল কথাবার্তা বলছিল। বিদিশা ইশারায় ডাকল ওকে।
শেখর উঠে কাছে আসতেই বিদিশা নীচু গলায় বলল, আজ সন্ধে সাতটায় আমার ডেঞ্জারাস এক্স-হাজব্যান্ডের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব। সাবধান থাকবেন…।
শেখর হেসে বলল, দারুণ থ্রিলিং ব্যাপার হবে। আপনার হাজব্যান্ড এক্স হোক আর ওয়াই হোক–আই ডোন্ট মাইন্ড। কিন্তু আপনার কাছে যা শুনেছি, যদি হঠাৎ করে ভদ্রলোক খেপে উঠে আপনাকে অ্যাটাক করেন?
বিদিশা সিরিয়াস চোখে তাকাল শেখরের দিকে আপনি কী করতে চান?
শেখরও সিরিয়াস গলায় বলল, আপনি যা হুকুম করবেন।
বিদিশা ঠান্ডা স্বরে বলল, দেন হিট হিম–।
আই উইল লাভ টু। সাংঘাতিক থ্রিলিং ব্যাপার হবে।
.
সেই সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার এতটুকু কমেনি। মাঝে-মাঝে খাপছাড়াভাবে দু-তিনবার বৃষ্টি হয়েছে। বিদিশা আর শেখর যখন সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে এসে নামল তখন বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু আকাশে কোনও চঁদ-তারা নজরে পড়ছিল না। বরং খানিকটা লালচে আভা দেখা যাচ্ছিল।
বাস থেকে নামার আগেই ওরা ঠিক করেছিল ওরা অচেনা লোকের মতো বাসের দুই দরজা দিয়ে নামবে। নেমে শেখর বিদিশার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাবে। দূর থেকেই ও বিদিশার ওপরে লক্ষ রাখবে। রণজয়ের সঙ্গে বিদিশার ব্যক্তিগত কথাবার্তার মাঝে ও থাকতে চায় না।
শেখর পিছনের দরজা দিয়ে নেমে সোজা রাস্তা পেরিয়ে চলে গেছে উলটো দিকের বাস স্টপে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ-সাতজন মানুষের মাঝে গা-ঢাকা দিয়েছে। ওর হাতঘড়িতে তখন সাতটা বেজে ছমিনিট।
বাসটা চলে যেতেই রাস্তার ওপারে বিদিশাকে দেখতে পেল শেখর। একা-একা দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে। রণজয়কে খুঁজছে।
যখন ওরা প্রায় অধের্য হয়ে উঠেছে তখন পাখির খাঁচার পিছন থেকে একটা ছায়ার মতো মানুষ ইতস্তত পায়ে এগিয়ে এল বিদিশার কাছাকাছি।
বিদিশা, আমি এসেছি।
চমকে বাঁ দিকে মুখ ঘোরাল বিদিশা।
করুণ মুখে ফরসা রোগা চেহারার রণজয় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে কেমন দ্বিধা, ইতস্তত ভাব, যেন কোনও অপরিচিত তরুণীর সঙ্গে আলাপ জমাতে এসেছে।
কী বলবে বলো– বিদিশা পাথরের মতো গলায় বলল।
চারদিকে দেখল রণজয়। এই জায়গাটায় তেমন আলো-টালো নেই। কিন্তু এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
রণজয় বলল, এখানে নয়, মানু…ওদিকটায় চলো। আঙুল তুলে সি. এ. পি. ক্যাম্প স্টপেজ থেকে বাঁ দিকে এ. ই. ব্লকের দিকে চলে যাওয়া নির্জন রাস্তাটা দেখাল ও।
বিদিশার ভেতরে কেমন একটা টেনশন শুরু হল। ওর চোখ রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা শেখরকে খুঁজল।
এমন সময় আচমকা ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বিদিশা চটপট ছাতা খুলে মাথায় দিল। কিন্তু রণজয়ের সঙ্গে ছাতা ছিল না। ও নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।
রণজয় আরও কাছে এগিয়ে এল। ওর সারা মুখ ভিজে চকচক করছে। চুল লেপটে আছে ফরসা কপালে। বৃষ্টির ফোঁটায় ওর মুখ খানিকটা ঝাপসা দেখাচ্ছে।
ওকে দেখে বিদিশার মায়া হল। ও রণজয়কে ছাতার তলায় ডাকল, বৃষ্টিতে ভিজো না। এসো।
রণজয় ওর লেডিজ ছাতার নীচে চলে এল। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোমাত্রই ও বিদিশার গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল : মানু..মানু…।
বিদিশা প্রতিক্রিয়ায় গাল সরিয়ে নিল। ও রণজয়কে ছাতার নীচে আসতে বলেছে মানবিকতা বোধ থেকে, ভালোবাসার টানে নয়।
ওর অবাক লাগছিল। কী সহজে ভালোবাসা মরে যায়। এক সময় এই পুরুষটা ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে বিদিশা ভেতরে-ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেত, শরীর পিচ্ছিল হয়ে উঠত।
আর এখন! ওর প্রতিটি রোমকূপ সতর্ক হয়ে রয়েছে বিপদের আশঙ্কায়।
বৃষ্টির ফোঁটা ছাতায় আছড়ে পড়ার তুমুল শব্দ হচ্ছিল। ছাতার রডের গা দিয়ে জল পড়ছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। রণজয়ের ভেজা শরীর বিদিশার পোশাক ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
রণজয় ওর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ওদিকটায় চলো।
বিদিশা ওর আঙুলের জোর টের পেল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শেখরকে শেষবারের মতো খুঁজতে চেষ্টা করল। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার ধোঁয়াটে পরদা সরিয়ে ও কিছুই দেখতে পেল না।
নির্জন এলাকা থেকে আরও নির্জন এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ওরা দুজনে।
সামনেটা বেশ অন্ধকার। বাড়িগুলোও বর্ষার ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে। দু-একটা খালি জমিতে বর্ষায় বেড়ে ওঠা গাছপালা আর আগাছার জঙ্গল। বিচিত্র আকারের অর্ধেক তৈরি একটা বাড়ি অন্ধকারে কবন্ধের মতো দাঁড়িয়ে।
মানু, তোমাকে আমি অনেক চিঠি লিখেছি..রোজ তুমি অফিসে গেলেই একটা করে আমার চিঠি পাবে…।
বিদিশা কোনও উত্তর দিল না।
বৃষ্টির তেজ হঠাৎই কমে এল। আর রণজয়ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।
মানু, মুখটা তুলে আমার দিকে একবার তাকাও।
রণজয়ের কথায় এমন কিছু ছিল যে, বিদিশা ভয় পেয়ে গেল। ও চোখ নামিয়ে বৃষ্টির খই-ফোঁটা ভিজে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আচমকা ছাতাটা টান মেরে ছিটকে ফেলে দিল রণজয়। বিদিশা অসহায়ভাবে ভিজতে লাগল। রণজয় তো আগেই ভিজে স্নান। সেই অবস্থায় ও হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল বিদিশার পায়ের কাছে। জাপটে ধরল বিদিশার ভিজে লেপটে যাওয়া শাড়ি, সেই সঙ্গে বিদিশাকে।
আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, মানু। তোমাকে ফিরে না পেলে আমি মরে যাব। কথা বলতে বলতে রণজয় মুখ ঘষছিল বিদিশার ঊরুতে। টের পাচ্ছিল, বিদিশার কোমল ভিজে শরীর, ভালোবাসার থরথর করে কাঁপছে।
আসলে বিদিশা ভয়ে কাঁপছিল। আর দমবন্ধ করে মরিয়া হয়ে শেখরকে খুজছিল বারবার।
রণজয়ের জড়ানো স্বর তখনও ভেসে আসছিল বিদিশার কোমরের কাছ থেকে : তোমাকে ফিরে না পেলে আমি শেষ হয়ে যাব, মানু…।
বিদিশার গা ঘিনঘিন করছিল। শরীরটা কাঠ। ও কোনওরকমে বলল, সেটা আর কিছুতেই সম্ভব নয়…।
চাবুকের মতো এক ঘটকায় উঠে দাঁড়াল রণজয়। বাঁ হাতের থাবায় চেপে ধরল বিদিশার গলা। ওর চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। মুখ বেঁকেচুরে বদলে গেছে। অচেনা রণজয় বেরিয়ে এসেছে নির্জন বৃষ্টিভেজা রাস্তায়।
চাপা হিংস্র গলায় রণজয় বলে উঠল, ফাকিং বিচ!
বিদিশার গলায় অসহ্য ব্যথা করছিল। মাথায়, মুখে, শরীরে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে ও মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। কী বোকার মতোই না ও রণজয়ের কথার ফাঁদে পা দিয়েছে। এই জানোয়ারটা একটুও বদলায়নি, বদলাতে পারে না।
গলার ওপরে আঙুলের চাপ বাড়ছিল। বিদিশার মুখ দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরোনোর উপায় নেই। রণজয় শক্ত হাতে ওর টুটি টিপে ধরেছে।
বৃষ্টি অনেক ফিকে হয়ে এসেছিল। আকুল হয়ে সি. এ. পি. ক্যাম্প স্টপেজের পাখির খাঁচার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিদিশা এক দীর্ঘ ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল। ছাতা মাথায় লম্বা-লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে আসছে। মাঝে-মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে অন্ধকারে কিছু একটা ঠাহর করতে চাইছে।
বিদিশা বেশ বুঝতে পারছিল, চিৎকার করে কোনও লাভ নেই। আর ওর কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো ওর ভয়ংকর স্বামীকে দেখতে বাধ্য হচ্ছিল।
বাঁ হাতে শক্ত করে ওর গলা খামচে রেখে ডান হাতে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় কষাল রণজয়।
বিদিশা চোখে সরষে ফুল দেখল। তার পরই চোখের সামনে একটা কালো পরদা নেমে এল যেন। মুখের বাঁ দিকটা অসহ্য যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে মাথা ধরে গেল। ঠোঁটে নোনা স্বাদ পেল ও। এই অন্ধকার বৃষ্টিভেজা রাতে ও কি রণজয়ের হাতে খতম হয়ে যাবে?
শেখর সেনের কথা মনে পড়ল : .যদি হঠাৎ করে ভদ্রলোক খেপে উঠে আপনাকে অ্যাটাক করেন?
আপনি কী করতে চান?
আপনি যা হুকুম করবেন।
দেন হিট হিম–
শেখর সেন যখন স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পেল তখন বিদিশার শরীরটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। আর ফরসা রোগা একটা বদ্ধ উন্মাদ তখনও হিংস্রভাবে বাঁ হাতে খামচে ধরে আছে বিদিশার গলা।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। শেখরের মাথার ভেতরেও। অন্ধকার এ. ই. ব্লকের রাস্তাটা চোখের সামনে টালিগঞ্জের ভোরবেলার রাস্তা হয়ে গেল। যে-রাস্তায় শেখর প্রতিদিন ভোরবেলা দৌড়োয়।
অনেক কষ্টে একঘেয়ে জীবনে খ্রিল দেখা দিয়েছে। শেখরের মনে পড়ল মাই লাইফ উইথ নাইফ, ইয়র্কশায়ার রিপার-এর কথা। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে থ্রিল নেমে এসেছে বাস্তবের রাস্তায়। এ-সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না।
হাতের ছাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছুটতে শুরু করল শেখর। আবছায়া অবয়বের অমানুষটা তখন বিদিশাকে পেড়ে ফেলেছে পথের ওপরে। দু-হাতে ওর শাড়ি-জামাকাপড় ধরে টানছে। আর আপনমনেই চিৎকার করে কীসব বলছে। শেখরের মাথায় সে-সব তখন একবর্ণও ঢুকছিল না।
ছুটতে ছুটতে লোকটার প্রায় ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল শেখর। সপাটে এক লাথি চালাল লোকটার কোমরে। লোকটা খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ল, কিন্তু বিদিশার শাড়ির আঁচল তখনও তার মুঠোয় ধরা।
শেখর আনন্দে টগবগ করে ফুটছিল। বইয়ের পাতা শেষ পর্যন্ত তা হলে সত্যি হল!
ও পড়ে যাওয়া রণজয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে না পড়ে ওর একটা পা চেপে ধরল। তারপর ওর দেহটা হিড়হিড় করে টানতে লাগল পিচের রাস্তায় ওপরে।
শেখরের মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছিল বারবার। আর ঝিম্ফাক মিউজিক বাজছিল। রণজয়ের পলকা শরীরটাকে নিয়ে ও দিশেহারার মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল রাস্তার এদিক-সেদিক।
এক সময় ও থামল। হাঁফাতে-হাঁফাতে ঝুঁকে পড়ল রণজয়ের ওপরে। বাঁ-হাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল ওকে। তারপর ওর কেটে-ছেড়ে যাওয়া মুখে ডান হাতের এক ভয়ংকর ঘুষি বসিয়ে দিল।
আঁক শব্দ করে উঠল রণজয়। ওর নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। শেখর পর-পর আরও তিনটে ঘুষি চালাল। চুলের মুঠি ধরে থাকা মাথাটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল তিনবার।
শেখর শুনতে পাচ্ছিল, ওর কানের ভেতরে কে যেন বারবার বলছে, দেন হিট হিম। দেন হিট হিম, দেন হিট হিম… আর শেখর সেই অলৌকিক নির্দেশের প্রতিটি শব্দ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছিল।
ক্লান্ত শেখর আহত রণজয়কে একসময় ছেড়ে দিল। বৃষ্টি তখন আরও জোরে নেমেছে।
শেখর একপলক অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে তাকিয়েছিল দুরে রাস্তায় পড়ে থাকা বিদিশার দিকে। সেই ফাঁকে রণজয় কোথা থেকে একটা লুকোনো ছুরি বের করে নিমেষে চালিয়ে দিল শেখরের মুখ লক্ষ করে।
ঠিক সেই সময়ে হেডলাইট জ্বেলে একটা গাড়ি বাঁক দিয়েছিল এ. ই. ব্লকের দিকে। গাড়িটার আলো রণজয়ের মুখে এসে পড়েছিল, আর শেখরের পিঠ-কাঁধ গাঢ় ছায়া ফেলেছিল রণজয়ের শরীরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছুরিটা চালিয়েছিল রণজয়।
নেহাতই প্রতিবর্তী ক্রিয়ার বশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল শেখর। তাই ছুরির ফলা ওর গলা আর ঘাড়ে রক্তাক্ত আঁচড় টেনে দিল। শেখর আহত জন্তুর মতো গনগনে রাগে রণজয়ের দু-পায়ের ফাঁকে এক মারাত্মক লাথি কষিয়ে দিল।
রণজয় চকিতে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু লাথিটা পুরোপুরি এড়াতে পারল না।
ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসা গাড়িটার হেডলাইটের আলোয় রণজয়ের রক্তমাখা মুখ ফ্যাকাসে লাগছিল। ও গাড়িটার দিকে একবার তাকিয়েই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটে পালাল অন্ধকারে। ওকে তাড়া করতে গিয়ে শেখর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। ওর গলা বেয়ে তখন দরদর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ওই জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যেও শেখর থ্রিলের কথা ভাবছিল, বিদিশার কথা ভাবছিল।
জ্ঞান হারানোর আগে শেখর দেখল, গাড়িটা ওর কাছটিতে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেছে। দুজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। কেউ যেন ওকে বহুদূর থেকে জিগ্যেস করছে, কী ব্যাপার, দাদা? কী হয়েছে?
আর একজন যেন কোথা থেকে বলে উঠল, মনে হয় ছিনতাইয়ের কেস।
কথাবার্তার শব্দ ক্রমেই বাড়ছিল।
কে যেন হুড়হুড় করে খানিকটা ঠান্ডা জল ঢেলে দিল শেখরের মুখে। ও চমকে চোখ মেলে তাকাল। এ কী! ও রাস্তায় পড়ে কেন? এই অন্ধকারে বৃষ্টিতে ও কী করছে? গলার পাশটা জ্বালা করছে। কয়েকটা ছায়া-ছায়া মুখ ঝুঁকে রয়েছে ওর শরীরের ওপরে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসল শেখর। আর তখনই ওর রণজয়ের ব্যাপারটা মনে পড়ল। ও পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরল গলায়। কয়েকটা হাত ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।
উঠে দাঁড়িয়ে বিদিশাকে দেখতে পেল শেখর। ছাতা দুটো কুড়িয়ে নিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল। নানাজনের প্রশ্নের উত্তরে ছিনতাইয়ের চেষ্টার কথাই বলল শেখর। কেন যেন মনে হল, রণজয়ের ব্যাপারটা বলে ফেলা ঠিক হবে না।
বিদিশাকে কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। দু-চোখে ভয় আর উৎকণ্ঠা। ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ। ও জিগ্যেস করল, আপনার লাগেনি তো, শেখর!
শেখর বলল, চিন্তা করবেন না। তেমন কিছু নয়।
দু-চারজন পরামর্শ দিল একটু ফার্স্ট এইড সেরে নেওয়ার জন্য। কে যেন একটা সাইকেল রিকশা ডেকে ওদের তুলে দিল। বলল, কোয়ালিটি স্টপেজের পাশে ওষুধের দোকান আছে। ওখানে দেখিয়ে নিন। আর পুলিশে একটা ডায়েরি করে দেবেন। এদিকটায় ছিনতাই বড্ড বেড়েছে।
রিকশা যখন চলতে শুরু করেছে তখন পিছন থেকে টুকরো একটা মন্তব্য ওদের কানে এল ও এই অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে কেউ কখনও এখানে প্রেম করতে আসে।
উত্তরে একজন বলল, না, না–ওরা আপনি করে কথা বলছিল…।
রাখুন, রাখুন। ও-সব লোকঠকানো প্যাঁচ পুরোনো হয়ে গেছে…।
রিকশা কালো রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল।
.
লাঞ্চের পর সুধীর বোস খড়কে দিয়ে দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে শেখরের টেবিলের কাছে এলেন। সেখানে বিদিশা আর দেবলীনা দাঁড়িয়ে ছিল। আর একটা চেয়ারে বসে ছিল অশোক। লাঞ্চের পর আধঘণ্টাটাক অফিসের মেজাজটা একটু ঢিলেঢালা থাকে।
বোসদা এসেই ঘোষণা করলেন, শুনেছ শেখরভায়া, আমাদের অফিসে শক্তিশালী জয়েন করেছে।
শক্তিশালী মানে? একটু অবাক হয়ে শেখর জিগ্যেস করল। ওর গলার বাঁ দিকটায় স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। এখন আর তেমন ব্যথা নেই।
বোসদা হাসলেন : তোমাদের কি সমাস-টমাস কিছুই পড়ানো হয়নি! শক্তিশালীর ব্যাসবাক্য হল, শক্তিপ্রসাদের শালি। আমাদের এম.ডি.-র পি.এ. শক্তিপ্রাসাদের শালি আজ থেকে কোম্পানিতে জয়েন করেছে।
শেখর হাসল। দেবলীনা আর বিদিশাও।
অশোক হেসে বলল, তো আপনার এত হিংসে কেন? আপনিও আপনার শালিকে এখানে ঢুকিয়ে দিন না–।
সুধীর বোস চোখ ছোট করে হেসে বললেন, আমার শালিকে আমি কোথায় ঢোকাব সেটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও না বাবা!
আপনার সঙ্গে না কথা বলা যায় না, বোসদা– বলে হাসি চেপে উঠে চলে গেল অশোক।
বোসদা কপট বিস্ময়ে তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কী খারাপ কথাটা বললাম। তুমিই বলো, জননী বিদিশার দিকে ফিরে বললেন বোসদা।
বোসদা, প্লিজ… প্রায় আবেদনের গলায় বলল বিদিশা।
দেবলীনা বলল, আমি সিটে যাই। নইলে পি. এল. চক্রবর্তী আবার ঝামেলা করবে।
ও চলে যেতেই বোসদা বললেন, দেবলীনা পালের একটাই বড় ডিফেক্ট, বড় লাজুক।, ভাই, তোমরা গপ্পো করো, আমি নীচ থেকে ঝট করে একটা পান খেয়ে আসি বলে দাঁত খুঁটতে-খুঁটতে সুধীর বোস চলে গেলেন।
অশোকের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটা দেখিয়ে শেখর বিদিশাকে বসতে বলল। তারপর জিগ্যেস করল, এখন কেমন আছেন?
সারাদিনে এই প্রথম ওরা আলাদা কথা বলতে পারছে।
বিদিশার ঠোঁটের কোণ, গাল ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণে ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ছে। ফরসা গলায় কালচে দাগ। আজ তেমন করে সাজগোজ করেনি ও। চোখে বিষাদ আর অনিশ্চয়তার ছায়া।
আমি ঠিক আছি। একটু থেমে : আপনি?
হাসল শেখর। ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বের করল। বলল, আমি কাল সকালের মতোই থ্রিল খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিন, এই বইটা দেখুন, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন…।
বিদিশা বইটার নাম দেখল ও ইন্টারভিউ উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার। তারপর মাথা নেড়ে না বলল। তারপর একটু সময় নিয়ে জিগ্যেস করল, সত্যি ঠিক আছেন? আমার খারাপ লাগছে। শুধু শুধু নিজের ঝামেলায় আপনাকে জড়ালাম…।
বিদিশার সাহস শেখরকে হতবাক করে দিয়েছিল। ও চাপা গলায় বলল, ঝামেলার আর কী আছে! কাল হোঁচট খেয়ে ওরকম পড়ে না গেলে আপনার এক্স হাজব্যান্ডকে চন্দ্রবিন্দু করে ছেড়ে দিতাম। একটু থেমে তারপর ও আমার কথা বাদ দিন। আমি তো সবসময় থ্রিল খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আপনার ভয় করে না?
বিদিশা কাচের চোখে শেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, না। কাল রাতের পর আমার সমস্ত ভয় পাওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে।
কথাটা বিদিশা মিথ্যে বলেনি।
কাল রাতে এক ডিসপেনসারি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে ওষুধ নেওয়ার পর বিদিশাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল শেখর।
সারাটা পথ বিদিশা কোনও কথা বলেনি। শুধু একবার বিড়বিড় করে বলেছে, রণজয় আমাকে বাঁচতে দেবে না। হয় ও, নয় আমি–যে-কোনও একজন থাকবে।
শেখর আগে কখনও বিদিশাদের বাড়ি আসেনি। বিদিশা কখনও আসার কথা বলেনি। কারণ, শেখর তখন ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানত না। এখন সবকিছু পালটে গেছে। তাই রাত সাড়ে আটটা নাগাদ যখন ওরা দুজনে অরুণা-সুধাময়-এ পৌঁছোল তখন বিস্ময়, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
অনেক প্রশ্ন, অনেক আলোচনা, অনেক কথা কাটাকাটি। রণজয়ের কাছ থেকে বিপদের ব্যাপারটা যে কত মারাত্মক হতে পারে সেটা অরুণা কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না। তখন শেখর জামা সরিয়ে নিজের ক্ষতচিহ্নটা দেখাল। অরুণা কথার মাঝখানেই চুপ করে গেলেন। বুঝতে পারলেন, শেখর শেষের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সুধাময় পুলিশে ফোন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অরুণা বললেন, ফোন করে তরুবালাকে সব জানাতে। বদ্ধ পাগল ছেলে কী ভয়ংকর পাগলামিতে মেতে উঠেছে সেটা মায়ের জানা দরকার। বাপ্পা রণজয়কে ফোন করে সরাসরি হুমকি দিতে বলল। বিদিশা হতাশায় কাঁদতে লাগল। আর এ-বাড়িতে প্রথম অতিথি শেখর বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর গলার পাশটা ব্যথা করছে। সামান্য চিনচিনে জ্বালাও করছে।
কী আশ্চর্য! আর-একটু হলেই শেখরের থ্রিল-খোঁজা জীবন খতম হয়ে যেতে পারত, অথচ শেখরের মনে ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। বরং অল্পের জন্য রণজয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ওর আপশোশ হচ্ছিল।
একটু পরেই বিদিশা যখন কথা বলল, তখন ও একেবারে অন্য মানুষ।
সুধাময়-অরুণা বারবার বলেছিলেন যে, ওর কিছুদিন অফিসে না যাওয়াই ভালো। বিপদটা কেটে যাক, তারপর দেখা যাবে।
উত্তরে বিদিশা রুক্ষ গলায় বলে উঠল, এ-বিপদ কোনওদিন কাটবে না। যেদিন আমি অফিসে যাওয়া শুরু করব সেদিনই আবার বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া বাড়িতে বসে থাকলেই যে কোনও বিপদ হবে না তার কী মানে আছে! যে মানুষটার মাথার গণ্ডগোল সে কখনও সুবিধে-অসুবিধে ভেবে কাজ করে নাকি? আমি কাল অফিসে যাব। আমাকে ভয় পেতে দেখলেই রণজয় আরও পেয়ে বসবে।
বহু তর্কবিতর্ক করেও বিদিশাকে টলানো গেল না। শেখরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল। অরুণা অনেক কান্নাকাটি করলেন, কিন্তু বিদিশার একরোখা জেদকে হারাতে পারলেন না।
বিদিশাদের পারিবারিক ব্যাপারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখরের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ও বাড়িতে একটা ফোন করে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। এখন দ্বিতীয়বার ফোন করে বলল, এখনই রওনা হচ্ছে।
ও চলে আসার আগে বিদিশা ছোট্ট করে জিগ্যেস করেছিল, কাল অফিসে আসছেন তো?
অফ কোর্স। জবাব দিয়েছিল শেখর, আমি অফিসে না এলে আপনাকে সেলি বাড়িতে পৌঁছে দেবে কে?
উত্তরে ম্লান হেসেছিল বিদিশা। পৃথিবীটা এখনও রণজয়রা কিনে নিতে পারেনি…শেখররাও আছে।
.
শেখর বলল, আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোবেন। আপনাদের বাড়ির কাছটা বেশ অন্ধকার। সন্ধে পার হলেই লোকজন ফিকে হয়ে আসে।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে বিদিশা সায় দিল, বলল, তা হলে আধঘণ্টা আগে বেরোব।
ঠিক তখনই পি. এল. চক্রবর্তী কোথা থেকে যেন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বিদিশার পিঠে হাত দিয়ে তাগাদা দিতে-দিতে বললেন, অ্যাই, বিদিশা, চলো, চলো। খুব জরুরি কয়েকটা ডিকটেশন দেওয়ার আছে।
বিদিশা কুঁকড়ে সরে গেল চক্রবর্তীসাহেবের সুযোগসন্ধানী হাতের আওতা থেকে। উঠে দাঁড়াল চট করে।
প্রশান্ত চক্রবর্তীর স্বভাবটাই এইরকম। সবসময় ছোঁকছোঁক করে বেড়ান। বিদিশার শরীরের যেখানে-সেখানে যৌনতা খুঁজে বেড়ান। বিদিশার গা ঘিনঘিন করে। এই লোকটাও রণজয়ের চেয়ে কম অসুস্থ নয়। শুধু রোগ-লক্ষণগুলো অন্যরকম।
চোখের ইশারায় শেখরকে আসছি বলল বিদিশা। দেখল শেখরের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ও চক্রবর্তীসাহেবের অসভ্যতায় ভেতরে-ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।
পি. এল. চক্রবর্তীর ডিকটেশন আর গায়ে-পড়া গালগল্পের হাত থেকে বিদিশা রেহাই পেল প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক পর। নিজের টেবিলে ফিরে ও চিঠিগুলো টাইপ করতে বসবে, দেখল ওর টেবিলে একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে আছে।
চেয়ারে গুছিয়ে বসে চিঠিটা খুলল বিদিশা।
যা ভেবেছিল তাই। রণজয়ের চিঠি। সেই একঘেয়ে কাঁদুনিঃ তুমি ফিরে এসো। আর চিঠির শেষ দিকে নির্লজ্জভাবে নোংরা ভালোবাসার কথা লেখা রয়েছে। সেই সঙ্গে কঁচা হাতের রেখায় আঁকা নারী-পুরুষের মিলনের ছবি।
রাগে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে লিটার বিনে ফেলে দিল বিদিশা। শরীরে ও কেমন এক অসহ্য জ্বালা টের পাচ্ছিল। ওর শান্তশিষ্ট জীবনটা একটা ভয়ংকর জন্তু কীরকম তছনছ করে দিচ্ছে।
বিদিশা আনমনাভাবে ভোলা জানলার দিকে তাকাল। আকাশে গাঢ় মেঘ। কিন্তু কোথাও কোথাও নীলের আভাস। আর কতদিন থাকবে এই মেঘ? লুকিয়ে থাকা নীলের জন্য আকুল হল বিদিশা।
বিদিশা কতক্ষণ যে ও-ভাবে বসে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎই দেখল, বঞ্জারা ওর টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
ম্যাডাম, আপনার ফোন আছে।
বিদিশা উঠে দাঁড়াল। রোবটের মতো নিপ্রাণ পায়ে এগিয়ে গেল টেলিফোনের দিকে। ও জানে, এই টেলিফোনটা কে করেছে। কিন্তু এত দেরি হল কেন? আরও অনেক আগে এই ফোনটা আসা উচিত ছিল।
হ্যালো টেলিফোনে যান্ত্রিক স্বরে কথা বলল বিদিশা।
কাল রাতের ওই শুয়োরের বাচ্চাটা কে? ক্ষিপ্ত রণজয়ের কথা ফেটে পড়ল রিসিভারে।
বিদিশা একটা ধাক্কা খেল। ভাবল, রিসিভার নামিয়ে রাখবে। কিন্তু তার পরই একটা তীব্র জেদ আর রাগ ফুটতে শুরু করল ওর মাথার ভেতরে। না, হার মানবে না বিদিশা। ও এই অসভ্য পাগলটার মোকাবিলা করবে।
ছোটলোকের মতো কথা বোলো না। এটা অফিস। এখানে ভদ্রলোকেরা কাজ করে। চাপা ধমকের সুরে বলল বিদিশা।
ও-প্রান্তে আসল রণজয়নোংরা হাসি। বলল, তুমি কি ভেবেছ ওই ভাড়া করা জানোয়ারটা তোমাকে বাঁচাতে পারবে! আমি ওটাকে খতম করে দেব। কেটে টুকরো-টুকরো করে ভাসিয়ে দেব মানিকতলার খালে। তারপর তোমাকে চৌরাস্তায় ন্যাংটো করে…।
চুপ করো। বদ্ধ পাগল কোথাকার বিদিশা হিসহিস করে বলল।
মানু, আমি তোমাকে কতবার বলেছি…।
রণজয়ের কথার ওপরে কথা বলল বিদিশা, তুমি একটা আস্ত পাগল। তোমার মাথার ভেতরে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে আছে। তোমার পাগলামি তোমার মা সহ্য করতে পারে–সেখানে গিয়ে পাগলামি করো–আমার সে-দায় নেই।
মানু– মিষ্টি করে বলল রণজয়, তোমাকে আমি ছাড়ব না, কিছুতেই ছাড়ব না। মিষ্টি সুরে বলল, কিন্তু সেই মুহূর্তে রণজয়ের মুখটা দেখলে বিদিশা ভয় পেত।
তুমি আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। নইলে আমি থানা-পুলিশ করতে বাধ্য হব। তোমার মতো ছোটলোক পাগলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আমি রাখতে চাই না। তুমি তোমার মাকে নিয়েই থাকো। তোমরা দুজনেই তো অ্যাবনরমাল-ফলে দিব্যি সুখে থাকতে পারবে…।
একইভাবে রণজয় আবার বলল, মানু, তোমাকে আমি ছাড়ব না…।
এবং লাইন কেটে দিল।
হঠাৎই বিদিশার শরীরের ভেতরে যেন লোডশেডিং হয়ে গেল। টলে পড়ে যেতে গিয়েও ও একটা থাম ধরে সামলে নিল। তারপর থামটার হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
সুধীর বোস তার ড্রাফটিং টেবিল থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। তিনি প্রায় ছুটে এসে বিদিশাকে হাত ধরে কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। কোথা থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে ধরলেন বিদিশার মুখের সামনে। বললেন, মা জননী, একচুমুক জল খেয়ে নাও, ভালো লাগবে…।
বিদিশা চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে ছিল। বোসদার কথায় গ্লাসের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল। বোসদাকে ওর ভীষণ ভালো লাগছিল। মনে পড়ল, সকালে এই মানুষটাই ওর আর শেখরের আঘাত আর ক্ষতচিহ্ন লক্ষ করে মন্তব্য করেছিলেন, তোমরা কি অফিসের পর ফ্রি স্টাইল কুস্তি লড়তে গিয়েছিলে নাকি? বয়েসকালে আমিও ওরকম অনেক কুস্তি লড়েছি। তা আমাকেও সঙ্গে নিতে পারতেনিদেনপক্ষে না হয় রেফারি হতাম। তারপর দিলখোলা হেসে শেখরকে বলেছেন, শেখর, সত্যি-সত্যি বলো তো, কী করে চোট পেলে?
শেখর মনগড়া একটা সাফাই দিয়েছে। বিদিশাও তাই। কিন্তু এখন চোখ খুলে ও দেখল, বোসদা স্নেহমাখানো উৎকণ্ঠায় ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে।
শেখরও কাছে এগিয়ে এসেছিল। ওর আশেপাশে আরও কয়েকজন।
এত মানুষের ভিড় দেখে বিদিশা কেমন অস্বস্তি পেয়ে গেল। ও আলতো গলায় বলল, এখন অনেকটা ভালো লাগছে… তারপর ধীরে-ধীরে উঠে ফিরে গেল নিজের সিটে।
শেখর, বোসদা ও আরও দুজন সহকর্মী বিদিশার সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছিল। বিদিশা ক্লান্ত গলায় বলল, আপনাদের আসার দরকার নেই। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল…এখন ঠিক আছি…আমি একটু একা থাকতে চাই…।
ওরা আর এগোল না। শেখর শুধু বলল, ছুটির পর আপনার সঙ্গে বেরোব–।
বিদিশা ফিরে না তাকিয়েই ঘাড় নড়ল–অর্থাৎ, ঠিক আছে।
নিজের সিটে এসে ক্লান্তভাবে টেবিলে মাথা নামিয়ে রাখল বিদিশা। রণজয়ের হিংস্র মুখটা ও দেখতে পেল। কী শান্তভাবেই না বাঁচতে চেয়েছিল বিদিশা। অথচ এই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত লোকটা ওর জীবনকে নরক করে তুলেছে। বিদিশা কি পালটা জবাব দিতে পারে না ওকে? তিল-তিল টেনশনের ভয়ংকর বিষ কি ও ছড়িয়ে দিতে পারে না ওই অমানুষটার জীবনেও?
বিদিশার বারবারই মনে হচ্ছিল, রুখে দাঁড়ানো দরকার। এইবার রুখে দাঁড়ানো দরকার।
চোখ বুজে থাকা সেই ঘোরের মধ্যে বিদিশা হিংস্র পশুটার গলা শুনতে পেল : মানু, তোমাকে আমি ছাড়ব না।
.
ভোরবেলা থেকেই মিহিদানার মতো বৃষ্টি পড়ছিল। ভোরের আকাশ আর ঘড়ির কাটায় কোনও মিল ছিল না। কিন্তু রোজকার অভ্যেস মতো সুধাময়ের জৈবিক-ঘড়ি তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল সাড়ে পাঁচটার সময়ে। নিয়মমাফিক কাজ সেরে সুধাময় বেরিয়ে এসেছেন বাইরের বাগানে। কোণের একটা ঘর থেকে বাগান পরিচর্যার দু-একটি যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে এসেছেন তার প্রিয় গাছপালার কাছে। বর্ষার জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা সবুজ পাতার দল তাকে মাথা নেড়ে সুপ্রভাত জানাল। সুধাময় হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন ওদের কাছে।
সুধাময়ের পরনে লুঙি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। তাঁর কাধ আর বাহু দেখলেই শরীরের শক্ত কাঠামো টের পাওয়া যায়। হাতের পিঠে আর কবজির কাছে দড়ির মতো ফুলে রয়েছে শিরা উপশিরা। মাথার কঁচাপাকা চুলে আর চশমার পুরু লেন্সের কাছে বৃষ্টির মিহি গুঁড়ো লেগে আছে। অথচ সেদিকে কোনও খেয়ালই নেই তার। কারণ, তিনি তখন শ্বেত করবী গাছের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আর একইসঙ্গে গাছ কাটার বড় কাঁচি নিয়ে করবী গাছের বেপরোয়া বেড়ে ওঠা ডালপালা হেঁটে মানানসই করে দিচ্ছিলেন।
একটা সিগারেটের জন্য তার ঠোঁটে গলায় কেমন তেষ্টা জাগছিল, কিন্তু সুধাময় চেষ্টা করে সেটা সামাল দিচ্ছিলেন। কয়েকবছর ধরে হাঁপের টানে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। সেই কারণেই রোজকার সিগারেটের অভ্যাস সাংঘাতিকভাবে কমিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে আছে, মনের সঙ্গে মোকাবিলায় পেরে না উঠলে এই নেশাটা একেবারে ছেড়েই দেবেন।
এখন তোর ফুলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই–তোর শরীরের দিকে মন দে। শরীর না থাকলে ফুল ফোঁটাবি কী করে? আপনমনে কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সুধাময়ের কঁচি চলছিল।
শ্বেত করবীর পর চারটে দোপাটি গাছ। একটাতেও ফুল নেই, শুধুই সবুজ পাতা। বর্ষায় কোঁকড়া-ঝকড়া হয়ে বেড়ে উঠেছে।
তোরা দেখছি পাতাবাহার গাছ হয়ে গেলি! অবশ্য কী করে ফুল দিবি! এখন তো ঠিক ফুলের সময় নয়।
হাতের কাঁচি রেখে সুধাময় গাছের পাতার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে লালচে-সবুজ ডালগুলো খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। এই সময়ে নজর না রাখলে একরকম সাদা-সাদা পোকা হয়।
পোকা খুঁজতে খুঁজতেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লোহার গেটের দিকে চোখ গেল তাঁর। গেটের বাইরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
গাছের পাতার আড়াল থেকে মাথা বের করে নিয়ে এলেন সুধাময়। সকাল ছটায়। এ কোন অতিথি এসে হাজির হল!
বাতাসে ভেসে বেড়ানো বৃষ্টির কুচির পরদা ডিঙিয়ে অতিথিকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না।
রণজয় সরকার–তাঁর জামাই। একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোহার গেটের কাছে। বাঁ হাতের নখ দাঁতে কাটছে।
আরে, তুমি! এসো, এসো–এই সাতসকালে হঠাৎ–।
ভোরবেলাতেই লোহার গেটের তালা খুলে দেন সুধাময়। তাই গেট ঠেলে ভেতর ঢুকতে কোনও অসুবিধে হল না রণজয়ের।
ওর পরনে গাঢ় নীল জিনস্-এর প্যান্ট, হলুদ রঙের ঢোলা টি-শার্ট।
হালকা চালে সুধাময়ের কাছে চলে এল রণজয় ও সাতসকালে গাছের যত্ন নিচ্ছেন?
সুধাময় বসেই ছিলেন। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখছিলেন রণজয়কে। এই কাকভোরে কী জন্য এসেছে ছেলেটা? কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো? হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না। কে জানে, হয়তো অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছে মানুর কাছে।
রণজয়ের মুখ হঠাৎ বিষণ্ণ হল। দু-হাত একসঙ্গে জড়ো করে মাথা নীচু করে নিজের জুতোর দিকে তাকাল ও। নরম গলায় বলল, কাল সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। আপনাদের কাছে।
আমি মরমে মরে আছি। আপনি…আপনি আমাকে…।
ঠিক আছে..ঠিক আছে…যাও, ভেতরে যাও। মানু বোধহয় এখনও ঘুমোচ্ছে..।
ছেলেটার চোখে জল। ওর রোগা ফরসা মুখে গাঢ় বিষণ্ণতা মাখানো। সুধাময়ের ভীষণ মায়া হচ্ছিল।
আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, বাবা– বলে ঝুঁকে পড়ে সুধাময়ের পায়ের ধুলো নিল রণজয়।
থাক, থাক– ওকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন সুধাময়। কিন্তু তিনি লক্ষ করেননি, রণজয় যখন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন ওর হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ধারালো হেঁসো। আগাছা পরিষ্কার করার জন্য সুধাময়ই ওটা নিয়ে এসেছিলেন কোণের ঘর থেকে।
রণজয়ের নিষ্ঠুর বাঁ-হাত চেপে ধরল সুধাময়ের চুলের মুঠি। এক হ্যাঁচকায় তার মাথাটাকে হেলিয়ে দিল পিছনে। পলকের জন্য সুধাময় দেখতে পেলেন মেঘলা আকাশের পটভূমিতে রণজয়ের বিকৃত মুখ ওর দু-চোখের লালসা, আর তীব্র বাঁকা পথে তার গলা লক্ষ করে নেমে আসা হেঁসোটা।
চিৎকার করতে পারলেন না সুধাময়। কিন্তু তার চিৎকারের চেষ্টাটা বুদ্ধুদের মতো বেরিয়ে এল গলার ফাঁক দিয়ে। আর রক্ত ছিটকে গিয়ে ছাপ ফেলল রণজয়ের জিন্স-পরা প্যান্টে।
তার প্রিয় গাছপালার পাশে চিত হয়ে পড়ে গেলেন সুধাময়। তার সামান্য হাঁ হয়ে থাকা মুখে বৃষ্টির কণা ঢুকে পড়ছিল। বাতাসে ছটফট করতে করতে গাছের পাতাগুলো ভীষণ অবাক হয়ে বারবার সুধাময়কে জিগ্যেস করছিল, তোমার কী হল গো? কী হল তোমার? অমন চুপ করে অবাক চোখে তাকিয়ে কী দেখছ? কিন্তু সুধাময় ওদের আর্ত প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছিলেন না।
রণজয় হেঁসোটা ফেলে দিল সুধাময়ের দেহের পাশে। তারপর অত্যন্ত সহজ হালকা পায়ে দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে চলে এল মোজেইক করা বারান্দায়। সদর দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল, রণজয় সতর্ক হাতে সেটা ঠেলে ঢুকে পড়ল বিদিশাদের বাড়ির ভেতরে। তারপর দরজা লক করে ছিটকিনি এঁটে দিল।
বাড়ির ভেতরটা নিঝুম…আবছায়া অন্ধকার। একে মেঘলা, তার ওপর সব কটা জানলাতেই পরদা টানা। কিন্তু এ বাড়ির ভূগোল রণজয়ের নিজের হাতের চেটোর মতোই চেনা। তাই ও বেড়ালের মতো পা ফেলে এগিয়ে গেল বিদিশার ঘরের দিকে। মানু কোথায়?
বিদিশার ঘরের দরজাটা বন্ধ। এখনও ও ঘুম থেকে ওঠেনি।
তার পরের ঘরটাই অরুণা-সুধাময়ের। অবশ্য এখন থেকে শুধুই অরুণার। সেই ঘরের দরজা স্বাভাবিকভাবেই ভোলা। সুতরাং শাশুড়ির ঘরে ঢুকে পড়ল রণজয়।
অরুণা তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। তবে হালকা ঘুমের মধ্যে সামান্য এপাশ-ওপাশ করছিলেন। রণজয় ওর ডান হাতটা কলারের পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল পিঠে। তারপর ঢোলা টি শার্টের ভেতর থেকে টেনে বের করে নিয়ে এল খবরের কাগজে ভালো করে মোড়া লম্বা মতো একটা কী যেন। ব্যস্ত হাতে মোড়কের কাগজগুলো খুলে ফেলে দিতেই করাতের দাঁতওয়ালা একটা ঝকঝকে ছুরি দেখা গেল। সেটা ডান হাতে বাগিয়ে ধরে অরুণাকে ধাক্কা মারল রণজয়।
আচমকা রুক্ষ ধাক্কায় চমকে জেগে উঠলেন অরুণা। ঘুম জড়ানো চোখে যা দেখলেন তা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মুখের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে গিয়ে জিভটা খসখস করছে। বুঝতে পারলেন, চিৎকারের চেষ্টা করে লাভ নেই, কারণ কোনও শব্দ বেরোবে না তার গলা দিয়ে। আর এ-ও বুঝতে পারলেন, কোন রণজয়কে দেখে বিদিশা এতদিন ভয় পেয়েছে।
রণজয়ের চোখে পাগলের দৃষ্টি, মুখে হাসি, হাতে করাতের দাঁতওয়ালা ছুরি। ও ঠান্ডা গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। মানুকে ডাকুন।
সুধাময়ের জন্য দুশ্চিন্তা হল অরুণার। মানুষটাতো বাইরে গাছগাছালি নিয়ে থাকার কথা। এখনও সেখানে আছে তো? ওকে কিছু করেনি তো রণজয়!
অরুণাকে এক হ্যাঁচকায় বিছানা থেকে টেনে নামাল রণজয়। তারপর একইরকম শান্ত গলায় বলল, মানুকে ডাকুন।
বিস্রস্ত পোশাক ঠিক করতে করতে বিদিশার ঘরের দরজায় এলেন অরুণা। দরজায় ধাক্কা দিয়ে মেয়েকে নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। অনেকক্ষণ পর ঘুম জড়ানো গলায় সাড়া দিল বিদিশা।
অরুণার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছিল। সাতসকালের এই অদ্ভুত ঘটনা তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মুখের ভেতরে জিভ নড়ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন কথা বলার চেষ্টা করলে কথা জড়িয়ে যাবে।
বিদিশা দরজা খুলল। রণজয়কে দেখেই ওর ফরসা মুখ পলকে রক্তহীন হয়ে গেল। ও আকুল আর্ত চোখে অরুণার দিকে তাকাল। যেন বোঝাতে চাইল, ওদের আর কিছু করার নেই। একটা ভয়ংকর বিষধর পাগল সরীসৃপ ধারালো দাঁত নিয়ে হাজির হয়েছে পাখির খাঁচায়। কামড় সে দেবেই।
অরুণাকে এক ঝটকায় পাশে ঠেলে দিল রণজয়। অদ্ভুত এক তৎপরতায় বিদিশাকে টেনে নিল কাছে। চাপা গলায় অস্বাভাবিক সুরে হিসহিস করে বলল, মানু, আমার..মানু…।
বিদিশা সিঁটিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। রণজয়ের বাঁ-হাত কিছুক্ষণ অসভ্যের মতো ঘুরে বেড়াল ওর পিঠে। তারপর ওকে পাশে সরিয়ে অরুণাকে ডেকে নিল রণজয়, আপনি এ-ঘরটায় ঢুকুন। আমি আর আপনার মেয়ে ও-ঘরটায় থাকব।
রণজয়ের কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত অরুণা চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন মেয়ে-জামাইয়ের দিক থেকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। রণজয় তাকে ডেকে যখন বিদিশার ঘরে ঢুকতে বলল তখন তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল।
বাপ্পা সদর দরজার দিকে ওর ছোট ঘরটায় ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুম থেকে উঠতে এখনও অনেক দেরি। রণজয় কি ওকেও ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলবে নাকি!
অরুণার ঘরের লাগোয়া গ্রিল দেওয়া বারান্দায় গেলে বাগানটা দেখতে পাওয়া যায়। আর একইসঙ্গে লোহার গেট, পিচের রাস্তাও দেখা যায়। সুতরাং বারান্দায় দিকের দরজাটা খুলে চিৎকার চেঁচামেচি করলে রাস্তার লোকজন শুনতে পাবে। কিন্তু এই ভোরে রাস্তায় মানুষজন পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া রণজয় হয়তো সেই সুযোগের কথা আঁচ করেই অরুণাকে বিদিশার ঘরে ঢুকতে বলেছে।
বিদিশার ঘরে ঢুকে অরুণা যখন সুধাময়ের চিন্তায় আর আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে আছেন তখন রণজয় এক চিলতে হেসে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার আগে ছোট্ট করে বলল, প্লিজ, চিৎকার-টিকার করবেন না। করলে আপনার মেয়ের গলা কেটে দেব– কথা শেষ করার সময় হাতের ছুরিটা উঁচিয়ে দেখিয়েছে রণজয়। তারপর বন্ধ দরজার হাঁসকল টেনে দিয়েছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে হাত চালিয়ে কপালে এসে পড়া চুল ঠিক করল রণজয়। তারপর রুক্ষভাবে বিদিশাকে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলল ডাইনিং হলের দিকে।
বন্ধ ঘরের ভেতরে বন্দি হয়ে অরুণা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। রণজয়ের সঙ্গে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যেতে সেই কান্নার গোঙানি শুনতে পেল বিদিশা। ওরও কেমন কান্না পেয়ে গেল। একইসঙ্গে সুধাময়ের চিন্তাটাও চলে এল মাথায় ও বাপি কোথায়?
ডাইনিং হলে এসেই এক অভদ্র ধাক্কায় বিদিশাকে একটা চেয়ারের দিকে ঠেলে দিল রণজয়। বিদিশা বেশ ব্যথা পেল কোমরে, কিন্তু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে ভয় পেল।
ছুরি হাতে রণজয় উদভ্রান্ত বিদিশাকে একবার দেখল, তারপর এগিয়ে গেল বাপ্পার ছোট ঘরের দিকে।
বিদিশা এবার চিৎকার করে উঠল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ক্ষিপ্ত চিতার মতো ওর দিকে ছিটকে এল রণজয়। এক ধাক্কায় ওকে চেয়ারসমেত কাত করে ফেলে দিল মেঝেতে।
বিদিশার ভয়ের চিৎকারটা মাঝপথে থেমে গিয়ে ব্যথার গোঙানি বেরিয়ে এল।
অগোছালোভাবে পড়ে থাকা বিদিশার দিকে তাকিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিল রণজয়। বিদিশা ওর ভয়ংকর চোখ-মুখ দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করল।
সকালবেলাতেই নানারকম শব্দ আর কথাবার্তা বোধহয় বাপ্পার ঘুম হালকা করে দিয়েছিল। কারণ, বাপ্পার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হল। রণজয় ছুটে সেই দরজায় কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাপ্পা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ওর পরনে ডোরাকাটা পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি।
বাপ্পাকে দেখে বিদিশা চিৎকার করে উঠল, শিগগির! ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দে! জলদি।
বুট পরা পায়ে বিদিশার পাঁজরে প্রচণ্ড এক লাথি কষাল রণজয়। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ফাকিং বিচ! তারপর এক লাফে পৌঁছে গেল বাপ্পার ঘরের দরজায়। কিন্তু বাপ্পা ততক্ষণে দিদির কথা মতো ঘরে ঢুকেই দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে।
রণজয় বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বাপ্পার ঘরের দরজাতেও হাঁসকল টেনে দিল। ও জানে, বাপ্পার ঘর থেকে পালানোর কোনও উপায় নেই। তা ছাড়া ওর ঘর থেকে চেঁচিয়ে রাস্তার কাউকে ডাকা বেশ কঠিন। কারণ, ওর ঘরের পাশ ঘেঁষে পরপর দুটো খালি প্লট আগাছা আর জঙ্গলে ছেয়ে আছে।
ছুরি হাতে এবার বিদিশার কাছে এসে দাঁড়াল রণজয়। ছুরিটা ডাইনিং টেবিলের একপাশে রেখে দিয়ে ওর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে তেরছাভাবে হাসল, বলল, এসো বউ, আর কোনও লজ্জা নেই–এবারে ফুলশয্যা হয়ে যাক।
বিদিশার ফরসা সুন্দর মুখ ভয়ে বেঁকেচুরে গেছে। কোমরে, পাঁজরে অসহ্য ব্যথা। ডাইনিং হলের এক কোণে রাখা টেলিফোনের দিকে তাকাল ও। যদি কোনওরকমে শেখরকে একটা ফোন করা যেত। কিন্তু ফোন করেই বা কী হত! শেখর টালিগঞ্জ থেকে আসতে-আসতে কম করেও একটি ঘণ্টা। তখন কি আর সাহায্যের কোনও দরকার হবে!
কিন্তু টেলিফোন আর কাউকে করা যায় না? বাড়ির কাছাকাছি কাউকে? পাশের লেনের রমেশবাবুকে, কিংবা ডক্টর সান্যালকে?
হঠাৎ-ই বিদিশা টের পেল, ও বোকার মতন দিবাস্বপ্ন দেখছে। রণজয়ের সামনে এখান থেকে কাউকে ফোন করা অসম্ভব। টেলিফোনের আর-একটা প্যারালাল লাইন রয়েছে সুধাময়-অরুণার ঘরে। সেটা মনে রেখেই বোধহয় রণজয় অরুণাকে বিদিশার ঘরে টেনে এনে বন্দি করেছে। কিন্তু সেখান থেকেও বা ফোন করবে কেমন করে! যদি সুধাময় থাকতেন বাড়িতে, তা হলে…।
কিন্তু বাপি কোথায়? বাইরের বাগানে, নাকি ভোরবেলাতেই বাজারে রওনা দিল? উঁহু, বাজারে। তো যায়নি–ওই তো, রান্নাঘরের দেওয়ালে বাজারের থলে ঝুলছে! বিদিশা হঠাৎ-ই সুধাময়ের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। ও আর কান্না চাপতে পারল না। হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
আর ঠিক তখনই রণজয় ঝুঁকে পড়ে বিদিশাকে এক হ্যাঁচকায় দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ওকে খুব কাছে টেনে নিয়ে বলল, বউ, কতদিন তোমাকে ভালো করে দেখিনি– ওর গালে ঠোঁটে পরপর কটা চুমু খেল রণজয়। তারপর আদুরে গলায় বলল, নাও, দেখাও।
বিদিশার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। ওর শরীরটা কাঠ হয়ে ছিল রণজয়ের হাতের বাঁধনে। কান্নার দমকে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠছিল বারবার। ও চোখ নামিয়ে রেখেছিল মেঝের দিকে। কী হবে এখন! এই বিপজ্জনক পাগলটার হাত থেকে কী করে রেহাই পাবে বিদিশা!
কী হল! দেখাও– ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রণজয়, নাও, চটপট সব খোলো–।
এতক্ষণে পাগলটার খামখেয়ালি মতলব স্পষ্ট হল বিদিশার কাছে। এই নোংরা লোকটার সঙ্গে ও দু-বছর ঘর করেছে ভাবতেও গা ঘিনঘিন করে উঠল ওর। ও আড়চোখে ডাইনিং টেবিলে রাখা নির্লিপ্ত ছুরিটার দিকে দেখল। পুরোনো কয়েকটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল বিদিশার। এইরকম বিপদ এড়াতেই ও মানিকতলার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল সল্ট লেকে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, লাভ কিছু হয়নি।
রণজয়ের হাত ওর শাড়ি খামচে ধরতেই বিদিশা চমকে উঠল। প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিল ভুল করে। ভুল যে হয়েছে সেটা বুঝিয়ে দিল রণজয়ের নৃশংস থাপ্পড়। বিদিশা টলে পড়ে গেল মেঝেতে। পড়ে থাকা চেয়ারটা ওর শরীরকে বাধা দিল। ফলে যন্ত্রণার তির বিধে গেল পিঠে, কোমরে। ও চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
আর তখনই শুনতে পেল, বন্ধ দরজার পিছন থেকে মা চেঁচিয়ে ডাকছে ওকে? মানু! মানু, কী হল? রনো, দরজাটা খুলে দাও। মাথা গরম কোরো না। কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো। মানুকে কিছু কোরো না…।
রণজয় একবার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল বন্ধ দরজাটার দিকে। তারপর ঝুঁকে পড়ে একমনে বিদিশার শাড়ি ধরে টানতে লাগল।
বিদিশা আর বাধা দিতে পারল না। শাড়ির পাক যতই খুলতে লাগল ওর শরীরটা ততই গড়িয়ে যেতে লাগল পাকে-পাকে।
রণজয় অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে দ্রুত হাতে কাজ সারতে লাগল। খুলে নেওয়া শাড়িটা ও দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল এক কোণে। তারপর পাথরের মতো মুখে বিদিশাকে হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল।
তুমি নিজে খুলবে, না কি আমাকে খুলতে হবে!
রণজয়ের গলার স্বর ভয় পাইয়ে দিল বিদিশাকে। ওর মনে হল, রণজয় বোধহয় বেশ কয়েকটা টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে এসেছে। ও তাড়াতাড়ি ব্লাউজের হুকে হাত দিল।
অরুণা তখনও ইনিয়েবিনিয়ে কেঁদে কেঁদে কীসব বলছিলেন ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না।
রণজয় সরাসরি বিদিশার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে চোখ রেখেই ও ডাইনিং টেবিলে উঠে বসল। বলল, মানু, আমি ফুলশয্যার রাতের মতো এক্সাইটেড হয়ে পড়েছি। কুইক। ওঃ, কাম অন–অত লজ্জা কোরো না। তোমার সবই তো আমার দেখা–শুধু মাঝে ন-দশ মাস দেখিনি। নাও, জলদি।
বিদিশার বোধহয় দেরি হচ্ছিল। অন্তত রণজয়ের সেইরকমই মনে হয়েছে। তাই ও একলাফে নেমে এল বিদিশার খুব কাছে। ওকে জাপটে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল, মুখ ঘষতে লাগল, শরীরে শরীরে ঘষতে লাগল। ওর হাত মাকড়সার মতো হেঁটে বেড়াতে লাগল বিদিশার সারা গায়ে।
বিদিশার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। ও এবার স্পষ্ট টের পেল রণজয়ের অবস্থা। সত্যিই ও টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে এসেছে। বিদিশা কাঁদতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু ওর গলা দিয়ে কেমন একটা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছিল।
ব্লাউজ কখন খুলে গেছে। রণজয়ের লোভাতুর হাতের সামনে কোনও আড়ালই আর নেই। বিদিশা নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অনুভব করতে লাগল ওর প্রাক্তন স্বামীর নির্লজ্জ আদর। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে মুখ দিয়ে। ও দেখতে পাচ্ছিল, ওর ফরসা বুকে রণজয়ের কালো মাথাটা কেমন ঘনিষ্ঠ হয়ে রয়েছে, পাগলের মতো ছটফট করছে এপাশ-ওপাশ।
হঠাৎ-ই রণজয় খ্যাপা কুকুরের মতো বিদিশাকে এক হাচড়ায় কোলে তুলে ফেলল। তারপর বসিয়ে দিল ডাইনিং টেবিলে। ওর শায়ার দড়ি ধরে প্রচণ্ড এক টান মারল। পট করে ছিঁড়ে গেল দড়ি। বিদিশা চোখ বুজে ফেলল। ঘেন্নায় ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
সেই অবস্থাতেই ও টের পেল শায়াটা ধরে ভয়ংকর এক টান মারল কেউ। শব্দে বুঝল শায়া অনেকটা ছিঁড়ে গেল। তারপর বেশ কয়েকটা হ্যাঁচকা টানে ওটা বিদিশার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হল।
লজ্জা ঢাকতে বিদিশা চোখ বুজেই ছিল। তবু টের পাচ্ছিল রণজয় ওর ইচ্ছে মেটানোর পথে ধাপে-ধাপে এগোচ্ছে। পাঁচ-দশ সেকেন্ড পরেই ডাইনিং টেবিলটা বিছানা হয়ে গেল, আর ডাইনিং হলটা বেডরুম। সেইসঙ্গে দিনটাও বোধহয় রাত হয়ে গেল।
সহবাস যে ধর্ষণের চেয়েও জঘন্য হতে পারে সেটা এই প্রথম উপলব্ধি করল বিদিশা। রণজয়ের ফ্রন্টাল লোবের যত গণ্ডগোল সব ধরা পড়ে গেল এই মিলনেও। উপোসী কোনও অশরীরী শরীর ফিরে পেতে যতটা আকুল হয় রণজয়ের চাহিদাও ছিল ঠিক ততটাই আকুল।
পরিশ্রমের ধকলে হাপরের মতো হাঁফাচ্ছিল রণজয়, আর কাঠ হয়ে পড়ে থাকা বিদিশার কোমল শরীর সেই কম্পন অনুভব করছিল। একইসঙ্গে বিদিশা ভাবছিল, কী করে রুখে দেওয়া যায় এই মারাত্মক অমানুষটাকে।
বাপ্পা চিৎকার করে ডাকছিল, দিদি! দিদি!
অরুণাও কান্না মেশানো গলায় মানু! মানু! করে ডাকছিলেন আর বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন।
রণজয় হঠাৎই বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় খিস্তি করে রাগের চোখে ঘুরে তাকাল বিদিশার ঘরের দিকে–যে ঘরে বন্দি আছেন অরুণা। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গেল সেদিকে।
বিদিশার চোখে জল, বুকের ভেতরে নাম-না-জানা কষ্ট। ও উঠে বসল ডাইনিং টেবিলে। ব্লাউজ হুকগুলো লাগিয়ে নিল। তারপর লজ্জা ঢাকতে নেমে এল ডাইনিং টেবিল থেকে।
ওকে নামতে দেখেই ক্ষিপ্ত রণজয় এক ঝটকায় ফিরে এল ওর কাছে। এক হাতে টুটি টিপে ধরল ওর।
বিদিশার গলা দিয়ে অস্পষ্ট একটা আঁক শব্দ বেরিয়ে এল। সেই অবস্থাতেই ও চোখের ইশারায় ঘরের কোণে পড়ে থাকা দলা পাকানো শাড়িটা দেখাল। রণজয় বুজতে পারল একটা ছোট্ট ধাক্কায় ওকে ঠেলে দিল সেদিকে।
অরুণা তখনও দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন, কান্না জড়ানো গলায় মানু! মানু করে ডাকছিলেন।
রণজয় সাংঘাতিক বিরক্ত হয়ে খ্যাপা কুকুরের মতো ছুটে গেল সেদিকে। দরজায় একটা জোরালো ধাক্কা মেরে অরুণাকে চুপ করতে বলল। তারপর অশ্রাব্য গালিগালাজের ফোয়ারা ছোটাল।
বিদিশা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিল। তখনই খেয়াল করল, টেলিফোনটা ওর একেবারে হাতের নাগালে।
রণজয় এখন বিদিশার কাছ থেকে অনেকটা দূরে। সুতরাং টেলিফোনটা বিদিশা চট করে একবার ব্যবহার করতে পারে। তবে রণজয় সেটা দেখতে পাবে এবং বিদিশাকে হয়তো অবাধ্যতার জন্য হিংস্র শাস্তি পেতে হবে।
রণজয়ের করাতের দাঁতওয়ালা ছুরিটা এখনও পড়ে আছে ডাইনিং টেবিলে–মাত্র কয়েকহাত দূরে। বিদিশা ইচ্ছে করলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা তুলে নিতে পারে। কিন্তু হাতে পেলেই কি ও জিততে পারবে এই পাগলটার সঙ্গে!
হয় টেলিফোন, নয় ছুরি। যে-কোনও একটা হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে বিদিশা। গায়ে শাড়ি জড়াতে-জড়াতে এই অঙ্কের হিসেবটাই কষছিল ও।
শেষ পর্যন্ত ও টেলিফোনের পক্ষেই গেল। শাড়ি খানিকটা অংশ মেঝেতে ফেলে দিয়ে সেটা ঠিক করা ভান করে ঝুঁকে পড়ল মেঝেতে।
সেই সুযোগে টেলিফোনের রিসিভারটা মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে শেখরের বাড়ির নম্বরটা ঘোরাল ডায়ালে : ফোর সেভেন টু ওয়ান নাইন ওয়ান সেভেন।
বিদিশার পিঠ রণজয়ের নজর আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি মুহূর্তই ও ভাবছিল, এই বোধহয় রণজয় এসে দাঁড়াবে ওর পিঠের কাছে, ধরে ফেলবে ওর অভিসন্ধি। তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকায় ওকে…।
মেঝেতে পড়ে থাকা রিসিভারে একটি মহিলা কণ্ঠ হ্যালো, হ্যালো করছিল। বিদিশা অতি সন্তর্পণে রিসিভারটা তুলে নিয়ে এল মুখের কাছে। ফিসফিস করে বলল, আমি বিদিশা বলছি। শেখরকে বলুন আমাদের বাড়িতে এক্ষুনি চলে আসতে। ভীষণ বিপদ…।
পিছন থেকে একটা লাথি এসে পড়ল বিদিশার পিঠে। বিদিশা ঠিকরে পড়ল ডাইনিং হলের বড় জানলার কাছে। ওর শাড়ির অর্ধেকটা কোমরে জড়ানো, বাকিটা লুটোপুটি। সেই অবস্থাতেই ও দেখল, রণজয় ডাইনিং টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে নিয়েছে। ছুরির এক কোপে কেটে দিল। টেলিফোনের তার। তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে জোরে আছড়ে মারল মেঝেতে। সংঘর্ষের শব্দ হল। চুরমার হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক আর ধাতুর টুকরো ছড়িয়ে গেল চারদিকে।
রণজয় হাসল বিদিশার দিকে তাকিয়ে। বলল, কী রে, মানু, ভয় পেলি? তারপরই একরাশ খিস্তিখেউড়।
ছুরির ডগাটা বিদিশার ব্লাউজের মাঝামাঝি ঠেকাল রণজয়। ছুরিটা ফেলে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল বিদিশার ওপরে। দাঁত দেখিয়ে হাসল, বলল, মানু, আয়, আরও একবার হয়ে যাক।
বিদিশার গা ঘিনঘিন করে উঠল। আবার! টেনটেক্স ফোর্টের তেজ সহজে কমে না।
কিন্তু আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই রণজয় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বিদিশার ওপরে। চাপা কর্কশ গলায় বলেছে, তোকে আমি ছাড়ব না!
টেলিফোন আছড়ে ফেলার শব্দে ভয় পেয়েছিলেন অরুণা। বাপ্পাও ভয় পেয়েছিল। সুতরাং কান্নার শব্দ আর দরজার ধাক্কা দুটোই কয়েক পরদা বেড়ে গেল।
রণজয় এবারে আর বিরক্ত হল না। কারণ ওর রক্তে তখন খই ফুটতে শুরু করেছে।
একটা নাম-না-জানা ঘৃণায় বিদিশা হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল, বাধা দিতে চাইল হামলে পড়া জন্তুটাকে। কিন্তু তার জবাবে বিদিশার গলা টিপে ধরল রণজয়। আর বিদিশা ডুবে যাওয়া মানুষের মতো এলোমেলোভাবে বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইল।
বিদিশার চোখের সামনে রণজয়ের বিকৃত মুখ, কপালে-নেমে-আসা চুল, আর গরম নিশ্বাস। আর ওর হাত নিতান্ত অকারণেই খড়কুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এরকমই একটা অবস্থায় বিদিশার হাত পড়ল বেগন পাওয়ারের স্প্রে সিলিন্ডারে। জানলার ঠিক নীচেই দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে সিলিন্ডারটা দাঁড় করানো থাকে। মশা মারার জন্য কেনা হয়েছে এই ওষুধটা। ধাতুর লম্বাটে বোতালের মাথায় সাদা রঙের বোতাম। বোতামে চাপ দিলেই বেরিয়ে আসে ধোঁয়ার মতো স্প্রে। কী বিশ্রী দুর্গন্ধ! নাকে এলেই বিদিশার মাথা ঝিমঝিম করে।
এটা রণজয়ের মুখে স্প্রে করলে কি ওকে থামানো যাবে? মশা মারার বিষে মানুষ কি একটুও অবশ হবে না!
বিদিশা আর ভাবতে পারছিল না। ও মরিয়া হয়ে সিলিন্ডারটা খামচে ধরে রণজয়ের মুখ লক্ষ করে বোতাম টিপে দিল। সাদা ধোঁয়ার মতো স্প্রে রণজয়ের মুখ ঝাপসা করে দিল। উকট দুর্গন্ধে বিদিশার গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু ও দাঁতে দাঁত চেপে বোতাম টিপেই রইল।
এইরকম একটা প্রতিরোধের জন্য রণজয় তৈরি ছিল না। মুখে স্প্রে এসে পড়ামাত্রই ও বিদিশাকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে গড়িয়ে গেল একপাশে।
কিন্তু বিদিশা কোণঠাসা বেড়ালের মতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। ও স্প্রে করেই চলল। কখনও রণজয়ের মুখে, মাথায়, কানে, গলায় কখনও বা হাতে, পায়ে, গায়ে। তাক কখনও ঠিক হচ্ছিল, কখনও বা ভুল। কিন্তু মরিয়া বিদিশা বোতামের ওপরে আঙুলের চাপ এতটুকু আলগা করেনি।
রণজয়ের মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু সেই অবস্থাতেও ও ছুরিটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছিল। কোথায় গেল ছুরিটা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলিন্ডার প্রায় শেষ হয়ে গেল। খালি বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চারপাশে দেখল বিদিশা। জানলার তাকে টুকিটাকি অনেক জিনিস। একটা তালাচাবি, সাবানকেস, মোমবাতি, ছোট একটা শেকল, দেশলাই, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, আরও কত কী।
দেশলাই! মশা মারার ওই ওষুধে কি সহজে আগুন ধরে? কেরোসিন তেলের মতো? বিদিশার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। ও উদভ্রান্ত নজরে দেখল, রণজয় সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। ওর হাতে সেই ছুরি। সারা গা বেগন পাওয়ারে ভেজা। চোখে খুনির দৃষ্টি।
বিদিশা আর কিছু ভাবতে পারল না। দেশলাইয়ের বাক্সটা তুলে নিয়ে কাঠি বের করে নিল। এক ঘষায় সেটা জ্বেলে ছুঁড়ে দিল রণজয়ের গায়ে।
চোখের পলকে যেন দেওয়ালি শুরু হয়ে গেল। রণজয়ের ছুরি বাগিয়ে ধরা লড়াকু শরীরটায় আগুন ধরে গেল দপ করে। তারপর লকলকে শিখায় এলোপাতাড়ি জ্বলতে লাগল।
আগুন ধরে গেল ঘরের বাতাসে, যেখানে ওষুধের বাষ্পের কণা ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর বিদিশার শাড়িও রেহাই পেল না। কখন যেন বেগন পাওয়ার ছুঁয়ে গেছে ওর শাড়ি।
বিদিশা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। রণজয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল জন্তুর গর্জন। আর বন্ধ দরজা দুটোয় কান ফাটানো শব্দ করছিলেন অরুণা ও বাপ্পা–সেই সঙ্গে তীব্র চিৎকার।
এই তুমুল বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিদিশার দিকে আঁপিয়ে পড়ল রণজয়ের জ্বলন্ত শরীর। ওর টলোমলো ডান হাত আনাড়ির মতো ছুরি চালাল বিদিশাকে লক্ষ করে।
বিদিশা তখন চিৎকার করে ছুটেছিল কলঘরের দিকে, আর পরনের শাড়িটাকে গা থেকে খুলে ফেলতে চেষ্টা করছিল। রণজয়ের ছুরি ওর ডান বাহুতে এসে লাগল, কিন্তু সেই যন্ত্রণা বিদিশা বোধহয় টের পেল না। ও পাগলের মতো ঢুকে পড়ল কলঘরে। শাওয়ারের কল খুলে দিল শেষ পাঁচ পর্যন্ত। তারপর শাওয়ারের নকল বৃষ্টির নীচে কয়েক লহমা দাঁড়িয়ে গোড়া কাটা গাছের মতো ঠাস করে পড়ে গেল কলঘরের মেঝেতে।
নকল বৃষ্টি ওর লজ্জাহীন শরীরকে তখন ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই অবস্থাতেও বিদিশা শেষবারের মতো দেখল, রণজয়ের দেহটা মেঝেতে পড়ে গিয়েও দাউদাউ করে জ্বলছে।
চেতনা হারানার আগে বিদিশা অনেকগুলো দরজায় একসঙ্গে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল। মনে হল, বাইরে থেকে কে যেন সদরে কলিংবেলের বোতাম টিপছে।
তারপর আর কিছু ওর মনে নেই।
.
চোখ খুলেই নার্সিং হোমের সাদা দেওয়াল, সাদা পোশাক পরা নার্স। এ ছাড়া সাবানের ফেনার মধ্যে ভাসছে বেশ কয়েকটা পরিচিত রঙিন মুখ। সেই মুখগুলোর মধ্যে মা-বাবা রণজয়কে খুঁজল বিদিশা। কিন্তু শুধু মাকে দেখতে পেল।
মাথার অসহ্য যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ও ভাবতে চেষ্টা করল।
না, এটা সেই প্রথমবারের নার্সিং হোম নয়। টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিদিশা এখানে আসিনি। এখানে ও এসেছে অন্য কোনও কারণে।
জলের গভীর থেকে বুদবুদ যেমন ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে আসে ঠিক সেইভাবে বিদিশার অচেতন মন চেতনায় ভেসে উঠছিল। শরীরের জ্বালা যন্ত্রণাগুলো একটু-একটু করে টের পাচ্ছিল ও। আর একইসঙ্গে চোখের নজর স্বচ্ছ হয়ে উঠছিল।
এইবার মুখগুলোকে স্পষ্ট করে চিনতে পারল বিদিশা। মা, বাপ্পা, শেখর, বোসদা, দেবলীনা, সুতপাদি আর অশোক চন্দ্র।
ওকে চেতনায় দেখে সবাই স্বস্তির হাসি ফোঁটাল মুখে।
বিদিশাও হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু ঠোঁটে বেশ ব্যথা।
অরুণা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করলেন, এখন কেমন আছিস?
বিদিশা সামান্য মাথা নেড়ে বলল, ভালো।
আর তখনই ও মায়ের সাদা শাড়ি খেয়াল করল।
ও সামান্য ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্টভাবে প্রশ্ন করল, বাপি আসেনি?
অরুণা বাপ্পাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মাথা নীচু করে আঁচলে মুখ গুঁজলেন। শেখর এগিয়ে এসে অরুণাকে আলতো করে ঠেলে সরিয়ে দিল। বিদিশার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনার এখন কথা বলার দরকার নেই–স্ট্রেইন হবে।
সুতপাদি আর দেবলীনা বিদিশার হাত ধরল, হাসল ঠোঁটে।
বিদিশার সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। নার্সিং হোমে ও কতদিন পড়ে আছে? পাঁচ দিন? সাত দিন? দশ দিন?
ও বিড়বিড় করে বলল, রণজয়…।
শেখর বলল, কথা বলতে বারণ করলাম না! আপনার আর কোনও ভয় নেই…আর কেউ কখনও আপনাকে বিরক্ত করবে না। সেরে উঠে পরে সব শুনবেন।
বাপি… ডুকরে কেঁদে উঠল বিদিশা। ওর চোখ ভিজে গেল।
নার্স এগিয়ে এল শেখরের কাছে। বলল, আপনারা এবার যান। পেশেন্টকে এবার ঘুমের ইনজেকশন দেব।
ওরা একে-একে সরে এল বিদিশার কাছ থেকে।
বিছানার পাশের জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিল বিদিশা। কোথাও সাদা মেঘ, আর কোথাও নীল আকাশ। কালো মেঘ কোথাও নেই।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সুধীর বোস বললেন, মা জননী, তুমি ঝটপট সেরে উঠে অফিসে জয়েন করো। তুমি অফিসে না এলে আমরা ঠিক কাজে মুড পাচ্ছি না।
অশোক চন্দ্র জিগ্যেস করল, বোসদা, আমরা মানে কারা?
ঘরের দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে শেখরের পিঠে চাপড় মেরে বোসদা বললেন, আমরা মানে আমি আর শেখরভায়া–।
অশোক অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠল, আমি কি সেদিনের মতোই এজ বারে আটকে গেলাম?
সুধীর বোস পান চিবোতে-চিবোতে গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়েস।
পোষা পাখির বাগানে
হিতেশ কাপুর
রোমিলাকে আমি সঙ্গে নিতে চাইনি।
নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গা, সেই কারণেই একটু ইতস্তত করেছিলাম। এখন দেখছি মনের বাধায় সাড়া দিলেই ভালো হত। এই ভয়ঙ্কর পরিণতি আমার ভাগ্যে জুটত না। প্রতিটি পল-অনুপল কাটাতে হত না অন্ধ আশঙ্কায়। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যে কাকে আমি দায়ী করব? কাহূরেইন-এর শেখ আবদুল অল হারিদকে? আমার বন্ধু মোহন খান্নাকে? আমার বোন রোমিলাকে? না দায়ী করব নিজেকেই?
প্রথমদিন থেকে ঘটনাগুলো যেন ছবির মতো মনে পড়ছে। ছোট্ট অ্যাভো প্লেনটায় আমরা তিনজন উড়ে চলেছিলাম কাহরেইন-এর দিকে। তিনজন বলতে আমি, মোহন আর রোমিলা। প্লেনে আর কোনও যাত্রী ছিল না। কারণ, শেখ হারিদ আমাদের জন্যেই পাঠিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব ছোট প্লেনটি। তিনজনেই বেশ খোশমেজাজে ছিলাম। কাজের সূত্রে এরকম নতুন দেশ দেখার সুযোগ কজন পায়। কিন্তু…
শুরু থেকেই তা হলে শুরু করা যাক।
.
রোমিলা জানলা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। নীচে, অনেক নীচে পার্শিয়ান গালফ সেখানে সূর্যের আলোয় নীল জল ঝিলিক মারছে। পথ ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু রোমিলাকে দেখে মনে হচ্ছে, নিজের সৌভাগ্যকে ও এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। কোনওদিন যে এরকম একটা দূর দেশে ও বেড়াতে আসবে সেকথা স্বপ্নেও ভাবেনি। ওকে খুশি দেখে আমার মনটা ভরে গেল। মা-বাপ মরা ওই একটা আদরের বোন আমার। আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। সারাটা জীবন ও ঘরকুনো হয়ে পড়ে রইল। জীবনের সাধ আহ্লাদ-আনন্দ কিছুই তেমন করে পেল না। এমনিতে ও খুব কম কথা বলে। নিঃশব্দে সাংসারিক কাজ সেরে দেয়। কিন্তু এখন ও একেবারে পালটে গেছে। সেই রওনা হওয়ার সময় থেকেই ছোট্ট মেয়েটির মতো খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে।
সংক্ষেপে আমার পরিচয়টা এখানে সেরে নিই।
আমার নাম হিতেশ কাপুর। এখনও মনের মতো মেয়ে পাইনি, তাই কুমার হিতেশ কাপুর হয়েই রয়ে গেছি। ভারতের এক নামি তেল কোম্পানিতে আমি চাকরি করি। চাকরিসূত্রে প্রায়ই আমাকে হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াতে হয়, কিন্তু ভারতের বাইরে এই প্রথম। বিদেশি তেল কেনাবেচার ব্যাপারে হঠাৎই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল পার্শিয়ান গালফ-এ যাওয়ার।
কোম্পানির ডিরেক্টরের কাছ থেকে কথাটা শুনে যে আনন্দ হয়নি তা নয়, কিন্তু একই সঙ্গে আর একটা চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে : রোমিলার কী হবে? কারণ পার্শিয়ান গালফ এ আমার সাতদিনও লাগতে পারে, আবার সাতাশদিনও লাগতে পারে। দু-চারদিনের ব্যাপার হলে রোমিলাকে একাই রেখে যেতাম। বাড়ির কাজের লোক ওর দেখাশোনা করত। কিন্তু এতগুলো দিন? তাছাড়া বেচারি মেয়েটা খুব মনমরা হয়ে পড়বে। সুতরাং সেদিনই বাড়ি ফিরে রোমিলাকে বললাম, অফিসের কাজে আমাকে মিডল ইস্ট যেতে হচ্ছে। সামনের সপ্তাহে।
ও ছোট্ট করে জিগ্যেস করল, ক-দিনের জন্যে, দাদা?
সাতদিনও লাগতে পারে, আবার এক মাসও লাগতে পারে।
রোমিলা গম্ভীর হয়ে গেল। ওর মুখটা বিষণ্ণ দেখাল। আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। একটু চুপ করে থেকে বললাম, ভাবছি, তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।
সঙ্গে-সঙ্গে অবাক কাণ্ড ঘটল। রোমিলা মুখ নামিয়ে বসেছিল, চকিতে মুখ তুলে তাকাল। চোখেমুখে খুশির ফুল ফুটেছে। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অবিশ্বাসে ভরা মিষ্টি গলায় বলে উঠল, সত্যি!
আমি প্রাণখোলা হাসি হেসে বললাম, সত্যি। তোর বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
আমার বরাবরের দেখা মনমরা চুপচাপ মেয়েটা আনন্দে খুকি হয়ে গেল। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বিদেশ ঘোরা আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল জানো? উফ, আমি ভাবতেই পারছি না দাদা, এই খবরটা সত্যি। যাই, টেলিফোনে বন্ধুদের খবর দিই।
ও ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হল, রোমিলার মনমরা চুপচাপ আচরণের জন্যে আমিই দায়ী। বাইরে ঘোরার নামে মেয়েটা এত খুশি হয়! ওকে খুশি রাখার জন্যে এবার থেকে মাঝে-মাঝে ওকে বেড়াতে নিয়ে যাব। নিজের ওপরে রাগ হল। এ কথাটা আমার আগে কেন খেয়াল হয়নি?
পরদিনই অফিসে সব ব্যবস্থা সেরে নিলাম।
অফিস থেকে পার্শিয়ান গালফ ট্যুরে আমি একা যাচ্ছি না। আমার সঙ্গী হচ্ছে সিনিয়র কমার্শিয়াল ম্যানেজার মোহন খান্না। মোহন আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড় হলেও সম্পর্কটা আমাদের বন্ধুর মতো। ওকে একান্তে নিয়ে রোমিলার কথা খুলে বললাম।
আমার সমস্যাটা শুনে ও রাজি তো হলই, তা ছাড়া নতুন বুদ্ধি দিল। বলল, হিতেশ, বোনকে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত খরচ তুমি করবে ঠিক করেছ জানি। কিন্তু তবুও একটা পরামর্শ দিই। আমরা দুজনেই অফিস থেকে ফার্স্ট ক্লাস এয়ার ফেয়ার পাই। যদি তা নিয়ে আমরা ইকনমি ক্লাসে ট্রাভেল করি তাহলে তোমার বোনের প্লেন ভাড়া তো উঠে যাবেই, তার ওপর হোটেল খরচও কিছুটা পাওয়া যাবে।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু তুমি কেন ফার্স্ট ক্লাস ছেড়ে ইকনমি ক্লাসে ট্রাভেল করতে যাবে? তোমার অসুবিধে হতে পারে।
মোহন আমার পিঠে একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় কষাল। তারপর হেসে বলল, নখরা ছোড়, ইয়ার। তোমার বোনকে সুখবরটা আজই ফাইনাল করে শুনিয়ে দাও, তারপর স্টার্ট প্যাকিং। সামনের মঙ্গলবার আমাদের ফ্লাই করতে হবে।
সেই মুহূর্তে মোহন খান্নাকে খুব ভাল লাগল আমার। বুকের ভেতরে খুশি উপচে পড়তে লাগল।
সেদিনই বাড়ি ফিরে হাঁকডাক করে রোমিলাকে ফাইনাল খবর জানিয়ে দিলাম। তারপর দু-ভাইবোন মিলে গোছগাছ শুরু করলাম। উৎসাহ কারও কম নয়। রোমিলাকে বললাম, ওখানে এক শেখের কাছ থেকে তেল আদায় করার জন্যে কোম্পানি আমাকে আর মোহন খান্নাকে পাঠাচ্ছে, বুঝলি? আমরা তিনজনে গিয়ে শেখকে নিংড়ে তেল বের করে ছাড়ব।
আমি আর রোমিলা গলা ছেড়ে হেসে উঠলাম। কাজের মেয়েটি, নাম কমলা, সেই হাসি শুনে ছুটে এল আমাদের ঘরে। হয়তো ভাবল, দাদা-দিদি পাগল হয়ে গেছে।
*
নিজের অবাক করা সৌভাগ্যে রোমিলা তখনও মশগুল। আমি ওর পাশে বসে গুগুন করে গানের সুর ভাঁজছি। আমাদের সামনের সিট থেকে মোহন খান্না ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। এয়ার হোস্টেসদের সুর নকল করে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল, লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।
রোমিলা খুশিতে ফিরে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। তারপর বলল, শেখ লোকটা কিন্তু দারুণ। তেহরান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজের এরোপ্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে।
আমি হাসলাম। কারণ এই প্লেনে ওঠার পর থেকে রোমিলা কমপক্ষে পাঁচবার শেখসাহেবের অতিথিপরায়ণতার প্রশংসা করেছে। এখন ও অবাক হয়ে প্লেনের বিলাসবহুল অঙ্গ সজ্জাগুলো আবার লক্ষ করছে। সত্যি, অ্যাভ্রো প্লেনটায় পেছনে বহু টাকা ও পরিশ্রম খরচ করেছেন শেষ আবদুল অল হারিদ।
একেই বলে কেতায় থাকা!–রোমিলা মুগ্ধ হয়ে বলল।
আমাদের তেল বেচুক আর না বেচুক, শেখের কখনও টাকার অভাব হবে না।
–মোহন ঠাট্টার হাসি হাসল। তারপর ছোট্ট করে মন্তব্য করল, তেল বেচাটা এই শেখগুলোর শখ!
রওনা হওয়ার আগে আমি শেখ হারিদ সম্বন্ধে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিয়েছিলাম। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, তার ওপর মধ্য প্রাচ্যে ইদানীং রোজই গোলমাল লেগে রয়েছে। সেইসব খোঁজখবরের ভিত্তিতেই বললাম, শেখ হারিদের সম্পর্কে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে বোঝা যায় হারিদ অন্যান্য শেখের থেকে আলাদা। নিজের কাহূরেইনকে তিনি বেশ কড়া শাসনে রেখেছেন। আর কিছুটা স্বেচ্ছাচারী। শুনেছি রাজ্যের লোকজনদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচারও নাকি করে থাকেন।
সত্যি বলছ?রোমিলা অবাক হয়ে জানতে চাইল। ওর মুখে ভয়ের সংশয় দেখা দিয়েছে। ওকে সাহস দেওয়ার জন্যে বললাম, অবশ্য খবরগুলো পুরোপুরি সত্যি কিনা জানি না–।
কিন্তু রোমিলা ছাড়ল না। বলল, না দাদা, সত্যি করে বলো, খবরগুলো তুমি কোত্থেকে পেয়েছ?
অতএব বাধ্য হয়ে সব খুলে বললাম।
মিডল ইস্টের কয়েকটা খবরের কাগজ আমার হাতে এসেছিল। তাতেই জেনেছি, কাহরেইনকে ঠিক প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য বলা যায় না। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নেই। বরং স্বৈরতন্ত্রই যেন বাসা বেঁধেছে। শেখ হারিদের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে এবং রাজ্যের যে-কোনও মানুষের তিনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
আমার কথা শুনে মোহন খান্না কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এতে নতুন কোনও ব্যাপার নেই, হিতেশ। মিডল ইস্টে এরকম রাজ্য আরও প্রায় একডজন আছে। সবই সেই মোগলাই ব্যাপার।
কিন্তু আমার মনের ভেতরে অন্য একটা কাটা খচখচ করছিল। সে কথাই মোহনকে বললাম, এরকম রাজ্য আরও আছে জানি, কিন্তু শেখ হারিদ-এর কুখ্যাতি সবার চেয়ে বেশি। রাজ্যের কয়েকটা বিদ্রোহ তিনি এমন নৃশংসভাবে দমন করেছেন যে, আমাদের সভ্য সমাজ ভাবতেও শিউরে উঠবে। খবরের কাগজের বক্তব্য হল, অহেতুক নৃশংসতার কোনও দরকার ছিল না। তাতেই মনে হয়, শেখ কিবা তার দলবল হয়তো স্বাভাবিক মেজাজের মানুষ নয়।
মোহন খান্না যৎসামান্য রাজনীতি চর্চা করে। শেখের বিরুদ্ধে আমার অসন্তোষ প্রকাশ পেতেই ও চড়া গলায় বলল, এ-যুগে কোন মানুষটা সুস্থ-স্বাভাবিক মেজাজের বলো দেখি? এ সবই হল কাগজের রিপোর্টারদের মনগড়া অভিযোগ। পৃথিবীর কোনও দেশকে এ-অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে বলতে পারো? হাঙ্গেরি আর চেকোস্লোভাকিয়ায় রাশিয়ার দাপট, তিব্বতের ওপর চিনদেশের অপশাসন, ভিয়েতনামে আমেরিকা আর আলজিয়ার্স-এ ফ্রেঞ্চ অত্যাচার। এমনকী সাইপ্রাসের ওপরে ব্রিটিশের অত্যাচার নিয়েও অভিযোগ তুলেছে রিপোর্টাররা। সুতরাং দোস্ত, কয়েকটা খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে আমাদের বন্ধু শেখ হারিদকে সমালোচনা কোরো না। তা ছাড়া, সে আমাদের তেল দেবে এটা ভুলে যেয়ো না।
কিন্তু তবুও আমি মোহন খান্নাকে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলাম না। বললাম, হয়তো তোমার কথা ঠিক, মোহন। কিন্তু যখন সমস্ত অত্যাচারের ঘটনাগুলো নিজের দেশেই ঘটে, তখন? আসলে কাহরেইন হল এমন একটা…।
মোহন হাত তুলে আমাকে বাধা দিল : কাহূরেইন-এর শাসনব্যবস্থা নিয়ে তোমার মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই, হিতেশ। তোমার-আমার কাজ হল সস্তায় শেখ হারিদের কাছ থেকে তেল কেনা, ব্যস।
সে যাই হোক, শেখ হারিদের ভদ্রতার তুলনা নেই। আমাদের নেওয়ার জন্যে নিজের প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে।
এ নিয়ে রোমিলা ছ-বার বলল কথাটা।
ফলে আমিও কাহরেইন-এর প্রসঙ্গ পালটে বললাম, যে-প্লেনে আমরা এসেছি তার সঙ্গে এ-প্লেনটার কোনও তুলনা চলে না।
ঠিক বলেছ!–মোহন খান্না হেসে সায় দিল ও ও-প্লেনটার এরকম আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না।
কথাটা বলে মোহন ইশারায় পাইলট কেবিনের দরজার কাছে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটির দিকে দেখাল। মধ্যপ্রাচ্যের এই রূপসী আমাদের বাতাস-বিনোদিনী। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় আহার-পানীয় ইত্যাদির ব্যবস্থা সে করে গেছে পরম যত্নে। রোমিলা হাজির থাকা সত্ত্বেও মোহন দু-একবার রসাল রসিকতা করতে ছাড়েনি। আমি বরং নিজেকে সামান্য সংযত রেখেছি।
হঠাৎই দেখি বাতাস-বিনোদিনী দু-পাশের সিটের মাঝখানের অলিপথ ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঠোঁটের মধুর হাসিটা যেন কেউ তেহরান থেকেই ওর মুখে তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে।
ওকে আসতে দেখে মোহন শিস দিয়ে উঠল। চাপা গলায় বলল, হিতেশ, তোমার শেখ ভাই যতই নৃশংস হোক, তার পছন্দ আছে।
আমাদের সামনে এসে মেয়েটি মিষ্টি স্বরে ঘোষণা করল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা কাহরেইন-এ নামব। আপনারা দয়া করে সিট বেল্ট বেঁধে নিন, আর সিগারেট নিভিয়ে ফেলুন।
আমি সিগারেট ধরিয়েছিলাম। মেয়েটির কথায় সেটি অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলাম।
ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে সে নিজের সিটে ফিরে গেল। টের পেলাম, প্লেনটা একপাশে কাত হয়ে চক্কর দিয়ে নামতে শুরু করেছে।
.
হিতেশ কাপুর
কাহরেইন দাঁড়িয়ে আছে পার্শিয়ান গালফ আধাআধি পেরিয়ে। উপকূল বরাবর প্রায় দশ মাইল চওড়া এবং বিশাল ইরানের মধ্যে প্রায় বিশ মাইল ঢুকে পড়েছে ছোট এই রাজ্যটি। মাত্র দুশো বর্গমাইল এলাকা হলে কী হবে, এটাই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জমি। কারণ গোটা দেশটাই ভাসছে তেলের ওপর। অথচ রোদে ঝিলিক তোলা সোনালি বালি দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
কাহরেইন-এর রাজধানীর নামও ওই একই। ছোট্ট এয়ারপোর্টটা রাজধানীর পশ্চিম ঘেঁষে। ছোট, তবে নিখুঁতভাবে তৈরি।
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগ বসবাস করে রাজধানীতে। অন্য শহরগুলোয় রাজধানীর রমরমা নেই। সেগুলো সত্যিই যেন মরুভূমি। প্লেন থেকে নামতেই একটা কালো এয়ার কন্ডিশন্ড মার্সিডিজ গাড়ি আমাদের তুলে নিল। তারপর হাওয়ার গতিতে ছুটে চলল হারিদের প্রাসাদের দিকে। চলার পথে ড্রাইভার একটিও কথা বলল না।
মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই শেখের প্রাসাদে পৌঁছে গেলাম।
প্রকাণ্ড লোহার গেটের সামনে সশস্ত্র প্রহরা। গেট পেরিয়েই টানা নুড়ি-পথ। তার দু পাশে সবুজ গাছপালা। নুড়ি-পথটা অনেকটা পাহাড়ি রাস্তার মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে একটা বড়সড় টিলার ওপরে। সেখানেই বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেখ হারিদের সাদা ধবধবে বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালে চোখে পড়ে তিনদিকের ধূলিমলিন শহরগুলো নীচে, অস্পষ্ট ধোঁয়াশার আস্তরে যেন ঢাকা। আর প্রাসাদের মুখোমুখি গালফ-এর শীতল জল নীল, মাঝে-মাঝে সাদা ফেনার টুকরো। ছোট-ছোট ঢেউ তুলে নীল জলরাশি যেন চঞ্চল খেলায় মেতেছে।
গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল একটা বড় মাপের গাড়িবারান্দা। কেতাবি আরবি পোশাকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। রোদ পড়ে তার সাদা আলখাল্লা ঝকঝক করছে। আমাদের কাছাকাছি এসেই ভদ্রলোক নীচু হয়ে অভিবাদন জানালেন।
আমার নাম হাসান, আমি শেখ আবদুল অল হারিদের ব্যক্তিগত সচিব। কারেইন-এ আপনাদের স্বাগত জানাই।
হাসানের কণ্ঠস্বর ভরাট, মার্জিত বেশ সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলার মতো। মুখচোখের রেখা সজীব ও তীক্ষ্ণ। থুতনিতে মিশকালো দাড়ি।
আমার ও মোহনের সঙ্গে করমর্দন করার সময় হাসানের ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটল। তারপর রোমিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে তিনি বললেন, এই সুন্দরীর পরিচয় জানতে পারি?
আমার বোন, রোমিলা।আমি সহজ গলায় বললাম। অথচ বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি জাগছিল।
স্বাগতম, মিস রোমিলা। হাসান রোমিলার হাত ধরলেন। তারপর অভিবাদনের ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ে হাতে চুমু খেলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন রোমিলাকে। তার কালো চোখ সম্মোহনের দৃষ্টিতে খেলে বেড়াতে লাগল রোমিলার সুন্দর মুখে।
রোমিলা হঠাৎই লজ্জা পেয়ে হাসল । ধন্যবাদ, মিস্টার হাসান। আমি একরকম জেদ করেই দাদার সঙ্গে এসেছি নতুন দেশ দেখব বলে। দাদা আর মিস্টার খান্না যখন ব্যবসায়িক কাজকর্ম সারবেন, সেই ফাঁকে আমি আপনাদের চমৎকার শহরগুলো দেখে বেড়াব।
আপনার বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চয়ই সুখের হবে, মিস রোমিলা।
পরক্ষণেই হাসানের মুখ থেকে বিগলিত ভাবটা মিলিয়ে গেল। ভাবলেশহীন মুখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে মাপা সুরে তিনি বললেন, আমাদের মাননীয় শেখের ইচ্ছে যে, কাহরেইন এ থাকাকালীন আপনারা তার প্রাসাদেই আতিথ্য গ্রহণ করেন।
কিন্তু আমি তো শুধু বেড়াতে এসেছি!–রোমিলা আপত্তি জানিয়ে বলল। তারপর আমার দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, কী হল, তোমরাও কিছু বলো!
আমি ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে গেলাম, কিন্তু হাসান যেন রোমিলা বা আমার কথা শুনতেই পাননি। তিনি তখন শান্ত সুরে যান্ত্রিকভাবে বলে চলেছেন, যদি আপনারা মাননীয় শেখের আতিথ্য-আপ্যায়ন প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন। অতএব আসুন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই। সঙ্গে নিয়ে আসা মালপত্রের জন্যে চিন্তা করবেন না। সেগুলো আপনাদের আগেই নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে যাবে।
হাসানের কথার সুরে ও ভঙ্গিতে এমন কিছু একটা ছিল যে, আমি বা মোহন কেউই তাঁর অনুরোধ বা আদেশের প্রতিবাদ করতে পারলাম না। আমরা তিনজনেই হাসানকে অনুসরণ করলাম।
প্রাসাদের ভেতরটা স্নিগ্ধ শান্ত। সাদা রং ছাড়া অন্য কোনও রং কোথাও নেই। কেন জানি না আমার তাজমহলের কথা মনে পড়ে গেল।
মার্বেল পাথরের মেঝেতে আমাদের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিভিন্ন দিকের দেওয়াল থেকে। অস্বাভাবিকরকম চওড়া অলিন্দ ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। মাথার অনেক ওপরে নকশাদার কারুকাজ করা সিলিং। কিছুদূর পরপরই সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে কাটগ্লাসের ঝকমকে ঝাড়লণ্ঠন। ডানদিকের দেওয়ালে সাজানো রয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নানারকম অয়েল পেইন্টিং। আর বাঁদিকে একটানা ঘরের মিছিল। আমরা একের পর এক কালচে কাঠের নকশা কাটা দরজা পার হয়ে চলেছি। পর-পর দুটো দরজার মধ্যেকার দূরত্ব দেখে বোঝা যায় ঘরগুলো আকারে বিশাল। দুটো দরজার মাঝের ফাঁকা দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে নানা ধরনের শিল্পসামগ্রী।
পাশাপাশি তিনটে ঘরে আমাদের স্থান দিলেন হাসান।
প্রতিটি ঘরের আকার-প্রকার ও সাজসজ্জা যে-কোনও পাঁচতারা হোটেলকেও লজ্জা দেবে। অবশ্য ঘর না বলে সেটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট বলাই ভালো।
আমি হতবাক হয়ে ঘরের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। মনে পড়ল, প্লেনে বসে রোমিলাও ঠিক এইরকম অবাক হয়েছিল।
একটু পরেই মোহন আর রোমিলা আমার ঘরে এল। ওরা জামাকাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। ওদের দেখে আমি হেসে মন্তব্য করলাম, এই যদি শেখের অতিথিশালা হয় তাহলে শেখ নিজে যে-ঘরে থাকেন তার জাঁকজমক কীরকম কে জানে!
মোহন বলল, তুমি যতই খুঁতখুঁত করো না কেন, আমার কিন্তু এখানে বেশ লাগছে। হোটেলে এই আরাম পাওয়া যেত না।
সে তুমি ঠিকই বলেছ।আমিও মোহনের সঙ্গে একমত হলাম।
রোমিলা এখন আবার খুশি হয়ে উঠেছে। ও বলল, দাদা, আমি শুধু ভাবছি কোন ড্রেসটা পরে শেখের সঙ্গে দেখা করতে যাব।
রোমিলা খুশি হয়েছে কারণ হাসান যাওয়ার সময়ে ওকে বলে গেছেন, মিস্টার কাপুর ও মিস্টার খান্না যখন মাননীয় শেখের সঙ্গে পরিচয় করতে যাবেন, তখন আপনিও অবশ্যই আসবেন, মিস রোমিলা।
রোমিলা খুশিতে ফুটছে। বলল, ও, বাড়ি ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সব গল্প শোনাতে আমার আর তর সইছে না!
মোহন গম্ভীরভাবে বলল, সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কে না আলাপ করতে চায়! শেখ তো তার ব্যতিক্রম নয়।
আমি বললাম, ধ্যুৎ, শেখদের সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে আমাদের হারিদ সাহেবের হয়তো একটা গোটা হারেমই রয়েছে। এতগুলো মেয়ে একটা পুরুষ কখনও সামলাতে পারে!
মোহন খান্না বিজ্ঞের মতো বারদুয়েক ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, যাই বলো ভাই, এই হারিদ লোকটার রুচি আছে।
রোমিলা বলল, আমি যাই। চটপট বেছে ফেলি কোন ড্রেসটা পরে শেখের দরবারে যাব।
ও চলে যেতেই মোহন আমাকে লক্ষ করে চোখ টিপল। বলল, হিতেশবাবু, বলা যায় না, শেখ হয়তো তার হারেম থেকে দুজন রূপসীকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে রাতে সেবা করার জন্যে।
আমি ওর কাঁধে এক থাপ্পড় মেরে বললাম, তোমার সবসময় খালি এক চিন্তা।
আমার মনের ভেতরে একটা অস্বস্তির কাটা খচখচ করতে লাগল। কারণ, হাসানের নজর আমার একটুও ভালো লাগেনি। মোহনকে অবশ্য সে কথা বললাম না। আর বললেও ও সেটা হেসে উড়িয়ে দিত।
.
শেখ আবদুল হারিদের চেহারা বেঁটে, মোটা। চোখ দুটো কুতকুতে। থুতনিতে চুঁচলো দাড়ি। তার ধারালো নজরের সামনে রোমিলা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল। বিশেষ করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর শেখসাহেব যখন ওর হাত তুলে চুমু খেলেন।
এ সত্যিই আমার মহা সৌভাগ্য, মিস কাপুর।–শেখের কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল হাসানের ভদ্রতা ও মোলায়েম ভাব। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস্টার কাপুর, আপনার বোন অপরূপ সুন্দরী। সামান্য হাসলেন শেখ হারিদ : এখান থেকে খুব কাছেই আমার চেনা কয়েকজন উপজাতির সর্দার আছে যারা মিস কাপুরের বিনিময়ে অসংখ্য ছাগল দেবে। অবশ্য আমার ধারণা, উনি বিক্রির জন্যে নন।
শেখের কথায় ঠাট্টার সুর থাকলেও আমার কেমন খারাপ লাগল। মনে হল, তিনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। কিন্তু কোনও এক শঙ্কায় আমি নিজের উত্তেজনা সামলে নিয়ে ঠাট্টার মেজাজেই বললাম, রোমিলার বদলে আমি যদি একপাল ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরি তা হলে আমার বন্ধু বান্ধব-আত্মীয়রা ছেড়ে কথা বলবে না। তারপর গলা নামিয়ে বললাম, তা ছাড়া স্যার, আপনাদের এদিকটায় ছাগলের সংখ্যাই বোধহয় বেশি, তাই না!
আমার কথায় ব্যঙ্গের খোঁচাটা শেখ হারিদ বুঝতে পারলেন কিনা জানি না, তবে তার মেজাজটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল।
হারিদ বললেন, আমার দেশ আর আপনাদের দেশের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। রাীতি নীতি, আদব-কায়দা, আইন-কানুন, সবাই আলাদা। বিংশ শতাব্দী অনেক এগিয়ে গেছে। সভ্যতাও থেমে নেই। অথচ কারেইন-এ আমরা আমাদের পুরোনো রীতি আর ঐতিহ্যের অনেকটাই এখনও ধরে রেখেছি। অবশ্য সভ্যতার অগ্রগতির সুফলগুলো আমরা এখানেও বেশ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করি।
শেখ কথা থামিয়ে আমাদের তিনজনের ওপর নজর বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, একমাত্র আল্লা ছাড়া আমাদের সবচেয়ে পবিত্র ঐতিহ্য হল আমন্ত্রিত অতিথির সেবা। আপনারা তো এখানে কয়েকদিন আছেন, আশা করি আমার অতিথিসেবার আন্তরিকতা ও নিদর্শন প্রমাণ করার সময় আমি পাব।
মোহন তাকে আশ্বস্ত করে বলল, আপনার আতিথেয়তা আর উদারতার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি, স্যার।
মোহনের কথায় হারিদ যেন সত্যিই খুশি হলেন। বললেন, শুনে আনন্দিত হলাম, মিস্টার খান্না, বড়ই আনন্দিত হলাম। আচ্ছা, এবারে আমাকে বিদায় নেওয়ার অনুমতি দিন। আগামীকাল সকালে, আমাদের ব্যাবসায়িক আলোচনা শুরুর আগে, আমার এই নগণ্য প্রাসাদের
কথাটা বলেই শেখ হারিদ ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে রোমিলার দিকে তাকালেন।
আমি দুঃখিত, মিস রোমিলা, আপনাকে আমাদের সঙ্গে নিতে পারব না। কারণ আমাদের রীতি অনুসারে প্রাসাদের বেশিরভাগ অংশই স্ত্রীলোকের কাছে নিষিদ্ধ।–শেখ হারিদ হাসলেন : বুঝতেই পারছেন, নারী প্রগতি আপনাদের দেশে যতটুকু এগিয়েছে আমাদের এখানে তার লক্ষ ভাগের এক ভাগও এগোয়নি। কোনওদিন আদৌ এগোবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে পরশুদিন আপনার সম্মানার্থে আমি নৈশভোজের আয়োজন করেছি। আপনি সে-অনুষ্ঠানে দয়া করে যোগ দিলে আমি যথেষ্ট সম্মানিত বোধ করব। আপনি আমার দেশে নিছকই বেড়াতে এসেছেন। সে কথা চিন্তা করে আমি একটা গাড়ি আপনার ব্যবহারের জন্যে দিচ্ছি। যদি চান ড্রাইভারও থাকবে গাড়িতে। গাড়ি নিয়ে আমার এই ছোট রাজ্যে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারেন। সোজা কথায়, এটাকে আপনি নিজের দেশ মনে করলেই আমি আন্তরিক খুশি হব। এবারে আমাকে অনুগ্রহ করে বিদায় দিন।
রাজসভা ভঙ্গ হল।
.
রোমিলা কাপুর
ঘড়িতে এখনও নটা বাজেনি, অথচ সূর্যের তাপ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। জোরালো আলোয় চিকচিক করছে পার্শিয়ান গালফ-এর পুঁতে রং জলের ঢেউ। জলের পাশ ঘেঁষে পিচের রাস্তা চলে গেছে আবাদানের দিকে। রাস্তা সামান্য উঁচু-নীচু। যেন এখানেও পার্শিয়ান গালফ-এর ঢেউয়ের ছোঁয়া লেগেছে।
কাহরেইন ও তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে একটা টুকটুকে লাল রঙের আলফা স্পোর্টস কার আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন শেখ হারিদ। আর তার বিশ্বস্ত অনুচর হাসান আমাকে উপহার দিয়েছেন কাহরেইন ও ইরানের রোড ম্যাপ। সেটা দেওয়ার সময় হেসে বলেছেন, যদি পথ ভুলে কোথাও হারিয়ে যান তাই এটা সঙ্গে দিলাম। বিপদে কাজে লাগতে পারে।
শেখ হারিদের অতিথিসেবায় হয়তো কোনও ত্রুটি নেই, কিন্তু তবুও আমি যেন স্বস্তি পাচ্ছি না। কোথায় যেন একটা সংশয়ের কাঁটা বিঁধে রয়েছে।
শেখ ড্রাইভার সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হইনি। কারণ আমি গাড়ি চালাতে জানি। তবে বিদেশি গাড়ি কখনও চালাইনি। তাই শেখকে অনুরোধ করলাম, ড্রাইভারকে উনি যেন নির্দেশ দেন আলফা চালানোর নিয়মকানুনগুলো আমাকে একটু শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে।
শেখ হাসলেন আমার কথায়। কিছুটা চতুর সে-হাসি। মুখে বললেন, যথা আজ্ঞা। সুন্দরীদের অনুরোধ রাখতে পারলে আমি খুশি হই!
তারপর দূরে দাঁড়ানো একজন রক্ষীকে ইশারা করলেন।
দাদা ও মোহনদা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের মুখে কেমন এক সতর্ক অভিব্যক্তি। কিছুতেই যেন সহজ হতে পারছে না। ওরা শেখের সঙ্গে চলে গেল মিটিং-এ বসবে বলে। যাওয়ার আগে শেখ বলে গেলেন, আপনার ভ্রমণ সুখের হোক, মিস কাপুর।
একটু পরেই সুপুরুষ চেহারার একজন যুবক এসে আমাকে আলফা চালানোর টুকটাক তালিম দিল। তারপর হেসে বিদায় নিল। এবং আমিও রওনা হলাম।
রওনা হওয়ার আগে একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম, গাড়িটার কোনও নাম্বার প্লেট নেই। তার বদলে সামনে ও পেছনে আঁকা রয়েছে দুটি রাজকীয় প্রতীকচিহ্ন।
দিলখুশ মেজাজে উদ্দাম বেগে গাড়ি ছুটিয়ে চলেছি। চুল উড়ে এসে পড়ছে নাকে, মুখে, চোখে। ড্রাইভারজাতীয় একটা অজানা-অচেনা লোক থাকলে হয়তো মন খোলসা করে ঘোরাঘুরি করতে পারতাম না।
এখানে এসে থেকেই মনে হচ্ছে আমার মনের সমস্ত ধোঁয়া আর কুয়াশা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। মা-বাবাকে হারিয়ে যে-দুঃসহ দুঃখটা বুকের মধ্যে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসেছিল, সেটা যেন কোনও জাদুকর হালকা করে দিয়েছে। দেশে ফিরে বন্ধুদের যে কতরকম গল্প কতদিন ধরে শোনাব তা ভাবতেও বেশ রোমাঞ্চ জাগছে।
রাস্তা থেকে উপকূলের কিনারা এখন আর চোখে পড়ছে না। দু-ধারেই ছোট-বড় গা ঘেঁষাঘেঁষি ঘরবাড়ি। আর থেকে-থেকেই চুড়াওয়ালা মসজিদ দেখতে পাচ্ছি। দাদার কাছে শুনেছি, এখানকার শতকরা নিরানব্বইজন মানুষই মুসলিম।
হঠাৎ সামনে একটা জটলা চোখে পড়ায় আমাকে ব্রেক কষতে হল। শব্দ করে নিশ্চল হল আলফার চাকা। একদল মানুষ নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় মত্ত। অন্তত তাদের হাত-পা নাড়া দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে।
আরও একটু লক্ষ করে যা বুঝলাম, একজন লোক কাঁধে করে কার্পেট ফিরি করছিল, তার সঙ্গেই দরাদরি অথবা অন্য কোনও কারণে কোনও খদ্দেরের ঝগড়া বেঁধেছে।
প্রথমে লোকগুলো আমার গাড়িটাকে ভ্রূক্ষেপ করেনি। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে ঝগড়াতেই ব্যস্ত। কিন্তু হঠাৎই একটি অল্পবয়েসি মেয়ে আঙুল তুলে আমার গাড়ির দিকে দেখাল। না, ঠিক গাড়ির দিকে নয়। বরং বলা যায় গাড়ির বনেটের ওপরে আঁকা রাজকীয় চিহ্নটার দিকে দেখাল।
চিহ্নটার দিকে অন্য সকলের চোখ পড়ামাত্রই মন্ত্রের মতো কাজ হল। নগ্ন আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মেয়ে-পুরুষের মুখে। তারা ঝগড়া থামিয়ে তড়িৎস্পৃষ্টের মতো পথ ছেড়ে ছিটকে গেল দু-পাশে।
আমি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলাম। বুঝলাম, শেখ হারিদকে তার প্রজারা অস্বাভাবিক ভয় করে। তা হলে কি প্লেনে আসতে-আসতে শেখ হারিদ ও কাহরেইন সম্পর্কে দাদা যে কথাগুলো বলছিল সেগুলো সব অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি?
হঠাৎই একটা নাম-না-জানা ভয় আমাকে পেয়ে বসল, আর তখনই টের পেলাম একটা গাড়ি আমাকে অনুসরণ করছে।
গাড়িটার রং আকাশি। চেহারা অনেকটা বেঁটেখাটো ভ্যানের মতো। উইন্ডশিল্ডের কাচটা সাধারণ স্বচ্ছ কাচ নয়–সানগ্লাসের মতো কালচে। কাচের পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত সূর্যের প্রতিবিম্ব ঠিকরে পড়েছে উইন্ডশিল্ড থেকে।
গাড়িটা আমি রিয়ারভিউ মিরারে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাইনি পেছনে। এই রাস্তাটার গাড়ির সংখ্যা এমনিতে খুব বেশি নয়। সেইজন্যেই আকাশি ভ্যানটাকে আমি এত অল্প সময়ে সন্দেহ করতে পেরেছি। শেখ হারিদ তা হলে আমাকে একা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ভয়ের সঙ্গে-সঙ্গে বিরক্তি ছাপ ফেলল আমার মনে। অ্যাক্সিলারেটারে চাপ দিয়ে আলফার গতি বাড়িয়ে দিলাম আচমকা।
রাস্তার অলিগলি পেরিয়ে একটা জমজমাট জায়গায় এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থামালাম রাস্তার ধার ঘেঁষে। তারপর গাড়ি থেকে নামলাম।
জায়গাটা মনে হয় মার্কেটজাতীয় কিছু হবে। বিভিন্ন দোকানপাট-ফিরিওয়ালায় গিজগিজ করছে। ক্রেতা ও বিক্রেতার ভিড় দেখলে তাক লেগে যায়।
হঠাৎ আকাশি ভ্যানটার কথা খেয়াল হতেই পেছনে তাকালাম। আশ্চর্য! গাড়িটা সামান্য
দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ রাগ হল এবার। মন খুলে বেড়াতেও পারব না এদেশে! কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে দ্রুত পা পেলে ভ্যানটার কাছে গেলাম।
জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দুজন মানুষের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল। ঠান্ডা নিরুত্তাপ ওদের দৃষ্টি। আমাকে দেখে এতটুকু বিচলিত হল না ওরা।
কী মতলবে ফলো করছেন আমাকে?
এক সেকেন্ড দুজনে-দুজনের দিকে তাকাল। তারপর স্টিয়ারিংয়ে বসা লোকটি ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে যা বলল তার অর্থ হল, ওরা শেখ হারিদের লোক। ওরা আমাকে অনুসরণ করছে না, বরং আমার যাতে কোথাও কোনও অসুবিধে না হয় সেদিকে নজর রাখছে। সোজা কথায় দেহরক্ষী। এর কারণ আমি শেখ হারিদের অতিথি, অর্থাৎ ভি. আই. পি।
বুঝলাম, ভুমিকা ওদের যাই হোক উদ্দেশ্য ওদের একটাই–আমাকে নজরে-নজরে রাখা। ঠিক করলাম, যে করে হোক লেজ থেকে এদের ছাড়াবই। সুতরাং ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।
বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চারপাশে দেখছিলাম।
পাথরের টুকরো দিয়ে গড়া বড়-বড় বাড়ি। কোনও-কোনও বাড়ির সামনে গাড়িবারান্দা। তার নীচেও বাজার বসে গেছে। বিক্রি হচ্ছে শুকনো ফল, সিগারেট, কার্পেট, খোদাই করা কাঠের কাজ, পেতলের কারুকাজ, নকশাছাপা কাপড়, আখরোট, আঙুর, বাদাম, আরও কত কী।
মুগ্ধ চোখে কতক্ষণ সব দেখছিলাম জানি না, হঠাৎই একটা মাঝবয়েসি লোক অসভ্যের মতো আমাকে ধাক্কা দিয়ে গা ছুঁয়ে গেল। আমি রেগে উঠে লোকটাকে ডেকে দুটো কড়া কথা বলতেই বিপদ হল। একগাদা লোক আমাকে ঘিরে ধরল। ওদের ভাষা আমি একটুও বুঝতে পারছি না। আর ওরা যে আমার কথা বুঝতে পারছে তাও মনে হল না।
অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছি, এমন সময় সুপুরুষ চেহারার একজন যুবক ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। না, সে আমার দেহরক্ষী নয়। আমার দেহরক্ষীরা এখন হয়তো গাড়িতে বসে হাই তুলছে আর মাছি মারছে।
যুবকটি অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ভিড় সরাতে লাগল। আর দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড, মিস! তারপর দেশজ ভাষায় ভিড় করা লোকজনকে কীসব বলে নিরুৎসাহ করতে লাগল। মিনিটকয়েক ধরে চলল তার অনর্গল কথা, দ্রুত হাত-পা নাড়া, তারপর একসময় লক্ষ করলাম জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক। আর ঘটনাস্থলে আমি ও অচেনা যুবক দুজনে একা।
আপনি আমাদের দেশে নতুন মনে হচ্ছে?–যুবক বিশুদ্ধ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, আমার নাম ইলিয়াস মহম্মদ ইলিয়াস।
আমি ওর প্রশ্নের জবাবে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে, আমি এদেশে নতুন। এবং ও নাম বলার পর ভদ্রতাবশত নিজের নামটা বললাম। সেইসঙ্গে ধন্যবাদও জানালাম ওকে।
ইলিয়াস বলল, ধন্যবাদের দরকার নেই। আসলে বিদেশি কেউ এলেই প্রথম-প্রথম এ জাতীয় অসুবিধেয় পড়তে হয়।
ইলিয়াসের গায়ের রং উজ্জ্বল সাদা। মাথায় কুচকুচে কালো ঢেউখেলানো চুল। প্রাণবন্ত কালো চোখের তারা। সুচারুভাবে তৈরি চওড়া পেন্সিল গোঁফ। দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো, তবে ফরসা গাল ও চোয়ালে নীলচে আভা। এছাড়া নাক-মুখ চোখের রেখা ধারাল।
সুদর্শন এই মানুষটার গায়ে লাল-নীল আড়াআড়ি ডোরা কাটা ব্যানলনের টি-শার্ট আর তার সঙ্গে মানানসই কর্ডের কালো প্যান্ট।
প্রখর রোদ আমাদের ঝলসে দিচ্ছিল। সামান্য ইতস্তত করে আমি বললাম, একটা ছায়া দেখে আশ্রয় নিলে হয় না?
ইলিয়াস দমফাটা হাসি হেসে উঠল হাটের মাঝে দাঁড়িয়ে।
ওর সুন্দর মুখ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। তারপর একসময় হাসি থামিয়ে চোখের কোণে জল মুছে বলল, দেখেছেন, আমি কী বোকা! আপনি আমার দেশে অতিথি। কোথায় আপনাকে আপ্যায়ন করব তা না, রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসুন, ওই রেস্তোরাঁটায় ঢোকা যাক– অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
ইলিয়াস আঙুল তুলে কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁর দিকে দেখাল। আমি ক্ষণিকের দ্বিধা কাটিয়ে ওর অনুরোধে রাজি হলাম। এবং দুজনে এগিয়ে চললাম সেদিকে।
আমার মনের মধ্যে খুশির জলতরঙ্গ বাজছিল। মনে হচ্ছিল, ভারতের রোমিলার সঙ্গে এ-রোমিলার কোনও সম্পর্ক নেই। রেশমি খোলস কেটে গুটিপোকা যেন বেরিয়ে এসেছে। দাদা আর মোহনদা যেন দুই দেবদূত। পলকে মিলিয়ে দিয়েছে আমার মুক্তির ছাড়পত্র। তবু এত আনন্দের মধ্যেও শেখ হারিদের মিছরি মাখা আচরণ কেন জানি না সন্দেহের খোঁচা দিয়ে চলেছে ক্রমাগত।
রেস্তোরাঁর নাম কারনামা। সাজগোজে তার কোনও ত্রুটি নেই। বিশাল কাচের দরজায় আলপনা আঁকা। ভেতরটা আধুনিকভাবে, অনেকটা পাশ্চাত্য রীতিতে, সাজানো।
রেস্তোরাঁর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাতাস যেন চোখেমুখে ঠান্ডা চুম্বন এঁকে দিল। বাইরের গরম ও চোখে ধাঁধানো রোদ্দুরের পর ভেতরে ছায়াময় শীতল পরিবেশ এককথায় মরুভূমির মরূদ্যান।
কারুকাজ করা স্বচ্ছ পরদা ঝোলানো একটা বড় কাচের জানলার পাশে একটা টেবিল বেছে নিল ইলিয়াস। আমরা দুজনে মুখোমুখি বসলাম।
ইলিয়াস বলল, শুধু আমার নামটাই আপনাকে বলেছি, মিস কাপুর। একজন অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে শুধু নামটুকু বোধহয় যথেষ্ট নয়। আসলে আমি একজন। রিপোর্টার । এখানে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ আছে, তার জন্যে খবর জোগাড় করি। এই যে আমি হাটের মাঝে ঘুরছিলাম, তাও খবরের খোঁজে। এখন এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, সেটাও হয়তো আগামী সংখ্যায় ছাপা হয়ে যাবে বিশাল হেডিং দিয়ে ও ভারতীয় তরুণীর চোখে কাহরেইন। সুতরাং রেস্তোরাঁর আপ্যায়নের বিল যদি আমি মেটাই তাহলে আর ওজর আপত্তি তুলবেন না। ধরে নিন, আপনার ইন্টরভিউ নেওয়ার জন্যে আমি এত কসরত করছি।
আমি হেসে বললাম, আপনার কথায় আপত্তি করব সে মনের জোর আমার নেই। কারণ, যে-বিপদ থেকে একবার বাঁচিয়েছেন।
ইলিয়াস হাতের ভঙ্গি করে বলতে চাইল, ও কিছু নয়।
ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিল ইলিয়াস। তারপর বলল, মিস কাপুর, এখান থেকে আর মাইলপাঁচেক পার হলেই আপনি কারেইন-এর সীমা ছাড়িয়ে ইরানে পা দেবেন। কাহূরেইন আসলে ইরানেরই অংশ, তবে এর শাসনব্যবস্থা স্বতন্ত্র।
দাদার কথাগুলো মনে পড়ল আমার। ইলিয়াস যখন রিপোর্টার তখন ও নিশ্চয়ই শেখ আবদুল অল হারিদ সম্পর্কে অনেক খবরই রাখে। তাই বললাম, আপনাদের কারেইন-এর রাজা শুনেছি সাঙ্ঘাতিক লোক!
স্পষ্ট লক্ষ করলাম, ইলিয়াস চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। তারপর থেমে-থেমে বলল, আপনি কোত্থেকে এ-খবর শুনলেন?
তখনই আমার খেয়াল হল, ইলিয়াসকে শুধু নামটা ছাড়া আর কোনও কথাই বলিনি আমি। অবশ্য ইলিয়াসও জানতে চায়নি। এখন প্রসঙ্গ ওঠায় ওকে বললাম, আমি বর্তমানে আপনাদের শেখসাহেবের গেস্ট, তারপর সংক্ষেপে সব খুলে জানালাম।
ওর নিষ্পাপ সুন্দর মুখ দেখে কেন যেন আমার মনে হল ওকে অকপটে সব খুলে বলা যায়। অনুসরণকারী আকাশি ভ্যানটার কথাও ওকে বললাম।
আমার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেল ইলিয়াস। ফিনফিনে পরদাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। খুব গভীরভাবে কী যেন ভাবছে ও। ঠিকরে আসা আলোর ছটায় ওর চোখ চিকচিক করতে লাগল।
এমন সময় বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল।
ইলিয়াস ঘোর কাটিয়ে সচেতন হল। তারপর অমলিন হাসি হাসল। বলল, ওসব কথা এখন থাক। লেট আস এনজয় দ্য মিল!
আমি সামান্য বিব্রত হয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।
খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও কথা বললাম না দুজনে। তারপর ইলিয়াস বলল, আপনাকে শেষে একটা দারুণ জিনিস খাওয়াই।
কী জিনিস?
খেয়েই দেখুন না–
ও বেয়ারাকে ডেকে স্বদেশি ভাষায় কী যেন বলল। বেয়ারা চলে গেল। তারপর আমাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করল, আপনারা শেখের ওখানে কতদিন আছেন?
জানি না, দাদার মিটিং যতদিন চলবে। তবে মনে হয়, সাত-দশ দিনের বেশি লাগবে না।
হতাশভাবে মাথা নাড়ল ইলিয়াস। বলল, সাত-দশ দিনে কি ইরান দেখা শেষ হবে? অন্তত দিনকুড়ি তো লাগবেই।
কেন, আপনি আমাকে ইরান ঘুরিয়ে দেখাবেন নাকি?
দেখাল ক্ষতি কী, মিস কাপুর! ইলিয়াস মুগ্ধ করা হাসি হাসল : ইরান আমার দেশ। আমার জন্ম তাবরিজ-এ। তেহরান-এর তুলনায় তাবরিজ অনেক ছোট শহর, কিন্তু আমার বড় প্রিয়। জানেন, তাবরিজ-এর খুব কাছেই রয়েছে উরমিয়া লেক! ইরানের সবচেয়ে বড় হ্রদ। আর তার ঠিক উলটোদিকে দুশো মাইলটাক পুবে রয়েছে বিখ্যাত কাস্পিয়ান সাগর। দেখলে আপনার তাক লেগে যেত।
বেয়ারা সুদৃশ্য কারুকাজ করা দুটো লম্বা ধাতব গ্লাস টেবিলে রেখে গেল। গ্লাসে উষ্ণ তরল রয়েছে।
আমি অবাক চোখে ইলিয়াসের দিকে তাকাতেই ও একটা গ্লাসে আমেজ-ভরা চুমুক দিল। তারপর দ্বিতীয় গ্লাসটা ইশারায় দেখিয়ে বলল, নিন, চুমুক দিন। এর নাম সবুজ চা, গ্রিন টি। মধ্যপ্রাচ্যে এই জিনিসটার দারুণ চল রয়েছে। আপনাদের ভারতে এটা তেমন জনপ্রিয় নয় বলেই শুনেছি।
আমি গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম যে, ও ঠিকই শুনেছে।
সবুজ চা শেষ করার পর ইলিয়াস বলল, নিন, এবারে বলুন, কাহরেইন কেমন লাগছে? আমি কিন্তু ইন্টারভিউটা সত্যিই নিচ্ছি…সিরিয়াসলি।
আমি থেমে-থেমে নিজের টুকরো মতামত জানালাম কাহরেইন সম্পর্কে। প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডায়েরি আর পেন বের করে কীসব টুকে নিতে লাগল ইলিয়াস। আর মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
আমি বললাম, কী ব্যাপার, হাসছেন কেন?
ও হাসতে হাসতে বলল, আমি ভাবছি আমার খুশ নসীবের কথা। কত সহজে হাজার হাজার মাইল দূরের এক বিদেশিনীর ইন্টারভিউ পেয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য রিপোর্টার বহু কাঠখড় পুড়িয়েও কোনও ভারতীয়ের ইন্টারভিউ জোগাড় করতে পারে না।
ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর ইলিয়াস বলল, চলুন এবারে ওঠা যাক।
ও ইশারায় বেয়ারাকে ডাকল। বলল বিল নিয়ে আসতে।
বিল এলে পর টাকা মিটিয়ে দিয়ে ইলিয়াস আমাকে জিগ্যেস করল, বলুন তো, এখানে কারেন্সির নাম কী?
তক্ষুনি আমার মনে পড়ল, ঘুরে বেড়ানো বা কেনাকাটার জন্যে কোনও টাকাপয়সা নিয়ে বেরোতে আমি ভুলে গেছি। তেহরান এয়ারপোর্টেই আমরা ভারত থেকে আনা মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে ইরানি টাকা নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন টাকা তো আনিনি, উপরন্তু তার নামটিও মনে করতে পারছি না। সে-কথা ইলিয়াসকে বলতেই ও হেসে বলল রিয়াল।–একটু থেমে আরও যোগ করল? তবে এখানে বহু দোকানেই মার্কিন ডলার নেয়। ও বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি তেমন নেই।
কারনামা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইলিয়াস আমার পাশে-পাশে হাঁটছে। ধুলো উড়ছে রাস্তায়। কাছে-দূরের মসজিদ থেকে আজান শোনা গেল।
ইলিয়াস বলল, আপনার ফেরার তাড়া আছে? না থাকলে আশপাশটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।
আমি হেসে বললাম, সেরকম কোনও তাড়া নেই। তা ছাড়া আমি তো দেশ দেখতেই বেরিয়েছি। আর আপনার মতো গাইড পেলে তো বর্তে যাব।
ইলিয়াস গলা নামিয়ে বলল, সো কাইন্ড অফ ইউ।
তারপর ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম দুজনে।
স্থানীয় লোকজন, তাদের জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বহু ইতিহাসই শোনাল ইলিয়াস। সেইসঙ্গে শোনাল ওর নিজের কথা। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর ও ফিরে যায় তাবরিজ-এ। সেখানে ওর মা-বাবা দুজনেই অল্পদিনের ব্যবধানে মারা যায়। মা অসুখে, আর বাবা সন্ত্রাসবাদী ঘটনায়। তখন ইলিয়াস দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ভারী মন নিয়ে। ওর সঙ্গে ছোট দু-বোন। বড় বোন আলেয়া আর ছোট নাজমা। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একসময় ওরা এসে পড়ে কাহূরেইন-এ। ইলিয়াস চাকরি নেয় খবরের কাগজে। তখন থেকে ওরা তিনজনে এখানকারই বাসিন্দা।
বেলা ক্রমশ পড়ে আসতে লাগল। ইলিয়াস একটা দোকান থেকে আঙুরের শরবত খাওয়াল আমাকে। তারপর কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে চললাম আমার আলফা স্পোর্টস-এর দিকে।
গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি আকাশি ভ্যানটা ঠিক একইভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইলিয়াস অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল ভ্যানটার দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, সাবধানে থাকবেন, মিস কাপুর। শেখ হারিদ লোকটা স্যাডিস্ট। এ-দেশ ছেড়ে আমি কবে চলে যেতাম…কিন্তু এখন জড়িয়ে পড়েছি…আর ফেরার উপায় নেই।
একটা বাচ্চা ছেলে ঘুরে-ঘুরে গোলাপের তোড়া ফেরি করছিল। ইলিয়াস তাকে কাছে ডাকল। একটা ছোট গোলাপের তোড়া কিনে আলতো করে তুলে দিল আমার হাতে। বলল, টেক কেয়ার। যদি সম্ভব হয় তাহলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করি এই গোলাপের গুচ্ছ সমস্ত বিপদ থেকে আপনাকে রক্ষা করুক।
আমি গাড়িতে উঠে বসতে যাচ্ছি, ইলিয়াস বলল, আবার আমাদের দেখা হবে এই আশা পোষণ করার মতো স্পর্ধা কি আমি দেখাতে পারি, মিস কাপুর?
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ পারেন। কাল সকাল নটায় আবার আমাদের এখানেই দেখা হবে।
শুক্রিয়া। ইলিয়াস হেসে হাত নাড়ল ও ইন্টারভিটা ভালো করে লিখে কাল আপনাকে শোনাব।
বাই অল মিনস। বলে আমি গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। গোলাপের তোড়াটা নাকের কাছে নিয়ে বারকয়েক ঘ্রাণ নিলাম। তারপর গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ইলিয়াসের সুন্দর মুখটা উইন্ডশিল্ড এর ওপরে ভাসতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরেই লক্ষ করলাম, আকাশি ভ্যানটা। যথারীতি আবার আমার পিছু নিয়েছে।
ঠিক করলাম, প্রাসাদে ফিরে দাদা বা মোহনদাকে অনুসরণকারী ভ্যানটার কথা বলব না। বললে হয়তো মিছিমিছিই আশঙ্কায় ভুগবে।
আর ইলিয়াসের কথা? ওর কথা খুব বেশি বলে ফেললে দাদা নিশ্চয়ই আমাকে আজেবাজে ঠাট্টা করে খ্যাপাবে। তার চেয়ে কিছু না বলাই ভালো।
বাতাস চিরে লাল আলফা স্পোর্টস ছুটে চলেছে, আর আমার বুকের ভেতরে কাল সকাল নটার ঘণ্টা বাজছে : ঢং.ঢং…ঢং!
.
হিতেশ কাপুর
সকালে রোমিলা গাড়ি নিয়ে কারেইন দেখতে বেরোল। আর আমি ও মোহন খান্না গেলাম শেখ হারিদের দরবারে।
আমাদের অবাক করে দিয়ে শেখ হারিদ বললেন, আমি নিজেই আপনাদের প্রাসাদ ঘুরিয়ে দেখাব। আপনারা আমার গুরুত্বপূর্ণ অতিথি।
আমরা শেখকে অনুসরণ করলাম। আমাদের ঠিক পেছনেই বিশ্বস্ত সচিব হাসান। এবং কিছুটা দূরত্ব রেখে আমাদের সঙ্গী হয়েছে চারজন সশস্ত্র রক্ষী।
শিল্পকলা ও পুরাসামগ্রীর অমূল্য সংগ্রহ ছড়িয়ে রয়েছে সারা প্রাসাদ জুড়ে। শেখ এক নিপুণ গাইডের মতো প্রতিটি জিনিসের খুঁটিনাটি ইতিহাস শোনাতে লাগলেন আমাদের।
এইভাবে প্রায় একঘণ্টা প্রাসাদ পরিক্রমার পর একটা লুকোনো লিফটে চড়ে আমরা উঠে গেলাম প্রাসাদের গম্বুজে। গম্বুজের ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা নীচে, বহু নীচে, প্রাণচঞ্চল শহরগুলো দেখতে লাগলাম। এটাই কাহরেইন-এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা।
আমাদের মুখে ফোঁটা-ফেঁটা ঘাম জমছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিল। মনে হল, আরব্য রজনীর রূপকথার কোনও গল্পে ঢুকে পড়েছি।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে শেখ হারিদ বললেন, এবারে আপনাদের এমন একটা জিনিস দেখাব যা বাইরের জগৎ কখনও চোখে দেখেনি। আশা করি আপনারা প্রাণভরে সে-দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
লিফট আবার ফিরে এল নীচে। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো অলিন্দ ধরে।
চলতে-চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম প্রাসাদের পেছনের এক বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে। প্রাসাদের কাছাকাছি মাঠের একটি অংশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলগুলো পাথরের টুকরো গেঁথে তৈরি। তার গায়ে সবুজ লতানে গাছের ঝাড়। ঘেরা অংশে প্রবেশ করার পথ একটাই ও প্রকাণ্ড ভারী এক লোহার দরজা। দরজায় সশস্ত্র প্রহরা। প্রাসাদে ঢোকার মুখেও এত কড়া পাহারা দেখিনি।
আমরা ভেতরে ঢুকতেই লোহার গেট আবার সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। শেখ হারিদ অনুচ্চ অহঙ্কারী কণ্ঠে বললেন, এই বাগানে আমার পোষা পাখিরা থাকে।
তার ঠোঁটে সামান্য ধূর্ত হাসি খেলে গেল।
আমি আর মোহন পরস্পরের চোখে তাকালাম। পোষা পাখি? কিন্তু কই, কোনও খাঁচা তো নজরে পড়ছে না। মাথার ওপরে ভোলা নীল আকাশ। পাখিদের বন্দি করার ব্যবস্থা কই?
অবাক হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের নজর আটকে গেল। মুগ্ধ অপলক চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম। এবং আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
নানান রঙের রূপসী ফুল ফুটে আছে বাগানে। তাদের বর্ণ গন্ধের তুলনা হয় না। সামনেই এক অগভীর দিঘি। আকাশ-নীল রঙের মার্বেলে বাঁধানো। নির্মল স্বচ্ছ তার জল। দিঘির মাঝে এক স্বপ্নিল ফোয়ারা। তার জলধারা শূন্যে বাঁক নিয়ে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে টলটলে জলে। কুলকুল শব্দ হচ্ছে জলতরঙ্গের মতো। দিঘির পাড়ে সূর্যের খরতাপ আড়াল করে দাঁড়িয়ে সুদীর্ঘ দেবদারু ও চিনার গাছের সারি। ছায়া-ছায়া সবুজ পরিবেশ যেন মায়াময় এক মরূদ্যান।
সব মিলিয়ে অপরূপ এই উদ্যান।
না, উদ্যানের অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্য আমাদের অবাক করে দেয়নি, পা জোড়া গেঁথে দেয়নি নরম ঘাসের জমিতে। আমাদের হতবাক করেছে বাগানের পাখিরা।
স্বর্গের এই নন্দনকাননে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে সুন্দরী তরুণীর ঝক। সংখ্যায় তারা কুড়ি, কি তারও বেশি হবে। কেউ পায়চারি করছে, কেউ দিঘিতে সাঁতার কাটছে, কেউ শুয়ে আছে ঘন দেবদারুর ছায়ায়, আর কেউ বা ঘাসের ওপর শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে।
প্রতিটি মেয়েই অপরূপ রূপসী ও তীব্র যুবতী। সবচেয়ে অবাক করে দেওয়া বিষয় হল, তরুণীরা সকলেই সম্পূর্ণ নগ্ন! শেখ হারিদের নগ্ন পোষা পাখির আঁক!
আপনাদের মুখ দেখে বুঝতে পারছি আপনারা খুশিই হয়েছেন। আসুন, একটু ঘুরে দেখা যাক।–শেখ মেজাজি স্বরে বললেন।
আমরা বাগানে পায়চারি করতে থাকলাম।
তখনই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম। চলার পথে যে-মেয়েটি আমাদের সামনাসামনি পড়ছে সে সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তারপর আমরা তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ামাত্রই সে আবার নিজের সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ফিরে যাচ্ছে। যে কাজে মেতে ছিল সেই কাজেই আবার মেতে উঠছে।
এ এক অদ্ভুত সম্মান। আবার একই সঙ্গে আমার শরীরে দপদপ করে উঠছে কামনার শিরা। প্রতিটি নগ্ন নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব যেন নতুন-নতুন বাসনার দীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে দেহের অন্ধকার কুঠরিতে।
চলতে-চলতে আমরা বাগানের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম।
মুখে সবজান্তা হাসি ফুটিয়ে শেখ হারিদ বললেন, ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমার যে-কোনও অতিথি এই বাগানে আসামাত্রই নির্বাক হয়ে যায়। কথা হারিয়ে ফেলে কোন অজানা জাদুমন্ত্রে।
মোহন খান্নাই প্রথম ভাষা খুঁজে পেল। বলল, স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই স্যার, এই দুর্লভ সুন্দরীদের দেখার অনুমতি ও সুযোগ দিয়ে আপনি একইসঙ্গে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন এবং অবাক করেছেন।
শেখ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন : দয়া করে ভুল বুঝবেন না, মিস্টার খান্না, এটা আমার হারেম নয়। সেটা আছে প্রাসাদেরই অন্য আর এক অংশে। সেখানে আমি ও আমার বিশেষ কয়েকজন রক্ষী ছাড়া আর কারও ঢোকার অধিকার নেই। তা ছাড়া আমার বেগমরা নগ্ন দেহে কখনও আত্মপ্রকাশ করেন না, সেরকম অনুমতি তাদের দেওয়া হয়নি।–শেখ হারিদ একটু থেমে নগ্ন তরুণীদের দিকে ইশারা করে বললেন, না, মিস্টার খান্না, বেগম নয়, এই মেয়েরা আমার কয়েদি।
আপনার কয়েদি?–আমি ও মোহন বিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করে উঠলাম শেখের কথার।
হ্যাঁ, কয়েদি। কোনও-না-কোনও অন্যায় আচরণের জন্যে ওরা এখানে বন্দি। সে অন্যায় আমার বিরুদ্ধে, আমার রাজ্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু সত্যিই কি ওরা অপরাধী?–দু-পাশে হাত ছড়ালেন হারিদ : আমার বিচার কি সঠিক বিচার হবে? কী করে ন্যায়বিচার করব আমি? আমি ওদের, রাজা, কিন্তু রাজা হলেও আমি এক ক্ষুদ্র মানুষ। তাই ওদের বিচারের ভার আমি তুলে দিয়েছি মহান আল্লার হাতে। আল্লাই ওদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। আল্লা ওদের বিচার করে চলেছেন, আর সেই বিচারের রায় অনুযায়ী দণ্ড পাওয়া পর্যন্ত আমি ওদের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে চেষ্টা করি। ওরা এই ঘেরা বাগানে বন্দি, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনওরকম অসুবিধে ওদের নেই। ওরা সম্মানিত অতিথির আপ্যায়ন পায়।
আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শেখ হারিদ। তারপর এক দুজ্ঞেয় হাসি হেসে বললেন, যাওয়ার আগে আর একটা কাজ বাকি আছে। আমার আতিথেয়তার নিদর্শনস্বরূপ আজ রাতে দুজন তরুণী আপনাদের শয্যা মধুময় করে তুলবে। ওদের মধ্যে থেকে আপনারা একজন করে বেছে নিন।
আমি একটু অস্বস্তি পেলাম। কী বলছেন শেখ হারিদ?
মোহনকে দেখে বেশ উল্লসিত মনে হল, কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। রোমিলার কথা মনে পড়ল। জানতে পারলে ও কী ভাববে?
সেই অস্বস্তির কথাই শেখকে বলতে গেলাম আমি।
কিন্তু আমার ছোট বোন সঙ্গে রয়েছে। ও যদি জানতে পারে…
শেখ হারিদ ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, আশা করি আমার আতিথেয়তাকে অসম্মান করার চেষ্টা আপনি করবেন না, মিস্টার কাপুর!
পরক্ষণেই হারিদের স্বর পালটে গেল। মেজাজি গলায় বললেন, ভয় নেই, আপনার সুন্দরী বোন কিছুই জানতে পারবে না।
আমি বুঝলাম, শেখ হারিদের ইচ্ছে বা অনুরোধ তার আদেশের চেয়েও শতগুণ ধারাল।
মোহন জিগ্যেস করল, যাকে খুশি বাছতে পারি?–সে যেন নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
যাকে আপনার খুশি!–শেখ মোহনকে আশ্বাস দিলেন : আপনিই প্রথমে পছন্দ করুন, মিস্টার খান্না।
শরীরে পোশাক থাকুক আর না থাকুক, ওদের মধ্যে যে-কেউই পুরুষের নজর টানে। কিন্তু মোহন একটু দ্বিধায় পড়ল। কিছুক্ষণ ঘুরে-ঘুরে দেখে ও শ্যামলা রঙের একটি মেয়েকে পছন্দ করল। আমরা যখন বাগানে ঢুকি তখন মেয়েটি দিঘির স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটছিল। আমাদের এগিয়ে আসতে দেখেই সে চটপট উঠে এসেছিল জল থেকে। তারপর নিশ্চল ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জলের অলস ধারা তার সুঠাম শরীরের স্তন, নাভি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। মাথার কালো চুল, সুন্দর মুখমন্ডল ও ডৌল স্তনের ওপর বিন্দু বিন্দু জলের মুক্তো চিকচিক করছিল। মেয়েটির বয়েস খুব বেশি হলে সতেরো কি আঠেরো, কিন্তু দেহের গঠনে কোথাও কোনও ঘাটতি নেই।
সুতরাং সুন্দরীদের সমাবেশে ওই মেয়েটিকেই সেরা সুন্দরী বলে মনে হল মোহনের।
এখানে সবাই দারুণ সুন্দরী, কিন্তু দিঘির ধারের ওই শ্যামবর্ণ মেয়েটিকেই আমার সবচেয়ে পছন্দ, স্যার।–একটু ইতস্তত করে মোহন বলল।
সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে আসা হল আমাদের কাছে। দু-হাত দু-পাশে ঝুলিয়ে রেখে সে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে–যেন মেহগনি কাঠে খোদাই করা মূর্তি।
তারপর শেখ হারিদের বিশ্বস্ত অনুচর হাসান ইশারা করতেই মেয়েটি আমাদের সামনে বারকয়েক পায়চারি করল, যাতে সবদিক থেকে আমরা তাকে খুঁটিয়ে দেখতে পারি।
পেছন থেকেও মেয়েটির যৌবনের আকর্ষণ কম নয়। তার ভারী নিতম্ব যেন চলার তালে তালে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার মনে হল, মেয়েটি ইচ্ছে করেই আমাদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে।
আপনার মেয়ে দেখার জহুরি চোখ আছে, মিস্টার খান্না।–শেখ খুশির সুরে বললেন, তাঁর হাত অন্তরঙ্গভাবে খেলে বেড়াতে লাগল মেয়েটির মসৃণ ত্বকের ওপর। তারপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, দারুণ পছন্দ! আজ রাতের জন্যে ও পুরোপুরি আপনার। তবে একটা কথা আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে : ওর শরীরের কোন অংশ আপনার চোখে সবচেয়ে লোভনীয়, মিস্টার খান্না?
ওর শরীরে কোনও খুঁত নেই। সবই সুন্দর।–মোহন স্বীকরা করল অকপটে।
কিন্তু শেখ হারিদ নাছোড়বান্দা।
কিন্তু এমন একটা অংশ তো আছে যেটা আপনার সবচেয়ে পছন্দ?
মোহন বুঝল উত্তর না দিয়ে রেহাই নেই। ফলে ও বলল, ওর পায়ের গড়ন সত্যি একসেলেন্ট। এরকম নিখুঁত গড়ন কখনও আমার নজরে পড়েনি।
চমৎকার! হাততালি দিয়ে উঠলেন শেখ হারিদ। তারপর তিনি ধীরে ফিরে তাকালেন আমার দিকে মিস্টার কাপুর, এবারে আপনার পালা। আপনি আপনার শয্যাসঙ্গিনী বেছে নিন। লজ্জা করবেন না মোটেই।
আমি নিরুপায় হয়ে নগ্ন সুন্দরীদের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম।
.
হিতেশ কাপুর
সারাদিন ঘুরে এসে রোমিলা খুশিতে টগবগ করে ফুটছিল। প্রচণ্ড উৎসাহে ও সারাদিনের ভ্রমণবৃত্তান্ত শোনাতে লাগল আমাদের।
সন্ধে গড়িয়ে রাত বাড়ছে। আমার মন ক্রমাগত উসখুস করে চলেছে। কারণ রাত আর একটু গাঢ় হলেই আমার ঘরে পৌঁছে যাবে আমার পছন্দ করা সুন্দরী। এই এক চিন্তা ও উৎকণ্ঠা আমাকে সারাক্ষণ অন্যমনস্ক করে রাখল।
তাকিয়ে দেখি মোহন খান্নার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। বারবার দরজায় দিকে তাকাচ্ছে।
আমরা রোমিলার ঘরে বসে ছিলাম। মোহন দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বারান্দার দিকে নজর রাখতে চাইছে।
কথা বলতে-বলতে রোমিলা একটু পরেই বুঝতে পারল আমরা কেউই ওর কথায় কান দিচ্ছি না। তখন অভিমানে আহত গলায় ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, তোমরা আমার একটা কথাও শুনছ না। ভেবেছিলাম, সারাদিনে আমি কোথায়-কোথায় ঘুরলাম সে কথা বলে তোমাদের তাক লাগিয়ে দেব, কিন্তু কোথায় কী! ধুৎ ছাই, মোহনদারও দেখছি এক অবস্থা।
হতাশায় হাত ছুড়ল রোমিলা।
কিছু মনে করিস না, রোমু।আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তারপর আড়চোখে দেখলাম মোহনের দিকে ও আসলে সারাটা দিন আমাদেরও কম খাটুনি যায়নি। ভাবছি ঘরে গিয়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
আমারও একই অবস্থা, রোমিলা। ঘুমে চোখ বুজে আসছে।–মোহন চটপট বলে উঠল।
কিন্তু রোমিলা সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে দেখল : কী হয়েছে বলো তো তোমাদের? এখনও তেমন রাত হয়নি! ভেবেছিলাম তোমাদের সঙ্গে রাতে বেড়াতে বেরোব, কাহরেইন এর রাতের জীবন দেখব।
প্লিজ রোমু, আজ নয়, কাল।আমি রীতিমতো অনুনয়ের সুরে বললাম, শরীরে আর কিছু নেই। নির্ঘাত গরমের জন্যে এমন কাহিল লাগছে।
একথা বলে রোমিলার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। স্পষ্ট টের পেলাম, রোমিলার নজর আমার পিঠে বিঁধছে।
শুনলাম, মোহন ওকে বলছে, আমিও চলি। গুড নাইট।
অবাক সুরে রোমিলা বলল, সত্যি, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আপনারা শুধু নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে এসেছেন। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
আমি নীরবে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলাম।
ঘরে আসার মিনিটদশেক পরেই আমার পছন্দ করা মেয়েটি এল। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবতে শুরু করেছি, আমাদের সকালে দেখা উদ্যান ও সেখানকার সমস্ত ঘটনা হয়তো নিছকই এক সুন্দর স্বপ্ন, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই ভাবনা থেমে গেল।
উপস্থিত শয্যাসঙ্গিনী এক সুন্দর স্বপ্ন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সঙ্গে সে মনোরম বাস্তবও বটে। পরনে তার আকাশ-নীল ম্যাক্সি। গলা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত বিছানো। অসংখ্য ভাঁজ তার শরীরের রূপরেখা স্পষ্ট অথচ রহস্যময় করে তুলেছে। সকালের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে।
পিঠ পর্যন্ত কালো চুলের ঝরনা। পাতলা টুকটুকে ঠোঁট। টানা-টানা ভুরু, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টানা কালো চোখ। গায়ের রং মার্বেল পাথরের মতো সাদা।
আমি কোনও কথা বলার আগেই গলায় বাঁধা পোশাকের ফঁসটা খুলে ফেলল সে। চাপা ফিসফিস শব্দ তুলে পোশাকটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ওর সুন্দর পায়ের পাতা ঘিরে যেন তৈরি হল এক সুনীল জলাশয়। এখনও ও সম্পূর্ণ নগ্ন। সকালে যে-নগ্ন রূপ দেখে আমি ওকে পছন্দ করেছি এখন তা যেন বিকশিত হয়েছে শতদল মেলে।
সকালে ওর সুতনু বাহুর প্রশংসা করেছি আমি। চাপার কলির মতো নিটোল প্রতিটি আঙুল। দীর্ঘ বাহু। নখ থেকে শুরু করে কাঁধ পর্যন্ত যে মোহময়ী রেখা বরাবর বাহুর গতি, তা যেন কোনও দক্ষ শিল্পীর সাবলীল তুলির টান।
ওর শরীরের কোন অংশ আপনাকে বেশি টানে, মিস্টার কাপুর!–শেখ হারিদ আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন।
আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছি, ওরকম সুঠাম দীর্ঘ বাহু কেবলমাত্র অপ্সরী কিন্নরীদের ছবিতেই দেখা যায়, স্যার। এই দুটো হাত বুকে জড়িয়ে আমি সারাজীবন বসে থাকতে পারি।
শেখ মুচকি হেসেছিলেন আমার কথা শুনে। অবশ্য কেন, তা বুঝতে পারিনি–অন্তত তখন।
ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে স্বপ্নচারিণী কথা বলল, তোমাকে আমি সুখী করতে চাই। সেরকমই আদেশ রয়েছে আমার ওপরে।
আমার অঙ্গের প্রতিটি শিরা দপদপ করে কাঁপতে লাগল। ওর অপরূপ হাত দুটো হাতে তুলে নিলাম। চোখের নজর যথেচ্ছ খেলে বেড়াতে লাগল ওর নিখাদ-নগ্ন শরীরে ফিসফিস করে বললাম, তোমার মতন সুন্দর কাউকে দেখিনি। শুধু তোমাকে দু-চোখ ভরে দেখতে চাই।
ও আলতো করে নমনীয় হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল আমার হাত থেকে। তারপর আরও কাছে এসে ধরা দিল আমার বাহুবন্ধনে।
দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমার মুখ নামিয়ে এনে গভীর চুম্বন এঁকে দিল আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে।
আমার শরীরের অভ্যন্তরে, পাগল করা বিস্ফোরণ ঘটে গেল সেই মুহূর্তে।
আমার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা সঙ্কোচ ছিল। কারণ অন্যের আদেশে এই মেয়েটি এসেছে আমাকে ভালোবাসতে। নিজের ইচ্ছেয় আসেনি। কিন্তু প্রথম স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উবে গেল আমার মন থেকে। ওর মোহময়ী যৌবন অনিবার্য নিয়তির মতো গ্রাস করল আমার নীতি আদর্শ-সহানুভূতি, সবকিছু। তা ছাড়া, দেখে মনে হল, একটি সুন্দর স্বপ্নময় সুখ-শয্যা রচনার ইচ্ছে আমার চেয়ে ওর কিছু কম নয়।
আমাদের মিলন হল একটি স্মরণীয় ঘটনা। দুজনেরই কৌমার্যব্রতের ইতি ঘটল সে-রাতে। তীব্র কামনা, আনকোরা অভিজ্ঞতার আনাড়িপনা, সবকিছু মিলে এক আশ্চর্য যুগলবন্দি সৃষ্টি করলাম আমরা দুজনে। ওর কামনার আবেগ যেন ওর সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়।
উত্তাল ঢেউ তুলে ও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল কোন অজানায়। মনে হল, এর চেয়ে সুখের নীড় তিন ভুবনের কোথাও নেই।
অবশেষে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি রাজকীয় শয্যায়। কথা বলছি নরম গলায়। জানলাম, ওর নাম আয়েষা। ছেলেবেলা থেকেই ও কারেইন-এ মানুষ। ইংরেজি শিখেছে ওর বাবার কাছে। তারপর…।
আমি ওর কানের কাছে মুখ এনে ছোট্ট করে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আয়েষা।
পলকে ওর নমনীয় শরীর শক্ত হয়ে গেল। আমি চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর কাজল কালো চোখে অন্তত দুঃখের ঢল নেমেছে, সঙ্গে আতঙ্কের জটিল স্রোত।
ওকথা বোলো না কখনও।–আয়েষা বিষণ্ণ স্বরে বলল।
কেন বলব না? আমাদের পরিচয় মাত্র একদিনের, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
না হিতেশ, তা হয় না। আমি শেখ হারিদের কয়েদি। আজ রাতের পর আর আমাদের দেখা হবে না।
কিন্তু কোন অপরাধে শেখ তোমাকে বন্দি করেছেন?–অধৈর্য হয়ে আমি জানতে চাইলাম।
আয়েষার মুখ-চোখে অসহায় ভাব ফুটে উঠল। বলল, অপরাধ আমি করিনি, করেছেন আমার বাবা। বাবার একটা খবরের কাগজ আছে কারেইন থেকে বেরোয়। সেই কাগজে এমন কিছু লেখা বেরিয়েছিল যা শেখ হারিদ মনে করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে।
তাতে তোমার কী করার আছে? আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
তুমি শেখকে চেনো না। নৃশংসতায় তাঁর জুড়ি নেই। বাবার ওপরে কী-ইবা প্রতিশোধ নিত শেখের লোকেরা! বড়জোর বাবাকে ওরা মেরে ফেলত। কিন্তু বাবা তো এমনিতেই অসুস্থ, যে-কোনওদিন মারা যেতে পারেন। সুতরাং বাবার অপরাধে যদি আমাকে শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে বাবার ওপর ধাক্কাটা অনেক বেশি আসবে। তাই এই ব্যবস্থা। আজ সকালে যে-সব মেয়েদের তুমি বাগানে দেখেছ ওদের বেশিরভাগই নিরপরাধ। ওদের প্রাসাদে এনে বন্দি করে রাখা হয়েছে কারণ অন্যায়টা করেছে ওদের কোনও আত্মীয় অথবা বন্ধু। একের পাপের শাস্তি অন্যকে সইতে হচ্ছে।
কিন্তু এখন তোমাকে নিয়ে শেখ কী করবেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
আয়েষা মনমরা সুরে জবাব দিল, কেউ সঠিক জানে না। কিন্তু এমন সব কথা আমরা কানাঘুষোয় শুনেছি যে, সেগুলো উচ্চারণ করতেও ভয় হয়। তবে এটুকু জানি, এখানে কোনও মেয়েকে এক বছরের বেশি আটকে রাখা হয় না। আর কোনও মেয়েকে যদি শেখের অতিথির সঙ্গে রাত কাটাবার জন্যে বেছে নেওয়া হয় তাহলে তারপর তাকে আর ওই বাগানে দেখা যায় না।
তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি থাকতে পারব না। বুঝতে পারছিলাম, আবেগে আমার স্বর বুজে আসছে।
শুধু-শুধু দুঃখ পেয়ো না। ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথা বিশ্বাস করো।
আয়েষা আমার কথা বিশ্বাস করল কিনা জানি না, তবে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল ওর সুন্দর ঠোঁটে। বলল, হিতেশ, ওসব কথা ভুলে যাও। শুধু আজকের রাতটুকুই আমার কাছে সত্যি। এসো, এই সময়টুকু আমরা সবকিছু উজাড় করে ভালোবাসার খেলা খেলি।
সে-রাতে আরও কতবার যে আমরা একই খেলায় মেতে উঠেছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, শেষবারের পর আয়েষার ধনী বুকের ওপর মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওর শরীরের সোঁদা গন্ধ নাকের ভেতরে ঢুকে আমাকে মাতাল করে দিচ্ছিল।
ভোরবেলায় যখন ঘুম ভেঙেছে তখন আয়েষা চলে গেছে।
.
প্রাতরাশের টেবিলে রোমিলা হালকা গলায় মন্তব্য করল, দাদা কাল সাত-তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও তোমাদের শরীরের কোনও উন্নতি হয়নি। ঠিক ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে।
আমি কোনও জবাব দিলাম না। শুধু মোহন খান্নার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল।
রোমিলা টেবিল ছেড়ে চলে যেতেই মোহন জিগ্যেস করল, কী দোস্ত, এখানকার হাওয়া এখন স্যুট করছে তো? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কাল রাতটা বেশ ভালোই কেটেছে।
আমি উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, তোমার?
একগাল হেসে মোহন বলল, দারুণ! শুধু খারাপ লাগছে এই কথা ভেবে যে, একটু পরেই শালা শেখের সঙ্গে তেলের দর নিয়ে মেছোবাজারের মতো দরাদরি করতে হবে। কিন্তু উপায় কী ব্রাদার, এর নাম চাকরি। চলো, তৈরি হয়ে নিই।
তেল নিয়ে কথাবার্তা সহজে মিটল না। চটপট কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেল না। শেখ হারিদের সঙ্গে হাজির ছিলেন তার মন্ত্রণা পরিষদ। হাসান হাজির ছিলেন নীরব সাক্ষীর মতো। আর মোতায়েন ছিল শেখের বিশ্বস্ত কয়েকজন রক্ষী।
অত্যন্ত ছোটখাটো ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একরোখাভাবে জেদ ধরলেন কাহরেইন-এর বাণিজ্য মন্ত্রণা পরিষদের মুখপাত্ররা। সব দেখেশুনে মনে হল চটজলদি কোনও চুক্তি করতে তেলের কুমিররা রাজি নন।
সারাদিন ধকলের পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম। মোহন বলল, ওরা মনে হয় অন্য কোনও পার্টির সঙ্গেও কথাবার্তা চালাচ্ছে।
হতে পারে।আমি ওর কথায় সায় দিলাম ও আমরা দরে যত পর্যন্ত উঠতে পারি সেই পর্যন্ত দেখব। তাতেও যদি ওরা রাজি না হয় তাহলে কোম্পানিতে টেলিগ্রাম করে ডিরেক্টরদের ডিসিশান জানতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
অগত্যা। বলল মোহন।
সারাদিনের মিটিংয়ে আমি কম বকবক করিনি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মোহনকে সাহায্য করার। কিন্তু তবু যেন মনে হচ্ছে মিটিংয়ে আমি একাত্মভাবে জড়িয়ে পড়তে পারিনি। আয়েষার কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল গত রাতের কথা। রাতের পুঙ্খানুপঙ্খ প্রতিটি স্মৃতি জুলজুল করছিল আমার চোখের সামনে, ভিড় করছিল আমার মনের ভেতরে। কেমন একটা অপরাধবোধ আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় আমি কোনও জালিয়াতি করে ফেলিনি তো? না কি আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই ওই শয্যাবিলাসের আয়োজন করেছিলেন শেখ হারিদ? কিন্তু এতটা শয়তানি প্যাঁচ কি খেলবে কাহূরেইন-এর এই নির্লিপ্ত মানুষগুলো? তা ছাড়া আয়েষার কথাগুলো কি বানানো গল্প, মিথ্যে?
অনেক ভেবেও আয়েষার কথাগুলো মিথ্যে বলে মনে হল না।
ওর বাবার অপরাধে ও শাস্তি ভোগ করছে।
কী নৃশংস এই শেখের বিচার!
আয়েষার কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। ওর সুন্দর মুখ, ওর অপরূপ অতুলনীয় দুটি বাহু, ওর জাদুমন্ত্রে ছোঁয়া লাগানো নগ্ন যৌবন।
যে করেই হোক আয়েষার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। কোনও বাধা, কোনও বিপদ আমাকে রুখতে পারবে না।
.
রোমিলা কাপুর
নির্দিষ্ট জায়গায় যখন পৌঁছলাম তখন নটা বেজে দশ মিনিট। আজও আকাশি ভ্যান আমার অনুসারী। বহু চেষ্টা করেও লেজ থেকে তাকে ছাড়াতে পারিনি।
আলফা থামিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই মহম্মদ ইলিয়াসের হাসিমুখ। আমার হাতে নাম না–জানা হলুদ ফুলের তোড়া। শেখ হারিদের চোখ-ভোলানো বাগান থেকে নিজে হাতে তুলে এনেছি।
তোড়াটা ইলিয়াসের হাতে দিয়ে বললাম, গোলাপের বদলে।
ইলিয়াস দুহাত পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। ডান হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে ফুলের তোড়াটা গ্রহণ করল। তারপর লুকনো বাঁ-হাত সামনে নিয়ে আসতেই লজ্জা পেলাম। ওর হাতে সদ্য ফোঁটা গোলাপের তৈরি একটা নতুন গুচ্ছ।
তোড়া দুটিকে হাতবদল করে মাথা ঝুঁকিয়ে আদাবের ভঙ্গিতে ওর গোলাপের তোড়াটা আমার দিকে এগিয়ে দিল ইলিয়াস। বলল, ইতনি আসান নহী হ্যায় কর্জ চুকানা ইয়ে বান্দেকি। এ বান্দার ঋণ শোধ করা অত সহজ নয়, মিস কাপুর।
তারপর গতকালের মতোই ও হাটের মাঝখানে হো-হো করে হেসে উঠল। আশেপাশের লোকজন বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল আমাদের দিকে।
ইলিয়াসের পোশাক আজ অন্যরকম। ফিনফিনে গোলাপি কাপড়ে তৈরি ফুলহাতা কাফতান আর আঁটোসাঁটো ব্লু জিন্স। কাঁধে ঝোলানো একটা চামড়ার ব্যাগ।
চলুন, কারনামায় গিয়ে বসি। ইলিয়াস বলল, ইন্টারভিউটা সঙ্গে এনেছি। আপনাকে পড়ে শোনাব।
আমি ওর পাশে হাঁটছি। কারনামা-র সুদৃশ্য দরজা ক্রমেই আমাদের কাছে এগিয়ে আসছে। এই মুহূতে ভারতের কথা ভাবলে দেশটার স্মৃতি কেমন আবছা মনে হয়। মনে হয়, কাহরেইন সত্যি, বাকি সব মিথ্যে।
গতকাল দাদা ও মোহনদার আচরণ আমার কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছে। বারবার মনে হয়েছে, কী একটা যেন ওরা গোপন করতে চেষ্টা করছে আমার কাছ থেকে। কোথায় চিন্তায় ছিলাম আমার কাহরেইন বেড়ানোর কতটুকু ওদের বলব, আর কতটুকু বলব না, উলটে ওরা আমার বেড়ানোর গল্পকে মোটে পাত্তাই দিল না। সেই মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওদের ওপর।
আজ সকালেও দাদা আর মোহনদার মুখে অবসাদ ও ক্লান্তির ছাপ দেখেছি। সেই সঙ্গে যেন একটা আবছা অপরাধবোধও ছায়া ফেলেছিল ওদের মুখমণ্ডলে। দাদা এমনিতে মনের ভাব খুব একটা লুকিয়ে রাখতে পারে না। তাই ওকে দেখেই আমার সন্দেহটা গাঢ় হল। শেখ হারিদ কি ওদের দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করিয়ে নিতে চলেছেন?
ইরান কথাটার অর্থ জানেন?
ইলিয়াসের আচমকা প্রশ্নে আমার চমক ভাঙল। দেখি কারনামা-র দরজায় পৌঁছে গেছি।
দরজা ঠেলে ভেতরের ঠান্ডা পরিবেশে ঢুকলাম দুজনে। আমি ছোট্ট করে বললাম, ইরান কথাটার আবার অর্থ আছে নাকি?
কাহরেইন-এর নেই, কিন্তু ইরানের আছে।
গতকালের টেবিলটার দিকে অজান্তেই চোখ চলে গেল আমাদের। টেবিলটা খালি। দুজনে চোখাচোখি হল। ইলিয়াসের কালো চোখের তারায় আশ্চর্য কৃতজ্ঞতার ইশারা। কিন্তু কেন, তা জানি না।
টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসলাম। তারপর আমি বললাম, আজ শুধু সবুজ চা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব।
ইলিয়াসের চোখ পলকের তরে সপ্রশ্ন হল। কিন্তু পরক্ষণেই বেয়ারাকে ডেকে সবুজ চা অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, এত তাড়া নিয়ে এলেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি-সত্যি আমার বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া নেই। কিন্তু ইলিয়াসের সঙ্গে বেশিক্ষণ বসতে আমার ভয় হচ্ছিল। তা ছাড়া আমি জানি, রেস্তোরাঁর বিল কিছুতেই ও আমাকে মেটাতে দেবে না। সেইজন্যেই আরও বেশি খারাপ লাগছিল। সুতরাং প্রসঙ্গ পালটে ঠোঁটে হাসি টেনে ওকে প্রশ্ন করলাম, কী হল, ইরানের অর্থটা বললেন না তো!
ইলিয়াসের মুখ সামান্য গম্ভীর হল। বলল, ইরানের অর্থ হল, আর্যদের দেশ। কারণ প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া থেকে দলে-দলে যেসব মানুষ ইরানে এসেছিল, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আর্য। সেইজন্যেই ওই নাম। উত্তর ভারত আর ইউরোপের সঙ্গে সেইসব আর্যদের রক্তের সম্পর্ক ছিল। সেইজন্যে তাদের বংশধরদের সঙ্গে দক্ষিণ ইউরোপের মানুষদের মিল আছে। আর প্রায় খাঁটি আর্য বলতে ইরানে রয়ে গেছে কয়েকটি উপজাতি–যেমন, কুর্দ, সুর আর বখতিয়ারি।
আমি হেসে ওকে বললাম, আপনি যে একেবারে ইতিহাস মুখস্থ করে রেখেছেন দেখছি!
ভুলে যাবেন না আমি রিপোর্টার। খবর বেচে খাই।
সবুজ চা টেবিলে এসে গেল। আমি ছোট্ট গোলাপের তোড়াটা নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। দেখাদেখি ইলিয়াসও আমার দেওয়া হলুদ ফুলের গুচ্ছ তুলে ধরল মুখের সামনে। বলল, আপনি গোলাপ ভালোবাসেন?
আমি হেসে বললাম, কে না বাসে!
ইলিয়াস আনমনা হয়ে গেল। থেমে-থেমে বলল, আলেয়া…আলেয়া গোলাপের নামে পাগল ছিল…।
আলেয়া! ইলিয়াসের বোন! কিন্তু ও এভাবে কথা বলছে কেন? আলেয়া গোলাপের নামে পাগল ছিল!
আমি ছোট্ট করে জিগ্যেস করলাম, আলেয়া এখন গোলাপ ভালোবাসে না?
একটা দীর্ঘশ্বাস ওর শরীরের গভীর অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এল বাইরে। পরদা ঢাকা জানলার দিকে তাকাল ইলিয়াস। অস্ফুট স্বরে বলল, এখন ও গোলাপ ভালোবাসে কিনা জানি না…
আমি চায়ের গ্লাসে চুমুক দিলাম। অখণ্ড নীরবতায় চুমুকের ক্ষীণ শব্দটা কটু হয়ে কানে বাজল।
ইলিয়াস এবার আমার দিকে চোখ ফেরাল। বলল, আলেয়া কাছে নেই। এখন তেরো বছরের নামাই আমার সব। ওকে সুখী রাখার জন্যে আমি যা খুশি করতে পারি। ও আমার চোখের মণি, রোমিলানা ভুল বললাম, তার চেয়েও বেশি।
ইলিয়াসের ফরসা মুখ লালচে হয়ে গেছে। এখুনি যেন রক্ত ফেটে বেরিয়ে ছিটকে পড়বে হলুদ ফুলের তোড়ার ওপর। ওর চোখ চকচক করছে কী এক অদ্ভুত আবেগে। আলেয়া ওর কাছে নেই কেন? আলেয়ার কি বিয়ে হয়ে গেছে? ইলিয়াসের চোখমুখ দেখে সে কথা জিগ্যেস করতে ভরসা হল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইলিয়াস চায়ে চুমুক দিল। ফুলের তোড়াটা নামিয়ে রাখল পাশের চেয়ারে। একটু পরেই ওর মুখে হাসি ফুটল। বলল, ইন্টারভিউটা তোমাকে পড়ে শোনাই।
আমি আগ্রহে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম।
প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজকরা কয়েকটা কাগজ বের করল ইলিয়াস। সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে পড়বার জন্যে তৈরি হল। বলল, এটা পার্সি ভাষায় লেখা, কিন্তু আমি ইংরেজি অনুবাদ করে পড়ে শোনাচ্ছি। বোর করলে সঙ্গে-সঙ্গে জানাবে, লজ্জা করবে না।
ও হাসল। আমিও হাসলাম। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে ইলিয়াস ইন্টারভিউটা আমাকে পড়ে শোনাতে লাগল। পড়া এবং শোনার ফাঁকে ফাঁকে চলতে লাগল আমাদের চায়ের চুমুক।
চা এবং ইন্টারভিউ-পাঠ প্রায় একই সঙ্গে শেষ হল। তখন ইলিয়াস প্রশ্ন করল, কেমন লাগল?
দারুণ?–একটু থেমে আরও বললাম, এটা কিন্তু মোটেই মন-রাখা কথা নয়।
সত্যি, এত চমৎকার ও সাবলীলভাবে ইন্টারভিউটা ইলিয়াস লিখেছে যে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা বেরিয়ে আসে।
ওর নানান গুণ আমাকে বিপজ্জনকভাবে মুগ্ধ করে চলেছে।
প্রশংসার জন্যে নরম গলায় আমাকে পালটা ধন্যবাদ জানাল ইলিয়াস। তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, তোমার তো আবার বাড়ি ফেরার তাড়া রয়েছে, নইলে…
হঠাৎই চুপ করে গেল ও।
আমি জানতে চাইলাম, নইলে কী?
ইলিয়াস একরাশ কুণ্ঠা নিয়ে নীচু গলায় বলল, কাল নাজমাকে তোমার কথা গল্প করেছিলাম। ও ভীষণ জেদ ধরেছে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। আসলে আমি চাকরিতে বেরিয়ে পড়ি। বাড়িতে ওর পিসির কাছে থাকে নাজমা। ফলে তেমন গল্পগুজব করার সঙ্গী পায় । তার ওপর তুমি ভারত থেকে এসেছ শুনে তো একেবারে আলাদীনের প্রদীপ হাতে পেয়েছে।
কথা বলতে বলতে একটা খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ছিল ইলিয়াসের চোখে-মুখে। হঠাৎই সেটা দপ করে নিভে গেল। অনেকটা সাফাই দেওয়ার সুরে বিড়বিড় করে ও বলতে লাগল, আসলে আমি নাজম