- বইয়ের নামঃ অনিশা দত্তর গল্প
- লেখকের নামঃ অনিশা দত্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
দাম্পত্য – অনিশা দত্ত
ত্রিকোণ প্রেম অথবা প্রেমের ত্রিভুজ গড়ে ওঠা প্রায়শই ঘটে যাওয়া, নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই আমরা, মানে আমি, প্রদীপ্ত, সুষমা, রাধাপ্রসাদ, বনানী সকলেই বিক্রম, অভিজিৎ ও শর্বরীর একত্রিত প্রীতি-মধুর ঘনিষ্ঠতায় বিস্মিত বা উদ্বিগ্ন ছিলাম না। ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে, কোনও সমস্যার উদ্রেকও হয়নি। বিক্রম একবছরের সিনিয়র, শর্বরী ও অভিজিৎ আমাদের সহপাঠী। বিক্রম ও আমি আবার একই পাড়ায় থাকি, সেই সূত্রে বাল্যবন্ধু। তাই বিক্রমের সঙ্গে আমার একটা সহজ সখ্যতার সম্পর্ক ছিল। আবার, দীর্ঘ পাঁচ বছর, একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে, অভিজিতের সঙ্গেও আমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উভয়েই তাদের শর্বরী সংক্রান্ত মনোভাবনা নির্দ্বিধায় আমার কাছে খোলাখুলি ব্যক্ত করত। প্রেমের লুকোচুরি খেলার আবেগঘন প্রেক্ষাপটে, যে সমস্ত ভাল লাগার ফুল ঝুরঝুরিয়ে ঝরে বিক্রম ও অভিজিতের মনের জমি ভরিয়ে তুলেছিল, সে সমস্ত ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস তাদের উভয়ের মাধ্যমে আমারও সুপরিচিত ছিল।
বিক্রম আমাদের এক বছর আগেই পাশ করে বেরোল, ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। ভাল রেজাল্টের জন্যই তোক বা তদ্বিরের খাতিরেই হোক অথবা ভাগ্যের দাক্ষিণ্যেই হোক, সরকারি মহাবিদ্যলয়ের এক অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করে ফেলল। অভিজিতের পাশ করে বেরোবার আগেই। তখন আমি শুধু বিক্ৰমরে বন্ধু নই, তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টাও বটে। তাই, বিক্রম যখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, দেখ তিমির, শর্বরীকে কি এখন বিয়ের কথা বলব? তুই কী বলিস?
ভেবে-চিন্তে, সুপরামর্শই দিলাম, আঘাত তো একজনকে পেতেই হবে। শর্বরীকে প্রস্তাবনা দিতে, এই-ই প্রশস্ত সময়। অভিজিৎ তখনও ছাত্র। বিক্রম যদি ধৈর্য ধরে বসে থাকে, কবে শর্বরী তার দিকে নিশ্চিতভাবে হেলবে, তবে ভুল করবে। শর্বরী, বিক্রম ও অভিজিৎকে দুপাশে নিয়ে, সোজা পথে হেঁটে চলেছে। যে আগে হাত ধরে কাছে টানবে, জিত তারই। বিক্রম এখন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচয়যোগ্য ব্যক্তি। বেচারি অভিজিৎ। এখন সহজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাবে। কিন্তু অভিজিৎ নিজের। পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে, পরিস্থিতি কী হবে বলা মুস্কিল।
বিক্রম ও শর্বরীর মধ্যে পারস্পরিক কি ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছিল, ট্রফি জিতে যাওয়ার পর, বিক্রম তা আর আমাকে জানায়নি। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই আমরা সকলে অভিজিৎ শুদ্ধ বিক্রম শর্বরীর বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম।
পরবর্তী এক বছরের ইতিহাসে, বিক্রমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ভাঁটা পড়ল, জোয়ারে ভেসে এল অভিজিৎ কারণ অভিজিৎ তখন উত্তীয়ের ভূমিকায়, ব্যর্থ প্রেমিক। এবং বিজয়ী বিক্রম বীর বিক্রমে পার্শ্ববর্তিনী শর্বরী সমভিব্যাহারে সারা কলকাতা বিনোদবিহার করে বেড়াচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা করার ফুরসৎ মিলছে না তার। বিক্রমের অবস্থা যেন গগনবিহারী পক্ষীরাজ। বন্ধুদের কথা সে সম্পূর্ণ বিস্মৃত। আমি তখন ক্রমে ক্রমে অভিজিতের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা হয়ে উঠছি। প্রথমদিকে অভিজিৎকে সান্ত্বনা দিয়ে, শর্বরীর কথা ভুলে যেতে পরামর্শ দিতাম। কিন্তু তাতে দেখি, বেচারা বেশি মনমরা হয়ে পড়ছে। বরং শর্বরীর সঙ্গে তার প্রাক্ মেলামেশার ইতিহাসে, সে আমার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে আনন্দ পায়। ইতিমধ্যে শর্বরী তার বিবাহবৎসর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালে অভিজিৎ আমার কাছে উপদেশ নিতে এল, তার পক্ষে শর্বরীর বাড়ি যাওয়াটা শাভঙ্গ হবে, না কি না যাওয়াটা দৃষ্টিকটু হবে? আমার মনে হল, নিমন্ত্রণ রক্ষা করাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। বললাম, শর্বরীর সঙ্গে তুই পুরনো বন্ধুর মত সহজ হয়ে যা।
.
অতএব, যাওয়া হল। শর্বরীর ব্যাঙ্ক থেকে যে নতুন ঝকমকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছে, আমরা সেখানেই পৌঁছে গেলাম। হাসি-হুল্লোড়ে সান্ধ্য মজলিস যখন সরগরম এবং নিমন্ত্রিরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্যালি জাহিরে ব্যস্ত, আমি সেই ফাঁকে খুঁটিয়ে শর্বরীকে লক্ষে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, শর্বরী সমস্ত অতিথিদের মধ্যে, অবশ্যই অভিজিতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। আমার অনুমান যে নির্ভুল, তা বিদায় মুহূর্তে অভিজিতের উদ্ভাসিত মুখ দেখে সুনিশ্চিত হওয়া গেল। শর্বরীকে আমি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। শর্বরী, অভিজিৎ সম্পর্কে নির্দয় ও নির্দায় হতে চায়নি। প্রাক্তন প্রীতির মর্যাদা দেওয়ার মতন উৎসুক উদার নরম মন তার রয়েছে।
যাই-ই হোক, শুরু হল দ্বিতীয় অঙ্ক। বিক্রমকে বদলি হয়ে যেতে হল মফঃস্বল কলেজে। শর্বরী ব্যঙ্কের চাকরি ছাড়তে চাইল না। কলেজে ছুটিছাটা প্রচুর। মফঃস্বল কলেজে আবার স্ন্যাক-সেশনে, দুটো অফ ডে। পুজো ও গ্রীষ্মবকাশ বাদ দিলেও, ছাত্র ধর্মঘট, অধ্যক্ষ ঘেরাও, অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ, পরীক্ষার খাতা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছাত্রছাত্রীদের হল ছেড়ে বেরিয়ে আসা, ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে নন-টিচিং স্টাফের হরতাল ইত্যাদি অনুষঙ্গের কারণে, কলেজে ক্লাস নেওয়ার হাত থেকে প্রায়ই অব্যাহতি মেলে। তাই কর্মস্থলে স্টাফমেসে থাকলেও, সেখান থেকে কলকাতা যাতায়াত, বিক্রমের পক্ষে এমন কিছু অনিয়মিত ব্যাপার ছিল না। তবে, শর্বরীকে সঙ্গদান করতে, বিক্রমের আগ্রহের অভাব ঘটেছিল কিনা, তা জানবার সুযোগ আমার না হলেও, এটুকু কানে এল যে, বিক্রমের অনুপস্থিতির দিনগুলো শর্বরীকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে হয় না। কারণ অভিজিৎ তখন শর্বরীকে নিয়মিত সঙ্গদান করে।