কেন্দ্র কবুতর
ছিটকে গিয়ে পড়লম ঘরের কোনায় রাখা শৌখিন টেবিলটার ওপর। মট করে ভেঙে গেল ওটার পায়া। টেবিলের ওপর থেকে কাচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল। আবার যখন ভালো করে তাকালাম, তখন আমার জিভের ডগায় নোনতা স্বাদটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রায় ছফুট লম্বা লোকটি পায়ে-পায়ে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, আমার কাছে রিভলভারও আছে।
এ-কথা বলার কোনওই প্রয়োজন ছিল না। কারণ ওর একটা ঘুষিতেই আমি সরষেফুল দেখছিলাম। কোনওরকমে বললাম, কী কী চাই তোমার? যদিও মনে-মনে ভালোই বুঝতে পারছিলাম যে ও কী চায়।
লোকটি বলল, পাণ্ডুলিপিটা।
ওই ব্যথার মধ্যেও আমার চোখে বোধহয় একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল। সেটা দেখে লোকটি বলল, আমার দলের চিহ্ন– বলে একটা কাগজ ওর জামার বুকপকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিল।
কাগজটার মধ্যে লাল রঙ দিয়ে তোলা একটা হাতের পাঞ্জার ছাপ। ওটা দেখছিলাম, লোকটির কথায় আমার চমক ভাঙলঃ আমি লালপাঞ্জা দলের কমরেড।
আমি হেসে বললাম, এটা খুব উঁচুদরের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, ঠিক ধরতে পারছি না। তবে মনে হয়, ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রতীরে সূর্যোদয়ের ছবি, তাই না?
উত্তরে একটা বুটসুদ্ধ ভারি পা দড়াম করে এসে পড়ল আমার চোয়ালে ও পাণ্ডুলিপিটা বের করে দাও।
মনে-মনে রাগ হলেও আমি নিরুপায়। বললাম, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে, বলে ওর পেছনে আঙুল নিয়ে দেখালাম। লোকটি ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল।
ব্যস, ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল আমার কাছে। একটুও দেরি না করে টেবিলের ভাঙা পায়াটা তুলে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়ে দিলাম ওর চোয়ালে। ফট করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে-সঙ্গে অতবড় দেহটা সটান পড়ে গেল মেঝেতে।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। লোকটি ঢুকল কোথা দিয়ে! ভালো করে দেখেশুনেও কোনও দরজা খোলা দেখলাম না। তবে কি জানলা দিয়ে ঢুকেছে! এই ভেবে এগিয়ে গেলাম জানলার কাছে।
দূরে হোটেলের কার পার্কের সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই উধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে একটা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে দিল। এও কি লালপাঞ্জার কমরেড নাকি? রহস্যের জট ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে দেখছি!
প্রথম থেকে ভাবতে লাগলাম ঘটনাগুলো।
ঘটনার শুরু সেইদিন থেকে, যেদিন অশোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় কলকাতায়–একরকম হঠাৎই বলতে হবে।
নিত্তনৈমিত্তিক একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি পাওয়ার আশায় সন্ধের সময় গিয়েছিলাম ময়দানে। ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই দেখা হয়েছিল অশোকের সঙ্গে। অশোক বোস–আমার স্কুলের বন্ধু ছিল ও।
আরে, কাঞ্চন না!
চন্ডাশোক নিশ্চয়ই! আমিও কম অবাক হয়নি।
হ্যাঁ। তা কী করছিস এখন?
এই দেশভ্রমণ বলতে পারিস হালকা সুরে জবাব দিয়েছিলাম।
আচ্ছা, কাঞ্চন, আমার একটা কাজ করে দিবি?
একটু আশ্চর্য হয়ে বলি, কী কাজ?
খুবই সামান্য একটা ম্যানাস্ক্রিপ্ট একজন প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
তা সেটা আমাকে করতে বলছিস কেন? জানতে চাইলাম আমি।
দ্যাখ, তোকে খুলেই বলি, বলল অশোক, তুই নিশ্চয়ই সিরাজনগর স্টেটের নাম শুনেছিস?
হ্যাঁ–শুনেছি। না শুনলেও বললাম আমি।
সেই সিরাজনগরের রাজা ছিলেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়। তিনি সিনেমার এক হিরোইনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল সুলক্ষণা সেন। পরে সিরাজনগরের বিপ্লবীরা বিপ্লবের সময় রাজা-রানীকে খুন করে। শোনা যায় এর পেছনে নাকি লালপাঞ্জা নামে একটা দলের হাত ছিল। রানী সুলক্ষণা অভিনেত্রী ছিলেন বলে তার ওপর বিপ্লবীদের রাগ বোধহয় বেশি ছিল। তাকে ওরা এমনভাবে পিটিয়ে মেরেছিল যে, রাজবাড়ির সিঁড়ির ওপর শুধু এক তাল মাংসপিণ্ড পড়ে ছিল। এরপর শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের প্রথম পক্ষের ছেলে অতলান্ত রায় রাজা হন। রানী সুলক্ষণার ব্যাপারটা তিনি জানতেন না। রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার সময় রানীর মৃত্যুর খবর পান তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর গুপ্তঘাতকের ভয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে শোনা যায় যে, তিনি নাকি নেপালে এক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কিছুদিন পর অবস্থা শান্ত হলে রণজিৎ সেন রাজ্যের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠায় তিনি অর্থ সাহায্যের জন্যে দু-একটি প্রদেশের কাছে গোপনে আবেদন জানান।
কিন্তু এর মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা আসছে কোত্থেকে? এতক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে উঠি আমি।
আসছে–আসছে। একটু ধৈর্য ধরে শোন, বলে অশোক আবার শুরু করল, তুই নিশ্চয়ই সুরেন্দ্র পালিতের নাম শুনেছিস? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও বলে চলল, সুরেন্দ্র পালিত ছিলেন সিরাজনগরের রাজা শুদ্ধসত্ত্বর মুখ্য প্রতিনিধি। এই দিনসাতেক হল তিনি মারা গেছেন। এই পালিতসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একটু বিচিত্রভাবে। সে আজ প্রায় বছরদুয়েক আগের কথা। সিরাজনগরে আমি গিয়েছিলাম অফিসের কাজে–সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে। একদিন রাতে একটা অন্ধকার গলিতে দেখি দুটো লোক একজন বৃদ্ধ লোকের ওপর চড়াও হয়েছে। রাস্তায় আর লোকজন ছিল না। আমি ছুটে গিয়ে ওদের ওপর পড়ি। তারপর আমার সেই পুরোনো অভিজ্ঞতা সামান্য পরিমাণে অবোধ শিশুদুটোকে দান করলাম। বলে প্রাক্তন জেলা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন অশোক হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখাল। আমরা একসঙ্গেই বক্সিং শিখতাম।