(খুনি) তুমি রবে নীরবে (নভেলেট)
নীতু মেহতা
নীতু মেহতার মৃতদেহটা যখন রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয় তখন সুদেশ সেখানে ছিল না। কিন্তু রতনলাল ছিল। সে কথা ওদের বলতে গিয়ে ঝিকিয়ে উঠেছিল রতনলালের কালো চোখ, ঝলসে উঠছিল হিংস্র দাঁতের সারি। রাহুল দস্তিদার চাপা স্বরে শাসিয়ে উঠল, রতন, রতন, আস্তে। লোকে শুনতে পাবে।
রাহুল দস্তিদার রাহুলদা–ওদের নেতা। সবাই ওর কথা শোনে। রতনলালও শুনল।
ওরা বসেছিল একটা রেস্তোরাঁয়। ওরা যখন আলোচনার জন্য জমায়েত হয়, তখন লোকজনের ভিড়ের মাঝেই আশ্রয় খুঁজে নেয়। লুকিয়ে কোনও গোপন জায়গায় সাক্ষাৎকারের চেয়ে চোখের সামনে থাকাটাই ভালো। তাতে গোয়েন্দা-পুলিশের নেকনজরটা কম পড়ে। কিন্তু সময়ে-সময়ে যে পোড়ো আস্তানায় দেখা করতে হয় না তা নয়।
রতনলালের স্বর আলতো হল। হল আরও হিংস্র। ও বলল, নীতুর কোনও আঙুলে নখ ছিল না। আঙুলগুলো ভেঙেচুরে চৌচির। আর–আর মাথায় একটা মস্ত গজাল ছুঁড়ে ছিল।
সুদেশ হুদা কেঁপে উঠল। এ সবই ওরা জানে, আগেই কানে এসেছে। কিন্তু তবুও ওদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ত্রাসের উলঙ্গ ছায়া। নীতু মেহতা ওদেরই একজন ছিল। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে, একইসঙ্গে সেই বীভৎস মৃতদেহ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে দলের বাকি সবাইকে।
সামনে পড়ে আছে চায়ের কাপ, ওমলেট। খাওয়ার ইচ্ছে মিলিয়ে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠছে। চারপাশের গুঞ্জন ওদের কানে আসে না। ওরা শুধু শুনতে পায় নিজেদের হৃৎপিণ্ডের শব্দ–টিক টিক-টিক। জীবনের ঘড়ি চলছে। এখনও।
সুদেশ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আড়চোখে তাকায় কাছে বসা পুতুল বক্সীর দিকে। ওর মুখের রং মিলিয়ে গেছে। সুদেশ অবাক হয়। মেয়েটা কেন তাদের দলে এল? আরও অবাক হয় এই ভেবে, রাহুল দস্তিদারের দলে এসে কীভাবে ও পুতুলের প্রেমে পড়ল!
রাহুল তখন নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। অর্থাৎ, ও এখন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। স্টিল ফ্রেমের চশমার আড়ালে ওর চোখে এক কুৎসিত দ্যুতি।
রাহুলের চেহারা রোগার দিকে। শরীরে এমন কিছু শক্তিও নেই। কিন্তু সে ইউনিভার্সিটির এক তুখোড় ছাত্র এবং সুদেশের ধারণা, যে-গঠনমূলক বিপ্লব বিস্ফোরণের পথে এগিয়ে চলেছে, তার পিছনে অনেকটাই কাজ করেছে রাহুল দস্তিদারের মাথা।
এ ভালো কথা নয়, বিড়বিড় করে বলল রাহুল, এ মোটেই ভালো কথা নয়। নীতু…।
মানে নীতু ওদের কাছে গান গেয়েছে?–প্রশ্ন করল ফিদা জয়সওয়াল, পুলিশ তাহলে আমাদের খবর জানতে পেরে গেছে?
নীতু গান গাওয়ার ছেলে নয়, কঠিন স্বরে ফিদার সন্দেহের উত্তর দিল রতনলাল, ওদের হাজার টরচারেও ও মুখ খুলবে না–আমি জানি।
মানুষের টলারেট করার একটা লিমিট আছে। ফিদা মন্তব্য করল।
না, নীতু কথা কইবার ছেলে নয়। রতনলাল আবার বলল, এ আমি জান বাজি রেখে বলতে পারি।
শুকনো স্বরে মুখ খুলল রাহুল দস্তিদার, সে-বাজি শুরু হয়ে গেছে, রতন। নীতু গেছে। এবার আমাদের পালা। বাজিতে তোমার জিত হোক তা-ই সবাই চায়।
ফিদা জয়সওয়ালের চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। যেন গোয়েন্দা-পুলিশ এখনই ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
কী করে জানব নীতু সবাইকে ফাসায়নি?–ফিদার কণ্ঠস্বর উষ্ণ, আমাদের এখন লুকিয়ে থাকাটাই ঠিক হবে।
তার মানে, নীতুর সঙ্গে যে আমাদের কানেকশান ছিল সেটা গোয়েন্দা-পুলিশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া।–চাপা অথচ শান্ত গলায় এ-মন্তব্য পুতুল বক্সীর। ওর মুখের রং ফিরে এসেছে। সুদেশ সেটা লক্ষ করল। তেজি জেনানা! ওর সহ্য শক্তি সম্পর্কে সুদেশের অনুমানে ভুল হয়েছিল!
রাহুল প্রশংসার চোখে পুতুলের দিকে তাকাল।
পুতুল ঠিক বলেছে, ফিদা। আমাদের এখন ভয় পেলে চলবে না। এখন মাথা ঠিক রাখতে হবে।–সে তাকাল সুদেশ হুদার দিকে। পুরু লেন্সের পিছনে রাহুল দস্তিদারের চোখ জ্বলছে? তুমি কী বলো, সুদেশ? একেবারে চুপচাপ যে?
সুদেশ কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, পুলিশকে এখনই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।
ফিদা জয়সওয়াল তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, নীতু যেমন ভেবেছিল!
সাপের চোখে ফিদার দিকে তাকাল সুদেশ। ওরা পরস্পরকে মোটেই পছন্দ করে না।
সুদেশ বলল, নীতু এখন সব আলোচনার বাইরে। সব সাহায্যের বাইরে। তবে আমার ধারণা, নীতু আমাদের কথা পুলিশকে বলেনি।
রাহুল তীক্ষ্ণ কৌতূহলে সুদেশকে খুঁটিয়ে দেখছিল–নীচের ঠোঁটে দাঁতের কামড়। তারপর বলল, তোমার এ ধারণার কারণ, সুদেশ?
এ তো একদম ক্লিয়ার। নীতু যদি সব ফাঁস করে দিত, তাহলে ওর ডেডবডি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে পুলিশ আমাদের অ্যালার্ট করে দিত না। ওরা প্রথমে আমাদের অ্যারেস্ট করত।
রাহুল দস্তিদার আঙুলে টুসকির শব্দ করল? সারা সন্ধের এই একটা দামি কথা। নীতু আমাদের নাম বলেছে কি বলেনি তার উত্তর হল, আমরা এখনও জেলের বাইরে। নীতু আমাদের নাম বলে থাকলে এতক্ষণে নীতু মেহতার দাওয়াই আমাদের ওপর চালু হয়ে যেত। নীতুকে যে হেভি অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে, সেটা আমাদের জানিয়ে পুলিশ বোকামি করত না। রাহুলের চোখ পিছলে গেল কাছাকাছি বসা এক যুবকের ওপর। সে খেতে-খেতে হঠাৎই চোখ তুলে তাকিয়েছিল ওদের দিকে।–ঢের হয়েছে। এবার উঠে পড়া যাক। নইলে সবাই আমাদের নজর করতে শুরু করবে। আবার আমাদের দেখা হবে। তবে, কোথায়, কখন, পরে জানিয়ে দেওয়া হবে…।
সুদেশ হুদা
রাহুল আর সুদেশ পুতুলকে বাসে তুলে দিল। ফিদা আর রতনলাল নিজের নিজের ডেরায় চলে গেল। পুতুলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল সুদেশের। কিন্তু নীতুর ভয়াবহ পরিণতি যেন ওদের মাঝে পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শুধু নীরবে হাতে চাপ দিয়ে পুতুলকে বিদায় দিয়েছে।
বাস ছেড়ে দেওয়ার পর নিজেকে ভীষণ একা মনে হল সুদেশের। মন হয়ে উঠল বিষণ্ণ। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর মনে পড়ল, দলের কথা, বর্তমান পরিস্থিতির কথা, নিজেদের লক্ষ্যের কথা।
রাহুল দস্তিদার সুদেশের কাঁধে হাত রাখল : চলো, সুদেশ। চায়ে একটু গলা ভেজানো যাক। কথা আছে।
সামান্য হাঁটা-পথ পেরিয়ে একটা নির্জন চায়ের দোকান ওদের চোখে পড়ল। ভেতরে ঢুকে দু-কাপ চা নিয়ে বসল দুজনে। রাহুল চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
চায়ে চুমুক দিয়ে বেশি গরম বলে মনে হল সুদেশের। অথচ গরম চা ওর প্রিয়। তবে আজ কেন…!
রাহুল সুদেশের দিকে তাকিয়ে। চশমার পিছনে ওর চোখ অগ্নিময়। সুদেশ, আমাদের ভেতর একজন ইনফরমার আছে।
সরাসরি এই মন্তব্যে সুদেশ প্রচণ্ড চমকে উঠল, কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। রাহুলের সেটা নজরে পড়ল। সে হাসল হালকাভাবে।
তুমিও যে এ-কথা ভাবোনি, সে-কথা আমাকে বলো না, সুদেশ। এ ছাড়া নীতুর অ্যারেস্ট হওয়া বা মৃত্যুর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই–থাকতে পারে না।
কিন্তু কিন্তু, এ যে অসম্ভব!
উজ্জ্বল ময়াল-চোখ সামান্য তীক্ষ্ণ হল চশমার আড়ালে।–কেন? অসম্ভব কেন?
যদি ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তা হলে সে শুধু নীতুর খবরই পুলিশকে জানাল কেন? সবাইকে কেন ধরিয়ে দিল না?
মাথা নাড়ল রাহুল, ঠোঁটের ওপর তীব্র হল ওর দাঁতের কামড়। ঠিকই বলেছ, সুদেশ। হয়তো সে নীতুর খবর পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়েছিল। হয়তো নীতু সেই ইনফরমারকে চিনে ফেলেছিল, তাই সে নিজেকে বাঁচাতে নীতুকে ধরিয়ে দেয়।
তা হলে নীতুকে ওরকম বীভৎসভাবে টরচার করা হল কেন?
রাহুল কাঁধ ঝাঁকাল, ওর ঠোঁট শক্ত হল।–এদেশের পুলিশরা স্যাডিস্ট। একটা কসাইয়ের কর্মচারীরা এর চেয়ে বেশি কী হবে?
রাহুল দেশনেতাকে কখনও নাম ধরে সম্বোধন করে না। বলে কসাই, অথবা বিশ্বাসঘাতক। দেশের রক্তচোষা।
সেই ইনফরমার আমাদের সম্পর্কে আর নতুন কী জানতে চায়? সুদেশ প্রশ্ন করল। আমরা কী, কে, তা তো সে ভালোভাবেই জানে!
সে জানতে চায় আমাদের বিস্ফোরণের দিনটা–কোন দিন আমরা আক্রমণ করব এই দুর্নীতিভরা শাসন ব্যবস্থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আমাদের আসল নেতাদের নাম-ঠিকানা। তাঁদের পরিচয় আমিও ঠিকঠাক জানি না। তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একজন মিলম্যানের মাধ্যমে।
সুদেশ সতর্কভাবে লক্ষ করছে রাহুল দস্তিদারকে।
আর কাউকে তোমার এ-সন্দেহের কথা বলেছ? বলেছ ইনফরমারের কথা?
ক্ষুরধার হাসি ফুটে উঠল রাহুলের ঠোঁটে, এবং মিলিয়ে গেল।
তোমাকেই প্রথম বললাম, সুদেশ।
কেন? আমাকে কেন?
আবার সেই হাসিঃ দলের মধ্যে তুমি একটু অন্যরকম, সুদেশ। তুমি আমাদের দেশের লোক নও। এখানে পড়তে এসেছ সুদূর মিক্স ইস্ট থেকে। আমাদের দলে তোমার যোগ দেওয়ার কারণ স্পষ্ট এবং জোরালো। আমাদের বিরুদ্ধে ইনফরমারগিরির জন্যে তুমি এত কষ্ট করে আমাদের দলে আসবে এ সম্ভবনা কম। তোমার প্রাণ দেশপ্রেমীর প্রাণ।
ধন্যবাদ রাহুলদা। সুদেশ হাসল।আমি তাহলে সন্দেহের বাইরে আছি?
আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই, সুদেশ।
বিশেষ কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?
তোমার হয়?
সুদেশ চোখ ছোট করে রাহুলের দিকে তাকাল ও আমাকে দিয়ে কী বলাতে চাও, রাহুলদা?
আবার হাসি।–যে-কোনও একজনের নাম করো। মনে রাখবে, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। সুতরাং, একজনের নাম করো। যে-কোনও একজনের।
এর কোনও মানে হয়?সুদেশ হুদা বলল, তুমি তো জানো, ফিদাকে আমি পছন্দ করি না। ওর নাম বললাম, কারণ, ওকে আমার ভালো লাগে না। ও ইনফরমার কি না জানি না– তবে হতেও পারে।
ফিদা।–আস্তে-আস্তে উচ্চারণ করল রাহুল দস্তিদার। ঠোঁট কামড়ে ধরল দাঁতে। হতে পারে। ইনফরমার আছে কি না আছে জানার আগে থেকেই ফিদাকে আমার সন্দেহ হত। বড় বেশি নার্ভাস– ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। দেখেছ, নীতুর খবর শুনে কীরকম লুকিয়ে পড়ার কথা বলছিল? অন্য কারও নাম বলো।
সুদেশ ইতস্তত করতে লাগল।–রতনলাল? আমার মনে হয় ইনফরমারগিরির বুদ্ধি ওর নেই।
হয়তো সেটা ওর অভিনয় হতে পারে। কারণ, কখনও কখনও ওকে বেশ বুদ্ধি খেলাতে দেখেছি। চালাকিটা চমৎকার। ওপর-ওপর এক বোকাসোকা গোবেচারা ছাত্র। নেহাতই আমার শেখানোর ঠেলায় আর পরীক্ষার হলে টোকাটুকির জোরে পাস করে। কেই-বা ওকে সন্দেহ করবে? অন্য কারও নাম কোরো, সুদেশ।
আর কে আছে?
হালকা হাসির লক্ষ্য এবার সুদেশ। সবে তো শুরু করেছ, সুদেশ।
আমি..আমি। বলল সুদেশ, কিন্তু তুমিই তো বলেছ, আমি সন্দেহের বাইরে।
ভুল করছ, সুদেশ। আমি বলেছি, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই।
সুদেশ রাহুল দস্তিদারের দিকে তাকিয়ে হাসল ও রাহুলদা, আমি কি নিজের সাফাই নিজেই গাইব? তিন মাস আগে আমি মিডল ইস্ট থেকে এসেছি। আমার পাসপোর্ট, কাগজপত্র, সব হোস্টেলের ঘরে আছে। পুলিশ কি আমার মতো একজন বিদেশিকে তোমাদের দলে ইনফরমার হিসেবে ঢোকানোর ঝুঁকি নেবে?
তাই বুঝি?–চশমার কাচের আড়ালে রাহুল দস্তিদারের চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল। সুদেশ হুদার সেটা নজর এড়াল না। সুদেশ, তুমি আইন-পালানো দাগি হতে পারো। এখানকার গোয়েন্দা পুলিশ এইরকম দাগিদেরই ইনফরমার হিসেবে পছন্দ করে।
আমি? দাগি?সুদেশের বিস্ময়ে ওরা দুজনেই হেসে উঠল।
রাহুল হাত বাড়িয়ে মৃদু চাপড় মারল সুদেশের হাতে।
আমার কথাগুলো মনে রেখো, সুদেশ। আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। এমনকী আমিও।
চেয়ারে হেলান দিয়ে রাহুলের চোখে চোখ রাখল সুদেশ।
তুমি?
মাথা নাড়ল রাহুল।–কেন নয়? সেটাই তো হবে সত্যিকারের চালাকি। যে-লোকটা সব সন্দেহের বাইরে–আমি–সে-ই হল গিয়ে আসল লোক। অ্যাটাকের দিনটার কথা আমিই প্রথম জানব। আমাদের দলের হাই লেভেল লিডারদের আমিই খানিকটা হয়তো চিনি।
রাহুলদা।–সুদেশ বলল।–এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আমি জানি, এই বিপ্লবের জন্য তোমার দরদ কতখানি। তুমি কখনও বিট্রে করতে পারবে না। যদি আমাদের মধ্যে ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তবে সে হয় রতনলাল, নয় ফিদা।
আমার কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ, সুদেশ। আমি বলছি, আমাদের কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। এখনও একজন বাকি আছে যার নাম আমরা এখনও তুলিনি।
সুদেশ হুদার দু-চোখে আতঙ্ক।
অসম্ভব, রাহুলদা! পুতুল হতে পারে না।
সেও তো আমাদের একজন।–মাথা নেড়ে বলল রাহুল।
তুমি ঠাট্টা করছ।
রাহুল দস্তিদারের ঠোঁটের রেখা হিংস্র হল। বলল, নীতু মেহতার সঙ্গে কেউ ঠাট্টা করেনি।
সুদেশ হিংস্র স্বরে জবাব দিল, পুতুলকে নিয়েও ঠাট্টা চলে না।
তুমি ওকে ভালোবাসো, তাই না সুদেশ?–শান্ত গলায় বলল রাহুল, বড়ই দুঃখের কথা যে, ভালোবাসা অন্ধ হয়।
সুদেশ চোখ নামিয়ে তাকাল চায়ের কাপের দিকে। চা এখন ঠান্ডা। সুতরাং, সুদেশের জিভে বিস্বাদ ঠেকবে। ওর চোখের সামনে পুতুলের মুখ। মনে-মনে ওর ঠোঁটের স্পর্শ, শরীরের উষ্ণতা, আর একইসঙ্গে ওকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে…সব মিলিয়ে এক বিষণ্ণতা ঘিরে ফ্যালে সুদেশ হুদাকে। এই রাজনীতির মধ্যে পুতুলের আসার কী দরকারটা ছিল?
সুদেশের রাগ হল। হিংসা, প্রতিহিংসা, রাজনীতি, বিপ্লব–এসব পুরুষদের কাজ। পুতুল তো ওর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পারত, পারত না?
হঠাৎই সুদেশের মনে পড়ল, পুতুল যদি রাহুলদার দলে না থাকত তা হলে সুদেশ এখানে এসে কোনওদিনই ওর দেখা পেত না। গড়ে উঠত না ওদের এই অদ্ভুত ভালোবাসা।
হ্যাঁ, ভালোবাসি। রাহুলের দিকে চোখ রেখে সুদেশ বলল, ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, রাহুলদা। সেইজন্যেই বলছি, ওকে সন্দেহ কোরো না। অন্য কাউকে সন্দেহ করো, আমাকে করো, কিন্তু ওকে না। আমাদের বন্ধুত্বকে বন্ধুত্বের মধ্যেই ধরে রাখো, রাহুলদা।
রাহুল দস্তিদারের চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি।
তোমার জন্যে দুঃখ হয়, সুদেশ। তোমরা ইরানিরা বড় অদ্ভুত। আমরা অন্যরকম–অন্তত আমি। কোনও মেয়ে আমার নজর কাড়ে না। এই বিপ্লবই আমার মা, বোন, বউ-সব। বলতে পারো এই বিপ্লবের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। সেই কারণেই পুতুল বক্সীকেও আমি সন্দেহের চোখে দেখি। সে পুরুষ কি মেয়ে তা দেখি না। আমি দেখি, সে আমাদেরই একজন, অতএব সন্দেহের বাইরে নয়।
আর কোনও কথা আমি শুনতে চাই না।–উঠে দাঁড়াল সুদেশ।
রাহুল দস্তিদার চারপাশে তাকাল। দোকানে ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন খদ্দের ঢুকেছে।
হ্যাঁ, সেই ভালো। আমাদের কথাবার্তা ক্রমশই উঁচু পরদায় উঠছে।
চশমার কাচ ভেদ করে সুদেশের দিকে তাকাল সে। আবার আমাদের দেখা হবে… শিগগিরই…দলের ডেরায়।
কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল সুদেশ হুদা।
.
সুদেশ হুদা বাড়ি ফিরতেই খবর পেল, একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা ইরানের লোক।
আপনার দেশ থেকে এসেছেন। প্রতিবেশী মহিলা বললেন সুদেশকে। তাঁর চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ৷ যাতে ভুলে না যাই সেজন্যে তাদের নাম-ধাম লিখে রেখেছি–এই যে।
এক টুকরো কাগজ সুদেশের হাতে তুলে দিলেন তিনি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। কসমোপলিটান হোটেল। রুম নাম্বার চারশো পাঁচ।
কাগজটা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে ফেলল সুদেশ।
কী হল, ঠিকানাটা আপনার লাগবে না?–মহিলাটি প্রশ্ন করলেন।
না। মনে থাকবে।
ওঁদের তাহলে আপনার ভালোমতো মনে আছে? ওঁরা বলছিলেন, আপনাদের ফ্যামিলির সঙ্গে নাকি ওঁদের জানাশোনা আছে। এ দেশে বেড়াতে এসে তাই ভাবছিলেন আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন। সত্যি, দুর-দেশে চেনা লোক পাওয়া মানে…।
হাতে স্বর্গ পাওয়া।–সুদেশের গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।
আপনি ঠিক দেখা করবেন কিন্তু। ওঁরা অনেক করে বলে গেছেন।
কাল দেখা করব। এখন পড়াশোনা আছে। খবরটা দেওয়ার জন্যে থ্যাঙ্কস।
আলোচনায় দাঁড়ি টেনে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল সুদেশ।
ফিদা জয়সওয়াল
সেই রাত্রেই ফিদাকে অনুসরণ করল সুদেশ।
ফিদা ওকে দেখতে পায়নি। রাস্তায় অনেক লোকের ভিড়। সুতরাং, নিজেকে গোপন রেখে অনুসরণে কোনও অসুবিধেই হয়নি।
ফিদার চালচলন এখন খেয়ালি, উদ্দেশ্যহীন। একটা দোকান থেকে একটা কোকাকোলা কিনে গলায় ঢালতে শুরু করল সে। তারপর একটা ম্যাগাজিন-স্টলে দাঁড়িয়ে দু-একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে দেখল। একটা সিনেমা হলের সামনে কিছুটা সময় কাটিয়ে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল ফিদা।
ফিদার সামনে চায়ের কাপ। চোখ চায়ের কাপে। মন অন্য কোথাও। ওর কপালে গভীর চিন্তার রেখা। সে-চিন্তার কি নীতু মেহতা আর নাম-না-জানা ইনফরমার জায়গা করে নিয়েছে? ভাবল সুদেশ। একটা থামের আড়ালে একটা টেবিলে বসেছে সুদেশ। গোপনে লক্ষ রাখছে ফিদা জয়সওয়ালের ওপর।
চায়ের কাপে টোকা মারছিল সুদেশ। তখনই সে দেখতে পেল জগদীশ আম্বাস্তাকে।
নেশা করা চোখ নিয়ে কালো জলহস্তীমার্কা জগদীশ আম্বাস্তা রেস্তোরাঁয় ঢুকেছেন। তার বেজির মতো চঞ্চল চোখ পিছলে যাচ্ছে প্রতিটি লোকের মুখে। পুলিশ বিভাগের চরম কুখ্যাত অফিসার জগদীশ আম্বাস্তা। রাহুল দস্তিদারের দলে ঢোকার কয়েকদিন পরেই জগদীশকে চিনিয়ে দিয়েছিল রাহুলদা। গোয়েন্দা-পুলিশের দলে সবচেয়ে নৃশংস স্যাডিস্ট এই জগদীশ। বিপ্লব সফল হলে তাঁর জন্য বিশেষ পুরস্কার তাকে তুলে রেখেছে রাহুলদা। নীতু মেহতার করুণ ধ্বংসের মুলে জগদীশ আছেন বলেই সকলের ধারণা।
জগদীশ সাদা পোশাকে আছেন। গিয়ে বসলেন ফিদার মুখোমুখি। ফিদার শরীর হাই ভোল্টেজ শকে শিউরে উঠল–সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য। কিন্তু সুদেশের সেটা নজর এড়াল না।
ফিদা চিনতে পেরেছে জগদীশকে।
জগদীশ পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করলেন। সকলের চোখের সামনেই ভেতরের তরলটুকু গলায় ঢাললেন। জগদীশকে সকলেই চেনে। কয়েক জোড়া ভয়ার্ত চোখ ছিটকে এল কুচকুচে কালো লোকটার দিকে। ফিদা চটপট ওর চা শেষ করল। তখনই জগদীশ কী যেন বললেন ওকে। তারপর বোতলটা পকেটে রেখে একটা চুরুট বের করলেন। ফিদা একটা দেশলাই এগিয়ে দিল তার দিকে। গোটাকয়েক কাঠি নষ্ট করে চুরুট ধরালেন জগদীশ। তিনি ফিদাকে আরও কী যেন বললেন। কাধ কঁকিয়ে ফিদা তাকাল দরজার দিকে। জানোয়ারের মতো হাসলেন জগদীশ, খামচে ধরলেন ফিদার কাঁধ। ফিদা কাষ্ঠ হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। হেসে কী যেন বললেন জগদীশ। ফিদা বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।
সুদেশও উঠে দাঁড়িয়ে অনুসরণ করল ফিদাকে।
ফিদা চটপট পা চালাল রাতের পথ ধরে।
নিজের আস্তানার কাছে পৌঁছে ওর চলার শব্দ আয়েশি হল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ফিদা। সুদেশ অপেক্ষা করতে লাগল রাস্তায়। রাস্তার অল্প আলোয় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সুদেশের তেমন কষ্ট হল না। তারপর আলো জ্বলে উঠল ফিদার ঘরে।
তোমার নজরদারির প্রশংসা করতে হয়, সুদেশ।
বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ। ওর গলা চিরে বেরিয়ে এল এক চাপা চিৎকার– ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়ানো আগন্তুকের ওপর যখন চিতাসুলভ ক্ষিপ্রতায় ও ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তখনই ও চিনতে পারল মানুষটাকে।
রাহুল দস্তিদার।
অল্প আলোয় ওর চশমার কাচ চকচক করছে।
রাহুলদা! তুমি এখানে কী করছ? ফিশফিশ করে বলল সুদেশ।
তোমাকেও তো একই প্রশ্ন করতে পারি।
আমি ফিদাকে ফলো করছিলাম।
আর আমি তোমাকে।
অবাক-দৃষ্টিতে রাহুল দস্তিদারের দিকে চেয়ে রইল সুদেশ। রাহুল নিঃশব্দে হাসল।
সন্ধেবেলা তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম, রাহুল বলল, কিন্তু তুমি বাড়িতে ছিলে না। পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি বোধহয় কসমোপলিটান হোটেলে গেছ তোমার দেশের কোন লোকের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর পথে তোমার দেখা পেয়ে ফলো করতে শুরু করলাম। পরে বুঝলাম, তুমি ফিদাকে ফলো করছ। সুতরাং, কোনও জানান না দিয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়।
তুমি সবই দেখেছ তাহলে? সুদেশ জানতে চাইল, ফিদা আর জগদীশকে দেখেছ?
হ্যাঁ, দেখেছি।
তাহলে তো সবই বুঝতে পারছ।
কী বুঝতে পেরেছি?
যে ফিদাই সেই ইনফরমার!
ফিদার ঘরের জানলার আলোর দিকে রাহুল দস্তিদারের চোখ স্থির। ঠোঁটের ওপর দাঁতের সেই পুরোনো খেলা।
আজ রাতে যা দেখেছ তার জোরেই বলছ যে, ফিদা ইনফরমার?
জগদীশ আম্বাস্তা ওর সঙ্গে কথা বলেছে। সে ফিদাকে চেনে, কিন্তু ওকে অ্যারেস্ট করছে না। কেন?
আমার তো মনে হয়েছে, জগদীশ আম্বাস্তা ফিদার কাছে দেশলাই চাইছিল।
সেই দেশলাইয়ের সঙ্গে কি কোনও সাংকেতিক খবর হাতবদল হতে পারে না? চুরুট ধরাতে জগদীশের অনেক বেশি সময় লেগেছে। কোনও খবর হাতবদল করতে তার বেশি সময় লাগে না।
ফিদার ঘরের আলো নিভে গেল।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল রাহুল দস্তিদার।
তোমার কয়েকটা কথা ভাববার মতো সুদেশ। কিন্তু তা বলে ফিদা যে নির্দোষও হতে পারে সে কথা ভুলে যেয়ো না। সেই ইনফরমার অন্য কেউও হতে পারে।
রতনলাল?–অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল সুদেশ। তারপর আরও অস্পষ্ট স্বরে যোগ করল, পুতুল?
রাহুল পকেট থেকে হাত বের করে হাওয়ায় দোলাল।
সেইজন্যেই আজ তোমার কাছে গিয়েছিলাম। ক্ষমা চাইতে। এই নয় যে, পুতুলকে আমি সন্দেহ থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। সেটা সম্ভব নয়। কারণ, অনেকগুলো লাইফের ব্যাপার। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব রাখতে চাই, সুদেশ। আজ সন্ধেয় তুমি রাগ করে চলে গিয়েছিলে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। আমাদের এখন একজোট হয়ে থাকতে হবে। জগদীশ আম্বাস্তা আর গোয়েন্দা পুলিশকে দূরে রাখতে গেলে এটাই একমাত্র পথ। শুনেছি, জগদীশ টরচার করতে এক্সপার্ট। আমি চাই না, সে তার টরচারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের ওপর চালাক।
চারপাশে তাকাল রাহুল। অন্ধকার নির্জন রাস্তা। ঘুমিয়ে পড়া বাড়ি-ঘর। ফিদার অন্ধকার জানলা।
রাত হয়েছে। আজ কারফিউ হতে পারে শুনেছি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার কোনও মানে হয় না। চললাম, সুদেশ। মনে রাগ রেখো না।
না। রাখব না।
সুদেশের দৃষ্টির সামনে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হল রাহুল দস্তিদার। ফিদার জানলার দিকে আর একবার তাকিয়ে রওনা হল সুদেশ। আজকের পরিশ্রমের ফল কী হবে সে জানে না।
তোমার জন্যে, পুতুল।–আপনমনে ভাবল সুদেশ।–যা করছি সব তোমার জন্যে। তোমাকে বাঁচানোর জন্যে।
জগদীশ আম্বাস্তা
পরের দিনটা সুদেশের পড়াশোনা, লাইব্রেরি নিয়েই কেটে গেল। বাড়ি ফিরতে সিঁড়িতে দেখা হল প্রতিবেশী সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তার চোখে-মুখে একটা বিস্রস্ত ছাপ।
মিস্টার হুদা! তাঁর গলার স্বরে ছেলে-কে তিরস্কারের ইঙ্গিত।–ওঁরা আবার এসেছিলেন– মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। আপনি কাল ওঁদের সঙ্গে দেখা করেননি বলে খুব দুঃখ করছিলেন।
সময় পাইনি।বলল সুদেশ, দেখা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, যেতেই পারিনি।
ওঁরা কালকের প্লেনে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। কী লজ্জার কথা বলুন তো! একবার দেখা করতে পারলেন না? ওঁরা এত আশা করে এসেছেন।
আজ রাতে দেখা করব। কোনও ভুল হবে না। আচ্ছা–ধন্যবাদ।
তাঁকে পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সুদেশ।
ঘরে ঢুকে বইপত্র নিয়ে আবার পড়াশোনায় বসল। কিন্তু মনে চিন্তার ঘূর্ণিঝড়, কালো ঘূর্ণিঝড়।
অন্ধকার ঘন হতেই পড়াশোনায় মনোযোগ ফিকে হয়ে এল সুদেশের।
ফিদা। ফিদা জয়সওয়াল।
*
সুতরাং, সংবিৎ যখন ফিরল, তখন গতকালের মতোই ফিদাকে অনুসরণ করে চলেছে সুদেশ।
একই রাস্তা ধরে পথ চলার অভ্যেস ফিদার। ওকে খুঁজে নিতে বেশি অসুবিধে হয়নি সুদেশের। এবং আজকের অনুসরণ গত সন্ধের অ্যাকশান রিপ্লে বলা যায়। অবশেষে সেই একই রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল ফিদা। সুদেশও ঢুকল।
জগদীশ আম্বাস্তা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেলেন ফিদার কাছে। একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন। ফিদা এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছিল–সেটা এসে পৌঁছলে জগদীশ ওকে কী যেন বললেন। সুদেশ শত চেষ্টা করেও কথাগুলো শুনতে পেল না।
হঠাৎই এক হিংস্র গর্জন করে লাফিয়ে উঠলেন জগদীশ। বাঁ-হাতের মুঠোয় খামচে ধরলেন ফিদার চুল। পিছন দিকে লাথি মেরে ফেলে দিলেন নিজের চেয়ার। এবং ডানহাতে গরম চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন ফিদার মুখে।
একটা জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল ফিদার গলা চিরে। রেস্তোরাঁর সব লোক ত্রাসে বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে। জগদীশের লাথি-ঘুসি এখন অবাধে ছিটকে পড়ছে ফিদার শরীরে।
শালা, বিপ্লব। গর্জে উঠলেন জগদীশ আম্বাস্তা। নীতুকে দেখে শিক্ষা হয়নি? চল সালা! তোকে বিপ্লব দেখাচ্ছি।
তার পরেই শুরু হল জগদীশের অশ্রাব্য খিস্তি।
অন্যান্য খদ্দেরের মতো সুদেশও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর হাত চলে গেছে পকেটে। রিভলভারের খোঁজে। পিছন থেকে কে যেন ওর হাত চেপে ধরল।
এক ঝটকায় ফিরে তাকাল সুদেশ।
রাহুলদা। রাহুল দস্তিদার।
কেটে পড়ো এখান থেকে।–চাপা গলায় বলল রাহুল। তারপর কোলাহল আর ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল।
সুদেশ জানে, আগামীকালই হয়তো বড় রাস্তায় পড়ে থাকবে ফিদা জয়সওয়ালের বডি।
প্রথম নীতু মেহতা। দ্বিতীয় ফিদা। তিন নম্বর কে?
আশপাশে তাকিয়ে রাহুলকে একবার খুঁজল সুদেশ। পেল না।
পুতুল এখন কোথায়? ভাবতে-ভাবতে বাড়ির দিকে পা চালাল ও।
পুতুল বক্সী
মাথা নীচু করে গভীর চিন্তা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছিল সুদেশ, হঠাৎই আলোর ঝলক চোখে পড়তেই মুখ তুলল। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ওর মুখোমুখি। তীব্র হেডলাইটের আলো ঝাপটা মারছে সুদেশের চোখ-মুখে। কুঁকড়ে গেল সে। তৈরি হল বিদ্যুৎবেগে দৌড়োনোর জন্য। তখনই ভেসে এল পুতুলের মিষ্টি গলা।
সুদেশদা!
গাড়িটা দেখে সুদেশ অবাক হল। ও দেখল, ভেতরে ড্রাইভার ছাড়া পুতুল একা।
গাড়িটা পেলে কোত্থেকে?
সে জেনে কী হবে? সময়ে-সময়ে দরকার হলে পাওয়া যায়। রাহুলই জোগাড় করে দিয়েছে। এখন এসো।
পিছনের সিটে পুতুলের পাশে গিয়ে বসল সুদেশ। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল ড্রাইভার যুবকটিকে দেখিয়ে।
দলের ছেলে।–ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল পুতুল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। জনবহুল চঞ্চল এলাকা এড়িয়ে শান্ত নির্জন পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। সুদেশের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু কোথায় শুরু করবে ও বুঝতে পারছে না। অবশেষে ফিদার কথাই ও বলল।
পুতুল, ফিদা ধরা পড়েছে।
জানি। জগদীশ আম্বাস্তা ধরেছে।–পুতুল বক্সীর চোখ সামনের অন্ধকার পথে স্থির।
কে বলল? রাহুলদা?
হ্যাঁ। আমাদের খতমের লিস্টে এর পরের নাম জগদীশ আম্বাস্তার। শান্ত স্বরে পুতুল বলল, রাহুলদা তোমাকে সকালে খুব খুঁজেছে, সুদেশদা।
আমি লাইব্রেরিতে ছিলাম।
আমরাও তাই ভেবেছি–যখন অন্য কোথাও তোমাকে পাইনি। বাড়িতে তো একটা খবর রেখে যেতে পারো।
কী করে জানব রাহুলদা ডাকবে। আমাকে বলেছিল, এখন কয়েকদিন আমরা একজোট হব না।
তোমার পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা রাহুলকে বলেছে তুমি নাকি আজকাল বাড়িতে প্রায় থাকোই না। শুধু স্নান করতে আর খেতে যাও।
এ কটাদিন খুব পড়াশোনায় চাপ যাচ্ছে। আমাদের মিটিং-এর জন্য পড়াশোনায় খুব পিছিয়ে পড়েছি। পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে আমার স্কলারশিপ নষ্ট হয়ে যাবে।–চোখ ফিরিয়ে পাশে বসা পুতুলের দিকে তাকাল সুদেশ।ভয় নেই, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।
অল্প হাসল পুতুল।–জানি। তা ছাড়া পালিয়ে যাবেই বা কোথায়! আমাদের যতজনকে তুমি চেনো, তার চেয়েও অনেক বেশি লোক এ-শহরে ছড়িয়ে আছে, সুদেশদা।
রাহুলদা কি পুতুলকে ইনফরমারের কথা বলেছে? ভাবল সুদেশ। সে সন্দেহ করেছিল ফিদাকে। ফিদা জয়শওয়ালকে। কিন্তু তার পরিণতি কী অদ্ভুত! জগদীশের নৃশংস হাতে ধরা পড়ল ফিদা।
ফিদাকে যখন ধরা হয়, তখন আমি জগদীশকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। আনমনাভাবে বলল সুদেশ, রাহুলদা বারণ করল। জানো পুতুল, আমি ফিদাকে পছন্দ করতাম না।
পছন্দ-অপছন্দ যার-যার নিজের কাছে। ফিদার কপাল খারাপ ছিল। তুমি কিছু একটা করতে গেলে ভালোর চেয়ে খারাপ হত।
পুতুল কি জানে, রাহুলদা পুতুলকে সন্দেহ করতে চেয়েছিল? সুদেশ পুতুলের পক্ষ নিয়ে বাধা দিয়েছে? হয়তো বলেনি। বললে পুতুল এত শান্ত, নিশ্চিন্ত, থাকতে পারত না। এই অনুভবের সঙ্গে-সঙ্গে এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা ঘিরে ফেলল সুদেশকে।
ও বাইরে তাকাল। শহর ছেড়ে ওদের গাড়ি শহরতলির খোলা পথ ধরেছে। দু-পাশে অন্ধকার প্রান্তর। আলো নজরে পড়ে না। শুধু নিজেদের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? সুদেশ জানতে চাইল।
বেশি দূরে নয়।
ঠিক কতটা দূরে? সুদেশের স্বরে কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা অধৈর্যের সুর।
পৌঁছোলেই জানতে পারবে।
মিটিং আছে?
হ্যাঁ।
আগে কখনও শহরের বাইরে আমাদের মিটিং হয়নি।
মিটিংয়ের জায়গা তো আমি পছন্দ করি না, সুদেশদা। রাহুলদা করে। মুখ ফিরিয়ে সুদেশের দিকে তাকিয়ে হাসল পুতুল। সে-হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা খুঁজে পেল সুদেশ।–আমাক তুমি বিশ্বাস করো না?
করি, পুতুল। সুদেশ হুদার কণ্ঠস্বর একাগ্র, একান্ত।
এই তো, এসে গেছি।বলার সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির গতি কমে এল।
রাস্তা নির্জন নির্জনতর। অন্ধকার। শুধু ওপরের আকাশে দিশেহারা নক্ষত্ররা চোখ পিটপিট করছে। এখানে, এই অদ্ভুত জায়গায় থামছে কেন গাড়ি? কই, অন্য কাউকে, রাহুলদাকে, তো চোখে পড়ছে না? সুদেশ অবাক হতে-না-হতেই গাড়ি একেবারে থেমে গেল।
এবার আমি চলে যাব।–বলল পুতুল।
চলে যাবে? সুদেশের স্বর বিপন্ন।
হ্যাঁ, রাহুলদার তা-ই নির্দেশ।
আকাশের ছেঁড়া মেঘের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে সুদেশ। চারপাশ একেবারে চুপচাপ, শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের চাপা গর্জন এক বিদ্রোহ।
কী ব্যাপার বলো তো, পুতুল?
জানি না।–ওর গলায় অস্বস্তির সুর। রাহুলদা আমাকে সব খুলে বলেনি। শুধু বলেছে আমি যেন এখানে না থাকি, আবার শহরেও ফিরে না যাই। গাড়ি নিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে অন্য একটা জায়গায়। সে-জায়গার নাম আমি আর রাহুলদা ছাড়া কেউ জানে না, জানবে না। তোমাকে জানানো ঠিক নয়, তবুও বলছি…অ্যাকশন সম্ভবত আজ রাতেই শুরু হবে। ফিদা ধরা পড়ার পর রাহুলদা আর দেরি করতে চাইছে না।
আজ রাতে?সুদেশের স্বর যেন পাহাড়ি প্রতিধ্বনি। তাহলে আমাকে এখানে আনা হয়েছে কী করতে?
অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার জন্য। আক্রমণের সময় তোমাকে একটা গ্রুপ লিড করতে হবে। তোমার সঙ্গে রিভলভার আছে তো?
আছে।
ভালো। ওরা যখন আসবে, তোমাকে সিগন্যাল দেবে–আলো জ্বালিয়ে-নিভিয়ে।
আর সঙ্গে-সঙ্গেই দু-হাতে সুদেশকে জড়িয়ে ধরল পুতুল। ওর ঠোঁট থমকে গেল সুদেশের ঠোঁটে। উষ্ণতা। আচ্ছন্নতা। অবাধ্য হৃৎপিণ্ডের শব্দ। সুদেশের ঘ্রাণে ফোঁটা পদ্মের গন্ধ। এই মুহূর্ত চিরন্তন হয়ে থাক।–ও ভাবল।
তোমার গায়ে আঁচ লাগতে দেব না,–পুতুল বক্সীর নরম শরীরে সুদেশের কথা জড়িয়ে যায়।–ভয় কোরো না। তোমার কোনও ক্ষতি আমি হতে দেব না। বিশ্বাস করো।
পুতুল ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ও ফিশফিশ করে বলল, যাও–বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো। ওরা এখুনি এসে পড়বে। আমি চললাম। গুড বাই, সুদেশ।
সুদেশ হুদা যেন শোলার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে গাড়ির অপস্রিয়মান লাল আলোর দিকে। দূরে, অন্ধকারে, কোথাও পাচা ডেকে ওঠে কর্কশ স্বরে। শরীরে শিহরন জাগে সুদেশের। এই মুহূর্তে পুতুল ওর সর্বাঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ও একা। সঙ্গী শুধু নৈঃশব্দ্য, আকাশের নক্ষত্র, আর অন্ধকার নির্জন প্রান্তর।
ইনফরমার
সত্যিকারের সময়ের অঙ্কে খুব বেশিক্ষণ ও অপেক্ষা করেনি, কিন্তু সুদেশের মনে হল এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। খোলা রাস্তায় ও পায়চারি করতে লাগল। কখনও রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল ঘাসে ছাওয়া অন্ধকার প্রান্তর, কখনও দেখল রাতের আকাশ। ওর মনে লক্ষ কথার ভিড়, লক্ষ ঘটনার ইশারা। পরিস্থিতি ওর বিচার-বুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে কেন?
প্রথমটা মনে হয়েছিল জোনাকির ছলনা। তারপর বোঝা গেল দূরাগত কোনও আলো দুটো চিতাবাঘের চোখ–দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে। এগিয়ে আসছে সুদেশ হুদার দিকে।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ও লক্ষ করে যায়। অবশেষে আলোয় উচ্ছ্বাসী ঢেউ ছন্নছাড়াভাবে স্নান করিয়ে দেয় ওকে।
যাক, তুমি তাহলে সময় মতোই এসেছ, সুদেশ।
কণ্ঠস্বর আলোয় দিক থেকে আসেনি। এসেছে তার অনেকটা বাঁ-পাশ থেকে। তাই চমকে ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ।
রাহুলদা! সুদেশ চিৎকার করে ওঠে, তুমি?
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, সুদেশ। এ-জায়গাটা তোমার মনে নেই? মনে থাকা উচিত। শত হোক, এখানেই তো তোমাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।
অনুমানে কণ্ঠস্বরের দিকে এগিয়ে যায় সুদেশ হুদা। কিন্তু আলোয় বন্যা তার শরীরে অঙ্গাঙ্গী। পিছন থেকে কার গলা শোনা যায়,–আর-এক পা-ও এগোবে না। আমার হাতে পিস্তল আছে।
রতনলালের গলা সন্দেহ নেই।
ত্রাসে বরফ সুদেশ।
এ সব, কী রাহুলদা?–সে চিৎকার করে ওঠে, এ কী ধরনের ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি নয়, ঠাট্টাও নয়, সুদেশ রাহুল দস্তিদারের কণ্ঠে হিংসা, উলঙ্গ হিংসা। মনে পড়ে? তিন মাস আগে এয়ারপোর্ট থেকে একজন ছাত্র ট্যাক্সি করে শহরে যাচ্ছিল। তার নাম সুদেশ হুদা। সুদূর ইরান থেকে এ-দেশে সে পড়াশোনা করতে এসেছিল। পথে জগদীশ আম্বাস্তার সিক্রেট-পুলিশ তাকে আটকায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়। তারপর তারা সুদেশ হুদাকে খুন করে। পুঁতে ফ্যালে এই ঘাসজমিতে। কিন্তু অন্য এক সুদেশ হুদা ঠিকই শহরে এসে পৌঁছোয়। ইউনিভার্সিটিতে ভরতিও হয়। যদিও সে তুমি–নকল সুদেশ। জগদীশ আম্বাস্তার ডিপার্টমেন্টের লোক, গোয়েন্দা পুলিশের লোক। বুদ্ধির তোমার তুলনা নেই, সুদেশ। ওরা তোমাকে ভালোই ট্রেনিং দিয়েছিল…তারপর পাঠিয়েছিল আমার দলে। আমার কথা বুঝতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?
সুদেশের হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতর দামামা। মস্তিষ্ক তীব্র চিৎকারে উন্মত্ত–পালাও, পালাও! কিন্তু সুদেশের পা অনড়, নিশ্চল। শ্যামাপোকার মতো আলোর বৃত্ত ওকে সম্মোহিত করে রাখে।
তুমি প্রোটেস্ট করবে না? সাফাইও গাইবে না? রাহুলদার গলায় ঠাট্টার সুর,সব্বাইকে ঠকালেও আমি ঠকিনি, সুদেশ। বিপ্লব আমার মা, বোন, বউ আমার রক্তে শুধু বিপ্লব আছে– আর কিছু নেই। ছাত্র সুদেশ হুদার মারা যাওয়ার খবরটা খবরের কাগজে বেরোয়নি–বের করা হয়নি। সুতরাং, তোমার কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। প্রথমটা হয়ওনি। নীতু মেহতা গেল। আমাকে ঠকানোর জন্যে তোমার পরিকল্পনায় সাহায্য করল জগদীশ আম্বাস্তা। ফিদার সঙ্গে মাখো মাখো ভাব দেখাল। তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদাই ইনফরমার। তোমার নির্দেশে ফিদা ধরা পড়ল। ছাড়াও পাবে। তখন তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদা জগদীশের লোক। তাই সে ফিদাকে ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। কই, নীতুকে তো দেয়নি! আমিও তাই বুঝতাম। কিন্তু তোমার সর্বনাশ ডেকে আনল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি।
এখন সুদেশ বুঝতে পারল অসহায়তা কাকে বলে। এই হতাশ অনুভূতিহীন মুহূর্তে বুঝতে পারল নীতুর শেষ অবস্থার কথা, জগদীশের হাতে ফিদার করুণ অবস্থার কথাও।
প্রথমে বুঝিনি তুমি তাদের এড়িয়ে চলছ কেন। নিজের দেশের লোক, প্রতিবেশী, পরিবারের বন্ধু–অথচ তাদের সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে তোমার নেই? এ তো ভালো কথা নয়! সুতরাং হোটেল কমোপলিটান-এ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজির সঙ্গে আমি দেখা করলাম। ওদের ঠিকানা তোমার প্রতিবেশী মহিলাই দিয়েছিলেন। যে সুদেশ হুদাকে তারা চিনতেন, সে বেঁটে এবং মোটা ছিল। তার গায়ের রংও পরিষ্কার। তুমি কে, সুদেশবাবু? নিজের লোকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো নোংরা মানসিকতা তোমার মনে কীভাবে জন্ম নিল? টাকার লোভে? পেটের দায়ে? তা হলে দ্যাখো, বড়লোক হয়ে ভরতি পেটে মরতে কেমন লাগে। রতনলাল!
আলো নিভে যায় মুহূর্তে। নিভেই থাকে। সময় দোদুল শূন্য। ক্রমশ গাঢ় হয় নৈঃশব্দ্যের পরদা। সুদেশ জানে, সামনে-পিছনে রাস্তা বন্ধ। এবং অন্ধকারে ওরা এগিয়ে আসছে, ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে ওকে শাস্তি দিতে। ওর শরীরে আলোড়ন তুলতে।
ওর সঙ্গে এখন রিভলভার নেই। সুতরাং ওরা নির্ভয়ে আসতে পারবে। ওর রিভলভার সরিয়ে নেওয়ার জন্যেই পুতুল ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। তখনই তুলে নিয়েছে সুদেশের আগ্নেয়াস্ত্র। এখন মনে পড়ছে, ওকে ছেড়ে দিয়ে পুতুলের কী কান্না! পুতুলের বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণার চেয়ে কী আর বেশি যন্ত্রণা ওরা দেবে? সুদেশ কাঁদবে না, ওর চোখে জল নেই। চোখের জল ফেলার অধিকারও ওর নেই। কারণ, সেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? নীতুর সঙ্গে, ফিদার সঙ্গে নীতুর আগে আরও অনেকের সঙ্গে, দেশের অন্যান্য জায়গায়। সুতরাং, চোখের জল ফেলার কোনও কারণ নেই। বরং কারণ আছে নীরব থাকার এবং প্রতীক্ষার। ও অপেক্ষা করছে করবে। হে ভগবান! নিঃশব্দ চিৎকারে ভাবল সুদেশ, ওরা এত দেরি করছে কেন…?
অপারেশন দাঁড়কাক
কথায় বলে কাক কাকের মাংস খায় না।
আমিও এতদিন তাই-ই জানতাম। কিন্তু একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক নিয়ে মহিন রায়ের আবির্ভাবের পর থেকে ওপরের প্রবাদ-বাক্যটা এই অধম ভুলতে বসেছে। লোকটা এমন এলোপাতাড়িভাবে ডাইনে-বাঁয়ে খুন করে যাচ্ছে যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আমার ক্লায়েন্ট কমে যাওয়ায় আমি যত না আঘাত পেয়েছি, তার চেয়েও বেশি পেয়েছি ওই খুন শব্দটাকে মহিন রায় যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করছে বলে।
অর্থাৎ মোদ্দা কথা, এতদিনের পর সতীশ দেবনাথ–অথবা শার্প দেবনাথ একজন উন্মাদ প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছে।
আমি সাধারণত এইসব মোক্ষলাভ করানোর (খুন শব্দটাকে আমি আবার ঠিক পছন্দ করি না) ব্যাপারে শিল্পীসুলভ মন নিয়ে কাজ করি। ডিটেলের দিকে দিই অখণ্ড গভীর মনোযোগর জন্যে পুলিশ চিরকালই মুখোমুখি হয়েছে এক অদ্ভুত সমস্যার : সেটা হল, খুনের পদ্ধতি তারা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে প্রফেশনাল কিলার হিসেবে আমার নামডাক বেড়েছে বই কমেনি।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, একটা নিখুঁত খুনের পেছনে দরকার সময়, অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং সবার ওপরে বুদ্ধি। অন্য সবকিছুতে আমার চেয়ে ছোট হলেও একটা ব্যাপারে মহিন রায় আমাকে ভীষণভাবে হারিয়ে দিয়েছে।
সে জিনিসটা হল সময়।
একটা নিখুঁত খুনের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সময়। মহিন সময়ের ধার ধারে না–যার ফলে ওর খুনগুলো ঠিক নিখুঁত নয়। যেমন কোনও পাঁচিলের আড়ালে বা ঝোঁপের ফাঁকে লুকিয়ে থেকে ভিকটিমকে গুলি করে স্রেফ চম্পট দেওয়া–এই টাইপের। না, মহিনকে প্রথম শ্রেণির খুনি বলতে আমি একেবারেই নারাজ। সুতরাং, এই অপরাধের জগতে একমেবাদ্বিতীয়ম নিখুঁত প্রফেশনাল কিলার সতীশ দেবনাথ যেমন চিরকাল দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে এসেছে, তেমনি আজও করবে। সেখানে মহিন রায়ের মতো একটা থার্ড গ্রেড কিলারের কোনও জায়গা নেই। কারণ সবকিছু সহ্য করলেও খুন-শিল্পের অপমান আমি কিছুতেই সহ্য করব না।
মহিনকে সরানোর প্ল্যান আমার তৈরিই ছিল। শুধু লাগসই জায়গা দেখতে দেখতে কেটে গেল একটি মাস। মঞ্চসজ্জার কাজ নিখুঁতভাবে শেষ করে নাটকের প্রথম দৃশ্যের জন্যে তৈরি হলাম। কিন্তু তখনও জানি না মহিন রায় আমার বিরুদ্ধে কী চক্রান্ত করে চলেছে।
*
রোজ রাতের মতো চৌরঙ্গি এলাকার একটি বিশেষ ল্যাম্পপোস্টের নীচে অলসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল মহিন রায়।
মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো। মেয়েদের মতো মাঝখান দিয়ে সিঁথি করা। চওড়া কপালের ডানদিকে একটা আঁকাবাঁকা নীলচে শিরার আভাস। ঘন ভুরুর নীচে ছোট-ছোট হায়েনা-চোখ। ভোতা নাকের নীচে গোঁফ। ক্ষুর দিয়ে চেরা কাটা দাগের মতো পাতলা ঠোঁট। গলায় রঙিন মাফলার। গায়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট। কোমরে চওড়া বেট–তার গায়ে মনোগ্রাম করা এম. আর। অর্থাৎ, মহিন রায়।
রায় তার লোমশ ফরসা হাত দুটো পকেটে ভরে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চোখজোড়া বেজির মতো চঞ্চল। কিন্তু ওর চোখে পড়েনি, রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে একজন লম্বা, রোগাসোগা চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক ওকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছে। হঠাৎ একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটা রাস্তা পার হতে লাগল। তার হাঁটার ভঙ্গিতে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব মহিনের নজর এড়াল না। লোকটা চকিতে একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর ধীরে-ধীরে মহিনের কাছে এগিয়ে এল। একটা নিওন সাইনকে তীক্ষ্ণ মনোযোগে লক্ষ করতে করতে কটা শব্দ ছুঁড়ে দিল, এম. আর.? পি. কে.?
মহিন জানে, এর অর্থ মহিন রায়? প্রফেশনাল কিলার? তাই ও ছোট্ট করে জবাব দিল, এল ৪৫৭। যার অর্থ, লুগার ৪৫৭।
রায়ের সম্মতি পেয়ে ভদ্রলোক ওর মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ালেন ও আমার নাম কাকু শর্মা। আপনার সঙ্গে কয়েকটা প্রাইভেট কথা আছে।
শর্মা চট করে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন? প্লিজ কাম উইথ মি। একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালেন শর্মা। তারপর মহিনের দিকে ফিরে বললেন, লেটস গো।
ট্যাক্সিতে উঠে শর্মা হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, মিস্টার রায়, আপনাকে একটা লোককে।
শাট আপ, প্লিজ। ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে ইশারা করে শর্মাকে থামতে বলল মহিন।
ভদ্রলোক বারকয়েক ঢোক গিলে চুপ করে গেলেন। তাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত মনে হল। মুখময় দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। অনিদ্রায় চোখজোড়া করমচার মতো লাল। চুল উশকোখুশকো–চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ডান গালে একটা ছোট্ট তিল। সারা মুখে কেমন একটা হিংস্র, রুক্ষ ভাব।
মহিনের ইশারা কাকু শর্মা বুঝতে পারলেন। তাই চুপচাপ বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
শর্মার নির্দেশে একসময় ট্যাক্সি এসে থামল পার্ক সার্কাসের একটা ফ্ল্যাটের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দুজনে পা বাড়ালেন অটোমেটিক এলিভেটরের দিকে।
চারতলায় পৌঁছে কাকু শর্মা পকেট থেকে চাবির গোছা বের করলেন। তাতে কম করেও প্রায় একডজন চাবি। মহিন পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে সবই লক্ষ করতে লাগল। দরজা খুলে মহিনকে ভেতরে ডাকলেন শর্মা, আসুন–ভেতরে আসুন।
মহিন ঢুকতেই অতি সাবধানে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন রহস্যময় ভদ্রলোক। কিন্তু দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই এক চরম বিস্ময়ের মুখোমুখি হলেন। তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। কোনওরকমে তোতলা স্বরে বলে উঠলেন, মি মিস্টার রায়! এ–এ কী?
মহিন তখন দাঁত বের করে হিংস্রভাবে হাসছে। ওর ডানহাতের অভ্যস্ত মুঠোয় এক বিচিত্র ভারসাম্য নিয়ে কঁপছে একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক। তার নলটা কাকুর চোখে যেন বড় বেশি কুৎসিত মনে হল।
শর্মার দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে এল রায়। পেটে রিভলভার দিয়ে এক খোঁচা মারল? চলুন– ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসুন।
শর্মা বিনা প্রতিবাদে মহিনের আদেশ পালন করলেন। মহিন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শর্মার জামাকাপড় সার্চ করতে শুরু করল। কিন্তু কিছু না পেয়ে একটু দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল : মিস্টার শর্মা, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। এসবই হল প্রফেশনাল ব্যাপার। যাকগে, এবার আপনার দরকারটা খুলে বলুন।
নির্বিকার ভঙ্গিতে রিভলভারটা জামার খাপে চালান করে দিল রায়। কাকু শর্মাকে এবার অনেকটা সহজ মনে হল। তিনি কাষ্ঠহাসি হাসলেন। মুখের চিন্তার ভাবটা আরও গম্ভীর হল। তিনি থেমে-থেমে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন, মিস্টার রায়, আমি একটা লোককে খুন করাতে চাই।
দু-হাজার লাগবে। মহিন শান্তভাবে জবাব দিল।
জানি। আমার চেনা একজনের কাছ থেকে আমি আপনার সব খবর পেয়েছি। কিন্তু এই ব্যাপারটা একটু কমপ্লেক্স।
মহিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল : তার মানে?
মানে–এই খুনটায় আপনি রিভলভার ব্যবহারের চান্স পাবেন না। তাই আমার সাজেশান অনুযায়ী আপনাকে খুনটা করতে হবে।
কারণ?
কারণ আমার ভিকটিম বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বেরোয় না। আর যখনই বেরোয় আমর্স নিয়ে বেরোয়। অর্থাৎ সেও আপনারই মতো একজন প্রফেশনাল কিলার!
কী বলছেন আপনি? প্রফেশনাল কিলার?
হ্যাঁ–তার নাম সতীশ দেবনাথ। তবে শার্প ব্রেনের জন্যে সকলে তাকে শার্প দেবনাথ বলে ডাকে।
মহিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে ফুটে উঠল আবেগহীন হাসি। শূন্য দৃষ্টিতে ও কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দেওয়ালের দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করল, মিস্টার শর্মা, আমার উত্তর শুনলে আপনি হয়তো খুব অবাক হবেন।
শর্মা জিজ্ঞাসার চোখে মহিনের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
এ-খুনটার জন্যে একটা পয়সাও আমি আপনার কাছ থেকে নেব না। কারণ, সতীশ দেবনাথ আমার একনম্বর রাইভাল।
ডোন্ট গেট এক্সাইটেড, মিস্টার রায়। হাত তুলে মহিনকে বসতে অনুরোধ করলেন কাকু শর্মা ও পুরো ঘটনাটা আগে আপনার শোনা দরকার।
মহিন রায় ধীরে-ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। কিন্তু ওর ডান হাত বুকের কাছে লাগানো রিভলভারে খামচি মেরে রইল।
মিস্টার রায়, রিমা কাশ্যপকে আপনি চেনেন? হঠাৎই প্রশ্ন করলেন শর্মা।
উঁহু। মাথা নাড়ল মহিন।
রিমা কাশ্যপ ছিল একজন ক্যাবারে ড্যান্সার–অশোক বারে ও নাচত। ওর ক্যারেকটার খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু তবুও আমি ওকে ভালোবাসতাম। হ্যাঁ, শুনে আপনার হয়তো অবাক লাগছে, মিস্টার রায় বাট ইট ওয়াজ আ ফ্যাক্ট। বিয়ে-শাদি আমি করিনি। একা থাকি, দুহাতে পয়সা খরচ করি। তাই জীবনের একমাত্র শখ হিসেবে পুষেছিলাম রিমাকে। কিন্তু তার বছরখানেক পরে, এই গত জুলাইয়ে, একটা ঘটনা ঘটল। এক ভদ্রলোক একটা ইন্টারন্যাশনাল র্যাকেটে রিমাকে জড়িয়ে ফেললেন। রিমা নিজে জানতেও পারল না, কখন ও এক ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যখন জানল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সেই সময়েই এক ক্লায়েন্টের কথায় সতীশ দেবনাথ ওকে খুন করে। সতীশ রিমার জুতোর তলায় দুটো ছোট-ছোট স্টিলের বল লাগিয়ে দেয়। তাতে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পা পিছলে রিমা এক প্যাথেটিক অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। পুলিশ ঘটনাটাকে নিছক অ্যাকসিডেন্ট হিসেবে দেখেছিল, কারণ, পরে রিমার জুতোর নীচে সেই স্টিলের বলদুটো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মিস্টার রায়, রিমা ছিল আমার সব। একজন তিনকুলে-একা পুরুষকে ও লোনলিনেস ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং সামবডি মাস্ট পে ফর রিমাজ অ্যাকসিডেন্ট। এবং সেই সামবডি সতীশ দেবনাথ ছাড়া আর কেউ নয়। মানি ইজ নো প্রবলেম, মিস্টার রায়–তাই সতীশকে সরানোর দায়িত্ব আমি আপনাকেই দিতে চাই। এবং ইট মাস্ট লুক লাইক অ্যান অ্যাকসিডেন্ট নট মারডার। যেমনটা হয়েছিল রিমার বেলায়।
মহিন একমনে কাকু শর্মার কথা শুনছিল। শৰ্মা থামতেই ও নীচু গলায় বলে উঠল, আমার ৪৫৭ ছাড়া আমি এক পাও চলি না–সেটাই আমার শেষ কথা।
আমি তা জানি, মিস্টার রায়। আপনার মেশিন আপনি ইচ্ছে করলে সঙ্গে রাখতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই সেটা ইউজ করতে পারবেন না। আশা করি সেরকম দরকারও হবে না। উঁহু, ব্যস্ত হবেন না। আগে ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন। পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান, সতীশ দেবনাথ বাড়িতে সবসময় রিভলভার সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না। নাম্বার টু, আপনি যখন ওকে ধাক্কা দিয়ে চারতলার ওই বারান্দা থেকে নীচে ফেলে দেবেন, তখনও ওর কাছে আর্স থাকবে না। সুতরাং আপনি নির্ভয়ে এ কাজটা হাতে নিতে পারেন। রিমার মৃত্যুর বদলা নিতে যত টাকা লাগে, আমি খরচ করব। না, নাটাকা নিতে আপনার আপত্তি থাকলেও আমি শুনব না। কাজ শেষ হয়ে গেলে দু-হাজার টাকা আপনাকে আমি গিফ্ট হিসেবে দিতে চাই।
মহিন নীরব। একদৃষ্টে ও চেয়ে রইল শর্মার মুখের দিকে।
আপনার যদি এ-কাজে আপত্তি না থাকে তো বলুন– শর্মা বলে চললেন, কালই প্রিলিমিনারি ইনস্পেকশানটি সেরে ফেলি।
প্রিলিমিনারি ইনস্পেকশান? ভীষণ অবাক হল রায় : তার মানে?
সেটা আপনাকে জানাব–যদি কাজটা আপনি হাতে নেন। তার আগে নয়।
ভালো। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সম্মতি জানাল মহিন।
ধন্যবাদ। পকেট থেকে এক প্যাকেট ক্যাপস্টান আর দেশলাই বের করে মহিনের দিকে এগিয়ে দিলেন শর্মা। মহিন মাথা নেড়ে না বলল। তখন নিজেই একটা ধরিয়ে প্যাকেট এবং দেশলাই আবার পকেটে চালান করলেন।
অলসভাবে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, মিস্টার রায়, আমার একটা আশ্চর্য গুণ আছে। তা হল, পৃথিবীর যে-কোনও তালাই আমি মিনিটদুয়েকের মধ্যে খুলে ফেলতে পারি।
কিন্তু এর সঙ্গে খুনের কি সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারছি না? শর্মাকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল মহিন।
আছে, মিস্টার রায়, আছে। বহু কষ্টে আমি সতীশ দেবনাথের ফ্ল্যাটের ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। কাল সতীশ যখন থাকবে না, তখন আপনাকে নিয়ে আমি একবার সতীশের ফ্ল্যাট ইনস্পেকশানে যেতে চাই। স্পটটা আগে থেকে দেখা থাকলে আপনার অনেক সুবিধে হবে, তাই না?
হয়তো তাই। অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল মহিন। ওর মন তখন চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ঠিক আছে। তা হলে কাল সন্ধে সাতটায় আপনি আমার এখানে আসুন। তারপর এখান থেকে একসঙ্গেই বেরোনো যাবে। ইন দ্য মিন টাইম আমি ফোন করে জেনে নেব সতীশ কখন বাইরে বেরোবে। ব্যস, তারপর আর কোনও চিন্তা নেই। হিংস্র উল্লাস খেলা করল কাকু শর্মার মুখে। আনমনে তিনি বলে চললেন, রিমার আত্মা এবার শান্তি পাবে।
তা হলে কাল সন্ধে সাতটা। মহিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে চলল দরজার দিকে।
কাকু শর্মা তখন টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে ফেললেন। ড্রয়ারে থরে থরে সাজানো নোটের বান্ডিল। আর তার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা ০.৩৮ পুলিশ স্পেশাল। রিভলভারের গায়ে একটা হাত রাখলেন কাকু। দাঁতে দাঁত ঘষে উচ্চারণ করলেন, মিস্টার দেবনাথ, এবার তোমার পালা।
.
পরদিন রাত আটটায় কাকু শর্মা আর মহিন রায় এসে দাঁড়াল সতীশ দেবনাথের বাড়ির সামনে। অন্ধকার এলাকায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার কোনও স্পষ্ট আদল পাওয়া গেল না। নীরবে দুজনে এগিয়ে চলল লিফটের দিকে।
লিফটে উঠে তিননম্বর বোতাম টিপলেন কাকু শর্মা। নিঃশব্দে উঠতে শুরু করলে লোহার খাঁচা। মহিনকে দেখে একটু উত্তেজিত মনে হল শর্মার। ওর হাত পোশাকের আড়ালে বোধহয় রিভলভারের ওপরে। শর্মা ওর কাঁধে হাত রাখলেন ও টেক ইট ইজি। আমি এখানে আসার আগেই ফোন করে জেনে নিয়েছি সতীশ দেবনাথ ওর ফ্ল্যাটে নেই। অতএব রিল্যাক্স।
এটা জাস্ট প্রিকশন। বরফশীতল স্বরে জবাব দিল রায়।
মৃদু হেসে ঘাড় ঝাঁকালেন কাকু।
লিফট থামতেই সন্তর্পণে করিডরে পা দিলেন তিনি। মহিন রায়কে ইশারায় আহ্বান জানালেন। সামনেই একটা ফ্ল্যাটের দরজা। মহিন লক্ষ করল ফ্ল্যাটের নম্বর ১২। দরজার ডান পাশে একটা কলিংবেল। শর্মা বারকয়েক কলিংবেলে চাপ দিলেন। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না ভেতর থেকে।
শর্মা ঘাড় ফিরিয়ে মহিনের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন চাবিভরতি রিংটা।
রায় চুপচাপ লক্ষ করে চলল শর্মার কার্যকলাপ।
মিনিটদুয়েক ধরে চাবির গোছা নিয়ে কীসব খুটখাট করলেন তিনি। তারপরই হাতল ঘুরিয়ে একটু-একটু করে খুলে ফেললেন ফ্ল্যাটের দরজা।
অভ্যাসবশে মহিন নিমেষের মধ্যে হোলস্টার থেকে বের করে নিল ওর লুগার অটোমেটিক। শর্মা কিন্তু ফিরেও তাকালেন না। আস্তে-আস্তে ঘরে ঢুকে পড়লেন। অতি সাবধানে তাকে অনুসরণ করল মহিন রায়।
শর্মা আলোর সুইচ অন করে অল্প পাওয়ারের একটা আলো জ্বেলে দিলেন।
একইসঙ্গে মহিনও ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল ফ্ল্যাটের দরজা।
মিস্টার রায়, এই হল সতীশের ঘর। ভালো করে দেখে রাখুন।
মহিন পেশাদার চোখে ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র খুঁটিয়ে লক্ষ করতে লাগল।
দরজার ডান পাশে একটা ছোট টেবিল। তার ওপর অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে খানকতক ক্রিমিনোলজির বই। টেবিল থেকে হাততিনেক দূরে একটা স্টিলের আলমারি। ডানদিকের দেওয়ালে ঝুলছে তিনটে ক্যালেন্ডার। ছবিগুলো নেহাতই ঠাকুর-দেবতার। দরজার মুখোমুখি একটা ছোট বারান্দা।
বারান্দার দু-দিকের দেওয়ালে দুটো জানলা। অত্যন্ত ছোট মাপের–গরাদ দেওয়া।
বাঁ-দিকের জানলার পাশে একটা বড় ওয়াল ক্লক। তার রেডিয়াম দেওয়া কাটা এই অল্প আলোতেও জুলজুল করছে। ঘড়ির দিকে নীচেই একটা টিপয়। তার ওপরে একটা টেলিফোন : সাদা রঙের।
ঘরের বাঁদিকে একটা লম্বা-চওড়া খাট। বিছানার সাদা চাদর বহু ব্যবহারে ময়লা হয়ে গেছে। একজোড়া বালিশ খাটের ও-মাথায় পড়ে রয়েছে। তার পাশে কিছু জামাকাপড়। আর এ-মাথায় পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ভাজ করা চাদর। খাটের নীচ থেকে উঁকি মারছে একটা স্যুটকেস, একটা ট্রাঙ্ক। দরজার বাঁদিকে একটা বড় কাঠের বাক্স ও তালাবন্ধ। তার পাশে একটা কুঁজো কাচের গ্লাস দিয়ে ঢাকা দেওয়া। আর চোখে পড়ছে একটা ছোট দরজা। সম্ভবত বাথরুম।
প্রতিটি জিনিসের ওপরে চোখ বুলিয়ে মহিন রায়ের চোখ এসে স্থির হল কাকু শর্মার চোখে। কাকু বুঝতে পারলেন মহিনের নীরব প্রশ্ন। তাই জবাব দিলেন, এই জিনিসগুলো ভালো করে দেখার ভীষণ দরকার আছে, মিস্টার রায়। এই ঘরের প্রতিটি ফার্নিচার এবং তাদের পজিশান আপনাকে এমনভাবে মনে রাখতে হবে, যাতে কেউ এ-বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলে আপনি তার কারেক্ট আনসার দিতে পারেন।
কিন্তু কেন? মহিন জিগ্যেস করল।
কারণ, অপারেশন সতীশ এক্সিকিউট করতে হবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। সুতরাং ওই অন্ধকারে আপনার নিজের পজিশান সঠিক রাখার জন্যে অন্যান্য আসবাবপত্রের পজিশান আপনাকে মেমোরাইজ করতেই হবে।
তারপর?
এবার আমি খুনের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো আপনাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিই।
মহিন সোজা গিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ল। রিভলভারটা আবার হোলস্টারে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর উৎসুক চোখ মেলে তাকাল কাকুর দিকে।
রাত ঠিক বারোটার সময় আমি আপনাকে এই ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছে দেব। আর সঙ্গে দিয়ে দেব এই ফ্ল্যাটের দরজার চাবি। তারপর, আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, আপনি এক থেকে একশো পর্যন্ত গুনবেন। কারণ ওই সময়ের মধ্যেই আমি রাস্তার ওপারে যে-ডাক্তারখানা আছে, সেখান থেকে সতীশকে ফোন করব। তখন আপনি ফোনের শব্দ শুনতে পাবেন। তারপর কথাবার্তায় যখনই বুঝবেন সতীশ রিসিভার টেবিলে রেখে বারান্দার কাছে যাচ্ছে, তখনই আপনি নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওর ঘরে ঢুকে পড়বেন।
কিন্তু আপনি কী করে শিয়োর হচ্ছেন যে, মিস্টার দেবনাথ বারান্দার কাছে যাবেন?
অধৈর্য হবেন না, মিস্টার রায়। বাইরের করিডর পুরো অন্ধকার থাকবে। অতএব সতীশ আপনাকে দেখতে পাবে না। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তবে সতীশ রিসিভার তুলে কথা বলার পর নিশ্চয়ই বারান্দার কাছে যাবে। কারণ, আমি তাকে ফোনে বলব, একটা লোক পাইপ বেয়ে তার বারান্দার ওঠার চেষ্টা করছে? সম্ভবত লোকটার মতলব ভালো নয়।
ও। তা হলে দেবনাথ তখন বারান্দার যাবেই। দেখতে চেষ্টা করবে, পাইপ বেয়ে সত্যিই কেউ ওঠার চেষ্টা করছে কি না। আর তখনই আমি…।
ছুটে গিয়ে ওকে বাইরে পড়তে সাহায্য করবেন। ক্লিয়ার?
অ্যাবসলিউটলি! দাঁতে দাঁত ঘষে জবাব দিল মহিন।
তা হলে নেক্সট উইকে, এই একই দিনে, আমরা এখানে আসব, আর সেটাই হবে সতীশ দেবনাথের শেষ রাত।
কাকুর কথা শেষ হতে না-হতেই একটা সামান্য শব্দে ওরা দুজনেই তড়িৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠল। কাকু তীরবেগে ছুটে গেলেন আলোর সুইচের দিকে। আর একইসঙ্গে রিভলভারটা বের করে মহিন দৌড়ল আলমারি লক্ষ করে।
রায় আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পড়ামাত্রই নিভে গেল ঘরের আলো। অন্ধকারে ও কাকুকে দেখতে পেল না।
এদিকে বাইরের পায়ের শব্দ এসে থেমেছে দরজার কাছে। তারপর শোনা গেল দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ।
একটু পরেই সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে দরজার পাল্লা ফাঁক হতে শুরু করল।
বাইরের আলোর পটভূমি দেখা গেল দরজায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় এক ছায়ামূর্তি।
হঠাৎ রায় অনুভব করল কার হাতের স্পর্শ। ও চমকে উঠতেই কানে এল কাকুর ফিসফিসে চাপা গলা, সতীশ দেবনাথ!
ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর এগিয়ে গেল আলোর সুইচের দিকে। আর সৌভাগ্যবশত ঠিক সেই মুহূর্তে ঝনঝন করে বেজে উঠল ঘরের টেলিফোন। ছায়ামূর্তি আলো না জ্বেলে ফোনের দিকে পা বাড়াতেই বিদ্যুঝলকের মতো দরজা লক্ষ করে ছুটে গেল মহিন আর কাকু। পলকের মধ্যে দরজা খুলে ওরা করিডরে পা দিল।
মহিন কাকুর আগে আগে ছুটছিল। ও দৌড়ে লিফটে উঠতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ভীষণভাবে নিজেকে সামলে নিল।
লিফটের জায়গায় লিফট নেই। অথচ কোলাপসি গেটটা হাট করে খোলা। উঁকি মেরে দেখল, লিফট দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই একতলায়।
তা হলে কোলাপসিবল গেটটা খুলল কী করে? কে-ইবা খুলল?
মুহূর্তের মধ্যে সিঁড়ি লক্ষ করে দৌড়তে শুরু করল মহিন। ওর পিছনে-পিছনে কাকু। তার পিছনে কি কারও পায়ের শব্দ ভেসে আসছে?
কীভাবে যে ওরা শেষ পর্যন্ত রাস্তায় এসে পৌঁছোল, তা ওদের মনে নেই। সতীশের বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। আজ খুব জোর বেঁচে গেছে!
চলে যাওয়ার আগে কাকু মহিনের কাঁধে টোকা মেরে মনে করিয়ে দিলেন, আগামী শুক্রবার রাত এগারোটায় আমরা বেরোব। আপনি আমার বাড়িতে সময়মত আসবেন, মিস্টার রায়। কারণ, পাংচুয়ালিটি আমি পছন্দ করি।
ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলল মহিন রায়। লুগার অটোমেটিক তখন ওর হোলস্টারে পরম নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করছে। কিন্তু ওর কপালে জমে ওঠা ঘামের ফোঁটা রাস্তার আলোয় চকচক করছিল।
.
শুক্রবার। রাত সাড়ে এগারোটা।
সতীশ দেবনাথের ফ্ল্যাট থেকে কিছুটা দূরে একটা লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কাকু। তার পাশে মহিন। ওর পরনের পোশাকে কোনও পরিবর্তন হয়নি। বুকের বাঁপাশটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে। না, অটোমেটিক লুগারকে মহিন রায় কোনও অবস্থাতেই কাছ ছাড়া করতে রাজি নয়।
দুজনের নজরই চারতলার অন্ধকার জানলার দিকে।
এই নিন। সতীশের ফ্ল্যাটের চাবি।
চুপচাপ কাকুর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে ডান পকেটে ভরে ফেলল রায়। এই উৎকণ্ঠাময় অপেক্ষা ও একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। শুধু ভাবছে, ঘড়ির কাঁটা কখন গিয়ে ঠেকবে বারোটার ঘরে।
মিস্টার রায়, বিরক্তিকর মনে হলেও ছোটখাটো ব্যাপারগুলো আরও একবার আপনাকে মনে করিয়ে দিই। কেশে গলা ঝাড়লেন কাকু?
ঠিক বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিটের সময় আমি আপনাকে সতীশের ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে দেব। করিডর অন্ধকার থাকবে। আশা করি আপনার চলাফেরায় কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আপনি এক থেকে একশো পর্যন্ত মনে-মনে গুনবেন। তারপর চাবি নিয়ে ঘরে ঢোকার জন্যে তৈরি হবেন। ঠিক সেই সময়ে আপনি শুনতে পারেন টেলিফোনের শব্দ। টেলিফোনের কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর ঠিক তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে আপনি দরজা খুলবেন। আর আমার অঙ্কে যদি ভুল না হয় তবে দরজা খুলেই আপনি দেখবেন বারান্দায় দাঁড়ানো অসতর্ক সতীশকে। ব্যস, বাকি কাজটুকু এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই আপনাকে সারতে হবে। তারপর পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোটের বান্ডিল বের করে মহিনের চোখের সামনে নাচালেন কাকু : আপনি নিন বা না নিন, আমার ডিউটি আমি করব।
ক’টা বাজে এখন? নিরুত্তাপ গলায় জানতে চাইল মহিন।
পৌনে বারোটা। আর মাত্র দশ মিনিট।
ধীরে-ধীরে সময় গড়িয়ে চলল।
জিরো আওয়ার। চলুন যাওয়া যাক। কাকু শর্মা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললেন। মহিনের ডানহাতের পাঁচ আঙুল অনুভব করল লুগারের অস্তিত্ব। তারপর চুপচাপ ও কাকুকে অনুসরণ করল।
নিঝুম বাড়ি। সদর দরজার তালা খুলতে কাকুর লাগল মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ভেতরটা একেবারে অন্ধকার।
আন্দাজে ভর করে দুজনেই এগিয়ে চলল।
হাতড়ে-হাতড়ে লিফটের দরজা হাতে ঠেকল কাকুর।
এদিকে চাপাস্বরে হতভম্ব মহিনকে আহ্বান জানালেন তিনি।
লিফটে ঢুকেই সুইচ অন করে অল্প পাওয়ারের আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন কাকু। তারপর চারনম্বর বোতাম টিপলেন।
ওপরের দিকে নিঃশব্দে ছুটে চলল লোহার খাঁচা।
লিফট থামতেই সুইচ অফ করে কাকু আলো নিভিয়ে দিলেন। তারপর খুব সাবধানে দরজা খুলে মহিনকে এগোতে ইশারা করলেন ও যান–দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক থেকে একশো পর্যন্ত গুনবেন। তারপর–।
আপনি আপনার কাজ করুন। মৃদু খসখস শব্দ করে অন্ধকার করিডরে পা রাখল মহিন।
কাকু লিফটের দরজা বন্ধ করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপলেন।
লিফট নামতে শুরু করল।
নিঃশব্দে সতীশের ফ্ল্যাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মহিন। লুগার অটোমেটিক হোলস্টার থেকে বের করে দু-হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ও। তারপর রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল। মনে মনে গুনতে শুরু করল, এক–দুই-তিন–।
.
রাস্তায় লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি দেখলেন কাকু। তার হাতঘড়িতে কাটায়-কাঁটায় বারোটা বাজতেই এগিয়ে গেলেন কাছেই এক ডাক্তারখানার দিকে। তার কঠিন মুখে সিদ্ধান্তের আভাস।
ডাক্তারখানায় ঢুকে কাউন্টারের ওপর একটা আধুলি ছুঁড়ে দিলেন তিনি। কোনও কথা না বলে এগিয়ে গেলেন কাউন্টারের বাঁ-পাশে রাখা টেলিফোনের দিকে।
রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন। ডাক্তারখানার শীর্ণ চেহারার কর্মচারীটি জুলজুল করে কাকুকে দেখতে লাগল।
.
ঠিক বারোটা বাজতেই দরজার বাইরে দাঁড়ানো মহিনের কানে এল দেওয়ালঘড়ির স্পষ্ট গম্ভীর আওয়াজ। ঢং-ঢং-ঢং-।
রাত্রির নিটোল নিস্তব্ধতা চুরমার করে বারোবার বাজার পর থামল সেই দেওয়ালঘড়ির শব্দ।
তারপরই মহিনের কানে এল ভেতরে কারও নড়াচড়ার শব্দ। লুগার আঁকড়ে ধরে ওঁত পাতা জাগুয়ারের মতো সামনের দিকে একটু ঝুঁকে এল মহিন। অস্পষ্টভাবে ওর নজরে পড়ল কলিংবেলের সুইচ, রুম নম্বরের ঝাপসা সাদা অক্ষর দুটো ও ১২। কিন্তু ওর কান সজাগ। শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি টান-টান।
হঠাৎই টেলিফোনের কর্কশ বেসুরো ঝনঝন শব্দে মহিন ভীষণভাবে চমকে উঠল। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে পকেট থেকে বের করল সতীশের ফ্ল্যাটের চাবি। ঘরের ভেতর কেউ রিসিভার তুলে নিল।
হ্যালো—
…
কে কথা বলছেন? এ-প্রান্তে দেবনাথের স্বর উত্তেজিত।
…
অসম্ভব। বাইরের পাইপ বেয়ে ওঠা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়!
…
হতেই পারে না। ঠিক আছে, তবু একবার দেখছি। হ্যালো? হ্যালো? হ্যাঁ।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ। মহিন একমনে দেওয়ালে কান পেতে সব শুনছিল। সতীশের দ্বিতীয় কথা শোনামাত্রই চাবি ঢুকিয়ে দিয়েছিল দরজার ফুটোয়।
সতীশ রিসিভার নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গে মহিনের পেশাদার হাতের নিখুঁত চাপে নিঃশব্দে দরজা খুলতে শুরু করল।
দরজা পুরোটা খুলতেই মহিন একপলক থমকাল। লুগারটা হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল। দেখল…।
.
সামনের রাস্তায় অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করছেন কাকু শর্মা। বারোটা পাঁচ বাজতেই তিনি সতীশের বাড়ির দিকে হেঁটে চললেন। পকেট থেকে বের করে নিলেন একটা পেনসিল টর্চ। তার আলোর পথ দেখে তিনি খোলা সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে। লিফটে উঠে চারনম্বর বোতাম টিপলেন। লিফট নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল।
.
মহিনের প্রথম নজর গেল বারান্দার। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি। দেখা যাচ্ছে বাইরের খোলা আকাশ। তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঠিক জমাট পাথরের মতো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই জায়গায়। ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে।
বাঁ-পাশে চোখ সরাতেই নজরে পড়ল ছোট্ট জানলা। পাল্লা দুটো না দেখা গেলেও, গরাদের ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাইরের কালো আকাশ। তার সামান্য পাশেই দেওয়ালে চকচক করছে দেওয়ালঘড়ির কাটা। ছোট কাটা আর বড় কাঁটা দেখে বোঝা যায় রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটের কিছু বেশি। তার নীচেই আবছাভাবে চোখে পড়ছে টিপয়ের ওপরে বসানো টেলিফোন। ছোট জানলার সঙ্গে বারান্দার ডানদিকের জানলার তেমন কোনও তফাত নেই। ওটাও হাট করে খোলা। বাইরের সামান্য আলোর খাট, বালিশ, বিছানাও মহিনের চোখ এড়াল না।
এইসব চোখ বুলিয়ে দেখতে মহিনের লাগল ঠিক ছসেকেন্ড। পরমুহূর্তেই ও জীবনপণ করে ছুটল ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব প্রতি মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে কমতে লাগল।
হঠাৎই মহিন আবিষ্কার করল ও ঠিক সতীশের পিছনে দাঁড়িয়ে। সর্বশক্তি দিয়ে সামনে হাত বাড়িয়ে ও ঝুঁকে পড়া সতীশকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল। সঙ্গে-সঙ্গেই কী যেন হয়ে গেল। দুলে উঠল বারান্দা, জানলা, ঘড়ি–এমনকী গোটা দেওয়ালটা। মহিন হঠাৎ যেন অনুভব করল ও শূন্যে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপরে আকাশ। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস। জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররা প্রতিফলিত হল মহিনের চোখের তারায়।
সমস্ত পৃথিবীটা মহিনের চোখের সামনে ঘুরপাক খেয়ে হঠাৎই উলটে গেল। দুটো ডিগবাজি খেয়ে জ্যাক নাইফ ডাইভিং-এর মতো ও সোজা এসে পড়ল বাইরের বাঁধানো রাস্তায়। তখনও পুরো ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা, বিস্ময় ওর মনকে ছুঁয়ে রেখেছে।
মহিনের কালো পোশাক পরা চেহারাটা ঠিক মরা দাঁড়কাকের মতো হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল। ঘাড় মটকে মাথাটা এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় পিছনদিকে চেয়ে রয়েছে। হাঁ করা মুখের ফাঁক দিয়ে জিভটা বেরিয়ে এসেছে। রক্তাক্ত মুখে নিষ্প্রাণ চোখজোড়ায় শুধুই বিস্ময়। মরে গিয়েও মহিন যেন এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
.
লিফট পাঁচতলায় এসে থামতেই কাকু শর্মা করিডরে পা দিলেন। পেনসিল টর্চের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে গেলেন ফ্ল্যাটের খোলা দরজার দিকে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর পেনসিল টর্চ পকেটে রেখে দেশলাই বের করলেন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের এক কোনায় রাখা একটা হ্যারিকেন নিয়ে এলেন। বোঝা গেল, এ-ঘরের সঙ্গে তিনি ভীষণভাবে পরিচিত। হ্যারিকেনের আলো জ্বালতেই কতকগুলো জিনিস চোখে পড়ল।
খাট, বিছানা, বালিশ ও টিপয়ের ওপরে রাখা টেলিফোন ছাড়া পুরো ঘরটাই ফাঁকা। ঘরে আর কোনও আসবাবপত্র নেই। ঘরের সিলিং ঢালাই করা সিমেন্টের নয়–প্লাইউডের তৈরি বারান্দার দিকের দেওয়ালও দেওয়াল নয় কালো রং করা প্লাইবোর্ড। বারান্দার জায়গাটা প্লাই কেটে তৈরি করায় বাইরের আকাশ চোখে পড়ছে। বারান্দার দুপাশের জানালাও একইভাবে প্লাইউড কেটে গরাদের মতো করা। জানলায় কোনও পাল্লা নেই। দেওয়ালঘড়ির জায়গায় কালো প্লাইয়ের ওপরে লুমিনাস পেইন্ট দিয়ে মিনিটের কাঁটা আর ঘণ্টার কাঁটা আঁকা রয়েছে–এমনভাবে, যাতে অন্ধকারে বারোটা বেজে পাঁচ-সাত মিনিট বলে মনে হয়।
জিনিস গুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে কাকু মুচকি হাসলেন। এগিয়ে গিয়ে বালিশের নীচ থেকে টাইম অ্যান্ড ক্লক ডিভাইস অটোমেটিক টেপ রেকর্ডার বের করলেন। রেকর্ডারের টেপ তখনও ঘুরে চলেছে। কাকু উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিলেন টেপের গতি। তারপর একসময় সুইচ টিপে প্রথম থেকে চালাতেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ ঢং-ঢং-ঢং। দেওয়ালঘড়ির ঘণ্টার শব্দ। ঠিক বারোবার বাজল। তারপর শোনা গেল কারও চলাফেরায় শব্দ। তারও কিছু পরে টেলিফোনের ক্রিং রিং–রিং ক্রিং রিং– রিং, এবং সবশেষে মহিনের শোনা কথাবার্তা আবার হুবহু শোনা গেল। এমনকী রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দও বাদ গেল না।
কাকুর তৈরি এই নাটুকে ঘরের একদিকে দরজা, তার দুপাশে দেওয়াল, কিন্তু আর-একটা দিকে এখনও দেওয়াল গাঁথা হয়নি–যেদিক দিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েছে মহিন রায় এবং বারান্দার দাঁড় করানো কার্ডবোর্ডের মূর্তিটা।
এবার ক্লান্তভাবে খাটের ওপরে বসলেন কাকু। বহুদিনের প্রতীক্ষার পর তার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল স্বস্তির নিশ্বাস।
*
ঠিকই আন্দাজ করেছেন আপনারা। সতীশ দেবনাথ এবং কাকু শর্মা এক ও অভিন্ন। আগেই তো বলেছিলাম, এই শার্প দেবনাথের সঙ্গে বুদ্ধির লড়াইয়ে কেউ পেরে ওঠেনিপারবেও না।
মহিনের মোক্ষলাভের ব্যাপারে কতকগুলো ব্যাপারে হয়তো আপনাদের ধন্দ লাগছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, একটা বড় সূত্র অনেক আগেই আপনাদের জানিয়ে দিয়েছিলাম। আজ যখন মহিনকে নিয়ে আমি লিফটে উঠলাম, তখন কত নম্বর বোতাম টিপেছি বলতে পারেন? চার নম্বর। অথচ প্রথমদিন ওকে যখন আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি, তখন টিপেছিলাম তিননম্বর। তা হলে? ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকছে না আপনাদের কাছে?
তা হলে প্রথম থেকেই বলি।
আপনাদের হয়তো মনে আছে, মহিনকে সরানোর ব্যাপারে লোকেশান ঠিক করতে আমার সময় লেগেছিল একটি মাস। কারণ, তৈরি হচ্ছে এইরকম একটা ফ্ল্যাট বাড়ি আমার প্রয়োজন ছিল। এবং প্ল্যানমতো পাঁচতলার একটা আধা-তৈরি ঘরের ঠিক নীচে, চারতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। আসবাবপত্রে সাজিয়ে ফেললাম ঘরটা। আর ওপরতলার মরণ-ফ্ল্যাটের সেট তৈরির সরঞ্জাম জোগাড় করে ফেললাম।
প্রথমে পরদাটাকে কাঁচি দিয়ে এমনভাবে কাটলাম, যাতে অন্ধকারে টাঙিয়ে রাখলে মনে হয় একটা বারান্দার দুপাশে দুটো জানলা (ঠিক আমার ফ্ল্যাটের মতো)। ব্যস, প্রাথমিক কাজ শেষ হল।
সুতরাং, তারপরই আমি দেখা করলাম মহিনের সঙ্গে। ও এই কিলিং বিজনেস-এ নামার পর থেকেই মোটামুটি ওই একই জায়গায় ঘোরাফেরা করে। তাই ওকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না। তারপর কায়দামতো সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ভুয়ো গল্প ফেঁদে বসলাম। আর সেই ফাঁদেই মহিন পা দিল।
প্রথম দিন ওকে নিয়ে গেলাম সেই মরণ-ফ্ল্যাট পরিদর্শনে। এমনভাবে ঘরের প্রতিটি জিনিস ওর মনে গেঁথে দিলাম, যাতে অন্ধকারেও ওর কোনও অসুবিধে না হয়। আমি যে সতীশ নই, সেটা প্রমাণের জন্যে একজন পেশাদার অভিনেতাকে ওই সময়ে আমার ফ্ল্যাটে আসার জন্যে বলে রেখেছিলাম। তা ছাড়া কী কী করতে হবে তাও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে যে কীরকম কাজ হয়েছে তা তো আপনারা ভালোভাবেই জানেন। আজ অন্ধকারে মহিন যখন দেখল খাট, বিছানা, বালিশ, টেলিফোন, জানলা, বারান্দা, ঘড়ি–সবই ঠিক জায়গায় ঠিকমতোই রয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ওর অবচেতন মন ধরে নিল, সেই একই ঘরে ও এসেছে। যে-যে ফার্নিচার ঘরে নেই, সেগুলোও আছে বলে ওর মন কল্পনা করে নিল। একে বলে সাইকোলজিক্যাল ইলিউশান, অথবা, সাইকোলজিক্যাল ইমপ্লিকেশান।
ঠিক একইভাবে অন্ধকারে প্লাইয়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো একটা কার্ডবোর্ডের মূর্তিকে ও আসল মানুষ বলে ভুল করল। কারণ, আমার শোনানো সেই টেলিফোন করার গল্প। তার ওপর সাইকোলজিক্যাল কনভিকশানের জন্যে সামান্য টেপরেকর্ডারের ব্যবস্থা। ব্যস। আমার বলে যাওয়া গল্প আর আপাতদৃষ্টিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা যোগ করে ও ধরে নিল, ও সেই একই ঘরে এসেছে, এবং সেই ফ্ল্যাটের বারান্দার দাঁড়িয়ে আছে সত্যিই একটি জলজ্যান্ত মানুষ।
তারপর যা হওয়ার তাই হল। ছুটে গিয়ে ওই মূর্তিটাকে ধাক্কা দিতেই ও পলকা প্লাইয়ের বাঁধন ছাড়িয়ে শূন্যে পা দিল।
ও যদি অন্ধকার ঘরে একটু ঘুরে-ফিরে দেখত, তা হলে বুঝত–ওই খাট, টেলিফোন ছাড়া আর কোনও ফার্নিচারই ঘরে নেই। আর ঘড়ির কাঁটার জায়গায় রয়েছে লুমিনাস পেইন্ট দিয়ে আঁকা দুটো সরলরেখা। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করায় রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ি বলে ভুল হয়। কিন্তু টেপরেকর্ডারের বারোটা বাজার ঘণ্টা, আর দেওয়ালের বারোটা পাঁচের লুমিনাস পেইন্টের দাগ দেখে ও ধরে নিল ওটা সত্যিই একটা দেওয়াল-ঘড়ি।
সুতরাং আপনারাই বলুন, এইরকম একটা বুদ্ধিদীপ্ত সাইকোলজিক্যাল মার্ডার আমি ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব?
তবে মহিনকে একটা সূত্র দিয়েছিলাম লিফটের বোতাম টেপার সময়। আমার ফ্ল্যাট যদি চারতলায় হয়, তবে আমাকে তিন নম্বর বোতাম টিপতে হবে। কিন্তু মহিন বোঝেনি, চার নম্বর বোতাম টেপার পর যে-তলায় গিয়ে লিফট থেমেছে, সেটা আমার ফ্ল্যাট নয়। সেটা পাঁচতলার সেই অসম্পূর্ণ মরণ-ফ্ল্যাট। কিন্তু সেই অসম্পূর্ণ দরজায় লাগিয়ে দিলাম প্লাস্টিকের ১২ নম্বর ও একটা কলিংবেলের ক্যাপ কারণ, ডিটেলের প্রতি আমি গভীর মনোযোগ দিই।
.
অতএব মনে রাখবেন বন্ধুগণ, প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম শার্প দেবনাথ। এই কিলিং মার্কেটে যিনি মনোপলি বিজনেস করে চলেছেন। সুতরাং তার সঙ্গে দুশমনির কথা ভুলেও মনে আনবেন না। তা হলে আপনাদেরও অবস্থা হবে ওই মহিন রায়ের মতো। কাউকে মোক্ষলাভ করানোর পর আমি মনে-মনে ভীষণ দুঃখ পাই, বিশ্বাস করুন। কিন্তু কী করব, আমি নিরুপায়। আফটার অল, আই অ্যাম দ্য কিং অফ প্রফেশনাল কিলার্স। দ্য গ্রেট শার্প। সুতরাং—।
অনেকক্ষণ ধরে ফোন করব কি করব না ভেবে শেষ পর্যন্ত নম্বরটা ডায়াল করেই ফেলল অভিলাষ।
কয়েক সেকেন্ড পার হতে না হতেই ও-প্রান্তে রিং বাজতে শুরু করল। অভিলাষের বুকের ভেতরে ধকুপুক শুরু হয়ে গিয়েছিল। লাইনটা কি এখনই কেটে দেবে? নাকি…।
না, না–লাইন কাটার কী দরকার! একটু কথাবার্তা বললে খোঁজখবর করলে ক্ষতি কী? আসল কাজে না এগোলেই হল।
হ্যালো একটি মেয়ের গলা।
এটা কি এন্ড গেম-এর অফিস? প্রশ্নটা করতে গিয়ে অভিলাষের গলা কেঁপে গেল।
হ্যাঁ–বলুন…। রোবটের মতো গলায় মেয়েটি বলল।
আ-আমি কয়েকটা ইনফরমেশান চা-চাই..। ।
এর জন্যে আপনাকে আমাদের অফিসে এসে কোনও একজন এক্সিকিউটিভের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাদের অফিসটা হল থারটি ফাইভ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। দ্য টাওয়ার্স বিল্ডিং এর সেভেনটিন্থ ফ্লোর। উই আর ওপেন টুয়েন্টিফোর ইনটু সেভেন। একটু দম নিয়ে মিষ্টি গলার মেয়েটি জিগ্যেস করল, মে আই নো হু ইজ মেকিং দিস কল?
কয়েকবার ঢোঁক গিলে অভিলাষ বলল, মানে…আপনাদের একটা এসএমএস দেখে আ আমি কল করেছি। আই মিন…।
ইটস ও. কে., স্যার। ইমপরট্যান্ট পারসন্সদের মোবাইল ফোনে কনট্যাক্ট করাটা আমাদের অ্যাড ক্যামপেইনের একটা পার্ট। এ ছাড়া স্যাটিসফায়েড ক্লায়েন্টদের হুইসপারিং ক্যামপেইনও আমাদের খুব হেল্প করে। আর আমাদের কোম্পানির মরাল হচ্ছে, আ ক্লায়েন্স সিক্রেট ইজ অলওয়েজ আ সিক্রেট। ক্লায়েন্টদের সব ব্যাপার আমরা গোপন রাখি। ফর এক্সাম্পল, এই যে আপনি আমাদের ফোন করেছেন, এটা কেউ জানতে পারবে না। ইভন দ্য পুলিস ক্যান নট ট্রেস দিস কল। বিকজ মোবাইল ফোন সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে আমাদের স্পেশাল এগ্রিমেন্ট আছে। উই পে দেম বিগ মানি। সো এভরিথিং ইজ হাশ-হাশ। একটু থামল মেয়েটি। বোধহয় অভিলাষকে সাহস জোগানোর সময় দিল। তারপর ও আই হোপ য়ু আর স্যাটিসফায়েড, স্যার। নাউ মে আই নো হু ইজ কলিং?
অভিলাষ ঘামতে শুরু করেছিল। ওর দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ও তাড়াতাড়ি লাইনটা কেটে দিল।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে কাল সকাল থেকে। ঘুম থেকে উঠেই চায়ের টেবিলে রঙ্গনার সঙ্গে প্রবল খটাখটি হয়ে গেল। ইস্যুটা খুবই সামান্য : অভিলাষের একটা নীলচে ফুলহাতার শার্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা রঙ্গনাকে জিগ্যেস করতেই ও ঠোঁট উলটে বলে বসল, তো আমাকে কী করতে হবে?
তাতে বিরক্ত হয়ে অভিলাষ বলেছে, কেন, তোমাকে জিগ্যেস করাটা কি অন্যায় হয়েছে?
অন্যায় না হলেও ন্যায়ের বেসিসটাও তো খুব একটা খুঁজে পাচ্ছি না। শার্টটা নিয়ে কি আমি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি? ভুরু উঁচিয়ে একটু তেরছা হাসি ছুঁড়ে দিয়েছে রঙ্গনা। তারপর : তুমি তো জানো, আমার ভাইয়েরা এত কম দামি শার্ট পরে না। দে অলওয়েজ গো ফর সুপারব্র্যান্ডস…।
ব্যস, শুরু হয়ে গেল।
ওদের বিয়েটা প্রেম করে হয়েছিল ঠিকই, তবে রঙ্গনা একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না ওরা ব্যাপক বড়লোক। বিয়ের প্রথম তিন-চার বছরে সেরকম কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুরু হয়েছে পাঁচে পা দেওয়ার পর। ওদের মধ্যে কোনওরকম ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হলেই দু-চার লাইন কথা চালাচালির পর রঙ্গনা ওর সেই গরু রচনায় ফিরে আসে। অভিলাষকে মনে করিয়ে দেয় যে, ওরা টগবগে বড়লোক।
তো সকালের ঝগড়ার প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর অভিলাষের মোবাইলে এসএমএস-টা আসে।
অভিলাষ তখন অফিসে। ল্যাপটপ কম্পিউটারের কিবোর্ডে ওর আঙুল চলছিল। মোবাইল ফোনটা রাখা ছিল একটা পেন ড্রাইভের পাশে। হঠাৎই এসএমএস-এর রিং বেজে ওঠায় কাজ থামিয়ে ও মেসেজটা দ্যাখে। অচেনা নম্বর থেকে আসা এক অদ্ভুত এসএমএস :
Harassed with any nagging problem? Call us, the PROBLEM SOLVER. Were the best.–END GAME (9832100051)
এসএমএস-টার মানে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি অভিলাষ। যে-কোনও ঘ্যাপচানো সমস্যায় ব্যতিব্যস্ত হলে এন্ড গেম সব সমস্যায় সমাধান করে দেবে? যে-কোনও সমস্যা বলতে…ওদের সমস্যায় এলাকাটা ঠিক কতটা বড়? গ্যাসট্রিক আলসার থেকে কিডন্যাপিং বা মার্ডার পর্যন্ত কি?
বলতে গেলে ঠিক তখনই রঙ্গনাকে খুন করার ব্যাপারটা প্রথম ওর মাথায় আসে।
ওদের বিয়েটা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে এখন যে-জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে অনায়াসেই বলা যায়, সম্পর্কটা উচ্ছে, পলতা পাতা, চিরতা, কালমেঘ, কি নিমপাতা সবাইকেই ছাড়িয়ে গেছে।
অভিলাষ মুখে তেতো স্বাদ পেল। এইভাবেই কি কাটবে বাকি দিনগুলো? নাকি…।
হঠাৎই দেখল সুমিতি ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।
সুমিতির সঙ্গে জ্যামিতির যে একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে সেটা ওর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। শরীরের ঠিক-ঠিক জায়গায় ঠিক-ঠিক মাপের বৃত্ত, উপবৃত্ত আর ত্রিভুজ বসানো রয়েছে।
সুমিতির পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি। তার সঙ্গে হালকা ছাই রঙের ব্লাউজ। গলায় একটা সাধারণ কালো পুতির মালা কিন্তু অসাধারণ লাগছে। ওর লম্বা কাঠামোর সঙ্গে বিদেশিনী মডেলদের মিল। গায়ের রংও সেইরকম। এমনভাবে অভিলাষের দিকে হেঁটে আসছে যেন মাটিতে পা পড়ছে না–ভেসে আসছে।
সুমিতি সিস্টেমস রিসার্চ ডিভিশনের প্রজেক্ট লিডার–এবং কোম্পানির অ্যাসেট। ওকে মনে মনে অনেকেই চায়, কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই। কারণ, ওর ব্যক্তিত্ব সহজে ভেদ করা যায় না।
অভিলাষের সঙ্গে কাজের কথা বলতেই এসেছিল সুমিতি। আলতো নরম গলায় ও কথা বলছিল। হালকা পারফিউমের গন্ধ অভিলাষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
কাজের কথা শেষ করে চলে যাওয়ার ঠিক আগে সুমিতি বলল, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করব…?
কী?
মুখটাকে এরকম পাচার মতো করে রাখবেন না। যদিও এত হ্যান্ডসাম প্যাচা আমি আগে কখনও দেখিনি।
সুমিতি ঠোঁটের কোণে হেসে চলে গেল।
অভিলাষের সঙ্গে মাঝে-মাঝে এরকম হালকা মজা করে সুমিতি। হয়তো অভিলাষকে ও কিছুটা পছন্দও করে। কিন্তু শত সাধ থাকলেও অভিলাষ কখনও পা বাড়ায়নি, নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেনি।
কারণ রঙ্গনা। অভিলাষ জানে, ওকে ডিভোর্সের কোনও প্রস্তাব দিলে ও সেটাকে এ-পাড়া থেকে শুরু করে বাপের বাড়ি পর্যন্ত রাষ্ট্র করে ছাড়বে। কথার খোঁচায় অভিলাষকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। কিন্তু ডিভোর্স দেবে না।
রঙ্গনা এইরকম। কারণ, ওর লোভঅর্থ আর শাসনের। অভিলাষের যা-কিছু আছে তার ওপরে দখল রাখতে রঙ্গনা ভালোবাসে, আর অভিলাষের ওপরে দখল রাখতে তার চেয়েও আরও অনেক বেশি ভালোবাসে।
এই দখলদারির বেড়া ভাঙতে চাইছিল অভিলাষ। তা হলেই ও অনেক স্বপ্ন দেখতে পারবে। এমনকী সুমিতিকে নিয়েও।
আরও আধঘণ্টা চিন্তাভাবনার পর অভিলাষ ঠিক করল ৯৮৩২১০০০৫১ নম্বরটায় ও ফোন করবে।
অভিলাষ ফোনটা করেছিল এসটিডি বুথ থেকে, যাতে কলার আইডি দেখে এন্ড গেম ওকে ট্রেস করতে না পারে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও অভিলাষ যেভাবে ঘেমে নেয়ে উঠল তা রীতিমতো লজ্জা পাওয়ার মতন। রঙ্গনা এ-দৃশ্য দেখলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর সেই হাসির এক-একটা কণা ধারালো ছুঁচের ডগা হয়ে ওকে রক্তাক্ত করত।
রঙ্গনা আপাদমস্তক আকাঙ্ক্ষাময় যুবতী। অভিলাষ ওকে কখনওই ঠিকমতো সন্তুষ্ট করতে পারেনিনা দিনে, না রাতে। ওর ছোটখাটো চেহারা আর ছোটখাটো প্রত্যঙ্গ নিয়ে কম খোঁটা দেয়নি রঙ্গনা। অতৃপ্ত অবস্থায় স্বামীর কাছ থেকে বিযুক্ত হওয়ার পর রঙ্গনা প্রায়ই ওকে খোকা মেশিন বলে ব্যঙ্গ করত। বলত, …একে তোমার খোকা মেশিন, তাতে আবার আধখানা গুলি ভরা আছে!
অভিলাষের বুকের ভেতরটা জ্বলতে লাগল। ও ধীরে-ধীরে বুঝতে পারল, ওর ভেতরে একটা খুনি জন্ম নিচ্ছে।
মোবাইল ফোনের এসএমএস-টা বারবার দেখতে লাগল অভিলাষ। আচ্ছা, ন্যাগিং প্রবলেম সভ করতে এন্ড গেম ঠিক কত টাকা নেয়?
.
টুয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরিতে এ ধরনের একটা অফিস ঠিক যতটা আধুনিক হওয়া সম্ভব এন্ড গেম-এর অফিস ঠিক ততটাই আধুনিক।
মোলায়েম ঠান্ডা পরিবেশ। চারিদিকে ধবধবে সাদা আলো–তবে লুকোনো লুমিনেয়ারগুলো চোখে পড়ছে না। মসৃণ আলোর দীপ্তি থাকলেও বিরক্তিকর চোখধাঁধানো ব্যাপার নেই। গোটা অফিসটাই কাচ আর আয়না দিয়ে সাজানো। ফলে অবজেক্ট আর ইমেজ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ইলিউশান তৈরি হয়েছে।
রিসেপশান থেকে প্রায় পুরো অফিসটাকেই দেখতে পাচ্ছিল অভিলাষ। টেবিল, চেয়ার, ফাইলিং ক্যাবিনেট, ল্যাপটপ কম্পিউটার, হলোগ্রাম ক্যালেন্ডার, আরও কত কী!
কাচ আর আয়না ঘেরা সরু-সরু অলিপথ ধরে তরুণ-তরুণীরা ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। তবে কে যে অফিসের স্টাফ আর কে যে ক্লায়েন্ট সেটা একটুও বোঝার উপায় নেই।
হঠাৎই অভিলাষের মনে হল, এন্ড গেম-এর যা ব্যবসা তাতে এই ব্যাপারটা যত গুলিয়ে যায় ততই ভালো। ক্লায়েন্টদের সেফটি আরও জোরালো হবে। তা ছাড়া নানান জায়গায় নানান অ্যাঙ্গেলে দাঁড় করানো আয়নার জন্য সব মানুষের চলাফেরার গতিপথ ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল রাতে আরও দুবার এন্ড গেম-এর অফিসে ফোন করেছিল অভিলাষ। দুবার-ই ও মাঝপথে ফোন কেটে দিয়েছে। কিন্তু তৃতীয়বারে সাহস করে মেয়েটির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা চালাতে পেরেছে।
অভিলাষকে একজন এক্সিকিউটিভের নাম আর মোবাইল নম্বর দিয়েছে মেয়েটি। বলেছে, এখন থেকে হি উইল বি ইয়োর ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। য়ু মাস্ট ডিপেন্ড অন হিম। উই উইল গিভ য়ু ভ্যালু ফর মানি…।
এন্ড গেম-এর অফিসে ঢুকে সেই এফপিজি–মানে, ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইডকে ফোন করল অভিলাষ। সঙ্গে-সঙ্গে আশ্বাসের হাসি, সুপ্রভাত, আর কোনও চিন্তা নেই-এর বন্যা বয়ে গেল। একইসঙ্গে গাইড্যান্সও পাওয়া গেল।
মোবাইল ফোনে পরের পর নির্দেশ দিয়ে অভিলাষকে গাইড করতে লাগলেন তিনি। আয়না আর কাচের গোলকধাঁধায় অভিলাষ অন্ধের মতো পথ খুঁজতে লাগল। বারবার ধাক্কা খেতে লাগল কাচে অথবা আয়নায়। নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে ধাক্কা এড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার নাকাল হল। তারপর, বহু ধস্তাধস্তির পর ও কিউব-১১০১১-এ পৌঁছতে পারল।
তখনই ও ওর এফপিজি-কে প্রথম দেখতে পেল।
বেঁটে চেহারার মোটাসোটা মানুষ। ফরসা, গালে সাহেবদের মতো লালচে আভা। মাথার প্রায় পুরোটাই টাক। চোখে চৌকো কাচের শৌখিন চশমা। চোখজোড়া গোল-গোল। তাতে সবসময়েই একটা অবাক ভাব। নাকের নীচে ছোট চওড়া গোঁফ। আর থুতনির নীচে গলকম্বল।
গোটা অফিসটা এসি হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রলোকের কপালে আর টাকে বিনবিনে ঘাম। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে ঘন-ঘন ঘাম মুছছেন।
এফপিজির চেহারা অভিলাষকে হতাশ করল। এ যে দেখছি বোকা বোকা একটা জোকার! যার সঙ্গে বুদ্ধি বা আই. কিউ.-র কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিলাষ। ভদ্রলোককে কয়েকবার জরিপ করল।
না, ভদ্রলোকের পোশাক বেশ স্মার্ট। ঘিয়ে রঙের ফুলশার্ট। গাঢ় নীল রঙের টাই। আর গাঢ় নীল টেরিউলের প্যান্টের ওপরে সরু-সরু সাদা স্ট্রাইপ।
এফপিজির নাম কমলপাণি। অভিলাষের সঙ্গে হাতমেলানোর সময় শুধু প্রথম নামটাই বললেন তিনি। তারপর ওকে নিয়ে কাচ আর আয়নার ঘেরা একটা কিউবিক্স-এ বসলেন।
অভিলাষ আগেই লক্ষ করেছিল, কিউবিগুলোর নম্বর ডেসিম্যাল নাম্বারে না লিখে বাইনারিতে লেখা। ও যখন এর কারণ ভাবছিল তখন কমলপাণি হাতে হাত ঘষে একটু খসখসে গলায় ওকে জিগ্যেস করলেন, বলুন, স্যার, আপনার ন্যাগিং প্রবলেমটা কী? আপনাকে এটুকু অ্যাশিয়োর করছি, নেচার অফ প্রবলেম যা-ই হোক না কেন, উই উইল সম্ভ ইট ফর গুড।
অভিলাষ আর দেরি করল না। সমস্যাটা ও বলতে গেলে কমলপাণির মুখের ওপরে উগরে দিল।
সমস্যাটা আমার ওয়াইফ। আই ওয়ান্ট টু বাম্প হার অফ–ওকে একেবারে খতম করতে চাই…।
গুড! কমলপাণি চাপা হেসে মাথা নাড়লেন ও আপনার ওয়ে অফ এক্সপ্রেশান আমার ভালো লেগেছে, স্যার। বি ডায়রেক্ট অ্যান্ড টু দ্য পয়েন্ট। সেক্স টাইম। কাচের টেবিলে আলতো করে আঙুলের টোকা মারতে শুরু করলেন কমলপাণি। সাদা সিলিং-এর দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে রইলেন। আস্তে-আস্তে বললেন, ওয়াইফকে…খুন…করতে…চান। তাই তো? চোখ নামালেন অভিলাষের দিকে : মোস্ট কমন প্রবলেম। হ্যাঁ, সভ হয়ে যাবে। তবে মার্ডার করতে চান কোন মোড়ে–ভারচুয়াল মোড, না রিয়েল মোড়?
তার মানে?
দেখুন, আমরা মার্ডার করি দু-ভাবে ইন ভারচুয়ালিটি, অ্যান্ড ইন রিয়েলিটি…।
অভিলাষ ফ্যালফ্যাল করে কমলপাণির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথায় তখনও ভালো করে কিছু ঢুকছিল না। ভারচুয়াল রিয়েল? এসব কী বলছে ওর এফপিজি! তাছাড়া মানুষটা মার্ডার করার ব্যাপারটা এমন মামুলিভাবে উচ্চারণ করেছে যে, অভিলাষের স্পাইনাল কর্ড বেয়ে বরফজলের হিমস্রোত নেমে গেল।
কমলপাণি যতই কথা বলছিলেন অভিলাষ ততই বুঝতে পারছিল বোকা-বোকা জোকার জোকার ভাবটা ওঁর ছদ্মবেশ। ক্ষুরধার বুদ্ধি না থাকলে এন্ড গেম-এর এক্সিকিউটিভ হওয়া যায় না।
..ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে দিই, স্যার… দু-হাত নেড়ে বললেন কমলপাণি, ধরুন, আপনাদের কনজুগাল লাইফ একদম ঘেঁটে গেছে। মানে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা একেবারে বিষিয়ে গেছে মিউঁচুয়াল হেট্রেড ছাড়া আর কিছু বাকি নেই। তখন, ধরুন, আপনি ডিসাইড করলেন যে, আপনার ওয়াইফকে মার্ডার করবেন–এই যেমন আপনি ডিসাইড করেছেন।
আমাদের সাইকোলজি ডিভিশান স্টাডি করে দেখেছে যে, এরকম কেস-এ প্রায় এইটিথ্রি পারসেন্ট মানুষের বেলায় রিয়েল মার্ডারের দরকার হয় না। ভারচুয়াল মার্ডার করলেই কাজ হয়ে যায়। মানে, য়ু গেট ইয়োর হেট্রেড আউট অফ ইয়োর সিস্টেম। তখন স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর রিলেশানটা আবার রিপেয়ার হয়ে যায়। এভরিথিং এস ওয়েল। ঠিক আছে?
ভারচুয়াল মার্ডার মানে? হতবাক অভিলাষ জিগ্যেস করল।
কমলপাণি হাসলেন, ওঁর হুঁড়ি হাসির দমকে কেঁপে উঠল। আঙুলের ডগা খুঁটতে-খুঁটতে তিনি বললেন, ভারচুয়াল মার্ডার মানে নকল খুন। কিন্তু আপনি ভাববেন আসল খুনই হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের কোম্পানির ইনভেনশান ইন্টারন্যাশনাল পেটেন্টও নেওয়া আছে। এর ডিটেইএ এখন যাচ্ছি না–পরে আপনি দেখতেই পাবেন–যদি অবশ্য আপনি ভারচুয়াল মোড়ে যান।
আমাদের কোম্পানির নিয়ম হল, ভারচুয়াল মার্ডার হলে সেটা অবশ্যই ক্লায়েন্টকে নিজের হাতে করতে হবে। আর…ইফ এনিবডি গোজ ফর রিয়েল মোড, এন্ড গেম টেক্স কেয়ার অফ এভরিথিং। ক্লায়েন্টকে কোনও ঝামেলা ঘাড়ে নিতে হবে না। বরং আমরা ক্লায়েন্টকে জবরদস্ত অ্যালিবাই তৈরি করে দেব–পুলিশের বাবাও তাকে সেই মার্ডারের সঙ্গে জড়াতে পারবে না। তা ছাড়া মার্ডারটা আমরা এমনভাবে কমিট করব যে, সেটা একটা পারফেক্ট অ্যাক্সিডেন্টের মতো দেখাবে। এই ধরুন কার অ্যাক্সিডেন্ট, কিংবা মালটিস্টোরিড বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া–এই টাইপের। অ্যাবসোলিউটলি নো উয়ারিজ ফর দ্য ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্টকে শুধু আমাদের প্রপার ফি-টা ক্রেডিট কার্ডে জমা করতে হবে। ব্যস…। ।
ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে অভিলাষকে সব বুঝিয়ে দিলেন কমলপাণি। তারপর ওকে একপৃষ্ঠার একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে দিলেন। বললেন, শুনুন, স্যার, একটা রিকোয়েস্ট আপনাকে করব। তাড়াহুড়ো করে কোনও ডিসিশান নেবেন না। গো হোম। রিল্যাক্স। আপনার স্ত্রী যখন আপনার প্রেমিকা ছিল–আই হোপ শি ওয়াজ–সেইসব মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবুন। ভাবুন আরও মিষ্টি রাতগুলোর কথা। ওহ্! দৌীজ ওয়ান্ডারফুল নাইটক্স!…এমন তো হতেই পারে, ওসব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় আপনার মনে হবে, য়ু ডোন্ট নিড আস অ্যাট অল।
একটা কথা আপনাকে বলি, স্যার–উই ডোন্ট বেগ ফর বিজনেস। যদি আপনি আমাদের হেল্প না নেন, তা হলে আমরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু যদি তিনদিন পর আপনি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসেন তা হলে বুঝতে হবে আপনার ডিসিশানটা জেনুইন। তখন আপনিই ঠিক করবেন কোন মোডে আপনি কাজটা করতে চান-ভারচুয়াল, না রিয়েল। যদি ভারচুয়াল অপারেশানে যান, তা হলে ওয়াইফকে আবার ফিরে পাবেন। আর যদি রিয়েল অপারেশানই আপনার ডিমান্ড হয়, তা হলে..ওয়েল শি উইল বি গন ফর গুড। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন কমলপাণি : তা হলে বাড়ি যান…ভাবুন…তিনদিন পর আমাদের দেখা হবে। সি য়ু…।
.
ফর্মটা ফিল-আপ করার সময় মোডের জায়গায় ভারচুয়াল লিখল অভিলাষ।
গত তিনদিন ধরে অনেক ভেবেছে ও। কমলপাণির কথাগুলো ওকে বেশ নাড়া দিয়েছে। কমলপাণি বলেছেন মিষ্টি দিনগুলোর কথা ভাবতে–যখন রঙ্গনা ওর প্রেমিকা ছিল। মিষ্টি দিন। আরও মিষ্টি রাত।
প্রথম যেদিন ওরা সবচেয়ে কাছাকাছি আসে সেদিন রঙ্গনা কী বলেছিল আজও অভিলাষের মনে আছে।
অভিলাষের ফ্ল্যাটে ওরা দুজনে সন্ধেটা কাটাচ্ছিল। অভিলাষ একটা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। একটু আগেই ওর তৃতীয় পেগ শেষ হয়েছে। মাথায় ঝিমঝিম ভাব, মনের মধ্যে নানান রঙের স্বপ্নের ওড়াউড়ি। মিউজিক সিস্টেমে রঙ্গনার ফেবারিট জিমি এক্স-এর ক্লোজ টু ইয়োর হার্ট বাজছিল। আর রঙ্গনা বসেছিল অভিলাষের হাতের নাগালে।
সুতরাং হাত হাতের কাজ করছিল, মন মনের।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই রঙ্গনা এসে গিয়েছিল অভিলাষের বুকের ওপরে। তারপর, দু-চার প্রস্ত আদরের পর, রঙ্গনা অভিলাষের বুকে মুখ গুঁজে মিনমিনে জড়ানো স্বরে বলেছিল, তোমার নামের মানে জানো?
হ্যাঁ–জানি। নীচু গলায় জবাব দিয়েছিল অভিলাষ।
তা হলে আর দেরি করছ কেন?
না আর দেরি করেনি অভিলাষ।
সেইদিন, আর তার পরের দিনগুলো–নাম অনুযায়ী কাজ করে চলেছিল।
ভাবতে-ভাবতে নরম হয়ে যাচ্ছিল অভিলাষ। আচ্ছা, রঙ্গনা কি নিজেকে একটু বদলে নিতে পারে না? দরকার হয় অভিলাষও নিজেকে একটু-আধটু বদলাবে।
সুতরাং, রঙ্গনার সঙ্গে কথাবার্তায় বা ব্যবহারে সচেতন হয়ে উঠল অভিলাষ। ওর সঙ্গে অতিরিক্ত মোলায়েম সুরে কথা বলতে লাগল, সংঘর্ষ এড়াতে নিজে হার মানল বহুবার।
রঙ্গনা বেশ অবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগল। একসময় তো বলেই বসল, কী ব্যাপার বলো তো? কোনও ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট খেয়েছ নাকি? তোমাকে ভারী পিকিউলিয়ার লাগছে….।
অভিলাষ তাও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর ওর মনটা ধীরে-ধীরে পালটাতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, রঙ্গনাকে আর-একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। দেখাই যাক না!
তাই কমলপাণির কাছে এসে ফর্মে মোডের জায়গায় ও লিখেছে, ভারচুয়াল।
খুব তাড়াতাড়ি সবরকম ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে দিলেন কমলপাণি। চোখ তুলে দেখলেন অভিলাষের দিকে, বললেন, ইট ওয়াজ আ গুড ডিসিশান, স্যার। য়ু উইল ফাইন্ড দ্য ভারচুয়াল মোড় নো লেস এফেকটিভ দ্যান দ্য রিয়েল মোড…।
অভিলাষ শুনল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। শুধু মনে-মনে ও ভারচুয়াল মার্ডারের এফেকটিভনেসটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল।
কমলপাণি অভিলাষের ফ্ল্যাটের ঠিকানা এবং মোটামুটি লোকেশান জেনে নিলেন। তারপর হাতঘড়ির ডায়ালে তারিখ দেখে অভিলাষকে সাতদিন পরের একটা তারিখ আর সময় জানালেন, বললেন, আরও সাতদিন সময় হাতে পেলেন। কিপ ইয়োর কুল। ওইদিন ঘড়ি ধরে চলে আসুন। কমিট দ্য ক্রাইম অ্যান্ড বি হ্যাপি। ও. কে.?
ও. কে.– বলল অভিলাষ।
.
অন্ধকার ঠান্ডা ঘরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে রঙ্গনাকে দেখছিল অভিলাষ।
ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এফপিজি কমলপাণি।
ওদের সামনে একটা বিশাল কাচের জানলা। জানলার ওপাশেই একটা আলো-ঝলমলে বেডরুম–অভিলাষের বেডরুম।
সুন্দর করে সাজানো বেডরুমের মোলায়েম বিছানায় আলুথালুভাবে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে রঙ্গনা। একহাতে ধরা একটা ইংরেজি পেপারব্যাক।
রঙ্গনার গায়ে লেসের কাজ করা গোলাপি রঙের একটা নাইটি। পোশাকটা ঠিকঠাক ওর গায়ে নেই। একটা পা ভাঁজ করা পোশাকটা উঠে গিয়ে হাঁটু এবং ঊরুর খানিকটা দেখা যাচ্ছে। মাথার চুল বালিশের ওপরে ছড়ানো। বাঁ হাতে কোমরের কাছটা চুলকোচ্ছে।
কমলপাণি ফিশফিশ করে বললেন, স্যার, এটা আপনার বেডরুমের হলোগ্রাফিক লাইভ টেলিকাস্ট। আপনি যা দেখছেন সবটাই হলোগ্রাফিক ইমেজ মানে মায়া। আমাদের ক্যামেরা এখন থেকে প্রতিমুহূর্তে আপনার ওয়াইফকে ফলো করবে। এই মুহূর্তে আপনার স্ত্রী ফ্ল্যাটে যা-যা করবেন তার প্রতিটি কণা আমাদের থ্রি-ডি ক্যামেরা সিস্টেম লাইভ টেলিকাস্ট করে আপনাকে দেখাবে…।
অভিলাষের তাজ্জব লাগছিল। কারণ, ওরা ওর ফ্ল্যাট থেকে অনেক দূরে এন্ড গেম-এর অফিসে একটা স্পেশাল রুমে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কমলপাণি বোধহয় অভিজ্ঞতা থেকেই অভিলাষের অবাক হওয়াটা টের পেলেন। চাপা গলায় বললেন, আপনি যা দেখছেন, পুরোটাই ভারচুয়াল রিয়্যালিটি। কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রীকে আপনি যেন সত্যি-সত্যি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন। আসলে যে-কোঅর্ডিনেটে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এগজ্যাকুলি সেই কোঅর্ডিনেটে আপনার ফ্ল্যাটের বেডরুমে একটা জানলা আছে ফ্রস্টেড গ্লাস লাগানো জানলা। আমরা যেন সেই জানলার কাচ সরিয়ে আপনার ওয়াইফের প্রাইভেসিতে ইনভেড করছি। ইটস সো-ও-ও রিয়েল! হঠাৎই কথা থামিয়ে অন্ধকারে অভিলাষকে ছুঁলেন কমলপাণি। চাপা গলায় বললেন, নিন–এটা ধরুন….।
জিনিসটা কমলপাণির হাত থেকে নিল অভিলাষ।
একটা রিভলভার।
আন্দাজে বুঝল, অস্ত্রটার ওজন প্রায় কেজিখানেক হবে।
এটা আপনার মার্ডার ওয়েপন। মডার্ন। ইমপোরটেড। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, মডেল ফোর জিরো জিরো সিক্স। জিরো পয়েন্ট ফোর জিরো ক্যালিবার। ডাল অ্যাকশান। এর ম্যাগাজিনে এগারো রাউন্ড বুলেট আছে। এই হ্যান্ডগানটার নল-টল সব স্টেইনলেস স্টিলের–আর গ্রিপটা ব্ল্যাক, সিনথিটিক। প্রথম কয়েকটা শটে আপনার স্ত্রী-কে মিস করলেও এগারোবার তো আর মিস করবেন না! নিন, এবার রেডি হোন…।
অভিলাষ রিভলভারটা উঁচিয়ে রঙ্গনার দিকে তাক করল। ও অ্যামেচার হলেও এত ক্লোজ রেঞ্জে রঙ্গনাকে মিস করা প্র্যাকটিক্যালি অসম্ভব।
রঙ্গনার সমস্ত খোঁচা, উপহাস আর ব্যঙ্গগুলো মনে পড়ল ওর। খোকা মেশিন…আধখানা গুলি ভরা…। আর এখন। অভিলাষের হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ মেশিন–তাতে এগারোখানা গুলি ভরা আছে।
কাচ সরিয়ে দিলাম কিন্তু! গেট রেডি! কমলপাণির গলা।
অভিলাষের হাত কাঁপছিল। ও মুঠো শক্ত করল বাঁটের ওপর।
সড়সড় শব্দ করে কাচের প্যানেল সরে গেল।
অভিলাষের মাথার মধ্যে খতমের সুর বাজছে।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কমলপাণি বললেন, ওয়ান, টু, থ্রি–ফায়ার!
অভিলাষ ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ফায়ারিং-এর শব্দে ওর কানে তালা লেগে গেল।
প্রথম বুলেটটা রঙ্গনার কোমরে গিয়ে লাগল। ওর হাতের বইটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ও চমকে ফিরে তাকাল জানলার দিকে..অভিলাষের দিকে। ওর অবাক হওয়া মুখটা পলকে ব্যথায় কুঁচকে গেল। কোমর থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। গোলাপি নাইটি লাল হতে লাগল। বিছানায় চাদরও।
অভিলাষ কিন্তু থামেনি। চোখ বুজে পাগলের মতো ফায়ার করেই চলল। রঙ্গনার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত দেখে ওর খুনে মেজাজ যেন আরও চড়ে গেল। ও ভুলে গেল, এটা ভারচুয়াল মার্ডার।
বুলেটের ধাক্কায় রঙ্গনা বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিল। মেঝেতে পড়ে থাকা ওর চিতপাত শরীর আর রক্ত দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, ও আর বেঁচে নেই।
অভিলাষের মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। ও হঠাৎই টলে পড়ে গেল মেঝেতে। কমলপাণি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়লেন ওর ওপরে। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলেন, নাড়ি দেখলেন। তারপর পকেট থেকে নিমপাতার মতো ছোট্ট আর পাতলা একটা মোবাইল ফোন বের করে কথা বললেন, আমি ক্লায়েন্ট নাম্বার ট্রিপল ওয়ান ট্রিপল জিরো ডাল ওয়ানকে নিয়ে ভারচুয়াল মার্ডার এক্সিকিউশান রুমে আছি। ভদ্রলোক সাডেন ট্রমায় সেন্সলেস হয়ে গেছেন। হেল্পলাইনকে অ্যাটিভ হতে রিকোয়েস্ট করছি।
.
অভিলাষ সুস্থ হয়ে উঠল আধঘণ্টার মধ্যেই। ও শুধু রঙ্গনার কথা ভাবছিল। জ্ঞান ফেরার পর কমলপাণি ওকে বারবার আশ্বাস দিয়েছেন যে, রঙ্গনার কোনও ক্ষতি হয়নি। ইট ওয়াজ ওয়ান হান্ড্রেড পারসেন্ট আ ভারচুয়াল মার্ডার।
শি ইজ পারফেক্টলি সেফ অ্যান্ড সাউন্ড। অভিলাষ ইচ্ছে করলে এখনই ওর স্ত্রীকে ফোন করতে পারে।
কিন্তু তবুও অভিলাষের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তাই রঙ্গনাকে ফোনই করল অভিলাষ।
রঙ্গনা—
হু ইজ দিস?
আমি –অভি। তুমি ঠিক আছ তো?
ক পেগ খেয়েছ?
আহ! একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল অভিলাষ। এটাই তো রঙ্গনার ক্যারেক্টারিস্টিক আনসার! দিস প্রক্স শি ইজ অ্যালাইভ অ্যান্ড ও. কে.।
রঙ্গনা, আই লাভ য়ু, বেবি।
কখন বাড়ি ফিরছ?
ঘড়ি দেখল অভিলাষ, বলল, এই ধরো সাড়ে দশটা নাগাদ।
সাড়ে দশটাই কোরো। তার চেয়ে বেশি দেরি যেন না হয়…।
এই কথায় প্রেমিকা রঙ্গনার ছায়া দেখল অভিলাষ। কমলপাণিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কারণ, তিনিই প্রথম ভারচুয়াল মার্ডারের সাজেশান দিয়েছিলেন।
রাস্তায় নেমে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসল অভিলাষ। গাড়ি ছুটিয়ে দিল। রাতের বাতাস ওর গালে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
রাতটা কী সুন্দর! আকাশের চাঁদটাও।
অভিলাষ যখন ওদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় এসে পড়ল তখনই একটা মালবোঝাই ফুল পাঞ্জাব ট্রাক পাগলাঘোড়ার মতো ছুটে এল ওর দিকে।
প্রবল সংঘর্ষের শব্দে নিঃস্তব্ধ রাত থরথর করে কেঁপে উঠল।
ট্রাকটা একটুও না থেমে উদ্দামগতিতে ছুটে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
অভিলাষের গাড়িতে আগুন ধরে গেল। তার একটু পরেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ।
অ্যাকশন ছবির দৃশ্যের মতো অভিলাষের গাড়িটা শূন্যে ছিটকে উঠল, আবার আছড়ে পড়ল রাস্তায়।
রঙ্গনা টেনশানে পায়চারি করছিল। হঠাৎই ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল রঙ্গনা। দশটা চল্লিশ।
তাড়াতাড়ি বোতাম টিপে হ্যালো বলতেই ও-প্রান্ত থেকে রোবটের গলায় একজন মহিলা বলে উঠল, ম্যাডাম, এন্ড গেম থেকে বলছি। আপনার কাজটা হয়ে গেছে। যেমন বলেছিলাম, ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট রোড অ্যাক্সিডেন্ট…। একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায়…।
অবচেতন
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আলতো করে হাত রাখলেন তার পোষা অ্যালসেশিয়ানের লোমশ পিঠের ওপরে। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। বিস্তৃত কপালে উড়ে আসা কয়েকগুচ্ছ রুপোলি চুলকে স্বস্থানে ফেরত পাঠিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন।
আমি পাঁচফুট চওড়া টেবিলের এ-প্রান্তে বসে বলে উঠলাম, ডক্টর, স্বপ্ন হোহাক, দুঃস্বপ্ন থোক– এর মানে কী?
আমার স্বরে উত্তেজনার আভাস পেয়ে কুকুরের পিঠ থেকে হাত তুললেন ডক্টর সমাদ্দার। সাইন পেনটা উঁচিয়ে ধরে সাদা প্যাডের ওপরে কিছু লেখার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, ইফ য়ু ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার রায়, আপনার গল্পটা আমি প্রথম থেকে আর-একবার শুনতে চাই। কাইন্ডলি একটু স্লোলি বলবেন। নিন, শুরু করুন।
আমি, সুদর্শন রায়, চেয়ারে গুছিয়ে বসলাম। ঘরে এয়ারকুলার থাকা সত্ত্বেও মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। ঘর এবং আসবাবপত্রের রং নিষ্কলঙ্ক, সাদা। ডক্টর সমাদ্দারের গায়েও সাদা স্ট্রেচলনের স্যুট। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। হাতের অনামিকায় হিরের আংটি।
একমাত্র ব্যতিক্রম দুশমন : ডক্টর সমাদ্দারের সাড়ে চারফুট লম্বা বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর। ওর রং কুচকুচে কালো। কাচের গুলির মতো চোখদুটো সবসময় ধকধক করে জ্বলছে।
ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে আমি আগেও কয়েকবার এসেছি। কারণ, আমার মাঝে-মাঝে দেখা দুঃস্বপ্নগুলো। তাই দুশমন এবং তার প্রভু, দুজনের সঙ্গেই আমি যথেষ্ট পরিচিত।
আমার আগের দেখা দুঃস্বপ্নগুলো যেমন অবাস্তব, তেমনই উদ্ভট। প্রথম দুঃস্বপ্নে দেখেছি, একটা এরোপ্লেন থেকে আমি একজন পাইলটকে ধাক্কা দিয়ে শুন্যে ফেলে দিচ্ছি। দ্বিতীয় স্বপ্নে দেখেছি জলের তলায় একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আমার মরণপণ যুদ্ধ চলছে। অবশেষে তাকে গলা টিপে খুন করে আমি জলের ওপরে ভেসে উঠছি (এবং একইসঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় উঠে বসেছি)।
দুঃস্বপ্ন হলেও সেগুলো কখন স্থায়ী হয়নি। ক্ষণিকের দেখা, এবং ক্ষণিকেই তা মিলিয়ে গেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার বলেছিলেন, এ-দুঃস্বপ্ন দেখার কারণ মনের অবচেতনে অপরাধ করার সুপ্ত বাসনা–এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ, চিন্তার কোনও কারণ নেই।
এসব ঘটনা প্রায় বছরখানেক আগের।
কিন্তু গত সাতদিন ধরে এক অদ্ভুত ধারাবাহিক স্বপ্ন আমি দেখে চলেছি। যা প্রথমে ছিল অর্থহীন, কিন্তু পরে…।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলাম। রুমাল বের করে চোখ মুছলাম। ডক্টর সমাদ্দার নীরবে আমার কথা বলার অপেক্ষায় রইলেন। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করলাম, ডক্টর, সবকিছুর শুরু লাস্ট মঙ্গলবার। আমি বিয়ে করিনি। শুতে-শুতে রোজই বেশ রাত হয়। সেদিনও রাত হয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসতে আমার কখনও দেরি হয় না। সুতরাং মিনিটকয়েকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ডুবে গেছি। সে-রাতেই অদ্ভুত স্বপ্নটা প্রথম দেখলাম।
দেখলাম, আমি একটা বিশাল বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে ব্যস্ত লোকজন সাদা পোশাকে চলাফেরা করছে। ফ্লুওরেসেন্ট আলো-ঝলমলে তেলচকচকে করিডর ধরে আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি। কাজে ব্যস্ত লোকজন কেউ যেন আমাকে দেখেও দেখছে না। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। সে-ঘরে সাজানো সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে নানান বয়েসের নারী-পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে।
প্রথম দিনের স্বপ্ন এখানেই শেষ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, কিন্তু দ্বিতীয় দিন একই স্বপ্ন আমি আবার দেখেছি। কিন্তু সেদিনের স্বপ্ন আমাকে আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেল। দেখলাম, সেই বিশাল সাদা ঘরটার একপ্রান্তে একটা ছোট দরজা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো যান্ত্রিকভাবে সেই ছোট দরজাটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম।
দরজার চৌকাঠ পেরোতেই নজরে পড়ল একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা হয়তো রান্নাঘর, হয়তো বাথরুম, হয়তো ভঁড়ার ঘর–ঠিকমতো কিছু বলতে পারব না। কারণ, ঘরের শুধুমাত্র ডানদিকের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছে। সেটা একটা সাদা বেসিন। স্টিলের কল থেকে টইটম্বুর বেসিনে টপটপ করে জল পড়ছে। আর আমি যেন নেশার ঘোরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই জল পড়ার শব্দ শুনছি…।
তৃতীয় দিনের স্বপ্নে প্রথম থেকে শুরু করে সেই বেসিন পর্যন্ত আসার পর খেয়াল করলাম, ঘরে আমি একা নই। একজন লম্বা মানুষ, পরনে সাদা ধবধবে আলখাল্লা, বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার মুখে ব্যঙ্গের হাসি। বিশ্বাস করুন ডক্টর, সেই সাদা পোশাক পরা ভদ্রলোকের চেহারা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে! যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার কালো জোড়া ভুরু, টিকোলো নাক, কালো কুচকুচে শৌখিন গোঁফ, ছোট-ছোট চোখ, ফরসা গালের বাঁ-দিকে একটা আঁচিল তিরতির করে কঁপছে।
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার এবার নড়েচড়ে বসলেন। বাঁ-হাতটা দুশমনের পিঠে রেখে বললেন, এক্সকিউজ মি ফর দ্য ইন্টারাপশন, মিস্টার রায়। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। একটা জিনিস আপনার জানা প্রয়োজন। সাধারণত কোনও স্বপ্নে আমরা যখন আমাদের অচেনা কোনও মানুষকে দেখি, তখন চেতনা ফিরে সেই স্বপ্নে দেখা মানুষের চেহারার নিখুঁত বর্ণনা আমরা কখনও দিতে পারি না। ইটস আউট অ্যান্ড আউট ইমপসিবল সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই লম্বা লোকটিকে আপনি আগে কোথাও দেখেছেন। য়ু মাস্ট হ্যাভ সিন হিম সামহোয়্যার। আই অ্যাম শুওর অফ ইট!
আমার পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে সম্ভবত একটা বিহ্বল ভাব ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, মিস্টার রায়। যেটা হওয়া উচিত সেটাই আপনাকে এক্সপ্লেইন করলাম। নাউ গেট অন উইথ ইয়োর স্টোরি বলে চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে সাদা ফ্লানেলে লেন্সদুটো ঘষে নিলেন। তারপর চশমা চোখে দিলেন।
আমি ঘটনা-পরম্পরা একবার ভেবে নিয়ে বলে চললাম, তৃতীয়দিনের স্বপ্ন সেখানেই শেষ। চারনম্বর দুঃস্বপ্ন দেখলাম আরও দু-দিন পরে, এবং আগের মতোই তিননম্বর স্বপ্নের অসমাপ্ত অংশ এবারেও শেষ হল চারনম্বরে গিয়ে।
একটু ইতস্তত করে আবার বলতে শুরু করলাম, ডক্টর, আমাকে দেখে সেই ভদ্রলোক হাসলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস্টার রায়। আই অ্যাম ডক্টর শঙ্করদাস গিরি। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর ডক্টর গিরি ঘুরে গেলেন বেসিনের দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়ালেন কলের সামনে। বাঁ-পাশের ছোট্ট তাক থেকে একটা সাদা রঙের সাবান নিয়ে তিনি মুখে ঘষতে লাগলেন। আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার মুখ ধোওয়া লক্ষ করে চললাম। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেলাম। আমার হাতদুটো যেন অধৈর্য আর চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। শেষে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম ডক্টর গিরির কাছে খুব কাছে। তারপর বিদ্যুঝলকের মতো ক্ষিপ্রতায় বেসিনের ওপর ঝুঁকে থাকা তাঁর মাথাটা চেপে ধরলাম। ডক্টর গিরির শরীরটা ঝটকা দিয়ে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। উনি প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও তারপরেই সর্বশক্তি দিয়ে আমার সঙ্গে যুঝতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর মাথাটা বেসিন-ভরতি জলের দিকে ঠেলে নিয়ে চললাম। আমি পেছনে থাকায় ডক্টর গিরি বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না। একসময় হেরে গেলেন।
ডক্টর গিরির মাথাটা জলে ডুবিয়ে চেপে ধরতেই তাঁর শরীরটা প্রচণ্ড আক্ষেপে কেঁপে উঠতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলল শরীরের ঝটাপটি। একসময় সব থেমে গেল।
দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়ে যখন জেগে উঠলাম, তখন আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। অসহায় চোখে তাকালাম অম্বিকা সমাদ্দারের দিকে। তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাঝে-মাঝে প্যাডের কাগজে কী যেন লিখছেন।
হঠাৎই মুখ তুলে তিনি প্রশ্ন করলেন, তারপর?
আমি মৃদুস্বরে জবাব দিলাম, তারপর, গতকাল, অর্থাৎ, সোমবার, স্বপ্নটা আবার শুরু থেকে দেখতে শুরু করলাম। সেই করিডর, সেই ঘর, সেই ছোট দরজা–অবশেষে ডক্টর গিরির নিথর শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি।
আমি গিরির বডিটা একটা ঘোরের মধ্যে কাঁধে তুলে নিলাম। ওঁর মাথার ভিজে চুল থেকে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে।
আগে খেয়াল করিনি, এখন দেখলাম, ছোট ঘরটার ডানপাশে, বেসিন থেকে কিছুটা এগিয়ে, একটা খোলা দরজা। আমি একটুও ভয় না পেয়ে শঙ্করদাসকে কাঁধে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের বা জুলছিল। সেটা পেরোতেই চোখে পড়ল একটা ছোট দরজা। দরজা খুলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে অন্ধকার খোলা মাঠ। দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি একটুও না থেমে হেঁটে চললাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না।
একসময় দেখলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কয়েকটা বড় বড় গাছ। কী গাছ জানি না। শঙ্করদাসের দেহটা ঘাসছাওয়া মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। তারপর একটা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। কোদালটা কোত্থেকে যে আমার হাতে এল বলতে পারি না।
মাটি খোঁড়া শেষ হল। সেই গর্তে ডক্টর গিরিকে আমি শুইয়ে দিলাম। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, তাঁর চোখদুটো কোটর ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ওঁর ডানহাতের শক্ত মুঠোয় ধরা রয়েছে সেই সাদা সাবানটা।
কেমন একটা ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। তাড়াহুড়ো করে গর্তে মাটি ঢালতে লাগলাম। একসময় ভরাট হল গর্ত। কোদালটা হাতে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসছি, তখনই আমার নজরে পড়ল, ডক্টর গিরির ডানহাতটা কবরের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। সে-হাতের শক্ত মুঠোয় তখনও ধরা রয়েছে সাদা সাবানটা। আমি ভয় পেয়ে খোলা মাঠ ধরে ছুটতে শুরু করলাম। কোদালটা কোথায় হারিয়ে গেল জানি না…।
একটু পরেই দেখি, আমি সেই বিশাল ঘরটায় দাঁড়িয়ে। যে-ঘরে সারি-সারিভাবে স্প্রিং এর খাট সাজানো রয়েছে। ঘরে একটা নীল রঙের আলো জ্বলছে। সাদা চাদরে ঢাকা মানুষগুলোকে পেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। দেখলাম, একেবারে শেষে একটা খাট খালি। কোনও লোক সেখানে শুয়ে নেই। আমি বাধ্য শিশুর মতো গিয়ে সেই ধবধবে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চাদরে ঢেকে ফেললাম আমার শরীর। ক্রমশ ঘুমে চোখ বুজে এল…।
স্বপ্নটা এখানেই শেষ, ডক্টর। আমার গলার স্বর যেন আশঙ্কায় কেঁপে উঠল । কিন্তু আজ দুপুরে ঘুমের মধ্যে আবার এই একই স্বপ্ন। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিছানায় শোওয়া পর্যন্ত, আবার দেখলাম। আমার ভয় হচ্ছে, এবার থেকে হয়তো এই দুঃস্বপ্নটা রোজ রাতে আমাকে দেখা দেবে।
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার ডানহাত আর বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল পরস্পরের মাথায় চুঁইয়ে কয়েকমুহূর্ত নীরব রইলেন। আপনমনেই বারকয়েক মাথা নেড়ে বললেন, আপনার অনুমান ভুল নয়। আমারও বিশ্বাস এ-দুঃস্বপ্ন রোজ রাতে আপনাকে দেখা দেবে। আপনার স্বপ্ন নিয়ে আমাকে দুটো দিন ভাবার সময় দিন। তারপরই আমি আপনাকে এর রিমেডি জানাব। আজ তা হলে।
আমি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গুনে-গুনে চৌষট্টি টাকা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। ডক্টর সমাদ্দার মাথা ঝুঁকিয়ে বিলটা লিখতে লিখতে বললেন, আপনি বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় আসুন। আর এর মধ্যে যদি ওই নাইটমেয়ার আবার দেখেন তা হলে আমাকে জানাবেন, কেমন?
ইয়েস, ডক্টর। বিলটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে পকেটে ভরলাম। যথাক্রমে দুশমন এবং তার প্রভুর সঙ্গে নজর মিলিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। স্প্রিং-এর দরজা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।
সিঁড়ি নামতে নামতে মনের আয়নায় ভেসে উঠল শঙ্করদাস গিরির মুখ। এবং পরক্ষণেই যেন দেখতে পেলাম কবরের বাইরে বেরিয়ে থাকা তাঁর সাবান-ধরা ডানহাতটা…।
.
বৃহস্পতিবার বিকেল ঠিক পাঁচটায় ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে হাজির হলাম। আমাকে দেখে পরিচিতের হাসি হেসে তিনি বসতে বললেন। দুশমন যথারীতি তার প্রভুর পাশে বসে। ডক্টর সমাদ্দারকে জানালাম তাঁর অনুমানই ঠিক। এই দু-দিনে সেই স্বপ্ন আমি আরও দুবার দেখেছি।
উত্তরে মনের বক্তব্যকে যেন গুছিয়ে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। মাথার রুপোলি চুলে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, মিস্টার রায়, এ দু-দিন আমি আপনার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। তাতে যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তার খানিকটা আমি আগেরদিনই আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। অর্থাৎ, ডক্টর শঙ্করদাস গিরিকে আপনি সত্যি-সত্যি কোথাও-না-কোথাও দেখেছেন।
আমি বিহ্বলভাবে মাথা নাড়লাম।
ডক্টর সমাদ্দার বলে চললেন, তা ছাড়া আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। মিস্টার রায়, কখনও কি আপনি কোনও হসপিটাল, নার্সিং হোম বা মেন্টাল হোমে ছিলেন?
আমি স্পষ্টস্বরে জবাব দিলাম, হ্যাঁ, ছিলাম। সামান্য মেন্টাল প্রবলেম হওয়ার জন্যে আমাকে মাসখানেক মাইথনের একটা মেন্টাল হোমে কাটাতে হয়।
কবে?
গতবছর শীতে।
সেই মেন্টাল হোমের নাম আর অ্যাড্রেস আপনার মনে আছে?
আছে। আমি নাম ও ঠিকানা বললাম।
প্যাডের কাগজে সেটা টুকে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। তারপর বললেন, এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন : স্বপ্নে দেখা সেই বাড়ির সঙ্গে মাইথনের সেই হোমের কি কোনও মিল আছে? ভালো করে ভেবে জবাব দিন।
অত ভাবার দরকার নেই, ডক্টর বিনা দ্বিধায় জবাব দিলাম, অনেকটাই মিল আছে।
তা হলে আমার অনুমানই ঠিক। ধীরে-ধীরে বললেন অম্বিকা সমাদ্দার, কারণ, বাড়িটার এমন বর্ণনা আপনি দিয়েছেন, যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় কোনও হসপিটাল বা নার্সিং হোমের। সুতরাং, এখন আপনার উচিত মাইথনের সেই মেন্টাল হোমে যাওয়া, এবং স্বপ্নে দেখা ব্যাপারগুলো মিলিয়ে নেওয়া। যেমন ধরুন, সত্যিই শঙ্করদাস গিরি নামে কোনও ডক্টর সেখানে আছেন কিনা। অথবা সেই জঙ্গল, মাঠ–সত্যিই এসবের কোনও অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে কিনা। তা হলেই আপনার কনশাস আর সাবকনশাস মাইন্ডের গরমিলগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে আপনার খোঁজখবরের রেজাল্ট আমাকে জানাতে ভুলবেন না, কেমন?
আলোচনা-শেষের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু আমি বসেই রইলাম। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললেন না। অভিব্যক্তিতে একটি নীরব প্রশ্নচিহ্ন ফুটিয়ে অপেক্ষায় রইলেন।
ডক্টর, আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। একটু ইতস্তত করে বললাম, মাইথনে আমার সঙ্গে আপনাকেও আসতে হবে। ওখানে একা যেতে হলে আমি খুব শেকি ফিল করব। ইফ য়ু ডোন্ট মাইন্ড–এ জন্যে আপনার ফিজ যা লাগে আমি দেব। প্লিজ, ডক্টর, প্লিজ, আমার সঙ্গে আপনি চলুন। একটা দিনের তো ব্যাপার!
ডক্টর সমাদ্দার কয়েকমিনিট চুপ করে রইলেন। কী যেন ভাবলেন মনে-মনে। অবশেষে মুখ খুললেন, আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি, মিস্টার রায়, কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া একটু প্রবলেম। আমার চেম্বার রয়েছে, রয়েছে দুশমন, তা ছাড়া।
আপত্তি করবেন না, ডক্টর। অনুনয়ের সুরে বললাম, প্লিজ, একটা দিন আপনি আমার জন্যে সময় দিন। বললাম তো, আপনার প্রপার ফিজ আমি নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। প্লিজ।
কিন্তু দুশমন? দুশমনের পিঠে হাত রাখলেন ডক্টর সমাদ্দার, আমাকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না। আমি ছাড়া কারও কথা ও শোনে না, কারও হাতে খাবার খায় না।
মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, ওকেও তা হলে সঙ্গে নিন। আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ডক্টর, প্লিজ, ওখানে আমাকে একা যেতে বলবেন না।
ডক্টর সমাদ্দার দুশমনের লোমশ কালো পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, আপনার কথাই থাক। দুশমনও আমাদের সঙ্গী তোক। তারপর দুশমনের পিঠে চাপড় মেরে গেট রেডি, দুশমন, কাল আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।
উত্তরে দুশমনের হিংস্র দাঁতের ফাঁক থেকে একটা চাপা গরগর শব্দ ভেসে এল।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ডক্টর। আবেগে ডক্টর সমাদ্দারের হাত চেপে ধরলাম। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভিজিট-এর চৌষট্টি টাকা তুলে দিলাম তাঁর শীর্ণ হাতে। বললাম, তা হলে আগামীকাল দুপুরের ট্রেনে আমরা রওনা হচ্ছি।
মৃদু হেসে ঘাড় হেলালেন অম্বিকা সমাদ্দার।
ওঁর চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম।
*
মাইথনের সেই মেন্টাল হোমের দরজায় যখন পৌঁছোলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ছটা।
বর্ষার শেষ এবং শরতের শুরু। হয়তো সেই কারণেই বেলাশেষের আলোটুকু পশ্চিমপ্রান্তে অদৃশ্য হওয়ার আগে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধাগ্রস্ত আমিও। এই নির্জন পরিবেশে দাঁড়িয়ে সেই দুঃস্বপ্ন যেন ফিরে আসছে বারবার।
সদর দরজায় লাগানো নামের ফলকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম, ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দারের স্বরে চমক ভাঙল, মিস্টার রায়, অকারণে সময় নষ্ট করে লাভ কী? চলুন, ভেতরে যাওয়া যাক।
অতএব আমরা এবং দুশমন–তিনজনেই পা বাড়ালাম অন্দরমহলের দিকে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় নির্জন ধু-ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটায় আলো জ্বলছে। সারি সারি জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলো যেন মাঝপথেই অন্ধকারের কাছে হার মেনে থমকে দাঁড়িয়েছে। চোখে এসে পড়ছে শুধুমাত্র তাদের মলিন আকৃতিটুকু।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই টানা করিডর। তার দুপাশে কিছুদূর পরপর পরদাটাকা দরজা। দরজার মাথায় সাইনবোর্ডের মতো বেরিয়ে থাকা কাঠের ফলকে অফিস, এনকোয়ারি, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইত্যাদি স্পষ্ট ইংরেজি হরফে লেখা। করিডরে নজরে পড়ছে সাদা-পোশাকে ফিটফাট কর্মীদের আনাগোনা।
করিডর ধরে অফিসরুমে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে অনুসরণ করলেন ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার। সঙ্গে দুশমন।
অফিস বলতে যা বোঝায়, ঘরটা ঠিক তাই। একেবারে নিখুঁত।
খুঁত শুধু টেবিলের ওপারে বসে থাকা ভদ্রলোকের ডানচোখে। চোখটা কালো প্যাঁচ দিয়ে ঢাকা। হয়তো কোনও দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ল, গত শীতে এঁকে আমি দেখিনি।
আমাদের বসতে অনুরোধ করে তিনি প্রশ্ন করলেন, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
জবাব দিলেন ডক্টর সমাদ্দার। যদিও প্রশ্নটা করা হয়েছিল আমাকে লক্ষ্য করেই। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার নাম ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার, সাইকিয়াট্রিস্ট। মিস্টার সুদর্শন রায় আমার পেশেন্ট। গতবছর, শীতের সময়, ইনি আপনাদের কেয়ারে কিছুদিন ছিলেন। এখন এঁর ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে আপনাদের একটু কোঅপারেশান দরকার–যেমন, প্রথমে মিস্টার রায়কে নিয়ে এই গোটা বিল্ডিংটা আমি একবার ঘুরে দেখতে চাই। তারপর–।
ডক্টর সমাদ্দারকে বাধা দিয়ে আমি বলে উঠলাম, এক্সকিউজ মি, এখানে ডক্টর শঙ্করদাস গিরি নামে কেউ আছেন?
শঙ্কর-দাস-গিরি? নামটা আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করলেন ভদ্রলোক। তারপর বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন।
পরক্ষণেই সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন বেয়ারা দরজায় এসে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে একচক্ষু ভদ্রলোক আদেশ করলেন, ভাটিয়াসাব কো সেলাম দো–।
মিনিটকয়েক নীরবতার পর বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। বারদুয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একচক্ষু ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন, হোয়াট্স দ্য ম্যাটার, মিস্টার মহাজন?
আসুন, মিস্টার ভাটিয়া। ইশারায় তাকে চেয়ারে বসতে বললেন মহাজন : এঁরা জানতে চাইছেন শঙ্করদাস গিরির কথা। আমি তো এখানে নতুন, তাই ভাবলাম, খবরটা আপনিই ভালো দিতে পারবেন।
ভাটিয়া চেয়ারে বসলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, দেখুন, ডক্টর শঙ্করদাস গিরির ব্যাপারটা একটু মিস্টিরিয়াস। মাসছয়েক আগে, গত শীতে, হঠাৎই একদিন তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বহু চেষ্টা করেও তার কোনও খবর আমরা পাইনি।
আমার হাত-পা থরথর করে কঁপতে লাগল। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেন আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করল। শরীরে রক্তের চাপ হঠাৎ বেড়ে ওঠায় ভাটিয়ার আর কোনও কথা আমার কানে ঢুকল না। শুধু শঙ্করদাস গিরির নিখোঁজ হওয়ার খবরটা আমার মাথার ভেতরে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল।
ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন, বি স্টেডি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
নিজেকে সামলে নিয়ে দেখি ভাটিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। মহাজন আমাদের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে। ডক্টর সমাদ্দার তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। দুশমনও উঠে পড়ল।
ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ডক্টর সমাদ্দার মহাজনকে জানালেন তাঁর খুব বেশি হলে আধঘণ্টা সময় লাগবে।
করিডর ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। এক-এক পা এগোচ্ছি আর আমার বুকের ঢিপঢ়িপ শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার কিন্তু নির্বিকার। দুশমনও নীরবে তার প্রভুকে অনুসরণ করে চলেছে।
মিনিটতিনেক হাঁটার পর চোখে পড়ল, আর-একটা করিডর আড়াআড়িভাবে প্রথম করিডরকে কেটে এগিয়ে গেছে। সেই চৌরাস্তায় পৌঁছে আমি একবার ডানদিকে এবং বাঁ-দিকে তাকালাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ডানদিকে এগোলাম। ডক্টর সমাদ্দারও আমাকে অনুসরণ করলেন।
কয়েক পা যেতেই বাঁ-দিকে একটা খোলা দরজা আমার নজরে পড়ল। দরজা পেরোতেই একটা বিশাল ঘর। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সাজানো রয়েছে সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে বিভিন্ন বয়েসের পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে খানিকটা করে ঢাকা। দেখে তাদের অসুস্থ বলেই মনে হচ্ছে।
বিশাল ঘরটায় ডানকোণে একটা ছোট দরজা দেখে আমি একটুও অবাক হলাম না। কারণ, এখন বুঝতে পারছি, এরপর কোন-কোন দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ছোট দরজা লক্ষ করে এগিয়ে চললাম। পেছনে অম্বিকা সমাদ্দার ও দুশমন।
ছোট দরজায় দাঁড়িয়ে আমার আর ডক্টর সমাদ্দারের চোখাচোখি হল। কারণ, দরজা পেরিয়েই একটা ছোট ঘর। সেই ঘরের ডানদিকে রয়েছে আর-একটা দরজা, আর দরজার পরে দেওয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে একটা ধবধবে সাদা বেসিন। সেটা জলে টইটম্বুর। কল থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল টপটপ করে বেসিনে পড়ছে। বেসিনের বাঁ-পাশে ছোট তাকে একটা সাবান রয়েছে । তার রং নীলসাদা নয়।
এবার আমি সম্মোহিতের মতো ডানদিকের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকালাম না। কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলাম ডক্টর সমাদ্দারের ভারী বুটের শব্দ।
সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেটার শেষ প্রান্তে একটা খাটো দরজা। দরজাটা ভেজানো ছিল, আমি সেটা খুলে বাইরের অন্ধকার খোলা মাঠে পা রাখলাম।
অন্ধকারের মধ্যেই দুরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি অক্লান্ত পায়ে হেঁটে চললাম। গন্তব্যস্থল কোথায় জানি না।
হঠাৎই পায়ের কাছে একটা আলোর বৃত্ত দেখে চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে দেখি ডক্টর সমাদ্দার পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বেলেছেন। এই ঘন অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলা দুশমনকে স্পষ্টভাবে নজরে পড়ছে না।
আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বলে উঠলেন অম্বিকা সমাদ্দার, মিস্টার রায়, একমিনিট। আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আপনার স্বপ্নের সঙ্গে এইসব মিলে যাচ্ছে?
আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা ঝাঁকালাম।
ডক্টর সমাদ্দার থমকে দাঁড়ালেন। আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম তাঁর মুখোমুখি।
আমার মনে হয়, আপনার অন্য স্বপ্নগুলোর মতো এটাও আপনার কল্পনা। শুধু এই হোমের পটভূমি আপনার কল্পনাকে স্বপ্নে গড়ে তুলতে হেল্প করেছে, তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং, আমার মনে হয়, আর সময় নষ্ট না করে আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো। বাড়ি ফিরে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করুন, ঘুরে বেড়ান, দেখবেন দু-দিনেই ওই নাইটমেয়ার কোথায় মিলিয়ে গেছে। সো, লেটস গো ব্যাক–
ডক্টর সমাদ্দার ঘুরে দাঁড়াতেই আমি চাপা গলায় বলে উঠলাম, নো ডক্টর, নেভার। আমি এর শেষ দেখতে চাই।
অন্ধকারে সমাদ্দারের অভিব্যক্তি আমার নজরে পড়ল না। শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শেষ মানে? ও. কে.–অ্যাজ য়ু উইশ। কাম অন, দুশমন–
আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।
আচ্ছন্নের মতো চলতে-চলতে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভিজে হাওয়ার ঝাপটা আমার চোখে-মুখে ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে চেয়ে দেখি কয়েকটা বড়-বড় গাছ : কী গাছ জানি না। তারই মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পায়ের কাছে টর্চের আলোর বৃত্তে নজরে পড়ল ঘাসে ছাওয়া মাটি।
আমাকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অম্বিকা সমাদ্দার কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দুশমনের চাপা হিংস্র গর্জন তাকে থামিয়ে দিল। দুশমন আমাদের ছাড়িয়ে চট করে কিছুটা এগিয়ে গেল। ছটফটে পায়ে ফাঁকা জায়গাটাতে পায়চারি করতে লাগল।
আমার বুকের ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা যেন পাকে-পাকে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে।
দুশমনের গর্জন একটু জোরালো হল। অন্ধকারে ওর আবছায়া শরীরটা ঘাস-ছাওয়া জমিতে নড়াচড়া করছে।
কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম নড়াচড়া নয়, দুশমন প্রাণপণে মাটি আঁচড়াচ্ছে।
ডক্টর সমাদ্দারের টর্চ-ধরা হাত কেঁপে উঠল। তারপর গিয়ে স্থির হল দুশমনের কালো বিশাল শরীরের ওপরে। ওর তীক্ষ্ণ থাবার আঁচড়ে ওপরের ঘাস ছিঁড়ে নীচের মাটি ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে।
মাত্র কয়েকমিনিট। তারপরই যে-দৃশ্য দুশমন দেখাল, তাতে আমি অবাক না হলেও ডক্টর সমাদ্দার চমকে উঠলেন। তাঁর মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। গর্জন করে উঠল দুশমন। আমি নিশ্চপ, নিথর। ডক্টর সমাদ্দারের টর্চের আলো খাবলানো মাটির ওপরে থরথর করে কাঁপছে। তবুও দেখতে আমাদের কোনও অসুবিধে হল না। স্পষ্ট দেখলাম, সামান্য খোঁড়া মাটি থেকে বেরিয়ে রয়েছে পচে যাওয়া একটা হাত। সে-হাতের কোনও-কোনও জায়গায় সাদা হাড়ের আভাস নজরে পড়ছে। আর সেই বিধ্বস্ত হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ময়লা সাদা সাবান।
অমানুষিক হাত
সকলে মিলিয়া বাসর জাগিতেছিলাম।
এই বাসর-জাগরণ অনুষ্ঠানে আমার মতো পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের সম্ভবত স্থান হইবার কথা নহে, কিন্তু বরপক্ষের একান্ত অনুরোধ ও দলবদ্ধ আড্ডার প্রতি আমার অনমনীয় আকর্ষণ এড়াইতে পারি নাই। বরপক্ষের একান্ত অনুরোধের একটি বিশেষ কারণ ছিল। কীরূপে যেন তাহারা জানিতে পারিয়াছিল আমার কণ্ঠসঙ্গীত তাবৎ কোকিল জাতিকে নিমেষে ব্রীড়াময় করিয়া তুলতে পারে। যদিও আমার স্ত্রী মালতী ওই মতের ঘোরতর বিরোধী, তবুও বাহিরের অভ্যাগতদের সম্মুখে নিজের স্বামীর প্রশংসা শুনিয়া সর্বসমক্ষে তাহার মত আর জাহির করে নাই। পরিবর্তে আমার কানের নিকটে মুখ লইয়া আসিয়া বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে এই কথা কয়টি উচ্চারণ করিয়া দ্রুতগতিতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছে।
বিবাহ আমার কনিষ্ঠা শ্যালিকা মাধবীর। অন্যান্য তিন শ্যালিকা অপ্রত্যাশিত তৎপরতায় নিজ-নিজ স্বামীগৃহে রিজার্ভেশন পাইলেও মাধবীকে তিনটি বৎসর ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখাইয়া রাখিতে হইয়াছিল। অবশেষে প্রজাপতির নির্বন্ধে ও মাধবীর পিতা-মাতার অনলস প্রচেষ্টায় কলিকাতা হইতে এই যমুনাপুর নামক অজ পাড়াগাঁয়ে ইঞ্জিনিয়ার পাত্র শ্রীমান চন্দ্রমোহন বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে এই ঘোরতর শীতকালে হ্যাজাক লন্ডনের আলোয় বিবাহকার্য সুসম্পন্ন করিতে আসিয়াছে।
এখন রাত্রি প্রায় বারোটা। অতএব বিবাহ এবং নিমন্ত্রণের পাট শেষ করিয়া সকলেই শয্যাভিমুখী হইয়াছে। বরযাত্রীদের অন্য বাড়িতে শয়নের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল–কেবলমাত্র চন্দ্রমোহনের তিন বন্ধু ও জনৈক আত্মীয় বিশ্বনাথবাবু বাসর-ঘরে চন্দ্রমোহনকে সঙ্গ দিতে থাকিয়া গিয়াছেন। কন্যাপক্ষের একমাত্র পুরুষ প্রতিনিধি আমি স্বয়ং, ইহা ছাড়া যে কয়েকজন বালিকা, কিশোরী ও তরুণী ঘরে উপস্থিত, তাহারা মৌমাছির ন্যায় মধুভাগুরূপ মাধবীকে ঘিরিয়া নানান জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত। কেবল মধ্যে-মধ্যে তাহাদের হাস্যরোল ও কলগুঞ্জন কানে আসিতেছে।
চন্দ্রমোহন ও তাহার তিন বন্ধু আমার সহিত অনেক গল্প করিলেও বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ করিলাম একেবারে নিশ্চুপ। শুধু প্রয়োজনমতো আমাদের বক্তব্য সমর্থন করিতেছেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় আমারই সমান। শান্ত দুইটি চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখে এক অদ্ভুত প্রচ্ছন্ন দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞার ছাপ। জুলপির চুলে বোধ করি তাঁহার অজ্ঞাতসারে পাক ধরিয়াছে। পরনের ধুতি পাঞ্জাবিকে বেষ্টন করিয়া সাদা রঙের লোভনীয় কাশ্মীরি শাল। অভিব্যক্তিতে অস্বস্তি ও বিষণ্ণতা আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুদের সহিত বিশ্বনাথবাবুকে আমি ঠিক মিলাইতে পারিতেছি না। যেন সিঁড়ি-ভাঙা কোনও সরল অঙ্কের উত্তর বারংবার ভুল হইয়া যাইতেছে।
আমার কৌতূহলী দৃষ্টি ও দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব সম্ভবত চন্দ্রমোহনের দৃষ্টি এড়ায় নাই। সুতরাং উপযাচক হইয়া সে আমাকে বিশ্বনাথবাবুর পরিচয় দিল। কহিল, সমীরদা, বিশ্বনাথদা আমার পিসতুতো ভাই–বলতে গেলে এক মহাপুরুষ। সারা ভারতের আনাচেকানাচে বহু ঘুরেছেন। ওঁর ঝুলিতে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। তা ছাড়া খুব ভালো হাত দেখতে জানেন…।
উত্তরে বিশ্বনাথবাবু মাথা নীচু করিয়া সলজ্জ হাসিলেন। মৃদু কণ্ঠে বলিলেন, তেমন কিছুই না, বই পড়ে শেখা বিদ্যে–
ভদ্রতাবশে আমার ডান হাতটি তাঁহার সম্মুখে বাড়াইয়া দিলাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত করিয়া তিনি আলোয়ানের ফাঁক হইতে নিজের ডান হাতখানি সামান্য বাহির করিলেন। আমার হাত টানিয়া লইয়া তাহাতে মনোনিবেশ করিলেন। অতঃপর চশমাটি ঈষৎ বিন্যস্ত করিয়া বলিলেন, আপনার ভাগ্যরেখা খুব ভালো। সচরাচর দেখা যায় না।
অনুভব করিলাম, বিশ্বনাথবাবুর হাতটি অত্যন্ত কর্কশ। অনুমান হয়, তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ। তাহার কথার জবাবে কহিলাম, সে তো নিশ্চয়ই, নইলে মালতীর মতো বউ পেয়েছি!
চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা হাসিয়া উঠিল। বিশ্বনাথবাবু আরও যোগ করিলেন, আপনার যশ-রেখাও ফ্যালনা নয়।
চন্দ্রমোহন কহিল, তাও তো হ্যাঁজাকের আলোয় ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ইলেকট্রিকের আলোয় আরও জোরদার দেখাত।
চন্দ্রমোহনের এক বন্ধু, অবিনাশ, আক্রমণাত্মক সুরে কহিল, দাদা, আর ছাড়ছি না। নিন, শুরু করুন। একটা অভাবনীয় সংগীতের মূর্ঘনায় আমাদের মূর্ছা ঘটিয়ে বিশ্বনাথদাকে প্রমাণ দিন যে আপনার যশ-রেখা সত্যিই জোরদার।
ব্যস, এইটুকুই যথেষ্ট। অতএব সকলের পীড়াপীড়িতে গান ধরিলাম ।
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান…।
বান যখন মধ্যপথে, তাহাকে বাধা দিল মালতী। লক্ষই করি নাই, কখন সে দরজার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এক্ষণে তাহার দশম বর্ষীয়া একমাত্র কন্যাসহ ঘুমাইয়া পড়িবার কথা। অতএব চন্দ্রমোহন যখন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিল, তখন স্বভাবতই অবাক হইলাম। গান থামিল। সকলের দৃষ্টিতেই নীরব প্রশ্ন ফুটিয়া উঠিল। মালতী সমস্ত কিছু উপেক্ষা করিয়া মৃদু কণ্ঠে আমাকে ডাকিল, একটু শুনবে?
আদেশ নীরবে পালন করিলাম। আমি নিকটে আসিলে সে ফিশফিশ করিয়া কহিল, আমার সীতাহারটা খুঁজে পাচ্ছি না!
লক্ষ করিলাম, তাহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। স্বাভাবিক। কারণ সীতাহারটি একাধারে আমাদের বিবাহের যৌতুক, মালতীর মাতৃবংশের ঐতিহ্যবাহী এবং সাড়ে নয় ভরি সোনায় তৈয়ারি। সর্বোপরি, উহা যে পুনরায় গড়াইয়া দেওয়া আমার ন্যায় চাকুরিজীবীর পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব, ইহা মালতী ও আমি উভয়েই সবিশেষ জানি।
প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, কন্যাকে ঘুম পাড়াইয়া সে যখন নিত্যকার অভ্যাসমতো শয়নের আগে কানের দুলজোড়া খুলিয়া আলমারিতে রাখিতে যায়, তখনই সবিস্ময়ে লক্ষ করে যে, সীতাহারটি যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। বিস্ময়ের কারণ, আলমারি সর্বদাই চাবিবন্ধ থাকে, এবং খুলিবার সময় মালতীকেও চাবি ব্যবহার করিতে হইয়াছে। বন্ধ আলমারি হইতে হার চুরি! এ ঘটনা যেমন অভিনব, তেমনই আশঙ্কাজনক। আলমারিতে টাকাপয়সাও ছিল, কিন্তু তাহাতে হাত পড়ে নাই।
আমাদের দুজনের নিম্নই আলোচনা যখন অপর সকলের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইবার মতো যথেষ্ট হইয়াছে, এবং আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সর্বশেষ সীমায় পৌঁছিয়াছি, তখন চন্দ্রমোহন প্রশ্ন করিল, কী হয়েছে, দাদা?
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া পড়িলাম। এই ঘটনা ব্যক্ত করিয়া বর ও বরযাত্রীদের ব্যতিব্যস্ত করিয়া লাভ কী? কিন্তু সীতাহার-শোকে বিহ্বলা মালতী নিজেকে সংবরণ করিতে পারিল না। প্রায় কঁদো কঁদো হইয়া কহিল, দ্যাখো না ভাই, আলমারি থেকে আমার বিয়েতে পাওয়া সাড়ে নভরির সীতাহারটা চুরি গেছে। অথচ আলমারিটা তালাবন্ধ ছিল। তা ছাড়া, ঘণ্টাখানেক আগেও হারটা আমি দেখেছি।
ঘরে যেন বজ্রপাত হইল। সকলের মনোযোগ মুহূর্তে আকৃষ্ট হইল মালতীর দিকে। হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোছায়ায় সকলেরই মুখমণ্ডলে ত্রাস ও বিস্ময়ের লুকোচুরি খেলা।
চন্দ্রমোহন হঠাৎই অস্বাভাবিক গম্ভীর স্বরে বলিল, বিশ্বনাথদা–।
বিশ্বনাথবাবু মুখ তুলিলেন। তাহার বিষণ্ণ মুখমণ্ডলে জটিল চিন্তার অসংখ্য রেখা। যেন ম্লান হ্রদের জলে মাছ-ধরা জাল বিছানো রহিয়াছে। তিনি চন্দ্রমোহনের সম্বোধনের কোনও জবাব দিলেন না। বরং পালটা প্রশ্ন করিলেন, আমি কি এই ঘর ছেড়ে এর মধ্যে বেরিয়েছিলাম?
একটু আগে বাথরুমে গেলে না?
ও..হ্যাঁ…। বিশ্বনাথবাবু স্বস্তির সুরে কহিলেন, ঠিকই বলেছিস, চাঁদু, আমার খেয়াল ছিল ।
কথা শেষ করিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
আমাদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছিল। চন্দ্রমোহন ও বিশ্বনাথবাবুর কথোপকথন কেমন অদ্ভুত হেঁয়ালি মিশ্রিত, রহস্যময়।
রহস্যের গভীরতা দ্বিগুণ করিয়া বিশ্বনাথবাবু আমার স্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। হয়তো হারটা খুঁজে বের করে দিতে পারব।
মালতীকে লইয়া ঘর ছাড়িবার পূর্বে বিশ্বনাথবাবু আমাকে প্রশ্ন করিলেন, এখানে কাছাকাছি কোথাও পুকুর আছে?
আমি বললাম, বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা ছোট ডোবা আছে।
যাক, তা হলে বেশি দূর যেতে হবে না। এই কথা বলিয়া বিশ্বনাথবাবু আমার স্ত্রী-কে একটি টর্চ বা লণ্ঠন আনিতে অনুরোধ করিলেন।
মালতী টর্চ লইয়া আসিলে অপর একজন মহিলা সঙ্গীসহ তাহারা দুইজন সীতাহার অনুসন্ধানের কাজে নিষ্ক্রান্ত হইল।
আমি যৎপরোনাস্তি হতভম্ব হইয়া চন্দ্রমোহনের নিকটে আসিয়া পুনরায় আসন গ্রহণ করিলাম। লক্ষ করিলাম, চন্দ্রমোহনের মুখভাবে অপরাধবোধের ছায়া। সে মাথা নীচু করিয়া নীরবে হাতের নখ খুঁটিতেছে। তাহার বন্ধুরা অপ্রস্তুত হইয়া পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। মাধবীকে ঘিরিয়া যে-মধুমক্ষিকার গুঞ্জন শুরু হইয়াছিল, তাহাও এখন স্তব্ধ। সীতাহার-দুর্ঘটনা কম-বেশি সকলকেই আঘাত করিয়াছে।
মিনিট কুড়ি পরে বিশ্বনাথবাবু ফিরিলেন। সঙ্গে মালতী। তাহাকে দেখিয়াই বুঝা যায় অভিযান সফল হইয়াছে। বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ করিয়া সে কহিল, আপনি হাত-পা ধুয়ে নিন। বাথরুমের দেওয়ালের দড়িতে গামছা টাঙানো আছে।
বিশ্বনাথবাবু দরজার নিকট হইতে চন্দ্রমোহনকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, হারটা পাওয়া গেছে, চাঁদু। পুকুরপাড়েই ছিল। আমি হাত-পা ধুয়ে আসছি। তিনি বাথরুম অভিমুখে রওনা হইলেন।
আমি উঠিয়া মালতীর নিকটে আসিলাম। সে অস্ফুট কণ্ঠে যাহা বিবৃত করিল তাহার সারমর্ম এই : টর্চ হাতে করিয়া বিশ্বনাথবাবুই পুকুরপাড়ের সর্বত্র অনুসন্ধান করিয়াছেন। মালতী অত্যন্ত সাহসী। সুতরাং এক মুহূর্তের জন্যও সে ভয় পায় নাই। কিছুক্ষণ অনুসন্ধানের পর একস্থানের মাটি যথেষ্ট আলগা বলিয়া মনে হওয়ায় মালতীর হাতে টর্চ দিয়া বিশ্বনাথবাবু স্বয়ং মাটি খুঁড়িতে শুরু করেন। আপনমনে শুধু একবার উচ্চারণ করেন, জানতাম, এখানেই এনে লুকোবে।
অতঃপর অল্প সময়ের মধ্যেই সীতাহার স্বমহিমায় প্রকাশিত হইয়া পড়ে এবং তাহারা ফিরিয়া আসে।
এমন সময়, যাঁহাকে লইয়া আলোচনা, তিনি উপস্থিত হইলেন। বিশ্বনাথবাবুকে দেখিয়া সকলের কৌতূহল সীমা ছাড়াইবার উপক্রম করিল। মালতী চলিয়া যাইতেছিল, বিশ্বনাথবাবু তাহাকে ডাকিলেন, গম্ভীর স্বরে কহিলেন, মালতীদেবী, যাবেন না। আসুন, এ-ঘরে বসুনকথা আছে।
তাহার স্বরে এমন কোনও প্রচ্ছন্ন জাদু ছিল, যাহাতে মালতী নীরবে সেই আদেশ পালন করিল। আমিও ঘরে আসিয়া বসিলাম। বিশ্বনাথবাবু আমার নিকটে বসিলেন। দেখিলাম, তাহার ধবধবে ধুতির শরীরে কাদার ইতস্তত কলঙ্ক লাগিয়াছে। কাশ্মীরি শালটিও পুরাপুরি রক্ষা পায় নাই। যে নীরব প্রশ্ন ও কৌতূহল আমি এ পর্যন্ত সকলের দৃষ্টিতে দেখিয়াছি, সম্ভবত তাহা বিশ্বনাথবাবুর নজরে পড়িল। তিনি উপস্থিত সকলের মুখের উপর পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া হঠাৎই মালতীকে লক্ষ করিয়া বলিলেন, মালতীদেবী, হারটা যে আপনি পেয়েছেন, সবাইকে দেখান।
বিস্মিত মালতী শাড়ির আঁচল খুলিয়া হারটি বাহির করিল এবং ঘরে উপস্থিত সকলের নিকট দৃশ্যমান হয় এমনভাবে উহা তুলিয়া ধরিল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হ্যাঁজাকের ছায়া-পরিম্নান আলোয় বিদ্ধ হইয়া সীতাহারটি ঝকমক করিয়া উঠিল।
মালতী হারটি পুনরায় যথাস্থানে বাঁধিয়া রাখিলে বিশ্বনাথবাবু কহিলেন, সমীরবাবু, একমাত্র চঁদুর সম্মান রক্ষার জন্যেই মালতীদেবীকে সীতাহারটা সকলকে দেখাতে অনুরোধ করলাম। তা ছাড়া, এই হার চুরিতে, আর বিশেষ করে তার উদ্ধারে, আপনারা সবাই যে ভীষণ অবাক হয়েছেন, তা বেশ বুঝতে পারছি। বিশ্বনাথবাবু একটু থামিলেন। চন্দ্রমোহনকে কিয়ঙ্কাল নিরীক্ষণ করিলেন। তাহার মুখমণ্ডলে এখন সামান্য স্বস্তির আভাস পাওয়া যাইতেছে। সে নতুন বর, ফলে তাহার সঙ্কট ও লজ্জা সর্বাপেক্ষা অধিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন সেই সঙ্কট ও লজ্জার মেঘ অদৃশ্য হইয়া চতুর্দশীর চাঁদ স্বস্তির ইঙ্গিত বহন করিয়া প্রকাশিত হইয়াছে। বিশ্বনাথবাবু আমাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, এই চুরি ও তার বিচিত্র আবিষ্কারের পেছনে আরও বিচিত্র এক কাহিনি আছে। কখনও সে কাহিনি কাউকে বলিনি। কিন্তু আজ বলব। কারণ, এর আগে কখনও আজকের মতো এমন অসম্মানজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। আপনারা বরপক্ষের লোকদের চোর ভেবে বসে থাকবেন, এটা চাদুর পক্ষে খুব একটা সম্মানের নয়।
আমি তাহার কথার প্রতিবাদে সৌজন্যমূলক কিছু একটা বলিতে মুখ খুলিতেই বিশ্বনাথবাবু বাধা দিলেন, বিব্রত হওয়ার কিছু নেই, সমীরবাবু। যা সত্যি, তাই বলছি। একটু আগেই চাঁদু বলছিল, আমি নাকি এক মহাপুরুষ– বিশ্বনাথবাবু হাসিলেন, পুনরায় কহিতে লাগিলেন, তা মহাপুরুষ আমি না হতে পারি, কিন্তু ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ঘুরে বহু মহাপুরুষের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি।
বর্তমানে আমি লোহার ব্যাবসা করলেও বছর কয়েক আগে পর্যন্ত কাঠ নিয়েই ছিল আমার কারবার। তখন আমি চাকরি করতাম–আধা-সরকারি চাকরি বলতে পারেন। সরকারের ইজারা নেওয়া বিভিন্ন জঙ্গলে যখন গাছ কাটা হত, তখন আমি তদারকিতে থাকতাম। আর এই কাজেই আমাকে দেশের আনাচেকানাচে গিয়ে ডেরা বাঁধতে হয়েছে।
বছর তিনেক আগে ঝাড়গ্রামে আমাকে যেতে হয় অফিসের কাজে। সেখানে তখন শালগাছ কাটার মরশুম চলছে। ফলে অফিসের কাজ শেষ হতেই আমার কাঁধে তুলে দেওয়া হল পুরোনো দায়িত্ব। অর্থাৎ, জঙ্গলে গিয়ে গাছ কাটার সময় তদারকির কাজ করতে হবে। কর্তার ইচ্ছা, অতএব কর্ম না করে উপায় নেই। উপস্থিত হলাম গিয়ে জঙ্গলের তাঁবুতে। যে-অফিসারটি সরেজমিনে ছিলেন, আমাকে দেখেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সব দায়-দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়ে সোজা রওনা হলেন দেশে। কালই নাকি চিঠি এসেছে, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী হাসপাতালে ভরতি হয়েছেন। ফলে আমি পড়লাম ফ্যাসাদে। তখনও বুঝিনি, কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে।
তাঁবুতে ক্যাম্বিসের খাট, বিছানা, ছোট টেবিল, হ্যারিকেন, পথ-ভুলে-চলে-আসা শেয়াল বা হায়েনার জন্যে শক্তপোক্ত লাঠি–সবকিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে দেখলাম। আমি বাউণ্ডুলে ব্যাচিলার মানুষ–কোনও অবস্থাকেই আর ভয় পাই না। সুতরাং তাঁবু আমার কাছে রাজবাড়ি বলে মনে হল। দেখলাম, ঝাড়গ্রামের প্রচণ্ড মশাকে প্রতিরোধ করার জন্যে একটা মশারির ব্যবস্থাও রয়েছে। আর কী চাই!
বিশ্বনাথবাবু এক মুহূর্ত থামিলেন। ঘড়ি দেখিলাম, রাত দেড়টা। চন্দ্রমোহন তাঁহার নিকট অনুমতি লইয়া একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিল। দেখাদেখি অবিনাশও তাহার অনুসরণ করিল। বিশ্বনাথবাবু ধূমপানের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখান করিয়া পুনরায় বলিতে শুরু করিলেন, যে-ছেলেটা তাঁবুতে আমার ফাইফরমাশ খাটত, সে ছিল স্থানীয় আদিবাসী। নাম ঝুমনা। বয়েস বছর ষোলো। কালো তেলতেলে রোগা চেহারা। কর্মঠ এবং চটপটে। জঙ্গলে যারা গাছ কাটে তারাও ওই আদিবাসী দলেরই, এবং তাদেরই একজনের–পরে জেনেছি, তার নাম রমেশকীরকম যেন আত্মীয় হয় ছেলেটা। সুতরাং ঝুমনা আমার কাছে যেন দেবদূত হয়ে দেখা দিল। ওপরওয়ালার অযাচিত আশীর্বাদ।
এহেন কর্মে সুপটু ছেলেটার একটা খারাপ অভ্যেস ক্রমে ক্রমে ধরা পড়তে শুরু করল। আমার গলায় একটা বিছেহার সব সময় পরা থাকত–শুধু রাতে ওটা আমি খুলে রাখতাম গলায় ফুটত বলে। একদিন সকালে বিছানা ছেড়ে রোজকার অভ্যেসমতো হাত বাড়িয়েছি পাশের ছোট টেবিলটার দিকে–এবং বিছেহারটা না পেয়ে চমকে উঠেছি। চমকে ওঠার দুটো কারণ আছে : এক, হারটা সোনার। দুই, ঝাড়গ্রামের মতো এই সঙ্গীবর্জিত নির্জন গ্রামে এসে কলকাতার মতো শহুরে চোরের উৎপাত পাব, আশা করিনি। অবাক হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়টা কেটে যেতেই মনে স্বাভাবিক প্রশ্নটা জেগেছে : কে চুরি করল হারটা? ঝুমনা? বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু পরিস্থিতি নিরুপায়। সুতরাং ওকে ডেকে সরাসরি হারটার কথা জিগ্যেস করলাম, এবং ও যথারীতি উচ্চস্বরে জটিল ভাষায় জানাল, হারটার কথা ও কিছুই জানে না। আমাকে তখন চুপ করে যেতে হল। কারণ, কোনও প্রমাণ আমার হাতে নেই।
সেইদিনই গাছ ফেলার সময় রমেশের কানে আমি কথাটা তুললাম। ও কিন্তু আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী বিস্মিত হল না, বরং বিড়বিড় করে বলল, ও কি চুরি করছ্যা? কু-দেবতা ভর করছ্যা বটে!… এরপর ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল।
দ্বিতীয় চুরিটা হল দিন চারেক পরেই। এবারের শিকার পাঞ্জাবির সোনার গিলটি করা বোতাম। ঘটনা ও পরিণতি প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি–এতটুকু তফাত নেই। কিন্তু এরপর থেকে আমি সতর্ক হলাম। ছেলেটাকে যথাসম্ভব চোখে-চোখে রাখতে শুরু করলাম। রসুল নামে যে আরদালিটি কাগজপত্র নিয়ে প্রতিদিন জঙ্গল-আপিস করত, সে একদিন আমাকে জানাল যে, আগের যে-বাবু ছিলেন, তারও নাকি একটা আংটি চুরি গিয়েছিল–কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। রসুল আরও বলল, বাবু, জেনে রাখবেন, এ ওই ঝুমনা ছোকরারই কাজ।…দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমাকে মনে-মনে রসুলের কথায় সায় দিতে হল। এমনিতে এই আদিবাসী লোকগুলো খুব সৎ, সাদামাঠা আর সরল। শিক্ষাদীক্ষা ও সভ্যতার বিষ এখনও ওদের ছোবল দিতে পারেনি। কিন্তু তারই মাঝে আশ্চর্য ব্যতিক্রম এই কিশোর।
তৃতীয় চুরির সময় ঝুমনা হাতেনাতে ধরা পড়ল। আমিই ধরলাম। সকালে উঠে হাত-মুখ ধুতে তাঁবুর বাইরে বেরিয়েছিলাম। ফিরে গিয়ে দেখি আচমকা আমার সামনাসামনি পড়ে গিয়ে ঝুমনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে। যেন এক পাথরের মূর্তি। ওর একটা হাত তখনও আমার বালিশের তলায় ঢোকানো। অর্থাৎ, কীভাবে ও জানতে পেরেছে আমার হাতঘড়িটা বালিশের তলায় রেখেই আমি শুয়ে থাকি, এবং সেটা সরানোর সুযোগ পেয়ে বিন্দুমাত্রও দেরি করেনি।
আমাকে দেখেই ও সরাসরি ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার পায়ে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। চিৎকার করে বলতে লাগল, হাই বাবু, গড় করি, মোকে ছেঁড়া দে! ই কাজ আর হবেক লাই! আর হবেক লাই! বিশ্বাস কর, এ মোর দোষ লয়! কু-দেবতা আছে বটে!.. কিন্তু আমি ওকে আর ক্ষমা করতে পারি না। বিশেষ করে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরে। তা ছাড়া ওর কু-দেবতার কথা আমার বিশ্বাস হয় না। নির্ঘাত নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই ছেলেটা ওই কু-দেবতার ধুয়ো ধরেছে। সুতরাং যা করণীয় তাই করলাম…।
বিশ্বনাথবাবু থামিলেন। লক্ষ করিলাম, ইত্যবসরে মাধবীর জনপ্রিয়তা যথেষ্টই ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। তাহার গুণমুগ্ধ সকলেই, বয়সের সীমারেখা নির্বিচারে, বিশ্বনাথবাবু, অথবা তাঁহার কাহিনির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে নববধূ মাধবীকেও বিশেষ বিচলিত বলিয়া বোধ হইল না, কারণ সেও বর্তমানে একই কাহিনি-স্রোতে অতি-মনোযোগে সন্তরণশীল।
আমি বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, ছেলেটাকে কী করলেন? পুলিশে দিলেন?
না, পুলিশে নয়–দিলাম ওদের সর্দারের হাতে। বিশ্বনাথবাবু উত্তর দিলেন, জঙ্গলে যেসব আদিবাসীরা গাছ কাটে, ওদের টাকাপয়সা কাজিয়া সব কিছুর সমাধান করে দেয় ওদের সর্দার বিজয় কাহার। বিজয় কাহারের বয়েস পঞ্চান্ন-ষাট হবে। মাথায় যেকটা চুল আছে সবই সাদা। পেটানেনা সমর্থ চেহারা বয়েস অনুমানে ভুল করিয়ে দিতে চায়। ঝুমনাকে নিয়ে আমি তার হাতেই তুলে দিলাম। একে-একে বললাম, হার, বোতাম ও ঘড়ি চুরির চেষ্টার কথা। বিজয় আমাকে তাঁবুতে ফিরে যেতে বলল। বলল, ছেলেটার ঘাড় থেকে ও ভূত নামিয়ে ছাড়বে। আমি তাবুতে ফিরে এলাম। মনে-মনে ঝুমনার জন্যে একটু যে কষ্ট হল না, তা নয়। কে জানে, ওরা বেচারা ছেলেটাকে কী শাস্তি দেবে!
তাঁবুতে ফিরে এসে বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করলাম। আমার অনেক সাধের ঘড়ি। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবা কিনে দিয়েছিলেন। রোল্ডগোল্ডের কেস, সঙ্গে সুদৃশ্য বাদামি চামড়ার ব্যান্ড। সুইজারল্যান্ডে তৈরি বিদেশি ঘড়ি। পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ইচ্ছে করলে ওটাতে অ্যালার্ম বাজানোর ব্যবস্থা করা যায়। এমনি দামের চেয়েও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ওটার দাম আমার কাছে অনেক বেশি। কারণ, ঘড়িটা আমাকে উপহার দেওয়ার মাস তিনেক পরেই থ্রম্বসিসে বাবা মারা যান। ঘড়ি নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতেই বাতাস কেটে আছড়ে পড়া চাবুকের প্রথম সপাং শব্দটা আমার কানে এল।
ঝুমনার শাস্তি শুরু হয়েছে। পরপর শোনা যাচ্ছে চাবুকের শব্দ ও পরক্ষণেই ঝুমনার কিশোর কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সে-চিৎকার অমানুষিক। শত হলেও বিজয় সর্দারের এই শাস্তি বরদাস্ত করা যায় না। ঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে বেরিয়ে এলাম তাঁবুর বাইরে। শব্দ ও চিৎকার লক্ষ করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললাম। পায়ের তলায় শুকনো শালপাতার পাঁজর ভাঙার শব্দ আমাকে এতটুকু অমনোযোগী করতে পারল না। অসংখ্য শালগাছের গোলকধাঁধা পার হয়ে অবশেষে ঘটনাস্থলে পৌঁছোলাম।
সম্প্রতি গাছ কাটার ফলে পরিষ্কার হয়েছে এমন একটা জায়গায় সব আদিবাসীরা জটলা করে দাঁড়িয়ে। ওরা পরস্পরের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় চাপা গলায় কীসব বলাবলি করছে। একজন আদিবাসী একটা শালগাছের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তার হাতে লম্বা সরু একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি। এটাকেই আমি চাবুক ভেবেছিলাম। আর সেই শালগাছের গোড়ায় গাছের গুঁড়িকে বেড় দিয়ে ঝুমনার দু-হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। কাছেই দাঁড়িয়ে বিজয় কাহার। সে চিৎকার করে এক-একটা সংখ্যা গুনছে আর সপাং করে কঞ্চির বাড়ি গিয়ে পড়ছে ছেলেটার হাতে–যে-হাত দিয়ে ও চুরি করেছে। ঝুমনার হাত কেটে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। মনে হল, হাত দুটো যেন বেশ ফুলেও উঠেছে।
আমি চিৎকার করে বিজয়কে থামতে বললাম। ও চমকে ফিরে তাকাল আমার দিকে। যে আদিবাসীটি বিজয়ের নির্দেশে কঞ্চির আঘাত করছিল, সে-ও থেমে গেল। একবার আমার দিকে একবার বিজয়ের দিকে দেখতে লাগল । অর্থাৎ, সে এখন কী করবে? কার কথা শুনবে? পরক্ষণেই বিজয় ইশারায় তাকে থামতে বলল। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে যা বলল তার সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় ও বাবু, একে আমি একশো বেত মারার শাস্তি দিয়েছিলাম, সবে আঠেরোটা হয়েছে– তাও আস্তে-আস্তে মেরেছে। আর আপনিই এখন শাস্তি দিতে বারণ করছেন? তা হলে ছেলেটার চুরির ব্যারাম সারাব কী করে?…তবুও আমার অনুরোধে বিজয় সর্দার গজগজ করতে করতে ঝুমনাকে ছেড়ে দিল। ওর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। রক্তাক্ত হাত নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল ছেলেটা।
এখানেই এ-কাহিনির শেষ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হল না। কারণ সেইদিনই সন্ধ্যায় সারাদিনের কাজ শেষ করে হিসেবপত্রের পাট চুকিয়ে ক্যাম্পখাটে শরীর এলিয়ে একটা গল্পের বইয়ের পাতায় চোখ বুলোচ্ছি, তাঁবুর দরজায় একটা খসখস শব্দ পেয়ে চমকে তাকালাম। কষ্ট হলেও হ্যারিকেনের আলোয় ঠাহর করতে অসুবিধে হল না। ঝুমনা। সকালের ঘটনার পর এই ওকে প্রথম দেখলাম। ও দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইল, ও ভিতরে আসতে পারে কি না। তারপর অনুমতি পেয়েই ভিতরে এসে সটান আমার পা জড়িয়ে ধরল। কৃতজ্ঞতা জানাল সকালে শাস্তির হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছি বলে। আমার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে ও যা বলল, তাতে বুঝলাম, এর মধ্যেই ওর হাত দুটো ভীষণ ছটফটে অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ওপর যদি হাত দুটোকে মারধোর করা হয়, কাটা-ছেঁড়া করা হয়, তা হলে মরিয়া হয়ে ওরা যে কী করবে বলা মুশকিল।…ওর দু-গাল বেয়ে অঝোরে নেমে এল অশ্রুর ধারা।
হাঁটুতে দু-হাত রেখে ছেলেটা বসেছিল। আমার নজর পড়ল ওর হাত দুটোর দিকে। হ্যারিকেনের আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে দেখলাম। হাত দুটোকে দেখে কোনও বৃদ্ধের বলে মনে হয়। কুৎসিত কদাকার বড়-বড় আঙুলের গাঁট। খসখসে ভাঁজ পড়া চামড়া। নখগুলো মোটা বাঁকানো, তাতে আবার কালচে ছোপ। শিরাগুলো ফুলে উঠে পার্চমেন্ট কাগজের মতো চামড়াকে থেকে-থেকে উঁচু-নীচু করে দিয়েছে। অবশ্য সকালের শাস্তির জন্যেও শিরাগুলো ফুলে উঠতে পারে।
জলভরা চোখ নিয়ে ঝুমনা বলল, এ আমার হাত নয় বাবু। এ আমার শরীরের কেউ লয়। কিন্তু আমার আর কুননা পথও লাই। তোকে তো আগেও বলেছি, অথচ তুই বিশ্বাস করিসনি। তোকে দিব্যি করে বলেছি, এসব চুরি এই হাত দুটো নিজে নিজে করে–আমি জানতেও পারি না।
বলাবাহুল্য, ওর কথা আমার এখনও বিশ্বাস হল না। ওকে বললাম, এসব কথা আর চিন্তা না করাই ভালো। কারণ, ও চুরি করেছিল এবং তার শাস্তিও পেয়ে গেছে।
ঝুমনা ওর হাত দুটো আমার কাছে তুলে ধরল : তুই নিজের চোখেই দ্যাখ, বাবু, এ আমার হাত লয়। তবে তুকে কথা দিচ্ছি, এরা আর চুরি করবেক নাই। তোর বিছেহার, বোতাম, সব এরাই চুরি করেছে। আগের বাবুর আংটিও এরা লিয়েছে। সোনার জিনিসে এদের বেশি লোভ। তবে সোনার জিনিস না পেলে হাতের কাছে যা পায়, তাই চুরি করে।
ওকে প্রশ্ন করলাম, তাই নাকি? আর কী চুরি করেছে এরা?
ও বলল, অনেক জিনিস। প্লেট, চামচ, রুমাল, সাবান…।
ওগুলো নিয়ে কী করেছিস?
মাটিতে পুঁতে রেখেছি। বেশিরভাগ সময়েই এই হাত দুটো যা চুরি করে, নিয়ে গিয়ে কোনও পুকুরপাড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলে। জঙ্গলের বাইরে যে-বড় দিঘিটা আছে, তারই পাড়ে সমস্ত জিনিস পোঁতা আছে। তোকে আমি জায়গাটা দেখিয়ে আনতে পারি। বিশ্বাস কর, একটা জিনিসও আমি বিক্রি করিনি। ওরা চুরি করে সব মাটিতে পুঁতে রাখে।
বলছিস তা হলে তোর কোনও দোষ নেই?
না! এ আমার হাত নয়!
তবে কার হাত?
নতুন করে কান্নায় ভেঙে পড়ল ঝুমনা। লজ্জায় মাথা নীচু করে অস্ফুট স্বরে বলল, আমার বাবার হাত।
কিন্তু রমেশ যে বলছিল, তোর বাবা মারা গেছে?..আমি ভীষণ অবাক হলাম।
হ্যাঁ, আমার জন্মের আগেই বাবা মারা গেছে।..ঝুমনা উত্তর দিল।
কী করে মারা গেল?
বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে সর্দারের হুকুমে।
হয়তো বিজয় কাহারের আগে যে-সর্দার ছিল তারই আদেশে। কিন্তু কেন? সে-প্রশ্ন ঝুমনাকে করতেই ও মাথা নীচু করল। আস্তে-আস্তে বলল, চুরির জন্যে, বাবু।…তারপর মুখ তুলে সরাসরি তাকাল। আমি আবার চোখ ফেরালাম ওর হাতের দিকে।
হাত দুটোর কদাকার-কুৎসিত চেহারা সত্যিই অতুলনীয় এবং ষোলো বছরের একটা ছেলের পক্ষে হাত দুটোর বয়েস অনেক বেশি। কিন্তু এগুলো যে ওর হাত নয়, ওর কথা না শুনে স্বাধীনভাবে কাজ করে বেড়ায়, একথা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। এ-গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। লক্ষ করে দেখি, ঝুমনা তখনও কাঁদছে।
বিশ্বনাথবাবু ঈষৎ থামিয়া ঘরের পরিবেশ নিরীক্ষণ করিলেন। ছোটরা প্রায় সকলেই তন্দ্রা অথবা নিদ্রায় আংশিক অথবা পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন। মাধবীও নিস্তার পায় নাই। কিন্তু আমি ও মালতী যতখানি সজাগ ততোধিক কৌতূহলী। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা গম্ভীর হইয়া নিবিষ্ট মনে বিশ্বনাথবাবুর কাহিনি শুনিতেছে। সম্ভবত বর্তমান ঘটনার সহিত ইহার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যোগাযোগের সূত্রটি নির্ণয়ের চেষ্টা করিতেছে। আমি বিশ্বনাথবাবুকে লক্ষ্য করিয়া প্রশ্ন করিলাম, তারপর? তারপর কী হল?
তিনি কহিলেন, ছেলেটাকে বললাম, এবার থেকে টুকিটাকি কিছু দরকার হলে যেন। আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সে বারবার করে প্রতিজ্ঞা করল, পুরোনো ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। সে একটা হেস্তনেস্ত করবেই করবে। তারপর হঠাৎ বলল, বাবু, আমাকে একটা বাক্স দিবি?
অফিসে কাঠের স্যাম্পেল পাঠানোর জন্যে মাঝারি সাইজের একরকম পিচবোর্ডের বাক্স আমরা ব্যবহার করতাম। তারই কয়েকটা তাবুর এক কোণে স্তূপাকারে পড়ে ছিল। সেদিকে আঙুল দেখিয়েই অনুরোধটা ঝুমনা করেছে। নির্বিবাদে একটা বাক্স ওকে দিয়ে দিলাম। তা দিয়ে ও কী করবে ও-ই জানে! বাক্সটা নিয়ে ও ছুটে বেরিয়ে গেল তাবু থেকে। মিলিয়ে গেল জঙ্গ লের গভীরে।
পরদিন খুব সকালে তাঁবুর বাইরে থেকে একটা হইচই গণ্ডগোলের শব্দ শুনতে পেলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেই এক ভয়ংকর দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। ঝুমনা আচ্ছন্নের মতো টলছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কবজি ও কনুইয়ের মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওর হাত দুটো কেউ কেটে নিয়েছে, আর রক্তাক্ত ভোতা প্রান্ত দুটো কাদামাটি মাখা ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে টপটপ করে তখনও ঝরে পড়ছে কাঁচা রক্ত। সে-নৃশংস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।
সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানকার এক তরুণ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে সঙ্গে-সঙ্গে ভরতি করে দেওয়া হল। রমেশ একসময় আমার পাশে এসে বলল, কু-দেবতার অভিশাপেই নাকি এমনটা হয়েছে।…ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম। আদিবাসীরা রোজকার মতো জঙ্গলে কাঠ কাটতে লেগে গেল। কিন্তু ঝুমনাকে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা দুশ্চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে সরাতে পারলাম না।
বিকেল হতে না হতেই হাসপাতালে রওনা হলাম ওকে দেখতে। ওর কাটা হাত দুটোয় এখন নতুন করে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তরুণ ডাক্তারটি আমাকে আশ্বাস দিল, রক্তপাত প্রচুর হয়েছে, তবে বিশেষ ভয় নেই। ও সেরে উঠবে। আমাকে দেখেই ঝুমনা ব্যান্ডেজ করা হাত দুটো উঁচিয়ে ধরল আমার মুখের সামনে। যেন হাত দুটো কেটে ফেলায় ও ভীষণ খুশি হয়েছে এবং একই সঙ্গে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু কে কাটল ওর হাত দুটো? কেমন করেই বা কাটল? একটু পরেই সে-প্রশ্নের উত্তর পেলাম।
ওকে জিগ্যেস করলাম, এসব কেমন করে হল রে, ঝুমনা? কে এ কাজ করল?
ও জবাব দিল, এ আজ নয় কাল আমাকে করতেই হত, বাবু। তোকে কথা দিয়েছি, আর আমি চুরি করব না। সে কথা রাখতে গেলে হাত দুটো কেটে ফেলা ছাড়া আর পথ কোথায়? এ-হাত যে আমার নয়! এদের আমি বিশ্বাস করি কেমন করে?
বুঝলাম, যা হয়েছে, ওর সম্মতিতেই হয়েছে। ওকে বললাম, এ তোর ভুল ধারণা। তোর শরীরের সবই তো তোর, অন্য কারও কি হতে পারে? কিন্তু এ কাজ করল কে?
উত্তরে ও জানাল, জঙ্গলের শেষে যে বোঙার মন্দির আছে, তার গুনিন রতন মাণ্ডি এ কাজ করেছে। কারণ সে হাত দুটোকে আগে থেকেই চিনত।
কী করে চিনল?–আমি জানতে চাইলাম।
আগেও এই হাত দুটো সে দেখেছে, ঝুমনা উত্তর দিল, অনেক বছর আগে…সে আমার বাপকে চিনত…।
এরপর কথা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কোনও ওষুধ নেই। সুতরাং ডাক্তারবাবুকে ওর দিকে নজর রাখার অনুরোধ করে আমি চলে এলাম। চলে আসার সময়েও শুনলাম ঝুমনা বলছে, আর আমার কোনও দুঃখ নেই রে, বাবু। আমার চোখে আর জল আসবে না।…কিন্তু দেখলাম, একথা বলার সময় ওর চোখ জলে ভেজা। হয়তো এর কারণ ওর শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। ডাক্তারবাবুর মতে ওর এখন প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন। কারণ, যে-পরিমাণ রক্তক্ষরণ ওর হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। অন্তত মাসখানেক সময় তো লাগবেই।
সে-রাতে একরকম বিষণ্ণ মনেই শুতে গেলাম। মশারির ভিতরে শুয়ে উথালপাতাল দুশ্চিন্তা করতে করতে শুনতে লাগলাম বাইরের উড়ন্ত মশার মিহি গুঞ্জন। এবং একসময় ঘুমিয়েও পড়লাম।
ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক খসখস শব্দে। মনে হল, তাঁবুর গায়ে বাইরে থেকে কেউ যেন আঁচড় কেটে চলেছে। আর মাঝে-মাঝে টোকা মারার ভেঁতা শব্দ। হয়তো কোনও পাচা কিংবা বাদুড় পথ ভুলে তাঁবুর গায়ে এসে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? মশারি ভেদ করে তাঁবুর খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের খোলা আকাশ ও সেখানে মেঘের আস্তরণে ঢাকা ঘোলাটে পূর্ণিমার চাঁদ। আর তার কিছুটা নীচেই শুরু হয়েছে আঁকড়া-মাথা শালগাছগুলোর অন্ধকার ছায়াপ্রাচীর।
শত চেষ্টাতেও চোখে আর ঘুম নামল না। বেচারা ঝুমনার কথা বারেবারেই মনে পড়তে লাগল এবং চোখের সামনে থেকে-থেকেই ভেসে উঠতে লাগল ওর কাটা হাত দুটোর ভয়াবহ দৃশ্য। আর একইসঙ্গে কানে আসছে টোকা দেওয়ার হালকা শব্দ, আঁচড় কাটার শব্দ–তাঁবুর চাদরে খসখস শব্দে কেউ যেন ছুটে বেড়াচ্ছে। কোনদিক থেকে যে শব্দটা আসছে, ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন অনুভূতি, সব যেন মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। এ কীসের শব্দ এমন বিচিত্রভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে?
রহস্যের গভীরতা ক্রমেই যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে, তখন শব্দের ধরনটা হঠাৎই পালটাল। সবসময় হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে তাবুতে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ছিল। বেশিরভাগ সময়েই তাতে জল ভরা থাকে। তখনও ছিল। জল ফুরিয়ে গেলে ঝুমনাই আবার জল এনে ভরতি করে রাখত। ওর বীভৎস দুর্ঘটনার পর রমেশই অনুগ্রহ করে সে কাজটুকু করে দিচ্ছিল। সুতরাং গামলার জলে ছলাৎ শব্দ শুনেই আমি চমকে উঠেছি। তার কারণ দুটো ও এক, শব্দের চরিত্র এককথায় অভিনব ও চূড়ান্ত রহস্যময়। দুই, এই প্রথম বুঝলাম, শব্দটা তাবুর বাইরে নয়, হচ্ছে তাঁবুর ভিতরে। সোজা কথায়, গামলার জলে কিছু একটা পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে গামলা বেয়ে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে আসতে। শোনা যাচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের ওপর খরখর আঁচড়ের অতিব্যস্ত শব্দ।
বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে ঘড়িটা বের করে নিলাম। রেডিয়াম ডায়ালে চোখ রেখে দেখলাম, রাত তিনটে বাজে। সুতরাং ঘুমোনোর চেষ্টা এখন বৃথা। মশারির বাইরে বেরিয়ে নীচু হয়ে ক্যাম্পখাটের কাছে রাখা হ্যারিকেনটা তুলে নিলাম। সলতে নামিয়ে আলোটা প্রায় নিবুনিবু করা ছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটাকে বাড়িয়ে দিলাম। সেই মুহূর্তেই হ্যারিকেন-শিখার আবছা আলোয় একটা জিনিস দেখতে পেলাম…এবং হ্যারিকেন আমার হাত থেকে খসে পড়ল মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাচের চিমনি। আলোয় শিখাও পলকে নিভে গেল।
আলো জ্বালিয়ে ওই অল্প সময়েই আমি দেখেছি, গামলার ভিতর থেকে পড়িমরি করে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছে কালো কঁকড়ার মতো অদ্ভুত দুটো প্রাণী। ছিটকে লাফিয়ে পড়েছে মেঝেতে, তারপর বিদ্যুৎগতিতে রওনা হয়েছে তাঁবুর দরজা লক্ষ্য করে। প্রাণী দুটোর রং গাঢ় বাদামি, পিঠ দুটো মাকড়সার মতো উঁচু হয়ে রয়েছে, এবং তার ওপরে পার্চমেন্ট কাগজের মতো চামড়ার আস্তরণ। প্রত্যেকটা প্রাণীর পাঁচটা করে পা, এবং তাদের ছুঁচোলো ডগায় কালচে ছোপ ধরা মোটা বাঁকানো নখ। না, দেখতে আমার ভুল হয়নি। এ ঝুমনার কেটে ফেলা সেই দুটো হাত! গামলার জলে ভিজে গিয়ে সেগুলোকে কেমন অদ্ভুত চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, ততক্ষণে হাত দুটো তাঁবুর বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে আমি এক ভয়ংকর অবাস্তব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে পড়েছি। এ যে আমি বিশ্বাসও করতে পারছি না!
দ্বিতীয় একটা হ্যারিকেন তাঁবুতে ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে সেটাকে খুঁজে বের করে জ্বেলে দিলাম। দেখলাম, আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাচের চিমনির ভাঙা টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আরও নজরে পড়ল, গামলা থেকে তাবুর দরজা পর্যন্ত একটা ভিজে দাগ। গামলার কাছে গিয়ে দেখি, সেটা জল কাদায় নোংরা ঘোলাটে হয়ে গেছে, এবং জলে তখনও ঢেউ খেলছে। যেন এইমাত্র কেউ জলে আলোড়ন তুলে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
যেসব আদিবাসী গাছ কাটত, তাদের কয়েকজন–জনা-চার-পাঁচ হবে কাজের শেষে আর ঝোঁপড়িতে ফিরে যেত না। আমার তাঁবুর লাগোয়া একটা তাঁবু তৈরি করে সেখানেই রান্নাবান্না করে, খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ত। হ্যারিকেনের চিমনি ভাঙার শব্দে ও আমার চলাফেরার আওয়াজে ওদের ঘুম হয়তো ভেঙে গিয়ে থাকবে। কারণ, একটু পরেই দুজন আদিবাসী আমার তাঁবুতে এসে হাজির হল। চিমনির ভাঙা কাচগুলো নজরে পড়তেই সেগুলো বঁট দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। কিন্তু মেঝেতে ভিজে দাগের ও গামলার ঘোলাটে জলের কোনও সহজ-সরল ব্যাখ্যা ওরা দিতে পারল না। ওদের বললাম যে, প্রাণীটাকে আমি ভালো করে দেখতে পাইনি, কারণ সত্যি কথাটা আমি নিজে তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। অন্য কেউ ওরকম গল্প আমাকে শোনালে আমি নিশ্চয়ই তার মুখের ওপর হো-হো করে হেসে উঠতাম।
তা যাই হোক, ওদের বললাম চোখ-কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে শুতে। কারণ সেই রাতের আগন্তুক চোরও হতে পারে, কিংবা শেয়াল অথবা হায়েনাও হতে পারে।
পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম, আদিবাসীদের তাঁবুতে আমাদের গাছকাটার যন্ত্রপাতি যে-জায়গাটায় থাকত, সে-জায়গাটা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে। রমেশ অনেক খোঁজাখুঁজির পর বলল, দু-একটা জিনিস চুরি গেছে। অথচ আশ্চর্য, কেউ কোনও শব্দ পায়নি, এক মুহূর্তের জন্যে কারও ঘুমও ভাঙেনি। আমি ব্যাপারস্যাপার কিছুটা অনুমান করতে পারলেও চুপচাপ রইলাম।
বেলা একটু বাড়তেই হাসপাতালে ঝুমনাকে দেখতে গেলাম। ডাক্তারের কাছে শুনলাম, ওর সামান্য জ্বর হয়েছে। তা ছাড়া শরীর খুব দুর্বল। ওকে শুধু দুধ-বার্লি আর ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে দেওয়া হচ্ছে। আমাকে দেখেই ও ব্যান্ডেজ বাঁধা দুহাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করল। ডাক্তারবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই আমি ঝুমনাকে প্রশ্ন করলাম, তোকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করলে কি জবাব দিতে খুব কষ্ট হবে?
ও বলল, না বাবু, যা প্রাণ চায় জিগ্যেস কর। এখন আমার তো কোন দুখ লাই।
ওকে বললাম, হাত দুটো কেটে ফেলে তুই কী করেছিস?
তোর দেওয়া বাক্সটায় রতন গুনিন ওগুলো রেখেছিল।
তারপর?
তারপর বাক্সটা সমেত মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ওইটুকুই আমার জানার দরকার ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে এলাম।
সে-রাতে আর দু-চোখের পাতা এক করিনি। শেয়াল কিংবা হায়না তাড়ানোর লাঠিটা হাতের কাছে নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু কিছুই হল না। তার পরের রাত, এমনকী তৃতীয় রাতেও কিছু হল না। আমি ভাবলাম, হয়তো হ্যারিকেনের আলোতে ওই মহাচোর হাত দুটো দেখা দিতে লজ্জা পাচ্ছে। সুতরাং পরের রাতে আলো নিভিয়েই শুয়ে পড়লাম।
এক অদ্ভুত শব্দে ঘুমটা ভাঙল। আমার কানের ঠিক নীচেই আমার হাতঘড়িটার অ্যালার্ম বাজছে। বালিশ ভেদ করেও চাপা শব্দটা আমার কানে আসছে। পাথরের মূর্তির মতো নিঃসাড়ে শুয়ে রইলাম। ধীরে-ধীরে হয়তো মিনিট পনেরো কেটে গেল। কারণ, তারপরই আমার কানে এল দ্বিতীয় অ্যালার্মের শব্দ। রাত এখন কটা বাজে কে জানে! কিন্তু অ্যালার্মটা নিজে থেকে বাজছে কেমন করে? আমি তো অ্যালার্মের চাবিতে দম দিইনি!
ধীরে-ধীরে একটা হাত বালিশের তলায় ঢুকিয়ে দিলাম। পরমুহূর্তেই এক অমানুষিক বিকৃত চিৎকার বেরিয়ে এল আমার ঠোঁট চিরে। বালিশের তলাতেই ওরা রয়েছে। সেই হাত দুটো! আর আমার হাতঘড়িটা সেই হাতের মুঠোর মধ্যে।
ঘড়ির চামড়ার ব্যান্ডের একটা প্রান্ত সামান্য বেরিয়ে ছিল। আমি সেটা ধরেই প্রাণপণে এক হ্যাঁচকা মারলাম। কিন্তু ওই হাতের আঙুলগুলো ভীষণ শক্ত, এবং আমার আঙুলগুলো ওরা সাঁড়াশির মতো তীব্রতায় আঁকড়ে ধরল। আমি আবার চিৎকার করে উঠলাম।
আমার চিৎকারে আদিবাসীদের তাবু থেকে অন্তত তিনজন ছুটে এসে হাজির হল। তাদের একজনের হাতে জ্বলন্ত হ্যারিকেন। কীসের সঙ্গে যে আমার আপ্রাণ ধস্তাধস্তি চলছে সেটা ওরা প্রথমটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারল না। কিন্তু আলোয় ইশারা পেয়ে হাত দুটো বোধহয় ভয় পেল এবং ঘড়িটা হঠাৎই ছেড়ে দিল। আমি চেষ্টা করেও ওদের আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলাম না। কালচে বাদামি হাত দুটো বিছানার সাদা চাদরের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎগতি কঁকড়ার মতো ছুটে গেল, মশারি ফাঁক করে ধপ শব্দে ছিটকে পড়ল মেঝেতে, তারপর ছুটে চলে গেল তাঁবুর দরজা লক্ষ করে।
ততক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে খাটের তলা থেকে লাঠিটা তুলে নিয়েছি এবং দুটো হাতের মধ্যে যেটা একটু পিছিয়ে পড়েছিল, সেটাকে লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করেছি। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা শূন্যে প্রায় হাতখানেক লাফিয়ে উঠল, তারপর চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। মুহূর্তের জন্যে হাতটা হতচকিত হয়ে থমকে রইল। যেন চিন্তা করল, সেই আকস্মিক আঘাতের প্রতিবাদে কী করা উচিত। তারপর হঠাৎই আমাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এল…অনেকটা তেড়ে আসার মতো। কিন্তু কী ভেবে এক ঝটকায় দিক পালটে করে আবার ছুটে চলল দরজার দিকে। তারপর একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের জঙ্গলের আড়ালে, অন্ধকার রাতের পরদার গোপন ভঁজে।
আমি আদিবাসী তিনজনকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললাম, শিগগির বিজয় সর্দারকে খবর দাও। এক্ষুনি!
ওরা ছুটে বেরিয়ে গেল বিজয় কাহারকে খবর দিতে।
বিজয় সর্দার এসে যখন পৌঁছোল, তখন আকাশ ভোরের ইশারা নিয়ে ধূসর ইস্পাতের ছাউনির মতো হয়ে উঠেছে–শুরু হয়েছে অসংখ্য পাখির মিলিত প্রভাতী গুঞ্জন। বিজয়কে সমস্ত ঘটনা প্রথম থেকে খুলে বললাম। ও গম্ভীরভাবে সব শুনল। তারপর বলল, ঝুমনাকে নিয়ে মন্দিরে যেতে হবে। সুতরাং সবাই মিলে ছুটলাম হাসপাতালে।
তরুণ ডাক্তারটিকে অনেক অনুরোধ করার পর বিজয়ের কথায় সে নিমরাজি হল। অর্থাৎ, ঝুমনাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আমাদের সঙ্গে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। জঙ্গলের পথ ধরে আমি, রমেশ ও বিজয় কাহার আগে আগে হেঁটে চলেছি, পেছনে আদিবাসীদের বয়ে আনা স্ট্রেচারে শুয়ে ষোলো বছরের অসুস্থ ছেলেটা। অবশ্য এখন ও আগের চেয়ে অনেকটা সেরে উঠেছে।
মন্দিরের কাছাকাছি এসে পৌঁছোতে জনদুয়েক আদিবাসী ছুটে এগিয়ে গেল মন্দিরের দিকে হয়তো রতন গুনিনকে খবর দিতে। কিন্তু একটু পরেই তারা উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। জানাল, আমরা আসছি খবর পেয়েই রতন গুনিন ভয়ে মন্দির ছেড়ে কোথায় পালিয়েছে–তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা শুনে বিজয় বলল, গুনিনের দরকার নেই, ঝুমনা দেখিয়ে দিলেই হবে। তারপরই সে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা ছেলেটার কাছে গিয়ে জানতে চাইল, হাত দুটোকে কেটে ফেলার পর রতন গুনিন সেগুলো কোন জায়গায় পুঁতেছে। উত্তরে ইশারা করে মাটিতে একটা নরম জায়গা দেখাল ঝুমনা। তখন বিজয় সবাইকে মাটি খোঁড়ার নির্দেশ দিল। প্রায় হাত আড়াই মাটি খোঁড়ার পর অতি পরিচিত পিচ-বোর্ডের বাক্সটার দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু সে বাক্স খোলা, কাদায় মাখামাখি। তার ভিতরে কোনও কাটা হাত খুঁজে পাওয়া গেল না!
হাত দুটোর সন্ধানে আমরা সকলে মিলেই খোঁজাখুজি শুরু করলাম, কিন্তু বৃথাই। আমার কেবলই মনে হতে লাগল, হাত দুটো আমার পিছু ছাড়েনি। লাঠির আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে ওরা তক্কেতক্কে রয়েছে।
তাঁবুতে ফিরে এসেও হাত দুটোর অদৃশ্য উপস্থিতি আমি টের পেলাম। আমার তাঁবুতে, আদিবাসীদের তাবুতে, গাছ কাটার যন্ত্রপাতির ওপরে, প্রায়ই হামলা হতে লাগল। তখন আমরা চারদিকে ইঁদুর-ধরা জাতিকল এনে পেতে রাখলাম। একদিন সকালে একটা জাতিকল বন্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। কিন্তু তার লোহার দাঁতে সামান্য একটু ছেঁড়া চামড়া ও কালচে রক্ত ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। বুঝলাম, একটা হাত ফাঁদে ধরা পড়েছিল। তখন দ্বিতীয় হাতটা এসে তাকে ফঁদ থেকে সহজেই উদ্ধার করেছে।
টোপ হিসেবে আমার হাতঘড়িটাকে বেশ কয়েকদিন খোলা জায়গায় রেখে দিলাম, কিন্তু বৃথাই। তবে যত্রতত্র হাত দুটোকে দেখা যেতে লাগল। গাছের ডালে, আমার মশারির চালে, ঘাসের ওপর, তাঁবুর গায়ে, শুকনো শাল গাছের পাতার ফাঁকে। আদিবাসীরা এত ভয় পেয়ে গেল যে, বিজয় কাহার শত বুঝিয়েও ওদের শান্ত করতে পারল না। ওরা একে-একে কাজ ছেড়ে পালাতে লাগল। তখন বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে গাছ কাটার কাজ বন্ধ রেখে আমরা ক্যাম্প গুটিয়ে ফিরে এলাম। ফেরার সময় আমার প্রতিটি জিনিস বারবার করে নেড়েচেড়ে আমি দেখে নিয়েছি কোনও কিছুর ফাঁকে সেই ধূর্ত হাত দুটো লুকিয়ে আছে কি না। অবশেষে স্থানীয় অফিসে কাজের সমস্ত দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি কলকাতা রওনা হলাম।
ট্রেনে ফেরার সময় হঠাৎই আমার নজরে পড়ল, শক্তপোক্ত করে বাঁধা বেডিংয়ের ভিতরে কিছু একটা যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। কারণ বেডিংয়ের কাপড়ের একটা জায়গা অদ্ভুতভাবে কেমন উঁচু ঢিবির মতো হয়ে রয়েছে, এবং সেই ঢিবিটা যেন কষ্টেসৃষ্টে চলে বেড়াতে চেষ্টা করছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বেডিংটা খুলে ফেলেছি, কিন্তু ট্রেনের কমজোরি আলোয় ভালো করে কিছু দেখতে পাইনি। একটা অজানা আতঙ্ক আমাকে ধীরে-ধীরে ঘিরে ধরেছে। হাত দুটো কি আমাকে ছাড়বে না? ওরা কি প্রতিশোধ চায়? কিন্তু কীভাবে ওরা প্রতিশোধ নেবে? বিজয় কাহার আমাকে বলেছিল, ওই হাত শুধু চুরি করে, কাউকে খুন করার ক্ষমতা ওদের নেই। আর সেরকম ক্ষমতা থাকলে বহু আগেই আমি ওদের শিকার হতাম। সুতরাং দুশ্চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় আমি যেন পাগল হয়ে উঠলাম। তারপর–
বিশ্বনাথবাবু হঠাৎই থামিলেন। চোখ হইতে চশমাটি খুলিয়া নিবিষ্ট মনে উহার কাচ দুটি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আমরা কৌতূহলে নীরব ও রুদ্ধশ্বাস। মালতী সভয়ে আমার আরও নিকটে ঘেঁষিয়া বসিল। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধু অবিনাশ এতক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন ধূমপানে ব্যস্ত ছিল, এখন উভয়েই হস্তধৃত সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজিয়া নির্বাপিত করিল। বিশ্বনাথবাবু আমাদের দিকে পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি রাখিলেন। হ্যাঁজাকের আলো তাঁহার মুখমণ্ডলকে ছায়াময় করিয়া তুলিয়াছে।
অবশেষে চশমা যথাস্থানে ফিরাইয়া তিনি কহিলেন, আজকের ঘটনার বুঝতেই পারছেন, সেই হাত এখনও আমার পেছু ছাড়েনি। সোনার জিনিসের প্রতি ওদের লোভ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। সেইজন্যেই আত্মীয়স্বজন কারও বাড়িতে আমি যাই না। চাকরিবাকরি ছেড়ে শুধু নিজের ব্যাবসা নিয়ে আছি। তিনি এইবার চন্দ্রমোহনের দিকে ইশারা করিয়া কহিলেন, চাদু আমার এই একাচোরা স্বভাবের কথা জানে, এমনকী চুরির ব্যাপারটাও জানে। কিন্তু কোনওদিন ওকে তার কারণ খুলে বলিনি। আজ বললাম, কারণ, এরকম অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে আগে কখনও পড়িনি। এইজন্যেই সঁদুকে আমি বারবার বলেছি, বরযাত্রী আমি যাব না। তুই বউ নিয়ে আয়, তখন আশীর্বাদ করব, কিন্তু কে শোনে কার কথা! ও বলল, তুমি চলো, আমি তোমাকে নজরে-নজরে রাখব।…আসলে চঁদুরও দোষ নেই। ও কী করে জানবে যে, যখন ওই হাত দুটো চুরি করে, তখন আমি এতটুকুও টের পাই না? কী করে জানবে, কত ভয়ংকর প্রতিশোধ ওই হাত দুটো আমার ওপরে নিয়েছে। কী করে জানবে, কত বিষাক্ত ছোবলে ওরা আমার গোটা জীবন নীল করে দিয়েছে! এই তো সেই হাত! এই তো সেই হাত! এই তো—
কাশ্মীরি আলোয়ান সরাইয়া বিশ্বনাথবাবু তাঁহার হাত দুইখানি প্রকাশিত করিলেন। গায়ের রঙের তুলনায় তাহার হাতের রং অনেক বেশি কৃষ্ণকায়। বলা যাইতে পারে, গাঢ় বাদামি। হত দুইখানির চামড়া অত্যন্ত কর্কশ। প্রতিটি শিরা-উপশিরা স্থূলভাবে প্রকট। কুৎসিত কদাকার আঙুলের গ্রন্থিগুলি অদ্ভুতরকম বেমানান। নখগুলি অত্যন্ত পুরু, গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছাপে কলঙ্কিত, এবং কোনও মাংসাশী জন্তুর নখের ন্যায় বক্র।
হাত দুইখানি হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোয় ভয়ংকর দেখাইতেছিল। বাহিরে কোথাও হইতে কর্কশ স্বরে কোনও পাচা ডাকিয়া উঠিল। ঠান্ডা বাতাসের ঝড় উন্মুক্ত জানলা দিয়া প্রবেশ করিয়া হু হু করিয়া ঘর তোলপাড় করিল। বিশ্বনাথবাবু উন্মাদের ন্যায় হাত দুইখানি দিয়া মেঝেতে আঘাত করিতে লাগিলেন। হাত ক্ষত-বিক্ষত হইয়া রক্তের ধারা বহিতে শুরু করিল। তিনি চিৎকার করিয়া কহিলেন, এ-হাত নিয়ে আমি কী করি! একে আমি না পারি রাখতে, না পারি ফেলতে! ওই ষোলো বছরের ছেলেটার মতো অত সাহস যে আমার নেই! ওঃ ভগবান, আমি এখন কী করি! আমার এ-শাস্তির কি শেষ নেই। বিশ্বনাথবাবু হাত দুইখানি ওইরূপে আঘাত করিতে করিতেই কান্নায় ভাঙিয়া পড়িলেন। কান্নার দমকে তাহার শরীর ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।
মালতী অস্ফুটে এক ভয়ার্ত চিৎকার করিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিল। চন্দ্রমোহন ও তাহার বন্ধুরা বিশ্বনাথবাবুকে সংযত করিতে মনোযোগী হইল। বিবাহোৎসবের আনন্দ মুহূর্তে মৃত্যুর বিষাদে পর্যবসিত হইয়া গেল। আমার বাকশক্তি যেন কোনও অদৃশ্য ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে রোধ করিয়া দিয়াছে…।
.
চার মাস পরে চন্দ্রমোহনের নিকট হইতে সংবাদ পাইলাম, বিশ্বনাথবাবু নিজ বাড়ির ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন।
অয়স্কান্তের অন্তিম ইতিহাস
(অয়স্কান্ত রুদ্রের কুয়াশাচ্ছন্ন অপমৃত্যুর সম্ভাব্য সমাধান কেউই করতে পারেননি। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য মৃত্যুকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করে দিনের পর দিন মানসিক কুরুক্ষেত্রের অংশীদার হয়েছে তার স্ত্রী অরুণা রুদ্র। অবশেষে কতকগুলো সাদা কাগজের পৃষ্ঠায় খুঁজে পাওয়া গেছে অয়স্কান্তের জীবনের অন্তিম দিনগুলোর কালো সাদা সাক্ষ্য। যেমন বিক্ষিপ্তভাবে তার শুরু, তেমনি বিক্ষিপ্তভাবে তার শেষ। তবু কি ফুটে ওঠে না এক অবিশ্বাস্য অশুভ ইঙ্গিত? ঘটনা ও ফলাফলকে আঙ্কিক নিয়মে যোগ করে অরুণার অন্তত তাই মনে হয়েছে।)
৫ মে, রাত দশটা
ক্লাব থেকে ফিরতে আজ অনেক রাত হয়ে গেল। অরুণা মনে হয় বেশ কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে। কারণ সংক্ষিপ্তভাবে বহু প্রচলিত এবং বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো (খাবার ঢাকা আছে) বলে ও শোওয়ার ঘরে চলে গেল। ভেবেছিলাম খাওয়াদাওয়ার পর মানভঞ্জনে আজকের রাতটা খরচ করব, কিন্তু শ্রীকান্তর কথাগুলো মনে পড়ায় তা আর হয়ে উঠল না। টেবিলে বসে খালি ওর কাছে শোনা কথাগুলোই ভেবেছি। জানি, ক্লাবের আর সকলে ওর কথায় তেমন আমল দেয়নি, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তা পারছি কই? সত্যিই কি সামান্য এক টুকরো সুতোর মধ্যে অত শক্তি আছে? ওই এক টুকরো সুতোর চাপে কেউ কখনও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়? কে জানে! শ্রীকান্ত বলছিল, স্ত্রী-হত্যার অপরাধে সেই ভদ্রলোকের কোনও শাস্তি হয়নি। কারণ সামান্য একগাছা সুতো দিয়ে যে কাউকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা যায়, আদালত সে কথা একেবারেই বিশ্বাস করেনি। ওই অবিশ্বাস্য ঘটনার পর ভদ্রলোক পাগল হয়ে যান। তিনি তো সত্যিই স্ত্রীকে খুন করতে চাননি। নিছক একগাছা সুতো গলায় জড়িয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!
না, এই সুতোর ঘটনাটা অরুণাকে বলা ঠিক হবে না। ও হয়তো ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্য, এই অবাস্তব ব্যাপারটা শুধু আমাকেই কেন এরকমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে?
৬ মে, রাত দশটা
আজ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় একটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। ধুতিটা আলমারি থেকে নিয়ে পরতে যাব, দেখি, একগাছা সরু কালো সুতো সাদা ধবধবে ধুতির ওপর সাপের মতো এঁকেবেঁকে পড়ে রয়েছে। জিনিসটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঘর আঁট দেওয়ার সময় আপদ দূর হবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, অফিস থেকে ফিরে এসে টেবিলের ওপর আবিষ্কার করলাম ওই কালো সুতোটাকে। আমার ফাউন্টেন পেনটার পাশে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে। জানি না কেন, ওটাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে শিউরে উঠেছিলাম। তা হলে কি আমার হঠাৎই মনে পড়ে গিয়েছিল বিশ বছর আগেকার স্মৃতির কথা? আমার ছোটবেলার কথা? নিশীথের কথা?
৮ মে, রাত বারোটা
বলব না বলব না করেও অরুণাকে আমার অস্বস্তির কথাটা জানিয়ে ফেলেছি। ও ব্যাপারটাকে যথারীতি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। তা তো দেবেই। ও তো আর জানে না বিশ বছর আগেকার ছোট্ট ঘটনাটা। জানে না নিশীথের আকস্মিক অপমৃত্যুর কথা! তা ছাড়া শ্রীকান্তর বলা গল্পটাও তো ওকে আর বলিনি!
১০ মে, রাত একটা
রাত দশটায় খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুম আসেনি। কারণ, কালো সুতোটা এখনও আমার সঙ্গ ছাড়েনি। আজ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ওটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে এসে দেখি সেই আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সুতোটা আমার ড্রয়ারের ভিতরে নিরীহভাবে পড়ে রয়েছে। তা হলে নিশীথ কি এতদিন পরে ওর প্রতি অবিচারের ন্যায়বিচার চাইতে এসেছে? আজও আমি ভুলিনি বিশ বছর আগের সরস্বতী নদীর কথা, তার ওপরের তালগাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি সাঁকোটার কথা। আর ভুলিনি এক লাটাই কালো সুতোর কথা। ওই সামান্য সুতো নিয়েই এক ধূসর সন্ধ্যায় নিশীথের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়, তারপর অনিবার্যভাবে হাতাহাতির শুরু। ওই ধস্তাধস্তির মধ্যে নিশীথ কীভাবে যে জলে পড়ে গেল, আমার মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, ডান হাতের শক্ত মুঠোয় লাটাইটা আঁকড়ে ও ছিটকে পড়েছিল সাঁকোর ওপর থেকে। সাঁতার জানত না নিশীথ। তাই অসহায়ভাবে হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে গেছে ঘোলা জলের নীচে। সন্ধের ঝাপসা অন্ধকারে নিঃসঙ্গ আমি শ্রান্ত পায়ে ফিরে এসেছি ঘরে। নিশীথের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার ঘটনা একেবারেই চেপে গেছি। কিন্তু দিন তিনেক বাদে মাইল দুয়েক দুরে ভেসে উঠল নিশীথের মৃতদেহ। সাত গাঁয়ের লোক ছুটল ওকে দেখতে। আমিও গেলাম। নিশীথের সারা শরীর গ্যাসবেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। চোখের জায়গায় দুটো বীভৎস কোটর। দেহের জায়গায় জায়গায় মাংস খোবলানো। কিন্তু ওর ডান হাতের শক্ত মুঠোয় লাটাইটা তখনও ধরা ছিল।
নিশীথের মৃতদেহের নৃশংস স্মৃতি আমাকে একটি রাতের জন্যেও মুক্তি দেয়নি। তখন আমার বয়স ছিল বছর বারো-চোদ্দো। আরও বছর পনেরো পর যখন অরুণাকে বিয়ে করলাম, তখন সে স্মৃতি বেশ ধূসর হয়ে এসেছে। তারপর এই পাঁচ বছরে নিশীথকে একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু শ্রীকান্তর বলা গল্পটা, আর এই সামান্য কালো সুতোটা, আমাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে সেই ভুলে যাওয়া বিষণ্ণ ধূসর সন্ধ্যার কথা। নিশীথের লাটাইয়ের কথা। কালো সুতোর কথা।
তা হলে কি এই সুতোই সেই সুতো? যে-সুতো আর সরস্বতী নদী সাক্ষী ছিল সেই বিয়োগান্ত নাটকের চরম পরিণতির?
১৩ মে, দুপুর দুটো
আমার টেবিলে একটা ছোট কাঠের মূর্তি আছে। হানিমুনের সময় কাশ্মীর থেকে অরুণাই ওটা পছন্দ করে কিনেছিল। মূর্তিটা একজন পুরুষের। কালো মিশমিশে তার সুগঠিত দেহের রং। দুটো হাত জয়ের ভঙ্গিতে মাথার ওপরে তোলা।
প্রথমটা আমি ঠিক খেয়াল করিনি। রাত তখন এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। শনিবার বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে অরুণাকে নিয়ে একটা বাংলা ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। সুতোটাকে তখনও ড্রয়ারেই দেখে গেছি। কিন্তু ফিরে এসে খাওয়ার পাট সেরে টেবিলে গিয়ে বসতেই লক্ষ করলাম ড্রয়ারটা হাট করে খোলা। অরুণাও সেটা লক্ষ করে বলে উঠল চোর-টোর এসেছিল কি না। কিন্তু আমি জানি, আসেনি। অরুণাকে শুতে যেতে বলে আমি ড্রয়ারটা পুরোটা খুললাম। ঠিক যা ভেবেছিলাম, তাই। সুতোগাছাটা ড্রয়ারে আর নেই।
ড্রয়ার বন্ধ করে টেবিলের ওপরে রাখা কালো মুর্তিটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। টেবিল ল্যাম্পের আলো সরাসরি গিয়ে পড়েছে মূর্তিটার ওপরে। তারই আলোর স্পষ্ট দেখলাম, মূর্তির যে-হাত দুটো জয়ের ভঙ্গিতে ওপরে তোলা ছিল, তাদের অর্থ কেমন যেন পালটে গেছে। হাতের ভঙ্গিতে কোনও রদবদল না হলেও এখন মনে হচ্ছে, মূর্তিটা যেন নিদারুণ আতঙ্কে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নিঃশব্দ চিৎকারে ঘর ভরিয়ে ফেলছে। ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ল কালো সুতোটা। মূর্তিটার গলায় সাপের মতো পাকে-পাকে জড়িয়ে রয়েছে সেই কালান্তক সুতো।
ভয়ে-ভয়ে হাত বাড়িয়ে সুতোটা খুলে নিতে চেষ্টা করলাম।
আশ্চর্য! অনায়াসেই ওটা খুলে চলে এল আমার হাতে। আরও আশ্চর্য, একইসঙ্গে যেন ফিরে এল মূর্তিটার আগের জয়োল্লাস। আতঙ্কের জমাট পরদাটা তার মুখ থেকে একেবারে নিঃশেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। এ কীসের ইঙ্গিত? শ্রীকান্তর বলা গল্পটা আরও একবার মনে পড়ল।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ঠিক করলাম, অরুণাকে সব জানানো দরকার। তাই রাতে শোওয়ার সময় ওকে বললাম, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী কথা?–ঘুমজড়ানো স্বরে অরুণা জানতে চাইল।
আবছা অন্ধকারে শূন্য দৃষ্টি মেলে ওকে শ্রীকান্তর বলা গল্পটা জানালাম।
ও প্রচণ্ড হাসিতে ভেঙে পড়ল, বলল, সুনু, তুমি ঠাট্টাও করতে পারো।
নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হতে লাগল। তা হলে এই বিপদের মুহূর্তে আমার পাশে কেউ নেই। অরুণার হাসির কোনও জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। সুতোটাকে কালো মূর্তিটার গলা থেকে খুলে কোথায় যে রেখেছি, আর মনে করতে পারছি না।
একটা সামান্য সুতো আমার জীবনকে যেন অদৃশ্য ফঁসে বেঁধে ফেলতে চাইছে।
১৪ মে, সন্ধ্যা সাতটা
ক্লাবে আজ আর যাইনি। একটু আগেই চেহারা খারাপ হয়ে গেছে বলে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়ার জন্যে শাসন করছিল অরুণা। তারপর পাশেই যেন কোন প্রতিবেশিনীর বাড়িতে গেছে সান্ধ্য পরনিন্দাচক্রে যোগ দিতে। ওকে নিশীথ বা কালো সুতোটা সম্পর্কে আর কোনও কথাই বলিনি। এও বলিনি যে, অফিস থেকে ফিরে একটু আগেই আমি কালো সুতোটাকে আবার খুঁজে পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি ভারি অদ্ভুত জায়গায়, ভারি অদ্ভুতভাবে।
অরুণার ড্রেসিং টেবিলে আমাদের বিয়ের (গলায় মালা দেওয়া অবস্থায়) একটা ফ্রেমে বাঁধানো বড় ফটো আছে। অফিস থেকে ফিরে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখি কালো সুতোটা অরুণা আর আমার ফটোর মাঝখানে পাঁচিল হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় অলসভাবে ঝুলছে। হাত বাড়িয়ে সুতোটাকে খুলে নিতে গিয়ে টের পেলাম, আমার কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এমনকী ফটোতে আমার মুখের হাসিখুশি ভাবটা পর্যন্ত মিলিয়ে গেছে। সেখানে ফুটে উঠেছে অনিশ্চয়তায় ভরা এক হতবুদ্ধি যুবকের আতঙ্কিত মুখ। হঠাৎ কী হয়ে গেল, পাগল করা রাগে সুতোটাকে দু-হাতের মুঠোয় ধরে আমি টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়তে লাগলাম। পাঁচ মিনিট পর যখন সংবিৎ ফিরে পেলাম, দেখি সুতোটা পাঁচ টুকরো হয়ে আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মনে হল, সুতোর টুকরোগুলো যেন কেঁচোর মতো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। হাজারো চিন্তায় আমার যুদ্ধক্লান্ত মস্তিষ্ক যেন অবশ হয়ে পড়েছে। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ায় নদীর জলের বাষ্প অনুভব করলাম। শুনলাম, কিছু একটা জলে আছড়ে পড়ার ঝপাং শব্দ। আমি কি ধীরে ধীরে কারও সুপ্ত অপূর্ণ ইচ্ছের শিকার হতে চলেছি।
১৪ মে, রাত একটা
শোওয়ার পর আজ কিছুতেই ঘুম এল না। সুতোটার অশরীরী উপস্থিতি আমাকে চঞ্চল করে তুলেছে। নিশীথের জলে ভেজা ফুলে ওঠা মুখটা এই মুহূর্তে যেন আরও বেশি করে মনে পড়ছে। ওর হাতের লাটাইয়ের কালো সুতো তো এত সহজে শেষ হওয়ার কথা নয়! সরস্বতী নদীর ঘোলাটে জলে সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আমার প্রতিবিম্ব নিশীথের জল-তল স্পর্শের আলোড়নে একই ছন্দে কাঁপছে। নিঃসঙ্গ আমি ধানখেতের আল ধরে আনমনাভাবে হেঁটে চলেছি। সন্ধের অন্ধকার চেপে বসেছে মাথার ওপরে। চোখের সামনে ভাসছে নিশীথের কালো সুতোয় ভরা লাটাইটা। আমি যেন…।
কীসের একটা যেন শব্দ হল। হালকা অথচ স্পষ্ট শব্দ। ঘরের অন্ধকারের ভিতরে যেন ফুটে উঠল নিশীথের ক্ষত-বিক্ষত চোখের মণিহীন মুখটা। শব্দটা কি ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে? কে যেন আমাকে চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াতে বলছে, কানের কাছে জলের নেশা-ধরানো কল্লোল, আমার হাত যেন শিথিল হয়ে আসছে, গলায় কীসের যেন অস্পষ্ট সুড়সুড়ি, বেশ শীত শীত করছে। আমার, কই অরুণা তো ঘুম ভেঙে উঠে এল না…একটা…একটা সাপিনীশীতল পরিবেশ আমাকে পরতে-পরতে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। নিশীথ, আমি তো তোকে খুন করিনি, নিশীথ, নিশীথ…।
(আচমকা এক চিৎকারে নাকি সে-রাতে অরুণার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই ও বুঝতে পারে সে-চিৎকার সুনুর, অর্থাৎ, তার স্বামী অয়স্কান্তের। পাশের ঘরে এসেই অরুণা আবিষ্কার করল ঘর অন্ধকার। কোনওরকমে হাতড়ে হাতড়ে ও যখন আলোর সুইচ জ্বালল, তখন দেখল ভারি অদ্ভুত এক দৃশ্য। অয়স্কান্ত রুদ্রের বিশাল দেহটা ঘরের সিলিং থেকে শূন্যে ঝুলছে। দেহটা দুলছে–ঠিক পেন্ডুলামের ধাতব দোলকের মতো। তখনই একটা ছোট্ট জিনিস নজরে পড়েছিল অরুণার। ঝুলন্ত দেহ ও সিলিংয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে শুধু একটা সরু কালো সুতো।)
অর্ধেক পুরুষ (নভেলেট)
সুপ্রতিম একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর মন বলছিল, ফোনটা আসবে। যদিও স্টুডিয়োতে লাইন পাওয়া বেশ ঝকমারি, তবুও ওর মনে হচ্ছিল সেই মেয়েটি যেরকম নাছোড়বান্দা তাতে লাইন ও পাবেই।
সন্ধে ছটা থেকে সাড়ে ছটা–এই আধঘণ্টা ধরে সাইবার চ্যানেল-এর মুশকিল আসান অনুষ্ঠান টিভিতে দেখানো হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সুপ্রতিম আর ওর অনুষ্ঠান-সঙ্গিনী মোনা। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে। মাত্র চারমাসেই মুশকিল আসান সকলের মন কেড়ে নিয়েছে।
দর্শকরা নানান প্রশ্ন পাঠান সুপ্রতিমদের কাছে। সুপ্রতিম আর মোনা পালা করে সেসবের উত্তর দেয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠান চলার সময় বহু ফোনও আসে ওদের স্টুডিয়োতে। কেউ-কেউ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন, আর কেউ-বা নিজের কোনও সমস্যা তুলে ধরেন ওদের কাছে।
চিঠিপত্রের উত্তরগুলো সাইবার চ্যানেল-এর অফিসে কয়েকজন বসে ঠিক করেন। সেখানে সুপ্রতিম আর মোনাও থাকে। তবে টেলিফোনে পাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সুপ্রতিম বা মোনাকেই চটজলদি করে সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হয়। এর জন্য যে-বুদ্ধি এবং স্মার্টনেস দরকার, সেটা সুপ্রতিম আর মোনা দুজনেরই আছে।
সুপ্রতিমের চেহারা বেশ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে কীরকম যেন একটা বনেদি ঢং আছে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। স্বাস্থ্য মাঝারি। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। দাড়ি সুন্দর করে কামানো হলেও ফরসা গালে, থুতনিতে, নীলচে আভা থেকে গেছে। ঠোঁটের ওপরে গোঁফ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। বয়েস পঁয়তিরিশ হলেও অনেক কম দেখায়।
সুপ্রতিম যত না সুন্দর তার চেয়েও অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে। ওকে ঘিরে অনেক দর্শকেরই কৌতূহল–বিশেষ করে মেয়েদের। অনেকেই ওকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি দেয়। আবার কেউ-কেউ ওকে নানান ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায়। সেইসব প্রশ্নের পাশকাটানো মজার উত্তর দেয় সুপ্রতিম।
ওর ডান ভুরুর ওপরে একটা কাটা দাগ আছে। সেটা নিয়ে এক তরুণী জিগ্যেস করেছিল, আপনার ডান ভুরুর ওপরে ওই লাভলি কাটা দাগটা হল কেমন করে?
সুপ্রতিম জবাব দিয়েছিল, ছোটবেলায় এভারেস্ট থেকে পড়ে গিয়ে।
একজন কিশোরী চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, আপনার নামটা দারুণ। ভীষণ এক্সাইটিং।
জবাবে সুপ্রতিম বলেছিল, মোটেই তা নয়। সুপ্রতিম মানে হচ্ছে ভালোর মতো কিন্তু পুরোপুরি ভালো নয়।
একজন পুরুষের কৌতূহল : আপনি কি বিয়ে করেছেন?
সুপ্রতিমের উত্তরঃ করিনি বললে আমার ছজন ওয়াইফ রেগে আগুন হয়ে যাবেন। আর বিয়ে করেছি বললে অনেক দর্শক দুঃখ পাবেন। তাই এই সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।
আসল ঘটনা হল সুপ্রতিম বিয়ে করেছে। স্ত্রী নয়নার সঙ্গে ওর পরিচয় সাত বছরের। তার মধ্যে প্রথম তিনবছর ওর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে, আর বাকি চারবছর চুটিয়ে সংসার করেছে। এখনও করছে। সুপ্রতিম যা কিছুই করে, সবসময় চুটিয়ে করতে চায়। তাই নিয়ে নয়নার সঙ্গে মাঝে-মাঝে বেশ ঝামেলাও হয়।
নয়না দেখতে বেশ সুশ্রী, মিষ্টি মেয়ে। তবে সুপ্রতিমের চেহারার পাশে নিজের চেহারা নিয়ে সবসময় ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। সুযোগ পেলেই ওই প্রসঙ্গ তুলে ঠাট্টা করে। সুপ্রতিম রোজ যখন অফিসে রওনা হয়, নয়না তখন আকুল চোখে স্বামীকে দ্যাখে।
সুপ্রতিম অবাক হয়ে বলে, কী ব্যাপার। এমনভাবে তাকিয়ে আছ যেন এই প্রথম চার চোখের মিলন হল!
নয়না ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায় ওর দিকে, বলে, ইচ্ছে করছে, থুতু ছিটিয়ে কানের লতিতে কুট করে কামড়ে দিই।
সুপ্রতিম ওর দিকে বাঁকান এগিয়ে দিয়ে বলে, এই নাও, তাই দাও। পারলে কপালের পাশে একটা কাজলের টিপও বসিয়ে দাও।
নয়না ওর কানটা কষে মুলে দিয়ে বলে, সাবধান! কারও দিকে বেশিক্ষণ তাকাবে না। কেউ যেন নজর না দেয়। তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।
টিভির মধ্যে দিয়ে কারও দিকে তাকানো যায়। তবে মোনা তো পাশে থাকে, ওর দিকে না তাকিয়ে উপায় নেই…।
মোনা খুব ভালো মেয়ে। বরং তোমাকেই বিশ্বাস নেই।
মোনার সঙ্গে নয়নার পরিচয় আছে। মোনা অনেকবার সুপ্রতিমের বাড়িতে এসেছে। দরকারে অদরকারে প্রায়ই ফোন করে। নয়না ওকে খুব পছন্দও করে।
মোনা এলাহাবাদের চৌকশ মেয়ে। বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ। সুন্দর, স্মার্ট। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলে সামান্য লালচে ভাব। টানা-টানা চোখ। শুধু ওর বাংলায় সামান্য টান আছে।
ও সুপ্রতিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। ওর কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তেই শেখার চেষ্টা করে। কথায় কথায় বলে, সুপ্রতিমদা, য়ু আর সিম্পলি লা-জবাব। আপনি সাইবার চ্যানেল-এর অ্যাসেট।
মুশকিল আসান অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সুপ্ৰতিমের দারুণ লাগে। অনুষ্ঠানের কিছুটা অংশ আগে রেকর্ড করা হয়। আর খানিকটা লাইভ। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নামীদামি ডাক্তার উকিল-জ্যোতিষী ইত্যাদি নানান পেশার মানুষ পালা করে এই অনুষ্ঠানে আসেন। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদেরও নিয়ে আসা হয় বিশেষ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। তবে সবশেষে থাকে মজাদার প্রশ্ন-উত্তরের পালা। তখন সুপ্রতিম আর মোনা যেন আরও স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে।
সব মিলিয়ে মুশকিল আসান একেবারে সুপারহিট।
দিনকুড়ি আগে একটা খাম এসে পৌঁছোয় সুপ্রতিমদের দপ্তরে। খাম খুলেই সুপ্রতিম দ্যাখে ভেতরে একটা টাটকা লাল গোলাপ, আর একটা চিঠি। খামের ওপরে কোনও ডাকটিকিট ছিল না। বোধহয় কেউ কুরিয়ারে পাঠিয়েছে।
চিঠিটা পড়েই সুপ্রতিমের কেমন অস্বস্তি হল।
প্রিয় সুপ্রতিম,
তোমার অনুষ্ঠান আমি সবসময় দেখি। খুব ভালো লাগে। তবে তার চেয়েও ভালো লাগে তোমাকে। শুধু তোমাকে দেখার জন্যেই অনুষ্ঠানটা প্রাণভরে দেখতে হয়। অনুষ্ঠানগুলো আমি সবসময় ভিডিয়ো ক্যাসেটে ধরে রাখি। তারপর যখনই মনখারাপ লাগে, তখনই ওগুলো চালিয়ে তোমাকে দেখি। তোমার সব সুন্দর নাক, মুখ, চোখ, এমনকী ভুরুর কাটা দাগটাও জানো, তোমার ওই কাটা দাগটা নকল করে আমি আমার বুকের বাঁ-দিকে একটা কাটা দাগ এঁকেছি। তোমার প্রতিটি অঙ্গের জন্যে আমার প্রতিটি অঙ্গ সবসময় কাঁদে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু অনুষ্ঠান চলার সময় কিছুতেই স্টুডিয়োর ফোনের লাইন পাই না। তাই বলে চেষ্টা ছাড়িনি। আবার চিঠি দেব। সঙ্গে যে-গোলাপটা পাঠালাম, সেটার কথা টিভিতে বলবে তো! বললে বুঝব আমার ভালোবাসা তুমি ফিরিয়ে দাওনি।
অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো–
ঝুমুর চৌধুরী
কলকাতা ১৪
সাইবার চ্যানেল-এর দপ্তরে প্রচুর প্রেমপত্র আসে। তাতে মোনার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করতে চাওয়া চিঠিই বেশি, সুপ্রতিমের কম। মোনাকে বিয়ে করতে চেয়েও বেশ কয়েকজন সুপাত্রের চিঠি এসেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ওরা কেউই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কারণ, এ-ধরনের স্পন্সরড প্রোগ্রামে এসব উৎপাত নেহাতই মামুলি ব্যাপার। কিন্তু এই চিঠিটা যেন ঠিক মামুলি নয়। কেমন যেন একটু অন্যরকম।
মোনা চিঠিটা নিয়ে সুপ্রতিমের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকি করে পিছনে লেগেছিল। কিন্তু সুপ্রতিম পুরোপুরি সহজ হতে পারেনি। দু-একদিন চিন্তা করার পর ও মোনার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিঠিটার একটা নির্দোষ উত্তর দিয়ে দেবে।
সাধারণত অফিসের সমস্যা বাড়িতে খুব একটা আলোচনা করে না সুপ্রতিম। কিন্তু ঝুমুর চৌধুরির চিঠিটার কথা বলল।
নয়না সেটাকে কোনও গুরুত্বই দিল না। বলল, ওর আর কী দোষ বলো! টিভিতে অমন হেসে-হেসে সুন্দর-সুন্দর করে কথা বলবে, আর প্রেমপত্র আসবে না–এ তো হতে পারে না! তুমি বরং বেচারিকে একটা সান্ত্বনাপত্র লিখে দিয়ো। আর শোনো, তোমাকে একটা গুড নিউজ দেব। আমি একটা বই লিখতে শুরু করেছি। নাম দিয়েছি সুন্দর সোয়ামীর সমস্যা।
ঠাট্টা কোরো না নয়না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছে সুপ্রতিম, চিঠিটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।
নয়না একটা হাতব্যাগে সুতোর নকশা বুনছিল, সিরিয়াস হয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। খামের মধ্যে ফুল পাঠানো, ভুরুর ওই কাটা দাগ নকল করা…। তুমি বরং একটা মামুলি উত্তর দিয়ে দিয়ো। উত্তর না দিলে আবার যদি কিছু হয়…।
পরের মুশকিল আসান অনুষ্ঠানে উত্তর দিয়েছিল সুপ্রতিম।
কলকাতা চোদ্দো থেকে গোলাপফুল পাঠিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানকে ভালোবাসা জানিয়েছেন ঝুমুর চৌধুরী। তাকে আমাদের শুভেচ্ছা জানাই। আর আপনারা, যারা এখন এই অনুষ্ঠান দেখছেন, আপনাদের জানাই–আপনারা যত খুশি প্রেমপত্র পাঠান, তবে মনে রাখবেন, সেগুলো যেন শুধু এই অনুষ্ঠানের নামেই হয়। আমার বা মোনার নামে নয়। কারণ, আমাদের জীবনে প্রচুর প্রেম আছে। আর বাড়তি প্রেম আমরা চাই না। হেসে মোনার দিকে তাকিয়ে সুপ্রতিম জিগ্যেস করেছে,
কী বলো, মোনা?
ঠিকই বলেছেন, সুপ্রতিমদা–এই অনুষ্ঠানকে আমরা আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই। আমরা চাই, এই অনুষ্ঠান হয়ে উঠুক আপনাদের আরও-আরও প্রিয়।
এই উত্তর ঝুমুর চৌধুরীকে যে খুশি করতে পারেনি, বরং ব্যথা দিয়েছে, সেটা বোঝা গেল ওর পরের চিঠিতে।
প্রিয় সুপ্রতিম,
কিছু দিতেই যদি চাও, তা হলে দুঃখ দাও কেন! তোমার এড়িয়ে যাওয়া উত্তরে খুব দুঃখ পেয়েছি আমি। সারাদিন, সারারাত শুয়ে-শুয়ে কেঁদেছি। তোমার অনুষ্ঠানকে ভালোবেসে আমি গোলাপ পাঠাইনি, তোমাকে ভালোবেসে পাঠিয়েছি। তুমি বলেছ তোমার জীবনে প্রচুর প্রেম আছে, বাড়তি প্রেম তুমি চাও না। তোমার মতো সুপুরুষ দেবতাকে অনেকেই যে ভালোবাসবে, সে তো স্বাভাবিক। তাই এ কথায় দুঃখ পাইনি। তবে তুমি জেনে রাখো, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। আমার বুকের কাটা দাগটায় আমি যখন আঙুল বোলাই তখন বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। মনে হয় আমি তোমার ভুরুতে আলতো করে আঙুলের ছোঁওয়া এঁকে দিচ্ছি। তোমাদের স্টুডিয়োর লাইনটা কবে পাব বলতে পারো। সবসময় খালি এনগেজড। ভাবছি, এবার থেকে বাড়ির ফোনেই তোমাকে ধরার চেষ্টা করব। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে তোমার নাম্বারটা পাব তো! বাড়িতে ফোন করলে তুমি কি রাগ করবে? আমি জানি, তুমি রাগ করবে না বরং খুশিই হবে। তারপর.একদিন..যখন আমাদের দেখা হবে…ওঃ! আমি আর ভাবতে পারছি না। বিশ্বাস করো সুপ্রতিম, তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না–তুমিও না। আজ শেষ করছি। অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো–
তোমার, শুধু তোমার
ঝুমুর
চিঠিটা পড়ার পর সুপ্রতিম কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে বসে রইল। ঝুমুরকে ঘিরে এলোমেলো চিন্তা ছুটোছুটি করতে লাগল ওর মাথার ভেতরে। মেয়েটি কেমন যেন অস্বাভাবিকভাবে নাছোড়বান্দা। তা ছাড়া চিঠির কোনও-কোনও জায়গায় কি পাগলামির লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে? নইলে সুস্থ কোনও মেয়ে হলে প্রথম চিঠির এড়িয়ে যাওয়া উত্তরেই তো সব বুঝতে পারত, আর তার ভালোবাসার অসুখটাও সেরে যেত।
ঝুমুর বাড়িতে ফোন করতে পারে ভেবে সুপ্রতিম একটু ভয়ও পেল। যদি ও সত্যি পাগল এবং নাছোড়বান্দা হয় তা হলে তো ফোন করে করে জ্বালিয়ে মারবে! তখন হয়তো পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া গতি থাকবে না। আর পুলিশে খবর দিলেই তো যত ঝামেলা! বাজে পাবলিসিটি!
আচ্ছা, ও যদি টেলিফোন ডিরেক্টরিতে সুপ্রতিমের ঠিকানা জেনে বাড়িতে এসে হাজির হয়! তা হলে তো আবার সেই থানা-পুলিশ!
প্রায় দু-দিন নানান দুশ্চিন্তার পর সুপ্রতিমের আশঙ্কা ধীরে-ধীরে কেটে গিয়েছিল। ও নয়নাকে বলে রাখল ঝুমুর চৌধুরী নামের কেউ ফোন করলে নয়না যেন বলে দেয় রং নাম্বার।
পরের দু-দিনে তিনবার ঝুমুরের ফোন এল। রং নাম্বার বলে ওকে কাটাতে পারেনি নয়না। তার মধ্যে দুবার সুপ্রতিম সত্যিই বাড়ি ছিল না। আর একবার নয়না আড়চোখে সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে ফোনে বলে দিল, উনি তো এখন বাড়ি নেই।
কখন ওঁকে পাওয়া যাবে বলুন তো?
ওঁর তো ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা মতন হবে। আপনি বরং প্রোগ্রাম চলার সময় স্টুডিয়োতে ট্রাই করে দেখুন।
ঠিক আছে। স্টুডিয়োতেই ট্রাই করব। রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল ঝুমুর।
নয়না সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, মেয়েটার গলাটা যেন পিকিউলিয়ার।
পিকিউলিয়ার মানে? ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেছে সুপ্রতিম।
কেমন যেন আদুরে, খসখসে।
হো-হো করে হেসে উঠেছে সুপ্রতিম। হাসতে হাসতে বলেছে, আদুরে! খসখসে! মাই গুডনেস। কী বিচিত্র অ্যাডজেটিভ! তুমি সেলাই ছেড়ে সাহিত্য করলে পারতে।
একটু পরে হাসি থামিয়ে সুপ্রতিম সিরিয়াস ঢঙে জানতে চাইল, অ্যাই, মেয়েটার বয়েস কীরকম হবে বলো তো? আঠেরো-উনিশ? নাকি চল্লিশ-বিয়াল্লিশ?
ঠিক বোঝা গেল না। সাতাশ-আটাশ হবে বোধহয়। ইতস্তত করে নয়না বলল।
তারপর থেকেই সুপ্রতিম কেমন এক অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে লাগল। ঝুমুর চৌধুরীর ছবিটা ওর কাছে কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। এ-ধরনের গায়ে-পড়া প্রেমিকাদের ও বহুবার সামাল দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম ও যেন ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শুরু করার পর থেকেই ও স্টুডিয়োতে ঝুমুরের ফোনের জন্য ভয়েভয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
আজ ওর মন বলছে, ফোনটা আসবে। আজ ওদের স্টুডিয়োর ব্যস্ত লাইনে টুক করে ঢুকে পড়বে ঝুমুর।
এবং সুপ্রতিমের আশঙ্কাই সত্যি হল। ঝুমুর যে ফোনটা করেছে সেটা ফোনে সাড়া দেওয়ার পরই ও বুঝতে পারল।
হ্যালো–মুশকিল আসান
সু-সুপ্রতিম! আমি গো…আমি বলছি…ঝুমুর…।
নয়না ঠিকই বলেছিল। খসখসে আদুরে গলা। কেমন যেন ফিশফিশ সুরে কথা বলছে।
নিজেকে শান্ত রেখে পেশাদারি ঢঙে কথা বলল সুপ্রতিম, কাইন্ডলি আপনার পুরো নাম বলুন।
ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর একটু ধাক্কা খেল : আমায়…আমায় চিনতে পারছ না! আমি ঝুমুর চৌধুরী। কলকাতা চোদ্দো থেকে বলছি। কত কষ্ট করে তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম।
ওদের টেলিফোন-ব্যবস্থাটা এমন যে, সব কথাবার্তাই টিভির দর্শকরা শুনতে পান। সেইজন্যেই সুপ্রতিম বেশ বিব্রত হয়ে পড়ছিল। ও ভাবছিল, কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে টেলিফোনের কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দেবে কি না। নাকি রিসিভার নামিয়ে রেখে লাইন কেটে দেবে? কিন্তু পাগল মেয়েটা তো রোজ ফোন করার চেষ্টা করে জ্বালাতন করে মারবে।
এইসব ভাবতে-ভাবতে সুপ্রতিম কষ্ট করে পেশাদারি হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে। তারপর ওর নিজস্ব ঢঙে জানতে চাইল, বলুন ম্যাডাম, কী আপনার সমস্যা? মুশকিল আসান নিশ্চয়ই তার সমাধান বাতলে দেবে।
আমার…আমার প্রবলেম তুমি। আমি তোমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করব। যখন..যখন আর কেউ থাকবে না। তোমার ফোন নাম্বার খুঁজে বের করে বাড়িতে তিনবার ফোন করেছিলাম…তোমাকে পাইনি। একটা মেয়ে ফোন ধরে বলে কী, রং নাম্বার। হুঁ, বললেই হল! কে ফোন ধরেছিল? তোমার…তোমার ওয়াইফ?
শেষ প্রশ্নটা দর্শকরা শুনতে পাওয়ার আগেই কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ টিপে কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দিল সুপ্রতিম। কিন্তু রিসিভার নামিয়ে রাখল না। ঝুমুর চৌধুরী সম্পর্কে একটা কৌতূহল ওর মধ্যে মাথাচাড়া দিল।
হ্যাঁ–আমার বউ নয়না। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কথাটা বলার সময় আড়চোখে মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল সুপ্রতিম। ওকে হাত নেড়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
হুঁ! জানতাম! বিরক্তি ফুটে উঠল ঝুমুরের গলায়। কিন্তু তারপরই ও কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। খসখসে আদুরে গলার হাসি?
একটু পরে হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, কাউকে আমি পরোয়া করি না। কেন জানো? কারণ, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। কবে তোমার বাড়ি যাব বলো? শেষ প্রশ্নটায় যেন কোনও কিশোরীর মিনতি ঝরে পড়ল।
সুপ্রতিমের মন খুব দ্রুত চিন্তা করছিল।
মেয়েটি তো মনে হচ্ছে নিশ্চিত পাগল। ওর সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি বুঝিয়ে বললে কি ওর এই প্রেমের পাগলামি সারতে পারে? ওকে বলবে একবার বাড়িতে আসতে? কিন্তু নয়না যদি কিছু মাইন্ড করে!
প্রতি মঙ্গলবার সন্ধেবেলা নয়না কাছাকাছি একটা সেলাই-স্কুলে এমব্রয়ডারির কাজ শেখাতে যায়। ছটায় বেরোয়, দু-আড়াই ঘণ্টা পর ফেরে। ওর হাতের কাজ খুব ভালো। তা ছাড়া সূক্ষ্ম সেলাই নিয়ে সময় কাটাতে ওর বেশ লাগে। মঙ্গলবার সাড়ে ছটা-সাতটা নাগাদ তা হলে ঝুমুরকে আসতে বলবে সুপ্রতিম। তখন ফ্ল্যাট ফাঁকাই থাকবে। ঠিকে কাজের লোক বিমলামাসিও রোজ সন্ধেবেলা বাসন মেজে, ঘর মুছে, ছটার মধ্যেই চলে যায়।
কিন্তু ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে মেয়েটা কোনও কাণ্ড বাধিয়ে বসবে না তো! দুর, কী আর করবে! সুপ্রতিম নিজে ঠিক থাকলে আর ভয় কীসের! কিন্তু মেয়েটার বয়েস কত? সতেরো, আঠারো বা কুড়ি হলে তো ইমোশনাল প্রবলেম হতে পারে।
সুপ্রতিম কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ঠিকমতো আর ভাবতে পারছিল না।
কবে যাব, বলো? খসখসে আদুরে গলায় আবার জানতে চাইল ঝুমুর।
মঙ্গলবার সন্ধেবেলা। ঠিক সাতটায়। সুপ্রতিমের মুখ দিয়ে কেমন যেন আলতোভাবে খসে পড়ল কথাগুলো।
তোমার ফ্ল্যাটবাড়িটা আমি দেখে এসেছি। কঁকুড়গাছিতে। সামান্য হাসল ঝুমুর। একটু থেমে তারপর বলল, তোমার ফ্ল্যাটটা তো একতলায়…।
পলকে ঘাম ফুটে উঠল সুপ্রতিমের কপালে। এর মধ্যেই ওর ঠিকানা বের করে বাড়িটা চিনে এসেছে মেয়েটা! মেয়েটাকে বাড়িতে ডেকে আবার কোনও বিপদ হবে না তো! তখন হয়তো সত্যি-সত্যি থানা-পুলিশ করতে হবে। কিন্তু আর তো ফেরার পথ নেই! তির ছিটকে গেছে হাত থেকে।
মঙ্গলবার সন্ধেবেলা যাব। ঠিক…সাতটায়…। দেখা হওয়ার আগে তা হলে ফোন করব না। একটু চুপচাপ। তারপর ও আমাকে একপলক দেখলেই তুমি বুঝবে কেন আমার ভালোবাসা অন্যরকম। চাপা গলায় কথাগুলো বলে অল্প হাসল ঝুমুর ও আই লাভ য়ু, লাভ। তুমি অপেক্ষা কোরো। ঠিক সাতটায়…।
রিসিভার নামিয়ে রেখে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল সুপ্রতিম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্মার্ট ঢঙে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেল। তা সত্ত্বেও সুপ্রতিম মোনার সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে সহজভাবে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল।
মোনা, তুমি ভীষণ সেলফিস।
কেন? মোনা দুষ্টু হেসে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে।
পাগলের প্রবলেমগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দিব্যি মজায় আছ। তারপর দর্শকদের লক্ষ্য করে : কী আপনারাই বলুন–
মোনাও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, যারা অন্যকে পাগল করে সেইসব পাগলের প্রবলেম তাদেরই সম্ভ করতে হবে। এটা আপনাদের সকলের প্রতি আমার উপদেশ। আশা করি ঠাট্টা করলাম বলে আপনারা কিছু মনে করবেন না। বড় করে হাসল মোনা। তারপর সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, সুপ্রতিমদা, এবার সাক্ষাকারপর্ব শুরু করুন। হাতে আর সময় বেশি নেই।
হ্যাঁ। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে এসেছেন ডক্টর পার্থসখা মণ্ডল। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। উনি শিশু ও কিশোরদের মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেবেন…।
এরপর শুরু হয়ে গেল আগে রেকর্ড করা ডক্টর মণ্ডলের সাক্ষাৎকার।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সুপ্রতিম ঠিক করল ঝুমুরের বাড়ি আসার ব্যাপারটা ও নয়নাকে জানাবে না। মোনা ওকে টেলিফোনের কথার্বাতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করেছিল। সুপ্রতিম ওকে সবই বলেছে। শুধু মঙ্গলবার সন্ধে সাতটার সাক্ষাৎকার-এর কথা বলেনি।
সুপ্রতিম হিসেব করে দেখল মঙ্গলবার আসতে এখনও ঠিক তিনদিন বাকি। সেদিন ওকে স্টুডিয়ো থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
.
দরজায় কেউ টুং-টাং করে কলিংবেল বাজাতেই সুপ্রতিম চমকে উঠল। চকিতে ওর নজর চলে গেল দেওয়ালে টাঙানো শৌখিন ইলেকট্রনিক পেন্ডুলাম ঘড়ির দিকে। এবং সঙ্গে-সঙ্গে ঘড়িও শব্দ করে ওকে জানিয়ে দিল এখন ঠিক সাতটা।
ড্রইংরুমের সোফায় বসে ঝুমুরের জন্য অপেক্ষা করছিল সুপ্রতিম। অপেক্ষা করতে করতে ওর টেনশান ক্রমে বাড়ছিল। নয়না, বিমলামাসি, অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। তখন থেকে সুপ্রতিম ফ্ল্যাটে একা। হাতে সময় পেয়ে সামান্য একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। শরীরের এখানে-ওখানে ডিওডোরান্ট স্প্রে করেছে। অবচেতনে ঝুমুরের আসার ব্যাপারটা মাথায় ছিল।
আবার বেজে উঠল কলিংবেল।
ঘোর কাটল সুপ্রতিমের। চটপট উঠে দরজার কাছে গিয়ে ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখল।
ঝুমুর নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। ম্যাজিক আই-এর লেন্স দিয়ে যেটুকু বিকৃত ছবি দেখা গেল তাতে বলা যায় লোকটি ফরসা, দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখে যেন একটা ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ ভাব।
দরজা খুলল সুপ্রতিম। সঙ্গে-সঙ্গে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ওকে ভাসিয়ে দিল।
লোকটি, অথবা ছেলেটি, সামান্য হাসল। হাসিতে লজ্জা, সঙ্কোচ। কোনওরকমে বুকের কাছে হাত তুলে সৌজন্যের নমস্কারের ভঙ্গি করল। তারপর এক পা বাড়িয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়ল, বলল, একটু কথা আছে।
উচ্চারণগুলো এতই অস্পষ্ট যে সুপ্রতিমকে বেশ কষ্ট করে কথাগুলো বুঝতে হল।
কখনও কখনও দু-একজন যশোপ্রার্থী মানুষ সুপ্রতিমের সঙ্গে দেখা করতে আসে। কী করে টিভিতে চান্স পাওয়া যায় তার কৌশল বা সুলুকসন্ধান জিগ্যেস করে সুপ্রতিমকে বিব্রত করে, বিরক্ত করে। ইনিও বোধহয় সেই দলের–ভাবল ও।
লোকটি বেশ রোগা, উচ্চতায় নিতান্তই খাটো, তবে মাথার চুল বেশ বড় কষে তেল মেখে কীর্তনীয়াদের মতো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখ টানা-টানা–কেমন এক তন্দ্রার ভাব সেখানে জড়িয়ে আছে। বাঁ-গালে, চোখের সামান্য নীচে, সরষের মাপের একটা কালো জজুল। পুরুষটি মেয়ে হলে ওটাকে বিউটি স্পট বলা যেত। পরনে সাদার ওপরে নীল স্ট্রাইপ দেওয়া ফুল শার্ট, আর নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট।
আর বয়েস কতই-বা হবে! বড় জোর তেইশ-চব্বিশ।
বলুন, কী দরকার? সুপ্রতিম জিগ্যেস করল।
এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে গেল।
সুপ্রতিমের চোখে চোখ রেখে লোকটি ডানহাতে খোলা দরজায় পাল্লাটাকে ঠেলে বন্ধ করে দিল। ক্লিক শব্দে নাইট ল্যাচ আটকে গেল।
তারপর আদুরে খসখসে গলায় বলল, তোমাকে চাই গো, তোমাকে চাই।
এবং তাড়া-খাওয়া হরিণের ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সুপ্রতিমের গায়ে। ওকে আঁকড়ে ধরে চকাৎ করে এক তীব্র চুমু খেল ওর ঠোঁটে।
গায়ে আরশোলা বা মাকড়সা পড়লে মানুষ যেমন ঘেন্না, অস্বস্তিতে শিউরে ওঠে, ঠিক সেইরকম প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল সুপ্রতিম। ওর গা ঘিনঘিন করছিল। হাতের পিঠ দিয়ে বারবার ঘষে-ঘষে ঠোঁট মুছল।
ছেলেটি পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে উঠে বসে কাতর আকুল চোখে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে। অদ্ভুত এক মেয়েলি সুরে বলল, আমাকে তুমি…চিনতে পারোনি… আমি…ঝুমুর…ঝুমুর চৌধুরী।
সুপ্রতিম ভীষণ একটা ধাক্কা খেল।
এতদিন এই ছেলেটাই ওকে মেয়ে সেজে চিঠি দিয়েছে, ফোন করেছে! একটা জঘন্য বৃহন্নলা! এইজন্যই পাগলটা চিঠিতে লিখেছিল? .আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি।
সুপ্রতিমের গা গুলিয়ে উঠল। ওয়াক উঠতে চাইল গলা দিয়ে।
ঝুমুর তখন পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গোলাপ ফুল আর একটা রঙিন কাগজে মোড়া বাক্স বের করে ফেলেছে। সে-দুটো সুপ্রতিমের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এই ফুল আর একটা পার্কার পেন…তোমার জন্যে এনেছি। তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না..প্লিজ…।
ঝুমুর যদি পুরুষ হয় তা হলে ওর গলাটা মেয়েলি। আর যদি ও মেয়ে হত তা হলে বলা যেত গলাটা কেমন যেন পুরুষালি। কিন্তু আসলে ও কী?
ঝুমুর উঠে দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে এল সুপ্রতিমের কাছে। মিষ্টি করে হেসে উপহার দুটো বাড়িয়ে দিল। বলল, আমি একটুও রাগ করিনি গো। আমার ভালোবাসার প্রথম প্রথম এরকম হয়– পরে সব ঠিক হয়ে যায়। এই নাও।
সুপ্রতিম কেমন এক অশুভ হাওয়া-বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল। ঝুমুরের কথায় ঘোর কাটতেই প্রচণ্ড রাগে সপাটে এক ঘুষি বসিয়ে দিল ওর মুখে।
বিশ্রী একটা শব্দ হল। ঝুমুরের ঠোঁট থেঁতলে রক্ত বেরিয়ে এল। ও আবার ছিটকে পড়ল মেঝেতে। উপহারগুলো হাত থেকে পড়ে ছড়িয়ে গেল।
সুপ্রতিম ভেতরে-ভেতরে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছিল। একসঙ্গে অনেক কথা বলতে গিয়ে সব কথা কেমন যেন আটকে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরে অনেক কিছু দপদপ করছে। এখুনি যেন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে।
এই মুহূর্তে বেরোও। জানোয়ার কোথাকার! আউট! হাঁফাতে-হাঁফাতে চেঁচিয়ে বলল সুপ্রতিম।
কিন্তু ঝুমুর ওর ধমক গ্রাহ্য করল বলে মনে হল না।
রক্তাক্ত মুখেই আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা। ওর সাদা জামায় রক্তের ছিটে লেগেছে। সেই অবস্থাতেই বিচিত্র বিভঙ্গে শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল ও। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, আমি কিছু মনে করিনি, হানি। তোমাকে আমি চাই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই। হাজার টরচার করেও তুমি আমাকে টলাতে পারবে না। তোমার হাতের ছোঁওয়া আমার কাছে যে কী, তা তুমি জানো না। আর…আর এইটা দ্যাখো। বলে একটানে জামাটা ছিঁড়ে দিল ঝুমুর। কয়েকটা বোতাম ছিঁড়ে ছিটকে গেল। বুকের কাছটায় অনেকখানি ফেঁসে গেল জামাটা। আর তখনই ঝুমুরের খালি বুক দেখা গেল।
ওর ঈষৎ মেয়েলি ঢঙের বুকে বাঁ-দিকে সত্যিকারের একটা ছোট্ট কাটা দাগ। সুপ্রতিমের ডান ভুরুর দাগটার মতো।
ঝুমুর চিঠিতে লিখেছিল, ও বুকে একটা কাটা দাগ এঁকে নিয়েছে। কিন্তু এ তো সত্যিকারের কাটা দাগ। ব্লেড, ছুরি অথবা ক্ষুর দিয়ে চিরে ও তৈরি করেছে।
আবার খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুমুর। রক্তমাখা মুখে ওর হাসি কেমন অলৌকিক দেখাচ্ছিল।
হঠাৎই ও আবার ঝাঁপিয়ে এল সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম খপ করে এক হাতে ওর গলা চেপে ধরল। তারপর ওর পলকা শরীরটাকে পিছনদিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল দরজার কাছে।
য়ু সান অফ আ বিচ! ফাকিং গে বাস্টার্ড! আর কখনও যদি আমাকে ডিসটার্ব করো তা হলে একেবারে খুন করে ফেলব!
দরজা খুলে ঝুমুরের দেহটাকে বলতে গেলে বাইরে ছুঁড়ে দিল সুপ্রতিম। ওর মাথাটা সিঁড়ির রেলিঙে ঠুকে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। ও কাত হয়ে টলে পড়ে যেতে গিয়েও সিঁড়ির রেলিং ধরে কোনওরকমে সামলে নিল। ঘোলাটে নজরে তাকাল ওর ভালোবাসার পুরুষের দিকে। জড়ানো খসখসে গলায় বলল, আমি কিছুই মাইন্ড করিনি। যতই ফিরিয়ে দাও, আবার আমি আসব। একদিন-না-একদিন তুমি আমাকে মেনে নেবেই…।
ওর গায়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল সুপ্রতিম। তারপর দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিমের সারা শরীর অবসাদ আর ক্লান্তিতে কেমন ভারী হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ও চোখ বুজে হাঁফাতে লাগল।
এক অদ্ভুত গ্লানি সুপ্রতিমকে জড়িয়ে ধরেছিল। বারবার ওয়াক উঠে আসতে চাইছিল ওর গলা দিয়। এরকম গা ঘিনঘিনে ঘটনার কথা কাউকে কি বলা যায়। শেষ পর্যন্ত কি সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে?
ঝুমুরকে ঘুষি মেরে সুপ্রতিমের ডানহাতের পিঠটা ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছিল। ছড়ে যাওয়া জায়গাটা ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে-জোরে কয়েকবার চুষল ও। তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা দলিত গোলাপ আর রঙিন প্যাকেটটার দিকে তাকাল। ঝুমুরের রক্ত-মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল আবার।
গোপনে কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা করলে সে-ঘটনাটা নয়নার কাছে ও অবশ্যই গোপন করতে চাইত। কিন্তু এই ব্যাপারটা এত অস্বস্তির আর এত লজ্জার যে, এটা আরও বেশি করে গোপন করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু নয়নাকে বলতেই হবে–সে ও যা-ই ভাবুক।
সবরকম দ্বিধা কাটিয়ে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেল সুপ্রতিম। নয়নাকে সেলাই স্কুলে। ফোন করে এখনই বাড়ি আসতে বলবে। তারপর…।
.
নয়নাকে সব কথা খুলে বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের কান্না পেয়ে গেল। একটা অসহ্য রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ওর ভেতরে দলা পাকিয়ে উথলে উঠছিল। নয়নাকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রতিম বাঁচার একটা পথ খুঁজছিল। সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত ওর শত্রু হয়ে দাঁড়াল। এমনই সুপুরুষ-সৌন্দর্য যে, একজন পুরুষও তার প্রেমে পড়ে যায়!
সারাটা রাত ওদের উথালপাতালভাবে কাটল। শেষ পর্যন্ত নয়না ওকে বলল, ব্যাপারটা থানায় জানানো দরকার।
সুপ্রতিম রাজি হল। তারপর মোনাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আপাতত সাত-দশদিন ওর পক্ষে অফিস করা সম্ভব হবে না। না, না, তেমন সিরিয়াস কোনও ব্যাপার নয়। পারিবারিক কয়েকটা ব্যাপারে চাপ এসে পড়েছে। ওরা যেন সুপ্রতিমের বদলে আর কাউকে দিয়ে কটা দিন কাজ চালিয়ে নেয়।
সুপ্রতিম জানে, ওরা বিপ্লব সরকার কিংবা অনির্বাণ পুরকায়স্থকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবে। আগেও দু-একবার এরকম হয়েছে।
মোনা অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সুপ্রতিম ঝুমুরের ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও বলল না। ও চাইছিল না ব্যাপারটা বেশি জানাজানি তোক। অদ্ভুত এক লজ্জা আর সঙ্কোচ ওর গলা টিপে ধরছিল।
নয়না আর সুপ্রতিম বেলা বারোটা নাগাদ থানায় পৌঁছোল।
বাইরের ঘরটায় কয়েকটা লম্বা-লম্বা বেঞ্চি পাতা। একপাশে বড় মাপের একটা টেবিল। তাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। টেবিলে পুরোনো আমলের টেলিফোন, কিছু ফাইলপত্র, বড় কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল।
ঘরটা এমন অন্ধকার-অন্ধকার যে, দিনের বেলাতেও দু-দুটো টিউব লাইট জ্বেলে রাখতে হয়েছে। সিলিং-এ সাবেকি একটা বেঢপ পাখা টিমে তালে ঘুরছে। তার হাওয়ায় দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে-থেকে কেঁপে উঠছে।
টেবিলের ওপাশে সাদা ইউনিফর্ম পরে একজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। বয়েস বড়জোর পঁয়ত্রিশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে উদাসীন বিরক্ত ভাব।
টেবিলে রাখা কাঠের নেমপ্লেট পড়ে জানা গেল অফিসারের নাম টি. দাস., সাব-ইনস্পেক্টর।
সুপ্রতিম আর নয়না বসল।
দাসবাবু সপ্রশ্ন নজরে ওদের দিকে তাকালেন।
একটু ইতস্তত করে সুপ্রতিম বলল, আমি…আমি…একটা ডায়েরি করতে চাই।
কথা বলতে বলতে ও চারপাশে দেখছিল। দু-একজন লোক এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। তাদের চোখেমুখে ব্যস্তসমস্ত ভাব।
সুপ্রতিমের মনে হল, দাসবাবু ছাড়া কেউ ওদের কথা শুনতে পাবে না। তাই দাসবাবু যখন ডায়েরি-বই নিয়ে ডটপেন বাগিয়ে বললেন, বলুন–, তখন ও প্রথমে নিজের পরিচয় দিল, তারপর সহজভাবেই ঝুমুরের ব্যাপারটা বলে গেল। টেবিলের আড়ালে নয়না ওর একটা আঙুল ছুঁয়ে ওকে সাহস জোগাচ্ছিল। ও টের পেল, সুপ্রতিমের আঙুল কাঁপছে।
কিছু লেখার আগে দাসবাবু ব্যাপারটা শুনে নিচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝে ছোটখাটো শব্দ করছিলেন, আর ডটপেনটা ডায়েরি-বইয়ের পাতায় ঠুকছিলেন।
শুনতে-শুনতে একসময় তার মুখে মজা পাওয়ার ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং!
হঠাৎই একজন সাদা-পোশাকের অফিসার সিগারেট টানতে টানতে এগিয়ে এলেন। ধপ করে বসে পড়লেন দাসবাবুর পাশের চেয়ারটায়। আড়চোখে নয়নার সৌন্দর্য চেটে নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, কী কেস, দাস?
হোমো কেস। দাস মুচকি হেসে বললেন।
নয়না আর সুপ্রতিম হোমো শব্দটা শুনে কেমন যেন সিঁটিয়ে গেল।
বলুন, তারপর কী হল– সুপ্রতিমকে তাড়া দিলেন দাস।
খুঁড়িয়ে চলা ছ্যাকড়াগাড়ির মতো থতিয়ে-থতিয়ে কথা শেষ করল সুপ্রতিম। টের পেল, ওর ঘাড়ে, কপালে, ঘাম জমছে।
ওর কথা শেষ হওয়ামাত্রই সাদা-পোশাকের অফিসারটি বলে উঠলেন, এ-ডায়েরি নিয়ো না, দাস–এই ভদ্রলোক ফেঁসে যাবেন।
দাসবাবু ওঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন, শঙ্করদা।
নয়না অবাক চোখে জানতে চাইল, কেন? ডায়েরি নেবেন না কেন? লোকটা আমাদের লাইফ হেল করে দিচ্ছে…।
সবুর, ম্যাডাম, সবুর…। সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে সাদা-পোশাকের অফিসারটি বললেন, একটু মাথা খাটান, তা হলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। একটা ইয়াং ছেলে আপনার হাজব্যান্ডকে আমি ভালোবাসি বলে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছে। মানছি, অন্যায় করেছে। কিন্তু তার বদলে আপনার হাজব্যান্ড কী করেছেন? না ছেলেটাকে তুলোধোনা করে মুখ-মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছেন। কী, ঠিক বলছি তো? শেষের প্রশ্নটা সুপ্রতিমকে লক্ষ্য করে।
সুপ্রতিম কোনও জবাব না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইল। নয়নাও ঠিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
সাদা-পোশাকের অফিসারের কথার খেই ধরে দাস সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই ছেলেটা যদি থানায় এসে আপনার নামে এফ.আই.আর. করে তা হলে তো আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন! তখন বিচ্ছিরি রকম স্ক্যান্ডাল হবে, লোক জানাজানি হবে–একটা কেলো হয়ে যাবে। একটু সময় দিলেন ওদের ও তার চেয়ে বরং বাড়ি যান। ছেলেটা আবার এলে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে নিন। ওর সঙ্গে মিউঁচুয়াল করে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনও ওয়ে আউট দেখছি না। শঙ্করদা কী বলেন? সাদা-পোশাকের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন দাস।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে দিতে শঙ্করবাবু বললেন, এ ছাড়া কোনও পথ নেই। এসব হোমো কেস নিয়ে ক্যাচাল যত কম হয় আপনাদের পক্ষে ততই ভালো। তবে এরপর কী হয়-না-হয় সেটা আমাদের ইনফর্ম করতে পারেন। সিরিয়াস কোনও টার্ন নিলে তখন…।
সুপ্রতিম আর নয়না ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অফিসাররা যে ঠিক কথাই বলছেন, সে নিয়ে ওদের মনে কোনওরকম সন্দেহ ছিল না।
এক অদ্ভুত আতঙ্কে অবশ হয়ে শোলার তৈরি পায়ে ওরা বাড়ি ফিরে এল। নয়না মনে মনে ভাবছিল, কেমন দেখতে এই ঝুমুর চৌধুরীকে?
সুপ্রতিম যখন ফ্ল্যাটের দরজায় নাইট ল্যাচের চাবি ঘোরাচ্ছে তখন শুনতে পেল ঘরের ভেতরে টেলিফোন বাজছে।
দরজা খুলে তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরল সুপ্রতিম।
হ্যালো।
সুপ্রতিম…মাই লাভ.আই লাভ য়ু…।
নয়না স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখল ওর মুখটা চোখের পলকে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নয়না বুঝতে পারল, সুপ্রতিমকে কে ফোন করেছে।
.
ঝুমুরের টেলিফোনের উৎপাত চলতেই থাকল, কিন্তু সুপ্রতিম কিছুতেই আর বিরক্ত হল না। থানার দুই অফিসারের কথা ওর মনে ছিল। তাই ও মোলায়েমভাবে কথা বলে ঝুমুরকে নিরস্ত করতে চাইল। ওকে অনুনয় করে বলল, তুমি যেরকম ভালোবাসা চাও আমার মধ্যে সেরকম ভালোবাসা নেই। তুমি ভুল করছ।
ওকে বাধা দিয়ে আদুরে ঢঙে ঝুমুর বলল, না, না, ভুল নয়। তুমি আমার কাছে ধরা দিলেই বুঝবে আমি ভুল করিনি। আমি মনের মতো মনের মানুষ পেয়েছি।
সুপ্রতিম অনেক চেষ্টা করেও গা ঘিনঘিন করা ভাবটা চেপে রাখতে পারেনি। এবং টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
কিন্তু পরে আবার ঝুমুরের ফোন এসেছে।
সুপ্রতিম প্রতিবারই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ফল হয়েছে উলটো। ফোনের ও-প্রান্তে ঝুমুর কেঁদে ভাসিয়েছে। আত্মহত্যা করবে বলে ওকে ভয় দেখিয়েছে। কখনও বলেছে, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। কখনও বলেছে, ট্রেনের তলায় মাথা দেবে। আবার কখনও বা বলেছে, গলায় দড়ি দেবে।
সুপ্রতিম বেশ বুঝতে পারছিল, ওর জীবনের কোথায় যেন পূর্ণগ্রাস গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে।
ঝুমুরের নিয়মিত ফোন আর ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম সুপ্রতিমকে অতিষ্ঠ করে তুলল। কয়েকদিন পর ওর মনে হতে লাগল ও বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সত্যি-সত্যিই ঝুমুরের অন্যরকম ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।
সুপ্রতিমের এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে এক মঙ্গলবার সন্ধে সাতটা নাগাদ ওদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।
নয়না বাড়িতে নেই। সেলাইয়ের স্কুলে গেছে। সুপ্রতিমকে একা রেখে ও যেতে চায়নি, কিন্তু সুপ্রতিমই জোর করে ওকে পাঠিয়েছে, বলেছে, আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! তা ছাড়া ওই ঝুমুর চৌধুরীকে ভয়ের কী আছে! অগের দিন ওকে বেধড়ক ঠেঙিয়েছি। আজ যদি হতচ্ছাড়াটা আসে তা হলে হকি স্টিক দিয়ে পেটাব।
সুপ্রতিম একসময় হকি খেলত। ওর হকি স্টিকটা বেডরুমের দেওয়ালের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা থাকে। সেটা এখন ও ড্রইংরুমের সোফার তলায় এনে রেখেছে। কারণ, ওর মন বলছিল, ঝুমুর যেরকম খ্যাপা তাতে ও কোনও একটা মঙ্গলবার সন্ধে সাতটায় আবার ওদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দিতে পারে সুপ্রতিমকে একা পাওয়ার জন্য।
তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই চমকে উঠেছিল সুপ্রতিম। তারপর সতর্ক পায়ে দরজার কাছে গিয়ে ম্যাজিক আই দিয়ে উঁকি মেরেছে।
না, ঝুমুর চৌধুরী নয়। দরজায় দাঁড়িয়ে ন্যাড়া মাথা গোঁফওয়ালা একজন লোক।
দরজা খুলে দিল সুপ্রতিম।
রোগা ছোটখাটো চেহারার লোকটি ঘরে ঢুকে পড়ল। তার হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস। শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে একেবারে ফিটফাট। মুখে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি।
সেল্সম্যান নাকি! ভাবল সুপ্রতিম। কিন্তু এই সন্ধে সাতটার কী বিক্রি করতে এসেছে?
সুপ্রতিম ভদ্রতা করে বলল, বলুন, কী চাই?
খুব ইমপর্ট্যান্ট বিজনেস। চাপা গলায় অস্পষ্টভাবে বলল লোকটি। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিম লোকটির দিকে পিছন ফিরে সোফার দিকে একটা পা বাড়িয়েছিল, দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ভুরু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
ততক্ষণে ঝুমুর ওর নকল গোঁফটা একটানে খুলে ফেলে দিয়েছে ঘরের মেঝেতে। আর হাতের ব্রিফকেসটাও একপাশে নামিয়ে রেখেছে।
তুমি!
হ্যাঁ গো, আমি। তোমার কাছে না এসে থাকতে পারলাম না। ফোনেই তো বলেছিলাম, তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যদি তুমি মুখের ওপরে দরজা দিয়ে দাও, তাই মাথা ন্যাড়া করে নকল গোঁফ লাগিয়ে আসতে হয়েছে…।
ঝুমুর বিচিত্র ঠমক-ঠামক করে কথা বলছিল। কটাক্ষ হানছিল। ঠোঁটের কোণ কামড়াচ্ছিল।
সুপ্রতিম পাথর হয়ে তাকিয়ে ছিল অদ্ভুত এই প্রাণীটার দিকে। আর প্রাণপণে গা ঘিনঘিন করা ভাবটাকে সামাল দিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল।
তুমি রাগ করলে না তো! তোমার ওপরে আমার কোনও রাগ নেই। যাকে ভালোবাসি তার ওপরে কি রাগ করে থাকা যায়!
কথাগুলো বলেই সুপ্রতিমের দিকে ঝাঁপিয়ে এল ঝুমুর। সুপ্রতিম ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই ও আবেগজর্জর প্রেমিকার মতো সুপ্রতিমের বুকে মুখ ঘষতে লাগল, আর ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগল, আমার আদর করো। লক্ষ্মীসোনা, আমায় আদর করো। আর আমি পারছি না। প্লিজ…প্লিজ…। আমার শুধু বাইরেটা পুরুষ–ভেতরটা নয়।
সুপ্রতিম মুখ নামিয়ে দেখল একটা ন্যাড়া মাথা ছেলে ওর বুকে মুখ ঘষছে। ও এমন নির্লিপ্তভাবে দেখছিল, যেন ওটা ওর বুক নয়–অন্য কোনও পুরুষের বুক।
হঠাৎই বিকট শব্দে ওয়াক তুলল সুপ্রতিম। ওর সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। এবং একইসঙ্গে এক ঝটকায় ঝুমুরকে ছিটকে ফেলে দিল। তারপর মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বারবার বমির হেঁচকি তুলতে লাগল।
ওর গলার পাশে শিরা ফুলে উঠল। খানিকটা জল আর লালা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
ঝুমুর তখন মেঝেতে সোজা হয়ে বসেছে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে সুপ্রতিমের দিকে। আর গুনগুন করে গাইছে, …তোমার আদর পেলে আমি স্বর্গে চলে যাই / মর্ত্যে যে আর আমার কিছু নাই…।
একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল সুপ্রতিমের মাথায়। ওর চোখ চলে গেল সোফায় নীচে হকি স্টিকের দিকে। হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে ওটা। চুলোয় যাক দাসবাবু আর শঙ্করবাবুর হিতোপদেশ! দাঁত বের করে বসে থাকা ওই জানোয়ারটা ওঁদের তো কিছু করেনি। শুধু সুপ্রতিমের জীবনটাকে নরক করে তুলেছে।
কয়েক সেকেন্ড নিজের সঙ্গে লড়াই করল সুপ্রতিম। তারপর ডানহাত বাড়িয়ে দিল হকি স্টিকটার দিকে। ওটা আঁকড়ে ধরল শক্ত মুঠোয়।
আজ শুয়োরের বাচ্চাটার একদিন কি আমার একদিন। দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল ও।
তারপর হকি স্টিক হাতে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। দু-পা ফেলে পৌঁছে গেল ঝুমুরের কাছে। এবং খ্যাপা দাঁতালো শুয়োরের রাগ নিয়ে হকি স্টিক চালাতে শুরু করল।
ছোটবেলায় ধুনুরিদের লেপ-তোশক তৈরি করতে দেখেছে সুপ্রতিম। শীতের রোদে ছাদে বসে জমাট বাঁধা শক্ত তুলোকে তারা পিটিয়ে-পিটিয়ে নরম করে। এখন হকি স্টিক চালাতে-চালাতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। তবে ধুনুরিদের শব্দ যদি সত্তর-আশি ডেসিবেল হয় তা হলে সুপ্রতিমের আঘাতের শব্দ কম করেও একশো ডেসিবেল। তা ছাড়া ধুনুরিদের বেলা এমন রক্তারক্তি ব্যাপারটা ছিল না।
সুতরাং মেঝেতে বসে থাকা ছোটখাটো ছেলেটাকে নিষ্ঠুরভাবে তালগোল পাকিয়ে দিল সুপ্রতিম। ঝুমুর ওর পায়ের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে কুকুরছানার মতো কেঁউকেঁউ করতে লাগল। শব্দটা কেমন কান্না মেশানো গোঙানির মতো লাগছিল। ওর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, জামায় রক্তের ফোঁটা ছিটকে লেগেছে, শরীরটা যেন ভাঙাচোরা দ হয়ে গেছে।
উন্মত্ত রাগ কমে এলে সুপ্রতিম হকি স্টিকটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাপরের মতো হাঁপাচ্ছিল ও। ভাবছিল, এত শব্দ-টব্দ পেয়ে লোকজন না ছুটে আসে ওর ফ্ল্যাটে। তারপর থানা-পুলিশ…।
কয়েক সেকেন্ড অন্যমনস্ক হয়েছিল সুপ্রতিম। সেই ফাঁকেই ওর উরুতে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
তালগোল পাকানো ছেলেটা বিদ্যুৎগতিতে হাত চালাল। একবার, দুবার, তিনবার। প্রথম দুবার ঊরুতে, তৃতীয়বার হাঁটুর নীচে।
সুপ্রতিমের মনে হল ওর পায়ে জ্বলন্ত কয়লা ঘষে দিয়েছে কেউ। ও ঝুঁকে পড়ে পা চেপে ধরল।
আর তখনই ওর কোমরে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
যত না যন্ত্রণা পেল তার চেয়ে বেশি অবাক হল সুপ্রতিম। ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না ওর পায়ের কাছে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ক্ষীণজীবী মাংসপিণ্ডটা এইরকম ভয়ানক কাজ করতে পারে।
সুপ্রতিম পড়ে গেল মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই পাগলটা লাফিয়ে উঠে এল ওর শরীরের ওপরে। ডানহাতে ধরা ক্ষুরটা চেপে ধরল সুপ্রতিমের বাঁকানের নীচে, খসখসে আদুরে গলায় বলল, ভালোবাসা আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই গো। তোমাকে খতম করে দিলে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা না পেলে কষ্ট যে আরও বেশি! আই লাভ য়ু, ডার্লিং…।
খুব কাছ থেকে ঝুমুরের মুখটা লক্ষ করে এই প্রথম ওকে ভয় পেল সুপ্রতিম। ওরা দুজনেই হাঁফাচ্ছিল। একজনের নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই-অক্সাইড ঢুকে পড়ছিল আর-একজনের নাকে। তাই ওদের দুজনেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।
এক অজানা ভয়ে সুপ্রতিম কাঠ হয়ে গেল। ও টের পাচ্ছিল, ওর কোমর, উরু, পা থেকে চুঁইয়ে-টুইয়ে রক্ত পড়ছে। নয়না এখনই এসে পড়ছে না কেন! নয়নার ফিরে আসার জন্য মনে মনে আকুল প্রার্থনা করতে লাগল ও।
ঝুমুর হিসহিস করে বলল, অসভ্যতা করলে গলা ফাঁক করে দেব। আর যদি চেঁচাও, তা হলে চিৎকারটা মুখ দিয়ে বেরোবে না–গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
ঝুমুর সুপ্রতিমের বুকের ওপরে উঠে বসল। বাঁ-হাতে টান মেরে সুপ্রতিমের জামা ছিঁড়ে দিল। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর বুকে ক্ষুর চালিয়ে আড়াআড়ি দাগ টেনে দিল।
সুপ্রতিম যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল।
ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করে ঝুমুর বলল, চুপ, সোনামণি। অনেক কষ্ট সয়ে তবেই আসল ভালোবাসা পাওয়া যায়।
প্যান্টের পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করল ঝুমুর। ডান হাতের ক্ষুর নাচাতে নাচাতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা সুপ্রতিমের মাথার দিকটায় গেল। তারপর উবু হয়ে বসে পড়ল। ক্ষুরটা হাতের কাছেই নামিয়ে রেখে নোড়ো না, লক্ষ্মীটি। নইলে বিপদ হবে। বলতে বলতে সুপ্ৰতিমের দুটো হাত বাঁধতে শুরু করল।
হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেলে দড়ির প্রান্তটা বেঁধে দিল একটা সোফার দু-পায়ার সঙ্গে। এখন অনেক চেষ্টা করে সুপ্রতিম হয়তো সোফাটাকে সামান্য নাড়াতে পারবে, কিন্তু সুপ্রতিম কোনওরকম চেষ্টা করছিল না। ও চোখ ঘুরিয়ে অন্যরকম ঝুমুরকে লক্ষ করছিল, আর মৃত্যুভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল।
দড়ির বাকি অংশটা ক্ষুর দিয়ে কেটে নিল ঝুমুর। চলে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। পা দুটো জোড়া করে শক্ত করে বাঁধল।
এমন সময় ঘরের টেলিফোন বাজতে শুরু করল।
ঝুমুর টেলিফোনটার দিকে একবার তাকাল শুধু। তারপর টেলিফোনের শব্দ কোনওরকম গ্রাহ্য না করে আর-একটা সোফা টেনে নিয়ে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। জোড়া পা বাঁধা পড়ল সোফায় দু-পায়ার সঙ্গে।
ঝুমুর এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে অদ্ভুতভাবে হাসল। ক্ষুরটা রেখে দিল সোফার ওপরে। তারপর নিজের পোশাক খুলতে শুরু করল। সুপ্রতিম ভয়ার্ত চোখে ওকে দেখতে লাগল।
বাজতে-বাজতে ক্লান্ত হয়ে টেলিফোন থেমে গেল একসময়।
ততক্ষণে সুপ্রতিমের চোখের সামনে প্রকাশিত হয়েছে প্রায়-নগ্ন ঝুমুর। ওর পরনে শুধু গাঢ় নীল রঙের জাঙ্গিয়া।
ফরসা ফ্যাকাসে রোগা শরীর, ন্যাড়া মাথা, মাথায় রক্তের দাগ, গলায় সামান্য রক্তের ছিটে, মুখে চওড়া হাসি, অথচ ঠান্ডা চোখ। ঝুমুরকে কেমন যেন অলৌকিক প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল।
এইবার ব্রিফকেসটা টেনে নিয়ে মেঝেতে বসল ঝুমুর। ওটা খুলতেই দেখা গেল মেয়েলি প্রসাধনের নানান জিনিস। একটা হাত-আয়না নিয়ে ঝুমুর সাজতে বসল। আর একইসঙ্গে গুনগুন করে গাইতে লাগল ও ভালোবাসার তুমি কী জানো? ভালোবাসার তুমি কী জানো? উ..উ..উ…পায়ের ওপর পা-টি তুলে / হিসাবের খাতা খুলে / বসে রও আপন ভুলে / যত বলি ঢের হয়েছে, / মানা না মানো। / ভালোবাসার তুমি…উ..উ..উ…।
মুখে পাউডার-ক্রিম ইত্যাদি মাখা হয়ে গেলে চোখে কাজল পরতে শুরু করল। তারপর চোখের পাতার ওপরে রং ঘষতে লাগল। মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান দিক থেকে নিজের প্রসাধন আয়নায় পরখ করল।
প্রসাধনে সন্তুষ্ট হয়ে হাতে লিপস্টিক তুলে নিল ঝুমুর। লাল ডগাটা বের করে ঠোঁটে ঘষতে লাগল। এবং সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েকবার কোমর বেঁকিয়ে-চুরিয়ে মেয়েলি নাচের ভঙ্গি করল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে এল অসহায় রক্তাক্ত সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম শুয়ে-শুয়েই স্নো-পাউডারের গন্ধ পেল।
সুপ্রতিমের ঠোঁটে, মুখে, বুকে লিপস্টিক ঘষে দিল ঝুমুর। তারপর লিপস্টিক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওকে কষে চটকাতে লাগল, আর জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমি তোমায় বড় ভালোবাসি / তোমায় বড় ভালোবাসি…আমি তোমায় বড় ভালোবাসি…।
সুপ্রতিম ভাবছিল, ও কি বেঁচে আছে? এই ঘটনাগুলো কি সত্যি? নাকি দুঃস্বপ্ন।
বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো। একবার বলো, আমায় ভালোবাসো। তুমি আমার আর কারও নয়। শুধু একবার বলো…।
অসুস্থ উন্মত্ত ছেলেটা সুপ্রতিমের জামা সরিয়ে দিয়ে খোলা বুকে মুখ ঘষছে। ঠোঁটে, গালে, চোখে যথেচ্ছ চুমু খাচ্ছে। হাতড়াচ্ছে যেখানে-সেখানে। আর অনর্গল ভালোবাসার কথা বলছে।
ঝুমুর ওর প্যান্টের বোতাম খোলা শুরু করতেই সুপ্রতিম চাপা চিৎকার করে উঠল।
কী, কষ্ট হচ্ছে? ঝুমুর নিষ্পাপ স্বরে জিগ্যেস করল, তুমি শুধু একবার বলো, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে…তা হলেই তোমার সব বাঁধন খুলে দেব। তুমি শুধু আমায় একটা চুমু খাও…একটা…তা হলেই আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে যাব।…শুধু একবার…।
সুপ্রতিমের গলা দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু গলা ফাঁক হয়ে যাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। ওর মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা করা দরকার…।
দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রতিম কোনওরকমে বলল, আমিও তোমাকে ভালোবাসি, ঝুমুর।
প্যান্টের জিপার খুলতে গিয়ে ঝুমুরের হাত থেমে গেল। ও আদুরে গলায় বললল, কী বললে গো? আর-একবার বলো। প্লিজ…।
আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরও ভালোবাসতে চাই।…আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও, প্লিজ…। কথা বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের দম আটকে যাচ্ছিল।
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো চট করে উঠে পড়ল ঝুমুর। হাঁফাতে হাঁফাতে সুপ্রতিমের বাঁধন খুলতে শুরু করল। উত্তেজনায় ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
বাঁধন খোলা হতেই সুপ্রতিমের কপালে হাত বুলিয়ে নরম সুরে ঝুমুর বলল, নাও এবার ওঠো।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে বসল সুপ্রতিম। কাটা জায়গাগুলো ভীষণ জ্বালা করছে।
ঝুমুরের আর তর সইছিল না। ও সুপ্রতিমের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। ওর কোলে উঠে বসল একেবারে।
সুপ্রতিমের মনে হল একটা কোলাব্যাঙ ওর কোলে বসে আছে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ও ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে-গালে চুমু খেল। বিড়বিড় করে বলল, আই লাভ ইউ ঝুমুর…।
শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসা বমির দমক রুখে দিয়ে সুপ্রতিম ভাবল, নয়না এখনও আসছে না কেন!
আর ঠিক তখনই ঝুমুরের নগ্ন কাঁধের ওপর দিয়ে সোফার ওপরে পড়ে থাকা ক্ষুরটা ও দেখতে পেল। হাতের প্রায় নাগালে রয়েছে ওটা।
ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে কোনওরকমে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুপ্রতিম। পলকা ছেলেটা সুপ্রতিমের আশ্লেষে আনন্দে টইটম্বুর হয়ে ভালোবাসার প্রলাপ বকছে শুধু। আর সুপ্রতিম নিজের প্রাণ বাঁচাতে একের-পর-এক চুমু খেয়ে চলেছে ওর স্নো-পাউডার ঘষা মুখে।
ক্ষুরটা এখন পুরোপুরি সুপ্রতিমের হাতের নাগালে।
ও মুঠো করে অস্ত্রটা ধরল। তারপর ঝুমুরকে আদর করতে করতে ক্ষুরটা নিয়ে এল ওর গলার খাঁজের কাছে।
কতক্ষণ আর সুপ্রতিমের শক্তি থাকবে কে জানে! মাথা ঝিমঝিম করছে। রক্তে চটচট করছে হাত-পা-বুক।
চুলোয় যাক ভদ্রতা, সভ্যতা, নীতি, দয়া ইত্যাদি।
আত্মরক্ষা মানুষের একটা আদিম ধর্ম।
বাঁ-হাতে ঝুমুরের মাথাটা পিছনে ঠেলে দিয়েই ডান হাতে ক্ষুর টেনে দিল সুপ্রতিম।
ঝুমুরের ভালোবাসার প্রলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। তার বদলে ঘড়ঘড় শব্দ বেরোতে লাগল মুখ আর গলা দিয়ে। ঝুমুর আর নেই।
রক্তে মুখ-গলা-বুক ভেসে গেল সুপ্রতিমের। ওর মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ও জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝুমুরের মৃতদেহ তখনও ওকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
একটি অচেতন দেহ ও একটি মৃতদেহ অসাড় হয়ে নয়না অথবা আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যে প্রথম এসে ঢুকবে ঘরে।
রক্তের ধারা তখন মেঝেতে গড়িয়ে-গড়িয়ে সময়ের হিসেব রাখছিল।
অসুর (নভেলেট)
শীতের দুপুরে কোনও এক শহরতলিতে তিনতলা বাড়িটা ছিল একা-একা দাঁড়িয়ে। সামনে একফালি বাগান, আর দু-পাশে খোলা মাঠের নির্জনতা। পিছন দিকটায় কিছু জংলা ঝোঁপ। বাড়ির বাসিন্দা ছজন মানুষ। কিন্তু ছজনের একজন গরহাজির ছিল সেই নির্জন দুপুরে। এবং ঠিক সেই সময়েই এসে হাজির হল সপ্তম ব্যক্তি…।
পরনে ফুল হাতার কালো জামা, কালো কর্ড-এর প্যান্ট। চোখে মুখে কেমন একটা উদাসীন দৃষ্টি। চেহারা তার রোগার দিকেই। কিন্তু চোয়ালের কঠিন রেখা ভেতরের শক্তির একটা আভাস দিচ্ছে। পা ফেলায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য নেই। অলসভাবে মেঠো পথ ধরে সে এগিয়ে আসছিল। আধা-গ্রাম আধা-শহর মিশিয়ে তৈরি এই শহরতলিতে তার আসা এই প্রথম। এবং বোধহয় এই শেষ।
রাস্তার দুপাশে ঘাসের ছোঁওয়া এখনও আছে। চোখ তুলে তাকালে দূরে দেখা যায় ওভারহেড লাইন। সেই তারে বসে আছে কয়েকটা ফিঙে। লেজ নাড়িয়ে দোল খাচ্ছে।
এ-অঞ্চলের বাড়িগুলোকে কেউ যেন সযত্ন পরিকল্পনায় হিসেবি দূরত্বে বসিয়ে দিয়েছে। কোনওটা একতলা, কোনওটা দোতলা, আর কোনওটা-বা তিনতলা। শীতের দুপুর। সব বাড়ির জানলা, দরজা বন্ধ। হয়তো বাসিন্দারা বিশ্রাম নিচ্ছে।
তিনতলা হলদে বাড়িটা তাকে টানল কোন অদ্ভুত কারণে, তা সে নিজেই জানে না। হয়তো বাড়ির সামনের এই একফালি বাগানটা।
নির্জন মাঠের এদিক-ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে সে বাড়িটার দিকে তাকাল। বাউন্ডারি গেটের হুড়কো খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
আধুনিক পরিকল্পনায় ছোঁয়াচ বাড়িটার সর্ব অঙ্গে।
ভারী কাঠের দরজার ওপরে নেমপ্লেট। তাতে লেখাঃ
সুশান্ত মল্লিক, অ্যাডভোকেট
আর একটু ওপরে, ডান পাশে কলিংবেলের সুইচ। বাগান চিরে যে-পথ দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে, তার দু-ধারে গেঁথে দেওয়া ইটে সাদা রং করা; খাটো বাঁশের বেড়াও রয়েছে একটা।
শ্লথ পায়ে দরজার কাছে পৌঁছে কী যেন চিন্তা করল সে। চোখ তুলে তাকাল দোতলার বারান্দার দিকে। সাদা রঙের গ্রিলে ঘেরা বারান্দা জনশূন্য। এবং যে-হলদে দরজাটা বাড়ি এবং বারান্দার যোগসূত্র, সেটা বন্ধ।
চিন্তার ইতি ঘটিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলের বোতামে হাত রাখল সে। ভেতরে ঝনঝনিয়ে ওঠা চাপা আওয়াজটা কানে আসতেই হাসল; বাঁ-হাতটা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে পকেটে ঢুকিয়ে অনুভব করল ভাঁজ করা স্টিলের ছুরিটা।
আর একবার হাসল সে।
*
একটা হালকা লেপ গায়ে দিয়ে বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতে শুয়েছিলেন সুশান্ত মল্লিক।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য দিনকয়েক ওকালতিকে ছুটি দিয়েছেন। পঞ্চাশ পার হওয়ার পর থেকে তার হৃৎপিণ্ড যেন শরীরের সঙ্গে লাগাতার বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলেন। ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ। সবাই জানে, এ সময়ে তাকে বিরক্ত করা বারণ। সাধারণত গল্পের বই পাশে নিয়ে শোন। মাথার কাছে রিডিং-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ পড়েন, তারপর একসময় আলো নিভিয়ে পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করেন।
সুশান্ত মল্লিকের একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যেই তিনি শুনতে পেলেন কলিংবেলের শব্দ। অর্থাৎ, দরজায় কোনও অতিথি অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিনি ব্যস্ত হলেন না। কারণ, বেলা এখন সবে দুটো। তার স্ত্রী, মেয়ে, বিধবা বোন এবং বাড়ির কাজের লোক– সকলেই এখন জেগে। কলিংবেলের শব্দ ওরা কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়ে থাকবে। তারপর ওদের কেউ যাবে দরজা খুলে দিতে।
প্রমাণিত হল, সুশান্ত মল্লিকের অনুমান নির্ভুল। তাঁর স্ত্রী, রমলা মল্লিক, দোতলার রান্নাঘরে এঁটো বাসন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কলের জলের শব্দে কলিংবেলের শব্দটা তার কানে যায়নি। রান্নাঘরের পাশেই একটা মাঝারি ঘর। সে-ঘরে সিনেমার পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে ব্যস্ত ছিল সুমনা– সুশান্ত মল্লিকের মেয়ে। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করার পর সুযোগ্য পাত্রের অপেক্ষায় দিন গুনছে। ঘণ্টার শব্দটা ওর কানে গেলেও বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা সুমনা করল না। কারণ ও জানে, আর কেউ-না-কেউ শব্দটা নিশ্চয়ই শুনতে পেয়ে থাকবে। তাই পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেও ওর কান পড়ে রইল সদর দরজার দিকে ও কখন শুনতে পাবে দরজা খোলার শব্দ। তারপর না হয় জানলা দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখবে, কে এল।
সুমনার বিধবা পিসি প্রভা রায়গুপ্ত পুজো-আচ্চা সেরে খাওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন, কানে এল ঘণ্টার শব্দ। এ-বয়েসে মানুষ হয়তো একটু অধৈর্য এবং খুঁতখুঁতে হয়। তাই খাওয়ার ব্যবস্থা ছেড়ে তিনি বাইরের করিডরে বেরিয়ে এসে ডেকে উঠলেন, সুমু, দেখ তো কে এল!
সুমনা দোতলায় নির্বিকার থাকলেও প্রভাদেবীর চিৎকারটা রমলাদেবীর কানে গেল। তিনি বাসন মাজা থামিয়ে চাকর অবিনাশকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন, অবিনাশ, দরজা খুলে দে। কে এল দেখ– কথা শেষ করে আবার হাতের কাজে মন দিলেন তিনি।
অবিনাশের বয়স বাইশ-তেইশ। কালো স্বাস্থ্যবান চেহারা। এ-বাড়িতে সে আছে প্রায় চার বছর। রোজকার মতো একতলায় বসে সে নিজের জামাকাপড় কাচছিল। কাপড় কাঁচা হলে স্নান সেরে দোতলার গিয়ে ঢেকে রাখা খাবার খাবে। তারপর একটু গড়ানোর ব্যবস্থা করবে।
কাপড় কাচার শব্দে ঘণ্টির শব্দ চাপা পড়ে যাওয়ায় সে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। কিন্তু মায়ের গলার আওয়াজে হাতের কাজ থামাল সে। শুনতে পেল ঘণ্টার অধৈর্য শব্দ।
একটু বিরক্ত হয়ে অবিনাশ উঠল। ভিজে হাত থেকে সাবান-জল ঝাড়তে ঝাড়তে দরজার কাছে এগিয়ে গেল।
.
নীরবে অপেক্ষা করতে করতেই তার নজর পড়ল টেলিফোনের তারটায়। দরজার বাঁ-পাশ দিয়ে দেওয়ালের গা বেয়ে সাপের মতো নেমে গেছে।
মনে-মনে হাসল সে।
বিজ্ঞানের লম্বা হাত এত দুরেও এসে পৌঁছেছে! এই ভাবনার সঙ্গে-সঙ্গে তার মনের হাসি কালো ঠোঁটজোড়ায় ছায়া ফেলল। বাঁ-হাতে ছুরিটা বের করে বুড়ো আঙুলে চাবি টিপতেই ঝলসে উঠল স্টিলের ফলা। এবং পরমুহূর্তেই নিখুঁত হাতে বিচ্ছিন্ন হল টেলিফোনের তার।
রোদ-ঝকমকে নীল আকাশে হঠাৎই যেন ছায়া ফেলল একটুকরো ঘন কালো মেঘ।
এমন সময় সশব্দে খুলে গেল সদর দরজা।
দরজায় দাঁড়িয়ে বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক। খালি গা। পরনে চেক লুঙ্গি। খাটো করে পরা। কোথাও কোথাও সামান্য ভিজে।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভিজে হাত দুটো লুঙ্গিতে মুছতে লাগল ছেলেটি। প্রশ্ন করল, কাকে চাই?
উত্তরে মৃদু স্বরে সে বলল, সুশান্ত মল্লিক, অ্যাডভোকেট।
উনি অসুস্থ। এখন বিশ্রাম করছেন।
নীরবে খোলা দরজার চৌকাঠ পেরোল সে। ছেলেটির বিস্ফারিত চোখের সামনে পিঠ দিয়ে বন্ধ করে দিল সদর দরজা। তারপর বাঁ-হাতটা উঁচিয়ে ধরল ছেলেটার চোখের সামনে। হাতে ধরা বস্তুর চরিত্র এই আধো-অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝল ছেলেটা। হয়তো আসন্ন বিপর্যয়ের কথা অনুমান করেই এক বুক ফাটা চিৎকারের জন্য ভোকাল কর্ডকে তৈরি করে হাঁ করল। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই অভ্যাসলব্ধ পেশাদারি ভঙ্গিতে সাপের মতো ক্ষিপ্রতায় আগন্তুকের বাঁ-হাত ছোবল মারল ছেলেটির গলায়। স্টিলের ফলাটা একইসঙ্গে তার চিৎকার এবং শ্বাসনালিকে মাঝপথেই বিচ্ছিন্ন করল।
অদ্ভুতভাবে ছেলেটার শরীরটা সামনে মাথা ঝুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে কয়েকমুহূর্তের জন্য। তারপরই সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়ল। মেঝে তখন রক্তে ভিজে উঠেছে।
ছটফট করা শরীরটার দিকে একপলক দেখল সে। দেখল বাঁ-হাতের রক্তাক্ত ছুরিটার দিকে। তাকাল কালো জামায় ছিটকে আসা রক্তের রেখার দিকে। তারপর নির্বিকারভাবে ছুরিটা ঘষে-ঘষে মুছে নিল জামার কাপড়ে। দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে ছেলেটার দেহ ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে। পা থেকে চটিজোড়া এককোণে খুলে রেখে নিঃশব্দ পায়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে…।
.
সুমনা শুয়ে-শুয়েই শুনতে পেল সদর দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ। সুতরাং অতিথির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার শব্দের প্রতীক্ষায় ও সময় গুনতে লাগল। কিন্তু মিনিটপাঁচেক পরেও যখন কারও পায়ের শব্দ ওর কানে এল না, তখন একটু অবাক হল ও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনেমা-পত্রিকাটা বালিশের পাশে রেখে বেশবাস গুছিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল।
ভেজানো দরজা খুলে বাইরের অলিন্দে এল সুমনা। ডান পাশেই রান্নাঘর, এখান থেকে মায়ের বাসন মাজার শব্দ বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মা-কে আর ব্যস্ত না করে বাঁ-দিকে এগোল। সুমনা। একপলক দেখল তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে, তারপর তাকাল বাবার ঘরের দরজার দিকে। দরজা রোজকার মতোই ভেজানোযাতে কোনও অবাঞ্ছিত অতিথি সুশান্ত মল্লিকের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
এবার নীচে নামার সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে সুমনা। যতই নামে ততই ও অবাক হয়। কারণ, একতলার বাথরুম থেকে অবিনাশের কাপড় কাঁচার একটানা শব্দ মোটেও শোনা যাচ্ছে না। এটা রোজকার নিয়মের ব্যতিক্রম। সুতরাং অস্বাভাবিক।
সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে কলতলার দিকে এগিয়ে চলল সুমনা।
কলতলা এবং বাথরুমের একটাই দরজা, এবং সেটা হাট করে খোলা।
ভেতরে উঁকি মারতেই কোনও শব্দ না শোনার কারণটা বোঝা গেল। কলতলার অবিনাশ নেই। বালতি, সাবান, কাপড়চোপড় সব ছড়ানো। বোঝাই যাচ্ছে, কাপড় কাচতে কাচতে হাতের কাজ ফেলে অবিনাশ উঠে গেছে সদর দরজা খুলতে।
বাথরুম দেখা শেষ করে সদর দরজার দিকে চলল সুমনা।
সদর দরজার হাতপাঁচেকের মধ্যে পৌঁছোতেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসটা যে অবিনাশ সেটা ও বুঝতে পারল।
কিন্ত সদর দরজা বন্ধ!
আর রক্তে ভেসে যাওয়া সিমেন্টের মেঝেতে বিস্তভাবে পড়ে আছে অবিনাশ। দু-চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। ঠোঁট দুটো ফাঁক করা। এবং গলার নলিটা কে যেন সযত্নে দু-টুকরো করে দিয়েছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সুমনা কয়েক মুহূর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ল। আপ্রাণ চেষ্টাতেও ওর মুখ থেকে সঙ্গে-সঙ্গে কোনও চিৎকার বেরিয়ে এল না। বুকে জমাট বাঁধা নিশ্বাসটা যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখনই শোনা গেল ওর উন্মাদ চিৎকার। যেন কসাইখানায় খতম হওয়ার সময়ে কোনও শুয়োর ভাঙা, মর্মন্তুদ, কর্কশ স্বরে আর্তচিৎকার করছে।
.
দোতলার ওঠার সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সে। দেখল, বাঁ-দিকে একটা ভেজানো দরজা। দ্বিধা কাটিয়ে দরজার হাতের চাপ দিল। ধীরে-ধীরে সেটা খুলে গেল। এবং নিঃশব্দ পায়ে আগন্তুক ভেতরে ঢুকল। আবার ভেজিয়ে দিল দরজাটা।
যে ঘরটায় সে পা রাখল সেটা অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করার জন্য আধা ড্রইংরুমগোছের একটা ঘর। দরজার বাঁ-পাশে রেফ্রিজারেটর। সামনে সাজানো সোফাসেট এবং একটা ছোট টেবিল হলদে কাপড় দিয়ে ঢাকা। বাঁ-দিকের শেষ প্রান্তে একটা কাঠের তাকে বসানো রেডিয়ো। এখন বন্ধ।
ঘরের আসবাবপত্রের ওপর একপলক চোখ বুলিয়ে সে এগিয়ে চলল।
সামনেই আর-একটা দরজা। আলতো করে ভেজানো।
দ্বিতীয় দরজা অতিক্রম করেই সে পৌঁছোল দোতলায় বারান্দার লাগোয়া বড় ঘরটায়। ঘরে আবছা অন্ধকার। ডানদিকে এবং বাঁ-দিকে দুটো বড় খাট। ডান পাশে দাঁড় করানো একটা বিশাল কাঠের আলমারি। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা চেয়ার ও টেবিল।
পরমুহূর্তেই তার চোখ পড়ল বাঁ-দিকের খাটে দেওয়ালের দিকে মুখ করে লেপ গায়ে ঘুমিয়ে রয়েছে একজন মানুষ। শুধুমাত্র তার মাথার পিছনটুকু অস্পষ্টভাবে নজরে পড়ছে। খাটের বাঁ-দিকে সাজানো একটা স্টিলের আলমারি, চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল। টেবিলে কয়েকটা জিনিস রাখা আছে। বোঝা গেলেও আবছা আঁধারে ঠিকমতো নজরে এল না। স্টিলের আলমারির গায়ে লাগানো এক বিশাল আয়না। সেই আয়নায় নিজেকে একপলক দেখে বাঁ-দিকের খাটটার কাছে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।
খাটের খুব কাছে দাঁড়িয়ে সে লেপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মাথাটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। জানলায় লাগানো কাচের শার্সির দৌলতে সামান্য আলো ঠিকরে পড়েছে শুয়ে থাকা মানুষটির গায়ে। তার নজরে পড়ল কাঁচা-পাকা চুলের হালকা আস্তরণ মাথার পিছনটা ঢেকে রেখেছে। মনে মনে কী ভাবল সে। তারপর পকেট থেকে ইস্পাতের ছুরিটা বের করে বাঁ-হাতে উঁচিয়ে ধরল। চাবির ওপর বুড়ো আঙুলের চাপ দিতেই একটা খ করে শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে ছিটকে এল ঝকঝকে ফলাটা। শুয়ে-থাকা লোকটা সে-শব্দ শুনতে পেল কি না ঠিক বোঝা গেল না।
সুতরাং নিশ্চিত ভঙ্গিতে সে খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ল, দু-চোখের কালো তারা কেন যেন ধকধক করে জ্বলছে…।
*
চিৎকারটা প্রথমে শুনতে পাননি রমলাদেবী। কারণ ধাতব বাসনে ছিটকে পড়া জলের শব্দ আর-সব শব্দ ঢেকে দিয়েছিল। আচমকা কলটা বন্ধ করতেই কারও গলা চিরে বেরিয়ে আসা তীব্র চিৎকারটা পাগলের মতো তার কানের পরদায় এসে আঘাত করল। একবার-দুবার-তিনবার…।
সম্পূর্ণ হতভম্ব রমলাদেবীর হাত থেকে অ্যালুমিনিয়ামের হাতাটা খসে পড়ে গেল। দিশেহারাভাবে কয়েকমুহূর্ত তিনি উবু হয়ে বসে রইলেন। তারপর বয়েসের তুলনায় ক্ষিপ্র চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালেন। ভিজে হাত দুটো পরনের শাড়িতে মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন বাইরের অলিন্দে। স্বভাবমতো ডেকে উঠলেন, কী হল? চেঁচাচ্ছে কে কী ব্যাপার?
অলিন্দ ধরে কয়েক পা এগিয়েই তিনি বুঝলেন, চিৎকারের শব্দটা আসছে একতলা থেকেই। সুতরাং নীচে নামার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ সুমনার কথা মনে হতেই আবার ফিরে এলেন রান্নাঘরের পাশের ঘরটায়। হ্যাঁ, চোখের কোণ দিয়ে যেটুকু তার নজরে পড়ছিল তা সত্যি ।
ঘরে সুমনা নেই।
সিনেমার পত্রিকাটা বালিশের পাশে নামানো। ঘরের দরজা হাট করে খোলা।
এবার রমলা মল্লিক ভয় পেলেন। সুমু-সুমু বলে চিৎকার করতে করতে তিনি টলোমলো পায়ে সিঁড়ি ভেঙে একতলায় নামতে শুরু করলেন।
সিঁড়ির মাঝামাঝি নামার পরই বিপরীত দিক থেকে উদ্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে ছুটে আসা সুমনার সঙ্গে তাঁর ধাক্কা লাগল।
সুমনার দু-চোখ আতঙ্ক-বিস্ফারিত। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা। ঘন নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে ওর ভারী বুক দুটো উঠছে-নামছে।
মা-কে সামনে পেয়ে জাপটে ধরল সুমনা। মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। রুদ্ধ আবেগে ওর শরীরটা রমলাদেবীর দুহাতের মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।
সেকেন্ডকয়েক পর সুমনার কাঁপা স্বর–অবিনাশ–মরে গেছে– এই শব্দ তিনটে উচ্চারণ করল এবং করেই চলল।
পাঁচবারের পর রমলাদেবী ওর কথার অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন। তখন আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন মেয়েকে। চাপা স্বরে বললেন, অবিনাশ মরে গেছে? কী করে?
সুমনা নীরবে সদর দরজার দিকে আঙুল দেখাল। ওর শরীরের কাপুনি তখনও থামেনি।
রমলাদেবীর অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়। প্রথম কয়েকমিনিট তিনি দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অবশেষে সিদ্ধান্তে এলেন, সুমনা মিথ্যে কথা বলছে না। কিন্তু ওর দেখা ও শোনার মধ্যে কোথাও হয়তো কোনও গলদ রয়েছে, তাই এরকম অসংলগ্ন আচরণ করছে। সুতরাং তিনি মেয়েকে সাহস দেখিয়ে বললেন, চল তো, দেখি কী ব্যাপার।
সুমনা শূন্য চোখে মায়ের চোখের দিকে দু-পলক চেয়ে রইল, তারপর নীরবে তাঁর কথা মেনে নিল। মায়ের হাত ধরে ও সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। ওর শূন্য দৃষ্টি সামনে–যেন অবিনাশের মৃতদেহটা ওর চোখের তারায় ভাসছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপে নামতেই রমলা মল্লিকের সন্ধানী নজর পড়ল এককোণে রাখা মামুলি একজোড়া চটির ওপর। কিছু একটা বলতে গিয়েও তিনি থমকে গেলেন। ক্লান্ত সুমনার দিকে মনোযোগ দিলেনঃ চল, আস্তে-আস্তে চল। কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি।
সুমনা মা-কে নিয়ে মৃত অবিনাশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধু রক্তের কালচে রং, আর কিছু কালো মাছি ছাড়া দৃশ্যপটের আর কোনও পরিবর্তন হয়নি।
রমলাদেবীর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এল। সুমনা ভাব-অনুভূতিহীন, নির্বিকার।
সংবিৎ ফিরে পেতে রমলাদেবীর যেটুকু দেরি হল সেটা তিনি পুষিয়ে নিলেন আচমকা ছুট দিয়ে। মেয়েকে ফেলে রেখে তিনি পাগলের মতো দৌড়োলেন সিঁড়ির দিকে। মেয়ের কথা তার মনেও রইল না।
মা-কে উধাও হতে দেখে সুমনাও চুপ করে থাকল না। অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে অনুসরণ করল। সিঁড়ির কাছে পৌঁছে যে-দৃশ্য ও দেখল তাতে অবাক হওয়ারই কথা। এবং সেইসঙ্গে ভয়ের পরশও বুঝি দোলা দিয়ে যায়…।
.
সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরে দাঁড়িয়েই নীচের তলার শোরগোলটা তার কানে গেল। একটু যেন বিচলিত হয়েই তার বাঁ-হাত পকেট ছুঁয়ে দেখল, অনুভব করল ইস্পাতের ভরসা। তারপর বেড়ালের পায়ে বেরিয়ে এল বসবার ঘরে। সিঁড়ির লাগোয়া দরজায় কান পেতে শুনতে পেল একাধিক নারীকণ্ঠ। ওরা কথা বলছে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই কথা মিলিয়ে আসতে লাগল– ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামছে।
সুতরাং সে বেরিয়ে এল দরজার বাইরে, চোরা পায়ে নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে– পলকের জন্য রেলিঙের পাশ দিয়ে তার চোখে পড়ল রঙিন শাড়ির আভাস। নির্লিপ্তভাবে ওদের অনুসরণ করল সে।
যখন সে সিঁড়ির শেষ ধাপে, নজরে পড়ল তার রেখে যাওয়া চটিজোড়া, এবং কানে এল একটা অদ্ভুত চাপা চিৎকার–যদি তাকে চিৎকার বলা যায়। পরক্ষণেই যে কারও ফিরে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেই চট করে চটিজোড়া হাতে তুলে নিল সে, শ্বাপদের মতো ক্ষিপ্র পায়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠতে শুরু করল। পিছনে ভেসে আসছে পায়ের শব্দ।
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে লুকোনোর চেষ্টায় আবার বসবার ঘরেই ঢুকে পড়ল সে। চঞ্চল চোখে জরিপ করে ডানদিকের দেওয়ালের গায়ে, সোফাসেটের ঠিক বিপরীত দিকে, সে আবিষ্কার করল একটা ছোট দরজা। ঝটিতি সেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাতের চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আবার দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর ভালো করে দেখতে লাগল ঘরটা।
আটফুট বাই চারফুট ছোট্ট ভঁড়ার ঘর। টুকিটাকি জিনিসে–হাঁড়ি, কড়াই, টিনের কৌটো, বালতি আর একটা বিশাল আলমারিতে ঠাসা। কোনওরকমে জনাতিনেক পাশাপাশি দাঁড়ানো যায়।
আলমারির পাশে একটা সবুজ কাঠের মই। মাথার ওপরে কাঠের সিলিং। তার এক জায়গায় একটা চৌকো ফোকর–অর্থাৎ, ওপরে কুঠরি-ঘরে যাওয়ার দরজা। সেই চৌকো তক্তাটা একটা আংটা দিয়ে বাইরের কাঠের সঙ্গে আটকানো। এবার কাঠের মইটার অর্থ বুঝতে পারল সে। এই মই বেয়ে উঠে কাঠের চৌকো তক্তাটা খুলে একজনের পক্ষে ওপরের কুঠরি-ঘরে যাওয়া সম্ভব। মই বেয়ে ওপরে ওঠার ইচ্ছেটা একবার তার মনে চাড়া দিয়ে উঠল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল বসবার ঘরের দরজা। হাঁফাতে-হাঁফাতে কেউ ঢুকল ঘরে। তারপর দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ছুটতে শুরু করল।
কান খাড়া করে নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়েছিল সে। চোখ ভঁড়ার ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে দুরের রোদে-ধোওয়া নীল আকাশে। মনে-মনে পরিস্থিতির ওজন মাপতে চাইল সে। পারল না। সব চিন্তা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ভেসে আসছে মশার গুনগুন একটানা কান্না…।
*
জমাট পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন রমলা মল্লিক। তেমনি নিশ্চল তার বিস্ফারিত দু-চোখ। তাকিয়ে আছেন সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছে দেওয়ালের পাশে একটি বিশেষ জায়গার দিকে। মায়ের হতবাক হওয়ার কারণ সুমনা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারল। মায়ের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে ও সেইদিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনও কিছুই ওর নজরে পড়ল না।
সুমনা ভয় পেয়ে দু-হাতে আঁকুনি দিল মাকে : কী হয়েছে মা? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?
ক্লান্ত আচ্ছন্ন স্বরে রমলা মল্লিক বললেন, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একজোড়া চটি দেখেছিলাম, এখন দেখছি না।
কথার অর্থটা মনের গভীরে কেটে বসতে সুমনার যেটুকু সময় লাগল। তারপরই ও ক্ষিপ্র পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। পিছন থেকে ভেসে আসা কী হল, সুমু?-র উত্তরে ও কোনওরকমে বলল, দাঁড়াও মা, অফিস-ঘরের চাবিটা নিয়ে আসি।
রমলা মল্লিক মেয়েকে চোখের আড়াল করতে চাইলেন না। ওকে অনুসরণ করলেন। সুমনা তখন একধাক্কায় বসবার ঘরের দরজা খুলে ফ্রিজের ওপরে রাখা অফিস-ঘরের চাবিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। দ্রুতপায়ে পাশ কাটিয়ে নেমে যেতে-যেতে মা-কে ও বলল, তুমি শিগগির বাবাকে ডাকো! আমি পুলিশে ফোন করছি।
মা-কে বিহ্বল অবস্থায় সিঁড়িতে রেখে সুমনা ছুটে গেল একতলার অফিস-ঘরে। অ্যাডভোকেট সুশান্ত মল্লিকের অফিসে।
মানসিক অস্থিরতায় তালার গায়ে চাবিটা ঢোকাতে কিছুক্ষণ সময় লাগল ওর। তারপর এক ঝটকায় দরজা খুলে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের বাঁ-প্রান্তে বসানো টেলিফোনের কাছে পৌঁছে গেল সুমনা। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে যেতেই বুঝল, রিসিভার নিস্তব্ধ। তাতে ডায়াল টোনের সুপরিচিত কড়কড় শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শত চেষ্টাতেও যখন কিছু হল না, তখন রূঢ় বাস্তবটা সুমনা বুঝতে পারল।
ওদের বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেউ কেটে দিয়েছে…।
.
সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে রমলা মল্লিক যখন সচল হলেন, তখন বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেছে। স্বামীকে অবিশ্বাস্য ঘটনা কীভাবে বিশ্বাস করাবেন সেই কথা ভাবতে-ভাবতে তিনি উঠে এলেন সিঁড়ি বেয়ে। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে চাইলেন নীচের চটিজোড়ার মতো এই বসবার ঘরে কোনওরকম গরমিল চোখে পড়ছে কি না। পড়ল না। সুতরাং ধীরে ধীরে তিনি এগোলেন সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরের দিকে।
ঘরের ভেজানো দরজায় হাত রাখতেই অস্পষ্টভাবে কারও নড়াচড়ার শব্দ তার কানে এল– বোধহয় ভঁড়ার ঘরের দিক থেকে। থমকে দাঁড়ালেন রমলাদেবী। চোখ এবং পা যথাক্রমে ফেরালেন ভঁড়ার ঘরের ভেজানো দরজার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন।
ভেজানো দরজায় হাত ছোঁয়াতেই বুক কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। তবু সাহসে ভর করে দরজায় চাপ দিলেন। ক্ষীণ প্রতিবাদে কাচক্যাচ সুরে খুলতে শুরু করল দরজা। খানিকটা খুলতেই দরজায় ফাঁক দিয়ে দেখতে চাইলেন, কিন্তু বিশেষ কিছুই তার নজরে পড়ল না। অতএব মনকে বোঝালেন শব্দটা অবাধ্য হঁদুরের। তারপর ফিরে এলেন শোওয়ার ঘরের দরজায় কাছে।
ঘরে ঢুকে প্রথমে যে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা রমলা মল্লিকের নজরে পড়ল, অথবা বলা যায়, কানে এল–সেটা সুশান্ত মল্লিকের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুপস্থিতি। ঘরের প্রতিটি জিনিসই নিজের নিজের জায়গায় স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে। এমনকী দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কান পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে সুশান্ত মল্লিকও স্বাভাবিকভাবে শুয়ে আছেন।
হঠাৎ যেন গতি এবং সংবিৎ ফিরে পেলেন রমলাদেবী। দ্রুতপায়ে পৌঁছে গেলেন স্বামীর বিছানায় কাছে। ঝুঁকে পড়লেন খাটের ওপর। স্বামীর গায়ে হাত রেখে ধাক্কা দিলেন, ডাকলেন, ওগো, শুনছ? শিগগির ওঠো! সর্বনাশ হয়েছে।
কিন্তু বারবার ডেকেও কোনও সাড়া না পেয়ে রমলা মল্লিক অবাক হলেন। আর তখনই তার চোখ পড়ল স্বামীর মাথার দিকে। এবং অসঙ্গতিটা নজরে পড়ল।
তার হাতের ধাক্কায় স্বামীর শরীরটা নড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই অনুপাতে মাথাটা প্রায় নড়ছে না বললেই চলে।
বুকভরা আশঙ্কা নিয়ে এক ঝটকায় লেপটা তুলে নিলেন রমলাদেবী। এবং বুঝলেন, মাথাটা কেন ঠিকঠাক নড়ছিল না।
সুশান্ত মল্লিকের মাথা এবং শরীরের মাঝে প্রায় চার আঙুল পরিমাণ ফাঁক যেন হাঁ করে রমলা মল্লিককে গ্রাস করতে আসছে।
রক্তাক্ত বিছানা-বালিশের রং হঠাৎ যেন হলুদ ফুলে বদলে গেল রমলাদেবীর চোখের সামনে। তিনি টলে পড়লেন মেঝেতে।
হয়তো সেই কারণেই, সুশান্ত মল্লিকের খাটের নীচে রাখা ফল-কাটার ধারালো রক্তাক্ত বঁটিটা তাঁর নজরে পড়ল না।
.
রমলাদেবীর পড়ে যাওয়ার ভারী শব্দটাও তার কানে গেল। এর আগের ছোটখাটো শব্দগুলো তার কানে গেলেও মাথায় ঢোকেনি। শেষ শব্দটায় সে চমকে উঠল। সন্তর্পণে খুলে ফেলল ভাড়ার ঘরের দরজা। ডাইনে-বাঁয়ে একপলক করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না-পেয়ে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে।
ওপরে যাওয়ার এবং নীচে নামার সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে একটু যেন দ্বিধায় পড়ল। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিল এবং নীচে যাওয়ার সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল।
নিঃশব্দ শব্দটা যেন তার পায়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুতরাং অবিচলিত ধীর পায়ে সে নেমে এল অফিস-ঘরের দরজার সামনে। চটিজোড়া আবার খুলে রাখল সিঁড়ির গোড়ায়। সামনেই বাথরুম। তার ভোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ছে ছড়িয়ে রাখা ভেজা কাপড়চোপড়, সাবান-জল ভরা বালতি, সব মিলিয়ে অসমাপ্ত কাজের ইশারা।
এবার তার মনোযোগ পড়ল অফিস-ঘরের দিকে।
কিছুটা কৌতূহল কিছুটা আগ্রহ নিয়ে সে ভেতরে উঁকি মারল।
দেওয়ালের দিকে মুখ করে, তার দিকে পিছন ফিরে, টেলিফোন নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে একটি মেয়ে-যুবতী।
হাসল সে। ফোনের তার তো সে আগেই কেটে দিয়েছে, তা হলে?
নীরবে মেয়েটির পিছনে গিয়ে থামল সে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা লক্ষ করতে লাগল। এবং নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
ফোন রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মেয়েটি তার মুখোমুখি হল।
মুহূর্তের নীরবতা।
তার কালো পোশাক এবং সাদা হাসির পরস্পরবিরোধী চেহারায় মেয়েটির চোখজোড়া অবাক হল, বিস্ফারিত হল।
এবং কোনও শব্দ তৈরির আশায় নরম ঠোঁটজোড়া স্ফুরিত হতেই বিদ্যুতের মতো তার থাবা আছড়ে পড়ল মেয়েটির মুখে…।
রমলাদেবীর জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্ন ভাবটা কাটতে বেশ সময় লাগল। তিনি কোথায়, কী করে, কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে-ধীরে তার মনকে ভারী করে তুলল। মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নীরবে তাকালেন স্বামীর শরীরের দিকে। স্বামীর লেপে-ঢাকা দেহটা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। দু-চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেল, জ্বালা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালেন। ইতস্তত তাকিয়ে ঝুঁকে পড়লেন খাটের নীচে, ফল-কাটার বঁটিটা টেনে নিতে গিয়ে থামলেন। কারণ, বঁটি রক্তে মাখামাখি। কিন্তু মনের দ্বিধা কাটিয়ে আস্থা-ভরা ডানহাতে তুলে নিলেন বঁটিটা। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে চলে এলেন বসবার ঘরে। ভাঁড়ার ঘরের খোলা দরজা দেখে সচকিত হলেন। ঢুকে পড়লেন ভেতরে।
কেউ নেই।
বসবার ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ফ্রিজের ওপর থেকে তালা এবং চাবিটা তুলে নিলেন। বঁটিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে দরজায় তালা দিলেন রমলাদেবী। চাবিটা কোমরে গুঁজে দোতলার বাকি দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, প্রতিটির দরজার কড়া সরু পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। পাটের দড়ির বাকিটা ফেলে দিলেন বারান্দার একপাশে। তারপর মেঝে থেকে রক্তাক্ত বঁটিটা তুলে নিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন।
দরজার কড়ায় দড়ি বাঁধার উদ্দেশ্য নিয়ে রমলাদেবীর মনে কোনওরকম ভুল ধারণা ছিল না। তিনি একমুহূর্তের জন্যও ভাবেননি, ওই হালকা দড়ি দিয়ে অদৃশ্য খুনিকে তিনি আটকে রাখতে পারবেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, তার অজান্তে কেউ কোনও ঘরে ঢুকলে সেটা যেন তিনি বুঝতে পারেন। আর বসবার ঘরের দরজায় তালা দেওয়ার কারণ, সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরেই তাদের টাকা-পয়সা, গয়না-সম্পত্তি ইত্যাদি থাকে। অনুপ্রবেশকারী যদি কোনও চোর-ডাকাত হয় তা হলে সেগুলো যাতে তার হাতে না পড়ে সেইজন্যই এই সাবধান হওয়া।
সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রমলাদেবী মনস্থির করতে কয়েক মুহূর্ত খরচ করলেন। তারপর গলা তুলে ডাকলেন, সুমু সুমুউউ!
বদ্ধ বাড়িতে তার ডাক কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।
দু-মিনিট অপেক্ষার পরও কোনও উত্তর পেলেন না। শুধুই নিস্তব্ধতা।
সুতরাং, এইবার সাততাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন তিনি। লক্ষ্য অফিস ঘর। বাইরের পৃথিবী তখন তার কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে। তা নইলে রমলাদেবী হয়তো শুনতে পেতেন প্রভা রায়গুপ্তের উৎকণ্ঠিত স্বর। তিনি তখন একনাগাড়ে রমলা মল্লিক এবং সুমনা মল্লিকের কুশল সম্পর্কে প্রশ্ন করে চলেছেন।
অফিস-ঘরে পৌঁছে ঘরের যা অবস্থা রমলাদেবীর নজরে পড়ল, তাতে ঘরটাকে অফিস ঘর ছাড়া আর সব কিছু বলা চলতে পারে। কাচের টেবিলের কাচ শতটুকরো, টেলিফোনটা পড়ে আছে মেঝেতে, খাতাপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে। একটা চেয়ার কাত হয়ে পড়ে আছে, আর সুমনা পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে। ওর বাঁকানের পাশে পড়ে আছে কালো টেলিফোন রিসিভারটা।
রমলাদেবী হাতের বঁটিটা একপাশে নামিয়ে রাখলেন। এগিয়ে গিয়ে সুমনার দেহের পাশে হাঁটুগেড়ে বসলেন। হাতের ধাক্কায় একমাত্র মেয়ের দেহটা চিত করে ফেললেন। বুঝলেন, ও আর বেঁচে নেই।
সুশান্ত মল্লিকের বেলায় রক্তপাতের যেমন ছড়াছড়ি ছিল এখানে তা নেই। টেলিফোনের কালো কর্ডটা সুমনার নরম গলায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। তার চাপে সুমনার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে, মুখের ভেতরে জিভের আর জায়গা হয়নি।
চাপা রাগে, আক্রোশে রমলাদেবীর বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সম্ভবত দোতলায় যে কয়েক মিনিট তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, সেই সময়ের মধ্যেই ঘটে গেছে অফিস-ঘরের তাণ্ডব। উঠে দাঁড়াতে গিয়েই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন রমলাদেবী। তাই হাত বাড়ালেন বঁটিটার দিকে।
এবং দেখলেন বঁটিটা তার জায়গায় নেই!
সুতরাং ভুল শোধরানোর সময়টুকু তিনি পেলেন না।
পরমূহুর্তেই তার শরীরের ওঠার চেষ্টাকে থামিয়ে দিল ধারালো কোনও কিছুর অমানুষিক আঘাত…।
.
প্রভা রায়গুপ্ত এবার অধৈর্য হয়ে পড়লেন। অফিস-ঘরের সশব্দ-তাণ্ডব তাঁর শুনতে না পাওয়ার কারণ তিনি বাড়ির পিছন দিকের ছাদে নিজের এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে রাখছিলেন। এবং প্রথমবার সুমনার চিৎকার তিনি যে শুনতে পাননি তার কারণ, তখন তিনি নিত্যকার নিয়মমাফিক খাওয়ার আগে সেই ছাদে দাঁড়িয়েই পাখিদের খাওয়াচ্ছিলেন। পাখিদের খাওয়ানো হলে তবে তিনি নিজে খেতে বসেন।
কিন্তু রমলাদেবীর শেষবারের চিল্কারে তিনি বিচলিত হয়েছেন, এবং বারবার ভ্রাতৃবধূ ও তার কন্যার নাম ধরে ডেকে উঠেছেন কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। মানুষের বয়েস হলে স্বভাব একটু খুঁতখুঁতে হয়, এবং অল্পেতেই ভয় পেয়ে যায়। হয়তো সেই কারণেই, রমলাদেবী অথবা সুমনার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন।
শীতের দুপুরে জানলা-দরজা ভেজিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শোয়াটা প্রভাদেবীর পুরোনো অভ্যেস। প্রথমত, সেই অভ্যেস ভেঙে তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে হল। তারপর নিরুপায় হয়েই তিনতলা থেকে তিনি নেমে আসতে লাগলেন দোতলায়।
দোতলায় এসে দাঁড়াতেই দুটো জিনিস তাকে ভীষণ অবাক করল।
এক, বসবার ঘরের দরজায় তালা দেওয়া, অন্যান্য ঘরগুলোর দরজার কড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা।
দুই, অদ্ভুত অপার্থিব নীরবতা।
কিন্তু একটা আবিষ্কার তাঁর অবাক হওয়ার প্রথম কারণকে একটু কমজোরি করে দিল। বাথরুমের লাগোয়া ঘরের দরজার কড়ায় দড়ি বাঁধা নেই। কিন্তু ভোলা দড়িটা একটা কড়া থেকে ঝুলছে বলে সিঁড়ির কাছ থেকে তার মনে হয়েছিল দরজা বুঝি বন্ধ।
আরও অবাক হলেন প্রভাদেবী। রমলাদেবী এবং সুমনার নাম ধরে আরও দু-চারবার ডাকলেন। তার গলা ক্রমশ খাদে নেমে আসতে লাগল। একবার ভাবলেন, নীচটা দেখে আসি। সুতরাং বাথরুম, রান্নাঘর এবং সুমনার ঘরে দড়ি-বাঁধা দরজাগুলোর দিকে একপলক তাকিয়ে তিনি একতলার সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করলেন। তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা কি ক্রমশ বেড়ে ওঠায় বুকের শব্দটা জোরালো ঠেকছে?
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে প্রায় একইসঙ্গে তিনটে জিনিসের ওপর প্রভাদেবীর নজর পড়ল।
বাথরুমের খোলা দরজা।
অফিস-ঘরের খোলা দরজা।
এবং একজোড়া চটি…।
চটচটে বঁটিটা নামিয়ে সে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বসল মাটিতে। দেখল একপলক নিজের তৈরি ধ্বংসস্তূপের দিকে।
এখন শীতকাল সুতরাং শীত করার কথা। কিন্তু তার শরীরে যেন অসহ্য জ্বালা। সেই জ্বালা মাকড়সা-হুল ছড়িয়ে দিয়েছে তার ওলটপালট মগজে।
জটপাকানো অন্ধ মস্তিষ্কে সুষম চিন্তা করতে চেষ্টা করল সে। ভাবতে চেষ্টা করল, সে কোথায়। এখানে এল কী করে? মেঝেতে শুয়ে আছে এরাই-বা কারা? কই, এদের কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না!
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর সে সিদ্ধান্তে এল, না, এদের কাউকেই সে চেনে না, এই বাড়িটাও তার অচেনা, এমনকী এই পৃথিবীটাও তার অচেনা। একমাত্র চেনা-পরিচিত যে ছিল, ও আজ কোথায়! সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল ওকে। আর তখনই এই পৃথিবী তাকে বাধা দিয়েছে। গলা টিপে শেষ করেছে তার ইচ্ছে-কে। আর, এক ইচ্ছে-কে শেষ করতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে ওদের দ্বিতীয় ইচ্ছে–যে ইচ্ছে ওদের মনের মাঝে ছিল। ওরা যখন তার সব ইচ্ছে শেষ করে দিচ্ছিল, তখন ওদের বাধা দিতে গিয়ে রুখতে গিয়ে মাথার ভেতরে ঘটে গেছে ভিসুভিয়াসের বিস্ফোরণ। তারপর?…তার পরের ইতিহাসে আছে সাদা ধবধবে চার দেওয়াল, দৈহিক অত্যাচার, ইলেকট্রিক শক, কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা পোশাক, আর স্টেথোস্কোপ। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে মুক্ত খোলা আকাশ, নীরব সুন্দর চাঁদ, আর মুখর তারা।
সুদীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি সে কাটিয়ে উঠেছে। তারপর এসে পৌঁছেছে এইখানে, একশো দুশমনের মাঝখানে। এখন এই শত্রুহীন মুহূর্তে নিজেকে আর-একবার ক্লান্ত বলে মনে হল। অবসাদ যেন বরফ-ঠান্ডা আস্তরে তার মনকে জড়িয়ে রেখেছে। দু-চোখ যেন চাইছে বুজে আসতে। আ–! বড় হাঁ করে শ্বাস নিল সে।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। ঢিলে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল দোতলায়। দোতলায় এসে অবাক হয়ে লক্ষ করল, সামনের দরজাটায় তালা দেওয়া। সুতরাং ডানদিকে এগোল সে। কী খেয়ালবশে থামল গিয়ে শেষপ্রান্তে, খাওয়ার ঘরের দরজায়। কড়ায় বাঁধা দড়িটা খুলে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। দরজা ভেজিয়ে দিল। সামনের টেবিলে রাখা জলের গেলাস দেখে তেষ্টা পেল তার। সুতরাং জল ভরতি গেলাসটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাল–।
এবং সেই মুহূর্তে এক হৃদয়বিদারী তীক্ষ্ণ চিৎকারে তার হৃৎপিণ্ড যেন হোঁচট খেল।
থামল না সেই চিৎকার। বিভিন্ন লয়ে বিভিন্ন পরদায় কাটা রেকর্ডের মতো বেজেই চলল।
একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণা নিয়ে পিছন ফিরে ঘরের দরজার দিকে তাকাল সে। দেখল চিৎকারের উৎস।
.
অফিস-ঘরের দরজায় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ দেখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি প্রভাদেবীর। বরং ঘরের দুজন যে মৃত সেটা বুঝতেই তাঁর সময় লাগল।
হতভম্ব প্রভাদেবীর সমস্ত মন যেন জমাট বেঁধে গেল সেই মুহূর্তে। অবস্থাটা ভালো করে যাচাই করার জন্য আলো জ্বাললেন তিনি। এবারে আরও স্পষ্টভাবে সবকিছু তার নজরে পড়ল।
সুমনা, রক্তমাখা বঁটি–যেটা এখন অচেনা লাগছে, এবং রমলার ধ্বংসাবশেষ।
পাকস্থলীর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় প্রভাদেবীর শরীরটা কেঁপে উঠল। গা গুলিয়ে উঠল। পেট চেপে ধরে উপুড় হয়ে বমি করতে লাগলেন তিনি। শরীরের প্রচণ্ড কাঁপুনি যেন কিছুতেই আর থামতে চাইছে না।
কিছুক্ষণ পর জল-ভরা লাল চোখে কাঁদতে কাঁদতে অফিস-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।
এবং তখনই নজরে পড়ল অচেনা চটিজোড়া।
সুতরাং এবারে কৌতূহল হয়ে উঠল প্রবল। প্রভাদেবী আবার ফিরে চললেন। দোতলায়।
প্রথমে দেখতে চাইলেন সুশান্তর শোওয়ার ঘর। বসবার ঘরের ভেতর দিয়ে সুশান্তর শোওয়ার ঘরে যেতে হয়। দেখলেন, সেই দরজায় তালা। তা হলে কি সুশান্ত বাড়িতে নেই? কিন্তু না, এই তো ওর চটি, জুতো–দু-জোড়াই এখানে রয়েছে।
দোতলায় উঠেই সামনের অংশটুকু জুতো রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার হয়। সেখানে শুধু সুশান্ত মল্লিক কেন, বাড়ির সকলের চটি এবং জুতোই রয়েছে।
আচ্ছন্ন প্রভাদেবী এগিয়ে চললেন খাওয়ার ঘরের দরজার দিকে। কারণ, একমাত্র ওটার দরজাই বাইরে থেকে ভোলা। সাধারণত আমিষাশীদের খাওয়ার ঘরে তিনি কখনওই পা দেন না, কিন্তু এই সংকট-মুহূর্তে সব নিয়মই ভাঙা যায়।
ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত ঠাকুরের নাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন প্রভাদেবী। তারপর হাতের চাপে খুলে ফেললেন খাওয়ার ঘরের ভেজানো দরজা।
সঙ্গে-সঙ্গেই সমস্ত ঘটনার কার্যকারণ তার বোধগম্য হল। বুঝলেন, তাঁর সামনে দাঁড়ানো এই একজনের উপস্থিতির ফলে, তার সমস্ত আত্মীয় এখন অনুপস্থিত। মরতে ভয় পান না প্রভাদেবী। কিন্তু তবুও কেন জানি না তার গলা চিরে বেরিয়ে এল এক অদ্ভুত চিৎকার। থামল না–বিভিন্ন লয়ে, বিভিন্ন পরদায় বেজেই চলল–
আর সেই মুহূর্তেই তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল কালো পোশাক পরা লোকটা…।
.
যে তার ঘৃণাভরা চোখে, তেষ্টাভরা বুক নিয়ে, তাকাল তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকা বিধবা মেয়েছেলেটার দিকে। হঠাৎই জমাট আক্রোশ ফেটে পড়ল তার দু-চোখে। জলের গ্লাসটা ঠোঁটের কাছ থেকে নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। কালো হাতায় ঢাকা দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে দরজা লক্ষ্য করে তিরবেগে ছুটল। বিধবা বুড়িটার চিৎকার তখনও তার কানে দামামা বাজিয়ে চলেছে।
মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেল, শূন্যে উঠল সাদা থান পরা শরীরটা। কালো দুটো হাতের এক ঝটকায় বারান্দার রেলিঙের আওতা ছাড়িয়ে একেবারে যেন উড়ে গেল বাইরে বাড়ির বাইরে। তার অন্তিম আর্তনাদটুকুর সাক্ষী রইল বাইরের ঘন নীল আকাশ, সোনালি রোদ্দুর, আর ধূসর প্রান্তর।
হতভম্বের মতো কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সে। বারকয়েক আক্ষেপে মাথা নাড়ল। তারপর পা বাড়াল বসবার ঘরের দিকে।
তালাবন্ধ দরজায় পৌঁছে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে চলল অফিস-ঘরের দিকে।
সেখানে পড়ে থাকা বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত মহিলার শরীর হাতড়ে চাবিটা একসময় পেল সে। সুতরাং আবার উঠতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে।
তালা খুলে বসবার ঘরে ঢুকে সোফায় কিছুক্ষণ সে বসল। নতুন করে ক্লান্তি অনুভব করল। তাই সোফায় গা এগিয়ে দিল।
ঘুমে যখন তার চোখ দুটো বুজে এসেছে তখন বসবার ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে তিনটের সঙ্কেত বাজল, ঢং-ঢং-ঢং…।
এবার আমরা সেই অনুপস্থিত, এ পর্যন্ত অপাংক্তেয়, মানুষটির প্রসঙ্গে আসব। বয়েস তার তেরো। ক্লাস এইটের মেধাবী ছাত্র। বাড়ির ছনম্বর বাসিন্দা। সুশান্ত মল্লিকের একমাত্র ছেলে সুকান্ত মল্লিক। রোজকার মতো স্কুলেই গিয়েছিল ও। ফিরছে এখন, পাঁচটার সময়। শীতের বেলা, তাই আঁধার নেমে এসেছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে রোজকার মতো দুলকি চালে মেঠো পথ ধরে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে। ও ওই দেখুন, বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপছে ছেলেটা, হা, রোজকার মতো। কিন্তু ও জানে না, রোজকার মতো নয় এমন কিছু একটা জিনিস এখন ওদের বাড়িতে রয়েছে।
সময়ের ঘড়িতে এখন পাঁচটা। স্কুলের ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব করে দশ-পনেরো মিনিটের পায়ে-হাঁটা পথ পেরিয়ে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগে বইকি!
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে পরপর দুবার অবাক হল সুকান্ত, এবং একবার আশ্বস্ত হল। প্রথম অবাক : দোতলার বাবার ঘরের আলো, যা রোজই জ্বলে, আজ জ্বলছে না।
দ্বিতীয় অবাকঃ বাড়ির সদর দরজা বন্ধ, অন্যদিন যা ভেজানো থাকে। এ ছাড়া দরজার মাথায় বসানো আলোটা আজ নেভাননা রয়েছে সুতরাং ব্যতিক্রম।
আশ্বস্ত হওয়ার কারণ, রোজকার মতো একতলায় অফিস-ঘরের আলো জ্বলছে।
কলিংবেলে আঙুলের চাপ দিল সুকান্ত। পরিচিত বাজার এর কড়কড় শব্দ জোরালোভাবেই ওর কানে এল। কিন্তু কোনও উত্তর নেই।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বেল বাজাল ও। কিন্তু কেউই কলিংবেলের ডাকে সাড়া দিল না।
ভয় পেল সুকান্ত। দু-হাতে পাগলের মতো পিটতে শুরু করল সদর দরজা। কিন্তু কোনও ফল হল না।
তখন ও চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করল, মামা! দিদি দিদি!
উত্তর নেই। তা হলে কি বাড়িতে কেউ নেই? উঁহু, তা সম্ভব নয়। কারণ, সদর দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। সুতরাং দ্বিতীয় পথের সন্ধানে অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলল সুকান্ত। ফুলবাগানের নরম মাটিতে পা ফেলে এক জায়গায় এসে থামল। কাধ থেকে নামিয়ে রাখল বইয়ের ঝোলানো ব্যাগটা। তারপর বহুবছরের অভ্যাসে পাঁচিলের গায়ে পা দিয়ে বেয়ে উঠতে চেষ্টা করল। এই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতরে আগেও অনেকবার ঢুকেছে ও। এখন এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ ওর কাছে ভোলা নেই।
পাঁচিল ডিঙিয়ে একলাফে ভেতরের ছোট্ট উঠোনে পড়ল। জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার। শুধু সামনে অফিস-ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে একটুকরো আলোর রেশ।
সেদিকে না গিয়ে প্রথমে সদর দরজার দিকে এগোল সুকান্ত। উদ্দেশ্য দরজার ছিটকিনি খোলা।
কিন্তু ওর ইচ্ছেয় বাদ সাধল অবিনাশের মৃতদেহ। অবিনাশের দেহের ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়ল ও। অন্ধকারে কিছু নজরে আসে না। তাই হাতড়ে হাতড়ে দেওয়ালের গায়ে বসানো আলোর সুইচ টিপল।
আলো জ্বালতেই গোটা দৃশ্যের বীভৎসতা ওর মুখে-চোখে আছড়ে পড়ল। ঘাড় মুচড়ে পড়ে আছে অবিনাশ। কালচে রক্তের ছোপ সর্বাঙ্গে, মেঝেতে, এমনকী সাদা দেওয়ালের গায়েও ছিটেফোঁটা নজরে পড়ছে।
অস্ফুট এক শব্দ করে ডুকরে কেঁদে উঠল সুকান্ত। ওর ছোট্ট বুকটা নিঃশব্দে ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ও হাঁটতে শুরু করল অফিস-ঘরের দিকে। ও যেন বোবা হয়ে গেছে। শুধু ভেতরের প্রচণ্ড আবেগে ওর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
অফিস-ঘরে পৌঁছে ভেজানো দরজায় হাতের চাপ দিল। ধীরে-ধীরে খুলে গেল নরকের দরজা।
পরের পাঁচমিনিট ও পাথর হয়ে গেল। আর সেই অবস্থাতেই তাকিয়ে দেখল সবকিছু।
সে-দৃশ্যের অভিঘাত বুঝি বৃদ্ধ, যুবক, শিশু বিচার করে না। সুতরাং নির্বাক, স্তম্ভিত সুকান্ত টলোমলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।
মা-কে এবং দিদিকে ও পরনের শাড়ি দেখেই চিনতে পেরেছে, চিনতে পেরেছে ফল কাটার বঁটিটাও। তবে অন্যমনস্ক থাকায় সিঁড়ির গোড়ায় রাখা চটিজোড়া ওর নজরে পড়ল না।
দোতলায় পৌঁছে শুধুমাত্র বসবার ঘরেই যে আলো জ্বলছে সেটা ওর চোখে পড়ল। এবং পুরোপুরি অবাক হয়ে ওঠার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল ডান প্রান্তে খাওয়ার ঘরের আলোটা।
সুকান্ত প্রথমে উঁকি মারল বসবার ঘরে। কেউ নেই।
চাপা স্বরে ডেকে উঠল, বাবা– বাবা!
উত্তর নেই।
তখন স্কুলের জামা-জুতো পরেই ও এগিয়ে চলল খাওয়ার ঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকেই দেখল, কালো পোশাক পরা একজন অপরিচিত লোক ওর দিকে পিছন ফিরে বসে কী যেন খাচ্ছে। গলার স্বর ভারিক্কি করে ও বলে উঠল, তুমি কে?
তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল লোকটা। বিদ্যুৎগতিতে চেয়ার ঠেলে ঘুরে দাঁড়াল।
তুমি এখানে কী করছ? আমার মা-কে, দিদিকে, অবিনাশদাকে মারল কে? তুমি?
অত্যন্ত সরল প্রশ্ন। এবং তার উত্তর ঠিক ততটাই জটিল ঠেকল লোকটার কাছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হাসল সে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে নিল ইস্পাতের ছুরিটা।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির নিয়ম অনুযায়ী এই মুহূর্তে সুকান্তর আতঙ্কে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে ঠিক বিপরীতটাই ঘটল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বসবার ঘর লক্ষ্য করে তিরবেগে ছুটতে শুরু করল ও।
একলাথিতে চেয়ারটা মেঝেতে ছিটকে ফেলে লোকটা ওকে তাড়া করল। অনেকক্ষণ বাদে তার মুখে-চোখে জিঘাংসার পুরোনো রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল।
অন্ধকার বারান্দার দৈর্ঘ্য পেরিয়ে দড়াম করে বসবার ঘরের আধ-ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সুকান্ত। চকিতে দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে খিল এঁটে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার ওপাশে লোকটার শরীর এসে আছড়ে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। গোটা বাড়িটা যেন সন্ত্রস্তভাবে কেঁপে উঠল।
পরের কয়েক সেকেন্ডে সুকান্ত ওর ভাবনা-চিন্তার কাজ শেষ করল। ও জানে, এই নির্জন লোকালয়ে, এই শীতের সন্ধ্যায়, সাহায্য আশা করা উদ্ভট কল্পনা। সুতরাং ওর এখন দরকার একটা নিখুঁত লুকোনোর জায়গা, কারণ, দরজার ওপিঠে রাগী চিতাবাঘের মতো প্রচণ্ড শক্তিতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলেছে লোকটা। কাঠের খিল কতক্ষণ এ-অত্যাচার সইতে পারবে কে জানে!
কী ভেবে বসবার ঘরে ছেড়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকল সুকান্ত।
ঘর অন্ধকার।
কিন্তু বহুবছরের চেনা ম্যাপে অন্ধকার কোনও বাধা নয়। তা ছাড়া এখন আলো জ্বালারও সময় নেই। দরজা পেটানোর দুদ্দাড় শব্দ কামানের বিস্ফোরণের মতো কানে এসে ঠেকছে। সুতরাং তড়িৎগতিতে ডানদিকের দেওয়ালে গাঁথা তাকের কাছে গেল সুকান্ত। তাকে রাখা টর্চলাইটের ধাতব শরীর অন্ধকারেও ঝিলিক মারছিল। সেটা হাতে করে বসবার ঘরে ফিরে এল ও। রেফ্রিজারেটরের মাথায় কয়েকটা চুলের কাটা ছিল–এখানে মা-দিদি যে এগুলো রাখে তা ওর বহুদিনের জানা। সেখান থেকে একটা কাটা নিয়ে সুইচবোর্ডের প্লাগ পয়েন্টে দুটো মাথা গুঁজে দিল। তারপর প্লাগ পয়েন্টের সুইন অন করে দিল।
একটা চাপা শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে গোটা বাড়িটার সমস্ত আলো নিভে গেল। আর সুকান্তের হাতে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। ও জানে কীভাবে বাড়ির সমস্ত আলো ফিউজ করতে হয়। আগেও একদিন করেছিল।
এবার ও ঢুকল ভাঁড়ার ঘরে। আলমারির পাশে রাখা কাঠের মইটা বেয়ে ওপরে উঠল। কাঠের সিলিংয়ের চৌকো অংশটায় জোর চাপ দিতেই ডালাটা ভেতরে ঢুকে গেল, আর ওপরের কুঠরি-ঘরে ঢুকে পড়ল সুকান্ত।
এই ছোট্ট কাঠের কার-এ ওদের চাল-গম-সরষের বস্তা থাকে। থাকে মুড়ি-চিঁড়ের সঞ্চয়। সুতরাং ইঁদুর-আরশোলার উপদ্রবও আছে। জ্বলন্ত টর্চটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে, ছোট্ট দুহাতে মইটাকে টেনে ওপরে তুলতে লাগল ওযাতে আর কেউ এই মই বেয়ে ওপরে উঠতে না পারে।
অতি কষ্টে, একরাশ ধুলো মেখে, মিনিটপাঁচেক পর ও সফল হল। মইটা অদ্ভুতভাবে কিছুটা ভেতরে কিছুটা বাইরে অবস্থায় আটকে রইল।
সুকান্তের সামনে-পিছনে ধুলোমাখা বস্তা আর থলে। টর্চের আলোর চোখে পড়ছে হলুদ আর শুকনো লঙ্কার ঠোঙা। এবং ওর সাধের হামানদিস্তে। প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর সময় সে হামানদিস্তে দিয়ে কাচ গুঁড়ো করে সুতোয় মাঞ্জা দেয়।
নিজের শরীরটাকে যতটা সম্ভব ভেতরে ঢুকিয়ে ও চুপটি করে বসল। নিভিয়ে দিল টর্চের আলো।
চারদিক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে যেতেই দরজা ধাক্কানোর শব্দটা বিকটভাবে কানে এসে বাজল। সুকান্ত শুনল, প্রতিবাদে-প্রতিবাদে ক্লান্ত কাঠের খিলের ক্ষীণ মচমচ শব্দ। ও বুঝল, বসবার ঘরের দরজা ভাঙতে আর দেরি নেই। কিন্তু বাবা, পিসিমণি–ওরা কি এ-শব্দ শুনতে পাচ্ছে না? শুনতে যদি পেয়ে থাকে তা হলে ছুটে আসছে না কেন?..তা হলে কি ওদের অবস্থাও মা-দিদি অবিনাশদার মতো?
হঠাৎ সুকান্তর মনে পড়ল, টর্চটা নিতে শোওয়ার ঘরে ঢুকবার সময় একটা বিশ্রী আঁশটে দুর্গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মেরেছিল। ও ফিশফিশ করে ডেকে উঠল, বাবা বাবা।
.
এক সময়, এক চূড়ান্ত মুহূর্তে, ভেঙে পড়ল শেষ প্রতিরোধ, বসবার ঘরের দরজা।
লাথি মেরে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাল্লাটা মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল সে।
সামনে অন্ধকার, পিছনেও অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে মাঝে-মাঝে ঝলসে উঠছে তার হাতের ইস্পাতের ছুরিটা। অন্ধকারে তার কালো পোশাক মিশে গেছে।
প্রথম কয়েক সেকেন্ড সে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুনতে চেষ্টা করল কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। তারপর ধীর পায়ে এগোল শোওয়ার ঘরের দিকে।
এখানেও যথারীতি অন্ধকার। নজর চলে না। সুতরাং পকেট হাতড়ে একটা সস্তার লাইটার বের করল সে। চাবি টিপতেই একটা নীলচে আলোর শিখা লাফিয়ে উঠল। ডানহাতে লাইটার উঁচিয়ে ধরল সে। ক্ষীণ আলোর বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা মৃতদেহটা আবছাভাবে চোখে পড়ল। নীচু হয়ে খাটের তলাটা দেখল সে। না, কেউই সেখানে লুকিয়ে নেই। এবং তার পরই শুরু হল তার তন্নতন্ন অনুসন্ধান পর্ব।
শোওয়ার ঘর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে দেখার পর সে ফিরে এল বসবার ঘরে। ইস্পাতের ছুরিটা পকেটে রেখে শোওয়ার ঘর এবং বসবার ঘরের মাঝের দরজাটা বন্ধ করল। বসবার ঘর থেকে এক গাছা দড়ি বের করে শক্ত হাতে বাঁধল দরজায় কড়া দুটো। পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালল আবার। কী এক অজানা প্রতিজ্ঞায় তার চোয়াল আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এবার ছুরিটা বের করে বাঁ-হাতে উঁচিয়ে ধরল সে।
শোওয়ার ঘর শেষ করে এবার বসবার ঘরের পালা।
প্রথমে সোফাসেটগুলোকে টেনে এনে ভাঙা দরজার মুখে স্তূপাকারে রাখল সে। উদ্দেশ্য জলের মতোই সরল : যাতে কেউ আচমকা দরজা ডিঙিয়ে পালাতে না পারে।
বসবার ঘরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেল না। সুতরাং সে নিশ্চিত হল, বাচ্চাটা ভঁড়ার ঘরে ঢুকেছে।
বুকভরা ভারী শ্বাস নিয়ে জ্বলন্ত লাইটার হাতে ভঁড়ার ঘরে ঢুকল সে। ডানদিকে বাঁ-দিকে তাকাল। তাকাতেই ওই ছোট ঘরটায় যে-বিশাল পরিবর্তনটা তার নজরে পড়ল তা হল সবুজ কাঠের মইটা। ওটার ওপরের দিকটা ঢুকে গেছে কুঠরি-ঘরের ভেতরে। আর বাকি অংশটা বেরিয়ে আছে। বাইরে। নির্ঘাত কুঠরি-ঘরে ঢুকেছে ছেলেটা। ছুরি উঁচিয়ে ওপরে তাকাতেই একইসঙ্গে মইয়ের শেষটুকু আর বাচ্চাটার জ্বলন্ত চোখে তার চোখ পড়ল। একমুহূর্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী স্থির হয়ে রইল। তারপর…।
.
সুকান্ত চারপাশের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে রেখেছিল। শুধুমাত্র শব্দ শুনেই পাশের ঘরের কাজকর্মের হদিস পাচ্ছিল ও। অবশেষে, যখন লাইটারের আলোটা ভঁড়ার ঘরের দরজায় এসে থামল, তখন ও ভয় পেল। শরীরটাকে আরও ভিতরে গুটিয়ে নিল।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর কৌতূহলে নীচের দিকে একবার উঁকি মারল।
এবং সঙ্গে সঙ্গেই কালো জামা পরা লোকটার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। ত্রাসে পিছিয়ে আসার আগেই ও শুনতে পেল এক অদ্ভুত জান্তব চিৎকার। সে-চিৎকারে ফেটে পড়ল জয়ের উল্লাস। পরমুহূর্তেই নীচের কালো চেহারাটা শূন্যে লাফিয়ে উঠল। ইস্পাতের বিদ্যুৎ খেলে গেল সুকান্তর চোখের সামনে। ঝটিতি মুখ সরিয়ে নিল ও। লোকটার ছুরির ফলা হাওয়ায় শিস কেটে ফিরে গেল নীচে।
এবার অবাক হয়ে সুকান্ত লক্ষ করল, লোকটা ছুরিটার গায়ে চাপ দিয়ে ভাঁজ করে ওটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখছে। তারপর খানিকটা বেরিয়ে থাকা মইটা লক্ষ্য করে আচমকা লাফ দিল সে। ভয়ে চমকে পেছোতে যেতেই হামানদিস্তের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুকান্ত। অন্ধকারে অনুভব করল ভিজের ডগায় নোনতা স্বাদ। একটা ঘড়ঘড় শব্দ করে ওর গায়ে গা ঘষে কাঠের মইটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই শব্দে সুকান্তর সংঘর্ষের শব্দটা চাপা পড়ে গেল।
একমিনিট…দু-মিনিট…।
সুকান্ত বুঝল, দেওয়ালের গায়ে মই লাগিয়ে, নিজেকে তৈরি করে, ওপরে উঠতে শুরু করেছে লোকটা। একটু পরেই চৌকো কাঠের ফোকরের ভেতরে জেগে উঠল কালো মাথাটা। জুলজুলে চোখজোড়া নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
লোকটা জ্বলন্ত লাইটার ধরা হাতটা ওপরে তুলে ধরতে গেল। আর সেইমুহূর্তেই এক অমানুষিক শক্তি সুকান্তর শরীরে ভর করল। হামানদিস্তের মোটা লোহার রডটা দিয়ে দু-হাতে সর্বশক্তি দিয়ে ও লোকটার মাথায় আঘাত করল। একবার, দুবার…।
ধীরে-ধীরে মইয়ের গা থেকে ঢলে পড়তে লাগল লোকটা। মইটা কাত হয়ে গিয়ে ঠেকল দেওয়ালের কোণে, আর লোকটার শরীর শানবাঁধানো মেঝেতে সশব্দে আছড়ে পড়ল। জ্বলন্ত লাইটারটা নিভে গিয়ে কোথায় যেন ঠিকরে পড়ল।
কুঠরি-ঘরের ফোকর দিয়ে টর্চের আলোর সুকান্ত দেখল, ঠিক নীচেই শ্লথ ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে লোকটা।
টর্চটাকে জ্বলন্ত অবস্থায় পাশে নামিয়ে রেখে দু-হাতে গোটা হামানদিস্তেটা তুলে ধরল ও। তারপর, গুলি খেলায় যেরকম নান্ধু করে, সেরকম ভঙ্গিতে লোকটার মাথা লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল হামানদিস্তেটা।
লোকটার মাথার সঙ্গে পাঁচ কেজি ওজনের লোহার সংঘর্ষের শব্দটা তেমন জোরদার হল না। ফট করে একটা শব্দ হল শুধু।
জ্বলন্ত টর্চটা হাতে নিয়ে একটা পা আলমারির গায়ে দিয়ে, অন্য পা-টা হেলে যাওয়া মইয়ের গায়ে রেখে অতি কষ্টে মেঝেতে নেমে এল সুকান্ত। টর্চের আলোয় দেখল, লোকটার কালো পোশাকের সঙ্গে রক্তাক্ত মুখটা নিতান্তই বেমানান লাগছে। আর হামানদিস্তের দুটো অংশ পড়ে রয়েছে দু পাশে।
অত্যন্ত গম্ভীরভাবে সুকান্ত লোকটার শরীর ডিঙিয়ে হামানদিস্তের রডটা তুলে নিল। তারপর কী ভেবে নিভিয়ে দিল টর্চটা। এবং লোকটার মাথা আন্দাজ করে রড দিয়ে পাগলের মতো আঘাত করে চলল–একবার, দুবার…।
জ্ঞানশূন্য মিনিট পাঁচেকের পর থামল সুকান্ত। রডটা নামিয়ে রেখে টর্চটা জ্বালল। তারপর জ্বলন্ত টর্চটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে লোকটার পা দুটো দু-হাতে চেপে ধরল। অনেক কসরৎ করে পা দুটোকে টেনে নিয়ে এল ভঁড়ার ঘরের দরজার বাইরে। আর শরীরের সমস্ত ক্ষমতা একজোট করে লোকটাকে টেনে নিয়ে এল বসবার ঘরে। সেখানে তাকে শুইয়ে রেখে ও আবার ভাড়ার ঘরে ঢুকল। পড়ে থাকা টর্চের আলোয় দেখতে পেল লাইটারটা। লাইটার আর টর্চটা তুলে নিয়ে ফিরে এল বসবার ঘরে। লাইটারটা পকেটে রেখে শোওয়ার ঘরের দরজায় বাঁধা রেশমি দড়িটা খুলতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় নিরাশ হয়ে ও লোকটার শুয়ে থাকা শরীরের পকেট হাতড়ে ছুরিটা বের করল। চাবি টিপতেই ফাটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। এরপর শোওয়ার ঘরের দরজা খোলা কয়েক সেকেন্ডের কাজ। সুতরাং…।
বাবার শরীর এবং মাথাকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেও বিচলিত হল না সুকান্ত। কারণ, ইতিমধ্যেই ও সবরকম ভাব এবং আবেগ নিঃশেষে খরচ করে বসে আছে। শুধু শ্লথ পায়ে ও ফিরে এল বসবার ঘরে। আধঘণ্টার চেষ্টায় অনেক টানাটানি করে ও সরিয়ে ফেলল সোফাসেটগুলো। তারপর ভাঙা দরজা পেরিয়ে টর্চ জ্বেলে রওনা হল তিনতলার দিকে। এখন ও খুঁজতে চলেছে পিসিকে।
তিনতলা, দোতলা, একতলায় খোঁজ করেও পিসিকে পেল না ও। তাই ফিরে এল বসবার ঘরে। কালো-পোশাকি লোকটার গায়ে টর্চের আলো ফেলে কী চিন্তা করল। তার পর ফিরে চলল খাওয়ার ঘরের দিকে।
বারান্দার বাঁ-কোণে খাওয়ার ঘরের দরজার ঠিক মুখেই থাকে কেরোসিন তেলের টিনটা। সেটাকে একহাতে নিয়ে অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে বসবার ঘরে ফিরে এল। টর্চটাকে জুলন্ত অবস্থায় একটা সোফার ওপরে রেখে কেরোসিন তেলের টিনটা লোকটার গায়ে উপুড় করে দিল।
একটু পরে খালি টিনটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলল। পকেট থেকে লাইটারটা বের করে জ্বালল। আগুন ধরিয়ে দিল কালো পোশাকে। তারপর লাইটার ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল বসবার ঘর থেকে। আগুনের শিখা তখন লোকটার শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।
অন্ধকারেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল সুকান্ত।
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে অন্ধকার অফিস-ঘরের সামনে একমুহূর্ত দাঁড়াল ও। তারপর এগিয়ে চলল সদর দরজায় দিকে। অন্ধকার থাকলেও এবারে অবিনাশের মৃতদেহে হোঁচট খেল না ও। পা যথাসম্ভব উঁচু করে দরজায় ছিটকিনিটা খুলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।
তারপর মেঠো পথ ধরে দিগ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে শুরু করল
আকাশবাণী নরক
মণিকার কথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
একটা নামগোত্রহীন আতঙ্ক পায়ের পাতায় বরফঠান্ডা স্রোতের মতো প্রবেশ করে সূক্ষ্মতন্তুজাল বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে উঠে আসতে লাগল মস্তিষ্কের দিকে। ঘরের মেঝেটা মনে হল নরম একতাল জেলি হয়ে গেছে। ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার।
মণিকা অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো সাদা হয়ে গেছে। ওর সৌন্দর্য উবে গিয়ে ভীষণ কুৎসিত দেখাচ্ছে। ওর আয়ত চোখে আতঙ্কের ঢেউ ঝাপটা মারছে। ও বলল, এখন কী করব?
টের পেলাম মণিকার গলা বিশ্রীভাবে কেঁপে গেছে। কে বলবে একদিন ওর অলৌকিক সুরেলা গান আমাকে পাগল করে দিয়েছিল–আজও দেয়! অন্তত এই মুহূর্তটুকুর আগে আমার এটাই বিশ্বাস ছিল।
সত্যিই তো! কী করব এখন? মণিকা জানতে চাইছে।
স্বপন–স্বপন বক্সী এভাবে কখনও যে ঝড় তুলবে এ তো কোনওদিন ভাবিনি।
কিছুক্ষণ পর মণিকাকে বললাম, তুমি যাও। চিকুর কাছে শোও গিয়ে। আমি দেখছি, কী করা যায়।
মণিকা চলে গেল। চোখে-মুখে অবিশ্বাস। আমার ওপরে এই মুহূর্তে ওর কোনও আস্থা নেই। তার জন্যে ওকে দোষ দেওয়া যায় না। আস্থা আমার নিজেরও কি আছে! মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার ওলটপালট শুরু হল। মণিকার জন্যে। চিকুর জন্যে। আমাদের দু-বছরের ছেলে চিকু।
তিন বছর আগে ঠিক এরকমই একটা ঝড় তুলেছিল স্বপন।
.
স্বপন বক্সী। আমার বন্ধু। একদিন হঠাৎই ও ঝোড়ো বাতাসের মতো এসে হাজির হয়েছিল আমার ঘরে। তখন আমি এ-ফ্ল্যাটে আসিনি। উত্তর কলকাতায় একটা ঘর ভাড়া করে থাকি–যাকে সোজা কথায় বলা যায় ব্যাচেলার্স ডেন। এবং এক ওষুধ কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি করি।
অফিসে বেরোব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। দেওয়ালে ঝোলানো ছোট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেহারার পালিশ শেষবারের মতো শানিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় প্রচণ্ড দড়াম শব্দে দরজা খুলে গেল। কাঠের জীর্ণ পাল্লা দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে কঁপতে লাগল।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে স্বপন।
কাল বিকেলে মণিকার সঙ্গে তুই ঘুরতে গিয়েছিলি?
ওর এই আচমকা অভিযোগমূলক প্রশ্নে আমি বিব্রত-বিচলিত। লক্ষ করলাম, স্বপনের চুল উশকোখুশকো, চোখ লালচে, মুখে না কামানো দাড়ি, পরনে অতি সাধারণ জামা, অতি সাধারণ প্যান্ট। যেমনটি বরাবর থাকে।
ডাক্তার-বাড়ি আর হাসপাতালের দোরে দোরে ওষুধ বেচে বেড়াস সেটাই জানতাম, আজকাল কি প্রেমও ফিরি করছিস? স্বপনের তীব্র শ্লেষ আমার শরীরে যেন কেটে বসল।
মনের রাগ অতি কষ্টে চেপে রেখে আমি বললাম, এখন অফিসে বেরুচ্ছি। তোর কী বলার আছে তাড়াতাড়ি বল।
স্বপন খুঁটিয়ে আমার চেহারা ও বেশবাস দেখল। যেন এই প্রথম দেখছে। আমি টাইয়ের না ঠিক করে নিয়ে বিছানায় বসলাম। অদ্ভুত চাউনি আমার শরীরের ওপরে স্থির রেখে স্বপন ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসল। পাশেই টেবিল। টেবিলে একটা কাচের গ্লাসে জল ঢাকা ছিল। ও কোনও কথা না বলে গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিল।
তারপর মুখ মুছে নিয়ে বলল, বিজন, সত্যি কথা বল। কাল তুই মণিকার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলি?
স্বপনের গলার স্বর অনেক শান্ত।
একটু বিরক্ত হয়েই জবাব দিলাম, সেটা মণিকাকেই জিগ্যেস কর না।
না! আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই!
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলাম। সত্যি কথা বলাটা কি ঠিক হবে? এইরকম উত্তেজনার মুহূর্তে আমার জবাবটা শুনে স্বপন একটা কাণ্ডই না করে বসে! মণিকার সঙ্গে স্বপনই আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। প্রায় মাসখানেক আগে ওর দোকানে একটা রেডিয়ো সারাতে এসেছিল মণিকা।
.
স্বপন আমার বহুদিনের বন্ধু। স্কুল পেরিয়ে আমি কলেজের পথে পা বাড়ালেও ওর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, হায়ার সেকেন্ডারিতে বার দুয়েক ঠেকবার পর ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজনেস করবে। জমানো পুঁজি যে খুব একটা ছিল তা নয়। বাবা-মা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে ধার করে ও একটার পর একটা ব্যবসাতে ভাগ্যপরীক্ষা করতে লাগল। এবং ব্যর্থ হতে লাগল ক্রমাগত। তখন ও ঠাট্টা করে বলত, বিজন, জানিস, বাপ-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমার নাম রেখেছিল স্বপন। কিন্তু পদবিটার কথা কেউ খেয়াল করেনি।
তার মানে? অবাক হয়ে জানতে চেয়েছি আমি।
বক্সী! স্বপন বক্সী! তার মানে আমার সমস্ত স্বপ্ন বাক্সে বন্দি হয়ে থাকবে। বক্সী শব্দটা নির্ঘাত বাক্স থেকেই এসেছে।
ওর ওই ঠাট্টায় আমি প্রাণ খুলে হেসেছি। কিন্তু এটা ছিল ওর কাছে এক নিষ্ঠুর তেতো ঠাট্টা।
যখন আমি কলেজ পেরিয়ে চাকরিতে ঢুকলাম তখনও উপার্জনের সমস্যা সমাধান করতে স্বপনের লাগাতার ভাগ্যপরীক্ষা চলছে। এক পাড়াতেই থাকি। ফলে দেখাও হয় প্রায় রোজই। দেখা হলেই ও হেসে বলে, বাক্সের তালা খোলেনি। আমি অস্বস্তিতে পড়ি ওর কথা শুনে।
হঠাৎ একদিন শুনলাম স্বপন রেডিয়ো মেরামতের দোকান খুলেছে। সুতরাং সেদিন সন্ধেবেলাতেই গেলাম ওর দোকানে। দোকানের নাম আকাশবাণী। মাপে ছোট্ট হলেও সুন্দর করে সাজিয়েছে। বেশ কিছু নতুন ও পুরোনো রেডিয়ো শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন তাকে। ওকে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম, বক্সীর বাক্সের তালা তা হলে খুলেছে!
ও হেসে জবাব দিয়েছে, মর্তে ঠাই হল না, তাই আকাশে যেতে হয়েছে।
তারপর দুজনে প্রাণভরে গল্প করেছি।
সেদিন থেকে সন্ধে সাতটার পর ওর দোকানে গিয়ে রোজ আড্ডা দেওয়াটা একরকম নিয়মের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেল।
লক্ষ করতাম, রেডিয়ো জিনিসটা স্বপনকে যেন পাগল করে তুলছে। দিনরাত পড়ে থাকে ওই রেডিয়োর পিছনে। নানান রকম অদৃশ্য বেতার তরঙ্গকে রেডিয়োর মাধ্যমে পাকড়াও করে শব্দময় প্রাণবন্ত করে তোলাটাই যেন ওর একমাত্র ব্রত। ছুটির দিনে গেলেও দেখেছি যন্ত্রপাতির গাদার মধ্যে কানে হেডফোন লাগিয়ে কীসব খুটুর খুটুর করছে। ছোট-বড় নব ঘোরাচ্ছে। সেইসঙ্গে কয়েকটা স্পিকারে তীক্ষ্ণ, মিহি, কর্কশ নানান স্বরধ্বনিতে একই কথা বেরিয়ে আসছে। যখনই ওর সঙ্গে গল্প করতে বসতাম, তখনই ওর মুখে থাকত বেতার-তরঙ্গ বিষয়ক মুগ্ধ আলোচনা। ও বলত, বিজন, আমাদের চারপাশে আকাশে-বাতাসে কত শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে জানিস? শুধু একবার তাদের ধরতে পারলেই হল। দেখবি, কত কথা তাদের বলার ছিল। এই তো, কাল রাত দুটো নাগাদ উরুগুয়ের একটা মিউজিক প্রোগ্রাম ধরলাম।
ওর কথা যেন শেষ হতে চায় না। দেখলাম, রেডিয়োর এই কারিগরি খুঁটিনাটি হল একমাত্র বিদ্যে যেটা স্বপন দারুণভাবে আয়ত্ত করেছে। অন্য বিষয়ে পড়াশোনার তেমন কোনও আগ্রহ কিংবা আকর্ষণ না থাকলেও এই একটি বিষয় নিয়ে ও যথেষ্ট চর্চা করে। যন্ত্রপাতি এবং বই একইসঙ্গে ঘাঁটাঘাঁটি করে।
একদিন সন্ধেবেলা ওর দোকানে গিয়ে দেখি দোকান খোলা, কিন্তু দোকানের মালিক তথা কর্মচারী অনুপস্থিত। অথচ ঘরের অসংখ্য রেডিয়োর কোনও একটাতে বেশ উচ্চগ্রামে খবর পড়া হচ্ছে। হঠাত্ খবরের মাঝখানে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অনেকটা খবর পড়ুয়া ঢঙেই কেউ বলছে, নমস্কার, আকাশবাণী থেকে বলছি। বিজন, তুই একটু বোস, আমি এখুনি আসছি।
আমি চমকে উঠলাম। এ তো স্বপনের গলা! চারপাশে তাকালাম ওর খোঁজে। ও নেই। বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করা উচিত, এমন সময় দোকানের পিছনের অংশ থেকে পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এল স্বপন। হেসে বলল, কী রে শালা, কেমন চমকে দিয়েছি।
আমি অবাক হয়ে স্বপনকে দেখছি। ও কি জাদু জানে! রেডিয়োতে ওর গলা আমি শুনলাম কেমন করে!
স্বপন আমার অবস্থাটা অনুমান করতে পারল। কাছে এগিয়ে এসে হাসল ও পরদার ফাঁক দিয়ে তোকে দেখে কথাগুলো বললাম।
কিন্তু রেডিয়োর মধ্যে দিয়ে শুনলাম কেমন করে?
এসব তো আমার কাছে ছেলেখেলা রে! বেতার-তরঙ্গ নিয়ে আমি যখন খুশি যা খুশি করতে পারি।
লক্ষ করলাম, স্বপনের চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। এতদিন যে নিজেকে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ বলে জানত, আজ যেন সে উপলব্ধি করতে পেরেছে এই একটি বিষয়ে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজেয়।
এর পর থেকে যে-কোনও রেডিয়ো প্রোগ্রামের মাঝে কথা বলাটা স্বপন বক্সীকে নেশার মতো পেয়ে বসল। এবং সবসময়েই ও রেডিয়োতে কথা শুরু করতে ওর দোকানের নাম আকাশবাণী উল্লেখ করে।
দিনে দিনে অচল রেডিয়ো সচল করার ব্যাপারে আকাশবাণীর সুনাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বহু দূর দূর থেকে লোক আসে ওর কাছে রেডিয়ো সারাতে। এইভাবেই একদিন এসে হাজির হল মণিকা সরকার।
দিনটা ছিল শনিবার। তখন প্রায় সন্ধে সাতটা হবে। স্বপন একটা ভাঙা রেডিয়ো মেরামতের কাজে নিবিষ্টমনে ব্যস্ত। আমি দোকানের কাউন্টারের একপাশে বসে চা খাচ্ছি। এমন সময় মেয়েটি এল।
পরনে উজ্জ্বল রানি রং শাড়ি। একই রঙের ব্লাউজ। বড় বড় মর্মস্পর্শী চোখ। তীক্ষ্ণ নাকের পাশে একটা বড় তিল। কপালে টিপ। হাতে বাদামি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট।
মেয়েটির উপস্থিতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। সুদর্শন এবং সুপুরুষ হওয়ার খাতিরে বহু মেয়ের সংস্পর্শেই আমি এসেছি। ভালোবাসাবাসিও নেহাত কম করিনি। তাদের কেউ কেউ বেশ রূপসিও ছিল। কিন্তু এই মেয়েটির মতো এমন করে কেউ আমাকে নাড়া দেয়নি।
মেয়েটি মাথা তুলে দোকানের সাইনবোর্ডটা একবার পড়ে নিল। তারপর এগিয়ে এসে আমাকে জিগ্যেস করল, আপনিই স্বপনবাবু? ওর কণ্ঠস্বরও মুগ্ধ করার মতো।
স্বপন কাউন্টারের আড়ালে মেঝেতে বসে কাজ করছিল। সম্ভবত মেয়েটির প্রশ্ন শুনতে পেয়েই ও তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়াল : আমি স্বপন বক্সী। বলুন, কী দরকার?
তখন হাতের প্যাকেটটি খুলে একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়ো এগিয়ে দিলে মেয়েটি এই রেডিয়োটা অনেকদিন ধরেই ভীষণ গোলমাল করছে। বহু দোকানে সারানোর চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। আপনার দোকানের খুব নাম শুনেছি, তাই।
আমাকে ডিঙিয়ে আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল স্বপন ও দিন তো, দেখি–।
তখন আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বলেছি, পরদিন সন্ধ্যায় আসব। কেন জানি না, মনে মনে সামান্য আহত বোধ করেছিলাম। হয়তো মেয়েটির মনোযাগ স্বপনের প্রতি নিবিড় হয়েছিল বলেই। অথচ জানি, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ সে রেডিয়ো সারাতে এসেছে। আমার সঙ্গে আলাপ করতে নয়।
স্বপনের আকাশবাণীতে এরপরে যেদিন গেলাম তখন প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। একটা হতাশা, ক্ষোভ, আর ব্যর্থতা কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার মনটাকে চেপে ধরেছে। মেয়েটির মুখ কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না। সুতরাং সাতদিন পর যেদিন স্বপনের দোকানে গেলাম, তখন তাকে দেখতে পাব এ-জাতীয় একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা মনে যে ছিল না তা নয়। এবং সে-প্রত্যাশা পূর্ণ হল পুরোমাত্রায়।
স্বপন দোকানের ভিতরে বসে মেয়েটির সঙ্গে গল্প করছিল। আমাকে আসতে দেখে বলল, আয় বিজন, মণিকার সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিই।
সেইদিনই মণিকার সঙ্গে প্রথম আলাপ। মণিকা সরকার। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে বি.এ. পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার।
তিনজনে মিলে আড্ডায় বসলেও আচ্ছা তেমন জমল না। বারবারই নিজেকে ভীষণ বাড়তি মনে হল। কারণ ওরা দুজনে নিজেদের গল্পে মশগুল।
একটা সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। মণিকা চলে যেতেই আমিও উঠলাম। কিন্তু স্বপন আমাকে ছাড়ল না। জোর করে আটকে রাখল। চা খাওয়াল। এবং গত সাতদিনে কী করে সে ও মণিকা পরস্পরের প্রেমে পড়েছে তার বিশদ কাহিনি শোনাল। আমার সন্দেহ প্রমাণিত হল। জিভে চায়ের স্বাদ সাপের বিষের মতো ঠেকল।
সে-রাতে ঘরে ফেরার পথে একটা পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করলাম। যুক্তি দিয়ে মনকে বোঝালাম, এর কোনও মানে হয় না। কিন্তু আমার অবুঝ মন জেদ ধরে ফুসতে লাগল। কী আছে স্বপন বক্সীর? অতি সাধারণ রোগা চেহারা। গায়ের রং মিশকালো। বিদ্যে স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। ভালো করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেও জানে না। পোশাক-আশাকে রুচির ছিটেফোঁটাও নেই। ওঃ অসহ্য!
অনেক চিন্তা করে দেখলাম, স্বপনের একটিমাত্র দক্ষতা মণিকাকে আকর্ষণ করেছে। সেটা হল বেতারবিদ্যা। স্বপনের কাছেই শুনেছি রেডিয়ো তৈরি করাটা মণিকার অত্যন্ত প্রিয় শখ। স্বপন যে শুধু ওকে সেই ট্রানজিস্টার রেডিয়োটা সারিয়ে দিয়েছে তা নয়, নতুন দুটো রেডিয়ো উপহারও দিয়েছে। যে-রেডিয়োতে মণিকার প্রিয় বিদেশি গান শোনা যায়। মণিকা নাকি খুব সুন্দর গান করে। সেই গান একই সঙ্গে তিন-চারটে রেডিয়োতে শুনিয়ে ওকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে স্বপন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার গায়ের জ্বালা ক্রমশ বাড়ছিল।
কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আমি অন্য পন্থা নিলাম। একরকম জোর করেই স্বপন ও মণিকার সঙ্গে মিশতে লাগলাম। সময় ও সুযোগ পেলেই মণিকাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি। ওর মোহভঙ্গের জন্যে তুণের সবকটি শাণিত তির একে একে নির্ভুল লক্ষ্যে নিক্ষেপ করি। একদিন, দুদিন, প্রতিদিন। স্বপন দু-একবার যে সন্দেহ করেনি তা নয়। তবে মুখে কিছু বলেনি।
অনন্ত প্রচেষ্টার পুরস্কার একদিন পেলাম।
মণিকা আমার সঙ্গে বেরোতে রাজি হল। এবং সেইদিনই আমি ওর কাছে আমার উৎকর্ষ অতি সুকৌশলে প্রতিষ্ঠিত করলাম। ওকে বোঝালাম, একজন মেকানিকের ভবিষ্যৎ মেকানিকের বেশি কিছু নয়। তা ছাড়া, রেডিয়োর প্রতি মণিকার এই আকর্ষণটা নেহাতই সাময়িক। সেটা উবে গেলে স্বপনের অস্তিত্বটুকুই কি ওর কাছে মিথ্যে হয়ে পড়বে না?
সে-রাতে বাড়ি ফেরার সময় মনে হল আমার জিত হয়েছে। আমি মণিকাকে সরল বাস্তব বোঝাতে পেরেছি। একটা আত্মপ্রসাদের ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। তখন ভাবিনি, এক আকস্মিক ঝড় আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। পরদিন স্বপন আসবে আমার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে।
.
চুপ করে থাকিস না! জবাব দে, বিজন! স্বপনের ভারী কণ্ঠস্বর আমাকে চমকে দিল। কাচের গ্লাসটা এখনও ওর হাতে ধরা।
পুরোনো পরাজয়ের লজ্জা ও অপমানের কথা নতুন করে আমার মনে পড়ল। সুতরাং স্বপনকে কঠিন আঘাত দেওয়ার একটা নিষ্ঠুর ইচ্ছে আমাকে হঠাৎই পেয়ে বসল। সরাসরি ওর চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম, স্বপন, কাল আমি মণিকাকে নিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেছি। ওকে চুমুও খেয়েছি। ও তোকে আর–।
স্বপনের হাতের মুঠোয় কাচের গ্লাসটা মটাস শব্দে ভেঙে গেল। কাচের টুকরো মিহি ঠুনঠুন শব্দে ঠিকরে পড়ল মেঝেতে। জল ও রক্তের মিশ্র ধারা স্বপনের হাতে, প্যান্টে, মেঝেতে। ওর মুখের সেই জেহাদি ভাবটা চুপসে গেছে।
আমি ওকে ধরতে উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু ও হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিল। হাতের যন্ত্রণায় বিন্দুমাত্রও ভুক্ষেপ না করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। গড়াতে লাগল গাল বেয়ে। ওর দেহটা কেঁপে উঠল কান্নার দমকে। ভাঙা অস্পষ্ট গলায় ও বলল, বিজন, তোকে আমি দোষ দিই না। আমার কী-ই বা আছে মণিকাকে দেওয়ার মতো। তবে জানিস, এই একটিমাত্র স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে–একটা মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছিল। আমি নিজেও সেটা বিশ্বাস করতে পারিনি। সত্যি সত্যি কি একটা স্বপ্ন আমার বন্ধ বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়ে সত্যি হয়ে উঠল? কিন্তু না, বরাবরের মতোই আমি হেরে গেছি।…না, তোর কাছে নয়, নিজের কাছে। বলতে পারিস, এর পরে আমি কী নিয়ে বাঁচব? এ-ঘটনা তো আমার জীবনে দ্বিতীয়বার আর ঘটবে না!
কথাটা শেষ করেই রক্তাক্ত হাতটা মুঠো পাকিয়ে টেবিলে এক প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিল স্বপন। তারপর যেমন এসেছিল তেমনই ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল।
সেদিন রাতেই খবর পেলাম ও আত্মহত্যা করেছে।
আকাশবাণীর ঘরে অত্যন্ত বীভৎসভাবে আত্মহত্যা করল স্বপন। মৃতদেহ দেখে ওকে চেনার কোনও উপায় ছিল না। মণিকাকে সঙ্গে নিয়ে যখন ওর দোকানে গেলাম, তখন সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। জনতার গুঞ্জন। পুলিশ কর্ডন করেছে। স্বপনের বাড়ির লোকেরা বুকফাটা কান্নায় হাহাকার তুলছে। দোকানের কাউন্টারটা একপাশে সরানো থাকায় ভিতরের দৃশ্য বেশ স্পষ্টই নজরে পড়ছে। অসংখ্য যন্ত্রপাতির মধ্যে ত্রিভঙ্গ অবস্থায় পড়ে রয়েছে স্বপনের দেহটা। পুড়ে কালো হয়ে গেছে। হাতে-পায়ে জড়ানো পোড়া কালো তারের অংশ অতি কষ্টে নজরে পড়ে।
শুনলাম, ও নাকি প্রথমে হাতে-পায়ে তার জড়িয়ে নেয়, তারপর ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের রক্তবাহী শিরাগুলো কেটে ফেলে। আর সবশেষে চারশো চল্লিশ ভোল্টের বিজলি লাইন অন্ করে দেয়। কী বীভৎস মৃত্যু!
আরও শুনলাম, দোকানের সবকটা রেডিয়ো নাকি ফুল ভলিয়ুমে চলছিল। পুলিশ অফিসাররা স্বপনের এই উদ্ভট খেয়ালের কোনও কারণ বুঝতে পারেননি। তবে ও মরার আগে নিজের হাতে স্পষ্ট চিঠি লিখে রেখে গেছে। আমার মৃত্যুর জন্যে আমি নিজেই দায়ী।
মনে আছে, স্বপনের মৃতদেহ দেখে মণিকা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
.
এ সবই তিন বছর আগের ঘটনা। কিন্তু আজ, একটু আগেই, আমার ও মণিকার জীবনে নতুন এক ঝড় তুলেছে স্বপন।
গত তিন বছরে ওর স্মৃতি বেশ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। শুধু মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে যেত ওর বীভৎস পোড়া চেহারাটার কথা। ও মারা যাওয়ার পর আকাশবাণী দোকানটাও উঠে গিয়েছিল। আমি এবং মণিকা ওকে নিয়ে আর বিশেষ মাথা ঘামাইনি। পুলিশি তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা যথারীতি বিয়ে করেছি। নতুন ফ্ল্যাট নিয়ে পুরোনো পাড়া ছেড়ে চলে এসেছি আমি। আর তার এক বছর পরেই এসেছে চিকু। স্বভাবতই পরিপূর্ণ সংসারী হয়ে চিকুকে কেন্দ্র করে আমি ও মণিকা দৃঢ়তর এক বন্ধনে নতুন করে পরস্পরের কাছে বাঁধা পড়েছি।
আজ রবিবার। খাওয়াদাওয়ার পর অফিসের কয়েকটা কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলাম। মণিকা রান্নাঘর গোছগাছ করতে করতে ট্রানজিস্টার রেডিয়োতে নাটক শুনছিল। চিকু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎই রান্নাঘর থেকে মণিকার একটা অস্ফুট চিৎকার শুনতে পেলাম।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ ফেলে আমি উঠে পড়লাম। এবং উদ্ভ্রান্ত মণিকা এসে ঘরে ঢুকল। আটপৌরে শাড়ি ওর সুঠাম শরীরে জড়িয়ে রয়েছে। আঁচল কোমরে গোঁজা। ও হাঁপাচ্ছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। তিলটা সূক্ষ্মভাবে কাঁপছে। আমাকে দেখেই ও সোজা এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিজন, বিজন! এইমাত্র রেডিয়োতে স্বপনের গলা শুনলাম!
আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। আমার হাতের বাঁধনে মণিকার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে অতিকষ্টে সামলে নিলাম। মনে পড়ল, স্বপন আমাকে যে-খেলা দেখাত, সে খেলা মণিকাকেও বহুবার দেখিয়েছে, হয়তো আচমকা সেই স্মৃতিই ওর মনে এসে ঝাপটা মেরেছে।
সেকথা মণিকাকে বলতেই ও বলল, না, বিজন, তা নয়। আমি স্পষ্ট শুনলাম, নাটক থেমে গিয়ে স্বপনের কথা শোনা গেল। ও বলল, মণিকা, মণিকা, আমি আবার তোমার কাছে এসেছি!
চকিতে দু-কাঁধ ধরে মণিকাকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ভালো করে সব কথা শুনতে চাইলাম।
ও বলল, ওই একটা কথাই নাকি পরপর তিনবার শোনা গেছে রেডিয়োতে। কেমন যেন এক প্রতিধ্বনিময় কণ্ঠস্বর। প্রথম উচ্চারণের পর ধাপে ধাপে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ও মণিকা, আমি আবার তোমার কাছে এসেছি!
মণিকাকে চিকুর কাছে যেতে বলে আমি ভাবতে বসলাম। কিন্তু রহস্যের কোনও উত্তর পেলাম না। স্বপন বক্সী মারা গেছে আজ তিন বছর। সেইসঙ্গে চিরস্তব্ধ হয়েছে তার কণ্ঠস্বর। তা হলে এই অলৌকিক আকাশবাণী প্রচারিত হয়েছে কোন প্রেতলোক থেকে? কেউ নিষ্ঠুর ঠাট্টা করছে না তো আমাদের সঙ্গে? কিন্তু কী করেই বা করবে?
সারাটা দিন দুশ্চিন্তায় কাটল। আমাদের হাসিখুশি ছুটির দিনটা ওই একটা ভয়ংকর ঘটনায় যেন হয়ে গেল কালরাত্রি। এমনকী চিকুর আধো-আধো কথাও আর হাসির হুল্লোড় তৈরি করতে পারছে না আমাদের অন্তঃস্থল থেকে।
দুপুরের পর থেকে রেডিয়োর ধারেকাছে ঘেঁষল না মণিকা। শেষ পর্যন্ত রাতে খাওয়ার সময় আমিই সাহস করে রেডিয়ো চালালাম। হিন্দি গান হচ্ছে। চিকু ঘুমিয়ে পড়েছে। মণিকা ওর কথাগুলো ভাঁজ করে বিছানায় মাথার কাছে রাখছে। এমন সময় স্বপন দ্বিতীয়বার কথা বলে উঠল।
বিজন, তুই মণিকাকে কেড়ে নিলি! কেড়ে নিলি!
এই একটা প্রশ্ন আমাকে একেবারে কুঁকড়ে দিল। প্রশ্নটা একটানা ক্রমাগত বেজে চলেছে। তার ছমছমে প্রতিধ্বনি ঘুরে বেড়াচ্ছে চার দেওয়ালের মধ্যে। যেন বিশাল কোনও খাদের অতল গহ্বর থেকে এই প্রশ্ন আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিচ্ছে স্বপন।
আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মণিকা বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সংবিৎ ফিরে পেয়েই রেডিয়োটা বন্ধ করে দিলাম। বুঝতে পারছি, স্বপনের মৃত্যুর ভয়াল স্মৃতি কালো ছায়া ফেলেছে আমাদের জীবনে।
দিনের পর দিন এই একই নাটক চলতে লাগল।
এই অলৌকিক ঘটনার কথা কাউকে বলতে পারি না। বলা যায় না। শুধু দুজনে মুখ বুজে সহ্য করি। তা ছাড়া আমার শিক্ষিত যুক্তিবাদী মন এইসব ঘটনা মেনে নিতেও চায় না। আবার আমি স্বপনের কাছে হেরে যাব!
যতই দিন যায় লক্ষ করি মণিকা ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে। বুঝতে পারি, যে-সময়টা আমি বাড়িতে থাকি না, ও প্রাণভরে রেডিয়ো শোনে। শোনে সেই অলৌকিক কণ্ঠস্বর। সম্ভবত মণিকা বুঝতে পারে, তিন বছর আগে স্বপনকে ও ঠকিয়েছিল। সেই কারণেই নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে দিনরাত ও স্বপনের অভিযোগ-অনুযোগ শুনতে চায়। নিজের অপরাধবোধে ক্রমে ক্রমে ও ডুবতে চলেছে।
একদিন বাড়িতে ফিরে শুনলাম রেডিয়োতে প্রতিধ্বনিময় কণ্ঠস্বর বাজছে? …আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি, মণিকা। চেয়েছি, সংসারের চরম সুখ বলতে কী সেটা তুমি আগে বোঝো। এখন তুমি সেই চরম সুখের খোঁজ পেয়েছ। ছেলের আধো-আধো কথা, স্বামীর আদর, নিজের তৃপ্তি। মণিকা, এখন তুমি বুঝতে পারবে, আমার কাছ থেকে তুমি কী জিনিস কেড়ে নিয়েছ! আর বিজন, বিজন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
আমি ঘরে ঢুকতেই মণিকা রেডিয়ো বন্ধ করে দিল। তারপর আমার বুকে মুখ রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম। একটা যন্ত্রণা আমার কণ্ঠনালীতে জমাট বেঁধে ওঠানামা করছে। মণিকার এই কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না।
আর একদিন স্বপন যখন আমাকে লক্ষ্য করে নানান অভিযোগ করছিল, আমি হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছি, স্বপন, তুই কী চাস?
রেডিয়োতে শোনা ওর কণ্ঠস্বরকে উদ্দেশ্য করে আমি এই প্রথম কথা বললাম। এবং ওর জবাব পেলাম সঙ্গে-সঙ্গেই। যেন ও আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে তীব্র গলায় ও বলে উঠল, জানিস না, শালা? মণিকাকে, মণিকাকে আমার চাই।
তাকিয়ে দেখি মণিকার মুখ রক্তহীন, দুধের সরের মতো সাদা।
সেই মুহূর্তে আমি বুঝেছিলাম, স্বপনের কাছে হয়তো আমাকে হারতেই হবে।
পরদিন সারা সকাল মণিকা খুশিতে একেবারে মেতে উঠল। চিকুকে নিয়ে দুরন্তপনার চূড়ান্ত করল। আমি অবাক হলেও ভীষণ খুশি হলাম। ওর মন থেকে পাষাণের ভারী টুকরোটা বোধহয় গলে বেরিয়ে আসছে বাইরে। অফিসে বেরোনোর মুহূর্তে হঠাৎই আমাকে জাপটে ধরে দুবার চুমু খেল। হাসল। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে কেমন ডুকরে কেঁদে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না, কিছু না। শুধু তুমি খুব ভালো হয়ে থেকো।
দুপুর দুটো নাগাদ অফিসে ফোন পেলাম।
সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এলাম বাড়িতে। মানুষজনের ভিড় ঠেলে শোওৰার ঘরে এলাম। সিলিং পাখার সঙ্গে শাড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়েছে মণিকা। চিকুকে প্রতিবেশীদের কেউ কোথাও সরিয়ে নিয়ে গেছে। এখনও থানায় খবর দেওয়া হয়নি। ঘরে রেডিয়ো চলছে। তাতে একটা বাংলা নাটক শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎই এক প্রতিধ্বনিময় কণ্ঠস্বর ভেসে এল রেডিয়ো থেকে : কী রে শালা, এসেছিস! তোর বাক্স থেকে একটা স্বপ্ন চুরি করে নিয়ে গেলাম রে!
উপস্থিত কেউই সেকথার তাৎপর্য বুঝল না। ভাবল রেডিয়ো-নাটকেরই কোনও অংশ। কিন্তু, হে ঈশ্বর, আমি তো জানি!
দু-হাতে মুখ ঢেকে আমি বসে পড়েছি মেঝের ওপর। জীবনে এই প্রথম কান্নার ঢেউ আমাকে বিপর্যস্ত, অসহায় করে দিল।
আকাশে কীসের শব্দ
আপনারা সকলেই জানেন, গত ১১ নভেম্বর, শনিবার, বেলা বারোটা নাগাদ দক্ষিণ কলকাতা ও দক্ষিণের শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকায় এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এই শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগে গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ থেকে শুরু করে আমতলা, নরেন্দ্রপুর পর্যন্ত সবাইকে জানান দিয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুতেই এই শব্দের উৎসের হদিস পাওয়া যায়নি। কোনও বিস্ফোরণের ঘটনাও টের পাননি কেউ, অথবা কেউ যে হতাহত হয়েছেন এমন খবরও শোনা যায়নি। ফোর্ট উইলিয়ামের চিফ অফ স্টাফ জে. কৌশিক বলেছেন, সেদিন কোনও শব্দ তারা শোনেননি। আওয়াজের ধরনের বিবরণ শুনে তিনি বলেন, ব্যাপারটা সনিক বুম হতে পারে। সুপারসনিক কোনও প্লেন আকাশপথে উড়ে গেলে একটা শক ওয়েভ তৈরি হয়। তার ফলে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় বাজ পড়ার মতো জোরালো শব্দ হতে পারে। অথচ তার আশপাশের মানুষজন সেরকম কোনও শব্দই শুনতে পাবেন না। শনিবার বারবেলার শব্দটা ছিল হয়তো তাই।
শব্দের রহস্যটা রহস্যই থেকে গেছে, কারণ সেদিন বেলা বারোটা নাগাদ কোনও অজ্ঞাতকুলশীল সুপারসনিক প্লেন কলকাতার আকাশপথে উড়ে গেছে এমন কোনও প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি।
অথচ প্রচণ্ড শব্দ যে একটা হয়েছে তাতে কোনও ভুল নেই। আর বহু বাড়ির কাচের জানলাও যে তখন ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়েছে তাও তো মিথ্যে নয়!
তা হলে কীসের শব্দ শোনা গিয়েছিল নভেম্বরের ১১ তারিখে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরাও বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন। সনিক বুম, মাক নাম্বার, মাক কোন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা রচনা প্রকাশিত হয়েছে নানান পত্রপত্রিকায়। এমনকী অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী আস্ট মাকের জীবনীও ছাপা হয়েছে একটি কিশোর-পত্রিকায়। তার ফলে, বিজ্ঞানী মাকের নাম থেকেই যে মাক নাম্বার, মাক কোন্–এইসব নামকরণ করা হয়েছে, সেটাও জনসাধারণ জেনে গেছে।
কিন্তু এত সত্ত্বেও শব্দের কারণটা কেউই জানতে পারেনি।
কারণ, এতদিন আমি মুখ খুলিনি। আর শুভদীপের গোপন পরীক্ষার কথাও কাউকে বলিনি। সেইসঙ্গে শুভদীপের স্ত্রী রনিতার কথাও খুলে বলা হয়নি কাউকে। ফলে নিখোঁজ বিজ্ঞানী শুভদীপ পালচৌধুরীর সঙ্গে এই বিস্ফোরণের যে কোনও সম্পর্ক আছে, সে-কথা কেউ বুঝতে পারেনি।
কিন্তু আর অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। কারণ, গতকালই শুভদীপের পাঠানো একটা মোটা খাম আমার ঠিকানায় এসে হাজির হয়েছে। আমাকে লেখা শুভর শেষ চিঠি।
চিঠিটা আমি যতই পড়েছি ততই অবাক হয়েছি। চিঠি তো নয়, সে যেন শুভদীপের জীবনের এক গোপন অধ্যায়ের বিবরণ। কী করে একটা সাধারণ ব্যাপার থেকে ওর জীবন এরকম বিপজ্জনক দিকে এগিয়ে গেল তা ভাবতে অবাক লাগে। অথচ শুভদীপ উচ্ছল হাসিখুশি ছিল।
ছাত্রজীবন থেকেই ওকে দেখেছি আমি। যেমনই বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা তেমনই প্রিয় ছিল সকলের। আর ওর দাজ দিলখোলা হাসি আমি যেন এখনও শুনতে পাই। যদিও জানি, শুভদীপ আর কখনও হাসবে না, কাঁদবে না। এমনকী আমার পিঠে এক জোরালো থাপ্পড় কষিয়ে আর কখনও বলে উঠবে না, বুঝলি শালা, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কেউ বিজ্ঞানী হয় না।
আমি ওর কথায় মোটেই আহত হতাম না। কারণ, আমরা বেশিরভাগই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করার জন্যে, ভালো-ভালো চাকরি পাওয়ার জন্যে, বিদেশে যাওয়ার জন্যে, অধ্যাপনার দায়সারা কর্তব্য পালনের জন্যে।
আর শুভদীপ? ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করত বিজ্ঞানকে ভালোবেসে।
আমি তাও মজা করে ওকে বলতাম, তুই বুঝি বিজ্ঞানী!
ইয়েস ব্রাদার, আমি রোজ মর্নিং-এ বিজ্ঞান দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাই। একথা বলেই শুভদীপ হো-হো করে হেসে উঠত।
শুভদীপ আমাদের অনেকের কাছেই প্রিয় ছিল, কিন্তু আমি বোধহয় ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। আমাদের ভালোবাসা এমনই ছিল যে, সাহেবদের দেশ হলে হয়তো অন্যায় সম্পর্কের অভিযোগে হাজতবাস করতে হত।
শুভদীপ পড়াশোনা আর গবেষণা নিয়ে দিব্যি ছিল। কিন্তু রনিতাকে বিয়ে করার পর ওর জীবনটা হঠাৎই বোধহয় অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই ধীরে-ধীরে ওর জীবনটা এগিয়ে গিয়েছিল গত ১১ নভেম্বরের দিকে।
১১ নভেম্বর সেই ভয়ংকর শব্দটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার মনটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠেছিল। কান্না এসে গিয়েছিল গলায়। বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বহুদিনের প্রিয় বন্ধু শুভদীপ আর নেই। ওই আশ্চর্য শব্দের মাধ্যমে ওর বিচিত্র মৃত্যুটাকে ও যেন ঘোষণা করে গেল।
না, শুভদীপ আত্মহত্যা করেনি। জীবনে অনেক শোক-দুঃখ ও পেয়েছে, কিন্তু কখনও আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। বরং আমি কখনও ওই প্রসঙ্গ তুললে হেসে বলত, ব্রাদার, আত্মহত্যা করার সাহস যদি কারও থাকে, তা হলে তার আর আত্মহত্যার প্রয়োজন হয় না।
শুভদীপ হাসত বটে, কিন্তু ওর মুখের আড়ালে আমি অনেক শোকগাথা টের পেতাম। অথচ রনিতাকে বিয়ে করার পর তখন সবেমাত্র বছরদুয়েক কেটেছে।
শুভদীপের ব্যাপারটা নিয়ে এই এক মাস আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। কলেজ-জীবনে তোলা আমাদের গ্রুপ ফটোটা দেখেছি। বারবার। ওর সুন্দর নিষ্পাপ মুখটা যেন আমার চোখে তাকিয়ে নীরবে বলেছে, বুঝলি, আমি চলে গেলাম। তোরা সব দুধে-ভাতে থাকিস।
কথায় কথায় শুভদীপ শুধু বলত, না ভাই, আমি দুধে-ভাতে মানুষ, আমার ওসব পোষাবে না।
একথা শুনে আমাদের আড্ডার নতুন কোনও সঙ্গী ভাবত, ও বুঝি খুব বড়লোক। তখন আমরাই হেসে ওর ঠাট্টার মর্মার্থটা বুঝিয়ে দিতাম তাকে। বলতাম, শুভদীপের কেষ্টপুরের বাড়িতে দুটো গরু ছিল। সেইজন্যেই ওর খাদ্যতালিকার প্রধান আইটেম ছিল দুধ-ভাত। বাবা-মায়ের চাপে এই মেনু ওকে প্রায় বিশ বছর সহ্য করতে হয়েছে।
তারপর ফিজিক্স নিয়ে এম. এসসি. পার্ট টু পরীক্ষা দেওয়ার সময় ও একদিন সগর্বে জানাল, ও আর দুধ-ভাত খাচ্ছে না।
আমরা সবাই জিগ্যেস করলাম, কেন? কেন?
ও বেশ দুঃখ-দুঃখ মুখ করে জানাল, ওদের গরু দুটো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, ওর বাবা বলেছেন, এখন তো তুই-ই বড় হয়ে গেছিস, তা হলে আমার আর ও-গরু দুটোকে রেখে লাভ কী?
ওর কথায় আমরা হো-হো করে হেসে উঠেছি।
গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি শুভর চিঠিটা পড়েছি। চিঠি তো নয়, সুদীর্ঘ এক কাহিনি।
সেই লেখা পড়ার পর বাকি রাতটা আমি আর ঘুমোতে পারিনি। আমার কানের কাছে ১১ নভেম্বরের সেই শব্দটা আবার বেজে উঠেছিল। একবার নয়, বারবার। যেন কামান দেগে ওর মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হচ্ছিল।
আজ সকালে নতুন সূর্য দেখার পর আমার মনটা যেন খানিকটা আশ্বাস পেল। মনে হল, শুভর কথা যদি আমি সবাইকে জানাই, তা হলে শুভর আত্মা বোধহয় তৃপ্তি পাবে। আর রনিতার? রনিতা বোধহয় অখুশি হবে না। কারণ, শুভকে ও ভীষণ ভালোবাসত।
অবশ্য রনিতাও তো এখন আর নেই! শুভর শেষ চিঠি পড়েই ব্যাপারটা জানতে পেরেছি আমি। কারণ, গত একবছর ধরে শুভ আমার সঙ্গে সেরকম যোগাযোগ রাখত না। শুধু মাঝে মাঝে খেয়ালখুশি মতো ফোন করত। কিছু জিগ্যেস করলেই বলত, এখন ও একটা অদ্ভুত গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছে। তার বেশি আর কিছু কখনও বলেনি। আর কথা শেষ করার আগে বলত, কোনওদিন যদি একটা জোরালো এক্সপ্লোশানের শব্দ শুনিস তা হলে বুঝবি আমি আর নেই।
এখন আমি সব বুঝতে পেরেছি। শুভর শেষ চিঠি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছে। তাই ওর সম্পূর্ণ কাহিনিটাই আমি আপনাদের কাছে পেশ করতে চাই। অন্তত আমি যেমন করে বুঝেছি। আর আগেই তো বলেছি, এখন আর চুপ করে থাকার কোনও মানে হয় না।
.
বারান্দার টবের গাছগুলোয় জল দিচ্ছিল রনিতা, আর আপনমনে কথা বলে যাচ্ছিল। আসলে ও প্রাণভরে গালমন্দ করছিল হতচ্ছাড়া চড়ুইপাখিগুলোকে। দুষ্টু পাখিগুলো রোজই ওর সাধের গাছগুলোর কচি পাতা আর ফুল ঠুকরে-ঠুকরে খেয়ে যায়।
শুভদীপ ওর পড়ার টেবিলে বসে বই আর কাগজপত্র নিয়ে কাজে ব্যস্ত ছিল। ডানহাতের কাছে চায়ের কাপ। সামনের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সকালের সূর্য। বারান্দার যেটুকু চোখে পড়ে তাতে রঙিন মরশুমি ফুল, দু-একটা চঞ্চল চড়ুইপাখি, সবুজ গাছের পাতা, আর রনিতাকে দেখা যাচ্ছে।
এই সকালবেলার শীতের আমেজ ঘেরা পরিবেশে সবই সুন্দর। রনিতাও। ঠিক এই সময়টা শুভদীপের মনে হয় বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও বেঁচে থাকার অন্যান্য আরও আকর্ষণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু রনিতার কথা ওর নরম ভাবনায় বাধা দিচ্ছিল বারবার।
রনিতা, চড়ুইগুলো এখনও এত সভ্য হয়ে ওঠেনি যে, তোমার বাংলাভাষা বুঝবে। শুভদীপ ঠাট্টা করে কথাটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিল।
বাংলাভাষা না বুঝুক, লাঠির ভাষা তো বুঝবে– রনিতা জানলার কাছে এগিয়ে এল। দেখা গেল ওর হাতে চড়ুইপাখি তাড়ানোর জন্য মানানসই একটা কাঠি।
সকালের মন-ভালো করা আলোয় রনিতাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।
শুভদীপ ওকে দেখল একটু অবাক হয়ে। রনিতা এত সুন্দর, অথচ এত কথা বলে!
বিয়ের পর বছরখানেক যেতে-না-যেতেই রনিতার কথা বলার বাড়াবাড়ি বাতিকটা টের পেয়েছে শুভ। রনিতা কখনও অল্পে থামে না। একদিন সন্ধেবেলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওকে জিগ্যেস করেছে।
তুমি এত কথা বলো কেন, রনিতা?
আমি বেশি কথা বলি? অবাক হয়ে স্বামীর দিকে ঘুরে তাকিয়েছে রনিতা। ও তখন নিজের শাড়ি-জামাকাপড় ঠিকঠাক করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল। আলমারির কাছ থেকেই একটু চোখা স্বরে ও আরও বলেছে, শেষকালে তুমি আমার এই বদনাম দিলে! জানো, সত্যি-সত্যি কাদের টকেটিভ বলে? যারা অপ্রয়োজনে বাড়তি কথা বলে। আমি তো দরকার ছাড়া একটি কথাও বলি না। আমাকে তুমি আর যাই বলো, টকেটিভ বলতে পারবে না। জানো তো, আমাদের।
হাত তুলে ওকে বাধা দিয়েছে শুভ ও থাক, থাক, বাবা। আমারই ভুল হয়েছে। তুমি বিন্দুমাত্রও টকেটিভ নও। বরং খুবই লক্ষ্মী মেয়ে।
তুমি কি চাও আমি বোবা হয়ে থাকি?
শুভ বুঝতে পারল রনিতা একটু সিরিয়াস হয়ে গেছে। তাই ও চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে উঠে গেল আলমারির কাছে। দু-হাতে আলমারির ভোলা পাল্লা ধরে রনিতাকে আগলে দাঁড়াল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, এখন তোমাকে দু-চার- সেকেন্ড বোবা করে দেব।
রনিতা একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
তার মানে এই। বলে রনিতাকে হতভম্ব করে দিয়ে চট করে ওকে চুমু খেল শুভদীপ।
সত্যি-সত্যি দু-চারসেকেন্ড পর ব্যাপারটা শেষ হতেই রনিতা আলতো রাগের ভান করে বলল, এটা কী হল!
শুভদীপ হাসতে-হাসতে জবাব দিল, চুমু খাওয়া হল। এতে তোমার রাগের কী আছে। আমি তোমার অফিসিয়াল চুম্বক, মানে, ম্যাগনেট।
চুম্বক! রনিতা আরও অবাক।
শুভ হেসে বলল, ব্যাকরণ ভালো করে পড়োনি? চুম্বন করে যে সে-ই হল চুম্বক। আমি তোমার হাজব্যান্ড–সো, অফিশিয়াল ম্যাগনেট।
এরপর রনিতা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বেশি কথা বলার অভিযোগটা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
কিন্তু রনিতার বেশি কথা বলার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে শুভদীপের মাথায় বাসা বেঁধে ফেলল। ও যখন রনিতার সঙ্গে কথা বলত তখনই ওর মাথার ভেতরে বিজ্ঞানী মন তার কাজ করে যেত।
সুতরাং একদিন কাজের বউয়ের বিনা নোটিসে কামাই করা নিয়ে রনিতা যখন সুদীর্ঘ তাৎক্ষণিক বক্তৃতা সবে শেষ করেছে, তখন শুভ বলে বসল, রনি, একটা নতুন আইডিয়া আমার মাথায় এসেছে।
রনিতা প্রায় অপ্রস্তুত হয়ে জিগ্যেস করল, কী আইডিয়া?
শুভ ওকে কাছে ডেকে নিজের পাশে বসাল। তারপর আগ্রহ দেখিয়ে বলল, মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করো। যদিও ব্যাপারটা বিজ্ঞানের, তবু মনে হয় না তোমার বুঝতে অসুবিধে হবে।
রনিতার বিষয় ছিল ফিলজফি। বিজ্ঞান সম্পর্কে ওর বিচিত্র আতঙ্ক আছে। কিন্তু শুভকে ও জানে। বিজ্ঞানের ব্যাপারে শুভ বেশ একরোখা। নতুন আইডিয়ার ব্যাপারটা যখন ও রনিতাকে শোনাতে চায়, তখন ও শোনাবেই।
রনিতা ছোট্ট করে ঘাড় নাড়তেই শুভ বলতে শুরু করল, দ্যাখো, শব্দ হল একরকমের শক্তি। যেমন আলো, তাপ–এসবই হল শক্তি। শক্তির কোনও বিনাশ নেই, তবে রূপান্তর হতে পারে। আমাদের এই মহাবিশ্বে আদিম অবস্থায় যে-পরিমাণ শক্তি ছিল, এখনও তাই আছে। শুধু শক্তির নানারকমের রূপান্তর হয়েছে।
রনিতা বলল, আমার একটু-একটু গুলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নো প্রবেলেম–তুমি বলে যাও।
তোমাকে তো বললাম, শব্দ একরকম শক্তি। এই যে তুমি এতক্ষণ ধরে কাজলের মায়ের কামাই নিয়ে এত কথা বললে, তাতে অনেক শব্দ হল–।
এত কথা আবার বললাম কোথায়! আমি তো শুধু বললাম, ও যে আসবে না সেটা আগে–।
রনিতা, প্লিজ। আমাকে আগে বলতে দাও, তারপর যত খুশি কথা বোলো।
রনিতার মুখ সামান্য গোমড়া হল।
শুভদীপ সেটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল না করে বলে চলল, তোমার উচ্চারণ করা শব্দগুলোকে নিয়ে আমি যদি রূপান্তর ঘটাতে পারি তা হলে হয়তো দেখা যাবে বেশ খানিকটা বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যাবে। মানে, সাউন্ড এনার্জি থেকে ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি। বলা যায় না, তোমার একটু আগের বলা কথাগুলো থেকে হয়তো ১৫ ওয়াটের একটা বাকে মিনিটপাঁচেক জ্বালানো যাবে।
রনিতা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ওর ফরসা মুখে কালচে ছায়া পড়েছে। শুভদীপের দিকে না তাকিয়েই ও বলল, ব্যাপারটা তোমার কাছে খুব মজার মনে হচ্ছে, তাই না?
শুভদীপ একটু সাবধানী গলায় বলল, হ্যাঁ, মানে একটু মজা তো আছেই। তবে…ইয়ে…আসল কথাটা শুনবে? যা বললাম, তা বোধহয় খুব একটা মিথ্যে নয়।
রনিতা সহজ হওয়ার ভান করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। অনেকটা নিজের সঙ্গে কথা বলার ঢঙেই বলল, তুমি উচ্চশিক্ষিত সায়েন্টিস্ট মানুষ। সব ব্যাপারে তোমার কথাই শেষ কথা।
শুভও পালটা জেদ দেখিয়ে বলল, বিজ্ঞান কখনও মিথ্যে কথা বলে না।
বিজ্ঞানীরা কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে পারে।
সেই মুহূর্তে ছন্দপতন ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু শুভদীপ একটা হিসেব কষছিল মনে-মনে। আচ্ছা, এটুকু সময়ে কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করল রনিতা? দুশো, তিনশো, নাকি আরও বেশি শব্দ উচ্চারণ করেছে?
এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে শুভদীপ ঠিক করল গুনে দেখবে। এরপর থেকে হিসেব করে দেখবে চব্বিশ ঘণ্টায় রনিতা কত কথা বলে মানে কটা শব্দ উচ্চারণ করে। তারপর তা থেকে হিসেব করবে, প্রত্যেক শব্দ উচ্চারণের পিছনে ঠিক কত আর্গ বা জুল শক্তি খরচ হয়। তারপর উত্তরটাকে নিয়ে আসতে হবে ওয়াট-ঘণ্টা বা কিলোওয়াট-ঘণ্টা এককে। তখনই বোঝা যাবে, রনিতা কদিন কথা বললে সেই শব্দ-শক্তি থেকে একটা ১৫ ওয়াট পাওয়ারের বাকে পাঁচমিনিট জ্বালানো যাবে।
এরপর থেকে রনিতার উচ্চারণ করা শব্দ গুনতে শুরু করেছে শুভদীপ। তখনই বুঝতে পেরেছে, বলা যত সহজ, বাস্তবে কাজটা তত সহজ নয়। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষক শুভদীপ তাতে পেছপা হয়নি। একটা নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণা কোনও খাঁটি গবেষকের কাছে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। শুভদীপ এই রোমাঞ্চকর নেশায় ডুবে গেল।
ও খুঁটিয়ে লক্ষ করে দেখল, কোনও মানুষ কথা বলার সময়ে উচ্চারণ করা শব্দগুলোর মাঝে সেভাবে কোনও ফাঁক রাখে না–যেমনটা পাওয়া যায় লেখা কথার সময়ে। রনিতার কথা গুনতে গিয়ে ও ঠিক এই সমস্যায় পড়ল। কিন্তু তার চেয়েও সমস্যা হয়ে দাঁড়াল রনিতার মেজাজ।
প্রথম-প্রথম শুভদীপ যখন রনিতার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করত তখন মাঝপথেই কথা থামিয়ে রনিতা বলে উঠত, কী আপনমনে বিড়বিড় করছ! তুমি আমার কথা কিছুই শুনছ না!
গুনলে কখনও আর শোনা যায়। শুভ তখন তাড়াতাড়ি রনিতার কথায় মন দিয়েছে। নিজের সাফাই হিসেবে বলেছে, না..ইয়ে…একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। প্লিজ, আর-একবার বলবে।
এভাবে বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর শুভদীপ হাল ছেড়ে দিল। কিন্তু ওর মনে কেমন একটা জেদও চেপে বসল–একটা-না-একটা পথ ওকে বের করতেই হবে। এই চিন্তায় ও দিনরাত ডুবে রইল। বইপত্র আর কাগজ নিয়ে নানান অঙ্ক কষল।
তার পর একদিন ও আর্কিমিদিসের মতো ইউরেকা! বলে চিৎকার করে উঠল। এবং গবেষণাগারে ওর কাজ শুরু করল।
দুধে-ভাতে মানুষ কথাটা শুভদীপ মজা করে ব্যবহার করলেও ওর পৈতৃক সম্পত্তি নেহাত কম ছিল না। এ ছাড়া ও নিজেও ভদ্রস্থ টাকা উপার্জন করে। সুতরাং দক্ষিণ কলকাতার ছিমছাম এলাকায় ওর এই ফ্ল্যাটের মাপ যথেষ্ট বড়। আর সেই কারণেই তার একটা ঘরকে ও একরকম ওর গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছে।
সমস্যাটার চলনসই একটা সমাধান খুঁজে পাওয়ার পর শুভদীপ ওর গবেষণাগারে আরও জোরালো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে উঠল।
ও দেখেছে, রনিতা মোটামুটিভাবে বলতে গেলে চাররকম স্পিডে কথা বলে। আর স্পিড যতই বাড়তে থাকে ওর কথার তীব্রতা ততই উচ্চগ্রামে চড়তে থাকে। এ ছাড়া ওর কথার কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করে শুভদীপ দেখেছে, কথার স্পিড বেড়ে গেলে কম্পাঙ্কের ঊর্ধ্বসীমা আরও ওপরে উঠে যায়।
সুতরাং, এইসব তথ্য এবং বেশ কয়েকবার ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরার করার পর শুভদীপ একটা যন্ত্র তৈরি করতে পারল। যন্ত্রটা খুব নিখুঁত হল না বটে, কিন্তু রনিতার উচ্চারণ করা শব্দের মোটামুটি একটা হিসেব কষতে পারল।
যন্ত্রটার তত্ত্ব খুব সহজ-সরল। প্রথমে উচ্চারণ করা শব্দগুলোর কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করে উচ্চতম কম্পাঙ্কটি সে নির্ণয় করে। তারপর মেপে নেয় ডেসিবেল তীব্রতা। এই দুটি তথ্য থেকে সে হিসেব কষে বের করে বক্তা কোন স্পিডে কথা বলছে। রনিতার চারটে স্পিডের জন্য প্রতি সেকেন্ডে উচ্চারণ করা শব্দের সংখ্যার চারটি গড় মান যন্ত্রটিকে আগেই জানানো আছে। সুতরাং স্পিড জানার পর যন্ত্রটা হিসেব করে বক্তা কত সেকেন্ড কথা বলল। তারপর সেই সময়কে নির্দিষ্ট গড়মান দিয়ে গুণ করে নিজের মেমোরিতে সঞ্চয় করে রাখে। এইভাবে সঞ্চিত তথ্যকে সে পরপর যোগ করে যোগফল বের করে রাখে। ফলে যে-কোনও সময় উচ্চারিত শব্দের সংখ্যা জানতে চাইলেই যন্ত্রটা সাম্প্রতিকতম যোগফল দেখিয়ে দেয়। এই যোগফলে ভুলের সম্ভাবনা বড়জোর শতকরা ১৭ ভাগ।
যন্ত্রটা যদি নির্দিষ্ট কোনও মানুষের কণ্ঠস্বরে টিউন করা থাকে তা হলে অন্য কারও কথা সে তার হিসেবের মধ্যে ধরবে না।
শুভদীপ যন্ত্রটার নাম দিল ডিজিটাল অডিয়ো ওয়ার্ড কাউন্টার।
নিজে কথা বলে ও বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে যন্ত্রটির দক্ষতা যাচাই করল। যখন দেখল, যন্ত্রের ভুল কোনও সময়েই শতকরা ১৭ ভাগের বেশি হচ্ছে না, তখন ও দারুণ খুশি হল। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় রইল, কবে ও ফ্ল্যাটটাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য একা নিজের দখলে পাবে।
সুযোগ এসে গেল আটদিনের মাথায়। রনিতা নীচের ফ্ল্যাটের মিসেস সেনের সঙ্গে পাড়ার মহিলা সমিতির একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেল। বলল, ঘণ্টাতিনেক পরেই ফিরবে। শুভদীপের তখন আনন্দে সাতহাত লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল।
অতএব নদিনের দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আসল পরীক্ষা।
পাঁচটা খুদে-খুদে মাইক্রোফোন ও বসিয়ে দিল ফ্ল্যাটের নানা জায়গায়। সেই মাইক্রোফোনগুলো রনিতার সমস্ত কথা নিখুঁতভাবে ধরে পৌঁছে দিতে লাগল শুভদীপের মূল যন্ত্রে। আর শুভদীপ প্রতিদিন রাতে সেই যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া কম্পিউটারের কিবোর্ডে বসে রনিতার উচ্চারণ করা শব্দের হিসেব রাখতে লাগল।
দশদিন পর একটা গড় হিসেব কষল শুভ। তাতে যে সংখ্যা পাওয়া গেল তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো : ১৬৬৪৩।
পরদিন চায়ের টেবিলে রনিতাকে খবরটা জানাল শুভ।
জানো, লাস্ট ১০ দিনে তুমি অ্যাভারেজে ডেইলি সাড়ে ১৬ হাজার শব্দ বলেছ।
রনিতা খবরের কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছিল। চোখ না তুলেই বলল, সবসময় ইয়ারকি ভাল্লাগে না।
না, ইয়ারকি না। সিরিয়াসলি বলছি।
এইবার খবরের কাগজ রেখে শুভর দিকে সরাসরি তাকাল রনিতা। কিছুক্ষণ স্বামীকে জরিপ করে জিগ্যেস করল, কী করে গুনলে?
শুভদীপ ওর যন্ত্রের ব্যাপারটা রনিতার কাছে একটুও ভাঙেনি। এখনও ভাঙতে চাইল না। তাই চোখ মটকে বলল, সে একটা কায়দা আছে। এখন বলব না। পরে বলব।
রনিতা আর কোনও কথা বলেনি। আবার খবরের কাগজের পাতায় চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওর ভাবভঙ্গিতে শুভদীপ এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, রনিতা ব্যাপারটা খুব খুশি মনে নেয়নি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও শুভদীপ এই রোমাঞ্চকর নেশায় ডুবে যাচ্ছিল। ওর যন্ত্রে রনিতার সমস্ত কথা টেপ করার ব্যবস্থাও ছিল। কখনও কখনও ও গভীর রাত পর্যন্ত টেপরেকর্ডার চালিয়ে রনিতার কথাগুলো শুনত আর নিজের নানান বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ করত। রনিতার কথার শব্দ শোনা আর শব্দ গোনা ওকে ক্রমশ যেন পাগল করে তুলল।
রনিতাকে ও ঠাট্টা করে মাঝে-মাঝেই ওর কথা বলার হিসেবটা শুনিয়ে দেয়। বলে, ডার্লিং, এই উইকে তোমার টকিং অ্যাভারেজ ১৫ হাজারের কিছু কম।
রনিতা কোনও জবাব দেয় না। কিন্তু দিনের-পর-দিন একই ধরনের হিসেব শুনতে-শুনতে ও ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে আসে। শুভদীপের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না। শুভদীপ কিছু জিগ্যেস করলে দায়সারা ছোট্ট জবাব দেয়। কিন্তু তাতে ওর দৈনিক গড় হিসেবে তেমন কোনও হেরফের হয় না। কারণ শুভদীপ যখন থাকে না, তখন রনিতা কাজের বউ, বারান্দার চড়ুইপাখি, বাথরুমে ঢুকে পড়া পায়রা, আচমকা বৃষ্টি, কিংবা চড়া রোদ্দুর–এদের সঙ্গে বকবক করে ওর ঘাটতি পুষিয়ে নেয়।
রনিতার সুন্দর চোখের তলায় ধীরে-ধীরে একটা কালচে ছোপ পড়ছিল। এখন ও সারাটা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। সে ব্যস্ততা এমনই যে, কাজ না থাকলেও ও সর্বক্ষণ এ-ঘর ও-ঘর করতে থাকে আর আপনমনেই বকবক করে যায়। শুভদীপ যখন ওকে কিছু বলতে চায় তখন কেমন রুক্ষভাবে জবাব দেয়। চেহারা আগের তুলনায় অনেক ভেঙে গেছে। প্রায়ই হজমের গোলমালে ভোগে।
শুভদীপ একদিন ওকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলতেই রনিতা একেবারে কঁঝিয়ে উঠল, বলল, আমি ঠিক আছি, ডাক্তার আমার দরকার নেই, দরকার আসলে– কথা শেষ করেনি রনিতা।
একদিন রাতে, অন্ধকারে, শুভকে পরম আগ্রহে অকুলপাথারে খড়কুটোর মতো জড়িয়ে রনিতা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
বলো–।
মেনে নিচ্ছি, আমি বেশি কথা বলি। তুমিই জিতলে, আমি হারলাম। কাল থেকে তোমার ওই এক্সপেরিমেন্ট তুমি বন্ধ করবে?
অন্ধকারে মশারির ছাদের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, দেখি।
কিন্তু ভেতরে-ভেতরে শুভদীপ টের পাচ্ছিল, এই নেশাটা ময়াল সাপের মতো ওকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে। ১৫ ওয়াটের একটা বা পাঁচমিনিট না জ্বালানো পর্যন্ত ওর নিস্তার নেই। একটা বিকৃত জেদ ভেতর থেকে ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
রনিতার উচ্চারণ করা কথা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য পাগলের মতো মেতে উঠল শুভদীপ। প্রায় সাড়ে চারমাসের অক্লান্ত গবেষণায় ও তৈরি করল একটা অভিনব যন্ত্র–তার নাম দিল এনার্জি ট্র্যাপার। এনার্জি ট্র্যাপার বা শক্তি-ফঁদ ওকে এতই খুশি করল যে, ও পাঁচদিন বিজ্ঞানের কাছ থেকে ছুটি নিল আর রনিতার কথাও গুনল না।
কিন্তু তারপর থেকেই ও আবার মেতে উঠল শক্তি-ফঁদ নিয়ে।
রনিতার টেপ করা কথাগুলোকে ও স্বাভাবিক ভলিউমে প্লে-ব্যাক করে তা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগল। চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে স্ট্যান্ডে বসানো একটা ছোট্ট গোলকে শব্দ-শক্তিকে ফোকাস করে কেন্দ্রীভূত করল শুভদীপ। তারপর অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফোর্স ফিল্ড প্রয়োগ করে সেই শক্তিকে বন্দি করল। আর তখনই চকচকে গোলকটা ভেসে উঠল শুন্যে। তার গায়ে আলো পড়ে অদ্ভুত এক বর্ণালী তৈরি করে ওটা যেন একটা স্বপ্নের বুদবুদ হয়ে ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াতে লাগল।
শুভদীপ অবাক হয়ে দেখতে লাগল রনিতার কথা ভেসে বেড়াচ্ছে ওর ল্যাবরেটরিতে। তার গায়ে বর্ণালীর খেলা।
এরপর অন্তত মাসখানেক ধরে শুভদীপ ওর এনার্জি ট্র্যাপার নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলল।
এখন ওর ল্যাবরেটরি দরজা খুললেই দেখা যায় ছোট-বড় অসংখ্য রঙিন বুদবুদ স্থির হয়ে ভেসে আছে ঘরের ভেতরে। বাতাসে সামান্য আলোড়ন তুললেই সেগুলো হেলেদুলে নড়েচড়ে বেড়ায়। শুভদীপ ঘরের ভেতরে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওগুলোকে দ্যাখে। আর একটা অদ্ভুত তৃপ্তি ওর বুকের ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে।
একদিন সন্ধেবেলা কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে শুভদীপ রনিতাকে বলল, রনি, আজ একটা গুড নিউজ আছে।
রনিতা নীচুগলায় যান্ত্রিকভাবে বলল, কী?
ডক্টর দত্ত, আমাদের ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর, বলেছেন আমার রিসার্চের থার্ড স্টেজ সাকসেসফুল হলে এই বিষয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করবেন–আমি হব তার চিফ ইনভেস্টিগেটর।
শুনে খুশি হলাম। রনিতার স্বরে কোনও প্রাণ ছিল না।
জানো, থার্ড স্টেজ মানে কী?
না, জানি না।
শুভদীপের মনে হল, ও যেন কোনও রোবটের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু তাতেও ও দমে গিয়ে বলল, থার্ড স্টেজ মানে একটা বাল্ব জ্বালানো–পাঁচ মিনিটের জন্যে।
রনিতা কোনও কথা বলল না। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না ওর চোখেমুখে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রনিতা বলল, যাই, তোমার জন্যে চা করি গিয়ে।
শুভ ওকে খুশি করার জন্য বলল, একবার ও-ঘরে গিয়ে দেখবে চলো, ঘরময় কতকগুলো রঙিন বল ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই বলগুলোর ভেতরে তোমার কথার শক্তি লুকিয়ে আছে। ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয় না?
রনিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, আমি যখন থাকব না, তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না?
হ্যাঁ। তুমি তো জানো, বিজ্ঞানীরা চলে যায় একের-পর-এক কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।
রনিতা হঠাৎই গলা পালটে কেমন অসহায় সুরে বলল, আমার কথা তুমি একটুও ভাবো না ।
শুভদীপ মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বলল, ভাবি। কিন্তু আমার রিসার্চটা যে অনেকটা সময় নিয়ে নেয়…।
রনিতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আর শুভদীপ ওর গবেষণার তৃতীয় ধাপ নিয়ে ভাবতে লাগল।
একটা ব্যাপার শুভদীপ লক্ষ করছিল। ওর সামনে রনিতা ইদানীং ভীষণ কম কথা বললেও সারাদিনে ওর টকিং অ্যাভারেজ আগের তুলনায় অনেক বেশি। শুভর ডিজিটাল অডিয়ো ওয়ার্ড কাউন্টার সেই তথ্যটাই রোজ-রোজ জানিয়ে দিচ্ছিল ওকে।
রনিতার টেপ করা কথাগুলো রাতে শোনার সময় বেশ তাজ্জব হয়ে যাচ্ছিল শুভদীপ। আগে ওর কথাবার্তার পিছনে যদিও বা কোনও অজুহাত বা কারণ থাকত, এখন সেসবের কোনও বালাই নেই। যখন-তখন যা খুশি বকবক করে যায় ও, কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই। একেবারে যেন পাগলের প্রলাপ।
রনিতা কথা বলতে এত ভালোবাসে!
শুভদীপ মাঝে-মাঝেই ভাবে, এ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করবে। কিন্তু ওর ভেতরে একটা জেদি আর কৌতূহলী মন ওকে থামতে দেয় না।
একদিন শুভদীপের গবেষণার তৃতীয় ধাপও সফল হল।
একদিন সত্যি-সত্যিই ও একটা ১৫ ওয়াটের বালবকে সাড়ে ছ মিনিটের জন্য জ্বালিয়ে রাখতে পারল। তখন ও খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল বাচ্চা ছেলের মতো। ওর গবেষণা নিয়ে রনিতার সঙ্গে আবোলতাবোল অনেক কথা বলে গেল। আনন্দের ঝোঁকে ও খেয়ালই করল না, রনিতার মুখে এক থমথমে ছাপ–মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে, চোয়ালের হাড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সেদিন রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
রাত তখন কত হবে শুভদীপ জানে না। জিনিসপত্র ভাঙচুরের শব্দ পেয়ে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
প্রথমেই যেটা খেয়াল করল, রনিতা পাশে নেই।
তখন শুভদীপ আর দেরি করেনি। পলকে ঘুমের ঘোর কাটিয়ে উঠে রওনা হয়েছে শব্দ লক্ষ করে। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, শব্দগুলো ভেসে আসছে ওর ল্যাবরেটরি থেকে।
ল্যাবে গিয়ে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল শুভদীপ।
ঘরের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ওলটপালট করে ভেঙেচুরে ফেলেছে রনিতা। ঘরের বুদবুদগুলো এপাশে-ওপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর অসহায় ভাঙাচোরা মেয়েটা মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে।
এসব কী হচ্ছে, রনি! কাঁদছ কেন?
রনিতা স্বামীর কথায় ভূক্ষেপই করল না, আকুল হয়ে কেঁদে চলল।
শুভদীপের কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতো লাগছিল। ও অনেক করে রনিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। এক প্রচণ্ড জেদ রনিতাকে একেবারে অন্য মানুষ করে দিয়েছে। ও শুভর কোনও কথায় কান দিল না। শুধু কান্নার ফাঁকে-ফাঁকে জড়ানো গলায় কীসব বলল। কথাগুলো শুভদীপ ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও দেখল ওঁর ডিজিটাল কাউন্টারের ডিসপ্লে প্যানেলে সংখ্যার মান বেড়ে যাচ্ছে।
অনেক চেষ্টার পর ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে শুভদীপ শোওয়ার ঘরে ফিরে এল। অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। তখনও ওর কানে রনিতার কান্নার গোঙানি ভেসে আসছে।
ভোরবেলা শুভদীপই রনিতার মৃতদেহ আবিষ্কার করল।
ডাইনিং হলে সিলিং পাখার সঙ্গে শাড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে ও। লম্বা হয়ে থাকা নিষ্প্রাণ পায়ের নীচে ডাইনিং টেবিল উলটে পড়ে আছে। আর ডাইনিং হলে ভেসে বেড়াচ্ছে দুটো শব্দের বুদবুদ। ল্যাবরেটরি থেকে কীভাবে ওরা এ-ঘরে এল কে জানে! শুভর মনে হল, এই বুদবুদজোড়া রনিতার আত্মহত্যার একমাত্র সাক্ষী।
কয়েকটা চড়ুইপাখি ঘরের জানলায় বসে কিচিরমিচির করছিল, ওদের সঙ্গে কথা বলার আর কেউ নেই।
একটু খোঁজাখুঁজি করতেই সুইসাইড নোটটা দেখতে পেল শুভদীপ। ডাইনিং হলের একপাশে একটা ক্যাবিনেটের ওপরে স্টিলের গ্লাস দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল। তাতে রনিতা লিখে গেছে?
আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।
অনেক কথা বলার ছিল বলা হল না।
শুভদীপ আর সইতে পারেনি। বেপরোয়া কান্নায় ভেঙে পড়েছে রনিতার পায়ের নীচে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, সুইসাইড নোটের শেষ লাইনটায় রনিতা যা বলতে চেয়েছে তার মর্ম শুভদীপ ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারবে না।
এরপর থানা-পুলিশ, পাড়া-প্রতিবেশীদের গুজব আর মন্তব্যে বেশ কটা দিন কেটে গেল। তারপর থেকে শুভদীপ একা। ওকে সবসময় ঘিরে থাকে রনিতার কথার রঙিন বুদবুদ। লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি শব্দের বুদবুদ।
মাঝে-মাঝে টেপ চালিয়ে রনিতার কথা শোনে ও। মনে পড়ে, রনিতা বলেছিল, আমি যখন থাকব না তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না? আর শুভদীপ উত্তরে বলেছিল, হ্যাঁ, তুমি তো জানো বিজ্ঞানীরা চলে যায় একের-পর-এক–কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।
সবসময় এই কথাগুলোই এখন ঘুরে বেড়ায় শুভদীপের মনে। রনিতার কথা থেকে আরও অসংখ্য বুদবুদ তৈরি করতে থাকে ও। এনার্জি ট্র্যাপার নিয়ে কাজ করে যায় পাগলের মতো। যেন শব্দের বুদবুদ তৈরি করা ছাড়া এখন ওর নিঃসঙ্গ জীবনের আর কোনও লক্ষ্য নেই।
শুভদীপ ক্রমশ মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল। তা ছাড়া ওর সবসময় মনে হত রনিতা ওর কানের কাছে ক্রমাগত বকবক করে চলেছে। ওর বিজ্ঞানী মন বলে উঠত, ব্যাপারটা শ্রুতিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ওর মনের একটা অংশ এই সরল যুক্তি মানতে চাইত না।
রনিতাকে হারিয়ে শুভদীপ একা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও একা থাকতেই চেয়েছিল। অথবা বলা যেতে পারে, ও রনিতার কথার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিল।
এরপর এমন একটা সময় এল যখন শুভদীপ রনিতার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। ল্যাবরেটরিতে বসে রনিতার কথার টেপ চালিয়ে ওর কথার পিঠে কথা বলে যেত। কোনও-কোনও সময় একা-একাই বিড়বিড় করত আপনমনে। রনিতা যে ওর কাছে নেই সেটা ও বুঝতে পারত না।
এইরকম একটা অদ্ভুত মানসিক অবস্থায় ও একদিন ঘোর দুপুরে একটা শব্দের বুদবুদ সঙ্গে করে বেড়াতে গেল লেকের ধারে। প্রায় জনহীন মাঠে দুপুরের রোদে বুদবুদটাকে শূন্যে ভাসিয়ে ও তার গায়ে নানা রঙের খেলা দেখতে লাগল।
ক্রমে-ক্রমে এই দুপুরে বেড়ানোটা শুভদীপকে পেয়ে বসল নেশার মতো। বুদবুদের গায়ে রঙের খেলা দেখতে-দেখতে ও বিড়বিড় করে কথা বলত রনিতার সঙ্গে। মাঝে মাঝে ভাবত, রনিতার অসংখ্য কথা মাঠে-ঘাটে-আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিলে কেমন হয়।
আমি যখন থাকব না তখনও ওগুলো থেকে যাবে, তাই না? শুভদীপের বুকের ভেতরে রনিতা কথা বলে উঠত।
এইভাবে যখন সময় কেটে যাচ্ছে তখন একদিন শুভদীপ ঠিক করল, ঘনীভূত শব্দের বুদবুদগুলোকে দুপুরের খোলা মাঠে নিয়ে গিয়ে সমস্ত শব্দ-শক্তিকে এক মুহূর্তে ছড়িয়ে দেবে আকাশে। বাতাসে। তাতেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি হবে রনিতা। আর শুভদীপের অপরাধবোধও একেবারে হালকা হয়ে যাবে। এইভাবেই বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে মুক্তির পথ।
দুপুরবেলা খোলা মাঠে গাছতলায় বসে শূন্যে ভেসে থাকা দু-একটা বুদবুদের রঙিন শরীরের দিকে তাকিয়ে শুভদীপ এই মুক্তির কথা ভাবত আর রনিতার সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলত আপনমনে।
ওর আশা ছিল শুধু একটাই, ও চলে যাবে, কিন্তু ওর বিজ্ঞান থেকে যাবে সকলের জন্য।
.
এখন আমি বুঝতে পেরেছি, ১১ নভেম্বর বেলা বারোটা নাগাদ কী হয়েছিল। লেকের মাঠ থেকে রনিতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল আকাশে-বাতাসে। আর সেইসঙ্গে একজন ভেঙে পড়া নুয়ে পড়া আদ্যন্ত বিজ্ঞানী তরুণের ছিন্নভিন্ন দেহ ধূলিকণার মতো মিশে গিয়েছিল বাতাসে।
সেদিন দুপুরে এই ঘটনার সাক্ষীও যদি কেউ থেকে থাকে তা হলে দূর থেকে শব্দের বুদবুদগুলোকে সে নিশ্চয়ই রঙিন গ্যাস-বেলুন বলে ভেবেছে। আর গ্যাস বেলুন থেকে যে এতবড় বিস্ফোরণ হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই কেউই বিশ্বাস করেনি।
চিঠির শেষে শুভদীপ লিখেছেঃ
আমার নিদের্শ মতো এ-চিঠি তোর হাতে পৌঁছোবে চরম ঘটনার বেশ কিছুদিন পর। তবে তার আগেই তুই শব্দ শুনে টের পেয়ে যাবি, আমি আর নেই। না, আমার এই ব্যাপারটাকে তুই সুইসাইড বলে ভুল বুঝিস না। এটা আমার এক্সপেরিমেন্টের একটা পার্ট। যদিও রনিতার কথা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে গেলে কী হবে তা দেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। আমার গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র এই সঙ্গে পাঠালাম। এগুলো আমাদের ইন্সটিটিউটের ডিরেকটর ডক্টর দত্তকে দিয়ে দিস।
আমি জানি, এ চিঠি পেলে তুই দুঃখ পাবি। কিন্তু জানিসই তো, বিজ্ঞানী চলে যায়, কিন্তু বিজ্ঞান থেকে যায়।
এটাই ছিল শুভদীপের শেষ চিঠির শেষ লাইন।
আগে বোঝা যায় না
কথাটা শুনে সুনন্দর ভুরু কুঁচকে গেল। চোখ সরু করে তিনি তাকালেন বিপিন চ্যাটার্জির দিকে। অবাক হয়ে তার কথাটাই আবার উচ্চারণ করলেন, আগে বোঝা যায় না! তার মানে?
বিপিন চ্যাটার্জি সিগারেটে টান দিয়ে সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, মানে অতি সহজ। তুমি যে ভূত দেখেছ সেটা তুমি আগে কিছুতেই বুঝতে পারবে না। একটু দম নিয়ে আরও যোগ করলেন, বুঝতে পারবে–তবে অনেক পরে। এটাই সরকারদের ভূতুড়ে বাড়ির স্পেশালিটি।
সুনন্দর স্ত্রী কল্যাণী মিষ্টি করে হেসে ঠাট্টার সুরে বললেন, তবে তো দারুণ ভালো। ভূতের ভয় পাওয়ার কোনও চান্সই নেই! কারণ, ভূত দেখার সময় ভূত বলে বুঝতে পারব না। যেমন, আপনি এখন গল্প করছেন, চা-বিস্কুট খাচ্ছেন–ব্যাপারটা এইরকমই মনে হবে। তারপর…আপনি যেমন বললেন…অনেক পরে–মানে, দু-চারদিন পরেও হতে পারে বুঝতে পারব যে, সেদিন আসলে ভূতের সঙ্গে কথা বলেছি, গল্প করেছি। তখন ভয় পাওয়ার কোনও মানে হয় না। সুতরাং আপনার ওই ভূত কাউকে ভয় দেখাতে পারবে না। এরকম দয়ালু বিবেচনা-বুদ্ধিওয়ালা ভূত সত্যিই খুব রেয়ার।
কল্যাণী বেশ কষ্ট করে হাসি থামিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, তোমার কী ওপিনিয়ান?
সুনন্দ হাতে হাত ঘষলেন। টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। তারপর বন্ধুর দিকে তাকালেন। হাসি চেপে রাখতে ওঁরও বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
বিপিন চ্যাটার্জি একটু আহত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে টেক্ল-ক্লথের নকশাটাকে জরিপ করছিলেন। সুনন্দ ছোট্ট করে কাশির শব্দ করায় ওঁর দিকে চোখ ফেরালেন। দেখলেন, সুনন্দও রীতিমতো হাসি চাপতে চেষ্টা করছেন।
বিপিন পাছে রাগ করেন, তাই সুনন্দ হাসির ঝোঁকটা সামলে নেওয়ার সময় দিলেন। তারপর বেশ সিরিয়াস মুখ করে বললেন, দ্যাখো, বিপিন…কল্যাণী মজা পেয়ে হাসছে বলে তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না। তুমি তো জানোই, কল্যাণী বা আমি কোনওদিনই ভূতে বিশ্বাস করিনি। আমাদের যত লেনদেন শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবে ভূত আছে এই কারণে তোমার ওই ইয়েদের বাড়িটার যদি দাম কম হয়, তা হলে আমাদের তো লাভ বই লোকসান নেই! সুতরাং তুমি এগোতে পারো…।
বিপিন তক্ষুনি কোনও জবাব দিলেন না। সিগারেটে বারকয়েক টান দিয়ে তারপর চাপা গম্ভীর গলায় বললেন, তোমরা যে ভুতে বিশ্বাস করো না সেটা জানি। আর জানি বলেই সরকারদের শোভাবাজারের বাড়িটা ভূতুড়ে জেনেও কথাবার্তা এগিয়েছি। ও-বাড়িতে বছর দশেক ধরে কেউ থাকে না। সরকার ফ্যামিলির সবাই আমেরিকায় সেন্ড। শুধু একজন, বামদেব সরকার, হরি ঘোষ স্ট্রিটে থাকেন। ওঁর বয়েস হয়েছে, বিয়ে-থা করেননি। বদনামী বাড়িটা কেউ কিনতে চাইলে তিনি রীতিমতো বর্তে যান। সেইজন্যেই মাত্র সাড়ে তিনলাখ টাকা চেয়েছেন। বাড়ির পেপারস তিনি সব ক্লিয়ার করে রেখেছেন। বাড়ি বিক্রি করার রেজিস্টার্ড পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিও ওঁর কাছে আছে….।
বাড়িটা কেনার পর রিপেয়ার খরচ কীরকম পড়বে?
তা ধরো প্রায় লাখখানেক। তবে ফার্নিচারপত্র যা আছে সবই তুমি ফ্রিতে পেয়ে যাচ্ছ। বামদেববাবু ওসব কিছু নেবেন না বলেছেন।
কেন, ওগুলো কি অভিশপ্ত? কল্যাণী জানতে চাইলেন। ওঁর কথায় একটু ব্যঙ্গের খোঁচা ছিল।
বিপিন চ্যাটার্জি উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন। ছোট-ছোট টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করলেন। তারপর মুখ তুলে ঘরের খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলোয় ওঁর খোঁচা-খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি চকচক করছিল। চশমার কাঁচেও খানিকটা আলো ছিটকে পড়েছিল।
সবাই চুপচাপ থাকায় কেমন একটা চাপ তৈরি হচ্ছিল ঘরের মধ্যে।
কী বললেন? অভিশপ্ত? ঠোঁটের কোণে আচমকাই হাসলেন বিপিন হয়তো হবে–আমি ঠিক জানি না। তবে একজনের কাছে যেটা অভিশাপ আর একজনের কাছে সেটা আশীর্বাদও হতে পারে। আমি দুর্বল, ভীতু মানুষজমি-বাড়ির দালালি করে পেট চালাই। বামদেব সরকারের বাড়িটা বিক্রি করিয়ে আমি সাতহাজার টাকা পাব ঠিকই, কিন্তু জোর করে কাউকে ওটা গছিয়ে দিতে চাই না..আপনাদের তো নয়ই! সুনন্দ আমার ছোটবেলার বন্ধু–একপাড়ায় থাকি। সেইজন্যেই আগে সবকিছু খোলসা করে জানিয়ে দিচ্ছি। সরকারদের বাড়িটার বেশ বদনাম আছে। তবে পিকিউলারিটি হচ্ছে, ভূতের ব্যাপারটা আগে বোঝা যায় না।
সুনন্দ মিত্র বামপন্থী মানুষ। যুক্তি দিয়ে সব খতিয়ে দেখেন। আধুনিক খোলা মন নিয়ে প্রগতির কথা ভাবেন। অফিসে ইউনিয়নের একজন হর্তাকর্তা। ওঁর স্ত্রী কল্যাণী হাই স্কুলের শিক্ষিকা। সাহিত্য, সিনেমা, সংস্কৃতি নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামান। বিয়ের আগে নাটকের দল চালাতেন। পরে সময় কমে আসায় সরে এসেছেন।
বিপিন জানতেন, এই বাড়িটা নিতে ওঁরা আপত্তি করবেন না। অন্য দু-একটা বাড়ির খোঁজও বিপিন দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো সুনন্দর বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর-একটু সময় পেলে বিপিন হয়তো একটু বেশি খোঁজখবর করতে পারতেন…সুনন্দর বাজেটের মধ্যেই কিছু হয়তো জুটে যেত, কিন্তু সুনন্দ আর কল্যাণী এমন তাড়াহুড়ো করছেন যে, সে-সময় আর মেলেনি। সুনন্দ বলেছেন, এ-মাসের মধ্যেই আমার বাড়ি চাই…যেভাবে হোক…।
ওঁদের তাড়াহুড়োর কারণ বিপিন জানেন না। দু-একবার বন্ধুকে জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু সুনন্দ এড়িয়ে গেছেন। কল্যাণীও কিছু ভাঙেননি। শুধু বলেছেন, ফ্ল্যাটবাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।
এখন ওঁরা সি. আই. টি. রোডের যে-ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন সেটা এমনিতে খারাপ নয়। কিন্তু হঠাৎ করে কী যে হল, ফ্ল্যাটে ওঁদের আর মন বসছে না।
আরও কিছুক্ষণ ভূত, ভুতুড়ে বাড়ি, এইসব নিয়ে আলোচনার পর বেশ হালকা মেজাজেই বিপিন চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, বামদেববাবুর সঙ্গে কথা বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে রেজিস্ট্রির দিন ঠিক করছি। আর তুমি যখন পাকা কথা দিলে তখন আমার চেনা এক কন্ট্রাকটরকে রিপেয়ারের ব্যাপারটা আগাম জানিয়ে রাখছি…যদি অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকে…।
আপত্তি! কেউ উপকার করতে চাইলে মানুষ কখনও আপত্তি করে! সুনন্দ বিপিনের হাত চেপে ধরলেন কৃতজ্ঞতায়। মনে-মনে ভাবলেন, বিপিন জানে না বিপিন আমাদের কী বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চলেছে।
বিপিন চলে যাওয়ামাত্রই ঘরের আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে গেল। হাসি-খুশির ছবিটাও মুছে গেল। সুনন্দ আর কল্যাণী বুক-চাপা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলেন। চুপচাপ–যেন ট্রেনের কামরায় অচেনা দুই সহযাত্রী।
সুনন্দ চোখের চশমাটা অকারণেই ঠিক করলেন। তারপর টেবিলের একপাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে পড়ার ভান করলেন। সেদিকে চোখ রেখেই বললেন, কী, এবার তুমি খুশি তো?
কল্যাণী স্বামীর দিকে তাকালেন : কেন, তুমি খুশি না?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুনন্দ, বললেন, হুঁ খুশি। আশা করি এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলে সমস্যাটা মিটে যাবে, কিন্তু তুমি ওকে রাজি করাতে পারবে তো?
করাতেই হবে। ওকে বোঝাতে হবে। মনে হয় ও বুঝতে পারবে।
বাইরে সন্ধে গাঢ় হয়েছিল অনেকক্ষণ। কল্যাণী উঠে ভেতরের ঘরে গেলেন। সুনন্দ টিভি অন করে রিমোট হাতে চ্যানেল সার্ফিং করতে লাগলেন।
এমন সময় ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল।
সুনন্দ চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই কল্যাণী ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন।
ঘরে ঢুকল অনুপম।
রোগাটে ফরসা চেহারা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঘন ভুরুর নীচে সামান্য টানা চোখ। চোয়ালের উঁচু হয়ে থাকা হাড় কুড়ি বছরের নবীন মুখে রুক্ষতার তুলি চালিয়েছে।
কী ব্যাপার! এত তাড়াতাড়ি চলে এলি? কল্যাণী জিগ্যেস করলেন।
কল্যাণীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় অনুপম জবাব দিল, কোচিং হল না। স্যারের শরীর খারাপ।
নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুনন্দর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল অনুপম। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
সুনন্দ কল্যাণীর অসহায় মুখের দিকে তাকাল। তারপর আবার টিভির দিকে।
কল্যাণী পায়ে-পায়ে সুনন্দর কাছে এগিয়ে এলেন।
সুনন্দ টিভির দিকে চোখ রেখেই চাপা গলায় বললেন, এখন কিছু বোলো না। আমি যখন বাড়ি থাকব না তখন মুড বুঝে নতুন বাড়ির ব্যাপারটা বোলা।
কল্যাণী যেন অচেতনভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। টিভির রঙিন ছবির দিকে তাকিয়ে অনুপমের কথা ভাবতে লাগলেন।
যখন সন্তান আসবে না এই সত্যিটা একরকম মেনে নিয়েছিলেন তখন চিকিৎসাশাস্ত্রের কী এক কারিকুরিতে অনুপম এসে পড়েছিল। তারপরই জীবনটা কী সুন্দর হয়ে গেল। হাসি, খুশি, আর ফুর্তি ছাড়া কিছু ছিল না সংসারে। কোনওরকম দুঃখ-কষ্ট গায়ে আঁচড় কাটতে পারত না।
এইভাবে আঠেরোটা বছর কীভাবে গড়িয়ে গেল কে জানে! আঠেরোটা বছরের হিসেব সেইদিন মনে পড়ল যেদিন কল্যাণী ছেলের মুখে মদের গন্ধ পেয়েছিলেন।
এলাকাটা যে খুব ভালো নয় এটা ওঁরা স্বামী-স্ত্রী আঁচ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে ওঁদের জীবনে আঁচ লাগাবে তা বুঝতে পারেননি।
এরপর যতই দিন যেতে লাগল ব্যাপারটা তত খারাপের দিকে গড়াতে শুরু করল।
সুনন্দকে কল্যাণী যখন জানালেন তিনি বললেন, বয়েসের ঝোঁক–পরে ঠিক সামলে নেবে।
মুখে এ কথা বললেও ভেতরে-ভেতরে সুনন্দ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
একদিন সন্ধেবেলা অনুপমের বই-খাতা হাতড়ে কল্যাণী কতকগুলো বাজে ছবি পেয়েছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দর কথাটা মনে পড়েছিল : বয়েসের ঝোঁক। কিন্তু যেদিন ছেলের টেবিলের ড্রয়ার থেকে কল্যাণী সাড়ে দশহাজার টাকা পেলেন সেদিন তিনি কেঁপে গিয়েছিলেন।
পাঁচশো টাকার নোটগুলো ওঁর হাতে কিলবিল করছিল।
কোথা থেকে এত টাকা পেল অনুপম!
সুনন্দ সত্যনিষ্ঠ মানুষ। কল্যাণীও তাই। অনুপমকে সেই মূল্যবোধের ওপরে দাঁড় করিয়ে অত্যন্ত যত্নে ওঁরা মানুষ করতে চেয়েছেন। এত কষ্টের ফল এই!
কল্যাণীর চোখে জল এসে গিয়েছিল। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শক্ত করলেন তিনি। তারপর অনেক রাতে ছেলের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন।
আলো জ্বেলে ঘুম-চোখে দরজা খুলল অনুপম। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে পাজামা।
কী ব্যাপার? ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল।
তোর সঙ্গে কথা আছে। কল্যাণী ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে বসলেন ছেলের বিছানায়। অপলকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কী কেস বলো তো?
তোর কথাবার্তাগুলো বদলে যাচ্ছে।
এই কথা বলার জন্যে এত রাতে ঘুম ভাঙালে? অনুপম হাই তুলল। মুখের সামনে বারকয়েক টুসকি দিল।
সাড়ে দশহাজার টাকা তুই কোথায় পেলি?
অনুপম বেশ অবাক এবং বিরক্ত হয়ে তাকাল মায়ের দিকে ও আজকাল লুকিয়ে আমার ঘর সার্চ করছ নাকি?
টাকাটা কোথায় পেয়েছিস? আমার কাছে লুকোবি না।
ও বিজনেসের টাকা।
বিজনেস! তুই বিজনেস করছিস নাকি?
হ্যাঁ।
কীসের বিজনেস?
জমি-বাড়ি কেনাবেচার বিজনেস।
কল্যাণী পাথর হয়ে গেলেন। আর সাত-আটমাস পরে যার বি. এসসি. অনার্সের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা সে বিজনেস করছে! জমি-বাড়ির দালালির বিজনেস!
তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! সামনে তোর পার্ট ওয়ান পরীক্ষা…তুই…তুই…।
এবার ধৈর্য হারাল অনুপম। বেশ রুক্ষভাবে বলল, বি. এসসি. পাশ করার পর কী করব বলতে পারো? চাকরি-বাকরির ব্যাপক ক্রাইসিস। এখন থেকে টুকটাক বিজনেসের লাইন ধরতে পারলে পরে আর চিন্তা থাকবে না। পালোদা বলেছে বিজনেস পার্টনার করে নেবে।
পাবলো!
শিউরে উঠলেন কল্যাণী। এই এলাকার কুখ্যাত মাস্তান এবং প্রমোটার পাবলো শিকদার। পুলিশের খাতায় ওর নাম উঠতে-উঠতে খাতার পাতা ফুরিয়ে গেছে।
লোকটাকে সুনন্দ বা কল্যাণী কখনও চোখে দেখেননি, তবে তার অনেক গল্প শুনেছেন।
ছেলের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। এঁদের একমাত্র সন্তান কখন যে বড় হয়ে গেল, কখন যে এরকম হয়ে গেল, ওঁরা টের পাননি। এই তো সেদিন ও টলোমলো পায়ে মাম, মাম বলতে-বলতে কল্যাণীর কোলে ঝাঁপিয়ে আসত। টেলিফোনে কথা বলার জন্য বায়না করত। হ্যালো বলতে পারত। আর থ্যাংক য়ু-কে বলত খ্যাংকু। হইহই করে গোটা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। সুনন্দ বাজার থেকে মাগুর মাছ নিয়ে এলে জুজুমাছ বলে থাবা মারতে চাইত।
সকলের আদরের বুবুসোনা কী তাড়াতাড়ি অনুপম হয়ে গেল। নার্সারি, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, এইচ, এস, তারপর কলেজ। ছুটে যাওয়া ট্রেনের জানলা দিয়ে যেন সিনেমা দেখছিলেন কল্যাণী। ফ্ল্যাশব্যাক। বুবু থেকে অনুপম পর্যন্ত।
তারপর পাবলো শিকদার!
কল্যাণীর ভেতরটা ভাঙচুর হয়ে গেল। চোখে মেঘ-বৃষ্টি। মুখে হাত চাপা দিয়ে ছেলের কাছ থেকে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। ভেতরে-ভেতরে একটা তরাস কাজ করছিল। যে করে তোক অনুপমকে বাঁচাতে হবে। যে করে হোক!
সে-রাতেই সুনন্দর সঙ্গে কথা বললেন। এতক্ষণ গলা টিপে রাখা কান্নাটা উথলে বেরিয়ে এল বাইরে। স্বামীকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় কী যে বললেন বোঝা গেল না। মুখের বাক্য না বুঝলেও অন্তরের কথা শুনতে পেয়েছিলেন সুনন্দ। অনুভব করেছিলেন, একজন মা কথা বলছে।
আর তারপর থেকেই সুনন্দ আর কল্যাণী নতুন বাড়ির খোঁজে পাগলের মতো হয়ে উঠেছেন। তবে বাড়ি খোঁজার আসল কারণটা কাউকে বলেননি। কখনও বলা যায়!
টিভিতে একটা জোরালো মিউজিক বাজিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হতেই কল্যাণী স্মৃতিপথ থেকে ফিরে এলেন। তখনই দেখলেন, অনুপম জিনসের পাঞ্জাবি আর সরু পাজামা পরে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে-গোটাতে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগোল অনুপম। চটি পায়ে গলাতে গলাতে দেওয়ালকে বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি।
কল্যাণী বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরিস।
কিন্তু ততক্ষণে শব্দ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
.
বাড়ি বদলের তোড়জোড় চলতে লাগল। বিপিন চ্যাটার্জি সাধ্যমতো দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলেন। আর কল্যাণী অনুপমকে ব্যাপারটা জানানোর জন্য একটা সুবর্ণ মুহূর্তের খোঁজে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
একদিন রাতে মরিয়া হয়ে অনুপমের মুখোমুখি হলেন কল্যাণী।
বুবু, আমরা এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
অনুপম টেবিলে বসে কীসব হিসেবপত্র করছিল। টেক্ল-ল্যাম্পের আলো ছিটকে পড়েছে। ওর মুখে। কল্যাণী আলোর ছটার বাইরে আঁধারি উপচ্ছায়া অঞ্চলে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মায়ের কথায় অনুপম মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। আলো পড়ে ওর মাথার চুল চকচক করতে লাগল, তবে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। তাই বিরক্তির ছাপটা কল্যাণী দেখতে পেলেন না।
এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি মানে!
এই ভাড়ার ফ্ল্যাটে আমাদের…খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমাদের বয়েসও বাড়ছে। তা ছাড়া নতুন যে-বাড়িটার খোঁজ পেয়েছি সেটা বেশ খোলামেলা। ওখানে গেলে আমার অ্যাজমার টানটা কমবে।
হাতে ধরা পেনটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিল অনুপম, চাপা গলায় বলল, হোপলেস!
কল্যাণী বেপরোয়া হয়ে ছেলের কাছাকাছি চলে গেলেন। বহু বছর যা করেননি তাই করলেন, সাহস করে ওর মাথায় আদরের হাত রাখলেন!
আমাদের ভালো তুই চাস না?
অনুপম চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকার পর কল্যাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মলিন গলায় বললেন, আমরা প্রতিমুহূর্তে তোর ভালো চাই।
অনুপমের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বুবুটা অল্প-অল্প জেগে উঠল। মায়ের দিকে সামান্য চোখ তুলে আলতো করে জিগ্যেস করল, বাড়িটা কোথায়?
শোভাবাজারে। ভুতুড়ে বাড়ি বদনাম নিয়ে বাড়িটা বহুবছর পড়ে ছিল। বিপিনকাকা ওটার খবর দিয়েছে। ভূতের ভয় আছে বলে দারুণ সস্তায় পাওয়া গেছে।
ভূতের ব্যাপারটা শুনে অনুপম মজা পেল। বলল, ভূত! আজকাল পাওয়া যাচ্ছে না কি? তাও আবার সস্তায়!
কল্যাণী ওর কাছ থেকে সরে এসে বিছানার ওপরে বসলেন। অনুপম বোধহয় একটু-একটু করে সহজ হচ্ছে। যেহেতু ভূতে ওর কোনওকালেই ভয়-ডর নেই, তাই একটা মজা মেশানো চ্যালেঞ্জ হয়তো তৈরি হচ্ছে।
আমি তোর বাবাকে বলেছি, ও-বাড়িতে ভূতের ছিটেফেঁটা যদি থাকেও বুবু তাকে উদ্বাস্তু করে ছাড়বে। তোমার কোনও চিন্তা নেই। তুই একদিন বাড়িটা দেখতে চল।
অনুপম হাসল ও বাড়িটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে…।
তা ছাড়া শোভাবাজার তো কাছেই। ইচ্ছে করলে তুই রোজই এ-পাড়ায় আসতে পারবি। পাতাল রেলে এসপ্ল্যানেডে নেমে বাসে এইটুকু পথকতক্ষণ আর লাগবে!
আরও কিছুক্ষণ একথা সে কথা বলার পর ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন কল্যাণী। ওঁর মনে হচ্ছিল, বরফ গলতে শুরু করেছে।
বাড়িটা রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর প্যাঁচ রিপেয়ারের কাজে হাত দিয়েছিলেন বিপিন। সেটা শেষ হতে প্রায় মাসদেড়েক লাগল। তারপর একটা লাগসই ছুটির দিন খুঁজছিলেন সুনন্দ। অফিসের নানান ঝামেলা। ইউনিয়নের মিটিং, ফ্ল্যাটবাড়ির বাড়িওয়ালার কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত নেওয়া, এইসব মিলিয়ে সময় কাটতে লাগল।
তারই মধ্যে একদিন রাত দশটা নাগাদ অনুপম বাড়ি ফিরল উদভ্রান্তের মতো।
কল্যাণী রান্নাঘরে ছিলেন। অনুপম সেখানে উঁকি মেরে চাপা গলায় বলল, মা, একবার শুনবে।
ওর গলায় এমন একটা টেনশান ছিল যে, কল্যাণীর খুন্তি-ধরা হাত কেঁপে গেল। গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
কী হয়েছে রে?
কেউ আমাকে ডাকতে এলে বলে দেবে বাড়ি নেই।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী ওর ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাইলেন। মনে হল যেন একটা অচেনা ভয় অনুপমের ভেতরে তিরতির করে কাঁপছে।
কী ব্যাপার? কোনও গোলমাল হয়েছে না কি?
কল্যাণীকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল অনুপম। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, নাঃ, কিচ্ছু হয়নি। তারপর চটপট চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
কল্যাণী নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা বিষধর সাপ মসৃণ মেঝের ওপর দিয়ে খুব ধীরে-ধীরে যেন ওঁর দিকে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সাপটা ঠিক কোথায় ছোবল মারবে সেটা কল্যাণী আঁচ করতে পারছিলেন না।
পরদিন থেকেই সুনন্দ আর কল্যাণীকে অবাক করে দিয়ে অনুপম নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠল। বাড়িটা একদিন দেখেও এল ও। তারপর বলতে গেলে একরকম ওর তাড়াতেই এক রবিবার দুপুরে নতুন বাড়িতে চলে এল ওরা।
কৌতূহলের তাড়নায় সুযোগ বুঝে অনুপমকে বারকয়েক বিরক্ত করেছেন কল্যাণী। জানতে চেয়েছেন, অনুপম হঠাৎ ভয় পেয়েছে কেন। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনুপম এইটুকু বলেছে, পালোদা খুব ডেঞ্জারাস টাইপের লোক। ওঁর সঙ্গে আর বিজনেস করব না।
এরপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহু প্রশ্ন করেও অনুপমের কাছ থেকে আর কোনও কথা কল্যাণী বের করতে পারেননি।
অনুপম শুধু একই কথা বারবার বলেছে, নতুন বাড়ির ঠিকানা এ-পাড়ার কাউকে দেবে না। ওখানে ফোন এলে ফোন নাম্বারও কাউকে দেবে না।
কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়লেও কল্যাণী ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলেছেন, না–দেব না।
রবিবার সকালে ওঁরা যখন লরিতে মাল লোড করে সঙ্গে প্রাইভেট কার নিয়ে রওনা হবেন, ঠিক তখনই শ্রীকান্তকে দেখতে পেলেন কল্যাণী।
চোখে চশমা, কদমছাট চুল, পড়ুয়াগোছের দেখতে এই ছেলেটি স্কুলে বুবুর সঙ্গে পড়ত। এখন কলেজেও। মাঝে-মাঝেই বাড়িতে আসে। আজ ওঁরা চলে যাবেন শুনে দেখা করতে এসেছে।
প্রাইভেট কারের জানলা দিয়ে বুবুর সঙ্গে কথা বলার পর সুনন্দ আর কল্যাণীর সঙ্গে সৌজন্যের দু-চারকথা বলে চলে যাচ্ছিল শ্রীকান্ত। কল্যাণী ওকে লরির আড়ালে ডাকলেন। অনুপমের অনেক খবর রাখে শ্রীকান্ত। হয়তো ওর কাছে অনুপমের আতঙ্কের একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
শ্রীকান্ত, শোনো।
কী, কাকিমা? কল্যাণীর কাছে এগিয়ে এল শ্রীকান্ত।
পাবলো শিকদারের সঙ্গে বুবুর কি কিছু হয়েছে? চাপা গলায় জানতে চাইলেন কল্যাণী। ওঁর বুকের ভেতরে একটা পাথর এপাশ-ওপাশ গড়াচ্ছিল।
না তো! কেন?
তখন কল্যাণী অনুপমের ভয় পাওয়ার কথা বললেন। বললেন, বুবু বলেছে, পালেদা খুব ডেঞ্জারাস টাইপের লোক। ওঁর সঙ্গে বুবু আর বিজনেস করবে না।
দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে চারপাশে একবার দেখে নিল শ্রীকান্ত। তারপর নিচু গলায় বলল, আমি বুবুকে বহুবার বারণ করেছি, কাকিমা। আপনারা এখান থেকে চলে যাচ্ছেন, খুব ভালো হয়েছে। আসলে লাস্ট উইকে সোমবার রাতে রেললাইনের ধারে শর্মাদের সিমেন্ট গোডাউনের একজন নাইটগার্ড মার্ডার হয়েছে। রিভলভারের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গেছে…।
কল্যাণীর ভয়ে বুক কাঁপছিল। শ্রীকান্তর কথা আর শুনতে চাইছিলেন না তিনি। কিন্তু শ্রীকান্তকে বারণ করার শক্তি ছিল না এতটুকু।
….পাড়ার অনেকেই খবরটা জানে। তবে কাগজে কিছু আসেনি। একটু দম নিয়ে শ্রীকান্ত বলল, নাইটগার্ডটাকে পাবলো শিকদার মার্ডার করেছে। তাতেই বুবু মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে।
বুকের ভেতরটা কেমন করছিল। শ্রীকান্তকে কোনওরকমে আসি বলে প্রায় টলতে টলতে প্রাইভেট কারের কাছে গেলেন কল্যাণী। ওঁকে দেখে সুনন্দ দুবার জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে? কিন্তু দুবারই কল্যাণী মাথা নেড়ে বোঝালেন কিছু হয়নি।
অনুপম মাকে দেখছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছিল।
দুটো গাড়ি রওনা হতেই স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কল্যাণী। মনে-মনে ভাবলেন, উৎকণ্ঠা আর দুঃস্বপ্ন চিরতরে পিছনে পড়ে থাক।
নতুনের পথ চেয়ে ওঁরা তিনজন অপেক্ষা করতে লাগলেন।
হাজার পোশাক বদল করেও আভিজাত্যকে লুকোনো যায় না। ঠিক তেমনই রং-চং বা রিপেয়ার করে বাড়িটার প্রাচীন সৌন্দর্য চাপা পড়েনি। এক অদ্ভুত গর্ব এবং দীপ্তি নিয়ে দোতলা বাড়িটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গার ওপরে দুকাঠা জুড়ে বাড়ি। জানলাগুলোর ওপরে ঢালাই লোহার নকশা–তাতে রংবেরঙের কাচ লাগানো। দোতলার বারান্দার রেলিংও ব্রিটিশ আমলের ঢালাই লোহার জাফরি দিয়ে তৈরি। কার্নিশে সিমেন্টের কারুকাজ। যেকটা থাম চোখে পড়ে সবই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা।
বিশাল লোহার গেট পেরোলেই দু-পাশে ছোট-বড় গাছের দল এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে। অনেকটা যেন না-আঁচড়ানো চুলের মতো। তারই ফাঁকফোকর থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
গেট থেকেই সাদা রঙের বাড়িটা দেখা যায়। গেট দিয়ে কেউ ঢুকলে দোতলার বারান্দা কিংবা তেতলার ছাদ থেকে তাকে স্পষ্ট চোখে পড়বে। বাড়ি আর গাছপালা মিলে জায়গাটা এমন যে, ভূতের যদি সত্যি-সত্যি কোনও অস্তিত্ব থাকত তা হলে এই আস্তানা তাদের বিলক্ষণ পছন্দ হত।
গোটাপাঁচেক বড়-বড় ঘর। মার্বেল পাথর বসানো মেঝে, বারান্দা, অলিন্দ। যদিও পাথরে লম্বা-চওড়া ফাটল ধরেছে।
ইশ, মেঝেগুলো কী ঠান্ডা! কল্যাণী খালি পায়ে মেঝেতে পা দিয়েই মন্তব্য করলেন।
স্রেফ ভূতের কল্যাণে বাড়িটা এমন সস্তায় পেয়ে গেলাম। সুনন্দ খুশির সুরে বললেন।
তাও আবার এমন ভূত যে, আগে বোঝা যায় না।
মায়ের কথা শুনে অনুপম অবাক হয়ে গেল, বলল, তার মানে?
কল্যাণী তখন বিপিন চ্যাটার্জির কথাগুলো ছেলেকে মজা করে শোনালেন। মনে হল, বহুদিন পর কল্যাণী আর সুনন্দ ছেলেকে কাছে ফিরে পেয়েছেন। কল্যাণীর বুকের পাথরটা কখন যেন অণু পরমাণু হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অনুপম বলল, মা, আমি দোতলার বারান্দাওলা ঘরটায় থাকলে তোমাদের প্রবলেম হবে?
প্রবলেম? কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন সুনন্দ? আমরা তো মনে-মনে ওই ঘরটাই তোর জন্যে ঠিক করেছি!
দু-চারদিনের মধ্যেই নতুন বাড়িতে ওঁরা গুছিয়ে বসলেন।
প্রথম-প্রথম টেলিফোন ছাড়া বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। টেলিফোন ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশান সুনন্দ অনেক আগেই করে দিয়েছিলেন। ফলে কুড়ি-বাইশ দিনের মাথায় টেলিফোন চলে আসামাত্রই ওঁরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নতুন বাড়িতে আর কোনও অসুবিধে রইল না।
সুনন্দর অফিস, কল্যাণীর স্কুল আর অনুপমের কলেজ নতুন বাড়ির সঙ্গে ছন্দে মানিয়ে গেল। এ ছাড়া পাড়াটাও বেশ নিরিবিলি আর নির্জন। পাবলো শিকদারের মতো উৎপাত এখানে নেই।
কল্যাণীর মনে হল, এখানকার বাতাসে অক্সিজেন বোধহয় বেশি। অ্যাজমার টানটা কমে গেছে। ভেতরটা সবসময় কেমন চঞ্চল উদ্দাম হয়ে উঠতে চায়। ছাদের খোলা হাওয়ায় বেড়ানো, বাগানে শুকনো পাতা মাড়িয়ে পায়চারি, পাখির ডাক…ওঃ ভাবা যায় না!
সুনন্দ কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বাড়ির আনাচেকানাচে ভূত খুঁজে চলেছেন। তা নিয়ে বউ কিংবা ছেলের সঙ্গে ঠাট্টা-মজাও কম করছেন না। রাত দশটার পর বাড়ির অন্ধকার ঘর, বারান্দা, কি অলিন্দে হঠাৎ করে পায়চারি শুরু করে দেন। চেঁচিয়ে কল্যাণীকে বলেন, শোনো, আমি এখন চিরুনি তল্লাশি করে ভূত খুঁজছি। আমাকে এখন ডিসটার্ব করবে না।
তারপর সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি, তার সঙ্গে আবৃত্তি : পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, / পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে…ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর গেলা কোঁকা রে, / অন্ধবনের গন্ধগোকুল, ওরে আমার হোঁকারে! আয়, আয়–দেখা দে বাবা, দেখা দে…।
জীবনের ছন্দ যখন বেশ সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে এল তখন একদিন কল্যাণী ছেলেকে একা পেয়ে শ্রীকান্তর কথাটা বললেন।
পাবলো শিকদার মার্ডার করেছে শুনে তুই খুব আপসেট হয়ে গেছিস। আসলে ওইসব লোক তো এই টাইপেরই হয়। ওখান থেকে সরে এসে কত ভালো হয়েছে বল তো!
বুবু মায়ের দিকে একবার তাকাল। তারপর দাঁত দিয়ে বাঁ-হাতের নখ কাটতে লাগল।
বাইরে বেলা চড়ে এসেছে। গাছগুলো খসখসে আওয়াজ তুলে হাওয়ায় দুলছে। ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। বারান্দার মার্বেলের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রোদ পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
বুবু হঠাৎ এক অদ্ভুত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। কয়েক লহমা চুপ করে থাকার পর বলল, শ্রীকান্ত পুরোটা জানে না। তোমাকে সত্যি কথাটা বলে দেব? ভয় পাবে না তো?
কল্যাণীর মুখ পলকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চেরা গলা দিয়ে ভালো করে আওয়াজ বেরোল না। বেশ কষ্ট করে বললেন, নাবল।
পাবলোদা যখন ওই নাইটগার্ডটাকে মার্ডার করে তখন আমি দেখে ফেলেছি। পালোদাও আমাকে দেখে ফেলেছিল। পরদিন একথা আমার কাছ থেকে শোনার পর স্যান্টো আর অভিরূপ…ওরা আমার খুব বন্ধু…আমাকে বলেছিল, পালোদা মার্ডারের কোনও সাক্ষী রাখে না। আমি যখন বললাম, পালোদা আমাকে ছোটভাইয়ের মতো ভালোবাসে, খুব লাইক করে–তখন স্যান্টো বলে, বাইরে থেকে দেখে তুই পালোদার ভেতরটা কিছু বুঝতে পারবি না। আর…আর অভিরূপ আমার দিকে আঙুল তুলে হাতটা রিভলভারের মতো এইরকম করে মুখে স করে গুলি করার শব্দ করেছিল…।
কল্যাণী অনুপমের কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ছেলের মুখটা কী করুণ আর মলিন দেখাচ্ছে! তা হলে সেই সময়ে ও মৃত্যুভয়ে পাগল ছিল!
এখানে আর কোনও ভয় নেই, বলো, মা– কল্যাণীর দিকে চেয়ে হাসল অনুপম ও তা ছাড়া আমি তো আর পুলিশকে কিছু বলিনি!
ধীরে-ধীরে হাত বাড়িয়ে ছেলের ডানহাতটা আলতো করে চেপে ধরলেন কল্যাণী। অনুপমের হাতটা কেমন ঠান্ডা মনে হচ্ছিল।
বিড়বিড় করে কল্যাণী বললেন, তোর কোনও ভয় নেই…আমরা তো আছি…।
জানলার বাইরে থেকে বুলবুলি পাখির ডাক শোনা গেল।
ওরাও আমার পাশে আছে। ভাবলেন কল্যাণী।
আর-একটা কথা তোমাকে বলব,? আচমকা কথা বলল অনুপম।
কী, বল–
গতকাল রাতে আমার একটা ফোন এসেছিল। বাবা ধরে আমাকে ডেকে দিয়েছিল। আমি যখন ফোনটা ধরে হ্যালো বললাম তখন ওপাশ থেকে কোনও সাড়া পেলাম না। অনেকক্ষণ ধরে হ্যালো হ্যালো করেও যখন সাড়াশব্দ না পেয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছি তখন চাপা গলায় কে যেন বলল, অনু তো? তারপরই লাইন কেটে গেল।
অনুপমের মুখে কালো ছায়া নেমে এল হঠাৎ। নিচু গলায় অস্পষ্টভাবে ও বলল, পালোদা আমাকে অনু বলে ডাকত। আমাদের ফোন নাম্বার পাবলোদা জেনে গেছে, মা।
কল্যাণী ভয় পাচ্ছিলেন, তবে প্রাণপণ চেষ্টায় সেটা ছেলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলেন। ওর হাতে চাপ দিয়ে পুরোনো কথাটাই আবার বললেন, আমরা তো আছি…।
বুবু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল।
কিন্তু সন্ধেবেলাতেই অনুপম সবকিছু ভুলে হুল্লোড়ে মেতে উঠল। ওর কলেজের তিন বন্ধু সুমিত, কিশোর আর সুবর্ণা এল ওদের বাড়িতে। ঘণ্টাখানেক পড়াশোনা চলার পর টেপ রেকর্ডার চালিয়ে গানবাজনা শুরু হল। সঙ্গে কল্যাণীর হাতে তৈরি চিংড়ির পকোড়া, ফিঙ্গার চিত্স, আর কফি।
আরও ঘণ্টাখানেক হইহই করে আড্ডা দিয়ে ওরা চলে যাওয়ার পর সুনন্দ বুবুকে বললেন, তোর বন্ধুবান্ধবদের মাঝে-মাঝেই আসতে বলিস। তা হলে অন্তত ভালো-মন্দ খাবার কিছু কপালে জুটবে। আড়চোখে কল্যাণীর দিকে তাকালেন তিনি।
কল্যাণী রাগ দেখিয়ে বললেন, তুমি ছেলের সামনে মিথ্যে কথা বললে! কেন, তোমাকে প্রন পকোড়া কি ফিঙ্গার চিত্স কখনও করে খাওয়াইনি?
হাসলেন সুনন্দ : খাইয়েছ। তখন বুবু ছোট ছিল হামাগুড়ি দিত।
বুবু মজার চোখে মা-কে দেখছিল।
কল্যাণী ওকে জিগ্যেস করলেন, কী রে, তোর মনে নেই?
কী করে মনে থাকবে। আমি তো তখন হামাগুড়ি দিতাম।
বাবা আর ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠল। কল্যাণী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, আমিও শোধ নেব। তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
সেদিন রাতে আবার সেই ফোনটা এল। সুনন্দ ফোনটা ধরে বুবুকে দোতলা থেকে ডাকলেন।
বুবু ফোন ধরে অনেকবার হ্যালো বলেও ও-প্রান্ত থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেল না। ও বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিল। তারপর যেভাবে সিঁড়ি লাফিয়ে দোতলায় উঠল তাতে মনে হল ভয়টা এবার ওকে কামড় বসাতে পারেনি।
পরদিন বুবু কলেজে বেরিয়ে গেল, সুনন্দও অফিসে রওনা হলেন, কিন্তু কল্যাণীর ছুটি থাকায় অলসভাবে একা-একা দিনটা কাটালেন। বিকেলে ছাদে উঠে আনমনাভাবে পায়চারি করতে করতে নানান পুরোনো কথা ভাবছিলেন। এইভাবে কখন যেন ছাদের আলসের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বড়-বড় গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সদরের লোহার গেটটা দেখা যাচ্ছিল। গেটটা সবসময় ফুটদুয়েক ফাঁক করে চেন-তালা দিয়ে বাঁধা থাকে। গেট থেকে যে-পথটা বাড়ির দিকে এগিয়ে এসেছে সেটা গাছের সবুজ পাতায় খানিকটা আড়াল হয়ে গেছে। পথের এখানে-ওখানে শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। কাল সকালে কাজের মাসি আবার আঁট দেবে।
কখন ফিরবে বুবু? বলেছিল সন্ধের আগেই ফিরবে।
হঠাৎই কল্যাণী দেখলেন, একটি ছেলে গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার রোগা চেহারা অনেকটা অনুপমের মতোই। তবে একটু বেশি লম্বা মনে হল। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে থাকায় কল্যাণী মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না।
ছেলেটা এগিয়ে আসতে-আসতে দোতলার বারান্দার নীচে আড়াল হয়ে গেল। এইবারই বোধহয় কলিংবেল বাজাবে!
তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলেন কল্যাণী। দরজার কাছে যেতে-যেতে কলিংবেলের শব্দ আশা করছিলেন, কিন্তু কোনও শব্দ হল না।
দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলেন।
কেউ নেই!
এলোমেলো শুকনো পাতা ছড়ানো পথটা চুপচাপ একা-একা লোহার গেট পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আর কেউ নেই!
রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির শব্দ, গাছের মাথায় পাখিদের শেষ বিকেলের কিচিরমিচির, বাতাসে দোল-খাওয়া পাতার খসখসানি শুনতে পাচ্ছিলেন কল্যাণী। কিন্তু কারও পায়ের শব্দ নেই।
বাইরে বেরিয়ে বাড়িটার চারপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। না, কেউ নেই।
তখন কল্যাণী বাইরের লোহার গেটের কাছে গেলেন। রাস্তায় পা দিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখলেন। নাঃ, ওরকম চেহারার কোনও ছেলেকে চোখে পড়ছে না।
গেট থেকে খানিকটা দূরে একটা ঝুপড়ি-দোকান। চা-ঘুগনি রুটি বিক্রি করে। ওই দোকানদারকে কি জিগ্যেস করা যায়? না, জিগ্যেস করলে লোকটা ভাববে কল্যাণী ভূতের ভয় পেয়েছেন।
কল্যাণী বাড়িতে ঢুকে পড়লেন আবার। মনে হয়, তিনি যখন নীচে নামছিলেন, ছেলেটা তখন গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে। বোধহয় ভুল করে এ-বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।
সুনন্দ আর অনুপম বাড়িতে ঢোকামাত্রই ব্যাপারটা ওদের জানালেন। দুজনেই আহ্বাদে একেবারে লাফিয়ে উঠল : এতদিনে তা হলে ভূতের দেখা পাওয়া গেছে।
সুনন্দ ঠাট্টা করে বললেন, বিপিন দেখছি ঠিকই বলেছিল? আগে বোঝা যায় না। তবে মানতেই হবে, এ নিতান্ত নিরিমিষ ভূত। এল আর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল!
বুবু চাপা গলায় বলল, বাবা, মা কিন্তু এবার রেগে যাবে।
কল্যাণী গম্ভীরভাবে বললেন, আমি ভূতের কথা কিছু বলিনি–মানুষের কথাই বলেছি। আমি ভেবেছি তোমাকে বা বুবুকে কেউ খুঁজতে এসেছে।
দেখতে কেমন, মা? বুবু জিগ্যেস করল।
ওপর থেকে মুখটা ভালো করে দেখা যায়নি।
বোধহয় ভুল করে এ-বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। সুনন্দ মন্তব্য করলেন, আমি তোমার সঙ্গে এতক্ষণ মজা করছিলাম। এবার কি একটু চা খাওয়াবে?
কল্যাণী হেসে বললেন, অত তোয়াজের দরকার নেই–এমনিতেই চা খাওয়াতাম।
ঠোঁটে একচিলতে হাসি নিয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখল বুবু। সত্যি, এ-বাড়িতে এসে ওদের জীবনটাই যেন বদলে গেছে! চারপাশটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনটাও কেমন সবুজ আর খোলামেলা হয়ে গেছে।
সেদিন রাতে ও অনেক সুন্দর-সুন্দর স্বপ্ন দেখল।
.
পরদিন সকালে সুনন্দ একটু বেলা করেই বাজারে বেরোচ্ছিলেন, গেটের কাছে একটি লোকের সঙ্গে ওঁর দেখা হল।
বয়েস আঠাশ কি তিরিশ হবে। চোখে সাধারণ ফ্রেমের চশমা। ফরসা সৌম্য মুখে একটা হাসি-হাসি ভাব। নাকের বাঁ-পাশে একটা বড় তিল। চুলগুলো সামান্য উশকোখুশকো–যেন দু-চারদিন তেল কি চিরুনি পড়েনি। গায়ে রঙিন চেক শার্ট, পায়ে জিম্স।
কাকু, অনুপম আছে? হাসিমুখে জিগ্যেস করল ছেলেটি।
মুখটা চেনা-চেনা লাগছে কি? সুনন্দ ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না। ওঁর কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ল।
চিনতে পারছেন না! আমি অভ্র। অনুপম কি পড়ছে এখন?
কী জানি, পড়ছে বোধহয়। তুমি যাও না, ও দোতলার ঘরে আছে।
অভ্র হেসে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সুনন্দ চলে এলেন গেটের বাইরে। হঠাৎই ওঁর মনে হল, অভ্রর জামার ফাঁক দিয়ে তিনি যেন একটু ব্যান্ডেজমতো দেখতে পেয়েছেন। কে জানে, ফুটবল খেলতে গিয়ে হয়তো পাঁজরে চোট পেয়েছে।
বাজার করে ফিরতে ফিরতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।
সদরের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কল্যাণীকে দেখতে পেলেন। একটা গাছের আড়াল থেকে এমন উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলেন যেন কাউকে খুঁজছেন।
সুনন্দকে দেখেই কাছে এগিয়ে এলেন কল্যাণী। হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করলেন, বুবুকে বাইরে কোথাও দেখলে?
না তো! কী হয়েছে? সুনন্দ কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
তুমি বাজারে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ঘরে ব্রেকফাস্ট দিতে গিয়ে দেখি নেই। তারপর এখানে-ওখানে সবজায়গায় খুঁজলাম… যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লেন কল্যাণী ও কোথাও নেই…।
অভ্র নামে ওর এক বন্ধু যে ওকে খুঁজতে এল…আমি বললাম, তুমি যাও, ও দোতলায় আছে…সেই ছেলেটা কোথায়?
অভ্র? দেখা করতে এসেছিল? আমি তো টের পাইনি!
তুমি হয়তো রান্নাঘরে কি টয়লেটে ছিলে–টের পাওনি। দ্যাখো, ওর সঙ্গেই কোথায় বেরিয়েছে। এক্ষুনি চলে আসবে।
সুনন্দ কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তাড়াহুড়ো করতে হবে, নইলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে।
কল্যাণীর মন মানছিল না। যেতে-যেতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। স্কুলে যাওয়া তখন ওঁর মাথায় উঠেছে।
সুনন্দর কাছে অভ্রর চেহারার বর্ণনা শুনে কল্যাণী বললেন, মনে হচ্ছে, কাল বিকেলে এই ছেলেটাই গেট দিয়ে ঢুকেছিল। পরে কী ভেবে চলে গেছে।
সুনন্দ চুপ করে রইলেন। সাড়ে দশটায় তিনি যখন অফিসে বেরোলেন তখনও বুবু ফিরল না।
রাস্তায় বেরিয়ে এদিক-ওদিক দোকানদারদের কাছে খোঁজখবর করে জানতে পারলেন, অনুপমকে তারা একটি ছেলের সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখেছে। এর বেশি আর কেউ কিছু জানে না।
সুনন্দর অফিসে বারবার ফোন যেতে লাগল ও বুবু এখনও ফেরেনি। সুনন্দ বাধ্য হয়ে অফিস থেকে বাড়ি চলে এলেন। তারপর শুধু একে-তাকে ফোন করা, বুবুর খোঁজ করা।
বুবুর ঘর সার্চ করে ওর একটা ছোট্ট ডায়েরি পাওয়া গেল। তাতে বেশ কিছু ফোন নম্বর পাওয়া গেল। তারপর আবার ফোন। ফোনের পরে ফোন।
কিন্তু কোনও লাভ হল না। বুবু কোথাও নেই।
রাত দশটার সময় স্বামী-স্ত্রীতে মিলে এলাকার থানায় মিসিং ডায়েরি করলেন। ছেলের একটা ফটো জমা দিয়ে সব খুলে বললেন। অভ্র নামের ছেলেটির চেহারার বর্ণনাও দিলেন।
থানার অফিসার-ইন-চার্জ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো ওঁদের আশ্বাস দিলেন আপনারা বাড়ি যান। আমরা কাজ শুরু করে দিচ্ছি। হসপিটাল, নার্সিংহোম সব খোঁজ করে দেখছি কোনও অ্যাক্সিডেন্টের কেস গেছে কি না। আর অভ্র ছেলেটাকেও আমরা ট্রেস করার জন্যে লেভেল বেস্ট চেষ্টা করছি। দরকার হলে আপনাদের পুরোনো পাড়াতেও এনকোয়ারি করব। ওর যেসব বন্ধুদের নামধাম দিলেন তাদেরও ইন্টারোগেট করে দেখব। মোদ্দা কথা, উই আর পুটিং ইন আওয়ার বেস্ট
এফার্টর্স। কোনও লিডই আমরা বাদ দেব না।
রাতের নির্জন পথ ধরে ওঁরা বাড়ি ফিরে এলেন। এতক্ষণ কল্যাণী বারবার চোখ মুছছিলেন। বাড়িতে এসে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আর সুনন্দর বুকের ভেতরটা থেকে-থেকেই মুচড়ে উঠছিল।
ওঁরা দুজনেই বুঝতে পারছিলেন বুবুকে ওঁরা কত ভালোবাসেন।
*
চুলচেরা তদন্ত করেও পুলিশ অনুপমের কোনও হদিশ পেল না।
প্রতিদিন থানায় খবর নিয়ে নিয়ে সুনন্দ আর কল্যাণী ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ওঁদের ওপরে অভিমান করে বুবু কি চিরদিনের জন্য ওঁদের ছেড়ে চলে গেল? কিন্তু কেন যাবে! আর অভ্রকেই বা কেন সঙ্গে নেবে!
দশদিনের দিন ও. সি. একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে সুনন্দদের বাড়িতে এলেন।
রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।
মুখটাকে পাথরের মতো করে সুনন্দ টিভি দেখছিলেন। কল্যাণী ভেতরের ঘরে গোছগাছের কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখছিলেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল।
দরজা খুলে অফিসার ইন-চার্জকে দেখেই সুনন্দর মুখ শুকিয়ে গেল। ও. সি.-কে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কোনও খারাপ খবর নিয়ে এসেছেন। ওঁর মুখ গম্ভীর। হাতে একটা ফাইল।
ওঁকে বসতে দিয়ে কল্যাণীকে চেঁচিয়ে ডাকলেন সুনন্দ। টের পেলেন, গলা কেমন যেন চিরে গেল।
ও. সি. বললেন, সরি, মিস্টার চৌধুরী, আপনার ছেলেকে এখনও আমরা ট্রেস করতে পারিনি। আমরা যা-যা করার সব করেছি…বাট য়ু নো…মানে, এখন লালবাজারের মিসিং পারসন্স স্কোয়াডের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দিতে হবে।
কল্যাণী কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিথরভাবে অফিসারের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
সুনন্দ ইতস্তত করে বললেন, এখন….এখন আমাদের কী করার আছে?
সেটাই তো ভাবছি… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোয়ালে হাত বোলালেন অফিসার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎই বললেন, ও হ্যাঁ, যে জন্যে এসেছি। ইনভেস্টিগেট করে একটা ব্যাপার আমরা কনফার্ম করতে পেরেছি। আপনাদের ছেলের কিডন্যাপিং-এর পেছনে মানে, যদি কেসটাকে আমরা কিডন্যাপিং বলে ভাবি–ওই পাবলো শিকদারের কোনও হাত নেই। কারণ, অনুপম মিসিং হয় এগারো তারিখ সকালে আর ওই অ্যান্টিসোশ্যালটা দশ তারিখে দুটো গ্যাং-এর এনকাউন্টারে গুলি খেয়ে সিরিয়াস ইনজুরি নিয়ে হসপিটালাইজড হয়। আর তার পরের দিনই মারা যায়…।
ও যদি কোনও শাগরেদকে পাঠিয়ে থাকে। মানে, ওই অভ্র নামের আনোন ছেলেটা যদি ওর গ্যাং-এর হয়… সুনন্দ আর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
এই দেখুন না, ওখানকার লোকাল থানা থেকে আমরা পাবলোর ফাইলের কপি আনিয়েছি। তাতে ওর দলের লিস্টে অ নামটা পাইনি। হাতের ফাইলটা খুলে ও. সি. পাতা ওলটাচ্ছিলেন।
ফাইলের দিকে চোখ পড়তেই সুনন্দ চমকে উঠলেন। এ কী! ওই ছবিটা কার?
আচমকা ফাইলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে একটা পৃষ্ঠা চেপে ধরলেন সুনন্দ। সেই পৃষ্ঠায় আঁটা একটা পাসপোর্ট ফটো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কঁপা গলায় চেঁচিয়ে বললেন, এই তো! এই তো অভ্র! এই..এই ছেলেটাই সেদিন বুবুকে খুঁজতে এসেছিল!
কল্যাণী প্রায় ছুটে চলে এলেন সুনন্দর পাশে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আঁচ করতে চাইলেন, এই ছেলেটিকেই তিনি দশ তারিখে ছাদ থেকে দেখেছিলেন কি না।
অফিসার অবাক হয়ে তাকালেন স্বামী-স্ত্রীর দিকে।
কী বলছেন আপনি! অভ্র কেন হবে! এটা তো ওই গ্যাংস্টার পাবলো শিকদারের ছবি!
সঙ্গে-সঙ্গে যেন শীত নেমে এল ঘরের মধ্যে। প্রাচীন বাড়িটা অন্তর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুনন্দ ঘামতে শুরু করলেন। কল্যাণী বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগলেন। অ্যাজমার টানটা ওঁকে কষ্ট দিচ্ছিল।
দশ তারিখে পাবলো শিকদার কখন গুলি খেয়েছে? জানতে চাইলেন কল্যাণী। ওঁর কঁপা গলা উত্তেজনায় টান-টান।
সুনন্দর হাতটা সরিয়ে দিয়ে ফাইলের পাতা ওলটালেন ও. সি.। পকেট থেকে রিডিং গ্লাস বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন, রিপোর্টে আছে সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে।
সুনন্দ অবাক চোখে কল্যাণীর দিকে তাকালেন। কী বলতে চাইছেন কল্যাণী ছেলের শোকে ওঁর কি মাথার গোলমাল হয়ে গেল!
পরদিন পাবলো শিকদার কটার সময় মারা গেছে? ভাঙাচোরা গলায় কল্যাণী আবার প্রশ্ন করলেন।
ফাইলের পাতায় তর্জনীর দাগ টানতে টানতে উত্তরটা খুঁজে পেলেন অফিসার।
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ…।
সবাইকে চমকে দিয়ে কান্নায় ভাঙচুর হয়ে গেলেন কল্যাণী। সুনন্দর হাত আঁকড়ে ধরে বুকফাটা গলায় হাহাকার করে উঠলেনঃ বুবু আর কোনওদিন ফিরে আসবে না গো, আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। ও…মাগো..মা…।
কী হল তোমার! পাগলের মতো এসব কী বলছ! সুনন্দ কল্যাণীর দুকাঁধ ধরে জোরে আঁকুনি দিলেন : তুমি শান্ত হও। প্লিজ…।
মুখে আঁচল গুঁজে কান্না বন্ধ করতে চাইলেন কল্যাণী। জড়ানো গলায় স্বামীকে বললেন, এখনও তুমি বুঝতে পারোনি! তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছিল ও আগে বোঝা যাবে না। পরে, অনেক পরে, যখন বুঝবে…তখন…তখন আর কিছু করার থাকবে না। অনেক দেরি হয়ে যাবে…অনেক দেরি হয়ে যাবে।
সুনন্দ এবার বোধহয় একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন। বিপিন চ্যাটার্জি তা হলে একবর্ণও মিথ্যে বলেননি।
ও. সি. কল্যাণীর কথার কোনও মাথা-মুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি সুনন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন? কী ব্যাপার?
কল্যাণী তখন জল-ভরা শূন্য দৃষ্টি মেলে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বিড়বিড় করে বলে চলেছেন : …দশ তারিখ বিকেলে পালো শিকদার গুলি খেয়ে মরতে-মরতেও মরেনি। তাই ও আসতে-আসতেও আসেনি। ওর প্রেতাত্মা আমাকে আবছাভাবে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে। পরদিন সকালে পাবলো শিকদার মারা যেতেই ওর প্রেতাত্মা সটান এসে হাজির হয়েছে। নিশির ডাকে ভুলিয়ে আমার ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বুবু আমাকে বলেছিল, পাবলো শিকদার মার্ডারের কোনও সাক্ষী রাখে না। ওঃ মাগো…।
সুনন্দ মাথা ঝুঁকিয়ে দু-হাতে কপাল চেপে ধরলেন। চাপা কান্নায় ওঁর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছিল।
ও. সি. কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
কল্যাণী ফিসফিস করে নিজের মনেই কীসব বলছিলেন।
তবে ওঁরা তিনজনেই বুঝতে পারছিলেন, অনুপম আর কোনওদিনও ফিরে আসবে না।
আপনার নির্বাচন
আপনাকে আমি একটু সমস্যায় ফেলতে চাই। খুব বড় মাপের কিছু না হলেও এটাকে মোটামুটি মাঝারি মাপের সমস্যা বলা যায়। আসলে আমাদের গোটা ব্যাপারটাই মাঝারি। যেমন, আপনার বয়েস মাঝারি, বুদ্ধিবৃত্তি মাঝারি, যদি বউ থাকে তো বউয়ের সৌন্দর্য মাঝারি, এমনকী উচ্চতা–তাও মাঝারি।
এই মাঝারি মাপের সমস্যাটা হল নির্বাচন ও আপনার পছন্দ করার ক্ষমতা। উঁহু, ভুল হল। বরং বলা উচিত একই ধরনের কয়েকটা জিনিসের মাঝ থেকে নিজের পছন্দটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা।
যেমন ধরা যাক, তিন-তিনটে মেয়েকে আপনি ভালোবাসেন। অথবা ভালোবাসেন বলে নিজে মনে করেন। মেয়ে তিনটির নাম ধরা যাক, রূপবতী, ধনবতী ও কলাবতী। রূপ, ধন ও কলা সংক্রান্ত গুণাবলি ওদের সকলেরই প্রায় সমান-সমান। আপনি ওদের তিনজনকেই চেনেন, জানেন, পছন্দও করেন। এমন অবস্থায় হঠাৎই একদিন আপনাকে বলা হল, তিনজনের মধ্যে থেকে একজনকে আপনার বেছে নিতে হবে। তখন আপনার অবস্থাটা কী হবে একবার ভাবুন তো!
আমি জানি, আপনি তিন-তিনটি রাত জেগে কাটাবেন। দাঁত দিয়ে নখ কাটবেন। কিংবা মাথার মাঝারি-সংখ্যক চুলের বেশ কিছু উপড়ে নেবেন। অথচ এতসবের পরেও আপনি নিঃসন্দেহ হয়ে বলতে পারবেন না কোনটি আপনার পছন্দ।
রূপবতী, ধনবতী, কলাবতী–এই তিন নারীর গোলকধাঁধায় আপনি ঘুরপাক খাবেন। অবশেষে মরিয়া হয়ে যদি বা কিছু নির্বাচন করেন, তাহলে সন্দেহ নেই, কয়েক দিন, কিংবা মাস, কিংবা বছরের পর আপনি সুনিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে যাবেন যে, আপনার নির্বাচনে গলদ ছিল।
এবারে আপনাকে দ্বিতীয় উদাহরণের কথা বলি।
ধরা যাক, আপনাকে বলা হল একজন মানুষ নির্বাচন করতে যার মতো হতে পারলে আপনার আর কোনও দুঃখ, আপোেশ বা ক্ষোভ থাকে না। আপনি একবার ভাবেন নেতাজি হবেন, পরক্ষণেই হতে চান মোহনদাস। তার পর ইচ্ছে হয় রাজেশ খান্না কিংবা অমিতাভ হতে। তারও পরে হাজি মস্তান বা বিবেকানন্দ হতে মন চায়।
এইভাবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কোনও পছন্দেই আপনার আশ মেটে না, খুঁতখুঁতুনি যায় না। সুতরাং, আপনি শ্রীনিবারণ গলুই বা যা-হোক কিছু, পরিণামে নিবারণ গলুই থেকে গিয়েই ক্ষান্ত হন।
এরপর মনে করা যাক, আপনাকে বলা হল একজন মানুষের নাম করতে–যে মরে গেলে আপনার বাধা-বিপত্তি-অসুবিধে দূর হয়। সোজা কথায় আপনার আশ মেটে। ব্যস, এ-অনুরোধ করামাত্রই আপনি একটি তালিকা তৈরি করে ফেলতে চেষ্টা করবেন–যে-তালিকায় আপনার আত্মীয় পরিজন-বন্ধুবান্ধব অথবা শত্রুদের শুভনাম লিপিবদ্ধ করা আছে।
এরপর আসবে বাছাইয়ের পালা। কারণ, মাত্র একজনকে নিশ্চিন্তে নিকেশ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে আপনাকে। অতএব আপনার মনে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে যাবে। নানান চরিত্রের নানান খুঁটিনাটি ঘটনা টেকনিকালার ছবির মতো সরে-সরে যাবে আপনার মাঝারি-নজরী চোখের সামনে। অনেক তোলপাড় হবে, অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হবে এবং এরকমটা চলতেই থাকবে। কোনও সিদ্ধান্তে আপনি পৌঁছোতে পারবেন না।
না, আপনাকে আমি বেহদ্দ শিরদাঁড়াহীন মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছি না। আসলে এই সমস্যাগুলো আমার নিজের। কোনওরকম সমাধানে পৌঁছোতে না পেরে আপনার মনে শরণার্থী হয়ে ঢুকে পড়তে চাইছিযদি আপনার কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য কিংবা পরামর্শ পাওয়া যায়।
যেমন ধরুন, নির্বাচন-সংক্রান্ত আরও একটা সমস্যা হল জননেতা নির্বাচন। কাকে ভোট দেবেন আপনি? অনেকগুলো নাম-ধাম-চরিত্র আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকেই ভালো-মন্দয় মেশানো মানুষ। আপনি, শ্রীনিবারণ গলুই, আবার সংকটে পড়ে যান। বন্ধুবান্ধব, এমনকী সহধর্মিণীর পরামর্শও হয়তো চেয়ে বসেন এ-বিষয়ে। না, প্রকৃত কোনও সাহায্য তারা আপনাকে করতে পারবে না–যেমন আমার বেলাতেও পারেনি। শেষমেশ মরিয়া হয়ে যা-হোক কাউকে ভোট দিয়ে ফেলেন আপনি–সুনির্বাচিত প্রতীক চিহ্নে সিলমোহর দেগে দেন পরম প্রত্যয়ে। এবং তার পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় বিবেক-দংশন। সিদ্ধান্তের ছোট-বড় গলদ খুঁজে পান আপনি। নিজেকে ধিক্কার দেন নির্বাচনে ভুলভাল করে ফেলার জন্য। তখন নিজেকে বোকা-টোকা ইত্যাদি বলে মনে হতে থাকে।
যেসব উদাহরণগুলোর কথা আপনাকে বিরক্তিকরভাবে শোনালাম, এসব ঘটনাগুলোই আমার জীবনে বাস্তবে ঘটে গেছে। এবং যথারীতি সব নির্বাচনেই আমি বিলকুল গরমিল করে বসে আছি। আসলে এই সমস্যাগুলো আমার-আপনার সবার। সোজা কথায়, তামাম মাঝারি মানুষের এক মৌলিক সমস্যা।
যাক, এখন আর-একটু সংকটময় বিপজ্জনক নির্বাচনে আসা যাক। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, আপনার মতে সবচেয়ে ব্যর্থ এবং অপদার্থ মানুষটি কে? লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে আপনাকে বলা হল সবচেয়ে ব্যর্থ অপদার্থ মানুষটি নির্বাচন করতে। ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে আপনার ধন্দময় অনুসন্ধান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তামাম তালাশি নেওয়ার পর আপনি শুন্য নজরে চেয়ে থাকেন। আমি জানি, কেন। কারণ, সেই বিশেষ মানুষটিকে খুঁজে পাননি আপনি। না, খুঁজে পাননি বললে ভুল বলা হয়, বরং বলা উচিত খুঁজে পেয়েও নির্বাচনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার নামটি উচ্চারণ করতে আপনার লজ্জা এবং সংকোচ হচ্ছে।
হ্যাঁ, এরকম লজ্জা-সংকোচ আমারও হয়েছিল। কারণ, নিজের নাম উচ্চারণ করতে আমরা, মাঝারি মানুষরা, সবসময়েই লজ্জা পাই। বলুন তো, সত্যি কোনও সন্দেহ কি আছে যে, আপনার বিচারে সবচেয়ে ব্যর্থ এবং অপদার্থ মানুষটি আপনি নিজে? যেমন, আমার বিচারে আমি!
এই নির্বাচনের ফলাফলটুকু আঁচ করার পর আমার মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার অর্থ কী? সত্যিই কি আমার, কিংবা আপনার, বেঁচে থাকার কোনও মানে আছে? যথাযথ কারণ আছে কি কোনও?
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি এবং আমি ব্যর্থ। সেরা অপদার্থও যে, তাতেও কোনও সন্দেহ কি আর বাকি আছে? আপনি এখনও ভাবছেন? না, আমার ভাবাভাবির পালা শেষ। কিন্তু তবুও আর-একটা নির্বাচনের সমস্যায় পড়েছি আমি।
আমার সামনে এই মুহূর্তে একটা নাক বোঁচা পিস্তল, তার পাশে বিষের শিশি, আরও আছে। ফাঁস লাগানোর নাইলন-দড়ি, কিংবা কেরোসিনের টিন, এবং সব শেষে অতি ধারালো জাপানি ক্ষুর। জাপান শব্দটায় কি গৌরবময় হারাকিরির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আপনার?
সে যাই হোক, এখন আপনি বলুন, কোন অস্ত্রটা আমি নির্বাচন করি! হ্যাঁ, নিজের বিচারে আমি যখন সবচেয়ে ব্যর্থ ও অপদার্থ মানুষ, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী! অন্তত নির্বাচনের সংকট থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু মুক্তি কই? এই আপন্ন মুহূর্তেও আমি অস্ত্র নির্বাচনের ক্ষুরধার সমস্যায় পড়ে গেছি! নির্বাচনের পর হয়তো বুঝব আমার বিচারে গলদ থেকে গিয়েছিল। তাই আপনার সাহায্য চাইছি আমি।
বলুন, দয়া করে বলুন, পিস্তল, বিষ, দড়ি, কেরোসিন, না ক্ষুর–কোন অস্ত্রটা আমি বেছে নিই। এ কী নিবারণবাবু, আপনিও গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন? আমারই মতো আপনিও শেষ নির্বাচনের সমস্যায় পড়ে গেলেন?
কী বললেন? ঠিক একইরকম অস্ত্রাবলি এইভাবে সাজিয়ে বহুদিন ধরে একই সংকটে ডুবে আছেন আপনিও? পছন্দ-অপছন্দের ঝড়ঝাপটায় ঘুরপাক খাচ্ছেন অসহায়ের মতো!
তাহলে এখন আমি কার কাছে যাই! কে আমাকে সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে এই সমস্যায়!
আচ্ছা আপনি, হ্যাঁ, আপনি যিনি এই সমস্যায় কথা এতক্ষণ ধরে পড়লেন। আপনি একটু সাহায্য করতে পারেন আমাকে? বলতে পারেন, কোন হাতিয়ারটা পছন্দ করি? পিস্তল, বিষ, দড়ি, কেরোসিন, না ক্ষুর?
প্লিজ, ব্যক্তিগত নির্বাচনে এটুকু সাহায্য আপনাকে করতেই হবে! বলা যায় না, এই নির্বাচন হয়তো একদিন আপনার নিজেরও কাজে লাগবে। এতএব দয়া করে বলবেন কি, পিস্তল, বিষ, দ—
আমরা সবাই সমান
বাপি অফিসে বেরিয়ে গেলে রূপান নিজেকে একজন কেউকেটা বলে মনে করে। কারণ, তখন বাড়িতে সে-ই একমাত্র পুরুষ সিংহ–অতএব হেড অফ দ্য ফ্যামিলি।
সদর দরজার কলিংবেলটা যখন বাজল তখন মা রান্নাঘরে–গরম কড়াইয়ে ছাকোর-ছোঁকর শব্দ তুলতে ব্যস্ত। আর রূপান অঙ্কের হোমটাস্ক নিয়ে মশগুল ছিল।
কিন্তু কলিংবেল বেজে উঠতেই রূপানের মনে হল, দরজা খোলার দায়িত্বটা হেড অফ দ্য ফ্যামিলিরই নেওয়া উচিত। তাই দৌড়োনো আর হাঁটার মাঝামাঝি ঢঙে ও পৌঁছে গেল দরজার কাছে।
কে এল এই অসময়ে? এখন তো কারও আসার কথা নয়!
ম্যাজিক আই-এ চোখ রেখে চকচকে একটা কিছু চোখে পড়ল। ঠিক যেন স্টিলের বাসন টাসন।
কিন্তু দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দেখল স্টিলের বাসন নয়, একটা রোবট দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়।
পথে-ঘাটে এখন যে-হারে রোবট ঘুরে বেড়ায় তাতে একটা মেটাল বডির রোবট দেখে ক্লাস সেভেনে পড়া রূপানের মোটেই অবাক হওয়ার কথা নয়। ও অবাক হয়েছে ওদের বাড়ির দরজায় একটা রোবটকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
রোবটটা লিকলিকে। চোখগুলো মানুষের মতো। বেশ টানা টানা। মাথায় চকচকে নাইলনের চুল অ্যালবার্ট কেটে আঁচড়ানো। পরনে রঙিন হাফশার্ট আর প্যান্ট। তবে মুখ আর দু-হাতে কোনও ঢাকাটুকি নেই। রোদ পড়ে চকচক করছে।
কাকে খুঁজছেন? রূপান গলাটা একটু ভারী করে জানতে চাইল।
আমি ম্যাথমেটিকা গ্রহ থেকে আসছি, স্যার,– রূপানকে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে মিহি গলায় বলল রোবটটা, আমার নাম লেবেসগিউ। আমি প্রফেসর শান্তারাম মিত্রের বাড়িটা খুঁজছি। আমাদের কাছে যা ডেটাবেস রয়েছে তাতে ওঁর বাড়িটা এই এলাকাতেই হওয়ার কথা, স্যার…।
রোবটটা ওকে স্যার বলে দুবার ডাকায় রূপানের মনে হল, ও আর মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই–দু-চার ফুট শুন্যে উঠে পড়েছে। একইসঙ্গে ও লেবেগিউর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল । রোবটটার ভেতরের কলকবজা কিংবা সফটওয়্যার বিগড়ে যায়নি তো! যার জন্য ও ভুল করে ভাবছে যে, ও অন্য গ্রহ থেকে এসেছে!
না, প্রফেসর শান্তারাম মিত্র নামে এই এলাকায় কেউ থাকেন না। কিন্তু রোবটটা ওঁকে খুঁজছে কেন? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করল রূপানের।
এই নামে এ পাড়ায় কেউ থাকে বলে মনে হয় না। গম্ভীর গলায় বলল, রূপান, কিন্তু ওঁকে খুঁজছেন কেন জানতে পারি?
হ্যাঁ, স্যার, বলছি–হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লেবেসগিউর নাক দিয়ে, তারপর বলল, সমান চিহ্ন নিয়ে ওঁর কাছে আমাদের একটা কমপ্লেন আছে। আপনাদের এই পৃথিবীতে ওটা ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করা হয় না।
মানে? তাজ্জব হয়ে গেল রূপান। এ-রোবটটা বলছে কী! ও নিজে সমান চিহ্ন ব্যবহার করে কত যে অঙ্ক করেছে তার হিসেব নেই।
হ্যাঁ, স্যার। আপনি তো জানেন, অঙ্কে এই ইকোয়ালস টু চিহ্নটা সবসময় ব্যবহার করা হয়। কারণ অঙ্ক মানেই তো ইকোয়েশান বাঁ-দিকের সাথে ডানদিন সমান। এই সমান চিহ্নটা ছাড়া অঙ্ক অচল। অন্তত আমাদের গ্রহে তো তাই, স্যার…।
রূপান তখনও বুঝতে পারছিল না, লেবেগিউ কী বলতে চায়। তাই ও চুপ করে রইল।
যেমন ধরুন স্যার… রোবটটা বলে চলল, ছয় যোগ চার সমান দশ। এই অঙ্কটা লিখে ফেললে দেখবেন, সমান চিহ্নের বাঁ-দিকে ছয় যোগ চার, আর ডানদিকে দশ। ৬+৪ লেখাটার সঙ্গে ১০ লেখাটার চেহারায় কোনও মিল নেই কিন্তু চেহারায় মিল না থাকা সত্ত্বেও ওরা সমান…।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন… রূপান সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা ভেবে একটু অবাকও হল।
তারপর, মনে করুন, এই পৃথিবীর সমস্ত অঙ্ক থেকে যদি সমান চিহ্নটা উধাও করে দেন তা হলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হবে! সবকিছু একেবারে ঘেঁটে যাবে। তার মানে, যে-কোনও অঙ্কে সমান চিহ্ন থাকাটা সবচেয়ে জরুরি…।
রূপান আবার সায় দিল।
আমাদের গ্রহে দুজন মানুষের মধ্যে চেহারা কিংবা অন্য কিছুর মিল না থাকলেও তাদের মধ্যে সমান চিহ্ন বসানো হয়। অর্থাৎ, ওরা সমান। দেখতে আলাদা হলেও ওদের মধ্যে আসলে কোনও তফাত নেই। তাই আমাদের গ্রহে সবাই সমান। কিন্তু পৃথিবী গ্রহে ইকোয়াক্স টু চিহ্নটার ব্যবহার শুধু অঙ্কের মধ্যেই আটকে গেছে মানুষের মধ্যে আসতে পারেনি। সেটা জানানোর জন্যেই ম্যাথমেটিকা গ্রহের মানুষরা আমাকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছে। বলেছে, ম্যাথমেটিশিয়ান প্রফেসর মিত্রকে আমাদের অভিযোগ জানাতে। উনি যদি বিষয়টা সবাইকে বোঝাতে পারেন…। ঠিক আছে, চলি, স্যার–প্রফেসর মিত্রের বাড়িটা খুঁজতে হবে…।
রূপানের মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলেন, রূপান, কে এসেছে?
রূপান বলল, কেউ না, মা–
লেবেসগিউ লম্বা-লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে রূপানের খুব ভালো লাগছিল। আজ ওকে রোবটটা অভিনব এক অঙ্ক শিখিয়ে গেল? সমান চিহ্নের ঠিকঠাক ব্যবহার।
আসলে আমরা সবাই সমান।
আমার বাঁ হাতের পাঁচ আঙুল
মৌমিতাকে আমার বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুলের আসল ব্যাপারটা খুলে বলিনি। কারণ, খুলে বলাটা খুব সহজ নয়। কিন্তু ও যে বারবারই আমার বাঁ-হাতের দিকে তাকায় সেটা আমি লক্ষ করেছি। এখনও দেখছি, ও কোল্ড ড্রিঙ্কের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমার বাঁ-হাতের দিকে চেয়ে আছে।
আমি বাঁ-হাতে সবসময় সাদা দস্তানা পরে থাকি। কাপড়ের দস্তানা। ঠাটবাটওলা রেস্তোরাঁয় বেয়ারারা যেমন পরে থাকে। এখনও আমাদের টেবিলের আশেপাশে দু-তিনজন বেয়ারা এরকম সাদা দস্তানা পরে আছে।
মৌমিতাকে আজ ডিনার খাওয়াতে দ্য অর্কিড-এ নিয়ে এসেছিলাম। ই এম বাইপাসের ধারে এই দ্য অর্কিড রেস্তোরাঁটা মন্দ নয়। এখানে জগঝম্প নাচ-গান নেই। তার বদলে শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ। খুব সফট টোনে খুশির মুড তৈরির মিউজিক বাজছে। এসি-র তীব্রতা প্রায় শীত করার মতো। বেশিরভাগ টেবিলই ভরতি থাকলেও কারও কথা শোনা যাচ্ছে না। সবাই নিশ্চয়ই নীচু গলায় কথা বলছে। আমাদেরই মতো।
একটা কথা জিগ্যেস করব? মৌমিতা হঠাৎ মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলল।
করো। আমি জানতাম ও কী জিগ্যেস করবে।
তুমি বাঁ-হাতে সবসময় গ্লাভস পরে থাকো কেন?
গ্লাভস নয়–গ্লাভ বলো… হেসে বললাম আমি, আমি তো শুধু বাঁ-হাতে পরেছি– দু-হাতে পরিনি।
তুমি আনসারটা এড়িয়ে যাচ্ছ। কোল্ড ড্রিঙ্কের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বায়নার সুরে ও বলল, বলো না! বলতে কোনও প্রবলেম আছে?
আমার মনটা হঠাৎ কেমন-কেমন হয়ে গেল। প্রবলেম? ভালো কথাই বলেছে মৌমিতা। প্রবলেম নেই আবার!
একহাতে দস্তানা পরে থাকি বলে অনেকের কাছেই আমাকে জবাবদিহি করতে হয়। কাউকে বলি, এটা আমার এক বিচিত্র শখ। কাউকে বলি, হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময় এই অভ্যেসটা ডেভেলাপ করেছে। আবার কাউকে বা তিতিবিরক্ত হয়ে বলি, আমার বাঁ-হাতে স্কিন ডিজিজ আছে।
কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা একজন ছাড়া কাউকে বলিনি–অন্তত এখনও। কৌতূহল থাকাটা দোষের নয়। সুতরাং মৌমিতার কোনও দোষ নেই। ব্যাপারটা ওর জানতে ইচ্ছে করতেই পারে। তাই ওর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মৌ, বলতে কোনো প্রবলেম নেই। তবে..মানে…এর পেছনে একটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি আছে…।
ও বড়-বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই? তা হলে বলো প্লিজ…।
রেস্তোরাঁর ছায়া-ছায়া আলোয় আমি ওকে ভালো করে দেখতে চাইলাম।
মৌমিতা। লম্বা স্লিম চেহারা। মাথার একরাশ চুলে সোনালি রঙের ঝিলিক। লম্বাটে ফরসা মুখ। টানা-টানা চোখ। এই চোখে চোখ পড়লে নজর ফেরানো যায় না। চোখা নাক। সামান্য ফোলা দু-ঠোঁট যেন সবসময়েই দুষ্টু হাতছানি দিচ্ছে।
মৌমিতাকে আমি ভালোবাসি। খুব সাধ ওকে নিয়ে বাকি জীবনটা একসঙ্গে থাকব। আমার ভেসে-বেড়ানো দিকশূন্য ছন্নছাড়া জীবনে ও সারথি হয়ে আসুক। আমাকে সামলে নিক। আমার সুখ-দুঃখের শরিক হোক। আমার অভিভাবক হয়ে উঠুক।
মৌমিতাকে এখনও এসব কথা বলিনি। দস্তানার গল্পটা বলার পর বলব। মনে হয় না ও আমাকে ফিরিয়ে দেবে।
আমি বেয়ারাকে ডেকে বিল দিতে বললাম। তারপর মৌ-কে চাপা গলায় বললাম, এখানে নয়–গল্পটা তোমাকে গাড়িতে যেতে-যেতে বলব।
ও খুব খুশি হল। কোল্ড ড্রিঙ্কের খালি গ্লাসটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, সোনু, আই লাভ য়ু…।
আমি বললাম, গল্পটা তো এখনও শোনোনি…আগে শোনো…তারপর…।
বিল মিটিয়ে আমরা দুজনে উঠে পড়লাম। রেস্তোরাঁর কাচের দরজার কাছে এসে দেখি বৃষ্টি পড়ছে–তবে তেমন জোরে নয়। আমি আর মৌ হাত ধরাধরি করে ছুট লাগালাম গাড়ি লক্ষ করে।
গাড়িতে গুছিয়ে বসার পর মৌ বলল, বৃষ্টিটা হেভি রোম্যান্টিক–তাই না?
তুমি পাশে থাকলে আমার কাছে মরুভূমিও রোম্যান্টিক লাগবে।
হোয়াও! বলে আমার জামা ধরে টান মারল মৌ। ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে ছোট্ট ঠোকরানো চুমু খেল গালে।
জানলার কাচ তোলাই ছিল। হালকা করে এসি চালিয়ে দিলাম। তারপর পার্কিং লট থেকে গাড়ি তুলে নিয়ে এলাম বৃষ্টিভেজা রাস্তায়।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল।
বৃষ্টির জন্যে রাস্তা দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে ওয়াইপার চালিয়ে দিলাম। ড্যাশবোর্ডের ঘড়ির দিকে চোখ গেল। আটটা ঊনচল্লিশ।
নাঃ, রাত বেশি হয়নি। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে মৌ-কে বাড়িতে পৌঁছে দিলেই হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সাইডরোডে ঢুকে পড়লাম। এ-রাস্তাটায় গাড়ি-টাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। দোকানপাটও চোখে পড়ছে না। আলো বলতে রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপোস্টগুলোর সোডিয়াম বাতি।
মৌমিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই দস্তানার ব্যাপারটা তোমার অনেকদিন ধরেই জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না?
হ্যাঁ। য়ু আর স্মার্ট, সোনু। তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই এটা আমার কাছে একটা বিশাল কিউরিয়োসিটি…। আজ কৌতূহল চাপতে না পেরে তোমাকে স্ট্রেটকাট জিগ্যেস করে ফেলেছি..। হঠাৎ কী ভেবে ও বলল, তুমি কি মাইন্ড করলে, সোনু? তা হলে থাক…।
ওহহো, কী যে বলো! হোয়াই শুড আই মাইন্ড? কথা বলতে-বলতে ঝুঁকে পড়ে ওর মাথায় একটা চুমু খেলাম ও তোমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি, গল্পটা শুনলে তুমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না।
উত্তরে মৌ আমার দস্তানা-পরা আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরল। প্রায় ফিশফিশ করে বলল, আই উইল বিলিভ এনিথিং য়ু সে।
ভালোবাসা এমনই জিনিস, আজগুবি রূপকথাও বিশ্বাস করতে মন চায়।
রাস্তার একটা বাঁক পেরিয়ে ঝোঁপজঙ্গল ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালাম। মৌমিতা তাতে অবাক হল না। কারণ, আগেও এরকম ফাঁকা স্পটে আমি গাড়ি দাঁড় করিয়েছি। এবং মৌমিতা আর আমি গাড়ির মধ্যে খুশিমতন হুটোপাটি করেছি। ইংরেজিতে একেই বোধহয় হেভি পেটিং বলে। আজও গল্প-টল্প বলা হয়ে গেলে ওসবে মন দেওয়া যাবে।
গাড়ির চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল। জানলার কাচ বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল। ওয়াইপার দুটো প্রাণপণে উইন্ডশিল্ডের জল সরাচ্ছিল। ওদের চলার তালে-তালে মোটরের মিহি শব্দ হচ্ছিল।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তারপরই মেঘের ডাক শোনা গেল।
আমি গল্পটা বলতে শুরু করলাম।
.
মৌ তোমাকে কখনও বলা হয়নি…মানে, আমার বাবা দেড় বছর আগে মারা গেছেন..মানে, খুন হয়েছিলেন। সেইসময় কলকাতায় একটা জঘন্য সিরিয়াল কিলিং চলছিল। একের পর এক খুন করে চলেছিল লোকটা। প্রথমে খুন করেছিল একটা এগারো বছরের বাচ্চা মেয়েকে। না–শুধুই খুন করেছিল–অন্য কিছু করেনি। মেয়েটাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছিল। খুনের পর মেয়েটার যা চেহারা হয়েছিল..মানে, কাগজে যেসব ফটোগ্রাফ ছাপা হয়েছিল…সেসব দেখলে তুমি শিউরে উঠতে। মেয়েটার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। ঠোঁটের কোণে ফেনা ছিল। আর জিভটা মরা ছাগলের জিভের মতো বাইরে বেরিয়ে ঝুলছিল।
মেয়েটার মারা যাওয়ার আগের ছবি আর পরের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল কাগজে। দেখে মনে হচ্ছিল, দেবশিশু আর পিশাচ। খুনির হাত ওকে এমনই বদলে দিয়েছিল।
কাগজে দিনের পর দিন এই খুনের রিপোর্ট বেরিয়েছিল। তাতেই পড়েছিলাম, খুনি এত জোরে মেয়েটার গলা টিপে ধরেছিল যে, থাইরয়েড বোন আর কার্টিলেজ বোন ভেঙে গিয়েছিল। এই যে…গলায়…এখানে। কণ্ঠমণি…মানে, ইংরেজিতে অ্যাডাম্স অ্যাপল যাকে বলে। না, না, তোমার শিউরে ওঠার কোনও কারণ নেই। বললাম যে, ব্যাপারটা তিনবছরেরও বেশি পুরোনো।
মেয়েটার নখের ভেতরে আঁশমতন কিছু পাওয়া গিয়েছিল। ফোরেনসিক পরীক্ষায় জানা গেল, সেগুলো পুরোনো শুকনো কোনও চামড়ার আঁশ। অর্থাৎ, খুনি চামড়ার দস্তানা ব্যবহার করেছিল। নাঃ, কোনওরকম আঙুলের ছাপ-টাপ পাওয়া যায়নি। পুলিশ ফুল এনথু নিয়ে ইনভেস্টিগেট করেও কিদ্যু করতে পারল না। মেয়েটার খুনি ধরা পড়ল না।
দ্বিতীয় খুনটা হওয়ার পর পুলিশ নড়েচড়ে বসল।
এবারে খুন হল একজন মাঝবয়েসি পুরুষ। খুনের স্টাইল একই। মার্ডার বাই স্ট্র্যাংগুলেশান। এবারেও ভিকটিমের নখের নীচে চামড়ার ফাইবার পাওয়া গেল। অর্থাৎ, সেই দস্তানা। প্রথমবারে যেমন খুনের মোটিভের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি, এবারেও তাই। সব মিলিয়ে পুলিশ বেকুব বনে গেল। খুনি রয়ে গেল সবার চোখের আড়ালে।
তিননম্বর খুনটা হওয়ার পর পুলিশ বুঝতে পারল ব্যাপারটা সিরিয়াল কিলিং। মিডিয়া খুনির নাম দিল দস্তানা-খুনি। ইংরেজি চ্যানেল আর খবরের কাগজ নাম দিল গ্লাভ কিলার। সারা শহর জুড়ে খুনির খোঁজ চলতে লাগল। সবাই জোট বেঁধে দস্তানা পরা লোক খুঁজে বেড়াতে লাগল। বুঝতেই পারছ, কলকাতা শহরে চামড়ার দস্তানা আর কোন কাজে লাগে! তাই দস্তানা পরা লোক খোঁজার কাজটা বেশ সহজ। কিন্তু সেরকম কাউকেই পাওয়া গেল না।
এদিকে খুনের ব্যাপারটা চলতেই লাগল। তিননম্বরের পর চারনম্বর, চারনম্বরের পর পাঁচনম্বর, তারপর ছনম্বর। আর ছনম্বরের পর..সাতনম্বর আমার বাবা।
বাবা খুন হওয়ার পরই সিরিয়াল কিলিং-এর ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। খুনি যেন হঠাৎই চলে যায় বনবাসে। কেউ-কেউ বলল, সাতটা খুন করাটাই লোকটার টার্গেট ছিল। আবার কেউ-বা বলল, ভয় পেয়ে খুনি গা-ঢাকা দিয়েছে। কারণ, গোটা শহরের লোক সাবধান হয়ে গেছে। তা ছাড়া সবাই এমন হন্যে হয়ে দিন-রাত দস্তানা পরা লোকের খোঁজ করছে যে, নতুন খুনের ভিকটিম খুঁজে পাওয়াই মুশকিল–তাকে খুন করা তো অনেক পরের ব্যাপার।
বাবা খুন হওয়ার পর আমি অনাথ হয়ে গেলাম, কিন্তু সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ, সাইকোপ্যাথ খুনির সিরিয়াল কিলিং বন্ধ হয়ে গেল।
এতে সমস্যা মিটলেও নতুন কিছু প্রশ্ন উঠে এল পুলিশের সামনে। আমার বাবা খুন হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে। মানে, এলাকার বাউন্ডারি ওয়ালের কাছাকাছি ঝোঁপের মধ্যে বাবার ডেডবডিটা পড়েছিল।
শুনলে তোমার অবাক লাগবে মৌ, বাবাকে কিন্তু গলা টিপে খুন করা হয়নি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে পাগলের মতো কোপানো হয়েছিল বাবাকে। ছত্রখান হওয়া ডেডবডিটা পড়ে ছিল ঘাসের ওপরে। মুখটা ধারালো ফলার কোপে শতচ্ছিন্ন। হাতের আঙুলগুলো শরীর থেকে আলাদা হয়ে এখানে-সেখানে পড়েছিল। বাঁ-হাতটা কাঁধের কাছ থেকে প্রায় খুলে এসেছিল। সে এক বীভৎস ব্যাপার!
বাবার পকেটে পাওয়া ক্রেডিট কার্ড থেকে পুলিশ পরিচয় আর ঠিকানার খোঁজ পায়। আমি বাবাকে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম হাতের একটা আংটি দেখে, আর ডানহাঁটুর নীচে একটা কাটা দাগ দেখে। আইডেনটিফাই করার পরই আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।
এবারে তোমাকে প্রশ্নগুলোর কথা বলি।
প্রথমত, বাবাকে গলা টিপে খুন করা হয়নি। ফলে খুনের কায়দাটা সিরিয়াল কিলারের স্টাইলের সঙ্গে মিলছে না। কেন খুনি হঠাৎ স্টাইল বদলাতে গেল?
দ্বিতীয়ত, মার্ডার স্পটে একটা কালো চামড়ার দস্তানা পাওয়া যায়। রক্তমাখা দস্তানা–ছুরির কোপে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। দস্তানার রক্তের সঙ্গে বাবার রক্ত মিলে গিয়েছিল। এই দস্তানাটি কি খুনির দস্তানা হতে পারে?
তৃতীয়ত, খুনের ধরনটা এমনই যে, পুলিশের মনে হয়েছে, খুনটা প্রতিহিংসা বা আক্রোশ থেকে করা হয়েছে। প্রচণ্ড আক্রোশ না থাকলে কেউ এভাবে খুন করে না। তা হলে সিরিয়াল কিলার হঠাৎ এই আক্রোশ দেখাল কেন?
পুলিশ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইছিল। কিন্তু তাতে একটিমাত্র বাধা ছিল। নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ কী সেই সিদ্ধান্ত, আর কী সেই বাধা?
যাকগে, আমিই বলছি।
পুলিশের সেই সিদ্ধান্ত হল । আমার বাবা-ই সেই সিরিয়াল কিলার। খুন হওয়া কোনও ভিকটিমের রিলেটিভ বা বন্ধুবান্ধব প্রতিহিংসায় আক্রোশে বাবাকে ওরকম বীভৎসভাবে খুন করেছে।
আর এই সিদ্ধান্তের পথে বাধা হল, খুঁজে-না-পাওয়া বাঁ-হাতের দস্তানা।
দস্তানাটা পুলিশ কেন খুঁজে পায়নি জানো? ওটা আমি নিয়ে এসেছিলাম।
প্রথমদিন অন্ধকারে পুলিশ ভালো করে জায়গাটা সার্চ করতে পারেনি। হয়তো বাবার সঙ্গে খুনি বা খুনিদের ধস্তাধস্তির সময় দস্তানাটা দূরে কোনও ঝোঁপের মধ্যে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। তাই ওরা সেটা দেখতে পায়নি।
খুনের পরদিন দুপুরে গোয়েন্দারা লোকজন নিয়ে এসে জায়গাটা তন্নতন্ন করে সার্চ করে। কিন্তু ওটার খোঁজ পায়নি। কারণ, সেদিন ভোরবেলা পাহারাদার কনস্টেবলদের চোখে ধুলো দিয়ে দস্তানাটা আমি খুঁজে বের করি। ঘন ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে ওটা লুকিয়ে ছিল। ওটার গায়ে কোনও ছুরির কোপ ছিল না। শুধু দু-একজায়গায় শুকনো রক্ত লেগে ছিল।
দস্তানাটা বাড়ি নিয়ে এসে আমি লুকিয়ে রাখলাম। বাবার শোক ভুলতে আমার কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, পুলিশের সন্দেহ ঠিক। আমার বাবা-ই সেই সিরিয়াল কিলার।
না, না–মৌ, তোমার আপসেট হওয়ার কিছু নেই। আফটার অল ট্রুথ ইজ ট্রুথ। সিরিয়াল কিলার লোকটা যে আমার বাবা, এর মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বহু সিরিয়াল কিলারই ফ্যামিলি ম্যান ছিল। মানে, ওরা কারও না কারও বাবা ছিল।
এবারে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড আরও একটু বলি। আমার মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। তাই মা-কে আমার ভালো করে মনে নেই। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে বাবা খুব বাজে-বাজে কথা বলতেন। প্রথম-প্রথম আমার খারাপ লাগত। কিন্তু পরে একই ধরনের কথা রোজ-রোজ শুনতে-শুনতে ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে এসেছিল। কে জানে, হয়তো বাবার অভিযোগগুলো বিশ্বাস করতেও শুরু করেছিলাম।
বাড়িতে মায়ের কোনও ফটো ছিল না। বাবা রাখেননি। তাই আমি আজও জানি না, আমার মা-কে কেমন দেখতে ছিল। এই শূন্যতা নিয়ে আমি বড় হয়েছি, মৌ।
আমার বাবা এমনিতে শান্ত মানুষ হলেও হঠাৎ-হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠতেন। ঘরের জিনিসপত্র পাগলের মতো ভাঙচুর করতেন। আমার মরা মা-কে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে নোংরা গালিগালাজ করতেন।
বাবার একটা ব্রিফকেস ছিল। ব্রিফকেসটা খুলে আমি কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস পেয়েছিলাম। মেয়েদের মাথার ক্লিপ, ছেলেদের দুটো রিস্টওয়াচ, তিনটে আংটি, একটা চামড়ার বেল্ট, আর দুটো নাইলনের প্যান্টি।
জিনিসগুলো দেখে আমার মনে হল, ওগুলো ভিকটিমদের গা থেকে বাবা খুলে নিয়েছেন। মানে, জিনিসগুলো মার্ডার সুভেনির।
সিরিয়াল কিলিং-এর ব্যাপারটা অনেক নিউজপেপারেই বেশ বড় করে দিনের পর দিন বেরিয়েছিল। বাবার ওই ব্রিফকেসে তার কাটিংগুলো আমি পেয়েছিলাম। সেগুলো বারবার করে খুঁটিয়ে পড়ে ভিকটিমদের হারানো কয়েকটা জিনিসের কথা জানতে পারলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, হারানো জিনিসগুলো বাবার ব্রিফকেসেই রয়েছে। সুতরাং, সন্দেহের আর কোনও জায়গা রইল না।
এবারে তোমাকে দস্তানাটার কথা বলি।
মাস আষ্টেক আগের কথা। তুমি তো জানো, আমি মাঝে-মাঝে একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি। একদিন রাতে বাড়িতে একা-একা বসে হুইস্কি খাচ্ছিলাম আর বাবার কথা ভাবছিলাম। ঘরে নাইটল্যাম্পের আবছা নীল আলো। সিডি প্লেয়ারে হালকা মিউজিক বাজছে। নেশা বেশ জমে উঠেছে।
সামনের টেবিলে বোতল আর গ্লাসের পাশে পড়ে ছিল বাবার দস্তানাটা।
আমি ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এর ভেতরে একটা খুনি হাত বাস করত। আর সেই হাতটা আমার বাবার হাত।
গ্লাভটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ কী-খেয়াল হল, আমি ওটা বাঁ-হাতে পরে ফেললাম।
সঙ্গে-সঙ্গে কী যে হল, তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার বাঁ-হাতের আঙুলের ডগাগুলোয় যেন হাই ভোল্টেজের শক খেলাম। বাঁ-হাতের প্রতিটি শিরা চিনচিন করতে লাগল। অসহ্য জ্বালায় আমি ছটফট করতে লাগলাম। ছটফট করতে করতে বেসামাল হয়ে ছিটকে পড়ে গেলাম চেয়ার থেকে। আমার পায়ের লাথিতে টেবিলটা উলটে গেল। তার সঙ্গে-সঙ্গে গ্লাস আর বোতলও।
হাতের অসহ্য জ্বালাটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। আমি মরিয়া হয়ে দস্তানাটা টেনে খোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! ওটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না। ওটা সিমেন্টের ঢালাইয়ের মতো আমার হাতে একেবারে সেঁটে গেছে!
মেঝেতে পড়ে আমি হিস্টিরিয়ার রুগির মতো হাত-পা ছুড়ছিলাম আর গ্লাভটা খোলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। হাতের জ্বালা-পোড়াটা এত বাড়তে লাগল যে, একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
যখন জ্ঞান ফিরল, টের পেলাম, জ্বালাটা আর নেই। নেশাও পুরোপুরি কেটে গেছে।
কোনওরকমে উঠে ঘরের টিউবলাইট জ্বেলে দিলাম। তারপর তাকালাম আমার বাঁ-হাতের দিকে।
কবজি থেকে আমার হাতের পাঞ্জা, আঙুল সব কালো চামড়ার ঢাকা। এমনকী হাতের তালুর রং-ও কালো হয়ে গেছে। তবে দস্তানাটাকে আর দস্তানা বলে চেনা যাচ্ছে না। ওটা যেন আমার হাতেরই চামড়া হয়ে গেছে। কারণ, কালো চামড়ার তালুতে হাতের রেখাগুলো আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। নখগুলোর আকার বোঝা গেলেও সেগুলোর রং আর চরিত্র বদলে গেছে।
কী আশ্চর্যভাবেই না আমি একটা কালো হাতের মালিক হয়ে গেলাম!
হতভম্ব হয়ে হাতটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই শুনলাম একটা কর্কশ স্বর: এইবার তুই উপযুক্ত হয়েছিস, সোনু। আমার অসম্পূর্ণ কাজ তুই শেষ করবি। যারা ঘোর পাপী, দুশ্চরিত্র, ব্যাভিচারী, তাদের সবাইকে তুই শাস্তি দিবি। আমার সব শক্তি আমি তোকে দিলাম। নে…।
আবার একপ্রস্থ জ্বালা-যন্ত্রণা, ছটফটানি, চিনচিনে ব্যথা।
তারপর, কিছুটা সময় কেটে যেতেই, আমি চেতনা ফিরে পেলাম। টের পেলাম, অদ্ভুত এক আনন্দ আর তৃপ্তিতে আমার মনটা টগবগ করছে।
তবে সমস্যা একটা হল। আমার এই কালো রঙের বাঁ-হাতটা দেখে কৌতূহলী লোকজন স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত করে মারবে। কিন্তু সবাইকে তো আর এ-গল্প বলা যায় না। তাই আমি সবসময় বাঁ-হাতে সাদা দস্তানা পরে থাকি। লোকে আমাকে হয়তো রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারা ভাবে। তা ভাবুক! অন্তত পাগল করা কৌতূহলের হাত থেকে তো আমি রেহাই পাব। কী বলো?
.
আমার গল্প শেষ হতেই মৌমিতা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সোনু, তুমি ফ্যানট্যাস্টিক! তোমার জবাব নেই। এই অন্ধকার…এই অল্প-অল্প আলো… এই বৃষ্টি…মাঝে-মাঝে মেঘের গর্জন…বিদ্যুতের ঝলকানি–এর চেয়ে আইডিয়াল পরিবেশ আর কী হতে পারে, সোনু? তোমার দস্তানার গল্পটা বানিয়েছ দারুণ। এবারে প্লিজ, রিয়েল স্টোরিটা বলো–।
কথা বলতে বলতে আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল মৌ। আমার গায়ে হাতও রেখেছিল। আর একইসঙ্গে ওর মিষ্টি গলায় খিলখিল করে হাসছিল।
আমি বারবার ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম…বলতে চাইলাম যে, আমি যা বলেছি সেটাই আসল ঘটনা কিন্তু কে শোনে কার কথা!
বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও মেঘের ডাকাডাকি চলছিল। আমি উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকালাম।
আর ঠিক তখনই মৌ একটানে আমার হাত থেকে সাদা দস্তানাটা খুলে নিয়েছে। আমি চমকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখের রং সাদাটে হয়ে গেছে। ও গোল-গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার কালো রঙের বাঁ-হাতটার দিকে, কালো রঙের পাঁচটা আঙুলের দিকে।
আমি নীচু গলায় বললাম, মৌ, প্রথম মেয়েটাও তোমারই মতন ছিল। ওর নাম ছিল জিনিয়া। সুন্দরী, ছটফটে, চঞ্চল, মুখে সবসময় খই ফুটছে। তার সঙ্গে উগ্র পোশাক। চটকদার মেকাপ। জিনিয়াও আমার গল্পটা বিশ্বাস করতে চায়নি। তখন বাবা ওকে শাস্তি দিতে বলল…।
মৌমিতা আর কোনও কথা বলতে পারছিল না–শুধু আমার কালো হাতটার দিকে তাকিয়ে ছিল।
এমন সময় আমার কালো হাতের আঙুলগুলো মাকড়সার পায়ের মতো নড়ে উঠল। আর কর্কশ গলায় হাতটা বলে উঠল, সোনু, আর দেরি করা ঠিক হবে না। তোর গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। নে, চটপট কাজ সেরে নে…।
পিতাশ্রীর আদেশ অমান্য করি কেমন করে!
আমার বাঁ-হাতের আঙুলগুলো যখন সাঁড়াশি হয়ে মৌমিতার গলায় চেপে বসল, তখনও ও অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা কিছুতেই ও বিশ্বাস করতে পারছে না।
জিনিয়াও বিশ্বাস করতে পারেনি। মৌমিতাও পারল না।
আর পরের মেয়েটাও পারবে না।
আমার স্ত্রীর আততায়ী
ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা দেখেই বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল।
কোনও-কোনওদিন অফিস থেকে ফিরে দরজা যে সামান্য খোলা পাই না তা নয়। কিন্তু আজ এমনভাবে এমন ভঙ্গিতে দরজার পাল্লাদুটো খোলা রয়েছে যে, দেখামাত্রই একটা অশুভ ঘণ্টা বুকের ভেতরে ঢং-ঢং করে বাজতে শুরু করেছে। ঘুমন্ত মানুষ ও মৃতদেহের মধ্যে ঠিক এইরকম তফাতই বুঝি থাকে। অজান্তেই বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
চকিতে নজর চলে গেল হাতঘড়ির দিকে। সাড়ে সাতটা সবে পেরিয়েছে। রোজ এরকম সময়েই অফিস থেকে ফিরি। বন্ধ দরজায় ঠকঠক করলে কুসুম এসে দরজা খুলে দেয়। সকালে আমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সারাটা দিন বলতে গেলে ও একাই থাকে। শুধু কাজলের মা এসে সকাল-বিকেল দু-বেলার ঠিকে কাজটুকু সেরে দিয়ে যায়। কুসুমকে সবসময় বলি দরজা বন্ধ করে সাবধানে থাকতে। দরজায় কেউ নক করলে হুট করে দরজা না-খুলতে। ওর সুবিধের জন্য দরজায় একটা ম্যাজিক আই বসিয়ে দিয়েছি। যাতে দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে ভেতর থেকেই ও দেখতে পায়। বুঝতে পারে সে চেনা কি অচেনা।
ফ্ল্যাটের দরজায় আলোটা জুলছিল। পঁচিশ পাওয়ারের বাম্ব। এ-বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগেরই দরজায় কোনও আলো নেই। বাদ্ধ লাগানোর দরকার মনে করেনি ভাড়াটেরা। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী কুসুম একা থাকে। রাতে দরজায় কেউ নক করলে ম্যাজিক আই দিয়ে নজর করে আগন্তুককে ওর দেখা দরকার। তাই আমি বিদ্যুৎ-খরচের কথা ভাবিনি।
খোলা দরজা পেরিয়ে সরু একচিলতে করিডর। ডানদিকে রান্নাঘর আর বাথরুম। দুটোই অন্ধকার। বাঁদিকে বসবার ঘর। সেখানে আলো রয়েছে। সামনে শোওয়ার ঘর। সেখানেও আলো জ্বলছে।
কুসুমের নাম ধরে মাঝারি গলায় বারদুয়েক ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই। বুকের ধুকধুকুনি বাড়তে লাগল।
জুতোজোড়া করিডরে একপাশে চটপট খুলে রেখে বসবার ঘরে ঢুকলাম। আবার কুসুমের নাম ধরে ডাকলাম।
বসবার ঘর খালি। একজোড়া সোফা, টেবিল, বুককেস, ফুলদানিসবই জায়গা মতো পরিপাটি করে সাজানো। ঘরে কেউ নেই। এসেছিল বলেও মনে হয় না। কারণ সোফার গদিতে কোনও গভীর ছাপ নজরে পড়ল না।
উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় প্রথমে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন একধরনের থমথমে নীরবতার মধ্যে একজন পুরুষের গলা কানে এল। ভেতরে শোওয়ার ঘরে কেউ যেন কথা বলছে। কিন্তু সদর দরজা হাট করে রেখে শোওয়ার ঘরে বসে কুসুম কারও সঙ্গে কথা বলবে কি? বসবার ঘর থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলাম। প্রায় ছুটে শোওয়ার ঘরে গেলাম। পুরুষের কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল।
শোওয়ার ঘরে ঢুকেই একটা ভীষণ ধাক্কা খেলাম।
যে-লোকটির কথা বসবার ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম এখন তাকে দেখতে পেলাম। টিভি-র চৌকো ফ্রেমের মধ্যে সে অভিব্যক্তিহীন মুখে খবর পড়ছে। ঘরে কেউ নেই। গোটা ঘর লন্ডভন্ড। যেন একডজন কালবৈশাখী জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরে হাডুডু খেলেছে।
প্রথমেই চোখে পড়ে বিছানা। কুসুম খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। ঘর গোছানো ওর শখ। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, বিছানার যে-হাল চোখে পড়ছে তা আর বলার নয়। বেডকভারটা কেউ খামচে টেনে এনেছে খাটের কিনারায়। কিছুটা অংশ শাড়ির আঁচলের মতো ঝুলছে। বম্বে ডাইং এর সুন্দর চাদরটা ছিঁড়ে ফালাফালা। একটা বালিশ মেঝেতে। অন্য আর-একটা বিছানার মাঝখানে। ফেটে তুলো বেরিয়ে এসেছে। অন্য বালিশগুলো এলোমেলো।
টিভি-তে পড়া খবরের একটা শব্দও আমার কানে ঢুকছিল না। বুকের ভেতরে বারবার বাজ পড়ছিল। চেষ্টা করে চোখের নজর পরিষ্কার রাখতে হচ্ছিল।
চট করে হাত বাড়িয়ে টিভি অফ করে দিলাম। নিস্তব্ধতার প্যারাশুট নিঃশব্দে ঘরে নেমে এল। আমি কুসুমের নাম ধরে নরম গলায় বারকয়েক ডাকলাম। দেখছি ঘর খালি, অথচ কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমি যদি তেমন করে ডাকতে পারি তা হলে কুসুম নিশ্চয়ই অলৌকিক কোনও উপায়ে কোথাও-না-কোথাও থেকে আমার সামনে এসে হাজির হবে।
অগোছালো ঘরের ছোট-বড় টুকিটাকি চিহ্নগুলো একে-একে নজরে পড়ছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে চৌচির। মাকড়সার জালের মতো ফাটল একটা বিন্দু থেকে জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আয়নার পরিসীমার দিকে। ড্রেসিং-টেবিলে সাজিয়ে রাখা চিরুনি, পাউডার, লিপস্টিক, সিঁদুর–সবই এখন ছত্রখান। কুসুম সাজতে ভালোবাসত, সাজাতে ভালোবাসত। এখন কষ্ট করেও সেটা বোঝবার উপায় নেই।
মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে একটা পেতলের ফুলদানি, জল, তেলানো রজনীগন্ধার স্টিক, কাচের চুড়ির টুকরো, ভাঙা শাঁখা, আর ছোট মাপের কয়েকটা কালচে ছোপ। রক্ত কি না জানি না। পরীক্ষা করে দেখতে ভয় করল।
আমার কান্না পাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে এই ফ্ল্যাটের শোওয়ার ঘরে। ভাঙা গলায় কুসুমের নাম ধরে আবার ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই।
এখন কী করব? চেঁচিয়ে তোক জড়ো করব, না পুলিশে খবর দেব? সন্দেহ নেই, চোর, লুঠেরা অথবা ডাকাতের দল হানা দিয়েছিল ফ্ল্যাটে। কিন্তু তারপর তারা কী করেছে? কুসুমকে কিডন্যাপ করেছে, না কি…?
ভয়ংকর কতকগুলো সম্ভাবনা মাথায় রঙিন বাবের মতো দপদপ করে উঠল। মাথায় হাত চেপে ছন্নছাড়া মেঝেতে বসে পড়লাম। শরীরের ভেতর থেকে তৈরি হয়ে নির্লজ্জভাবে বেরিয়ে আসা থরথর কাঁপুনিকে চেষ্টা করেও বশে আনতে পারলাম না। আর ঠিক তখনই একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ আমার কানে এল। আমাকে দারুণভাবে চমকে দিল।
বেডকভারটা খাটের কিনারায় ঝুলে থাকায় খাটের তলাটা একরকম আড়ালই হয়ে গিয়েছিল। মনে হল যেন গোঙানির শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটানে বেডকভারটাকে ফেলে দিলাম মেঝেতে। খাটের তলায় চোখ গেল। কুসুম–অথবা কুসুমের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম।
খাটের তলায় আধো অন্ধকার, তবে দেখতে কোনও অসুবিধে হল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে দলা পাকিয়ে কুসুম পড়ে রয়েছে। জায়গার অভাবে একটা ট্রাঙ্ক আর একজোড়া সুটকেস খাটের নীচে থাকত। সেগুলো এখন ছিটকে গেছে দেওয়ালের গায়ে কোনের দিকে। সেই একটা সুটকেস অদ্ভুতভাবে আঁকড়ে ধরে কুসুম কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে। গোঙাচ্ছে।
কুসুম। কুসুম! অনেক কিছু মিশে ছিল এই ডাকের মধ্যে ও উবেগ, ভয়, স্বস্তি, আনন্দ, আরও কত কী!
ঝুঁকে পড়ে খাটের নীচে ঢুকে গেলাম খানিকটা। হাত বাড়িয়ে কুসুমকে ধরলাম। ছোঁওয়ামাত্রই ও যেন আঁতকে উঠল। ছিটকে যেতে চাইল আমার কাছ থেকে। একটা অদ্ভুত চাপা-আর্তনাদ করে উঠল।
আমি অন্ধকারের মধ্যেই ওর কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম। বললাম, কুসুম, আমি রণবীর রুণু।
তারপর ওকে টেনে বের করে নিয়ে এলাম খাটের তলা থেকে। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিলাম ছত্রখান বিছানার। দেখলাম, সেখানে ও চমৎকার মানিয়ে গেছে। কারণ, ওর শরীরটাও ছত্রখান।
খোঁপা খুলে চুল এলোমেলো। সিঁদুর ঘষে গিয়ে ফরসা কপাল লালচে। ডান-চোখের নীচটা বিশ্রীভাবে ফুলে রয়েছে, কালসিটে পড়ে গেছে। বাঁ-গালে দুটো ক্ষতের দাগ, চামড়া কেটে মাংস দেখা যাচ্ছে। ওপরের ঠোঁট জখম হয়ে কষ বেয়ে রক্তের দাগ নেমেছে। একইরকম রক্তের দাগ দেখলাম হাতে, বাহুতে, কোমরে। শাড়ি ছিঁড়ে জট পাকিয়ে কোমরের কাছে জড়ানো। ব্লাউজ গলার কাছে টান মেরে ছেঁড়া। ধবধবে গলায়, বুকে, নখের আঁচড়ের কয়েকটা সমান্তরাল দাগ চোখে পড়ল। অন্তর্বাস জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ছিঁড়েছে ব্লাউজের হাতা, কোমরের কষি।
সব মিলিয়ে সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য।
কুসুম কোনওরকমে চোখ খুলে দেখতে চেষ্টা করল। তারপর আমার কোলে মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল।
.
কুসুম, কী হয়েছিল?
যতটা সম্ভব শুশ্রূষা, পরিচর্যা করে কুসুমকে কিছুটা সুস্থ করে তুলেছি। এক্ষুনি ডাক্তারকে খবর দিতে যাব। কিন্তু তার আগে, সবকিছু জানাজানি হওয়ার আগে, পরিস্থিতির ওজনটুকু আঁচ করা দরকার।
কুসুমের সামনে যতই সহানুভূতির ভাব ফুটিয়ে তুলি না কেন ভেতরে-ভেতরে একটা ভয়ংকর রাগ দাপাদাপি করছিল। যে করেই হোক, আমার বউয়ের ওপরে এই অত্যাচারের শোধ তুলতেই হবে। যেমন করেই হোক বদলা আমার চাই-ই চাই। অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে শুয়ে থাকা কুসুমকে আবার নরম গলায় প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছিল, কুসুম?
দুর্বল অস্পষ্ট গলায় থেমে-থেমে বহুক্ষণ ধরে ও যা বলল তার সারমর্ম হল এই : হাতের কাজ-টাজ সেরে রোজকারমতো ছটা বত্রিশে ও টিভি দেখতে বসে। কাজলের মা তার একটু আগেই চলে গেছে। কতক্ষণ টিভি দেখছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ শোনে দরজায় কেউ নক্ করছে। কেন যেন ওর মনে হয়েছিল, নক্ করার ভঙ্গিটা ঠিক আমার মতো। ভেবেছিল, আমি হয়তো অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি। তবুও অভ্যাসবসে দরজার কাছে গিয়ে ও ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখে। যে নক্ করেছিল সে একপাশে দাঁড়িয়েছিল, কারণ, শুধু তার কাঁধের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। আর আশ্চর্য, যে-নীল রঙের জামাটা কুসুমের চোখে পড়ে আমার ঠিক সেইরকম একটা জামা আছে–যদিও আজ অন্য রঙের জামা পরে আমি অফিসে গেছি। কিন্তু সেইমুহূর্তে কুসুমের সেটা খেয়াল হয়নি। মোটামুটিভাবে আমি ফিরে এসেছি ভেবেই ও দরজা খুলে দেয়।
লোকটি ঢুকেই বলে যে, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, একটু অপেক্ষা করবে। অস্বস্তি হলেও কুসুম তাকে ঠিক মুখের ওপর না বলতে পারেনি। বসবার ঘরে গিয়ে বসতে বলেছে। অপরিচিত একজন পুরুষ ফ্ল্যাটে ঢোকার ফলে ইচ্ছে করে ফ্ল্যাটের দরজাটা ও আর বন্ধ করেনি। হাট করে খুলে রেখে দিয়েছে। তারপর চায়ের আয়োজন করবে বলে শোওয়ার ঘরে আসে কাচের আলমারি খুলে সুদৃশ্য কাপ-প্লেট বের করার জন্যে ও অতিথি-অভ্যাগত এলে তবেই এগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শোওয়ার ঘরে ঢুকে আলমারির কাছে পৌঁছোনোর আগেই দরজায় একটা শব্দ শুনতে পায় কুসুম। পেছন ফিরে দেখে সেই লোকটা শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তখন তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। কুসুম কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই লোকটা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দাঁত বের করে হেসে বলে, শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন কেন, মাইরি! কুসুম চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু সেই চিৎকার আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা বোধহয় শুনতে পায়নি। প্রথমত, ভয়ে কুসুমের গলা প্রায় বুজে গিয়েছিল, তাই চিৎকারের আওয়াজটা হয়তো ঠিকমতো বেরোয়নি। দ্বিতীয়ত, ঘরে টিভি চলছিল। আর তৃতীয়ত, সান্ধ্য আইন অনুযায়ী এ-বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাটেই জোরালো ভলিয়ুমে টিভি চলে।
এরপর যা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কুসুমের পক্ষে অস্বস্তিকর। লোকটা হঠাৎই খ্যাপা জানোয়ার হয়ে ওকে আক্রমণ করে। কুসুম নিজেকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণপণ লড়াই করেছে। শেষে মরিয়া হয়ে ও ঢুকে পড়ে খাটের তলায়। ধস্তাধস্তি চলতেই থাকে। হঠাৎই সিঁড়ির কাছে কয়েকজনের কথাবার্তা আর হাসির শব্দ শোনা যায়। লোকটা তাতেই কেমন যেন ভয় পেয়ে কুসুমের মুখে একটা ঘুষি মেরে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে ওকে ছেড়ে দেয়। ওর তখন মাথা ঝিমঝিম করছে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে রয়েছে, শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করার মতো সাড়টুকুও নেই। দেখল, লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে কাচের আলমারির আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেল।
লোকটা চলে যেতেই কুসুম বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে। কারণ, আমার ডাকে চেতনা ফিরে পেয়ে ও আমাকেই হঠাৎ আততায়ী বলে মনে করেছিল।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কুসুম বারবার কেঁদে ফেলছিল। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিলাম। আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ জ্বালা করছিল। অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু একটা অজানা আশঙ্কা আমার টুটি টিপে ধরছিল বারবার।
শেষ পর্যন্ত একটা প্রশ্নই করলাম ওকে।
লোকটাকে কেমন দেখতে? আবার দেখলে চিনতে পারবে?
কুসুম ইতস্তত করে বলল, গায়ের রং কালো। মুখ ভালো করে দেখিনি–আর আমার মুখের ওপরে যখন মুখ নিয়ে এসেছিল তখন কিছু দেখে থাকলেও মনে নেই। তবে মনে হয়, লোকটার ঠোঁটের নীচে ডানদিকে একটা বড় আঁচিল ছিল। আর ভুরু দুটো খুব ঘন, জংলা–তার নীচ দিয়েই লোকটার চকচকে চোখজোড়া তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আর…।
আমার মনে পড়ল, কুসুম বলেছে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসেছিল। তাই জিগ্যেস করলাম, লোকটার দাঁতগুলো মনে আছে?
কুসুম ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল আমার চোখে। তারপর বলল, সত্যিই তো একদম খেয়াল করিনি–লোকটার ওপরের পাটির সামনের একটা দাঁত অর্ধেকটা ভাঙা ছিল। এছাড়া আর কিছু মনে নেই।
আর কিছু? আমি মনে-মনে হাসছিলাম। আততায়ীর যে খুঁটিনাটি বর্ণনা কুসুম দিয়েছে তাতে একে খুঁজে বের করতে পুলিশের সাতদিনও লাগবে না–যদি অবশ্য আমি পুলিশে খবর দিই। চেষ্টা করলে আমি নিজেও হয়তো ওই ইতর ছোটলোকটাকে খুঁজে বের করতে পারব। লোকটাকে খুঁজে পাবই, এ-বিশ্বাস মনের মধ্যে নিশ্চিত হলেও একটা ব্যথা বুকের ভেতরে আঁচড় বসাচ্ছিল বারবার : কলকাতা শহরে এত বাড়ি থাকতে ওই ভয়ংকর ক্ষুধার্ত আততায়ী আমার ফ্ল্যাটটাই বেছে নিল। বুঝতে পারছি, আমার নামটা জানতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ, সেটা প্লাস্টিকের হরফে ফ্ল্যাটের দরজার গায়েই লেখা আছে।
কুসুমকে বললাম, আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।
আমাদের বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে ডক্টর দাস থাকেন। অসুখ-বিসুখ হলে উনিই আমাদের দেখেন। ওঁর নানারকম বিলিতি ডিগ্রি আছে। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোনোর সময় কুসুমকে বারবার সাবধান করে দিয়ে বললাম, আমার গলা না-পেলে একদম দরজা খুলবে না। শুধু আজ নয়, কোনওদিন এরকম হুট করে আর দরজা খুলবে না।
কুসুম সেই তখন থেকেই মুখ নামিয়ে রয়েছে। আমার দিকে যেন সহজভাবে তাকাতে পারছে । আমার কথায় কুসুম ছোট্ট করে বলল, হু। তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে খিল দিয়ে দিল।
আমি সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম।
.
ডক্টর দাস অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে কুসুমকে পরীক্ষা করলেন।
আমি শোওয়ার ঘরের দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁতে নখ কাটছিলাম। ঘরটা আমিই ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করেছি। আতঙ্কের দুনিয়া আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাইরেটুকু অন্তত। শুধু ভাঙা আয়নাটা স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘরটা দেখে, কুসুমকে দেখে, বিশ্বাসই হতে চাইছে না কোনও আততায়ী মাত্র ঘণ্টাদেড়েক আগে ঢুকে পড়েছিল এই ঘরে।
সিঁড়িতে কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ শুনে লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে যারা উঠছিল বা নামছিল, তারা নিশ্চয়ই এই ফ্ল্যাটবাড়িরই বাসিন্দা বা তাদের আত্মীয়স্বজন। আমার ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা দেখেও তারা কৌতূহলী হয়নি, ফ্ল্যাটের ভেতরে উঁকি মারেনি। নিজেদের মনে ঠাট্টা-মশকরা করতে করতে চলে গেছে। যদি কেউ একবার ফ্ল্যাটে ঢুকত তা হলে ওই লোকটা নিশ্চয়ই ধরা পড়ত। আমি এ-বাড়িতে কিছুদিন হল এসেছি। এখনও ভালো করে সবার সঙ্গে আলাপ সালাপ হয়নি। সেইজন্যেই কি সিঁড়ির মানুষগুলো আমার ফ্ল্যাটের খোলা দরজাকে উপেক্ষা করেছে? নাকি এটাই ওদের অভ্যাস?
ডক্টর দাস কুসুমকে ইনজেকশান দিলেন। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে উঠে এলেন। আমাকে ডেকে বললেন, একটু বাইরে আসুনকথা আছে।
করিডরে বেরিয়ে আমার আগে লক্ষ করলাম, কুসুম কৌতূহলী নজরে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে।
বসবার ঘরের কাছে এসে ডক্টর দাস আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন : ওষুধগুলো আনিয়ে নিন। প্রথম ট্যাবলেটটা রাত দশটা নাগাদ খাইয়ে দেবেন, বাকিগুলো কাল থেকে শুরু হবে। সব লেখা আছে। এখন ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছি–রেস্ট দরকার। যা ধকল গেছে!
আমি যন্ত্রের মতো সব কথা শুনে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শেষ কথাটায় একটা ধাক্কা খেলাম। চমকে তার দিকে তাকালাম।
ডক্টর দাস তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আরে না, না! ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন সান্ত্বনার ঢঙে। আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু হয়নি। ভাগ্যিস লোকটা মাঝপথে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!
কুসুমের কাছে শোনা সব কথাই ডক্টর দাসকে খুলে বলেছি। কিছুই লুকোইনি। আমি ওঁর মুখটা লক্ষ করছিলাম। লক্ষ করতে করতেই পকেট থেকে ভিজিটের টাকা বের করে ওঁর হাতে দিলাম। শুনতে পেলাম উনি আরও বলছেন? ইউ আর এ লাকি ডগ। নেহাত কপাল ভালো, নইলে আরও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারত। যাকগে, এ-নিয়ে আর থানা-পুলিশ করে কোনও ঝামেলা করতে যাবেন না যেন। সেরকম কিছু হলে তখন না-হয় থানা-পুলিশ করতেন। প্রতিবেশি হিসেবে এটাই আমার সাজেশান।
আমি অবাক হয়ে বিলিতি ডিগ্রিওয়ালা মধ্যবয়েসি ডাক্তারবাবুকে দেখছিলাম। একটা অজ্ঞাতকুলশীল লোক আমার স্ত্রীকে আক্রমণ করল, তাকে অপমান করল, এমনকি মারধোরও করল, সেটা আমার মুখ বুজে সইতে হবে। অবশ্য ডাক্তারি মতে আমার স্ত্রীর সতীত্ব ক্ষুণ্ণ হয়নি। হলে পরে থানা-পুলিশ, হইচই, আরও অনেক কিছু করা যেত।
করিডরের উলঙ্গ বালবের আলো ডাক্তার দাসের মুখে পড়েছে। উনি এমনিতে ফরসা, তবে এখন কেন যেন ভীষণ কালো দেখাচ্ছিল। চোখ দুটো কেমন চকচক করছে। ভুরু দুটো কী ঘন, জংলা! ইশ, ঠোঁটের নীচে ডানদিকে যদি একটা বড় আঁচিল থাকত! জানি না, ওর এই চেহারাটা কুসুমের নজরে পড়েছে কি না। পড়লে হয়তো ও আঁতকে উঠত।
ডক্টর দাস ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোনোর সময়েও বারবার বলতে লাগলেন, ওঃ আপনার স্ত্রী খুব বাঁচান বেঁচে গেছে মশাই, খুব বাঁচান বেঁচে গেছে। কলকাতা শহর বলে কথা, এখানে একটু সাবধানে না-থাকলে চলে।
উনি চৌকাঠ পেরোনোমাত্রই আমি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে কী খেয়াল হতে ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখলাম। দেখলাম, নীল জামা পরা একটা শরীরের অংশ দরজায় ওপিঠে সরে গেল।
.
পরদিন সকালেই অন্যান্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটেরা আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল।
মনে হল, গতকাল ওরকম একটা ঘটনা না-ঘটলে ওদের সঙ্গে কবে ভালো করে আলাপ হত কে জানে! হয়তো কোনওদিনই হত না। কী করে ওরা খবর পেল জানি না। আমি ওদের কিছু বলিনি। কিন্তু গতকাল রাতে কি ওরা খবর পায়নি? কাল তো কেউ আসেনি। আজ, এই রোদ-ঝকঝকে সকালে, ওরা এসে হাজির। ওদের দেখলে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই–কোনওদিন ছিল না।
আমি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। কুসুমের এখন বিশ্রাম দরকার। তা ছাড়া, এমন একটা সময়ে অপরিচিতি মানুষগুলোর মুখোমুখি হওয়াটা ওর কাছেও রীতিমতো অস্বস্তিকর। কিন্তু কাউকে সে কথা বলতে পারছিলাম না, আর ওরাও নিজে থেকে বুঝতে পারছিল বলে মনে হল না। যথাসম্ভব সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা ওদের বলতে একরকম বাধ্য হয়েছি।
নানাজনে নানা কথা বলছিল।
আচ্ছা, আমাদের পাড়ার পুঁটেদা, চ্যাংলাদা, ওদের দলের কারও কি সামনের দাঁত ভাঙা আছে?
রণবীরবাবু, আপনি খবরের কাগজের আপিসে যান। ওদের সব খুলে বলুন। এইসব রেপ কেসগুলো আজকাল বড্ড বেড়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া হওয়া দরকার।
আমার মনে হয়, ঘটনাটা পুলিশে জানানো উচিত। লোকটা যখন একবার এই বাড়িটা নোট করে গেছে তখন আবার এখানে ঘুরে আসতে পারে। আপনার ফ্ল্যাটে হয়তো আর কিছু করবে না, তবে আমাদের কারও ফ্ল্যাটে হানা দিতে পারে। আপনারা কী বলেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সিকিওরিটি বলে একটা ব্যাপার আছে তো!
আমার স্ত্রীও তো মশাই সারাটা দিন একা বাড়িতে থাকে!
চ্যাটার্জিদা, আপনার ওসব ভয় নেই! বুড়োবুড়িদের ফ্ল্যাটে ওসব লোক ঢুকবে না।
তুমি তো ভালো কথাই বললে, ভায়া! আমাদের বুড়োবুড়ির না-হয় ভয় নেই, কিন্তু ছুঁড়ি ঝি-টা রয়েছে না!
ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ, কী যেন নাম? লতা, তাই না। হ্যাঁ, ওর চেহারাটা বেশ ডাগর-ডোগর…।
আপনার স্ত্রীর কমপ্লিট রেস্ট দরকার। একটা মেন্টাল চাপও তো গেছে। আপনি না-হয় কিছুদিন অফিস ছুটি নিয়ে নিন।
যদি বলেন তো আমি লোক্যাল থানায় ইনফর্ম করতে পারি। থানার ও.সি. আমার চেনা।
আপনার স্ত্রীর ক্ষমতা আছে! ওইরকম একটা অবস্থার মধ্যেই লোকটার চেহারা মনে রেখেছে। দেখবেন, পুলিশ দু-দিনেই লোকটাকে পাকড়াও করে ফেলবে।
শুনেছি এসব লোকদের আবার নাকি পুলিশে হাত থাকে। কে জানে, ধরার দু-দিন পরে আবার ছেড়ে দেবে কি না। তখন লোকটার আক্রোশ আরও বাড়বে।
আচ্ছা, আপনি আমাদের সত্যদাকে একটু ধরুন না।
সত্যদা?
আরে আমাদের লোকাল এম-এল-এ। সত্যরঞ্জন চাকলাদার। শুনেছি লোকাল লোকদের খুব হেল্প-টেল্প করেন। ওঁর হেল্প পেলে লোকটার সাজা হবেই হবে। গ্যারান্টি।
চলি, আমার আবার অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেল।
ভাবছি, বউকে আর ছেলেকে কদিনের জন্যে বাপের বাড়িতে রেখে আসব।
আপনিও সেখানে চলে যান না, মিস্টার গুপ্ত, তা হলে একটা ফ্ল্যাট খালি হয়। আমার শালা অনেকদিন ধরে বলছিল।
কেন, আমার কি শালা নেই নাকি?
চলি, কাল আবার খবর নেব।
খবরের কাগজের ব্যাপারটা ভুলবেন না যেন।
চলি–।
ওরা সব চলে গেল। আমি বসবার সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। জানি, কর্তারা অফিস-কাছারিতে বেরিয়ে গেলেই এরপর একে-একে এ-বাড়ির নানা ফ্ল্যাটের মেয়েরা-বউরা আসবে!
কিন্তু এখন কী করব? কী করা উচিত! নাঃ, থানায় খবর একটা দেওয়া দরকার। আমি খবর না-দিলেও অন্য কেউ খবরটা দিতে পারে। সকলের সিকিওরিটির ব্যাপার রয়েছে।
সুতরাং কাজলের মাকে সতর্ক থাকতে বলে, কুসুমকে ওষুধ খাইয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরোলাম। ডক্টর দাস আজ রাতে একবার দেখতে আসবেন বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় তার বোধহয় আর দরকার হবে না। ঠিক করলাম থানায় যাওয়ার পথে ওঁর বাড়িতে জানিয়ে দেব।
রাস্তায় পা দিয়ে প্রতিটি পথচারীকে আমি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম নীল জামা, জংলা ভুরু, আঁচিল, আর ভাঙা দাঁত। এই শহরেই কোথাও-না-কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছে শয়তানটা।
আমার শরীর আবার জ্বালা করছিল।
.
রেপ কেস?
ডায়েরির খাতার ওপরে পেনসিল থামিয়ে অফিসারটি আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমি কী জবাব দেব বুঝে উঠতে পারলাম না।
ওসির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনিই একজনকে ডেকে আমাকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ঘরটা বেশ বড়। তিনটে টেবিল, গোটাচারেক চেয়ার আর কয়েকটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। মাথার ওপরে, পরস্পরের কাছ থেকে কিছুটা দুরে দুটো জম্পেশ ফ্যান কাচকাচ করে ঘুরছে।
ফাঁকা ঘরে মিনিটখানেক অপেক্ষা করার পর একজন উর্দি পরা অফিসার খাতা-পেনসিল হাতে নিয়ে ঢুকেছেন। হয়তো এস-আই টেস-আই হবেন। আমার মুখোমুখি বসে খাতা খুলে প্রথমেই আমার নাম-ঠিকানা সব টুকে নিলেন। তারপর বললেন, কী কমপ্লেন বলুন।
আমি মোটামুটি সব খুলে বলতেই তিনি বললেন, রেপ কেস?
এটা প্রশ্ন না মন্তব্য ঠিক বুঝতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম।
অফিসার পেনসিল দিয়ে দাঁত খুঁটতে লাগলেন। শব্দ করে ডায়েরির খাতাটি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাই তুলে বললেন, লোকটা ধরা পড়লে আপনার ওয়াইফকেই ঝাটে পড়তে হবে। উকিলদের জানেন তো, ওদের মুখে কিছু আটকায় না। কাঠগড়ায় আপনার বউকে দাঁড় করিয়ে উকিলরা অনেক খারাপ-খারাপ প্রশ্ন করবে। যেমন, লোকটা ঠিক কী কী করেছে। শরীরের ঠিক কোথায়-কোথায় হাত লেগেছে। তারপর, ধরুন ইয়ে করার সময় আপনার বউ ঠিক কী কীভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সরকারি ডাক্তাররা আপনার স্ত্রী-কে নানা পরীক্ষা করে দেখবে, জোর করে–মানে ইয়ের সময় জবরদস্তির চিহ্ন আছে কি না…।
হঠাৎই টেবিলে দু-হাতের ভর দিয়ে অফিসার সামনে ঝুঁকে এলেন। আমার মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, পারবেন এসব সহ্য ক